এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বাড়ি বদলে যায়।

    I
    অন্যান্য | ১৭ জানুয়ারি ২০১৩ | ৩৩৮৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • I | 24.99.73.171 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২২:৫৩585158
  • বিলেত গেলাম ২০০৫-এর এপ্রিল মাসে। টুংকাই তখন তিন মাস বয়সী। তখনো ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ কলকাতা ছেড়ে যায় নি। সকাল সাড়ে সাতটায় ফ্লাইট ছিল। সকলে মিলে সী অফ করতে গেল অন্ধকার থাকতে। সেই প্রথম প্লেনে চড়া। মন খারাপের সঙ্গে কেমন একটা রোমাঞ্চর বোধ। অন্য একটা মহাদেশের কতগুলো মানুষ, তাদের কথা এত পড়া, মাঝেমধ্যে এখানে ওখানে দেখতেও পাই, তারা আমার সঙ্গে একই পৃথিবী শেয়ার করছে, অথচ তারা কেমন থাকে, কী খায়, কিভাবে কথা বলে জানি না, কেমন অলীক লাগে ভাবতে। এবার তাদের কাছ থেকে দেখবো, কি জানি কেমন ইন্টার অ্যাকশন হবে, নতুন একটা সুন্দর দেশ দেখতে পাবো, ভাবতে ভালোই লাগছে। আবার একই সঙ্গে পরীক্ষার ভয়, নতুন জায়গায় মানিয়ে নেওয়ার ভয়।

    আমার সঙ্গে অ্যাপোলোর আর এক ডাক্তার চলেছে, একজন পাঞ্জাবী মহিলা, অ্যানাস্থেসিওলজিস্ট। তারও এই প্রথম বিদেশযাত্রা, দুজনে মিলে একই সঙ্গে হীথরো থেকে ইস্টহ্যাম যাবো ঠিক করলাম। সে আবার প্লেনেই তার এক পরিচিত দিদি পেয়ে গেল, আমরা অতএব দলে আরেকটু ভারী হলাম। দমদম এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি চেক চলছে, আমার পাশ দিয়েই প্লেনের কেবিন ক্রু-রা উঠে গেল। একটু হতাশ হলাম , অন্ততঃ এক-আধজন সুন্দরী এয়ার হোস্টেস দেখতে পাবো আশা করেছিলাম। কিন্তু সবই কেমন রাগী দিদিমনি টাইপের দেখতে, পরে বুঝেছিলাম সব টিপিক্যাল ব্রিটিশ ফিচার, অল্পবয়সেই মাঝবয়সী লাগে দেখতে। কিন্তু একজন পুরুষ ক্রু-কে দেখে একদম মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। কালো চামড়া যে এত চকচকে হতে পারে, ধারণা ছিল না। খুব ঘন কালো অবশ্য নয়। গায়ে দুর্দান্ত সুগন্ধ, চুলে ভেজা ভাব , দেখে মনে হল যেন এইমাত্র সুরভিত ধারাজলে আনখশির ভিজে এল। প্লেনে উঠে অবশ্য কয়েক্জন ভালো দেখতে মহিলা ক্রু-ও দেখতে পেলাম, তবে যদ্দুর মনে হয় তারা ইংরেজ ছিল না।
    প্লেন ভর্তি যাত্রীদের মধ্যে আমি তো একদম নতুন ছেলে নটবর, হাঁ করে সব কাণ্ডকারখানা দেখছি। পবিত্র সরকারের লেখা মনে পড়ে যাচ্ছে, সেই সুগন্ধী টিস্যুকে রুটি জাতীয় সুখাদ্য ভেবে খেতে যাওয়ার গপ্পো। এমনি ক্যালানে, সেফটি ইনস্ট্রাকশন দেওয়ার সময় যখন অক্সিজেন মাস্কের কথা বলা হল-এইভাবে অক্সিজেন মাস্ক নাকে চেপে ধরবেন-আমি চারিদিকে তাকিয়ে কোথাও মাস্ক দেখতে না পেয়ে তো উঠেই দাঁড়িয়েছি। আমার সীটের কাছে নিশ্চয় মাস্কের বন্দোবস্ত রাখতে ভুলে গেছে, একটা বিপদ না হয় শেষটা ! তখন চেপেচুপে বুঝিয়েসুঝিয়ে বলা হল, একমাত্র আপৎকালীন অবস্থাতেই মাস্ক নেমে আসে। আমার একগাল মাছি, এয়ার হোস্টেস মুখ চেপে হাসলেন কিনা দেখি নি। কিংবা হয়তো এইসব দু-পয়সার ফার্স্ট টাইমারগণকে দেখে ওঁদের চোখ সয়ে গেছে।

    প্লেনে উঠে বাংলায় ঘোষণা শুনে যুগপৎ বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছিলাম। তবে সে যা উচ্চারণ, বলে না দিলে তাকে বাংলাভাষা বলে বোঝা মুশকিল। খুব কান খাড়া করে না শুনলে ব্রিটিশ ইংরেজী ও ঢাকাইয়া বাঙাল ভাষার সেই মিশ্রণকে ধরা যাবে না। খানিক পরেই বাংলাদেশী সেইসব ক্রুদের দেখতে পেলাম। না, ভাব জমাবার চেষ্টা করিনি।

    পেছনের সীটে গায়ক রশিদ খান বসেছিলেন। এক মোটামত ভদ্রলোক তাঁকে প্রাণপন কীসব যেন বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন দেখলাম। কীরকম একটা আবছা মনে আসছে, রশিদ খান বোধ হয় সেবার সুইট্জারল্যাণ্ড যাচ্ছিলেন। ভুলও হতে পারে। হিথরোতে নেমে যখন হাঁটছি, দেখলাম এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এক ভদ্রমহিলা হাসিমুখে গিয়ে কথা বললেন-আপনার গানের খুব ভক্ত ইত্যাদি। আমি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতেই থতমত খেয়ে বললেন-"কী, সব ভালো তো?'' আমারই মত ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা দেখে মনে শান্তি হয়েছিল এক ফোঁটা। কিম্বা হয়তো ভ্যাবাচ্যাকা ছিলেন না, নিশ্চয় অনেক বার বিদেশ গেছেন এর আগে। হয়তো ফ্যান সামলাতে পারেন না।
  • nina | 79.141.168.137 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০০:৩৪585159
  • sabbaar ek jorhaa kare DyaabDyaabe chokh thaake-
    -dekhate kajan paay ?!
    sei ki Jen bale--
  • nina | 79.141.168.137 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০০:৩৮585160
  • ঃ-০
    এডা কি হইল? ক্যমনে পোস্ট হইল ঃ-০
    বলছিলেম---
    সব্বার একজোড়া করে চোখ ড্যাবড্যাব করে , Kঈণ্টূ দেখতে কজন পায়??
    আর আমি তো পাই ই না তার নমুনা আমার আগের পোস্টঃ-((
  • nina | 79.141.168.137 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০০:৩৯585161
  • * কিন্তু ঃ-((((((((((((((((((((((((((
  • I | 24.96.99.29 | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০০:০৫585162
  • প্লেনের মধ্যেই তিনজনে মিলে হিথরো থেকে ইস্টহ্যাম কীভাবে যাওয়া হবে তাই নিয়ে জল্পনাকল্পনা করছিলাম। তাই শুনে এক সহৃদয় বাঙালী ভদ্রলোক যেচে এসে জানালেন, হিথরোর সবচেয়ে কাছের টিউব স্টেশন হ্যাটন ক্রস। হিথরো থেকে হ্যাটন ক্রস বিনি পয়সায় এয়ারপোর্টের বাস যায়। হ্যাটন ক্রস পৌঁছে সেখান থেকে ব্লু লাইনের টিউব ধরে হ্যামারস্মিথ, হ্যামারস্মিথ থেকে গাড়ি বদলে হ্যামারস্মিথ -সিটি লাইন ধরে ইস্টহ্যাম। শুনলাম বটে, খুব একটা ভরসা পেলাম না। এই এখান থেকে অমুক গাড়ি বদলাও, তারপর সেখান থেকে তমুক গাড়িতে ওঠো ! তখন যদি জানতাম লণ্ডন টিউবে যাতায়ত করা কত সোজা ব্যাপার !
    কিছুক্ষণ পরেই জানালা নামিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে অনেকেই দেদার ঘুম; হয়তো ডেইলি প্যাসেঞ্জার। আমি জানলার ধারে সীট পেয়েছিলাম, অপলক চেয়ে রইলাম। সেই কখন কলকাতার স্কাইলাইন ছোট হতে হতে ঝাপসা খোপ খোপ বিমূর্ত দাবার ছক হয়ে মিলিয়ে গেছে, তারপর নীল নীল ঘন নীল। সেই প্রথম জানা গেল, আকাশের আসমানী নীলের ওপরে তুলোমেঘের রাজত্ব, তারো ওপরে অচেনা কালচে নীলের বিপণ্ণতা, সেদিকে তাকালে বুক দুরদুর করে ওঠে। যেন ঐখান থেকে মৃত্যুর শুরু,এতক্ষণ মেঘময় তুলোময় অস্তিত্ব ছিল , ভালো ছিল। ঐখান থেকে অনস্তিত্বের অসহনীয় ভার। আর যেকথা তখন জানতে পারি নি, ঐ সময় থেকে জীবন আমাকে ঘাড়ে ধরে আর এক অচেনা কালচে নীলের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে আমি আর কখনো আগের আমি হয়ে ফিরে আসবো না। ফিরে এলে সঙ্গীতা বলবে-তুমি বেশ বদলে গেছো, একটু শক্তপোক্ত হয়েছ, আগে কেমন সুইটমত (পড়ুন নড়বড়ে) ছিলে।

    দৃশ্য বদলে যায়, একসময় নীচের সমস্ত বিশালতা জুড়ে বরফের উঁচুনীচু রাজ্য দেখা গেল।" সী, দ্য স্নো-পিকড মাউন্টেন ক্যাপ্‌স''-এক বাঙালী বয়স্কা সহযাত্রী আমাকে ডেকে বললেন। এই অনন্ত আকাশে উঠে, পৃথিবীর এই ভূগোল বই ছাপিয়ে ওঠা জ্যান্ত বুকের ধুকপুক দেখে তাঁর প্রাণ খুলে গেছে। একটা সময় সমুদ্র দেখতে পেলাম, তার ওপর দিয়ে সাদা সাদা বিন্দুর মত ওরা কি নৌকো, সাদা ঢেউয়ের রেখা টেনে টেনে চলেছে? এই কী ভূমধ্যসাগর, মেডিটেরেনিয়ান, চারুলতা-য় সৌমিত্রর মুখে ছন্দে দুলে ওঠা সেই মেডি-টেরে-নিয়ান?

    ঘড়িতে তখন কলকাতার হিসেবমত বিকেলবেলা, প্লেন হু হু করে নামতে লাগল। নীচে এক প্রকাণ্ড সবুজ শহর আবছায়া থেকে দ্রুত আলোয় ফুটে উঠল। চারিদিকে অজস্র সবুজ সব মাঠ-ময়দান, অজস্র গাছপালা, কালো মসৃণ সব রাস্তা-তার ওপর দিয়ে সাঁ সাঁ করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, আমাদের চেনা রাস্তাঘাটের মত ভীড়ে ভীড়াক্কার জরদ্গব অবস্থা নয়। একটু যেন ভেজা ভেজা সবুজ, শহরের ওপর কালচে মেঘের ছায়ারা ঘোরাফেরা করছে। এরোপ্লেনের শব্দযন্ত্রে পাইলটের গলার স্বর ভেসে এল-লণ্ডন শহরে আপনাকে স্বাগত। আজ লণ্ডনের দিন তেমন রৌদ্রকরোজ্জ্বল নয়, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা....
  • I | 24.96.99.29 | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০১:১২585163
  • হিথরো নেমে এরোব্রিজ দিয়ে হেঁটে আসছি, তারপর আরো হাঁটা, হাঁটছি তো হাঁটছিই, পাশে পাশে আমার পঞ্জাবী সহযাত্রী ও সহকর্মী, তার পাতানো দিদি, আবার তাঁর এক পরিচিত ব্রিটিশ বাঙালী বোন/বান্ধবী, তিনি মৃদু হেসে ব্রিটিশ অ্যাক্সেন্টের বাংলায় সহবত শেখাতে শেখাতে চলেছেন। অবশেষে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালাম।বেশ কিছু শিখ কর্মী দেখে অবাক হয়েছিলাম, তখনো সাউথলের নাম শুনি নি, জানতাম না এই শিখ-অধ্যুষিত এলাকাটি হিথরোর কত কাছে। ইমিগ্রেশনে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এবং অন্যান্যদের আলাদা কাউন্টার এবং দুই কাউন্টারের আচার-ব্যবহারের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত দেখে আহত হয়েছিলাম মনে আছে। ইউরোপীয়ান হওয়ার সুবাদে এক কাউন্টার দিয়ে লোক হাসতে হাসতে পাস করে যাচ্ছে, অন্যত্র ভিড়ে ভিড়াক্কার। সিমরন ( আমার সহযাত্রীকে এই নামেই ডাকা যাক) এক লাইনে দাঁড়াল, আমি অন্য লাইনে। কথা রইল ইমিগ্রেশন চেক ইত্যাদি হয়ে গেলে পরে লাগেজ কালেক্ট করে একসঙ্গে বেরোব। আমার লম্বা লাইন, অন্য লাইনগুলো তেমনি, সিমরনকে কখনো দেখা যাচ্ছে, কখনো যাচ্ছে না। অবশেষে আমার টার্ণ এল, গম্ভীর লাল গোঁফ ও লাল চুল ওয়ালা সাহেব আমার কাগজপত্তর ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, হাইয়া,আর য়ু অল রাইট? আমি বললাম-ইয়েস, আই অ্যাম। সাহেব বললেন, য়ু উইল বি। ব্যাস, আমার ইন্টারভিউ খতম। লাইন পিছনে ফেলে বেরিয়ে এলাম।

    বেরিয়ে এসে আর এক কীর্তি। সিমরনের টিকিটির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। এদিক চাই, ওদিক চাই, না সিমরন, না তার পাতানো দিদি। এই বিরাট লণ্ডনসমুদ্রে, এই সম্পূর্ণ অচেনা মহানগরে আমি একা । লাগেজ কালেক্ট করতে গেছে কিনা এই ভেবে লাগেজের ওখানে গেলাম। সেখানে গুচ্ছ গুচ্ছ কনভেয়ার বেল্ট। কোনটাতে আমার লাগেজ আসবে বুঝতে না পেরে আমি ক্যাবলাকার্তিক সবচেয়ে কাছের কনভেয়ার বেল্টের সামনেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। এবং আশ্চর্য, সেখানেই আমার লাগেজও চলে এল। কিন্তু সিমরন প্রমুখের তখনো দেখা নেই। হয়তো একদম বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ভেবে বাইরে বেরিয়ে এলাম। না, নেই। তখন কেমন একটা কুচিন্তা হচ্ছে মনে। আমায় ফেলে দুই কন্যা একা একাই হাঁটা লাগাল নাকি? সময় প্রায় ঘন্টাখানেক পেরিয়ে গেছে তখন, কী করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এমন সময় যাত্রীদের রিসিভ করতে আসা লোকেদের মধ্যে একটি চেনা মুখ দেখতে পেলাম। সেও অ্যাপোলোতে চাকরি করত, আমাদের থেকে বেশ ছোট। ছেলেটির নাম জেমস, ঝাড়খণ্ড নিবাসী খ্রীশ্চান, ইতিমধ্যে সে বিলেতে এসে একটি চাকরি জুটিয়ে ফেলেছে, সে এসেছে তার ভাইকে রিসিভ করতে, এই একই প্লেনে তার ভাইও এসেছে। গন্তব্য একই। সেই ইস্টহ্যাম, সেই প্ল্যাব পরীক্ষা, সেই ব্রিটেনের চাকরিসাগরে টিকে থাকার লড়াই। এক সময় তার ভাই এসে পৌঁছল, তাকে নাকি অনেক গ্রীল করা হয়েছে, তার বাক্স ঝেড়েজুড়ে নাকি কীসব সাদা সাদা গুঁড়ো পাওয়া গিয়েছিল, সেই অজানা বস্তুটিকে মাদক ভেবে তার অনেক পরীক্ষানিরীক্ষাও হয়েছে। তারা এবার ইস্টহ্যামের দিকে রওনা দেবে। আমিও, এবার নিশ্চিত সিমরনরা আমায় ফেলে চলে গেছে জেনে ওদের সঙ্গে হ্যাটন ক্রসের বাসে উঠে পড়লাম। হায়, তখন যদি জানতাম তারো ঘন্টা চারেক পরে সিমরনের সঙ্গে আমার সেই ইস্টহ্যামে দেখা হয়ে যাবে, এবং তাদের ফেলে আসবার জন্য সে আমায় রীতিমত মুখঝামটা দেবে ! তাদেরো নকি ইলাবোরেট সব শারীরিক পরীক্ষা হয়েছে, তৃতীয় বিশ্ব থেকে আগত টিবি জীবাণুর ডিপো সন্দেহে তাদের চেস্ট এক্স রে করা হয়েছে, এবং এইসব পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে তাদের যখন ছাড়া হয়েছে, আমি হিসেব করে দেখলাম, সময়টা আমার হিথরো ত্যাগেরও প্রায় আধ ঘন্টাখানেক পরে। হা! মেয়েটার অমন স্নেহসিঞ্চিত বপু দেখেও টিবিরোগী ভাবা ! আমায় ধরলেও নাহয় বুঝতাম।

    কিন্তু তাই বলে আমায় অমন মুখ ঝামটা ! নাঃ, বাঙালী বিয়ে করেও সিমরনের পঞ্জাবী স্বভাবচরিত্র কিছু বদলায় নি।

    ডিঃ সিমরন এই লেখা পড়বে না জানি, কিন্তু বিবেক বলেও তো একটা ব্যাপার আছে! সে ছিল একটি শান্ত মিষ্টি মেয়ে, তেমন হট্টাকট্টা পঞ্জাবী নয় মোটেও; যদিও তাকে রোগা বলা চলে না, কিন্তু মোটা সে কখনো ছিল না। কোথায় আছে এখন কে জানে ! লিখতে বসে অনেক দিন বাদে সেই পথের সাথীর কথা মনে পড়ল।
  • I | 24.96.143.94 | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২০:৫৪585164
  • হ্যাটন ক্রস স্টেশনে প্রথম সায়েব ভিখিরি দেখেছিলাম। কোট-প্যান্টুলুন পরে, চশমা চোখে কেমন অনাথ অনাথ ভাব নিয়ে একটি প্ল্যাকার্ড সমেত বসেছিল। ডাউন'স ছিল কী? স্টেশনের এক কর্মচারী সহাস্যে তার সঙ্গে গপ্পো করছিল।
    এপ্রিল মাস , লণ্ডন শহর ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে।সেইসব ফুলের গন্ধও যেন নাকে এসে লাগছিল মালুম হচ্ছে। লম্বা সময় লেগেছিল লণ্ডন মহানগরীকে পশ্চিম থেকে পূবে আড়াআড়ি ক্রস করতে। প্রায় পুরো পিংক লাইনই (হ্যামারস্মিথ -সিটি) পেরোতে হয়েছিল, শুরুর স্টেশন হ্যামারস্মিথ থেকে ইস্ট হ্যাম , শেষের ঠিক আগের স্টেশন। শেষ স্টেশন ছিল বার্কিং । পশ্চিমী একটা কসমোপলিটান শহর দেখছিলাম টিউবের মধ্যে, কত বিচিত্র রংয়ের ও সাজসজ্জার মানুষ। এই রামধনু শহরের সাদাদের মধ্যে যে অনেক রকম শেড তথা জাতীয়তা রয়েছে, সেটা অবশ্য প্রথম দর্শনে বুঝতে পারি নি। লণ্ডন শহরে এত কালার্ড ও এশীয় মানুষজন থাকেন তাও জানতাম না। বেশ কিছু আফ্রিকান মানুষ দেখেছিলাম, তাঁদের নিজস্ব রং চংয়ে পোষাক পরে ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে ইংরেজীতে কথা বলছেন। অজস্র টানেল পেরিয়ে যাচ্ছিল গাড়ি, মাঝে মধ্যেই লাইনের দুপাশের দেওয়ালে বিচিত্রবর্ণ গ্রাফিত্তি। ওয়েস্ট হ্যাম স্টেশনে দুজন ফুটবল খেলোয়ার জার্সি পরেই ট্রেনে উঠেছিল মনে আছে। তাদের থাই দেখে হাঁ হয়ে গেছিলাম, এত্ত বড় !

    লণ্ডন টিউবের স্বাচ্ছন্দ্যও আমার বাক্স টানাটানির কষ্ট কমাতে পারে নি। সঙ্গে ছিল যতদূর বড় হতে হয় একটা স্যামসোনাইটের লাগেজ, তার সঙ্গে একটা বিশাল ব্যাগ, এই দুইয়ের মধ্যেই আমার আগামী কয়েক মাসের বেঁচে থাকার যাবতীয় সম্বল। থিতু না হওয়া অবধি এই বাক্স-প্যাঁটরা টেনে টেনে বেড়াতে হবে জানতাম। হায় , শুধু যদি জানতাম যে ইউ কে-তে থিতু হওয়াই আর আমার হয়ে উঠবে না, তাহলে কী আর এই ফ্যাঁচাকলে সাধ করে গলা দিতাম ! লোকে বারণ যে করে নি তাও না। আমার বিদেশযাত্রার কয়েকদিন আগেই অ্যাপোলোতে এক ইংরেজ মহিলা ভর্তি হয়েছিলেন আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করে। দয়াবতী সেই মহিলা ছিলেন ইউ কে-র কোনো একটি হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজর। আমি বিলেত যাচ্ছি শুনে উনি প্রভুত বারণ করেছিলেন ও সেই সুবাদে এন এইচ এস-এর প্রবল সমালোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন, এরা শুধুমাত্র টাকা কামানোর ধান্দায় এখনো প্ল্যাব পরীক্ষা নিয়ে যাচ্ছে ও লাখ লাখ বিদেশী ডাক্তারকে পথে বসাচ্ছে, কখনো কখনো লিট্যারালি। কেননা উনি এমন কিছু ডাক্তারকে জানেন যাঁরা চাকরী-বাকরী কিচ্ছু না পেয়ে এখন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমন কি দেশে ফিরবার টাকাটা পর্যন্ত তাঁদের কাছে নেই। এন এইচ এসের এক্ষুণি উচিৎ চাকরীর বাজারের বাস্তব পরিস্থিতি সবার সামনে তুলে ধরা এবং অনতিবিলম্বে প্ল্যাব পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া।
    চাকরীর বাজার যে খুব খারাপ , সে আমরা সবাই জানতাম। কিন্তু আশায় মরে চাষা। তাছাড়া পিছিয়ে আসার পক্ষে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।
  • rivu | 85.102.68.241 | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২১:১৩585165
  • "ভিন্টেজ ইন্দোদা" র কিছু লিংক কেউ দিতে পারেন? ফেরারী চড়া হলো, এবার বেন্টলি চড়া যাক।

    আই বাবু, কি ছেড়ে কি বলি, তবু, এরোপ্লেনের বর্ণনাটা অনবদ্য। কখনো চেয়ে দেখাই হয়নি এভাবে !
  • I | 24.96.143.94 | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২৩:০৪585166
  • ইস্ট হ্যাম স্টেশন থেকে বেরিয়েই হাই স্ট্রীট। সেখান থেকে কয়েক পা এগোলেই পারপেণ্ডিকুলারলি বার্জেস রোড। হাই স্ট্রীট আর বার্জেস রোডের কাটাকুটির জায়গাটাতেই লিডল, যেখানে আমার ইস্টহ্যাম বাসকালে দিনের মধ্যে গড়ে দু-তিন বার করে আসতে হবে; জেমস বলল- চিনে রাখো। আর তার ঠিক উল্টো দিকে রাস্তা পেরোলেই ভিডের অফিস কাম প্ল্যাবের পাঠশালা, যেখানে আমাকে প্ল্যাব পরীক্ষার আগে অবধি ( তার পরেও এমন কি ) আরো বেশীবার আসতে হবে। জেমস, বলা বাহুল্য, আবার বলল- চিনে রাখো।

    আকাশ কিছু কৃপাসিন্ধু নয়, মেঘলা। নতুন অচেনা শহর, বাড়িঘরদোর সব একরকম , সার সার চলে গেছে রাস্তার দুপাশ দিয়ে , যতদূর চোখ যায়। রাস্তার পাশে কিছুদূর অন্তর অন্তর বড় বড় গাছ, এই বসন্তশুরুতে তারা বেশ সবুজ হয়ে আছে, আর কিছুদিন বাদেই ফল কালার দেখা হবে। ব্যস্তসমস্ত গাড়ি ও লোকজন হুস হাস এদিক-সেদিক বেরিয়ে যাচ্ছে। আকাশের ওপরের আকাশ দিয়ে সাদা রেখা টেনে একাধিক জেট প্লেন চলে যাচ্ছে, তাদের ধোঁয়ার রেখায় কাটাকুটি হয়ে যায়। সেদিকে তাকিয়ে আনমনা জেমস ঠেঁট ভোজপুরীতে বলে-বোম মেরে ফেলে দিতে হয় এইসব যন্তর;কতদূরে এনে ফেলেছে।

    রাস্তাঘাট ভেজা ভেজা , হাওয়ায় অন্যরকম ভেজা গন্ধ, হাওয়া এসে সুঁচের মত বিঁধে যাচ্ছে গায়ে। বিলেতের উপযোগী শীতবস্ত্র কিনতে আমার বোনকে পাঠানো হয়েছিল গজকুমারের দোকানে, আমি তখন নাওয়াখাওয়া ভুলে পরীক্ষার পড়া পড়ছি, -সে একটি পার্ক অ্যাভেন্যু'র জ্যাকেট কিনে এনে হাজির। সেই জ্যাকেট পরে কলকাতার শীত দিব্য ঠেকিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু এই লণ্ডনের ভেজা বাসন্তী হাওয়া তাকে বিন্দুমাত্র রেয়াত করছে না। প্রত্যেক রন্ধ্র দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে, মনে হয় যেন স্রেফ একটা পাতলা জামা পরে আছি, গায়ে আর কিছু নেই। পাশ দিয়ে ঝকঝকে গাড়ি বেরিয়ে যায়, হুড খোলা, গাড়ির মধ্যে হুল্লোড়ে ক`টি কালো চামড়ার যুবা, অত্যন্ত হাই ভল্যুমের গানের তালে তালে গাড়ি থর থর করে কাঁপছে। এই যুবকদের প্রায়ই দেখতে পাবো বার্জেস রোডে, হাই স্ট্রীটে, তেমনি জোরে গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছে, একদিন দেখব পুলিশসঙ্গে, পুলিশ তাদের পিছমোড়া করে গাড়ির ওপর ঠেসে ধরে আছে।
    বাড়ি খোঁজা শুরু হল। কোথাও তেমন আশা নেই। জেমসই ঘোরাচ্ছে বিভিন্ন চেনা-আধচেনা ঠেকে, আমি ওদের সঙ্গে সেঁটে রয়েছি। এই ইস্ট হ্যামে বেশ কিছু লোকের উপার্জনের একটা বড় অংশ আসে ভিনদেশী ডাক্তারদের ঘর ভাড়া দিয়ে, প্রায়শই তা সরকারী নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে না। এ কাজে এশীয়রা এগিয়ে যদিও, ইংরেজরাও কম যায় না। ক্কচিৎ রেইড হয়, কোনো কোনো বাড়ি সীল করে দিয়ে যায় পুলিশ। এখন যেমন একটা বাড়ি দেখতে এলাম, একজন ইংরেজের বাড়ি, তার সর্বত্র অকুপায়েড, শুধু অ্যাটিকে জায়গা হলেও হতে পারে। অ্যাটিকে উঠে দেখা গেল, কপাল মন্দ, আমাদের কিছু আগেই জনা দুয়েক এসে তাদের দেশোয়ালী বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে বুক করে গেছে, সেখবর এখনও বাড়িওলা জানে না। দুদিকে ঢালু হয়ে ছাদ নেমে গেছে, তার নিচে দম বন্ধ করা তেকোনা দুফালি জায়গা, তারি মধ্যে ম্যাট্রেস পেতে দুজন মানুষ ঘরগেরস্থালি করছে; চারিদিকে বইপত্তর-টেবল ল্যাম্প-জামাকাপড় ছড়ানোছেটানো, সবকিছুর ওপরে থাক থাক বিষণ্ণতা জমে আছে, ছেলেদুটির মুখেও। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, এই সরু ফালিটুকুও ফাঁকা নেই। মুখ তেতো লাগে।

    জেমসদের লক্ষ্য হল যতটা সম্ভব কম পয়সায় একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করা। আমি ওরকম পেরে উঠবো না মনে হচ্ছিল। আমি জানি এখানে নীলাঞ্জনাদি আছে, ফোন নম্বর নিয়ে এসেছি সেখানে গেলে একটা সুরাহা হতে পারে, কিন্তু বাড়ির নাম শুনে জেমসরা নারাজ। সে নাকি এক্সপেন্সিভ হবে। কিন্তু শেষমেশ আর কোথায় জায়গা না পেয়ে জেমসদের সায় দিতেই হল। ফোন করে পৌঁছে গেলাম 4, লিডইয়ার্ড রোড। দরজা ঠকঠকাতেই এক অচেনা মহিলা দরজা খুলে-''ইন্দ্রনী-ই-ল'' বলে চওড়া একটা হাসি দিয়ে দু হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল। নীলাঞ্জনাদি ! একে তো বেশ রোগা হয়ে গেছে, তায় শার্ট-প্যান্ট পরা। চিনতে পারিনি।
    বাড়ির হিল্লে হয়ে গেল। বাড়িওলা একজন শ্রীলঙ্কান তামিল, দেখাশোনা করে মেরি বলে একজন মহিলা, নীলাঞ্জনাদি তার সঙ্গে কথা বলে সব বন্দোবস্ত করে ফেলল।বেশ পছন্দসই বড় ঘর, চারজনের থাকার মত, আমরা অবশ্য তিনজন। বলি নি, আমাদের সঙ্গে বিনোদ বলে অন্ধ্রের একটি ছেলে এসে জুটেছিল। জেমসদের অবশ্য পছন্দ নয়, ঘরভাড়া শুনে মুখ ভার, বলল- অন্য একটা বাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেলেই এ বাড়ি ছেড়ে দেবো। আমি পড়েছি ফ্যাসাদে, আমার অন্যত্র নড়তে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু স্টাডি পার্টনার না পেলেও আবার পরীক্ষা পাশে প্রবল মুশকিল। কিন্তু তখন আর ভাবার অবস্থা নেই, হাঁটু ভেঙ্গে আসছে ক্লান্তি ও শীতে, একটু হাত-পা না মেললে আর চলছেই না। পরের ভাবনা পরে। নীলাঞ্জনাদি ডেকে চা খাওয়ালো, বলল -"এই দ্যাখ কমন কিচেন, কমন আভেন, এই যে লু'-শুনে কিছুই বুঝলাম না, তারপর মাথা খাটিয়ে বের করলাম বাথরুমের কথা বলছে। জল খাবো বলাতে বলল -"এই যে গ্লাস আছে, এই যে কল সিঙ্কের ওপরে, খুলে খেয়ে নে'। আমি কাষ্ঠ হেসে বললাম-বাঙাল পেয়ে ঠাট্টা করছো? নীলাঞ্জনাদি বলল-"আরে না, এখানে কলের জলই সবাই খায়'।
  • Abhyu | 107.89.18.209 | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২৩:১৫585001
  • তের বচ্ছর হয়ে গেল আমি প্রবাসী। ডাক্তারের লেখা পড়ে নতুন করে মন খারাপ হয়। ফিরে যেতে চাই আমার নিজের শহরে।
  • I | 24.96.143.94 | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২৩:৪৩585002
  • অভ্যু মাইট, ঃ-( ম্লান হাসির ইমো
  • Yan | 161.141.84.239 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৬:২৩585003
  • বড়াই, খুব ভালো লাগছে। ঐ অদ্ভুত এক মৃত্যুনীলের মধ্য দিয়ে-- একদিন আমিও---প্রথম আকাশে ওড়ার প্রায় বিশ বছর আগেই---কিন্তু সে থাক। তোমার এই লেখা বড় ভালা পাই, লেখো অনেক।
  • aka | 85.76.118.96 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৭:২৫585004
  • আমার এমন সহজিয়া লেখা ভালো লাগে। আবার বললাম। ভাষার ঝকমারি হল টেকনিক, সেটা একটু এদিক ওদিক করে আয়ত্ত করা যায়। কিন্তু সহজিয়া ভাষায় গভীর পর্যবেক্ষণ সেটা আকর্ষণ করে।
  • ঐশিক | 24.140.33.186 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১০:৫১585005
  • ইন্দোদা খুব ভালো লাগছে
  • I | 24.99.177.222 | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৮:৪৩585006
  • 4, লিডইয়ার্ড রোড যেন একটি মিনি উপমহাদেশ। এখানে তামিল আছে, মালয়ালী আছে, অন্ধ্রের লোক আছে, বাঙালী, বিহারী, ঝাড়খণ্ডী, মুম্বাইবাসী আছে, পাকিস্তানী আছে। আর বাড়িওলা ও তার চেলাচামুণ্ডারা তো শ্রীলঙ্কান তামিল। নীলাঞ্জনাদি'র রুমমেট একটি পাকিস্তানী কন্যা, খুব সুন্দরী, তবে নীলাঞ্জনাদি'র সঙ্গে তার বাক্যালাপ বন্ধ। নাকি কবে ভারত সম্বন্ধে ডেরোগেটরি মন্তব্য করেছিল। অতএব একই ঘরে দুই খাটের মাঝখানে ওয়াঘা সীমান্ত। নীলাঞ্জনাদি'র আরো দাবী, কন্যা নাকি একই জ্যাকেট দিনের পর দিন পরে থাকে, গায়ে গন্ধ। এদিকে কড়া আর এস এস রাহুলের ( নাম পরিবর্তিত) আবার পাকি কন্যার সঙ্গে বেশ একটু প্লেটনিক মত। রাহুলের এই পাকিপ্রেম পরে আরো দেখেছি। আসমা বলে একটি ছোট্টখাটো মিষ্টি মেয়ে পরের দিকে আমাদের বাড়িতে পড়তে আসত, তার সঙ্গেও রাহুলের কেমন যেন মাখোমাখো। এই রাহুল একটি অদ্ভুত চরিত্র। বিহারী, বাড়ি শুদ্ধ সব সিপিআই, দাদু না জ্যাঠা সেই পুরনো আমলের বিহারের সিপিআইয়ের কেউকেটা মত ছিলেন, যখন বিহারে সিপিআইয়ের বেশ রমরমা ছিল; রাহুল নিজে ছাত্রজীবনে এস এফ আই করেছে, এখন আর এস এস। অথচ অদ্ভুত পাঠাভ্যাস, মার্কেজ পেলে আর কিছু চায় না। আমাদের মধ্যে সাহিত্য নিয়ে বিস্তর গপ্পো হয়েছে ( নীলাঞ্জনাদিও প্রবল সাহিত্যপ্রেমিক ও বামপন্থী, যদিও ট্যাঁশ), রাজনীতি নিয়ে বিস্তর তক্কাতক্কি হয়েছে,প্রায়শই তা তুমুল ঝগড়ায় গড়িয়ে যেত, মুখ দেখাদেখি বন্ধর মত অবস্থা, নীলাঞ্জনাদি তো একবার রাগ করে দুমদুম করে দোতলার ঘরে উঠে গেল। ভাত পরে রইল, রাত থমথম করছে, নীলাঞ্জনাদি নামে না। রাহুল আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে নীলাঞ্জনাদি'র দরজায় নক করছে- ম্যাডাম, আও , খা লো।

    লিডইয়ার্ড রোডের সেই বাড়ি ছিল কলকাতার মেসের আন্তর্জাতিক একটি সংস্করণ। সারাক্ষণ এ-ওর-তার বন্ধুবান্ধব আসছে -যাচ্ছে, পড়াশুনো হচ্ছে, আড্ডা হচ্ছে। কিম্বা তাকে মিনি শ্রীক্ষেত্তরও বলা যেতে পারে, বত্রিশ জাতের লোকজন জাত খুইয়ে যার-তার হাতের ডুডু ও তামুক এবং অরহান পামুক খাচ্ছে। কিংশুকদা আসত সেই কত্ত দূর থেকে , আধ ঘন্ট -আধ ঘন্টা আসতে-যেতে, আসমা আসত কে জানে কোত্থেকে, থিরু বলে একটি মালয়ালী ছেলে ছিল, খুব লাজুক স্বভাব, লিডইয়ার্ড বাড়ির অ্যানেক্সে থাকত ও দেদার মদ গিলত, তার একজন মোটামত বান্ধবী আসত, জনশ্রুতি সে থিরুর জন্য পাগল ছিল, কিন্তু থিরু তাকে পাত্তা দিত না মোটে; মুম্বাইকার (আদতে বিহারী)রাকেশ আসত এবং হাঃ হাঃ করে ছাদ ফাটিয়ে হাসত, রাকেশ এলেই ঘরটা আলো হয়ে যেত। লণ্ডনবাসের প্রথম রাত্তিরে সে আমায় টি এফ সি-র উইংস অ্যাণ্ড চীপস সেধেছিল-এ লে ঃ, খা লে বেটা- বলে , আমি সলজ্জভাবে প্রত্যাখ্যান করি। পরে অবশ্য ঐ উইংস অ্যাণ্ড চীপস আমার অনেক দুপুরের লাঞ্চ হবে, ওরকম সুস্বাদু খাবার অত অল্প দামে ( দাম ছিল 99 পি ) বিলেতের আর কোথাও পাই নি।
  • I | 24.99.225.99 | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১২:০৯585007
  • আর কার কাছে জানি না, লেখালিখি অন্তত আমার কাছে পুরোপুরি গেরিলা ব্যাপারস্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনযাপনের মধ্য থেকে কখনো আধ ঘন্টা খানেক সময় চুরিচামারি করে বাগিয়ে নিতে পারলে এসে দুছত্তর লিখে যাই। তারপর হয়তো টুংকাই উঠে পড়ে, দরজার বেল বাজে; লেখার যোশ ছেড়ে যায়, লেখা খারাপ হয়ে যেতে থাকে। লেখাকে অ্যাম্বুশ করতে এসে আমিই নিহত পড়ে থাকি।কত লেখা এভাবে মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল। এই আবার আর একটা লেখা শুরু করেছি, এটাকে টেনে নিয়ে যেতে হবে!
  • I | 24.99.225.99 | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১৩:২৪585008
  • লিডল নামের জার্মান রিটেল চেনটি আমাদের নাইয়েখাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল। টেসকো, সেইন্সবারি ও আসডায় গিয়ে নিত্যিদিনের মালমসল্লা কেনবার মত সামর্থ্য আমাদের ছিল না। আমাদের দিন কাটত ডিম ভাত অথবা চিকেন খেয়ে, সস্তার মধ্যে পেট ভরাবার অপশন ওদুটো্‌ই ছিল কেবল। আর মনে কিছু ফুর্তির সঞ্চার হলে খাওয়া হত সস্তার আইসক্রীম, 99 পি-তে বেশ ভালো আইসক্রীম পাওয়া যেত লিডলে, আমার বিশেষ প্রিয় ছিল র‌্যাস্পবেরী রিপল। প্রথম দিন লিডলে গিয়ে জেমস কিছু বেকন কিনল, তারপর আমার দিকে ফিরে বলল-তুমি এসব খাও-টাও তো, এদেশে থাকতে গেলে কিন্তু এসব খেতে-টেতে হবে। আমি তো মহানন্দে সায় দিলাম। সে তো আর জানে না, আমি জাতখোয়ানো বাঙালী, হিঁদুর মধ্যে পড়ি না। সেই প্রথম বেকনের স্বাদ পাওয়া।

    এই খাদ্যও সকলে অবশ্য নিত্যিদিন অ্যাফোর্ড করতে পারত না। প্রায়দিনই বিনোদ প্রমুখ দুপুর-সন্ধ্যে মহালক্ষ্মী টেম্পলে গিয়ে ধর্না দিত চাট্টি গরম ভাত-সম্বর-রসমের জন্যে। আমিও গিয়েছিলাম বার কয়েক, কিন্তু তেমন পোষায় নি, বাবু টাইপের লোক কিনা ! দুপুর-সন্ধ্যেয় রীতিমত ভীড়ে ভীড়াক্কার মহালক্ষ্মী টেম্পল চত্বর, খাবারের গং বাজলেই হুড়োহুড়ি, লোকজন কোনোদিন স্ট্যাম্পেড হয় নি কেন কে জানে। মোটামুটি ঐরকম সময়েই বোধ হয়, দেশে আনন্দবাজার পত্রিকায় ইউ কে-তে চাকুরিপ্রার্থী ভারতীয় ডাক্তারদের দুরবস্থা নিয়ে একটা বড়সড় লেখা বেরিয়েছিল, তাতে মহালক্ষ্মী টেম্পলের কথা ছিল সবিস্তারে। সেই লেখা পড়ে বাড়ির লোকের মনের ভাব কী হয়েছিল , জানার চেষ্টা করিনি।

    জনগণ আর যেত বার্কিংয়ের গুরদোয়ারায়। সে বেশ অনেক দূর ইস্টহ্যাম থেকে , হেঁটে পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট লাগত, লোকের তাও উদ্যমের কোনো ঘাটতি ছিল না। গুরদোয়ারার খাবারটা ছিল বেশ ভালো, গরম গরম চাপাটি-লেবু-আচার-তরকারি সমেত জমজমাট ব্যাপার। রোববার নাকি জিলিপি ও ঘি-চপচপে হালুয়াও দিত, শোনা কথা, আমি কোনো রোববার যাই নি। খেয়ে উঠে চাট্টি করসেবা করতে হত, নিজের থালা ধোয়া ও বটেই, অপরের থালাও ধুয়েমেজে রাখতে হত। ও হ্যাঁ, মাথায় রুমাল বাঁধা ছিল মাস্ট। রাহুল দেখতাম গুরু নানক ও গোবিন্দ সিংহের ছবির সামনে বেশ ভক্তিবিহ্বল হয়ে পড়ত, অনেকক্ষণ কপালে হাত ঠেকিয়ে বিড়বিড় করতে দেখেছি তাকে। শিখ ধর্ম সম্পর্কে বেশ শ্রদ্ধাশীল ছিল সে, শিখরা না থাকলে ভারতবর্ষের যে কী দুরবস্থা হত মুসলিমদের হাতে, সে বিষয়ে এক-আধবার বার্কিং যাওয়ার পথে জ্ঞান দিয়েছিল । বার্কিং গুরদোয়ারায় বসে বসে প্রচুর শিখ মহিলা তরকারি কুটতেন, লেবুর খোসা ছাড়াতেন, রুটি বেলতেন। তাঁদের মধ্যে জনৈক বৃদ্ধা একদিন আমাদের দিকে তাকিয়ে গুরুমুখী ভাষায় অনেক ক্ষণ ধরে কীসব বলে গেলেন। একবর্ণ বুঝিনি, তবে মনে হল বেশ ভর্ত্সনার সুর। আমার পাপী মন। আর একটা গুরদোয়ারাও ছিল, সেটা, লোকে বলে, খালিস্তানীদের। সেখানে খেতে গেলে নাকি বেশ কড়া চোখে তাকানো হত। আমি কোনোদিন যাই নি।

    বার্কিং যাওয়ার রাস্তাটি ছিল অতি মনোহর। গাছের ছায়ায় ছায়ায় ঢাকা একটা বড় স্ট্রেচ আমাদের পেরোতে হত, দুপাশে মাইলের পর মাইল গমের ক্ষেত দেখতে পেতাম। রাস্তার দুধারে অচেনা বুনো ফুল ফুটে আছে এবং রং ও গন্ধ ছড়াচ্ছে। তখন বসন্তকাল , আগেই বলেছি। ব্লুবেল, পিটুনিয়া, ক্লোভার, ডেইজি ফুটে ওঠার সময়। রাস্তা উঁচু -নীচু, বেশ শীত, কিন্তু রোদ্দুর ও নীল আকাশ, বেশ একটা দার্জিলিং দার্জিলিং ভাব। এক পাশে সার সার বাড়ি, সামনে সুন্দর করে সাজানো ছোট বাগান, ঝাঁপালো লোমওয়ালা কুকুর ছুটে বেড়াচ্ছে, দুটি সোনালী চুলের বাচ্চা খেলা করছে। এই সবের মধ্য দিয়ে আমি রুটির সন্ধানে কয়েক মাইল হেঁটে গুরদোয়ারায় যাচ্ছি। কোথাও একটা জলা, তাতে বার রীডের জঙ্গল, জলজ লিলি ফুটে আছে। রাস্তার একটা স্ট্রেচ বেশ উঁচু এবং লম্বা ব্রীজ দিয়ে সংযুক্ত। সেই ব্রীজের ওপর দিয়ে যাচ্ছি, অনেকটা নীচে বিশাল চওড়া রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে বিশাল বিশাল সব ঝাঁ চকচকে ট্রাক সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে, অতবড় ট্রাক জম্মে দেখি নি। ব্রীজের রেলিং ধরে নিচু হয়ে ঝুঁকে থাকি। কিংশুকদাকে বলি নাকি নিজেকেই মনে মনে বলি মনে নেই- নবনীতা দেব সেন একবার একটা টিভি সাক্ষাৎকারে হাসতে হাসতে বলেছিলেন-জীবনটাকে যদি যুদ্ধ ভাবো, তাহলে শুধু রক্তপাতই হবে।
  • ঐশিক | 132.181.132.130 | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১৯:১৭585009
  • ইন্দো দা সাথে আছি, খুব ভালো লাগছে আমার পড়তে, জানি ব্যস্ততা আছে তাও লিখে যেও সময় করে
  • sosen | 111.63.231.102 | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২০:০৭585010
  • আছি , আছি
  • nina | 79.141.168.137 | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৪:৪৬585012
  • আমিও, শত কাজ ফেলেও--------------
  • 4z | 109.227.143.99 | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৬:২৮585013
  • ইন্দোদার কলমে ভর করে মনটা দশ বছর পিছিয়ে গেল। মনে করিয়ে দিচ্ছে কত কিছু। লিখতে থাকো ইন্দোদা, থেমো না।
  • I | 24.99.255.181 | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২০:৩৫585014
  • বসন্ত শেষ হয়ে গ্রীষ্ম আসছে লণ্ডনে। লোকজন জেগেই ছিল, আরো বেশীমাত্রায় জেগে উঠছে। পাবে পাবে ধুমধাড়াক্কা ভীড়, জায়ান্ট স্ক্রিনে ফুটবল দেখানো হচ্ছে, জনতা সে কী উত্তেজিত ! সেই প্রথম জানতে পারা, ফুটবল হল ইংরেজদের প্রিয়তম খাদ্য, ফিশ অ্যাণ্ড চিপসকে সে দু-গোল দিয়ে বসে আছে । আর জাতীয় পানীয় বীয়ার। বাবা-ছেলে দল বেঁধে বীয়ার মাগ হাতে জার্সি পরে ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাচ্ছে। কিন্তু ইস্টহ্যামের লোকেরা কাকে সাপোর্ট করত? জানবার চেষ্টা করি নি, ফুটবল আমার চায়ের কাপ নয়। ওয়েস্টহ্যামকে কী?
    পাবগুলোতে ঢুকতে এক আধবার ইচ্ছে হত, কিন্তু আমি ও রসে বঞ্ছিত গোবিন্দদাস। কতকটা সেই কারণে, অনেকটাই সাহসের অভাবে,কিছুটা সঙ্গীসাথীহীনতায় ও ফুটো পকেটের প্রতি মমত্ববশতঃ পাবে আর ঢোকা হয়ে উঠল না। ইস্টহ্যাম থাকাকালীন। পরে একবার দীপাংশু পাবমিল খাইয়েছিল, আহা, সে স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
    আর সে কী যৌবনজলতরঙ্গ ! আহ গ্রীষ্ম, লণ্ডনের গ্রীষ্ম! তৃতীয় বিশ্বের যৌন উপবাসী জনতার জন্যে যে এমন সহ্যের অতিরিক্ত দৃশ্যসুখ রচনা করতে নেই, সেকথা লণ্ডনললনাদের কে বোঝাবে। রাকেশ একদিন দুপুরবেলা সিরিয়াস মুখ করে এসে বলল-রাহুলভাই, হাইস্ট্রীট যাইয়ে, লড়কিয়াঁ নাঙ্গে ঘুম রহী হ্যায়। অবস্থা প্রায় তেমনই। সে আরেক কালচারাল শক, কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় যাবে। হনুদা যারে আজকের রবিবারোয়ারি-তে কয়েছেন ধর্মসংকট। তবে পরীক্ষার টেনশন আমার কাজ কিছু সহজ করে দিয়েছে, কেননা এখন দিন কেটে যায় প্ল্যাবের গ্রিলিংয়ে। বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে চলেছে, যত প্ল্যাবের দিন এগিয়ে আসছে। আমার আবার জোড়া ফাঁড়া, প্ল্যাবের দুদিন বাদেই এম আর সি পি-র ডেট পড়েছে। সস্তায় মেরে দেওয়ার জন্য একসঙ্গে ডেট নেওয়া, এখন মনে হচ্ছে কী মূর্খামি করেছি। প্ল্যাবের চোটে এম আর সি পি-র পড়া চৌপাট। যদি একূল ওকূল দুকূল যায়, তাহলে হাতে রইল দেশে ফেরার টিকিট ও বেকারত্ব। এতগুলো টাকার অনিশ্চিত ইনভেস্টমেন্ট ! পরে হিসেব করে দেখেছিলাম, দু-দফার বিলেতবাস ও পরীক্ষা-টিউটোরিয়াল মিলিয়ে আমার সর্বমোট খরচা পড়েছিল ন' লাখের কিছু বেশী।
  • h | 127.194.255.103 | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২০:৫৪585015
  • যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত বা আহত সাথী কে যেহেতু ফেলে যাওয়াটা কাজের কথা না, তাই এই লেখাটিকে কাঁধে করে সুস্থ জীবন দেওয়া ডাক্তারের শত কাজের একটা কাজের মধ্যে যেন পড়ে, এই বলে গেলাম, নইলে খুব খারাপ হবে।
  • dd | 125.187.60.36 | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২১:০৪585016
  • এই যে পোস্টিং করছি সেটা খুব খারাপ হচ্ছে। মানে অনুচিৎ। হয়তো স্লাইটলি বেআইনী ও। অনুপ্রবেশ গোছের।

    মানে যেটা বলতে চাই যে উল্লিখিত হানুরচনা বড্ডো ভালো হয়েছে। য্যামনটা হয় ।তা এই টই ছাড়া আর কোথায়ই বা লিখতাম শুনি?
  • I | 24.99.255.181 | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২১:৫৫585017
  • একটা বড়সড় পোস্ট এইমাত্র উড়ে গেল। বড় ভালো হয়েছিল। তাও যে আমি এখনো কুল রয়েছি, সে শুধু সাধুসঙ্গের পুণ্যফলে। আজ সকালের রবিবারোয়ারির হনুউবাচ পাঠের পুণ্য ইত্যাদি।
  • sosen | 125.242.197.53 | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২২:১১585018
  • লেখকের জন্য উপদেশ-
    একটি ওয়ার্ড ডক খুলিয়া রাখুন, কয়েক মিনিট অন্তর অন্তর কন্ট্রোল সি ও কন্ট্রোল ভি করিতে থাকুন।
  • I | 24.99.255.181 | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২২:৫৮585019
  • প্ল্যাব একটি গ্রেট লেভেলার। হেথা শক,হুণ , পাঠান, মোগল, যে যার জাতিগৌরব-বংশগৌরব ইত্যাদি ফেলে রেখে এক হাঁড়িকাঠে এসে মাথা নোয়ান। যেমতি এতাবৎ অর্জিত যাবতীয় পুণ্যফল চৌকাঠের ওপাশে ময়লা জুতোর মত খুলে রেখে মানুষজন যান বারযোষিতসন্দর্শনে। এখানে আপনি MD/MS নাকি DM/MCh না শুধু MBBS , কদ্দিন ডাক্তারী করেছেন, ক'জন রোগীকে হাত ধরে এ ভবসাগর , সে বৈতরণী পার করিয়েছেন, সে প্রসঙ্গ অতীব তুশ্চু, আলতো ফুঁয়ে উড়িয়ে দেওয়ার শিমূল তুলো, খরবর্ষায় পাহাড়ীনদীজলে ভেসে যাওয়া কাষ্ঠখণ্ডবৎ। শুধু একটি প্রশ্ন, একটিই জ্যান্ত প্রশ্ন পবিত্র লিঙ্গের ন্যায়, তুষারমেঘভেদী হিমাচলশৃঙ্গের ন্যায় জেগে আছে- যে, হ্যাঁ গো মহাই, সবই তো বুঝলুম, আপনার নখের তলায় তিন থাক ময়লা, নখ কাটবার অবসর বিশেষ নেই,দেশে রোগীর চাপে সাত দিন চান করেন না জানি, উদরকম্বল আবৃত করবার মত রেডিমেড পেন্টুল বাজারে দুর্লভ; কিন্তু আপনি , ইয়ে, পারবেন তো, বিলেতীমতে ডাক্তারকেরাণীর কাজ পারবেন তো?

    এইরূপ কাঙ্খিত বৈদ্যকরণিক হওয়ার জন্য আমাদের অতএব শিখতে হত কায়দামাফিক বিপি মাপা, ভেনিপাংচার, সরলতম স্টিচ করা ইত্যাদি, এবং হ্যাঁ, সবচেয়ে জরুরী যে বিষয়- সায়েবী কেতায় হিস্ট্রি নেওয়া ও কাউন্সেলিং-ঐ দুটি স্টেশনেই সবচেয়ে বেশী ছাত্র ফেল করত কিনা। বিদ্যে বস্তুতঃ তেমন কিছু না, কিন্তু সব বিষয়েরই কিছু কিছু, যেটা স্পেশালিস্ট ট্রেনিং নেওয়ার এতকাল পরে আমাদের অনেকেরই অসুবিধা হত; অন্যান্য বিষয়েই মূলতঃ, কিন্তু কখনো কখনো নিজের বিষয়েও, কারণ ঐ যে বললাম কেতামাফিক হওয়া চাই ! তাই এমনটাও হতে দেখা যেত স্টিচ দেওয়ার স্টেশনে ফেল করছেন অভিজ্ঞ সার্জেন কিম্বা বিপি মাপায় ফেল মারলেন কার্ডিওলজির ডি এম। আর তাই সেসবের ট্রেনিং নেওয়ার জন্য কাতারে কাতারে আমরা নাম লেখাতাম মাথা মুড়িয়ে ও ট্যাঁক খসিয়ে নানাবিধ প্ল্যাব ট্রেনিং সেন্টারে, আমরা নানান বয়স ও অভিজ্ঞতার ডাক্তার, আসছি মূলতঃ উপমহাদেশের নানান আনাচ-কানাচ থেকে , এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য থেকে, আফ্রিকা থেকে, পূর্ব ইউরোপ থেকে খুব অল্পই(কেননা ইউরোপীয়ান ইউনিয়্ন, ব্রেখটের গানের আট নম্বর ঘোড়া)। আমাদের পড়াতেন যাঁরা, প্রায়শঃই তাঁদের বয়স ও ডাক্তারী অভিজ্ঞতা আমাদের তুলনায় কম, কিন্তু প্ল্যাবের ঐ কটি স্টেশন তাঁরা পাখিপড়ার মত রপ্ত করেছেন।

    মাঝেমধ্যে ইস্টহ্যামের চার্চে যাওয়া মেগা ট্রেনিং সেশনের জন্য, সে এক মহতী জমায়েত। কখনো বৃষ্টি, কয়েকশো ভিজে ছাতা চার্চের সামনের ঘরে মেলা। ফেরার পথে রৌদ্রাভাষ, লেদার জ্যাকেট পরা বাইকারদের রেস। ফেরার পথে রাহুলের সঙ্গে সিপাহীবিদ্রোহে বাঙ্গালী রেনেশাঁপুরুষদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা। মসে ভরা পাঁচিল থেকে ম্যাগপাইয়ের রূপোলী-কালো উজ্জ্বল উড়াল। লাল-সবুজ চুলের একটি মেয়ে তার কিশোর বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। দেশের কথা আনমনে মনে পড়ে যায়। আমার ছেলের বয়স চার মাস।

    কখনো বেরিয়ে আসি বাড়ির পেছনদিকের খোলা উঠোনটাতে। চারিদিকে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। অন্যান্য বাড়িতে এই টুকরোটায় লিলিপুল কিম্বা সবুজ ঘাসে ঢাকা বাগান, এখানে সেসব নেই, কংক্রিটে মোড়া। আউটহাউজ মত একট আছে, সেখানে থিরু থাকে, আর একজন, তার নাম ভুলে গেছি। প্রচণ্ড অগোছালো ঘর। অগোছালো জীবন। নানান বিভঙ্গে দাঁড়ানো-শোয়ানো ভরা কিংবা খালি বোতলে ভর্তি। আকাশে এই মেঘ এই রোদ্দুর। প্রায়শঃ মেঘ অথবা নীল চিরে জেটপ্লেনের যাতায়ত, ল্যাজ থেকে বেরোনো ধোঁয়ার রেখা। কোথায় এনে ফেলেছে !

    সামনের গাছটার নাম জানি না। পাতাগুলো মেপলের মত, আমরা ওর নাম রেখেছি মেপলিশ। ফল কালারে ভরপুর গাছটা মায়া বাড়ায়। নীলাঞ্জনাদির সঙ্গে বসে বসে আমরা বৈষ্ণবভোগ্য আর্ল গ্রে চা খাই। ডিলান টমাস কিম্বা উইলিয়াম গোল্ডিং নিয়ে গপ্পোগাছা করি। পাওলো কোয়েলহোকে নাকচ করি। ইয়েট্‌স নীলাঞ্জনাদির খুব প্রিয়। ট্রেড সফট্‌লি বিকজ ইউ ট্রেড অন মাই ড্রিমস -লাইনটা মাথা থেকে বের করতে পারি না , আমি বলি। নীলাঞ্জনাদি আবৃত্তি করে-

    HAD I the heavens' embroidered cloths,
    Enwrought with golden and silver light,
    The blue and the dim and the dark cloths
    Of night and light and the half-light,
    I would spread the cloths under your feet:
    But I, being poor, have only my dreams;
    I have spread my dreams under your feet,
    Tread softly because you tread on my dreams

    নীলাঞ্জনাদি'র ঘরে বিশাল বড় টেডি পুতুল, তাকে হাগ করে সে বাবিলের দুঃখ ভুলতে চায়। বাবিল একটি ভদ্রসভ্য পাগ, নীলাঞ্জনাদিকে ছেড়ে সে-ই বা কেমন আছে কে জানে। এছাড়াও নীলাঞ্জনাদি'র বিছানায় শুয়ে থাকে জুজুপ। জুজুপ একজন রবারের সাপ, আশ্চর্য রকম জ্যান্ত দেখতে। কিন্তু সাত চড়ে রা নেই, এত শান্তশিষ্ট, সহবতজানা। রাহুল ওকে নিয়ে কী পরিমাণ টানাটানিটাই না করেছে, ল্যাজে গিঁট পাকিয়ে দিয়েছে,দেয়ালে ছুঁড়ে মেরেছে; একটিবারের জন্য সে ফোঁস পর্যন্ত করেনি, কামড়ানো তো দূরের কথা। সুকুমার রায় যে জুজুপের কথাই ইনিয়েবিনিয়ে বাবুরাম সাপুড়েকে বলেছিলেন, সে তো আমরা সবাই জানতাম।

    সেই জুজুপও একসময় ছিঁড়ে গেল। তখন আর আমরা চার নম্বর লিডইয়ার্ড রোডে থাকি না, যে-যেখানে পারি ছিটকে গেছি। লিডইয়ার্ড বাড়িতে শত টেনশনের মধ্যেও আমাদের মুখে হাসি ছিল, বৈষ্ণবভোগ্য চা ছিল, মনে জ্বলজ্বলে আশা ছিল। তখন সেসব কোথায় ! আশা ফিকে হয়ে হয়ে ছেঁড়া ত্যানার মত ঝুলছে , আমরা সবাই সারাক্ষণ রেগে থাকি, আমাদের কারো চাকরি নেই- বাকরি নেই। এ ওকে চিবিয়ে খাচ্ছি। জুজুপ যে ছিঁড়ে যাবে এতে আর আশ্চর্য কী !
  • Abhyu | 85.137.0.209 | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২৩:৩০585020
  • বড় ভালো লেখা।
  • dd | 125.187.32.123 | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২৩:৩৯585021
  • ওঃ।
    আমার ইন্দোদা আবার,ফের,পুনর্বার ইন্দোত্বায় ফিরেছেন। পুরো হীরকখন্ডোগুলি। চমকাচ্ছে।

    ঠাকুর তো বলেইছেন "ও রে পোদো, অ্যাতো উতলা হস নে। ইস্টব্যাংগোল আর ইন্দোদায় বিশ্বাস রাখ। উনারা ফির্বেন"।

    পোদো দাঁত কচলায় ।"কিন্তু ছিপিএম ফের হেরে যাবে"।
  • ঐশিক | 132.181.132.130 | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১২:২৮585023
  • এরকম লেখা পড়তেই বার বার ফিরে আসি গুরুতে
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন