এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বাড়ি বদলে যায়।

    I
    অন্যান্য | ১৭ জানুয়ারি ২০১৩ | ৩৩৮৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Yan | 161.141.84.239 | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০১:৪৯585024
  • বড়াইদাদা ফিরেছেন, আহা, চমৎকার!!!!!
  • I | 24.99.23.13 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৮:৩২585025
  • প্ল্যাব, এম আর সি পি (ফার্স্ট পার্ট) দেওয়ার পর যেন একটা বিশাল ভার নেমে গেল কাঁধের ওপর থেকে। একদিন তাহলে সেন্ট্রাল লণ্ডন দেখতে বেরোতে হয়। আমার রেস্ত সামান্যই, কতটুকুই বা ঘুরতে পারবো। একা যেতে ইচ্ছে করে না, ভরসাও হয় না। অভিজ্ঞ কাউকে দরকার। পাকড়ালাম বিনোদকে। সে বেটা খালি তা-না-না করে। অনেক সাধ্যসাধনার পরে বোঝা গেল, তার সমস্যা অর্থকরী। তবে ঘুরতেও যে খুব আগ্রহ, তেমনটা নয়। আমায় বলল, তুমি যদি আমার আদ্ধেক ভাড়া দাও, তাহলে যাবো। তাই সই। বিনোদ পরে আমায় বলেছিল, আমি অন্ধ্রের চাষীর ছেলে। বাবার আয় তেমন কিছু নয়। হাতে পয়সাকড়ি বেশি নেই, যা আছে ,জলদি ফুরিয়ে আসছে। ভালো ইংরাজী জানি না। আগেরবার প্ল্যাব পাশ করতে পারি নি। দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে আছি। এবার পাশ করতেই হবে। তাড়াতাড়ি একটা চাকরি জোগাড় করতে হবে। নইলে মুখ দেখাতে পারবো না। বাবার এতগুলো টাকা ....

    দিনটা ছিল ঝকঝকে, রৌদ্রোজ্জ্বল। লণ্ডন ব্রিজের ওপর নিত্যযাত্রীদের সেই বিখ্যাত ব্যস্ততা ততটা ছিল না, আমরা যখন গেছি তখন বেলা খানিকটা গড়িয়ে গেছে। লণ্ডন ব্রিজ থেকে নেমে টাওয়ার ব্রিজের দিকে হাঁটছিলাম টেমস পাথ ধরে, ডানদিক দিয়ে। একটি যুবক একমনে চেলো বাজাচ্ছিল, কেউ শুনছিল কিনা কে জানে, তার সামনে কেউ অন্ততঃ দাঁড়িয়ে ছিল না। কয়েকজনকে ছবি আঁকতে দেখলাম। টেমস পাথের এই স্ট্রেচটুকু খুব যত্ন নিয়ে সাজানো।, মাঝেমধ্যেই পাথরের প্লাকে কবিদের উদ্ধৃতি। বাচ্চাকাচ্চাসমেত অনেকে ছুটি কাটাতে এসেছেন, সুন্দর ফুটফুটে নীল চোখের বাচ্চারা টলমলে পায়ে এদিক ওদিক দৌড়ে আসছে। নদীর ধার ঘেঁষে কিছু ইতিহাসমাখা যুদ্ধজাহাজ দাঁড় করানো, তার মধ্যে HMS Belfastএর কথা মনে আছে। সেটি এখন একটি মিউজিয়াম। লোকজন গিয়ে ঘুরে আসছেন। আমরা গেলাম না, টিকিটের পয়সা নেই। একজায়গায় ফটোগ্রাফির বিশাল একটা ওপেন এয়ার প্রদর্শনী, ফটোগ্রাফার ভদ্রলোকের নাম মনে নেই। সব ছবিই হেলিকপ্টার থেকে তোলা। গোটা পৃথিবীর নানান এলাকার ছবি। একে তো ছবিগুলির ঐ বিশালতা, তার ওপরে সারা পৃথিবী এসে উপুড় হয়ে পড়েছে রৌদ্রমাখা এই নদীটির পাড়ে, যে জল ও ইতিহাস একসঙ্গে বয়ে নিয়ে চলেছে। এই নদী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কলোনিয়াল শক্তির উত্থান ও তার পতন দেখেছে, রক্তময় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে, একে নিয়ে ক্লদ মোনে ছবি এঁকেছেন, চার্লস ডিকেন্স উপন্যাস ফেঁদেছেন, শার্লক হোমস তো ওয়াটসনকে সঙ্গে নিয়ে অথবা না নিয়ে মাঝেমধ্যেই এই নদীটির আশপাশ ঘুরে গেলেন, তাঁর ভবঘুরে গুপ্তচর বাচ্চারা এর পাড়েই বড় হয়েছে, খবর জোগাড় করে হোমসের কাছ থেকে পেনিটা-আশটা পেয়েছে। এর বন্দরে বন্দরে জাহাজে করে পৃথিবীর প্রায় সবখানটার জল-হাওয়া-গন্ধ-আর মানুষ, তাদের ভাষা, তাদের দেশের ফুলের গন্ধ, লোকগান, ফেলে আসা বৌয়ের স্মৃতি, কোহিনুর হীরে আর বাজরার রুটি, কয়লা আর সোনা, ঘাম আর সাভানার রোদ্দুর এসে পৌঁছেছে। এই নদীটা আসলে পৃথিবী। এর পাড়ে , তাই সেই খোলা পৃথিবীর ছবি দেখে সেদিন মন উচাটন হল খুব। ছবিসংগ্রহে আমার দেশের ছবিও কয়েকখানা ছিল। বেনারসের এক কাপড় রং করবার ভাঁটি, তার খুব কাছ দিয়ে উড়ে গেছে হেলিকপ্টার, অজস্র শ্রমিক, তাদের কয়েকজন মনে হল বিরক্ত হয়েছে, হাত নেড়ে ছবি তুলতে বারণ করছে। আহ ! সে কী রংয়ের রায়ট !

    শান্ত নদী, ছোট নদী। আমাদের দেশের নদীগুলির কাছে কিছুই না। নদীর ওপর দিয়ে নানান আকার ও আকৃতির জলযান ভেসে যাচ্ছে; অনেক মানুষ রোয়িং, কায়াকিং করছেন। এই একখানা জাহাজ যাচ্ছে, তাকে যেতে দেবার জন্য টাওয়ার ব্রীজ দু-ভাগ হয়ে খুলে গেল ঐ যে। সেই দুর্লভ দৃশ্যের ছবি তুলবার জন্য কাতারে কাতারে বিদেশী ট্যুরিস্ট দৌড়ে আসেন, অজস্র ক্যামেরা একসঙ্গে ক্লিক ক্লিক করে ওঠে। পুলকিত বিস্ময়ে রাত্রিকে ফোন করি, যদিও এই ভর দুপুরবেলা ফোন চার্জ বেশী, কিন্তু আনন্দ চেপে রাখতে পারি না। একদিন আমরা সবাই মিলে এই নদীর পাড়ে ঘুরবো, তখন আমার একটা ডিসেন্ট চাকরি হয়েছে, সোনালিকে কোনো ফটোগ্রাফি স্কুলে ভর্তি করে দেবো; মাঝেমাঝে ইউরোপ বেড়াতে যাবো। হা জীবন !

    না, আমরা আর তেমন কোনো সাইট সিইং করি নি। আমরা লণ্ডন আইতে চড়ি নি, টাওয়ার অফ লণ্ডনে যাই নি, মাদাম তুস্যোয় ঢুকিনি, ব্রিটিশ মিউজিয়াম, টেট মডার্ন, সায়েন্স মিউজিয়াম-কোত্থাও না। পয়সা লাগে না? শুধু হাইড পার্কে গেলাম এর পর, তাতে টিকিট লাগে না, আর ঘুরে এলাম রাণীর বাড়ির সামনেটা থেকে। বিখ্যাত চেঞ্জ অফ গার্ড দেখতে পাইনি, প্রচুর হাভাতে ট্যুরিস্ট দেখেছি, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, এই বুঝি রয়াল ফ্যামিলির কেউ বেরিয়ে এসে তার হাত ঝাঁকিয়ে বলবেন, হ্যালো, হাউ ডু য়ু ডু? এর থেকেও হাভাতেরা বাকিংহাম প্যালেসকে পেছনে রেখে ছানাপোনাসমেত পোজ দিচ্ছেন। বেশ একটা মেলা-মেলা ভাব চারপাশে, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বইয়ের থেকে উঠে আসা গরানহাটা কিংবা ঝিকড়গাছার মেলা; শুধু বড় বড় তেলেভাজা আর রসটুবুটুবু জিলিপি-অমৃতি বিক্কিরি হচ্ছে না পদ্মপাতায় করে, এই যা। বাঙালী একাই হাভাতে নয়, সেই প্রথম জানা গেল।

    চিরকাল শুনে এসেছি হাইড পার্কে বক্তৃতা হয় এবং লণ্ডন শহরে নাকি অনেক বাগ্মী পাগল আছে, তাঁরা লোক থাকলে ভালো, নাহলে একা একাই হাত পা নেড়ে তড়বড়িয়ে বকে যান, তুশ্চু দুদিনের দুনিয়াদারিতে টাকাপয়সার তোয়াক্কা বিশেষ করেন না। সত্যিকারের হাইড পার্কে তেমন কাউকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হলাম। শুধু মাইল মাইল সবুজ শান্তিকল্যাণ বিছিয়ে রয়েছে, গাছে গাছে ঢাকা। মাঝেমধ্যে ওয়াটার বডি, তাতে অলস রাজহাঁসেরা ভেসে বেড়াচ্ছে,ওদের কোনো প্ল্যাব নেই। জলের ধারে উইপিং উইলো ঝুঁকে পড়েছে, এখানে সেখানে বোর্ডে লেখা রয়েছে হাইড পার্কের ফ্লোরা ও ফনা সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ। বিনোদ আর আমি একটা বেঞ্চে বসি, জলের ধারে। বসে বসে প্যাকেট খুলে বিস্কুট খাই। জল খাই। কেঁদো কেঁদো কাঠবেড়ালীরা কাছে এসে জুলজুল করে তাকায়। মানুষ সম্পর্কে ওদের কোনো ভয়ভীতি নেই। ওদেরও ভাগ দিই। অলস হাওয়ায় ফর ফর করে একটা খবরের কাগজের পাতা গায়ের ওপর উড়ে এসে পড়ে। তাতে লেখা NHS -এ চাকরির সঙ্কট। আর লেখা ভারতীয় ও ফিলিপিনো নার্সরা অনেকেই চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন, কেননা প্রায়শঃ পদোন্নতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। ব্রিটিশ নার্সদের তুলনায়। বিকেল হয়ে আসে। আমরা উঠে পড়ি। ফেরার সময় হল। ফিরতে গিয়ে দেখি জলার ধারে সরসর করে কী যেন জলজন্তু কাচ্চাবাচ্চা সমেত নেমে গেল। ভোঁদড় কি?

    আর দেখি পিটার প্যানকে। হাইড পার্কের পশ্চিম অংশে , এর পোষাকী নাম কেনসিংটন গার্ডেন- পিটার প্যান সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। চিরকৈশোর তার শরীরে বাঁধা পড়ে আছে, তার হাতে একটি ভেঁপু, সে আর বড় হবে না, সে ভয় পায় না-না মৃত্যুতে, না জীবনে। একলা একটি ভেঁপু নিয়ে সে তার নেভারল্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আছে, সবাই তাকে দেখতে পায় না। যে দেখে তার চোখ জ্বলে যায়।
  • nina | 79.141.168.137 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৯:৪৯585026
  • অদ্ভুত সুন্দর লেখা----
  • kumu | 132.161.228.79 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১০:৩৩585027
  • ইন্দোর ইন্দোকে ছাড়িয়ে যাওয়া লেখা-
  • Abhyu | 85.137.8.90 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১০:৪৭585028
  • সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটা কথা বলে রসভঙ্গ করি। সরি, কিন্তু মোনের ছবির কথা শুনে মনে পড়ে গেল। আটলান্টায় একটা অ্যাড দেখেছিলাম। লিলিস আর ব্লুমিং ইন হাই মিউজিয়াম। মোনের প্রদর্শনী চলছিল। (ছবি নিয়ে কোনো টই নেই কেন? আচ্ছা আমিই খুলব।)

    খুব, খুব সুন্দর লেখা ইন্দোদা।
  • ........ | 24.139.211.2 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১৩:৪৪585029
  • অসাধারণ লেখা
  • I | 24.99.79.191 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২২:১৭585030
  • প্ল্যাব পাশ করে গেলাম। গ্রেট ইয়ারমাউথে দীপাংশুর বাড়িতে বসে নেটে সে খবর পেলাম। আর লিডইয়ার্ড রোডের বাড়িতে এক অলস দুপুরে শুয়ে আছি, রাহুল ভিডের ক্লাশ থেকে ফোন করে বলল-তুমি এম আর সি পি পার্ট ওয়ান ক্লিয়ার করে দিয়েছো। পাশ করাদের মধ্যে তোমার নাম দেখাচ্ছে। কিন্তু আমার বান্ধবী পাশ করতে পারে নি।

    এবার তবে বাঁধো গাঁটরী। ইস্টহ্যামের দিন ফুরোলো। চাকরি খোঁজার পালা। তার আগে অনারারি অবজার্ভারশিপ। ডক্টর ভিডে'র ভাষায়- ওয়েলকাম টু দ্য হেল অফ প্ল্যাব সারভাইভরস্‌ !

    দীপাংশু গ্রেট ইয়ারমাউথে চাকরি করে। ওর স্ত্রী পারমিতাও তাই। ওখানেই সে আমার জন্য একটি অবজার্ভারশিপ যোগাড় করেছে। আমার কনসালট্যান্ট একজন ব্রিটিশ শ্রীলঙ্কান। আমার শ্রীলঙ্কা কানেকশন আর গেল না ! লিডইয়ার্ড রোডের বাড়িতে একবার ঘর পরিষ্কার করতে এসেছিল একটি শ্রীলঙ্কান ছেলে, তাকে লোক বলাই ভালো- অসাবধানে সে আমার গরীবের টাইমপিসটি ফেলে দিয়ে তার বারোটা বাজায়। আমি তাকে দুকথা শুনিয়ে দেওয়ায় সে ভয়ঙ্কর একটা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে প্রায় ধমকে বলেছিল-আই ইউল মেন্ড ইট ! পরে রাহুল আমায় বলেছিল-আরে, তুমি করেছোটা কী ! ও একজন তামিল টাইগার, তা জানো? ঘাড়ে গুলির দাগ আছে দেখবে!
    আমার এই কনসালট্যান্ট অবশ্য তামিল নন, ইনি সিংহলী।

    গ্রেট ইয়ারমাউথ একটি ছোট্ট ম্যারিটাইম টাউনশিপ, নরফোক কাউন্টির অন্তর্গত। নরউইচের কাছাকাছি। নাকি ইংল্যাণ্ডের পূর্বতম ভূমিখণ্ড। খুব শান্ত, নিরিবিলি; লণ্ডনের ব্যস্ততার পর একে কেমন ঘুমিয়ে থাকা গ্রাম বলে মনে হয়। এশিয়ান প্রায় নেই, হাসপাতালের ডাক্তার আর ইরাকী কাবাবের দোকানের মালিক ও কর্মচারী ছাড়া। নর্থ সী'র ধারে। সমুদ্র বলতেই আমি কেমন একটা টলটলে নীল জল আশা করেছিলাম। নর্থ সী মোটেও সেরকম কিছু না। কেমন একটা কালোপানা গোমড়ামুখো মত। সী বীচে তেমন লোকজন নেই দেখে দীপাংশুকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কেউ সমুদ্রে স্নান করে না? দীপাংশু কেমন ঘাড় বেঁকিয়ে কান চুলকে মিনিটখানেক থেমে কাক্কেশ্বর কুচকুচের মত বলল- ইট ডিপেণ্ডস ।
    -মানে?
    -মানে কেউ যদি সুইসাইডাল হয়, নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে সুইসাইড করতে চায়, তাহলে করতেই পারে ।
    সমুদ্রটি বিষণ্ণ। একহারা লম্বা, যতদূর চোখ যায় মেলে রাখা সী বিচটিও তাই। রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা নীচে নেমে সী বিচ। পাথুরে। এক ধারে লাইট হাউস। একলা বৃদ্ধ একটি কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে বিকেলের আবছা আলোয় সমুদ্রপাড়ের বেঞ্চে বসে আছেন। ঝড়ের মত হাওয়া দিচ্ছে, ঠাণ্ডা। পাড়ের লম্বা ঘাসজাতীয় ঝোপগুলির মাথা নুয়ে যাচ্ছে। সমস্তটা মিলিয়ে একটা মনোক্রোম ছবি। গ্রেট ইয়ারমাউথ ভাবলেই মাথায় এই ছবিটা ভেসে ওঠে। তখন হয়তো আমি ভার্জিনিয়া উলফের To The Lighthouse পড়ছি। না কি আরো পরে? For we all perished, each alone -এই লাইন ক'টি মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করে। একটি মেয়ে একটি অসমাপ্ত ছবির সামনে রং-তুলি নিয়ে বসে আছে। লাইটহাউসটি নিকটেই কিন্তু অগম্য। সমুদ্র আমাদের পায়ের তলা থেকে বেঁচে থাকার সমস্ত জমি খেয়ে নেয়। বাচ্চাদের শোবার ঘরের দেয়াল থেকে একটা বিশ্রী শুওরের খুলি ঝুলে থাকে।

    শরৎকালের খানিকটা কাটে গ্রেট ইয়ারমাউথে, অন্য আরেক দফায় অবশ্য। এদেশে শরৎকালের কোনো চিহ্ন নেই। শুধু বেরিজাতীয় অজস্র বুনো ফলে ভরে থাকে ঝোপঝাড়গুলি। সবুজ, সবুজ মিডো পেরিয়ে পোস্ট অফিসে আসতে-যেতে হয়। তখন আমার দৈনিক চিঠি ছাড়ার পালা শুরু হয়ে গেছে। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার NHS Jobs খুলে হাঁ করে বসে থাকা, চটপট সম্ভাব্য চাকরির অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করা আর তারপর সারা সপ্তাহ ধরে সেগুলি ভর্তি করে দফায় দফায় পোস্ট করা। রয়াল মেল ফুলেফেঁপে উঠছে আমাদের টাকায়। প্রায়দিনই পোস্ট অফিস। এমনি সব যাতায়তের মাঝখানে একদিন থমকে দাঁড়ানো। চেনা মিডোর প্রান্তে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে , না কাশ নয়, কাশের মত একধরণের লম্বা লম্বা ঘাস। হয়তো দেশে তখন মহালয়া। দেবীপক্ষ। ইন্টারনেটে আনন্দ উৎসব চালিয়েছে দীপাংশু। চণ্ডীদাস মালের গলায় আগমনী। গিরি, এ কী তব বিবেচনা। গেল সম্বৎসর, হয় না অবসর, গৌরী আনার কথা মনে তো হল না। চোখে জল এসে গেছিল। আগস্টের বিকেলে কর্নেল গেরিনেল্ডো মার্কেজ যেন। একটিবার আনমনা।মাকোন্দো থেকে টেলিগ্রাফ করে অরেলিয়ানোকে যুদ্ধের খবরাখবর পাঠাচ্ছেন। 'অরেলিয়ানো, মাকোন্দোয় এখন বৃষ্টি পড়ছে'। হা, এ কী কোনো যুদ্ধের খবর হতে পারে!
    হায় সাত্যকী, আমাদের কৈশোরের সেই সব খেলাধূলা কোথায় গেল, এই ভ্রাতৃঘাতী, মিত্রঘাতী যুদ্ধ কেন এল ! কুরুক্ষেত্রে দুর্যোধনের বিলাপ। একটিবার, শুধু ঐ একটিবার।
  • কৃশানু | 213.147.88.10 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২২:২৪585031
  • উফ।
  • sosen | 125.242.139.167 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২২:২৭585032
  • এই লেখা ছাপা হলে ছবি আমি আঁকব -ইঁট পেতে রাখলাম-
  • h | 127.194.239.15 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২২:৩৫585034
  • যেটার কথা বলছিলি, যদি ঠিক বুঝে থাকি, বাড়িটার নাম ঘেরকিন।
    http://en.wikipedia.org/wiki/30_St_Mary_Axe
  • T | 24.139.128.15 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২২:৩৬585035
  • অনবদ্য!
  • I | 24.99.79.191 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২৩:২৬585036
  • যুদ্ধের কথা বলছিলাম। যুদ্ধ তখন সত্যি সত্যি শুরু হয়ে গেছে। এক একটা হাসপাতালে একটা-দুটো পোস্টের জন্য অন্তত হাজার দশেক অ্যাপ্লিকেশন পড়ে। কার সময় অত পড়ে দেখার ! অধিকাংশই শ্রেডারের ভেতর ঢুকে যায়। শর্ট লিস্টিং কিসের ভিত্তিতে হয় কে জানে। লটারির মত করে, নাকি চেনা মুখ দেখে - কেন না অনেক সময়েই একই হাসপাতালের অন্য বিভাগে কাজ করতে করতেই লোকে অ্যাপ্লাই করে। হয়তো তার বর্তমান চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। কখনো কখনো হাসপাতালে অবজার্ভারশিপ করা ডাক্তার অগ্রাধিকার পায়। আর অবশ্যই অগ্রাধিকার পায় ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের ডাক্তাররা। মূলতঃ পোলিশ, রাশ্যান,চেক ইত্যাদি পূর্ব ইউরোপের দেশ থেকে আসা মানুষেরা, ক্কচিৎ জার্মান। বিখ্যাত গাইজ হাসপাতালের জব অ্যাপ্লিকেশনে সেল্ফ শর্ট লিস্টিংয়ের জন্য পয়েন্ট সিস্টেম মেনশন করা থাকে। অমুক অমুক বিষয়ে এত করে পয়েন্ট, সব মিলিয়ে দশের বেশী পয়েন্ট পেলে তবেই অ্যাপ্লিকেশন করবেন , নচেৎ নয়। সর্বমোট পয়েন্ট হয়তো পনেরো, তার মধ্যে পাঁচ নম্বর আলাদা করা থাকে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের লোকেদের জন্য। এদিকে NHS -এর ওয়েবসাইটে বড় বড় করে লেখা থাকে- আমরা চাকরীর ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণের কোনো ফারাক করি না। এই NHS -ই আবার একদা দুর্দশার দিনে উপমহাদেশের লোকেদের একপ্রকার হাতে-পায়ে ধরে জামাই আদর করে চাকরীতে ঢুকিয়েছে।

    যুদ্ধ, অতএব। চেনা বন্ধুরা, যারা এককালে হাতে হাত ধরে বিদেশবাসের শুরুর সেই কষ্টকর দিনগুলি কাটিয়েছে, তাদের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস জমতে থাকে। একটা চাকরীর জন্যে শুধু। কোথাও কোনো অবজার্ভারশিপের খবর পেলে লোকে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। ঘটনাচক্রে ল্যাঙ্কাশায়ারের বার্নলীতে নীলাঞ্জনাদি, রাহুল আর আমার-তিনজনেরই একটা কমন কানেকশন বেরোয়। অবজার্ভারশীপ, তাও চাকরী নয়। নীলাঞ্জনাদি পষ্টাপষ্টি আমায় বলে - তুই বার্নলীতে আমার আগে যাস, আমি সেটা চাই না। অগত্যা বুকের মধ্যে রক্তপাত। কেননা, জীবনটাকে যুদ্ধ ভাবতে শুরু করেছি।

    এবার শুরু হয় আমার মুসাফিরির পালা। কখনো এখানে, কখনো সেখানে। ইস্টহ্যাম, গ্রেট ইয়ারমাউথ, বার্নলী। ছোটোখাটো আরো নানা শহরে নানা রকম কোর্স করতে যাওয়া। পরনের খাকি জামায় যতগুলি পারি মেডেল ঝোলানোর ব্যবস্থা করা। যাতে চকচক করে। যাতে দূর থেকে লোকের চোখে পড়ে। সেই শুরু বাসে বাসে ইংল্যাণ্ডের নানান প্রান্তে ঘোরা। সঙ্গী সেই বিশাল স্যামসোনাইট আর ঢাউস ব্যাগ। তার মধ্যে আকামের প্রেশার কুকারটি অবধি।বাসে রাত কাটে। বাসে দিন কাটে। বাদামী চামড়া, তাও তেমন ব্রিটিশ ঝিলিক নেই দেখে সচরাচর পাশে কেউ বসতে চায় না। অন্ততঃ আমার তাই মনে হয়। এদিকে ভিক্টোরিয়া বাস টার্মিনাস মুখস্থ হয়ে যায়।

    যাক সে সব কথা। আপাততঃ গ্রেট ইয়ারমাউথ নিয়ে আমার আরো দু'কথা আছে , বলে যাই। এখানে দিন কাটে বেশ আরামে। হাতের নাগালে সর্বক্ষণ ইন্টারনেট। বহুকাল বাদে বাংলা লাইভে ফিরে আসি। সেখান থেকে গুরুচণ্ডালীর খোঁজ পাই। সৈকত একদিন মেল করে নেট ঠিকানা দেয়। ততদিনে দীপ্তেনদা'র আমার সত্তর বেরিয়ে গেছে। এসে দেখি, নরক গুলজার। বাংলা লাইভের সব ক'জন পছন্দের মানুষ এসে জুটেছেন। সঙ্গে পামিতাদি, অক্ষদাও বোধ হয়। তার সঙ্গে অজস্র সিনেমা দেখার সুযোগ। প্রতি সপ্তাহে দু-তিনটে করে নতুন সিনেমা দেখা। বার্গম্যান সেই প্রথম দেখতে পাওয়া। এবং প্রথম দর্শনেই প্রেম। শুরু ওয়াইল্ড স্ট্রবেরীজ দিয়ে। আমায় আর পায় কে!

    প্রত্যেক দিন দুপুরে হসপিটাল থেকে ফিরে এসে বেশ খানিকটা সময় আমার একলার। দীপাংশু-পারমিতা তখনো হসপিটালে। দরজা খুলে বেরিয়ে আসি। গায়ে একটা পাতলা সোয়েটার। বাইরে রোদ্দুর, কিন্তু খালি পা পরীক্ষামূলকভাবে পাথরের ওপর রাখলেই পা জমে পাথর। পাশের একফালি জমিতে দীপাংশু ক'টা পেঁয়াজ পুঁতে দিয়েছে, রোজ তাদের জল দিই। রোজ খোঁজ নিই, তারা কদ্দূর বাড়ল।
    এমন এক দুপুরে হঠাৎ করে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েন এক মাঝবয়সী মহিলা। সালোয়ার কামিজ পরা। উর্দুতে কথা বলছেন, ইংরেজী জানেন না। দেখে তেমন সম্পন্ন লাগছে না। কথা বলেন আর আড়ে আড়ে ত্রস্ত তাকান পেছনের এক বাড়ির দিকে। পাকিস্তানী, এঁকে ঐ বাড়ির ডাক্তারসাহেব দেশ থেকে নিয়ে এসেছেন বাচ্চা দেখাশোনার কাজে। কিন্তু ওঁর মন উচাটন। দেশে ফিরে যেতে চান। মালিকরা কেউ ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন না। আমি কি উর্দু জানি? আমি কি কোনো উপায় করতে পারি?

    রাতে দীপাংশু-পারমিতাকে বলি। ওরাও দুঃখ পায়, কিন্তু করবার কী আছে ভেবে পায় না। উক্ত পাকিস্তানী ডাক্তারটি গ্রেট ইয়ারমাউথ হাসপাতালেই চাকরী করেন, কিন্তু ওদের বিভাগে নয়। কী করার আছে?

    এইসব ছড়িয়ে যাওয়ার কথা। দেশ হারানোর কথা।বাড়ি হারানোর কথা। ফিরতে না পারার কথা। রাতে মাথার মধ্যে দুঃস্বপ্নের অবিরাম, অবিরাম যাতায়তের কথা।

    সবুজ সংকেতে রাস্তা এপার ওপার করার সময় পথের কোণে সেদিন দুটো পড়ে থাকা শব্দ পেলাম-বাড়ি কোথায় !
    ও মস্ত বড় শহর, তোমার মানুষভীড়ে ট্র্যাফিকতীরে শব্দ এসে আছড়ে পড়ে -বাড়ি কোথায় !

    বাড়ি কোথায়, বাড়ি কোথায়
    বাড়ি কোথায়, বাড়ি কোথায়, বাড়ি কোথায়?
  • de | 130.62.178.62 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২৩:৪৪585037
  • আহা! কি লেখা!
  • Abhyu | 85.137.8.90 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২৩:৪৫585038
  • ডাক্তার তো নিজের বাড়ি ফিরে গিয়ে এই লেখা লিখছে। দেশ হারানোর কথা।বাড়ি হারানোর কথা। ফিরতে না পারার কথা। যারা এখনো বাড়ি ফেরেনি, তাদের বুকে কতটা লাগছে সে খবর রাখছে কি?
  • rivu | 85.102.69.73 | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২৩:৪৬585039
  • বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ছিঁড়ে দিলেন মশাই।
  • I | 24.99.79.191 | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০০:১৭585040
  • হনুবাউ,
    ঠিকই। এটাই।

    অভ্যু মাইট,
    সরি।
  • Abhyu | 85.137.8.90 | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০০:২৬585041
  • না না। বড়ো ভালো লেখা।
  • 4z | 109.227.143.99 | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০২:১০585042
  • ইন্দোদা, প্রত্যেকটা লাইন, প্রত্যেকটা শব্দের সঙ্গে আইডেন্টিফাই করতে পারছি। খুব ভালো লেখা...
  • Yan | 161.141.84.239 | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৩:২৪585043
  • ইচ্ছে করছে ঠাঁই ঠাঁই করে লেখকের মাথাটা দেয়ালে ঠুকে দিই, আর বলি "বজ্জাতের আন্ডিল কোথাকার!"

    এত ভালো লেখা কেউ লেখে? যে লেখা পড়লে ভীষণ গড়াগড়ি দিতে ইচ্ছে হয়, চিৎকার করে জিনিসপত্তর ভাঙতে ইচ্ছে হয়, আর্কিমিডিসের মতন রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়? বলি আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হলে তখন কী হবে????
  • ম্যাক্সিমিন | 69.93.203.178 | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৪:২৫585045
  • প্রথম পাতা পড়া হয়নি। বাকীটা একটানা পড়লাম। ভালো লেগেছে। প্ল্যাব একটি গ্রেট লেভেলার অংশটা বিশেষ করেই ভালো লাগল।
  • ম্যাক্সিমিন | 69.93.203.178 | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৪:৩৫585046
  • 'কোথাও গিয়ে বসলে এদিক-ওদিক থেকে শিকড় তো গজাতেই থাকে, শিকড়ের ধর্মই এই .. শেষবারের মত পাটনা স্টেশন ছেড়ে অমৃতসর মেলে উঠে বসলাম যেদিন, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম ঠিকই, কিন্তু বুকের মধ্যে কোথাও একটা ফাঁকা লেগেছিল এও সত্যি। আলবিদা পাটনা ! আর স্টেশন ছেড়ে ভারি লাগেজ কাঁধে হনুমান মন্দিরের দিকে হেঁটে যাওয়া হবে না, কুলির দলবল ছেঁকে ধরবে না, রিক্সায় উঠে বলব না-চলিয়ে জী ভিখনাপাহাড়ী।' -- কুর্ণিশ।
  • nina | 79.141.168.137 | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৫:২৫585047
  • আমিও কুর্ণিশ!!
    পাটনার কথা ডাক্তারের কলমে আমার আঁখ পানিপানি --
  • i | 147.157.8.253 | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৫:৫৬585048
  • মায়াময় গদ্য, আর বিন্যাস। তবু মুসাফিরি কিছু কম ঠেকে...
    জানি না ঠিক বলছি না ভুল- কাউকে বলছি না নিজেকে তাও জানি না- এ গল্প যখন শৈশব, শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, পরবর্তীতে যৌবন ও প্রবাসে যাবে-ভাষা কেন বদলাবে না, কেন বদলাবে না ভঙ্গি, বিষাদে ভিন্নতর শেডই বা লাগবে না কেন, চলন কেন সর্বত্র একইরকম?
  • Yan | 161.141.84.239 | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৭:০১585049
  • তার উপর কৈশোর, যৌবনের কথা তো সেভাবে এলোই না! কেমন যেন দ্রুততালে পার হয়ে গেল, গ্যালপিং ট্রেনের মতন, কিছুই দেখা গেল না। স্বপ্নথরথর কৈশোর, ভালোবাসা-থিরথির যৌবন ---কিছুই দেখা গেল না। ঐ জায়্গাগুলো আবার লেখক ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেখান, থেমে থেমে প্লীজ।
  • Yan | 161.141.84.239 | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৭:১০585050
  • ছোটাইদি, কয়েকটা লেখাপত্র নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে, ইমেইল করবে যদি সময় থাকে? যদি অসুবিধা হয়, তাহলে দরকার নেই।
  • I | 24.96.19.160 | ০১ মার্চ ২০১৩ ০০:৫০585051
  • রুটির এই টুকরোটা বাবার জন্য, এইটা আলেক্সান্দ্রোর জন্য, এটা ভয়লার জন্য, এটা আমাদের যে ছেলেটা সমুদ্রে আছে, তার জন্য, এটা আমাদের বন্ধুর জন্য, এটা অচেনা কোনো আগন্তুকের জন্য-যদি এত রাত্তিরে কেউ এসে পড়ে-,এটা মায়ের জন্য ....

    ---------

    নিজেকে , নিজের ব্যক্তিগতকে ক্রমাগত নানান পোস্টে প্রকাশ করে যাওয়া, এক রকমের দুঃখ খুঁড়ে আনা সর্বসমক্ষে,- বেশ অস্বস্তিকর লাগছিল এই লেখা শুরুর কিছু পর থেকেই। কিছু কি অপমানজনকও?কেননা আমি তো বিশ্বাস করতাম যা কিছু ব্যক্তিগত, তা পবিত্র। পাবলিক স্ফিয়ারে বিলিয়ে দেওয়ার মত সুলভ অন্ততঃ নয়। তাও কেন লিখে গেলাম, কি মতিচ্ছন্নতায় পেল আমায়, আমার গদ্যের ঈশ্বর জানেন।
    কিন্তু আহত সৈনিককে নাকি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কাঁধে করে নিরাপত্তা নামের ঘরের ওমে ফিরিয়ে আনতে হয়, যার পর ড্রপসিন পড়ে ও এনকোর হয়,কিম্বা স্তব্ধতা। তাই আবারো লেখা। তবে আর বেলতলা দিয়ে নয় , এবার আঘাটায়।বিপথে। তাছাড়া কোনটা পথ , তাই বা কে বলবে ! এই মাটি, এ পার্থেনিয়াম , শেয়ালকাঁটা ও অচিন লতাগুল্মে ভরা, এর মধ্যে দিয়ে যে কোনো একদিকে সৈনিক-কাঁধে দৌড় লাগালেই হয়, আসল গন্তব্য তো যুদ্ধের থেকে দূরে। অর্থাৎ কিনা সার্চলাইটের বৃত্ত, উপবৃত্তের বাইরে।

    ------

    যে বৃদ্ধটি এইমাত্র ল্যাভেন্ডার ফিরি করে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, যার একগোছা ল্যাভেন্ডারও কেউ কিনল না, যার সব দাড়ি সাদা, ভাঙা মুখ, তোবড়ানো গাল, নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে, আমি তার পিছু হাঁটি। সে আমারই পিতা, আর কয়েক মুহূর্ত পরে সে বত্তিরিশ বছরের স্বেচ্ছানির্বাসন ফেলে রেখে এম ভি ইউক্রেনিয়া জাহাজ থেকে গ্রীসের মাটিতে এসে নামবে। ভাঙা গলায় সে বলবে- এই তো আমি ! সে আজ বত্তিরিশ বছর পরে বাড়ি ফিরছে। আমি তাকে বাড়ি নিয়ে যাই, আমি ও আমার বোন ভয়লা। মা'কে দেখবার আগে তার বুক দুর দুর করে, মায়ের চোখের রং সে ভুলে গেছে।
  • I | 24.96.19.160 | ০১ মার্চ ২০১৩ ০১:৩৭585052
  • বুড়ো মানুষটা ফিরছে তার গ্রামের বাড়িতে। গ্রাম বলতে সবুজ ঘাসে ছাওয়া মিডো, কুয়াশায় ঢাকা মিডো, নিষ্পত্র একলা গাছ এখানে -ওখানে-হুই সুদূরে দাঁড়িয়ে থাকার মিডো। যেখানে বত্রিশ বছরে কখনো কিছু ঘটে না। ভাঙাচোরা অযত্নের কবরখানায় বুড়ো তার একদা পথের সাথীদের খুঁজে পায়-হায় দিমিত্রি, তুমি এখানে, এইখানে লেনি.... কত অনাদরে তারা মাটির সঙ্গে মাটি হয়ে মিশে আছে। পাখির সুরে শিস দিয়ে গোপন কোডে কথা বলবার কেউ নেই, একজন ছাড়া।

    -----
    ওরা আসছে, ঐ যে হেঁটে আসছে, খচ্চরের পিঠে চেপে, ট্রাকে করে... বুড়ো স্পাইরোসের চোখ জ্বলে উঠে। সেই একজন বলে, ওরা ফিরছে বিক্রিবাট্টা শেষ করে, কবরখানায় নয়, ওরা অন্যদিকে যাবে, অন্যপথে, পারলে আকাশটাকেই বিক্রি করে দিত।

    খোলা আকাশের তলায়, সবুজ প্রান্তরে , বিশাল ওয়াইড অ্যাঙ্গলে একলা গাছের তলায় দুই বুড়োর নাচ পায়, যৌবনের নাচ-চল্লিশটা আপেল আমার রুমালে বাঁধা/ হায় হায়। কতকালের বন্ধ ঘর খুললেই সাথীদের ফিসফিসানির বাষ্প উপচে পড়ে। জানলায় জানলায় খবরের কাগজ সাঁটা। কবেকার কাগজ! কবেকার সময়।

    -----

    এই বাড়িটা বেচে দিতে হবে, এই পুরো মিডোটা। এখানে শীতকালীন রিসর্ট উঠবে, কেননা একঘেঁয়ে এই আকাশ, প্রান্তর, এখানে সারাক্ষণ ঘ্যানঘেনে কুয়াশা এসে ঝুলে থাকে , অপার্থিব মরা আলো খুলির ফাঁকফোকড় দিয়ে রক্তে এসে মেশে। দুপুরের শিল কাটাও ডাক,সকালের রাই জাগো গান, বসন্তের জারুলের বেগুনি ফুল , পাখিরা-ছাতারে, দুর্গা টুনটুনি, বসন্তবৌরি, ইষ্টিকুটুম, পাপিয়া, কোকিল, ফুলঝুরি, মাছরাঙা। বেচে দিতে হবে এদের। জলের ট্যাংকটা ভাঙা পড়ে যাচ্ছে, রেখে কী হবে, গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের জল এখন ঘরে ঘরে। ঐ ট্যাঙ্কটার ওপর লোকে বলে ঈগলের বাসা ছিল। ট্যাঙ্কের ওপরের খুপড়ি ঘরে জং ধরা ন্যাপলা, ওয়ান শটার, নল কাটা পাইপ গান রাখা থাকত। ওখানে ছিল আমাদের খেলার মাঠ, ওখানে সাপেরা ডিম পাড়ত। একবার বল খুঁজতে গিয়ে মদের বোতলের ভাঙা কাচে উত্তমের পা আড়াআড়ি চিরে গিয়েছিল।

    ----

    এই মিডোটাকে অতএব বেচে দিতে হবে, মেয়র বলেন। গ্রামের প্রতিটি মানুষের সই লাগবে, নাহলে হবে না। স্পাইরোস, তোমার কিসের এত জেদ, বেজন্মা, বত্রিশ বছর আগে তুমি আমাদের এক যুদ্ধের মধ্যে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলে পাহাড়ে-জঙ্গলে, আজ আবার ফিরে এলে আর এক অশান্তি নিয়ে। আগুন নিয়ে। স্পাইরোস, তুমি বেঁচে নেই , তুমি আসলে একজন মৃত, ঘুণে খাওয়া, গায়ে হাত দিয়ে দেখো, তুমি ঝুরঝুর করে পড়ে যাবে। কতবার তোমার নামে শ্যুট টু কিল অর্ডার জারি হল, কতবার জেলখানা, ফায়ারিং স্কোয়াড। স্পাইরোস, ভুত , দয়া করো, আমাদের ছেড়ে যাও। স্পাইরোস, তোমার সঙ্গে কী বিষম যুদ্ধ করেছি এককালে, গুলির লড়াইয়ের তুমি একদিকে , আমি একদিকে। ওরা তোমাকে আর আমাকে একে অন্যের দিকে লেলিয়ে দিল, মানুষের সঙ্গে মানুষের লড়াই, নেকড়ের সঙ্গে নেকড়ের। বত্রিশ বছর কেটে গেল, না তুমি জিতলে, না আমি। পড়ে রইল একটা খাঁ খাঁ মিডো, তোমার বেহালা, একটা ভাঙা বাক্স।এই খচ্চরটা।
  • ............ | 24.139.211.2 | ০১ মার্চ ২০১৩ ০৯:১৩585053
  • .............................................।
  • dd | 132.167.30.131 | ০১ মার্চ ২০১৩ ১৩:৫৮585054
  • এইট্টা কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
    এই যে পর পর দুটো পোস্টিং হোলো, ইন্দোদা করলেন।

    আগের ল্যাখার অ্যাডেন্ডাম নাকি অন্য কোনো নতুন ল্যাখা ? কিছু অনুবাদ? আমি বোধয় কিছু মিস করে গেলাম।

    খুব ধন্দে আছি।
  • sosen | 24.139.199.1 | ০১ মার্চ ২০১৩ ১৫:০৯585056
  • আম্মো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন