এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  নাটক

  • পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে

    সে
    নাটক | ২১ অক্টোবর ২০১৩ | ৫৪৪৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সে | 188.83.87.102 | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ১৩:৫৯620862
  • পাতালের পথ এবং হাইডি
    ------------------------

    একই রাস্তা। অথচ আমূল ভোল পাল্টায় ঋতু পরিবর্তনে।

    বসন্তে গ্রীষ্মে যে পথের দুধার ফুলে ফুলে রঙীন, যেখানে দুপা চলতে না চলতেই দৌড়তে মন চায়, সবকিছু ভুলে গড়াগড়ি খেতে খেতে ঢালু ঘাসের গালচে বেয়ে অনায়াসে নেমে যেতে ইচ্ছে করে, সেই পথই শীত পড়লে অন্যরকম। একদম।

    যেদিকে দুচোখ যায় সেসব দিক অধিকাংশ সময়ে সাদা তো বটেই তার ওপরে রাতগুলো বড়ো বেশী দীর্ঘ। আরো বেশী নিঃস্তব্ধ - অথচ তার অন্ধকারের ঘনত্ব কেমন যেন ফিকে। তুষারের ওপরে আকাশের আলোর প্রতিফলন অন্ধকারের বারোটা বাজিয়ে দেয়। তবুও রাত্রির দৈর্ঘ্য ক্রমশঃ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় - ভূগোলের নিয়মে। ঘড়ির কাঁটা ঘন্টাখানেক পিছিয়ে দিয়েও হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে থাকি সকালটাকে।

    ঘড়ির কাঁটা সকাল সাতটা ছুঁলেও চারিদিকে নিশুত রাত।

    সেই রূপকথার গল্পের রাস্তা।

    সমস্তই দেখা যাচ্ছে আবছা আলোয় কিন্তু আকাশে সুজ্যি নেই। গাছগুলো সব নেড়া। পায়ের নীচে তুষার কখনো বালির মতো নরম, কখনো কাদাকাদা, কখনো জমাট বরফের পাথর; মরণ ফাঁদ - পদস্খলন হলে ভোগান্তি আছে। চতুর্দিকে চলাফেরা করছে ছায়ামূর্তিরা। তাদেরকে অনায়াসে এই আঁধারে রাক্ষস খোক্কস বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পাতলপুরীর মতই, তবে একেবারে কার্বন কপি ঠিক নয়। শুধু তুষারটুকু বেমানান।

    আমি প্রতিনিয়ত ট্রেনে উঠি। এই ট্রেন ধরাটা এত বেশি রুটিনমাফিক হয়ে গেছে যে মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি ট্রেন না ধরলে, ট্রেন আমাকে ধরবে ফেলবে - ক্যাঁক্‌ করে - ভূতে ধরার মতো। যদি আমি বালির মতো ঝুরঝুরে বরফের ওপর দিয়ে দৌড়বার ছল করে ভেসে যেতে চাই, ঘাসে গড়াগড়ি খেতে খেতে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে চাই নীচের উপত্যকায় বা কোনো হ্রদে, কি জানি হয়ত সেখানেও গজিয়ে উঠবে সমান্তরাল দুটো ইস্পাতের রেল - হাঁ হাঁ করে তেড়ে আসবে ট্রেন, খপ্‌ করে ধরে ফেলবে আমার টুঁটি, আর টুপ করে গিলে নিয়ে ভরে ফেলবে একটা কামরার মধ্যে। আমি পালাতে পারব না।

    অজগরের পেটের মধ্যে ঢুকে আমি ওভারকোটটা খুলে ঝুলিয়ে দেবো জানলার পাশের হুকে। সীটটাকে অল্প এগিয়ে পিছিয়ে নেবো সুবিধেমতো বোতাম টিপে টিপে আর চেষ্টা করব কাঁচে ঢাকা জানলার দিকে না তাকাতে। শুধু শীতকালে।

    বসন্ত গ্রীষ্ম শরৎ যত খুশী দেখতে পারি আমি জানলার বাইরে। তখন অজগর মর্তের ওপর দিয়ে যায়। শুধু শীতে সে যায় পাতালের পথ দিয়ে। আর তখনই আমার ভয় করে।

    ভয়টা অমূলক নয়। শীতের রাস্তায় রেলপথে আমি অজগরের পেটের ভেতরে বসে দুরন্ত বেগে পার হয়ে চলেছি নদী গ্রাম শহর পাহাড় উপত্যকা হঠাৎ জানলার কাঁচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম - হাইডিকে।

    হাইডি, যাকে নিয়ে গল্প। যাকে নিয়ে সিনেমা, কার্টুন, অ্যানিমেশন। সেই হাইডিই কি? ঊনবিংশ শতকের গ্রাম্য মেয়ে। সুইস দেশের গ্রাব্‌ভিন্‌ডেন্‌ অঞ্চলের বালিকা। অনাথ। একবার অবশ্য সে গেছল বিরাট এক গমগমে শহরে, ফ্রাঙ্কফুর্টে। সেখানে ক্লারা বলে আরেকটা মেয়ে ছিলো, যে হাঁটতে পারে না। তারপরে কী কী হয়েছিলো সেসব গল্প প্রায় সবাই জানে।

    একবার জুরিখ এয়ারপোর্টের এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যাচ্ছি, একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে রেলপথে। হঠাৎ জানলার পাশে হাইডিকে দেখা গেল, তার মাথায় বেড়া বিনুনী করা। চুপচাপ আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে জানলার কাঁচে চুমু খেয়ে গেল হাইডি। তারপরেই গরুর গলায় বাঁধা ঘন্টার ঢং ঢং শব্দ। চমকে গেছলাম আমরা সবাই। উঃ দারুণ তো! টেকনোলজির কি অপূর্ব ব্যবহার। চাপা প্রশংসার গুনগুনানিতে ভরে গেছল সুড়ঙ্গ।

    শীতের রেলপথে আমার ঠিক পাশেই কাঁচের ওপারে যে হাইডি -তার বয়েস এখন অনেক।

    একটু খুঁটিয়ে দেখলে তার পাক ধরা রূপোলী চুল, মুখের বলিরেখা সব নজরে আসবে। মহানগরের কলকারখানার ধোঁয়ার গন্ধ তার পোশাকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই হাইডি অন্ধকার পাতালের ভেতর জানলার কাঁচের পাশে পাশে আমার সঙ্গে সবখানে যায়, কটমট করে বারবার তাকায় আমার চোখের ভেতরে। তাই আমি ওদিকে দেখিনা। শুধু চুপ করে অপেক্ষা করি আলো ফোটার। আলো ফুটতে না ফুটতেই অজগর উঠে আসে মর্তে। জানলার পাশের হাইডি নিমেষে মিলিয়ে যায়।

    আমিও তৃপ্তির সঙ্গে দেখতে থাকি বাইরের দৃশ্যাবলী। প্রতিনিয়ত।
  • সে | 188.83.87.102 | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ১৪:০২620863
  • স্বর্গ থেকে বিদায়
    -----------------
    ভোর হয়ে আসছে, অন্ধকার কাটছে একটু একটু ক'রে। জানলার সামনে পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। তার পরণে শুধু সৌখিন অন্তর্বাস। আলো আরেকটু বাড়লো, নারীটি ফস্‌ করে লাইটার জ্বালিয়ে ধরালো সিগারেট। এবার এক পুরুষ কন্ঠ বলে উঠলো, "নাতাশা, আমি তোমাকে ভালোবাসি" - নারীটির এতে কোনো প্রতিক্রিয়া হ'লো না। এরপরে পুরুষটি বলে বসল, "আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই"। নাতাশা ঘাড় ফিরিয়ে হোটেলকক্ষের বিছানায় শুয়ে থাকা পুরুষটির দিকে তাকালো, তার দিকে এগিয়ে গেল। আমাদের দৃষ্টিও সেইদিকে, আমরা ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখছি নাতাশা ও পুরুষটির চলাফেরা-কথোপকথন। পুরুষটির হাতে ডলার বিল। সে ডলার গুণে নাতাশার হাতে দিচ্ছে পারিশ্রমিক। নাতাশা মুচ্‌কি হেসে সেটা নিতে গিয়েও নিলো না, পুরুষটির চোখে বিষ্ময়, নাতাশা এই প্রথম মুখ খুলল, "আমাদের দেশে মেয়েরা বিছানায় শোবার জন্যে স্বামীর কাছ থেকে টাকা নেয় না।" এটাই প্রথম দৃশ্য ছিলো, "ইন্তারজেভোচ্‌কা" ছবির। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৮৯ এর গ্রীষ্মশেষে, সোভিয়েত দেশে। হ্যাঁ তখনো সেটা সোভিয়েত দেশ। পিয়োতর তাদারোভ্‌স্কির ছবিতে নাতাশার শহরটার নাম তখনো লেনিনগ্রাদ, আজকের সাঙ্ক্‌পিয়োতর্‌স্‌বুর্গ নয়। ছবিটি এক রাশিয়ান মেয়ের বিয়ে হয়ে সুইডেনে চলে যাওয়া নিয়ে। মেয়েটির নাম যে নাতাশা, আর তার অন্যতম পেশা যে বেশ্যাবৃত্তি, সেটাতো প্রথম দৃশ্যেই আমরা আঁচ করে নিয়েছি। মেয়েটির মূল জীবিকা অন্য, সে নার্সের কাজ করে, কিন্তু ধনতান্ত্রিক দেশগুলো তাকে হাতছানি দেয়, বিদেশী ট্যুরিস্টদের কাছ থেকে দেহের বিনিময়ে আয় করে ডলার, পাউন্ড, বিদেশীমুদ্রা। একদিন এরকমই কোনো বিদেশী তাকে প্রস্তাব দেয় বিয়ের, কোনো নাতাশাই আর পেছন ফিরে তাকায় না যত বাধাই থাকুক না কেন, প্রতিটি বাধার জন্যে একে একে গুণে গুণে মূল্য ধ'রে দিয়ে ছুটে যায় পশ্চিমে। এই ছবিটিতে নাতাশা চলে এসেছিলো সুইডেনে, সুইডিশ স্বামীর সঙ্গে। লেনিনগ্রাদের সরকারী অ্যাপার্টমেন্টে ফেলে এসেছিলো মা কে, আর সেই কোন ছোটোবেলায় যে বাবাকে শেষ দেখেছে কি দেখেনি মনেই নেই, সেই বাবার কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়েছিলো দেশের নিয়ম অনুসারে। হ্যাঁ, দেশের নিয়ম ঐরকমই। অচেনা পিতার কাছে গেল সে, ছাড়পত্রে সই করাতে। বৃদ্ধ, প্রায় অথর্ব, অ্যালকোহলিক বাবা, যে মেয়ের খোঁজ কোনোদিন রাখেনি, তার সঙ্গে করল, ছশো ডলারের সওদা। মেয়ে যখন ফরেনারকে বিয়ে করছে, ভালো টাকা পয়সা নিশ্চয়ই আদায় করা যাবে সে মেয়ের কাছ থেকে। বিয়ের আনন্দে বেশ্যাবৃত্তি ছেড়েই দিয়েছিলো নাতাশা, ফের বাপকে দিয়ে কাগজ সই করাতে আবার করতে হলো দেহের সওদা, এবারের খদ্দের এক জাপানি ডিপ্লোম্যাট। এসব কথাতো হবু বরটিকে বলা চলে না, কতো ছোটো হয়ে যাবে না নাতাশার বাপ তথা রুশ সমাজ, একজন বিদেশীর চোখে? নতুন দেশে যায় নাতাশা, মুক্তি সমাজতন্ত্রের রেজিম থেকে, মুক্তি বাধা বাঁধন থেকে, অথচ মেয়েটার মনে আনন্দ নেই, তার চঞ্চলতা লাফানো ঝাঁফানো উচ্ছ্বাস, সব কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছে। আমরা দর্শকরা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, কেন এমনটি হ'লো? গল্পটা ভুল? পরিচালকের দোষ? স্বপ্নের মতো দেশটাতে গিয়ে কী এমন অসুখ করেছিলো নাতাশার? যে অসুখের শেষ পর্যায়ে সে বেরিয়ে পড়ে একা, হাইওয়ের ওপর দিয়ে চুড়ান্ত স্পীডে গাড়ী নিয়ে এগোতে থাকে, চোখ ঝাপসা, চারিদিকে শুধু আলো।

    প্রচুর বিজনেস করতে পেরেছিলো ছবিটা। যদিও শেষটা অস্পষ্ট লেগেছিলো, কেউ কেউ বলেছিলো, মেয়েটা তো মূলতঃ বেশ্যাই যতই ভালো জীবন দাও না কেন, ওদের স্বভাব বদলাবার না। কেউ মন্তব্য করেছিলো, যাই বলো না কেন, জননী জন্মভূমিশ্চ ইত্যাদি। একটা প্রচন্ড আওয়াজের শেষে ছবিটা শেষ হয়েছিলো।আজ আঠারো বছর পরে সুইটজার্ল্যান্ডেও সারি সারি নাতাশা দেখতে পাই। কেউ এসেছে রাশিয়া থেকে, কেউ ইউক্রেন, কেউ স্লোভাকিয়া, কেউ ঘানা, ব্রেজিল, নিকারাগুয়া, কোস্তারিকা, ভিয়েৎনাম , কোথা থেকে নয়? সবাই যে আগে একেকটি দেহপসারিণী ছিলো, তা নয়। সবার নাম ও এক নয়, ভাষাও নয়, কিন্তু এরা সকলেই আজ কোনো না কোনো ভাবে, কোনো সুইসের ঘরণী। সুখী গৃহে সুখী ঘরণীরা আছে নিশ্চয়, এমনকি যাদের চোখের চারপাশ থেকে স্বপ্নের মায়াজাল আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে তাদেরও সংসার ধরে নিচ্ছি সুখেরই, কিন্তু তাদের মুখের সঙ্গে সিনেমার নাতাশার কোনো একটা অ্যাঙ্গল থেকে মিল যেন রয়েছে। ডোরা ব'লে একটি মেয়ে, ঘানা থেকে আসা সুইস গৃহবধু, রাস্তায় রাস্তায় হন্যে হয়ে কাজ খুঁজে চলেছে, গতকালই দেখা হলো ওর সঙ্গে, সাফাইয়ের কাজ খুঁজছে ডোরা, মুখের পেশিগুলোকে কুঁচকে হাসির মতো করে তুলছে ভঙ্গিটা, চোখের ভেতরে হয়ত চিক্‌চিক্‌ করছে বালি, কিম্বা আমার দেখার ভুল। মনে হয়, ডোরা আরেকবার মুক্তি খুঁজছে। সাতদিনের কোস্তারিকা ট্যুরে গেছলেন এক সুইস ব্যাঙ্ক কর্মচারী। সেইখানেই ফাতিমার সঙ্গে আলাপ একটা বারে। ও ওয়েট্রেসের কাজ করছিলো। সেই সাতদিনের আলাপেই বিয়ে হয়ে গেল। সাড়ে তিন বছর হলো ফাতিমা তার কুমারী জীবনের পুত্রসহ স্বামীর সংসার করছে জুরিখে, কিন্তু নাঃ, এবার যেমন ক'রেই হোক একটা কাজ জোটাতেই হবে। এইরকমই গল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুনতে পাবো জাপানের মেয়ে তোমোকো'র কাছে, হাঙ্গেরীর টিওডোরার কাছে, পারাগুয়ায়ের ক্লাউদিনার কাছে। ঠিক কী যে হয় সেই আসল রহস্যটা কেউ খুলে বলে না। ফাঁস করতে চায় না। ভালোবাসার টান কি প্রাচুর্যের টান জানিনা, কোনো একটা টানে তো ছুটে ছুটে আসে এরা, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটের বিয়ে ক'রে ক'রে। নাকি আমারই দেখার ভুলে, মনের ভুলে সকলেই ফেলতে চাইছি এক ছাঁচে। তার পরে কী হয়? নাতাশা প্রচন্ড বেগে চালাতে থাকে গাড়ী, মাথা খারাপ হ'য়ে যাবার মতো আলোর ঝলকানি চতুর্দিকে, প্রচন্ড আওয়াজ, নাতাশার নিথর দেহ, গলায় রক্ত জবার মালা, সারা গায়ে অজস্র রাঙাজবা। ব্যাকগ্রাউন্ডে শুনতে পাচ্ছি, ম্লান হয়ে এলো কণ্ঠে মন্দার মালিকা, হে মহেন্দ্র নির্বাপিত জ্যোতির্ময় শিখা, মলিন ললাটে, পুণ্যবল হল ক্ষীন, আজি মোর স্বর্গ হতে বিদায়ের দিন।।। হল খালি হয়ে গেছে, উঠুন। শো শেষ। সবাই বেরিয়ে গেছে, আমাকেও বেরোতে হবে। সিনেমার শেষটুকু কিন্তু ঐ উজ্জ্বল আলো আর আওয়াজ অবধিই ছিলো, বাকিটুকু আমি বাড়িয়ে লিখেছি, বাকি সবটুকুই। পুরোটাই আসলে কষ্টকল্পনা।
  • সে | 188.83.87.102 | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ১৪:০৩620864
  • একটা হাটের গল্প
    --------------------
    সুইস দেশের উত্তরে খোঁচার মতো যে জায়গাটা ফ্রান্স আর জার্মানীর সীমান্তে ব্যস্ততায় জমজমাট, সেই বাজ্‌ল্‌ শহর থেকে মাত্র পঁইত্রিশ কিলোমিটার দূরত্বে - ফ্রান্সের মুলুজ। মেরে কেটে চল্লিশ মিনিটের রাস্তা। বাজ্‌লের রেল স্টেশন থেকে হরদম মুলুজগামী ট্রেন ছাড়ছে; ফ্রান্স আর জার্মানী থেকেও সকাল বিকেল যাতায়াত করছে ডেলী প্যাসেঞ্জারের দল। অফিসের কফিব্রেকে ফুটবল, দামী মোটরগাড়ী, ফ্যাশন, পোলিটিক্স, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ফ্রান্সের ট্রেন ধর্মঘট, থেকে শুরু করে ভিডিও গেম ইস্তক যাবতীয় বিষয় নিয়েই তুমুল আলোচনা তর্ক বিতর্ক চলে। একেকটা বিষয় থেকে শুরু করে আমরা বিষয়ান্তরে চলে যাই, আলোচনা জমে ওঠে। তেমনি একদিন আলোচনার হাত ধরেই কেমন করে যেন ঢুকে পড়লাম মুলুজে। মুলুজেই শুধু নয়, মুলুজ শহরের মধ্যিখানে, একটা হাটে। এই সস্তার হাট বসে হপ্তায় দুদিন। বিষ্যুদবারে হাটটা ছোটো করে বসে - একদিকে জামাকাপড় অন্যদিকে শাক-সবজী-ফলমূল। শনিবারেও আবার বসে ঐ একই হাট, তবে সেদিন আকারে বিরাট। আসলে আমাদেরই সহকর্মিনী নাদিন, প্রায় জোর করেই শোনাতে শুরু করেছিলো এই হাটের গল্প। আমার কফিব্রেকের সঙ্গীরা সবাই ডেলী প্যাসেঞ্জার, প্রতিদিন তারা জার্মানী বা ফ্রান্স থেকে এদিকে আসে, মোটামুটি কাছাকাছিই গ্রামে ও শহরে এদের বাড়ী। আর এদের প্রত্যেকের বাড়ী থেকেই মুলুজ গাড়ী করে বড়জোর আধঘন্টার পথ, কিন্তু শুধু ঐ নাদিন ছাড়া আর কেউই সে হাটে কখনো যায় নি অবশ্য। নাদিন আমাদের শোনায় সেই হাটের ফল আর সবজীর বর্ণনা। ঐ হাটে সবজী আর ফলমূল নাকি যেমন সস্তা আর তেমনি টাটকা। শুনে লোভ হয় আমার, বাকীদেরও লোভ হয় হয়ত। কিন্তু তারা আর শুনতে চায় না। হঠাৎ যেন হাটের গল্প থামিয়ে দিতে চায়। একজন বলে ওঠে, ওসব হাটে যাওয়া খুব ঝামেলার, আমি তো কিছুতেই আমার বৌকে নিয়ে যেতে পারব না। -কেন? কেন? বেশ কয়েকজন জিগ্যেস করে ওঠে একসঙ্গে। তাদের মুখে মৃদু হাসি, যেন খুব মজার কোনো উত্তর খুঁজছে।- বৌকে নিয়ে যাবো না, কারণ, গাড়ী ছাড়া তো বৌকে নিয়ে বাজার করে ফিরতে পারব না! আরেকজন যোগ করে,- কেন গাড়ী করে ফিরবে কেন? হেঁটে ফিরবে! হেঁটে!এই শুনে সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে, যেন খুব হাসির ব্যাপার।অমনি আরেকজন বলে ওঠে,- ঐ হাটে কিন্তু এলজেসিশ (ল্সäস্সিস্চ) ভাষা চলবে না। আরেকজন বলে ওঠে "ফরাসীও চলবে না!"তবে চলবেটা কী? অ্যাঁ? সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।তারপরে একজন আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, এলজেসিশ ভাষাটা কী, তা জানো কি?জানব না কেন? গড়গড়িয়ে বলে যাই, ফ্রান্সের পূব দিকের ঐ অঞ্চলগুলোতো দুই বিশ্বযুদ্ধে বহুবছর ধরে বারবার করে জার্মানীর দখলে চলে গেছে, তখন ঐসব অঞ্চলগুলোয় জার্মান ভাষা ছিলো বাধ্যতামূলক ও একমাত্র ভাষা, ফরাসী বললে ধড়ে প্রাণ থাকত নাকি? সেই থেকে ওরা ঐ বিশেষ জার্মান ডায়লেক্টেই কথা বলে, ওটাই এখন ওদের ভাষা। - কিন্তু মুলুজের হাটে ফরাসীও চলে না এলজেসিশও চলে না!এই বলে আবার কয়েকজন ভয়ানক হাসতে থাকে।- তাহলে কোন ভাষা চলে সেখানে?আবার হোহো করে হাসির ধূম।আর ঐ হাসির মধ্যেই কফিব্রেক ভেঙ্গে যায়।

    আরেকদিন একলা পেয়ে নাদিনকে শুধো`ই, মুলুজের হাটে কোন ভাষায় বেচাকেনা করে দোকানীরা?- কেন? ফরাসীতে।- তবে যে সেদিন ওরা বলছিল ফরাসী চলে না ওখানে?আমার প্রশ্নে নাদিন কিন্তু একটুও হাসে না, শুধু আমরা দুজনে আলাদা করে সময় নিয়ে চলে যাই কাফেটেরিয়ায়, যে কফিব্রেকে নাদিন আমাকে শোনায় ঐ হাটের দোকানীদের গল্প। দোকানীরা মূলতঃ উত্তর আফ্রিকার মানুষ। যদিও আজ তারা ফরাসী দেশেরই নাগরিক। এরা ফরাসীতেই কথা বলে সবাই। ঐ যেমন, এক পরিচিত দোকানী নাদিনের, তার মেয়েতো গতবছর পাশ করলো সোবোর্ণ থেকে, সাহিত্যে এম।এ। সেই মেয়েটিও পারী থেকে ফিরে এসে মাঝে মাঝে সাহায্য করে বাবা আর কাকাকে সবজীর ব্যবসায়। চাকরী পেল না কিনা। আর পাবে কিনা কে জানে। ওর অ্যাপ্লিকেশনের প্রথমেই একটা বিরাট ভুল - ওর নাম। হামিদা। এমন হামিদারা অসংখ্য। এলজেসিশ এরা বলতে পারে না, কারণ এরা ইমিগ্র্যান্ট, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার অনেক পরে পা রেখেছে ফরাসী মাটিতে। এদের ফরাসীতে আরবী শব্দের ছোঁয়া। কেউ এসেছে মরোক্কো, কেউ অ্যালজিরিয়া, কেউ তুনিসিয়া থেকে। এই কিছুদিন আগেই তো রাজধানী পারীর শার্ল দ্যগল এয়ারপোর্ট থেকে গুনে গুনে ঠিক একশো জনের চাকরী গেছে। এই একশোজনেরই কারো নাম মুহামেদ, কারো আব্দুকাদির, কারো এল'দ্রিস, ইত্যাদি। এরকম নাম যাদের, তাদের তো ঠিক এয়ারপোর্ট সিকিওরিটির কাজে রাখা যায় না। সন্দেহভাজন হয়ত একজন, কিন্তু সাবধান তো হতে হবে। তার ওপর গতবছর কম গাড়ী জ্বলেছে গোটা ফ্রান্সে? শুনলে না, বাজারের শেষে হেঁটে হেঁটে ফেরার কথা বলছিলো ওরা? ওরা ভয় পায়।

    হঠাৎ আমার চোখের সামনে একটা সিনেমার মতো ভেসে ওঠে মুলুজের কেন্দ্রস্থলের ঐ হাটটি। শনিবারের সকাল। বিকোচ্ছে টাটকা টম্যাটো, স্যালাদ পাতা, আপেল, প্লাম, আঙুর। রীতিমতো দরকষকষি চলছে ক্রেতা বিক্রেতায়। কেউ কেউ বেচছে মুর্গীর ডিম, আর আরেকটু ওদিকে জামা কাপড়ের বাজারেও রীতিমতো ভীড়। ঝলমলে রোদ আকাশে; আর যদি মেঘলা করে আসে, যদি ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি নামে, সেজন্যেও প্রস্তুত দোকানীরা। কিনে বেচে সকলেই বেশ খুশী, বেশ তৃপ্ত। ভীড়ের মধ্যে নাদিনের সঙ্গে আমিও চলতে থাকি, বেশ মজা লাগে, যেন উৎসব, যেন নিমন্ত্রণ। মানে ফিয়েস্তা, ফেৎ, কিংবা কেফে। "কেফে" - শব্দটা নতুন শিখেছি। ফরাসীতে এমন দু একটা অ্যালজিরিয়ান-আরবী শব্দের ব্যবহার কি খুব দোষের? খুব শীগগীরই আমি যাবো ঐ উৎসবে। খুশীর নিমন্ত্রনে।

    -------------------

    এই লেখাটা ২০০৬ এর।

    এর পরে সত্যি সত্যিই গেছি সেখানে বেশ কয়েকবার। মুলুজের হাট আমায় মাঝে মাঝেই ডাকে।
  • সে | 188.83.87.102 | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ১৪:১৩620865
  • আল্লাদি
    -------
    "মনা, আর ঘুরো না, আর ঘুরো না", কথাগুলো মাথার মধ্যে হঠাৎ উঠে এলো।

    গ্রীষ্মের দুপুর। বাইরের জানলা সব বন্ধ, তবুও খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আলো আসায় ঘর তেমন অন্ধকার নয়, মাথার ওপরে খটাং-খটাং শব্দে ঘুরছে মান্ধাতার আমলের ডিসি পাখা। ঘরের চারপাশে অনেক জিনিস অনেক আসবাবপত্র, কিন্তু মধ্যিখানে অনেকটা ফাঁকা জায়গা; সেই ফাঁকা জায়গার পরিধি বরাবর আমি একনাগাড়ে ঘুরে চলেছি। ঘুরতে ঘুরতে নেশা ধরে গেছে, থামতে চাইলেও পারছি না, থামতে গেলে হঠাৎ মাথা ঘুরে যাবে, সেইসঙ্গে বারণও শুনতে পাচ্ছি, মনা আর ঘুরো না।

    আমার বয়েস তখন তিনের কম, তখনও মন্তেস্যারীতে ভর্তি হই নি, আর যে আমায় বারণ করছে, তার বয়েস নয় ।।। বড়জোর দশ, তার মুখখানা ঠিক রতনের মত। সত্যজিৎ রায়ের পোস্টমাস্টার সিনেমার রতনের মত। কিম্বা তা হয়ত নয়, কারণ আমার তো ঠিক মনে নেই অত ছোট বয়েসের কথা, মুখখানা হয়ত আমার কল্পনা। কিন্তু ওই ছোট মেয়েটি যার নাম ছিল আহ্লাদী, সে আমার দেখাশোনা করত। জন্মের পরে যখন আমি হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসি সেই সময় থেকে আহ্লাদীও আমাদের বাড়ি কাজ করতে আসে। সদ্যজাত আমার দেখাশোনা করা, কাঁথা পাল্টানো, আমার সদ্যপ্রসুতি মা কে ছোটখাটো কাজে সাহায্য করা, এইসবই ছিল তার কাজ। সে ই আমার প্রথম নামকরণ করে,- মনা ।

    আমিও জানতাম ওর নাম আল্লা এবং ও আমার দিদি, তাই ও আল্লাদি।

    ও নাকি গান গেয়ে গেয়ে নাচত, "নাচতো দেখি বালা, নাচত দেখি, সোহাগ চাঁদবদনি ।।।" আমাকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে। এসব আমার মনে নেই, শোনা কথা। আমি হাঁটতে শিখি বেশ দেরী করে, হাঁটতে গেলেই পড়ে যেতাম, ফ্লত ফুটেড, যাকে লোকে বলে লক্ষ্মী-পা। তবু আমার দৌড়তে ইচ্ছে হয়, আল্লাদির বারণ না শোনায় আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাই । ঘরের কোণে মেঝেতে রাখা ছিল ভারী কাঁসার বাটি, পড়বার সময় সেটার কানা আমার কপালে গেঁথে যায় । প্রচুর রক্ত বেরোয় কপাল কেটে । অন্যঘর থেকে ঠাকুমা এসে কপালে আর্নিকা লাগিয়ে দেয়, আর্নিকা খেতেও দেয়, আমি শান্ত হয়ে সোফায় শুয়ে পড়ি, ও গুনগুন করে গান গাইতে থাকে, "সোহাগ চাঁদবদনি।।।", তারপরে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। বিকেলে মা ফিরে আসে, কপাল কেটে গেছে দেখে ভয় পেয়ে যায়, রক্ত দেখালে মায়ের মাথা ঘোরে, মা আরও ওষুধ দেয় আমার কপালে, স্টিকিং-প্লাস্টার লাগিয়ে দেয়। সন্ধ্যেবেলা বাবা অফিস থেকে ফিরলে বাবা-মা আমাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে একটা টেবিলের ওপর আমাকে শুতে বলা হল। আমি শোব না, বসে আছি; আমার চোখে মুখে ভয়। সাদা ট্রেতে কাঁচি, লোহার টেবিলে সবুজ অয়েলক্লথ। ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করে, "তোমার নাম কী?", আমি নাম বলি। আমার ভয় কাটাবার জন্যে সে আবার বলে, ইশ তোমার জামাটা কী সুন্দর, আমারটা বাজে, তুমি আমাকে তোমার জামাটা দেবে?।।।, এইসব। এইসময়ে বাবা বলে, একটা কবিতা আবৃত্তি করতে। আমি আবৃত্তি করতে থাকি, "গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা।।।"

    কবিতা শেষ হলে সেই ডাক্তার বাবাকে বলে, "এত ছোট বাচ্চাকে এইসব কবিতা কেন? বাচ্চাদের কবিতা, ছড়া এসব শেখান নি?" আমাকে বলে, "শিশু থেকে শিখবে, 'শিশু', কেমন?" এরই মধ্যে ইনজেকসান দেওয়া হয়ে যায়, আমার ঘুম পেতে থাকে ।

    আমি ইনজেকসানে ব্যথা পেলেও সেদিন কাঁদিনি, বাবার হাত ধরে ছিলাম, কপালে স্টিচ করা হয়েছিল। মা বরঞ্চ রক্ত দেখে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। আল্লাদি নিশ্চয় অনেক বকুনি খেয়েছিল, আমাকে ঠিকমত আগলে না রাখতে পারার জন্যে। কিছুদিন পরে স্টিচ কাটাবার জন্যে আবার যেতে হলো হাসপাতালে। এবারেও যদি আবার কবিতা বলতে হয়, তাই আমি ভালো করে শিখে নিয়েছি অন্য আরেকটা কবিতা, শিশু থেকে নয়, বাবা কবিতা পড়ে আপন মনে তাই শুনে শুনে; আমি তো পড়তেই জানিনা। আমি মুখস্থ করি, "এখনি অন্ধ বন্ধ কোরোনা পাখা ।।।" পুরো কবিতাটা বড্ড বড়, পুরোটা মুখস্থ হয় না। কিন্তু স্টিচ কাটাবার দিন হাসপাতালে গেলাম সকালবেলা, দেখলাম অন্য একজন ডাক্তার; সে নাম জিজ্ঞেস করে না, কবিতাও শুনতে চায় না, টেনে টেনে তিনটে স্টিচ কেটে দেয়, আমি চীৎকার করে কেঁদে উঠি।

    ওই কপাল কেটে দাগ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই দুঃখ করতে লাগল প্রকাশ্যে, একেবারে খোলাখুলি বলত, আহারে মেয়ে বাচ্চা ব'লে কথা, এমনিতেই রঙ ময়লা তার ওপরে কপালে ওরম বড় একটা দাগ রয়ে গেলে পরে বিয়ে দিতে ঝামেলা হবে।

    আমার মা-বাবা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিয়ে দিত, শুধু চেহারা দিয়ে কী হবে, আজকালকার দিনে লেখাপড়া শেখাটাই আসল গুণ, বুঝলেন? ছেলে হোক কি মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাই আসল।

    তবুও দাগ কমানোর দামী মলম লাগাতে হয়েছিল আমাকে অনেক দিন নিয়ম করে। কতটুকু কমেছিল জানিনা, কিন্তু যখন থেকে আয়না দেখার স্মৃতি, তখন থেকেই ওই দাগটা কপালে বহাল; যেন ঐটা নিয়েই আমি জন্মেছিলাম, যেন সেই দুপুরে খটাং-খটাং ডিসি পাখার শব্দের তালে তালে অবাধ্য একটি শিশু একমনে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাতাল হয়ে যায় নি।

    আল্লাদি আমাদের বাড়িতেই থাকত, আমি বড় হয়ে উঠছিলাম কিন্তু আমার ছোটবোনের দেখাশোনার জন্যে ও রয়ে গেল। যে সময়ের কথা বলছি, সেটা ষাটের দশকের শেষ, তথাকথিত ভদ্রলোকেদের বাড়ি বাড়ি এরকম শিশুশ্রম একেবারেই দৃষ্টিকটু ছিল না। আমি যদিও জেনে ফেলেছিলাম ও আমার নিজের দিদি নয়, ওর মা টাকা নিতে আসে এবং ওর নিজের একটা দিদি আছে যাকে দেখলেই মনে হতো খুব রেগে আছে। দিদির বিয়ে হয়েছিল কোনো "হিন্দুস্থানির" সঙ্গে, সে শ্বশুরবাড়ি যেত না। ওর মা ও দিদি দুজনে মিলে জৈন শিল্প মন্দিরে মশলা গুঁড়ো করতে যেত। লোকের বাড়ি পুঁচকে শিলনোড়ায় মশলাবাটা ঝিয়ের কাজ নয়, বড় বড় হামানদিস্তায় মশলা গুঁড়ো করার কাজ। ডেলী কাজ, ডেলী টাকা, ঝিগিরির থেকে অনেক বেশি ইনকাম। এসব আমি শুনেছি যখন আল্লাদির মা আসত আমাদের বাড়ি, আল্লাদিকে দেখে যেত এবং ওর মাইনের টাকা নিয়ে যেত। জৈন শিল্প মন্দির শুনলেই আমার কেবল মনে হতো একটা মন্দিরের ভেতরে সারিসারি বউ হামানদিস্তায় মশলা পিষছে।

    এই রকম করেই চলছিল কিংবা হয়ত চলতেই থাকত, যদিনা এক ছুটির দুপুরে আমার মা হঠাৎ আল্লাদিকে বলত, "তুই রোজ আমার বাচ্চাদের তেল মাখাস, চান করিয়ে দিস, আয় আজ আমি তোর হাতে পায়ে একটু তেল মালিশ করে দিই "।

    ও নিজেও তখন শিশু, এতটুকুও আপত্তি করেনি। কিন্তু তেল মাখাতে গিয়ে মা আবিষ্কার করে কয়েকটা ছোট ছোট দাগ ওর পায়ে, হাতে।

    - এই দাগগুলো কীকরে হলো রে?

    - জানিনা।

    - আগে ছিল?

    - নাতো, দেখিনি।

    - ব্যথা আছে?

    - নাঃ ব্যথা নেই।

    আহ্লাদী হাত টেনে সরিয়ে নেয় নিজের দিকে।

    এসব ঘটনা অনেক পরে শুনেছি । মা আহ্লাদিকে নিয়ে ডাক্তারখানায় ছোটে সন্ধ্যেবেলা; ডাক্তারবাবু ছুঁচ ফোটালেও ওই দাগ হওয়া জায়গাগুলোর কোনো সাড়ই অনুভব করে না ও। পরের দিন অফিসে যায় না বাবা, ওকে নিয়ে যায় কুষ্ঠহাসপাতালে। প্রেমানন্দ ডিস্পেন্সারী ফর লেপ্রসি। এরপরে নিয়মিত চিকিৎসা শুরু হয়, ওষুধ লাগিয়ে দেয় মা। দেয়াল আলমারীতে রাখা থাকে ওর ওষুধ। বাইরের কাউকে ঘুণাক্ষরেও বলা হয় নি একথা। ঠাকুমার প্রাথমিক আপত্তির উত্তরে জানিয়ে দেওয়া হয়, এ কুষ্ঠ ছোঁয়াচে নয় এবং প্রথম দিকে ধরা পড়েছে, নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে গেলে সেরে যেতে বাধ্য। কয়েকমাস এভাবে চলতে না চলতেই উপস্থিত আল্লাদির মা। এবার দিদি আসে নি। নতুন খবর নিয়ে এসেছে আল্লাদির মা, দিদিকে তার বর শ্বশুরবাড়ি নিয়ে গেছে কয়েকদিন আগে।

    বাঃ , এতো চমৎকার খবর! সবাই খুব খুশি হয় শুনে।

    কিন্তু ওর মা জানায়, এরফলে মশলা গুঁড়োর কাজ একা করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে, আহ্লাদিও তো এখন বড় হচ্ছে, একটু ভারী কাজ নিশ্চয় করতে পারবে; ওর কি উচিৎ নয় মা কে সাহায্য করা? মোটকথা মা ওকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে এসেছে।

    - কীরে আহ্লাদি, যাবি?

    আমার মা প্রশ্ন করে ওকে। ও ভ্যাবাচাকা খেয়ে একবার ওর মায়ের দিকে তাকায় একবার আমার মায়ের দিকে। তারপরে নিজের মায়ের সঙ্গে চলে যেতে চায়। আটকে রাখা যাবে না ওকে, কিন্তু চিকিৎসা যে চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, তাই অবশেষে ওর মায়ের কাছে ভাঙ্গা হয় ওর অসুখের কথাটা। সব শুনে আহ্লাদির মা রণমূর্তি ধরে, এ রোগ কিছুতেই হতে পারে না তার মেয়ের, তারা কোনো পাপ করে নি, এসব মিথ্যে কথা, মেয়েকে আটকে রাখার ফন্দি। ঝগড়া করতে করতে আহ্লাদিকে নিয়ে নিমেষে বের হয়ে যায় ওর মা। মাইনের বকেয়া টাকা নেয় না, অন্যান্য ওষুধ ও শিশিটা দিতে চাইলেও নেয় না। যেতে যেতে জানিয়ে দেয়, সে আহ্লাদীর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে, ইত্যাদি।

    আমার মা পায়ে চটি গলিয়ে সমস্ত ওষুধ নিয়ে ওদের পেছন পেছন গিয়েছিল কিছুদুর, কিন্তু ওরা ততক্ষণে বড়রাস্তায় পৌঁছে ট্রাম ধরে ফেলেছে।

    প্রথম কয়েকমাস আমরা অপেক্ষা করতাম সকলে, যদি ওর মায়ের রাগ পড়ে, যদি নিজের মেয়ের ভালো চায় তবে নিশ্চয় ফিরে আসবে, অন্ততঃ ওষুধটুকু নিতে। কিন্তু আসেনি। ওষুধ ও শিশিটা দেয়াল আলমারীতে রাখা ছিল বহুদিন, বহুমাস, বহুবছর; ওষুধএর এক্সাপায়ারী ডেট পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও।

    মা অনেককে জিজ্ঞেস করেছিল, আহ্লাদির মা কোথায় থাকে ? যদি দেখা হয় বলতে যেন একবারটি আসে আমাদের বাড়ি।

    কিন্তু কেউ বলতে পারে না কোথায় ওদের ঘর, কেউ বলে নারকেলডাঙ্গার বস্তি তো কেউ বলে উল্টোডাঙ্গা, ঠিক করে কেউ জানে না। তবে একথা ঠিক যে দিদি এখন মায়ের সঙ্গে নেই, কিন্তু ওর মা তো এখন মশলার কাজ করে না, সেতো অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ হাসপাতালের আয়ার কাজ ধরেছে। ডেলী বারো ঘন্টা ডিউটি কিন্তু হালকা কাজ টাকা বেশি। আর আহ্লাদি? তার খবর কেউ দিতে পারে না।

    কেউ বলে, "ওকেই বা খু ঁজছেন কেন? বাচ্চা সামলাবার জন্যে অল্পবইসী ঝি চাই তো? সন্ধানে থাকলে জানাব।"

    আবার কেউ বলে, "আজকাল বিশ্বাসী কাজের লোক পাওয়া খুব কঠিন। দুদুটো বাচ্চাকে অচেনা লোকের হাতে রেখে যাওয়া খুব রিস্কি। তার ওপর বাচ্চা মেয়ে, খুব সাবধান" ।।।কেউ বলে,"খুব বেঁচে গেছেন যে চোখের সামনে দিয়ে গেছে, যদি চুরি করে পালাত ? জিনিসপত্র তো চুরি করতেই পারত, কিন্তু মনে করুন যদি বাচ্চাদুটোকেই চুরি করে নিত, তখন?" কিংবা, "উঠতি বয়েসের ঝি একদম রাখবেন না, ওদের মতিগতি ভালো নয়, হয় বুড়ি নয় বাচ্চা "।

    এরপরে বাড়িতে রাতদিনের কাজের জন্যে আসে তারাপদর মা। বুড়ী, বিধবা, সাদা থান পরণে, একাদশীর দিন আমিষ খায় না । সে দোক্তার কৌটো খুলে পা ছড়িয়ে বসে জিরোয়, মাঝে মাঝে রেগে থাকে, কাজ ছেড়ে দেবে বলে শাসায়, আবার মন ভালো থাকলে আপন মনে ছড়া কাটে, সে ছড়া গালিগালাজে ভর্তি ।

    দুঃসময় কবিতাটা এরমধ্যে আমার পুরো শেখা হয়ে গেছে, আমি জেনে গেছি বন্ধ কোরোনা পাখা মানে সীলিং ফ্যান বন্ধ করবার কথা নয় । একটা পাখি উড়তে উড়তে পথ হারিয়ে ফেলেছে, ঘন অন্ধকারে সে কিছু দেখতে পায় না, নীচে সমুদ্র। সমুদ্র দেখিনি কিন্তু পাখিটার জন্যে ভয় হয়, পড়ে গেলে ডুবে মরে যাবে, আর কতক্ষণ উড়বে ও? এ কী ভয়ের কবিতা! এতো একানড়ের গল্পের চেয়েও বেশী ভয়ের! সন্ধ্যেবেলা দোতলায় পশ্চিমের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে, বলাইপালের মাঠের অন্ধকারে শুধু তাল আর নারকেল গাছ দেখা যায়। সেখানে একানড়ের ভয় জমাট হয়ে থাকে, কিন্তু দৌড়ে ঘরে ফিরে আসাও যায়।

    অথচ, এই কবিতার কোথাও বলা নেই এর পরে কী হলো । আমি ওই পাখিটার কথা ভুলে যেতে চেষ্টা করি।

    সেবার মৌলালীর রথের মেলা থেকে তিনটে কাঠের পুতুল কেনা হলো । নামেই কাঠের পুতুল, আসলে ওগুলো বাঁশের পুতুল, লম্বা সরু সরু প্রিজমের মতো আকৃতি। ওরই মধ্যে অল্প খা ঁজকাটা, তার ওপরে রং করা টানাটানা চোখ, কুচকুচে কালো চুল, কপালে লাল টিপ, গায়ে নীল শাড়ী, সবুজ শাড়ী, লাল শাড়ী; তিনজনেরই গায়ের রং হলুদ, মা দুর্গার মূর্তির যেমন হয়। তিনজনের মুখে হাসি, আমাদের কাঠের দেরাজে বন্দি পেতলের পার্ব্বতী মূর্তির মতন। পুতুলগুলো সস্তা, দম দিতে হয় না, টিপলে প্যাঁ করে আওয়াজ করে না ঠিকই ; কিন্তু হাত থেকে পড়ে গেলে ভাঙ্গেও না, অল্প রং চটে যায় এই যা!

    পরপর তিনদিন সকালে আমি তিনটে পুতুলের নাম দিই, প্রতিদিন একটা করে। বাবা ফাউন্টেন পেন দিয়ে প্রতিটি পুতুলের পেছনে নাম ও তারিখ লিখে দিল। আমি তখনও লিখতে শিখিনি।

    ওদের প্রত্যেকের নাম দিলাম আল্লাদি।
  • | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ১৫:০৭620866
  • ডলির গল্পটা বহু আগে পড়েছিলাম।

    হাইডি থেকে মাঝখানের তিনটে লেখা সুপার্ব! অসাধারণ।

    আল্লাদিরা এরকম টুপ করে হারিয়ে যায়। :-((
  • i | 134.149.161.171 | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ১৬:২৯620867
  • অসাধারণ লেখা। অসাধারণ।
  • i | 134.149.161.171 | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ১৬:৪৯620868
  • হাইডি পড়েছিলাম প্রবাসীর পত্রে। হাটের কথাও। যদ্দূর মনে পড়ে।।সেই এক রকম ভালো লাগা। কি একটা আছে সে র লেখায়-এখনও আবিষ্কার করতে পারি নি...
  • Abhyu | 138.192.7.51 | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ২৩:১২620869
  • অসাধারণ লেখা।
  • এমেম | 69.93.194.120 | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৯620870
  • কী আছে? অনেক ভয় আছে। আজও কি কাটিয়ে উঠতে পেরেছ সেই ভয়কে?
  • এমেম | 69.93.194.120 | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:২০620872
  • স্বর্গ থেকে বিদায় অপূর্ব লাগল।
  • Atoz | 161.141.84.164 | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ০৫:২৭620873
  • মনে পড়ে গেল সেই শান আর ডলির গল্প। সাংঘাতিক গল্প। আগে পড়েছিলাম কোথাও। কিন্তু ওর অভিঘাত একটুও কমে নি, আজও। কেবল ভাবি, যখন একটা সমুন্নত সমাজব্যবস্থার মধ্যেও ডলিরা প্রতিদিন দেহ থ্যাৎলানো আর আত্মসম্মান থ্যাৎলানো মেনে নিয়ে থাকতে বাধ্য হয়, কোনো প্রতিকার পায় না, তখন এর সমাধান কোথায়? আদৌ সমাধান আছে কি?
  • π | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ১১:৩১620874
  • আল্লাদি পড়লাম। মাথার ভিতর ঘুরছে।
  • Tim | 188.91.253.21 | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ১২:২৫620875
  • সে'র লেখা বরাবরের মতই ভালো লাগছে পড়তে।
  • সে | 203.108.233.65 | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ১৩:০৮620876
  • সকলকে ধন্যবাদ।
  • সে | 203.108.233.65 | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ১৩:০৯620877
  • দীর্ঘ পথ, শর্ট ট্রিপ
    -----------------
    জুরিখ শহরের ৩২ নম্বর ট্রলিবাসের রুটটা বিরাট লম্বা; শহরের উত্তর-পশ্চিম সীমানা থেকে শুরু হয়ে অলিগলিচলিরাম ক'রে, নদীনালা ডিঙিয়ে, অনেক লম্বা চওড়া রাস্তা পেরিয়ে, গোটাকয়েক প্যাঁচ খেয়ে খেয়ে তার গন্তব্য অবশেষে শহরের দক্ষিণ পশ্চিমে। এই গোটা পথপরিক্রমায় সে পেরিয়ে আসে একটা বিশেষ রাস্তা, যে রাস্তার নাম লাংষ্ট্রাস্‌সে, বাংলায় যার অর্থ লম্বা রাস্তা। ঐ একমাত্র ৩২ নম্বরই সাহস করে লাংষ্ট্রাস্‌সের গোড়া থেকে ডগা অবদি বেশ কয়েকটা স্টপেজ থামতে থামতে যায়, আর কোনো বাস ঐ বিশেষ রাস্তাটির ছায়া মাড়ায় না। জুরিখে
    যাঁরা একাধিকবার এসেছেন টুরিস্ট হিসেবে, কিম্বা জুরিখ সম্বন্ধে হাল্কা ধারণাও যাঁদের আছে, লাংষ্ট্রাস্‌সের নাম তাঁদের কানে কখনো না কখনো আসবেই। এটাই শহরের মূল রেডলাইট এরিয়া। যাঁরা "বর্ণ্‌ ইন্টু ব্রথেল্‌স্‌" অথবা "ল্যান্ড অফ্‌ মিসিং চিল্ড্রেন" গোছের ডকুমেন্টারী দেখে কলকাতার রেডলাইট এরিয়া সোনাগাছি সম্পর্কে আবছা হলেও
    কিছুটা অন্ততঃ ধারণা করে ফেলেছেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই, লাংষ্ট্রাস্‌সের সঙ্গে সোনাগাছির অমিলই বেশি। গোটা রাস্তাটা জুড়ে ছোটো বড়ো কয়েকশো অফিস, তাদের মধ্যে বেশ কিছু সরকারী অফিস ও রয়েছে, এমনকি একটা বাসস্টপের
    নাম বিজ্ঞানী রোয়েন্টগেনের নামে। বাস থেকে নামলেই দেখা যাবে অফিসবাড়ীর একতলাগুলোয় সব নাইটক্লাব, আর তাদের দেয়াল জুড়ে লাস্যময়ী নগ্নিকাদের ফোটোসহ বিজ্ঞাপন। প্রদীপের তলাতেই যে অন্ধকার হয় তার এক্কেবারে মোক্ষম উদাহরণ। বড়োবড়ো সব উকিলের চেম্বার, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পার্লামেন্টের মেম্বার, আছেন প্রচুর কৃতীব্যক্তি, বড়োবড়ো ডাক্তার মোক্তার, তাঁরাও ঐসব নাইটক্লাবের পাশের দরজা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজ নিজ অফিসে চলে যান। এই এলাকায় অফিসস্পেসের ভাড়া মারাত্মক বেশী। আবার
    এইসব বাড়ীগুলোর পেছনদিকগুলোয় থাকে অ্যাপার্টমেন্ট, যেখানে ঢেলে দেহব্যবসা চলে। মোটকথা এই রাস্তাটি শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে খুবই কাছে এবং দিনে ও রাতে সমান ব্যতিব্যস্ত।
    এপাড়ায় অফিস খুলেছেন বেশ কিছু স্বেচ্ছসেবী সংস্থা, যাঁরা সমাজ সংস্কারে আগ্রহী, মেয়েদের দুর্ভোগ যাঁদের বরদাস্ত হয়না। তাঁরাই দিনদুপুরে জুগিয়ে চলেছেন প্রয়োজনীয় সাহায্য এবং দরকারী মতামত, যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় বড্ড কম অথবা আইনের মারপ্যাঁচে নিস্তেজ। পাড়ার ডাক্তারদের কাছ থেকেও নর্তকীদের দৈনন্দিন জীবনের শোষণ অবিচার অত্যাচার অসহায়তার খবর পাওয়া যায়, কিন্তু প্রতিকারের খবর কেউ দেয় না। হিউম্যান ট্র্যাফিকিং হতেই থাকে, পাসপোর্ট-ভিসা-ওয়ার্কপার্মিট এর সমস্ত নিয়ম কানুন মেনেই।
    সকলেরই জীবনে দরকারী কাজ আছে, তাই ঊর্ব্বশীরা নাচতেই থাকে নৃত্যের তালে তালে এক এক করে তাদের পোশাক খুলে যেতে থাকে, লজ্জা টজ্জাও খুলে খুলে ঝরে পড়ে মাটিতে মিলিয়ে যেতে থাকে, আমাদের কারোর ই কিছু এসে যায় না এতে, কারণ আমরা সব একেবারেই নিপাট ভদ্রলোক, লাংষ্ট্রাস্‌সের ক্রেতা বা বিক্রেতা কোনো ক্যাটেগোরীর অন্তর্ভূক্তই নই, তবুও ৩২ নম্বরের জানলার কাচ ভেদ করে করে আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখের সামনে এসে পড়ে এই মরশুমের নতুন নর্ত্তকীদের ফোটো। আমরা যুধিষ্টিরের দল শুধু
    আলতো পাপক্ষয়ের নিমিত্ত অনিচ্ছায় ৩২ নম্বরে চড়ি, নরকদর্শণের ঘৃণা সত্ত্বেও আড়চোখে দেখতে পাই দোকানগুলোয় এসেছে নতুন নতুন স্টক।
    কৌতুহলের জেরে জানা হতে থাকে নানান তথ্য। অন্য একদিন এদেশের নানান ধরণের ওয়ার্ক পার্মিট নিয়ে আলোচনা হবে'খন, এখন শুধু গণিকা-নর্তকীদের ওয়ার্ক পার্মিটের কথা বলি বরঞ্চ।
    শুনতে একটু অস্বস্তিকর হলেও, বিদেশ থেকে গণিকাবৃত্তি করতে আসা এই নর্ত্তকীদের আর বিভিন্ন দেশ থেকে অল্প সময়ের জন্য কাজ
    করতে আসা কনসাল্টেন্টদের পার্মিট অভিন্ন ক্যাটেগোরীর। ক্যাটেগোরী , হাজারে হাজারে তথ্যপ্রযুক্তি বিশারদেরা স্বল্পমেয়াদী প্রোজেক্ট করতে এই পার্মিট ই পেয়ে থাকেন। স্বল্পমেয়াদ বলতে
    তিনমাস থেকে বড়জোর দুবছর, আর এই অক্ষরটির অর্থ অ্যাপ্রেন্‌টিস্‌ বা প্রশিক্ষণএর জন্যে হলেও আদতে এর অর্থ লিমিটেড ক্যাটেগোরী, তার লিমিটেশন নানাবিধ- যতদিন এদেশে কাজ করবে
    মণিবকে বদলাতে পারবে না, চাকরী ছেড়ে দিলে বা চাকরী চলে গেলে অনতিবিলম্বে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
    কিন্তু মজাটা অন্যখানে। বাঘা বাঘা ডিরেক্টর ম্যানেজার অফিসার ব্যক্তিদের দেখেছি, পার্মিট নিয়ে এদেশে এসে বছরখানেক কাটিয়ে যেতে। পার্মিটের সুফলটুকু উপভোগ করেছেন এঁরা, সোশ্যাল সিকিওরিটি বাবদ যেটাকা বেতন থেকে কাটা যায় সফরশেষে সুদে আসলে ফেরত পান সেসব, শুধু ট্যাক্সটুকু দিতে হয় এই-ই যা। অথচ নর্তকীদের পার্মিটের গায়ে লেখা থাকে এক
    অদ্ভুত সাংকেতিক শব্দ, "শিল্পী"- Küন্স্ত্লেরিন; শিল্পই বটে। এদের পার্মিটের মেয়াদ সীমিত তিনমাসের জন্যে, তিনমাস কেটে গেলে ফেরৎ
    যায় শিল্পী, আসে নতুন শিল্পী তার শিল্পের নতুন পসরা নিয়ে। সোশ্যাল সিকিওরিটি বাবদ এদের বেতন থেকেও কাটা যায় অর্থ, কিন্তু সিকিওরিটি শব্দটাই এক্ষেত্রে এদের কাছে অর্থহীন; ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাউকে দিয়ে কাজ করানো, তা সে যে কাজই হোক না কেন, যা সুইস আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তা ই হয়ে চলেছে প্রদীপের নীচে,
    চারপাশে, প্রতি নিয়ত। তার ওপর এই "শিল্পের" বাজারে খদ্দেরদের সবসময় নতুন নতুন জিনিস চাই, তিনমাস হয়ে গেলেই মুখগুলো, দেহগুলো পুরোনো হয়ে যায়। তখন আসবে নতুন নতুন কচি কচি ফ্রেশ শিল্পীরা, ব্যাঙ্কক থেকে, পূর্ব ইউরোপ থেকে, মনভরা আশা নিয়ে ভালো বেতনের কাজের খোঁজে। ভালো বেতন, অথচ চীপ-লেবার, কী অদ্ভুত প্যারাডক্স। অবশ্য, গোড়ার দিকে এই
    "কাজ"-এর গতিপ্রকৃতি অধিকাংশ সময়েই জানা থাকেনা নর্তকীদের। এদেশের মাটিতে পা রাখার পর সত্যের উদ্‌ঘাটন হতে থাকে। কিন্তু তখন ফিরবার উপায় নেই। নেই বললে ভুল হবে, আছে, কিন্তু তার মূল্য প্রচুর। তারচেয়ে তিনমাসের
    নর্তকীজীবনের সঙ্গে সমঝোতাই নাহয় হল। সেই তিনমাসে যদি বরাত খুলে যায়, কে বলতে পারে? হয়ত দেখা হয়ে গেল কোনো স্বপ্নের সওদাগরের সঙ্গে, হতেই পারে, কখনো কখনো হয় ও। আমি চিনি একটি মেয়েকে, তার নাম মাম, তার সফরও শুরু হয়েছিল ঐ লম্বা রাস্তায় একটা শর্ট ট্রিপ দিয়ে। বছর দুয়েক পরে মাম আবার ব্যাঙ্কক থেকে ফিরে এসেছে এদেশে, থাকে একটা ছোট্টো রাস্তায়, শুরু করেছে একটা অন্য জীবন খুব ধীর পদক্ষেপে।
    কিন্তু সবাইতো মাম নয়। এক গ্রীষ্মের ভোরে অচেনা পথ ধরে খেয়ালহীন হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেছলাম রোয়েন্টগেন নামাঙ্কিত সেই বাসস্টপটার পেছনের গলিতে, হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি,
    ফ্রেমে বাঁধানো এক শিল্পকর্ম বুঝি, তবে সেটা ছিল চকিতের ভুল; ঠাওর করে বুঝলাম, জানলার ফ্রেমে বাঁধা পড়ে আছে এক তরুণী, অতি স্বল্পবাস, একহাতে চিরুণী। শার্সিতে ঠেশ দিয়ে বসে যেন এক মোমেগড়া পরী। ঐ নিখুঁত ভাস্কর্য এক ঢাল চুল
    আঁচড়েই চলেছে, হয়ত মণিবের ওরকমই নির্দেশ, হয়ত ওভাবেই ক্রেতাদের ডাকতে হয়।
    আমার ভয় হয়েছিলো সেদিন, যা দেখলাম তা কি সত্যিই দেখলাম ঝকঝকে দিনের আলোয়? শুধু আমি কেন, আরো চারপাশের সবাই নিশ্চয় দেখেছিলো, তবু কেউ কেন কোনো প্রতিবাদ করল না? একতলার জানলায় বসা মেয়েটিকে কেন আমি শুধু একটি কথা জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না, যে ও কি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেতেই ওখানে ঐভাবে বসে আছে? আমার সমস্ত জড়তা ভীড় করল জিভে, আর
    আমি দৌড়ে পালাতে লাগলাম ঐ লম্বা রাস্তা ধরে সিধে, যেন রোয়েন্টগেনের অদৃশ্যকণিকা আমাকে তাড়া করেছে, আমার ভেতরটা ভেদ করে সব দেখে নেবে, তাই তাকে ছাপিয়ে আমার মান সম্ভ্রম আগলে ধরে আমি দৌড়ে পার হয়ে গেলাম লাংষ্ট্রাস্‌সে।
    অদ্ভুত ম্যাজিক! নিরাপদ ভদ্রপাড়ায় পৌঁছেই আমার ওপর ভর করে বসল সহমর্মিতা সহানুভূতি ইত্যাদি যাবতীয় ভালোভালো জিনিস, আবার ইচ্ছে হতে লাগলো মেয়েটিকে একবার দেখে আসবার,
    তবুও যেতে পারিনি, আর সময় গড়িয়ে গেছে নিয়ম করে, তিনমাস পরপর গলে গেছে পুরোনো মোমের পুতুলগুলো, বসেছে নতুন পুতুল,
    ভেবে দেখলাম বেসিক্যালি ওভাররিয়াক্ট করে ফেলেছি তালে গোলে, শুধু ফ্রেমগুলো রয়ে গেছে অবিকৃত অবিনশ্বর।
    --------------------------------------

    এই লেখার (২০০৬) পরেও একটা ছোটো করে উপসংহার আছে। সেটা আশাপ্রদ।
  • b | 135.20.82.164 | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ১৩:২৪620878
  • আল্লাদি দারুণ। সে, আপনি আপনার বাবা-মাকে আমর নমস্কার জানাবেন।
  • π | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ১৩:২৭620879
  • 'ভালো বেতন, অথচ চীপ-লেবার, কী অদ্ভুত প্যারাডক্স।'

    এই প্যারাডক্সটা ঠিক বুঝলাম না।
  • সে | 203.108.233.65 | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ১৩:৩১620880
  • এখানকার নিক্তিতে চীপ লেবার, কিন্তু যারা আসছে তাদের নিক্তিতে ভালো বেতন।
    কিন্তু উপসংহার আছে। সেটা পরে লিখবো।
  • i | 134.168.2.225 | ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৫:৫০620881
  • লিখুন।
  • de | 190.149.51.67 | ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৬:৫০620883
  • বাঃ - এই টইটা তো বোধহয় আগে দেখিনি - খুব ভালো লেখা হচ্ছে সে -
  • শিবাংশু | ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৯:৩৫620884
  • 'সে'ই কি বিলিতি বোষ্টুমি ? :-)
  • Du | 127.194.210.26 | ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ২১:০৭620885
  • শান, ডলি আর সেই প্রোফেসরের বৌ এর গল্প আগে পড়ে কি যে ঘুরে গিয়েছিল মাথাটা সে এখনও মনে আছে
  • Atoz | 161.141.84.164 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:১৪620886
  • সে, ও সে, কই গো সুগন্ধী পুরানো চালের ভাত রাঁধবে না আর?
  • nina | 78.37.233.36 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৮:৩৫620887
  • সে কি এল? সে কি এলনা লেখা দিয়ে গেলনা গেলনা--
  • সে | 198.155.168.109 | ১৬ জুন ২০১৬ ১৩:০১620888
  • হলদিয়া ও ক্যাটামারান
    ------------------------
    ১৯৯৯র দ্বিতীয় ভাগ। সারা দুনিয়া ছটফট করছে ওয়াই-টু-কে জনিত উত্তেজনায়। নাম করা বিগ ফাইভ (মতান্তরে বিগ সিক্স) অডিটিং ফার্মের একটায় তখন চাকরী করছি। আইটি শাখায়। তারা কনসাল্টেন্সি করে। ওদিকে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল তখন রমরমিয়ে উঠছে। প্রোডাকশান শুরু হতে জাস্ট একটু বাকি। দামি সফটওয়্যার কিনেছে তারা, এবং দামি কনসাল্টিং কোম্পানী সেই জিনিস ওখানে সাল্টে দেবে, সমস্তই প্ল্যানমাফিক চলছে। আমাদের কোম্পানী থেকে গোটা চল্লিশ কনসাল্টেন্ট কাজ করে চলেছেন। গত শতাব্দী বলে কথা। রিমোট কনসাল্টিং সেরকম মাথা চাড়া দেয় নি। নেটওয়ার্ক ঝুলস্য ঝুল। কনসাল্টেন্টরাও নানান ইন্টারন্যাশানাল প্রোজেক্ট সাকসেসফুলি ইম্পলিমেন্ট করবার দৌলতে প্রত্যেকেই প্রায় বিলেত ফেরৎ। তাদের একটা ক্লাস তৈরী হয়ে গেছে। হলদিয়ার মতো এঁদো জায়গায় তারা যাবে না। প্রোজেক্ট অ্যাকসেপ্ট করতেই চাচ্ছিলো না প্রথমে। অতি কষ্টে সোনি (কুঁড়ি নয়) র, টেট্রাপ্যাকের, প্রোজেক্টের লোভ দেখিয়ে, ভবিষ্যৎ বিদেশযাত্রার মুলোটা কলাটা দেখিয়ে তাদের নিমরাজি করানো গেলেও তারা অনসাইট হলদিয়া যাবে না সেকথা একদম স্থির। অতএব কোলকাতা থেকেই ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের বিল্ডিংএর একটা ফ্লোর দখল করে কাজ শুরু হয়ে গেল। যন্ত্রপাতি কম্পিউটার সার্ভার সবই সেই অফিসেই। কমপ্যাকের লেটেস্ট মডেলের বাঘা সার্ভার। জায়গাটা তারাতলা রোডের সন্নিকটে স্টেট গ্যারেজ বাসস্টপ। আমি টেকনিক্যাল লোক। কম্প্যাকের সঙ্গে বসে বসে আমার সফ্টওয়্যার ইন্সটল করে দিলাম। কনসাল্টেন্টরা লিগ্যাসি সিস্টেম থেকে ডাটা ভরতে লাগলেন। খুচখাচ সমস্যা ইত্যাদিতে হাত লাগাই। কাজের চাপ মিডিয়াম। রোজ সকালে একজন কনসাল্টেন্ট লাঞ্চের অর্ডার নেন। তিনি খাতায় কলমে একটা দরকারি মডিউল সামলাচ্ছেন। কিন্তু কার্যতঃ লাঞ্চের অর্ডার দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে কমপ্লিট করেন। খুব মিষ্টি স্বভাব। তিনরকমের লাঞ্চ অপশান। ভেজ, ননভেজ এবং ফ্রুটলাঞ্চ। দীর্ঘকাল ধরে তেল মশলাওয়ালা ননভেজ লাঞ্চ খেয়ে খেয়ে যাদের জিভের তার মরে যাচ্ছে, তারা ফর অ্যা চেইঞ্জ ফ্রুটলাঞ্চটাই প্রেফার করেন। লাঞ্চের লিস্টি হয়ে গেলে, সেই কনসাল্টেন্ট অন্য লিস্ট চেক করেন। সেই লিস্ট হচ্ছে জন্মদিন, বিয়ে, বেবি শাওয়ারের লিস্ট। সেই লিস্টে কাছাকাছি কার কার জন্মদিন কি বিয়ে কি বেবি শাওয়ার পড়ছে সেইমতো মিলিয়ে নিয়ে, কী কী প্রেজেন্ট কেনা হবে সেটা ঠিক করা হয়। প্রোজেক্ট মিটিংএ এই নিয়ে একটা টাইমস্লট অ্যালোকেট করা থাকে। সেখানে মতামত নেওয়া হয়। কায়দা করে যাকে প্রেজেন্ট দেওয়া হবে তাকে স্থানান্তরে সরিয়ে দেওয়া হয় কোনো একটা কাজের অছিলায়। তারপর প্রেজেন্টের সামগ্রী বাছা নিয়ে তর্কাতর্কি কথা কাটাকাটি ভোট ইত্যাদি হয়ে গেলে সেই কনসাল্টেন্ট দোকানে গিয়ে জিনিসগুলো চাক্ষুষ দেখে এসে কস্ট এস্টিমেট দেন। দুতিন রকম রঙের অপশান থাকলে আরেকপ্রস্থ তর্কাতর্কি কথা কাটাকাটি ভোট ইত্যাদি হয়, তারপরে গড়ে পারহেড কত করে চাঁদা দিতে হবে সেটা ডিসাইড করা হয়। অবশ্যই রাউন্ড ফিগার। একটা ফাণ্ডও আছে। সেই ফাণ্ডেই ক্যাশ জমা পড়ে। এরপর বাকি দিনগুলো তিনি জনে জনে ক্যাশ কালেকশান করেন। ওঁর এসডি (সেলস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশান) মডিউলের কাজ অন্য কনসাল্টেন্টরা করে দেন। একদিন জনান্তিকে এক কোলিগকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এরকম ব্যবস্থা কেন? তাতে জানলাম যে ঐ ছেলেটি খুব ভালো, যদিও কাজকর্ম ভাল পারে না এবং। এই এবংটা খুব ইম্পরট্যান্ট। ওর বাবা কোলকাতা পুলিশের মেজসায়েব। ওর সঙ্গে সবাই তাই খুব খাতির রাখতে চায়। এমনকি চাকরিটাও ঐ খাতিরের কারণেই পেয়েছে। কাজ শেখানো যাচ্ছে না। তবে অনেকেই আশাবাদী যে একদিন নিশ্চয় ও কাজ শিখে নেবে নিজের উৎসাহেই। এভাবেই দিন কাটছিল আনন্দে।
    বাট, কী ছিল বিধাতার মনে।
    ডেভালাপমেন্টের কাজ চমৎকার এগিয়ে গেছে, কোয়ালিটি সিস্টেমে ঝাকাঝাক টেস্টিং কম্পলিট করেই ট্রান্সপোর্ট রিকুয়েস্ট প্রোডাকশান সারভারে ইম্পোর্ট করে চলেছি, চাপ বেশ খানিকটা বেড়েছে কাজের। এমনি এক সময় সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে, যে গোটা কতক জায়গায় কোয়ালিটিতে গিয়ে ধরা পড়েছে যে টাইম এক বছর বাড়িয়ে দিলেই ২০০০ সালের বদলে ১৯০০ সাল হয়ে যাচ্ছে। সারা প্রোজেক্টে থমথমে ভাব। একজন প্রোজেক্ট লীড পরেরদিনের জন্য ছুটির দরখাস্ত করে বসলেন। সারাক্ষণ গুম মেরে বসেছিলেন সেদিন বাকি সময়টা। আরো অনেকেই বেশ চিন্তিত। যদিও এই বাগ ফিক্স টা আমাহেন টেকসাপোর্টকেই করতে হবে। এই ডেট ফিল্ট ঘেঁটে যাবার গুরুত্ব তখনও আমার মাথায় ভাল করে ঢুকছে না। তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। নোটস খুঁজছ, সফ্টওয়্যার কোম্পানীকে মেসেজ করেছি। বাগফিক্স তারাই বলে দেবে। হাই প্রায়োরিটি মেসেজ। জার্মানী থেকে তারা ফোনও করতে পারে। কাজে কাজেই সন্ধে কি রাত্তির অবধি অপেক্ষা করতে হবে। মোবাইল নেই। ল্যান্ড লাইন। সিস্টেম ওপেন করে দিতে হবে তাদের। মেলা ঝামেলা অপেক্ষা করে রয়েছে সামনে। সবাই বাড়ী চলে গেল একে একে। সন্ধের মুখে মুড়ি, অমলেট, আরো কী কী যেন আনানো হয়, সেসব ভুলে গেল সবাই। সক্কলের মুখে চিন্তার মেঘ ঘণীভূত। সেই ঘন মেঘের ছায়ায় আমরা টেকসাপোর্টরা ম্যাদামেরে রইলাম।
    অনতিবিলম্বে জার্মানীর হাইডেলবের্গের সন্নিকটস্থ ওয়ালডর্ফ (পার্কস্ট্রটীটের রেস্টুরেন্ট নয়, সেখানে তখন মালিকানা বদল হয়ে যাবার ফলশ্রুতিতে হিলসা ফেস্টিভ্যাল চলছিল) নামক ভিলেজ থেকে আমাকে কন্ট্যাক্ট করে বলল, খোলো খোলো দ্বার, সিস্টেম খুলে দাও, আমরা দেখব।
    যাই হোক, দেখা টেখা হয়ে গেল, তারা বলল, পরে সব ফিক্স পাঠিয়ে দেবে।
    আমরা টেক সাপোর্টেরা একটু রাত করে বাড়ির পথ ধরলাম।
    রাস্তাটা এবড়ো খেবড়ো। ট্যাক্সিও নেই। বাস খুব কম। ভাবলাম হেঁটেই তারাতলার মোড় অবধি মেরে দিই। ব্রিটানিয়া অবধি চলার পরে, বাসের দেখা মিলল, স্টপেজ নয়, তবু হাত দেখাতেই থেমে গেল সেই বাস। বাসে উঠে দেখলাম লাইট খুব কম, লোকও খুব কম। বাসটা ব্রেসব্রীজের দিক থেকে আসছিল। কয়েকজন লোক কী একটা বিষয় নিয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে।

    পেছনের দরজা দিয়ে উঠে বাঁদিকের লেডিস সীট ফাঁকা। বাসে আমি ছাড়া আর লেডিস নেই, তাই কমপ্যাকের ইঞ্জিনিয়ার দুজন ও আমি, এই তিনজনে সেই লেডিস সীটে পাশাপাশি বসে টিকিট কাটবার জন্য স্বল্পালোকে নিজ নিজ মানিব্যাগে খুচরো খুঁজতে লাগলাম। ওদিকে, আমাদের সামনেই আলোচনা তখন তুঙ্গে। সারা বাস মন দিয়ে শুনছে। গোলমালটা ঠিক কোথায় ঠাওর করতে পারছি না। তারপর বারদুয়েক হলদিয়া এবং একবার পেট্রোকেমিক্যাল কারখানা শব্দগুলো কানে ঢুকবার পরে আলোচনাটা মন দিয়ে শুনতে লাগলাম। আলোচনাকারীদের দাবী,
    ঐ কারখানা খুললে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে, কিন্তু কারখানাটা খুলতে খুব দেরি করছে। দেরি করবার পেছনে একটা গম্ভীর সমস্যাও আছে। লাইফ রিস্ক। কারখানা মানে তো আর এমনি ছোটোখাটো ব্যাপার নয়। ওগুলোকে বলে - প্ল্যান্ট। তা সেই প্ল্যান্টে একটা প্রকাণ্ড মাপের চুল্লি থাকে। চুল্লিটা জ্বালাতে হবে প্ল্যান্ট চালু করবার সময়। কিন্তু সেইখানেই প্রবলেম। চুল্লিতে যে প্রথম যাবে আগুনটা ধরাতে, তার বিরাট লাইফ রিস্ক। আগুনটা এত তাড়াতাড়ি দপ করে জ্বলে উঠবে, যে , যে লোকটা আগুন দিল তাকেও ধরে নেবে নেই চুল্লি। একমাত্র উপায় আগুনটা ধরিয়ে দিয়েই প্রাণপনে দৌড়ে পালাতে হবে। তাতেও যে বাঁচতে পারবে এরম কোনো গ্যারান্টি নেই। তাই রাজি হচ্ছে না কেউ। যত টাকাই দিক না কেন প্রাণের বিনিময়ে এই রিস্ক নিতে কেউ এগিয়ে আসছে না। কিন্তু ফাইনালি নাকি একটা মুসলিম ছেলেকে বুঝিয়ে বাঝিয়ে রাজি করানো গেছে। সে ছেলেটা খুব সাহসী, খুব ভাল দৌড়তেও পারে। সে ই করবে কাজটা।
    এটুকু শুনতে শুনতেই তারাতলার মোড় এসে গেল।

    পরদিন সক্কাল সক্কাল গিয়ে আমরা বাগফিক্স করতে উঠে পড়ে লাগলাম। চারদিকে কী হয়ে চলেছে সেসবে নজর দেবার ফুরসৎ ছিলো না। লাঞ্চের অর্ডার দেওয়াটুকুই করেছি, প্রাত্যহিক প্রোজেক্ট মিটিং থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল আমাকে। সাড়ে বারোটা একটা নাগাদ যখন স্তুপীকৃত লাঞ্চ প্যাকেটের দিকে সবাই ধেয়ে চলেছে, আমারো ক্ষিদে পেয়েছে ভালই, আমিও বাক্স নিয়ে খেতে থাকলাম, কেবল বোঝা যাচ্ছিলো যে প্রোজেক্ট মিটিংএ গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা হয়েছে, যেটা প্রেজেন্ট ঘটিত টপিক, বা আর্চিজ গ্রিটিংস কার্ড বনাম হলমার্কের গ্রিটিংস কার্ডের মত ব্যাপার নয়। সবার মুখেই অল্পবিস্তর উদ্বেগ। এনিওয়ে, চিকেন ফ্রায়েডরাইস পেঁদিয়ে পুনরায় টেস্টিং, এবং দিনের শেষে সমস্যা আর খুঁজে পাওয়া গেল না। তার পরের দিন সেই ডেভালাপারদের টিম লিডার একদিনের ছুটি কাটিয়ে ফের জয়েন করলেন। আজ তাঁর মুখে কান এঁটো করা হাসি। নিরুদ্বিগ্ন মুখ। প্রোজেক্ট মিটিং শুরু হবার আগেই সবাই তাকে একদিন ছুটি নেবার কারণটা জানতে একেবারে চেপে ধরল। না বললে ছাড়বেই না, চুলোয় যাক প্রোজেক্ট মিটিং। অবশেষে তিনি মুখ খুললেন। ওয়াই টু কে সমস্যার সিভিয়ারিটি হৃদয়ঙ্গম করে গত পরশু তিনি ভয়ানক দুশ্চিন্তায় ছিলেন। ব্যাঙ্কে জমানো টাকাপয়সা মানে যাবতীয় সেভিংস যদি ওয়াই টু কে র কোপে পড়ে রাতারাতি হাওয়া হয়ে যায়? কে বাঁচাতে আসবে? নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে। একদিন ছুটি নিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন তিনি। ক্রিসমাসের আগেই সব টাকা তুলে নিয়ে আসবেন, তারপরে বছর ঘুরলে আবার সব জমা করে দেবেন। একদিনে পুরোটা হবে না। অনেকটা ক্যাশ কিনা। কয়েকদিন ধরে তুলতে হবে। ব্যাঙ্ককে একটা নোটিশও দিতে হবে।
    এই সমস্ত ব্যবস্থা করতে পেরে মনটা এখন ফুরফুরে হালকা। গোঁফের কোণে কনস্ট্যান্ট হাসি।
    মিটিংএ গিয়ে জানা গেল হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল আর কোলকাতায় সারভার রাখবে না। রাতারাতি নাকি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই তুঘলকি সিদ্ধান্তের পেছনে গুঢ় মতলোবটা আদতে কী, এবং কারা এই ষড়যন্ত্রের পেছনে থেকে কলকাঠি নেড়েছে সেসবের একটা সম্ভব্য লিস্ট তৈরী হয়ে গেল ঐ মিটিঙেই। মুখে মুখে। গুঞ্জন আগের দিনই উঠেছিল, যে মিটিংএ আমি ছিলাম না। আজ সেটা কনফার্মড।
    কিন্তু সারভারসহ সক্কলকে হলদিয়া পাঠাতে চাইলেই কি পাঠানো যায়। ওরা যদি আমাদের জব্দ করতে চায়, তবে আমরাই কি কম ত্যাঁদোড় নাকি?
    অতয়েব শুরু হয়ে গেল টাগ অব ওয়ার। কিছুতেই যাবে না কেউ হলদিয়া। কী করবি কর। দরকার হলে চল্লিশ পঞ্চাশজন কনসাল্টেন্ট গণরিজাইন করবে। কোম্পানী কেমন করে তার মোকাবিলা করে দেখে নোবো। সবার তো সব ঘামাসান বায়োডেটা। বড় বড় কোম্পানীরা ওৎ পেতে বসে আছে লুফে নেবে বলে।
  • সে | 198.155.168.109 | ১৬ জুন ২০১৬ ১৩:০৯620889
  • এসমস্ত শুনবার পরে প্রোজেক্ট ম্যানেজারের মুখে ছায়া ঘনাইছে, ওঁকে সবাই দিদি দিদি করে কত আব্দার করে, তা বলে আজ এ কেমনতরো বেয়াড়া আবদার? মেঘ জল হয়ে ঝরে পড়ল, কিন্তু তাতেও কারো মন ভিজল না।
    একতাই বল" এই টপিকের ওপরে স্কুলজীবনে অনেকেই ভাবসম্প্রসারণ করেছি। তাই একতা অর্থাৎ ইউনিটি ভেঙে ফেললে প্রবলেমটা সলভ করে ফেলতে পারবে কর্তৃপক্ষ। আলাদা আলাদা করে একে ওকে তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে লোভ দেখাতে লাগল আপার ম্যানেজমেন্ট। টোপ একজনের পর আরেকজন গিলতে থাকলে একতা অচিরেই ভেঙে পড়বে। আল্টিমেটলি হলোও তাই। তবুও যতটা পারে চাপ দিয়ে আদায় করে নেবার এই সুযোগ অনেকেই ছাড়েনি। ম্যারেড ফ্যামিলি মেনরা বললেন, আমাদের বৌদেরো সঙ্গে করে নিয়ে যাবো। অনেকেই আবার নিউলি ম্যারেড, ইশু নেই। ফরেণে প্রোজেক্টে গেলে বৌ সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু দেশের ভেতরে এরকম দাবী আগে কেউ তোলে নি। নেভার। কোনো প্রোজেক্টেই নয়, তা সে দিল্লি হোক কি মধ্যপ্রদেশ। আর এ তো পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই। উইকেণ্ডে ফিরে আসবার অপশান আছে। হপ্তায় চারটে রাত পরপর বৌ ছাড়া থাকতে পারবে না? এই আদিরসগন্ধী কোশ্চেনের উত্তরেও সবাই সলিডারিটি দেখিয়ে সামান্য ফিক্ করেও হাসলো না। ব্যাজার মুখে গোঁ ধরে রইল। কোম্পানী আর কী করে? বৌ নিয়ে যাওয়া মানেই ট্র্যাভেল কস্ট দ্বিগুণ। ফ্যামিলিম্যানদের ডাবলবেডওয়ালা রুম লাগবে। নো রুম শেয়ারিং। বৌরা সারাদিন হোটেলে কী করবে কে জানে। ভাল হোটেল লাগবে। এবং যাতায়াতের ব্যবস্থাটা পদের করতে হবে। বৌ মানেই ডবল লাগেজ। ফাইনালি ঠিক হলো যাতায়াত হবে সিলভারজেটে। নতুন চালু হয়েছে জিনিসটা এই হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালের কল্যাণেই। ওরকম একটা ন্যাপথা ক্র্যাকার প্ল্যান্ট পশ্চিমবঙ্গের গর্ব। প্রোজেক্ট গো লাইভ অবধি ক্যাটামারানই আমাদের ভরসা। কেবল সেই সাহসী ছেলেটা আগুন ধরিয়ে দৌড়ে পালাতে পারলেই ষোলোকলা পূর্ণ হবে।
    কোলকাতায় গঙ্গার ঘাট থেকে ছাড়বে সিলভারজেট। জলের ওপর দিয়ে গেলে কী হবে, সে উঁচুজাতের জলযান। রিপোর্টিং টাইম, বোর্ডিং টাইম, অনেক রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস লেখা আছে টিকিটে।

    হলদিয়া যাওয়া হবে শুনে যারা খুব আপত্তি করেছিল, এখন দেখা গেল তারা অনেকেই এই যাওয়া ব্যাপারটা আদতে খুব এনজয় করছে। সেভাবে দেখতে গেলে এটা সত্যিকার্র ক্লায়েন্ট সাইট। হুগলী নদী তো আছেই, হলদি নদীও পাওয়া যাবে। ওসব এলাকায় ভাল মাছ পাবার প্রোব্যাবিলিটি ভেরি হাই। নদীর চড়ায় যদি রোদ পোয়ানো কুমীরের দেখা মেলে, তবে তা হবে যা তা ব্যাপার। সঙ্গে ক্যামেরা নিতে হবে। মাল (অ্যালকোহল) কতটা কীরকম পাওয়া যায় সেটা মেয়ে প্রোজেক্ট ম্যানেজারকে ডিরেক্টলি জিজ্ঞাসা করা এথিকাল কি আনএথিকাল সেই ফাইন লাইন সম্পর্কে কারোরই সম্যক ধারণা নেই। অ্যাপ্রাইজালে এর প্রভাব পড়লে কেলো হতে পারে। কিন্তু গাঁজা নেবার ব্যাপারে কোনো রিস্ক নেওয়া কাজের কথা নয়। সেই এসডি কনসাল্টেন্টের করার মতো কাজ প্রায় থাকবেই না হলদিয়ায়। লাঞ্চবক্স কনসেপ্টই নেই। দারোয়ান টু টপবস সবাই খাবে ক্যান্টিনে। থালি সিস্টেম। ফ্রি লাঞ্চ। নো চাইনিজ, নো ফ্রুট লাঞ্চ। লাঞ্চের অর্ডার না নেবার থাকলে ওর সকালবেলার দিকটা তো কোন কাজই থাকছে না। সকালের দিকটায় ও যদি হলদিয়ার মধ্যে কি আশেপাশে ঘুরে গাঁজার জোগাড় করে রাখে, তা মন্দ কী? ম্যাক্সিমাম পাবলিকই গাঁজা খাবে। মেয়েরা বাদ। ফ্যামিলিমেনরা বৌদের শাসন থেকে ছুটি পেয়ে খুব বেশি সুখটান দেবার স্কোপ পাবে না হয়ত। তা সত্ত্বেও বাকি রইল একটা বড়ো সংখ্যার জনতা, যারা সারাটা সন্ধে এবং রাত, আপটিল মধ্যরাত বোর হয়ে যাবে ঐ গণ্ডগ্রামে। অতয়ের গাঁজা মাস্ট। এসডি কনসাল্টেন্টকে বলা হলো, তুই গাঁজাটা অ্যারেঞ্জ করতে পারবি তো। সে আমতা আমতা করে কী বলল শোনা গেল না। একদম জুনিয়ার একটা ছেলে তাকে ধমক দিয়ে বলল, ধুস্ তুমি পারবে না, তোমাকে দিয়ে এসেপিটাই হচ্ছে না তো গাঁজা। বাদ্দাও।
    এইরকম করে অপমান করায় টিমের মধ্যে প্রায় মারামারি লেগে যাবার উপক্রম। সিনিয়ারকে এরকম বললি কেন? ক্ষমা চা। তোর খুব সাহস হয়েছে নারে?
    জুনিয়ার সবে খড়গপুর থেকে বেরিয়েছে, রক্ত টগবগ করছে। ক্ষমা সে চাইবেই না, উপরন্তু পুলিশের ছেলে টেলে বলে আরো কীসব বলতে যাচ্ছিল, সিনিয়াররা বেগতিক দেখে সরিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করে সিগারেট ফিগারেট খেয়ে ফিরে এসে আস্তে আস্তে মিটমাট করে নিল। সেদিন শুক্রবার। উইকেন্ডে সারভার চলে যাবে। সোমবারে আমরা যাবো।

    বেশ ভোর ভোর পৌঁছতে হল ফেরিঘাটে। সিলভারজেট ছাড়বে কিছুক্ষণ পরে যদিও। শীতের সকাল। গঙ্গা, থুড়ি হুগলী নদীর ওপরে অল্প ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব। এই ঘাটটা বাবুঘাটের থেকে সামান্য দূরে। ধবধবে সাদা সিলভারজেট অপেক্ষা করছে। ঘাট থেকে ক্যাটামারান অবধি চওড়া স্মুদ পাটাতন। ইউনিফর্ম পরা ক্রু মেম্বারস, সিকিওরিটি চেকিং, টিকিটের বিনিময়ে বোর্ডিং পাস। অফিসের চেনামুখগুলো দেখা যাচ্ছে। খুব সফিসটিকেটেড বাক্য বিনিময় হচ্ছে ইতিউতি। দুটো কাপল আসতে একটু দেরি করছে, তাই নিয়ে মৃদু উদ্বেদ, হালকা চাঞ্চল্য। একজন বরানগর থেকে আসবে, তাই বৌয়ের আবার বেশ খানিকটা অ্যাডভান্সড স্টেজ অফ প্রেগন্যান্সী। এমতাবস্থায় সে বৌকে শ্বশুরবাড়ী একা ফেলে রেখে কিছুতেই যেতে রাজি হয় নি। অন্যজন টিপিক্যাল ল্যাদখোর। রোজই দেরি করে আসার অভ্যেস। বাবুব ঘুমই ভাঙে বেলা করে। যাইহোক আমরা একে একে জলযানে বোর্ডিং করলাম। সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট অনেকটা এরোপ্লেনের স্টাইলে, তবে প্রস্থে বড়ো। পুরো ফ্লাইটের স্টাইলে এখানেও রয়েছেন একঝাঁক হোস্টেস। শুনলাম, এদের নাম ওয়াটার হোস্টেস। এঁরা সব প্যান্ট শার্ট কোট পরা। সাজগোজের পারিপাট্যে এয়ার হোস্টেসদের ডিসকাউন্ট ভার্শান হলেও ব্যবহার খুব মিষ্টি। নৌকো ছেড়ে দেবার মিনিট কয়েক আগে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন জোড়া দম্পতি। তারা ঢুকে পড়তেই নৌকো একটু কেঁপে উঠলো যেন। মনে হয় নোঙর তুলে নেওয়া হলো। আমরা বন্ধ বাক্সের মধ্যে। আমরা ইকোনমি ক্লাস। একটু হাই লেভেলের কয়েকজন ঢুকে গেছেন সামনের দিকে, যেটা বিজনেস ক্লাস। নৌকো ছাড়বার পরে ওয়াটার হোস্টেসরা ( এদের কেন মারমেইড কিংবা জলপরী বলা হয়না এই নিয়ে একটা কন্ট্রোভার্শিয়াল চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করতে লাগল, এনিওয়ে।।।) ঠিক ফ্লাইটের স্টাইলে বুঝিয়ে দিলেন যে এই জলযানে আমাদেরকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। এটা নাইনটি নটিকাল মাইল পার আওয়ার গতিবেগে কোলকাতা থেকে হলদিয়া বন্দরের দিকে ধেয়ে যাবে, যাত্রাপথের মোট সময় প্রায় দুঘন্টা, লাইফ জ্যাকেট কোথায় রাখা আছে, এবং আমাদের জন্য জলযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। একটু পরেই ট্রপিকানার বড়ো প্যাকেট থেকে প্লাস্টিকের গেলাসে ঢেলে ঢেলে এঁরা অরেঞ্জ জুস পরিবেশন করে গেলেন। বিজনেসক্লাস ও ইকোনমি ক্লাসের মধ্যে একটা ভারী নীল পর্দার ব্যবধান। ওদিকে কী আছে, ওদের কী খেতে দিচ্ছে, ওদিকের হোস্টেসরা কেমন দেখতে, এইসব নিয়ে অল্প কৌতুহল আমরা সকলেই দেখালাম। তারপর তো হুহু করে দক্ষিণমুখে ধেয়ে চলল সিলভারজেট। আমরা বসেছি মধ্যিখানে, যারা জানলার দিকটায় সীট পেয়েছে তারা বাইরের সীনারি দেখতে পাচ্ছে। দুদিকেই পাড় দেখা যাচ্ছে। অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ল। হলদিয়ায় পৌঁছেই তো সোজা প্ল্যান্টে যেতে হবে। যাদের বৌ আছে তারা বৌদের হোটেলে পৌঁছিয়ে তারপর যাবে। আস্তে আস্তে আমরা দুয়েকজন উঠে বাইরে ডেকের দিকে গেলাম। এটা পেছনের দিক। নদী অসম্ভব চওড়া হয়ে গেছে। ছেলেরা সিগারেট ধরাতে পারছে না এমনি হাওয়া। ভেতরে তো স্মোকিং নট অ্যালাওড। বাইরেও অ্যালাওড কিনা বলেনি যদিও। আরেকটু পরে দূরে ঝাপসা মত কালো কালো কীসব দেখা যায়। অল্প পরেই সেগুলো বিশাল বড়ো হয়ে যায়, সংখ্যায় বাড়তে থাকে। জাহাজ। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব মালবাহী জাহাজ দেখা যাচ্ছে। কোথায় লাগে সিনেমার টাইটানিক। নানান দেশের জাহাজ। রাশিয়ান ভাষাতেও লেখা রয়েছে কয়েকটা জাহাজে। দ্রুত পড়ে ফেলি, ওদেসা বন্দর থেকে এসেছে এতদূরে। আমরা ডানদিকের পাড়ে নোঙর করব। বাঁদিকের পাড় দেখা যায় না। ওদিকটায় সুন্দরবন। ঠিক যেন সমুদ্রের মতন। সমুদ্র খুব বেশি দূরেও নয়, এটা তো মোহনা। তবে কি এর জলের স্বাদ নোনতা? আভাতি বেলা লবনাম্বু এটসেটরা এসব দেখেই লেখা হয়েছিল সাহিত্যে পরিস্কার টের পাচ্ছি। কিন্তু ভাবুক হবার টাইম শেষ, জলপরীরা সীটে ফেরৎ যেতে বললেন। সিলভারজেট ডানপাশে একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। ওহো গলি নয়, খাড়ি। নাকি এটাই হলদি নদীর মোড়। ওয়াটারহোস্টেসরা আবারো মাইকে ঘোষণা করলেন যে আমাদের যাত্রাপথ শেষ হলো, এই জলযানে চড়বার জন্য আমাদেরকে ধন্যবাদ জানালেন। এই বন্দরটা ছোটো। চাকচিক্য কিচ্ছুটি নেই। সবাই নেমে এক জায়গায় জড়ো হয়ে গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। চারিদিক বেশ সবুজ। ছায়া সুনিবিড় গোছের। যদিও পরে প্ল্যান্টের কাছাকাছি যত যাচ্ছিলাম দেখছিলাম সারি সারি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। যাকে বাংলায় কোয়ার্টার বলা হত। এবং হলদিয়ার রাস্তাগুলো খুব সুন্দর, এক কথায় প্ল্যান্ড শহর। একে একে অনেকগুলো গাড়ী এছে পৌঁছল সেই বিশাল কারখানার কাছে। যারা এর আগে রিলায়েন্স পেট্রোকেমিক্যালের প্রোজেক্টে কাজ করে এসেছে সেরকম দুতিন জন ছিল আমাদের মধ্যে। তারাও স্বীকার করল, যে হলদিয়াও কিছু কম যায় না। অ্যাটলিস্ট প্ল্যান্টের পরিসীমা বরাবর যা সাইজ বোঝা গেল, তাগড়া জিনিস বানিয়েছে। এখন নশো কত ডিগ্রী যেন টেম্পারেচারে ন্যাপথা ক্র্যাক্ করাতে পারলেই পশ্চিমবঙ্গ গর্বসহকারে অনেক পন্য উৎপাদন করতে পারবে। সেই বিশাল কর্মযজ্ঞের একটা টেকনিক্যাল পার্টে আমরাও কন্ট্রিবিউট করব। আর সেই সাহসী বোকা ডেসপারেট কিংবা গরীব ছেলেটারো অবদান থাকবে, যে সলতেয় আগুন দেবার কাজটা করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু প্ল্যান্টের গেটে এসে পৌঁছলেও আমাদের ঢুকতে দেয় না অত সহজে। গেটপাস চাই। গেটপাস।
    এরকম হবে সেটা আমি আগেই জানতাম। শুধুমাত্র ফুটানি মেরে এসব প্ল্যান্টে গ্যাটগেটিয়ে ঢুকে পড়া অসম্ভব। তা সে তুমি যতই কোটপ্যান্ট পরে কায়দা মেরে ইংরিজি বলো না কেন। এ জিনিস আমি দুর্গাপুরে অলরেডি দেখে এসেছি।
  • সে | 198.155.168.109 | ১৬ জুন ২০১৬ ১৩:১৩620890
  • আমাদের মধ্যে থেকে খুব স্মার্ট দুতিনজন গেটে গিয়ে কথা বলে এলো। ভেতরে খবর গেছে। গেটপাস তৈরী হয়ে আসবে। ততক্ষণ বাইরে ওয়েট করতে হবে। আমাদের পাশ দিয়েই স্থানীয় শ্রমিকরা পাস দেখিয়ে ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। সকলের মাথাতেই প্লাস্টিকের হেলমেট। ছেলেরা সিগারেট ধরায়। আমরা গাছের ছায়া খুঁজি। রোদের তেজ বাড়ছে তা সে যতই শীতকাল হোক না কেন। গেটের দুপাশে দেয়াল জুড়ে ছবি আঁকা। দেয়াল লিখন স্টাইলে। না, ঠিক দেয়াল লিখন নয়, পরিবার পরিকল্পনা কি নিরোধের বিজ্ঞাপন যেমন হতো, অনেকটা সেইরকম। সেই স্টাইলের ছবি ও লেখা। জন্ম নিয়ত্রণের গল্প নয়। লাল টিপ মাথায় ঘোমটা দেওয়া বৌ বৌ চেহারার মেয়ের ছবি। তার সঙ্গে বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ের ছবি। মানে একটা ফ্যামিলি বোঝাতে চাইছে। পাশে লেখা রয়েছে, এদের কথা মনে রাখুন, সুরক্ষাই প্রধাণ। অসতর্ক হবেন না। প্রাণের ঝুঁকি নেবেন না। এই ধরণের কথা। একজ্যাক্ট হুবহু এই শব্দ নয় হয়ত, কিন্তু কাছাকাছি। মূল বক্তব্য হচ্ছে সেফটি ফার্স্ট। কাজ করতে এসে বেশি সাহসিকতা দেখাতে গেলে প্রাণটি খোয়া যেতে পারে, তখন বৌ বাচ্চার কী হবে সেটা ভেবে দেখো। যাইহোক, গেট থেকে চেঁচিয়ে ডাকে আমাদের। গেটপাস হয়ে গেছে। আমাদেরো পরতে হয় প্লাস্টিকের হেলমেট। এবং বুঝিয়ে দেওয়া হয় চলাফেরার এক্তিয়ার কোথায় কোথায় এবং কতটুকু। নির্দিষ্ট পথ ধরেই হাঁটতে পারব কেবল। দেড়শো মিটার দূরত্বে রয়েছে আমাদের অফিস। অফিস থেকে ক্যান্টিন। ব্যাস। আর কোত্থাও যেন না যাই। যে রাস্তায় লেখা আছে হাঁটবার রাস্তা, কেবল সেখানেই হাঁটা যাবে। তার বাইরে প্রকাণ্ড চওড়া রাস্তা যেসব রয়েছে সেখানে হাঁটা নিষেধ। সাইকেলের জন্য অন্য রাস্তা। টিমের লোকেদের মুখ ব্যাজার হয়ে যায়।
    এরপর ব্যাগেজ নিয়ে ঢোকাটাও সমস্যার। ব্যাগেজ চেক করবে হয়ত। এদের কি আর মেটাল ডিটেক্টর আছে? যদি ব্যাগ খুলতে বলে? তাহলে তো অনেক টাইম বরবাদ হয়ে যাবে। এদিকে লাঞ্চের টাইম ঘনিয়ে আসছে। কতক্ষণ যে এ গেটেই আটকে থাকতে হবে কে জানে। ব্যাগ চেক করা হবে কিনা এইসব আলোচনার মধ্যে সেই খড়গপুর থেকে সদ্য পাশ করা জুনিয়ার ছেলেটির মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। কে যেন ওকে বলে, কীরে? নার্ভাস লাগছে? পাতাগুলোকি তোর ঐ ব্যাগে নাকি? ঘাবড়াস না।
    জুনিয়ার একটু চুপ করে থেকে তারপরে বেশ জোরেই বলে ফ্যালে, ও ফাক্! সরি সরি, শীট্ ম্যান! গাঁজার প্যাকেটটা বাড়িতে রেখে এসছি।
  • ranjan roy | 132.162.161.160 | ১৬ জুন ২০১৬ ১৩:৫৫620891
  • এগুলো নিয়ে একটা বই? মানে একটা দুরন্ত উড়ন্ত চটি??
  • kc | 198.71.237.185 | ১৬ জুন ২০১৬ ২২:১৯620892
  • পড়ছি। সে'দি, সেশ করবেন কিন্তু।
  • সে | 198.155.168.109 | ১৭ জুন ২০১৬ ১৬:১৪620894
  • আমরা গুটি গুটি হাঁটার পথ ধরে ধরে কখনো শেডের তলা দিয়ে, কখনো গাছের ছায়ায় ঢাকা পথ দিয়ে দিয়ে আমাদের একতলা অফিসে পৌঁছে যাই। জুনিয়ারের এইরকম আতাক্যালানে দায়িত্বজ্ঞানহীন অপদার্থতাকে অনেকেই ক্ষমা করতে পারছে না। কিন্তু এটা ক্লায়েন্ট সাইট। রাগের মাথায় বেশি উত্তেজনা কি ঘুঁষোঘুঁষি ব্যাক ফায়ার করতে পারে। সবাই চুড়ান্ত ভদ্র পোলাইট হয়ে পড়ি। একটা বড়োসড়ো ক্লাসরুম টাইপের ঘরে পরপর ছোটো ছোটো টেবিল ও চেয়ার দিয়েছে। পরীক্ষাহলের স্টাইলে। তেরছা বা মুখোমুখি করে বসবার অ্যারেঞ্জমেন্ট কিছুই নেই। যে যার মতো হুড়মুড়িয়ে পেছনের সীটগুলো দখল করে নিলো। প্রত্যেক টেবিলে কম্পিউটার রয়েছে। সেসময়ে ম্যানেজার টাইপ র্যাঙ্কিং না থাকলে কোম্পানী ল্যাপটপ দিতো না, মোবাইল ফোন তো আরো কঠিন লড়াই করে আদায় করতে হতো। লেভেল ফোর, লেভেল ফাইভ, এদের জন্য ওসব ছিলো। লেভেল ফাইভ অনেক ডিরেক্টরও ছিলেন বলে শুনেছি। সেক্ষেত্রে আমরা সব লেভেল থ্রি কি টু। টিম লিডাররা লেভেল ফোরে উঠেছেন উন্নতি করতে করতে। লেভেল দেখে মান সম্মান খাতিরের একটা ব্যাপার থেকেই যায়, আর থাকবে না ই বা কেন? না থাকলে লেভেল রাখারইতো কোনো মানে হয় না। তা সে যাগ্গে, আমাদের ম্যানেজার দিদিমুনি আসাদা ঘর পেলেন সেখানে। উনি তো আর এখানে থাকতে আসেন নি। সেদিনই বিকেলের দিকে ফিরে যাবেন সিলভারজেটে। পাশে আরো এমন ক্লাসরুম আছে মনে হয়, নইলে এতগুলো কনসাল্টেন্ট ধরবে কেমন করে? তবে, এখন কাজ ফাজ নয়, সবার আগে খাওয়া। লাঞ্চ। আমরা সেই দাগিয়ে দেওয়া সরুমতন হাঁটবার রাস্তায় লাইন করে ক্যান্টিনের দিকে চললাম।
    এই দিনের পর দিন চাইনীজ খেয়ে খেয়ে অনেকেরই স্বাস্থ্যের বেশ ক্ষতি হয়ে গেছে। ক্যান্টিনের খাবার সে তুলনায় অনেক স্বাস্থ্যকর। লাল আটার রুটি যত ইচ্ছে নাও, ভাত তো আছেই মোটা চালের। সঙ্গে ডাল, তরকারি, একটা আমিষ পদ, নিরিমিশ খেতে চাইলে আরেকটা তরকারি, এবং একটা বাটিতে এক টুকরো মিষ্টি। মিষ্টি না নিতে চাইলে সম্ভবত দই। হাতে ট্রে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করতে হবে। রান্নার স্বাদ মোটামুটি, তবে তেল মশলা কমের দিকেই।

    এভাবেই চলতে লাগল দুপুরের খাওয়ার ব্যাপারটা। খাওয়া হয়ে গেলে ছেলেরে গুটি গুটি গেটের দিকে একটা নির্দিষ্ট গাছতলায় গিয়ে সিগারেট ফোঁকে। সেখানে ম্যানলি আলাপচারিতা হয়। মেয়েরা ( আমাকে নিয়ে দুজন) একটু হেঁটে যাই অন্যদিকে। প্রচুর গাছ ফুলের চারা সেখানে। গোলাপ দোপাটি চন্দ্রমল্লিকা ডালিয়া ইত্যাদি স্ট্যান্ডার্ড শীতকালীন ফুলগাছ দিয়ে সাজানো বাগান অ্যাটমসফেয়ার। অনেক দূরে বেশ উঁচুতে খানিকটা জলের ট্যাঙ্কের মত দেখতে কীসব যেন। তার আশেপাশে কতরকমের সব পাইপ। ওইটেই প্ল্যান্ট। ঝকঝক করছে। একেকটা অংশের একেকরকম রং। সেইসব রঙেরও কোনো মানে আছে নির্ঘাৎ।
    একদিন ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেলাম ওয়েব্রীজ (weighbridge) - এটাও পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয়। এটার কাজকর্মের স্বয়ংক্রিয়তা পেছনে যে প্রযুক্তিটা রয়েছে সেটাও আমাদের প্রোজেক্টেরই অবদান। ট্রাক এসে পৌঁছনো থেকে মাল তুলে/নামিয়ে চলে যাওয়া পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটাই যন্ত্রচালিততো বটেই, তবে সেই ব্যাপারটার মধ্যে কারোকে হাত লাগাতে হয় না, কেবল ড্রাইভারকে গাড়িটা চালাতে/থামাতে হয় । তবু একজন আছেন সেখানে বসে, যিনি নজর রাখছেন এসব কাজে। তিনিই বলেন, আপনারা একদিন গোটা প্ল্যান্টটা ঘুরে আসুননা সময় করে। আপনাদের ডিপার্টমেন্টকে বলুন। গাড়ির ব্যবস্থা এরাই করে দেবে। গাড়ি লাগবে, পাস লাগবে, আরো যা যা লাগবে সব হয়ে যাবে। দেখার মতো জিনিস। এখনোতো ফুললি অপারেশনাল হয়নি। একটা পার্টে শুধু কাজ শুরু হয়েছে।
    এটুকু শুনবার পরেই আমার মুখে হাসি খেলে যায়। আমার মুখে হাসি দেখে ভদ্রলোক আরো উৎসাহিত হয়ে বলেন, দেখবেন খুব ভাল লাগবে আপনাদের প্ল্যান্টটা ঘুরে দেখতে। ওয়েস্ট বেংগলে এরকম একটা জিনিস এই ফার্স্ট, আর ইন্ডিয়ায় খুব সম্ভবত থার্ড।
    আমি কেন মুচকি হেসে ফেলেছিলাম, সে তো আর ভদ্রলোককে বলা যাচ্ছে না। আমার তো যখন তখন সেই বাসের ঘটনাটা মনে পড়ে যায়। কারোকে বললে মনে করবে গুল মারছি, তাই নিজে নিজেই হাসি গিলে ফেলি।
    আমার সঙ্গের মেয়েটি বলে, থার্ড কেন? সেকেন্ড নয়? ফার্স্ট হচ্ছে রিলায়েন্স , তারপরেই তো এটা, তাইনা কি?
    ভদ্রলোক জিব কেটে বলেন, এতবড়ো একটা কোম্পানীর নাম বাদ দিলেন ম্যাডাম? ইন্ডিয়ান অয়েল কে ভুলে যাচ্ছেন?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন