এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  নাটক

  • পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে

    সে
    নাটক | ২১ অক্টোবর ২০১৩ | ৫৪৩৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১৩ নভেম্বর ২০১৩ ২২:১১620829
  • তারপর?
  • সে | 203.108.233.65 | ১৪ নভেম্বর ২০১৩ ১৫:১৯620830
  • কিছুক্ষণ সবাই চুপ। সকলেই আমার দিকে ফিরে। দিলীপবাবু নীচু হয়ে ঝুঁকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক আমার মতো তারও দুকোমরে হাত।
    আমিও কটমট করে তাকাই। এবার লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হেঁটে যায় পিসীমাদের দিকে, তারপরে বলে ওঠে-
    Theirs not to reason why,
    Theirs but to do and die.
    (সেদিন শুনেও বুঝিনি। অনেক বছর পরে কবিতাটা পড়বার সময় এই কবেকার শোনা ছত্রদুটো আবার মনে পড়ে যায়)।

    -শিকার করোনি তোমরা?
    পিশেমশাই কিছু একটা বলতে যেতেই ঐ অতো লম্বা বড়ো লোকটা ওদের পায়ের কাছে মেঝের ওপর বসে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে।
    - বৌদি, আমি ভিখারী। আপনি আমাকে ভিক্ষা দিন।
    পিসীমা চেয়ার থেকে উঠে দৌড়ে চলে যায় অন্যদিকে। লোকটা ঐখানে বসেই হাঁউ হাঁউ কাঁদতে থাকে।
    দিলীপবাবুর বউ ও লালবংশী এসে ওঁকে তুলে ইজিচেয়ারে বসিয়ে দিয়ে পা থেকে টেনে টেনে জুতো খুলতে থাকে। আমরা সেখান থেকে চলে যাই।

    পিসীমাদের ঘরে ঢুকতেই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে, হাঁফাতে হাঁফাতে ফিস্‌ফিসিয়ে পিসীমা বলে - তোমার আর একটা কথাও আমি শুনছি না, কাল সকাল হলেই এখান থেকে আমরা চলে যাচ্ছি।
    পিশেমশাই ঘুমন্ত বোনের কাছে গিয়ে লেপ তুলে বলে - ভিজিয়ে ফেলেছে, কাঁথা বদলাতে হবে।
    - আমরা কালকেই চলে যাব পিসীমা?
    - হ্যাঁ
    - বেড়াতে যাবো না পরেশনাথ পাহাড়ে?
    - না
    - মাথার স্টীচ্‌ কালকে কাটা হবে না?
    - কোলকাতায় গিয়ে কাটা হবে। এখানে নয়। ঐ লোকটা তোর বোনকে নিয়ে নেবে জোর করে। কেড়ে নেবে। জানিস?

    আমি বুঝতে পারিনা কী বলছে পিসীমা। কিন্তু এখন আর ফিস্‌ফিস্‌ করে নয়, এমনি গলাতেই বলে - দত্তক জানিস? দত্তক?

    (ক্রমশঃ)
  • Reshmi | 129.226.173.2 | ১৪ নভেম্বর ২০১৩ ১৬:৩৯620831
  • খুব ভালো লাগছে সে-র লেখা পড়তে। অন্য টইতে সিনথিয়াদের গল্পটার কি হল?
  • সে | 203.108.233.65 | ১৪ নভেম্বর ২০১৩ ১৬:৪৫620832
  • সিনথিয়াদের গল্পটা হবে। অনেক ক্ষত আড়াল করে রেখে লিখতে হয় ঘটনা গুলো। সেইজন্যে সময় লাগে। লিখব।
    ধন্যবাদ সকলকে যাঁরা সময় নিয়ে পড়ছেন।
  • সে | 203.108.233.65 | ১৪ নভেম্বর ২০১৩ ২২:৫৩620833
  • ভয়। অসম্ভব ভয়ে আর ঘুম আসে না। ঘুমিয়ে পড়লে যদি ওরা এসে কেড়ে নিয়ে যায় বোনকে? ভোর যতক্ষণ না হচ্ছে জেগে থাকতে হবে।
    নিজের বিছানায় শুয়ে অন্ধকারে জানলার কাচের শার্সির বাইরে তাকিয়ে থাকি। যেই ভোর হবে চুপিচুপি গিয়ে বাবুলালকে ডেকে দেবো। তারপরে সবাই মিলে পালিয়ে যাবো এখান থেকে। কত রাত এখন? ভোর হতে কতক্ষণ বাকি?
    কোলকাতার কথা মনে পড়ে যায়। দিদির কথা মনে পড়ে। দিদি আমাকে কত ভালোবাসে, কত আদর করে - "আমার ভাই, আমার ভাই" বলে জড়িয়ে ধরে। সব জায়গায় হাত ধরে ধরে নিয়ে ঘোরে, কিছুতেই হাত ছাড়ে না।
    সেই একদিন ভারি মজা হয়েছিলো। দিদি আমাকে ওর ফ্রক পরালো, নিজে পরল আমার শার্ট-প্যান্ট। তারপর দুজনে মিলে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ালাম। আরেকদিন - সেদিন বাড়ীতে নয়, মেট্রোপোলিটান বিল্ডিং এ পার্টি হচ্ছে। সেই বাড়ীটায় দিদির হাত ধরে ছুটছি ভেতরের বারান্দা দিয়ে। লুকোচুরি খেলবার খুব ইচ্ছে আমার, তবু দিদি হাত ছাড়ে না। কতো লোক আসছে যাচ্ছে, আমরা তাদের পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে হাত ধরে ধরে দৌড়চ্ছি। হঠাৎ সামনে জেঠামশাই, সঙ্গে একজন ভদ্রলোক। আমরা থেমে গেলাম। জেঠামশাই দিদিকে দেখিয়ে সেই ভদ্রলোককে বলল - এই আমার মেয়ে। দিদি যে আমার হাত ধরে রয়েছে তখনও, তবু আমাকে যেন জেঠামশাই দেখতেই পেল না। দিদিকে বলল - ইনি রবিশংকর, এঁকে প্রণাম কর।
    ভয়ঙ্কর কান্না পেয়ে যায়। কাল ভোরে আমাদের পালাতেই হবে। চোখ খুলে জেগে থাকি। কোলকাতায় ফিরে দিদিকে বলব এইসব ব্যাপার।
    তাও ঘুমিয়ে পড়ি।
    সকালে পিসীমা এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে বলে- মুখ ধুয়ে নে, ডাক্তার এসে গেছে স্টীচ্‌ কাটতে। আয় বাবু, একটু ব্যাথা লাগবে কিন্তু কী আর করা যাবে? তার পরে আমরা অনেক দূরে বেড়াতে যাবো।
    - আমরা আজ কোলকাতায় যাবো না?
    - চুপ চুপ।

    ব্যাথা দিয়ে টেনে টেনে স্টীচ্‌ কাটে ডাক্তার। আমি চিৎকার করে কাঁদি। আরেকটা নতুন ব্যান্ডেজ হয় মাথায়।

    আরেকটু পরে দুটো গাড়ি করে আমরা বেড়াতে যাই পরেশনাথ পাহাড়।
    মেয়েরা প্লিমাউথে - সেটা চালাচ্ছে বাবুলাল।
    আমরা ছেলেরা অস্টিনে। দিলীপবাবু চালায়, পাশে পিশেমশাই। আমি পেছনের সীটে। আমার হাতে দিয়েছে একটা মোটা ভারী ওয়াটার বটল। সেটার গায়ে আবার সোয়েটার পরানো।

    (ক্রমশঃ)
  • π | ১৪ নভেম্বর ২০১৩ ২৩:১২620834
  • পড়তে শুরু করলাম, বেশ লাগছে।
  • | 24.97.50.200 | ১৫ নভেম্বর ২০১৩ ১২:১৩620835
  • হেঁইয়ো

    আরেকটু বেশী করে লেখা যায় না সে? 'তারপর কী হল' এই কৌতুহলটা একেবারে কটাশ করে কামড়ে ধরছে।
  • tania | 218.87.233.180 | ১৬ নভেম্বর ২০১৩ ০২:২৫620836
  • সে আর পাই পর পর থাকায় সেপাই পড়লাম প্রথমে ঃ-)

    সে, দারুন লাগছে, একটু হাত চালিয়ে প্লিজ।
  • Suhasini | 212.62.70.2 | ১৬ নভেম্বর ২০১৩ ২২:০৮620837
  • পরের কিস্তির আশায় বসে আছি।
  • Ranjan Roy | ১৬ নভেম্বর ২০১৩ ২৩:৩৫620839
  • কি হল? ও সে'মশাই? জেগে আছি পড়ব বলে!
  • aranya | 154.160.98.31 | ১৮ নভেম্বর ২০১৩ ১০:৩১620840
  • সে দিব্য লেখেন, ভাল লাগছে
  • | 127.194.88.150 | ১৮ নভেম্বর ২০১৩ ১০:৪৫620841
  • " বসে আছি পথ চেয়ে.... "
  • সে | 203.108.233.65 | ১৮ নভেম্বর ২০১৩ ১৬:১৭620842
  • আসবার পথে দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিলো ধাপ কাটা পাহাড়ের চুড়োয় মন্দির। গাড়ী যেখানে থামানো হয়েছে সেখান থেকে মন্দির দেখা যায় না - সামনে শুধু ধাপ, অল্প এঁকে বেঁকে ওপরে উঠে গিয়েছে।
    পাহাড়ে চড়তে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমরা সবাই উঠবো ওপরে, শুধু পিসীমা থেকে যাবে নীচে বোনকে নিয়ে।
    দিলীপবাবুর বউ হাতে একটা থালা নিয়ে উঠছেন। থালাটা গোলাপী কাপড় দিয়ে ঢাকা।
    পিসীমা বারবার আমায় জিগ্যেস করে, তুই উঠতে পারবি তো বাবু? হাঁফিয়ে যাবি না?
    - হ্যাঁ হ্যাঁ পারবো। ঐতো মন্দির।
    - পায়ে ব্যাথা করলে নেমে আসবি তো?
    - হ্যাঁ।

    আমি লাফাতে লাফাতে এগিয়ে চলি, পিসীমা ফের ডাকে।
    - বাবু! শোন।
    - কী?
    - যদি কোনো দুষ্টু লোক বা মনে কর কোনো ছেলেধরা তোকে ধরে নিয়ে যায়, যদি হারিয়ে যাস - তবে পুলিশকে তোর বাড়ীর ঠিকানা বলতে পারবি?
    বাড়ীর ঠিকানা তো জানি না। ওদিকে পিসীমা খালি আটকে দিচ্ছে।
    - বাড়ীর টেলিফোন নম্বর জানিস?
    - বড়বাজার ওয়ান ডবল সেভেন।
    - লক্ষ্মী ছেলে। পুলিশকে ফোন নম্বরটা বলবি। মনে থাকবে তো?

    দৌড়ে দৌড়ে প্রথম কয়েক ধাপ উঠে যাই। দিলীপবাবুর বউ অনেকটা ওপরে উঠে গেছে, তাকে ভালো করে দেখা যায় না। পিশেমশাই ও দিলীপবাবু পাশাপাশি ওঠে। আমি সবার পেছনে। আরো লোক জন আছে যারা নামছে উঠছে। যত ওপরে উঠি সিঁড়িগুলো তত গরম হয়ে যায়। খানিকটা উঠে জিরিয়ে নিই। বসে পড়ি ধাপের একপাশে। সেখানে পাহাড়ের গায়ে একটা জায়গায় ছোট্টোছোট্টো বেগুনী ফুল ফুটে আছে। একটা ফুল ছিঁড়ে নাকের কাছে নিয়ে দেখি কোনো গন্ধ নেই।
    আবার উঠে সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি দিলীপবাবু নেমে আসছে আমারই দিকে। পিশেমশাইকে দেখা যাচ্ছে না। দিলীপবাবু আমাকে দুহাতে ধরে কোলে তুলে নিয়ে আবার উঠতে থাকে ওপরের দিকে।
    আমার ভীষণ ভয় করে তবু চুপ করে থাকি। নীচে আমাদের গাড়ীটাও দেখা যাচ্ছে না। ওপরের দিকে পিশেমশাই অনেকটা এগিয়ে গেছে। আমি কোলে চেপেই কিছুক্ষণ ওপরে উঠি। তারপরে পিশেমশায়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে কোল থেকে নেমে যাই।

    মন্দিরে ওরা পুজো দেয়। মহাবীরের মূর্তিকে হাতজোড় করে নমষ্কার করা হয়ে গেলে আমি ঘুরে ঘুরে দেখি সন্ন্যাসীদের। সন্ন্যাসী নয় তো - শ্রমণ। এদের মুখে কাপড় বাঁধা। তাদের একজনের সামনে এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ি সেই পাথরের মেঝেতে।

    (ক্রমশঃ)
  • Suhasini | 202.165.214.193 | ১৮ নভেম্বর ২০১৩ ১৯:৪০620843
  • এবার অতি অল্প হইল। এত কমে মন ভরে না ঃ(
  • সে | 203.108.233.65 | ১৮ নভেম্বর ২০১৩ ২৩:৩১620845
  • সেই দিনই সন্ধ্যেবেলা আমরা বেড়াতে যাই একজন ভদ্রলোকের বাড়ী - তিনি ঠাকুর্দার চেনা।
    আমরা যখন পাহাড়ে উঠছিলাম তখন তিনি নামছেন। নীচে আমাদের গাড়ীর নম্বরপ্লেট দেখে এগিয়ে যেতেই পিসীমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে গিয়েছিলো।
    ঐ মন্দিরে মুখে কাপড়বাঁধা শ্রমণদের দেখে এমন অদ্ভুত ভালো লেগেছিলো যে মনে হচ্ছিলো অনেকক্ষণ থাকি - সন্ধে বা রাত্রি পর্যন্ত। কিন্তু নীচে ওরা বসে রয়েছে বলে তাড়াতাড়ি ফিরতে হলো। পিশেমশায়ের হাত ধরে যখন নীচে নামছি, বৌয়ের সঙ্গে থালা হাতে দিলীপবাবু এমন আস্তে আস্তে পা ফেলছিলো যে ওদের দেখে আর ভয় করে নি।
    এরপরে আমরা সেখান থেকেই ঠাকুর্দার চেনা সেই ভদ্রলোকের বাড়ী বেড়াতে চলে যাই। শুধু আমরা। দিলীপবাবুরা আসেনি সঙ্গে।
    অনেকগুলো উঁচু উঁচু পাম গাছ আর পাঁচিলে ঘেরা সেই বাড়ীটায় যখন ঢুকছি, আকাশটা লাল হয়ে গেছে। এক ঝাঁক টিয়া পাখী উড়ে গেল খুব কাছ দিয়ে।
    একতলার একটা ঘরে আমরা বসেছিলাম। গল্প, চা এসবের পরে সেই ভদ্রলোক ছড় টেনে টেনে এস্রাজ বাজিয়েছিলেন।
    পিশেমশাই গান গেয়েছিলো।
    গাইতে বললেই যে গানটা সব সময় গায়।
    গাইতে গাইতে মনে হয় যেন চোখের জল নাকের পাশ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে।

    ...প্রাণ মন মম ধীরে ধীরে...

    শুনলে কেমন মন খারাপ হয়ে যায় না? তবে পিশেমশাই কাঁদছে না। দিলীপবাবুর মাথা খারাপ কিনা - তাই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদে। বাকি সব ছেলেরা বড়ো হয়ে গেলে আর কাঁদে না। আসলে ঠান্ডা লেগে পিশেমশাইয়ের সর্দি হয়েছে।

    (ক্রমশঃ)
  • | 127.194.86.4 | ১৮ নভেম্বর ২০১৩ ২৩:৩১620844
  • সুহাসিনী ভাটে লেখো না। অনেক দিন দেখা নেই...
  • jhiki | 212.67.46.19 | ১৯ নভেম্বর ২০১৩ ০৭:২৩620846
  • খুব ভাল লাগছে।
  • kiki | 69.93.194.101 | ১৯ নভেম্বর ২০১৩ ১০:১৮620847
  • বাহ!
  • পার্থ | ১৯ নভেম্বর ২০১৩ ১১:০৬620848
  • খুব ভালো
  • | 24.97.27.98 | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ১১:৪৫620850
  • তারপর?
  • jhiki | 149.194.249.127 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ ২১:১২620851
  • সে, এই গল্পটা শেষ করবেন না?
  • সে | 203.108.233.65 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৪ ০০:৪০620853
  • করব। সময় পাচ্ছিনা যে মোটে।
  • nina | 22.149.39.84 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৪ ০০:৪০620852
  • এত অল্প করে লেখা তাও কত্ত দেরি করে করে :-(
    ভাল্লাগেনা--
    এই যো তারপর কি হল----
  • arindam | 69.93.253.53 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:১১620854
  • গোলা লেখা।
  • সে | 203.108.233.65 | ৩১ জানুয়ারি ২০১৪ ১৬:১২620855
  • সুচিত্রা সেনকে নিয়ে দুটো ঘটনা লিখে যাই।

    ১।এটা প্রায় ঐ সময়েরই কথা (বছর দু তিনের পরের হবে হয়ত) যেটা নিয়ে এতক্ষণ লিখেছি। সুচিত্রা সেন গাড়ি কিনবেন। জ্যাঠামণির বাড়িতে সেই উপলক্ষ্যে আসবেন। সংগ্রহে যে গাড়ি আছে তা দেখানো হবে। কোন গাড়িটা দেখানো হবে তাও ঠিক হয়ে গেছে।
    এদিকে জ্যাঠামণির কড়া নির্দেশ সুচিত্রা সেন যখন আসবেন তখন কেউ যেন বাইরে না বেরোয়। কেউ মানে আমরা সব - বাড়ীর বাচ্চারা (সকলে তেমন বাচ্চা নই যদিও, প্রচুর ধেড়েও রয়েছে)। বড়দা বোধহয় তখন ছিলো না - লন্ডনে ম্যানেজমেন্ট পড়তে গিয়েছিলো।
    বাকি সবাই দুঃখে মুষড়ে পড়েছে।
    দেখা করতে পারবেন শুধু জ্যাঠামণি ও বড়মা।
    আফশোসে মুখ কাঁচুমাচু করে ঘুরতে লাগলাম আমরা বাড়ীর ভেতরে।
    বিকেল বেলায় সুচিত্রা সেন এলেন। ওঁর গাড়ী যখন বাড়ীর গেট দিয়ে ঢুকল, আমরা বাচ্চারা সব হুমড়ি খেয়ে দোতলার বারান্দায় ঝুঁকে পড়েছি।
    জ্যাঠামণি এগিয়ে এসে ওঁকে অভ্যর্থনা করতে গিয়ে একটু ঘাড় তুলে ওপরের দিকে তাকালেন। ঘাড় তুলবার আগেই আমরা নিমেষে সব সরে গিয়েছি রেলিঙের ওপর থেকে।
    তারপরে তো আর কিছুই দেখতে পেলাম না।
    কিন্তু সকলকে ঠেকিয়ে রাখা কি অত সহজ? বাংলা চলচ্চিত্রের একছত্র সাম্রাজ্ঞীকে সামনাসামনি দেখবার সুযোগ এত সহজে সকলে হাতছাড়া করতে পারে না।
    বসবার ঘরে সুচিত্রা সেনকে আপ্যায়ন করছেন জ্যাঠামণি ও বড়মা। উর্দিপরা বেয়ারারা এক এক করে ট্রে তে সাজিয়ে নিয়ে আসছে নানারকমের জলখাবার, চা, ইত্যাদি।
    এইরকমই ট্রেনিং ছিলো। কিন্তু বাস্তবে একটু অন্যরকম হয়ে গেল ব্যাপারটা।
    ট্রে তে সাজিয়ে নানারকমের জলখাবার, চা, ইত্যাদি আসতে লাগলো ঠিকই, এবং উর্দিপরারাই সেসব আনতে লাগল, কিন্তু তারা মাইনে করা বেয়ারাদের একজনও নয়। মেজদা, সেজদা, ছোড়দা এই তিনজনে ক্রমাগত খাবার ও চা সার্ভ করে গেল জ্যাঠামণির নাকের ডগা দিয়ে। অন্য সময় হলে কী হতো তা কল্পনা করতেও ভয় পাই, কিন্তু সুচিত্রা সেনের সামনে বসে জ্যাঠামণি টুঁ শব্দটি করতে পারলেন না। "বেয়ারারা" ড্যাব্‌ড্যাব্‌ করে সুচিত্রা সেনকে দেখতে লাগলো। খালি ট্রে হাতে নিয়ে বেরোতেও চায় না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। জ্যাঠামণি নিজের তিন পুত্রকে হুঙ্কারও দিতে পারেন না, শত হলেও সুচিত্রা সেন তাঁর সামনে।
    শুধু ন'দা কে দেখা গেল না। সে কি তবে এই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে?
    সত্যিই তো! খেয়াল করে দেখা গেল ন'দা নেই। সেই তল্লাটেই নেই। তবে কি সে সুচিত্রা সেনের ফ্যান নয়?
    গাড়ি দেখাতে নিয়ে গিয়ে দেখা গেল - গাড়িটা নেই।
    পুরো গাড়িটাই উধাও।
    সমস্ত ব্যাপারটা জানা গেল অনেক পরে।
    ন'দা করেছে কি, সেই গাড়ি নিয়ে নিজেই বেরিয়ে গেছে ড্রাইভ করতে। যাবার আগে বলে গেছে "যে গাড়িতে সুচিত্রা সেন চড়বে, সেটা আমি সবার আগে একবার চালিয়ে দেখে নেবো না - তা কখনো হতে পারে?"
    তাই করতে গিয়ে উৎসাহের চোটে খুব স্পীডে চালিয়ে ধাক্কা ফাক্কা লেগে জঘন্য অ্যাক্সিডেন্ট। গাড়ীর অনেকটাই তুবড়েছে। তখন আর ঐ গাড়ী নিয়ে বাড়ী ফেরা নিরাপদ নয় বুঝে সোজা ড্রাইভ করে কোলকাতা পেরিয়ে বহুদূরে এক মাসীর বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
    বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে "তাকে কিছু করা হবে না" এই আশ্বাস পেয়ে তবে ন'দা ফিরে আসে।

    ২। একবার ঐ সময়েই, বর্ধমানের দিকে কোথায় একটা যাবার সময় রাস্তায় গাড়ি থামানো হয়। গাড়ীতে বড়মা বসে ছিলেন পেছনের সীটে। চোখে ছিলো রোদের চশমা। কেন জানিনা স্থানীয় লোকজন ভুল করে ভীড় করেছিলো "সুচিত্রা সেন" দেখতে।
  • Suhasini | 212.62.70.2 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৬:২১620856
  • আগের লেখাটা পড়ব বলে বসে আছি যে, ও মশাই...
  • সে | 203.108.233.65 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৯:১৯620857
  • এর পরে আরো কিছু দিন ছিলাম আমরা গিরিডিতে। হয়ত এক সপ্তাহ বা আরো বেশি।
    সুমতিলালের সঙ্গে ফড়িং, প্রজাপতি, ভেসে উড়ে চলা পাখির পালক - এসবের পেছনে ছুটে ছুটে ফুরিয়ে যেত দিন। নইলে বেরোতে হতো পিকনিকে, নদীর তীরে বা উশ্রীর দিকটায়।
    কেমন একটা তাড়াহীন সময়। ছুটি যে ফুরিয়ে যায় তা জানতামই না। তখন সবসময়ই ছুটি, তখন ফুটে উঠেতে থাকা প্রতিটি ডালিয়ার ওপরে আমার কড়া নজর।
    দুম করে একদিন বাড়ী থেকে ট্রাঙ্ককল এলো - এইবারে আমায় ফিরতে হবে।
    পিসীমা বলল - বাবু তুই কত্তো বড় হয়ে গিয়েছিস জানিস? কোলকাতায় গিয়ে ইস্কুলে ভর্তি হবি।
    ইস্কুল কেমন জিনিস সে আমার জানা নেই। তবে কোলকাতায় ফিরবার একটা আকর্ষন রয়েছে। বাবুলাল যে কথা দিয়েছে বাড়ী ফিরেই সে আমায় ড্রাইভিং শিখিয়ে দেবে।
    সেবার সেই একটিবারই পিশেমশাইকে খুব কাছ থেকে কয়েকদিন দেখেছিলাম। তারপরে সে কেমন যেন আবছা হয়ে যাচ্ছিলো আস্তে আস্তে। এই নয় যে মরে গিয়েছিলো বা সন্ন্যাসী হয়ে পাহাড়ে জঙ্গলে চলে গিয়েছিলো। নিরুদ্দেশও হয় নি। পিশেমশাই ছিলো কিন্তু তাকে খোঁজা হত না।
    বাড়ী ফিরে আসার সময়টায় কোনো সমস্যা হয় নি, কেবল অনেকদূর আসবার পরে খেয়াল হয় যে সেই সোয়েটার পরানো জিঙ্কের ওয়াটারবটলটা ভুল করে আমাদের সঙ্গে চলে এসেছে।
    ফিরবার আগে দিলীপবাবু আমাকে একটা বিলিতি খেলনা উপহার দিয়েছিলেন। ছোটো ছোটো সব টুকরো জুড়ে জুড়ে বানানো যায় এমন একটা রেলগাড়ী। মস্ত একটা বাক্সের মধ্যে সেগুলো রাখা। বাক্সের ওপরে সেই রেলগাড়ীটার ছবি। খেলনাটার নাম মেকানো।
    ফিরবার পথে গাড়ীতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলে দেখি একটা মেয়ে আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে ফিকফিকিয়ে হাসছে। দেখে আমার কেমন লজ্জা করে। কি সুন্দর তার মুখখানা। সে ঝুঁকে পড়ে আমায় দুহাতে তুলে উঁচু করে ধরে বলে - এই ছেলেটা কার? উঁ? কার ছেলে এটা? কাদের বাড়ীর ছেলে তুমি?
    আমার লজ্জা করে, তবু বলি - আমি তো এ বাড়ীতেই থাকি।
    সে আমায় জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে খেয়ে অস্থির করে দেয়। এই তো আমার মা। আমি ভুলেই গেছলাম। এইবারে মনে পড়েছে - আর লজ্জা করে না তাকে।
  • সে | 203.108.233.65 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৯:২২620858
  • (ক্রমশঃ)
  • সে | 188.83.87.102 | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ১৩:৫৮620859
  • তিরুপতি
    --------
    শিকাগো শহর থেকে কিছু দূরে ওয়েস্টমন্ট নামে একটা জায়গায় থেকেছিলাম কিছুদিন। তখন ২০০১ সাল হলেও নাইন ইলেভেনের অনেক আগে। অ্যামেরিকা তখন আমার কাছে নতুন দেশ, অচেনাতো বটেই তার ওপরে তখন আমি প্রবল হোমসিক। এক সহকর্মী ছিলো, বয়েসে অনেক ছোটো আমার চেয়ে, তামিলনাডুর ছেলে, নাম শানমুগন লিঙ্গম্‌, ছোটো করে ডাকলে শান। সে আমাকে দিদিজ্ঞানে খুব ভক্তিশ্রদ্ধাহেল্প করত। মনের কথাবার্তা বলবার মত তখন ঐ শানই একমাত্র লোক, এবং ওর ক্ষেত্রেও ঠিক তাই, ওরও কথা বলবার মতো কেউ ছিলো না ঐখানে। ফলত, আমরা একে অন্যকে নিজেদের গল্প বলতাম নির্দ্বিধায়। তখন একটা ভয়ঙ্কর সময় গেছে, ভীষণ বিপদের সময়, সে গল্প বলব পরে, আজ নয়। যে এম্‌প্লয়ার আমাদের চাকরী দিয়েছিলো, শানকে এবং আমাকে, সে পুরো ঠগ্‌। এক্কেবারে জালি লোক। আমি ওয়ান ওয়ে টিকিট কেটে অ্যামেরিকায় গিয়েছিলাম, সঙ্গে খুব কম ডলার, সেই ডলারে ফেরার টিকিট কেনা সম্ভব নয়। মাইনেপত্র যে মিলবে না, সেটা গোড়াতেই বুঝে গেছি। শান আমার থেকে প্রায় এক বছর আগে এসেছিলো, এই এক বছরে ও কোনো বেতন পায় নি, শুধু থাকা আর খাওয়া পায়, আর উপায় খোঁজে পালাবার। এই ভয়ানক বিপদ থেকে কিভাবে মুক্তি পাবো তা ভেবেই আমার হুহু করে কান্না পেত। শান আমাকে বোঝাতো, আর বলত প্রাণপনে ঠাকুরকে ডাকতে। ঠাকুর দেবতার প্রতি ওর তীব্র আস্থা। কিন্তু আমি তো ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস করি না শান। একথা শুনে শান প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পরে নিজেকে সামলে নিল। বলল, ওহো আপনি তো ওয়েস্ট বেঙ্গলের লোক, কমুনিস্ট? কমুনিস্ট নই জেনে, আবার পুনরুদ্যমে বোঝাতে শুরু করে দিল। বলল, যেকোনো ঠাকুরকে ডাকলেই যে ফল দেবে এমনটা ভাবা কিন্তু ঠিক নয়। খুব জাগ্রত কোনো ঠাকুরকে ডাকা উচিৎ। আমরা আমাদের জালি এম্‌প্লয়ারের চোখ এড়িয়ে সন্ধ্যেবেলায় বেরিয়ে পড়তাম রাস্তায়; মে মাসের সন্ধ্যে , হাঁটতে হাঁটতে দেখতাম আশেপাশের বাড়ীতে বারবিকিউ হচ্ছে, তার গন্ধ নাকে ঢুকে মন আরো খারাপ করিয়ে দিত। দুজনে মিলে পালাবার অনেক মতলব করতাম। তার কিছু কিছু বাস্তব, কিছু কিছু সায়েন্স ফিকশনের প্লটের মতো। ঠিক কী করা উচিৎ বুঝতে না পেরে হতাশ হয়ে গেছি যখন, তখন শান আমাকে ওর নিজের দিদির গল্প শুনিয়েছিলো। ও চাইছিলো, আমি যেন ভেঙ্গে না পড়ি। ও যেমন করে বলেছিলো, সেভাবেই লিখি। ডোন্ট গেট সো আপসেট, মাই সিস্টার ইজ জাস্ট লাইক ইউ। শি হ্যাড অলসো সাফার্ড এ লট। এটা বুঝতাম যে আমাকে ওর নিজের দিদির মতো লেগেছে। শুনেছি অন্যের দুঃখকষ্টের কথা শুনলে, নিজের দুঃখের ভার লাঘব হয়, তাই আমি শুনে চলি। শান বলে চলে, ওর দিদির বিয়ে হয়েছিলো খুব সাকসেসফুল এক পাত্রের সঙ্গে; জামাইবাবু বিরাট কোম্পানীতে আইটি ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার। আজ বিলেতে মিটিং করতে যাচ্ছে তো, কাল অ্যামেরিকায় ক্লায়েন্ট মীট। কিন্তু এত ভাল বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও ভাগ্য দোষে দিদির খুব খারাপ সময় গেছে। এই অবধি শুনে, আমি মনে মনে প্রস্তুত হই, যে কোনো দুর্ঘটনা বা কোনো মৃত্যুর কথা হয়তো আসতে চলেছে, কিংবা কোনো ভয়ানক রোগ দুর্ভোগ। কিন্তু না। ঘটনাটা অন্যরকম। বিয়ের দুবছরের মধ্যে ওর দিদির চার পাঁচবার অ্যাবর্শান হয়। হয় মানে করানো হয়, শ্বশুরবাড়ীর আদেশে। দিদি যেই প্রেগন্যান্ট হতো, প্রতিবারই আল্ট্রাসাউন্ড যন্ত্রে ধরা পড়ে যেত যে গর্ভে পুত্রসন্তান নেই। তৎক্ষণাৎ ভ্রূণটির বেড়ে উঠবার এবং তার ভুমিষ্ঠ হবার অধিকার লোপ পেত। এরকম চলতে থাকায় ওর দিদি মানসিকভাবে ভেঙ্গে তো পড়েই, শারীরিকভাবেও খুব রোগা আর দুর্বল হয়ে যায়, ভয়ানক রক্তাল্পতায় ভুগতে থাকে। শানের নিজের ভাষায়, "ইভ্‌ন্‌ ডক্টর্স অল্‌সো টোল্ড দ্যাট্‌ কি ওয়ান মোর আব্যবর্শান ক্যান কজ হার ডেথ।" আমি রেগে যাই এবার। দেশে কোনো আইনকানুন নেই নাকি? এভাবে আল্ট্রাসাউন্ড দিয়ে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ তো ভারতে অ্যাক্কেবারে বেআইনী! যে সব ডাক্তারেরা এভাবে সেক্স ডিটারমিনেশান করে, তাদের এগেইন্‌স্টে কেউ রিপোর্ট করে না কেন? আর বলিহারি তোমার দিদি ও জামাইবাবুকে, অদ্ভুত ভাবনা চিন্তা তো! আই অ্যাম্‌ সরি টু সে, কিন্তু থার্ড মিলেনিয়ামেও এই মানসিকতা? শান একটু লজ্জিত হয়ে বলে, "হ্যাঁ হ্যাঁ, অফিশিয়ালী তো বেআইনী বটেই, তেমনি আরো কত কিছুই তো বেআইনী আমাদের দেশে। তবুও জানবার দরকারও তো আছে? আগে থাকতেই জেনে নিলে তো সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া যায়, রাইট? না জানলে নিজেদেরই ক্ষতি, একটার পর একটা মেয়ে জন্মাবে, তখন? আজকালকার দিনে খুব বেশী বাচ্চা তো অ্যাফোর্ড করা যায় না! তার চাইতে আগে জানা থাকলে অন্ততঃ প্রিভেনটিভ ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ইট্‌ ইজ্‌ বেটার টু বি সেফ্‌ দ্যান সরি, রাইট? আর আজকাল এইসব টেস্ট ভীষণ এক্‌স্‌পেনসিভ হয়ে গেছে, খুব রিস্কি তো, তাই আন্ডার দ্য টেবিল প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়।" আমার বিরক্ত লাগতে থাকে, আর এদিকে শান বলেই চলতে থাকে দিদির কথা। দিদির মঙ্গলকামনা করে শানের মা মন্দিরে মন্দিরে মানত করে। অনেক ব্রত, অনেক উপোস, অনেক পুজো, অনেক প্রার্থনা, হে ভগবান পরের বার যেন ছেলে হয়, পরের বার যেন মেয়ের গর্ভে কন্যাভ্রূণ না আসে। কিন্তু কোনো ফল হয় না। বরঞ্চ দিদির শরীর দিনকে দিন আরো ভেঙ্গে পড়ে, চোখের কোণে কালি, মেজাজ বিগড়ে আছে সর্বক্ষণ। দিদি একেকবার গর্ভবতী হয়, তার কিছুমাস পরে আল্ট্রাসাউন্ডে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। শানের মা তখন মন্দিরে বসে থাকেন নির্জলা উপোস করে, এদিকে আল্ট্রাসাউন্ডের ডাক্তার হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দেন, পেটে কন্যাভ্রূণ; শুধু ইশারায়, কারণ লিখিতভাবে জানানোর নিয়ম নেই, এমনকি মুখে বলতেও ভয় পান ডাক্তার, কে কোথা থেকে আড়ি পেতে খবর দিয়ে দেয় যদি, খুব সাবধান, কখন কে শত্রুতা করবে ফাঁদ পেতে রেখে, কাউকে বিশ্বাস নেই! এই ডায়াগোনিসিসের পরে, দিদি পুরো হিস্টেরিক হয়ে যায়। তাকে আবার যেতে হবে অ্যাবর্শান ক্লিনিকে। তারপরে আবার চেষ্টা করতে হবে পুত্রবতী হবার। ক্রমশঃ বিপদ আরো ঘনায়। শেষবার শানের জামাইবাবু নিজেই জানান যে, একটা লাস্ট ট্রাই নেওয়া হবে। এই লাস্টবারেও যদি ভাগ্য না প্রসন্ন হন, দেন হী ক্যানট অ্যাকসেপ্ট হার এনি মোর। তখন একটা লীগ্যাল সেপারেশনের কথা ভাবতে হবে। এটা জেনে শানের দিদি প্রায় পাগল হয়ে যায়। শান বলে, "জাস্ট ইম্যাজিন, উই অল্‌ নিউ কি দিস ওয়জ হার লাস্ট চান্স, শী ওয়জ সো ডিপ্রেস্‌ড্‌, সো ডিপ্রেস্‌ড্‌ কি, আই ক্যান্ট এক্স্‌প্রেস্‌ ইন ওয়র্ড্‌স্‌, অ্যান্ড্‌ মাই মাদার ওয়জ অলসো টোটালি আপসেট।" এই অবধি শুনে আমি বলি, "এরকম লোককে তো অনেক আগেই ডিভোর্স্‌ দেওয়া উচিৎ। তোমরা এরকম একটা লোককে মেনে নাও কেমন করে?" শান সামলে নিয়ে বলে, " নো, নো, হিয়ার মি, থিংস্‌ আর নট্‌ সো ইজি না! ইফ্‌ মাই ব্রাদার ইন্‌ ল থ্রোজ হার অ্যাওয়ে, হোয়ার উইল শী গো, আফ্‌টার অল শী ইজ্‌ ম্যারেড না? ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড বাবা, আওয়ার ইন্ডিয়ান সোসাইটি, ইট্‌ ইজ্‌ আওয়ার কালচার। অ্যাকচুয়ালী মাই ব্রাদার ইন ল ইজ এ ভেরী গুড ফেলো, বাট হী ওয়জ অলসো আপসেট না! এভরিওয়ন ওয়ান্ট্স্‌ এ বয় চাইল্ড।" আমি শুনতে থাকি, "সো আল্টিমেটলি মাই মাদার প্রেইড টু তিরুপতি!" শানের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, "অ্যান্ড ইউ ওন্ট বিলীভ, দিস্‌ টাইম শী হ্যাড এ বয়! নাউ দে আর ওয়েল সেট্‌ল্‌ড্‌- আওয়ার ফ্যামিলি ইজ্‌ সো হ্যাপ্পী নাউ"। আর তোমার দিদি নিজে? অব্‌ভিয়াস্‌লি! দিদি তো হ্যাপী হবেই। কত কষ্টভোগের পর ছেলের জন্ম দিয়েছে সে। এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করে না। শুধু তাই না, জামাইবাবুও আগের সব রাগ ভুলে গেছে, দিদিকে অ্যাকসেপ্ট করেছে এবং নিজেই গিয়েছিলো তিরুপতিতে পুজো দিতে, পুত্রের কল্যাণে। কথায় কথায় দেখি চারপাশ ঘোর অন্ধকার, হাঁটতে হাঁটতে বহুদূরে চলে গিয়েছিলাম আমরা। এবার ফেরার পথ ধরি। আমার মনে পড়ে যায় ডলির কথা। ছাত্রাবস্থায় তাশকেন্তের হোস্টেলে, এক বাংলাদেশী ছাত্রের বউ ডলির সঙ্গে বেশ আলাপ হয়েছিলো আমার। ওর বর তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, সে তুলনায় আমি তখন সদ্য আগত, নেহাৎ ই জুনিয়র। ডলি অবশ্য পড়াশুনো করত না। সংসার সামলাত আর কোলে তখন বছর দেড়েকের একটা বাচ্চা। ডলির মেয়ে, নাম মিলি। ঐ হোস্টেলে আমি ছাড়া আর কোনো বাঙালী মেয়ে ছিলো না, আর ডলিও বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানত না, না ইংরিজি, না রাশিয়ান। মাঝেমাঝেই দেখতাম, দোতলার করিডোরে পা ঘষে ঘষে হাঁটছে, এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, উদ্দেশ্যবিহীন। একদিন আমাকে দেখে অল্প হাসির ভঙ্গী করেছিলো মুখে, সেই থেকে আলাপ শুরু হয়ে গেল। অসম্ভব রোগা আর রক্তশূণ্য চেহারা, শরীরের যে যে অংশ শাড়ী ব্লাউজে ঢাকা থাকত না, সেখানে মাঝে মধ্যেই দেখা যেত রং বেরঙের কালশিটে, ক্ষত। মোটকথা, ডলি নিয়মিত মার খেত ওর বরের হাতে। ও নিজেই বলেছিলো আমাকে পর্দার রড খুলে গত পরশু পিটিয়েছে বর, কানের নরম হাড়ে সাংঘাতিক লেগেছে, মাথার তালুতেও ফুলে আছে কিছু জায়গা, মাথার চুল সরিয়ে দেখালো সন্তর্পনে। ঠোঁট অধিকাংশ সময়েই কাটা বা ফোলা থাকত, কখনো কপাল ফোলা, বা ফোলা কমে এলে চোখের নীচে কালি। এর কোনো প্রতিকার নেই? বাধা দেবার কেউ নেই? বড্ড আশ্চর্য লাগত আমার। এত ছাত্র ছাত্রী বাস করে যে হোস্টেলে, তাদের অনেকেই বিবাহিত বা সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে নিয়ে রয়েছে, সেখানে প্রকাশ্য দিবালোকে একটা মেয়ে দিনের পর দিন মার খাচ্ছে, লোকে দেখছে, অথচ কেউ কিছু বলছে না? এ ধরনের ব্যবহারের জন্যে ওর বরের সোজা হাজতবাস হতে পারে। কিন্তু কিছুই হতো না। কিচ্ছুটি না। আরো জানালো ডলি, যে ঐ মিলির জন্মের পরে ওরও নিয়মিত অ্যাবর্শান করানো হচ্ছে। তাতেই এত রোগা হয়ে গেছে। অ্যাবর্শান কেন? অন্য অনেকরকম ব্যবস্থা আছে তো জন্মনিয়ন্ত্রণের, সেগুলো চেষ্টা করে দেখেছো? হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে থাকে ডলি। তারপরে আমাকে পুরো চমকে দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে যে, আমি অতসব জানলাম কোত্থেকে? আমার তো বিয়েই হয় নি। তারপরে, যেন খুব হাতেনাতে ধরে ফেলেছে এমন ভাবে চোখ টিপে হাসে। ওকে বললাম যে, এসব জানবার জন্যে বিয়ে করবার দরকার হয় না, তাছাড়া ইস্কুল কলেজের বইতেই এসব কথা লেখা থাকে। ডলি বিশ্বাসই করে না যে ইস্কুলের বইয়ে এসব কথা লেখা থাকে। ছিঃ! লজ্জায় লাল হয়ে গেল, একথা শুনে। তারপরে হাসিমুখে বলল, ভালই হয়েছে আব্বা আমাকে ক্লাশ ফোরের বেশি পড়ায় নি! তারপরে, যেন খুব গোপন কথা বলছে এমন করে বলল, মিলির জন্মের সময়েই ধাই দেখে নিয়েছে, পরপর আরো সাতটা মেয়ে আছে ভেতরে। - মানে? ভেতরে মানে? কী বলছ আজেবাজে কথা? - আহ্‌ আস্তে কও। ভেতরে মানে পেটের ভেতরে। যে কইছে সে খুব ভালো দাই। শয়ে শয়ে বাচ্চা প্রসব করাইছে। - কোনদেশে জন্মেছে তোমার মেয়ে? সোভিয়েত ইউনিয়নে নয়? এদেশের শিক্ষিত ডাক্তার নার্স আয়া, কেউই এরকম অদ্ভুত ভুল কথা বলতে পারে না! এ পুরো মিথ্যে কথা। - না, তোমার কসম, সত্যিই বলেছে, এর পরে আরো সাত সাতটা মেয়ে পেটে ধরব আমি! - ওরকম দেখা যায় নাকি? মিথ্যের একটা সীমা থাকা দরকার।কে তোমাকে বলেছে ডলি? আর কোন ভাষায় বলেছে? তুমি তো রাশিয়ান ভাষা জান না। - আহা, আমারে কয় নাই, আমার সায়েবরে কইছে। এত বড় প্রবঞ্চনা, অথচ ঐ অশিক্ষিত মেয়েটা জানেও না, তার বর তাকে মিথ্যা গল্প বলে চলেছে। আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও, ও মানবে না। ভ্রূণের লিঙ্গ ও তার পেছনে ক্রোমোজোমের ভূমিকা নিয়ে কিছুই ওকে বোঝানো যাবে না। যে মেয়ে স্থির মনে বিশ্বাস করে চলেছে যে তার জরায়ুর মধ্যে অনাগত সাতটি কন্যা অপেক্ষা করছে, তাকে কীকরে বোঝাবো যে এসব মিথ্যে, আর বোঝালেও বা সে আমার কথা মানবে কেন? আন্তর্জাতিক নারীদিবসের দিন আরেকবার প্রচন্ড মার খায় ডলি। রাস্তায় শাড়ীপরে স্বামীর পেছন পেছন হেঁটে আসছিলো। পাশাপাশি হাঁটবার মতো বেয়াদপিও করেনি। কিন্তু উটকো ঝঞ্ঝাট উপস্থিত হয়, হঠাৎ এক সুবেশী যুবা এত তোড়া ফুল উপহার দিয়ে যায় তার হাতে, নেহাৎই ভদ্রতা বশতঃ সমগ্র নারীজাতির প্রতি অভিনন্দন জানিয়েই। তার নিঃসন্দেহে কোনো কূট উদ্দেশ্য ছিলো না, কারণ সে ফুলের তোড়া ও সাদর সম্ভাষনটুকু জানিয়েই চলে গিয়েছিলো। কিন্তু প্রবল বিপদে ফেলে দিয়ে গেল সে ডলিকে। পথ চলতে পিছন ফিরে ডলির স্বামী দৃশ্যটি দেখে, তখনকার মতো হাসিহাসি মুখ করেছিলো, কিন্তু সেটা নেহাৎ ই মুখোশের হাসি। এক্কেবারে রাস্তার ওপর তো বউকে পেটানো যায় না। চুপচাপ ঘরে ফিরে বউকে মনের সুখে পেটালো মামুন ইসলাম। তারপরে সাজসজ্জা করে বেরিয়ে গেল তার রাশিয়ান বান্ধবীর সঙ্গে উৎসবসন্ধ্যাটুকু কাটিয়ে আসতে। `সিঁড়ির আবছায়া অন্ধকারে দেখি গোলাপী বেনারসীতে ঢাকা ডলি লুকিয়ে লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ভয়ানক রাগ তার ঐ অচেনা যুবকটির ওপর। কী দরকার ছিলো, চেনা নেই জানানেই, ফুলের তোড়া দেবার? ডলি ডুক্‌রে কেঁদে উঠে বলে, "আমি কি রাস্তার খান্‌কি? আমারে ফুল দেয় ক্যান?" একবার কয়েকজন প্রোফেসরের সঙ্গে ডলির এই সমস্যা নিয়ে কথা পেড়েছিলাম। প্রতিকারের উপায় কী? আপাতভাবে কিছু প্রতিকারের উপায় থাকলেও, এর কোনো স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায় নি। মামুন কে তার কৃত অপরাধের জন্যে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু তার ফল ক্ষণস্থায়ী। শাস্তিভোগের পর, মামুন কিন্তু পুরো শোধ তুলে নেবে ডলির ওপরে। আরো বেশী অত্যাচারিত হতে পারে সে। পড়া শেষ করে সস্ত্রীক দেশে ফিরে গিয়ে সে কিন্তু সুদে আসলে প্রতিশোধ তুলবে ডলির ওপরে। সেটা ডলি সহ্য করতে পারবে কি? তার কি সামর্থ আছে এই চক্রব্যুহ থেকে বেরিয়ে আসবার? কিংবা সাহস দরকার। তা যদি না থাকে তবে, কোনো প্রতিকার নেই। মাঝেমাঝে দেখতে পেতাম ডলি পা ঘষে ঘষে হেঁটে চলেছে রান্নাঘরের দিকে, চোখাচোখি হলে শুকনো হাসত, কিংবা ফিস্‌ফিসিয়ে বলতে, "কাইলই নষ্ট করাইসি, শরীর ভালো নয়, দুর্বল লাগে, ব্যাথা, এখনো খুব ভাঙ্গছে"। আমি হঠাৎ ভাবি, ডলি কি ওপরওয়ালার কাছে সুবিচার চেয়ে প্রার্থনা করেনি? কেমন হয় যদি আমি প্রার্থনা করি ওর জন্যে, যেমন শানের মা করতেন নিজের মেয়ের জন্যে? হিন্দু দেবতা কি মুসলমান মেয়ের দুঃখে মুখ তুলে চাইবেন? কী চাইব ডলির জন্যে? ওর বর ওকে পেটানো বন্ধ করুক, অত্যাচার বন্ধ করুক, এইসব? নাকি, ইন জেনেরাল বলব, হে তিরুপতির দেবতা, এই মেয়েগুলোকে আর কিছু নয় শুধু একটু আত্মসম্মানবোধ দিও, সেইসঙ্গে কিছুটা সাহস, যেটায় ভর করে তারা অজানা ভয় কাটিয়ে নিজের সামর্থমত নিজের ইচ্ছেমত বাঁচার কথা ভাবতে পারে।
  • সে | 188.83.87.102 | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ১৩:৫৯620862
  • পাতালের পথ এবং হাইডি
    ------------------------

    একই রাস্তা। অথচ আমূল ভোল পাল্টায় ঋতু পরিবর্তনে।

    বসন্তে গ্রীষ্মে যে পথের দুধার ফুলে ফুলে রঙীন, যেখানে দুপা চলতে না চলতেই দৌড়তে মন চায়, সবকিছু ভুলে গড়াগড়ি খেতে খেতে ঢালু ঘাসের গালচে বেয়ে অনায়াসে নেমে যেতে ইচ্ছে করে, সেই পথই শীত পড়লে অন্যরকম। একদম।

    যেদিকে দুচোখ যায় সেসব দিক অধিকাংশ সময়ে সাদা তো বটেই তার ওপরে রাতগুলো বড়ো বেশী দীর্ঘ। আরো বেশী নিঃস্তব্ধ - অথচ তার অন্ধকারের ঘনত্ব কেমন যেন ফিকে। তুষারের ওপরে আকাশের আলোর প্রতিফলন অন্ধকারের বারোটা বাজিয়ে দেয়। তবুও রাত্রির দৈর্ঘ্য ক্রমশঃ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় - ভূগোলের নিয়মে। ঘড়ির কাঁটা ঘন্টাখানেক পিছিয়ে দিয়েও হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে থাকি সকালটাকে।

    ঘড়ির কাঁটা সকাল সাতটা ছুঁলেও চারিদিকে নিশুত রাত।

    সেই রূপকথার গল্পের রাস্তা।

    সমস্তই দেখা যাচ্ছে আবছা আলোয় কিন্তু আকাশে সুজ্যি নেই। গাছগুলো সব নেড়া। পায়ের নীচে তুষার কখনো বালির মতো নরম, কখনো কাদাকাদা, কখনো জমাট বরফের পাথর; মরণ ফাঁদ - পদস্খলন হলে ভোগান্তি আছে। চতুর্দিকে চলাফেরা করছে ছায়ামূর্তিরা। তাদেরকে অনায়াসে এই আঁধারে রাক্ষস খোক্কস বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পাতলপুরীর মতই, তবে একেবারে কার্বন কপি ঠিক নয়। শুধু তুষারটুকু বেমানান।

    আমি প্রতিনিয়ত ট্রেনে উঠি। এই ট্রেন ধরাটা এত বেশি রুটিনমাফিক হয়ে গেছে যে মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি ট্রেন না ধরলে, ট্রেন আমাকে ধরবে ফেলবে - ক্যাঁক্‌ করে - ভূতে ধরার মতো। যদি আমি বালির মতো ঝুরঝুরে বরফের ওপর দিয়ে দৌড়বার ছল করে ভেসে যেতে চাই, ঘাসে গড়াগড়ি খেতে খেতে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে চাই নীচের উপত্যকায় বা কোনো হ্রদে, কি জানি হয়ত সেখানেও গজিয়ে উঠবে সমান্তরাল দুটো ইস্পাতের রেল - হাঁ হাঁ করে তেড়ে আসবে ট্রেন, খপ্‌ করে ধরে ফেলবে আমার টুঁটি, আর টুপ করে গিলে নিয়ে ভরে ফেলবে একটা কামরার মধ্যে। আমি পালাতে পারব না।

    অজগরের পেটের মধ্যে ঢুকে আমি ওভারকোটটা খুলে ঝুলিয়ে দেবো জানলার পাশের হুকে। সীটটাকে অল্প এগিয়ে পিছিয়ে নেবো সুবিধেমতো বোতাম টিপে টিপে আর চেষ্টা করব কাঁচে ঢাকা জানলার দিকে না তাকাতে। শুধু শীতকালে।

    বসন্ত গ্রীষ্ম শরৎ যত খুশী দেখতে পারি আমি জানলার বাইরে। তখন অজগর মর্তের ওপর দিয়ে যায়। শুধু শীতে সে যায় পাতালের পথ দিয়ে। আর তখনই আমার ভয় করে।

    ভয়টা অমূলক নয়। শীতের রাস্তায় রেলপথে আমি অজগরের পেটের ভেতরে বসে দুরন্ত বেগে পার হয়ে চলেছি নদী গ্রাম শহর পাহাড় উপত্যকা হঠাৎ জানলার কাঁচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম - হাইডিকে।

    হাইডি, যাকে নিয়ে গল্প। যাকে নিয়ে সিনেমা, কার্টুন, অ্যানিমেশন। সেই হাইডিই কি? ঊনবিংশ শতকের গ্রাম্য মেয়ে। সুইস দেশের গ্রাব্‌ভিন্‌ডেন্‌ অঞ্চলের বালিকা। অনাথ। একবার অবশ্য সে গেছল বিরাট এক গমগমে শহরে, ফ্রাঙ্কফুর্টে। সেখানে ক্লারা বলে আরেকটা মেয়ে ছিলো, যে হাঁটতে পারে না। তারপরে কী কী হয়েছিলো সেসব গল্প প্রায় সবাই জানে।

    একবার জুরিখ এয়ারপোর্টের এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যাচ্ছি, একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে রেলপথে। হঠাৎ জানলার পাশে হাইডিকে দেখা গেল, তার মাথায় বেড়া বিনুনী করা। চুপচাপ আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে জানলার কাঁচে চুমু খেয়ে গেল হাইডি। তারপরেই গরুর গলায় বাঁধা ঘন্টার ঢং ঢং শব্দ। চমকে গেছলাম আমরা সবাই। উঃ দারুণ তো! টেকনোলজির কি অপূর্ব ব্যবহার। চাপা প্রশংসার গুনগুনানিতে ভরে গেছল সুড়ঙ্গ।

    শীতের রেলপথে আমার ঠিক পাশেই কাঁচের ওপারে যে হাইডি -তার বয়েস এখন অনেক।

    একটু খুঁটিয়ে দেখলে তার পাক ধরা রূপোলী চুল, মুখের বলিরেখা সব নজরে আসবে। মহানগরের কলকারখানার ধোঁয়ার গন্ধ তার পোশাকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই হাইডি অন্ধকার পাতালের ভেতর জানলার কাঁচের পাশে পাশে আমার সঙ্গে সবখানে যায়, কটমট করে বারবার তাকায় আমার চোখের ভেতরে। তাই আমি ওদিকে দেখিনা। শুধু চুপ করে অপেক্ষা করি আলো ফোটার। আলো ফুটতে না ফুটতেই অজগর উঠে আসে মর্তে। জানলার পাশের হাইডি নিমেষে মিলিয়ে যায়।

    আমিও তৃপ্তির সঙ্গে দেখতে থাকি বাইরের দৃশ্যাবলী। প্রতিনিয়ত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন