এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • অচলায়তনের দেয়ালের ফোকর ও ভালবাসা

    ranjan roy
    অন্যান্য | ১৩ জুন ২০১৬ | ১২৩৫১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Abhyu | 113.218.236.171 | ১৯ আগস্ট ২০১৬ ২২:১০708273
  • আসলে আমার পরিচিত শ খানেক মিশনের ছাত্ররা সবাই শেষ পর্যন্ত টিঁকে গিয়েছিল। ফলে তাদের কাছ থেকে ২-৩ বছরের টর্চারের স্মৃতির কোনো বিবরণ পাই নি। যা শুনেছি সবই অন্য লোকের মারফত যাকে স্ট্যাটিসটিক্সে বলে সেকেন্ডারি ডেটা।
  • pi | 24.139.209.3 | ১৯ আগস্ট ২০১৬ ২২:২২708274
  • একদম অরণ্যদার কথাটাই বলেছিলাম।
  • pi | 233.231.44.149 | ১৯ আগস্ট ২০১৬ ২২:২৫708275
  • আমি লেখাটা ভাল করে পড়িনি, মন্তব্যগুলো পড়ে মনে হয়েছে মিশনে হোমো সেক্স হচ্ছে, কোন সন্ন্যাসী কারো প্রেমে পড়েছেন, তার জন্য মিশন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, এগুলো সত্যি ঘটনা হলেও মিশন বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, কারুর সম্বন্ধেই আমার খারাপ কিছু ধারণা হবেনা, এটাই বলার ছিল।
  • sinfaut | 11.23.252.170 | ১৯ আগস্ট ২০১৬ ২৩:০০708276
  • পাবেই এমন দাবী তো করছিনা অভ্যু।
  • Abhyu | 113.218.236.171 | ১৯ আগস্ট ২০১৬ ২৩:০৫708277
  • ঠিকই। এবং কি ইমপ্রেশন ক্রিয়েটেড হবে সেটা লেখক-পাঠকের মধ্যের ব্যাপার। ফিকশানের সাথে রিয়েলিটির যোগ থাকতেও পারে না-ও থাকতে পারে।
  • sinfaut | 11.23.252.170 | ১৯ আগস্ট ২০১৬ ২৩:০৯708278
  • রাকৃমির রিয়ালিটির সাথে ফিকশনের আঁশটে গন্ধের দূরত্ব স্থাপনের এই নিরন্তর প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়।
  • Abhyu | 113.218.236.171 | ১৯ আগস্ট ২০১৬ ২৩:২৩708279
  • সে-ই :)
  • Abhyu | 113.218.236.171 | ১৯ আগস্ট ২০১৬ ২৩:২৯708280
  • sinfaut, আমার Date:13 Aug 2016 -- 10:38 AM আর Date:15 Aug 2016 -- 07:23 AM পোস্টদুটো সেই জন্যেই করা :)
  • Ranjan Roy | ২০ আগস্ট ২০১৬ ০০:১৭708281
  • ৪)
    নতুন মহারাজের আমলে রান্নার স্বাদ বদলে গেছে। রান্নাঘর আর ডাইনিং হলের পিঁড়িগুলো বেশ পরিষ্কার। এখন প্রত্যেক রোববারে ওসব গরম জল আর সোডা দিয়ে ধোয়া হয়। তদারক করেন ব্রহ্মচারী সুবীর আর ব্রহ্মচারী বরেন। বড় মহারাজ ওঁদের কড়া করে বলেছেন-- তোমরা রান্নার ঠাকুর আর চাকরকে খাটাও না? এখন ডাইনিং হলেই রাত্তিরে দুধ দেওয়া হয়।
    আমরা কখনও ওতে লেবু চিপে ছানা বানাই বা কলাই করা মগে দইয়ের সাজা দিয়ে পেতে দিই। সকালে উঠে যখন দেখি জমে গেছে তখন কী ভালো লাগে।
    ক্লাস ইলেভেনের অসীমদাকে মহারাজ বিশেষ পারমিশন দিলেন -- ও স্টেনলেস স্টিলের থালায় খাবে আর রোজ ওর পাতে একটা করে ডিম দেওয়া হবে। এটা ওর বাবা স্বামীজিকে অনুরোধ করে রাজি করিয়েছেন। এর পয়সাটা উনিই প্রতিমাসে জমা করে দেবেন।
    আমি বুঝতে পারি--অসীমদা বেশ বড়লোক ঘরের ছেলে। ও পাঁচটাকা দামের চটি পরে , আমরা আট আনার হাওয়াই চটি বা বারো আনার চপ্পল। ওর কাছে বেশ নগদ পয়সা থাকে। যদিও নিয়ম হল কোন আবাসিক ছাত্রের হাতে পয়সা দেওয়া যাবে না। যা দেওয়ার অফিসে জমা রাখতে হবে।
    ডাইনিং হলের দেওয়ালে বেশ বড় করে দুটো লাইন বাঁধিয়ে উঁচুতে টাঙিয়ে রাখা আছে। রামকানাইদা করে গেছলেন।
    গীতার থেকে নেওয়া দুটো শ্লোকঃ
    "ওঁ ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণাহুতং,
    ব্রহ্মৈবতেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম সমাধিনা।
    হরি ওঁ তৎ সৎ।"
    [ ব্রহ্মরূপী অগ্নিতে ব্রহ্মহবিঃ ব্রহ্মকে অর্পণ করে ব্রহ্মদ্বারা আহুতি দেওয়া হল। এই নৈবেদ্য ব্রহ্মকর্ম সমাপনের উদ্দেশে ব্রহ্মএর কাছেই যাবে।]
    কাগজটা হলদেটে, ফ্রেমটা একদিকের দড়ি ছিঁড়ে কেতরে রয়েছে। কেউ ঠিক করছে না। ওয়ার্ডেন অচ্যুতদাকে বলে কোন লাভ হল না, দুটো হুঁ আর হাঁ শোনা ছাড়া।
    কিন্তু আমাকে যে রোজ ডাইনিং হলে গীতা পড়তে হয় --জোরে জোরে পাঠ করি।--যতক্ষণ ভাত ডাল ও একটা তরকারি পরিবেশন সম্পূর্ণ হচ্ছে ততক্ষণ। দুবেলা। তারপর পকেট গীতা বন্ধ করে পাশে রেখে ওই দুইলাইন জোরে জোরে টেনে টেনে বলি। অনেকেই গলা মেলায়। তারপর হাপুশ হুপুশ করে খাওয়ার শব্দ। সেকেন্ড কোর্স , বেশির ভাগ দিন মাছের ঝোল দেওয় হয়।
    খাওয়া শেষ হলেও কেউ আগে উঠবে না। আমি খেয়াল করে দেখব অধিকাংশের খাওয়া হয়েছে কি না। তারপর উঁচু আওয়াজে শ্লোগান দেওয়ার মতন বলবঃ
    " যয়, গুরু মহারাজ কী জয়, --জয়!
    জয়, সাধূমহারাজ কী জয়,--জয়!
    জয়, গঙ্গা মাঈকী জয়,--জয়!"
    কখনও লখনও এই বিশেষ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করি। মাসে একদিন মাংস আর গুঁড়োদুধের পায়েস। সেদিন কী যে হয়! পঞ্চা ঠিক করে রাঁধতে পারে না, তায় দুশো জনের রান্ন। মাংস পুড়ে যায়, পায়েসে দুধ তলায় লেগে যাওয়ায় পোড়া গন্ধ টের পাই। তবু আমরা উলুত পুলুত করে খাই।
    সেদিন মাংসটা আগে দেয়। বন্ধুরা চোখের ইশারায় বলে এবার গীতাপাঠ শেষ করে "ব্রহ্মার্পণং" বল্‌ দিকি!
    আমি দেখেও দেখি না, পাঠ চালিয়ে যাই। ওরা চোখ বড় করে, পাতে রাখা মাংসের দিকে ইশারা করে করুণ ভাব ফুটিয়ে তোলে। আমিআরও মগ্ন হয়ে সাংখ্যযোগের অধ্যায়ে ডুবে যাই--
    গম্ভীর আওয়াজে পড়িঃ
    নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবক;ঃ,
    ন চৈনং ক্লেদয়ন্তাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।
    ওরা দাঁত কিড়মিড় করে ইশারায় বলে ক্যালাবে, কিন্তু জানে যে কিছুই হবে না। কারণ এই দায়িত্বটি আগে যিনি পালন করতেন সেই অমল নাগ পাশ করে যাওয়ায় কাজটা বন্ধ হয়ে গেছল। তখন ক্লাস সেভেনের প্রদ্যুম্ন গিয়ে রামকানাইদাকে বলেছিল-- আমি এটা পারব। ছোটবেলায় দাদুর সঙ্গে করে শিখেছি।
    রামকানাইদা হেসে বলেছিলেন-- পারবি? বেশ, একবার পড়ে শোনা।
    শুনে বললেন --ঠিক আছে, তবে তোর তিনটে স , মানে সন্দেশের স, শালগমের শ আর ষাঁড়ের ষ,-- সব একরকন শোনাচ্ছে। আর র ও ড়। এবং ণ। আয় ব্যাটা, দেখে নে। অভ্যাস কর। তারপর সোমবার থেকে লেগে পড়।
    নীচুক্লাসের ছেলে ডাইনিং হলে রোজ গীতাপাঠ করছে-- হল্লা হয়ে গেল। কেলটে এবং পুকুরের পচা জলে খোস-পাঁচড়া হওয়া ঘেয়ো বাচ্চা প্রদ্যুম্ন ওরফে পোদোকে সবাই সম্ভ্রমের চোখে দেখতে লাগল।
    সেভেনের বাচ্চারা গর্বিত।
    --অ্যাই পোদো, আমাকেও শিখিয়ে দে না!
    --- আচ্ছা, পোদো, প্রথম থেকে না দেখে কতট বলতে পারবি? একবার করে দেখা! বইটা কিন্তু আমার হাতে থাকবে।
    --ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ,
    মামকাপান্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বতঃ সঞ্জয়?
    -- বারে পোদো, বেশ তো! হ্যাঁরে পোদো, তুই কি বড় হয়ে সন্ন্যাসী হবি? আমাদের রামকানাইদার মতন?
    পোদো অহংকারী ভঙ্গিতে ঘ্যাম লইয়া গম্ভীর হইয়া যায়। বিধাতাপুরুষ সেদিন অলক্ষ্যে হাসিয়াছিলেন বোধহয়।
    --
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২০ আগস্ট ২০১৬ ০১:৪৪708283
  • পড়ছি।
  • সিকি | ২০ আগস্ট ২০১৬ ০৫:২৩708284
  • মাইরি, পাতে মাংসের টুকরো নিয়ে গীতাপাঠ? ধম্মে সয় এসব? ঠাকুর পাপ দেয় না?
  • Bhagidaar | 216.208.217.6 | ২০ আগস্ট ২০১৬ ০৭:১৯708285
  • না না সেতা বলতে হবে আর কোন আশ্রমের তুলনায় রাকৃমির এইসব রেস্ট্রিক্শন কম।
  • Ranjan Roy | ২০ আগস্ট ২০১৬ ১৮:৫১708286
  • ৩)
    গায়ের ব্যথাট্যাথা সারিয়ে ক্রিকেটে মন দিয়েছি। বছরের প্রথম, এখনও পড়ার চাপ নেই। কিন্তু ক্লাস টেনের ম্যাথস যে রকেটের স্পীডে এগিয়ে চলেছে। ক্লাস নাইনের সময় প্রদ্যুম্নকে হিউম্যানিটিজ অথচ সংস্কৃত, অর্থনীতির সঙ্গে ইলেক্টিভ ম্যাথস্‌ জাতীয় বেয়াড়া কম্বো নেওয়ায় ভুগতে হয়েছিল। ওকে ম্যাথস্‌ ক্লাস করতে হয়েছিল টেকনিক্যাল স্ট্রিমের সঙ্গে। ক্লাস টেনে ওকে বসতে দেওয়া হল সায়েন্সের সঙ্গে। ও আর বিপ্লব পাশাপাশি বসে।
    কিন্তু ও যে স্কুলের সরস্বতী পূজোর দায়িত্ব নিয়েছে আর এর ফলে অংকের ক্লাস হরবখত মিস হচ্ছে। চাঁদার হিসেব, কুমোরটুলি গিয়ে প্রতিমার বায়না, ঢাকি ঠিক করা, ঠাকুর আনতে যাওয়া--কত কাজ। এই ফাঁকে হরদম গেটপাস বানাতে হচ্ছে আর অচলায়তনের পাথরের দেয়ালের বাইরে গিয়ে মাঠ, গরু-ছাগল চরছে , কর্পোরেশনের কলের থেকে জল ভরার লাইনে চুলোচুলি হচ্ছে --এইসব প্রাণভরে দেখতে পাচ্ছে।
    মাঝে মাঝে , যেন ভুল করে, অংকের ক্লাসে ঢুকে পড়ছে। কিন্তু ঢুকে মনে হচ্ছে যেন বানের জলে সাঁতার কাটা!
    আগের ক্লাসটায় এপি সিরিজ বোঝানো হচ্ছিল, সে একরকম। কিন্তু তারপর জিপি একটু খটোমটো আর এইচ পিটা কেমন যেন জালিমার্কা।
    আজ তো দেখছে দুটো তিনটে সিরিজ জড়িয়ে মড়িয়ে একটা। তোমাকে সেগুলো আলাদা করতে হবে। মরেছে! এরচেয়ে ঘুড়ির মাঞ্জার জট ছাড়ানো অনেক সোজা।
    ওকে স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে ডাকলেন। ও অসহায় চোখে একবার বোর্ডের মধ্যে সংখা আর সাইনগুলোর দিকে তাকায় আবার লাস্ট দুটো বেঞ্চ আলো করে বসে থাকা আশ্রমের আবাসিক বন্ধুদের দিকে।
    পেছন থেকে কিছু ধরতাই এল বটে, ফিসফিস করে, কিন্তু ধরতে জানতে হয়। ওর মনে বাজছে 'তারে ধরি ধরি মনে করি ধরতে গিয়ে আর পেলাম না'।
    অংকের স্যার কেন যে ওকে টার্গেট করলেন?
    ওরও দোষ আছে, সব ব্যাপারে পট্পট করে উত্তর দেওয়ার রোগ।
    ওর বন্ধু রমেন শেষ বেঞ্চে বসে একটা বই পড়ছিল। তার বাদামী রঙের কভারে বেশ বড় বড় অক্ষরে লেখা "আদর্শ বাংলা ব্যাকরণ"; কিন্তু ভেতরে আসল বইটা হল লাইব্রেরি থেকে আনা "চরিত্রহীন"। একবার মনে হল স্যার ওকে দেখছেন। পোদো সতর্ক করায় ও বলল-- দাঁড়া, এখন কিরণময়ী বৌদি দেওরকে লুচি ভেজে দিতে দিতে লাইন মারছে-- ডিস্টার্ব করবি না। স্যার-ফ্যার তুই সামলে নিস।
    ধেত্তেরি!
    কিন্তু একটু পরে চোখে পড়ল স্যার পড়াতে পড়াতে চক ভেঙে ছোট ছোট টুকরো করছেন। সব ক্লাসেই উনি এটা করেন। এর মানে হচ্ছে উনি এবার ওই টুকরো অন্যমনস্ক ছাত্রের কপালে ছুঁড়ে মারবেন। আর গোটা স্কুল জানে, ওঁর টিপ ফস্কায় না। গাঁয়ের আম পাড়া টিপ।।
    স্যার তাকিয়ে আছেন রমেনের দিকে, মুখে বলছেন -- র‌্যাশনাল আর ইর‌্যাশনাল নাম্বারের ব্যাপারটা ভাল করে বোঝ, আর রিয়েল ও ইমাজিনারি। বেশ!
    বলতে বলতে উনি রমেনের সামনের দুই সারির ছেলেদের মাথা সরিয়ে নিতে ইশারা করলেন।
    প্রদ্যুম্ন কী করবে? কী করে রমেনকে সাবধান করবে? ও তো পোদোর ভরসাতেই ক্লাসে গল্পের বইটা পড়ছে। কিন্তু কোন উপায় নেই। স্যার যে ওকেও কড়া নজরে রেখেছেন।
    এবার উনি রাইফেল শ্যুটারদের মত লক্ষ্যস্থির করছেন। মুখ চলছে- ইয়েস, মিন্টিজার--পজিটিভ অ্যান্ড নেগেটিভ--। বুলেটের মত চকটা ছুটে এল। কিন্তু পোদোর হাতের লাল বাঁধানো খাতা ওর অজান্তেই চকটাকে স্যারের টেবিলে টেবল টেনিসের মত ব্যাকহ্যান্ড রিটার্ন করে দিল।
    ভাগ্যিস স্যারের গায়ে লাগে নি, শুধু ওঁর টেবিলে পড়েছে।
    এতক্ষণ দম বন্ধ করে তামাশা দেখা গোটা ক্লাস হো-হো হাসিতে ফেটে পড়েছে।
    কিন্তু পোদোর মুখ শুকিয়ে গেছে। ও এটা কী করল? স্যারের কিল যে বিখ্যাত। উনি দোষী ছেলেদের ঘাড় ধরে ঝুঁকিয়ে পিঠটা উঁচু করিয়ে তারপর গোয়ালাদের মত গদাম করে মারেন।
    --- লালখাতা কার? উঠে এস। উঠে এস, আমার সময় নষ্ট কর না।
    গোটা ক্লাসে আবার সন্নাটা। মহাল্যাবা পক পক করে বাতেলা দেওয়া পোদোর কপালে আজ দুক্খু আছে।
    এক পা এক পা করে এগোতে থাকি। স্যারের টেবিল ও আমার মধ্যের দুরত্ব ক্রমশঃ কমে আসছে। মার থেকে বাঁচার কি কোন উপায় নেই? আছে, একটা আছে। ও সজহে চোখে জল আনতে পারে। কী করে পারে কে জানে! কিন্তু পারে।
    একটা নাতকের রিহার্সালে অমন রেডিমেড চোখের জল দেখে রামকানাইদা খুব তারিফ করেছিলেন। তারপর থেকেই ও আশ্রমের নাটকের দলে রেগুলার।
    উঃ, এখন রামকানাইদা মাথায় থাকুন, ওঁর আশীর্বাদ পেলেই যথেষ্ট। পোদো পা মেপে মেপে ফেলার ফাঁকে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কোন দুঃখের গটনা মনে মনে রি-ওয়াইন্ড করে সিনেমার মত দেখতে থাকে।
    অংকের স্যার হতভম্ব। একী, ক্লাস টেনের ছেলের চোখে জল কেন? আরে আমি তো মারি টারি নি, শুধু উঠে আসতে বলেছি।
    বন্ধুপ্রীতি ভাল, কিন্তু ভাল কাজের জন্যে। ও যে ক্লাস ফলো করছে না, তুমি ওর পক্ষ নিচ্ছ? এটা কি ভালো?
    পোদোর মুখে কথা নেই।
    কিন্তু স্যারের নরম গলা শুনে গোটা ক্লাসের সংহতি বোধ জেগে উঠল। ওরা শামলা পরে আর্গুমেন্ট শুরু করল।
    -- স্যার! ও খুব ভাল ছেলে স্যার। ওকে ছেড়ে দিন স্যার। ভুল করে করে ফেলেছে স্যার। নাইনে হাফ ইয়ার্লিতে অংকে টপ করেছিল স্যার। সায়েন্সের ছেলেদের থেকেও বেশি পেয়েছিল।
    স্যার কড়া চোখে প্রদ্যুম্নকে মেপে নিয়ে বললেন--বেশ, ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু বোর্ডে এই অংকটা কষে দেখাক, কেমন অংকের ছেলে!
    পোদোর প্রাণপাখি উড়িয়া গেল, ও মাথা নাড়ল।
    কিন্তু গোটা ক্লাস উৎসাহের সঙ্গে--হ্যাঁ স্যার , হ্যাঁ স্যার, ও পারবে স্যার বলে পোদোর গলা হাঁড়িকাঠে ঢুকিয়ে দিল।
    না, পোদো ওরফে প্রদ্যুম্ন কৃষ্ণপুত্র হলেও সেদিন কোন দেবতার বরাভয় পায় নি।
    ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়লে স্যার উঠে দাঁড়িয়ে ওকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে উঁচু গলায় বললেন--গোটা ক্লাস মিথ্যেবাদী। এ ড্যাম লায়ার! এই ছেলে ভবিষ্যৎ অংকে নয়, চিৎপুরের যাত্রাদলে।
  • Ranjan Roy | ২০ আগস্ট ২০১৬ ১৯:২৬708287
  • স্যার যাই বলুন আমার তো স্বপ্ন রণজি ট্রফিতে অফস্পিনার হিসেবে খেলার। বেশ ভালই টার্ন করাচ্ছি। ফ্লাইট আর ফ্লিপারটা একটু কন্ট্রোল হলে--, তবে আশ্রমের আঙিনায় টেনিস বলে খেলাটাও ছাড়ি নি। এতে আমার মত ভীতুর ফিল্ডিং শুধরে যেতে পারে। কভার বা গালিতে দাঁড়াতে থাকি।
    কিন্তু কোথাকার জল যে কোথায় গড়ায়!
    আজ রোববার। ন'টার থেকে ধর্মক্লাস, দশটায় টেনিস বলে কোর্টইয়ার্ড ক্রিকেট।
    তবে সেদিনের ঘটনার পর থেকে বড় ও মেজোমহারাজ আমাদের এই সাপ্তাহিক ধর্মক্লাস নেওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ওটা এখন ছোট মহারাজ অনিলদার দায়িত্ব। অনিলদা আজকে একটু বেশি জমে গেছেন। শুরু করেছিলেন বেদের হোমাপাখির গল্প দিয়ে , কিন্তু খেই হারিয়ে রবীন্দ্রনাথের বোলপুর প্রবন্ধের 'গাড়ি ছুটিয়া চলিল। সবুজ তরুশ্রেণী" এই সব বলতে লাগলেন। এরমধ্যে ক্লাস এইটের এক কারবাইড-পাকা ছেলে ফিনিক্স আর হোমাপাখির গল্পের কম্পারেটিভ স্টাডিতে মেতে উটহল, অনিলদা শুনলেন। ভাবলাম ছুটি দেবেন। কোথায় কি?
    সবাই উসখুস করছে, কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু আজ অনিলদা কোন ওপেনিং দিচ্ছেন না।
    আমি নিচুগলায় কিছু বলার চেষ্টা করতেই বিপ্লব জোরে চিমটি কেটে বলল-- মুখ বন্ধ রাখ। তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার, ওরে ভীরু!
    দূর! সময় চলে যাচ্ছে, আজকের খেলার কী হবে? কী যে হবে তা প্রশান্ত হস্তমুদ্রায় বুঝিয়ে দিল।
    এরপর যা ঘটল তাকে স্বতঃস্ফুর্ত বললে কম বলা হয়।
    অনিলদা প্রশ্ন করেছেন--মানুষ কখন চারপেয়ে হয়?
    বিপ্লব নীচু গলায়-- যখন চারপাইয়ে শোয়, এটা কোন প্রশ্ন হল?
    --- কী? পারলে না তো? যখন বিয়ে করে। বৌয়ের দায়িত্ব নেয়।
    -- তাহলে মহারাজ, যখন বিয়ের পর বৌয়ের বাচ্চা হবে তখন কি ছ'পেয়ে হবে? আর দুটো বাচ্চা হলে?
    -- তোমার এসব জেনে লাভ?
    -- না, কোন লাভ নেই। মিনিমাম কৌতূহল। মানে জানতে চাইছি ঠাকুর এ নিয়ে কিছু বলে গেছেন কি না?

    ধর্মক্লাসে বিরতি। না, বিরতি নয়, পূর্ণচ্ছেদ। অনিলদাও আর নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার উৎসাহ দেখান না। আমাদের ব্যাচটা বেয়াড়া। ইলেভেনের ছেলেরা বোর্ডের চিন্তায় মগন। ধর্মক্লাসে আসতে চায় না।
    কিন্তু সেদিন সবাই খুশি। দশ-দশ ওভার খেলা হতেই পারে।
    ফটাফট টস করে ফিল্ডাররা দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমার ব্যাটিং সাইড, শেষের দিকে নামি। দশ ওভারে চান্স নেই। তাই আম্পায়ারিং করছি। উইকেট কিপার ও আমি হাফপ্যান্টের উপর গামছা জড়িয়ে নেমেছি।
  • Bratin | 11.39.37.220 | ২০ আগস্ট ২০১৬ ২০:১৪708288
  • জমে গেছে।

    রঞ্জন দার কথা শুনে মনে পড়লো।আমো তখন খুব ছোট ।ক্লাশ সিক্স বা সেভেন।বাপি বলেছিল"গীতা" থেকে রোজ একটা শ্লোক মুখস্ত করতে। বাপি র মোটামুটি পুরো মুখস্ত।

    কিন্তু আমার ও ই দু চার টের বেশী আর এগোয় নি

    ঃ((
  • Ranjan Roy | ২১ আগস্ট ২০১৬ ০১:০১708289
  • সবাই পজিশন নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু বোলার বল করতে এসে থেমে গেল।
    শর্ট লেগ কোথায় গেল? টেনিস বলের ম্যাচে শর্ট লেগ অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট, কারণ এখানে ফিল্ড করলে ব্যাকফুটে খেলা ডিফেন্সিভ স্ট্রোকের থেকেও বল তুলে নেওয়া যায়। আর কোন চোট খাওয়ার ভয় নেই। ওখানে তো আমাদের গ্রেট রমেনের দাঁড়াবার কথা। গেল কোথায়? বাথরুমে? কী বিরক্তিকর!
    তখন নিখিলেশ বলে উঠল--ওই তো রমেন! ডাক শালাকে!
    ডাইনিং হলের বারান্দায় বড় থামের পাশে রমেন প্রায় কোণঠাসা করে কড়া চোখে নিচুগলায় কিছু বলছে সোমেশ দত্তকে। আমাদের ব্যাচে সোমেশকে নিয়ে একটু হাসাহাসি হয়। বড় ঘরের ছেলে।নিষ্পাপ স্বপ্নালু চোখ, আদরে বড় হয়েছে। ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছিল।
    ওর নরম সরম ভাব দেখে আশ্রমের ছেলেরা ওর নাম দেয় মাদী দত্ত। কয়েক বছর পরে ওই নামটা ওর সঙ্গে সেঁটে যায়।
    সিক্সে বেলেঘাটা থেকে আসা একটা ফচকে ছেলে ওকে খ্যাপাবার জন্যে তাসাপার্টির বাদ্যের অনুকরণে মুখে বোল তৈরি করেঃ
    মাইদ্যা মাদী কুড় কুড় কুড়!
    মাইদ্যা মাদী কুড় কুড় কুড়!
    কুড়ুকুড় -- ঝুংকুরুকুর,
    মাইদ্যা মাদী কুড় কুড় কুড়!

    বিব্রত সোমেশকে ঘিরে তিনটে বাচ্চা নেচে বেড়ায় আর মুখে ওই বোল তোলে। সেটা অনিল মহারাজের চোখে পড়ে যায় । উনি এসে সোমেশকে একতরফা হেনস্থার থেকে রক্ষা করেন।
    বাকি তিনটে কে ভালকরে থাপড়ে সিধে করেন আর মারতে মারতে বলতে থাকেন-- অসভ্য কথা বলছ, অসভ্য কথা বলছ? মাইদ্যা মাদী কুড় কুড় কুড়! অসভ্য কথা বলছ?
    তারপর থেকে সবার সামনে কুড় কুড় বোল তোলা বন্ধ হয়ে গেছল। কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা কখনও কখনও ওকে মাদী বলে সম্বোধন করে মজা পেত।
    এহেন সোমেশ বিব্রত মুখে থামে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আর সোমেন ওর দিকে ঝুঁকে একটা হাত ওই থামে কায়দা করে ঠেকিয়ে কী যে বিড় বিড় করছে বোঝা যাচ্ছে না। যেটুকু বুঝতে পারছি যে ওদের মধ্যে একটা কথা কাটাকাটি চলছে। আমি একবার চেঁচালাম-- আব্বে রমেন! ওসব প্রেমলাপ শেষ কর। ঝুড়ি চাপা দে। শর্ট লেগে আয়, নইলে--।
    ও ক্রুদ্ধ বাইসনের মত মাথা তুলে আমাকে দেখে হাত তুলে ইশারা করে--আসছি!
    ধেত্তেরি! আর ভাল লাগে না। ঘরে গিয়ে একটা সিগ্রেট খেলে কেমন হয়! কিন্তু আম্পায়ার যে সরতে পারে না।
    একটা আর্ত চীৎকার! সবাই একসঙ্গে সেদিকে তাকিয়ে দৌড়্লাম।
    বাইসনের শিং দিয়ে গুঁতিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে ঘাড় গুঁজে মাথা নীচু করে রমেন সমানে ঘুষি মারছে সোমেশ দত্তের মুখে। সোমেশ প্রানপণে ঠেকাতে চেষ্টা করছে, দুহাত তুলে মুখ আড়াল করছে, কিন্তু এর্মধ্যেই ওর ঠো`ঁট ফেটে কষ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে!
    কী কান্ড!
    -- কী রে রমেন ? দত্তকে অমন করে মারছিলি কেন?
    রমেন রাগী মোষের মত ফোঁস ফোঁস করে, উত্তর দেয় না।
    --সুমিত , তুই বল।
    -- আমি কি বলব? ও খালি বলছে-- তুই আমাকে ভালবাসিস কি না বল? আমি ওর কথা বুঝতেই পারছি না। বল্লাম , তোরা সবাই আমার বন্ধু। আমি সবাইকেই ভালবাসি।এতে জিগ্যেস করার কি আছে?
    কিন্তু ---কিন্তু ও জিদ করছে যে আমি ওকে ছাড়া কাউকে ভালবাসতে পারব না। আমি নাকি শুধু রমেনের!
    যেই বলেছি যে এরকম কিছু হয় না, আমি কাউকে আলাদা করে স্পেশাল ভালবাসতে পারব না, অমনি ও আমাকে মারতে লাগল আর বিড়বিড় করছিল -- আমাকে ভালবাসতেই হবে, তুই শুধু আমার! অন্য কাউকে ভালবাসলে মেরে ফেলব। এ কী পাগলামি বলত! এখন আমি কী করি, তোরাই বলে দে।
    ও ফোঁপায়। আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। রমেন নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। আর আমাদের ক্রিকেট খেলার সেদিন তিল-আলোচাল -কলা দিয়ে মেখে পিন্ডদান হয়।
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২১ আগস্ট ২০১৬ ১৪:২৭708290
  • लिखिये...
  • Bratin | 11.39.37.192 | ২১ আগস্ট ২০১৬ ১৭:১৫708291
  • যাঃ
  • Ranjan Roy | ২২ আগস্ট ২০১৬ ০১:১১708292
  • ৬)
    " ভাঙ খেয়ে বিভোর ভোলানাথ, ভূতগণ সঙ্গে নাচিছে,
    সদা কালী কালী কালী বলে মধুর ডমরু বাজিছে।
    শিরেতে শোভিছে জটাজুট ফণী,
    ললাটে শোভিছে দেবী মন্দাকিনী,
    চরণ চাপিয়া ভূধর ধরণী কুলুকুলু ধ্বনি করিছে।"
    সকাল দশটা বাজে। প্রেয়ার হলের বারান্দায় হারমনিয়াম ও খোল বাজছে; আমরা যে যার মত নাচছি গাইছি। আজকে আর স্কুল হবে না।
    আজকে যে মহাশিবরাত্রি। শীত প্রায় চলে গেছে, সান্ধ্য বাতাসে আমের বউলের গন্ধ আর কোকিলের ডাক। আজকে সারাদিন উপোস।
    তবু ভাল লাগে। বাঁধা রুটিনের বাইরে কিছু একটা হলেই ভাল লাগে। কাল থেকে তো আবার সেই! তাই আজকের দিনটা বেশি ভাল লাগে। এ যেন তেহাই দিয়ে সমে ফিরে আসা।
    খালি এইটুকু? না, না। আজ আমরা সারাদিন উপোস করে বেলা বাড়লে অনিল মহারাজের সঙ্গে মিছিল করে গাইতে গাইতে কুঠিঘাটের গঙ্গায় যাব। সেখানে স্নান করে এঁটেল গঙ্গা মাটি তুলে এনে আশ্রমে শিব গড়ে ঘরের সামনে বারান্দায় রাখব। তারপর সন্ধ্যে থেকে লেবুর ও বেলের সরবত খেয়ে উপোস ভাঙ্গা হবে। এর পর ফল প্রসাদ, সন্দেশ সব খেয়ে রাত্তিরে জমপেশ করে খিচুড়ি খেয়ে পর্বটি শেষ হবে।
    আস্তে আস্তে আমরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের ইচ্ছেমত গাইছি, কেউ কেইউ নাচছি।
    অমিয়দারা গাইছেঃ
    " জয় শিবশংকর হর ত্রিপুরারি,
    পাশী পশুপতি পিনাকধারী।
    শিরে জটাজুট কন্ঠে কালকূট,
    সাধক-জন-মন -মানস-বিহারী।"

    আমি, বিপ্লব ও নিখিলেশ গাইছিঃ
    " নাচে পাগলা ভোলা বাজে বম বম বম,
    আবার শিঙা বাজিছে ভোঁ ভোঁ ভম ভম ভম।
    শিরে করিছে গঙ্গা কল-কল-কল,
    আবার চরণচাপেতে ধরা টলমল টল,
    আবার মৃদঙ্গ ধরে তাল তাথম তাথম"।
    এখন আমরা সবাই শিবের চেলা। তাই নন্দী-ভৃঙ্গী হওয়ার বাসনা। প্রায় সবাই খালি গায়ে একটা গামছা জড়িয়ে। কেউ কেউ রুম থেকে মুখে পাউডার ঘষে ছাইমাখার অনুষঙ্গ আনার চেষ্টা করেছে। কারণ ঘন্টাখানেক পরেই আমরা মিছিল করে গঙ্গায় স্নান করতে যাব। ভাঁটার সময়। পাড়ের কাছে কাদা। সেখান থেকে মাটি তুলে এনে শিব গড়ব-- জোয়ার আসার আগেই। আবার বিকেলে ভাটার সময় গঙ্গায় গিয়ে শিব বিসর্জন দিয়ে ফিরে তারপর উপোস ভাঙ্গবে।
    শিবরাত্রির উপোস জানতাম মেয়েরা করে, শিবের মত বর পাওয়ার জন্যে। এখানে ছেলেরাও করে। কেন করে? সবাই করে তাই।
    ভুল বললাম। সবাই করে না। এর জন্যে কোন চাপ নেই। কর্তৃপক্ষ কাউকেই উপোস করতে বাধ্য করেন না। তবে যারা করবে না তাদের ব্রহ্মচারী হরেনকে জানিয়ে দিতে হবে যাতে দুপুরের রান্না কতটা হবে তার আন্দাজ পাওয়া যায়।
    কোন বছর না করে দেখেছি-- নিজেকে কেমন দলছাড়া একলা লাগে। একসাথে উপোস করলে নেচে গেয়ে কখন সময় কেটে যায়, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয় টের পাওয়া যায় না।
    ক্ষিদে? পায় বই কি! তবে মাঝে মাঝে, ওই জোয়ার-ভাঁটার মত অনুভূতিটা আসে যায়।
    দুপুরের দিকে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে সবচেয়ে ভাল।
    এবার রামকানাইদা নেই। অনিলদা বেসুরো। তাতে কি? আমরা চেঁচিয়ে কর্ত্তাল বাজিয়ে কোন কসুর রাখছি না।
    এসে পড়ল কুঠিঘাট।
    আমরা হৈ হৈ করে জলে নামছি। বেশ কাদা। পা হড়কে যাচ্ছে। কারও কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। প্রশান্তকে নিখিলেশ ল্যাং মেরে কাদায় ফেলে দিল। ও চেঁচাচ্ছে , নিখিলেশকে শকার-বকারে আপ্যায়িত করছে। সবাই হেসে কাদায় গড়াচ্ছে। অনিল মহারাজ আজ দেখেও দেখছেন না।
    আমি সাঁতার জানি না। ভয়ে ভয়ে জলের ধারে ধারে ঘুরে বেড়াই, নামি না।
    যারা জানে, তারা কেউ কেউ জলে নেমেছে, স্নান করছে কম, জল ছিটোচ্ছে বেশি। অন্যেরা পাড়ে বা কাদায় বাবু হয়ে বসে গায়ে কাদা মাখছে। কেউ কেউ মাথায় মুখে এমন করে কাদা মেখেছে যে চেনাই যাচ্ছে না।
    আমি এদের মধ্যে ঠিক কি করব বুঝতে না পেরে ক্যাবলা ক্যাবলা মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এদের মেক আপ দেখছি।
    পেছন থেকে কাদামাখা দুটো হাত আমাকে জড়িয়ে ধরে তারপর আমাকে টানতে টানতে আরও কাদায় নিয়ে ঠেলে ফেলে দেয়। আমি ভয়ে ঘেন্নায় চেঁচিয়ে উঠি। গঙ্গার হাওয়ায় সেই ডাক ছড়িয়ে যায়, কারও কানে পৌঁছয় না।
    মূর্তিটা আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে-- লাকি, গাধার মত চেঁচাস না তো! আয়, তোকে ভাল করে কাদা মাখিয়ে সাজিয়ে দিই। তারপর আমার সঙ্গে হাত ধরে জলে নেমে ডুব লাগাবি। সব ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে দেব। ভয় পাস না; আমি ভালরকম সাঁতার জানি। হিন্দু স্কুলে পড়তে কলেজ স্কোয়ারে শিখে নিয়েছি।
    বিপ্লব! মানে মিতা?
    মিতা আমাকে পনের মিনিট ধরে কাদা মাখায়, সাজায়--- এই বার তোতে আমাতে মিলে পারফেক্ট নন্দী- ভৃঙ্গী , বুঝলি?
    গায়ে কাদা শুকিয়ে চড়চড় করছে। এবার স্নান করতে হবে। অনিল মহারাজের কড়া নির্দেশ-- যারা সাঁতার জানে তারা একটা চেইনের মত করে বুকজলে দাঁড়াবে। আর যারা জানেনা তারা ওই চেইনের এপারে কোমর জলে ডুব লাগিয়ে চান করবে। আনাড়িগুলো পাড়ে উঠলে পরে তবে সাঁতারুদের পালা।
    আমাকে মিতা বুকজলে টেনে নিয়ে যায়, ভয় করে। ও আমার দুহাত ধরে এক-দুই-তিন বলে টেনে একসঙ্গে ডুব দেয়, খানিকক্ষণ জলের নীচে দম ধরে রাখে , আমি একটু পরেই হাঁচোড় পাঁচোড় করে ভেসে উঠে শ্বাস টানতে থাকি। ও যত্ন করে পিঠের কাদা শুইয়ে দেয়।
    বলে--এই শেষ বার। এবার জলের নীচে চোখ খুলে দেখার চেষ্টা কর। মজা পাবি। সাহস বাড়বে। নে, আমার হাত ধর। এক -দুই-তিন!
    আমি জলের নীচে চোখ খোলার চেষ্টা করি। কিচ্ছু দেখতে পাইনা, শুধু একটা ঘোলাটে দেওয়ালের মত। কিন্তু হটাৎ মিতা ওর হাত ছাড়িয়ে নেয়।
    আমি ভয় পেয়ে ভুস্‌ করে ভেসে উঠে দেখি পাশে মিতা নেই।
    চারদিকে তাকিয়ে দেখছি -কানে এল পাড়ের থেকে গেল-গেল-ডুবে গেল; মা ডেকে নিলেন-- চেঁচামেচি। নদীর দিকে ভাল করে তাকাতেই চোখে পড়ল-- বিপ্লব, অনিরুদ্ধ,অমিয়দা প্রাণপণে সাঁতরাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে নদীর আরও গভীরে। বেশ দুরে একটা মানুষ উঠছে-ডুবছে, মাঝে মাঝে হাত তুলছে।
    ঘাট থেকে দুজন স্থানীয় লোক আন্ডারওয়ার পরা অবস্থায় জলে ঝাঁপ দিল। এরা দ্রুত স্ট্রোক কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ডুবন্ত মানুষটার দিকে। সমবেত চিৎকার, টেনশন, হ্যাঁ ওরা পেরে যাবে, ---না, পারবে না। মা যাকে টেনেছেন একবার--।
    আমি মাথামুন্ডু কিছুরই নাগাল পাচ্ছি না। দুজন পৌঁছে গেছে। কিন্তু বডিটাকে ধরছে না। একবার ঠেলা মারছে, তারপর সরে যাচ্ছে। আবার ঘুরে এসে ওর হাত বা জামা ধরে টানছে। সেইসময় একটা নৌকো এসে পড়ায় লোকটাকে টেনে তুলে পাড়ে নিয়ে আসা হল।
    এ যে আমাদের রমেন! ও কাউকে না বলে অতদূরে কেন চলে গেছল। একলা একলা? উত্তর কে দেবে? ও তো অনেক আগেই জ্ঞান হারিয়েছে।
    কাশীপুর হাসপাতালের বেডে শুয়ে ওর জ্ঞান ফিরল প্রায় দুঘন্টা পরে।
    ওর ঠোঁট নড়ছে। অমরা ঝুঁকে পড়লাম। কী হয়েছে? বল, কিছু বলবি? বল, শুনছি।
    --- আমি বাঁচতে চাই না!
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ০২:০২708294
  • ভয়ঙ্কর
  • Ranjan Roy | ২২ আগস্ট ২০১৬ ২১:১১708295
  • ৭)
    সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর থেকে আমরা রমেনকে ঘাঁটাই না। ও একটু গুমসুম হয়ে থাকে। কিন্তু ওকে কখনও একলা থাকতে দিই না। যতক্ষণ পারি আমরা কেউ না কেউ চোখে চোখে রাখি। আর সোমেশকে ওর কাছে যেতে দিই না। আসলে আমরা ওকে ভয় পেতে শুরু করেছি।
    কোথায় হারিয়ে গেছে সেই বিহার থেকে আসা চ্যাংড়ামিতে ভরপুর ছেলেটা! যে আমাদের নিজস্ব মহফিলে বেডকভার দিয়ে ঘাঘরা বানিয়ে বৈজয়ন্তীমালার নাচ দেখাত! যে একার সাহসে সিনিয়র বক্সিং চ্যাম্পিয়নের গুন্ডামি ও ছোটদের সঙ্গে যৌন হরকত করা বরাবরের মত বন্ধ করে দিয়েছিল!
    ওই ঘটনায় আমাদের সে বার শিবরাত্রি, দোল ও নববর্ষের আনন্দ কেমন পানসে করে দিল। আমাদের ব্যান্ডপার্টি আর প্র্যাকটিস শুরু করল না। ড্রাম, কেটল ও বিউগলগুলো স্টোররুমে তালাবন্ধ হয়ে গেল। নতুন মহারাজদের ব্যান্ডপার্টি নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না।
    আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দোলের দিন একটা চেষ্টা করেছিলাম।
    মন্দিরে সকালের পূজোর পর বড়, মেজ ও ছোট মহারাজদের পায়ে আবির দিয়ে তারপর ছোটদের রং খেলা শুরু হল। বেয়াড়া রং নিয়ে খেলার নিষেধ আছে, কিন্তু বাগানের গোবর ও কাদামাটি?
    রমেন চুপচাপ গম্ভীর মুখে ঘরে যাচ্ছিল। হাতে ছোট প্যাকেটে আবির নিয়ে আমরা ওকে হাসিমুখে ঘিরে ধরলাম। একটু যেন লজ্জা পেল, কিন্তু গোমড়া ভাবটা গেল না।
    আমরা সরে গেলে ওকে একলা ধরল সোমেশ। ওকে রঙ মাখিয়ে বলল-- শোন, মন খারাপ করিস না। আজ থেকে তুই আমার বন্ধু, স্পেশাল বন্ধু। কিন্তু এখানে স্পেশাল বলতে সবাই যেরকম ভাবে সেরকম কিছু না।
    একটা কথা ভাব; যা আমার ভাল লাগে না সেটা নিয়ে জোরাজুরি করবি? তুই কেমন বন্ধু?
    তার চেয়ে তোর আর আমার যা যা পছন্দ সেগুলো নিয়েই তো আমরা কত খুশি হতে পারি।
    --- তুই কী চাস?
    --- আমি চাই তুই আজ আমাদের সান্ধ্য আড্ডায় আগের মত মুকেশের গান গাইবি। আমার স্পেশাল অনুরোধ তোর গলায়--দিল তড়প তড়প কে কহরহা--,; কী রাজি তো?
    -- ভেবে দেখব।

    সেদিনের পর থেকে রমেন একটু কথা টথা বলতে শুরু করল, কিন্তু কোথায় যেন একটু আড়ষ্ট ভাব। হয়ত সেই গঙ্গার ঘটনাটা ওকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে।

    কয়েকদিন গেল; এল চৈত্রসংক্রান্তির বিকেল। আর এল আপাত মেঘহীন নির্মল আকাশে এক অকালবৈশাখীর ঝোড়ো হাওয়া।
    বড় মহারাজের অফিসে আমাদের তলব হয়েছে। হটাৎ। কেন? কিচ্ছু জানি না। তবে সংবাদবাহকের হাবভাবে বুঝলাম বেশ ঘোরালো কেস-- একেবারে হাতে হ্যারিকেন!

    সবাই মাত্র জলখাবার খেয়েছি। তবু মহারাজের চিরকুটে লেখা নামের লিস্টি অনুযায়ী আমরা ক্লু-লেস দশজন মার্চ করে গেলাম। আমাদের গুরু অমিয়দা বেশ অফেন্ডেড। এইসব অপোগন্ডদের সঙ্গে ওর মত মহামহিমকে কেন তলব করা হয়েছে!
    অফিসে ঢুকে আমাদের মাথা আরও গুলিয়ে গেল।

    টেবিলের ওপাশে বড় ও মেজমহারাজ --দুজনেই গম্ভীর । অনিলদা বারান্দায় একটা চেয়ারে। আর টেবিলের একপাশে একটা চেয়ার ও টুলে বসে আছেন একজন অল্পবয়সী মহিলা। পাশের ভদ্রলোকটি বোধহয় ওঁর স্বামী।
    ভদ্রলোক উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছেন। মহিলা শান্ত, কিন্তু বেশ গম্ভীর।
    আমরা ঢুকতেই ভদ্রলোকটির চোখের সার্চলাইট আমাদের চেহারার উপর দিয়ে একদফা ঘুরে গেল। উনি ভদ্রমহিলাটিকে কিছু বলতে যেতেই মেজ মহারাজ হাত তুলে ওঁকে থামালেন।
    তারপর বাঁজখাই গলায় কম্যান্ড দিলেন-- সবাই লাইনে দাঁড়াও; ফল ইন। মেক ইট এ স্ট্রেইট লাইন, ওকে।
    এবার মহিলাটিকে বললেন-- মা, আপনার কোন ভয় নেই, কোন সংকোচ নেই। আপনি উঠে যান, ওদের কাছে গিয়ে একটা একটা করে মুখগুলো খুঁটিয়ে দেখুন। আইডেন্টিফাই করুন রাসকেলটাকে!
    ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন অমিয়দার দিকে। ভাল করে দেখে মাথা নেড়ে এগিয়ে গেলেন। এবার প্রশান্ত। উনি এগিয়ে গেলেন আর নিখিলেশের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এর পরেই আমি। বেশ ভয় পাচ্ছি। এসব কী হচ্ছে? আসলে কী হয়েছে?
    ওঁর স্বামী ও মেজ মহারাজ বেশ উত্তেজিত।
    --এই হারামজাদা?
    --দিস রাস্কেল?
    কিন্তু মহিলা মাথা নেড়ে আমার সামনে আমি চোখ নামিয়ে নিয়েছি। ভদ্রমহিলা খুব সুন্দর দেখতে, কিন্তু আমার চেয়ে অন্ততঃ দশবছরের বড় হবেন।
    উনি এগিয়ে গেলেন।
    এবার সোমেশ। ও আর রমেন গাঁ ঘেষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে। উনি সোমেশ এর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পলক পড়ছে না। আপাদমস্তক দেখে নিচ্ছেন। একবার এগিয়ে গেলেন। বাকিদের দিকে একনজর দেখে নিয়ে বললেন-- এরা কেউ নয়, তবে হলে এই ছেলেটা হতেও পারে।
    আমরা ভয় পেয়েছি। অজানার ভয়, অমঙ্গলের গন্ধ পাচ্ছি। কী হয়েছে?
    --- শুয়োরের বাচ্চা!
    চেয়ার ছেড়ে ছুটে এসেছেন স্বামীদেবতাটি আর কলার চেপে ধরেছেন সোমেষের। ও ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
    এক লহমায় ওঁর হাত মুচড়ে ধরেছে রমেন।
    --ছাড়ুন! ছেড়ে দিন ওকে!
    --- তুমি জান ও কী করেছে?
    --- জানি না, জানতে চাই না। খালি এইটুকু জানি যে ও কোন খারাপ কাজ করতে পারে না।
    -- এত ভরসা বন্ধুর চরিত্র নিয়ে?
    এবার আমরা সরব হই।
    সোজা বড় মহারাজকে বলি-- মহারাজ! কোথাও একটা ভুল হচ্ছে! এনারা কে আমরা জানি না। কিন্তু এঁদের সামনে দাঁড় করিয়ে আমাদের মুখ চেনাচ্ছেন ? অপরাধটা কি সেটা আগে বলবেন না?
    -- অপরাধটা কী? তোমাদের জিগ্যেস করতে লজ্জা করছে না?
    এই পরিবারটি পাশের বাড়ির দোতলায় নতুন ভাড়াটে হয়ে এসেছেন। তোমাদের মধ্যে কেউ এঁকে জানলায় দেখলেই অসব্যতা করে। আয়না দিয়ে মুখে আলো ফেলে। উনি সহ্য করে যাচ্ছিলেন। বেশির ভাগ সময় বারান্দার দিকের জানলা দরজা বন্ধ রাখতেন। কাল সকালে যখন উনি কাপড় মেলতে বারান্দায় এসেছিলেন তখন সেই বদমাশ ওঁর দিকে প্যান্ট সরিয়ে অভব্য ইশারা করেছে। কে সে? তোমরা ভালয় ভালয় নাম বলে দাও। তাকে রাস্টিকেট করার আগে পিঠের ছাল-চামড়া তুলে ছাড়ব। আশ্রমের মান -সম্মান তোমরা মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছ।
    আমরা গুরুর দিকে তাকাই। গুরু ফিল্ডে নাম। আমরা যে কিছুই বুঝতে পারছি না। কিংকর্তব্যম্‌?
    -- আচ্ছা, বৌদি। আপনি কি শিওর যে এই ছেলেটিই?
    -- ঠিক শিওর নই। তবে অনেকটা এর মত হাইট আর ফর্সা।
    -- আন্দাজ ক'টা নাগাদ?
    -- কাল সন্ধে ছ'টা সাড়ে ছ'টা হবে।
    -- ওই ছেলেটার চেহারায় অন্য কিছু মনে পড়ছে।
    --- না, তেমন কিছু না। দাঁড়ান, দাঁড়ান। অতদূর থেকে ভাল বোঝা যায় না। তবু---, ও হাসছিল আর দেখলাম ওর সামনের পাটির দুটো দাঁত নেই।
    আমাদের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহ। ঝটকা থেকে বাঁচতে একে অন্যের হাত চেপে ধরি।
    এ তো "গ্যারেজ"! মানে ক্লাস এইটের বখা চিন্ময়!
    সামনের দুটো দাঁত ভেঙে যাওয়ায় এই নাম।
  • | ২২ আগস্ট ২০১৬ ২২:২০708296
  • তারপর?
  • Ranjan Roy | ২২ আগস্ট ২০১৬ ২৩:৩১708297
  • মেজ মহারাজের চোখ আমাদের দিকে।
    --তোমরা কেউ চিনতে পেরেছ কালপ্রিটকে?
    আমরা চুপ।
    গুরু এসব এড়িয়ে মহিলাটিকে প্রশ্ন করেঃ
    -আচ্ছা, বৌদি,! ওই ছেলেটা কিছুদিন ধরেই আপনাকে বিরক্ত করছিল, তাই না? এই একটা ছেলেই তো, আর কেউ? কখনও একসঙ্গে কয়েকজন?
    -- না,না; শুধু ওই একটাই। আমি ওর জ্বালায় বারান্দায় আসতে পারিনা। ওদিকের জানলা দরজা ভেজিয়ে রাখি।
    --- আপনার বারান্দা আর ওর জানলা কী মুখোমুখি? দোতলায়?
    --হ্যাঁ।
    --আপনার কোন বাড়িটা বলুন তো? কী রঙের?
    --হলুদ রঙের; বাড়িওয়ালা ভাড়া দেওয়ার সময় রঙ করিয়ে দিয়েছিল।
    -- মহারাজ, কোথাও একটা বড় ভুল হচ্ছে। আমদের এই কয়জনের রুম নাম্বার হল ২ ও ৩। হলদে রঙা বাড়িটা আমাদের জানলর দিকেই না। ওটা প্রায় নাইনটি ডিগ্রিতে। ওঁর বারান্দার সামনে অন্য কোন ঘরের জানলা। আমাদের না।
    মেজ মহারাজ ধমকে ঊঠলেনঃ হোয়াট ইজ দিস? ওঁরা কি বাড়ি বয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে ফলস্‌ কম্প্লেন করতে এসেছেন?
    --- না, মহারাজ! বলছি, ওরা নয় আপনারা। আপনারা ভুল করছেন। একবার গিয়ে দোতলায় উঠে দেখে আসুন বা বাইরে অনিল মহারাজকে জিগ্যেস করুন-- ওঁর বারান্দা আমদের ঘরের জানলার দিকে নয়। তাই উনি আমাদের মধ্যে কাউকে শনাক্ত করতে পারেন নি। উনি আমাদেব্র কখনও দেখেন নি। আমরাও না।
    ঠিক ঘরের ছেলেদের ডেকে আনুন। ওনার সামনে দাঁড় করান। আসল দোষীকে উনি ঠিক চিনে নেবেন।
    দুই মহারাজ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
    বড় মহারাজ বললেন-- ঠিক আছে, তোমরা এখন যাও।
    ঘরে এসে আমরা হাঁফ ছাড়ছি , আমি বললাম-- শালা গ্যারেজ এবার ফেঁসে গেল। ছোটলোক! ওকে চাবকানোই উচিত! তবে রমেন হেবি দিলি মাইরি! সোমেশের জন্যে লড়ে গেলি! মুহব্বত হো তো অ্যায়সা!
    সবাই হেসে ওঠে। রমেন ও হাসে। বালে --আমি জানতাম ও কোন মহিলার সঙ্গে অসভ্যতা করতে পারে না।
    -- কী করে জানতি?
    --ব্যস্‌, জানতাম।
    -- আমি জানি! আমিই জানি!
    নিখিলেশ চেঁচিয়ে ওঠে।
    -- কী জানিস?
    --কেন সোমেশ মহিলাদের সঙ্গে কোন গড়বড় করতে পারে না-- সেটা।
    --কেন?
    -- ও তো নিজেই একটা মহিলা--মাদী বোস। একেবারে মাইদ্যা মাদী কুরকুরকুর!
    সোমেশ রেগে যায়। আর রমেন নিখিলেশকে তাড়া করে নীচের সিঁড়ি পর্য্যন্ত খেদিয়ে দিয়ে আসে।
    অমিয়দা অন্যমনস্ক।
    -- কী হল, গুরু? মেজ মহারাজের শিকার ভসকিয়ে দিলে?
    --ছাড় তো! আমি ভাবছি অন্য কথা।
    --কী কথা? ব্যাঙের মাথা?
    --আরে সবাই তো গ্যারেজ বা চিন্ময়কে দোষী ভাবছিস? কিন্তু ক্লাস এইটের গ্যারেজ তো একতলায় থাকে। ও কী করে দোতলার বৌদিকে সামনা সামনি বিরক্ত করবে?
    -- হয়ত অন্য কারও ঘরে ঢুকে -- ও কী কম চালাক?
    -- সে এক-আধদিন হতে পারে। কিন্তু দেখলি তো, উনি বললেন --ওই একটা ছেলেই সবসময় করে।
    --- উঁ উঁ । মন্দ বল নি। তাহলে?
  • Ranjan Roy | ২৩ আগস্ট ২০১৬ ১৫:৪৬708298
  • রহস্যের সমাধান হল আকস্মিক ভাবে।
    হলদে বাড়ির ব্যালকনির উল্টোদিকের রুম নম্বর ৭।
    এইঘরের ক্যাপ্টেন সমীরণদা। সেখান থেকে পাঁচজনকে আনা হল। না, অভিযোগকারিণী এঁদের কাউকে চেনেন না।
    মেজ মহারাজের পুলিশি মগজে বাল্ব জ্বলে উঠল।
    --সমীরণ, তোমার ঘরে নিয়মিত অন্য কেউ আসে? ধর জুনিয়র কেউ? পড়া বুঝে নিতে বা কোন সাহায্য চাইতে?
    সমীরণদা ঘামতে থাকে। কার নাম নেবে? আসে তো অনেকেই।
    মেজ মহারাজ এবার চোখ ছোট করে অন্য চারজনকে বললেন-- তোমরা বল। কে অন্যদের থেকে বেশি এই ঘরে আসে? রঙ ফরসা ও সামনের দুটো দাঁত ভাঙা?
    বিপুল কিছু বলবে?
    -- মহারাজ। বুঝতে পারছি না। খুব ফরসা একজন নীচের তলার থেকে ঘন ঘন ওপরে আসে বটে, কিন্তু তার সামনের দুটো দাঁত? ঠিক বুঝতে পারছি না, কী বলব।
    -- তুমি শুধু নামটা বল। বাকি আমরা দেখে নেব।
    সমীরণদা খুব ঘামছে।
    --- ওর নাম ভাস্কর, ক্লাস নাইন। গত বছর ভর্তি হয়েছে।
    -- ডেকে নিয়ে এস। বল, আমি ডাকছি।
    সমীরণদা দরদর করে ঘামছে।
    ভাস্করকে দেখেই মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন--এই-ই!
    যাদবপুরের ঝিল রোডের বাসিন্দে ভাস্কর। তুলি দিয়ে টানা চোখ। চোখের মণির রং বাদামী। ওর দাঁত ভাঙা নয়, কিন্তু ঝকঝকে বাকি দাঁতের পাটির মধ্যে বেমানান দুটো কালো ক্ষয়াটে দাঁত, প্রথম নজরে মনে হবে খালি।
    সেইদিনই ভাস্করকে আশ্রমের ডজ গাড়িতে করে বাক্সপ্যাঁটরা সমেত ঝিল রোডে ছেড়ে আসা হল।
    কিন্তু এই ঘটনা আবার দুটো ভিন্ন ঘটনার জন্ম দিল।
    সমীরণদা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।
    মহারাজ ওকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে ভাল করে কড়কে দিয়েছেন। কেন নীচের তলার থেকে ক্লাস নাইন সায়েন্সের ছেলে ভাস্কর দোতলার ৭ নম্বর ঘরে ঘনঘন আসত? আর গুপ্তচর সূত্রে জ্ঞাত যে আসত ক্যাপ্টেন সমীরণদার কাছেই। কেন? পড়া দেখে নিতে ? হতেই পারে না। বারাসতের গেঁয়ো সমীরণ আর্ট্স পড়ে। পড়াশুনোয় সাধারণ মানের। ওর কাছে সায়েন্সের ছেলে কেন আসে? আর কী ভাবে ওদের অনুপস্থিতিতে ছেলেটা ওদের জানলা দিয়ে উল্টোদিকের বারান্দায় ব্যস্ত মহিলার দিকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে? এর ফলে আশ্রমের যে সম্মান গেল তার কোন দায় কি সমীরণের নয়?
    ওকে সাতদিনের জন্যে সাসপেন্ড করা হল। এর মধ্যে ও যদি ক্ষমা চেয়ে চিঠি লেখে ও কথা দেয় যে এরকম ভুল ভবিষ্যতে আর হবে না তবে ওকে আশ্রমে থাকতে দেওয়া হবে। নইলে ডে-স্কলার হিসেবেই ইলেভেনের পাঠ পুরো করে বোর্ডে বসতে হবে।
    সাতদিনের নিজগৃহবাস কাটিয়ে সমীরণদা ফিরে এল। ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা। কী ব্যাপার কেউ জানে না।
    বিকেলে প্রিয়ব্রত খবরটা নিয়ে এল।
    ---- কী হয়েছে জানিস? সমীরণদা গেছল বারাসত থেকে যাদবপুর। ওই ঝিল রোড না কী যেন, সেই ভাস্করের বাড়িতে। তারপর কী হল শোন। ভর দুপুরে চাঁদিফাটা রোদে সমীরণদা খুঁজেপেতে গিয়ে ঠিক ওদের দোতলা বাড়ির দরজায় কড়া নেড়েছে।
    ওরা বোধহয় দোতলার জানলা দিয়ে আগেই দেখে ফেলেছিল। দরজা খুলল ভাস্করের বাবা। কী চাই?
    -- ভাস্কর আছে? এটা মানে ওর বাড়ি তো?
    --- আর কার বাড়ি হবে, তোর শ্বশুরের। শালা! আমার ছেলের সব্বোনাশ করেও আশ মেটেনি? বাড়ি অব্দি ধাওয়া করেছিস?
    --- এসব কী বলছেন মেসোমশায়? আমি তো কিছুই মানে?
    -- শুয়োরের বাচ্চা! কে তোর মেসোমশাই? মেরে হাড় ভেঙ্গে দেব।
    --- প্লীজ, আমার কথাটা শুনুন।
    --- কোন কিছু শোনার দরকার নেই। ছেলে আমাকে সব বলেছে। তোমরা সব এক একটি ছেলেধরা। ছি ! ছি! ছি!
    সমীরণদা তখন ডেস্পারেট, বুঝলি! বলল-- মেসোমশায়, একবার ভাস্করকে ডাকুন। ও আমার সামনে এসে বলুক। দেখবেন আমি ওর কোন ক্ষতি করি নি।
    --- ও আর তোমার সামনে আসবে না। চুপচাপ এখান থেকে যাও। এখন যদি আমি একটা ডাক দিই --গোটা পাড়া এসে তোমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
    -- একগ্লাস জল দেবেন?
    ভদ্রলোক ঘর থেকে জল আনিয়ে দিলেন। খেয়ে মুখ মুছে পেছন ফেরার সময় ওর চোখ গেল দোতলার জানলায়,-- ভাস্কর দাঁড়িয়ে আপেল খাচ্ছে আর হাসছে।
  • ranjan roy | 132.162.175.132 | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ২৩:০৫708299
  • ৮)
    নতুন নিয়ম হয়েছে। আমাদের হেডমাস্টার মশায় নিজের ছোটছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দোতলার দুটো ঘরে থাকবেন। ইউ -শেপের দোতলায় প্রায় পনেরটা ঘর। ওনার জন্যে ঘর ছেড়ে দেওয়া হল প্রথম সমকোণের ওপর ঘরটায়।
    আরে, ওর পাশ দিয়েই তো আমাদের ছোট ছাদে যাওয়ার জায়গা। তারমানে?
    --মানে খুব স্পষ্ট ; কোন শালা নতুন মহারাজদের কাছে গিয়ে দালালি করেছে যে ক্লাস টেনের ছেলেগুলো ওই ছোটছাদটিতে সিগ্রেট খাওয়া আর আড্ডা মারার ঠেক বানিয়েছে। আর গরমের দিনে ওরা খোলা ছাদে বিছানা করে ঘুমোয়!
    -- বেশ করি ঘুমোই, কার বাবার কি! একটা ঘরেও পাখার বন্দোবস্ত নেই, তো? গরমে সেদ্ধ হব? তারচেয়ে খোলা হাওয়ায় ছাদে শুলে কার কি ক্ষেতি? বরং ভোরের দিকে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙে।
    --- বুঝলি না! এসব ওই ক্লাস এইটের বাঁদরগুলোর কাজ। ওরা সেবারের ঘটনার জন্যে আমাদের উপর খার পুষে রেখেছে।
    গুরু মুখ খোলে।
    -- ওদের পরে দেখে নেব। কিন্তু সবসময় নেগেটিভ ভাবিস কেন? খালি চুগলি আর ষড়যন্ত্রের ভূত! কারও আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। আসলে হেডস্যারের অসুখ সেরে গেছে, তাই।
    বিপ্লব আমাদের মত লোয়ার ক্লাসে হোস্টেলে আসেনি। ও জানে না। তাই বলে দিই।
    -- স্যারের হয়েছিল হাইড্রোসিল। অমন দোর্দন্ডপ্রতাপ লোক। শুধু ছাত্ররা নয়, কিছু স্যারও ভয় পেতেন। উনি কখনও হাসতেন না। 'বেরিয়ে যা শুয়ার'--ছিল ওনার বাঁধা বুলি। একবার ভুল করে একজন নতুন স্যারকে বলে ফেলেছিলেন, তিনি পরের দিন রিজাইন করেন।
    --উঃ প্রেসি কর। উনি দোতলায় কেন?
    -- আরে বলতে তো দে! তা অমন রাগী লোক হাইড্রোসিলে কাবু হলেন। সেইজন্যে ওঁকে একতলায় বাথরুমের পাশে একটি ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। তখন পায়খানায় জলের কল ছিল না। বাইরের চৌবাচ্চার থেকে ছোট একটা বালতি করে জল নিয়ে ঢুকতে হত।
    কিন্তু ওই ফোলা ধুতি নিয়ে পা ফাঁক করে হাঁটতে গিয়ে জল তোলা আর হয়ে উঠত না। তখন যে কোন বাচ্চাকে দেখলেই বলতেন --বৎস, আমায় এক বালতি জল এনে দাও তো!
    --- তোরা দিয়েছিস?
    '--সবাই । যে যখন সামনে পড়েছে আর কি।
    --তুই?
    -- একবার। ওই সামনে পড়ে গেছ্লাম। কিন্তু সেদিন ওই রাগী ভদ্রলোক অনুনয়ের গলায় বলেছিলেন--বাবা, একটু জল দিয়ে যাবে বাবা? বড় কষ্ট পাচ্ছি গো!
    সেই হেডস্যার এখন দোতলায় মানে উনি সেরে গেছেন। আর কাউকে জল টেনে দিতে হবে না।
    হঠাৎ গুরু চমকে ওঠে। --অ্যাই পোদো! শীগগির যা! নীচের বারান্দায় দেয়ালের গায়ে যে ম্যাগাজিনটা ঝুলছে ওটা নামিয়ে নিয়ে আয়।
    --কেন গুরু?
    --কেন কী রে ভোঁদাই? ওতে হেডস্যার নাম দিয়ে একটা কবিতা আছে না? স্যার দেখলে--!
    -- আরে গুরু! ভাল মনে করিয়েছ, ওটা পোদোর জিদেই ছাপা হয়েছিল। ওই খুলে আনুক।
    ছাপার কথাটা বাড়াবাড়ি।
    আসলে গত কয়েকমাস ধরে আমরা একটা হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের করেছি--- নবীনসাথী। আমি সম্পাদক, কিন্তু তিনজনের কমিটি আছে। একেকবার একেক রঙের আর্ট পেপারে ক্লাস নাইনের সুব্রত্র সুন্দর হাতের লেখায় ভরে দেওয়া হয়।
    এবারে ক্লাস ফোরে একটি বাচ্ছা ফ্রি-তে ভর্তি হয়েছে। ওর মা এই পাড়ায় কাজের মাসি। বাবা নেই। চক্চকে চোখের বাচ্চাটা এবার ম্যাগাজিনের জন্যে ।
    কবিতাটি পড়ে কমিটি খুব হাসল, কিন্তু ছাপতে চাইল না। আমি তখন সম্পাদকের ভেটো পাওয়ার প্রয়োগ করে ছাপালাম। তর্ক দিয়েছিলাম-- ছন্দ ও অন্ত্যমিল নিখুঁত, সেন্স অফ হিউমার আর ছোট্ট বাচ্চাকে উৎসাহ দেওয়া।
    তাই বড় বড় অক্ষরে বেরোল এবং ছেলেরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে পড়তে লাগলঃ
    হেডশ্বর
    =========
    আমাদের ইস্কুল দুই তিন তলা,
    টিফিনেতে খেতে দেয় পাউঁরুটি কলা।
    আমাদের হেডশ্বর এমে বিয়ে পাস,
    পড়া না পারলে মারে ঠাস ঠাস।।
  • ranjan roy | 132.162.175.132 | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ২৩:১৮708300
  • না, ওই দেয়ালপত্রিকা ঠিক সময়েই নামিয়ে আনা হয়েছিল। তারপর এক জরুরী মিটিং এ সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে সম্পাদকের পদ থেকে নামিয়ে শুধু কমিটি মেম্বার করে দেওয়া হল। নতুন সম্পাদক হবে প্রশান্ত।
    কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা গেল। রাত্তিরে ওঁর ঘর ডিঙিয়ে ছাদে যাওয়া সম্ভব নয়। সিগ্রেট খাওয়া তো দূর অস্ত্‌।

    উনি বর্ধমানের লোক। প্রতি শনিবার বা অন্ততঃ একবার বাদ দিয়ে পরের বার ট্রেন ধরে বাড়ি যান। সোমবারে দুপুরে ফিরে আসেন। ফলে আমাদের সেই দুদিন ১৫ ই আগস্ট আর ২৬ শে জানুয়ারী। ঘটা করেই পালন করা হয়।
    কিন্তু একদিন খবর ভুল ছিল। উনি বর্ধমান জান নি। শরীরটা একটু খারাপ হওয়ায় ঘরে শুয়ে ছিলেন। শুধু ওঁর ছেলে গেছল।
    সন্ধ্যের মুখে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার জুড়লেন।
    -- ও মহারাজ ! মহারাজ! ও অনিল মহারাজ, এদিকে আসুন।
    অনিলদা অবাক। ব্যস্তসমস্ত হয়ে একতলার থেকে দোতলায় এলেন।
    --কী হয়েছে মাস্টারমশাই?
    --আর বলবেন না। ক্লাস টেনের রমেনকে দেখি এমনি এমনি করে টেবিল বাজিয়ে বাজিয়ে গাইছে-- আমার যৌবন জ্বালা জুড়াইল রে, আমার যৌবন জ্বালা জুড়াইল রে!
    এই বয়সেই যদি ওদের যৌবনজ্বালা জুড়িয়ে থাকে তা'লে পরে কী হবে গো!

    সেদিন আমরা ১৫ই আগস্টের বদলে ১৪ই আগস্ট দেখলাম।
  • Du | 182.58.105.216 | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০৭708301
  • কবিতটা বেশ তো ঃ))
  • ranjan roy | 192.69.111.196 | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১৬:৪২708302
  • কিন্তু হেডস্যারের সঙ্গে ১৫ই অগাস্ট জুড়ে গেছে যে!
    কোথায়? আমার স্মৃতিতে।
    আমি তখনো প্রদ্যুম্ন থেকে পোদো হই নি। কচুরিপানায় ঢাকা পুকুরের ঘাটলায় শামুকপচা জলে থালাবাটি ধোয়া, কাপড় কাচা, আর স্নান করে করে হাত- পা খোস-পাঁচড়ায় ভরে যায় নি। ক্লাস সিক্সে নতুন ভর্তি হওয়া রোগা প্যাংলা ভীতু ছেলেটি তখনও মোটা ভাতের সঙ্গে আধসেদ্ধ ছরছরে ডাল, কারি পাউডারের ঝোল আর জলখাবারে ডালডা-চিনি-মুড়ি খেতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি।
    এমন সময় ঘনঘোর বর্ষার মধ্যে এসে গেল স্বাধীনতা দিবস। আশ্রমের আবহাওয়া বদলে গেল। চারদিকে সাজো সাজো রব।
    ১৪ অগাস্টের রাত্তির থেকে সবাইকে নিজেদের বিল্ডিং ছেড়ে ক্যাম্পে থাকতে হবে। সবাই নিজে নিজের বিছানা , দুদিনের মত জামাকাপড়, ডায়েরি, পেন সাবান, ব্রাশ ইতাদি নিয়ে চলে যাবে। ১৫ তারিখ ক্যাম্প ফায়ারের পর প্রাইজ দেওয়া হলে সবাই সে'রাত্তির ক্যাম্পে ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে আবার পুরনো জীবনে ফিরে আসবে।
    প্রদ্যুম্ন দেখল এলাহি ব্যাপার। সমস্ত ছেলেগুলোকে আটটি গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ১৩ অগাস্ট ডাইনিং হলে তাদের নাম ও গ্রুপ ক্যাপ্টেনের নাম ঘোষণা করা হল। জানা গেল যে হাইস্কুল বিল্ডিং খালি করে ধুয়ে মুছে সেটাকে দু'দিনের জন্যে ক্যাম্প ঘোষণা করা হয়েছে। সামনের আঙিনা ঘিরে গেছে অস্থায়ী পোল ও তারের বেড়ায়। একটা গেট। সেই গেটে কাঠের রাইফেল নিয়ে পাহারা দেবে একজোড়া সেন্ট্রি। দু-দুঘন্টা মার্চ করে করে, বাই টার্ন, সব গ্রুপ থেকে। আর কাউকে ক্যাম্পে ঢুকতে হলে গেটপাস দেখাতে হবে--সেগুলো ক্যাপ্টেনরা জারি করবেন।
    গেটপাস দেখাতে না পারলে অনিল মহারাজ , হেডস্যার কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হবে না।
    আগের বছর একটি গ্রুপের জোড়া সেন্ট্রি, ক্লাস এইটের দুই ছোকরা, অনিল মহারাজকে আটকে দিয়েছিল। উনি রেগে গিয়ে রামকানাইদাকে কম্প্লেন করায় জবাব পেলেন-- ওরা ওদের ডিউটি ঠিকমত করেছে।আর সেই গ্রুপটা এই পয়েন্টে বেশি নম্বর পেল।
    নম্বর অনেক কিছুতে, সেন্ট্রি দেওয়া , ঘর পরিষ্কার, কীর্তালি(কোন ভাষা?) --মানে আশ্রমের মাঠঘাট, পুকুর, নালা-নর্দমা পরিষ্কার করা, মার্চপাস্ট, ডাইরি লেখা, স্বাধীনতা দিবসের উপর রচনা, কবিতা লেখা, পাঁচ মিনিট এলোকুশন (মানে কী?), সন্ধ্যেয় ক্যাম্প ফায়ারের গান, নাটক ও ইম্প্রোভাইজড কোন স্কিট, মিমিক্রি --সবেতেই।
    আর সকালে জলখাবারে মগে করে গরম চা দেওয়া হবে, আর্মি স্টাইলে। বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজে প্রীতি-ফুটবল--স্টাফ ভার্সাস স্টুডেন্ট্স।
    সন্ধ্যেয় অমূল্যদার ম্যাজিক লন্ঠন, অথবা কথা বলা পুতুলের কেরদানি!

    তা সেই আমার জীবনের প্রথম ক্যাম্পে হেডস্যার আমাদের স্বাধীনতা দিবসের মর্ম বোঝাতে গিয়ে বললেন-- মনে রেখ, আজ থেকে মাত্র ১৪ বছর আগে এই শহরে ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত। তোমাদের মধ্যে যাদের বয়েস ১৪ বছরের কম তারা নিজেদের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও; পরাধীনতার অপমান তোমাদের ভুগতে হয় নি।

    এগার বছরের প্রদ্যুম্ন্ব ভাবল -- ইস্‌, মাত্তর ১৪ বছর আগে এখানে বৃটিশরা ছিল? রাইটার্স বিল্ডিংয়ের মাথায় ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত? কী অন্যায় ! কী অন্যায়! ভগবানের একচোখোমি!
    ওকে যদি ভগবান আরও দুই দশক আগে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিত তো ও নিশ্চয়ই কিছু একটা করে ফেলত। সূর্য সেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ না হোক অন্ততঃ ১৪ বছরের ক্ষুদিরাম। কিন্তু কোথাও একটা হিসেবে ভুল হচ্ছে না?
    পাটিগণিতে কাঁচা শ্রীমান প্রদ্যুম্ন কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারল না।
  • Sayantani | 113.215.54.51 | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ২০:০৯708303
  • কিরতালি ব্রতচারী থেকে এসেছে। ওখানে ষোলো আলি আছে যা ব্রতচারীদের পালনীয়।
  • ranjan roy | 192.69.111.196 | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ২৩:০৭708305
  • @ সায়ন্তনী,
    কী আশ্চর্য! আমি আশ্রমে একবছর ব্রতচারী করেছি। জ-সো-বা, জ-সো-ভা!
    বা গান ও নাচ!
    হল মাটিতে চাঁদের উদয় কে দেখবি আয়
    বা
    চল কোদাল চালাই, ভুলে মানের বালাই; আবার 'আমরা বাঙালী সবাই বাঙলা মার সন্তান' ইত্যাদি।
    কিন্তু কিরতালি খেয়াল করিনি, লজ্জার কথা।
    আপনাকে ধন্যবাদ!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন