এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নানা রঙের দিনগুলি - ৩

    মানব মীরা দে লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৭ জুন ২০২৪ | ১২৩ বার পঠিত
  • রস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে শ্রীকান্ত ও তার বন্ধুদের প্রথম আন্দোলন শুরু হয় — যা ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতি পদক্ষেপে করতে হচ্ছে। ডাকু বলত, "জীবনটাই একটা আন্দোলন – সংগ্রাম।"

    ডাকু হল শ্রীকান্তর এক জিগরি দোস্ত। শ্রীকান্তকে বাবা প্রথম ডাকুই খাইয়েছিল। ডাকুই শ্রীকান্তকে প্রথম বারে নিয়ে গেছিল। আরো অনেক কিছু প্রথমের অভিজ্ঞতা ডাকুর সহচার্যে শ্রীকান্ত পেয়েছিল। ডাকুর কথায় পরে আসা যাবে। দেখেছেন আবার কেমন ভুলভাল বিষয়ান্তরে চলে যাচ্ছি! চলুন ফিরে আসি সরস্বতী পুজোর আন্দোলনে। ঘটনাটা ওই ডিসেম্বর নাগাদ শুরু হয়। যখন দিনের শেষ পিরিয়ডে ইতিহাস ক্লাস চলাকালীন পড়ানোর শেষে আবদ্দুল্লা-স্যার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন, "এবারের পুজো তো ইলেভেনের দাদারা করবে—তোরা কেউ কেউ ওদের সাহায্য করবি।"
     
    ২০২৩-এর ক্রিকেট বিশ্বকাপের বা ২০১৪-র ফুটবল বিশ্বকাপের বা আরো ভাল করে সেই সময়টা বোঝাতে চাইলে ১৯৯০-এর ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালের কথা মনে পরে? — কি পরিমাণ মন ভেঙে ছিল মনে আছে? — ১৯৯০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানী (তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানী)-র কাছে মারাদোনার আর্জেন্টিনার পরাজয়ে শ্রীকান্তরা যে পরিমাণ শোকাহত হয়ে স্তব্ধ হয়ে বাকরূদ্ধ হয়েছিল সেদিন বোধহয় আরেকবার হল। স্যারের মন্তব্যের পর ক্ষণিকের বিহ্বলতা কাটিয়ে নাইন বি সেকশানের ফাস্ট বয় স্বর্ণেন্দুই বলে ওঠে, "স্যার, এটা কি করে হয়? এবার তো আমাদের করার কথা!"
     
    স্যার বলেন, "আরে তোরাও করবি, ইলেভেনে উঠে করবি। এ বছর তো ওদের শেষ বছর না—পরের বছর তো ওদের এইচ.এস।"

    শ্রীকান্তর রোল নম্বর ছিল উনত্রিশ, সে কোন কালেই তত ভালো ছিল না পড়াশুনায় আবার আমার মত ফেলুমাস্টারও ছিল না। ​ইংলিশে যাকে বলে 'সো' – 'সো' ছিল। কিন্তু অন্যান্য কাজ যেমন কোন অনুষ্ঠানের আয়োজনে, লেখালেখিতে বা ফুটবল-ক্রিকেট খেলার আয়োজনে (যদিও সে খুব বাজে খেলতে) সে সবার আগে থাকত, এক কথায় সে ভালো সংগঠক ছিল। তবে তার এই গুণ একার ছিল না ক্লাসে, আরো অনেকেরই ছিল। শ্রীকান্ত বলে ওঠে, "স্যার তা'হলে তো খুব অন্যায় হবে।"
     
    স্যার বলেন, "এখানে আবার অন্যায়ের কি পেলি?"
     
    শ্রীকান্ত বলে, "স্যার, ইলেভেন-টুয়েলভে আমাদের স্কুলে আর্টস আর সায়েন্সই আছে , কমার্স নেই। ফলে আমাদের ব্যাচ থেকে যারা কমার্স নেবে তারা তো সব অন্য স্কুলে চলে যাবে—মানে তারা কোনদিনই এই স্কুলের সরস্বতী পুজোয় সে ভাবে থাকতে পারবে না, তখন যে স্কুলে যাবে সেই স্কুলের পুজোতে ব্যস্ত থাকবে। এত বছর যে স্কুলে কাটালো সেই স্কুলের পুজোটাই করত পারবে না!  এটা তো সারা জীবনের একটা কষ্ট হয়ে থাকবে!– তা'হলে এটা কি তাদের প্রতি অন্যায়-অবিচার নয়?"
     
    কথাটা বলতে বলতে 'অন্যায়-অবিচার' বলেই  শ্রীকান্তর 'অন্যায়-অবিচার' নামে একটা সিনেমার কথা মনে পড়ে যায়, তাই একটু ফিক্ করে হেসে ফেলেও তারপর কোন ক্রমে জিভ কামড়ে হাসির প্লাবন আটকায়। স্যার বলেন,"খারাপ কিছু বলিস্ নি। দেখ্ কাঞ্চন-স্যার আর অমল-স্যার এবারের পুজোর দ্বায়িত্বে আছেন, তোরা কথা বলে দেখা ওনাদের সাথে। কি বলেন ওনারা।"
     
    ক্লাস শেষে ঘন্টা পড়ে যাওয়া ছুটি হয়ে গেল। সেদিনের মতো ব্যাপারটা ওখানেই ধামাচাপা পড়ে গেল। দু'দিন পরে আগুনটা আবার উসকালো সূর্য।
     
    টিফিনের পর ক্লাস শুরু হবার জন্য সবাই স্যারের জন্য অপেক্ষা করছে। নিয়মানুসারে এ হপ্তায়ের মনিটার সূর্য। সূর্য পড়াশুনাতে তেমন ভালো না'হলেও স্কুলের এক পপুলার ছাত্র, খুব ভালো গান করে!—স্কুল শুরু আগে প্রেয়ার বা সমবেত প্রার্থনা সঙ্গীতে সূর্যই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানে লিড করে আর সাথে সহযোগী হিসেবে থাকে অতনু। সংগঠক হিসেবেও সূর্য বেশ প্রভাবশালী। সেদিন হঠাৎ করে মনিটার সূর্য ব্ল্যাক বোর্ডে এসে বড় বড় করে লেখে, "ভাইসব"—ক্লাসের সবাই নড়েচড়ে বসে! কারণ 'ভাইসব' হল সূর্যর জ্বালাময়ী বক্তৃতার সম্বোধন পর্ব! সূর্য বলে, " ভাইসব, তাহলে এবারের পুজো আমাদের ইলেভেনের দাদারাই করবে–তাই তো?—আর আমরা বসে বসে আঙুল চুষবো?"

    সুজন বলে ওঠে, "আর কি বা করব আমরা? কে শুনবে আমাদের কথা? এটাই তো নিয়ম!–তাছাড়া–"

    সুজনের কথা মাঝ পথে থামিয়ে সূর্য উচ্চস্বরে বলে ওঠে, "ঝ্যাঁটা মারি অমন নিয়মের মুখে! যত্তসব হাড়হাভাতের দল!"

    এক্ষেত্রে বলে রাখা প্রয়োজন সূর্য আর অতুনর মধ্যে প্রবল না'হলেও কিঞ্চিৎ নারীসুলভ হাবভাব বিদ্যমান!—যার কারণ অবশ্যই হরমোনাল এবং এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। এহেন কোমল হৃদয়ের সূর্য ক্রোধে উত্তপ্ত হলে নিজের নামটিকে সার্থক করে তোলে। সূর্য বলে চলে, "মেনিমুখোর দল, নিজের অধিকারের কথা নিজেরা না বললে আর কে বলবে?!—স্বর্গ থেকে মরা ঠাকুরদা তো আর নেমে এসে বলবে না!"

    অশেষ বলে, "আমরা বলব কি ভাবে?"

    স্বর্ণেন্দুর পরামর্শ, "আমরা সকলে মিলে হেডুর কাছে একটা আবেদনপত্র জমা দি।"

    শ্রীকান্ত বলে, "কিন্তু শুধু আবেদনে কি কাজ হবে?"

    শমিক বলে, "নাহ্ হবে না। আন্দোলন করতে হবে।"

    অনির্বানের প্রশ্ন, "কি ভাবে?"

    সূর্যর উত্তর, "যতক্ষণ না আমরা উচিত ন্যায় পাবো ততক্ষণ আমরা কেউ প্রেয়ারে গান গাইব না।"

    ক্লাসের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ অলকের আবেদন, "ততদিন আমর কেউ পড়া দেব না, বাড়ির কাজ করব না।"

    ক্লাসের সেকেন্ড বয় সৌমিত্র বলে, "শাস্তি দিলে কি হবে?"

    সূর্যর কঠিন কণ্ঠের বক্তব্য, "দিলে দেবেন স্যারেরা। কিন্তু আমাদের প্রবলেম না মেটা পর্যন্ত কেউ পড়া দেব না।"

    শ্রীকান্ত বলে, "তাতে যদি সবাইকে ক্লাসের বাইরে নীল ডাউন হতে হয়, তাই হবো আমরা। 'এ' আর 'সি' সেকশানকেও জানাতে হবে।"

    স্বর্ণেন্দু বলে, "ওদের আমি যা বলার বলে দেব।"

    সূর্য বলে, "ওদের কয়েক জনের সাথে আমার কথা হয়েছে, ওরা বলেছে ওরা সবাই সাথে আছে। আমরা যা করব ওরাও তাই করবে। আফটার অল্ এটা আমাদের হোল ক্লাস নাইনের প্রেস্টিজের ব্যাপার।"

    স্বর্ণেন্দুকেই হেড স্যারকে আবেদনপত্র লেখার দায়িত্ব দেওয়া হল। ক্লাস নাইনের 'এ'-সেকশান, 'বি'-সেকশান আর 'সি'-সেকশানের প্রায় সবাই মিলেই সেই আবেদনেপত্রে সই করে হেড স্যারের কাছে জমা দিল। কিছু ভিতু ছাত্র সই করতে চাইলে না। সূর্য তাদের বলল, "একবার আমরা জিতে যাই, তারপর আসিস্ পুজোর দিন খেতে–কি করি দেখ্।"

    আবেদনপত্র তো জমা পড়ল, কিন্তু কারুর কোন হেলদোল নজরে পড়ল না! উল্টে  আবেদনপত্র জমা দেওয়ার ঠিক দু'দিন পরে স্কুলে ক্লাস ইলেভেনের ছেলেদের নিয়ে পুজো সংক্রান্ত একটা মিটিংও হয়ে গেল। ফলতঃ আন্দোলনের প্রকৃতি এবার পরিবর্তিত হল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন