এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নানা রঙের দিনগুলি — ৭

    মানব মীরা দে লেখকের গ্রাহক হোন
    ০১ জুলাই ২০২৪ | ৮৮ বার পঠিত
  • বাড়িতে ফিরে শ্রীকান্তর কিছুই ভাল লাগছিল না। এসে  হাত-মুখ ধুয়ে খেঁজুরের গুড় দিয়ে দুটো রুটি খেয়ে পড়তে বসে গেল। পড়াতেও মন বসছিল না। তবু পড়তে হল কারণ জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সেকেন্ড টার্মের তিনটে পরীক্ষা আছে। সন্ধেবেলা শ্রীকান্তর প্রিয় খাবার মায়ের হাতে তৈরী তেলেভাজা চিঁড়ে ও বাদাম ভাজাও স্বাদহারা মনে হল! নন্টে-ফন্টে-এর বই দেখতে দেখতে খেল সে কিন্তু সেই আমেজটা ঠিক পেল না। এই এক সমস্যা শ্রীকান্তর—ঝগড়া হলে, মারপিট হলে বা কথাকাটাকাটি হলে ওর মনটা বড় নির্জীব হয়ে ওঠে। এ রকম কোন ঘটনার পরবর্তী তিন-চারদিন খাওয়া-দাওয়া, পড়াশুনা , খেলাধূলা সব কিছুর থেকে উদাসীন হয়ে যায়। এই সময় শুধু সুযোগ পেলেই সে ঘুমিয়ে পড়তে চায়। মস্তিষ্কের বিশ্রাম যেন তার আঘাতপ্রাপ্ত হৃদয়কে ও শরীরের শীথিল পেশীকে পুনরায় সংযোজিত করে।

    তবে সে আজ যত না বেশি দুঃখিত তার থেকেও বেশি বিভ্রান্ত। মিষ্টভাষী ভালো বন্ধুরূপে বন্ধুমহলে সে বিপুল না'হলেও ভালোই জনপ্রিয়। কিন্তু আজকাল কেমন যেন একটু ঠোঁটকাটাও হয়ে উঠছে সে—সেটা অন্য কেউ বুঝতে না পারলেও সে নিজে কিন্তু ব্যাপারটা খুব ভাল করেই অনুধাবন করে! তাই সে ভাবছে আজ হেড স্যারকে ওমন ভাবে তার বলাটা আদৌ উচিত হয়েছে কিনা?!—ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বক্তব্য, "মামা, তুমি ফাটিয়ে দিয়েছ!"

    এখানে বলে রাখা প্রয়োজন শ্রীকান্তকে বন্ধুরা সবাই আদর করে 'মামা' বলে ডাকে। এই 'মামা' নামের পেছনেও একটা ইতিহাস আছে। সেটাও না হয় অন্য একদিন বলব—না থাক আজই বলেনি। অনির্বান আর শ্রীকান্তর ভাল বন্ধুত্ব থাকায়, তারা একে অপরকে দাদা আর ভাই বলে সম্বোধন করত। অনির্বান শ্রীকান্তর থেকে দশ মাসের বড় ছিল, তাই অনির্বান দাদা আর শ্রীকান্ত ভাই। এবার এই 'মামা' সম্ভাষণেরও দুটো ইতিহাস আছে—ইতিহাস নম্বর এক, ক্লাস ফাইভে শ্রীকান্ত গল্পের পিরিয়ডে খুব ভালো গল্প শোনাত বলে অজয়-স্যার একদিন শ্রীকান্তকে মজা করে বলেন, "মামাবাবু, একটা গল্প শোনান দেখি।"

    সেই থেকে শ্রীকান্তকে সবাই 'মামা' বলতে শুরু করে।

    ইতিহাস নম্বর দুই, অন্য একটি মতানুসারে শ্রীকান্ত যখন ক্লাস ফাইভে পড়ত তখন ক্লাস সেভেনের সিনিয়র দাদা অলক (যে এখন শ্রীকান্তর ক্লাসমেট) শ্রীকান্ত আর অনির্বানের টিফিন এক রকম জোর করে খেয়ে নিত। যেহেতু শ্রীকান্ত আর অনির্বান একে অপরকে দাদা আর ভাই বলতে, তাই অলক অনির্বানকে 'বড়মামা' আর শ্রীকান্তকে'ছোটমামা' বলে ডাকতে শুরু করে। সেই দেখে দেখে অন্য বন্ধুরাও তাদের ওই নামেই ডাকতে শুরু করে। কালক্রমে অনির্বানের 'বড়মামা' নামটা জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করলেও শ্রীকান্তর 'ছোটমামা' নামটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে 'ছোটমামা' ডাকটা 'শুধু 'মামা'-তে রূপান্তরিত হয়।

    আজ আর বেশি দেরি করে না শ্রীকান্ত কোনক্রমে রুটি আর  আলুভাজা খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। মা একবার খালি ফোঁড়ন কাটেন, "বাবাঃ !—আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছে কে জানে?! কি ভাগ্যি আমার বেশি বলতে হল না, ঝট্ করে খেয়েই বাবু শুয়ে পড়লেন।"

    সাধারণত সাতটার আগে শ্রীকান্তর ঘুম ভাঙে না। আজ যখন চোখ খুলল তখনও ঘড়ির ছোট কাঁটা ছয়কে ছোঁয়ে নি। ঘুম থেকে উঠেই শ্রীকান্তর মনে হল শরীরটা খুব হালকা কিন্তু মাথাটা বেশ ভারী। একবার মনে হল আজ আর স্কুল যাবে না সে। আবার পরক্ষণেই মনে হল, মা জিজ্ঞাসা করবে, "কেন যাবি না স্কুল!?"—ভাবতে পারে শরীর খারাপ হয়েছে বা স্যারের কাছে বকা খেয়েছে বা পড়া দেওয়ার ভয়ে স্কুল যাচ্ছে না। আবার ভাবল, এখনও পর্যন্ত এই শিক্ষাবর্ষে ওর অনুপস্থিতির সংখ্যা শূন্য, তাই অকারণে স্কুল কামাই করার কোন মানেই হয় না। এত কিছু ভেবে শ্রীকান্ত বিছানার মায়া কাটিয়ে উঠে পড়ে। এমনিতেই বাঙালীর শীতকালীন বিছানার মায়া বড় বেশি, বিশেষ করে ভোরবেলা। কোনক্রমে নাগ স্যারের পড়াটা মুখস্থ করে আর অলোক-স্যারের দেওয়া বাড়ির কাজের অংকগুলো করে সে স্নানে চলে যায়।

    একান্নবর্তী পরিবারের হাঁড়ি আলাদা হলেও বাড়ি আলাদা না হবার জন্য বাথরুমটা একই ছিল। এখানে কিছুটা বলা উচিত শ্রীকান্তদের বাড়ির রূপরেখা।—প্রায় চার কাটা জমির ওপর বাড়িটা তৈরি হয়েছিল, সালটা সম্ভবত উনিশ ষাট। থামযুক্ত দোতলা বাড়িটাকে আকাশ থেকে দেখলে ইংরাজীর 'এল'-এর মত লাগাতে পারে। ওপরে বারো বাই বারোর একটা ও বারো বাই আঠারোর দুটো ঘর। তলায় বারো বাই বারোর দুটো ঘর, সাথে ছয় বাই দশের পুজোর ঘর তার পাশে দশ বাই পনেরোর কয়লার বড় দুটো উনুনযুক্ত রান্নাঘর। আর সমস্ত বাড়ির থেকে বিচ্ছিন্ন সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করেই একটু এগিয়ে গেলেই ছিল বাথরুম ও পায়খানার (শব্দটা পায়খানাই ব্যবহার করলাম কারণ সে সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটাই ব্যবহার করা হত) জায়গা। আরো মজার ব্যাপার স্নানের বাথরুমটা সমতলে হলেও পাযখানা (বর্তমান প্রজন্মরা পড়ুন পটি) করতে এগারোটা সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ে উঠতে হত!—কারণ শ্রীকান্তদের বাড়িতে প্রাথমিক লগ্নে খাটা পায়খানা ছিল। যদিও শ্রীকান্ত সেটাদেখেনি। খাটা পায়খানা সম্পর্কে নবীন প্রজন্মরা না জানলেও শ্রীকান্তদের প্রজন্মরা অন্ততঃ জানত। সে এক নির্মম এবং অমানবিক পদ্ধতি—পায়খানার মাধ্যমে মল একটা বড় মালশায় জমা হত। আর নির্দিষ্ট দিন অন্তর অন্তর সাফাই কর্মীরা এক টিনের ডাব্বা করে মালশা থেকে সেই মল তুলে নিয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে আসত! যে কারণে আগেকার দিনে শৌচাগার বাড়ির মূল বসতির থেকে বাইরে ও নিচের তলাতেই থাকত। এটাচ্ বাথরুমের অত চল ছিল না। অপেক্ষাকৃত ধনবান ব্যক্তিরা দোতলায় শৌচাগার বানালেও সেই শৌচাগার বানতেন বাড়ির পেছন দিক সংলগ্ন করে কিন্তু কোন ঘরের সাথে যুক্ত করে নয়—বারান্দার সাথে যুক্ত থাকত। আর সেই শৌচাগারের মল পরিস্কারের জন্য বাড়ির পেছনে  একটা লোহার গোল করে বাঁকনো সিঁড়ি থাকত। এই সিঁড়ি দিয়েই সাফাই কর্মীরা বাড়ির মূল অংশকে ষ্পর্শ না করে যে কোন তলায় উঠে মল পরিস্কার করে নিয়ে যেতেন। তাই এই সিঁড়িকে বলা হত 'মেথরের সিঁড়ি'। শৌচাগারের পদ্ধতি পরিবর্তিত হলেও এখনও বহু প্রাচীন বাড়িতে এ ধরনের অব্যবহৃত জং ধরা লোহার গোল 'মেথরের সিঁড়ি' দেখা যায়।—এটা গোল স্প্রিং-এর মত করা হত যাতে টিনের মহলর  আধার মাথায় নিয়ে সহজেই নেমে আসা যায়। যাই হোক পরবর্তীতে শ্রীকান্তদের খাটা পায়খানা অন্তর্নিহিত পরিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক চৌবাচ্চাযুক্ত সেনিটেরি পায়খানায় রূপান্তরিত হলেও বহিরাঙ্গের কৌলিন্য এখনও রেখে দিয়েছে।
     
    পাহাড়ে চড়ে প্রাতঃকৃত্য শেষ করে, ঘি দিয়ে আলুভাতে ভাত খেয়ে বাস ধরতে বেরিয়ে পড়ে শ্রীকান্ত। সোজা হেঁটে গদাধর সিনেমাহল বাস স্টপ্, সেখান থেকে ৮৫ নম্বর বাসে আট আনা ভাড়া দিয়ে সোজা স্কুল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • যোষিতা | ০১ জুলাই ২০২৪ ১৭:৪৯534016
  • পড়ছি
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন