এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ছেঁড়াকাঁথা

  • ছেঁয়াবাজীর ছলনা  - ২১

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ছেঁড়াকাঁথা | ০২ জুলাই ২০২৪ | ২৭৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • আমাদের সেই উমনো ঝুমনো ছেলেবেলায় শীত আসত রাজার মত। চারিদিকে সাজ সাজ রব পড়ে যেত দুর্গাপুজোর পর থেকেই। লক্ষ্মীপুজোর ভোগ রান্নার সময় একপ্রস্থ আলোচনা হত শীতের আগমন কিম্বা অনুপস্থিতির কারণে ফুলকপির স্বাদের তারতম্য নিয়ে। শীতের কপির স্বাদ যে না-শীতের কপির থেকে একেবারে আলাদা সে নিয়ে কারো কোন সন্দেহ ছিল না। ইস্কুলের পুজোর ছুটি খোলার আগেই বাগানে কোদাল পড়ে যেত। আশ্বিনমাসে ভাল রোদ্দুর পেলে বাগানের মাটি একেবারে সাদাটে রঙ ধরে থাকে। অ্যাই বড় বড় ফাট, তাতে  সরু মোটা কালো কালো ইকড়ি মিকড়ি। ধাঁই ধপাধপ ধাঁই ধপাধপ সে মাটি কুপিয়ে,  জল দিয়ে, খুরপি দিয়ে মিহি করে নিড়িয়ে শুকনো গোবরগুঁড়ো আর বর্ষাকাল থেকে বাগানে পচানো পাতা, তরকারির খোলা, কয়েকগাছি খড় মেশানো কম্পোস্ট  সার মিশিয়ে এক সপ্তাহ ফেলে রাখা হবে। এক সপ্তাহ জমিটুকুনি রোদ্দুর খাবে, ভিজে ভাব আস্তে আস্তে শুকিয়ে কালচে মাটি ধুলোটে রঙ ধরবে,  তারপর  তাতে সরু সরু ফাট ধরবে। এ ফাট কিন্তু আশ্বিনের রোদে জ্বলা মস্ত মস্ত ফাট নয়, এ হল মিহিমত ফাট, যেন বা সুনীতিপিসী চুল শুকাতে বসে হিলিকিলি করে বিলি কেটে এলিয়ে রেখেছে কাঁচাপাকা চুলের রাশি। 

    তারপরে সরু খুরপি দিয়ে ভাল করে নিড়িয়ে খোল পচানো জল দেওয়া হবে। আহা তার কি গন্ধ!! পুবের জানলা সবসময় বন্ধ রাখতে হয় প্রায়। দুদিন, তিনদিন দুবেলা করে খোল পচানো জল দেবার পর একদিন বিকেলের রোদ পশ্চিমে ঢললে এইটুকু টুকু ফুলকপি, ওলকপি, শালগম আর বেগুনের চারা বসানো হবে। কচি কচি চারাগুলো এক্দম ঘাড় নুইয়ে নেতিয়ে পড়ে থাকে, যেন আর বাঁচবেই না। এইবারে তাতে ঝাঁঝরি করে জল দিয়ে রাতের মত রেখে দেওয়া, এরমধ্যে খবরের কাগজের টুকরো আর ঝাঁটার কাঠি দিয়ে বানানো হয়েছে ছোট ছোট টোপর। পরদিন বেলা ন'টা বাজলেই সব চারাগাছে টোপর পরানো হয়ে যাবে, নাহলে অত কচি চারা সারাদিনের রোদ্দুরে শুকিয়েই মরে যাবে যে! বিকেল চারটেয় আবার তারা টোপর খুলে নেতিয়ে শুয়ে থাকবে, আবার ঝাঁঝরিতে চান করবে। এই চলবে যতদিন না চারাগুলো একটু ডাঁটো হয়ে রোদ্দুরের সাথে খেলতে শিখে যায়। কোদাল দিয়ে মাটি কোপানো থেকে শুরু করে বাগানের সব কাজ দাদু একাই করে। মানে করত আর কি। এবারেও দাদু শুয়ে শুয়ে বিড়বিড় করে ‘মাটিডা কোপানি দরকার। অঘ্রাণের হিম না পাইলে কোফি ভালা হইব না।‘ দিদা দাঁত চেপে বলে ‘হ ম্যালা কোফি করস, অহন শুইয়া থাহো।‘ দাদু জেদ করে নিজে নিজে উঠে বসতে চায়, মাথা ঘুরে শুয়ে পড়ে।  

    ওদিকে আমাদের মর্নিং স্কুল আধঘন্টা পরে শুরু হয়। আর সক্কাল সাড়ে  ছটার মধ্যে দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পৌঁছাতে হয় না, সাতটা বাজার ৫-১০ মিনিট বাদে গেলেও দিদিমনিরা তেমন কিছু বলেন না। স্কুল ছুটি হয় কিন্তু সেই একই সময়, সাড়ে দশটা। ক্লাসের সময় এমনভাবে কমে যাওয়াটা ভারী ভাল লাগত। যেন একটা মুক্তির স্বাদ, রুটিন পড়াশোনা থেকে খানিক আলগা হওয়া। আর তখন তো নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসেই বার্ষিক পরীক্ষা হত। দিদিমনিরা যাতে খাতা দেখার জন্য বেশীদিন সময় পান, তাইজন্য  নভেম্বরেই পরীক্ষা শেষ করার চেষ্টা থাকত স্কুলগুলোর। তাছাড়া ডিসেম্বরে আবার ক্লাস টেনের টেস্ট পরীক্ষাও হবে। সে ভারী গুরুত্বপূর্ণ  ব্যপার। তাই আমরা ছোটরা ডিসেম্বরটা প্রায় পুরোই ছুটি পেতাম। কিন্তু তার আগে নভেম্বরের মাঝামাঝি কোনও এক সময় থেকে প্রতি রবিবার ইতুপুজো হত। এই পুজোটা খালি আমার বড়মামীমা করত। সে নাকি টানা সতেরো বছর করতে হয়। ইতুপুজোর জন্য প্রতি শনিবারে  টাটকা মুড়কি বানাত দিদা আর বড়মামীমা। রবিবারে তাই আসত প্রসাদ হয়ে, চালকলার সাথে মাখা হয়ে। ভাইয়ের জন্য আলাদা একটা বাটিতে করে আসত শুকনো মুড়কি, ও খুব ভালোবাসে তাই। আমিও খুব ভালোবাসতাম, কিন্তু ‘মেয়েদের আবার অত নোলা কি?' তাই আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে শুকনো মুড়কি একটা একটু হ্যাংলামত লোভের নাম হয়ে থেকে গেছে।

    নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে পাওয়া যেত কাঁচা আমলকি। মামার বাড়ীতে ৫-৭ কিলো আমলকি কিনে কুচি কুচি করে কেটে সামান্য নুন মাখিয়ে বারান্দায় খবরের কাগজ বিছিয়ে তাতে শুকানো হত। দুপুরে যখন বড়রা সবাই ঘুমোয় কিম্বা গল্পের বই পড়ে তখন কয়েকটা তুলে এনে ছাদে বা উঠোনের কোণার দিকে বসে চুষে চুষে খাওয়া আর শেষ হলে একগ্লাস জল খেয়ে নেওয়া, একেবারে রোজের রুটিন। এদিকে  বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরোবে সেই ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ। ততদিন মনের আনন্দে সারাদিন খেলা আর বই পড়া। মাঝেমধ্যে টুকটাক বেড়ানোও হত। আর বেড়ানো মানেই গরম জামা নাও রে, টুপি নাও রে, কারো অল্প ঠান্ডা লেগে থাকলে তার জন্য মাফলারও দরকার, যাতে উত্তুরে হাওয়ায় আরও বেশী ঠান্ডা না লাগে। হাতে বোনা সেসব সোয়েটার, মাফলার আবার বংশানুক্রমে বয়ে চলত, রিইউজেবল ফাংশানের মত। ছোটদির  সরষে রঙের চওড়া বর্ডার দেওয়া অফ হোয়াইট  সোয়েটারটা ছোটদির পর আমি পরেছি বছর চারেক, তারপর সেটা সেজমামার মেয়ে খুকু পরে বছর দুই, তারপর যথাক্রমে ছোটমামার দুই মেয়ে রনি, বনি এবং সবশেষে বনির মামাতো বোন মৌটুসী পরে। এদিকে গরমজামার এত রিইউজেবিলিটি থাকলে কি হবে, ওদিকে মা, মামী, জিজি, মীনামা'রা পুজোর পরে পরেই দোকানে গিয়ে নানারকম উল কেনা শুরু করে দিত।

    আর ছিল নকশা শিকার। কারো গায়ে যদি এমন কোনও সোয়েটার দেখা গেল, যার গায়ের নকশা একদম নতুন, সেটার প্যাটার্ন উলকাঁটায় তুলতে না পারা পর্যন্ত এই মা-মামী কুলের রাতের ঘুম চলে যেত প্রায়। এরমধ্যে সবচেয়ে আগ্রাসী ছিল জিজি। জিজি শিকারীর ক্ষিপ্রতায় গিয়ে পাকড়াও করত নতুন নকশাওলা সোয়েটার পরিধানকারি /কারিণীকে। তারপর নানারকম  আশকথা পাশকথায়  ভুলিয়ে সোয়েটার খুলিয়ে সামনে পেছন ভাল করে দেখে  নকশা  মাথার মধ্যে গেঁথে নিয়ে বিজয়গর্বে ফিরে আসত। পরবর্ত্তী দুই তিনদিনের মধ্যে সেই নকশা উলেকাঁটায় তুলে ফেলে তবে শান্তি। তারপর শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই নকশাকরা সোয়েটার  হয়ত পাবে দাদা কিম্বা আমি, নয়ত ছোড়দি অথবা আমার পুঁচকে ভাইয়ের জন্যও হতে পারে তা। জিজি প্রতিবছর আট থেকে দশখানা সোয়েটার বুনত। মাঝেমধ্যে উলের চাদরও বুনে ফেলত একটা দুটো। এখন ভাবলে প্রায় অবিশ্বাস্য লাগে, জিজি ছোটবেলায় বার দুই গরমজলে পুড়ে গিয়েছিল, ফলে বাঁ হাতের আঙুলগুলো, বিশেষ করে বুড়ো আঙুল  চামড়া দিয়ে জুড়ে গেছিল অন্য আঙুলগুলোর সাথে। তার জন্য বাঁ হাতের কাঁটা ধরত মুঠো করে; ঐ প্রতিবন্ধকতাকে  বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অজস্র গরম জামাকাপড়  বুনত প্রতিবছর আর সেসব কি ডিজাইন! এখনকার মন্টি কার্লো ইত্যাদির অমন ডিজাইন কিনতে  গেলে  মানিব্যাগে  ম্যানহোল তৈরী হয়ে যাবে।  

    আমাকে একটা আকাশী নীল রঙের ছয় কাটের উলের ফ্রক বানিয়ে দিয়েছিল, তাতে সাদা কুরুশের কাজ করা ঝালর, ফুলপাতা বসানো, সাদা ক্রচেট সুতো দিয়ে বোনা আড়াই ইঞ্চি চওড়া বেল্ট৷ সঙ্গে একই কম্বিনেশানের টুপি। আরেকবার, আমি গোলাপী রঙ ভালোবাসি বলে আমাকে টানা দুইমাস ধরে জিজি লোভ দেখাচ্ছে যে আমার জন্য নাকি একটা দারুউণ সুন্দর গোলাপী সোয়েটার বানানো হচ্ছে। এত দেরী হওয়ার কারণ সেই অসাধারণ সোয়েটারের নকশার উপযুক্ত  ম্যাচিং উল পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে সরস্বতী পুজোর  আগের দিন জিজি এল সেই সোয়েটার নিয়ে। বার করে আস্তে আস্তে খুলে ধরল আমার সামনে। শকিং পিঙ্ক পুলওভার বুকের কাছে  চার আঙুল চওড়া ধপধপে সাদা অংশে তুঁতে, উজ্জ্বল সোনালী হলুদ আর সেই শকিঙ পিঙ্ক দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জ্যামিতিক নকশা। খুব কাছ থেকে হাতে নিয়ে না দেখলে বোঝা যায় না মেশিনে না হাতে বোনা। কিন্তু হায় অত শকিং রঙ তখন আমার একটুও পছন্দ হল না, আমার মুখের ভাব দেখে জিজি কতকিছু বলল। কিন্তু ছোটরা বড় নির্মম হয়, তাই আমি অবলীলায় বলে দিলাম ‘এটা একটা বিশ্রি জামা। অত ক্যাটক্যাটে  রঙ আমি কক্ষণো পরব না।‘

    বেচারী কত আশা করে নিজের স্বপ্ন আর ভালবাসা মিলিয়ে মিশিয়ে বুনেছিল সেই গরমজামাখানা। সেই জামা আমি বড় হয়ে কলেজে পড়ার সময় অনেক পরেছি। যে দেখত সেই প্রশংসা করত, আমারও শকিঙ পিঙ্ক আর তখন মোটেই খারাপ লাগত না। কিন্তু জিজিকে সেকথা কেন যেন কখনও সেরকম করে জানানো হয় নি। আজ যখন  এটা জানিয়ে দেওয়ার আর কোনওই উপায় নেই, তখন  জিজির সেই কেমন একটা হতাশ দু:খীমত তাকিয়ে থাকাটা বারবার মনে পড়ে ... সময়কে তো  আর আগের তারিখে সিস্টেম রেস্টোর করা যায় না। সেই বছরের শীতকালও এইসব নিত্য নৈমিত্তিকতার টুকরো টাকরা নিয়ে চলছিল। বেড়াতে যাওয়ায় এবার গোটা পুজোর ছুটি জুড়েই প্রায় কোনওরকম পড়াশোনা হয় নি, তাই পরীক্ষার আগে যে ক'দিন ক্লাস হল, তাতে ভালই হেনস্থা হল, মা'র কাছে নালিশও করলেন রেখাদি, অঞ্জলীদি, শিখাদি। বাড়ীতে কিছু মারধোরও পড়ল,  আর দিনের মতে দিন কেটে গিয়ে বার্ষিক পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল। এবার পুজোবার্ষিকী আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, প্রভাতীগুলো আগে পড়া হয় নি, তাই সময় কাটাতে সমস্যা নেই কোনও। বড়দের বই পড়া আমার বারণ, কিন্তু মা'র পরীক্ষার খাতাদেখা আছে তাই শারদীয়া প্রসাদ, নবকল্লোল, উল্টোরথও আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে ফেলি, মা একদম টের পায় না। 

    ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে দুপুরবেলা  জিজি আসে কাঁদতে কাঁদতে। মীনামা মারা গেছে সকাল এগারোটায়, দাদা চাকরি করে অমৃতসরে, টেলিগ্রাম গেছে, দাদা আসলে সব হবে। মা জিজির সাথে কল্যাণী চলে যায়, আমি আর ভাই ভ্যাবলাচোখে তাকিয়ে বসে থাকি বারান্দায়। 'মারা গেছে' শব্দদ্বয়ের মানে আমি এখন স্পষ্ট বুঝি, ভাইও মনে হয় অনেকটাই বোঝে। কিন্তু তবু সেবারও ঐ শব্দদুটো কেমন পিছলে পিছলে যেতে থাকল, মানে বুঝলেও তাকে যেন ঠিক করে বুঝে ওঠা যায় না, শুধু আমার পৃথিবীর আউটলাইনটা আরো একটু ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে।  মা ফিরে আসে অনেক রাতে, নাকি পরেরদিন সকালে, এখন আর ঠিক করে মনে পড়ছে না। মা'র কাছে শুনি মীনামাকে বরফের বিছানায় শুইয়ে রেখে দাদার জন্য অপেক্ষা করছিল সকলে, জানি মরে গেলে আর শীত লাগে না, কিন্তু তাও বারবার মনে হয় মীনামা যে বড্ড শীতকাতুরে ছিল। জিজি এসে কয়েকদিন পরে আমাকে কল্যাণী নিয়ে গেল, আবার সেই গাদাগাদা অচেনা লোক, সেই একগাদা হাবিজাবি মন্ত্র আর বারবার করে 'প্রেত প্রেত' করতে লাগল ঠাকুরমশাই। আবার আমার ইচ্ছে করে এই ঠাকুরমশাই নামের লোকটাকে ধাঁইধাঁই করে মারতে।

    মীনামার মত ভালমানুষ যে কাউকে কোনোদিন একটু জোরে বকে নি, সবসময় হাসিহাসি মুখে থাকত, তাকেই এই পাজী লোকটা 'প্রেত প্রেত' বলছে! আমাকে যারা যারা ভালবাসত তাদেরকে এই ঠাকুরমশাইরা 'প্রেত' বলে ডাকে আর তারপর একগাদা কাপড়চোপড়, বাসনপত্র, খাবারদাবার এমনকি বিছানা বালিশ, ছাতা পর্যন্ত পোঁটলা বেঁধে নিয়ে চলে যায়!! এই নামাবলি জড়ানো একটু কুঁজোমত লোকগুলোর প্রতি এক তীব্র বিতৃষ্ণা, প্রায় বিদ্বেষ জন্ম নিতে থাকে আমার মনে। সময় নিজের নিয়মে বয়ে গিয়ে ব্ছরটা শেষ হয়ে নতুন বছরের ক্লাস শুরু হয়ে যায়। দাদা ফেরত যায় অমৃতসরে। এর মধ্যে দাদু আরও কয়েকবার আস্তে করে পড়েটরে গেল। আজকাল দাদু বাথরুমে যাওয়ার সময় দিদা বা বড়মামীমা নজর রাখে, বৃদ্ধ মানুষটির তাতে বড় অপমানবোধ হয়, সারাজীবন সোজা হয়ে হাঁটা মানুষটির কারো ঘাড়ে বা কাঁধে ভর রেখে চলতে বড় লজ্জা হয়। ফলতঃ বৃদ্ধ সুযোগ খোঁজে, দয়াময় সময় তাকে সুযোগ করে দেয়; দুপুর ও বিকেলের সন্ধিক্ষণে যখ্ন সবাই যে যার ঘরে, ভেতরের বারান্দা য্খন ফাঁকা, বৃদ্ধ নেমে আসে খাট থেকে, হেঁটে যেতে চেষ্টা করে বাথরুমের দিকে। নিষ্ঠুর সময় দেখিয়ে দেয় সে কেড়ে নিয়ে গেছে তার পায়ের জোর, শরীরের ভারসাম্য ... ঘর, বারান্দা কিম্বা বাথরুমের কোনও এক জায়গায় সে পড়ে যায়।

    দড়াম করে শব্দ হয় ... দৌড়ে আসে আপনজনেরা। গটগটিয়ে হেঁটে যাবার দিন তার শেষ  এটা দেখাতেই যেন সময় তাকে রোজ ঐসময় ভুলিয়ে নিয়ে যেতে চায় আর মাটিতে আছড়ে ফেলে শিক্ষা দিতে চায়।  সময় একদা কেড়ে নিয়েছিল তার বাড়ীঘর, দেশ, পেশা ও নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। তখন সময়কে অগ্রাহ্য করে একবস্ত্রে দেশ ছেড়ে সে পাড়ি দিয়েছিল অন্য দেশে, খুঁজে নিয়েছিল নতুন পেশা, আবার গড়ে তুলেছিল নিজস্ব গৃহ, স্থাপন করেছিল গৃহদেবতার আসন। আজ  সময় শেষ পর্যন্ত বাগে পেয়েছে তাকে, এটা কিছুতেই সে মেনে নিতে  পারে না।  মাটিতে পড়ে অসহায় বিড়বিড় করে 'আমি পারতাম, আমারে ছাইড়্যা দাও', ধরে তুলতে আসা লোকজন প্রথমে কিছুদিন দুঃখ পায়, বুঝিয়ে বলতে চায়। সময় টান ধরায় তাদের ধৈর্য্যে, বিরক্তি বাড়ে,  অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে কাছের লোকেরা। দরজার বাইরে থেকে হাঁসকল লাগানো হয়, খাট সরিয়ে মেঝেতে টানা বিছানা করে দেওয়া হয় পতনসম্ভাবনা কমানোর জন্য। সব পরামর্শ আজকাল দিদা কিম্বা বড়মামার সাথেই করে সবাই, দাদু কিছু জিজ্ঞাসা করলে হয় উদাসীন 'পরে কইতাছি' আর  নয়ত অসহিষ্ণু 'শুইয়া বইসা থাক না, অহন বিশ্রাম লও, তুমার অত সবেতে মাথা দেওনের কাম কি অহনও!?' এরপরে এগারো বছর ধরে আমরা দেখব এক বনস্পতির ঘুণ ধরে আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যাওয়া।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০২ জুলাই ২০২৪ | ২৭৮ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
     কবিতা - Suvankar Gain
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 172.56.33.28 | ০২ জুলাই ২০২৪ ১৮:০৭534083
  • এইবারের পর্ব অনেকদিন পরে এলো। এদের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। ছোট্টছোট্ট চারাগাছদের জন্য মনটা খুব খুশি লাগলো। আর মনখারাপ লাগছে শুকনো মুড়কি নামক হ্যাংলা মত লোভটার জন্য, জিজির হতাশ দুঃখী মতো তাকিয়ে থাকার জন্য, লোকের বিরক্তি আর উদাসীনতা পাওয়া দাদুর জন্য।
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ০২ জুলাই ২০২৪ ১৮:২১534086
  • এগারো বছর ধরে - ওঃ! বড়ই কঠিন, বড়ই করুণ! 
     
    আমরা কাঁচড়াপাড়া থেকে কোন্নগর যেতাম, আমাদের দিদিমণি-পিসি-কাকুদের কাছে।
     
    কত খুঁটিনাটি মনে রেখে, কি নিটোল গল্প বলো তুমি! heart
  • Suvasri Roy | ০৩ জুলাই ২০২৪ ০৭:৫২534102
  • অতুলনীয় স্মৃতি। দারুণ কলম।
  • Aditi Dasgupta | ০৩ জুলাই ২০২৪ ০৮:১৬534104
  • এতদিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে! 
     
    এ লেখা নিয়ে কিছু বলতে গেলে মনে হয় কৈফিয়ত দিচ্ছি নিজের ভাবনা, নিজের অনুভূতির, নিজের যাপনের! 
     
    হিলিবিলি কিলিকিলি করে দিতে ইচ্ছে করে লেখিকা কে যদি হাতের কাছে পাই!​
  • Kishore Ghosal | ০৩ জুলাই ২০২৪ ১৭:০৫534119
  • অপূর্ব। 
     
    "এগারো বছর ধরে আমরা দেখব এক বনস্পতির ঘুণ ধরে আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যাওয়া"। সেকালের দাদুরা ছিলেন সত্যিই বনষ্পতি - ঝড়ঝাপটা সয়ে মাথা উঁচু করে থাকা - শাখাপ্রশাখা ছড়ানো - বৃহৎ ছায়া - তাঁদের গা ঘেঁষে শুধু বসে থাকাতেও পেয়েছি জীবনের নানান পাঠ...
     
    অপূর্ব।  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন