এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নানা রঙের দিনগুলি - ৪

    মানব মীরা দে লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ জুন ২০২৪ | ১০৫ বার পঠিত
  • ক্লাস নাইনের প্রত্যেকটা সেকশানের ঘরের সামনে, করিডোরে এমন কি বড় বেদীর ওপরও ক্লাস নাইনের বেশির ভাগ ছাত্র—তিন সেকশান মিলিয়ে কমসে কম একশ কুড়ি জন তো হবেই—সবাই নীলডাউন হয়ে রয়েছে প্রায় সারাদিন ধরে! কারণ সরস্বতী পুজোর আয়োজনের অধিকার তাদের কাছ থেকে অন্যায় ভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তাই তারা কোন স্যারকে পড়া দিচ্ছে না, অংক করছে না, অর্ধেক ছেলে স্কুলে বই আনছে না! স্যারেরা বেত দিয়ে মারলেও তারা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছে না! 'বেত' বলতে গিয়ে মনে পড়ল,  এযুগের স্টুডেন্টরা তো 'বেত' কি? তাই জানে না! নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত দেবদেবীদের মত স্যারেরা যে সকল অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ছাত্রদের নেতিবাচক প্রবৃত্তিগুলিকে বধ করতেন; সে সকল অস্ত্রের মধ্যে 'বেত' ছিল প্রধান ও সর্বাধিক ব্যবহৃত ও পরীক্ষিত অস্ত্র —এই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। তা যেটা বলেছিলাম, তারপর স্যারেরা জাতিধর্ম নির্বিশেষে ক্লাস নাইনের সবাইয়ের গার্জেন কল করেছেন। সারা বছরে ক্লাসের আচরণের উপর নির্ভর করে যে ইন্টারনাল নম্বর দেওয়া হয়, সব স্যারেরা বলেছেন ক্লাস নাইনের সবাইকে ইন্টারনালে শূন্য দেবেন। তাতেও ছাত্ররা দমে না গিয়ে খেলার পিরিয়ডে ফুটবল খেলতে গিয়ে নিজেদের গোলেই সবাই আত্মঘাতী গোল করছে! স্কুল শুরুর আগে প্রার্থনা সঙ্গীতে ক্লাস নাইনের কেউ  অংশগ্রহন করছে না—এবং তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে সূর্য ও অতনু।—পাঠকরা যদি ভাবেন এমন ভাবেই আন্দোলন হয়েছিল তা'হলে সম্পূর্ণ ভুল ভাবছেন। উপরোক্ত কোন ঘটনাই ঘটেনি। তবে হ্যাঁ প্রার্থনার সময় সূর্য ও অতনু গানে লিড করত। আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর যখন স্কুলের তরফ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না। এবং উল্টে ক্লাস ইলেভেনের সাথে সরস্বতী পুজোর প্রথম মিটিংটাও হয়ে গেল। তখন সেই মিটিং-এর ঠিক পরেরদিনই সূর্য ও অতনুর নেতৃত্বে ক্লাস নাইনের সবাই প্রার্থনা সঙ্গীতে অংশগ্রহণ করল না! রোজকারের মত সবাই অন্য ক্লাসের সাথে প্রেয়ারে লাইন দিলেও, সূর্য আর অতনু যথারীতি রোজের মত মঞ্চে দাঁড়িয়ে হারমোনিয়াম বাজালেও, কেউ কিন্তু গান গাইল  না, শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তাও অতনু মাঝে মাঝে স্কুলের অন্য ক্লাসের ছেলেদের সাথে ঈষৎ ভয়ে লিপ মিলিয়ে ফেললেও সূর্যর প্রখর চাহনিতে সে কাজ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করেছে। প্রতিদিনের মত ক্লাস নাইনের কাঁসর ভাঙা কণ্ঠস্বর যে প্রার্থনা সঙ্গীতের সঙ্গে শরিক হয় নি সেটা স্যাররা ভালো করেই বুঝতে পারছিলেন। তাই প্রেয়ার শেষ দুর্গাবাবুর গম্ভীর ঘোষনা, "ক্লাস নাইন বাদে অন্য ক্লাস নিজের ক্লাসরুমে যাবে। আর মাস্টারমশাইরা আপনারা স্বাভাবিক ক্লাস শুরু করুন। ক্লাস নাইন 'এ'-'বি'-'সি' সেকশানে এখন যাদের ক্লাস আছে, তারা এখানেই থাকুন আমার কথা শেষ হলে নিজের স্টুডেন্টদের নিয়ে ডাইরেক্ট ক্লাসে চলে যাবেন।"

    এক এক করে নাইন বাদে অন্যান্য ক্লাসের সব ছেলেরা নিজেদের ক্লাসে চলে গেল। ক্লাস নাইনের ছেলেরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিন সেকশানের তিন ক্লাস টিচার বাদে বাকি টিচাররা যে যার ক্লাসে চলে গেলেন। দুর্গাবাবু পাযাণের দৃঢ় মুর্তির মত বেদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে দুধ সাদা ফুলহাতা শার্ট আর ততোধিক পরিপাটি করে পরা তুষারধবল ধুতি। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, পায়ে চকচকে পাম্পশু, এক নজরে দেখলে মনে হয় যেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচভের যমজ ভাই শুধু হাইটটা একটু বেশি মাত্র। দুর্গাবাবুর ডান পাশে একটু পেছনে তিন স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। বাঁ পাশে ছোট টেবিলে হারমোনিয়াম রাখা, তার পেছনে দাঁড়িয়ে সূর্য ও অতনু! তাদের অবস্থা বড়ই করুণ—ততোধিক করুণদশা বাকি ছাত্রদের; ঠিক ভাবে কান পেতে শুনলে কারুর কারুর ভয়েতে হাঁটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকির শব্দও শুনতে পেলেও শোনা যেতে পারে! দুর্গাবাবুর জলদ গম্ভীর কিন্তু খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, "আজ তোমরা যেটা করলে সেটাকে এক কথায় সীমাহীন চরম অবজ্ঞা ও নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি অবমাননা বলা যেতে পারে। যে অহমিকা এবং স্পর্ধা থেকে তোমরা এটা ঘটালে সেটা ভবিষ্যতে তোমাদের চেয়ে ছোট বহু ছাত্রকে উচ্ছ্বঙ্খল করে তুলতে সাহায্য করবে। যেটা তোমাদের এই আচরণের সবচেয়ে বড় কুফল হয়ে উঠবে। সেটার কি কোন প্রতিকার সম্ভব?—আমার তো মনে হয় তা সম্ভব নয়।"

    দুর্গাবাবু প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য থামলেন। আর সেই সুযোগে যে ছাত্ররা এতক্ষণ দম বন্ধ করে দুর্গাবাবুর কথা শুনছিল তারা নিশ্বাস ছাড়ল! দুর্গাবাবু আবার বলতে শুরু করলেন, "এবার আসি মূল বিষয়ে, এবারের সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে তোমরা আমাদের একটা চিঠি দিয়েছ। আমি পড়ে দেখেছি সেটা। তোমাদের কাছে আমার প্রশ্ন ইলেভেনের দাদারা তো তোমাদের সিনিয়র, তারাই আয়োজন করুক না এবছরের পুজোটা—তাদের জন্য তোমারা এইটুকু সেক্রিফাইসটা করতে পারবে না?"

    ভিড়ের মধ্যে থেকে শ্রীকান্ত হঠাৎ হাত তোলে। দুর্গাবাবু তাই দেখে বলেন, "শ্রীকান্ত তো?—কি বলবে বলো?"

    এই একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট ছিল ওনার! —সব ছাত্রের নাম কি ভাবে মনে রাখতেন তা ভগাই জানেন! শ্রীকান্ত ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বলে, "স্যার, হয়তো আমি ভুল হতে পারি। আমাদের বেশির ভাগ দাদারাই ক্লাস নাইনে থাকাকালীন অলরেডি একবার পুজোর আয়োজন করে ফেলেছে।  কিন্তু আমরা কোনদিনও করিনি, ক্লাস ইলেভেন-টুয়েলভে শুরু না'হলে এবছর আমরাই পুজোটা করতাম। তাই স্যার, এই একই সেক্রিফাইসটা আমাদের দাদারাও তো আমাদের জন্যে করতে পারে।"

    তখন ঝড় ওঠার আগের নীরবতা সারা মাঠ জুড়ে। দুর্গাবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুজনবাবু শ্রীকান্তর দুঃসাহসিকতাকে আড়াল করতে দুর্গাবাবুর কানে কানে কিছু একটা বলেন। আবার সম্পূর্ণ নীরাবতা! সেই নীরবতাকে খান্ খান্ করে ভাবোচ্ছ্বাসহীন মুখে দুর্গাবাবু বলে ওঠেন, "তোমারা আজ টিফিনের পর ফিফথ্ পিরিয়ডে হোল ক্লাস দশজন দশজন করে এক একটা টিমে ভাগ হয়ে ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত প্রতিটি সেকশানে এক একটি করে টিম গিয়ে আজকের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে আসবে। এখন সবাই ক্লাসে যাও।"

    কথাগুলো শেষ করেই দুর্গাবাবু নিজের অফিসের দিকে দ্রুত হেঁটে চলে যান!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন