এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগল

    সিকি লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ১০ নভেম্বর ২০১৭ | ৩১৮০৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সিকি | ২৪ নভেম্বর ২০১৭ ১৯:৩৬370633
  • আমাকে siki.guru জিমেলে একটা মেল করে দিন।
  • সোমনাথ | 24.139.160.252 | ২৫ নভেম্বর ২০১৭ ১৩:৫৫370634
  • সিকিদা,
    আপনাকে একটা মেইল করেছি । একটু দেখবেন ।
  • সিকি | ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ২৩:১৩370635
  • হেঁইয়ো।

    অন্যত্র দায়মুক্ত হয়েছি, এইবারে আশা করছি আগামী উইকেন্ডের মধ্যে এখানে পরের কিস্তি দিতে পারব।
  • abcd | 113.42.173.26 | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৮:৫০370636
  • দারুন। অনেকদিন হা পিত্যেশ বসে আছি, কবে পরের কিস্তি আসে
  • সিকি | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ২২:০৪370637
  • ২১শে অক্টোবর, দ্বিতীয় দিন

    সকালে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙল। গায়ের ব্যথা আর নেই, একদম ফ্রেশ। কাল রাতেই চান অরেছি তাই আর সকাল সকাল চান করার চাপটা নিলাম না। ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে ঘর থেকে বেরোলাম। পাশেই এক চিলতে রিসেপশন, সেখানে মেঝেতে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে তিনটে মূর্তি, রিসেপশনে কাল রাতে যে ছেলেটা ছিল, কাল আমার লাগেজ যে ওপরে তুলে এনে দিয়েছিল, আর আরেকজন কেউ। রিসেপশনের মোটা কাচের দরজা লক করা।

    অগত্যা, ডাকতেই হল। নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে একজন উঠে দরজাটা খুলে দিয়েই আবার ধুপুস করে পড়ে ঘুমিয়ে গেল।

    আজ সমস্ত লাগেজ নিজেকেই নামাতে হবে। সাহায্য করার আর কেউ নেই। দুতিন খেপে নামাবো। ঘরে গিয়ে দুটো ব্যাগ নিয়ে ঘুমন্ত তিনজনকে সন্তর্পণে ডিঙিয়ে বাইরে এলাম। সিঁড়ি বেয়ে নিচে বাইকের কাছে রেখে আবার তড়িঘড়ি ওপরে এসে বাকি লাগেজ কোনওরকমে নিয়ে আবার ঘুমন্ত তিনমূর্তিকে ডিঙিয়ে ফাইনালি নিচে। পেমেন্ট ইত্যাদি কালকেই করে রেখে দিয়েছি, সুতরাং আর কাউকে জাগানোর নেই। এই গরুর রাজ্য থেকে এবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালালে বাঁচি।

    গোরখপুর বা বারাণসী, এগুলো সব বিহার লাগোয়া উত্তরপ্রদেশের শহর, ফলে এখানকার হিন্দিতে বিহারী অ্যাকসেন্ট অত্যন্ত স্পষ্ট। সকাল বেলায় উঠে লাগেজ বেঁধে প্রথম কাজ অতি অবশ্যই বাইকের ট্যাঙ্ক ফিল আপ করা – তা হোটেলের সামনেই একটা বড়সড় পেট্রল পাম্প আছে। সেখানে ঢুকলাম যখন, ঘড়িতে বাজে পৌনে সাতটা। পেট্রল পাম্প তখনও খোলে নি – খুলব খুলব করছে। বলল, তানিক ওয়েট কর লিজিয়েগা। আধঘণ্টা ওয়েট করতে হবে।

    আধঘণ্টা? পাগল নাকি? আজকে আমার দৌড় সাতশো কিলোমিটারের, আধঘণ্টা মানে আমার কাছে অনেকটা সময়। বেরিয়ে পড়লাম, খানিক দূরেই আরেকটা বড়সড় পেট্রল পাম্প। সেটি তখন খুলেছে। ট্যঙ্কে তেল ভরলাম, জেরিক্যানে ভরলাম। এদিকে একটা ফগলাইট তখনও নাটবল্টু খোলা অবস্থায় ঝুলছে। লাগাবার জন্য একজন মেকানিক দরকার। আশেপাশে কাউকেই দেখছি না। জিজ্ঞেস করতে যাবো, তার আগেই পেট্রল ভরার ছেলেটি অন্য অক্ষত ফগলাইটটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ই কা হ্যায় বা? কেমরা বা? বললাম, না, লাইট বা। অতএব, পরের আবদার, লাইট বা? তানিক জলাকে দিখাইয়ে না – বহুত দূর সে আ রাহে হ্যায় কা?

    হেসে ফেললাম, এর কাছে আর মেকানিকের কী জিজ্ঞেস করব – যে লাইট দেখে ক্যামেরা ভাবে। দেখি রাস্তায় যদি কোনও মেকানিক পাই। খানিক লাইট জ্বালিয়ে দেখিয়ে তাকে খুশি করে এগিয়েই গেলাম।

    কিন্তু গোরখপুর এমনই ঘিজিমিজি এলাকা, জিপিএস আমাকে ঢুকিয়ে দিল একটা গলির ভেতর। সেখান দিয়ে খানিক এগিয়ে দেখলাম ছিমছাম সরু রাস্তাঘাট, চারদিকে পরিচ্ছন্ন কোয়ার্টার – গোরখপুর ক্যান্টনমেন্ট। তার পরে ক্যান্টনমেন্ট পেরিয়ে একটা লেভেল ক্রশিং, সেটা পেরিয়ে দেখি রাস্তা আরও সরু। দাঁড়ালাম। জিপিএসে স্ক্রোল করে করে দেখলাম আর দেড় কিলোমিটার চললেই ন্যাশনাল হাইওয়ে সাতাশ। এবং যাবার মতন রাস্তাও দেখাচ্ছে নীল রঙে। অগত্যা, আবার এগোলাম – এবং একটু এগোটেই গিয়ে পড়লাম একটি বস্তির মধ্যে। একপাশে উঁচু পাঁচিল, পাঁচিলের অন্যপ্রান্তে রেললাইন, সারি সারি মালগাড়ি দাঁড় করানো, এটা বোধ হয় গোরখপুর জংশনের কারশেড, আর পাঁচিলের অন্যপ্রান্তে এক ফালি রাস্তা, শুধু মোটরসাইকেলই যেতে পারে, রাস্তার অন্যদিকে সারিসারি এবরোখেবড়ো ইঁটের বাড়ি, কোথাও রাস্তার ওপর চারপাই খাটিয়া নিয়ে বসে বয়স্করা গুলতানি মারছে, কোথাও রাস্তার ওপরেই বাচ্চারা খেলছে, তার মধ্যে দিয়ে হর্ন টর্ন বাজিয়ে ধীরে ধীরে এগোটে লাগলাম। এই রকমের লাগেজবোঝাই মোটরসাইকেল, কেউ যদি বেশি কৌতূহলী হয়ে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে, সেই ভয়েই আমি কারুর দিকেই তাকাচ্ছিলাম না, জাস্ট চালিয়ে যাচ্ছিলাম, শেষ মুহূর্তে বাদ সাধল একটা শুওর – তার জীবনে কীসের দূঃখ ছিল কে জানে, একদিক থেকে ঘ্যাঁচঘ্যাঁচঘোঁচঘোঁচ আওয়াজ করতে করতে তিরবেগে এসে পড়ল আমার বাইকের সামনের চাকার সামনে, প্রাণপণে ব্রেক মারলাম, শুওরটা বেঁচে গেল, আমি বাইকসমেত সামান্য টলে গেলাম।

    আত্মহত্যার প্রচেষ্টা বিফলে গেল দেখে শুওরটা আবার অন্যদিকে ছুটে চলে গেল, আমি কি আর ওখানে দাঁড়াই? একবার বেঁচেছি, শুওরটা আজ আমার বাইকে চাপা পড়লে আমার কপালে গল্প লেখা ছিল। অবিশ্যি গোরখপুরে শুওর মারলে কিছু না-ও হতে পারে, আফটার অল, শুওর-রখপুর তো নয় ওটা।

    সাথে সাথে সেকেন্ড গিয়ারে তুলে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে গেলাম আর ঠিক একশো মিটার এগোতেই চোখের সামনে আড়াআড়ি দেখা দিল চওড়া হাইওয়ে। তাড়াতাড়ি হাইওয়েতে উঠে বাঁদিকে টার্ন। খাইক এগোতেই একটা আরও চওড়া হাইওয়ে শুরু হল, সামনে বড় বড় বোর্ডে লেখা পূর্ণিয়া, কিষেণগঞ্জ, শিলিগুড়ির নাম। জয়গুরু, ঠিক রাস্তায় আছি।

    আধঘণ্টা চালাবার পরে রাস্তার ধারে একটা ধাবা পেলাম। সেখানে বসে খানিক পরোটা ওমলেট আর তরকারি খেয়ে নিলাম পেটপুরে। সাড়ে আটটা বাজে, এইবারে লেট লাঞ্চ করলেও চলবে। এগনো যাক।

    আরেকটু এগোতেই শেষ হল উত্তরপ্রদেশের সীমা। বিহারের শুরু এখান থেকেই – সারি সারি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে, আর, আর –



    কাশবন। দিগন্তবিস্তৃত, চরাচর ছেয়ে ফেলা কাশের সারি। যতদূর চোখ যায় – শুধু কাশ আর কাশ। চারিদিকে আর কেউ কোত্থাও নেই, কিচ্ছু নেই। এক জায়গায় বোর্ডে লেখা – গোপালগঞ্জ। দাঁড়ালাম, দাঁড়াতেই হয় এমন অপূর্ব শোভার সামনে। ছবি তোলার একটু চেষ্টা করলাম, তবে মনে হল না ক্যামেরা এ সৌন্দর্য ধরতে পারে।



    আবার এগোনো। একে একে পেরিয়ে গেল গণ্ডক নদীর ওপর মাঝারি ব্রিজ, তার পর এল মুজফফরপুর। তার পর কত নাম না জানা জায়গা – রাস্তা ভালো মন্দয় মিশিয়ে, কিন্তু চারপাশের সৌন্দর্য অসাধারণ, ধীরে ধেরে পূর্বভারতের চেনা মাঠঘাট খালবিল চোখে পড়ছে, তালগাছের সারি, খড়ে ছাওয়া কুঁড়েঘর ইতস্তত, তার মধ্যেই পার হয়ে যাওয়া কিছু গঞ্জ, শহর, আধা শহর। অবিরাম চলা। দারভাঙা এল, কোশী নদী পেরোবার পরে ফোর্বসগঞ্জ এল, তার পরে আরারিয়া এল, আমি এখন নেপালের বর্ডারের খুব কাছ দিয়েই যাচ্ছি। আরারিয়ার পরে রাস্তা ঘুরে গেল খানিক দক্ষিণের দিকে, পুর্ণিয়া ঢুকলাম বিকেল তখন তিনটে।

    খাওয়া উচিত? নাঃ, খিদে পায় নি খুব একটা। সামনের হোর্ডিংয়ে পর পর দূরত্বগুলো দেখাচ্ছে জায়গাগুলোর – এর পরেই আসবে বারসোই, ডালখোলা, কিষেণগঞ্জ। শিলিগুড়িরও নাম আসছে, এমনকি গুয়াহাটি বা ডিমাপুরেরও নাম দেখছি কয়েকটা বোর্ডে। এই ন্যাশনাল হাইওয়ে শিলিগুড়ি পেরিয়ে আসাম হয়ে চলে গেছে সোজা নাগাল্যান্ডের দিকে। নামগুলো চোখে পড়লেই খিদেতেষ্টা সব ভুলে যাই, কেবল মনে হয় চলতেই থাকি, চলতেই থাকি। … দেখি, আরেকটু এগোই – খাবার জায়গা অনেক থাকবে নিশ্চয়ই আগে।

    এর পরের রাস্তা আমার খানিক চেনা, কলেজের যখন পড়তাম, তিস্তা তোর্সা, কামরূপ, সরাইঘাট – এরা সব এই রাস্তা ধরেই আসত যেত। মানে – এখনও এই রুট ধরেই আসে যায় হাওড়া-শিয়ালদাগামী সমস্ত ট্রেন। রাস্তার পাশ দিয়েই রেললাইন থাকার কথা। কিষেণগঞ্জের সেই অখাদ্য পরোটা তরকারি যে কতবার খেয়েছি পাঁচ টাকায় দশ টাকায়। সেই খেয়েই রাত কাটাতাম, বিনা টিকিটে দল বেঁধে বাড়ি আসার সময়ে।

    ডালখোলা আসার আগে রাস্তার অবস্থা বিশালভাবে খারাপ হয়ে গেল। বাধ্য হয়েই স্পিড কমাতে হল। ডালখোলা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ-বিহারের বর্ডার। সুবিশাল একখানা ক্রেটার, পাশে একটা ফ্লাইওভার বানানো চলছে – কে জানে কতদিন ধরে। চতুর্দিকে অগুনতি ট্রাকের মাঝখানে স্যান্ডউইচ হয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম জ্যাম কাটার আশায়। অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না, খানিক বাদেই আমার দিকের ট্র্যাফিক খুলে গেল, এবং এই ট্রাক সেই ট্রাকের ফাঁকফোঁকর দিয়ে লাগেজসমেত নাচতে নাচতে পেরিয়ে গেলাম রাস্তাজোড়া সেই সুবিশাল গর্ত। পশ্চিমবঙ্গে চাকা রাখল আমার বাইক। প্রথমবার।

    গর্তময় রাস্তার পাশেই বাজার বসেছে। বাংলা-হিন্দি মেশানো টুকটাক কথা কানে আসছে, আর চোখে পড়ছে বাজারে মাছের আধিক্য। ম ম করছে পরিবেশ মাছের গন্ধে – সেই বাজার পেরিয়ে আসার খানিক পরে আবার রাস্তা ঠিক হল। সাড়ে পাঁচটা বাজে, দিনের আলো এবার নিভে আসছে। এখন আমি পূর্বভারতে চলে এসেছি, এখানে দিল্লির থেকে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে হয়।

    বারসোইয়ের পর কিষেণগঞ্জ। যদিও পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়েছি, তবে এ রাস্তা চলেছে খানিক বিহার, খানিক পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দিয়ে – ক্ষণে ক্ষণে বর্ডারের এপার ওপার করে চলেছে রাস্তা, সে প্রতিটা মোড়ে দাঁড় করানো পুলিশের ব্যারিকেড দেখে বুঝতে পারছি, কখনও ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ, কখনও বিহার পুলিশ। চারপাশের দোকানের সাইনবোর্ডে বাংলার থেকে হিন্দিভাষারই আধিক্য বেশি।

    আর দেখছি, গামা গামা প্যান্ডেল। দিল্লির দিওয়ালি, বাংলায় কালীপুজো। তা সে জিনিস মিটে গেছে দুদিন আগে, উনিশে অক্টোবর, কিন্তু বাংলার বুকে উৎসবের রেশ কাটে নি এখনও। রাস্তার এদিকে ওদিকে বিশাল বিশাল কালীপুজোর প্যান্ডেল, আগেপিছে এক কিলোমিটার করে তার টেনে মাইকে চলছে বিকট উচ্চারণে শ্যামাসঙ্গীত, অথবা লাকি ড্র-এর বিজেতাদের নাম ঘোষণা।

    বাংলায়।

    বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুদিনের মাথায় প্রথম বাংলা ভাষার গান, বাংলাতে ঘোষণা শুনে কেমন যেন একটা হতে থাকল মনের মধ্যে। পুরনো দিনের অনেক অনেক স্মৃতি ভিড় করে আসতে থাকল। এই ভাষা বোধ হয় আমার আপনজনের থেকেও আপন। সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে গেল। হলেই বা বিকট উচ্চারণ, নাই বা হল পান্নালাল, তবু বাংলা গান তো – প্যান্ডেলের পর প্যান্ডেলে সেইসব শুনতে শুনতে এক সময়ে এসে গেল কিষেণগঞ্জ। এর পরের জায়গাগুলো আমার ভীষণ চেনা – পাঞ্জিপাড়া, ধানতলা, ইসলামপুর। শিলিগুড়ি প্রায় এসে গেছে – জিপিএসে দেখাচ্ছে আমার হোটেল আর ঠিক পঁয়ষট্টি কিলোমিটার, আর রাস্তার ওপরে ন্যাশনাল হাইওয়ের হোর্ডিং দেখাচ্ছে শিলিগুড়ির সাথে সাথে জলপাইগুড়ি, গুয়াহাটি, গ্যাংটকের দূরত্ব। সারাদিনে যে আমি দুটি পরোটা আর একটা ডবল ডিমের অমলেট ছাড়া আর কিছুই খাই নি, খিদে পাওয়া উচিত – পুরো ভুলে গেলাম সেই মুহূর্তে।

    ইসলামপুরের শেষে জিপিএস হঠাৎ করে আমাকে একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, সরু রাস্তায় ঢুকিয়ে দিল। এক ফোঁটা আলো নেই, চারদিকে উঁচু উঁচু গাছের দল। মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি যাচ্ছে, আসছে – কিন্তু তাদের কারুরই ডিপার ব্যবহার করার অভ্যেস নেই। আমি একা বেকার বেকার হেডলাইটের সুইচ দিয়ে ব্লিঙ্ক করে করে ক্লান্ত হয়ে গেলাম, কেউ তাতে ভ্রুক্ষেপও করল বলে মনে হল না – সব্বাই হাই বিমে হেডলাইট আমার চোখের দিকে তাক করে এল-গেল।

    রাস্তাটা আমাকে নিয়ে এল বাগডোগরা। এয়ারফোর্সের এরিয়া, মাটিগাড়া। কলেজ থেকে একবার এসেছিলাম এখানে, এয়ারফোর্সের পরীক্ষা দিতে, চান্স পাই নি অবভিয়াসলি, মানে আমাদের কলেজ থেকে কোনও বছরই কেউই চান্স পায় না, তাও বাসে করে নিয়ে আসা হত, পরীক্ষা নেওয়া হত, আর পরীক্ষার শেষে সব্বাইকে রিজেক্ট করে দেওয়া হত, প্রত্যেক বছর।

    রাস্তায় এবার আলো আছে, রাস্তাটাএকটু চওড়াও হয়েছে, সামনেই ডানদিকে বাগডোগরা এয়ারপোর্টের রাস্তা, ঝলমল করছে মোড়ের মাথাটা। এয়ারপোর্ট পেরোতেই, একটা বিশাল বড় মোড়, চারপাশের দোকানপাটের সাইনবোর্ডে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, মোড়টার নাম বর্ধমান মোড়, শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি শহরের শুরু। বর্ধমানে যেমন একটা আছে দার্জিলিং মোড়, তেমনি শিলিগুড়িতে এইটা বর্ধমান মোড়। আবছা আবছা মনে পড়ল, এসেছিলাম এইদিকে বার কয়েক, কলেজ থেকে।

    শহর শুরু হয়ে গেছে। আঠেরো বছর আগে যে শহর দেখে গেছিলাম – সে ছিল আধাখিচুড়ি একটা না-মফসসল না-শহর। হিলকার্ট রোড বরাবর উঁচু উঁচু পাকা বাড়িঘর, আর হিলকার্ট রোড পেরিয়ে এদিক ওদিক ঢুকলেই গ্রাম্য পরিবেশ ছিল। এখন সেই শিলিগুড়িকে রাতের আলোয় দেখে কলকাতা বলে ভ্রম হয়। রাশিরাশি গাড়ি, শপিং প্লাজা – কী নেই?

    কতটা তফাত জানেন? আমি যখন উত্তরবঙ্গ ছাড়ি, সেই ১৯৯৯ সালে, তখন খোদ কলকাতা শহরেই কুল্লে দশটার বেশি এটিএম ছিল না। মোবাইল ফোন তখন সদ্য এসেছে – যাদের হাতে মোবাইল থাকত, তারা সেটিকে জামার বুকপকেটে রেখে ফ্লন্ট করত, আর সেই তখনকার মোবাইল ফোনের মাথায় টিকির মত অ্যান্টেনা থাকত। ইনকামিং কলে চার্জ লাগত। সেই জমানায় আমি শেষ দেখেছি শিলিগুড়িকে।

    এখন শিলিগুড়ি অনেক বেশি রঙীন। রাস্তায় প্রচুর ট্র্যাফিক। তখন শুধু রিক্সা চলত, এখন রিক্সা আর চোখে পড়ছে না, কেবলই অটোরিক্সার সারি। তুমুল ট্র্যাফিক।

    সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। দূরে সিগন্যালটা দেখা যাচ্ছে লাল হয়ে রয়েছে, গাড়ির লাইন পৌঁছে গেছে এই অবধি। সিগন্যাল সবুজ হতে এখনও সাতাশি সেকেন্ড – বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকলাম। ঠিক সেই সময়েই একটা আপাচে আরটিআর চালিয়ে একজন আমার কাছাকাছিই এসে দাঁড়াল। তারও পেছনের সীটে লাগেজ বাঁধা – সেই ভায়াটেরা ক্ল (যে স্যাডল ব্যাগ নিয়ে আমি লাদাখ স্পিতি ঘুরে এসেছি)।

    ট্র্যাভেলার। বাইকার। কিন্তু গ্রুপ আছে, না একা? এদিক ওদিক দেখলাম, আর কোনও বাইকারকে দেখতে পেলাম না। মনে হল একাই। তখনই দেখি – সে আমাকে হাত নাড়িয়ে ইশারা করছে। আমি হেলমেটের কাচটা তুললাম – ছেলেটা জিজ্ঞেস করছে আমাকে, সোলো?

    আমি তার বাইকের নাম্বারপ্লেটের দিকে তাকালাম। কর্ণাটকের নম্বর। বললাম, ইয়েস, ইউ টু?

    ছেলেটা হেলমেটের ভেতর থেকেই হাসল, ইয়া, টুডে কামিং ফ্রম ক্যালকাটা, গোয়িং টু ভূটান। আর ইউ অলসো গোয়িং টু ভূটান?

    বলে কী! কলকাতা থেকে এসেছে মানে, কিছু না হোক সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার চালিয়ে এসেছে। ভূটান, মানে জয়গাঁও তো এখান থেকে আরও দেড়শো কিলোমিটার। বাজে রাত পৌনে আটটা। এখন জয়গাঁও যেতে চায় – এ কি পাগল?

    পাগলই বটে। সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেছিল, আমি ওকে বললাম, সিগন্যালটা পেরিয়ে সাইডে দাঁড়াও, আমি যাচ্ছি, ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি।

    সিগন্যাল পেরিয়ে সাইডে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, সে-ও সোলো। মানে একাকী। ব্যাঙ্গালোর থেকে এসেছে। সেখানে একটা ছোট স্টার্টাপ সংস্থায় কর্মরত। কী রেঞ্জের পাগল, বলে ব্যাঙ্গালোর থেকে ভুবনেশ্বর নাকি একদিনে এসেছে, দেড় হাজার কিলোমিটার। মানে –
    আমি যে দূরত্ব এসেছি এই দুদিনে, সেটা সে একদিনে চালিয়েছে। বললাম, তুমি কি পাগল? একদিনে দেড় হাজার কিলোমিটার – কতক্ষণে কভার করেছো?

    ছেলেটা এক গাল হেসে বলল, বাইশ ঘণ্টায়।

    বাইশ ঘণ্টায় পনেরোশো কিলোমিটার – মানে, গড়ে সত্তর কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়! একটানা! এ ছেলে ভূটান কেন, চাইলে আজ রাতেই চীনেও চলে যেতে পারে। ছেলেটি নিজের পরিচয় দিল, সোনি গুপ্তা, ভোপালের ছেলে, চাকরিসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে থাকে। খুব করুণ মুখ করে বলল, কলকাতায় খুব বৃষ্টি হচ্ছে, নইলে কখন চলে আসতাম। ভুবনেশ্বর থেকে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে চালিয়ে এসেছি বলে কলকাতার বেশি এগোতেই পারি নি কাল।

    কলকাতা সমেত দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি চলেছে কালীপুজোর দিন থেকে, সে আমি খবরেই দেখেছি। বললাম, সে না হয় করেছো, কিন্তু এখন ভূটান গিয়ে করবে কী? আজ তো শনিবার। কাল রবিবার, কাল ইমিগ্রেশন অফিস বন্ধ থাকবে। আজ পৌঁছেও তুমি কাল ভূটান ঢুকতে পারবে না, তোমাকে সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।

    সোনি গুপ্তা এতকিছু খবর নিয়ে আসে নি, সে দৃশ্যতই হতাশ, তা হলে?

    বললাম, আজ শিলিগুড়িতে থেকে যাও না, কাল চলে যেও জয়গাঁওতে।

    কিন্তু সে তাতে রাজি নয়। বলল, আমি বরং আজ গ্যাংটক চলে যাই, তুমিও কি আজ রাতেই গ্যাংটক যাচ্ছো?

    আমি হেসে ফেললাম, না বস, আমার কাল সকালের প্ল্যান। আমি আজ শিলিগুড়িতেই থাকব। এই সামনেই হোটেল, জিপিএস বলছে আর দেড় কিলোমিটার দূরত্বে।

    – আর গ্যাংটক মাত্র দেড়শো কিলোমিটার – নো ম্যান, আই ক্যান রিচ দেয়ার টুনাইট।

    যথাসম্ভব নিরস্ত করার চেষ্টা করলাম, শোনো সোনি, একে রাত হয়েছে, তার ওপরে এর পরেই পাহাড়ি রাস্তা শুরু হবে, এটা তোমার প্লেনল্যান্ড নয়, যেভাবে হিসেব করছো, তোমার গ্যাংটক পৌঁছতে পৌঁছতে মাঝরাত পেরিয়ে যাবে। কেন অত চাপ নিচ্ছো?

    সোনি সে কথার উত্তরই দিল না, – ম্যান, তোমার নাম্বারটা পেতে পারি? কাল যদি তুমি গ্যাংটক আসো তো কাল দেখা হয়ে যাবে। উই ক্যান দেন প্ল্যান টুগেদার।

    নম্বর দিলাম। বললাম, আরেকবার ভেবে দ্যাখো। শিলিগুড়ির পরে কিন্তু সেই গ্যাংটকেই হোটেলের অপশন পাবে। না গেলে যদি চলে, থেকে যাও। আমি কাল দুপুরের পরে গ্যাংটক পৌঁছব। তুমি কি তা হলে ভূটান যাচ্ছো না?

    সোনি মহা উত্তেজিত হয়ে বলল, না না, আমি তো কালকেই গ্যাংটক থেকে ফুন্টশোলিং চলে যাবো। … আমি আবার তাকে বোঝালাম, বস, কাল রোববার। কাল তুমি জয়গাঁওই যেতে পারবে। ফুন্টশোলিং পরশু।

    নম্বর টম্বর নিয়ে সোনি এগিয়ে গেল গ্যাংটকের দিকে, আমি জিপিএস দেখে দেখে পরের টার্নেই ডানদিক নিলাম। হিলকার্ট রোড শুরু হল। এখানেও বোধ হয় একটা ফ্লাইওভার বানানোর চেষ্টা চলছে, খানিক ডাইভার্সনের মধ্যেই বেশ কয়েকটা বুলেট ইত্যাদি দেখে ফেললাম, বাইকারদের একটা দল শিলিগুড়িতে ঢুকছে, ওয়েস্ট বেঙ্গলের নাম্বারপ্লেট, জানি না কোথা থেকে এসেছে। একটু এগোতেই জিপিএস আমাকে বাঁদিকের একটা সরু গলিতে ঢুকিয়ে দিল। হোটেলের দূরত্ব বলছে আর মাত্র পাঁচশো মিটার, সামনে গিয়ে ডানদিকে বাঁক, তার পরে আবার ডানদিকে টার্ন নিলেই হোটেল। তো, প্রথম ডানদিকের টার্ন নিতেই একটা অভূতপূর্ব দৃশ্য সামনে দেখে আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল।

    একটা ছোট্ট কালীপুজোর প্যান্ডেল, আর তার সামনে একদল ছেলেবুড়োজোয়ানমদ্দ খুব নাচছে, খুব। অথচ গলির ভেতরটা পুরো নিঃশব্দ। কোথাও কোনও মাইক বা বক্স বাজছে না, নীরবতার মধ্যে, কারুর মুখে কোনও কথা নেই, কিন্তু নেচে যাচ্ছে সবাই। রাস্তা জুড়ে। মোটামুটি একই ছন্দে। কেসটা কী? আমি যে একটা লাগেজবোঝাই মোটরসাইকেল নিয়ে হেডলাইট জ্বালিয়ে প্রায় তাদের সামনে এসে পড়েছি, তাদের জাস্ট কোনও খেয়াল নেই। একটু এগোবার চেষ্টা করতেই একটা বাচ্চা ছেলে নাচের ঝোঁকে পুরো আমার সামনের চাকার ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে উলটে পড়ল, অমনি সবাই সজাগ হয়ে গেল, এই বাপন, কী করিস? দেখতেসিস না মোটরসাইকেল আসতেসে?

    আআহ্‌! শিলিগুড়ির বাংলা ডায়ালেক্ট। আর তখনই আমি আবিষ্কার করলাম এদের নাচের রহস্য। এদের প্যান্ডেলে লাইট চলে গেছে, বক্স বাজছে না, তাই বলে তো ফুর্তি বন্ধ করা যায় না, তাই একজন মোবাইলে গান চালিয়ে দিয়েছে, আর সেই গানের তালে সবাই নাচছে। এখন, একটু দূর থেকে আমি সেই গান শুনতে পাচ্ছি না, আমার মাথায় হেলমেট, কান চাপা, ফলে ওইটুকুনি মোবাইলের আওয়াজ তো আমার কানে আসছিল না – তাই মনে হচ্ছিল সবাই এমনি এমনি নাচছে।

    বাপন নামের বাচ্চাটিকে সরিয়ে দিয়ে ছেলেরা আমাকে জায়গা করে দিল, আমি এগিয়ে ডানদিকে বাঁক নিতেই হোটেল দেবজ্যোতিতে পৌঁছে গেলাম।

    হোটেলটা আগে থেকে বুক করে রাখা ছিল, তাই কিছু করার ছিল না, কিন্তু গতকাল রাতেই মেকমাইট্রিপে এমন একটা প্যারাগ্রাফ চোখে পড়ে গেছিল হোটেলটার বুকিং কনফার্মেশন চেক করতে গিয়ে, মাথা গরম হয়ে গেছিল। মরাল মেসোমশাই হবার অভ্যেসে বাঙালি কোনও অংশে যে কম নয়, তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ এই হোটেল দেবজ্যোতি।



    হোটেলটি ভালো, ছিমছাম, পার্কিং বেশ বড়সড়। হোটেলের একটি ছেলে বলল, চিন্তা করবেন না, আমাদের সিসিটিভি লাগানো আছে, আপনার যেটুকু লাগেজ দরকার, সেটুকু খুলে নিন, বাকিটা এখানেই বাঁধা থাক, কিচ্ছু হবে না। পেট্রলের ক্যানও ছেড়ে যেতে পারেন। কেউ নেবে না।

    রাতের পরার জামাকাপড় সমেত একটা ব্যাগ নিয়ে ওপরে উঠে এলাম। দক্ষিণবঙ্গ নাকি বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে, শিলিগুড়িতে বৃষ্টি নেই, তবে ঠাণ্ডাও নেই। অবশ্য এখনও ঠাণ্ডা পড়ার সময় হয়ও নি।

    হোটেলেই অর্ডার দিয়ে রাতের খাবার সেরে নিলাম। এর পর ঘুম। কাল তাড়াহুড়োর কোনও দরকার নেই। এখান থেকে গ্যাংটক মাত্রই একশো দশ কিলোমিটার। বেরোলেই পৌঁছে যাবো। কাল বরং সকালে উঠে প্রথমে মেকানিক দেখে ফগলাইটটা মাউন্ট করতে হবে। ওটা এখন প্রায়োরিটি।

    হোয়াটস্যাপ খুলে সোনি গুপ্তাকে মেসেজ করলাম – কোথায় পৌঁছলে?

    পরদিন সকালে তার উত্তর পেয়েছিলাম, দেখুন সে কোথায় পৌঁছে গেছিল সেই রাতে।



    পাগল কত রকমের হয়!
  • সিকি | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ২২:০৫370638
  • ভিডিওর প্রিভিউ আসে নি।

  • শঙ্খ | 126.206.220.177 | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ২৩:১৭370639
  • বাহ!
  • amit | 213.0.3.2 | ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৫:৪৯370640
  • দারুন হচ্ছে লেখাটা। আরো ছবি থাকলে আরো সুন্দর হবে হয়ত।

    এক দিনে ২২ ঘন্টা চালানো !!! এটা পাগলামি শুধু নয়, মিনিমাম সেফটি বোধ টুকুও সোনি গুপ্তা ছেলেটার নেই। এক -আধ সেকেন্ডস এর ঝিমুনিতে চোখ লেগে গেলে যাচ্ছেতাই এক্সিডেন্ট হতে পারে, শুধু নিজে মরলে তো হয়েই যেত, কিন্তু আরো পাঁচটা লোক যে মরতে পারে সেটুকু কমন সেন্স তো থাকা উচিত। এমনিতেই ইন্ডিয়াতে গাড়ি চালাতে অনেক বেশি এলার্ট থাকতে হয়। সাইড রোড ট্রাফিক, গরু ছাগল-কুকুর, সাইকেল, চোখ থেকেও অন্ধ মানুষ ইত্যাদি । এতো আর বাইরের দেশের হাইওয়ে নয় যেখানে গাড়ি ছাড়া অন্য কিছু উঠতেই দেয়না।

    আমি একবারই চালিয়েছি NH-৫ ধরে কলকাতা থেকে চেন্নাই । আর নয়, ঘাট হয়েছে। রাস্তা সমস্যা নয় , আসল সমস্যা মানুষ। মিনিমাম ড্রাইভিং না জেনে সব উল্টো দিকে হাইওয়ে তে গাড়ি চালায়। ধাক্কা লাগলে বড়ো গাড়ি যার তার দোষ, আর দামি গাড়ি হলে তো হয়েই গেলো, দরাদরি ওখানেই শুরু।

    বাইরে দেখি নরমাল GPS-মডেল গুলোতে ডিফল্ট সেটিংস এ ২-৩ ঘন্টা পরে থেকেই ওয়ার্নিং দিতে থাকে ব্রেক নেওয়ার জন্য। ফোনেতেও সেটিংস করে নেওয়া যায়। লং ড্রাইভ এ গেলে ২ -৩ ঘন্টা হাই স্পিড এ চালানোর পরে একটা ১০-১৫ মিন এর ব্রেক খুব দরকারি।
  • সিকি | ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৮:০৭370641
  • একমত। অনেক কমবয়েসী এইসব কাজকম্মো করে। একে বলে আয়রন বাট রাইডিং। মানে লোহার তৈরি পাছু। আমার ট্রিপ চলাকালীনই খবর পেলাম পশ্চিমবঙ্গে একটি ছেলে আয়রন বাট করতে গিয়ে আলটিমেটলি গার্লফ্রেন্ড সমেত ট্রাকের তলায়। দুজনেই শেষ।
  • de | 24.139.119.175 | ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭ ১২:২৮370643
  • বাপরে - একদিনে কলকাতা থেকে সোজা নামচি! বাচ্চা ছেলে - পোচ্চুর এনার্জি!!!
    খুব ভালো হচ্ছে- চলুক -
  • স্বাতী রায় | ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৯:১১370644
  • সোনি গুপ্তার গপ্পটা দারুণ লাগলো! "এ ছেলে ভূটান কেন, চাইলে আজ রাতেই চীনেও চলে যেতে পারে।" - পরে অনেকক্ষণ ধরেই নিজের মনে হেসে যাচ্ছি!
  • সিকি | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৯:৫৩370645
  • ২২শে অক্টোবর, তৃতীয় দিন

    ঘুম তো ভাঙল, কিন্তু এত সকালে তো করার কিছু নেই। খানিক ফেসবুক, খানিক হোয়াটস্যাপ সেরে আটটা নাগাদ মনে পড়ল উগিয়েনকে ফোন করতে হবে।

    উগিয়েনের সঙ্গে আমার আলাপ, মানে ভার্চুয়াল আলাপ ভুটানের পারমিটের খোঁজখবর করতে গিয়েই। কয়েক দিন আগেই বাংলা এক কাগজে একটি মেয়ের গল্প বেরিয়েছিল, সে স্কুটিতে করে কলকাতা থেকে ভুটান ঘুরে এসেছে – খোঁজ নিয়ে জানা গেল মেয়েটি আমার এক বন্ধুর স্ত্রীয়ের বন্ধু। ফোন নম্বর জোগাড় করতে সময় লাগল না, এবং তার পরে মেয়েটির সাথে কথা বলে তার কাছ থেকেই উগিয়েনের নম্বর পেয়েছিলাম। হোয়াটস্যাপে যোগাযোগ, এবং যখন আমি জয়গাঁওয়ের বিভিন্ন রকমের এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করে সন্তোষজনক আশ্বাস না পেয়ে রীতিমত তিতিবিরক্ত, তখন এই উগিয়েনই আমাকে বলেছিল, আমি তোমার অনলাইন পারমিটের ব্যবস্থা করে দেব। তোমাকে কোথাও লাইনে দাঁড়াতে হবে টবে না, একেবারে স্মুথ হবে তোমার ভুটান এন্ট্রি। তুমি শুধু আমাকে পাসপোর্টের কপিটা পাঠিয়ে দিও।

    দিয়েছিলাম। তার পরে আলাপ করে জেনেছিলাম উগিয়েন ট্রেকিং করে। বলেছিল – আমি তো কুড়ি একুশ পর্যন্ত ট্রেকিং দলের সাথে থাকব, তুমি আমাকে বাইশ তারিখে একবার হোয়াটস্যাপ করে রিমাইন্ডার দিয়ে দিও, আমি তোমার পারমিটের জন্য অনলাইন অ্যাপ্লাই করে দেব, তিন থেকে চারদিনে, তোমার ভুটান আসার অনেক আগেই তোমার হাতে পারমিট থাকবে। তুমি শুধু ফুন্টশোলিংয়ে পারমিট দেখাবে আর পারোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে।

    আজ সেই বাইশ তারিখ, অতএব, উগিয়েনকে হোয়াটস্যাপ করে রিমাইন্ডার দিলাম, সাথে সাথে তার উত্তর এল, হ্যাঁ, সে আজকেই আমার পারমিটের জন্য অ্যাপ্লাই করে দেবে।

    সোয়া আটটা নাগাদ দাঁত টাঁত মেজে বেরনো গেল। চায়ের নেশা আমার নেই – জাস্ট এমনিই উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটু এদিক ওদিক ঘুরে এলাম, শিলিগুড়ি জেগে গেছে অনেক আগে, চওড়া হিলকার্ট রোড তখন গাড়িতে পরিপূর্ণ, তার চারপাশে লোহাবাঁধানো ফুটপাথ হকারে ভর্তি, তারা উপচে পড়েছে রাস্তার ওপরেও, অটোওলাদের এলোপাথাড়ি দাঁড়িয়ে পড়া, তার মাঝেই দেখছি রাস্তার ধারে সারি সারি টাটা সুমো দাঁড়িয়ে আছে, তাদের গায়ে লেখা সিকিমের আর জলপাইগুড়ির বিভিন্ন জায়গার নাম – মঙ্গন, গ্যাংটক, জোরথাং, রোরাথাং, মালবাজার, বীরপাড়া, হাসিমারা। আর দেখছি এনবিএসটিসির ছোট ছোট মিনিবাস চলছে – সেখানে লেখা শিলিগুড়ি-পানিট্যাংকি, কিন্তু লেখা হিন্দিতে। পানিট্যাংকি নেপালের বর্ডার, কিন্তু জায়গাটা তো ভারতের মধ্যেই, তাও যে কেন উত্তরবঙ্গ পরিবহনের এই বাসটা হিন্দিতে বোর্ড লাগিয়ে ঘুরছে, কে জানে।

    রাস্তার ধারে ছোট ছোট খাবার দোকানে লোকজন ঢুকছে, বেরোচ্ছে, তাদের কেউ বেরিয়েছে ব্যবসার কাজে, কেউ ট্যুরিস্ট, কেউ ট্রেকার, কেউ বাইকার। আমিও তাদের একজন হয়ে ঢুকলাম, আহা, এত সুন্দর বানিয়েছিল ঘুগনি আর পরোটাটা – খান সাতেক খেয়ে তবে থামলাম। হোটেলে সাবান দিয়েছে, তবে শ্যাম্পু দেয় নি – অতএব পাশের দোকান থেকে দুটো শ্যাম্পুর পাতাও কিনতে হল – টানা দুদিন ধরে মাথায় হেলমেট চাপিয়ে রেখে চুল একেবারে চিটচিটে হয়ে গেছে। ফুটপাথে জনসমাগম বাড়ছে – গাঁদাফুলের মালা, খবরের কাগজ আর চুল কাটার লোক পাশাপাশি বসে তাদের দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহ করছে – মানে, দেখে বোঝাই যাচ্ছে না এটা কলকাতার মানিকতলা না শিলিগুড়ি।

    হোটেলে ফিরলাম, জম্পেশ করে চান টান সেরে এইবারে মোটরসাইকেলটা নিয়ে বেরোলাম। রিসেপশনের লোকটা বলল, এই এদিক দিয়ে সোজা চলে যান, দু নম্বর সিগন্যাল পেরোলেই সেবক মোড় পাবেন, ওখান থেকে বাঁদিকে ঘুরলে অনেক গাড়ি রিপেয়ারিংয়ের দোকান দেখতে পাবেন।

    গেলাম। দোকানও দেখলাম, কিন্তু একটা দোকানও খোলা পেলাম না। কিছু খাবারের জায়গা আর ওষুধের দোকান বাদ দিলে পুরো শিলিগুড়ি বেলা দশটার সময়ে আটকাঠ বন্ধ। কারণ? কারণ আজ রোববার। টিপিকাল কলকাতা। গাড়ি রিপেয়ারিং শপগুলোও যে ঠিক কেন বন্ধ, আশেপাশে জিজ্ঞেস করে জানলাম তারা বেলা এগারোটার সময়ে খোলে। তবে আজ খুলবে কিনা শিওর নয়।

    ধুত্তেরি বলে অবশেষে ফিরে এলাম হোটেলেই, বাঁদিকের ফগলাইট সেই স্ক্রু-খোলা অবস্থায় ঝুলতেই থাকল, ফেরার আগে হিলকার্ট রোডের ধারেই একটা পেট্রল পাম্প থেকে বাইকের ট্যাঙ্ক ফিল আপ করে নিলাম। হোটেলে পৌঁছে লাগেজ সমস্ত বাঁধাছাঁদা সেরে ছোট্ট করে একটা ফটোসেশন, তারপরে মোটামুটি পৌনে এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম ফাইনালি গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। শিলিগুড়িতে ফেরার আর গল্প নেই।




    কয়েক কিলোমিটার এগোতেই জনবসতি কমে এল, আর তখনই চোখে পড়ল রাস্তার বাঁদিকে একটু ঢালু, আর সেই ঢালু জমির শেষে পর পর কয়েকটা মোটরসাইকেল সারানোর দোকান। দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকতেই একটা ছেলে দৌড়ে এল, আর ঠিক তিরিশ সেকেন্ডে ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে আবার দৌড়ে গেল দোকানের ভেতর, মাপমত স্ক্রু-নাট নিয়ে চটপট ফিক্স করে দিল ফগলাইট। মাত্র কুড়ি টাকা আর দশ মিনিট সময়। ঘড়িতে বাজে বারোটা দশ। আবার বাইকে স্টার্ট দিলাম এবং চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই একটা অসাধারণ সুন্দর গাছে ঢাকা রাস্তার মাঝে চলে এলাম। সেভক ফরেস্ট। চারদিক সবুজে ঢাকা, আর তার মাঝখান দিয়ে রানওয়ের মত মসৃণ রাস্তা। অল্প এঁকেবেঁকে চলেছে।



    শিলিগুড়িতে এসে ইস্তক দেখছি বেশ চোখে পড়ার মত ভুটানের গাড়ি। প্রাইভেট গাড়ি, বাস, ট্রাক। লাল রঙের নাম্বারপ্লেট হয়, চেনা খুবই সহজ। আবহাওয়া দিব্যি মনোরম। কিছু বাইকারও দেখছি, বিদেশী নাম্বারপ্লেট, পেছনে ছোট্ট করে সুইটজারল্যান্ডের পতাকা লাগানো, দুই সুইস নাগরিকই হবে, দুই না, তিন – দুজন পুরুষ, একজন মেয়ে – তিনটে সুইস মোটরসাইকেলে করে তারাও চলেছে গ্যাংটকের দিকে।

    একটু পরেই সেই মনোরম জঙ্গলের রাস্তা শেষ হল, পাহাড় শুরু হল। আরও খানিক বাদে বাঁক ঘুরতেই চোখের সামনে চলে এল করোনেশন ব্রিজ। গ্যাংটক যাবার জন্য ব্রিজে ওঠার দরকার নেই, পাশ দিয়ে রাস্তা বেরিয়ে গেছে রংপোর দিকে, সেই রাস্তা ধরে এগোতে থাকলাম। সকালের পরোটা অনেকক্ষণ হজম হয়ে গেছে, কিন্তু গ্যাংটক – মানে, রানীপুল দেখাচ্ছে আর মাত্র পঞ্চান্ন কিলোমিটার, একেবারে গিয়েই খাবো না হয়!



    হোমস্টের মালিকটি বেশ ভাল, চলতে চলতেই একবার তাঁর ফোন পেলাম, স্পষ্ট ইংরেজিতে বেশ সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন রানীপুল এলাকায় এলেই যেন তাঁকে একবার ফোন করে নিই। কারণ হোমস্টে-টা, মানে তাঁর বাড়ি, ঠিক গ্যাংটক যাবার মেন রাস্তায় পড়ে না, ওটা রানীপুল থেকে একটা এক কিলোমিটারের ডাইভার্সন আছে।

    আড়াইটে নাগাদ রানীপুলে পৌঁছলাম। একবার ফোন করে ভদ্রলোকের কথামত বাঁদিকে গ্যাংটকের রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে টার্ন নিলাম। রানীপুলের বাজার এলাকা ছাড়িয়ে একটা ছোট সাদা রঙের ব্রিজ, পাতলা একটা নদীর ওপরে – এটাই রোরো নদী।





    বাড়িটা নদীর অন্য পারে, কিন্তু যে জায়গায় বাড়ি, সেইখান পর্যন্ত বাইক যাবে না। তাই নদীর এইপারে বাইক পার্ক করে লাগেজ নিয়ে যেতে হবে ঐ পারে। ছবির মত সুন্দর একটা পায়ে চলার কাঠের পুল – অনেকটা আমাদের লছমনঝুলার মিনিয়েচার ভার্সন, সেইটা পেরিয়ে রাশিরাশি গাঁদা আর টিউলিপ ফুলের ঝাড়ি পেরিয়ে ছোট্ট একটা বাড়ি। লাল রঙের দোতলা বাড়ি। আশেপাশে অবশ্য আরও অনেক বাড়ি আছে, তবে এই বাড়িটা, হয় তো লাল রঙের জন্যই চোখে পড়ে। বাড়িতে ঢোকার মুখেও সুন্দর বাগান, নানা রঙের ফুল সেখানে। গৃহস্বামী আর স্বামিনী আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। মধ্যবয়েসী লোকটির মাথায় নেপালি টুপি, কথায় কথায় জানালেন, এথনিসিটির দিক দিয়ে, তাঁরা নেপালিই – এই এলাকাটাই নেপালিদের।




    খিদে পেয়েছে খুবই – কিন্তু সে কথা বলার আগেই ভদ্রলোক বলে বসলেন, আপনি নিশ্চয়ই এখন লাঞ্চ আর করবেন না। আমাদের দিওয়ালির কিছু মিষ্টি আছে, খান। স্ত্রীকে বললেন চা করে দিতে।

    কী আর বলব, এর পরে আর লাঞ্চ চাওয়া যায় না। মনে ভাবলাম, কেন খেয়ে ঢুকলাম না একেবারে।

    মিষ্টি যা এল, সে মানে, যাকে বলে নিদারুণ। কে জানে, নেপালি মিষ্টি এ রকমেরই হয় কিনা। খানিকটা ঠেকুয়া ঘেঁষা – মনে হল ছানার জিলিপিকে টানা দেড় বছর রোদে শুকিয়ে আমসত্ত্ব বানালে যা হয়, সেই রকমের টেস্ট। অতি বিকট খেতে। – এ তো আর হোটেল নয়, লোকের বাড়ি, অতএব, সোনামুখ করে কোনওমতে সেই দুটো জিনিস গলার্ধকরন করলাম। এর পরে চা। একটু নোনতা কিছু দিলেও মুখটা ছাড়ত – মানে, লোকের মাথায় এত কম বুদ্ধি যে কেন হয় – মিষ্টির পরে চা দিলে কি আর চায়ে মিষ্টি লাগে?

    আমার ঘর দোতলায়। সেখানে লাগেজ তুলে আবার নিচে এসে বসা গেল, একটু আলাপ করি হোমস্টে মালিকের সঙ্গে।

    ভদ্রলোক এলআইসির এজেন্ট, দীর্ঘদিন সিকিমের বাসিন্দা, ভূমিপুত্রই বলা যায়। এখানে রো রো নদীর ধারে বাড়িটি বানিয়েছেন সে-ও প্রায় অনেক বছর হল, দোতলায় পর পর কয়েকটা ঘর, হোমস্টে হিসেবে ভাড়া দেন, নিচের তলায় নিজেরা থাকেন। একটি ছেলে, সে ক্লাস এইটে পড়ে। তার মা জানালেন, এই রো রো নদী আসলে তৈরি হয়েছে ছাঙ্গু লেকের জল থেকে। ওখান থেকে বেরিয়ে এসে গ্যাংটকের পাশ দিয়ে রানীপুল পেরিয়ে খানিক এগিয়ে এই ছোট্ট নদীটা পড়েছে গিয়ে তিস্তায়।

    তরাই ডুয়ার্সে এ রকম অনেক ছোট ছোট নদী তৈরি হয়। জলপাইগুড়িতে আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যেই এ রকম দুটো নদী আছে, – রুকরুকা আর চুকচুকা। কলেজ লাগোয়া ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান, সে চা বাগানে সেচ করা জল থেকে এই নদীদুটো তৈরি, খানিক এঁকেবেঁকে এগিয়েই তারা গিয়ে পড়েছে পাশের করলা নদীতে। পাহাড়ে হলে এই নদীগুলোকেই ঝোরা বলে। রো রো, সেই রকমেরই একটা ঝোরা।

    ক্রমশ বুঝলাম, হোমস্টে-র মালিকের একটু অভ্যেস আছে সিচুয়েশন নিজের কন্ট্রোলে রাখার এবং সকলের হয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবার। আমি চাই কিনা, সেটা না জিজ্ঞেস করেই উনি যেমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন আমি লাঞ্চ খাবো না, তেমনি উনিই আমার বাকি দিনের ইটিনেরারি তৈরি করে দিলেন। – একটু ফ্রেশ হয়ে নাও, তার পরে এলাকাটা একটু ঘুরে দ্যাখো, সানসেটের সময়ে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো এখানকার শিবজির মন্দিরে, এই এখান থেকে একটু আগেই, আমাদের গ্রামের মন্দির, খুব সুন্দর। … এমনিতে আমাদের গেস্টদের খাবার এই পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা তৈরি করে দেন, তবে এখন তো দিওয়ালির সিজন চলছে, আমাদের নেপালিদের কাছে দিওয়ালি খুব খুব বড় উৎসব, দেখি একবার জিজ্ঞেস করে – উনি ছেলেকে পাঠালেন পাশের বাড়িতে জিজ্ঞেস করার জন্য, ছেলে খানিক বাদে ফিরে এসে জানালো আন্টি থাকছেন না, তাই উনি বানাতে পারবেন না – সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক আমার দিকে ফিরে বললেন, তা হলে তুমি আমাদের সাথেই রাতে ডিনার করে নিও, আমরা সাড়ে সাতটাতেই ডিনার করি, আশা করি তোমার অসুবিধে হবে না।

    কী মুশকিল! এমনিতে আমার রাত সাড়ে দশটার আগে খাবার খাবার অভ্যেস নেই, তবে রাস্তায় বেরিয়ে ঘরের অভ্যেস তো চলে না, এদিকে দুপুরে পেটভরে খাওয়াও জোটে নি, তাই রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি হলে এমনিতে অসুবিধে নেই, কিন্তু সাড়ে সাতটায় তো আমি সন্ধ্যের চা-ও খাই না এমনিতে! কোনওরকমে তাঁকে থামিয়ে বললাম – আটটায় করলে চলবে?

    উনি বোধ হয় কাউন্টার-প্রশ্ন আশা করেন নি। দৃশ্যতই বেশ অসন্তুষ্ট মুখে বললেন, আচ্ছা, সে দেখা যাবে।

    একশো দশ কিলোমিটার চালিয়ে খুব কিছু ক্লান্তি আসে না, বিশেষত যে আগের দুদিনে দেড় হাজার কিলোমিটার চালিয়ে এসেছে। দোতলায় গিয়ে পোশাক অল্প বদলে তাই ক্যামেরা নিয়ে নিচেই নেমে এলাম। ছবির মত সুন্দর জায়গাটা, ছোট্ট পুল, রো রো নদী আর আশেপাশের ঘিরে থাকা পাহাড়েরা মিলিয়ে সৌন্দর্য আপ্রাণ বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করলেও বেরসিকের মত এখানে ওখানে হাইটেনশন তারের টাওয়ার আর খাপচা খাপচা বাড়িঘর, সেই সৌন্দর্যকে যথাসম্ভব নষ্ট করে ফেলেছে। কী আর করা, এ তো গ্যাংটকের গা ঘেঁষা, এখানে তো জনবসতি ঘন হবেই, আর জনবসতি বাড়লে সভ্যতার বাকি অভিশাপরাও আসবে।

    ঠিক পাঁচটার সময়ে ভদ্রলোক এসে আমাকে ধরলেন। একটা ট্র্যাকস্যুট আর মাথায় নেপালি টুপি চড়িয়ে নিয়েছেন, বললেন, চলো, শিবজির দর্শন করে আসি।

    এমনিতেই এই মন্দির ভগবান এসবে আমার বিস্তর অ্যালার্জি, তার ওপরে পাহাড়ের ভগবানরা দেখতে আদপেই হ্যান্ডসাম হয় না। সেই একবার আমার দুই বন্ধু – ব্ল্যাঙ্কি আর অর্পণের সঙ্গে গেছিলাম দয়ারা বুগিয়াল ট্রেকিং করতে। ট্রেকিং তো ঘণ্টা করেছিলাম, হ্যাহ্যা করে হাঁফাতে হাঁফাতে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ওপর নিচ করে এসেছিলাম – তা সে ফেরার পথে একটা মন্দিরে ঢুকেছিলাম। পাইলট বাবার আশ্রম। সে গল্প আমার পুরনো লেখায় আছে – তা সেখানে চেনা অচেনা সব রকম ভগবানের আখাম্বা আখাম্বা সব মূর্তি আছে, সে মানে অতীব কদাকার দেখতে ছিল সবকটা। শিবকে বাঁদর মনে হচ্ছিল, হনুমানকে মনে হচ্ছিল হেলিকপ্টার – এই রকম। অবশ্য সিকিমের ভগবানকে অন্য রকমের দেখতে হলেও হতে পারে।

    পুল পেরিয়ে অন্যপারে এলাম। একসাথে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করছিলাম সিকিম সম্বন্ধে। কত পার্সেন্ট সিকিমিজ, কত পার্সেন্ট অন্য কেউ – তা উনি বললেন, ঠিক কি বেঠিক জানি না, যে সিকিমিজ বলে আলাদা কোনও জনজাতি হয় না। এটা ভুটিয়া, লেপচা, নেপালি আর তিব্বতীদের একটা মিশ্র জাতি। কে কতদিন সিকিমের বাসিন্দা, তাই দিয়ে ডোমিসাইল নির্ধারিত হয়।

    প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটতে হাঁটতে উনি নানা কথা শোনাচ্ছিলেন, বেশির ভাগই নিজের সম্বন্ধে – উনি দুবার দিল্লি গেছেন, দিল্লি খুবই পল্যুটেড, ইত্যাদি ইত্যাদি। এক কিলোমিটারের মাথায় গিয়ে দেখলাম একটা লম্বা সিঁড়ি নেমে গেছে নদীর দিকে। উনি সেইদিকে ইশারা করে বললেন, নিচে, নদীর ধারে মন্দির।

    আমি একটা লম্বা দম নিলাম। পাহাড়ে আমার হাঁটাহাঁটির পারফরমেন্স খুবই খারাপ। সিঁড়িটা সুন্দরভাবে বানানো, মোটেই খাড়াই নয় – আন্দাজ নেবার জন্য আমি গুনতে শুরু করলাম, কারণ ফেরার সময়ে তো এতগুলো সিঁড়িই উঠতে হবে।

    একশো নিরানব্বইটা। তার পরে একটা লম্বা চাতাল, একটু এগিয়ে কংক্রিটের পথটা বেঁকে গেছে – সামনেই নদী, বড় বড় বোল্ডারের ওপর দিয়ে নেচে নেচে চলেছে রো রো নদী, আর নদীর ধারেই একটা আবার বড়সড় চাতাল, মন্দির।

    নদীর জলে নেমে খানিক এগিয়ে গেলাম। হিমশীতল জল, কিন্তু ভীষণ আরামদায়ক। এখনও ঠাণ্ডা পড়ে নি তেমন। এর পরে তাঁর কথামত তাঁর পিছুপিছু ঢুকতেই হল মন্দির চত্বরে। ঢোকার মুখেই এক পাঁজা কাঁসার বাসনকোসন নিয়ে মাজতে বসেছিলেন এক মহিলা, ভদ্রলোক তার সঙ্গে নেপালিতে খানিক কী সব হাসিমজার কথা বলে আবার এগোলেন। আমিও পিছু নিলাম। একটা গুহা মতন – তার ভেতরে পাথর কেটে ঘর বানানো, সেই ঘর ছাদ থেকে মেঝে সর্বত্রই সাদা টাইল দিয়ে বসানো, মাঝে একটা বড়সড় শিবমূর্তি। ঘরে আনুষঙ্গিক যা যা থাকে, তাইই ছিল, প্রদীপ, ধূপকাঠি ইত্যাদি।

    ভদ্রলোক এর পরে দাবি করলেন, ক্যামেরাটা দাও, শিবজির সাথে তোমার একটা ছবি তুলে দিই। … কী আর বলব, হাসি হাসি মুখে শিবজির কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হল, তিনি ছবি তুললেন, এর পরে দাবি পেশ হল তিলক লাগিয়ে নাও – পাশেই দাঁত টাঁত বের করে একজন পুরোহিত আলাপের ভঙ্গিতে হাসছিলেন, এইবারে তিনি একটা সিঁদুরে চোবানো দেশলাই কাঠি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন এবং আমার কপালে একটা সরু সিঁদুরের রেখা বানিয়ে দিলেন, হল তিলক পরানো।

    আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হয় এইসবে, আমি একেবারে তিলক ফিলক কাটায় অভ্যস্ত নই – কপাল সুড়সুড় করছে, কিন্তু আপাতত কিছু বলে লাভ নেই, ফেরার পথে অন্ধকারে মুছে নিলেই হবে। অতঃপর অনুরোধ এল, গুহাটিকে প্রদক্ষিণ করতে হবে। বেশ, তাও করলাম, প্রদক্ষিণ করতে করতে তিনি মন্দিরের গল্প বললেন।

    এই জমিটা স্থানীয় একজন ব্যক্তির। একদিন রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন, মহাদেব তাঁকে আদেশ করছেন, রো রো নদীর ধারে তাঁর মন্দির গড়ে দিতে হবে। সকালে উঠে সেই ব্যক্তি রো রো নদীর ধারে আসেন এবং এই জায়গায় এই গুহাটি আবিষ্কার করেন, গুহার পাথরটা এমনভাবে লম্বা লম্বা আড়াআড়ি হাল্কা খাঁজকাটা যে ওটাকে ‘একটা সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে’ টাইপের আইডিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়, এর সাথে দু ছটাক ভক্তি মিশলে তো আর কথাই নেই – সাপ মানেই মহাদেব, অতএব এইই উত্তম প্রশস্ত স্থান মহাদেবের মন্দির স্থাপনার। খুব নাকি জাগ্রত শিব, আশেপাশের অনেক গ্রাম থেকে লোকজন এসে মানত করে যায়, সবার মনষ্কামনা পূর্ণ করেন শিবজি।

    আসল কথাটি উনি বললেন সবার শেষে, তখন আমরা ফিরতি পথে সেই একশো নিরানব্বই সিঁড়ির কাছে এসে গেছি। ওনার থেকে জানলাম, শিবজির এমনই অসীম কৃপা – আলোচ্য ব্যক্তিটি সিকিম সরকারের ল্যান্ড ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী। আসলে তো এটা ফরেস্ট ল্যান্ড, কিন্তু শিবজির কৃপায় উনি এই জমির নেচার সরকারি দলিল দস্তাবেজে বদলে নিতে পেরেছিলেন, কোথাও কিছু আটকায় নি – তাই শিবজি এইখানে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন।

    এতক্ষণে গল্পটা ক্লিয়ার হল। ভদ্রলোক সরল বিশ্বাসে আমাকে মন্দিরের ইতিহাস বলে চলেছিলেন, ভাগ্যিস অন্ধকার হয়ে গেছিল, তিনি তাই আমার ঠোঁটে অবিশ্বাসীর তীব্র বাঁকা হাসিটা আর দেখতে পান নি।

    সাড়ে ছটায় আবার আস্তানায় ফেরত। একশো নিরানব্বইটা সিঁড়ি উঠতে একটু হাঁফাতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আমি দিব্যি উঠতে পেরেছি, কোনও অসুবিধে তো হয় নি! তার পর আবার এক কিলোমিটার হেঁটেওছি। তা হলে বোধ হয় সমস্যা সত্যিই হয় না অতটা। এই ট্রিপে আমার একটা ট্রেক আছে কদিন পরে। খুবই খাড়াই ট্রেক। তার একটা ফিটনেস টেট হয়ে গেল আজ।

    বিকেলে যে অত অনুরোধ করেছিলাম, তা মনে হয় পুরোটাই বিফলে গেল। ঠিক সাড়ে সাতটায় ছেলেকে দিয়ে ডাকিয়ে দোতলা থেকে আমাকে নামিয়ে আনলেন গৃহস্বামীবাবু। তাঁদের সঙ্গে ডিনার করতে হবে। সসঙ্কোচে তাঁদের ঘরে ঢুকলাম, অনতিবিলম্বেই খাবার ডাক এল।

    ঠিক যে আশঙ্কাটা করছিলাম, সেটাই। আপাদমস্তক ভ্যাজ। মানে, যে সে ভ্যাজ নয়, সেথায় কোনও আলু নেই, মটরশুঁটি নেই, ফুলকপি নেই, তার বদলে বোধ হয় মূলো ছিল, গাজর ছিল, লাউ ছিল, আর কী কী সব মিলিয়ে মিশিয়ে দুখানা ঘ্যাঁট ছিল – এমনকি ডালেও কীসব শাকপাতা ভাসছিল, মানে, আমি যা যা খাই না, ঠিক সেই সব জিনিস চারদিকে সাজিয়ে আমাকে রুটি খেতে দেওয়া হল। হায় হায়, একে তো দুপুরে খাওয়া জোটে নি, তার ওপরে একশো নিরানব্বইটা সিঁড়ি ভেঙে পেট আরও খালি – এর পরে এইসব জিনিস খাওয়া যায়?

    কুঁতিয়ে কাঁতিয়ে তিনখানা রুটি আর শাক বেছে ডাল দিয়ে খানিকটা ভাত কোনওরকমে খেয়ে উঠে পড়লাম। আপ্যায়নের কোনওরকম ত্রুটি ছিল না, কিন্তু কী করব, আমি ভ্যাজ খেতে পারি না।

    অতঃপর, খেয়ে উঠে আবার ড্রয়িং রুম। আমার মন তখন পুরোপুরি বিরক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে, ওপরে যেতে পারলে বাঁচি, কিন্তু গৃহস্বামীর সেদিকে কোনও নজর নেই। তিনি আমাকে শোকেসের ওপরে, অ্যালবামের র‍্যাক থেকে বিভিন্ন ফটো, অ্যালবাম, বই ইত্যাদি বের করে দেখিয়ে যা বোঝালেন তার মোদ্দা কথা হল এই, উনি ভূতত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত (জিও-কিছু একটা বলেছিলেন, ভুলে গেছি) কোনও একটা বিষয়ের ওপরে পড়াশোনা করে পেপার লিখেছিলেন, মানে কো-অথর ছিলেন, তো সেই পেপার পড়তে তাঁকে একদা কানাডায় ডাকা হয়েছিল, মন্ট্রিয়েল শহরে। সেইখানে গিয়ে উনি পেপার সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন, এবং সেখানকার জ্ঞানীগুণীদের নেপালী উত্তরীয় নেপালি টুপি ইত্যাদি প্রদান করে আসেন।

    কুড়ি মিনিট সেই সম্বন্ধে বক্তব্য পেশ করার পর তাঁর চোখ গেল তাঁরই ঘরের টেবিলের ওপর রাখা একটি ম্যাগাজিনের দিকে। ম্যাগাজিনের নাম – হিন্দুইজম টুডে। বেশ ভাবালু হয়ে ম্যাগাজিনটি আমাকে উল্টেপাল্টে দেখতে অনুরোধ করলেন।

    রাত হয়েছে, এখন যদি তাড়িয়ে দেয়, আমার থাকার জায়গা জুটবে না, স্রেফ এই ভয়ে আমাকে হিন্দুইজম টুডে-র পাতা ওল্টাতে হল। অ্যাজ এক্সপেক্টেড, ফিফটি পার্সেন্ট হিন্দুধর্মসম্পর্কিত কিছু বেড়াবার জায়গার বিবরণ, ভক্তিরসে পরিপুর্ণ ট্র্যাভেলগ এবং বাকি ফিফটি পার্সেন্ট ধর্মসংক্রান্ত বালবিচিতে ভরপুর একটি ইংরিজি পত্রিকা। শাইনিংদের জন্য আদর্শ। আমি অপেক্ষা করছিলাম, এর পরে কতক্ষণে নরেন্দ্র মোদীর কথা আসে, তা উনি সেদিকে না গিয়ে ম্যাগাজিনটি সম্পর্কে গুণকীর্তন শেষ করেই প্রসঙ্গ পালটে চলে গেলেন তাঁর হোমস্টে ব্যবসার দিকে। কীভাবে শুরু করলেন, এখন কেমন লোক আসে, ইত্যাদি। জানা গেল, ওঁর হোমস্টের ওপরতলায় একটি ঘরে একজন অতিথি দীর্ঘদিন ধরে রয়েছেন। পারকিনসনসে আক্রান্ত, জার্মান নাগরিক। প্রায় মাস ছয়েক হল আছেন। নিয়মিত বিল মিটিয়ে দেন, আর মুম্বাই থেকে প্রতি মাসে ওঁর জন্য কুরিয়ারে এক কার্টন করে ওষুধ আসে। স্ত্রী-কন্যা সবাই ছিল, আছে, কিন্তু পারকিনসনসে আক্রান্ত হবার পরে সংসার তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। কারুর নির্ভরতায় বাঁচবেন না বলে নিজে নিজেই ভারতে চলে আসেন সেই জার্মান ব্যক্তি, এবং সিকিমে এসে ওঁর এই হোমস্টে-টি খুব পছন্দ করে এখানেই থেকে গেছেন প্রায় ছ মাস হল। ঘর থেকে বিশেষ বেরোন না, লেখালিখি করেন, কারুর সাথেই মেশেন না।

    পরদিন আমাকে গ্যাংটকে যেতে হবে পারমিটের জন্য, সকাল সকাল বেরোতে হবে – ভেবেছিলাম এসে একবার চান করে নেব, কিন্তু হোমস্টে-তে কোনও টাওয়েল দেওয়া হয় না, আমি নিজেও কোনও তোয়ালে বা গামছা ক্যারি করছি না, অতএব, আজকের মত চান কাটিয়ে দিতে হল। পৌনে নটা নাগাদ শুভরাত্রি জানিয়ে ওপরের তলায় নিজের ঘরে গিয়ে খিল দিলাম।

    কাছেই কোথায় যেন একটা মাইকে কেউ মাঝে মাঝেই টেস্টিং করে যাচ্ছে। খুবই কাছে, বেশ জোরালো আওয়াজ। ভাবলাম, কোনও অনুষ্ঠান চলছিল হয় তো, শেষ হচ্ছে। নিচের তলা থেকে আওয়াজ পাই নি, দোতলায় আওয়াজ একদম স্পষ্ট।

    কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ তো নয়, মনে হল শুরু হচ্ছে। একটা বাচ্চা ছড়া টাইপের কিছু একটা বলল মাইকে, বোধ হয় নেপালী ভাষায়। খুব সমবেত হুল্লোড়ের আওয়াজ আসছে, হাসিমজাইয়ার্কি, কমবয়েসী ছেলেমেয়ের দল। তারও খানিক পরে, মোটামুটি রাত দশটার একটু আগে থেকে মাইকে শুরু হল গান। নেপালী ভাষার অনুষ্ঠান। সেই ছোটবেলায় দূরদর্শনে দেখতাম, আর তারপরে আজ শুনছি।

    গানগুলো বেশিরভাগই নেপালী লোকসঙ্গীতের সুর, খুব ক্যাচি আর শ্রুতিমধুর, কিন্তু আমি তখন হা-ক্লান্ত। পেট ভরে নি, ঘুম পেয়েছে প্রচণ্ড, এদিকে কানের গোড়ায় মাইকে তখন গানের তাল আরও তীব্র হয়েছে, সমবেত হাহাহিহির পরিমাণও বেড়েছে প্রচণ্ড – এ কী বিড়ম্বনা!

    সাড়ে বারোটা পর্যন্ত চলল সেই সুমধুর অত্যাচার, তার পরে হঠাৎ করে থেমে গেল নেপালী ভাষার অনুষ্ঠান। আমি আর চোখ খুলতে পারছিলাম না, মাথার ভেতরে তখন কীরকম দপদপ করছিল, গানের জলসা শেষ হওয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়লাম।

    এক ঘুমে সকাল।
  • | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ১০:৪২370646
  • হ্যা হ্যা এই হোমস্টের আবার কি পোসোংশা করছিলে পৌঁছানোর আগে।

    গলাধঃকরণ। রেফ নেই
  • avi | 57.11.5.108 | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ১২:৫২370647
  • দিব্য চলছে।
    তিনটে জিনিস। এক, প্রপার শিলি অনেকটাই মানিকতলা প্যাটার্ন, বিশেষ করে রাস্তা এবং তার আশপাশ। দুই, সকালে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করার ব্যাপারে শিলি কলকাতার বাবা। ফার্স্ট হাফে প্রায় সবই বন্ধ থাকে। তিন, পানিট্যাঙ্কি যাওয়ার বাসে লেখাটা সম্ভবত নেপালী, স্ক্রিপ্ট একই। বাসে বাংলা, ইংরেজিও থাকে।
  • সিকি | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৫:৩৮370648
  • অক্কে।
  • শঙ্খ | 126.206.220.177 | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৮:৩৬370649
  • পড়ছি। চ্চলুক।
  • aranya | 172.118.16.5 | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৪:১৮370650
  • ছবি, লেখা সবই দারুণ, আর কাশবনটা জাস্ট মাইন্ড ব্লোয়িং
  • সিকি | ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৪:৫৭370651
  • এটা, জাস্ট ফর মাই ওন রেকর্ড দিয়ে রাখলাম। ভারি মোটরসাইকেল পড়ে গেলে সহজে তোলার টেকনিক।

  • সিকি | ০৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:৪৪370652
  • ২৩শে অক্টোবর, চতুর্থ দিন

    আজ সেই অর্থে কোথাও যাওয়ার নেই, গ্যাংটকেই আজ পারমিট বানানোর দিন। গ্যাংটক এখান থেকে এগারো কিলোমিটার, কিন্তু পৌঁছতে হবে সকাল নটার মধ্যে। ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে তাই বেরিয়েই পড়লাম, এমনিতেও সারাটা দিন আজ গ্যাংটকেই কাটাতে হবে, গ্যাংটকেও তো অনেক কিছু দেখার আছে - যদি পারি, দেখে নিই। হোমস্টে-তে খুব তাড়াতাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই। আজ রাতেও সেখানেই থাকতে হবে। এখন বুঝতে পারছি, রানীপুলের কাছে হোমস্টে দেখে খুব একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নি। এক তো লোকটিকে আমার পছন্দ হয় নি, দ্বিতীয়ত, দূরত্বটা বেশ খানিক দূর। এগারো কিলোমিটার। পাহাড়ি রাস্তায় এগারো কিলোমিটার মানে খুব কম রাস্তা নয়। আজ পারমিট হয়ে গেলেই পরের দিন সকাল সাতটার মধ্যে পৌঁছতে হবে এই এম জি মার্গে,পুলিশের পারমিট নেবার জন্য, সেইটা খুব চাপ হয়ে দাঁড়াবে। প্রপার গ্যাংটকে থাকার জায়গা হলে খালি মোটরসাইকেল নিয়ে সকালবেলায় এসে পুলিশ পারমিট করিয়ে নিতাম, তারপরে টক করে হোটেলে গিয়ে লাগেজ গুছিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে যেতাম। এখন কাল আমাকে অনেক ভোরে বেরিয়ে লাগেজ সমস্ত বেঁধে তৈরি হয়ে আসতে হবে। আবার ফিরে গিয়ে লাগেজ আনতে যাওয়া সম্ভব হবে না। ... দেখি, তিন দিন বাদে আবার তো গ্যাংটকেই ফিরে আসতে হবে, বুকিং ওখানেই করা আছে, সেইটাকে ক্যানসেল করে গ্যাংটক শহরের মধ্যে কোনও বুকিং করে রাখা যায় কিনা।

    মনন ভবন, গ্যাংটকে খুবই পরিচিত জায়গা। পৌনে আটটার মধ্যে গ্যাংটকে ঢুকতেই দেখতে পেলাম একটা প্রমিনেন্ট মোড়, সেখান থেকে বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন রাস্তা গেছে, ওপরের দিকে, নিচের দিকে। ডানদিকের একটা রাস্তা মোড় ঘুরতেই শেষ, শক্তপোক্ত লোহার বেরিয়ার দিয়ে ঘিরে রাখা একটা এলাকা। বেরিয়ারের ওপারেও রাস্তা আছে, তবে সে যেন এক টুকরো বিদেশ। কালো পাথরে মোড়া রাস্তা, সুন্দর ডিভাইডার, একটু দূরে দূরে বসার জন্য সুদৃশ্য বেঞ্চ, আর সবার আগে একটা মহাত্মা গান্ধীর প্রমাণ সাইজের মূর্তি। খুব চেনা জায়গা, গ্যাংটকের মল্‌, বা মহাত্মা গান্ধী মার্গ। এখানে গাড়ির প্রবেশ নিষিদ্ধ, কেবল পায়ে হেঁটে ঘোরা যায়।




    আর সেই মোড়ের বাঁদিকে একটু এগোতেই বাঁদিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে একটা বেশ বড়সড় সবুজ রঙের বিল্ডিং, অ্যাপ্রোচ রোডটা একদম খাড়াই নেমে গেছে মেন গেটের দিকে। সিকিম সচিবালয়, সেক্রেটারিয়েট, এরই নাম মনন ভবন। এখানেই সিকিমের পাসপোর্ট অফিস, আর এখান থেকেই প্রতিদিন পারিমিট লেটার ইস্যু হয়।



    ঘড়িতে এখন বাজে আটটা, অবশ্যই অফিস খোলে নি, অফিসের গেটও খোলে নি। মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে চলে এলাম মলএর দিকে। সকাল বেলায় মল একেবারে জনশূন্য। দু চারজন কর্মী বড় বড় ঝাঁটা নিয়ে সাফ করছেন চত্বর। লোহার ব্যারিকেডের ঠিক সামনেই বাইকটাকে রেখে ঢুকলাম ভেতরে। সামনে আরও দু চারজনকে দেখা যাচ্ছে, হাতে পারমিটের জন্যই কাগজপত্র। এদের মধ্যে ঠিক বাইকার তো কাউকেই দেখছি না, যাই হোক, ফলো করেই দেখি কোথায় যায়।

    গান্ধীজির মূর্তির ঠিক ডানদিকেই একটা সিঁড়ি নেমে গেছে, সিঁড়িটা শেষ হয়েছে একটা বড় লোহার গেটের সামনে, যার ওপরে লেখা, সিকিম পাবলিক সার্ভিস কমিশন। লোকগুলো সেখানেই ঢুকছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এই সেই জায়গা, যেখানে প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে রুটের পারমিট দেওয়া হয়। আর আমার আশেপাশে যে লোকগুলো হাতে কাগজ নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে, তারা সকলেই এখানকার ক্যাবের ড্রাইভার। টুরিস্টদের বুকিং আছে, তাদের কাগজপত্র নিয়ে পারমিট করাতে এসেছে। ক্যাবের পারমিটের জন্য মনন ভবনে যেতে হয় না, ওদের এখান থেকেই পারমিট বেরোয়। রাস্তার অন্যদিকে আরেকটা বড় বিল্ডিং, সিকিম পুলিশের সদর দফতর। গেটের মুখেই একটা ছোট খাবারের দোকান, সদ্য ঝাঁপ খুলছে, আর তার পেছনে একটা বড়সড় পার্কিং লট, কমার্শিয়াল গাড়ির, তার পেছনের পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে ধূসর রঙের মেঘ। আস্তে আস্তে ঢেকে যাচ্ছে সবুজ রঙের পাহাড়টা।

    খিদে পেয়েছে সাঙ্ঘাতিক। কাল সারাদিনে প্রায় কিছু জোটেনি খাবার মত। লম্বা জার্নিতে ঠিকঠাক খেতে না পাবার অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু সকাল আটটার গ্যাংটক শহরে দাঁড়িয়ে খালিপেটে মনন ভবন খোলার অপেক্ষা করার কোনও মানেই হয় না। গুটিগুটি ঢুকলাম পুলিশ স্টেশনের গেটের মুখে সেই ছোট্ট রেস্টুরেন্টে। কী পাওয়া যাবে?

    মোমো। জয়গুরু, চিকেন মোমো তৈরি আছে। এক প্লেট মোমো আর গরমাগরম কফি অর্ডার দিয়ে দিলাম। ঝটপট এসেও গেল তারা টেবিলে। টেবিলের পাশেই জানলা, সেখান দিয়ে দেখছি, একপ্রস্থ মেঘ গড়িয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে, সবুজ পাহাড় আবার দৃশ্যমান, ওপরের দিকে আরেকপ্রস্থ মেঘ গড়িয়ে নামার তোড়জোড় করছে। সারা আকাশই মেঘে ঢাকা, রোদের ছিটেফোঁটাও নেই কোথাও। অবশ্য, ঠাণ্ডাও নেই বিশেষ।

    পেটপুরে মোমো আর কফি খেয়ে এগনো গেল মনন ভবনের দিকে। নট বাজতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি, গেট খুলে গেছে, ভেতরে লোকজন ঢুকছে মোটরসাইকেল নিয়ে - একজন, দুজন। মোটরসাইকেল রাখতে গিয়ে খেয়াল করলাম, পাশেই আরেকটা মোটরসাইকেল, দিল্লির নম্বর।

    মনন ভবনের ভেতরে ঢোকার নিয়ম নেই, দরকারও নেই, ঠিক নটার সময়ে মূল প্রবেশপথের পাশে একট কাচের ঘরে একজন মহিলা এসে বসলেন, এবং সবাইকে একটা সাদাসিধে ফর্ম ভরতে দিলেন। নিতান্তই সহজ সরল, নাম ঠিকানা, কজন যাচ্ছে, গাড়ির নম্বর, ড্রাইভিং লাইসেন্সের নম্বর, কোন কোন জায়গা যেতে চাও। মহিলার সঙ্গে একজন সহায়ক, তিনি জিজ্ঞেস করামাত্র ধৈর্য ধরে সব্বাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কী কী ভরতে হবে, লিখতে হবে, কী কী দরকার আর কী কী দরকার নেই।

    আমি ফর্ম ভরলাম। একটানা নর্থ আর ইস্ট সিকিমের যাবতীয় গন্তব্যের নাম লিখে তো দিলাম, ফর্মটা সহায়কের হাতে দেওয়ামাত্র তিনি চোখ বুলিয়ে বললেন, চোলামু কেটে দাও, ওটার পারমিট পাবে না, বাকি সব ঠিক আছে।

    চোলামু, গুরুদোংমার লেকের থেকে মাত্র চার পাঁচ কিলোমিটার এগোলেই আরেকটা ছোট লেক। এমনিতে দেখার কিছু নেই, বিশেষত্ব হচ্ছে, এই লেকটা একেবারে যাকে বলে ব্যাং অন দা চায়না বর্ডার। সদাসর্বদা আর্মির পেট্রলিং চলে, তাই সিভিলিয়ানদের এর ধারেকাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। পারমিট পাওয়া যায় না।

    ঠিক আছে, চোলামু না হোক, গুরুদোংমারই সই। চোলামু কেটে দিলাম, সাথে মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পল্যুশন সার্টিফিকেট আর ইনশিওরেন্সের ফোটোকপি নিয়ে জমা করে দিলাম, ভদ্রলোক নিয়ে বললেন, ঠিক চারটের সময় চলে এসো, লেটার পেয়ে যাবে।

    বেরিয়ে আসার আগে একটু চারদিকে চোখ বোলালাম। আমার পাশে বসেই একটি কমবয়েসী ছেলে বসে একই ফর্ম ভরছিল, হাতে একটা পলিথিনের শাড়ির দোকানের প্যাকেট, তার মধ্যে তার ডকুমেন্ট সব রাখা, ছেলেটির চোখমুখ এবং প্যাকেটের শাড়ির দোকানের নাম বলে দিচ্ছে, ছেলেটি বাঙালি। সিকিমে বাঙালি ট্যুরিস্ট এবং বাইকারের সংখ্যা সবসময়েই বেশি। - আলাপ জমালাম। বলল, বাবার সঙ্গে এসেছি। প্রতি বছরই আসি বাবাকে নিয়ে, বাবাকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে একবার করে গুরুদোংমার ভিজিট করে আসি।

    বেশ কথা। শুনেছি, রাস্তা খুব খারাপ ঐ রুটে, বাবাকে পেছনে নিয়ে চালাতে সমস্যা হয় না?

    ছেলেটা কম কথার মানুষ। একটু হেসে বলল, অভ্যেস হয়ে গেছে।

    পরমুহূর্তেই দেখি, একটি দম্পতির সঙ্গে সেই সহায়ক ব্যক্তিটির বেশ তুমুল তর্কবিতর্ক হচ্ছে। দম্পতিটিকেও শুরু থেকেই দেখছি, তাঁরা বোধ হয় পুণে বা মুম্বাই থেকে এসেছেন, বারবার করে প্লিড করছেন - ইয়ার মুঝে পতা নেহি থা, ক্যায়সে পতা চলেগা, দো দিন কে লিয়ে হি আয়া হ্যায়, প্লিজ পারমিট দে দো, আর সহায়ক তাঁর বক্তব্যে অবিচল, না, পারমিট দেওয়া যাবে না।

    কেসটা কী? এমনও হয় নাকি? কোনও পেপার, ডকুমেন্ট শো করাতে পারেন নি কি তাঁরা? কান পেতে শুনে যা বুঝলাম, তাঁরা পরের দিন ছাঙ্গু আর নাথু লা যেতে চান। মানে, ইস্ট সিকিম। এখন, নাথু লা-ছাঙ্গু প্রতি সোম আর মঙ্গলবার সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ থাকে, সেদিন কোনও ভিজিটর অ্যালাওড নয়। সহায়ক ভদ্রলোক বলছেন, আপনারা অন্য কোথাও ঘুরে নিন কালকের দিনটা, আমি পরশুর জন্য পারমিট করে দিতে পারব, এদিকে এনাদের পরের দিনেরই বুকিং আছে জুলুকে, এবং তার পরের দিনই ফেরার রাস্তা ধরতে হবে, হাতে এই একটা দিনই। তাই আকুতি, প্লিজ পারমিট দিয়ে দিন, আর ভদ্রলোক একটানা বলে যাচ্ছেন - কী করে দিই, এটা তো আর্মির রুল, ওরা অ্যালাও করবে না, দেবার নিয়ম নেই -

    খানিকক্ষণ দেখে বেরিয়ে এলাম। পৌনে দশটা বাজে। কী করা যায়? কোথায় বেরিয়ে আসা যায়? গ্যাংটকে বেশ কিছু দেখার জায়গা আছে বটে, তবে সবই আমার দেখে আসা কলেজজীবনে। দেখা নেই একটা জিনিস - রুমটেক মনাস্ট্রি। সকালে রানীপুল থেকে গ্যাংটক আসার পথে একটা ছোট ডাইভার্সন দেখেছিলাম, লেখা ছিল, ওয়ে টু রুমটেক মনাস্ট্রি। রুমটেকের গল্প পড়েছিলাম সেই সমরেশ মজুমদারের অর্জুন সিরিজে, রুমটেক মনাস্ট্রির হীরে। এর আগে গ্যাংটক এলেও তাশি ভিউ পয়েন্ট, হনুমানটক ইত্যাদি দেখেছি, রুমটেক দেখা হয় নি। তো, চলা যাক রুমটেক। বাইকের মোবাইল মাউন্টে মোবাইল লাগিয়ে ডেস্টিনেশন সেট করতেই দেখাল তেইশ কিলোমিটার।

    এগোলাম। সেই মোড়েও পৌঁছে গেলাম, ওয়ে টু রুমটেক মনাস্ট্রি লেখা ফলকটার পাশ দিয়ে রুমটেকের রাস্তা নিয়েও নিলাম। এইবারে যাচ্ছি তো যাচ্ছি, রুমটেকের দূরত্ব কমছে ঠিকই, কিন্তু আশেপাশে কেমন যেন জনমনিষ্যি দেখতে পাচ্ছি না, রাস্তা বলেও প্রায় কিছুই নেই, নেহাত বাইক বলে চলছে, গাড়ি বোধ হয় এ রাস্তা দিয়ে যায় না, একে তো সরু, মাঝেমধ্যে কাদা, স্লাশ, আর পাথর, এবড়োখেবড়ো।

    অনেকটা চলার পর, যখন দেখাচ্ছে রুমটেক আর আটশো মিটার, তখনও নজরে কোনও মনাস্ট্রি ইত্যাদি আসছে না। কেবল দেখলাম একটা ছোট মোড় মতন, সেখানে একজন লোক বসে আছে, জিপিসে দেখাচ্ছে এখান থেকে ডানদিকে আটশো মিটার। এদিকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ডানদিকের রাস্তা একটু এগিয়েই শেষ। লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম - রুমটেক মনাস্ট্রি ...? সে আমাকে হাত তুলে অন্য সোজা রাস্তাটা দেখিয়ে দিল।

    কী করা যায়? যা হয় হোক, সারাটা দিন তো সময় আছে, সোজাই এগিয়ে দেখি।

    একটু এগোতেই রাস্তা আরও খারাপ হল, আর জিপিএস কী সব ক্যালকুলেশন করে নতুন করে দূরত্ব বের করে জানাল, রুমটেক আর চোদ্দ কিলোমিটার।

    যাব্বাবা! এ কোথায় এলাম রে বাবা - কোথাও কোনও সাইনেজ নেই, শুনেছি তো খুবই বিখ্যাত মনাস্ট্রি, কেউই কি আসে না এখানে? আরও দু কিলোমিটার গেলাম - কোত্থাও কেউ নেই, একটা লোক নেই, একটা গাড়ি নেই, জাস্ট গাছপালা, আর শুঁড়িপথ, মনেও হল না এ রাস্তায় কোনও গাড়ি চলে বলে।

    অগত্যা রণে ভঙ্গ দিতে হল। রুমটেক না দেখেই আবার ফিরে এলাম উল্টোরাস্তায় - বারোটার সময় আবার গ্যাংটকের মলএ। উদ্দেশ্যহীনভাবে খানিক ঘোরাঘুরি - সকালের মোমো কখন হজম হয়ে গেছে, খিদে পেয়েছে বিস্তর। এম জি মার্গের পাশেই একাধিক সিঁড়ি নেমে গেছে জায়গায় জায়গায় নিচের রাস্তার দিকে - সেই রকমই একটা সিঁড়িতে নামার মুখেই একটা বাঙালি রেস্টুরেন্ট, সেখানে ঢুকলাম, ম ম করছে মাছমাংসের গন্ধে।

    আহা, কী খেলাম! আলুভাজা, বড়ির তরকারি, বাটা মাছের ঝাল, মাটন কষা আর শেষপাতে চাটনি। কালকের যত অখাদ্য খাওয়া খেতে হয়েছিল, সবকিছুর শোধ তুললাম গলা অবধি গিলে।

    খেয়ে দেয়ে পেট তো ভরল, কিন্তু মন উঠল অভিমানে উথলে। গ্যাংটকে এত ভালো ভালো খাবারের অপশন থাকতে আমি কিনা মাত্র এগারো কিলোমিটার দূরে বসে ভ্যাজ খাবো? আর ঐ ভদ্রলোকের হ্যাজ শুনতে বাধ্য হব? কভি নেহি!

    তিন দিন বাদে আমার আবারও ঐ হোমস্টে-তেই বুকিং করা আছে, নর্থ সিকিম ঘুরে এসে একরাতের জন্য গ্যাংটকে স্টে, তার পরের দিন আবার ইস্ট সিকিমের জন্য এগনো। ঝটপট সেই বুকিং ক্যানসেল করে ফেললাম। সকাল থেকে গ্যাংটকের এমাথা থেকে ওমাথা ঘোরাঘুরি করে শহরটা এখন মোটামুটি মুখস্থ হয়ে গেছে, সুতরাং একটু নেট ঘেঁটে ঝটপট একটা হোটেল সিলেক্ট করে ফেললাম শস্তা দেখে - শহরের মধ্যেই, মল থেকে জাস্ট আড়াই কিলোমিটার দূরে। ঝট করে মোটরসাইকেলটা নিয়ে ম্যাপ দেখতে দেখতে হোটেলের সামনে পৌঁছে গেলাম, নর্থ বা ইস্ট সিকিম যাবার রাস্তাতেই পড়ে হোটেলটা। ওখানে দাঁড়িয়েই অনলাইন বুকিং সেরে নিলাম।

    চারটে প্রায় বাজে। পারমিটের চিঠি নেবার সময় হয়ে গেছে। অতএব ফিরে এলাম মনন ভবনে। সকালবেলার ডেজার্টেড লুক এখন আর নেই, গাড়িতে মোটরসাইকেলে বেশ জমজমাট। কাচের ঘরে মহিলাটি এখন আর নেই, তবে সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে বসে রয়েছে সকালবেলার প্রচুর চেনা মুখ। কেরালা থেকে আসা বাইকারদের একটা দল, সেই ছেলেটি যে কিনা প্রত্যেক বছর বাবাকে পিলিয়নে বসিয়ে গুরুদোংমার বেড়াতে আসে, আরও বেশ কিছু জন।

    ঠিক চারটে বেজে সাত মিনিটে সেই সহায়ক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন - হাতে একতাড়া কাগজ নিয়ে। একে একে নাম পড়ে ডাকতে লাগলেন, আর প্রত্যেকের হাতে পারমিটের চিঠি ধরিয়ে দিতে থাকলেন। আমারও নাম এল, ছখানা চিঠি পেলাম। বয়ান একই - একটা আমার নিজের কপি, আর অন্য পাঁচটা বিভিন্ন জায়গায় সাবমিট করতে হবে।



    সিকিমের পারমিট পাবার পদ্ধতি এতটাই সোজা। স্রেফ ফর্ম ভরে সকালে জমা করা, আর বিকেলবেলা গিয়ে চিঠিগুলো নিয়ে নেওয়া। আলাদা করে কোনও ভেরিফিকেশনের প্রসেস নেই, মানে, আমার বদলে আমার চেনা কেউ যদি এই কাজটাই আমার হয়ে করে রাখতে পারে, তা হলে আমাকে গ্যাংটকে একটা দিন বাড়তি স্টে করারও দরকার হয় না।

    চিঠি নিয়ে ফিরে আসা গেল মলএ। মলও এখন জমজমাট। সমস্ত দোকানপাট খোলা, লোকজন টুরিস্ট গিজগিজ করছে।



    বসে বসে ফেসবুক ঘাঁটছি, একটা মেল এল। উগিয়েনের। আমার ভুটানের ই-ভিসা হয়ে গেছে, পিডিএফ পাঠিয়ে দিয়েছে, লিখেছে, এইটার প্রিন্ট আউট নিয়ে ফুন্টশোলিংয়ের ইমিগ্রেশনে দেখালেই আর কোনও লাইন নেই, কোনও জিজ্ঞাসাবাদ নেই, সোজা এন্ট্রি হয়ে যাবে ভুটানে।

    বাঃ, খুবই ভালো কথা, কিন্তু এখন এখানে আমি প্রিন্ট আউট পাই কোথায়?

    মলএর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরলাম। সব রকমের দোকান আছে, কিন্তু সাইবার কাফে নেই। একজন বলল, ওই কোণের ওই রাস্তাটা ধরে একটু ওপরে উঠে যাও, পাবে। তাও গেলাম - কিন্তু না, কোনও সাইবারকাফে টাফে নেই কোথাও। তা হলে উপায়?

    উপায় এখন সেই হোমস্টে-র লোকটিই, সেই বিরক্তিকর লোকটি, যদি তার বাড়িতে প্রিন্টার থাকে, তা হলে সেখান থেকেই প্রিন্ট নিতে হবে। আশা করি তার কাছে এত তাড়াতাড়ি ইন্টিমেশন পৌঁছয় নি আমার পরের স্টে ক্যানসেল হবার।

    সন্ধ্যে ছটা বাজে। পেট যদিও ভর্তি, কিন্তু রাতে তো খিদে পাবেই, একখুনি তাই ফেরার দরকার নেই। কে জানে, আজকেও সে পাড়ায় নেপালিদের দিওয়ালির উৎসব পালনের ব্যাপার আছে কিনা।

    মলএই খানিক বসে রইলাম। কী আর করব, এমনিতে তো টাইম কিল করা ছাড়া আর কিছু করার নেই, সন্ধ্যে হবার পরে ঠাণ্ডাও অল্পস্বল্প পড়েছে, তাই খানিক বসে থেকে আবার গুটিগুটি চলে গেলাম সেই দোকানে, যেখানে দুপুরে গাঁতিয়ে খেয়েছিলাম। খানিক মাটন কষা আর তিনটে রুটি একটা থার্মোকলের প্লেট সমেত প্যাক করে নিয়ে গ্যাংটক ছেড়ে পাকাপাকি ফিরেই চললাম রানীপুলের দিকে। কাল সক্কাল সক্কাল উঠে চলে আসতে হবে, এসে পুলিশের কাছে লাইন দিয়ে পারমিট তুলতে হবে, দিয়েই বেরোতে হবে লাচেনের উদ্দেশ্যে। তাই আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া দরকার। ফেরার পথে বাইকে আর জেরিক্যানে পেট্রলও ভরে নিলাম। কাল সকালে আর ভরার জন্য থামতে হবে না।

    সাড়ে সাতটার সময়ে ঢুকলাম হোমস্টে-তে, ঢুক্তেই দেখা সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে, বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন - আজ আর চা-ও অফার করলেন না।আমিই যেচে বললাম, কাল সকাল সাড়ে ছটায় বেরোব, আপনাদের কাজের ছেলেটাকে একটু বলে রাখবেন আমাকে পুল পার করে লাগেজগুলো বাইক অবশি দিয়ে আসতে হবে এক দু খেপে। উনি খুব শান্ত স্বরে বললেন, বেশ, বলে দেব। - একবারের জন্যও আর রাতে খাবো কিনা ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলেন না, খাবার অফারও করলেন না। অবিশ্যি তাতে আমিই বর্তে গেলাম। খেতে বললে না-ই বলতে হত।

    এর পরে প্রিন্ট আউটের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম। হ্যাঁ, ওনার প্রিন্টার আছে। তো, এই ভিসা পেপারটার তিন কপি প্রিন্ট আউট পাওয়া যাবে? দু কপি হলেও হবে। উনি আরও শান্ত স্বরে বললেন, এটা তো তোমার ভুটানের পেপার, না? তুমি তো নর্থ সিকিম সেরে আবার এখানে আসবে? তখন প্রিন্ট আউট নিয়ে নিও।

    মানে, ভদ্র ভাষায়, দেবেন না। একটা প্রিন্ট আউট নিতে খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট লাগে - কিন্তু যে হেতু তখন সাড়ে সাতটা বাজে, তাঁর ডিনার টাইম, তাই তিনি কিছুই আর করবেন না।

    বয়ে গেছে। আমি অন্য কোথাও দেখে নেব।

    একটু ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল, কিন্তু তবু মাটন কষা আর রুটি খেয়ে মন আর পেট দুইই ভরে গেল। আজ রাতে আর কোথাও গানের আসর বসে নি - চারিদিক নিস্তব্ধ। রাত সাড়ে নটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম। আসল বেড়ানো কাল থেকে শুরু।
  • রোবু | 213.132.214.83 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:১৩370654
  • সিকি, "মিষ্টি যা এল, সে মানে, যাকে বলে নিদারুণ। কে জানে, নেপালি মিষ্টি এ রকমেরই হয় কিনা। খানিকটা ঠেকুয়া ঘেঁষা – মনে হল ছানার জিলিপিকে টানা দেড় বছর রোদে শুকিয়ে আমসত্ত্ব বানালে যা হয়, সেই রকমের টেস্ট। অতি বিকট খেতে।" - এটার নাম শেলরুটি। বেশ ভালো খেতে হয়। হয়তো তুমি যে হোমস্টে-তে ছিলে, তারা ভাল বানাননি। অনেকটা শুকনো মালপো-র মত খেতে হয়।
  • রোবু | 213.132.214.83 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:১৯370655
  • "এটা ভুটিয়া, লেপচা, নেপালি আর তিব্বতীদের একটা মিশ্র জাতি।" - সঠিক।
  • সিকি | 158.168.40.123 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:২৭370656
  • হ্যাঁ, অনেকটা শুকনো মালপোয়ার মতই খেতে, কিন্তু বিকট মিষ্টি কম। র‌্যাদার একটু যেন নোনতাও ছিল।
  • রোবু | 213.132.214.83 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:৩৮370657
  • তাই-ই হয়।
  • রোবু | 213.132.214.83 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:৪১370658
  • https://en.wikipedia.org/wiki/Sel_roti
    আমি যতবার দিওয়ালির সময়ে সিকিম গেছি, ততবারই খেয়েছি।
    তুমি যদি দিওয়ালির দিন যেতে, তাহলে আর এক অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেতে। দোল বেঁধে একেবারে নার্সারি থেকে কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা তোমার ঘরে/হোমস্টেতে/হোটেলে আসবে, গান, আবৃত্তি এসব করবে, তারপর কিছু টাকা চাইবে।
  • সোমনাথ | 167.49.36.201 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১৩:২৭370659
  • ভালো চলছে , চলুক !

    সিকিম এ GPS ব্যবহার করা যাবে না ? মানে ম্যাপ নিয়ে ঘুরতে হবে না কি ?
  • সিকি | 158.168.40.123 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১৩:৫২370660
  • তা কেন! ওহো, ঐ পারমিটের চিঠিতে যেটা লেখা আছে?

    না না, তেমন কোনও ব্যাপার নয়। মোবাইলের জিপিএস তো প্রকাশ্যেই আমার মাউন্ট করা ছিল। কেউ কিছু বলে নি, বলেও না। আর এমনিতে, পাহাড়ি এলাকায় রাস্তার তো খুব একটা ব্র্যাঞ্চিং হয় না, একটাই রাস্তা এঁকেবেঁকে চলতে থাকে, তাই জিপিএস না হলেও কিছু এসে যায় না।
  • রোবু | 213.132.214.85 | ০৯ জানুয়ারি ২০১৮ ১০:৪০370661
  • না, রুমটেক নিয়ে জিপিএস ছড়ানোয় বলছে।
  • de | 69.185.236.57 | ০৯ জানুয়ারি ২০১৮ ১২:৫১370662
  • ভালো হচ্চে -

    সিকির ফটোতে এমন আর্মি জোয়ানদের মতো পোশাক কেন? কোন সুবিধে আছে এই পোশাকের?
  • সিকি | ০৯ জানুয়ারি ২০১৮ ১৩:২৯370663
  • ধুউর, সুবিধে কেন? আমার একপ্রস্থ এই জংলাছাপ জামা আর কার্গো আছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরি, বাকি জামাকাপড়ের সাথে। আমার ডিজাইনটা ভালো লাগে।
  • dc | 57.15.184.55 | ০৯ জানুয়ারি ২০১৮ ১৫:১১370665
  • সীমান্তে দাঁড়াতে সুবিধে হয় মনে হয়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন