এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগল

    সিকি লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ১০ নভেম্বর ২০১৭ | ৩১৮১৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সিকি | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ২৩:১৬370699
  • সব ছবি তুলতে নেই :)
  • সিকি | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ২২:১১370700
  • আঠাশে অক্টোবর, নবম দিন

    গান শুনে ঘুমিয়েছিলাম, ঘুম ভাঙল গানের সুরে। সকাল সাড়ে ছটা, কাচের জানলা ভেদ করে ঘুমন্ত আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে সকাল বেলার রোদ্দুর। আমার কিনা মুণ্ডুটাও লেপের তলায় ছিল, তাই আমি বুঝতে পারি নি।

    তাড়াতাড়ি উঠে ধড়াচুড়ো পরে বাইরে এলাম। কাঁচা সোনার রঙের রোদ ছেয়ে আছেসামনের মাঠটা জুড়ে, আর আকাশের দিকে তাকালে চোখ সরিয়ে নিতে হয়, এমন চোখ-ধাঁধানো নীল। সামনে ভুলো কুকুর আপন খেয়ালে নেচে বেড়াচ্ছে দুই মেঘবালিকার আশেপাশে, আর তারা বালতি নিয়ে জল ভরছে সামনের একটা নল থেকে, গলা বেয়ে উঠে আসছে অদ্ভূত মাদকতাময় গানের সুর, ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, ভরিয়ে দিচ্ছে আমাকে।

    মোটরসাইকেলটার দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। সারারাত শিশির পড়েছে, এবং তার পরে তাপমাত্রা চলে গেছে শূন্যের নিচে, ফলে সেই ফোঁটা ফোঁটা শিশিরের বিন্দুরা কিছু টের পাবার আগেই জমে বরফ হয়ে গেছে, স্বচ্ছ। ট্যাঙ্ক, সীট আর ক্যারিয়ারের রড জুড়ে সেই স্বচ্ছ জমাট বাঁধা শিশিরদানারা।



    প্রাথমিক মুগ্ধতার রেশ কেটে গেলে পরের চিন্তাটা মাথায় আসে। খুব ঠাণ্ডায় মোটরসাইকেলের ব্যাটারি বসে যেতে পারে, স্টার্ট নিতে সমস্যা হতে পারে। স্পিতিতে এই স্টার্ট হবার সমস্যা নিয়ে খুব ভুগেছিলাম। তাড়াতাড়ি চাবি নিয়ে এসে স্টার্ট দিলাম, না, মোটরসাইকেলের ঠাণ্ডা লাগে নি, সাথে সাথে সাড়া দিল। আওয়াজে পেছন ফিরল মেঘবালিকাদের একজন, চায় পিওগে স্যর?

    নিশ্চয়ই খাব। মৃদু হেসে ঘাড় নাড়াবার ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার সামনে এসে হাজির হয়ে গেল ধূমায়িত চায়ের কাপ। কনকনে ঠাণ্ডায় এমন উষ্ণ আতিথ্যই কি ধীরে ধীরে গলিয়ে দিল আমার মোটরসাইকেলের সীটে জমে থাকা শিশিরদের? সকালের রোদে বোধ হয় অতটা উষ্ণতা ছিল না।

    কাল থেকে এই দুটি মেয়ে আর তাদের একজন বুড়ি মা (মাসি-পিসিও হতে পারেন) ছাড়া আর কোনও পুরুষকে দেখি নি এখানে। আজ দেখছি, সামনে একটা বোলেরো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, আর তাকে একটা কাপড় দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছে একটা ছেলে, বেশ মিষ্টি দেখতে। আমাকে দেখতে পেয়ে একগাল হেসে এগিয়ে এল, গুডমর্নিং ভাইয়া। দিল্লি সে আয়ে হো? সানরাইজ দেখনে নহি গয়ে?

    সানরাইজ? মানে, এখানকার সানরাইজ কি দেখার মতন কিছু ছিল? কেউ তো বলে নি!

    আরে ভাইয়া, কিছু মিস করলে তো। এখানে আমাদের গ্রামের ওই প্রান্তে একটা পয়েন্ট আছে, ওখান থেকে যে সানরাইজ দেখা যায় না, টাইগার হিলে অত ভালো সানরাইজ দেখতে পাবে না। এ হে, তুমি কি আজকেই চলে যাচ্ছো?

    আমি ঘাড় নাড়লাম, হুঁ, আমাকে তো আজই চলে যেতে হবে। যাঃ, এখানকার স্পেশাল সানরাইজ দেখা হল না তা হলে – আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আবার আসব নাথাং, একদিন না একদিন। তখন সানরাইজ দেখব এসে।

    মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। স্রেফ সময়টুকু দেখাচ্ছে। আর জিপিএসে পরের ডেস্টিনেশন অফলাইন সেট করা আছে, ফলে এর বেশি আর কিছু দেখার নেই মোবাইলের স্ক্রিনে।

    একটু বাদেই ব্রেকফাস্টের ডাক এল। ব্রেকফাস্ট এখানে কমপ্লিমেন্টারি। গরম গরম রুটি, এবং তার সাথে একবাটি ডাল আর আলুভাজা। এবং পেঁয়াজ। পেট ভরে খেলাম। এবার বিদায়ের পালা। এত ভালো একটা এক্সপিরিয়েন্স হল, যে এক রাতের থাকার যে ভাড়া, খুবই সামান্য টাকায় বুক করেছিলাম, তার ওপরে আরও একশো টাকা ধরিয়ে দিলাম মেঘবালিকাদের হাতে। তারা তো নেবে না কিছুতেই, শেষে জোরাজুরি করতে খুব লজ্জা পেয়ে নিল, এবং খুব খুব খুশি হল। আমাকে বলল, পরের মাসেই মোবাইলের টাওয়ার ঠিক হয়ে যাবে গ্রামে, এর পর এলে আমি যেন ওদের সরাসরি ফোন করে আসি, ওরা আমার জন্য এই ঘরটাই রেখে দেবে।

    বাঁধাছাঁদা সেরে, সাড়ে আটটায় স্টার্ট করলাম। আকাশে খুব কাছ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে অল্প অল্প সাদা মেঘ। ফিরতি অনেকখানি রাস্তা আমার চেনা, আগের দিন এই গ্রামে আসার জন্য যে তিন কিলোমিটার ডিট্যুর মেরেছিলাম, সেইটা আবার ফিরতে হল, তবে আবার মেন রাস্তা। রাস্তার পাশে মাইলস্টোন দেখাচ্ছে এর পরেই আসছে জুলুক, পদমচেন ইত্যাদি জায়গারা। আর জুলুক যাবার পথে তো পড়বেই বিখ্যাত থাম্বি ভিউ পয়েন্ট।

    একটু এগোতেই দেখি রাস্তার বাঁকে আমার জন্য অপেক্ষা করছে একতাল মেঘ। মোটরসাইকেল নিয়ে ঢুকে গেলাম তার মধ্যে। ভিজে ভিজে অনুভূতি – আকাশে সূর্য, কিন্তু এই মুহূর্তে তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, সে এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা, আবার খানিক এগোলাম, মেঘের শেষে আবার ঝলমলিয়ে উঠল সূর্য। পেছন ফিরে না তাকালে মনেই হয় না যে এতক্ষণ মেঘের মধ্যে দিয়ে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলাম। আবার খানিক বাদে পাশের খাদ থেকে গুঁড়ি মেরে উঠে আসে মেঘ, ঢেকে দেয় রাস্তা, দু হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না, তার মধ্যে দিয়ে চালানো। স্বর্গ বুঝি এখানেই – এ যে কী আনন্দের অভিজ্ঞতা, লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।



    একটা মিলিটারি এসটাবলিশমেন্ট পেরিয়ে এলাম। কেউ দাঁড়াতেও বলল না, স্রেফ ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখল, আমি দিব্যি পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। এসট্যাবলিশমেন্টের পাঁচিল পেরোতেই একটা বাঁক পেরিয়ে দেখলাম সেই অসাধারণ দৃশ্য। দাঁড়াতেই হল।



    পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে আসছে মেঘ, আর সেই মেঘ একটু সরে গেলেই দেখা যাচ্ছে স্তরে স্তরে জিগজ্যাগ মার্কের মত সরু সরু রাস্তা, ধাপে ধাপে নেমে গেছে নিচের দিকে, যে রাস্তায় একটু বাদেই আমি নামব। অপূর্ব সুন্দর এক দৃশ্য।





    খানিক সময় কাটিয়ে আবার এগোলাম, এইবারে আস্তে আস্তে নামা, অনেকগুলো আঁকবাঁক পেরিয়ে এল একটা জায়গা, যেখানে লেখা আছে থাম্বি ভিউ পয়েন্ট, কিন্তু থাম্বির থেকে অনেক অনেক বেশি সুন্দর ভিউ আমি আরও ওপর থেকেই পেয়ে দেখে এসেছি। সামান্য ছোট একটাস্টপ দিয়ে তাই আবারও নামতে থাকলাম। ক্রমশ মেঘের রাজ্য পেরিয়ে নেমে এলাম আরেকটু নিচে।

    পদমচেন এসে গেল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের মাথায় একটা সবুজ গালিচা বিছানো, সেইখানে ছোট্ট ছোট্ট খেলনার মত কিছু বাড়ি। ছবির মত সুন্দর।



    পদমচেন আসতেই পকেটে মোবাইল বেজে উঠল। সিগন্যাল এসে গেছে। ফোন এসেছে একটা। হেলমেটে ব্লুটুথ স্পিকার সেট করাই আছে, ফোন ধরতেই দেখি গ্যাংটকের সেই হোটেলের ভদ্রলোকটি, আমি যে নর্থ সিকিম সেরে ফিরতি পথে ওনার হোমস্টে-তে দ্বিতীয়বার থাকার বুকিংটা ক্যানসেল করেছিলাম, সে খবর বোধ হয় উনি পান নি, এখন আমাকে নেটওয়ার্কে পেয়ে ফোন করেছেন, আপনি এলেন না তো?

    ঝটিতি বললাম, না, আমি আটকে পড়েছিলাম, ফিরতে পারি নি লাচুং থেকে, তাই আসতে পারি নি, আর এখন আমি সিকিম থেকে চলে এসেছি – বলেই কেটে দিলাম। এনার সঙ্গে আর বেশিক্ষণ ভদ্রতা চালিয়ে যাবার ইচ্ছে নেই।

    আজকে আমার গন্তব্য রোরাথাং। পশ্চিমবঙ্গ সিকিম সীমান্তে রংপো নদীর কিনারে একটি হোমস্টে, কান্নন রিভারসাইড হোমস্টে। অনেক খুঁজেপেতে এদের পেয়েছিলাম। রেশিখোলায় তো সবাই যায় – আমি অফবিট লোকেশন হিসেবেই এই জায়গাটা চুজ করেছিলাম। হোয়াটস্যাপে কথাবার্তা হয়েছিল, আমি দিল্লি থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে আসছি শুনেই হোমস্টে-র মালিক খুব উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, তুমি তা হলে আমাদের হোমস্টে-র ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর হবে। তোমার বইতে আমার হোমস্টে-র কথা লিখবে। সামান্যই খরচ এক রাতের থাকার জন্য, তাতে ব্রেকফাস্ট ইনক্লুডেড। ব্রেকফাস্টের অপশনও হোয়াটস্যাপে লিখে দিয়েছিলেন উনি – লুচি তরকারি বা চাউমিন, রাতে রুটি-চিকেন। খুবই উৎসাহী হয়েছিলাম আমিও, সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় যাবো, যেখানে আমার চেনাশোনা কেউ যায় নি।

    বেলা প্রায় বারোটা নাগাদ রংপো নদীর ধার বরাবর এগিয়ে একটা বড়সড় ব্রিজে এসে পৌঁছলাম। জিপিএস বলছে এটার নাম রোরাথাং ব্রিজ, এখান থেকে ব্রিজ পেরিয়ে বাঁদিকে দু কিলোমিটার গেলেই কান্নন রিভারসাইড হোমস্টে। ব্রিজের নিচে রেশিখোলা নদী এসে মিশেছে রংপো নদীর বুকে। অবশ্য, নদীটার নাম বোধ হয় রেশি বা ঋষি। নেপালি ভাষায় খোলা নামেই নদী।

    সকালের ঠাণ্ডার লেশমাত্র আর নেই, গায়ের জ্যাকেট ছ্যাঁকা দিচ্ছে, আমি সমতলের খুব কাছাকাছি নেমে এসেছি, কিন্তু এখন জ্যাকেট ছাড়ার উপায় নেই, একেবারে হোমস্টে-তে পৌঁছে হাল্কা হতে হবে। ব্রিজ পেরিয়ে আমি বাঁদিকের রাস্তা নিলাম।

    এপারে রাস্তা বেশ বেশ খারাপ। মোটরসাইকেল চলল লাফাতে লাফাতে, ঠিক দু কিলোমিটারের মাথায় পৌঁছে দেখি জিপিএস বন্ধ হয়ে গেল, ইওর ডেস্টিনেশন হ্যাজ অ্যারাইভড। কিন্তু কোথায় সে হোমস্টে?

    নদীর ধার বরাবর রাস্তা, নদীর অন্যপারে তাকিয়ে দেখলাম একটা ছোট রিসর্ট টাইপের, বেশ কয়েকটা চালাঘর মত ছাউনি দেওয়া ঘর, সামনে একটা প্লে-এরিয়া, একটা ছাউনির ওপর বড় বড় করে লেখা – যা নদীর এপার থেকেও স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে, কান্নন রিভারসাইড হোমস্টে।

    লে হালুয়া। জিপিএস আমাকে এনে ফেলেছে নদীর অন্য পারে। মানে ব্রিজের আগেই নিশ্চয়ই কোনও রাস্তা আছে ওখানে পৌঁছনোর, আমাকে ফিরতে হবে রোরাথাং ব্রিজের দিকেই, কিন্তু তার আগে হোমস্টের মালিককে একবার ফোন করা যাক।

    প্রথমবার ফোন করলাম, কেউ তুলল না। পিঠ পুড়ে যাছে সূর্যের তাপে। তিন মিনিট অপেক্ষা করতে আবার ফোন করলাম, এইবারে ফোন তুললেন মহিলা – বললাম, আমি পৌঁছে গেছি, কিন্তু নদীর অন্য পার থেকে দেখছি, কী করে পৌঁছবো আপনাদের হোমস্টে-তে?

    উনি বললেন, একেবারে চিন্তা করবেন না, আপনি ব্রিজে ফিরে আসুন, ওখানেই দাঁড়ান – আমি হোমস্টে-র ছেলেটাকে পাঠাচ্ছি, ও আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবে। আমি বাজারে আছি, একটু পরে ফিরব।

    খুব ভালো কথা। আবার সেই ভাঙা রাস্তা ধরে ফিরে এলাম ব্রিজের ওপরে। দূরে দূরে একটা দুটো গাড়ি, মোটরসাইকেল, স্থানীয় লোক, হয় ব্রিজের ধারে পা ঝুলিয়ে গল্প করছে, নয় তো গাড়ি পরিষ্কার করছে। পৌনে একটা বাজে, একটা অলসতা ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে।

    দেড়টা বাজে। রোদে সারা গা তেতেপুড়ে যাচ্ছে। কারুর দেখা নেই, প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গেল। আরেকবার কি ফোন করব?

    আরও পাঁচ মিনিট বাদে একটা ছেলে, পনেরো ষোল বছর বয়েস হবে – এসে ইশারা করল আমার দিকে। কান্নন থেকে এসেছে। মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে নিলাম। ব্রিজ পেরিয়ে এইবারে বাঁদিকের বদলে ডানদিকে বেঁকতে বলল ছেলেটা।

    ব্রিজের শেষেই, ডানদিক ঘেঁষে একটা চায়ের দোকান। রাস্তা চলে গেছে এদিকেও, একই রকমের ভাঙাচোরা। ছেলেটা আমাকে বলল, এইখানে মোটরসাইকেলটা রেখে দিন।

    মানে? আর লাগেজ?

    ছেলেটা বলল, হোমস্টে অবধি তো গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না, হাতে হাতে নিয়ে যেতে হবে। নদীর ওপর দিয়ে হাঁটা – নদীতে তো এখন জল নেই। এইখানে মোটরসাইকেল রাখলে কোনও অসুবিধে নেই, আমার এই দোকানের লোকটাকে বলে রাখা আছে, ও দেখে, রাতেও দেখবে।

    আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলাম। সবশুদ্ধ চার পাঁচখানা ব্যাগপত্র নিয়ে, কিছু না হোক, অন্তত চল্লিশ কিলো লাগেজ নিয়ে চলেছি আমি। এ একটা রোগাসোগা ছেলে, কত লাগেজ বইবে? আর বইতে হবে তো – কতদূর? হোমস্টে তো দেখে এসেছি, অন্যদিকে, এখান থেকে দু কিলোমিটার দূরে। নদীতে জল প্রায় নেই, খুবই কম – কিন্তু এই চল্লিশ কিলো লাগেজ নিয়ে দুজনে মিলে নদীর বেড ধরে দু কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে উঠতে হবে হোমস্টে-তে থাকার জন্য? আর নদীর বেড মানে, বড় মেজ বোল্ডারের ওপর দিয়ে হাঁটা। গুরু, এটা তো সিলেবাসে ছিল না! এবং এর মানে, কাল সকালে আবার এই লাগেজ নিয়ে ভোরবেলায় উঠে দু কিলোমিটার হেঁটে আসতে হবে মোটরসাইকেল অবধি, তার পরে বাঁধতে হবে? এ তো সাংঘাতিক একটা ব্যাপার! মানে, করতে চাইলে করাই যায়, কিন্তু একটা হোমস্টে-র আতিথ্য নেবার জন্য এত লেবার দিতে যাবো কেন আমি? আর এই বাচ্চা রোগাসোগা ছেলেটাকে দিয়ে বিশ পঁচিশ কিলো মাল আমি বওয়াবোই বা কেমন করে?

    সম্ভব নয়। সবে পৌনে দুটো বাজে, জিপিএসে দেখে নিলাম – রংপো টাউন এখান থেকে মাত্রই দশ কিলোমিটার দূরে, সাড়ে তিনটের মধ্যে আরামসে পৌঁছে যাব। কিন্তু এইভাবে ঠা-ঠা রোদের মধ্যে লাগেজ নিয়ে নদীর ওপর দু কিলোমিটার হাঁটতে পারব না। ভাগ্যিস অ্যাডভান্স কিছু দিয়ে রাখা নেই। ছেলেটাকে বললাম, তুমি ফিরে যাও, মালিককে বোলো, আমি এখানে থাকছি না।

    আবার মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলাম। বাঁদিকের রাস্তা। রংপো, এগারো কিলোমিটার। অসম্ভব ভাঙাচোরা রাস্তা, তার ওপর, এ আবার বাসরাস্তা। ওদিক থেকে বাস আসছে, এবং তখন প্রায় সাইডে সরে দাঁড়ানোর মতও জায়গা থাকছে না।

    প্রায় আট কিলোমিটার চলার পর রাস্তা ঠিক হল। পাহাড়ের অনেকটা নিচে নেমে এসেছি, এখন আর তত সৌন্দর্য নেই, দুপাশের গাছপালায় পুরু ধুলোর স্তর, ক্রমশ বাড়ছে, বাড়ছে, বাড়তে বাড়তে এক জায়গায় এসে আটকে যেতে হল। সামনে লম্বা গাড়ির লাইন। বেশ কিছু ডাম্পার, বুলডোজার আর ট্রাক ব্যস্ত হয়ে দৌড়োদৌড়ি করছে।

    একটু এগিয়ে বোঝা গেল সামনে ছোট করে ধস নেমেছে, রাস্তা বন্ধ, সেইটা সাফ করার তোড়জোড় চলছে। ভারী ধুলোর মেঘ পাক খাচ্ছে সর্বত্র। নাকমুখ কষে বেঁধে বসে রইলাম। কিছু করার নেই, এগনো সম্ভব নয়।

    প্রায় আড়াইটে বাজে – খিদে পেয়েছে সাংঘাতিক। সেই সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি, পেটে এখন আর কিছু নেই। সেই কুড়ি তারিখে যেদিন দিল্লি থেকে বেরিয়েছিলাম, বেরোবার সময়ে সিকিনী একটা বড় হরলিকসের বোতল ভর্তি করে চিড়ে-বাদামভাজা ভরে দিয়েছিল, রাস্তায় আপৎকালে যদি কাজে লাগে। জানিয়ে রাখা ভালো, সিকিনীর রান্নার হাতটি অতি চমৎকার, সে চিড়েভাজাই হোক বা মোচার ঘণ্ট, কিংবা মাটন রেজালা। তো, সেই চিড়ে-বাদাম্ভাজা আজ এইখানে আপৎকালে কাজে লেগে গেল। পিঠের ব্যাগ থেকে হরলিকসের বোতল বের করে গপগপ করে খানিক চিড়েভাজা খেয়ে ঢকঢক করে আধ বোতল জল। ব্যস। এখন ঘণ্টাদুয়েকের জন্য নিশ্চিন্ত।

    টানা দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরে রাস্তা খুলল, প্রথমেই আমাদের দিকের ট্র্যাফিক। আমি, আরও কয়েকজন স্থানীয় ছেলেপুলে ছিল মোটরসাইকেলে, আমরা আগে বেরিয়ে গেলাম – এবং আর কয়েক কিলোমিটার যেতেই দস্তুরমত একটা বাজার এলাকায় এসে পৌঁছলাম, সামনেই স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বড় মত হোর্ডিং, রংপো ব্র্যাঞ্চ। চারদিকে দোকানপাট, পেট্রলপাম্প, ছোটমাঝারি হোটেল এবং প্রচুর প্রচুর ট্র্যাফিক। তিনমাথার মোড় একটা।

    খুবই ক্লান্ত, যদিও খুব বেশি চলা হয় নি আজ, কিন্তু মূলত সকালবেলার সাথে এখনকার টেম্পারেচার ডিফারেন্সটা আমাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। পেট্রল পাম্পের ঠিক সামনেই দেখলাম সিকিম ট্যুরিজমের হোটেল। জানি, দামী হবে, কিন্তু আর শস্তা দেখে কী করব, আজই শেষ রাত আমার সিকিমে, ইন ফ্যাক্ট, এটাকে সিকিম না বলে পশ্চিমবঙ্গ বললেও হয়, কারণ, পেট্রল পাম্পের পাশেই একটা ছোট্ট ব্রিজ, রংপো নদীর ওপর, আর ব্রিজের ওপারটাই কার্শিয়াং। পশ্চিমবঙ্গ। ঢুকে গেলাম সিকিম ট্যুরিজমের হোটেলে। এগারোশো টাকায় তোফা একটা ঘর পেয়ে গেলাম। স্রেফ ঘরটা দোতলায়, ফলে মোটরসাইকেল থেকে লাগেজ বের করে ওপরে আনা নেওয়া করতে একটু সময় গেল।

    লাগেজ রেখে আবার নেমে এলাম। চারপাশে অসংখ্য খাবার দোকান, বাইরে বেরিয়ে খানিক খাবার প্যাক করে নিয়ে এসে বিকেল পাঁচটার সময়ে খেতে বসলাম। এতক্ষণে মোবাইল খোলার সময় হল।

    অসংখ্য মেসেজ জমা হয়েছে এই কদিনে। ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে। শৌভিক মেসেজ করেছে – তুই কবে জয়গাঁওয়ের দিকে আসছিস?

    শৌভিক আমার হুগলির বন্ধু। আমরা একসাথে পড়তাম, ব্যান্ডেল সেন্ট জনস হাইস্কুলে, তার পরে হুগলি ব্র্যাঞ্চ হাইস্কুলে ইলেভেন টুয়েলভ। এর পরে আমি ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে চলে আসি জলপাইগুড়ি, শৌভিক জেনারেল স্ট্রিমে পড়াশোনা শেষ করে এখন কাজ করে – মূলত উত্তরবঙ্গ জুড়েই ওর কাজের “ফিল্ড”। মালদা থেকে কুচবিহার। শিলিগুড়িতে অফিস আছে, ইন ফ্যাক্ট, শুরুতে আমি যখন এই জার্নির প্ল্যান করেছিলাম, তখন শৌভিক উৎসাহ দেখিয়েছিল আমার সঙ্গে অন্তত সিকিমটা করার। ও একটা বুলেট চালায়, যদিও ঠিক সেই অর্থে লম্বা রেসের ঘোড়া ও নয়, তবে আমি বেরিয়েছিলাম মাসের শেষদিকে, সেই সময়ে ওর পক্ষে ছুটি ম্যানেজ করা সম্ভব হয় নি, সেলসে কাজ করে, মাসের শেষ কয়েকদিন ওকে অ্যাকাউন্টসের সাথে বসে সারা মাসের হিসেব মেলাতে হয়, ছুটি পায় না। সেই শৌভিক মেসেজ করেছে – আমি মালবাজারের মোড়ে তোর জন্য অপেক্ষা করব, কাল কখন আসছিস জানা, ওখান থেকে আমরা একসাথে জয়গাঁও যাবো। স্কুল ছাড়ার পরে আমাদের মধ্যে আর কখনও দেখা হয় নি – ফেসবুকের মাধ্যমেই যেটুকু যোগাযোগ রয়ে গেছে।

    শৌভিককে ফোন করলাম। কাল আমার জয়গাঁও পৌঁছবার দিন, মোটামুটি কোন সময়ে মালবাজারে পৌঁছতে পারি, সেই বিষয়ে একটা আইডিয়া দিয়ে কথা দিলাম, দেখা হবে।

    সিকিমের পাট শেষ, মুগ্ধতার এই রেশ রয়ে যাবে অনেকদিন। আমি আবার আসব, স্পেশালি এই ইস্ট সিকিম দেখার জন্য আমাকে আবার আসতেই হবে, এবার আসব আরও বেশি সময় হাতে নিয়ে।

    কাল নতুন পথের যাত্রা। মোটরসাইকেলে প্রথমবারের জন্য, আমার সো-কলড “বিদেশভ্রমণ”।
  • সিকি | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ২৩:৪৯370701
  • উনত্রিশে অক্টোবর, দশম দিন

    ছোটবেলাটা আমার ছড়ানো-ছিটনো। তাই ছোটবেলার বন্ধু বলতে গেলে আমাকে আগে চোখ বুযে হাতে পেন্সিল নিয়ে ক্যালকুলেশন করতে হয়। বাবার ছিল বদলির চাকরি, ফলে এদিক সেদিক প্রাইমারি সেকেন্ডারি করতে করতে যখন ব্যান্ডেল সেন্ট জনসে এসে ঢুকেছিলাম, তখন সেটা হয়েছিল আমার পঞ্চম স্কুল। মাধ্যমিক দিয়ে বেরিয়েছিলাম এখান থেকে। এর পর উচ্চ মাধ্যমিক আরেকটা স্কুল থেকে, সব মিলিয়ে ছটা স্কুল জুড়ে ছড়িয়ে আছে আমার “ছোটবেলা”।

    শৌভিক আমার সেই সেন্ট জনসের বন্ধু। এর পরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ও আমার সাথে একসাথেই পড়ে, তার পরে আমাদের স্ট্রিম আলাদা আলাদা হয়ে যায়। স্কুল ছাড়ার পরে শৌভিকের সাথে বোধ হয় কখনও আর দেখা হয় নি, বেশ অনেক বছর পরে ফেসবুকের কল্যাণে আবার যোগাযোগ স্থাপন।

    সকালে ঝটিতি হোয়াটসঅ্যাপের বার্তালাপে ঠিক হল, আমি সেভক ব্রিজ পেরিয়ে ওকে জানিয়ে দেব, মাদারিহাটের মোড়ে ও আমার জন্য অপেক্ষা করবে, একসাথে আমরা জয়গাঁও পর্যন্ত যাবো, সেখান থেকে ও ফিরে আসবে আবার।
    জয়গাঁও এর আগে আমি দু বার গেছি, শেষ যাওয়া সেই উনিশশো আটানব্বই সালে, কলেজ থেকে, চুখা হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্ট দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ছোট্ট গঞ্জ একটা, সামান্য কয়েকটা হোটেল, কিছু দোকান – এইসবই দেখেছিলাম, মনে আছে, আর ভুটান গেট পেরোলেই অন্য দেশ, অন্য রাষ্ট্র, সাজানো গোছানো। কোনও একটা মনাস্ট্রি দেখে এসেছিলাম, আর ফুয়েন্টশোলিংএর দিকে একটা ছোটো ক্রোকোডাইল প্রজেক্ট ছিল, সেখানে বেশ কিছু কুমীরছানা দেখে এসেছিলাম, আর সেই প্রজেক্টের পাশেই ছিল একটা সিনেমাহল, সেখানে তখন চলছিল গোবিন্দার সিনেমা ‘ছোটে সরকার’। ... জয়গাঁও সম্বন্ধে এই আমার স্মৃতি।

    সেই জয়গাঁওতে এখন পুলিশের ওসি আমার কলেজের বন্ধু স্বরাজ। ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছাত্র ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে পুলিশের ওসি হয়েছে, এমন উদাহরণ আমি দেখি নি কখনও, তবে এককালে শুনেছি লোকে ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে ব্যাঙ্কের অফিসার হত। এও সেই রকমের কিছু হবে হয় তো।

    স্বরাজের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল আগে থেকেই, সেই ফেসবুকেরই কল্যাণে। ও-ই আমাকে বলে রেখেছিল, তোকে থাকার ব্যাপারে কোনও চিন্তা করতে হবে না, জয়গাঁওতে এসে আমাকে একটা ফোন করিস শুধু। তা হতেই পারে – আমি গাজিয়াবাদের ওসি হলে আর স্বরাজ গাজিয়াবাদে বেড়াতে এলে আমিও ওকে এই রকমই কিছু বলতাম হয় তো – সেটা কথা না, কিন্তু স্বরাজকে মনে রাখা আর ওর কাছে ফিরে যাবার পেছনে আরও একটা বড় কারণ আছে।

    গান।

    আমাদের সময়ে হস্টেলে এক একটা উইংয়ের ছেলেদের মধ্যে যতটা ইউনিটি হত, এক উইংএর সাথে অন্য উইংয়ের খারাখারিও কম হত না। ব্যাপারটা দুয়েকবার মারামারির দিকেও এগোত। আমি অনেকদিন আগে “উত্তরবঙ্গ” নামে একটা ধারাবাহিক লেখা শুরু করেছিলাম গুরুচণ্ডা৯র পাতায়, সেটা আর শেষ করা হয়ে ওঠে নি, সেইখানে না বলা কিছু স্মৃতিকথার টুকরোটাকরা বরং এখানে লিখে ফেলি – এতদিন বাদে, আশা করি স্বরাজ যখন এই লেখা পড়বে, কিছু মনে করবে না আর।

    আমি ছিলাম দোতলা ব্যাক উইংএর বাসিন্দা, আর স্বরাজ ছিল তিনতলা ব্যাক। এই দুটি উইংএর মধ্যে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না, বিশেষত, তিনতলা ব্যাকে কয়েকটি ইতর অমানুষ ছাত্র হিসেবে বাস করত। তারা টপার ছিল, ব্রিলিয়ান্ট ছিল, কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট মানুষ যখন বখে যায়, তখন সে যতটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, তিনতলা ব্যাকের সেই ছেলেগুলো সেই লেভেলেরই বিপজ্জনক ছিল।
    একটা উইংএ কুড়ি থেকে চব্বিশজন ছেলে থাকত, সবাই তো এক রকমের হয় না, কিন্তু মূলত ঐ কয়েকজনের জন্য আমি পারতপক্ষে তিনতলা ব্যাকের ছায়া মাড়াতাম না। গেলে যেতাম একজনের কাছেই। স্বরাজ।

    তখন সেকেন্ড ইয়ার। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এসব কথা অবিশ্বাস্য লাগতে পারে, কিন্তু পঁচানব্বই সালে জয়েন্টে চান্স পেয়ে যখন আমি জলপাইগুড়ি পৌঁছই, তখনও পর্যন্ত আমার বাড়ির ভাবধারা অনুযায়ী হিন্দি গান গাওয়া টাওয়া ছিল মোটামুটি বখে যাবার শেষ ধাপ। আমিও খুবই ভালোমানুষ টাইপের ছিলাম, ফলে জলপাইগুড়ি যাবার পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আঠেরো বছর বয়েস হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি কিশোরকুমার, আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকর বা মহম্মদ রফির একটা হিন্দি গানও শুনি নি।

    স্বরাজের কাছে ছিল গানের ক্যাসেটের এক অবিশ্বাস্য কালেকশন। বাংলা, হিন্দি। আমি শুধু নয়, হস্টেলশুদ্ধ ছেলেপুলে স্বরাজের থেকে ক্যাসেট ধার নিয়ে যেত। স্বরাজের একটা মহাজনী খাতা ছিল, সেইখানে সে সব টুকে টুকে রাখত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় – চাটুজ্জে, দশই ফেব্রুয়ারি, মহম্মদ রফির গোল্ডেন কালেকশন – সিকি, সতেরোই এপ্রিল। ঠিক সময়মত সে সেই ছেলেটির ঘরে গিয়ে ক্যাসেট ফেরত দেবার জন্য তাগাদা দিতে যেত। এই স্বরাজের দৌলতেই আমার প্রথম হিন্দি গানের স্টক তৈরি হয়। স্বরাজকে নিজেকে কোনওদিন গান গাইতে শুনি নি, খুবই মুখচোরা টাইপের ছেলে ছিল, খুব মৃদুস্বরে কথা বলত, রোগা পাতলা ফিনফিনে চেহারা।

    সেই স্বরাজ কিনা এখন পুলিশ অফিসার, তাও ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ বর্ডার টাউনে। আর প্রস্থে সে এখন আমজাদ খানকেও ছাড়িয়ে গেছে, ফেসবুকে যা ছবিটবি দেখেছি। কী করে এমন মেটামরফোসিস হল, জানার খুবই ইচ্ছে, অতএব, সকাল সকাল রংপোতে হোটেলের পয়সা মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

    গেট থেকে বেরিয়ে একশো মিটার এগোতেই ঢুকে পড়লাম কালিম্পংএ – পশ্চিমবঙ্গ। এখান থেকে সেভক ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা একই, যে রাস্তায় এসেছিলাম। মাঝে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে পরোটা আলুচচ্চড়ি খেয়ে পেট ভরিয়ে নিলাম।

    সাড়ে নটায় সেভক ব্রিজ। এসেছিলাম এক পাশের রাস্তা দিয়ে, ব্রিজের ওপরে উঠতে হয় নি, সেই রাস্তা সোজা চলে যাচ্ছে গ্যাংটক থেকে রংপো হয়ে শিলিগুড়ির দিকে, আর ব্রিজ পেরিয়ে অন্যদিকের রাস্তা নিলে সেটা যাচ্ছে তরাই পেরিয়ে ডুয়ার্সের দিকে।




    ব্রিজ পেরোতেই তরাই নতুন ভাবে নিজেকে মেলে ধরল আমার সামনে, আর আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলাম।




    বহু বহুকাল আগে কয়েকবার এ রাস্তায় এসেছিলাম, কলেজ থেকে এমনিই, কখনও পিকনিকে, কখনও কারুর সাথে ঘুরতে, সরু রাস্তা ছিল, ভাঙাচোরা গুমটি দোকানঘর ছিল, সন্ধ্যের পর সেখানে কুপি লম্ফ জ্বলত, আটটার পরে মানুষজন দেখা যেত না, এখন দেখছি রানওয়ের মত চওড়া রাস্তা দিগন্তকে ছুঁয়ে ফেলেছে দূরে গিয়ে, দুধারে যতদূর চোখ যায়, কিছুকিঞ্চিত মিলিটারি এসটাবলিশমেন্ট, তা বাদ দিয়ে চা বাগান, চা বাগান, অনন্ত চা বাগান। উজ্জ্বল সবুজ রঙের চা বাগান সোজা গিয়ে মিশেছে নীলচে পাহাড়ের কোলে, সে যে কী অপূর্ব দৃশ্য, আগে কখনও এভাবে অনুভব করি নি। উত্তরবঙ্গ পুরো ভোল পালটে ফেলেছে, জায়গায় জায়গায় সেই কুড়ি বছর আগে দেখা ছোট ছোট টাউনেরা আসছে, মংপু, কালীঝোরা, ওদলাবাড়ি, ডামডিম, মালবাজার।

    মালবাজারে এসে তো আমি চমকে গেছি, এ একেবারে ছোটখাটো একটা শহর! বড় বড় বাড়িঘর শপিং প্লাজা, কয়েক হাত অন্তর অন্তর পেট্রল পাম্প, অনবরত যাতায়াত করছে মিলিটারির গাড়ি, রুটের বাস আর ভুটানের গাড়িরা। মসৃণ চওড়া রাস্তা। মালবাজার আসতে আসতে চারপাশের পাহাড়েরা হাওয়া, আর তাদের দেখা যাচ্ছে না, যদিও চা বাগানেরা রয়েছে সবসময়েই, এ সব এলাকার টি গার্ডেন তো নামকরা, ওদলাবাড়ি টিএস্টেট, বিন্দু, চালসা – এক সময়ে এই রাস্তা ধরেই এসেছিলাম তিস্তা নদীর চরে পিকনিক করতে, চালসা টি গার্ডেনের পাশ দিয়ে, মনে আছে সেদিন ছিল পূর্ণিমা, বিকেলের পরে তিস্তার জল থেকে উঠে এসেছিল ইয়াব্বড়ো একটা থালার মত চাঁদ, একজন গিটার নিয়ে গেছিল, তিস্তার ওপর একটা বোল্ডারে বসে আমাদের সমবেত হুল্লোড়ে গাওয়া পাপা কহতে হ্যায় ... অন্য জন্ম মনে হয়, পূর্বজন্ম মনে হয়। এখন আর কিছুই চিনতে পারি না। সব শহর হয়ে গেছে, সেই সব ছোট ছোট গঞ্জেরা আর নেই, আর সর্বত্র, সর্বত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি, কাটআউট, ব্যানার, পোস্টার।



    মালবাজারে মোটরসাইকেলে তেল ভরে শৌভিককে একটা ফোন করে নিলাম। ও মাদারিহাটের মোড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। মাদারিহাটের মোড় কত বড়, সেখানে শৌভিককে স্পট করব কী করে – তা তো জানি না। তবে দেখা যাক।

    মালবাজার ছাড়াতেই আশপাশের দু চারটে ট্র্যাফিক ব্যারিকেড দেখে বুঝলাম, আমি এইবারে আলিপুর দুয়ার জেলায় ঢুকে পড়েছি। আলিপুর দুয়ার ছিল জলপাইগুড়ির একটা মহকুমা, জলপাইগুড়ি জেলার একমাত্র পাহাড়ী অঞ্চল – ডুয়ার্স। আমার জন্মস্থান। আমার এক বছর বয়েসে বাবা সেখান থেকে বদলি হয়ে চলে আসে বর্ধমানের গুশকরা গ্রামে, ফলে আলিপুর দুয়ারের কোনও স্মৃতি আমার নেই, শুধু মায়ের কাছে গল্প শুনেছি সেখানে এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কাঠের ঘরে আমরা ভাড়া থাকতাম, সেখানে নেপালি আয়া মা-কে কমলালেবু ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খাওয়াত। আশেপাশে নানা রকমের জায়গা, পিকনিক স্পট, রাজাভাতখাওয়া, ফাঁসিদেওয়া – সেইখানে একবার পিকনিক করতে গিয়ে বাবা মা বুনো হাতির মুখে পড়েছিল, সে গল্প অন্যত্র লিখেছি।

    জেলা হয়ে আলিপুর দুয়ার এখন আকারে বহরে বেড়েছে। শুধু পাহাড় নয়, সমতলের কিছু এলাকাও এখন আলিপুর দুয়ার জেলায় চলে এসেছে – চালসা, কুর্তি, চ্যাংমারি, দেবপাড়া, বানারহাট, বিনাগুড়ি, গয়েরকাটা, বীরপাড়া, মাদারিহাট, হাসিমারা (সমেত জলদাপাড়া অভয়ারণ্য) এবং জয়গাঁও। সমস্ত এখন নতুন জেলা, এবং আমার কুড়ি বছর আগে দেখে আসা স্মৃতির সঙ্গে আজকের সেই সব জায়গার কোনও মিল নেই।

    মাদারিহাট – হায়, সেখানে একটা ঝুপসে জীবনের প্রথম শুওরের মাংস, ঝাল ঝাল আর রুটি খেয়ে এক রাত টুরিস্ট লজে কাটিয়েছিলাম, তখন জেনারেটরে করে টুরিস্ট লজে লাইট জ্বলত, বাকি কোথাও ইলেকট্রিসিটির কানেকশনই ছিল না, মূলত মদেশিয়া রাজবংশী ইত্যাদি আদিবাসীদের বসতি – সেই মাদারিহাট আজ ঝলমল করছে সারিসারি দোকানপাট শোরুমে। এটিএম, পেট্রল পাম্প, জুয়েলারির দোকান, রেস্টুরেন্ট – কী নেই? এমনকি ট্রাফিক সিগন্যাল এবং ট্রাফিক কন্ট্রোল করা পুলিশও রয়েছে মোড়ের মাথায়, শেষ যখন দেখেছি – তখন ট্র্যাফিকই ছিল না এ রাস্তায়, রাস্তাটাই কত সরু ছিল! সারাদিনে দুচারটে বাস যেত, বাকি শুধু সাইকেল।

    মাদারিহাটের মোড়টা খুব বড়সড় কিছু না, শুধু সেখান থেকে রাস্তাটা বাঁদিকে বেঁকে গেছে। মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে তো শৌভিককে দেখতে পেলাম না, কিন্তু মোড় থেকে বাঁকতেই দেখি রাস্তার ধারে একটা বুলেট দাঁড়িয়ে আছে, আর বুলেটে বসে আছে যে লোকটি – বাইশ বছর বাদে দেখলেও সে লোকের মুখ খুব একটা বদলায় নি। আমার তুলনায় শৌভিকের গোঁফ উঠেছিল একটু তাড়াতাড়িই, সেই গোঁফ এখন পুরুষ্টু, বয়সোচিত একটু ওজন লেগেছে শরীরে, কিন্তু মুখ আর চশমার ফ্রেমটা সেই একই রকমের আছে।

    শৌভিক বলল, চল, আগে জয়গাঁও পৌঁছই, ওখানে পৌঁছে গল্প হবে। বেশ, তাই চলা যাক।

    খুব বেশি রাস্তা আর বাকি ছিল না, বেলা দুটো নাগাদ জয়গাঁও পৌঁছে গেলাম। যথারীতি – জয়গাঁওও আর আগের মত নেই। প্রথমত জয়গাঁও ঢোকার মুখে বেশ খানিকটা রাস্তা ভাঙাচোরা, জয়গাঁও টাউনে ঢুকলাম রাস্তার দুপাশে উপচে পড়া নোংরা নিয়ে, বর্ডারের এক কিলোমিটার আগে থেকে রাস্তার মাঝে শুরু হয়েছে ডিভাইডার, আর দুপাশে রাশিরাশি দোকান, শোরুম, প্লাজা, এটিএম, ব্যাঙ্ক, মন্দির, গুরুদোয়ারা, মসজিদও। এবং মন্দির। এরা কি আগে ছিল?



    জয়গাঁও পুলিশ স্টেশনটি একদম রাস্তার ওপরেই। সেখানে মোটরসাইকেল রেখে ভেতরে ঢুকলাম, স্বরাজের নাম করতেই সবাই চিনল, কিন্তু ‘স্যার তো এখন নেই, ডিউটিতে গেছেন বিকেলে আসবেন’। তা হলে উপায়? স্বরাজকে ফোন করলাম, ফোনে স্বরাজ বলল, এক কাজ কর – থানার বাইরেই দেখবি কালীমন্দির, ওর পাশে মুখার্জি প্লাজা। প্লাজার দোতলায় একটা হোটেল আছে কস্তুরী বলে। আমি বলে রেখেছি, ওখানে গিয়ে আমার নাম করলেই পাঁচ নম্বর রুম খুলে দেবে। তুই যা, ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নে, আমি বিকেলে এসে তোকে ডেকে নিচ্ছি।

    কস্তুরীতে গিয়ে বলতেই খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, স্যার বলে গেছেন, আসুন স্যার, আসুন – বলে সত্যিই পাঁচ নম্বর রুম খুলে দিল। আমি আর শৌভিক ঢুকে ঘরের দখল নিলাম। ... তবে বিশ্রাম নেবার সময় এখনও নেই, পাশে থানার পার্কিংএ মোটরসাইকেলে সমস্ত লাগেজ বাঁধা রয়েছে, সেগুলোকে তুলে আনতে হবে। আমরা দুজনে মিলে ধরাধরি করে একবারেই তুলে আনলাম সমস্ত লাগেজ, এইবারে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসা গেল। আঃ, কী আরাম। ঝট করে চানটাও সেরে নিলাম।

    অনেক অনেক গল্প হল – যেমন হয় আর কি, পুরনো দিনের গল্প, মোটরসাইকেলের নেশা চড়ার গল্প, আরও এদিক সেদিক। তিনটে নাগাদ বোঝা গেল, খুব খিদে পেয়েছে। এই দোতলাতেই ওদের বিশাল বড় খাবার জায়গা, সেইখানে গিয়ে খাবার অর্ডার দেওয়া, খাওয়া, এবং তার পরে আবার খানিক আড্ডা।

    পাঁচটা নাগাদ শৌভিককে বিদায় নিতে হল, ও মাদারিহাট ফেরত যাবে, ওর কাছাকাছিই ওর শ্বশুরবাড়ি, সেইখানে ফিরতে হবে। কয়েকটা ঘণ্টা কীভাবে কেটে গেল বুঝে ওঠার আগেই আমরা নিচে নেমে এলাম, শৌভিক ওর বুলেটে স্টার্ট দিয়ে মিলিয়ে গেল রাস্তার বাঁকে।

    ঠিক পৌনে ছটা নাগাদ একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল আমার মোবাইলে – জিনু, ফ্রেশ হয়েছিস? আমি স্বরাজ বলছি, অফিসে এসে গেছি। চলে আয়।

    ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে সকলেরই একটা নিকনেম তৈরি হয়। আমার নাম ছিল জিনু। কারণ কিছুই না, র‍্যাগিং পিরিয়ডে আমাকে লাগাতার গান গাইতে হয়েছিল, আর আমি তখন সুমনের প্রথম চার পাঁচটা ক্যাসেটের সমস্ত গান হুবহু গেয়ে দিতে পারতাম। এদিকে জলপাইগুড়ির ক্যাম্পাসে সুমন তখনও সেইভাবে এন্ট্রি পান নি, ফলে ক্যাম্পাসে সুমনের গান গেয়ে আমার নাম হয়ে গেছিল ‘জীবনমুখী’। সেইটারই শর্ট ফর্ম, জিনু।

    স্বরাজ তার ঘরে বসে ছিল অফিস আলো করে। শেষ তাকে দেখেছিলাম রোগা লিকলিকে চেহারা, আর এখন দেখছি আমজাদ খানের মত মোটা একজনকে। আঠেরো বছর বাদে দেখা। গল্প হল আবারও, অনেক। কীভাবে কীভাবে এদিক সেদিক চাকরি করতে করতে কাগজে সাব ইন্সপেক্টর পদে ভর্তির বিজ্ঞাপন দেখে অ্যাপ্লাই করা, আর সেই থেকেই পুলিশে চাকরি করা, জয়গাঁওতে আসা, বর্ডার টাউন হিসেবে কত রকমের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া – সে সব লিখতে গেলে হয় তো আলাদা বই হয়ে যাবে, মোদ্দা কথা এটাই বোঝা গেল, জরাসন্ধের যুগ পেরিয়ে এলেও পুলিশের চাকরিতে বৈচিত্র্য খুব একটা কমে না।

    কথায় কথায় ভুটানের পারমিটের কথা উঠল। স্বরাজও আমাকে একজন এজেন্টের নাম ফোন নম্বর দিয়ে রেখেছিল, কিন্তু আমার যেহেতু উগিয়েনের মাধ্যমে একেবারে ই-ভিসাই হয়ে গেছে, ফলে আর সেই এজেন্টের দরকার পড়ে নি। সেটাই জানিয়ে দিলাম। এক ফাঁকে স্বরাজ বলে দিল, দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়েছিস তো? রাতে আমরা খেতে বেরোব তোকে নিয়ে।

    বাঃ, বেশ কথা। খাবার ব্যাপারে আমি কখনওই অরাজি হই না।

    এ কথা, সে কথার পর এইবারে প্রসঙ্গ উঠল আমার বাইক নিয়ে এই ঘোরাঘুরির প্রসঙ্গ। ‘জিনু, তোকে তো যখন চিনতাম তখন এ সব শখ টখ হতে দেখি নি, কবে থেকে এ সব করছিস?’ ... বললাম ছোট করে আমার গল্প। শুনে খুব খুশি হয়ে স্বরাজ বলল, ‘কলেজের সকলের সঙ্গে তো তুই বোধ হয় আর যোগাযোগ রাখিস না, তাই না?’

    না। আমাদের সেই দোতলা ব্যাকের ছেলেপুলেরা একবার একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বানিয়ে সেখানে আমাকে অ্যাড করেছিল। বাপ রে, সপ্তাহখানেক থেকে বুঝতে পেরেছিলাম আমি ওখানে ভয়ঙ্কর রকমের মিসফিট। মাঝখানের এতগুলো বছরে আমার মানসিকতাই হয় তো পালটে গেছে, কিংবা তাদের – কে জানে, আমি দেখলাম, কিছু ছেলে সর্বদাই ইংরেজিতে লিখছে, অথচ গ্রুপের সবাই বাঙালি, কিছু পাবলিক সর্বদাই এদিক সেদিক থেকে বস্তাপচা হাসি-পায়-না-এমন লো উইটের জোক শেয়ার করছে, বাকিরা তাই পড়ে ইমোটিকনের বন্যা বওয়াচ্ছে, আর কয়েকজন জাস্ট কিছু কিছু পোস্টের পর আগের পোস্টদাতার পিঠ চুলকে দিচ্ছে ভার্চুয়ালি – বাঃ, নাইস ওয়ান, ওয়াও, কী দারুণ লিখলি রে ... ইত্যাদি। – মানে, হয় তো পুরনো কলেজদিনের বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু আমার পোষায় না, আমি গ্রুপ ছেড়ে দিয়েছিলাম এক সপ্তাহ বাদে।

    সেই গল্পই করছিলাম স্বরাজের সাথে, এমন সময়ে স্বরাজ বলল, সুকান্তদাকে মনে আছে?

    সুকান্তদা? সে কে?

    স্বরাজ বলল, আমাদের এক বছরের সিনিয়র, সুকান্ত দাস। মনে নেই?

    অনেক কষ্টেও মনে করতে পারলাম না, তবে সেটা বুঝতে না দিয়ে মুখে কৃত্রিম উৎসাহ ফুটিয়ে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, সুকান্তদা তো? কী খবর তার?

    স্বরাজ একগাল হেসে বলল, সে-ও তোর মতই পাগল। তবে ও সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। দাঁড়া তোর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিই। – বলে ফোনে নম্বর হাতড়াতে লাগল।

    আমি প্রমাদ গণলাম। সত্যিই মনে পড়ছে না। কী কথা বলব? স্বরাজ ততক্ষণে ফোনে ধরে ফেলেছে সুকান্তদাকে – আরে সুকান্তদা, স্বরাজ বলছিলাম, কেমন আছো? ... হ্যাঁ, লখনউতে? আচ্ছা, তোমার জিনুকে মনে আছে? আমাদের ব্যাচের – গান টান করত, ... হ্যাঁ, সেই জিনু এখন আমার সামনে বসে আছে, কী কীর্তি করেছে, দিল্লি থেকে সোজা মোটরসাইকেল চালিয়ে আমার এখানে এসে উঠেছে – হে হে, ... হ্যাঁ, এই নাও, কথা বলো।

    ফোনটা নিলাম। স্বরাজের অফিসঘরের একদিকের দেওয়ালে একটা লম্বা কাঠের বোর্ড, তাতে পর পর লেখা আছে, এই চেয়ারে এর আগে কে কে কবে থেকে কবে পর্যন্ত বসে গেছেন, সাদা রঙের সরকারি অক্ষরদের আমি দেখছি, শেষ নামটা স্বরাজের, To তারিখের জায়গাটা খালি, ঠিক সেই সময়েই ফোনের মধ্যে থেকে একটা গলা, যেন কতদিনের পরিচিত, ভেসে এল – ‘কী রে জিনু? আরে, তোর আসল নামটা কী যেন ছিল? আমি তোকে ঠিক প্লেস করতে পারছি না।’

    চিনতাম না তো কী হয়েছে? চিনে ফেলতে লাগল ঠিক কয়েক সেকেন্ড, লখনউতে থাকে, ওখানেই চাকরিবাকরি, সাইকেলে করে ঘোরার প্রসঙ্গ উঠতেই খুব লজ্জা পেয়ে বলল, আরে না না, সে রকম কিছু না, ঐ একবারই সাইকেল চালিয়ে একটা লম্বা ট্রিপ করেছিলাম – লখনউ থেকে ব্যাঙ্গালোর।

    আমাকে নড়েচড়ে বসতেই হল। লখনউ থেকে ব্যাঙ্গালোর – মানে, কিছু না হোক, দু হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব এই আপাত-অচেনা লোকটি সাইকেলে করে পেরিয়েছে? বলে কী?

    মুখে বেশি কিছু বললাম না, কিন্তু মনের খাতায় নোট করে নিলাম, আমাকে এর সাথে দেখা করতেই হবে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুকান্তদা, তুমি থাকো কোথায়?’

    ‘লখনউ।’

    আরিব্বাস! আমি তো এসেছি লখনউয়ের ওপর দিয়েই, আগে জানলে দেখা করে আসা যেত। ফেরার পথে কি সম্ভব হবে? ফেরা তো আমার হুগলি থেকে, বেনারস হয়ে সোজা রাস্তাটা এলাহাবাদ কানপুর হয়ে, কিন্তু চাইলে তো ওটাকে লখনউ হয়ে ফেরার রাস্তা করে নেওয়াই যায়। লখনউ থেকে সোজা এক্সপ্রেসওয়ে একদম আগ্রা হয়ে আমার বাড়ির সামনে পর্যন্ত, নন-স্টপ। জানি না, সম্ভব হবে কিনা।

    মুখে বললাম, সুকান্তদা, আমি চেষ্টা করব, ফেরার পথে তোমার সাথে দেখা করবার। আমার ফেরার দিন সোমবার পড়বে, হয় তো তোমার অফিস থাকবে, তবে বোলো, সে রকম হলে আমি তোমার অফিসের গেটে গিয়েও দেখা করে আসব।

    ফোনটা রেখে স্বরাজকে ধন্যবাদ দিতেই হল এমন একটা কনট্যাক্ট জোগাড় করে দেবার জন্য। সুকান্তদার নম্বরটা নোট করে নিলাম আমার মোবাইলে। এবার পরের কাজ। কাল ভুটান ঢুকব। প্রথমদিনের গন্তব্য পারো। তো, সবার আগে ভুটানের একটা সিমকার্ড জোগাড় করতে হবে। স্বরাজকে বলামাত্র, ডেস্ক থেকে একটা মোবাইল বের করে তার সিমকার্ডটা খুলে বের করে আমাকে দিয়ে বলল, এই নে, ফেরার সময়ে ফেরত দিয়ে যাস মনে করে।

    সাড়ে সাতটা নাগাদ স্বরাজ উঠল চেয়ার থেকে। ততক্ষণে দারুণ দারুণ সব গল্পের স্টক জমে গেছে আমার ঝুলিতে ওর কল্যাণে। কীভাবে আধার কার্ড আর পাসপোর্টের জালিয়াতি হয় এই অঞ্চলে, ভুটান পাহাড়ে বন্যা হলে ভুটানিজদের জিনিসপত্র কীভাবে নদীতে ভেসে নেমে আসে ভারতে, পরে সেগুলো কিছু উদ্ধার হয়, কিছু হয় না, কিছু স্থানীয় লোকেরা আত্মসাৎ করে নেয়, পুলিশ কীভাবে সেইসব ক্লেম হ্যান্ডল করে – সে এক বিস্তারিত ব্যাপারস্যাপার। ... যাই হোক, সাড়ে সাতটার সময় উঠে স্বরাজ বলল, জিনু, তুই তা হলে আরেকটু রেস্ট করে নে, আমরা নটা নাগাদ খেতে বেরোব, তুই এখানে চলে আসিস আবার নটার সময়ে।
    হোটেলে ফিরলাম আবার। চাবি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকতেই, মাথাটা কেমন যেন একটু টলে গেল। শরীরটা, ঠিক যেন ভালো ঠেকছে না। পেটের কাছে সামান্য একটু টান, তার পরেই আর কিছু নেই। ... বিছানায় এসে বসলাম। একটানা চলছি, কদিন নাওয়াখাওয়ার ঠিক নেই, সমস্যা হতেই পারে। একঘণ্টা আছে এখনও বেরোতে, না করে দেব? নাকি বেরোই – বেশি কিছু খাবো না?

    খানিক বাদে উঠে চোখেমুখেঘাড়ে জল দিলাম, মনে হল এখন ঠিক আছে। পেটে হালকা একটা অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু সেটা হজম সংক্রান্ত কিছু না, কী রকম যেন কিছু একটা টেনে ধরছে ভেতর থেকে, আবার ততটাও কিছু মারাত্মক নয়। ইগনোর করে নেওয়াই ভালো। ফিরে এসে ঘুমিয়ে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

    নটার সময়ে আবার যখন নিচে নেমে থানার দিকে এগোলাম, তখন আমি একদম ঠিকঠাক। কোনও অস্বস্তি নেই কোথাও। স্বরাজ থানার গেটেই দাঁড়িয়ে ছিল, একটা গাড়ি এসেছে, স্বরাজের সঙ্গে আরও দু তিনজন লোক, তারা পুলিশ না স্থানীয় বাসিন্দা নাকি স্বরাজের বন্ধু, জানি না – আলাপ হল এক এক করে।

    গাড়িতে চেপে বসলাম, গাড়ি থানার গেট পেরিয়ে যখন রাস্তায় নামল, তখন রাত সাড়ে নটা বেজে গেছে।
  • সিকি | ০৬ মার্চ ২০১৮ ০০:২৪370702
  • গাড়ি চলল থানা থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে। এটুকু জেনেছিলাম আমরা ডিনার করব ফুন্টশোলিংয়ের কোনও এক রেস্তরাঁয়, কিন্তু ভুটান গেট তো ডানদিকে, এরা বাঁদিকে যাচ্ছে কেন?

    খানিক এগিয়ে বুঝলাম, মেন রাস্তার প্যারালাল আরেকটা রাস্তা দিয়ে, অন্য কোনও একটা এন্ট্রি দিয়ে আমরা ভুটানে ঢুকলাম। এমনিতে সাড়ে নটার সময়ে ভারত থেকে ভুটানের দিকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় – কিন্তু এটা হল পুলিশের গাড়ি, জয়গাঁও থানার ওসি, তাঁর গতি অবাধ ফুন্টশোলিংয়ের সর্বত্র। ঢোকার মুখে চোস্ত ভুটানি ভাষাতেই ভুটানি নিরাপত্তারক্ষীটির সাথে কী সব কথা বলল স্বরাজ, ভুটানি পুলিশটি একগাল হেসে গাড়ি যাবার জায়গা করে দিল, কুড়ি কুড়ি বছরের পার জীবন বয়ে যাবার পরে আমি আবার ভুটানে ঢুকলাম পুলিশের গাড়িতে চেপে।

    রাত হয়েছে, গাড়ির ভেতরে কথা চলছে মূলত তিনটে ভাষায় – বাংলা, বিহারি অ্যাকসেন্টের হিন্দি আর একটা অজানা ভাষায় – সেটা মদেশিয়া ভাষাও হতে পারে, ভুটানিও হতে পারে – আমি শিওর নই। আমি মূলত শ্রোতার ভূমিকায়। একজন ছিলেন গাড়িতে, বেশ হাসিখুশি, তিনি দু একটা রেস্তরাঁর অপশন দিলেন ড্রাইভারকে, ড্রাইভারটিও বেশ আমুদে, কথায় কথায় জানা গেল আরও একটি গাড়িতে করে আরও দুজন সামনে সামনেই আছে, তারা নির্দিষ্ট রেস্তরাঁটির সামনে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

    পৌঁছলাম সেখানে – গাড়ি লাগিয়ে দেবার পরে ভেতর থেকে একজন খবর নিয়ে এসে বলল, ইধার কারাওকে নেহি হ্যায়। বাকিদের চোখেমুখে স্পষ্ট হতাশা ফুটে উঠতে দেখলাম – কারাওকে নেহি হ্যায়? তো এখানে ঢুকে আর কী হবে? অ্যায়, এখানে কারাওকে-ওলা রেস্টুরেন্ট আর কটা আছে?

    আমি বেশ ঘেঁটে যাচ্ছি, এসেছি তো রাতের খাবার খেতে, তাও ভেবেছিলাম স্বরাজ আর আমিই আসছি, বাকিরা আসবেন আন্দাজ ছিল না, তাও না-হয় এলেন, কিন্তু কারাওকের সঙ্গে খাবারের কী সম্পর্ক?

    গাড়ি আবার পার্কিং থেকে বেরোল পরের খোলা রেস্তরাঁর খোঁজে। রাত প্রায় সাড়ে দশটা। লাইসেন্সড ছাড়া এই সময়ে খাবারের দোকান খোলা থাকার কথা নয় ভুটানে। কথায় কথায় জানলাম, আমার জন্যেই আজ এত খাতিরদারি। আমি বড়বাবুর কলেজের বন্ধু, আজ তাই স্পেশাল ডিনার, সাথে স্পেশাল এন্টারটেনমেন্ট – গান, কারাওকের সাথে। হাসিখুশি লোকটি, জানা গেল, গান করেন নিজের কাজকর্মের বাইরে – তিনি কারাওকেতে গান গেয়ে আমাদের মনোরঞ্জন করবেন। মনোরঞ্জনের রঙ যেন ফিকে না হয়, তাই একটা বারএ গাড়ি থামিয়ে কিছু বোতলও তুলে নেওয়া হল, আর এইবারে আমি প্রমাদ গণলাম। রাত পৌনে এগারোটা বাজে, এবং আমাকে কাল সকালে উঠতে হবে। এমনিতেই অ্যালকোহল জিনিসটার সামনে আমি একেবারে আড়ষ্ট হয়ে যাই, কিন্তু … কিছু করার নেই আপাতত। এখন ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।

    একটা অর্ধেক বন্ধ রেস্তোরাঁ কাম হোটেলের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল। অর্ধেক শাটার নামানো ছিল, মানে, রেস্তরাঁ বন্ধ হয়েই গেছে, কিন্তু গিয়ে জানানো হল জয়গাঁও থানার বড়বাবু এখন কয়েক ঘণ্টার জন্য আতিথ্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক, অতএব, খানিক অনিচ্ছে সত্ত্বেও তারা শাটার তুলে আমাদের ঢুকতে দিল। আমরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় এলাম।

    রেস্তরাঁ প্রায় অন্ধকার, কেউ নেই, পাশে একটা প্রাইভেট রুম। সেখানে গুটি তিনেক লম্বা সোফা লাগানো, আর সামনে রাখা একটা ইয়াব্বড়ো টিভি, দুপাশে সাউন্ড সিস্টেম। আমরা গিয়ে বসলাম, এবং বসামাত্র হুকুম হল, অ্যায়, কারাওকে অন করো।

    একটি সিস্টেম, টিভির সাথেই লাগানো, অন হল, আমাদের হাতে এল একটি রিমোট, একটি ছেঁড়াখোঁড়া ক্যাটালগ আর একটি কর্ডলেস মাইক। বিস্তর চর্চার পর গান ঠিক হল, হাসিখুশি সঙ্গীটি পুরনো দিনের গান প্রেফার করেন জেনে আমিও একটু স্বস্তি পেলাম, কারণ আমার পছন্দও পুরনো দিনের গানেই, আর অন্তত পক্ষে সেগুলো লাউড হবে না বেশি। রেস্ট পেয়েছি দুপুর থেকে – তবুও রাত এগারোটায় শরীর এখন বিশ্রাম চাইছে। কাল সকালে উঠে পারমিট করিয়ে যেতে হবে পারো, অনেকটা রাস্তা – এখন আর জোরালো আওয়াজ ভালো লাগছে না।

    কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা বলার আগেই একটি গানের জোরালো মিউজিক বেজে উঠল টিভির সাউন্ড সিস্টেমে, এবং আমাদের সঙ্গী গান ধরলেন – আজীব দাস্তাঁ হ্যায় ইয়ে …

    দু স্ট্যাঞ্জা গাইবার পরে বুঝলাম ইনি হাইফাই না হলেও মন্দ গান না, তবে প্রতি দু লাইনে এএএ – ব্বাবাআআআ বলে একটা চিক্কুর পাড়ার স্বভাব আছে, স্টেজে গাইতে গাইতে অভ্যেস হয়ে গেছে হয় তো। মুবারকেঁ তুমহে কি তুমমম, কিসি কি নূর হো গয়ি –এএএ-ব্বাবাআআআ, কিসি কে ইতনে পাস হো, কি হম সে দূর হো গয়ে – এএ-ব্বাবাআআআ – আজীব দাস্তাঁ হ্যায় ইয়ে …

    মাইক হাতফেরতা হতে থাকল, গায়কের হাত থেকে স্বরাজের হাতে, সেখান থেকে আমার হাতে, বাকিদের হাতেও, সবাই প্রাণপণে নিজেদের সুগায়ক প্রমাণিত করার চেষ্টা করে যেতে থাকল, আর আমার তখন ছেড়ে-দে-মা-কেঁদে-বাঁচি অবস্থা – উরেবাবা, পুলিশের সাথে ডিনার করার যে এই পরিণতি, কে জানত। একটা গান ছেড়ে পরের গান, সেটার পরে আরেকটা গান – এদিকে বোতল খালি হয়ে যাচ্ছে, খাবারের নাম নেই। অর্ডার অবশ্য একটা দেওয়া হয়েছে, প্রায় সাড়ে এগারোটা – কী আর খাবো, খানিক চিকেন কারি আর রুটি বলেছি, উপরোধে এক বোতল বীয়ারও খেতে হয়েছে, তার পরে তিনবার টয়লেটেও যেতে হয়েছে, প্রত্যেকবারেই টয়লেট যাবার সময়ে মনে হচ্ছিল, আআআহ, কী শান্তি, এখানে ঐ ঘরের আওয়াজ এসে পৌঁছচ্ছে না। কিন্তু অখণ্ড নীরবতার মাঝে শরীরের ভেতর সমানে কিছু একটা জানান দিয়ে যাচ্ছিল, কিছু একটা ঠিক নেই। পেটের ভেতর থেকে একদম রেকটামের কাছ পর্যন্ত কী রকম যেন একটা শিরা টেনে ধরার মত হাল্কা যন্ত্রণা, খানিকক্ষণ হচ্ছে, আবার থেমে যাচ্ছে। যখন থেমে যাচ্ছে, একেবারে কিছু নেই, কিন্তু যখন হচ্ছে, বেশ ভালোরকম অস্বস্তি হচ্ছে।

    টয়লেট থেকে ফিরে এলাম আবার সেই ঘরে। গানের তেজ বেড়েছে বই কমে নি, নেশাও চড়েছে অল্পবিস্তর সকলের। গান হচ্ছে, খানিক গল্প হচ্ছে, মূলত এলাকার ব্যবসাপত্রের হাল হকিকত, কিছু পরিচিত রেফারেন্স সমেত – যেগুলোর সাথে আমি একেবারেই অপরিচিত।

    একটি মেয়ে এল রাত বারোটা নাগাদ, সম্ভবত রেস্তরাঁর পরিচালক, এসে খুবই বিব্রত এবং জড়োসড়ো মুখ করে বলল, স্যারেরা যদি একটু আস্তে করেন ভল্যুমটা, হোটেলের বোর্ডারেরা কমপ্লেন করছে, তারা ঘুমোতে পারছে না …

    বলামাত্র, আপাত শান্ত, হাসিখুশি গায়ক ভদ্রলোকটির মুখের চেহারা গেল পালটে। নেশা চড়েছে বোঝা যাচ্ছিল সহজেই – খুব অ্যাগ্রেসিভ এবং জড়ানো কণ্ঠে মেয়েটিকে উঠে দাঁড়িয়ে যা বললেন, তা হল এই – কোন শালার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে? তাকে নিয়ে আসো এই রুমে, বলো গিয়ে জয়গাঁও থানার বড়বাবু এসেছেন এখানে, তাঁর যতক্ষণ ইচ্ছে হবে এখানে গান চলবে, যতক্ষণ থাকবেন এখানে খাওয়াদাওয়া চলবে, কার বাপের তাতে কী? যাও – বলে দাও ভল্যুম কমবে না।

    মেয়েটির মুখ সাদা হয়ে গেছিল, স্রেফ জয়গাঁও থানার বড়বাবু সামনে বসে আছেন, হয় তো সেই জন্যেই আর কথা না বাড়িয়ে, মুখ নিচু করে মেয়েটি আস্তে আস্তে পেছন ফিরে, দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি স্তম্ভিত হয়ে শুধু দেখলাম। লোকটি, যেন কিছুই হয় নি, এমন ভাব করে পরের গান বাছতে লেগে গেছেন আবার।

    জয়গাঁও থানার বড়বাবুর প্রতাপ তা হলে পাশের রাষ্ট্র ভুটানের একটা ছোট শহর পর্যন্ত বিস্তৃত! যে বড়বাবু একদিন আমার সাথে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তেন!

    স্বরাজ বিচক্ষণ ব্যক্তি। নিজেও বুঝল, তাল কেটেছে। তড়িঘড়ি সোজা হয়ে বসে বলল, না না, বহুত রাত হো গয়া। আমার বন্ধুকে কাল সকালে আবার বেরোতে হবে, খাবারটা দিয়ে দিতেই বলে দাও।

    খাবার এল। খেলাম। রাত প্রায় দুটো বাজে যখন, তখন উঠলাম, আমি তখন টায়ারনেসের শেষ সীমায়। মনে মনে ঠিক করলাম, কাল অন্তত আটটা অবধি তো ঘুমোতেই হবে। ফুন্টশোলিংয়ে ইমিগ্রেশন অফিস খুলবে সকাল নটায়। তাড়াতাড়ি উঠে গোছগাছ সেরে নিয়ে বেরোব।

    গাড়ি আমাদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে এল ভারতে। স্বরাজের বাকি বন্ধুরা যথাসম্ভব আপ্যায়ন করে আমাকে হোটেলের গেট অবধি ছেড়ে দিলেন, এবং বললেন, আমি যেন কাল চলে না যাই, কাল আমরা আবার পার্টি করব। আমি কুঁইকুঁই করে জানালাম, আমার তো ছুটি লিমিটেড, আর কাল থেকে আমার পারোতে হোটেল বুক করা আছে। সেটা সেরে কলকাতা যেতে হবে, তার পরে দিল্লি – লম্বা জার্নি, একটা দিনও নষ্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ইত্যাদি।

    বন্ধুরা খুবই মনক্ষুণ্ণ হয়ে আমাকে শুভরাত্রি জানালেন, দাবি করলেন আমি যেন আবারও জয়গাঁও বেড়াতে আসি এবং সেবারে যেন শুধু জয়গাঁওতে তাঁদের আতিথ্য নেবার জন্য আরও বেশিদিন হাতে নিয়ে আসি – আমি মিষ্টি হেসে সবাইকে ‘অবশ্যই’ বললাম এবং প্রায় টলতে টলতে উঠে নিজের ঘরে গিয়ে শুলাম।

    ধুপুস। আর কিছু মনে নেই।

    --------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

    তিরিশে অক্টোবর, একাদশ দিন
    ===================

    সকাল ছটায় ঘুম ভাঙল, তলপেটে তীব্র যন্ত্রণা সমেত। সেই এক জিনিস – নাভির কাছ থেকে কিছু একটা যেন টেনে ধরছে রেকটামের দিক পর্যন্ত। কোমর টাটিয়ে যাচ্ছে, এপাশ থেকে ওপাশ ফিরতে কষ্ট হচ্ছে।

    আস্তে আস্তে ঘুমের ঘোর কাটল। বাথরুমে গেলাম, ফ্রেশ হলাম, কিন্তু সমস্যা কমল না। সাথে পেনকিলার আছে, কাল রাতে খেয়ে শুলেই হয় তো ভালো হত, এখন খাওয়া একেবারেই উচিত নয়, সামনে সারাদিনের রাইডিং আছে, ইমিগ্রেশন অফিসে দৌড়ঝাঁপ আছে, রাতে মাত্র চার ঘণ্টার ঘুম সেরে এতকিছু মেকআপ দেওয়া সম্ভব নয়, অতএব এখন দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে যেতে হবে। একেবারে পারোতে পৌঁছে পেনকিলার খাবো, যদি তখনও ব্যথা থাকে তো।

    সকালে উঠে আমার চা খাবার একটা অভ্যেস আছে, কিন্তু নেশা নেই। আমি সাধারণত বাড়ির বাইরে চা খাই না। তাই দাঁত মেজে নিচে নেমে রাস্তায় এলাম, একটু টাকা পয়সা তুলতে হবে। … এতক্ষণে যন্ত্রণাটা খানিকটা সহ্যের মধ্যে এসেছে, মানে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। দেখি একটু হাঁটাহাঁটি করে যদি কমে।

    বাইরে হাল্কা ঠাণ্ডা আমেজ। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, যদিও তাতে ভিজে যাবার বিশেষ কোনও চান্স নেই। এটিএম একটু দূরেই, গেলাম, টাকা পয়সা তুলে ভাবলাম একবার ইমিগ্রেশন অফিসটা রেকি করে আসি।

    থানা পেরিয়ে দু পা এগোতেই ডানদিকে ভুটান গেট। স্মৃতিরা মাঝে মাঝেই ঝাপটা দেয় – শেষ যখন এসেছিলাম, তখন স্রেফ হাতে গোনা কয়েকটা দোকানপাট ছিল, আর এই জমকালো গেটটা ছিল, গেট দিয়েই আমরা ঢুকেছিলাম বেরিয়েছিলাম। এখন চারদিকে – না, আলিপুর দুয়ার জেলা নয়, জয়গাঁও নয়, সমগ্র ভারত যেন হামলে পড়ছে তার যাবতীয় কদর্যতা নিয়ে, গায়ের ওপর গা লাগানো ঘিঞ্জি দোকানপাট, কালো ধোঁয়া বের করা কাটাতেলের অটো, সাইকেল, রিক্সা, স্কুটার, আর পিলপিল করছে অগুন্তি লোক। থানা পেরিয়ে যে রাস্তাটা একদম ভুটানের বর্ডারে এসে একটা টি জাংশনে শেষ হচ্ছে, সেইখানে একজন ভারতীয় সেনার জওয়ান মেশিনগান হাতে ছোট্ট ছাউনিতে বসে লোকজনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছেন, তার ডানদিকে ওপরে নিচে বড় বড় বোর্ডে ভারতের জাতীয়তাবোধ একেবারে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে, শহীদের বলিদান, ভারতের ম্যাপের ওপর সিংহবাহিনী ভারতমাতা তেরঙ্গা পতাকা নিয়ে পোজ দিচ্ছেন, এদিকে এক দিয়া শহীদোঁ কে নাম, বন্দে মাতরম, মানে আপাতমস্তক শহীদের হাহাকারে মাখানো জিঙ্গোয়িস্টিক দেশপ্রেমে মোড়া সামনের পাঁচিলের ভারতের দিকটা।

    মনে মনে হাসলাম – কতটা তফাত সেই নাথু লা পাসের বিলবোর্ডগুলোতে আর এই জয়গাঁওয়ের বিলবোর্ডগুলোতে। ওখানে সীমান্তের অন্যপারে চীন, তাই এপারে ভারত মানে ভরতনাট্যম, তাজমহল আর লালকেল্লার সুবিশাল ছবি, আর এখন সীমান্তের অন্যপ্রান্তে ভুটান, যাদের অস্তিত্বই রয়েছে ভারতের জন্য, ছোট্ট নির্ঝঞ্ঝাট বন্ধুত্বপূর্ণ একটা রাষ্ট্র, তার সামনে তাই ভরতনাট্যম নেই, তাজমহল নেই, কেবল জঙ্গী উগ্র দেশপ্রেমের ছড়াছড়ি – যা দেখে ভারত দেশটার শক্তি সম্বন্ধে শ্রদ্ধা জাগে, সমীহ জাগে। ছোট ভাইয়ের সামনে বড়দাদা তার ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে, সেই বড় দাদাই যখন আরও বড় এক দাদার সামনে, তখন তার তেজ সেখানে দৃশ্যমান নয়।



    ছবি তুললাম একটা। তার পরে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে ক্যামেরা ফোকাস করে ভুটান গেটের ছবি নিচ্ছি – এমন সময়ে ছোট্ট ছাউনি থেকে জওয়ানটি আমাকে ডাকলেন – তুমি কি এদিককার ছবি নিয়েছো?

    এদিককার মানে এই – জওয়ান সমেত চারপাশের বিলবোর্ড। বেমালুম অস্বীকার করলাম, কই না তো! আমি তো এই জাস্ট ক্যামেরা অন করলাম, ভুটান গেটের একটা ছবি নেব বলে। জওয়ান বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন, হাঁ, সিরফ গেট কা ফোটু লেনা, ইধর কা ফোটু লেনা অ্যালাউড নেহি হ্যায়।

    মুখে বললাম, জরুর, জরুর, মনে মনে বললাম, ফোটো শালা। বলে, ভুটান গেটের ছবি নিলাম।



    এইবারে একটু পায়ে হেঁটে ঢোকা যাক। কিন্তু কী আশ্চর্য, এগোতে যেতেই গেটের মুখে ভুটানি পুলিশ আটকে দিল, ইধারসে নেহি ইধারসে নেহি, উধারসে এন্ট্রি।

    সে আবার কী? এখন ভুটান গেট দিয়ে ঢুকতে দেয় না? ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম, তাই তো! গাড়ি বেরোচ্ছে বটে ফুন্টশোলিং থেকে ভুটান গেট দিয়ে, কিন্তু না মানুষ, না গাড়ি, কেউই তো ঢুকছে না এখান দিয়ে!

    এইবারে বুঝলাম কাল স্বরাজের গাড়ি কেন আমাদের ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেছিল। পেছন ফিরলাম। সেই জওয়ান যেখানে বসে ছিলেন, তার থেকে একটু এগিয়েই ডানহাতে পদযাত্রীদের জন্য এন্ট্রি। একটা সরু গেট পার হয়ে ফুন্টশোলিংয়ে ঢুকতে হয়। ঢুকলাম। ঢোকামাত্র পরিবেশ বদলে গেল। গেটের ওপ্রান্তে কেওটিক ভারত, আর এ পাশে সুন্দর, শান্ত, সাজানো, ছবির মত ভুটান, কোথাও হর্ন বাজছে না, কোথাও অটোরিক্সা কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে না, কেউ লাইন ভেঙে দৌড়চ্ছে না গাড়ি নিয়ে – সব কিছু কেমন নিয়ম শৃঙ্খলায় বাঁধা। ম্যাজিক, গেটের এপারে আর ওপারে যেন দু রকমের দুটো দুনিয়া!

    রাস্তাটা একটু এগিয়ে এসে মিশেছে ফুন্টশোলিংয়ের মূল রাস্তাতেই, যেটা ভুটান গেট থেকে শুরু হয়েছে। ডানদিকে একটা ছোট একতলা বিল্ডিং, সেটা একটা ইমিগ্রেশন অফিস – ইন্ডিয়ান ব্যতীয় বাকি সমস্ত দেশের ভিসাধারীদের জন্য, তার পরে একটা ভারত পেট্রোলিয়ামের পেট্রল পাম্প, তার পরে মূল ইমিগ্রেশন বিল্ডিং, বড়সড়, এখানে ভারতীয়দের পারমিট দেওয়া হয়। এখন সাড়ে আটটা বাজে, সব বন্ধ, জাস্ট খেজুর করার উদ্দেশ্যেই ইমিগ্রেশন বিল্ডিংয়ের গেটে দাঁড়ানো পুলিশটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কটায় খুলবে?

    পুলিশটি, আমাকে প্রায় হতচকিত করে দিয়ে জানাল, এমনিতে নটায় খোলে, কিন্তু আজ তো খুলবে না – আজ ইমিগ্রেশন অফিস বন্ধ।

    মানে?

    মানে আজ এন্ট্রি হবে না। কাল আসুন।

    কেন? মানে, কেসটা কী?

    আজ চুখা ফেস্টিভাল। ফুন্টশোলিংয়ের সমস্ত সরকারি অফিস বন্ধ।

    আমার অবস্থা প্রায় খাবি খবার মত। আমি তো সমস্ত খোঁজ খবর নিয়ে ই আমার ট্রিপের প্ল্যান বানিয়েছিলাম, আজ তিরিশে অক্টোবর তো ছুটির কোনও গল্প কোথাও লেখা ছিল না? … সরে গিয়ে মোবাইল খুলে আবার সার্চ করলাম ভুটানের ছুটির দিনের ওপর – নাঃ, পরের ছুটি পরশু দিন, রাজার রাজ্যাভিষেক দিবস, পয়লা নভেম্বর, কিন্তু আজ তো কোথাও কোনও ছুটি নেই! চুখা ফেস্টিভালটা কী?

    ফিরে গেলাম আবার পুলিশটার কাছে। জানা গেল এটা শুধুমাত্র ফুন্টশোলিং ক্ষেত্রের উৎসব, জাতীয় লেভেলের নয়, তাই শুধু ফুন্টশোলিংয়েই সমস্ত সরকারি অফিস বন্ধ।

    খানিকক্ষণ সময় লাগল ফ্যাক্টটা হজম করতে, যে, আজকে আমার তা হলে সত্যিই যাওয়া হবে না।

    কী মনে হল, ভাবলাম, একবার পেট্রল পাম্পের অন্যপাশের ইমিগ্রেশন অফিসটাতেও কথা বলে দেখি। আফটার অল, আমার তো আম ভারতীয়দের মত পারমিট করানোর ব্যাপার নেই, আমার তো ই-ভিসা আছে!



    এগিয়ে দেখি, হ্যাঁ, সেই ভুটান গেটের মুখেই ছোট ইমিগ্রেশন অফিসটা খোলা আছে, ছোট্ট একটি লাইন, কিছু সাদা চামড়ার বিদেশি এবং কিছু ভারতীয় (পরে জেনেছিলাম, তাঁরা শ্রীলঙ্কান) লাইনে দাঁড়িয়ে, এবং প্রত্যেকের হাতে আমার মতই ই-ভিসার পেপার।

    খানিকক্ষণ পরেই আমারও ডাক এল একটা কাউন্টারে, উল্টোদিকে ভুটানের সরকারি পোশাক “ঘো” পরে বসে আছেন এক অফিসার। আমার ভিসাটি হাতে নিয়ে বললেন, গাইড কোথায়?

    গাইড মানে, উগিয়েন। ওর নামই দেওয়া আছে ট্র্যাভেল অপারেটর গাইড হিসেবে। আমি বললাম, গাইড তো পারোতে থাকে। আমি সেখানেই যাচ্ছি।

    অফিসার ভিসাটি আমার হাতে ফেরত দিয়ে বললেন, হবে না। গাইডকে এখানে ফিজিকালি উপস্থিত থাকতে হবে, নইলে ভিসা গ্র্যান্ট করা যাবে না।

    আমি আবার আতান্তরে। গাইডকে কীভাবে আমি পারো থেকে ফুন্টশোলিংয়ে এনে হাজির করব? এ রকমের কোনও নিয়ম আছে, তাই তো জানি না, কোথাও লেখাও নেই। বিনীতভাবে আরেকবার অনুরোধ করলাম, অফিসার উত্তরে আরেকটু রুড হলেন, লাভ হল না কিছুই।

    বেরিয়ে এলাম বাইরের ছোট্ট চাতালে। উগিয়েনকে ফোন করলাম। ফুন্টশোলিংয়ের ভেতরে খানিকদূর অবধি এয়ারটেলের কানেকশন কাজ করে। যদিও আমার কাছে এখন ভুটানের সিমও আছে। কাল স্বরাজ দিয়েছিল। উগিয়েন তখন সবে ঘুম থেকে উঠেছে। সে-ও গল্প শুনে হতবাক – এমন তো কখনও শুনি নি, গাইডকে আসতে হয়। আমি আমার সরকারি গাইড ব্যাজ ছবি তুলে আপনাকে হোয়াটস্যাপে পাঠাচ্ছি, ওটা দেখান।

    আমি বললাম, আপনার চেনাশোনা কেউ আছে এখানে, যে এসে আপনার নাম নিয়ে বলতে পারে, সে-ই আমার গাইড?

    উগিয়েন কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, হ্যাঁ, আমার এক ভাই সম্পর্কের একজন থাকে ফুন্টশোলিংয়ে, আপনি ওখানেই দাঁড়ান, আমি ওকে ফোন করে পাঠাচ্ছি আপনার কাছে।

    আধ ঘণ্টা বসে বসে দেখলাম, লোকজন কী অনায়াসে ভিসার পেপার নিয়ে ভেতরে ঢুকছে আর খুশিমনে বেরিয়ে আসছে। একটা সময়ে আরেক ব্যক্তি এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন, ঘো পরা। উগিয়েনের সম্পর্কিত ভাই, উগিয়েনের ফোন পেয়ে এসেছে।

    এবং ভাই এসে আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ভেতরে গিয়ে অফিসারের সঙ্গে ভুটানি ভাষায় কথা বলে তাকে কী জাদু করল, কে জানে, অফিসার এইবারে আমার ভিসার পেপারটি চেয়ে নিলেন, পাসপোর্ট চেয়ে নিলেন এবং ঘটাং করে স্ট্যাম্প মেরে দিলেন “অ্যারাইভড” বলে। আমার ভিসা স্ট্যাম্পিং হয়ে গেল। ভুটানে আমার এন্ট্রি পাকা।

    জয় গুরু। জয় ইয়েকীযেন। এতক্ষণে শরীরের ব্যথার কথা প্রায় ভুলেই গেছি। কিন্তু না – আরেকটা কাজ বাকি আছে। মানুষের ভিসা হবার পরের স্টেপ হচ্ছে ভেহিকলের পারমিট বের করা। সেটা হয় ফুন্টশোলিংএর বাস টার্মিনাস আরএসটিএ থেকে। আরএসটিএ মানে রয়্যাল সেফটি অ্যান্ড ট্র্যান্সপোর্ট অথরিটি। হিসেবমত সেটাও আজকে বন্ধ থাকার কথা। এই ভিসার কাগজ দেখিয়ে আমার মোটরসাইকেলের পারমিট বের করতে হবে।তবু, একবার গিয়ে দেখাই যাক। যদি কোনও জানলা খোলা থাকে।

    আরএসটিএ কাছেই। উগিয়েনের ভাই আর আমি মিলে পৌঁছলাম সেখানে, কিন্তু না, শেষমেশ ভাগ্য আর প্রসন্ন হল না। আরএসটিএর ভেতরে সেই ঘরটিকে লোকেট করলাম যেখানে ভেহিকল পারমিট ইস্যু করা হয়, কিন্তু সেটি পুরোপুরি বন্ধ। পাহারার দায়িত্বে থাকা আরেক পুলিশ জানালেন একই কথা – চুখা ফেস্টিভাল, অল ক্লোজড টুডে।

    কিছু করার নেই। কিচ্ছু করার নেই। আজকের দিনটা নষ্ট হবেই। যাওয়া যাবে না। উগিয়েনের ভাই খুবই কাঁচুমাচু মুখে দুঃখ প্রকাশ করলেন, আমাকে তাঁর নাম্বার দিয়ে বললেন, কাল সকাল ঠিক আটটায় উনি চলে আসবেন এখানে, আমার মোটরসাইকেলের পারমিট করিয়ে দিয়ে যাবেন।

    পারোতে যে হোমস্টে-তে আমার পরের তিন দিনের বুকিং ছিল, সেখানে ফোন করে বললাম, এই ব্যাপার, আজ আসতে পারছি না, ফুন্টশোলিংয়ে সব বন্ধ। আমি কাল পৌঁছব। আমার তিনদিনের বুকিংকে যেন ওঁরা দুদিনের বুকিং করে নেন।

    কাল সকালটাই টাইম। কাল হওয়াতেই হবে, না হলে পরশু আবার ভুটান জুড়ে ছুটি। অন্তত একটা কাজ হয়ে গেছে – আমার পারমিট। জাস্ট মোটরসাইকেলের পারমিটটা বাগিয়ে ফেলতে পারলেই –

    ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম, এবার ভুটান গেট দিয়েই। দশটা বাজে। সারাদিনে যখন আর কিছুই করার নেই, একটা পেনকিলার খেয়ে রাতের অসমাপ্ত ঘুমটা শেষ করি। অন্তত শরীরটা একদিনের রেস্ট পেলে ঠিক হয়ে যাবে।
  • সিকি | 158.168.40.123 | ০৬ মার্চ ২০১৮ ১১:৪১370703
  • একটু ঘ্যানঘ্যান করি। লেখাটা কেউ পড়ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সেই দোসরা ফেব্রুয়ারির পর থেকে একেবারে মনোলগ হয়ে চলছে। লেখার ফ্লো, কোয়ালিটি ইত্যাদি সম্বন্ধে কি একটু ফীডব্যাক পেতে পারি?
  • dc | 181.49.176.79 | ০৬ মার্চ ২০১৮ ১১:৫১370704
  • আমি তো প্রত্যেকটা পোস্ট পড়ি! আমার এমনিতেই ট্র্যাভেলগ পড়তে ভাল্লাগে, বেড়াতেও, আর সিকির লেখাও পড়তে ভাল্লাগে। এমনকি সিকির বইটা অবধি কিনে পড়ে ফেলেছি (নেটে কোথাও পাইরেটেড কপি না পেয়ে ঃ()। এই পোস্টগুলো পড়তে ভাল্লাগে বলে আলাদা করে কিছু লিখিনি।
  • TM | 174.100.152.63 | ০৬ মার্চ ২০১৮ ১২:১৭370705
  • দারুন হচ্ছে সিকিদা। চালিয়ে যান। মানসদর্শন সেরে ফেলছি আপনার লেখার মাধ্যমে।
  • sch | 132.160.114.140 | ০৬ মার্চ ২০১৮ ১২:২০370706
  • লেখাটা পড়ছি গোগ্রাসে - কিন্তু এটাও বই হিসেবে চাই - এভাবে পড়ে মন ভরে না
  • একক | 53.224.129.46 | ০৬ মার্চ ২০১৮ ১৪:৩৭370707
  • পড়ছি । ইমিগ্রেশন তো কস্মিনকালেও গাইড এর পরিচয় চায় না ভারতীয়দের ক্ষেত্রে । বেকার হ্যারাস করেছে , কিম্বা হতে পারে কোনো প্রবলেম ছিল ওই সময় । মাঝে মাঝে দেখতুম ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে নির্দেশ আসতো , আর এরা ব্যাপক কড়াকড়ি করত ।
  • সিকি | 158.168.40.123 | ০৬ মার্চ ২০১৮ ১৬:১৩370528
  • এটা ই-ভিসা। ওখানে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে বানানো পারমিট নয়। পারমিটে অবশ্যই লাগে না। ই-ভিসা গাইড আমার বিহাফে বানিয়ে দিয়েছে, সেই কনটেক্সটে হয় তো চাইছিল। এবং শুধু ইমিগ্রেশন নয়, পরে সমস্ত জায়গাতেই একই দাবি পেশ করেছিল।
  • dc | 181.49.176.79 | ০৬ মার্চ ২০১৮ ১৬:৪৪370529
  • আমার একটা জিনিস বলার আছে, সেটা অবশ্য লেখা নিয়ে না - সিকি পিঠের ব্যথা কন্ট্রোল করে কি করে? আমি অতোক্ষন বাইক চালাতে গেলে পিঠে, কাঁধে, পায়ে সর্বত্র ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়বো।
  • সিকি | ০৬ মার্চ ২০১৮ ১৮:১১370530
  • আমার পিঠে ব্যথা হয় না। ঘাড়ে একটা অল্প ব্যথা হয় বটে, হেলমেটের ওজন প্রায় দেড় কিলো, তো সেটুকু ব্যথা কোনও ট্রাবল দেয় না।

    ঐ ব্যথাটাই স্যাটিসফ্যাকশন :)
  • tania | 165.57.254.1 | ০৬ মার্চ ২০১৮ ২৩:৫০370531
  • দারুন হচ্ছে! লা জবাব দিল্লি অনেক আত্মীয় বন্ধুকে গিফ্ট করেছি ও প্রশংসা শুনেছি। মোটর সাইকেল ডাইরি এখনও হাতে আসেনি। এটাও বই হিসেবে চাই। দাবী জানিয়ে গেলাম।

    গাইডকে ইন পার্সন প্রেজেন্ট থাকতে হয় রাশিয়াতেও। আমাদের গাইডের কাছে এই নিয়ে অনেক গল্পও শুনেছিলাম।
  • tania | 165.57.254.1 | ০৭ মার্চ ২০১৮ ০০:১৮370532
  • অ্যাকচুয়ালি,রাশিয়াতে গাইডকে থাকতে হয় যদি তিন বা পাঁচদিনের ভিসিটর ভিসা চাওয়া হয়। রেগুলার ভিসা যেটা করতে অনেক সময় ও পয়্সা লাগে, সেটা আগে থেকে করা থাকলে একাই ডিসেম্বার্ক করা যায়।
  • শঙ্খ | 55.112.70.234 | ০৭ মার্চ ২০১৮ ০০:৩৪370533
  • আরে আমি গত কাল রাতেই পড়ছিলুম, তারপর অনেক রাত হয়ে যেতে আর কোন মন্তব্য না লিখেই কেটে পড়ে ছিলুম। আগে লিখেছি, আবারও লিখি, লেখায় একটা প্রসাদগুণ আছে, হয়ত আপাত ভাবে সাধারণ ঘটনাও লেখার গুণে পড়তে ভালো লাগে, তরতরিয়ে পড়ে ফেলা যায়।
    চলুক। পরে পরে পড়ে আবার ফীডব্যাক দিয়ে যাবো 'খন।
  • aranya | 172.118.16.5 | ০৭ মার্চ ২০১৮ ০৮:৪৬370535
  • খুবই উপাদেয় লেখা হচ্ছে, বলাই বাহুল্য
  • aranya | 172.118.16.5 | ০৭ মার্চ ২০১৮ ০৮:৪৬370534
  • আমিও পড়ছি। আর পড়ামাত্তর কিনা দুঃখ উথলে ওঠে, সব অ্যাডভেঞ্চার হতচ্ছাড়া অচল সিকি করে নিল, নিজ ভাগ্যে লবডঙ্কা, তাই আর কমেন্ট করি না
  • S | 194.167.2.96 | ০৭ মার্চ ২০১৮ ০৮:৫০370536
  • আরে ফুন্টশোলিং তো। কত্তদিন আগে গেছিলাম।
  • গবু | 57.15.142.229 | ০৮ মার্চ ২০১৮ ০৮:১৪370537
  • ট্রাভেলগ পড়তে পড়তে হিংসায় চোখ ছোট হয়ে যায়, জিভের তলা শুকিয়ে যায়, হাতের আঙ্গুল শক্ত হয়ে যায়, কমেন্ট করার খুব অসুবিধে। ☺️☺️☺️

    হচ্ছে তো ভালোই, তবে আরেকটু ঘন ঘন হলে আরো ভালো হতো।
  • dd | 193.82.19.49 | ০৮ মার্চ ২০১৮ ০৯:০২370539
  • হুলিয়ে পড়ছি। বেমালুম পড়ছি। খুঁটিয়ে পড়ছি।
  • স্বাতী রায় | ০৯ মার্চ ২০১৮ ১১:৪১370540
  • দারুণ লাগছে। নাথাং যেতেই হবে মনে হচ্ছে।
  • সিকি | 158.168.40.123 | ০৯ মার্চ ২০১৮ ১৫:০৩370541
  • থেঙ্কু। আশা করি কালকের মধ্যে পরের পর্ব এসে যাবে। এইবারে ভুটান।
  • সিকি | ১০ মার্চ ২০১৮ ০৯:৪৮370542
  • অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল কেমন একটা ঘোরের মধ্যে। ক্ষিদে পেয়েছে। না, শরীরের ব্যথা আর নেই। পেনকিলারের এফেক্ট, কিন্তু ভারী পর্দায় ঢাকা ঘরের মধ্যে বোঝা যাচ্ছে না বেলা কত হল। চোখ খুলতে হবে, কিন্তু চোখের পাতার ওজন মনে হচ্ছে কয়েক কিলো বেড়ে গেছে।

    নির্জীবের মত পড়ে রইলাম আরও খানিকক্ষণ। তার পরে আস্তে করে উঠে মোবাইলটা জ্বাললাম – স্ক্রিনের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল, কোনওরকমে সময়টা পড়তে পারলাম, দুটো বেজে তিন মিনিট। মাথা ভারী হয়ে আছে, পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে।

    একটা দিন পুরো ওয়েস্ট। কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই। ভালো করে একটু চান খাওয়া করে আরেকবার ঘুমোবার চেষ্টা করতে হবে – যতটা রেস্ট নিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা তার চেয়েও বড়; আগে চান, না আগে খাওয়া? ক্ষিদে পেয়েছে সাঙ্ঘাতিক, ওদিকে চান করাটাও জরুরি। আজন্ম সংস্কার আমাকে শিখিয়ে এসেছে চান করেই দুপুরের খাওয়া খেতে হয়, কিন্তু সংস্কার না মানাটা আমার এমনই অভ্যেস হয়ে গেছে, বার তিনেক মাথা চুলকে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম, আগে খেয়ে আসি। খেয়ে এসে চান করব আরামসে।

    রুম থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে দু পা এগোতেই হোটেলের রেস্টুরেন্ট, একই ফ্লোরে, লোকজনের ভিড়ে গমগম করছে। এক থালা বিরিয়ানির অর্ডার দিলাম। জয়গাঁওয়ের বিরিয়ানি কেমন হবে জানি না, কিন্তু খেতে হবে। … তা, মন্দ বানায় নি। খেতে শুরু করলাম।

    একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। পশ্চিমবঙ্গের নম্বর।

    অন্যপ্রান্তের আওয়াজটি পরিচয় দিলেন – আমি কুমার কৌস্তুভ রায়, লোনলি হাইওয়ে নামে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটার আমি মডারেটর। তুমি করেই বলছি ভাই, তোমার বইয়ের প্রকাশ হচ্ছে তো চার তারিখ? আমি অমুক জায়গা থেকে আসব, তোমার অনুষ্ঠানের ভেনুতে কী করে পৌঁছব …

    আলাপ করে খুব খুশি হলাম। তখনও জানি নি লোকটার মধ্যে কতগুলো গল্প ফোল্ড করে ঢুকিয়ে রাখা আছে, সে সব জেনেছিলাম আরও পরে – সে গল্প যথাসময়ে হবে। ডিরেকশন দিলাম হুগলি চুঁচুড়া মিউনিসিপ্যালিটি আসার, সেখানেই হচ্ছে কিনা আমার ট্র্যাভেলগের বই হিসেবে আত্মপ্রকাশ, যে বইটাকে আমি নিজেও চোখে দেখি নি এখনও।

    খেয়ে দেয়ে ফিরে এলাম ঘরের দিকে। লম্বা করিডরের অন্যপ্রান্তে রিসেপশন, সেখানে গিয়ে বলে এলাম, আজকেও থাকছি – পারিমিট পাই নি, ফুন্টশোলিংয়ে সমস্ত বন্ধ আজ।

    কিছু টুরিস্ট এসেছেন, সম্ভবত অন্ধ্র বা তেলেঙ্গানা থেকে। তাঁদের সঙ্গে এসেছে একতাড়া লাগেজ, সেসব টপকে আমি ঘরের দিকে এগোতে গিয়ে … থমকে গেলাম ছ নম্বর রুমের সামনে। আমার ঠিক পাশের রুমটা।

    গান ভেসে আসছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত। পুরুষ কণ্ঠ, উদাত্ত।

    আমি তোমায় যখন খুঁজে ফিরি, ভয়ে কাঁপে মন –
    প্রেমে আমার ঢেউ লাগে তখন।
    তোমার শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে
    শেষ করে দাও আপনাকে যে–
    ওই হাসিরে দেয় ধুয়ে মোর বিরহের রোদন …

    … ও মোর ভালোবাসার ধন …

    বিক্রম সিং শুনেছি। বারবার। কিন্তু এ যেন অন্য লেভেলের গায়কী। টপ্পাঙ্গের গান, প্রতিটা সুরের ভাঁজ শুধু নিখুঁত লাগছে, তাই নয়, সুরের প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে কী রকম যেন মনে হচ্ছে একটা কান্না ঝরে ঝরে পড়ছে। বিক্রমের গলায় এই গানে আমি বিষণ্ণতা পেয়েছি, এখানে একটু অন্য রকম মুড়কি লাগছে – কিন্তু কে গাইছে এমন করে?

    আমার চারপাশ থেকে মুছে গেছে সবকিছু, সামনে রেস্তরাঁ, পেছনে রিসেপশনের কোলাহল এক ঝটকায় মুছে দিয়েছেন রবিঠাকুর, আসা যাওয়ার পথের মাঝে সরু করিডোরে অন্য রুমের সামনে আমার একলা দাঁড়িয়ে থাকাটা বেখাপ্পাই লাগছিল হয় তো, কিন্তু আমার তখন সে হুঁশ নেই, আমি শুনছি ভেতরের উদাত্ত গলাটা পরের গান ধরেছে, শুনি ওই রুনুঝুনু পায়ে পায়ে নূপুরধ্বনি, চকিত পথে বনে বনে …

    কী মনে হল, গানটা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করলাম। তার পরে থাকতে না পেরে দরজাতে নক করলাম।

    দরজা খুলল একটা ছেলে, মানে কমবয়েসী একজন, খুব বেশি হলে ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়েস হবে। প্রথমেই নজর কাড়ে ছেলেটার চোখ, প্রচণ্ড গভীর, এক দৃষ্টিতে যেন সামনের জনের ভেতরটা দেখে নিতে পারে, এই রকমের তীব্র।

    ছেলেটা দরজা খুলে তাকালো আমার দিকে, চোখেমুখে প্রশ্ন, আমিই প্রথম কথা বললাম – নমস্কার, আমি পাশের রুমেই আছি। আপনার ঘর থেকে এইমাত্র একটা গান শুনে দাঁড়িয়ে গেছিলাম, আপনিই গাইছিলেন?

    ছেলেটা খুব হতচকিত ভাব নিয়ে বলল, হ্যাঁ, কেন বলুন তো?

    একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললাম, আমি কি ভেতরে এসে একটু বসতে পারি? আপনার গান আমার প্রচণ্ড ভালো লেগেছে, যদি আরও একটা দুটো গান শোনান – আপনি চাইলে আমার ঘরেও এসে বসতে পারেন। আমি জাস্ট আপনার গলায় আরও কটা গান শুনতে চাই, মানে – এই রকম ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত আমি আগে কখনও শুনি নি। যদি আপনার আপত্তি না থাকে …

    ছেলেটা একগাল হেসে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল –আসুন। বসুন।

    পরের তিনটে ঘণ্টা কীভাবে কেটে গেল – জানি না। কিন্তু যেটুকু যা শুনলাম ছেলেটির সম্বন্ধে, হাঁ হয়ে যাবার পক্ষে যথেষ্ট। সমীরণ তার নাম (আসল নাম নয় অবশ্য)। নৈহাটিতে থাকত এককালে, বাবা জুটমিলের কর্মচারী ছিলেন। খুব স্বাচ্ছন্দ্যের সংসার ছিল না জুটমিল সংলগ্ন কলোনিতে, এমনকি পরিবেশও খুব একটা ভদ্রস্থ ছিল না, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তার অসম্ভব অনুরাগ দেখে মা তাকে নিয়ে যান কাঁঠালপাড়ার এক দিদির কাছে গানের তালিম নিতে, যে দিদি ছিলেন দক্ষিণীর ছাত্রী। পড়াশোনার পাশাপাশি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গান শেখা সেই দিদির কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের হাতেখড়ি বেশ চলছিল, হঠাৎ জুটমিলের ভেতর অ্যাক্সিডেন্টে বাবা মারা যান পরিবারটিকে একেবারে রাতারাতি পথে বসিয়ে। সমীরণ তখন ক্লাস এইট। সঞ্চয় বলতে প্রায় কিছু ছিল না। জুটমিল নিজেই তখন বন্ধ হবার মুখে – একটি টাকা পয়সাও পাওয়া যায় নি।

    এর পর? মায়ের বাপের বাড়ি শিলিগুড়িতে – কয়েক মাসের মধ্যে সেইখানে গিয়ে ওঠা, এবং মামার দয়ায় কোনওরকমে মাধ্যমিক পাশ করা। এর পরে আর মামাবাড়িতে ঠাঁই হয় নি। ফুলবাড়ি এলাকায় একটা শস্তার এক কামরার ঘর ভাড়া নিয়ে মা আর ছেলের পরের স্ট্রাগল শুরু হয়। সমীরণ পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল, কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে পড়াশোনা করা ছিল নিতান্ত বিলাসিতা। প্রথমে দরকার ছিল ঘরটুকু ধরে রাখার চিন্তাআর পেটের দুটো নুনভাত ফ্যানভাতের জোগাড় করার চিন্তা।

    প্রথমে ফুলবাড়ি এলাকার একটা ভাতের হোটেল, পরে শিলিগুড়ির একটা মধ্যমানের রেস্তরাঁয় ওয়েটারের চাকরি। সামান্যই মাইনে, কেবল খাওয়াটা ফ্রি। রেস্তরাঁ খোলে সকাল এগারোটায়, বন্ধ হয়ে বেরোতে বেরোতে রাত বারোটা। রাতের খাবার মায়ের কাছে নিয়ে পৌঁছনো যেত না, সকালেও মায়ের খাবারের বন্দোবস্ত করা যেত না সময়মত, তাই মালিককে অনুরোধ করে রেস্তরাঁতেই রাতে শোবার বন্দোবস্ত করা, আর রেস্তরাঁরই আরেক ওয়েটার দাদাকে ধরে রাত নটার মধ্যে মায়ের কাছে মায়ের একার মত ভাত তরকারি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে সে। পুরো ব্যবস্থাই হয় সেই দাদার উৎসাহে। এর পর সেই দাদার উৎসাহে ভর করেই পরের স্বপ্নের উড়ান। দাদাই তাকে স্বপ্ন দেখতে শেখান। …

    … আমি স্রেফ হাঁ হয়ে শুনছিলাম, মাঝেমধ্যে দু একটা প্রশ্ন করেছিলাম বলেই হয় তো আজ এতটা ডিটেলে লিখতে পারছি। ফিকশনও বোধ হয় এতটা টানটান উত্তেজনার হয় না। রেস্তরাঁতে কাজ করতে করতে সমীরণ একটা নাইট স্কুলে ভর্তি হয়, ক্লাস ইলেভেনে। আর্টস। সপ্তাহে একদিন ছুটির বন্দোবস্ত হয় রেস্তরাঁ থেকে, স্কুলেরই একজন স্যার তাকে দুটো সাবজেক্ট পড়ানোর দায়িত্ব নেন। এবং, টানা দু বছর সে দাঁতে দাঁত চেপে রেস্তরাঁর কাজ চালাতে চালাতে পড়াশোনা শেষ করে, প্রথম বারের প্রচেষ্টাতেই হায়ার সেকেন্ডারি উতরে যায়।

    জেদ বেড়ে যায় সমীরণের। এর পরে সে জোগাড় করে আরেকটা চাকরি – এটিএমের সিকিউরিটি গার্ডের। ছোটাছুটি নেই, কাজ বলতে সে রকম কিছু নেই, কেবল টুলে বসে থাকা, দিনে দশটি ঘণ্টা। মাইনে একটু বেশি। এতটুকুই বেশি, যে মা-কে শিলিগুড়িতে এনে একটা ঝুপড়ি ঘরে রাখা যায়।

    চাকরিটা সমীরণ এই কারণেই বেছে নিয়েছিল – ও পড়তে চেয়েছিল। পড়তে পারবে – এই ভয়ঙ্কর আত্মবিশ্বাসটা ও পেয়ে গেছিল উচ্চমাধ্যমিকের জন্য দু বছর লড়েই। আর এটিএমের সিকিওরিটি গার্ডের চাকরিতে পড়াশোনা করবার জন্য অফুরন্ত সময়। শিলিগুড়ির এক কলেজে ইকোনমিক্স নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় তাকে, লোকাল পার্টির দাদাকে ধরেকয়ে, অবশ্য, মাঝে একটা বছর নষ্ট হয়েই গেছিল, প্রথম বারে হয় নি।

    “সেদিনও, আর আজও, বুঝলে দাদা, গান আমার একমাত্র এন্টারটেনমেন্ট। যখন পড়তে বসে বোর হয়ে যেতাম, দুটো একটা গান গেয়ে নিলেই ফ্রেশ। যে পরিবেশ থেকে বেড়ে উঠেছি, ও গান না থাকলে ঐসব জায়গার আর পাঁচটা ছেলে যেভাবে বয়ে যায়, আমিও সেইভাবেই বয়ে যেতাম। ঐ এক রবিঠাকুরের গান আমাকে কী রকম জাদু করে রাখত, আজও রাখে। বন্ধুবান্ধব পাড়ার লোক অনেকের কাছে হ্যাটা খেয়েছি এই বাজারে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে পাগলামো করার জন্যে – আর সেসব থেকে দূরে সরতে গিয়ে ঐ রবীন্দ্রসঙ্গীতকেই নিয়ে ভেগেছি।”

    গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষার দু মাস আগে, মা মারা যান। টিবি হয়েছিল, ছেলেকে টের পেতে দেন নি, ছেলে যতক্ষণে টের পায়, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই, সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা শুরু করার দু দিনের মধ্যেই মা মারা যান।

    “দুঃখ পেয়েছিলাম, মানে যতটা পাওয়া যায় আর কি – বুঝলে। মায়েরও আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না, আমারও মা ছাড়া আর কেউ রইল না। মামাদের সাথে বেরিয়ে আসার পরে আর কোনও সম্পর্ক রাখি নি। শেষ কাজও আমি একা হাতেই করেছি। আর, সবকিছু মিটে যাবার পরে, সবার প্রথমে যে জিনিসটা আমার মাথায় এল – সেটা হচ্ছে, আর দেড় মাস বাকি পরীক্ষার। এবং, আমার আর কোনও পিছুটান রইল না। আগে তাও মায়ের জন্য দিনে একবার বাড়িতে ফেরার গল্প ছিল, এখন আর সেটাও রইল না – তো বুঝলে দাদা, পরীক্ষাটা দিয়েই ফেললাম। আর বলতে নেই, ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলাম। আমাদের কলেজ থেকে মাত্র তিনজন ইকোনমিক্স অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল, বুঝলে।”

    পাশ করার ছ মাসের মাথায়, সদ্য পাঁচদিন আগে সমীরণ একটা চাকরি পেয়েছে, কলকাতায়। সামান্য চাকরি, কিন্তু এটা ওকে ওর পরের স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করবে। পরের স্বপ্ন, মাস্টার্স করা, কলকাতা থেকে, এবং ছোটবেলাতেই থেমে যাওয়া গানের তালিম আবার শুরু করা। কাঁঠালপাড়ার সেই দিদির সঙ্গে আবার যোগাযোগ হয়েছে, তিনি এখন কলকাতাতেই গান শেখান। শিলিগুড়ির পাট চুকিয়ে ডিসেম্বর মাসেই সমীরণ কলকাতা চলে যাবে, তাই এটিএম গার্ডের চাকরি থেকে পাকাপাকি ছুটি নিয়ে একলা ঘুরতে বেরিয়েছে। টাকাপয়সা জমেছে কিছু। পাড়ার একজনের কাছ থেকে একটা স্কুটারও জোগাড় হয়েছে। ওরও ভুটান যাবার ছিল আজকেই। ইমিগ্রেশন বন্ধ থাকার জন্য যেতে পারে নি। কাল সকালে যাবে।

    আমি মোটামুটি কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এ রকমের গল্প তো জাস্ট সিনেমা টিনেমায় হয় বলে শুনেছি – এই লাইফ কাটিয়ে আসা একজন ছেলে, সত্যি সত্যি আমার সামনে বসে আছে?

    আরও খানিকক্ষণ গল্প হল। আমিও আমার গল্প বললাম – সেই টিবির কবল থেকেই বেঁচে ফেরার গল্প। আমার বেড়ানোর গল্প। এবং, গল্পের মাঝে মাঝে গান হল। সে অবশ্য একতরফা। অসম্ভব সাধা গলা সমীরণের, শুনলে জাস্ট গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এই ছেলেটি তো কাল আমার যাত্রাপথের সঙ্গী হতে পারে! জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবে প্রথম? কী প্ল্যান ভুটানে?

    সমীরণ বলল, প্রথমে থিম্পু যাবো, ওখানে আমার পাড়ার একজন চাকরি করে। ওর কাছে দুদিন থেকে পারো ঘুরে ফিরে আসব। এসে দার্জিলিং যাবো আবার।

    তা – থিম্পু আর পারোর তো বেশির ভাগটাই একই রাস্তা। যাবে আমার সাথে? কাল আমিও পারমিট নিতে বেরোব তো সকালে।

    সমীরণ একটু ফ্যাকাসে হাসল, দাদা, একটা কথা বলি – কিছু মনে কোরো না – আমি একলা ঘুরতে চাই। লোকজনের সঙ্গ ছাড়া।

    তড়িঘড়ি বললাম, আরে না না, মনে করার কী আছে, আমি নিজেও তো ঐ রকমই – এই দ্যাখো, এতটা রাস্তা তো একা একাই ঘুরছি – ঠিক আছে, ঠিক আছে, কোনও ব্যাপার না, তুমি তোমার মত বেরিও। আমি আমার মত বেরোব।

    এর পরেও গান হল। শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, লোকগীতিতেও সমীরণের অবাধ দক্ষতা। গোটা দুয়েক ভাওয়াইয়া গান শোনাল। আর অতুলপ্রসাদ।

    এক সময়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি পড়াশোনায় খুব ভালো, বুঝলাম, কিন্তু রোজগারের রাস্তা হিসেবে গান কেন বেছে নাও নি কখনও? এত অসাধারণ গানের গলা তোমার, তুমি তো স্বচ্ছন্দে রেডিও টিভিতে অডিশন দিতে পারো। ফাংশন টাংশন থেকে কখনও ডাক আসে নি?

    সমীরণ হাসল, না। গান গেয়ে পয়সা আমি এ জীবনে রোজগার করতে পারব না দাদা – ওটা আমার অক্সিজেন। অক্সিজেন বেচতে পারব না আমি, বুঝলে।

    ***

    একা থাকতে আমিও চাই, তাই সাড়ে সাতটা নাগাদ সমীরণের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে ফিরলাম। একটু বাদে রাতের খাবার খেতে বেরোব, একলাই যাব। তলপেটের ব্যথাটা আবার একটু একটু করে ফিরে আসছে, পেনকিলারের এফেক্ট শেষ হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে আরেকটা পেনকিলার মেরে ঘুমোতে যেতে হবে, যাতে কাল সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারি। বার বার জিজ্ঞেস করে এসেছি, কাল ইমিগ্রেশন খোলা থাকবে, অবশ্য আমার পারমিট হয়েই গেছে, স্রেফ মোটরসাইকেলের পারমিটটা বানানো বাকি, আশা করি বেশি সময় লাগবে না। উগিয়েনের ভাই কাল আরএসটিএর সামনে আসবে সকাল সাড়ে আটটায়।

    ঘরে গিয়ে গোছগাছ সেরে নিলাম, আজ আর স্বরাজের কল আসে নি, সাড়ে আটটার সময়ে একাই বেরিয়ে গেলাম। বাইরে একটা ছোট ভাতের হোটেল টাইপের দেখে এসেছি, ওখানেই সেরে এলাম রাতের খাবার, খেয়ে এসে পেনকিলার খেয়ে একটু এপাশ ওপাশ করে, সোজা ঘুম।

    কাল কি হবে, ভুটান?
    =======================================================================

    ৩১শে অক্টোবর, দ্বাদশ দিন

    ঘুম ভাঙল সকাল সাতটায়, একেবারে ফ্রেশ। কোনও সমস্যা নেই শরীরে। ঝটপট উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম, আজ তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বেরিয়ে পড়তে হবে। দুদিন পুরো থাকার ছিল পারোতে, সেইটা কমে এক দিন হল, যদি আজ বিকেলের মধ্যে পারো পৌঁছে যেতে পারি, তা হলে পারো শহরটা ঘুরে নেব, প্রশ্ন হচ্ছে কাল কোনটা করব – চেলে লা পাস, নাকি টাইগার্স নেস্ট। যাক গে, আগে তো পৌঁছই, তার পরে দেখা যাবে।

    বাইরে বেরিয়ে একবার সমীরণের দরজায় নক করতে গিয়েও, হাত সরিয়ে নিলাম। থাক, পথের আলাপ, পথেই শেষ হয়ে যাওয়া ভালো। ফোন নম্বরও নিই নি। যদি ওরও আজ বেরনোর থাকে তো ওখানে আরএসটিএ অফিসেই দেখা হয়ে যেতে পারে।

    মোটরসাইকেলটা থানাতেই রাখা রয়েছে, কাল আর বের করা হয় নি সারাদিনে। ধুলো খেয়েছে গোটা একদিন ধরে, পায়রাতেও নোংরা করেছে খানিক, একবার ধুয়ে নিতে পারলে ভালো হত। কাল সকালের হালকা বৃষ্টিতে ধুলো আরও বসে গেছে সর্বাঙ্গে।

    ফুন্টশোলিংয়ের আরএসটিএ অফিসে পৌঁছে উগিয়েনের ভাইকে ফোন করলাম, এখানে আর এয়ারটেল ধরছে না, ভুটানের সিম থেকে এই প্রথম ফোন করলাম। দশ মিনিটের মধ্যেই ভাই এসে পৌঁছে গেলেন। সক্কাল সক্কাল ফিটফাট, ঘো পরিহিত। ভুটানের নিয়ম হচ্ছে, নন–ভুটানিজদের জন্য এমনিতে কোনও ড্রেসকোড নেই, কিন্তু ভুটানিজদের জন্য সরকারি অফিসে, যিনি কাজ করছেন, এবং যিনি ভিজিট করছেন, দুজনকার জন্যই ন্যাশনাল ড্রেস পরে থাকা মাস্ট। নিজেদের সংস্কৃতিকে ওরা প্রচণ্ড ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে জীবনের প্রতিটা পদে।

    উগিয়েনের ভাই বার বার লিখতে খারাপ লাগছে, কিন্তু তার নাম সত্যিই মনে নেই, তাই ভাই বলেই চালাই আপাতত। ভাইকে নিয়ে দোতলায় উঠলাম, পারমিটের ঘরটা কালকেই দেখে এসেছি, সেইখানে গিয়ে দাঁড়ালাম, ভাই ভেতরে ঢুকে দেখে এসে বললেন, অফিসার এখনও আসেন নি, একটু দাঁড়ানো যাক।

    ঠিক নটায় অফিসার এলেন, একই রকমের ঘো পরা, ভাই তাঁর পেছন পেছন ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলেন আমার স্ট্যাম্প মারা ভিসা, পাসপোর্ট আর গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে। এবং ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় মুখ চুন করে বেরিয়ে এলেন – পারমিট হয় নি, সেই একই সমস্যা – উগিয়েন স্বয়ং এখানে উপস্থিত না থাকলে ভেহিকল পারমিট দেওয়া হবে না। হবে না তো হবেই না, কোনও ভাবেই এখানে চিঁড়ে ভেজানো যায় নি।

    আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আমার অবস্থা দেখে ভাই আবার একবার ভেতরে গেলেন, আবার বেরোলেন, এবং এবার তিনতলায় গেলেন, আবার নেমে এলেন দোতলায়। নাঃ, কাঁধ ঝুলিয়ে ক্ষমাপ্রার্থীর ভঙ্গীতে দাঁড়ালেন ভাই, ভেরি সরি ব্রাদার, আই কুডন্ট ডু দিস।

    কোনওরকমে হাসিমুখে ভাইকে বিদায় জানাতে হল। বললাম, আমি ইমিগ্রেশন অফিসে একবার লাইন দিয়ে দেখি, নর্মাল পারমিট প্রসেসে একবার চেষ্টা করে যদি পারমিট বের করে নেওয়া যায়, তা হলে আর এই ই-ভিসার দরকার হবে না, তা হলেই আর গাইডের উপস্থিতির ক্লজটা থাকবে না। এমনি পারমিট পেলে তো সেই পারমিট দেখিয়েই ভেহিকল পারমিট বের করে নেওয়া যায়।

    ভাই বললেন, হ্যাঁ, দেখুন ব্রাদার। আমি তো ওদিকের প্রসেস জানি না –

    ভাই চলে গেলেন। আমি হাঁটতে লাগলাম ইমিগ্রেশন অফিসের দিকে। সোয়া নটা বেজেছে। ইমিগ্রেশন অফিসের ভেতরের চত্বরে লম্বা লাইন লেগেছে। কাল গেট বন্ধ, শুনশান ছিল জায়গাটা। আজ গমগম করছে। এদিক ওদিক কিছু দালাল ঘুরছে, দেখলেই চেনা যায়। সে রকম একজন দালাল, দাঁড়কাকের মত চেহারা, চোখে কালো চশমা, বিহারী অ্যাকসেন্টে আমাকে জিজ্ঞেস করল, পারমিট করাতে হবে কিনা।

    গল্পটা বললাম, এই এই হয়েছে। এখন নর্মাল পারমিট করিয়ে বেরোতে চাই। ই-ভিসায় কাজ হবে না।

    দালাল বরাভয় দেখিয়ে বলল, কোনও চিন্তা নেই, কুছ পরোয়া নেই – মহিলাদের একটা দল সামনেই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাদের দেখিয়ে বলল, আপনাকে আমি এই গ্রুপের সঙ্গে করিয়ে দিচ্ছি। সাড়ে ছশো টাকা লাগবে, আমি পারমিটের ফর্ম এনে দিচ্ছি।

    পারমিটের ফর্ম আমি নিজেই তিন কপি সঙ্গে রেখেছিলাম, ব্যাগ থেকে বের করে বললাম, পাঁচশো দেব।



    লোকটা কালো চশমার ফাঁক দিয়ে একবার আমাকে দেখে বলল, একা আছো না? সাড়ে পাঁচশো। এখন একশো টাকা দাও, আর – পাশে ঘো পরা আরেকটা চিমসে মতন ছেলে বাকি দলের ফর্ম ভরতে সাহায্য করছিল – ভুটানি দালাল আর কি – তাকে দেখিয়ে বলল, একে সাড়ে চারশো দিয়ে দিও। এ তোমাকে লাইনে লাগিয়ে দেবে। আমাকে তোমার বাইকের কাগজপত্রগুলো দাও, আমি পারমিট করিয়ে আনছি ততক্ষণে। আধঘণ্টায় চলে আসব, ততক্ষণে এখান থেকে পারমিট বের করে নাও।

    ফর্ম ভরে লাইনে দাঁড়ালাম। চারপাশে বিভিন্ন রকমের লোকজন – কেউ জটলা পাকিয়ে অন্য কোনও দালালের সঙ্গে নিগোশিয়েশন চালাচ্ছে, কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে ফর্ম ভরছে, একটা বাইকার গ্রুপ মনে হল দেখে, তারাও ফর্ম ভরছে আরেক দিকে বসে। কেউ যাচ্ছে চাকরির কাজে, কেউ টুরিস্ট, কেউ বিজনেসের ব্যাপারে। সামনে বারান্দা মতন একটা এলাকা, সেইখানে দুজন অফিসার বসে ফর্ম স্ক্রুটিনি করে যাচ্ছেন। আমাদের গ্রুপের ফর্মের বান্ডিলও এক সময়ে গেল সেখানে, এবং প্রায় কিছু না দেখেই ওকে হয়ে ফেরত এল। এর পরে একটা সময়ে আমাদের ডাক এল, বারান্দার পাশেই একটা দরজা দিয়ে ঢুকে সেই মহিলাদের গ্রুপটার পিছু পিছু আমিও ওপরে উঠে গেলাম।

    বড় হলঘর, সারি সারি কাউন্টার, সেখানে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর আমাদের ডাক এল সাত নম্বর কাউন্টারে। এক এক করে সমস্ত মহিলার হয়ে যাবার পরে মহিলাদের লিডার টাইপের যে মহিলাটি, কথায় বার্তায় জেনেছিলাম মিজোরাম পুলিশ, তিনি আমাকে কাউন্টারের সামনে এগিয়ে দিলেন।

    ফর্ম জমা দিয়ে ছবি তোলা হল, এইবারে পরিচয়পত্র দেবার পালা। পাসপোর্ট বাড়িয়ে দিলাম, সেটাকে খুলেই কাউন্টারের লোকটি বললেন, আপনার তো এন্ট্রি হয়ে গেছে, আর তো হবে না। সিস্টেম চেক করেও বললেন, না, আপনার গতকালই এন্ট্রি হয়ে গেছে, আর তো এন্ট্রি করানো যাবে না।

    আবার বোঝালাম তাঁকে ব্যাপারটা। কী বুঝলেন জানি না, বললেন, এই ভিসাটা ক্যানসেল করিয়ে নিচ থেকে অ্যাপ্রুভ করিয়ে আবার ওপরে আসুন, পারমিট হয়ে যাবে।

    কী ঝমেলা, জিজ্ঞেস করলাম, আমার ঐ ওপাশের বিল্ডিং থেকে ভিসা হয়েছে, ওটা ওখান থেকেই ক্যানসেল করিয়ে আসব তো? এখানে করানো যাবে না? কাউন্টারের লোকটি বললেন, হ্যাঁ, ভিসা ওখান থেকেই ক্যানসেল করাতে হবে, করিয়ে নিচ থেকে আবার অ্যাপ্রুভ করে ওপরে আসুন।

    নিচে নেমে এলাম। দালালটার ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছিলাম, তাকে ফোন করলাম একবার – বস, এই এই বলছে, কী করব?

    আমার কেস বোধ হয় ইউনিক, সে শোনে নি কখনও ই-ভিসার গল্প, যেমন উগিয়েনের ভাই পারমিটের গল্প জানে না বলেছিল। বলল, আচ্ছা – বলছে যখন, করিয়ে নাও ক্যানসেল। আমি তোমার বাইকের পারমিটটা নিয়ে আসছি আর দশ মিনিটের মধ্যেই।

    আমি বেরিয়ে এসে পেট্রল পাম্পটা পেরিয়ে পাশের ইমিগ্রেশন অফিসে গেলাম আবার। পারমিটের ইমিগ্রেশন অফিসটাতে যত ভিড়, এখানে তেমনিই নির্জন, শুনশান। অন্য একজন অফিসার বসে ছিলেন। গিয়ে ভিসার কাগজটা বাড়িয়ে ধরে বললাম, আমাকে ওই ইমিগ্রেশন অফিস থেকে বলছে এটা ক্যানসেল করালে তবে পারমিট দেবে। ক্যানসেল করিয়ে দিন, প্লিজ।

    অফিসার, সরু সরু চোখদুটোকে আরও সরু করে বললেন, কালকেই এন্ট্রি করিয়েছো, আজকে এক্সিট করে দেব? আর ইউ শিওর?

    আমি বললাম, হ্যাঁ শিওর।

    ভদ্রলোক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ওকে দেন – বলে স্ট্যাম্প মেরে দিলেন, ভিসায় আর আমার পাসপোর্টে – এক্সিট, ফুন্টশোলিং।

    আমি সেটা নিয়ে আর পারমিটের কাগজপত্র নিয়ে আবার ফিরে এলাম আগের ইমিগ্রেশন অফিসে, নিচের কাউন্টারে গিয়ে আবার পারমিটের ফর্ম দেখিয়ে বললাম, ই-ভিসাটা ক্যানসেল করাতে গেছিলাম, এবার ওপরে গিয়ে পারমিট বানাবো, অ্যাপ্রুভ করে দিন।

    অফিসার ই-ভিসাটা চেয়ে নিলেন। একবার সেটার দিকে দেখলেন, একবার আমার দিকে দেখলেন, দেখে বললেন, এটা আপনি এইমাত্র ক্যানসেল করিয়ে এসেছেন?

    কিছু একটা ভুল হচ্ছে বা হয়ে গেছে – সেন্স করলাম, আস্তে করে বললাম, হ্যাঁ … কেন?

    পারমিটের ফর্ম আর ই-ভিসা আমাকে ফেরত দিয়ে বললেন, ফেরত যাও। একবার এক্সিট করে গেলে পনেরো দিনের আগের পরের পারমিট পাওয়া যাবে না।

    মানে???

    মানে, এটাই নিয়ম। পারমিট হোক বা ভিসা, একবার এক্সিট ছাপ পড়ে গেলে পনেরো দিনের কুলিং পিরিয়ড। তার আগে পারমিট দেবার নিয়ম নেই।

    আমার মাথা টলে গেল। আমি জেনেবুঝে আমার পারমিট ভিসা ক্যানসেল করিয়ে এসেছি, করানোর আগে পর্যন্ত আমাকে কেউ এই তথ্যটা দেয় নি, একবার বললে আমি করাতাম না – ওপরের কাউন্টারের লোকটা কী শয়তান! একবার বলল না, ক্যানসেল করালে পনেরো দিনের আগে আর করানো যাবে না! তাই বারবার বলছিল নিচ থেকে অ্যাপ্রুভ করিয়ে ওপরে আসবে, মানে ও জানতি, যে ক্যানসেল করানোর পরে নিচ থেকে আর অ্যাপ্রুভ করবে না!!

    সব আশা শেষ। আর কিচ্ছু করার নেই। আমারই বোকামির জন্য আমার ভুটান যাত্রায় এবারের মত ইতি পড়ল।

    পেছন ফিরতে দেখি সেই দালাল ঢুকছে গেট পেরিয়ে। আমাকে বলল, এই নাও, তোমার মোটরসাইকেলের পারমিট। তোমার পারমিট হয়ে গেছে?

    বললাম। মানে, নিতান্ত অশিক্ষিত লোক একজন, জাস্ট সোজাসাপটা প্রসেসটা জানে, একটু এদিক ওদিক হলে কী নিয়ম কানুন, কিস্যু জানে না। কিস্যু না। সে আবার গেল সেই ডেস্কে, কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু নিয়ম হল নিয়ম। আগের ইমিগ্রেশন অফিসে গিয়ে কথা বলো, যদি ওরা কিছু করতে পারে। এখানে কিচ্ছু করা যাবে না।

    আর তো কিছু বলারই নেই। লোকটাও আর সাহস করে সাড়ে চারশো টাকা চাইতে পারছে না। আমি বললাম, বাইকের পারমিট নিয়েই বা আমি আর কী করব, ছিঁড়ে ফেলে দাও। আমি ফেরত যাই। আমারই বোকামি।

    দালাল লোকটা, কী ভেবে কে জানে, ভেহিকল পারমিটটা ভাঁজ করে আমার জামার পকেটে ঢুকিয়ে দিল জোর করে, বলল, দাঁড়াও, দেখছি। কোথা থেকে সেই চিমসে মতন ভুটানিজ দালাল ছেলেটাকে ধরে আনল। সে এসে আবার আমার কাছে বুঝতে চাইল, কী হয়েছে। আমি আবার বোঝালাম। সে বলল, আচ্ছা, চলো, দেখি কিছু করা যায় কিনা, ওখানে ছোট ইমিগ্রেশন অফিসে আমার এক বন্ধুর ভাই কাজ করে।

    তাকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম আবার সেই ই-ভিসা ইস্যু করার ইমিগ্রেশন অফিসে। সে ভেতরে ঢুকল। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ভেহিকল পারমিটের কাগজটা বের করলাম। উগিয়েনের ভাই আরএসটিএ অফিসে গিয়ে অতক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি করার পরেও পারমিট বের করতে পারে নি, আর এই লোকটা কিনা একশো টাকা নিয়ে ওখানে গিয়ে আমাকে ছাড়াই পারমিট বের করে ফেলল? আমাকে যেতেও হল না?

    ভেহিকল পারমিটের কাগজটা বের করে দেখি, তিনি আরেক কীর্তি করে রেখেছেন। মোটরসাইকেলের নম্বরে DLএর জায়গায় সেই দালাল, কিংবা অন্য কেউই হবে, লিখেছে WB।

    প্রায় পনেরো মিনিট বাদে সেই চিমসে দালাল বেরিয়ে এসে বলল, কে বলেছিল তোমাকে এটা ক্যনসেল করাবার কথা?

    আমি বললাম, ওই ইমিগ্রেশন অফিসের দোতলায় সাত নম্বর কাউন্টারে যিনি বসে আছেন। আমি গেলে চিনতে পারব।

    ছেলেটা আমাকে নিয়ে আবার ভেতরে ঢুকল। সেই অফিসারের সঙ্গে, যাঁর কাছ থেকে আমি একটু আগেই ভিসা ক্যানসেল করিয়েছি, তাঁর সাথে অনর্গল ভুটানিজ ভাষায় কিছু বলতে লাগল। দুজনেই খুব উত্তেজিত হয়ে কথোপকথন চালালো, আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে একবার এর মুখের দিকে, একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চলেছি। বুঝতে পারছি না কিছুই।

    দশ মিনিট কথা চালাচালির পর, ছেলেটা আমাকে ডেকে আনল বাইরে। গলা নামিয়ে বলল, আমি কথা বললাম, ওরা আবার তোমাকে এন্ট্রি করিয়ে নেবে, সিস্টেমে ডেটা চেঞ্জ করে দেবে, কিন্তু টাকা চাইছে।

    কত?

    ছেলেটা আমার চোখে চোখ রেখে বলল, পাঁচ হাজার।

    আমি ঢোঁক গিললাম। দু সেকেন্ড ভেবে নিলাম, কী বলা উচিত। বাইরে বেরিয়েছি, এখনও অবধি বড় কোনও খরচা হয় নি, পাঁচ হাজার আমি দিতেই পারি, কিন্তু আমি একটা বিদেশী রাষ্ট্রের এন্ট্রি পয়েন্টে একজন বিদেশী ইমিগ্রেশন অফিসারকে ঘুষ দিচ্ছি সে দেশে ঢোকার জন্য, কোনওভাবে যদি কেঁচে যায় কেস তো আমার গল্প আজ এখানেই শেষ হয়ে যাবে।

    তার পর বললাম, দেব। কিন্তু পারমিট বানিয়ে দিতে হবে।

    ছেলেটা বলল, চিন্তা নেই, হয়ে যাবে। এরা তিন হাজার নেবে, আর ওই অফিসে রেকর্ড বদলাবার জন্য দু হাজার দিতে হবে। তোমার কাছে ঐ ভিসার আর কপি আছে?

    আছে। নীলাদ্রিদা একসাথে তিন কপি প্রিন্ট আউট দিয়েছিল। বললাম, সে আছে, কিন্তু আমাকে একবার এটিএমে যেতে হবে। পকেটে তো অত টাকা নেই।

    চিন্তার কিছুই নেই, সামনেই ভুটান গেট, আর গেট পেরোলেই সবার প্রথমে সামনে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের এটিএম। ছেলেটাকে নিয়ে গেট পেরিয়ে টাকা তুলে আবার ফিরে এলাম, সে টাকা নিয়ে আর আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল, অফিসার আমাকে খুব তম্বি করে বললেন, কেন তুমি ওর কথা শুনে ক্যানসেল করিয়ে গেলে, আমার সাথে একবার কথা বলা উচিত ছিল না তোমার – (যেন আমি আগে থেকেই সমস্ত নিয়ম জেনে বসে আছি, কী আর বলব, দোষ আমারই) – বলে কম্পিউটারে খুটখাট কী সব এন্ট্রি করে আমাকে বললেন, পাসপোর্ট দাও। ভিসার কপি দাও।

    দিলাম। তিনি ভিসার নতুন কপিতে, আর পাসপোর্টের যে পাতায় এক্সিট স্ট্যাম্প মারা ছিল, তার পরের পাতায় আবার এন্ট্রি স্ট্যাম্প মেরে দিয়ে বললেন, চলো আমার সাথে।

    বলেই হনহন করে হেঁটে অফিস ছেড়ে বেরিয়ে চললেন পাশের ইমিগ্রেশন অফিসের উদ্দেশ্যে, আমিও চললাম তাঁর সাথে, তিনি সোজা আমাকে নিয়ে বারান্দার সামনে ডেস্ক পেতে বসা সেই অফিসারের কাছে গিয়ে আমাকে দেখিয়ে ভুটানিজ ভাষায় কী সব বলতে লাগলেন। তার পরে আবার, আমার দিকে ফিরে, ফলো মি, বলে পেছনে আরেকটা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে বললেন, এইখানে চুপ করে দাঁড়াও, আমি আসছি।

    এটা ঐ বড় ইমিগ্রেশন অফিসের ব্যাক অফিস। মানে যে বিল্ডিংএর দোতলায় পারমিট করানো হয়। সমস্ত ফাইল, সার্ভার, দস্তাবেজ এখানে মজুদ আছে। ডেটা সেন্টার। সেখানে আমার সব কাগজপত্র নিয়ে গেলেন, এবং দশ মিনিট বাদে ফিরে এলেন আমার নতুন ভিসার প্রিন্ট আউটে আরেকটা স্ট্যাম্প মেরে, এসে বললেন, হয়ে গেছে। গুড লাক। এইবারে যাও।

    আমি তখন, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেললাম, পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে? একজন ভুটানিজ ইমিগ্রেশন অফিসারকে? এ-ও সম্ভব?

    লোকটার সাথে হ্যান্ডশেক করে দুবার থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু বলে আমি বেরিয়ে এলাম। আমার কাজ হয়ে গেছে, এইবারে ফিরে যাই হোটেলে, স্বরাজকে বলে টলে বেরোই। বেলা বারোটা বাজে। সকাল থেকে টেনশনের চোটে খাওয়াদাওয়া কিচ্ছু হয় নি, এইবারে টের পেলাম – পেট একদম খালি।

    চিমসে মত ছেলেটা বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল, ওকে আবার ভেহিকল পারমিটের কাগজটা দেখিয়ে বললাম, এখানে আমার মোটরসাইকেলের নম্বর তো ভুল লেখা হয়েছে, এটা আবার ঠিক করাতে যেতে হবে তো? … ছেলেটা এদিক ওদিক তাকিয়ে, আমার কাছ থেকেই পেন চেয়ে নিয়ে WB কেটে দিয়ে, পাশে লিখে দিল, DL। পাশে একটা ঘিজিমিজি ইনিশিয়ালও মেরে দিল। এইভাবেই, এইভাবেই তবে কাজ হয়ে যায়। বেকার শর্টকাট মারতে গিয়ে সবচেয়ে লম্বা প্রসেস, আর সবচেয়ে বেশি টাকা খুইয়ে অবশেষে আমার ভুটান যাওয়া হচ্ছে।



    ইমিগ্রেশন অফিসের উল্টোদিকের ফুটপাথেই একটা জেরক্স সেন্টার, তার পাশে একটা ব্রেকফাস্ট করার ছোট রেস্তরাঁ। ভেতরে ঢুকে দেখলাম চমৎকার পরোটা আর ঘুগনি পাওয়া যাচ্ছে, ছখানা পরোটা খেয়ে বুঝলাম খিদে মরেছে। আর বেশি খাবার দরকার নেই, এখনি দেড়শো কিলোমিটার চলা শুরু করতে হবে। সাড়ে বারোটা বাজছে।

    ফিরে এলাম জয়গাঁও – প্রথমে স্বরাজকে ফোন করে বললাম, পারমিট হয়ে গেছে রে, আমি এইবারে বেরোচ্ছি। স্বরাজ বলল, ঠিক আছে, আমি এখন সাইটে আছি, দেখা করতে পারলাম না, ভালো করে ঘুরে আয় – আর … হোটেলে কোনও পয়সা দিতে হবে না, আমি বলে রেখেছি। ফিরে এসে সিম কার্ডটা মনে করে ফেরত দিয়ে যাস।

    স্বরাজের সঙ্গে আর দেখা হয় নি। দুটো দিন বন্ধুর নিঃস্বার্থ আতিথ্য উপভোগ করে বেরিয়ে পড়লাম, তাকে এতটুকুও প্রতিদান দেওয়া হল না।

    ছ নম্বর রুম বাইরে থেকে বন্ধ, তালা মারা। সমীরণ কখন বেরিয়ে গেছে, জানি না। বেরিয়ে যাওয়াই উচিত। দেখা হল না ওর সাথেও।

    হোটেল থেকে লাগেজ নামিয়ে বাইকে বাঁধলাম, থানা থেকেই একটা ন্যাকড়া জোগাড় করে বাইকটাকে যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে, যখন স্টার্ট দিলাম, ঘড়িতে তখন বাজে সোয়া একটা। প্রচুর দেরি এমনিতেই হয়ে গেছে। ফুন্টশোলিংয়ে তখন প্রচুর গরম, নাকি আমার দৌড়ঝাঁপের চোটে আমার গরম লাগছে, কে জানে, দরদরিয়ে ঘামছি তখন। পরশু রাতে স্বরাজের গাড়ি যে রাস্তা দিয়ে ঢুকেছিল, ঐটা হল ইন্ডিয়ার গাড়ি ভুটানে ঢোকার রাস্তা। রাস্তাটা চিনে রেখেছিলাম, দুপুর বেলার জ্যামজমাট জয়গাঁওয়ের রাস্তা ঠেলে আমি ঢুকলাম ফুন্টশোলিংয়ে। আমার মোটরসাইকেল তা হলে ভারতের বাইরে চাকা ছোঁয়াল অবশেষে।

    তবে, পায়ে হেঁটে যে জিনিসগুলো বোঝা যায় না, বাইকে বা গাড়িতে চাপলে সেগুলো চট করে নজরে পড়ে যায়। এতবার ফুন্টশোলিংয়ে ঢুকলাম বেরোলাম, দেখেছি তো বটেই, কিন্তু খেয়াল করি নি, ফুন্টশোলিং নো হঙ্কিং জোন। ওখানে কেউ হর্ন বাজায় না। এবং, নো ওভারটেকিং। মোড় থেকে ট্রাক টার্ন নিচ্ছে, বাঁ দিক দিয়ে গলে বেরিয়ে যাবার জায়গা থাকলেও মোটরসাইকেল নিয়ে তোমাকে পেছনেই দাঁড়াতে হবে, সিগন্যাল সবুজ হবে, ট্রাক বেরোবে, তবে তুমি বেরোবে।

    পুরো ভুটানেই এই নিয়ম। ওভারটেকিংএর জন্যেও হর্ন মারা নিষেধ। ডিপার জ্বালিয়ে সিগনাল দাও, পাহাড়ি রাস্তায় জায়গা মিললে সামনের গাড়ি নিজেই সাইড হয়ে তোমাকে যাবার রাস্তা করে দেবে, তখনই তুমি ওভারটেক করতে পারবে।

    ভুটান গেট থেকে সোজা রাস্তাটা ছশো মিটার গিয়ে মিশেছে একটা মোড়ের মাথায়, যার বাঁদিকে গেলে আরএসটিএ অফিস, আর ডানদিকে পারো-থিম্পুর রাস্তা। এগিয়ে গেলাম। জাস্ট একটু এগোতেই শহরের ভিড় কমে গেল, পাহাড়ের দৃশ্য শুরু হল, একটা বাঁকের মুখে দাঁড়াতেই হল – ভুটানের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে সামনে দিগন্তের শেষ অবধি দেখা যাচ্ছে, বিস্তীর্ণ সমতল জমি – ভারত।



    মাউন্টে মোবাইল লাগানো আছে, আমার অফলাইনে পারোর হোমস্টে-র লোকেশন আর রুটও সেভ করা আছে, নেভিগেশন চালু করতে গিয়ে দেখি, লে হালুয়া, নেভিগেশনের অপশনটাই নেই আর গুগল ম্যাপে। এ আবার কী কেস? ব্যাক করে এসে, ফোন রিস্টার্ট করে, বহুভাবে চেষ্টা করলাম, কিন্তু না, ম্যাপের সমস্ত ফীচার কাজ করছে, স্রেফ নেভিগেশন কাজ করছে না। এমনি রুট দেখিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু নেভিগেট করতে গেলেই লিখছে, দিস ফীচার ইস নট অ্যাভেইলেবল ইন ইওর কান্ট্রি।

    কেসটা কী? দু মিনিট দাঁড়িয়ে গুগল করলাম – হুঁ, যা ভেবেছি, তাইই। ভুটান দেশে মোবাইলে জিপিএসে নেভিগেশন নিষিদ্ধ। তা হলে চিনে পৌঁছব কী করে? … কিছুই করার নেই, এমনি রুট খুলে রাখো, দেখতে দেখতে যাও। সমস্যা হচ্ছে, এইভাবে তো যাওয়া যায় না, নেভিগেশন চালু না হলে স্মার্টফোন একটু বাদে বাদেই বন্ধ হয়ে যায়। তো, সেইভাবেই এগোলাম।

    তিন চার কিলোমিটারের মাথায় চেকপোস্ট। পারমিটের কপি দেখানো হল, একটা স্ট্যাম্প পড়ল আবার, এবং আবার চলার শুরু।

    উচ্চতা ক্রমে ক্রমে বাড়ছে, আর, রোদের তেজ কমে আসছে, মেঘেরা আবার ভিড় করে আসছে রাস্তার ওপরে। একটা জায়গায় দেখলাম রাস্তার পাশে খানিকটা জমি, সেখানে বেশ কয়েকজন বাইকার দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে রেন গীয়ার পরছে। বৃষ্টি পড়ছে না যদিও, তবে মেঘ এখানে বেশ ঘন, ভেতর দিয়ে যাবার সময়ে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আমিও দাঁড়ালাম একটু দূরত্ব রেখে। আমার রেন গীয়ার পরে নিলাম। ছেলেগুলোর সাথে আলাপ হল – কেরালা থেকে এসেছে। থিম্পু যাচ্ছে।





    ওরা বেরিয়ে গেলে আবার একলা চলা। রাস্তা মোটামুটি ভালোই।

    ভুটান, আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেকেরও কম। পাহাড়ের ওপর এই ভূখণ্ডের নাম একদা ছিল ভোদন্ত, সরল বাংলায় এর মানে হল তিব্বতের অন্ত। তিব্বতের শেষে এই দেশ। সম্ভবত সেই ভোদন্ত থেকেই দেশটার নাম ভুটান। তবে ভুটানিজদের কাছে তাদের দেশের আরেকটা নাম আছে – ড্রুক য়ুল – ল্যান্ড অফ থান্ডার ড্র্যাগন। মোটামুটি ৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে বৌদ্ধ গুরু পদ্মসম্ভব, যাঁর তিব্বতী ভাষায় নাম হল গুরু রিনপোচে, তিনি তিব্বত থেকে – রূপকথা অনুযায়ী এক উড়ন্ত বাঘের পিঠে চড়ে এসে পৌঁছন এই দেশে। সেই সময় থেকে এই এলাকার ইতিহাস শুরু। তার আগের খবর জানা যায় না বিশেষ।

    আজকের ভুটান অত্যন্ত সুন্দর, শান্ত , ছিমছাম একটা দেশ। তবে প্রায় সমস্ত কিছুতেই তারা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ভুটানের রাস্তায় ভুটানিজ মিলিটারির পাশাপাশি ইন্ডিয়ান আর্মির গাড়ি আকছারই দেখা যায়। ভুটানের রাস্তাঘাট সমস্তই ব্রো-এর বানানো। ভুটানের সমস্ত পেট্রল পাম্পও হয় ইন্ডিয়ান অয়েল, নয় হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম।

    ভুটানের কারেন্সির নাম গুলট্রাম – Ngultrum। শর্টে Nu লেখা হয়। এর মূল্য ভারতীয় টাকার বরাবর। পুরো ভুটানেই ভারতের টাকা অ্যাট পার চলে ভুটানের টাকার সঙ্গে। আগে আমাদের ছাত্রজীবনে জলপাইগুড়ি পেরিয়ে শিলিগুড়িতেও ভুটানের নোট চলত, এখন ভুটানের নোটের সার্কুলেশন ভারতে জয়গাঁওয়ের বাইরে আর কোথাও নেই। ভুটানিজরা ভারতীয় মুদ্রা বেশি প্রেফার করে, কারণ যে কোনও রকমের মেডিকেল এমার্জেন্সিতে তাদের গন্তব্য ভারত – হয় নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ, নয় কলকাতা। ফলে ভারতীয় মুদ্রার একটা চাহিদা সবসময়েই থাকে।

    ভুটানের গাড়ির নাম্বারপ্লেট দু রকমের হয়। সাধারণ মানুষের গাড়ির নাম্বারপ্লেট লাল রঙের হয়, আর আরবিপি, বা রয়্যাল ভুটান পুলিশ – তাদের গাড়ির প্লেট হয় নীল রঙের। সরকারি গাড়ির নম্বর হয় লালের ওপর হলুদ রঙে, প্রাইভেট গাড়ির নম্বর লালের ওপর সাদা রঙে লেখা হয়। কমার্শিয়াল অবশ্য আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, হলুদের ওপর কালো।

    চুখা পেরোলাম একটা সময়ে, এইবারে আবার খিদে পাচ্ছে, ঠাণ্ডাও পড়েছে ভালোই, আর খালিপেটে ঠাণ্ডা বেশি লাগে – একটু কিছু খেয়ে নিতে পারলে ভালো হয়।

    প্রায় সাড়ে তিনটের সময়ে পৌঁছলাম চাপছা নামে একটা জায়গায়। ছোট্ট বসতি, পর পর অনেকগুলো খাবারের দোকান। একটা দোকানে ঢুকে খানিক নুডলস আর কফি খেলাম, কফিটা ঠিক জুতের লাগল না যদিও। কেমন যেন ফ্লেভার্ড ক্রিম দিয়ে বানানো কফি, আর ফ্লেভারটা কেমন স্ট্রবেরি টাইপের। কফি খাচ্ছি বলে মনেই হল না।

    চারটের সময়ে উঠে আবার চলা।

    সন্ধে নামল একটা জায়গায়, সেখানে আরেকটা চেকপোস্ট, আরেকবার সব পারমিট দেখাতে হল। কেরালার দলটার সাথে আবার দেখা হয়ে গেল। পারমিটে স্ট্যাম্প লাগাবার পরে এইবারে পারোর ফার্মস্টে-তে ফোন করলাম। সম্ভবত ফার্ম সংলগ্ন হোমস্টে। ভদ্রলোককে আজ দুপুরেই জানিয়ে রেখেছিলাম ফুন্টশোলিং থেকে শুরু করার সময়ে। এইবারে ভালো করে ডিরেকশন জেনে নিলাম আরেকবার। খুব সহজ বলে মনে হল না চিনে বের করা। যাই হোক, এটা বুঝলাম, পারোতে ঢুকলে আকটা বড়সড় মার্কেট পড়বে। সেই মার্কেট পেরিয়ে আরও পাঁচ কিলোমিটার গেলে তবে তার হোমস্টে-র রাস্তা পড়বে, সেখানেও প্রায় দু কিলোমিটার মত কাঁচা রাস্তা নাকি।

    প্রায় পৌনে সাতটার সময়ে একটা ব্রিজের কাছে এসে পৌঁছলাম, সামনে একটা জমকালো গেট। ব্রিজটা বাঁ হাতে, শুরুতেই একটা বড় করে বোর্ড লাগানো তাতে লেখা বিভিন্ন রাস্তার ডিরেকশন, ব্রিজে না উঠে এই সামনের গেট দিয়ে ঢুকলেই সোজা থিম্পু, ব্রিজ পেরিয়ে ডানদিকে গেলে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে পারো, আর ব্রিজ পেরিয়ে বাঁ দিকে গেলে হা ভ্যালি। রাস্তা এখান থেকে বেশ চওড়া হয়ে গেছে, ঘুটঘুটে অন্ধকারেও তাই চালাতে আর কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। একটা সময়ে এসে পৌঁছলাম পারো এয়ারপোর্ট, রানওয়ের ঠিক পাশ দিয়েই সরু রাস্তা গেছে – এটাই ভুটানের মূল এয়ারপোর্ট। বাই এয়ার থিম্পু আসতে গেলেও এই পারোতেই নামতে হয়।

    যেহেতু নেভিগেশন কাজ করছে না, তাই পারো শহরে ঢোকার পরে একটু সময় নষ্ট হল সঠিক রাস্তাটা বাছতে, শেষে এক পুলিশকে জিজ্ঞেস করে আবার এগোলাম, আর এগোতেই সামনে পেলাম পারো মার্কেট। ছবির মত সুন্দর ভুটানিজ স্থাপত্যে বানানো কাঠের বাড়ি পরপর সারবাঁধা। রাতের আলোতে আরও মোহময় লাগছিল। মার্কেট পেরোতেই আবার ফোন এল হোমস্টে-র ভদ্রলোকের। বললাম, মার্কেট এলাকা জাস্ট পেরিয়েছি, উনি আবার ডিরেকশন দিলেন, আমি বললাম, আমি সাড়ে আটটার মধ্যে তো পৌঁছচ্ছিই।





    নেভিগেশন কাজ না করলেও অফলাইন সেভ করা ছিল লোকেশন, দেখতে পাচ্ছি আর ছ কিলোমিটার দূরে আমার হোমস্টে। বেশ খানিকটা এগোবার পরে দেখলাম ম্যাপ আমাকে বলছে এইখান থেকে বাঁদিকের রাস্তা নিতে। মানে, বাঁদিকে একটা কাঁচা রাস্তাই বটে। এইবারে শুরু হল চাপ, ম্যাপ যেমন যেমন বলছে, আমি তেমন তেমন এগোচ্ছি, ভেতরে কাঁচা রাস্তার অনেক ব্র্যাঞ্চিং হয়েছে, ওদিকে নেভিগেশন চলছে না বলে ফোনও একটু বাদে বাদেই অফ হয়ে যাচ্ছে, আবার গ্লাভস খুলে ফোন অন করতে হচ্ছে, এদিকে ঠাণ্ডাও চূড়ান্ত। … এই করতে করতে শেষমেশ যেখানে ম্যাপ বলল, এই সেই হোমস্টে – আমি দেখলাম এদিকে একটা খাটাল, আর ওদিকে জঙ্গল, সামনে ঘুটঘুট্টে অন্ধকার, কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। ফার্মস্টের ফ-ও নেই কোথাও।

    শরীর আর দিচ্ছে না। আজ সারাদিনে আর পেনকিলার খাওয়া হয় নি, পেটের ব্যথা ফিরে আসছে আবার। রীতিমত জানান দিচ্ছে। ভাগ্যি ভালো, ফোনে এখনও নেটওয়ার্ক রয়েছে। ফোন করলাম ভদ্রলোককে আবার। উনি কিছুই বুঝতে পারলেন না, আমিও বোঝাতে পারলাম না আমি কোথায় আছি।

    সভ্যতার এক সাঙ্ঘাতিক আশীর্বাদ হোয়াটসঅ্যাপ। আমি লোকেশন শেয়ার করলাম, উনিও ওনার ফার্মস্টে-র লোকেশন শেয়ার করলেন, দুটো লোকেশনের মধ্যে তুলনা করে বুঝলাম আমি একটু বেশি এগিয়ে এসেছি, দু কিলোমিটার ফিরতে হবে উল্টোদিকে। বললাম, দাঁড়ান, আমি আসছি আস্তে আস্তে।

    সড়ে আটটাও বেজে গেছে। ফিরলাম, কিন্তু – যেখানে এইবারে লোকেশন দেখাচ্ছে, সেটা প্রায় রাস্তার ওপরে – এবং, সেখানে লেখা তেনজিং ড্রুক প্রাইমারি স্কুল। ফার্মস্টে কোথায়? ভালো করে ম্যাপ দেখছি, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আরেকবার ফোনই করে নেব তা হলে? বলব, এখানে এসে আমাকে তুলে নিয়ে যেতে?

    স্কুলের সামনেই দাঁড়িয়ে গল্প করছিল দুটি কিশোরী মেয়ে। আমাকে খানিকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটি মেয়ে, অপরূপ সুন্দরী, এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, এক্সকিউজ মি, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন? …

    … আমি থাকি দিল্লিতে। সেখানে এই ধরণের অ্যাপ্রোচ দেখতে পাওয়া অভাবনীয়। একটি অচেনা লোক, মোটরসাইকেলে করে একটা নির্জন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে, আর তাকে সাহায্য করতে যেচে এগিয়ে আসছে এক কিশোরী মেয়ে – এই খুব স্বাভাবিক, খুবই নির্লিপ্ত মানবিকতা দেখার অভ্যেস আমার নেই। মেয়েটিকে দিয়ে প্রথম ভুটান দর্শন হল আমার। পরিচয় পেলাম ভুটানিজদের অতিথিবৎসলতার। সে আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে ফার্মস্টে-র লোকটির সাথে কথা বলে আমাকে ফোনটা ফেরত দিয়ে বলল, ফলো মি, আমি নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে। সঙ্গিনীটিকে ভুটানিজ ভাষায় কিছু একটা বলল, বোধ করি বলল – একটু দাঁড়া, আমি এনাকে এগিয়ে দিয়েই আসছি।

    এর পরে শুরু করল দৌড়, মেয়েটি দৌড়চ্ছে রাস্তার ধার ধরে, আমি পেছন পেছন মোটরসাইকেল নিয়ে তাকে ফলো করে যাচ্ছি। স্কুলের পাশে মাঠ, কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, পেছন দিকে কিছু বাড়িঘর থেকে একটা দুটো আলোর রেখা এসে পৌঁছচ্ছে।

    প্রায় এক কিলোমিটার দৌড়বার পরে, কাঁটাতারের শেষপ্রান্তে এসে, একটুও না হাঁফিয়ে মেয়েটি এসে আমার মোটরসাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়াল – ক্যান ইউ সী দ্যাট লাইট আপ দেয়ার? দ্যাট ইজ দা ফার্মস্টে ইউ ওয়্যার লুকিং ফর। জাস্ট গো দিস ওয়ে, অ্যান্ড টার্ন লেফট।

    ধন্যবাদ দেবার ভাষা হারিয়ে যায় কোনও কোনও সময়ে। আমার মুখ নাক সব ঢাকা, শুধু চোখদুটো খোলা আছে হেলমেটের ভেতর থেকে। মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, থ্যাংকিউ, থ্যাংকিউ।

    মিষ্টি একটা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে কিশোরীটি বলল, ইউ আর ওয়েলকাম, অ্যান্ড, ওয়েলকাম টু পারো। বলেই পেছন দিকের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল – তার সঙ্গিনী অপেক্ষা করছে স্কুলের কাছে।

    আমি ফার্মস্টে-তে ঢুকলাম। রাত নটা বাজে। একটি ছেলে নেমে এল, আমাকে লাগেজ খুলতে সাহায্য করছিল – চটজলদি আলাপ সেরে জানলাম, আমাকে ফোনে সে-ই ডিরেকশন দিচ্ছিল। দিল্লি থেকে ভুটান এসেছি শুনে সে যারপরনাই চমৎকৃত। জিজ্ঞেস করল, রাতের খাবার খাবেন তো?

    অবশ্যই খাবো। অবশ্যই।

    লাগেজ ওপরে আমার ঘরে তুলে জিজ্ঞেস করলাম, আমার তো একদিন পেরিয়ে প্রায় দুদিন নষ্ট হয়েছে, হাতে স্রেফ কালকের দিনটা রয়েছে, কী করা উচিত, চেলে লা পাস ঘুরে এসে থিম্পু বেড়িয়ে আসব? নাকি টাইগার্স নেস্ট যাব?

    ছেলেটা একগাল হেসে বলল, আপনি তো গুরুদোংমার ঘুরে এসেছেন, আর চেলে লা গিয়ে কী করবেন, ছোট্ট এইটুকুনি একটা পাস। বরং টাইগার্স নেস্ট করে আসুন, এখান থেকে চার কিলোমিটার। ঐটা না করলে আপনার পারো বেড়ানো কমপ্লিট হবে না। বিকেলে এসে পারো শহরটা ঘুরে নেবেন বরং।

    তুলতুলে নরম বিছানা। শুয়ে পড়তেই চোখ জুড়িয়ে এল – কিন্তু আগে ব্যাকলগ ক্লিয়ার করে নিই – হোয়াটসঅ্যাপের আনরেড মেসেজে চোখ রাখতে দেখি, অনুপের মেসেজ, অ্যাম ইন পারো, গোইং টু টাইগার্স নেস্ট টুমরো, হাউ ইজ ইওর ট্রিপ গোইং?

    পৃথিবী সত্যিই গোল। গুরুদোংমারে সঙ্গ দেওয়া সেই অনুপের সাথে আবার দেখা হবে কাল, টাইগার্স নেস্টে।



    ভরা পেটে, এক শরীর ক্লান্তি নিয়ে ভরপুর ঘুম।
  • Ekak | 53.224.129.43 | ১০ মার্চ ২০১৮ ১০:৩২370543
  • আহা চুখা র রাস্তার ধারে রেস্টতে ফ্রায়েড মোমো খেতে পারতে :) তুমি তো খুবই কম খাওয়াদাওয়া করো রাস্তায় যা দেখছি
  • dd | 59.205.217.23 | ১০ মার্চ ২০১৮ ১১:০২370544
  • পারোর হোম স্টে তে কী খেলে, সেটা লিখলা না তো ?
  • dc | 181.61.241.104 | ১০ মার্চ ২০১৮ ১২:২৪370545
  • এটা আমিও লিখব ভাবছিলাম। খাবারের আরেকটু বর্ণনা দেওয়া যায় না? ঘোরার গপ্পে খাবারের বর্ণনা থাকলে আরও জমে।
  • সিকি | ১০ মার্চ ২০১৮ ১৭:৪৬370546
  • আরে এতদিন বাদে আর অত থরোলি মনে আছে নাকি কবে কী খেয়েছিলাম? এমনিতেও অন দা মুভ আমি খাওয়ার বেশি চেষ্টা করি না, খিদে সইবার একটা বাজে অভ্যেস আছে আমার লং জার্নিতে।

    তবে নন- ভেজ খেয়েছিলাম এখানে, মনে আছে :)
  • শঙ্খ | 126.206.220.24 | ১০ মার্চ ২০১৮ ১৮:০৫370547
  • সিকি সকালে উঠে পেটে কয়েকটা কিল মেরে নেয়। ঐতেই দুপুর অবধি চলে যায়। তারপরে দুপুরদুটোর দিকে সিকিনীর বানানো হরিমটর খেয়ে নেয় কয়েক গাল। আর সন্ধ্যে পেরিয়ে গেলে সিকি কক্ষনো দু ঢোঁক হাওয়া ছাড়া কোনওরকম সলিড বা লিকুইডের তো প্রশ্নই নেই, খায় না। আরে বাবা শরীরটাতো রাখতে হবে।
    ডিঃমঃ
  • dc | 116.203.116.60 | ১০ মার্চ ২০১৮ ১৮:২৩370548
  • এবাবা আমার তো পষ্টো মনে থাকে কবে কোথায় কি খেয়েছি। আর সেসবের টেস্টও মনে থাকে। অবশ্য আমার মতো হ্যাংলা লোক পাওয়াও দুষ্কর।
  • Du | 57.184.23.62 | ১০ মার্চ ২০১৮ ১৯:৫৮370550
  • এ পর্বটা বিশেষ করে ভালো লাগলো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন