এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগল

    সিকি লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ১০ নভেম্বর ২০১৭ | ৩১৮১২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • abcd | 24.139.163.173 | ২৬ মার্চ ২০১৮ ১৬:১৮370551
  • tiger's nest যেতে আর কত সময় লাগবে? ধৈর্য তো রাখা যায় না আর! সিকি দা?
  • সিকি | 158.168.40.123 | ২৬ মার্চ ২০১৮ ১৮:৪৬370552
  • হপ্তাদেড়েকের জন্য বেড়াতে গেছিলাম - তাই আর এগোয় নি। আশা করছি এই সপ্তাহে পরের কিস্তি আসবে।
  • সিকি | ০১ এপ্রিল ২০১৮ ১২:১৫370553
  • ১লা নভেম্বর, ত্রয়োদশ দিন
    ================

    সক্কাল সক্কাল ঘুম ভাঙল, যথারীতি। ব্রেকফাস্ট এখানে কমপ্লিমেন্টারি। আগের দিন রাতেই বলে রেখেছিলাম সকাল সাতটায় খাব, কিন্তু রাতের খাবারটা এতই উপাদেয় হয়েছিল যে একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছি। সকালের খাবার কি খাইবার উপায় হইবে?
    নিচে নেমে এলাম। একটি মোটাসোটা সাদাকালো রঙের ভুটানিজ বেড়াল খুব গম্ভীর মুখে আপন মনে একটানা নিজের ডান পায়ের থাবাটি জিভ দিয়ে চেটে বা চুলকে চলেছেন। আমাকে দেখেও বিশেষ পাত্তা দিলেন না। পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলাম মোটরসাইকেলের দিকে। ঠাণ্ডা যে খুব বেশি কিছু আছে এমন নয় – কিন্তু নাথাং ভ্যালির সকালের মতই মোটরসাইকেলের সীটের ওপর বিন্দু বিন্দু শিশিরের ফোঁটারা জমে বরফ হয়ে আছে, সকাল সাড়ে ছটার রোদে তারা ঝিকমিক করছে।


    আজ এমনিতে খুব বেশি যাবার নেই, তবে তাড়াতাড়ি টাইগার্স নেস্ট মনাস্ট্রি হয়ে গেলে পরে থিম্পুটা একবার ঘুরে আসতে পারি। এখান থেকে মাত্রই পঁচিশ তিরিশ কিলোমিটার। কিন্তু শরীর বেশ জানান দিচ্ছে যে, সে ঠিক নেই। তলপেটের ব্যথা আগের দিনের থেকে একটু বেশিই মনে হচ্ছে, উঠতে বা বসতে গেলেই কেমন টান লাগছে ভেতর থেকে। দেখি, কতদূর কী করা যায়।
    জেরিক্যানে পেট্রল ছিল, সেইটা ঢেলে ট্যাঙ্ক ভর্তি করে নিলাম, আপাতত আবার ভারতে ফেরা পর্যন্ত আর তেল লাগবে না। দোতলায় উঠে দেখি ব্রেকফাস্টের এলাহি আয়োজন। ব্রেড জ্যাম মাখন কফি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই – জিজ্ঞেস করে একটা মশালা অমলেটও বানিয়ে দিয়ে গেল।

    খেতে খেতে অনুপকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করলাম, তৈরি হচ্ছে কিনা জানতে। অনুপ বলল, হ্যাঁ – আমি আর আমার এক বন্ধু, দুজনে মিলে যাবো, পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে নটা মতন বাজবে। তুমিও মোটামুটি ঐ সময়ে চলে এসো – একসাথে হাঁটা যাবে।
    অনেকটা সময় আছে – ধীরেসুস্থে ব্রেকফাস্ট শেষ করতে লাগলাম। হোমস্টের ছেলেটি এসে জিজ্ঞেস করল, রাতে খাবো কিনা। তা হলে সন্ধ্যে সাতটার আগে জানিয়ে দিতে হবে। একটু ভেবে দেখলাম, দরকার হবে না। কাল আসার সময়েই দেখে নিয়েছি পারোর মার্কেট এলাকা খুব একটা দূরে নয়। আর যদি ফিরতি পথে থিম্পু যাই – তো সেখানেই ডিনার সেরে একদম ফিরতে পারি, হোমস্টে-তে বসে রাতের খাবার খাওয়ার কোনও মানেই হয় না। অতএব, মানা করে দিলাম।

    তৈরি হয়ে, স্নান সেরে ঠিক নটাতে বেরোলাম। হোমস্টে থেকে মাত্র তিন চার কিলোমিটার দূরেই এই মনাস্ট্রি। আসল নাম তাকসাং গোম্পা। তাকসাং (Taktsang) মানেই হচ্ছে বাঘের বাসা – টাইগার্স নেস্ট। অষ্টম শতাব্দীতে গুরু পদ্মসম্ভবের স্মৃতিবিজড়িত এই গুহা। কথিত আছে, এক বাঘিনীর পিঠে চড়ে উড়ন্ত অবস্থায় এই গুরু পদ্মসম্ভব, তিব্বতী ভাষায় যাঁর নাম রিনপোচে – তিনি তিব্বত থেকে এসে পৌঁছন এই গুহার প্রান্তে। এইখানে তিনি, স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী তিন বছর তিন মাস তিন সপ্তাহ তিন দিন ... এবং তিন ঘন্টা বুদ্ধের উপাসনা করেন, এবং পুরো উপাসনার সময়কাল সেই বাঘিনী, যা আরেক উপকথা অনুযায়ী গুরু রিনপোচেরই এক ছদ্মবেশী শিষ্যা, এইখানে অবস্থান করতেন। সেই থেকে এই গুহা টাকসাং বা টাইগার্স নেস্ট নামেই খ্যাত, এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বৌদ্ধ পিলগ্রিমেজ। যুগে যুগে বিভিন্ন সমস্যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এখানে আসতেন তপস্যা করার জন্য।

    গুহাটি ছিল, কিন্তু মনাস্ট্রি বা গোম্পা (আমরা যাকে গুম্ফা বলি) তৈরি হয় তার অনেক অনেক পরে। সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগে নাগাওয়ন্দ নামগিয়াল, যিনি প্রথম ভুটানকে একটি দেশরাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস শুরু করেন, তিনিই প্রথম এখানে একটি মনাস্ট্রি স্থাপন করার কথা ভাবেন। অবশ্য জীবদ্দশায় তিনি সে মনাস্ট্রি তৈরি দেখে যেতে পারেন নি – এই মনাস্ট্রির জন্য প্রথম ভিত্তিপ্রস্তরটি স্থাপিত হয় সপ্তদশ শতকের একেবারে শেষভাগে। গিয়ালসে তেনজিং রাবগ্যে, ভুটানের তৎকালীন নেতা, ১৬৯২ সালে প্রথম এই মনাস্ট্রি বানাবার কাজ শুরু করেন, জোব চার্নক কলকাতা গ্রামে পা রাখার বছর দুই পরে।

    সুপ্রাচীন এই মনাস্ট্রিটি ১৯৯৮ সাল নাগাদ আচমকা এক অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণ পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়, এর পরে ভুটান রাজ-সরকার সুদীর্ঘ প্রচেষ্টায় আবার ধীরে ধীরে ২০০৫ সাল নাগাদ তাকে তার আগের রূপে পুনর্নির্মিত করেন। আজ আমরা যে টাইগার্স নেস্ট দেখি, এটা এই আধুনিক টাইগার্স নেস্টই। গুহাটি অবশ্য পাশেই অবিকৃত আছে।

    নটা কুড়িতে পৌঁছে দেখি বেশ বড়সড় এক পার্কিং এরিয়া, সেখানে বেশ কিছু গাড়ি জড়ো হয়ে গেছে, লোকজন যাত্রা শুরু করার তোড়জোড় করছে। বেশির ভাগই কমার্শিয়াল গাড়ি, পশ্চিমবঙ্গ বা ভুটানের নাম্বারপ্লেট সমেত। মোটরসাইকেল এক পাশে পার্ক করে আমি এগিয়ে গেলাম। সঙ্গে পিঠের ব্যাগে কেবল একটি জলের বোতল রেখেছি। নিজেই জানি না পারব কিনা, এর আগে দয়ারা বুগিয়ালের পাঁচ কিলোমিটার চড়তে গিয়ে আমি এক কিলোমিটারও চড়তে পারি নি, ঘোড়া ডাকতে হয়েছিল। তার ওপর শরীর ভালো নেই, থেকে থেকেই পেটের ভেতর কেমন একটা অদ্ভুত টান ধরছে।

    অনুপকে ফোন করে জানলাম তারা এখনও তৈরি হয় নি, আসতে আসতে দশটা বাজবে – আমি যেন ওদের জন্য অপেক্ষা না করে এগোতে থাকি। ... ভালোই হল, আমি হয় তো পুরোটা উঠতেই পারব না, বা পারলেও খুবই আস্তে আস্তে উঠব, ওদের সাথে তাল মেলানোর ক্ষমতা আমার নেই। মোটরসাইকেলে আমি যতটা সাবলীল, পাহাড়ী পথে পায়ে হাঁটায় আমি ততটাই অক্ষম।

    সামনে কয়েকজন ভুটানি বসে লম্বা লম্বা লাঠি বিক্রি করছে – ট্রেকিং স্টিক, পঞ্চাশ টাকা করে। কিনতে গিয়েও ভাবলাম, না, থাক, যদি পারি, নিজের পায়ের জোরেই পারব, লাঠির দরকার হবে না। সামনে কিছু পাহাড়ি খচ্চর নিয়েও লোকজন দাঁড়িয়ে ছিল, আড়াই কিলোমিটারের মধ্যে প্রথম এক কিলোমিটার এরা খচ্চরে চাপিয়ে নিয়ে যাবে, বাকিটা অবশ্য নিজেকেই হাঁটতে হবে। তাদেরও মানা করে দিয়ে আমি এগোলাম। এটা আমার একলা হাঁটা। পারি বা না পারি, স্রেফ নিজের কাছে লেখা থাকবে।


    প্রথমে কয়েক কদম গাছপালায় ছাওয়া একটা অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা, হাল্কা চড়াই, প্রচুর লোকজন একসাথে বা আলাদা আলাদা গ্রুপ করে হাঁটছে, বয়স্ক লোকজনও আছেন, স্কুলের বাচ্চাদের দলও আছে। কয়েক পা এগিয়েই বুঝলাম, দম কুলোচ্ছে না। দাঁড়ালাম। আশেপাশে খচ্চরওলারা ঘুরঘুর করছে, লাগবে? ঘোড়া লেগা?

    না। ঘোড়া খচ্চর লাঠি কিছুই আমি নেব না। দেখি আমার দম আমাকে কোথায় নিয়ে যায়।

    গাছে ঢাকা এলাকাটা ছাড়াতে দেখলাম সামনে উঠে গেছে খাড়াই একটা উঁচু পাহাড়, নিচ থেকে সেটার উচ্চতা পঞ্চাশ তলা, ষাট তলা, সত্তর তলা – কি তারও উঁচু কোনও বাড়ির সমান তো হবেই। সেই পাহাড়ের একেবারে মাথায় একটা কানার দিকে, প্রায় যেন ঝুলছে ছোট্ট সাদা একসারি বাড়ি। সেইখানে উঠে পৌঁছতে হবে।


    শুরু হল আমার হাঁটা। পাঁচ ছ পা হাঁটি, দম পুরো শেষ হয়ে যায়, আর তার পরে পাঁচ থেকে দশ মিনিট বিশ্রাম। একেবারে বুক সমান উঁচু চড়াই রাস্তা। রাস্তা মানে পায়ে চলা পথ, প্রথম এক কিলোমিটার তাও খচ্চরের যাওয়া আসার মতন চওড়া করা আছে, তার পরে হয় তো আরোই সরু রাস্তা হবে।

    উঠছি, থামছি, হাঁফাচ্ছি। পাশ দিয়ে লোকজন আমাকে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, কিছু বয়স্ক লোকজন আমার মতই ধীরে ধীরে উঠছেন। কেউ কেউ গাইড নিয়ে এসেছেন, গাইড তাঁদের জলের বোতল, জ্যাকেট, পিঠের ব্যাগ একলা বয়ে নিয়ে চলেছেন, পেছনে পেছনে তাঁরা। পৃথিবীর সমস্ত দেশ থেকে বোধ হয় লোক আসে দৈনিক, এই মনাস্ট্রি দেখতে। চলছেন, থামছে, কাউকে কাউকে দেখলাম এর মধ্যেই নেমেও আসতে। এঁরা কি পুরোটা গেছিলেন? কত সকালে শুরু করেছিলেন?

    একটু দূরে দূরে কোথাও জল খাবার জায়গা, কোথাও বসে জিরোবার জায়গা। আমি তখন শেষ শক্তি নিংড়ে ওঠার চেষ্টা করছি। কাল এত ক্লান্ত ছিলাম, কালকেও রাতে পেনকিলার খেতে ভুলেছি, ব্যথাটা এখন রীতিমত সোচ্চারে জানান দিচ্ছে। বসতে গেলেও কষ্ট, উঠতে গেলেও।

    বেশ খানিকটা ওঠার পর, ততক্ষণে চারপাশের কিছু মানুষের মুখচেনা হয়ে গেছে, যারা আমার সাথে সাথেই আগেপিছে উঠছেন, কেউ একটু পরে এগিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন, কেউ আমার মতই থেমে থেকে উঠছেন – বেশির ভাগই বয়স্ক লোকজন – এক জায়গায় বসলাম, এক বয়স্কা মহিলা আমার থেকে একটু দূরেই বসলেন। অল্পপরিচিতির হাসি বিনিময় হল, উনি আলাপ করতে বেশ উৎসুক – একা এসেছো?

    বললাম, হ্যাঁ। আপনিও একা?

    হ্যাঁ, আমিও। তুমি কোথা থেকে এসেছো?

    ইন্ডিয়া। ডেলহি। আপনি?

    আলাপ এগলো। তিনি এসেছেন ইজরায়েল থেকে। আমি আইটি ফিল্ডে কাজ করি শুনে জানালেন, উনিও আইটি ফিল্ডেই কাজ করেছেন দীর্ঘকাল। কোবোলে প্রোগ্রামিং লিখতেন। তার আগে মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজ। রিটায়ার করে একলা একলা দেশ দেখতে বেরিয়েছেন। বার বার বললেন, ইজরায়েল ইজ আ ভেরি বিউটিফুল কান্ট্রি। অবশ্যই এসো, তোমার ভালো লাগবে।
    দীর্ঘশ্বাস মনে চেপে বললাম, নিশ্চয়ই আসব, একদিন নিশ্চয়ই দেখা হবে।

    এক কিলোমিটারের মাথায় একটা চাতাল মত এলাকা। কিছু বসার জায়গা। আর ডানদিকে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে একটা ক্যাফেটেরিয়ার দিকে। আমার পেটভর্তি, কিছু খাবার এমনিতে দরকার নেই, তবু দেখি, একটা কোকাকোলার বোতল যদি পাওয়া যায় –

    ক্যাফেটেরিয়াটি বেশ বড়সড়। অনেকজনের খাবার জায়গা আছে ভেতরে, বাইরে বসেও খাবার জন্য ছোট ছোট শেড লাগানো, এদিক ওদিক দু একটা স্যুভেনির শপ। কিন্তু দাম শুনে ছিটকে যেতে হল। ছোট কোকের বোতল – যেটা পঁয়ত্রিশ টাকায় পাওয়া যায় ভারতে, সেটার দাম দাবি করছে নব্বই টাকা।

    বেরিয়ে এলাম। আমার কাছে যা জল আছে, তাই দিয়েই চলে যাবে।

    আবার ওঠা। এবারে রাস্তা আরও খাড়াই। তার মধ্যেই অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েরা কেমন তড়বড় করে বাঁকা রাস্তা না ধরে পাহাড়ের ঘাসপাতা মাড়িয়ে শর্টকাট মেরে ওপরের রাস্তায় উঠে যাচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে উঠছি, থামছি, হাঁফাচ্ছি। চলাটা ধাতস্থ হয়েছে এতক্ষণে, কিন্তু তলপেটের ব্যথা এতটুকু কমে নি, আর দমও বাড়ে নি। চলার থেকে থামতেই হচ্ছে বেশিক্ষণ।



    হঠাৎ পেছন থেকে একটা অস্পষ্ট ডাক শুনলাম – সিকিদা, সিকিদা! পেছন ফিরে দেখি, অনুপ এগিয়ে আসছে, সঙ্গে একজন। অনুপ একগাল হেসে বলল, তা হলে আবার দেখা হয়ে গেল, অ্যাঁ?

    ম্যাজিকের মত, অনুপের সাথে দেখা হবার পরেই দেখলাম রাস্তাটা প্রায় সমতল হয়ে এল, আর একটু পরেই – সামনে দেখা যাচ্ছে অতল সিঁড়ি, প্রায় হাজারখানেক স্টেপ হবে, নেমে যাচ্ছে পাহাড়ের একদম নিচের দিকে, আর তার পরে আরও শ তিনেক সিঁড়ি উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে মনাস্ট্রির দরজার গোড়ায়। সিঁড়ি যেখানে নেমে শেষ হয়েছে, সেইখানে একটা ছোট্ট পুল, আর তার সামনে বিপুল বেগে নেমে আসছে একটা ঝর্না। ঝর্নার একেবারে ওপরের দিকে একটা গুহা। সেই গুহা, যেখানে পদ্মসম্ভব তপস্যা করেছিলেন। মনাস্ট্রি এখন একেবারে আমার চোখের সামনে, পাহাড়ের কানা বেয়ে ঝুলন্ত।




    সিঁড়ি শুরু হবার মুখে একটা ধাপিতে বসে আছেন সেই ইজরায়েলি মহিলা। আমাকে দেখে আবার একগাল হাসলেন। বললাম, চলুন, বাকিটাও সেরে আসি।

    উনি করুণ হাসলেন। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, পরিশ্রান্ত। একটু দম নিয়ে বললেন, নো বাডি, আমার শরীর এর চেয়ে বেশি আর পারমিট করবে না। তোমরা এগোও, যদি পারি, আমি একটু পরে চেষ্টা করছি। না হলে এখান থেকেই ফিরে যাবো। গুড লাক।
    সিঁড়িতে পা রাখার আগে একটু ফটোসেশন করে নেওয়া গেল। তেমন কিছু ছবি ওঠে নি, জাস্ট অনুপের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ওর ছবি দিলাম এখানে। সাথে আমারও একটা।



    সিঁড়িতে পা রাখলাম। অতল, অতল সিঁড়ি। তবু, মনে এখন জোর এসে গেছে। পারতেই হবে। পারবই। নামাটা তো অত কষ্টকর নয় – নেমে এলাম, তার পরে আবার শ তিনেকের মত সিঁড়ি উঠতে হবে, মনাস্ট্রিতে যাবার জন্য। আবার হাঁফ ধরে যাওয়া, আবার থামা, জিরনো, আবার ওঠা। অনুপকে বললাম, তোমরা এগোও, আমি আসছি। অনুপ, বোধ হয় কৃতজ্ঞতাবশতই আমার সঙ্গ ছাড়ল না। গুরুদোংমারের রাস্তায় আমি ওকে সাহায্য করেছিলাম, সম্ভবত সেই স্মৃতির ভারেই অনুপ বলল, ঠিক আছে, তুমি চলো, আমি তোমার জন্য দাঁড়াছি।

    তা সঙ্গ দিল। টুক টুক করে একসময়ে উঠে পড়লাম টাইগার্স নেস্ট মনাস্ট্রির চাতালে। আকাশে তখন ঘন কালো মেঘ, ইলশেগুঁড়ি শুরু হয়েছে, সাথে হাওয়ার টান। আমার তখন আর কিচ্ছু মাথায় নেই, আমি খালি এটুকু বুঝতে পারছি, আমি পেরেছি। পেট থেকে নিচের দিক অবধি ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ঐ, ... এক্সট্যাসি, আমি পেরেছি সত্যি সত্যি, দয়ারা বুগিয়ালের সেই ব্যর্থতার পর
    এটা আমি সত্যি পেরেছি। হলেই বা মাত্র আড়াই কিলোমিটার, এটুকুই আমার পেরে ওঠা।

    অনুপের বন্ধু গেল মনাস্ট্রির ভেতর, আমি আর অনুপ বসে রইলাম বাইরে। একটু বিশ্রাম দরকার। হালকা বৃষ্টির মধ্যে বসে থাকতে দারুণ লাগছিল। কিছু কিছু বৃষ্টি বরফকুচি হয়ে ঝরে পড়ছিল।

    বোতলের জল শেষ। আমাদের সামনেই দুজন সিকিওরিটি গার্ড বসে ছিলেন, জিজ্ঞেস করাতে সামনের একটা ছোট থান টাইপের জায়গার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। একটা ছোট গুহামুখ দিয়ে জলের ধারা এসে পড়ছে বাইরে। সামনে কিছু বৌদ্ধ ধর্মগুরুর ছবি রাখা। সিকিওরিটি বললেন, এই জল অত্যন্ত পবিত্র, এটাই খেয়ে নিতে পারো। সবাই খেয়ে যায়।

    তবে এক চুমুক জল আঁজলা করে তুলে খেয়ে খুব একটা সুবিধের টেস্ট লাগল না। থাক। নামতে আশা করি অতটা কষ্ট হবে না। বেলা প্রায় তিনটে বাজে। আস্তে আস্তে নিচে নামলাম আবার সিঁড়ি বেয়ে, তার পরে আবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠা। বৃষ্টি বেড়ে আবার কমেও গেল। শেষ সিঁড়ির ধাপে পৌঁছে সেই ইজরায়েলি মহিলাকে আর দেখতে পেলাম না। হয় তো এখান থেকেই ফিরে গেছেন।
    ওপরে ওঠার মতই নিচে নামাটাও একই রকমের চ্যালেঞ্জিং। এতটাই খাড়াই রাস্তা, শরীরের ব্যালেন্স রাখতে গিয়ে পায়ের কাফ মাসল টনটন করে যাচ্ছে। তবু শেষমেশ যখন নিচে নেমে এলাম, ঘড়িতে দেখলাম বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। আট ঘন্টা লাগল পাঁচ কিলোমিটার উঠতে এবং নামতে। ছায়ারা দীর্ঘ হয়েছে। নিচে নেমে একবার পেছন ফিরে টাইগার্স নেস্টকে আবার দেখলাম, দূর থেকে।

    পার্কিংয়ে গিয়ে মোটরসাইকেলে বসতে গিয়ে টের পেলাম, বসতেও অসুবিধে হচ্ছে। মেন রোড থেকে এক কিলোমিটার ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে এই পার্কিং। প্রতিটা ঝাঁকুনিতে আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল ব্যথা কোথায় এবং কতটা। মেন রোডে পড়বার আগে একটা ছোট রেস্তরাঁ মত, সেইখানে গিয়ে ঢুকলাম আমি, অনুপ আর ওর বন্ধু। সে-ও বোধ হয় কন্নড়, দুজনে অনর্গল নিজেদের ভাষায় কথা বলে যাচ্ছিল – আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পেটপুরে ম্যাগি, কফি আর স্থানীয় ফ্রুট জুস খেলাম। ক্লান্তি খানিক দূর হল।
    কাল পারো ছেড়ে, ভুটান ছেড়ে যাবার দিন। এবার ফেরার পালা। কতকিছু দেখতে এসেছিলাম, প্রথমে ফুন্টশোলিংয়ে ছুটি, তার পরে পারমিটের চক্করে পড়ে প্রায় কিছুই দেখা হল না। এখন শরীরের যা অবস্থা, মনে হচ্ছে না থিম্পু পর্যন্ত যেতে পারব। ম্যাগি শেষ করে একটা পেনকিলার খেলাম। থিম্পু থাক। আবার কোনওদিন এলে হবে ’খন।

    অনুপকে শেষবারের মত বিদায় জানিয়ে আমি হোমস্টে-র রাস্তা ধরলাম। প্রতিটা ঝাঁকুনিতে সর্বাঙ্গ কুঁকড়ে যাচ্ছে, এত ব্যথা চলছে।
    হোমস্টে-তে ঢুকলাম। রাতের খাবার মানা করাই ছিল, আর বললাম না খাবার বানাবার কথা – যেটুকু যা খেয়েছি, একেবারে পেট ভরে আছে, আশা করি রাতটা কেটে যাবে এতে। একেবারে কাল সকালে খাবো। আর ওঠার ক্ষমতা নেই।

    কোনও রকমে জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে পড়লাম। তলপেটের যন্ত্রণা এখন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, উল্টোদিকে পেনকিলার তার কাজ শুরু করছে, প্রথমে যন্ত্রণা, ঢেউয়ের মতন আসছে, কমছে, বাড়ছে, কেমন নেশার মত লাগছে। ক্রমশ ঘুম এসে দখল করে নিল সমস্ত চেতনা। এপাশ ওপাশ করতে করতে এক সময়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
  • | ০১ এপ্রিল ২০১৮ ১২:৩৮370554
  • .................
  • শঙ্খ | 126.206.220.245 | ০২ এপ্রিল ২০১৮ ২০:৪০370555
  • পড়ছি।
  • dd | 193.82.17.211 | ০২ এপ্রিল ২০১৮ ২২:০৭370556
  • কী সব যায়গায় খ্যাঁচ করে ল্যাখা বন্ধো করে দ্যায় দেখুন। এম্নিতেই আমার নিউরোসিস, ঘুম টুম হয় না, তার উপরে এই সব ...........
  • সিকি | ০৩ এপ্রিল ২০১৮ ০৭:২৬370557
  • আপিসের ম্যাঞ্জারটা হেব্বি বেদো। লিখতে সময়ই দেয় না। দেখি, আজ রাতে যদি বসা যায় :)
  • বাংলা | 110.34.214.98 | ০৪ এপ্রিল ২০১৮ ০৬:০৫370558
  • ম্যাঞ্জার বাংলা জানে না বুঝি? নইলে এসব উটকো ঝামেলা হয় না!
  • সিকি | 158.168.40.123 | ০৪ এপ্রিল ২০১৮ ১১:০৩370559
  • রাজমাল্যান্ডে আর বাঙালি ম্যাঞ্জার কোথায় পাব? তবে বাঙালিদের থেকে অবাঙালিরা কম বিপজ্জনক এবং কম খচ্চর হয়।
  • abcd | 24.139.163.173 | ০৪ এপ্রিল ২০১৮ ১১:২০370561
  • tiger's nest যাওয়া, উপরে ওঠা, নামা ইত্যাদি নিয়ে আর একটু ডিটেল লেখা কোথায় পাই, বলুন তো, সিকি দা।
  • সিকি | 158.168.40.123 | ০৪ এপ্রিল ২০১৮ ১২:২৪370562
  • দুচারটে ট্র্যাভেলগ দেখেছি, তবে এর বেশি কিছু তো দরকার হয় না। পারো যাও, আড়াই কিলোমিটার ট্রেক আপ, সেই রাস্তাতেই ট্রেক ডাউন। দেড় কিমি মতন পাহাড়ে চড়াই, তার পরে অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে আবার নিচে নামা, তারপর আবার অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে মনাস্ট্রির দরজায় পৌঁছনো। ফেরার সময়েও তাই, সিঁড়ি দিয়ে নামা, ওঠা, পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে নামা।
  • গবু | 52.110.147.126 | ০৪ এপ্রিল ২০১৮ ১৩:১৬370563
  • মাঝখানে একটা ক্যাফে আছে, অকথ্য কস্টলি। কিন্তু অন্য কিছু নেই, তাই লোকে ওখানেই খায় - মোটামুটি পার্ক স্ট্রিট ফ্লুরিজের দাম।

    আর দল বেঁধে গেলে যার যার পারমিট তার তার কাছে রেখে নেবেন, আমরা সেটা জানতাম না। অন্য একটি দলের দয়ায় (তাদের সমসংখ্যক লোক যায়নি) ঢুকতে পারি, রিনপোচের দয়াও বলা চলে।
  • সিকি | ০৪ এপ্রিল ২০১৮ ১৩:৪৫370564
  • অকথ্য কস্টলি। নামার সময়ে খোঁজ নিতে গেলাম খাবার পাওয়া যাবে কিনা জানতে। তা দেখি নুডল পাস্তা ভাত আরো কী কী সব সাজানো আছে, বাফে, সাড়ে পাঁচশো টাকা পারহেড। জিজ্ঞেস করলাম, এত দাম ঠিক কীসের জন্য? তো বলল, আপনি শুধু নুডলটা খেতে পারেন, সাড়ে তিনশো টাকা।

    এর পরে 'বাবার লুঙ্গি দেখোচো' বলে বেরিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
  • de | 24.139.119.172 | ০৪ এপ্রিল ২০১৮ ১৬:৩৪370565
  • অনেকদিন পর পড়লাম - শরীর ঠিক আছে তো এখন? পড়তে পড়তে আমারই পেটে টান ধরছে মনে হোলো - উফ্‌!

    কি সুন্দর রাস্তা - বনের মধ্যে সত্যি ও'রকম বেগুনী রঙের জমি? এই ছবিটায় তাকিয়ে থেকে মনে হোলো নীচে আলোর নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছি!
  • বাংলা | 110.34.214.98 | ০৪ এপ্রিল ২০১৮ ১৭:৪২370566
  • চ্যাংড়ামো কচ্চিলুম মহায়! শরীর ও কাজ সামলে যখন লিখতে পারবেন, লিখুন! আসলে আপনার কলমের একটা ইয়ে আছে কি না, তাই অপেক্ষা কর্তে মন্চায় না!
  • abcd | 24.139.163.173 | ০৭ এপ্রিল ২০১৮ ১০:২২370567
  • সত্যিই, অপেক্ষা করতে মন চায় না... :)
  • সিকি | ০৮ এপ্রিল ২০১৮ ০০:২৮370568
  • ২রা নভেম্বর, চতুর্দশ দিন

    শেষরাতে ঘুম ভাঙল। কেমন একটা অদ্ভূত পরিস্থিতি, আচমকা যেন কেউ আমাকে অতল থেকে টেনে তুলল বাস্তবে। ঘর অন্ধকার, এবং মাথাও পুরো অন্ধকার – কয়েক মিনিট সময় নিল বুঝতে, আমি কোথায়। ধীরে ধীরে ব্রেনে রেজিস্টার করল ফ্যাক্টগুলো – আমি বারো-তেরো দিন ধরে বাড়ির থেকে বাইরে, এটা আমার বাড়ির বিছানা নয়, আমি এখন ভুটানে, পারোতে, কাল টাইগার্স নেস্ট সেরে আসার পর থেকে আমি ঘুমোচ্ছি, পেটে এবং তার পরে সারা শরীর প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ফিরেছিলাম।

    … ওয়েট, ওয়েট … ব্যথা? কোথায়? তলপেটে? শরীরের অন্যত্র? না তো! আমি তো বাঁপাশ ফিরে শুয়ে আছি পারোর এক হোমস্টে-র বিছানায় – ঠিক যে রকম ঘরের বিছানায় শুই – এই তো চিৎ হলাম, ডানপাশ ফিরলাম, হাঁটু ভাঁজ করলাম, বাঁ পা সোজা করলাম আবার – কই, কোথাও তো কোনও ব্যথা কিছু নেই!

    মোবাইল জ্বালাতেই তার উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। পাঁচটা কুড়ি। ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। আমার ঘরটা একেবারে ভেতরদিকে, এখানে বাইরে দেখার মত কোনও জানলা নেই। বাথরুমটা বাইরে – সম্পূর্ণ কাঠের বাড়িতে কোনও অ্যাটাচড বাথ নেই।

    উঠে দাঁড়ালাম বিছানা ছেড়ে। না, আর সত্যিই কোনও ব্যথা নেই। একদম ফ্রেশ লাগছে। দরজা খুলে বেরোলাম, ভোরের আলো ফুটছে বাইরে। টয়লেট সেরে নিচে নেমে এলাম। গতকালকের মতই মোটরসাইকেলের ট্যাঙ্ক আর সীটের ওপর বিন্দু বিন্দু বরফ জমে আছে, অথচ শীত তেমন কিছু নেই।




    এক কুকুরী ভেতরের কোন ঘুপচি ছেড়ে বেরিয়ে এল। বাইরে পোড়া ছাইয়ের গাদায় ঘুমোচ্ছে এইটুকু টুকু তার সন্তানেরা। মা কুকুরী তাদের কাছে গিয়ে বাচ্চাদের গা শুঁকতে লাগল। একটু পরেই বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে মায়ের দুধ খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমিও মোটরসাইকেলের হাওয়া ইত্যাদি চেক করে আবার ওপরে উঠে এলাম। কাল রাতে আরেকটি ফ্যামিলি এসেছে এখানে। হিন্দিভাষী। স্বামী-স্ত্রী, সঙ্গে একটি ছোট ছেলে, সে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে, নামছে, আবার উঠছে। আলাপ করলাম, ভুটান বেড়াতে এসেছেন গাজিয়াবাদ থেকে।




    সাতটায় ব্রেকফাস্ট এসে গেল, কালকের মতই, ব্রেড টোস্ট, মাখন আর জ্যামের সাথে, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আর ওমলেট। কালকের বেড়ালটাকে আর দেখতে পেলাম না।

    এইবারে ছেড়ে যাবার পালা। চেক আউট করে পৌনে আটটা নাগাদ মোটরসাইকেলের পেছনে লাগেজ বাঁধাছাঁদা শেষ হল। জিপিএস চললেও, নেভিগেশন এই দেশে কাজ করে না, তাই যতটা রাস্তা মনে ছিল, সেই মত চালাতে থাকলাম, তার পরে আবার থেমে থেমে মোবাইল অন করে ম্যাপ দেখে দেখে একটু একটু করে এগনো।

    একে একে পেরিয়ে গেলাম পারোর বাজার, আগের রাতে দেখা সেই প্যালেস। ক্রমশ সেই ব্রিজের কাছে চলে এলাম, যেখান থেকে সোজা গেলে হা ভ্যালি, আর ব্রিজ পেরিয়ে বাঁ দিকে গেলে থিম্পু। থিম্পু আর এ যাত্রায় আমার যাওয়া হচ্ছে না। আমি ব্রিজ পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা নিলাম – ফুন্টশোলিং।

    শরীর একদম সুস্থ, আর কোনও সমস্যা নেই, জাস্ট আর একটা দিন থেকে যেতে পারলে আজ পুরো পারো আর থিম্পু ঘুরে ফেলাই যেত, কিন্তু থাকার উপায় নেই, ছেড়ে যেতেই হবে। মেঘের মধ্যে দিয়ে ভাসিয়ে দিলাম আমার মোটরসাইকেল।

    ক্রমশ নিচের দিকে নামতে নামতে প্রথমে উধাও হল মেঘেরা, তার পরে ঠাণ্ডা। ফুন্টশোলিংয়ে ঢোকার আগে শেষ চেকপোস্টে আবার পারমিট দেখাতে হয়, সেখানে যখন এসে পৌঁছলাম, তখন সকালের ঠাণ্ডা উধাও, রীতিমত গরম লাগতে শুরু করেছে।

    শেষবারের মত পারমিটের কাগজ দেখালাম – ভেতর থেকে ভুটানি পুলিশ অফিসারটি মন দিয়ে দেখে প্রশ্ন করলেন, গাইড কোথায়?

    তিন দিন আগে পারমিট পাবার সময়ে যা বলেছিলেম, এবারেও তাইই বললাম, গাইড তো এখন নেই, সে তো পারোতে ছিল, সে ওখানে অন্য টুরিস্টদের নিয়ে ঘুরছে, আমি তো বেরিয়ে আসছি। পুলিশ মাথা নেড়ে বলল, ই-ভিসায় তো গাইড ছাড়া চলার নিয়ম নেই, এনিওয়ে, ঘুরেই যখন এসেছো, ঠিক আছে, বেরোবার সময়ে পারমিট জমা করে যাবে ইমিগ্রেশন অফিসে।

    পনেরো মিনিটের মাথায় ভুটান গেটের সামনে পৌঁছে গেলাম, ইমিগ্রেশন অফিসে। সাইডে, ভুটান গেটের একদম গা ঘেঁষেই বিশাল পার্কিং, কিন্তু সেখানে মোটরসাইকেল রাখতে যেতেই এক ভুটানি পুলিশ তেড়ে এল, না, এখানে রাখা যাবে না, এটা ইমিগ্রেশন অফিশিয়ালদের জন্য সংরক্ষিত। এখান দিয়ে ইউ টার্ন মেরে হুই ওদিকে যাও, সেইখানে গিয়ে পার্কিংয়ে মোটরসাইকেল রেখে আসতে হবে।

    আর্গু করার চেষ্টা করলাম, বস, মাত্র পাঁচ মিনিটের কাজ, ভিসার পেপারটা জমা দেব, পাসপোর্টে একটা এক্সিট স্ট্যাম্প লাগবে, বেরিয়ে আসব। আর আমার মোটরসাইকে লাগেজ আছে, এটাকে তো অন্য কোথাও রেখে আসতে পারি না, পাঁচটা মিনিটের জন্য রাখতে দাও – কিন্তু ছোট্টখাট্টো চেহারার ভুটানি পুলিশ কোনও কথাই শুনতে রাজি নয়, এটা সাধারণ মানুষের পার্কিং নয় তো, নয়।

    কী আর বলব, শেষ মুহূর্তে আর বাগবিতণ্ডায় জড়াতে ইচ্ছে হল না, গেট থেকে বেরিয়ে একশো মিটার দূরেই তো জয়গাঁও পুলিশ থানার বিশাল পার্কিং, ওটা সিকিওরড, ওখানেই রেখে আবার হেঁটে ফিরে আসি।

    তাই করতে হল। থানার পার্কিংয়ে মোটরসাইকেল ছেড়ে আবার হেঁটে ফিরে যেতে হল ফুন্টশোলিং ইমিগ্রেশন অফিসে। আসার সময়ে যেটা একশো মিটার দূরে ছিল, যাবার সময়েই সেটা তিনশো মিটার হেঁটে যেতে হল, কারণ ঐ, ভুটান গেট দিয়ে বেরনো যায়, ঢোকা যায় না। পেছন দিয়ে ঘুরে ঢুকে আসতে হয়।

    ইমিগ্রেশন অফিস খালিই ছিল, এখানে বোধ হয় প্রতিদিন অফিসার বদলে যায় – আগের দিনের চেনা মুখ কাউকে দেখতে পেলাম না। দু মিনিটে কাজ শেষ করে আবার জয়গাঁওতে ফেরত এলাম। স্বরাজের দেওয়া ভুটানের সিম কার্ড ফেরত দেবার ছিল, তো, স্বরাজ এখন নেই, ডিউটিতে কোথায় ঘুরছে, ওখানে থানায় আরেকজন ডিউটি অফিসারের হাতে সিমকার্ডটা ফেরত দিয়ে বেরিয়ে এসে, মোটরসাইকেলে আবার স্টার্ট দিলাম।

    আজ আমার গন্তব্য জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ। ১৯৯৯ সালে কলেজ ছেড়ে বেরোবার পরে আর কখনও আসা হয় নি। এমন নয় যে কলেজের প্রতি আমার খুব মায়ার টান আছে টাছে, চারটে বছর কাটিয়েছি – সেভাবে কখনও ভালোবাসতে পারি নি। স্মৃতিরা কেবল সঙ্গে রয়ে গেছে, থেকেও যাবে আজীবন, সেই স্মৃতিচারণা করতেই একবার গুরুচন্ডালির পাতায় লিখতে শুরু করেছিলাম আমার কলেজজীবনের গল্প, ধারাবাহিকভাবে, উত্তরবঙ্গ নামে। হয় তো লেখায় ভালোবাসা ছিল না বলেই, সে ধারাবাহিক আর শেষ করা হয়ে ওঠে নি।

    তবু, স্মৃতি তো থেকেই যায়, সেই ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান, সেই কলেজ মোড়, করলা নদীর ধার, ওভালের সামনে সারি দিয়ে দাঁড়ানো এক নম্বর আর দু নম্বর হস্টেল – এরা তো ভুলতে দেয় না নিজেদের।

    ফেসবুকের কল্যাণেই যোগাযোগ হয়েছিল কলেজের বর্তমান জিএসের সঙ্গে। সে বলেছিল, দাদা, একদম চিন্তা কোরো না – আমি ব্যবস্থা করে রাখব। জয়গাঁওতে বসেই ওকে একবার ফোন করে আপডেট দিয়েও দিয়েছিলাম যে, দু তারিখ বিকেলে পৌঁছচ্ছি। সে বলেছিল, কোনও অসুবিধে নেই, কলেজের কাছাকাছি এসে আমাকে একবার ফোন করে দিও।

    জয়গাঁও থেকে যখন স্টার্ট করলাম, তখন প্রায় একটা বাজে, জয়গাঁওতে খেয়ে নেওয়াই যেত, সকালে পারোতে খাওয়া খাবার কখন হজম হয়ে গেছে, কিন্তু আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না, খুব সাঙ্ঘাতিক কিছু খিদেও পায় নি এখন, দেখি, যতটা পারি টেনে নিই। জয়গাঁও থেকে কলেজ ঠিক একশো কিলোমিটার, ঘণ্টাদুত্তিনে টেনে দেওয়া যায় – কলেজের কাছেই তিস্তা নদীর ব্রিজ পেরিয়ে বাচ্চুদার ধাবা ছিল, যেখানে আমরা হস্টেল থেকে প্রায়ই যেতাম – যেদিনই মেসের খাবার খাদ্যোযোগ্য থাকত না। দেখি, বাচ্চুদার ধাবা যদি আজও থাকে, তা হলে সেখানে লেট লাঞ্চ করা যেতে পারে।

    ভুটানের সিম আর আমার মোবাইলে নেই, এখন ভারতের এয়ারটেলের সিম কার্ড চলছে, তাও, সম্ভবত ভুটানের প্রক্সিমিটির জন্যেই এখানেও নেভিগেশন ব্লকড গুগল ম্যাপে। কেবল ম্যাপ দেখা যাচ্ছে, নিজের পজিশন দেখা যাচ্ছে, কিন্তু নেভিগেট করা যাচ্ছে না। জয়গাঁও ছাড়িয়ে, ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে যখন টাউনের বাইরে চা বাগানের ধারে এসে দাঁড়ালাম – তখন মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে আরেকবার জিপিএস অন করে দেখলাম, এইবারে নেভিগেশন স্টার্ট হল। নেভিগেশনটা দরকার, কারণ জলপাইগুড়ি টাউনে যাবার জন্য বীরপাড়া আর গয়েরকাটার মাঝে একটা মোড় থেকে বাঁদিকের রাস্তা নিতে হয়, সেই মোড়টা পয়েন্ট করা দরকার।

    একই রাস্তায় ফিরে আসাটা ততটা ইন্টারেস্টিং থাকে না সব সময়ে, কিন্তু উত্তরবঙ্গের তরাই আর ডুয়ার্সের অপরিসীম সৌন্দর্য কখনও বোর হতে দেয় না। ক্রমশ পেরিয়ে এলাম হাসিমারা, মাদারিহাট, ভুটানের পাহাড় আবছা নীলচে হয়ে হারিয়ে গেল আকাশের মাঝে, সঙ্গ দিতে থাকল শুধু একের পর এক চা বাগান। বীরপাড়ার পর বাঁদিকের রাস্তায় বাঁক নিলাম, সামনে স্পষ্ট করে লেখা – এই রাস্তা যাচ্ছে জলপাইগুড়ি হয়ে শিলিগুড়ি। স্মৃতিরা সমানেই তুলনা করতে চায়। উনিশ কুড়ি বছর আগে শেষ যখন এ রাস্তায় এসেছি, তখন সে রাস্তা ছিল মোটা তিস্তা নদীর বোল্ডার ক্রাশ করা পাথরে পিচ মিশিয়ে বানানো, সরু রাস্তা। আর এখন সম্পূর্ণ ম্যাস্টিক অ্যাসফল্টের রাস্তা, ইয়া চওড়া। ভুটানের সাথে উত্তরবঙ্গের মিল শুধু একটাই – ভুটানে যেমন রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন হোর্ডিংয়ে রাজার হাসিমুখের ছবি ছড়ানো, উত্তরবঙ্গের যেটুকু এলাকা আমি ঘুরলাম, সেখানেও একই রকমভাবে কিছুদূর অন্তর অন্তর আরেকটা হাসিমুখের ছবি, বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, বিভিন্ন পোজে – মমতা ব্যানার্জির।

    খিদে পেয়েছে এইবারে। বাচ্চুদার ধাবা পর্যন্ত রিস্ক নেওয়া উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছি না। দুদিকে চোখ রাখতে রাখতে চলছিলাম, আমার খাবার জন্য এমন জায়গা দরকার, যেখানে খাবার টেবিল থেকে মোটরসাইকেলের দিকে নজর রাখা যায়। ক্রমশ এগোতে এগোতে, মাগুরমারির কাছে দেখলাম ডানদিকে রাস্তার ওপরেই একটা বড়সড় খাবার জায়গা – সৈনিক ধাবা।

    মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে সেইখানেই ঢুকলাম। কী পাওয়া যাবে?

    বেলা আড়াইটে বাজে – খদ্দের বিশেষ কেউ নেই, তবে মাছভাতের আশ্বাস পাওয়া গেল। আলুভাজা, ডাল, ভাত আর ইয়াব্বড় মাছের পেটি আর ল্যাজা সমেত চমৎকার ভরপেট খাওয়া হল। খেতে খেতে ধাবার লোকটার সাথে গল্প করছিলাম, মানে সে-ই আমার মোটরসাইকেলে বাঁধা লাগেজ আর দিল্লির নাম্বারপ্লেট দেখে এসে আলাপ করল। বললাম, আমি শেষ এই রাস্তায় এসেছি কুড়ি বছর আগে, তখন এই রাস্তা ছিল সরু, ভাঙাচোরা, এদিক সেদিন কুপি জ্বলত, সন্ধ্যের পরে ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে কীভাবে আমরা ফিরেছিলাম মাদারিহাট থেকে। লোকটা একগাল হেসে বলল, ‘হ্যাঁ দাদা, লোকালিটি অনেক পালটে গ্যাসে, আপনে এদিকে কী করতে আইসতেন তহন?’

    ‘ইঞ্জিন কলেজের স্টুডেন’ ছিলাম শুনেই লোকটার চোখেমুখে সম্ভ্রম জেগে উঠল। ঠিক কুড়ি বছর আগেও যে জিনিস দেখতাম, জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছেলেপুলেদের অনেক বাঁদরামির কারণে অনেক লোক অপছন্দও করত, কিন্তু সেই অপছন্দের সাথে মিশে থাকত একটা সম্ভ্রম – ‘ইঞ্জিন কলেজের স্টুডেন’।

    আরও জানলাম, কয়দিন আগেই এহান দিয়া মোটরসাইকেল ৎসালায়ে বোম্বাই থিকে কয়েকডা লোক আসসিলো ভুটান যাবার জন্য, তারা এহানেই দুপুরের খাওয়া খায়ে গেসল।

    গল্প শুনতে শুনতে আমার খাওয়া হয়ে গেল। খেয়েদেয়ে উঠে আবার এগনো। কলেজ আর মাত্র বত্রিশ কিলোমিটার। আর কিছুক্ষণ পরেই আমার চেনা এলাকা শুরু হয়ে যাবে। এই রাস্তাটার নাম ময়নাগুড়ি বাইপাস। কলেজের দিকে যাবার পথে বাচ্চুদার ধাবা পড়ার একটু আগেই আসবে তিস্তা নদীর ওপর সেই বিশাল ব্রিজ – আপনারা আশির দশকে অমিতাবচ্চনের সুপারহিট বাংলা সিনেমা অনুসন্ধান দেখেছেন নিশ্চয়ই? যার হিন্দি ছিল বরসাত কি এক রাত? তাতে কালীরাম ওরফে আমজাদ খানের জিপের পেছনে পুলিশের জিপ নিয়ে অমিতাবচ্চনের একটা চেজিং সীন ছিল, এই তিস্তা নদীর ব্রিজটার ওপর। আর এই ব্রিজের কাছেই তিস্তার চরের পাশে রয়েছে ঐতিহাসিক ভবানী পাঠকের মন্দির, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের দৌলতে যা দেবী চৌধুরানীর কালীমন্দির নামে খ্যাত।

    বিশাল, চওড়া তিস্তা এখানে ধীরগতি। তার বয়ে যাবার পথ রুদ্ধ করে নদীর গতিপথে শুয়ে রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় সুবিশাল সাইজের বোল্ডার। এক বোল্ডার পেরিয়ে অন্য বোল্ডারে পা রেখে অনায়াসে পেরিয়ে যাওয়া যায় নদী, কদাচিৎ জলে পা ঠেকে গেলে কনকনে ঠাণ্ডায় বোঝা যায়, সে সদ্য নেমে এসেছে পাহাড় থেকে। …

    …অনেকদিন আগে, তখন আমরা সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, কলেজ বাসের ড্রাইভার থাপাদাকে পটিয়ে জনাতিরিশ বন্ধুবান্ধব মিলে এই পথ ধরে গেছিলাম উত্তরবঙ্গের আরেক ক্ষীণতোয়া নদীর ধারে, চাবাগানের ধার ঘেঁষে মূর্তি নদীর চরে। সারাদিনের হইহুল্লোড়, দূর থেকে স্থানীয় মদেশিয়া কামিনদের জীবনচর্যার এক ঝলক দেখা, নবীনদার রাঁধা মাংসের ঝোল আর ভাত খেয়ে সেদিনের পিকনিক দারুণ কেটেছিল। বিকেল পেরিয়ে যখন গোধূলি নামছে, কাউবয় হ্যাট মাথায় চড়িয়ে গিটার নিয়ে নদীর ঠিক মাঝখানটায় একটা বড় বোল্ডারের ওপরে গিয়ে বসল দেবকান্তি … দেবকান্তিই নাম ছিল তো তার? সাথে আমরা সবাই – অগস্তি, আমি। অগস্তির দাদু ছিলেন মহিষাদল রাজবাড়ির সভাগায়ক, উত্তরাধিকার সূত্রে সুন্দর গানের গলা পেয়েছিল সে। সমস্বরে হাততালি দিয়ে গান শুরু হল – ইঞ্জিন কলেজের তখনকার দিনের এভার পপুলার সং, পাপা কহতে হ্যায় বড়া নাম করেগা – পেছন থেকে চা বাগানের অন্ধকার ঝোপ ভেদ করে উঠে এল থালার মত বিশাল বড় পূর্ণিমার চাঁদ …

    জীবন গিয়াছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার, এখনও মনে হয়, এই তো সেদিন। সেদিন জাস্ট ভাবতেও পারি নি, একদিন, কুড়ি বছর পরে আমি নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে এ তল্লাটে বেড়াতে আসব সুদূর দিল্লি থেকে। কীরকম স্বপ্ন মনে হচ্ছিল সবকিছু, সে যেন আমার গতজন্মের স্বপ্ন ছিল, আমি ঘুম ভেঙে ঢুকে পড়েছি আমার অনেকদিনের পুরনো একটা স্বপ্নের মধ্যে।

    তিস্তার ব্রিজের ওপর দাঁড়ালাম। কলেজের জিএসকে একটা ফোন করতে হবে। পাঁচটা বাজে। ফোন করলাম। কেউ তুলল না। আবার ফোন করলাম – কেউ তুলল না।

    পরপর তিনবার কল করলাম। অন্যপ্রান্তে কোনও জবাব নেই। কেলো করেছে – জিএস ছাড়া আমি তো আর কারুরই নাম্বার জানি না, সে যদি ফোন না তোলে তো আমি কোথায় যাবো?

    খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার দু-একবার চেষ্টা করলাম। নাঃ, অন্যপ্রান্ত একইরকম নীরব।

    আপাতত এখানে দাঁড়িয়ে কিছু করার নেই, কলেজ পর্যন্ত তো যাই, তারপরে দেখা যাবে, জিএস যখন – কলেজের ছেলেপুলে কেউ না কেউ তো নাম জানবে। হোয়াটস্যাপে মেসেজ করে রাখলাম, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি, ফোন তোলো।

    তিস্তা নদী পেরোতেই খানিক বাদে কলেজের মোড় চলে এল, দশ মিনিটও লাগল না। কলেজের মোড় দেখেও অবাক হতে হল, অনেকটা একই রকম আছে, তবে আগের সেই গুমটির দোকানগুলো সব উধাও, এখন পাকা দোকানঘর হয়েছে চারদিকে, সংখ্যায়ও বেড়েছে। বাঁদিকে মাষকলাইবাড়ির দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে, আমরা বলতাম মস্কো – সেটা এখন বেশ চওড়া, ঝকঝকে মসৃণ রাস্তা।

    কলেজে ঢোকার মুখে একটা ভাঙাচোরা লজঝরে গেট ছিল, সেখানে এখন সুন্দর চওড়া লোহার গেট, আর গেটের ঠিক ভেতরে একটা অদ্ভূতদর্শন তোরণদ্বার বানানো, সেখানে নীল উর্দিপরা দুজন সিকিওরিটি গার্ড বসে আছে। না, সিকিওরিটি গার্ড ব্যাপারটা আমাদের সময়ে এক্সিস্টই করত না। চব্বিশ ঘণ্টা এই গেট খোলা থাকত, যখন ইচ্ছে যাও, এসো।




    ভেতরে ঢুকে গেলাম, কেউ আটকালো না। কলেজের মেন বিল্ডিংয়ের সামনে এসে মোটরসাইকেল থামালাম, কলেজ বোধ হয় একটু আগেই ছুটি হয়ে গেছে, ইতস্তত দু একটা স্কুটি, মোটরসাইকেল এক সাইডে পার্ক করে রাখা, আর কিছু সাইকেল, ছেলেপুলে বিশেষ নেই। একজনকে পেলাম, তাকে ডেকে নাম ধরে জানতে চাইলাম – ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট, কলেজের জিএস, তাকে কোথায় পাবো বলতে পারো?

    সে বেচারা কথা বলবে কি, আমার লাগেজভর্তি মোটরসাইকেল দেখেই আর চোখ সরাতে পারছে না। বোধ হয় ফার্স্ট ইয়ার, সে না চেনে জিএস-কে, না শুনেছে তার নাম। তাকে ছাড়ান দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে ভাবছি কী করব। এইসময়ে মোবাইল মাউন্টে আলো জ্বলে উঠল – হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। দাদা, আমি একটা সেমিনারে আছি, তুমি গেস্ট হাউসে চলে যাও – কথা বলা আছে, তোমার জন্য ঘর রাখা আছে। আমি সেমিনার শেষ করে আসছি।

    প্রাণে আশা ফিরে এল। যাক, যোগাযোগ হয়েছে তা হলে। গেস্ট হাউস আমি খুব চিনি। কলেজ ছাড়ার মুখে বাবা-মা-দিদি এসেছিল জলপাইগুড়ি আর সিকিম বেড়াতে, তখন তাদের গেস্ট হাউসেই রেখেছিলাম, মেন বিল্ডিংয়ের পেছন দিক দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে লেডিজ হস্টেল পেরিয়ে (আমরা বলতাম ‘পাকিস্তান বর্ডার’ – অবশ্যই মজা করে) প্রিন্সিপাল কোয়ার্টারের দিকে, সেই রাস্তাতেই পড়ে। কলেজের সোশাল হত যখন, তখন আমন্ত্রিত এলসিড্যার্জ – মানে কিনা লোরেটো কনভেন্ট দার্জিলিংয়ের সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের তো এই গেস্টহাউসেই রাখা হত। আজ সেই গেস্টহাউসে আমি অতিথি।

    কলেজ বিল্ডিং নিজেও প্রস্থে বেড়েছে। আমি যখন পাস করেছিলাম এখান থেকে, তখন এই কলেজ ছিল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে – এখন পশ্চিমবঙ্গের বাকি সমস্ত ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজগুলোর সঙ্গে জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ – আমরা যাকে ‘জলু’ নামে ডাকি ও ডাকতাম – তারা সবাই MAKAUT বা মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির আন্ডারে চলে গেছে, তবে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় তার দাবি ছাড়ে নি। মূল বিল্ডিং যতটুকু আমাদের সময়ে ছিল, তার পেছনের দিকে দেখলাম কলেজ আয়তনে বেড়েছে, নতুন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং তৈরি হয়েছে, আর দেখতে পাচ্ছি একটা বোর্ড লাগানো আছে, ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ বেঙ্গল, জলপাইগুড়ি ক্যাম্পাস। সামনে কয়েকটি ছেলেমেয়ে একটা মুভি ক্যামেরা আর ট্রাইপড নিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে।

    মেন বিল্ডিং পেরিয়ে এগোলাম গেস্ট হাউসের দিকে, বাঁদিকের উঁচু পাঁচিলটা, যেটা কলেজ ক্যাম্পাসের সীমানা নির্দেশ করে, তার চেহারা এত বছর পরেও একই রকমের আছে, কালচে মৈসে পড়া, সামনের রাস্তাটা একই রকমের সরু, কেবল চমৎকার অ্যাসফল্টের প্রলেপ পড়েছে তার ওপর, সামান্য এগোতেই ডানহাতে গেস্ট হাউস। গেটে তালা মারা, তবে ভেতরে লোক আছে মনে হল। দুটো মোটরসাইকেল আর একটা গাড়ি দাঁড় করানো।

    হর্ন মারলাম দুবার। একজন লোক বেরিয়ে এল। তাকে বললাম জিএসের নাম দিয়ে – আমার নামে ঘর বলে রাখা আছে। সে তো আকাশ থেকে পড়ল, না – এহানে তো শিলিগুড়ি পলিটেকনিক থেকে আসা ছেলেরা রয়েছে, সব ঘর তো ভর্তি, আমাকে তো কেউ কিসু বলে রাহে নাই।

    এবার আকাশ থেকে পড়ার পালা আমার। জিএসকে আর ফোন করলাম না, সেমিনারে ব্যস্ত আছে – লোকটাকে বললাম, একটা কাজ করো, অনেকদূর থেকে আসছি, সেই ভুটান থেকে, একটু বসি নিচের ঘরটায়, আমার নামে যে বুক করেছিল, সে মিটিংয়ে আছে, শেষ করে এখানে আসবে, তখন তার সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করে নেওয়া যাবে। আমি এই কলেজের অনেক পুরনো স্টুডেন্ট, তুমি আমাকে চিনবে না।

    শেষ কথাটায় কাজ হল, লোকটা সাগ্রহে আমাকে নিচের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। বসালো বলতে, দুটো টিনের খাট পাশাপাশি রাখা, এই দারোয়ান আর কুক শোয় এখানে। জিএসকে আবার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে রাখলাম, সেমিনার শেষ হলে একবার এসো – এই এই ব্যাপার।

    দারোয়ান ভাই অদ্যাবধি এমন পায়ে-নীগার্ড-বাঁধা, গলায়-ক্যামেরা-ঝোলানো, মোটরসাইকেলে-লাগেজ-বাঁধা অতিথ দেখে নি, তার তাই কৌতূহলের শেষ নেই। জিজ্ঞেস করলাম, নবীনদা আছে এখনও? … নবীনদার গল্প লিখেছিলাম আমার উত্তরবঙ্গ ধারাবাহিকে, গুরুচন্ডা৯র পাতায় এখনও পাওয়া যাবে তাদের, আমাদের দু নম্বর হস্টেলের ক্যান্টিন চালাত। জানা গেল নবীনদা এখন কলেজের সামনে আলাদা ক্যান্টিন খুলেছে, সেইটা চালায়, হস্টেলেরটা অন্য কেউ চালায়।

    ছটা নাগাদ জিএসের ফোন এল, সিকিদা, তুমি কোথায়? তুমি তো গেস্টহাউসে নেই! আমি আবার অবাক। আমি তো গেস্টহাউসেই আছি – কলেজে এখন কটা গেস্টহাউস?

    দারোয়ানই জানাল, হ্যাঁ, বছর পাঁচেক আগে আরেকটা গেস্টহাউস হয়েছে বটে, ওয়ার্সশপের পাশে পিডাব্লুডি অফিসের সামনে। এটাতে সবসময়ে আশপাশের কলেজ থেকে আসা ছেলেপুলেদের রাখা হয়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের আয়োজন হয়, আর ঐ গেস্টহাউসটা কলেজের গেস্টহাউস।

    আমি জিএসকে ফোনে বললাম, এই ব্যাপার, আমি কলেজের পেছনে লেডিজ হস্টেলের কাছে যে পুরনো গেস্টহাউস আছে, সেইটাতে এসে বসে আছি – নতুন গেস্টহাউস তো আমি চিনি না, তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও।

    পাঁচ মিনিটের মাথায় দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে জিএস হাজির। সূর্য ততক্ষণে ডুবে গেছে, অন্ধকার নেমে এসেছে ক্যাম্পাসের বুকে। তারা আগে আগে চলল সাইকেল নিয়ে, পেছন পেছন হেডলাইট জ্বালিয়ে মোটরসাইকেলে আমি। কলেজের পেছন দিয়ে রাস্তাটা এসে পড়েছে কলেজ ক্যান্টিনের কাছে, সেখান থেকে বাঁদিকের রাস্তা চলে গেছে হস্টেলের দিকে, আর সোজা রাস্তা ওয়ার্কশপের দিকে। এই কলেজের পেছনের রাস্তাটার নাম আমরা দিয়েছিলাম ভাইবোন সরণী – মানে, মূলত তখনকার ছেলেমেয়েদের প্রেম করার জায়গা, যারা কিনা স্যার দেখলেই ভাইবোন সাজার চেষ্টা করত। ছেলেমেয়েরা এখন কোথায় প্রেম করে, কে জানে! অবিশ্যি এত বড় ক্যাম্পাসে কি প্রেম করার জায়গার অভাব!

    জিএসই দেখাল, কলেজের ক্যান্টিন এখন পাশাপাশি দুটো, তার একটা নবীনদা চালায়। বললাম, ঠিক আছে, আগে ফ্রেশ হয়ে আসি, তারপরে নবীনদার সাথে একবার দেখা করে নেওয়া যাবে।

    পিডাব্লুডি অফিসের পাশে ফাঁকা জমিতে বানানো হয়েছে নতুন গেস্টহাউস। পুরোপুরি বানানো হয় নি বলেই মনে হল। নিচের তলায় বড়সড় একটা ঘরে দুজন লোক বসে কিছু অ্যালুমিনিয়ামের বোর্ড আর কী সবে যেন একমনে পেন্ট লাগাচ্ছে, ঘর ভরে আছে তার্পিন তেলের গন্ধে। জানা গেল, কদিন পরেই সোশাল শুরু হবে, তারই প্রস্তুতি চলছে। জিএস বলল, তুমি এইখানেই ঘরের ভেতর মোটরসাইকেল ঢুকিয়ে দাও, লাগেজ এখানে সেফ থাকবে, যেটুকু দরকার, খুলে নিয়ে ওপরে চলে যাও।

    ওপরের ঘর দেখতে উঠলাম। চওড়া কমন স্পেস, তার এপাশে একটা ঘর, ওপাশে আরেকটি। ঘরে একটা বিশাল বিছানা, মনে হল না চাদরটা পাতবার পরে কোনওদিন কাচা হয়েছে আর। ঘরের আনাচেকানাচে ঝুল জমে আছে, এককোণে একটি টিউবলাইট যথেষ্ট আলো দিতে পারছে না। অন্যপ্রান্তে আরেকটি ঘর, সেখানে কোনও এক ছাত্রের বাবা মা এসেছেন, স্রেফ বাবাকেই দেখলাম, খালি গায়ে একটা গামছা পরে ভুঁড়ি দুলিয়ে কমন স্পেসের মধ্যে চলেফিরে বেড়াচ্ছেন, বোধ হয় বাহ্যি যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

    জিএস বলল, ফ্রেশ হয়ে নাও, পাশাপাশি দুটো বাথরুম আছে, তুমি বাঁদিকের বাথরুমটা ইউজ করো। আমি হস্টেলে যাচ্ছি, হয়ে গেলে ফোন কোরো – আমি এসে নিয়ে যাবো।

    সঙ্গে যে লোকটি চাবি নিয়ে এসেছিল, সে এবার আমাকে একা পেয়ে বলল, দাদা, রাতে খাবেন না তো কিছু?

    আমি বললাম, না – আমি বেরবো, বাইরেই খেয়ে নেব।

    লোকটা এইবারে বলল, আমি এইহানেই থাকি, রাতে নিসে শুই। আপনে ঘরের ভাড়াটা আমাকেই দিয়া দিবেন।

    আমি চমৎকৃত হলাম, এই ঘরেরও ভাড়া দিতে হয়? তা হলে আর কলেজে থাকতে এলাম কেন? আমাদের সময়ে তো ভাড়া লাগত না – অন্তত কলেজের ছাত্রদের মা-বাবা আর পুরনো ছাত্রদের থেকে ভাড়া নেবার কথা কখনও শুনি নি। সোশালের সময়েও বাইরের কলেজ থেকে ছেলেমেয়েরা আসত, গেস্টহাউস তো এমনিই পাওয়া যেত। হয় তো নিয়ম বদলে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, কত দিতে হবে?

    লোকটা ঘাড় চুলকে বলল, দ্যান তিনশো ট্যাহা।

    তিনটে একশো টাকার নোট পেয়ে লোকটা খুবই উৎফুল্ল হয়ে ঘরের কোণে একটা আলমারি দেখিয়ে বলল, এহানে লেপকম্বল সাদোর (চাদর) সব আসে, লাগলে নিয়া নিবেন। আমি নিসেই শুই, দরকার লাগলে ডাকে নিবেন। আর এই ন্যান চাবি, মেন গেটের চাবি এইটা – সকালে যহন বাইর হবেন, গেট খুল্যে বাইক বাইর করে চাবিটা ভিতরের ধাপিতে রাখে যাবেন।

    টিপিকাল জলপাইগুড়ির ডায়ালেক্ট, কলেজ ছাড়ার পরে আজ প্রথম শুনছি। হেসে ফেলে বললাম, ঠিক আছে, তুমি এসো তা হলে।

    বাথরুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম, কোনওরকমে টয়লেটটা হয়ে যাবে, আদারওয়াইজ, বেশ নোংরা। মাকড়সার জাল, ঝুল, ধুলো – সব মিলেমিশে একাকার। পাশের টয়লেটটি বন্ধ, সেই গামছাপরা ভদ্রলোক বোধ হয় ভেতরে হালকা হচ্ছেন।

    যেহেতু এটা কলেজের গেস্টহাউস, হোটেলের রুম নয়, অতএব, গামছা বা তোয়ালে পাবার কোনও আশা এখানে নেই, তাই চান আর করা হল না। কোনওরকমে মুখেচোখে একটু জল দিয়ে ঘরে ঢুকে বসলাম। এমনিতে খুব একটা ক্লান্ত নই, সন্ধে সবে সাড়ে ছটা কি সাতটা বাজে, একবার হস্টেলে ঘুরে আসতে পারলে মন্দ হয় না, আঠেরো বছর আগেকার হস্টেলকে চেনা যায় কিনা দেখবার জন্য খুবই ইচ্ছে করছিল।

    নিচে নেমে মোটরসাইকেল থেকে লাগেজ খুলে ওপরে নিয়ে এসে আবার জিএসকে ফোন করলাম। দশ মিনিটের মধ্যে সে তার বন্ধুকে নিয়ে সাইকেলে চেপে হাজির হয়ে গেল গেস্টহাউসে। ওদের পিছু পিছু আমি মোটরসাইকেল নিয়ে চললাম সত্যেন বোস হলএ, অর্থাৎ হস্টেল তিনের দিকে।



    সুবিশাল হস্টেলের মাঠের এক প্রান্তে হস্টেল এক আর দুই, যথাক্রমে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আর জগদীশচন্দ্র বসুর নামে, আর মাঠের অন্যপ্রান্তে, চা-বাগান ঘেঁষে এই হস্টেল তিন। আমাদের সময়ে হস্টেল এক আর দুইয়ের একতলায় ভাগাভাগি করে থাকত ফার্স্ট ইয়ার, আর দোতলা আর তিনতলায় থাকত সেকেন্ড আর থার্ড ইয়ার। হস্টেল তিন ফোর্থ ইয়ারের জন্য, ছোট ছোট রুম, প্রত্যেক রুমে একজন করে থাকতে পারে। খাট ওয়ার্ডরোব আর টেবিল বাদ দিলে ঘরে হাঁটাচলার জায়গা বিশেষ থাকে না। এবারে দেখলাম হস্টেল এক-দুই আর তিনের মাঝে, মাঠের আরেক প্রান্তে তৈরি হয়েছে আরেকটা হস্টেল, এখন ফার্স্ট ইয়ার সেইখানে থাকে। হস্টেল এক আর দুইয়ের একতলা থেকে তিনতলা পুরোটাই সেকেন্ড ইয়ার আর থার্ড ইয়ারের দখলে। হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ আমরা কলেজ ছাড়ার পরে নতুন নতুন ডিপার্টমেন্ট খুলেছে এখানে, ফলে ছাত্রসংখ্যাও বেড়েছে।



    হস্টেল তিনে ঢুকলাম। আঠেরো বছরে একফোঁটা বদলায় নি, কেবল দেয়াল, ভেতরের মাঠ – সমস্তকিছু দেখলে বোঝা যায় এদের বয়েস বেড়ে গেছে অনেকটা। এর মধ্যে, কে জানে, হয় তো নতুন করে রঙের প্রলেপ আর পড়ে নি, বিবর্ণ দেয়াল, মেসের বাইরে নোটিসবোর্ডটাও আদ্যিকালের পুরনো, আমরা যেমন দেখে গেছিলাম, তেমনটিই, বাইরে ইতস্তত সাইকেল দাঁড় করানো এদিক সেদিক।

    তিন নম্বর হস্টেলটা একেবারে আইডেন্টিকাল তিনটে ব্লকে বানানো, যে কোনও একটা ব্লকে কাউকে দাঁড় করিয়ে দিলে, প্রথম বারের জন্য তার পক্ষে বলা সম্ভব নয় সে কোন ব্লকে দাঁড়িয়ে আছে – ফ্রন্ট, মিডল না ব্যাক এবং বাইরে যাবার রাস্তা কোনদিকে। এই হস্টেলের ছাদে যাবার সিঁড়ি একটা জানলার ভেতর দিয়ে পৌঁছতে হয়। হস্টেলটা তৈরি হয়েছিল নকশাল পিরিয়ডে, এবং এই অদ্ভুত স্থাপত্যের দৌলতেই এই হস্টেলের তথা এই ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে অনেক অনেক কাহিনি, নকশাল আমলের। এক সময়ে এই করলার জলে ভেসে গেছে অনেক ছাত্রের লাশ।



    মনে পড়ে গেল আমার সেই প্রথম এই তিন নম্বর হস্টেলে আসার স্মৃতি। … উনিশশো পঁচানব্বই সালের আগস্ট মাস। সদ্য র‍্যাগিং পিরিয়ড শেষ হয়েছে। আমি র‍্যাগিং পিরিয়ড স্কিপ করে পৌঁছেছিলাম আমার চোখের একটা অপারেশনের কারণে। গান গাইতাম, এবং বন্ধুদের প্রথম দাবিদাওয়ার মাঝে সুমনের গান গেয়ে ফেলেছিলাম বলে আমার নিকনেম হয়েছিল জীবনমুখী, সেই থেকে শর্টে জিনু। একদিন, তখন সবে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে হপ্তাদেড়েক হবে – একজন এল আমার রুমে, এসে বলল, এই, তোর নাম জিনু? তোকে ফোর্থ ইয়ার হস্টেলের ওমুকদা ডেকেছে। আজ সন্ধ্যেবেলায় একশো বারো নম্বর রুমে যাবি।

    চিরকালীন ভিতু, আবার চোখে সর্ষেফুল দেখলাম। ফোর্থ ইয়ার মানে একটা দূর গ্রহের ব্যাপার, তারা নিশ্চয়ই খবর পেয়ে গেছে যে আমার র‌্যাগিং ঠিকমত হয় নি, ফোর্থ ইয়ার আমাকে ডেকেছে মানে আমাকে নিশ্চয়ই ফেলে পেটাবে এবার। শুনেছিলাম র‌্যাগিং স্কিপ করলে ডবল র‌্যাগিং করা হয়।

    আমার রুমমেট অতীন, মধু, আর বৌদি মিলে যে যতরকম পারে ভয় দেখাল আমাকে, আর প্রচুর সহবৎ শেখাল, হাসবি না, কলারের বোতাম আটকে, বেল্ট আর ঘড়িটা খুলে যা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

    সেই মতো সেজেগুজে পুরো মুরগীর ছানা হয়ে সন্ধ্যেয় একা একা পৌঁছলাম ফোর্থ ইয়ারের হস্টেলে। উফ্‌ফ্‌, পুরো যেন বাঘের গুহা। সম্পূর্ণ অন্যরকম! এক আর দুই নম্বর হস্টেলের সাথে কোনওরকম মিল নেই! ভেতরে ঢুকে সব গোলকধাঁধা। কোথায় যে একশো বারো নম্বর রুম, খুঁজে বের করতে ঝাড়া কুড়ি মিনিট লাগল।

    সেই ঘরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল ছ জন ফোর্থ ইয়ারের ছেলে। আজ আর তাদের নাম মনে নেই, একজন ছিল, দাড়িওলা, বেঁটে করে, সে-ই আমাকে বলল, তোর নাম অচল সিকি?

    পরের প্রশ্নগুলো এল অ্যাজ এক্সপেক্টেড, কেন র‌্যাগিং পিরিয়ড কাটিয়ে এসেছি ইত্যাদি ইত্যাদি।

    আমার প্রচন্ড আড়ষ্ট ভাব দেখে একজন এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে হাসল, ভয় পাস না রে, র‌্যাগিং পিরিয়ড শেষ, আমরা কেউ র‌্যাগ করতে ডাকি নি তোকে। তুই কাল কলেজ মোড়ে জামাইদার দোকানে বসে গান গাইছিলি?

    আড়ষ্টভাবেই বললাম, হ্যাঁ। কী জানি, কলেজ মোড়ে গান গাওয়া অপরাধ কিনা! পাশের আরেকজন জানাল, ওমলেট বলল, তুই নাকি হ্যাভক গান গাস! তোর গান শুনতে ডেকেছি।

    আর বলতে হল না। ফোর্থ ইয়ার হস্টেল থেকে বেরোলাম পরদিন সকাল সাতটায়। রাত আড়াইটে পর্যন্ত গানবাজনা হয়েছিল। সেই দাড়িওলা দাদা, ঝাড়া এক ঘন্টা মাউথ অর্গ্যানে বিভিন্ন গান বাজিয়ে শুনিয়েছিল। বাকিরাও যে যেমন পারে গলা মিলিয়েছিল। সময়ে সময়ে চা, চানাচুরের সাপ্লাই ছিল নিয়মিত। রাতে ওরাই আমার জন্য মেস থেকে খাবার তুলে আনল। একসাথে খেলাম, তারপর আবার গান। বাকি রাতটা একজনের ঘরে শোবার জায়গাও হয়ে গেল। এই প্রথম হস্টেল জীবনের স্বাদ পেলাম। মস্তি কা পাঠশালা। অ্যায়শ্‌শালা!

    এ দিকে আমার রুমমেটদের হাল খারাপ। সারারাত ফিরি নি, ফোর্থ ইয়ার হস্টেলে গিয়ে খোঁজ নেবার মত সাহসও কারুর ছিল না স্বাভাবিকভাবেই। প্রায় প্রত্যেকে চিন্তা করেছে আমার জন্য। পরদিন সকালে যখন অক্ষত ফিরলাম, তখন সক্কলে হাঁউমাউ করে একসাথে কোশ্চেন করতে শুরু করল। নিজেকে বেশ হিরো হিরো মনে হচ্ছিল। সেই সকালটা এখনও মনে আছে।

    তার পর এক সময়ে কালের নিয়মে নিজেরাই ফোর্থ ইয়ার হয়ে গেছিলাম, কলেজ থেকে বেরিয়ে বুঝতে পারলাম, সব হয়েছে, ইঞ্জিনীয়ারিংটাই শেখা হয় নি। সাথে সাথে আরেকটা কোর্সে ভর্তি না হলে হয় তো জীবনে কখনওই ভালো চাকরি পাওয়া হত না।

    … সেই ফোর্থ ইয়ার হস্টেলে আজ আঠেরো বছর বাদে ঢুকছি আমি, সিনিয়রেরও সিনিয়র হয়ে। বর্তমান জিএস আমাকে খুব খাতিরযত্ন করে নিয়ে যাচ্ছে, নিয়ে যাচ্ছে সেই ঘরে, দোতলা ফ্রন্ট উইংয়ে, যেখানে এক সময়ে আমি থাকতাম, সেই ঘরে এখন আরেকজন রয়েছে, বর্তমান ফোর্থ ইয়ার, আমাকে দেখে সে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল, আমি দেখলাম সেই খাট, সেই ওয়ার্ডরোব আর সেই টেবিলচেয়ার, এত বছরেও তারা বদলায় নি, আরও কালো হয়ে গেছে, দেয়ালে নতুন রঙ পড়ে নি কতকাল কে জানে, ছাদ থেকে ঝুলছে মোটা মোটা ঝুল, চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, টেবিলের ওপর রাখা একটা মোবাইল ফোন আর একটা ল্যাপটপ, আমাদের সময়ে যে জিনিসদুটো ভারতে প্রায় এক্সিস্টই করত না।

    শুনলাম, এখন হস্টেলের ঘরে ঘরে ল্যান কানেকশন, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস আছে। সবাই আজ খুব ব্যস্ত, কারণ কদিন পরেই টিসিএসের ইন্টারভিউ হবে, আজ রাতের মধ্যে সব্বাইকে অনলাইন ফর্ম ভরতে হবে। টিসিএসের নাকি ইয়া লম্বা অনলাইন ফর্ম হয়, অনেক কিছু ভরতে হয়, যে আগে শেষ করে ফেলছে, সে বন্ধুকে সাহায্য করছে।

    এই ব্যস্ততার মধ্যে গিয়ে আমার নিজেকে একটু অপরাধীই লাগছিল, কিন্তু ছেলেগুলো দেখলাম বিন্দাস – ও কোনও ব্যাপার না, আজ পুরো রাতটা তো আছেই।

    গল্প হল খানিক, আমার সময়ের গল্প বললাম ওদের, ওদের মানে, ওরা তিন চারজন ছেলে – ওরাও শোনাল কলেজের বর্তমান হাল হকিকৎ। অনেক কিছুই বদলে গেছে, আমাদের সময়ের জীবনযাত্রা আর এখনকার জীবনযাত্রায় অনেক অনেক তফাৎ। আগের বারের সোশালের ভিডিও দেখাল আমাকে ইউটিউব থেকে, ওদের ব্যাচের কয়েকজন ছেলেমেয়ে অপূর্ব কোরিওগ্রাফি করে, আর একজন দারুণ ভিডিওগ্রাফি করে, সেই ভিডিওগ্রাফারের তোলা কোরিওগ্রাফির ভিডিও দেখলাম ইউটিউবে, ছেলেমেয়েরা কতকিছুতে ইনভলভড, কত ট্যালেন্টেড এখন। আমাদের সময়ে তো এসব কিছুই ছিল না।

    ‘দাদা, রাতে কি এখানেই খেয়ে যাবে?’ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে থমকালাম একটু। খাওয়া নিয়ে আমার গুচ্ছ চাপ আছে, আমি বললাম, না – আমি বাইরেই খেয়ে নেব ভাবছি, চলো তোমরাও, কিছু খেয়ে আসি।

    ছেলেগুলো হাতে পুরো চাঁদ পেল। হস্টেল লাইফে রোজকার একঘেয়ে মেসের খাবারের জীবনের মধ্যে এই রকম কেউ এসে বললে কত ভালো লাগে, সে কি আমি জানি না? জিএস একজনকে সাথে সাথে কলেজ মোড়ে পাঠিয়ে দিল টোটো ধরার জন্য। আমরা বেরোলাম গেস্টহাউসের উদ্দেশ্যে, মোটরসাইকেলটা রেখে আসার জন্য।

    টোটো চলে জলপাইগুড়ি শহরে, আর পাঁচটা মফস্বল শহরের মতই। মস্কোর রাস্তা, মনে পড়ল, সেবারে বন্যা হয়েছে জলপাইগুড়িতে, আমরা বন্যা দেখতে বেরিয়েছিলাম, এই মস্কোর রাস্তার ওপর দিয়ে প্রচণ্ড তোড়ে বয়ে যাচ্ছে জল, তিস্তার দিকে, আমরা পাঁচজন ছেলে হাত শক্ত করে ধরে রেখে পায়ে পায়ে এগোচ্ছি, হাত ছেড়ে দিলেই ভেসে বেরিয়ে যেতে পারি – এত স্রোত। সেই রাস্তা এখন চকচকে, অনেক উঁচু। রাস্তার ধারে ডানদিকে একটা ভাঙা বাড়ি ছিল, জলপাইগুড়ির টিবি হাসপাতাল, এখন সেটা একটা মাল্টিস্টোরিড টিবি হসপিটাল। মস্কোর মোড় ছেড়ে বাঁদিকে বেঁকে শান্তিপাড়া বাসস্ট্যান্ড এখন ঝাঁ-চকচকে আধুনিক এক বাসস্ট্যান্ড, ইতিউতি চোখে পড়ল আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক আর স্টেট ব্যাঙ্কের এটিএম। প্রচুর প্রচুর দোকানপাট, বেগুনটাড়ির মোড় জমকালো হয়ে গেছে, কদমতলার মোড়কে আর চেনা যায় না, শুধু রূপশ্রী, রূপমায়া আর দয়াল সিনেমাহলেরা আজও আছে। রূপশ্রীর এক ঝলক দেখতে পেলাম। এক জায়গায় একটা হোটেল ছিল রুবি বোর্ডিং নামে, তার কাছেই এক বৌদির রেস্তরাঁ ছিল, সেখানে আমরা পিজ্জা খেতে যেতাম। এখন রাতের অন্ধকারে আর কিছুই, কিচ্ছুটি চিনে উঠতে পারলাম না। জলপাইগুড়ি টাউন বদলে গেছে বিলকুল।

    আজ সকালে ছিলাম ভুটানে, রাতে ডিনার করছি জলপাইগুড়িতে, আজই আমার বেড়ানোর মোটামুটি শেষ, কাল সকালে যাত্রা শুরু হুগলির উদ্দেশ্যে, সেখানে আমার বইপ্রকাশের অনুষ্ঠান হবে পরশু।

    ভরপেট খাওয়াদাওয়া সেরে আবার একটা টোটো ধরে রাতে আবার ক্যাম্পাসে ফেরত। ফেরার সময়ে মনে পড়ল, নবীনদার সাথে আর দেখা হল না। অনেক, অনেক স্মৃতি নবীনদাকে নিয়ে, সেই শীতের ছুটিতে ছটি মাত্র প্রাণীর হস্টেলে টিকে থাকা নবীনদার রান্না করা খাবারের দৌলতে, সেই রংধামালি পেরিয়ে বোদাগঞ্জ ফরেস্টের বাংলোতে রাত কাটানো, তিস্তা নদীর ব্যারেজে রাতের বেলায় চাঁদের আলোর প্রতিফলন দেখতে দেখতে হাতির গল্প শোনা … কাল ভোরেই বেরিয়ে পড়তে হবে, এখান থেকে দক্ষিণবঙ্গে আমার বাড়ি সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার, লম্বা জার্নি।

    প্রায় পৌনে এগারোটা বাজে, পাশের রুমের সেই কোনও এক ছাত্রের বাবা তখনও জেগে। একই রকমের খালি গা, ভুঁড়িটা ঝুলছে, নিম্নাঙ্গে একটা গামছা – ইনি কি গামছা ছাড়া কিছুই পরেন না? – আমার দিকে জুলজুল করে দেখছেন। আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলাম।

    বিছানার চাদরটা বড্ড নোংরা, আলমারি খুলে দেখি ভালো চাদর আছে কিনা।

    আলমারিটা খুলতেই ছিটকে পিছিয়ে আসতে হল। কত বছরের পুরনো লেপ, কে জানে, জীবনে কোনওদিন কাচা হয় নি, তীব্র বোঁটকা একটা গন্ধ আসছে আলমারির ভেতর থেকে, একেবারে পেটের ভেতর পর্যন্ত ঘুলিয়ে উঠল একেবারে, তড়িঘড়ি আলমারির দরজা বন্ধ করলাম।

    যদিও ঘুম আসছে না, তবু ঘুমোতেই হবে। সকাল সাড়ে পাঁচটায় অ্যালার্ম দিয়েছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পড়তে হবে, বাড়ি পৌঁছে একেবারে চান হবে।

    নোংরা চাদরটা তুলে, একটা পাশ খালি করে সেখানেই শুয়ে পড়লাম।
  • abcd | 24.139.163.173 | ০৮ এপ্রিল ২০১৮ ০৯:৫০370569
  • সিকিদা, ধন্যবাদ আর একখান রত্নের অনুসন্ধান দেওয়ার জন্য, উত্তরবঙ্গ। জানতামই না, আপনার ব্লগেও নেই।
  • Lama | 160.129.65.28 | ০৮ এপ্রিল ২০১৮ ১৩:২৯370570
  • বাহ।

    প্ল্যানটা মাথায় রেখো কমরেড
  • সিকি | ০৮ এপ্রিল ২০১৮ ১৫:০৬370572
  • আছে :)
  • সিকি | ০৯ এপ্রিল ২০১৮ ০৭:৩৭370574
  • ওটা টোটাল রহস্যজনক। ভুটান থেকে ফেরার দিন সেই যে নিজে থেকে ঠিক হয়ে গেল - আর কখনও জ্বালায় নি। পাঁচ মাস হয়ে গেল, দিব্যি আছি। ওষুধ বলতে খেয়েছিলাম দুটো কি তিনটে ফ্লেক্সন।
  • dd | 59.205.219.132 | ০৯ এপ্রিল ২০১৮ ০৭:৪৫370575
  • কিন্তু ফেলে রাখলে তো চলবে না। টেস্ট মেস্ট সব করাও বাপু।

    কোনো রাইভাল ভ্রমন লেখক কালা যাদু করে নি তো? একটা পুজোও দিও।
  • সিকি | 158.168.40.123 | ০৯ এপ্রিল ২০১৮ ০৯:১৮370576
  • পুজো? হ্যাঁ, দেবো - সেটা দিতে গেলে আবার ঐ তাওয়াং বমডিলা - ঐসব দিকে যেতে হবে। ঐখানে গিয়ে পুজো না দিলে আবার মর্মপীড় তুষ্ট হবেন্না। সেই প্ল্যানই ভাঁজছি।
  • avi | 57.11.182.89 | ০৯ এপ্রিল ২০১৮ ০৯:২৬370577
  • অনন্য লেখা। আর উত্তরবাংলা, সিকিম, ভুটানের প্রকৃতি যাকে একবার পেয়েছে, সে তো এজন্মের মতো তরে গেছে। এ জায়গাগুলোতে আমি এখন খেয়ালখুশিতে ঘুরে বেড়াই, সুন্দরভাবে ভিসুয়ালাইজ করলাম। আরো হৌক। :)
  • সিকি | 158.168.40.123 | ০৯ এপ্রিল ২০১৮ ১০:৫২370578
  • প্রায় মেরে এনিচি - আর মাত্র চার দিনের লগ লেখা বাকি, আশা করছি এ মাসের মধ্যে শেষ করে ফেলতে পারব। এর মধ্যে দুদিন স্রেফ ফেরার গল্প - কিন্তু সে-ও কোনও অংশে কম ঘটনাবহুল নয়।
  • amit | 213.0.3.2 | ০৯ এপ্রিল ২০১৮ ১১:২০370579
  • একটা কোশ্নো সিকি কে।

    লিখেছেন যে ভুটানে মোবাইল এর ন্যাভিগেশন কাজ করে না, কিন্তু এমনি জিপিএস ন্যাভিগেশন, মানে ন্যাভিমান বা টমটম, ও সব কাজ করে কি ? এতো ফরেন টুরিস্ট আসে ভুটানে, তারা কি করে ম্যানেজ করে ? অফলাইনে ম্যাপ নিয়ে লম্বা চালানো একটু ডিফিকাল্ট।
  • সিকি | 158.168.40.123 | ০৯ এপ্রিল ২০১৮ ১২:৫৮370580
  • হাল্কা সার্চ করে যা বুঝলাম - অফলাইন ছাড়া উপায় নেই। মোবাইলের নেভিগেশন বলে তো কিছু হয় না, নেভিগেশনটা প্রোভাইড করছে গুগল ম্যাপ। গুগল ম্যাপ কাজ করছে, জিপিএসের মাধ্যমে নিজের পজিশনও বুঝতে পারছি, কিন্তু ডেস্টিনেশন সেট করে যে "স্টার্ট নেভিগেশন" বাটন টিপে নেভিগেট করতে হয়, সেইটা মিসিং ভুটানের নেটওয়ার্কে। মোবাইলে যে সমস্যাটা হয়, নেভিগেশন মোডে না থাকলে কয়েক সেকেন্ড বা এক মিনিট বাদে মোবাইল আপনাআপনি নিভে যায়। একমাত্র নেভিগেশন চালু থাকলেই মোবাইল কন্টিন্যুয়াসলি অন থাকে। অন্য জিপিএস ডিভাইসে সে সমস্যাটা নেই - সাধারণত সেগুলোতে ডিসপ্লে অনই থাকে। তাই, পজিশন ধরে ধরে এগনো যায়, পাথও দেখিয়ে দেয় প্রথম রুট সার্চ করলে, সেই নীল দাগ ধরেও এগনো যায়, কেবল নেভিগেশন কাজ করে না। ম্যাপ নিজে নিজে এগোবে না আপনার সঙ্গে, টার্ন রাইট টার্ন লেফট ইত্যাদি বলবে না।

    আমি শুধু গুগল ম্যাপের পরিপ্রেক্ষিতে আমার এক্সপেরিয়েন্স লিখলাম, অন্যন্য জিপিএস ডিভাইস কীভাবে কাজ করে, বলতে পারব না। নেটে সার্চ মেরে দেখলাম ভুটানের জন্য অফলাইন নেভিগেশন ডিভাইস বিক্রি হচ্ছে অ্যামাজনে।
  • সিকি | ১১ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০৪370581
  • ৩রা নভেম্বর, পঞ্চদশ দিন
    ================

    পাসপোর্টে লেখা আছে, প্লেস অফ বার্থ, জলপাইগুড়ি। তবে কথাটা আজকের দিনে আর তেমন সত্যি নয়, কারণ আমার জন্ম হয়েছিল পাহাড়ে, আলিপুর দুয়ারে। তখন সেটা ছিল জলপাইগুড়ি জেলার একটা মহকুমা, আজ সেটা আলাদা একটা জেলা। যে মহকুমা হাসপাতালে আমার জন্ম হয়েছিল, সেটা আজ জেলা হাসপাতাল। যদিও আমার তেমন কোনও স্মৃতি নেই আলিপুর দুয়ারের, কারণ আমার যখন এক বছর বয়েস, তখনই বাবা ওখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে চলে আসে।

    আমার ছোটবেলা কেটেছে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর। তার কিছু কিছু জায়গা আজ ছুঁয়ে যাবার আছে। কলেজে পড়াকালীন এ পথে আমার কতবারের যাতায়াত হয়েছে, সমস্তই ট্রেনে যদিও, একবার উল্টোডাঙ্গা থেকে রকেট বাসে চেপেও এসেছিলাম, কিন্তু নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে উত্তরবঙ্গের একদা পরিচিত জায়গা থেকে দক্ষিণবঙ্গে আমার বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার থ্রিলটা সম্পূর্ণ আলাদা। দৈর্ঘ্যে পশ্চিমবঙ্গ বেশ লম্বা, কলেজ থেকে আমার বাড়ি পাঁচশো তেষট্টি কিলোমিটারের দূরত্ব। তাই, সকাল সকাল জার্নি শুরু করতে হবে – নইলে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে রাত্তির হয়ে যেতে পারে। আগামীকাল হুগলি চুঁচুড়া মিউনিসিপ্যালিটির কনফারেন্স হলএ আমার লাদাখ আর স্পিতি বেড়ানোর গল্পের বই সর্ষেদানায়, ইচ্ছেডানায় প্রকাশিত হবার দিন। হুগলিতে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু চিররঞ্জন সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছে, আমাকে শুধু সেখানে উপস্থিত থেকে ধন্য করতে হবে। কলকাতা থেকে গুরুচন্ডা৯ টিমের একগুচ্ছ বন্ধুবান্ধব আসছে, সরাসরি প্রেস থেকে আমার বই নিয়ে, নিজের বই এডিট করেছি হাজারবার, কিন্তু ছেপে বের হওয়া সে বই চোখে দেখব আগামীকালই, প্রথমবারের জন্য। এ উত্তেজনার সঙ্গে হয় তো কিছুটা তুলনা করা যায় নিজের সন্তানজন্মের ক্ষণের।

    ভোর পাঁচটাতেই ঘুম ভেঙে গেছিল, সাড়ে পাঁচটায় তৈরি হয়ে গেলাম। বাইরের মেন গেটের চাবি আমার কাছেই রাখা রয়েছে। নিচে মোটরসাইকেলে লাগেজ বেঁধেছেঁদে স্টার্ট দিয়ে বের করলাম। বাইরে থেকে আবার তালা লাগিয়ে চাবিটা, আগের দিনের কথামত ভেতরের ধাপিতে রেখে দিলাম।

    ক্যাম্পাস ঘুমোচ্ছে, লোকজন বিশেষ নেই। এক নিমেষে কলেজ ক্যাম্পাস পেছনে ফেলে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। রাস্তার এই অংশটার নাম কলেজ মোড়, বহু বহু রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের সাক্ষী, আমাদের সময়ের। বাঁদিকে চলে যাচ্ছে ময়নাগুড়ি যাবার পথ – যে পথ দিয়ে কাল আমি এসেছি, ডানদিকে শিলিগুড়ির রুট। আমাকে যেতে হবে এদিকে। শিলিগুড়ি শহরে ঢুকব না, বাইরে দিয়ে একটা বাইপাস হয়ে নেমে যেতে হবে নিচের দিকে।

    কলেজ থেকে একটু এগোতেই একটা Yএর মত রাস্তার কাট আছে, যেটার নাম আসাম মোড়। না, আলাদা করে আসামে যাবার কোনও রুট এদিক থেকে শুরু হয় নি, রাস্তা একটাই, কেবল Yএর ডানদিকের রাস্তাটা ঢুকে যাচ্ছে জলপাইগুড়ি শহরের ভেতর, মাষকলাইবাড়ি, শান্তিপাড়া হয়ে কদমতলার দিকে, আর বাঁদিকের রাস্তাটা ময়নাগুড়ি বাইপাসের, জলপাইগুড়ি শহরের বাইরে দিয়ে, আমাদের কলেজের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে – হ্যাঁ, এ রাস্তা দিয়ে আসাম যাওয়া যায় বৈকি। ভুটানও যাওয়া যায়।

    এই আসাম মোড়ে একটা পেট্রল পাম্প ছিল। জলুরই কোনও এক এক্স স্টুডেন্টের মালিকানায় চলত। ভাবলাম, সেখানেই মোটরসাইকেল আর জেরিক্যানের জন্য পেট্রল ভরে নেব, কিন্তু আসাম মোড়ে পৌঁছে দেখলাম পেট্রল পাম্পটি খোলে নি তখনও – বন্ধ। অতএব, আবার এগিয়ে গেলাম। একটু এগোতে মোহিতনগর সাবস্টেশন, জলু কলেজের ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই লাইন গেছে এখান থেকে, একবার কলেজের প্রফেসরের সাথে এখানে এসেছিলাম ট্রান্সফর্মার আর কী কী সব যেন দেখতে, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তাম তো। তো, সেই মোহিতনগর সাবস্টেশন এখনও একইরকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, মৈসে পড়া একদা-হলুদ-রঙের দেয়াল নিয়ে।

    মোহিতনগরের পর লোকালয় কমে এল, এর পরে শুধুই সরু রাস্তা শিলিগুড়ি যাবার জন্য। রাস্তাটা এখনও একই রকমের সরু আছে। দুদিকে ধানক্ষেত। মাঝে মাঝে একটা দুটো গ্রাম পড়ে, ফাটাপুকুর, রাধাবাড়ি, ফুলবাড়ি।

    একটা জিনিস মাথায় ঘুরছিল। এইটাই তো সেই সময় – তা হলে কাল দেখতে পাই নি কেন? আজ কি দেখা যাবে?

    কলেজে যখন পড়তাম, নভেম্বরের গোড়া থেকে ডিসেম্বরের দশ বারো তারিখ পর্যন্ত, উত্তরবঙ্গে শীত পড়ার আগে পর্যন্ত, চারপাশের আবহাওয়া যখন একদম পরিষ্কার হয়ে যেত, এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা যেত আমাদের ক্যাম্পাস থেকে, বা বলা যায়, দোতলা ব্যাক উইংয়ে আমার ঘর থেকে।

    কাঞ্চনজঙ্ঘা। সম্পূর্ণ কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ সেই সময়ে প্রতিদিন দেখা যেত, কত যে দেখেছি ভোর থেকে উঠে হস্টেলের ছাদে বা টেরেসে বসে, সূর্যোদয়ের মুহূর্তে, টকটকে লাল থেকে কাঁচা সোনার রঙ, তার পরে পাকা সোনা, তার পরে রূপোলী ঝিলিক মেরে ধীরে ধীরে সাদা হয়ে যাওয়া কাঞ্চনের চূড়া। আবার বিকেল বেলায় রঙগুলো ফিরে আসত উলটো অর্ডারে। দিনের পর দিন দেখেছি।

    আজ তেসরা নভেম্বর। এই তো সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাবার, ডানদিকে চোখ রাখলেই দেখতে পাবার কথা, … হ্যাঁ, ওই তো দেখা যাচ্ছে, খুব প্রমিনেট নয় যদিও, আবছামতন, কিন্তু উত্তরবঙ্গ আমাকে নিরাশ করল না, ধানক্ষেত আর গাছপালার পেছনে ধবধবে সাদা রঙের ওই তো দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনকে। এর থেকে বেশি স্পষ্ট হবার সময় আসে নি এখনও, নভেম্বরের শেষদিকে আরও ভালো ভিউ আসে, কিন্তু আজ এই সময়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার সকালের রূপ দেখে আমার মনে হল, আমার উত্তরবঙ্গ ফিরে আসা এতক্ষণে সার্থক হল। আর কোনও অতৃপ্তি নেই।



    ফুলবাড়ি এখন শিলিগুড়ির আউটস্কার্টে বেশ বড়সড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব। গ্রাম পঞ্চায়েতই আছে, কিন্তু গ্রাম্য ভাবটা আর নেই, এটা শিলিগুড়ি শহরের একদম শুরু, এখান থেকে তৈরি হয়েছে বিশাল চওড়া এক্সপ্রেসওয়ে – ফুলবাড়ি-ঘোষপুকুর বাইপাস, যেটা শিলিগুড়ি শহরের বাইরে দিয়ে একদম নিয়ে গিয়ে ফেলে আমাদের চিরপরিচিত এন এইচ সাতাশে, যেটা আমাকে নিয়ে যাবে দক্ষিণবঙ্গের দিকে।

    ফুলবাড়ি থেকে বাইপাস ধরে উড়িয়ে দিলাম গাড়ি – দু পাশে পর পর চা বাগান, একটা শেষ হলে আরেকটা, সেটার পরে আরেকটা। ট্র্যাফিক নেই খুব বেশি, অসাধারণ রাস্তা। … একটা জিনিস বুঝলাম, আগে জানতাম চা বাগান শুধু দার্জিলিং আর জলপাইগুড়ি জেলাতেই আছে (এখন আলিপুর দুয়ারকেও ধরতে হবে) – কিন্তু আসতে গিয়ে দেখলাম উত্তর দিনাজপুর পর্যন্ত চা বাগান রয়েছে।

    অনেকটা চলার পরে একসময়ে বাইপাস শেষ হল, পূর্ণিয়া কিষেণগঞ্জ লেখা বোর্ড সামনে এল। এই রাস্তাও পুরোটা চলার নয়, ইসলামপুর পেরোবার পরে ধানতলা বলে একটা জায়গা পড়বে, সেইখান থেকে ডানদিকের রাস্তা নিয়ে পরের হাইওয়ে ধরতে হবে। এমনিতে এই সোজা রাস্তা সোজা বিহার হয়ে গোরখপুরের দিকে যাচ্ছে, যে রাস্তা দিয়ে আমি তেরো দিন আগে এসেছিলাম।

    ইসলামপুর পেরিয়ে জিপিএসের দিকে চোখ রাখছি, চওড়া হাইওয়ে, বাঁ পাশে ইতস্তত দুটো একটা গ্রাম, সামান্য কয়েকটা বাড়ি, গোটাদুই দোকান, তার পরে আবার ফাঁকা – ঠিক যে জায়গাটায় বাঁদিকে বেঁকতে বলল, সেখানে আমি কোনও কাটই দেখতে পেলাম না, এমনিই ইতস্তত বাড়িঘর, তার মাঝখান দিয়ে এদিক ওদিক গলি – ভাঙাচোরা খোয়া ওঠা সরু রাস্তা মত – সেগুলো কোনওমতেই কলকাতা যাবার রাস্তা হতে পারে না। জিপিএস নিশ্চয়ই ভুল কিছু দেখাচ্ছে, সোজা খানিক এগিয়ে যাই, আগে নিশ্চয়ই আবার রাস্তা আছে কোনও, জিপিএস হয় তো আগে আগেই কাট দেখাচ্ছে, কাট হয় তো পরে কোথাও আছে।

    এগোতে থাকলাম, জিপিএসে দেখলাম আমি কাট পেরিয়ে চলে যাচ্ছি, এক কিলোমিটার, দুই কিলোমিটার – তার পরে দেখি জিপিএস রিক্যালকুলেট করে আমাকে বলছে চার কিলোমিটার আগে থেকে ইউ টার্ন নিয়ে আবার আগের পয়েন্টে এসে সেখান থেকেই টার্ন নিতে বলছে।

    এ তো মহা মুশকিল হল। আমি তো কাট বুঝতেই পারছি না – তা হলে কি ফিরে গিয়ে ওখানে কোনও লোককে জিজ্ঞেস করে দেখব? … তাই করা যাক।

    চার কিলোমিটার আরও এগিয়ে যেতে হল ইউ টার্ন নেবার জন্য – আমার ডানদিকে তখন গাইসাল স্টেশন, ঘুরে গিয়ে আবার ছ কিলোমিটার ফেরত এলাম, আবার ডিভাইডারের মাঝে পরের কাট খুঁজে সেই জায়গায় ফেরত এলাম, যেখানে জিপিএস আমাকে বলছে বাঁদিকে যেতে।

    একটা ভাঙাচোরা পাথর বের করা সরু রাস্তা, সামনে একটা গার্ড রেলিং দাঁড় করানো, পাশে একটা লোক বসে আছে। মোটরসাইকেল থামিয়ে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম – আচ্ছা, মালদা যাবার জন্য কি এইটাই রাস্তা?

    লোকটা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ, এই রাস্তা ধরে সোজা –

    আমি হতবাক। এই রাস্তায় কী করে যাবো? আবার জিজ্ঞেস করলাম – রাস্তা কি আগে এই রকম ভাঙাচোরা? লোকটা আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, না না, এই দুশো মিটার মতন ভাঙা আছে, আগে একদম ফাইন রাস্তা পাবেন, ওই বাঁকের পর থেকেই ভালো রাস্তা শুরু। এই গার্ড রেলিংয়ের পাশ দিয়ে চলে যান সোজা।

    সাহসে ভর করে হ্যান্ডেল ঘোরালাম বাঁদিকে। লোকটা ঠিকই বলেছিল – ঠিক দুশো মিটার বাদেই সুন্দর রাস্তা শুরু হয়ে গেল। একদম স্মুথ। খানিকটা এগোতেই মকদমপুর বলে একটা জায়গাতে গিয়ে সেই রাস্তা আবার ন্যাশনাল হাইওয়েতে পড়ল – এটাই বোধ হয় এন এইচ থার্টি ফোর, উত্তরবঙ্গের সাথে দক্ষিণবঙ্গের কানেক্টর রাস্তা। হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি, বড় বড় সাইনবোর্ডে লেখা মালদা, বহরমপুর, ফারাক্কার নাম। জয় গুরু, চালাও পানসি।

    রাস্তা এখান থেকে বেশ চওড়া, ন্যাশনাল হাইওয়ে যেমন হওয়া উচিত আর কি। সকাল থেকে খাওয়া দাওয়া হয় নি কিছু, কাল রাতে জলপাইগুড়িএ রেস্তরাঁয় গলা পর্যন্ত ঠেসে খেয়েছি, তাই দিয়েই চলছে এখনও। মনে মনে ঠিক করলাম, ফারাক্কা পেরিয়ে একেবারে লাঞ্চ করব, দেখি না, ওদিকে কোনও লাইন হোটেলে যদি ভালো মাছভাত পেয়ে যাই। ঠিকঠাক এই স্পিডে চললে বেলা সাড়ে বারোটার মধ্যে মালদা টাউন, আর দেড়টার মধ্যে তো ফারাক্কা পৌঁছে যাবই।

    রাস্তা মোটের ওপর ভালো, কখনও কখনও বড়সড় গর্ত, কোথাও কোথাও রাস্তা সারাইয়ের কাজ চলছে, কোথাও বা রাস্তা আবার সরু হয়ে গেছে লোকালয়ের মধ্যে – তাই সেইমত স্পিড বাড়িয়ে কমিয়ে চলতে থাকলাম। রায়গঞ্জ এসে গেল এক সময়ে। মালদা আর ষাট কিলোমিটার মত দেখাচ্ছে।

    এর পরে এল গাজোল। আমার খুব পরিচিত একজন এই গাজোলে ল্যান্ড রেভিন্যু অফিসার হিসেবে কাজ করতেন এক সময়ে। অনেক গল্প শুনেছি গাজোলের, তাঁর কাছ থেকে, সেই গাজোলে এখন আমি দাঁড়িয়ে – এখান থেকে মালদা টাউনের দূরত্ব আরও কম – আর মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার।

    চাপটা শুরু হল সেখান থেকে। মালদা শহরের ওপর দিয়ে গেছে এই ন্যাশনাল হাইওয়ে, রথতলা হয়ে – আর মোটামুটি গোটা শহরটা এই হাইওয়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। রাস্তাও এখানে সরু, এলোপাথাড়ি ট্র্যাফিক, জাস্ট এগোবার কোনও রাস্তা নেই, এ ওর গায়ে সে তার ওপর দিয়ে – সে মানে বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার। তার ওপরে দেখলাম মালদায় একটা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হয়েছে, একেবারে হাইওয়ের পাশে, সেখানে জ্যাম আরও ভয়াবহ, দুর্বিষহ।

    স্রেফ মালদার কয়েক কিলোমিটার পার করতে আমার চল্লিশ মিনিট খরচা হয়ে গেল। দেড়টা বাজে। ফারাক্কা এখান থেকে এখনও পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূর। এ জ্যাম কতক্ষণে কাটবে, কে জানে!

    কাটল, রথতলার সেই ভয়াবহ মোড় থেকে আরেকটু এগিয়ে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এসে ট্রাফিক একটু হালকা হল। মোটরসাইকেলে আবার স্পিড তুললাম।

    খিদের চোটে মাথা ঘুরছে প্রায়, ফারাক্কা ব্যারেজ আসব আসব করছে, ঠিক সেই সময়েই বাঁদিকে দেখলাম বেশ খোলা চত্বরের পাশে একটা ধাবা, ঠিক যেখানে বসে খেতে খেতে মোটরসাইকেলের দিকে নজর রাখা যায়।

    গোগ্রাসে খেলাম মাছ আর ভাত। শেষে মাংস আছে জানতে পেরে একবাটি খাসির মাংসও চেয়ে নিলাম, আর তিনবার করে ঝুরো ঝুরো আলুভাজা চাইতে হল। গলা পর্যন্ত ঠেসে খেয়ে আবার বেরিয়ে যখন গাড়িতে স্টার্ট দিলাম, তখন আড়াইটে বাজে। আর ঠিক এক কিলোমিটার দূরেই শুরু হচ্ছে ফারাক্কা ব্যারেজ। যখন জলুতে পড়তাম, আসা যাওয়ার পথে এই পর্যন্ত জেগে থাকতেই হত, চারদিকে উজ্জ্বল আলোয় ঝকমক করা ফারাক্কা ব্যারেজ আর তার পাশে এনটিপিসির এলাকা দেখার জন্য।

    সেই ব্যারেজ আজ দিনের আলোয় পার করছি, নিজের মোটরসাইকেলে চেপে। কী নিদারুণ সে অভিজ্ঞতা! রাস্তা বলে কিছু নেই, এবড়োখেবড়ো খোয়া ওঠা একটা পথ, এত আস্তে যেতে হচ্ছে তাতেও ঝাঁকুনি কমছে না, এদিকে এত খেয়েছি যে সামান্য ঝাঁকুনিও অসামান্য হয়ে দেখা দিচ্ছে – রাস্তা এত সরু যে সোয়া দু কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই ব্রিজের ওপর আমি একবারের জন্যও একটা গাড়িকে ওভারটেক করতে পারলাম না, পনেরো কুড়ির স্পিডে পুরোটা চলে তবে ভালো রাস্তা পেলাম আবার।

    আমার ছোটবেলার এলাকা, আবার। উনিশশো তিরাশি থেকে পঁচাশি আমি থাকতাম রঘুনাথগঞ্জে। বাবার অফিসের জীপগাড়িতে চেপে আমি বোধ হয় কতবার এসেছি ফারাক্কা ধূলিয়ান আহিরণ বহরমপুর খাগড়া নিমতিতা। পুরো স্মৃতি নেই, কারণ তখন আমার বয়েস ছিল নিতান্তই পাঁচ সাত বছর, কিন্তু ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি রয়ে গেছে, যাদের সঙ্গে আজকের মুর্শিদাবাদকে মিলিয়ে দেখার আর কোনও উপায় নেই।

    আমার ছোটবেলা পশ্চিমবঙ্গের যে সমস্ত জেলায় ছড়িয়ে আছে, তার মধ্যে সেরা জায়গা ছিল এই মুর্শিদাবাদ। পেটি পেটি আম আসত ঘরে, লিচু আসত, কাঁঠাল আসত, আর একটা কিছু আমাদের পয়সা দিয়ে কিনে খেতে হত না – সব এর ওর তার বাগানের ফল। খেয়ে খেয়ে গরমকাল ফুরিয়ে যেত, ফলের স্টক শেষ হত না। … আর, ইলিশ। বাবা অফিসের কাজে যেত ধূলিয়ান, একদিন রাত এগারোটার সময়ে ফিরল, হাতে ঝোলানো এক মা ইলিশ আর খোকা ইলিশ, পদ্মা থেকে ধরে আনা। তখন ফ্রিজ ছিল না, গ্যাস ওভেন ছিল না, মা আবার কয়লা বসিয়ে ঘুঁটে ধরিয়ে উনুন সাজাল – অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সকালে উঠে ইলিশ মাছ ভাজা খেয়েছিলাম, আর যখন তখন ইলিশ মাছের পার্বণ তো তখন নিত্যিকার ব্যাপার ছিল – এতটাই ইলিশ পাওয়া যেত।

    অনেক, অনেক মণিমুক্তো ছড়ানো আছে আমার মুর্শিদাবাদে, রঘুনাথগঞ্জ স্কুলের হেডস্যার, আমাকে নিজের ছেলের মত ভালোবাসতেন – বাবার আবার যেদিন বদলি হয়ে যাবার দিন এল, আমরা বাক্স তোরঙ্গ গোছাচ্ছি, হেডস্যার সাইকেল চেপে এলেন আমাদের কোয়ার্টারে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ হেডস্যারের দু চোখে জল দেখে বাচ্চা-আমি যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম, আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন দুটো বই – যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে আর ফটিকচাঁদ – আর একটা দামী আর্টেক্স পেন, স্যার আর্টেক্স পেনের দিওয়ানা ছিলেন, ওই পেন কিনিয়ে দিনের পর দিন আমার পেছনে লেগে থেকে আমার হাতের লেখা সুন্দর করে ছেড়েছিলেন। স্যারের দুই মেয়ে ছিল, আমাকে নিজের ছেলের মত ভালোবাসতেন। … এত ভালোবাসা পেয়েছি, এত ভালোবাসা – আমার তবলা শেখার শুরু সেখানে, অনিলদা, আমার তবলার প্রথম গুরু, সর্বক্ষণ হাসি ফাজলামি ইয়ার্কি আর মুক্তোর মত হাতের লেখায় তবলার বোল লিখে দিত আমার খাতায়, আমি তো বাচ্চা ছিলাম, সে খাতার যত্ন রাখতে পারি নি, তিন বছরে ছিঁড়ে গেছিল, আমরা চলে আসার দিন সেই অনিলদা কেঁদেছিল, নতুন একটা বাঁধানো খাতায় – তখন পত্রালি, বঙ্গলিপি, নবলিপি – এইসব নামের খাতা পাওয়া যেত, সেই রকম কোনও একটা খাতায় আমার তিন বছরে শেখা সমস্ত তবলার বোল আবার প্রথম থেকে যত্ন করে লিখে দিয়েছিল তার সবুজ রঙের কালির পেনে। … বড় হয়ে কতবার ভেবেছি একটিবার মুর্শিদাবাদে যাবো, সেই হেডস্যার আর অনিলদার সাথে আরেকবার দেখা করব – আজও যাওয়া হয় নি।

    হুড়মুড়িয়ে মাথা বেয়ে নেমে আসছে পুরনো স্মৃতিরা, আর আমি ফারাক্কা ব্রিজ পেরিয়ে চলেছি আরও দক্ষিণে, ধূলিয়ান, নিমতিতা, সুতি, ঔরঙ্গাবাদ, আহিরণ – ইতিহাসের জায়গা সব, নামগুলো দেখছি বোর্ডে – আর কত কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ছোটবেলার। কেমন ছিল তখনকার রাস্তাঘাট – মনে পড়ে না, বাবার অফিসের জীপগাড়ির চারপাশ খোলা ছিল, খুব ধূলো মাখতাম গাড়িতে বসে বসেই, এটুকু মনে আছে।

    রঘুনাথগঞ্জের খুব কাছেই উমরপুর। আমরা প্রথম যখন মুর্শিদাবাদে আসি – বাবার ট্রান্সফার হয়েছিল বর্ধমান থেকে, তখনও রঘুনাথগঞ্জে আমাদের ডেজিগনেটেড কোয়ার্টার খালি হয় নি, একমাস মত আমাদের থাকতে হয়েছিল এই উমরপুরে পিডাব্লুডির বিশাল বড় বাংলোতে। বড়রাস্তার ওপরেই ছিল সেই বাংলোটা। উমরপুর পেরিয়ে এলাম এইমাত্র, কিন্তু বাংলোটা ঠিক কোথায় ছিল, আর মনে করতে পারলাম না।

    মোরগ্রাম থেকে জিপিএস আমাকে বলল ডানদিকের রাস্তা নিতে। যদিও সামনে বড় বড় সাইনবোর্ডে লেখা আছে সোজা রাস্তা বহরমপুর কৃষ্ণনগর হয়ে কলকাতা যাচ্ছে – এন এইচ থার্টি ফোর, কিন্তু জিপিএস দাবি করছে ডানদিকের রাস্তা নিতে হবে।

    নিলাম। একটুখানি ডানদিকে বেঁকেই আবার বাঁদিকে টার্ন। স্টেট হাইওয়ে সেভেন। দাঁড়ালাম। কী করা উচিত? স্টেট হাইওয়েই নেব, নাকি ফিরে যাব চেনাপরিচিত এন এইচ থার্টি ফোরে?

    ফোন বাজছে, বাবা ফোন করেছে, বললাম, উমরপুর পেরিয়ে এসেছি একটু আগে, সন্ধ্যে তো হবেই বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে, আমি ছটা নাগাদ ফোন করে আমার পজিশন জানিয়ে দেব।

    জিপিএসে রাস্তা স্ক্রোল করে দেখলাম, অনে-কদূর গিয়ে এই রাস্তা গিয়ে পড়েছে বর্ধমানে। আর, বর্ধমান মানেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে, সেখানে একবার গিয়ে পড়লে আর বাড়ি পৌঁছতে কতক্ষণ! এই স্টেট হাইওয়েতে আমাকে মাত্র একশো পঁচিশ কিলোমিটার যেতে হবে।

    মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে নিলাম এস এইচ সেভেনের দিকে।

    রাস্তাটি বড় মনোরম, টিপিকাল গাছে ঘেরা পুকুরপাড়, আধপাকা বাড়িঘর, গ্রামবাংলার রূপ ছড়ানো চারদিকে, তার মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে যাচ্ছে পরিচ্ছন্ন পরিপাটি রাস্তা, পিডাব্লুডি মেনটেন করে। দুদিকে গ্রামের বাড়িঘর পেরিয়ে যতদূর চোখ যায়, শুধু ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। গাড়িঘোড়া খুব কম, চালাতে কোনও অসুবিধেই হচ্ছে না, কেবল মাঝেমধ্যে ট্রাক সামনে চলে এলে তাকে ওভারটেক করাটা প্রায় দুঃসাধ্য কাজ হয়ে যাচ্ছে, কারণ রাস্তা বেশ সরু।

    বেলুয়া, রাজমহল, বুড়াডাঙ্গা এইসব নামে গ্রাম পেরিয়ে হঠাৎ একটা বাজার মত এলাকা এল, আর রাস্তা ভয়ঙ্কর খারাপ হয়ে গেল। ইঁট বের করা, এবড়োখেবড়ো – লাগেজভর্তি মোটরসাইকেল নিয়ে তার ওপর দিয়ে চলা – সে এক বিড়ম্বনাবিশেষ। অবশ্য এক কিলোমিটার বাদে, বাজার শেষ হতেই রাস্তা আবার ভালো হয়ে গেল, আবার স্পিড তোলা গেল।

    কিন্তু সুখ বেশিক্ষণ সইল না, ক্রমশ এল খড়গ্রাম বলে একটা জায়গা, আর সেইখানে সেই যে খারাপ রাস্তা শুরু হল – সে আর শেষ হতেই চায় না। লোকালয় শেষ হয়ে গেল, তবু রাস্তা আর ঠিক হয় না, মনে হল বছর কুড়ি আগে একবার রাস্তা বানানো হয়েছিল – তার পরে আর কোনওদিন তাকে রিসারফেস করা হয় নি, এদিকে বিকেল সাড়ে চারটে বাজে, নভেম্বরের বিকেল – আরেকটু পরেই তো অন্ধকার নেমে যাবে, আমি মনে হচ্ছে এখনও মুর্শিদাবাদ জেলা ছেড়ে বেরোইই নি, – মরিয়া হয়ে স্পিড তোলার চেষ্টা করলাম, … না, সম্ভব না, মোটরসাইকেল সোজা রাখাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে, অতএব, আবার আস্তে আস্তে, পনেরো-কুড়ির স্পিডে।

    শেষরক্ষা হতে গিয়েও হল না, কোনও এক বাজারের মধ্যে, সরু রাস্তার প্রায় পুরোটাই জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক বড়সড় ডাম্পার। তার পাশ দিয়ে – মনে হল জায়গা আছে, বেরিয়ে যেতে পারব, সেইমত হ্যান্ডেল বাঁকিয়ে বেরোতে যেতেই ‘টং’ করে এক জোরালো শব্দ, পেছন ফিরে দেখি – লাগেজ ক্যারিয়ার সমেত মোটরসাইকেলের প্রস্থ আন্দাজ করতে ভুল করেছিলাম, ক্যারিয়ারের বাঁপাশটা ধাক্কা খেয়েছে ডাম্পারের সামনে।

    পড়তে গিয়েও পড়লাম না, স্পিড বেশি ছিল না বলে, সামলে নিলাম। এবার ক্লান্ত আর হতাশ লাগছে – এই খারাপ রাস্তার কি শেষ নেই? তাও তো দিনের আলো রয়েছে এখনও, এর পরে অন্ধকার নামলে এই রাস্তায় চলব কী করে?

    ভাবতে ভাবতেই দেখি আবার ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তা ফিরে এল, একটা বাজার পেরোতেই – প্রায় দশ পনেরো কিলোমিটার রীতিমত এবড়োখেবড়ো খোয়া বের করা রাস্তার ওপর দিয়ে চালিয়েছি আমি। এদিক ওদিক দুএকটা সাইনবোর্ড দেখেও জায়গাটার নাম বুঝে উঠতে পারলাম না, কোনও একটা গ্রাম হবে। একটু পরেই এক সরু নদীর ওপর একটা ছোট্ট ব্রিজে উঠলাম – জিপিএসে দেখলাম, নদীটার নাম ময়ূরাক্ষী। এত সরু?

    এর পর আর খারাপ রাস্তা নেই – খানিক পরে মঙ্গলকোট পেরোলাম, বর্ধমান এখান থেকে আর বত্রিশ কিলোমিটার, প্রায় মেরে এনেছি, আর সেখানেই সন্ধ্যে হল। এত সুমধুর সন্ধ্যে আমি আর কখনও দেখি নি, সরু রাস্তা, দুদিকে আদিগন্ত ধানক্ষেত আর ইতিউনি কিছু তাল নারকোল টাইপের গাছ দেখা যাচ্ছে – সেই ধানক্ষেতের পেছনে কমলা থেকে লালচে হয়ে, সারা আকাশকে লাল রঙে রাঙিয়ে সূর্য ম্লানমুখে ডুব দিল। একটা নির্মেঘ আকাশে স্পষ্ট সূর্যাস্ত দেখলাম, খানিকক্ষণের জন্য চলা থামিয়ে।

    সূর্য ডুবতেই তাপমাত্রা কমে এল বেশ খানিকটা, তবে আমার রেনগীয়ার পরা আছে, খুব অসুবিধে কিছু হল না, ওটাই উইন্ডচীটারের কাজ করে।

    মঙ্গলকোট পেরিয়ে এল ভাতার, আর তার পরেই একটা তিন মাথার মোড় এল, বাঁদিকে চলে যাচ্ছে কাটোয়ার রাস্তা, সোজা বর্ধমান। রাস্তা এখনও পর্যন্ত বেশ ভালো – বর্ধমান পর্যন্ত যদি ঠিকঠাক রাস্তা পেয়ে যাই তো আর চিন্তা নেই, তার পরেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে।

    ক্রমশ লোকবসতি বাড়ছে, সরু রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও বাড়ছে, অটো, মিনিবাস দেখা যাচ্ছে বর্ধমানগামী। বর্ধমান আসছে, আসছে, হঠাৎ কোথা হইতে কী হইয়া গেল, একটা মোড় ঘুরতেই দেখি তুমুল গাড়িঘোড়া, আমি একটা ফ্লাইওভারের ওপর উঠে গেলাম, আর নিচে একটা রেলস্টেশন, ফ্লাইওভারের পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্টেশনের সাইনবোর্ড – বর্দ্ধমান জং। আমি একেবারে বর্ধমান স্টেশনের মাথায়। ফ্লাইওভার আমাকে নামাল তিনকোনিয়া বাসস্ট্যান্ডের পাশটিতে, চারপাশে অগুন্তি মিষ্টির দোকান, বারকোশে করে সীতাভোগ আর মিহিদানা বিক্রি হচ্ছে চতুর্দিকে। … কিনব একটু? না, একেবারে না, তিনকোনিয়া বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে যে সব মিষ্টির দোকান থাকে, তাদের থেকে নাকি আসল সীতাভোগ মিহিদানা পাওয়া যায় না, আসল সে জিনিস নাকি পাওয়া যায় বর্ধমান শহরের বিশেষ একটা দুটো দোকান থেকে। আর এই ভিড়ের মধ্যে লাগেজবাঁধা মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে দোকানে ঢোকাও রিস্কি। তিনকোনিয়া পেরিয়ে তাই এগোতে থাকলাম – মাঝে উঁচু ডিভাইডার আর রেলিং দেওয়া রাস্তা, এগোতে এগোতে হঠাৎ দেখি আমার ডানদিকে কার্জন গেট! আরে, তাই তো!

    এই বর্ধমানও আমার ছোটবেলার জায়গা। মুর্শিদাবাদের আগে থাকতাম বর্ধমানে। উত্তমকুমার যে বছর মারা যান, সেই বছরে আমরা আসি এখানে, কোয়ার্টার পাওয়া যায় নি – নতুন পল্লীতে এক বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম। কার্জন গেট পেরিয়ে একটু এগোলেই বাঁ হাতে একটা সিনেমাহল ছিল – মৌসুমী সিনেমা। সেইখানে বাবামায়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেছিলাম, ওগো বধূ সুন্দরী। …

    … তখন আমি সবে প্রথম ভাগ শেষ করেছি। সাড়ে তিন বছর বয়েস। সিনেমা শুরুর মুখে পর্দায় বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে, তখনকার দিনের কাপড়ের ব্র্যান্ড – স্টানরোজ। এখন বোধ হয় আর সে ব্র্যান্ড নেই, তো যাই হোক, স্টানরোজ লেখাটা এমন স্টাইল করে লেখা ছিল, প্রথম বানান করে পড়বার মজায় আমি হল কাঁপিয়ে চীৎকার করে পড়েছিলাম – সটানরোজ, আর হলশুদ্ধু লোক হ্যাহ্যা করে হেসে উঠেছিল। আমি তখনও যুক্তাক্ষর পড়তে শিখি নি আসলে। পরের দিন বাবা আমাকে বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ এনে দিয়েছিল।

    এই মৌসুমী সিনেমার ঠিক সামনেই একটা স্কুল ছিল, বাণীপীঠ বিদ্যালয়। আমার প্রথম স্কুল, কেজি টু পড়েছিলাম এখানে, উনিশশো বিরাশি সালে, তার পরে আমরা মুর্শিদাবাদ চলে যাই। গুগল ম্যাপ খুঁজেও আর সেই বাণীপীঠ স্কুল বা মৌসুমী সিনেমা হলের দেখা পেলাম না। বর্ধমানের কেউ থাকলে জানাবেন তো, তারা এখনও আছে কিনা।

    বর্ধমান শহরের একদম মাঝখান দিয়ে ট্র্যাফিক ঠেলতে ঠেলতে এক সময়ে পেয়েই গেলাম দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েকে – ব্যস, এইবারে আমার চেনা রাস্তা। আবার স্পিড তোলা গেল। প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে, ঘণ্টা দেড়েক আরও তো লাগবেই। শক্তিগড় পেরিয়ে মেমারীতে একটা কাট আছে, যেটা দিয়ে আদি জিটি রোড ধরে পাণ্ডুয়া বৈঁচি হয়ে ব্যান্ডেল ঢোকা যায়, কিন্তু সে বড় ভয়ংকর রাস্তা – ভাঙাচোরা। তার চেয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে সিঙ্গুর দিয়ে ঢোকা ভালো, একদম টিপটপ রাস্তা, সিঙ্গুর নসিবপুর পেরিয়ে সোজা নিয়ে ফেলবে চন্দননগরের দিল্লি রোডে, সেখান থেকে আবার একটু বাঁদিকে পিছিয়ে এসে সুগন্ধ্যা হয়ে চুঁচুড়া ঢোকা ভালো। সুগন্ধ্যা থেকে চুঁচুড়া স্টেশনের তলা দিয়ে খাদিনা মোড়, সেখান থেকে আবার বাঁদিক নিলেই আদি জিটি রোড ধরে সোজা আমার বাড়ি। এ তল্লাটের প্রতিটা রাস্তা প্রায় আমার চেনা।

    শক্তিগড় পেরোল, দুপাশে সেই বিরক্তিকর ল্যাংচা হাব। অগুনতি ল্যাংচার দোকান সারি সারি, লোকে গাড়ি মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে হাম হাম করে ল্যাংচা খাচ্ছে। কী বাজে খেতে – আগের বারে যাওয়া এবং আসার পথে দু বারই চারটে আলাদা দোকান থেকে খেয়ে দেখেছিলাম, অতীব জঘন্য খেতে হয়। বরং এরা সকালবেলায় কচুরি আলুরদম করে, সেইটা উমদা খেতে হয়, কিন্তু এখন তো আর সকাল নয়, আর এই ভিড়ের মধ্যে মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে খাওয়ারও ইচ্ছে নেই। অতএব এগিয়ে গেলাম।

    চওড়া দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে রাতের অন্ধকারেও দারুণ রঙীন। দু পাশে কিছুদূর অন্তর অন্তর ফুড জয়েন্ট, ধাবা। দুদিক দিয়ে হু হা স্পিডে বেরিয়ে যাচ্ছে বাঁকুড়া, শিলিগুড়ি কি বহরমপুর থেকে আসা রকেট বাসের দল। মেমারীর কাটও পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম, এমনিতেও, বোধ হয় রাস্তা ভালো নয় বলেই, জিপিএসও এই রুট সাজেস্ট করছে না – সোজা এগিয়ে যেতেই বলছে।

    অনেকটা যাবার পরে জিপিএসের কথামত বাঁদিকের রাস্তা ধরে নিলাম। যদিও আশেপাশে কোথাও সিঙ্গুর লেখা বোর্ড দেখতে পেলাম না, এখানে একটা বড় বোর্ড থাকার কথা ছিল। যাক গে, পরিষ্কার দেখছি সোজা রাস্তা – আর বোর্ড দেখে কী হবে।

    চলতে থাকলাম, গ্রামের রাস্তা, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, কিন্তু বেজায় সুন্দর, মসৃণ রাস্তা। একটা সময়ে দিল্লি রোডের কাটও পেয়ে গেলাম, সেখান থেকে বাঁদিক নিতে হবে। এবং এর পরের মোড় – সুগন্ধ্যার মোড় থেকে ডানদিক নিতে হবে।

    নিলাম। এইবারে একটু এগোলেই চুঁচুড়া ধান্য গবেষণা কেন্দ্র আর তার পরেই চুঁচুড়া স্টেশন। কিন্তু রাস্তাটা কেমন অচেনা ঠেকছে কেন? চলতে চলতে একটা সময়ে হঠাৎ দেখি জিপিএস আমাকে বলছে সামনে একটা তিনমাথার মোড় আছে, সেখান থেকে ডানদিকে বেঁকতে।

    এইখানে খটকা লাগল – ডানদিক কেন? ডানদিকে তো কোথাও বেঁকার কথা নয়!

    এগিয়ে গেলাম – সরু সরু তিনটে রাস্তার সংযোগস্থল, মাঝখানে শরৎচন্দ্রের একটা আবক্ষ মূর্তি বসানো। … নাঃ, মিলছে না তো, সিঙ্গুর ধনেখালীর রাস্তায় কোথাও তো এমন তিনমাথার মোড়ে শরৎচন্দ্রের মূর্তি ছিল না!

    তা হলে কী করব – ডানদিকে যাবো, না বাঁদিকে? যাক, জিপিএস যা বলে বলুক, আটটা পনেরো বাজে, আমি বাঁদিকেই টার্ন নিই।

    নিলাম, খানিকদূর এগিয়ে আরও কেমন অচেনা লাগল। জিপিএস বারবার বলছে ইউ টার্ন নিয়ে উল্টোদিকে ফিরতে। একবার দাঁড়িয়ে স্ক্রোল করে দেখলাম মোবাইলে, আমার বাড়ি নাকি এখান থেকে আর মাত্র তিন কিলোমিটার! … ঠিক দেখাচ্ছে তো! কী করে হয়?

    মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে আবার ফিরে গেলাম সেই তিনমাথার মোড়ে, আর তখনই বিদ্যুৎচমকের মত মাথায় এল, তবে কি, তবে কি আমি সিঙ্গুর পর্যন্ত যাইই নি? এটা তার আগের কাট?

    জিপিএসে কথা মত ডানদিকের রাস্তাই নিলাম, এবং কিছুদূর এগোতেই রেললাইনের নিচে আন্ডারপাস পেয়ে গেলাম, খুব খুব চেনা আন্ডারপাস – কিন্তু না, এটা চুঁচুড়া স্টেশনের আন্ডারপাস নয়, ওপরে বড় করে সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে, ব্যান্ডেল জংশন।

    এতক্ষণে পুরো গল্পটা ক্লিয়ার হল। আমি সিঙ্গুরের কাট পর্যন্ত যাইই নি, বেলমুড়ি থেকে ধনেখালীর রাস্তা নিয়েছি, যেটা সিঙ্গুরের রাস্তার মতই সরু। সিঙ্গুর পেরিয়ে নসিবপুর পেরিয়ে যেখানে রাস্তাটা দিল্লি রোডে এসে মেশে, ধনেখালীর রাস্তাও একইভাবে দিল্লি রোডে এসে মেশে, কিন্তু সেই মোড়টাই সুগন্ধ্যার মোড়। আমি যেখান থেকে বাঁদিক নিয়ে পরের মোড়কে সুগন্ধ্যার মোড় ভেবে ডানদিক নিয়েছিলাম, সেটা আসলে ছিল পোলবার মোড়, আমি পোলবা হয়ে কোরোলা কাজিডাঙা পেরিয়ে এইমাত্র দেবানন্দপুরের মোড় থেকে ডানদিক নিলাম, তাইজন্য ওখানে শরৎচন্দ্রের মূর্তি বসানো ছিল। আর তাই চুঁচুড়ার বদলে আমি এসে পড়েছি একদম ব্যান্ডেল স্টেশনের সামনে, আর তাই তখন আমার বাড়ি দেখাচ্ছিল তিন কিলোমিটার। সুগন্ধ্যা থেকে আমার বাড়ি কিছু না হোক আট ন কিলোমিটার তো হবেই।

    মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে একবার বাবাকে ফোন করে বললাম, ব্যান্ডেল স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আর দশ মিনিটে বাড়িতে ঢুকছি।

    দশ মিনিটও লাগল না, ঢুকে গেলাম বাড়িতে। আটটা তিরিশ।

    মোটরসাইকেল চালিয়ে হুগলি অবধি চলে আসব, এমন প্ল্যান শুরুর দিকে ছিলই না – বইপ্রকাশের অনুষ্ঠান আমাকে টেনে নিয়ে এল। কাল বেলা দুটো থেকে মিউনিসিপ্যালিটির কনফারেন্স হল বুক করে রাখা আছে।

    রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, ডাউন মেমোরি লেন বোধ হয় একেই বলে। আজ সকাল থেকে এমন একটা জার্নি করে এলাম – আমার সমস্ত ফেলে আসা দিনগুলোকে ছুঁতে ছুঁতে ফেরা, ছোটবেলার স্মৃতি, কিশোরবেলার স্মৃতি – সব দেখতে দেখতে আমার আসল ঘরে ফেরা হল আজ।
  • | 144.159.168.72 | ১১ এপ্রিল ২০১৮ ১৭:৪৭370583
  • ওহো এই পর্বটা এসে বসেছিল খেয়ালই করি নি
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন