এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগল

    সিকি লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ১০ নভেম্বর ২০১৭ | ৩১৮১০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সিকি | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:২৯370666
  • ২৪শে অক্টোবর, পঞ্চম দিন

    ভোর মানে, একদম ভোর। সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙল, তড়াক করে উঠে বসলাম। ব্যাগপত্তর কালকেই গুছিয়ে রেখেছিলাম, এখন প্রথমে জিনিসগুলোকে দোতলা থেকে একতলায় নামাতে হবে, তার পরে পুল পেরিয়ে হুই মোটরসাইকেলের কাছ অবধি নিয়ে যেতে হবে। তিনটে ব্যাগ, একটা স্লিপিং ব্যাগ, একবারে তো সম্ভব হবে না। কাজের ছেলেটির সাহায্য করার কথা, কে জানে সে এখন কোথায়।

    ছটার মধ্যে তৈরি হয়ে প্রথম প্রস্থের লাগেজ নিয়ে নিচে নামলাম। ছেলেটা নিচেই বসে ছিল আমার অপেক্ষায়। সঙ্গে সঙ্গে ওপরে উঠে বাকি লাগেজ নামিয়ে আনল। তার পরে বের করল একটা খাতা। চেক আউটের সই, এবং দেড়শো টাকা। … টাকা কেন? আমি তো পেমেন্ট সমেত বুকিং করেছিলাম! দেখলাম, পাশে লেখা আছে, ডিনার। বোঝো! সেই রাতের সেই অখাদ্য – যা আমি প্রায় খেতে পারি নি, এমন আপ্যায়ন করে নিজের খাবার টেবিলে বসিয়ে খাওয়াল, তার দাম দেড়শো টাকা।

    যাক গে, আর তো ফিরছি না এখানে। যা গেছে তা যাক! টাকাটা দিয়ে, অর্ধেক লাগেজ ছেলেটার হাতে দিয়ে পুল পেরিয়ে একবারেই সমস্ত সমেত পৌঁছে গেলাম মোটরসাইকেলের কাছে। বাঁধাছাঁদা সেরে স্টার্ট দিলাম গাড়িতে, এবং সওয়া সাতটার সময়ে পৌঁছে গেলাম গ্যাংটক মলের নিচে সেই পাবলিক সার্ভিস কমিশন অফিসে, যেখানে দিনের বেসিসে পারমিট ইস্যু করা হয়। আগের দিনের পাওয়া চিঠির এক কপি দেখাতে হয়, সেইটা জমা নিয়ে ছোট্ট একটা স্লিপ কেটে দেওয়া হয় চালকের নাম, গাড়ির নম্বর ইত্যাদি বিবরণ সমেত, দশ টাকার বিনিময়ে।

    আক্ষরিক অর্থে সাতসকাল, খুব বেশি ভিড় তাই ছিল না,মূলত লোকাল ক্যাব ড্রাইভারদেরই জমায়েত, তিন মিনিটের মধ্যে স্লিপ বা পর্ছি পেয়ে গেলাম। এইটারও গোটা আষ্টেক কপি করিয়ে রাখতে হয়, জায়গায় জায়গায় পুলিশ চেকপোস্টে এই স্লিপের কপি জমা দিতে হয়। কিন্তু, স্লিপে শুধুই নর্থ সিকিমের গন্তব্যের কথা লেখা কেন? গুরুদোংমার, ইয়ুমথাং, জিরো পয়েন্ট … ব্যস? আমার চিঠিতে তো ইস্ট সিকিমের গন্তব্যও লেখা ছিল! সেগুলো কেন নেই?



    কাউন্টারের ফাঁক দিয়ে আবার মাথা গলালাম। ওপ্রান্তে বসে থাকা পুলিশ অফিসার বুঝিয়ে দিলেন, এই চিঠি আর এই স্লিপের একটা করে কপি বাঁচিয়ে রাখো। নর্থ সিকিম সেরে যখন বার গ্যাংটকে ফিরবে, পরের দিন ইস্ট সিকিম শুরু করার আগে আবার সকালবেলায় এখানে এসে ওগুলো দেখাবে, আরেকটা স্লিপ বানিয়ে দেব ইস্ট সিকিমের জন্য। এক একটা স্লিপে এক এক দিকের পারমিটই দেওয়া হয়।

    আচ্ছা, বোঝা গেল। আগের দিনই রেকি করে এসেছি – পাবলিক সার্ভিস কমিশন অফিসের ঠিক পেছনেই একটি ফোটোকপি সেন্টার, যাকে পূর্বভারতের লোকেরা জেরক্স সেন্টার বলেন। সেখানে গিয়ে কপি টপি সব করে রাখলাম। ফিরে এসে দেখি কালকে দেখা সেই কেরালাইট ছেলেদের দল এসে গেছে। তিনজনের দল। আরও কিছু বাইকার ঘোরাঘুরি করছে, বেশির ভাগই বাঙালি। তাদের মধ্যে থেকেই একজন, অবাঙালি মত দেখতে একটা ছেলে – আমার হাতে পারমিটের কপির তাড়া দেখে আমাকে এসে ধরল, এখানে ফোটোকপি কোথায় হয়?

    তাকে ডিরেকশন দিয়ে দিলাম। সৌজন্যমূলক আলাপ হল-টল, নাম অনুপ, বেঙ্গালুরু থেকে এসেছে। ওখানেই চাকরি, ওখানকারই ছেলে। একলাই এসেছে, যাবে নর্থ সিকিম, গুরুদোংমার দেখতে। … শুধু গুরুদোংমার? লাচুংএর দিকে যাবে না? ছেলেটা মিষ্টি করে হাসল, নাঃ, গুরুদোংমার দেখেই আমি যাবো ভুটানের দিকে। ওটা সেরে আবার লুরুতে ফেরত।

    যাঃ, শুধু এই টুকুনি দেখার জন্য লুরু থেকে এলে? এলেই যখন, সব দেখে যেতে পারতে। যাক গে, একাই আছো তো?

    অনুপ বলল, হ্যাঁ। তুমিও একা?

    এঁজ্ঞে। আমি হাসলাম। চলো তা হলে, গুরুদোংমারটা দুজনে মিলে করে আসি, যদি তোমার আমার সঙ্গে চলতে আপত্তি না থাকে।

    অনুপ লুফে নিল প্রস্তাবটা – না না, আপত্তি কেন, একসাথেই যাবো। তুমি তো দেখছি লাগেজ নিয়েই এসেছো, আমার সামনেই হোটেল – মোটরসাইকেলটা নিয়ে গিয়ে লাগেজ বেঁধে নিয়ে এখানেই আসছি, তুমি দাঁড়াবে একটু?

    – হ্যাঁ-হ্যাঁ, কোনও অসুবিধে নেই। আজকের দূরত্ব তো খুব বেশি নয়, একশো কুড়ি কিলোমিটার মত।

    – তোমার নাম্বারটা তা হলে দাও, আমি সেভ করে নিই। আমি আধঘণ্টার মধ্যেই আসব, দরকার হলে কল করে নেব।

    আমি নাম্বার বলছি, অনুপ মোবাইলে টাইপ করছে – করতে করতেই দেখছি, তার মুখ বদলে যাচ্ছে প্রচণ্ড বিস্ময়ে – তুৎ-তুমি … তুমি অচল সিকি? দিল্লিতে থাকো?

    আমি তো হাঁ। মাইরি আমি কি ছেলেবিটি হয়ে গেলাম নাকি? লিখি তো বাংলায় – এ ব্যাটা কান্নাডিগা হয়ে আমার নাম জানল কেমন করে? – তুমি আমার নাম জানলে কী করে?

    অনুপ তখন হা হা করে হাসছে, ডেস্টিনি, ডুড, ডেস্টিনি। মনে আছে, তোমার সঙ্গে আমার জুন মাসে এই ট্রিপ নিয়ে চ্যাট হয়েছিল? – এই দ্যাখো!

    অনুপ আমাকে তার ফেসবুক মেসেঞ্জার খুলে দেখাল, সত্যিই তো আমিই! আমার সাথেই এর কথা হয়েছিল। অনুপ আমাকে দেখাল, হোয়াটসঅ্যাপেও আমার সাথে ওর বাক্যালাপ হয়েছিল বটে! – কেস হচ্ছে, জুন জুলাই নাগাদ যখন আমি প্ল্যান ফাইনালাইজ করছি, তখন বিসিএমট্যুরিং সাইট আর কয়েকটা ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা হয়েছিল, ট্র্যাভেল পার্টনার হবার জন্য। অনুপ তাদের মধ্যেই একজন। একে অপরের প্ল্যান শেয়ার করেছিলাম, কিন্তু ম্যাচ করে নি তাই আর কথা বাড়ে নি। যে হেতু একাধিক লোকের সাথে ঐ সময়ে কথা চালাচালি হয়েছিল, আমি আর তাই আলাদা করে কারুর নামই মনে রাখি নি। এখন দেখি গ্যাংটকে এসে আমাদের দেখা হয়ে গেল, আর কী আশ্চর্য, এতটা আসার পরে এমন একজনের সঙ্গে আগামী দুদিন কাটাতে চলেছি, যার সাথে আগেই আমার ভার্চুয়ালি আলাপ হয়েছিল।





    ডেস্টিনি, সত্যিই ডেস্টিনি। নাম্বার আদানপ্রদান করে অনুপকে বললাম, তুমি লাগেজ বেঁধে নিয়ে এসো, আমি মনন ভবনের ঠিক সামনে দাঁড়াচ্ছি, এখানে দাঁড়ানোর জায়গা কম।

    পাঁচশো মিটার দূরেই মনন ভবন, সেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময়ে মোবাইলে আরও একটা মেসেজ এল, হোয়াটসঅ্যাপে, কী ব্রাদার, স্টার্ট করেছিস, গ্যাংটক থেকে?

    নীলাদ্রিদা আমার কলেজে তিন বছরের সিনিয়র। ছোটোখাটো গোলগাল চেহারা, ইঞ্জিনীয়ারিংএর থেকে কাব্যই বেশি মাথায় ঘুরত, তার ওপরে আমাদের কলেজের সেই মাথাঘোরানো সৌন্দর্য, হস্টেলের পেছনেই বিস্তীর্ণ চা-বাগান, তার মাঝখান দিয়ে ছুটে যাওয়া ডিব্রুগড় রাজধানী, এপাশ ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসা রুকরুকা নদী আর করলা নদীর ধারা, বিকেলবেলায় আকাশ লাল করা সূর্যাস্ত, আর আরেকটু দূরে চোখ মেললেই যেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা সান্দাকফুর ঝকঝকে রেঞ্জ দেখা যেত, সেখানে বসে ইলেকট্রিকাল মেশিনের পড়াশোনাতে মন দেওয়া খুবই শক্ত কাজ ছিল, অন্তত নীলাদ্রিদার কাছে তো বটেই। কেরিয়ার প্রায় ডিরেল্‌ড হতে বসেছিল তার কবিতা লেখার আবেগে, কোনওরকমে সামলে সুমলে এখন সে কোর ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়েই রয়েছে। শিলিগুড়ির ছেলে, দীর্ঘদিন মণিপুরে ছিল, পরে এদিক ওদিক করে এখন সিকিমে একটা হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্ল্যান্টে স্থিতু হয়েছে, গ্যাংটক থেকে সামান্য দূরে – ডিকচু বলে একটা জায়গায়। সেই নীলাদ্রিদার মেসেজ। কাল রাতেই মেল করে তাকে আমার ভুটানের ই-ভিসাটা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, কথা হয়েছিল, নর্থ সিকিম সেরে যখন গ্যাংটকের দিকে ফিরব, দেখা করা যাবে, প্রিন্ট আউটও হস্তান্তর করে নেওয়া যাবে। ডিকচু যদিও আমার যাওয়া আসার রাস্তায় পড়ে না, তবে ডিকচুর অনতিদূরে একটা জায়গা আছে – মঙ্গন নাম। সেই মঙ্গন থেকে ডিকচু হয়েও গ্যাংটক আসা যায়, একটা অলটারনেট রুট আছে।

    প্রসঙ্গত, কলেজে পড়াকালীন, আমার প্রথম গ্যাংটক আসাও নীলাদ্রিদার সাথেই।

    নীলাদ্রিদাকে উত্তর দিতে দিতেই অনুপ এসে গেল, সাড়ে আটটায় আমরা চলা শুরু করলাম। সুন্দর রাস্তা, মাঝে একটু আধটু ভাঙাচোরা আছে, কিন্তু অসাধারণ সৌন্দর্য, টিপিকাল সিকিম। নীলচে সবুজ পাহাড়, হাতের নাগালে পাক খাচ্ছে ছাইরঙা মেঘ, কাছে গেলেই তারা কুয়াশা। ভিজে ভিজে ভাব, আবার পেরিয়ে গেলেই সূর্য। মাঝে মধ্যে দু একবার ফটো তোলার জন্যে দাঁড়ানো, আবার চলা।

















    সাড়ে দশটার মধ্যে একটা বড়সড় তিনমাথার মোড়ে এসে পৌঁছলাম। মঙ্গন। এখান থেকে বাঁদিকে একটা রাস্তা গেছে ডিকচু হয়ে -সেটা আগে গিয়ে আবার দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে, একটা গেছে গ্যাংটকের দিকে, অন্যটা শিলিগুড়ির দিকে, আর মঙ্গনের মোড় থেকে ডানদিকের রাস্তাটা ধরে আমাদের যেতে হবে চুংথাং হয়ে লাচেন।

    সকাল থেকে খাওয়া হয় নি কিছু, মঙ্গনে বড় বড় বেশ কয়েকটা ধাবা টাইপের ফুড জয়েন্ট। আমরা প্রথমটাতেই ঢুকলাম। মালিকটি মোটামুটি মনে হল আমাদেরই বয়েসী, খুব হাসিখুশি। দেখে অবশ্য সিকিমের লোক বলে মনে হল না। কী পাওয়া যাবে জিজ্ঞেস করাতে বলল, আলু পরাঠা খান। গরমাগরম বানানো হচ্ছে। সঙ্গে কফি দিই?

    তাই দিন। বসার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এসে গেল আলু পরোটা। পেছনের দিকের টেবিলে কয়েকজন বিদেশী ছেলে গল্প করছে, ওরাও বাইকার, এখানে এসে বুলেট ভাড়া করেছে। মালিক ছেলেটাকে তাদের একজন ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করছিল, এখানে বাইক রিপেয়ারিং শপ কোথায় আছে। উত্তরে মালিক স্পষ্ট এবং নির্ভুল ইংরেজিতে তাদের বলল, এমনিতে তো এখানে কিছু নেই, তবে ডিকচুতে গেলে একটা রিপেয়ারিং শপ পাওয়া যেতে পারে। সেখানে না হলে গ্যাংটকের আগে কোনও উপায় নেই।

    কার বাইকে কী সমস্যা হয়েছে জানি না – কিন্তু প্রথমে মালিক লোকটির হিন্দি, তার পরে ইংরেজি শুনে কেমন চমকিত হয়ে গেলাম। এত পলিশড! ঠিক ধাবাওয়ালা বলে তো মনে হচ্ছে না! আরও চমকিত হয়ে গেলাম আলু পরোটা মুখে দিয়ে। একটা করে অর্ডার করেছিলাম, শেষমেশ দুজনেই চারটে চারটে করে আলু পরোটা খেয়ে ফেললাম গরম কফির সাথে।

    খেয়ে নিয়ে আলাপ জুড়লাম লোকটার সাথে। আপনি সিকিমের লোক তো না – কোথায় বাড়ি?

    লোকটি আমাকে চমকে দিয়ে বলল, দিল্লি।

    কী সাংঘাতিক! দিল্লির কোথায়?

    দিল্লির যে জায়গার নাম বলল, আমার তার ঠিক দুটো সেক্টর পাশেই বাড়ি, একই এলাকায়, খুব বেশি হলে তিন কিলোমিটারের দূরত্বে। … তা, দিল্লি ছেড়ে এখানে? নাম কী আপনার?

    সুনীল। সুনীল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ে অনেকদিন কাজ করেছে আইবিএমে। গুরগাঁও আইবিএম – সিলোখেরা অফিসে। প্রথমে টেকনিকাল, পরে প্রজেক্ট ম্যানেজার। ওখানে এক সময়ে আমিও কাজ করতাম। তিন বছর আগে সুনীল সিকিম ঘুরতে আসে। প্রথম দেখাতেই এত ভালোবেসে ফেলে জায়গাটাকে, ফাইনালি দু হাজার সতেরোর গোড়াতেই সিকিমের স্থানীয় এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে এই ফুড জয়েন্টটা খুলে ফেলে, আইবিএমের চাকরি ছেড়ে।



    – পোষাচ্ছিল না, বুঝলেন। কর্পোরেট জগতটা শালা এত বেশি হারামিতে ভর্তি, চোখের সামনে ম্যানেজারের খচরামির জন্য দুরন্ত টেকনিকাল জনতাকে একের পর এক কম্পানি বদলাতে দেখেছি, ভেবেছিলাম আমি অন্য রকমের ম্যানেজার হব, কিন্তু কর্পোরেট কালচার শালা বিষ মাল, আমাকেও ওই রকমের খচ্চর হবার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছিল। সহ্য করা একেক সময়ে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। সিকিম আমাকে মুক্তি দিয়েছে। আমি খুশি, খুব খুশি। যা কামাতাম, তার থেকে সামান্য কম কামাই এখানে, কিন্তু এ তো আর দিল্লি নয়, যা রোজগার হয় তাই দিয়ে আমার দিব্যি চলে যায়। ভালো সেভিংস হয়। জানুয়ারিতে এসেছিলাম, আর দিল্লি যাই নি, দেখি, আসছে জানুয়ারিতে হয় তো যাবো একবার।

    আমি হাঁ করে শুনছিলাম। প্রপার দিল্লিতে বড় হওয়া একজন ছেলে, অথচ “দিল্লির মাইন্ডসেট” বলতে আমরা যা বুঝি, তার থেকে কতটা আলাদা! এ যেন হুবহু আমার মনের কথাগুলো বলে গেল – শুধু আমি হয় তো কোনও দিন সাহস করতে পারব না সব ছেড়ে এ রকম পাহাড়ে এসে নিজের বিজনেস চালাবার। সুনীলের চোস্ত হিন্দি আর ইংরেজি বলার রহস্য এইবারে আমার কাছে পরিষ্কার হল, আর পরিষ্কার হল আলু পরোটার টেস্ট এমন দিল্লি-দিল্লি টাইপের উমদা কেন। সুনীলের প্যাশন রান্না করা, এখানে একজন কুক রেখেছে, তবে ভিড় বাড়লে নিজেও রান্না করে। আর সেইজন্যেই গ্যাংটক থেকে ছেষট্টি কিলোমিটার দূরে এই মঙ্গনেও একদম দিল্লির স্বাদে আলু পরোটা পাওয়া যায়।

    সুনীলকে বললাম, কোনওদিন যদি এই জার্নি নিয়ে লিখি, তো তোমার কথা নিশ্চয়ই লিখব। … আজ কথা রাখা হল সুনীলের কাছে। আপনারা এর পরে যখন গুরুদোংমারের দিকে যাবেন, মঙ্গনের মোড়েই স্পট করতে পারবেন চিরাগ দা ধাবা-কে। অবশ্যই ওখানে আলু পরোটা খেয়ে যাবেন।



    সুনীলের সাথে অতক্ষণ কথা বলতে দেখে বিদেশী ছেলেদের দলের একজন এগিয়ে এসে আলাপ করল। ইউক্রেন থেকে এসেছে, পাঁচ বন্ধু। গুরুদোংমার সেরে কালকেই ফিরেছে, এই ধাবাতেই কাল রাতে থেকেছে। রাস্তা নাকি এত খারাপ, এত খারাপ – একজনকার বুলেটের সাইলেন্সার-এক্সহস্ট ঝাঁকুনির চোটে ভেঙে বেরিয়ে গেছে। এমনিতে গাড়ি চালাতে তার জন্য কোনও অসুবিধে হচ্ছে না – কিন্তু সাইলেন্সারটা ওয়েল্ডিং করে আবার লাগানোটা জরুরি। কতটা খারাপ রাস্তা, কে জানে! আমার লাদাখে দীর্ঘ দেড়শো কিলোমিটার অফরোডিং করা আছে, আর এই সেদিন স্পিতি ঘুরে এসেছি ভয়ঙ্কর খারাপ রাস্তা দিয়ে, তার থেকেও কি খারাপ হবে? মনে হয় না।

    প্রায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ওখানে সময় কাটিয়ে আবার এগোলাম। অর্ধেকের বেশি রাস্তা পেরিয়ে এসেছি, আর সামান্যই বাকি আছে আজকের জন্য। অনুপকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি লাচেনে হোটেল বুক করে রেখেছো? অনুপ বলল, ধুর – ওখানে গিয়ে দেখে নেব। আমি বললাম, তা হলে আমার সাথেই থেকে যাও – আমার তো বুকিং করা আছে, যদি রুম খালি থাকে তুমিও একটা রুম ওখানেই নিয়ে নিও। কাল ভোর ভোর একসাথেই বেরোব।

    বাকি রাস্তাটা মোটামুটি একই রকম, দুটো সওয়া দুটো নাগাদ চুংথাংএ পৌঁছলাম। ছোট্ট একটা জনপদ, গুটিকয় বাড়ি, একটা বিশাল গুরুদ্বারা, একটা হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার স্টেশন আর সামান্য আর্মি এসট্যাবলিশমেন্ট। চুংথাংএর মোড়টা খুবই প্রমিনেন্ট, সোজা রাস্তা চলে যাচ্ছে লাচুংএর দিকে, আমরা নিলাম বাঁদিকের রাস্তা, লাচেন।



    তিনটে নাগাদ লাচেনের গেট পেলাম। একটা তিব্বতী স্টাইলে বানানো তোরণদ্বার মত, পাহাড়ের সব ছোটবড় টাউনেই এই রকমের ওয়েলকাম টু … লেখা তোরণদ্বার থাকে। সেইখানে ফাইনাল চেকপোস্ট, চিঠি এক কপি জমা করতে হয়। জমা নিয়ে অফিসার বললেন – সঙ্গে প্লাস্টিক পলিথিন কিছু আছে?

    মানে, সে তো আছেই – আমার জেরিক্যান পলিমার প্লাস্টিকের, সঙ্গে জলের বোতল আছে, সেটা ডিসপোজেবল নয় যদিও – বের করে দেখালাম। উনি দেখে বললেন, না – ঠিক আছে, এগুলো অ্যালাওড। কিন্তু ডিসপোজেবল প্লাস্টিক কিছু থাকলে এখানেই ফেলে যান। পরে যদি লাচেন বা তার পরের কোনও ডেস্টিনেশনে প্লাস্টিক ফেলতে গিয়ে ধরা পড়েন, দশ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে জেলেও ঢুকতে হতে পারে। খুব সাবধান।

    অনুপের কাছে একটা বিসলেরির বোতল ছিল – ডিসপোজেবল। সেটাকে খালি করে ওখানেই ক্যানে ফেলে দিয়ে আমরা এগোলাম।

    লাচেন ছোট্ট একটা টাউন। ঢুকতেই লাচেনের মার্কেট, মার্কেট মানে কয়েকটা দোকান মাত্র – সেগুলো পেরোতেই ডানহাতে আমাদের হোটেল পেয়ে গেলাম – মাউন্টভিউ রেসিডেন্সি। নাম বলতেই খুদে খুদে চোখদুটোকে একমুখ হাসিতে পুরো ঢেকে দিয়ে আমাদের স্বাগত জানালেন মালিক, থোপদেন সোনম ভুটিয়া। আমি বললাম, বুকিং তো আমারই ছিল, কিন্তু এ (অনুপকে দেখিয়ে) আমার সঙ্গে এসেছে – এর জন্যেও একটা ঘর দরকার।

    সোনম বলল, কোনও অসুবিধে নেই, আপনার জন্য ডবল বেডরুমই রেখেছি, দেখে নিন, যদি দুজনে থাকতে না পারেন, আমি অন্য ঘর খুলে দেব। ঘর খালি আছে।

    খুব ভালো কথা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম নিচে। পাহাড়ি রাস্তার ধারে বিল্ডিং যে রকম হয় – রাস্তার লেভেলে এন্ট্রান্স, বাকি বাড়িটা পাহাড়ের নিচের দিকে। একটু এগিয়ে ঘুরে ব্যালকনির দিকে যেতেই বিস্ময়ে আমার দু চোখ ভরে গেল।



    সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সামনের বিস্তীর্ণ দুটো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে খেলে যাচ্ছে নীলচে মেঘ, আর তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গলের শিল্যুয়েট, আর সেই জঙ্গলের বুক চিরে দূরে বয়ে চলেছে একটা সাদা সুতোর মত নদী, কিংবা ঝোরা। সে যে কী অপূর্ব দৃশ্য, বলে বোঝানো যাবে না। … সন্ধে হয়ে আসছে, খুব বেশিক্ষণ আলো থাকবে না, তাই তাড়াতাড়ি লাগেজ ঘরে ঢুকিয়ে আমি ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে এলাম আবার ব্যালকনিতে। বেশ সুন্দর ঠাণ্ডা – তিন চার ডিগ্রি মত হবে, সেই এক সময়ে আমাদের দিল্লিতে ডিসেম্বরের শেষদিকে যে রকম ঠাণ্ডা পড়ত, হাত ঠাণ্ডা করে দেওয়া, কিন্তু দারুণ আরামদায়ক।



    ব্যালকনির ঠিক নিচেই এক চিলতে জমি, সেইখানে ফলেছে ইয়া বড় বড় সাইজের বাঁধাকপি আর শালগম। সোনম কফি নিয়ে এসেছিল, তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এ তার নিজের হাতে ফলানো ফসল। সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে ফলানো – কোনও কেমিকাল ইউজ হয় না। পুরো সিকিম জুড়ে কেমিকাল সার ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। কেউ কেমিকাল ইউজ করলে তাকে সরকারের তরফ থেকে শাস্তি দেওয়া হয়, চাষ করার লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়। পুরো রাজ্যটা অর্গানিক পদ্ধতিতে সমস্ত ফসল ফলায়।

    এদিকে অনুপের অবস্থা রীতিমত খারাপ। সে এই ঠাণ্ডায় রীতিমত কাবু। তিন চার ডিগ্রি সহ্য করার অভ্যেস তার নেই – সে কখনওই এত ঠাণ্ডা নাকি এর আগে দেখে নি। অতএব, ঘরে ঢুকে প্রথমেই লেপ চাপিয়ে নিয়েছে নিজের ধরাচূড়ো না ছেড়েই, তাতেও তার ঠাণ্ডা কমছে না, সোনমের কাছে তার দাবি পেশ হল, একটা রুম হীটার এনে দাও। সোনম খুব কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, রুম হীটার ব্যবহার করা এখানে নিষিদ্ধ, ধরা পড়লে আমার হোটেলের লাইসেন্স চলে যাবে। আমি আপনাকে আরেকটা ব্ল্যাঙ্কেট এনে দিচ্ছি। আপনারা কি কিছু খাবেন?

    সকালের আলু পরোটা অনেকক্ষণ হজম হয়ে গেছে, দুপুরে লাঞ্চ হয় নি, বললাম, খাবো। লাঞ্চ হোক বা ডিনার, ভরপেট খাবারের ব্যবস্থা করে দাও প্লিজ – আর – কী বললে, এখানে এই ঠাণ্ডায় রুম হীটার কেন নিষিদ্ধ?

    সোনম জানাল, লাচেনে সমস্ত সাপ্লাইই আসে মঙ্গন থেকে, তার আগে কিছু নেই। আর ইলেকট্রিসিটি আসে চুংথাংএর হাইডেল প্ল্যান্ট থেকে, প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ ইলেকট্রিসিটি। কেউ যদি রুম হীটার ইউজ করে, তাতে কানেকশন ট্রিপ করে গেলে সমস্যা তো শুধু একার নয়, পুরো লাচেন এলাকার সবার ইলেকট্রিক কানেকশন চলে যাবে। আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বিজলি অফিসের লোকজনের পক্ষে সবসময়ে সারাতে আসা সম্ভব না-ও হতে পারে, বরফে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে তো চিত্তির, যতক্ষণ না কেউ আসছে, পুরো গ্রামটাকে অন্ধকারে কাটাতে হবে। এই কারণেই রুম হীটার নিষিদ্ধ, এই কারণেই ফাইন বা অন্যান্য শাস্তি।

    সাতটার সময়ে খাবারের ডাক এল ওপর থেকে। সদ্য হাঁড়ি থেকে নামানো ভাত, ফুটন্ত ডাল, পাঁপড়, আলুভাজা আর গরমাগরম অমলেট। আহা, অমৃত, অমৃত। সোনম জানাল, চিকেনের সাপ্লাইও এখানে আসে মঙ্গন থেকে, আজ তো আর হল না, কাল দুপুরে গুরুদোংমার ঘুরে আসার পরে আমাদের গরম গরম চিকেনের ঝোল আর ভাত খাওয়াবে।

    আহা, সোনম পুউরো দেবদূত। অমন চমৎকার ঠাণ্ডায়, একটাআস্ত ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে কোনও রকমে একটা হাত বের করে অনুপ ডিনার সারল – আমি খেয়ে উঠে একটু হাঁটতে বেরোলাম। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ, অসংখ্য তারা ঝিকমিক করছে।

    খানিক বাদে ঘরে ফিরে এসে দেখি পাশের বিছানায় লেপের একটা স্তুপ হয়ে আছে, তার ভেতর থেকে কন্নড় ভাষায় কিছু কথাবার্তা ভেসে আসছে। অনুপ, কাউকে ফোন করছে।

    ফোন টোন সেরে, খানিক গল্পগুজব হল। সোনম আবার এসে একটা ব্যাটারি ল্যাম্প দিয়ে গেল – জানিয়ে গেল সকাল সাড়ে পাঁচটার সময়ে এখান থেকে স্টার্ট করতে হবে, ও পাঁচটার সময়ে ঘরে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিয়ে যাবে। জেলি, ব্রেড, অমলেট, চা।

    কাল তা হলে গুরুদোংমার হচ্ছে। লাগেজ এখানেই রেখে যাবো, ফিরতি পথে লাঞ্চ সেরে, লাগেজ নিয়ে লাচুং চলে যাবো, অনুপ ফিরে যাবে গ্যাংটকের দিকে।

    জয় গুরু। দোংমার।
  • | 144.159.168.72 | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ১০:২৪370667
  • আহ লাচেন! আমাদের সেই ভয়ংকর হোটেলটা! প্রোচন্ড বকাবকি করে এক বালতি গরম জল যোগাড় করেছিলাম, তাই দিয়ে রাতের মুখ ধোয়া, খেয়ে আঁচানো, অজ্জিতরাও ঐ বালতির জলেই মুখ তুখ ধুতে পেরেছিল। আর রাস্তা! উফফ! আমাদের সেই রাত সাড়ে নটা'য় হোটেল পৌঁছানো, তখন গোটা লাচেনে মাঝরাত
  • | 144.159.168.72 | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ১০:২৫370668
  • ক্যান্সেল করলে যে, সেই হোমস্টে'র মালিক আর জ্বালায়নি আশা করি।
  • সিকি | 158.168.40.123 | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:১৭370669
  • জ্বালিয়েছিল, তবে তখন আমি জুলুক থেকে রংপোর দিকে নামছি :) স্বর্গীয় রাস্তা, তখন আর ওসব খিচিমিচিতে কে মন দেয়। "না আসি নি" বলে কেটে দিয়েছিলাম ফোন।
  • | 192.66.10.217 | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:২৯370670
  • হা হা ঠিক মনে হয়েছিল এ ব্যাটা ফোন করে কৈফিয়ৎ টাইপ চাইবে "কেন ক্যান্সেল করেছ হে?'
    :-))
  • সুকি | 52.99.164.70 | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ১২:১৫370671
  • এই লেখাটা ভালো লাগছে - পড়ছি
  • abcd | 24.139.222.72 | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ১৪:১১370672
  • ব্যাপক হচ্ছে, ব্যাপক
  • সিকি | 158.168.40.123 | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ১৪:৪০370673
  • থেঙ্কু।

    দ, অজ্জিত, আসলে এখন চুংথাং হয়ে লাচেন বেশ সুন্দর রাস্তা হয়ে গেছে। চুংথাংএর পর পাঁচ কিলোমিটার মত রাস্তা ভাঙাচোরা, তাও তেমন কিছু নয়, পাহাড়ি রাস্তা যেটুকু ভাঙাচোরা হয় আর কি, তারপরে একদম রানওয়ের মত স্মুথ রাস্তা। আশেপাশের ন্যাচারাল বিউটি উপভোগ করা ছাড়া আর কিছুই বিবরণ দেবার নেই। লাচেন অবধি মোটামুটি স্মুথ জার্নি। আসল গল্প তো এর পরে, গুরুদোংমারের রাস্তায়। কোথায় লাগে স্পিতির অফরোডিং!

    পরের কিস্তিতে :)
  • সিকি | 158.168.40.123 | ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০৯:০৮370674
  • হেঁইয়ো। তুলে রাখলাম, পরের পর্ব আজই আসবে।

    একটা মেজর কারেকশন - আগের পর্বে যাকে আমি সোনম বলে উল্লেখ করেছি, লাচেনের মাউন্টভিউ রেসিডেন্সির মালিক, ওর নাম সোনম নয়, ছিরিন (শিরিন?) থোপদেন ভুটিয়া। সোনম অন্যজন, সে পরের পর্বে আসবে।

    ব্লগে আপডেট করে দিয়েছি, এখানে তো আপডেট সম্ভব নয়, আপনারা সোনমকে ছিরিন ভেবে পড়বেন।
  • ল্যাগব্যাগর্নিস | 128.185.75.71 | ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:০২370676
  • আমি তো গত বছরেই গেলুম আবার - চুংথাং এর পর লাচেন অবধি আগের মত ভাঙাচোরা অবশ্যই নেই, তবে খুব ভালোও নেই। বরং লাচুং এর দিকটা বেটার।
  • ল্যাগব্যাগর্নিস | 128.185.75.71 | ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:২৮370677
  • কিন্তু যেটা হয়েছে সেটা বেশ বাজে হয়েছে।

    আগে, মানে ২০০৯/২০১০ নাগাদ, নর্থ সিকিমে যেত শুধু নর্থ সিকিম ডিস্ট্রিক্টের গাড়িই। গ্যাংটক শহরের উত্তরে গাড়ির স্ট্যান্ড ছিল। এখন সিকিমের বাকি তিনটে জেলার গাড়িও যেতে দিচ্ছে। ফলে দুটো ব্যাপার হয়েছে -

    (১) প্রচন্ড ভিড় বেড়ে গেছে। লাচেন/লাচুং দুটোই বেশ নিঝুম জায়গা ছিলো। এখন ট্যুরিস্টের ভিড়ে ইনডিসক্রিমিনেটলি হোটেল গজিয়ে উঠেছে - কিন্তু ওই লেভেলের লোক নেওয়র ক্ষমতা নেই জায়গাগুলোর। লাচুং প্রায় বাজার হয়ে গেছে একটা। আগে বেশির ভাগ লোক ইয়ুমথাঙেই বসে থাকতো, পিকনিক টিকনিক করতো নদীর ধারে। এখন ইয়ুমথাঙ শুধু স্টপ-ওভার পয়েন্ট - সেখান থেকে শীতের পোশাক, বুট ইত্যাদি ভাড়া করে লোকে জিরো পয়েন্টে ভিড় করছে। সেখানে মাইল তিনেক লম্বা গাড়ির জ্যাম হয়, আর ধোঁয়ায় লোকের দম আটকানোর হাল হয়। কপালে না থাকলে আসল জিরো পয়েন্ট অবধি যাওয়াই যাবে না, গাড়ি তার আগেই আটকে যাবে। একই হাল হয়ে গেছে গুরুদোংমারেও। থাংগু আর তার পরের চেকপয়েন্টে ইনফ্রার অবস্থা খুবই খারাপ।

    (২) নর্থ সিকিম আর বাকি জেলাগুলোর গাড়ির মধ্যে রেষারেষি শুরু হয়েছে - যে কারণে রোড রেজ, ঝগড়া, মারামারিও লেগেই থাকছে।
  • de | 24.139.119.175 | ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:৪১370678
  • একটু ফাঁকা কখন পাওয়া যায়?
  • ল্যাগব্যাগর্নিস | 128.185.75.71 | ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:৪৩370679
  • কঠিন প্রশ্ন। তবে ডিসেম্বরের দিকে টুরিস্ট কম থাকার কথা। সিওর না ওদিকে রাস্তা খোলা থাকে কিনা। ইস্ট সিকিম (জুলুক) খোলা থাকে জানি।

    গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটিতে কদাপি যাবেন না।
  • সিকি | 158.168.40.123 | ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১৩:১৪370680
  • পঁচিশে অক্টোবর, ষষ্ঠ দিন
    ===============

    কনকনে ঠাণ্ডায় ভোর পৌনে পাঁচটায় লেপের নিচে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকাটা সোজা, নাকি গুরুদোংমারের ডাকে সোজা লেপ টেপ ঝেড়ে ফেলে রেডি হওয়াটা সোজা?

    অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করেও এর সঠিক উত্তর খুঁজে পেলাম না। সাড়ে চারটেয় অ্যালার্ম বেজে গেছে। কাল যেহেতু রাত প্রায় সাড়ে নটা থেকেই ঘুমোচ্ছি, ফলে ঘুম ভাঙতেও অসুবিধে হয় নি, কিন্তু মুণ্ডু বের করেই বুঝলাম হাড়কাঁপানো শীত। ঘরের ভেতরেই এই, বাইরে নিশ্চয়ই দুত্তিন ডিগ্রি মত হবে। বেরোতে হবেই, লেটেস্ট বাই সাড়ে পাঁচটা বেরোতে হবে, নইলে সাড়ে সাতটার মধ্যে থাঙ্গুতে রিপোর্ট করা চাপ হয়ে যাবে। তাই প্রথমে মুণ্ডু, তার পরে বাঁহাতের কড়ে আঙুল – এইগুলো এক এক করে লেপের থেকে বের করে ঠাণ্ডাটা আস্তে আস্তে সইয়ে নিচ্ছিলাম, এমন সময়ে দরজায় ধাক্কা পড়ল। ছিরিন, ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছে।

    উঠতেই হল। তড়াক করে উঠে দরজা খুললাম, হিমেল হাওয়ার একটা ঝটকা আমাকে একবার আপাদমস্তক মেপে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। পাঁচটা বাজতে পাঁচ। ছিরিন নিয়ে এসেছে গরম গরম স্লাইস ব্রেড, ওমলেট, জ্যাম আর কফি।

    স্তুপের নিচ থেকে অনুপকে আবিষ্কার করলাম, সে উঠেই মোজা পায়ে গলিয়ে চটি পরে বাথরুমে ঢুকে গেল। ‘ফ্রেশ’ হতে হবে। এদিকে আমার আবার ছোটবেলা থেকে এই সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হবার বাধ্যবাধকতা টাইপের অভ্যেস নেই। যখন সময় সুযোগ পাই, দরকার মনে হয়, ফ্রেশ হয়ে নিই। সুতরাং, অনুপ মনের আনন্দে ‘ফ্রেশ’ হয়ে যখন বেরোল, আমার খাওয়া ততক্ষণে শেষ, এবং অনুপের ভাগের অমলেট কফি প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

    অনুপ প্রায় কিছুই খেল না – ‘ম্যান, ইচ্ছে করছে না। লেটস গো’ বলে অর্ধেক পাঁউরুটি ছেড়ে জুতো পরতে শুরু করে দিল। আমার ততক্ষণে আমার মতন করে ‘ফ্রেশ’ হয়ে নিয়ে (মানে শুধু দাঁত মেজেছিলাম) জুতো পরাও শেষ। আজ তো কোনও লাগেজ নিয়ে যাবার নেই, সব রেখেই যাবো, ফিরতি পথে এখানেই লাঞ্চ করে আবার লাগেজ বেঁধে নিয়ে আমি চলে যাবো লাচুং, আর অনুপ চলে যাবে গ্যাংটকের দিকে। জাস্ট পিঠের ব্যাগে পারমিটের চিঠি, স্লিপ, আর তার বাকি ফোটোকপি ইত্যাদি নিয়ে বেরোতে গিয়েও কী মনে হল, ওষুধের প্যাকেট থেকে ডায়ামক্সের স্ট্রিপটা বের করে নিয়ে ব্যাগে ঢোকালাম। বাকি সব থাক।

    ছিরিন বলল, কাল কলকাতা থেকেও আরেকটা বাইকারদের গ্রুপ এসেছে, ওরাও তৈরি হচ্ছে, একটু পরেই বেরোবে। আমি বললাম, তা হলে জেনে এসো না, এক্ষুনি বেরোবে না টাইম লাগবে। পাঁচ দশ মিনিট মতন ওয়েট করতে পারি, পাঁচটা পঁচিশ বাজে এখন। – ছিরিন খোঁজ নিয়ে এসে বলল, না, ওদের বেরোতে বেরোতে পৌনে ছটা বা ছটা বাজবে।

    অতএব, আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। ভারতের পূর্বদিক, তাই এখানে সবেমাত্র সূর্য উঠে গেছে, চারপাশে একটা গাঢ় নীলচে ভাব ক্রমে সোনালি, তারপরে রূপোলি সাদা হয়ে উঠছে। গাছপালার ফাঁকফোঁকর দিয়ে লুকোচুরি খেলছে মেঘ বা কুয়াশারা – তার মাঝখান দিয়ে ঠিকরে পড়ছে সকালের প্রথম সূর্যের কিরণ। দু দণ্ড না দাঁড়িয়ে এর শোভা উপভোগ করি কেমন করে?



    ঠিক এইটাই, এইটাই কারণ সাড়ে পাঁচটায় বেরনোর। প্রথম রিপোর্টিং থাঙ্গু-তে পুলিশ চেকপোস্টে, সেটা এখান থেকে মাত্র বত্রিশ কিলোমিটার দূরে, সেইখানে রিপোর্টিং টাইম সকাল সাড়ে সাতটা, কিন্তু দু ঘণ্টা সময় হাতে রেখে বেরোতে হয় তার একটা কারণ হল এইটা। বত্রিশ কিলোমিটার গড়গড়িয়ে চলে যেতে চাইলেই যাওয়া যায় না – অসম্ভব সৌন্দর্য তোমাকে প্রতিটা বাঁকে বাঁকে দাঁড় করাবেই। গাছপালা পাহাড়ের বাঁক সামনের আঁকাবাঁকা রাস্তা – সবাই কেমন অলস হয়ে সকালটা উপভোগ করছে মেঘকুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে, তার মাঝখান দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে মন চায় না। দাঁড়াতেই হয়।

    অবিশ্যি, সময় বেশি লাগার আরও একটা কারণ আছে।

    রাস্তা।

    লাচেনের পরে প্রায় গুরুদোংমার পর্যন্ত রাস্তাটা প্রায় নেই-রাস্তা বললেই চলে। কাদা, মাটি, পাথর, আর পাথর-মাটি-কাদা। বাইক আজ খালি, লাগেজবিহীন, ফলে একেকটা পাথরের ওপর পড়ে বা গর্তের মুখে এসে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে – সে এক প্রাণান্তকর, কিন্তু রীতিমত এনজয়েবল অভিজ্ঞতা। চারপাশের প্রকৃতির থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না, তার ফল হিসেবে পরের গর্তে চাকা পড়ে লাফিয়ে উঠছে মোটরসাইকেল – সময়ে দেখতে পাই নি। আবার পথের দিকে মন দিলে চারপাশের দৃশ্য মিস হয়ে যাচ্ছে।

    হোটেল থেকে খানিকটা মোটামুটি ভালো রাস্তা। দুদিকে ছোটখাটো দোকান, আর হোটেল। একটা হোটেল থেকে দেখলাম চার পাঁচটা মোটরসাইকেল বাঁধাছাঁদা করে বেরোবার তোড়জোড় করছে। মোটরসাইকেলগুলোর নম্বর কেরালার।

    এখান থেকেই বাঁদিকে আরেকটা পায়ে চলা রাস্তা চলে গেছে। এটা ট্রেকিং রুট। গ্রীন লেকের দিকে যাবার। মোটরসাইকেল সে রাস্তায় নিয়ে যাওয়া যায় না।

    খানিক চলার পরেই দেখি ঠাঁই-ঠং-ঠঙাস করে একটা আওয়াজ এল আমার বাইকের পেছন দিক থেকে। তড়িঘড়ি বাইক থামিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। অনুপ এগিয়ে গেছে খানিকটা, কীসের আওয়াজ? – দেখি, একটা কালো রঙের রড পড়ে আছে রাস্তার ওপর। সেটা খুলে বেরিয়েছে আমার ক্যারিয়ারের পেছন থেকেই। আমার বাইকে লাগানো ক্যারিয়ারটা তো ডি-অ্যাসেম্বল করা যায়, বিভিন্নপ্রকার নাটবল্টু দিয়ে শক্ত শক্ত লোহার ফ্রেম রড দিয়ে বানানো এটা – ঝাঁকুনির চোটে নাট ঢিলে হতে হতে একসময়ে একটা রড পেছন থেকে খসে পড়েছে। দৌড়ে গিয়ে রডটা কুড়িয়ে আনলাম। ক্যারিয়ারের দিকে তাকিয়ে লোকেটও করতে পারলাম ঠিক কোন জায়গা থেকে খুলেছে ওটা, কিন্তু ঝাঁকুনির ইমপ্যাক্টে নাটবল্টুগুলো কোথায় খুলে পড়ে গেছে – সে আর পাওয়া গেল না।

    ক্যারিয়ারের একদম পেছনদিকে, সীটের পেছনটায়, যেখানে স্লিপিং ব্যাগ আর ত্রিপলের প্লাস্টিক ভাঁজ করে রাখা ছিল, সেইখানে পরপর দুটো লোহার রড দিয়ে প্যারালালি আটকেএকটা বেস বানানো ছিল। তার একটা খুলে বেরিয়ে এসেছে, অন্যটার একদিকের নাটবল্টু খুলে হাওয়া, এবং অন্য দিকটাও ঢলঢল করছে, যে কোনও মুহূর্তে সে-ও খুলবে। করোল বাগে সাঙ্ঘাতিক টাইট করে যে সব জিনিস ফিট করা হয়েছিল, তারা এখন এতটাই লুজ হয়ে গেছে যে আমি হাতে করে নাট ঘুরিয়ে বাকিটা খুলে ফেললাম। দুটো রডই ব্যাগের ভেতর চালান করে আবার একবার পুরো ক্যারিয়ার ফ্রেমটা ভালো করে নেড়ে ঝাঁকিয়ে দেখে নিলাম। নাঃ, বাকিটা পোক্ত আছে বলেই মনে হচ্ছে।







    সাড়ে সাতটার একটু আগেই থাঙ্গুর চেকপোস্টে পৌঁছে গেলাম। তিন চারটে বাড়ি, আর একটা পুলিশ পোস্ট, যাবার সময়ে ডানদিকে পড়ে। বাকি আর্মির এসট্যাবলিশমেন্ট। অনুপ তো আমার আগেই এগিয়ে গেছিল – সে কই? কোথাও তো দেখছি না, ভাবতে ভাবতেই অনুপ এসে হাজির হল, কখন পিছিয়ে পড়েছিল – খেয়াল করি নি। কী রকম একটু কাহিল লাগছে তাকে। আমরা পারমিটের কপি জমা করলাম পুলিশের কাছে, রাস্তা সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে জানলাম, পুরো রাস্তাই এই রকমেরই খারাপ, কেবল গুরুদোংমারের আগে এগারো কিলোমিটার রাস্তায় ঠিকঠাক পিচ টিচ আছে।

    অনুপ উবু হয়ে বসে পড়েছে তার মোটরসাইকেলের সামনে। গ্লাভস পরা দুই হাত ঠেসে ধরেছে ইঞ্জিনের ওপর, সাইলেন্সারের ওপর। ঠাণ্ডা ওর প্রচণ্ড লাগছে, আর তাতে ও একেবারে কুপোকাত। এত ঠাণ্ডা ও জাস্ট সহ্য করে উঠতে পারছে না। আমার অল্প হলেও অভ্যেস আছে, ফলে শীত করলেও সেটা অসহনীয় লাগছে না, কিন্তু অনুপের একেবারেই অভ্যেস নেই। ঠকঠক করে কাঁপছে আর ইঞ্জিনের গরমে হাত সেঁকে গরম হবার চেষ্টা করছে। আরও পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার যাবার আছে, পারবে তো?

    খানিকক্ষণ দাঁড়ালাম ওর সাথে। অনুপই বলল, ব্রো, ডোন্ট ওয়েট ফর মি, আমি চলে যাবো। তুমি এগোও, আমি রাস্তায় তোমাকে ধরে নেব।

    আমি তাও দুবার ওকে জিজ্ঞেস করে নিলাম, সব ঠিক আছে তো? এমন কিছু দেরি হয় নি, দরকার হলে তুমি আরেকটু গরম নিয়ে নাও – আমি দাঁড়াচ্ছি। কিন্তু অনুপ বলল, দরকার নেই – ও আরেকটু হাত সেঁকে নিয়েই এগোবে।

    অগত্যা আমি একাই এগোলাম আবার। এবার উচ্চতা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছে, একেকটা বাঁকে রাস্তা একদম হুশহাশ স্বর্গের দিকে উঠে যাচ্ছে। বাইকটা নেহাত লাগেজবিহীন, তাই কোনও অসুবিধেই হচ্ছে না।

    গাছপালার সংখ্যা কমে এসেছে। জায়গায় জায়গায় উজ্জ্বল হলুদ বা কমলা বা খয়েরি রঙের ঝোপ। ঝাঁকে ঝাঁকে রঙের সমাহার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। খানিক এগিয়ে চোখে পড়ল দূরে একটা উপত্যকা মত, হাল্কা বরফে ছেয়ে আছে, আর তার মাঝে একলা একটা সেতু, বোধ হয় কোনও নালা আছে ওখানে, এখন জমে বরফ। চারপাশে জনপ্রাণী নেই। যতদূর চোখ যায়, আমি একা।



    নটা পনেরো নাগাদ পৌঁছলাম গিয়ে সেই আর্মি চেকপোস্টে। এখানেই লাস্ট কাগজপত্র দেখাতে হয়। চিঠি জমা দিতে হয় – এর পর থেকেই এগারো কিলোমিটার ভালো রাস্তা – তার শেষেই নাকি গুরুদোংমার। কিন্তু কোথায় ভালো রাস্তা? চেকপোস্টের ব্যারিকেডের এপার থেকে উঁকি মেরে যতদূর দেখলাম, একই রকমের ভাঙাচোরা অফরোড।



    বাইক সাইডে দাঁড় করিয়ে চিঠি জমা করতে গেলাম। ভেতরে একটা চুল্লি মতন ব্যবস্থা জ্বলছে, মানে লোহার একটা বড় পাত্রে আগুন জ্বলছে, বোধ হয় তেলে জ্বালানো হচ্ছে, আর তার ওপর থেকে একটা চিমনির মত নল বেরিয়ে গেছে ছাদের দিকে। সকালে দেখা কেরালার ছেলেগুলো কখন আমাদের ওভারটেক করে এগিয়ে গেছে – তারা ছিল, আর দু তিনটে ট্যুরিস্ট ক্যাব ছিল। ঝটপট চিঠি জমা করা হয়ে গেল, ভেতরে জমা নেওয়া আর্মি জওয়ান বলল, সব পারমিট আর চিঠি এখানে জমা করে দাও, ফেরার সময়ে নিয়ে যাবে। সাড়ে বারোটার মধ্যে ফিরতে হবে, নইলে কিন্তু ডকুমেন্ট ফেরত পাবে না।

    সাড়ে বারোটা বেজে এক মিনিট হয়ে গেলে আমি ফেরত আসতে পারব কিনা জানবার আগেই আমার ডকুমেন্ট জমা হয়ে গেল, একটা রাবার ব্যান্ডে আটকে আমাকে জানানো হল, আমার নম্বর বারো। মানে, এসে বারো নম্বর বললেই এই বান্ডিলটি আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, যাতে সমস্ত বাকি পারমিট, স্লিপ, ফোটোকপি ইত্যাদি রয়েছে।

    বেশ। বারো নম্বর নিয়ে বেরোলাম ঘর থেকে। ঠাণ্ডাটা কাঁপাকাঁপি, কিন্তু বড়ই মনোরম। সামনেই একটা আর্মি কাফেটেরিয়া। এত ঝাঁকুনি খেয়েছি এই ষাট কিলোমিটার – সকালের ব্রেকফাস্ট কখন হজম হয়ে গেছে। কী পাওয়া যায় দেখি – অনুপ তো এখনও এসে পৌঁছয় নি।

    ক্যাফেটেরিয়াতে মোমো চাউমিন আলুপরোটা সবই পাওয়া যাচ্ছে, আর পাশে দুটো বড় বড় ফিল্টারে জল আর কফি রাখা আছে, আরেকগুচ্ছ ফাইবারের গ্লাস পাশে উপুড় করে রাখা। কফি, গুরুদোংমারে আগত সমস্ত যাত্রীদের জন্য আর্মির তরফ থেকে ফ্রি! গ্লাসে নাও, কফি খাও, এবং হয়ে গেলে পাশের ফিল্টার থেকে জল ঢেলে গ্লাস ধুয়ে আবার উপুড় করে দাও। সেলফ হেল্প। বাকি আইটেমের জন্য ফেলোকড়িমাখোতেল।

    কফি খেলাম এক গ্লাস। বেশ আরাম, যদিও কফিটা মোট্টেও ভালো খেতে ছিল না। কিন্তু অনুপ কেন আসে না? এখানে ফোনের নেটওয়ার্কও নেই, কল করা যাবে না। কেরালার গ্রুপটা বেরিয়ে গেল। তিনটে টাটা সুমোভর্তি ট্যুরিস্ট চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি সাড়ে নটা বাজছে, নটা চল্লিশ। আরও দুটো ট্যুরিস্ট ক্যাব এল। ধড়ফড় করে এক ভদ্রলোক তাঁর মা-কে নামালেন। ভদ্রমহিলাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি এএমএসে আক্রান্ত হয়েছেন, হাঁ করে করে শ্বাস টানছেন। দুজন আর্মি জওয়ান ছুটে এল, সামনে বাঁদিকেই মেডিকেল চেকআপ ক্যাম্প, সেইখানে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেল ভদ্রমহিলাকে। আরও কয়েকজন নিজেদের প্রায় ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিয়ে চলল সেদিকে। … আমি নিজের বুকপকেটে একবার হাত বোলালাম। আছে, ডায়ামক্সের স্ট্রিপটা আছে। যদিও একেবারেই কোনও সমস্যা হচ্ছে না আমার। আমাকে এএমএস অ্যাটাক করে না। তবুও …

    তিনটে মোটরসাইকেল এসে দাঁড়াল। পশ্চিমবঙ্গের নাম্বারপ্লেট। সামনের জন, অবভিয়াসলি বাঙালি, একদম বাংলা অ্যাকসেন্টের ইংরেজিতে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, সাদা রঙের অ্যাপাচে আরটিআর, কর্ণাটকের নম্বর, ও কি তোমার সঙ্গে আসছিল?

    আমার বুকটা ধক করে উঠল – হ্যাঁ, কেন? কোথায় সে? কী হয়েছে?

    প্রশ্নগুলো বাংলাতেই করলাম। বাঙালির সাথে ইংরেজিতে কথা চালাবার কোনও মানেই হয় না। ছেলেটা বলল, ও বোধ হয় খুব অসুস্থ। বমি হয়েছে দু একবার। বলল ধীরে ধীরে আসছে, এখনও বোধ হয় পাঁচ-ছ কিলোমিটার পেছনে আছে।

    অসুস্থ? কী হয়েছে – কে জানে! আমি কি পিছিয়ে গিয়ে দেখব, নাকি এখানেই ওয়েট করব? আমি ভাবতে থাকলাম, ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় দেখলাম অনুপ আসছে ধীরে ধীরে। কোনও রকমে বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে ওকে ধরে ধরে নিয়ে গেলাম ঘরের ভেতর, যেখানে পারমিটের চিঠি জমা হচ্ছে। ধরে ধরে বসিয়ে দিলাম সেই চুল্লির সামনে। অনুপ পারলে প্রায় চুল্লির আগুনেই হাত ঢুকিয়ে দেয় আর কি। আমি ওর কাছ থেকে ওর কাগজপত্র নিয়ে জমা করলাম, নম্বর নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? অনুপ বলল, সকাল থেকেই শরীর খারাপ লাগছে, এক তো প্রচণ্ড শীত, তার ওপর বোধ হয় ফুড পয়জনিং হয়েছে, ডাইজেশনের সমস্যা হচ্ছে। তোমার কাছে কোনও ওষুধ আছে?

    আছে তো! নরফ্লক্স নিয়ে এসেছি – কিন্তু সে তো হোটেলেই রেখে এসেছি, এখন আমি স্রেফ ডায়ামক্স নিয়ে বেরিয়েছি। পেট খারাপের ওষুধ এখানে লাগতে পারে, সেটা তো আগে ভাবি নি! বললাম, শোনো, একটু হেঁটে চলো, এই সামনেই এদের মেডিকেল ক্যাম্প, ওখানে পেয়ে যাবে।

    নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও কোনও রকমে হেঁটে গিয়ে অনুপ ঢুকল মেডিকেল ক্যাম্পে, আমিও ঢুকলাম পেছন পেছন। পরপর দুটো সারিতে কিছু খাট পেতে রাখা – প্রত্যেকটার পাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার। অনুপ গিয়ে ধপ করে একটা খাটে কাটা কলাগাছের মত লুটিয়ে পড়ল। একজন আর্মিম্যান ওকে শুশ্রূষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। প্রথমে মুখে অক্সিজেন মাস্ক। ওপরে দু প্রস্থ কম্বল। প্রায় দশ মিনিট অক্সিজেন নেবার পরে মনে হল একটু সুস্থ হয়েছে। ডাক্তার এলেন বেডের কাছে – লুজ মোশন কন্ট্রোল করার জন্য দুটো ট্যাবলেট চেয়ে নেওয়া হল। আবারও দশ মিনিট অক্সিজেন।

    প্রায় আধ ঘণ্টা বাদে অনুপ বলল, না, আমি উঠতে পারব। আমি বললাম, এক কাজ করো না – তুমি এখানেই রেস্ট নাও। আর এগোতে হবে না, সামনে তো আরও অলটিট্যুড বাড়বে, শরীর খারাপ করতে পারে। আমি ঘুরে আসি – তুমি আমার সঙ্গেই ফিরবে। …কিন্তু যে ছেলে ব্যাঙ্গালোর থেকে এতদূর এসেছে মোটরসাইকেল চালিয়ে গুরুদোংমার দেখবে বলে – সে আর এগারো কিলোমিটার না চলে ফিরে যাবে, জাস্ট শরীর খারাপ বলে? অনুপ বলল, না, আমি ঠিক আছি, আমি যাবো।

    ওকে বের করলাম মেডিকেল ক্যাম্প থেকে। ক্যাফেটেরিয়াতে নিয়ে গিয়ে কফি খেতে দিলাম, সাথে সেই ডাইজেশনের ওষুধ, আর আমি দিলাম একটা ডায়ামক্স। বললাম, হোটেলে ফিরলে নরফ্লক্স দেব। ওটা আলটিমেট।

    কফি খেয়ে, ওষুধ খেয়ে আমার মোটরসাইকেল অবধি ফিরে আসার আগেই অনুপ লাফিয়ে উঠল মোটরসাইকেলে, বলল, আমি আগে আগে বেরিয়ে যাচ্ছি, গুরুদোংমার টাচ করেই আমি ফিরব হোটেলে। একদম হোটেলে গিয়ে কথা হবে, কেমন?

    ব্যারিকেডের কাছে একজন হাবিলদার দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমি গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম – এই খারাপ রাস্তা আর কতদূর আছে? ভদ্রলোক হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, বেশি না, এই দুশো মিটার, তার পরে বঢ়িয়া রোড পাবেন।

    সোয়া নটায় ঢুকেছিলাম, অনুপের চক্করে পড়ে বাজে এখন বেলা এগারোটা। সাড়ে বারোটার মধ্যে ফিরতে হবে। আর কালবিলম্ব না করে আমি মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে এগোলাম, এবং সত্যিই দুশো মিটার পরে দেখলাম একদম সেই রানওয়ের মত রাস্তা, মসৃণ ম্যাস্টিক অ্যাসফল্ট। লেখা আছে, গুরুদোংমার, এগারো কিলোমিটার। সকাল থেকে এই প্রথম ষাটের ওপর স্পিড তুলতে পারলাম। দেখতে দেখতে দশ কিলোমিটার শেষ হয়ে গেল, তার পরে রাস্তা আরও চলে গেছে সোজা, কিন্তু রাস্তার ডানদিকে একটা অ্যারোমার্ক সমেত ছোট্ট বোর্ড, গুরুদোংমার লেক, এইদিকে।



    রাস্তা ছেড়ে আবার অফরোডিং। শেষ এক কিলোমিটার চড়াই ছিল মারাত্মক। একবারের জন্য বাইকের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলে উল্টোদিকে গড়িয়ে পড়ে নেমে আসা কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। গোঁ-গোঁ শব্দে মোটরসাইকেলের প্রচণ্ড অপছন্দ অস্বীকার করে আমি চলতে শুরু করলাম, প্রায় মাথা-সমান উঁচু খাড়াই, জাস্ট চাকার দাগ ধরে ধরে এগনো, রাস্তা বলে কিছু নেই, এটুকু বুঝছি, একটা পাহাড়ের মাথায় চড়ছি মোটরসাইকেল নিয়ে।

    চড়াই শেষ হওয়ামাত্র, আমার দু চোখ ভরে এল নীল রঙে। সামনে সুনীল জল নিয়ে বেলা সাড়ে এগারোটার সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে গুরুদোংমার লেক। ওপরে কোবাল্ট ব্লু কালারের আকাশ। আর চারদিকে প্রহরীর মত ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বরফঢাকা পাহাড়ের চূড়োরা, এত কাছে, মনে হল হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। মুগ্ধতায় কথা হারিয়ে যায়, সে এমন সুন্দর।





    অনুপ তখন ক্যামেরা ব্যাগে ভরে ফেরার তোড়জোড় করছে। ওকে দাঁড় করিয়ে আমার দু একটা ছবি তুললাম। অনুপ তুলে দিয়েই বলল, ভাই, আমি এবার নামি, মাথা ঘুরছে প্রচণ্ড। হোটেলে ফিরে রেস্ট নিচ্ছি, তুমি এসো ধীরেসুস্থে। ওখানে দেখা হবে।





    অনুপকে বিদায় জানিয়ে আমি খানিক বসলাম ওখানে। বাঙালিদের দলটা একটু দূরে হইহল্লা করে সেলিব্রেট করছে, ফটো তুলছে। আমি একদৃষ্টে চেয়ে থাকলাম নীল জলের দিকে। অনেকদিন আগে, প্যাংগংয়ে এই রকমের নীল দেখেছিলাম। …





    গুরুদোংমারের জলের কাছে যাবার বোধ হয় কোনও একটা রাস্তা আছে, নিচের দিকে জলের ধার ঘেঁষে পায়ে চলা রাস্তা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু সে কোথা থেকে নামে, বোঝা গেল না। সময়ও শেষ হয়ে আসছে। পৌনে বারোটা বাজে। সাড়ে বারোটার মধ্যে সেই আর্মি চেকপোস্টে ফিরতে হবে, অরিজিনাল ডকুমেন্ট ফেরত নেবার জন্য। দশ কিলোমিটার যেতে পনেরো মিনিট মত লাগবে। একবার কি চোলামু ট্রাই করব না? পারমিট নেই অবশ্যই – যদি আটকায়, ফিরে আসব, তবু, মাত্র ছ কিলোমিটার দূরত্বে আরেকটা লেক না দেখে ফিরে আসব? যাইই না, ট্রাই করি।

    আসল নাম সো লামো। তিব্বতী ভাষায় সো মানে লেক, হ্রদ। প্যাংগং সো, সো মোরিরি ইত্যাদি। সো লামো কথ্য ভাষায় চোলামু হয়ে গেছে। লেকের ইতিহাস-টাস লিখছি না এখানে, কারণ ওগুলো উইকি করলেই পাওয়া যায়। এটা একেবারে তিব্বত বর্ডারে অবস্থিত বলে পারমিট দেওয়া হয় না এখানে আসার, তবু চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? দিল্লি থেকে প্রায় দু হাজার কিলোমিটার চালিয়ে এতদূর এসেছি, আর ছ কিলোমিটারের জন্য একবার চেষ্টা করব না?

    গুরুদোংমারকে বাই বাই করে নেমে এলাম পাকা রাস্তায়। এবার বাঁদিকে মিলিটারি চেকপোস্টের দিকে না গিয়ে ডানদিকে টার্ন নিলাম। ত্রিসীমানায় কোথাও কেউ নেই। অনেকটা এগোবার পর দূরে একটা লেকের মত কিছু মনে হল দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তার আগেই একটা ব্যারিকেডের মত গেট, এবং সেখানে দুজন আর্মির লোক দাঁড়িয়ে। আমাকেও সেখানে গিয়েই দাঁড়াতে হল। পেপার দেখানোর গল্পই নেই, কারণ পেপার সমস্তই গুরুদোংমারের এগারো কিলোমিটার আগের চেকপোস্টে জমা করে রাখা আছে। একবার রিকোয়েস্ট করলাম, জাস্ট চোলামু দেখেই ফিরে যাবো, বাইকের নাম্বারপ্লেট দেখিয়ে বললাম, দিল্লি থেকে এতটা এসেছি। কিন্তু মিলিটারি কথা শুনবে না, সে জানাই ছিল, শুনলও না। জাস্ট ওখানে দাঁড়িয়ে দূরে একটা লেকের এক চিলতে দেখতে পেলাম, সম্ভবত সেটাই চোলামু। জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাওয়া গেল না, আমাকে বার বার বলা হল ফিরে যেতে। তো, ঐটুকু দেখেই বাইক ঘোরাতে হল।

    ঠিক সাড়ে বারোটায় আগের চেকপোস্টে ফিরে এসে কাগজপত্র ফেরত নিয়ে লাচেন ফেরার রাস্তা ধরলাম। সেই একই হাড়ভাঙা ঝাঁকুনির রাস্তা। থাঙ্গু ঢোকার একটু আগে মনে হল এবার আমার মোটরসাইকেল ক্যারিয়ারের ডানদিকটা থেকেও কেমন যেন আওয়াজ বেরোচ্ছে। দাঁড়ালাম – সে মানে এমনই এবড়োখেবড়ো যে ঠিকমত স্ট্যান্ডও দেওয়া যাচ্ছে না মোটরসাইকেলে। হ্যাঁ, ডানদিকের ফ্রেম যেখানে বাইকের পেছনদিকে মোটা স্ক্রু-নাট দিয়ে কষে বাঁধা, সেই স্ক্রু-নাটও ঢিলে হয়ে আসছে – যদিও খুলবে না। আমার কাছে স্ক্রু টাইট করার মত কিছুই নেই, হাতে করেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলাম, খানিক ঘুরল, কিন্তু আওয়াজ তাতে কমল না, তবে এটুকু দেখে বোঝা গেল যে খুলে বেরিয়ে আসবে না। কোনওরকমে লাচেন পৌঁছতে পারলে হয় এবার – কষে লাগেজের সঙ্গে ফ্রেমটাকে বাইকের সাথে পেঁচিয়ে বানজি কর্ড দিয়ে বেঁধে ফেললে আর আওয়াজ করবে না।

    থাঙ্গুর কাছে দেখি একটা ছোট্ট দোকানের সামনে সেই টাতা সুমোটা দাঁড়িয়ে আছে, যে গাড়ির বয়স্কা মহিলা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দেখে আমিই দাঁড়ালাম। মহিলার ছেলে এগিয়ে এলেন। মায়ের শরীর এখনও ঠিক হয় নি। আমি বললাম, তা হলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন, তাড়াতাড়ি নিচে নেমে যান। আপনাদের আজ কোথায় বুকিং আছে?

    ভদ্রলোক বললেন, আজ তো গ্যাংটক ফেরত যাবার ছিল – কিন্তু কী করে যাই – মায়ের অসম্ভব মাথায় যন্ত্রণা করছে।

    আমি বললাম, কাঁচি আছে?

    – আজ্ঞে?

    – কাঁচি ব্লেড – যা হোক একটা দিন, আমি আমার স্ট্রিপ থেকে দুটো ডায়ামক্স কেটে দিচ্ছি।

    দোকান থেকেই একটা কাঁচি এনে দুটো ডায়ামক্স ওঁকে দিলাম, বললাম, কিছু একটা খাইয়ে এক্ষুনি এটা খাইয়ে দিন, আর যত নিচে নামবেন, তত ঠিক বোধ করবেন উনি – এর আর কোনও চিকিৎসা নেই। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে, যত কষ্টই হোক, আপনারা নিচে নামতে থাকুন।



    সাড়ে তিনটের সময়ে লাচেনে ঢুকলাম। ছিরিন আমার জন্য দাঁড়িয়েই ছিল। কলকাতার ছেলেগুলোও নাকি ফিরে এসেছে, অনুপ তো ফিরে এসে থেকেই তিনটে লেপের তলায়, একেবারে কাহিল হয়ে গেছে ছেলেটা। আমিই আসা বাকি ছিলাম। তাড়াতাড়ি নিচে গিয়ে অনুপকে দেখলাম। গলা দিয়ে প্রায় আওয়াজ বেরোচ্ছে না, কুঁইকুঁই করছে। সেইভাবেই জানাল, ও ঠিক আছে, আজ রাতেই গ্যাংটক পৌঁছবে।

    আমি বললাম, বস, পাগলামি কোরো না। গ্যাংটক ফেরার অবস্থায় তুমি একেবারেই নেই। হোটেল তোফা রয়েছে, এখানে আজ রাতটা থেকে যাও, আমি ওষুধ দিচ্ছি, কাল সকালের মধ্যে চাঙ্গা হয়ে যাবে।

    অনুপ তাও অ্যাডামেন্ট – যেতে ওকে হবেই, কাল ওকে জয়গাঁও পৌঁছতে হবে, পরশু ভুটানে এন্ট্রি নিতে হবে। শেষমেশ অনেক বোঝানোর পর সাব্যস্ত হল, ও আরও ঘন্টাদেড়েক বিশ্রাম করে বেরোবে, তবে গ্যাংটক নয় – মঙ্গনে আজ রাতটা থাকবে। কাল সকালে মঙ্গন থেকে সোজা জয়গাঁও চলে যাবে, এমন কিছু বাড়তি দূরত্ব হবে না। মঙ্গনে সেই সুনীলের ধাবায় রাত কাটানোর একটা বন্দোবস্ত নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।

    অনুপ রাজি হল। ছিরিনকে ডেকে বললাম, ওকে এক প্যাকেট বিস্কিট দাও। আমার কাছে নরফ্লক্স গোটা পাতাটাই পড়ে ছিল, সেখান থেকে চারটে ট্যাবলেট ওকে দিয়ে বললাম, বিস্কিট খেয়ে একটা খেয়ে নাও, রাতের মধ্যে যদি বেটার না লাগে, তা হলে আরেকটা খেয়ে নেবে। কাল সকালে চাঙ্গা হয়ে যাবে।

    চারটে বেজে গেছে। ছিরিন তাড়া লাগাচ্ছে লাঞ্চের জন্য, আজ চিকেন বানিয়েছে স্পেশালি। অনুপ তো খাবার অবস্থায় নেই, আমিই পেটপুরে চিকেন আর গরমাগরম ভাত খেলাম। সাথে আলুভাজা আর ডাল – আহা!

    খেতে খেতে ছিরিন আর তার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হল। ছিরিন এখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী, হোটেলটা স্ত্রীর নামে। স্ত্রী-র হাতের রান্না খুবই ভালো, তিনিই রান্নাটা দেখেন, আর ছিরিন হোটেল বিজনেসের বাকিটা দেখে। তখনই প্রথম ছিরিনের পুরো নামটা জানলাম।

    খাওয়া শেষ, এবার বিল মেটানোর পালা। ছিরিন বিল আনল, চোদ্দশো টাকা। আমি তো অবাক! থাকার খরচাই আমার একার ছিল সাতশো টাকা – সেখানে দুজনের থাকা খাওয়া মিলিয়ে চোদ্দশো টাকায় হল কী করে?

    ছিরিনই বুঝিয়ে দিল, রুম তো স্যার আপনারা ঐ একটাই নিয়েছেন, তাই রুমের কোনও এক্সট্রা চার্জ নেই। বাকি সাতশো শুধু কাল রাতের আর আজ দুপুরের খাওয়া আর সকালের ব্রেকফাস্ট। দুজনকার মিলিয়ে।

    আমি জাস্ট মুগ্ধ। ছিরিন আমার লাগেজ বাইকে বাঁধতে পুরো সাহায্য করে দিল, কোথা থেকে অনুপের জন্য বিস্কিটের প্যাকেট এনে দিল। এবার যাবার সময়। নিচে অনুপের কাছ থেকে ফাইনালি বিদায় নিয়ে আবার ওপরে এলাম। অনুপের সাথে আর দেখা হবার নেই। বললাম, জয়গাঁও পৌঁছে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে জানিও।

    ওপরে এসে ফাইনালি ছিরিনের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। দুহাতে জড়িয়ে না ধরে উপায় ছিল না। এই মানুষগুলোর সাথে দেখা হবার জন্যই তো রাস্তায় বেরোই, এমন সোনার মন, এতটা আতিথ্য, আশা করি নি। ছিরিনকে বললাম, লাচুং পৌঁছে ওকে খবর দেব।

    সাড়ে পাঁচটায় স্টার্ট করলাম। এবার চুংথাং অবধি নিচে নামা – তার পরে ওপরে ওঠা। চুংথাং নেমে আসতে আসতেই অন্ধকার ঘনিয়ে এল। পূর্বপ্রান্ত, তাই সন্ধ্যেও তাড়াতাড়ি হয়। এবার এগনো লাচুংয়ের দিকে। সোজাই রাস্তা। লাচুং হোমস্টে, যেখানে আমার বুকিং করা, সেখানে লোকটিকে একটু আগেই ফোন করে ডিরেকশন বুঝে নিয়েছি। লাচুংয়েরও একটা তোরণদ্বার আসবে, সেইখান থেকে দু কিলোমিটার আগে এগিয়ে ওকে ফোন করলেই ও চলে আসবে। তবে আমিও জিপিএসে সেট করে নিয়েছি ডেস্টিনেশন, অসুবিধে হবার কথা নয়।

    চুংথাং থেকে প্রথম পাঁচ কিলোমিটার বেশ খারাপ রাস্তা, তার পরে আবার রাস্তা ভালো হয়ে গেল। প্রায় আটটা নাগাদ হঠাৎ দেখি লোকবসতি শুরু হয়ে গেল, একটা দুটো হোটেল, দোকানপাট, সবকিছুতেই লাচুং লেখা। আমি কি লাচুং ঢুকে গেছি? তোরণ তো কই দেখতে পেলাম না? কী করব? লোকটাকে ফোন করব? নাকি জিপিএস ধরেই এগোব?

    জিপিএস ধরেই এগোই। আরেকটু এগোতেই চোখে পড়ল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, লাচুং ব্র্যাঞ্চ। জিপিএস আরেকটু এগিয়ে ইঙ্গিত করল ডানদিকে টার্ন নিতে। সেখানে ঢুকে একটা জায়গায় এসে বলল, ইওর ডেস্টিনেশন ইজ অন দা লেফট। আমি এদিক তাকালাম, ওদিক তাকালাম, মাঝারি থেকে বড়মাপের বেশ কিছু হোটেল এদিক ওদিক, কিন্তু আমার সেই হোমস্টে কোথায়?

    অগত্যা ফোন লাগাতে হল। সে ফোন তুলে বলে, তুমি কোথায়? এইবারে আমি পড়লাম মুশকিলে, আমি কোথায় সে তো আমি নিজেই জানি না – আমি বললাম, জাস্ট তিনশো মিটার আগে আমি একটা স্টেট ব্যাঙ্ক পেরিয়ে ডানদিক নিয়েছি। হোমস্টের লোকটা শুনে বলল, আরে আরে, তুমি তো পেরিয়ে এগিয়ে গেছো – ফিরে এসো। আমি – কোথায় ফিরব? লোকটা বলল – এক কাজ করো, স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে চলে এসো, আমিও আসছি ওখানে, তোমাকে রিসিভ করে নেব।

    ফিরতে গিয়ে হল কেলো। স্টেট ব্যাঙ্ক কোন রাস্তায় যেন পেরিয়ে এসেছিলাম? খুঁজে পাচ্ছি না তো!

    দাঁড়ালাম। দুটো লোক আসছে। হাত নেড়ে ডাকলাম – ভাই, স্টেট ব্যাঙ্ক কিধার পড়েগা?

    লোকদুটো খুব একটা বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হল না – উলটে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কেয়া কাম হ্যায়? আমি বললাম, কিসিকো আনা হ্যায় উধার, মিলনা হ্যায়, লোকদুটো শুনে আরও উলটো জবাব দিল – লেকিন স্টেট ব্যাঙ্ক তো আভি বনধ হ্যায়।

    এ কি খিল্লি করছে নাকি আমার সাথে? আমি কি রাত্তির সাড়ে আটটার সময়ে টাকা জমা দেব বলে স্টেট ব্যাঙ্ক খুঁজছি? ধৈর্য ধরে বললাম, আমার ব্যাঙ্কে কাজ নেই, ব্যাঙ্কের সামনে একজন আসবে, তার সাথে দেখা করতে হবে, ব্যাঙ্কটা কোন রাস্তায় যাবো, বলে দাও –

    নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও সামনের দিকে হাত দেখিয়ে একজন বলল, আগে চলা জাও।

    আমি আবার বাইকে স্টার্ট দিলাম, এবং, যেখানটায় দাঁড়িয়ে আমরা এতক্ষণ কথা বলছিলাম, সেখান থেকে ঠিক পঞ্চাশ মিটার আগেই ছিল স্টেট ব্যাঙ্কটা। সেখানে দাঁড়াতেই একটা ছেলে এগিয়ে এল, অত্যন্ত সুদর্শন, কমবয়েসী একটা সিকিমিজ ছেলে – তুমি সিকি? দিল্লি থেকে? আমি ঘাড় নাড়তেই হাত বাড়িয়ে বলল, আমি সোনম, আমিই তোমার সাথে ফোনে কথা বলছিলাম।

    সোনম একটা মোটরসাইকেলে করে আমাকে পথ দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে চলল তার বাড়িতে। স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে একটু পিছিয়ে একটা ঢালু রাস্তা, এদিক ওদিক সেদিক বেঁকে কীভাবে যেন আমাকে নিয়ে গিয়ে ফেলল ওদের বাড়িতে। লাদাখ হলে বলতাম, টিপিকাল লাদাখি বাড়ি, কিন্তু সিকিম, তাই এটা সিকিমের বাড়ি। একদিকের দেওয়াল বানানো টুকরো টুকরো কাঠ গুঁজে গুঁজে, বড় একটা উঠোন, সামনে আংটা থেকে ঝোলানো আছে এক কাঁদি ভুট্টা। মানে গুচ্ছখানেক ভুট্টা একসাথে বেঁধে ঝোলানো আছে – দেখে মনে হচ্ছিল কলার কাঁদির মত।





    চারখানা খাট পাশাপাশি রাখা একটা ঘর। বিশাল বড়। রাত নটা বাজে। ছিরিনকে ফোন করে দিলাম, বাড়িতে ফোন করলাম – এর পরে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসা। প্রথমে সোনম আলাপ করিয়ে দিল ওর মায়ের সাথে, মিষ্টিমতন দেখতে সিকিমিজ বয়স্কা মহিলা, হিন্দি প্রায় বলতে পারেন না, সোনম বুঝিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। যেমন হয়ে থাকে, আমি কে, কোথা থেকে এরসেছি, বিয়ে করেছি কিনা ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর পেয়েই তিনি থামলেন, কারণ চা হয়ে গেছিল। বিশাল বড় একটা কাপে করে চা, আর সাথে ভুট্টাভাজা, চুল্লির সামনে বসে। পাশে একটা পেটমোটা বেড়াল। আহা, হামিনস্তো হামিনস্তো ব্যাপার।

    সোনমের সাথে আলাপ হল। ছাব্বিশ বছরের যুবক, হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ দিয়ে দুবাইতে একটা বিশাল বড় হোটেলে চাকরি পেয়েছিল। কিন্তু লাচুং ওকে টানছিল – তাই দুবাইকে বাই বাই করে ও চলে আসে এইখানে, এসে হোমস্টে-র বিজনেস খুলেছে।

    কথা বলতে বলতেই রাতের খাবার এসে গেল। রুটি তরকারি ভাত ডাল আর ডিমের ঝোল। সোনম বলল, ডালটা শুধু মা বানিয়েছে – বাকি সমস্ত আমার নিজের বানানো।

    মাইরি বলছি, আমি যদি মেয়ে হতাম বা সোনম যদি মেয়ে হত, তক্ষুনি প্রপোজ করে ফেলতাম। ফাটাফাটি হ্যান্ডসাম দেখতে, তার এমন সুন্দর রান্নার হাত – কী আর বলব।

    খেতে খেতে পরের দিনের প্ল্যান হল। আমি সকালবেলায় বেরিয়ে ইয়ুমথাং আর জিরো পয়েন্ট ঘুরে দুপুর বেলাতেই ফিরে আসতে পারব, এমন কিছু দূরে নয়। আর এই সময়ে তো ইয়ুমথাংয়ে কিছুই দেখার নেই। মানে কোথাওই কিছু দেখার নেই, জাস্ট টাচ করে ফিরে আসা, ইয়ুমথাংয়ে ছোট বাজার বসে, ওখান থেকে কিছুমিছু কিনতে পারি। দুপুরে ফিরে এসে এখানেই লাঞ্চ সারব, তার পরে গ্যাংটকের দিকে ফেরত, সন্ধ্যের মধ্যে গ্যাংটক ফিরে আসতে পারব আরামসে।

    সাড়ে দশটা বাজে। সকাল থেকে প্রচুর চলা হয়েছে, এইবারে ঘুমোতেই হবে। হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসছি, সোনম খুব কিন্তু কিন্তু স্বরে আমাকে প্রশ্ন করল, ইয়ে, কালকে দুপুরের জন্য – তুমি, তুমি কি মুর্গী খাও?

    আমার প্রশ্নটা বুঝতে তিরিশ সেকেন্ড মতন লাগল – তারপরে বললাম, সোনম, ধরে নাও আমি মুর্গীই খাই। আরও অনেক কিছুই খাই – কিন্তু চিকেন দিব্যি ভালোবেসে খাই। আর দুপুরে রুটি করতে হবে না, ভাতই খাবো তোমার রাঁধা চিকেনের ঝোল দিয়ে। … সোনম শুনে এত খুশি হল, কী বলব, মুখে প্রায় হাজার ওয়াটের এলইডি বাল্ব জ্বলে উঠল। বলল, কালকে তোমাকে আমার স্পেশাল চিকেন কারি বানিয়ে খাওয়াবো।

    ঘুম ঘুম ঘুম। কাল বেশি ভোরে ওঠার গল্প নেই। সাতটায় উঠে সাড়ে আটটায় বেরোলেই চলবে।



    (এই ছবিটা অনুপ তুলে দিয়েছে।)
  • de | 24.139.119.172 | ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১৫:১৮370681
  • খুব ভালো - তবে বড্ড হেকটিক - কোথাও বসে রেস্ট নেওয়া নেই - আমি আবার একটু রয়েসয়ে পথচলা পছন্দ করি -
  • ল্যাগব্যাগর্নিস | 128.185.75.71 | ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১৫:২৬370682
  • নর্থ সিকিমে রয়েসয়ে পথ চলার উপায় নেই। আপনার জানমাল গাড়ির ড্রাইভারের হাতে, এবং নর্মালি সে রয়েসয়ে চলবে না (চেনা ড্রাইভার না হলে) - কারণ এই সব জায়গা থেকে গাড়ি চালু করার ফল হল বিরাট কম্পিটিশন - সেখানে ওই টু নাইট থ্রী ডেজ প্যাকেজ যত তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারবে তত আরেকটা ট্রিপের চান্স বাড়বে।

    নিজের গাড়ি নিয়ে যেতে দেবে না যতদূর জানি। বাইকের ক্ষেত্রে আলাদা নিয়ম মনে হয়।
  • সিকি | 158.168.40.123 | ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১৭:৩৬370683
  • হুঁ, প্রাইভেট কার একটিও দেখি নি।
  • সিকি | 158.168.40.123 | ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১৭:৪০370684
  • হেকটিক - ইয়েস। টোটাল আঠেরো দিন রাস্তায় ছিলাম, শুধু তিনদিন অলমোস্ট নো-রাইড দিবস গেছে। পনেরো দিনে একান্নশো কিলোমিটার, মানে গড়ে সাড়ে তিনশো কিমি প্রতিদিন।

    আই লাভ্ড ইট :) আজ থেকে তিরিশ চল্লিশ বছর পরে, যখন আর সেইভাবে চলাফেরার অবস্থায় থাকব না, মনে কোনও রিগ্রেট থাকবে না সেদিন।
  • স্বাতী রায় | ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১৯:৫১370685
  • পড়ছি না নিজেই ঘুরছি তা গুলিয়ে যাচ্ছে। ঝকঝকে লেখা আর মন কাড়া ছবি। আর নিজের কোন কিছু না চালাতে পারার দুঃখটা উথলে উঠছে।

    চিরাগ দ্য ধাবা র সুনীলকে স্যালুট।
  • সিকি | ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ ১৮:২২370687
  • ছাব্বিশে অক্টোবর, সপ্তম দিন

    না, লাচেনের মত ঠাণ্ডা লাচুংয়ে নেই। অথবা হতে পারে গত দুদিন ধরে লাচেনের ঠাণ্ডা সয়ে আসার পর এখন আর লাচুংয়ের ঠাণ্ডা গায়ে লাগছে না। নইলে ঘুম থেকে উঠে, দরজা খুলতেই তো দিব্যি দেখতে পাচ্ছি যে চারপাশে বরফঢাকা পাহাড়েরা ঝকমক করছে সকালের রোদ্দুরে। ঠাণ্ডা। গা জুড়িয়ে দেওয়া হাওয়া।

    সকাল সাড়ে ছটা। সোনম উঠোনে দাঁড়িয়ে একটা গাঁটরিতে অনেক গাছের শুকনো ডাল, মানে জ্বালানী কাঠ, বাঁধছে। আমাকে দেখেই একগাল হেসে বলল, ব্রেকফাস্ট রেডি – হাতমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নাও।

    হাতমুখ ধুলাম। এক জেরিক্যান পেট্রল বাকি ছিল, সেটাকে ঢেলে বাইকের ট্যাঙ্ক আবার ফুল করলাম। আজকে লম্বা জার্নি আছে। গ্যাংটক অবধি যেতে হবে সন্ধ্যেবেলায়। ব্রেকফাস্ট সেরে, জ্যাকেট গ্লাভস ইত্যাদি পরছি, সোনম ঘর থেকে একটা জিনিস নিয়ে এসে আমার হাতে দিল। চেস্টগার্ড। বেশ মোটা শক্তপোক্ত এবোনাইট বা ফাইবারের বর্মমত, স্ট্র্যাপ দিয়ে পিঠের দিকে আটকে নেওয়া যায়। সোনম বলল, এটা ঠাণ্ডা হাওয়া আটকায় – সরাসরি বুকে এসে লাগে না, ঠাণ্ডা লাগার হাত থেকে বাঁচায়।

    জিনিসটা অতীব আরামদায়ক, পরামাত্র মনে হল ঠাণ্ডাটা যেন আরও অনেকটা কমে গেল। সোনমকে ধন্যবাদ জানিয়ে আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম।



    আজ রাস্তা বেশ ভালো, আকাশ একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার, নীল রঙে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। লাচুং থেকে বেরিয়ে খানিক এগোতেই প্রথম চেকপোস্ট, কপি জমা করে আবার এগোলাম। ইয়ুমথাংয়ের জন্য কিছুদূর অন্তর অন্তর মাইলস্টোন দেখাই যাচ্ছে, মনের আনন্দে চলতে থাকলাম। বেশ খানিকটা এগোবার পর আরও বেশ কয়েকটা ট্যুরিস্ট ক্যাব চোখে পড়ল, পর পর যাচ্ছে সব – জিরো পয়েন্টের দিকেই। রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে, মাঝে মাঝে এদিক ওদিক দিয়ে কিছু কাঁচা শুঁড়িপথ টাইপের রাস্তা নেমে গেছে নিচের দিকে। এমনি একটা কাট পেরোবার পরেই হঠাৎ দেখি একটা ক্যাব, মেন রাস্তা ছেড়ে নিচের দিকের কাঁচা রাস্তায় নেমে গেল। আমি সোজাই এগোচ্ছিলাম, ক্যাবটার তারস্বরে হর্ন বাজানো দেখে থামতে হল। ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি, ড্রাইভার আমাকেই ইশারা করছে বার বার হর্ন বাজিয়ে। হাত নেড়ে বলল, নিচে এসে ওকে ফলো করতে।

    কেন? কেসটা কী? দিব্যি পাকা রাস্তা – খামোকা নিচে নামতে যাবোই বা কেন? আর সে কোথায় যাচ্ছে আমি তো জানি না – আমি কোথায় যাচ্ছি, তারও জানার কথা নয়। … তাও, কী ভেবে বাইক ঘুরিয়ে নিচের রাস্তাতেই এগোলাম। এই সব জায়গায় খারাপ কিছু হবার চিন্তা দূর দূর পর্যন্ত মনেও আসে না, ড্রাইভারও লোকাল, ক্ষতি কিছু হবে না, একবার নেমে জেনেই আসি, কেন ডাকছে।

    কিন্তু, নামতে শুরু করতেই সামনের ক্যাবটা চলতে শুরু করল ব্লিঙ্কার জ্বালিয়ে – মানে, মোটামুটি যা বুঝলাম, ও আমাকে বলছে ওকে ফলো করে চলতে। তাই চললাম।

    খানিক এগোবার পরে রাস্তা একেবারেই নেই হয়ে গেল, একটা শুকনো ঝোরার খাত, বড়মেজ বোল্ডার ছড়ানো। তার ওপর দিয়ে গাড়িও চলল, আমিও চললাম। কী ভেবে যে তার পিছু নিয়েছিলাম, জানি না, কেবল এটুকু বুঝতে পারছিলাম এটা একটা অল্টারনেট রাস্তা, চলার জন্য। মূল রাস্তা কি আগে কোথাও বন্ধ আছে, তাই ডাইভার্সন? – বেশ অনেকটা যাবার পর আবার মনে হল মূল রাস্তায় এসে মিশলাম, আবার মাইলস্টোন দেখতে পেলাম রাস্তার ধারে, আর ভালো রাস্তা পেয়েই সামনের ক্যাবটা হুউশ করে স্পিড বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। জিজ্ঞেসও করতে পারলাম না, কেসটা কী ছিল।

    যাই হোক, আবার পরিষ্কার রাস্তা। ইয়ুমথাং দশ কিলোমিটার আর। কোনও এক শিবমন্দির সতেরো কিলোমিটার। পৌনে দশটার মধ্যে ইয়ুমথাং পৌঁছে গেলাম।

    নভেম্বর মাসে সেখানে কিছুই দেখার নেই। রাস্তার দুপাশে রকমারি স্যুভেনির আইটেমের পশরা সাজিয়ে বসেছে স্থানীয় দোকানীরা। একটা জায়গায় একটা বোর্ড বসানো, হট স্প্রিং, আর ডানদিকের জঙ্গলটা দেখে মোটামুটি আন্দাজ করা গেল এটাই রডোডেনড্রন ভ্যালি। এপ্রিল মাসে এখানে ফুলে ফুলে ভরে যায়।

    দোকানীরা সকলেই মেয়ে, কেউ কেউ আবার অসম্ভব রকমের সুন্দরী। হাতছানি উপেক্ষা করা খুবই কঠিন কাজ। তবুও এগোতে হবে। ছোট্ট ফটো স্টপ সেরে নিয়ে তাদের দু একজনকে জানালাম, জিরো পয়েন্ট দেখে এখান দিয়েই ফিরব, তখন কিছু কিনব। … কিনতে হবেই কিছু অফিসের সহকর্মীদের জন্য, বাড়ির লোকেদের জন্য। এখানে ভালো ভালো কিছু গিফট আইটেম পাওয়া যাচ্ছে।





    এগোলাম। খানিক এগোতেই একটা আধভাঙা ফটক টাইপের কিছু এল, তাতে কিছু একটা স্যাংচুয়ারির নাম লেখা। ভেতরে খানিক যাবার পরেই আবার রাস্তা নেই হয়ে গেল, খানিক ভাঙাচোরা কংক্রিট, খানিক বোল্ডার, এবার তার সঙ্গে যুক্ত হল বয়ে যাওয়া জলের ধারা। তার মধ্যে দিয়েই বাইক চালিয়ে নাচতে নাচতে এগিয়ে যাওয়া। আবার খানিকক্ষণ বাদে পাকা রাস্তা ফিরে এল, এবং তার পরেও খানিক এগোবার পরে দেখা গেল মিলিটারি চেকপোস্ট। জিরো পয়েন্ট আর আট কিলোমিটার।

    ভেতরে বসা জওয়ানটি বেরিয়ে এলেন, পারমিটের একটা কপি নিলেন, এবং জিজ্ঞেস করলেন – দিল্লি সে আয়ে হো?

    ওনার বাড়ি চণ্ডীগড়ে। খানিকক্ষণ গল্প হল, তার পরে বললেন, এর পরে বাকি রাস্তাটুকু কিন্তু ক্যামেরা অন করবেন না। মিলিটারি এলাকা, এখানে ছবি তোলা বারণ, একেবারে জিরো পয়েন্টে পৌঁছে ছবি তুলবেন। আর জিরো পয়েন্টে পৌঁছে দেখবেন ওখানে এই পাকা রাস্তা শেষ হয়ে গেছে, ওখান থেকে একটা কাঁচা রাস্তা পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। ঐ কাঁচা রাস্তায় ভুলেও এগোবেন না। যদি ওখানে আপনাকে আর্মি ধরে ফেলে, কেউ ছাড়াতে আসবে না।

    বাপ রে! এইভাবে ভয় দেখিয়ে দিলে আর কেউ ক্যামেরা বের করে নাকি? মানে, আলাদা করে ছবি তোলার কিছু ছিলও না – রাস্তা আগেও যতটা সুন্দর ছিল, এখনও ততটাই সুন্দর। ক্রমশ রাস্তা খারাপ হচ্ছে, গাছপালা একেবারে কমে গেছে চারদিকে, এই রকম সময়ে একটা বাঁক ঘুরতেই চোখে এল একটা বিস্তীর্ণ উপত্যকার মত অঞ্চল। চারপাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধবধবে সাদা পাহাড়ের চূড়োরা, সামনে দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে একটা সরু জলধারা, গ্রীটিংস কার্ডে আঁকা ছবির মত তার ওপরে কেউ একটা ছোট্ট সাঁকো বানিয়ে দিয়েছে। তার সাথে এক ঝাঁক টুরিস্ট, গাড়ির লাইন, ম্যাগি কফি কুড়কুড়ের গোটা দশেক স্টল। বাইকার কেউ নেই। আমি একাই। ফলে লোকে একটু ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে, অবভিয়াসলি।




    অসম্ভব সুন্দর জায়গা। স্রেফ ছুটে বেড়ানোর জন্য বেরিয়েছি, তাই সময় নেই। ফিরতেই হবে। আধঘণ্টা কাটালাম। এক দল গুজরাতি, এবং আরও একটা কাপলের অনুরোধে তাদের ছবি তুলে দিয়ে তাদের দিয়েই আমারও ছবি তুলিয়ে নিলাম।



    এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথে ইয়ুমথাংএ একটু দাঁড়ালাম। দু চারটে দোকান ঘুরে কিছু টুকটাক জিনিস কিনলাম। এমনিতেই এই সময়ে এখানে টুরিস্ট খুব বেশি আসে না, ফলে যা হয়, আমাকে কেনাকাটা করতে দেখে আশপাশের সমস্ত দোকানীরা এসে প্রায় ছেঁকে ধরল আমাকে। যাই হোক, দু-তিনটে দোকান ঘুরে কয়েকটা জিনিস নিয়ে বাইকের ক্যারিয়ারে বাঁধছি, এই সময়ে একজন বয়স্কা দোকানী, কাছে এসে একটানা বলতে লাগলেন, ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে – আমার দোকানে এসে ম্যাগি খাও, চা খাও।

    আমার একেবারে খাবার ইচ্ছে ছিল না, কারণ এক তো, সময় কম, ফিরতে হবে, দুই, সোনমের বাড়িতে দুপুরে খাবারের কথা হয়ে আছে। এখানে ম্যাগি খেয়ে আমি পেট ভরাতে চাই না, আর আমি চাতাল নই, বাড়ির বাইরে আমি সাধারণত চা খাই না। মৃদু স্বরে বললাম, নেহি জি, আভি কুছ নেহি খানা হ্যায়। মহিলা তবুও নাছোড়বান্দা, খাও না, খাও না, খাও না, আমাকে ততবারই বলতে হচ্ছে, না, খাব না, এখন খাবার ইচ্ছে নেই, পরে কখনো এলে আপনার দোকানেই খাবো।

    বাঁধাছাঁদা শেষ করে আমি বাইকে যখন চড়ে বসলাম, মহিলা তখন বুঝলেন যে আর ঘ্যানঘ্যান করে লাভ নেই, এ সত্যিই খাবে না। ওনার মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেল, কেমন এক্কাদোক্কা খেলার ভঙ্গিতে এক পা দু পা করে নাচতে নাচতে ঘুরতে লাগলেন আমার সামনে, আর আমাকে মুখ ভেঙিয়ে ইমিটেট করতে শুরু করলেন – নেহি জি, নেহি খাউঙ্গা, কুত্তে, নেহি খাউঙ্গা, কুত্তে, হারামি, কুত্তে, হারামি …

    রাগ দেখিয়ে লাভ নেই, ইনি খুব ভালো হিন্দি বলতে বা বুঝতে পারেন না, খালি হেসে বললাম, গাল দিচ্ছেন? কেন?

    মহিলার ভ্রূক্ষেপ নেই, উনি সমানে নেচে যাচ্ছেন আর আমাকে উদ্দেশ্য করে চোখমুখ বেঁকিয়ে কুত্তা-হারামি বলে যাচ্ছেন। আমি আবারও হেসে বললাম, আমি কিন্তু ফিরে গিয়ে সবাইকে বলব আপনি আমাকে এইভাবে গাল দিচ্ছেন। কেউ আসবে না আর আপনার দোকানে চা খেতে …

    মহিলা একই রকম। খুব নিচু গলায় একইরকম ভাবে বলে যাচ্ছেন, কুত্তা, হারামি, নেহি খাউঙ্গা জি বোলতা।

    আমি আশেপাশের দোকানে তাকালাম। কেউ শুনতেও পাচ্ছে না, কেউ কিছু বলতেও আসছে না, ন্যাচারালি। মহিলার সম্ভবত মাথা খারাপ, কিংবা উনি হয় তো দুটো হিন্দি গালাগাল শিখেছেন, কাউকে দেবার সুযোগ পান নি, আমাকে একলা অপরাধী পেয়ে আমার ওপরেই ঝেড়ে যাচ্ছেন। ইগনোর করাই ভালো। বাইকে স্টার্ট দিলাম, এবং বেরিয়ে গেলাম। আবারও সেই জায়গা এল, যেখান থেকে আমি ক্যাব ড্রাইভারের কথামত ডাইভার্সন নিয়েছিলাম বোল্ডারের ওপর দিয়ে, কিন্তু এখন তো মেন রাস্তা দিয়েই এলাম, কোথাও কোনও অবস্ট্যাকল তো নেই! … রহস্যই রয়ে গেল।





    তিনটের সময় ফিরলাম। লাচুং ঢুকতেই ফোনে নেটওয়ার্ক এসে গেছিল, আর আসামাত্রই নীলাদ্রিদা-র ফোন। বললাম, বেরোতে বেরোতে চারটে বেজে যাবে, মঙ্গন পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে ছটা তো বাজবেই। নীলাদ্রিদা বলল, কোনও চিন্তা নেই, আমি সেই মতন অফিস থেকে বেরোব, তুই শুধু চুংথাং এলে আমাকে একবার ফোন করে দিস। আর তোর ভিসার কাগজ প্রিন্ট নেওয়া হয়ে গেছে।

    সোনমের ডাইনিং রুমে বসে যে মাংসভাত খেলাম, অনেকদিন তার স্বাদ মনে থাকবে। প্রতিটা পিস তারিয়ে তারিয়ে খেলাম, এতটাই উমদা হয়েছিল। সাথে পাঁপড়, তরকারি, চাটনি, ডাল। একেবারে বাঙালি রান্না যাকে বলে। খেয়ে উঠে বাইকে এইবারে লাগেজ বাঁধাছাঁদা শুরু। তার আগে চাকায় একটু হাওয়া ভরে নিতে হবে। আমার কাছে টায়ার ইনফ্লেটরটা ছিল, সেইটা লাগাতেই সোনম কাছে ঘেঁষে এসে চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগল। বাইকের ব্যাটারি থেকেই পাওয়ার নিয়ে বাইকের চাকায় হাওয়া ভরা, ব্যাপারটা ওর কাছেও নতুন। খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, আমার মোটরসাইকেলেও একটু হাওয়া ভরে দেবে? লাচুংয়ে কোনও হাওয়া ভরার দোকান নেই, সেই চুংথাং গিয়ে ভরতে হয়।

    ভরে দিলাম। গা থেকে ভেস্টটা খুলে ফেরত দিলাম ওকে। অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে অবশেষে পৌনে পাঁচটা নাগাদ বেরোতে পারলাম। আজ গ্যাংটক পৌঁছতে যে কত সময় লাগবে, কে জানে! কাল সকালে তো আবার বেরনো।

    নেমে আসাটা সবসময়েই সোজা। বেশ অনেকক্ষণ মোটরসাইকেলের স্টার্ট বন্ধ রেখেই এমনি এমনি গড়াতে গড়াতে সাড়ে পাঁচটায় নেমে এলাম চুংথাং। সেখান থেকে নীলাদ্রিদাকে আরেকবার ফোন করে আবার চলা। খানিক পরেই সন্ধ্যে নেমে এল, কিন্তু তাতে আর কোনও অসুবিধে নেই, সুন্দর রাস্তা, বাইকের সমস্ত লাইটও একদম ঠিকঠাক কাজ করছে। একমাত্র অসুবিধে হল, অন্ধকার নেমে এলে চারপাশের সৌন্দর্যগুলো আর উপভোগ করা যায় না, একমনে কেবল চলতেই হয়। চলতেই হয়।

    মঙ্গনে ঢোকার মুখেই পেট্রল পাম্প পড়ে। ট্যাঙ্ক ফুল করে নিয়ে আরেকবার নীলাদ্রিদাকে ফোন করে জানানো গেল আমার অবস্থান। ঠিক সোয়া সাতটার সময়ে গিয়ে যেই দাঁড়ালাম সুনীলের সেই চিরাগ দা ধাবার সামনে। দাঁড়ানো মাত্র ফোন বাজল – ‘তুই কি এইমাত্র যে নীল রঙের মোটরসাইকেলটা যাতে নীলরঙের টুনিবাল্ব লাগানো সেইটাতে করে এসে ডানদিকের ধাবাটার সামনে দাঁড়ালি?’
    – ‘হ্যাঁ। তুমি কোথায়?’
    – ‘পেছন ফিরে দ্যাখ, আসছি।’

    পেছন ফিরে দেখি অন্ধকার ফুঁড়ে রাস্তার অন্যপ্রান্ত থেকে বেঁটেখাটো একটা ছায়ামূর্তি ঠিক একই রকম ভাবে হেলেদুলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কুড়ি বছর বাদে প্রায় দেখা, নাকি বাইশ বছর? – কিন্তু হাঁটার স্টাইল একেবারে বদলায় নি। চশমার ফ্রেমটা বোধ হয় একটু বদলেছে, চুলে পাক তো ধরেইছে, কিন্তু হাসার ভঙ্গী আর কথা বলার স্টাইলটা টিপিকাল নীলাদ্রিশেখর – অননুকরণীয়।

    সুনীলের দোকানে নয়, বসা গেল উল্টোদিকের দোকানে। চা আর স্যান্ডুইচ অর্ডার করে খানিক গল্পগাছা হল। আমার ভুটানের ভিসা একেবারে তিন তিন কপি কালার প্রিন্ট আউট করিয়ে নিয়ে এসেছে, সেসব হস্তান্তরিত হল। পুরানো সেই দিনের অনেক অনেক কথা হল। তবে বিশ বছরের জমানো কথা কি কয়েক মিনিটে শেষ হয়? তাই উঠতেই হল এক সময়ে। মঙ্গনের অনতিদূরেই ডিকচুতে একটি প্রাইভেট হাইডেল প্রজেক্ট, সেখানকার তিনি সিনিয়র ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ার। বেরোবার মুখে প্ল্যান্ট থেকে ফোন এল, অন্যপ্রান্তের কথা তো শুনতে পেলাম না, নীলাদ্রিদা শুনে টুনে বলল – ও, চোদ্দশো মেগাওয়াট নিতে পারছে না? ঠিক আছে, টারবাইনের আরপিএম কমিয়ে দেখুন বারশো মেগাওয়াট করানো যায় কিনা … হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, বারোশোতে রাখুন আমি গিয়ে দেখছি।

    সইত্যের খাতিতে বলতে হয়, সংখ্যাগুলো ঠিক বারোশো বা চোদ্দশো ছিল কিনা এতদিনে আর মনে নেই, কিন্তু কলেজ ছাড়ার পরে মাস স্কেলে এই রকমের ‘মেগাওয়াট’, ‘টারবাইন’ শুনে কেমন যেন লাগছিল – মানে, আমারও তো ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং ছিল, কিন্তু আজ তার আর একটা লাইনও মনে নেই, এইসব জার্গন শুনলে টুনলে কেমন গতজন্মে শোনা কথা মনে হয়।

    পৌনে আটটার সময়ে উঠতেই হল। আবার কবে দেখা হবে জানা নেই, সামনে এখন অনেকটা পথ পড়ে আছে – এখনও প্রায় পঁয়ষট্টি কিলোমিটার। এগোলাম। অন্ধকার রাস্তা, প্রায় কোথাওই কোনও জনবসতি নেই, মাঝমধ্যে দু একটা গ্রাম পড়ছে, সাতটা বাড়ি, দুটো দোকান, তিনটে গাড়ি – ব্যস। অর্ধেক রাস্তা পেরিয়ে আসার পরে ফোন এল হোটেল থেকে, আপনি কতক্ষণে আসবেন স্যার? বললাম, সাড়ে নটা তো বাজবেই। অন্যপ্রান্তের মহিলাটি বললেন, আসলে আমাদের কিচেন নটায় বন্ধ হয়ে যাবে, আপনি যদি এখানে ডিনার করেন তো অর্ডারটা দিয়ে দেবেন? আমরা খাবার তৈরি করে রাখব।

    উত্তম প্রস্তাব। চিকেন চাউমনের অর্ডার দিয়ে আবার বাইকে স্টার্ট দিলাম। ক্লান্ত লাগছে এইবারে।

    পৌনে দশটায় হোটেলে ঢুকলাম শেষমেশ। এবারের হোটেলটি বেশ ভালো। সুন্দর পার্কিং লট, সুন্দর রুম। বিকেল বিকেল এলে একটু আরাম করা যাত, এখন জাস্ট আর খেয়ে ঘুমনো ছাড়া আর কিছু করার নেই।

    করার অবশ্য আছে। আমার বই, যা কিনা আর কদিন পরেই প্রকাশিত হতে চলেছে – সেটি এখন প্রেসস্থ। প্রেস থেকে কিছু কারেকশন করে পাঠাতে বলেছে, অতএব, ল্যাপটপ খুলে আবার বসতে হল। প্রুফে কারেকশন সেরে টেরে মেলে ফাইনাল কপি পাঠিয়ে, অবশেষে যখন শুতে যেতে পারলাম, তখন ঘড়িতে বাজে রাত দেড়টা।

    তা ভাই, প্রসববেদনা এ রকমই হয়, সে তো আর সময় বুঝে আসে না
  • Du | 57.184.27.211 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:৪৫370688
  • অ্যাজ ইউজুয়াল পুরো লাইভ, মাইনাস পিঠে ব্যথা যেটা সত্যি সত্যি গেলে হত।
  • সিকি | ২৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০৯:২৯370689
  • দুটো ছবি বাদ পড়ে গেছে।


    এই রাস্তার ওপর দিয়ে চলতে হয়েছিল খানিকক্ষণ।


    জিরো পয়েন্টে আমার শোভন।
  • শঙ্খ | 52.110.144.183 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:১৫370690
  • টগবগে...
    পিলিয়নে বসে কোমর ধরে গেল গা।
  • সিকি | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৮:৩৬370691
  • একটা ছোট্ট হেঁহেঁ। আমার এবারের গোটা বেড়ানোটা ছোট আকারে এই মাসের ভ্রমণ পত্রিকায় আজ প্রকাশিত হয়েছে। মানে, আমি নিজে দেখি নি এখনও - তবে যারা পশ্চিমবঙ্গে আছেন, ম্যাগাজিন কর্ণার থেকে জোগাড় করে নিয়ে পড়তে পারেন।
  • de | 69.185.236.54 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৫:৪৯370692
  • দিল্লীওয়ালা সিকিমে গিয়ে গাল খেয়ে এলে! ঃ))

    ছবি আর লেখা দুটোই সুন্দর!

    কোর এঞ্জিনিয়ারিংয়ের লোক আইটি তে চলে যায় কি পরসা বেশী বলে, না কি কোরে জব সাফিসিয়েন্ট নাম্নারে নেই বলে?
  • সিকি | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১০:১৩370693
  • সাতাশে অক্টোবর, অষ্টম দিন

    ধড়মড় করে উঠে বসলাম যখন ঘুম ভেঙে, দেখলাম কাল রাতে ঘরের লাইট জ্বালিয়েই শুয়ে পড়েছিলাম। ল্যাপটপ বন্ধ করেই কখন ঘুমিয়ে গেছি খেয়াল নেই। কী সব উদ্ভুট্টে স্বপ্ন টপ্ন দেখছিলাম কে জানে – এক ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইলের সুইচ টিপে দেখি পৌনে সাতটা বাজে। সোনমের মেসেজ এসেছে, আমি গ্যংটক ঠিকঠাক পৌঁছেছি কিনা, জানতে চেয়ে। ওকে ঝটপট রিপ্লাই করে দিলাম – কত সহজে এখানকার লোকজন, কত অল্প আলাপেই এ রকম আপন হয়ে যায়।

    আজ আবার সেইখানে যেতে হবে – পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অফিসে, এইবারে ইস্ট সিকিমের জন্য পারমিট স্লিপ কাটতে যেতে হবে। তার ওপর মোটরসাইকেলের কেরিয়ারের দু দুখানা রড খুলে গেছে, ডানদিকের ফ্রেমের অন্তত দু জায়গায় স্ক্রু আলগা হয়ে সমানে ঘটঘট আওয়াজ হয়ে যাচ্ছে, সামনে এখনও বেশ কয়েক দিনের জার্নি। সমস্ত কিছু ঠিকঠাক শেপে না আনলে পরে মুশকিলে পড়তে হবে। গ্যাংটক শহরে এই সব সারানোর প্রচুর জায়গা আছে – দেখে এসেছি, যত সময়ই লাগুক, সমস্ত ঠিক করে নিয়েই বেরোতে হবে।

    সকালের ব্রেকফাস্টের জন্য অর্ডার করেছিলাম পুরি-ভাজি, সেটা আর কিছুই না, বাঙালি লুচি আর আলুর ঝোল। পেটপুরে খেলাম। ফ্রেশ টেশ হয়ে একদম পৌনে আটটায় বেরোলাম। পারমিট স্লিপ আনতে।

    আগের দিনের পুলিশটিই ছিলেন। আবার সেই চিঠি দেখানো হল – উনি জিজ্ঞেস করলেন, এবারেও কি ইস্ট সিকিম করে আবার গ্যাংটকে ফেরত আসবে?

    না, আমার আর ফেরার নেই, ওখান থেকে সোজা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে যাব। সে কথা জানাতেই ঘসঘস করে পারমিট লিখে দিয়ে আমার হাতে তুলে দিলেন। পুরো প্রসেসটায় সময় লাগে তিন মিনিট ম্যাক্সিমাম। আবার ফিরে যাওয়া সেই জেরক্সের দোকানে, দশ কপি করিয়ে নিয়ে মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলাম। হোটেলে ফেরার পথেই পেট্রল পাম্প পড়ে, তার পাশেই গাড়ি আর বাইকের সার্ভিস স্টেশন – দেখে এসেছি। আগে পেট্রল ভরে নিই।

    কিন্তু না, গ্যাংটক শহরের একদম মাঝামাঝি অবস্থিত এই পাম্পে পেট্রল নেই। তা হলে উপায়? পাম্পের লোকটিই বললেন – এই রাস্তা দিয়ে নিচে নেমে যান (যেটা আসলে আমার হোটেলে যাবারই রাস্তা), পাঁচ কিলোমিটার গেলে পেট্রল পাম্প পাবেন, ওতে তেল থাকবে। সবাই ওখানেই যাচ্ছে। অগত্যা, মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে এলাম সার্ভিস স্টেশনে। ছেলেটাকে রড আর ক্যারিয়ারের ফ্রেম দেখানো মাত্র, সে চটপট তার টুলবক্স থেকে কয়েকটা নাটবল্টু বের করে ঠিক কুড়ি মিনিটের মধ্যে জিনিসটাকে আবার শক্তপোক্তভাবে সেট করে দিল আমার মোটরসাইকেলের সঙ্গে। এক্কেবারে প্রথম দিনের মত। ভয়ে ভয়ে একবার জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, নাথুলার দিকে রাস্তা কেমন? ছেলেটা খুব কনফিডেন্সের সাথে বলল, এদিকের রাস্তা একদম ঠিকঠাক, মাঝে সামান্য খারাপ আছে।

    হোটেলে ফিরে এলাম। লাগেজ সমস্ত বেঁধেছেঁদে একবারে বেরোলাম। পেট্রল ভরে বেরোব।

    দ্বিতীয় পেট্রল পাম্পটা খুব সহজেই পেয়ে গেলাম খানিক এগোতেই। ভালো করে পেট্রল ভরে, দুটো জেরিক্যান ফুল করে, আবার ফিরে আসা হোটেলের রাস্তায়, এবং এখান থেকেই এবার সোজা ছাঙ্গুর রাস্তায়।

    সাড়ে নটা বাজে। খুব দেরি কিছু হয় নি, কারণ আজ আমার গন্তব্য মাত্রই পঁয়ষট্টি কিলোমিটার দূরে। নাথাং ভ্যালিতে, নাথাং রেসিডেন্সি। আরামসে পৌঁছে যাবো। দেখার জিনিস তো মাত্র দুটো – ছাঙ্গু লেক আর নাথুলা পাস। সিকিমের পূর্ব অংশের এই রাস্তা অতি প্রাচীন সিল্ক রুটের অংশ। অতি প্রাচীন এই রাস্তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হত ভারতের সাথে চীনের ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য, এবং এই রাস্তাটিই বিভিন্ন সিল্ক রুটের মধ্যে একমাত্র পথ, যা আজও ভারত আর চীনের মধ্যে স্থলপথের বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হয়।

    গ্যাংটক শহর থেকে বেরিয়ে একটু এগোতেই বোর্ডে বড় বড় করে সো-ঙ্গো (Tsomgo) লেখা বোর্ড পেরিয়ে ছাঙ্গুর রাস্তা ধরলাম। একটু এগোতেই আর্মির ব্যারিকেড, সেখানে একটা চিঠির কপি জমা দিয়ে এগোনো, এবং আরও একটু এগোতেই মোবাইল থেকে নেটওয়ার্ক চলে গেল।

    খানিক ওঠার পরে মেঘেরা দল বেঁধে সঙ্গ নিল, কখনও মেঘের মধ্যে দিয়ে, কখনও দূর থেকে তাদের পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা উঠতে লাগল। … অনেক, অনেক বছর আগে আমি এই রাস্তায় এসেছিলাম, এখন আর কিছুই চিনতে পারছি না অবশ্য।

    উনিশশো সাতানব্বই বোধ হয়, নাকি ছিয়ানব্বই? নীলাদ্রিদার সঙ্গেই এসেছিলাম গ্যাংটক। ফেব্রুয়ারি মাসে, চূড়ান্ত ঠাণ্ডায়, সিকিম বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা বাঙালি হোটেল ছিল, হোটেল শান্তিনিকেতন। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীরারিং কলেজের ছাত্রদের অন্য একশো টাকায় রুম ভাড়া পাওয়া যেত। জাস্ট টুকরোটাকরা দু তিনটে স্মৃতিই মনে আছে, সেই আমার প্রথম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রার অনুভূতি পাওয়া – রাতে খেয়ে উঠে হাত ধুতে গিয়ে মনে হয়েছিল হাতটা আর নেই, এত অসাড় হয়ে গেছিল, ছাঙ্গু যাচ্ছিলাম আমরা একটা কম্যান্ডার জীপে, আরও কিছু টুরিস্টদের সঙ্গে, রাস্তা বেশ ভাঙাচোরা ছিল, খানিক ওপরে উঠে দেখেছিলাম আমরা ওপরে – পাশে পাহাড়ের খাদে আমাদের থেকে নিচের দিকে মেঘ ভাসছে, মানে আমরা তখন মেঘের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম। পাশ দিয়ে মিলিটারির ট্রাক যাচ্ছিল, সেই প্রথম ট্রাকের চাকায় চেন বাঁধা অবস্থায় চলতে দেখা, আর ছাঙ্গুর আশপাশ বরফে ঢাকা ছিল, একটু দৌড়তে যেতেই দম ফুরিয়ে আসছিল।

    কুড়ি বছর পর আজ আমি আবার সেই রাস্তায়। এটা অবশ্য ফেব্রুয়ারি নয়, অক্টোবর, ঠাণ্ডা এখনও সেভাবে পড়ে নি। আর আজকের যাত্রায়, আমি একা। রাস্তা একদম ঝাঁ চকচকে। মাঝে অবশ্য একটুখানি ভাঙা কাদাপাথরভরা এলাকা পেরোতে হল, তবে সেটা দেখে মনে হল, সম্প্রতি ওখানে ছোট করে ধস নেমে রাস্তা নষ্ট হয়েছে। সারাইয়ের কাজ চলছে। এর বাইরে রাস্তা একদম পরিষ্কার।

    আরেকটু ওপরে উঠতেই, দূর থেকে চোখে পড়ল সামনে লম্বা গাড়ির লাইন, সারি সারি সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কী ব্যাপার?

    কাছে যেতে পরিস্থিতি বোঝা গেল। কিছুই না, ওপর থেকে মিলিটারির ট্রাকের দল নামছে গ্যাংটকের দিকে। সরু রাস্তা, তাই ধীরে ধীরে নামতে হচ্ছে, একদিকে ওপরের দিকে যাবার গাড়ির লাইন, লাইনের বাইরে ট্রাক যাবার মত যথেষ্ট রাস্তা বেঁচে নেই, অন্যদিকে খাদ, তাই কখনও একটা করে গাড়ি এগিয়ে, কখনও একটা করে মিলিটারি ট্রাক এগিয়ে – একটু একটু করে ট্রাকগুলোকে পাস করানো হচ্ছে।

    আজ এ রাস্তায় আর একটিও বাইকার দেখতে পাচ্ছি না। আমি একমাত্র। প্রায় চল্লিশ মিনিট আটকে থাকার পর দেখা গেল, আমি এমন একটা পজিশনে আটকে আছি, আমার সামনে ছটা গাড়ি, এগনোর জায়গা নেই, পিছোনোরও জায়গা নেই, ওদিকে ছ নম্বর গাড়ির সামনে একটা বাঁক, সেখান দিয়ে একটা মিলিটারি ট্রাক নামার জায়গা পাচ্ছে না। বহু কসরত করেও নামতে পারছে না, সাফিশিয়েন্ট জায়গা নেই।

    সবাই এদিক ওদিক সেদিক জরিপ করে দেখে আমাকেই ধরল এসে। এমনিতে এই সব ক্ষেত্রে পাহাড়ে ওভারটেকিং স্ট্রিক্টলি নো-নো। একজন ওভারটেক করতে গেলেই পুউরো কেস একদম সেই খাইবার পাস হয়ে যাবে, ক-রে কমললোচন শ্রীহরি, খ-রে খগ আসনে মুরারি। কিন্তু আমি মোটরসাইকেলে আছি। আমি গাড়িদের থেকে কম প্রস্থ নিচ্ছি, অতএব, সামনের ছ নম্বর গাড়ি আর উল্টোদিকের ট্রাকের মাঝে যেটুকু ফাঁক আছে, সেখান দিয়ে একমাত্র আমিই গলে যেতে পারব, আর আমি গলে গেলে আমার জায়গায় তৈরি হওয়া ফাঁকটাতে একটা একটা করে ছটা গাড়ি পিছিয়ে এলে ট্রাকটা এগোবার জায়গা পেয়ে যাবে।

    উত্তম প্রস্তাব। টুক করে এগিয়ে গিয়ে গলে গেলাম ফাঁক দিয়ে – পেছনে আরও চারটে ট্রাক ছিল, কিন্তু আমার যাবার রাস্তা ততক্ষণে তৈরি হয়ে গেছে। বাকি জ্যামও খানিক পরেই খুলে যাবে, জায়গা হয়ে গেছে আগুপিছু করবার।

    আকাশে আর আমার চারপাশে মেঘরোদ্দুরের খেলা দেখতে দেখতে একটু পরেই ছাঙ্গু লেকে এসে পৌঁছলাম – কিন্তু এ কী? কুড়ি বছর আগে যে অযত্নের সৌন্দর্য দেখেছিলাম ছাঙ্গুতে, সে সৌন্দর্য তো আর নেই! দীর্ঘ লেকের পাশ দিয়ে রানওয়ের মত রাস্তা চলে গেছে, আর লেকের চারপাশ শক্তপোক্ত রেলিং দিয়ে ঘেরা। ছাঙ্গু লেকে এলাম, না কলেজ স্কোয়্যারের পুকুরের সামনে, বোঝাই মুশকিল।




    খানিকক্ষণ দাঁড়ালাম। দু একটা ছবি নিলাম। কিন্তু কুড়ি বছর আগের সেই মুগ্ধতা আর ফিরে এল না। এখানেই কাছাকাছি কোথাও বাবা হরভজন সিংয়ের মন্দির ছিল, ইন্ডিয়ান আর্মির কুসংস্কারের ফসল – আর্মির মধ্যে বিশ্বাস, তিনি এখনও চীন সিকিম সীমান্ত পাহারা দেন, রক্ষা করেন, আর্মি থেকে এখনও বাবা হরভজন সিংয়ের নামে স্যালারি জেনারেট করা হয়, প্রতি বছর নতুন উর্দি দেওয়া হয় মন্দিরে। মন্দিরটা এখন আরেকটু দূরে কোথাও একটা শিফট করে গেছে – আমার দেখার লিস্টিতে সেটা নেই। বাবার ভূতকে একটু কষ্ট করে ডোকলামে নিয়ে গেলেই আর্মিকে এত নাকানিচোবানি খেতে হত না। যাই হোক, মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে আবার এগোলাম। একটু পরেই নাথু লা আসবে।

    একটু এগোতেই ছাঙ্গুর থেকেও ওপরে চলে গেলাম, আর ওপর থেকে দুচোখ ভরে দেখলাম ছাঙ্গুকে। সামনে দাঁড়িয়ে যে সৌন্দর্য দেখে উঠতে পারি নি, শেষ বাঁকে হারিয়ে যাবার আগে সেই সৌন্দর্য দেখিয়ে দিল ছাঙ্গু। চারদিকে খাড়াই পাহাড় আর আঁকাবাঁকা রাস্তাকে কোলে নিয়ে, আধা মেঘলা আধা নীলচে আকাশের ছবি বুকে এঁকে দাঁড়িয়ে আছে ছাঙ্গু লেক। দাঁড়াতেই হল, ছবি নেবার জন্য।



    খানিক এগোতেই পড়ল আরেক চেকপোস্ট। আর্মির। মোটরসাইকেল সাইডে রেখে ভেতরে গিয়ে চিঠির কপি জমা দিতে হল, মোটরসাইকেলের নম্বর পড়ে আর্মি অফিসারের কৌতূহলী প্রশ্ন, দিল্লি সে আয়ে হো? আকেলা? দিল্লি মে কাঁহা পে রহতে হো? উত্তর দিয়ে বললাম, আপ ভি দিল্লি সে? অফিসার হাসলেন, না না, আমার বাড়ি হিমাচলে, আমি দিল্লি ক্যান্টনমেন্টে পোস্টেড ছিলাম তিন বছর।

    হাতে একটা হলুদ কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা সাবধানে রাখো। নাথুলায় ঢোকার মুখে আরেকট চেকপোস্ট পড়বে, ওখানে জমা দিয়ে তবে এগোতে হবে – হারিয়ে গেলে কিন্তু আর নাথু লা যেতে পারবে না।

    অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। কার্ডটাকে সযত্নে জ্যাকেটের পকেটে রেখে চেন টানলাম। আরও খানিক এগোতেই আবার গাড়ির লাইন, সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে – অথচ সামনের দিকটা একেবারে ফাঁকা, সেইখানে আর্মির একটা ব্যারিকেড মত। দাঁড়িয়ে যেতে হল লাইনের শেষে। এবার কী কেস?

    একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম লাইনের মুখে। সমস্তই সিকিমের ট্যাক্সি। ড্রাইভাররা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গজল্লা করছে, আমিও ঢুকে গেলাম তাদের মধ্যে। জানা গেল, আর্মির খুব হাই র‍্যাঙ্কের কোনও অফিসার এসেছেন নাথু লা পাস ভিজিটে, প্রায় ভগবানের সমতুল্য র‍্যাঙ্ক। আর্মিতে হায়ারার্কি ব্যাপারটা খুব, মানে, খুবই প্রকট, ফলে সেই হাই র‍্যাঙ্কের অফিসারের ভিজিটের জন্য আপাতত খানিকক্ষণের জন্য জেনারেল সিভিলিয়ানের অ্যাকসেস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এই রুটে। উনি এখনই নেমে আসবেন, নেমে এলে আবার রাস্তা খোলা হবে।

    দশ মিনিট গল্পগুজব সারলাম, ইতিমধ্যে হঠাৎ লাইনের মধ্যে থেকে একটা ইনোভা বেরিয়ে এসে খানিক আগুপিছু করে উল্টোমুখে দৌড় দিল – ছাঙ্গু লেকের দিকে। সামনের গাড়ির ড্রাইভার বলল, কেয়া দিমাগ লাগায়া ভাইয়া, ওদের শিলিগুড়ি যাবার ছিল, আজ সন্ধ্যেয় এনজেপি থেকে ট্রেন, বললাম আর দশ মিনিট দাঁড়িয়ে যাও, এখনই নাকা খুলে যাবে, এখান থেকে শিলিগুড়ি কাছে পড়বে, ওদের আর তর সইল না, ওরা এখন ফিরে যাচ্ছে, গ্যাংটক হয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছবার চেষ্টা করবে, কে জানে সন্ধ্যের মধ্যে শিলিগুড়ি পৌঁছতে পারবে কিনা – এদিকের রাস্তা সহজ ছিল …

    বলতে বলতেই দূর থেকে দেখা গেল ভগবান নেমে আসছেন। সত্যিই ভগবানের সমতুল্য র‍্যাঙ্কের অফিসার হবেন, আগেপিছে পাইলট কার তো বটেই, সঙ্গে একটা অ্যাম্বুলেন্সও প্যাঁপোঁ করে নেমে এল লাইন ধরে, আর ব্যারিকেড পাস করা মাত্র ব্যারিকেডের দায়িত্বে থাকা দুই সেনা জওয়ান খটাস করে তাল মিলিয়ে স্যালুট ঠুকে, আকাশবাতাস বিদীর্ণ করে ‘জয়হিন্দ সাআব’ বলে ভগবানের ক্যারাভানকে বিদায় জানাল। ব্যারিকেড খুলে গেল, আমরা নাথুলা পাসের দিকে আরও একটু এগিয়ে গেলাম।

    সামনেই রাস্তাটা Y-এর মতন করে দুভাগ হয়ে গেছে। ডানদিকের রাস্তাটা নাথাং হয়ে জুলুক, পদমচেন পেরিয়ে রংপো হয়ে শিলিগুড়ির দিকে যাবার রাস্তা, বাঁদিকেরটা বেশ খাড়াইভাবে উঠে গেছে ওপরদিকে, এইটা নাথুলা পাসে পৌঁছবার রাস্তা। নাথুলা টপ এখান থেকে আর চার কিলোমিটার। এন্ট্রান্সের মুখে আর্মির বাঙ্কার এবং, আবারও ব্যারিকেড। সেই হলুদ কার্ড জমা দিতে হল এখানে, দিয়ে ওপরে উঠতে থাকলাম।

    শেষ বাঁকটা পেরোতেই চোখে পড়ল সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সামনে একটা বিশাল বোর্ডে লেখা নাথু লা, আর তার সামনে খানিকটা ফাঁকা রাস্তা, পালে পালে লোকজন হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে আরেকটু দূরে একটা উঁচু জায়গার দিকে, সেখানে লাল ঢালু ছাদওলা দু তিনটে বাড়ি মতন। সামনের দিকের বিল্ডিংগুলো ভারতের, আর পেছনের দিকের বিল্ডিংগুলো চীন।



    মোটরসাইকেল তো গাড়ির লাইনের পাশে পার্ক করে দিলাম, কিন্তু একটু এগিয়ে দেখলাম দুজন আর্মি জওয়ান প্রায় জনে জনে ডেকে বলে যাচ্ছেন, মোবাইল ক্যামেরা সব গাড়ি মে ছোড়কে আইয়ে, আগে অ্যালাওড নেহি হ্যায়। – এইটা আমার কাছে কেলো, কারণ মোটরসাইকেলের সমস্ত লাগেজ তো বানজি কর্ডে বাঁধা, সেইখানে পাবলিকলি সেসব দড়িদড়া খুলে তাতে ক্যামেরা আর মোবাইল ফোন ঢুকিয়ে আবার বেঁধে রেখে সেটাকে আনঅ্যাটেন্ডেড অবস্থায় আবার ছেড়ে রেখে আসব, এতটা বুকের পাটা আমার অন্তত নেই। আর্মি জওয়ান সমস্ত টুরিস্টকে গাড়ি-থেকে-নামা টুরিস্ট ধরেই ট্রিট করছে, মোটরসাইকেল থেকে নেমে আসা টুরিস্টও যে থাকতে পারে, সেটা তিনি হিসেবের মধ্যে ধরেন নি। অগত্যা, গলায় ক্যামেরা নিয়ে সোজা তার কাছে গিয়েই বললাম, দাদা, মোটরসাইকেলে এসেছি। রাখার তো জায়গা নেই, তবে লাগেজের মধ্যে ব্যাটারিটা ছেড়ে এসেছি – খুলেও দেখালাম – এই দেখুন, ব্যাটারি নেই, আমি এটা নিয়ে এগোই?

    কিন্তু অত সহজে রাজি হয়ে গেলে ব্যাটা আর আর্মি জওয়ান কেন হবে। তবে লোকটা ভালো, মাথা নেড়ে বললেন, না, ক্যামেরা নিয়ে তো যাওয়া যাবে না, তবে ঐ যে, ঐখানে দেখুন আরেকজন দাঁড়িয়ে আছেন আর্মি ড্রেসে, ওর কাছে জমা করে ওপরে গিয়ে দেখে আসুন, নামার সময় ওখান থেকেই নিয়ে নেবেন। আমি ওকে বলে দিচ্ছি। … বলে একটা বিশাল হাঁক ছাড়লেন – কাকা, এ কাকা।

    দূর থেকে কাকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। এই জওয়ান আমাকে দেখিয়ে বললেন, ইসকা ক্যামেরা অওর ব্যাগ জমা কর লেনা। বাইক সে আয়ে হ্যায়।

    আমি এগিয়ে গেলাম। লাইন ধরে দর্শনার্থীরা এগিয়ে চলেছেন। সারা ভারত থেকে আসা লোক – গুজরাতি, তামিল, ওড়িয়া, হিমাচলি, বাঙালি, কত রকমের বিস্ময়বোধক বাক্য, শব্দ। সামনেই সুভেনির শপ, তার সামনেই কাকা দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাকা লোকটি বেশ হাসিখুশি, আমার পিঠ থেকে ব্যাগ আর হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে বললেন, ইতনা ভারি ব্যাগ পিঠ মে লেকে কিঁউ ঘুমতা হ্যায়? – বলে পাশেই মেডিকেল রুমের মধ্যে ও দুটো রেখে দিয়ে বললেন, জাও, ঘুম কে আও।

    উঠলাম ওপরে। গল্প শুনেছি, এইখানে নাকি হাত বাড়িয়ে চাইনিজ সোলজারদের সাথে হ্যান্ডশেকও করা যায়। যদিও ধারেকাছে চাইনিজ কোনও সোলজারকেই দেখা গেল না, অবিশ্যি দেখা হলেও হ্যান্ডশেক করার চেষ্টাও করতাম না। … একটা বড় চাতাল, সেখানে ঢাউস ঢাউস শান্ত সুবোধ সুশীল ইন্ডিয়ার ছবি লাগানো পর পর, তাজমহল, ভারতনাট্যম, রয়েল বেঙ্গল টাইগার – এই সিরিজে, মানে ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ার মেগা ভার্সন, সবকটাই চীনের দিকে মুখ করে। … ভো পাঠক, এই ঢাউস ঢাউস ছবিগুলোকে মনে রেখে দেবেন, ভালো করে মনে রাখবেন ভারতের এই সুবোধ সুশীল ব্যানারগুলোকে – আমরা আবার এর বিবরণ নিয়ে ফিরে আসব কয়েক পর্ব পরেই। আপাতত, সামনে একটা বিশাল পাঁচিল, চীনের পাঁচিল, না মানে সেই ঐতিহাসিক চীনের প্রাচীর নয়, এটা ভারত চীন বর্ডার, আর পাঁচিল বরাবর কাঁটাতারের ফেন্সিং লাগানো, তার বেশি কাছে যেতে দিচ্ছে না ওখানে দাঁড়ানো ইন্ডিয়ান আর্মির লোকজন, তারই মধ্যে আমি একটু এগিয়ে ঝুঁকে দেখে এলাম, চাতালের শেষ মাথায় পাঁচিলের নিচের দিকে একটা বিশালাকার রাজকীয় লোহার গেট। একজন আর্মিকে জিজ্ঞেস করলাম, এই রাস্তা ধরেই কি মানস সরোবরের যাত্রা হয়?

    উনি বললেন, হাঁ জি, ইসি রোড সে কাফিলে আগে নিকলতে হ্যায়। এহি হ্যায় সিল্ক রুট।

    ফিরে এসে কাকার সাথে হ্যান্ডশেক করে ব্যাগ আর ক্যামেরা ফেরত নিলাম, আবার হেঁটে হেঁটে মোটরসাইকেলের কাছে আসার মুখে কী রকম মনে হল পকেটের মধ্যে যেন ফোনটা কেঁপে উঠল। এমনিতে ফোন নিয়ে যাওয়া মানা, তবে আমি ফোনটাকে পকেটের মধ্যেই রেখেছিলাম, সিগন্যাল তো নেই, বাজবেও না, কেউ টেরও পাবে না। – পায়ও নি।



    ফাঁকা জায়গা দেখে সন্তর্পণে পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম, একটা এসেমেস এসেছে এইমাত্র, আর, আর, আমার ফোনে ফুল সিগন্যাল। রোমিং নিয়েছে চায়নার কোনও এক ইউনিকম নামের মোবাইল অপারেটরের সিগন্যালের। আমার মোবাইলের ঘড়িতে তখন বাজে চারটে বেজে চার মিনিট – চীনের সময়, আসলে তখন ভারতীয় সময় দুপুর একটা চৌত্রিশ।



    আবার নেমে এলাম সেই ওয়াই জংশনে, এইবারে নেমে নাথাং ভ্যালির পথ ধরলাম। পথের দেখার জিনিস আজকের মত এখানেই শেষ, এইবারে হোটেল খুঁজতে হবে। মোবাইলে বারও কোনও সিগন্যাল নেই, তবে আমি নাথাং রেসিডেন্সির লোকেশন অফলাইনে সেভ করে রেখেছিলাম, ফলে নেভিগেশন করতে বিশেষ কোনও অসুবিধে হল না – এমনিতেও রাস্তা একটাই।

    একটু এগোতেই চোখে পড়ল পাশাপাশি দুটো লেক, এমনিতে ছোট ছোট দুটো ডোবার মত দেখতে, কিন্তু পাহাড়ে এদের সৌন্দর্যই আলাদা। অ্যাজ সাচ কোনও নাম নেই এদের, নাথু লার কাছে টুইন লেক নামেই খ্যাত এরা।



    গ্যাংটকের মূল টুরিস্টের ঢল এই নাথু লা-তে এসেই শেষ হয়ে যায়। এর পর একেবারে ফাঁকা রাস্তা। যতদূর চোখ যায়, আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও মানুষ নেই, কোনও গাড়ি নেই। গাছপালা প্রায় কমে এসেছে, ছোট ছোট কাঁটাগাছ রাস্তার দুদিকে কী পরম সৌন্দর্যের সাথে বেড়ে উঠেছে, লাল রঙের কাঁটাঝোপ, আর মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা, শুধু মনে হয় চলতেই থাকি, চলতেই থাকি … চলতেই থাকি … মাঝে মাঝে মেঘেরা আসছে, ভিজে হাওয়া আর জলকণারা চেপে বসছে হেলমেটের ভাইসরের ওপর, ভাইসর তুললে তারা বসে পড়ছে আমার চোখের পাতায়, কয়েক হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না, আবার মেঘ পেরিয়ে এলেই ঝকঝকে রোদ্দুর আর ঝিকমিকে নীল আকাশ।

    নাথাং এসে গেলাম একটু পরেই, রাস্তা সোজা চলে গেছে জুলুকের দিকে, জিপিএস তো তাইই বলছে, কিন্তু জিপিএস বলছে এইখানে আমাকে নিচের দিকের সরু রাস্তাটায় ডাইভার্সন নিতে হবে। এটা কাঁচা রাস্তা, এবড়োখেবরো, উঁচুনিচু, এই রাস্তায় আর তিন কিলোমিটার গেলেই নাকি নাথাং রেসিডেন্সি।

    নাথাং রেসিডেন্সি। নাম শুনলেই বেশ হাইফাই হোটেল মনে হয়, কিন্তু মোবাইল সিগন্যালবিহীন এলাকায় এমন হোটেল চালায় কী করে? আর তিন কিলোমিটার দূরেই যে হোটেল – তার ত্রিসীমানায় লোকবসতি নেই কেন? যতদূর অবধি চোখ যাচ্ছে, শুধু পাহাড়, ছোট ছোট ঝোপজঙ্গল, আর মেঘ। মনুষ্যবসতির স্রেফ কোনও চিহ্নই নেই কোথাও। কিন্তু জিপিএস আমাকে দেখাচ্ছে নাথাং রেসিডেন্সির দিকে আমি ক্রমশ এগিয়ে চলছি।

    এক একটা বাঁক ঘুরছি, আর ভাবছি, এই বুঝি নাথাং ভ্যালির লোকবসতি দেখতে পাবো, এই বুঝি দেখা যাবে, কিন্তু না – দূরত্ব কমতে কমতে তখন দুশো মিটার, তাতেও একটা কুঁড়েঘরও চোখে পড়ল না। তা হলে কি ভুল রাস্তায় এলাম? ফিরে যাবো আবার মেন রোডে?

    ভুলটা ভাঙল আর ঠিক একশো মিটার এগোতেই। শেষমাথায় একটা বাঁক, আর সেই বাঁক ঘুরতেই দেখা গেল ছোট্ট একটা গ্রাম, হ্যামলেট। সেটা এমন জায়গায় পাহাড়ের কোলে অবস্থিত, যে পেছনের রাস্তার কোনও বাঁক থেকেই তাকে দেখতে পাবার কথা নয়।

    গ্রামে তো পৌঁছলাম। জিপিএসও বলছে ডানদিকেই ঘিজিমিজি অতগুলো বাড়িঘরদোরের মধ্যে কোনও একটার নামই নাথাং রেসিডেন্সি। কিন্তু কোনটা?

    গ্রামের সমস্ত দোকান বন্ধ। ঘড়িতে বাজে সওয়া দুটো। একটি বুড়ো আর দুটি বাচ্চা কেবলমাত্র দৃশ্যমান। তাদের কেউ যে হিন্দি বুঝবে, আর বুঝলেও নাথাং রেসিডেন্সি খায় না মাথায় দেয় তা বুঝবে, এমন প্রত্যয় হল না। তবুও, তাদের জিজ্ঞেস করা ছাড়া তো উপায় নেই। জিজ্ঞেস করলাম। বৃদ্ধ আরেকজন কাকে ডেকে আনলেন। দুজনে মিলে খুব আলোচনা করে ঠিক করলেন সামনে যে হলুদ রঙের বিল্ডিংটি দেখা যাচ্ছে, ওটাই নাথাং রেসিডেন্সি। কিন্তু যাবো কী করে? সরাসরি তো যাবার কোনও রাস্তা দেখছি না – এদিকে বাঁশের বেড়া।

    বৃদ্ধর সঙ্গী বললেন, এগিয়ে যাও, ওদিক থেকে রাস্তা আছে।

    এগোতে গিয়ে মোড় মুড়তেই দেখলাম একটা ছোট্ট টিনের ঘর, তাতে কাঁচা হাতে লেখা নাথাং পুলিশ পোস্ট। যাক – এইখানেই ভালো করে জেনে নেওয়া যাবে।

    মোটরসাইকেল থেকে নামলাম। কেউ কি আছে? সামনে ভারী তেলচিটে পর্দা ঝুলছে। কোই হ্যায়?

    ভেতর থেকে একটা আওয়াজ এল, অন্দর আইয়ে।

    একজনই পুলিশ। পুলিশ হবার কারণেই তিনি আমাকে কী নাম, কোথা থেকে আসছি, কোথায় যাবো ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে ফেললেন নিজে উত্তর দেবার আগেই, আদারওয়াইজ তিনি বেশ হাসিখুশি লোক। বললেন, এই রাস্তাটা ধরে উঠে গিয়ে ডাইনে মুড়ে যাও, ঐ বাড়িটার সামনে পৌঁছে যাবে। বলে পারমিট স্লিপের একটা কপি চেয়ে নিয়ে রেখে দিলেন।

    রাস্তা বলে যেটা দেখালেন, সেটা আসলে পাথর আর কাদা মাখানো একটা অস্থায়ী রাস্তা মত। তার ওপর দিয়েই নর্দমা চলে গেছে, অবশ্য নোংরা জল নয়, এমনিই জল বইছে। অফরোডিংই বলা যায়, সেইখানে তুললাম মোটরসাইকেল, এবং বাঁক ঘুরে আরও কয়েকটা এর বাড়ির দালান তার বাড়ির উঠোনের ওপর দিয়ে চালিয়ে আবার বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল সামনে একটা বিস্তীর্ণ মাঠ।

    সেই মাঠের প্রান্তে বিশাল একটা পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের মাথায় একটা সবুজ রঙের চালাঘর। সেই ঘরকে ঢেকে দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে গড়াতে গড়াতে মাঠের ওপর নেমে আসছে এক সুবিশাল মেঘের ঢল। হালকা ধূসর রঙের। ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে পাহাড়টা, চালাঘরটা …




    আমি ডানদিকে তাকালাম। বিল্ডিংটা আমার চোখের সামনেই, কিন্তু আগেপিছে এপাশে ওপাশে কোথাও নাথাং রেসিডেন্সি লেখা বোর্ড নেই। এবং কাছেপিঠে আবারও, কোনও লোক নেই কোথাও।

    বিল্ডিংয়ের উঠোনে ইয়া একটা জাঁদরেল চেহারার মোরগ ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রায় আমার হাঁটুর সমান উঁচু। দু তিনটে লোমশ কুকুর। আর সামনে একটা দরজা। সেইখানে গিয়ে হাঁক মারলাম।

    ভেবেছিলাম চুক আর গেকের বাবা-সদৃশ একটা লোক বেরিয়ে এসে বলবে, আমার ঘরে অতিথটা এল কে – কারণ ঠিক সেই মুহূর্তেই, দূরে কোথাও একটা গোম্ফা থেকে বোধ হয় মোটা স্বরের ঘণ্টা বাজছিল, কী রকম মনে হচ্ছিল ঘন্টাটা বলছে, তির-লিং-লিলি-ডং, তির-লিং-লিলি-ডং, তাইগার অরণ্যে তো আমি নেই, … দরজাটা তখনই খুলল।

    তাদের কী বলব আমি? কী নাম দেব? মেঘবালিকা? হ্যাঁ, এই নামটাই সঠিক, তাদের দুজনের জন্য। দুটি অপরূপ সুন্দরী তরুণী বেরিয়ে এল, চোখে মুখে প্রশ্ন নিয়ে – ইয়েস?

    বুকিংয়ের প্রিন্ট আউট আমার ব্যাগেই ছিল, বের করে দুই মেঘবালিকার একজনের হাতে দিলাম। তাদের ছোট্ট চোখে বিস্ময় ফুটল, লালচে গাল আরও একটু লাল হল, ইউ মেড বুকিং অনলাইন?

    – হ্যাঁ, সেই আগস্ট মাসে বুকিং করে রাখা – আপনারা মেসেজ পান নি?

    – না, আসলে এখানে তিন মাস আগে টাওয়ার ভেঙে যাবার পর থেকে আর বিএসএনএল সারাতে আসে নি, আমাদের গত তিন মাস ধরে এখানে ফোন বা ইন্টারনেটের কানেকশন নেই, আমরা কোনও খবরই তো পাই নি।

    তা হলে উপায়?

    নো প্রবলেম স্যার, এখানে আজ একজনও টুরিস্ট নেই, পুরো প্রপার্টিই খালি, আপনার থাকতে কোনও অসুবিধে হবে না, প্লিজ ওয়েট, আপনার ঘর খুলে দিচ্ছি।

    আমি বানজি কর্ড খুলতে লাগলাম। দুই মেঘবালিকা নিপুণ গতিতে একদম সামনের একটা বড়সড় ঘর খুলে দিল, আমার হাত থেকে প্রায় ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে ঘরের কোণে সাজিয়ে দিল – সামনের মাঠ তখন মেঘের পাঁজায় অদৃশ্য হয়ে আছে, বাইরে আমার মোটরসাইকেলের চারপাশে তদারকি করছে দুই লোমশ কুকুর আর সেই হাঁটু-সমান উঁচু মোরগ। আমি ঘরে ঢুকলাম। মোটরসাইকেল রইল ঘরের ঠিক সামনেই একটা ছাউনির নিচে।



    ধড়াচুড়ো ছেড়ে বসতে না বসতেই আবার দরজায় ঠকঠক। স্যর, চায় পিওগে? চায় লায়ি হুঁ।

    অবশ্যই খাবো। বেশ দাঁত বসানো ঠাণ্ডা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা এসে গেল। খেয়ে নিয়ে একটু বেরোলাম হাঁটতে। সামনের মাঠটা আবার দৃশ্যমান হয়ে গেছে। মেঘ সরে গেছে কোথায় কে জানে। আকাশ এখন নীল, তাতে হাল্কা লালচে আভা ধরছে, সন্ধ্যে হবে একটু পরেই।

    কেমন একটা অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছিল। এত সুন্দর জায়গা এই নাথাং, জানলে অন্তত আরেকটা দিন থেকে যাওয়া যেত। কিন্তু কাল সকালেই আবার চলে যাওয়া। থামার উপায় নেই। নাথাং, যেন আমি নাথাং দেখব বলেই বাড়ি ছেড়ে এতদূরে এসেছি। বাকি সব, সব, গৌণ। গুরুদোংমার লেক, নাথুলা – সে তো সবাই দেখে। এই সৌন্দর্য, এ তো পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। ইস্ট সিকিম, অনেক, অনেক, অনেএক বেশি সুন্দর, বাকি সিকিমের থেকে।

    ফিরে আসতেই দ্বিতীয় মেঘবালিকা আবার হাজির। চায় পিওগে? ফীলিং কোল্ড?

    আমি এম্নিতে খুব একটা চাতাল নই, আর বাড়ির বাইরে চা খুব একটা খাইও না, কিন্তু এমন সুন্দরী মেঘবালিকাদের ‘না’ বলতে মন চাইল না। আবারও ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা এসে গেল, মেঘবালিকা তার টুকটুকে লাল গালে আরও লালচে আভা ছড়িয়ে বলল, আমরা না, এখানে জলদি ডিনার করে নিই, সাড়ে সাতটায় ডিনার বানিয়ে দেব?

    ঠিক আছে, তাই দিও।

    আপনি … চিকেন খাবেন তো স্যার? দেশি চিকেন?

    এটাই বুঝি বাকি ছিল। যুগ যুগ ধরে ব্রয়লার চিবিয়ে ক্লান্ত দাঁত-জিভকে কি আর কেউ জিজ্ঞেস করে, দেশি চিকেন খাবেন কিনা? তাও এই নাথাংয়ে? মনের উল্লাস মনেই চেপে রেখে বললাম, নিশ্চয়ই খাব। রুটি আর চিকেন কোরো তা হলে।

    চা শেষ করে … কী করা যায়? মোবাইলে সিগন্যাল নেই। পৃথিবী থেকে আমি বিচ্ছিন্ন। অতএব, ল্যাপটপ খুলে বসলাম, সিনেমা দেখা যাক একটা।

    ঠিক সাড়ে সাতটার সময়ে খাবার ডাক এল। পাশের ঘরে, যেইখানে দরজায় আমি প্রথম ডাক দিয়েছিলাম, সেই দরজার ভেতরেই ডাইনিং হল, পাশে কিচেন। কনকনে ঠাণ্ডাতে হাতে গড়া গরমাগরম রুটি আর ধোঁয়া ওঠা দেশি চিকেন, সাথে গোল গোল করে কাটা পেঁয়াজ – সে যে কী অমৃত, কী অমৃত, সে আর আপনাদের কী বলব, আপনারাও নিশ্চয়ই খেয়েছেন কোথাও না কোথাও। পাশের ঘরে রুটি সেঁকতে সেঁকতে পরিশীলিত ইংরেজি উচ্চারণে এক মেঘবালিকা কোনও এক ইংরেজি গান ধরেছে, অপূর্ব সুরেলা আওয়াজ, আমি ইংরেজি গান বিশেষ শুনি না, তাই চিনতে পারলাম না, কেবল মনে আছে, বড় সুন্দর ছিল সেই সুর। রুটি দিতে আসার সময়ে থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, তোমার গানের গলাটা তো খুব সুন্দর – আরেকটা গান শোনাবে?

    মেঘবালিকা উত্তরে খিলখিলিয়ে হেসে এত বেশিমাত্রায় ব্লাশ করল যে তার সারা মুখ লাল হয়ে গেল। … আমি কি খুব বেশি প্রগলভ হয়ে যাচ্ছি? তড়িঘড়ি বললাম, ঠিক আছে, এখানে গাইতে হবে না, কিচেনে বসেই যেমন গাইছিলে, গাও, যদি তোমার ইচ্ছে হয়, আমার শুনতে খুব ভালো লাগছে।

    মেঘবালিকা তাইই করল। কিচেনে বসে ধরল আরও একটা গান। আমি গান শুনতে শুনতে আটখানা রুটি খেয়ে ফেলে, তারপরে সেটা বুঝতে পেরে নিজেই লজ্জিত হয়ে খাওয়া থামিয়ে দিলাম।

    হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা বাইরে, ঘরের ভেতর দারুণ কোজি। তবু, ঘরে থাকতে ইচ্ছে করল না। আর তো কিছু করার নেই, ঘুমোনোই বাকি শুধু। আর এক চক্কর মেরে আসি। … মাঠের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝকমকে কালো আকাশ, নক্ষত্রখচিত। কালপুরুষ দেখা যাচ্ছে। তাকিয়ে রইলাম।

    সিকিমে আজই আমার শেষ রাত্রি। কাল থেকে অন্য দিকে, নতুন এক জার্নির শুরু। প্রতিটা ইন্দ্রিয় দিয়ে, প্রতিটা রোমকূপ দিয়ে শুষে নিতে চাইছিলাম এই সৌন্দর্য, আর কখনও এখানে আসা হবে কিনা জানি না, কবে আসব, আদৌ আসব কিনা – সে প্রশ্ন এখন মুলতুবি থাক, নাথাং, তোমায় আমি ভুলব না। সিকিম আমার মন ভরিয়ে দিল – অপূর্ব। অসাধারণ।

    তখনও কি জানি, আরও কত সৌন্দর্যের পসার আমার সামনে মেলে ধরবে ইস্ট সিকিম, পাকাপাকি ভাবে তাকে ছেড়ে চলে আসার আগে?

    সে গল্প পরের পর্বে।
  • aranya | 83.197.98.233 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১০:৪৬370694
  • 'ছোট ছোট কাঁটাগাছ রাস্তার দুদিকে কী পরম সৌন্দর্যের সাথে বেড়ে উঠেছে, লাল রঙের কাঁটাঝোপ, আর মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা, শুধু মনে হয় চলতেই থাকি, চলতেই থাকি' - কেন যেন বিভূতিভূষনের কথা মনে পড়ে।

    লেখা আর ছবি - লা জবাব। নাথাং ডাকছে।
  • abcd | 113.42.172.209 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১০:৪৮370695
  • এই কিস্তিটা দারুন লাগল।
  • aranya | 83.197.98.233 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১০:৫৩370696
  • একলা পথ চলার ব্যাপারটা বুঝি না, নিজেরই খামতি।
    আমার সব সময়েই ইচ্ছে হয়, অন্যদের সাথে পথের সৌন্দর্য্য ভাগ করে নিতে, প্রেমিকা হোক, বা বন্ধু
  • শঙ্খ | 126.206.220.114 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৩:২৩370698
  • মেঘবালিকার/দের ফটুক কৈ?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন