এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • দেশভাগঃ ফিরে দেখা(দ্বিতীয় পর্ব)

    I
    অন্যান্য | ২৬ অক্টোবর ২০১৭ | ৫৯০৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • গবু | 52.110.133.247 | ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ২৩:২০370889
  • শুভ নববর্ষ! পড়ছি।
  • I | 57.15.174.167 | ১৮ এপ্রিল ২০১৮ ২৩:৩৮370890
  • সাধারণভাবে নিচু জাতের হিন্দুরা ছিলেন অর্থনৈতিকভাবেও অনগ্রসর। তবে এই নিয়মের কিছু ব্যতিক্রম ছিল। যথা, পূর্ব ও মধ্যবঙ্গের নমঃশুদ্র ও উত্তরবঙ্গের রাজবংশী গোষ্ঠী। পাটচাষে লাভের সুবাদে আর্থিক সচ্ছ্লতার মুখ দেখা এই গোষ্ঠী দুটি পুনা চুক্তির সুবিধা দুহাত ভরে গ্রহণ করে। ভদ্রলোক হিন্দুরা এইসব 'ছোটলোক'দের বাড়বাড়ন্ত মোটেও ভালো চোখে দেখেন নি। কোথাও কোথাও তো 'ছোটলোক' হিন্দুরা মুসলিম বর্গাদারদের সঙ্গে জোট বেঁধে হিন্দু জমিদারের বিরুদ্ধে মজুরি-বৃদ্ধির লড়াইয়ে অবধি সামিল হচ্ছিল।[1]এ সবই বর্ণহিন্দুদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিছু গান্ধীবাদী নেতা 'শুদ্ধি'করণের মাধ্যমে আদিবাসী ও অচ্ছ্যুতদের হিন্দুধর্মের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করলেও মোটের ওপর হিন্দু ভদ্রলোকেরা ছোটলোকদের প্রতি যথেষ্ট বিরূপ ছিলেন।[2]১৯৩৩ সালে দলিত নেতা এম সি রাজা কেন্দ্রীয় আইন সভায় Untouchability Abolition Bill আনার চেষ্টা করলে তাঁকে বাঙালী বর্ণহিন্দু নেতাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশী বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়। অমর নাথ দত্ত বলেনঃ 'Let these people be more clean, more pure and cherish better ideals of life and . . . then I shall associate with them ..,' [3]. রাজা বিদ্রূপ করে বলেন-"অবাক কান্ড... সবচেয়ে বেশী বিরোধিতা এল বাংলা থেকে, যেখানে নাকি, ওঁরা বলেন, কোনো অচ্ছ্যুত নেই।"[4].

    বাংলার হিন্দু কংগ্রেস নেতারা পুনা চুক্তির জন্য গান্ধিকে কোনোদিন ক্ষমা করেন নি। একেই বহুকাল ধরে বাংলার কংগ্রেস রাজনীতিতে গান্ধি-বিরোধিতার একটি স্রোত বহমান ছিল। চিত্তরঞ্জন দাস ছিলেন খোলাখুলি গান্ধি-বিরোধী; তাঁর মৃত্যুর পর সুভাষ বোসকে বঞ্ছিত করে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা কলকাতার মেয়র-পদে নির্বাচিত করায় বাঙালী কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা আরো ক্ষুব্ধ হন। সবশেষে এল এই পুনা চুক্তির ঘা। যে বাঙালী ভদ্রলোক একদা ভারতবর্ষের কংগ্রেসী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন, তাঁদেরই কিনা অন্ধকারে রেখে সেই জাতীয় কংগ্রেস এমন একটি সিদ্ধান্ত নিল, যা সরাসরি তাঁদের ভাগ্যবিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বঙ্গীয় নেতারা-কংগ্রেসী/অকংগ্রেসী নির্বিশেষে একে বিশ্বাসঘাতকতা মনে করেছিলেন।[5]

    বলা বাহুল্য,এই সময় থেকেই কংগ্রেসী রাজনীতিতে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত আগের তুলনায় অনেক বেশি ঘোরালো হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের সমর্থন পেতে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কম্যুন্যাল অ্যাওয়ার্ড নিয়ে একটি না ঘরকা- না ঘাটকা সিদ্ধান্ত নেন। মদন মোহন মালব্যর মত কট্টর অ্যাওয়ার্ড-বিরোধী রাজনীতিবিদ এর প্রতিবাদে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে ন্যাশনালিস্ট পার্টি স্থাপন করেন। সুভাষ বসু ও তাঁর অনুগামীরা সাথে সাথে এই নতুন দলে যোগ দেন। অবশ্য এঁরা পুরোপুরি কংগ্রেস-সঙ্গ ত্যাগ না করে স্বরাজ্য পার্টির মতই একটি প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কংগ্রেসের মধ্যে থাকতে চেয়েছিলেন।

    যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত'র মৃত্যুর পরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির দায়িত্বভার যায় ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের। অভিজাত বিধানবাবু সেই অর্থে ঠিক জনতার নেতা ছিলেন না; না ছিল তাঁর নিচুতলার কংগ্রেস কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ , না যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তর মত সাংগঠনিক ক্ষমতা । গান্ধির সঙ্গে অন্তরঙ্গতার সুবাদে তিনি প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি মনোনীত হন, যদিও সেসময় এই পদটি লোভনীয় ছিল বললে সত্যের অপলাপ করা হবে। কংগ্রেসের দীনহীন অবস্থার উন্নতির জন্য তিনি বসু-শিবিরের পেশ করা 'অ্যাওয়ার্ড-বিরোধী বিক্ষোভ'এর একটি কর্মসূচীকে সমর্থন করে হাইকম্যান্ডের কাছে প্রস্তাব পেশ করেন। মুসলিম -মন পেতে মরিয়া হাইকম্যান্ড অবশ্য এই প্রস্তাবটিকে একবাক্যে নাকচ করে দেয়। বিধান বাবুও আর কথা না বাড়িয়ে মাথা নত করে বাধ্য ছাত্রের মত হাইকম্যান্ডের লাইনে ফিরে যান।

    নোটঃ
    1.Tanika Sarkar, Bengal 1928-1934, pp. 39-40.
    2.Tanika Sarkar, 'Jitu Santal's Movement in Malda, 1924-1932: A Study in Tribal Protest', in Ranajit Guha (ed.), Subaltern Studies IV, p. 136
    3.Legislative Assembly Debates on the Untouchability Abolition Bill, in Government of India, Home Political Files 50/7/33 and 50/11/34
    4.ibid.
    5.Joya Chatterjee, Bengal Divided : Hindu Communalism and Partition, 1932-47, Cambridge University Press (2002), p.43.
  • I | 57.15.174.167 | ১৮ এপ্রিল ২০১৮ ২৩:৪০370891
  • গবু, শুভ নববর্ষ।
  • I | ২১ এপ্রিল ২০১৮ ২৩:২৬370892
  • ত্রিশের দশকের আগে থেকেই বাংলায় জমিদারী-প্রথার ওপর চাপ বাড়ছিল। অনুপস্থিত জমিদারদের (absentee Landlord) এস্টেট প্রায়শঃই বারো ভুতে (নায়েব-গোমস্তার দুর্নীতি, দিনের-পর দিন চলতে থাকা গাদা গাদা নিষ্ফলা মামলা ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় খরচা ইত্যাদি) লুটে-পুটে খাচ্ছিল। যে সব জমিদার গ্রামে থেকে নিজেদের এস্টেট তদারক করতেন , তাঁরা অবশ্য এই চাপ সামলেও লাভের মুখ দেখতেন। জমিদারদের এই প্রতিপত্তি-হ্রাসের সময়ে দ্রুত উঠে আসেন পাটের চাষে লাভ -করা সম্পন্ন কৃষক তথা জোতদারেরা।এঁদের দেখাদেখি ছোট চাষীরাও দাদনী মহাজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে পাট্চাষ শুরু করেন; কিন্তু এইসব চাষীর জমির পরিমাণ ও কৃষিতে বিনিয়োগের সামর্থ্য ছিল অল্প। অল্পসময়ের মধ্যেই এঁরা লাভের মুখ দেখা তো দূরের কথা, উল্টে ক্রমবর্ধমান ঋণজালে জড়িয়ে পড়ে ঘটি-বাটি বিক্রি করতে বাধ্য হন। জোতদারদের উত্থানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন তালুকদার/ছোট জমিদারেরা। ভদ্রলোক শ্রেণীর অধিকাংশই এই গোষ্ঠী থেকে উঠে আসা। গ্রামীণ অর্থনীতিতে তেমন সুবিধা করতে না পারায় এঁরা অনেকেই শহর-মফঃস্বলে চাকরীর সন্ধানে ছড়িয়ে পড়েন। কিন্তু প্রশাসনিক চাকরির সংখ্যা স্বল্প; প্রতিযোগিতা প্রবল। ভালো চাকরী পাওয়ার জন্য যে পরিমাণ যোগাযোগ থাকা দরকার, তা এঁদের অনেকেরই ছিল না। বাধ্য হয়ে এঁদের অনেকেই ছোটখাট কেরাণী কিম্বা শিক্ষকের চাকরী নিতেন। কিন্তু শহরে থাকা-খাওয়ার খরচা ক্রমেই বেড়ে চলছিল। অধিকাংশ নীচুতলার ভদ্রলোকের প্রায়শঃ ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোতো না। এই শ্রেণী সম্বন্ধে ১৯১৫ সালে J. C. Jack লিখেছেনঃ
    'Upon this class the rise in prices which has been constant for half a century and always increasing in intensity has had such a disastrous effect that too many live on the margin of starvation ... it is known that the number of unemployed among the bhadralok is large and the circumstances of many families are pitiful and their sufferings very great. [1] মনে করে দেখুন জীবনানন্দ দাশের ডায়েরির পাতাগুলি, বরিশালের সর্বানন্দ-ভবনের তুলনামূলক স্বাচ্ছন্দ্য থেকে যখন এসে পড়ছেন 'লিবিয়ার জঙ্গলের মত' দয়াহীন শহর কলকাতায়। [2]

    জমির খাজনার আদায়-উশুল কমে আসার ধাক্কা সামলাতে বেশ কিছু সমর্থ জমিদার মহাজনী ব্যবসা শুরু করেন। ছোট জমিদার কিম্বা তালুকদারদের সে ক্ষমতাও ছিল না। ত্রিশের মহামন্দা শুরু হতেই গ্রামবাংলার এই নড়বড়ে আর্থিক ব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়ে। পাটের দাম মুখ থুবড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাট-রপ্তানীকারী শিল্পপতি ও দাদনী মহাজনরা পাটে বিনিয়োগ পুরো বন্ধ করে দেয়। বাধ্য হয়ে ক্ষুদ্র চাষী গ্রামীণ মহাজনের দিকে মুখ ফেরায়। কিন্তু মহামন্দার দিনে তাদের অবস্থাও সঙ্গীন। বাজার থেকে ধারের টাকা উদ্ধার করতে না পারায় তারাও নতুন করে ধার দেওয়ার মত অব্স্থায় ছিল না। শুরু হয়ে যায় এক বিষচক্র। ধার দেওয়ার কেউ নেই, ফলে নতুন করে কৃষিতে বিনিয়োগ করার অবস্থা নেই, অগত্যা চাষবাস বন্ধ।চাষবাস বন্ধ, তাই গরীব চাষী দিনদিন আরো গরীব হয়; বাজারে তার ধার আরো বাড়ে,জমিদারী খাজনাও জমতে জমতে পাহাড় হয়। চাষী-জমিদার সংঘাত চরমে ওঠে। অনেক জমিদার আদালতে যান; চাষীরাও এই দুর্দিনে জমিদারী খাজনা ও মহাজনের সুদ দিতে স্রেফ অস্বীকার করে। জমিদারেরা সন্দেহ করতে শুরু করেন, এ সবই স্থানীয় নেতাদের উস্কানির ফল। টিপেরার মত মুসলিম-প্রধান জেলায় হিন্দু জমিদারেরা "শান্তিরক্ষিণী সমিতি" নামে একটি সংগঠন তৈরী করেন। সংগঠনটি নালিশ করে- "Rank Bolshevism is being spread by a number of persons......peasants and cultivators, specially Muhammadans are asked to make a common cause against money-lenders, traders and landlords." [3]

    মহামন্দার দিনগুলিতে অজস্র ছোট চাষী শেষ সম্বল জমিটুকুও বেচে দিয়ে ভাগচাষীতে পরিণত হন। কিন্তু মন্দা এক শ্রেণীর মানুষের কাছে অযাচিত সুযোগ নিয়ে উপস্থিত হয়। এঁরা হলেন সম্পন্ন কৃষক ও জোতদার শ্রেণী। মন্দার সুযোগ নিয়ে এঁরা উদ্বৃত্ত শস্য চড়া দামে বেচতে থাকেন; গরীব প্রতিবেশীদের খাদ্যশস্য ধার দেন এবং যথাসময়ে ধার শোধ না হলে তাঁদের জমিজমা দখল করে নেন। চাষী-জমিদার সংঘাতের সুযোগ নিয়ে এঁরাও জমিদারের খাজনা দিতে অস্বীকার করেন। বাংলার গ্রামাঞ্চলে ক্ষয়িষ্ণু জমিদার ও মৃতপ্রায় ছোট চাষীর সম্পদের বিনিময়ে এঁরা ফুলে-ফেঁপে ওঠেন।[4 ]এঁদের এই আর্থিক প্রতিপত্তি এবার রাজনৈতিক প্রতিপত্তিতে বদলে যাওয়ার পালা।

    ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট চালু হওয়ার সাথে সাথে কলকাতা শহর বাংলার রাজনীতির সিংহাসন থেকে চ্যুত হয়; গ্রামবাংলা এসে দাঁড়ায় রাজনীতির কেন্দ্রে, এই প্রথমবার। বঙ্গীয় আইনসভায় হিন্দুদের জন্য বরাদ্দ ৭৮টি আসনের মধ্যে মাত্র ১২টি বণ্টিত হয় শহরে, বাকিগুলি গ্রামে। মুসলিম আসনগুলির মধ্যে এই সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় ১১৭ তে ৬টি। কলকাতা-কেন্দ্রিক কংগ্রেস দলের মাথায় হাত পড়ে। এতকাল তার যাবতীয় আন্দোলন, যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালিত হয়ে এসেছে শহুরে নেতাদের নির্দেশে, শহুরে কর্মীদলের কাঁধে ভর দিয়ে। গ্রামে তার গণভিত্তি কোনোকালেই ছিল না। শুধু কংগ্রেস কেন, কোনো দলেরই ছিল না।[5]

    পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ সবার আগে নেন মুসলিম নেতারা। ফজলুল হক, আক্রম খান, তমিজুদ্দিন খানের মত আতরফ নেতারা নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি নামে একটি কৃষক সংগঠনের জন্ম দেন। অবশ্য খুব শিগগিরই এর কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হবে; ফজলুল হক সংখ্যাগরিষ্ঠ উদ্যমী নেতা-কর্মীদের নিয়ে সংগঠন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে কৃষক প্রজা পার্টি নামের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করবেন। আক্রম খান অবশিষ্ট অংশ নিয়ে পুরনো দলের নেতা হিসেবে থেকে যাবেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর দলটি মুসলিম লিগে মিশে যাবে।

    মুসলিম লিগ নেতৃত্বের বিপরীতে কৃষক প্রজা পার্টির নেতারা অধিকাংশই ছিলেন সাধারন, অসম্ভ্রান্ত আতরফ মুসলমান,যদিও এঁদের কেউ কেউ ছিলেন স্বপ্রতিষ্ঠিত সফল ব্যারিষ্টার অথবা প্রশাসনিক কর্তা। কিন্তু সফলতা তাঁদের গ্রামবাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করেনি। এবং সেটিই ছিল তাঁদের জনপ্রিয়তার ভিত্তি। নামে কৃষক প্রজা পার্টি হলেও দলটি ছিল একান্তভাবেই জোতদারদের দ্বারা পরিচালিত জোতদারদের স্বার্থরক্ষাকারী পার্টি। সাধারণ কৃষকদের খুশী করবার জন্য এঁদের ম্যানিফেস্টোতে খাজনা ও ঋণ মকুবের কথার উল্লেখ থাকলেও এঁদের আসল শ্লোগান ছিল 'জমিদারী হটাও'। জমিদার ও মহাজনেরা ছিলেন এঁদের আক্রমণের মূল লক্ষ, যাঁরা আবার কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হিন্দু। ফলতঃ গরীব মুসলিম চাষীদের সঙ্গে এঁরা একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আত্মীয়তা গড়ে তুলতে সক্ষম হন। অবশ্য তাই বলে এঁদের গোঁড়া মৌলবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়াও ভুল হবে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাবো, মুসলিম জমিদারদের বিরুদ্ধেও কৃষক প্রজা পার্টি কিভাবে সমান সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। ১৯৩৬ সালে কুমিল্লার এক জনসভায় ৪০০০ মানুষের সামনে সুবক্তা ফজলুল হক সম্ভ্রান্ত জমিদার সার মহিউদ্দিন ফারুকি ও সার নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রবল বিষোদ্গার করেন।

    ১৯৩৬ সালে ধর্মীয় লাইনে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে (যদিও আসলে তা ছিল সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার কৌশল) ঢাকার নবাব হাবিবুল্লার নেতৃত্বে একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়, নাম দেওয়া হয় 'ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি'।[6] প্রসঙ্গতঃ, বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লিগ দলটি ততদিনে সাইন বোর্ডে পরিণত হয়েছে। নতুন দলের সভাপতি হন নবাব স্বয়ং, সম্পাদক হন হুসেন শহিদ সুরাবর্দি। সুরাবর্দি ছিলেন বাংলার অন্যতম খানদানী আসরাফ মুসলিম বংশের সদস্য। খিলাফৎ আন্দোলনে যোগদান করে সুরাবর্দির রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়; খিলাফৎ আন্দোলন শেষ হলে ইনি স্বরাজ্য পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২৬ সালে কলকাতার দাঙ্গার পরে সুরাবর্দি স্বরাজ্য পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যোগ দেন। নিজের স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন-'at one time I had as many as 36 trade unions as members of a Chamber of Labour I had founded to oppose the Communist labour organisations'."[6] এই সময়েই তিনি বেশ কিছু মুসলিম গুন্ডা-দাঙ্গাবাজদের আশ্রয় দিতে শুরু করেন (এঁদের একজন হলেন কুখ্যাত গুন্ডা মীনা পেশোয়ারী); কলকাতার অন্ধকার জগতের সঙ্গে এইভাবে তাঁর যোগাযোগের সূত্রপাত।[7]

    নোটঃ
    1.J. C. Jack, Bakarganj SSR (1900-08), Calcutta, 1915, pp. 87-88.
    2.ভূমেন্দ্র গুহ'র লেখা 'জীবনানন্দ ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য' বইটি থেকে উদ্ধৃত করছি-"...টিউশনি তো করেছেন সারা-জীবন-ভর প্রায়... বড়োলোকের প্রাইভেট সেক্রেটারির চাকরিতে মনোনীত হবার জন্য চেষ্টার কসুর করেন নি... কর্পোরেশনের বাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছেন, যদি একটা ভেকান্সির সন্ধান পান সুভাষ বোসকে গিয়ে বলবেন, সেই ফাঁকটায় যদি তাঁকে গলিয়ে দিতে পারেন; কালীঘাট-পলতা লাইট রেলওয়ের টিকিটচেকার 'এর অথবা গার্ড'এর চাকরির ধান্দা করেছেন... খবরের-কাগজের রিপোর্টার'এর চাকরির জন্য স্টেটসম্যান কাগজে ধর্না দিয়েছেন, সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছেন যে, তাঁর ইন্টারভিউ'র আগেই বিজ্ঞাপিত শূন্য পদ ভরাট হয়ে গিয়েছে... এমন-কী খবরের-কাগজের-ফেরিওয়ালার কাজও কাম্য ব'লে মনে হয়েছে... জ্ঞানবাবুর চায়ের-দোকানের মতো একটা চায়ের দোকান অথবা কুষ্ঠরোগিণীর পানের-দোকানের মতো একটা পানের-দোকান করতে পারলে হত।।।সে সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করা চেষ্টাও করেছেন..." (ভূমেন্দ্র গুহ, জীবনানন্দ ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য,পৃ ২৯৭)

    3.A. B. Dutta to the Political Secretary, 4 December 1931, GB HCPB File No. 849/31 (1-9).
    4. Saugata Mukherji, 'Agrarian Class Formation', p. PE-17.
    5.Joya Chatterjee, Bengal Divided : Hindu Communalism and Partition, 1932-47, Cambridge University Press (2002), p.68
    6.ibid p.79.
    7.M. H. R. Talukdar (ed.), The Memoirs of Huseyn Shaheed Suhrawardy, pp. 106-107.
    8.Kazi Ahmed Kamal. Politicians and Inside Stories, p. 54.
  • I | ২৬ এপ্রিল ২০১৮ ২২:৫৪370893
  • কিন্তু সদ্য-গজিয়ে ওঠা এই মুসলিম দলটির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা ছিল তার শহর-কেন্দ্রিকতা। গ্রামবাংলা দখল করতে না পারলে বাংলার রাজনীতিতে আর প্রাসঙ্গিক থাকা যাবে না, সে কথা তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন। সেই উদ্দেশ্যে তাঁরা প্রজা সমিতিগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন; কিছুটা সফলও হন। আক্রম খানের নেতৃত্বাধীন নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির অবশিষ্টাংশ তাঁদের দলে যোগ দেন। কিন্তু আক্রম খান নেহাতই প্রান্তিক শক্তি। গ্রাম বাংলার মুকুটহীন রাজা তখন ফজলুল হক। অনেক সাধ্যসাধনা করেও ফজলুল হককে দলে টেনে আনা গেল না। হক নিজের শক্তি ও আসন্ন ক্ষমতাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। সেই ক্ষমতা তিনি অন্য কারো সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতে চান নি।

    উপায়ান্তর না দেখে ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির নেতারা জিন্নার শরণাপন্ন হলেন। জিন্না তখন সারা ভারত জুড়ে মুসলিম লিগকে গড়েপিটে তুলছিলেন; বাংলার মাটিতে পা রাখবার এই সুযোগ তিনি ছাড়লেন না। ১৯৩৬ সালের অগাস্ট মাসে জিন্না কলকাতা এলেন; নবাবের পার্টিকে বুঝিয়েসুঝিয়ে মুসলিম লিগে টেনে আনা তাঁর পক্ষে শক্ত কাজ হল না। কিন্তু তিনি ধাক্কা খেলেন অন্যত্র। বাংলার কৃষকের অবিসংবাদী নেতা শের-ই- বাংলা ফজলুল হক কায়েদ-ই-আজমের প্রস্তাবে সম্মত হলেন না। হকের এই ঔদ্ধত্যে জিন্না বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই ; এর পর থেকে তিনি সবসময় ফজলুল হককে ডাকবেন "That impossible man" বলে। এবং ফজলুল হকও চিরকাল জিন্নাকে নাম ধরেই সম্বোধন করবেন, কস্মিনকালেও 'কায়েদ-ই-আজম' বলে ডাকবেন না [1]

    ফল দাঁড়াল এই যে হিন্দু মহাসভা বা কংগ্রেস নয়, দুটি মুসলিম-প্রধান দল- কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লিগ আসন্ন নির্বাচনে একে অন্যকে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নিল। মুসলিম আসনগুলির একটিতেও কংগ্রেস কোনো প্রার্থী দিল না। ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিও হিন্দু আসনগুলিতে কোনো প্রার্থী দিল না, যদিও তাদের দলে বর্ণহিন্দু ও নমঃশুদ্র জোতদারের অভাব ছিল না। হক আপাতভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচন-পরবর্তী সমঝোতার পথ খোলা রাখলেন, কিন্তু নির্বাচনের আগে তিনি কোথাও কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো যৌথ কর্মসূচীতে গেলেন না। প্রজা পার্টির নির্বাচনী লাইন ছিল মোটের ওপর সেকুলার; ধর্মীয় ইস্যুর পরিবর্তে তাঁরা ডাল-ভাতের ওপরে জোর দিলেন।

    উল্টোদিকে মুসলিম লিগের শ্লোগান হল মুসলিম সম্প্রদায়ের একতা ও উন্নয়ন। সম্ভ্রান্ত উচ্চবংশীয় নেতাদের সঙ্গে সাধারন গরীব মুসলিম চাষির অসেতুসম্ভব অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবধান তাঁরা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করলেন 'ইসলাম' এর নামে। (যদিও লিগ নেতা সুরাবর্দি, তাঁর সর্বোচ্চ নেতা জিন্নার মতই , ইসলামিক রীতি-অনুশাসন কিছুই মানতেন না। হ্যাম খেতেন, স্কচ পান করতেন, পশ্চিমী নাচ, সুরা ও নারীসঙ্গ পছন্দ করতেন, পশ্চিমী সঙ্গীত শুনতে ভালোবাসতেন; তাঁর কাছে পশ্চিমী সঙ্গীতের হাজারের ওপর রেকর্ডের ঈর্ষণীয় সংগ্রহ ছিল। জনৈক রুশ অভিনেত্রীকে তিনি বিবাহও করেছিলেন।) [2] জোতদার-জমিদার বিরুদ্ধতাকে ভোঁতা করবার জন্য তাঁদের অস্ত্র হল মুসলিম সাম্প্রদায়িক রেটোরিক।

    লড়াই বেশ তিক্ত হয়ে উঠল। প্রচার-পর্বের তুঙ্গ মুহূর্তে ফজলুল হক নাটকীয়ভাবে (নাটকীয়তা ছিল তাঁর স্টাইল) খাজা নাজিমুদ্দিনকে ( বিশিষ্ট মুসলিম লিগ নেতা ও ঢাকার নবাবের জ্ঞাতিভাই) আহ্বান জানালেন যে কোনো আসন বেছে নিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতা করতে। নাজিমুদ্দিন পটুয়াখালি নর্থ আসনটি বেছে নিলেন। এর পেছনে অনেক হিসেবনিকেশ ছিল। প্রথমতঃ, আসনটি নবাবের এস্টেটের অংশ, সেখানে নবাবের ব্যক্তিগত প্রতিপত্তি কাজে লাগানো যাবে। দ্বিতীয়তঃ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ১৯২৭ সালে এই এলাকাটি কুৎসিত হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সাক্ষী হয়েছে। ইসলামের নাম কাজে লাগিয়ে ও দাঙ্গার স্মৃতি উসকে দিয়ে ভোটে জেতা সেখানে সহজ হবে। নবাববাড়ির সবরকম প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজে লাগানো হল আসনটিতে জেতার জন্য। এমন কি গভর্নর সার জন অ্যান্ডারসনকে পর্যন্ত নিয়ে আসা হল নাজিমুদ্দিনের হয়ে প্রচার করবার জন্য।[3]

    এতদসত্বেও নাজিমুদ্দিন হারলেন। বেশ শোচনীয়্ভাবে হারলেন। ফজলুল হকের প্রাপ্ত ভোটের অর্ধেকেরও কম ভোট পেলেন তিনি। পটুয়াখালি নর্থ সম্প্রদায় হিসেবে বাংলার মুসলিমদের সমসত্ব মানসিকতা ও তথাকথিত "কৃষক-সাম্প্রদায়িক চেতনা"(Peasant-communal consciousness) নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তুলে দিল।[4] গ্রামবাংলার অধিকাংশ আসনেই একই ছবি দেখা গেল। শহর এবং শহর-ঘেঁষা এলাকায় অবশ্য মুসলিম লিগ ভালো ফল করল। ভোটের শতাংশ কম হওয়া সত্বেও লিগ, কৃষক প্রজা পার্টির থেকে তিনটি বেশী আসন দখল করল।
    অপর একটি কৃষক সংগঠন "টিপেরা কৃষক সমিতি" (পরবর্তীকালে এর নাম হবে "কৃষক ও শ্রমিক সমিতি") টিপেরা জেলায় বেশ ভালো ফল করল। জেলার সাতটি আসনের মধ্যে পাঁচটি তারা দখল করল। এই দলটির নেতৃত্বে ছিলেন বামপন্থী নেতা ইয়াকুব আলি ও ওয়াসিমুদ্দিন আহমেদ। টিপেরা কৃষক সমিতি ও কৃষক প্রজা পার্টির এই সাফল্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সাধারণ মুসলিম জনতা, অন্ততঃ ১৯৩৬-৩৭ সালে, সাম্প্রদায়িক চেতনায় ভেসে যায় নি; অনেকক্ষেত্রেই তারা মনে রেখেছে-ধর্ম নয়, সমস্যা জমির। [5]

    গ্রামবাংলার এই রাজনৈতিক ডিসকোর্সের মধ্যে কংগ্রেস খুব দিশাহীন অবস্থায় পড়ে গেল। জমিদার-মহাজনের দল কংগ্রেস ১৯২৮এর Bengal tenancy Ammendment Bill-এর যাঁতাকলে পড়েই বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিল। জমিদারী বিলোপ আন্দোলন, জোতদার শ্রেণীর উত্থান, মহামন্দার ফলে সাধারণ চাষীদের খাজনা ও ঋণ শোধ না করা-এই সবই জমিদারদের ক্ষিপ্ত করে তুলছিল। জমিদার-কৃষক সমিতির ময়দানের লড়াই জায়গায় জায়গায় বেশ হিংসাত্মক হয়ে উঠছিল।সাধারণ কৃষকদের প্রতিবাদকে জমিদারবাহিনীর পক্ষ থেকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছিল 'সাম্প্রদায়িক' বলে। দল হিসেবে কংগ্রেসকে এর দায় বহন করতে হচ্ছিল। এদিকে নির্বাচনী রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে গ্রামবাংলার এই সাধারণ কৃষকদের ফেলে দিলেও চলবে না। কংগ্রেস পড়ে গেল এক উভয়সংকটে।

    সশস্ত্র বিপ্লবী দলের অনেক সদস্য আন্দামান-দেউলিতে নির্বাসনদণ্ড কাটিয়ে তখন ফিরে আসছেন। এঁদের অনেকেই নির্বাসনে থাকাকালীন মার্ক্সবাদী রাজনীতির পাঠ নিয়েছেন। এঁরা কংগ্রেসে যোগ দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা মেটানোর কাজে নেমে পড়লেন। ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টি 'যুক্তফ্রন্ট'এর তত্ব প্রচার করে সদস্যদের বললেন কংগ্রেসের ভেতরে থেকে কৃষকদের কাছে বিপ্লবী রাজনৈতিক মতাদর্শ পৌঁছে দিতে। এইসব কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা কংগ্রেসের হয়ে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের নিয়ে জেলায় জেলায় কৃষক সমিতি গড়ে তুলতে শুরু করলেন।

    কংগ্রেসের জমিদার-প্রধান নেতৃত্ব স্বভাবতঃই তরুণ তুর্কীদের এই বৈপ্লবিক কাজকর্ম সমর্থন করেন নি। জায়গায় জায়গায় দুটি উপদলের মধ্যে কোন্দল শুরু হয়ে গেল। প্রার্থীতালিকা থেকে র‌্যাডিক্যালদের নির্মমভাবে ছেঁটে ফেলা হল। বিত্তশালীদের প্রার্থী না করে কংগ্রেসের তখন উপায়ও কিছু ছিল না, কেননা প্রদেশ কংগ্রেসের তহবিল পুরো ফাঁকা। ভোটের কাজে খরচা করবার মত পয়সা নেই, প্রার্থীরা নিজেদের খরচা নিজেরাই যোগাড় করে নিতে পারলেই ভালো।

    নোট -
    1.Kazi Ahmed Kamal, Politicians and Inside Stories, p. 18.
    2.জয়া চ্যাটার্জির সঙ্গে নিখিল চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার। নিখিলবাবু মুসলিম লিগ নেতা আবুল হাসিমের সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করতেন ও সেই সুবাদে সুরাবর্দিকে কাছ থেকে চিনতেন। এছাড়াও পড়ুন- S.Rahmatullah Memoirs, IOLR MSS Eur F/180/14 a.
    3.Kazi Ahmed Kamal, Politicians and Inside Stories, pp. 118-120.
    4.Partha Chatterjee argues that 'the very nature of peasant consciousness . . . is religious'.
    See his 'Agrarian Relations and Communalism', pp. 11, 31.
    5.Joya Chatterjee, Bengal Divided : Hindu Communalism and Partition, 1932-47, Cambridge University Press (2002), p.88.
  • I | ২৬ এপ্রিল ২০১৮ ২৩:০২370894
  • ফেসবুকে কোথাও একটা দেখলাম ইশান এই সময়টাকে নিয়ে লিখছে। ইন ফ্যাক্ট দুজনে দুজায়গায় মোটামুটি একই কথা লিখছি। পাই দেখলাম অনেক প্রশ্ন-টশ্নও করছে।

    কিন্তু এখন আর ফেসবুক চিরুনি দিয়ে খুঁজেও লেখাটা খুঁজে পাচ্ছি না। আছেন, কেউ সাহায্যকারী?
  • সিকি | ২৬ এপ্রিল ২০১৮ ২৩:১৮370895
  • ঈশানের লেখা তো পড়ি নি! কোথায় লিখছে?

    এটা পড়ছি। একদম থ্রিলার।
  • dd | 59.205.218.108 | ২৭ এপ্রিল ২০১৮ ০৭:৫৩370896
  • লাস্ট কিস্তিটা খুব ইন্টেরেস্টিং হয়েছে।
  • pinaki | 90.254.154.99 | ২৭ এপ্রিল ২০১৮ ১৫:৩২370897
  • কমরেড ইন্দোদা, ফেসবুকে চিরুনি দিয়ে খুঁজলে হবে না। সৈকত নাম দিয়ে খুঁজতে হবে। :-P

    "দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা হচ্ছিল। সেই প্রসঙ্গেই এই লেখাটি। বলাবাহুল্য, এই বিষয়টিতে আমি কোনোভাবেই বিশেষজ্ঞ নই। অন্যের কিছু লেখা পড়েছি মাত্র। তার উপর এই লেখাটি মূলত স্মৃতি থেকে লেখা। সামান্য দু-একটা রেফারেন্স চেক করেছি শুধু। মোটা দাগে ঘটনাবলী ঠিকই আছে, কিন্তু এর মধ্যেও নানা বাঁক, দলবদ্ল, স্বার্থের সংঘাত, এইসব ছিল। যেগুলো এই লেখায় নেই। সেই সময়ের ইতিহাস এক গণবিস্মৃতির শিকার মনে হচ্ছিল, তাই এইটি লেখা। ভারত ছাড়ো আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজ এইসব ইশকুল পাঠ্য বস্তুর নিচে যা যা ঘটেছিল, সেটাই এর উপজীব্য। মোটাদাগের ব্যাপারটা এরকমই ঘটেছিল। তবে সূক্ষ্মতর বিষয়গুলিতে কেউ আগ্রহ পেলে অবশ্যই নিজে নিজে বইপত্র পড়বেন।
    ---
    অবিভক্ত ভারতবর্ষকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র এবং সাম্প্রদায়িকতার স্বাদ ব্যাপকভাবে বৃটিশরা প্রথম দেয় ১৯৩২ সালে। কয়েকদফা গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হবার পর, যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ভারতীয়দের ভোটে নির্বাচিত আইনসভার কথা ঘোষণা করেন, যে ঘোষণা 'সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা' বা 'কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড' হিসেবে পরিচিত। পরে ৩৫ সালে সেটা আইন হয়। অবশ্য গণতন্ত্র বা সাম্প্রদায়িক, কোনো শব্দটিই তখন আজকের অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। 'সাম্প্রদায়িক' শব্দটির গায়ে তখনও নিন্দাসূচক তকমা পড়েনি। আর ভোট মানেও আজকের সার্বজনীন গণতন্ত্র নয়। প্রস্তাবানুসারে ভোটদানের অধিকার নির্ধারণের কিছু মাপকাঠি ছিল, যা আজকের যুগে অদ্ভুত লাগবে। যেমন, একটি নির্দিষ্ট পরিমানে কর দিলে, অথবা বিশ্ববিদ্যালয় গ্র‌্যাজুয়েট হলে, কিংবা উকিল বা ডাক্তার হলে ভোটাধিকার পাওয়া যাবে, এইরকম (হুবহু নয়, হুবহু জানতে গেলে বইপত্র কনসাল্ট করুন, আমার মনে নেই)। যদিও ভোটদাতাদের সংখ্যা এতেও অব্শ্য আগের চেয়ে অনেক বাড়ে, কিন্তু তার পরেও সংখ্যাটা গোটা জনসমষ্টির ১৫% এর নিচে ছিল। আজকের চোখে আরও অদ্ভুত যেটা লাগবে, সেটা হল ভোটদানের পদ্ধতি। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিশ্চান, ইত্যাদি সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এবং আরও কৌতুহলোদ্দীপক হল, হিন্দুরা কেবল হিন্দুদেরই ভোট দেবে, মুসলমানরা মুসলমানদের, জমিদাররা জমিদারদের। কোনো সন্দেহ নেই, ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির এ একদম কপিবুক প্রয়োগ।

    বাংলায় এর ফলে ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে হয়ে দাঁড়ায়। হিন্দু মুসলমানের অনুপাত তখন বাংলায় ছিল ৪৫%-৫৫% এর মতো। কিন্তু ২৫০ আসনের আইনসভায় মুসলমান দের আসন ছিল ১২০ র মতো, হিন্দুদের ৭০ (১/৪ এর একটু বেশি)। হিন্দুদের আসনের মধ্যে আবার ছিল অনুন্নত শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণ। পরে গান্ধী-আম্বেদকর পুনা চুক্তির পরে সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা আরও বাড়ে। ভদ্রলোক হিন্দু বাঙালির আসন সংখ্যা কমে আসে ৪০ এ। অর্থাৎ ১/৫ এরও কম। প্রসঙ্গত গান্ধী-আম্বেদকরের চুক্তির সময় কোনো বাঙালি নেতা উপস্থিত ছিলেননা, তাঁদের মত নেওয়া হয়েছিল বলেও জানা যায়না। এর ফলে যা হবার তাইই হয়। বাংলার কংগ্রেস জন্মলগ্ন থেকেই অঘোষিতভাবে ছিল হিন্দু এবং জমিদারদের দল। চাকরি বাকরি এবং অন্যান্য 'ভদ্র' কারবারে মুসলমানদের উপস্থিতি খুবই কম ছিল। ফলে বাংলার কংগ্রেস এবং ভদ্রলোক ও জমিদাররা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। প্রতিবাদটা একেবারে অন্যায্য ছিলনা, কারণ জনসংখ্যার অনুপাতে আসন ভাগ একেবারেই হয়নি। এবং সেটা হবার কথা ছিল বৃটিশের ভাগ করার নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু তা না হয়ে বৃটিশের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিবাদ একেবারেই সাম্প্রদায়িক খাতে বয়ে যায়। হিন্দু মহাসভা থেকে অমৃতবাজার, রবীন্দ্রনাথ থেকে শরৎচন্দ্র, সবাই এই একই লাইনে বক্তব্য রাখেন বা সমর্থন করেন। উল্টোদিকে মুসলমান সমাজে প্রাথমিকভাবে প্রতিক্রিয়া কিছুটা মিশ্র ছিল। দীর্ঘ 'অবিচার' এর থেকে মুক্তির একটা উল্লাস ছিল, কিন্তু অনেকেই নানা কারণে সংরক্ষণহীন বা সার্বজনীন ভোটের পক্ষে ছিলেন। তার একটা কারণ হল, মুসলমানদেরও ৫০% এর কম আসন দেওয়া হয়েছিল। অবাধ নির্বাচন হলে তার থেকে অনেক বেশি আসনই পাওয়া যাবে, এটা অনেকেই ভেবেছিলেন। পরের দিকে মুসলমান সমাজেও সাম্প্রদায়িক প্রবণতা বৃদ্ধির একটা লক্ষণ দেখা যায়।

    এর থেকে মনে হতে পারে, ১৯০৫ সালের যে অর্জন, সেটা ১৯৩২ সালে এক ধাক্কায় বাঙালি হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু মজা হল, বিষয়টা সেরকম দাঁড়ায়নি। আইন ১৯৩৫ এর, আর নির্বাচন ১৯৩৭ সালে। তার আগে থেকেই সামাজিক মেরুকরণ অদ্ভুত ভাবে বদলে যেতে শুরু করে। এর মূল কান্ডারি ছিলেন ফজলুল হক। সে সময় মুসলিম লিগ বাংলায় একবারেই শক্তিশালী ছিলনা। ঢাকর নবাব নাজিমুদ্দিন বা অভিজাত ও শিক্ষিত সুরাবর্দী -- এরকম কিছু উচ্চশ্রেণীর মুসলিম মাতব্বর অবশ্যই ছিলেন, কিন্তু তাঁদের জনভিত্তি তেমন ছিলনা। উল্টো দিকে ছিলেন তুলনায় সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা ফজলুল হক। তিনি অভিজাত না হওয়ায় ব্যাপারটা শাপে বর হয়েছিল। রাজনীতির সহজাত ক্ষমতা দিয়ে ফজলুল বোঝেন, যে, অভিজাতদের সঙ্গে লড়তে গেলে, ধর্ম নয়, অন্যান্য বিষয়কে আলোচনার কেন্দ্রে আনতে হবে। অতএব তিনি তৈরি করেন কৃষক প্রজা পার্টি। সেই পার্টির লক্ষ্য ছিল জমিদাররাজকে আক্রমণ করা। এবং সাধারণ রায়ত, বা মতান্তরে সম্পন্ন কৃষক এবং জোতদারদের স্বার্থরক্ষা করা। ধর্ম একেবারেই ছিলনা। উল্টোদিকে, নাজিমুদ্দিন বা সুরাবর্দী সরাসরি মুসলিম লিগের হয়ে নির্বাচনী মঞ্চে নামেন। তাঁদের অস্ত্র ছিল ধর্ম। মুসলমান আসনগুলিতে এই দুই দলই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। সুস্পষ্টভাবে নিজেকে হিন্দুদের দল হিসেবে চিহ্নিত করে মুসলিম আসনে কংগ্রেস একটিও প্রার্থী দেয়নি। সেটাতেও শাপে বর হয়। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের কাছে এটা আর হিন্দু বনাম মুসলমান লড়াই ছিলনা। ছিল ধর্ম বনাম জমিদারতন্ত্রবিরোধিতার লড়াই। ফজলুল হকও বেছে বেছে মুসলমান জমিদারদেরই আক্রমণ করতে থাকেন। এবং ধর্মের বিরুদ্ধে শেষ হাসি তিনিই হাসেন। ঢাকার নবাবের খাস তালুকে তিনি নবাবকে বিপুল ভোটে হারিয়ে জয়লাভ করেন।

    হিন্দু আসনগুলিতে সবচেয়ে বেশি জেতে কংগ্রেস। যেহেতু সেখানেও হিন্দু মুসলমান বিরোধের কোনো ব্যাপার ছিলনা, তাই সাম্প্রদায়িকতা ছড়ায়নি। এর মধ্যে নির্বাচনের ঠিক আগে প্রদেশ কংগ্রেসের শীর্ষস্থানে আসেন সুভাষ বসুর দাদা শরৎ বসু। হক নির্বাচনের পরে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট সরকার গড়ার দিকেই ঝুঁকেছিলেন। আজীবন অসাম্প্রদায়িক শরৎ বসু তাঁর সঙ্গে একটি সমঝোতাসূত্রও তৈরি করেন। কিন্তু বঙ্গ কংগ্রেসের বিরোধী গোষ্ঠী আর কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের যৌথ নীতিতে যদিও সেটা বাস্তবায়িত করা যায়নি, কিন্তু মুসলমান সমাজের কাছে নিঃসন্দেহে কংগ্রেস তথা শরৎ বসুর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। ফলে জোট না হওয়াতেও সম্প্রীতি ব্যাহত হয়েছিল বলা যাবেনা।
    এই ১৯৩৭ সাল থেকেই বাংলা এবং ভারতে নানা নাটকীয় ঘটনা ঘটতে থাকে। বাংলার ক্ষেত্রে সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এবং পরবর্তীকালে প্রতিশ্রুতি মাফিক একের পর এক বিল আনতে শুরু করেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি ছিল, ১। জমিদারদের বিরুদ্ধে রায়তদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রজাসত্ব আইন ২। সুদ ব্যবসায়ী দের বিরুদ্ধে মানিলেন্ডার্স অ্যাক্ট (বিলের নাম ইত্যাদি বিশদ মনে নেই)। মুসলিম লিগের কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেও নির্বাচক জনসমষ্টির দিকে তাকিয়ে লিগকেও এগুলো মেনে নিতে হয়। রাজনীতিতে ধর্মের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ইস্যুর জয় হয়। বাংলায় আর কমিউনিস্টদের দরকার নেই, ফজলুল হকই সাড়ে সব্বোনাশ ডেকে আনবে এরকম শোনা যেতে শুরু করে। অন্যদিকে ১৯৩৮ সালে প্রজাসত্ব আইন পাশ হয়। হরিপুরায় র‌্যাডিকাল সুভাষ চন্দ্র বসু কংগ্রেস সভাপতি হন। এবং তাঁর দাদা শরৎ বসু বাংলার কংগ্রেসের একটা অংশে প্রভাব বিস্তার করেন। বাংলার কংগ্রেস আবার মোটামুটি আড়াআড়ি ভাবে ভেঙে যায়। একদিকে জমিদার ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। ভাবাদর্শে মুসলিম লিগ অনুসারী, কেবল ধর্মটা আলাদা। অন্যদিকে বসু গোষ্ঠী। তাঁরা স্রেফ জমিদার নয়, গ্রামাঞ্চলে চাষীদের মধ্যে সংগঠন বিস্তারের প্রয়োজন্ বুঝিছিলেন। এবং শুধু হিন্দু কৃষক নয়। তাঁরা বামপন্থী ঘরানা অনুসরণ করতে শুরু করেন। কৃষক সমিতিতে জোর দেওয়া হয়। আন্দামান ফেরত বিপ্লবীরা, তাঁদের অনেকেই তখন কমিউনিস্ট, বসু গোষ্ঠীর সংগঠক হন। কমিউনিস্ট পার্টিও কংগ্রেসের মধ্যে বসু গোষ্ঠীর হয়ে কাজ শুরু করে। ফলে, একদিকে যেমন মুসলিম লিগ বনাম কৃষক প্রজা পার্টি, অন্যদিকে কংগ্রেসের দুটি গোষ্ঠী দুটি দক্ষিণ ও বাম, এই দুই বিপরীত মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করতে থাকে। সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা তিরিশের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিমন্ডলকে সাম্প্রদায়িক করতে সক্ষম হয়না। বরং অন্য একটি মেরুকরণই ক্রমশ সুস্পষ্ট হয়। তখনও বাংলা ভাগের কথা কোনো পক্ষের কোনো মানুষের মাথায় আসেনি। বস্তুত পাকিস্তান নামটাই তখনও অজানা।

    কিন্তু ১৯৩৯ সাল থেকে পট পরিবর্তন শুরু হয়। সে পরিবর্তন আর নাটকীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে গান্ধীজির ইচ্ছা এবং প্রার্থীর বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতির পদে বাম ঘেঁষা র‌্যাডিকাল সুভাষ বসু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জয়ী হন। বাংলায় ওই বছরই ফজলুল হক নিয়ে আসেন মানিলেন্ডার্স বিল। গ্রামের জমিদার এবং শহরের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, উভয়েরই তুমুল স্বার্থহানির সম্ভাবনা দেখা দেয়। শরৎ বসুর নেতৃত্বে দ্বিধাবিভক্ত কংগ্রেস ওই বিলের সর্বাত্মক বিরোধিতা থেকে বিরত থাকে। তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে উল্টোপক্ষে এই প্রথম বাংলার রাজনীতিতে সরাসরিতে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন কিছু অবাঙালি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মালিক। নেতৃত্ব দেন দেবীপ্রসাদ খৈতান্ নামক্ এক মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী। সঙ্গে ছিলেন আরেক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, নলিনীরঞ্জন সরকার। প্রভাব্শালী হিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী মহল, এবং গণমাধ্যম এই বিলের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ প্রকাশ করে। মার্চ মাসে ত্রিপুরী কংগ্রেসে নির্বাচিত সভাপতি সুভাষের বিরুদ্ধে তীব্র চাপ তৈরি করেন গান্ধী সহ তৎকালীন গোটা নেতৃবৃন্দ। গান্ধীর কূটকৌশলের কাছে নতিস্বীকার করে পরের মাসে সুভাষ পদত্যাগ করেন। কালবিলম্ব না করে অচিরেই তাঁকে এবং তাঁর দাদাকে কংগ্রেস দরজা দেখিয়ে দেয়। মে মাসে কলকাতায় তৈরি হয় ফরোয়ার্ড ব্লক। কংগ্রেসের মধ্যে বাম ও দক্ষিণের যে ভারসাম্য ছিল, গান্ধীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে তা নির্মূল করে কংগ্রেসকে কেবলমাত্র হিন্দু জমিদার ও ব্যবসায়ীদের পার্টিতে পরিণত করার পথ প্রশস্ত হয়। কিন্তু এইটুকুতেই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী খুশি হয়নি। ওই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে সাভারকর হিন্দু মহাসভার পুনর্জাগরণের জন্য কলকাতায় একটি সভা করেন। কংগ্রেসের উপর বিরক্ত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মহাসভাকে অকাতরে সাহায্য করতে শুরু করে। জালান, গোয়েঙ্কা, খৈতান, কানোরিয়ারা সবাই ছিলেন এই দলে। পর্দার আড়ালে কী হয়েছিল জানা নেই। তবে কংগ্রেসকে পথে ফিরিয়ে আনার জন্য ক্রমশ হিন্দু মহাসভার লাইনই গ্রহণ করতে হয়। বিশ্বযুদ্ধ এবং ভারত ছাড়োর ডামাডোলের বাজারে সেটা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান না হলেও, যুদ্ধের শেষে স্পষ্ট বোঝা যায়। বস্তুত হিন্দু মহাসভার অস্তিত্ব বাংলায় সম্পূর্ণ বিপন্ন হয়ে পড়ে ১৯৪৫ এর পর। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি নির্বাচনে জিতেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে। বাকি সর্বত্রই কংগ্রেস। ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর আনুকূল্যে কংগ্রেসই উদ্যোগ নিয়ে 'হিন্দু' জনসমাজের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। এবং সারা বাংলা জুড়ে ৪৫ সালের পর দেশবিভাগের পক্ষে প্রচারান্দোলন সংগঠিত করে। 'জাতীয়' সংবাদপত্রগুলি কংগ্রেসের সঙ্গ দেয়। বাধা দেবার বিশেষ কেউ ছিলনা। যিনি দিতে পারতেন, সেই সুভাষ বসু ৪১ সালে দেশ পরিত্যাগ করে জার্মানি চলে যান। ফরোয়ার্ড ব্লক খন্ডবিখন্ড হয়ে পড়ে। শৎ বসুর সমস্ত গোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিলনা। অন্য বিকল্প ছিল কমিউনিস্টরা। নৌবিদ্রোহ বা আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের সময় গণ আন্দোলনের ঢল নেমেছিল, কিন্তু কমিউনিস্টদের গোটা আন্দোলনকে চালিত করার ক্ষমতা ছিলনা। এবং তারাও নীতিগতভাবে দেশভাগ মেনে নেয়। ফলে একতরফা ভাবে হিন্দু সাম্প্রদায়িক লাইনই বাংলার কংগ্রেসের লাইন হিসেবে পরিচিত হয়। বাংলা কংগ্রেস বিধান চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে হাইকম্যান্ডের বশংবদ একটি গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। উল্টোদিকে তোলার মতো শক্ত কোনো গলা ছিলনা। প্যাটেল এবং নেহেরু অবাধ্যতা সহ্য করতে রাজি ছিলেননা। তোলার মতো হিম্মতও কোনো 'জাতীয় ব্যক্তিত্ব'এর ছিলনা। একমাত্র সম্ভাব্য বিরোধী যিনি হতে পারতেন, তিনি তখন লেজেন্ড, আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক, মৃত কিংবা বন্দী কিংবা নিখোঁজ। তিনি বেঁচে ছিলেন না মারা গিয়েছিলেন, এই লেখায় সে নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই, থাকার মানেও নেই। কিন্তু বেঁচে থাকলেও তাঁকে দেশে ফিরতে না দেবার মতো যথেষ্ট কারণ মজুদ ছিল, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

    এতো গেল হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার গল্প। উল্টোদিকের গল্পটাও বলে নেওয়া যাক। ১৯৩৭ সালে ফজলুল হক যে সরকার গঠন করেন, সেটা ছিল সংখ্যালঘু সরকার। মুসলিম লিগের সঙ্গে তাকে জোট বাঁধতে হয়। এবং প্রাথমিক অ্যাজেন্ডার প্রশ্নে, আগেই বলা হয়েছে, প্রজাদের (যাদের বেশিরভাগই ছিল মুসলমান) রুটিরুজির প্রশ্নে তিনি গোঁড়া কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। কিন্তু সংখ্যালঘু দলের যা সমস্যা, এই সরকারেও তা দেখা দেয়। ক্ষমতালাভের পরেই অন্তর্দ্বন্দ্বে কৃষক প্রজা পার্টি দুভাগ হয়ে পড়ে। ফজলুল হক জোটসঙ্গী খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা সরকারের শেষদিন পর্যন্ত করে যান। কিন্তু কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত কখনই সমর্থন যোগাতে রাজি ছিলনা, তাদের ঝোঁকটা, আগেই বলা হয়েছি, হিন্দু মহাসভার অ্যাজেন্ডা পুনর্দখল করায় নিয়োজিত ছিল। বসু গোষ্ঠীও কখনই সমর্থন জোগানোর মতো দানা বাঁধতে পারেনি। অতএব সরকার টেকাতে ফজলুল হককে শেষমেশ মুসলিম লিগের অ্যাজেন্ডার দিকে ঝুঁকতে হয়। জিন্না ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে সর্বপ্রথম মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা পেশ করেন। তার আগে তিনি বাংলা এবং পাঞ্জাবের মুসলিম নেতাদের সমর্থন নিশ্চিত করেন। ফজলুল হকের ক্ষেত্রে সরকার টেকানোর দাম ছিল লাহোর প্রস্তাব সমর্থন। বস্তুত লাহোর শহরে প্রস্তাবটির উত্থাপক তাঁকেই হতে হয়। বাংলায় তাঁর জমিদারবিরোধী নীতিতে কংগ্রেসের মতই সাবেক মুসলিম লিগ নেতা সুরাবর্দী বা নাজিমুদ্দিন কারোঅই সমর্থন ছিলনা, তাঁরা ছিলেন জমিদার বা ব্যবসায়ী শ্রেণীভুক্তই। কিন্তু জিন্নার কাছে এটা ছিল বৃহত্তর লক্ষ্যের জন্য ছোট্টো আপোস। বৃহত্তর লক্ষ্য, অর্থাৎ মুসলমান আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবী। সেজন্য ফজলুল হক ব্যবহৃত হন। পরবর্তীকালের পাকিস্তানের দাবী বৈধতা পায়। এত কিছুর পরেও সরকার অব্শ্য টেকেনি। মুসলিম লিগ ফজলুলের পায়ের তলা থেকে মই ঠিকই কেড়ে নেয়। ফজলুল নানা ভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করেন, এমনকি শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গেও একবার জোট করেন। কিন্তু বৃহত্তর খেলায় জিতে যাবার পর, মুসলিম লিগের কাছে বাকিটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। ১৯৪১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ফজলুলকে সরিয়ে তারা ক্ষমতা দখল করে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হন সুরাবর্দী। বাংলায় 'সেকুলার'দের মূলত জায়গা ছাড়তে হয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ নামক দুই 'কেন্দ্রীয়' শক্তির কারণে। বাংলার জনতার সাম্প্রদায়িকতার কারণে নয়। দুই দলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা দুরকম হলেও মূল পদ্ধতিটি একই ছিল। 'বাম ঘেঁষা' বিকল্পকে যেকোনো মূল্যে ছেঁটে ফেল।

    এর পর বাকিটা স্রেফ গতিজাড্য। সুরাবর্দী প্রশাসক হিসেবে অপ্দার্থ এবং দুর্নীতিতে প্রশ্রয়দানকারী ছিলেন বলে বাকি কাজটা আরও সহজ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্ভিক্ষে বহু মানুষের মৃত্যু হয়, গুজব ছড়ায়, তিনিও তা থেকে পয়সা কামিয়েছেন। মুসলমানদের অধিক পরিমানে চাকরিতে নিয়োগ করতে শুরু করেন তিনি। ফজলুল হকের সময়েও সেটা হয়েছিল, কিন্তু নীতি মেনে। তাই তাঁর দিকে কেউ আঙুল তোলেনি। সুরাবর্দীর আমলে নিয়োগে দুর্নীতি তীব্র হয়। সর্বস্তরে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত অপদার্থতাও প্রকট ছিল। এমনকি ১৯৪৬ সালে জিন্নার ডায়রেক্ট অ্যাকশন ঘোষণার পর কলকাতায় যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়, সেটাও সুরাবর্দীরই জন্য। তিনি পুলিশকে দিনকতকের জন্য নিষ্ক্রিয় রেখেছিলেন। তাতে যে মুসলমানদের বিশেষ লাভ হয়েছিল তা নয়। তারা হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় মারা গিয়েছিল এই দাঙ্গায়। হিন্দুদের সংখ্যাধিক্য ছিল এই এলাকায়। তদুপরি প্রস্তুতিও ছিল দীর্ঘদিনের। হিন্দু মহাসভার অ্যাজেন্ডা বস্তুত হাইজ্যাক্ অকরে নিয়েছিল কংগ্রেস। পাড়ায় পাড়ায় চালু হয়েছিল 'হিন্দু'দের অস্ত্রচর্চা। তৈরি হয়েছিল নানা হিন্দু সংগঠন, ব্যায়াম সমিতি, এবং তৈরি করা হয়েছিল রক্ষাকারী দাদাদের। পুরোমাত্রায় অর্থ সাহায্য যুগিয়েছিলেন পূর্বোক্ত ব্যবসায়ীরা। একদিকে সুরাবর্দীর শাসনকালকে 'মুসলমান শাসন' বলে দাগিয়ে দেওয়া, বাংলা জুড়ে দেশভাগের পক্ষে প্রচার, বৃহৎ সংবাদপত্র গোষ্ঠীর সমর্থন, এবং দাঙ্গায় মেরুকরণ তৈরি, পুরোটাই সর্বভারতীয় কংগ্রেসের দেশভাগের অ্যাজেন্ডার পক্ষে যায়। কলকাতার পরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্রও। নোয়াখালিতে আরেকদফা নরমেধ যজ্ঞ হয়। মেরুকরণ তীব্র হয়। এমন একটা আবহাওয়া তৈরি করা হয়, যেন এই মেরুকরণের পরিবেশে সহাবস্থান অসম্ভব। হিন্দু ভদ্রলোক এবং মুসলমান বড়লোকদের একটা বড় অংশ এই প্রচারে সাড়া দিয়েছিলেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু ফজলুল-সুভাষ যে জনগোষ্ঠীর ইসুকে রাজনীতির মূখ্য বিষয় করতে চেয়েছিলেন, তাদের মতামত কেউ জানতে চায়নি। কোনো পক্ষ থেকেই। অবশ্য সত্যের খাতিরে এও বলা উচিত, যে, মুসলিম লিগ বিভাজনের প্রশ্নে তুলনামূলকভাবে নমনীয় ছিল। ক্যাবিনেট কমিশন একটি আলগা ফেডারেশন হিসেবে অবিভক্ত ভারতের যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাতে জিন্না অরাজি ছিলেননা, কিন্তু কংগ্রেস রাজি হয়নি। শেষ চেষ্টা হিসেবে সুরাবর্দী, শরৎ বসু, কিরণ্শঙ্কর রায় অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শরৎ বসু তখন গুরুত্বহীন, ভাইয়ের ক্যারিশমা তাঁর ছিলনা। কিরণশংকরকে হাইকম্যান্ড এক ধমকেই থামিয়ে দেয়। ফলে বাংলা বিভক্ত হয় প্রায় বিনা প্রতিবাদে। একটি জাতি বিভক্ত হয়। লাখে লাখে মানুষ ঘটিবাটি হারিয়ে প্রাণ দেন, বা প্রাণ হাতে করে সীমান্ত পার করেন, ভাগ করার সময় যাঁদের সম্মতি নেওয়া হয়নি। ১৯৪০ থেকেই বাংলার কংগ্রেসকে কেন্দ্রের জো হুজুর বানিয়ে ফেলা হয়েছিল, ১৯৪৭ এর পর তার নতুন অধ্যায় শুরু হয়। পশ্চিমবাংলার তথাক্থিত রূপকার বিধান চন্দ্র রায় অবশ্য বহুকাল থেকেই ব্যাপারটায় অভ্যস্ত ছিলেন।"
  • pinaki | 90.254.154.99 | ২৭ এপ্রিল ২০১৮ ১৫:৩৫370899
  • যাই হোক, এবারে জাস্ট একটু ভালো বিরিয়ানি খাওয়ালেই চলবে। বেশি কিছু দাবীদাওয়া নেই। পরেরবার একটু বেশি চার্জ করব। ;-)
  • I | 57.15.196.180 | ২৭ এপ্রিল ২০১৮ ২২:১৮370900
  • হ্যাঁ চলো খেয়ে আসি।আর্সালান যাবে? আমার বাড়ির কাছে চিনার পার্কে আছে।
  • I | 57.15.196.180 | ২৭ এপ্রিল ২০১৮ ২২:২২370901
  • মামু হেব্বি লিখেছে,তবে একটা ছোট ভুল করেছে।ফজলুল হক হারিয়েছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিনকে।তিনি ঢাকার নবাব ছিলেন না,নবাবের কাজিন ছিলেন।ঢাকার তখনকার নবাব ছিলেন হবিবুল্লা। এঁর বাবা সলিমুল্লা মুসলিম লিগ পত্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।এঁরা আদতে বাঙ্গালী ছিলেন না;ছিলেন কাশ্মীরী। বড়লোক চামড়া ব্যবসায়ী।পরে জমি জিরেত কিনে নবাব হন।
  • সিকি | ০৯ মে ২০১৮ ১৪:১৬370902
  • আচ্ছা, লেখাটা নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যায় নি?
  • গবু | 52.110.149.79 | ০৯ মে ২০১৮ ১৯:০৭370903
  • কি প্রশ্ন!! না না, অপেক্ষা করছি i দাদা
  • সিকি | 894512.168.0145.123 | ১৯ জুলাই ২০১৮ ১৫:৩৯370904
  • লেখাটা কি শেষ?
  • Indo | 7845.15.900.255 | ২০ জুলাই ২০১৮ ০০:০৫370905
  • না না । অনেক বাকি।
  • সিকি | 894512.168.0145.123 | ২০ জুলাই ২০১৮ ০৯:০২370906
  • ওকে। তোমার লেখাগুলো দুটো টই আর একটা ব্লগে ছড়ানো আছে, আমি কাল একত্র করে পিডিএফ বানিয়েছি। দরকার লাগলে বোলো।
  • I | ২২ জুলাই ২০১৮ ২১:২৯370907
  • সাধারণ নির্বাচনের ফল বেরোলে দেখা গেল কোনো দলই সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় নি। কংগ্রেস পেয়েছে ৫৪টি আসন, মুসলিম লিগ ৪০টি ও কৃষক প্রজা পার্টি ৩৫টি। কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টির কোনো ঘোষিত প্রাকনির্বাচনী জোট না থাকলেও তলায় তলায় একধরণের বোঝাপড়া ছিল। কৃষক প্রজা পার্টির জয়ের সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য কংগ্রেস মুসলিম আসনগুলিতে কোনো প্রার্থী দাঁড় করায় নি, নিজেদের এলাকায় প্রজা পার্টির সভা আয়োজনে কোনো বাধাবিপত্তিও সৃষ্টি করে নি। প্রতিদানস্বরূপ কৃষক প্রজা পার্টি তাদের ইস্তাহারে রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি-র দাবীটি ( যা কিনা কংগ্রেসের মুখ্য দাবীগুলির একটি) অন্তর্ভুক্ত করেছিল।

    স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচন-পরবর্তী পর্যায়ে ফজলুল হক কংগ্রেসের কাছে জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব নিয়ে এলেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নিলেন শরৎ বসু, বিধান চন্দ্র রায় ও কিরণ শঙ্কর রায়। কিন্তু জোট দানা বাঁধল না। কংগ্রেসের ভেতরকার প্রভাবশালী জমিদার শ্রেণীর আশঙ্কা ছিল (এবং তা মোটেও অযৌক্তিক ছিল না) ফজলুল হক ক্ষমতায় এলে জমিদার-মহাজনদের সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কংগ্রেস দাবী করল রাজনৈতিক বন্দীমুক্তিকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে, প্রয়োজন হলে এই ইস্যুতে সরকার পদত্যাগ পর্যন্ত করতে রাজী থাকবে। ফজলুল হক জানতেন , যে কৃষক-জোতদারদের সমর্থনে তিনি এতদূর এসেছেন, তাদের কোনো কাজে না লেগে পদত্যাগ করলে তারা তাঁর দলকে ছেড়ে কথা কইবে না। তাঁর অগ্রাধিকার হল কৃষক কল্যাণ।(1)

    আলোচন ভেস্তে গেল।(2) জোট সরকারে যোগদান তো দূরস্থান, কংগ্রেস ফজলুল হককে বাইরে থেকে সমর্থন করতেও রাজী হল না। এমনকি ইস্যুভিত্তিক সমর্থনও না। ফজলুল হকের অজস্র অনুনয়-বিনয় বৃথা গেল। বাধ্য হয়ে তিনি মুসলিম লিগের সঙ্গে জোট করে সরকারে এলেন।(3) মুসলিম লিগের পক্ষেও ফজলুল হকের জমিদার-বিরোধিতা মেনে নেওয়া বেশ মুখরোচক হয় নি, বলাই বাহুল্য, তবে তারা আশায় ছিল জমিদারীতে তাদের যে ক্ষতি তা তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে পুষিয়ে নেবে(4)। তাছাড়া সরকারে থাকার সুবিধা নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, ফজলুল হকের সঙ্গে দর কষাকষি করে জমিদার-বিরোধী বিলগুলির নখদাঁত ভোঁতা করে দেওয়া- এইসবও বিবেচনার মধ্যে ছিল। এবং এর সবক`টিই তারা ঘটিয়ে ছেড়েছিল। সে হিসাবে ১৯৩৭ সালে বাংলার মুসলিম লিগ নেতারা কংগ্রেসের তুলনায় বেশী দূরদর্শী ছিল বললে ভুল হবে না।

    কৃষক প্রজা পার্টির হাত ছেড়ে দিয়ে কংগ্রেস ভালো কাজ করেনি।বাংলার সেকুলার রাজনীতি এতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায়।কালে কালে মুসলিম লিগ কৃষক প্রজা পার্টিকে গিলে খাবে এবং বাংলার রাজনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণ সম্পূর্ণ হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উর্ধ্বে শ্রেণীস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার এই কংগ্রেসী নীতির ফলে যে ঘটনাপ্রবাহ শুরু হবে তার অন্তিম অঙ্কে আসবে বাংলাবিভাজন।

    Notes
    1.Abul Mansur Ahmed, Arnar Dekha Rajnitir Panchash Bachhar, pp. 134-139.
    2. কংগ্রেস-প্রজা পার্টির জোট না হওয়ার কারণ হিসেবে এক পক্ষ আবার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ও গান্ধিকে দায়ী করেন। তাঁদের মতে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দ বঙ্গীয় নেতাদের জোট সরকারে যোগদান কিম্বা সমর্থনের অনুমতি দেন নি।
    3. Humayun Kabir, Muslim Politics 1906-47 and other Essays, Calcutta, 1969, p. 27.
    4. Joya Chatterjee, Bengal Divided : Hindu Communalism and Partition, 1932-47, Cambridge University Press (2002),p.107.
  • I | ২২ জুলাই ২০১৮ ২১:৩০370908
  • বহুদিন বাদে একটা ছোট কিস্তি।
  • সিকি | ২২ জুলাই ২০১৮ ২১:৪৫370910
  • পড়ছি।
  • Tim | 2378.36.341212.91 | ২২ জুলাই ২০১৮ ২২:০০370911
  • পড়ছি ইন্দোদা।
  • গবু | 2345.110.894512.170 | ২২ জুলাই ২০১৮ ২৩:৩০370912
  • পড়ছি। চলুক।
  • অর্জুন অভিষেক | 342323.223.454512.122 | ২৪ জুলাই ২০১৮ ০১:৩৫370913
  • উর্বশী বুটালিয়া, 'পার্টিশন' এর ওপর বহুবছর খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।

    তার The other side of silence এই বিষয়ে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই।

    সেই বিষয়ে তার একটি talk র লিঙ্ক এখানে দিলাম।

  • I | ২৭ জুলাই ২০১৮ ০১:৩৮370914
  • দাঁড়ান, একটা গাম্বাট লেখা নিয়ে ফিরে আসছি, সম্ভবতঃ সপ্তাহান্তে। ততক্ষণ খচরমচর করে কোনোরকমে ভেসে থাকুন, ডুবে যাবেন না।

    আর, বুটালিয়া অনেক দূর। সবে তো ১৯৩৭ সাল।
  • অর্জুন অভিষেক | 341212.21.5667.220 | ২৯ জুলাই ২০১৮ ০৩:৪১370915
  • বেশ। অপেক্ষায় রইলাম।
  • অর্জুন অভিষেক | 341212.21.5667.220 | ২৯ জুলাই ২০১৮ ০৩:৫৬370916
  • I আপনি আপনার কমেন্টে অনেকের লেখার কথা উল্লেখ করেছেন।

    পার্টিশন নিয়ে আয়েশা জালালের কাজ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
  • I | ২৯ জুলাই ২০১৮ ২২:৩৪370917
  • বাংলার রাজনীতিকে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনোত্তর অবস্থায় ফেলে রেখে এবার একটু জাতীয় রাজনীতিতে ফিরে আসি। সেখানে আমরা ১৯৩২ সালে দাঁড়িয়ে রয়েছি। একটু ক্যাচ-আপ করা প্রয়োজন। সময় মত আবার বাংলায় ফিরে আসবো।

    দেশভাগের তাত্বিক ভিত্তি অর্থাৎ দ্বিজাতিতত্ব (Two nation theory) নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। চলতি ধারণায় দ্বিজাতিতত্ব বললেই মহম্মদ আলি জিন্নার নাম উঠে আসে । সাধারণভাবে জিন্নাকেই দ্বিজাতিত্ত্বের জনক বলে আমরা ভাবি। সেটা কতদূর ঠিক, একটু খতিয়ে দেখা যাক।

    কলোনিপ্রভুরা ভারতবর্ষকে কখনোই একটি ঐক্যবদ্ধ "নেশন" হিসেবে দেখেন নি; দেখেছেন আলাদা আলাদা কতগুলি ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রদায়ের সমাহার হিসেবে। এবং ভয় পেয়েছেন এই ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়গুলি এক হলে ভারবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান অবশ্যম্ভাবী (1)। হয়তো এর পেছনে ব্রিটিশ মননে সমকালীন ইউরোপীয় সমাজের ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট বিভাজনও কাজ করে থাকবে (2)। কারণ যাই হোক না কেন, এ অবস্থায় শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে যা করা দরকার,ব্রিটিশ শাসক ঠিক তাই করেছিল-বেছে নিয়েছিল ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি। এ নিয়ে কিছু কথা আগেই বলা হয়েছে, তাই আর বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। বলবার শুধু এটুকুই যে, এর ফল ফলতে বিশেষ সময় লাগে নি। অবশ্য জমি কতদূর প্রস্তুত ছিল, তাও তর্কযোগ্য।

    উনিশ শতকের বাংলার এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ছিলেন নবগোপাল মিত্র। হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমরা তাঁকে মনে রেখেছি (কিম্বা হয়তো রাখিনি)।সত্যেন ঠাকুর ও গগন ঠাকুরের সহপাঠী এই ভদ্রলোক দেবেন্দ্রনাথেরও কাছের লোক ছিলেন। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার কাজে প্রবল উৎসাহী ছিলেন নবগোপাল। সম্ভবতঃ তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শব্দটি ছিল "ন্যাশন্যাল"। তিনি ন্যাশন্যাল প্রেস, ন্যাশন্যাল পেপার, ন্যাশন্যাল স্কুল, ন্যাশন্যাল সোসাইটি, ন্যাশন্যাল স্টোর এবং ন্যাশন্যাল জিমন্যাসিয়াম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও বিখ্যাত ন্যাশন্যাল থিয়েটার আর ন্যাশন্যাল সার্কাসও তাঁর হাতে গড়া (তাঁকে ঠাট্টা করে বলা হত "ন্যাশন্যাল" মিত্র)। এহেন নবগোপাল ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলতে অবশ্য বুঝতেন হিন্দু জাতীয়তাবাদ। তাঁর মত ছিল জাতি হিসেবে হিন্দুরা মুসলিম ও খ্রীষ্টানদের থেকে উন্নত এবং ভারতের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি হল হিন্দুধর্ম (3)।

    বিভেদের এই চর্চা পরবর্তী শতকে আরো প্রবল হয়।১৯০৮ সালে আর্যসমাজী ভাই পরমানন্দ (যিনি পরে হিন্দু মহাসভার নেতা হবেন) ভারতকে হিন্দু -মুসলিম দুই ভাগে বিভক্ত করার কথা বলেন- "সিন্ধের ওপারের অঞ্চলকে আফগানিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করে একটি বৃহৎ মুসলিম রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করা উচিত। সেখানকার হিন্দুরা ভারতে চলে আসুক, ভারতের বাকি অংশের মুসলিমদের ওখানে পাঠিয়ে দেওয়া হোক" (4)।

    ১৯২৪ সালে তাঁরই কথার প্রতিধ্বনি করবেন হিন্দু মহাসভা নেতা লালা লাজপত রাই। কোহট দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পাঞ্জাবকে মুসলিম ও অমুসলিম দুই ভাগে ভাগ করার কথা বলবেন (5)। ১৯২৩-২৪ সালে বীর সাভারকর তাঁর সাড়া-জাগানো বই "হিন্দুত্বঃ হিন্দু কে?" প্রকাশ করবেন। বলবেন- সংখ্যালঘু মুসলিম ও খ্রীষ্টানরা বহিরাগত ও অ-ভারতীয়।

    হিন্দুত্ব নির্মাণের এই প্রকল্পটি সাভারকর ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী নেতারা আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন ভবিষ্যতে। এ নিয়ে কিছু কথা বলা হয়েছে, কিছু এখনো বলা বাকি। সেকথায় আবার আসবো। তবে তার আগে মুদ্রার অন্য পিঠটি এবার দেখে নেওয়া যাক। অর্থাৎ দ্বিজাতিতত্বে মুসলিম অবদান।

    ১৯০৯ সালে যুক্তরাজ্য ও জার্মানী প্রত্যাগত কবি -দার্শনিক ইকবাল লিখলেন "তরানা-ই মিল্লি"। লিখলেন-'মুসলিম হ্যয় হম ওয়তন হৈ সারে জাহাঁ হামারা।' সেই ইকবাল , যিনি এর ৫ বছর আগে লিখেছিলেন তরানা-ই-হিন্দ-'সারে জাহাঁ সে অচ্ছা, হিন্দুস্তাঁ হামারা।' যে কাব্যের ষষ্ঠ স্তবকটি হল-
    'মজহব নহিঁ সিখাতা আপস মেঁ বৈর রাখনা
    হিন্দি হ্যয় হম ওয়তন হৈ হিন্দুস্তাঁ হামারা।'

    সম্প্রদায়ের মিলন আর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার ভ্যানগার্ড, এলিট মুসলিম সমাজের মুখ মহম্মদ ইকবাল পাশ্চাত্য থেকে ফিরে এসে পৌঁছলেন মুসলিম উম্মার ধারণায়। মনে হল জাতীয়তাবাদ একটি অনৈসলামিক ধারণা; অতএব নিন্দনীয়। জানালেন, 'ইসলাম ছাড়া নেই আমাদের জন্মভূমি'। 'ইন তাজা খুদাওঁ মেঁ বড়া সবসে ওয়তন হৈ/যো পৈরহন ইস কা হৈ, উও মজহব কা কফন হৈ (এইসব নবীন /ছদ্ম ঈশ্বরদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হল জন্মভূমি; এর পোষাক আদতে ধর্মের শব-আচ্ছাদন।)(6)

    হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কথা বলতেই যাঁর ভালো লাগতো এককালে, সেই ইকবালের মনে হতে লাগলো, এই ঐক্য-ভাবনা সুন্দর হলেও বাস্তব নয়; মনে হল ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামের আধ্যাত্মিক ভিত্তিকেই ধ্বংস করে ফেলবে; সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর সংস্কৃতি চেপে মেরে ফেলবে মুসলিম ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। আম্বেদকরের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানালেন, কোনো কেন্দ্রীয় ভারত সরকার নয়, বরং ব্রিটিশ রাজের অধীনে স্বশাসিত প্রদেশ গঠনই তাঁর কাম্য। তিনি চান মুসলিম প্রদেশসমূহের স্বশাসন।

    ১৯৩০ সালে মুসলিম লিগের এলাহাবাদ কনফারেন্সে সভাপতি নির্বাচিত হলেন ইকবাল। সভাপতির ভাষণে তিনি আরো স্পষ্ট করে বললেন বললেন-

    "...I would like to see the Punjab, North-West Frontier Province, Sind and Baluchistan amalgamated into a single state. Self-government within the British Empire, or without the British Empire, the formation of a consolidated Northwest Indian Muslim state appears to me to be the final destiny of the Muslims, at least of Northwest India..." (7) .

    "দ্বিজাতিতত্ব" শব্দটি উল্লেখ না করলেও ইকবালই মুসলিম রাজনীতিবিদদের মধ্যে সর্বপ্রথম, যিনি এর এর মূল ধারণাটিকে স্পষ্ট করলেন। যে, মুসলমানরা একটি সম্পূর্ন স্বতন্ত্র নেশন এবং সেই কারণে তাদের ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশ ও সম্প্রদায়সমূহের থেকে রাজনোতিক ভাবে আলাদা হয়ে যাওয়া উচিৎ। সেকুলারিজম ও জাতীয়তাবাদের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য তিনি মুসলিম উলেমাদের সমালোচনা করতেও ছাড়লেন না।

    এর তিন বছর পর ১৯৩৩ সালে আর এক পাঞ্জাবী মুসলিম চৌধরী রহমৎ আলি কেম্ব্রিজে একটি প্যাম্ফলেট প্রকাশ করবেন-"Now or Never; Are We to Live or Perish Forever?" সেই প্রচারপুস্তিকায় উত্তর ভারতের পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে একটি পৃথক মুসলিম হোমল্যান্ডের দাবী জানানো হয়। পাঞ্জাব, আফগান প্রদেশ (উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ),কাশ্মীর, সিন্ধ ও বালুচিস্তান-এর প্রথম চারটির আদ্যক্ষর ও বালুচিস্তানের 'স্তান' নিয়ে এর নাম দেওয়া হয় 'পাকস্তান'। পরবর্তীকালে উচ্চারণের সুবিধার জন্য রহমৎ আলি একে ঈষৎ বদলে করেন 'পাকিস্তান'(9)। শব্দটি যে নিছকই অ্যাক্রোনিম নয়, উর্দু ও ফারসীতে এর যে একটি অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে, "পাকিস্তান" নামের জনক রহমৎ আলি তা-ও বুঝিয়ে বলেন-'It means the land of the Paks – the spiritually pure and clean.'(10)

    পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৪ সালে রহমৎ আলি ও তাঁর বন্ধুরা জিন্নার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে পাকিস্তানের দাবীকে সমর্থনের অনুরোধ জানান। জিন্না তাঁদের কিঞ্চিৎ আশাহত করেই বলেন-"My dear boys, don't be in a hurry; let the waters flow and they will find their own level"(11)। বস্তুত জিন্না কেন, সেইসময় কোনো মুসলিম নেতাই হয়তো ভারতীয় মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা হয়ে একটি পৃথক মুসলিম হোমল্যান্ডের দাবী জানানোর মত র‌্যাডিক্যাল অবস্থানে গিয়ে পৌঁছন নি। ১৯৩৩ সালের অগাস্ট মাসে একটি মুসলিম প্রতিনিধিদল ভারতীয় সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত একটি পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে গিয়ে বলে আসেন-'পাকিস্তানের দাবী কাল্পনিক ও অবাস্তব'(12) । অনেক ঐতিহাসিকের মতে, যে ইকবাল ১৯৩০ সালে উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাজ্য দাবী করেছিলেন, তিনিও খুব সম্ভবতঃ দেশভাগ চান নি। আসলে তিনি যা চেয়েছিলেন, তা হল ভারতীয় ফেডারেশনের মধ্যে একটি পৃথক স্বশাসিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ(13),(14),(15),(16)। জিন্না তো আরো বছর দশেক কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা-দর কষাকষি চালিয়ে যাবেন ও অবশেষে ১৯৪০ সালে লাহোর বক্তৃতায় দ্বিজাতিতত্বের প্রতি তাঁর সমর্থন সুস্পষ্টভাবে জানাবেন। (যদিও আয়েষা জালাল মনে করেন জিন্না মন থেকে কখনোই পাকিস্তান চান নি; কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা রাস্তা বেরোবে বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল। পাকিস্তানের দাবী ছিল তাঁর কাছে দর কষাকষির একটি অস্ত্রমাত্র)।

    ১৯৪০ সালের তিন বছর আগেই অবশ্য আমেদাবাদে হিন্দু মহাসভার ১৯তম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে বীর সাভারকর বলবেন-
    “As it is, there are two antagonistic nations living side by side in India. Several infantile politicians commit the serious mistake in supposing that India is already welded thus for the mere wish to do so. … India cannot be assumed today to be Unitarian and homogeneous nation, but on the contrary there are two nations in the main: the Hindus and the Muslims, in India.” (17)

    সেই বছরেই , অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে জিন্নাকে পাঠানো একটি চিঠিতে ইকবাল লিখবেন-'....A separate federation of Muslim Provinces, reformed on the lines I have suggested above, is the only course by which we can secure a peaceful India and save Muslims from the domination of Non-Muslims. Why should not the Muslims of North-West India and Bengal be considered as nations entitled to self-determination just as other nations in India and outside India are?'(18)

    লক্ষণীয়, ইকবাল এবার উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিমদের সঙ্গে বাংলার মুসলিমদের জন্যেও পৃথক ফেডারেশনের কথা জিন্নাকে ভাবতে বলছেন। এর বছরখানেক আগে থেকেই জিন্না ও ইকবালের মধ্যে ভারতীয় মুসলিম রাজনীতির বিষয় নিয়ে জোর চিঠি চালাচালি শুরু হয়েছিল। পরবর্তী বছরগুলিতে জিন্না ইকবালকে তাঁর মেন্টর বলে মেনেও নেন। বার্নি হোয়াইট-স্পানার (ও আরো অনেকে) তাঁর 'Partition' বইতে দাবী করেছেন, লন্ডনে জিন্নার স্বেচ্ছা-নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে উপমহাদেশের রাজনীতিতে আবার ফিরে আসার পেছনে ইকবালের যথেষ্ট অবদান ছিল।

    এর তিন বছর বাদে অর্থাৎ ১৯৪০ সালে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলিম লিগ প্রতিনিধিরা লিগের বাৎসরিক অধিবেশনের জন্য লাহোরে জমায়েত হলেন।লাহোরের মিন্টো পার্কে (বর্তমানে ইকবাল পার্ক) শেষদিন সভাপতির ভাষণ দিতে উঠে জিন্না সেই বক্তৃতা পেশ করলেন, যার জন্য তাঁকে এরপর থেকে 'দ্বিজাতিতত্বের প্রণেতা' বলে অভিহিত করা হবে-
    '.. it is a dream that the Hindus and Muslims can ever evolve a common nationality, and this misconception of one Indian nation has troubles and will lead India to destruction if we fail to revise our notions in time. The Hindus and Muslims belong to two different religious philosophies, social customs, literatures. They neither intermarry nor interdine together and, indeed, they belong to two different civilizations which are based mainly on conflicting ideas and conceptions. ...To yoke together two such nations under a single state, one as a numerical minority and the other as a majority, must lead to growing discontent and final destruction of any fabric that may be so built for the government of such a state. (19)
    .

    এই ঘটনার দু বছর আগে ইকবাল প্রয়াত হয়েছেন। একদা-সেকুলার ইকবাল, যিনি একদা-সেকুলার ও 'হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত' জিন্নাকে ধীরে ধীরে হাতে ধরে দ্বিজাতিত্ত্বের মত র‌্যাডিক্যাল অবস্থানে নিয়ে গেছেন।

    ২৪শে মার্চ জিন্না তাঁর এই বিখ্যাত ভাষণ দেন। তার আগের দিন সর্বসম্মতভাবে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই প্রস্তাবের তৃতীয় অনুচ্ছেদে দাবী করা হয়-'উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের পরস্পর-সংলগ্ন মুসলিম- প্রধান এলাকাগুলিকে স্বশাসিত, স্বাধীন ও সার্বভৌম 'স্টেট' হিসেবে ঘোষণা করতে হবে' (20)। প্রস্তাবটিতে 'পাকিস্তান' নামের উল্লেখ না থাকলেও সংবাদমাধ্যমে ও গণমানসে এটি 'পাকিস্তান প্রস্তাব' নামেই পরিচিত হয়।

    লক্ষণীয়, ভারতীয় মুসলমানদের সকলেই কিন্তু দুহাত তুলে দ্বিজাতিতত্ব কিম্বা দেশের পরিবর্তে ধর্মের আনুগত্য মেনে নেওয়ার বিষয়টিকে সমর্থন করেন নি। জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা তো ছিলেনই। এছাড়াও ছিলেন দেওবন্দী স্কুলের উলেমারা, যাঁরা স্পষ্টতঃই ঘোষণা করেন 'দেশের প্রতি আনুগত্য' ইসলাম-স্বীকৃত।(21) এমন কি ১৯৪৫ সালে জমিয়ত-উল উলেমা'র প্রধান একটি ফতোয়া দিয়ে জিন্নাকে 'কাফির-ই আজম' ঘোষণা করেন (কায়েদ-ই -আজম'এর সঙ্গে pun করে)(22)।

    আরো তিন বছর পরে ১৯৪৩ সালে নাগপুরে সাভারকর সর্বসমক্ষে স্বীকার করলেন হিন্দু ও মুসলিম চরমপন্থীদের এই নিয়ে কোনো বিরোধ নেই-“I have no quarrel with Mr Jinnah’s two-nation theory. We, Hindus, are a nation by ourselves and it is a historical fact that Hindus and Muslims are two nations.(23) ”

    দেখেশুনে স্তম্ভিত বি আর আম্বেদকর বলবেন-“ Strange it may appear, Mr. Savarkar and Mr. Jinnah instead of being opposed to each other on the one nation v's two nations issue are in complete agreement about it. Both agree, not only agree but insist that there are two nations in India- one the Muslim nation and the other the Hindu nation.”(24)

    Notes :
    1.Abbott Lawrence Lowell (1918), Greater European governments, Harvard University Press, ... "The people of India are not a nation, but a conglomerate of many different races and religions ... enabled the British to conquer and hold the country. If the inhabitants should act together, and were agreed in wanting independence, they could get it. In short, if they were capable of national self-government, the English would live on a volcano ..."

    2.Ian Talbot and Gurharpal Singh, The Partition of India,Cambridge University Press, p28.
    3.http://caravandaily.com/portal/how-hindu-right-helped-propound-the-2-nation-theory-and-pakistan/
    4.https://www.quora.com/What-is-the-role-of-RSS-in-the-partition-of-India -সাংবাদিক অমল করের মন্তব্য।
    5.Neeti Nair: Changing Homelands-Hindu Politics and the Partition of India. Permanent Black,2011. p.77-81.
    6. Nasim A. Jawed (1999), Islam's political culture: religion and politics in predivided Pakistan, University of Texas Press, ISBN 978-0-292-74080-8
    7.1in author list, Iqbal Academy (26 May 2006). "Allama Iqbal – Biography" (PHP). Retrieved 7 January 2011
    9."Chaudhry Rehmat Ali". Story Of Pakistan.
    10.Choudhry Rahmat Ali, 1947, Pakistan: the fatherland of the Pak nation, Cambridge, OCLC: 12241695.
    11.Rahmat Ali: A Biography, by K.K. AZIZ, Vanguard ,1987, Lahore, 1987.
    12.Ian Talbot and Gurharpal Singh, The Partition of India,Cambridge University Press, p31.
    13.K.K. Aziz, Making ofPakistan (London: 1970), p.81.
    14. Verinder Grover (ed.), Muhammad Iqbal: Poet Thinker of Modern Muslim India Vol. 25 (New Delhi: Deep & Deep Publications, 1995), pp.666–67. 15.Tara Chand, History of Freedom Movement in India Vol. III (New Delhi: 1972), p.253.
    16.lang, 23, 24 & 25 March 2003; Also see, Safdar Mahmood, Iqbal, Jinnah aur Pakistan (Lahore: Khazina Ilm-wa-Adab, 2004), pp.52–69.
    17. https://www.counterview.net/2016/01/savarkar-in-ahmedabad-declared-support.html
    18.In author list, Iqbal Academy (26 May 2006). "Allama Iqbal – Biography" (PHP). Retrieved 7 January 2011.
    19. Official website, Nazaria-e-Pakistan Foundation. "Excerpt from the presidential address delivered Muhammad Ali Jinnah in Lahore on March 22, 1940". Archived from the original on 28 June 2006.
    20.Ian Talbot and Gurharpal Singh, The Partition of India,Cambridge University Pressp.33
    21.Yoginder Sikand (2005). Bastions of the Believers: Madrasas and Islamic Education in India. Penguin Books India. pp. 228–. ISBN 978-0-14-400020-3.
    22. Yasmin Khan: The Great partition, Penguin Books, 2013 edition, p.36
    23.https://www.counterview.net/2016/01/savarkar-in-ahmedabad-declared-support.html
    24.https://www.quora.com/What-is-the-role-of-RSS-in-the-partition-of-India
  • সিকি | ৩০ জুলাই ২০১৮ ০০:১৮370918
  • দুরন্ত।
  • Tim | 89900.228.0167.253 | ৩০ জুলাই ২০১৮ ০১:০৫370919
  • ভালো হচ্ছে লেখাটা। এটা যেন শেষ করা হয়।
  • amit | 340123.0.34.2 | ৩০ জুলাই ২০১৮ ০৪:৩০370921
  • এই পর্বটা সত্যি খুব ভালো হয়েছে। দ্বিজাতি তত্ত্ব নিয়ে হিন্দু মহাসভার রোলটা একেবারেই জানা ছিল না। জেনারেল ইতিহাসে একেবারে চেপে যাওয়া হয় সেটা।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন