এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • দেশভাগঃ ফিরে দেখা(দ্বিতীয় পর্ব)

    I
    অন্যান্য | ২৬ অক্টোবর ২০১৭ | ৫৯০৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অর্জুন অভিষেক | 341212.21.90067.61 | ০৯ অক্টোবর ২০১৮ ১৯:২০370795
  • মাদাম কাইশেকের Obituary বেরিয়েছিল 'দেশ' পত্রিকায়। পড়েছিলাম। ভাল ছিল লেখাটা।

    Wiki বলছে ২০০৩ এ ১০৫ বছর বয়েসে উনি অ্যামেরিকায় মারা যান।

    তখন 'দেশ' র শেষ পাতায় বিশিষ্ট জনদের নিয়ে ভাল লেখা বেরোত।
  • I | 785612.40.2378.154 | ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ২১:৫৩370796
  • ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতায় নেহরু বেশ ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি কায়মনোবাক্যে চাইছিলেন ফ্যাসিস্টমুক্ত এক পৃথিবী এবং তার জন্য যে কোনো মূল্যে চেয়েছিলেন ফ্যাসিস্টবিরোধী বাহিনীর পাশে দাঁড়াতে।কোনো পরিবর্তন ছাড়াই তিনি ক্রিপস মিশন মেনে নিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু সহকর্মীদের বিরোধিতায় পেরে ওঠেন নি। আজাদ স্মৃতিচারণ করেছেন, জওহরলালের একটা স্বভাব ছিল - মানসিক উদ্বেগ বেড়ে গেলে তিনি রাতে ঘুমের মধ্যে কথা বলতেন। ক্রিপস মিশন ভেস্তে যাওয়ার সময় জওহরলাল রামেশ্বরী নেহরু'র (জওহরলালের খুড়তুতো দাদা ব্রিজলালের স্ত্রী) বাড়িতে ছিলেন। আজাদ নেহরু'র সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে আসার সময় রামেশ্বরী তাঁকে বলেন-গত দু'রাত জওহরলাল একফোঁটা শান্তিতে ঘুমোতে পারেন নি। ঘুমের মধ্যে সারাক্ষণ বকবক করে গেছেন। যেন কারো সঙ্গে তর্ক করছেন; কখনো বিড়বিড় করে, কখনো উচ্চগ্রামে। মাঝেমধ্যেই 'ক্রিপস','গান্ধীজী', 'আজাদ' -এই সব নাম উচ্চারণ করেছেন(1)।

    ক্রিপস মিশন ভেস্তে যাওয়া চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারিকেও প্রভাবিত করেছিল। বেশ কিছুকাল ধরেই তিনি হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। কংগ্রেসের মধ্যে তিনিই প্রথম নেতা, যিনি প্রকাশ্যে মুসলিম লীগের প্রস্তাব মেনে নিতে চেয়েছিলেন। ১৯৪০ সালেই অখিল ভারত কংগ্রেস অধিবেশনের শেষে তিনি বলেছিলেন গভর্নমেন্ট যদি এখনই একটি জাতীয় সরকার ঘোষণা করতে সম্মত হয়, তাহলে তিনি তাঁর সহকর্মীদের বলে-ক'য়ে রাজী করাবেন যাতে মুসলিম লীগকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দেওয়া হয় এবং প্রধানমন্ত্রী তাঁর মনোনীত মন্ত্রীদের বেছে নিতে পারেন(2) । (সেইসঙ্গে অবশ্য তিনি এও বলেছিলেন যে দ্বিজাতিতত্ব একটি ক্ষতিকর ধারণা ও তা শেষমেশ ভারতকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।) যুদ্ধে জাপানের অগ্রগতি তাঁরও শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । তাঁর মনে হয়েছিল জাপানের ভারত আক্রমণ করা একটি অত্যন্ত সম্ভাব্য ঘটনা, যে কোনো সময় তা ঘটতে পারে ( এ বিষয়ে তিনি গান্ধীর চিন্তাভাবনার বিপরীতে ছিলেন )। আর এরকম কোনো ঘটনা ঘটলে ভারতবাসীদের ব্রিটিশের সহায়তা দরকার হয়ে পড়বে। তার জন্য অবিলম্বে লীগের সঙ্গে বোঝাপড়ায় এসে ভবিষ্যতের ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে সংবিধান প্রণয়নের কাজটি সেরে রাখা প্রয়োজন।প্রবল ব্রিটিশবিরোধিতার দিকে তিনি এইসব ভেবে যেতে চান নি।'৪২-এর এপ্রিলে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কোথাও কোথাও জাপানী বোমারু বিমান বোমা ফেলাতে তিনি আরো শঙ্কিত হয়ে পড়েন। মাদ্রাজ কংগ্রেস পরিষদীয় দল তাঁর নেতৃত্বে একটি রেজোলিউশন আনে-কংগ্রেসের উচিৎ লীগের দাবী মেনে নিয়ে ভারত ভাগের দিকে এগোনো; অবিলম্বে স্বাধীনতা অর্জনের এটিই একমাত্র পথ। এই প্রস্তাবটিই সি আর ফর্মুলা নামে পরিচিত হয়, যার ওপর ভিত্তি করে ১৯৪৪ সালে গান্ধী জিন্নার সঙ্গে বৈঠকে বসবেন।

    কংগ্রেস নেতৃত্ব দলের মধ্যে আলোচনা না করে প্রকাশ্যে পার্টিস্ট্যান্ডের এই বিরোধিতার ব্যাপারটিতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। রাজাগোপালাচারিকে রেজোলিউশন ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। রাজাগোপালাচারি কংগ্রেস সভাপতি আজাদকে লেখা একটি চিঠিতে পার্টিনীতির খেলাপ করার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন ও ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বলেন যে প্রস্তাবটি ফেরত নেওয়া সম্ভব নয়, সেটি তাঁর সুচিন্তিত মতের বহিঃপ্রকাশ। গান্ধী অবশ্য সকলকে ধৈর্য ধরে রাজাজীর মতামত শুনতে বলেন। তিনি মন্তব্য করেন -"যদিও রাজাজী তাঁর সমর্থনে আমার নাম উল্লেখ করেছেন , কিন্তু আমি দেখছি যে চক ও চীজের মধ্যে যেরকম প্রভেদ বিদ্যমান, তাঁর সঙ্গে আমার সেইরকম প্রভেদ রয়েছে। তিনি জাপানীদের দূরে সরিয়ে রাখবার আশায় ঐক্যের বিনিময়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার অধিকার মেনে নিতে চান। আমি মনে করি যে ভারতবর্ষকে ভাগ করা পাপ"(3)। রাজাজীর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়।

    রাজাজীর প্রস্তাবের মধ্যে প্রদেশগুলির স্বায়ত্তশাসনের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে একজন মানুষ কিন্তু খুব খুশী হন। তিনি রামস্বামী পেরিয়ার। তাঁর মনে হয়, তাঁর পৃথক দ্রাবিড়নাডু'র দাবী আদায়ের দিকে এটি একটি বড় পদক্ষেপ। প্রবল ব্রাহ্মণ্যবাদ -বিরোধী পেরিয়ার চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ রাজাগোপালাচারিকে 'কমরেড' বলে সম্বোধন করে বসবেন। পরে কোনো এক সময়ে পেরিয়ার বলবেন-"কমরেড আচার্য'র সঙ্গে দেখা হল, তিনি জোর দিয়ে বললেন-'স্বরাজ পাই আর না পাই, এই উত্তর-ভারতীয়গুলোর উপদ্রবের হাত থেকে রেহাই পেতে হবে' "(4)।

    Notes
    1. Azad, pp. 68
    2.The Transfer of Power in India, Vol 4, p.93.
    3.Mahtma, vol 6, p.87.
    4.More, J. B. Prashant (2004). Muslim Identity, Print Culture, and the Dravidian Factor in Tamil Nadu. Orient Blackswan. ISBN 978-81-250-2632-7, pp 161-62.
  • I | 785612.40.2378.154 | ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ২৩:৪০370797
  • আজাদ বলছেন, ক্রিপস চলে যাওয়ার পর গান্ধী'র মনোভাবে একটি অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। যে গান্ধী যুদ্ধ শুরুর সময় থেকে ব্রিটিশ শাসনকে বিব্রত না-করার নীতি নিয়ে চলেছেন, চেয়েছেন যুদ্ধ ও হিংসা'র মধ্যে যেন ভারত কোনোভাবেই না জড়িয়ে পড়ে, যাঁকে এমনকি 'ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ'র মত নির্বিষ আন্দোলনে রাজী করানোও কঠিন ছিল, সেই তিনিই অকস্মাৎ জঙ্গী মেজাজ ধারণ করলেন। ১৯৪২ এর জুন মাসে আজাদ ওয়ার্ধায় গান্ধী-আশ্রমে গিয়ে দিন পাঁচেক ছিলেন। সেসময় তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে গান্ধীকে তাঁর মনের কথা বলেন। আজাদের মনে হচ্ছিল সরকার জাপানের ভারত-আক্রমণের আশঙ্কা করছে এবং সেজন্য সম্ভাব্য সবরকম প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদি জাপান গোটা ভারত আক্রমণ না-ও করে, অন্ততঃ বাংলা তারা আক্রমণ করবে। সে কারণে সরকার পোড়ামাটি -নীতি নেওয়ার কথা ভেবেছে। বিপদ বুঝলে তারা জরুরী ব্রিজ-কল-কারখানা ধ্বংস করে ফেলার কথা ভেবে রেখেছে। জামশেদপুরের টাটা'র ইস্পাত কারখানা ভেঙ্গে ফেলবার একটা পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে।

    আজাদ বলেছিলেন, জাপান যদি ভারত আক্রমণ করে, তাহলে প্রত্যেক ভারতবাসীর পবিত্র কর্তব্য হবে যে কোনো মূল্যে জাপানী আক্রমণের মোকাবিলা করা।পুরনো প্রভুর বদলে নতুন প্রভু বেছে নিতে তাঁর সায় ছিল না। বিশেষ করে সে যদি হয় জাপানের মত আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।

    গান্ধী অবশ্য আজাদের সঙ্গে একেবারেই একমত হন নি।তাঁর মনে হয়েছিল জাপান ভারতে এলে তাদের শত্রু হবে ব্রিটিশরা, ভারতীয়রা নয়। আর ব্রিটিশরা যদি ভারত ছেড়ে চলে যায়, তাহলে জাপান ভারত আক্রমণ করবে না। আজাদ কিছুতেই গান্ধীর এই মত মেনে নিতে পারেন নি।

    জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ওয়ার্ধায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভা ছিল। সেই সভায় গান্ধী বাকিদের চমকে দিয়ে তাঁর 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের খসড়া পেশ করেন। এর আগেই এপ্রিলে এলাহাবাদের সভায় গান্ধী যে খসড়া পেশ করেছিলেন, তাতে ছিল -"...ভারত যদি স্বাধীন হয়, তাহলে তার প্রথম কাজই হবে জাপানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা...জাপানের সঙ্গে ভারতের কোনো শত্রুতাই নেই।" নেহরুর পীড়াপীড়িতে খসড়ার এই অংশটি বাদ দেওয়া হয়। সম্মেলনে নেহরু বলেন-".. গান্ধীজী মনে করেছেন জাপান আর জার্মানী জিতবে। তাঁর এই মনে হওয়াই অচেতনভাবে তাঁর সিদ্ধান্তকে চালিত করেছে।"

    আর এবারের সম্মেলনে তো গান্ধী বিস্ফোরণ ঘটালেন 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের প্রস্তাব উত্থাপন করে। আজাদ যুক্তি দিলেন, যুদ্ধের এই অবস্থায় এমন কিছুই করা উচিৎ হবে না, যাতে জাপান ভারত আক্রমণ করতে উৎসাহিত হয়। গান্ধী মানলেন না। বললেন, ভারতবাসী মুখিয়ে আছে স্বাধীনতার জন্য। সময়ের দাবী কংগ্রেসকে মেনে নিতে হবে। দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করতে হবে-ইংরেজ, ভারত ছাড়ো। ব্রিটেন যদি সে দাবী মানতে রাজী হয়, তবে ভারতবর্ষ জাপানকে আর অগ্রসর হতে বারণ করবে। তা সত্বেও যদি জাপান অগ্রসর হয়, তবে তা হবে স্বাধীন ভারতবর্ষের ওপর আক্রমণ। সেক্ষেত্রে ভারতবাসী সর্বশক্তি দিয়ে তার মোকাবিলা করবে। আজাদের মনে হল , এটি একটি অবাস্তব ভাবনা। ব্রিটিশশক্তি ভারত ছেড়ে যেতে রাজী হলে শেয়ালকে ভাঙা বেড়া দেখানো হবে। জাপান দ্বিগুণ উৎসাহে ভারত আক্রমণ করতে আসবে। তার বয়ে গেছে ভারতবাসীর অবেদন-নিবেদনে কান দিতে।

    গান্ধী যুক্তি দিলেন, যুদ্ধ যেহেতু ভারতসীমান্তে এসে পৌঁছেছে, সেহেতু ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন শুরু হলেই একটা সমঝোতায় পৌঁছতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। যদি তা না-ও হয়, সরকার অন্ততঃ কড়া কোনো পদক্ষেপ নেবে না, বিশেষ করে জাপান যখন দরজায় কড়া নাড়ছে। সেই সুযোগে আন্দোলনকে বেশ গুছিয়ে নেওয়া যাবে। আজাদ কিন্তু দেখতে পাচ্ছিলেন যে, যুদ্ধের এই মরন-বাঁচন অবস্থায় সরকার কোনো রকমের গণ আন্দোলন সহ্য করবে না। যে মুহূর্তে আন্দোলনের ঘোষণা হবে, সেই মুহূর্তে সরকার কংগ্রেসের সব নেতাকে ধরে জেলে ভরে দেবে। তখন সম্পূর্ণ নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় আন্দোলন কী আকার ধারণ করবে, আদৌ তা অহিংস থাকবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আন্দোলনকারীদের সেক্ষেত্রে খোলা বন্দুকের মুখে ছেড়ে দেওয়া হবে।

    ওয়ার্কিং কমিটিতে কিন্তু আজাদ নেহরু ছাড়া আর কাউকে পাশে পেলেন না। প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, আচার্য কৃপালনী'র গান্ধীর ওপর অটুট বিশ্বাস। তাঁদের মতে , গান্ধী যখন ভেবেছেন, তখন নিশ্চয়ই কিছু একটা রাস্তা বেরোবে। কীভাবে সেই রাস্তা বেরোবে, সে রাস্তাই বা কেমন হবে, সে বিষয়ে যদিও তাঁদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। সেই ভাবনাচিন্তা-র ভার তাঁরা গান্ধীর হাতে ছেড়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত।

    মতপার্থক্য এমন চরমে পৌঁছয় যে, গান্ধী ৭ই জুলাই সকালে আজাদকে একটি হাতচিঠি পাঠান। সে চিঠির বক্তব্য- কংগ্রেস যদি গান্ধীর নেতৃত্বে আন্দোলনে আগ্রহী থাকে, তাহলে আজাদ'কে সভাপতির পদ এমন- কি ওয়ার্কিং কমিটির পদও ছাড়তে হবে। নেহরুকেও পদত্যাগ করতে হবে। কেননা , নেতৃত্বের মধ্যে এতখানি মতভেদ নিয়ে আন্দোলন চালানো যায় না।

    সর্দার প্যাটেল এই চিঠির বক্তব্য জেনে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। অবিলম্বে তিনি গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর এই চিঠির কড়া সমালোচনা করেন। বলেন, এমন ঘটনা ঘটলে (আজাদ ও নেহরু উভয়ের পদত্যাগ) দেশের লোকের ওপর তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে। ভুল বুঝতে পেরে গান্ধী আজাদকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর কাছ থেকে চিঠিটি ফেরত নিয়ে নেন। দুপুরে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসলে গান্ধী প্রথম কথাই বলেন-"The penitant sinner has come to the Maulana"।

    ঐ বৈঠকেই নেহরু বলেন-গান্ধীর এই আহ্বান আদতে খোলাখুলি এক বিদ্রোহের ডাক, সে বিদ্রোহ অহিংস হোক আর যা-ই হোক। সমালোচনা হিসেবে এলেও কথাটি গান্ধীর বেশ পছন্দ হয়ে যায়। এর পর থেকে তিনি মাঝেমধ্যেই এই " অহিংস বিদ্রোহ' শব্দবন্ধটি ব্যবহার করবেন।

    ১৪ই জুলাই গান্ধীর জেদের কাছে হার মেনে ওয়ার্কিং কমিটি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব পাশ করে।
  • I | 785612.40.2378.154 | ১৫ অক্টোবর ২০১৮ ০১:২৩370798
  • প্রস্তাব পাশ হয়ে যাওয়ার পর গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব মহাদেব দেশাই মীরা বেন'কে (1)ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলন সম্বন্ধে তাঁকে অবহিত করবার জন্য ওয়ার্ধা থেকে দিল্লী পাঠান। কিন্তু ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত সচিব তাঁকে জানান, ভাইসরয় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী নন। এরকম একটি বিদ্রোহের ডাক দেওয়ার পরে কংগ্রেসের কোনো প্রতিনিধি'র সঙ্গে সাক্ষাৎ করা বা আলাপ-আলোচনা করা, ভাইসরয়ের মতে, অর্থহীন। সচিব তাঁকে এ-ও জানান, আন্দোলন অহিংস বা হিংসাত্মক যা-ই হোক না কেন, সরকার তাকে কড়া হাতে দমন করবে।

    এরকম একটি বিস্ফোরক পরিস্থিতিতে এ আই সি সি'র অধিবেশন বসে বোম্বাইতে। অধিবেশনে 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের প্রস্তাব পেশ করা হয়। অল্প কিছু কমিউনিস্ট সদস্য ছাড়া বাকিরা প্রস্তাব সমর্থন করেন। কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীরা ও বামপন্থী সোশ্যালিস্টরা এই বিষয়ে এক হয়ে যান।৮ই অগাস্ট প্রস্তাবটি পাস করানো হয়। ডাক দেওয়া হয় 'যতদূর সম্ভব বড় মাত্রায় অহিংস পন্থায় গণ-সংগ্রামের।' গান্ধী তাঁর আবেগময় 'করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে' ভাষণে বলেন-কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে যদি গ্রেপ্তার করে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে প্রত্যেক স্বাধীনতা-সংগ্রামীকে নিজেই নিজের দিশারী হয়ে উঠতে হবে। পুলিশ গায়ের জোরে না তুলে নেওয়া অবধি কেউ যেন স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার বরণ না করেন। এই দফায় শুধু জেল খাটাই যথেষ্ট নয়.. মন্ত্রের সাধন, নয় শরীর-পাতন। আন্দোলনের কোনো স্পষ্ট রূপরেখা দেওয়ার বদলে আন্দোলনটিকে কেন্দ্রহীন, নেতৃত্বহীন এক পথে ঠেলে দেওয়া এবং তা সত্বেও তাকে এক প্রবল দেশজোড়া বিদ্রোহের দিকে এগিয়ে দিতে পারা- এ কেবল গান্ধীর ক্যারিসমার পক্ষেই সম্ভব ।

    ৮তারিখ রাতেই আজাদ নিজস্ব সূত্রে খবর পেয়ে যান, সরকার পরদিন ভোরবেলাতেই তাঁকে ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তার করে জেলে ভরে দেবে। তিনি এ-ও শোনেন, সরকার খতিয়ে দেখছে নেতাদের ভারতে না রেখে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠিয়ে দেওয়া যায় কিনা। পরবর্তীকালে তিনি জানতে পারেন, সরকার সত্যি এরকম একটি সম্ভাবনার কথা ভাবছিল; শেষ মুহূর্তে কোনো অজানা কারণে তা বাস্তবায়িত হয় নি।

    বোম্বাই এলে আজাদ ভুলাভাই দেশাইয়ের বাড়িতে উঠতেন। সে রাতেও তিনি তাই করেছিলেন। বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। উদ্বিগ্ন ভুলাভাই সব খবরই আজাদকে জানান; ক্লান্ত আজাদ অবশ্য তখন একটু ঘুমোতে পারলে বাঁচেন। যদিও ভোর পাঁচটার আগেই পুলিশের ডেপুটি কমিশনার এসে তাঁর ঘুম ভাঙাবেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তিনি দেখতে পাবেন খাঁ খাঁ প্ল্যাটফর্মে একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনতিবিলম্বে নেহরু, আসফ আলি সহ আরো বেশ কিছু কংগ্রেস নেতা এসে হাজির হলেন। নেহরু'র কাছে আজাদ খবর পান, গান্ধীও একই ট্রেনে রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন সরোজিনী নাইডু। করিডোর ট্রেন হওয়ায় তাঁরা গান্ধী'র সঙ্গে দেখা করেও আসেন। গান্ধীকে বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল । তিনি আঁচ করতেই পারেন নি, সরকার এত দ্রুত আঘাত করবে। পরিস্থিতি-বিচারে এত বড় ভুল করে ফেলায় গান্ধী যেন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছিলেন।

    অরুনা আসফ আলি তাঁদের বিদায় জানাতে এসেছিলেন। ট্রেন চলতে শুরু করলে তিনি হাত নেড়ে বললেন-'আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক কিছু না কিছু একটা কাজ বেছে নেব; চুপচাপ বসে থাকবো না।'

    আজাদ বলছেন-'পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে বোঝা গিয়েছিল তিনি (অরুনা আসফ আলি) ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন।'

    নোট ঃ
    1.ম্যাডেলিন স্লেড; সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশ পরিবারে এঁর জন্ম, বাবা ছিলেন রয়াল নেভি'র অ্যাডমির‌্যাল। গান্ধীবাদী এই নেত্রী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জরুরী ভূমিকা নিয়েছিলেন।
  • aranya | 3478.160.342312.238 | ১৫ অক্টোবর ২০১৮ ০৪:২৭370799
  • খুবই ভাল হচ্ছে, বলাই বাহুল্য। আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। শেষ হলে যেন চটি হিসাবে প্রকাশ পায়
  • amit | 340123.0.34.2 | ১৫ অক্টোবর ২০১৮ ০৫:৫৬370800
  • অসাধারণ হচ্ছে এই লেখাটা। এই বিষয় নিয়ে কত বই পড়েছি, কিন্তু একটা সম্পূর্ণ অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে নতুন করে ভাবাচ্ছে এটা। এটা বই হিসেবে পাবলিশ নাহলে সত্যি খারাপ লাগবে। আগাম বুক করে রাখলুম।

    লেখাটা পড়ে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, ডেমোক্রেসি কনসেপ্ট টাই হয়তো আরো অনেক বছর লাগবে পরিণত হতে, যেখানে লোকে চিন্তা করে নিজের মতামত দেবে। গান্ধী হোক বা হিটলার বা মোদী, নিজের মত চাপিয়ে দিতে কেও আদৌ অন্যদের মতামতের ধার ধারেন নি, সেই ক্ষেত্রে সবাই ডিকটেটর, প্রতিবাদ করলেই বাকিরা কন্সপিরেটোর।

    এক জিনিস আজও চলছে, S-বলেছিলেন কিছুদিন আগের টইতে। ব্যক্তি র মতামত বা চ্যারিশ্মা দলের বাকিদের মতের চাইতে বেশি। আর সেটা লোকে বেশ পছন্দও করে, কোনো এক সুপারহিরো এসে সব সমস্যা মিটিয়ে দেবে। এই বিষয়ে ইন্ডিয়া আর বাকি দেশের মইধ্যে মূল তফাৎ কিছু নেই। তফাৎ শুধু প্রেসেন্টেশন এর।
  • সিকি | ১৫ অক্টোবর ২০১৮ ০৬:০৭370801
  • ইন্দোদাদা বড় হয়ে দারোগা হোক, এই আশীর্ব্বাদ করি।
  • Du | 237812.58.560112.249 | ১৬ অক্টোবর ২০১৮ ২২:৫০370802
  • হাইন্ড্সাইটেও ব্যাপারটা চাপের। মানে জাপান কি করবে সেটা।
  • I | 7845.15.90090012.117 | ১৭ অক্টোবর ২০১৮ ১৯:৩৯370803
  • যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ব্রিটিশ আমলাদের হাত নিশপিশ করছিল কংগ্রেসকে কোন না কোন ভাবে আঘাত করবার জন্য। আর এবারে সরকার সেই কাঙ্খিত সুযোগ পেয়েই গেল। সরকারী তরফে ঠিক হয় নির্দয়ভাবে এই আন্দোলনকে দমন করতে হবে। যার সূত্রপাত ৮ তারিখ আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ঠিক পরদিন ভোরবেলার মধ্যেই কংগ্রেসের গোটা নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করে ফেলার মধ্য দিয়ে। গান্ধীকে রাখা হয় পুনাতে আগা খান প্যালেসে; বাকি নেতাদের নিয়ে যাওয়া হয় আহমেদনগর ফোর্টে।

    প্রশাসনের তরফ থেকে নিশ্চ্ছিদ্র গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও খবরটা চাউর হয়ে পড়ে; সম্ভবতঃ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কিছু ভারতীয় কর্মী খবরটা ছড়িয়ে দেন ( আন্দোলনের পরবর্তী সময়েও এঁরা আন্দোলনকারীদের নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন বলে সুমিত সরকার মন্তব্য করেছেন)। ফলে ঐ ভোরবেলাতেই পুনা স্টেশনে এক দঙ্গল মানুষ জড়ো হয়ে যান। গান্ধীকে যখন ট্রেন থেকে নামানো হচ্ছে, তাঁরা "মহাত্মা গান্ধী কি জয়" নাড়া লাগান। পুলিশ নির্দয়্ভাবে তাদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে ভবিষ্যতে সরকার এই আন্দোলনের সম্পর্কে কী মনোভাব নিতে চলেছে।

    কিন্তু ব্রিটিশের এই দমননীতি উল্টে এক স্বতঃস্ফূর্ত গণবিস্ফোরণের রাস্তা খুলে দেয়। নেতৃত্বহীন মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েন নানা বিচিত্র পন্থায় ব্রিটিশ সরকারকে প্রত্যাঘাত করতে। সরকার এত ব্যাপকমাত্রার জঙ্গী আন্দোলনের জন্য সম্ভবতঃ প্রস্তুত ছিল না। ৩১শে অগাস্ট লিনলিথগো চার্চিলকে টেলিগ্রাম করে বলেন-" ১৮৫৭ থেকে আজ অবধি সবচেয়ে গুরুতর বিদ্রোহ। সামরিক নিরাপত্তার খাতিরে এর গুরুত্ব ও প্রসারকে আমরা এযাবত পৃথিবীর কাছ থেকে গোপন করে রেখেছি " (1) । '৪২ সালে মানুষের মেজাজ ছিল তুঙ্গে। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন জাপান-জার্মানীর হাতে ব্রিটিশের পরাজয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। অন্নদাশঙ্কর রায়ের 'ক্রান্তদর্শী' উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র বিলেতফেরত সুকুমার দত্ত অনুভব করছেন-

    " এদেশে দেখছি হিটলারের অগণ্য ভক্ত। অনেকের বিশ্বাস হিটলার আসলে নিষ্ঠাবান হিন্দু। তার প্রমাণ হিন্দুদের স্বস্তিক হিটলার তাঁর বাহুতে ধারণ করেন। স্বস্তিক তাঁর নাৎসীদলের প্রতীক। ওরাও নাকি আসলে হিন্দু। জার্মানরা জিতলে আর্যরা ভারতে আসবে। এদেশের আর্যদের সঙ্গে হাত মেলাবে। এদের যা কিছু আক্রোশ তা ইংরেজের বিরুদ্ধে" (2) ।

    দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ -সিংহের তখন ল্যাজে-গোবরে অবস্থা। তার মধ্যেও দেখা গেল তারা কতদূর বর্ণবিদ্বেষী হতে পারে। মালয়-সিঙ্গাপুর-বার্মা থেকে সবরকম যানবাহন দখল করে ইউরোপীয়রা নির্লজ্জের মত পালিয়ে চলে এল; সেখানকার অধিবাসীদের তারা ফেলে এল জাপানীদের হাতে। আর ভারতীয় সৈন্য ও প্রবাসী ভারতীয়রা দেশে ফিরল বিনা যান-বাহনে, দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে হাঁটতে হাঁটতে। যুক্ত প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আর বিহারে যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন সবচেয়ে ব্যাপক হয়েছিল, তা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। প্রধানতঃ এইসব অঞ্চল থেকেই শ্রমিকরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশে দেশে মজুরী খাটতে যেতেন। যুদ্ধে ব্রিটিশের হার ও কলোনির মানুষজনকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে কাপুরুষের মত পলায়ন তাঁরা চাক্ষুষ করেছেন। তাঁদের ক্রোধ, অসহায়তা এবং আশা ( যে,যুদ্ধে ব্রিটিশের হার অবশ্যম্ভাবী) তাঁরা ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশে ফিরে তাঁদের ভাই-বেরাদরদের মধ্যে। তার ওপর যেসব ব্রিটিশ, মার্কিন ও অস্ট্রেলীয় সৈন্য সেসময় ভারতে ছিল তাদের আচার-আচরণে কখনোই তাদের জনযুদ্ধের সৈনিক বলে মনে হয় নি। জাতিগত দুর্ব্যবহার আর ধর্ষণের ঘটনা অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের ফলে সাধারণ মানুষের অবস্থাও সঙ্গীন হয়ে উঠেছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম চড়চড় করে বেড়ে চলেছিল; সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল চাল আর নুনের ঘাটতি।চলছিল ঢালাও কালোবাজারি। কালোবাজারি বন্ধ করতে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থাই নেয় নি ( এরই পরিণামে ১৯৪৩ সালে বাংলায় ঘটবে এক ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ, সেকথায় পরে আসছি)।

    আবার একই সঙ্গে এক উল্টো ঘটনাও ঘটছিল। মধ্যপ্রদেশের লাট লিনলিথগোকে জানাচ্ছেন- মালয়, সিঙ্গাপুরের পতনের ফলে যে মারাত্মক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তাতে 'বানিয়া আর মারোয়াড়িদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে'(3)। সুমিত সরকার লিখেছেন-".... এমন হওয়াও অসম্ভব নয় যে ভারতীয় ব্যবসাদাররা অল্প কিছুদিনের জন্য হয়তো সেই আন্দোলনকে গোপনে মদত জুগিয়েছিলেন, যে আন্দোলন (সহিংস হলেও) ব্রিটিশদের দ্রুত বার করে দিতে পারে... কিন্তু আন্দোলন যেই পরাস্ত হল আর জাপানীদের অগ্রগতি আসাম সীমান্তে এসে স্পষ্টতই থেমে গেল, স্বাভাবিকভাবে হিসেবও গেল পাল্টে।ভারতীয় ব্যাবসাদাররা ব্রিটিশের যুদ্ধপ্রয়াসকে 'সমর্থন' জানিয়ে সানন্দে ফিরে গেলেন তাঁদের আরো নিত্যকর্মে, অর্থাৎ ফাটকা ও মুনাফার পেছনে দৌড়নোয়"(4) ।

    Notes
    1.Mansergh , vol 2, p.853
    2.অন্নদাশঙ্কর রায়, ক্রান্তদর্শী, ২য় খন্ড, পৃ ৩১
    3.Mansergh , vol. 2, pp.117-19
    4.সুমিত সরকার, পৃ ৩৫১
  • দ্রি | 5690012.135.4590012.134 | ১৭ অক্টোবর ২০১৮ ২০:১৬370805
  • রেফারেন্স ১ঃ ম্যান্সার্গের কোন বই? কমনওয়েথ এক্সপিরিয়েন্স?
  • I | 7845.15.90090012.117 | ১৭ অক্টোবর ২০১৮ ২১:৩৫370806
  • ৯ তারিখ ভোরে গ্রেপ্তার-হওয়া কংগ্রেস নেতাদের বিদায় জানিয়ে এসে অরুনা আসফ আলি আর সময় নষ্ট করেন নি। এ আই সি সি-র অধিবেশন চালু রাখতে তিনি নিজে সভাপতিত্ব করেন, পতাকা উত্তোলনও করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৩। গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানের সেই অধিবেশনকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি অবধি চালায়। অবশ্য তারা অরুনা আসফ আলিকে ধরতে পারে নি; তিনি পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করে থাকেন। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকাকালীনই তিনি রাম মনোহর লোহিয়ার সঙ্গে যুগ্মভাবে কংগ্রেসের মাসিক পত্রিকা ইনকিলাব-এর প্রকাশ জারি রাখেন। আন্দোলনের গোটা সময় জুড়ে কখনোই পুলিশ তাঁর কোনো সন্ধান পায় নি , যদিও তাঁর খোঁজ দেবার জন্য প্রশাসন ৫০০০ টাকা ইনাম ধার্য করেছিল। গান্ধীর আবেদনেও তিনি পুলিশের হাতে ধরা দেন নি। তিনি প্রকাশ্যে আসবেন ১৯৪৬ সালে যখন তাঁর নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হবে।

    সরকার কংগ্রেস দলকে বেআইনী বলে ঘোষণা করে। আন্দোলনের রাশ চলে যায় নিচুতলার তরুণ, জঙ্গী কংগ্রেস কর্মীদের হাতে। আন্দোলনের বদনাম করার জন্য ও দুনিয়াব্যাপী ফ্যাসিস্টবিরোধী জনতার সহানুভূতি কুড়োনোর জন্য পৃথিবী জুড়ে প্রচার করা হয়, কংগ্রেস দল ফ্যাসিস্টদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন আর 'ভারত ছাড়ো আন্দোলন' আসলে পঞ্চম বাহিনী'র চক্রান্ত। ভারতসচিব লিও আমেরি প্রচার করতে থাকেন , কংগ্রেস যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর আক্রমণ আর অন্তর্ঘাত চালাতে চাইছে। কিন্তু এতে উল্টো ফল হয়। সাধারণ মানুষ মনে করেন, সত্যিই বুঝি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এমন কোনো নির্দেশ জারি করেছে। ফলে সত্যি সত্যিই এবারে টেলিগ্রাফের তার কাটা, রেললাইন উপড়ে ফেলা, রেলস্টেশন,পোস্ট অফিস ও অন্যান্য সরকারী অফিস ভাঙচুর করা শুরু হয়।

    ভারত ছাড়ো আন্দোলনের তিনটি পরিষ্কার পর্ব ছিল। প্রথম পর্বের আন্দোলন ছিল শহরকেন্দ্রিক, ব্যাপক ও উগ্র; পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ এবং ধর্মঘট-হরতাল ছিল এর বৈশিষ্ট্য। আন্দোলনের চালক ছিলেন মূলতঃ মধ্যবিত্ত ছাত্ররা, যদিও শ্রমিকদের অবদান ভোলবার মত নয়। টাটা ইস্পাত কারখানা ১৩ দিন বন্ধ ছিল; শ্রমিকদের একমাত্র শ্লোগান ছিল-'জাতীয় সরকার গঠন না হওয়া অবধি তারা কাজ শুরু করবে না'(1)। আমেদাবাদের সুতোকলে ধর্মঘট চলেছিল টানা সাড়ে তিন মাস।

    অগাস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্দোলনের ভরকেন্দ্র সরে যায় গ্রামে। জঙ্গী ছাত্ররা দলে দলে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েন। আন্দোলনের এই পর্ব এক ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহের চেহারা নেয়। পশ্চিম বিহার, পূর্ব যুক্ত প্রদেশ, বাংলার মেদিনীপুর, ওড়িশার তালচের, মহারাষ্ট্রের সাতারায় জাতীয় সরকার তৈরী হয়। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আন্দোলন প্রবেশ করে তার সবচেয়ে কম শক্তিশালী কিন্তু দীর্ঘতম পর্বে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অন্তর্ঘাত এবং পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী লড়াই শুরু করে শিক্ষিত যুবকরা। কোথাও এটি গেরিলা যুদ্ধের চেহারা নেয় (যেমনটা ঘটেছিল বিহার-নেপাল সীমান্তে জয়প্রকাশ নারায়ণ ও রামনোহর লোহিয়ার নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকারের মদতে)। কোথাও কোথাও আংশিক সময়ের কৃষক বাহিনী দিনের বেলায় চাষ করতেন, রাতে করতেন অন্তর্ঘাতমূলক কাজ (কর্ণাটক)। শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার চেষ্টার পাশাপাশি, নগণ্য হলেও চলছিল নিজেদের গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরী ও চালু রাখার চেষ্টা। বোম্বাই শহরে একটি গোপন বেতার কেন্দ্র প্রায় তিন মাস চালু ছিল।

    আন্দোলনের মোকাবিলা করতে সরকার পাশবিক দমন-নিপীড়ণ নামিয়ে আনে। ১৯৪৩ এর শেষদিকে সরকারী বিবরণ থেকে জানা যায় এ পর্যন্ত প্রায় ৯২ হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; পুলিশ-মিলিটারির গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ১০৬০ জন (সুমিত সরকার বলছেন, নিঃসন্দেহে সংখ্যাটি অনেক কমিয়ে দেখানো হয়েছে)। লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করার পাশাপাশি বিমান থেকে মেশিনগানও চালানো হয় (স্বয়ং বড়লাট লিনলিথগো'র নির্দেশে)। পিটুনি কর আদায় করা হয় ব্যাপকভাবে। এছাড়াও ছিল প্রকাশ্যে বেত মারা, গুহ্যদ্বারে ডান্ডা ঢোকানো'র মত অত্যাচার ও নারীধর্ষণ। সরকারী বিবরণ অনুযায়ীই ২১৬ জন পুলিশ বিদ্রোহীদের দলে যোগ দেন। পুলিশের অগ্নিসংযোগকারী বাহিনীকে নামানো হয় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য। পাইকারি হারে গণ-জরিমানা ধার্য করা হয়। আজমগড়ের জেলাশাসক নিবলেটকে অত্যন্ত নরম হওয়ার অপরাধে সরিয়ে দেওয়া হয়। যৌথ জরিমানাকে তিনি বলতেন 'সরকারী ডাকাতি'। অগ্নিসংযোগের মত শ্বেত সন্ত্রাসের তিনি সমালোচনা করেছিলেন। তিনি তাঁর লোকজনকে সাবধান করতেন-'মনে রেখো, তোমরা শিকার বা তাণ্ডব করতে বেরোও নি (2)।অবশ্য তাঁর এই সাবধানবাণীতে কেউই বিশেষ কান দিত না।

    Notes
    1.Linlithgow to Amery, Mansergh, p. 777
    2.R H Niblett, The Congress Rebellion in Azamgarh, pp. 26, 40,44, 49.
  • I | 7845.15.90090012.117 | ১৭ অক্টোবর ২০১৮ ২১:৩৭370807
  • @ দ্রি,
    Transfer of Power. আগে মেনশন করা আছে।
  • সিকি | ১৮ অক্টোবর ২০১৮ ১১:৩২370808
  • অতি অল্প হইল তো! আরো আসছে তো?
  • I | 7845.15.234523.101 | ২০ অক্টোবর ২০১৮ ০১:১২370809
  • ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের মতই '৪২ এর আন্দোলনও গোটা ভারত জুড়ে সমান তীব্র ছিল না। পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ছিল প্রায় শান্ত। যুদ্ধের সময় পাঞ্জাবের কৃষক পরিবারগুলি থেকে প্রচুর পরিমাণ সেনা নিয়োগ আর কৃষ্যিপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাষীর অখুশী হওয়ার কারণ ছিল না।চাষীদের মধ্যে তৈরী হয়ে উঠছিল এক সমৃদ্ধ কুলাক-সম্প্রদায়, যারা পাঞ্জাবের ক্যানাল -কলোনির সুবিধা নিয়েছিল দুহাত ভরে। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিও ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত; সম্ভবতঃ রাজাজী আন্দোলন থেকে দূরে থাকার ফলে। কেরল কংগ্রেস কমিউনিস্টদের অধীনে থাকার ফলে সেখানেও কর্মীরা ছিলেন নিষ্ক্রিয়।কলকাতা ও বোম্বাইয়ের শ্রমিকদের মধ্যেও ততদিনে কমিউনিস্ট-প্রতিপত্তি গড়ে উঠার ফলে এই দুই শহরে শ্রমিকরা খুব একটা আন্দোলনে যোগ দেন নি। দেশীয় রাজাদের এলাকাগুলির মধ্যে মাইসোরেই আন্দোলন সবচেয়ে বড় আকার নেয়।

    মুসলিম লীগ শুরু থেকেই এই আন্দোলনের বিরোধী ছিল।বস্তুতঃ আন্দোলনে যোগ দিয়ে কংগ্রেস নেতা ও কর্মীরা ব্যাপকহারে জেল চলে যাওয়ার ফলে মুসলিম লীগ ভারত জুড়ে খোলা ময়দান পেয়ে যায়। সেই সুবিধা তারা ছাড়ে নি। পরবর্তী কয়েক বছর প্রচারে ও প্রভাবে তারা অনেকখানি এগিয়ে যায়। সংগঠন দ্রুত বাড়তে থাকে। কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলি পদত্যাগ করায় বেশ কয়েকটি প্রদেশে মুসলিম লীগ সরকারে যোগদান করার অপ্রত্যাশিত সুযোগ পায়,যেমন সিন্ধ ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। দুটি প্রদেশেই লীগ সরকার তৈরী হয় রাজনীতিতে তাদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা হিন্দু মহাসভার সঙ্গে হাত মিলিয়ে। এ ব্যাপারে দুই বিরোধী সাম্প্রদায়িক দলের কারোরই কোনো ছুৎমার্গ ছিল না। সিন্ধ প্রদেশের এই মিলিজুলি সরকার এমন কি ১৯৪৩ সালে প্রাদেশিক আইনসভায় 'পাকিস্তান প্রস্তাব' পাশ করে (ভারতে সর্বপ্রথম); তা সত্ত্বেও হিন্দু মহাসভার তিন মন্ত্রী পদত্যাগ না করে স্বচ্ছন্দে মন্ত্রীত্ব করে যান ( যদিও প্রস্তাব পাশের দিন তাঁরা লোক-দেখানো বিরোধিতা'র মধ্য দিয়ে শ্যাম ও কূল দু-ই বজায় রেখেছিলেন ) (1)।

    শ্যাম ও কূল বজায় রাখবার আরেকটি আদর্শ উদাহরণ হল বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভার ফজলুল হকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করা (ব্যঙ্গ করে লোকে যাকে 'শ্যামা-হক' সরকার বলে ডাকত)। ফজলুল হকের 'তথাকথিত' হিন্দুবিরোধী নীতির কট্টর সমালোচক শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ১৯৪১ সালে অদ্ভুত ডিগ্‌বাজি খেয়ে দ্বিতীয় হক- মন্ত্রীসভায় যোগদান করলেন; ফজলুল হক তার আগেই নিজের তৈরী কৃষকপ্রজা পার্টি ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগদান করেছিলেন; ৪১ সালে আবার তিনি লীগ থেকেও বেরিয়ে এলেন।শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী হলেন দলহীন ফজলুল হক, দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ। এই সমঝোতার প্রশংসা করে '৪২ সালের হিন্দু মহাসভার কানপুর অধিবেশনে হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট সাভারকর বললেন - "... মিনমিনে কংগ্রেস যাদের পোষ মানাতে পারে নি, সেইসব গোঁড়া লীগপন্থীরা দিব্যি সুন্দর প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক ও আমাদের শ্রদ্ধেয় হিন্দু মহাসভা নেতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সক্ষম নেতৃত্বে তৈরী জোট সরকারের অধীনে আপোষরফা করে মানিয়েগুছিয়ে চলছে ...""(2)।

    উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেসের ডাকে ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসেরই শাখা সংগঠন ফ্রন্টিয়ার ন্যাশনাল কংগ্রেস নেতা খান আব্দুল জব্বর খানের সরকার পদত্যাগ করে। সরকারে আসে মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভা ও অকালি দলের জোট সরকার। এমন কি পাঞ্জাবেও মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভার মধ্যে সরকার গঠন নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়, যদিও তা শেষমেশ বাস্তবায়িত হয় নি। সাভারকর ও মুঞ্জে উভয়েই এ ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। জিন্না শিয়ালকোটে তাঁর এক ভাষণে বলেন- লীগকে যদি হিন্দু মহাসভার সঙ্গে সরকার গড়তেই হয় তো হবে! (3)

    কাজেই বোঝাই যাচ্ছে মুসলিম লীগের মতই হিন্দু মহাসভাও অগাস্ট আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল। সাভারকর এমনকি হিন্দু মহাসভার কর্মী-নেতাদের একটি চিঠি পাঠান-'কেউ পদ ছাড়বেন না' এই শিরোনামে। তাতে বলা হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে সব হিন্দু মহাসভা সদস্য আইনসভা/মিউনিসিপ্যালিটি/ স্থানীয় বোর্ড ইত্যাদির পদাধিকারী আছেন, তাঁরা কেউ 'ভারত ছাড়ো আন্দোলনে' প্রভাবিত হয়ে পদত্যাগ করবেন না-সকলেই পদ আঁকড়ে বসে থাকবেন (4)। হিন্দু মহাসভার তৎকালীন লাইনকে বোঝা সহজ হবে সাভারকর-ব্যবহৃত দুটি শব্দবন্ধ দিয়ে-'Responsive cooperation'(ব্রিটিশ প্রভুর সঙ্গে) ও 'Reasonable compromise'(5)। মহাসভা নেতা ও বাংলার প্রাদেশিক সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ বাংলার গভর্নরকে একটি চিঠি লেখেন এই আন্দোলন কিভাবে দমন করতে হবে সেবিষয়ে তাঁর মতামত জানিয়ে- "প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে এই আন্দোলনকে (ভারত ছাড়ো) বাংলায় আমরা প্রতিহত করতে পারি? প্রদেশের প্রশাসন এমনভাবে চালাতে হবে যেন কংগ্রেসের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও এই আন্দোলন প্রদেশে শিকড় গাড়তে না পারে..." (6)।

    আর এস এস অত্যন্ত সাবধানে অগাস্ট আন্দোলনের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলে। গোলওয়ালকর পরবর্তীকালে জানাবেন এইসব আন্দোলন মানুষকে আইনশৃঙ্খলাহীন করে তোলে.. আর এস এস সেই সময় অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে এই আন্দোলনকে পরিহার করে চলেছিল; কেবলমাত্র দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্যেই সংগঠন নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরও সে কথা স্বীকার করে। বোম্বাই সরকারের পাঠানো একটি নির্দেশনামার উত্তরে আর এস এস বলে-সরকারী আদেশ অমান্য করবার কোনো ইচ্ছেই তাদের নেই। ব্রিটিশ সরকার মনে করে আর এস এস -এর দিকে থেকে সরকারবিরোধী কোনো গোলমালের আশংকা নেই; কাজেই তাদের অন্যান্য কাজকর্ম নিয়ে সরকারের মাথা ঘামানোরও কোনো দরকার নেই (7)।

    Notes
    1.Muslim League and Hindu Mahasabha in Coalitions, Dr. Hari Desai , 25th September 2017,https://www.asian-voice.com/News/India/Muslim-League-and-Hindu-Mahasabha-in-Coalitions
    2.During the Quit India Movement, RSS was in bed with Muslim League, Shamsul Islam, Aug 8th, 2017, https://www.nationalheraldindia.com/eye-on-rss/during-the-quit-india-movement-rss-was-in-bed-with-muslim-league
    3.Muslim League and Hindu Mahasabha in Coalitions, Dr. Hari Desai
    4.Prabhu Bapu (2013). Hindu Mahasabha in Colonial North India, 1915–1930: Constructing Nation and History. Routledge. pp. 103–. ISBN 978-0-415-67165-1
    5.During the Quit India Movement, RSS was in bed with Muslim League, Shamsul Islam.
    6.Abdul Gafoor Abdul Majeed Noorani (2000), The RSS and the BJP: A Division of Labour, LeftWord Books, pp. 56–, ISBN 978-81-87496-13-7.
    7.Bipan Chandra, Communalism in Modern India,2008, p.140.
  • I | 7845.15.120123.164 | ২১ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৪৪370810
  • অগাস্ট আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন কমিউনিস্টরাও। আগেই বলা হয়েছে, কমিউনিস্টদের জনযুদ্ধের তত্ত্ব দেশের একটা বড় অংশের মানুষকে তাঁদের প্রতি বিমুখ করে তুলেছিল। সি পি আইয়ের তাত্ত্বিক নেতা ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী (1) শেষজীবনে এসে লিখেছিলেন- " ফ্যাসিবাদ -বিরোধী যুদ্ধে আমাদের সাধারণ সমর্থন ঘোষণা সঠিক ছিল। তাছাড়াও জাপানী আক্রমনের বিরুদ্ধে আমাদের দেশকে রক্ষা করতে হবে এই কথা বলাও সঠিক ছিল।কিন্তু জাতীয় আন্দোলন ছাড়া কি কমিউনিস্ট পার্টি দেশকে রক্ষা করতে পারত? একথা কল্পনা করা কি বাস্তবানুগ ছিল যে আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে দেশের জনসাধারণ, জাতীয় নেতৃত্ব ফ্যাসিবাদের পক্ষে চলে গেছে বলে তাদের ত্যাগ করবে এবং ফ্যাসিবাদ-বিরোধী দেশপ্রেমিক কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মিলিত হবে?... একমাত্র পথ ছিল জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, তার বিরোধিতা করা নয়(2)।"

    সুভাষচন্দ্রকে 'কুইসলিং' বলা ছিল কমিউনিস্টদের আরেক বড় ভুল। জাপ বাহিনীর সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে এগোতে থাকা সুভাষচন্দ্র শিগ্গিরই ব্রিটিশকে কুপোকাত করে ভারত স্বাধীন করে দেবেন, এই বিশ্বাস বহু মানুষের মধ্যে তখন বদ্ধমূল। এহেন সুভাষচন্দ্রকে 'বিশ্বাসঘাতক' বলে কমিউনিস্টরা পুরো একঘরে হয়ে পড়লেন। মণিকুন্তলা সেন স্মৃতিচারণ করেছেন-
    "এর ফলে জনতার কাছ থেকে আমরা উপহার পেলাম ঘৃণা, বিতৃষ্ণা ও ধিক্কার। সুভাষচন্দ্র তখন বাংলার জনমানসে যে কতবড় শ্রদ্ধার আসনে বসেছিলেন, সেটা বোধ হয় আমাদের জানা ছিল না। নয়তো সুভাষচন্দ্র কী করছেন জানবার আগেই আমরা তাঁকে কী অপমানই না করলাম, এবং দেশের মানুষকে কী আঘাতই না দিলাম ! সুভাষ বসুর প্রশংসা গান্ধীজিও করেন নি, জওহরলালও করেন নি।... জাপানী বাহিনী নিয়ে এলে জওহরলাল নিজে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, এও বলেছিলেন।...সুভাষচন্দ্রের লাইন আদৌ কংগ্রেস-সমর্থিত ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে কংগ্রেসের চুনোপুঁটি থেকে নেতারা পর্যন্ত বাংলাদেশে সুযোগ বুঝে পরম সুভাষভক্ত সেজে কি লম্ফঝম্পটাই না করল ! ... ইংরেজের 'দালাল' বলে কংগ্রেসীরা আমাদের গালাগাল দিত। কিন্তু পার্টির লাইনের বক্তব্যে তা ছিল না। বরং ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যা বলা হত তাতে তারা ক্রুদ্ধ হয়েও কিছু করার সাহস পায় নি আমাদের ফ্যাসিস্টচক্রের বিরোধিতার জন্য। এ বিরোধিতা তো কংগ্রেসকেও স্বীকার করতে হয়েছিল আন্তর্জাতিক পটপরিবর্তন ও ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক মনে রেখেই। কিন্তু একথা তাঁরা সরাসরি তাঁদের মঞ্চ থেকে প্রথমদিকে বলতে পারলেন না এবং কংগ্রেসকর্মীদেরও শেখালেন না বোধ হয় দুটো কথা মনে রেখে। প্রথমত এতে ইংরেজবিরোধিতার ধার কমে যাবে এই ভয় এবং দ্বিতীয়ত দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে যদি কমিউনিস্টদের কিছুটা কাৎ করা যায় তো মন্দ কি? সুতরাং স্বাধীনতা যখন এলই না, তখন কারান্তরালে চুপচাপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলেন তাঁরা (3)

    ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জেলে চলে যাওয়াটা সত্যিই কংগ্রেস নেতাদের কাছে শাপে বড় হয়েছিল। মুক্ত থাকলে তাঁদের বেশ একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হত। প্রথমতঃ, বিশ্বরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁদের ফ্যাসিবিরোধী ভাবমূর্তিতে প্রবল আঘাত লাগতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সহানুভূতি কতদিন বজায় থাকত বলা কঠিন।জওহরলাল যে কী করে বসতেন তাও বলা মুশকিল। দ্বিতীয়ত, আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে ওঠার দায়ভারও তাঁদের, বিশেষতঃ গান্ধীকে নিতে হত। সেই অবস্থায় গান্ধী কী করতেন, আন্দোলন প্রত্যাহারের ডাক দিতেন কিনা তাও তর্কযোগ্য।

    সাময়িকভাবে ব্রিটিশ-বিরোধিতার লাইন ছাড়ার জন্যে সরকার কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তা হলেও ব্রিটিশ প্রশাসনের সন্দেহের তালিকা থেকে কমিউনিস্টরা মুক্ত হয়েছিল এটা বোধ হয় বলা যাবে না। সুমিত সরকার লিখছেন -"সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত নথিপত্র থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, (যুদ্ধপ্রস্তুতিতে) কমিউনিস্টদের হঠাৎ -দেওয়া সমর্থন-প্রস্তাবকে বহু সরকারী আমলাই গভীর সন্দেহের চোখে দেখেছিলেন, বিশেষতঃ জাপ-বিরোধী গেরিলা-শিক্ষণের অনুরোধকে ঃ 'বাহ্যত ওরা ফ্যাসি-বিরোধী ও যুদ্ধের পক্ষে কিন্তু তলায় তলায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী; এবং এই দিক থেকে চিন্তা করলে ওদের দাবীর ব্যাপারে একটার সঙ্গে অন্যটার যোগ থাকতেই পারে।' (লিনলিথগোকে বিহারের লাট স্টুয়ার্ট, ৬ই মে, ১৯৪২, ম্যানসার, খন্ড ২, পৃ ৪৬)।" (4)

    কমিউনিস্ট পার্টির লাইনটি অবশ্য পার্টি-কর্মীদের কাছেই বেশ অস্প্ষ্ট ঠেকছিল। আরেকবার মণিকুন্তলা সেনকে উদ্ধৃত করি-
    " পার্টির নির্দেশ ছিল 'দেশপ্রেমিক ও পুলিশের মাঝখানে দাঁড়াও', 'পঞ্চম বাহিনী ও দেশপ্রেমিকদের মাঝখানে দাঁড়াও', কিন্তু কেমন করে এ নির্দেশ কার্যকর করবো? কারা পঞ্চমবাহিনী? যারা আমাদের কথা মানে না, তারাই কি? এখন মনে হয় ঐ কথাটা প্রয়োগ না করলে ভালো ছিল। 'দেশদ্রোহী' বললে যেমন আমাদের গায়ে জ্বালা ধরে, না জেনে কাউকে 'পঞ্চমবাহিনী' বলার অধিকারও তেমনি আমাদের নেই... ফলে 'পঞ্চমবাহিনী' কথাটার হাস্যকর অপপ্রয়োগ ঘটতে লাগল। সামান্য একটা 'ভুখামিছিল' নিয়ে যাচ্ছিল সোশ্যালিষ্ট পার্টির লোকেরা। মিছিলে ছিল নিতান্তই ছোট ছোট ছাত্র ও ছেলেমেয়েরা আর অল্প কিছু গরীব লোক। এই মিছিল বেশী এগোলেই পুলিশ ওদের পেটাবে মনে করে আমরা কিছু কর্মী সেটা ঠেকাতে গেলাম। ওরা রেগে গিয়ে আমাদের একজন কর্মীকে মারধোর করল। আমরাও 'পঞ্চমবাহিনী' বলে ওদের গালাগাল দিলাম। পরে জেনেছিলাম-আমারই এক পরিচিত সোশ্যালিষ্ট বন্ধুর নেতৃত্বে ঐ মিছিলটা যাত্রা শুরু করেছিল। তিনি আমাদের লাইন না মানতে পারেন, কিন্তু পঞ্চমবাহিনী কখনোই নন। পরে তিনি আমাকে অনুযোগ করেছিলেন, 'তুমি এই কাজ করলে?' এ ধরনের ভুল অনেক ঘটতে লাগল।" (5)

    এসবের পর ১৯৪২ সালে 'পাকিস্তান ও জাতীয় ঐক্য' বিষয়ে সি পি আই গ্রহণ করল গোলমেলে 'অধিকারী তত্ত্ব'। তত্ত্বটি শুরু হয়েছিল ভারত একটি বহুভাষাভাষী ও বহু জাতিসত্ত্বা নিয়ে তৈরী দেশ-এই বিষয়টির ওপর জোর দিয়ে, যা মোটেও অযৌক্তিক ছিল না। বলা হল, সোভিয়েট ইউনিয়নের মত এখানেও বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারকে মেনে নিতে হবে; তাহলেই তৈরী হবে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছা-সংযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তারপরেই থিসিসটি এসে পৌঁছল সিন্ধি, বালুচি, পাঞ্জাবী (মুসলমান), পাঠান ইত্যাদি মুসলিম জাতিসত্ত্বার বিচিত্র ধারণায়; এবং শেষ হল এই বলে যে, মুসলিম লীগ নেতৃত্ব এখন 'কতকটা জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বের মতই সাম্রাজ্যবাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক বিরোধী ভূমিকাই পালন করছেন' (6) । জাতিসত্ত্বার আইডেন্টিটি ও ধর্মীয় আইডেণ্টিটি এক করে ফেলার এ এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি প্রয়াস। ফলে কমিউনিস্ট পার্টিলাইনে অগ্রাধিকার পেল লীগের মধ্যে প্রগতিশীল অংশকে খুঁজে বের করা, বারংবার গান্ধী ও জিন্নাকে সমঝোতা করবার আবেদন জানানো, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সন্ধিস্থাপনের চেষ্টা। পার্টি এমনকি দেশভাগ ও পাকিস্তানের দাবীও প্রায় মেনে নিতে চলেছিল, কিন্তু ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টি নেতা রজনী পাম দত্ত (7) এসে হস্তক্ষেপ করে পার্টিলাইনে বদল আনেন।রজনী পাম সি পি আই নেতাদের মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক চরিত্র সম্বন্ধে সাবধান করে বলেন ভারতের এখন যা প্রয়োজন তা হল একতা; বিভেদ নয়। তাঁর মনে হয়েছিল মুসলিম লীগ তাদের সাম্প্রদায়িক কর্মসূচী অগ্রসর করতে গিয়ে আসলে ব্রিটিশের হাতেই তামাক খাচ্ছে। দুটি শত্রুভাবাপন্ন পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম বৃটিশের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতিকেই পরিপুষ্ট করবে। কিন্তু ভারতকে যদি একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, কেন্দ্রীয় প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে তার সমাজবাদী নীতিগুলিকে কার্যকর করতে হয়, তাহলে সবার আগে তাকে অখন্ড রাখতে হবে। (8)

    Notes
    1. ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী একজন বিখ্যাত মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ও রসায়নবিজ্ঞানী। আইনস্টাইন ও ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের সঙ্গে কাজ করেছেন। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় কারারুদ্ধ হওয়ায় স্বয়ং আইনস্টাইন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‌্যামসে ম্যাকডোনাল্ডকে চিঠি লিখে অধিকারীকে মুক্ত করতে অনুরোধ করেন।
    2.Communist Party and India`s path, p.51
    3.মণিকুন্তলা সেন, সেদিনের কথা, নবপত্র প্রকাশন, পৃ ৬০-৬১।
    4.সুমিত সরকার, পৃ ৩৫৫।
    5.মণিকুন্তলা সেন, পৃ ৬১।
    6.Gangadhar Adhikary, 'National Unity Now !', People's Age, 8 Aug, 1942
    7. রজনী পাম দত্তঃ বাঙালী পিতা ও সুইডিশ মাতার সন্তান রজনী পাম দত্তের জন্ম ও কর্ম ইংল্যান্ডে। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রজনী পাম ছিলেন রামবাগানের দত্তবাড়ির সন্তান। পিতা উপেন্দ্রনাথ ছিলেন সার্জেন। রজনী পাম দত্তের ঠাকুর্দার ভাই ছিলেন বিখ্যাত ঐতিহাসিক-সাহিত্যিক রমেশ চন্দ্র দত্ত।১৯৩৯-৪১ অবধি তিনি ছিলেন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি। বরাবরের ভারত-বন্ধু রজনী পাম দত্তের উল্লেখযোগ্য বইগুলির মধ্যে একটি হল India Today।
    8.Muhammad Amir Hamzah, Role of the Communist Party of India in Pakistan Movement with reference to the right of self -determination, http://www.academia.edu/14288233/Role_of_the_Communist_Party_of_India_in_Pakistan_Movement_with_reference_to_the_right_of_self_-determination
  • I | 7845.15.674523.4 | ২১ অক্টোবর ২০১৮ ২১:৪৯370811
  • কারারুদ্ধ হওয়ার ৬ মাস পর ১৯৪৩ এর ৯ই ফেব্রুয়ারি গান্ধী আগা খাঁ প্যালেসে ২১ দিনের অনশন শুরু করেন। ৩১শে ডিসেম্বর বড়লাট লিনলিথগো-কে লেখা একটি 'ব্যক্তিগত' চিঠিতে তিনি বলেন- যেভাবে তাঁকে ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, গ্রেপ্তারের পরে বড়লাট যে সরকারী বয়ান দিয়েছেন, ভারতসচিব লিও আমেরি তাঁর বিরুদ্ধে যেরকম বিষোদ্গার শুরু করেছেন, সেসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ তিনি এই অনশন করতে চলেছেন। লিখেছেন- ''আমার কাছ থেকে আশা করা হচ্ছে আমি কংগ্রেসীদের 'তথাকথিত' হিংসাত্মক কার্যকলাপের নিন্দা করবো; কিন্তু খবরের কাগজের 'heavily censored' রিপোর্ট ছাড়া এমন আর কোনো তথ্য আমার কাছে নেই যার ভিত্তিতে আমি এর নিন্দা করতে পারি। আর আমি বলতে বাধ্য যে এইসব রিপোর্টের ওপর আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই।" (1) .

    একটি অস্ট্রেলীয় দৈনিক The Mercury-র লন্ডন সংবাদদাতা তাঁর ১২ই ফেব্রুয়ারি'র প্রতিবেদনে লিখছেন-" The fast is a sequel to correspondence with the Viceroy (Lord Linlithgow) in which Gandhi repudiated the suggestion that Congress was responsible for murder and sabotage, which he blames on the Government." মৌলানা আবুল কালাম আজাদ লিখেছেন, জেলে বসে তাঁরা খবরের কাগজ মারফৎ জানতে পেরেছিলেন গান্ধীজী 'চিত্তশুদ্ধি'র জন্য অনশন শুরু করেছেন। আজাদের মনে হয়েছিল গান্ধীজী দুটি কারণে এবারের অনশন শুরু করে থাকতে পারেন-এক তো তিনি ভাবতেই পারেন নি সরকার এত তাড়াতাড়ি তাঁদের গ্রেপ্তার করবে। দ্বিতীয়তঃ, তাঁর আশা ছিল তিনি তাঁর অহিংসার আদর্শে আন্দোলনটিকে গড়ে তুলতে যথেষ্ট সময়-সুযোগ পাবেন। দুটির কোনোটিই না ঘটায় তিনি তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ অনশন করছেন (2) ।

    সে যাই হোক,লিনলিথগো'র প্রত্যুত্তর গান্ধীকে খুশী করতে পারে নি। দুজনের মধ্যে চিঠি বিনিময় চলতে থাকে। ৫ই ফেব্রুয়ারির চিঠিতে লিনলিথগো লেখেন- "I would welcome a decision on your part to think better of it, not only because of my own natural reluctance to see you willfully risk your life, but because I regard the use of a fast for political purposes as a form of political blackmail (himsa) for which there can be no moral justification, and understood from your own previous writings that this was also your view." (3) জবাবে ক্ষিপ্ত গান্ধী লেখেন -"উত্তরপুরুষ আমাদের বিচার করবে-আপনি, যিনি এক সর্বশক্তিমান সরকারের প্রতিনিধি আর আমি, একজন সাধারণ মানুষ যে কেবল তার দেশ ও মানবতার সেবা করতে চেয়েছিল।"

    গান্ধীর অনশন সম্বন্ধে ব্রিটিশ সরকারের মনোভাবের সঙ্গে একমত না হলেও একথা অবশ্যই মনে হয়, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার জন্য অনশনের ব্যবহার এক ধরণের বলপ্রয়োগ তো বটেই। গান্ধীর অনশনের বিরুদ্ধে এই রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেলিংয়ের অভিযোগ বারবারই উঠেছে তাঁর বিরোধীদের পক্ষ থেকে। গান্ধী যদিও ব্যাপারটিকে এইভাবে দেখাতে চান নি; তিনি বলেছেন নৈতিক চাপের (moral Pressure) কথা। কিন্তু গান্ধীকথিত 'কোনোরকম বলপ্রয়োগ ছাড়াই ক্ষমতা' অর্জনের আদর্শের সঙ্গে এর বিরোধ রয়েছে। Rediscovering Gandhi বইয়ের লেখক
    ডঃ জয়নারায়ণ শর্মা লিখেছেন-'...আসলে দুজন গান্ধী ছিলেন-একজন আদর্শবাদী গান্ধী, অন্যজন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ গান্ধী। আদর্শবাদী গান্ধী স্বপ্ন দেখতেন সম্পূর্ণ চাপমুক্ত এক রাজনৈতিক ক্ষমতার , যেখানে সহিংস বা অহিংস, কোনোরকম বলপ্রয়োগেরই প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু বাস্তবে যখন তিনি তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন তখন প্রতিপক্ষের ওপর কিছু চাপ তো থাকতোই।' (4)।

    উদাহরণস্বরূপ গান্ধী-আম্বেদকর পুনাচুক্তির কথা ভাবা যেতে পারে। ১৯৩২ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর কমিউন্যাল অ্যাওয়ার্ড প্রত্যাহারের দাবীতে গান্ধী ইয়েরওয়াদা জেলে আমরণ অনশন শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে, কমিউন্যাল অ্যাওয়ার্ড তথা পৃথক ইলেকটোরেট দলিতদের (Depressed Class) দাবীমত ঘোষণা করা হয়েছে, অতএব দলিতরা তাঁদের দাবী থেকে সরে না এলে সরকারের কিছু করার নেই। সরকারী এই ঘোষণা শুনে কংগ্রেসের বর্ণহিন্দু ও দক্ষিনপন্থী নেতারা আম্বেদকরের ওপর চাপ তৈরী করেন পৃথক ইলেকটোরেটের দাবী থেকে সরে আসার জন্য। স্যার তেজবাহাদুর সপ্রু একটি মীমাংসাপ্রস্তাব আনেন- দলিতদের আলাদা কোনো ইলেকটোরেট থাকবে না, সকল হিন্দুর জন্য একটি জয়েন্ট ইলেকটোরেটই বহাল থাকবে, কিন্তু তার মধ্যে দলিতদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন বরাদ্দ থাকবে। আম্বেদকর নিমরাজি হয়ে যান গান্ধীর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে। এর পর প্রশ্ন ওঠে কতদিনের জন্য এই ব্যবস্থা বহাল থাকবে তাই নিয়ে।আম্বেদকর দাবী করেন যে অন্ততঃ ১৫ বছরের জন্য এই ব্যবস্থা বহাল থাকুক; ১৫ বছর বাদে একটি গণভোট করে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হোক। গান্ধী ১৫ বছরের বদলে ৫ বছর-এ রাজী হয়ে যেতে বলেন আম্বেদকরকে। গান্ধী এ-ও বলেন যে তিনি স্বীকার করেন আম্বেদকরের যুক্তি অকাট্য। কিন্তু বর্ণহিন্দুদের মনপরিবর্তনের জন্য ৫ বছরই যথেষ্ট বলে তাঁর মনে হয়। তার বেশী সময় যদি আম্বেদকর দাবী করেন তাহলে তাঁর(গান্ধীর) মনে হবে যে আম্বেদকর বর্ণহিন্দুদের উদ্দেশ্য ও সততা সম্বন্ধে সন্দিহান ও আসলে চান দলিতদের সংগঠিত করে গণভোটের রায়কে প্রভাবিত করতে। আম্বেদকর দর কষাকষি করে ১০ বছরের দাবী জানালে গান্ধি তাঁর শেষকথা শুনিয়ে দেন-'৫ বছর অথবা আমার মৃত্যু। বেছে নিন।' (5) । সাক্ষাৎকারটি সেখানেই শেষ হয়ে যায়। আম্বেদকর চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ভগ্নমনোরথ হয়ে ফিরে আসেন।

    ডঃ শর্মা বলেছেন রাজনৈতিক পদ্ধতি হিসেবে অনশন কেবল সহানুভূতিশীল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই সফল হতে পারে। মহম্মদ আলি জিন্নার মত আপোষহীন গান্ধীবিরোধীর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দিতায় গান্ধী কখনো অনশনের পথে হাঁটেন নি। পুনা চুক্তি নিয়ে অনশনের ক্ষেত্রে আম্বেদকরের জায়গায় যদি জিন্না থাকতেন , তাহলে ফল সম্পূর্ন উল্টোও হতে পারতো। (6)

    Notes
    1.MKG to Linlithgow, 31st December, 1942, The National Archives, London.
    2.Azad, p.94.
    3.Linlithgow to MKG , 5th February,The National Archives, London.
    4.Jai Narain Sharma,Rediscovering Gandhi, Concept Publishing Company, 2007, Vol. 3, p. 99.
    5.Ibid, p.94
    6.Ibid, p.98
  • I | 7845.15.011223.145 | ২১ অক্টোবর ২০১৮ ২৩:২১370812
  • আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এবারে কিন্তু লিনলিথগো গান্ধীকে এক ইঞ্চিও জমি ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। সরকার ধরেই নিয়েছিল, গান্ধীর যা বয়স আর স্বাস্থ্যের যা অবস্থা, তাতে ২১ দিন অনশন করা মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু। কিন্তু সরকার সেই সম্ভাবনায় বিচলিত হয় নি। ঠিক করা হয়েছিল গান্ধীর কোনো দাবীই মেনে নেওয়া হবে না। "আমার নিজস্ব মতামত সম্পূর্ণ পরিষ্কার। গান্ধী যদি অনশন করে মরতে চান তাহলে তাঁকে মরতে দেওয়া হোক"- আমেরি-কে লিখেছেন লিনলিথগো। (1)

    প্রশাসন গান্ধীর সম্ভাব্য মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে থাকে। দাহকার্যের জন্য চন্দনকাঠও এনে রাখা হয়। ঠিক হয়, আগা খাঁ প্যালেসেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে ও চিতাভষ্ম ছেলেদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।(2)। চার্চিল লিনলিথগোকে চিঠি লিখে জানতে চান-"আমি শুনেছি গান্ধী ওর অনশনের ধোঁকাবাজির সময় খাবার জলে গ্লুকোজ মিশিয়ে নেয়। সেটা সত্যি কিনা খতিয়ে দেখা যাবে কি?" (3)

    ১৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে গান্ধীর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি শুরু হয়। চিন্তিত রুজভেল্ট ( ''সম্ভবতঃ মাদাম চিয়াং কাই শেক ও শ্রীমতি রুজভেল্টের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে''- লিখেছেন ভারতসচিব লিও আমেরি ) লিনলিথগো'র কাছে তাঁর বিশেষ দূত পাঠান বড়লাটকে বুঝিয়েসুঝিয়ে গান্ধীকে মুক্ত করতে। লিনলিথগো রুজভেল্টের দূতের সঙ্গে দেখা করতেই অস্বীকার করেন; বলেন মার্কিন- হস্তক্ষেপের ফল হবে 'disastrous।' (4)

    ২১শে ফেব্রুয়ারি রাতে গান্ধীর খিঁচুনি শুরু হয়। ৯ জন ডাক্তারের প্যানেল ঘোষণা করে, গান্ধীর ইউরেমিয়া এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে অবিলম্বে অনশন প্রত্যাহার না করলে তাঁর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে। জেনারেল স্মাটস চার্চিলকে একটি ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়ে অনুরোধ করেন- গান্ধীর মৃত্যু এড়ানোর জন্য সবরকম চেষ্টা করা উচিৎ। দরকার হলে ওঁকে জোর করে খাওয়ানো হোক বা ইঞ্জেকশন দেওয়া হোক। নিরুদ্বিগ্ন চার্চিল উত্তর দেন-" আমার মনে হয় না গান্ধীর মরবার সামান্যতম ইচ্ছে আছে।সম্ভবতঃ গত এক সপ্তাহে ও আমার চেয়েও ভালো খাবারদাবার খেয়েছে।"

    ডাঃ বিধান রায় গান্ধীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে তাঁর দেখাশোনা করবার জন্য সরকারের কাছে চিঠি লেখেন। সরকার সে আবেদন মঞ্জুর করে। একটা সময় অবস্থা এতটাই সংকটজনক হয়ে পড়ে যে, সরকার গান্ধীমৃত্যুর ঘোষণা ভারতবাসীর কাছে প্রচার করবার জন্য বিশেষ বুলেটিন বানানোর কাজ শুরু করে। কিন্তু অতিমানবিক ইচ্ছাশক্তির জোরে গান্ধী এবারের ফাঁড়া কাটিয়ে উঠলেন। ২১ দিন পরে তিনি তাঁর অনশন ভঙ্গ করেন।

    গান্ধীর জন্য অবশ্য আরো আঘাত অপেক্ষা করছিল। ডিসেম্বর মাসে কস্তুরবা নিউমোনিয়ায় মরনাপন্ন হয়ে পড়েন। গান্ধীকে জেল থেকে সাময়িকভাবে ছাড়া হয় মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রী-র পাশে থাকবার জন্য। অনেকদিন ধরে ভুগে, অনেক কষ্ট পেয়ে অবশেষে ২২শে ফেব্রুয়ারি কস্তুরবা মারা যান। দাহকাজ শেষ হলে গান্ধী জেলখানায় ফিরে যান। মীরা বেন সেই রাস্তায় গান্ধীর সঙ্গে ছিলেন।সেই প্রথম তিনি গান্ধীকে কাঁদতে দেখেন।

    তার অনেক আগেই গান্ধীর প্রিয় সচিব মহাদেব দেশাই আগা খাঁ প্যালেসে গান্ধীর চোখের সামনেই হৃদরোগে মারা গিয়েছেন।

    ১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাসে জেলখানায় মৌলানা আজাদের কাছে একটি টেলিগ্রাম এসে পৌঁছয়। তাতে তাঁর স্ত্রী-র মৃত্যুসংবাদ ছিল। আজাদ স্ত্রী-র শেষকৃত্য করবার জন্য বড়লাটের কাছে সাময়িক মুক্তির আবেদন জানান। বড়লাট তার কোনো উত্তর দেন না। এর তিনমাস পরে আজাদের বোন মারা যান।

    স্বাধীনতার পথ ছেয়ে যায় প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের বেদনায়। যদিও আরো অনেক মৃত্যু, হিংসা, দাঙ্গা-দেশভাগ তাঁদের পথ চেয়ে বসেছিল। সমষ্টির যে বেদনার কাছে নিজের ব্যক্তিগত ব্যথা তুচ্ছ হয়ে যায়।

    Notes
    1. Linlithgow to Amery, 8 Feb 1943,The National Archives, London.
    2. Ajad, p.94
    3. Churchill to Linlithgow, 11 Feb, 1943,The National Archives
    4. Linlithgow to William Phillips, 19 Feb, 1943
  • সিকি | 894512.168.0145.123 | ২২ অক্টোবর ২০১৮ ০৯:৩৬370813
  • ইন্দো,

    পড়ছি। একটা রিকো আছে। সর্দার বল্লভভাই পটেল লোকটির ওপর কি একটু আলাদা করে আলো ফেলতে পারবে? পাসিং রেফারেন্স পড়েছিলাম কোথাও একটা যে, পটেল হিন্দু মহাসভা তথা আরএসএসের ওপর যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন। মূলত তাঁর সহানুভূতির কারণেই সাভারকরের ট্রায়াল খুব ভালোভাবে সম্পন্ন হয় নি এবং সহজেই গান্ধীহত্যা ষড়যন্ত্রের আরোপ থেকে সাভারকর মুক্তি পেয়ে যান বেকসুর।

    পরবর্তীতে পটেল দিল্লিতে আরএসএসের শোভাযাত্রায় প্রথান অতিথিও হয়েছিলেন বলে পড়েছিলাম। লিঙ্ক দিতে পারব না - তুমি একটু সাহায্য করবে?
  • I | 7845.15.451223.183 | ২২ অক্টোবর ২০১৮ ১০:২৯370814
  • হ্যাঁ সেসব কথায় পরে আসবো। প্যাটেলকে নিয়ে অনেক কিছু লেখার আছে।
  • Du | 7845.184.2345.14 | ২৪ অক্টোবর ২০১৮ ০৫:৩৪370816
  • লেখাটা চুম্বকের মতো হচ্ছে। অসম্ভব ভালো।
  • I | 785612.40.90034.186 | ২৪ অক্টোবর ২০১৮ ১০:৪৮370817
  • ধন্যবাদ, দু দি।
  • de | 90056.185.673423.53 | ২৪ অক্টোবর ২০১৮ ১৫:০৮370818
  • অসামান্য লেখা - এ লেখা বই হয়ে যেন অবশ্যই বের হয় - আমি দত্তক নেবো - আগেভাগেই বলে দিলাম -
  • দু | 237812.58.560112.134 | ২৪ অক্টোবর ২০১৮ ২০:০৩370819
  • আমিও আছি।
  • I | 785612.40.5656.86 | ২৫ অক্টোবর ২০১৮ ২৩:৫৩370820
  • জওহরলাল নেহরু ফজলুল হকের পলিটিক্যাল সেক্রেটারি ছিলেন ১৯১৮ থেকে ১৯১৯।জানতেন? আমি তো জানতাম না!
  • I | 785612.40.9001212.179 | ২৭ অক্টোবর ২০১৮ ২৩:৪৮370821
  • আগের লেখায় একটা ভুল তথ্য দিয়েছি। শুধরে নিচ্ছি। কস্তুরবা তাঁর স্বামী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে আগা খাঁ প্যালেসেই বন্দী ছিলেন। বন্দী থাকা অবস্থাতেই তাঁর নিউমোনিয়া হয় ডিসেম্বরে। ফেব্রুয়ারিতে তাঁর মৃত্যুও হয় ঐ আগা খাঁ প্যালেসে। কাজেই গান্ধীকে জেল থেকে ছাড়া হয় স্ত্রী-র পাশে থাকার জন্য-এই তথ্যটি ডাহা ভুল। গান্ধী কস্তুরবার অসুস্থতার গোটা সময় জুড়ে তাঁর পাশেই ছিলেন। তাঁকে সাময়িক্ভাবে ছাড়া হয়েছিল কস্তুরবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করবার জন্য।

    পরের লাইনটি অবশ্য সঠিক (অন্ততঃ মীরা বেন'এর বক্তব্য অনুযায়ী)। যে, মীরা বেন সেই প্রথম গান্ধীকে কাঁদতে দেখেন।

    যেটুকু জুড়বার, তার সঙ্গে এই লেখার মূল ধারার কোনো যোগ অবশ্য নেই। গান্ধী কস্তুরবার চিকিৎসার জন্য একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক নিয়োগ করবার দাবী জানিয়েছিলেন; বেশ দেরী করেই সরকার একজন কবিরাজকে নিয়োগ করে( এই বিলম্ব, গান্ধীর মতে ছিল, অযৌক্তিক)। মৃত্যুর দিন সকালে কনিষ্ঠ পুত্র দেবদাস মায়ের জন্য কলকাতা থেকে পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন নিয়ে এসে পৌঁছেছিলেন; কিন্তু গান্ধীর বিরুদ্ধতায় তাঁকে সেই ইঞ্জেকশন দিতে দেওয়া হয় নি।
  • S | 90067.146.9004512.46 | ২৭ অক্টোবর ২০১৮ ২৩:৫৭370822
  • পোথোম পব্বের লিন্ক কোথায়?
  • S | 90067.146.9004512.46 | ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০০:২৭370824
  • ধন্যযোগ।
  • I | 785612.40.9001212.179 | ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০২:৩৮370825
  • 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের মেয়াদ ফুরিয়ে এল '৪২ এর শেষদিকে। ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে আর কোনো বড়মাপের আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হয় নি ব্রিটিশ ভারত সরকারকে। হলে অবশ্য ব্রিটিশ সরকার তা সামলাতে পারতো কিনা তা লাখ টাকার প্রশ্ন। অত্যন্ত নির্মমভাবে অগাস্ট আন্দোলন দমন করা হয়েছিল। সাময়িকভাবে জাতীয় আন্দোলন হেরে গিয়েছিল বটে, কিন্তু লম্বা দৌড়ে এর ফল ব্রিটিশের পক্ষেও খুব আশাব্যঞ্জক হয় নি। যুদ্ধের শেষে ব্রিটেন বিজয়ী হয়ে বেরিয়ে এল ঠিকই, কিন্তু যে সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না, সেই মহামহিম 'এম্পায়ার' তখন তার অতীতের ছায়া। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দুই মহাশক্তি-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। ব্রিটেন সেখানে অনেক পিছিয়ে থাকা তিন নম্বর শক্তি।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তখন তার প্রবল ঋণের বোঝা। সেই প্রথমবারের জন্য ভারতবর্ষও ব্রিটেনের ঋণগ্রহীতা থেকে ঋণদাতার তালিকায় উঠে এসেছে। '৪৩-এর এপ্রিল নাগাদ যুদ্ধবাবদ ভারতের কাছে ব্রিটেনের ঋণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ কোটি পাউন্ড স্টার্লিং আর ঋণের বোঝা বাড়ছে তো বাড়ছেই; এর আর কোনো শেষ দেখা যাচ্ছে না ('৪৫ সাল নাগাদ এই পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ১০০ কোটি পাউন্ডে)। ১৯৪৪ সালে অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস ভারতের ঋণ শোধ করবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ধার অথবা 'উপহার' নেওয়ার কথা ভাবছেন। ব্রিটিশ প্রশাসনের অনেকেই অব্শ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্রিটেনের অভ্যন্তরীন বিষয়ে নাক গলাতে দিতে চান না; তার চেয়ে বরং ভারতকে এককালীন কিছু থোক টাকা ধরে দিতে তাঁদের আপত্তি নেই। (1)

    এহেন দুর্বল অর্থনীতি নিয়ে ভারতশাসন তখন ব্রিটেনের কাছে সহায়্সম্বলহীন জমিদারের হাতিপোষার অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত তখন শোষিত হতে হতে ছিবড়েতে পরিণত; লাভের গুড় সব শেষ। উল্টে এই বিশাল উপমহাদেশের প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না। এই অবস্থায় আবার একটি বিদ্রোহ দমনের ঝুঁকি ব্রিটেনের পক্ষে নেওয়া সম্ভব ছিল না। বজ্রমুষ্টিতে শাসন চালানোর দিন শেষ-এবার প্রয়োজন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনোভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে মানে মানে ঘরে ফিরে যাওয়া। ১৯৪৩-এর গ্রীষ্মে লিনলিথগো ভাইসরয়ের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করলেন। যাবার আগের বছরই মার্কিন সাংবাদিক লুই ফিশারের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন-"আমরা আর খুব বেশীদিন ভারতে থাকছি না। কংগ্রেস অবশ্য একথা বিশ্বাস করে না।কিন্তু আমাদের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। আমরা ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছি।"(2)

    পরবর্তী ভাইসরয় হয়ে এলেন ভারতের সেনাপ্রধান লর্ড ওয়াভেল; এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন স্যার ক্লড অকিনলেক। ওয়াভেল কোনোদিক থেকেই অতি উদারপন্থী ছিলেন। কিন্তু তখন সময় অন্য, চোখ রাঙানীর দিন শেষ, এবার আলোচনার টেবিলে বসবার পালা। ওয়াভেল চার্চিলকে লিখলেন ঃ যুদ্ধের পরে সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক জনমত ,ব্রিটিশ জনসাধারণ এবং সেনাবাহিনীরও যা মনোভাব হবে, তাতে গায়ের জোরে ভারতকে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। 'এই ধরণের বিদ্রোহী, যেমন ডি ভ্যালেরা, জগলুল (পাশা), এদের সঙ্গে আগেও আমাদের আলাপ -আলোচনা করতে হয়েছে' আর বাস্তবিকই এখনই আলোচনা শুরু করে দেওয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ যুদ্ধ শেষ হলেই বন্দীরা মুক্তি পাবে এবং সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া ও বেকারির ফলে আসবে অশান্তি, আর তাতেই তৈরী হবে 'বিক্ষোভ দেখানোর এক উর্বর ক্ষেত্র, যদি না তার আগেই আমরা কংগ্রেসের শক্তিকে ঘুরিয়ে দিতে পারি আরো লাভজনক কোনো খাতে, যেমন ভারতের প্রশাসনিক সমস্যা সংক্রান্ত কাজকর্ম বা সাংবিধানিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টায়'। (3)

    বস্তুতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়ের পেছনে ভারতীয় সৈনিকদের অবদান ছিল বিশাল (যদিও পশ্চিমী ইতিহাস সেকথা সুবিধেমত ভুলে গিয়েছে)। আড়াই লাখ সৈন্যের এই বিশাল বাহিনী ( দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বৃহত্তম বাহিনী এবং মানবসভ্যতার ইতিহাসে বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী) মিত্রশক্তির হয়ে যুদ্ধে লড়েছে উত্তর ও পূর্ব আফ্রিকার মিশর, তিউনিসিয়া,আলজেরিয়া, ইথিওপিয়ায়,লড়েছে ইউরোপীয় রণাঙ্গনে ফ্রান্স-গ্রিস-ইতালিতে; এবং সবচেয়ে বেশী লড়েছে পূর্ব রণাঙ্গনে মালয়-বোর্ণিও-সিঙ্গাপুর-হংকং ও বার্মায়। ৮৭ হাজারের মত সৈনিক (কোনো কোনো হিসাবে ৮৯ হাজার) মারা গেছেন, আহত হয়েছেন ৩৪ হাজারেরও বেশী, এবং যুদ্ধবন্দী হয়েছেন আরো ৬৭ হাজার।(4) যুদ্ধে ব্রিটেনকে ভারতের দেওয়া যুদ্ধসামগ্রী- রসদের আর্থিক মূল্য অর্থনীতিবিদরা তাও হিসেব করে উঠতে পারেন, কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ সৈনিকের ত্যাগের মূল্য কিভাবে হিসেব করা সম্ভব জানি না।

    চার্চিল অবশ্য ছিলেন অনমনীয়; পরিস্থিতির গুরুত্ব তিনি বুঝতেন না, এমনটা নিশ্চয় নয়, কিন্তু 'এম্পায়ার' নিয়ে এক প্রাচীন, অন্ধ মোহ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এটা অনস্বীকার্য। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করুন-"I have not become the King's First Minister in order to preside over the liquidation of the British Empire." (5) অবশ্য চার্চিলের দিন ফুরিয়ে আসছিল। বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটেনে ভারতবর্ষের অধিকার নিয়ে চার্চিলের অবাস্তব আবেগের সমর্থক খুব একটা কেউ ছিলেন না-না ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ-প্রশাসকরা, না সাধারন ব্রিটিশ জনগণ । চার্চিল ক্রমেই একা হয়ে পড়ছিলেন। আর ১৯৪৫ সালের নির্বাচনে তো তিনি ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেলেন।

    Notes
    1.Tunzelmann, p.122 (Robert Skidelsky, John Maynard Keynes: Fighting for the Britain, 1937-1946, Macmillan, London, 2000, pp.341-2, 379-84

    2.Ibid (Fischer, Life of Mahtma Gandhi, p. 394

    3.সুমিত সরকার, পৃ ৩৪৮ (Wavell, The Viceroy's Journal, Oxford, 1973, pp.97-8)

    4.https://en.wikipedia.org/wiki/Indian_Army_during_World_War_II (https://issuu.com/wargravescommission/docs/ar_2014-2015?e=4065448/31764375)

    5.https://www.telegraph.co.uk/culture/books/non_fictionreviews/3667997/How-victory-spelt-the-end-of-empire.html
  • amit | 340123.0.34.2 | ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০৪:৩৩370827
  • যথারীতি দারুন।

    একটা প্রশ্ন আছে, ভারত তো তখনো ব্রিটিশ এম্পায়ার এর অংশ, তাহলে এই ১০০ কোটি পাউন্ড এর ধার কিভাবে হিসেবে করা হয়েছিল - ? মানে ভারতে কি তখন আলাদা করে বাজেট করা হতো ? না কি ফেডারেল বুজতে একটা পার্ট ইন্ডিয়ার জন্য ধরা হতো ? আমি ইকোনমিক্স একেবারেই বুঝি না, বোঝার চেষ্টা করছি আজকে ভারতে কেন্দ্র সরকার আর রাজ্য সরকারের মধ্যে যে ভাবে দু লেভেল এ বাজেটিং করা হয়, আরো বড়ো স্কেল এ ইংল্যান্ড আর ভারতের মধ্যেও কি সেভাবে করা হতো ? নাকি আলাদা ?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন