আমি গেলেই ডাকতেন, ও খোকা, মিত্তিরবাবুর বাড়ির ছেলে না ? হ্যাঁ, বলতে তাঁর একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে আসত আমার দিকে। “ভাত খেয়েচ? কী দিয়ে ভাত খেলে ? মাছ খেইলে ? কী মাছ। মাছের কালিয়ায় কি ফুলকপি ছিল। টমটমের চাটনি ছিল কি ? ক্ষীর খেয়েচ কাঁটাল দিয়ে। মাংস কবে খেয়েচ খোকা…” এখন বুঝতে পারি ক্ষুধার্ত মানুষের জিজ্ঞাসা ওসব। গরিব কাহার পাড়ার মানুষের না ছিল জমি, না ছিল কাজ। অন্ন সংস্থান হবে কী করে ? ভোটো কাহার রিকশা করেছিল, তা তার নিজের না অন্য কারোর টাকায় কেনা তা জানতাম না। গ্রামের বাঁড়ুজ্যে বামুনের সঙ্গে ভোটো কাওরার খুব বিবাদ ছিল। রিকশায় চেপে তিনি এক টাকা ভাড়া হলে আট আনা দিতেন। আট আনা বাকি থাকল। বাকিটা শোধ দিতেন না। বাঁড়ুজ্জ্যে মশায়ের ছেলেদের নাম ছিল, ধরুন, অমলকিশোর, বিমলকিশোর, কমলকিশোর, কুনালকিশোর...। ভোটো কাহার কী করল, তার ছেলেদের নাম সব বদলে অমলকিশোর, বিমলকিশোর...। করে দিল। সেই নামে ডাকা শুরু করল। বাঁড়ুজ্জ্যে মশায় রেগে কাঁই। একদিন বেজায় খাপ্পা হয়ে রাস্তায় ঝগড়া, তাঁর ছেলের নামে নিজের ছেলের নাম রেখেছে কেন ভোটো ? ভোটো উদাসীন হয়ে জবাব দিয়েছিল, নাম কি কারোর নিজের সম্পত্তি। মেয়ের নামও বাঁড়ুজ্জ্যে মশায়ের মেয়ের নামে রেখেছিল, ছায়া, মায়া... ... ...
আজ এই হেমন্তের সন্ধ্যায় হাসপাতালের সামনের ফুটপাথে সেই কুয়াশা তাকে আবার ঘিরে ধরেছিল- যে কুয়াশা তাকে এই ক'বছরে বারে বারে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে তার শৈশবে আর সে কখনও মা, কখনও বাবা , কখ্নও জেম্মার সঙ্গে কথা বলেছে ফোনে। আজ সে' উপায় ছিল না- তার শৈশবের শেষ যোগসূত্র এই হাসপাতালের চারতলার ঘরে নাকে মুখে নল নিয়ে শুয়ে ছিল তখন। হাসপাতালের কাচ দরজা খুলছিল, বন্ধ হচ্ছিল। নীল আলো জ্বালিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এসে থামছিল পরপর। হিম নামছিল ফুটপাথে। সেই হিমের সঙ্গে হাসপাতালের চারতলা থেকে কুয়াশার মত মৃত্যুর ছায়া এসে মিশছিল যেন। ... ...
তার দৌড় ছিল খিদিরপুরের জাহাজঘাটা অবধি। একটা বড় বাক্স ভরে গেলেই একদিন নৌকায় করে হুগলি নদী পেরিয়ে পৌঁছে যাও কলিঙ্গা বাজার। খিদিরপুর। কলিন লেন, টার লেনে জাহাজে মাল চড়ানোর জন্য বসে আছে চিকনদারি কাজের ব্যবসাদার। মাল পাঠাবে নিউ অরলিন, চার্লেস্তান, সাভানা আর কীসব খটমটো নামের সব জায়গায়। আলেফ সেসব হদিশ জানত না তখন। কে বিক্রি করে কাকে তাও না। আলেফের চাচা মোকসাদ আলি আগে এই কাজ করত, তারপরে চলে গেল ওই দেশে। তার কাছেই শুনেছে সে নাকি বসেছে এখন নিউ ইয়র্কের ডকে। মাল পৌঁছালে চলে যায় তার কাছে কি তার মত আরও সব লোকজন যে যেখানে আছে। চাচা যে এরপর তাকেও সঙ্গে নিতে চাইবে তখনো খবর ছিল না আলেফের। ... ...
১৯৯৭/৯৮ সালে ব্যাঙ্ক অফ রাশিয়া (আমাদের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক) ডলার আর রুবলের বিনিময় মূল্যের একটি মান বেঁধে দিয়েছিল। এক ডলারের দাম ৫ আর ৭ রুবলের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে পারে। যদি রুবলের দাম কমে, বাজার থেকে ডলার কিনে ব্যাঙ্ক অফ রাশিয়া রুবলকে চাঙ্গা করবে। আর যদি রুবল শক্তিশালী হয়ে এক ডলারের বদলে ৫ নয়, ৪ রুবলের দিকে চলে যায়, বাজারে ডলার বিক্রি করে ব্যাঙ্ক রুবলের ভাও আবার পাঁচে নিয়ে আসবে। এর কেতাবি নাম ভাসমান গাঁটছড়া (ফ্লোটিং পেগ) বা ম্যানেজড পেগ। এই ভাবে রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রুবলের মূল্যরক্ষার শপথ নিলো। কাগজ-কলমে এই পদ্ধতি আগ মার্কা শুদ্ধ। কিন্তু এটির শক্তি নির্ধারিত হয় যেকোনো দেশের ডলারের ভাঁড়ারে সঞ্চিত ধন (ডলার) এবং দেয় সুদের হার অনুযায়ী। মাত্র ছ’ বছর আগে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড এইরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করে পাউন্ডের দাম ধরে রাখতে সম্যক ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁদের প্রতিরক্ষা প্রয়াস একদিনেই বিধ্বস্ত হয় – কালো বুধবার ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯২। এই জুয়োয় দান দিয়ে জর্জ সোরোস একদিনে এক বিলিয়ন ডলার লাভ করেন। ... ...
গল্পটা একজন উজ্জ্বল যুবকের, অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে যিনি কানপুর আই আই টি-র মত প্রথম সারির একটা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে পেরেছিলেন। কিন্তু গল্পটা শুধু তাঁর সাফল্যের নয়, চাকরী পাবার পর সহকর্মীদের তরফ থেকে তিনি যে অহেতুক শত্রুতার শিকার হয়েছিলেন, আর যেরকম শান্তভাবে অথচ দৃষ্টান্তমূলক দৃঢ়তার সঙ্গে তার মোকাবিলা করেছিলেন এটা আসলে সেই গল্প। মানুষের চরিত্র ও নীতিবোধ যে কতখানি ভঙ্গুর হতে পারে, পরশ্রীকাতরতা যে মানুষের নিজস্ব আচরণ কিভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে সেটা চাক্ষুষ করার জন্যও গল্পটা সকলের জানা দরকার। ... ...
বিদুর বালকের চোখে দেখলেন এক ঝলসানো ক্রোধ! অর্জুন সোজা তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। রেখাটা গাঢ় হল মাত্র। বিভাজন ঠেকানো সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। কৌরব বংশ একত্রিত হলে যা হতে পারতো তা শুধু কষ্টকল্পনা এখন থেকে। ওই বালকের ক্রোধ বলে দিচ্ছে গৃহযুদ্ধের দামামা বেজে গেল। এখন এই বালককে আপ্তবাক্য শুনিয়ে লাভ কি? অথচ তিনি বিদুর। দুর্যোধন তাঁরও ভ্রাতুষ্পুত্র, ঠিক এঁদেরই মতন। মহারাজ পাণ্ডু আর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বিবাদেও তিনি কিন্তু পক্ষ নেননি কোনো। শুধু পাণ্ডবদের ন্যায্য অধিকারের জন্যই কুরুসভায় দাঁড়িয়েছিলেন। তাহলে এখন তাঁকেও কি পক্ষ নিতেই হবে? গাঙ্গেয়র মতন তিনি যে এড়িয়ে যেতে পারছেন না। গাঙ্গেয় তাঁর মতন সম্পর্কের, মোহের অথবা প্রেমের বাঁধনে যে বাঁধা নেই। তিনি, ধর্মবেত্তা বিদুর যে প্রথম প্রেমের কাছে সদা সমর্পিত, তাঁর কী হবে? ... ...
ভ্যাকসিন নিয়ে সবার মধ্যে এতো ভয়, অথচ করোনা নিয়ে কারও মন কোনো ভয় আছে বলে মনে হচ্ছে না। সব দলই ভোটের আগে জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ইশতেহারে দারুণ দারুণ কথা লিখেছেন। কিন্তু সেসব দলের মিছিল, জনসভা দেখলেই টের পাওয়া যায়, ওই কথা গুলি কেবল কথার কথা। নিশ্চিতভাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যখন বাংলায় ঢুকে পড়েছে, তখনও তারা জনসভায়, মিছিলে ভিড় বাড়াতে ব্যস্ত। যেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্কের ব্যাবহার ইত্যাদির কোনো অস্তিত্ব নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে নীতি- আদর্শগত নানা রকম পার্থক্য আছে, কিন্তু এই একটা ব্যাপারে তারা মোটামুটি একই রাস্তায় হাঁটছে। ... ...
আমি গেছি দূর মফঃস্বলে চাকরি করতে। তখন যা দিন, মোবাইল ফোন কেন সেই মফঃস্বলে ইলেকট্রিকের আলো ছিল না, পোস্ট অফিস ছিল না। চিঠি ফেলতে ভিন গাঁয়ে যেতে হত। চিঠি দিলে একমাস আগে কলকাতা পৌঁছত না। বাস থেকে নেমে এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটতে হত অফিস মানে হল্কা ক্যাম্পে পৌঁছতে, এমনই সে জায়গা। ছোটনাগপুরের মালভূমির লেজা সেই অঞ্চল। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের একটি কন্যা। বয়স তার আড়াই তিন। সে তার ঠাকমাকে বলল, ছেলেধরা নিয়ে গেছে বাবুজিকাকাকে। হারিয়ে গেছে, আর ফিরবে না। শিশু যা শোনে তাই বলে। তাকে যা বলে ভয় দেখান হয়, সেও তাই বলে ভয় দেখায় ঠাকমাকে। মা তখন পিতামহী। মায়ের ঘুম আসে না। ছুটিতে বাড়ি এলে জিজ্ঞেস করে মা রাধারানি, কী খাই, কেমন জায়গা। ডাল আলু সেদ্ধ আর কুঁদরি পোস্ত ? মাছ হয় না? মাংস ? সকাল বিকেল মুড়ি, কেন পরোটা লুচি করে দিতে পারে না ? জানেই না মা ওসব। আমাদের দেশটা আসলে খুব গরিব। গ্রামটা আরো গরিব। শুনতে শুনতে মা চুপ। বুঝতে চাইছিলেন দেশটাকে আমার চোখ দিয়ে। ধরা গলায় বললেন, তুই বরং চাকরি ছেড়ে দিয়ে আয়, অন্য কিছু দেখ। না, চাকরি আমার কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে, দেশটাকে আমি চিনতে পারছি দিনে দিনে। মা চুপ করে থাকলেন, অবশেষে বললেন, দেশ সব জায়গা থেকে চেনা যায়। জমি মাটি মানুষ না চিনলে বড় হওয়া যায় না। মা বলল, বড় হবি তুই ? কী করে, প্রমোশন কবে হবে ? প্রমোশন না মা, লিখতে চাই, গল্প লিখছি, শুনবে? আমি কী বুঝব, কিন্তু তুই যদি নিজে বুঝিস হচ্ছে, তবে ছাড়বিনে, ধরে রাখবি, ছাড়বিনে একদম। মন্ত্র পেয়ে গিয়েছিলাম। ... ...
আমি গিয়ে ভাব করি ইনশাস রাইফেল নিয়ে ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছত্তিশগড় আর্মড পুলিশের দুই জোয়ানের সঙ্গে। একজন চেয়ে নেয় সাক্ষরতার একটি ম্যাগাজিন। বলে -- আমি উত্তরপ্রদেশের গ্র্যাজুয়েট। বই পড়তে ভালবাসি, এখানে কিছু পাইনে। রোদ্দূর চড়ছে। আমরা দুজন হ্যান্ডপাম্প থেকে জল খেতে একে অন্যের সাহায্য করি, জানতে পারি সকাল থেকে ওর পেটে কিছু পড়েনি। ভোর ছ'টার থেকে ডিউটি লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই দুপুরে লাঞ্চের সময় কিছু জুটবে। জিগাই-- রাত্তিরে মশারি? জঙ্গলে ওডোমস? -- ওসব সি আর পি'র জোয়ানরা পায়, হাজার হোক কেন্দ্রীয় সরকারের সেপাই। আমাদের কে পোঁছে? ইতিমধ্যে সর্দারজী টাটা সাফারিতে চড়ছেন দেখে সরকারি ছোট আমলাদের মধ্যে টেবিলে সাজানো কাজু-কিসমিস- বিস্কুট-কলা-আঙুর খাবলে নিয়ে পকেটে পোরার অশ্লীল প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। দেখতে দেখতে টেবিল সাফ। আমার পকেটে কিছু বিস্কুট, আর কিসমিস। তার থেকে গুনে ক'টি দেই ওই ছয়ফুটিয়া সেপাইকে, ও হেসে ধন্যবাদ দেয়। সলওয়া জুড়ুম শিবিরের জনতাকে মন দিয়ে দেখেছি। মনে হয় ওদের আজ গাঁয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেও ফিরে যাবে না। মানুষ অভ্যাসের দাস। সেই খাঁচার পাখি, বনের পাখি গল্প। -- এই মালী, চৌকিদার, রাঁধুনি, এস পি ও (স্পেশাল পোলিস ফোর্স)। -- আমাদের সাক্ষরতা অভিযানের উদ্দেশ্য সরকারি চাকরি পাইয়ে দেয়ার চেয়েও পেশাগত দক্ষতা হাসিল করে সেল্ফ এমপ্লয়মেন্টের দিকে যাওয়া। আর শিক্ষিত কে? যে লোকটি এম বি এ করে দিল্লিতে মাল্টিন্যাশনালে চাকরি করে রাত্তিরে মত্ত অবস্থায় বৌকে পেটায় সেই শিক্ষিত? ... ...
কতটা বিভক্ত এই দেশ? তেল আভিভ হতে ডেড সী যাবার মোটরওয়েতে বারবার চোখে পড়বে বড়ো অক্ষরে লেখা A B C : এটি কোন বর্ণ পরিচয়ের পাঠশালা নয়। এই অক্ষর মালা নির্দেশ করে কোন অঞ্চল কার তাঁবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার বহু বছর পরেও ব্রিটিশ ফরাসি আমেরিকা এই তিন মিত্র শক্তি শাসন করেছে পশ্চিম বার্লিন। আপনি হাঁটছেন, হঠাৎ দেখলেন একটা মানুষের সাইজে সাইনবোর্ড – তাতে লেখা ‘আপনি ফরাসি সেক্টর পরিত্যাগ করিলেন’। এবার আপনাকে আরেকটি সাইনবোর্ড আমেরিকান সেক্টরে আপনাকে স্বাগত জানায়। মিত্র শক্তির এই দফায় দফায় দেওয়া নোটিসে আপনার চলা ফেরার কোন অসুবিধে হতো না কারণ কেউ আপনার পাসপোর্ট ভিসা পরীক্ষা করতে চায় নি ( যদিও সে ক্ষমতা তাদের ছিল। এক সেক্টর ছেড়ে অন্য সেক্টরে প্রবেশ করলে কোন পরিবর্তন চোখে পড়ে না, কেবল পুলিশের, সৈন্যের পোশাকটা বদলে যায়। মুশকিল ছিল সোভিয়েত সেক্টর নিয়ে, সেখানে উঁচু দেওয়াল। ... ...
ঘাটের কিনারায় আস্তানা গাড়া হলো। একেবারে ফেলু মিত্তিরের কাশীবাসের মতই পরের দিন সকালেই আলাপ হয়ে গেল একজন অদ্ভুত লোকের সাথে। ভদ্রলোক বাঙালী, দক্ষিণ কলকাতায় বাড়ি, তন্ত্রসাধনা সম্পর্কিত বই লেখেন। বয়সে আমার থেকে কয়েক বছরের বড়, শিবপুর বা যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একদা বহুজাতিকে চাকরি করেছেন। এখন সেসবে মন নেই। সংসারী মানুষ, কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময় আজ হিমালয় তো কাল কাশী এইসব করেন। বললেন কয়েকটা বই বেরিয়েছে, ছদ্মনামে (আমি খুঁজে দেখেছি, ঐ নামে লেখক ও তন্ত্র ইত্যাদির বই আছে, তবে একই লোক নাও হতে পারে)। এরপর ভদ্রলোক আমায়, বললে বিশ্বাস করবেন না, ভোরবেলার স্নিগ্ধ রোদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে, কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গেলমেন্ট নিয়ে চাট্টি ভাট দিলেন। ... ...
জলে ঝাঁপাচ্ছে যে শিশুর দল, তাদের কেউ প্রশ্ন করে তার পরিচয় কী? সে বসনিয়াক না সার্ব না ক্রোয়াট? জিজ্ঞাসে কোনজন? পথের দু-পাশ সবুজে ভরে আছে। আকাশ কী উজ্জ্বল! বিশ বছর আগে এই রাস্তায় দেখা গেছে ট্যাঙ্কের সারি, জ্বলন্ত বাড়ির আড়ালে আড়ালে স্নাইপারের ছায়া, কখনো আকাশে সারবিয়ান বোমারু বিমান, কোনো বাড়ির উঠোনে বসে সেই বিমানের দিকে বন্দুক তাক করছে এক যুবক। সারি সারি দেহকে একই সঙ্গে গোর দেওয়া হচ্ছে, কোথাও ক্যাথলিক কোথাও অর্থোডক্স ক্রসের নিচে। দু-হাত দূরে মুসলিম মাজার। এই সেদিন। ... ...
হঠাৎ করেই একটা চিন্তা তার ভাল লাগাটাকে ঢেকে দিল৷ অর্ডারের চায়ের দামের ব্যাপারে এতক্ষণ খেয়ালই ছিল না তার৷ প্রয়োজনই মনে করেনি৷ সাধারণ চায়ের দাম বেশি না। তবে এমন চায়ের দাম নিশ্চয়ই বেশি হবে৷ সে ভাবল, ওয়েটারের গল্প ফ্রি, তবে অভিনেতাদেরকে অবশ্যই কিছু দেওয়ার কথা৷ কে আর বিনা পারিশ্রমিকে এখানে সময় নষ্ট করে বসে থাকবে! ... ...
ডামল মায়ের দিকে তাকিয়ে চোক নাচিয়ে মুচকি হেসে বলল, “আমার বাপ তোরে কোনদিন কয়েচিল, কোতা যায়, কী করে? শুধোলি কইত “আজকাজ”। আমারও সেই “আজকাজ”। তয় কোন আজা, কেমন আজা, তার আনি কে, সেটি বুলতে পারবনি। আমার বাপও ওই কাজই করত, সে কতা তুই, জানিস। তুই যে ওই ভুঁড়ো-শেয়াল নাদুটাকে ঢিট করেছিলি, সে কতাটা জেনেই বাপ আমার, তোকে-আমাকে ছেড়ে লিশ্চিন্তে বাইরে বাইরে কাজে ফিরতে পারত। তুই আমার বৌ হুলটার বুকেও অমন বল এনে দে দিকিন, মা”। “নে, নে আমারে আর বেশি ভালাই বুলোতি হবে নি। আজকাজ করিস না কি ছাইপাঁশ করিস, বুজি না বাপু। আজার সঙ্গের নোকেরাও দেকেচি – কেমন সোন্দর সাজপোশাক পরে, মাথায় পাগ বাঁধে, গলায় এতএত সোনার হার পরে। তোদের বাপ-ব্যাটার মতো অখদ্দ্যে চেহারার কাউকে কোনদিন দেকিনি”। ডামল অবাক হয়ে বলল, “তুই আবার আজা-আনিদের কবে চাক্ষুষ করলি, মা?” ... ...
ইন্দ্রনীলের স্কুলের বন্ধু গাই বিরনবাউম থাকতো ওয়েস্ট হ্যাম্পষ্টেডে। তাদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের অসম্ভব নৈকট্য গড়ে ওঠে। অনেক সাবাথের সন্ধ্যা কাটিয়েছি তাদের সঙ্গে। বাংলায় আমরা যাকে ভুরি ভোজ বলি সেটা শুক্রবার ইহুদি সাবাথের সান্ধ্য ভোজনের তুলনায় জলখাবার মাত্তর! গাইয়ের মা বিরশেবাকে বলতাম শনিবারের দিনটায় কাজ কর্ম কেন যে মোজেস বারণ করে গেছেন এবারে বুঝলাম। আগের দিনের সেই বৃহৎ ভোজন উৎসবের পরে শনিবার শরীরকে ব্যস্ত না করাই ভালো! ... ...
প্রথমত একটা কথা খুব পরিষ্কারভাবে জেনে রাখা দরকার যে বিভিন্ন অঞ্চলে চাষবাস নিয়ে যে কাজ হচ্ছে তার মধ্যে খুব নতুন কিছু নেই। একার্থে মূলত আমাদের কার্যপদ্ধতি, অতীতের নানা কৃষিজ্ঞানকে স্মরণ ও অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। আবার বর্তমান সময়ের নিরীখে যাকে বলে ইম্প্রোভাইজেশন, তা করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফসলচক্র নিয়ে ভাবনা ও পরীক্ষানিরীক্ষা৷ জলবায়ু পরিবর্তনকে মাথায় রেখে ফসল নির্বাচন, রোপণের সময় পরিবর্তন করা, যে অঞ্চলে এই অনুশীলন হারিয়ে গেছে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। আবার পুরানো অভিজ্ঞানের অনুশীলনের সঙ্গে প্রয়োজনমতো বর্তমানের কিছু প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা। তবে "খুব নতুন কিছু নেই" বলে দিলে মনে হতে পারে "তাহলে এ আর এমন কী?" ... ...
ছাত্র ফেডারেশনের হয়ে সদস্য করতে বা ক্লাস ডায়াসিংয়ে গেলে গভীর চোখে তাকাত শোভা। ২৫ পয়সা দিয়ে এসএফআই-য়ের সদস্য পদ নিয়েছিল সবার আগে। সে সময় ২৫ পয়সা অনেক। তিনটে চপ বা পাঁচটা আইসক্রিম হতে পারতো। একটা পাঁউরুটির দাম তখন ১৫ পয়সা। বাপুজী কেক তখন বাজারে আসেনি। আরামবাগের পপুলার বা কোহিনূর কেকের দাম ২০ পয়সা। শোভা এখন ঝাড়া হাত পা। বর অবসরে। বন্ধুদের গ্রুপে কবিতা লেখে আর সবাইকে তাগাদা দেয়, চলো দেখা করি। সে এক্কেবারে তিনদিনের দীঘা ট্যুর ফেঁদেছে। কয়েকজন জুটেও গেছে। প্রসেনজিৎ রায়, সস্ত্রীক নবকুমার, সস্ত্রীক রমেশ, সস্ত্রীক আজম, সস্ত্রীক পীযূষ, নন্দিনী, মালা। প্রসেনজিৎ চুপচাপ ছেলে। পুনর্মিলনে বিরাট ভুমিকা নেয় অনন্তদা, জ্যোতির্ময়, সুবীর রক্ষিতদের সঙ্গে। ... ...
ভুল ভাঙল চারদিন পর রাত্তিরের টিভি নিউজে। ন্যাশনাল হাইওয়ে ৬৩তে জগদলপুর থেকে গীদম যাওয়ার পথে বাস্তানারে হাইওয়ের ওপর সকাল নটায় ছুটিতে আসামে নিজেদের ঘরে ফিরতে উৎসুক সি আরপি'র ছয়জন জোয়ানকে মাওবাদীরা ব্লাস্ট করে উড়িয়ে দিয়েছে। এর জন্যে ওরা দিন পাঁচেক আগে পিচ রাস্তায় পাঁচ ফুট নীচে ড্রিলিং করে পাইপের মধ্যে অ্যামোনিয়াম সালফাইড ভরে পুঁতে রেখে ছিল।আজ রিমোট ব্যবহার করতেই আতংক আর হাহাকারের পরিবেশ। গত রোববারই আমাদের কাফিলা সকাল ন'টার সময়েই বাস্তানার পেরিয়েছিল। কয় সপ্তাহ পরে জগদলপুরের থেকে মাত্র ২৭ কিলোমিটার দূরে হাইওয়ের ওপর বনবিভাগের বাংলোতে রাত্তিরে হামলা করে ভাঙচুর করে, আগুন লাগায়। পরদিন দুপুর বারোটায় আটটি মোটরবাইকে চড়ে ষোলজন পুলিশ রাত্রের হামলার তদন্ত করতে আসে। কাজ শেষ করে ফেরার পথে রেস্ট হাইউস থেকে মাত্র তিনশ' মিটার দূরে ওদের ওপর হামলা হয়। তাতে জনা আটেক মারা যায়। এদের মধ্যে থানাদার মহেন্দ্র সোড়ীর নাম গতবছর কেলেংগায় দুজন আপাতনির্দোষ গ্রামীণকে এনকাউন্টারের অছিলায় মারার জন্যে মাওবাদীদের হিটলিস্টে ছিল। ... ...
এ লেখার নাম, ‘ধানাই পানাই’। দু হাজার তিন সাল থেকে ডায়েরির পাতায় হিজিবিজি লিখে গেছি, প্রধানতঃ নিজেই অবসরে পড়ব বলে। ডায়েরির পাতায় লিখলেও ডায়েরির মত ক্রোনোলজি নেই। মাঝে মধ্যে তারিখের উল্লেখ থাকলেও আগের বা পরের ঘটনা উল্টে পাল্টে গেছে। আমার তখন গোটা দুয়েক বাসস্থান ছিল। একটা ফ্ল্যাট ছিল, যাতে আমার পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকত, আর আমার পৈত্রিক বাড়িটার তখন জরাজীর্ণ দশা, সেখানে থাকতাম আমি একা। কিছুটা সময় কাটানোর তাগিদেই লিখতে শুরু করেছিলাম ধানাই পানাই। ... ...
আটের দশকের একটি ঘটনা মনে পড়ে। লেবাননে তখন গৃহ যুদ্ধ চলছে। ইউনি লিভারের মাইক ডার্বিশায়ারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনারা যে লেবাননে সাবান শ্যাম্পু বেচছেন তার টাকা ডলারে বা পাউনডে ফেরত পাবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত নন? যে সব দেশে মাল বিক্রির ঝুঁকি নিয়ে আপনারা চিন্তিত সে তালিকায় লেবাননের নাম দেখি না! মাইক হেসে বললেন আমরা সে দেশে কোন ব্যাঙ্ক নয়, সরাসরি একটি লেবানিজ পরিবারের সঙ্গে বাণিজ্য করি। যুদ্ধ হোক আর শান্তি বারি বর্ষিত হোক, তারা ঠিক দাম মিটিয়ে দেবে। শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম। ইউনি লিভারের মতো কর্পোরেট ব্যাপারী মনে করেন লেবাননের একটি পারিবারিক সংস্থা তাঁদের আস্থার যোগ্য। সবাই তাহলে একই ম্যানেজমেন্ট মন্ত্রে বিশ্বাসী নন। একই ইস্কুলে এম বি এ করেন নি। ... ...