গাড়ির বর্ণনায় এতটুকু বলা যায়ঃ গাড়িটি চলছে মন্থর; মন্থর। তার ওপর গাড়ি ছাড়ার মুহূর্তে এমন এক বান্ধবীর অবির্ভাব যার সাথে অনেকদিন দেখা নেই, যে সীল মাছ পছন্দ করত। সীল মাছের মসৃণ ত্বক দেখার বাসনায় সে বিয়ে করেছিল চিড়িয়াখানার এক বড় কর্মকর্তাকে। তা, সেই বান্ধবীর ফিরে আসা তাই প্রতীকের কাছে গোলকধাঁধার মতো মনে হয়। পুরো ব্যাপারটা ছিল নিছক একটা দুর্ঘটনা। হয়তো কোনো আত্মীয়কে সি-অফ করতে এসেছিল সে। কিন্তু যখন সে প্রতীককে বলে, সে তার কাছেই এসেছে, অনেক পথ পাড়ি দিয়ে, ব্যাপারটা এমন যেন কোনো পোষা বিড়ালকে ফেউ-লোকেরা বস্তাবন্দি করে অনেক দূরে ছেড়ে এসেছিল আর সেই বিড়াল বিশ্বস্ত আত্মার মতো, কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তির গুণে পুরনো মালিকের কাছে ফিরে এসেছে - তখন পুরো ইতিহাসটি আবারো উঠে আসে। কী কারণে সে চলে গেলো? কেনই বা ফিরল? আর এমন একটা সময়েই বা কেন? যখন সে আটকুড়িয়া যাবে বলে সব কিছু গুছিয়ে এনেছিল। তার বাস তো ছাড়তে গিয়েও পেছন থেকে লাগাম টেনে ধরা গরুর মতো আটকে ছিল, যেন সময়ের দড়িটি ছিঁড়বে-ছিঁড়বে অবস্থা, এমন সময় তা লোহার শেকলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে; বাতাসের জলীয় কণা তার শরীরে প্রবল বেগে আছড়ে পড়ছে, মুহূর্তে মরিচা ধরে খয়ে যাচ্ছে, আবার কোনো দৈব কারসাজিতে নিকেলের হাসি হেসে শক্তপোক্ত হয়ে উঠছে ঝনঝনিয়ে। ... ...
বৃষ্টি এখানে কম। এখানে বিশ্বচরাচর নিঝুম করে শুরু হয় স্নোফল। কিন্তু কুছ পরোয়া নেহি। বরিষণমুখরিত দিনে যারে খাওয়া যায়, নিঃশব্দ তুষারপাতেও তারে পাওয়া যায়। ধুমায়িত খিচুড়ির কোনো জবাব নেই। মৌমিতা ভৌমিক ... ...
কিন্তু রোজ বিকেলে পাড়ার ওই বাঁদরের দল খেলত এসে গলিটাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মাতিয়ে রাখে। বাঁদরের দল নামটা রায়দাদুই ওদের দিয়েছেন। বাঁদরের দল অর্থাৎ পাঁচটি ছেলেমেয়ের দল। রায়দাদু ছাড়া সকলে ডাক নাম ধরেই ডাকে ওদের ... রাজু, বিল্টু, রিয়া, রিম্পা এবং রনি। ওদের চেঁচামেচিতে রায়দাদু সর্বদাই বিরক্ত থাকতেন। কিন্তু আবার কোনোদিন ওরা খেলতে না এলে ওনার কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। ... ...
গ্রামে কিছু মানুষ থাকতেন যাঁরা বই পড়তে পারতেন না, কিন্তু অঙ্কের ধাঁধা জানতেন আর বুদ্ধির খেলা বাঘবন্দীতে ছিলেন ওস্তাদ। আমি ফুটবল ক্রিকেট হাডুডু কবাডি নুনচিক বুড়ি বসন্তি ভলিবল একটু হকি --সব খেলতাম, কিন্তু বাঘবন্দি চাইনিজ চেকার দাবায় ওস্তাদ হয়ে উঠি। ক্যারাম তাসে সুবিধা করতে পারি নি। তা বাঘবন্দি খেলছি এক ওস্তাদ খেলুড়ের সঙ্গে। সংকল্প হারাতেই হবে। এমন সময় দেখি একটা সিংহের মতো দেখতে বিশাল কুকুর হেলতে দুলতে আমাদের খামারে হাজির। সোনালী ঝালর কেশর। বুকের কাছে বেশ চওড়া। কোমর সরু। এমন কুকুর কেবল সিনেমায় দেখেছি আগে। পরে বাস্তবেও এতো সুন্দর কুকুর দেখিনি। সংকর প্রজাতি। দেশি আর বিদেশি মিশেল। ... ...
জীবন লজের বাইরে দাঁড়িয়ে, দিব্যেন্দুকাকুর সাথে ফোনে কথা বলা শেষ করে, সিগারেট ধরিয়েছিল সৌম্য। ফাঁকা রাস্তা দেখে এক হাতে রজতের ঘাড়ে আঁকিবুঁকি কাটছিল। হঠাৎ একটা গাড়ি প্রচণ্ড জোরে কোথা থেকে এসে হুশ করে বেরিয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে রজত সৌম্যকে ধরে এক ঝটকায় সরে না গেলে একটা বড়সড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেত। রজতের মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে গিয়েছিল। একটু সামলে নিয়ে বলল, “আমাদের কেউ খুনের চেষ্টা করছে।” সৌম্য মৃদু হেসে বলল, “এগুলো রাতের শহরে বড়লোকের বখাটে ছোঁড়াদের কাজ। রাত বাড়লে সবাই সলমন খান হয়ে যায়।” রজতকে এই বলে প্রবোধ দিলেও সাদা ইনোভার পাশের আঁচড়ের দাগটা সৌম্যর চোখ এড়ায়নি। অর্থাৎ কেউ এখন আর শুধু ওদের ওপর নজর রেখে ক্ষান্ত দিচ্ছে না, সরাসরি খুন বা আহত করার চেষ্টা করছে। ... ...
এ এক অদ্ভুত বই। পাতার পর পাতা উলটেও আমি ঠিক করতে পারিনি এ কোন বৃক্ষের ফুল, কোন জনরেঁ এর উৎস। প্রবন্ধ, ইতিহাস, রসনা-রেসিপি, ইদানীং ফুড-ব্লগ নামে যা জগত-বিখ্যাত, শিল্প ও শিল্পীর ওপর কিছু কথা, নাকি কেবলই মনোহরণ দাস্তান বা আখ্যানগুচ্ছ। সব কাননের ফুলের সুবাস পাওয়া যাবে এতে আলাদা করে, আবার প্রত্যেকটি মিলেমিশে একটি নিবিড় কথকতা! বাংলা সাহিত্যে এরকম আর কিছু আছে কি? ... ...
ছোট বেলায় দেখতাম, মায়ের তেমন কোন ভাল শাড়ি ছিলনা। কোথাও নেমন্তন্ন থাকলে মা কোন বন্ধুর থেকে শাড়ি চেয়ে নিয়ে পরত। সেকালে এমন চল ছিল অবশ্য। ইমিটেশন গয়না পরত। একজোড়া কানের রিং ছাড়া মায়ের আর কোন সোনার গয়না ছিলনা। ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগত। একটু বড় হতে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করলাম - ‘এত বড়ো বংশের মেয়ে লাবণ্য। বড় ঘরের বৌ! গয়না ছিলনা মা? বন্ধুরা সব গল্প করে, ঠাকুমার বালা, দিদার বিছে হার। তোমার তো কিছু নেই। তোমাকে দেয়নি? - সব গেছে, দেবে কী করে? - গেছে মানে, কীকরে গেল সব? প্রথমে বললে হারমোনিয়াম গেছে, তারপর বললে, দিদার হাতের কাজগুলো গেছে। এখন বলছ গয়না গাঁটি গেছে। গেল কীভাবে, সেটা তো বলো। মা বলল, - আজ কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেল মা, আবার একদিন হবে। মেলা কাজ পড়ে আছে।’ - যাঃ জানা হলনা তবে? ... ...
- ওহ, রুশ ভাষায় মাকে বুঝি নেনকো বলে? আর কী কী শিখেছিলে? - বাড়িতে বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে অনেক গুলো ডিকশনারি ছিল। সেখান থেকে এ টি দেবের ইংরেজি থেকে বাংলা ডিকশনারির শেষে দেখলাম গ্রিক আর রুশ বর্ণমালা রয়েছে। ব্যাস আর আমায় পায় কে? দিনরাত নতুন বর্ণমালা মকশো চলল রাফ খাতায়। প্রগতি প্রকাশনের রুশ গল্পের বাংলা অনুবাদ যত আছে, সব নিয়ে খাটে ছড়িয়ে বসলাম। মলাটের পরের পাতায় বাংলার নিচে ছোট ছোট করে রুশ ভাষাতেও লেখা থাকত। উভচর মানুষ বইটার লেখক আলেকজান্ডার বেলায়েভ। রুশ বর্ণমালা মিলিয়ে দেখলাম, লেখা আছে, এ বেলায়েভ। বাংলায় মস্কোর নিচে যা লেখা আছে, তা বাংলা মতে উচ্চারণ করলে দাঁড়ায় মস্কভা - মানে মস্কো। হায় কপাল! ইস্কুলের ভূগোল বইতে লেখা আছে, মস্কো শহর মস্কোভা নদীর ধারে। ভুল, এ যা দেখছি, তাতে মস্কো শহর মস্কো নদীর ধারে। দৌড়লাম, মাকে এই নতুন আবিষ্কার জানানোর জন্য। মা শুনে বেশ অবাক হল, বলল - - ‘বাবা! পড়ে ফেললি তুই। তুই যেমন রুশ ভাষা শেখার চেষ্টা চালাচ্ছিস, আমার মাও এভাবে ইংরেজি শেখার চেষ্টা করত।’ ... ...
লকডাউন পিরিয়ড কর্মহীনতাকে মাত্রাছাড়া করে তুলেছে। ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির ফাঁদে পড়ে বহু ছাত্রকেই আয়ের পথ খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে। যে ছাত্রকে আজ সুদিনের আশায় অব্যহতি দেওয়া হল সে ফিরতি বছরে আদৌ স্কুলমুখী হবে কিনা তা বলা মুশকিল। গোটা বিশ্বেই এই আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে যে অতিমারীর প্রকোপ কাটলে ভয়াবহ ড্রপ আউট হতে চলেছে স্কুল কলেজে। ভারতে এর মাত্রা যে ঠিক কত ভয়াবহ হতে পারে তা আন্দাজ করাও মুশকিল। জিরো অ্যাকাডেমিক ইয়ারের প্রাথমিক অব্যহতি নড়িয়ে দিতে পারে ফিরতি বছরের শিক্ষার্থীর হারকেই। তাছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা নিজেই অর্থনীতির একটা বড় অংশ। এই গোটা ব্যবস্থার সাথে যুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের ভিতর বিভাজন কম নয়। ... ...
- "মা, তুমি গান জানো, আমাকে তো কোনদিন বলোনি। - গান জানিনা তো। - তাহলে বাজাচ্ছো কি করে? - আমার মায়ের কাছে শিখেছি। শুরু করেছিলাম। তারপর আর হলনা। - হলনা কেন? - হারমোনিয়ামটা হারিয়ে গেল। - কীকরে? - সে অনেক কথা, পরে বলব।" ছোটো করে একটা ধাক্কা লাগল মনে। লাবণ্যর হারমোনিয়াম হারিয়ে গিয়েছিল? কি এমন কথা আছে, মা বুকে চেপে আছে? ... ...
চাঁদ সেদিন সরু হতে হতে সুতোর মতো, যেন সেদ্ধ ডিম ফালি করা যাবে তা দিয়ে। নিমগাছটায় রাতজাগা কাকের পালক ঝাড়ার আওয়াজ কানে এল আন্নুর। রাত কতো হল কে জানে, সাতদিন পার করে আজও দিলদার ফিরল না। আপসোস। পাশের ঘর থেকে ক্রমাগত ধর্ষণের হুমকি আর দেওয়ালে লাথি মারার আওয়াজ এই সবে থামলো। ঝুলে পড়া তলপেট খালি করতে যাবার এই তো সময়। আন্নু খসে পড়া ওড়না তুলে মাথায় দেয়। খোলামাঠে উদোম হয়ে বসার সময়ও মাথার কাপড়টি ঠিক রাখতে হবে। নাহলে রীত ভঙ্গ হয়। বাহারে দুনিয়া, বাপ ছেলে এক নারীকে ভোগ করলে, টাকা দিয়ে মেয়ে কিনে তাকে ভঁইসার মতো খাটালে, কোন রীত ভাঙে না, দুনিয়া উলটে যায় শুধু মাথায় কাপড় না থাকলে ! ... ...
মিসের হাই হিলের ঠক ঠক শব্দে তার চিন্তার জালটা ছিন্ন হলো। টেবিলের ওপর হাতের ফোল্ডারটা রেখে ঠোঁটদুটো সামান্য ফাঁক করে মৃদু হেসে সমস্ত ছাত্রীদের ‘গুড মর্নিং’ বললেন তিনি। ব্যস্ত হাতে গাঢ় নীল রঙের ফোল্ডারের স্ট্র্যাপটা খুলে স্টেপল করা একতাড়া A4 সাইজের কাগজ বের করে রাখলেন টেবিলে । সামনের বছরেই সেকেন্ডারি স্কুলের শেষে GCSE পরীক্ষা, তাই পড়াশোনা এখন জোরদার। ওই একতাড়া কাগজগুলো হলো প্রতিটি ছাত্রীর জন্য তৈরি করা আজকের লেসন। ... ...
বলি, গল্পে একটু কম গা ঘিনঘিনেমি না দিলে কি ভাত হজম হত না বাছা? একজন স্বাধীন উপার্জনক্ষম নারী মনোবিদ মানেই কি তাঁকে দর্শন চোবানো আইটেম বানিয়ে ফেলতে হবে, যিনি রোগ সারাতে সারাতে নিজের অরগাজমে ভেসে যান? মানছি যে কোনও অ্যাকমপ্লিশমেন্টের মধ্যেই অরগাজমের সমতুল্য সুখ লুকিয়ে থাকে। ... ...
আমরা কোনো প্রশ্ন করি না কেন? কেন সব ঘাড় গুঁজে মেনে নিই? ততদিনে আমরা আর ক্রীতদাস নই, কিন্তু সে কেবল নামেই। মাথা ঝুঁকিয়ে কাজ করে যাওয়ার বাইরে কিছুই শিখিনি। রেভারেন্ড ওয়ালেস তার বক্তিমে থামিয়ে আমার দিকে সোজা চোখে তাকাল। কী বলতে চাইছ হে ছোকরা? আমার হাতে একটা বই ছিল, সেটার দিকে তাকিয়ে বলল, দু’পাতা পড়েই নিজেকে পন্ডিত ভাবছ বুঝি? শুনি তোমার বিদ্যের বহর। কী বলতে চাও? বললাম তো। যা দেখছি চারদিকে সব কিছুকে প্রশ্ন করতে হবে। আমরা এখানে ভগবানের কথা বলছি – জেসাস। সেটা কি মাথায় ঢুকেছে খোকা? তাকেও প্রশ্ন করো। চু-উ-প! ফেটে পড়েছিল রেভারেন্ড ওয়ালেস। আর একটা কথা না। আমার তখন রক্ত নবীন, হেঁকে উঠলাম, কেন চুপ করব? সাদাদের ভগবান নিয়ে আমাদের এত আহ্লাদ কিসের? দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে জমায়েতের দিকে তাকিয়ে রেভারেন্ড ওয়ালেস বলে উঠল, দ্যাখো, এই জন্যেই কি আমরা নিগ্রো বাচ্চাদের পড়তে-লিখতে শেখাচ্ছি? আমার মাথায় তখন আগুন দপদপ করছে। আমিও সমানে চেঁচিয়ে বললাম, তুমি কিছুই শেখাচ্ছ না, সাদাদের বলে দেওয়া বুলি আওড়াচ্ছ। ... ...
যিশু নামের একজন মানুষের কথা খুব শোনা যাচ্ছে। গুজব তিনি পঙ্গুকে সচল করেন, অন্ধকে দৃষ্টিদান করেন, সাতটা রুটি আর কয়েক টুকরো মাছ দিয়ে পাঁচ হাজার মানুষকে পেট পুরে খাওয়ান। এই বার্তা রটি গেল গ্রামে শহরে, তিনি এবার জেরিকো আসবেন। জাকেউস এক ধনী ব্যক্তি, তখন জেরিকোর ট্যাক্স কালেক্টর, শহরে বাজারে তাঁকে কেউ পছন্দ করে না। এমন মানুষও কৌতূহলী হলেন- কে এই যিশু? তাঁকে কি আগে ভাগে দেখা যায়? একটা সমস্যা ছিল- জাকেউস মাথায় খাটো। যিশুর ভক্ত গোষ্ঠীর ভিড়ভাট্টার ভেতরে তিনি কি সেই যিশু নামক মানুষটির কাছাকাছি যেতে বা তাঁকে দেখতে পাবেন? জাকেউস একটা শর্ট কাট বের করলেন - শহরের ঢোকার মুখে চৌরাস্তার মোড়ে ছিল একটি সিকামুর গাছ, তিনি সেই গাছে চড়ে বসলেন। ... ...
ঠাকুমা কলতলা থেকে এসেই স্টোভের আঁচ বাড়িয়ে দিল। পুঁইয়ের কচি ডগাগুলো হাত দিয়ে ভেঙে নেয় ঠাকুমা। লোহার কড়াইয়ে সেই পুঁইয়ের পাতাডগা, হলুদ, লবণ আর কাঁচামরিচ ফেলে ঠাকুমা তাতে ঢেলে দিল অনেকটা সর্ষের তেল। আলতো নয়, বেশ জোর দিয়েই ঠাকুমা তা মাখাতেই পুঁইয়ের পাতাডগা সব এলিয়ে পড়ল। ঠাকুমা এবার তার উপরে শুইয়ে দিল কতগুলো ইলিশমাছের চাকা। হাত-ধোয়া জল জড়িয়ে গেল মাছগুলোর গায়ে। ... ...
এর মধ্যে আবার শুনলাম মতির ছেলেরা ফের বাবার কাছে গিয়েছিল বলতে যে অভিযোগ যেন তুলে নেয়। বাপ বলে পাঠিয়েছে, তোদের মাকে বল আমাকে নিঃশর্ত আইনি বিচ্ছেদ দিয়ে দিতে, তবে মামলা তুলব। সপ্তাহ খানেক পর কোর্টের খবর আসে, জানা যায় কাগজটা ভুয়ো। এমন কোন কাগজ আদালতে জমাই পড়েনি। সবই মতির বরের চালাকি। মা আর তিন ছেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পুলিশ আসবে শুনে সকলেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওরাও তো আর সব সময়ে সোজা পথে চলে না। তবে ডামাডোলে রেশন কার্ড ফেরৎ পাবার কথাটা ধামাচাপা পড়ে যায়। শহর থেকে বিস্তর ফোনাফুনি করে মতি যাতে চাল গম পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়। মতি অনেক জ্বালিয়েছে ঠিকই, ওর এই দুর্দশার দিনে মোটেই খুশি হতে পারি না। বরঞ্চ কপালে করাঘাত করে ভাবি, এই মতি এখনও স্বপ্ন দেখে যে তার যোগ্য বর ওকে আবার ঘরে নেবে, আবার ও তার সঙ্গে সংসার করবে। ... ...
এই গল্প যেন তার নিজের জীবনে খুঁজে বেড়ানো একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির গল্প। এভাবেই সে হারিয়ে যেতে চেয়েছে নানা চরিত্র হয়ে বারবার। অথচ চেনা পাকদণ্ডীর মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে চলেছে এতগুলো বছর ধরে। তার জীবনেও তো আসতে পারত সেই জাদুকর যে তাকে সোনার কাঠি বুলিয়ে ঘুচিয়ে দিত সব বিষাদ। ... ...
কূলের কিনার থেকে ডাক দেয় পরীবানু। মাঝির মতিগতি যেন কেমন কেমন লাগছে। এত কি কথা বলেশ্বরের সঙ্গে ! বাসুকীর মা মাসীমা এসেছিল গেল কাল সন্ধ্যায়। রোজা থেকে থেকে মিলনের মুখের রুচি চলে গেছে, খেতে স্বাদ পাচ্ছে না শুনে কলাপাতায় মুড়ে কতগুলো পুরনো টক তেঁতুল দিয়ে গেছে শরবত বানানোর জন্য। চোত বোশোখ মাসে রোজা করা মানে জাহান্নামের আগুনে সেদ্ধ হওয়ার সমান। জিভ শুকিয়ে খড়ি হয়ে যায়। খা খা করে শরীর। যাওয়ার সময় মাসী চুপিচুপি বলে গেছে, মাইয়েরে মাইয়ে, চক্ষু দুইহান চেতায়ে রাহিস। রোজার ধকল তাও সয়, সাগরের ডাক কিন্তুক মানানো যায় না রে মাইয়ে। ঢনঢন করে ওঠে পরীবানুর বুক। রাগে দুঃখে গাল পাড়ে, ঢ্যামনা বলেশ্বর। মাইয়ে পোলাপানগো লাগান ছেনাল হইছিস হারামাজাদা তুই। বলেশ্বর ঢেউ তুলে কতগুলো কচুরীপানা ভাসিয়ে দেয় কূলের কিনারে। মিলনের পেছনে দপদপিয়ে হেঁটে আসা পরীবানু কি বুঝে কে জানে। নিজের প্রৌঢ় চোখকে বিশ্বাস করতে না পেরে বার বার পেছনে তাকায়। কুলকুল করে হাসছে বলেশ্বর ! পানি ছিটোচ্ছে ওদের ফেলে আসা পদচিহ্নমাখা পথে। ... ...