ভ্যান্ডারলুস্ট। আর কোনো শব্দে ব্যাখ্যা করা যাবে না এ কাণ্ড। ১৯৭৫। বাঁকুড়ার ছোট্ট মফস্সল শহর বিষ্ণুপুর থেকে বেরিয়ে পড়লেন তিন তরুণ। দুনিয়া ঘুরে দেখতে হবে। সাইকেলে। ইন্টারনেট নেই। জিপিএস নেই। অর্থবল নেই। মাতৃভাষা বাংলা বই দুটি ভাষা জানা নেই। সম্বল স্রেফ স্বপ্ন। আর জেদ। হাল ছাড়লেন দুজন। কুছ পরোয়া নেহি। ঘুরতে থাকল তৃতীয়জনের সাইকেলের চাকা। ১৭ বছর। ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। ১৫৪টি দেশ। আজও এ কীর্তিতে তিনি অদ্বিতীয়। এ সফরনামা শুধু রুদ্ধশ্বাস নানা ঘটনার ভিড় নয়, নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া এক মুসাফিরের অনন্য জীবনবীক্ষা। এই প্রথম দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সে পরমাশ্চর্য সফরের অনুপুঙ্খ কাহিনি শোনাচ্ছেন জয় মণ্ডল। আলাপে নীলাঞ্জন হাজরা। ... ...
প্রকৃতি একটু একটু করে খুলে দিচ্ছিল তার জাদু-দরজা। ঘরের একদিকের দেয়ালের পাশে ছিল লম্বা লম্বা পাতার কিছু গাছ। তাতে অদ্ভুত দেখতে কিছু কলি। ধীরে ধীরে কলিরা বড় হচ্ছিল। হঠাৎ এক সকালে দেখি, কলি নয়, ফুল। কি অবিশ্বাস্য সুন্দর ফুল! বাবাকে গিয়ে ধরলাম, কি ফুল বাবা? বাবা বলল, কলাবতী। এমন ও ফুল হয়, এমন ও নাম হয়! আমার চেতনার কূল ভাসিয়ে বাজতে থাকে কলাবতী, কলাবতী, কলাবতী। তারপর একদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে। গায়ে সেদিন অল্প অল্প জ্বর। মা বলে, – আজ আর দুজনের কারো, স্কুলে গিয়া কাজ নাই। আমি চাদর মুড়ি দিয়ে হাত-পা ঢেকে বিছানায় বসে থাকি, জানালার পাশে। দেখি, কলাবতী বৃষ্টিতে স্নান করে। পাতার গা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে – টুপ – – টুপ, টুপ টুপ। ফুলের গা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে – টুপ – – টুপ, টুপ টুপ। ঠাকু’মা এসে পাশে দাঁড়ায়। – কেমন আছ অহন? – ভালো। – জলীয় বাতাস লাগাইও না। জ্বর বাড়ব। জানালার পাল্লা অনেকটা বন্ধ হয়। একটু ফাঁক রাখা থাকে–নাতির জন্য, কলাবতীর জন্য। ছোট দু’ ভাই এবার ঘিরে আসে, – ঠাকুমা গল্প বলো। ... ...
বস্তারের যেখানে অত্যাচার, সেখানেই অদম্য সোনি সোরি। স্কুল কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত অসহযোগিতা করলেও নির্যাতিতা মেয়েদের হয়ে মামলা রুজু করেছেন সোনি। পরিষ্কার বললেন, তার গুপ্তাঙ্গে পাথর ঢোকানো পুলিশ অফিসারটি এবার রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পেয়েছে, ওর সদম্ভ চলাফেরা দেখলে বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে যায়, মগর ক্যা করু, দেশ কা সংবিধানমে বহোত বিশোয়াস রখতি হুঁ। না, বন্দুক হাতে তুলে নেবার কথা একবারও ভাবেননি সোনি। বরং একবারই গলা ধরে এলো বাবাসাহেবের এই সত্যিকারের সন্তানের, যখন বললেন তার ভেঙে দেওয়া স্কুলহোস্টেলে পঞ্চাশটি অনাথ বাচ্চা থাকতো যাদের বাবা মায়েরা খুন হয়েছে রাষ্ট্রের পোষা আতঙ্কবাদী সালোয়া জুড়ুমের সদস্যদের হাতে। তাদের কি হল তিনি জেলে যাবার পর জানা নেই, শুধু এই সেদিন গহন বনের ছায়ায় এক গ্রামে ধর্ষণের ঘটনা শুনে সোনি যখন ছুটে যাচ্ছিলেন দুটি মাওবাদী তার পথ আটকায়। যাবার হুকুম নেই। কথা কাটাকাটি শুরু হতেই বন্দুক হাতে ছুটে আসে আর এক তরুণ, প্রাক্তন শিক্ষিকার পা ছুঁয়ে মাফি মাঙে। এ সেই অনাথদের একজন। ... ...
ধরা যাক আমাদের n-সংখ্যক ভোটার আছে, n বিজোড় সংখ্যা (অর্থাৎ “টাই” অসম্ভব)। প্রত্যেক ভোটারের ঠিক বিকল্পে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা ধরা যাক pc, এবং সবার ভোট পড়ে গেলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে “মেজরিটি রুল” অনুযায়ী, অর্থাৎ যে সবথেকে বেশি ভোট পাবেন, সেটিই আমাদের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। কনডরসে-র উপপাদ্যে এও ধরে নেওয়া হয়, যে, প্রত্যেক ভোটার ‘স্বতন্ত্র’, ‘দক্ষ’ এবং ‘আন্তরিক’। ‘স্বতন্ত্র’ – অর্থাৎ যে যার নিজের ভোট দিচ্ছেন বা একজনের পছন্দ আরেকজনকে প্রভাবিত করে না। ‘দক্ষ’ – অর্থাৎ, প্রত্যেকের ঠিক বিকল্প খুঁজে নেওয়ার সম্ভাবনা অর্ধেকের থেকে বেশি, যত সামান্যই হোক, এক্কেবারে র্যান্ডম গ্যেস অর্থাৎ ইকির-মিকির-চামচিকির করে আন্দাজে যা-ইচ্ছে-তাই একটা বোতাম টিপে দেওয়ার থেকে তার প্রজ্ঞা বা দক্ষতা একচুল হলেও বেশি। আর শেষ অ্যাজ়াম্পশনের কথা আগেও লিখেছি, ভোটার-রা ‘আন্তরিক’, সিরিয়াস-ও বলা যায়—কেউ ইচ্ছে করে ভুলভাল ভোট দিয়ে নষ্ট করছেন না। ... ...
গাঙ্গুলি বাড়ির বৌ হয়ে যেদিন প্রথম এসেছিল সৌদামিনী, শাশুড়িমা থুতনি ধরে চুমু খেয়ে বলেছিলেন, তোমার নামটা বাছা আমি একটু বদলে দেব। একে অতবড় নাম ধরে ডাকাও যায়না, তাছাড়া আর একটা সমস্যাও আছে। তোমার কোনও ডাক নাম নেই? সৌদামিনী বলল, হ্যাঁ আছে তো, মিনু। উনি বললেন, তাহলে আজ থেকে সবাই মিনু বলেই ডাকবে তোমায়। সবাই আর কে, বাড়িতে তো আর মোটে তিন জন, কত্তা, গিন্নী আর সৌদামিনীর বর মহাদেব। সৌদামিনী তবুও জিজ্ঞেস করল, সমস্যা কী একটা আছে বলছিলেন মা? গাঙ্গুলি গিন্নী বললেন, আসলে আমাদের বাড়িতে যে কাজের মেয়ে, তার নামও সৌদামিনী। অবশ্য তাকে আমরা সদু বলে ডাকি। এ নামটা তো আমার মায়ের আমলের, এই আধুনিক যুগেও এমন নামে দু-দুজন? যাক, সমস্যা আর থাকল না। ... ...
লখিমপুর-খেরি বিজেপির গলায় কাঁটা হয়ে খচখচ করছে। তার কারণ দুটো। প্রথমত বিধানসভা নির্বাচন ঘাড়ের ওপর। এখন এই গন্ডগোল খুনখারাপির কারণে বিজেপি-বিরোধী জনমত আরও না দানা বাঁধে। দ্বিতীয় কারণটিও খুব গুরুতর। লখিমপুর-খেরি উত্তর প্রদেশের সবচেয়ে বড় জেলা, এর অবস্থান রাজ্যের পূর্বদিকে। অতীতে এখানে কৃষক আন্দোলনের অতো বাড়বাড়ন্ত ছিল না, কিন্তু এখন হচ্ছে, তার মানে নতুন নতুন জায়গায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে। এতোদিন উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাংশে ৩০টি জেলায় আন্দোলনটি সীমাবদ্ধ ছিল। এখন পূবেও তা যদি ছড়িয়ে পড়ে, সে দাবানল নেভাবে কে? অতএব সামনের কয়েকটি দিন লখিমপুর-খেরি বিজেপির শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে থাকবে এটা একেবারে নিশ্চিত। ... ...
মুশকিল হলো যে মানুষটা সারাজীবন ব্রিটিশ পুলিশের নেক নজরে থাকলেন, যাঁর নামে ঢাউস ফাইল তৈরি হলো আইবি দপ্তরে, তাকে ইংরেজের পোষ্য বললে ঠিক হয় কি? তবু শুনি তিনি নাকি বেঙ্গল কেমিক্যালসে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় নাইট্রিক এসিডের উৎপাদন অব্যাহত রেখে ইংরেজ সরকারকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। তা খালি ইংরেজ সরকার বলা হচ্ছে কেন, ভাই? মিত্রশক্তি বলে একটা কিছু ছিলো না তখন? নাইট্রিক এসিডের আকালে ভারত থেকে, এই কলকাতা থেকে নাইট্রিক এসিড যোগানো হয়েছে, তা ইস্তেমাল করে মিত্রশক্তি জিতেছে। ভালো হয়েছে। আপনার আমার গ্রেটার, লেসার ইভিল বেছে নেবার স্বাধীনতা আছে, আচার্যের নেই? তিনি কাইজারের তুলনায় ইংরেজকে লেসার ইভিল ভেবেছেন, সেই অনুযায়ী কাজ করেছেন। এতে এতো আপত্তির কী আছে? নাকি ক্রিটিকালি দেখতে হবে বলেই যা খুশি তাই বলে দেওয়া যায়! ... ...
বস্তুত আমাদের সকলের চোখের সামনে এই সমস্যা ক্রমশ যেন এক টইমবোমার রূপ নিচ্ছে, যা যে কোনো সময়েই ফেটে পড়তে পারে। অথচ রাষ্ট্রের দিক থেকে এ নিয়ে কোনো কেন্দ্রীয় নীতি থাকা তো দূরস্থান, এমনকি সমস্যাটির যথাযথ স্বীকৃতিদানেও অনীহা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যা শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীনই নয়, চূড়ান্ত অমানবিকও বটে। ... ...
আর দায় নেই চুপটি থাকার, বলব যা আজ চাইবে মন, ভক্তকূলও ঝুঁকিয়ে মাথা, ঘুরবে পিছে সর্ব ক্ষণ। গান্ধীবাড়ির হিসাব জিগাই, ঠিক ভুলে যাই আম্বানি, নীরব, মেহুল ? - দূর মহাশয়, সবার কি আর নাম জানি? নারদাতেও যেমনি টাকা, নেয়নি মোটে ভোন্দুও, গ্রিটিংস কার্ডেই খাম ভরা সব, পাঠিয়েছিল বন্ধু ওর। ... ...
পোস্টাল অ্যাড্রেস যাই থাকুক, এ' রাস্তার নাম কিন্তু সদর স্ট্রীট। হা হা। অবাক হচ্ছেন? এই তো' লেখকের কাজ - স্থান কাল পাত্র নিয়ে খেলা করে করে পাঠককে ধন্দে ফেলে দেওয়া। ছোটোবেলা থেকেই কাজটিতে আমি পটু। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার স্বভাব বরাবরের; তার ওপর মানুষ, পশু, পাখি এমনকি জায়গার নাম বদলে দেওয়ার একটা ফেজও চলেছিল বহুদিন - আমিই এ' গলির নাম দিয়েছিলাম সদর স্ট্রীট।' -এই অবধি ব'লে কমলিকা সামন্ত কফিতে চুমুক ... ...
বারে বারে সে নিজের মাউথ অর্গান তুলে নিয়েছে ঠোঁটে। যা যা সুর শুনছে, সেগুলোকে নকল করবার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সবসময় পারেনি। কিন্তু কোনও কোনও মুহূর্তে তার সুর হুবহু টিলার মাথার সুরের সংগে মিলে গেছে। রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে তার সারা শরীর। আর যখনই এটা হয়েছে, ডেসমন দেখেছে টিলার মাথায় লোকগুলো গান বাজনা থামিয়ে দিয়েছে। থামিয়ে দিয়ে তার দিকে যেন তাকিয়ে থেকেছে। ডেসমনের গায়ে কাঁটা দিয়েছে। আপনা হতেই চুপ হয়ে গেছে তার মাউথ অর্গানও। তারপর সে দেখেছে, লোকগুলো সকলে যেন কোমরের ওপর থেকে শরীর একটু ঝুঁকিয়েছে তার দিকে। তারপর আবার শুরু করেছে গান। লোকগুলো কি তাকে অভিবাদন জানাল? ডেসমন ঠিক বোঝে না, তবে এরকম ভংগী সিনেমাতে দেখেছে। দেখেছে মাথায় টুপি কালো কোট আর মাছি গোঁফওয়ালা একটা লোকের সিনেমাতেও। কাউকে সম্মান জানাতে হলে মানুষ এমন ভাবে নুয়ে পড়ে। ডেসমনও মাথা ঝোঁকায়। প্রণাম করে মনে মনে। তারপর আবার মাউথ অর্গান তুলে নেয়। ... ...
অবশ্য তাতে তাঁর কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। কারণ তিনি নিশ্চিতভাবেই জানেন, আজ থেকে কয়েক দশক পরে যখন পূর্ব কলকাতার এই জলাভুমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যখন এই শহরটাও আর বাসযোগ্য থাকবেনা, তখন ঠাঁইনাড়া মানুষ তাঁর লেখা পড়ে জানবে এই আশ্চর্য বাস্তুতন্ত্রের কাহিনি। এও এক সত্যি রূপকথা। সত্যিই কি তাই হবে? সত্যিই কি আন্তর্জাতিক রামসর স্বীকৃতি পাওয়া এই জলাভূমি সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে? আমি জানি না। আমি কেবল স্বপ্ন দেখতে পারি। আমি স্বপ্ন দেখি, তাঁকে মাথায় রেখে গড়ে উঠেছে একটি আন্তর্জাতিক মানের ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট, যেখানে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিয়ে হাতেকলমে গবেষণা করছে ছাত্রছাত্রীরা। দেশ বিদেশের বিভিন্ন শহর থেকে প্রতিনিধি দল আসছে এই মডেল রূপায়ণের জন্য। রাজ্যের নানান প্রান্ত থেকে স্কুলের ছেলেমেয়েরা আসছে শিক্ষামূলক ভ্রমণে । আমি স্বপ্ন দেখি, এই জলাভূমি মুক্ত রাখার জন্য এক বিশাল মিছিল, যাতে পা মিলিয়েছে সেই তরুণ প্রজন্ম যারা সেদিন ক্যাম্পাস মুক্ত রাখার জন্য পথে নেমেছিল। এবারের বইমেলার থিম কান্ট্রি হয়েছে রাস্তার অন্য পারে পূর্বকলকাতার জলাভূমি, আমি স্বপ্ন দেখি, বিশাল মাল্টিমিডিয়া প্যাভিলিয়ান। হাতুড়ি ঠুকে মেলার উদ্বোধন করছেন জলাভূমির একনিষ্ঠ ভাষ্যকার। কলকাতার নতুন লোগোয় হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া আর শহিদ মিনারের বদলে এখন থেকে জলজমিনের ছবি। ... ...
বিংশ শতাব্দীর শুরু ও শেষ এইখানে। সারায়েভোতে। গাভ্রিলো প্রিঞ্চিপের পিস্তলের গুলি—দুটি নয়, বহু কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। খুন কা বদলা খুনের খেলা শুরু হল — চলবে গোটা শতাব্দী জুড়ে। ইতিহাসে গাভ্রিলো প্রিঞ্চিপের স্থান বার বার পরিবর্তিত হয়েছে—কারো চোখে তিনি সন্ত্রাসবাদী, কখনো বা জাতীয়তাবাদের পুরোধা। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই সহিংস প্রতিবাদ যে ঘটনাচক্রের সূচনা করল, তা হয়তো বদলে দিয়েছে বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের ভবিষ্যতকে। ... ...
মুগের জিলিপি দেখতে অনেকটা ছানার জিলিপির মতো। সাধারণ জিলিপির মতো আড়াই প্যাঁচ দেওয়া যায় না। একটাই প্যাঁচ। কিন্তু প্যাঁচের দু’টো মুখ পরস্পরের কাছাকাছি এসে লাজুক ভাবে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। সেই জন্য মনে হয় অর্ধেক অর্ধেক প্যাঁচ মিলে এক প্যাঁচ হয়েছে। উপকরণ সামান্যই। মুগ ডাল। ডালের কাই ধরে রাখার জন্য সামান্য ছাঁটাই বিড়ির ডাল মেশানো হয়। অর্থাৎ খোসা ছাড়ানো। সেই মিশ্রণ প্যাঁচ মেরে তেলে ভাজা। তার পর রসের সাগরে ছেড়ে দেওয়া। আগে হাতে বাটা হত ডাল। শিলনোড়ায়। পাড়ার মেয়েরা কেজি প্রতি টাকা নিয়ে ডাল বেটে দিতেন। সেই বাটা ফেটাতে হত ভাজার আগে। ফেটানোর কাজটা বিশ্বনাথবাবু করতেন। তিনি জানালেন, ফেটানোর ওপরেই নির্ভর করে জিলিপির স্বাদ। যেদিন উনি ফেটান না সেদিন জিলিপির স্বাদের তফাৎ হয়ে যায়। খদ্দের সেটা বুঝতেও পারেন। এখন অবশ্য বাটা এবং ফেটানোর কাজটা মেশিনে হয়। জিলিপির জন্য ডাল বাটা ফেটাতে ফেটাতে এক সময়ে ডান হাতের পেশি জখম হয়ে গিয়েছিল বিশ্বনাথবাবুর। ভেলোরে গিয়ে অপারেশন করাতে হয়। জামা খুলে দেখালেন কাটা দাগ। তার পর থেকে মেশিন। তবে ফেটানোটা এখনও যন্ত্রবিদের হাতের কৌশল। স্বাদের ফারাক হয় তাতেও। ... ...
বিনয় চৌধুরীর মণ্ডল কমিশনকে এই রাজ্যে পশ্চাদপদ শ্রেণি বা ওবিসি নেই চিঠি দিয়ে জানানোর প্রায় ২৩-২৪ বছর বাদে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়ে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওবিসি বা পশ্চাদপদ জাতির বা ওবিসিদের তালিকা তৈরি করতে শুরু করে। বলা যায় বাধ্য হয়ে এই কাজে হাত দেওয়া হয়। কারণ ততদিনে, অনেক রাজ্যেই ওবিসি এবং দলিতরা নির্বাচনে বড়ো ভূমিকা পালন করছে, তাঁদের নেতা-নেত্রীরাও বিভিন্ন রাজ্য-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। ওই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে অর্থনৈতিক মাপকঠিতে ওবিসিদের জন্য সংরক্ষণও ঘোষণা করা হয়। মুসলিমদেরও একটা বড়ো অংশ এই তালিকাভুক্ত হন। ২০১০-১১ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত এলাকায় একটি সমীক্ষা হয় পশ্চাদপদ জাতির সংখ্যা ঠিক মতো জানতে। যতটুকু সমীক্ষা হয়েছিল তা থেকে তখন একটা ধারণা হয়েছিল, গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় ৩৪ শতাংশ ওবিসি। যদিও এটা সরকারি তথ্য নয়। ... ...
গোপন কথাটি রবে না গোপনে এমন তো নয় যে আমেরিকা সারা বিশ্বের শান্তিরক্ষার ইজারা নিয়েছিল কোনোদিন। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে যখন দুনিয়া উত্তাল তখনও আমেরিকা একবারও মুখ ফুটে কোনো প্রতিবাদের ধার কাছ দিয়েও যায়নি কেন? সামান্য হিপোক্রেসিও কি আশা করা যেত না? লেখক বাস তিনটি কারণ বলেছেন। প্রথম দুটি গৌণ। প্রথমত, নিকসন আর ইয়াহিয়া, দুজনের কেউই যখন নিজের নিজের দেশের প্রেসিডেন্ট নন, তখন থেকেই দুজনের মধ্যে একটা সখ্যতা ছিল। নিকসনের অন্তরঙ্গ কথোপকথনের যে টেপ পাওয়া যায় তাতে দুজনের সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ হয়েছে একাধিক বার। দ্বিতীয়ত, নিকসন, ইন্দিরা গান্ধিকে রীতিমতন অপছন্দ করতেন। রাশিয়ার সাথে মাখামাখি, ইন্দিরা সোস্যালিস্ট ঝোঁক—শুধু এগুলিই নয়। মানুষ হিসেবেই ইন্দিরাকে নিকসন পছন্দ করতেন না। এর আগে একবার দুজনের মিটিং হয়েছিল দিল্লিতে মিনিট কুড়ির জন্য। ইন্দিরা নাকি যথেষ্ট উৎসাহ তো দেখানইনি, তায় তাঁর এক সহকর্মীকে হিন্দিতে প্রশ্ন করেন, “এ আরও কতক্ষণ টাইম নেবে?” নিকসনের আর-এক পরামর্শদাতার মতে নিকসন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কোনো মহিলাকে হজম করতে পারতেন না। তো সে কথা বলতে কী, নিকসন গোটা ভারতীয় জাতিকেই অপছন্দ করতেন, বলেছিলেন ভারতীয়রা ‘Slippery and treachorous’। পাকিস্তান ও তার অধিবাসীদের ক্ষেত্রে কিন্তু প্রশংসাই বরাদ্দ ছিল। ... ...
এই আটক-হওয়া মানুষদের অবস্থা বন্দীদের থেকেও খারাপ। তিনি ক্যাম্পের একটি দুঃখজনক বিবরণ দিয়েছেন, যেখানে দেখিয়েছেন যে এঁরা অন্যান্য "নাগরিক বন্দীদের" তুলনায় কেমন অনেক বেশি বিধি নিষেধের মধ্যে থাকেন। কোকড়াঝাড় কারাগারের নারী বন্দীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, এই মহিলাদের প্রায় এক দশকের মধ্যে একটি মোটামুটি ৫০০ বর্গ মিটারের ঢাকা জায়গার বাইরে বেরোতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই আটক-হওয়া মানুষদের অধিকার সম্পর্কে কেন্দ্র বা রাজ্যের থেকে কোন নির্দেশিকা বা নির্দেশ নেই। আসাম জেল ম্যানুয়ালের দ্বারা এই আটককেন্দ্রগুলি পরিচালনা করা হয়। রাজ্য আটক-কেন্দ্র ও কারাগারের মধ্যে বস্তুতঃ কোন তফাত করে না , এবং জেল কর্তৃপক্ষ আটক-হওয়া-মানুষ আর কোন অপরাধের-দায়ে-অভিযুক্ত বা দোষী-প্রমাণিত-হওয়া কারাবন্দীদের মধ্যে বেছে বেছে আসাম জেল ম্যানুয়ালের বিধিগুলোর প্রয়োগ করেন। জেল-নিয়মের আওতায় থাকা বন্দীরা প্যারোল বা কাজ-করে-মাইনে পাওয়ার মত যে সব সুবিধাগুলি পান, সেগুলোর থেকে এই আটক-হওয়া মানুষেরা বঞ্চিত। পুরুষ, নারী ও ছয় বছরের উপরের ছেলেদের তাদের পরিবার থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটি বলে যে কীভাবে এই নির্বিচারে, অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাবন্দীদের মত অবস্থায় আটক করে রাখা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। প্রতিবেদনটি আরও জানায় যে আসন্ন NRC র ( যা কিনা সম্ভবতঃ লাখ লাখ মানুষকে রাজ্যহারা করবে) প্রেক্ষিতে কিভাবে মানুষের মৌলিক অধিকার, বিশেষতঃ সব থেকে পবিত্র সংবিধানের আর্টিকল ২১ দ্বারা সুনিশ্চিত করা যে অধিকার, বিপন্ন। এই সব রাজ্যহারা মানুষদের নিয়ে কী করা হবে, সে বাবদে ভারতের কোন নীতি নেই। সুতরাং, আটক শিবির সম্পর্কে সত্যিগুলো বাইরে বেরিয়ে এসেছে। রিপোর্টে অনেককিছু আছে এবং পরিস্থিতির গভীরতা বোঝার জন্য, আমি আন্তরিকভাবে চাই যে সবাই এই নিবন্ধ এবং পূর্ণ রিপোর্টটি পড়ুন ... ...
ফেরো, আমার দেশ, ঘরে ফেরো। আর যেওনা রাক্ষসের নরভুক পুরীর উন্নয়ন-পুজোয় বলি হতে। নিজের ঘরে থাকো। নিজের জোরে থাকো। ও মা আমার, তোমার লক্ষ মুখ যখন কাতরাচ্ছিল, যখন মায়ের কোলেও ঘুমোচ্ছিল না খিদেয় কাঁদা শিশুরা, যখন সতেরো দিনের বাচ্চা কোলে বাড়ি যাবে বলে হাঁটছিলে তুমি, তখনও তোমার মাথার ওপর জেগে ছিল নীল আকাশ। মেঘ। গাছপালারা তাকিয়েছিল দূর থেকে। পাশের সরু ঘোলাটে জলধারাটি যে তোমার ফেটে যাওয়া বুকে ওই কাদাজলের অঞ্জলি জোগাচ্ছিল- এরা সবাই তাকিয়েছিল তোমার দিকে। তোমার অপেক্ষায়। ওরাও আশ্রয়হারা। তুমি ওদেরও বাঁচাও। আমাদের বাঁচাও, শিক্ষিত করো আমাদের। তুমি নিজের ঘরে থাকো। ... ...
আমরা আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাস, ইউরোপের কলোনি ও যুদ্ধ-বাণিজ্য বিস্তারের ইতিহাস, সমস্ত কিছুতেই এই রাষ্ট্রধারণার প্রাবল্য দেখি। এমন কী ধর্মকেও রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হয়। কিন্তু, ভারতীয় দেশগুলিতে যেহেতু এই রাষ্ট্রচেতনা গণমানসে খুবই ক্ষীণ, তাই রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিসমূহ নিয়ে আলোচনা-আন্দোলনে জনতার উৎসাহও কম। সম্ভবতঃ, আজকের ভারতেও আমরা দেখতে পাই, এই চেহারাটা। রাজনৈতিক দলগুলির ভাগাভাগি, একই এজেন্ডা নিয়ে একাধিক নামে দল তৈরি হওয়া, ব্যক্তিগত প্রভাবের প্রাচুর্য সবই পলিটিকালাইজেশোনের অভাবকে একভাবে সূচিত করে। এমন কী, রাজনৈতিক দলগুলিও সেখানেই সফল যেখানে তারা রাষ্ট্রনীতির পরিসর, পার্লামেন্টারি ডিবেটের বাইরে সামাজিক সংযোগ করেছে। যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ এইদেশে পলিটিক্স-এর অচলতার কারণ বুঝেছিলেন, এই প্রবন্ধগুলিতে বেশ বিশদে তা আলোচনা করেছে। ... ...
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে একটি বৃহৎ উপাসনালয়, পাপ মোচন জেলখানায় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার; কারণ পাপ মোচন না হলে পরবর্তী পাপের প্রেরণা কোথা থেকে আসবে? ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারটির উপাসনালয়ে যাওয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষ নিদেনপক্ষে একজন সাধারণ কারা প্রহরীর অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হয়না। অথচ কারাগারের লাইব্রেরীতে প্রবেশের জন্য জেল সুপারসহ তিন স্তরের কারা প্রহরীর অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হয়। তবে বেশিরভাগ সময়ই কেউ এত ঝামেলা পোহাতে চায় না, বা এই অনুমতিই মেলে না। ... ...