মরা মাছের চোখের মত তা ছিল ক্ষুদ্র ও নিষ্প্রভ, আমাদের স্কুল জীবন বা মফস্বল। মরা মাছের চোখ যায় যত দূরে, সাইকেল বুঝি কখনো অপেক্ষা করত ঠিক ততটা দূরে পার্শ্ববর্তী স্কুলের শেষ ঘন্টাটি শোনার জন্য। কার জন্য, আজও জানি না। তবে, রবিবারে ক্ষমাদি আসতেন সেতার শিখতে পাশের বাড়িটিতে, তার শাড়ি বা সালোয়ার মিশে থাকত তার পেলব ত্বকে, আজ যদি বলি সে’ই ছিল সেতার আর হাসলে ঝালা বাজত দুই বাড়ির সীমানায় থাকা কাঞ্চন ফুলের গাছে, তাহলে আজ সেই শহরের অনেকেই মেনে নেবেন, সেই ছিল আমাদের মধুবালা টু সুচিত্রা সেন। মাধ্যমিকের পর জেনেছিলাম ক্ষমাদির ছেলে পড়ে আমার থেকে এক ক্লাস নীচুতে, কাজেই দলে ভারী হওয়ারই সম্ভাবনা। গুপী ডাক্তারের মেয়ে মহাশ্বেতা ছিল আমার থেকে দুই বছরের ছোট। শান্ত মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে তর্ক করত নাওয়া-খাওয়া ভুলে, সেই JNU যাওয়ার আগে পর্যন্ত। কানগুলো লাল হতে হতে কখন যে ঝান্ডা হয়ে পতপত করে উড়ত টের পেতাম না। ... ...
প্যারিস, ১৮০৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধ। বিখ্যাত ফরাসি গণিতজ্ঞ এড্রিয়ান-মারি লেজানড্রার (Adrien-Marie Legendre) বাড়িতে তাঁর সাথে দেখা করতে এলেন অপরিচিত এক ব্যক্তি। লেজানড্রার হাতে একটা বই ধরিয়ে দিয়ে আগন্তুক বললেন, ‘বইটা যদি একবার পড়ে দ্যাখেন’। খানিক অবাক হয়ে লেজানড্রা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি বই এটা?’ সসংকোচে আগন্তুক জানালেন, ‘আজ্ঞে, কাল্পনিক সংখ্যার (Imaginary number) উপর ... আমার নিজের কিছু মতামত’। ‘কাল্পনিক সংখ্যা!’ হালকা চমক লাগে লেজানড্রার। ‘বলে কি লোকটা! ... ...
নিদারুণ অবিশ্বাসের পরিবেশে ভালো কাজ হয় না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, জটিল রোগীর সঠিক রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত চিকিৎসার ক্ষেত্রে ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের ভূমিকা বিরাট। রোগী দেখার সময় পূর্ণ মনোযোগ রোগীর দিকে দিতে পারলে তবেই মনের সবটা, ষষ্ঠেন্দ্রিয় সমেত, কাজ করে। যদি অর্ধেকটা মন পড়ে থাকে নিজের পিঠ বাঁচানোর দিকে, রোগী দেখার সময় যদি ভাবতে হয় “এই রোগী নিয়ে কী ধরণের কেস খেতে পারি” বা “এর বাড়ির লোক ঝামেলা করতে পারে কিনা”, তাহলে মনের সেই আশ্চর্য রত্নভাণ্ডারে তালা পড়ে যায়, বদলে সামনে আসে কৈকেয়ীর গোঁসাঘর আর মন্থরার ফিসফাস। রোগীকে ভালোবেসে দেখা, তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে “কিচ্ছু হবে না, আমি তো আছি” বলা, বা হাল ছেড়ে দেবার আগে নিজের জ্ঞানবুদ্ধি অনুসারে নিয়মের বেড়া ডিঙিয়ে শেষ চেষ্টা করার বদলে এখন অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি শব্দ খাতায় লিখে রাখা, আত্মীয়দের কটার সময় কী জানানো হয়েছে তা নথিবদ্ধ করে সই করিয়ে নেওয়া, বইতে যেটুকু লেখা আছে তার বাইরে যাবার চেষ্টা না করা, দায়িত্ব নিজের কাঁধে না রেখে অন্যান্য স্পেশালিস্টদের রেফার করে দেওয়া, ইত্যাদি। যেন রোগীকে নয়, নিজেকে বাঁচানোর জন্য চিকিৎসা করছি। এভাবে আর যাই হোক, সুচিকিৎসা হয় না। যাঁদের প্রতি সমানুভূতি লাভ করার কথা, তাঁদেরকেই সম্ভাব্য আক্রমণকারী বা আদালতের প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবতে হবে বলে যদি জানতাম, তাহলে আমরা অনেকেই হয়ত অন্য পেশা বেছে নিতাম, যেখানে এর চেয়ে কম পরিশ্রমে এর চেয়ে বেশি উপার্জন করতে পারতাম। চিকিৎসা পেশার একটা নেশা আছে, যেটা চলে গেলে আমাদের অনেকের জন্যেই কাজটি অর্থহীন হয়ে যায়। ... ...
দরজার বেল বেজেছিল একটু পরেই । পর্দার তলার ফাঁকটুকু দিয়ে সদর দেখা যায় না; নারীকণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল- ' নমস্কার , আমি শান্তি। শান্তিলতা।' কণ্ঠস্বর ক্রমশঃ এগিয়ে আসছিল বসার ঘরের দিকে- ' আপনাদের পাড়া আমাদের আগের পাড়ার তুলনায় কত আলাদা! জানেন, ঐ মোড়ের মাথায় যেখানে অনেক দোকান টোকান - মিষ্টি কিনতে গেলাম একটু আগে- দেখি একটা কুকুরছানাকে খাওয়াচ্ছে একটা বাচ্চা ছেলে- বিস্কুট টিস্কুট দিচ্ছে আর হাত নেড়ে কুকুরছানার গায়ের মাছি তাড়াচ্ছে - আমরা যেমন অতিথির খাওয়ার সময় করি আর কি- খেতে খেতে কুকুরটা তাকালো আর ছেলেটা বলল, আগে তুই খা! উনি কী বলবেন জানি না- কিন্তু এও তো এক গল্প, বলুন?' ... ...
রামজন্মভূমি ন্যাস কমিটি গড়ে উঠল। মাথায় রইলেন রামচন্দ্র পরমহংস। পিছনে অশোক সিঙ্ঘল, প্রবীণ তোগাড়িয়া। আর তাঁদের প্রধান মুখ তখন আদবানি। বাজপেয়ীকে ছাপিয়ে উঠতে চাইছেন। এরমধ্যেই ধুয়ো উঠল বোফর্স কেলেঙ্কারির । রাজীব গান্ধির অর্থমন্ত্রী মান্ডির রাজা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং মন্ত্রিসভা থেকে বের হয়ে এলেন। বের হলেন আরিফ মহম্মদ খান এবং অরুণ নেহরু। ভিপি সিং এবং আরিফ মহম্মদ খান তখন বামপন্থীদের নতুন নায়ক। আরিফ মহম্মদ খান আগেই পদত্যাগ করেছিলেন মুসলিম মহিলা বিলের বিরোধিতা করে। তিনি বলতে বলে এলেন সিপিএমের বর্ধমান জেলা কমিটির ডাকে। বর্ধমান টাউন হলে। হইহই করে সবাই গেলাম। এরমাঝে এসেছে জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬। ... ...
রাজামশাইয়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মহামন্ত্রীমশাই বললেন, “আপনার রাজত্বকালের পনের বছর পূর্ণ হতে চলল। প্রথম দুবছরের কিছু গৌণ বিদ্রোহ এবং দু-একটা ছোটখাটো যুদ্ধের পর এই রাজ্যের সর্বত্র শান্তি বিরাজ করছে। অতএব অস্ত্র-শস্ত্রের কোন ঝনৎকার বহুদিন শোনা যায়নি। অসিবল্লভের সমস্যাটা ঘটছে সেখানেই। অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবহার যদি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, অস্ত্র-শস্ত্রের চাহিদা যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের কোন প্রয়োজনই থাকছে না। অসিবল্লভের কথায় ওর অস্ত্রনির্মাণশালায় যে ভাণ্ডারগুলিতে ও নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষণ করে, সেগুলিতে আর স্থান সংকুলান হচ্ছে না। উপরন্তু, সংরক্ষিত অস্ত্রশস্ত্রগুলির অনেকাংশই দীর্ঘ অব্যবহারে জং ধরে এবং ধুলো পড়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠছে”। রাজামশাই চিন্তিত মুখে বললেন, “হুঁ। তার মানে, আপনি কি বলতে চাইছেন, রাজ্যের পক্ষে নিরঙ্কুশ শান্তিও কাম্য নয়”? ... ...
কিন্তু এই কাজগুলোর সবকটাতেই সেই সময়ের দুটি চরিত্র স্পষ্ট। এক, এই সেই সময় যখন শিক্ষিত চাকরি করা স্বচ্ছল মধ্যবিত্তের সাথে নিম্নবিত্তের মানসিক দূরত্ব অনেক কম ছিল। দুই, ভারতীয় সমাজে তখনও ব্যক্তির থেকে সমষ্টির ভালোমন্দ বেশি গুরুত্ব পেত। এই দুটি ঘটনাই এখন অতীত, এবং ব্যক্তি বা সমষ্টির মধ্যে কার গুরুত্ব বেশি, সেই বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই, কুন্দন শাহের ছবিতে কালের নিয়ম মেনেই সেই চিহ্নগুলো ফুটেছে শুধু এট্কুই বক্তব্য। কুন্দন শাহের বংশে সিনেমার কোন ইতিহাস নেই। পরিচালক হিসেবেও তিনি নিজেকে বর্ননা করেছেন বৃত্তের বাইরের একজন হিসেবে, যাঁকে মেইনস্ট্রিমে ফেলা যায়নি, এবং তথাকথিত প্যারালাল সিনেমার কুশীলবদের তালিকাতেও রাখা হয়নি। এমনও নয়, তিনি একমাত্র পরিচালক যিনি মধ্যবিত্তের সুখদুঃখ নিয়ে কাজ করেছেন। কুন্দন শাহকে শুধু আলাদা করেছে তাঁর গল্পের চরিত্রেরা, কারণ তারাও আসলে অনেকেই পরিচালকের মতই সাফল্য-ব্যর্থতার বৃত্তের বাইরের মানুষ, তাদেরও কোন হিসেবে এঁটে ফেলা যায় না। দেগে দেওয়া যায়না "ব্যর্থ" হিসেবে। বরং তারা অবলীলায় ব্যর্থতার লাশ বয়ে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠে পরবর্তী ব্যর্থ প্রোজেক্টের অনুসন্ধানে যাত্রা করে। ... ...
নানা পণ্ডিতের নানা মত, তাও মোটামুটিভাবে বহুজন গ্রাহ্য টাইম লাইনটা এরকম- কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ, যদি সত্যি ঘটে থাকে, মানে একটা বড় রকমের যুদ্ধ, তবে সেটি হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতকে (কম বেশি একশো বছর)। এবং মহাভারতের আদি রচনাকাল শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে। প্রথমে ছিল জয় নামে এক নেহাতই যুদ্ধ কাহিনী, পরে নানান ধর্ম ও উপনিষদের সংস্পর্শে এসে একটা মহাকাব্যের রূপ নেয় খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের আগেই। এটি দ্বিতীয় পর্যায়, যেখানে যুদ্ধ বিবরণীর সাথে যোগ হয়েছিলো নানান উপকথার। প্রায় এক পুরাণের মতন। ... ...
হনুমান বিভীষণের চোখে চোখ রাখে- কাগুমামা। আপনের মতো ভাই খেদায়া নিজে রাজা হইবার শখ তারো আছে। ধর্মশপথ করা বামুনগো কথা অবিশ্বাস কইরা অভিশাপের ভাগ নিতে চাইব না সে। বামুনগো অভিশাপ নিয়া বাড়ি ফিরলে বশিষ্ঠরে দিয়া সীমান্তেই তারে ঠেকাবে ভরত। …তবে পরীক্ষা শুরুর আগেই আপনের বামুনগো বড়ো বড়ো ঘরানা আর অভিশাপ টভিশাপের কাহিনী তারে একটু শোনায়া দিয়েন… ... ...
কমিউনিস্ট বলতে জনমানসে এক বিচিত্র স্টিরিওটাইপ রয়েছে। তারা দুর্নীতিমুক্ত সৎ হবে, তারা বহুজনহিতায় জীবন উৎসর্গ করবে, তারা সর্ববিষয়ে আদর্শ হবে, তারা প্রতিস্রোত হবে, নীরব সেবাব্রতী হবে ইত্যাদি প্রভৃতি। সমস্যা হল সর্বগুণে গুণান্বিত সিপিএমের এই নব্যপ্রজন্ম আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসে নি। ফলে এই বিচিত্র স্টিরিওটাইপ তাদের অধিগতও নয়, আকাঙ্ক্ষিতও নয়। তারা অনেক বেশি বাস্তববাদী। ... ...
পার্ক সার্কাসে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই আমার মনে পড়ে রক্তবীজের কাহিনী। আকাশ-চাটা আগুন-চিতায় সহমরণে মরতে যাওয়া মায়ের অসহ্য যন্ত্রণার চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে জরায়ু উন্মোচনে তার জন্ম। একফোঁটা রক্ত যেখানে পড়ে সেখানেই জন্ম হয় রক্তবীজের। এক থেকে একশ, হাজার, লক্ষ -- লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তরুণাসুর রক্তবীজের সংখ্যা। ... ...
... কি আশ্চর্য্য, বিমান বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যর দায় স্বীকারের কথা উঠলেই সব তছনছ হয়ে যায়, কিন্তু বাম সমর্থকদের 'প্রতিনিধি' সেজে পার্টির সাধারণ সম্পাদককে কাঠগড়ায় দার করানোটা আবার কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ! নেপথ্য ভাষ্যকারকে সবিনয় অনুরোধ যে এই সুবিদাবাদী, সংকীর্ণ দলবাজির রাজনীতি এবং দ্বিচারিতা বন্ধ করুন। এতে বামপন্থার কোনো লাভই হবে না। সিপিআইএম-এর সাধারণ সম্পাদক পার্টির আজ এই বিপর্যয়ের জন্য অনেকাংশেই দায়ী। তাঁর তথাকথিত 'থার্ড-ফ্রন্ট'-এর নামে মুলায়াম সিংহ-জয়ললিতার লেজুরবৃত্তিও মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁকেও যেমন এই বিপর্যয়ের দায় নিতে হবে, তেমনি এই রাজ্যের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব, পার্টির রাজ্য সম্পাদক ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীরও এই বিপর্যয়ের দায় মাথা পেতে স্বীকার করা উচিত। কারণ পশ্চিমবঙ্গে গত ছয় সাত বছর ধরে বামপন্থী রাজনীতির যে কদর্য অবক্ষয় আমরা দেখেছি - গায়ের জোরে জমি অধিগ্রহণ, নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানো, রেশন ব্যবস্থায় দুর্নীতি, রিজবানুরের অপমৃত্যু, মহিলাদের প্রতি অসম্মানজনক মন্তব্য এবং সর্বপরি আক্রান্ত বামপন্থী কর্মীদের পাশে না দাঁড়াতে পারা - তার জন্য রাজ্যের বাইরের কাউকে দায়ী করা অনুচিত।... ... ...
একই পদ্ধতিতে, নকশাল-দমনের উদ্যেশ্যে সন ২০০৬তে সালওয়া জুডুম কম্যাণ্ডো-বাহিনী গঠিত হয় বস্তার সম্ভাগে।এই বাহিনীর পুরোভাগে ছিলেন ভা-ক-পা বিতাড়িত কংগ্রেস নেতা মহেন্দ্র কর্মা। বাহিনীর সদস্য হল ছোটো ছোটো আদিবাসী কিশোরেরা। তাদের হাতে বন্দুক ধরিয়ে দেওয়া হতে লাগল এবং দুই সপ্তাহের ট্রেণিং দেওয়া হতে লাগল, তাদের লাইসেন্স দেওয়া হল বস্তারের জংলা গাঁ-গঞ্জে যখন তখন হানা দেওয়ার, যত খুশি লুট, খুন, ধর্ষণ ও গৃহদাহ সংঘটিত করার। গ্রাম-কে-গ্রাম জ্বলে ছাই হয়ে গেলো। তটস্ত আদিবাসীরা পাহাড়ি জঙ্গল ছেড়ে নেমে এলো পাকা-রাস্তা তথা হাইওয়ের দুইধারে খাঁচার মত করে তৈরী ‘ক্যাম্প’-গুলিতে। পাশাপাশি ‘কোয়া’-উপজাতির আদিবাসী কিশোর যুবকদের দিয়ে তৈরী হল কোয়া-কম্যাণ্ডো। একই ধরণের কার্য্যকলাপের উদ্দ্যেশ্যে। এই সবের জন্য টাকাপয়সা সহ সমস্ত সুবন্দোবস্ত করে দিলো সরকার। এই সব ‘স্থানীয় কম্যাণ্ডো’-বাহিনীর পাশাপাশি জোরকদমে ‘মিলিটারাইসেশান’। স্থানীয় থানাগুলির হাতে চলে এল প্রচুর অর্থ, ক্ষমতা ও ক্ষমতার উৎস তথা ভয়াল অস্ত্রশস্ত্র। বস্তারজুড়ে প্রায় সমস্ত থানা পরিণত হল কাঁটাতার পাঁচিলে ঘেরা ক্যাম্পে। এবং একের পর এক আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন হতে থাকল অঞ্চলে, অজস্র গ্রামকে ঘিরে ফেললো সি-আর-পি-এফ, বি-এস-এফ, কোব্রা ব্যাটেলিয়ন নাগা ব্যাটেলিয়নের ক্যাম্প। শক্ত নজরদারীতে ঘেরবন্দী হয়ে গেলো বস্তারের মানুষেরা। তার পাশাপাশি অন্ধ্রের কুখ্যাত নকশাল-দমক গোষ্ঠী ‘গ্রেহাঊণ্ড’ এসে করে যেতে লাগল একের পর এক এনকাউণ্টার। ২০০৮-এ যখন অপারেশান গ্রীণ হাণ্ট আরম্ভ হয় তখন থেকে আজ অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ২০১৬ অবধি আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন হয়েছে বস্তারে। ... ...
বিদেশে এসে যুদ্ধ করে টিকে গেলে NRI - আর যে অতি কষ্ট করছে টিকে যাওয়ার জন্য - তার দিকে নাক সিঁটকে সমালোচনা- বিদেশে থাকার এত লোভ!” - নিজে সহজে রাস্তা করতে পেরেছে বলে অন্যদের সংগ্রাম/ ইচ্ছে / স্বপ্ন ছোট করার অধিকার অর্জন করে নেয়। স্টিমুলাস চেক - কী সব কথা! বাড়ি বসে বসে গরিব লোককে খোলামকুচির মত টাকা দিয়ে ওদের কাজ করার মানসিকতা সরকার নষ্ট করে দিয়েছে! আমার চেনা বেশ কিছু অতি স্বচ্ছল পরিবার সেই নিয়মের ফাঁকে দিয়ে স্টিমুলাস চেকগুলো পেল! এক গুজরাটি পরিবার যার বেশ কিছু বাড়ি আর ব্যবসা - দশ হাজারের ডলারের বেশি স্টিমুলাস চেক পেয়ে নানা জায়গা ঘুরে এল। আর আমার সাথে কথা হলেই শুধু বলবে যে কাজ করার জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার আনএম্প্লয়মেন্ট বেনিফিট আর স্টিমুলাস দিয়ে শ্রমিকদের অলস বানিয়ে দিয়েছে। অনেক বাঙালি তো লজ্জায় বলতেও পারে না যে স্টিমুলাস পেয়েছে। যে মুখে সমাজ সংস্কার আর দাতব্যের এত গল্প - সোসাইটিতে নাক উঁচু স্টেটাস - ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় দয়ার দান যারা নেয় তারা খুবই নিম্নমানের মানুষ। কিন্তু নিজের ভাগ কেউ ছাড়েনা। হ্যাঁ - নিজের ভাগ ছাড়ার তো কথা ও না। কিন্তু অন্য কেউ ভাগ নিচ্ছে সেটা যদি হজম না হয় - তবে তো সমস্যা। ... ...
হিন্দুরা বলেন লঙ্কা দ্বীপে রাবণের তোরণদ্বার খোলার সময় ঐ শব্দ হয়। মুসলমানেরা বলেন ইমাম মেহেদীর আগমন জনিত কারণেই ঐ শব্দ। হিস্ট্রী অব বাকেরগঞ্জের লেখক বেভারীজ সাহেব সিদ্ধান্তে এসেছেন যে জৈষ্ঠ্য আষাঢ় মাসে ঝড়ের সময় এই শব্দ চারবার শোনা যায়। উনি স্থির করেছেন এর পেছনে বায়ুমন্ডলের কোনো বৈদ্যুতিক ঘটনার যোগ রয়েছে। তবে প্রবল তরঙ্গাভিঘাতের জন্যও এই শব্দ হতে পারে। এ বিষয়ে আরো বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজন। ক্রমশঃ আরো রাত ঘনায়। মোকাম আবাদী জুড়ে চলাফেরা বাড়ে। রুপোলী আঁশ মাখা জাল নিয়ে জেগে ওঠে চরমমতাজ। হোগলা কুটীর ছাওয়া ঘর দোর উঠোন আদুল গায়ে মাখে রাত। হাজার হাজার অশরীরী ছুটে চলে জলাভূমি, নদীঘাট, বর্ষা বাদল পেরিয়ে ভাটার সাগর। তারপর এ দ্বীপ ও দ্বীপ সে দ্বীপ… ... ...
যদিও সব কাঠই চালান যায় এক শহর থেকে অন্য শহরে, যদিও সব করাতই সরবরাহ করে শহর, যদিও শহুরে মুনাফা কোনোদিনই সংগত করে না এখানকার সস্তা শ্রমের, তা বলে কোনো শহরকে তো কাঠচোর শহর বলা যায় না! কেন-না শহর মানেই সভ্যতা। সভ্যতা মানেই বিপ্লব। বিপ্লব মানেই অগ্রগতি। অগ্রগতি মানেই মানুষের ক্রমমুক্তি। তাকে তো আর যা-ই হোক কাঠচোর উপাধি দেয়া যায় না। দিলে নিজের মুখেই থুতু পড়ে, উত্তর পুরুষের বাড়া ভাতে ছাই পড়ে, পূর্ব পুরুষের কথাসাগর নিমিষে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। ফলে, শিক্ষা, সংস্কার, মূল্যবোধ, সংস্কার, স্বাস্থ্যসূচি, গণতান্ত্রিক বাতাবরণ, মেহনতি ঐক্য, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, সূর্য অভিযান, ইত্যাদি প্রভৃতি যাবতীয় শব্দ হয়ে পড়ে মূল্যহীন। ... ...
বিগত আড়াই দশক ধরে এই রাজ্যে সরকারের ভ্রান্ত নীতি আর ব্যবসায়িক পুঁজির যুগলবন্দীতে সরকারি স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্রমশ পঙ্গু করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রমরমা হয়েছে। বলা বাহুল্য, তাতে পৌরহিত্য করেছে সংবাদমাধ্যমের একাংশ, সমাজের বিপুল অংশের মানুষের মধ্যে এই ব্যাপারে সহমত নির্মাণ করেছে। (তাতে পুরোহিতের ছাঁদার যোগান নিশ্চিত হয়েছে, সেটা বিজ্ঞাপনের পাতায় চোখ রাখলেই টের পাওয়া যায়।) মধ্যবিত্ত তো বটেই, নিম্ন আয়ের মানুষেরাও আজ এক প্রকার বাধ্য হয়েছেন এই বেসরকারি ব্যবস্থার কাছে যেতে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে দানা বেঁধে উঠছে অনিশ্চয়তা, স্নায়ুচাপ, ক্ষোভ। দমদমে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ঘটনা এই জটিল পরিস্থিতির ইঙ্গিতবাহী। যে চা-দোকানি মেয়েকে সরকারি অবৈতনিক স্কুলে না পাঠিয়ে আয়ের সিংহভাগ খরচ করে পাড়ার নামজাদা মিশনারি প্রতিষ্ঠানে পড়তে পাঠাচ্ছেন, আর যে মাংসবিক্রেতা টাকার অভাবে ভাইঝিকে পাঠাতে পারলেন না, যে মধ্যবিত্ত গৃহবধূ স্কুলের দিদিমণির কাছে মেয়েকে টিউশন পড়তে পাঠিয়েছেন “স্পেশাল কোচিং” – এর আশায়, আর যে বস্ত্র ব্যবসায়ী ফি বছর স্কুলে মোটা টাকা ডোনেশান দেন মেয়েকে “স্পেশাল অ্যাটেনশন” -এর লোভে, যে অভিভাবক সেটা দিতে পারেন না, আর যে ছোকরা বিপিও কর্মচারী চোখ শানিয়েছে স্কুল ছুটির পর স্কার্টের নীচে কিশোরী হাঁটু দেখে ... এরা সকলেই ভেতরে এক-একটি কালো চোরা স্রোত পুষে অপেক্ষা করে থাকে, আর একদিন একটি মর্মান্তিক ঘটনা, সেই ঘটনাকে ঘিরে রটনা, এই সব স্রোতগুলোকে মিলিয়ে দেয়। আর সবাই ইটপাটকেল নিয়ে জড়ো হয় দিনভর লাইভ সম্প্রচারিত উন্মত্ত জনগণেশের পুজোয়। ... ...
কলকাতার বিকাশ এবং বাংলার বিকাশ এক ধারায় হয়নি। আজকের দুনিয়ার মতো সেদিনের দুনিয়া “গ্লোবালাইজড” হয়ে যায়নি। এজন্য উপনিবেশের অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কলকাতা যেভাবে পরতে পরতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেভাবে সমগ্র বাংলার রূপান্তর ঘটেনি। উনবিংশ শতাব্দীর ৩য় দশকের আগে কলকাতার সাথে বৃহত্তর গ্রামীণ বাংলার উভয়মুখী যাত্রাও দুর্বল ছিল। ফলত কলকাতার খণ্ডচিত্র ভিন্নধর্মী – বাংলার অন্য অংশের চেয়ে। সমাচার দর্পণ পত্রিকায় ১০ কার্তিক ১২৪১ তথা ২৫ অক্টোবর ১৮৩৪-এ প্রকাশিত একটি সংবাদে বলা হয়েছিল – “বঙ্গ দেশে যে ৩ কোটি লোক আছে তাহারদিগকে ইঙ্গলণ্ডীয়রা ৯০০ সামান্য গোরা সিপাহী ও ১০০ ফিরিঙ্গি ও ২১০০ সামান্য সিপাহী অর্থাৎ বরকন্দাজ লইয়া জয় করিলেন এবং মুষ্টি পরিমিত সৈন্যের অধ্যক্ষ ৩১ বৎসর বয়সের মধ্যে এক জন অর্বাচীন অর্থাৎ লার্ড ক্লাইব ছিলেন ... দেখুন বঙ্গদেশীয় জমিদারদের মধ্যে ঘোড়ায় চড়িতে পারেন এমত ৫০ জন পাওয়া ভার অতএব বঙ্গদেশীয় লোকেরদের দ্বারা কি প্রকারে ভয় সম্ভাবনা।” (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পাদিত, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ১৯৩) এ লেখার মাঝে চরম আত্মগ্লানি আছে। কিন্তু কলকাতার জনসমাজকে এ কথাগুলো সেভাবে স্পর্শ করেছিল কি? ... ...
ইতিহাস বলে, সংকট মানুষকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়, সমাধানের পথ বাৎলে দেয়। করোনাভাইরাস থমকে দিয়েছে উন্মত্ত পৃথিবীর অর্থহীন দৌড়, হয়ত সাময়িকভাবেই। অভূতপূর্ব এই বিশ্বজোড়া মানুষের এতটা দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকা, নিজের ঘরের চৌহদ্দিতে। এই পড়ে-পাওয়া সময় হয়ত প্রকৃতির দান, কিম্বা প্রকৃতির পাঠানো কোনো সংকেত -- অন্তর্দর্শনের ডাক। আরও অনেক বড় বড় সঙ্কটের সূচনায় করোনা হয়ত এক ছোট্ট যতিচিহ্নের মতো। ... ...
এর থেকে মনে হয়, হাসাকে যতটা সুখী ভাবতাম-মানে এখন ভাবছি বসে- ততটা সুখী নিশ্চয় সে ছিল না। শাশুড়ী ও পোড়া রুটি প্রসঙ্গে তার অত খচে যাওয়ারই বা কি ছিল, সেসব কি তার দুর্বল পয়েন্ট, অ্যাকিলিসের হিল? আর বনিতা, সে-ই কি সার্থক সুখী ছিল? নাকি সুখের কল্পনা করে রস পেত এত?সে কি হাসা'র নাম করে নিজের ভবিষ্যৎজীবনের সুখের ছড়াই বানাত বসে বসে? এমন বনিতা , যার পায়ে সোনার নূপুর, যার শাশুড়ী পালিয়ে বেঁচেছে, এবং যে দিনান্তে পেট ভরে রুটিটা - পোড়া হোক যাই হোক-অন্ততঃ খেতে পায় ! এইরকম সব প্রশ্ন পায় এখন ভাবতে বসলে। হাসা ও বনিতাকে পেলে খুঁটিয়ে জেনে নেওয়া যেত। কিন্তু তাদের পেলে তবে তো ! আমারও বয়স বাড়লো, আর দুজনেই এক এক করে- না, যা ভাবছেন তা নয়, একসঙ্গে নয়- যে যার মত আলাদা আলাদা কোথায় যে খসে পড়লো, কে জানে। আর তাদের খুঁজে পাওয়া গেল না। ... ...