স্টেটস্ম্যান পত্রিকায় উনসত্তর সালের গোড়ায় একটি ছোট্ট খবর বেরিয়েছিল --- বস্তারের সদর জগদলপুর শহরে মাওবাদী পোস্টার দেখা গেছে, পুলিশ সন্দেহ করছে বাইরে থেকে আসা কিছু যুবককে। শেষে ধরা পড়লেন ইস্পাতনগরী ভিলাইয়ের দুই বাঙালী। তাঁদের কিছুদিন জেলহাজতে রাখা হল। একজন অল্পদিনেই মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। অন্যজন কিছুদিন পরে জামিনে ছাড়া পেলেন। ইতিমধ্যে কোলকাতার মনুমেন্ট ময়দানে মে দিবসের জনসভায় কানু সান্যাল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) গঠনের ঘোষণা করেছেন। এবার রাজ্য কমিটিগুলো গঠনের পালা । তখন ছত্তিশগড় বিশাল মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত একটি অঞ্চল মাত্র। আর কেরালার চেয়ে সামান্য বড় বস্তার ছিল ছত্তিশগড়ের একটি জেলা। ... ...
সুপ্রীম কোর্টের রায় নিঃসন্দেহে হতাশ করেছিল কিন্তু তার থেকেও বেশি আঘাত দিয়েছিল সেই রায়ের ভাষা। সে সম্পর্কে অন্যত্র লিখেছি তাই এখানে আর লিখছি না। তবে দুঃখ, কষ্ট হতাশার সঙ্গে যেটা যোগ হয়েছিল, সেটা একটা রাগ, একটা হতাশাজনিত ক্ষোভ। শুধু আমার মধ্যে নয়, আমার মত চারপাশের অনেক মানুষের মধ্যেই দুঃখর থেকেও বেশী ফুটে উঠেছিল রাগ, দেশের প্রতি প্রবল অভিমান। সেই সময় সেই অভিমানের অভিঘাত থেকে একটা লেখা লিখেছিলাম। প্রকাশের অযোগ্য ভাষার কারণে সেই লেখাকে সেই সময় প্রকাশ করা যায় নি। আজ এক বছরের মাথায় সেই লেখাটাকেই একটু কাঁচি চালিয়ে সভ্য করে দিলাম। মনে হল, সেই যে প্রবল রাগের অনুভূতি সেটাও ডকুমেন্টেড হয়ে থাকা দরকার। ... ...
নিঃশ্বাস ফেলে জুনো বিশ্বস্ত আর্গাসের নিথর শরীর থেকে চোখগুলো তুলে এনে নিজের পোষা ময়ূরের পেখমের মধ্যে বসিয়ে দিলেন। ময়ূর জুনোর প্রতীক, পবিত্র পাখি। ওর মধ্যে দিয়ে বেচারা আর্গাস চিরজীবন বেঁচে থাক। আর কেউ যেন কোনদিন তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে না পারে। ... ...
পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হল, মা ছাড়াও অন্যরা এ দায়িত্ব বেশ নিতে পারে। কোলের শিশুটিকে নামিয়ে রেখে যখন দেশান্তরে যেতে হয়, তখনও মায়ের কোল ছেড়ে মাসির আদরে শিশুটি ভালোই থাকে। এরপরে স্কুলে ভরতির পালা। এদিক-ওদিক স্কুলে স্কুলে ঘুরে যে জ্ঞানটা পেলাম, সেটা হল মায়েরা চাকরী করলে সেই সন্তানেরা মানুষ হয় না। অতএব কোন কোন স্কুল চাকরী করা মায়েদের সন্তান ভর্তি করে না। কেউ বা ইন্টারভ্যুতে মায়ের ডিউটি-আওয়ারস শুনলে সেই যে চোখ মাথায় তোলে, শিশুটি দরজা দিয়ে বেরনর আগে আর সে চোখ নিচে নামে না। প্রশ্ন শুনলাম, how do you expect your daughter to grow up, if you do not give her time? উত্তরটা জানা ছিল। কারণ আমি নিজে চাকরী-করা মায়ের মেয়ে। যদিও সত্যির খাতিরে বলতেই হয় আমার মায়ের অফিসিয়াল ডিউটি আওয়ারস আমার থেকে অনেক কম ছিল, কিন্তু সাংসারিক কাজের ঘণ্টা যে মায়ের অন্তহীন ছিল! সে খবরে কারোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু মোদ্দা কথা বুঝলাম, আমার মত ট্যাঁরা মা, যে সন্তানের স্কুলে ভর্তির মত মহান কাজের জন্য নিজের তুশ্চু চাকরী ছাড়তে রাজি না, সে রকম মা থাকাটাই স্কুলে ভর্তির জন্যে বিপদ। ... ...
কিছু হলদে পাতা।সাদা পাতা হলে এদ্দিনে তা হলদে হয়েই যেত বোধহয়। হলদে পাতা হলদে হলে টের পাওয়া দায়। হলদে পাতারা পুরোনো হয় না। লেখাগুলো পুরানো। টুকরো টুকরো কিছু স্টিকি হলুদ পাতায় টুকরো টুকরো কিছু লেখা। কিছু আঁচড়। অনেক কিছু কথা, যা বলতে পারিনি, কিছু কিছু কথা, যা বলব ভেবেছিলাম, বা অল্প কিছু কথা, যা বলেছিলাম। বলতে পেরেছিলাম। টুকরো টুকরো ক’রে। আমি তাদের জমিয়ে রাখতে থাকি। ফ্রেমে। ... ...
টিভি যাতে বেশি দেখতে না পারি এই বিষয়ে মালকিনের নজর ছিল অবাক করার মত ,পাঁচ মিনিট দেখতে না দেখতেই রান্না ঘরে অকারণে ডাক পড়ত আর আমার মেজাজ গরম হয়ে যেত , পরে রাগ করে টিভি দেখাই ছেড়ে দিলাম । তবে বিজয় দাদা ‘ কহোনা প্যার হ্যায় ‘ দেখিয়েছিল । বাড়িতে ভিডিও প্লেয়ার এলো , মেঝেতে শতরঞ্চি বিছানো হল আর কিছুক্ষণের মধ্যে ম্যাজিক । এই লোকটা মানুষ ? এই রকম রবারের মত শরীর ব্যাঁকায় কীভাবে । আমি প্রায় পাগলের মত গিলতে থাকলাম । আমি তখন হিন্দির সাথে সড়গড় কিন্তু গল্পে কোন আগ্রহ নেই যত আগ্রহ ওই পাগলের মত শরীর দোলানোতে । সিনেমা শেষ হল । ফিরে গেলাম রান্না ঘরের কোনে আমার বিছানায় ,কিন্তু ঋত্বিক রোশন আমার মাথায় কেমন যেন ঝড় তুলতে থাকলো । একা একা অন্ধকার রান্না ঘরে শুরু হল ঋত্বিক রোশনকে নকল করার চেষ্টা । নেশা ধরে গেল বলতে পারেন । সময় অসময়ে নেচে নিতাম -একদিন হঠাৎ বিজয় দাদা আমার নাচ দেখে হেসেই কুটোপাটি । আমি তো লজ্জায় লাল । পরের দিন বিজয় দাদা কেবল আমার জন্য আবার ভিডিও প্লেয়ার ভাড়া করে আনলেন । চুক্তি হল আমাকে ঋত্বিক রোশনের মত নেচে দেখাতে হবে । ... ...
প্রথমবার অফশোর সারভাইভ্যাল ট্রেনিং করতে যাচ্ছি – আমাকে ঠিকানা দিয়ে দেওয়া হল ট্রেনিং সেন্টারের – ম্যাপ দেখে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। শেষে গিয়ে পোঁছলাম – এখানে আমাদের কোম্পানির হাজারো কিসিমের ট্রেনিং হয় – জঙ্গলের মধ্যে একটা নদীর পাশে। এই ট্রেনিং নিয়েই আলাদা করে লেখা যায় – তবে আজকের লেখা প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি অফশোর সারভাইভ্যাল ট্রেনিং এক সপ্তাহের হয়। থিওরি থেকে শুরু করে প্রচুর প্র্যাক্টিক্যাল – পাশ করলে তবেই সার্টিফিকেট। অনেক কিছু শিখতে হত – আগুন কেমন করে নেভাবেন, ফার্স্ট-এড, এক বোট থেকে অন্য বোটে কি ভাবে দড়ি দিয়ে ঝুলে ট্রান্সফার করবেন নিজেকে, প্ল্যাটফর্মে বিপদ হলে জলে কেমনভাবে ঝাঁপ মারবেন, লাইফ-বোট কি ভাবে অপারেট করবেন – ইত্যাদি। পাঁচ দিনের মধ্যে দুই দিন প্রায় জলেই কাটাতে হত – বিশাল সুইমিং পুলের মত ব্যবস্থা আছে, যদিও গভীরতা সাধারণ সুইমিং পুলের থেকে অনেক বেশি। সেখানে শেখানো হত জলে বেঁচে থাকার পদ্ধতি – লাইফবোট না থাকলে কতক্ষণ জলে ভেসে থাকা যায় গ্রুপ করে ইত্যাদি। ... ...
ফ্যাশান ম্যাগাজিনটিতে পুরো ডুবে গিয়েছিলেন, তাই গাড়িটা গেইটের কাছে এসে যখন ধাক্কা খেল, তিনিও গাড়িটার সাথে শরিক হলেন, দু'জনে মিলে কিছুক্ষণ ভীষণ দুলে যখন থামলেন, তখন দু'জনেরই জল গড়িয়ে পড়ছে শরীর থেকে। অচিরেই দালানের ভিতর থেকে আসা একটা কানে তালা দেয়া আওয়াজ সেই জল পড়া থামিয়ে দিল। একই সঙ্গে তার স্বয়ংক্রিয় হৃদপিণ্ডটাও যেন থেমে যাওয়ার উপক্রম হল! ড্রাইভার আবুল একটুখানি ঘুরে এসে তা-ই জানালো যা তিনি আগেই জানতেন। দুইদিন পরপরই বদমাশগুলির মাথায় কী একটা কিরকিরা উঠে আর বেতন বাড়ানোর জিকির তুলে কা কা করতে থাকে সমস্বরে! ... ...
সুলতানার গ্রামের মানুষ তার প্রতিবশীরা অবশ্য বলেছিলেন, সরল,পরিশ্রমী এই মেয়েটির ন্যায়বিচারের জন্য যতদূর প্রয়োজন, তাঁরা যাবেন। সেই কথা তাঁরা রেখেছেন। এরপরই সুলতানার ধর্ষণ আর হত্যার বিচার আর দোষীদের শাস্তির দাবিতে সুলতানার গ্রামের মানুষ রাস্তায় নামেন। তাঁদের সাথে আমরা যাই সোনারপুর থানায়। সুলতানার দুই সন্তানও সেদিন বিচার চাইতে গিয়েছিল সোনারপুর থানায়। যেভাবে গোটা ঘটনাটার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রথম থেকে অসংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছে, সুলতানার ধর্ষণ হয়েছে কিনা তার থেকেও বড় হয়ে উঠেছে মেয়েটি মদ খেয়েছিল কি খায় নি, সোনারপুর থানায় যাওয়ার পর যেভাবে স্থানীয় তৃণমূল নেতারা এলাকার মানুষদের ভয় দেখাতে শুরু করে,প্রায় এক ঘণ্টা তাদের সাথে উত্তপ্ত বাগবিনিময়ের পরই একমাত্র থানায় ঢোকা সম্ভব হয়। আমাদের শুনতে হয় যে, এলাকার মেয়ে,আমরা বুঝে নেবো,যদিও এত বড় নৃশংসতার পরও তাদের কাউকে কোনভাবে পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় নি। ... ...
আদিম এই পেশাটিতে ঠেলে দেবার পেছনে যদিও দারিদ্র, বিশ্বাসঘাতকতা, ঘর বাঁধবার দুস্তর স্বপ্ন, যা মরিয়াও মরে না-- এইগুলি এবং হিউম্যান ট্রাফিকিং প্রায় একশ পার্সেন্ট দায়ী, তবু কাঁচা পয়সার প্রাবল্য একটা বড় ব্যাপার। অনেক মেয়েই সেই লোভ কাটিয়ে উঠতে পারেনা। আর পুনর্বাসনের নামে তার সামনে যেসব প্রকল্প রাখা হয়, সেগুলোর অবস্থা অতি করুণ। দিনে দশ বার ঘন্টা সেলাই মেশিন চালিয়ে বা বিড়ি বেঁধে সে মাসিক যা ইনকাম করবে সোনাগাছিতে একদিনে তার বহুগুণ বেশি করবে। এই খানে ছোট্ট একটি তথ্য। একজন জনপ্রিয় যৌনকর্মী দিনে গড়ে প্রায় কুড়ি জন খদ্দেরের সন্তুষ্টি বিধান করে। এদের প্রায় প্রত্যেকের টাকায় তার আত্মীয় স্বজন প্রতিপালিত হয়। যেন সব লেডি দস্যু রত্নাকরের জীবনকাহিনী। পাপের ভাগ নয়, টাকার ভাগ চাই। ... ...
মতামত দিয়েছেন - যশোধরা রায়চৌধুরী, জয়া চৌধুরী, রৌহিন ব্যানার্জ্জি, অচল সিকি, সৌভিক ঘোষাল ... ...
অথচ এই হাড়গিলেরা একদিন কলকেতাকে প্রায় ‘জোড়াসাঁকো পার্কে’ পরিণত করেছিল। শুধু কলকেতা নয়—ঢাকা, রেংগুন, গৌহাটি—প্রায় সব ক-টি বড়ো শহরই! তালঢ্যাঙ্গা চেহারা... বগের ঠ্যাং-এর পা... পিঠের ইয়া বঢ়কা পালকগুলিরই যত দ্যাখনশোভা... তারপর সেই যে শাপলার ডাঁটার মতো গলা চলছে তো চলছেই... মাঝে গলকম্বল... শেষ হল গিয়ে কাগের বাসার মতো একমাথা উশকোখুশকো মুণ্ডুতে আর দেড়ফুটিয়া লোহার পাতের মতো চঞ্চুর খাইখাই চাঞ্চল্যে! ... ...
এমনকি এই যে আমাকে আর ভাইকে নিয়ে ছড়া লিখেছে কত , কিন্তু মনেই পড়ে না , বাবার কাছে বসে ছড়া শুনছি ঘরে বসে | আর এমনিতে যদি কবিতা পাঠের কথা বল ,সে তো অজস্র | কবিতার আসর , সাহিত্যবাসর লেগেই থাকত | অনেক কবিতা পড়ত সেখানে | শুনে শুনে আমার যে কত কবিতাই মুখস্থ ! -- ছড়া ? বা: ! আচ্ছা, কবিতায় ছন্দ নিয়ে কিছু বিশেষ মতামত ছিল ? --অবশ্যই ! বাবা প্রায়ই লিখেছে , ‘ ছন্দে লেখো আগে | পরে ছন্দ ভাঙার খেলা’ | এই যে সবাই কবিতা লেখে ; ছন্দের ছাঁকনি খুব দরকার | ওই ছাঁকনি ব্যবহার করলেই অ-কবি রয়ে যাবে ছাঁকনিতে আর কবিরা স্বতন্ত্র হয়ে বিরাজ করবেন | তখন সেই সব কবিদের মধ্যে আবার মূল্য নির্ণয়ন করা যাবে…কে কত উজ্জ্বল | এই তো, শান্তিনিকেতনে হয়েছিল ..কবিতা লেখার ক্লাস | সে কী উত্তেজনা | ছেলেপুলেরা লিখছে , বাবাকে দেখাচ্ছে, পড়ে শোনাচ্ছে | বাবা মাত্রা মেপে ঠিকঠাক করে শিখিয়ে দিচ্ছে | বাবা বলত , ' ছন্দ গড়তে শেখার পর…. বুঝতে পারবে | ওই যে সেই খুব চেনা কথা ক'টি ….বাবাই লিখেছিল , ' ভাঙা ….গড়ার চেয়েও মূল্যবান কখনো সখনো ' .. | ... ...
কামদুনির নাছোড়বান্দা মানুষ ব্যাঙ্কশাল কোর্টে নজরদারি চালিয়ে যেতে চান। তাই সব ডেটেই তাঁরা আসেন কলকাতা। কিন্তু পুলিশ তাঁদের প্রতিদিন হয়রানি করে। আসার পথে তাঁদের গাড়ি বারবার বেরাস্তায় ডাইভার্ট করে দেয়া হয়। কোর্টের কাছে তাদের গাড়ি রাখতে দেওয়া হয়না, পুলিশ টাকা চায়। ক্ষুব্ধ মানুষগুলো জানান যে সরকার যদি ভেবে থাকে যে বারাসাত থেকে কলকাতায় কেস নিয়ে এনে ও পুলিশ দিয়ে হয়রানি করে কামদুনির আন্দোলনকারীদের থামিয়ে দেবে তবে তারা ভুল করছে, ভিক্ষে করে হলেও তাঁরা আসবেন। ১০সেপ্টেম্বর তাই আরো বেশী সংখ্যায় এসেছিলেন তাঁরা। এপয়া ও মৈত্রী সংগঠনের কর্মীরাও হাজির ছিলেন। জিপিও-র সামনে পুলিশ তাদের বেধরক লাঠিপেটা করে, অপরাজিতার ছোটো ভাই ও মৌসুমি কয়াল সহ বেশ কয়েকজনকে আহত রক্তাক্ত করে এবং ১১জনকে গ্রেপ্তার করে লালবাজার লকআপে নিয়ে যায়, বাকীদের হেয়ার স্ট্রীট থানায়। ... ...
ঘন জঙ্গলের মধ্যে বজ্রযোগিনীর মন্দির থেকে তখনো কাঁসরঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছিল বাতাসে। দিগন্তজোড়া গাছগাছালির মধ্যেকার ফাঁকফোকর দিয়ে অতি অল্প যেটুকু দৃশ্যগোচর হয়, তাতে কেবলমাত্র মন্দিরের আকৃতি টুকুই বোঝা যায়। সন্ধ্যার অন্ধকারে নাটমন্দিরের জ্বলন্ত প্রদীপমালায় কিছু দুর্বোধ্য অক্ষরের আভাস পাওয়া যায়। সন্ধ্যারতির সময় কিছু ভক্তসমাগম হয়, নারী পুরুষ, বালক, বালিকা সকলেই আসে, ভক্তিভরে অঞ্জলিপ্রদান করে তারা যে যার ঘরে ফিরে যায়। তারপরে শুরু হয় দেবদাসীদের পিশাচিনী নৃত্য। মন্দিরের অনতিদূরে মৃতদেহ সৎকার করতে আসা আত্মীয় পরিজন রা অতি সম্ভ্রমে দূর থেকে এই ডাকিনী নৃত্য দর্শন করে। কখনো বা মৃতদেহ সৎকার সম্পুর্ণ না করেই পালিয়েও যায়। কিছুক্ষন আগেই যে এই সব দেবদাসীরা স্বাভাবিক ভাবে ভক্তবৃন্দের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলো তা বিশ্বাস করাই দুষ্কর হয়ে ওঠে। তাদের দু এক প্রহর আগেও দেখলে মনে হতে পারে তারা আপন আপন গৃহস্থী সামলাতেই ব্যাস্ত। তারা সকলেই কৃশকায়, পরনের লালপেড়ে সাদা শাড়িটি রাঢ় বঙ্গের রীতি অনুসারে পরা। নদীমাতৃক বঙ্গভূমিতে শাঁখ ঝিনুক ইত্যাদির অভাব নেই তাই তাদের আভরণেও শঙ্খের প্রাধান্য। কদাচিৎ বিশেষ তিথিতে পোড়ামাটির গয়নায় সর্বাঙ্গ ঢেকে এই যুবতীরা একসাথে শ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীবক্ষে নগ্নিকা নৃত্য করে। কিছু নিজ অভিজ্ঞতা কিছু জনরব আর বাকীটা কল্পনার পাঁচমিশেল-- এই সবে মিলে এই বজ্রযোগিনীর মন্দিরটি চূড়ান্ত রহস্যজালের সৃষ্টি করে সাধারণ গ্রামবাসীর কাছে ... ...
রঙের খেলা, কথার মেলা ওদের কলমে, পেনসিলে। লেখার মুন্সীয়ানা হার মানাবে যে কোনও চন্ডালকে, আমাদের সাধ্যি কি তাতে কলম চালাই? আমরা শুধু লাইন টেনে দিতে পারি, আর পারি সব্বাইকে পড়ে শোনাতে। ... ...
আসলে হাওয়ার রাত ছিল সেদিন। ফুলশয্যার খাটে ঘন নীল মশারি ফুলে ফুলে উঠছিল। তখন নীলকমলকে হাতির গল্পটা বলেছিল স্বপ্না। নীলকমল হাসিমুখ করে শুনছিল তারপর বলেছিল -ধ্যাত, সরু গলিতে হাতি ঢুকবেই না। হাতি বিষয়ে নীলকমল সবই জানে-এরকমই মনে হয়েছিল তার নতুন বৌয়ের। তখন স্বপ্না অন্য গল্প বলবে ভাবছিল- বিরাট উঠোনে জ্যোৎস্নায় লক্ষ্মীপ্যাঁচা নামত, সেই গল্প। নীলকমল ততক্ষণে সুকুমারের গল্প শুরু করেছিল। চাঁদ আর জ্যোৎস্না দিয়েই শুরু করেছিল নীলকমল। বলেছিল সুকুমারের আশ্চর্য বাড়ির কথা। বলেছিল, চাঁদ উঠলে সুকুমারের বাড়ির সামনের রাস্তায় আইসক্রীম ট্রাক আসে। লাল নীল আলো জ্বলে,ঘন্টা বাজায়। নীলকমল বলেছিল সুকুমার আইসক্রীম ভালোবাসে। স্বপ্নারও একটা গল্প ছিল আইসক্রীমের। প্রাচীন এক আইসক্রীমের রেসিপির- যা ও এক মেমসাহেবের থেকে পেয়েছিল কুচবিহারে-ওর বাপের বাড়ির পাড়ায়। জীর্ণ এক বাড়িতে থাকত সেই মেম আর তার অন্ধ কুকুর। স্বপ্না অবশ্য সে গল্প বলে নি তখন। সুকুমারের গল্প শুনেছিল চুপ করে। এক বছর শুনেছিল সুকুমারের গল্প। তারপর বছর ঘুরতেই কুচবিহার গিয়ে রুফাসকে নিয়ে এসেছিল। বলেছিল বাপের বাড়ির কুকুর। বলেছিল ছোটোবেলায় ও ইংরিজি শিখেছিল এক মেমের কাছে। ইংরিজি শিখত আর রান্না। রুফাস আর রান্নার বই এনেছিল কুচবিহার থেকে। বলেছিল মেম দিয়েছে। নীলকমল রান্নার বই উল্টে দেখেছিল। সমস্ত উপকরণ, মাপামাপির হিসেব অচেনা ঠেকেছিল নীলকমলের। বলেছিল -এসব এদিকের বাজারে পাওয়া যায় না। বলেছিল - সুকুমারকে বলে দেব, দেশে এলে নিয়ে আসবে। স্বপ্না সে বই তুলে রেখেছিল। রুফাস তখন ছোটো। স্বপ্না বলেছিল মেমের অন্ধ কুকুরের নাতি রুফাস। মেমই নাম রেখেছে। পরে একদিন তুমুল ঝড় জলে শিয়ালদায় স্বপ্নার পিসতুতো দাদার সঙ্গে নীলকমলের দেখা হয়েছিল। দার্জিলিং মেল ধরার কথা দুজনেরই। ট্রেন লেট ছিল সেদিন। অনেকক্ষণ গল্প করেছিল ওরা। মেমের কথা কিছু জানে না স্বপ্নার পিসতুতো দাদা, বরং, সেদিন সে রুপুর কথা বলেছিল আচমকা। বলেছিল, রুপু স্বপ্নার প্রেমিক ছিল কুচবিহারে। বাড়ি ফিরে স্বপ্নাকে সে সব কিছু বলে নি নীলকমল। প্রথম ইন্টার্ভিউ দিতে গিয়ে সুকুমারের ট্রেন আটকে পড়েছিল পাটনায়-সে গল্প বলেছিল। ... ...
বাবা একদিন মরে পরে রইলেন চেয়ার মধ্যে। যে কাঠের চেয়ারটায় রোজ বসে থাকতেন বারান্দা, একদিন দেখা গেলো মাথাটা হেলে আছে চেয়ারের কাধে, মুখ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে…। খুব বড় আয়োজন করে বাবার কুলখানি করলেন বড় ভাই। আমাদের ডালডা আর তেলের কারখানাটা বড় ভাইই চালান। ভাবী আমাদের এখানে থাকতে চান না বলে উত্তরায় ফ্ল্যাট কিনে ভাই-ভাবী সেখানেই থাকেন। এই বাড়িতে এখন আমি একা। পুরো একটা বাড়িতে একা থাকতে আমার একটুও একা লাগে না। কেন লাগে না জানি না। স্বপন যে ঘরটাতে ফাঁস দিয়েছিল সেঘরটা তালা দেয়া থাকে। মাঝে মাঝে খুলে ভেতরে ঢুকি। চেষ্টা করি স্বপনের কোন অস্তিত্ব অনুভব করতে। আজ ২২ বছর স্বপন নেই! মণীশ জ্যাঠার যেমন বয়স আটকে আছে মহাকালের ফ্রেমে, স্বপনও সদ্য যৌবনের চেহারা নিয়ে এ্যালবামে আটকে আছে। কি অদ্ভূত, মণীশ জ্যাঠা এ বাড়ির মায়া আজো কাটাতে পারলেন না কিন্তু স্বপনকে কতদিন প্রত্যাশা করেছি শুধু একবার দেখবো…। কিন্তু স্বপন যে দূর কোন দেশের অধিবাসী। স্বপন চলে গিয়ে আর ফিরে আসেনি…। ... ...
মেয়েটির মায়াময় মুখ এক নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কন্ঠস্বরও। - ওই নেকুপুষুমনু শব্দ অনেকবার শুনেছি স্যার। আমাদের গাড়ির কাছে আসতে দেখলেই কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে মিথ্যে ফোনে ব্যস্ত হন সাহেব-মেম, নয়তো কপালে হাত ঠেকিয়ে মাফ করতে বলেন... ফাটা নোট চালিয়ে দিয়ে মনে মনে হাসে লোকে। হলদে, সাদা, লাল – কোন গোলাপই নই স্যার। আমরা হলাম শল্লকী... সারা গায়ে কাঁটা গাঁথা শজারু। নিজের মা সকালে উঠে আমার আর ভাইয়ের মুখ দেখত না। সোজা গোয়াল ঘরে গিয়ে এঁড়ে, বকনা – যা হয় দেখে আসত – এদের কি দোষ। ... ...
রঞ্জনরা ফিরে আসার পর বাবুর বাড়ির ছেলে দুপুরে খেতে বসেছে। হ্যাঁ ঠিক, এ একেবারে ধ্রুব যে, জীবনের শেষ সুখাদ্যটি আমি সেদিন রঞ্জনের জননীর হাতে খেয়েছিলাম। অথচ গৃহস্বামীর কী কুণ্ঠা! "এ মানুষে খায় নাকি? এ তো আমরা খাই। এ তুমি কী করিকি খাব গো?" কাদা কাদা ভেজা মাটির ওপর পেতে দেওয়া রঞ্জনের মায়ের পরণের শাড়ির ওপর খেতে বসেছে তিনটি মানুষ। সামনে গালে হাত রঞ্জনের মা। লাল আকাঁড়া ডুমোচালের ফেনাভাত। ঝড়ে ভেঙে পড়া পেঁপেগাছের ডগার কোঁড়ের তরকারি। তেঁতুলফুল পাতার চচ্চড়ি আর ডোবা-ভাসা ধেনো চিংড়ির টক। এই মাত্র খাদ্যতালিকা। চিরজাগরুক অমৃতের জিহ্বাস্নান। স্বাদ কী বস্তু? রন্ধনশৈলী কেমন হলে স্বাদকে জাপটে ধরা যায়? রন্ধন কাকেই বা বলে? ... ...