আমাদের দেশে এবং সমগ্র বিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো করোনা-কাহিনী স্বাস্থ্য নাগরিকত্বের এই দ্বিত্বতা প্রকট করেছে। ইউরোপ আমেরিকায় একভাবে প্রকটিত, ভারতবর্ষে আরেকভাবে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এর মতো বিশ্ববন্দিত মেডিসিনের জার্নালে আমেরিকায় কালো এবং অন্যান্য গোত্রভুক্ত মানুষের স্বাস্থ্যের সাথে সাদা মানুষদের প্রকট স্বাস্থ্য বৈষম্যকে বলা হয়েছে “স্ট্রাকচারাল রেসিজম” বা সমাজের কাঠামোগত বর্ণবিদ্বেষ। ... ...
গোটা বস্তার সম্ভাগের যা আয়তন, তার ৫১% জমি তুলে দেওয়া হয়েছে মাইনিং, পাওয়ার-প্ল্যাণ্ট সহ বিভিন্ন প্রজেক্টের জন্য। এর মধ্যে ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্টের খাঁই মারাত্মক। ঐখানে কাজ করা এক বন্ধু জানিয়েছিলো যে প্ল্যাণ্টের যন্ত্রপাতির অবস্থা তথৈবচ। অথচ, ভারতের গৌরব এই বি-এস-পি, নবরত্নের এক রত্ন সে, তাকে তো উৎপাদন করে চলতেই হবে। তাই, আউটপুট বাড়াতে, ইনপুট বাড়াতেই হবে। এ’দিকে ছত্তিসগড়ের রাজনন্দগাঁও জেলাস্থ দল্লী-রাজারার মাইন শেষ হওয়ার মুখে। অতএব, বস্তার সম্ভাগের কাঁকের ও নারায়ণপুর জেলা জুড়ে রাওঘাটে আকরিক লোহার নতুন মাইন বানাও নতুন, দান্তেওয়াড়া জেলার খ্যাতনামা বৈলাডিলার চলতি মাইনের প্রোডাকশান ক্যাপাসিটি ২৯ মিলিয়ন টন থেকে ২০২০র মধ্যে ১০০ মিলিয়ন টন কর, রাজনন্দগাঁওর মহামায়া অঞ্চলে ও বস্তার-সংলগ্ন বালোদ জেলার দুলকিতে নতুন মাইন বানাও, প্রভৃতি উদ্যোগ। শুধুই কি ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্ট? আয়রণ ওর মাইনের নাম করে নারায়ণপূরের অবুজমাড়ে, কাঁকেরের চারগাঁ নামের দুইটি গ্রামে এসে গিয়েছে নিক্কো-জয়সওয়াল কোম্পানী। দান্তেওয়াড়ার বাচেলি ও কিরণ্ডৌলে তৈরী হচ্ছে আয়রণ ওর বেনেফ্যাকশান প্ল্যাণ্ট। ইতিমধ্যে বস্তারেই তৈরী হচ্ছে তিনটি স্টীল প্ল্যাণ্ট – ডিলমিলি, নগরনাড় ও লোহাণ্ডিগরে। প্রথমটি আবার ‘আল্ট্রা মেগা’। কাঁকেরের আমাবেড়া অঞ্চলে তৈরী হচ্ছে বক্সাইট মাইন। ... ...
১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে বাংলা একাডেমী আয়োজিত বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে দুটো ব্যানার হোর্ডিং-এর লেখা শ্লোগান পড়ে খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম—“শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলুন”, “শুদ্ধ বানানে বাংলা লিখুন”। তখনই মনে কয়েকটা প্রশ্নের উদয় হয়েছিল। শুদ্ধ ইংরেজি বলা বা লেখার জন্য আমরা যতটা আগ্রহ বোধ করি এবং যত্ন নিই, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তার অভাব কেন? আমরা সকলেই কি বেশিরভাগ সময় শুদ্ধ বাংলা বলি বা লিখি? অথবা ব্যাপারটা কি এরকম যে বাংলা ভাষায় সব রকম বানানই চলে, এবং, শুদ্ধতার কথা বলা এক রকম স্পর্শকাতরতা বা ছুতমার্গ? নাকি, আমরা যে অনেক সময়ই ভুল বলি বা লিখি তা নিজেরাও জানি না বলেই এই সব ভাবি? ... ...
পুজোয় ছুটি বেশি, ঈদে দুদিন ছুটি দিলেই তোষণ থিওরি চলে আসে। সরকার প্রতিমা বিসর্জন সংক্রান্ত দূষণ নিয়ে যতটা চিন্তিত, কুরবানিতে তেমন ব্যবস্থা নিলে অনেক অভিযোগের অবকাশ থাকে না। এইসব বহুকালের ব্যক্তিগত অভিযোগ স্বজাতি বাঙালীর কাছে, বাঙালী হিসেবে খানিক আত্মসমালোচনার। ঈদ নিয়ে মিডিয়ার হইচই নেই, বিজ্ঞাপনদাতাদের দাপাদাপি নেই, এমনকি জরুরী খবর ছেড়ে উৎসব কভার হয় না। যদিও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ভাইচারার জায়গাটা থাকে। মুসলমানরা পুজোয় অঞ্জলি দেন না ঠিকই, মুসলিমদের সহযোগিতাপূর্ণ অংশগ্রহণ নতুন কিছু নয়। অথচ দুঃখের বিষয় সেটিকে উপপাদ্য আকারে প্রমাণ করতে হয়। কখনো মন্ডপে টুপিওয়ালা কিশোরের ছবি, কিংবা মন্ডপের সামনে কর্মরত দাড়িওয়ালা মুসলমান বৃদ্ধের ছবি সহকারে বর্ণনা দিয়ে। নতুন করে প্রমান করার কিছু নেই! পশ্চিমবঙ্গের অনেক পুজোর কমিটিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ বহুকাল থেকেই। সারা পশ্চিমবাংলার পাশাপাশি মুসলিম প্রধান এলাকা গাডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ এলাকায় মুসলমানরাই পুজোর দায়িত্ব নেন। ... ...
ছকে বাঁধা জীবনে আমি পারিনি মানাতে। আমি যা চাই, যা পছন্দ করি তা সমাজ পছন্দ করে না। কারণ আমার মন বললেও আমার শরীরের গঠন অনুযায়ী আমার জীবনযাপনের পদ্ধতি সমাজের বাঁধাধরা নিয়মকে আঘাত করে। এক জনের শরীর দেখে তাকে বিচার করা সমাজের কাছে যতটা সহজ, এক জনের অবয়বহীন মানস দেখে তাকে বিচার করা ততটাই কঠিন। আমার শরীরটা একজন নারীর। সমাজ চায় না আমি ছোট করে ছেলেদের মতন চুল রাখি। আমার বিনুনি বাঁধা উচিত। আমি কোন পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি তাতে সমাজের কিছু আসে যায় না। আমাকে নিয়মের মধ্যে থাকা উচিত। সমাজ চায় না আমি জিন্স প্যান্ট পরি, আমার পোশাক হওয়া উচিত সালোয়ার আর শাড়ি। সমাজ চায় না আমি সাইকেল-বাইক চালাই, চায় কারুর বাইকের পিছনে আমি বসি। সমাজ চায় না আমি বাড়ির বাইরে বেরোই, কাজ করি। চায় আমি রান্না বান্না আর সন্তান জন্ম দিয়ে তাদের দেখাশুনা করি। চায় না আমি মাঠে ঘাটে গিয়ে খেলাধূলা করি, শরীরচর্চা করি। চায় আমি বাড়ির উঠোনে স্কিপিং করি আর শাহ্রুকের রোমান্টিক ফিল্ম দেখি। চায় না আমি কোন ‘নারী’কে সঙ্গিনী হিসাবে বেছে নি। কারণ শরীরের উপর ভিত্তি করে যে সকল নিয়ম কানুন গড়ে উঠেছে, এ সব কিছু তারই অংশ বিশেষ। মন বা মানসের কোন স্থান এখানে নেই। ছত্তিরিশটা বছর ধরে মোটা কাপড়ের নীচে শরীরটাকে আষ্টেপৃষ্টে ঢাকা দিয়ে বাড়ির বাইরে বার হই, লোকের সাথে মিশি। বাড়ি ফিরে বিবস্ত্র হয়ে আয়নার সামনে যখন দাঁড়াই, কুঁকড়ে যাই। যাঁরা আমাকে চেনেন জানেন তাঁদের কাছে আমি কোন আলোচনার বস্তু না, কিন্তু যাঁরা আমাকে চেনেন না, আমাকে নতুন দেখলেন তাঁরা শুধু আমাকে বিস্ময়সূচক দৃষ্টি নিয়ে আপাদমস্তক পরীক্ষা করে গেলেন। আমি চলে গেলে পিছন থেকে কিছু অস্পষ্ট কথা শুনতে পাই, ‘এটা কে? ছেলে না মেয়ে?’ ... ...
`রাত আড়াইটের সময় ট্রেন জলগাঁও পৌঁছাল। জলগাঁও থেকে ফর্দাপুর পঞ্চাশ মাইল। অজন্তা সেই সময় জঙ্গলাকীর্ণ। মুকুলকে চার মাইল দূরে ফর্দাপুরে থাকতে হবে। ১৯৬৫ সালে যখন নারায়ণ সান্যাল অজন্তা আসছেন তখন এই রাস্তায় বাস চলে। ১৯১৭-তে বলা বাহুল্য কোনো বাস নেই। বাইশ বছরের মুকুল অজন্তা দেখার উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছেন। তিনি এক মুহূর্তও নষ্ট করবেন না। রাত আড়াইটেতেই তাঁর টাঙা চাই। সে অবশ্য পাওয়া গেল না। ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল। টাঙাওয়ালা ভাড়া নিল ছাব্বিশ টাকা। হাওড়া থেকে জলগাঁও ট্রেন ভাড়ার প্রায় দ্বিগুণ। টাঙা থেকে দেখা পশ্চিম ভারতের গ্রামের চমৎকার বিবরণ মুকুলের বইতে আছে। নেরি নামের এক গ্রামের কথা আছে যেখানে মাত্র কিছুদিন আগেই প্লেগ হওয়ায় গ্রামের সবাই বাড়ি ফেলে পালিয়েছে। সাজানো-গোছানো লালিত্যময় সে গ্রাম। দরজায় নকশা আঁকা। খাঁ খাঁ করছে। ... ...
ফাইনম্যান নাসার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা নিয়ে বিস্তারিত একটি রিপোর্ট লিখে মতামত দেন, যে এই ভেঙে-পড়া ব্যবস্থা ঠিক না হওয়া অবধি মহাকাশযাত্রা স্থগিত থাকুক। বলেন, “For a successful technology, reality must take precedence over public relations, for nature cannot be fooled”। রজার’স কমিশনের ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও সে রিপোর্ট শেষমেশ প্রকাশ পায়, তবে একেবারে শেষে অ্যাপেন্ডিক্স-এফ হিসেবে। অথচ, থিওকল, বইসজলি আর তাদের সঙ্গীদের সমস্ত সাবধানবাণী ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে, নাসার ম্যানেজমেন্ট উৎক্ষেপণের আগে যে প্রি-লঞ্চ এস্টিমেটটি কষেছিলেন, তাতে বলা ছিল, লঞ্চে শাটল ফেল করার সম্ভাবনা ১০০,০০০এ মাত্র ১ – প্রায় নেই বললেই চলে। তাহলে? ... ...
অনভ্যস্ত ফার্স্ট ইয়ার আমাদের পক্ষে বুঝে ওঠা সত্যিই কষ্টকর যে ইউনিয়ন না থাকা মানে দিন দিন আমাদের কথা বলার ন্যূনতম অধিকার চলে যাওয়া । প্রেসিডেন্সির ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্য সাতচল্লিশ থেকে সত্তর পেরিয়ে আজও প্রাসঙ্গিক, তাকে রক্ষার দায় যদি নাও বোধ করি, তাও, নিজেরা হেসেখেলে নিজেদের ক্যাম্পাসটায় বেঁচে থাকার জন্যই বোধয় একটা সুস্থ স্টুডেন্ট’স বডি প্রয়োজন । যা হচ্ছে হোক যদি চলতে থাকে , তেমন হাল হবে নাতো , নীম্যোলার যেমন বলে গেছিলেন , ওরা যখন ধরতে আসবে তখন কেউই থাকবে না যে প্রতিবাদ করবে . . ... ...
বাইরে ডাক্তার ও সুঁইকুমারীর সমবেত গগনভেদী আর্ত্তনাদ, লোকজনের হৈচৈ,পাড়াতুতো কুকুরবাহিনীর উচ্চস্বরে প্রতিবাদ - এতসবের মধ্যেও চেম্বারে ঢুকে প্রথমেই নজরে পড়ল ডাক্তারবাবুর ফোনটি( ততক্ষণে আমরা নিজেদের মধ্যে ফিরে এসেচি, এ দরজা ভেঙে ঢোকার ক্ষমতা গরুর হবে না)। অকম্পিত হাতে ফোন তুলে দৃঢ়স্বরে বাড়ীতে বলে দিলাম বাচ্চাদের ক্যারাটে ক্লাশ থেকে নিয়ে আসতে। কর্ত্তা যথারীতি সামান্য প্রতিবাদ করছিলেন, তোমরা কোথায় আছ? আমি তো ঠিক চিনি না ক্যারাটে ম্যাডামের বাড়ী (পড়ুন - টিভিতে ম্যাচ চলছে) এইসব। তার উত্তরে আরও দৃঢ়স্বরে জানিয়ে দিলাম যে আমাদের গরু তাড়া করেছে, এ জীবনে বাড়ী ফেরা হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ফিরতে না পারলে সবুজ ব্যাগে ব্যাংকের পাশবই ও টাকা রাখা আছে (সেই সেলফোন, এটিএম কার্ডবিহীন সময়ে ব্যাংকের বইয়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল)। ... ...
সবথেকে খারাপ লাগত যেটা, সেটা হচ্ছে এদের বেশির ভাগেরই বাংলা আর বাঙালিদের সম্বন্ধে একটা নিচু দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে চলা। এদের কাছে বাংলায় কথা বলা যে-কোনও লোকই বাংলাদেশি, যারা সঙ্ঘের জয়যাত্রাকে রুখে দেবার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে অবিরাম। আমি একবার শুনেছিলাম আশুতোষ ঝা নামে এক নামী ল কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রকে ভোপালের বাসিন্দা জনৈক ময়াঙ্ক জৈন টাস্ক দিচ্ছে, হয় অন্তত ৫০ জন বাংলাদেশিকে পিটিয়ে এসো, নয় তো সঙ্ঘ ছেড়ে দাও। এঁদের অনেকেই খোলাখুলি অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে রাখতে উৎসাহ দিতেন, যাতে কিনা দরকার পড়লে মুসলমানদের আর রাজ্যের পুলিশদের সাথে টক্কর দেওয়া যায়। আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে, আমি কিছু সিনিয়র সঙ্ঘ সদস্যের সুনজরে পড়ে গেছিলাম। প্রশান্ত ভাট থেকে ডক্টর বিজয় পি ভাটকর, প্রায় যতজন সিনিয়র সঙ্ঘ ইন্টেলেকচুয়ালকে আমি জানতাম, প্রত্যেকেই হিন্দুত্বের ওপর আমার কাজকর্মের খুব প্রশংসা করেছিলেন। ... ...
এখানেই এই উপাখ্যান শেষ হতে পারত। কিন্তু মানুষের মৃত্যর পরও তার ছায়া থেকে যায়, আর উপসংহারের পরেও থেকে যায় পরিশিষ্ট। ২০১৩ সালে শঙ্কর কিষ্ণরাও খাড়ে বনাম স্টেট অফ মহারাষ্ট্র মামলায় রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট তার পূর্বতন মৃত্যুদন্ডের সিদ্ধান্তগুলি খতিয়ে দেখে। ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় মামলা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সেই মামলার রায়ের কিয়দংশ উদ্ধৃত করা হয়। এটা কোনো আপতিক ঘটনা নয়, যে, আমরা আগের পরিচ্ছেদে ওই মামলার যেদুটি অনুচ্ছেদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি, সুপ্রিম কোর্টও উদ্ধৃত করে সেই দুটি অনুচ্ছেদ থেকেই। এবং তারপর এক লাইনে মন্তব্য করা হয়, “Prima facie, it is seen that criminal test has not been satisfied, since there was not much discussion on the mitigating circumstances to satisfy the ‘criminal test’.” খুব ছোটো করে এর মানে এইরকম, যে, ধনঞ্জয়ের শাস্তিদানের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র সেই পারিপার্শ্বিকতাগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যারা দন্ডদানের পরিমাপ বাড়ায় (অ্যাগ্রাভেটিং সারকমস্ট্যানসেস)। যাতে দন্ডদানের পরিমাপ কমে, সেই পারিপার্শ্বিকতা (মিটিগেটিং সারকমস্ট্যানসেস) কে দেখা হয়নি। দার্শনিকভাবে দেখলে, এও এক পূর্বনির্ধারিত আখ্যানের একরকম স্বীকৃতি, যার চাপে কিছু পারিপার্শ্বিকতাকে উপেক্ষা করা হয়, আর কিছু পারিপার্শ্বিকতাকে দেওয়া হয় অধিকতর গুরুত্ব। ... ...
তবে আর কী। হাতে নিন হাতা-খুন্তি। আর নিজেই করে ফেলুন খানা তৈয়ার। দুই কিসিমের রেসিপি এবার। যারে কয় হাঁসজারু, থুড়ি ফিউশন খাবার—নাম? ফুলকপির হাইকু! আহা খানা নয়, যেন পঙ্ক্তি কবিতার! সঙ্গে তার খানা গুরুবাদী, থুড়ি খানা অথেন্টিক, আগমার্কা খাঁটি— বাদশাহি বিন্স। চেবাতেই মেজাজখানা ঠিক যেন রাজা-রাজড়ার। ভয় নেই, মশলার ভুলে পড়বে না ঢি ঢি! বলে দিতে রান্নার নানা প্যাঁচপয়জার হাজির যে ডিডি। ... ...
অষ্টমঙ্গলার ঠিক কুড়ি বছরের মাথায় ক্যান্সার ধরা পড়েছিল লতিকার। বহুদিনই একটা লাম্প পুষেছিল বুকে। যখন বোঝা গেল, অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে রোগ। ডাক্তার খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন লতিকাকে, অশোককে। বলেছিলেন, ভ্গবানকে ডাকুন। মির্যাকল তো হয়ও। বাড়ি ফিরে খিলখিল করে হেসেছিল লতিকা- 'একদম মিলি । পুরো মিলি। জয়া ভাদুড়ির সেই সীনটা মনে আছে?' অশোক পাগল হয়ে গিয়েছিল যেন- লতিকার ওপর রাগ করেছিল, খ্যাপার মত বলেছিল, 'শুধু সিনেমা , না? শুধু সিনেমা? তুমি মিলি হতে চেয়েছিলে , তাই বলো নি। আমি জানি। সিনেমাই সব তোমার। আমি, বাবলু -কেউ না?' লতিকা শান্ত চোখে তাকিয়েছিল। বলেছিল-'কেঁদো না।' ওকে নন্দিনী মালিয়ার মত লাগছিল অশোকের । যেন ওরা দুজনে ভ্রমর আর অমল। যেন ওদের জোর করে কেউ সিনেমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে-অভেদ্য এক পর্দায় আটকে গিয়েছে লতিকা আর ও- দম আটকে যাচ্ছে, কিছুতেই বেরোনো যাচ্ছে না - 'ছুটি'র লাস্ট সীন চলছে। সিনেমার থেকে বেরোতে না পেরে অশোক ভাবল, তবে সিনেমাই দেখা যাক। ... ...
সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেই উনচল্লিশটি বিধান বিস্তৃত হল। জেফ্রি আমাকে বোঝালেন সেটি খুবই সহজ ছিল। এই ধরো বিজলি/ইলেক্ট্রিসিটি। সুইচ টিপলে আলো বা অগ্নির উৎপাদন হল। প্রাথমিক উনচল্লিশটি বিধানে আগুন জ্বালানো মানা। তাই এটির বারণ। মোজেসের আমলে মোটর গাড়ি, বিজলি বাতি, হাওয়াই জাহাজ, স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট, ফ্রিজ বা ওয়াশিং মেশিন ছিল না। সাবাথের রীতি নীতি অনুসারে বাতিল হল গাড়ি চালানো বা চড়া, বিজলি বাতি জ্বালানো বা নেভানো টেলিভিশন দেখা ফোন করা বা ধরা। বই পড়তে পারেন অবশ্যই। তবে আইপ্যাড বা স্মার্ট ফোনে নয়। তার সুইচ অন করাটা একটা কাজ! ... ...
সোজা চোখে দেখলে, বাংলা সিনেমা একরকম করে যে ধ্বংস হয়েছে, তার কারণ বাজার নয়, কারণটি রাজনৈতিক। বস্তুত একটি পদ্ধতিগত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বাংলা সিনেমার 'কলকাতা ঘরানা'টিকে ধ্বংস করা হয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর তাঁত শিল্পের সর্বাঙ্গীণ ধ্বংসসাধন সম্পন্ন হয়েছিল ৩০ বছরের মধ্যে। সঙ্গে ছিল মন্বন্তর, এবং কিছুদিনের মধ্যেই হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা অর্জনের পর, ৩০ বছরের মধ্যে সিনেমা শিল্পের সর্বাঙ্গীণ ধ্বংসসাধন হয়ে গেছে, এবং একটু আগে থেকে হিসেব করলে মন্বন্তর, বঙ্গভঙ্গ, সবই ছিল সঙ্গে, শুধু কালানুক্রমটি একটু উল্টে পাল্টে গেছে। ... ...
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বলতেন 'দেবশিল্পী'। সলিল চৌধুরী বলতেন, 'হেমন্তদা বা লতা যখন আমার গানের শিল্পী, তখন কল্পনা আমার দিগন্ত ছাড়িয়ে যায়। Sky is my limit.' আকাশই তাঁর সীমা হতে পারে। আকাশ পেরিয়ে ঐ পারেও রয়েছে তাঁর রাজপাট। বাঙালি হয়ে জন্মাবার সুবাদে যেসব ওয়রিশন ফাঁকতালে পেয়ে গেছি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে একটি সেরা অহংকার। নীল ধ্রুবতারা। সব প্রশ্ন থেমে যায় সেদিকে তাকিয়ে। তাকিয়ে থাকাটাই আমাদের প্রাপ্তি । অমলিন উজ্জ্বল উদ্ধার। ... ...
আমরা অবশ্য ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফাঁকে ফাঁকে সাস্টেনেবিলিটি শব্দটা গুঁজে দিয়ে ফান্ডিং চাইছি আজকাল। সাস্টেনিবিলিটির আরেক নমুনা দেখলাম সাইজুদ্দিন ঢালির ক্ষেতে এসে। অসাধারণ চাষের বাহার। এক জায়গায় বেগুন হয়েছে তো পাশে কুমড়ো, কিছুটা সর্ষের ক্ষেত। একটা ধানের বীজতলা। আর টাটাদের পাঁচিলের গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে রজনীগন্ধার গাছগুলি। জিগেশ করলাম ‘চাষে এখন খরচা কেমন? জল পান কোথা থেকে?’ সাইজুদ্দিন বললেন ‘শ্যালো আছে আমার, জল তুলে নিই’ওয়াটার রিসোর্সের ক্লাস করা আমি এবার আঁতকে উঠি- ‘জলসেচ ছিল না এখানে?’ – ‘ছিল তো। বাগজোলা থেকে জল আসত। তো ২০০০ সাল নাগাদ সে সব পুরো রাজারহাটে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই নোটিশ বেরোনোর কিছু আগে। যাদের পাম্প কেনার পয়সা নেই, তারা এমনিই চাষ ছেড়ে দ্যায়।’ কী ভয়ংকর! মাটির তলা থেকে জল তুলে চাষ করা কতটা ক্ষতিকর তা নিয়ে এখানে আলাদা করে লিখছিনা। কিন্তু সত্যিই শিউরে উঠি আমি, কয়েক বছর আগে সেচ বন্ধ করে তারপর জমি দখল করে বাড়ি তোলার ধান্দা যাদের, তারা তো আক্ষরিক অর্থে নিজের মাকে বিক্রি করে দিতে পারে! জমিতে চাষ করছিলেন যে চাচা, তিনি বললেন- ‘আমি তো চাষ ছাড়া আর কিছুই জানিনা। জমি চলে গেলে এই বয়সে খাবটা কী?’ এ প্রশ্ন অনেকবার আলোচনা-টোনায় শুনেছি। কিন্তু এখন যিনি খাবটা কী বললেন, ওই বীজতলার ধান ছড়িয়ে বড় করে আমার অন্ন তিনিই হয়তো সংগ্রহ করেন। সাইজুদ্দিননে জিগেশ করলাম, ওই যে বড় বাড়িগুলো, একসময়ে আপনার, আপনার ভাই বন্ধুদের মাঠ ছিল। এখন পিচ-কংক্রিট। কেমন লাগে? উত্তর দিলেন- ‘কী বলব দাদা, ওখানে এখন তো আমাকে ঢুকতেও দ্যায়না, দেখতেও দ্যায়না ভেতরে কী আছে। কিন্তু একটা হাসপাতাল যদি হত। দরকারে অদরকারে আমিও যেতে পারতাম।’ ... ...
তেমনই বুদ্ধদেব গুহ, থিম্যাটিকালি না হলেও, বাঙালি শহুরে, উচ্চবিত্ত আর ধনী চরিত্রদের বাংলা মূলধারার সাহিত্যে আনলেন। বুদ্ধদেব গুহর বাইরে মূলধারায় উচ্চবিত্ত চরিত্র সেরকমভাবে এসেছে কি? তার একটা কারণ অবশ্যই আমাদের সাহিত্যিকরা ব্যক্তিগত জীবনে মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরীরা ধনী ঘরের সন্তান ছিলেন। তাঁদের গল্পে উচ্চবিত্ত ও ধনী চরিত্র এসেছে সময়ে সময়ে, কিন্তু শরৎচন্দ্র থেকে হালফিলের যে উপন্যাস পড়ি, সেখানে উচ্চবিত্ত চরিত্র খুব কম ক্ষেত্রেই মূল চরিত্রের স্থান পেয়েছে ওই কারণে। ... ...
এই ধরণের নানান বঞ্চনা আর অত্যাচার এই মানুষগুলোর মোহভঙ্গ ঘটাচ্ছিল, সেই সঙ্গে জন্ম নিচ্ছিল ক্রোধ এবং হতাশা। অথচ এর থেকে বেরোনোর কোন রাস্তা তাদের সামনে খোলা ছিল না। ফলস্বরূপ সমাজের একটা বড় অংশ ড্রাগ এবং অন্যান্য নেশার ঝোঁকে পড়ে যাচ্ছিল। এক সময় প্নজাব আর নেশা প্রায় সমার্থক হয়ে গেছিল – অশিক্ষা আর দারিদ্র পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলছিল ক্রমশঃ। মানুষগুলো উদভ্রান্ত, দিশাহারা হয়ে পড়ছিলেন। স্বভাবতঃই এই প্রেক্ষিতে যখন ডেরা সাচা সৌদার মত আশ্রম এগিয়ে এল তাদের ত্রাতা হিসাবে, এরাও সাড়া দিলেন। না দেবার কোন কারণ ছিল না, কারণ ডেরা তাদের সম্মানজনক জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ডেরায় এই মানুষগুলির শিক্ষালাভের ব্যবস্থা আছে, তাদের ড্রাগ ও অন্য নেশা থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা আছে এবং সর্বোপরি, খাদ্যসংস্থান আছে। ডেরা তাদের কর্মসংস্থান দেয়, জীবনের উদ্দেশ্য দেয়। দিশাহারা অসহায় মানুষের কাছে খড়কুটোর মতন যে বাবাজী দিশা দেখাচ্ছে, সে রেপিস্ট কি না জানতে বা মানতে তাদের বয়ে গেছে। ভুললে চলবে না – পেটে সর্বগ্রাসী খিদে থাকলে কে আমাকে খাবার দিচ্ছে, সে খুনী না ধর্ষক, তাতে আমার কিছুই এসে যায় ... ...
বিদেশিদের শনাক্তকরণের অভিযান আসামে অনেকদিন ধরে চলছে। ইলিগাল মাইগ্র্যান্টস (ডিটেকশন বাই ট্রাইব্যুনাল) ও ফরেনারস ট্রাইব্যুনাল – এই দুই আইনি হাতিয়ার দিয়ে বিদেশিদের পাকড়াও করে বহিষ্কার করা হচ্ছিল। এন আর সি নবীকরণ একই উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, তবে এটা আগেরগুলোর তুলনায় আরও ব্যাপক আর উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্প। এন আর সি’র অর্থ ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস, ভারতের জাতীয় নাগরিকপঞ্জী। ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতে প্রথম জনগণনা করা হয়। তখন সমস্ত ভারতীয় নাগরিকের হিসেব নেওয়া হয়েছিল, এন আর সি’তে সে তথ্য ঢোকানো হয়েছিল। আসামে এন আর সি নবীকরণ করা হচ্ছে প্রকৃত নাগরিকদের থেকে বিদেশিদের ছাঁকনি দিয়ে বের করার উদ্দেশ্যে। বিদেশি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে আসামে একাধিক আন্দোলন দানা বেধেঁছে। আশির দশকের শুরুতে চলা আসাম আন্দোলনে তার সবথেকে বড় রূপ দেখা যায়। আন্দোলন শেষ হয় আসাম চুক্তিতে। ধার্য হয় ২৪ মার্চ ১৯৭১-এর পর আসামে আসা বিদেশিদের সনাক্ত করে বহিষ্কার করা হবে। বাস্তবে বহিষ্কারের কাজ বড় একটা এগোয়নি। একটা হিসেব অনুযায়ী ২০১২ পর্যন্ত ২৪৪২ জনকে বহিষ্কার করা হয়, আর প্রায় ৫৪ হাজার লোককে আদালত বিদেশি সাব্যস্ত করে। অন্য দিকে কেন্দ্র সরকারের গৃহ মন্ত্রকের বিবৃতি বলছে ২০০১ সালে আসামে নাকি ৫০ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশি বসবাস করতেন (সারা দেশে ১ কোটি ২০ লক্ষ)। গৃহ মন্ত্রক কোত্থেকে এই তথ্য জোগাড় করেছে জানা যায় নি। ... ...