ঠাকুমা তো জানে না—এগিয়ে চলা প্রতিটি মুহূর্ত আমার বুকের ভেতর দামামা বাজাচ্ছে। বুঝতে পারছি সব আকুতি বিফল হয়ে আমাদের আরেকটু পরেই শহরে ফিরে যেতে হবে। এমন সময়গুলোতে আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। এসব সময়ে আমি শুধু দেখি আমার বাড়িটাকে, দেখি বাড়ির মানুষগুলোকে, এমনকি উঠোনে দুলতে থাকা গাছের ছায়াগুলোকেও। শহরের বাসায় রোদতপ্ত নিরিবিলি দুপুরে মা যখন ভাতঘুম দেয়, তখন নির্ঘুম আমি মায়ের পাশে শুয়ে এসব আবার দেখি খোলা চোখের অন্দর পেরিয়ে বুকের কোঠর থেকে। ... ...
বিপদ নয় তো আমার ভয় ফুরিয়ে আসা দিনে, তরতর করে এগিয়ে আসা ফিরে যাবার দিনে। তাই নবমী ফুরিয়ে দশমীর সকাল আসতেই আমার চোখে কষ্ট জমে জল হয় বারবার। আর আমার সে কষ্টকে বুঝেই ঢাকেও সুর ওঠে, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন… ... ...
তো, নস্টালজিয়ার একটা সেট প্যাটার্ন আছে। প্রথমটায় ঠাট্টা, ফাজলামি প্রচুর করুন। এমন কি বুঝিনা বুঝিনা করে একটু অসভ্য টাইপের জোকও করতে পারেন - কিন্তু সেটা ইশারাতেই। তারপরে একেবারে শেষটায় একটা হুল্লাট ইমোশনাল মোচড় - একটা দগদগে চোখ ছলছলে ভাব - বুক চাপা একটা কান্না গোছের। তাইলে জমবে। আমি প্রথমেই জানিয়ে দি'- আমার এই নস্টালজিক খানা পিনার ব্যাখ্যান একেবারে পুরো ফ্যামিলি নিয়েই পড়তে পারবেন। রেটিং একেবারে ইউনিভার্সাল। আর শেষটাতেও কোনো হায় হায় রে ক্লাইম্যাক্স নেই। খুবই সহজপাচ্য। আসলে এই আমাকে দেখুন। জন্ম ৫৩ সালে (AD), সেই কলেজ বেলার থেকে কতো যে নতুন নতুন খাবার খেয়ে অবাক হলাম। এবং এখনো সেই অবাক হওয়া শেষ হয় নি। ... ...
আমি একটা ফেসবুকের পাতা বানিয়েছিলাম, সেখানে নানা ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা লেখা, আঁকা, মোবাইলে তোলা ফটো, নিজের করা হাতের কাজ, রান্নার ছবি, গান, নাচ বা আবৃত্তির ভিডিও - লকডাউনে যে যা পাঠাত, সেগুলো আপলোড করতাম। এছাড়া ওদের মন ভাল করার অন্য কীই বা উপায় ছিল! বেশিরভাগ তো সব দূরদূরান্তে অজ পাড়াগাঁয়ে বাড়ি, কলেজের কাছে মেস করে থাকে। নিজেরা হাত পুড়িয়ে রান্না করে খায়। একবার একটা পিজি ব্যাচ পাশ করে মেস ছাড়ার আগে আমাদের নেমন্তন্ন করে মাংস ভাত খাইয়েছিল। যা হোক, আলটপকা দু সপ্তাহের লকডাউন হতে দু তিনটে জামাকাপড় নিয়ে সব বাড়ি চলে গিয়েছিল। বই খাতা মেসে পড়েছিল, আর যে ওগুলো নিতে ফিরতে পারবেনা, তা তো স্বপ্নেও ভাবেনি। বাড়িতে বসে লেখা পড়া যে করবে, উপকরণ ছিলনা। আমি যখন বলতাম এই তো রবীন্দ্র জয়ন্তী এসে গেল, কিছু লিখে পাঠাও। অনেকে বলেছিল, ঘরে কাগজ নেই ম্যাডাম। তখন আমি বললাম, যে ওমা! লিখতে বুঝি সব সময়ে কাগজ লাগে? আমি তো মোবাইলে লিখি। তখন আর্জি এলো কোন, জয়ন্তী নয়, শুধু আমাদের জন্য মোবাইলে লিখুন ম্যাডাম। ... ...
জীবনের এক অধ্যায়কে পিছনে ফেলে গাড়ি এসে দাঁড়ায় কাজের পরিসরে। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের ভিতরে। শালিক পাখির গল্প লেখার জন্য আমার নামে পুরষ্কার উঠেছে। আজই অনুষ্ঠান। হাসিমুখে দাঁড়াই মঞ্চে, মাইক ধরে দু চার কথা বলি নিপুণ পেশাদারিত্বে। আজ এই দৃশ্য দেখে যারা সবচেয়ে খুশি হত, তারাই আজ নেই। এ যে কী শূন্যতা বলে বোঝানো যায় না। আত্মীয় স্বজনের গুঞ্জন কানে ভাসে, 'তোমার খুব মনের জোর।' 'তুমি তো একটা ছেলের কাজ করছ'। এদের কাছে অন্তর ঢেকে রাখি সঙ্গোপনে। অসুস্থ বোনটা বাবা মায়ের কাছেই থাকত। এখন তাকে নিয়ে এসেছি সব পাট চুকিয়ে। আর আমার দুটো মেয়ে নয়, তিনটে। মনে ভাবি সামলাতে পারব তো সব দায়িত্ব! ... ...
আমার কর্তা এমন ব্যবস্থা করেছিলেন যে, যতদিন আমরা আড়বালিয়ায় থাকব, বড়জেঠু, মেজজেঠু, সেজজেঠু কারোর পরিবারে আলাদা হাঁড়ি চড়বেনা, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হবে। সে বড়ঘরের ছেলে, বাড়িতে অনেক লোকজনের থাকা খাওয়ার আয়োজনের জন্য কীভাবে সুচারু বন্দোবস্ত করতে হয় - এসব বিষয়ে অল্প বয়স থেকেই বেশ পাকাপোক্ত। তাই আমাকে কিছুই মাথা ঘামাতে হয়নি। ওর এই ব্যবস্থায় আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম, কারণ কয়েকদিনের জন্য হলেও আমার ছোটবেলা যেন ফিরে এসেছিল। ... ...
এসে গেল শীতকালের দিন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভ্যাকসিন মানুষের হাতের মুঠোয় আসতে চলেছে শিগগির। আনলক চতুর্থ পর্ব চলছে। যেহেতু কলেজ এখনও খোলেনি, তাই আমার লকডাউন বহমান, থামার জো টি নেই। লকডাউনের অবসরে কর্তামশাই আমার এই একচিলতে বাসার জানলাগুলো বাগান করে ভরিয়ে দিয়েছেন। জানলা থেকে পুঁইশাক কেটে খাওয়া চলল নানারকম, কখনো শাক, কখনও শুধু ডাঁটা অথবা পুঁইমিটুলির চচ্চড়ি। বিলোনোও হল কিছু নিকট আত্মীয় আর প্রতিবেশীকে। এখন ঐ জানালার একফালি রোদে তার বীজ শুকনো হচ্ছে আবার নতুন করে বোনার জন্য। বারান্দাকে তো একটু বড়সড় জানলা হিসেবে ভাবাই যায়, সেখানে তিনি ফলিয়েছেন ছোটো ছোটো বেগুন, দুরকম - সাদা আর বেগুনি। এখন শীতকালে দক্ষিণের জানলায় রোদ আসে বেশ। ছোটোবেলার স্মৃতি আর ইউ টিউবের পড়া মিশিয়ে, রান্নার মেয়েটির সঙ্গে যুক্তি করে থালায় থালায় দিলাম বড়ি। শুকোতে দিলাম সেই জানলায়। ... ...
একই জিরা,ধনে,লংকা,হলুদ (একটু গ্যাপ দিয়ে পড়বেন প্লীজ) ঐ সব দিয়ে একই ঘ্যাঁট রেঁধেছি আর খেয়েছি- দিনের পর দিন। তা ও ভালো ইউ টিউব আসায় গুল তাপ্পি মারা সহজ হয়েছে। কিন্তু মাসের পর মাস - কতোই বা লিখবো? সুবিধের মধ্যে এই, যে আপনেরাও বিশেষ পড়েন টড়েন না। তা ও, কথা যখন দিইছি, তখন লিখবোই। এইবারের থিম হচ্ছে "হারিয়ে যাওয়া খাবার"। জানেননি তো, যাদের আর কিছু নেই, তাদের নস্টালজিয়াই সম্বল। ... ...
ভারি আশ্চর্য। এখানকার কোন মেয়ে বসে থাকেনা। ঘরের কাজের সঙ্গে মাঠে কাজ করে, কাজু বাদামের বিচি থেকে শাঁস ছাড়ায়, বিড়ি বাঁধে। সরকারি ভাতাও পাচ্ছে। একটু সম্পন্ন ঘরে পরিচারিকা বা রান্নার কাজও করছে। আবার শ্বশুরবাড়িতে বরের মার খাচ্ছে, অভিভাবকদের বকুনি খাচ্ছে - এমন অল ইন ওয়ান উপযোগী প্রাণী যার ঘরে থাকবে তার লাভ। মেয়ে কমার তো কথা নয়। পড়াশোনা জানা ঘরে মেয়েরা কেউ কেউ শিক্ষিকা হয়, কিন্তু বেশিরভাগ নার্সিং পড়ে। বোধ করি সারা দেশে এখানকার নার্স আছে। হঠাৎ মাথার মধ্যে টপ করে একটা চিন্তা আসে। মেয়ে কমেছে না কি ছেলে বেড়েছে? ... ...
আমাদের কর্তা গিন্নি দু'জনের জীবনেই ঝুলন পূর্ণিমার স্মৃতি মনের ঝিলের গভীর স্তরে সাজানো আছে। আমার স্মৃতিতে ভরে আছে - কাঠকলে গিয়ে বস্তা করে কাঠের গুঁড়ো আনা, সেগুলো নানারকম রঙ করা, গ্রাম, শহর, জঙ্গল সব পাশাপাশি, একধারে পাহাড়, নদী, ঝরনা - সেই পাহাড়ের মাথায় শিব ঠাকুর। প্যাকিং বাক্স ওপরে ওপরে রেখে, কাদা জলে ছোপানো কাপড় দিয়ে ঢেকে সেই পাহাড়, কায়দা করে শিব ঠাকুর বসানো। নিচে বড় মোটর সাইকেলের পাশেই ছোট ছোট হাতির সারি। স্বচ্ছ প্লাস্টিক দিয়ে করা একরত্তি পুকুরে উত্তরাধিকারে পাওয়া এক মস্ত পোর্সেলিনের হাঁস। আর ঝুলন যেদিন শেষ হয়, সেদিন হল রাখী। ... ...
মংলুমামা ছিলেন পেটুক মানুষ। কতক্ষণে খাবার সময় হবে তার আর সবুর সইছে না। একটু নিরিবিলি হতেই তাড়াতাড়ি একটা টুলে চড়ে শিকলি খুলে, চুপিচুপি খাটের তলা থেকে হাঁড়িটা টেনে নিয়ে মস্ত এক খাবলা দই মুখে পুরেই পরিত্রাহি চিৎকার! আসলে সেটা তো দই-ই ছিল না, ছিল পানে খাবার চুন। আবার নতুন চুনের ঝাঁঝ খুব বেশি হয়। কাজেই মংলুমামার যে কী দশা হল তা তো বুঝতেই পারা যাচ্ছে। দই খাওয়াও হল না, তার ওপর চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়ার লজ্জা! রায় পরিবারে সুখাদ্যের প্রতি আকর্ষণের শুরুটা হত একেবারে জন্মাবার পর থেকে। সুকুমারের ছোট ভাই নানকু অর্থাৎ সুবিমল সবে জন্মেছে। সে যখন মাত্র কয়েকদিনের, দুপুরে মা তাকে পাশে নিয়ে একটু ঘুমিয়েছেন। হঠাৎ চকাৎ চকাৎ শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখেন, পাঁচ বছরের কন্যা টুনি পান্তুয়া খেতে খেতে ফোঁটা ফোঁটা রস টিপে টিপে ভাইয়ের মুখে দিচ্ছে আর ভাই দিব্যি চকচক করে খাচ্ছে। ... ...
সারাদিনে এই একটা সময় যখন ঠাকুমার ডাকে আমার সারা দিতে ইচ্ছা হয় না। এই সময়ে ঠাকুমাও খুব কঠোর। আমার সকল অনিচ্ছাকে অবহেলা করে নির্দ্বিধায় আমার হাতে ধরিয়ে দেয় পেতলের ছোট গ্লাসে শেফালি পাতার রস আর চিরতার রস। চোখ ভরা অভিমান আর নি:শ্বাস আটকে আমি শেষ করি সেই তিতকুটে রস। ফাঁকা গ্লাস ঠাকুমার হাতে পৌঁছে যেতেই আমি আবার ফিরে পাই আমার সেই ঠাকুমাকে, যে ঠাকুমা কারণে অকারণে আমার হাত ভরে দেয় আনন্দ আর আস্বাদে, - ও ঠাকুমা, কোথায় পেলে রাঘবসই? দাদু এনেছে? ... ...
কোন সবজেক্টে ব্যাবাক মানুষে, মানে ভারত তথা বাংলা তথা গুরুচন্ডালীর সব্বাই, যাকে বলে একেবারে হুলিয়ে পন্ডিত? মানে যাকে বলে প্রাজ্ঞ? না, না, ফুটবল নয়, পোলিটিক্স নয়, সাহিত্য বা ক্যালকুলাসও নয়। আসলে সবাই যে ব্যাপারে মতামতে ভর্পুর এবং অভিজ্ঞতায় উপছে পড়েন সেটা হচ্ছে বিরিয়ানি। একবার হাটে হাঁড়ি ভেঙেই দেখুন না, ঘটি বাঙাল, বাসী, প্রবাসী বা অ্যান্টিবাসী, তরুন বা বুড়োটে, সব সব রকমের জেন্ডার - মানে সকলেই তাদের অফুরন্ত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ভান্ডার নিয়ে হাজির হবেন। তক্কো জুরে দিবেন, কোনটি খাঁটি আর কোনটি বর্ণ সংকর দুষ্ট, কে অথেন্টিক, কে নকল নবীস। শেষ কথা কে কবে? ... ...
— চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে শহুরে সংস্কৃতি গ্রামে খুব একটা ঢোকেনি। টিভিও খুব কম ঘরে ছিল। তাই ব্যাপারটা লেখাপড়ার জন্য নয়। লেখাপড়ার চর্চা ওসব জায়গায় খুব ভালো ভাবেই ছিল। তারিণীপ্রসাদ আর তাঁর বয়স্যরা মিলে স্বাধীনতার পরে তৈরি করেছিলেন ঐ এলাকার ছেলেদের জন্য প্রথম হাইস্কুল। আর মেয়েদের ইস্কুল শুরু হয়েছিল তোর ঠাকুমা বেলারানীর তত্ত্বাবধানে, তোদেরই বাড়ির দাওয়াতে। — এই তো, এবার ইস্কুলের গল্প চলে এসেছে। বল, বল পুরোটা। কিন্তু আমি তো জানতাম ইস্কুল, হাসপাতাল সব কিছু বুড়ো ঠাকুরদা তারিণী করেছেন। এর মধ্যে ঠাকুমাও ছিল! ঠাকুমা লেখাপড়া জানতো? একটু খুলে বল দেখি। ... ...
বিয়ের পরে নতুন বউ, শ্বশুর বাড়িতে দুর্গাপুজো, শাশুড়ি বরণ শেখাচ্ছেন, সিঁদুর খেলা, বরের ক্যামেরায় সিঁদুর মাখা মুখের ছবি, মত্ত হয়ে ছিলাম। বাড়িসুদ্ধ সবাই মাতোয়ারা। হঠাৎ চোখে পড়লো, সবার প্রিয় বড়দি, আমার বড় ননদ ঘরে মুখ চেপে ডুকরে কাঁদছে। বিধবা বলে এই আনন্দে তার অধিকার নেই, নিজের বাড়িতেও। সেদিন বিজয়ার আর একটা নির্মম মানে বুঝলাম - সধবার স্বীকৃতি আর আনন্দের তলায় বিধবার দুঃখ। সধবার অধিকারের উলটো দিকে রয়েছে বিধবার নিঃসঙ্গতা - একরকম সামাজিক বহিষ্কার। এ চাবুক চোখে দেখা যায়না, তাই আসল চাবুকের চেয়ে অনেক কঠিন আর ধারালো, চামড়া কেটে গভীরে বসে যায়। ঐ দৃশ্য দেখার আগে বিজয়া দশমী যে কিছু মেয়ের জন্য এতটা অপমানের তা বুঝতে পারিনি। এখন দশমীর বরণে পারুল কে ডাকি। অল্প বয়সে পারুলের বর সুরাটে কাজ করতে গিয়ে এইডসে মারা যায়। তিনটি শিশু সন্তানসহ একঘরে পারুলকে শাশুড়ি আশ্রয় দেন। পারুল বলে, "হ গো বৌদি, মো কি ঘরো পূজা করিনা? শুধু সিন্দুর দিবানি, প্রদীপ, ধূ্প, মিষ্টি, জড়ো, পানো সবু দিবা"। প্রথাগত শিক্ষার নাগালের বাইরে থাকা আত্মবিশ্বাসী নারীকে বড় ভালো লাগে। ... ...
— তোর ঠাকুরদার জন্ম ১৯২৩ সালে। ঐ সময়ে বাংলার অবস্থাটা আগে মন দিয়ে বোঝ। অমর যখন সাত বছরের বালক, তখন ঘরের পাশে পিছাবনিতে হয় লবণ সত্যাগ্রহ। — আরে পিছাবনি দিয়ে যখন আমাদের গাড়ি ঢোকে, তখন বাজারে ইস্কুলের কাছে একটা স্তম্ভ আছে, সেইটা? বাবা বারবার দেখায়? — হাঁ সেইটাই ঐ সত্যাগ্রহের স্মারক স্তম্ভ। জেলাশাসক পেডির সামনে মিছিল থেকে আওয়াজ উঠেছিল, ‘আমরা পিছাবনি’। — তারপর? ... ...
সারাদিনের মধ্যে এই ফুলতোলার সময়টুকুতেই তো ঠাকুমাকে আমি আমার মতো করে পাই। এ-কথা ও-কথায় আমরা দু-জনকে বারবার জানাই—আর কেউ না, তুমিই আমার সব আবদারের জায়গা। তবে শহরে যাবার পর অবশ্য ঠাকুমার আবদার আমার থেকেও বেড়ে গেছে। ফুলের সাজি হাতে বাইরবাড়িতে যেতে যেতেই ঠাকুমার আবদার, ও দিদি, এবার বার্ষিক পরীক্ষায় খুব ভালো করতে হবে কিন্তু তোমার। শহরে বাবা নিয়ে গেছে তো ভালো করে পড়াতে। বাবার কথা মানতে হবে দিদি। ... ...
আজ আকাশের গায়ে অন্ধকার একটুও বসতে পারছে না। সুপারি বাগানের মাথায় বসে থাকা চাঁদটা এরইমধ্যে আরোও বড় হয়ে উঠেছে। সেই চাঁদের আলো সন্ধ্যা আকাশের গা থেকে ঠিকড়ে পড়ছে আমাদের উঠোনে। উঠোনে এবার পাঁচ প্রদীপ জ্বলে উঠল। কলার মাইজে একমুঠো ধান, একগোছা দূর্বা আর ক’খানা কড়ি রাখল ঠাকুমা। আর কলার খোলে পড়ল তালের ক্ষীর, তালের ফুলুরি, তিলের ক্ষিরশা আর পাতাপোড়া পিঠা। ... ...
আজ গুজার কাটা মাছের রসা হবে। আর হবে পুঁটি মাছের জ্বালের ঝোল। ডালে এবার কাটা পড়ল, তা ঘুরানো হল নরম হাতে। যেন কিছু ডাল আস্ত থেকে যায়। জলে ভালোভাবে সেদ্ধ ডাল মিশে যেতেই তাতে পড়ল কতগুলো বুক-চেরা কাঁচামরিচ। কাঁচামরিচ আর ডাল ফুঁটে হাওয়ায় মিশতে শুরু করল ঘ্রাণ। রান্নাঘরের কালো ঝুল কালি মাখা কালো জানালা পেরিয়ে সেই ঘ্রাণ গিয়ে দাঁড়াল উঠোনে। উঠোনে তখন বারবেলার রোদ সবে গা মেলেছে। সেই রোদে পেয়ারা গাছের ডাল দুলে দুলে ছায়ার আল্পনা আঁকতে। ... ...
যে রাজা কোনারকের সূর্য মন্দির তৈরি করেছিলেন, সেই রাজাই রেমুনার এই গোপীনাথের মন্দির তৈরি করেন। এখন ঘটনা হল, শ্রীচৈতন্যের গুরু যে ঈশ্বর পুরী, তাঁর গুরু হলেন মাধবেন্দ্র পুরী। তিনি একবার এই মন্দিরে কিছুদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। মন্দিরে থাকার সময়ে তিনি জানতে পারেন এই মন্দিরে গোপীনাথকে ক্ষীর নিবেদন করা হয়। আমার শ্বশুরবাড়ির স্থানীয় ভাষায় পায়েস, ক্ষীর এইসব ভোগকে বলা হয় ক্ষীরিভোগ। একদিন পুজোর আগে ঠাকুরের সামনে পরপর ক্ষীরের পাত্রগুলি এনে রাখা হচ্ছিল। মাধব ঠাকুরের মনে হল, ইশশ্, যদি একবার চেখে দেখতে পারতাম কেমন স্বাদ, তবে আমার আশ্রমেও আমি ঠিক এমনই ভোগের ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্তু এই ভাবনা আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চমকে উঠলেন, এ কী সর্বনাশ করে ফেললেন। তিনি যে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। তাঁর কি সাজে দেবতার ভোগ দেবতাকে নিবেদন করার আগে নিজে সেবন করার ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেওয়া? ... ...