এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • মঠের দেশে, পরণকথার দেশে

    I
    অন্যান্য | ১৩ অক্টোবর ২০১১ | ৬৪৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • rimi | 168.26.205.19 | ২৯ অক্টোবর ২০১১ ০১:১৮494681
  • তুলে দিলাম। ও ইন্দোদাদা, না লিখেই ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না!
  • I | 14.96.77.15 | ২৯ অক্টোবর ২০১১ ০১:৩৫494682
  • আজ আর হবে না বুইনডি । লেখা আসতেছে না। দেখি কাল আবার !
  • I | 14.96.77.15 | ২৯ অক্টোবর ২০১১ ০১:৪৪494683
  • আজ আর হবে না বুইনডি । লেখা আসতেছে না। দেখি কাল আবার !
  • nabagata | 212.23.103.72 | ২৯ অক্টোবর ২০১১ ০২:৩০494684
  • এই টৈ আমার খুব গভীর কিছু জায়গা স্পর্শ করছে। ৯৪ এ রাজসাহী গেছিলাম, তার পর থেকে অন্তত ৯৯ সাল অব্দি ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম/জেনেছিলাম বেশ কিছু মানুষকে য্‌নারা মুক্তিযুদ্ধের বুকে চেতনার প্রদীপ জ্বালিয়ে লড়াই করে চলেছেন জামাতি ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে যারা ইতিহাস উল্টে দিতে চায়। আজ সেই যোগ অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ নানা কারণে, তবু রাজশাহীর আবু বকর খুলনার মুক্তি মজুমদার এনাদের কথা মনে পড়ে। সময় পেলে কখোনো শোনাবো।
  • I | 14.99.58.34 | ৩০ অক্টোবর ২০১১ ০০:৩০494685
  • ফিরে আসছি শহীদ মিনার থেকে। রফিক ভাই ও সুষেণ এলোপাথারি এদিক-ওদিক দেখাতে দেখাতে চলেছেন- এই যে এদিকে জগন্নাথ হল-সরু গলি চলে গেছে, আলোর মালায় সাজানো, পুজো হচ্ছে; এই কার্জন হল, ভাষা আন্দোলনের কত ইতিহাসের সাক্ষী এ; "এই যে মধুদা'র ক্যান্টিন'-রফিক ভাই হাত নাড়িয়ে কোন এক অনির্দেশ্যর দিকে দেখান : আমিও হ্যাঁ হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ি, কে মধুদা-কেন মধুদা-কিছু না জেনেই।

    অন্ধকার হয়ে গেছে। আলো জ্বলে উঠেছে ঢাকা শহরের। আমরা এবার এসেছি বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দুর্গাপূজা দেখতে। হা, এই নাকি ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুজো, এ তো ঢমক-চমক কিছুই নেই, আমাদের পাড়ার পুজোর মত ! মূল মন্দিরটি ছোট বলে সামনে স্থায়ী মণ্ডপে পুজোর ব্যবস্থা। অন্তত: প্রতিমা দেখে শান্তি হবে ভেবেছিলাম-সাবেক একচালার প্রতিমা, কাঁচাহলুদ রং-টানা টানা চোখ -এইসব ভেবেছিলাম। তা সেসব কিছুই নেই। মাটির প্রতিমা, মাটির চুল, মাটি দিয়ে কাপড়, দুর্গা-লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক -গণেশ সবাই আলাদা আলাদা, কোথায় যেন একটু ফিল্মী ভাব। কলকাতা শহরে আশির দশকে যেমনটা দেখা যেত। টুংকাই কিন্তু খুব খুশী, প্রতিমায় বেশ একটা বীভৎস রসের আভাস পেয়েছে, আমায় বললো- দ্যাখো, দ্যাখো, সিংহের কামড়ে মহিষটার কেমন নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এসেছে !
    মূল মন্দিরটি পেছনে, সেখানে গিয়ে দেবী ঢাকেশ্বরীর প্রতিমা দর্শন করা হল। প্রায় আটশো বছরের পুরনো আদি প্রতিমাটি ৭১-এর যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়। বল্লাল সেনের প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির, কেউ কেউ বলেন অন্যতম শক্তিপীঠ এটি। একপাশে চারটি শিবমন্দির, সেখানে আর ঢুকলাম না। চার শিবের সিগনিফিক্যান্স কী তাও বুঝতে পারলাম না।
    বেরিয়ে এলাম আবার সেই সামনের দিকের পূজামণ্ডপ দিয়ে। সেখানে সারি সারি চেয়ার পাতা, সম্ভবত: কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। প্রচুর পুলিশ মোতায়েন চারদিকে, বেশ কিছু মহিলা পুলিশ, তাদের কয়েকজনকে দেখে তো আমার বেশ সুন্দরী লাগলো । আস্তে আস্তে লোক জমে উঠছে, এঁদের অনেকেই কিন্তু মুসলিম। বেশ কিছু বোরখা-পরা মহিলা দেখলাম। দেখে বড় প্রাণে আরাম হল। একপাশে একটি স্টেজ মত করা আছে, সেখানে প্ল্যাকার্ড টাঙানো, তাতে লেখা :

    ধর্ম যার যার-উৎসব সবার
    শারদীয়ার অভিনন্দন।।
  • I | 14.99.58.34 | ৩০ অক্টোবর ২০১১ ০১:৪২494686
  • আজকের মত ঢাকা অভিযান শেষ। শুধু আজকের মত নয়, এবারের মত শেষ বলা উচিত। আবার কবে ঢাকা আসবো, আদৌ আসবো কিনা কে জানে। আমরা এখন যাচ্ছি যাত্রাবাড়ি-শনির আখড়া, সুষেণ ও তার দিদি'র বাড়ি। আজকের রাতটা ওখানে কাটাবো, আগামীকাল সন্ধ্যার লঞ্চে বরিশাল গমন; বুড়িগঙ্গা-পদ্মা-যমুনা-মেঘনা -কীর্তনখোলা বক্ষে ওভারনাইট জার্নি। তার আগে কাল সকালে যাবো নারায়ণগঞ্জ-বারদি, লোকনাথ বাবার জন্মস্থান। না নিয়ে গেলে শাশুমা মারদাঙ্গা শুরু করে দেবেন।

    না, এভাবে নয়। এভাবে ঠিক হয় না। কিছুই তো দেখা হল না ঢাকার, চিনলামই না শহরটাকে; একদিনে আর কী-ই বা হয় ! মাসখানেক, নিদেনপক্ষে দু হপ্তা অন্তত: থাকতে হয় ঢাকা শহরকে চিনতে গেলে। দুপুর নাগাদ খেয়েদেয়ে বেরোবো ভাতঘুমের টান অগ্রাহ্যি করে, বাংলাবাজারে গিয়ে বই হাঁটকাবো, নতুন -পুরনো বইয়ের বুকে মুখ ডুবিয়ে সুঘ্রাণ নেবো, বিকেল হতে গিয়ে বসবো শহীদ মিনারের সিঁড়ির ধাপে। বন্ধুরা মিলে আড্ডাবাজি করবো, ঝালমুড়ি খাবো, নারকেলের টুকরোয় কামড় দেবো, বেশী ঝাল খেয়ে ফেলে শিশাবো। সবাই যখন ব্যস্ত-সমস্ত এদিক ওদিক ছুটছে, আমরা তখন আলসের মত ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে গুটগুট করে হাঁটছি দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম, শহরের গন্ধ-মানুষপাথার-ইতিহাস ধীরে ধীরে নখের ডগা দিয়ে কোষে কোষে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। রায়ের বাজার-শাঁখারী বাজার- নয়া বাজারে হাঁটবো, ছবি তুলবো; শ্যাম বাজারে পাইকারি আদা-পেঁয়াজ-রসুন-কাচ্চি হলুদ-আমচুরের গন্ধ নেবো, ব্যস্ত কুলি-রিক্সাওলা ধাক্কা লাগিয়ে দিলে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করবো- মিঞা, চক্ষে দ্যাখতে পাও না,চক্ষুদুইখান হোগায় ঢুকাইসো? বলে। তারপর সদরঘাটে গিয়ে বসবো, কাবাব চাখবো, আনারসের নৌকার ব্যাপারীর সঙ্গে আনারসের দরদাম করবো, একে একে বরিশাল-খুলনা-ভোলা'র লঞ্চ ছেড়ে চলে যাবে , বুড়িগঙ্গার কাঁপা কাঁপা কাজলজলে আলোরা সব কাঁপতে কাঁপতে দূরে চলে যাবে, মন উদাস হয়ে উঠবে, জীবনের অনিত্যতা নিয়ে ভাবতে বসবো। একদিন টমটম চড়ে টকাটক টকাটক ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে পুরোনো ঢাকা দেখতে বেরোবো। রিক্সা চড়ে ঘুরতেও যেতে পারি, ইন ফ্যাক্ট, ঢাকার রিক্সাওলাদের নিয়ে একটা ছবির সিরিজ বানাতে পারি, সঙ্গে থাকবে আমার কমেন্টারি। রমনা ময়দানে হাঁটবো, ভোরবেলা ওঠা আমার পোষাবে না বন্ধু, বিকেলেই চরতে বেরোবো না হয়। সংসদ ভবনের সামনে আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা ছবি আঁকতে বসেন, তাঁদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নেবো; সন্ধ্যেয় নাসিরুদ্দিন ইউসুফ কি রামেন্দু মজুমদারের নাটক দেখতে যাবো, সেলিম আল দীনের জন্য দু:খ করবো। কমলাপুর রেল স্টেশনের ফাটাফাটি আর্কিটেকচার দেখে হাঁ হয়ে যাবো, তারা মসজিদ-বায়তুল-মোকার্‌রম ঘুরে ঘুরে দেখবো, ক্রিসেন্ট লেকের সামনে গিয়ে ট্রাইপডে ক্যামেরা লাগিয়ে লম্বা এক্সপোজার দেবো। ইচ্ছা হলে একদিন বেনারসী মার্কেটে যাবো, কিন্তু বেনারসী-জামদানী কিনবো না; একদিন যাবো মহম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে- বিহারী মুসলমানরা সেখানে থাকে, বেনারসী সেলাই করে-কাবাব সেঁকে-পেঠা বানায়-হারিয়ে যাওয়া দেশ পাকিস্তানের জন্য বুড়োবুড়িরা মনে মনে কাঁদে; খোলা নর্দমার গন্ধ ওঠে, মাছি ওড়ে, ঘিঞ্জি বস্তিতে ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো করে না। ৭১-এর মোহাজির এরা, পাকিস্তান এদের ভুলে গেছে, বাংলাদেশ এদের গিলতে পারে নি। একাত্তরের যুদ্ধে প্রচুর বাঙালী এদের পূর্বপুরুষদের হাতে কোতল হয়েছে, বাঙালীরাও এদের মারতে ছাড়ে নি, প্রায় ১৫-৫০ হাজার বিহারী খুন হয়েছে, তাদের সবাই খুনী-লুটেরা ছিল না। কোনো যুদ্ধই ধর্মযুদ্ধ না।

    আবার আসবো ঢাকা, একুশের রাতে শহীদ মিনারের সামনে আল্পনা দেওয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো, একুশের ভোরে পাজামা-পাঞ্জাবী পরে খালিপায়ে মিছিলে হাঁটবো; পয়লা বৈশাখের প্রভাতফেরীর ছবি নিতে আসবো, বাঙালীর একমাত্তর কার্নিভ্যাল, না এলে হয়? এক-আধটা সুন্দরী মেয়ে যদি জুটে যায় ( নিজের ক্ষমতায় তো জুটাতে পারবো না, যদি দয়াপরবশ হয়ে জোটে, বিদেশী দেখে জোটে, মলিন মুখ দেখে জোটে), সাবেকী ঢংয়ে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা কন্যা, তার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিতে দিতে রমনা ময়দানে পান্তাভাত-ইচা মাছ খাবো। আর,না এলেই বা কী? কত সাধ বুকে নিয়ে তো লোকে মরে যায়, কত জায়গার জল তো খাওয়া হয় না, তেষ্টা পেলেও না; সুকুমার রায় তার লম্বা লিষ্টি জানেন। চললাম, ঢাকা!
  • a | 208.240.243.170 | ৩০ অক্টোবর ২০১১ ০১:৫৬494687
  • এই লেখাটা জদি ঢাকায় থাকার সময় পেতুম!!! এখন ভাবি এক বছর ঢাকায় ছিলাম কিন্তু গুলশন-ধানমন্ডি-বাংলাবাজারের বাইরে আর কিছু দেখা হয়নি!! সাভার গেছি, আর কক্সের বাজার, চিট্টাগাঁ।

    তবে, ধানমন্ডির দুইখান কাবাবের দোকান আর গুলশনের ফকিরুদ্দিনের কাচ্চি বিরিয়ানি, ওহ শুধু এর জন্যেই ঢাকা যাওয়া যায়।

    যাহ, টই এর রসভঙ্গ করব না আর। ডাগতারদা, দারুন হচ্ছে।
  • achintyarup | 59.93.242.134 | ৩০ অক্টোবর ২০১১ ০৪:১৪494688
  • পড়ছি
  • r2h | 24.0.227.215 | ৩০ অক্টোবর ২০১১ ০৪:২৪494689
  • হুঁ, খুব মন দিয়ে পড়ছি...
  • dd | 124.247.203.12 | ৩০ অক্টোবর ২০১১ ০৮:৫৩494447
  • খ্যাল করবেন লেখক স্বদেশপ্রীতি, সাবেকী নস্টালজি,বহমান ঐতিহ্যের প্রতি প্যাশন , জন্মচুক্তির বেড়াভাঙা আত্মীয়তা, ইত্যকার কঠিন ও শব্দময় বুড়ি ছুঁয়েও একটি পরকীয়া প্রতি (ঐ যে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা কন্যা) তার লোভ সামলাতে পারেন নি, অসাড়ে প্রকাশ পেয়ে গ্যাছে।

    পুরো লোলা পার্টী।

  • rimi | 75.76.118.96 | ৩১ অক্টোবর ২০১১ ০১:২৭494448
  • ও ইন্দোদাদা, আজও না লিখে ঘুমিয়ে পড়লে?

    ডিডিদা, :-)) লেখকের সঙ্গে নিজেকে বেশ আইডেন্টিফাই করলাম :-)
  • s | 117.194.97.114 | ৩১ অক্টোবর ২০১১ ০৯:২৫494449
  • ইন্দোদাদার এই টইয়ে দু-চাট্টে লাইন লিখব?
    যদি জনতা মারতে না আসে তবেই:-)
  • aranya | 68.38.243.161 | ৩১ অক্টোবর ২০১১ ১০:৫২494450
  • সামরানের হাতেও জাদু কলম আছে, আর বাংলাদেশের কথা যত শুনি, ততই ভাল লাগে। অপেক্ষায় রইলাম।
  • s | 117.194.97.114 | ৩১ অক্টোবর ২০১১ ১২:০৩494451
  • অরণ্য,
    এট্টু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? তাও থেঙ্কু। শুনতে আর কার না ভাল লাগে বল:-)

    এট্টু ভূমিকা-ছোট্ট এট্টুশখানি লেখা, ভাটে সেদিন দু লাইন লিখেছিলাম, তারপর ছ'দিনে তিন প্যারা।
  • s | 117.194.97.114 | ৩১ অক্টোবর ২০১১ ১২:১১494452
  • বিদ্যাসাগর সেতুর উড়ালপুলময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য, অজস্র ভাঙা কাঁচের টুকরোর উপর দিয়ে, উড়ালপুলের চড়াই উৎরাই ভেঙে, ইত্যাদি ইত্যাদি করে চার কিমি হাঁটলে তবেই পৌঁছানো যায় এক বিলাসবহুল উদ্যানে। সেই উদ্যানের ভিতরে কোথাও পথ বকুল বিছানো, যে পথে সে গিয়াছে চলে… কোথাও নাম না জানা ফুলে চাপা পড়ে যাওয়া সরু পিচরাস্তা তো কোথাও শুকনো পাতার মোটা গালিচা পাতা। যে পথে চলতে গিয়ে মনে পড়বেই শুকনো পাতার নুপুরের কথা। নাম না জানা সব পাখির ডাক শুদ্ধ করে দেয় কান, মন আর মস্তিস্ককে। ধবল বক এখানে শুধুই মাছের আশে ধ্যানমগ্ন হয়ে জলের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে না, তারা হেঁটে-চলে বেড়ায় গাছতলায়, মাঠে। গাছেদের থেকে রঙ নিয়ে ঝিলের জল এখানে গাঢ় সবুজ। সবজেটে এই জলের আয়নায় প্রাচীন গাছেদের প্রতিবিম্ব। মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম… না... এই ঝিলে কোনো হংস মিথুন নেই। ...

    এই জলে, এই নি:ঝুম ধোয়া ধোঁয়া ভোরে এঁকে-বেঁকে এগিয়ে যাওয়া ঝিলের জলে থরে থরে ফুটে আছে সব পদ্ম। লাল সাদা। দেখে কেমন ঘোর লেগে যায়। এদিকে ইন্দোদাদার পরাণকথার দেশ আর এদিকে এক ঝিল পদ্ম। মনে পড়ে, মন পড়ে থাকে শালুক পদ্মের ফাঁকে ফাঁকে..

    ০২
    হাওড়ের মাঝখান দিয়ে সদ্য হওয়া এক পিচরাস্তা, যে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে পথে পড়বে দু খানা নদী, যারা এখান দিয়ে সেখান দিয়ে মাঠ পেরিয়ে, বিল ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে মিশেছে মেঘনায়। শুকনো মরশুমের শুকিয়ে থাকা বিলের ইতি উতি জমে থাকা জলে রাজহাঁসের দল। সাদা, ছাই ছাই রঙা সব হাঁসের দল চড়ে বেড়াচ্ছে রাজকীয় মেজাজে। ছানা হাঁস, মা হাঁস, বাবা হাঁসেদের সঙ্গে তাদের পাড়া-পড়শী আর আত্মীয় স্বজনেরা। জল সরে যাওয়ার পর মাছেরা আটকা পড়ে এইসব ছোট ছোট পুকুরের মত দেখতে গর্তে। বড় মাছ সব জাল ফেলে তুলে নেওয়ার পরেও পড়ে থাকে কিছু ছোট মাছ। হাঁসেরা সেখানে খুঁটে খুঁটে খায় সব শামুক, পড়ে থাকা চুনো মাছ। কেউ বা গলা উঁচিয়ে রাজার মতই এদিকে ওদিকে সেদিকে চোখ চালিয়ে দেখে তাদের রাজত্ব। বর্ষার জল নেমে যাওয়ার পরে বেরিয়ে এসেছে সব ফসলী জমি। সদ্য বোনা কচি ধানগাছেদের রঙ নরম আর মোলায়েম এক সবুজ। কোথাও এখনও কিছুই লাগানো হয়নি, জমি শুধু চষে তৈরি করে রাখা। দূরে দূরে গ্রাম দেখা যায়, গাছ-গাছালীতে ঢাকা ছায়া সুনিবিড় সব গ্রাম। সন্ধে হলে যেখানে এখনও লম্ফ বা হ্যারিকেনের আলো জ্বলে। সেই সব গ্রামে এই দুই হাজার এগারোতেও বিজলীবাতি নামে কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। বিলের মাঝে বাথানে বাস করা রাখাল গরু-ছাগলের দলকে বিলে ছেড়ে দিয়ে শুয়ে-বসে অলস সময় কাটায় ছায়া খুঁজে নিয়ে। বিলে ঘুরে বেড়ানো বেশিরভাগ হাঁসেদের ঠিকানা ঐসব বাথান। শুনশান হাওড়। নতুন এই রাস্তায় গাড়ি চলে সারাদিনে হাতে গুনে কয়েকটা। মাঝে মধ্যে হুস হাস শব্দে হাওড়ের এখানে সেখানে ঝিমুতে থাকা পাখা-পাখালীদের উড়িয়ে দিয়ে যায় মোটর বাইক। হাঁসেরা ঘাঁড় বেঁকিয়ে তাকিয়ে থাকে শব্দের উৎসের দিকে।

    বোধ হয় বছরখানেক হয়েছে ইঁট বিছিয়ে বছরের পর বছর পড়ে থাকা এই সড়ক পাকা হয়েছে, মেঘনার এই ছোট আর সরু দুই শাখানদী, বর্ষায় যাকে দেখলে মনে হয়- কূল নাই কিনার নাই অথৈ দইরার পানি… সেই ছোট্ট ছোট্ট দুই নদীর উপর কবে থেকে যেন সেতু বানাবে বলে খাম্বা গেড়ে রেখেছিল। বহু বছর পর এই সেদিন সত্যি সত্যিই সেতু হয়েছে, গুদারা ঘাটের গুদারা গুলো গেছে অন্য কোনো নদীতে, যেখানে এখনও সেতু হয়নি। গুদারাঘাটের পাশেই ঘাট, ইঞ্জিনের নৌকোরা সব এখনও আছে, সকাল বিকেল তারা সওয়ারী তুলে নিয়ে যায় কাছে দূরের সব গাঁয়ে, গঞ্জে, যেসব জায়গায় যেতে এখনও বাহন বলতে শুধু নৌকাকেই বোঝায়। এই রাস্তার শেষে আছে এক গ্রাম, যেখানে আমার মামার বাড়ি। একসময় আম্মা বাপের বাড়ি যেত শুধুমাত্র বর্ষাকালেই। নৌকায় চেপে। এই রাস্তায় রিকশা বা বেবি ট্যাক্সিতেও যাওয়া যেত, কিন্তু সময় অনেক বেশি লাগত, আর যাত্রাও ছিল কষ্টকর, বর্ষাকালে ছইওয়ালা নৌকায় লোকে এমনিও বেড়াতে যেত তো আম্মা যেত বাপের বাড়ি।

    এবার বাড়ি গিয়ে মামার বাড়ি একনজর দেখে আসার সাধ হওয়াতে আমরা দুই বোন রওয়ানা দিলাম সিএনজিতে, নতুন রাস্তা দিয়ে, নতুন হওয়া সেতুর উপর দিয়ে। বিষন্ন মুখে আম্মা বলল, কই যাইবা, ছাড়া বাড়ি ছাড়া ঘর… বাবলী, আমার বোন বলল, চল না আপা, লংঘন নদী দিয়ে নৌকা করে আমরা বেড়িয়ে আসব আম্মার নানির বাড়ি পর্যন্ত, ডাকবাংলার সামনে বসে চিপস আর চানাচুর খাব কোকাকোলার সঙ্গে! নদীর পাড়ে বসে চিপস- চানাচুর- কোকাকোলা খাওয়াটা লোভনীয় অফার হলেও মামার বাড়ি থেকে একবার এমনি এমনি ঘুরে আসাটা অনেক, অনেক বেশি আকর্ষনীয়…

  • I | 14.96.26.46 | ৩১ অক্টোবর ২০১১ ১৩:০২494453
  • আহা !
    তারপর?
  • s | 117.194.97.114 | ৩১ অক্টোবর ২০১১ ১৭:৩৩494454
  • শূণ্য এক বাড়ি। উঠোনের উত্তরে আর দক্ষিণের ভিটেয় তালাবন্ধ সব শূণ্য ঘর। দক্ষিণের ভিটের এই লম্বাটে হাফ ইঁটের দেওয়ালের উপর টিনের ঘরটা আমার মেজমামার। আমার মেজর মামার। একাত্তরে মামার পোস্টিং ছিল পেশোয়ারে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিজের ভূমে এসে যুদ্ধ করতে আদেশ দিয়েছিল সেনাবাহিনি। যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে চাকরী ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরতে চাওয়ায় মামা বন্দী হয় সেখানকার জেলে। যুদ্ধ শেষ হয়। দেশ স্বাধীন হয়। মামার কোনো খবর আসে না। আত্মীয়-স্বজনেরা মামিকে বলে বিধবার বেশ- সাদা কাপড় পরতে। শোকে-দু:খে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া মামি আমার দৌড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যেত, রাস্তায় চলে যেত সাদা কাপড় দেখলে, পরনের কাপড় পড়ে থাকত পেছনে, মামি দৌড়াত রাস্তায়।

    তিয়াত্তরের শেষের দিকে, যখন মামিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে মামা আর নেই, মরে গেছে, মিশে গেছে পাকিস্তানের মাটিতেই সেই সময় একদিন মামা ফিরে আসে। ছ’ফুট লম্বা সাজোয়ান মামা আমার প্রায় পঙ্গু আর কুঁজো অবস্থায় ফেরে। রোজ সকালে নিয়ম করে জিজ্ঞাসা করা হত, অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যাবে কিনা। না- শোনামাত্রই সব কটা নখে সুঁই ফোটানো হত, চোখের পাতা যতটা সম্ভব টেনে ভুরুর দিকে নিয়ে গিয়ে আলপিন দিয়ে আটকে দেয়া হত। মাটির সানকি, যাতে খেতে দেয়া হত, বাধ্য করা হত ঐ সানকিতেই পায়খানা-পেচ্ছাপ করতে। শুধু মামা নয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনিতে যে সমস্ত বাঙালী সৈনিক ছিল, তাদের প্রায় সকলেরই উপর একই রকমের অত্যাচার চলত। খুব অল্প সংখ্যক বেঁচে গিয়েছিল- যারা রাজী হয়েছিল নিজের দেশ- নিজের মানুষ- স্বজনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে। রাজাকার হতে। যখন দেশে ফেরে, মামার ভুরুতে কোনো চুল নেই, হাতে-পায়ে কোনো নখ নেই। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না মামা আমার। বছরখানেক বাড়িতে থেকে মামা আবার চাকরীতে ফিরে যায়। এবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনি। শারীরিক অক্ষমতার কারণে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ডেস্কে বসে কাজ করতেন মেজর আকরাম হোসেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত মামা। নানান রকম অসুখ বাসা বেঁধেছিল শরীরে। একদিন রাতে বুকে ব্যথা শুরু হয়, হাসপাতালেও নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিজের শরীরের সঙ্গে যুদ্ধে আর পেরে ওঠেনি মামা আমার। থেমে যায় ধুকপুকুনি। হাসপাতালের মাটি চাপড়ানোর শব্দ জানান দেয়, মামা আর নেই।

    নিয়ামুল, মেজমামার ছেলে। সিলেটের এক চা বাগানে চাকরী করে। বাগানেই থাকে। অকালেই বুড়িয়ে যাওয়া সাদা চুলের সামসুন্নাহার, ফোকলা মুখের সামসুন্নাহার, আমার মামার বড় আদরের নাহার- সেখানেই থাকে ছেলে আর ছেলেবৌয়ের সঙ্গে। এক নাতি আর এক নাতনি মামির। ঈদে-চান্দে তারা সবাই বাড়ি আসে, তালা খোলে ঘরের, মামি তার ছেলের বৌকে নিয়ে ঘর-দোর-উঠোন সাফ সুতরো করে, দু-চারদিন থাকে তারা বাড়িতে। আত্মীয়-স্বজন আসে এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে। মামি তাদের সঙ্গে গল্প করে, যুদ্ধের গল্প, ‘তাইন’এর গল্প। নিয়ামুলের ছুটি ফুরোয়, ঘরদোর তালাবন্ধ করে তারা চলে যায় সিলেটের কোনো এক চা বাগানে। আবার একবছরের জন্য।..

  • aranya | 144.160.226.53 | ৩১ অক্টোবর ২০১১ ২২:১১494455
  • এই লেখাগুলো বড় কষ্ট দেয়। দেশের সুসন্তানদের হত্যা করা হয়, পঙ্গু করে দেওয়া হয়, অত্যাচারের প্রতিবাদ করলেই। স্বাধীনতার পরেও সেই ট্র্যাডিশন চলতে থাকে। 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' লেখার জন্য হুমায়ুন আজাদ-কে কুপিয়ে মারার চেষ্টা হয়, এমনকি শামসুর রহমান - যিনি জাতির কন্ঠস্বর, তাকেও মৌলবাদীরা আক্রমণ করে....
    সামরান, তোমার হাতে যে জাদু কলম আছে, এ একলা আমার কথা নয়, তোমার পাঠকেরা সবাই মনে হয় একই কথা বলবে। একই জাদু আছে ইন্দো-র লেখাতেও।
    তোমাদের যুগলবন্দী চলতে থাকুক।
  • Nina | 12.149.39.84 | ৩১ অক্টোবর ২০১১ ২২:৩৫494456
  • শাহজাদি
    কত্তদিন পর তোর জাদু কলমে হেসে কেঁদে একসা হলেম----
    কলকাতায় কবে তোর মুখটা দেখব --দিন গুনছি রে ।
  • rimi | 168.26.205.19 | ০১ নভেম্বর ২০১১ ১৭:৫৬494458
  • তুলে দিলাম। এবার লেখো।
  • I | 14.96.62.33 | ০১ নভেম্বর ২০১১ ২১:৩১494459
  • সামরানদি লিখছে না ক্যানো? তাহলে আমি লিখবো?
    অবশ্য গুরুর যা স্পিড, কদ্দুর লেখা যাবে কে জানে !
  • pi | 72.83.90.203 | ০১ নভেম্বর ২০১১ ২১:৪৩494460
  • রাজাকার বা খান সেনাদের অত্যাচারের কথা আগে অনেক লেখায় পড়েছি, কিন্তু সামরানদি, তোমার যুদ্ধে অনিচ্ছুক বাংলাদেশী সৈন্যদের এরকম ট্র্যাজিক কাহিনী আগে পড়িনি। আরো লেখা, তোমার আত্মীয় বন্ধু, আশে পাশের মানুষজনের কথা।

    ইন্দোদা, এমনি ওয়ার্ড বা নোটপ্যাডে লিখে রাখতে পারো তো। সেটা একবারে কপি করে এখানে পেস্ট করে দিলেই হবে।

    আর, বাংলা জার টা নামিয়েছিলে না ? ওটা দিয়ে লেখা যাচ্ছে না ?
  • pi | 72.83.90.203 | ০১ নভেম্বর ২০১১ ২১:৪৫494461
  • মানে, এই কলে লেখা বড় হয়ে গেলে অনেক সময় হ্যাং করে যায় দেখেছি। ওটা করলে সেই ঝোলাঝুলির সময়টুকু বাঁচবে।
  • s | 117.194.97.104 | ০১ নভেম্বর ২০১১ ২২:৩০494462
  • ইন্দোদাদা,
    তুমি লেখো। তোমার বরিশাল-পর্বের অপেক্ষায় আছি।
    মামাবাড়ির গপ্প আমি পরে শোনাব আবার।
    বম্বেপি ঠিক কয়েছে, ওয়ার্ড বা প্যাডে লিখে পোস্টো দিয়ে দাও না।

    বম্বেপি,
    রাজাকার-কথা রাজাকারের গল্পের তরে আছে, এখানে সেসব নয়। এমনিতেও এখন মায়ে-ব্যাটায় জ্বরকে বাছা-সোনা-মনা করে বিদেয় করার চেষ্টায় আছি। সময় বুঝে চোখও আবার জ্বালাতে শুরু করেছে। সিরিয়ালি ডাক্তার- বাড়ি, বাড়ি ডাক্তার চলছে।
  • Nina | 69.141.168.183 | ০২ নভেম্বর ২০১১ ০৪:৪৬494463
  • সে কি রে সামরু
    এত জ্বর হয় ক্যান :-০ ডাক্তার কি কয়?
  • Diptayan | 115.113.42.194 | ০২ নভেম্বর ২০১১ ১৭:৫৩494464
  • ইন্দোদা, অসাধারণ। এটার জন্য ওয়েট করছিলাম। একদমে পড়ে উঠলাম সবটা। গল্পে-শোনা, বই তে পড়া দেশ, আমার পূর্বপুরুষের দেশ পদ্মা-মেঘনা-ধলেশ্বরী-বুড়িগঙ্গা প্লাবিত সেই আশ্চর্য সুন্দর ভূখন্ড; তার কথা। আমাদের জেনারেশন, যারা দেশভাগ কে বই এর পাতায় দেখেছে,'৭১ মানে যাদের কাছে জাহানারা ইমাম আর কাদের সিদ্দীকি - যারা সেই মাটি-র vivid বর্ণনা শুনেছে দাদু-ঠাকুমা র কাছে - তাদের কাছে এই লেখাটা একটা মহাভোজ।
    আমার দাদু বেঁচে থাকলে তোমাকে হট্‌ কাটির রোল খাওয়াতেন ঠিক - সঙ্গে ফ্রী আশির্ব্বাদ।

    যাবই আমি যাবই, ডানাহীনতা পাশরি গিয়ে - কেউ ঠেকাতে পারবে না।

    চালিয়ে যাও।
  • siki | 123.242.248.130 | ০৩ নভেম্বর ২০১১ ১০:০০494465
  • ইন্দোদাদা কি আর লিখবে না?
  • I | 14.99.91.65 | ০৩ নভেম্বর ২০১১ ২২:৪৩494466
  • রাত সাড়ে আটটা- নটা নাগাদ যাত্রাবাড়ী পৌঁছলাম। এই অঞ্চলটি অনেক আগে প্রায় অগম ছিল, কোনো স্থলপথই ইন ফ্যাক্ট ছিল না, নদীপথে নৌকো করে ঢাকা থেকে আসতে হত। ঢাকা শহর বাড়তে বাড়তে সেই সব নদী-নালাকে এখন গ্রাস করে ফেলেছে। এখানে বিনোদন বলতে সে সব সময় ছিল বাঘের ডাক শোনা (রহস্য-রোমাঞ্চ) এবং যাত্রাপালা(মিশ্র রস)। একটি বড় যাত্রাগানের মণ্ডপ ছিল নাকি, তার থেকেই এই নামকরণ।

    রফিক ভাই নামিয়ে দিয়ে গেলেন, মালপত্তর হাতে করে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিতেও চেয়েছিলেন; আমরা বারণ করি। বললেন, "আবার আসবেন।' আমরা বললাম, "রফিক ভাই, ভালো থাকবেন, আপনার স্ত্রী-ছেলেরা (ওঁর দুটি ছেলে) ভালো থাকুক।' রফিক ভাই বললেন," জ্জে, দোয়া করবেন। ইনশাল্লা, আবার দেখা হবে'। আমরা অভিভূত; কলকাতা শহরে এইরকম ব্যবহার কোনো গাড়ি-চালকের কাছ থেকে ভাবতেই পারিনা কখনো। এই রফিক ভাই আমার শাশুড়ি-মাকে আমড়া কিনে দিতে চেয়েছিলেন। আমরা তখন ধানমণ্ডিতে মুজিবের বাড়ি দেখতে গেছি;পায়ের ব্যথার জন্য মা যেতে পারেন নি, দোতলায় উঠতে হবে। গাড়িতে বসে থেকে থেকে ওঁর খুব আমড়া খেতে ইচ্ছে করছিল, কেমন সুন্দর ফুলের মত করে কাটা আমড়া, যে কারোর লোভ লাগবে। কিন্তু কোনো খুচরো নেই, মানি এক্সচেঞ্জে প্রাপ্ত সর্বনিম্ন কারেন্সি ১০০ টাকা। রফিক ভাই বললেন, "খালাম্মা, আপনে খান। আমি কিন্যা দিত্যাছি।'

    সুষেণের দিদি স্বর্ণা (আমাদের থেকে ছোট অবশ্য) বেশ শান্ত, লক্ষ্মী মেয়ে; কথা কম বলে। কিন্তু ভালোবাসার অত্যাচারে সে-ও কিছু কম যায় না। ওর ঐ শান্ত লুকটাই ডিসেপটিভ। আমরা যাওয়ার মুহূর্তের মধ্যে সে কোথা থেকে রাশি রাশি ফল কেটে এনে হাজির করলো; মনে রাখবেন তার আধ ঘন্টার মধ্যেই আমাদের ডিনারে বসতে হবে। তবে বাংলাদেশে মনে হয় ইন জেনারেল লোকে ফল খেতে ভালোবাসে (সামরানদি ভালো বলতে পারবে), মহম্মদপুরের বাসাতেও আমাদের একগাদা ফল দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়েছিল । আর হ্যাঁ, ওদেশে মাল্টা খুব চলে।

    ডিনার খুব হাল্কা ছিল, আমরা অনেক ঘুরেটুরে পরিশ্রম করে এসেছি তো ! চার রকমের মাছ-কোরাল, বেলে, ইলিশ, চিংড়ি, মুরগির মাংস, ডাল ও তরকারি( কী কী ছিল ভুলে গেছি), শেষপাতে দই ও মিষ্টি। কী আর এমন-ঐ সামান্য ক'টা ফলের পরে ! এমন কী বয়স হয়েছে, যে এটুকু খেতে পারবে না ? আমি তো গা গুলোচ্ছে, পেট ভালো নয়, এইসব বলেটলে ( কিছু সত্যতা ছিল) খানিকটা পরিত্রাণ পেলাম, বাকিদের অবস্থা অনুমানের জন্য কোনো পুরস্কার নেই।

    আরো কিছু রাতে স্বর্ণা'র স্বামী এলেন। উনি গার্মেন্টস ইন্ড্রাস্ট্রী'তে চাকরি করেন, ওঁর কোনো ছুটি নেই। নেই বলতে নেইই। সপ্তাহে সাত দিন, বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন-সকাল আটটায় বেরিয়ে যান, রাত সাড়ে দশটা -এগারোটা নাগাদ ফেরেন। বললেন, সংসারের ব্যাপারস্যাপার কিছুই দেখতে পারিনা, স্বর্ণাই দেখে, মাসের শুরুতে ওর হাতে মাইনের টাকা তুলে দিয়েই খালাস। উপায়ই বা কী!
    বাংলাদেশে গার্মেন্টস ইন্ড্রাস্ট্রী'র এই এক্সপ্লয়টেশনের কথা আগে শুনেছিলাম (নাসরীন জাহানের একটি উপন্যাসের কথাও মনে পড়ছে); আজ স্বচক্ষে দেখে গেলাম। গোটা দেশ জুড়ে সবচেয়ে থ্রাইভিং দুটো সেক্টর-গার্মেন্টস ও এন জি ও। দুটোতেই আমার পরিচিত জনেরা রয়েছেন। বাংলাদেশে তৈরী গার্মেন্টস পৌঁছে যায় যুক্তরাষ্ট-যুক্তরাজ্যের শপিং মলে; সামান্য মাইনেয় গার্মেন্টসের মেয়ে শ্রমিকরা উদয়াস্ত খেটে যায়; রপ্তানীকারকদের পেট দিন দিন ফুলে ওঠে, ঢাকার রাস্তায় টয়োটা,বি এম ডাব্লু-মার্সিডিজ বেঞ্জের ভীড় বাড়ে। দেশ জোড়া মাকড়সা'র জালের মত এন জি ও-সেসবেতে কী কাজ হয় ঈশ্বরই জানেন।
  • pi | 72.83.90.203 | ০৩ নভেম্বর ২০১১ ২৩:০২494467
  • বাংলাদেশের গারমেন্ট ওয়ার্কারদের নিয়ে কাল এক ছোট কিন্তু মর্মান্তিক ভিডিও দেখলাম। রেকর্ড করেছি, তবে ভালো আসবে না মনে হয়। দেখি, পারলে কোথাও আপলোড করে দেব।
  • I | 14.99.91.65 | ০৪ নভেম্বর ২০১১ ০০:২৯494469
  • পরদিন সকালে উঠে নারায়ণগঞ্জের রাস্তায় বেরিয়ে পড়া গেল। গন্তব্য বারদি-লোকনাথ বাবা'র জন্মস্থান। ভাবলাম বেশ ফ্যাবুলাস মন্দির-টন্দির থাকবে।
    রাস্তায় কয়েকটা সেতু পার হয়ে যেতে হল। ছোট-খাটো সব নদী, বুড়ীগঙ্গা'র শাখা-প্রশাখা কিনা কে জানে। ছোট ছোট স্টীমার, যন্ত্রচালিত নৌকায় ভর্তি। নদী সরু হয়ে আসছে, দু-পাড়ে চড়া পড়েছে, ম্যান-মেড চড়া। সুষেণ ডেকে দেখালো, দু-পাড়ে বালির লরি দাঁড় করানো, রাশি রাশি বালি এনে নদীর বুকে ঢালা হচ্ছে;ঐখানে নদী ভরাট করে প্রোমোটারেরা ফ্ল্যাট বাড়ি তুলবে। সঙ্গীতা বলল-"এরকম বেআইনী কাজ কী করে?' সুষেণ জানাল-বেআইনী আবার কী, স্বয়ং আইন ওঁদের সাথে, নিশ্চিত কোনো না কোনো মন্ত্রীর চেলাবেলা এঁরা। শীর্ণা নদীটি অতশত বোঝে না মানুষের রকমসকম, সে কঁকিয়ে বলে-বাপা হে ! আবার জলের দিনে এইসব মানুষী যোগাড়যন্তর তোড়ে ভাসিয়ে দেবে কি না, তা সে নিজেই জানে না।

    রাস্তায় একস্থানে গ্যাস ভরতে গাড়ি দাঁড় করানো হল; এখানে অঢেল গ্যাস স্টেশন, গ্যাস বেশ সস্তা, অধিকাংশ গাড়ি গ্যাসেই চলে।এমনকি রান্নার গ্যাসও সস্তা, আপনি যতই গ্যাস ব্যবহার করুন না কেন, মাসের শেষে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকাই আপনাকে দিতে হবে, তা-ও খুব বেশী নয়। তাই অনেকে গ্যাস আর বন্ধও করে না নাকি, এক রান্না থেকে আরেক রান্নার মধ্যবর্তী সময়ে গ্যাসানল জ্বলতে থাকে আপনভোলা। এত প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্ভার কোথায় বাংলাদেশে ! কেউ বলতে পারল না। নাকি কোনো সুহৃদ রাষ্ট্রের প্রীতি?
    যে কথা বলছিলাম। গ্যাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি বড় হোর্ডিং দেখছিলাম রাস্তার ধারে-এক দাড়িওলা কোট-প্যান্ট ও চশমা-পরা মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি দেশ টিভিতে "কে হতে চায় কোটিপতি' নামে Who wants to be millionaire টিভি শো'র বাংলাদেশী ভার্সন সঞ্চালনা করছেন। কাল রাতেও এই ভদ্রলোককে দেখেছি, শো-টির শেষটুকু দেখতে পেয়েছিলাম চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে, খুব চেনা চেনা লাগছে এঁকে। কোথায় দেখেছি আগে? সুষেণকে জিগ্যেস করলাম।
    সুষেণ বলল-"ইনি বাংলাদেশের বিখ্যাত নাট্যশিল্পী আসাদুজ্জামান নূর ।'

    আসাদুজ্জামান নূর ! বহুব্রীহি-র সেই চাপদাড়িওলা পাজামা-পাঞ্জাবী পরা বিপত্নীক কবি! আমাদের তখন সদ্য টিভি এসেছে বাড়িতে, আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা'র পর, ৮৮-৮৯ সালে। সেসময় বাংলাদেশ টিভি সহজে আসত, একটা বাড়তি অ্যান্টেনা লাগত শুধু, কখনো কখনো বিনা অ্যান্টেনাতেও আসত, তবে একটু ঝাপসা। শুক্রবার-শুক্রবার কত ভালো টিভি নাটক হত, তার পাশে আমাদের কলকাতা দূরদর্শন তখন কোথায়-চাঁদে আর বাঁদরের ইয়েতে। আর হত এই বহুব্রীহি। হুমায়ুন আহমেদের লেখা ( তখন জানতাম না) এই টিভি-নাটকটি, কী ঝরঝরে সিটকম একখানা, গায়ে একফোঁটা বাড়তি চর্বি লেগে নেই, কোনো গ্যাদগেদে সংলাপ নয়, তাও মাঝেমধ্যেই সিরিয়াস সব ইস্যু উঠে আসে; আর বাংলাদেশ চেনা হতে থাকে; ঢাকা শহর। সেই নাটকটিতে আসাদুজ্জামান করতেন ঐ আনিস ভাই-য়ের রোল। এক আপনভোলা ফিল্যানথ্রপিস্ট খ্যাপাটে গৃহকর্তা (আবুল হায়াত করতেন কী?) ও তাঁর পরিবার, আশ্রিত এক বৃদ্ধ ও তাঁর নাতনী, গৃহকর্তার অকর্মা রাজা-উজির মারা সাধাসিধে শালা, মজাদার কাজের লোকেরা আর ভাড়াটে এই বিপত্নীক , দুটি রামদুষ্টু ছেলেমেয়ের বাবা,কবি আনিস ভাই। যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন-কী উইটি ছিল নাটকটা ! আসাদুজ্জামান তখন এন্তার নাটক করছেন, বাংলাদেশ টিভিতেই ওঁকে একবার দেখলাম "ওয়েটিং ফর গোডো' করতে; পরে একবার নাটকের দল নিয়ে কলকাতা ঘুরেও গেলেন। সদ্য গোঁফ গজাচ্ছে তখন, কবি-শিল্পী-গ্রুপ থিয়েটার অভিনেতাদের দেবদূতের মত দেখতে লাগে, আসাদুজ্জামান আমার হিরো হয়ে গেলেন। ঐ মুখ ! ঐ চাপদাড়ি ! এ লোকটা নিশ্চয় পবিত্রতার শেষ কথা। এ কখনো খারাপ হতে পারে না।

    সেই আসাদুজ্জামান নূর এখন এম. পি হয়েছেন আওয়ামী লীগের হয়ে। দেশ টিভি-র একজন মালিক নাকি। আবার স্যুট পড়ে "কে হতে চান কোটিপতি' সঞ্চালনা করেন । নাটক আর করেন কী?

    ফিরে এসে সোনালীকে বললাম-সোনালীও খুব ফ্যান ছিল ওঁর- জানিস রে, আসাদুজ্জামান নূরকে দেখলাম অমুক তমুক। সোনালী শুনে বলল- তো? আমরাই কি আর আগের মত আছি? পালটাই নি?

    চুপ করে গেলাম। ভুলে যাই আসলে মাঝেমধ্যে।

    (পরে উইকি খুঁজে দেখলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা-যুদ্ধেও আসাদুজ্জামান অংশ নিয়েছিলেন; নাকি আগে অনেকবার রাজনীতিতে যোগদানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন । ওঁকে বেনিফিট অফ ডাউট দেওয়া যেতেই পারে। আর,সাদা-কালো ছেড়ে ধূসরকে চিনতে শেখো, একটু বড় হতে শেখো-নিজেকে বলি। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো।

    নিজেকে বলি। )
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন