এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • মলয়ের লেখাপত্তর

    pi
    বইপত্তর | ২৪ মার্চ ২০১২ | ২৪৪৫৪০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শংকর সেন | 122.177.250.87 | ০৬ অক্টোবর ২০২২ ১২:১০738554
  • মলয় রায়চৌধুরীর প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং ক্ষমতায়নের কবিতা
    শংকর সেন
    মলয় রায়চৌধুরী কেবল প্রেমের কবি নন । তিনি প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ক্ষমতায়নের কবিতা লিখেছেন ষাটের দশক থেকে । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করার পূর্বে তিনি লিখেছিলেন ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ নামক গ্রন্হ এবং অনুমান করেছিলেন যে সোভিয়েত দেশ ভেতর থেকে ভেঙে পড়তে পারে । সেই সময়ে একটি প্রবন্ধে মলয় রায়চৌধুরী বলেছিলেন যে কবিতা রচনা সেই দিন থেকে আরম্ভ হয়েছিল যেদিন প্রথম গুহাবাসী একটা পাথর তুলে নিয়েছিল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জন্য । হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক ও ধর্মবিষয়ক ইশতাহার উত্তরঔপনিবেশিক সমাজকর্তাদের সরাসরি আক্রমণ করেছিল । মনে রাখা দরকার যে মলয় রায়চৌধুরী লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটোকাগজের মঞ্চ থেকে যাত্রা আরম্ভ করেননি । তিনি একটি অভূতপূর্ব পথ নিয়েছিলেন এবং তা হল ফালি কাগজের লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করা । ফলত কাউকে স্টলে গিয়ে পত্রিকা কিনতে হয়নি । পাঠকের কাছে ফ্রি বিলি করা ফালি কাগজ, যাকে বলা হতো বুলেটিন, তা হাতে-হাতে বুদ্ধিজীবীদের কাছে পৌঁছে যেতো । ১৯৬১ সালে আরম্ভ করা হাংরি আন্দোলনের বুলেটিনের আকর্ষণ ছিল অমোঘ এবং ত্রিশ-চল্লিশজন কবি, লেখক, শিল্পী তাঁর আন্দোলনে যোগদান করেন ।
    প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার আওয়াজ মলয়ই প্রথম তোলেন বাংলার সংস্কৃতিতে ।  প্রতিষ্ঠান বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্বাস হল এমন একটি যা  সমাজের প্রচলিত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নীতির বিরোধিতা করে এবং সামগ্রিক মানুষের শুভবোধের কথা বলে । মলয়ের তোলা আওয়াজের বহু পরে অন্যান্য দেশে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন চোখে পড়ে । যেমন প্যারিসের ছাত্র আন্দোলন । যেমন ২০১১ সালে, কঠোরতা বিরোধী বিক্ষোভের উত্থানের সাথে, আরব বসন্ত, আরম্ভ হয়েছিল এবং 'অ্যানোনিমাস'-এর মতো অনলাইন অ্যাক্টিভিজম এবং 'অকুপাই' বিক্ষোভের আবির্ভাব ক্ষমতাবানদের লক্ষ্য করে  গর্জে ওঠে । ‘ভি ফর ভেন্ডেটা’ ফিল্ম দ্বারা বিখ্যাত গাই ফকস মুখোশটি প্রতিষ্ঠা বিরোধী প্রতিবাদ গোষ্ঠীর প্রতীক হয়ে উঠেছে।
    ২০০১ সালে ‘হাওয়া-৪৯’ পত্রিকায় উৎপলকুমার বসু মলয়ের প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্হান সম্পর্কে  লিখেছিলেন “মলয় রায়চৌধুরী এখনকার বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট নাম । তিনি ছয়ের দশকে লিখতে শুরু করেন এবং এখনও লিখছেন । তাঁর কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, ইস্তাহার ও Polemics এর সমগ্র সংগ্রহ প্রকাশিত হলে একটি প্রয়োজনীয় কাজ হবে বলে আমার ধারণা । তিনি সাহিত্যিক নন । অর্থাৎ ‘সাহিত্যের সেবক’ বললে আমাদের স্মরণে যে-ছবিটি ভেসে ওঠে, তাঁকে সেই শ্রেণিতে ফেলা যাবে না । বাংলা সাহিত্য তাঁর হাতে যতটা না পূজিত হয়েছে — আক্রান্ত হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি । গত চল্লিশ বছরে, বাংলা সাহিত্যের রণক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তা লিপিবদ্ধ করার যোগ্যতা বা ধৈর্য আমার নেই । তবে, সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে মলয় রায়চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই যুদ্ধে নেমেছিলেন । তাঁর তাত্বিক প্রস্তুতি ছিল । এবং তথাকথিত বাংলা ‘সংস্কৃতি’-র ঘরে তাঁর লালন পালন নয় বলে ওই কালচারের পীঠভূমিগুলিকে অবজ্ঞা করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন । বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ । তাঁকে পিছনে ফেলে এগিয়ে না-গেলে পরবর্তী একটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিল না । জীবনানন্দ কয়েকটি উপাদানকে অবলম্বন করেছিলেন । যেমন অভিনব ইমেজ বা চিত্রকল্পের ব্যবহার, মহাজাগতিক সচেতনতা, মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা এবং সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি গৌণ বিষয় । মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ওই পাঠশালাতেই হাতেখড়ি হয়েছিল । কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের অন্য ধরণের পথসন্ধান শুরু হয় । বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণাত্মক প্রবণতা লক্ষ্য করি । কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন — ‘লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে ?’
     
    কবিতা যে কতো ক্ষমতা ধরে তা অনুধাবন করা যায় হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে । কবিদের দলটিকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কোমরে দড়ি বেঁধে চোর-ডাকাতের সঙ্গে পথে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, লকাপে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল এবং মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে পঁয়ত্রিশ মাসব্যাপী মামলা চালানো হয়েছিল । এই মামলায় এগারোজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল এবং গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ছয় জন ; কিন্তু সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করে সরকার । এ থেকেই স্পষ্ট যে মলয় রায়চৌধুরীকেই প্রতিবাদী ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী হিসাবে চিহ্ণিত করেছিল তদানীন্তন বঙ্গসমাজ ।
    ১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটির জন্য মলয় অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন এবং ৩৫ মাসব্যাপী কোর্ট কেস চলে । কলকাতার নিম্ন আদালতে সাজা ঘোষণা হলেও, ১৯৬৭ সালে উচ্চ আদালতে অভিযোগমুক্ত হন । মলয়ের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং সত্রাজিত দত্ত । মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, পবিত্র বল্লভ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসু । 
    মকদ্দমা চলাকালীন মলয়ের খ্যাতি আমেরিকা ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে, এবং বিভিন্ন ভাষায় এই কবিতাটি অনুদিত হয় । ৪৫ বছর পরও কবিতাটি নিয়ে বিতর্ক কবিতাটিকে জীবন্ত রেখেছে, এবং এম ফিল ও পি এইচ ডি গবেষণার বিষয়বস্তু হয়েছে । গবেষণা করেছেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক কুমারবিষ্ণু দে ও রবীন্দ্রভারতী থেকে অধ্যাপিকা স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায় । ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত 'Modern And Postmodern Poetry Of The Millenium' সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে অন্তর্ভুক্ত এইটিই একমাত্র কবিতা বলে ভূমিকায় জানিয়েছেন সম্পাদক জেরোম রোদেনবার্গ। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে The Hungryalists নামে ২০১৮ সালে একটি বই লিখেছেন মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী । মলয় রায়চৌধুরীর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটিকে অধ্যাপক শীতল চৌধুরী বলেছেন এটি বাংলা সাহিত্যে একটি সার্থক ও গুরুত্বপূর্ণ কবিতা।
    কবিতা রচনার আরম্ভ থেকে বইপোকা মলয়ের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, প্রতিবাদী কবিতা হল কবিতার যে কোনও রূপ যার অন্যতম প্রধান কাজ, কিছু বিদ্যমান বর্তমান ঘটনা বা পরিস্থিতিতে ত্রুটি খুঁজে বের করা। এই ধরনের কবিতা প্রায়শই একটি সরকার কর্তৃক জনগণের উপর আরোপিত অপকর্মের উপর আলোকপাত করে। এটি যুদ্ধ বা জাতিপ্রথা, ধর্মান্ধতার মতো ভয়ানক সামাজিক অসুস্থতার প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। প্রতিবাদী কবিতার সবচেয়ে কার্যকরী রূপগুলো এমন সব গুণাবলীকে একত্রিত করে যা  কবিতাটিকে বিষয়ের প্রতি অকৃত্রিম আবেগ দিয়ে তৈরি করে। প্রতিবাদী কবিতা পাঠকের আগ্রহ এবং সহানুভূতিকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং কখনও কখনও তাকে চটিয়ে দিয়ে কর্মে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। মলয় রায়চৌধুরীর এই কবিতাটি পড়ুন, শিরোনাম ‘মেশোমশায় পর্ব’:                                       
                                                                  যুধিষ্ঠির
    আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির
    বহুতল বাড়ি থেকে নেবে আয় গলির মোড়েতে
    লিআয় ল্যাংবোট কৃষ্ণ ভীম বা
     নকুল কে-কে আছে
    পেটো হকিস্টিক ক্ষুর সোডার বোতল ছুরি সাইকেল চেন
    বলেদে দ্রৌপদীকে আলসে থেকে ঝুঁকে দেখে নিক
    আমার সঙ্গে আজ কিছু নেই কেউ নেই
    থৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধন নেই
    তোদেরই অঙ্গুলিহেলনে কেটে তর্জনীও দিয়েছি শৈশবে
    দাঁড়াচ্ছি পা-ফাঁক করে দন্তস্ফুট হয়ে যাবে জয়ধ্বনি তোর
    সিঁড়িতে শেকলবাঁধা মহাপ্রস্হানের কুত্তা লেলিয়েও দ্যাখ
    ন্যাটা হাতে যুঝে যাব জমিন ছাড়ব না
    লুমপেন বলে তোরা ঘিরে ধরবি
    আরেকবার ছিটকে পড়ব ফুটপাথে মুখে গ্যাঁজলা নিয়ে
    ছুটন্ত খচ্চরবাচ্চা পিঠের ওপরে খুর দেগে যাবে
    নাভিতে ব্লেডের কুছি দিয়ে তোরা খোঁচা দিবি
    পায়ধমুখে জ্বলন্ত সিগারেট
    পাঁজরে আছড়ে পড়বে কম্বলে মোড়া সোঁটা
    দেখে নিস তোরা
    মাটিতে গোড়ালি ঠুকে পৃথিবীর চারিধারে জ্যোতির্বলয় গড়ে যাব ।
    উপরোক্ত কবিতাটি একটি রিডল বা ধাঁধা । প্রশ্ন ওঠে মেশোমশায় কে ? শকুনি তো মামা !ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে আমরা যে মাসির কথা শুনি, তাঁর অনুপস্হিত স্বামীই  মেশোমশায় অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান । বর্ণপরিচয়ে বর্ণিত গল্পটা এরকম : “দশম পাঠের শিরোনাম ‘চুরি করা কদাচ উচিত নয়’। এখানে যে-কাহিনি দেওয়া হয়েছে, আজকের দিনের পুস্তকপ্রণেতাগণ তা পড়লে শিউরে উঠবেন। এই পাঠের প্রধান চরিত্র ভুবন। শৈশবে সে পিতামাতাকে হারায়। এরপর মাসির কাছে বড় হতে থাকে। স্কুল থেকে একবার ভুবন একজনের বই চুরি করে নিয়ে আসে। কিন্তু মাসি কোনো শাসন করেনি; ফলে ভুবনের সাহস দিনে দিনে বাড়তে থাকে। গল্পের পরিণতিতে আছে, বড় হয়ে ভুবন বড় চোরে পরিণত হয়। বিচারক তাকে ফাঁসির আদেশ দেন। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভুবন তার মাসির সঙ্গে দেখা করানোর অনুরোধ করে। ভুবনের মাসিকে ফাঁসির মঞ্চের কাছে আনা হলে মাসি ভুবনকে দেখে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে থাকে। ভুবন মাসিকে বলে, ‘এখন আর কাঁদিলে কি হইবে।’ এরপর মাসির কানে কানে একটি কথা বলার জন্য কাছে ডাক দেয়। মাসি কাছে গেলে ভুবন মাসির কান কামড়ে কেটে নেয়। আর ভর্ৎসনা করে বলে, মাসি যদি আগে থেকেই তাকে সাবধান করত, তাহলে তার জীবনে এই পরিণতি হতো না।” 
    মলয় আক্রমণ করছেন এখনকার যুধিষ্ঠিরদের, যারা নিজেদের ধর্মের ধ্বজাধারী হিসাবে সমাজের বুকে দাপিয়ে বেড়ায় । অথচ মহাভারতের যুধিষ্ঠির ছিলেন ধর্মাবতার। মলয় বলছেন যে তিনি তাদের হুকুমে একলব্যের মতন আঙুল কেটে দিয়েছেন আর সেই আঙুল হল লেখার আঙুল, তর্জনী । বর্তমান সময়ের প্রাতিষ্ঠানিক গুণ্ডাদের তিনি চ্যালেঞ্জ করছেন । কবিতার শেষে তিনি দিয়ে দিচ্ছেন নিজের বিজয়বার্তা।
     মলয় রায়চৌধুরীর নিম্নোক্ত কবিতাটি পড়ুন কবিতার নাম ব্লাড লিরিক । আপনার অসুবিধা হবে একে কোন ধরণের কবিতা বলবেন। প্রেমের, প্রতিবাদের, প্রতিরোধের না রাষ্ট্রবিরোধিতার । বস্তুত প্রেমের কবিতার বনেদে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ সমাজ সম্পর্কে বক্তব্য রাখছে কবিতাটি । এখানেই মলয় রায়চৌধুরীর বৈশিষ্ট ; তিনি অন্যান্য কবিদের মতো সহজ-সরল কবিতা লিখছেন না । তাঁর পাঠকেরা অবন্তিকার সঙ্গে পরিচিত, কেননা সে বনলতা সেন, নীরা, সুপর্ণার মতন নয় ।
     ব্লাড লিরিক
    অবন্তিকা, তোর খোঁজে মাঝরাতে বাড়ি সার্চ হল
    এর মতো ওর মতো তার মতো কারো মতো নয়
    যেন এমন যেন অমন যেন তেমন নয়
    .
    কী করেছি কবিতার জন্য আগ্নেয়গিরিতে নেমে ?
    একি একি ! কী বেরোচ্ছে বাড়ি সার্চ করে
    কবিতায় ? বাবার আলমারি ভেঙে ব্রোমাইড সেপিয়া খুকিরা
    কবিতায় । হাতুড়ির বাড়ি মেরে মায়ের তোরঙ্গে ছেঁড়ে বিয়ের সুগন্ধি বেনারসি
    কবিতায় । সিজার লিস্টে শ্বাস নথি করা আছে
    কবিতায় । কী বেরোলো ? কী বেরোলো ? দেখান দেখান
    কবিতায় । ছি ছি ছি ছি, যুবতীর আধচাটা যুবা ! মরো তুমি মরো
    কবিতায় । সমুদ্রের নীলগোছা ঢেউ চিরে হাড়মাস চেবাচ্ছে হাঙর
    কবিতায় । পাকানো ক্ষুদ্রান্ত্র খুলে এবি নেগেটিভ সূর্য
    কবিতায় । অস্হিরতা ধরে রাখা পদচিহ্ণে দমবন্ধ গতি
    কবিতায় । লকআপে পেচ্ছাপে ভাসছে কচি বেশ্যাদেখা আলো
    কবিতায় । বোলতার কাঁটা পায়ে সরিষা ফুলের বীর্যরেণু
    কবিতায় । নুনে সাদা ফাটা মাঠে মেটেল ল্যাঙোটে ভুখা চাষি
    কবিতায় । লাশভূক শকুনের পচারক্ত কিংখাবি গলার পালকে
    কবিতায় । কুঁদুলে গুমোট ভিড়ে চটা-ওঠা ভ্যাপসা শতক
    কবিতায় । হাড়িকাঠে ধী-সত্তার কালো কালো মড়া চিৎকার
    কবিতায় । মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরলে না কেন
    কবিতায় । মুখে আগুন মুখে আগুন মুখে আগুন হোক
    কবিতায় । মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরো
    কবিতায় । এর মতো ওর মতো তার মতো কারো মতো নয়
    কবিতায় । যেন এমন যেন অমন যেন তেমন নয়
    কবিতায় । অবন্তিকা, তোর খোঁজে সার্চ হল, তোকে কই নিয়ে গেল না তো !
    .
    কেন কবিতা লেখা ও পড়া এবং শোনা  প্রয়োজন ? বিশেষ করে  সংকটের সময়ে ? মানুষেরইতিহাস জুড়ে, কবিতা সবসময় সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং, দুঃখজনক এবং গঠনমূলক পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ক্ষমতায়নের কথা বলেছে। মানুষের জীবনে ও সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য কবিরা চিরকাল অগ্রণী । সতেজ এবং শক্তিশালী, প্রতিবাদের মঞ্চে এবং সমাবেশে, কবিতা একটি চিরকালীন আর্ট ফর্ম। নাগরিক অধিকার এবং নারীমুক্তি আন্দোলন থেকে শুরু করে বক্তব্য রাখার  স্বাধীনতা পর্যন্ত, কবিতা হাওড়া স্টেশনে, খালাসিটোলায়, কফিহাউসে, মধুসূদন দত্তের সমাধিতে ভিড় জড়ো করার জন্য যথেষ্ট – তা হাংরি আন্দোলনকারীরা করে দেখিয়েছিলেন ।  মলয় রায়চৌধুরী যাঁদের কবিতা অনুবাদ করেছেন তাঁদের পথেরই যাত্রী মলয় নিজেও, যেমন, উইলিয়াম ব্লেক, শার্ল বোদলেয়ার, পল ভেরলেন, জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো, জাঁ জেনে, জাঁ ককতো, অ্যালেন গিন্সবার্গ, আঁদ্রে ব্রেতঁ, স্যামুয়েল বেকেট, চার্লস বুকাওস্কি, উইলিয়াম বারোজ, জ্যাক কেরুয়াক, বুল্লে শাহ, ত্রিস্তঁ জারা, হাবিব জালিব, আরনেস্তো কার্দেনাল, ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি, ওসিপ ম্যানডেলস্টাম, আনা আখমাতোভা, হোর্হে লুই বোর্হেস, আদুনিস, তামিম আল বারঘুতি, রবের্তো বোলানো, পাবলো নেরুদা, গ্যারি স্নাইডার, হীরা বাণসোডে, অরুণ বালকৃষ্ণ কোলটকর, পারিজাত, নাগার্জুন, ডেনিস ব্রুটাস, পল সেলান, সিলভিয়া প্লাথ, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, ফ্রেডরিক নীৎশে, গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার, মার্ক শাগাল, পাবলো পিকাসো, জাক প্রিভের, নিকানর পাররা, আরাগঁ, স্টিফেন মালার্মে প্রমুখ ।
    বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে মনোযোগ আকর্ষণ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। ফেসবুকে প্রায় ২০০০ কবির কবিতা পাঠ করেছেন দেবাশিস ভট্টাচার্য ; তাঁরা বিভিন্ন দেশের কবি এবং অধিকাংশ কবিতা প্রতিবাদী কবিদের । মলয় রায়চৌধুরী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিবাদী কবিদের কবিতা অনুবাদ করে গ্রন্হাকারে প্রকাশ করেছেন । বইটির নাম ‘ভিনভাষী প্রতিষ্ঠানবিরোধী কবিদের কবিতা  । ভারতীয় কবি ইকরার খিলজির ‘খবিশ’ নামের কবিতাটা পড়ুন ।
    আমি অশুদ্ধ, আমি নোংরা
    আমি ভবঘুরেপনার প্রচারক
    স্বর্গের বিশুদ্ধ পরিদের গানের
    সৌন্দর্যের প্রতিমা আমি নই
    আমি আমার কামনার দাসী
    আমি লালসার বুদবুদ
    আমি জীবন্ত, আমি ভঙ্গুর
    তবু আমি অহঙ্কারের মিনার
    আমি মাত্রাধিক অহমিকার মানুষী
    তোমরা আমাকে কখনও ছুঁতে পারবে না
    তোমাদের মনে হতে পারে আমি খড়ের বা লাঠির শব
    কেনই বা আমি ভুয়ো আকাঙ্খায় গড়ব নিজেকে ?
    তোমরা যতোটা স্বার্থপর, আমিও ততোই
    কেনই বা আমি পরার্থতার প্রতিমা হবো ?
    তোমাদের মতনই মিষ্ট আমার কথাবার্তা
    আমি কেন মিছরির তৈরি সৎচরিত্রের দেবী হবো ?
    আমি অতিসাধারণ
    তোমাদের খাতিরে ভালো হবার ভার আমি কেন বইব ?
    তোমাদের রয়েছে উন্নত হবার গর্ববোধ
    কিন্তু খ্যাতি আমার কাছে সহজেই আসে
    তোমাদের যদি প্রাণহীন হাসিমুখ ভালো লাগে
    তাহলে শ্বেতপাথরের মূর্তি যোগাড় করে নাও
    তোমাদের আনন্দের খাতিরে আমার কপালের বলিরেখা উবে যাবে না
    আমার মুখমণ্ডলের ভাবভঙ্গী তোমাদের আদেশ পালন করে না
    এমনকী তা তোমাদের খাতিরে নয়
    আমি সৌন্দর্যের জিনিস নই
    আমি বিনয়ের আজ্ঞাবহ নই
    আমি লাবণ্যের কথা জানি না
    আমি পুজো করা মানি না
    তোমাদের স্নেহ বা মনোযোগ চাই না
    মনে করার কারণ নেই যে তোমাদের ছাড়া আমি দুর্দশাগ্রস্ত
    তোমাদের রাজত্বের প্রজা আমি আর নই
    বাধিত নই তোমাদের কৃতজ্ঞতায়
    মনে কোরো না তোমাদের প্রাসাদের আমি পাপোশ
    এবার বলো, তোমাদের বিশ্বস্ততার প্রতিশ্রুতি কেমন ছিল
    যখন আমি ছলনাময় তাবিজ হয়ে উঠি
    যে তোমাদের  জাহাঙ্গীর করে তুলেছিল
    আমি আর তীরবঞ্চিত ঢেউ নই
    স্বর্গের কৌতূহলে চেপে আমি উড্ডীন
    ইতিহাসের পাতা আমাকে মুছে ফেললেও
    বিশ্বাসীরা আমাকে আশীর্বাদ করবে
    আমার দেহ আর আমার মনকে বহুকাল বোরখায় ঢেকে রাখা হয়েছে
    কিন্তু এই অন্ধকার সময়ে আমার অস্তিত্ব দীপ্তিময়ী
    আকাশে এমনই কানাকানি চলছে
    শেকলে বেঁধে কতোকাল আমাকে পেছনে ফেলে রাখবে
    আমার ক্ষমতা বহুকাল প্রদর্শিত হয়েছে
    আর কতোদিন মাদ্রাসাগুলো আমাকে অপমান করবে
    বহুকাল আমি পদাতিকের যুদ্ধ লড়ে চলেছি
    আমার বিদ্রোহ এই পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে
    আর আমার ষড়যন্ত্র দুর্বলও নয় মূর্খেরও নয়
    যে ক্ষমতাপ্রাসাদ থেকে তোমরা আমাকে দাবিয়ে রাখো তাতে আমি ঢুকে পড়েছি
    আমি তোমাদের জগতকে অলঙ্কৃত করার জন্যে যে সৃষ্ট নই তা তোমাদের জানার সময় এসে গেছে
     
    উত্তরঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে, অস্পষ্ট, ম্যানিপুলেটিভ বা আরও খারাপ অবস্হা সৃষ্টির রাজনৈতিক ও মিডিয়ার চোখরাঙানো ক্ষমতার মুখের ওপর সত্য কথা বলা কবিদের  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না । কবিরা ভয়াবহ সত্য প্রকাশ করেন, চেতনায় জাগরণ ঘটান এবং হাংরি আন্দোলনের মতো ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গড়ে তোলেন। কবিতা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। আত্মতুষ্টির বিরুদ্ধে সবাই একত্রিত হয়ে দেখাতে পারে যে কেন রাজনৈতিক সংকটের মুহুর্তে কবিতা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে । আন্তর্জাল ও সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করে গঠনমূলক সমালোচনা এবং প্রকৃত প্রতিবাদের  সম্ভাবনাকে মান্যতা দিয়েছেন কবিরা। তবে মাধ্যমটি সহজলভ্য বলে ট্রোল  করা হয় প্রচুর । হাংরি আন্দোলনকারীদের, আন্দোলনের ষাট বছর পরও অকারণ ট্রোল করা হয় । মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাতকারের তিনটি সংকলন পড়লে স্পষ্ট হয় যে যাঁরা সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন তাঁরা তাঁর অধিকাংশ বই পড়েননি । এই ভণ্ডামির এ বার প্রতিবাদ হওয়া দরকার ।  অশীতিপর মলয় রায়চৌধুরী আজও  প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাই বলে হাংরিরা কোনও সমসত্ত্ব প্রজাতি নন যে, সব ঘটনায় তাঁদের সবাই একই ভাবে প্রতিবাদ করবেন। 
    পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মারামারি, হানাহানি ও আধিপত্যবাদের কালোছায়ার পাশাপাশি জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবার আতঙ্কে আতঙ্কিত বিশ্ববাসী। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ চায় স্বাধীনতা ও মুক্তবিশ্ব। স্বভাবতই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী কবিদের হাতে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের কবিতা হয়ে উঠছে আরও শানিত। কবিতা প্রেমের, কবিতা দ্রোহের, কবিতা ভালোবাসার। কবিতা প্রতিবাদের। আমরা নিশ্চিত যে কবিতার সবর্গ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞা নেই, অথবা কবিতাকে কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। এ যেন প্রবাহমান জলস্রোত, কখনো শান্ত, সমাহিত, স্নিগ্ধ এর রূপ। কখনো বা খ্যাপা দুভার্গা, দুকুল বিনাশী তীর ভাঙা ঢেউ, কখনো বা সোনা ফলানো পলিমাটিতে অঙ্কুরিত নানা জাতের নানা বণের্র নানা রঙের তৃণরাশি। এই যে বণির্ল চিত্র যা সহজেই অন্যকেও প্রভাবিত করে, ভিন্ন হৃদয়াবেগকে আলোড়িত করে তার রূপলাবণ্য।মানবসমাজে অস্থিরতার সময়ে, কবিতার ভূমিকা কি অগ্নিশিখার পাখা নাকি শীতল মেজাজ? কবিতা অসাধারণভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। 
     একটি কবিতা লিখতে বসার সময় একজন কবির মনে অনেকগুলি কাজ থাকতে পারে। কবি হয়তো অন্য কারো প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করছেন, বন্ধু হারানোর জন্য বিলাপ করছেন অথবা কোনো সুন্দর দৃশ্যের বর্ণনা করছেন। যদিও বিষয়গুলি পরিবর্তিত হয়, তবে সমস্ত কবিতার মূলে এমন কিছু থাকতে হবে যা পাঠক বা শ্রোতাকে এমনভাবে জড়িত করে যা কেবল কবিতাই পারে। প্রতিবাদী কবিতা একজন কবির হাতে থাকা সমস্ত সরঞ্জামকে গুছিয়ে তোলে, যার মধ্যে থাকে ব্যঙ্গ, ছড়া, রূপক, মাত্রা, প্রাণবন্ত ভাষা এবং আরও অনেক কিছু । অনেক ক্ষেত্রে, প্রতিবাদী কবিতা একটি নির্দিষ্ট সরকারী শাসনের প্রতি অসন্তোষের সাথে যুক্ত। কবিতা কঠোরভাবে বস্তুনিষ্ঠ হবার প্রয়োজন নেই । একটি প্রতিকূল চেহারায় শাসক দলের ক্রিয়াকলাপ বা মতাদর্শ দেখানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। বৃহত্তর সামাজিক অস্থিরতার সময়ে, কবিতাগুলি প্রায়শই একক কবি দ্বারা লিখিত হয় যাতে সাধারণ মানুষের মতামত প্রতিফলিত হয়।
    ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে রচিত বহুবিধ সাধারণ সামাজিক অসুস্থতা নিয়েও প্রচুর প্রতিবাদী কবিতা লেখা হয়েছে। প্রতিবাদী কবিতার অন্যতম জনপ্রিয় বিষয় মানুষে-মানুষে, দেশে-দেশে, ধর্মে-ধর্মে অবনিবনা এমনকি যুদ্ধ । যতদিন কবিতা লেখা হয়েছে, কবিরা তাদের দক্ষতা ব্যবহার করেছেন দ্বন্দ্ব ও অবনিবনার ট্র্যাজেডি উপস্হাপনের জন্য। সমীর রায়চৌধুরী “হাওয়া#৪৯” পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় এই দ্বন্দ্ব ও অবনিবনাকে বিশ্লেষণ করতেন।ভিয়েৎনাম যুদ্ধের সময়ে তিনি ‘আমার ভিয়েৎনাম’ নামে একটি কাব্যগ্রন্হ প্রকাশ করেছিলেন । আরেকটি বিষয় যা প্রজন্মের জন্য কবিদের ক্রোধকে জাগিয়ে তুলেছে তা হল ধর্মবিদ্বেষ।
    অনেক ধরনের কবিতা আছে  যেগুলোকে প্রতিবাদী কবিতা হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়, তবে এটি এমন একটি ধারা যা কম দক্ষ কবিদের হাতে সহজেই বিকৃত হতে পারে।  একজন কবিকে একটি প্রতিবাদী কবিতা লেখার জন্য কোনও ইস্যু দ্বারা আবেগগতভাবে অনুপ্রাণিত হতে হয়, চিন্তা করতে হয়, তারপরই তিনি আবেগ বর্জন করে প্রতিবাদী বা প্রতিরোধের কবিতা লেখেন । একটি ইস্যুতে আটকে পড়লে  কবিতাটা  শিল্পকর্ম কম আর সংবাদ প্রতিবেদন বেশি মনে হবে ।
    মলয় রায়চৌধুরী (জন্ম: অক্টোবর ২৯, ১৯৩৯)  কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবি এবং সর্বোপরি ১৯৬০-এর দশকের হাংরি আন্দোলন—হাংরিয়ালিজম—তথা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক এবং এ কারণে ১৯৬০-এর দশক থেকেই ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলিকাতা খ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উত্তরপাড়া শাখার সন্তান। পিতা রঞ্জিত রায়চৌধুরী (১৯০৯-১৯৯১) ছিলেন ভারতীয় চিত্রশিল্পী এবং মাতা অমিতা (১৯১৬-১৯৮২) ছিলেন পাণিহাটিস্থিত নীলামবাটির কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর (রোনাল্ড রস-এর সহায়ক) জ্যেষ্ঠ কন্যা। কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিষদ কর্তৃক সংরক্ষিত সংগ্রহশালার (জাদুঘর) তথ্য অনুযায়ী মলয় রায়ের পিতামহ লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রশিল্পী। মলযের বড়ো ভাই সমীর রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের একজন বিতর্কিত কবি। পাটনার সেইন্ট জোসেফ কনভেন্টে প্রাথমিক এবং রামমোহন রায় সেমিনারিতে ম্যাট্রিকুলেশানের পর অর্থনীতিতে সাম্মানিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন মলয় রায়। গ্রমীণ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ দলে প্রশিক্ষনের পর প্রথমে রিজার্ভ ব্যাংক ও তারপর এঅরডিসি এবং নাবার্ডে গ্রামীণ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞের উচ্চপদে ভারতের বিভিন্ন শহরে ১৯৯৭ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। যুগশঙ্খ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের রিডার ডক্টর শঙ্কর ভট্টাচার্য বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন যে মলয় রায়চৌধুরী সমগ্র জীবন ভারতের চাষি, তাঁতি, জেলে ও হস্তশিল্পীদের মাঝে কাটিয়ে প্রভূত অভিজ্ঞতা লাভ করেন, এবং তা তার সাহিত্যকর্মে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
    আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। গতানুগতিক চিন্তাধারা সচেতনভাবে বর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতাবাদ চর্চা এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে "প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার" কবিতার জন্যে রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন।
    মলয় রায়চৌধুরীর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য সাহিত্যের সনাতন ধারা অনুশাসনের বিরুদ্ধাচারণ। এ বিষয়ে স্বপ্ন পত্রিকায় লিখিত প্রবন্ধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ডক্টর তরুণ মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, 'সাহিত্যের সনাতন অনুশাসনগুলির বিরুদ্ধে মলয় রায়চৌধুরীর বিদ্রোহ তার রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য'। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতের অধিক। তার ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১০টি উপন্যাস, দুটি ডিটেকটিভ উপন্যাস, একটি ইরটিক নভেলা, ১২টি সমালোচনা গ্রন্থ, চারটি জীবনী এবং বহু অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েঝে। উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে শয়তানের মুখ, জখম, ডুব জলে যেটুকু প্রশ্বাস,নামগন্ধ চিৎকার সমগ্র, কৌণপের লুচিমাংস, মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো, বাউল-কবিতা সিরিজ ডোমনি, অ্যালেন গিন্সবার্গের হাউল ও ক্যাডিশ কাব্য-গ্রন্থের অনুবাদ প্রভৃতি অন্যতম। তিনি বিট মহিলা কবিদের রচনা অজস্র অনুবাদ করেছেন, পরাবাস্তব কবিদের অনুবাদ করেছেন এবং জাঁ জেনের সমস্ত কবিতা অনুবাদ করেছেন । লোকনাথ ভট্টাচার্যের পর তিনি দ্বিতীয় বাঙালি যিনি জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো'র নরকে এক ঋতু এবং ইল্যুমুনেশান্স অনুবাদ করেছেন । বুদ্ধদেব বসুর পর প্রথম বাঙালি যিনি বোদলেয়ারের সমগ্র কবিতা অনুবাদ করেছেন । বিদেশি কবি ওকতাভিও পাজ, আরনেস্তো কার্দেনাল, অ্যালেন গিন্সবার্গ, ডেইজি অ্যালডান প্রমুখ ভারতে এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন । পেঙ্গুইন র‌্যাণ্ডাম হাউস থেকে তাঁকে নিয়ে 'দি হাংরিয়ালিস্টস নামে একটি গ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছে, যা লিখেছেন মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী । তাঁর কবিতা নিয়ে পিএইচডি করেছেন হিডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো, আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিষ্ণুচন্দ্র দে এবং উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদয়শঙ্কর বর্মা । ২০০৩ সালে অনুবাদ সাহিত্যে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
    ১৯৬১ সালে দাদা সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়ার (দেবী রায়) সঙ্গে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করে আবির্ভাবেই সাড়া ফেলে দেন। তার সাংগঠনিক দক্ষতায় প্রায় চল্লিশজন কবি, লেখক ও চিত্রশিল্পী এই আন্দোলনে যোগ দেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিনয় মযুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ প্রমুখ। এই আন্দোলনের মুখপত্র হিসাবে এক পাতার বুলেটিন প্রকাশ করা হতো। ১০৮টি বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছিল, যার মাত্র কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি এবং ঢাকার বাংলা একাডেমিতে সংরক্ষণ করা গেছে। ১৯৬৫ পর্যন্ত এই আন্দোলন পুরোদমে চলেছিল; বিখ্যাত হাংরি মামলার পর তা ভেঙে যায়। আন্দোলনটি নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী হাংরি কিংবদন্তি নামে একটি গ্রন্হে আন্দোলনের ইতিহাস তত্ব ও তথ্য নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। পরবর্তীকালে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় নথিপত্র, আদালতে সাক্ষ্য, আদালতের রায় এবং হাংরি আন্দোলনকারীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে হাংরি আন্দোলন গ্রন্হ। মলয় রায়চৌধুরী তিরিশ বছর যাবত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেগুলি একত্রিত করে প্রকাশ করেছেন তিনটি প্রকাশন সংস্হা, মহাদিগন্ত, প্রতিভাস এবং আলোপৃথিবী প্রকাশনী।
    আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর বিষ্ণুচন্দ্র দে "মলয় রায়চৌধুরী ও হাংরি আন্দোলন" বিষয়ে ৩৫০ পৃষ্ঠার গবেষণাপত্রের জন্য ডক্টরেটে লাভ করেন। ২০১৩ সালে হাংরি আন্দোলন নিয়ে আইআইটি খড়গপুর থেকে ডক্টরেট করেছেন অধ্যাপক রিমা ভট্টাচার্য। ১৯৯৭ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বিষয়ে ডক্টরেট করেছেন অধ্যাপক উদয়নারায়ণ বর্মা। দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় সম্পর্কে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে এমফিল করেছেন। রূপসা দাস ২০১৮ সালে মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে গবেষণা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো হিডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন।
     
    প্রতিটি প্রজন্মে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের  দক্ষ কবি পেয়েছি আমরা । অনেকের কবিতা স্হায়ী হয়েছে,কিন্তু অনেকের হয়নি । সর্বজনীনভাবে আবেদনময় হয়ে উঠছে না অনেকের কবিতা । অনেকের কবিতা প্রতিষ্ঠানের, বিশেষকরে সংবাদপত্র ও রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষণার কারণে আড়ালে থেকে যাচ্ছে, যেমন হাংরি আন্দোলনের কবি ফালগুনী রায় এবং শম্ভু রক্ষিতের কবিতা। আমি মনে করি না যে তরুণ কবিরা সুন্দর এবং শক্তিশালী প্রতিবাদী কবিতা লিখতে অক্ষম। আপনি যদি এখনকার তরুণ কবিদের রচনা সম্পর্কে চিন্তা করেন, আর  অতীতের কবিদের কবিতা পড়ি তাহলে দেখা যাবে যে বহু কবিতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এটা বিশেষ করে প্রতিবাদী কবিতার ক্ষেত্রে সত্য যেগুলো স্বভাবগতভাবে খুব কমই সর্বজনীন অথচ অনুষ্ঠান-বিশেষে পাঠকরা হয়, যেমন সুকান্ত ভট্টাচার্য, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। সেগুলো সর্বদা  নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এবং  নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মঞ্চে পাঠ করা হয়৷ আরেকটি সাম্প্রতিক ঘটনা হলো বাচিক শিল্পীদের নিজস্ব ভালো-লাগা অথবা প্রতিষ্ঠান তাঁদের কোন কবিদের পছন্দ করতে বলছে তাও বিবেচ্য ।
    মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্হ শয়তানের মুখ ১৯৬৩ সালে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে গ্রন্হটিকে একটি জলবিভাজক বলে মনে করা হয়। মলয় তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্হে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার কবিতার জনকরূপে বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন। তার কবিতা বাংলাসাহিত্যের সনাতন ঐতিহ্যকে, নিয়মানুবর্তিতাকে, আমূল নাড়া দিয়েছিল। কবিতার ভাষায়, ছন্দে, অলংকারে, চিত্রকল্পে তুমূল ভাংচুর পাঠকের অভ্যস্ত চোখ ও কানকে বিব্রত করেছিল। যৌনতার সংগে তিনি এনেছিলেন ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও অসহায় মানুষের নিষগফলতার যন্ত্রণা। উপন্যাস ও ছোটগল্পে তিনি নিজস্ব গদ্য সৃষ্টি করেছেন এবং তার প্রবন্ধকে আপোষহীন বলে মনে করা হয়। তার নাটক তিনটিকে বলা হয়েছে উত্তরাধুনিক, যদিও সেগুলি হাংরি আন্দোলনের সময়ে রচিত। তার প্রবন্ধ ও পোলেমিক্সগুলি থেকে স্পষ্ট হয় কেন তাকে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক বলা হয়। মলয় যাঁদের কাজ অনুবাদ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন উইলিয়াম ব্লেক, জাঁ ককতো, সালভাদোর দালি, পল গঁগা, ব্লাইজি সঁদরা, ত্রিস্তান জারা, অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, পাবলো নেরুদা এবং ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা।মলয় গ্রন্হে সম্পাদক মুর্শিদ এ. এম. ভূমিকায় জানিয়েছেন যে নব্বুই দশকের পর রচিত তার সাহিত্যকর্মকে বলা হয়েছে অধুনান্তিক।
    ২০১২ সালে তিনি প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস রচনা আরম্ভ করেন। তার সৃষ্ট মহিলা ডিটেকটিভ রিমা খান (নোংরা পরি) একজন ভিন্ন প্রকৃতির চরিত্রবৈশিষ্ট্যসহ উপস্হাপিত। বর্তমান যুগের পুলিশ কর্মকর্তাদের মতো রিমা খান নির্দয় ও নির্মম। মলয় রায়চৌধুরীর গোয়েন্দা উপন্যাসটির নাম ডিটেকটিভ নোংরা পরির কঙ্কাল প্রেমিক।
    মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা, গল্প ও উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হল যে সেগুলো মুক্ত-সূচনা ও মুক্ত-সমাপ্তি দ্বারা চিহ্নিত; এবং তা বহুমাত্রিক. আঙ্গিক-ভাঙা, ঘটমান, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত, কেন্দ্রাতিগ, অফুরন্ত অর্থময়, সংকরায়িত, রাইজোম্যাটিক. অপরিমেয়, ভঙ্গুর বাকপ্রতিমায় আপ্লুত, একাধিক বার্তাবহ এবং ক্যানন-অতিক্রমী।উত্তরপ্রবাসী পত্রিকার হাংরি আন্দোলন সংখ্যায় অধ্যাপক নন্দলাল শর্মা জানিয়েছেন যে, স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পবস্তু বা 'আর্ট ফর আর্ট সেক'-এর ঔপনিবেশিক তত্বকে বর্জন করার কথা বলেছেন মলয়, যা বাংলা সাহিত্যে তার পূর্বে কেউ বলেননি ।
    তরুণ কবিরা সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করেন লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটোকাগজের মাধ্যমে। ছোটকাগজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ছোটকাগজ নিজের ভাষার অতীত ও বর্তমান সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অনন্য অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে পথচলা শুরু করে এবং তার মাধ্যমে  নিজস্ব সংস্কৃতিতে অন্যদের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। ছোটোকাগজ লেখকদের স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে পাঠদিগন্তকে প্রসারিত করতে সহায়তা করে । পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্য-সংস্কৃতি কীভাবে তাদের থেকে পৃথক তা বিশ্লেষণ ও অবলোকন করে। প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা  ছোটকাগজের প্রাণ এবং এই চারিত্র্য তারা পেয়েছে মলয় রায়চৌধুরীর আরম্ভ করা হাংরি আন্দোলনকে অনুসরণ করে । তারপরের দশকগুলিতে তরুণদের হাতে বাংলা কবিতার, গদ্যের ভাষা ও বিষয়ের বড় ধরনের যে দিক বদল ঘটেছে, একই রচনাতে কবিতার, গদ্যে ভাষার রীতি ক্রমশ দুরূহতা থেকে যোগাযোগ প্রবণ হবার প্রয়াস করেছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’ নামের দীর্ঘ কবিতাটি। ‘জখম’ এ-পর্যন্ত চারবার মুদ্রিত হয়েছে এবং মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার মতো পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। 
    অবন্তিকাকে নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর প্রতিটি কবিতা মূলত নারীর ক্ষমতায়নের কবিতা । এরকম প্রেমের কবিতা বাংলা ভাষায় আর কেই লিখেছেন বলে মনে হয় না । অবন্তিকা নানা রূপে এসেছে তাঁর কবিতায়, ডেথমেটাল গাইয়ে-নাচিয়ে, সাংবাদিক, হিপিনি, গণিতজ্ঞ, কুৎসিত, সুন্দরী, নেশাড়ু, লড়াকু, পলাতকা, ঘরভাঙা, নর্তকী – বস্তুত অবন্তিকাকে নিয়ে ছেয়ে আছে ইউটিউব – অনেকের কন্ঠে। মলয় রায়চৌধুরীর কন্ঠেও ।
    নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর অবস্হান সম্পর্কে বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায় লিখেছেন,  “আমি তাঁর বেশ-বয়সের অবন্তিকাদের মধ্যে একজন। ডিট্যাচড, পড়ুয়া, চোখে চশমা আঁটা, উচ্চাশী অবন্তিকা। তিনি আমার পিতৃপ্রতিম। জাগতিকে তাঁকে তেমনই ভালোবাসি। আর অন্য এক জায়গায় তাঁকে ভালোবাসি, যেমন ক’রে তাঁর অসাধারণ উপন্যাস “ডিটেকটিভ নোংরা পরীর কঙ্কাল প্রেমিকে”, অনেক আগে মরে যাওয়া কঙ্কালকে, এক বৃদ্ধের কংকালকে, তার জীবনের কনসেপ্টকে ভালোবেসে ফেলেছিল ইন্সপেক্টর রিমা খান। কেন? সেই গণিতবিদ, উৎশৃংক্ষল কংকালের পৌরুষের জন্য। আমি এই অদ্ভুত আখ্যানটি লিখছি কারণ, কবে এই কিংবদন্তীস্বরূপ বৃদ্ধ ফট ক’রে মরে যাবেন। এখনো দেখা করিনি। ফোন করিনি। যদি মরে যান, একা ফ্ল্যাটে ছটফট করবো শোকে। সেই ভয়ে, এখন কিছু দিয়ে রাখা। টিকে যেতেও পারেন অনেকদিন আরো। ভীষণ জীবনীশক্তি। জীবনকে ভালোবেসে চুষে খাবার ইচ্ছে।
    “মলয় রায়চৌধুরীকে দাদা বলার দূরভিলাষ হয় নি কখনো আমার। এই গ্যালিভার কেন যে লিলিপুটের সংসারে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় সারা শরীরে তাদের মই বেয়ে উঠতে দেন, সেই নিয়ে আমার এক চাপা ক্ষোভ ছিল। ইনি ভীষন পণ্ডিত। বাকি বড় বড় কবিদের মতো দূর থেকে কিছু কিছু জ্ঞানের কথা লিখলেই লোকে আশেপাশে ঘুরতো বেশী বলে আমার বিশ্বাস। তাও আমাদের মতো নতুন শিঙওলাদের, এবং আমাদের চাইতেও আরো আরো খাজা জনগণকে উনি প্রশ্রয় দেন। এই মার্কেটিঙের স্টাইলটা আমার পছন্দ নয়। কিন্তু পুরুষালী কড়া মদের মতো তীব্র আত্মবিশ্বাসে উনি যে এটা ক’রে যান, প্রচণ্ড টেক-স্যাভি, সরাসরি, আড়ালহীন প্রচার, এটাও আমার আজকাল ভালই লাগে।
    “তাঁর হাত দিয়ে যে কবিতা বেরিয়েছিল, (“প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ১৯৬৩ সালে ভারতীয় কবি মলয় রায়চৌধুরী রচিত ৯০ লাইনের একটি জলবিভাজক কবিতা। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে।প্রকাশের পর সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে কবিতাটি নিষিদ্ধ করা হয়। ভারতীয় আদালতে হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তিনটি ধারায় মামলা হয় এবং মলয় রায়চৌধুরীসহ অন্যান্য আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে মামলাটি নাকচ হয়ে যায়। মামলা চলাকালীন সময়ে আমেরিকা ও ইউরোপে মলয় রায়চৌধুরীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, এবং বিভিন্ন ভাষায় কবিতাটি অনুদিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত 'মর্ডান অ্যান্ড পোস্টমর্ডান পোয়েট্রি অফ দ্য মিলেনিয়াম" সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে একমাত্র কবিতা হিসেবে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।” (উইকিপিডিয়া থেকে)), সেই কবিতা কারোর হাত থেকে বেরোনো শক্ত। সারা পৃথিবীর কবিতাপ্রেমী তা জানে। আমি আর তা নিয়ে বলি কেন। ওরকম একটা কোনদিন নামাতে পারলে বুঝতাম, হুঁ, কিছু করা গেলো। হবে না। সে আধার নেই আমার। তাই বলে ওনার এখনকার অনেক কেমন-যেন কবিতাকে লাইক টাইক দিতে পারি না। প্রয়োজনও নেই। যার এত উপন্যাস আছে, তাকে কেবা কবিতায় যাচে?
    “মলয় রায়চৌধুরীর  উপন্যাসগুলি ভীষণ ভীষণ আণ্ডাররেটেড। বাংলা সাহিত্যে ঠিক ওরকম উপন্যাস বেশি লেখা হয় নি। ভালোয় মন্দে শুধু না, অদ্ভুত অন্য ধারার জন্য। কেন লেখা হয় নি তার বড় কারণ আমার মতে এই যে, ওরকম টেস্টোস্টেরন সম্বলিত প্রেমিক পুরুষ খুব বেশী নেই মনে হয় বাংলা সাহিত্যজগতে।
    “এই জগতের ক্যাচাল আমি তেমন জানি না। কিন্তু মলয় রায়চৌধুরী, মাঝে মাঝেই কাজের মেয়ে না এলে স্ত্রীএর সঙ্গে মন দিয়ে রান্নাবান্না বাসনমাজা, কাপড় কাচা ইত্যাদি করে ফেলেন। করার তো কথাই। জানি না তিনি জীবনে কতটা বিশ্বাসী অবিশ্বাসী ছিলেন সামাজিক অর্থে। খালি জানি, ইনবক্সে যখন কোন প্রশ্নের উত্তরে বলেন “বলে ফ্যাল । আজকে কাজের বউ আসেনি । বুড়ো-বুড়িকে অনেক কাজ করতে হবে । লাঞ্চে খিচুড়ি । ডিনারে প্যাটিস।”, কি ভালো যে লাগে! এই বুড়ি, যাঁকে আমি খালি ছবিতে দেখেছি, একসময়ের দাপুটে হকি খেলোয়াড়, তাঁকে এই “অ-কংকাল প্রেমিক” ভীষণ দাপটে ভালোবেসে গেছেন, এমন একটা ছবি বেশ মনে মনে আঁকতে পারি, এঁকে ভালো লাগে।
    “মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাসের পুরুষদের মতো প্রেমিক আমি বাংলা উপন্যাসে কম দেখেছি। তাঁর “ডিটেকটিভ নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক” উপন্যাসে, এক গণিতবিদ, বহুগামী অবিবাহিত পুরুষ, হঠাৎ এক স্বল্পপরিচিত সহকর্মী মহিলার “চলুন পালাই” ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গিয়েছিলেন বিন্ধ্যপর্বতের অন্য দিকে, তামিল দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। নাগরিক সভ্যতার থেকে পালাতে চেয়েছিলেন এই উচ্চশিক্ষিতা তরুণী মায়া, আর মায়ার ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকে গেছিলেন সেই গণিতবিদ। এই উপন্যাসটি ছোট্ট, গোগ্রাসে গেলার মতো, নানান ভাবে রগরগে, আর নানান ভাবে ভীষণ ভীষণ সেরিব্রাল, মস্তিষ্কপ্রবণ। এই উপন্যাসে, জঙ্গুলে জীবনে ফিরতে চাওয়া মায়ার ঋতুস্রাবকালে, তাকে নিজ হাতে ধুইয়ে দিয়েছে তার প্রেমিক। অথচ দুজনে দুজনকে ডেকেছে “আপনির” দূরত্বের পবিত্রতায়, নিজেদের স্বত্ত্বাকে আলাদা বোঝাতে, “পবিত্রতার মতো অস্পষ্ট” শব্দকে ধূলিসাৎ করেও। এই উপন্যাসটির একটি রিভিউ আমি আগেও করেছি। বিশদে যাবো না। শুধু, এই প্রেমিকের প্রতি আমার গভীর মায়া যে বলে “চাল-পোড়া তো খাওয়া যাবে না , তাই মায়া চাল দাতাকে অনুরোধ করেছিল যে আমাদের একমুঠো ভাত দিলেই চলবে, কাঁচকলা পোড়া বা কাঁঠালবিচি পোড়া দিয়ে খেয়ে নেয়া যাবে, লঙ্কার টাকনা দিয়ে । প্রায় প্রতিদিনই ভাত পেতে লাগলুম , যদিও কলকাতায় যা খেতুম তার চেয়ে অনেক কমই, কিন্তু কম খেয়ে আর রাতে না খেয়ে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল কম খাবার । আমি চাইতুম মায়া বেশি খাক, মায়া চাইত আমি বেশি খাই । আমি একদিন বলেই ফেললুম, প্রকৃত ভালোবাসা কাকে বলে জানি না, কেবল যৌনতাই জেনে এসেছি এতকাল, আপনি ভালোবাসতে শেখালেন। জবাবে মায়া বলেছিল, অতীতকে আনবেন না প্লিজ, আপনি কী ছিলেন, কী করেছিলেন, সব ভুলে যান, সমস্তকিছু মুছে ফেলুন, আমি কি কোনো স্মৃতিচারণ করেছি?”। বা যে বলে “জীবনের বাঁকবদলগুলো, যতবার ঘটেছে বাঁকবদল, সব সব সব সব নারীকেন্দ্রিক ; নারীর ইচ্ছার, নির্দেশের, দেহের, আকর্ষণের, রহস্যের মোহে । স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভাল, সান্মানিক স্নাতকে খুব-ভাল , স্নাতকোত্তরে অত্যন্ত ভাল, তাদেরই কারণে , প্রভাবে, চাপে, আদরে । চাকরিতে যোগ নারীর জন্যে উন্নতি নারীর জন্যে, চাকরি ছাড়া নারীর জন্যে , ভাসমান জীবিকা নারীর জন্যে , অবসরে পৈতৃক বৈভবে পরগাছাবৃত্তি নারীর কারণে । কে জানে, হয়তো মৃত্যুও নারীর হাতেই হবে । জীবনে নারীদের আসা-যাওয়া, সেনসেক্স ওঠা-পড়ার মতন, না ঘটলে, আমার ব্যর্থতা, ব্যথা, পরাজয়, গ্লানি, অপরাধবোধ, এ-সবের জন্যে কাকেই বা দায়ি করতুম ! কাকেই বা দোষ দিতুম আমার অধঃপতনের জন্যে ? লোভি লম্পট মাগিবাজ প্রেমিক ফেরারি হয়ে ওঠার জন্যে ? হবার, নাকি হয়ে ওঠার ? আসলে আমি একটা কুকুর । আগের সিডিতে লিখেছি, তবু রিপিট করছি শেষনির খাতিরে । যে-মালকিনির হাতে পড়েছি , সে য-রকম চেয়েছে, যে-রকম গড়েছে , তা-ই হয়েছি । সেবার কুকুর, কাজের কুকুর, প্রজননের কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর, পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপি কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, কোলের কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর, সেই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু একমাত্র কুকুর যেটাকে আমি ভালবেসেছি, তা হল মালকিনিকে উন্মাদের মতন ভালবাসার কুকুর । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল , চিরকাল তেমনই থেকে গেছে।”।
    “আমি নিশ্চিত যে, মলয় রায়চৌধুরীও  এরকমই আকাশমুখো লেজের কুকুর। তিনি প্রবলভাবে, ভিতর থেকে, লিঙ্গসাম্যে বিশ্বাসী। “অরূপ, তোমার এঁটো কাঁটা” উপন্যাসে তিনি যে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মহিলা চরিত্র বানিয়েছেন, যে লোভে লালসায়, ভালোবাসায়, প্রতিশোধে, ভীষণ রকম জীবন্ত ও অসহায়, মেয়েদের সবটুকু নিয়ে সবটুকু দিয়ে ভালো না বাসতে পারলে, রূপের মধ্যে ওরকম অরূপ, আর তার এঁটো কাঁটাসহ মচ্ছগন্ধ ধরে রাখা যায় না। এখানেই মলয় রায়চৌধুরীর পৌরুষ। যে রকম পৌরুষ “দেহি পদপল্লবম উদারম” এর মতো উদাত্ত হাঁক দিতে পারতো জয়দেবের কালে, পারে একালেও। তাঁর “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” আর “ছোটোলোকের যুববেলা” তেমনই অকপট, দাপুটে, উজ্জীবিত, ভিগরস। নিজেকে বিশ্রেণীকরণ করেছেন শুধু জোর করে নয়। তিনি সেরকম হয়েও উঠেছেন। তাঁর মেজদার জন্মরহস্য পড়ে এক একবার মনে হয়েছে, সবটা বলে দেওয়া কি তাঁর ঠিক কাজ হয়েছে পরিবারের প্রতি? আবার এক একবার মনে হয়েছে, বেশ করেছেন, ঠিক করেছেন। বিহারের প্রান্তিক মানুষের জীবন, তাঁর লেখায় দারুণ উঠে এসেছে। “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” উপন্যাস যেমন লিরিক্যাল কোথাও কোথাও, তেমনই, গভীর রাজনৈতিক চেতনায় প্রোথিত। তাঁর অনেক উপন্যাসই তাই। খুব কাটাকাটা, খুব ন্যাকামোহীন, নির্মোহ, নিজের প্রতিও, নিজের নায়কদের প্রতিও, অনেকটা নায়িকাদের প্রতিও। এরকম ধারাবিবরণী বাংলায় লেখা কম উপন্যাসেই আছে। খানিকটা সমরেশ বসুর “যুগযুগ জীয়ে”তে কাছাকাছি কিছু স্বাদ পাই। তাও, এই উপন্যাসগুলি লেখার ধরণে অনেক আলাদা। আর এই সবের পরেও রচৌকে জিগালে, তাঁর সব জীবনদর্শনের মধ্যে, সব ছাপিয়ে, হয়তো কৈশোরের ভুবনমোহিনী রাণা উঠে আসবে, প্রথম চুমুর টেণ্ডারনেস নিয়ে। কিশোর পুরুষে।
    “এই লেখাটা আবেগতাড়িত। খাপছাড়া। কর্মক্লান্ত দিনের শেষে রাত দেড়টা থেকে তিনটের মধ্যে আজ লিখবোই, বলে লিখে ফেলা। পরে হয়তো সংশোধন করবো আরো। উপন্যাসগুলোর, প্রবন্ধগুলোর, কবিতাগুলোর, ইদানীং লেখা ওনার কিছু কেমন-যেন-ভাল-না কবিতাগুলোও আলোচনা করা যাবে আরো কিছু। তবে এই লেখা অনেকাংশে ব্যক্তিগত ভাবের লেখা। তাই এভাবেই অকপটে লিখছি। আমার গবেষণাপত্রটি যখন শেষও হয় নি, মলয় রায়চৌধুরী আমাকে তখনই খুব উতসাহ দিতেন। আমাকে নিয়ে তাঁর যে অবন্তিকা, তা তখনই লেখা। পরে যখন গবেষণাপত্রটি বেরোলো, আমার ক্ষীণ অনুরোধ থাকা সত্ত্বেও, ফেসবুকে প্রায় সাতশোবার শেয়ার হওয়া এই লেখা, এবং আরো অনেকবার শেয়ার হওয়া লেখার নানান রেফারেন্স কিছুতেই টুইটারের মুখ দেখলো না বাঙ্গালি সমাজে। অথচ টুইটার কাউণ্টই জার্নাল মেট্রিক গ্রাহ্য করে। এই অশীতিপর বৃদ্ধ তখন, না বলতেই, বহুবার, চুপচাপ, এন্তার লোককে, সংস্থাকে ট্যাগ করে, টুইট করেছেন আমার গবেষণার লিংক, বহুদিন। ভালোবাসি কি সাধে?”
    আমরাও, যারা সাধারণ পাঠক, মলয় রায়চৌধুরীকে শ্রদ্ধা করি, তিনি বহুগুণে গুণান্বিত বলেই কেবল নয় । তিনি অমরত্বের বোধে পীড়িত নন । তাঁর শত্রুদেরও তিনি ক্ষমার চোখে দেখেছেন ।
  • Malay Roychoudhury | 223.229.178.225 | ০৮ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৫১738562
  • Autobiography of a Slumbred Bengali 
    Malay Roychoudhury
    One
    I was probably born in 1939 and lived in Imlitala slum with thatched mud houses in narrow lanes without electricity and piped drinking water in any of them,  of Patna town of Bihar state in India, with an extended family of twenty members whom my father had to take care of after my grandfather’s death. I have used the word ‘probably’ because Ma did not ever go to school and Dad learned his alphabet late. Other six brothers of Dad and their wives  did not go to school either. The first member in our dynasty to go to high  school was my elder brother Samir. 
    Imli means tamarind tree and ‘tala’ means beneath the tree. No one in the locality knew where and when there had been a tamarind tree – may be during During the reign of Emperor Ashoka in the 3rd century BCE, when it was one of the world's largest cities, with a population of about 150,000–400,000 or maybe when Megasthenes was a Greek ambassador of Seleucus I Nicator in the court of Chandragupta Maurya or may be it is just a figment of someone's imagination. However, when I visited the locality after forty years, it had completely changed, the inhabitants were upper caste people living in brick houses, not in thatched huts. Drains had been covered, electricity and drinking water had entered lanes and bylanes as well as houses. 
    Eyes closed, holding a tiny steel chisel between forefinger and thumb for cutting my nails, Ma would reminisce of a devastating earthquake in Bihar when she lost the family’s blackbuck and couple of swans, yes swans she insisted, not ducks that you find at Imlitala searching for food in the open dirty stinking drains in which the slum children shitted in early morning. That mudhut was in the Bajaja area, another slum, which crumbled in a few seconds and everybody had to flee for life. 
    The family pooled their resources and purchased the thatched Imlitala residence which had to be reconstructed to suit the requirements of a big family like ours. There was a water well within the house which had to be closed by filling with debris as local women had been using it for their marriage rituals during which they sang songs considered obscene by the male elders of the family. However, a sign of a circle remained on the floor which was not considered auspicious by Granny. 
    Compared to other areas in Patna the Imlitala abode was cheaper not only because it was in a slum also because the inhabitants were, almost all, members of the underworld, eaking out their living by resorting to banditry, hooching, bootlegging, dacoity, thievery, pickpocketing, mugging, counterfeiting cheap items, looting, illegally tapping toddy etc.. They were not organized criminals but got together when needed, the reason being, though all belonged to the lowest of castes among Hindus, at that time labeled as ‘untouchables’  there were various types of castes, some of whom felt they were of higher order.
    The slum had a Muslim part as well and they were all Shia Muslims who were members of harems of various landlords and Nawabs of Lucknow who fled the town when the East India Company dethroned Wazed Ali Shah. The Muslim area was much more poorer as they did not resort to crime but lived on earnings from selling duck and hen eggs, chickens, goats and preparing Biri, an Indian home made cigarette. My initiation to literature, specially poetry, developed because of a Muslim family whose members still held their Lucknow fascination for urdu poetry and strangely, now forbidden, songs. At that time I did not know there were various divisions among Muslims. The Muslims of Imlitala used to beat one's own self with ropes or chains and bled intentionally during muharram . Such behavior was not seen among the Muslims of Dariapur, the area where Dad shifted later. Once I thought of entering the mosque at Dariapur and was stunned when the cleric said, “looks like you have come to steal shoes.” In the frontside room of Kulsum Apa’s family Biri used to be prepared with tobacco in leaves tied with a string then placed on a net kept over an oven. I also participated in their Biri preparation though I had to wash my hand at the roadside tap so that Ma did not know about it. In that room they had a replica of a flying horse made of tin and a framed photo of Karbala which they revered.
    The Imlitala public tap was just in front of the small square of our house. When ladies came to fetch water in buckets or wash their clothes, they used to keep their children with my friend Kapil’s grandfather. The old man used to teach obscene abuses to the children who did not know the meaning of the words. Sometimes a kid used to ask the old man whether he should abuse the lady or the man at the tap. Nobody seemed to bother being abused by kids and laughed away. In our house, however, we were forbidden to sit near the window and listen to those obscene abuses, though I learned all the abuses from the old man’s school.
    There were no restrictions for us children of the area to enter any house during playing hide and seek or any other game. A boy could even hide below a cot on which someone was having an evening nap. We could enter the house of the Muslim families and the adjacent mosque. We could hide behind prayer mats kept inside the mosque – this is unthinkable these days. I visited a particular Muslim family to purchase duck eggs as our family was prohibited from eating chicken eggs. There were no restrictions either from our family elders. Ladies of those families came to our house to gossip with Ma and aunts. Their language was rustic and only when we grew up we came to know that several expressions that Ma and aunts picked up from them were considered obscene by the educated and cultured wing of the society, both Hindi speaking and Bengali.
    During such visits a Muslim teenage girl took fascination in me and I had my first exciting experience of my skin touching female skin. This was happening even though India had been partitioned in 1947 and relations between Hindus and Muslims had turned sour. Strangely, Ilmitala slum was not affected. Her name was Kulsum and I called her Kulsum Apa as she was four years older than me. She had big black eyes and eyelashes looked so artificial that just a stare at them created hallucination. Her skin was glazing black reminding that she was carrying the history of an African slave girl sold to a king by Portugese slave merchants. She had dimpled cheeks. She took me to a dark dingy damp room full of hens, ducks, goats and sheeps, told me to close my eyes, and started reciting a poem of Faiz Ahmed Faiz, while her lips travelled all over me. She took my right hand and I wondered if the female organ was so soft and grew fine hairs like mine. Another day, when a nanny goat was giving birth to kid goats, she told me that human babies are born in the same way and showed me a hairy vagina again. I could not check my strong urge to put my lips on it. I had to reduce my frequency of visits as one of the cousin sisters, Dolly, uncle Sushil’s daughter, asked me why Kulsum was in search of me. Arun seemed to be aware and advised me not to get into any trap.
    The lane on the left side of our house was a blind one at the end of which there was a semicircle compound in the middle of which there was a five feet deep ditch surrounded by huts and cannabis shrubs which grew all through the year. The ditch was used for slaughtering pigs for celebrating a successful banditry by the residents. Whenever I saw that a pig was being brought, legs tied to a bamboo pole, carried on the shoulders of two men, I could make out that they had a good booty some days back. In the evening when we used to study in kerosine lantern light, we used to hear the frightening shriek of the pig put in the pit and being killed by hot iron rods pierced in its body. Nevertheless, the next day Samir, Arun and myself would visit them for our share of cooked pig meat to be taken with palm-toddy or rice liquor. A couple of inhabitants in that compound also ate roasted greater bandicoot rats and we three brothers tasted the flesh which did not seem different in taste from other flesh except for the smell. My initiation to toddy, country liquor, cannabis, pig and rat meat was through these men who loved us all three brothers, though they had a special bonding with Arun. There were two dogs in that lane which were considered Hindu dogs. Similarly there were two dogs near Kulsum Apa’s house which were considered Muslim dogs. Dogs of one side did not venture into that of the other. When a pig was roasted the dogs knew they are going to have their share. The dogs also knew how to bark when a police party arrived in search of suspected criminals. Such barks were an indication to the criminals who would get upon the roof of thatched huts and walk over them in light foot and disappear into the mango orchard behind the blind lane. We went to our roof to watch their creepy disappearance. 
    In that lane there was a milkman family with a few cows and goats who sold milk and cow dung for living. The family had a male member who was considered mad and was kept chained where the goats and cows were tethered. He used to drink milk directly from udders with his mouth and copulated with the animals. Members of his family knew about his activities but did not bother as they felt his mind and body was satisfied and that is what they wanted. All the residents of Imlitala knew about it and felt nothing wrong with it. 
    There was also in that lane an widow who had two male goats, that is bucks or billies, one white with long neck and another black and sturdy. Both of them were always in a fighting mood with each other for which the lady chained them separately, one inside her hut and another outside tethered in metal chains. People who wanted to get their nannies or doe mated knew of their goats' estrous cycle,the beginning of one estrus (heat) to the beginning of the next estrus (heat). To bring the female goat to heat, the lady would rub a cloth on one of the bucks and let the nanny goat smell it. She charged double for the white one and argued that when one searches for a fair complexioned groom he pays more dowries than a dark skin groom. Moreover, the breed of the white one was more in demand during Muslim festival of Bakrid for their better quality of meat. During Bakrid we used to get a front leg of the slaughtered goat from Kulsum Apa’s house.
    On one night Arun unchained both of the billies quite silently and allowed them to fight each other. The sound was such that several people got up with a kerosene lamp in their hands to find out as to what was happening. Arun had come back and peeped through the window to enjoy the ruckus. He whispered to us and all brothers and sisters gathered in the room without light to peep through. The widow came out hearing the sound of billies fighting each other during the night. Along with her came out a fair complexioned person, the widow’s paramour, whom we recognized as the sweetmeat seller on the main road. Arun, who did not sleep during the night , had known about their love affair. The fellow had to marry the widow. We joined in the marriage for goat meat, sweets and toddy.
    On the right side lane there was an old man named Hulasbabu,who was considered to be a soothsayer, expert in Tusidasa’s Ramcharitmanas. He had a pen made of lead. Whenever someone had a problem he or she would visit him. The person was advised to close his eyes, open a page of Ramcharitmanas and point the lead pen to any stanza on the page. Hulasbabu would explain the meaning of the stanza and forecast what is going to happen to the person, good or bad. Hulasbabu did not talk of remedies to get out of the problem. 
    I was born during a lagoon coloured autumn at Patna in the Prince of Wales Hospital, now called Patna Medical College and Hospital, five or maybe five and half years after the earthquake that demolished the hutment Dad with five brothers and a sister lived in. I was called Fauna at home though formally named Malay because the Hindu Zodiac indicated the letter ‘M’ on the day of my first rice ritual. The ward in which I was born has been demolished and the hospital has been renamed after India’s independence, giving me no chance to check the exact date on which I was born from the records of the Hospital.
    Dad consulted the Hindu almanac, deciding on an auspicious date at the time of my admission to junior kindergarten at Saint Joseph's convent, in order to convince the Irish doe-eyed nun of the fact of my birth on October 29, 1939. We were a very poor family to afford payment of fees for studying at a convent school. It was just by chance that I was playing at my father’s photo shop at the age of three when Father Hillman, a German priest and an ameteur photographer, had come to the shop and wondered why I had not been admitted to a good school. When Dad spoke of his financial condition, Father Hillman arranged for my admission and allowed remission of fees. Ma contested this birthdate till she died of an enlarged heart in 1982, as she thought I was born on a Friday on the eleventh day of the month of Kartika with metal forceps nurses used to pull me out of her body, for my legs had come out first. Elder brother Samir studied at a vernacular school and was packed off to our maternal uncles’ house for studying at City College, Kolkata. Dad feared that Samir may be spoiled for his association with the teenagers of Imlitala.
    A devout Brahmin, revelling in his puritanic logic, Dad insisted, A Hindu Aryan was born of his sacred thread ceremony and that we were descendants of Bidyadhar Roychoudhury, the great zemindar who was forced by the Mughal king’s agent in Bengal to hand over the villages Kolikata,  Gobindapur and Sutanuti to Job Charnok of East India Company for a meagre sum, which became joie de vivre called Calcutta, now Kolkata. Bidyadhar  was great grandchild of Lakshmikanto, who was awarded the Roychoudhury title and the villages along Sundarbans by Mughal emperor Jehangir. 
    Lakshmikanto,  was originally from Jessore, now in Bangladesh, as a minister of King Pratapaditya. Pratapaditya was a Mughal vassal of Jessore and one of the most powerful zamindars of lower Bengal, before being crushed by the Mughal Empire. He was eulogized, in an ahistorical manner, by 20th century Bengali nationalists as a Hindu liberator from foreign (Islamic) rule. Tradition asserts that Pratapaditya had his uncle Basanta Ray murdered around 1598 - 1600, with support from the Portuguese, and declared his independence. In return, he  allowed the Christian Missionaries to settle in his territories — the first Church in Bengal would be opened at Chandecan in about 1600.  Lakshmikanto had left king Pratapaditya when the king conspired and killed his own uncle Basanta Ray. The Mughals came into conflict with Pratapaditya for various reasons and the king of Jessore was defeated, chained and died while being taken to Delhi. Lakshmikanto had settled at Barisha-Behala at the end of the then Calcutta. As his family became quite big with brothers and their children, one of the descendants, Ratneshwar, shifted to western side of Hooghly river in 1709 and established a new town named Uttarpara.  The house on Choudhury Para Street was built by Ratneshwar  based on Turkish architectural design and called ‘Sabarna Villa’. The villa was dismantled in 1990 and housing colonies constructed in its place.
     My grandmother, Apurbamoyee, who died at the age of ninety four at Savarna Villa, used to say that we became poor because the Roychoudhurys mated with several wives and bred like pigeons. 
     Laksminarayan, youngest of three children of Jadunath, was the first professional Indian photographer-painter born in 1866. Lakshminarayan had two elder brothers, Harinarayan and Baikunthanath.  The descendants of Ranteshwar Roychoudhury had crossed hundreds through his three wives and wives of his sons by the 1800s which forced members to branch out and seek their own livelihood. The main source of income of Sabarna Choudhury zamindars had been revenue from vast tract of land and gold corpus given to them by Emperors Akbar and Jahangir.The Roychoudhury title was bestowed on the family by Mughal Emperors. The family’s surname was, in fact, Gangopadhyay or Ganguly till the doyen of the clan Lakshmikanta Gangopadhyay ( 1570-1649) received the title. They were Brahmins.
    Consequent on acquisition of Calcutta and villages around it by the East India Company in 1698, the clan had started disintegrating. They had also sided with Nabob Sirajuddaula during the battle of Plassey resulting in disfavour from the British when they became rulers. Lakshminarayan had the knack of drawing sketches from childhood. After his marriage to thirteen year old Apurvamoyee Mukherjee of Central Calcutta, when he was in search of a source of income other than doles from his father, he came across 19th Century gentries known to his father in law, and was thus introduced to the evolving culture of writing and painting of his time. He learned the rudiments of formal drawing from the circle of intellectuals of the Brahmo Samaj ; however, his conservative Hindu father Jadunath and mother Matangini were against his friendship with the members of the Brahmo Samaj. During this period of indecision he could impress a representative of the Emir of Bahawalpur with his art who invited him to paint portraits of members of the Emir’s family. The representative had gone to Calcutta in connection with some business. Being a member of the Sabarna Choudhury clan, Lakshminarayan knew pre-British state language Persian as well as Arabic which proved helpful for him in getting his first job.
    Bahawalpur was far away from Calcutta. Lakshminarayan preferred to get out of the family restrictions imposed by his father, and reached Bahawalpur with his wife after about six months. The Emir was quite impressed with his art work and assigned paintings of his family members to young Lakshminarayan. It is said that a few of the drawings made by Lakshminarayan later found their way to the postage stamps of the state. His popularity in Bahawalpur got him invitations from Chitral, Hunja, Fulra and Makran kingdoms — places now in Pakistan. He also visited Kabul on receipt of invitation from the members of the King’s court. Having saved sufficient money he moved to Lahore to settle at the place as his wife was pregnant with their first child.
    In Lahore Lakshminarayan met John Lockwood Kipling, father of famous colonial writer Rudyard Kipling, in search of a job so that he may have a fixed source of income and at the same time improve his skill. In 1875 John Lockwood Kipling was appointed Principal of Mayo College of Arts, Lahore ( present day National College of Arts, Pakistan ). John Lockwood Kipling also became curator of Lahore Museum. Lakshminarayan came to know about photography from Kipling. By this time photography had progressed in Europe and Daguerreotype cameras had been replaced by bellow-lens cameras ; the processing of photographs had undergone revolutionary changes. In Daguerreotype photography, invented in 1830, an image could be made only once by immersing it in salt water. In 1841 Fox Talbot had invented the Calotype process ; in it a negative was made from which unlimited copies could be made. However, these were on paper.
    In 1848 Frederic Scott Archer had invented the wet Collodion process image. This process produced a negative image on a transparent photographic medium ; the photographer could make multiple prints from just one negative. This process required a darkroom for processing. Lakshminarayan got the opportunity to learn photography from John Lockwood Kipling and purchased a bellow-lens camera. In 1880 he  established a photographic company styled as Roychowdry & Co with a darkroom at his residence. The Collodion process had been replaced by gelatin dry plates — glass plates with a photographic emulsion of silver halides suspended in gelatin.
    With the new invention, painting portraits of regal women became easier for Lakshminarayan. Earlier it was quite difficult for him to convince conservative  family heads of Maharaja, Raja, Raje, Deshmukh, Nabob, Baig, Khan, Mirza or Emirs to allow their female members to be seated for quite sometime in front of him in order to draw their sketches to be converted into paintings. Now he could just take a photograph and draw a painting based thereon. The feudal kings were also fascinated with photographs.
    Lakshminarayan started receiving offers from other Indian kingdoms. Thus his journey as a mobile photography company began. He had three sons by now. Pramod, Sushil and Ranjit. It is said that my grandmother was so fascinated with stories about Maharaja Ranjit Singh that she named their third son Ranjit. Whenever Lakshminarayan received calls from faraway Kings or Emirs he took his entire family along with him. As a result the children could not have regular education and had to be taught by a teacher of the court deputed by the Kings or Emirs. They, nevertheless, learned the skills of the trade from their father which became quite helpful for them later in life.
    Promod had grown up and helped his father  in carrying the bellow-lens camera in a wooden box whenever Lakshminarayan was invited for family photographs of clients. Sushil carried the camera tripod on which the field camera used to be placed and Ranjit carried the black hood which was required at the time of focusing the lens before a photo was shot. If there was lack of sufficient light all the three boys held burning magnesium wires during the photo shoot.
    Grandfather had three more sons, Anil, Sunil and Bishwanath. He decided to station his family at Uttarpara when he received a call from his father Jadunath who wanted to divide his property among his three sons. Apurvamayee was pregnant and gave birth to a daughter who was named Kamala. The three younger sons and the daughter remained at Uttarpara with Apurvamayee whereas Lakshminarayan moved from one feudal kingdom to another with Pramod, Sushil and Ranjit. Among his sons he loved Ranjit the most as Ranjit perfected not only photo shooting but also in darkroom work and making collodion emulsion for photo processing. The emulsion was a mixture of silver bromide, pyrogallic acid, potassium bromide and ammonium carbonate in prescribed proportions.
    Lakshminarayan got his two sons Pramod and Sushil married during this time to Nanadarani and Karuna. Since Apurvamayee stayed at Uttarpara, ladies were required for kitchen etc work when Lakshminarayan and the three sons moved from place to place. Later, when Kishorimohan Bandyopadhyay approached him for preparing slides for magic lantern to be used for Bandyopadhyay’s anti-malaria campaigns in Bengal villages, Lakshminarayan got his son Ranjit married to Kishorimohan Bandyopadhyay’s daughter Amita. Kishorimohan Bandyopadhyay was research assistant of Ronald Ross. Ross was awarded the Nobel Prize while Kishorimohan Bandyopadhyay was awarded with a gold medal by King Edward VII.
    On an invitation from the Maharaja of Darbhanga to the Maharaja’s Patna palace ( now a Patna University Building ) Lakshminarayan went to Patna and called Apurvamayee along with the other children since Patna was quite close to Uttarpara. Unfortunately Lakshminarayan had a heart attack and died at Patna in 1933.
    Death of Lakshminarayan created a great financial burden on his children as they were not personally known to their father’s feudal clients. Lakshminarayan handled this aspect himself. Apurvamayee pursued with his cousin brother Troilokyanath Mukhopadhyay, who was a reputed author as well as Assistant Curator of Calcutta Museum. On Troilokyanath’s recommendation Pramod got the job of ‘Keeper of Paintings and Sculpture’ at the Patna Museum. However, his salary was not sufficient for the family. The brothers decided to open a photographic shop at Patna and Chhapra in Bihar and one at Uttarpara itself. Sushil was sent to Chhapra, Anil to Uttarpara and Ranjit took the responsibility to run the main shop at Patna. Anil was married to Amiya of Calcutta so that he may take interest in the business and run the shop and earn profit.
    Both Sushil and Anil failed in their ventures,  and went back to Patna with their family. Apurvamayee decided to stay alone at the Sabarna Villa which had started crumbling due to neglect. The business venture henceforth remained centred at Patna with a photographic shop in front of the Bihar National College on Ashok Rajpath, which later shifted to Dariapur in front of Patna Collegiate school on Bari Road. Since there was no competition and Roychowdry & Co held agencies of photographic material and equipment companies it became famous in a very short time. It also became popular among the young freedom fighters of the Indian National Congress. Sushil and Anil were given the work of converting photos into paintings.
    The company shifted to Dariapur in 1954. It started receiving even 50 year old photographs from various clients to be retouched and remade. In many cases such old photographs had only the face intact ; either Nandarani, who was plump, or Amita, who was thin, posed as models so that the face of the lady was placed on their torso. Sushil and Anil were experts in reconstructing such photographs. At that time there were neither mobile phones, computers or photoshopping techniques. Dad wished to stay at Uttarpara when young but lived instead 550 kilometers away at Patna, the seat of the Buddhist Emperor Ashoka during 264-223 B.C.E.
    After the death of Ranjit in 1991 the business venture has undergone sea change in view of digitization of photography. It is now run by Ranjit’s grandson Hridayesh, elder son of Samir, who has received special training in digital photography. He has widened the scope of the business venture to suit the fast paced world of modern-day photography.
    Two
    Despite Grandpa’s adventurous life, Dad cocooned in an orthodox seed : a vegetarian, devoted to a 333 million pantheon, fasting on the eleventh day of lunar fortnight, mantras at lunch and dinner, a change of sacred thread once a month, no eating cereals cooked by untouchable castes, a daily mustard-oil bath in cold water.
    Grandma lived alone in Uttarpara, a auburn twenty kilometres away from Kolkata, across the Hooghly river, in the ancestral edifice, in ruins inhabited by hundreds of wild pigeons and bats, with incorrigibles weeds shooting out of a miasma of tentacles from the salty wind-eroded, moss eaten greenish clay bricks. Here she roamed with a torn napkin around her skinny waist, dried teats dangling on her topless bust. Her companions were single-room tenants using the same dingy dark toilet built probably hundred years earlier, and a couple of black cows she milked with her own hands for a living till her death at ninety four years of age. There were guava and strapple trees within the compound and near the gate, creeper reaching roof directed with the help of ropes unable to bear gourds-- ash gourds, bottle gourds -- festooned precariously overhead. In the courtyard, there was a remnant of a wood-stalk for slaughtering goats and buffaloes : The age-old tradition was  prevalent during Ratneshwar’s time,  to please Goddess Kali. Kali Puja took place during Diwali, which is celebrated every year on Amavasya night in the months of October or November.
    In the unused upper floor rooms there were very old swords, spears and other such items which were used by bodyguards of Ratneshwar, as well as various Persian, Arabic and Sanskrit books, which unfortunately, we did not take interest at that time and were disposed of by Biswanath. Biswanath also disposed of palm-leaf Bengali and Sanskrit manuscripts, Mughal coins and huge brass utensils of Ratneshwar when he moved childless to Uttarpara from Patna. He also persuaded Grandma to legally hand him over the lands owned by the family in Uttarpara and around. On one of the lands he built a brick house in which he constructed small staircases in one of the rooms to reach a tiny sculpture of goddess Kali made of stone. He issued leaflets about the appearance of goddess Kali in his land while building the house in order to collect money for running his daily expenses, which was not much as he was childless. He collected vegetables and cereals from the market in the name of goddess Kali. As the couple grew older they adopted the daughter of his elder brother in law and got her married so that a young man is available at hand to help them. On the advice of Biswanath’s adopted daughter, he got an apartment building constructed on the land, selling off a few flats and shops on ground floor, consigning goddess Kali in Ganges river and installing idols of Radha-Krishna made of silver in one of the rooms. When climbing became difficult for them they sold off their flat and shifted to a ground floor flat at Uttarpara, where uncle Biswanath and aunt Kuchi died.
    Biswanath had left behind a big metal trunk at Patna. Several years later, when I was in college, cousin brother Ajay, eldest son of Kamala, Dad’s only sister, had come for a visit to Dariapur and encouraged us to open the trunk and find out whether the coins were there. We opened the lock with a hammer and found out, instead of costly things, the box contained many naked photographs of uncle Biswanath’s wife Kuchi, in various poses that we find in paintings of old masters. Biswanath and Kuchi used to sleep in the studio hall of Dariapur house and those photographs were certainly shot during night and prints taken in the darkroom which was adjacent to the studio. The photos were verymuch sex appealing but we decided to destroy them, Ajoy keeping one with him as memento. I never thought aunt Kuchi had such a perfect body and smooth skin. At Imlitala house she never participated in kitchen work or washing utensils. She was always found lying on her cot in Biswanath’s room and whiling away her time. Probably being childless caused depression in her. Instead of taking her to a psychologist, I do not know whether there were any at Patna at that time, she was taken for treatment to our family MBBS doctor Akshay Gupta. 
    After Granny’s death in December 1964, Uttarpara’s Savarna Villa looked deserted except for strange tenants who did not know to whom to pay the rent. It is at this time that Biswanath arrived and occupied eastern portion. After a few years, Sunil, another uncle, arrived to occupy the western portion. Since the building had four staircases intact, the brothers, who were at loggerheads, had separate entries and exits. Seven years after Granny’s death, when the roof of the biggest ground floor room crashed and it became haunted, as cousin Puti, Uncle Sunil’s eldest daughter, uprooted the noose of a heifer and hung herself from the exposed wooden beam of the ceiling to be discovered in the night chill by a tenant who took her to be a flying ghost. Puti was in love with a Marxist revolutionary, dubbed by the government as ‘Naxalite’ who was killed in a staged ‘encounter’. Sunil had three sons and four daughters. Sunil’s eldest son Nilkumar eloped with a girl of lower caste and left Uttarpara for Hyderabad. Sunil was the only uncle who had attended primary classes in school at Patna which drew a railway officer to select him as his son in law and appoint as an employee at railway catering, the job which he liked and got posted at several cities in India. 
    After Dad and his brothers shifted to Imlitala house, ours was the only brick dwelling in the entire slum, the house having been constructed in installments, each brother and his family got a small room with a common bath  and toilet. Water had to be fetched in buckets by male members including Samir and myself from a roadside tap. Dad got a ten-foot-by-ten-foot room facing west  on the first floor, a cot beneath which our belongings were kept, a wooden packing box used as our bookshelf cum table, and a wall to wall wire for hanging our clothes. The packing box was one in which photographic items came from various suppliers and we got them changed quite frequently, mainly because wood pieces were used for firing coal ovens when dung cakes were not available or there was shortage of coal. Coals were purchased in big chunks which had to be broken in small pieces by Samir and myself.
    Imlitala was a Hindi speaking area, the Hindi being a mix of Bhojpuri, Magdhi and other dialects ; hoochers and gamblers had their nights, no neighbours’ children went to school, women in veils kneaded dung cakes for fuel as well as for sale. The outer wall of our house was used to paste and dry the dung cakes, which our family purchased at regular intervals in order to fire two coal ovens in the kitchen. Nobody knew of tooth-brush paste, we brushed our teeth with fresh coal ash powder using our forefingers. Once in a month we were advised by elders to brush our teeth with salt and mustard oil to make them shine. Dad also preferred Neem tree fibrous twig to cleanse his teeth. All male members had to take bath at the roadside tap. Ma, aunties and sisters took baths with the water that was stored in a cement tank at the corner of the toilet. 
    Uncle Promod’s daughters, Sabu and Dhabu, were married before my birth, prompting him to purchase a male infant from a Punjabi prostitute whom he did not legally adopt and could not decide what to do with as the boy grew up to become a ruffian and mugger at fifteen, exhibiting unabashed scorn for everything Bengali to deculturise himself. Uncle Promod admitted him to various schools but he never took interest in studying and ultimately got rusticated from each school. He was three years junior to Samir but Samir could never recollect the mother of this boy, who was named Arun. Except for Sabu, Dhabu and Samir none of us cousin brothers and sisters knew that he was a purchased brother. We came to know of it when he turned rouge.  I was a few years junior to him and in complete awe of the fearful respect he generated in neighbours. As he reached his teens, he procured a country made revolver spinning on his forefinger. One day he allowed me to shoot at a sitting popinjay – I got my thumb bruised. I learned shooting with revolvers and rifles when I joined the National Cadet Core after entering College.
    Sabu and Dhabu were married to two brothers of a family. Their uncle was a famous criminal lawyer at Patna High Court, but was childless. When a landlord of Gaya was exonerated of several murders in a criminal case, the landlord transferred a large cultivable area and a market to the lawyer. He did not legally pass on his huge zamindari house to his younger brother whose sons were married to Sabu and Dhabu. The aunt stayed at the Gaya property which the brothers would visit for collecting monthly rent from persons who had shops in the market and for sale of crops when they were harvested. The aunt became religious minded and a few sanyasis took advantage in getting some cultivable land transferred in the name of their organization. The brothers did not do any work which led to their separation in the same building. After several years of court cases they could retain the huge Patna house where an eight storied building now stands. Sabu and Dhabu both learned classical music from Pandit Bulakilal at Imlitala house and introduced uncle Promod to the elder brother which led to Sabu’s marriage to Dinanath. Promod loved music and played clarinet himself. Lots of musical items had been brought from Uttarpara on boats through Ganges river. Imlitala house had sitar, harmonium, organ, tabla, gramophone and gramophone records. After Sabu and Dhabu’s marriage most of the items were not in use. When in college I had tried my hand on violin and organ but left practicing because of tough studies.
    I remember Arun whose nickname was Buro – an affectionate name in Bengali families for a lovable male child — brought a whore home with him secretly, double his age, and the thud of the wooden bolt woke up an aunt whose midnight yell pulled out sleepy  adults and children from their rooms, an event sufficient to provoke Dad and my uncles to dismantle the Imlitala establishment. In 1953 we, Dad Ma Samir and myself shifted to the thatched hut that Dad had purchased for construction of an alternate shop. 
    Arun had a sad death, Aunt Nandarani, Promod uncle's wife and Buro’s foster mother, who loved the boy like his own son, on advice from some quack of a sanyasin, devised an enchantment potion made of intoxicant herbs, fed to him weekly with the food items Buro loved to eat, resulting in slow poisoning. He grew weak and dropped dead right on the circle which demarcated the water well which was filled up and closed at the time of constructing our Imlitala house. Aunt Nandarani wailed uncontrollably over his corpse. Uncle Promod refused to go to the burning ghat for cremation. There were discussions as to who should burn the fire and perform last rites. Sabu’s husband was selected to do the job. Aunt Nandarani ordered that everything that belonged to Buro should be consigned on the burning pyre so that all memories are wiped off.
    Uncle Pramod worked as a keeper of paintings and sculptures at Patna Museum. He tucked his shirt inside his dhoti and wore a sun hat.  I sat at the back of his bicycle and visited it during our school holidays. The Museum was not air conditioned at that time ; uncle Promod would sit in his room with curtains drawn and fill a few inches of the floor with water from the tap in his room. As he took his nap I roamed around the Museum halls for hours to become a part of ancient and prehistoric mysteries amid granite apsaras, Egyptian mummies, fossilised monsters, remnants of various Indian kings, going back home with him on his bicycle, the only movable asset of the household, cleaned and oiled in turns by children. I learned how to cycle on it and in 1956 Dad purchased a bicycle for me, enabling me to learn by heart the town’s alleys and joints. I also watched the activities of some visitors. Ladies would touch the penis of a bust without head, probably of Alexander ; gents would touch the breasts of an apsara while passing through. This made the two parts shine and this shine itself attracted others who felt like touching.
    In 1956 I was in college and had a class friend named Tarun whose uncle owned several lorry trucks. We travelled to various Indian cities on those trucks carrying salable items as well as goats, sheeps, cows etc. Transportation of animals was prohibited on trucks from one state to another. The owner of the animals would take them down before interstate border crossing and take the animals to the other side through cultivable fields. The drivers took rest during the day on roadside hotel cots, drank country liquor with roasted chicken and drove during the night. They knew about the villages on the road where prostitutes would be waiting for customers. They would stop the truck and carry a tarpaulin to spread over grass for a shot. They requested us also to participate but both Tarun and me were scared of syphilis and gonorrhea, transmissible deaseses through sex. Moreover we had our fill of country liquor and chicken roasts which made us sleepy. 
    Imlitala was considered to be a dangerous locality by the Bengali cultural gentry who did not venture to come to our house even if they were friends of Dad or any uncle. Even my  friends avoided the locality. We were thus outsiders to the Bengali culture of the town. We had to create our own happy cultural events. Aunt Nandarani, who came from a family of priests, used to make various types of sweets on auspicious days of Hindu calendar and we enjoyed the feasts. The kitchen, however, was controlled by Ma as Dad was the main earning member of the family. While going to his shop he would hand over a list of items needed in the kitchen to the grain merchant who would deliver the items and the children had to compare them with the list. Unlike Dad, Ma was a nonvegetarian like all other members except uncle Biswanath who also was a vegetarian, and she loved to eat small fishes of various types since my maternal grandfather had two ponds at Panihati, which have now been sold of by maternal uncles, as they found it difficult to maintain after influx of Bengali refugees and forcible occupation of land because of India’s partition. 
    The government failed to relocate most of the refugees who had to resort to forcible occupation of other people’s lands and properties. The West Bengal government wanted to settle them in Andaman and Nicobar islands and convert them into Bengali colonies but the then communist party leaders misguided the refugees for their own benefit and the proposal did not succeed. Later the same communists after forming government, killed thousands of refugees on the island of Marichjhapi at the Sundarbans where the refugees had resettled themselves, built roads, water connection etc. A few who survived the bullets were bundled on trucks and sent outside West Bengal to some arid places for resettlement. I have visited several of those settlements during my tenure as Rural Development Expert and found that the children have forgotten to talk and write Bengali. The refugees who came from Punjab were mostly cultivators whereas the refugees who came from East Bengal were of various castes and most of them did not know how to cultivate land and grow crops. Some refugees had been settled at Motihari in Bihar and I remember Ma was stunned to find a Bengali rickshaw puller as she thought Bengalis could never go down to such a lower level. She started crying on Bari Road as she was not much aware of the political nightmare of the time. 
    Uncle Promod Loved picnics. On holidays our entire clan except  Dad would go out to cook and eat by a slim stream in a mango orchard or near a wellspring. Sometimes other Bengali acquaintances were invited to join the picnics, probably as an effort to overcome alienation from mainstream Bengalis of Patna. One of the ladies or Sabu and Dhabu would burst out singing, invariably a Hindu religious song, as film songs were taboo and Rabindranath Tagore songs considered un-Hindu. Rabindranath Tagore’s songs, novels, poems were banned at Imlitala as Granny and uncle Promod considered Brahmo religion harmful. Tagore entered our house without anybody knowing that the beautiful songs they were listening to were composed by Tagore. 
    Since uncle Pramod, a patient of diabetes, did not have a son when he died – in 1966 during a hectic election campaign for an obscure Marwari candidate — I performed the funeral rituals by setting fire to the pyre on which lay his cold body embalmed by me with clarified butter.  He was a fat man who turned to ashes in two hours in a yelling blaze that licked the horizon on the other side of Ganges river. Satish Ghoshal, our family priest, directed me to collect a few bones from the ashes, which I immersed in the river. This was my first encounter with the beyond, as I was not allowed earlier to accompany Arun’s dead body to the shores of Ganges for his funeral, a plight Satish Ghoshal sermonized not to give importance to as it happens to all when you came to burn or bury the dead.
    Uncle Pramod used to practice homoeopathy and the Marwari family, who had more faith in homoeopathy than allopathy, was his client. Uncle Pramod treated us as well during fever or stomach trouble. The Marwari family used to invite our entire family whenever there was a function at their house, which was quite frequent. We brothers and sisters used to pocket extra sweets to enable us to eat them during the week.
    A couple of years later Aunt Nandarani died of burn injuries she received when her cooking stove exploded. I was not allowed to perform the funeral rites in her case as Sabu and Dhabu thought this might lead to a claim by me on the Imlitala property, although their own zamindari building called ‘Sylvan House’ was quite big with a dust road leading up to their main building, there being tall flowering trees  and flower gardens on both sides which gradually disappeared due to neglect and lack of resources. There were guava, jackfruit, and many other fruit trees. I used to visit them and played with my nieces who were a few years younger than me. Aunt Nandarani used to stay on the upper floor and gave the first floor on rent to two families. They belonged to the milkman caste to which the Chief Minister of Bihar belonged. Despite efforts by Sabu and Dhabus husbands, they did not vacate and ultimately the house had to be sold to them at throwaway prices. When I visited the area in 1990 everything had changed. I could not recognize Imlitala in my childhood.
    Three
    As any venture uncle Sushil embarked upon was a flop he joined Dad at the photography shop on the main road that shifted later to Dariapur in 1953. The shop which had been opened for him at Chhapra, on the other side of Ganges had to be closed when aunt Karuna, uncle Sushil’s wife developed tuberculosis. In a  room on the ground floor of Imlitala house was given to her, where she lay on the bed on cement floor, our family doctor Akshay Gupta visiting and prescribing whatever medicine he thought fit as tuberculosis at that time was considered untreatable and contagious. She died in that room leaving her husband and two daughters, Dolly and Monu, to be looked after by Dad and Ma. Dad performed her funeral rituals as uncle Sushil did not take much interest.  Dolly and Monu regularly flunked school. Whenever they attended school regularly they brought lice in their hair for which their hair had to be regularly shaved.
    I have recollections of uncle Sushil as a snuff inhaling afternoon dreamer though an artist par excellence. Whatever money Dad gave him for daily expenses he would purchase sweetmeats or fruits and eat on the road as if nobody is looking at him. He, Dolly and Monu had a big room upstairs where all three preferred to sleep on the floor. Uncle Sushil got up quite late and went to Dad’s shop to attend to the work given to him. He and Satish Ghoshal, the family priest, were friends, and loved to watch Hindi films on Tuesdays when the shop was closed. They discussed the beauty and dresses of  heroines which Dad found quite embarrassing. 

     
  • সোনালী মিত্র | 223.229.178.225 | ০৮ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৫৩738563
  • সোনালী মিত্র : মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতা

    মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে প্রজ্ঞা ও আত্মসংযমবোধের গভীরতা, অভিজ্ঞতা ও উন্মেষ দরকার, তা হয়তো আমার নেই। ষাট দশকের বিবর্তিত কবিতা-ধারার পুরোধা যিনি,তাঁর প্রেমের কবিতাও যে স্বতন্ত্র এবং পাঠকের আত্মস্থগ্রন্থিকে অন্য রকমের স্বাদ দেবে, আজকে আর বলার প্রয়োজন আছে কি! বিশ শতকের ষাট দশকের সেই চিরযুবক মলয় রায়চৌধুরী একুশ শতকের দ্বিতীয় অধ্যায় জুড়েও যে প্রেম ও কবিতা-প্রেমিকা নিয়ে রাজত্ব করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ও একান্ত ব্যক্তিগত ভঙ্গিমায় তিনি যা লেখেন, তাতে সনাতন চিন্তাধারার ধ্যানধারণা ভেঙে যায়, গুঁড়িয়ে যায় শালীন – অশালীন গণ্ডী। তিনি অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই হয়তো বলেন, হয়তো একটু চিৎকার করেই বলেন, কিছু কথা হয়তো চিৎকার করেই বলতে হয়!
    আসলে সত্যের সামনে একজন ঋষি, একজন কবি ও একজন ঈশ্বর সমান। সত্য যেহেতু সর্বদা সত্য এবং তার গ্রহণযোগ্যতা বাস্তবধর্মী, তাই সাধারণ মানুষ সবসময় সেই সত্যের সম্মুখীন হতে সাহস পায় না। দ্বিধাযুক্ত মানুষ মানিয়ে চলতে চলতে এক সময় থেমে যায়। মলয় এই ব্যাপারে আপোষহীন। নিজের রহস্যময় অভিজ্ঞতা ও কবিতা-ভাবনাকে শব্দানুভাবের মধ্যে দিয়ে প্রকাশের ব্যাপারে তিনি দ্বিধাহীন।
    আটপৌরে সামাজিক মানুষের চিন্তাভাবনার স্থিরতা নেই, নির্দিষ্ট কোনও দিশাও নেই। আজকে যে সম্পদ ডাস্টবিনে প’ড়ে আছে, আগামীদিনে হয়তো সেটাই শোবার ঘরে শোভা বৃদ্ধি করবে। আত্মবিস্মৃতির মানুষ খুব বেশিদিন এক অবস্থানে থাকতে পারে না। তাই মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা বর্তমানে কিছু-কিছু পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও একদিন যে হবে না, এমন জোর করে বলার মানুষটিও কি আছে? এখন ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি বারংবার প্রকাশিত হয়, এবং বলার প্রয়োজন হয় না যে সেটি কে কবে রচনা করেছিলেন।
    আমার সমকালীন সহকর্মী কবিদের নিয়ে লেখা মলয়ের প্রেমের কবিতা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব যখন এসেছিল, একটু ভয়ই পেয়েছিলাম! (অবশ্য শুধু সমকালীন কবিদের নিয়েই নয়, নামহীন কল্প-প্রেমিকাদের নিয়েও প্রেমের কবিতা লিখেছেন কবি ; হয়তো তাঁরা তাঁর জীবনে কখনও অনুপ্রবেশ করেছিলেন, আমরা জানি না, তাঁর গোপন জীবনের প্রতিটি ঘটনা জানা সম্ভবও নয়। তাই, প্রেম এখানে অনির্বাণ আগুন, শুধু পোড়ায় না,দগ্ধ হতে হতে শুদ্ধও করে।) কারণ, ওনার প্রেমের কবিতা নিয়ে কিছু বলতে চাওয়া মানে, নারী হিসাবে, পাঠিকা হিসাবে, নিজেকে ভেঙে আয়নার সামনে দাঁড়ানো। এই একাকী দাঁড়ানোর মধ্যে নগ্নতা আছে, আছে চোখকে অন্তরের মধ্যে স্থাপন করার প্রস্তাবনা। সমকালীন কবিদের নিয়ে লেখা তাঁর নিরীক্ষামূলক ( হয়তো পোস্টমডার্ন আঙ্গিকে রচিত ) প্রেমের কবিতার মধ্যে ধ্রুপদ আত্মসমর্পণ আছে, কিন্তু সেই আত্মসমর্পণে দুঃখ নেই, সারস ঠোঁটের মতো বীক্ষণের গভীরতা আছে। এই গভীরতায় মধ্যে ডুবে যেতে পারলে কবিতা সোনার খনিতে পরিণত হয়ে ওঠে, পাঠক হয়ে ওঠে সোনার কারিগর।
    এখানে আলোচ্য আমার পঠিত প্রেমের কবিতাগুলি প্রধানত এই সময়ের লেখা কবিতা। সত্তর উত্তীর্ণ কবির প্রেম ও তৃষ্ণা কবিতার উপত্যকা জুড়ে ঘন সবুজ পাইনের মতো ঋজু ও স্বতন্ত্র হয়ে বিরাজ করছে। অমায়িক বাতাসে শিরশিরানির আ্‌হ্বান, আহ্লাদী ধানের গুচ্ছের মতো ঢলে পড়ছে এ-ওর গায়ে। ‘তানিয়া চক্রবর্তীর জন্য প্রেমের কবিতা’ কবিতাটা নিয়েই প্রথমে দেখা যাক। প্রেম যেন এখানে ভূমি, সেই ভূমি মরুভূমিই হোক বা সমতলের দোয়াস ভূমি হোক! সমস্ত ভূমিই আসলে মা! প্রতিটা মায়ের মধ্যেই আছে সন্তান উৎপাদনের সেই প্রভূত সম্ভাবনা। সেই উৎপাদন সম্ভাবনায় তো ভূমিকে মায়ের ভূমিকা দিয়েছে। কবিতার শুরুতেই সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন কবি –
    ”কী নেই তোর? মরুভূমির ওপরে আকাশে পাখিদের তরল জ্যামিতি
    প্রতিবার — বিপদের ঝুঁকি — সম্ভাবনা — বিরোধ — সমাক্ষরেখা —
    আমি তো লাল-ল্যাঙোট সাধু, আমি বাস্তব, তুই বাস্তবিকা ”
    সত্যিই তো, কী নেই তোর! কী নেই- এর মধ্যেই রয়েছে সবকিছু। একটু খুঁজে দেখলে যেকোনও বস্তুর মধ্যেই প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। তাই ‘কী নেই তোর’ এর মধ্যেও কবি খুঁজে পেয়েছেন সেই শাশ্বত প্রেমের বৈদিক অঙ্গীকার। এই কবিতার মধ্যে চিরকালীন যুবা কবি স্বপ্ন ও সাধের সেই সেতুটিকে খুঁজতে চেয়েছেন, যে সেতু দিয়ে আফ্রোদিতি ও সরস্বতীর নিত্য চলাচল। যে সেতু দিয়ে উপনিষদের ঋষিপুত্র পালিত গাভীর মুখে সবুজ ঘাস তুলে ধরবার জন্য ছুটে চলেন বছরের পর বছর! এই চাওয়ার মধ্যে পরাজয়ের ভীতি নেই, নেই আত্মগরিমা হারানোর ভয়! মহাভারতের সেই মৎস্যগন্ধা তরুণীটির কথা মনে পড়ে।
    ”টের পাই কালো বিশ্ববীক্ষায় আমার নামের স্থায়িত্ব নেই
    আমি তো সাধু-প্রেমিক তোর, পৃথিবীর নাম দিসনি কেন?”
    এই লাইনের মধ্যে যখন দেখি ব্যক্তিগত চাওয়াগুলি মহাবিশ্বের মধ্যে বিলীন ক’রে কবি সাধুর ভূমিকায় নতজানু দাঁড়িয়েছেন প্রেমের সামনে! এই প্রেম যেন সাধনা! প্রত্যাশাবিহীন এই সাধনার মধ্যে কবির অন্তর প্রেমের কাছে সমর্পিত ক’রে শূন্য হাতে দাঁড়িয়েছেন মহা আনন্দের দিকে। যেন তাঁর নেওয়ার কিছু নেই, যেন তাঁর প্রত্যাশা পূরণের চাপ নেই। শুধু সেই অনাদি প্রেমের নৌকায় মহাবিশ্বে ভেসে বেড়ান আছে।
    বোধ এবং বোধি একাত্ম হতে পারলেই একটা সময়ের পরে প্রেম ও পূজা একাকার হয়ে যায়! যদিও মলয় যাঁদের নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখেছেন, তাঁরাও কেউ কেউ কবি। এই সময়ে নিজের ঢাক নিজে বাজানোর বাজারে প্রত্যেকেই যখন আত্মকে বলিদান দিয়ে নাম-প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত, তখনই কবি-মলয় এই কবিদের যাপনকেও তাঁর ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। ”সোনালী মিত্র’র জন্য প্রেমের কবিতা” পড়লে কিছু লাইনে এসে চোখ আটকে যায়।
    ”সোনালী প্রেমিকা! তুইই বুঝিয়েছিলিস : হুদোহুদো বই লিখে
    বিদ্বানের নাকফোলা সাজপোশাক খুলে দেখাও তো দিকি
    কালো জিভ কালো শ্লেষ্মা কালো বীর্য কালো হাততালি”
    উন্নাসিক সময়ের মানুষের প্রতি কবির শ্লেষ ঝ’রে পড়েছে ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে। নিজের নবরসের অলঙ্কারগুলিকে বলছেন কালো। তিনি কি শ্রীকৃষ্ণ? তিনি কি ওথেলো? কাউকে ভালোবাসা মানে তো শুধু তাকে ভালোবাসা নয়, তার দর্শন, তার নৈতিক বিস্তারকে ভালোবাসা। কাউকে ভালোবাসা মানে তার সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলিকে আত্মস্থ ক’রে মনের মহিমা দিয়ে তাকে স্পর্শ করা। বোধের বাইরে থেকে অন্ধের মতো কাউকে ভালোবাসার চেয়ে, তার সৃষ্টির প্রতি সম্মানিত থেকে তাকে সমর্থনের মধ্যে দিয়েও যে ভালোবাসার জন্ম হয়, মলয়ের কবিতায় সেই মগ্নচৈতন্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
    আত্মসচেতন কবি স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে যে প্রেমকে ধরতে চেয়েছেন, রক্তমাংসের প্রেমের মধ্যে সেই প্রেম হয়তো-বা নেই! সাধারণভাবে প্রেমের যে আবেগ আমরা অন্যান্য প্রেমের কবিতায় এতকাল দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, এই প্রেমের কবিতার মধ্যে সেই আবেগ আছে, কিন্তু সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো! পাঠক সেই লাভাস্রোতের সন্মুখীন হবার আকাঙ্খায় নিজেকে প্রস্তুত রাখতে বাধ্য। প্রকৃত অনুভবের কোনও পাঠক সোনারকাঠি ছুঁইয়ে সেই আগ্নেয়গিরির ঘুম ভাঙালেই যেন জেগে উঠবে সংবেদনের লাভাস্রোত, তারপরে মনকে ভস্ম করে দেবে।
    চিরাচরিত ঔৎসুক্যের বাইরে যে আকাঙ্খা বিরাজ করে, তার খোঁজ পায় না সাধারণ মানুষেরা। আকাঙ্ক্ষা হল পাকা ও মিষ্টি ফলের মতো। যে ফলের দিকে চোখ ও ক্ষুধা হাপিত্যেশ করে ব’সে থাকে। আকাঙ্ক্ষাকে দমন না করতে পারলে আগাছার মতো বৃদ্ধি পেতে পেতে প্রকৃত ফসলকে নষ্ট করে দেয়। মলয় তাঁর প্রেমের কবিতায় এই আকাঙ্ক্ষাকে নির্মূল করেননি, কিন্তু বাড়তেও দেননি প্রকৃত পরিচর্যার মধ্যে দিয়ে। তাই অতিরিক্ত আবেগের লাগামহীন ঘোড়া পেরিয়ে যায়নি রেসকোর্স ময়দান, অন্যের আস্তানায় ঢুকে চুরি করেও খায়নি খুদকুঁড়ো। তাই তো ”ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়-এর জন্য প্রেমের কবিতা’ য় যখন কবি লেখেন –
    ”অসহ্য সুন্দরী, আমার নিজের আলো ছিল না
    তোর আলো চুরি করে অন্ধকারে তোরই ছায়া হয়ে থাকি
    তোর আর তোর বরের নাঝে শ্বাসের ইনফ্যাচুয়েশানে
    অসহ্য সুন্দরী, বেহালার কোন তারে তোর জ্বর, তা জানিস?”
    আসলে ভালোবাসার মধ্যে থাকাটাই জরুরি! কীভাবে আছি সেটা বড় কথা নয়। আছি, ছিলাম, এটাই জরুরি! এককেন্দ্রিক ভালোবাসার মধ্যে যে জগত আছে, সেই জগতের অধিপতি একবার হতে পারলে না-পাওয়ার ব্যর্থতা আর জড়িয়ে ধরতে পারে না। ভালোবাসা প্রধানত নিজের রক্তের গতিকে সচল ও ঠিক রাখার হাতিয়ার! আমি তোমাকে ভালবাসছি মানে নিজের অস্তিত্বকে সতেজ রাখছি। প্রতিটি ভালোবাসায় মনে হয় আগে নিজেকে ভালো রাখার সেই বর্ম, যে বর্ম পরেছিলেন কর্ণ। ভালোবাসা সেই বর্মের কাজ করে, যে বর্ম রক্ষা করে ব্যক্তিগত দুঃখ, শোক, গ্লানি, ক্ষোভ, অসহায়তা থেকে। তাই মলয়ের প্রেমের কবিতায় দেখা যায় প্রেমিকা যেই হন না কেন, তাঁর সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, সেটা প্রধান নয়। স্বামী, পুত্র, সংসার রইলই বা সেই প্রেমিকার, তাকে কবির কিছুই এসে যায় না ; তিনি তো শ্রীকৃষ্ণের মতন প্রেমে ও কুরুক্ষেত্রে সমান দরদি। তিনি তো প্রেমিকার আলোয় নিজেকে বিকশিত করতে চাইছেন। আলোকে তো আর বন্দি করে রাখা যায় না, ফাঁকফোকর গ’লে ঠিক অন্ধকারের দিকে এগিয়ে আসে। কবি মুখগহ্বরের বিশ্বরূপ-দেখানো আলোর বন্যায় নিজেকে ও সবাইকে উদ্ভাসিত করতে চেয়েছেন, হয়েওছেন উদ্ভাসিত।
    মলয় রায়চৌধুরী কবি-প্রেমিকের বয়সকে বেঁধে রেখেছেন সুনির্দিষ্ট একটা বয়সের মধ্যে। কিংবা কবি-প্রেমিকের বয়স বলেও কিছু হয় না, যেমন হয়নি রবীন্দ্রনাথের, জীবনানন্দের, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। বয়স একটা সংখ্যা ছাড়া যেন আর কিছু নয়। বয়স আমাদের মরতে শেখায়, কিন্তু ভালোবাসা শেখায় জীবনকে উপভোগ করতে! আয়ু একটা শ্বাসের নাম, শ্বাস ফুরলে আয়ু ফুরিয়ে যায়। কিন্তু ফুরিয়ে যাওয়ার আগে কি ফুরিয়ে যাওয়া মানায়! ভালোবাসা বাদ দিয়ে পৃথিবীতে এসে মানুষ যেটুকু অর্জন করেছে তা হল, হিংসা, দ্বেষ, লোভ, ও ক্ষয়। দেহের সঙ্গে এইসব কিছুই যাবে না জেনেও মানুষ ক্রমশ ভালোবাসা থেকে দূরে যত সরেছে, তত বেশি করে জড়িয়ে ধরেছে এইসব রিপু-জনিত ক্ষয়! তাই মলয় রায়চৌধুরী সজ্ঞানেই, শার্ল বোদলেয়ার, পাবলো নেরুদা, এমিলি ডিকিনসন, জন কিটস, মায়া অ্যাঞ্জেলু, সিলভিয়া প্লাথ, টমাস হার্ডি প্রমুখ ইউরোপীয় ভাষার কবি-প্রেমিকদের মতো একইভাবে ভালোবাসার মধ্যে প্রবেশ করেছেন, আর এই ভালোবাসা চক্রব্যূহ নয়। এই ভালোবাসার মধ্যে প্রতিদিন পাখি জন্মায়, পাখি সভ্যতার মধ্যে দিয়ে কবি এগিয়ে যান চিরকালীন সেই প্রেমসত্যর দিকে। তাই তো কবি ”অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর জন্য প্রেমের কবিতা”য় উচ্চারণ করতে পারেন –
    ”মনে থাকে যেন, রাজি হয়েছিস তুই, হাত ধরে নিয়ে যাবি নরকের খাদে
    রাবণের, কর্ণের, ভীষ্মের, দুর্যোধনের আর আমার জ্যান্ত করোটি
    হাজার বছর ধরে পুড়ছে অক্ষরে, বাক্যে, ব্যকরণে, বিদ্যার ঘৃণায়
    মনে থাকে যেন, শর্ত দিয়েছিস, আমার সবকটা কালো চুল বেছে দিবি”
    এই গন্তব্যর শেষ নেই। এই এগিয়ে চলার মধ্যেই আছে জীবনের পূর্ণতা। আজকের দিনটা ভালো করে যদি বাঁচা যায়, আগামী দিনগুলি গোলাপের মতো ফুটে ওঠে। কবি এই উন্মাদ প্রেমের মধ্যে দিয়ে বাস্তব ও অধিবাস্তবের সেই নীল সীমানায় পৌঁছতে চান যেন, যেখানে জঁ আর্তুর র‌্যাঁবো যেতে চেয়েছিলেন। সেখানের কোন পাহাড়ি ঝর্নার জলে একবার দেহমন ডুবিয়ে তিনি চাক্ষুষ করতে চান মায়াপ্রেমের অলৌকিক সেই প্রত্যয়।
    এতক্ষণ সমকালীন কবিদের নিয়ে লেখা প্রেমের কবিতা নিয়ে কিছু কথা বলেছি। এবার যদি একটু পেছনের দিকে তাকাই, ফেলে আসা দিনে প্রেম কীভাবে এসেছিল কবির জীবনে দেখা যাক। ১৩৯২ সালে প্রকাশিত ‘ বাজারিণী’ কবিতাটা নিয়ে দেখা যাক, যেখানে কবি লিখেছেন –
    ”ত্রিশ বছরের পর এলে তুমি। তোমার আদুরে ভাষা পালটে গিয়েছে
    বারবার। জানি তুমি শুভ্রা রায় নও। ওরকমভাবে একঠায়ে
    সারাদিন মাথানিচু করে বসে থাকো। আমার চুলেতে পাক
    ধরে গেছে। শেখাও তোমার ভাষা এইবার। দেখি কীরকম
    ঠোঁট নড়ে। না্ভি খিল-খিল কেঁপে হেসে কুটি হয়। যুবকেরা
    ঘিরে থাকে বহুক্ষণ তোমায় আড়াল করে। কিসের কথা যে এতো হয়
    কিছুই বুঝি না। অন্তত কুড়ি বছরের ছোট হবে তুমি।”
    ”তুমি শুভ্রা রায় নও” তো কে তুমি? শুভ্রা রায় যদি নাই হয় কাকে খুঁজছেন কবি? এই পর্বের প্রেমের কবিতাগুলি অনেক বেশি রক্তমাংসের! অনেক অভিজ্ঞতার আঘাত ও রক্তপাতের উত্থান-পতনের সঙ্গী। ত্রিশ বছর পরে কবি কোন পুরনো শুভ্রা রায়কে খুঁজে পাননি, পেয়েছেন আজকের শুভ্রা রায়কে, যে শুভ্রা রায় অন্তত কুড়ি বছরের ছোট। মলয় তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন তাঁর চেয়ে প্রায় দুই দশক ছোটো মমতা অবস্হী নামে এক তরুণীর কথা, যিনি তাঁকে বিবাহিত জেনেও বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, এবং তরুণীটি তাঁর স্ত্রীকেও জানিয়েছিলেন যে তিনি মলয় রায়চৌধুরীকে বিয়ে করতে চান ; তার অন্যথা হলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। সেই তরুণী শেষ পর্যন্ত টয়লেটের অ্যাসিড পান করে আত্মহত্যা করেন। মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতাগুলিতে সেই ক্ষত ও হাহাকার লুকিয়ে থাকে।
    প্রেম হল ঋতুফসল! ঋতুফসলকে দূর থেকে একইরকম দেখতে লাগে, একই অনুভূতিতে যেন তা ভরা থাকে। খুব নিকটে গিয়ে পর্যবেক্ষণ না করলে হয়তো ধরাও যায়নি যে প্রতিটি ফসলই স্বতন্ত্র। তাই তো আজকে যাকে খুঁজে পেয়েছেন কবি তিনি শুভ্রা রায় নন, তিনি মমতা অবস্হী, হয়তো ঋতুফসলের মতো একই অনুভূতি জাগছে, তবুও এই শুভ্রা আলাদা এক মমতাময়ী! প্রেমের এই চিরন্তন যাওয়া-আসা থাকে, পুরনোকে সরিয়ে নতুন আসে। তাই তো জীবন ও মনের যৌথযন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত আমাদের কল্প-প্রেম-বাস্তবতা এসে জাগিয়ে রাখে, জাগিয়ে রাখে ঘুম থেকে। ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর মধ্যে দিয়ে যে শুভাকে প্রত্যক্ষ করেন পাঠক সেই নায়িকা কিন্তু আর তার পরের কবিতাগুলোয় এত তান্ডব নিয়ে ফিরে আসে না।যারা আসেন তাদের আবেদনে গড়িয়ে পড়ে সুরম্য লস্য, মমতাময়ীর রহস্য। মলয় রায়চৌধুরীর এই পর্বের লেখাগুলি যেন ‘ঘুম-স্বপ্ন-বাস্তব’ এই তিন আত্মনিষ্ঠুরতার অবস্থানের মধ্যে থেকে লেখা হয়েছে। প্রেম থেকে দূরত্ব গভীর হলে প্রতিটি কম্পাস ভুল সংকেত দেয়। আর একটা কবিতা একটু দেখা যাক-
    ”জরায়ুটা বাদ দিয়ে অমন আনন্দ কেন অবন্তিকা
    তাও এই গোরস্হানে দাঁড়িয়ে গাইছিস তুই
    মৃত যত প্রেমিকের গালমন্দে ঠাসা ডাকনাম
    যারা কৈশোরে তোর বিছানার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে
    ভুতুড়ে কায়দায় ঝুঁকে প্রেম নিবেদন করেছিল?”
    জরায়ুহীন অবন্তিকাকে আমরা কি কেউ দেখিনি? মলয় রায়চৌধুরী তাঁর ‘হাততালি’ কবিতটি যাঁকে উৎসর্গ করেছেন, তিনি মীরা বেণুগোপালন, মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনই তাঁকে বলেছিলেন যে তাঁর জরায়ু নেই! সেই মহিলার সঙ্গে মলয়ের সম্পর্ক কেমন হয়েছিল, কতোদিন ছিল, আমরা জানি না, কিন্তু সেও যে কোনো এক অবন্তিকার আড়ালে লুকিয়ে নেই তা কবিতার অন্তর্ঘাত থেকে পাঠক বুঝে যান।
    হাজার হাজার অবন্তিকা আমাদের খুশি রাখার জন্য রাত জাগেন, কনডোম পরিয়ে দেন যত্ন ক’রে। রেলব্রিজের তলা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া কোনও অবন্তিকা হোক, বা নোংরা ঘরের মধ্যে এক হাতে মদ অন্য হাতে জলের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার অবন্তিকাকে তো জয়ায়ুহীন অবস্থায় দেখে অভ্যস্ত। জরায়ু থেকেও যাদের জরায়ু থাকে না, সেইসব অবন্তিকার কাছে কবি হাঁটুমুড়ে অভিবাদন জানান।
    ”যারা কৈশোরে তোর বিছানার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে
    ভুতুড়ে কায়দায় ঝুঁকে প্রেম নিবেদন করেছিল?”
    এই তথাকথিত যারা একদিন ‘ভুতুড়ে’ কায়দায় প্রেম নিবেদন করেছিল, তাদের প্রতি কবি উষ্মা প্রকাশ করেন। এই অবন্তিকা তো শাশ্বত প্রেমিকা, মদের গ্লাসের সঙ্গে সঙ্গে যাদের প্রেমিক পরিবর্তন হয়। মলয় রায়চৌধুরী এইসব নগণ্য প্রেমিকাদের প্রতি যেন দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই তাঁর মনে সঞ্চারিত হয়েছে মানবীপ্রেমের। এই প্রেমের জয়পরাজয় নেই, মোহনার দিকে ভেসে যাওয়া আছে। সময়ের দরজায় দাঁড়িয়ে সময়কে চুমু খাওয়া সোজা ব্যাপার নয়। প্রেম হল সময়ের এক অঙ্গীকারপত্র। সেই প্রেমকে প্রকৃত কবিই গ্রহণ করতে পারেন, যদি তাঁর অন্তরের মন্দিরে জ্বালিয়ে রাখতে পারেন প্রদীপ।
    নামহীন বা নামযুক্ত নায়িকার প্রতি লেখা কবিতাই হোক না কেন, কোথাও যেন এসে মনে হয় এই তানিয়া, সোনালী,অনামিকা, কৃতী, অথবা অবন্তিকা সবাই যেন কোনো এক অদৃশ্য যোগসূত্রে গাঁথা একটি মালারই ফুল, যেন স্তরে স্তরে সাজানো একটিই প্রেমস্বরের বিভিন্ন সুর। অথচ কবি প্রতিটি কবিতায় বা বলা ভালো, প্রতিটি প্রেমিকার ক্ষেত্রে ন্যারেটিভ টেকনিক বা ভিন্ন আঙ্গিকের নিরীক্ষা করেছেন, যেন কবিতাই তাঁর আসল প্রেমিকা। প্রকৃতভাবে কবিকে চিনতে গেলে তাঁর কয়েকটি কবিতা নয়, বিচরণ করতে হয় একটি সম্পুর্ণ গোলক।
    মলয়ের উপন্যাসগুলোতে যে ভাবে তাঁর ব্যক্তিগত রহস্যময় জীবনের নারীচরিত্ররা ছায়া ফেলেছে, ঠিক সেভাবেই কবিতাও জারিত হয়েছে একই সম্মোহনে। “ভালবাসার উৎসব” কাব্যনাট্য বা “অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস” পড়লে দেখা যায়, যে-নায়িকারা রয়েছেন তাঁরা একজন আধচেনা পুরুষের হাত ধরেও বলতে পারেন,’চলুন পালাই’। সেই মমতা অবস্হীর ছায়া, যিনি মলয়ের হাত ধরে কোনো দূরপাল্লার বাস ডিপোতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘চলুন পালাই’।
    এই হাওয়াটাই দোলা দিয়ে গেছে তাঁর প্রেম সিরিজের কবিতাগুলোর মধ্যে। অদ্ভুতভাবে বাস্তবায়িত নায়িকা চরিত্রগুলোকে হাটে-মাঠে-ঘাটে এমন কি পাঠকের বুকের ভিতর খুবলে এনে হাজির করেছেন কবি তাঁর কবিতায়। এঁরা যেন কবির নিজস্ব সম্পত্তি নয়। কবি নিজেই কোথাও বলেছেন,অবন্তিকা একটি স্বনির্মিত প্রতিস্ব। এর আগে রামী, বনলতা, নীরা, সুপর্ণা ইত্যাদি ছিল কবিদের নিজস্ব নারী। অবন্তিকা সে রকম নারী নয়, সে স্বাধীন, হয়তো মীরা বেণুগোপালনের মতো। সে পাঠকের কাছে, আলোচকের কাছে, নির্দ্বিধায় হেঁটে যায়। অবন্তিকা কবির স্লেভগার্ল নয়। কবির লেখা ‘চলুন পালাই’ পর্ব থেকে প্রেম যত নির্লিপ্তির পথ ধরে যেতে চেয়েছে [ কবি স্বীকার করেছেন কখনো কখনো তাঁর জীবনে এই রোম্যান্টিক স্বত্ত্বাই তাঁকে বিপদে ফেলেছে বারবার] ততই যেন প্রেম আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে বাকশিল্পের মধ্যে দিয়ে নির্গমনের পথ খুঁজেছে কবিত্বের নির্বিবাদ আত্মা।
    মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা নিয়ে আলোচনার জন্য ক্ষুদ্র পরিসর যথেষ্ট নয়। আবার তা যদি প্রেমের কবিতা হয়, তাহলে তো আরও যথেষ্ট নয়। ঋতু বিবর্তনের মতোই ভালোবাসা বিবর্তনের মধ্যে চলা এই সময়ে, সুস্থ ও স্বাভাবিক চিন্তার নষ্ট পরিবেশে মানুষকে ভালোবাসার কাছে ফেরত পাঠানো মোটেও সহজ নয়। মলয় এই পরমাণু-গন্ধ সময়ে, বয়সকে দুই তুড়ি মেরে সেই ঐশ্বরিক ভালোবাসার কাছে সঁপেছেন আত্মাধ্বনিকে। তারপরে ফাঁসির আসামীর মতো বয়ে নিয়ে চলেছেন ভালোবাসার সেই নবজন্ম ঐতিহ্যকেই। একদিন একদিন করতে করতে মানুষের বয়স বেড়ে যায়। আর দেখতে পায়, তার সঙ্গে জড় হয়েছে পার্থিব সম্পদ। কিন্তু নিঃশব্দে ভালোবাসা দূরে সরে গিয়েছে মানুষের থেকে। মলয় রায়চৌধুরী সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন জীবনের মধ্যে, দিতে চেয়েছেন বাঁচার প্রকৃত স্বাধীনতা, কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের সামনে শ্রীকৃষ্ণের মুখগহ্বরের আলোকোজ্বল বার্তা।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.229.178.225 | ০৮ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৫৫738564
  • জাঁ জেনের একমাত্র ফিল্ম ‘প্রেমের গান’ ( Un Chant d’amour )
    মার্ক সিম্পসন- অনুবাদ মলয় রায়চৌধুরী
              ১৯৫০ সালে রিলিজ হওয়া জাঁ জেনে’র একমাত্র ফিল্ম ‘প্রেমের গান’কে বলা হয়েছিল পর্নোগ্রাফিক। তিনি যে বিষয় বা বিষয়হীনতা নিয়ে ফিল্মটি করেছিলেন তা এখন আমেরিকা ও ইউরোপে মেইনস্ট্রিম হয়ে গেছে , কিন্তু পৃষ্ঠতলের আড়ালে রয়ে গেছে সমাজের যা সত্যকার নষ্টামি ও বিকৃতি । ১৯৪৩ সালের তাঁর প্রথম উপন্যাস, “আওয়ার লেডি অব দি ফ্লাওয়ার্স’-এ জেনে লিখেছিলেন, “আমি ভাবতুম যে একজন সুপুরুষ তরুণ কয়েদির সঙ্গে একজন সুপুরুষ পাহারাদারের দেখা হলে তার ফল কী হবে।” তখন তিনি যাবজ্জীবন খাটছেন একজন ছিঁচকে অপরাধী হিসাবে, যে ছাড়া পেলেই চুরি-ছিনতাই-বেশ্যাবৃত্তি করতো । জেল থেকে মুক্তি সম্ভব হয়েছিল কবি ও ফিল্ম নির্মাতা জাঁ ককতোর উকিলের দরুণ । রাষ্ট্র জেনেকে ক্ষমা করে ছেড়ে দ্যায় । জেনে লিখেছিলেন, “দুটি চিত্র কল্পনা করে আমার আনন্দ হতো : একটা রক্তাক্ত আর নৈতিক অভিঘাত, কিংবা সাহস আর পেইনটিঙের দাঙ্গায় একটা দীপ্তিমান আলিঙ্গন ।”
              আমাদেরও তাই হয়েছে, সমসাময়িক জনপ্রিয় সংস্কৃতির রক্তাক্ত নৈতিক অভিঘাতের প্রতি আবেশ দেখে, অশ্লীল পেইনটিঙ আর সাধারণত নিচু স্তরের আবেগের বাড়াবাড়ি দেখে, তা সে টিভির কোনো কারাগার-নাটক হোক বা গাই রিচি নির্দেশিত ফিল্ম, কিংবা নেট সারফিং করে  ঈক্ষণকামী আকম্প পাবার ইচ্ছে ।
              জেনের ১৯৫০ সালের বিখ্যাত ছোটো ফিল্ম ‘প্রেমের গান’ ( Un Chant d’amour ), সর্বপ্রথম ডিভিডিতে রিলিজ করেছিল বিএফআই এবং এইটিই একমাত্র ফিলম সিনেমাটিক ও সাহিত্যিক প্রতিভার, যা দেখে মনে হয় তা ‘আওয়ার লেডি অব দি ফ্লাওয়ার্স’-এর চাক্ষুষ অন্বেষণ। ফরাসি কারাগারের পৃষ্ঠভূমিতে, নির্বাক, শাদা-কালো পঁচিশ মিনিটের এই ফিল্মটির ডিভিডি কিনেছেন ধনী সমকামী সংগ্রহকারীরা তাদের ব্যক্তিগত আনন্দের জন্য । দাম রাখা হয়েছিল ইংল্যাণ্ডে ষোলো পাউণ্ড । এতোদিন পরে ‘প্রেমের গান’কে মনে হয় একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী ‘মডার্ন’ ভিশনারি ফিল্ম ।
                ‘প্রেমের গান’ প্রশ্রয় দিয়েছিল আনডারগ্রাউণ্ড ফিল্ম নির্মাতাদের এবং ডেরেক জারমান ও টডি হেইনসের মতন সমকামী সিনেমা পরিচাকদের । কিন্তু ফিল্মটির প্রভাব - এবং জেনের যে সংবেদনশীলতায় ফিল্মটি চোবানো-- তা আরও দূরে আর গভীরে যায়, এবং যাকে বলা চলে বড্ডো বেশি বিকৃত । ঘটনাচক্রে এর যা ফলাফল হয়েছে, তা জেনেকেও বিরক্ত করতো ; জেনের প্রান্তিক চেতনা, বহিরাগত মাস্তান, নারীর পোশাক পরা গাণ্ডু এবং দারিদ্র্যের জীবন ইত্যাদির প্রতি টান-- এবং সর্বোপরি সুপুরুষ নমনীয় খুনি বজ্জাতদের সম্পর্কে তাঁর আবেগ, হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও হীনবীর্য ফ্যাশানে, মেইনস্ট্রিমের গতিক ।
              ‘প্রেমের গান’-এ কী হয় ? বিশেষ কিছু নয় । পুরো ফিল্মে ছেয়ে থাকে বিষাদ ও হতাশা -- আর সেই সঙ্গে বেপরোয়া, অধীর-অথচ-গীতিময় কামদযৌনতা যা আসে একা থাকার দরুণ, কারারুদ্ধ ও পাহারাদার, উভয়ের ক্ষেত্রে । একজন পাহারাদার দেখতে পায় যে কারাকুঠরির জানালা থেকে একটা ফুলের তোড়া এগিয়ে দেয়া হচ্ছে, দেখা যায় প্রতিবেশি কয়েদির হাত, কুঠুরির শিকের ভেতর দিয়ে প্রতিবেশি কয়েদির হাত সেটা বারবার ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না । পাহারাদার তদন্ত চালিয়ে বিভিন্ন কুঠরির নজর রাখার ফুটো দিয়ে দেখতে পায় একের পর এক পুরুষ কয়েদি নিজের কুঠুরিতে নানা কায়দায় বসে স্বমেহন করছে, কেউ তৎপর হয়ে নাচছে, কেউ নিজের বাংকে শুয়ে করছে, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ করার পর ধুচ্ছে । অমন কাণ্ড দেখার পর উত্তেজিত, হয়তো দৃশ্যের কারণে বা মর্ষকামী পুলকের দরুন, পাহারাদারও স্বমেহন করতে আরম্ভ করে । শোবার ঘরে ইনটারনেট নামের ফুটো আবিষ্কারের অর্ধশতাব্দী আগেই জেনে তাঁর দৃষ্টিপ্রতিভায় ওয়েবক্যাম, বিগ ব্রাদার জগতের নাগরিকদের ওপর নজর রাখা, মহানগরের একাকীত্ববোধ ও ঈক্ষণকাম, জনসমুদায়কে আলাদা করে লক্ষ্য রাখা, খাঁচার ইঁদুরের একঘেয়ে শহুরে জীবন, ক্লান্তির ব্যাপার আঁচ করেছিলেন । 
              দেখা যায় একজন বুড়ো কয়েদি দেয়াল ঠুকছে, দেয়ালে নানা রকমের গ্রাফিতি এবং একটা বিশাল লিঙ্গ আঁকা, দেয়াল ঠুকে প্রতিবেশি কুঠরির তরুণ কয়েদিকে আকর্ষণ করতে চাইছে। তরুণ নোংরা পোশাকে একাই জ্যাজ নাচ নাচছে ; তার মুখ যেমন কোমল তেমনই বলিষ্ঠ, যেমন মার্লন ব্র্যাণ্ডোকে দেখা যায় স্ট্যানলিতে । বুড়োর ঠোকাঠুকিতে আগ্রহহীন তরুণ নেচেই চলে আর নিজের কাঁধে আঁকা উলকি আদর করতে থাকে । বুড়ো লোকটা একাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে, দেয়াল জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে, চাটে, নিজের লিঙ্গ চেপে ধরে দেয়ালে । শেষে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফুটো দিয়ে খড় ঢুকিয়ে পাশের কুঠুরিতে ধোঁয়া পাঠায় । ফ্লার্ট করার এই প্রয়াসকে অবহেলা করে তরুণ । বুড়ো কয়েদি নিভিয়ে ফ্যালে সিগারেট । তারপর আবার একই কাজ আরম্ভ করে দ্যায় ।
              এইবার, খড়ের ধোঁয়া আরও ভেতরে ঢোকে, তরুণ সাড়া দিয়ে, চোখ বন্ধ করে হাঁটু মুড়ে বসে আর মুখ খুলে পাঠানো ধোয়ার শ্বাস নেয়। জেন জিলে তাঁর ‘ক্রিমিনাল ডিজায়ার্স : জাঁ জেনে অ্যাণ্ড সিনেমা’ গ্রন্হে বলেছেন, “সিনেমায় এটি সবচেয়ে ইরটিক দৃশ্য” । কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো গ্রাফিতি আঁকা অবিচলিত দেয়াল, আর তার ক্ষুদ্র অনমনীয় ফুটো । জেনে জানেন যে রোমান্স, এবং আকাঙ্খা নিজেই -- তখনই সম্ভব যখন তা অসম্ভব ( আর হয়তো সেকারণে প্রেমের গানের চাক্ষুষ ক্ষুধা আগাম আঁচ করে বস্তুদের বিজ্ঞাপনের বিস্ফোরণ )। ফিল্মটিতে একমাত্র ‘সেক্স’ যা চোখে পড়ে  তা হলো স্বমেহনের ছায়াময় আভাস -- এবং কয়েদিদের ও পাহারাদারের ইরটিক ভাবাবেশ ।
              ফিল্মটা ১৯৫০ সালে যদিও তৈরি হয়েছিল সমকামীদের উত্তেজিত করার উদ্দেশে, ‘প্রেমের গানের’ সঙ্গে সমসাময়িক পায়ুকামী পর্নোগ্রাফির কোনো মিল নেই । গে ফিল্মগুলো দেখানো হলেও, এখনও জাঁ জেনের ‘প্রেমের গান’ জনসমক্ষে দেখানো নিষিদ্ধ ইউরোপ-আমেরিকার কোনো-কোনো শহরে ।
              ‘প্রেমের গান’ ফিল্মে পেশাদার অভিনেতারা অভিনয় করেননি । এবং তাঁরা কেউই সমকামী ছিলেন না । লুসিয়েন সেনেমো, যে তরুণ কয়েদির অভিনয় করেছিল, সে জাঁ জেনের একনিষ্ঠ পাঠক, ফিল্ম করার সময়ে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল এবং বউ অভিনয়ে নিষেধ করেননি । পারিশ্রমিক হিসাবে জেনে তাঁদের একটা বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন । বুড়ো কয়েদির অভিনয় করেছিলেন টিউনিসিয়ার এক পাঁউরুটিঅলা, যার দোকান ছিল মমার্ততে । দেয়ালে লিঙ্গোথ্থানের জন্য অবশ্য একজন পেশাদার অভিনেতাকে ছায়ায় দেখানো হয়েছিল ।
               জেনে চেয়েছিলেন ফিল্মটা প্রামাণিক হোক, কেননা তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল নিজস্ব, পেশাদার ফিল্ম পরিচালকদের মতো নয় । অনাথ শিশু, ফরাসি সরকারের খরচে শৈশব কাটানোর পর চল্লিশ বছর কাটিয়েছেন পলাতক বালকদের ‘হোমে’, সংশোধনাগারে এবং কারাগারে । 
              শেষ দৃশ্যে, পাহারাদার  তদন্ত করে যখন কারাগার থেকে ফিরে যাচ্ছে তখন একজন কয়েদির ছোঁড়া ফুলের তোড়াটা আরেকজন কয়েদি লুফে নিতে পারে । কিন্তু পাহারাদার তা দেখতে পায় না । সে পেছন ফিরে চলে যেতে থাকে ।
    [অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী]
              
  • Indrajit Bhattacharya | 223.229.178.225 | ০৮ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৫৭738565
  • Dr Indrajit Bhattacharjee : Anti-Establishment Pioneers
    The Hungry Generation Movement in Bangla literature and painting, also known as Hungryalism, Hungrealism, Hungry Andolon, Sarvagrasa, Khutkatar, Khsudharta, Bhukhi Peedhi, which shook post-colonial Bangla culture with an intensity comparable to the impact of pre-colonial Young Bengal social movement, was the brain-child of Malay Roychoudhury who, after his post-graduation, was working on an essay on ‘the philosophy of history’, when he came across the book The Decline of the West written by Oswald Spengler. Though Malay did not accept the Spenglerian philosophy, he was impressed with the argument that history should not be construed in a linear progression, but flowering of a number of cultural inclinations, each with a characteristic spiritual tone, or conception of the space within which they act. This was a decisive break with the Hegelian concept of history as a process governed by reason.
    For 22 year old Malay, who had already conceived of a programme to launch a movement in Bangla literature and painting, Spengler cast a spell in view of the post-colonial and post-partition nightmare that had overtaken Bangla culture, especially when compared to the time and space of 19th century Bangla renaissance. Oswald Spengler’s metaphor was biological. That is, cultures go through a self-contained process of growing, reaching a crescendo, and withering away. This decay may be withstood if the culture feeds on alien diet. A culture is self-creative during ascendancy, but once the rot sets in, the culture, instead of creating from within, starts engulfing and assimilating contributions from outside. Its demand for outside elements becomes insatiable during descend. This process was termed as hunger by Malay when he came across Geoffrey Chaucer’s stunning line ‘In The Sowre Hungry Tyme’. In 1959-1960, post-partition Bangla polity was definitely on the downslide of sour time of putrefaction. Today, when we look at West Bengal, the Hungryalist premonition appears prophetic.
    2.
    Socio-cultural sarvagrasa, or devouring as a concept, that Malay was trying to put into a contemporary mould, had Indian puranic connotations inasmuch as lord Shiva became sarvagrasi when he drank the poison that up-welled in the aftermath of churning of the seas (samudra manthana) by gods and demons in order to protect the universe. Initially Malay had decided to use the term ‘Sarvagrasi Prajanma’ or the ‘Devouring Generation’. He felt, quite rightly, that such a term would not be authentically acceptable, and may even carry wrong signals. He opted for the words ‘Hungry Generation’.
    The word Hunger or ‘Khaoa’ in Bengali is used as a signifier for various activities. For example, one may eat the breeze for a stroll, eat a somersault for a loss, eat money for bribe, eat happiness for a contended life, eat cannabis for incorrect message, eat broomstick for dismissal, eat the head for spoiling, eat fear to get terrorized, and many such images are commonplace with the word ‘Hungry’ in Bangla. Later, when a large number of writers, poets and painters joined the movement, ‘Hungry’ was open to interpretation in a manner that a particular participant preferred. This open-endedness would have been difficult with the words ‘Devouring Generation’. Nevertheless, the appellation had later been banalised by some participants, especially by those who were trying to re-root in India after partition; they glorified poverty in the name of ‘Hungry’ movement.
    In the ‘Overviews’ which Malay wrote for Postmodern Bangla Poetry (2001) and Postmodern Bangla Short Stories (2002) both edited by his elder brother Samir (one of the founder member of the movement), he has elaborated upon the cultural, aesthetic, socio-political, literary-historical factors which forced the movement to burst upon the Bangla space in November 1961. I would prefer to draw on his arguments that, like in any other language, Bangla literary modernism had its own contradiction between radical disruption of form and traditionalism of content and ideology, as were exemplified in pre-Hungryalist literatre, inasmuch as Parichay(1931), Kallol (1932) etc periodicals were managed, written, defined and canonized within Kolkatacentric middle class values, and identified themselves with the occidental canons and discourses, whereas Krittibas (1953) and Notun Reeti (1958) adopted a mode of counter-identification by staying within the governing structure of above ideas, with a mix of Soviet discourse in case of some authors. They combined aesthetic self-consciousness and formalist experimentation. The Hungryalists wanted to go beyond the structure of oppositions and sanctioned negations of the discourse through de-identification. Krittibas and Notun Reeti poets and writers had ultimately degenerated into traffickers of immoral discourse which completely destroyed the achievements of 19th century reformers. The Hungryalist movement aspired to locate itself in an essentially adversarial relation to aesthetic realism.
    3.
    Malay discussed his ideas with his friend Debi Ray, elder brother Samir, and Samir’s friend Shakti Chattopadhyay, and all of them agrred to launch the movement by publishing a weekly bulletin to be funded by Malay, and if required, by Samir. Shakti was requested to take up leadership, a decision later regretted by both Samir and Malay as a socio- aesthetic blunder, a decision for which they were criticized by participants who had subsequently joined the movement. Debi Ray, whose real name is Haradhon Dhara, was to be editor, and his Howrah slum-residence to be used for correspondence. Haradhon Dhara belonged to subaltern caste, and the decision was intentional, as prior to him subaltern authors were not given any space at all.
    However, there were printing problems at the outset as the printing presses at Patna, a Hindi speaking town, did not have sufficient Bangla typefaces. The only press which could have had printed them, refused to entertain. Malay was thus forced to draft the text of the first bulletin in English. The first one-page bulletin, as follows, appeared in November 1961:-
    -----------------------------------------------------------------------------------------------------------
    WEEKLY MANIFESTO OF THE HUNGRY GENERATION
    Editor: Debi Ray Leader: Shakti Chatterjee
    Creator: Malay Roychoudhury
    Poetry is no more a civilizing maneuver, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual Hunger.
    Poetry is an activity of the narcissistic spirit. Naturally, we have discarded the blankety-blank school of modern poetry, the darling of the press, where poetry does not resurrect itself in an orgasmic flow, but words come out bubbling in an artificial muddle. In the prosed- rhyme of those born-old half-literates, you must fail to find that scream of desperation of a thing wanting to be man, the man wanting to be spirit.
    Poetry of the younger generation too has died in the dressing room, as most of the younger prosed -rhyme writers, afraid of the Satanism, the vomitous horror, the self-elected crucifixion of the artist that makes a man a poet, fled away to hide in the hairs.
    Poetry from Achintya to Ananda and from Alokeranjan to Indraneel, has been cryptic, short-hand, cautiously glamorous, flattered by own sensitivity like a public school prodigy. Saturated with self-consciousness, poems have begun to appear from the tomb of logic or the bier of unsexed rhetoric.
    Published by Haradhon Dhara from 269 Netaji Subhas Road, Howrah, West Bengal, India
    The bulletin, which appears quite innocent today, had taken Kolkata by storm, as Debi Ray had arranged to get it distributed in one single day at the intellectual joints, offices of periodicals and college campuses. There was no cultural precedence to this kind of literary behavior for people to relate to. The move had attacked all strata of the Establishment and annoyed anyone who mattered. However, Shakti felt disturbed because of references to the four poets named in the last paragraph. The bulletin was, therefore, reprinted in December 1961 wherein the last paragraph was changed, and an additional paragraph added, as under:-
    “Poetry around us these days has been cryptic, shorthand, cautiously glamorous, flattered by own sensitivity like a public-school prodigy. Saturated with self-consciousness, poems have begun to appear from the tomb of logic or the bier of unsexed rhetoric.
    Poetry is not the caging of belches within form. It should convey the brutal sound of the breaking values and startling tremors of the rebellious soul of the artist himself, with words stripped of their usual meaning and used contrapuntally. It must invent a new language which would incorporate everything at once, speak to all the senses in one. Poetry should be able to follow music in the power it posses of evoking a state of mind, and to present images not as wrappers but as ravishograms.”
    The revised bulletin was again reprinted in 1962. In November 1963 it was printed for a third time under the heading ‘The Hungryalist Manifesto on Poetry’, and names of 25 participants printed on the flip-side. Meanwhile several other manifestoes and bulletins were published and distributed freely, which caused the number of participants to cross 40 in January 1964. Samir had brought in his friends Sandipan Chattopadhyay, Utpalkumar Basu and Binoy Majumdar; Malay had brought in his friends Subimal Basak, Sambhu Rakshit, Tapan Das, Anil Karanjai and Karuna Nidhan Mukhopadhyay; Subimal Basak had brought in his friends Tridib Mitra, Alo Mitra and Falguni Ray; Shakti had brought in Arupratan Basu, Pradip Choudhuri and Basudeb Dasgupta; Debi Ray had brought in Subo Acharya, Subhas Ghosh, Satindra Bhowmik, Haranath Ghose, Nihar Guha, Saileswar Ghosh, Amritatanay Gupta, Ramananda Chattopadhyay, Sunil Mitra, Shankar Sen, Bhanu Chattopadhyay, Ashok Chattopadhyay, Jogesh Panda and Manohar Das. Anil and Karuna, who were painters, brought in painters Subir Chatterjee, Bibhuti Chakrabarty, Arun Datta and Bibhas Das into the fold of the movement. Hungry Generation had become a socio-cultural force to reckon with.
    4.
    In view of such a large and unwieldy gathering, and frequent one-page publications, certain events took place which never had happened earlier. Rajkamal Choudhry carried the movement into the domain of Hindi literature; Ameeq Hanfee into Urdu; ‘Pank Ghentey Pataley’ group in Assam; poet Parijat into Nepali literature; and a group in the then East Pakistan comprising of Rafeeq Azad, Abdullah Abu Sayeed, Abdul Mannan Sayad, Asad Choudhury, Shahidur Rahaman, Mustafa Anwar, Faruque Siddiqui, Mahadeb Saha, Shahnur Khan Kaji Rab carried the dynamics to Bangladeshi literature.
    The movement gathered a decentering quality, inasmuch as each participant was free to publish a bulletin, which Shakti, Utpal, Binoy, Anil-Karuna and Rajkamal had done, though funded either by Malay or Samir. The handbill-type bulletins were also aesthetically anti-occidental, since they could not be preserved for an immortal space in history. More than 100 bulletins were published in the movement’s life-span between 1961 and 1965, out of which only a dozen or so are traceable.
    Excepting for Debi Ray, Tridib and Alo Mitra, who were stationed at Howrah, across Kolkata, most of the participants came from outside the metropolis. They belonged to the periphery. Subimal, like Malay, came from Patna; Samir was Chaibasa-based; The Ghosh brothers, Subhas and Saileswar, were from Balurghat; Shakti was from Jaynagar-Majilpur; all the painters were from Varanasi; Pradip Choudhuri, originally from Tripura, was based at Shantiniketan; Subo Acharya was at Bishnupur and Ramananda Chattopadhyay at Bankura. The Hungryalist movement thus developed spatial qualities instead of time-centric features of earlier post-Tagore literary generations. Hungryalism emerged as a post-colonial counter-discourse. In the first bulletin itself the movement gave a battle cry against ‘modern poetry’, as well as against the ‘tyranny of logic’. Till then the concept of modern and logical progression of the text was considered the ultimate in literary canons.
    From 1961 onward as the movement gathered momentum and participants, by 1963 it was on the verge of activating extrication from occidental canons and discourse, which was articulated in a trilingual (Bengali-Hindi-English) cylostyled bulletin by Subimal Basak and Rajkamal Choudhary, as under:-
    PREVAILING CANONS
    1. Establishment
    2. Tyranny
    3. Insiders
    4. Elite high-brow culture
    5. Satisfied
    6. Cohesive
    7. Showy
    8. Sex as known
    9. Socialite
    10. Lovers
    11. Ecstasy
    12. Unmoved
    13. Hatred as camouflage
    14. Art films
    15. Art
    16. Sugam sangeet( Tagore songs)
    17. Dream
    18. Tutored language
    19. Redeemed
    20. Framed
    21. Conformist
    22. Indifferent
    23. Mainstream
    24. Curiosity
    25. Endocrine
    26. Conclusions inevitable
    27. Ceremony
    28. Throne
    29. Entertainer
    30. Self-projecting
    31. How am I
    32. Symmetrical
    33. Accountants of prosody
    34. Revising poems
    35. Fantasy’s game
    HUNGRYALIST CANONS
    1. Anti-Establishment
    2. Protester
    3. Outsiders
    4. Commoners’ culture
    5. Unsatisfied
    6. Brittle
    7. Raw-bone
    8. Sex as Unknown
    9. Sociable
    10. Mourners
    11. Agony
    12. Turbulent
    13. Real hatred
    14. All films
    15. Life
    16. Any song
    17. Nightmare
    18. Gut language
    19. Unredeemed
    20. Contestetory
    21. Dissident
    22. Struck ethically
    23. Watershed
    24. Anxiousness
    25. Adrenalin
    26. No end to unfolding
    27. Celebration
    28. Abdication
    29. Thought provoker
    30. Self-effacing
    31. How are you
    32. Tattered and decanonised
    33. Extravagance
    34. Continuous revision of life
    35. Imagination’s flight
    5.
    At the peak of the movement, Binoy Majumdar developed schizoid problems. Shakti was pressurized by literary guardians to leave the movement and issue anti-Hungryalist statements. Sandipan Chattopadhyay was lured by a mass circulation
    periodical with an assurance to publish his novel provided he leave the movement. Sunil Gangopadhyay, in his editorial in Krittibas, castigated the movement. As a result several fence-sitters were caught in an intellectual bind. These writers ultimately devoted themselves to prolific commercial writing. By the middle of 1964 only Utpal, Samir, Malay, Debi, Subimal, Subhas, Saileshwar, Pradip, Karuna, Anil, Tridib, Alo, Falguni, Subo and Ramananda remained in the movement.
    The departure of fence sitters proved to be a positive factor. The process hastened the collapse of aesthetic realism, leading to gradual deconstruction and dissolution of high and subaltern cultural distinctions. Hungryalist texts developed subversive and multi-vocal semiotic and semantic features. The mono-centric correctness as demanded by the then ruling academicians were being constantly attacked by the participants. In case of prose writers such as Samir, Falguni, Subhas and Subimal, as well as in the dramas written by Malay, textual reality developed as complexities of heteroglossia.
    The academic standards had started dwindling in West Bengal one and half decade after the departure of the Empire, mainly because of the incessant post-partition influx which corroded the Bangla intellectual and social fabric. There were no multi-disciplinary critics comparable to the 19th century stalwarts. The critics themselves were colonial constructs. They were oblivious of the fact that all knowledge is partial, embodied knowledge, produced by particular groups, communities, sects, governments, media, universities, schools, families, localities and persons, for particular purposes, within particular contexts. Their claim to speak on behalf of all Bengalies, restricted plurality and tolerance.
    In order to denigrate the Hungryalist movement, the print-media based critics started comparing the Hungryalist movement with Angry Young Men of England and Beat Generation of USA, assuming that texts could be independent of the motherland of the writer. This was compounded by the fact that Allen Ginsberg, who came to India in 1962, had met some Hungryalists at Kolkata, Patna, Varanasi and Chaibasa in 1963. It was Ginsberg whose poetry and religious life was changed completely because of the Hungryalists. Ginsberg could never again write in the form and technique of Howl and Kaddish; his post-India poems developed features of Bangla poetry.
    6.
    It had become clear by the end of 1963 that three participants, viz. Malay, Debi and Subimal had become key figures of the movement who had picked up certain anti-establishment modules from stories about the activities of ‘Young Bengal’, Vidyasagar and Gandhi. They were being called the Hungry troika and cartoons on them started appearing in dailies such as Basumati, The Statesman and Jugantar.
    Tabloids and glossy magazines such as Desh, Chatushparna, Darpan, Amrita, Now, Janata, Link, Anandabazar, Blitz, Naranari, Jalsa etc attempted to sensationalize news about the Hungryalists. The daily Jugantar wrote its main editorial, twice, for them. The daily Searchlight of Patna issued a special supplement on the movement. In other Indian languages periodicals that covered their activities were Dharmayug, Gyanodaya, Dinaman, Saptahik Hindustan, Nayee Dhara, Yugprabhat, Vatayan, Anima, Ingit, Jansatta, Lahar, Asso, Adhikaran, Bharatmail etc.
    One evening Subimal was encircled and threatened in front of the College Street Coffee House (Albert Hall) by a literary group comprising of Bimal Raychoudhuri, Shankar Chattopadhyay, Pranabkumar Mukhopadhyay, Parbati Mukhopadhyay, Dipak majumdar, Sharat Kumar Mukhopadhyay, Belal Choudhuri, Bijon Ray, Rupendra Basu, Dhiresh Bagchi, Samir Sengupta, Tarapada Ray, Shanti Kumar Ghosh and Shakti Chattopadhyay. Sunil Gangopadhyay, who was in USA on a USAID funded trip, wrote a bizarre letter to Malay, a letter which has since gained special significance in Bangla literary history.
    Meanwhile, the under-noted political manifesto created a great turmoil in the Bangla administration:-
    Hungry Generation Bulletin No. 15
    The Political Manifesto of Hungryalist Movement
    1. To depoliticize the soul of each solitary individual.
    2. To let every individual realize that existence is pre-political.
    3. To let it be noted historically that politics invites the man of the third quality, aesthetically the most lowest substratum of society, at its service.
    4. To make it clear that the conceptions of Elite and that of the Politician differ absolutely after the death of Gandhi.
    5. To declare the belief that all intellectual fakeries called political theory are essentially the founts of fatal and seductive lies erupting out of abominable irresponsibility.
    6. To demarcate the actual position of a politician in a modern society, somewhere between the dead body of a harlot and a donkey’s tail.
    7. To never respect a politician, to whatever species or organism he may belong to.
    8. To never escape from politics, and at the same time, neither let politics escape from the terror of our aesthetic being.
    9. To remodel the basis upon which political creeds are founded. __________________________________________________________________
    Today, when we look at Indian politics we are stunned by this prophetic discourse delivered more than 40 years ago. The Hungryalists further confounded the situation by the slogan PLEASE REMOVE YOUR MASK printed on paper-masks of jokers, demons, animals, ghosts, Hindu gods/goddesses etc. and mailed to chief and other ministers, chief and other secretaries, district magistrates, police big bosses, commercial authors, newspaper editors, sundry politicians, that is, anyone who mattered. This action was a piece of sheer genius which has become a part of literary folklore. Another action comparable to actions of 19th century ‘Young Bengal’ was distribution of turmeric-smeared Hindu wedding cards complete with symbols of butterfly and palanquin wherein the ruling school of poetry was vehemently attacked, and the intellectuals indirectly called headless.
    7.
    Manifestoes appeared regularly on short story, drama, religion, criticism, painting, discourse, obscenity, style, diction etc during the peak of 1963-64. Alongside, magazines edited by Hungryalists started appearing quite frequently. Malay edited Zebra; Tapan Das edited Pratibimba; Subimal edited Pratidwandi; Debi edited Chinho; Tridib & Alo edited Unmarga and Waste Paper; Shambhu edited Blues; Pradip edited Swakal/Phooo. The poems and fictions printed therein drew the attention of print-media writers who charged the authors to be swathed in sexual hunger. Literary and news-magazines whose hegemony was threatened, continued their tirade against the Hungryalists almost everyday.
    Written and verbal complaints against the Hungryalists to the Chief Minister and Calcutta Police Commissioner continued pouring in. There were various allegations, including, conspiracy against the Establishment, corrupting the youth, defamation, violation of Press Act, obscenity, disruption of public decency etc. In the beginning of 1964 Kolkata was agog with rumours of an imminent action against Malay, Debi and Subimal, a scenario that even the Dadaists and Surrealists could not have contemplated. A Deputy Commissioner of Police who later became famous for Naxalite encounters was, incidentally, maternal uncle of a Krittibas group poet. Things obviously moved quite fast. Sunil Gangopadhyay had just arrived back from USA.
    On September 2nd, 1964 arrest warrants were issued against eleven Hungryalists on charges of conspiracy against the Establishment (Section 120 of Indian Penal Code) and obscenity in literature (Section 292 of Indian Penal Code). Samir, Malay, Subhas, Saileshwar, Debi and Pradip were arrested. Pradip was rusticated from Visva Bharati; Utpal was dismissed from his professor’s job; Malay and Samir were suspended from service; Debi and Subimal were transferred out of Kolkata by their employers. Samir and Malay had to present themselves before a specifically constituted ‘Investigating Board’ which interrogated them for several hours to find out whether they were really involved in any conspiracy.
    This phase of the Hungryalist movement is the murkiest period in the history of Bangla literature. Shakti and Sandipan, who had moved out of the movement about a year back, volunteered and recorded testimonies against Malay Shakti on 18 February 1965 and Sandipan on 15 March 1965); Subo, Basudeb and Ramananda fled from Kolkata; Subhas and Saileshwar signed good-conduct bonds (on 2nd September 1964) indicating that they had nothing to do with the Hungry Generation movement, and that they will not associate with the movement in future. However, 40 years later when Hungry Generation movement became a legendary proposition,
    obviously a salable one, these two brothers were the first to claim that they were the genuine Hungryalists! In view of the weak character of majority of the Hungryalists, who testified against Malay in Court, the movement withered away in May 1965. It was in May 1965 that Malay was charge- sheeted by Establishment police and all others were set free. (Case No. GR 579 of 1965, in the court of Presidency Magistrate, 9th court, Calcutta).
    During the short span of 1961-65 the movement had created an indelible impact on Bangla literature. In an interview to Dhurjati Chanda, Malay had stated that Hungryalism was the first and the last iconoclastic venture in Bangla literature which in retrospect now appears to be a socio-political aesthetic triumph, that artistic freedom in which life was put at stake and the rules of which required brazen acts of impudence to be legitimized by manifestoes. In another interview he gave to Anadiranjan Biswas, Malay had said that the Hungryalist defiant ventures were attempts to wrest the power of definition, distinction and evaluation from those who claimed themselves to be authorities of literary discourse. The writers of West Bengal and Bangladesh who were called 50’s poet were writing pale and stale poems till 1959; they changed completely only after the implosion of the Hungryalist movement.
    It is a different story that Malay had to go through a 35 month long ordeal of arrest, conviction by lower court ( on 28 December 1965) and ultimately exoneration by High Court of Calcutta. However, the movement did create a world wide stir that had brought Bangla literature in to international limelight again. Both English and Spanish versions of TIME magazine wrote about the movement. Periodicals in Europe, USA, Latin America, Australia and Asia such as City Lights Journal, SanFrancisco Earthquake, Eco, El Corno Emplumado, Kulchur, Klactoveedsedsteen, Burning Water, Intrpid, Salted Feathers, Evergreen Review, Panaroma, Trace, El Rehelite, Imago, Work, Iconolatre, Whe’re, Ramparts, Los Angeles Free Press, My Own Mag, Vincent etc either printed, reprinted or brought out special issues.
    In Hindi, Sharad Deora wrote a novel titled College Street Ka Naya Masiha based on the Hungryalists; Phanishwarnath Renu wrote Ram Pathak Key Diary Sey; Dharmaveer Bharati and S.H.Vatsayan Ajneya wrote quite frequently about them in the periodicals they edited; Ashok Shahane, Dilip Chitre and Arun Kolatkar hailed them in Marathi; Umashankar Joshi introduced them to Gujarati readers; Ameeq Hanfee translated and introduced them to Urdu readers. The Bengali intelligentsia had not bargained for this unexpected international exposure. Reputed academicians of the time viz. Sukumar Sen, Asitkumar Bandyopadhyay, Haraprasad Mitra, Bhabatosh Datta, Ujjwalkumar Majumdar, Kshetra Gupta, Saroj Bandyopadhyay, Shashi Bhushan Dasgupta, Sukumari Bhattacharya, Debiprasad Bhattacharya, Bhudeb Choudhury, Tarapada Mukhopadhyay, Chinmohan Sehanabis and others preferred to ignore the movement. Some academicians even persuaded academicians of other languages to ignore the Hungryalist impact. Nevertheless, intellectuals from other countries, such as Octavio Paz and Ernesto Cardenal sought the Hungryalists when they visited India.
    That the Hungryalist movement had shattered the colonial canons and had encircled the centre by a new epistemic periphery, became clear with emergence of powerful post-Hungryalist writers and poets such as Subimal Mishra, Arunesh Ghosh, Prasun Bandyopadhyay, Pradip Das Sharma, Atindriya Pathak, Kamal Chakraborty, Barin Ghoshal, Saswata Sikdar, Anuradha Mahapatra, Ajit Ray, Aloke Biswas, Pranab Pal, Sankarnath Chakraborty, Arun Basu, Sridhar Mukhopadhyay, Dipankar Datta, Debdas Acharya, Biswajit Sen, Achin Dasgupta, Bikash Sarkar, Abani Dhar, Nabarun Bhattacharya, Samiran Ghosh, Nitya Malakar, Manab Chakraborty, Aloke Goswami, Moulinath Biswas, Madhumay Pal, Koushik Chakraborty and a host of other writers. Any literary defiance, Hungryalism being the most potent in post-colonial Bangla literature, embodies the provocation of a literary code into a socio-cultural and political code. The ultra-leftist naxalite political explosion in Bangla polity occurred obviously immediately after the Hungryalist canonical implosion in literature and painting.
    8.
    Some of today’s critics have opined that the main reason for aesthetic percolation of the spirit of the movement, and its power to withstand the steamroller of Establishment juggernaut, may be found in the range of experience and variety of erudition of the participants who refused to hang around vernacular newspaper offices or the joints of political masters as has been the case with most of the pre-Hungryalist writers, especially of Krittibas and Notun Reeti brands. Those wre also the contributory factors to Hungryalist texts which could gather propensities of hybridity, syncreticity, rhizomatism, heterogeneity, optativeness, disjunctiveness, immanence, irony, logical cracks etc; Hungryalist painting imbued de-layering, de-proportioning, multi-scaling, de-perspectivisation, de-structuring, fragmentariness and such other poly-hued mélanges. Poet Falguni Ray and painter Anil Karanjai have become underground cult figures after their death.
    Two manifestoes of the Hungryalist movement which are quoted by critics either to argue for and against their texts are as under:-
    THE OBJECT OF HUNGRYALISM (HUNGREALISME)
    1. To never imitate the reality of Aristotle, but to take the un-enameled whoring reality by surprise under the genital of Art.
    2. To let speechlessness burst into speech without breaking the silence.
    3. To let loose a creative furor, in order to undo the done-for world and start afresh from chaos.
    4. To exploit every matrix of senses except that of a writer.
    5. To disclose the belief that world and existence are justified only as an aesthetic phenomenon.
    6. To accept all doubts and despairs rather than to be content to live with the sense made by others.
    7. To lash out against the values of the bi-legged career-making animals.
    8. To abjure all meretricious blandishments for the sake of absolute sincerity.
    9. To stop writing and painting beyond the point of self-realization.
    MANIFESTO OF THE HUNGRY GENERATION
    1. The merciless exposure of the self in its entirety.
    2. To present in all nakedness all aspects of the self and things before it.
    3. To catch a glimpse of the exploded self at a particular moment.
    4. To challenge every value with a view to accepting or rejecting the same.
    5. To consider everything at the start to be nothing but ‘thing’ with a view to testing whether it is living or lifeless.
    6. Not to take reality as it is but to examine it in all its aspects.
    7. To seek to find out a mode of communication, by abolishing the accepted modes of prose and poetry which would instantly establish communication between the poet and his reader.
    8. To use the same words in poetry as are used in ordinary conversation.
    9. To reveal the sound of the word, used in ordinary conversation, more sharply in the poem.
    10. To break loose the traditional association of words and to coin unconventional and here-to-fore unaccepted combination of words.
    11. To reject traditional forms of poetry, and allow poetry to take its original forms.
    12. To admit without qualification that poetry is the ultimate religion of man.
    13. To transmit dynamically the message of the restless existence and the sense of disgust in a razor-sharp language.
    14. Personal ultimatum.
    _____________________________________________________________________________
    ______________________________________________________________________________
    The reasons why these two manifestoes are referred to by critics while analyzing the movement in the perspective of preceding literary thinkers are that the arguments put forth were completely different from what Buddhadeva Basu, Dipti Tripathi, Abu Sayeed Ayub, Debiprasad Chattopadhyay, Al Mahmood, Shamsur Rahaman, Binoy Ghosh, Nirendranath Chakraborty, Shakha Ghosh etc had been articulating till then. The Hungryalists not only drew upon words, experiences, epithets, incidents, diction hitherto considered taboo by ‘bhadralok’ gentry, but they virtually dismantled the single dimension metropolitan domination of Bangla literature. They introduced grammatically prohibited ‘guruchandali’ in poetry and prose, that is, mixing of words used by Brahmins and Untouchables.
    The Hungryalists were disgusted and impatient with the slothful, sluggish pace of change. When the famous ‘troika’ submitted a shoe-box for book review to the newspaper with largest circulation, an action that would have definitely been appreciated by Ramtanu Lahiri, Radhanath Sikdar and Pyarichand Mitra, the anti-Establishment luminaries of 19th century, the Hungryalists were waging war against canonical hegemony, and bombarding modernist boundaries.
    The Hungryalist authors and painters nativised Bangla discourse. The above two manifestoes aspired to regain the pre-colonial philosophy of atman wherein culture and nature are not considered to be separate spheres. The two manifestoes refused to view culture as the product of traumatic self-extrication from nature. The pre-Hungryalist writers and painters reflexively depended upon the idea of culture as the formation of subjectivity out of the primitive unconsciousness of matter. The Hungryalists, on the contrary, were thrilled with an awareness of value immanent in the relations between the natural and the human as had been exemplified in the fictions Chhatamatha by Subimal Basak, Amar Chabi by Subhas Ghosh, Kather Phul by Falguni Ray, Randhanshala by Basudeb Dasgupta, prose pieces in Malay Roychoudhury’s Bhenno Galpo, and the poems Poper Samadhi by Utpalkumar Basu, Janoar and Aamar Vietnam by Samir Roychoudhury, Choushatti Bhuter Kheya by Pradip Choudhuri and Jakham by Malay Roychoudhury. All of these works are considered exceptional today.
    After the movement withered away with the commencement of Malay’s trial, when Subhas, Saileswar, Sandipan and Shakti became police witness and testified against Malay in court, the writers and poets branched out of their own. Like most of the post-partition families, Subhas, Basudeb and Saileshwar joined the governmental leftists, participating in anti-people activities; Subo Acharya became devotedly religious and a disciple of god-man Anukul Thakur of Deoghar; Anil and Karuna joined the naxalite movement; Tridib and Alo gave up writing; Utpal departed for London; Pradip shifted his craft from Bengali to French; Falguni resorted to excessive drug abuse and died; Debi joined the Radical Humanists; Malay and Samir preferred to keep silent for more than a decade.
    During the post-naxal period, 10-12 years after Malay’s trial, some literary aspirants in North Bengal and Tripura suddenly started calling themselves Hungryalists, though they were unaware of the manifestoes of the Hungry Generation movement and, obviously, major Hungryalist works were unavailable to them. They simply tried to be different from the commercial mainstream. From among them, names that crop up from time to time, are Arunesh Ghosh, Nitya Malakar, Jibotosh Das, Aloke goswami, Rasaraj Nath, Selim Mallik, Satwik Nandi, Arun Banik, Shankhapallab Aditya, Raja Sarkar, Bikash Sarkar, Samiran Ghosh, Prabir Seal, Subrata Paul, Arun Basu and Pranab Debnath.
    With the re-emergence of Malay and Samir in the late 80s things have completely changed. A new generation of critics, academicians and readers has emerged for whom the Hungryalists are legends. Samir gave this observation a proper premise with his periodical Haowa 49. Malay, one may like to say, returned with a vengeance, and his novels, drama, poetry, essays, interviews, drew respectful attention of the earlier generation also who had once denigrated the Hungryalists. With the range of Hungryalist corpus, command over Bangla language, and the depth of knowledge and variety of experience of these authors, whose avant garde discourse and discursive practices had once created literary and social avalanche, they have made history. Researchers are doing their M.Phil. and Ph.D. on them. Several periodicals have published special issues on individual Hungryalist writers and painters.
    (Courtesy: Prof Niraj Bakshi, Editor, Black Rainbow, Indore. 2003)

    Statement of Saileshwar Ghosh against Hungry Generation movement.
    My name is Saileshwar Ghosh, son of Biseswar Ghosh> One Debi Ray alias Haradhon Dhara asked me to contribute in poems in Hungry Generation magazine in the last part of September 1963 in Coffee House, College Street. After that I came to know most of the Hungry Generation contributors as well as other writers also. I personally know Sandipan Chattopadhyay, Shyamal Gangopadhyay, Sunil Gangopadhyay, Rabindra Dutta, Basudeb Dasgupta, Pradip Choudhuri and Utpalkumar Basu> The April last oneday I met Malay Roychoudhury in the Coffee House, and he requested me to give him some of my poems. From him I came to know that Hungry Generation is going to be published. A month ago I got a packet containing the copies of the same. I know malay Roychoudhury who is the creator of Hungry Generation. I contributed twice in poems in Hungry Generation. Malay had sent me some leaflets and 2-3 magazines but I got no instructions what to do with these papers. Usually these papers were kept in my room. Excepting this I know nothing of Hungry Generation. To write in obscene language is not my motto. I am a school teacher of Bhupendra Smriti Vidyalaya at Bhadrakali, Hooghly from 1962 on a monthly salary of Rs 210/-. After the publication of the recent issue of Hungry Generation, which was published without my knowledge and consent, I have cut off all relations from the said organisation. In future neither I shall keep relation nor I shall contribute in the Hungry Generation. I shall not write anything obscene and that is my literary intention. The booklet in question was published by Pradip Choudhuri
    Signed by Saileshwar Ghosh
    at Lalbazar DD Headquarters
    on 2nd September 1964.
    [ Because of Saileshwar Ghosh and Subhash Ghosh's testimony against Malay Roychoudhury at Bankshall Court, Kolkata, Malay was sentenced one month's imprisonment for his poem STARK ELECTRIC JESUS ]
  • Samantak Das | 223.229.178.225 | ০৮ অক্টোবর ২০২২ ১৮:১১738566
  • The Hungryalists and Beatniks : who influenced whom?
    To what can we attribute the constant over-valuation of the Westerner, often to the detriment of our own artists?
    By Samantak Das
    American poet Allen Ginsberg greets Bhaktivedanta Swami, founder of the International Society for Krishna Consciousness, at the San Francisco airport on January 17, 1967.
    In a recent forum on contemporary Bengali poetry, I was somewhat taken aback to hear that the most important influence on post-1960s bangla kobita was the visit of the American Beat poet, Allen Ginsberg (1926-1997), and his partner, Peter Orlovsky (1933-2010), to Calcutta in the early 1960s. Having created waves with his 1956 poem, “Howl”, the 36-year old poet was in search of alternatives to the capitalist Judaeo-Christian way of life and living as he had experienced them in the United States of America and hoped to find, if not peace, at least some kind of understanding that would help him come to terms with both his own sense of disenchantment with his country as well as his mother’s mental breakdown and death — and this he hoped to find in the exotic East. In India, Ginsberg did all the things we have come to associate with a certain kind of naïve, over-earnest Westerner, whose attitude to this multifarious land is made up of equal parts condescension and befuddlement — a sort of well-meaning, if unthinking, Orientalism of the kind so delightfully analysed by Edward Said in his 1978 book of the same name.
    Perhaps Ginsberg’s closest associate in India was the Bengali poet and iconoclast, and founding member of the Hungryalist Movement, Malay Roychoudhury, who had already, “created” (in his own words) the “Manifesto of the Hungry Generation” in November 1961. The Manifesto makes for interesting, if somewhat tame, reading now, nearly 60 years after its composition, but there is something that seems to link its opening lines to those of Ginsberg’s best-known poem.
    This is how “Howl” opens: “I saw the best minds of my generation destroyed by madness, starving hysterical naked,/dragging themselves through the negro streets at dawn looking for an angry fix,/angelheaded hipsters burning for the ancient heavenly connection to the starry dynamo in the machinery of night…” And this is the opening of the first Hungry Manifesto: “Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual Hunger. Poetry is an activity of the narcissistic spirit.” These two texts, composed six years apart, continents away from each other, by two authors who did not know of the other’s existence, seem to share a similar view of language/poetry as needing to wholly destroy and re-assemble itself in order to convey something real about the spirit of their age. So it is no wonder that these two poets took an instant shine to each other, and remained lifelong friends. Of course, Roychoudhury was not the only Bengali poet Ginsberg befriended during his sojourn in India. Others, including Sunil Gangopadhyay, Sakti Chattopadhyay, Samir Roychoudhury (Malay’s brother), Sandipan Chattopadhyay, Binoy Majumdar, Utpal Kumar Basu, Basudeb Dasgupta, Saileswar Ghosh, and many more, came into contact with — and were suitably impressed and shocked by — the openly gay Beat poet, who often introduced Orlovsky as his “wife”.
    So, yes, Ginsberg, and his morals and mores, did have an impact on these young Bengali poets, but just how significant was that impact? This is not the time or place to go into the debates and discussions and dissensions that arose between these Bengali poets in later years, with a considerable amount of name-calling and mud-slinging, especially during Malay Roychoudhury’s prosecution for obscenity, in 1965-66, but it is surely significant that even today Bengali intellectuals are more likely to talk about Ginsberg’s influence on Bengali poetry, rather than the other way around.
    To what, I have been wondering since the day of that fateful poetry forum, can this be attributed, this constant over-valuation of the Westerner, often to the detriment of our own artists and creators? 
    From well before the 19th century, the West has thought in terms of a social and cultural hierarchy where there are three clearly defined stages of development: ‘savagery’ (such as found in African and so-called ‘primitive’ societies, such as those of the native Australians, Americans, or our own tribes); ‘barbarism’ (found among pre-Christian Western societies such as that of ancient Greece, and in India or China); and ‘civilization’ (found only in the advanced-Western, that is, Christian, nations). According to this formulation, every society must go through these three stages, ascending from savagery through barbarism to civilization. Lewis Henry Morgan’s Ancient Society or Researches in the Lines of Human Progress from Savagery through Barbarism to Civilization, published in 1877, was, and remains, the classic statement of this position, and has inspired thousands of anthropologists, sociologists, philosophers, and thinkers at large, including Friedrich Engels, whose The Origin of the Family, Private Property and the State (1884) was directly inspired by Morgan’s work.
    According to this scheme we Indians can, at most, aspire to be among the very best of the barbarians. We still have some time to go before we can be admitted to full membership in the club of truly civilized (= Western) cultures. Could it be because of this that a Bengali intellectual, speaking in Calcutta in 2019, in Bangla, of the relationship between Ginsberg and modern Bengali poetry, seems enthralled by the idea that Ginsberg it was who rejuvenated Bengali verse, rather than the other way round? Is this the root cause why such intellectuals seem to mimic the 54-year-old position enunciated by TIME magazine, which had declared in 1964 that it was Ginsberg who had provided an “inspirational assist” to Calcutta’s Hungry Generation?
    One of the abiding images from Hollywood is that of the weary traveller in some arid landscape whose diminishing strength is inversely proportional to the number of slow-circling vultures overhead. These birds begin as mere specks and gradually grow in size as they come closer and closer to the ground with every faltering step of the fast-fading hero or heroine. Even children are not spared. In the 1994 animated Disney feature The Lion King, young Simba runs away from his pride and is on the point of turning into vulture-lunch when the irrepressible duo of warthog and meerkat (Pumbaa and Timon) rescue him with their savoir-faire and oft-chanted motto of “Hakuna matata” (“No worries”). It has often struck me that those of us who are allegedly in the business of analysing culture and cultural artefacts are like vultures: circling overhead, waiting to pounce when the adversary is too weak to defend her/himself. But vultures are not all bad. Like all scavengers, they perform the vital function of taking away remains that other predators aren’t interested in, often helping prevent the spread of disease, thus helping to keep the environment clean, and playing an important part in the food chain (The Lion King’s “circle of life”).
    Instead of being mimic-vultures preying on the weak Oriental from an Occidental position of strength, perhaps we should simply stop worrying ourselves about what the West thinks of us, our cultures, our societies, or our work, and get on with the actual business of art, or indeed any other human activity, including the analysis of what is created by art. Which is something both the Beats and the Hungryalists would probably have agreed with, had their members and movements still been around.
  • তুষ্টি ভট্টাচার্য | 223.229.178.225 | ০৮ অক্টোবর ২০২২ ১৮:২৮738567
  • তুষ্টি ভট্টাচার্য : মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতা
    মলয় রায়চৌধুরী কেবল কবি নয়। মলয় রায়চৌধুরী পাটনার ইমলিতলা পাড়ার ছোটলোক, অন্ত্যজদের সঙ্গে ছেলেবেলা কাটিয়েছেন । মলয় রায়চৌধুরীর কেনা জাঠতুতো ভাই  মেজদা চোর ছিলেন। কবিতা লেখার দায়ে মলয় রায়চৌধুরীকে কোমরে দড়ি বেঁধে কয়েকজন চোর-ডাকাতের সঙ্গে রাস্তায় হাঁটিয়ে পুলিশ আদালতে তুলেছিল। হিংসুটেরা বলে, মলয় রায়চৌধুরী আত্মপ্রচার সর্বস্ব একজন মানুষ। সেযুগে যখন আন্তর্জাল ছিল না, হাংরি বন্ধুদের কাছে পোস্টকার্ডে নিজের লেখার খবর জানাতেন। মলয় রায়চৌধুরী অত্যন্ত অশ্লীল লেখেন, কম বয়সী মেয়েদের সঙ্গে এখনও নষ্টামি করে চলেছেন। আমি এই মলয় রায়চৌধুরীর গত জন্মের ঠাকুমা ছিলাম। এ জন্মেও সেই আত্মিক টান কাটিয়ে উঠতে পারি নি। বছর চারেক আগে   ‘কালিমাটি’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় আমার বাবাকে নিয়ে একটু লিখেছিলাম। তখনও মলয় রায়চৌধুরীকে আমি চিনি না। মানে গত জন্মের স্মৃতি মনে আসে নি।
    উনি সেই লেখা পড়ে মন্তব্য করলেন, ‘বাবার মুখ রেখেছিস তুই। যোগ্য বাপের যোগ্য মেয়ে।‘ পড়ে খুবই আবেগ প্রবণ হয়ে পড়লাম। আর তারপর বললেন, ‘আমি তোর বাপের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। আমাকে জেঠু বলবি।‘ সেই নতুন লিখতে আসা একটি মেয়ে এরকম আন্তরিকতার ছোঁয়া পেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই আপ্লুত হয়েছিল। এবং তারপর থেকে আমার সমস্ত লেখার দিকে ওঁর কড়া নজর থাকে । এক সময়ে জানালেন, ‘বড় লেখার হাত তৈরি হয়ে গেছে। এবার উপন্যাস শুরু কর।‘ বারবার আমাকে কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে উৎসাহ দিয়েছেন। আর শুধু উৎসাহ বললে কম বলা হবে, কোন সাইটে গেলে ভাল তথ্য পাওয়া যাবে, সে বিষয়েও জানিয়েছেন। তো সেই আত্মপ্রচারক মলয় রায়চৌধুরী, যে কিনা নিজের লেখা ছাড়া আর কারুর লেখার দিকে নজর দেয় না বলে প্রচারিত ছিল, বুঝলাম সেই ধারণা কত ভুল, কত ঈর্ষান্বিত । এক সময়ে ওঁর নিজের মুখেই শুনেছি, যার বা যাদের লেখা ওঁর ভাল লাগে, তাদের উনি এভাবেই নিশ্চুপে উৎসাহ দেন।
    মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে লেখা,  বা ওনার কবিতা নিয়ে লেখা, আমার কর্ম নয়, এ আমি স্পষ্ট বুঝে গেছি। এখনও এই বয়সে হাজার রকম শারীরিক অসুবিধে নিয়ে এক আঙুলে কিবোর্ডে টাইপ করে লিখে চলেছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ আর প্রবন্ধ কত যে লিখেছেন আর লিখছেন, ছোটবেলার স্মৃতিকথা, ওঁর দাদার কথা, আমি এই লেখার সমুদ্রে পড়ে হাবুডুবু খেতে-খেতে হাল ছেড়ে দিয়ে ডাঙায় উঠে বসেছিলাম বেশ কিছুদিন। নাহ, মলয় রায়চৌধুরীকে  নিয়ে লেখা আমার দ্বারা আর হল না। তবু মাঝেমাঝে মনে পড়ে যেত ওঁর কথা । এই তো সেদিন ওনার দাদা সমীর রায়চৌধুরী চলে গেলেন, মৃত্যুর পরে ওঁকে নিয়ে কত লেখালেখি হল, হয়ে চলেছে, হবে । মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে লেখার জন্য আবার আদা জল খেয়ে নামলাম । ইদানীং নিজের ব্লগে মলয়দা ওঁর বেশ কয়েকজন তরুণী প্রেমিকাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তার আগে ওঁর সেই বিখ্যাত অবন্তিকা সিরিজ পড়েছি। তাই ভাবলাম, এমন একজন প্রেমিক পুরুষের প্রেমের কবিতা নিয়েই কিছু লিখি। হয়ত লিখতে গিয়ে এত-এত প্রেম ওঁর আসে কোত্থেকে, জানা যাবে!
    মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর উল্লেখা না করলে উনি অসম্পূর্ণ থেকে যাবেন। এরকম এক পাগল করা কবিতা পড়তে গিয়ে আমি যে লাইন গুলোয় থেমে যাই, যেখান থেকে প্রেমিক মলয় রায়চৌধুরীর জন্ম, সেই উৎসমুখ হল শুভা।
    ‘আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম
    আমি বুঝতে পার্ছি না কী জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি
    আমার পূর্বপুরুষ লম্পট সাবর্ণচৌধুরীদের কথা আমি ভাবছি
    আমাকে নতুন ও ভিন্নতর কিছু কোর্তে হবে
    শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
    জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে
    আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
    মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
    তোমার তীব্র রূপালি য়ূটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
    শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
    তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল
    আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
    আমার বাবা-মা অন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?
    সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম ?
    আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?
    শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন ?
    ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
    শুভা, ওঃ শুভা
    তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়
    পুনরায় সবুজ তোশকের ওপর চলে এসো শুভা
    যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়’
    কবির নিজের ভাষাতেই বলি, যেন ধর্ষণ থেকে ফিরে এসেছেন প্রেমে । নিজের মৃত্যু দেখতে চেয়েছেন, আরেকটা জন্ম পাবেন বলেই। আর এই শুভা ছাড়া এই বিবর্তন আমরা দেখতে পেতাম না কিছুতেই। এইখান থেকে শুরু হল এক উপাখ্যান। হাংরি মলয় রায়চৌধুরীর পাশে চিরনবীন, সবুজ এক প্রেমিক কবিকে পেয়ে গেলাম আমরা।
    এরপর দেখি অবন্তিকাকে। একজন আধুনিকা যিনি টেবিলের ওপর ঝুঁকে বসে আলফা, গামা, বিটার বিস্তারে অঙ্ক কষছেন, আর কবির তখন এই ইউক্লিডিনি প্রেমিকার অঙ্ক দেখে মাথা ঝাঁঝাঁ করছে, তাঁর নিজের লেখা চিঠিকে মহেঞ্জোদরোর লিপি বলে ভ্রম হচ্ছে। কবি তাঁর নবতম প্রেমিকা অবন্তিকার প্রেমে পুড়ে যেতে-যেতে তাকেই আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে চলেছেন, কি লিখেছিলাম আমি ওই পুরনো ভাষায় ?  এই সুন্দরী কি মর্ম উদ্ধার করতে পেরেছে প্রবীণ কবির অস্থিরতাকে ? তারপর যখন দেখি এই কবিকে তন্নতন্ন করে কী যেন খুঁজছেন। অবন্তিকাকে খুঁজছেন মাঝরাতে? নাকি মায়ের ট্রাঙ্ক খুলে নিজের বিয়ের কার্ড দেখছেন? লকআপে পেচ্ছাপের ওপর বসে থাকা বেশ্যাকে খুঁজছেন? দুপুর রোদে লাঙল কাঁধে চাষীকে খুঁজছেন? রক্তমাখা অতীতকে খুঁজছেন আসলে। এবং সেটাও কবিতায় কবিতায়। এভাবেই প্রেমিক মলয় রায়চৌধুরীর এক একটি নির্মাণ কী নিপুণ ভঙ্গিতে কবিতা হয়ে উঠছে!
    আবার কখনও এই অবন্তিকা যেন এক অনির্ণেয় সংজ্ঞা। যাকে কেউ কখনও দেখে নি, যার কন্ঠস্বর কেমন কেউ জানে না। যার নরম যৌনতাকে তুলনা করা যায় না কোন যৌনভাষ্য দিয়ে। যার পূর্বপুরুষের কোন দেশ, কাল সীমা নেই। সে যদি কোনও বেড়ালকে কোলে তুলে আদর করে, সে নিজেই তখন বেড়াল হয়ে যায়। যেমন তেমন বেড়াল না, আলফা বিড়ালিনী ! তার ক্যাট-ওয়াকে চন্দ্র সূর্য হেলে যায়, সৌরমন্ডল কেঁপে ওঠে। এমন এক অবিশ্বাস্য প্রেমিকা কবির কাছে নীলাভ দূরত্বে থাকা অরুন্ধতী ছাড়া কীই বা হতে পারে ! কোনও পুরুষ এই অবন্তিকাকে ছুঁতে পারে না। ক্ষমা, শ্রদ্ধার প্রতিমূর্তী এই অবন্তিকাই আবার ক্যাটওয়াকের সময়ে কবিকেই খোঁজে !
    এ হেন আধুনিকা অবন্তিকাকে কবি আবার বিড়ি ফোঁকা, গুটকা খাওয়া, বাংলা টানা, মিছিলে যাওয়া শ্রমিক মজুরের মত কল্পনা করেছেন। তার চুমুতে শ্রমের স্বাদ, নিঃশ্বাসে ঘুমের গন্ধ, তার জিভে রক্তের ছোঁওয়া, আর গায়ের ঘামে দিবাস্বপ্ন দেখতে পেয়েছেন কবি। জরায়ু বাদ দিয়ে গোরস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা অবন্তিকা যখন তার পূর্ব প্রেমিকদের বহুগামীতার কথা ভাবছে, তখন কবি লিখছেন শরীরই সার্বভৌম :-.
    ‘এই মনে করে যে দেহটা তো সার্বভৌম, মন বা মনন নয়–
    মন না চাইলেও দেহে খেলে যায় ওগরানো তরল বিদ্যুত
    যা কিনা ভালো-খারাপের উর্দ্ধে ; ঠিকই বলেছিস তুই
    শরীরই সার্বভৌম….’
    আর ‘অবন্তিকার শতনাম’ কবিতাটি আমার মনে হয় অবন্তিকা সিরিজের সেরা কবিতা । কয়েকটি লাইন এখানে দিই:-
    আমি অবন্তিকার দুটো মাইয়ের নাম দিয়েছি কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া…বাঁদিকেরটা আদর করলেই গোলাপি হয়ে যায়…ডানদিকেরটা আদর করলেই হলদেটে রঙ ধরে…বাঁদিকের বোঁটার নাম করেছি কুন্দনন্দিনী…বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ তখন ও পড়ছিল চিৎ শুয়ে…ডানদিকের বোঁটার নাম ও নিজেই রেখেছে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার যে লোকটা সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের ডিটেকটিভ…ডিটেকটিভ বই পড়তে ওর জুড়ি নেই…ছুঁলেই কাঁটা দিয়ে ওঠে তাই…যোগেন চৌধুরীর আঁকা ঝোলা মাই ওর পছন্দ নয়…প্রকাশ কর্মকারের আঁকা কালো কুচকুচে মাই ওর পছন্দ নয়…পেইনটিঙের নাম রাখা গেল না…যোনির কি নাম রাখবো চিন্তা করছিলুম…অবন্তিকা চেঁচিয়ে উঠলো পিকাসো পিকাসো পিকাসো…পিকাসোর যোনির কোনো আদল-আদরা নেই…কখনও বাদামি চুল কখনও কালো কখনও কিউবিক রহস্য…তাহলে ভগাঙ্কুরের…ও বলল সেটা আবার কি জিনিস…ওর হাত দিয়ে ছুঁইয়ে দিতে বলল অমঅমঅমঅম কি দেয়া যায় বলতো…পান্তুয়া চলবে…ধ্যুৎ…রস মানেই পান্তুয়া নাকি আরও কতো রকম মিষ্টি হয়…ছানার পায়েস…নারকেল নাড়ু…রসমালাই…নকশি পিঠা…রাজভোগ…লবঙ্গলতিকা…হলদিরামে ভালো লবঙ্গলতিকা পাওয়া যায়…আমি বললুম স্বাদ কিছুটা নোনতা…ও বলল দুর ছাই আমি নিজে টেস্ট করেছি নাকি যাকগে বাদ দে…হ্যাঁ…এগোই…পাছার কি দুটো নাম হবে…ডিসাইড কর…ডিসাইড কর…তুই কর আমি তো দেখতে পাচ্ছি না…না না ফের ফের…লাবিয়া নোনতা হলেও ওটার নাম দিলুম গোলাপসুন্দরী…পারফেক্ট হয়েছে…তাহলে পাছার একটাই নাম দিই…নরম নরম কোনো নাম…পাসওয়র্ড…ঠিক…এর নাম দেয়া যাক পাসওয়র্ড…ধ্যাৎ…পুরো রোমান্টিক আবহাওয়া ফর্দাফাঁই করে দিচ্ছিস……গ্যাস পাস হয় বলে পাসওয়র্ড হতে যাবে কেন…ছিঃ…তাহলে এর নাম হোক গরমের ছুটি…’
    এই কবিতায় যেন দুই কিশোর কিশোরীকে প্রত্যক্ষ করলাম আমি। যেন এরা শরীরের খেলায় মাতছে না, খেলা এদের প্রাণের। এদের বয়সও বাড়বে না যেন কোনদিন, এভাবেই এরা ছেলেমানুষ থেকে যাবে। কবিতাটি তাই যৌনক্রীড়া ছেড়ে কেমন ভাবে যেন শিশুখেলার মাঠ হয়ে গেছে, কীভাবেই বা হল এমন…… ভাবি আর ভাবতেই থাকি।
    অবন্তিকা ব্যায়াম করা থেকে ওঠাবসা, প্রায় সমস্ত কল্পনাতেই কবি তীব্র প্যাশন এনেছেন। অবন্তিকাকে নিয়ে অনেক অনেক কবিতা লিখেছেন কবি, হয়ত সংখ্যায় সব থেকে বেশি প্রেমের কবিতা লিখেছেন এই অবন্তিকাকে নিয়েই। প্রেমের মোহময় রূপ শুধু না, শরীরী আকর্ষণ শুধু না, অবন্তিকার সুখ, দুঃখ, রোজকার জীবনের ছোট বড় সমস্ত অভিঘাত এসেছে এই সিরিজে । এক কথায় বলতে গেলে, অবন্তিকাই কবির স্পেশাল প্রেমিকা। তবে সমস্ত কবিতাগুলোতেই আবেগ যেমন আছে, প্যাশন যেমন আছে, নির্মাণও তেমনি আছে ষোলকলায়। আর এই মিস্তিরিগিরিতে মলয় রায়চৌধুরী আমাদের সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে একেকটি নির্মাণ নিপুণ শিল্প হয়ে উঠতে পারে, আদ্যপান্ত কবিতা হয়ে উঠতে পারে।
    মলয় রায়চৌধুরী কবি ও প্রেমিক। কবিতা, নাকি তাঁর প্রেম, কাকে মাহাত্ম্য দেব, আমি বুঝে পাই নি এখনও। আর চিরতরুণ সবুজ এই কবি নিজেই লিখেছেন তাঁর ‘ঘাস’ কবিতায় –
    ‘ঢেউ তুলব ঘর্মাক্ত শরীরে, একদা
    সবুজ ঘাস আমি, নবজন্মে আজ
    প্রহেলিকা ইশারার ফাঁদ পেতে আছি
    জানি কোনো সৎ-কাপুরুষ আসবে
    তার বাড়তি বীজ ফেলার জন্য রাতে’
     
    তাই তাঁর প্রেম আর ফুরোয় না। বিগত জন্মের যে প্রেমিকাকে স্বীকৃতি দিতে পারেন নি, এ জন্মে তার জন্যই লিখেছেন, মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখ :-
     
    ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো
    মুখ দেখে ভালোবেসে বলেছিলে, “চলুন পালাই”
    ভিতু বলে সাহস যোগাতে পারিনি সেইদিন, তাই
    নিজের মাথা কেটে পাঠালুম, আজকে ভ্যালেনটাইনের দিন
    ভালো করে গিফ্টপ্যাক করা আছে, “ভালোবাসি” লেখা কার্ডসহ
    সব পাবে যা-যা চেয়েছিলে, ঘাম-লালা-অশ্রুজল, ফাটাফুটো ঠোঁট
    তুমি ঝড় তুলেছিলে, বিদ্যুৎ খেলিয়েছিলে, জাহাজ ডুবিয়েছিলে
    তার সব চিহ্ণ পাবে কাটা মাথাটায়, চুলে শ্যাম্পু করে পাঠিয়েছি
    উলঙ্গ দেখার আতঙ্কে ভুগতে হবে না
    গৌড়ীয় লবণাক্ত লিঙ্গ দেখবার কোনো স্কোপ  নেই
    চোখ খোলা আছে, তোমাকে দেখার জন্য সবসময়, আইড্রপ দিও
    গিফ্টপ্যাক আলতো করে খুলো, মুখ হাঁ-করাই আছে
    আমার পছন্দের ননভেজ, সন্ধ্যায় সিঙ্গল মল্ট, খাওয়াতে ভুলো না
    মাথাকে কোলেতে রেখে কথা বোলো, গিটার বাজিয়ে গান গেও
    ছ’মাস অন্তর ফেশিয়াল করিয়ে দিও, চন্দনের পাউডার মাখিও
    ভোর বেলা উঠে আর ঘুমোতে যাবার আগে চুমু খেও ঠোঁটে
    রাত হলে দু’চোখের পাতা বন্ধ করে দিও, জানো তো আলোতে ঘুমোতে পারি না
    কানে কানে বোলো আজও উন্মাদের মতো ভালোবাসো
    মাথা কেটে পাঠালুম, প্রাপ্তি জানিও, মোবাইল নং কার্ডে লেখা আছে ‘
    কী ভয়ানক প্রেমিক ! পড়লে গা শিউরে ওঠে। যে চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে এই কবিতায়, একটা কাটা মাথা র‍্যাপারে মুড়ে পৌঁছচ্ছে প্রেমিকার বাড়ি ।  সেই মুখে আবার ছ’মাস অন্তর ফেশিয়াল, আবার আলো পড়লে ঘুমোতে পারেন না বলে চোখের পাতা বুজিয়ে দিতে হবে ! এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে এই কবিই পারেন সম্ভবত।
     
    আবার এই কবিই ‘এক ন্যাংটো তন্বীর জন্য প্রেমের কবিতা’য় লিখছেন-
     
    ‘কুচকুচে চকচকে পুংঘোড়া হাঁকিয়ে ন্যাংটো তন্বী তুমি
    দুর্বিপাক ডেকে আনলে ঝুলে-পড়া গোলার্ধ দুটোয়
    জুজুবুড়ি জুজুবুড়ো খোকোন খুকুরানি তটস্হ সক্কলে…’
     
    যেন মনে হচ্ছে পৃথিবী ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে, আর কবি এই মেয়েটিকে আর তার ঘোড়াকে দায়ী করছেন এর জন্য। যৌনতাকে এখানে তিনি ‘সবার আগে’ বা ‘সার্বভৌম’ বলতে পারেন নি। এও কি তাহলে এক দ্বিচারিতা নয়?  নাকি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যৌনতার ভেদাভেদ হয়? এখানে আমাদের কবি ভাবার সময় দিয়ে চলে গেলেন অন্য কবিতায়। ‘কঙ্কালের দেশের জন্য প্রেমের কবিতা’য় যেখানে লিখছেন –
     
    ‘আমি বিষ খাই বিষ খাই বিষ খাই দীর্ঘ হয়ে উঠি
    আকাশে মাথা ধাক্কা খেলে বুঝতে পারি উড়ছে অন্ধ পেঁচারা
    আমার চোখ লক্ষ্য করে কঙ্কালরা হাড়ের স্লোগান আওড়ায়
    চারিদিকে মানুষীদের জরায়ু পড়ে আছে বিষে নীল
    নেকড়েরা তবুও জরায়ু টানাটানি করে চলেছে
    আমি দীর্ঘ হতে থাকি দীর্ঘ হতে থাকি দীর্ঘ হতে থাকি
    বিষ আমাকে এতো ক্ষমতা দেবে তা তোমরা জানতে না
    তোমরা মানুষ ছিলে এককালে এখন জানোয়ারের কঙ্কাল হয়ে গেছো’
     
    এখানে দেখি, মানুষের অধঃপতন আর তার ফল। এই বিষ কি আমাদের শরীরেও প্রবেশ করল না কিছুটা? মানুষের চামড়ায় ফোস্কা পড়বেই, যদিও তারা ক্রমে জানোয়ার না হয়ে উঠেছে।
     
    অবন্তিকা ছাড়াও কবি প্রেমের কবিতা লিখেছেন অনেকের জন্যই। তানিয়া চক্রবর্তীর জন্য প্রেমের কবিতায় দেখতে পাই, কবি যেন এক উদাসী পুরুষ। বারবার সাবধান করছেন প্রেমিকাকে:-
    ‘আমি তো বুনোপ্রেমিক সাধু, আমার প্রেম বদনাম করবে তোকে
    প্রাণচঞ্চল বাদামি পাথরের কাঁপুনি, অণুরণন, অয়ি প্ররোচনাময়ী
    অ্যানার্কি — হাই ভোল্টেজ উল্কি — ক্রিয়া না বিশেষ্য বুঝতে পারি না
    আমি তো মাটিতে-পোঁতা সাধু, তুই খুঁড়ে তুলবি বিপদে পড়বি
    আমি ভাটিয়ালি গেয়ে বেড়াই, নৌকোর দাঁড় বাইনি কখনও’
    দিল্লি-নিবাসী সুন্দরী সম্পাদিকা সোনালী মিত্রকে লিখছেন এভাবে:-
    ‘সোনালী প্রেমিকা ! তুইই বুঝিয়েছিলিস : হুদোহুদো বই লিখে
    বিদ্বানের নাকফোলা সাজপোশাক খুলে দেখাও তো দিকি
    কালো জিভ কালো শ্লেষ্মা কালো বীর্য কালো হাততালি
    উলঙ্গ নাচো তো দেখি তাণ্ডবের আঙ্গিকবর্জিত তালে তালে
    চুমুর পুনঃচুমু পুনঃপুনঃচুমু দিল্লির নিম্নচাপ মেঘে
    এ দ্যাখ গণ্ডারের শিব-সত্য-সুন্দরের চামড়া খুলে ফেলে
    আজকে পেয়েছি নখে প্রেমিকার চুলের জীবাশ্ম !’
    কবিকে যেন পান্ডিত্যের, আভিজাত্যের বর্ম থেকে বের করে সাধারণ মানুষের মত বোধ আয়ত্ব করিয়েছেন তাঁর এই প্রেমিকা।
    বিবাহিতা ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়-এর জন্য প্রেমের কবিতায় কবি যেন হয়েছেন সুন্দরের পূজারী:-
    ‘অসহ্য সুন্দরী, আমার নিজের আলো ছিল না
    তোর আলো চুরি করে অন্ধকারে তোরই ছায়া হয়ে থাকি
    তোর আর তোর বরের নাঝে শ্বাসের ইনফ্যাচুয়েশানে
    অসহ্য সুন্দরী, বেহালার কোন তারে তোর জ্বর, তা জানিস ?
    জানি না কেমন করে রেমব্রাঁর তুলি থেকে পিকাসোর তুলিতে চলে গেলি !’
    বাংলাদেশি প্রেমিকা উপমা অগাস্টিন খেয়ার জন্য প্রেমের কবিতায় রয়েছে শুধুই প্রেম আর প্রেম, একটু বিষাদ মাখা বিরহের ছোঁয়াও আছে অবশ্য:-
    ‘উপমাকে পেতে আমার সারা জীবন লেগে গেল, জানি পাবো না
    পুরুষদের কাটা মাথার আবর্জনায় আমার মাথা তুই চিনতে পারিসনি
    কবিতারা কেন যে উপমাকে বাদ দিতে শকুন কলোনিতে ঢোকে
    আকাশে পাক ধরেছে, দেখতে পায় না—‘
    এভাবেই একে একে অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃতি ঘোষ, সোনালী চক্রবর্তীর জন্য লিখেছেন বিভিন্ন স্বাদের প্রেমের কবিতা। কবির অফুরান কলমের কালি, অবিরাম মেধা আর শ্রম রয়েছে এই কবিতাগুলোর পিছনে।
    তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমার দুটি কবিতাকে মনে হয়েছে ভীষণ রকম আন্তরিক। যার পেছনে কারিগরির থেকে অন্তরের আবেগের টানটাই বেশি। ‘বুড়ি’ কবিতার কাছে আমার আজীবন প্রণাম রেখে গেলাম। আর কবির মৃত্যুচেতনা নিয়ে লেখাগুলোর মধ্যে এটিও একটি।
    ‘এই বুড়ি আমার দিদিমার বয়সী
    চুল পেকে গেছে, কয়েকটা দাঁত
    নেই, দিদিমার মতন শুয়ে থাকে–
    কবে শেষ হয়ে গেছে পুজো-পাঁজি
    ক্যালেণ্ডারে ছবি-আঁকা তিথি
    দিদিমার মতো এরও প্রতিরাতে
    ঘুম পায় কিন্তু আসে না, স্বপ্নে
    কাদের সঙ্গে কথা বলে, হাসে
    চোখে ছানি তবু ইলিশের কাঁটা
    বেছে ঘণ্টাখানেকে মজে খায়
    দিদিমার মতো, বলেছে মরবে
    যখন, চুড়ি-নাকছাবি খুলে নিয়ে
    পাঠাতে ইনসিনেটরে, এই বুড়ি
    চল্লিশ বছর হলো সিঁদুর পরে না
    পঞ্চাশ বছর হলো শাঁখাও পরেনি
    দামি-দামি শাড়ি বিলিয়ে দিয়েছে
    দিদিমা যেমন তপ্ত ইশারায়
    দাদুকে টেনে নিয়ে যেতো রোজ
    এও আমাকে বলে এবার ঘুমোও
    আর রাত জাগা স্বাস্হ্যের পক্ষে
    খারাপ, এই বুড়ি যে আমার বউ
    বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়
    কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়–
    এ-কথাটা আমারই, কাউকে নয়
    কারুক্কে বোলো না মরে গেছি ।‘
    আরেকটি কবিতা, যা ঠিক প্রেমের কবিতা না হলেও এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। নববিবাহিত দুজনের প্রেমের ওপর বাবা-মা’র যে আস্কারা বা যে অধৈর্য হয়ে পড়ার চিত্র এই কবিতায় দেখি, তাও মনে থাকবে অনেক দিন।
    ‘নতুন বউ
    আমরা দুজনে বাথরুমে বৃষ্টির তলায় নাচি
    আমাকে সাবান মাখাচ্ছে ও, আমি ওর চুলে
    শ্যাম্পু লাগিয়ে তুলছি বঙ্গোপসাগরের ফেনা
    মুখে ঢেউ বুকে বানভাসি হাসছি দুজনে
    দেড় ঘণ্টায় আমি ওর ও আমার মাংসে মিশেছে
    বন্ধ দরোজার ভেতরে আয়না লাগিয়ে
    দিয়ে গেছে দাদা, নতুন বউ যে এসেছে সংসারে–
    দেখাচ্ছি দুজনের বেপরোয়া পেছলা তাণ্ডব
    প্রথম দিনের স্নানে জীবন্ত পেইনটিঙ
    বাথরুমে বনাঞ্চল ঝর্ণা নতুন বউকে নিয়ে
    সাবান মাটিতে পড়লে চেঁচিয়ে উঠছে ও
    “এই এই ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি
    বাথরুমে নয়, কালই তো ফুলশয্যা করেছিলে”
     
    হঠাৎ বাইরে থেকে বাবার কন্ঠস্বর শুনি :-
    “আর কতোক্ষণ লাগবে তোদের, দুঘণ্টা তো হলো
    কখন করব চান, কখন বসব খেতে, আজকে পূর্ণিমা”
    মায়ের ফিসফিসানিও শুনতে পাই, বাবাকে বলছেন :-
    “আহ, দাও না দুজনকে একটু ভালোভাবে
    পরিচয় করে নিতে, কাল থেকে তো সেই
    চাড্ডি মুখে গুঁজে নিয়ে দশটা পাঁচটার সংসার”’
     
    অনেক দিন আগে  মলয় রায়চৌধুরী লিখেছিলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প_তিষ্ঠিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার জন্য আমন্ত্রিত এক কবিতায়, যা পত্রিকা-কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেননি,  ‘নীরা আমার ঠাকুমা ছিলেন।‘ সুনীলের নীরাকে নিজের ঠাকুমা বানিয়ে দিয়েছিলেন অবলীলায় ! একজন নীরা, যে কিনা সারাজীবন আগের প্রজন্মের এক কবির প্রেমিকা, অধরা মাধুরী, যার বয়স কোনদিন বাড়ল না, আর তাকেই মলয় রায়চৌধুরী বানিয়ে দিলেন নিজের ঠাকুমা ! তো, সব শেষে এসে এইখানে নিজের জন্য একটু আশার আলো আমি দেখতে পাই। নীরা যদি ঠাকুমা না হয়েও মলয় রায়চৌধুরীকে দিয়ে ঠাকুমা’র কবিতা লেখাতে পারেন, আমি যে কিনা মলয় রায়চৌধুরীর গত জন্মের ঠাকুমা ছিলাম, আমাকে  নিয়েও নিশ্চই লেখা হবে কোন যুগান্তকারী কবিতা, একদিন না একদিন।
     
  • Aloke Goswami | 223.229.178.225 | ০৮ অক্টোবর ২০২২ ১৮:৪০738568
  • অলোক গোস্বামী :  মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'
    শ্বসন অথবা শাসন প্রণালী
    প্রস্তাব এসেছিল মলয় রায়চৌধুরীর যে কোনো একটি গদ্য কিংবা কবিতা সংকলন নিয়ে আলোচনা করার, কিন্তু আমি তো ফোরেনসিক আলোচক নই। কোনো রচনাকে পোস্টমর্টেম টেবিলে ফেলে, ফালাফালা করে, মাংস-কৃমি খুঁটে বের করে, ভালো কিংবা মন্দ লাগাকে তত্ত্বের কড়াপাকে নাড়াচাড়া করে বিশ্লেষণ করতে শিখিনি। কোনো রচনা যদি পারে হ্যাঁচকা টানে গভীর সমুদ্রে ফেলে দিয়ে হাঙরের ঢেউয়ে লুটোপুটি খাওয়াতে তাহলে তারপর যা পারি তাহলো গ্রন্থটির খোলা পাতার সামনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে। অনেক ক্ষণ। দীর্ঘক্ষণ। তারপর বড় জোর সমমনস্ক কারো সঙ্গে পাঠ প্রতিক্রিয়াটুকু বিনিময় করতে পারি। তাই কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছিলাম আমার অপারগতার কথা কিন্তু ওরা ওই পাঠ প্রতিক্রিয়াটুকুতেই রাজী হওয়ায় বেছে নিলাম,“ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” উপন্যাসটি।
    কেন এই নির্বাচন, সেটা এক কথা্য় বলা যাবে না। পেছনে অনেকগুলো  কারণ আছে। প্রধান কারণ অবশ্যই, এটা কবি মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম উপন্যাস যা লিখিত হয়েছিল ১৯৯১-৯৩তে এবং হাওয়া ঊনপঞ্চাশ প্রকাশনী থেকে ১৯৯৪ তে প্রকাশিত হয়েছিল। সে সময়ই আজীবন ভ্রাতৃবৎসল সমীর রায়চৌধুরী আমাকে উপন্যাসটি উপহার দিয়ে পড়ে দেখতে অনুরোধ করেছিলেন।বইটা নিয়েছিলাম বটে কিন্তু পড়িনি। অবহেলা বশতঃ ফেলে রেখেছিলাম, অন্ততঃ মাস খানেক তো বটেই। তারপর কী জানি কেন, একদিন পড়তে শুরু করেছিলাম! তারপর আর ফেলে রাখতে পারিনি। প্রায় এক সিটিঙেই শেষ করেছিলাম ছিয়ানব্বই পাতার এই উপন্যাসটি। স্বীকার করতে অসুবিধে নেই, পাঠ শেষে এতটাই  মুগ্ধ হয়েছিলাম যে এরপর এই চব্বিশ টাকা মূল্যের বইটির অনধিক চব্বিশ বছর আমার সঙ্গী হয়ে থাকতে অসুবিধে হয়নি। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, এর মধ্যে আমার বাসভূমির বদল ঘটেছে। নিজস্ব শহর এবং পৈত্রিক দ্বিতল বাড়ি(যার একতলায় নিজস্ব লাইব্রেরি ছিল)ছেড়ে এসে মাথা গুঁজতে হয়েছে ভিন শহরের  ছশো স্কোঃ ফুঃ- র এক শয়নকক্ষ সমৃদ্ধ ফ্ল্যাটে। মাপজোখের তথ্যটা জানানোর কারণ, স্থান সমস্যার কারণে ইচ্ছে অনিচ্ছায় আমাকে অনেক বইপত্রর মায়া ত্যাগ করে আসতে হয়েছে। এমন কী নিজের গল্প সংকলনের দু/তিন কপি বাদ দিয়ে বাকিগুলো অকাতর  বিলিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম অথচ কী আশ্চর্য, এই বইটির ক্ষেত্রে ততটা নিস্পৃহ হোতে পারিনি!কিছু বাছাই বইপত্রের মাঝখানে ছোট্ট উপন্যাসটি আজও মুখ গুঁজে রয়েছে। এখন পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার স্বার্থে ফের যখন উপন্যাসটি পড়ছি তখনও অবাক হয়ে লক্ষ করছি এই রচনার বিষয়বস্তু এবং গদ্যশৈলী প্রথমদিন আমাকে যতটা আকৃষ্ট করেছিল, আজও ততটাই করছে। বাধ্য হয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করছি, তবে কি চব্বিশ বছর ধরে এই উপন্যাসটি আমার সঙ্গ ছাড়েনি এই কারণে যে একদিন আমাকে দিয়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখিয়ে ছাড়বে,তাই?
     হোতেই পারে এটা নিছকই আমার মনগড়া কল্পনা! হয়ত এই ভাবনা আমাকে তৃপ্তি দিচ্ছে! সে যা হোক মোদ্দা কথা হলো আপাততঃ এটাই প্রধান কারণ।   
     যারা উপন্যাসটি পড়েননি তারা কেউ জানতে চাইতেই পারেন, কী এমন মনিমাণিক্যের সন্ধান জুগিয়েছে মাত্র ছিয়ানব্বই পাতার এই উপনাস!কৌতুহলটা অবাঞ্ছিতও নয়, কিন্তু এ প্রসঙ্গে পরে কথা হবে। আপাতত জানাতে হবে, কেন আমি সেদিন মলয়ের উপন্যাসটির ব্যাপারে প্রথমে আগ্রহ দেখাইনি? কেন  অবহেলায় ফেলে রেখেছিলাম? আমি যে ততদিনে  মলয় রায়চৌধুরীর নাম শুনিনি কিংবা ওঁর লেখাপত্র পড়িনি, তা তো নয়! তাহলে?
    এই বিবমিষা প্রসঙ্গে কথা বলতে হলে আমাকে ব্যক্তি মলয় রায়চৌধুরী প্রসঙ্গে ঢুকতেই হবে এবং সেটা যে খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে, তাতো নয়। হাংরি ম্যানিফেস্টো অনুযায়ী বাসুদেব দাশগুপ্ত বাদে সব হাংরি গদ্যকারই লেখার মালমশলা তুলে এনেছেন নিজের জীবন থেকে এবং কোনো মীথ-মেটাফর-অ্যালিগরির ধার না ধেরে সরাসরি সেসব তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। ওদের কাছে, যা কিছু ব্যক্তিগত সেটাই অশ্লীল। ওরা সন্ধান করেছেন গা-গতরের ভাষার। মেধার কর্টেক্সে পেনসিল ডুবিয়ে শিল্পচর্চা করার ঘোর বিরোধী ওঁরা প্রত্যেকেই। বন্ধুদের সঙ্গে যতই বিরোধিতা থাকুক মলয়ও বরাবর একই কাজ করেছেন, করে আসছেন। তিনি এবং তাঁর সাহিত্য, একে অন্যের পরিপূরক। তিনিও কোনদিন কল্পনাশ্রিত সাহিত্যচর্চা করেননি। সরাসরি বলেছেন-- দেখি খুল্লামখুল্লা লেখার চেষ্টা করে কতোটা কি তুলে আনতে পারি! উপন্যাস লিখতে বসে ঘটনা খুঁড়ে তোলার ব্যাগড়া হয় না। জীবনকেচ্ছা লিখতে বসে কেচ্ছা-সদিচ্ছা-অনিচ্ছা মিশ খেয়ে যেতে পারে, তার কারণ আমি তো আর বুদ্ধিজীবি নই। জানি যে মানুষ ঈশ্বর গণতন্ত্র আর বিজ্ঞান হেরে ভুত…..বাঙালি সাহিত্যিকদের চাঁদমারি ভাগ্য যে তাঁদের ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় না। বাংলা পাল্প ফিকশন হলো ঘোলা জলের আয়নায় মুখদর্শন…...সাহিত্যজগত থেকে ছিঁড়ে নিজেকে আলাদা না করলে লেখালিখি করা যায় না….আমি সাহিত্যিক লাউডগাগিরিতে ভুগি না, বুঝলেন তো! আমার লেখালিখি নিছক সাহিত্য নয়। গণপাঠককে আনন্দ দেবার জন্য নয় তা। পাঠককে চৌচির করে তার ভেতরে সমাজরাষ্ট্রের গুগোবর ভরে দেবার জন্য। আর আমি শিল্প ব্যাপারটার বিরুদ্ধে , কেননা আমাকে সারিয়ে প্রাচীন গ্রিক হেলেনিক সমাজের যোগ্য করে তোলা যাবে না। আমি চাই না যে আমার শবযাত্রায় কবি লেখকরা ভিড় করুক। একজনকেও চাই না…আমি লেখালিখি বেছে নিইনি, লেখালিখি আমাকে বেছে নিয়েছে ….প্রথম আদিম মানুষ যেমন পাথরের ছোরা আবিষ্কার করেছিল তেমনই আমি নিজের লেখালিখির অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছি।
      যারা এই উপন্যাসটি পড়েছেন তারা হযত ধুঁয়ো তুলবেন,কই, এই উপন্যাসে তো ম্যালা চরিত্র! তাদের একেক জনের জীবন একেক রকম। এবং তারা কেউ মলয় রায়চৌধুরী নন।  মলয় রায়চৌধুরী নামে একটি চরিত্র আছে বটে কিন্তু সারা উপন্যাসে তার উপস্থিতি মোটে দুবার, দু লাইনে। এবং সেই চরিত্রের ভূমিকাও নিছকই একজন আমোদগেঁড়ের।
     উদ্ধৃত করতেই পারেন বইটির ভেতরের পাতায় লিখে দেয়া লাইনগুলো ,” ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস একটি কাল্পনিক উপন্যাস। চরিত্র, ঘটনা বা সংস্থার সঙ্গে মিল ঘটে গিয়ে থাকলে তা আকস্মিক।”
     আমার কাছে একটি আপত্তিও গ্রহণযোগ্য হবে না কারণ উপন্যাসটি পাঠের পর কারুরই বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে এই উপন্যাসেও মলয় নিজেকেই ব্যবহার করেছেন। প্রতিটা চরিত্রই তার খুব কাছের মানুষজন। এই লুকাছুপির কারণ, উপন্যাসটির ব্যাকপ্রাউন্ড ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং উপন্যাস রচনা কালীন সময়ে যেহেতু মলয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অধিকর্তা পদে কর্মরত তাই জীবিকা স্বার্থেই এই বিধিসম্মত সতর্কীকরণ এবং ওইসব ফর্মগত ছলচাতুরী। ঘরপোড়া গরুর তো সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরানোর কারণ থাকেই। এসব তুচ্ছ বিষয় বাদ দিলে যা থাকে তার সবকিছু মলয়সুলভই।
    অতএব এরপর আমি নিশ্চিন্তে এই উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে নির্দ্বিধার ব্যক্তি মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে কিছু কথা বলতেই পারি এবং সেই বলাটা আদৌ শিবগীতি হবে না। তারচেও বড় কথা হলো, ইতিহাসের স্বার্থেই ওসব কথা আমি বলতে বাধ্য। বর্তমান সময় থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আমাকে পিছিয়ে যেতেই হবে। জানাতেই হবে যে, কিভাবে কিভাবে একদা মলয় রায়চৌধুরীর সংস্পর্শে এসেছিলাম।
     আজ যেমন বাংলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রই ওঁর রচনার সঙ্গে পরিচিত, সেদিন, আটের দশকের শুরুতে আমার কিন্তু তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। ক্ষুধার্ত আন্দোলন বিষয়ে জানকারি বাড়াতে গিয়ে মলয়ের নাম শুনেছিলাম বটে কিন্তু সেটা ছিল জাস্ট উল্লেখ মাত্র। তৎকালীন ক্ষুধার্ত লেখকবৃন্দ অনেক নামের সঙ্গে মলয়ের নামটুকু জানিয়ে ছিলেন বটে, ওঁর ক্যারিশ্মা সম্পর্কে কোনো তথ্যই ফাঁস করেননি। সেদিন তাই সবার লেখা পড়লেও মলয়ের লেখার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। ওঁর,” প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” শুধু যে পড়িনি, তা নয়, জানতামও না যে ওই কবিতার কারণেই রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত কেস কাছারি ঘটেছিল। বরং জানতাম শৈলেশ্বরের একটি কবিতাই ছিল ওই মোকদ্দমার কারণ।
    অন্যভাবে‌ও মলয় সম্পর্কে জানার কিংবা ওঁর লেখাপত্র পড়ার সুযোগ ছিল না। কোথাও পাওয়া যেত না  মলয়ের লেখাপত্র।  মলয়ের সঙ্গে যোগাযোগেরও সুযোগ ছিল না কারণ অভিমান এবং ক্যারিয়ার গোছানোর কারণে মলয় তখন ছিলেন স্বেচ্ছা অজ্ঞাতবাসে।
    তো মলয় রায়চৌধুরীর কিরিয়া করমের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে  তিরাশি/চুরাশি নাগাদ, ‘পথের পাঁচালী’ পত্রিকার পাতায়। পুনরাবির্ভাবেই ফের শোরগোল মাচিয়ে দিলেন মলয়। হাংরি আন্দোলেন ওঁর ভূমিকার কথা সেই প্রথম জানলাম বটে কিন্তু সেই জানকারির পুরোটাই ছিল ভাসাভাসা। কারণ তথ্যের পরিবর্তে ওই সাক্ষাতকারের পুরোটাই ছিল প্রাক্তন সহলেখকদের বিরুদ্ধে  ব্যক্তিগত বিষোদ্গার এবং অহং সর্বস্ব রণহুঙ্কার। (যে অভ্যেস মলয় আজও বজায় রেখেছেন। ভালোমন্দ কিম্বা ভদ্রতা-অভদ্রতার তোয়াক্কা না রেখে কারণে-অকারণে ছোড়া মলয়ের ইগোয়িস্ট হুঙ্কার চোখে পড়েনি এমন পাঠক আজ বিরল। অবশ্য দৃষ্টি আকর্ষণের এই কৌশলটা যে পুরো বিফলে যায়নি তার প্রমাণ, এপার ওপার বাংলা মিলিয়ে আজ মলয় রায়চৌধুরীর পাঠক সংখ্যা নেহাত কম নয়।)
    সেদিন কিন্তু বিরক্তই হয়েছিলাম। শুধু আমি নই, বাংলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রেরই একই রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। সেটাই ছিল স্বাভাবিক কারণ মলয়ের ঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বী,শৈলেশ্বর ঘোষ ততদিনে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান বিরোধী কবি। উল্টোদিকে মলয় নতুন প্রজন্মের কাছে বিলকুল অচেনা। প্রাক্তণেদরও মলয়ও একদা এতটাই উত্যক্ত করেছিলনে যে তারাও মলয়কে পাত্তা দিতে চাননি।
     মলয় রায়চৌধুরীর দ্বিতীয় উপস্থিতি সম্ভবত চোখে পড়েছিল ‘কবিতা দর্পন’ পত্রিকায়। সেই একই রকম খোট্টা পালোয়ান সুলভ আস্ফালন। যথারীতি সবার কাছে বিরক্তিকর।
    মলয়ের তৃতীয় উপস্থিতি  ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায়। একমাত্র এই উপস্থিতির মাত্রা ছিল ভিন্ন রকম। মহাদিগন্ত পত্রিকা সেদিন হাংরি মামলার খুঁটিনাটি( দলিল দস্তাবেজ সহ) প্রকাশ করেছিল। বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরা প্রকৃত সত্য জানতে পেরেছিল। সেই প্রথম আমরা পড়েছিলাম মলয় রায়চৌধুরীর  ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ সহ আরও কিছু লেখাপত্র। বুঝেছিলাম, সেদিনের হাংরি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠানের ভিত কাঁপিয়ে দেয়া, আন্তর্জাতিক নজর আকর্ষন করা, সবকিছুর পেছনেই ছিল মলয় রায়চৌধুরীরই প্রধান ভূমিকা এবং মোকদ্দমা-জেল-জরিমানা এবং নিশর্ত মুক্তিপর্বের পর সত্যি সত্যিই সেই হাংরি অান্দোলনের মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল। যা ছিল সেটা শুধুই ক্ষুধিত প্রজন্মের সাহিত্য, যার চালিকা শক্তি ছিলেন শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, অরুনেশ ঘোষেরা। সেটা আদৌ আন্দোলন ছিল না। মলয়ের মতো আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা ওদের কারো ভেতরই ছিল না।  
    এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে মলয় রায়চৌধুরীর পুনঃপ্রতিষ্ঠার মঞ্চটা সাজিয়ে দেয়ার পেছনে ডঃ উত্তম দাশের নিখুঁত সম্পাদনার ভূমিকা অনস্বীকার্য।  কে জানে. হয়ত স্বভাবগত কারণে মলয় এই গুরুত্বকে অস্বীকার করবেন, হয়ত একই রকম অহঙের উদগার তুলবেন  কিন্তু তাতে ইতিহাসের কিছু এসে যায় না। ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট।
     
     হ্যাঁ, মহাদিগন্ত পর্বের পরই  মলয়ের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মেছিল। ঠিকানা জোগার করে একটা চিঠিও পাঠিয়ে ছিলাম। কিন্তু মলয় সেই চিঠিকে সাক্ষাতকারের রূপ দিয়ে এবং আমাকে শৈলেশ্বরের অনুচর ঠাউরে নিয়ে  যে উত্তর দিয়েছিলেন তাতে সেদিন আমার সদ্য যুবক শরীর রাগে ঘৃণায় রী রী করে জ্বলে উঠেছিল। লেখাটির  ছত্রে ছত্রে শুধু গরিলা সুলভ বুক চাপড়ানি এবং অপরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা। ছিল পেশার অহঙ্কার। একটা লাইন তো এমনও ছিল যে, ওই সাক্ষাতকার প্রকাশ করলে আমি নাকি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাব! বলাবাহুল্য মলয় রায়চৌধুরী মারফত নিজেকে বিখ্যাত বানানোর প্রবৃত্তি সেদিন অবহেলায় ত্যাগ করতে পেরেছিলাম।
    মলয়ের তৃতীয় সাক্ষাতকার পড়ি অরুনেশ ঘোষ সম্পাদিত ‘ জিরাফ’ পত্রিকায়। সেখানেও  সেই একই রকম বিষোদ্গার এবং বুক চাপড়ানির সিক্যুয়েল। আজও মনে আছে একটা প্রশ্নের উত্তরে অরুনেশকে বলেছিলেন,“ লন্ডন স্কুল অফ ইকনোমিক্সে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, সাহিত্যের কারণে ভর্তি হইনি। সুতরাং বুঝতেই পারছ, যা যোগ্যতা ছিল তাতে তোমার মতো গাঁয়ের স্কুলে মাস্টারির চাকরি জোগাড় করতে আমার কোন অসুবিধেই হোত না।”
    ভদ্র এবং অস্পষ্টবাদী হিসেবে আমারও যে খুব সুনাম আছে তেমন কিন্তু নয় তবু সেদিন মলয় রায়চৌধুরীর ওই ঝাঁঝ সামলানো আমার পক্ষে অস্বস্তিকরই হয়েছিল। সুতরাং এরপর  দুজন ঘেঁটিত্যাড়ার ভেতর দুস্তার ব্যবধান জেগে ওঠাটাই ছিল স্বাভাবিক। বড়জোর ওঁকে হয়ত শহীদের স্বীকৃতি দিতাম কিন্তু কী এক দুর্জ্ঞেয় কারণে শেষ অবধি তেমনটা হোল না! এরপর থেকে যেখানে যত লেখাপত্র প্রকাশিত হোত মলয় নিয়মিত সেসবের জেরক্স কপি আমাকে পাঠাতেন।  বেশীর ভাগই ছিল কবিতা কিংবা যুযুৎসীয় প্যাঁজ পয়জার।  পড়তাম সেসব। কবিতাগুলো ভালো লাগত না। অন্যগুলো থেকে শেখার চেষ্টা করতাম লেজে পা দেয়া মানুষকে অপমান করার কৌশল।
    শুধু লেখাপত্র নয়, কাঁপা কাঁপা অথচ সুন্দর হস্তাক্ষরে মলয় কখনও কখনও পোস্টকার্ডও পাঠাতেন। সৌজন্য বশতঃ সেসবের উত্তরও দিতাম। ব্যস, এই অবধিই। আমার পত্রিকার জন্যও কখনও মলয়ের লেখা চাইনি, মলয়ও কখনও আগ বাড়িয়ে পাঠাননি।
    মলয়ের সুবাদেই এরপর সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। সহোদর হওয়া সত্ত্বেও  যেহেতু তিনি ছিলেন ভিন্ন চরিত্রের মানুষ তাই আমাদের সখ্য গড়ে উঠতে বেশী দেরী হয়নি। দিনকে দিন সেই সখ্য নিবিড়তর হয়ে উঠেছিল। যে কোনো বিষয়ে খোলাখুলি মত বিনিময় করতে আমরা কখনও দ্বিধা দেখাইনি। পরবর্তিতে সমীরকে নিয়ে আমার পত্রিকা ‘গল্পবিশ্ব’ এ ক্রোড়পত্রও প্রকাশ করেছিলাম। সমীর রায়চৌধুরীকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত সেটাই প্রথম কাজ।
    সমীর রায়চৌধুরী প্রসঙ্গে অনেক কিছু বলার আছে কিন্তু সেসবের জন্য এই পরিসর উপযুক্ত নয়। এখানে শুধুই মলয় রায়চৌধুরী এবং ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস। আপাততঃ সে প্রসঙ্গে ফেরা যাক।
    তো পড়লাম উপন্যাসটা। এবং চমকে উঠলাম। এ কোন মলয় রায়চৌধুরী! অনর্গল আঁচড়ানি কামড়ানির ফাঁকে ফাঁকে কিভাবে রপ্ত করলেন এই ভাষা! কর্কশ মানুষটার ভেতরে এই পেলব কথনভঙ্গী ছিল নাকি কখনও? মানুষের অন্তরকে খুঁটিয়ে দেখার মতো রঞ্জন রশ্মী ছিল নাকি ওঁর চোখে! ছিল নাকি এতটা সোহাগ, প্রশ্রয় ওঁর অন্তরে? কই, টের পাইনি তো!
    সত্যি বলতে কী সেদিন আমার পাঠ অভিজ্ঞতাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল এই উপন্যাস। ভঙ্গী এবং প্লট মারফত।
    ভঙ্গীর কথায় পরে আসব। প্রথমে বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে আসা যাক।
    কীভাবে ব্যাখ্যা করব এই উপন্যাসের প্লট। শিল্পনীতি মোতাবেক কোনো বাঁধা রুটম্যাপই তো নেই!  বাঁধাই সড়কে চলতে চলতে মলয় অনায়াসে পথ বদলে উঠে পড়েছেন ফুটপাথে,সেখান থেকে দ্দে ছুট কানা গলিতে, নাহ্, গলিটা আদৌ অন্ধা নয়, দেয়ালের ফোঁকড় দিয়ে পথ বের করে নেমে পড়েছেন  মাঠে ঘাটে। ফলো করতে গিয়ে আমার নাজেহাল দশা। কখনও চলা থামিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ছেন  বটে খোলা মাঠে, দেখছেন বটে আকাশ বাতাস চরাচর কিন্তু আমার পরিশ্রম থামছে কই!
    কথাগুলোতে কারুর হেঁয়ালি ঠেকলে আমি লাচাড়।  কারণ, রচনাটা আদৌ একমাত্রিক নয়,বরং বহুস্তরীয়। ফলে ঠিক করা মুশকিল হয় কাকে শনাক্ত করব এই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র হিসেবে? পাঁচ ফিটের ফর্সা, গালফোলা কোঁকড়া চুল, চনমনে অবাঙালি চেহারা বেপরোয়া সুশান্ত ঘোষকে? যে কিনা উপন্যাসের প্রথম পাতাতে হাজির হওয়া মাত্র ইন্দিরা গান্ধীকে সম্বর্ধনা জানাতে জোগার করা হাতির শুঁড়ের মৃদু আদরে ঘাড় ভেঙে ফেলে, চাকরীর পাশাপাশি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যায় ব্যবসা ধান্দায়, জমি পুনর্দখলের অভিপ্রায়ে গুন্ডা ভাড়া করতে গিয়ে নিজেই দখল হয়ে গিয়ে বাধ্য হয় চোদ্দ বছরের এক নাবালিকাকে বিয়ে করে জমি মাফিয়াদের ঘরজামাই হয়ে যেতে!
    নাকি বাবার আত্মহত্যার সুবাদে চাকরি পাওয়া অতনু চক্রবর্তিকে? কিন্তু সে তো ভীষন অন্তর্মুখি! কথা বলতে হবে, এহেন আতঙ্কে সে কারুর মুখোমুখি হোতে চায় না। ধুতি পঞ্জাবী পরে। সর্বোপরি নারীসঙ্গ বিহীন। দলে ভিরে মদ মেয়েমানুষবাজী করতে গিয়েও সবকিছু কেমন দরকচা করে ফেলে! সঙ্গমের অভিজ্ঞতা হয় বটে এক সময়, কিন্তু সেই ঘটনায় পুরুষালির বিন্দুমাত্র ছিঁটেফোটা থাকে না, বরং তা যেন গণধর্ষনের ফাঁদে পড়ে ভার্জিনিটি খোয়ানোর এক মেয়েলি কিস্যা।
    তাহলে মানসী বর্মন? যে কিনা ডিভোর্সী কিম্বা ডির্ভোসী নয়। ননীদা আর সুলতানার বাচ্চার সারোগেট মাদার হওয়ার মতো সাহস দেখিয়ে ফেলে বটে কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনা। শেষ অবধি গ্রামে গিয়ে নকশাল আন্দোলনে যোগ দেয়। এই সাহসিকতা এবং সততার পরও কিনা মানসী বর্মনের গচ্ছিত রেখে যাওয়া ব্যাগের ভেতর পাওয়া যায় রাশি রাশি নোট!
    কিন্তু ননীদা কিংবা সুলতানাকেই বা বাদ দেই কিভাবে! অবসরের পর যাকে বিয়ে করলেন ননীদা তাকে সুশান্ত এবং অতনু দেখেছিল হোটেলের কামরায় ঢুকতে এবং বেরতে।
    প্রধান চরিত্র হওয়ার যোগ্যতা অরিন্দমেরই বা কম কিসে! স্বামীর অনুপস্থিতিতে পাশের ফ্ল্যাটের মহিলাকে যৌন খোরাক জোগাতে জোগাতে প্রথমে পাগল এবং পরে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় অরিন্দ। বহুদিন পর তার সন্ধান পাওয়া যায় এক গ্রাম্য রেলস্টেশন। চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে চাকরিতে ফের যোগ দেয় অরিন্দম এবং দৃঢ়তার সঙ্গে জানায় যে পাগল সে আদৌ হয়নি কখনো,যৌন কাতরতা থেকে মুক্তি পেতেই সে মানসিক চিকিৎসালয়ে ভর্তি হয়েছিল। অর্থাত চলতি কথায় যাকে আমরা বলি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার। এবং এরপর সত্যি সত্যি একদিন ফ্ল্যাট ছেড়ে অফিস কোয়ার্টারে এসে ওঠে অরিন্দম। তারপর বদলি হয়ে কোলকাতায় চলে যায়, চিরতরে।
    এরকম আরও অজস্র চরিত্র আছে এই উপন্যাসে, কাহিনী বিন্যাসের ক্ষেত্রে যাদের ভূমিকা এক তিলও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
    শুধু মানব চরিত্রের কথাই বা বলছি কেন? চরিত্র হিসেবে প্রাধান্য পাবার ক্ষেত্রে   বিহার রাজ্যটাই খুব এলেবেলে নাকি! দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা  বিহারের জাতপাতের রাজনীতি, মাফিয়া সন্ত্রাস, অপহরণ ব্যবসা এবং   পোকামাকড়ের চেও অসহায় ভাবে সাধারণ মানুষকে গণহত্যার শিকার বানানো, কয়েক পুরুষ ধরে বিহারবাসী হওয়ার সুবাদে মলয় সেসব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরেছেন। যদিও এসব ঘটনা যে বহুদিন ধরেই  বিহারি সংস্কৃতির অঙ্গ সে বিষয়ে টুকচাক বিবরণ মিডিয়া আমাদের জানিয়েছে। সেসব ছিল ওদের নিজস্ব ব্যাপার, কিন্তু মলয়ের আঁখো দেখা হাল তুলে ধরেছে  চাঁদমারিতে কিভাবে ক্রমশঃ ঢুকে পড়েছে কয়েক পুরুষ ধরে ওই রাজ্যে বাস করা বাঙালী পরিবারগুলোও। ফলতঃ স্ত্রী কন্যা পুত্র সহ বেঁচেবত্তে থাকার সোশ্যাল সিক্যুরিটি জোগাড় করতে গিয়ে তাদের সামনে রয়ে গিয়েছে মাত্র দুটো পথ। হয় নিজের বাঙালি পরিচয়কে মুছে ফেলে পুরোপুরি বিহারি হয়ে যাওয়া, নতুবা পূর্ব পুরুষের ভিটে ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়া।  
      
    এসবের পাশাপাশি এই উপন্যাসে আরও একটা চরিত্র আমাকে তীব্র ভাবে আকর্ষণ করেছে, সেটা হলো বাতিল পচা নোট। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনের ফুটপাতে বরাবরই  কিছু মানুষকে টেবিল পেতে বসে থাকতে দেখেছি, যাদের পেশা বাট্টার বিনিময়ে ছেঁড়া ফাটা নোট বদলে ঝাঁ চকচকে নোট দেয়া। এটুকু জানতাম যে দালালগুলো এরপর ওই ছেঁড়া ফাটা নোটগুলোকে ব্যাঙ্কের কাউন্টার থেকে বদলে নেয় কিন্তু ব্যাঙ্ক ওই অচল নোটগুলোর কি গতি করে সেটা জানা ছিল না। জানার কথাও নয়, কারণ এই সংক্রান্ত তথ্য কোথাও কোনদিন নজরে পড়েনি। সাহিত্যও পারেনি তেমন জ্ঞান জোগাতে। মলয় রায়চৌধুরীর আগে কেউ এহেন পটভূমিকায় কোনদিন  গল্প/ উপন্যাস কিছুই লেখেন নি। পেশায় ব্যাঙ্ককর্মী এরকম অনেক লেখকের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, সুতরাং দায়িত্ব নিয়েই বলছি কথাটা। হয়ত না লেখার অজুহাত, বিষয়টাকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ প্লট মনে না করা। আর এখানেই মলয় রায়চৌধুরীর বৈশিষ্ট। একটা না প্লটকে এমন জবরদস্ত প্লট হিসেবে তুলে ধরেছেন যে পড়তে পড়তে শিউরে উঠেছি। নোট বদলের ভেতর এত দুর্নীতি আছে! নোটের বান্ডিলগুলোকে বাতিল করার জন্য পাঞ্চিং মেশিনে ফেলে যে ছ্যাঁদা করা হয় তাতে স্বেচ্ছায় আঙুল বাড়িয়ে দেয় কিছু মানুষ? সরকারের থেকে কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য এতবড় আত্মত্যা! হ্যাঁ, আত্মত্যাগই বলবো, কারণ ওই ক্ষতিপূরণের পণ দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেয়া যাবে, চাষের জমি কেনা যাবে কিম্বা জমি রক্ষার জন্য কেনা যাবে বন্দুক।    
          
    এখানেই শেষ নয়। এরপর আছে রাশি নোট বাতিল হওয়ার পর সেসবের  সদগতি পর্ব। কি করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সেসব বাতিল বস্তা পচা নোট নিয়ে? ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস মারফত জানলাম, জাস্ট কেরোসিন ঢেলে চুল্লীতে  জ্বালিয়ে দেয়া হয়। প্রক্রিয়াটা শবদাহরই মতো। চুল্লীর চিমনি দিয়ে একই রকম গলগলিয়ে ধোঁয়া ওঠে, বিশ্রী কটু গন্ধে চারপাশ ম ম করে ওঠে, আগুন দেয়ার সময় একই ভঙ্গিতে ‘হরিধ্বনি’ কিম্বা ‘ রাম নাম সৎ হ্যায়’ উচ্চারণ করা হয়।
    হ্যাঁ, এরপরই আমার কাছে উপন্যাসটা সার্থকনামা হয়ে ওঠে। একদিকে বিহারের টুঁটি চেপা সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ অন্যদিকে দিনের পর দিন রাশিরাশি বাতিল বস্তাপচা নোট গোনা, বাতিল করা এবং পোড়ানো, সর্বোপরি দুর্নীতির করাল থাবা ঘাড়ের ওপর সদা উদ্যত, সামন্য ভুলে জীবন কিংবা জীবিকা তছনছ  হয়ে যাবার বিপুল সম্ভাবন। এই জীবনকে ডুবজল ছাড়া আর কী বা বলা যেতে পারে! আর যে কোনো প্রাণী যেহেতু সামান্য শ্বাসটুকু নেয়ার তাগিদে মরীয়া হয়ে ওঠে, অক্সিজেনের খোঁজে বেপরোয়া ঢুঁ মেরে বেরায়, এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোও সেটাই করেছে। তাদের সমস্ত আচরণগুলোই ডুবজলে থেকে বাঁচার সন্ধান করার প্রবণতা।
    প্লট বিষয়ে আমি আর কিছু বলব না। বলাটা অপ্রয়োজনীয়ও, কারণ আমি এখানে উপন্যাসটির পাঠ অভিজ্ঞতার কথাই জানাতে চেয়েছি। এবং সেটা সাধ্যমত জানানোর চেষ্টা করেছি। যারা এই উপন্যাসটি আদৌ পড়েননি তারা কিভাবে এই রচনা মারফত প্রকৃত সাহিত্যের স্বাদ পাবেন?  সাহিত্যের ঝাঁজ কান নয়, মন দিয়ে গ্রহণ করতে হয়।
    না বলার আরও একটি কারণ হলো, অধিকাংশ পাঠকই প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সিলেবাসের বাইরে কিছু পড়তে আগ্রহী নন। খবরের কাগজের পাতায় ডঃ বাবুরা যা প্রেসক্রাইব করেন, ওরা সেটাই পড়েন। এর বাইরে গিয়ে অহেতুক ঝুঁকি নিয়ে সময়-অর্থের অপচয় ঘটাতে চাননা। যদি বা ওসব প্রেসক্রাইবড বই ভালো না লাগে তবু ঠোঁট ফাঁক করেন না। পাছে লোকে নন এলিট রিডার ভাবে! তাদের কেউ যদি ভুল করেও আমার লেখাটি পড়েন তাহলেও হয়ত মলয়ের লেখাপত্রের প্রতি আগ্রহী হবেন বলে মনে হয় না। তাহলে আর বেগার খাটনি খাটা কেন!
    তবুও যারা মলয়ের লেখাপত্রের সঙ্গে সামান্য হলেও পরিচিত অথচ এই উপন্যাসটি পড়ে উঠতে পারেননি তাদের জন্য ওরঁ বাক্যরচনা তথা চিত্রকল্প নির্মাণের কিছু কিছু নমুনা পেশ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। কারণ তাছাড়া বোঝা সম্ভব হবে না, প্রথম উপন্যাসেই মলয় রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের চলতি ধারা থেকে হঠকে কিভাবে নিজস্ব ভোকাবলারি আলাদা করে নিয়েছিলেন। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যকে অনেকেই আধুনিকতার  চরম উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন কিন্তু আমার মনে হয়েছে মলয়ের গদ্যশৈলী তারচে ১০০ গুণ আধুনিক। এবং সংখ্যায় স্বল্প হলেও পরবর্তী প্রজন্মের কিছু কিছু গদ্যকারের রচনায়  আমি এই শৈলীর ছায়া দেখেছি। সেসব প্রয়াসকে অক্ষমও বলা যাবে না। এভাবেই তো সাহিত্যের উঠোন ক্রম বিস্তারিত হয়।
    তো আসুন নমুনা পেশের ময়দানে। উপন্যাসটি শুরু হচ্ছে এভাবে--“ লাশগুলোকে নামানো হচ্ছিল হোসপাইপ কেটে থামানো পাটনা-মুখো দরোজা জানলা বাথরুমের পাল্লাহীন গয়া প্যাসেঞ্জারের অন্ধকার লাগেজ ভ্যান থেকে, একের পর এক আদুল গা তামাটে পুরুষের পেশীদার শরীর ঠান্ডা কাঠ, পুণ্যলাভের জন্য পুড়তে যাবে গঙ্গায় আর এই লেভেল ক্রসিং থেকে, যেখানে রাস্তার ধারে ফোলডিং চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে ল্যাম্পপোস্টের তলায় বসে স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রমাণপত্র দিয়ে চলেছে পাটনা কর্পোরেশনের গণসেবক ডাক্তার সুনীলরঞ্জন নাহাবিশ্বাস ওরফে বিসওয়াজজি, শ্মশানঘাট কাছেই বলে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফুলকো মেলার জমজমাট ভিড় আগেভাগে তৈরি, তাদের বাঁশের মাচান, ফুল, শাদা আর গোলাপি থান কাপড়, ঠ্যালা, রিকশা, ট্যাকসি, ধুপ, সিঁদুর, খুচরো টাকা পয়সা, খই বাতাসা, কাতাদড়ি, মাটির কলসি; বিহারী সংস্কৃতির মড়াপোড়ার যা কিছু।”
      প্রথম প্যারাগ্রাফে এহেন নিষ্ঠুর বর্ণনার পরই মলয় লেখেন,“ ঘনসবুজ কচি আমের থুতনিতে হাত দিয়ে আদর করছিল একটা প্রৌঢ় আমপাতা। গাছের প্রায়ান্ধকার গোড়ায়, আধভিজে উইপোকার মেটেরঙা দেউড়ি। মিহিন আবেগপ্রবণ বাতাস বেড়াতে বেরিয়েছে হাত ধরাধরি করে। আকাশে দীঘল ফোলাফোলা মেঘ। অনেক দূরে, ওইদিকে, একাধটা ঠুনকো বিদ্যুতের অদৃশ্য আওয়াজ। এখন রূপসী মর্জির বিকেল। অল্প বয়সী কয়েকটি খেটে খাওয়া কাক চলে গেল দক্ষিণ থেকে উত্তরে। একটু আগে সামনের ছাতিম গাছে যে চড়াই পাখিগুলো স্থূল রঙ্গরসিকতায় মশগুল রেখেছিল নিজেদের, তারাও এখন চুপচাপ। রাস্তার ওপারে ধনী আর উদার কাঁঠালগাছ। রোদ্দুর বোধহয় গাছের ছায়া মাড়ায় না এ অঞ্চলে। চারদিকের এমন অতীন্দ্রিয় জগতের আভাস পেয়ে ছোটছোট গোলগোল নুড়ির দল উদাসীন শুয়ে আছে কালভার্টের তলাকার ছিপছিপে নালার কিনার বরাবর।”
          
    বাতিল নোটের অজানা জগত বিষয়ে মলয় জানকারি দেন এভাবে, “ কতো রকমের নোট যোগাড় করে আনে দালাল নোটবদলকারীরা! এতো সূক্ষ্ম জোড়াতালি, সাদা চোখে টের পাওয়া যায় না কিচ্ছু। অফিসাররা পরখ করার জন্যে, টেবিলের এনামেল গামলার জলে ছাড়লে, কিছুক্ষণে আলাদা হয়ে ছিতরে যায় তাপ্পি দেয়া জোড়াতালি নোট। হয়তো দুকোণের সংখ্যাগুলো আলাদা, আদ্দেক আসলের সঙ্গে জোড়া আদ্দেক নকল, কিংবা কুড়ি টাকায় দু টাকার তাপ্পি, পাঁচশো টাকায় পাঁচ টাকা, সাতটা একশো টাকার নানান টুকরো জুড়ে একটা আস্ত। নোট যত পচা, যতো বেশী নষ্ট, আবদার ততো বেশি, অনুমোদনের নিয়ম ততো খুঁতখুঁতে, পাশ করার অফিসারের পাদানি ততো উঁচু। জুড়ে জুড়ে কাঠ হয়ে গেছে যেসব নোটের প্যাকেট বান্ডিল, গায়ে গা মিলিয়ে আলাদা হতে চায় না, উইচাটা থিকথিকে, গ্রামীন আটচলায় ছিল সোঁদা দেয়ালবন্দী, খামারবাড়ির মাটির অযাচিত গভীরে কলসিবন্ধ, গাছতলায় পোঁতা গুমোট কাঠের বাক্সে, আত্মহত্যাকারিণীর সঙ্গে জ্বলে খাক বা আধসেঁকা ঝুরঝুরে, চেহারা পাল্টে কাগজ না নোট বোঝার উপায় নেই।”
    এতো গেল নোটের বিবরণ, নোট গুনিয়েদের দশাটা কিরকম?
    “ পুরানো হিলহিলে নোটের স্যাঁতসেঁতে গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলোয় অতনুর অ্যালার্জি হয়েছিল চাকরিতে ঢুকেই। জ্বর, নাকের জলে রুমাল ভিজে ধুতির খুট ভিজে সহ্যশক্তি না গজানো অব্দি অ্যানালজেসিক আর অ্যালার্জির বড়ি খেয়ে অর্ধ নিমীলিত, ক্যানটিনের বেঞ্চে বা ডিসপেনসারির স্ট্রেচারগাড়িতে। বড়ো খাজাঞ্চি বলেছিলেন এ চাকরির অনেক হ্যাপা কিন্তু সয়ে যাবে, এরপর যদি আস্তাকুঁড়ে শোও তাহলেও অসুখে পড়বে না।
    ওদের সংস্থায় প্রত্যেক বছর একজন পাগল হয়। গেলবার দুবেজি হয়েছিল, তার আগের বছর এম কে ঝা পাগল হয়ে আর ফেরেনি। আসছে বারে কার পালা কে জানে।”
    ব্যস, এনাফ। আর একটি উদ্ধৃতিও আমি দেব না। নাহলে পাঠককে প্রভাবিত করার দোষে অপরাধী হওয়ার পুরো সম্ভাবনা থাকবে। না,তেমন কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই। গোটা রচনাটি মারফত আমি শুধু বোঝাতে চেয়েছি, এই উপন্যাসটি আজও আমাকে কতটা প্রভাবিত করে রেখেছে। জানাতে চেয়েছি চুটকির ইশারায় ডেকে এনে মলয় রায়চৌধুরী কিভাবে আমাকে আচমকা ডুবজলে ঠেলে দিয়েছিলেন। স্বস্তি এটুকুই যে এই জলের অপর নাম জীবনও। এর গভীর অতলে আমি পেয়েছি জীবনের সার সত্য।
    একদা মলয় আমাকে লিখেছিলেন,“ আমি মলয়, মলয় রায়চৌধুরী।আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করিনা, প্রতিষ্ঠানই আমার বিরোধিতা করে। কারণ আমিই প্রতিষ্ঠান।”
    কথাগুলোকে সেদিন মলয়ের হামবাগপণার নমুনা মনে হলেও আজ আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে মলয় রায়চৌধুরী সত্যিই এক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান ওঁর বিরোধিতা করে কারণ মলয় স্থির কোনো অচলায়াতন নন। ভাষাকে পিতা এবং সন্তান গন্য করে প্রতি মুহুর্ত্বে তাকে শ্রদ্ধা এবং লালন পালন করে চলেছেন। আজকের লেখকের সামনে এক নয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, সম্ভব হলে আমাকে অতিক্রম করে দেখাও, হে মুন্সীরা!
    বাংলাভাষা তথা সাহিত্য নিয়ে যে যতই হতাশ হোক না কেন আমি নিশ্চিত পরবর্তি প্রজন্ম এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেই। কিন্তু কবে, তা জানিনা। কেননা ওই যে মলয়, মলয় রায়চৌধুরী, আজও ছুটে চলেছেন। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে বলছেন, ছুঁয়ে দেখাও। পরক্ষণেই স্যাঁৎ।   
                                                                          
  • জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায় | 223.229.178.225 | ০৮ অক্টোবর ২০২২ ১৮:৪২738569
  • জ্যোতির্ময় মুখার্জি : মলয় রায়চৌধুরীর 'জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা'
    আমার ছোটবেলা কেটেছে রূপকথার দেশেই। ব‍্যাঙ্গমা-ব‍্যাঙ্গমি, সুয়োরানি-দুয়োরানি, ব‍্যাং-রাজা ইত‍্যাদির  খোঁজে প্রায়ই পাড়ি দিতাম কল্পনার সাতসমুদ্র তেরোনদীর পারে, আমার প্রিয় পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে। তখন তো মোবাইল ছিল না বা ভিডিও গেম, কার্টুন চ‍্যানেল। টিভি ছিল বটে, কিন্তু বয়স্কদের মতে টিভি দেখলে যেহেতু ছোটদের চোখ পচে যায় তাই টিভির সাথে বন্ধুত্ব হয়নি কোনদিন। হলেও খুব একটা লাভ হতো বলে মনে হয় না, সেই তো গুরুগম্ভীর ডি.ডি। তাই ছোটবেলায় আনন্দ বলতে চুটিয়ে খেলা খেলা আর খেলা। মাটি মেখে ধুলো মেখে জলে ভিজে কাদা মেখে গাছে চড়ে পুকুরে সাঁতরেই কেটে গেছে আমার ছেলেবেলা। এসব রিয়ালিটির মাঝেই কল্পনার ফানুস উড়িয়ে দিতাম চাঁদমামা, শুকতারা, কিশোরভারতী, ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদার ঝুলি, আবোল তাবোল, ছোটদের রামায়ণ, মহাভারত  ইত্যাদিতে। রূপকথার গল্প সমন্ধে তাই আমার একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল বা আছে। মলয় রায়চৌধুরী যখন বললেন, ‘তুমি আমার একটা গল্প আলোচনা করো ।’’ তখন আমি ভয় পেয়ে গেলেও বিশ্বাস ছিল যে কিছু একটা লিখতে পারব। কিন্তু সেই সমস্যা যে কতবড় পদক্ষেপ ছিল, তা বুঝতে পারলাম ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’ গল্পটি পড়তে গিয়েই , মলয় রায়চৌধুরীর ‘গল্পসংগ্রহ’তে অন্তর্ভুক্ত একটি কাহিনি । আত্মপ্রশ্নে ক্রমাগত আক্রমণ সয়ে যাবার পর ভাবলাম, জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা নামের কাহিনির বুনন ও বাঙালি ‘পলিটি’ সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরীর ভাবনাচিন্তা নিয়েই লিখি ।
    গল্পের নাম, জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা। প্রকৃত প্রস্তাবে রূপকথা এটি রূপকথা নয়, অরূপকথা, বাস্তবতা থেকে ছেঁকে নেয়া অতিবাস্তব রূপকথা । লেখা হয়েছে, ২০০৬-এ। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ বইটির ১০০ বছর পূর্তিতে।
    কাহিনির প্রধান চরিত্র এক যুবক শকুন, যার নাম শিলাদ, সে শকুন পরিবারের শেষ সদস্য । কিন্তু সেই অর্থে শিলাদ কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়। শিলাদের ক্রম পরিবর্তনশীল কায়া, আকার, রূপ, জীবন ও যাপনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে গল্পস্রোত এবং পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গের জীবনযাপনকে । অবশ্য  শিলাদের সঙ্গে সঙ্গে এগোয়নি গল্প, ও গল্পটি ওপন এনডেড । পোস্টমডার্ন বলা হবে নাকি হাইপাররিয়াল ? কনফিউজড্‌? দেখা যাক ।
    আসুন, এবার তবে ঢোকা যাক গল্পের মধ্যে। গল্পের মূল কাহিনীটা ঠিক এইরকম, শিলাদ নামক একটা শকুন যে তার দাদুর সঙ্গে গভীর আকাশে উড়ছিল, দাদুর সান্নিধ্য থেকে হারিয়ে গিয়ে,  গল্পের ধাপে-ধাপে সে অন্যান্য প্রাণিতে পরিবর্তিত হয়েছে । প্রথমে পেঁচা তারপর টিকটিকি (গিরিগিটি) তারপর মাছ তারপর বাঘ এবং শিকারীর গুলিতে সুন্দরবনের নদীতে সমুদ্রের দিকে ভেসে গেছে সে ; তার চামড়া ছাড়ানো দেহের ওপরে বসে তার দাদু তার নাম ধরে ডাকলেও সে শুনতে পাচ্ছে না । শিলাদের এই প্রতিটি রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে কাহিনী। শিলাদের চোখ দিয়ে দেখছি পৃথিবী আর কান দিয়ে শুনে নিচ্ছি পৃথিবীর অরূপকথন। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ, জঙ্গল, ভূগর্ভ থেকে, দিনে ও রাতেও। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছেন গল্পকার,  শিলাদের অস্তিত্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে । মুভি ক‍্যামেরা নিয়ে পশ্চিমবাংলার রূপান্তরিত ঘটনাবলীর পেছু নেবার মতো । এখানে ক‍্যামেরা হল শিলাদ আর জীববিজ্ঞানী ক‍্যামেরাম‍্যান? মলয় রায়চৌধুরী।
    গল্পের কাহিনী এগিয়েছে ক‍্যামেরাম‍্যানের সাথে সাথে উত্তরাধুনিক ক‍্যামেরার পরিবর্তিত অবস্থান ও লেন্সে। গল্পটি পড়তে পড়তে তাই আমরা যা পড়ছি, মানে গল্পের মূলটেক্সট,  তার বাইরেও রয়েছে আরো একাধিক সাবটেক্সট। যা বলা হচ্ছে না, বা যা লেখা নেই। পাঠককে সবই একসঙ্গে বিশ্লেষণ করতে-করতে এগোতে হবে, সমান্তরাল ভাবে। গল্পের মধ্যে ছাড়া আছে সেই পরিসরগুলো, যার মধ্যে দিয়ে পাঠক অনায়াসে ঢুকে জেনে নিতে পারেন না-লেখা সাবটেক্সটগুলো । গদ‍্যের নির্মাণ করা হয়েছে এমনভাবে যাতে পাঠক প্রতিমুহূর্তে পরিসর খুঁজে পায় গল্প থেকে গল্পের বাইরের ইশারাগুলো বুঝে  নেওয়ার। পাঠককে গল্পটি পড়ার সময়ে এগোতে হবে একাধিক দিক থেকে, একইসাথে, মস্তিষ্কের রসায়নে। মলয় রায়চৌধুরীর রচনামাত্রেই সিরিয়াস অনুধাবন দাবি করে ।
    মুসলমান শাসকরা বঙ্গদেশকে বলতেন জিন্নত-উল-বিলাদ। অর্থাৎ মর্ত্যের স্বর্গ। কিন্তু গল্পের প্রেক্ষাপট অখণ্ড বাংলা নয়, মূলত পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে। উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনৈতিক, প্রসাশনিক, শিক্ষাব‍্যবস্থা ইত‍্যাদির কঙ্কালটা চোখের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়াই মলয়ের ঝুলির এই  আড়ালে অরূপকথনের লক্ষ্য।
    ‘যাতুধান তরফদার…. এই দেশের এক অতি বৃদ্ধ শকুন, এককালের বিশাল পরিবারের অভিজ্ঞ কুলপতি, যার পরিবারে যুবক নাতি শিলাদ ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই।’…….উত্তর-ঔপনিবেশিক  পশ্চিমবাংলায় ক্রমশ ভেঙে পড়ছে একান্নবর্তী পরিবারগুলো । টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে পরিবারগুলোর গঠন ও সামাজিক দায়দায়িত্ব এবং মূল‍্যবোধ। যৌথ-পরিবারের শেষ উত্তরাধিকারী মলয় রায়চৌধুরীর কি দীর্ঘশ্বাস পড়েছে যাতুধান তরফদারের বুকের বিদার থেকে ? তাঁর ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ কি প্রতিফলিত এই অরূপকথনে ? জানি না। কিন্তু প্রাক-ঔপনিবেশিক সাবটেরানিয়ান এথনিক বাঙালিয়ানা যে আর সম্ভব নয় সেটা মলয় রায়চৌধুরীর’ বিভিন্ন প্রবন্ধে আমরা পড়েছি । খোপ-বাড়ির খোপে খোপে বাস করা বাঙালির চিন্তা জগতেও যে দৈন্যতা প্রকট হয়ে উঠেছে এই ব‍্যাপারেও মলয় রায়চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধগুলোতে বিশ্লেষণ করেছেন, বিশেষ করে তাঁর ‘উত্তরদার্শনিকতা’ প্রবন্ধে।
    বহুত্বের পাঁচমেশালি পঞ্চরত্ন বা লাবড়া নয়, বাঙালি তৃপ্ত আজ আলুভাতে ডালভাত আর পোস্তগোলাতেই। একান্নবর্তী পরিবারের  বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে যে বহুমাত্রিক সম্পর্ক ও তার টানাপোড়েন, বিতর্ক-বিবাদের পর’ও একসাথে, একই ছাদের নিচে, বাস করার যে সহনশীলতার শিক্ষা,  তা থেকে বাঙালি আজ বঞ্চিত। বঞ্চিত নিজেকে বহুধায় বিভক্ত করতে, যার প্রভাব পড়ে জনজীবনে, সমাজে, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে, চিন্তায় ভাবনায়, লেখালেখি শিল্পজগতে। মলয় রায়চৌধুরী,  স্বীকার করেন যে, লেখালেখি ঘরের দরজা জানলা এঁটে সাধনা নয়। মানুষ ও সমাজবর্জিত হয়ে চিন্তাজগতে ঢেউ তোলা নয়। তাতে সাহিত্য খন্ডিত বা একপেশে হয়ে পড়ে, তাতে আর যা হোক সমাজের আসল চিত্রটি প্রতিফলিত হয় না। লেখক-শিল্পী যত মানুষের সাথে মিশবেন, যত সমাজের আনাচে কানাচে পৌঁছাবেন তত পুষ্ট হবে তার অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার ইরিটেশনেই নির্মিত হবে সাহিত্য, শিল্প।
    মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে উৎপলকুমার বসু লিখেছেন যে, ‘বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি  একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণকারী প্রবণতা লক্ষ করি । কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন — “লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে ।” বলা বাহুল্য, তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি । তিনি বলেছেন, “পলিটি”-র কথা । আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব — মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন ।’
    ‘জিন্নতুলবিলাদ’ সম্পর্কিত কাহিনি জুড়েই লেখকের এই অভিজ্ঞতা বা শিলাদের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক মননের জার্নিটা স্পষ্ট। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ, দিন-রাত, জঙ্গল-নদী, আন্ডার গ্রাউন্ড-মাল্টিপ্লেক্স, বেশ‍্যাপল্লী-ক্লাসরুম  ইত্যাদি সময় পরিবেশ ও অবস্থানের যে বর্ণনা আমরা পাই এবং তার সাথে সাথে যেভাবে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের প্রকৃতি তা যে মোটেই ভাববিলাসে লিখিত নয়, এইটুকু স্পষ্ট বুঝে নেওয়া যায়। ঘটনা, পরিবেশ ও চরিত্রের এই নিঁখুত নির্মাণ বা শার্পনেস্ স্পষ্ট করে দেয় যে এ সবই লেখকের অভিজ্ঞতালব্ধ। আমরা জানি যে গ্রামোন্নয়ন অফিসারের চাকুরিতে তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার, গ্রামে-গঞ্জে চাষি, তাঁতি, জেলে, ছুতোর, খেতমজুর ইত্যাদি মানুষের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখেছেন
    লেখার সততা রক্ষার জন্য কলমকে অবশ্যই হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে হবে সমাজের কোণে কোণে। শুধু আলোলাগা পথে পথে নয়, ছায়ামায়া গলিতে গলিতে নয় এমনকি কালোআলো সুড়ঙ্গেও। সমাজের প্রতিটি অন্ধকার, নগ্ন, পুঁজমাখা ক্ষতকেও লেখার মধ্যে ধরতে পারলেই লেখাটি তার সততা রক্ষা করবে। তুলে ধরতে পারবে সমাজের প্রকৃত ছবি। তাহলেই পাঠক অনায়াসে নিজস্ব দৃষ্টিপ্রতিভা ও মন দিয়ে পড়ে নিতে পারে সমাজের প্রকৃত চিত্রটিকে। লেখকের কাজই হলো লেখার এই সততা রক্ষা করা এবং সেই লক্ষ্যের পথে যাবতীয় বাধা ও ঠিক-ভুলের দ্বন্দ্ব, ন‍্যায় অন‍্যায়ের যাবতীয় বেড়াগুলোকে ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যাওয়া। লেখার জায়গায় লেখকই নির্মাণকর্তা। আর ঈশ্বর যখন, তখন বিরাজ করবেন সর্বভূতে।
    গল্পকার উত্তরঔপনিবেশিক বাঙালির বাস্তবজীবনকে অনবরত স্ক‍্যানিং করে গেছেন। পাঠবস্তু নির্মাণে তাই কোনো বাছবিচার নেই। নেই নেকুপুসু মার্কা শ্লীল-অশ্লীলের দ্বন্দ্ব। গল্পের সাবজেক্ট পজিশনেও তাই বহুত্বের যথেচ্ছাচার স্পষ্ট। গল্পের হাঁ-মুখে সেঁধিয়ে গেছে বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, সন্ত্রাসবাদ, যৌনতা ইত্যাদি । অনায়াসে সবকিছুকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে পাঠবস্তুটি। কখনো পাশাপাশি আবার কখনও বা একটার সাথে আর একটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে অবস্থান করছে। পাঠককে যে সবসময় পাকগুলো খুলে খুলে পড়তে হবে এমনও নয়। পাঠবস্তুটি সবকিছু গলাধঃকরণ করে নিজেই একটা আলাদা সাবজেক্ট-বহুত্ব গড়ে তুলেছে। সবজিগুলো তাই তাদের একই খেতে উৎপাদিত  হয়েই খুশি। অথচ কনট্রাস্টটি হলো পাঠবস্তুটি যখন বহুধায় বিভক্ত তখন শিলাদকে সামনে রেখে গল্পকার মলয় রায়চৌধুরী নির্মাণ করে গেছেন ব‍্যক্তির নিজস্বতা বা ইউনিকনেস। একদিকে গল্পের কৌম-পরিসর বাড়িয়েছেন, খুলে দিয়েছেন পাঠবস্তুকে। অপরদিকে ব‍্যক্তিকে একক হিসাবে ধরে ব‍্যক্তির ভালোলাগা, মন্দলাগা, সাদা কালো ধলো দিয়ে নির্মাণ করেছেন ব‍্যক্তির নিজস্বতা। সামাজিক জীব হয়েও ব‍্যক্তি এককের নিজস্বতা বা ইউনিকনেস নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন পুরো অরূপকথন জুড়ে।
    ‘আমি সত্যিই কনফিউজড, ঘুমন্ত ঘুমে ঘুমিয়ে থাকা শিলাদ ঘুমের মধ্যে নিজেকে দিয়ে বলালো।’ মানুষ সামাজিক জীব হলেও যে সে আদতে আলাদা বা ইউনিক, প্রতিটি মানুষেরই যে কৌম এবং নিজস্ব আইডেন্টিটি থাকা উচিত, সে যে ভিড়ের মাছ নয় বা পালের ভেড়া নয়, সে যে চিন্তা করার ক্ষমতাসম্পন্ন  মানুষ এটাই বারবার হাইলাইট করেছেন শিলাদের চরিত্র নির্মাণে। আবার নির্মাণের সাথে সাথে তিনি ভেঙে ফেলেছেন নির্মিত চরিত্রের ইঁট-বালি-রড-পাথর। ব‍্যাক্তি এককের আইডেন্টিটি বা ইউনিকনেস নির্মাণ ও বিনির্মাণের খেলা চলেছে পুরো অরূপকথন জুড়ে। ‘রাতের জীবন চেয়ে শেষে কি এই ঘন অন্ধকার জুটল?’ ক্রিয়েট করেছেন আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। বারবার। বারবার শিলাদ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেকে নিয়ে, নিজের পরিচয় নিয়ে, আত্মজিজ্ঞাসায় আক্রান্ত হয় । ‘জীবনের মানে খুঁজতে চাই। নিজেকে ডিফাইন করতে চাই।’….’আমি একটা পারপাস চাই, অতিরঞ্জন চাই, কর্মব্যস্ততা চাই।’ আবার ঠিক পরক্ষণেই ‘কেয়ার ফ্রি লাইফ চাই আমি, কাঁধের ওপর উদ্দেশ্যপূর্তির নোংরা বস্তা যাতে না বইতে হয়। আই ওয়ান্ট টু জাস্ট ফ্রিক আউট, জাস্ট চিল, হ্যাভ ফান।’ পাঠককে খুব সচেতন ভাবে খেয়াল রাখতে হবে এই ভাঙা-গড়ার খেলাটি। ‘আমি তো অন্যরকম জীবন চেয়েছিলুম’ ; কীভাবে সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতি, সুযোগ, লোভের তালে তালে মানুষ পাল্টে ফেলে তার রং। ‘স্বপ্নভঙ্গ বলে কিছু হয় না, অবস্থা বুঝে নিজেকে বদলাতে হয়। তার ফলে জীবনের উদ্দেশ্য আপনা থেকেই পাল্টি খায়।’
    ‘এসে পড়েছে যখন-তখন সঙ্গমের অবরোহী ঋতু, শকুন যুবতীর খোঁজে বহু ব্যর্থ ওড়াউড়ির শেষে, সাতসকালে, একজন বয়স্কা ভূবনচিল যখন বটগাছের ন্যাড়া ডালে বসে তৃপ্তি করে মুর্গিছানার হৃৎপিন্ড চোষায় মগ্ন, শিলাদ তার অন্যমনস্ক পিঠে আলতো করে নেমে, ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল। অসবর্ণ সঙ্গমের হবোহবো মুহূর্তে, ওই চিলগৃহিণীর পরিবারের লোকজন শিলাদকে ঘিরে ফেলে হৈ-চৈ বাধাতে, প্যাঁদানির ভয়ে মেঘের এগলি-সেগলি হয়ে ও পালায়, চিলেদের অনধিগম্য আকাশে, যেখানে ওকে হাঁপাতে দেখে, জেরা করে সবকিছু জানার পর, যাতুধান ওকে বুড়ি শঙ্খচিল, খুকি উটপাখি আর সোমত্ত টার্কিদের নামঠিকানা বাতলায়, যাদের ওপর আচমকা বসে তাড়াতাড়ি পায়ুসঙ্গম বা ধর্ষণ সেরে কেটে পড়া যায়, যদিও তাতে মন ভরবে না, উল্টে আনচান বেড়ে অসুখ করবে। বাট দেন, দ্যাট ইজ লাইফ।’.….যৌনতা এবং জাতিপ্রথার দ্বন্দ্ব এসেছে এভাবেই, স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। জীবনের অংশ হিসেবে নয়, সমাজের সদস্যদের জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য ক্রিয়া হিসাবে। ইয়েস্ দ‍্যাট্ ইজ লাইফ। মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় অবশ্য এটাই স্বাভাবিক।
    সনাতন ভারতবর্ষে যৌনতা নিয়ে এখনকার মতো ভিকটোরিয় বাছবিচার ছিল না, বরঞ্চ যৌনতা ছিল জীবন-শিল্প-সাহিত্যের স্বাভাবিক শর্ত। দেখা হতো লেখাটি নবরসকে মান্যতা দিয়েছে কিনা। আর শৃঙ্গার তো নিজেই আদিরস। যৌনতা ব‍্যভিচার নয়, সনাতন ভারতবর্ষে যৌনতা আবশ্যিক যাপন। ক্রমশ ইসলামি শাসন তারপর খ্রিস্টধর্মি যাযকদের চাপানো মূল‍্যবোধে মাথা গেঁজিয়ে এবং দেখনদারি হিন্দুয়ানার দাপটে ভারতবর্ষের এই স্বাভাবিক ব‍্যাপারটাই অস্বাভাবিক বা অশ্লীল হয়ে পড়েছে। মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় আমরা সনাতন ভারতবর্ষের সেই স্বাভাবিক যৌনতাকে রিগেন করতে দেখি স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় যৌনতা আরোপিত নয় বা লেখায় মশলা মেশাবার উদ্দেশ্যেও নয়। 
    হাগা-মোতা-খাওয়া-শোওয়ার মতোই যৌনতা এসেছে দৈনন্দিন যাপনে। আবার ওনার লেখায় যৌনসংসর্গের অভাবহেতু যেমন যৌনতার হাহাকার দেখি তেমনি দেখতে পাই ক্রমাগত সেক্স করতে করতে মেন্টাল ফ‍্যাটিগনেস। ‘আমার এই জীবন এমনই সুখী যে ভীষণ রিপিটিটিভ হয়ে গেছে, প্লিজ ডু সামথিং, একদম ভাল্লাগছে না। এরকম খাও-দাও-সঙ্গম করো জীবনের মানে হয় না’ যৌনক্রিয়া বা সেক্সকে তিনি বিভিন্ন ডাইমেনশনে ধরেছেন। সেক্সকেই একটা নিজস্ব চরিত্র করে তুলেছেন, যা প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনে, স্বভাবে ও অভাবে ক্রমাগত বদলে বদলে ফেলে তার আদল। শকুন-শিলাদ যখন যৌনসঙ্গী এবং জীবনসঙ্গীর অভাবে ইভটিজিং ও ধর্ষণে উদ‍্যত তখন মাছ-শিলাদের সে সাহস নেই। সে দূর থেকেই দৃশ‍্যসুখে ও কল্পনায় পরিতৃপ্ত হতে বাধ্য। কিন্তু আপনা হাত জগন্নাথ নয়। ‘যারা পাত্তা পায় না তারা মাছকুমারীটাকে লক্ষ্য করে ফিচিক-ফিচিক বীর্য ছোঁড়ে। শিলাদের অনেকটা জমে ভাঁড়ার থইথই টসটস রসরস, কিন্তু ছুঁড়ে অপচয়ের মানে হয় না বলে যোগ্য-অযোগ্য যে-কাউকে খুঁজে বেড়িয়েও জোটাতে পারেনি।’…..স্বমেহনকে মলয় রায়চৌধুরী একবারো যৌনক্রিয়ার মধ্যে ফেলেননি। এটা আমার বেশ আবাকই লেগেছে, বরঞ্চ মাছ-শিলাদ খোঁজ করছে সমকামী সঙ্গীর। ‘মাছসমাজে সমকামের গোপন গোষ্ঠীটার সাকিন-ঠিকুজি জানলে কিছুটা অন্তত দুঃখামৃত বেরিয়ে যেত।’
    শকুন শিলাদের মধ্যে আবার দেখতে পাই খাদ‍্যযোগ‍্য পাখিদের খাদ্য হিসাবে নয়,  যৌনক্রিয়ার খেলনা হিসাবে ভাবছে। ‘সবরকম রঙের প্রাণী খেলে স্বাস্থ‍্য নাকি ভাল থাকে। অথচ শিলাদের ইচ্ছে করে রোজ একটা রঙ বেছে নিয়ে সেই রঙের পাখির পিঠে বসে, মাথার চাঁদিতে চঞ্চু টিপে ধরে, দুপাশে ডানা নামিয়ে ইয়ে করে।’ অর্থাৎ তারমধ্যে নারীদের সেক্স এলিমেন্ট হিসাবে দেখার প্রবণতা প্রবল। শুধু অভাবে নয়, স্বভাবেও সে ইভটিজার ও ধর্ষণকারী। কখনো বাস্তবে আবার কখনোবা কল্পনায়। বাসে ট্রেনে রাস্তা ঘাটে শকুন-শিলাদদের যে অভাব নেই সে তো স্পষ্ট আর ধর্ষণের বিরামহীন ঘটনায় শকুন-শিলাদরা যে শুধুই যৌনসঙ্গীর অভাবে ধর্ষণ করে এমন নয়, মানসিক চরিত্রের অভিঘাতেই একজন মানুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে, ‘এসে পড়ে যখন তখন সঙ্গমের অবরোহী ঋতু’। অপরদিকে প‍্যাঁচা-শিলাদের সুখী ও পরিপূর্ণ সেক্স লাইফ। খাও-হাগো-শোও আর সেক্স করো, শোও-হাগো-খাও আর সেক্স করো। সুন্দরী ও তৃপ্তিযোগ্য সেক্স পার্টনার, সেক্সকে আকর্ষণীয়, নিত্য-নতুন রঙিন করে তোলার জন্য বিছানার ডেকরেশনে অনবরত পরিবর্তন, তবুও প‍্যাঁচা-শিলাদ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, কাজ নেই, কর্মব্যস্ততা নেই, শুধু সেক্স সেক্স আর সেক্স,  একটা প্রাণীকে ক্লান্ত করে তোলার জন্য যথেষ্ট।
    ‘শিলাদ বুঝতে পারছিল যে খারাপ লাগার ক্রিয়াটা রয়েছে ওর নিজের প্যাঁচা-মস্তিষ্কে, ঘাপটি মেরে, তাতে ফর্সা-তামাটে-কালোর কিছু করার নেই, চব্বিশ ঘন্টা অহরহ সঙ্গম করেও তা যাচ্ছে না, নানা সুরের মিউজিকাল কন্ডোম পরা সত্বেও।’ সেক্সের জন্য লাইফ নয়, লাইফের জন্য সেক্স। যৌনতাকে আলোকিত করার জন্য লেখা নয়, লেখার প্রয়োজনেই যৌনতা আসবে স্বাভাবিক ভাবে, মলয় রায়চৌধুরীর এই বার্তা স্পষ্ট বুঝে নেওয়া যায় এই অরূপকথন থেকে। আবার গিরিগিটিরূপী শিলাদের সেক্স লাইফ দ্রুত, ঝটিতি, স‍্যাটাস‍্যাট মাল খসিয়ে খালাস। ‘ওরফে গরম-গরম উত্তেজিত স্বরে বলল, কী রে রঙ্গিলা স্পাই, টিপতে এসছিস মাই, নে, কত টিপবি; বি কুইক অ্যান্ড ফাস্ট।’ যুবতীটির নাম ‘ওরফে’ ; যৌনকর্মীরা যেমন প্রতি সন্ধ্যায় নাম পালটে নতিন নাম রাখেন. সেই সতত নাম পরিবর্তনকে ‘ওরফে’ শব্দের সাহায্যে আক্রমণ করেছেন মলয় । আমরা দেখেছি,  পার্কে, হোটেলে, ঝোঁপে ঝাঁড়ে রকেটসেক্স ঘটতে ? তাও তো রকেটসেক্সের পিছনে কারণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সেক্স এন্ড ওনলি সেক্স। কিন্তু বাঘ-শিলাদের সেক্স লাইফ আবার শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য। কোনো উপভোগ্য যৌনক্রিয় নয়, জাস্ট প্রয়োজনের তাগিদে ঝটতি সেক্স। গড় বাঙালির সেক্স লাইফ তো আদতে তাই-ই। আমাদের সমাজ ও ধর্মের জ‍্যেঠামশাইরাও ভাবেন ঠিক এমনই। যৌনতা সন্তান উৎপাদনের তরে, পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা, আর নারী সেই সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। বাঘ-শিলাদের সেক্স এক্সপেরিয়েন্স বর্ণানায় সন্তান উৎপাদনের প্রয়োজনে আসা সেক্স পার্টনারের মুখ দিয়ে বারবার ‘হালুম’ শব্দের প্রয়োগ কি এই সেক্স নিয়ে অচলায়তন ধারণাকে টিটকারি মারা? ব‍্যঙ্গ করা? হয়তো তাই ।
    কাহিনির বাকি অংশের সাথে ‘হালুমের’ রিপিটেশন খাপ খায় না। এই অংশটি পড়তে বেশ বিরক্তি লাগে, দুর্বল লাগে গল্পের বুনোটে। ‘ল্যাজের অবগুন্ঠন সরিয়ে আগে আমার স্ত্রীযন্ত্রের অগরু শোঁকো মুখপোড়া, হালুম, তবে তো বুঝবে, হালুম, আমি অনঘ-নিরঞ্জন হিটে আছি কি না, হালুম, নাক দিয়ে হৃদয়ে সৌরভবার্তা গেলেই, হালুম, দেখবে বাদবাকি কাজ আপনা-আপনি ঘটে যাচ্ছে, হালুম।’ হয়তো বিরক্তি সৃষ্টি করাই এই দুর্বল বুননের উদ্দেশ্য। পাঠকের লিঙ্গ দাঁড়াবে না বা সেক্স ফিল হবার সুযোগটুকুও দিতে চান না গল্পকার। বাঘ-শিলাদের সেক্স এক্সপেরিয়েন্স বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি করে ফেলেছেন ঘর ঘরকা সেক্স এক্সপেরিয়েন্স বর্ণনা। ‘ভারজিন যুবকের বীজ নিলুম, হালুম, আনন্দ নিলুম, হালুম, চললুম, হালুম।’ আর সেক্স পরবর্তী মানসিক অবস্থার সাথেও বেশ পরিচিত বেশিরভাগ বাঙালিরা বিশেষ করে বাঙালি বধূরা। শুধু তাই নয় সমাজে অসম বয়স্ক যৌনক্রিয়ার চাহিদাকেও তিনি দেখিয়েছেন অনায়াসে, ‘হ্যাঁ, আজকাল তো বয়স্কা বাঘিনীরা টয়বয় খোঁজে।’
    যৌনতা নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর এই দ্বিধাহীন স্পষ্ট ও বহুরৈখিক ভাবনার পরিচয় পাই হাংরি আন্দোলনের সময় থেকেই। তার বিখ্যাত কবিতা ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত যৌনচেতনা। এই কবিতাটির উপর অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল। যদিও আমার মনে হয় প্রশাসনের কাছে এই অশ্লীলতার অভিযোগটি করার উদ্দেশ্য ছিল যেনতেন প্রকারেণ একটা অভিযোগ খাড়া করা। কোমরে দড়ি বেঁধে ঘোরানোর মানসে করা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ধোপে টিকবে না দেখে, এবং সেই অভিযোগটা আদালতে এনে ফেললে নিজেদেরই নিম্নদেশ বস্ত্রহীন হবে দেখে, অশ্লীলতার অভিযোগটিকেই ভেসে যাওয়া খড়খুটো হিসাবে ধরা। যদিও এই অভিযোগটিতে মলয় রায়চৌধুরীর লাভ হয়েছিল প্রচুর, ও ক্ষতিও। মামলা চলাকালীন সময়ে মলয় রায়চৌধুরীর নিঃসঙ্গে, কপর্দকহীন, অসহায় ও অসহ্য জীবনের কথা মাথায় রেখেও বলব এই অভিযোগ রাতারাতি মলয় রায়চৌধুরীকে হেডলাইন বানিয়ে ফেলেছিল। দেশে ও বিদেশেও।
    এই একটি কবিতা মলয় রায়চৌধুরীকে খ‍্যাতির চূড়ায় টেনে তুলেছে, তাঁকে মিথ বানিয়ে তুলেছে। এই ব‍্যপারটা আমরা সবাই জানি, নতুন করে আর কিছু বলার নেই। হাংরি আন্দোলন ও ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নিয়েও কোনো একদিন আমার মতামত লিখব কোথাও। দীর্ঘ প্রস্তুতি ও চিন্তা ভাবনা সত্ত্বেও কীভাবে একটা ছোট্ট ভুল এক আলোকবর্ষ দূরত্বের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল বলব সেটাও কোনো একদিন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে গ্রেপ্তারি ও কবিতাকেন্দ্রিক মামলা,  এই ঘটনাটি মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষতিও করেছে প্রচুর এবং করে চলেছে আজও । ব‍্যক্তি মলয় রায়চৌধুরীর কথা অনুমান করতে পারি, কিন্তু সৃষ্টিশীল মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষতিটা অপরিসীম। মলয় রায়চৌধুরীকে মিথ বানিয়ে আর ওই একটি কবিতাতে মগজ নয় শুধু হাত সেঁকেই মলয় রায়চৌধুরীকে পাঠক-পাঠিকারা স‍্যালুট ঠোকে বারংবার। এই পপসঙ্গে জিন্নতুলবিলাদে একটি চরিত্রের উক্তি প্রসঙ্গিক: ‘আমাকে কেউ শ্রদ্ধাভক্তি করে না, ওরা জাস্ট আমার কংকালটাকে ভয় পায়। কেননা কংকালটা হল আমার রাজনৈতিক জীবনের কিংবদন্তি।’ মলয় রায়চৌধুরীর রচনাগুলোর আগে-আগে ছোটে ওনার কিংবদন্তি । অথচ ওনার লেখা পড়ে যেটুকু বুঝেছি, প্রায় শতাধিক বই আছে ওনার,  উনি বারবার চেয়েছেন বা মনে করেন, লেখক নয়, রচনা-বিশেষের গুরুত্ব থাকা উচিত পাঠকের কাছে। অথচ ওনার ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উল্টোটাই। সাধারণ পাঠক-পাঠিকা  ওনার অন্য লেখা পড়েন না বা পড়তে চান না, ওই একটা কবিতা দিয়েই দূর থেকে মেপে নিতে চান মলয় রায়চৌধুরীকে। অথচ যখন তিনি বারবার বদলে ফেলছেন তাঁর গদ্যের ডিকশন, কবিতার ফর্ম, সিরিয়াস পাঠক ছাড়া  খেয়াল করেন না সেটা।
    ‘সে-সময়ে নিচু জাতের, নিচু জাতের চেয়ে নিচু জাতের, তার চেয়েও নিচু জাতের, অঢেল দাসী বাঁদি চাকরানি ঝি কামিলনি নড়ি আমিনী কিংকরী ভাতুনি প্রেষিনী খানজাদনি পুষতো খানদানি লোকেরা। তারা মরে গেলে তাদের অচ্ছুৎ মড়া না পুঁতে না পুড়িয়ে ভাসিয়ে দিত নদীতে, যার ওপর আরাম করে বসে ভাবতে-ভাবতে হাসতে-হাসতে কাশতে-কাশতে ভাসতে-ভাসতে ঠাকুর্দার বাপ-পিতেমো চলে যেত অনেক-অনেক দূরে। কত ভাগাড় দেখা হতো। কত শ্মশান। কত তান্ত্রিকের যোগাড়যন্তর। স্বাদ বদলাতে একান্নবর্তী শকুনরা এক ভাসন্ত মড়া থেকে উড়ে আরেক ভাসন্ত মড়ায় গিয়ে বসত।’…..দগদগে ঘায়ের মতো জাতিপ্রথা ও ক্রীতদাসপ্রথার ইতিহাস এসেছে এইভাবেই। স্বতঃস্ফূর্ত, গল্পের স্রোতকে  না ভেঙেই।
    একইসাথে ধর্মের নামে নষ্টামিকে তুলে ধরতেও তিনি পিছহাত নন। ধর্মকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপও করেছেন অনায়াসে। অবলীলায় আঘাত করেছেন ধর্মের অচলায়তনে। ‘ওকে পোড়ালে ও হিঁদু হয়ে যেত আর পুঁতে দিলে মোচোরমান, তাই ওকে ওভাবে ফেলে দিয়েছে। ওর মড়া বদ-ভাবনার বাতাসে ভরা, খেলেই তোর বায়ু রোগ হতো। আর উড়তে পারতিস না।’ অবশ্য ধর্মের নামে বিভিন্ন অমানবিক অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি চিরদিনই সোচ্চার। হাংরি আন্দোলনের সময়েও তাই দেখি আলাদা ভাবে ধর্ম নিয়ে ইশতাহার । শিলাদকে তার দাদু বলছে, ‘এই যে শঙ্কর, রামানুজ, বল্লভাচার্য, শ্রীধরস্বামী, নিম্বকাচার্য, মাধবাচার্য, কেবলভক্তি, বলদেব বিদ্যাভূষণ, মধুসূদন সরস্বতী, ওনারা তো তোর-আমার জন্যে ভগবানের কথা ব্যাখ্যা করেননি; করেছেন নিজেদের আর চেলাদের জন্যে।’ এইভাবেই ধর্মের মুলো ঝুলিয়ে চলছে অবিরত ধর্মের গুরুঠাকুরদের ব‍্যবসা। বংশপরম্পরায় বসে খাওয়ার সুবন্দো‍বস্ত। রাজতন্ত্র আর ধর্ম চিরদিনই হাতে হাত মিলিয়ে হেঁটেছে। একজন আর একজনকে পুষ্ট করে ক্ষমতা বাড়িয়েছে দুজনরেই, যাতে নিশ্চিন্তে ভোগবিলাসে দিন কেটে যায় এবং রাত। ‘লর্ড মাত্রেই তাদের পি.এ., পি.এস., স্ত্রী ছেলে মেয়ের জন্যে অনেক কিছু করে, যাতে তারা কয়েক পুরুষ বিলাস বৈভব ক্ষমতায় থাকে।’ এই কথাটি এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের জীবনের সত্য ।
    ‘আজকাল যে-সব মড়া পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই গরু ছাগল আর ভেড়ার রুগি লাশ। গরু-মোষের স্বাস্হ্যবান মড়া হলে তার মাংসে এত কীটনাশক যে অক্কা অনিবার্য। ওসব খেয়েই তো শকুনরা আজ নির্বংশ।’….বিজ্ঞানের অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগেও তাঁর সজাগ শকুনের দৃষ্টি। ‘সেদিনকে একটা আড়মাছ ধরেছিল শিলাদ; ছেড়ে দিতে হল। মহিষাসুরের গায়ের তিতকুটে সবুজ রঙ খেয়ে মায়ের দয়া হয়েছিল মাছটার।’
    ‘পার্টি-অপার্টির লোকেরা খুনোখুনি করে লাশ ফেললে পুলিশে তুলে নিয়ে যায়, আমাদের খেতে দেয় না। মর্গের বাইরে যে মড়াগুলো ফেলে দেয় সেগুলো চুরি করে নিয়ে যায় কংকালের ব্যাপারীরা।’ ….. টকে যাওয়া রাজনীতি আর সমাজের পচনশীল শবগুলোর ভিতরেও গলা পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিতে তাঁর আপত্তি নেই। ছিঁড়ে ছিঁড়ে টেনে আনেন বঙ্গসমাজের পচা-মাংসের টুকরো, পচে-যাওয়া নাড়িভুঁড়ি। এখানে ‘অপার্টি’ শব্দটির প্রয়োগ বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। তুমি আমার দলের নও, মানে তুমি ‘অপর’, দি আদার । বিরোধী পার্টি আবার কী বস্তু? খায় না মাথায় দেয়? সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের গুরুত্ব অপরিসীম, কে বলল? ওসব বইয়েতে লেখা থাকে, বাস্তবে নয়। ‘সেই থেকে ফিবছর মেমননের স্মৃতিতে একদল পাখি জেতে আর আরেকদল হারে।’ সুবিধাবাদী রাজনীতির মুখোশ খুলেছেন তিনি অনায়াসেই। ‘এই যেমন কাশ্মীরে বোমাবাজদের সম্পর্কে যে ধরনের ভাষ্য দেয়া হয়, ত্রিপুরার বোমাবাজদের সম্পর্কে তার চেয়ে গরম ভাষ্য দেয়া হয়। কেননা ত্রিপুরায় ভাষ্যকারের মেসো-জ্যাঠা-কাকা-মামা থাকে। কাশ্মীরে ভাষ্যকারের কেউ থাকে না।’
    সংবাদমাধ‍্যমের দ্বিচারিতা, নিজেদের লাভের কথা মাথায় রেখে মিথ্যা খবর তৈরি করাকেও তিনি মোটেই ভালোভাবে নেননি। ‘আপনার অবৈধ প্রেম যাতে ব্রেকিং নিউজ হয় তার জন্যে নিউজ চ্যানেলদের বলে দেব, সে বাবদ এক্সট্রা দিতে হবে না, বিজ্ঞাপন থেকে কভার করে নেব।’ গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যম খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মনে করা হয় সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের জাগ্রত প্রহরী। কিন্তু এটাও সেই খাতায় কলমেই থেকে গেছে। ভুয়ো আর মিথ্যা খবর গিলে-গিলেই আমরা আজ অভ‍্যস্থ । ‘নজরে পড়লেই সংবাদ মাধ্যমের ছোঁড়াছুঁড়িরা আজেবাজে কথা রসিয়ে-খসিয়ে লিখে দেবে। ও হয়ত বলল হা-লু-ম। ওরা লিখে দেবে শিলাদ তরফদার বলেছেন, মুখে হাগুম।’ কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা পার্থক্য করতে, ভাবতেই ভুলে গেছে সংবাদখাদকরা । খবরটাও এখন ব‍্যবহৃত হয় এন্টারটেইনমেন্ট পার্পাস। ‘ব্রেকিং নিউজের খাতিরে আজকাল তো ধর্ষকদের ক্যামেরার সামনে আবার ধর্ষণ করে ঘটনা তুলে ধরতে হয়, যাতে জনসাধারণ স্বচক্ষে দেখতে পায়। অবশ্য তার জন্যে সস্তার অভিনেতা-অভিনেত্রী ভাড়া করতে হয়।’
    হাংরি আন্দোলনের সময় দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগটা চেপে গিয়ে অশ্লীলতার অভিযোগটা সামনে আনা। হাংরি মানে যে কবি ও কবিতার (সৃষ্টিশীলতা) সর্বগ্রাসী ক্ষুধা, সর্বগ্রাস, অনেক দিন খেতে না পাওয়া মানুষের মতো গোগ্রাসে খেয়ে ফেলা সবকিছুই, খাওয়ার নিয়ম নীতি শিষ্টাচার কিছুই না মেনে। কবিতার পাঠবস্তুটি কখনো কোনকিছুতে বাছবিচার করবে না, তার প্রকান্ড হাঁ-মুখে তলিয়ে যাবে সবকিছুই। থাকবে না কোনো বাইনারি বৈপরীত্য,  হ‍্যাঁ-না, ঠিক-ভুল, ন‍্যায়-অন‍্যায়, শ্লীল-অশ্লীলের দ্বন্দ্ব, এটাকে সম্পূর্ণ না জেনে, না বুঝে প্রচার করা হল হাংরি আন্দোলন মানে না খেয়ে, খালি পেটে কবিতা লেখা । তারসাথে নেশা করা, যৌনক্ষুধা ইত্যাদির মশালাদার খবর তো আছেই। সেই সময়ের সংবাদপত্রের পাতা ওলটালেই চোখে পড়বে নানা রকমের রসালো গালগল্প তৈরি করেছে লেখক-সাংবাদিকরা । জ্যোতির্ময় দত্ত লিখেছিলেন, ‘বাংরিজি সাহিত্যে ক্ষুধিত বংশ’ ।
    চাকরির পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে যখন শিক্ষিত বেকারের দল (না, শিক্ষিত বলব না, ডিগ্রিধারী বেকারের দল) খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো হচ্ছে সুটেডবুটেড ফেরিওয়ালা। সামান্য একটা জিনিস বেচার জন্য আন্তরিক মিথ্যা কথা বলছে, তাদের সেই তাড়না, তাদের সেই নিরুপায় তাগিদটা চোখে পড়ার মতো। একইসাথে চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে আবার চোখের কোণে কোণে খেলে যায় তাচ্ছিল্যের হাসি। ‘ভাল্লাগবে স্যার উলুক, অবশ্যই ভাল্লাগবে, আমি দুবছরের গ্যারেন্টি আর তিন বছরের ওয়ারেন্টি দিচ্ছি, একবার এসে চোখ আর লিঙ্গ সার্থক করুন, তারপর বলবেন। ক্যাশ ডিসকাউন্ট আছে।’
    যৌনপল্লীর বর্ণনাতেও গল্পকার বেশ স্বাচ্ছন্দ্য এবং রিয়ালিস্টিক। ‘ডালে-ডালে কোটরবাড়ির দরজায় পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে প্যাঁচাপেঁচি বুলেভার্দের দামি-দামি কলগার্ল। খুড়ুল্লে প্যাঁচা যার গায়ে বুটিদার বুটিক শাড়ি, ছাইরঙা টু-পিসে হুতুমনি, ফিল্ম স্টারের ডিজাইনার পোশাকে লক্ষ্মীপ্যাঁচা, বাদামি চুড়িদার কুর্তায় ভুতুমনি, খয়েরি মিনি স্কার্ট-ব্লাউজে কালোপ্যাঁচা। ঠোঁট দিয়ে গায়ের পোকা বেছে রূপটান দিচ্ছে ভুতুমনি।’ শুধু বাইরে নয়, ভিতরেও। ফার্স্ট টাইমারের ফিলফিল ফ‍্যালফ‍্যালে ফিলিংস থেকে ফুরফুরে ফুর্তিটুকু বেশ যত্ন সহকারে বর্ণিত। ‘কী ভাবে শুরু করবে ভাবছিল শিলাদ। কিছুক্ষণেই যার সঙ্গে শোবে, এমন সুশ্রী সুবেশা অপরিচিতার সঙ্গে কথা বলার মাত্রা ওর জানা নেই। ইতস্তত ভাবটাই বা কাটানো যায় কী ভাবে? নিঋিতির জানা আছে প্রেমিকদের প্রাথমিক সমস্যা; তাই ওই শুরু করল। ……শিলাদের অস্বস্তির ভিন্ন ব্যাখ্যা করে নিঋিতি বলল, তুমি কি প্রথমবার? দাঁড়াও দেখিয়ে দিচ্ছি কী ভাবে এগোবে। এই নাও কন্ডোম, এটা পরে নাও, ঝিঁঝির অন্তর্বাস-ডানা দিয়ে তৈরি মিউজিকাল কন্ডোম।’
    ‘নিঋিতির কথাটা শেষ হতেই, গ্রেনেড ফাটার আর গুলি চলার শব্দে শিলাদকে চমকে উঠতে দেখে ও বলল, ও কিছু নয়, সম্ভবত সন্ত্রাসবাদীরা খুনোখুনি খেলতে বেরিয়েছে, কিংবা বোধহয় চিনের কয়লাখনিতে সাপ্তাহিক বিস্ফোরণ হল।’……হ‍্যাঁ, চমকানোর কিছু নেই, এ তো ডেলি রুটিন। কিছু না হলেই বরঞ্চ বাসি বাসি লাগে।
    ‘এভাবে, সরকারি কর্মীর মতন, শিলাদের ঘুমিয়ে দিন যায়, জেগে রাত যায়।’….গল্পকারের স‍্যাটায়ারের প্রয়োগেও একইসাথে ফিচিক ফিচিক হাসি আর কর্কশ নিমতেতো।  ‘বাইরে শ-খানেক চড়াইপাখি জোরে-জোরে স্লোগান দিচ্ছে, চলবে না চলবে না, চক্রান্তকারীর হলুদডানা গুঁড়িয়ে দাও গুঁড়িয়ে দাও, আমাদের আবাসন বানিয়ে দিতে হবে দিতে হবে, কুটোকাঠি এনে দিতে হবে দিতে হবে, বাবুইবাসা চলবে না চলবে না’…..মিছিলনগরী কোলকাতার স্মৃতি তো আজও স্বপ্নে ও জাগরণে। পাল্লা দিয়ে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ। আমি আজ পর্যন্ত এই কালো হাতগুলোকে কোনদিন দেখতে পাইনি। ভাঙতে বা গুড়িয়ে যেতেও দেখিনি। কিন্তু আছে জানি, থাকবেও। কিন্তু দেখতে পাই না কখনো। হয়তো কালো কালো হাতের সারি চোখের সামনেই। আসলে দুরকমের যাতায়াত থাকে সিঁড়ি বেয়ে। এই যে সব নীরব মিছিল বা উদ‍্যত হাত। বিজ্ঞাপনে দীর্ঘ হয় জুতোর আকার। ‘এর সঙ্গে যোগ হল একমাসের বেশি রোজ ভোরে ঘুমোতে যাবার সময় থেকে সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙার সময় পর্যন্ত ভোট, লোট আর ফোট উৎসবের ছ্যাঁচোড়দের এই ধরনের অবিরাম গলাবাজি । …জলে স্হলে অন্তরীক্ষে সর্বত্র এই বকুনিবাতেলার চোঙা।’ কী আর করা যাবে, সইতে তো হবেই। গণতন্ত্রের গণোৎসব।
    ‘গাঁয়ে-গঞ্জে ভোট, লোট আর ফোট উৎসবের ফলে অনেক মানুষ ইঁদুরের বাড়ি থেকে ধান চুরি করছে তা তো আমরা স্বচক্ষে নাইটভিশানে দেখেছি।’ আরে ভোটের তো কিছু খরচ-খরচা আছে, নাকি। আহা বেচারিরা পাবে কোথায়, সারাটা জীবন তো শুধু নিঃস্বার্থভাবে সমাজের সেবা করে গেল। দাও, দাও হাত উপুড় করে। আর না দিলে ? ছিঃ ছিঃ এসব পোলাপানামো মৃত‍্যুপথযাত্রীরা করে। আর বলছিলাম কী, বাড়ি টাড়ি করলে আমাদেরকে বলবেন, কোনো সমস্যা হবে না। ইঁট-বালি-সিমেন্ট ইত্যাদির ব‍্যবস্থা আমরাই করে দেবো। আপনাদের কোনো সমস্যা হোক এটা আমরা ভাবতে পারি, বলুন। অবশ্য কিছু দোষ তো থাকতেই পারে, বলুন। কাজ করলেই ভুল হবে। ‘সুপারির ট্যাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করিস না, বিরোধী প্রার্থীকে মাস্তান সাপ্লাই দিয়েছিস, ধর্ষণে যাবার আগে আমাদের সঙ্গী করিস না, আমার এলাকায় ট্রাক লুটিস, পুকুর বোজাবার আমাদের গুয়ের গাড়ি ছিনিয়ে নিস, আমাদের এলাকার ঠিকেদারি নিয়ে নিস, পুজোয় তোলা আদায় করে পুরোটা রেখে নিস, আমার চুল্লুঠেকের খবর পুলিশকে দিস, আমাদের পাচারের মাগিদের পেছন শুঁকে বেড়াস, ইত্যাদি।’
    ‘থলথলে ঘাড়েগর্দান বনবাবু বলছিল, আরে ওখানে একটা আধফোকলা বুড়ো বাঘ থাকে যার এই বয়সে ম্যানইটার হওয়া অসম্ভব; আপনারা নিশ্চিত হয়ে চিংড়িপোনা ধরুন, আমরা তো আছি, ভয় কিসের।’….প্রশাসনের মিথ্যা আশ্বাস আর মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ভুলিয়ে রাখার এক ওয়েস্টবেঙ্গলসম দক্ষতা এড়িয়ে যায়নি গল্পকারের চোখ থেকে। হাংরি আন্দোলনের সময় প্রশাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার এটাও ছিল একটা মস্ত কারণ।  হাংরি আন্দোলনের পরপরই পশ্চিমবঙ্গে ঘটে গেছিল নকশাল আন্দোলন। দেবেশ রায় এই দুটি আন্দোলনে একই বিশ্ববীক্ষার কথা বলেছিলেন । অথচ দুটোর উদ্দেশ্য, প্রস্তুতি ও গভীরতা সম্পূর্ণ আলাদা । হাংরি আন্দোলন যেখানে দেশভাগোত্তর বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সংস্কৃতি, ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্যে স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে আঘাত হানার চেষ্টা করেছিল , সেখানে নকশাল আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল মার্কসীয় পন্হায় রাজনৈতিক ক্ষমতাদখল । হাংরি আন্দোলনে ক্ষমতার বিরুদ্ধে যে জেহাদ তার কারণ মূলত প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং শিল্প ও সাহিত্যকে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের বাণিজ্যিক প্রয়াস। শিল্প ও সাহিত্যের পায়ে ভিক্টোরিয়ান মূল‍্যবোধের বেড়ি পরিয়ে দেওয়া। তাছাড়া শিল্প ও সাহিত্যজগতের মানুষের মধ্যে এসেছিল জাড্যের উদাসীন স্থিতাবস্থা। সমাজবিমুখ হয়ে সাহিত্য ও শিল্পের বাজার আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । ভাবনাতেও এসে গেছিল দৈন্য। কোনো নতুন আইডিয়া নেই। শুধু কালিতে কালি বুলিয়ে সুখী সুখী নির্মাণই ছিল শিল্প ও সাহিত্য সাধনা। এরসাথে যুক্ত হয়েছিল ক্ষমতার পদলেহন করে স্বীকৃতি যোগাড়। ঠিক এই জায়গাতেই আঘাত হেনেছিল হাংরি আন্দোলন। যদিও অ্যাবস্ট্রাক্ট সিস্টেমের নি-জার্ক প্রতিক্রিয়ায় আজও কোনো হেলদোল নেই।
    হাংরি একটা কামড়  দিতে পেড়েছিল সেই পচাগলা মাংসে। হাংরি আন্দোলনে আন্ডারগ্রাউন্ড বা চোরাগোপ্তা পথের কোনো স্থান ছিল না। যুদ্ধটা সামনাসামনি। আর ক্ষমতার উৎস বন্দুকের নল নয়, কলম-তুলি। যা মুখোশ খোলে, রক্ত খায় না। ‘ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে দেখল জঙ্গিলা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের গুপ্ত গুলছররা চলছে।’….নকশাল আন্দোলন ছিল অপরদিকে  চোরাপথে গেরিলা কায়দায় আঘাত হানা, এখন মাওবাদীরা জঙ্গলে লুকিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়াস করছেন, ভারতের জাতিপ্রথার কোনো বিশ্লেষণ তাঁরা করেন না । গল্পকার যে এই চোরাগোপ্তা পথে মানুষখুনের আন্দোলনগুলিকে ভালো ভাবে নেননি তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই গল্প থেকে। ‘সবাই ইংরেজিতে কথা বলছিল, তর্কাতর্কি করছিল, চাপানউতর করছিল; মনে হল ওটাই জঙ্গিলাদের পিতৃভাষা।’ মার্কসবাদকে সামনে রেখে দেশে দেশে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে সবচেয়ে ভুল ছিল, আঞ্চলিক বা নিজস্ব সমস্যাকে বিচার বা বিশ্লেষণ না করে সবকিছুকেই মার্কসবাদের আলোকে ফেলা। অর্থাৎ এখানেও যেন সেই ধর্মের মতো গোঁড়ামি। নিজস্ব চিন্তাভাবনা নয়, নিজের সমাজকে চিনে বিচার বিশ্লেষণ নয়, ধর্মগ্রন্থের মতো একটি বইয়ের কথাগুলিকে চিরসত‍্য ধরে তা প্রশ্নহীন আনুগত্যে পালন করে যাওয়া। ‘মনে হল ওটাই জঙ্গিলাদের পিতৃভাষা’-র মধ্য দিয়ে গল্পকার যেন এটাই বোঝাতে চাইলেন যে, কীভাবে আন্দোলনকারীরা নিজেদের ভারতীয় আইডেন্টিটি ভুলে গিয়ে, নিজেদের চিন্তাভাবনার পরিসরটাকে শূন্য করে ক্রমাগত কপচে যায় মুখস্থ করা বুলি। আর অ্যাকশন্ ঠিক সেই আদি অকৃত্রিম পথেই। নিজস্ব পথ আবিস্কারের কোনো চেষ্টা নেই।
    ‘একের পর এক দিগগজ নেতার তরল সান্দ্র গভীর সংঘাতী তঞ্চিত খামিরি মাতানো ধূমিত রসাল ভারিক লঘু চোহেল আবিল সতেজ শুটকো আধসেদ্ধ বিদগ্ধ বক্তৃতা শুনতে-শুনতে জঙ্গিলা-জীবন আর জীবনদর্শন সম্পর্কে খটকা লাগল শিলাদের। বিস্ফোরক বানানো, সেটাকে যার মাথায় ইচ্ছা ফাটানো, আর যার মাথায় ফাটানো হচ্ছে তাকে জঙ্গিলা শত্রু ঘোষণা করা, এইই মনে হচ্ছে মোদ্দা কথা।’……এইভাবেই তিনি সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলনগুলিকে সন্ত্রাসবাদের সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সাধারণ মানুষ মেরে আর যাইহোক সমাজের ভালো কিছু হয় না। যা মানবিক নয়, যা ধ্বংস করে মানবিকতাকে তাকে সরকারি সন্ত্রাসবাদ বলতে তিনি দ্বিধাহীন। কোনো আদর্শের মোড়কেই এই মানুষ হত‍্যাকে তিনি জাস্টিফাই করতে চান না। শ্রীকৃষ্ণের হাত দিয়ে শুরু হয়েছিল যে যাত্রা, যুদ্ধের সাথে হত্যার সাথে ধর্মকে সরাসরি মিলিয়ে দেওয়া, তার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে আজও । আসলে রক্তে হাত ভেজানোটাই আসল। আদর্শ, মতবাদ,  জাস্ট আই-ওয়াশ, ঝুলিয়ে রাখা কেতাবি ধুলো। ‘আমি তো হতে চেয়েছিলুম সমাজবদলকারী; হয়ে গেলুম সেলাম-গ্রহণকারী উড়োনছু কংকাল, ওই সব জঙ্গিলাগুলোর জন্যেই। কত ভাল-ভাল কথা শুনিয়ে জনগণকে বোকা বানিয়ে আমায় করে ফেললে উড়োনছু কংকাল আর নিজেরা দিব্বি আমোদ-প্রোমোদ নিয়ে মজা করে চালালে।’ ব্যাপারটি যেন পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক পটচিত্র ।
    সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ রক্তপায়ী। রক্ত পান করার সুযোগ তাকে ছলে বলে কৌশলে আবিস্কার করে নিতেই হয়। সন্ত্রাসীদের দ্বিচারিতাও ধরা পড়েছে শিলাদের কথায়, স্পষ্টভাবেই, ‘জঙ্গিলা জীবনের কত কি জানত না শিলাদ। নানা রঙ্গিলার দেশে গিয়ে তাদের পয়সায় ডেঁড়েমুশে খেয়ে মৌজ করা, আর সেখানে লুকিয়ে থাকা যে জঙ্গিলার উদ্দেশ্য তা জানত না । ভ্যাবাচাকা গিলে-গিলে খেতে লাগল শিলাদ।’ বহু লেখক ও কবি একসময়ে সোভিয়েত দেশে যেতেন, ছেলে-মেয়েদের পাঠাতেন আনন্দ করার জন্য । তাদের মুখোশ খুলতে, তাদের নগ্ন করতে, মহান আদর্শের ফাঁকা বুলি ঝেড়ে, আন্ডারগ্রাউন্ডে ঘটে চলা প্রকৃত সত্যকে তিনি আমাদের চোখের সামনে ঝুলিয়ে দিয়েছেন । ‘অধৈর্য হবেন না সাথী; অ্যানোলসাথী এবার চরস গাঁজা আফিম কোকেন হেরোইন বিক্রির টাকা ডলার পাউন্ড ইয়েন রিয়াল রুবল লিরা দিরহাম ফ্রাঁ মার্ক আমাদের বিলি করবেন।…….হ্যাঁ সাথী, তা না হলে আর্ডিএক্স মর্টার বাজুকা রকেট রাইফেল গ্রেনেড ডিটোনেটর কিনবেন কী করে? খালি হাতে কজনকেই বা মারবেন? আর চোখ কান বুজে মারতেই যদি না পারলেন তাহলে জীবনের উদ্দেশ্য কী করে পুরো হবে?….শুনে, দমে গেল, মুষড়ে পড়ল শিলাদ, হতাশ, মনোহত। জঙ্গিলা মানে কি মারা, মরা, মারা, মরা, মারা, মরা, মারা, মরা? ধুসশালা।’…..এই প্রশ্নের উত্তর আজও আমরা খুঁজে পাইনি। হয়তো পাবোও না কোনদিন। ধুসশালা।
    বিশ্বজুড়ে বাড়বাড়ন্ত সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, বালক-কিশোর সন্ত্রাসবাদী। শৈশবকে জাস্ট খুন করে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে অস্ত্র। কখনোবা তারা মানববোমা। বালক হওয়ার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই অনেক সময় সন্দেহের বাইরে থাকে তারা। এই সুযোগটাই বারবার নিয়ে চলেছে সন্ত্রাসের সর্বাধিনায়কেরা। আবার অনেক সময় শিশু চুরি করে এনে ছোট থেকেই ব্রেন ওয়াশ করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে হার্ডকোর টেররিস্ট রূপে। আদিম যোদ্ধাগোষ্ঠীগুলোতেও ছিল এই একই প্রক্রিয়া। তা সে চেঙ্গিজের বা আত্তিলার সেনা, নিনজা হোক বা স্পার্টান। বর্তমানের কদর্যতম রূপ এটাই যে বালিকা ও কিশোরীদের অপহরণ করা হচ্ছে সন্ত্রাসীবাদীদের যৌনদাসী হিসাবে ব‍্যবহার করায় জন‍্যে। ‘আমরা রঙ্গিলা ডিম চুরি করে এনে জন্মের আগে থেকে জঙ্গিলা বানাই। জঙ্গিলা গোষ্ঠীর রঙ অনুযায়ী সেই মতাদর্শের আরকে চোবাই। ডিম ফুটে বেরোলেই ওদের ইনডকট্রিনেট করে জীবন্ত অস্ত্রশস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে শত্রু নিধনে পাঠানো হয়।’
    ‘রঙ্গিলা জীবনে ল্যাজ নিয়ে করবিটা কী? কাউকে কায়দামাফিক সেলাম ঠুকতে হয় না। তোদের তো হেঁ হেঁ করলি, হাত কচলালি, ব্যাস, সেলাম হয়ে গেল।’…..সন্ত্রাসীদের নগ্ন ছবি আঁকতে আঁকতে মেরুদন্ডহীন দুধে ভাতে বাঙালিকে কি খোঁটা দিয়ে গেলেন গল্পকার?
    ‘আপনি ভুল করছেন। জঙ্গিলা আমি স্বেচ্ছায় হয়েছি। কেউ আমায় ভুল বুঝিয়ে, ফুসলিয়ে, লোভ দেখিয়ে, কেতাব পড়িয়ে বা বাড়ি থেকে চুরি করে এনে জঙ্গিলা বানায়নি।’….স্বেচ্ছায় যে কেউ সন্ত্রাসবাদী হয় না, তার পিছনে যে থাকে নেতারা, এই নির্জলা সত‍্যটাকে তুলে ধরতে কসুর করেননি গল্পকার। মহাভারতের  সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা অর্জুন’ও নাকি তাঁর অস্ত্র নামিয়ে নিয়েছিলেন । তারপর তাঁর রথের উপর উপবিষ্ট সর্বাধিনায়কের ব্রেন ওয়াশের পর সে নির্দ্ধিধায় লেগে যায় মারো মারো আর মারোর রক্তপানে। ফর্ গডস্ সেক্, হোল্ড ইয়োর বো এন্ড কিল্ দ‍্য এনিমি। এনিমি? শত্রু? কে শত্রু? তুমি যাকে মারবে সেই তোমার শত্রু। যে অপর, সেই তোমার শত্রু। বিরুদ্ধ মত ও পথ বলে পৃথিবীতে কিছু হয় না। হয় ‘আমরা’ নয় ‘ওরা’ । আবার সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে বিভাজনটাও কিন্তু খুব স্পষ্ট। সবাই ফ্রন্টে গিয়ে গুলি খাওয়ার রিস্ক নেয় না। তাদের জীবন যে ভীষণ ‘দামি’। তাই কেউ কেউ মারে ও মরে আর কারো কারো হাতে রথের দড়ি। ‘ওইটুকু জঙ্গিলা জীবনে ও দেখেছিল তাদের মধ্যে খয়রাতি জঙ্গিলা আর ভিখিরি জঙ্গিলার মাঝে বর্ণভেদ রয়েছে, তেমনই আছে বড়লোক জঙ্গিলা আর ছোটলোক জঙ্গিলার মাঝে, ডলার জঙ্গিলার সঙ্গে টাকা জঙ্গিলার, শাস্ত্রজ্ঞের সঙ্গে আনপঢ়ের, আস্তিকের সঙ্গে না-আস্তিকের, গোরার সঙ্গে কালার, বলিতে পাঠাও আর বলিদান দাও জঙ্গিলার মাঝে, বস্তিছাপ আর এয়ারকান্ডিশান জঙ্গিলার মাঝে।’ বিপ্লবের রোমান্টিসিজম্ এইভাবেই শুষে নিয়ে গল্পকার, কদর্য সত‍্যটাকে তুলে ধরেছেন। ‘জঙ্গিলাজীবন আর আগেকার কালের হিরো-জীবনের মতন রোমান্টিক নেই; এখন সবাই ধান্দাবাজ।’
    শুধু সমাজ-বদলকারীদের নয়,  সুখী সামাজিক মানুষদের শ্রেণিবিভাজন’টাও তিনি ধরেছেন  নিপুণভাবে। ‘রয়েছে যবাক্ষারজান জলের নিচড়া বর্গ, রোদবৃষ্টিমাখা জলের উচড়া বর্গের সঙ্গে মাঝামাঝি জলের নিচড়া বর্গ। অতি নিচড়া বর্গের গায়ে আঁশ নেই চোয়াল নেই ডানা নেই, তলানি খায়। নিচড়া বর্গের গায়ে হাড় নেই, সবই কার্টিলেজ, কানকোর জায়গায় খড়খড়ি; জলের বেসমেন্টে নামলে চোখের তলায় গর্ত দিয়ে শ্বাস নেয়। আর উচড়া বর্গ তো রোদের পাউডার চাঁদের ক্রিম আর শিশিরের পারফিউম মেখে চোপরদিন গোমরে ঝিকিমিকি।’ এই বিভাজনকে বৈচিত্র্য মেনে মানুষ’ও বেশ খুশি। তাই  সুখী খুশি কানে যদি কেউ নতুন কিছু শোনাতে যায় শোনে না, ভাবতেও চায় না, শুনতেও। ‘রঙিন কাউকে দেখলেই ওদের পোঁদে হিং জমে’। চিরদিনই নতুন কিছু যাঁরা জানাতে চেয়েছেন মানুষকে, তাঁদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘রঙিন বলে ওই সব বর্গের মাছেরা কেউই শিলাদকে নিজেদের লোক বলে মনে করে না, অথচ খুব হিংসে করে।’
    এই অরূপকথনে সাম্রাজ্যবাদীশক্তির দাদাগিরিকেও তিনি শিলাদের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। ‘এই বোটকা মালটা কোত্থেকে এল রে সুনন্দা, আমেরিকা না ইজরায়েল? সেই বুড়ো বাঘটার এলাকা গায়ের জোরে জবরদখল করে বসে আছে।’ হয়তো উপনিবেশের রঙ পাল্টে গেছে, ‘নিজেকে আলেকজান্ডার কিংবা দারিয়ুস ভাবছে, মুতে-মুতে জবরদখল আর পাকাপাকি রাজ্যপাট, হাঃ হাঃ হাঃ…’ এখন লক্ষ্য অর্থনৈতিক উপনিবেশ স্থাপন। কিন্তু তার এফেক্ট একই। অসংখ্য হাড়জিরজিরে মানুষের লাশের উপর গুটিকয় নাদুসনুদুস মানুষের ভুড়ি ভুড়ি ভুরিভোজ। ‘দ্যাখে কি, গির্গিটবোমা অ্যানোলের পচাগলা লাশের মোরব্বা চেখে-চেখে খাচ্ছে মার্কিন কানিমাগুর আর ব্রিটিশ পাঁকাল।’
    পশ্চিমবঙ্গের পুঁথিনির্ভর শিক্ষকমুখী শিক্ষাব‍্যবস্থার হাল যে কতখানি করুণ তা আর নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। এটা যেন ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে, সবাই মানে তবু হরিদাসের গোয়াল খালি থাকে না। উপায়ও নেই। যেন তেন প্রকারেণ চাই ডিগ্রি, পরীক্ষায় পাশ করাটাই সাফল্যের খতিয়ান। শিক্ষা? সেটা আবার কী স‍্যার? ‘শিমুল-পলাশের ডালে-ডালে ঠাকুরাল-বাঁদর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছাত্র পড়ানো দেখছিল শিলাদ। প্রগতিশীল বাঁদর স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেশ হোঁতকা-হোঁতকি রাঙা পোঁদা রাঙামুখো। কারোর চতুর্থ হাতে বিপত্তারিণির হর্তুকি, কারোর তৃতীয় হাতে জয় বজরংবলির মাদুলি, কারোর দ্বিতীয় হাতে রুপোর চেনে মাকলা-বাঁশের শেকড় বাঁধা। ছাত্র-ছাত্রীরা রোগা টিংটিঙে।’….শিক্ষকরা নিজেরাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আর তারাই দেয় বিজ্ঞানের শিক্ষা। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে-পড়া ছেলেমেয়েরা আসে ফ্রি স্কুলে শিক্ষা নিতে। বাড়িতে ঠিকঠাক খেতেও পায় না। অপুষ্টি শরীরে ও মনে, আর তারাই মুখস্থ করে বাড়ি ফেরে ভিটামিন কাহারে কয়। এই দূরাবস্থা থেকে আজ আশার আলো স্কুলে-স্কুলে মিড-ডে মিল প্রকল্প। এই গল্পটি যখন লেখা হচ্ছে তখন মিড-ডে মিল চালু হয়নি। তাই গল্পকারের তর্জনী নিক্ষেপ সফল। অবশ্য শুধু সরকারি ফ্রি স্কুল নয়, ঝাঁ চকচকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষাব‍্যবস্থাও যে খুব ভালো এমনও নয়। সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব‍্যবস্থার মূল লক্ষ্যই হলো নাম্বার, আরো নাম্বার, আরো আরো নাম্বার। নো ইনোভেশন ওনলি মুখস্থং নোটং।
    ‘একজন টিচার বেশ ঠাটি, ফুটেক ল্যাজের ছড়ি উঁচিয়ে, মগডাল থেকে তাক-তিড়িং-তুং লাফ মেরে ক্লাসে নামল, তারপর, হেঁচকা মেরে, এক মাওরা ছাত্রীকে চামড়াসুদ্ধ এক-খাবলা লোম তুলে নিয়ে যেতে, বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকারা পেছনের দুহাতে তালি বাজিয়ে বাহবা দিল। এরপর এক ধিঙ্গিনাচন শিক্ষিকা, পলাশের কাঁটাদার জিঙ্গলকাঠি ভেঙে তিন হাত দিয়ে এক কচি ছাত্রকে দমাদম উত্তম-মধ্যম দিতে, সে আধমরা হয়ে গাছের নমনা আঁকড়ে ঝুলতে লাগল।’…….শিক্ষার অধিকার আইনে আজ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক ন‍্যূনতম নির্যাতন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আজও শিক্ষার্থীরা একইরকম শারীরিক ও মানসিক আঘাতের শিকার হয়ে চলেছে প্রতি মুহুর্তে।
    ‘শিলাদ তরফদার নিজেকে বোঝাল, ভাগ্যিস ও মানবজীবন চায়নি বা পায়নি। সেক্ষেত্রে ছাত্র আর শিক্ষক দুটো স্তরের রাঙাপোঁদা রাঙামুখো পর্ব পেরোতে হতো। শিক্ষকরা তো মানব গড়ার কারিগর।’ তবে আমার ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছে, এই ব‍্যাপারটা এখন অনেক কমেছে। শিক্ষার্থীরা আজ অনেকটাই শিক্ষক-শিক্ষিকার বন্ধুর মতো। ঠিক ভয় পায় না, কিন্তু ভালোবাসে। এখানেও আবার দেখি উল্টো সমস্যা, গার্জেনদের বলতে শুনি, এখনকার চ‍্যাংড়া মাস্টাররা সব পড়ায় কোথায়? ক্লাসে বসে শুধু গল্প আর আড্ডা। সারা ক্লাস জুড়ে শুধু হো হো আর হা হা। আমাদের সময় ক্লাসে মাস্টার ঢুকলে ভয়ে কথা বলতে পারতাম না। উফ্ কী পড়াতেন, পড়া ধরতেন, বাড়ির জন্য হোমটাস্ক দিতেন আর না বলতে পারলেই মার। এদের সে দায়িত্ব কোথায়, এরা তো জানে মাস ফুরালেই মোটা মাইনে তাই পরের ছেলে পরমানন্দ, যত উচ্ছন্নে যায় তত আনন্দ।
    ‘ডাকাতগুলো এখন পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত খাবে। তারপর ছ-জন নাক ডেকে ঘুমিয়ে রাতে বেরোবে গেরস্ত জেলেদের নৌকোসুদ্ধ বমাল ধরতে। কাদের ধরতে হবে সে খবর ওরা পঞ্চায়েতের লোকেদের ভাঙিয়ে জেনেছে।’…….সুন্দরবন খাড়ি অঞ্চলে জলদস‍্যুদের উৎপাত একটা জ্বলন্ত আন্তর্জাতিক সমস্যা। এই জলদস্যুরা বেশিরভাগই আসে বাংলাদেশ থেকে। লোকাল সোর্স’ও থাকে। ডাকাতি করে তারা আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে যায়। হাতেনাতে না ধরতে পারলে প্রশাসন তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না। অবশ্য সুন্দরবন অঞ্চলে প্রসাশনের অস্তিত্ব প্রায় নামেই। জঙ্গলে চলে জঙ্গলেরই নিয়ম। বাঘ কুমির আর ডাকাতদের সাথেই সহবাস সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষদের। আমার একজন বন্ধুর সুন্দরবনের কোনো এক ছোট্ট দ্বীপে বাড়ি। ও বলতো, আমাদের গ্রামে প্রায়ই বাঘ আসে। গরু ছাগল খেতে। তবে বেশিরভাই বুড়ো বাঘ। তোরা যেভাবে কুকুর তাড়া করিস আমরা সেইভাবেই লাঠি নিয়ে সবাই মিলে বাঘ তাড়া করি। বেঁচে থাকাটাই তাদের কাছে বিস্ময়ের। মৃত্যু তো স্বাভাবিক পরিণতি। প্রায় প্রতি ঘরে বিধবার অস্তিত্ব সেই তথ‍্যকে পুষ্টি যোগায়। এরসাথে রয়েছে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র। মূলত বাঘের চামড়ার কারবারিরা আসে বাঘশিকার করতে। ‘কপালে গুলি মারলি কেন? মাথার চামড়াটা ড্যামেজ হলে ভাল দাম পেতে অসুবিধা হবে,  জানিস না?’ তাদের হাতে মানুষের সরাসরি কোনো ক্ষতি হয় না ঠিকই, বরঞ্চ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লোকাল ইন্ধন থাকে পুরোপুরি। কিন্তু বাস্তুতন্ত্র তথা সুন্দরবনের মূল বাসিন্দা রয়েল বেঙ্গল টাইগার আজ বিলুপ্তির মুখে। সরকারি প্রচার ও বিভিন্ন পশুপ্রেমী সংস্থার প্রচারে বর্তমানে সুন্দরবন বাসিন্দাদের মধ্যে কিছু সচেতনতা দেখা দিয়েছে।
    ‘পর-পর চারটে গুলি লাগল বুকে আর পেটে। শিলাদ বুঝতে পারল ও মরে যাচ্ছে।’……শকুন থেকে যে জার্নিটা শুধু হয়েছিল গল্পকারের এবং আমার, শিলাদের অস্তিত্বের অবসানে চোখ শুকনো রাখার কোনো উপায় ছিল না আর। শিলাদের সাথে আমিও এতক্ষন এগিয়ে গেছি অরূপকথনের পথে । নিজেকে যেন আমি শিলাদের সাথে এক করে ফেলেছিলাম। হয়তো এটা গল্পকারের দক্ষতা বা আমার মানসিক দুর্বলতা। সে যাইহোক, গুলি খেতেই চমক ভাঙল, বুঝলাম যে আমি বেঁচে আছি আর শিলাদ নেই। ‘ও চলে গেল জলের তলায়।’….’দাদুকে চিনতে অসুবিধা হয়নি শিলাদের। দাদু-দাদু চিৎকার করেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারল না। নিজের শবের ওপর দাদুকে নিয়ে ভেসে চলল শিলাদ তরফদার।’……শেষ হলো একটা জার্নি।
    মন খারাপ হলেও অবকাশ পেলাম নিজেকে খোঁজার, জীবনের অর্থ খোঁজার শিলাদের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে। ‘নানা পর্বের ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে সন্দেহ ধরে গেল যে জগৎসংসার সম্ভবত বোধগম্য, সুসংহত, আসঞ্জনশীল ব্যবস্থা নয়। উদাসীন পৃথিবীটা আমাকে লাথিয়ে-লাথিয়ে আমারই স্বাধীনতায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে, আর আমি, পাখনা চাপড়ে বিলাপ করতে বাধ্য হচ্ছি। সম্ভাবনার সুযোগ সুবিধের মধ্যেই আমাকে কাৎ মেরে-মেরে খতিয়ে বেরোতে হবে। না কি?’ প্রশ্ন করতে বাধ‍্য হই নিজেকে, আর উত্তর? ‘নিজেকে নিজের কাছে, নিজের বাছবিচারের সম্ভবানার কাছে, বেঁচে থাকার খামখেয়ালি অথচ নির্বিকার স্রোতের কাছে, নিজেকে পরাজিত লাগে, হেরো, পরাভূত।’
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.229.178.225 | ০৮ অক্টোবর ২০২২ ১৮:৪৮738570
  • নষ্টনটদের কলোনি - একটি ম্যাশাপ উপন্যাস
    মলয় রায়চৌধুরী
    এক
    [ ম্যাশাপ কাকে বলে আগে জেনে নিন :For the uninitiated, a ‘mashup’ is when you take several established styles of anything and mix them together to make something completely new and unique. The popularity of the mashup really exploded onto the cultural scene with the advent of postmodern literature. It combines all literary canons and makes fun of it by indirectly attacking the author's rotting society. Creative artists of all kinds have been doing mashups for quite some time. Ever hear of fusion cuisine? Ate a fusion dish ? Drank fusion liquor ? Heard fusion music ? They’re mashups. A mashup novel or text (also called  "mashed-up text"), is an unauthorised non-canonical (and not even in-universe) work of fiction (often parody) which combines a pre-existing literature text, often work of authors, with another genre,  into a single narrative. Marjorie Kehe of the Christian Science Monitor renders this admixture of classic text as "somewhere between 60 and 85 percent original text, with new plot twists added by contemporary co-authors". The term appears to have first been coined in a review of Seth Grahame-Smith's 2009 novel, Pride and Prejudice and Zombies. Initially calling it a 'parody' and 'literary hybrid', Caroline Kellogg, lead blogger for Jacket Copy, The LA Times' book blog, later describes the work as "novel-as-mashup". As the popularity of the narrative grew and a bidding war commenced over the film rights to the book, the term spread. Subsequent mash-up narratives include Sense and Sensibility and Seamonsters, "Little Women and Werewolves'' and Abraham Lincoln, Vampire Hunter (also by Grahame-Smith). তাছাড়া, 1969 সালে, কবি হাওয়ার্ড ডব্লিউ. বার্গারসন এবং জেএ লিন্ডন একটি কাট-আপ কৌশল তৈরি করেন যা শব্দভাণ্ডার ক্লেপ্ট কবিতা নামে পরিচিত , যেখানে একটি বিদ্যমান কবিতার সমস্ত শব্দ নিয়ে তাদের পুনর্বিন্যাস করে, প্রায়শই মাত্রা এবং স্তবকের দৈর্ঘ্য সংরক্ষণ করে একটি কবিতা তৈরি করা হয়। কৌশলটির একটি নজির 1920-এর দশকে একটি দাদাবাদী সমাবেশের সময় ঘটেছিল যেখানে ত্রিস্তান জারা একটি টুপি থেকে এলোমেলোভাবে শব্দ টেনে ঘটনাস্থলে একটি কবিতা তৈরি করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন । কোলাজ , যা মোটামুটিভাবে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের সাথে সমসাময়িকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল, কখনও কখনও সংবাদপত্র বা ব্রোশারের মতো পাঠ্য অন্তর্ভুক্ত করে। এই ইভেন্টের আগে, টেকনিকটি জারার কবিতায় 391 সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, দাদা ম্যানিফেস্টো  : দুর্বল প্রেম এবং তিক্ত প্রেমের উপ-শিরোনামে, একটি দাদাইস্ট কবিতা তৈরি করুন । 1977 সালে পারফরম্যান্স কবি হেডউইগ গোর্স্কির পাঁচটি কণ্ঠে লেখা একটি নাটক মুদ্রণ প্রকাশের পরিবর্তে শুধুমাত্র অভিনয়ের জন্য কবিতা তৈরির ধারণার উদ্ভব করেছিল। বুবি, মামা শিরোনামের ‘নব পদ্য নাটক’ ! পাবলিক প্লেসে "গেরিলা থিয়েটার" পারফরম্যান্সের জন্য লেখা সংবাদপত্রের কাট-আপগুলির সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছিল যা অ-পেশাদার অভিনেতাদের একটি দলের জন্য সম্পাদনা এবং কোরিওগ্রাফ করা হয়েছিল। ক্যাথি অ্যাকার , নানা ধরণের ম্যাশাপের ন্যারেটিভ তৈরি করেছিলেন । আমি এখানে যে নাম ব্যবহার করেছি, তা সাহিত্যের বিখ্যাত চরিত্র । ]
    দুই
    কলোনি সরকারের বিজ্ঞপ্তি : 
    ( ‌১ ) দেখুন, আপনাকে যারা চেনে জানে, সেই মুষ্টিমেয় পাঠকেরা এই সমস্ত প্রাসঙ্গিকতার প্রমাণ চায় না, স্যর। বোঝেন তো, বাংলা সাহিত্য-পড়া যুবক-যুবতী প্রতিক্রিয়াশীল খোকা-খুকি সিলেবাস-প্যাঁদানো অভিজ্ঞতায় ভারতচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে খুব বেশি দূর এগোতে পারেন নি — বড়োজোর ১ ছটাক বঙ্কিম সাড়ে ৩ সের শরৎ ও ৬০ মন রবীন্দ্রের সঙ্গে পোয়াটাক বিভূতি প্লাস তারাশঙ্করের চাকনা ছিটানো লাবড়া সাপটে এখন নীতিঠাকমার পুণ্য দায়িত্ব স্বেচ্ছায় পালন করছেন “স্বচ্ছ ভারত”-তুল্য তৎপরতায়। যদিও, আপত্তির মূল কারণ — “মোটা ও মসৃণ তুলতুলে বাহু”-র মধ্যে যে অনাধুনিক আটপৌরে মাধুর্য আছে তা আপনার প্রিয় অথচ “ছোটো বুক” ভাল্লাগে না আপনার। বলিহারি আপনার রুচি। এ ভারি অন্যায়, হ্যাঁ ! ক্রমশ অ্যানোরেক্সিয়া আক্রান্ত বেআক্কেলে ফ্যাশনিস্তার সামনে সত্যি কথা টুসকি মেরে মুখের উপর বললে মুখঝামটা খেতেই হবে সাবেকি মিসোজিনিস্ট হওয়ার অভিযোগে। (আঁচলগোঁজা নারীবাদী জেঠিমারা তেড়ে এলো বলে!)
    আরে... মহায়, আলঙ্কারিক আড়ম্বর ছেড়ে সোজা কথার সরল স্বীকারোক্তি যে ডিসফাংশনাল হরমোন-স্রাবী অপরিণত দেহের মেয়েছেলেটার হীনম্মন্যতা ফিরিয়ে আনতে পারে — এবার থেকে সেটাও খেয়াল রাখবেন মাইরি লিখতে বসার আগে। ব্যঙ্গভূমির ধুমাধাড় সঙোসকিরিতি আপনার ক্ষুধার্ত যুগেও যা ছিল, এখনও তা-ই আছে। এককথায় যা তা। ঔচিত্যবোধ নিংড়ে যে গেরস্তের পাঁচালি হতে পারে কিন্তু সাহিত্য হতে পারে না — সাহিত্য যে হিতোপদেশের সংকীর্ণ উপত্যকা ছেড়ে সেই ৬০ দশকেই মধ্যবিত্ত ছুঁৎমার্গ ডিঙিয়ে বিশ্বকৃষ্টির বিচিত্র মোহনায় মেশার স্পর্ধা দেখাতে পেরেছিল, অন্তত প্রাতিষ্ঠানিকতা ভাঙার ঐকান্তিক প্রয়াস একটা ছিল — সে আর ক’জন মনে রেখেছে‽ (গণখোরাকের চিড়বিড়ে পুলকে অস্থির পাঠকবৃন্দ ভাবছে কে এই মলয় মাকড়া? আমি তো ফালগুনী রায়, অরুণেশ ঘোষ, সুবিমল বসাক কাউকে চিনি না; রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবারুণ ভট্টাচার্য পটল তুলেছে তাতে কারোর সামান্যতম ছেঁড়া যায়নি। পেঁয়াজি মারা হচ্ছে, অ্যাঁ, নষ্টনট ?
    ( ২ ) নষ্টনটদের কলোনিতে তাদেরই পাঠানো হয় যারা অতিবুদ্ধিমান হবার দরুন সরকারের পক্ষে ক্ষতিকর । কেবল পুরুষদের পাঠানো হয় । কলোনি একেবারে নারীবর্জিত । সরকারি আইন অনুযায়ী পালা করে তারা সমকামে লিপ্ত হবার অধিকার পেয়েছে । তাই তাদের কোনো পোশাক দেয়া হয়নি । শীত গ্রীষ্ম বর্ষা হেমন্ত বসন্ত শরৎ সারা বছর তারা উলঙ্গ থাকে । তাদের খাবার আকাশ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয় । জলের আকাল থাকলেও সেই জল খেতে তারা অভ্যস্ত । কেউ মরে গেলে তার মাংস খাবার অনুষ্ঠান করা হয় । কলোনির অদৃশ্য সরকার তাদের হুকুম দিয়েছে যে তারা সারা বছর অপেক্ষা করবে নানা সমস্যা গড়ে ওঠার জন্য এবং সেগুলো সমাধান করার জন্য আকাশপথে একজন নটবর আবিভূত হবে । 
    ( ৩ ) এই কলোনিতে যারা আছে তারা কেউ ব্রহ্মার মুখ, বাহু, ঊরু ও পা থেকে জন্মায়নি । তারা ডারউইন সাহেবের কলম থেকে জন্মেছে ।
    ( ৪ ) নষ্টনট কলোনির নিবাসীরা একে আরেকজনের স্বপ্ন হ্যাক করার ক্ষমতা রাখে । তাই কে কার নাম নিয়ে কী বলছে তা টের পাওয়া কঠিন । তাদের যখন কলোনিতে পাঠানো হয় তখন একটা নাম বাছাই করার সুযোগ দেয়া হয় । কিন্তু কলোনির নিবাসীদের সঙ্গে মেলামেশার দরুন তারা পরস্পরের নাম আর বক্তব্য চুরি করে নিজের বলে চালায় । তারা জানে যে এই পদ্ধতি তাদের অমরত্ব দিয়েছে । 
    তিন
    দেবদাস : যত্তো সব মাতালের দল । খালাসিটোলা আর বাঙালিটোলার তফাত জানে না ।
    গোরা : আমরা পাগলটোলায় জড়ো হয়েছি কেন, কিসের জন্য অপেক্ষা করছি ?
    বিনয় : আজকে নটবরের আসবার কথা ।.
    মহেন্দ্র : পাগলটোলায় কোনও কাজ হচ্ছে না কেন ?
    বিপ্রদাস : পাগলরা কেন আইন প্রণয়ন না করে বসে আছেন? 
    মধুসূদন : কারণ নটবর আজকে আসবেন ।.
    নলিনাক্ষ : পাগলদের এখন আইন প্রণয়ন করে কী লাভ ?
    নক্ষত্র রায় :নটবর একবার এখানে এসে পড়লে তিনিই আইন প্রণয়ন করবেন ।.
    গোবিন্দমাণিক্য : আমাদের রাজপুত্তুর এতো ভোরবেলা উঠে পড়লেন কেন ? আর কেনই বা উনি শহরের মাঝখানে সিংহাসনে বসে আছেন ? মাথায় মুকুট পরে, দরবার সাজিয়ে ?.
    অমিত রায় : কারণ নটবর আজকে আসবেন ? আর রাজপুত্তুর ওনাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য অপেক্ষা করছেন ।
    শশাঙ্ক : তাঁকে দেবার জন্য ওনার হাতে একটা গোটানো কাগজও রয়েছে, নানা খেতাব, গম্ভীর রকমের উপাধির তালিকা ।.
    রঞ্জন : আমাদের দুজন খোচর আর কোটনা বাইরে বেরিয়ে এসেছেন কেন ? ওনাদের কারুকাজ করা লাল রঙের পোশাক পরে ?.
    মদন : ওরা নীলকান্তমণি-বসানো ব্রেসলেট পরে আছে কেন ? আঙুলে ঝলমলে পান্নার আঙটি ?
    অর্জুন : ওদের হাতে ছড়ি রয়েছে কেন, রুপো আর সোনার সুন্দর কাজ করা ?
    রহমত : কারণ আজকে নটবর আসছেন, আর ওই ধরণের জিনিসে নটবরের চোখ ধাঁধিয়ে যায় ।
    তারাপদ : আমাদের পাগল-হাউসের বাগ্মীরা রোজকার মতন আসেননি কেন ? বাকতাল্লা দেবার জন্য, যা বলবার তা বলার জন্য ?
    নিখিলেশ : কারণ নটবর আজকে আসছেন, আর উনি বাগ্মীতা আর বক্তৃতায় বিরক্ত বোধ করেন। 
    চন্দ্রকান্ত : কেন হঠাৎ এই ধন্দ, এই বিভ্রান্তি?
    সন্দীপ : রাস্তাগুলো আর চৌমাথা এতো তাড়াতাড়ি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে কেন ? সবাই চিন্তায় মশগুল হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে ?
    জগমোহন : রাত হতে চলল আর নটবর এখনও এলেন না ।
    নীলান্দস্বামী : আর পাগল স্ট্রিট থেকে আমাদের যে লোকজন এসেছে তারা বলছে, নটবর বলে  কিছু নেই ।
    আদিত্য : এবার আমাদের কী হবে নটবর না এলে ?
    নবকুমার : নটবরই তো ছিলেন সমস্যা-নির্মাণ আর আগুনখেকো  সমাধান ।
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । পার্বতী আর চন্দ্রমুখীর তফাত জানে না ।
    মাল্যবান : আমাকে একটু আহ্লাদ দাও।
    জিতেন দাশগুপ্ত : স্বপ্নের কী জানেন ফ্রয়েড? ভিয়েনা শহরে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে স্নায়ুরোগীদের স্বপ্ন নিয়ে কোনো স্বপ্নতত্ত্ব বানানো যায় না। চড়কের মাঠে কোনোদিন তো আর যাবেন না ফ্রয়েড সাহেব,স্বপ্নের আর কী বুঝবেন।
    কতলু খাঁ : ঐ দেখ ! যেন পদ্মবনে হংসী সমীরণোত্থিত তরঙ্গহিল্লোলে নাচিতেছে; প্রফুল্ল পদ্মমুখী সবে ঘেরিয়া রহিয়াছে। দেখ দেখ, ঐ যে সুন্দরী নীলাম্বরপরিধানা, ঐ যার নীল বাস স্বর্ণতারাবলীতে খচিত, দেখ! ঐ যে দেখিতেছ, সুন্দরী সীমন্তপার্শ্বে হীরকতারা ধারণ করিয়াছে, দেখিয়াছ উহার কি সুন্দর ললাট! প্রশান্ত, প্রশস্ত, পরিষ্কার; এ ললাটে কি বিধাতা বিলাসগৃহ লিখিয়াছিলেন? ঐ যে শ্যামা পুষ্পাভরণা, দেখিয়াছ উহার কেমন পুষ্পাভরণ সাজিয়াছে? নারীদেহ শোভার জন্যই পুষ্প-সৃজন হইয়াছিল। ঐ যে দেখিতেছ সম্পূর্ণ, মৃদুরক্ত, ওষ্ঠাধর যার; যে ওষ্ঠাধর ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া রহিয়াছে, দেখ, উহা সুচিক্কণ নীল বাস ফুটিয়া কেমন বর্ণপ্রভা বাহির হইতেছে; যেন নির্মল নীলাম্বুমধ্যে পূর্ণচন্দ্রালোক দেখা যাইতেছে। এই যে সুন্দরী মরালনিন্দিত গ্রীবাভঙ্গী করিয়া হাসিয়া হাসিয়া কথা কহিতেছে, দেখিয়াছ উহার কেমন কর্ণের কুণ্ডল দুলিতেছে? কে তুমি সুকেশি সুন্দরী? কেন উর:পর্যন্ত কুঞ্চিতালক-রাশি লম্বিত করিয়া দিয়াছ? পদ্মবৃক্ষে কেমন করিয়া কালফণিনী জড়ায়, তাহাই কি দেখাইতেছ? আর, তুমি কে সুন্দরী, যে  সুরা ঢালিতেছ? কে তুমি, যে সকল রাখিয়া তোমার পূর্ণলাবণ্যদেহ আমাপ্রতি  ঘন ঘন সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতেছে? কে তুমি অব্যর্থ কটাক্ষে  হৃদয় ভেদ করিতেছ? ও মধুর কটাক্ষ চিনি; তুমি বিমলা। অত সুরা ঢালিতেছ কেন? ঢাল, ঢাল, আরও ঢাল, বসন মধ্যে ছুরিকা আছে ত? আছে বই কি। তবে অত হাসিতেছ কিরূপে? কে তোমার মুখপানে চাহিতেছে। ও কি? কটাক্ষ! ও কি, আবার কি! ঐ দেখ, সুরাস্বাদপ্রমত্ত যবনকে ক্ষিপ্ত করিলে। এই কৌশলেই বুঝি সকলকে বর্জিত করিয়া আমার প্রেয়সী হইয়া বসিয়াছ? না হবে কেন, যে হাসি, যে অঙ্গভঙ্গী, যে সরস কথারহস্য, যে কটাক্ষ! আবার সরাব!  যে চাহনি চাহিয়া বিমলা হাতে সুরাপাত্র দিতেছে! ও কি ধ্বনি? এ কে গায়? এ কি মানুষের গান, না, সুররমণী গায়? বিমলা গায়িকাদিগের সহিত গায়িতেছে। কি সুর! কি ধ্বনি! কি লয়!  এ কি? মন কোথায় তোমার? কি দেখিতেছ? সমে সমে হাসিয়া কটাক্ষ করিতেছে; ছুরির অধিক তোমার হৃদয়ে বসাইতেছে, তাহাই দেখিতেছ? অমনি কটাক্ষে প্রাণহরণ করে, আবার সঙ্গীতের সন্ধিসম্বন্ধ কটাক্ষ! আরও দেখিয়াছ কটাক্ষের সঙ্গে আবার অল্প মস্তক-দোলন? দেখিয়াছ, সঙ্গে সঙ্গে কেমন কর্ণাভরণ দুলিতেছে? হাঁ। আবার সুরা ঢাল, দে মদ দে, এ কি ! এ কি! বিমলা উঠিয়া নাচিতেছে। কি সুন্দর! কিবা ভঙ্গী! দে মদ! কি অঙ্গ! কি গঠন!  স্থির হও!“
    দেবদাস : যত্তো সব মাগিবাজ । ইনডিয়া আর ভারতের তফাত জানে না ।
    হেম : যে-সব সাহচর্য তোমাকে ঘিরে থাকে,তারা তোমার চারিত্র্যও কোনো-না কোনো ভাবে কাটে-ছাঁটে; তুমি যে-সমাজে বাস করতে শুরু কর,তার কথ্যভাষার টানটাও তোমার জিভে এসে যায় ।
    গফুর : প্রথম যখন আমার খৎনা হলো, তখন আমার বয়স আট বৎসর। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। রোল, একানব্বই। মোট ছাত্র-ছাত্রী বিরানব্বই। পড়াশোনায় ছিলাম ডাব্বা। ভাবলাম, শাস্তি হয়তোবা। একজন ডাক্তার আসলেন স্কুলে। এসে আমার প্যান্ট খুলে বললেন, 'কই দেখি ছোটপাখি? কিচিরমিচির ডাকি ডাকি..!' বলে আমার ছোটপাখি বের করে কচ করে কেটে দিলেন অল্প একটু চামড়া। আমি তারস্বরে চিৎকার করে উঠলাম। কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী আমার দিকে আঙ্গুল তাক করে হাসলো। আমি চিৎকার গিলে ফেললাম। বাসায় ফেরার পথে দেখলাম, আমার প্যান্টের জিপারে রক্ত লেগে আছে। রাস্তাঘাটের অনেকেই আমার দিকে আঙ্গুল তাক করে কুৎসিত কথা বলল। বাসায় ফিরে ছোটপাখি কাটা যাওয়ার তীব্র যন্ত্রণা সামলে উঠতে সময় লাগল বেশ কিছুদিন। আমি ঘর থেকে বের হতে পারলাম না। হাঁটতে গেলেও লুঙ্গিতে ঘষা খেত আহত পাখি। কিচিরমিচির ডেকে উঠত খুব। ঘাম দিতো শরীর। সেকি যন্ত্রণা! পুরো নয়দিন লাগল যন্ত্রণা দূর হতে। দশদিনের মাথায় আমি পুরোপুরি সুস্থ। ফের খেলতে ছুটলাম, ব্যাগ কাঁধে স্কুল। সব ঠিকঠাক। এক মাস পর রাস্তায় হাঁটছি। হাতে ব্যাট। মাত্রই ক্রিকেট খেলে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। ডাক্তার সামনে উপস্থিত। হাতে যন্ত্রপাতি। আমি আশপাশ তাকালাম। আজ কার ছোটপাখি কাটা হবে? ডাক্তার এসে আমার প্যান্ট খুলে আমারই ছোটপাখি বের করে ফের কেটে দিলেন আরেকটুখানি। আমি চিৎকার করে উঠলাম।
    'এক পাখি কয়বার কাটবেন হারামজাদা?' 'এক দুই মাস পর পর কাটতে হবে বেটা।' ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আমার বিশ্বাস হলো না। কী বলে এই লোক! দৌড়ে বাড়ি আসলাম। আব্বা লুঙ্গি উঁচু করে বসে বললেন, 'কী হয়েছে রে তোর?' 'আমার ছোটপাখি দুইবার কাটা হয়েছে।' আব্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 'আমার চারশো একান্নবার।'আব্বার চোখে জল। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম আব্বার বুকে। আব্বা কাঁদো স্বরে বোঝালেন, 'কিচ্ছু করার নেই বাবা। এটাই আমাদের শরীর। মাসে এক দুইবার করে কাটা যাবে।' 'আমাদেরই কেন?' 'প্রকৃতি এইভাবেই তৈয়ার করেছে আমাদের।' 'তাই বলে মাসের পর মাস?' 'তো কী? এখন ডাক্তার কাটতেছে, আরেকটু বড়ো হলে নিজেকেই কাটতে হবে।' 'নিজেকে মানে? নিজের পাখি নিজে কী করে কাটবো?' আমার বয়স এখন একুশ। আজ জোছনা রাত। ছাদে লুঙ্গি খুলে বসে আছি। হাতে কেঁচি। একটু পর যখন চাঁদ উঠবে, সমস্ত ছাদজুড়ে জোছনা থইথই করবে, কুটুস করে আমি আমার ছোটপাখির মাথা কেটে নিবো তখন। তিরানব্বই বারের মতোন। রক্তে ভেসে যাবে ছাদ। অথচ কেউ টের পাবে না। কেউ জানবে না। শহরের ছাদে ছাদে অসংখ্য পাখি কাটা যাবে, রক্তে ভেসে যাবে জোছনা, কারো টু শব্দ থাকবে না। পুরুষের শারীরিক দুঃখ কষ্টগুলো অত্যন্ত গোপন একটা বিষয়। আশপাশের কেউ তার হদিস রাখে না।
    দেবদাস :  যত্তো সব  মাতাল । খোসা-ছাড়ানো বাঙালি আর খোসাসুদ্দু বাঙালির তফাত জানে না ।
    রাজপুত্র : ওই তো আকাশ থেকে নটবরের ইগলু নামছে, তিনটে প্যারাশুটে বাঁধা।
    সওদাগরপুত্র : ওটা ইগলু নয় । মহাকাশযান থেকে কাউকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে । সেই লোকটা ওই ক্যাপসুলে বসে আছে ।
    শ্রীকান্ত : আমার মনে হয়, স্বর্গ থেকে মেনকা, উর্বশী, রম্ভা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, অলম্বুষা, মিশ্রকেশী্, জানপদী,  বিদ্যুৎপর্ণা, অদ্রিকা, পঞ্চচূড়া, সোমা, মরীচি, শুচিকা, অম্বিকা, ক্ষেমা, অসিতা, সুবাহু, সুপ্রিয়া, সুগন্ধা, সুরসা, বিশ্বাচী, পূর্বচিত্তি, প্রম্লোচা, বর্গা, প্রমথিনী, কাম্যা, শারদ্বতী, গুণবরা, ঋতুস্থলা, বুদ্বুদা, সৌরভেয়ী, ইরা, চিত্রাসেনা, সমীচী, চারুনেত্রা, পুঞ্জিকস্থলা, শুচিস্মিতা, বিশালনয়না যে সব অপ্সরারা থাকে তাদের গুমুত আর মাসিকের কাপড় ফেলা হচ্ছে ডাবায় ভরে । দেবরাজ ইন্দ্র প্রায়েই অপ্সরাদের মর্তে পাঠান নেতাদের লোভ দেখিয়ে চুতিয়া বানাবার  জন্য। 
    খোকা : যখন আমাকে নেতারা এখানে পাঠাচ্ছিলেন তখনই দেখেছিলুম ওনারা মহাচুতিয়া ।
    রাজপুত্র : অপ্সরাদের গুমুত দিয়ে মূর্তি গড়ে আমরা একজন শাসক তৈরি করতে পারি । অবশ্য যদি নটবর এসে পড়েন তাহলে গুয়ের তৈরি শাসকের দরকার নেই ।
    অমরনাথ : যে নামছে, তাকে আমরা নটবরের জায়গায় বসাই আর ওকেই অনুরোধ করি আমাদের সমস্যা তৈরি করে তার সমাধান খুঁজে বের করতে ।
    শচীন্দ্র : ও কি জানে এটা নষ্টনটদের কলোনি আর আমরা উলঙ্গ, সরকার আমাদের পোশক বরাদ্দের আইন পাশ করেনি, ল্যাংটো করে নষ্টনট কলোনিতে পাঠিয়েছে, সঙ্গে তরতাজা যুবতীদের পাঠায়নি ।
    নগেন্দ্র : আমি মোটেই নষ্টনট নই, আমি স্কিৎসোফ্রেনিক ।
    মহেন্দ্র : আমিও নষ্টনট নই । আমি মনোরোগে ভুগছি ।
    সতীশ : আর সবাই জানে আমি হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হই ।
    রমেশ : আগে দেখা যাক যে নামছে সেও নষ্ট কিনা । হয়তো অন্য গ্রহ থেকে ওকে নষ্টনটদের কলোনিতে পাঠানো হয়েছে, আমাদের সঙ্গ দেবার জন্য ।
    বেণী ঘোষাল : চল চল চল চল নেমেছে নেমেছে ।
    সব্যসাচী : লোকটা নিজে থেকেই বেরোবে না আমরা লাথি মেরে ক্যাপসুলটা খুলবো ?
    অপূর্ব : যদি কেউ ভেতরে না থাকে ? যদি অপ্সরাদের গুমুত দিয়ে ভরা থাকে ? 
    গফুর : যদি লোকটা পাগল না হয় ?
    মহিম : যদি ওর মধ্যে কোনো পাগলি থাকে ?
    শশী: পাগলি থাকলে আমি নেবো । সহনশীল হতে হতে এক অত্যাশ্চর্য ঘুণপোকা হবার পর, কুরে খাচ্ছি নিজের একান্ত ব্যক্তিগত মস্তিষ্ক ।
    আনন্দ : না আমি নেবো । তোমার তো কুসুম আছে । রোজ শালবনে নিয়ে গিয়ে চোদনকম্মো করতে, মানিক বাঁড়ুজ্জে জানতে পারলে তোমার লিঙ্গ কেটে তোমাকে খাইয়ে দিতো ।
    যতীন : পাগলি থাকলে আমরা কি তাকে নটবউ বলব ? 
    সদানন্দ : নটবউ হলে তো মুশকিল, আমাদের সমস্যা বেড়ে যাবে । পাগলদের দেশে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিষিদ্ধ । হয়তো তিনি রুপবতী, তিনি গুনবতী, তিনি ভাগ্যবতী। হয়তো তাঁর কপালের সাথে আপনার কপালের একটি মাত্র ঘষায় আপনিও হয়ে উঠতে পারেন বাংলার মুকেশ আম্বানি। হয়তো তিনি বাহিরে গরম, ভিতরে শরম টাইপ মানবী। হয়তো কন্যার হাসি আপনার সালমান খানের  মতন কঠিন হৃদয়ও গলিয়ে ফেলে ভানু বাঁড়ুজ্জের মতো হাসতে হাসাতে শেখাবে। হয়তো কন্যার কথায় আপনি আদানির মতো চানাচুর বেচে তিন দিনে কোটিপতি হওয়ার মতো মোটিভেশান পাবেন। ভাইসব সামনে শীতকাল, যিনি আসছেন সেই কচি এলাচের মতো কোমল হৃদয়ের নারীটির ওপর রহম করেন, বিনিময়ে সে পুরা শীতকাল নোরা ফাতেহির মতো তার শাড়ীর আঁচল কেটে আপনারে ল্যাঙোট পরাবে। তাঁর জন্য একটি শীতকালীন টাটকা প্রেমিক আবশ্যক, তাঁর জন্য একটি জীবন্ত কম্বল জরুরী,পরবর্তীতে তিনি শীতকালীন প্রেমকে গ্রীষ্মকালীন তিন তালাকে রুপান্তর করে দেবেন। অতএব ভাইসব যারা শীতকালীন প্রেমিক হইতে আগ্রহী তারা কন্যারে নক দিয়ে দলে দলে দোজাহানের নেকি হাসিল করুন।
    ঠকচাচা : মোর উপর এতনা টিট্‌কারি দিয়া বাত হচ্ছে কেন? মুই তো এ শাদি কর্‌তে বলি —একটা নামজাদা লোকের বেটী না আন্‌লে আদমির কাছে বহুত শরমের বাত, মুই রাতদিন ঠেওরে-ঠেওরে দেখেছি যে, পাগলরা আচ্ছা আদমি —তেনার নামে বাগে গরুতে জল খায় —দাঙ্গা-হাঙ্গামের ওক্তে লেঠেল মেংলে লেঠেল মিল্‌বে —আদালতের বেলকুল আদমি তেনার দন্তের বিচ —আপদ্ পড়্‌লে হাজারো সুরতে মদত্‌ মিলবে। কাঁচড়াপাড়ার রামহরি বাবু সেকন্ত আদ্‌মি —ঘেসাট ঘোসাট করে প্যাট-টালে —তেনার সাথে খেসি কামে কি ফায়দা? 
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । লাবিয়া ম্যাহোরা আর লাবিয়া মাইনরার তফাত না জেনেই প্রেম করতে যায় ।
    বিপিন : নটবউ নয়, যারা ক্যাপসুলে বসে নামে তাদের বলে অ্যস্ট্রোনট । 
    সত্যচরণ : ধ্যুৎ, পুঁজিবাদীরা বলে অ্যাস্ট্রোনট, আমরা বলি কসমোনট ।
    খোকা : আমি তো নষ্টনট হবার আগে শুনেছিলুম ওদের বলে অন্তরীক্ষযাত্রী ।
    অপু : না, না, মহাকাশচারী ।
    হরিহর : তোরা জানিসনে । ওদের বলে নভচর । নভচর মানেই নটবর। নব ঘোরা দিকি, বেরিয়ে আসুক লোকটা । একটা ছোট্ট নব, সারাবছর যার কোনো ভূমিকা বা গুরুত্বই নেই, এই সময়ে তাকে হিমসিম খেতে হয়। কান মুচড়ে, কান মুচড়ে তাকে একটাই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে--টু বি অর নট টু বি? হ্যাঁ দ্যাট ইজ দ্য প্রশ্ন বটে ! ফ্যান চলবে কি চলবে না? চললেও একে না দুয়ে নাকি তিনে? মিনমিন করে মিন যারা, তারা বলবে, বন্ধই থাক। একে করোনা, তায় হিম। সমস্বরে ওদিক থেকে প্রতিবাদ আসবে। তা কি হয়? ফ্যান চলুক। তালে কততে? আবার কান মুচড়োবে তার.. গলদঘর্ম হয়ে সে গান ধরবে--মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে, এদিন ভরা সাঁঝে..যেতে যেতে দুয়ার হতে কী ভেবে ঘোরালে নবখানি ।
    নিখিলেশ : আমরা সবাই মার্কামারা নষ্টনট । 
    সন্দীপ : ওঙ্কারের মতো ছড়িয়ে যায় কে দাবানল দাবানল খেলে ! প্যালেট জুড়ে অদ্ভুত আঁচড়ে বিধবা রঙের চাঁদ আঁকতে গেলে মর্গের শীতল বায়ু মনে পড়ে। মনে পড়ে কন্ঠনালীতে বসে যাওয়া দাগ এক করুণ বিলাপ, রুদ্ধ চিৎকার, কালচে ক্ষত। জাহাজের সারেং গুছিয়ে নিচ্ছে নোঙরের দড়ি, সেও এক দৃশ্যবাজিকর। কুয়াশা ভেজা আধো আলোতে নগ্ন পথ হেঁটে যেতে যেতে মুছে ফেলতে চাই স্পর্শের সমস্ত আকুলতা। জোছনাদগ্ধ তৃষ্ণাতুর ভেজা চোখ গলে গলে পড়া পীচ জানে ঠিক কী কী অপমানে অট্টহাসিও ক্ষয়ে যায়। মন খারাপের এমন রাতে পৃথিবীর দীর্ঘতম শ্বাস ফেলে আকাশে তাকালে হলুদ হয় চোখ। মৃত্যু ভয় করে না বলে চিলেকোঠা সাজে ফাঁসের দড়িতে। ছেলেবেলার পানকৌড়ির ডুব মনে পড়ে খুব। বিষণ্ণ প্রাণ মুক্তি না পেলে উচ্ছলের ভাব-সম্প্রসারণ হয় না, তাই হারিয়ে যাবার নাম রাখা হোক- একটি নিখোঁজ সংবাদ। এই যে রোদ্দুর নেই, ছায়া নেই, বৃষ্টি নেই। এতোখানি আয়ু নিয়ে কী করে নষ্টনটের দল ?
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । স্বদেশ আর পায়ুদেশের তফাত জানে না ।
    চার
    ক্যাপসুল মাটিতে নামার পর নষ্টনট কলোনির ল্যাংটো ভাবুকরা লাথি মেরে খুলে দেখতে পায় ভেতরে একজন বসে আছেন, কথা বলার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না । লোকটার মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে খোকা চেঁচিয়ে উঠলো, ও বলছে ওর নাম রুক-রুককে-করো। 
    হরিহর : ওকে কাতুকুতু দে, তাহলে মুখ দিয়ে স্পষ্ট কথা বেরোবে, পুরো নাম বলবে। 
    ঠকচাচা : মুই বলি এসব ফেল্‌ত বাতের দরকার কি? ত্যাল খেড়ের বাতেতে কি মোদের প্যাট ভর্‌বে? 
    খোকা : বলেছে, বলেছে । ওর নাম রুক্মিণীকুমার ।
    নবকুমার : হারুকি মুরাকামি কী লিখছেন, মিলান কুন্দেরা কী লিখেছেন, সেসব দিয়ে আমাদের  বিচার হওয়া উচিত নয়। ওঁরা কোনোকালে মঙ্গলকাব্য পড়েননি, চরিতামৃত পড়েননি, কথামৃত পড়েননি, বিষাদসিন্ধু পড়েননি। ওঁদের চিন্তার জাত  আমাদের  জাতের সঙ্গে মিলতেই পারে না। যদি মিলে যায়, আমাদের কোনো নষ্টনটের নষ্টামির সঙ্গে যদি দেখা যায় ওরহান পামুকের বেশ মিল আছে, মুরাকামির লেখা মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর লেখা পড়ে, বুঝতে হবে সেটা ম্লেচ্ছ নষ্টামি। ম্লেচ্ছ নষ্টামি আন্তর্জাতিক নষ্টামি নয়। আন্তর্জাতিক নষ্টামি তখন হবে, যখন আমাদের কোনো নষ্টনট বিশ্বনষ্টামিতে এমন কিছু যোগ করতে পারবেন, যার ফলে পৃথিবী নড়েচড়ে উঠবে। সেটা অনুকরণ, অনুসরণ বা নকলনবিসির দ্বারা হওয়ার নয়। যে নষ্টনট শিবপুরাণ পড়েননি, তাঁকে আমি সন্দেহ করি। 'কাফকা অন দ্য শোর' না পড়েও নষ্টামি করা যায়, কিন্তু 'রামকৃষ্ণ কথামৃত' যে পড়েনি, সে বাঙালি নষ্টনটই নয়, আন্তর্জাতিক নষ্টামি তো দূরের কথা।।
    গোবিন্দমাণিক্য : নষ্টনটেরা কতদিন নষ্টনটদের বিরুদ্ধে ছড়ি ঘোরাতে পারে? আমার চোখে দেখা 
    কত কঠোর নষ্টনট শিক্ষক রিটায়ার্ড হলেন, কত দক্ষ নষ্টনট প্রশাসক বদলি হলেন, কত বড় বড় নষ্টনট নেতা মন্ত্রী চলে গেলেন, দেশবরেণ্য কত নষ্টনট ...আজ আর কেউ বেঁচে নেই ! তারা কত দাপুটে ছিলেন; কাজেই, কি হয় এতসব - সাময়িক ভয়াবহ ভনিতা কঠোরতা কান্ডকারখানা করে? এতকিছু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরেও নষ্টনট কলোনির উন্নতি সেভাবে হলনা ! তুমি তবে কিএমন মারাক্কু মোরব্বা খাওয়াবে? নষ্টনটরা কতদিন নষ্টামির ছড়ি ঘোরাতে পারে? নষ্টনটরা নিজেও সেটা বুঝতে পারেনা; তাই ক্ষমতার মদগর্বে, আত্মঅহংকারে ধরাকে সরা ভাবতে ভাবতে বড় বেশি সরভাজা খেয়ে ফেলে।
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । সরভাজা আর ডিমভাজার তফাত জানে না ।

    পাঁচ
    রুক্মিনীকুমার বেরিয়ে আসেন । বকরবকর শুরু করে । মহাকাশে মুখ বন্ধ রাখতে হয়েছিল বলে কতো কথা জমে আছে পাকস্হলিতে ।
    রুক্মিণীকুমার : আমি কতকগুলো জিনিস বিশ্বাস করি । আপনি হয়তো অদ্ভুত মনে করবেন । আমি বুঝলেন বংশ মর্যাদায় বিশ্বাস করি । আপার ক্লাসে বিশ্বাস করি । আপার ক্লাসের মনটা, তার সেনসিবিলিটি আপার ক্লাসের । আপার ক্লাস বলতে ভারতীয় আপার ক্লাস ।  হঠাৎ কতোগুলো আইডেনটিটি অফ ওয়র্ড উপনিষদ থেকে বললুম সেরকম মিস্টিসিজম হয় না -- তার অত্যন্ত একটা, ফলে তার সৌন্দর্যবোধ একটা থাকে যাতে করে টপটপ করে -- আজকে ধরুন গ্রিস মরে গেছে, কী করে হল যে ভারতীয় দুম করে উঠে গেল । 
    খোকা : এখেনে সবাই ডিক্লাস নটবর সাহেব, মুকখুর ডিম, সবাই সাবঅলটার্নদের চেয়েও তলাকার, দেখছেন তো গায়ে দেবার পৈতেটুকুও নেই ।
    সত্যচরণ : কবি লিখেছিলেন, করুণ শঙ্খের মতো স্তন, দুধে আর্দ্র আর কলোনির সরকার লিখলেন: উড্ডীয়মান মনিময়তা ! স্তন এখানে যেন ম্যাক্স আর্নস্তের সবুজ জীবাশ্ম নিসর্গের গুহ্য চোখ, মাইয়ের বোঁটায় যার এমারেলড চাহনি। যদিও এই রূপকল্পটি  সুকুমারীদির স্তনের নয় পার্সি স্টাইলে পরা শাড়ির ঘোমটার পিন অর্থাৎ চমৎকার পান্নার হিরোনডেলের বর্ণনায় দিয়েছেন যার শুধু ডানাদুটি চুনীর, ইহা এক বিশাল ক্লাসিসিজম ! আছে আছে আছে আছে, গল্পটা দশবার পোড়ো।ও কেউ আর লিখতে পারবে না কোনো দিন । ভালো জিনিসকে মডেল করলে জিনিস ভালো হয়... এখানে আমি বিশেষত রাত ভ'রে বৃষ্টি-র অনুষঙ্গে কবিবর বুবু’র এই পদটিকে উজ্জ্বল স্তনের ইমেজ-ব্যঞ্জনা হিসেবে কাজে লাগালাম; কবিবর বুব একটা পাতা শুধু রতিসুখ আপ্লুত ক্লান্ত নিদ্রাতুর মালতীর স্তনের জমকালো পরাবাস্তব নির্জন ভয়াল বিনির্মাণে খরচ করেছেন, ফাদার দ্যতিয়েনের বাংলা গদ্যপরম্পরা দুইতে সংকলিত হওয়ার মতো ইটসেলফ পৃষ্ঠাটিই একটি মাস্টারপিস…
    গোবিন্দমাণিক্য : খরচ করলেও, ওসব বেচেবুচে টাকাকড়িও কম করেননি ।
    সওদাগরপুত্র : আপনি শেষ কবে স্তন ছুঁয়েছেন ? মনে হয় মায়ের স্তন ছাড়া অন্য কারোর স্তন ছোঁয়া হয়নি জীবনে ।
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । স্তন আর মাইয়ের তফাত জানে না ।
    রুক্মিণীকুমার : আমি কৌশিক সরকারের ম্যাশাপ পেইনটিঙে দেখেছি, বুকের একদিকে মাই আর অন্য দিকে স্তন ।
    চন্দ্রকান্ত : পর্দায় থাকতে হবে, তীব্র গরমে হাত-মোজা, পা-মোজা, মাথায় বাঁধাকপি বেঁধে বেরুতে হবে বাইরে তাও অতিশয় ইমার্জেন্সি না হলে না, নিনজা টারটেলস এর মতন চক্ষু দেখা যাবে কি যাবে না কারণ চক্ষে আবার অপ্সরাদের ব্যাপক তৃষ্ণা ও কাম ঝরঝর করে ঝরে পড়ে, সেইটায় আবার তাগো ঝিরঝিরা এন্টেনায় নেটওয়ার্ক আইসা পড়ে। পড়াশোনা করানোর দরকার নেই ঘরে থাকুক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুরুষ টিচার আছে, সহপাঠী আছে। যদিও পড়াশোনা করেই ফেলেন বিয়ের পর সব বন্ধ। ডাক্তারের ও চাকরির দরকার নেই, পুং ডাক্তার আছে ওখানে। কোন পুং কে রক্ত দেয়া যাবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি (কারণ এরা তেঁতুঁল)। এরাই আবার এইরকম ও চায়। এখন তাইলে কি করতে হবে? ডেলিভারির আগে মঙ্গল বরাবর দরখাস্ত করবেন জনাব, টুপ করে ঝরে পড়বে ডাক্তার, মহিলা এলিয়েনেরা। আর আপনি সারাজীবন এইরকম খাবি খাওয়া খুব কিউট এবং সমানতালে কনফিউজড ক্যারেক্টার নিয়া দৌড়াইবেন। আপনারে ভালুবাসা । ডাক্তারের চাইতে যখন তার লিঙ্গ(খুবই ফেয়ার অর্থে) বড় হয়ে যায় আরকি, হেহে...ওই যে সিকিৎসার সময়! বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিঁচিঁইঁইঁইঁ...
    শ্রীকান্ত : নিশ্বাস ফেলিয়া পাল্‌কিতে উঠিয়া বসিলাম। দেখিলাম, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না—ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে। ছোট-খাটো প্রেমের সাধ্যও ছিল না—এই সুখৈশ্বর্য্য-পরিপূর্ণ স্নেহ-স্বর্গ হইতে মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য আমাকে আজ একপদও নড়াইতে পারিত। বাহকেরা পাল্‌কি লইয়া ষ্টেশন-অভিমুখে দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। মনে মনে বারংবার বলিতে লাগিলাম, লক্ষ্মী, দুঃখ করিয়ো না ভাই, এ ভালই হইল যে, আমি চলিলাম। তোমার ঋণ ইহ-জীবনে শোধ করিবার শক্তি আমার নাই। কিন্তু যে জীবন তুমি দান করিলে, সে জীবনের অপব্যবহার করিয়া আর না তোমার অপমান করি—দূরে থাকিলেও এ সঙ্কল্প আমি চিরদিন অক্ষুণ্ণ রাখিব। 
    রুক্মিণীকুমার:  স্তন চোখের থেকেও রহস্যময়, শিল্পী না হলে মর্ম বুঝবে না, ওটা বরিশালের কবির সাবজেকট, স্তনের সফটনেস: স্তনের ভায়োলেন্স: স্তনের কটাক্ষ, পেন্সিলে ছাড়া আঁকা যায় না
    স্তনের মনুমেন্টালিটি, ল্যাবিরিন্থ, স্তনের অভ্যুত্থান, স্তব্ধতা ভার্টিগো।
    বেণী ঘোষাল : আপনি বোধহয় আফ্রিকার স্তনে টোকে মেরে টনটন শব্দ শোনেননি । এক্কেবারে মেটালিক সাউণ্ড । আপনাকে নটবরের মান্যতা দেয়া বেশ কঠিন । এই নষ্টনট কলোনির পাগলবৃন্দ, আপনারা সমস্যা তৈরি করুন, দেখুন, যদি উনি সমাধান বের করতে পারেন । এর চেয়ে তো অপ্সরাদের গুয়ের ডাবা পড়লে আনন্দ হতো । যাদের লিঙ্গোথ্থানের সমস্যা তার সুরাহা হতো।
    গোরা : নষ্টনটদের অনেকের লিঙ্গের দোষ ছিল বলে এই কলোনিতে পাঠানো হয়েছে । কেননা লিঙ্গ-যোনির মিল হয়নি । ফলে ডিভোর্স - যে কোন কারণেই হতে পারে। কিন্তু যে কারণেই হোক, ডিভোর্স লেটারে স্পস্টভাবে প্রতিটায় উল্লেখ থাকে মেয়েটা চরিত্রহীনা। এটা যদি ছেলে নাও দিতে চায় তার ফ্যামিলি এবং লইয়ার ফোর্স করে দেয়ায়। কারণ তাতে নাকি ডিভোর্সের উপযুক্ততা শক্তপোক্ত হয়। আপনি দীর্ঘ সময় প্রেম করে বিয়ে করলেন, বিয়ের পর টিকলো না। হতেই পারে। আপনি বিয়ে করলেন, মোটামুটি পরিচিত, মিলছে না। হতেই পারে। আপনার এক বা দুইটা সন্তান আছে, তবুও সম্ভব হচ্ছে না। হতেই পারে। বা মনে করেন প্রেমের এক পর্যায়ে দুইজন সিদ্ধান্ত নিলো ঠিক আছে আমরা আমরা করে ফেলি পরে ফ্যামিলিকে রাজী করানো যাবে। ফ্যামিলি রাজী হচ্ছে না, হলো না। ফ্যামিলির বাইরে বিয়ে করার সাহস আছে, কিন্তু ফ্যামিলি জানার পর সংসার করার সাহস নেই। সো, ডিভোর্স। মানলাম এটাও হতেই পারে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ায় যাবার সাথে সাথে একজন উকিল কী পরিমান বাজে কথা বলবে, একমাত্র এটা প্রমাণের জন্য যে, শুধুমাত্র চরিত্রের দোষে এটা ডিভোর্সে যাচ্ছে।  চরিত্র বলতে আমরা  বুঝি, এই মেয়ে বিভিন্ন জায়গায় নানা পুরুষের সঙ্গে শোয়। সিরিয়াসলি, এটাই চরিত্রের একমাত্র ডেফিনিশন । আর বাকি যে স্বামী তিনি ফুলেল চরিত্রের অধিকারী। বা তার ডিভোর্স পেপারে এটা থাকার বাধ্যকতা নেই। একটা মেয়ে চেষ্টা করে প্রচুর, টেকাতে। অনেক ছেলেও করে৷  জীবনভর বিতৃষ্ণা, মারামারি, কাটাকাটি, ভেতরে মরে যাবার চাইতে ডিভোর্স ভালো। কিন্তু এই ডিভোর্সের সময় মেয়েদের শারীরিক অত্যাচারের প্রমাণ দিতে হয়, না হলে প্রমাণ হয় না সে নির্যাতিত। কোন মেয়েই পারতপক্ষে বাইরে বলে না আঘাতের দাগটা তার স্বামীর মার। সে বলে কোনভাবে আঘাত পেয়েছে। কেন বলে এমন, কারণ সে মানে ওটা তার পরিবার, পরিবারের সম্মান। সে চায় একদিন ঠিক হয়ে যাবে। সে সহ্য করে। কিন্তু ওই পরিবারে সে শুধুমাত্র পরের ঘরের। আপন নয়। সবাই এমন তাও না, আমি ম্যাক্সিমামের কথা বলছি। কেউ চায়না এই প্রমাণ করে বা বলে তার সিচুয়েশনটুকু পরিবারে আরো খারাপ পর্যায়ে যাক। যে পরিবারের সম্মান, স্বামীর সম্মান সে ভেবে এগুলো চেপে যায়, সে পরিবার তাকে কতটুকু ভাবে? এখন সবাই কি প্রমাণ রেখে মারে? সেখানে মেয়ের পরিবারের কেউ উপস্থিত থাকলে মারবে নাকি উপস্থিত করে মারবে। মেয়েটা কি ডাক্তারের কাছে যাবার সুযোগ পাবে? বা গেলেও ওটাই বলবে স্বামী দ্বারা নির্যাতিত? তো এই ব্যাপারগুলো কিভাবে প্রমাণিত হয়? কেন সাক্ষী বা ডাক্তারি সার্টিফিকেট এতো জরুরি। কেউই সেই পর্যায়ে না গেলে অন্তত কোর্ট পর্যন্ত যায় না, অথচ ওখানে একমাত্র মেয়ে ও তার ফ্যামিলি তীর্যক দৃষ্টি, সামাজিক ব্যাভিচার ও অযাচিত অন্যায় অপমানের শিকার হন। আমাদের ল ইয়ারদের কি মনে হয়না তারা অন্যায় করছেন? আমাদের সমাজে যারা ভালো অবস্থানে আছে, তারা পারেন না এইরকম আইন গুলো সংশোধন এর জন্য দুটো কথা বলতে? বাংলাদেশের ম্যাক্সিমাম পরিবারে আমাদের কন্যা, বোন, সুসম্পর্কের আত্মীয় স্বজন এর এই ঘটনা আছে। আমরা মেনে নিয়ে চুপ করে থাকি। একবার ভাবিনা এই একটা কারণে ওই মেয়েটার ভবিষ্যৎ কোথায় চলে যাচ্ছে। একটা পুরুষ এভাবে ভোগে কম।
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । ডিভোর্স আর ভেন্ন হবার তফাত জানে না ।
    গফুর : নটবর সাহেব! আমি যে বিরাট কাজ্জাব হয়ে যাচ্ছি; আমি আমার ভেতর নাফাকির সমস্ত আলামত দেখতে পাচ্ছি । নটবর সাহেব  আমি বুঝতে পারছি, আমি চিনতে পারছি, মানুষের নানারঙি হিজাবের বাতাস । নটবর সাহেব, আমি যে পাপে ঢুকেই যাচ্ছি, ডুবেই যাচ্ছি, আমাকে উদ্ধারের কোনো পথ আমি পাচ্ছি না যে! নটবর সাহেব ! আপনার  মিঠা-চরিত্র আমি পড়ি, আমি মুক্তি পাই না, আমি নাজাত পাই না । নটবর সাহেব ! আমার সামনে আন্ধারের আয়না কালো আরও কালো হয়ে আছে । আমি ভিতরজ্বলনে দগ্ধ, ভিতরআগুনগ্রস্ত, ভিতরের তলানি আমায় খেয়ে ফেলেছে সবটুকু । নটবর সাহেব,  আমি  দারুণ পীড়িত, রুগ্‌ণ, আমি কী করে আপনাকে বলি! নটবর সাহেব, নষ্টনটদের কলোনিতে আমি তো ডুবে আছি অবিশ্বাসিদের জড়াজড়ি খেলায় ।কী করব বলুন, নষ্টনটেরা যে  পিছনের দিকে গতিশীল । যখন  কেটে নিয়েছিলেন খোসা, আমি তখন বোদলেয়ার র‌্যাঁবো ভেরলেন অতোনা আতো আওড়াই; আমার প্রিয় পরিজন বলে কেউ নাই । নটবর সাহেব ! আপনার সুশীতল হাত আমার মাথার উপর নাই, আমি অধঃপতিত হয়ে গেছি নটবর সাহেব। আমার দেহে দেখা দিয়েছে ছত্রাক, মানে মাশরুম, কিন্তু তা বিক্রি করতে পারছি না, অথচ আমার গালে-মুখে দুধসাদা মুথাঘাস গজিয়েছে, হে নটবর সাহেব, আমি পীড়িত, জ্বলে যাচ্ছে পুরো দেহ, আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি, আমি দপ করে নিভে যাই,আমি জ্বলে উঠি,  আমার মুক্তি আসে না, আমি কবিতা লিখি, জোয়ান বয়সে ঢুকে আমি ঘুরি বিশ্বসাহিত্যের জানলায়, বাতাসে, আমি শব্দকে পাই ওকতাভিও পাজের কথায়, রক্তের আগে, চিন্তারও আগে, নটবর সাহেব, একদিন সালমান রুশডির পাঠানো  প্রিয় দূত জিবরিল বলেছিল চল মাগিবাজি করি, সে কথা যখন আমি শুনি জান্নাতের পথভ্রষ্ট কোনো মানুষের মুখে,কী করে আমি তাকে অগ্রাহ্য করি? যখন ওপথের যাত্রি নষ্টনটরা দিতে পারেন না কোনো সন্তোষ-বাণী  নটবর সাহেব ! গঙ্গাজলে ধোয়া ছিল আপনার হৃদয়,আপনাকে বানানো হয়েছিল, যাতে আপনি কমলকুমার মজুমদার অমিয়ভূষণ মজুমদার বিনয় মজুমদার আওড়ান, হে নটবর, আপনার মতো সুষম কোনো মানুষ-অস্তিত্ব এ জগত দেখেনি,সংসার দেখেনি কোনো এমন অবিশ্বাস্য নট । আপনি বুঝতেন হৃদয়ের অন্ধারের কথা, আপনি কাঁদতেন মাটিচাপা কুসুমকন্যাদের কথা মনে করে, আপনি রক্ত ঝরিয়েছেন আল মাহমুদ পড়ে, আপনার ছিল না কোনো অভিযোগ মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি, নীটশের প্রতি তো আপনি ছিলেন—দেরিদার মুখে, তার হাবিব, হে নটবর, আর যারা নষ্টনট—যেমন জীবনানন্দ : এরা মানুষের প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসা খণ্ডন করতে-করতে চঞ্চল থেকেছেন কোনো এক অসাধারণ কারণে কারুবাসনায়, আমি জানি, হে নটবর! আমার মতো না থেকেও তারা আমার মতোই ছিলেন, ছিলেন অস্থিতি আর অস্থিরতার ঝড়ের পতাকা, এরা ক্রমাগত লাফিয়েছেন, আটকে গেছেন, আবার চিৎকার করেছেন, নীরব হয়ে গেছেন, এদের কারো কেটে নেয়া হয়েছে জিভ আর কারো লিঙ্গ আর পাঠানো হয়েছে এই কলোনিতে ! আমি তো তাদের তুলনায় নস্য, ওই মাপকাঠিতে তো আমাকে মাপা যায় না; আমার ভাষা একটাই, আমার অক্ষর অক্ষমতা শুধু এক ভাষাতেই; আমার দৌড়ঝাপ-আর্তনাদ সীমাবদ্ধ ভাষার পরিসীমাতেই । আমি শুধু আপনার উলঙ্গ শরীর দেখতে চেয়েছি, তাও স্বপ্নে, এখন আপনাকে স্বচক্ষে দেখছি, আপনার কপচানো শব্দগুলোর অর্থানুধাবন করি, আমার দু চোখ থেকে বেরিয়ে আসে পিরিতির গরম ধাতুরস; আর আপনার নাম-স্মরণে,  এক লাল মিনারের নিচের জ্বলনে আমার চামড়া পুড়ে-পুড়ে যায়, দেহের ক্ষত থেকে ঝরে পড়তে থাকে অসহ্য সোনারুপোর গলন, হে নটবর, আমি নষ্টনটোত্তম, মিথ্যুক ও অপরাধী, আমি মুখোশধারি, হিপোক্রেট, জায়গাবিশেষে মাস্তান, কামাসক্ত, আপনাকে আমার কী বলার থাকতে পারে! আমার ভিতর-জ্বলন, আমার  কান্না; আমার আশৈশব ল্যাংটো থাকার অভিশাপ;  হায়, নটবর ! আমি শান্তি খুজছি...নটবর,  আমি শক্তি খুজছি...নটবর,  আমি শান্তি খুজছি...
    রুক্মিণীকুমার : নাটক কোরো না ; অধঃপতন থেকে ওঠা যায় না । দ্যাখো, সিনেমা বানাতে পারবে না তাই ওসব রয়েসয়ে দেখবে অনেক ভালো ছবি অনেক আছে সব দেখার দরকার নেই ওসব বাজে প্রলোভন। বই পড়ো, তাহলে ভাবতে পারবে, ভাবতে খরচা লাগে না। সিনেমা একটা আউটমোডেড মিডিয়াম যত দিন যাবে তত খারাপ হবে; এটা করপোরেট দুনিয়া রে ভাই পুরো জালি লাইন ওখানে সারভাইভ করতে প্যাখম বেরিয়ে যাবে -- নির্জনতা নেই। ভাবো, ভাবো, ভাবার কোনো বিকল্প হয় না। নষ্টামি জিনিসটা, বিজ্ঞানের চেয়েও বড় বিদ্যা, তুখোড় রিগরাস সায়েন্স! ওসব কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে-টাসে বরিশালের কবির আঁতলামি ভুলে যাও; আরে, হৃদয় খুঁড়েই তো আসল মজা মহেঞ্জোদারো -- আর্কিওলজি অব নলেজ, হৃদয় না খুঁড়লে প্রুস্তিয়ান প্রজেক্টে ঢুকবে কী করে! বেদনা ছাড়া কিছু নেই; বুদ্ধ এটা জানতে পেরেছিলেন তাই বলেছিলেন জীবন দুঃখময় -- সো মাচ দা বেটার! দুঃখ আমার উইজডম। দেরিদা বলেন আই মোর্ন দেয়ারফোর আই অ্যাম: আমি শোকগ্রস্ত, শোকেই আমি সুন্দর ! ধন্যবাদ , মানে একর্ডিং টু হাইডেগার আই উইল থিঙ্ক অব ইউ! নষ্টামি তোমাকে কোনো কিছু ভুলতে দেবে না, মন সব কিছু ছুঁয়ে যাবে, ছুঁয়ে থাকবে, চিরকাল ভাবতে থাকো…
    নিখিলেশ : মহাকাশে সিনেমা হলও আছে ? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। ফেলিনির ছবিতে যেমন মার্সেলো মাস্ত্রেওয়ানি, কুরোসাওয়ার সিনেমায় যেমন তোশিরো মিফুনো, চ্যাপলিনের ছবিতে যেমন স্বয়ং চ্যাপলিন, কীটনের সিনেমায় স্বয়ং বাস্টার কীটন, হিচককের সিনেমায় কেরি গ্রান্ট, ঠিক তেমনই সত্যজিতের সৌমিত্র। এ নিয়ে অনেকের অনেক বক্রোক্তি থাকতে পারে, কিন্তু কিছু করার নেই। উত্তমকুমার আর সৌমিত্রর একটা তুলনা প্রায় ৫০ বছর চলছে, কিন্তু সেটারও কোনো ভিত্তি আমি দেখি না। উত্তমের সঙ্গে তুলনা করতে হলে দিলীপ কুমারের করা যায়, যে দিলীপ কুমার ভারতের প্রথম মেথড এক্টর, কিন্তু শেষ বিচারে হয়ত উত্তমকুমার তাঁর চেয়ে বড় অভিনেতা। উত্তমের সঙ্গে তুলনা রাজ কাপুর বা শিবাজি গণেশনের হয় স্টার হিসাবে। কিন্তু সৌমিত্রের জিনিয়াসের সঙ্গে উত্তমের তুলনা হয় না। এ দেশে সৌমিত্রর চেয়ে দক্ষ অভিনেতা একজনও জন্মায়নি। এ দেশ বলতে আমি ভারত বোঝালাম, পশ্চিমবঙ্গ নয়। দক্ষতা দিয়েই শ্রেষ্ঠত্বের বিচার হয় না। শেষ কথা বলেন জীবন দেবতা। যদি অমিতাভ বচ্চন, বলরাজ সাহানি, মোতিলাল, অশোক কুমার, ছবি বিশ্বাস, নাসিরুদ্দিন, কমল হসন, মোহনলাল, সঞ্জীব কুমার আর বিকাশ রায়ের সঙ্গে সৌমিত্রের তুলনা করতে চান, সেটা একেকটা জ্যোতিষ্কের সঙ্গে আরেকটার তুলনার ব্যাপার হয়ে যাবে। বিচার করবেন জীবন দেবতা।
    রুক্মিণীকুমার : না, টাকাকড়ির অভাবে ব্লু ফিল্মও করে উঠতে পারিনি । কৌশিক সরকার অবশ্য বলেছেন যে টাকা যোগাড় করে দেবেন ।
    গোবিন্দমাণিক্য : কিছু মানুষ থাকে তারা কোনকিছুতেই সন্তুষ্ট না, তুমি যদি পাঁচ টাকার আইসক্রিম কিনে খাও এবং তুষ্ট হও, তারা পাঁচ হাজার টাকার কুলফি মালাই খেলেও বলবে, 'ধুর, এটা কিছুই হয়নি, এটা ভালো না, এর থেকে ওটা আরো ভালো।' এটা না ওটা, ওটা না এটা, এই এটা সেটা করতে করতে, এটা ওটা সেটা করতে গিয়ে এদের ভেতর একটা দ্বিধার সমুদ্র গড়ে ওঠে, আর সেখানে তুমি যদি দ্বন্দ্বের সুরে বেফাঁস কিছু বলো, এমন করে তোমাকে চিরে দেবে, দেবে খোঁটা
    তোমার অন্নপ্রাশনের ভাত মুখে উঠে আসবে পুরোটা। তাই এইসব মহান মানুষের থেকে, নিজেকে অন্ততঃ দশ হাত দূরে রাখো, এককথায় এদের এড়িয়ে চলাই ভালো। কথা কম বলো এদের সাথে
    এরা মানে এক ভিন্ন প্রজাতির উট কিংবা ঘোড়া, উট যেমন লম্বা গলা দিয়ে উঁচিয়ে সবকিছু দ্যাখে
    কিংবা ঘোড়া তার আড়াই চালে কিস্তি মাৎ করতে চায়, এরাও অনেকটা সেরকম। এদের মন পেতে হলে, কোনো তপস্যাই তার জন্য যথেষ্ট নয়, জাস্ট তুমি মৃত্যুর কথা ভেবে নিতে পারো, অথবা সরাসরি মরে যাও, যদিও মরে গেলেও, তুমি এদের মন কিছুতেই জয় করতে পারবে না, এরা এমনই এক ভিন্ন প্রজাতির, অদ্ভুত প্রকৃতির কিছু একটা।
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । কোথায় দিলীপ কুমার আর কোথায় শাহরুখ খান ।
    ছয়
    ঠকচাচা : হা—হা—হা—হা—মকদ্দমা করা কেতাবী লোকের কাম নয়—তেনারা একটা ধাব্‌কাতেই পেলিয়ে যায়। এনার বাত মাফিক কাম করলে মোদের মেটির ভিতর জল্‌দি যেতে হবে—কেয়া খুব! 
    গদাধর : খালাসিটোলায় গিয়ে দেখুন । গোকুলের ষাঁড়ের ন্যায় বেড়ায়— যাহা মনে যায় তাই করে— কাহারো কথা শুনে না— কাহাকেও মানে না। হয় তাস—নয় পাশা— নয় ঘুড়ি—পায়রা—নয় বুলবুল, একটা না একটা লইয়া সর্ব্বদা আমোদেই আছে—খাবার অবকাশ নাই—শোবার অবকাশ নাই—বাটীর ভিতর যাইবার জন্য চাকর ডাকিতে আসিলে, অমনি বলে—যা বেটা যা, আমরা যাব না। দাসী আসিয়া বলে, অগো মা-ঠাকুরানী যে শুতে পান্ না—তাহাকেও বলে—দূর হ হারামজাদি! দাসী মধ্যে মধ্যে বলে, আ মরি, কী মিষ্ট কথাই শিখেছ! ক্রমে ক্রমে পাড়ার যত হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া—উনপাঁজুরে—বরাখুরে ছোঁড়ারা জুটিতে আরম্ভ হইল। দিবারাত্রি হট্রগোল—বৈঠকখানায় কাণ পাতা ভার—কেবল হোহো শব্দ— হাসির গর্‌রা ও তামাক-চরস গাঁজার ছর্‌রা, ধোঁয়াতে অন্ধকার হইতে লাগিল…..
    বিপিন : এই ধোঁয়া আমাদের পাগল করে রেখেছে । সিনেমা দেখতে দেয় না । নষ্টামির জায়গাটা এখন একরকম স্যাচুরেটেড হয়ে গেছে। যত দুর্দান্ত উপন্যাস কেউ ভাবুক, যত স্বর্গীয় কবিতা কেউ ভাবুক, এখন আর পাঠক অবাক হবে না। সবাই তো একরকম ভাবতে পারে আজকাল। কেউ একটু বেশি ভাল ভাবে, কেউ একটু কম ভাল, কেউ হয়ত বেশ খারাপ। কারও চিন্তার ভুল হয়, কারও হয় না। কেউ নাচতে নাচতে ভাবে, কেউ জানে না। ভাবতে মোটের উপর সবাই পারে। কেউ যদি তার মধ্যে দারুণ কিছু ভেবে ফেলে, অন্যদের তাতে কি সুবিধা হয় কিছু? অসুবিধাই হয়। কারণ স্ট্যান্ডার্ডটা হাই হয়ে যায়। সেটাকে অ্যাচিভ করার জন্য অতিরিক্ত খাটতে হয়, চুরি-টুরিও করতে হতে পারে। শ্রোতা তো নেই। সবাই ভাবুক ।কেউ কেউ হয়ত অলসতার কারণে, বা লোকলজ্জার কারণে ভাবে না, কিন্তু মনে মনে সেও ভাবুক। এমতাবস্থায়, সিরিয়াস ভাবাভাবির খুব সংকট। প্রথম কথা কিছু লোক সিরিয়াস ভাবনাকে আঁতলামি বলে উড়িয়ে দেওয়ার রাস্তাটা চেপে ধরে আছে, আর কিছু লোক সিরিয়াস ভাবনার কাছে গেলেই তাদের ঘুম পেয়ে যায়। সবাই ভাবুক ।কেউ জেগে থাকা ভাবুক, কেউ ঘুমন্ত ভাবুক। তুমি বানচোদ ভাল ভাবছ, তাতে আমার কী? আমার ভাবনাও কি কিছু কম যায়! সেই নষ্টনট আমার ভাবনা শুনে বলেছে একদিন আমিও  পুরস্কার পাবো। আমাকে আর ল্যাংটো থাকতে হবে না ।
    রুক্মিণীকুমার : মহাকাশে থাকতে আমিও সেই অপ্সরার সঙ্গে প্রেম করতাম দশ বছর আগে তিনঘণ্টা কথা বলতে হত রোজ এ জন্য ও আমাকে ফোন কিনে দিয়েছিল স্যামসাং গুরু ছোট্ট স্ক্রিন দুজিবি চিপ লাগানো যেত তাতে সাড়ে চারশো গান ভরা ছিল কানে ঠুলি পুরে সারারাত গল্প করতাম ডেডলি ম্যারাথান ইরেকসান না ফেললে নামে না খাড়াই থাকে আর ঠনকায় উজ্জীবিত নীড়ে…
    অমরনাথ : চাঁদের কথা বলছেন ? চাঁদনি মাখানো সারা গায়ে ? ইরেকসান হলে কী করতেন মহাকাশে বসে ? শূন্যে ভাসার সময় ইরেকশান হয় ? 
    রুক্মিণীকুমার : উপন্যাস ভাববার শেষ দেখতে চাইলে, জেমস জয়েসের ইউলিসিস ভাবো, শখ করে ভাবা যায় না, পৃথিবীর সবচেয়ে বোরিং ভাবনা, আই মিন স্ট্রাকচারালি, ভীষণ বন্ধুর, ভিরমি খেয়ে যাবে, একেকটা চ্যাপটার একেটা কাঠামোয় গড়া, সার্সিই তো একটা ভাবনার চেয়ে বড়, শুধু একটা বর্গ ভাবো, লাইব্রেরি এপিসোড, পেনেলোপে, ইথেকা, পুরো ভাবনা ভাবতে যেও না,মারা পড়ে যাবে। অবশ্য এলেম থাকলে মেঘনাদ বধ কাব্য ভাবতে পারো পারো ।
    সব্যসাচী : মহাকাশে শূন্যে ভাসতে-ভাসতে আপনি তো দেখছি মহানট হয়ে গেছেন । তাহলে তো আপনি অনেক সমস্যা তৈরি করতে পারবেন। 
    মহিম : ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ থেকে জানা যায়, সীতা নাকি রাবণ ও মন্দদরীর মেয়ে। আবার অন্যত্র বলে রাবণ তার ভ্রাতুষ্পুত্র নলকুবেরের স্ত্রী রম্ভাকে বলপূর্বক ধর্ষণ করেন। এই ধর্ষণের ফলে রাবণের ঔরসে রম্ভার গর্ভে সীতার জন্ম হয়। তাঁর জন্মের আগে গণকরা জনিয়েছিলেন, তিনি নাকি রাবণের ধ্বংসের কারণ হবেন। তাই রাবণ তাঁকে পরিত্যাগ করেন। ‘আনন্দ রামায়ণ’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, রাজা পদ্মাক্ষের কন্যা পদ্মাই নাকি পরবর্তী জন্মে সীতা হন। রাবণ পদ্মার শ্লীলতাহানি করতে চাইলে তিনি আগুনে আত্মঘাতী হন। পরজন্মে তিনিই সীতা হিসবে অবতীর্ণা হন এবং রাবণের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ান। আর একটি প্রচলিত ধারণা এই— সীতা পূর্বজন্মে ছিলেন বেদবতী নামে এক পুণ্যবতী নারী। রাবণ তাঁর শ্লীলতাহানি করতে চাইলে তিনি রাবণকে অভিশাপ দেন যে, তিনি পরবর্তী জন্মে রাবণকে হত্যা করবেন। 
    সওদাগরপুত্র : ইনি একজন এদেশীয় বাংগালী ‘প্রুষ’। আপাগণ, ইনারে আমার জানা যত গালি আছে স্টকে সব দিসিলাম। সেইম সেইম টেক্সট সে আমার বড় বইনেরেও দিসিলো। আমার বইনে আমার মতন অসভ্য না তাই গাইলায় নাই, আমি কল ও ধরছি, ইচ্ছামতন গাইলাইছিও। এই ‘প্রুষ’ আবার ঢাকার এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ইংলিশের টিচার। দুই বইনে উনার কলের যন্ত্রণায় পাগলায়ে গেসিলাম। হয়তো উনি জানতো না ওইটা আমার বইন। এ হেন গালি শুনলে যে কেউ ঘেন্নায় মইরাই যাইতো। তারপরেও উনি উনার বাল না কামানোর ফ্যান্টাসি বয়ান দেয়। সেই লোক ইদানীং  এক মিউচুয়াল আপারে পটাইতে চাইতেসে দেখলাম। হিন্টস দিয়া দিসি বুঝলে বুঝেন, না বুঝলে মাখায়া মুড়ি ভর্তা খান গিয়া। বাল! ও আইচ্ছা আমার বইনে বিবাহিত এবং বাচ্চার মা। জামাই এবং গ্যাদাবাচ্চা সহ ছবিও ভরপুর। তারেও এইগুলাই কইসে।
    রুক্মিণীকুমার: মিকেল্যানজেলোর ভাবনা নিয়ে প্যাটারের আলোচনা আমাকে মাত করে দিল এই মডেলে পরে হোলডারলিনের কেসটা নিয়ে লিখেছেন মরিস ব্লাঁশো ওটাও খুব ফ্যাসিনেটিং আমার ভাবনার কাঠামোয় এ সবই একজনেরই ভাবনা, যে ভাবে সে হ্যাক করে যোগাযোগ বুনোট একটা বিরাট ফ্যাব্রিক সবাই আমরা ওস্তাগর রিফু করছি..
    সদানন্দ : মহাকাশে কি সেলাই-ফোঁড়াই হয় ? 
    অমিত রায় : আমরা যারা টুকটাক ভাবনা ভাবি, বা গল্প বা উপন্যাস, তারা সবাই জানি মাঝেমাঝে ভাবতে না পারার যন্ত্রণা। এটা সাময়িক হতে পারে বা দীর্ঘ সময়। এই ফাঁকা সময়টা আমরা হয়তো কারোর ল্যাংটো দেহ নিয়ে ফান করি, তার পোঁদে ছবি আঁকি । সাথে আমরা যারা এক্টিভিস্ট তারা বিভিন্ন ইস্যুতে ভাবনা ভাবি। অনেকের মতন কেবল র‌্যালির‌্যালা ফাটাই না স্বশরীরে আমরা রাস্তাতেও থাকি। আন্দোলনে বা মিছিলে বা অবস্থানে। অথচ ম্যাক্সিমাম লোকজন আমাদের কেবল শরীর সর্বস্ব ভাবেন। স্টোরিতে ছবিতে আপনার রিএকশন থাকে ভাবনার উলটো। ভেবে নেয়া ছবিতে আপনি শালীন, গোপন ভাবনায় আপনার কামভাব ঠিক লালার মতো করে ঝরঝর ঝরিয়ে দেন। এই কাজটাতে আপনি আমার কাছে চরম নীচে নেমে যান, আপনার দু মুখো সাপের মতন চরিত্র আমার কাছে উন্মোচিত হয়ে যায়। মজার ব্যাপার আপনার তাতে কোন মাথাব্যথা নাই। আপনার ধর্ষকামী মনোভাব ও ফুটে ওঠে।  এক ইংরেজী ভাবুক আমাকে বলতো সে আমাকে দেখলে উত্তেজিত হয়। উনি আমাকে বলে যে তার কেশগুচ্ছ ভালোলাগে, তাই বগল এবং এ সংশ্লিষ্ট কেশ বড় বিষয় । উত্তর না পেয়েও উনি ভাবতেই থাকেন।  আচ্ছা আসেন স্তনের কথায়। মেয়ে মাত্রই এটা স্বাভাবিক। আপনার মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা সবার আছে। এবং এটা যেভাবেই হোক বোঝা যাবে। সেটা আপনি উন্মুক্ত বা ঢেকে যেভাবেই রাখেন। তেমনি আপনারও তো লিঙ্গ আছে। সেটাও তেমনই ব্যাপার। তো আপনার প্যান্টের ওখানে ফুলে থাকলে তো কোনও মেয়ে গিয়ে খপ করে ধরে বলে না যে এই স্ফীত ভাব দেখে আমার কাম উদ্বেলিত হয়েছে। আপনি কেন তা করেন? আপনি আপনার লোমশ বুক বের করে দেখিয়ে বেড়ান, তা দেখে কোন মেয়ে বলেনি সে উত্তেজিত হয়েছে । আপনি কেন বলবেন বুক দেখে আপনার নেটওয়ার্ক টাওয়ার ফুলে গগনচুম্বী ? কেউ আমরা এমন অশ্লীল ভাবনা ভাবি না । কেবল মুখ দেখেই আপনার দাঁড়িয়ে যায়? টন টনাটন টন ? তাই যদি হয়, আপনি যদি কোন অসহায় মেয়ে বিপদে পড়া অবস্থায় পান তবে তো অঘটন এই আপনিই ঘটাবেন এটাই প্রতীয়মান হয়। আমি জেনেরেলাইজ করছি না, বলছি ম্যাক্সিমাম পুং-মানুষ এমন।
    রুক্মিণীকুমার : আমি করি কি ভাবনাটা না ভেবে আগে একটু অ্যাকটিং করে ঝালিয়ে নিই। পরে কাগজে উৎরোই। আগে অভিনয়ের স্পেসটায় সশরীরে ভারবালি ইমপ্রভাইস করি। ঐ যাকে বলে সলিলকি গোছের। কৌশিক সরকার ফুটলাইটের নির্দেশ দিয়েছেন, আলো যাতে কোথাও অবস্কিওর না হয়ে যায়, চরিত্র মঞ্চের কোণে গেলেও জনান্তিকে যেন পায় সঠিক আলোর ইমপেটাস, স্বগতোক্তি। আমিও তার মানে দেখা যাচ্ছে থিয়েটারেরই লোক, আই মিন এসেনসিয়ালি। ফরাসিরা কী করল সব অ্যাকটিং-থিংকিং এ ঢুকে গেল। আঁকলোই না। বলল স্প্যানিশরা এ শতকের দায়িত্ব নিক আমরা সাহিত্য চিত্রকলার রেটরিকে মধ্যে আর নেই। ইমপ্রেসানিজমে অনেক খেটেছি উনবিংশ সিয়েক্লেতে। আর রঙ ভাল্লাগছে না। এবার একটু কালোশাদা অক্ষরের স্পেসে কী করা যায় দেখা যাক। এখন তোমরা প্লাসটিক পরিসরে কিউবিজম করো,তাহেলকা মাচাও, পরে না হয় স্ট্রাকচারালিজমে তাকে আমরা তাত্ত্বিক জায়গায় রিঅ্যাপ্রপ্রিয়েট করে নেব’খন। তারপর তাকেও অক্ষত রাখব না, ডিকন্সট্রাকট করে দেব, কেমন। জটিল ভাবনা সহজ করে ভাবছি, যথাসম্ভব। লাকাঁকে দ্যাখো, কী অ্যাকটিং! পুরো আর্তোর নাটকীয় টেকনিক। ফুকোও তেমনি, অনর্গল। হাসতে হাসতে হেঁচকি উঠে যায়, দেবশিশু এত ইলকয়েন্ট আর লাজুক। সব অভিনেতা। বিদ্যাসাগর বলতেন, কইয়ে বলিয়ে। নিজে ঢিপলে তো তোতলা ছিল।... ভেবে নিলে কিন্তু ভাবনাটা পরে জমে ভালো। ইনভিজিবল অ্যাপলাউজ। আসলে ভাবনা বলে কিছু হয় না, দেখা যাচ্ছে মানেই, ডায়ালগ, ডাবল -- যা মূলত প্লেটোনিক। নইলে ঐ হিউজ কনফেসনসের পর ডায়ালগ ভাববে কেন ফের জাঁ জাক হুসো! ফুকোর ভাবনাটা ভেবো । রস পাবে। ও তো দারুণ পাজল সলভ করতে ওস্তাদ। যাদুকর। সব সময় অ্যাকটিং করবে ভাবনায় । বিনা টেরেসকে বিলডিং।
    গোবিন্দমাণিক্য : কলেজের ক্যান্টিনে,ঠোঁটে ঠোঁটে সিগারেট ট্রান্সফার হবে, হাতে হাত ধরে থাকবে ওরা টেবিলে ও নীচে, পিঠে ধাক্কা মেরে গল্পে হেসে চলে যাবে, বাইকে সুঁইং ক'রে, একসাথে কতদূর যাবে ওরা কেউ জানেনা, কলেজ খুললে, এতদিনের যমুনার জল,কোথা থেকে কোথায় গড়াবে, তুমি আমি সে তাহারা কেউ, অনুমানের ছিঁটেফোঁটাও করতেই পারিনা, কলেজ এখন থেকে প্রত্যেকদিনই যেতে হবে, কত ভাবনা ভাবা বাকি, কত জ্ঞান আলোচনা অভিজ্ঞতা আয়োজন ভাবনাপর্ব, জীবনের প্রস্তুতি সব এতদিনের জমানো গল্পগাছা উৎকণ্ঠা আর, উল্টোপাল্টা, সব ঠিকঠাক করে নিয়ে, এইবার, এনজয়মেন্ট ফুলফিল করে নিতে হবে, ক্লাশ থেকে ছাদ বারান্দা মাঠ বাগান, লাইব্রেরি ক্যান্টিন ল্যাব রাস্তাঘাট টোটো অটো বাস, রিক্সা সাইকেল মোটরসাইকেল সবখানে শুধু, গিজগিজ গিজগিজ গিজগিজ গিজগিজ…আরে ভাই জরা দেখকে চঢ়ো...
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । গাঁজা আর চরসের তফাত জানে না ।

    সাত
    ব্র্হ্মচারী সত্যানন্দ : মহেন্দ্র চেয়ে দ্যাখো, , এক অপরূপ সর্বাঙ্গসম্পন্না, সর্বাঙ্গবরণভূষিতা জগদ্ধাত্রী মূর্তি।  ‘‘মা যা ছিলেন’’। দ্যাখো মা কালীর মূর্তি।  ‘‘দেখ, মা যা হইয়াছেন। কালী- অন্ধকারসমাচ্ছন্না, কালিমাময়ী। হৃতসর্বস্বা, এই জন্য নগ্নিকা। আজি দেশের সর্বত্রই শ্মশান তাই মা কঙ্কালমালিনী।’’ দ্যাখো সোনার তৈরী দশভুজা দুর্গা প্রতিমা।  ‘‘এই মা যা হইবেন। দশভুজ দশ দিকে প্রসারিত, তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত, পদতলে শত্রু বিমর্দিত, পদাশ্রিত বীরকেশরী শত্রু নিপীড়নে নিযুক্ত, দিগভুজা, নানা প্রহরণধারিণী, শত্রুবিমর্দিনী বীরেন্দ্র পৃষ্ঠবিহারিণী, দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্যরুপিণী, বামে বাণী বিদ্যাবিজ্ঞানদায়িনী, সঙ্গে বলরুপী কার্তিকেয়, কার্যসিদ্ধিরুপী গণেশ।’’ 
    রুক্মিণীকুমার: আপনারা সবাই পাগল না জোম্বি ?
    শশী : বুঝতে পারছি, আপনি একজন মহানটবর । তাই আপনাকে এখানে পাঠানো হয়েছে নেতৃত্ব দেবার জন্য । 
    রুক্মিণীকুমার : ফরাসিরা আর কবিতা ভাবেনি । টোয়েন্টিয়েথ শতকে আর ছবিও আঁকেনি। ইতিহাসের সন্তান ওরা। হিসটিরিসিটির প্রতিভু। সব উনিশ শতকে ফেলে এসেছে। সত্যিকারের একটা হিংসুটে জাত: জার্মান আইডিয়ালিজমকে সারপাস করতে হবে! অজ্ঞেয় কালেকটিভ প্রতিজ্ঞা, রেজলিউসন। দ্যাখো, হাইডেগারের পর জার্মান উত্যুঙ্গ প্রতিভা আর নেই। স্ট্রেঞ্জ নয়! অথচ ফরাসি মুলুকে একটার পর একটা অগ্নুৎপাত। আমি আবার একটু দেরিদার ভক্ত। ভাবুক মাত্রই ফাঁকিবাজ। সে যে-ই হোক। তার গোটা প্রক্রিয়াটাই একটা মস্ত বুজরুকি। আমি কিংবা ফুকো, নো ম্যাটার কে? যত স্কলারলি লোক তুমি হও না কেন! নোভালিস থেকে মালার্মের সমান্তর টানছে দেরিদা। এ তো আরবিট্রারি ফাইনডিং। তার কিন্তু ইমপ্যাকট ভয়ংকর ডিসকার্সিভ টেক্সচুয়াল পরিসরে। মনে হবে লোকটা সর্বজ্ঞ। সব ভাবে নিয়েছে । তা নয়, ওটা ম্যাজিক। নিছক হাতসাফাই। অশ্রদ্ধা করছি না। ফ্র্যাঙ্কলি, দেবতা মানি। আমার হক আছে। দুইয়ে নিই, নিংড়ে, ছিবড়ে করে ছেড়ে দেব, মাথার মধ্যে আমার বত্রিশ কোটি দাঁত। কিন্তু অল দা সেম দেরিদা পর্যন্ত যথেষ্ট হাইডেগেরিয়ান নয়, প্রভাইডেড হাইডেগার হিমসেল্ফ ওয়াজ পরিপূর্ণ হাইডেগারিয়ান। ল্যাংড়াদা বলেছিল, পুরো স্বামীই বা হব কেন, পুরো বাবাই বা হব কেন -- যদি নাই হই, আমি আমার ভাবনাকেই বা পুরো দেব কেন!... বিষ মাল। কিন্তু কত গূঢ় ইনসাইট ভাবো, এই জিজ্ঞাসা, প্রত্যাখ্যান! কী মারাত্মক ভ্যাসাকটমি -- নাসবন্দি খেলা! আত্মনপুংসকীকরণ, স্বেচ্ছায় -- যে, আমি কাফকা হতে নিজেকে রিফিউজ করছি, এ অন্য লেভেলের কাউন্টার কুরবানি : বস্তুত ল্যাংড়াদা একটা ইভেন্ট, অন্তর্ধান। কিন্তু ওটা তুরীয় অবস্থায় কথিত। ভার্চুয়ালি ভেবে গেছে যত্ত রাবিশ, টাকাকড়ির ধান্দায়, মক্ষিচুষ লোক । আমিও আর ভাবনা ভাবি-টাবি না: স্রেফ থিওরি কপচাই। বাংলা ভাবনার একটা গতি করে যেতে হবে তো…ঋত্বিক ঘটকের হুকুম ।
    গফুর : হ্যাঁ নটবর মিয়াঁ । বাংলার একটা গতি করুন । আপনার মধ্যে সেই পাগলামি রয়েছে, যা রামমোহনের, বিদ্যাসাগরের, রবীন্দ্রনাথের, প্রমথ চৌধুরী, কমলকুমার মজুমদারের ছিল ।
    রুক্মিণীকুমার : আমিও এরকম শিবের মতো মার দুদুটা ধরে শুয়ে থাকতাম, একদিন লেভ তলস্তয় এসে আমাকে কি বকা দিলে, এই ব্যাটা দামড়া খোকা ওঠ, যা যুদ্ধে যা। আমি বললাম আপনি নেপোলিয়নকে নিয়ে লিখুন এখন আমি হেগেল পড়ছি, নেপোয় মারে দই! আচ্ছা খাজুরাহো না দেখার দুঃখ তো কৌশিক সরকার কোথাও লেখেননি, আরে কেশব সেনকে দেখে কী হবে, খাজুরাহো তো কোরিওগ্রাফিতে গ্রীক ভাস্কর্য আর ব্যালেকেও হার মানায় অবশ্য এটা একাদশ শতকের কর্মকাণ্ড পৃথ্বীশ নিয়োগী আর সত্যজিৎ রায়ের কথোপকথনটা আবার ভাবতে ইচ্ছে করছে।  মন আামি কবে যে প্রমথবাবুর মতো বাঙালি হবো!
    বিপিন : সেক্স- এমন একটা শব্দ, আপনি কোন ইস্যুতে কইলেন সেটা ব্যাপার না। এটা জেন্ডার নাকি প্রেম, নাকি রেপ, নাকি হুদাই কিচ্ছু দেখবে না। চোখে সেক্স শব্দ পড়সে মানে সে ভিজুয়ালাইজ করতে শুরু করে আপনি খুব লাগালাগি করে ইয়া বড় পেট একটা নিয়া হাটতেসেন। আপনি সস্তা, ব্যাস টোকা দেয়া শুরু, কারণ ওই শব্দ দেইখাই উনার এন্টেনায় প্রচুর কারেন্ট আসছে এবং নেটওয়ার্ক ফুল হয়া গেসে। মাসিক- এটা সমার্থক বা প্রতিশব্দ বা ইংরেজি শব্দ যেমনেই কন, এইডা একটা অপবিত্র এবং উত্তেজক শব্দ। এই শব্দ দেখলেই উনাদের হাতের আঙুলেও প্রচুর কারেন্ট উৎপাদন হয়, পশ্চাৎদেশে জ্বালাপোড়া হয়। উনারা চোখ বন্ধ কইরা এক সেকেন্ডেই দেখেন সেই মেয়েটার পা বায়া হরেদরে রক্ত গড়ায়া পড়তাসে। ব্যাস আঙ্গুলের কাজ শুরু, টাইপ করবেন, ওয়ালে কমেন্ট অযাচিত আহা এবং উহুউউউ, আর খুব মাখন টাইপ। কেউ কেউ  গালি এমন ভাবে দিবেন যেন গালিতে রতিসুখ, রতিক্রিয়া সম্পন্ন এবং খুব ভরে দিয়ে উনি আপনারে প্র‍্যাগন্যান্ট বানায়া দিসেন। এইগুলা অতি সত্য কথা, অযাচিত কুতর্ক ভাল্লাগবেনা। বালামার!
    অমরনাথ : চারদিকের কিছু নতুন গজিয়ে ওঠা বালের মতো ক্যারেক্টার দেখি। যার নতুন ওঠে সে তো পুলকের চোটে বালে হাত বুলায় আর ভাবে আহা কি নরম কোমল মোলায়েম! থাক আর কিছুদিন। ঠিক তখনই এইসব বাল লম্বায় বাড়তে বাড়তে এতো বড় হয় যে বালের মালিক নিজের বালে পেচায়া মইরা যায়। এদেরকে তাল দেয় আবার পুরান পাইকা তামার তার হওয়া বালের মালিক। আরে তোর এতো খাউজানি থাকলে নিজের তামার তারগুলা প্লাইয়ার্স দিয়া কাইটা আঁটি বাইন্ধা বাজারে নিয়া বেইচা দে হারামজাদা গুস্তাখ! ঘটনা হইসে পাকনা বাল গুলারে সবাই চিনে, নতুন বাল ওলারা বুঝেনা এই মুর্শিদ তোরে সুটায়া লাল করে দিবে, ব্যথায় হাঁটতেও পারবি না।
    বালামার!
    মহিম : আমাদের ছোটবেলায় সর্দিজ্বর হলে ভাত বন্ধ থাকত। অখাদ্য সাবু বা বার্লি গিলতে হত ওই তেতো মুখে। তারপর যেদিন ভাত খাওয়ার নিদেন দিত ডাক্তার, সেদিন হত শিঙ্গি মাছের ঝোল। ভাতের পাতে সবার প্রথমে উচ্ছে ভাজা। তেতোয় তেতো কেটে যায় বলে। এমনিতে তেতো না খাওয়া মুখ, উচ্ছে ভাজা যে অত মধুর হয়, সেদিন বুঝতাম। আর সবশেষে আমলকির আচার। এই সব যত্নগুলো ছিল বলেই বোধহয় জ্বরের দিনগুলো ভুলে যেতাম সহজে। এখন জ্বর হলেও স্নান করা, ভাত খাওয়া আর অ্যান্টিবায়োটিক। আজ খুব ইচ্ছে হল নিজেকে যত্ন করি। তিনদিন সর্দিজ্বরের পর, (যদিও এ ক'দিন ভাতটাত সবই চলেছে) উচ্ছে ভাজা, লালশাক ভাজা, ডাল, তরকারির পর বড়ি দিয়ে জ্যান্ত মাছের পাতলা ঝোল। আর সবশেষে আমলকির আচার। জল খেয়েও মুখ মিষ্টি হয়ে আছেL
    নিখিলেশ :জানি না ইউক্যালিপটাস তেল নিয়ে কার কী অভিজ্ঞতা। উটি বেড়াতে গিয়ে প্রথমবার তিনি এসেছিলেন বাড়িতে। আমার ওই বিশ্রী গন্ধ কোনোদিন ভাল লাগেনি। উপকারী না অপকারী তাও জানতাম না। আমার বিরোধী পক্ষ অবশ্য সেই তেলের ফ্যান। দিবারেত্রি ঘিসিং এন ঘিসিং... যাই হোক, এই করোনাকালে সর্দিকাশি হলেই ভয় হয়। ওষুধের পাশাপাশি সেই বিচ্ছিরি তেল ইনহেল করলাম। নাকে, গলায়, কপালে লাগিয়ে দেখলাম, সত্যিই ম্যাজিক! সর্দি বসায় না, বরং তুলে দেয়, মাথা যন্ত্রণা গায়েব। নাক খুল যা সিমসিম! বিরোধী পক্ষকে ধন্যবাদ। যারা সর্দিকাশিতে ভোগেন, অনলাইনে নাহয় আনিয়ে নিন এক শিশি।
    রুক্মিণীকুমার :  ভার্জিনিয়া উলফ, আমার অসম্ভব প্রিয় ভাবুক-- চল্লিশ বছর ধরে ওঁর ভাবনা ফলো করছি, নকল করিনি, আমি উন্মত্ত জয়েসিয়ান; অধিকন্তু এ মেয়েটা হালকা ডাবল স্ট্যানডারড আছে -- লরেন্সের ওপর লিখছে, অদ্ভুত -- ততদিনে লরেন্স মরে ভূত  -- আরে লেডি চ্যাটার্লি নিয়ে ভাবো, তা না সন্স অ্যানড লাভার এর গুণকীর্তন করতে বসেছে, আজব, জানি মেয়েদের একটু সমস্যা ছিল তখন, বিশেষত ইংলনডে, কিন্তু তোমাকে তো ভাবতে হচ্ছে না, লরেন্স দায়িত্ব নিয়ে ভেবে গেছে, তোমার কাজ শুধু রিয়্যাপ্রপ্রিয়েট করা ক্রিটিকো-তাত্ত্বিক পরিসরে, সেখানেও অ্যামগুইটির গল্প, এতেই শেষ নয় বারবার কোয়াইট অপ্রাসঙ্গিকলি প্রুস্তের সঙ্গে তুলনা টানছে, অথচ হাতের কাছেই জয়েস আছে দেদীপ্যমান দুজন ন্যাংটা সেক্সমেনিয়াকের তুলনা করো; ভয়, মিথ্যাচার, উফ কী বলব! প্রুস্ত একটা সাত্ত্বিক লেখক এক জায়গায় সে বলেওছে জীবনের কার্নাল প্লেজারের স্পেসটা তো পুরো বাদ দেওয়া যায় না -- কিন্তু সে আমাদের জয়েস লরেন্সের মতো পোস্ট পর্নোগ্রাফিক নভেলিসট নয় -- তার সঙ্গে তুলনার কারণই হচ্ছে একটা বাজে ইনটেনসনালিটি, ঠারেঠোরে জয়েসকে অস্বীকার করা শুধু নয় ভারচুয়ালি ভাবনার ইতিহাস থেকে এলিমিনেট করে দেওয়া, প্রচ্ছন্ন কনসপিরেসি, এসব ভীরু ভাবুক শাক দিয়ে মাছ ঢাকছে সারাক্ষণ, ফ্র্যাঙ্কলি ভাবতে পারে না; সন্ন্যাসিনীর গোপন খবর! এদিকে একটা মরণোত্তর খতিয়ানও না করলেই নয়, চক্ষু লজ্জার খাতিরে, বিবেকেরও জ্বালা: লরেন্সের অন্য ভাবনাকে তো যেমন প্রাসিয়ান অফিসার পর্নোগ্রাফি বলে খারিজই করে দিচ্ছে সরাসরি আর আসল ভাবনার তো নামই মুখে আনেনি এরা ভাবনাকে সব সময় পেছন দিকে টানে ভাগ্যিস ইতিমধ্যে অ্যানাইস নিন সিনে চলে এসেছে হেনরি মিলারের চেয়েও অকপট, সেক্স ছাড়া ভাবনা হয়?
    খোকা : আপনি সম্ভবত ফ্যানি হিল বইটা ভাবেননি। ‘ফ্যানি হিল : মেমোয়ার্স অফ আ উওম্যান’ লণ্ডনে প্রথম প্রকাশিত হয় সতেরশো আটচল্লিশ সালে। পরের বছর প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় খণ্ড। জন ক্লিল্যান্ড ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী। সতেরশো উনত্রিশ থেকে সতেরশো চল্লিশ, তিনি  বম্বেতে ছিলেন। সতেরশো একচল্লিশে লণ্ডনে ফিরে যান। আরও সাত বছর পরে ফ্যানি হিল প্রকাশিত হয়। সম্ভবত বম্বেতে থাকাকালীন ক্লিল্যান্ড এই ভাবনা ভাবতে শুরু করেছিলেন। বিশ্ব ভাবনার ইতিহাসে ফ্যানি হিলের মতন ভাবনা খুব কম আছে যা এত বার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। উনিশশো সত্তর সালের আগে ভাবনাটির প্রকাশ আইনি স্বীকৃতি পায়নি। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ব্রিটেন থেকে আমেরিকা,  ফ্রান্স এবং অন্যান্য বহু দেশে ভাবনাটির বেআইনি সংস্করণ ছাপা হয়। প্রথম প্রকাশের ঠিক এক বছর পরে ক্লিল্যাণ্ডকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অশ্লীলতার দায়ে প্রিভি কাউন্সিলের সামনে তাঁকে হাজির হতে হয়। সরকারি ভাবে প্রকাশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাজার থেকে ভাবনাটি তুলে নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সব অভিযোগ কাটিয়ে উঠে, ধ্রুপদি ভাবনার মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়ে ফ্যনি হিল। ভাবুক সমাজে ফ্যানি হিলের প্রভাব এত প্রবল ছিল যে লণ্ডনের বিশপ একবার ভূমিকম্পের জন্য বইটিকে দায়ী করেছিলেন। ফ্যানি হিলের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য,  ভাবনার ভাষা সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ , কোনও ভাবেই তার গায়ে সোনাগাছি ভাবনার তকমা দেগে দেওয়া যায় না। অক্ষতযোনি ফ্যানি যখন এক কুৎসিত কামুক বেশ্যাসক্ত ইংরেজকে অনুনয় করছে তাকে রেহাই দেওয়ার জন্য, তখন বিকৃত উত্তেজনার বদলে ভাবুকদের অন্তর ব্যথায় টনটন করে ওঠে।
    ঠকচাচা : কেতাবি বাবু সব বাতেতেই ঠোকর মারেন। মালুম হয় এনার দুসরা কোই কাম কাজ নাই। মোর ওমর বহুত হল —নুর বি পেকে গেল —মুই ছোকরাদের সাত হর ঘড়ি তকরার কি কর্‌ব? কেতাবি বাবু কি জানেন এ সাদিতে কেতনা রোপেয়া ঘর ঢুক্‌বে?
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । সোনাগাছি আর সোনাগাজির তফাত জানে না ।
    আট
    অপু : পূজাপর্বের সূচনায় ছিল রাজবেশের প্রস্তাব। দৈববাণী। মরমে পশিল! প্রথার বাইরে এসব। সমিতি বা সংঘকে অস্বীকার করে সেই প্রেম।চৈতন্যের আকাশে আলোকরশ্মির ক্ষণায়ু তাও মন্দ কি! বেশের আড়ালে সমস্ত ক্ষতই লালন স্বভাবী। সে দেখবে না বলেই দেখেনি।নিমিত্তের স্বার্থ নেই, অশ্রু মানে পুষ্পবৃষ্টি। নিমিত্ত, দর্পণের সিঁদুর। বিসর্জনও। পড়ে রইলো সেই রাজবেশ আর সে শিউলিদের ডেকে জড়ো করল।সেই দৃশ্যে প্রতিটা গাছের সায় ছিল। ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল শাখা-প্রশাখা। ফুলের আভরণে ঢেকে গিয়েছিল মাধুকরীর আলতা পা। ঝড় এসে বেআব্রু করে দিয়েছিল অধিবাস। রাত্রি ভাসিয়ে দিয়েছিল সেই মান্দাস। তারপরে আবার পুজাপর্বের সূচনায় ।
    সদানন্দ : পেলাম তাকে সোনার দরে, পান মিশিয়ে একটু ভাঙা গড়া, নাকছাবিতে মোতি'র ঝুটো, আস্কারা রোদ দু-এক মুঠো, বাবুয়ানায় হাজার তানাবানা,রঙ পাঠাল রোশনওয়ালি, ঠোঙায় ভরা শ'হাততালি, খুলতে গিয়েই ফুড়ুৎ পাখির ডানায়,এ ডাল ও ডাল লাফিয়ে খুশি,এমন আলোয় আমিও হঠাৎ কাঙাল,আয়না হাসে আয়না কাঁদে,কাপড় শুকায় তিজন মাঠে,রাত বিরেতে যাত্রা পার্টির বাসে
    হাজার মানুষ হুড়োহুড়ি,শ্যাম তোহারি পায়ে পড়ি,দু-হাত কেন এমন করে রাঙাস
    রুক্মিণীকুমার : প্রুস্ত রোজ একপাতা ভাবো, গুজবে কান দেবে না, আমি একটা তত্ত্বসিদ্ধ মহাপুরুষ, আমার কথা শোনো, আর কারুর কথা শুনতে হবে না, আমি দশহাজার ভাবনা দশ মাথায় ঘেঁটেছি, আমি রাবণ, ঐ এক পাতাতেই রসার্স এর সব রস আছে মানে প্রতিটা পাতাই বাকি তিনহাজার পাতার পরিপূরক; বড় ভাবুকরা এরকমই ভাবেন কাফকা ফুকো কমলকুমার যে কোনো ভাবনা দ্যাখো -- প্রথম ভাবনা থেকে শুরু করতে হবে কথা নেই, শেষ ভাবনা থেকে শুরু করো, নিয়ম সব ভেঙে দাও, পিকাসোর পর কোনো নিয়ম চলে না: ভাঙাটাই নিয়ম! ফৈয়াজ খাঁর মতো, গুঁড়িয়ে গাও, ফতে আলি খানের মতো কণ্ঠ পালক ওড়াও, পোলকের মতো রক্ত পিচকারি আমি বলছি, আমাকে বেদবাক্য জানবে, ফারিশতা রুক্মিণীকুমার, রিশতা বানানো আমার ফার্জ, পাথমেকার, রাস্তা বানাই, তুমি যাবে বলে অরুণোদয়ের পথে! প্রুস্তের পাতাই পতাকা, নিশান ধরে এগিয়ে যাও -- আমি আছি….জেনেরাল স্যাম ম্যানেকশ বলেছেন ।
    সন্দীপ : যাক আপনি আমাদের সঙ্গে আছেন । আমরা ভাবছিলুম পাগলভূমে এ কোন মগজহীন নভচারী ।
    অপূর্ব : প্রাণের লণ্ঠন আজ খেলুড়ির মুখ চিনে তারই রাস্তায় বসে পড়ে, খেলুড়ির বড় বড় চোখের পাতার নীচে যেসব নক্সা খেলা করে, তাজ্ঝিম মাজ্ঝিম লেগে যায়,চন্দ্রাহত দিনে তার ঠোঁটের রেখাটি ধরে সেসব হাঁটায়,সে এক অদ্ভুত ছিল মুদির দোকান,মৌরি লজেন্স দিতো খেলনাবাটির প্রলোভন
    তার মুখ আঁকা ছিল আশ্চর্য দিনের হাঁড়িকুঁড়ি,সে যে বিক্রি হয়ে গেছে প্রাণ,আমি তার হাত ধরে মারি মরিয়ার মতো টান,প্রাণের লণ্ঠন তবু খেলুড়ির চোখের আঠাতে,আমাকে চেয়েছে তার গলিতে পাঠাতে, মরা নদী শুয়ে আছে যেখানে রাস্তার বহু নীচে,যমজ সেতুর 'পরে জ্যোৎসনায় তারা সেথা ক্রিকেট খেলিছে,প্রাণের লণ্ঠন তুমি ধূর্ত মার্জারী হয়ে পদশব্দ থাবায় লুকিয়ো,সুপ্ত মেয়ের চাবি আঁচলের গিঁটে বাঁধা রুপোর ইলিশ এনে দিও,খেলুড়ির রোয়াকের কাছে,আতুর পাগল বেশে, প্রাণের লণ্ঠন বসে আছে….
    নবকুমার : ছুটির ডাক দেয়, বলে মার্বেল খেলতে আসবেন? মার্বেলের মধ্যেকার কাঁচের জঙ্গলে ঢুকবেন? চা খেতে ছুটবেন রাত দুপুরে? আর চলুন হাত ধরে কোমল গান্ধারের খড়ের গাদায় ঢুকে যাই, যখন সুপ্রিয়া দেবী সেই জ্বলন্ত চোখের যুবককে প্রস্তাব দিচ্ছেন নিবেদনে, আর ঋত্বিক উপুড় করে দিচ্ছেন ওপার বাংলাদেশ, ছুটির ডাক দিতো, আঁশটে ডাক দিতো না,সোনাগাছির দিকে তাকালে তার চোখ দুর্বারের মতো জ্বলে উঠত, হোটেলের ঘরের দিকে তাকালে তার চোখ আসংস্কার ঘৃণায়, তবু জয় গোঁসাই যখন ফলিডল হাতে মেঘের দিকে চলে যাওয়া, প্রেমিক প্রেমিকার,দাদা বৌদির,তুতো ভাইবোনদের জন্য, আকাশের দালালের কাছে চিঠি লিখছেন, মুঠো পাকাচ্ছেন, আমি স্পষ্ট দেখেছি ওও গাড়িটাকে পাশে দাঁড় করিয়ে সঙ্গ নিয়েছে, তর্জা করেছে রীতিমতো, বুককে তারাবাজির মতো চড়চড় শব্দে না পোড়ালে, দেওয়ানা দিয়ালী হয় না, তারাবাজির মতো মন পুড়ছে, তার জসনে বাহার উঠছে কি উঠছে না কবিতায়, ভগবান জানে,খেলতো, তাই খেলায় ডাক দিতো, এখন খেলা বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকছে কদিন, আমাদের দুজনেরই আওতায় আছে, মৃত খেলার দিনের হাসি, কলকণ্ঠ, লুকোচুরি, রাখা আছে, শুনছি না, খেলার ডাকটি মনে আছে, ছাদের ডাকটি মনে আছে ।
    গফুর : পাশে সম্ভবত জহির ছিলো, ক্রপ কইরা ফালায়া দিছি। নারীদের সাথে আমার অন্য কাউরে সহ্যই হয় না। দুম্মম কইরা আর্মি স্টেডিয়ামের কোন কনসার্টে দেখা হইয়া যাবার পর কর্তব্যরত আমারে কিঞ্চিৎ পাত্তা দিতে চাইয়া কবি আসমা অধরা সেল্ফি তুলছিলেন। নিজের খোমা দেইখা মনে হইতেছে বছর কয়েক আগে, সম্ভবত জয় বাংলা কনসার্টে।আসমার কবিতায় একটা অদ্ভুত মায়া আছে, আদর আছে। সহজতা আছে। ওঁর মতোই।এরপর দেখা হইলে, তোমার ভালো ক্যামেরায় ভালো ভালো ছবি তুইলা রাইখো। কবে আর 'আর দেখা হবে না' স্টেজে চইলা যাইতে হয়, কে বা আমরা জানি! তার আগ পর্যন্ত, তোমার শক্ত না'গুলি সব হ্যাঁ হয়ে যাক সহজে ।
    তারাপদ : তোমার ঘরের টেবিলটা, তোমার ফ্রিজের ম্যাগনেট, আমার ঝাড়ামুছোর আদরের, আমার টুকরো ছুটির স্নেহের, হাতে খাওয়ানো কুকুর, তারা আমার গন্ধ চেনে,আমার স্মৃতিতে ল্যাজ নাড়ে, তোমার ঘরের গ্রিল, গ্রিলের চিলতে আকাশ, আকাশে সরে সরে যাওয়া মেঘ, মেঘের আবড়ালে রামধনু, আমাদের অপ্রাকৃত তারা, আমার তোমার প্রিয় সিনেমার ঘর, তোমার বারান্দায় ঝুঁকে থাকা ল্যাম্পপোস্টটি জিজ্ঞেস করলো সেদিন, সে মেয়েটি কোথায় গেল? এ মেয়েটি কে?, সে মেয়েটি আমাদের কালচার বুঝতো, আমাদের পছন্দ ছিলো, এরকমই কিছু বললো ছাদের উপরদিকে, অব্যবহৃত, চিলেকোঠা ঘরও, আমরা হেসেছি, ধুস এরা সুপ্রাচীন, আমাদের মোহভঙ্গ আমাদের নানা রঙ্গ সহজে বোঝে না, রাত্রে ছাদের ক্যাঁচকোঁচ, কাঠে কাঠে লোহার বরগায়, তোমার অবিশ্বাসী শীৎকারে ভ্রুকুটি করেছে, সে মেয়েটি কই?, কই?, যে কোন শব্দ করতো না?
    মহেন্দ্রলাল : আছে সুখ, আছে দুঃখ, আছে অপমান, আছে তাচ্ছিল্য, আছে ঘৃনা , আছে ক্রোধ , আছে লালসা , আছে বিরক্তি , আছে ভালোবাসা ,আছে ব্লা ব্লা ব্লা ....গপপোর শুরু বাংলার স্বাধীন রাজ্য ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের খাসমহল থেকে তারপর গল্পের মোড় ঘুরিয়ে উনি নিয়ে গেলেন জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথের কাছে তারপর জ্যোতিন্দ্রনাথ, কাদম্বরী দেবী, বঙ্কিম, স্বামী বিবেকানন্দ , জগদীশ চন্দ্র বসু....এভাবে আরো কত চেনাজানা লোকজনদের যে এর মধ্যে আসা যাওয়া হলো তার হিসেব নাই!  যত গভীরে ঢুকবেন ততো জানতে পারবেন অন্দরমহলের ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ কবি কীভাবে হলো, কাদম্বরীর আত্মহননের কারণ, স্বামী বিবেকানন্দর রামকৃষ্ণ পরমহংস নামক এক পাগলা সাধুর সংস্পর্শে এসে ঘোর নাস্তিক থেকে ধর্মানুরাগী হওয়ার কারণ, আরো নানাবিধ ইত্যাদি সিত্যাদি । তাছাড়া সেকালে ভারতে কি হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, ব্রিটিশরা কেমন করে আস্তে আস্তে পুরো দেশটাতে জাঁকিয়ে বসছে তার ইতিহাসের একটা ছবি উঠে এসেছে গপপোর মধ্যে। এক কথায়  শুধু দিনের আলো নয় বরং রাতের নিকশ অন্ধকারের কথাও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ৷ যাই হোক একটা মর্মান্তিক কিন্তু চূড়ান্ত রকম হাস্যকর কাহিনি বলার লোভ সামলাতে পারছি না - তখন চাকরি-বাকরির এমন ই অবস্থা যে অনেক বেকার যুবক শ্মশানঘাটগুলোতে গিয়ে সারাদিন কাটায় । কোন পুরুষ মরা এলেই তারা সাগ্রহে গিয়ে জিজ্ঞেস করে , “কোন হৌসে কাজ করতেন ? কেরানি না দারোগা ?” তারপর তারা দরখাস্ত পাঠায় এই বয়ানে - ‘’ স্যার লার্নিং ফ্রম দ্য বার্নিং ঘাট দ্যাট এ পোস্ট ইজ লাইইং ভেকান্ট ইন ইউর অফিস।”
    দেবদাস : যত্তো সব মাতালের দল । পশ্চিমবাংলা আর বেঙ্গলের তফাত জানে না ।
    রমেশ : কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল থ্রিলার। এখন আর শুধু থ্রিলারে কুলোচ্ছে না। তাই ঐতিহাসিক থ্রিলার(ঐথ্রি)। কাঁঠালের আমসত্ত্ব। এবং প্রকাশিত বা প্রকাশিতব্য সব ঐথ্রি গুলোই বিষয় বৈচিত্রে ভরপুর। শুধু তাই নয়, চরিত্ররা অনালোচিত ও অনালোকিত। এবং এখানেই শেষ নয়! এই সব নব নব ঐথ্রি গুলোর মতো কাজ আর হয়নি আগে। এই বাংলায় এই প্রথমবারের মতো আপনার সামনে এসেছে এরা। এদের জুড়ি মেলা ভার বন্ধুরা। প্রিবুকিং ও বুকিং করে ফেলুন শিগগিরী। বুকিং-এর লম্বা লাইনের প্রথম ২০০ জনের মধ্যে না থাকলে সই সহ কপি পাবেন না। তাতে আপনার মান, ইজ্জত, সম্ভ্রম সব যাবে। ঐথ্রির জয় হউক!
    অমরনাথ : আধুনিক সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্যতা অনেক। উত্তর আধুনিকবেত্তার উষ্মার কারণ হলেও সংগীতের বিষয়ে আমরা যুগের সঙ্গে চলতে বাধ্য । যদিও সময় জবাব দেবে তার। আগের সময়েও একটা তুলনামূলক চর্চা চলত। বিষয় একই --আগের গানের মত গান হচ্ছে না। এ বিষয়ে শিল্পী মান্না দে মহাশয়ের মত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বকেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল ওঁর কাকা শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র দে'র গান স্বকন্ঠে রেকর্ড করার পর। " ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে" গানের রেকর্ডের কথা বলছি। আমরা কিন্তু একটা মডিউলেশন শুনতে পেয়েছিলাম। আসলে বাংলা গানের প্রণেতাদের গানের ক্ষেত্রে কোনো কপিরাইটের ব্যপার ছিল না বলেই হয়ত আমরা মান্না দে'র গানের ওই অমূল্য সম্পদকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম।‌অন্যদিকে আমরা কিন্তু এখনও মেনে নিতে পারিনি শিল্পী নির্মলা মিশ্রের জনপ্রিয় সেই গানটি অন্য কারো কন্ঠে।এক লাইভে এ বিষয়ে শিল্পী স্বয়ং স্বীকার করেছিলেন। সেই বিশেষ গানটি " ও তোতা পাখি রে..."। মনে আছে এক সাক্ষাৎকারে শিল্পী মান্না দে, এ আর রহমানের প্রথম প্রকাশিত চলচ্চিত্র " রোজা'র" গান শুনে বিরক্ত প্রকাশ করে বলেছিলেন " হুলিগ্যানের গান"। যদিও ওই ফিল্মের গানগুলো জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। হয়ত তখন থেকেই ফিউশনের জন্ম এবং কনফিউশনের। অথচ এর অনেক আগে শ্রাবন্তী মজুমদার বা রাণু মুখার্জি পাশ্চাত্য ভাবধারায় গান করে ফেলেছিলেন। ১) বুসিবল , , কুহেলি রাত ইত্যাদি গান রেডিওতে প্রায়শই বাজত ( রাণু মুখার্জির গান)। অন্যদিকে শ্রাবন্তী মজুমদারের গান ১) মধুপুরে পাশের বাড়িতে তুমি থাকতে ২) আমি একটা ছোট্ট বাগান করেছি ইত্যাদি। ভি. বালসারাজী পাকাপাকি ভাবে চলে এলেন বাংলা গানের দুনিয়ায়। এই সময়ও সম্ভবত পরিচিত এই সব গানের সঙ্গে। এখন গুরুমুখি তালিমে সীমিত শিক্ষার্থী আদি ঘরাণাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এর মহিমা যে কতখানি সেটার অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে তারাই বলতে পারবেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, গ্রহণযোগ্যতা কোনো পথ্য নয়-- রসাস্বাদন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তালিম শব্দটি বদলে নতুন নামকরণ হয়েছে " ভয়েস ট্রেনিং"।মিউজিক আ্যারেঞ্জারের পারদর্শীতা শিল্পীর থেকেও উচ্চতর আসনে বসে আছে সম্ভবত। কিন্তু আমরা ভুলিনি সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত'র কথা বা নচিকেতা ঘোষ অথবা প্রবীর মজুমদারের কথা অথবা আরও অনেকে। একই ভাবে হিন্দি গানের ক্ষেত্রেও সেই স্বর্ণযুগের অবসান রাহুল দেব বর্মনের গান দিয়ে। পরীক্ষা নিরীক্ষা সব সময় চলেছিল বা এখনও চলছে। এসে গেছেন কবীর সুমন, নচিকেতা আরও অনেকে। মানুষ গ্রহণ করেছেন কারণ শ্রোতারও একটা খিদে থাকে। অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে " মহীনের ঘোড়াগুলি" র মত কতটা কালজয়ী হবে এদের গান সেটাও সময়ের তূল্যমূল্যে। সম্প্রতি একটি ওয়েব সিরিজের নাম না করে পারছি না। Bandish Bandits। ফিউশন বনাম কনফিউশনের এক দ্বন্দ্ব এক অদ্ভুত বাতাবরণের সৃষ্টি করেছে। ফিউশনকে যদি blending বলা হয় তবে তার সঙ্গে আন্দাজের দক্ষতা অনিবার্য। জয়পুর ঘরাণার কিছু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পাশে ফিউশন তাৎক্ষণিক বিনোদনে থেমে গেছে। তখনই একজন শিক্ষার্থীকে আমরা দেখতে পেলাম যে তাকে ফিরে যেতে হচ্ছে সরস্বতী আরাধনায়। এখান থেকেই কনফিউশনের জন্ম। নিজেকে এবং শ্রোতাকে যাচাই করার সদিচ্ছা হয়ত আরও উন্নততর প্রসাদ আমাদের হাতে তুলে দেবে। হোক না সে নিমিত্ত মাত্র। এই সাধনার ফসল আমাদের উপহার দিয়েছে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া'র মত এক বংশীবাদক কে, যিনি পন্ডিত রবিশঙ্করের স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে সঙ্গীত জীবনের মধ্যাহ্নে উপস্থিত হয়েছিলেন। ওঁকে তালিম দিতে প্রথমে রাজি হননি অন্নপূর্ণা দেবী। শেষে এক কঠিন শর্ত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া'কে সম্মত করেছিল তালিম নেওয়ার জন্য। রাতারাতি উনি অন্নপূর্ণা দেবীর নির্দেশে বাঁ হাতে বাঁশি তুলে ধরেন। এক কঠিন অধ্যাবসায়। অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে এর কারণ বিষয়ে। অন্নপূর্ণা দেবী চেয়েছিলেন অন্য ঘরাণার ছাপ যেন ওঁর ছাত্রের সুরে ও সুর প্রয়োগে না পড়ে। এই অভিনিবেশ সত্যিই অবাক করে দেবার মত। অবশ্যই একে ছুৎমার্গ বলা চলে না। প্রশ্নটা ছিল সিগনেচারের। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি গানকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। অতীতের অনেক শিল্পীই এখন ট্র্যাকে গান গাওয়ায় অভ্যস্ত অথবা ডাবিংয়ে। আসলে এই সমঝোতা সংগীতের প্রতি ভালোবাসার কারণে। কনফিউশন থাকলে রি-- টেকের সুবিধাও রয়েছে। তীর্থের পথ এখন দূর্গম নয় । পথ পরিণত হয়েছে রাস্তায়।
    নগেন্দ্র : দুই শতকেরও বেশি সময় ধরে, আমাদের যে প্রত্যক্ষ ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে হয়েছিল--- সেই সত্যকে আমরা বাদ দিতে পারি না। ভুলে থাকতে পারি না, পাশ কাটিয়ে যেতে পারি না। তার পাশাপাশি আবার প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বে ফিরে যাবার চেষ্টা করেও ঔপনিবেশিকতাকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব নয়। মলয় রায়চৌধুরী তাই তাঁর এই উপন্যাস তিনটিতেই ইউরোপীয় সন্দর্ভগুলিকে এবং সেই সঙ্গে ইউরোপ ও ভারতবর্ষের ক্রিয়া-প্রতিক্রয়ার মধ্যে অবস্হানকারী সুবিধাভোগী অংশের দ্বারা উৎপাটিত সন্দর্ভগত সক্রিয়তাকেও ইন্টারোগেট করেন। সেই সূত্রে তিনি বুঝে নিতে চান, ইউরোপ কেমনভাবে মতাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সূত্রে তাদের কোড বা সংকেতগুলিকে আমাদের সামাজিক ব্যবস্হার প্রবহমানতার মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে তুতে পেরেছিল, এবং এখনও কেন পারছে। এইভাবে বুঝে নিতে চাইবার পরিণতিতে, আধিপত্যকামী সন্দর্ভের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে, মলয় রায়চৌধুরীকে নির্মাণ করে নিতে হয়েছে বিকল্প সন্দর্ভের এমন এক পরিসর যা ঔপনিবেশিকতার প্রভাবমুক্ত জাতীয় ও আঞ্চলিক উপাদানের দ্বারা সম্পৃক্ত এক সচল চিন্তাপ্রবাহের দ্বারা নির্ধারিত। এই চিন্তাপ্রবাহের সূত্রেই মলয়ের বিকল্প সন্দর্ভ প্রতিনিয়ত শুষে নিচ্ছে চারপাশের নিরুচ্চার বর্গের জীবন থেকে স্বতোৎসারিত বিভিন্ন জায়মান কোড বা সংকেতগুলিকে, এবং সেই সঙ্গে শিল্পের নিজস্ব পরম্পরা এবং শৃঙ্খলার সূত্রেই তা ক্ষয়িত করে বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত আধিপত্যকারী সন্দর্ভকে।
    নয়
    রুক্মিণীকুমার :  বিদ্যাসাগর এসে হাজির আমাদের ক্রিক রোর বাসায়। বলেন, তুই নাকি দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করছিস? বললাম খেপেছেন, রোজ দুটো ডিম খাই তবু একটাকে সামলাতে পারছি না, ঢলানি বুকের আঁচল খসিয়ে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ফ্রি শো দেয়। তার ওপর দ্বিতীয় বিয়ে করলে শিলাজুৎএও আর সামলাতে পারব না। বিদ্যাসাগর বললেন, তবে কি মদনা ভুল বলল?
    -- না ঠিকই শুনেছেন।
    -- তাহলে খবর্দার তুই এ বিয়ে করবি না।
    বললাম, শিবনাথও তো দুটো বিয়ে করেছে একটা আবার কচি মেয়ে শীল ভাঙেনি প্রথমটার সঙ্গেই শোয় এক রাত কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারে না রোজ তিনখেপের কোটা বরাদ্দ, ছোট মেয়েটা কাঁদে পাশের ঘরে শুয়ে খুব সেক্স পায় বেচারার -- শিবুকে তো বুকে আগলে রেখেছেন, ওর বাপ পর্যন্ত ওর জন্য সুপারি ফিট করেছে, কবে উড়িয়ে দেয় ঠিক নেই, এ শালা মুঘল মসনদের থেকে খাতারনাক হিন্দুত্ববাদ, ছেলেকে এলিমিনেট করে দিচ্ছে বাপ হয়ে, ভাবা যায়! ওকে বলুন বুড়িটাকে ছেড়ে চিকনা কচিটার সঙ্গে ইলোপ করতে। বিদ্যাসাগর আর দাঁড়ালেন না, চটি খটখটিয়ে সটান হাঁটা দিলেন। জানি এ লোক কোনো দিন আর আমার মুখদর্শন করবেন না। কিন্তু কী করব, রসের টান; আমি ফিওদর পাবলোভিচ কারামাজভ: সব মেয়েকে ভালো লাগে, ইরেকটাইল ডাবল ফাংসানিংএ ভুগি, সারপ্লাস ভ্যালু, সবই লিবিডিনাল ক্যাপিটালের খেলা, পুঁজি শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে নিজের ভিতরে অনবরত পুনরুজ্জীবিত হয়, ইরসান আছে কিন্তু এসেন্সিয়ালি পুঁজির বিনাশ নেই, সে পাল্টে যায় ।
    বাঞ্ছারাম : ক্রিক রো ? মহাকাশেও আছে নাকি অমন গলি ? ক্রিক রো-এর নাম পাল্টে স্যার নীলরতন সরকার সরণি হয়েছে I নীলরতন সরণি আমরা কজন বলি, আমার জানা নেই I অন্তত আমি কারো মুখে ক্র্রিক রো কে নীলরতন সরণি বলতে শুনিনি I কিন্তু যদি কোনো দিন ক্রিক রো এই নামটা হারিয়েও যায়, তার ইতিহাস হারিয়ে গেলে খুব দুঃখজনক হবে I ক্রিক রো-এর এককালে নাম ছিল 'ডিঙ্গাভাঙ্গা' লেন I কেন? ক্রিক রো ছিল তখন গঙ্গার অংশ I গঙ্গা থেকে একটা শাখা বেরিয়ে এসে পড়েছিল ওয়েলিংটন স্কয়ারে-এ I আর সেখান থেকে সাপের মতন এঁকে বেঁকে গিয়ে শেষ হতো আমাদের এখনকার সল্ট লেক-এ, যেটা তখনকার সময় ছিল জনমানবশূন্য নোনা জলা জমি I ওয়েলিংটন থেকে এই শাখাটির নাম ছিল ক্রিক রো I তখন এই জলের ওপর নৌকা চলাচল করতো I দুপাশের পাড়ে ছিল সবুজের সমারহ I কোনো এক ঝড়ের রাতে এখানে ডুবে গেছিলো কারোর নৌকো, সেই থেকে অনেকে বলেন ডিঙ্গাভাঙ্গা লেন I কালে কালে এই নদীর জল গেল শুকিয়ে, আর ঠিক তখনি আর পাঁচটা রাস্তার মতন এই নদীর খাল বুঝিয়ে তৈরী হলো রাস্তা I ক্রিক রো দিয়ে হেটে গেলে তার দুপাশের বাড়ি গুলো লক্ষ্য করলে এখনো দেখা যাবে সেই নদী তে নামার বাড়ি থেকে সিঁড়ি I তখন হয়তো এই সমস্ত বাড়ির পূর্বপুরুষেরা জল নিতে এই ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে জল আনতেন I 
    রুক্মিণীকুমার : যথার্থ বলেছেন । আমি মহাকাশে নৌকো পারাপার করতুম । মঙ্গল থেকে শনি থেকে বৃহস্পতি । আমি যে মহানটবর তা নিজেই জানতুম না ।
    হরিহর : ভেবে ফেলেছিলাম এক বড়সড় ঐতিহাসিক ভাবনা । এবার আকার আয়তন, অফ টপিক দেখে প্রকাশক না পাওয়া...ভেবেছিলাম হয়ত উপন্যাসটি আর বই হবে না। তারপর লকডাউন। প্রলম্বিত অপেক্ষা, উদবেগ কাটিয়ে অবশেষে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। সম্পাদনার কাজ চলছে আপাতত। আমিও অবাধ্য, জেদি, নিজের জায়গায় অনড়, সম্পাদকও তেমনই। এইসবের মধ্য দিয়েই ভাবনাটা প্রকাশিত হবে খুব তাড়াতাড়িই মনে হচ্ছে। একটা ভাবনা আর তাকে পুস্তকাকারে পেতে এত বেগ পেতে হয়েছে, এত দীর্ঘ সময় হতাশায় কাটাতে হয়েছে..সেইসব আমার কাছেই থাক। আলো আসুক। একজন ভাবুকের দীর্ঘ পরিশ্রম আর অপেক্ষা দীর্ঘায়িত না হোক, এই কামনা কর নষ্টনট কলোনির নিবাসীরা । আলোকিত হোক বিশ্বভুবন। আশায় বাঁচুক ভাবুকরা । 
    রুক্মিণীকুমার : গেল বুধবার কালই তো, রেলগাড়ির কামরায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হঠাৎ দেখা! বললেন এসো  যদি আপত্তি না থাকে তোমার সঙ্গে একটা সেলফি তুলব, পয়সা দোব বিশ্ব-বা-রথীর অ্যাকাউন্ট থেকে, জানি তুমি অভাবী লোক। তুমি ভায়া এখন আমার চেয়েও বেশি নটরায়টি হাসিল করেছ এত চাপ সামলাও কী করে, আমি তো সমালোচনা পড়া ছেড়েই দিয়েছিলুম। বললাম, আমার সঙ্গে ছবি তুলবেন, আমি কিন্তু আপনার লেখা পড়ি না! রবিবাবু বললেন, দুর! আমি কি তোমাদের মতো ইনটেলকচুয়ালদের জন্য লিখি আমার লেখা অমিয়ভূষণ শঙ্খ সুনীল গাঙ্গুলি পড়বে তোমরা ফুকো পড়বে দেরিদা পড়বে। আমি ওসব কঠিন বই পড়িটড়ি না, আমি মনের খেয়ালে লিখেছি , ওসব হাবিজাবি লোক মুখস্থ করে আওড়ায় আবৃত্তি করে, খেউড় বোঝ! -- কিন্তু গুরুদেব ছবি তোলার মুশকিল আছে লোকে ভাববে আমি সুপারইমপোজ করেছি, সত্যিই আপনার সঙ্গে মোলাকাত হয়নি। তখন হো হো করে এমন হাসলেন যে ডেনচার ছিটকে বেরিয়ে এল আমি ঠিক ডাইভ দিয়ে সোলকারের মতো ধরে ফেলেছি গালিতে, ক্যাচ। আপনাদের কারোর দাঁতের পাটি না থাকলে বলবেন; লাগিয়ে দেবো ।
    মহীন : মানুষ এক আলোকভুখা পোকা, বিষাদের ঘন উদযাপনে, আমি আজ একটি প্রদীপও জ্বালাই নি, যেমন প্রেমের কাছে আধেক যাওয়া যায় না, তেমনি আলোর কাছেও আধেক যাওয়া যায় না, আমি আজ দীপান্বিতা ভারতকে দূর থেকে দেখি, প্রাণভরে দেখি, ভুলে যেও না মানুষ একটি আলোকভুক পোকা, চড়চড় শব্দে তারাবাজি জ্বলে ওঠে, ছাদে ছুটে যাই, যাদের মুখ নীচে উদ্ভাসিত
    যাদের মুখ নীচে উৎসবের দিনে উপচারের অভাবে ম্লান, তাদের বিষাদ আনন্দ সঙ্ঘটনের চাইতে অনেক দূরে, আকাশের দিগন্তে দিগন্তে শব্দহীন আলোয় জ্বলতে থাকা বহুতল বাড়ি, আর নিঃশব্দ সুদূরের গোত্রহীন তারাবাজি, তাদের অপরূপে আমায় মনে করিয়ে দেয়, ব্রহ্মাণ্ডের অন্তহীনতায় আমার যে আত্মচেতনা, স্থায়িত্বের জন্য আমার যে কাঙালপনা, তা ভ্রান্ত, আমি এই ছাদে উঠে প্রত্যেকবার শুধু কষ্ট পেয়েছি, সামনের ঘন সবুজ কবে দালানকোঠার হাতে মারা পড়বে, সন্ধেয় প্রতিবেশী বাড়িগুলোর ফাঁক দিকে হ্রদের বুকে সূর্যের প্রাত্যহিক আত্মহত্যা, কবে তা আর দেখতে পাবো না, এই প্রতি মূহুর্তের হারানোর ভয়, আঁকড়ানোর যাতনা, যুধিষ্ঠির যেমন বলেছেন, পৃথিবীর পরম আশ্চর্য, মৃত্যুর প্রতি নশ্বরের শাশ্বত অবিশ্বাস, শহরের দিগন্তবৃত্তে হঠাৎ জ্বলে ওঠা তারাবাজি
    সবুজ, সোনালী, ঘন লাল, অদ্ভুত ফোয়ারার মতো উত্তল, অবনত, ওহে পরিবেশ প্রেমী, সমস্ত বছর গাছ লাগিও বরং, আজ বাদ সেধো না, ভুলে যেও না মানুষ এক আলোকভুক পোকা, যুগ যুগান্ত ধরে সে মণি মাণিক্যে আলো পরিধান করেছে, আলোর উপাসক, আলো থেকে জন্মে, আলো চেয়ে, একদিন প্রবল প্রতিবাদে অন্ধকারে মিশে যাবে, ক্ষনিক তারাবাজি, আমার একটি পয়সা খরচ না করে চুরি করে দেখা শহর ময় আলো, আমার সুন্দর তারাবাজি, আমি আলোর কাছে আর প্রেমের কাছে ফিরে যাবো, ক্ষণিক হলেও সম্পূর্ণে যাবো, পূর্ণতায় যাবো, 
    অপু : বিরক্তকর লোকটি খোয়াবের মধ্যে খুবই জ্বালাচ্ছে,ঘুমাতে দেয়না; বলছেঃ ধানের সাথে, ভাতের, ক্ষুধার এবং কৃষিঋণের সম্পর্ক;লাঙ্গলের সাথে মাটির আর কৃষ্ণ কৃষকের এবং মশালের সাথে আগুনের খেলা! স্বপ্নের মধ্যে সে সন্ত্রাসী, তার গায়ে অবসরপ্রাপ্ত আর্মি-আর্মি গন্ধ, ওস্কে দিতে দিতে উর্দূতে বলছেঃ -“তোমার জন্ম তো পূর্ব পাকিস্তান, পাক সার জমিন সাদ বাদ, গেয়ে গেয়ে...তুমি বেড়ে উঠেছো, বড় হয়েছো। খাজনা দাও”। -“কেনো এতো ‘নাও নাও’ করো! কি কারণে এতো নদীমার্তৃক? "কাঠ আর লোহার পেরেকে সেলাই করা নৌকার, সাথে নৌকাডুবির সম্পর্ক”!, ঘুমের মধ্যে ঘিন্না, ঘুমের মধ্য জিন্না, এবং ঘুমের মধ্যেই তাকে কীভাবে যেনো খুন করলাম।, জেগে দেখি, আমার হাতে শয়তানের শাদা রক্ত!, .
    মাল্যবান : কোনোদিন ফুরুবে না শীত,রাত আমাদের ঘুম? ফুরুবে না।ফুরুবে না। কোনোদিন ফুরুবে না শীত, রাত,আমাদের ঘুম? না,না,ফুরুবে না। কোনোদিন ফুরুবে না শীত,রাত,আমাদের ঘুম? ফুরুবে না।ফুরুবে না।কোনোদিন…
    সন্দীপ : আরে মশাই মাল্যবান, আপনি তো ডায়রিতে সাংকেতিক ভাষায় লিখেছিলেন যে আপনার বউটা মরে গেলেই ভালো । তাহলে খোলা মনে লিখতে পারবেন । আপনাকে নষ্টনটদের কলোনিতে না পাঠিয়ে বদনটদের কলোনিতে পাঠানো উচিত ছিল ।
    মুরারী শীল : মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে, মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি; আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি। জেগেই দেখি কৈশোর আমাকে ঘিরে ধরেছে। যেন বালিশে মাথা রাখতে চায় না এ বালক, যেন ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে মশারি, মাতৃস্তনের পাশে দু'চোখ কচলে উঠে দাঁড়াবে এখুনি; বাইরে তার ঘোড়া অস্থির, বাতাসে কেশর কাঁপছে। আর সময়ের গতির ওপর লাফিয়ে উঠেছে সে। না, এখনও সে শিশু। মা তাকে ছেলে ভোলানো ছড়া শোনায়। বলে, বালিশে মাথা রাখো তো বেটা। শোনো, বখতিয়ারের ঘোড়া আসছে।
    আসছে আমাদের সতেরো সোয়ারি, হাতে নাংগা তলোয়ার। মায়ের ছড়াগানে কৌতূহলী কানপাতে বালিশে, নিজের দিলের শব্দ বালিশের সিনার ভিতর।, সে ভাবে সে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়দৌড়। বলে, কে মা বখতিয়ার?, আমি বখতিয়ারের ঘোড়া দেখবো।, মা পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাসেন, আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।, যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা, আর মানুষ করে , মানুষের পূজা, সেখানেই আসেন তিনি। খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি। দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে, দ্যাখো, দ্যাখো।, মায়ের কেচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে বালক, তুলোর ভেতর অশ্বখুরের শব্দে স্বপ্ন তার, নিশেন ওড়ায়।, কোথায় সে বালক?, আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা
    মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।, বারুদই বিচারক। আর, স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । অন্তর্ঘাত আর পোঁদে আঘাতের তফাত জানে না ।
    দশ
    নিখিলেশ : ভাতের ফেনা ফুটতে থাকে টগবগ, জুঁই ফুলের মতন ঘুরতে থাকে ভেতরে, কেমন এক মাতাল করা সুবাস ভেসে বেড়ায়। আমার তোমাকে মনে পড়ে। ভেতরে অমন তীব্র বলক ওঠা মন নিয়ে আমি ভাতের মাড় ঝরাই, হাত বেয়ে লাভার মতন মাড় পড়তে থাকে। আমি ধরেই থাকি, আমার তোমাকে মনে পড়ে। এমন সওয়ার হলে, ডাকিনী যোগিনী পালিয়ে যায় দূরে। ভাঁপে পোড়া হাত নিয়ে ভাবি সালুন থাক আজকে, খানিক আগুন ঝাল ভর্তা বানানো যাক, ঝালের আড়াল হয়েও খানিক যদি ঝরে যাও তুমি। লইল্লা ইচা খোলাতে হালকা থেকে গাঢ় লাল হয়। আমার তোমাকে আরো বেশি মনে পড়ে। নিজেকে সীমার বাইরে বধীর করে নেবার পর, বুকের ভেতর আস্ত কামারশালার হাপর জ্বলে যায় মুখাভিনয় বন্ধ থাকেনা, চোখের পিউপিল বদলে যায় ধীরে। এই মনে না করার প্র‍্যাকটিসে পারদর্শী হবার পর অন্তত এ ভারী অন্যায়! নিবিষ্ট মনে পেঁয়াজ টেলে নিয়ে গরম তেলে শুকনো মরিচের সাথে মন টাও ভাজতে থাকি বেশ উল্টেপাল্টে। সেখান থেকে তীব্র ঝাঝালো তোমার গন্ধ ভেসে আসে। পোড়া মন আর ঝালের রঙ ততোধিক কালচে লাল হয়, থেঁতো পেঁয়াজের সাথে তাকে মাখাচ্ছি বেশ, লাল কমছে না তো!
    রুক্মিণীকুমার : এখন প্রুস্ত ভাবছি । বারগোতের মৃত্যু। ভারমিয়েরের একটা হলুদ দেওয়ালের প্যাচ। প্রাক বার্থিয়ান অলৌকিক পাংকটাম। এ নিয়ে প্রুস্ত যা করল, এ যে কী অবস্কিওরানটিস্ট পরম্পরা, ফ্লোবেয়ারে শুরু, তারপর প্রুস্ত তারপর নাতালি সারোত রিখিয়ার লেখক। সুহাসিনীর পোমেটম এ একটা জীর্ণ দেওয়ালের এমন বিবরণ আছে যে, ওটাই ক্রুসিফিকস এরোটো ধর্ষকাম, বেশ্যার মতো হলহলা ফুটো। ঢোলকা পেরেকের গর্ত। বালি খসছে। বরিশালের কবি যেমন জল খসাত। যেন সাই টমলের ক্যানভাস, নাথিংনেসের গ্রাফিজম। বারগোৎ এগজিবিশানে অই হলুদ প্যাচওয়ার্ক দেখে ভাবল আমার এরকমই ভাবা উচিত। আমার শেষ বইগুলো বড্ড বিশুষ্ক, রস চাই! ভাবতে ভাবতে সে অক্কা পেল। সটান পটল ড্যাঙায়, পাড়ি। এ তো ফ্লোবেয়ারের অ্যামবিসান! যা সারোত প্ল্যানেটরিয়াম এ আনজাম দেওয়ার চেষ্টা করেছে: কে কোথা থেকে কী নিয়েছে সব জানি। আমি প্রুস্তের মতোই একজন শার্লক হোমস। সাহিত্য পুরোটাই -- যত সিরিয়াসই হোক -- ডসটয়েভস্কি জয়েস লরেন্স স্টার্ন, নিছক ডিটেকটিভ গল্প, আমরা সবাই জাসুস, এতে লজ্জার কিছু নেই, খোঁজ নিয়ে চলেছি সন্ন্যাসিনীর গোপন খবর; ইনকিওরিবল ফ্রয়েডিয়ান, স্বপ্নে পর্যন্ত হানা দিই…ইউলিসিস ডিসাইফার করতে হবে না, শুধু রিদমটা ধরো। স্বগত ছন্দ, স্বর ও নিশ্বাসের বিন্যাস; মন্থর শব্দ উদগিরণ; যা দেখছে তাই বলছে: ভিতর বাহির জাকসটাপজিসন। স্মৃতি আর চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা। অবলোকন ও স্পেকুলেসন। আর একটার পর রাস্তা পার হয়ে যাওয়া, অন্তহীন পথনামচা। কলকাতা রোডম্যাপ খুলে ভাবা যায় এ ভাবনা । খুব সোজা। অলিগলির নাম ইতস্তত ঢুকিয়ে দিলেই পাঠক হ্যালু খেয়ে যাবে। গল্প একটা ডিসকনটিনিউয়াস প্রসেস, তুমি আরবিট্রারি শব্দ টপকাও আমি মানে করে নেব । না নিয়ে উপায় নেই আমার। ভাবুকই অরগ্যানিক হোল। ভাবুক নৈরাজ্য, কেঅসমস। যা খুশি ভাবুক ভেবে খালাস। বিপন্ন কৌশিক সরকার ওসব সাজাতে বাধ্য হয়। ও ব্যাটা বিশৃঙ্খলতার মধ্যে বাস করতে পারে না…
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । কবে দেশ স্বাধীন হয়েছিল ? ২০১৪ সালে না ১৯৪৭ সালে ?
    হুতোম : আজকাল বাঙ্গালী ভাষা কৌশিক সরকারের মত মূৰ্ত্তিমান কবিদলের অনেকেরই উপজীব্য হয়েছে। বেওয়ারিশ লুচীর ময়দা বা তইরি কাদা পেলে যেমন নিষ্কৰ্ম্মা ছেলেমাত্রেই একটা না একটা পুতুল তইরি করে খ্যালা করে, তেমনি বেওয়ারিস বাঙ্গালী ভাষাতে অনেকে যা মনে যায় কচ্চেন; যদি এর কেউ ওয়ারিসান থাকৃত, তা হলে স্কুলবয় ও অসিদের মত গাধাদের দ্বারা নাস্তানাবুদ হতে পেতে না-তা হলে হয়ত এত দিন কত গ্রন্থকার ফাঁসী যেতেন, কেউ বা কয়েদ থাকতেন, সুতরাং এই নজিরেই আমাদের বাঙ্গালী ভাষা দখল করা হয়। কিন্তু এমন নতুন জিনিস নাই যে, আমরা তাতেই লাগি—সকলেই সকল রকম নিয়ে জুড়ে বসেছেন বেশীর ভাগ অ্যাকচেটে, কাজে কাজেই এই নক্সাই অবলম্বন হয়ে পড়লো। কথায় বলে, এক জন বড়মানুষ, তারে প্রত্যহ নতুন নতুন মঙ্করামে দ্যাখাবার জন্য, এক জন ভড় চাকর রেখেছিলেন; সে প্রত্যহ নতুন নতুন ভাঁড়ামো করে বড়মানুষ মহাশয়ের মনোরঞ্জন কত্তো, কিছু দিন যায়, অ্যাকদিন আর সে নতুন ভাঁড়ামো খুঁজে পায় না; শেষে ঠাউরে ঠাউরে এক ঝাঁকা-মুটে ভাড়া করে বড়মানুষ বাবুর কাছে উপস্থিত। বড়মানুষ বাবু তার ভাঁড়কে ঝাঁকা-মুটের ওপর বসে আসতে দ্যাখে কুলন,—“ভাড়, এ কি হে?” ভাঁড় বলে, “ধৰ্মাবতার। আজকের এই এক নতুন !”
    ঠকচাচা : কাল রাতে কোন কবিতা ভাবছিলাম! এই দেখো, না লিখে খুব ভুল হয়ে গেল! তোমার নাম শুনলে কোন গন্ধ আমার মনে পড়ে! তোমাকে সবুজ ভেবে ব্যক্তিগত করে রাখি, আমি ছাড়া অন্য কোথাও তোমার আনন্দ হলে আমার দুঃখ লাগে, আমি কি কালার ব্লাইণ্ড! তা না হলে কেন খালি সবুজের কথা বলি! সমস্ত ধূসর কেন সবুজের ভিতর দিয়ে দেখি! কাকের কথার দিকে গেলে কলস আর পাথরের কথা ভাবি, আমি ত অর্থ জানি না, একটা শব্দ লিখে তারপর অভিধান দেখি, কী আশ্চর্য! অজ্ঞাত শব্দ তবু দরদের সম্ভাবনার দিকে কদম ফেলে রাখে, আমি ত লিরিক্যাল নই, তবু কেন লিরিক্যাল বাতাস চারদিকে, কখনো ডালডার কথা মনে হয়, কখনো তালমাখনার কথা
    আর থেকে থেকে ইতিহাসের নানা গুড়াগাড়া খাবারের উপাদানের কথা মনে পড়ে, স্বামীর সন্দেহের মতো তোমাকে আলগোছে দেখি, সদকার প্রশান্তিমতো তোমার সাথে কথা বলা, আমার কালো অস্মিতার ভিতর হলুদ ওড়না উড়ে যায়, আমি কালো ও হলুদকে ভালোবেসেছি, হলুদ খাতার ভিতর নিজস্ব ফার্ম গড়ে তুলেছি, প্লাস্টিক চেয়ার কালো হাতলের ইমেজ সেখানে গড়ে ফেলে, এক নির্জন চেয়ার কোথাও আমার জন্য কাদে, রাগ করে কোনোদিন ভাত না খেয়ে থেকে যেতে ভয় লাগে,
    যেদিন থেকেছি সেদিন খুব করে কেউ ডাকেনি, এ এমন দিন, দেজা ভ্যুর ভিতরে হেজে গিয়ে, যেন উঠে বসি আশ্চর্য বিদাশে, যেন একটা দিন যাবে চুপিসারে আর কিছু নয়, কোথাও কোনো প্রাণ একটুও বড় হবে না ।
    মাল্যবান : ওপরের ঘরের বাথরুমে  স্নান করতে দেয় না আমার বউ ।  স্নান করতে হবে বাড়ির অন্য মহিলাদের নজরের সামনে নীচের চৌবাচ্চায়। এক-গা লোম নিয়ে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বৌ-ঝিদের আনাগোনা চোখ-মারা মুখ-টেপার ভেতর স্নান করতে ঠিক জুত লাগছে না আমার । যেন শিবলিঙ্গের কাক-স্নান হচ্ছে । উত্তরে বউ বলে, তা হলে তুমি কি বলতে চাও দরজা জানলা বন্ধ ক'রে এক-হাত ঘোমটা টেনে তুমি ওপরের বাথরুমে গিয়ে ঢুকবে, আর মেয়েমানুষ হয়ে আমি নিচের চৌব্বাচায় যাব--ওপরের বারান্দায় ভিড় জমিয়ে দিয়ে ওদের মিনসেগুলোকে কামিখ্যে দেখিয়ে দিতে?
    বিপিন : আপনাদের রাধেশ্যাম গড়াইয়ের গল্প বলি...কয়লাখনি অঞ্চল রানিগঞ্জ থেকে জাতীয় সড়ক ধরে সিউড়ির দিকে কিমি দশেক গেলে চিচুরিয়া মোড়...সেখান থেকে আরও কিমি পাঁচেক গেলে আলিনগর গ্রাম। ১৯৮৯ সাল থেকে এই গ্রাম ও লাগোয়া এলাকায় গাছ পুঁতে এসেছেন রাধেশ্যাম.. .৩২ বছরে কতগুলি গাছ বসিয়েছেন তিনি? পাঁচ লক্ষ (ঠিকই পড়লেন, সংখ্যাটা পাঁচ লক্ষ) .... এলাকাটি পুরোদস্তুর বনভূমির চেহারা নিয়েছে এখন...আপনি গুগল ম্যাপ দেখুন, জঙ্গলটা ভালো করে বুঝতে পারবেন...একটা মানুষ সম্পূর্ণ একার হাতে এই জঙ্গল তৈরি করেছেন কোনও সরকারি, বেসরকারি দাক্ষিণ্য ছাড়া...পরে অবশ্য তাঁর ছেলে তাঁকে সাহায্য করতেন...কেন এই জঙ্গল বানালেন রাধেশ্যাম? খনি এলাকার রুক্ষ পাথুরে জমি গ্রীষ্মে তেতে ওঠে...হাঁটাচলাই দায়...চড়া রোদে তালু ফেটে যায় যেন...রাধেশ্যাম ভাবলেন, এই সব পতিত জমিতে যদি গাছ বসানো যায় তবে মানুষ একটু ছায়া পাবে, অত কষ্ট হবে না...সেই শুরু...প্রতিদিন সকালে লুঙ্গি পরে একচিলতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তেন রাধেশ্যাম...বউ গামছায় মুড়ি আর শসা কিংবা গুড় বেঁধে দিতেন...সারাদিন গাছ বসিয়ে অক্লান্ত রাধেশ্যাম সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে পরদিনের পরিকল্পনা করতেন...জঙ্গলের ভিতরে একটি জলাশয় তৈরি করে, তাতে কটা মাছও ছাড়লেন...এভাবেই একদিন তাঁর স্বপ্নের অরণ্য তৈরি হয়ে গেল...এই যে জঙ্গলের ছবিটা দেখছেন, এটা ওঁর হাতে তৈরি...ভাবতে পারছেন, একটা মানুষ একার হাতে এই পতিত জমিতে অরণ্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন !! পুরস্কার, সম্মান এসব কিছু পেয়েছেন?
    হ্যাঁ... একবার বন দপ্তরের কিছু কর্তা বনভূমি দেখে খুব প্রশংসা করে উপহার তুলে দিয়েছিলেন রাধেশ্যামের হাতে...কী উপহার? একটি লুঙ্গি আর একটি গামছা...বলা যেতে পারে শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার...
    বাঞ্ছারাম : একদিন স্মৃতির ভিতর বিকট শব্দ তুলে একটি ট্রেন ঢুকে এল, কালো ধোঁয়া, অমনোযোগী বিকেল আর সাদাকালো ভিক্ষাপাত্র সমেত, এই রেল ঝমঝম করছে ব্রিজের উপর। নীচে অনন্ত খাদ, তোমার জানুর মতো উপত্যকাগুলি কেঁপে উঠল একবার, হে প্রলয়, দেখো বিস্ময় কেমন স্থির হয়ে আছে গাছের বয়সের কাছে, এই যে ভ্রমণে লেগে গেল অকারণ রমণ তাকে নিয়ে তুমি হো হো হেসে ওঠো, ওই জলোচ্ছ্বাসের মতো ঠোঁট এবার ডুবিয়ে মারবে ভ্রমণে ভ্রমণে, এই সামান্য করতল আমার, তাতে লেগে গেছে যে বিষণ্ণ ছায়া তাকে তুমি তাচ্ছিল্য করেছ। হে প্রলয়, হে ব্যাভিচার, তুমি অসহায় মানুষের গায়ে চালিয়ে দিয়েছ দুরন্ত রেল, গবগব করে ধোঁয়া উঠছে, ঢেকে যাচ্ছে আকাশের গা, ভিতরে নিভে এল গান, রাত্রি ছুঁয়েছিল রেলের চাকায় ছিটিয়ে যাওয়া শব্দের পরাগ, এইমাত্র স্মৃতিখানি ভেঙে গিয়ে ছায়ারিক্ত হয়ে এল ভ্রমণ, সামান্য ঠোঁট আর চোখের পলক পথে পথে ফেলে গেছে রক্তাভ রমণ….
    অমিত রায় : বাপের বিষয় পেতে আর ধুমধামের পরিসীমা ছিল না। যখন যা মনে আসে তাই করেন। কখন হোটেলের খানা আনিয়ে আমোদ আহ্লাদ কচ্চেন, কখন তেলেভাজা ফুলরি বেগ্‌নির সহ রকমারি নিয়ে ইয়ারকি দিচ্চেন। আজ স্যাম্‌পেন ঢালোয়া -- কাল ব্রাণ্ডির মোচ্ছব -- পরশু পাঁচ রকম মদ দিয়ে পঞ্চ্‌ কচ্চেন। বাঁদি নেসা না হলে কখন বা মদের সঙ্গে, লডেনম্‌, ও মরফিয়া মিশাচ্চেন। পাঁচ ইয়ারির দল হলেই পাঁচ রকম লোক এসে যোটে। কোথাও ভটচাজ্জির টিকি কেটে সন্দেশের সঙ্গে ফ্যান্সি বিষকুট দিয়ে খাওয়াচ্চেন। কোথায় কাহাকে ডাবের জলে এমিটিক দিয়ে খাওয়াচ্চেন। কোথায় কেহ নেশায় অচেতন হয়ে পোড়ে আছে। কোথায় কেহ হাত পা আছড়াচ্চে, কোথাও কেহ গড়াগড়ি দিচ্চে, কোথাও কেহ বমি কোচ্চে, কোথাও কেহ দুটো হাত তুলে ইংরাজী লেকচার দিচ্চে, কোথাও কেহ বাঙ্গালায় বক্তৃতা কোচ্চে।”
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । হুইস্কির বোতলে কটা পেগ আর চুল্লুতে কটা ভাঁড় তার তফাত জানে না ।
    এগারো
    মেঘের ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে জাম্বোজেট উড়োজাহাজের সবকয়টা পায়খানা একসঙ্গে খুলে দেবার ফলে নষ্টনটদের মাথার ওপর ঝরে পড়তে লাগলো গুমুত বৃষ্টির ফুল । তারা তো আহ্লাদে কুচুরমুচুর। রুক্মিণীকুমারকে নিয়ে নাচা আরম্ভ করে দিলে ; উদ্ধারকারী নটবর এসে ওদের পাগলামি সারিয়ে দিয়েছে, তাই, আকাশ থেকে গুমুতপুষ্প বৃষ্টি সৃষ্টি করতে পেরেছে, কলোনিবাসীদের মাথায় হাওয়া ভরে দিতে পেরেছে ।  তারা নাচতে নাচতে গাইতে থাকে…”মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ। তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে, তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ॥ হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে, কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে, নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ। কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ, দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ--সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ॥ সে কী অপরূপ দৃশ্য ! কয়েক হাজার উলঙ্গ মানুষ দুহাত ওপরে তুলে নাচছে । 
    সন্দীপ : ক্ষুদ্র কীট যেমন পুপসহবাসে দেবশিরে আরোহণ করে, আমরা বাস্তবতাকে মুছে ফেলতে পারি, যদিও এতে ভয়ের কিছু নেই, যেহেতু ঐ বস্তু তার অনপনেয় দাগ রেখে যায়।
    নিখিলেশ : দিন কতক ভাবিনি।  রাজ্যের ডিফিকাল্ট ভাবনা। এমনকি ভিটগেনস্টাইন। তবে মুখ্যত ফুকো। কৌশিক সরকারকে বললাম, ফুকোকে রিয়্যাপ্রপ্রিয়েট করতে যে আরো কত বছর লাগবে ভাবলে ভিরমি খেতে হয়। অথচ ওর প্রতিভা ডিসকোর্স আকস্মিক নয়। প্রাকৃতিক ইতিহাস যখন জীববিজ্ঞান হল সেই ট্রানজিশনাল জাঙ্কচারটা ও খুলে দেখালো, এ কবিতার চেয়ে হাজার গুণ কঠিন প্রভোকেটিভ ফ্যাসিসিনেটিং উদঘাটন; বোকারা কবিতা পড়ে, কবিতা লেখে: ফুকো পড়ো যদি কবিতার প্রকসিমিটিতে বসত করতে চাও, কবিতা কবিতায় নেই, কবিতা উত্তর দার্শনিক ডিসকোর্সে আছে। সন্ধ্যেবেলা কল করল কুন্তল। এরম সময় করে না। আমি ভাবলাম, উন্মেষ। যে, আসব? অর্থাৎ পাঁইট নিয়ে। গতদিন বাদামমাখাটা আনেনি। যে বাদাম আনল সেটা আপ টু দা মার্ক নয়। ফার ফ্রম ইট। সড়া হুয়া। সাপোজ পচা বাদাম একটা আগার মুখে পড়ল -- পড়েওছিল -- থুকিয়ে, সে গ্লানি, অবমাননা হিউমিলিয়েসন আমি এমনকি বলব কনসপিরেসি থেকে শত কুলকুচো চতুর্দিকে করেও নিস্তার নেই। উন্মেষ হলে কী বলব ভাবলাম। ফোন রিসিভ করার আগে এমনকি কার কল দেখার আগেও উপন্যাসোপম বিদ্যুৎ-লেখা অকল্পনীয় ডিফেন্স মেকানিজম টেক্সটুয়ালি তৈরি প্রুফ কারেকসান সমেত ঝটিতি প্রিন্ট আউট হয়ে যায়, সার্কুলেট করে, সর্বত্র। অথচ গরজ ওর একার নয়। মেয়েকে লুকিয়ে কিচেনে ছাপ্পারে খাওয়ার গিল্ট এড়াতে এখানে আসে। কী বলব: হ্যাঁ-হ্যাঁ চলে আয়! নাকি আজকের দিনটা স্কিপ করে যাই চল, কাল শনিচার, কাল আায়! সাত্যকি হলে বলত, আজকের দিনটা কাটিয়ে দিন। অনেকদিন আবার সাত্যকির কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি কল করি না। ও খুব মুডি ছেলে। পরম বন্ধু। বয়সে অনেক ছোট। পরম বন্ধু কিন্তু কথার কথা নয়। ফ্র্যাকসানস অব সেকেন্ড। তার মধ্যে কত সংঘর্ষ, চিন্তা সিদ্ধান্ত। লেখা শুধু স্পনটেনিয়াস নয় অসম্ভব ক্রিটিকাল। একটা শব্দও আরবিট্রারি নয়। রাইটিং পিকুলিয়ার রেসপনসিবিলিটি। সাত্যকির সঙ্গে অদ্ভুত সম্পর্ক। ইউনিক। এরকম পৃথিবীর কারুর সাথে কারুর নেই। ও আমার পাঠক। দেবতাজ্ঞান করে। খুবই এমব্যারাসিং ব্যাপার। ছিল সন্দীপনের ভক্ত, আমি হ্যাক করে নিয়েছি। ও আমার ইঁউহি তুড়িতে, চুটকিসে। এসব ফেরেব্বাজি আমার খুব ভালো আসে। পাঠক ফুসলানো। তা বলে ভেব না ও ধুর! বস্তুত সবচেয়ে সিরিয়াস, রোম্যান্টিক, একগুঁয়ে পাঠক। ওকে আমি কোনো দিন ফিলজফি পড়াতে পারব না। ও কেরুয়াকের ভক্ত। আমার সব কেরুয়াক ওর কাছে। ওর সব কুন্দেরা আমার কাছে। এরকম হয়। কুন্দেরা আমি মাস্টারবেট করার জন্যও পড়ি না। ট্রিসট ট্রপিক আমার জান। ওটাও ও রেখে গেছে, ক্লোদ লেভি-স্ট্রোস। রোজ একটা প্যারা পড়লেই হল। একেকটা সম্পর্ক কত গভীরে চলে যায়, পরস্পরের। পাঁচ বছর বাদে দেখা হয়। তেরো বছর বললে লোকে বিশ্বাস করবে না, উঞ্ছ সন্দীপন বলেছিল। প্রথম পৃষ্ঠায় কেউ এসব লেখে! বলে একাধিক বার ব'লে দেখেছি, কেউ বিশ্বাস করেনি। অর্থাৎ সূর্যোদয় দ্যাখেনি। খসড়া, ছাপার আগে, আমাকে পড়ালে, বকা দিতাম। ওটা কেটে দাও সন্দীপন। অত এগজিস্টেন্সিয়ালিস্ট অ্যাবসার্ডিস্ট হতে হবে না। মরুগ্গে যাক। সাত্যকির সঙ্গে যত কমই দেখা হোক না কেন রোজ আমরা পরস্পরকে ভাবি, আমার ধারণা। এটাই সম্পর্ক। খারাপ ভাবি না। অনেক রিলেসান আছে খারাপ না ভেবে উপায় নেই। ওসব কুচুটে লোক। বৌ আরো কুচুটে। কত সম্পর্ক শুরুটা ভালো ছিল। বিষিয়ে গেল। টেঁকেনি। অনিমেষ, কেটে পড়ল, না বলে, আমার লাইফ থেকে। সাদমা। আমার অহংকার, আমার বলে নয়, যে কারুর -- যাকে বলে, সেলফ এসটিমেসান, হুবহু পিকাসোর মতো, অবিকল -- এসব বলতে আমার মুখে আটকায় না, যে জিলোকে বলেছিল: আমাকে কেউ ছেড়ে যায় না! এই আস্ফালন টুকু না করলেই হয়ত জিলো থেকে যেত। অন্য ভাবে বলতে পারত, মত যা, গোরী! যে যাবার সে অবশ্য যাবেই। হাতেপায়ে ধরেও আটকানো যাবে না। সেলিনের অন্য উত্তর আছে, কুইকার দ্যান দা বস্। মালিক তোমায় স্যাক করার আগে তুমি রেজিগনেশন লেটার দাখিল করো। কুন্তল জিগেস করল, ফারনান্দো পেশোয়া কি সুইসাইড করেছিলেন? জানি না। তবে বায়োগ্রাফি নিয়ে বেশি কালক্ষেপ কোরো না। অভয়ের কথা পড়বে। ক্ষেত্রও খুব সম্ভব খুদখুশি করেছিলেন। ত্রিবেদী ইঙ্গিত দিলেও রাজ খুলাসা করেননি। এত বড় ঘটনা, মিসতিরি, মোহিতলাল কেন আলোচনা করলেন না আই ওয়ানডার। সেলিনও, ইন অল প্রব্যাবিলিটি। বলতেনও, নিজেকে আমি শেষ করে দেব। পারসিকিউসন মেনিয়া, আমরা ভাবতাম। আমার ধারণা সে লেথাল বড়ি গিলে ঘুমিয়ে পড়ল। কেননা নর্থ লিখছিল সেদিন লুসেতকে ডেকে বলল, লেখা শেষ, গালিমারকে এত্তেলা করো। সেদিন সন্ধ্যবেলায় সেলিন চোখ বুঁজলেন। ইনসমনিয়াক। এর আগে কোনো দিন ঘুমোননি। মাথায় বিস্ফোরণের শব্দ হত, বিরামহীন....
    গোবিন্দমাণিক্য : সুনসান নীরবতা। অশোক-এর পাতা নীরবে কাঁপছিল। মৃদু-ভূ কম্পনের লক্ষণ।
    বাতাসে ভর করেছিল ভয়। নারীরা সিঁদুর মুছে ফেলেছে। পায়ের নকশা অ্যারাবিক কৌশল হয়ে গেছে ততক্ষণে। পালিয়েছে হনুমানজি। শস্য আর সূর্যী দেবী ছেড়ে গেছে পূজারী। এমনটা আগে কখনও, চারিদিকে খাজুরাহো ভাঙা পাথর। খচ্চরের সেনাবাহিনী পিঠ ঠেসে দিয়েছে মাটিতে। হে বখতিয়ারের খচ্চর তুমি কি সু-সংবাদ এনেছো? নাকি দানব দাঁত কেলাচ্ছে নাঙ্গা খঞ্জর হাতে? নিরীহকে অধিগ্রহণ নেশায় মত্ত একদল নষ্টনট। যোনী নাকি পায়ু থেকে জন্মেছিলে ?  একটা অধ্যায় আবার, ভ্রুণ হয়ে ঢুকে গেছে জঠরে। আসো শান্তির ছায়া তলে। আসো, নিজে থেকেই হয়ে যাও। ওই যে সিন্দুক। সেখানে রাখবো তোমায়। তুমি গাধা হয়ে যাও। হে বখতিয়ারের গাধা তুমি আর কি এনেছো? এই বাংলা ভূখণ্ডে। সেদিন তুমি আর যা এনেছিলে তার নাম আরোপিত বিশ্বাস।  আরও একটা ভাইরাস।
    রাজপুত্র : আপনার বক্তিমে শেষ করেন ।
    রাজপুত্তুর রুক্মিনীকুমারকে নিয়ে গিয়ে প্লাস্টিকের সিংহাসনে বসিয়ে গোটানো কাগজ থেকে খেতাবগুলো পড়তে শুরু করল ।
    রাজপুত্র : মহামান্য নটবর, আজ থেকে আপনার পরিচয় সান্দ্রোকোত্তোস-এ-আজম আন্দ্রাকোত্তাস, আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন বাহাদুর আলমগীর  বাদশা গাজী, সর্বদক্ষিণাপথরাজ, উদায়িভদ্দক, নুরুদ্দিন মহম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী, সালভাদোর ডোমিঙ্গো ফেলিপি জেসিন্তো দালি ই দোমেনেখ, ১ম মার্কুইস দ্য দালি দ্য পুবোল, পাবলো, দিয়েগো, হোসে, ফ্রান্সিসকো ডি পাওলা, হুয়ান নেপোমুসিনো, মারিয়া ডি লস রেমিডিওস, সিপিয়ানো ডে লা সান্তিসিমা ত্রিনিদাদ, রুইজ পিকাসো, মাসাচ্চিও, ব্রুনেলেস্কি, গিবারটি, পিয়েরো ডেলা ফ্রান্সেসকা, ডোনাটেল্লো, ও মাইকেলোতসো, ভিনসেন্ট ভ্যান গখ, পল সেজান, পল গোগাঁ, জর্জ সেরাট এবং অঁরি দ্য তুলুজ-লোত্রেক,  হেনরি মাতিস, জর্জ ব্রেক, আন্দ্রে ডারেন, রৌল ডিফী, জ্যান মেটজিংগার,মরিস ডি ভ্যালমিনক, আবুল মোজাফ্ফর সাহিব উদ্দীন মোহাম্মদ সাহিব-ই কিরান শাহজাহান বাদশা গাজি, কুতুব উদ্দিন মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম শাহ আলম, দ্য অর্ডার অফ লেনিন, আসফ জাহ  মীর আকবর আলী খান সিকান্দার জাহ, দ্য মোস্ট এক্সিলেন্ট অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার, নাইট ইন দি অর্ডার অব দি আর্টস অ্যান্ড লিটারেচার, সেজোং দা গ্রেইট, গ্র্যান্ড প্রিন্স  আইভান ভেসিলিভিখ দ্য টেরিবল….
    সওদাগরপুত্র : থাক, থাক, অতো বড়ো গোটানো কাগজে মুড়ে ওনাকে এবার মহাশূন্যে পাঠানো হোক, ওই যে একটা ক্যাপসুল আসছে ওনাকে নিতে ।
    নিখিলেশ : না না, আরেক কিস্তি গুমুতপুষ্প বৃষ্টি করতে আসছে ।
    বারো
    কাগজে মোড়া রুক্মিনীকুমার চিৎকার করতে থাকেন বাঁচাও,  বিশ্বরূপ দে সরকার বাঁচাও শিগগির এসো, বাঁচাও এই নষ্টনট কলোনির পাগলদের হাত থেকে । সব কটা ল্যাংটো পোঁদে আমার সঙ্গে যা-তা করতে চাইছে, বিশ্বরূপ দে সরকার, আকাশ থেকে নেমে এসো, অপ্সরাদের কোল থেকে নেমে এসো, ইন্দ্রের বাকল ছেড়ে বেরিয়ে এসো ।
    দেবদাস : যত্তো সব মাতাল ।
  • Raghunath naiya | 2409:4061:2001:6216::215e:b0b0 | ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:২৮739321
  • Raghunathnaiya
  • নেছারুল হক | 58.145.184.226 | ১৩ আগস্ট ২০২৩ ১২:৫০740499
  • উপন্যাসের শৈল্পিক ও সাংগঠনিক বিচার বিশ্লেষণ! বিস্তারিত চাই
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:b42b:f4bf:3b45:46e7:f4b2 | ১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৩৬740502
  • অঁতনা আতো’র কবিতা : রেড ইনডিয়ান সংস্কৃতি
    আমি মেক্সিকো এসেছি লাল পৃথিবীর সঙ্গে
    যোগাযোগ করতে              
    আর সে মিষ্টি গন্ধে দুর্গন্ধময়ী
    আর যখন সে দুর্গন্ধময়ী হয়ে ওঠে তখন তার সুগন্ধ পাই।
    নিটোল যোনির ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে 
    আদিবাসী পেচ্ছাপ                                              
    যে অঙ্গকে তুমি  নিজের আয়ত্বে নিতে চাও     
    কর্পূরগন্ধী যোনিপথ                                               
    মৃত যোনি
     তোমার কান মুচড়ে দেয় 
    তুমি পেচ্ছাপ ছড়িয়ে দাও
    যখন তুমি মিরাদোরের ওপর থেকে 
    পিত্রের দিকে তাকাও      
    ভয়ানক বাপের  সমাধিতে পুঁতে রাখা,      
    গর্ত ফাঁপা হয়ে গেছে, অম্লে চোবানো             
    গর্তে লাল আগুনে ফুটন্ত উকুনের ঝাঁক ,      
    সৌর লাল উকুন চক্র      
    শিরার তন্তুজাল সব সাদা
    সময়ে           
    সত্তর বার অপবাদ দিয়েছে
     যখন মানুষ
     নিজের সাথে সঙ্গম করে    
    সন্তানের জন্ম দিয়েছে
    যে পায়ুসঙ্গমে জন্মেছে
    তার নিজের
    পালোয়ানি পোঁদ
    তাহলে, তাদের কোন দুটো
    এবং কেনই বা, প্রথম জায়গায়, দুটো কেন ?
    বাপের অনুকরণে করুণ ভাঁড়,  
    ফাঁপার ভেতরে  নোংরা পরজীবী মঁবলাঁ পর্বত
     আগুন থেকে  টেনে তোলা মায়ের মাংস
    তোমার চারপাশে ফুরিয়ে যাওয়া সমস্ত বৃত্তাকার সূর্যের জন্য
    থপথপে পায়ের পাশে কিছুই নেই
    পুরোনো  অপরিমেয় উচ্চারণ 
    সঙ্গে জঙ্ঘায়  যেখানে
    হাড় পচে যায় ,
    যুদ্ধের মতন মাটির তলা থেকে ওপরে উঠছে
    সমস্ত হাড়ের বর্ম
    ওটার মানে কি?
    এর মানে হল যে মাবাপের ঝগড়া বন্ধ করো                                                            
    সহজাত পথচারী                       
    খ্রিস্টান হুল্লোড়ের নোংরা শ্লোক,                          
    হাসি আর কান্নার মধ্যে মাথা গলায়                          
    যারা হাসি-কান্নায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল;
    আর এর মানে তো যুদ্ধ
    মাবাপের জায়গা নেবে
    এখানে যেখানে পায়ু বাধা তৈরি করেছে
    পুষ্টিকর প্লেগের বিরুদ্ধে
    লাল পৃথিবীতে গোর দেয়া
    শবের তলায়
    যোদ্ধা
    যা দিয়ে যেতে ভয় পেত
    সাপের ছোবলে বারবার
    যে তার লেজকে সামনে থেকে কামড়ায়
    বাবামা তৈরি করার সময়
    সহজাত পথচারী,                         
    যা দিয়ে যেতে ভয় পেত
    বাবামা তৈরি করার সময়
    সামান্য ফেনিল রক্তাক্ত
    আর কাছে থেকে দেখছি,
     এক টুকরো  ফাটা ঠোঁটে
     পুরানো দাগ-দেয়া উরু,
    তারা এদিক ওদিক পড়ে যাচ্ছে, দুর্গন্ধমযয়ী;
     আর পুরোনো যোদ্ধা উঠে দাঁড়ায়
     তার বিদ্রোহী নিষ্ঠুরতা নিয়ে,
    সেই অকথ্য নিষ্ঠুরতার সাথে
    সেখানে বেঁচে থাকা ছাড়া জীবনের জন্য
    তুমি ন্যায্য নও;       
    আর পৃথিবীর স্থির গর্তে                
    ওপর থেকে আর ভেতরে থেকে দেখা যায়,
    জিভের  আলোকিত ডগাগুলো ঝরে পড়ছে
    যারা একদিন নিজেদের আত্মা ভেবেছিল      
    এমনকি ইচ্ছা না থাকলেও; 
    আর তারা আমার মরা হাত দিয়ে
    চাবুক উঁচিয়ে ধরে                                                 
    মেলে দেয়া জিভের বিরুদ্ধে
    আর কামনার লিঙ্গ, 
    যারা শুধুমাত্র মুখের তৈরি ঘুটি      
    অস্তিত্ব দখল করার ক্ষমতা যাদের নেই;
    তবুও তারা সূর্যের চেয়ে উজ্জ্বল       
    যেখানে গুহার মধ্যে ছড়ানো রশ্মি      
    বাবামা আর দেবদূত ছেলে      
    তারপর থেকে একে অপরকে খুন করছে      
    আগে সব দুর্গন্ধ ছড়িয়েছিল
    যখন সৌর গাধা নিজেকে মনে করেছিল
    সৌম্য আর ভালো।           
    আর কখনই বা                                    
    স্বর্গ রয়েছে
    তাদের বৃত্তে ?
    যখন তারা                      
    এর বাইরে,      
    একেবারে বোবা                                    
    নিজের যোনির গন্ধ শোঁকে                                                     
    যখন শূন্যের সামনে
    বাধা হিসাবে আর কিছুই দাঁড়িয়ে নেই                                       
     অকার্যকর, বাতিল,
    যেখানে দিগন্ত নেই,
    বা ভূপৃষ্ঠ নেই
    উচ্চতা নেই ,
    আর সবকিছু তোমাকে গভীরতার সংস্পর্শে ফিরিয়ে আনে
    যখন কেউ বহুক্ষণ ঋজু হয়ে আছে।
    .
    [ এই কবিতাটা অনেকে অনুবাদ করেছেন । তাদের মধ্যে থেকে আমি জ্যাক হার্শম্যানের অনুবাদ বেছে নিয়েছি]

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:b42b:f4bf:3b45:46e7:f4b2 | ১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৩৮740503
  • অঁতনা আতো : ‘আতো দ্য মোমো’ কাব্যগ্রন্হ থেকে
    মাটির সাথে মিশে যাওয়া গলিত শবের চাকা লাগানো জমিতে,
    গলিত শবের  শ্বাসপ্রশ্বাসের জমিতে
    এই শূন্যতার,
    শক্ত আর নরমের মধ্যে।
    .
    কালো, বেগুনি,
    অনমনীয়
    বিনোদনমূলক
    আর এটাই সবকিছু।.
    .
    যার মানে হলো একটা হাড় রয়েছে,
    কোথায়
    সৃষ্টিকর্তা
    বসলেন  কবির ওপর,
    তার বাক্যগুলোর
    গ্রাহীক্ষমতা মুছে ফেলার  জন্য
    যেন মগজটা পাদছে
    যে সে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তার গুদের ভেতর থেকে বের করে আনে,
    যে সে তার ভেতর থেকে বের করে আনবে
    যুগের তলানি থেকে,
    তার গুদের  গর্ত পর্যন্ত,
    আর  এটা গুদ সম্পর্কে কোনো কৌতুক নয়
    যে সে তার উপর এভাবেই খেলতে থাকে,
    এটা সমগ্র পৃথিবীর কৌতুক
    যার অণ্ড আছে
    তার পুরুষালি গুদের ভেতরে
    আর যদি আপনি ছবিটা বুঝতে  না পারেন,
    --আর সেই কথাই  আমি আপনাকে  বলতে শুনছি
    বৃত্তের মধ্যে, যে
    আপনি ছবিটা টের পাবেন না
    যা একেবারে তলার দিকে
    আমার গুদের গর্তে,--
    তার কারণ আপনি অতলের কথা জানেন না,
    জিনিসপত্রের নয়,
    তা আমার গুদের,
    আমার,
    যদিও যুগের তলানি থেকে
    আপনারা সবাই  সেখানে গোল-চক্কোর মেরে জিভ দিয়ে চাটছেন
    যেন একজন পরকীয়াকে গালাগাল দিচ্ছেন,
    বন্দী করে মৃত্যুদণ্ডের ষড়যন্ত্র কষছেন।
    গে রে ঘি
    রেগহেঘি
    গেঘেনা
    এ রেঘেনা
    আ গেঘা
    রিরি
    পোঁদ আর শার্টের মধ্যে,
    বীর্য আর জুয়ায় কম বাজির  মধ্যে,
    সদস্য আর হেরো লোকের মধ্যে,
    ঝিল্লি আর ব্লেডের মধ্যে,
    নরুন এবং ছাদের মধ্যে,
    শুক্রাণু এবং বিস্ফোরণের মধ্যে,
    'মাছের কাঁটা’ আর  'শিকনির’  মাঝে

    পোঁদ এবং প্রত্যেকের মধ্যে
    খিঁচুনি
    চেপে দেবার ফাঁদ
    একটা বীর্যপাত মৃত্যুর হইচই
    একটা বিন্দু নয়
    বা একটা পাথরও নয়
    আবদ্ধ এলাকায় মরে  ফেটে যাওয়া
    বা আত্মার বিচ্ছিন্ন অংশও নয়
    (আত্মা জিনিসটা পুরোনো করাত ছাড়া আর কিছুই নয়)
    বিচ্ছিন্নতার শ্বাসের
    কিন্তু ভয়াবহ কালহরণ
    ধর্ষিত, ডানা-ছাঁটা, পুরোপুরি চুষে ফেলা
    সমস্ত অস্বচ্ছল ক্যারদানি করে
    গুমাখা লোকগুলোর
    বেঁচে থাকার জন্য
    যাদের খাবার মতন আর কোনো খোরাক ছিল না
    আতোকে
    গিলে ফেলা ছাড়া
    মোমো
    আমার তুলনায়
    সেখানে, যেখানে একজন তাড়তাড়ি সঙ্গম সেরে ফেলতে পারে
    আমার চেয়ে
    দ্রুত ঠাটিয়ে ফেলতে পারে
    আমার ভেতরে
    যদি সে তার মাথা রাখার যত্ন নেয়
    সেই হাড়ের বাঁকের ওপরে
    যা মলদ্বার আর লিঙ্গের মাঝে থাকে,
    যে কোদাল হাড়ের কথা আমি বলছি
    একটা স্বর্গের 
    আঁস্তাকুড়ের মধ্যে
    পৃথিবীতে যার প্রথম প্রতারণা
    বাবা বা মা ছিল না কেউ
    কে তোমাকে এই গুহায় এনে ফেলেছে,
    কিন্তু
    আমি
    আমার উন্মাদনায় জড়িয়ে গেছি।"
    ওরা এটারই  অনুশীলন করে।
    যদি কোনো ডাক্তার না থাকত
    তাহলে কোথাও কখনো রোগী হত না,
    রোগাক্রান্ত কঙ্কালদের
    মেরে ফেলে কাটাছেঁড়া আর চামড়া ছাড়াবার জন্য,
    কেননা সমাজ আরম্ভ হয়েছে ডাক্তারদের মাধ্যমে 
    রোগীদের মাধ্যমে নয়।
    যারা বেঁচে থাকে, তারা মৃতদের জিনিসপত্র খেয়ে বাঁচে।
    আর এর জন্য জরুরি যে একইভাবে মৃত্যুও বেঁচে থাকুক;
    আর উন্মাদ আশ্রমের মতন কিছুই নেই যা শান্তভাবে পালন করবে
    মৃত্যুকে , এবং মৃত মানুষদের  ইনকিউবেটরে পুরে রাখবে।"

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:b42b:f4bf:3b45:46e7:f4b2 | ১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৩৯740504
  • অঁতনা আতো সম্পর্কে অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর সাক্ষাৎকার
    প্রশ্ন : অঁতনা আতো সম্পর্কে বলুন।
    গিন্সবার্গ: ঠিক আছে, কবি ফিলিপ ল্যামান্তিয়ার উন্মত্ত উত্তেজনা আর স্নায়বিক  ভবিষ্যদ্বাণীর একটি নজির রয়েছে, আর তার বড় অনুপ্রেরণা, র‌্যাঁবো ছাড়াও, যিনি সকলের বড় অনুপ্রেরণা, ছিলেন অঁতনা আতো – এক ধরণের বিংশ শতাব্দীর র‌্যাঁবো, যাঁর জীবনী আপনি পড়ে দেখতে পারেন  – পাগলামি এবং শক এবং হেরোইন এবং ফ্রান্স.. তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র-অভিনেতা,  থিয়েটারের মানুষ, কিন্তু সর্বোপরি একজন অসাধারণ কবি এবং একজন অসাধারণ…
    প্রশ্ন : একটি খুব সুন্দর ফিল্ম ইউনিভার্সিটিতে দেখানো হচ্ছে…তাতে তিনি "দ্য প্যাশন অফ জোয়ান অফ আর্ক"-এ বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। 
    গিন্সবার্গ : জোয়ান অফ আর্ক, হ্যাঁ। উনি একজন চলচ্চিত্র-অভিনেতা। তাঁর জীবনী.. আপনি এটি বইয়ে দেখতে পারেন বা, যেমন কেরুয়াক বলেছেন, "যদি সঠিক শব্দগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়" - বা সঠিক তথ্যগুলি গুরুত্বপূর্ণ হলে আপনি বইটিতে তা পাবেন। আমি যা বলতে চাই তা হল.. তিনি এমন এক ধরণের কবিতার লেখক যা সমস্ত আমেরিকান কবিতাকে প্রভাবিত করেছে - এবং পরবর্তীকালে ফরাসি - অর্থাৎ কান-ফাটানো হিস্টিরিকাল শ্বাস-প্রশ্বাস-বাক্য-চিৎকার ভবিষ্যদ্বাণীমূলক শৈলী, যার  প্রতিটি লাইন এক-একটা কঠিন বিদারক শ্বাস। প্রতিটি লাইন পাগলাগারের উন্মাদের মতো এগিয়ে যায়, গভীর শ্বাস নেয়, এবং তারপর একটি অভিশাপ, বা একটি কান্না বা উপদেশ দেয়। আমি অঁতনা আতো থেকে আমার নিজস্ব অনেক স্টাইল পেয়েছি, যদিও অনেক জলে ডুবে আছি।  আপনি এইমাত্র শুনলেন যে ফিলিপ লামান্তিয়া শৈলী পেয়েছেন, যে আপনি  উত্তেজনার যে সামান্য কাঁপুনি পেয়েছেন তা অঁতনা আতো থেকে। তাই আমি এখন আতো থেকে একটু পড়ে শোনাতে চাই।না একটু নয়, আমি আতো থেকে বেশ কিছু কবিতা পড়ব...যা আমি আসলে নই.. যা পেতে হয়তো একটু সময় লাগবে। আমি  খুব ঘন ঘন পড়িনি। আমি  একটা টুকরো পড়ব, বা এর ভেতরে আর বাইরের । তিনি পাগলাগারদে ছিলেন, এবং তাঁর ধারণা ছিল যে মানুষের প্রাকৃতিক অবস্থা সমস্ত শর্ত থেকে মুক্ত, বাবা এবং মা থেকে মুক্ত, জন্ম থেকে মুক্ত, পৃথিবী থেকে মুক্ত, সময় থেকে মুক্ত, পুরুষ এবং মহিলা এবং এটি…. আচ্ছা, ওনাকে নিজেই ব্যাখ্যা করতে দিন। মজার বিষয় হল কবিতাটি বোধগম্য শব্দাবলী থেকে বেরিয়ে বিশুদ্ধ শব্দে চলে যায়। তিনি সেই কয়েকজন কবিদের মধ্যে একজন যিনি স্ব-উচ্চারিত মন্ত্রের সাথে সরাসরি ঘোষণামূলক উত্তেজিত ভাষা মিশিয়ে লিখতেন।পড়ছি তাহলে ওনার কবিতা থেকে “এবং এখন,/ আমি তোমাকে/ তোমাদের সকলকে বলি,/ তোমরা সর্বদা আমাকে হাগিয়েছ/ কেন তুমি চুদতে যাও না/ একটি কাঁটাযুক্ত গুদ/ চামউকুন/ অনন্তকালের/ আর কখনও আমার কিছু হবে না/ যারা জীবনের লোহার গুঁড়ো গিলে খায় তাদের সাথে করো। ঈশ্বর আমাকে এখানে ফিরিয়ে দিয়েছেন। (দ্য বাস্টার্ড।)/ এভাবেই তারা/বাবামাকে ঝাঁকালো/ আর এতে জে-এর ভাজা চর্বি/ক্রি/ আমার থেকে, লিঙ্গের বাইরে/ মহান শ্বাসরোধের কেন্দ্রে/যা এই ক্রস থেকে ঝাঁকুনি দেওয়া হয়েছিল... ”…”এবং এভাবেই:/ রেড ইনডিয়ান সংস্কৃতির মহান রহস্য/ বিশ্বকে শূন্যে ফিরিয়ে আনা/সর্বদা…”/ …“মন্তব্য… “তারা এসেছিল, সমস্ত জারজ,/ বড় অসঙ্গতির পরে/ওপর থেকে শব্দ করে নীচে।/ ডিমের-মুখ/ (ফিসফিস করে)/ আপনি কি জানেন না যে /ডিমের/ অবস্থা ছিল আর আতোকে বিষ দেওয়ার জন্য/ কিছু নেই/ চাবুক মারার মতো/ একটি ভাল অমলেট/পরিসরে//জেলি বুলস-আই পয়েন্টে টার্গেট করা/ যে আতো/মানুষ বানাতে চাইছে/পালিয়েছে/একটি ভয়ঙ্কর প্লেগের মতো/এবং এটাই হল/তারা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে/কিছুই, আমি বলি , একটি ভাল স্টাফড অমলেট/বিষ, সায়ানাইড এবং ক্যাপার্সের মতো,/ তার অঞ্চলে বাতাসে ছুঁড়ে দেওয়া/ আতোকে বিচ্ছিন্ন করতে/ তার হাড়ের অ্যানাথেমায়/  এক, ভিতরের মৃতদেহ থেকে ঝুলে থাকা/ এবং দুই, প্যালাউয়েট টানছে/ লার্গালালুয়েট কাউলিং/ তিন, তুবান টাইটিটার্টিং / মাথার মাথা দিয়ে আপনাকে ঘোলাচ্ছে/ চার, হোমুনকুলাস ফ্রন্টাল/ ঘুষি/ চিমটি থেকে ব্যভিচার করছে...”…. "আতো/ কে জানত যে মন নেই/ কিন্তু কেবল শরীর/ যা আবার তৈরি হয় মৃতদেহের গিয়ারের ভাঙা দাঁতের মতো..." ... "সমস্ত সত্য ভাষা/ বোধগম্য নয়/ ফাটা দাঁতের কিড়মিড়ের মতো;/ অথবা হাততালি (বেশ্যাঘর)/ ফিমার পিষে দেওয়া (নাকাল, রক্তাক্ত, নকল)/ জামাই যেমন/ হাড় থেকে চাওয়া ব্যথা থেকে...”…"উপসংহার"/ আমার জন্য, জটিল/ অঁতনা আতো,/ কেউ আমাকে স্পর্শ করতে পারে না/ যখন একজন শুধুমাত্র একজন মানুষ/ বা/ একজন দেবতা/ আমি বাবাকে বিশ্বাস করি না/ মাকে/ কোনো বাপ-মা/প্রকৃতি নেই /মন/অথবা ঈশ্বর,/শয়তান/শরীর/অথবা সত্তা/জীবন/অথবা কিছুই নেই/ভেতরে বা বাইরে কিছুই নেই/এবং সর্বোপরি মুণ্ডুতে থেকে মুখ নেই/যে নর্দমা দাঁত দিয়ে ছেঁদা করা হয়েছে/যেখানে মানুষ যে তার মাংস চুষে নেয়/আমার কাছ থেকে/দেখে আমার কাছে সব সময়/ একজন বাপ-মাখৈ ধরে রাখার অপেক্ষায়/আর একটা অস্তিত্ব পুনর্নির্মাণ করে/আমাকে মুক্ত করে/আমার মৃতদেহের উপরে/নিয়ে নেওয়া/শুন্য থেকে/নিজেকে/এবং শুঁকেছি/সময়ে/সময়ে/আমি কথা/ওপর থেকে/সময়/যেন সময়/ভাজা হয় নি/এই শুকনো ভাজা ছিল না/সব চূর্ণবিচূর্ণ/শুরু থেকে/তাদের কফিন থেকে আরও একবার বেরোচ্ছে।" …আমি মনে করি এটি রোদেজ অ্যাসাইলামে শক-ট্রিটমেন্টের একটি সিরিজের রচনা/মন্তব্য হিসাবে লেখা হতে পারে (যেমন), যেখানে অন্য একটি প্রবন্ধে [“ভ্যান গগ, দ্য ম্যান সুইসাইড বাই সোসাইটি”] তিনি দাবি করেছেন যে, কারণ সমাজের ক্ষেত্রে, তিনি "আত্মহত্যা" (বা নিহত, বা মারা গেছেন), কয়েক ঘন্টার জন্য একটি মৃত অবস্থায় বসবাস করেছিলেন এবং তারপরে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন। সুতরাং এটি মৃত্যু থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য, এবং তাই তিনি আসলে, এক অর্থে, সময়ের উপরে কথা বলছেন। আপনি যদি সেই অভিজ্ঞতাটিকে আক্ষরিক অভিজ্ঞতা হিসাবে নিতে চান (যেটি তিনি করেছিলেন) আক্ষরিক অভিজ্ঞতা হিসাবে নেওয়া হলে, এটি তাঁকে এতটাই উন্মাদনা-শক্তি দিয়েছিল যে তিনি ১৯৪০ এর দশকে সমস্ত প্যারিসকে আতঙ্কিত করেছিলেন এবং হয়ে ওঠেন একজন মহান কবি-নায়ক, রজার ব্লিন, একজন অভিনেতাকে প্রভাবিত করে এবং "চিলড্রেন অফ প্যারাডাইস" ("লেস এনফ্যান্টস ডু প্যারাডিস"), সিনেমা, এবং...
    প্রশ্ন: তা কেমন করে ? তিনি কীভাবে ‘স্বর্গের সন্তান’দের[ Les Enfants du Paradis ]প্রভাবিত করেছিলেন?
    গিন্সবার্গ: তিনি কেবল সমস্ত অভিনেতাকে প্রভাবিত করেছিলেন (এবং তার প্রধান শিল্প ছিল থিয়েটার) তাদের কোনওভাবে তাদের স্হবিরতা থেকে অন্য মস্তিষ্কে নিয়ে যাওয়ার জন্য - ঠিক একজন ব্যক্তি হিসাবে - সবাই তাঁকে রাস্তায় দেখেছিল, সবাই তার সাথে কথা বলেছিল, কেউই…
    প্রশ্ন:  তখন কি ফ্রান্স জার্মান দখলে ছিল? যে এই সব ঘটছিল?
    গিন্সবার্গ: তখন ১৯৪৪ সাল, আমার মনে হয় সম্ভবত তাইই [সম্পাদকের নোট: মার্সেল কার্নের ‘স্বর্গের সন্তান’ ১৯৪৫ সালে ফ্রান্সে এবং ১৯৪৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পায়]  আমি মনে করি  স্যামুয়েল বেকেটের ওপর অঁতনা আতোর কিছু প্রভাব ছিল আর ১৯৪০ এর দশকে, আমেরিকান কবিতায়, ব্ল্যাক মাউন্টেন গোষ্ঠীতে আর আমার নিজের লেখায়, তাৎক্ষণিকভাবে, ১৯৪৮ সালের দিকে, কার্ল সলোমনের সাথে একটি মানসিক হাসপাতালে। . কার্লের কাছে এই কবিতাটির একটি কপি ফরাসি ভাষায় ছিল [“এখানে রয়েছেন” (চি-জিট)] এবং ওনার মন্ত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন  যে “ডাকান্তাল/ডাকিস টেকেল/তা রেদাবা/তা রেদেবেল/দে স্ট্রা মুনটিলস/ও এপিটি আনিস/ও ইপিটি অত্র.." এবং এটি ছিল, একটি খুব সূক্ষ্ম ভয়ঙ্কর মন্ত্র, পাগলাগারদের ভাষার বকবক ভেদ করে। বুঝলেন ? 
    প্রশ্ন : কবিতাটার নাম কী?
    গিন্সবার্গ: এটি ফরাসি ভাষায় "চি-জিট" ("এখানে মিথ্যা"), শুরুটা এরকম - "আমি, অঁতনা আতো, আমার ছেলে, আমার বাবা, আমার মা/নিজেকে/পরিবারের গাছের শিকড়/চামড়া ছাড়ানো/ স্তরের বাবা-মা/এবং শিশু/ঠাকুমার গাধা থেকে/বাবা আর মায়ের চেয়ে অনেক বড়ো” – ঠিক আছে, বুঝলে, আমি ফিলিপ ল্যামান্তিয়ার অলঙ্কৃত শৈলীর কিছু উৎস দেখানোর চেষ্টা করছিলাম। 
    প্রশ্ন: অ্যালেন, আমি মন্ত্রের আধ্যাত্মিক অর্থ বুঝতে পারি না, কিন্তু মনে হচ্ছে দেহ এই সমস্তকিছু বের করে দিচ্ছে – এটা কোনও সুযোগ দেয় না, আপনি জানেন, আমি ফর্ম সম্পর্কে একটি কবিতা লিখছি বা বলা যায় ভাবছি
    গিন্সবার্গ : ব্যাপারটা শ্বাস-প্রশ্বাসের। ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস।
    প্রশ্ন: আচ্ছা, তাহলে কেমন করে তা অনুশীলন করতে হবে ? ঘরের দরোজা বন্ধ করে ?
    গিন্সবার্গ: উন্মাদনার জন্য ? - আমি জানি না আপনি তা অনুশীলন করতে পারেন কিনা। আপনাকে সত্যিই তা হতে হবে। ব্যাপারটা এমন কিছু নয় যা আপনি অনুশীলন করলে পাবেন । আপনি কথাটা সংশোধন করতে পারেন, মানে, আপনি অঁতনা আতো হতে চান না।
    প্রশ্ন: হা ভগবান !
    গিন্সবার্গ: ইতিমধ্যে একজন আতো তো হয়েছেন।. আপনি লামান্তিয়া থেকে বেরিয়ে আসুন। শুধু একজন নেশাখোর হতে চান আর ব্যথা পেতে চান ! না,  আমি আপনার প্রশ্নেরউত্তর দিচ্ছি না । আমাকে এই বিষয়ে একটু কাজ করতে দিন। 
    প্রশ্ন : আপনি কি জানেন কেমন করে আতো মেক্সিকোতে রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে মিশেছিলেন? 
    গিন্সবার্গ: শুরু হয়েছিল মেক্সিকোতে। সেটা প্রথম দিকের ঘটনা। ১৯৩০-এর দশকে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন.. “তারাহুমারাদের দেশে যাত্রা" নামে একটি বই আছে। তিনি পিয়োটি এবং পিয়োটির  আচার-অনুষ্ঠান এবং চিহুয়াহুয়া ইন্ডিয়ান, তারাহুমারা ইন্ডিয়ানদের গোপন মাদকের আচার আবিষ্কার করার জন্য  গিয়েছিলেন। রচনাটা ইংরেজিতে অনুবাদ ও প্রকাশিত হয়েছিল, ১৯৪২ সালে ট্রানজিশন ম্যাগাজিনে আর সেটা ছিল প্রারম্ভিক সাইকেডেলিক রচনাগুলোর একটা, যা মানুষকে এর সম্ভাবনার কথা প্রথম জানিয়েছিল।তিনি বিমূঢ় হয়ে পড়েন এবং ভেবেছিলেন যে রেড ইন্ডিয়ানরা তাঁর কাছে তাদের আচার গোপন রাখছে কারণ তারা তাঁকে তাদের সাথে পিয়োটি খোঁজার জন্যপাহাড়ে উঠতে দেবে না , আর আমার মনে হয় তার ফলে তিনি ভয়  পেয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণ ধারণা হলো যে সেটা ছিল আদিম বা আদি সংস্কৃতি, আদি মানবচেতনা যা আধুনিক চেতনাকে প্রত্যাখ্যান করে আর আতো অনুভব করেছিলেন যে তিনি আধুনিক চেতনাকে মূর্ত করছেন, যা তিনি চাননি। তিনি আদিম পর্বে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন, এবং তিনি অনুভব করেছিলেন যে তারাহুমারা আদিবাসীরা তাঁকে এক ধরণের অস্হির নরকে পাঠিয়ে দিয়েছিল, কারণ তারা তাঁকে গ্রহণ করতে চায়নি।ব্যাপারটা একেবারে সাধারণ শ্বেতাঙ্গের মাদকপ্রি মনোভাবের মতো, জঙ্গলে ঢুকে পড়া… কিন্তু তিনি তাঁর সমুদ্রযাত্রার  দুর্দান্ত গল্পটা লিখেছেন। আপনি এটা পড়েছেন, আমি মনে করি? এটা উপলব্ধ, আমার মনে হয়, সম্প্রতি আবার অনুবাদ করা হয়েছে এবং হার্পার দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে [সম্পাদকের নোট: ফারার, স্ট্রস এবং জিরো দ্বারা প্রকাশিত] গত বারো মাসে, "জার্নি টু দ্য ল্যান্ড অফ তারাহুমারাস"-এর একটা নতুন চমৎকার অনুবাদ, যাতে  প্রথম দিকের সাইকেডেলিক অ্যাডভেঞ্চার গল্প আছে।
    প্রশ্ন: আমার কাছে বইয়ের একটা পর্বের অনুবাদ আছে।
    গিন্সবার্গ : এটা সম্ভবত একটা অধ্যায়, একজন ভদ্রমহিলা  অনুবাদ করেছেন যিনি কেরুয়াকের বান্ধবী ছিলেন, অদ্ভুতভাবে, ১৯৫৭ সালে, হেলেন.. আমি ভুলে গেছি.. কিছু... যে মেয়েটি অনুবাদ করেছিল সে ছিল কেরুয়াকের বান্ধবী এবং সেও একজন সদস্য ছিল যে ১৯৬৩ সালে লেনি ব্রুসের জন্য একটি প্রতিরক্ষা কমিটি গঠন করেছিল। এটা একটা মজার আন্তঃসংযুক্ত সংস্কৃতি। আমি ওর নাম মনে করতে পারছি না। মনে করতে পারো? তোমার কোন ধারনা আছে? - হেলেন উইভার বোধহয় । ঠিক আছে, আমি যা বলার চেষ্টা করছিলাম তা হল ফিলিপ ল্যামান্তিয়ার শৈলীর সাথে সম্পর্কযুক্ত, এবং, আমি জানি না আপনি বলতে পারেন কিনা, আমার কবিতা "আমেরিকা"-তে আমার নিজস্ব কিছু শৈলী, বা বলুন, "ভ্যান গঘের কানের মৃত্যু"র সঙ্গে মিল থাকতে পারে। কাদিশের "ডেথ টু ভ্যান গঘের কান" কবিতাটি সেই শৈলীতে, অঁতনা আতো শৈলীতে  করা হয়েছে, কারণ আমি তা আতোর "ভ্যান গগ, দ্য ম্যান সুইসাইডেড বাই সোসাইটি" যা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিশ্লেষকদের পুরো ষড়যন্ত্রের ওপর প্রথম সত্যই বুদ্ধিমান উপলব্ধিমূলক আক্রমণগুলির মধ্যে একটা,  যা সবাইকে পাগল করে তুলছিল, তিনি ভেবেছিলেন, অনিয়মিত আচরণ বা অস্বাভাবিক অনুপ্রাণিত আচরণকে স্কিৎসোফ্রেনিয়া বা প্যারানয়া হিসাবে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে গণ-মগজ ধোলাই পশ্চিমা সংস্কৃতির একটা ষড়যন্ত্র। সুতরাং তা ছিল, সংস্কৃতির উপর সম্পূর্ণ আক্রমণ। এড স্যান্ডার্সের সেই বাক্যাংশ - "সংস্কৃতির উপর সম্পূর্ণ আক্রমণ" - আমার ধারণা, এমনকি অঁতনা আতো থেকেও উদ্ভূত ।আপনি কি সেই বাক্যাংশটি জানেন?, "সংস্কৃতির উপর সম্পূর্ণ আক্রমণ"? - একটি 'ষাটের দশকের যুদ্ধ-বিরোধী স্লোগান। সুতরাং অঁতনা আতো ছিলেন সেই ব্যক্তি যাঁর মস্তিষ্কের ছুরিটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির যুক্তিবাদের বেশিরভাগ অংশকে কেটে ফেলেছিল - কিন্তু, কবিতার দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি এই দুর্দান্ত শ্বাস-রেখাটি বিকশিত করেছিলেন, একটি লাইন যেখানে একটি বক্তৃতা বিন্যাস, যেখানে প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি লাইন, আক্ষরিক অর্থে, বাতাসে, জগতের মধ্যে একটি নিঃশ্বাসের নির্গমন, যেখানে প্রতিটি লাইনের উদ্দেশ্য একটি মন্ত্রের তীব্রতা, চেতনার বস্তুগত প্লেনগুলির মধ্য দিয়ে কাটা-কাটা। কথিত আছে যে তার কণ্ঠে, কণ্ঠস্বর হিসাবে, সেই গুণমান ছিল, সেই সময়ের ফরাসি রেডিও রেডিওডিফিউশন ফ্রানসেইজি দ্বারা তৈরি একটি টেপ আছে, তিনি অন্য একটি রচনা পরিবেশন করছেন, যা সম্ভবত তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ, “ঈশ্বরের  বিচারকে বাতিল করা বিষয়ক”,যাকে বলা হয় সমস্ত রকমের জমাট চেতনা থেকে মুক্তির ঘোষণা।
    প্রশ্ন: সেটা কি সংকলনে আছে ?
    গিন্সবার্গ :আমি মনে করি না সেটা সংকলনে  আছে। দেখা যাক... না, আমি মনে করি না এটা। এটি মূলত প্রকাশিত হয়েছিল, ভ্যান গঘের প্রবন্ধ, "ভ্যান গগ, দ্য ম্যান সুইসাইডেড বাই সোসাইটি", মূলত ১৯৪০-এর দশকে একটা লিটল সাহিত্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল আর তারপরে আবার মুদ্রিত হয়েছিল। 
    প্রশ্ন: আপনি বোধহয় বিষয়টা সম্পর্কে কয়েক বছর আগে নারোপা বিশ্ববিদ্যালয়ে বলেছিলেন? 
    গিন্সবার্গ: আমার মনে হয় অতোটা পর্যন্ত যাইনি।
    প্রশ্ন: আপনি বলেছিলেন মনে হয়।
    গিন্সবার্গ :হ্যাঁ, আমি এটা উল্লেখ করেছি। আমার কাছে এটা এই বাড়িতে কোথাও আছে, ফরাসি ভাষায়, আর আমার মনে হয় একটা ইংরেজি অনুবাদও আছে.. আমি জানি জ্যাক হির্শম্যানের একটি অনুবাদ রয়েছে, যিনি ১৯৬৮ সালে সিটি লাইটস বইয়ের জন্য এই অঁতনা আতো সংকলনের  বেশিরভাগ অনুবাদ করেছিলেন।  বা তাই [সম্পাদকের নোট, ডেভিড রাট্রে সহায়তা করেছিলেন ] – এটা.. আমি বলব.. উন্মাদনা–মৃগী–আমি  অপমান করতে চাই না, তবে এটি উন্মাদ এই অর্থে.. একটি অনুপ্রবেশকারী একক-বিন্দু মস্তিষ্কের  সন্ত্রাসের চিৎকার, দৃশ্যত দৃঢ় বস্তুগত বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া, যা তিনি মনে করতেন, একেবারেই অলীক এবং সিআইএ-পুঁজিবাদী ক্যাবালিস্ট ষড়যন্ত্রের উপজাত। কিন্তু, আমি যেমন বলেছি, এটা বলা হয় যে তার কণ্ঠে হাড় ভেদ করার ক্ষমতা ছিল। কার্ল সলোমন দাবি করেন যে তিনি প্যারিসে ছিলেন ১৯৪০ এর দশকের গোড়ার দিকে একজন বণিক নাবিক হিসেবে, যেদিন অঁতনা আতো একটি কবিতা পাঠের আয়োজন করেছিলেন, একটি দোকানের সামনে, একটা খুব বিখ্যাত কবিতা পাঠ, যেখানে জাঁ লুই ব্যারাল্ট এবং রজার ব্লিন  এবং অন্যরা গিয়েছিলেন, আর কার্ল সলোমান বলেছিলেন যে তিনি আতোকে এর থেকে কিছু লাইন পড়তে শুনেছিলেন, ওই “ঈশ্বরের বিচার", আর শোনার সময়ে তাঁর শরীরে একটা কাঁপুনি সৃষ্টি করেছিল, আর কার্ল আমেরিকায় ফিরে আসার সময় ,  সেই কণ্ঠস্বরের কারণে নিজেকে পাগলের ঘরে বন্ধ করে  রেখেছিলেন। লেখাটার পাঠ বাস্তবতার চেহারা কেটে বসিয়ে দেয়,আর কার্লের অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে অসুস্হ করে তুলেছিল।আতোর একটি তত্ত্ব আছে, আমার মনে হয়, ‘থিয়েটার অ্যান্ড ইটস ডাবল’, কিংবা ভ্যান গগ প্রবন্ধে , যা আমি প্রায়ই পড়ি, যাতে বলা হয়েছে  যে কিছু শব্দ আছে যা তাদের কম্পনের অদ্ভুত গুণমান দ্বারা, যখন তারা আপনার স্নায়ুতন্ত্রে প্রবেশ করে, অণুগুলিকে পুনর্বিন্যাস করে। অন্য কথায়, মানবদেহে প্রবেশকারী কিছু শব্দ-কম্পন আসলে স্নায়ুর অণুগুলোকে পুনর্বিন্যাস । তাই তিনি কবিতায় এত শক্তি দেখতে পেরেছেন।
    প্রশ্ন : মনে হয় প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো এই ব্যাপারে সব কিছুই জানতো।
    গিন্সবার্গ : হ্যাঁ ।
    প্রশ্ন : আধুনিক সমাজে সবই হারিয়ে গেছে।
    গিন্সবার্গ : আমি মনে করি অঁতনা আতো ছিলেন সেই একজন মানুষ, যিনি আধুনিক কবিদের মধ্যে, একটা ধারণা হিসাবে, বা একটা মৌলিক পদ্ধতি হিসাবে এটাকে আবার আবিষ্কার করেছিলেন।(আচ্ছা, এখন আপনি ফিলিপ  ল্যামান্তিয়ার সাথে আতোর সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় - আমরা কীভাবে এটি ব্যবহার করতে পারি? আমি মনে করি, প্রথমত, শ্বাস-প্রশ্বাসের মৌলিক চেতনা এক অর্থে অস্ত্র, বা শ্বাস একটি সত্তা, এবং প্রতিটি লাইন, শ্বাস-প্রশ্বাস লিখতে পারে, হতে পারে, একটি পৃথক বস্তুর মতো, যা পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হয়–- চেতনা এবং অঁতনা আতোর রচনায়, একটি মৌলিক উপলব্ধি রয়েছে যে প্রতিটি নিঃশ্বাসের কণ্ঠস্বর আছে অথবা মানেহীন শব্দেরও কণ্ঠস্বর  হয়।  একটি সামান্য কঠিন বস্তু যা মহাবিশ্বকে পরিবর্তন করার চূড়ান্ত ক্ষমতা রাখে - এটি একটি উন্মাদনাময়, যাদুকর, ব্যাখ্যার মতো বৌদ্ধধর্মে মন্ত্রের শান্ত ,আরো মৃদু, শিক্ষানবিস তত্ত্ব। এটা সম্ভবত মূলত বৌদ্ধ ধারণা, বা প্রাচ্যীয় ধারণাগুলির একটি বিকৃতি - এবং প্রকৃতপক্ষে, এখানে একটি খুব মজার রচনা রয়েছে, যার নাম "দালাই লামাকে চিঠি"। আমি এটি পড়তে যাচ্ছি । সুতরাং এটি ফরাসি পরাবাস্তববাদী কবিতা, আমার মনে হয়, ১৯২০ এর, একটা বার্তা পাঠাচ্ছেন। আতো এই সময়ে দুটি চিঠি লেখেন - একটি পোপকে,  পোপকে একটি কুকুর বলে , যা ১৯৫৯ সালে ইংরেজিতে বিগ টেবিল ম্যাগাজিনে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হবার পর অ্যালেন টেট আর  কবিদের একটা দল বিগ টেবল পত্রিকায় লিখতে অস্বীকার করেছিল - এটি প্রথমবারের মতো একজন পোপকে একজন গুমুখো কুকুর বলেছিলেন, আমি বলতে চাচ্ছি, পোপকে ছেড়ে দিন, সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিন, এটা আবার, বৌদ্ধ তত্ত্ব বা বৌদ্ধধর্মের এক ধরণের অদ্ভুত বিপরীত ধারণা। [অ্যালেন আর্টাউডের "দালাই লামার সম্বোধন" পড়তে এগিয়ে যান - "আমরা আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দাস, হে গ্র্যান্ড লামা, আমাদের অনুগ্রহ/আমাদেরকে এমন ভাষায় আপনার আলোকসজ্জা দিন যা আমাদের দূষিত ইউরোপীয়/মন বুঝতে পারে..."...আমরা আশেপাশের পোপ, কবি, সমালোচক, কুকুর, আমাদের/ মন চলে গেছে সেই কুকুরদের দিকে যারা/ সরাসরি ভাবে/ পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে/ যারা বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে ভুলভাবে চিন্তা করে। আপনি, হে পোপ/অভ্যন্তরীণ শিখরে। এটা অভ্যন্তরীণভাবে যে আমি তোমার মতো: আমি, ধূলিকণা, ধারণা, ঠোঁট, উচ্ছ্বাস,/স্বপ্ন, কান্না, ধারণার ত্যাগ, সমস্ত রূপের মধ্যে ঝুলে থাকা এবং/ বাতাস ছাড়া আর কিছুর আশা করছি না"] - আসলে, এটি বেশ ভাল ফরাসি কবিতা ।এতে পরাবাস্তববাদ এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান  গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়েছে। এবং এই আলোড়ন আসলে ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে আমেরিকাকে কিছুটা আক্রমণ করেছিল। এটি প্রচুর মৃত্যু এবং মাদকাসক্তির বিভ্রান্তিকর ঘটনা ঘটিয়েছে, এবং সম্ভবত সঠিকভাবে যে স্টাইল বা পদ্ধতির (চোগ্যাম) ত্রুংপা ক্রমাগত নিন্দা করে আসছেন, আসলে এটি আরও এক আবর্জনা।কিন্তু আতোয় একটি স্বজ্ঞাত বুদ্ধিমত্তা রয়েছে যা আমি পছন্দ করি, কারণ এটি প্রায় একধরনের প্রজ্ঞাকে প্রায় আনুমানিক করে, এবং এতে সূর্যতা বা  শূন্যতার ধারণা, বা শূন্যতার  একটি মজার পশ্চিমা ম্যানিচিয়ান সংস্করণ রয়েছে। কিন্তু এটি খুবই পশ্চিমা, এই অর্থে যে এটি শরীরকে বাতিল করছে। শরীরের স্বচ্ছতা বা শূন্যতা এবং এটির অপ্রাসঙ্গিকতা দেখার চেয়ে, এটি শরীরের জন্য পাগল এবং এটি বিষ্ঠার জন্য পাগল, এবং এর মূল রেফারেন্স-পয়েন্ট হল পৃথিবী এবং বিশ্ব এবং শরীরকে বিষ্ঠা হিসাবে, যা বেশ পশ্চিমা, আসলে - কিন্তু, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি এটিকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, কবি হিসাবে, তাঁর সময়ের যে কোনও কবির চেয়ে অনেক বেশি সাহসের সাথে, এবং সেই সময়ে, কারণ তাঁকে তাঁর যন্ত্রণা এবং বেদনাকে সোচ্চার করতে হয়েছিল,  তিনি এমন একটি কবিতা-পদ্ধতি বিকশিত করেছেন যা অসাধারণভাবে ব্যবহারযোগ্য, অন্যভাবে, আমাদের নিজেদের দ্বারা। কিভাবে আপনি এটা পাবেন ?  আমি মনে করি আপনাকে আপনার অস্থায়ী ধারণাগুলিকে খুব গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার জন্য নিজেকে সচেষ্ট হতে হবে, এবং সেগুলিতে সম্পূর্ণরূপে বিনিয়োগ করতে হবে - একরকম আপনার ধারণা এবং এর কণ্ঠস্বর, এই মুহূর্তে, বা প্রকৃতপক্ষে কবি হিসাবে.. - যদি আপনি  একজন কবি হন এবং আপনার কবিতাগুলি জোরে জোরে পড়া হয় – আসলে নিজেকে সেগুলির মধ্যে ফেলে দেওয়া, যেমন, একজন মহান অভিনেতার মতো, আপনার যা আছে তা দিয়ে দিন, যদিও আপনি এটি বিশ্বাস না করেন , আপনি যা বলছেন তার ধারণায় নিজেকে বিলীন করুন , এবং এটিকে উচ্চারণ করুন যেন এটি সম্পূর্ণ বাস্তব - এবং এটি দেয়.. এটি আসলে খুব বিশ্বাসযোগ্য, একটি হ্যালুসিনেটিরি স্তরে, কিছুটা। অবশ্যই, আপনি যদি অভিজ্ঞ বৌদ্ধদের একটি দলের মুখোমুখি হন, সবাই তাদের নাক দিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন, আপনি হয়ত কোনও অণু পরিবর্তন করতে পারবেন না, তবে আপনি যদি ভীরু এবং অনিশ্চিত হন তাহলে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়াটা অপরাধ বলে গণ্য হবে।
    প্রশ্ন: অথবা  অন্য কেউ যে আপনার মত একই  বিশ্বাস করে। 
    গিন্সবার্গ: হ্যাঁ।
    প্রশ্ন: তাঁর ক্ষেত্রে…
    গিন্সবার্গ: আতোর ক্ষেত্রে ?
    প্রশ্ন: এতে তাঁর উদ্বেগ  বেড়েছে বলে মনে হয়।
    গিন্সবার্গ : কীভাবে আপনি অমন অবস্হা পেতে পারেন ?  আমি মনে করি আপনাকে আপনার অস্থায়ী ধারণাগুলোকে খুব গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার জন্য নিজেকে জীবনের মধ্যে নিক্ষেপ করতে হবে, এবং সেগুলোয় সম্পূর্ণরূপে বিনিয়োগ করতে হবে - একরকম আপনার ধারণা তৈরি হবে এবং এটির কণ্ঠস্বর, এই মুহূর্তে, বা প্রকৃতপক্ষে কবি হিসাবে.. - যদি আপনি  একজন কবি হন আর আপনার কবিতাগুলো জোরে জোরে পড়া হয় – আসলে নিজেকে সেগুলোর মধ্যে ফেলে দেওয়া, যেমন, একজন মহান অভিনেতার মতো, আপনার যা আছে তা দিয়ে দিন, যদিও আপনি এটি বিশ্বাস নাও করতে পারেন , আপনি যা বলছেন তার ধারণায় নিজেকে বিলীন করুন , আর এটিকে উচ্চারণ করা যেন এটি সম্পূর্ণ বাস্তব - এবং এটি আপনাকে দেবে.. এটি আসলে খুব বিশ্বাসযোগ্য, একটি হ্যালুসিনেটিরি স্তরে, কিছুটা। অবশ্য, আপনি যদি অভিজ্ঞ বৌদ্ধদের একটি দলের মুখোমুখি হন, সবাই তাদের নাক দিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন, আপনি হয়ত কোনও অণু পরিবর্তন করতে পারবেন না, তবে আপনি যদি ভীরু এবং অনিশ্চিত মানুষ হন তবে এটি তাদের গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট অপরাধী করে তুলতে পারে...।যেমন, আতো ভেবেছিলেন, সম্ভবত, নিম্নতমের মাধ্যমে, একটি নতুন দৃষ্টি জগতে পৌঁছানোর জন্য - এবং সেগুলি অবশ্যই আর্তুর র‌্যাঁবোর দ্রষ্টা হওয়ার প্রচেষ্টায় ফিরে যায়, একটি "দীর্ঘ যুক্তিযুক্ত বিভ্রান্তির মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গুলির" - সমস্ত ইন্দ্রিয়ের একটি দীর্ঘ যুক্তিসঙ্গত বিভ্রান্তি ("dérèglement de tous les sens"), বিচ্ছিন্নতার সাথে পরীক্ষা করার মাধ্যমে, মামা-পাপা (বা বাবা-মা) দ্বারা নিঃশর্ত চেতনার সমতলে পৌঁছে। এবং, প্রকৃতপক্ষে, এটি বৌদ্ধ অনুশীলন থেকে খুব বেশি দূরে নয়, কারণ, মনোযোগ দিয়ে, সামথ্থ ধ্যানে, শ্বাস-প্রশ্বাসের  প্রতি, আপনি যা করছেন তা ঐতিহ্যের যান্ত্রিক শৃঙ্খল, বা যৌক্তিক মেলামেশা এবং মন-উচ্চারণে বাধা সৃষ্টি করছে। যে জগতে আপনি আপনার জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত, যে জগতে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত, এবং মনকে শূন্য করে ফেলছি, বা ঝলকানো ছবিগুলোর সেই শৃঙ্খলাকে আরও স্বচ্ছ করে তুলছি, যতক্ষণ না সেগুলি কম আবেশী এবং কম দৃঢ় না হয় , যতক্ষণ না তারা স্বচ্ছতার একটি অবস্থা অর্জন করে, যেখানে আপনার আর তাদের উপর কাজ করতে হবে না। কিংবা, ধরা যাক, যৌন আনন্দের একটা ছবি , এবং তারপরে তাকে আপনার মনের মধ্যে  বারবার জাগিয়ে তোলা, ত্রিশ দিন ধরে দিনে দশ ঘন্টা বসে থাকা, যতক্ষণ না আপনি টের পাচ্ছেন, আপনি এতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, আসলে যা  উইলিয়াম বারোজ, আসলে, ‘নেকেড লাঞ্চ’ এর "ব্লু মুভি" অংশ - যেটিতে তিনি তাঁর মৌলিক আবেশমূলক যৌন থিমগুলি গ্রহণ করেছেন - যা  অনৈচ্ছিক প্রচণ্ড উত্তেজনা ,যা তাঁকে সর্বদা ব্যস্ত রাখে, - এবং এটি পরিচালনা করে একটি "ব্লু মুভি" - দৃশ্যের পর দৃশ্য বিভিন্ন সংমিশ্রণে - যতক্ষণ না, শেষ পর্যন্ত, তিনি যা করতে পারেন... .. শেষ কাজটি হল অভিনেতারা তাদের গলায় দড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে এবং সামান্য শুক্রাণু ফোঁটা ফেলছে ঠোঁটে এবং একটি ক্লান্ত, ক্লান্ত, অভিব্যক্তি, সম্পূর্ণ উদাস, ঝুঁকে পড়ছে– এটা নেকেড লাঞ্চের "ব্লু মুভি" অংশ। সুতরাং এটা অঁতনা আতো আরফিলিপ ল্যামান্টিয়া আর অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর একটি নির্দিষ্ট বিন্দু। আমার যে কবিতাটা আমি আপনাকে পড়ার পরামর্শ দিচ্ছি সেটি হল "পোয়েট অ্যাজ প্রিস্ট"-এর শুরু, যা - "ডেথ টু ভ্যান গগ’স ইয়ার" - যার শিরোনাম অঁতনা আতোর বাক্যাংশ থেকে নেয়া হয়েছে - আর ভ্যান গঘ  কী ব্যাপারে পাগল ছিলেন? তিনি কেবল একটি কান বা এ জাতীয় কিছু কেটে ফেলেছিলেন। একজন বেশ্যার দ্বারা অপমানিত হওয়ার সময় তিনি কেবল একটি কান কেটে ফেলেছিলেন - একে পাগলামি বলে না! - তিনি শুধুমাত্র একটি কান কেটে ফেলে ছিলেন যখন কিনা আণবিক বোমা ফেলারর যৌথ ষড়যন্ত্রকারীদের চারপাশে দানব দৌড়াচ্ছে। তিনি যা করেছিলেন তা হলো স্রেফ নিজের একটা কান কেটে ফেলা। তাই আমার শিরোনাম ছিল, "ডেথ টু ভ্যান গঘস ইয়ার"।
    [ অ্যালেন গিন্সবার্গ আরকাইভে প্রকাশিত ]
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:b42b:f4bf:3b45:46e7:f4b2 | ১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৪১740505
  • অঁতনা আতো : মলয় রায়চৌধুরী
    আধুনিক নাটক তত্ত্বের বিবর্তনে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত অঁতনা আতো, ফ্রান্সের মার্সেইতে ১৮৯৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন । তাঁকে স্যাকরেড হার্ট কলেজে ভর্তি করা হয় । এই প্রতিষ্ঠানে  তাঁর পরিচয় হয় আর্তুর র‌্যাঁবো, স্তেফান মালারমে আর  এডগার অ্যালান পো’র বইপত্রের সঙ্গে । সহপাঠীদের  সহযোগিতায় একটি ব্যক্তিগত সাহিত্য পত্রিকা আরম্ভ করেন। ১৯০৭ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত কলেজ শিক্ষার শেষে তিনি লক্ষণীয়ভাবে সামাজিক জীবন থেকে সরে যেতে শুরু করেন এবং নিজের  বেশিরভাগ রচনা ছিঁড়ে পুড়িয়ে দেন আর সংগ্রহের বইপত্র বিলি করে দেন । ছেলের আচরণে এরকম পরিবর্তন দেখে অঁতনা আতোর বাবা-মা তাঁকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান আর জানতে পারেন তাঁদের ছেলে মাঝেমাঝে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে । তখনকার চিকিৎসা পদ্ধতি তেমন উন্নত ছিল না । মস্তিষ্কের চিকিৎসার জন্য আফিমের নানারকম রসায়ন ব্যবহার করা হতো । 
    আঁতোর সম্পূর্ণ নাম আঁতোয়া মারি য়োসেফ পল আতো । সৃজনশীল জীবনে তিনি একজন ফরাসি লেখক, কবি, নাট্যকার, ভিজ্যুয়াল শিল্পী, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা এবং থিয়েটার পরিচালক হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। অনেকে মনে করেন যে তাঁর পরিবারে নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ের কারণে অঁতনা আতোর মস্তিষ্কের রোগ হয়ে থাকবে। তাঁর বাবা-মা ছিলেন প্রথম খুড়তুতো ভাই-বোন । তাঁর ঠাকুমা ছিলেন স্মির্নার অধিবাসী, এখনকার ইজমির, তুর্কির অন্তর্গত । তাঁর পিতামহ, ক্যাথরিন চিলি, মার্সেইতে থাকতেন, যেখানে তিনি একজন ফরাসি নাগরিক মারিয়াস আতোকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর দিদিমা, মারিয়েট চিলি, স্মির্নাতে থাকতেন, যেখানে তিনি স্থানীয় জাহাজি লুই নালপাসকে বিয়ে করেন। ফলে আতো  সারা জীবন তাঁর গ্রীক বংশধারার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন। শৈশবে ধরা পড়ে তিনি বংশানুক্রমিক সিফিলিসে আক্রান্ত ।
    প্রায় পাঁচ বছর বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসালয়ে আঁতোর চিকিৎসা হয়।১৯১৬ সালে আঁতোকে ফরাসি সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হলে তাঁর চিকিৎসায় কিছুকালের বিরতি ঘটে। "একটি অনির্দিষ্ট স্বাস্থ্যের কারণে" তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল । আতো  পরে দাবি করেছিলেন যে তিনি রাতের বেলায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হেঁটেচলে বেড়াতেন, তাই তাঁকে ছাঁটাই করা হয়েছিল । আতোর মা জানিয়েছিলেন যে অঁতনা আতো একটুতেই নার্ভাস হয়ে পড়তেন বলে সেনাবাহিনী তাঁকে বরখাস্ত করেছিল। আবার আঁতোকে ভর্তি করা হয় মানসিক চিকিৎসালয়ে । ১৯১৯ সালের মে মাসে, মানসিক চিকিৎসালয়ের পরিচালক আতোর জন্য লাউদানাম প্রেসক্রাইব করেন । 

    অঁতনা আতো সারাজীবন লাউদানামের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন । ১৯২১ সালে আঁতো  প্যারিসে ডাক্তার এদুয়ার তুলুজের মানসিক চিকিৎসালয়ে আবাসিক হিসাবে থাকা আরম্ভ করেন । তিনি কিছু দিনের জন্য সেরে উঠতেন কিন্তু আবার আক্রান্ত হতেন । লাউদানাম হল আফিমের একটি টিংচার যাতে ওজন অনুসারে প্রায় ১০% গুঁড়ো আফিম থাকে (১% মরফিনের সমতুল্য )।  আফিম পোস্তোর নির্যাস ( পাপাভার সোমনিফেরাম ) অ্যালকোহলে ( ইথানল ) দ্রবীভূত করে লাউদানাম তৈরি করা হয়। লালচে-বাদামী রঙের এবং অত্যন্ত তেতো, লাউদানামে মরফিন এবং কোডিন সহ বেশ কয়েকটি আফিম অ্যালকালয়েড রয়েছে । উনিশ শতক পর্যন্ত লাউদানাম  বিভিন্ন অবস্থার চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হত , কিন্তু এর প্রধান ব্যবহার ছিল ব্যথার ওষুধ এবং কাশি দমনকারী হিসেবে । বিশ শতকের গোড়ার দিকে, লাউদানাম প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হত এবং এটা অনেক পেটেন্ট ওষুধের একটা উপাদান ছিল । ১৯৮০ থেকে মার্কিন চাপে লাউদানাম মাদক হিসাবে  বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত । মানসিক চিকিৎসকদের সম্পর্কে আতো লিখেছিলেন, "একজন ডাক্তার এবং একই সঙ্গে একজন সৎ মানুষ হওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু একই সাথে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য উন্মাদনার ছাপ বহন না করে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়া অশ্লীলভাবে অসম্ভব।”
    ফ্র্যাংক হিলটন তাঁর বই ‘বদলেয়ার ইন চেইন’-এ লিখেছেন, মাদকাসক্ত শিল্পী হিসেবে বোদলেয়ারের ব্যক্তিত্ব, লেখা, আঁকা, পরিবার, টাকাকড়ি সামলানো, সামাজিক এবং যৌন সম্পর্কের উপর আফিম আসক্তির খারাপ পরিণতির ছবি তুলে ধরে। হিলটনের মতে, বোদলেয়ারের  গোপন অমীমাংসিত ইডিপাল কমপ্লেক্স ছিল না। লাউদানামে আসক্তির কারণে তাঁর বন্ধু-সম্পর্ক,  রাজনৈতিক আর ধর্মীয় আদর্শবাদও ব্যর্থ হয়েছিল। মাদকের অপব্যবহার তাঁর প্রেমেও প্রভাব ফেলেছিল। গ্রেট ব্রিটেনে ১৮৬৮ সালের ফার্মেসি অ্যাক্টের আগে, নাপিত, কেক-বিস্কুটের দোকান, লোহা-ব্যবসায়ী, স্টেশনারি দোকান, তামাক ব্যবসায়ী, মদ ব্যবসায়ী' সবাই আফিম বিক্রি করত। আফিম আর লাউদানাম পাওয়া সহজ ছিল । অঁতনা আতোর ক্ষেত্রে আরেকটি মাত্রা যোগ হয়েছিল ; তা হলো তাঁর মানসিক ভারসাম্যহীনতা । কিন্তু বোদলেয়ারের বিপরীত, যৌনতাকে এড়িয়ে চলতেন আতো। তিনি মানব শরীরের  প্রতি আচ্ছন্ন ছিলেন; তিনি যৌনতার ধারণাকে ঘৃণা করতেন এবং নিজের যৌন প্রতিত্ব থেকে নিজেকে আলাদা করার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন ।
    অঁতনা আতো : ম্যান অব ভিশান’  গ্রন্থে, লেখিকা  বেটিনা এল. ন্যাপ আতোর  মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে লিখেছেন: “আতো জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে অক্ষম ছিলেন; তিনি অন্যদের সাথে সম্পর্ক গড়তে পারতেন না; এমনকি তিনি তাঁর নিজের পরিচয় সম্পর্কেও নিশ্চিত ছিলেন না।” ন্যাপ মন্তব্য করেছেন যে "আতো মূলত তাঁর অসুস্থতাকে ঘিরে একটা সম্পূর্ণ আধিভৌতিক পরিমন্ডল তৈরি করেছিলেন, অর্থাৎ নিজের রোগের মাধ্যমে রহস্যবাদীর রাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তিনি নিজে এবং সবকিছুই তাঁর কাছ থেকে বাহ্যিকভাবে বিকিরিত হতো।" আতোর ‘দ্য আম্বিলিকাস অফ লিম্বোকে; উল্লেখ করে, ন্যাপ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আতো "মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে" লোকদের এমন একটা যাত্রায় নিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, 'যেখানে যেতে তারা কখনই সম্মত হবে না।' যেহেতু নাট্যকলা সম্পর্কিত তাঁর ধারণাগুলো তাঁর অসুস্থতা থেকে উৎসারিত হতো, তাই তিনি থিয়েটারকে একটা নিরাময়কারী প্রণালী হিসাবে দেখেছিলেন; এমন একটা উপায় যার মাধ্যমে ব্যক্তিকে  থিয়েটারে টেনে এনে তার  ব্যবচ্ছেদ, শল্যচিকিৎসা  এবং কেটে ফেলে তাকে খুলে ফেলা , এবং তারপরে তার নিরাময় করা।
    অনুরূপ বক্তব্য সানচে ডি গ্রামন্টের ‘হরাইজন’ পত্রিকার  প্রবন্ধে প্রকাশ করা হয়েছিল, যিনি আতো সম্পর্কে লিখেছেন, "যদি মনে করা হয় যে আতো একজন পাগল মানুষ, তবে আতো নিজের পাগলামিকে স্বাগত জানিয়েছেন । তাঁর কাছে যুক্তিবাদী জগত ছিল না; তিনি হ্যালুসিনেশনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন যা যুক্তিকে বিলুপ্ত করে এবং তার বিচ্ছিন্নতার মর্মার্থ গড়ে তোলে । আতো ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে সেই সীমার বাইরে রেখেছিলেন যেখানে বিচক্ষণতা এবং উন্মাদনার বিরোধিতা করা যেতে পারে এবং নিজেকে জাদু এবং অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি ব্যক্তিগত জগতের কাছে সমর্পণ করা যায়।”
    আমরা জানি এলিজাবেথ ব্যারেট-ব্রাউনিং, লর্ড বায়রন, উইল কলিন্স, জর্জ ক্র্যাবে, চার্লস ডিকেন্স, জন কিটস, পার্সি বিশি শেলি এবং ওয়াল্টার স্কটের মতো ইউরোপীয়  লেখকরা আর পেইনটাররা অনেকেই আফিম বা আফিম থেকে তৈরি মাদক খেতেন । অন্যান্য ওষুধগুলোও আইনত উপলব্ধ ছিল।  রানি ভিক্টোরিয়াকে  মাসিকের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির  জন্য মারিহুয়ায়ানার টিংচার দেওয়া হতো । এমনকি রানি ভিক্টোরিয়া জনপ্রিয় পণ্য ‘ভিন মারিয়ানির’ জন্য একটি প্রশংসাপত্র লিখে দিয়েছিলেন, যা ছিল  অ্যালকোহল আর কোকেনের মিশ্রণ, আর তিনি  ক্লোরোফর্মের 'আনন্দজনক পরিমাপের বাইরে' প্রভাবগুলি উপভোগ করতেন যখন তা তাঁকে প্রসবের সময় দেওয়া হতো । সেসময়ে আফিম আর লাউদানাম  শিশু আর প্রাপ্তবয়স্ক সকলের জন্যই উদ্বেগজনক  রোগে দেওয়া হতো, যেমন 'স্নায়বিক কাশি', হুপিং কাশি, অন্ত্রের প্রদাহ, দাঁতের ব্যথা, ড্রপসি আর অবিরাম হেঁচকি। লাউদানাম ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় যা  জ্বর, অনিদ্রা, এলার্জি, পিত্তশূল, মূত্রাশয়ের প্রদাহ, কলেরা মর্বাস, ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, আর পাইলসের ক্ষেত্রে সুপারিশ করা হতো। 
    পিকাসো ছিলেন প্যারিসে বসবাসকারী শিল্পীদের অন্যতম যিনি জাঁ ককতোর সঙ্গে  আফিম নিতেন । প্যারিসের আরও বহু শিল্পী লাউদানাম নিতেন । এই শিল্পীদের অনেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন এবং পিকাসোও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁকে আর তাঁর বন্ধুদের প্রায়ই তাঁর ধোঁয়ায় ভরা স্টুডিওর মেঝেতে  দেখা যেত। পিকাসো আফিমের ধোঁয়ার গন্ধ সম্পর্কে বলেছিলেন যে এটা 'পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান গন্ধ'। একবার একটা ড্রইঙ এঁকে অঁতনা আতো তার ওপর লিখেছিলেন,  "মোটেই বাস্তব নয় কিন্তু সর্বদা সত্য  এবং এভাবেই বিষণ্নতার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তিনি অনুভব করতেন যে তিনি বাস্তব নন, তিনি অন্য কেউ, অথচ তবুও  জানতেন যে তা একেবারে সত্য ।
    স্বাভাবিক যে মাথার যন্ত্রণা থেকে ছাড়ান পাবার জন্য অঁতনা আতো অহরহ লাউদানাম খেতেন । যাইহোক, আতো যে  শুধুমাত্র লাউদানাম খেতেন  তাই নয়,  তিনি অন্যদেরও  তার ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন।  যারা কোকেন এবং আফিমের মতো মাদকদ্রব্যকে নিষিদ্ধ করতে চাইছিল তাদের আতো কড়া ভাষায় আক্রমণ করতেন । ১৯২৫ সালে তিনি বলেছিলেন, "যেহেতু আমরা কখনই মানবতার হতাশার কারণগুলি সনাক্ত  এবং নির্মূল করতে সক্ষম হব না, আমাদের কোনও অধিকার নেই একজন মানুষকে নিজের দুঃখ থেকে  মুক্ত হবার উপায়কে  বাধা দেওয়ার। যদিও আতো লাউদানাম ব্যবহারের সুপারিশ করতেন,  মাদকের সাথে তাঁর  সুস্থ সম্পর্ক ছিল না। একবার মেক্সিকোতে গিয়ে যখন হেরোইনের উইথড্রল সিম্পটম দেখা দেয়, তখন তাঁকে তাঁর ঘোড়ায় ওপরে ঠেলে বসিয়ে দিয়েছিল কয়েকজন লোক মিলে,  কারণ আতো শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন । তিনি নিজেই সেই অবস্হার বর্ণনা করে লিখেছেন যে “যেন একট ফুলে ওঠা আঠার দৈত্য হয়ে গিয়েছিলাম।”
    মানসিক চিকিৎসা সম্পর্কে আতো লিখেছেন, “"আমি, নিজে, ৯ বছর একটি উন্মাদ আশ্রমে কাটিয়েছি আর কখনও  আত্মহত্যা করার কথা ভাবিনি, যদিও আমি জানি যে সকালের পরিদর্শনের সময় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আমার প্রতিটি কথোপকথন আমাকে নিজেকে ফাঁসিতে লটকাতে প্ররোচিত করেছিল কারণ আমি সচেতন ছিলাম যে আমি তার গলা চিরে মারতে  পারব না।” মানসিক চিকিৎসা সম্পর্কে বেশ বিরক্ত ছিলেন তিনি যা তাঁর এই উক্তি থেকে স্পষ্ট হয়, “এ কারণেই আমাদের কলঙ্কিত সমাজ কিছু উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তির তদন্তের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করার জন্য মনোরোগবিদ্যা আবিষ্কার করেছে কেননা ভবিষ্যদ্বাণীর অনুষদগুলি তাদের অসুবিধাজনক মনে হয়। না, ভ্যান গঘ উন্মাদ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর চিত্রকর্মগুলো ছিল গ্রীক আগুন, পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ, যার দৃষ্টিকোণ বুর্জোয়াদের বর্ণালী সামঞ্জস্যকে গুরুতরভাবে বিপর্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছে।” 
    দুই
    ষোলো বছর বয়সে তাঁর প্রথম মানসিক ভারসাম্যহীনতার পর অঁতনা আতো জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন চিকিৎসালয়ে, তবুও হার মানেননি। "নিরাময়যোগ্য প্যারানয়েড প্রলাপ" রোগে আক্রান্ত আতো হ্যালুসিনেশন, গ্লোসোলালিয়া এবং হিংসাত্মক ক্রোধে ভুগতেন।  তাঁর চিকিৎসা সম্ভবত ততটাই ক্ষতি করেছিল যতটা সুস্হ করেছিল। তিনি অত্যন্ত সন্দেহজনক ইনসুলিন থেরাপি সহ বৈদ্যুতিক শক চিকিৎসার মতো  সত্যিকারের ভয়ঙ্কর পদ্ধতি সহ্য করেছিলেন, যার দরুন কিছু সময়ের জন্য আতো কোমায় চলে যান। তা সত্ত্বেও, অঁতনা আতো একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী তাত্ত্বিক এবং নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি পান, যিনি "নিষ্ঠুর থিয়েটার" ভাবকল্প তৈরি করার জন্য বিখ্যাত। তাঁর মঞ্চনাটক আর শ্রুতিনাটক দর্শক ও শ্রোতাদের ইন্দ্রিয় এবং সংবেদনশীলতাকে আক্রমণ করার জন্য ভেবেচিন্তে তৈরি করা হয়েছিল এবং তাদের জীবনের যেগুলো মূল বাস্তবতা —- যৌনতা, নির্যাতন, হত্যা এবং ধাতুরস, ঋতুরক্ত, মলত্যাগ সম্পর্কে বোধ জাগিয়ে তোলার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। অঁতনা আতো অভিনেতা আর দর্শকদের মধ্যে সীমা ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন, আর নাটককে এমন একটা অনুষ্ঠান হিসেবে উপস্হাপন  করতে চেয়েছিলেন যা আনন্দদায়ক, অনিয়ন্ত্রিত এবং এমনকি বিপজ্জনক হবে । অঁতনা আতোর নাটকের ধারণা ইউরো-আমেরিকান মঞ্চে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে।  সুসান সন্টাগ যেমন  লিখেছিলেন, "এখন থিয়েটার নিয়ে যারা কাজ করে তারা কেউই আতোর নাট্য ধারণার প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।"
    অঁতনা আতো প্যারিসে ১৯২০ এর দশকের পরাবাস্তববাদী লেখক, শিল্পী এবং পরীক্ষামূলক নাট্যদলে যোগ দেন।  রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ফলে আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁকে পরাবাস্তববাদী গোষ্ঠী থেকে বের করে দেন । ১৯২৭  সালে আঁদ্রে ব্রেতঁ কর্তৃক বহিষ্কৃত হওয়ার কারণ ছিল কমিউনিজমে  অঁতনা আতোর অবিশ্বাস । ফ্রান্সে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে পরাবাস্তববাদীদের যোগাযোগ বৃদ্ধিকে ভালো চোখে দেখেননি অঁতনা আতো।  রস মারে লিখেছেন, "আঁতো মোটেও রাজনীতির মানুষ ছিলেন না, এমনকি তিনি মার্কসবাদিদের বর্জন করতে বলতেন।তাছাড়া, "ব্রেতঁ বেজায় থিয়েটার-বিরোধী হয়ে উঠছিলেন কারণ ব্রেতঁ থিয়েটারকে বুর্জোয়া এবং প্রতিবিপ্লব হিসাবে দেখেছিলেন।" অঁতনা আতো বলেছিলেন, আঁদ্রে ব্রেতঁর মুখের ওপর, “মার্কসবাদিদের মুখে আমি হেগে দিই।” পরাবাস্তববাদীদের নিজেদের মধ্যে মারামারি হলেও, আতোকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পায়নি । আঁদ্রে ব্রেতঁ অবশ্য পরবর্তীকালে লিখেছিলেন, “ অঁতনা আতোর  সমস্তকিছুকে অস্বীকৃতির আবেগপূর্ণ, নায়কোচিত  বার্তাকে আমি অভিবাদন জানাই কেননা সেগুলোই আমাদের জীবিত রেখে হত্যা করে।” 
    আতোর প্রথমদিকের কাজগুলোকে "কৃত্রিম" হিসাবে বর্ণনা করেছেন কেউ-কেউ, তা এই জন্য যে সেই সময়ে গতানুগতিক নাট্যধারণা ছিল প্রবল । আঁতোর কাছে তাঁর ধারণাগুলো ছিল একযোগে আশীর্বাদ এবং অভিশাপ —দুইয়ে মোড়া, যা তিনি টুকরো-টাকরা কাগজে লিখতেন এবং ১৯৩০ এর দশকের শেষের দিকে বন্ধু, শত্রু এবং কয়েকজন নেতা ধরণের ব্যক্তিত্বকে ( এমনকি  হিটলারকে ) পাঠিয়েছিলেন। এই কাজগুলোর কোনও অনুবাদ বা প্রতিলিপি করা হয়নি, আর হাতের লেখা বেশ দুর্বোধ্য হওয়ায় পাঠকদের সামনে আসেনি । অভিনেতা রজার ব্লিনকে লেখা চিঠিতে আতো বলেছিলেন,  “যারা আমাকে হেরোইন নেওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য অভিনয় করে তারা সবাই,  আর যারা ১৯৩৯ সালের রবিবারের [অবৈধ] মে মাসের জন্য অ্যান ম্যানসনের [একজন বন্ধুর] উপর আঙুল তুলেছে, আমি তাদের প্যারিসের একটা চৌরাস্তায়  জীবন্ত পোড়াবো,  আর  আমি তাদের শরীরে ছেঁদা করে দেব আর তাদের মজ্জা পুড়িয়ে দেব।
    ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে অঁতনা আতো প্রকাশ করেন তাঁর “সুস্পষ্ট ভাষা বিষয়ক ম্যানিফেস্টো”, মূলত পরাবাস্তববাদীদের, বিশেষ করে আঁদ্রে ব্রেতঁ’র বক্তব্যের সঙ্গে তাঁর মতামতের পার্থক্য স্পষ্ট করার জন্য  । আতো’র ম্যানিফেস্টোটা এরকম :
      “আমি যদি খারাপ বা ভালোতে বিশ্বাস করি না । যদি আমি ধ্বংস করার মতো প্রবল প্রবণতা অনুভব করি, যদি নীতিমালায় এমন কিছু না থাকে যা আমি যুক্তিসঙ্গতভাবে মেনে নিতে পারি, তাহলে বুঝতে হবে তার অন্তর্নিহিত কারণটি  রয়েছে আমার শরীরের মাংসে।
    “আমি ধ্বংস করি কারণ আমার দৃষ্টিতে, যুক্তি থেকে যা কিছু গড়ে ওঠে তাতে বিশ্বাস করা যায় না। আমি কেবলমাত্র সেই প্রমাণে বিশ্বাস করি যা আমার মজ্জাকে আলোড়িত করে। যা আমার যুক্তিবোধের প্রতি সম্বোধন করে তাতে  নয়। আমি স্নায়ুর রাজ্যে নানা রকম স্তর খুঁজে পেয়েছি।  বুঝতে পারি যে এখন সাক্ষ্য-প্রমাণের মূল্যায়ন করতে আমি সক্ষম। আমার জন্য বিশুদ্ধ মাংসের এলাকায় এমন  প্রমাণ রয়েছে যার সঙ্গে যুক্তি  প্রমাণ করার কোন সম্পর্ক নেই। যুক্তি এবং হৃদয়ের মধ্যে চিরন্তন দ্বন্দ্ব আমার শরীরে নিষ্পত্তি হয়, যদিও তা আমার মাংসে স্নায়ু দ্বারা সিঞ্চিত । অনুভূতিশীল অকল্পনীয়তার রাজ্যে, আমার স্নায়ুর দ্বারা গড়ে ওঠা ছবিখানা  সর্বোচ্চ বুদ্ধিবৃত্তির রূপ নেয়, যা থেকে আমি তার বুদ্ধিবৃত্তির গুণকে ছিনিয়ে নিতে অস্বীকার করি। সুতরাং  বলতে হচ্ছে যে, আমি একটি ভাবকল্পের গঠন পর্যবেক্ষণ করি, যা কিনা  বস্তুসমূহের প্রকৃত পূর্ণতা বহন করে, তা আসলে একটা ভাবকল্প যা সৃষ্টির ধ্বনি নিয়ে আমার কাছে পৌঁছোয়।
    “ কোনও ইমেজ আমাকে সন্তুষ্ট করে না যদি না তা সেইসঙ্গে  জ্ঞান হয়, যদি না ইমেজটা তার সাথে নিজস্ব সারবত্তা এবং নিজস্ব স্পষ্টতা ধরে রাখে। আমার মন, বিতর্কমূলক যুক্তির কারণে ক্লান্ত, একটা নতুন,  পরম মাধ্যাকর্ষণের চাকায় সম্পৃক্ত হতে চায়। আমার কাছে  এটা  সর্বোত্তম পুনর্গঠনের মতো ব্যাপার, যাতে শুধু  অযৌক্তিক নিয়মগুলো লাগু হয়,  আর  জয় হয় একটা নতুন মর্মার্থের আবিষ্কার । এই মর্মার্থ মাদকের ব্যাধিতে হারিয়ে গেছে আর  ঘুমের পরস্পরবিরোধী কল্পনার কাছে একটা গভীর বুদ্ধিমত্তার চেহারা উপস্থাপন করেছে। এই মর্মার্থ মনের ওপর নিজের বিজয় , আর যদিও এটা যুক্তির দ্বারা অখণ্ডনীয়, তবু তা উপস্হিত থাকে , অবশ্য সেটা কেবল মনের ভেতর । এটা হলো শৃঙ্খলা,  বুদ্ধিমত্তা । এটাই বিশৃঙ্খলার গুরুত্ব। কিন্তু তা এই বিশৃঙ্খলাকে যেমনকার তেমন ভাবে গ্রহণ করে না, এটা তাকে ব্যাখ্যা করে আর ব্যাখ্যা করে বলে তাকে হারিয়ে ফ্যালে। এটা হলো অযৌক্তিকতার যুক্তি। আর একজন লোক শুধু এই সব কথাই বলতে পারেন । আমার স্বচ্ছ অযৌক্তিকতা বিশৃঙ্খলাকে ভয় পায় না.
    “মন বলতে যা বোঝায় তার কিছুই আমি বাতিল করি না। আমি শুধু আমার মনকে তার নিজস্ব নিয়ম আর অঙ্গসুদ্ধ অন্য কোথাও নিয়ে যেতে  চাই। আমি মনের যৌন প্রক্রিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করি না, বরং এই প্রক্রিয়াটির বিপরীতে আমি সেই আবিষ্কারগুলোকে আলাদা করে দিতে চাই যা স্বচ্ছ উদ্দেশ্য  সরবরাহ করে না। আমি স্বপ্নের জ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করি, কিন্তু তা কেবল তাদের কাছ থেকে নতুন মালমশলা পাবার জন্য। আমি চাই সংখ্যাবৃদ্ধি, সূক্ষ্মতা, প্রলাপের বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টি,  দ্রুত ভবিষ্যবাণী  নয়। একটি ছুরি আছে যা আমি কখনও ভুলি না।
     “কিন্তু এই ছুরিটা  স্বপ্নের ভেতরে অর্ধেক ঢুকে আছে, যা আমি নিজের ভেতরে রাখি, যা আমি স্বচ্ছ ইন্দ্রিয়ের পরিসীমানায় আসতে দিই না। যাকিছু ইমেজের এলাকার অন্তর্গত তা যুক্তির দ্বারা অপরিবর্তনীয় এবং তাকে অবশ্যই ইমেজের মধ্যে থাকতে হবে বা বিনষ্ট হতে হবে। সে যাই হোক, ইমেজের মধ্যে একটা কার্যকারণ থাকে, এমন বহু ইমেজ আছে যেগুলো ইমেজে-ভরা বিশ্বের জীবনীশক্তির তুলনায় পরিষ্কার ।
    “মনের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে অসংখ্য প্রাণীর বহুরূপী এবং ঝকমকে ইঙ্গিত থাকে। এই ইন্দ্রিয়াতীত এবং চিন্তাশীল ধূলিকণা নিজের ভেতর থেকে নিয়মানুসারে গড়ে ওঠে , স্বচ্ছ যুক্তি  বা আটকে দেয়া চেতনার এলাকার  বাইরে ।
    “ইমেজের উচ্চতর এলাকায়,  সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় বিভ্রম, বা বস্তুগত ত্রুটির অস্তিত্ব নেই, বিশেষ করে জ্ঞানের বিভ্রমের প্রসঙ্গ তো তোলাই উচিত নয় । তবে  এটাই হলো  আসল কারণ কেন একটা নতুন জ্ঞানের মর্মার্থ জীবনের বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে অবতীর্ণ হতে পারে ।
    “জীবনের সত্য বস্তুসমূহের আবেগের মধ্যে নিহিত।  মানুষের মন নানা রকমের ভাবকল্প দিয়ে বিষিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষকে সন্তুষ্ট হতে বলবেন না, তাকে কেবল শান্ত হতে বলুন, যাতে সে বিশ্বাস করে  যে সে  তার অবস্থান খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র পাগলরাই সত্যিকার শান্ত থাকতে পারে ।”
    তিন

    প্যারিসে, আতো বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ফরাসি নাটক-পরিচালকের কাছে শিক্ষানবিশী করেন ।  এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জ্যাক কোপেউ, আঁদ্রে আঁতোয়া, গেয়র্গে এবং লুদমিলা পিতোয়েফ, শার্ল দুলাঁ, ফারমাঁ গেমিয়ার এবং লুনে পো । লুনে পো, প্রথম আতোকে  পেশাদার থিয়েটারে  প্রথম কাজ দিয়েছিলেন, পরে তিনি আতোকে "অভিনেতাদের মাঝে হারিয়ে যাওয়া একজন চিত্রশিল্পী" হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর মূল নাট্য প্রশিক্ষণ ছিল শার্ল দুলাঁর  দল, ‘থিয়েটার দে ল'আটেলিয়ারের’ অংশ হিসেবে, যেটিতে আতো ১৯২১ সালে যোগদান করেন। সেই দলে আতো  আঠারো মাস  ছিলেন।
    শার্ল দুলাঁর দলের সদস্য হিসাবে, আতো প্রতিদিন ১০ থেকে ১২  ঘন্টা প্রশিক্ষণ নিতেন। আতো দুলাঁর শিক্ষার একজন শক্তিশালী প্রবক্তা ছিলেন । আতো বলেছিলেন: "দুলাঁর প্রশিক্ষণে আমি অনুভব করি যে আমি প্রাচীনকালের যাবতীয়  গোপনীয়তা এবং উৎপাদনের সম্পূর্ণ বিস্মৃত রহস্য আবার আবিষ্কার করছি।"  তাঁরা পূর্ব এশীয় থিয়েটারে, বিশেষ করে বালি এবং জাপানের অভিনয় ঐতিহ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন । দুলাঁ  অবশ্য পশ্চিমা মঞ্চনাটকে পূর্ব এশীয় থিয়েটারের ভাষা ও শৈলী গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেননি। দুলাঁর বক্তব্য ছিল, "আমাদের পশ্চিমা থিয়েটারের উপর একটা দীর্ঘ ঐতিহ্যের থিয়েটারের নিয়ম চাপিয়ে দিতে চাওয়া, যার নিজস্ব প্রতীকী ভাষা আছে,  একটা বড় ভুল হবে।"
    নানা বিষয়ে দুলাঁর সঙ্গে আতোর মতপার্থক্য দেখা দেয়, বিশেষ করে  আলেকজান্ডার আর্নক্সের হুওন ডি বোর্দোতে সম্রাট শার্লেমেনের অভিনয় নিয়ে মতান্তর এমন স্তরে চলে যায় যে ১৯২৩ সালে আতো দুলাঁর দল ছেড়ে বেরিয়ে  যান। তারপর তিনি ১৯২৩ সালে পিতোয়েফের দলে যোগ দেন, কিন্তু পরের বছর সেই দলও ছেড়ে দেন তার কারণ এই সময়ে আতো  সিনেমা করার দিকে ঝোঁকেন। চলচ্চিত্রে একজন সমালোচক, অভিনেতা এবং লেখক হিসেবে কাজ করার  একটি সক্রিয় কর্মজীবন ছিল অঁতনা আতোর। আতো কুড়িটিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি অ্যাবেল গ্যান্সের ‘নেপোলিয়ন’ ( ১৯২৭ ) ছবিতে জাঁ-পল মারাট এবং কার্ল থিওডর ড্রেয়ারের ‘দ্য প্যাশন অফ জোয়ান অফ আর্ক’ ( ১৯২৮) ফিল্মে একজন সন্ন্যাসীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পরিচালক জার্মেইন ডুলাক-এর ,  সিশেল অ্যান্ড দ্য ক্লারজিম্যান’ ফিল্মের স্ক্রিপ্ট  ( ১৯২৮ ) লিখেছিলেন আতো । এই ফিল্মটি পরাবাস্তববাদী সালভাদর ডালি এবং লুই বুনুয়েলকে প্রভাবিত করেছিল।১৯২৯ সালে বিখ্যাত চোখের মণি কাটার দৃশ্য দিয়ে আন চিয়েন আন্দালু’  তৈরি করেছিলেন। অ্যাবেল গ্যান্সের ‘নাপোলেয়ঁ’ ( ১৯২৭ ) ছবিতে জাঁ-পল মারাতের চরিত্রে আতোর অভিনয় মারাতের ব্যক্তিত্বের শৌর্য  বোঝাতে অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিয়েছিলেন আতো । তিনি বেশ কয়েকটা চলচ্চিত্রের দৃশ্য লিখেছিলেন, তার মধ্যে দশটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। অঁতনা আতোর একটা দৃশ্যকল্প তৈরি করা হয়েছিল ‘দি সিশেল অ্যান্ড দি ক্লার্জিমান’ ফিল্মে ( ১৯২৮ ) । জার্মেইন দুলাক পরিচালিত এই ফিল্মটিকে অনেক সমালোচক  প্রথম পরাবাস্তববাদী চলচ্চিত্র বলে মনে করেন। সিনেমা সম্পর্কে আতো লিখেছেন, “সিনেমা বলতে বোঝায় মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখীতা, আলোকবিদ্যার সম্পূর্ণ উত্থান, দৃষ্টিভঙ্গি এবং যুক্তির ভাঙন। এটি ফসফরাসের চেয়ে বেশি উত্তেজনাপূর্ণ, প্রেমের চেয়েও বেশি চিত্তাকর্ষক।"

    ফিল্ম নির্মাণ ও স্ক্রিপ্ট লেখা ইত্যাদির পথ বন্ধ অনুভব করে, তিনি রজার ভিত্রাক এবং রোবের অ্যারনের সাথে আলফ্রেড জ্যারি থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা করেন।  ‘থিয়েটার আলফ্রেড জ্যারির’ জন্য লেখা "দ্য ম্যানিফেস্টো ফর অ্যান অ্যাবোরটিভ থিয়েটার" (১৯২৬-২৭) তে, অঁতনা আতো পরাবাস্তববাদীদের  সরাসরি আক্রমণ করেছিলেন, যাদের তিনি "ঠোঙা বিপ্লবী" বলে অভিহিত করেন । তিনি ঘোষণা করেন যে পরাবাস্তববাদীরা "কমিউনিজমের কাছে মাথা নত করছে", যা "একটি অলস মানুষের বিপ্লব" বই আর কিছু নয় । রজার ভিত্রাক আর রোবের্ অ্যারনের সাথে কাজ করার জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করার প্রয়াস করেছিলেন যা ফরাসি থিয়েটারে আমূল পরিবর্তন ঘটাবে। অঁতনা আতো সেই সময়কার পশ্চিমা থিয়েটার-ভাবনার বিরোধীতা আরম্ভ করেন । তিনি বলেছিলেন যে গতানুগতিক পরিকল্পিত প্লট এবং স্ক্রিপ্টেড ভাষা প্যানিং করে তাঁর সমসাময়িকরা সাধারণত একই প্রথায় দিনের পর দিন নাটক মঞ্চস্হ করে চলেছেন, কোনও নতুন ভাবনা-চিন্তা নেই । রজার ভিত্রাককেও পরাবাস্তব আন্দোলন থেকে বের করে দিয়েছিলেন আঁদ্রে ব্রেতঁ । তাঁরা ১৯২৭ সালের জুন থেকে ১৯২৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চারটি প্রযোজনা মঞ্চস্থ করেন । নাটকগুলো  স্বল্পস্থায়ী ছিল, কিন্তু আর্থার অ্যাডামভ, আন্দ্রে জিদ এবং পল ভ্যালেরি সহ ইউরোপীয় শিল্পীদের একটি বিশাল  অংশ আতোর নাটকগুলো দেখতে আসতেন ।
    ১৯৩৩ সালে আতো ‘থিয়েটার অব ক্রুয়েলটি’ নামে একটি ম্যানিফেস্টোতে নাটক সম্পর্কে তাঁর ভাবনা-চিন্তা প্রথম প্রকাশ করেন । ১৯৩৮ সালে লেখেন ‘থিয়েটার অব দি ডাবল’।অঁতনা আতোর এই গুরুত্বপূর্ণ তত্বটি ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি গালিমার প্রকাশনার ‘মেটামরফোসিস’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয় ।  যখন এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল, তখন আতো সেন্ট-অ্যানের একটি মানসিক চিকিৎসালয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্হায় ছিলেন, যাকে বলা যায়  প্রায় ক্যাটাটোনিক । প্রবন্ধসংগ্রহ জুড়ে, আতো প্রচলিত থিয়েটারের উপর তাঁর আক্রমণের রূপরেখা দিয়েছেন এবং ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন। অভিব্যক্তি ছিল দর্শকদের সাথে তাঁর সংযোগের কেন্দ্রবিন্দু। আতোর সংজ্ঞায়িত ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি’, দর্শকদের সংবেদনকে আক্রমণ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। বলেছে যে নাটকটা যেন দর্শকদের  এমনভাবে ক্রোধান্বিত করে  যা সেই সময়ের ইউরো-আমেরিকান থিয়েটার করতো না।
    নিষ্ঠুরতার থিয়েটার - এটা কি? "যা কিছু কাজ করে তা একটি নিষ্ঠুরতা" আতো  তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন। "একটা চরম কর্মকাণ্ডের ধারণার উপর ভিত্তি করে, সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে,  ঠেলে, পরিধি বাড়িয়ে থিয়েটারকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে।" আতোর বিষয়বস্তু যদি দেখা হয় - মারকুইস ডি সাদে, ব্লুবিয়ার্ড, জেরুজালেমের পতন, মেক্সিকো জয় -  এই ফরাসি কবি, অভিনেতা, মিডিয়ামের বিপ্লবী অভিব্যক্তির পিছনে এমন একজনকে পাবেন  যিনি শিল্পীকে লেখক বা পরিচালক হিসাবে না দেখে একজন সৃষ্টিকর্তা হিসাবে ভেবেছিলেন। একজন স্বপ্নদর্শী ।
    নিষ্ঠুরতার থিয়েটার ভাবকল্প সম্পর্কে আতো লিখেছেন, “নিষ্ঠুরতার থিয়েটার মানে আমার জন্য প্রথমত কঠিন এবং নিষ্ঠুর থিয়েটার। এবং, কর্মক্ষমতার স্তরে, এটি এমন নিষ্ঠুরতা নয় যে আমরা একজন আরেকজনের দেহে  আঘাত করে, আমাদের ব্যক্তিগত চামড়া-মাংস-অন্ত্র ছিঁড়ে বের করব, কিংবা সেই অ্যাসিরিয়ান সম্রাটদের মতন, মানুষের কান, নাক, বা সুন্দরভাবে কেটে নেয়া নাকের পার্সেল পাঠিয়ে একে অপরের উপর অনুশীলন করব । নিষ্ঠুরতার থিয়েটার কিন্তু অনেক বেশি ভয়ানক এবং প্রয়োজনীয় নিষ্ঠুরতা যা আমাদের বিরুদ্ধে সমাজ ব্যবহার করে । আমরা স্বাধীন নই। এবং আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়তে পারে। এবং নিষ্ঠুরতার থিয়েটার  সবাইকে সতর্ক করে শেখানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে।”
     এই তত্বগুলোর মাধ্যমে অঁতনা আতো ইউরোপীয় আভাঁ গার্দের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসাবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি পান। বিশেষ করে, তিনি ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির; ধারণার মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীর থিয়েটারে গভীর প্রভাব ফেলেছেন। এবং আদিবাসী মেক্সিকান এবং বালিনিজ নাট্যপ্রথাকে কাজে লাগিয়েছেন। ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি’ ঐতিহ্যগত পশ্চিমা থিয়েটার থেকে আলাদা  । আতোর  কাজগুলো জাঁ জেনে, গেয়র্গে গ্রোটোস্কি, পিটার ব্রুক এবং রোমিও ক্যাসেলুচি সহ বহু শিল্পীর ওপর  প্রভাব ফেলেছে ।
    পরীক্ষামূলক থিয়েটার এবং পারফরম্যান্স শিল্পের বিকাশে একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছে আতোর ভাবনা-চিন্তা ও কর্মকাণ্ড। তাঁর ধারণাগুলো. পারফরম্যান্স অনুশীলনের ভাষার,  এবং যুক্তিবাদের প্রভাবশালী ভূমিকা বর্জন করে,  পৃথিবীব্যাপী আভাঁ গার্দ আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করতে সহায়তা করেছে। তাঁর মৃত্যুর পরও  তাঁর অনেক কাজ জনসাধারণের সামনে উপস্হাপন করা সে সময়ে সম্ভব  হয়নি। যেমন  ‘স্পার্ট অফ ব্লাড’ ১৯২৫ সালে লেখা অথচ ১৯৬৪  সাল পর্যন্ত দেখানো হয়নি। পিটার ব্রুক এবং চার্লস মারোভিটজ রয়্যাল শেক্সপিয়ার কোম্পানিতে তাদের "থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি" সিজনের অংশ হিসাবে এটি মঞ্চস্থ করেছিলেন। কারেন ফিনলে, স্প্যাল্ডিং গ্রে, লিজ লেকম্পটে, রিচার্ড ফোরম্যান, চার্লস মারোভিটজ, স্যাম শেপার্ড, জোসেফ চাইকিন, চার্লস বুকাওস্কি, অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং আরও অনেকের মতো শিল্পীরা আতোকে তাঁদের অন্যতম প্রভাব হিসাবে উল্লেখ করেছেন। উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য প্রকাশের উদ্দেশ্য বলে মনে করা হয়, আঁতো’র ছোট নাটক ‘জেট অফ ব্লাড’, বা ‘স্পার্ট অফ ব্লাড’ । পাঠ্যটি যুক্তিভাঙনময় এবং মঞ্চের দিকনির্দেশগুলি পরাবাস্তব। ধ্বংসের দৃশ্য রয়েছে । একটি ভূমিকম্প আছে, একটি বিশাল হাত — এবং রক্তের একটি ফোয়ারা। নারীর যোনি থেকে বিছে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে। মঞ্চ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে  মৃতদেহ। এটি প্রথম ১৯৬৪ সাঁলে আতো’র থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি সিজনের অংশ হিসাবে প্রদর্শনের পর ১৯৬৫ সালে অ্যালবি থমাস তৈরি করেন এর একটি ফিল্ম সংস্করণ, ‘দ্য স্পার্ট অফ ব্লাড’। সমালোচক অ্যালিসন ক্রগগন এই নাটক সম্পর্কে বলেছেন যে, আতো  ' গতানুগতিক মডেলের পরিবর্তে একটি অনুঘটক এবং একটি প্ররোচনা' গড়ে তুলেছেন।
    উন্মাদনার তাৎক্ষণিক ঝাঁকুনি সত্ত্বেও, নাটকটির  মধ্যে আকর্ষণীয় কিছু আছে। আতো বলেছিলেন যে ফরাসী ভাষা বড্ডো সীমিত, সমস্ত ভাবনা লিখে প্রকাশ করা যায় না । তাঁর নাটকটা তাই বিপরীত ভাষা থেরাপির মতো, আমাদের বাস্তবতাকে ঘিরে বর্ণালী দেয়াল ভেদ করার একটি জাদুবিদ্যার উপায়। যেহেতু এটা দর্শক-শ্রোতার ইন্দ্রিয়ের ওপর আক্রমণ করে, টের পাওয়া যায়, মাদক  সবসময় প্রভাব ফেলেছে। এটি নেরভাল এবং আলফ্রেড জারির জন্য জরুরি ছিল, দুজনেই আতোর  অগ্রদূত। জারিকে নাকি খড়ের বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, কাছাকাছি ইথারের একটা সিলিন্ডার। আতোর এমন ছিলেন যে লোকটাকে বেশ্যালয়ে তাজা মৃতদেহের মতো দেখাতো -  তাঁকে সরবরাহ করা বিভিন্ন ওষুধের যেকোনো একটি দ্বারা তাঁর মৃত্যু ঘটা অসম্ভব ছিল না। 
    চার
    বেশিরভাগ সমালোচক বিশ্বাস করেন যে নাট্যতত্ত্বে আতোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হল তাঁর "নিষ্ঠুরতার থিয়েটার", একটি তীব্র নাট্য অভিজ্ঞতা যা  প্রপস, জাদু কৌশল, বিশেষ আলো, আদিম অঙ্গভঙ্গি, বক্তব্য এবং ধর্ষণ, নির্যাতন এবং হত্যার থিমগুলিকে একত্রিত করে মঞ্চস্হ করার কথা বলে  । দর্শক ও শ্রোতারা জীবনের মূল উপাদানগুলির মুখোমুখি হন। ১৯৩১ সালে,  প্যারিস ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে অঁতনা আতো বালির নৃত্য পরিবেশন করতে দেখেছিলেন। অনেকের মতে আতো যা দেখেছিলেন তার অনেকটাই তিনি ভুল বুঝেছিলেন, তবু তা নাটকের জন্য তাঁর অনেক ধারণাকে প্রভাবিত করেছিল। অ্যাড্রিয়ান কার্টিন লিখেছেন যে বালিনিজদের সঙ্গীত এবং শব্দের ব্যবহারের তাৎপর্য ইউরোপীয়দের থেকে ভিন্ন । আতো তাদের 'হিপনোটিক' ছন্দ, উচ্চনাদ  দামামার  প্রভাবের পরিসর, সঙ্গীতজ্ঞদের তৈরি বিভিন্নরকম কাঠের বাজনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । 
    সেটা ছিল  বালিনিজ থিয়েটারের একটি অংশ যা আতো ১৯৩১ সালে প্যারিস ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে দেখেছিলেন,  যা অঙ্গভঙ্গি এবং অভিনয় সম্পর্কে তাঁর ধারণাগুলো বদলাতে  শুরু করেছিল। তিনি মুখের অভিব্যক্তি এবং কথ্য শব্দের আপেক্ষিক গুরুত্বহীনতার ব্যবহারে আগ্রহী ছিলেন। অঙ্গভঙ্গি, তিনি অনুভব করেছিলেন, একজন শিল্পীর অচেতন এবং সচেতন উদ্দেশ্যগুলোকে এমনভাবে জুড়ে দিতে পারে যা শব্দেরা প্রকাশ করতে পারে না (যদিও একজন লেখক হিসেবে তিনি নিজে,  বিশ্বাস করতেন যে শব্দগুলো কী-কী করতে পারে)। যা শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয় তা অঙ্গভঙ্গি করে অভিনেতারা মঞ্চে সেগুলো দৃশ্যমান করতে পারে। তিনি বললেন যে,  'সমস্ত সত্য অনুভূতি বাস্তবে উপস্হাপন-যোগ্য নয়। প্রকাশ করা মানেই বিশ্বাসঘাতকতা। কিন্তু উপস্হাপন করা মানে তাকে ছত্রভঙ্গ করা।  সেজন্যই একটা ছবি, একটা রূপক, একটা ফিগার যা কিনা প্রকাশ করা যায় মুখোশের সাহায্যে   সেটা সংলাপ আর তার বিশ্লেষণের চেয়ে আত্মার জন্য বেশি তাৎপর্য রাখে।
    এর কিছুদিন পরেই তিনি ‘লা নুভেলে রেভিউ ফ্রানসেইজি” পত্রিকায় তাঁর 'ফার্স্ট ম্যানিফেস্টো ফর এ থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি' প্রকাশ করেন; এটি পরে তার মূল বই “দি থিয়েটার অ্যান্ড ইটস ডাবল’-এ একটি অধ্যায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল । এতে তিনি 'টোটেম এবং অঙ্গভঙ্গির একটি নতুন নাট্যভাষা তৈরি করার তাঁর অভিপ্রায় বর্ণনা করেছেন - যা কথোপকথন বর্জিত স্থানের ভাষা যা সমস্ত ইন্দ্রিয়কে আবেদন করবে'।
     অঁতনা আতোর  থিয়েটারে শ্রোতা-দর্শক যা দেখছেন-শুনছেন সেই তত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়েছিল।  তিনি বিশ্বাস করতেন যে থিয়েটারের অনেক পুরোনো নিয়মনীতি বাতিল করতে হবে । তিনি অনুভব করেছিলেন, মঞ্চে যা দর্শক-শ্রোতা দেখবে,  'স্বপ্নে তাদের গুরুত্ব থাকা উচিত' । প্রসেনিয়াম আর্চ,  তার বিরুদ্ধে কাজ করে। নাটকের অভিনয়ে তিনি শ্রোতা এবং অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে কোনো বাধা ছাড়াই একটি একক খেলার জায়গা তৈরি করতে অডিটোরিয়াম এবং মঞ্চের বিলুপ্তিতে বিশ্বাস করতেন।
    নিষ্ঠুরতার থিয়েটার একটি দর্শন এবং একটি ডিসিপ্লিন, দুইই ।  আতোর থিসিসে 'নিষ্ঠুরতা' ছিল  শ্রোতাদের চমকে দেওয়ার এবং মোকাবিলা করার উপাদান । শব্দের বাইরে গিয়ে আবেগের সাথে সংযোগ করার কথা বলেছেন তিনি,  যা কিনা স্নায়ু এবং হৃদয়কে জাগিয়ে তোলার  ক্ষমতা   রাখে । তিনি বিশ্বাস করতেন অঙ্গভঙ্গি এবং আন্দোলন,  পাঠ্যের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। শব্দ এবং আলো সংবেদনশীল ব্যাঘাতের সরঞ্জাম হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। দর্শকদের, তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, অভিনয়ের একটি অংশ হিসেবে প্রস্তুত করা উচিত। থিয়েটার হওয়া উচিত 'সংগঠিত নৈরাজ্যের' একটি কর্মকাণ্ড । আতোর থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির ধারণা হলো  অভিনয়ের  শ্রোতাদের অংশভাক করে তোলা। শ্রোতা এবং অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া হওয়া উচিত, আলো, নড়াচড়া, নাচ, কান ফাটানো শব্দ এবং আরও অনেক কিছুর মাধ্যমে শ্রোতা-দর্শকদের নাটকের চরিত্র করে তোলা প্রয়োজন মনে করতেন আতো।
    দুর্ভাগ্যবশত ‘লেস সেন্সি’ ছিল একমাত্র নাটক যা আতো তাঁর ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির’ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে মঞ্চস্হ করেছিলেন। এটি পার্সি বিসি শেলির ‘লেস সেন্সির’ ওপর ভিত্তি করে অভিনীত হয়েছিল, ১৮১৯ সালে রচিত একটি কাব্যনাট্য। কবিতাটা ছিল হাউস অফ সেন্সি দ্বারা অনুপ্রাণিত । যখন লেখা হয়েছিল তখন এটি মঞ্চযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। এতে পিতৃহত্যা এবং অজাচারের কাহিনি দর্শানো হয়েছিল। বর্তমানে, শেলির ‘লেস সেন্সি’ ইউরো-আমেরিকান নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়।নাটকটি অঁতনা আতোর  সংস্করণে প্যারিসের থিয়েটার দেস ফোলিস-ওয়াগ্রামে অভিনীত হয়েছিল।  শুধুমাত্র ১৭ বার দেখানো হয় কিন্তু দর্শকদের থেকে আশানুরূপ  প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তা সত্ত্বেও, তা ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির’ উৎকৃষ্ট নিদর্শন হিসাবে সমালোচকদের আকৃষ্ট করেছিল । ‘লেস সেনসি’ সম্পর্কে মঞ্চ-উপস্হাপক  বলেছিলেন যে শুরুর দৃশ্যটা ছিল "তীব্র ঝড়-ঝাপটার বায়ুমণ্ডলীয় অশান্তির ইঙ্গিত , যার সাথে বাতাসে দোল খেতে থাকা পর্দা, হঠাৎ-হঠাৎ বিকট আর বাড়তে থাকা আওয়াজের  তরঙ্গ আর সেই সঙ্গে নাচানাচি করতে থাকা ভিড়ের বেলেল্লাপনা” । সমালোচক জেন গুডঅল ‘দ্য সেনসি’ সম্পর্কে লিখেছেন, "প্রতিফলনের উপর কর্মের প্রাধান্য, ঘটনাগুলির বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছিল ।একক সংলাপ, আকস্মিক, ঝাঁকুনিপূর্ণ পরিবর্তনের প্রয়োজনে কাটা-কাটা সংলাপ, প্রয়োগ করা হয়েছিল আকস্মিকতার প্রভাব তৈরি করার জন্য। সংলাপ আর নানারকম ধ্বনির চরম ওঠানামা সংবেদনশীল সচেতনতাকে ধরে রাখার চেষ্টা করে নাটকটায় ।”
    তাঁর জীবদ্দশায় অঁতনা আতোর তত্ত্বগুলো প্রাথমিকভাবে তত্ত্ব হিসেবেই রয়ে গিয়েছিল কিন্তু ক্রমশ  তাদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে থাকে । অবশ্য অনেকে  যুক্তি দেন যে আতোর ধারণাগুলো সর্বদা সুসংগত বা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তবু একথা অনস্বীকার্য  যে তাঁর তত্ত্বগুলো সমসাময়িক থিয়েটারের গতিপথ বদলে দিয়েছে ।  জাঁ জেনে এবং স্যামুয়েল বেকেট সহ ইউরোপীয় লেখকদের একটা প্রজন্মের উপর তাঁর কাজ গভীর প্রভাব ফেলেছিল। পরিচালক পিটার ব্রুক ছিলেন আতোর তত্বের  একজন প্রধান সমর্থক, যা তাঁর বই ‘দ্য এম্পটি স্পে’স-এ প্রকাশ করেছেন। পিটার ব্রুক প্রযোজিত ‘কিং লিয়ার’ এবং ‘মারাট/সেড’ সবচেয়ে স্পষ্টভাবে আতোর চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত । জিম মরিসন, ১৯৬০-এর দশকের আমেরিকান ব্যান্ড ‘দ্য ডোরস’-এর প্রধান গায়ক, অনুষ্ঠান এবং পারফরম্যান্সের উপর আতোর তত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। জন কেজ, মার্স কানিংহাম এবং দ্য লিভিং থিয়েটার সকলেই আতোর প্রতি ঋণ স্বীকার করেছেন।
    ১৯৬৪ সালে পিটার ওয়েইসের নাটকের প্রযোজনায় আতোর তত্ব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করা হয়েছিল - যার নাম ছিল  ‘দ্য পার্সকিউশন অ্যান্ড অ্যাসাসিনেশন অফ মারাট অ্যাজ পারফর্মড বাই দ্য অ্যাসাইলাম অফ দ্য অ্যাসাইলাম অফ দ্য মারকুইস ডি সেড’। ব্রুকের নির্দেশনায় - রয়্যাল শেক্সপিয়ার কোম্পানির জন্য।  প্রায়শই, আতোর নাটক প্রদর্শন করার সময়ে দর্শকদের কেন্দ্রে রেখে চারপাশে  অভিনয়ের কাঠামো তৈরি করা হতো । নাটকের ভিতর আটকে থাকা দর্শকদের গতানুগতিক থেকে একেবারেই ভিন্ন অভিজ্ঞতা হতো। আতোর ‘লেস সেন্সি’ ( ১৯৩৫ ) নাটকটি এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়ে যে তার নিজের মেয়েকে ধর্ষণ করে এবং তারপর তার মেয়ের ভাড়াটে খুনিদের হাতে খুন হয় । মেয়েটি বাপকে নির্মূল করার জন্য লোকগুলোকে নিয়োগ করেছিল। আতোর কাজের আরেকটি উদাহরণ হল ‘দ্য ফাউন্টেন অফ ব্লাড’ ( ১৯২৫ ), মানুষের, বিশেষ করে নারীদের দ্বারা বিশ্ব সৃষ্টি এবং এর ধ্বংস সম্পর্কে একটি প্রহসন। আতোর অন্যান্য নাটক, দৃশ্যকল্প এবং গদ্যের মতো, ‘লেস সেনসি’ এবং ‘দ্য ফাউন্টেন অফ ব্লাডকে’ প্রচলিত, সভ্য মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করার উদ্দেশ্যে লেখা। আতো চেয়েছিলেন মানুষের পরিমার্জিত মুখোশের পেছনে লুকিয়ে থাকা প্রাকৃতিক, বর্বর প্রবৃত্তিকে বের করে আনা। ‘ দ্য ফাউন্টেন অফ ব্লা’ড সম্পর্কে, অ্যালবার্ট বারমেল  লিখেছেন,  “সব মিলিয়ে, ‘দ্য ফাউন্টেন অফ ব্লাড’ হল একটি দুঃখজনক, বিদ্বেষপূর্ণ, আবেগপ্রবণ প্রহসন, জল্পনা-কল্পনার এক অপূর্ব স্রোত এবং নাটকের ইতিহাসে এক অনন্য অবদান। "
    যদিও আতোর নিষ্ঠুরতার থিয়েটার ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হয়নি, তাঁর ধারণাগুলো আধুনিক থিয়েটারের অনেক চিন্তকের বিষয়বস্তু হয়েছে এবং অনেক বিশ্লেষক আতোর ধারণাগুলো এখনও  অধ্যয়ন করে চলেছেন। লেখক জর্জ ই. ওয়েলওয়ার্থ,  ‘ড্রামা সার্ভেতে’, নিষ্ঠুরতার থিয়েটারকে ব্যাখ্যা করেছেন "নৈর্ব্যক্তিক, নির্বোধ-এবং সেইজন্য নির্মম-নিষ্ঠুরতার বয়ান, যার সবকিছু পিতৃতন্ত্রের  অধীন। আতোর দৃষ্টিতে জগতসংসারের প্রাকৃতিক শক্তিসহ মহাবিশ্ব প্রকৃতপক্ষে নিষ্ঠুর , এবং এই নিষ্ঠুরতা, তিনি অনুভব করেছিলেন, এটি একটি একক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য যার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন হতে হবে। আতোর থিয়েটার অবশ্যই দর্শকের অনুভূতিকে চূর্ণ এবং সম্মোহিত করবে।"  ‘সেওয়ানি রিভিউতে’ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ওয়ালেস ফাউলি  নিষ্ঠুরতার থিয়েটারের আরেকটি বর্ণনা দিয়েছেন এবং তা হলো: “এমন নাটকীয় উপস্থাপনা  যার মঞ্চায়নের সময় দর্শক বিস্মিত এবং এমনকি আতঙ্কিত হয় ।সন্ত্রাস বা উন্মত্ততার সেই অভিজ্ঞতার সময়  দর্শকরা সত্যের একটি নতুন বয়ান বোঝার প্রয়াস করেন ।”
    সুসান সোনট্যাগ  লিখেছেন যে আতোর তত্ব এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে 'পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকার সমস্ত সাম্প্রতিক থিয়েটারের কোর্সকে দুটি কালখণ্ডে ভাগ করা যেতে পারে - ‘আতোর আগে এবং আতোর পরে'।
    পাঁচ
    অঁতনা আতোর নিষ্ঠুরতার থিয়েটার তাঁর নিজের জীবন থেকে পাওয়া । তাঁর জীবনের জটিলতাগুলোর মাধ্যমে তিনি দর্শকদের তাদের নিজস্ব জটগুলো খোলার হদিশ দিতে চেষ্টা করেছেন । সারা জীবন একজন কবি, লেখক, নাট্যকার, অভিনেতা, থিয়েটার পরিচালক এবং আরও অনেক কিছু হিসাবে কাজ করেছেন আতো। তিনি আজ বিংশ শতাব্দীর থিয়েটারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে স্বীকৃত।  পরীক্ষামূলক থিয়েটারের এই ধারাটি এমনভাবে সীমানা ঠেলে-ঠেলে এলাকাকে বাড়িয়ে দিয়েছে যা অন্য ধরনের ইউরো-আমেরিকান থিয়েটার করতে পারেনি । আতো দর্শকদের অভিজ্ঞতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। 
    ১৯৩৫ সালে অঁতনা আতো মেক্সিকো যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । তাঁর মনে হয় যে “দেশটার সভ্যতায় ফিরে আসার পক্ষে এক ধরণের গভীর আন্দোলন" এখনও ঘটছে । প্যারিসের মেক্সিকান লিগেশন তাঁকে একটি ভ্রমণ অনুদান দেয় এবং তিনি ১৯৩৬ সালের জানুয়ারিতে মেক্সিকো চলে যান, কিন্তু সেখানে  তিনি এক মাস পরে পৌঁছোন। ১৯৩৬ সালে তিনি তাঁর প্রথম মেক্সিকান-প্যারিসিয়ান বন্ধু, চিত্রশিল্পী ফেদেরিকো ক্যানত্যুর সাথে দেখা করেন। সেই সময়ে ক্যানতু  পশ্চিমা সভ্যতার অবক্ষয় নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। মেক্সিকোয় গিয়ে আতো তারাহুমরান আদিনিবাসিদের বিষয়ে অধ্যয়ন ও তাদের সঙ্গে জীবনযাপন করা আরম্ভ করেন । তিনি তাদের মাদক পিয়োটির আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন । সেই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিলেন ‘ভয়েজ টু দি ল্যাণ্ড অফ দি তারাহুমারা’ যেটা ইংরেজিতে ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দি পিয়োটি ডান্স’ নামে । এই অভিজ্ঞতার বিষয়বস্তু তাঁর পরবর্তী  কবিতাগুলোর সাথে  সাদৃশ্যপূর্ণ, প্রাথমিকভাবে অতিপ্রাকৃতের সাথে সম্পর্কিত। তারাহুমারাদের দেশে প্রবেশের পর আতো হেরোইন থেকে তার ভয়ঙ্কর উইথড্রয়াল সিম্পটম রেকর্ড করেছিলেন। একটি পাহাড়ের ধারে তাঁর মাদকের শেষ সরবরাহ ত্যাগ করার পর, তাঁকে আক্ষরিক অর্থে তার ঘোড়ায় তুলে দিতে  হয়েছিল ।.
    আতোর কাজগুলোতে প্রায়শই পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মাদকের ব্যবহার, রহস্যবাদ এবং আরও নানারকম  থিম রয়েছে।  সারা জীবন  তিনি স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় ভুগেছেন এবং মানসিক হাসপাতালে জীবন কাটিয়েছেন। আতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভয় পাননি এবং যে পর্যায়ে তিনি মেক্সিকোতে তারাহুমরান লোকদের সাথে থাকতে গিয়েছিলেন আর তাদের জীবনযাত্রা থেকে জরুরি নাটকীয় ও সাহিত্যিক সম্পদ আহরণ করতে চাইছিলেন, তখনও তাঁর স্কিৎসোফ্রেনিয়া চাগিয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল।  সেখানে, দক্ষিণ আমেরিকার আদি নিবাসীদের  পিয়োটি আচার-অনুষ্ঠান উৎসবে অংশ নেয়া আর তারাহুমারা ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় এই মাদক ও সংশ্লিষ্ট উৎসব সম্পর্কে লিখেছেন।পিয়োটি হল একটা ছোট, ডাঁটিহীন ক্যাকটাস যাতে সাইকোঅ্যাকটিভ অ্যালকালয়েড, বিশেষ করে মেসকালাইন থাকে। পিয়োটি মেক্সিকো আর দক্ষিণ-পশ্চিম টেক্সাসের স্থানীয় ক্যাকটাস। খাওয়ার ফলে এর সাইকোঅ্যাকটিভ বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত, পিয়োটি অন্তত ৫০০০ বছর ধরে আদিবাসী  আমেরিকানদের দ্বারা সাংস্কৃতিক উৎসবে  এবং ঔষধি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে । 
    ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, শিল্পী এবং কবিরা চিরকালই স্বাভাবিক উপলব্ধি এবং দৈনন্দিন চেতনার বিকল্প অন্বেষণ করেছেন। অ্যালডাস হাক্সলির মতো ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের মেসকালিন ভ্রমণ থেকে শুরু করে উইলিয়াম এস বারোজের দুঃস্বপ্নের সাইকেডেলিক দর্শন পর্যন্ত, হ্যালুসিনোজেন দ্বারা প্রভাবিত লেখকরা দেবতা এবং দানব উভয়ের সাথে পরিচিত হয়েছেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে কবি, শিল্পী, লেখকদের মধ্যে হ্যালুসিনোজেনিক ওষুধের প্রতি আগ্রহের আবির্ভাব কথাসাহিত্যে একটি ক্রমবর্ধমান দূরদর্শী প্রবণতা তুলে ধরে, যা সাহিত্যিক অভিব্যক্তির পূর্ববর্তী রূপগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে । স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো প্রারম্ভিক রোমান্টিক কবিদের জন্য, নেশাগ্রস্ত কবির জীবনযাত্রায় কল্পনার রশ্মিনির্দেশক  হিসাবে লাউডানাম এবং অ্যালকোহল জরুরি মনে করা হতো। পরের প্রজন্মে কবি-শিল্পীরা আকৃষ্ট হলেন রাসায়নিক মাদকে ।
    উইলিয়াম বারোজ এবং পঞ্চাশ ও ষাট দশকের বিট লেখকরা তৃতীয় বিশ্বে তাদের জৈব শেকড় অনুসন্ধান করতে হ্যালুসিনোজেনগুলোকে ড্রয়িংরুমের বাইরে এবং রাস্তায় সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সাইকেডেলিক ল্যান্ডস্কেপ পুনর্বিন্যাস করেছিলেন। ঔপন্যাসিক উইলিয়াম বারোজ  এবং কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ মেক্সিকোতে পিয়োটি এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ইয়েজ গ্রহণ করেছিলেন।  গিন্সবার্গের কবিতা ‘হাউল’-এর কিছু অংশ পিয়োটির প্রভাবে লেখা হয়েছিল। গিন্সবার্গ এলএসডিতে থাকাকালীন একটি কবিতাও লিখেছিলেন যা তাঁকে নৃবিজ্ঞানী গ্রেগরি বেটসন দিয়েছিলেন । জাঁ জেনের মতো অন্যান্য নাট্যকাররাও থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। জেনে ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার যিনি  রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর কাজগুলি প্রায়ই ইচ্ছাকৃতভাবে উত্তেজক ছিল। তিনি অপরাধ, সমকামিতা এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে লিখেছেন।  বেশিরভাগ আলোচক মনে করেন আতোর থিয়েটার দ্বারা সবচেয়ে সফলভাবে প্রভাবিত হয়েছেন জাঁ জেনে ।
    কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ দাবি করেন আতোর কাজ, বিশেষ করে “ঈশ্বরের বিচারকে বাতিল করা বিষয়ক” শ্রূতিনাটক, তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা "হাউল"-এর উপর অসাধারণ প্রভাব ফেলেছিল।তাঁর প্রভাব দেখা যায়: কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’ ( ১৯৪৭) এর ব্যারাল্টের প্রযোজনায় । ১৯৬৮ সালের শীতকালে, উইলিয়ামস কলেজে আতোর প্রতি  উৎসর্গীকৃত ইন্টারসেশন ক্লাস হয়েছিল, যাতে কিথ ফাউলারের নির্দেশনায় সপ্তাহব্যাপী "নিষ্ঠুরতার নাট্য উৎসব" হয়। এই উৎসবে ‘দ্য জেট অফ ব্লাড’, ‘অল রাইটিং ইজ পিগ শিট’, এবং আতোর বেশ কিছু মূল রচনার প্রযোজনা অন্তর্ভুক্ত ছিল ; একটি ‘টেক্সাস টাওয়ার’ হত্যাকাণ্ডের উপর ভিত্তি করে এবং আরেকটি ‘দ্য রেসারেকশন অফ পিগ ম্যান’ নামে  এনসেম্বল ক্যাথারসিস উপস্হাপন করা হয়েছিল। কানাডায়, নাট্যকার গ্যারি বোটিং দ্য এওলিয়ান স্ট্রিংগার থেকে জেন রক ফেস্টিভ্যাল পর্যন্ত ‘আতোনীয়’ কর্মকাণ্ডের একটি সিরিজ তৈরি করেন এবং ‘প্রমিথিউস রি-বাউন্ড’ সহ  আতোনীয় থিম সহ এক ডজন নাটক মঞ্চস্হ করেন। লেখক এবং অভিনেতা টিম ডালগ্লিশ ইংরেজি ফিজিক্যাল থিয়েটার কোম্পানি বেয়ার বোনসের জন্য দ্য লাইফ অ্যান্ড থিয়েটার অফ অঁতনা আতো ( ১৯৯৯ ) নাটকটি লিখেছেন এবং প্রযোজনা করেছেন। নাটকটি আতোর নাট্যকার হয়ে ওঠার প্রথম বছর থেকে আরম্ভ হয়  যখন তিনি প্রতিষ্ঠা পেতে চাইছিলেন এবং  তাঁর শেষ বছরগুলি কতো যন্ত্রণাদায়ক, আইকনোক্লাস্টিক ও বহিরাগত হিসাবে মানসিক চিকিৎসালয়ে কাটিয়েছেন ।
    অঁতনা আতো লিখেছিলেন, “সব লেখাই শুয়োরের গু । যারা অস্পষ্টতা ত্যাগ করে এবং তাদের মাথায় যা সক্রিয় তা সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করে তারা,  শুয়োর । সমগ্র সাহিত্যিক মহল হলো শুয়োরের খোঁয়াড়। বিশেষ করে তারা, যারা তাদের আত্মার মধ্যে সুবিধার গোপন ডেরা বেঁধেছে, আমি বলতে চাইছি, তাদের মাথার কোনও না কোনও অংশে আর  কঠোরভাবে  মস্তিষ্কের নির্ধারিত  এলাকায় । তারা ভাবে তারা তাদের ভাষার অভিভাবক; যাদের জন্য শব্দের অর্থ আছে । আমি তাদের সুনির্দিষ্ট কাজের কথা ভাবছি, সেই স্বয়ংক্রিয় নাকালের কথা যা তাদের আত্মাকে বাতাএ উড়িয়ে দেয় - তারা শুয়োর।”
    দার্শনিকদের ওপরও আতোর উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখা যায় । আতো লিখেছিলেন, “আপনি যখন মাংনুষকে অঙ্গবিহীন একটি শরীরে পরিণত করবেন, তখন আপনি তাকে তার সমস্ত স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তি দেবেন এবং তাকে তার প্রকৃত স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবেন।”  জিলে দেল্যুজ এবং ফেলিক্স গুয়াত্তারি , আতোর  "অঙ্গ ছাড়া শরীর" শব্দবন্ধ  নিয়েছিলেন তাঁদের শরীরের ভার্চুয়াল মাত্রা এবং  পুঁজিবাদ এবং স্কিৎসোফ্রেনিয়ার বাস্তবতার মৌলিক স্তরের ধারণা বর্ণনা করার জন্য। দার্শনিক জ্যাক দেরিদা আতোর কাজের অবদান ‘প্রধান দার্শনিক চিকিৎসা’ বর্ণনা করেছেন তাঁর "প্যারোল সোফেলি" ধারণার মাধ্যমে। নারীবাদী দার্শনিক জুলিয়া ক্রিস্তেভা আতোর  "প্রক্রিয়ায় বিষয়" নিয়ে আলোচনা করেছেন।
    ছয়
    ১৯২৩ সালে, আতো তাঁর কয়েকটা কবিতা ‘লা নুভেল রেভিউ ফ্রান্সেইজি’ জার্নালে পাঠিয়েছিলেন। সেগুলো প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, কিন্তু আতোর কবিতা এনআরএফ-এর সম্পাদক জ্যাক রিভিয়েরকে কৌতুহলী করেছিল, আর তিনি আতোকে ডেকে পাঠান। পোস্টের মাধ্যমে দেখা করার পর তারা তাদের সম্পর্ক চালিয়ে যান। এই চিঠিগুলির সংকলন একটি গুরুত্বোপূর্ণ কাজ ছিল । আতোর প্রথম প্রধান প্রকাশনা। আতো এনআরএফ-এ তাঁর আরও রচনা প্রকাশ করতে থাকেন, যার মধ্যে রয়েছে "ফার্স্ট ম্যানিফেস্টো ফর এ থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি" ( ১৯৩২ ) এবং "থিয়েটার অ্যান্ড দ্য প্লেগ" ( ১৯৩৩ )। দ্য থিয়েটার অ্যান্ড ইটস ডাবলকে একত্রিত করার সময় তিনি এই প্রকাশনাগুলি তাতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন । আতো লিখেছেন, "কবিতা একটি বিচ্ছিন্ন এবং নৈরাজ্যিক শক্তি যা উপমা, সংসর্গ এবং চিত্রকল্পের মাধ্যমে পরিচিত সম্পর্কগুলোকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।"
    শিল্পীর মানসিক অসুস্থতার জন্য অনেক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময় আতোর সৃজনশীল ক্ষমতাগুলো আংশিকভাবে থেরাপির উপায় হিসাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এডোয়ার্ড টুলুজের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলাকালীন, আতোকে কবিতায় নিজেকে প্রকাশ করতে উৎসাহিত করা হয়, যা টুলুস পরে ‘জার্নালে ডেমেন’-এ প্রকাশ করেন। আতোর জীবন এবং তাঁর কাজ, সাইকোথেরাপির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, তাঁর মানসিক যন্ত্রণাকে প্রতিফলিত করেছে এবং মাদকদ্রব্যের উপর তাঁর নির্ভরতার কারণে তা আরও জটিল হয়েছিল। মাঝে মাঝে তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রকাশ করতেন ; অন্য সময় তিনি চার্চের নিন্দা করতেন এবং নিজেকে দেবতায় উত্তীর্ণ করেছেন। তিনি মানবদেহের প্রতিও আচ্ছন্ন ছিলেন; তিনি যৌনতার ধারণাকে ঘৃণা করতেন এবং নিজের যৌন প্রতিস্ব থেকে নিজেকে আলাদা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
    ‘অঁতনা আতো : ম্যান অফ ভিশান’ গ্রন্থে, লেখক বেটিনা এল. ন্যাপ তাত্বিক হিসাবে আতোর মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে লিখেছেন: “আতো জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে অক্ষম ছিলেন; তিনি অন্যদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারতেন না; এমনকি তিনি তাঁর নিজের পরিচয় সম্পর্কেও নিশ্চিত ছিলেন না।” ন্যাপ মন্তব্য করেছেন যে "আতো মূলত তাঁর অসুস্থতার চারপাশে একটি সম্পূর্ণ আধিভৌতিক প্রণালী গড়ে নিয়ে ছিলেন, বা, বলা যায়,, তাঁর নিজের রোগের মাধ্যমে রহস্যবাদীর রাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তিনি নিজে  এবং সবকিছুই তাঁর অস্তিত্ব থেকে বাহ্যিকভাবে বিকিরিত হতো ।" আতোর ‘দি আমবিলিকাস অফ লিমবো’-র কথা উল্লেখ করে, ন্যাপ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আতো দর্শক-শ্রোতা-পাঠকদেরও  "'ডিরেঞ্জড ম্যান' তৈরি করতে চেয়েছেন, মানুষকে এমন একটি যাত্রায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন 'যেখানে তারা যেতে কখনই সম্মত হবেন না।'" তিনি আরও ব্যাখ্যা করেছেন, "যেহেতু নাটকীয় শিল্প সম্পর্কে আতোর ধারণা ছিল যে সেগুলো তাঁর অসুস্থতাসঞ্জাত,  তিনি থিয়েটারকে  নিরাময়কারী ওষুধ হিসাবে দেখেছিলেন। এমন একটা উপায় যার মাধ্যমে মানুষ থিয়েটারে এসে ছিন্নভিন্ন, বিভক্ত এবং কেটে খুলে ফেলার জন্য রাজি,  তারপরে তার নিরাময় করা যেতে পারে।" ন্যাপ তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে আতোর জনপ্রিয়তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন: “তাঁর সময়ে, তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি নিজের  সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, নিজের মধ্যে বিভক্ত, তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে তাঁর অভ্যন্তরীণ জগত এবং বাইরের শক্তির শিকার। তাঁর কল্পনার জোয়ারের শক্তি এবং তাঁর থেরাপিউটিক অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করা হয়েছিল এবং একজন পাগলের উন্মাদনা হিসাবে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিষ্ঠান তাঁকে একপাশে সরিে দিয়েছিলছিল।বর্তমান কালখণ্ডের মানুষ  আতোর রচনা, ভাবনা, আঁকায় সাড়া দিতে পারে কারণ তারা অনেক মনস্তাত্ত্বিক মিল খুঁজে পায় এবং সখ্যতা ভাগ করে নেয়।"
    সানচে ডি গ্রামন্ট ‘হরাইজন’ পত্রিকার  প্রবন্ধে আতো সম্পর্কে লিখেছেন, "যদি আতো পাগল ছিলেন, তবে আতো নিজের পাগলামিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর কাছে যুক্তিবাদী জগত সন্দেহজনক  ছিল; তিনি হ্যালুসিনেশনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন যা যুক্তিকে বিলুপ্ত করে এবং তার বিচ্ছিন্নতার মর্মার্থ তৈরি করে। আতো ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে সেই সীমার বাইরে রেখেছিলেন যেখানে বিচক্ষণতা এবং উন্মাদনার বিরোধিতা করা যেতে পারে, এবং নিজেকে জাদু এবং অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি ব্যক্তিগত জগতের কাছে আত্মসমর্পণ করা যেতে পারে।"
    আতো তাঁর শেষ এগারো বছরের মধ্যে নয়টি মানসিক চিকিৎসালয়ে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন কিন্তু জীবনীকার সুসান সন্টাগের মতে, তাঁর জীবনের শেষ তিন বছরে তাঁর কিছু সেরা কবিতা  লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন: “এই সময়ের মধ্যে আতোর  লেখার দুর্দান্ত বিস্ফোরণ পর্যন্ত হয়। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮ এর সময়টায়. আতো কবিতাকে ‘বদ্ধ লিরিক বিবৃতি’ হিসাবে  ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন এবং কবিতায় একটি দীর্ঘশ্বাসের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছিলেন যা তাঁর কল্পনাপ্রসূত প্রয়োজনের পরিসরের জন্য পর্যাপ্ত ছিল। এমন একটি কণ্ঠস্বর যা প্রতিষ্ঠিত ফর্ম থেকে মুক্ত এবং যার সমাপ্তিও ছিল মুক্ত, এজরা পাউন্ডের কবিতার মতো।" যাইহোক, সোনটাগ, অন্যান্য জীবনীকার এবং পর্যালোচকরা একমত যে আতোর সামগ্রিক ও প্রগাঢ় প্রভাব ছিল থিয়েটারে। ১৯২০-১৯২৬ সালের অঁতনা আতোর  প্রারম্ভিক চিঠি, প্রবন্ধ, উক্তি, নাটক; এবং অন্যান্য লেখাগুলি পড়লে একটি অভ্যাস, বৈশিষ্ট্য এবং আবেশ প্রকাশ করে যা তাঁর নিজস্ব। প্রধান জীবনীকার এবং সমালোচকরা পর্যাপ্তভাবে ব্যাখ্যা করেননি, যেমন, তাঁর আফিম খাওয়া; তাঁর স্বনির্বাচিত একাকীত্ব; এবং তাঁর চরম উদ্ভাবনের সময়কাল, "অসাড়তা ছড়ানো" এবং মানসিক শূন্যতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি।  তাঁর সুপরিচিত "লেটারস টু রিভিয়ের" এর আগে, তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, তিনি কখনই "সম্পূর্ণভাবে" তাঁর মনকে দখল করতে পারেননি  ( ১৯২১ ) এবং তিনি প্রশ্ন করেছিলেন যে তার কবিতাগুলি "প্রকৃত এগারোটি মনের স্হিতি" ( ১৯২২ ) প্রকাশ করেছে কিনা।
    "লেটারস টু রিভিয়ার"-এ আতো বলেছিলেন  যে চিন্তাভাবনা এবং ভাষার সাথে তাঁর সমস্যাগুলি "মনের ভয়ঙ্কর  রোগ" থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, কিন্তু রিভিয়ার এবং পরবর্তী সমালোচকরা  তাঁর রচনা বিশ্লেষণের অন্যান্য ব্যাখ্যার পরামর্শ দিয়েছেন: শারীরিক বা রূপক অসুস্থতা, এবং বিস্তৃত তাত্ত্বিক কাঠামো যা আতোকে একটি সারিতে বসায় । ধর্মনিরপেক্ষ রহস্যবাদী, দূরদর্শী বিদ্রোহী বা "শুদ্ধ" চেতনার শিষ্যের মতো ভূমিকা ইত্যাদি ব্যাখ্যাগুলির কোনটাই বলতে পারে না কেন তিনি এত অসহায় বোধ করতেন।আতোর সমস্যা এবং একক অভিজ্ঞতার সর্বোত্তম ব্যাখ্যা সিজোফ্রেনিয়া রোগে খোঁজার চেষ্টা  হয়। 
    আগেই জানিয়েছি, অঁতনা আতো ষোলো বছর বয়সে তাঁর প্রথম বিষণ্নতাজনিত ভারসাম্যহীনতার শিকার হন; একুশ বছর বয়সে, তাঁর বংশগত সিফিলিস ধরা পড়ে। ১৯২০ থেকলে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত তাঁর বেশিরভাগ কাজ, যা প্রচলিত ইইউরোপীয় মতামতের বিপরীতে লিখেছিলেন , আবেশ তাড়িত আত্মজীবনীমূলক, “মন" এবং "মাংস"-র সার্বজনীন সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা না করে তাদের ভেতরে তাঁর  ক্রমাগত ক্রমবর্ধমান স্কিৎসোফ্রেনিক বিভাজন থেকে চাগিয়ে ওঠা একক সমস্যা এবং উদ্বেগগুলি প্রকাশ করার চেষ্টা করেছে।  আম্বিলিক্যাল লিম্বো, (নার্ভ স্কেলস, দ্য সিচুয়েশন অফ দ্য ফ্লেশ, ক্লিয়ার ল্যাঙ্গুয়েজে ম্যানিফেস্টো, হেলয়েস এবং অ্যাবেলার্ড এবং নরকে একটি ডায়েরি থেকে টুকরো টাকরা) রচনাগুলো ছাড়াও তাঁর প্রধান প্রবন্ধগুলো একটা গভীর স্কিৎসোফ্রেনিক সংকটের প্রকৃতি এবং প্রভাবগুলি বর্ণনা করেছে  যার অভিজ্ঞতা ১৯২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর হয়েছিল। এই কাজগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর তিক্ততা, সাধারণ পাঠকের কথা ভেবে যা কবি-লেখকরা এড়িয়ে চলেন। তাঁর সমসাময়িক লেখক-আলোচকদের কাছে নিজেকে সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে, যার মধ্যে স্পষ্টতই, পরাবাস্তববাদীরা ছিল, তিনি আলাদা হয়ে যেতে থাকেন সমগ্র পাঠক সমাজ থেকে। 
    অঁতনা আতোর জন্য, অন্ধকারে নিমজ্জন ছিল অন্ধকারকে কাটিয়ে ওঠা। আনাইস নিন জানিয়েছেন, একবার  প্যারিসের এক উজ্জ্বল রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে আতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে পথচারীদেরকে তাদের অভ্যন্তরীণ অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে উৎসাহিত করছিলেন । আতোর দৃষ্টিতে, শরীর এবং মন ছিল অবিচ্ছেদ্য, এবং যা একই যন্ত্র হিসাবে কাজ করে। চিকিৎসালয়ে তিনি ইলেকট্রিক শকে ক্ষুব্ধ,  মেজাজহীন, আপাতদৃষ্টিতে নানা রকমের আত্মপ্রশ্নে জর্জরিত, তবুও সর্বদা অধ্যবসায়ে একাগ্র ছিলেন। মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছেন জেনেও নিজেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেননি।অনেক সময়ে তিনি  একজন প্রতারক ঈশ্বরকে উৎখাত করতে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন । 
    সাহিত্যের সেবক  হিসেবে মার্কামারা লেখক হওয়াকে আতো ঘৃণা করতেন। এটি লেখক হতে জানতেন। ১৯৪৭  সালের আন্তর্জাতিক পরাবাস্তববাদী প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য ব্রেটনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করার পর তিনি আঁদ্রে ব্রেতঁকে বলেছিলেন "আমার জন্ম, জীবন, মৃত্যু, বাস্তবতা এবং ভাগ্য সম্পর্কে নিজস্ব ধারণা আছে, এবং আমি এমন কোনো সাধারণ ধারণায় অংশগ্রহণ করি না যার মাধ্যমে আমি নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো মানুষের সাথে থাকতে পারি।" তিনি আরও বলেছিলেন যে তিনি "পৃথিবীর সমস্ত জাদুকর এবং সূচনাকারীদের সমস্ত সম্প্রদায়ের সাথে প্রতি রাতে এবং দিনে প্রকাশ্য সংগ্রামে যুঝে চলেছেন।"

    সাত
    বহু ক্ষেত্রে আতোর কাজ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অন্তর্নিহিত, তবে এটি সংজ্ঞায়িত করা সহজ নয়। সর্বোপরি, তাঁর লেখা আর আঁকা যেন হতাশার স্মৃতিময়, ভাষার অপ্রতুলতার প্রতিবাদের একটি দীর্ঘ আর্তনাদ, মানবসমাজ, দেহ ও মনে। আতো ছিলেন এমন একজন বিপ্লবী যিনি চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করে দেয় এমন সীমাবদ্ধতা উৎখাতের জন্য লড়াই করে গেছেন। যেন  তাঁর উপলব্ধির প্রান্তে  আধ্যাত্মিক সারাংশের উপচ্ছায়া গড়ে তুলতে পেরেছেলেন এবং তাকে দখল করতে তাঁর অক্ষমতার ফলে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত কাজকে "নথিপত্র" হিসাবে বর্ণনা করেছেন—-অর্থাৎ, কবিতা, প্রবন্ধ, বিতর্ক, নাটক ইত্যাদি "শিল্প" নয়, কিন্তু সত্যের অধরা স্তরে পৌঁছানোর জন্য তাঁর ক্ষীণ প্রচেষ্টার নথি মাত্র। মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট-এর প্রদর্শনীতে থাকা তাঁর আঁকা ড্রইঙগুলোকে তিনি একইভাবে "নথিপত্র"-র তকমা দিয়েছেন৷ প্রায় সত্তরটা আইটেম রয়েছে—তাঁর জীবনের শেষ দশকের ড্রইঙ (তিনি ১৯৪৮ সালে মারা যান), পেইনটারদের কাছে তেমন সুপরিচিত নয় । তারা একক এবং শক্তিশালী কাজ। আতো তাঁর লেখালিখি আর আঁকাকে কখনও "ক্যারিয়ার" এর পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করেননি ।
    আতো ১৯৪৪ সালের দিকে আন্তরিকভাবে আঁকতে শুরু করেছিলেন। ১৯৪৫ সাল নাগাদ, তিনি হায়ারোগ্লিফিক্স নামে একটি বড় ছক তৈরি করছিলেন: মানুষের চিত্র, প্রতীকী বস্তু এবং শব্দের ক্ষেত্র, যার মধ্যে অনেকগুলি তাঁর উদ্ভাবিত ভাষায়। রঙের ইঙ্গিতসহ  পেন্সিলের এই ড্রইঙগুলোর মধ্যে কয়েকটাতে  চিত্রগত গুণ রয়েছে যা অত্যন্ত  উদ্দীপক বলে মনে করেন শিল্প আলোচকরা । প্রকৃতপক্ষে, প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন, কেউ কেউ এগুলোকে বাতিক হিসাবে ভুল করতে পারে। একাধিক স্তন, বিভিন্ন যৌনাঙ্গ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দালির পেনিস-অন-ক্র্যাচের প্রভাব আছে । ক্রাচ হল সালভাদর দালির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি এবং তাঁর অনেক কাজে এর উপস্হিতি পাওবঅ ড়অব। এটি প্রথম এবং সর্বাগ্রে বাস্তবতার প্রতীক এবং বাস্তব জগতের মাটিতে একটি নোঙ্গর, জীবনের অপ্রতুলতার জন্য আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক সমর্থন প্রদান করে। ক্রাচ ঐতিহ্যের প্রতীক, অপরিহার্য মানবিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখে ।
    ১৯৪৬ সালে, অঁতনা আতোর পেন্সিলের কাজ  আরও জোরালো হয়ে ওঠে, রঙগুলি আরও দৃঢ়, দুঃস্বপ্নের দিকগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। ‘দ্য থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি’ শিরোনামের একটি কাজে,  কাঁচের কফিনে ১৯৪৬ সালের মে মাসে, তিনি তাঁর প্রথম আত্মপ্রতিকৃতি তৈরি করেছিলেন। এতে এত বেশি আঁচড় দেয়া হয়েছে যে এটা দেখতে প্রায় ভাস্কর্যের মতো, এবং  বিন্দু দিয়ে আচ্ছাদিত যা দেখতে গুটিবসন্তের মতো —- ক্যাটালগের একটি প্রবন্ধ ফ্রয়েডকে উদ্ধৃত করেছে, জিলে ডেলিউজের কথায়, "পৃষ্ঠ এবং ত্বককে অনুধাবন করার জন্য স্কিৎসোফ্রেনিক যোগ্যতার উপর অসীম সংখ্যক ছোট গর্ত দিয়ে বিদ্ধ করা হয়েছিল। একই সময়ে তৈরি একটি নীল মাথা আরও ভয়ঙ্কর, যেন চিৎকারে ধরা পড়ে, সমস্ত রোগাক্রান্ত বিন্দু দিয়ে আবৃত, চোখ এবং  গলা। এটা, নরক  থেকে বাড়িয়ে দেয়া একটা মুখ.।
    ১৯৪৭ সালে, আতো রোডেজের মানসিক হাসপাতাল থেকে আইভরি-সুর-সেইনের একটি বাসায় চলে যান, যেখানে তিনি বেশি সক্রিয় ছিলেন আর  তিনি লোকজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তেমন অস্বস্তি বোধ করতেন না । এখানে তিনি আঁকেন, অনুপ্রবেশকারী এবং বেশ বৈচিত্র্যময় প্রতিকৃতিগুলির একটি সিরিজ। উদাহরণস্বরূপ, রোলাঁ প্রেভেলকে প্রায় ম্যাটিস ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়েছে, কোলেট থমাসকে এমন সূক্ষ্ম করা হয়েছে যা কোমলতার সমান, যখন জ্যাক প্রেভেরকে মনে হয় দুই ভাগে করাত দিয়ে কাটা  হয়েছে আর আবার সেলাই করা হয়েছে, ম্যানিয়া ওইফার একটি পেঁচায় পরিণত হয়েছে, আর্থার অ্যাডামভের  নাক আর লিঙ্গ জায়গা বদল করেছে।ছবিগুলো সম্পর্কে আতো বলেছেন, "আপনি অবশ্যই ড্রইঙগুলো দেখুন এবং ভিতরে কী আছে তা বোঝার চেষ্টা করুন।" তিনি আরও লিখেছেন যে "মানুষের মুখ একটি শূন্য শক্তি, মৃত্যুর একটি ক্ষেত্র" এবং রূপ এবং বিষয়বস্তুর প্রান্তিককরণ মুখের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের তলায় যা রয়েছে তার মধ্যে বৈসাদৃশ্যের বেশি দূরে নেই। তাঁর প্রতিকৃতিগুলি এতটাই আপসহীন যে তারা পিকাসো বা জিয়াকোমেত্তির চেহারাকে ভদ্র করে তোলে।
    আতো মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হতে পারেন, কিন্তু তাঁর শিল্প  উন্মাদনায় আক্রান্ত নয় । পোর্ট্রেট, যেখানে তিনি বিকৃতি এবং কাগজ ছিঁড়ে যাওয়া শারীরিক শক্তির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ প্রতিনিধিত্ব করার সময় বাহ্যিক বাস্তবতাকে চিত্রিত করার জন্য শান্ত পর্যবেক্ষণ এবং একাডেমিক দক্ষতা ব্যবহার করেছিলেন, উদাহরণস্বরূপ, তার দর্শনের অনেক আকর্ষণীয় বিজ্ঞান-কাল্পনিক প্রকাশগুলোর চেয়ে বেশি সমস্যাজনক। তাঁর কাজকে ব্লেক বা হোল্ডারলিনের তুলনায় "বহিরাগত শিল্প" ধরণের তকমা পরানো যায় না । আতোর শিল্প ছলনাময়। আমরা যা দেখি তার ভেতরে অনুপ্রবেশ বেশ  তীব্র আঘাত সৃষ্টি করে। ছবিগুলোর স্পষ্টতা তাদের বিভ্রম গড়ে তোলার ক্ষমতায়। আতো বলেছেন, “দেহের এইসব কাটা, এই জখম, এই ফাটল, এই আকস্মিক এবং অতল ঝরনার স্মৃতি ঠিক করা এবং স্থায়ী করা ছাড়া আমি কখনও অন্য কারণে লিখিনি।”
    আতোর জীবনের সংক্ষিপ্ত শেষ পর্ব  ১৯৪৬  সালে প্যারিসে ফিরে আসা থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ফরাসী মানসিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে নয় বছর কারাভোগ করার পর থেকে আতোর সবচেয়ে অসাধারণ কাজ হলো তাঁর কবিতা ।  ব্ল্যাক হিউমারের সাহায্যে, আতো তাঁর নিজের মর্যাদাকে তিরস্কার করেছেন। মার্সেই-তে জন্ম নেওয়া বোকাশিশু অর্থাৎ "মোমো" ( তাঁর নিজের নামকরণ )  তাঁর আত্মপরীক্ষাকে আলোকিত করে। আতোর “মোমো” চরম ধর্মহীন অশ্লীলতা এবং তার তাৎক্ষণিক শারীরিক উপলব্ধি এবং তার একাকীত্বের অনুভূতির সূক্ষ্ম উদ্ভবের মধ্যে চলে যায়। বইটির পাঁচ-অংশের ক্রমটি শেষ হয় আতোর মনস্তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠানের  নিন্দার মাধ্যমে । আতো দ্য মোমো, ভিচি ফ্রান্সের অধীনে রোদেজের একটি স্যানিটোরিয়ামে থাকার সময় তার  শেষ লেখা। এই সময়ে, তিনি ইলেক্ট্রোশকের সম্মুখীন হন, এবং নিজস্ব নরকের ডাবল মোমোর সাথে যুদ্ধ করেন।
    ‘আতো দ্য মোমো’ একটি ভয়ঙ্কর কাব্য সংকলন। এর ভাষা সমসাময়িক মান অনুযায়ী হিংসাত্মক এবং পর্নোগ্রাফিক। মোমোর  যন্ত্রণাদায়ক এবং পৌরাণিক ব্যক্তিত্ব। বিষয়বস্তুতে দ্য মোমোর প্রধান ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আতো তাঁর সুস্থতার সময়ে তৈরি করেছিলেন। এতে গ্লোসোলালিয়া ( বিশেষ করে ধর্মীয় উপাসনায় একটি অজানা ভাষায় কথা বলার আপাতদৃষ্টিতে ঘটনা ; এটা বিশেষ করে পেন্টেকস্টাল এবং ক্যারিশম্যাটিক খ্রিস্টানদের দ্বারা অনুশীলন করা হয় ।) , কাল্পনিক হারমেটিক ( দুর্বোদ্ধ ভাষা )  এবং স্ক্যাটালজিকাল ( মলত্যাগ বিষয়ক ) শব্দের খেলা রয়েছে। ‘আতো দ্য মোমো’-র প্রধান আকর্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে নিজের অঙ্গ, এবং পৌরাণিক ঐতিহ্যের মধ্যে সৃষ্টির ভূমিকা । আতোর কবিতাগুলো মাংস ও মলমূত্রকে মহিমান্বিত করে, কিন্তু যৌনতা তাঁর জন্য ছিল সর্বদাই ত্যাজ্য। অজাচার, নরমাংস খাওয়া এবং আত্মহত্যা কবিতার স্বাভাবিক প্ররোচনা, যা সভ্য পশ্চিমা মানুষের দ্বারা নিশ্চিহ্ণ করে দেয়া উপজাতীয় সংস্কৃতির কার্যকলাপ দ্বারা প্রমাণিত । সভ্যতা এতটাই ক্ষতিকর  যে ইউরোপ মেক্সিকোর মতো একসময়ের গর্বিত উপজাতীয় দেশগুলিকে অবক্ষয় এবং মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে গেছে, মাংসের পবিত্রতাকে পৃথক করে ঈশ্বরের মন্দ দিয়ে বিষাক্ত করেছিল ইউরোপ। অনিবার্য শেষ পরিণতি হবে আত্ম-ধ্বংস এবং মানসিক দাসত্ব,  যে দুটি মন্দ তাঁর নিজের জীবনে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ও কারাবাস ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। এইভাবে তিনি রাজনীতি এবং মার্কসবাদকে সর্বান্তকরণে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যার ফলে পরাবাস্তববাদীরা তাকে বহিষ্কার করেছিল। 
    আতো শিল্পের অসম্ভবতা উপস্থাপন করেন। তাঁর অস্বাভাবিক নকল, দ্য মোমোর সাথে তাঁর টানাপোড়েন সম্পর্কটাকে  দৈহিক এবং আধিভৌতিক এবং মূলত চিন্তাভাবনা, অভিজ্ঞতা এবং মানসিক অসুস্থতার চারপাশে পরস্পরবিরোধী সত্যকে তুলে ধরে। তিনি দেখান সাইকোথেরাপি এবং ফার্মাকোলজির দ্বৈতবাদের বাইরেও একটি জগত রয়েছে। কিন্তু তা দেহের অনিবার্যতার সত্য, আমাদের দেহের অনিবার্য ভাঙ্গন, তিক্ততা দূর করে না। যেহেতু স্কিৎসোফ্রেনিয়ার আধিভৌতিক দিকগুলির বিষয়ে কোনও ঐক্যমত হতে পারে না, তাই আভাঁ গার্দ ধারাবাহিকভাবে "পাগলামি"কে  গুরুত্ব দিয়েছে, যেমন ঘটেছে সালভাদর দালি, ফ্রিদা কাহলো, পিকাসোর পেইনটিঙের ক্ষেত্রে। 
    আট
    ‘আতো দ্য মোমো’ থেকে একটা অংশের অনুবাদ এখানে দিচ্ছি যাতে পাঠক অঁতনা আতোর কাব্যকৃতির সঙ্গে পরিচিত হন 
    মাটির সাথে মিশে যাওয়া গলিত শবের চাকা লাগানো জমিতে,
    গলিত শবের  শ্বাসপ্রশ্বাসের জমিতে
    এই শূন্যতার,
    শক্ত এবং নরমের মধ্যে।
    .
    কালো, বেগুনি,
    অনমনীয়
    বিনোদনমূলক
    এবং এটাই সবকিছু।.
    .
    যার মানে হলো একটা হাড় রয়েছে,
    কোথায়
    সৃষ্টিকর্তা
    বসলেন  কবির ওপর,
    তার বাক্যগুলোর
    গ্রাহীক্ষমতা মুছে ফেলার  জন্য
    যেন মগজটা পাদছে
    যে সে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তার ভোদার ভেতর থেকে বের করে আনে,
    যে সে তার ভেতর থেকে বের করে আনবে
    যুগের তলানি থেকে,
    তার ভোদার  গর্ত পর্যন্ত,
    আর  এটা ভোদা সম্পর্কে কোনো কৌতুক নয়
    যে সে তার উপর এভাবেই খেলতে থাকে,
    এটা সমগ্র পৃথিবীর কৌতুক
    যার অণ্ড আছে
    তার পুরুষালি ভোদার ভেতরে
    আর যদি আপনি ছবিটা বুঝতে  না পারেন,
    --আর সেই কথাই  আমি আপনাকে  বলতে শুনছি
    বৃত্তের মধ্যে,
    যে আপনি ছবিটা টের পাবেন না
    যা একেবারে তলার দিকে
    আমার ভোদার গর্তে,--
    তার কারণ আপনি অতলের কথা জানেন না,
    জিনিসপত্রের নয়,
    তা আমার ভোদার,
    আমার,
    যদিও যুগের তলানি থেকে
    আপনারা সবাই  সেখানে গোল-চক্কোর মেরে জিভ দিয়ে চাটছেন
    যেন একজন পরকীয়াকে গালাগাল দিচ্ছেন,
    বন্দী করে মৃত্যুদণ্ডের ষড়যন্ত্র কষছেন।
    গে রে ঘি
    রেগহেঘি
    গেঘেনা
    এ রেঘেনা
    আ গেঘা
    রিরি
    পোঁদ আর শার্টের মধ্যে,
    বীর্য আর জুয়ায় কম বাজির  মধ্যে,
    সদস্য আর হেরো লোকের মধ্যে,
    ঝিল্লি আর ব্লেডের মধ্যে,
    নরুন এবং ছাদের মধ্যে,
    শুক্রাণু এবং বিস্ফোরণের মধ্যে,
    'মাছের কাঁটা আর এবং 'শিকনির  মাঝে

    পোঁদ এবং প্রত্যেকের মধ্যে
    খিঁচুনি
    চেপে দেবার ফাঁদ
    একটা বীর্যপাত মৃত্যুর হইচই
    একটা বিন্দু নয়
    বা একটা পাথরও নয়
    আবদ্ধ এলাকায় মরে  ফেটে যাওয়া
    বা আত্মার বিচ্ছিন্ন অংশও নয়
    (আত্মা জিনিসটা পুরানো করাত ছাড়া আর কিছুই নয়)
    বিচ্ছিন্নতার শ্বাসের
    কিন্তু ভয়াবহ কালহরণ
    ধর্ষিত, ডানা-ছাটা, পুরোপুরি চুষে ফেলা
    সমস্ত অস্বচ্ছল ক্যারদানি করে
    গুমাখা লোকগুলোর
    বেঁচে থাকার জন্য
    যাদের খাবার মতন আর কোনো খোরাক ছিল না
    আতোকে
    গিলে ফেলা ছাড়া
    মোমো
    আমার তুলনায়
    সেখানে, যেখানে একজন তাড়তাড়ি সঙ্গম সেরে ফেলতে পারে
    আমার চেয়ে
    দ্রুত ঠাটিয়ে তুলতে পারে
    আমার অভ্যন্তরে
    যদি সে তার মাথা রাখার যত্ন নিয়েছে
    সেই হাড়ের বাঁকের ওপরে
    যা মলদ্বার আর লিঙ্গের মাঝে থাকে,
    যে কোদাল হাড়ের কথা আমি বলছি
    একটা স্বর্গের 
    আঁস্তাকুড়ের মধ্যে
    পৃথিবীতে যার প্রথম প্রতারণা
    বাবা বা মা ছিল না কেউ
    কে তোমাকে এই গুহায় এনে ফেলেছে,
    কিন্তু
    আমি
    আমার উন্মাদনায় জড়িয়ে গেছি।"
    ওরা এটারই  অনুশীলন করে।
    যদি কোনো ডাক্তার না থাকত
    তাহলে কোথাও কখনো রোগী হত না,
    রোগাক্রান্ত কঙ্কালদের
    মেরে ফেলে কাটাছেঁড়া আর চামড়া ছাড়াবার জন্য,
    কেননা সমাজ আরম্ভ হয়েছে ডাক্তারদের মাধ্যমে 
    রোগীদের মাধ্যমে নয়।
    যারা বেঁচে থাকে, তারা মৃতদের জিনিসপত্র খেয়ে বাঁচে।
    আর এর জন্য জরুরি যে একইভাবে মৃত্যুও বেঁচে থাকুক;
    আর উন্মাদ আশ্রমের মতন কিছুই নেই যা শান্তভাবে পালন করবে
    মৃত্যুকে , এবং মৃত মানুষদের  ইনকিউবেটরে পুরে রাখবে।
    নয়
    ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য অঁতনা আতো ধ্বংসাত্মক নন, তিনি জানতেন তিনি মরণশীল, তাই দগ্ধ করার ভাষায় লিখে গেছেন, ধূমায়িত রেডিয়াম মাছের ধোঁয়ার মতো। এই দৃষ্টান্তে রেডিয়াম, ওপর থেকে চাপানো ঝামেলা হিসাবে নয়, শক্তি হিসাবে,  যা মানুষের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা থেকে উদ্গত হয়। যদিও প্রায় ক্রমাগত শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে – তিনি যখন পাঁচ বছর বয়সে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এবং মাথাব্যথা তাঁর বাকি জীবন ধরে চলতে থাকে—-এবং মানসিক যন্ত্রণা, তিনি একচল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে কাজ করেছিলেন, যখন বেশ কয়েকটি মানসিক ঘটনা তাঁকে বিপর্যস্ত করেছিল, বিশেষ করে মানসিক হাসপাতালে বন্দী করা, যাকে   "অনিরাময় প্যারানয়েড প্রলাপ" হিসাবে বর্ণনা করা হয়,  তাতে ভুগেছিলেন এবং সেই আশ্রয় ছেড়েছিলেন কেবল অন্য আরেকটিতে প্রবেশ করার জন্য। সব মিলিয়ে, তিনি  বাহান্ন বছরের মধ্যে প্রায় পনেরোটি এক বা অন্য ধরণের চিকিৎসালয়ে বন্দীর জীবন কাটিয়েছেন ।
    মানসিক ভারসাম্যহীনতা আর চিকিৎসালয়ের বন্দীজীবন সত্ত্বেও আতো যথেষ্ট লেখালিখি করতে পেরেছিলেন। তাঁর  লেখাগুলো ফরাসি সংস্করণে ২৬টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একজন অভিনেতা হিসাবে প্রশিক্ষিত ছিলেন, এবং ফিল্ম পরিচালনা করেছিলেন, নিজের অভিনয়-মঞ্চ খুঁজে পেয়েছিলেন এবং দ্য থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি হিসাবে সংগৃহীত দূরদর্শী তাত্ত্বিক প্রবন্ধগুলির একটি সেট লিখেছিলেন, যা আজও নাট্য অনুশীলনকারীদের প্রভাবিত করে চলেছে। তিনি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন । বহুমুখী প্রতিভা বলতে যা বোঝায় তাই ছিলেন তিনি ।  তিনি পরাবাস্তববাদীদের একজন প্রাথমিক সদস্য এবং গোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় গবেষণা ব্যুরোর পরিচালক ছিলেন। দুই বছর পর আঁদ্রে ব্রেতঁ  তাঁকে গোষ্ঠী থেকে বের করে দেন–-প্রায় সকল সদস্যকে তাড়াতাড়ি বা পরে বহিষ্কার করা হয়েছিল—-কিন্তু ব্রেতঁ পরে অনুতপ্ত হয়েছিলেন, আতোকে একজন "উদ্ভাবনী মানুষ" এবং “সম্ভবত সবার মধ্যে সত্যিকারের পরাবাস্তববাদী” বলে অভিহিত করেছিলেন।
    অভিব্যক্তির অন্তর্নিহিত স্তর  আতোর জন্য প্রাথমিক ছিল আর শিল্পীর গভীর, অত্যাবশ্যক চরিত্রের যোগাযোগের জন্য প্রযুক্তিগত নির্বাহ ছিল গৌণ। তাঁর পরবর্তী কাজগুলোতে, এই দর্শনটি জটিল হয়ে উঠেছে কারণ তিনি কখনও কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে প্রথম রচনাকেই ব্যবহার করতেন, কোনো পরিশীলন করতেন না।মনে হয়  অভিব্যক্তির শক্তি পরীক্ষা করে চলেছেন আজীবন। এই পদ্ধতিটি তাঁর তথাকথিত "বানানো", টেক্সট এবং চিত্রের মিশ্রনে  সর্বোত্তম অভিব্যক্তি খুঁজে পেয়েছিল যা আতো ১৯৩৭ সালে আয়ারল্যান্ড ভ্রমণের সময় একটি স্নায়বিক বিপর্যয়ের  পরে তৈরি করতে শুরু করেছিলেন।  আতোর কাজকে পরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হলে, তাঁর ডাক্তার মানসিক অসুস্থতার প্রমাণ হিসাবে “বানানো” কাজগুলো উল্লেখ করেছিলেন। দেশলাই আর সিগারেট দিয়ে পোড়ানো এবং ক্রস, ইনফিনিটি চিহ্ন এবং অন্যান্য বিমূর্ত চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা, কাগজের এই নৃশংস টুকরোগুলোতে লুকিয়ে আছে আতোর, তীব্র আর্তনাদ।  কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে আতোর কাজগুলো - একই সাথে ভয়ঙ্কর এবং সুন্দর - তাঁর বিপর্যস্ত জীবন যাপনের খতিয়ান । যেন তাঁর প্রতিস্ব কাগজের পৃষ্ঠায় জ্বলছে । জীবনের শেষের দিকে এসে নিজেকে এবং নির্যাতিত উথালপাথালদের সমন্বয় করার চেষ্টা করে গেছেন।
    ৬ এপ্রিল, ১৯৩৩ তারিখে, রেনে অ্যালেন্ডির আমন্ত্রণে, অঁতনা আতো ‘দ্য থিয়েটার অ্যান্ড দ্য প্লেগ’ নামের অদ্ভুত শিরোনাম দিয়ে সোরবোনের দর্শকদের কাছে একটি সম্মেলনের প্রস্তাব দেন। সেখানে যে অনুষ্ঠানটি হতে চলেছে তার পূর্বাভাস কেউ  দেয়নি, ফলে তার কোনো নথিপত্র নেই। একমাত্র প্রমাণ যা আছে তা আনাস নিনের ডায়েরির লিখন । ডায়রিতে নিন লিখেছিলেন “অ্যালেন্ডি এবং আতো একটা বড় টেবিলের পিছনে বসে ছিলেন। অ্যালেন্ডি আতোর সাথে শ্রোতা-দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেন। ঘর শ্রোতায়  ছিল ঠাশাঠেশি।  সোরবোন মঞ্চে বসে আতো কী বলবেন তা ভুলে যান আর কোনো শব্দ বেরোয় না তাঁর মুখ থেকে । তিনি কোথায় বসে আছেন তা ভুলে গিয়েছিলেন,  ভুলে গিয়েছিলেন  সম্মেলনের কথা।  থিয়েটার, তাঁর পাশের ডক্টর অ্যালেন্ডি, উপস্হিত দর্শক, তরুণ ছাত্র, শিক্ষক এবং মঞ্চ পরিচালকদের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁর মুখে যন্ত্রণার খিঁচুনি দেখা দেয় এবং তাঁর চুল ঘামে ভিজে ওঠে। চোখ বিস্ফারিত, পেশী শক্ত, আঙ্গুলগুলোর নমনীয়তা বজায় রাখতে লড়াই করছেন । হঠাৎ হাউমাউ করে উঠলেন । স্বগত প্রলাপ বকতে লাগলেন। যেন তিনি প্রত্যক্ষ করছেন তাঁর  মৃত্যু ঘটছে, যেন ক্রুশবিদ্ধ হবার প্রতিনিধিত্ব করছেন। উপস্হিত দর্শকদের দমবন্ধ হতে থাকে।  তারা হাসতে হাসতে ফেটে পড়ে। সবাই হাসছিল ! শেষে লোকজন এক-এক করে বেরিয়ে গেল, চেঁচামেচি করে, প্রতিবাদ করে। চলে যাওয়ার সময় তারা দরজায়  লাথি মারতে মারতে বেরিয়ে গেল। কিন্তু আতোর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।” অঁতনা আতোকে ( ১৮৯৬ - ১৯৪৮ ) কোনো একটা নির্দিষ্ট খোপে ফেলে আলোচনা  করা কঠিন । যদিও তাঁর নাম সাধারণ পাঠকেরা বিশেষ জানে না তিনি থিয়েটার, সমালোচনা এবং শিল্পকলার উপর প্রগাঢ় প্রভাব  ফেলতে সফল  হয়েছেন, যাঁরা তাঁর নাম শোনেনি তারাও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত ।
     
    দশ 
    ১৯৩৭ সালের আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে, আতো আয়ারল্যান্ডে গিয়েছিলেন আসন্ন সর্বনাশের প্রস্তুতি বা সাক্ষী হতে। তাঁর গন্তব্য ছিল ইনিশমোর, তিনটি আরান দ্বীপপুঞ্জের একটি (সাধু ও পণ্ডিতদের দ্বীপ হিসেবে খ্যাত )। সম্ভবত আতো ভাবছিলেন যে সময়ের শেষ কালখণ্ডে আটলান্টিকের তরঙ্গের সাথে পূর্ব দিক বিধ্বস্ত হবে। তিনি নিজের সঙ্গে একটা বেতের ছড়ি নিয়ে ঘুরতেন যা তাঁর মতে ছিল যিশু খ্রিস্ট এবং সেন্ট প্যাট্রিক-এর। আয়ারল্যান্ডে থাকতে আতো ফ্রান্সের বেশ কয়েকজন শিল্পী ও লেখককে পোস্টকার্ড এবং চিঠি লিখেছিলেন, যার মধ্যে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের নেতা আঁদ্রে ব্রেতঁও ছিলেন । 
    আয়ারল্যান্ডে ঘুরে বেড়াবার সময়, আতো ইওগানাচটের বিচ্ছিন্ন গ্রামে এবং কিলরোনান, গালওয়ে, কোব আর ডাবলিনে সময়  কাটিয়েছিলেন। মনে হয় তিনি আয়ারল্যান্ডে তার পুরো সময়টা কাটিয়েছিলেন কোনো টাকাকড়ি ছাড়াই। ডাবলিন পুলিশের সাথে তাঁর বেশ কয়েকদিন ক্রুদ্ধ ঝগড়া হয়েছিলখ। তাঁকে সম্ভবত একজন ভবঘুরে হিসেবে মারধর করা হয়েছিল। তাঁকে ডাবলিনের মাউন্টজয় কারাগারে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। সদুত্তর দিতে পারেননি বলে একজন অবাঞ্ছিত বিদেশি হিসাবে আয়ারল্যান্ড থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। আসলে খুব কম ইংরাজি এবং  গ্যালিক বলতে না পারায় তিনি নিজেকে বোঝাতে পারেননি ।  প্যারিস দূতাবাস থেকে একটা পরিচয়পত্র ছিল তাঁর কাছে । আইরিশ সরকারী নথি অনুযায়ী তাঁর বেশিরভাগ সময় একটা হোটেল ঘরে কেটেছিল  যার জন্য তিনি খরচ মেটাতে পারেননি। জেসুইট সম্প্রদায়ের মিলটাউন হাউসের মাঠ থেকে তাঁকে জোর করে তাড়িয়ে  দেওয়ার চেষ্টা হয়, কিন্তু আতো চলে যেতে অস্বীকার করেন।আয়ারল্যাণ্ড থেকে নির্বাসনের আগে তিনি কিছু সময়ের জন্য কুখ্যাত মাউন্টজয় কারাগারে বন্দী ছিলেন। নির্বাসনের সময়ে তাঁর দুই হাত বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ।

    ১৯৪৩ সালে, যখন ফ্রান্স জার্মানি এবং ইতালির দখলে ছিল, তখন রোবের ডেসনোস আতোকে ভিচি অঞ্চলের অভ্যন্তরে রোদেজের মানসিক হাসপাতালে স্থানান্তর করার ব্যবস্থা করেছিলেন, যেখানে তাকে ডাঃ গ্যাস্টন ফেরডিয়ারের দায়িত্বে রাখা হয়েছিল। রোডেজে আতোকে  ইলেক্ট্রোশক শক  আর্ট থেরাপি  করা হয়েছিল। চিকিৎসক বিশ্বাস করতেন যে আতোর যাদুমন্ত্র তৈরি করা, জ্যোতিষের চার্ট তৈরি করা এবং অদ্ভুত ছবি আঁকার অভ্যাস মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। আতো অন্যদের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু করেন। আতো ইলেক্ট্রোশক চিকিৎসার নিন্দা করতেন এবং ক্রমাগতভাবে তাদের বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করতেন। তিনি ডাক্তারদের অনুরোধ করতেন যে তাঁকে “তার বান ফিরিয়ে দেয়া হোক”।আলোচক আলেকজান্দ্রা লুকস লিখেছেন যে "তাঁর নামের 'পুনরুদ্ধার'" সম্ভবত "স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাঁর ডাক্তারদের ধারণাকে শান্ত করার একটা কারসাজি"। এই সময়েই আতো আবার লিখতে এবং আঁকা শুরু করেন, দীর্ঘ সুপ্ত সময়ের পর। ১৯৪৬ সালে, ফার্ডিয়ের আতোকে তাঁর বন্ধুদের কাছে দিয়ে আসেন, যারা তাঁকে আইভরি-সুর-সেইনের সাইকিয়াট্রিক ক্লিনিকে ভর্তি করে দেন।এই ক্লিনিকে  বন্ধুরা তাঁকে আবার লিখতে উৎসাহিত করেন, যেকারণে নিজের  কাজের প্রতি আগ্রহ আবার জেগে ওঠে। তিনি প্যারিসের অরেঞ্জেরিতে  ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের একটা প্রদর্শনী দেখতে যান এবং"ভ্যান গগ, দ্য ম্যান সুইসাইডেড বাই সোসাইটি" প্রবন্ধটা লেখেন। ১৯৪৭ সালে, ফরাসি ম্যাগাজিন K এটি প্রকাশ করে।
    ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে, আতোর মলদ্বারে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এর দিন কয়েক  পরে, ৪ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে প্যারিসের দক্ষিণ-পূর্ব শহরতলির  আইভরি-সুর-সেইনের একটি মানসিক ক্লিনিকে তিনি মারা যান। তাঁকে এস্টেটের মালী প্রথম দেখতে পান। আতো নিজের বিছানার পাশে  একটা জুতা হাতে চুপচাপ বসে আছেন।  সন্দেহ করা হয়েছিল যে তিনি মাদক ক্লোরাল হাইড্রেটের বেশি ডোজ নেবার দরুন মারা গিয়েছেন। নীটশে এবং বুদ্ধের মতো, অঁতনা আতো দুঃখকে অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য হিসাবে দেখেছিলেন এবং একজন সম্পূর্ণ মানুষ হওয়ার জন্য যে মূল্য দিতে হয় তা তিনি জানতেন।  তিনি সমস্ত ইউটোপিয়াকে অনিবার্য ডিস্টোপিয়া হিসাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:b42b:f4bf:3b45:46e7:f4b2 | ১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৪৩740506
  • অঁতনা আতো : নরকের  ডায়েরি থেকে টুকরা-টাকরা - অনুবাদ মলয় রায়চৌধুরী

    আমার কান্নাও আমার নয়্, আমার জ্বরও আমার নয়। আমার শক্তির এই ভঙ্গুরতা, আমার চিন্তা আর আত্মার এই গোপন উপাদানগুলোর, আপনারা কি সেসবের  অধ্যবসায়কে কল্পনা করতে পারেন?
    এই "কিছু" আমার সাধারণ পরিবেশের রঙ এবং আমার বাস্তবতার বিন্দুর মাঝামাঝি রয়েছে।
      এক ধরণের প্রাথমিক বিবেকের মতো আমার পুষ্টির প্রয়োজন নেই।
    জীবনের এই গিঁটে আঁকড়ে আছে চিন্তার পথ।
    শ্বাসরোধের এক কেন্দ্রীয় গিঁট।
     আমার কাছে কেবল এক স্পষ্ট সত্যের ওপর থিতু হওয়া দরকার, যেটা একক প্রান্তে অবস্হান করছে।
    আমার "আমির"  ক্ষয়ক্ষতির সমস্যা এখন আর কেবল ব্যথার প্রশ্ন নয়। আমি  আমার জীবনের বিকৃতকরণে হস্তক্ষেপকারী নতুন কারণগুলো অনুভব করতে পারি আর আমার অন্তরঙ্গ ভঙ্গুরতায় নতুন বিবেকের মতো কিছু একটা আছে।
     আমি একটা ঘুটি ছুঁড়ে ফেলায় আর নিজেকে একটি পূর্ব-অনুভূত সত্য নিশ্চিতকরণের   অভিনয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার  সম্পূর্ণ কারণ দেখতে পাই, যেমন একটা কাজ হতে পারে গুণবাচক ।
    ঘন্টার পর ঘন্টা, আমি একটা ধারণার বা একটা শব্দের প্রভাবে থাকি। আমার আবেগ সময়ে বিকশিত হয় না, সময়কে অনুসরণ করে না। আমার আত্মার প্রতিফলনগুলো আমার আত্মার পরম আদর্শের সাথে নিখুঁতভাবে খাপ খায়।
    আমি আমার নিজের জন্য তৈরি করা অধিবিদ্যাকে আমার মধ্যে বহন করা শূন্যতার মুখোমুখি বসিয়ে রাখি।
    এই বেদনা আমাকে একটা পেরেকের মতন চালিত করে, যা গিঁথে থাকে আমার সবচেয়ে বিশুদ্ধ বাস্তবতার কেন্দ্রে, সেই সংবেদনশীলতার জায়গায় যেখানে শরীর আর আত্মার দুটো জগৎ আবার মিশে যায় - আমি শিখে ফেলেছি কীভাবে একটা বিভ্রমের প্রভাবের মাধ্যমে এটা দিয়ে নিজেকে বিভ্রান্ত করতে হয়।
    এই মুহুর্তের ভেতর, যা একটা মিথ্যা সৃষ্টির সময়টুকুতে স্থায়ী হয়, আমি নিজের জন্য একটা বিভ্রান্তি  তৈরি করে ফেলি, একটা ফাঁকি, আর আমার রক্ত যেদিকে আমাকে নিয়ে যায়, এক মিথ্যার পথে ছুটে যাই। আমি আমার বুদ্ধিমত্তার দৃষ্টি বন্ধ করে নিই আর আমার ভেতর যা  অব্যক্ত তাকে কথা বলতে দিয়ে, আমি নিজেকে এমন একটা প্রক্রিয়ার বিভ্রমে ফেলে দিই যা আমি বুঝতে পারি না। কিন্তু এই ক্ষুদ্রতম ভুল থেকে আমি  সংগ্রহ করি অজানা কোনও-কিছু বাস্তব । আমি স্বতঃস্ফূর্ত কুহকে বিশ্বাস করি। যে পথে আমার রক্ত আমাকে নিয়ে যায়, সেখানে এমন কোনো দিন আসতে পারে না যেদিন আমি সত্য আবিষ্কার করতে পারব না।
    পক্ষাঘাত আমাকে পরাস্ত করে আর একটু একটু করে আমাকে নিজের কাছে ফিরে আসতে বাধা দেয়। আমার কোনও স্পর্শপাথর নেই, কোন ভিত্তি নেই। আমি চিনতে পারি না এমন সমস্ত জায়গায় নিজেকে খুঁজি। আমার চিন্তাভাবনা আমার আবেগ আমার মধ্যে জেগে ওঠা  ছবিগুলোকে  আর ধাক্কা দিতে পারে না।
     আমি এমনকি আমার ক্ষণিকের আবেগেও নিজেকে নপুংসক  অনুভব করি । আমার বুদ্ধিমত্তা এবং আমার সংবেদনশীলতা, প্রতিটি অর্থে আমাকে  পরিত্যাগ করতে হয়েছে,  যে কারণে আমি আমার মধ্য দিয়ে দিনটাকে উজ্বল হতে দেখি । এটা বুঝতে হবে যে  আমার মধ্যে জীবিত মানুষটা, যে প্রভাবিত হয়, আর যে পক্ষাঘাত আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে, তা আমার মামুলি প্রতিস্বের কেন্দ্রে রয়েছে । তা  আমার ভাগ্যের সাথে একজন মানুষ হওয়ার অনুভূতি থেকে জেগে ওঠেনি। আমি অবশ্যই জীবনের সঙ্গে মিশে আছি।
    আমার যন্ত্রণা যেমন সূক্ষ্ম এবং মার্জিত, তেমনি তা কঠোর এবং রুক্ষ। এই শ্বাসরুদ্ধকর শ্বাসকষ্টের ফাটলে আমার কল্পনাপ্রসূত প্রচেষ্টার প্রাচুর্য চাই, তা দশগুণ  হওয়া দরকার, এমনকি আমাকে কী কষ্ট দেয় সেটা ভাবতেও তা দরকার। আর যদি আমি এই সাধনার জন্য অধ্যবসায় করি, তাহলে চিরকালের জন্য এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্হাকে কবজা করতে পারবো।
     আমি একটি চাপা মৃত্যুর দ্বারা কলঙ্কিত, যেখানে সত্যিকারের মৃত্যু আমার কাছে কোন ভয় রাখে না।
    এই ভয়ঙ্কর রূপগুলো আমার দিকে এগিয়ে আসছে - আমি মনে করি,  তারা আমাকে যে হতাশায়  নিয়ে আসে তা জীবন্ত। এটা জীবনের গিঁটে আটকে  যায়,  যার পর অনন্তকালের রাস্তাগুলো হয় অবারিত। সত্যিই, চিরকালের বিচ্ছেদ। আঙ্গিকসমূহ তাদের ছুরিগুলোকে আমার কেন্দ্রকে ফালাফালা  করে, যেখানে আমি একজন পুরুষের মতো অনুভব করি, তারা জরুরি বাঁধনগুলোকে কেটে দেয়,  যা আমাকে একটা স্পষ্ট বাস্তবতার ধারণার সাথে যুক্ত করে দেয়।
    মূলধন হতাশার রূপ (সত্যিই অত্যাবশ্যক),
    বিচ্ছেদের মোড়,
    আমার শরীরে অনুভূতির একটি মোড়,
    আমার শরীর দ্বারা পরিত্যক্ত,
    মানুষের সমস্ত সম্ভাব্য অনুভূতি দ্বারা পরিত্যক্ত।
    আমি একে কেবল সেই অবস্থার সাথে তুলনা করতে পারি যেখানে একজন মানুষ নিজেকে জ্বরের প্রলাপের সময় খুঁজে পায়,  যা তার গুরুতর অসুখের সময় ঘটে।
    আমার গভীরতম সরলতা আর আমার বাহ্যিক অসুবিধার মধ্যে অ্যান্টিমনি এমন যন্ত্রণা তৈরি করে যা আমাকে খুন করে ফ্যালে
    সময় চলে যায় আর জগতসংসারের সামাজিক খিঁচুনি পুরুষদের চিন্তাভাবনাকে ধ্বংস করতে পারে, তবে আমি সেইসব   চিন্তা থেকে মুক্ত যা এই ধরনের ঘটনায় হারিয়ে যায় । আমাকে আমার আবছা মেঘের কাছে ছেড়ে দাও, আমার অমর শক্তিহীনতা, আমার অযৌক্তিক আশার কাছে। তবে এটা জানাবেন যে আমি আমার কোনো ভুলই মাফ করি না। আমি যদি ভুল করে থাকি, তবে সেটা আমার মাংসের দোষ, কিন্তু এই আলোগুলো, যেগুলো আমার মন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছেঁকে তুলতে থাকে,  তা আমার শরীরে  রয়েছে, যেখানে বিদ্যুতের ঝলকানিতে তা আমার রক্তে মিশে যায়।
    সে আমার সাথে নার্সিসিজমের কথা বলে, আমি তাকে জানাই  যে এটাই আমার জীবন। শব্দের বাস্তব অর্থ আমার নিজের জন্য নয়, আমার মাংসের প্রতি নিবেদিত এক ধর্ম আছে। আমি স্পর্শ করেছি,  সে "আমি" নয়, সে আমার মাংস; ব্যাপারগুলো এর  সাথে মিশ খায় , যেখানে তারা একে ঝাঁকুনি দেয়, তবে তার বেশি  কিছু নয় । সরাসরি আমার ত্বককে যা ছোঁয় তা ছাড়া কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না বা আগ্রহী করে না। আর তখনই সে  আমাকে আমার অহং সম্পর্কে বলে। আমি উত্তর দিই যে ‘আমি’ এবং ‘অহং’ দুটি স্বতন্ত্র পদ, বিভ্রান্ত হবেন না, আর ঠিক এই দুটি পদ যা মাংসের ভারসাম্যকে এড়িয়ে চলে
    আমি অনুভব করতে পারি আমার চিন্তার তলদেশে ভূমিক্ষয় হচ্ছে, এবং এটি  তাদের  অধঃস্তরের প্রকৃত অর্থের সমর্থন ছাড়াই যে শব্দগুলো আমি ব্যবহার করি তা কল্পনা করতে আমাকে নির্দেশ দেয় । আর তার থেকেও ভালো: এই সাবস্ট্রেটাম হঠাৎ করেই অবিশ্বাস্যভাবে সংবেদনশীল এবং ভার্চুয়াল হয়ে ওঠে। আমার কাছে একটি অপরিকল্পিত এবং স্থির স্থানের ধারণা আছে, যখন স্বাভাবিক সময়ে সবকিছুই চলাচল, যোগাযোগ, হস্তক্ষেপ, যাত্রা ঘটতে থাকে।
    কিন্তু এই ক্ষয় যা আমার চিন্তাকে তার মূল প্রশ্নে পৌঁছে দেয়, বুদ্ধিমত্তা এবং মনের সহজাতভাবের সাথে, তার সবচেয়ে জরুরি যোগাযোগের মধ্যে, একটি অসংবেদনশীল বিমূর্তের এলাকায় কিন্তু যায় না, যেখানে শুধুমাত্র তীক্ষ্ণ ধীশক্তির টুকরোগুলো অংশগ্রহণ করে। আত্মা যতটা অক্ষত থাকে, তা বেশ কিছু বিন্দুতে ভর করে থাকে , এই ক্ষয় আমার চিন্তার স্নায়বিক যাত্রাকে দূরে সরিয়ে দেয়। আমি  আমার অঙ্গ এবং রক্তে এই অনুপস্থিতি এবং অচলতা অনুভব করতে পারি।
     প্রচণ্ড ঠান্ডা,  নৃশংস পরিহার,  দুঃস্বপ্নের অস্থি এবং পেশী,  কার্যকারিতার অনুভূতিসহ একটি ঝড়ের ফসফোরেসেন্সে একটি পতাকার মতো পতপত করতে থাকে।
    লার্ভা চিত্রগুলি এমনভাবে চলমান যেন  আঙুল দিয়ে টুসকি মারা হয়েছে আর  কোনও উপাদানের সাথে তা সম্পর্কিত নয়।
    আমি আমার হাত-পা সব নিয়ে একজন মানুষ, আমার পেট, আমার মাংসের হৃদয়, আমার পেটে গিঁট পড়ে গেছে   জীবনের বিচ্ছিন্নতার সাথে।
    তারা আমার সাথে কথা বলে, কিন্তু তা  শব্দ নয়, তা আত্মার সময়কাল।
    শব্দের এই রোঁয়া যে ওড়ে, আমাদের মনে রাখা উচিত  যে আত্মা তাতে  জড়িয়ে নেই। মনের পাশেই আছে জীবন, আছে মনের ঘূর্ণিতে আঁকা বৃত্তে মানুষ, বহু সুতোয় বাঁধা তারা ।
    না, সমস্ত শারীরিক অঙ্গচ্ছেদ, শারীরিক ক্রিয়াকলাপের এই সমস্ত হ্রাস এবং নিজের শরীরের উপর নির্ভরশীল বোধ করার জন্য এই বিব্রতবোধ, আর সেই দেহটি নিজেই মার্বেল দ্বারা ভারাক্রান্ত এবং সস্তা কাঠের উপর শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল, এর কোনটিই শারীরিক সক্ষমতা অস্বীকার করার দুঃখের সমান নয় এবং তা একজনের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যের মর্মার্থ । যে আত্মার ভাষা নেই, বা যে ভাষা আত্মাকে ব্যর্থ করে দেয়, আর এই বিরতি সমভূমির অর্থে হতাশা এবং রক্তের বিস্তীর্ণ লোমের মতো আঁকতে থাকে, এটিই বড় দুঃখ, যা পোশাকটাকে খায়, বাকলকে নয়। বা কাঠামোকে নয় । কেউ এই ভ্রান্ত দীপ্তিকে হারাতে উঠে পড়ে লেগেছে , কখনও বা কাউকে  আমরা অনুভব করি যে সে এক অতল গহ্বর যার ফলে সে  নিজের মধ্যেই বিশ্বের সমগ্র সম্ভাব্য বিস্তৃতি অর্জন করেছে, আর এমন এক অসারতার অনুভূতি সঞ্চয় করেছে যে এটা যেন মৃত্যুর গিঁট । এই অকেজোভাব,  এই অতল গহ্বরের নৈতিক রঙের মতো, আর  এই তীব্র মূর্খতার মতো, এবং এর শারীরিক রঙ মস্তিষ্কের ছিদ্র দিয়ে নির্গত রক্তের স্বাদ এনে দেয়।
    যদিও আমাকে প্রায়ই বলা হয় যে এই গলাকাটার বোধ আমার মধ্যে রয়েছে, তাই আমি জীবনে অংশগ্রহণ করি, আমি নিয়তির প্রতিনিধিত্ব করি, যে আমাকে বেছে নেয়; এবং এটা হতে পারে না যে আমি এক নির্দিষ্ট মুহুর্তে বিশ্বের সমস্ত প্রাণের  মধ্যে গণ্য হব: তার প্রকৃতির দ্বারা গণ্য হব, এই বিশ্বের, এই সমস্ত প্রাণ জীবনের নীতিকে হুমকি দেয়।
    মানুষের সমস্ত ক্রিয়াকলাপের ঊর্ধ্বে কিছু আছে: অর্থাৎ, এই একঘেয়ে ক্রুশবিদ্ধকরণের উদাহরণ, এই ক্রুশবিদ্ধকরণ যেখানে আত্মা কখনই পুরোপুরি মারা যায় না।
    যে দড়িটি দিয়ে আমি বুদ্ধিমত্তার ভেতরে ছেঁদা  করতে দিই, তা আমাকে দখল করে, আর অচেতনের মধ্য দিয়ে তা আমাকে পুষ্ট করে,  তার উজ্বল উপাদানে আরও সূক্ষ্ম সুতো আবিষ্কার করে। এইভাবে, একটি নতুন জীবনের পুনর্জন্ম ঘটে, আরও বাগ্মী, গভীর এবং মূলভূত।
     এই আত্ম-শ্বাসরোধকারী আত্মার দ্বারা কখনই কোন সূক্ষ্মতা সম্ভব নয় , কারণ যে যন্ত্রণা এটিকে হত্যা করে, যা এটিকে রেশা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে, চিন্তার তলায় চাপা পড়ে , এমন  নীচে যেখানে ভাষা প্রবেশ করতে পারে, কারণ এটি সেই একই জোড়ালাগা যা এটা নিজেই তৈরি করে। এবং এটি আধ্যাত্মিকভাবে কেন্দ্রীভূত , যা জীবনকে অবিচ্ছিন্ন উজ্জ্বলতার দিকে ডাকার সাথে সাথে ভেঙে পড়ে । এই আবেগ, এই ধরণের চক্রাকার এবং মৌলিক অপঘাতে কখনই কোন উজ্জ্বলতা নেই। এবং তবু, এটি বেঁচে থাকে,  তবে তাকে যখন মান্যতা দেয়া হয় তখন , যেখানে তা ক্ষণস্থায়ী জঙ্গমের সাথে মিশে যায় । বিভ্রান্তি সময়হীন একটি উজ্জ্বলতার বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী ভাষার সাথে মিশে যায়। এই অভিশাপ তার বসবাসের গভীরতাকে শিক্ষিত করে, কিন্তু বিশ্ব তার পাঠ শুনবে না।
    একটি আঙ্গিকের স্ফূটনের দ্বারা উদ্ভূত আবেগ, কোনও সময়কাল ছাড়াই,  বক্তৃতার মায়ার সাথে,  আমার হাস্যরসের অভিযোজন আমার কাছে মোটেই রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যবান  কার্যকলাপ নয়।
    এটা  আধ্যাত্মিক মিথ্যার পরশপাথর।

     এই ধরণের পদক্ষেপ যা আত্মা তৈরি করে, চেতনার নীচে এটি দেখছে, তা হল জীবনের আবেগের সন্ধান করা। এই আবেগটি সেই নির্দিষ্ট বিন্দুর বাইরে যেখানে আত্মা এটির সন্ধান করে, এবং একটি সমৃদ্ধ ঘনত্ব এবং একটি নতুন প্রবাহ নিয়ে আবির্ভূত হয়, এই আবেগ যা আত্মাকে বস্তুর হৃদয়গ্রাহী শব্দ ফিরিয়ে দেয়, আত্মা সম্পূর্ণরূপে এখানে প্রবাহিত হয় এবং তার প্রখর আগুনের মধ্য দিয়ে যায়। কিন্তু আগুনের চেয়েও যা আত্মাকে মুগ্ধ করে তা হল এই অতি-ঠাণ্ডা পদার্থের অলসতা, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাভাবিকতা এবং হিমবাহের প্রখরতা, উষ্ণ এবং ঠাণ্ডা।

    . এই বিষয়টির উত্থানের অর্থ কী এবং কোন আন্ডারগ্রাউন্ড গণহত্যার জন্য এর হ্যাচিং খরচ তা একজনই জানেন। এই ব্যাপারটি এমন একটি শূন্যতার মানদণ্ড যা অলক্ষিত হয়।

    যখন আমি ভাবি, আমার চিন্তাগুলি একটি নতুন স্থানের ইথারে অনুসন্ধান করে। আমি মেঘের মধ্যে আছি যেমন অন্যরা তাদের বারান্দায় রয়েছে। আমি আমার আত্মার ফাটলে গ্রহের মাধ্যাকর্ষণে অংশগ্রহণ করি।

     জীবন উন্মোচিত হবে, ঘটনাগুলি উন্মোচিত হবে, আধ্যাত্মিক দ্বন্দ্বগুলি সমাধান হবে এবং আমি অংশগ্রহণ করব না। শারীরিক এবং নৈতিকভাবে, আমার জন্য অপেক্ষা করার কিছু নেই। আমার জন্য, এটি চিরকালের বেদনা এবং ছায়া, আত্মার রাত, এবং আমার কান্নার শব্দ নেই।
    আপনার ঐশ্বর্য সেই অবোধ দেহ থেকে অনেক দূরে জীর্ণ যে কোন ঋতু, আধ্যাত্মিক বা ইন্দ্রিয়গত, পরিবর্তন করতে পারে না।
     আমি অন্যদের মত বেদনা এবং ছায়ার রাজ্য বেছে নিয়েছি যেটি দীপ্তি এবং পদার্থের সঞ্চয়নের জন্য বেছে নিয়েছি।
    আমি কোন ডোমেইনের এলাকায় পরিশ্রম করি না।
    আমি একটি অতুলনীয় সময়কালের জন্য পরিশ্রম করি।
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:b42b:f4bf:3b45:46e7:f4b2 | ১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৪৪740507
  • অঁতনা আতো : কবিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
    যখন আমরা কবিতার জগতে প্রবেশ করছি, তখন আমরা কেবল আত্মার অবতার হয়ে লিখছি, কিন্তু আত্মা ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, আর তা আমাদের দ্বারা নয়।  কবি, যিনি লেখেন, শব্দকে সম্বোধন করেন এবং শব্দের নিজস্ব আইন রয়েছে। এই আইনগুলিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্বাস করা কবির অচেতন অবস্থায় রয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন যে তিনি স্বাধীন কিন্তু তা তিনি নন।
    কবির মাথার পিছনে এবং কানের পিছনে কিছু আছে - তার চিন্তার জিনিসগুলো। তার ঘাড়ের কোণে কিছু একটা বেড়ে উঠছে, যার শেকড় তার কবিজন্ম উৎপত্তির আগে থেকে রয়েছে । তিনি তাঁর কাজের সন্তান, সম্ভবত, কিন্তু তাঁর কাজগুলো তাঁর দ্বারা গড়া হয়নি; কারণ তাঁর কবিতায় নিজের যা কিছু আছে, তা তিনি সেখানে রাখেননি, বরং জীবনের একজন অচেতন নির্মাতা রেখেছেন, যিনি তাঁকে তাঁর কবি হিসাবে মনোনীত করেছিলেন এবং যিনি স্পষ্টতই তাঁর প্রতি কখনই ভাল আচরণ করেননি।
    সে যাই হোক, আমি আমার অচেতন প্রযোজকের কবি হতে চাই না; অথবা সেই প্রতিস্ব যে আমাকে কবি হিসেবে বেছে নেবার নজিরহীন কল্পনা করেছিল ; আমি বরং একজন কবি-স্রষ্টা হতে চাই, যে  অহং এবং প্রতিস্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এবং আমি অহং আর প্রতিস্বের বিরুদ্ধে পুরানো বিপ্লবের কথা ভাবি । এবং আমি আমার কাছে আসা আঙ্গিকগুলোর বিরুদ্ধে পুরানো বিপ্লবের কথা ভাবি। অহংকার আর নিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমেই আমি নিজেকে শব্দের সমস্ত মন্দ অবতার থেকে মুক্তি দিতে পারি, যেগুলো  মানুষের জন্য কাপুরুষতা এবং বিভ্রমের মধ্যে সব সময় সমঝোতা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন কাপুরুষতা এবং বিভ্রমের কথা আসে তখন আমি যা জানি তা হল ঘৃণ্য ব্যভিচার।
    আমি চাই না যে  কোনো শব্দ আমার কাছে এখনও-অজানা কোনও নাক্ষত্রিক কামশক্তি থেকে আসবে ; তা আসবে ইচ্ছার গঠন সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে, যা আমার এবং শুধুমাত্র আমার। আমি জানি না মানবিক শব্দের আকারে কী কী ধর্ষণাত্মক ক্রিয়াকলাপ আছে, এও জানি না কী কী নিজেকে খেয়ে ফেলার লোভে সক্রিয়, যেখানে কবি বস্তু-বিশেষের প্রতি আত্মসমর্পিত, দেখতে পান যে সেটা তাঁকে খেয়ে ফেলছে।শব্দকে মাংস দিয়ে তৈরির অপরাধ হলো প্রথমে তাকে সেই কাজে অনুমতি দেওয়ার অপরাধ। কামশক্তি হল জানোয়ারের  চিন্তা আর এই একই প্রাণীরা একদিন মানুষে পরিণত হয়েছিল।
    মানুষের দ্বারা সৃষ্ট শব্দ হলো বস্তু-বিশেষের প্রতি জান্তব প্রতিক্রিয়ায় কবরে উল্টো লটকানো লোকের ধারণা, যে কিনা ( সময় এবং বস্তুদের শহিদ করার ) ভুলে গেছে যে শব্দটি উদ্ভাবিত হয়েছিল।উল্টো লটকানো হল সেই ব্যক্তি যে নিজেকে খায়, এবং চায় তার প্রতিস্ব তার লালন-পালন করুক, তার নিজের মধ্যে  মাকে পেতে চায় আর মাকে নিজের জন্য অধিকার করতে চায়। অজাচারের আদিম অপরাধ কবিতার শত্রু আর তাকে যারা খতম করে তারা কবিতায় নিষ্পাপ ।

    আমি আমার কবিতাকে খেয়ে ফেলতে চাই না, তবে আমি আমার কবিতাকে আমার হৃদয় দিতে চাই। আর আমার  হৃদয় আমার কবিতায় কী ? যা আমার অহং নয় তা আমার হৃদয় । নিজের কবিতার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াও কবিতার দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার ঝুঁকি। আর আমি যদি আমার কবিতার জন্য কৌমার্য বজায় রাখি, তবে তা আমার কাছে কুমারী থাকতে বাধ্য।  আমি একজন বিস্মৃত কবি,  বস্তুতে পালটে ফেলা ছাড়া আর কিছুই নই, যদিও বস্তু আমাকে বা আমার অহংকারকে কখনও গ্রাস করবে না। আমি এই পুরোনো প্রতিফলনগুলো চাই না; এগুলো প্রাচীন অজাচারের পরিণতি, যা জীবনের কৌমার্যের নিয়মনিষ্ঠা  সম্পর্কে জানোয়ারদের অজ্ঞতা থেকে এসেছে।  প্রতিস্ব এবং অহং দুটোই অস্তিত্বের বিপর্যয়কর অবস্থা, যেখানে একজন জীবিত ব্যক্তি অনুভূত আঙ্গিকের দ্বারা বন্দী হয়। নিজেকে ভালবাসা  মানে একজন মৃত ব্যক্তিকে ভালবাসা, এবং কৌমার্যের নিয়মনিষ্ঠা অসীম।
    আমাদের নিজেদের প্রতিস্বের অচেতন প্রযোজক হলো একজন প্রাচীন সঙ্গমকারী যে আদিম জাদু আচারে লিপ্ত হয়, আর যে  এই জাদু ব্যাপারটা বজ্জাতের কাছ থেকে পেয়েছে এবং নিজেকে বারবার ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, তাই সে এখন একটি শবের জন্য একটি শব্দ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। কামশক্তি হল একটি শবের জন্য এই ইচ্ছার সংজ্ঞা, আর অধঃপতিত মানুষটা একজন উল্টো লটকানো অপরাধী। আমি সেই রকমের আদিম। আমি যাবতীয় ব্যাপার-স্যাপারের অসহনীয় ভয়াবহতা নিয়ে অসন্তুষ্ট। আমি ব্যাপারগুলোয় নিজেকে পুনরুৎপাদন করতে চাই না, তবে আমি নিজের মাধ্যমে ব্যাপারগুলো ঘটাতে চাই। আমি আমার কবিতায় আমার অহংকারের কোনও ইঙ্গিত রাখতে চাই না আর আমি কবিতায় আবার নিজের সাথে দেখা করতে চাই না।
    আমার হৃদয় হল সেই চিরন্তন গোলাপ যা প্রথম ক্রুশকাঠের জাদুশক্তি থেকে এসেছে। যিনি নিজেকে ক্রুশবিদ্ধ করিয়েছিলেন তিনি কখনো নিজের কাছে ফিরে আসেননি। কখনই না। কেননা তিনিও আত্মসমর্পণ করেছিলেন জীবনের কাছে, যার দ্বারা তিনি নিজের আত্মবলিদান দিয়েছিলেন,  নিজের জীবনের সত্তায় পরিণত করতে নিজেকে বাধ্য করেছিলেন।
    আমি কেবল চিরকালের জন্য সেই কবি হতে চাই, যে নিজেকে  কাব্বালার  নিষ্পাপ ধারণার কাছে  আত্মাহুতি দিয়েছিল।
    টীকা : কাব্বালা শব্দটি ইহুদি রহস্যবাদের একটি বিশেষ বৈচিত্র্যকে বোঝায়, যা প্রথম দ্বাদশ শতকে প্রোভেন্স এবং কাতালোনিয়াতে আবির্ভূত হয়েছিল। এটি ঐশ্বরিক রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত অভ্যন্তরীণ কাঠামো এবং প্রক্রিয়াগুলির সাথে সম্পর্কিত ছিল, যার আধিভৌতিক গতিশীলতার উপর কাবালিস্টরা প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছিল।
     
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:b42b:f4bf:3b45:46e7:f4b2 | ১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৪৬740508
  •  চেনচি ( Les Cenci )  শেলি ও আতো’র নাটকের সত্য ঘটনা
    চেন চি ( The Cenci ) হল ইংরেজি ভাষার কবি শেলির ‘দি সেনসি. কাব্যনাট্য অবলম্বনে লেখা অঁতনা আতো’র একমাত্র পরিচিত নাটক যা থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির নির্দেশিকা ভিত্তিক। এই সত্য ঘটনা নিয়ে আরও যাঁরা লিখেছেন তাঁরা হলেন : ফিলিপ ম্যাসিঞ্জারের নাটক দ্য আনন্যাচারাল কমব্যাট ( ১৬১৯) মামলার  বর্ণনা রয়েছে এবং ২০০ বছরের মধ্যে বিয়াত্রিচের রোমান্টিক পুনরুজ্জীবনের পূর্বাভাস দেয়  ।"লেস সেন্সি", স্তাঁদালের একটি ছোট গল্প ( ১৮৩৭ )।Béatrix Cenci , পোলিশ কবি জুলিয়াস স্লোওয়াকির কাব্যনাট্য  ( ১৮৩৯) । বিয়াত্রিচে সেনসি , ফ্রান্সেস্কো ডোমেনিকো গুয়েরাজির একটি উপন্যাস ( ১৮৫৪ )। বিয়াত্রিচে সেনসি (একটি শহরের দোকানে) ( ১৮৭১) সারাহ মরগান ব্রায়ান পিয়াট , আমেরিকান কবির একটি কবিতা । Béatrix Cenci , Astolphe de Custine-এর কবিতা।নেমেসিস , আলফ্রেড নোবেলের ট্র্যাজেডি ।বিট্রিস সেনসি , আলবার্তো মোরাভিয়ার একটি নাটক ( ১৯৫৮)। ট্রান্স। অ্যাঙ্গাস ডেভিডসন-এর গল্প ( ১৯৬৫ )। Beatriz Cenci , গনসালভেস ডায়াসের একটি পদ্য নাটক ।Beatrix Cenci , শেলি নাটকের উপর ভিত্তি করে আলবার্তো গিনাস্টেরার অপেরা । Beatrice Cenci , বার্থহোল্ড গোল্ডস্মিডের অপেরা , শেলি নাটকের উপর ভিত্তি করে লেখা। দ্য সেনসি , সেলিব্রেটেড ক্রাইমস ( ১৮৪০ ) আলেকজান্ডার ডুমার প্রবন্ধ । Legende und Wahrheit der Beatrice Cenci ( ১৯২৬), Stefan Zweig এর ছোট গল্প । দ্য সেন্সি (1951-52), হ্যাভারগাল ব্রায়ানের একটি অপেরা (শেলির নাটক থেকে ) । দ্য সেন্সি ফ্যামিলি (২০০৪),লু কেম্প পরিচালিত লিজি হোপলির একটি রেডিও নাটক ।বিয়াত্রিচে সেন্সি ( ২০০৬), আলেসান্দ্রো লন্ডেই এবং ব্রুনেলা ক্যারোন্টির সঙ্গীত নাটক । Béatrice Cenci : Telle une fleur coupée , Jean Rocchi এর একটি উপন্যাস, ( ২০০৪ )। "ফিনিস দ্য সেনসি" (1954), ইভেন্টস অ্যান্ড সিগন্যালে এফআর স্কটের একটি 17 লাইনের কবিতা ; এছাড়াও তার নির্বাচিত কবিতা (১৯৬৬) এবং সংগৃহীত কবিতায় (১৯৮১)।এ টেল ফর মিডনাইট (1955), ফ্রেডেরিক প্রকোশের একটি উপন্যাস । জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক এবং জেমস রল্ফের লেখা কানাডিয়ান অপেরা বিট্রিস চ্যান্সি (এবং শেলি নাটক থেকে অনুপ্রাণিত), গল্পটিকে উনবিংশ শতাব্দীর নোভা স্কটিয়ায় স্থানান্তরিত করে । আ বিয়াত্রিচে সেনসি , সাব্রিনা গাট্টি (ইতালীয় লেখক), ইল ট্রোনো দে পোভেরি ( ২০২০) এর কাব্যিক গদ্যের একটি অংশ। এছাড়া মূর্তি, পেইনটিঙ ইত্যাদিতে চেন চি পরিবারের কাহিনি পাওয়া যায় । 
    গল্পটা এমন যে আতো এতে যথেষ্ট নিষ্ঠুরতার উপাদান পেয়ে যান। কিংবদন্তি অনুসারে, ফ্রান্সেস্কো চেনচি তার প্রথম স্ত্রী এরসিলিয়া সান্তাক্রুজ এবং  ছেলেদের সাথে দুর্ব্যবহার করতো আর বারবার মেয়ে বিয়েত্রিচেকে ধর্ষণ করতো। লোকটা নানা অপরাধের জন্য কারাগারে বন্দী ছিল, কিন্তু তার ঘুষ আর মর্যাদার কারণে তাড়াতাড়ি ছাড়া পায়।পরিবারটা রোমে রিওনে রেগোলার পালাজো চেনচিতে বসবাস করত । একত্রে বসবাসকারী বর্ধিত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিল কাউন্ট ফ্রান্সেসকোর দ্বিতীয় স্ত্রী লুক্রেজিয়া পেট্রোনি ; বিয়াত্রিচের বড় ভাই গিয়াকোমো; এবং বার্নার্ডো, তার দ্বিতীয় বিয়ে থেকে ফ্রান্সেস্কোর ছেলে। রোমের উত্তর-পূর্বে আব্রুজি পাহাড়ের একটা ছোট গ্রাম পেট্রেলা সালটোর লা রোকায় একটি দুর্গও তাদের দখলে ছিল ।
     বাপ তাকে ধর্ষণ করে সেকথা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।বিয়াত্রিচে ছিল এরসিলিয়া সান্তাক্রুজ আর কাউন্ট ফ্রান্সেস্কো চেনচির মেয়ে। লোকটা প্রচুর সম্পদের মালিক হলেও ছিল অলস আর হিংস্র মেজাজের।  বিয়াত্রিচের বয়স যখন সাত বছর, ১৫৮৪ সালের জুন মাসে তার মা মারা যান।   
    বাপ যখন  জানতে পারল যে তার মেয়ে তার নামে নালিশ  করেছে, তখন সে বিয়াত্রিচেকে রোম থেকে দূরে লা পেট্রেলা দেল সালটোতে পারিবারিক দুর্গে বসবাস করতে পাঠায়।ছেলেরা আর বিয়াত্রিচে সিদ্ধান্ত নেয় যে  কাউন্ট ফ্রান্সেসকো থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই আর সবাই মিলে লোকটাকে খতম করার পরিকল্পনা করে। ১৫৯৮ সালে, ফ্রান্সেস্কোর প্রাসাদে থাকাকালীন সময়ে, দুই জন চাকর (যাদের মধ্যে একজন বিয়াত্রিচের গোপন প্রেমিক ) লোকটাকে মাসক খাইয়ে নেশা করিয়েছিল। বিয়াত্রিচে, তার ভাইরা এবং তাদের সৎ মা মিলে  হাতুড়ি দিয়ে ফ্রান্সেসকোকে খুন করে । যাতে মনে হয় লোকটার মৃত্যু  দুর্ঘটনায় হয়েছে, তারা লাশটিকে একটা বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দেয়।
    কাউন্টের অনুপস্থিতি কারণ খুঁজতে  পোপের পুলিশ তদন্ত করে। বিয়াত্রিচের প্রেমিককে  নির্যাতন করে খবর আদায়ের চেষ্টা হয় কিন্তু সত্য প্রকাশ না করেই সে  মারা যায় । এদিকে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অবগত এক পারিবারিক বন্ধু  ঝুঁকি এড়াতে দ্বিতীয় চাকরকে হত্যার নির্দেশ দেয়। তবুও, চক্রান্তটা জানাজানি হয়ে যায় আর চেনচি পরিবারের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয় আর  মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় । হত্যার কারণ জানতে পেরে, রোমের সাধারণ মানুষ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, যার ফলে ফাঁসি কিছুকালের জন্য স্থগিত হয় । পোপ ক্লিমেন্ট অষ্টম ,  কোনো দয়া দেখাননি আর শাস্তি মুকুব করেননি। একটা কুড়ুল দিয়ে প্রত্যেকের মাথা ধড় থেকে আলাদা করা হয় । মৃত্যুর সময়ে বিয়েত্রিচে ছিলেন শান্ত আর দোষ স্বীকার করেননি।
    বিয়েত্রিচেকে মন্টোরিওর সান পিয়েত্রোর গির্জায় সমাহিত করা হয় । বিয়াত্রিচে রোমের মানুষের কাছে অহংকারী অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে । জনগণের বিশ্বাস যে  প্রতি বছর তার মৃত্যুর বার্ষিকীর আগের রাতে, সে সান্ত'অ্যাঞ্জেলো সেতুতে তার কাটা  মাথাটি নিয়ে ফিরে আসে, যেখানে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল । 

    দর্শকদের নৈতিক পূর্ব ধারণাগুলিকে অভিভূত করার জন্য  নিষ্ঠুরতার শৈলীতে লেখা, কাউন্ট  তার পরিবারের উপর  যে অত্যাচার চালিয়েছিল, তা নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করেছেন অঁতনা আতো।নাটকটির মঞ্চোয়নে , আলো আর শব্দের আতোর দর্শন জড়িত। ১৯৩৫ সালে নাটকটির  প্রযোজনায় সেন্সি চরিত্রে আতো অভিনয় করেছিলেন। নাটকটি কেবল তার নিষ্ঠুরতা, সহিংসতা, অজাচার এবং ধর্ষণের কারণেই দর্শকদের হতবাক করেনি, বরং এর চরিত্রগুলোকে দিয়ে তিনি অদ্ভুত এবং কৃত্রিমভাবে কথা বলিয়েছিলেন। কারণ নাটকটির  তত্ত্ব , যা পরাবাস্তববাদী আন্দোলন এবং বালিনী নৃত্যনাট্য দ্বারা প্রভাবিত, চরিত্রগুলোকে বাস্তববাদী মানুষদের বদলে সর্বজনীন শক্তির প্রতিনিধিত্ব করার জন্য উপস্হাপন করেছিলেন।
    আতোর কাছে, এই প্লট ছিল পাঠ্যপুস্তক থেকে একটি বিরল অব্যাহতি। একজন নাটকীয় চিন্তাবিদ হিসাবে তাঁর প্রভাবকে অতিরঞ্জিত করা যায় না, তবে সেই একই লোকেরা যারা তাঁর তত্ত্বগুলো প্রশংসা করে প্রায়শই তাঁর নাটকগুলোকে মেনে নিতে পারে না।  সুসান সন্টাগ লিখেছেন যে "এখন থিয়েটারে কাজ করে এমন কেউই আতো’র  ধারণাগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়," তবুও তিনি আরও বলেছেন "দ্য চেনচি "খুব ভাল নাটক নয়।" আতোর দ্বারা নাটকটির মঞ্চায়ন ছিল বাণিজ্যিক ফ্লপ , ১৭ দিন মঞ্চায়নের পর বন্ধ হয়ে যায়। এবং ব্রিটিশ পরাবাস্তববাদী সাইমন ওয়াটসন টেলরের একটি ব আজে অনুবাদের কারণে, নাটকটি কার্যত ইংরেজি ভাষাভাষীদের দ্বারা উপেক্ষিত । আলোচকদের মতে নাটকটি খুবই গ্রাফিক, হিংসাত্মক এবং বিরক্তিকর, এবং  প্রায়শই এর অত্যধিক পরাবাস্তবতার জন্য সমালোচিত হয়। এটি খুব কমই মঞ্চয়ন হয়েছে কারণ দর্শকরা এটিকে অসহ্য ও  বেদনাদায়ক বলে মনে করেন।
    তিরিশ বছর পর নাটকটি নিউ ইয়র্কে মঞ্চস্হ হয় । অধ্যাপক রিচার্ড সিবার্থের নাটকটি ইংরেজিতে নতুন অনুবাদ করেন (নাটকটির প্রথম আমেরিকান অনুবাদ)। তবুও নাটকটির মঞ্চায়ন কঠিন ছিল মূলত আতো’র নাটকটি নিয়মহীন, উদ্ভট ভাষা, অস্পষ্ট চরিত্র এবং বিভ্রান্তিকর প্লট টুইস্টে ব্যবসা করে এবং এটিকে সুসংগতভাবে মঞ্চায়ন করা একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ ছিল।

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:b42b:f4bf:3b45:46e7:f4b2 | ১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৪৭740509
  • আতো’র অঙ্কনপ্রতিভা : মলয় রায়চৌধুরী
    ফরাসি নাট্যকার, সমালোচক এবং শিল্পী অঁতনা আতোকে ( ১৮৬৯- ১৯৪৮) কোনো বিশেষ শিল্পের খোপে ফেলা কঠিন । একজন আইকনোক্লাস্ট এবং যিনি স্বীকার করেন যে তিনি উন্মাদ , তিনি বিশ শতকের প্রথম দিকে পরীক্ষামূলক থিয়েটারের একটি নতুন যুগের সূচনা করতে সাহায্য করেছিলেন, দর্শকদের সমালোচনামূলক ব্যস্ততাকে, অভিনয় দেখার সময়ে জাগ্রত করার জন্য, তাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে উপস্হাপনের মর্মান্তিক আবেদনের প্রক্রিয়ার তত্ব তৈরি করেছিলেন। যে শিল্পকর্মের জনারে হাত দিয়েছেন, তাতেই রদবদল ঘটিয়েছেন। 
    তাঁর নামের সঙ্গে ইউরোপের সাধারণ পাঠকরা পরিচিত নন, বাংলা ভাষাতেও তাঁকে নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়নি, তাঁর প্রভাব কিন্তু পড়েছে নাটকে, নাটকের মঞ্চায়নে, সমালোচনায় এবং ফিল্মে ( মাদার ) ও টেলিভিশনে ( দি হ্যাণ্ডমেইডস টেল ) হিংস্রতা দেখানোয় । পর্দায় ও মঞ্চে তাঁর বর্বরতা উপস্হাপনকে বলা হয়েছে ‘বারোক’।বলা বাহুল্য যে ছবি আঁকাতেও পাওয়া যাবে মানবমুখ ও শরীরকে দোমড়ানো-মোচড়ানোর শৈলী ।  যদিও তিনি খ্যাত তাঁর সমালোচনামূলক প্রথাবিরোধী লেখাগুলির জন্য, তাঁর খ্যাতির আসল কারণ , বিশেষত ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত তাঁর  প্রবন্ধ সংকলন ‘দি থিয়েটার অ্যান্ড ইটস ডাবল’-এর বক্তব্যগুলো  বৈচিত্র্যময় । 
    জাক দেরিদা এবং  পল থিভেনাঁ ১৯৯৬ সালে আতোর আঁকা জীবনের শেষ দিকের ছবিগুলোর একটি প্রদর্শনী করেছিলেন এবং সেই উপলক্ষে আতো’র অঙ্কনপ্রতিভার বিশ্লেষণ করেছিলেন । কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত এই কাজগুলি - একই সাথে ভয়ঙ্কর এবং সুন্দর - একটি বিধ্বংসী রেকর্ড যা একজনের আত্মাকে আঁকড়ে কাগজের ওপর তাকে তুলে ধরেছে। বোঝা যায় যে  একজন শিল্পীর তার জীবনের শেষের দিকে এসে নিজেকে এবং নির্যাতিত অন্তরজগতের উথালপাথালকে  একত্রিত করার চেষ্টা করে গেছেন। আর এই ছবিগুলো আঁকার মাধ্যমে তাঁর তত্বকেও স্পষ্ট করতে চেয়েছেন ।  আতো তাঁর  জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন এক গারদ থেকে অন্য গারদে, আর তাঁর আঁকা ছবিগুলোতেও পাওয়া যায় গারদে  বন্দি একজন শিল্পীর  আর্ত চিৎকার।
     থিভেনাঁ লিখেছেন যে, গ্রাফিক শিল্পে আতো’র আগ্রহের বিকাশের পাশাপাশি তিনি ইমপ্রেশনিজম এবং ফাউভিজমের মতো শিল্প আন্দোলন এবং এদুয়ার মুঞ্চের উদ্বেগজনক, কখনও কখনও নিঃস্ব, ল্যান্ডস্কেপগুলোকে নিজের আঁকা ছবিতে বিনির্মাণের চেষ্টা করেছেন।  থিভেনা’র মতে, অভিব্যক্তির অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া ছিল আতোর প্রাথমিক আকর্ষণ। শিল্পীর গভীর, অত্যাবশ্যক চরিত্রের যোগাযোগের জন্য প্রযুক্তিগত নির্বাহ ছিল গৌণ। তাঁর পরবর্তী কাজে, এই দর্শনটি জটিল হয়ে ওঠে কারণ তিনি কখনও কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে অশোধিত কাজ তৈরি করতেন, এটিকে একটি অবিচ্ছিন্ন নৈপুণ্যের নির্মম আঘাতের কাছে জমা দিয়ে অভিব্যক্তির শক্তি পরীক্ষা করতেন দর্শকদের আঘাত দিয়ে জাগিয়ে তোলার জন্য।
     তাঁর তথাকথিত ‘পাগলামিতে পেয়ে বসার সময়ে’ আতো আশ্রয় নিতেন আঁকার। তাঁর সর্বোত্তম অভিব্যক্তি খুঁজে পেয়েছিল, লেখনকর্ম আর চিত্রের মিশেলে যা আতো ১৯৩৭ সালে আয়ারল্যান্ড ভ্রমণের সময় একটি স্নায়বিক আক্রমণের পরে তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। আতোকে পরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হলে, তাঁর ডাক্তার মানসিক অসুস্থতার প্রমাণ হিসাবে "পাগলামিতে পেয়ে বসা" উল্লেখ করেছিলেন। দেশলাই  আর সিগারেট দিয়ে পোড়ানো এবং ক্রস, ইনফিনিটি চিহ্ন এবং অন্যান্য বিমূর্ত চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা, কাগজের এই ছেঁড়া বা আধপোড়া টুকরোগুলো আতোর মগজের তীব্র চিৎকারকে রূপায়িত করেছে । থিভেনাঁ মনে করেন যে, এই ধারণা এড়ানো কঠিন যে এই আঁকাগুলো আতো’র রচনার পরিশিষ্ট নয় যতটা তাদের সমাপ্তি। তাঁর আজীবন থিম্যাটিক আগ্রহ - মানুষের দেহের নিগ্রহের সঙ্গে তার মলমূত্রের দৈবিক সংমিশ্রণ - কাগজের ওপর সমস্ত বিদ্বেষ আর ধ্বংসাত্মক মনোভাবের সাথে প্রকাশ করা হয়েছে যে ব্যাপারটা তাঁকে তাঁর নাট্য প্রযোজনায় এড়িয়ে গিয়েছিল। আতোর চূড়ান্ত কাজ, নিজেরই বিকৃত প্রতিকৃতিগুলির একটি সিরিজ।
     ‘পাগলামিতে পেয়ে বসা’ পর্বের পরে আতো পরিচিতদের প্রতিকৃতির একটি সিরিজ এঁকেছিলেন, সেইসাথে প্রতীক এবং শরীরের অংশগুলির রহস্যময় মিলনগুলি এসেছিল যেখানে একটি ম্যানিক গ্রাফিজম পৃষ্ঠাটিকে ছাড়িয়ে যায়। ১৯৪৫ সাল থেকে "বিইঙ অ্যান্ড ইটস ফিটাসেস”-এ, আমরা হাড়, অন্ত্র এবং একজন মহিলাকে জ্যামিতিক আকারে কাটাছেঁড়া অবস্হায় দেখি। বিকৃত আত্মপ্রতিকৃতিগুলো তাঁর বৈদ্যুতিক শক থেরাপির দুঃসহ যন্ত্রণার পরে তাঁর নিজের ছিন্নভিন্ন অনুভূতিকে পুনর্গঠন করার চেষ্টা বলে মনে হয়; বৈশিষ্ট্যগতভাবে, তাঁর শৈলী ছিল  নিরাময়ের কৌশল ।  বিকৃত আত্মপ্রতিকৃতিগুলো তাঁর বৈদ্যুতিক শক থেরাপির দুঃসহ যন্ত্রণার পরে তাঁর নিজের ছিন্নভিন্ন অনুভূতিকে পুনর্গঠন করার চেষ্টা বলে মনে হয়; বৈশিষ্ট্যগতভাবে, তাঁর শৈলী ছিল  নিরাময়ের কৌশল । ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৪৬ সালে আঁকা একটি আত্মপ্রতিকৃতিতে দেখা যায় আতো’র  মাথা পৃষ্ঠার মাঝখানে ঘোরাফেরা করছে, আপাতদৃষ্টিতে শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। আরেকটি আত্মপ্রতিকৃতিতে, মে মাসের ১১ তারিখে আঁকা,  তাঁর মুখাবয়ব পচে গেছে বলে মনে হচ্ছে; পেন্সিলের খোঁচা দিয়ে ছবিটাকে বিদ্ধ করেছেন ।  এটা ঠিক যে, অঁতনা আতো নামের লোকটিকে তাঁর উন্মাদনা  থেকে আলাদা করা  বিশেষভাবে কঠিন, কারণ তাঁর জ্বরে উত্তপ্ত আঁকা ছবি আর লেখাগুলো প্রায়শই তাঁর অসুস্থতা থেকে সরাসরি উদ্ভূত । 
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:b42b:f4bf:3b45:46e7:f4b2 | ১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৪৯740510
  • অঁতনা আতো’র কবিতা : মলয় রায়চৌধুরীর অনুবাদ
    নিরংশু কবি
    নিরংশু কবি, একটি তরুণীর বুক
    তোমাকে হানা দিয়ে বেড়ায়,
    তিক্ত কবি, জীবন ফেনিয়ে ওঠে
    আর জীবন পুড়তে থাকে,
    আর আকাশ নিজেকে বৃষ্টিতে শুষে নেয়,
    জীবনের হৃদয়ে নখের আঁচড় কাটে তোমার কলম ।
    অরণ্য, বনানী, তোমার চোখ দিয়ে প্রাণবন্ত
    অজস্র ছেঁড়া পালকের ওপরে ;
    ঝড় দিয়ে বাঁধা চুলে কবি চাপেন ঘোড়ায়, কুকুরের ওপরে ।
    চোখ থেকে ধোঁয়া বেরোয়, জিভ নড়তে থাকে
    আমাদের সংবেদনে স্বর্গ উথালপাথাল ঘটায়
    মায়ের নীল দুধের মতন ;
    নারীরা, ভিনিগারের কর্কশ হৃদয়,
    তোমাদের মুখগহ্বর থেকে আমি ঝুলে থাকি ।
    আমার টাকাকড়ি নেই
    আমার টাকাকড়ি নেই কিন্তু
    …………………………………………………..
    আমি আঁতোনা আতো
    আর আমি ধনী হতে পারি
    ব্যাপকভাবে আর এক্ষুনি ধনী হতে পারি
    যদি আমি তার জন্য প্রয়াস করতুম ।
    সমস্যা হলো আমি চিরকাল টাকাকড়িকে,
    ধনদৌলতকে, বৈভবকে ঘৃণা করেছি ।
    ………………………………………………………….
    কালো বাগান
    এই কালো পাপড়িগুলো ভারতের আকাশের  ঘুর্ণাবর্তকে ঘোরাও।
    ছায়ারা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলেছে যা আমাদের সহ্য করে ।
    তোমার নক্ষত্রদের মাঝে চাষের জমিতে পথ খুলে দাও ।
    আমাদের আলোকিত করো, নিয়ে চলো তোমার নিমন্ত্রণকর্তার কাছে,
    চাঁদির সৈন্যবাহিনী, নশ্বর গতিপথে
    আমরা রাতের কেন্দ্রের দিকে যেতে চেষ্টা করি ।
    …………………………………………………………………………….
    আমি কে
    আমি কে ?
    আমি কোথা থেকে এসেছি ?
    আমি আঁতোনা আতো
    আর আমি একথা বলছি
    কেননা আমি জানি তা কেমন করে বলতে হয়
    তাৎক্ষণিকভাবে
    তুমি আমার বর্তমান শরীরকে দেখবে
    ফেটে গিয়ে বহু টুকরো হয়ে গেছে
    আর তাকে আবার গড়ে ফেলবে
    দশ হাজার কুখ্যাত পরিপ্রেক্ষিতে
    এক নতুন শরীর
    তখন তুমি আমাকে
    কখনও ভুলতে পারবে না ।
    …………………………………………………………………….
    স্নায়ু ছন্দ
    একজন অভিনেতাকে দেখা হয় যেন স্ফটিকের ভেতর দিয়ে ।
    মঞ্চের ওপরে অনুপ্রেরণা ।
    সাহিত্যকে বেশি প্রবেশ করতে দেয়া উচিত নয় ।
    আমি আত্মার ঘড়ি ধরে কাজ করা ছাড়া আর কোনো চেষ্টা করিনি,
    আমি কেবল নিষ্ফল সমন্বয়ের যন্ত্রণাকে লিপ্যন্তর করেছি ।
    আমি একজন সম্পূর্ণ রসাতল ।
    যারা ভেবেছিল আমি সমগ্র যন্ত্রণার যোগ্য, এক সুন্দর যন্ত্রণা,
    এক ঘন আর মাংসল পীড়া, এমন এক পীড়া যা বিভিন্ন বস্তুর মিশ্রণ,
    বুদবুদ-ভরা একটি নিষ্পেশিত ক্ষমতা
    ঝুলিয়ে রাখা বিন্দু নয় — আর তবু অস্হির, উপড়ে-তোলা স্পন্দনের সাহায্যে
    যা আমার ক্ষমতা আর রসাতলের দ্বন্দ্ব থেকে আসে
    শেষতমের উৎসার দেয় ( ক্ষমতার তেজের দ্বন্দ্বের মাপ বেশি ),
    আর কোনও কিছু বাকি থাকে না বিশাল রসাতলগুলো ছাড়া,
    স্হবিরতা, শীতলতা–
    সংক্ষেপে, যারা আমাকে অত্যধিক জীবনের অধিকারী মনে করেছিল
    আত্মপতনের আগে আমার সম্পর্কে ভেবেছিল,
    যারা মনে করেছিল আমি যন্ত্রণাদায়ক আওয়াজের হাতে নির্যাতিত,
    আমি এক হিংস্র অন্ধকারে লড়াই করেছি
    তারা সবাই মানুষের ছায়ায় হারিয়ে গেছে ।
    ঘুমের ঘোরে, আমার পুরো পায়ে স্নায়ুগুলো প্রসারিত হয়েছে ।
    ঘুম এসেছে বিশ্বাসের বদল থেকে, চাপ কমেছে,
    অসম্ভাব্যতা আমার পায়ের আঙুলে জুতো-পরা পা ফেলেছে ।
    মনে রাখা দরকার যে সমগ্র বুদ্ধিমত্তা কেবল এক বিশাল অনিশ্চিত ঘটনা,
    আর যে কেউ তা খুইয়ে ফেলতে পারে, পাগল বা মৃতের মতন নয়,
    বরং জীবিত মানুষের মতন, যে বেঁচে আছে
    আর যে অনুভব করে জীবনের আকর্ষণ আর তার অনুপ্রেরণা
    তার ওপর কাজ করে চলেছে ।
    বুদ্ধিমত্তার সুড়সুড়ি আর এই  প্রতিযোগী পক্ষের আকস্মিক প্রতিবর্তন ।
    বুদ্ধিমত্তার মাঝপথে শব্দেরা ।
    চিন্তার প্রতিবর্তন প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা একজনের চিন্তাকে হঠাৎ নোংরামিতে পালটে দ্যায় ।
    এই সংলাপটি চিন্তার অন্তর্গত ।
    ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়া, সবকিছু ভেঙে ফেলা ।
    আর হঠাৎ আগ্নেয়গিরিতে এই পাতলা জলের স্রোত, মনের সরু, আস্তে-আস্তে পতন ।
    আরেকবার নিজেকে ভয়ঙ্কর অভিঘাতের মুখোমুখি আবিষ্কার করা, 
    অবাস্তবের দ্বারা নিরসিত, নিজের একটা কোনে, বাস্তব জগতের কয়েকটা টুকরো-টাকরা ।
    আমিই একমাত্র মানুষ যে এর পরিমাপ করতে পারি ।
    …………………………………………………………………………………..

    ভালোবাসা
    আর ভালোবাসা? আমাদের নিজেকে পরিষ্কার করে ফেলতে  হবে
    এই বংশগত নোংরামি থেকে
    যেখানে আমাদের ভেতর নাক্ষত্রিক পোকা
    কিলবিল করে বেড়ায়
    .
    সেই অঙ্গ, যে অঙ্গ বাতাসকে পিষে মারে
    উত্তাল সমুদ্রের জোয়ারকেও
    সেগুলো আসলে এই বিরক্তিকর 
    স্বপ্নের ফালতু সুর
    .
    ওই মহিলার , আমাদের বা এই আত্মার
    আমাদের সাথে ভোজসভায় বসেছে
    আমাদের বলুন কে প্রতারিত হয়েছে,
    কুখ্যাতির এই প্রেরণাদায়িনী
    .
    যে মহিলা আমার বিছানায় ঘুমায়
    আর আমার ঘরের বাতাসে  ভাগ বসায়,
    আমার মনের কড়িকাঠে বসে
    টেবিলে পাশা খেলতে পারে
    ………………………………………………………………………………………..
    কালো কবি       
    কালো কবি, একটি কুমারীর স্তন
    তোমাকে তাড়া করে,
    বিষণ্ণ কবি, জীবন ছটফট করে
    আর শহরগুলো পুড়ে খাক হয়ে যায়,
    আর  আকাশ  চুষে নেয় বৃষ্টিকে,
    ঠিক যেমন তোমার কলম  জীবনের হৃদয়ে লেখালিখি করে ।
    .
    বনাঞ্চল, বনাঞ্চল, তোমার চোখে জীবিত,
    একাধিক ডানার ওপর;
    ঝড়ে ওড়ানো চুল নিয়ে,
    কবিরা ঘোড়ায় চড়ে, কুকুরের ওপর চড়ে।
    .
    চোখ জ্বলে ওঠে, জিভ ছোবল মারে,

    আকাশ আমাদের ইন্দ্রিয়ে ঢুকে ঢেউ তোলে
    মায়ের পুষ্টিকর দুধের মতো;
    নারীর দল, আমি তোমাদের মুখ থেকে ঝুলে আছি
    .
    আর তোমাদের কঠিন অম্লজারিত হৃদয়কে লাথাচ্ছি ।
    ……………………………………………………………………………
    রহস্যময় জাহাজ
    আমার অসুস্হ স্বপ্নগুলোকে ভিজিয়ে দেয় এমন সমুদ্রে,
    সেই প্রাচীন জাহাজ গিয়েছে হারিয়ে
    কুয়াশায় লুকিয়ে আছে তার উঁচু মাস্তুল
    বাইবেলের আর বৃন্দগানে-ভরা আকাশে।
    .
    তা কিন্তু গ্রিক যাজকদের মতন হবে না
    যারা পাতাহীন গাছের মাঝে হালকা চালে খেলা করে;
     বিদেশে তার বিরল পণ্যসম্ভার
    কখনই বিক্রি করবে না পবিত্র জাহাজ
    .
    জাহাজটা তো পৃথিবীর কোন উষ্ণ বন্দরের কথা জানে না,
    চিরকাল একা, ও কেবল একমাত্র ঈশ্বরকে জানে,
    যেমন-যেমন জাহাজটা  মহিমান্বিত, অসীম তরঙ্গে ঢেউ তুলে এগিয়ে যায় ।
    .
    রহস্যের মধ্যে ডুবে যায় তার ছুঁচালো মুখ;
    রাতে, এর মাস্তুলের বাতিগুলো জ্বলজ্বল করে
    মেরু নক্ষত্রের রহস্যময় রূপালী  নিয়ে।
    ………………………………………………………………………..
    প্রার্থনা
    আহ, আমাদের দাও জ্বলন্ত করোটিগুলো
    আকাশ থেকে বাজ পড়ে যে করোটিগুলো পুড়ছে
    পরিষ্কার করোটি, আসল করোটি,
    যেগুলো আপনার উপস্থিতির দ্বারা শুদ্ধ
    .
    আমাদের গভীর আকাশের গর্ভে পৌঁছে দাও
    যেখানে ঝরনার জলে ভরে যায় খাদ 
    আর  যেখানে ঘুর্নিজল তোমার ভাস্বর শক্তি দিয়ে 
    আমাদের পূর্ণ করে তোলে
    .
    আমাদের খেতে দাও - এই দিনটিতে প্রতিদিনের 
    বিভ্রান্তির পবিত্রতা খাওয়াও আমাদের,
    আহ, তোমার রক্তের বদলে
    আমাদের সাথে নক্ষত্র আর আগ্নেয়গিরির লাভা ভাগাভাগি করো,
    .
    আমাদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করো।  উপজাতিতে বিভক্ত করো
    তোমার হাতের অনন্ত আগুন দিয়ে
     আমাদের  জ্বলন্ত রাস্তা দিয়ে পাঠাও,
    যেখানে আমরা মৃত্যুর ওপারে গিয়ে মরতে পারবো
    .
    আমাদের মগজকে মুচড়ে বিকৃত করে দাও
    আর যেমন-যেমন আমরা নতুন ঝড়ের মুখোমুখি হবো
    আমাদের দেবত্বের পরিচয় জেনে নিয়ে,
    আমাদের বুদ্ধিমত্তায় আনন্দ করো ।
    …………………………………………………………………….
    .
    যৌনতার পাড়া
    যৌ্নতার পাড়া হঠাৎ  জীবন্ত হয়ে ওঠে
    অবাঞ্ছিত মুখ দেখা দেয়;
    ক্যাফেগুলো চোর-বাটপাড়ের, গুজগুজ-ফিসফিসে ভরা
    রাস্তার দুধার।
    .
    যৌনসঙ্গ-লোভী হাত পকেট হাতড়ায় ,
    পেটের তলায় কুঁচকি  তপ্ত হয়ে ওঠে;
    আর যখন ইচ্ছার সংঘর্ষ হয়,
    গর্তের তুলনায় মাথার দাম কমে যায় ।
    ………………………………………………………………………….
    .
    আমার সাথে কুকুরদেবতা আর তার জিভ'
    (The Umbilicus of Limbo থেকে)
    আমার সাথে আছে কুকুরদেবতা আর  তার জিভ,
    যা গলায় ফাঁস দিয়ে কেটে বসে যেতে পারে 
    চুলকানিময় বিশ্বজগতের 
    দুটো খিলানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা চামড়ার টুপিঅলাকে ।
    .
    আর এখানে রয়েছে জলের ত্রিভুজ
    যা পোকার আদলে কুঁকড়ে-কুঁকড়ে চলে,
    কিন্তু যা একটা জ্বলন্ত কুঁড়িকে
    ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুরি মারতে তৈরি।
    .
    জঘন্য এই বিশ্বজগতের  বুকের তলায়
    লুকিয়ে রেখেছে দেবী-কুক্কুরী
    পৃথিবীর স্তন এবং হিমায়িত দুধ
    যে তার ফাঁপা জিভকে  পচিয়ে দেবে ।
    .
    আর  এখানে রয়েছে হাতুড়ি-হাতে একজন কুমারী,
    পৃথিবীর গুহাগুলোকে চুরমার করার জন্য তৈরি
    সেখানে কুকুর নক্ষত্রের মাথার করোটি
    ভয়ঙ্করভাবে উঠতে শুরু করে।
    ………………………………………………………………….

    .

     
     
     
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:b42b:f4bf:3b45:46e7:f4b2 | ১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৫১740511
  • অঁতনা আতোর শ্রুতিনাটক : ঈশ্বরের বিচারকে বাতিল করা বিষয়ক
    মলয় রায়চৌধুরীর অনুবাদ

    টীকা : বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে তাঁর শেষ বছরগুলো কাটাবার পরে, অঁতনা আতো ১৯৪৭ সালে এই  শ্রুতি নাটক “ঈশ্বরের বিচারকে বাতিল করা বিষয়ক” লিখে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চেয়েছিলেন। যদিও কাজটি তাঁর ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির’ পর্যায়ে পড়ে, মানেহীন শব্দ, কান্না, চিৎকার এবং কণ্ঠস্বর ব্যবহার করার কথা ছিল । ফরাসি রেডিও এই শ্রুতিনাটককে দোসরা  ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ তারিখে  সম্প্রচার করার কথা ঘোষণা করে । অঁতনা আতোর এই শ্রুতিনাটক ছিল তাঁর  শেষ কাজ ।   এটা সেই সময়ের অন্তত কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোকের কাছে সমানভাবে অপ্রিয় বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ফরাসি রেডিওর নাটকীয় এবং সাহিত্যিক সম্প্রচারের প্রধান ফার্দিনান্দ পাউয়ের দ্বারা পরিচালিত, কাজটি অঁতনা আতো সেই সময়ে লিখেছিলেন যখন তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুটা সময়  একটা মানসিক হাসপাতালে কাটিয়েছিলেন যেখানে তাঁকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে খারাপ চিকিৎসা পদ্ধতি সহ্য করতে হয় । শ্রুতিনাটকটা  ততটাই খোলামেলা আর আবেগগতভাবে নগ্ন যতটা পাঠক অঁতনা আতোর কাছে আশা করতে পারেন - সমাজের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ। স্ক্যাটোলজিকাল চিত্র, চিৎকার, বাজে শব্দ, আমেরিকাবিরোধী আর ক্যাথলিকবিরোধী কথাবার্তায় ভরা লিখন-উন্মাদনা। কিন্তু তার আগের দিন অনুষ্ঠান বাতিল করে দেয়া হয়। স্টেশন ডিরেক্টর ভ্লাদিমির পোর্শে শেষ মুহুর্তে এটিকে প্রোগ্রাম থেকে ছাঁটাই করে দিয়েছিলেন। স্পষ্টতই, তিনি মলত্যাগ এবং বীর্য বা আমেরিকাবিরোধী আক্রমণ প্রসঙ্গ মোটেই পছন্দ করেননি । কিন্তু  পোর্শের প্রত্যাখ্যান প্যারিসীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল। রেনে ক্লেয়ার, জাঁ ককতো এবং পল এলুয়ারসহ অন্য কবি-লেখক-শিল্পীরা জোর গলায় এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছিলেন যার ফলে পাউই এমনকি প্রতিবাদে তাঁর চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, যদিও কোন লাভ হয়নি। এটি  তখন প্রচারিত হয়নি। অঁতনা আতো প্রত্যাখ্যানটি খুব ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেছিলেন, আর এক মাস পরে মারা যান।

    Kré ক্রে

    puc te
    পুক তে
    kréক্রে

    সবকিছু অবশ্যই
    .
    প্রস্তুত থাক
    .
    একটি চুলের পরিমাপের
    .
     পরিপূর্ণতার
    .
    শৃঙ্খলার মধ্যে
    .

    puk te
    পুক তে
    pekপেক

    li le
    লি লে
    kréক্রে

    pek ti le
    পেক তি লে


    Kruk
    ক্রুক
    প্টে

    আমি গতকাল জানতে পারলুম
    (আমি হয়তো সময় থেকে  পিছিয়ে আছি , কিংবা সম্ভবত এটা শুধুমাত্র অলীক গুজব, সেইসব কটূ মন্তব্যগুলোর মতন যা প্রস্রাবঘর আর পায়খানার মাঝে চালাচালি  করা হয়  যখন হজমকরা খাবারগুলো আরও একবার ঢালু বালতিতে ফেলে দেওয়া হয়)
    আমি গতকাল জানতে পারলুম
    আমেরিকান পাবলিক স্কুলের সেই সরকারি অনুশীলনের  সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ব্যাপার 
    নিঃসন্দেহে এই সত্যের জন্য দায়ী যে ওই দেশ নিজেকে প্রগতির এগিয়ে থাকা দূত বলে বিশ্বাস করে। 
    দেখা গেছে যে , প্রথমবার সার্বজনীন স্কুলে প্রবেশ করার জন্য 
    একটি শিশুর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা বা পরীক্ষাগুলোর মধ্যে, 
    একটা হলো ধাতুরস বা শুক্রাণু পরীক্ষা, 
    যার জন্য স্কুলে প্রবেশকারী ছোটো শিশুটিকে বলা হয় তার ধাতুরস 
    একটা বয়ামে জমা করতে 
    যাতে পরবর্তীকালে তা কৃত্রিম প্রজনন প্রচেষ্টার জন্য হাতের কাছে থাকে।
    .
    কারণ আমেরিকানরা আরও বেশি বুঝতে পারছে 
    যে তাদের পেশীশক্তি এবং সন্তানের অভাব রয়েছে, 
    অর্থাৎ শ্রমিক নয় চাই সৈনিক, এবং তারা যেকোনও মূল্যে এবং সম্ভাব্য সব উপায়ে
     সৈন্য তৈরি করে রাখতে চায় যাতে সমস্ত গ্রহগুলোর ভবিষ্যৎ যুদ্ধে পরবর্তীতে কাজে লাগে
     আর তা  আমেরিকান পণ্যের শ্রেষ্ঠত্ব, এবং সমস্ত কার্যকলাপের ক্ষেত্রে 
    আমেরিকান ঘামের ফলাফল দর্শানো যাবে 
    এবং শক্তির সম্ভাব্য গতিশীল  বলপ্রয়োগের অপ্রতিরোধ্য গুণাবলী  প্রদর্শন  করা হবে।.
    .
    কারণ প্রত্যেককে অবশ্যই উৎপাদন করতে হবে, 
    সবাইকে অবশ্যই সমস্ত সম্ভাব্য ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে 
    প্রকৃতিকে যেখানে-যেখানে সম্ভব সরিয়ে দিতে হবে, 
    একজনকে অবশ্যই মানব জড়তার জায়গায় 
    একটা প্রধান কর্মোদ্যম খুঁজে বের করতে হবে, 
    শ্রমিকদের অবশ্যই সবসময় ব্যস্ত রাখার জন্য কিছু থাকা দরকার, 
    কাজকর্মের নতুন এলাকা তৈরি করতে হবে 
    যেখানে আমরা শেষ পর্যন্ত সমস্ত নকল  পণ্যের রাজত্ব দেখতে পাব,
     সমস্ত জঘন্য কৃত্রিম বিকল্পগুলো পাবো যেখানে সুন্দর বাস্তব প্রকৃতির কোনও অবদান নেই, 
    আর সেই সমস্ত নকল বিজয়ীদের সামনে অবশেষে 
    এবং লজ্জাজনকভাবে পথ ছেড়ে দিতে হবে  
    যেখানে সমস্ত কৃত্রিম প্রজনন কারখানার শুক্রাণু  একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটাবে 
    যা থেকে পয়দা হবে সেনাবাহিনী এবং অগুন্তি যুদ্ধজাহাজ।
    আর ফলফুল দরকার নেই, আর গাছপালা দরকার নেই, 
    আর শাক-সবজি  দরকার নেই, আর কোনো ওষধি চারাগাছ দরকার নেই 
    ফলে আর কোনো খাদ্যবস্তু দরকার নেই, 
    কিন্তু তৃপ্তির জন্য নকল জিনিস, ধোঁয়ার মধ্যে, 
    বায়ুমণ্ডলের বিশেষ হাস্যরসের মধ্যে, 
    বায়ুমণ্ডলের বিশেষ অক্ষে হিংস্রভাবে আঘাত করে 
    কেড়ে নেয়া  প্রকৃতির প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে যা ভয় ছাড়া যুদ্ধের কিছুই জানে না।
    আর যুদ্ধ কতো বিস্ময়কর, তাই না?

    কেননা যুদ্ধের জন্যই তো, তাই না, 
    আমেরিকানরা ধাপে ধাপে এইভাবে নিজেদের তৈরি করছে আর প্রস্তুতি নিচ্ছে। 
    এই বুদ্ধিহীন উৎপাদনকে সমস্ত প্রতিযোগীতা থেকে আড়ালে রাখার জন্য, 
    যে প্রতিযোগীতা চারিদিক থেকে দাঁড়ালে তাকে  ব্যর্থ করা যায় , 
    একজনের অবশ্যই সৈন্য, সেনাবাহিনী, বিমান, যুদ্ধজাহাজ থাকতে হবে,
     আর তাই এই শুক্রাণু সংগ্রহ  মনে হয় 
    আমেরিকার সরকারগুলিকে চিন্তা করার দুঃসাহস যুগিয়ে  ছিল।
    কারণ আমাদের জন্য অপেক্ষা  করছে একাধিক শত্রু, আমার ছেলে, 
    আমরা, জন্মগত পুঁজিবাদী আর এই শত্রুদের মধ্যে স্টালিনের রাশিয়া, 
    যেখানে সশস্ত্র লোকেদের অভাব নেই।
    এই সব খুবই ভাল, কিন্তু আমি জানতাম না আমেরিকানরা এমন যুদ্ধবাজ মানুষ। 
    যুদ্ধ করার জন্য একজনকে অবশ্যই গুলি খেতে হবে 
    আর যদিও আমি অনেক আমেরিকানকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখেছি, 
    তাদের কাছে সবসময় ট্যাঙ্ক, বিমান, যুদ্ধজাহাজের বিশাল বাহিনী ছিল 
    যা তাদের ঢাল হিসাবে কাজ করছিল।
    আমি মেশিনগুলোকে অনেক লড়াই করতে দেখেছি 

    কিন্তু তাদের অনেক পেছনে আমি তাদের চালনা করার লোকগুলোকে দেখেছি। 
    যে সমস্ত লোক তাদের ঘোড়া, গবাদি পশু এবং খচ্চরকে 
    তাদের ছেড়ে যাওয়া শেষ বিশাল ওজনের 
    আসল মরফিন খাওয়ায় আর ধোঁয়া থেকে তৈরি বিকল্প দিয়ে প্রতিস্থাপন করে, 
    তাদের চেয়ে আমি তাদের পছন্দ করি যারা খালি মাটিপৃথিবীর প্রলাপ খায় 
    আমি বলতে চাই যেখান থেকে তাদের জন্ম হয়েছিল,
     অর্থাৎ ‘তারাহুমারা’ জন্মের সময় মাটি থেকে পিয়োট তুলে খাচ্ছে 
    আর যারা কালো রাতের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সূর্যকে হত্যা করেছে, 
    এবং যারা ক্রুশকাঠকে আছড়ে ভেঙেছে 
    যাতে ফাঁকা জায়গাগুলোর জায়গার সঙ্গে আর ক্রুশকাঠের দেখা না হয় ।
    আর তাই আপনি টুটুগুরির নাচ শুনতে পাবেন।

    টুটুগুরি

    কালো সূর্যের অনুষ্ঠান
    আর নীচে, যেন তেতো ঢালের একেবারে তলায়,
    হৃদয়ে নিষ্ঠুর হতাশায়,
    ছয় ক্রুশকাঠর  বৃত্তের ফাঁকা মাঝখানে,
    খুবই নীচের দিকে
    যেন মাতা-পৃথিবীতে গেঁথে আছে,
    মায়ের অশ্লীল আলিঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন
    তারা ঝিমোচ্ছে।
    কালো কয়লার পৃথিবীই
    একমাত্র স্যাঁতসেঁতে জায়গা
    এই ফাটলধরা পাথরে।
    অনুষ্ঠানের নিয়ম হল যে নতুন সূর্য পৃথিবীর চূড়ায় জ্বলে ওঠার আগে সাতটি বিন্দুর মধ্য দিয়ে যায়।
    আর ছয়জন পুরুষ আছে,
    প্রতিটি সূর্যের জন্য একটি,
    আর সপ্তম পুরুষ
    যে নিজেই সূর্য 
    কাঁচা অবস্হায়
    কালো আর লাল মাংস পরে আছে।
    .
    কিন্তু, এই সপ্তম মানুষ

    একটা ঘোড়া,
    একটা ঘোড়া যাকে নিয়ে যাচ্ছে একজন লোক।
    .
    কিন্তু এই ঘোড়াটাই
    আসলে সূর্য
    মানুষটা নয় ।

    .

    একটা ড্রাম এবং একটা  ট্রাম্পেটের দীর্ঘ সময়ের কাতরতায়,
    অদ্ভুত,
    সেই ছয়জন পুরুষ
    যারা শুয়ে ছিল,
    মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল ,
    সূর্যমুখী ফুলের মতন এক এক করে লাফিয়ে উঠে,
    সূর্যগুলোর মতন নয়
    কিন্তু ঘুরন্ত পৃথিবীর মতন,
    শাপলাগুলোর মতন,
    এবং প্রতিটি লাফ
    ক্রমশ মৃদু বিষণ্ণতা
    আর সংযতের মতন হয়ে উঠছিল
    .
    ড্রামের ঢমঢম আওয়াজ
    যতক্ষণ না সে হঠাৎ টগবগিয়ে ছুটে আসে, ঘুর্নির গতিতে,
    শেষ সূর্য,
    প্রথম মানুষ,
    কালো ঘোড়ার সঙ্গে একজন
    উলঙ্গ মানুষ,
    একেবারে ল্যাংটো
    এবং চিরকুমার
    ঘোড়াটায় চেপে যাচ্ছে
    .
    তারা লাফিয়ে ওঠার পরে, তারা ঘুরতে থাকা বৃত্তের চারিধারে এগিয়ে যায়
    এবং  ঘোড়ার পিছনে মাংসের রক্তক্ষরণ
    আর না থেমে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে
    শিলাপাথরের চূড়ায়
    যতোক্ষণ না ছয়জন  পুরুষ 
    ছটা ক্রুশকাঠকে
    ঘিরে রেখেছে
    পুরোপুরি ।
    এখন, এটাই অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত সারবস্তু
    ক্রূশকাঠের বিলোপ
    যখন তারা বাঁক না নিয়ে থেমেছে
    তারা উপড়ে ফেললো
    পৃথিবীর সমস্ত ক্রুশকাঠ
    এবং উলঙ্গ মানুষটা
    যে ছিল ঘোড়ার ওপরে
    তুলে ধরলো
    ঘোড়ার একখানা বিশাল নাল
    যা সে নিজের জখমের রক্তে চুবিয়ে দিলো ।
    সুবিধার সাধনা
    যেখানে সেখানে বিষ্ঠার দুর্গন্ধ
    সেখানেই অস্তিত্বের গন্ধ ।
    মানুষ না হাগলেই ভালো হতো,
    পোঁদের গর্ত না খোলা থাকলেই ভালো হতো,
    কিন্তু সে হাগা  বেছে নিয়েছে
    যেমনভাবে  সে বাঁচতে চেয়েছে
    তার বদলে বেঁচে মরে থাকার সম্মতি দিয়েছে।

    কারণ হাগবার জন্য,
    তাকে সম্মতি দিতে হবে
    যাতে তার অস্তিত্ব না থাকে,
    কিন্তু সে অস্তিত্ব খুইয়ে ফেলার ব্যাপারে  
    মনস্থির করতে পারেনি
    অর্থাৎ বেঁচে থেকে মরে যাওয়া 
    তার অস্তিত্ব । .
    মলত্যাগ ( এখানে আওয়াজ শোনানো হবে )
    অস্তিত্বের জন্য কেবল নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হবে,
    কিন্তু বাঁচতে হলে,
    একজন কেউকেটা হতে হবে,
    কেউকেটা হবার জন্য,
    একটি হাড় ধাকা জরুরি,
    যে হাড় দেখাতে ভয় পাবে না,
    আর সেই প্রক্রিয়ায় মাংস হারিয়ে ফেলবে।
    মানুষ সবসময় মাংস পছন্দ করেছে
    হাড়ের পৃথিবী তুলনায়
    কারণ আগে থাকতে শুধু মাটি আর হাড়ের লাঠি ছিল,
    আর  তার খাবার মাংস রোজগার করতে হয়েছিল,
    সেসময়ে শুধু লোহা আর আগুন ছিল
    এবং কোনও  গুগোবর ছিল না,
    আর মানুষের গু হারানোর ভয় ছিল
    কিংবা হয়তো মানুষ নিজেই গু  চেয়েছিল
    এবং, সেই জন্য, এই রক্ত বলিদান ।
    হাগবার জন্য,
    অর্থাৎ মাংস চাই,
    যেখানে শুধু রক্ত ছিল
    এবং হাড়ের আঁস্তাকুড়
    এবং যেখানে জেতার জন্য কেউই ছিল না
    কিন্তু যেখানে জীবন ছিল হারাবার জন্য
    শূন্য অনুসন্ধান মোড
    সম্পাদনা করতে
    ৎসা বলুন
    তাউ-দারি
    পেদে মলত্যাগ  করো
    এই সময়ে লোকটা উঠে পড়ে আর পালায় ।
    তারপর জন্তুগুলো তাকে খেয়ে ফ্যালে ।
    .
    ব্যাপারটা ধর্ষণ ছিল না
    ও নিজেই নিজেকে অশ্লীল খাবার হিসেবে ছেড়ে দিলো ।
    .
    খেয়ে ওর তৃপ্তি হলো,
    সে নিজেই শিখেছিল
    পশুর মত কাজ করতে
    আর ইঁদুর খেতে
    বেশ মজায় ।
    .
    আর এই নোংরা অবজ্ঞা কোথা থেকে আসে?
    .
    ঘটনা হলো  যে পৃথিবী এখনও গড়ে ওঠেনি,
    কিংবা জগতসংসার  সম্পর্কে মানুষটার কেবল যৎসামান্য ধারণা আছে
    আর তবু চিরকাল আঁকড়ে থাকতে চায়?
    .
    এই সত্য সেই তথ্য থেকে এসেছে যে মানুষ,
    আচমকা এক দিন,
    জগতসংসার সম্পর্কে চিন্তা করা
    বাতিল করে দিলো ।
    .
    তার জন্য দুটি পথ খোলা ছিল:
    একটা ঘেরাটোপহীন অসীম,
    অন্যটার ভেতরে অনন্ত ।
    .
    আর ও বেছে নিলো যার ভেতরে অনন্ত।
    যেখানে একজনকে শুধু মোচড়াতে হবে
    প্লীহা,
    জিভ,
    মলদ্বার
    কিংবা শিশ্নমুণ্ড ।
    আর ঈশ্বর, ঈশ্বর নিজেই মোচড়খানা দিলেন ।
    .
    ঈশ্বর কি কোন সত্তা?
    সে যদি তাই  হয় তবে সে গুগোবর।
    যদি সে তা না হয়
    তাহলে তার অস্তিত্ব নেই।
    .
    কিন্তু তার অস্তিত্ব আদপে নেই,
    কেবল শূন্যতা ছাড়া যা তার সমস্ত রূপ নিয়ে এগিয়ে আসে
    যার সবচেয়ে নিখুঁত চিত্রকল্প হলো
    অসংখ্য চামউকুনের একটা এগোতে থাকা দল।
    .
    “তুমি উন্মাদ না কি মসিয়ঁ আতো ? গির্জায় জনসমাবেশের কী হবে ?”
    .
    আমি গির্জার পবিত্র জল আর জনসমাবেশ অস্বীকার করি ।
    মানুষের এমন কোনও কাজ নেই,
    অভ্যন্তরীণ কামদ স্তরে,
    তথাকথিত যীশু-খ্রিস্টের
    বেদীর ওপর
    নেমে আসা ।
    .

    কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না

    আর আমি দেখতে পাচ্ছি জনসাধারণ তাদের কাঁধ নাচিয়ে আমার কথা বাতিল করছে
    কিন্তু তথাকথিত খ্রিস্ট তিনি ছাড়া আর কেউ নন
    যারা চামউকুন দেবতার উপস্থিতিতে
    দেহ  ছাড়া বাঁচতে সম্মত হলো,
    যখন পুরুষদের একটা সৈন্যবাহিনী
    ক্রুশকাঠ থেকে নেমে এলো,
    ঈশ্বর ভেবেছিলেন যে তিনি তাদের পেরেক দিয়ে গেঁথে ফেলেছেন
    তারা বিদ্রোহ করেছে,
    আর ইস্পাতের মোড়কে সজ্জিত,
    রক্ত দিয়ে,
    আগুন দিয়ে, আর হাড় দিয়ে,
    এগোতে থাকে, যা অদৃশ্য তাকে প্রকট  করে
    ঈশ্বরের বিচারকে বাতিল করার জন্য ।
    তাহলে প্রশ্ন ওঠে…..
    যা  একে গুরুতর করে তোলে
    যে আমরা জানি
    এই বিশ্বের
    শৃঙ্খলার বাইরে
    আরেকটি আছে।
    .
    সেটা কেমনতর ?
    .
    আমরা তা জানি না

    .
    সম্ভাব্য অনুমানের সংখ্যা এবং ক্রম
    এই এলাকায়
    মোটামুটিভাবে
    অনন্ত !
    .
    আর অনন্ত কী ?
    .
    সেটা আসলে আমরা জানি না !
    .
    এটা একটা শব্দ
    যা আমরা ব্যবহার করি
    আমাদের চেতনাকে
    উদ্বোধন করার জন্য
    নির্দেশ করি
    সম্ভাবনার দিকে
    পরিমাপের বাইরে,
    অক্লান্ত আর পরিমাপের বাইরে।
    .
    আর নির্দিষ্টভাবে চেতনা বলতে কী বোঝায় ?
    .
    প্রকৃতপ্রস্তাবে তা আমরা জানি না ।
    .
    তা শূন্যতা ।
    .
    একটা শূন্যতা
    যে আমরা ব্যবহার করি
    নির্দেশ করতে
    যখন আমরা কিছুই জানি না
    কোন দিক থেকে
    আমরা এটা জানি না
    আর তাই
    আমরা বলি
    চেতনা,
    চেতনার দিক থেকে,
    কিন্তু এক লক্ষ অন্যান্য পক্ষ আছে.
    .
    নয় কি ?
    .
    মনে হয় সেই চেতনা
    আমাদের মধ্যে আছে
    জড়িয়ে
    যৌন লোভের দিকে
    আর খিদে
    কিন্তু এটা পারে
    ঠিক তেমনি
    তাদের
    নেয়া হবে না
    .
    একজন বলেন,
    কেউ বলতে পারে,
    যারা বলেন
    যে চেতনা
    একটা খিদে,
    বেঁচে থাকার খিদে;
    আর সময় নষ্ট না করে
    বেঁচে থাকার খিদের পাশাপাশি,
    এটা খাবার জন্য খিদে
    যেটা প্রথমেই মনে আসে;
    যেন খাওয়ার লোক নেই
    কোনো রকম খিদে ছাড়াই;
    আর  যারা খিদেতে মরছে।
    এর জন্যও
    রয়েছে
    খিদে
    খিদে না থাকলেও লোকে খায়;
    .
    নয় কি ?
    .
    আমরা হব
    সম্ভাবনার উৎস
    আমাকে একদিন দেওয়া হয়েছিল
    একটা জোরে পাদার মতন করে
     আমি তৈরি করব;
    কিন্তু কোনও জায়গা নয়,
    সম্ভাবনাহীনতা,
    আমি কি ঠিক জানতাম এটা কী ?
    আর আমি এটা কী তা জানার দরকার মনে করিনি,
    ওগুলো ছিল নিছক শব্দ
    যা আগে থাকতে ছিল
    কিংবা ছিল না
    প্রয়োজনের 
    তাড়াহুড়োর মাঝে :
    ধারণাটাকে নির্মূল করার প্রয়োজনীয়তা,

    ধারণা আর তার কিংবদন্তি,
    আর তার জায়গায় সিংহাসনে বসাবার
    বজ্রপাতের মতন
    এই বিস্ফোরক প্রয়োজনীয়তা:
    আমার অভ্যন্তরীণ রাতের শরীরকে প্রসারিত করতে
    ভেতরকার শূন্যতা
    আমার নিজের
    যা রাত্রিকাল,
    শূন্যতা,
    চিন্তাহীনতা,
    .
    কিন্তু যা বিস্ফোরক নিশ্চিতকরণ
    আছে
    কিছু
    এর জন্য জায়গা তৈরি করতে:
    .
    আমার দেহ।
    .
    আর সত্যিই কি
    পাদের এই বিটকেল গন্ধকে অবশ্যই কমাতে হবে,
    আমার দেহের ভেতর ?
    বলতে গেলে আমার দেহ আছে
    কারণ আমার দুর্গন্ধযুক্ত পাদ আছে
    সেটা কি আমার
    ভেতরে গড়ে ওঠে ?
    .
    আমি ঠিক জানি না
    কিন্তু
    আমি জানি যে
    .
    পরিসর,
    সময়,
    আকার,
    হয়ে ওঠা,
    ভবিষ্যত,
    নিয়তি,
    অস্তিত্ব,
    অনস্তিত্ব,
    অহং,
    অহংহীনতা, আমার কাছে কিছুই নয় ;
    কিন্তু একটা জিনিস আছে
    যা আসলে একটা ব্যাপার,
    শুধু একটাই জিনিস
    যা কিছু একটা,
    এবং যা আমি অনুভব করি
    কারণ এটা 
    বেরিয়ে যেতে চায় :
    যা কিনা আমার শরীরের
    যন্ত্রণা,
    একখানা হুমকি,
    ক্লান্ত হয়  না
    আমার
    দেহের
    উপস্থিতি ;
    .
    যদিও বজ্জাত লোকেরা  প্রশ্ন তুলে আমাকে চাপ দেয়
    আর যদিও আমি দৃঢ়ভাবে সমস্ত প্রশ্ন অস্বীকার করি,
    একটি সময়-বিন্দু আছে
    যখন আমি নিজেকে বাধ্য মনে করি
    নাআআআআআ বলতে
    নাআআআআআ
    তারপর
    অস্বীকার করার জন্য ;
    আর ঠিক এই সময়টা
    আসে যখন তারা আমাকে চাপ দেয়,
    যখন তারা আমাকে চাপ দেয়
    আর যখন তারা আমাকে ঠেলে নিয়ে যায়
    বেরোবার রাস্তা অব্দি
    আমার থেকে
    পুষ্টির,
    আমার পুষ্টির
    আর তা পোষনের দুধ,
    আর তাহলে  কী অবশিষ্ট থাকে ?
    .
    আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে
    .
    আর আমি জানি না এটা একটা কাজ কিনা
    কিন্তু এইভাবে প্রশ্ন দিয়ে আমাকে কোনঠাসা করে
    অনুপস্থিতি পর্যন্ত
    এবং শূন্যতা পর্যন্ত
    প্রশ্নের
    তারা আমাকে কোনঠাসা করে
    যতক্ষণ না দেহের  ধারণা 
    আর একটা দেহ হয়ে ওঠার ধারণা
    আমার ভেতরে
    গলাটিপে শ্বাসরোধ করা হচ্ছে
    .
    আর ঠিক তখনই আমি অশ্লীলতাকে অনুভব করলুম
    .
    আর আমি পাদলুম
    ভুলবশত
    অতিরিক্ত জমেছিল বলে
    আর বিদ্রোহ হিসেবে
    যখন আমার শ্বাসরোধ করা হচ্ছিল ।
    .
    কেননা ওরা আমাকে কোনঠাসা করছিল
    আমারই দেহের সঙ্গে
    দেহের জন্য
    .
    আর ঠিক  তখনই 
     আমি সবকিছু ফাটিয়ে বেরোলুম
    যাতে আমার দেহ
    আর ছোঁয়া না যায়।
    উপসংহার
    –আর এই সম্প্রচারের উদ্দেশ্য কী ছিল মসিয়ঁ আতো ?
    —মোটামুটি  আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত এবং স্বীকৃত কিছু সামাজিক অশ্লীলতার নিন্দা করা। ভ্রূণের কৃত্রিম প্রজননের জন্য শিশুদের  দান করা  শুক্রাণুর এই নির্গমন এখনও জন্মায়নি  আর যা এক শতাব্দী বা তারও বেশি সময়ের পরে জন্মাবে ।
    —নিন্দা করার জন্য ।  এই একই আমেরিকান জনগণের মধ্যে যারা প্রাক্তন রেডইনডিয়ান মহাদেশের সমগ্র ভূপৃষ্ঠ দখল করে আছে, প্রারম্ভিক আমেরিকার সেই যুদ্ধবাদী সাম্রাজ্যবাদের পুনর্জন্ম যা পূর্বোক্ত লোকদের দ্বারা প্রাক-কলম্বিয়ান রেডইনডিয়ান উপজাতিদের অধঃপতনের কারণ হয়েছিল।

    —আপনি তো অদ্ভুত কথাবার্তা বলছেন, মসিয়ঁ আতো ।
    ১- হ্যাঁ, আমি কিছু উদ্ভট কথা বলছি। যে সমস্ত ব্যাপার আমাদের বিশ্বাস করানো হয়েছিল, তার উল্টো আসল ঘটনা হলো যে প্রাক-কলম্বিয়ান রেডইন্ডিয়ানরা এক অদ্ভুত সভ্য মানুষ ছিল এবং প্রকৃতপক্ষে তারা একচেটিয়াভাবে নিষ্ঠুরতার নীতির উপর ভিত্তি করে সভ্যতার একটি রূপ জানত।
    ২- আর নিষ্ঠুরতা বলতে কী বোঝায় তা কি আপনি সঠিকভাবে জানেন?
    ৩- এভাবে জিগ্যেস করলে বলব, না, আমি করি না।
    ৪- নিষ্ঠুরতা মানে রক্তের মাধ্যমে নির্মূল করা এবং যতক্ষণ না রক্ত প্রবাহিত হয়, দেবতা, যে কিনা মানুষের অচেতন  পশুত্বের  দুর্ঘটনা, যেখানেই এটি পাওয়া যায় নির্মূল করতে হবে।
    ৫- মানুষ, যখন সে সংযত থাকে না, তখন সে একটি কামোত্তেজক প্রাণী,
    তার মধ্যে একটি অনুপ্রাণিত শিহরন আছে,
    এক ধরনের স্পন্দন
    যেটি সংখ্যা ছাড়াই প্রাণী উৎপন্ন করে যার জন্য পৃথিবীর প্রাচীন উপজাতিরা সর্বজনীনভাবে ঈশ্বরকে দায়ী করে।
    এটি একটি সৃষ্টি বলা হয় কি আত্মা।
    শুনুন, আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে উদ্ভূত এই চেতনা আজ সারা বিশ্বে বৈজ্ঞানিক ভঙ্গিতে আরেকবার আবির্ভূত হচ্ছে যা কেবল তার অসুস্থ সংক্রামক শক্তিকে বাড়িয়ে তোলে, তা হলো অযাচারের  লক্ষণীয় অবস্থা, কিন্তু তা একটা অযাচার  যা রোগের সাথে খলবল করে,
    কারণ, ভালো লাগলে আপনি হাসুন,
    যাকে জীবাণু বলা হয়
    তা দেবতা , আর আপনি কি জানেন যে আমেরিকানরা আর রাশিয়ানরা তাদের পরমাণু তৈরি করতে কী ব্যবহার করে?
    তারা ঈশ্বরের জীবাণু দিয়ে তা তৈরি করে।
    - আপনি পাগলামি করছেন, মসিয়ঁ আতো।
    আপনি উন্মাদ।
    - আমি পাগলামী করছি না।
    আমি উন্মাদ নই।
    আমি আপনাকে বলছি, বিশ্বাস করুন,  তারা ঈশ্বরের একটা নতুন ধারণা আরোপ করার জন্য জীবাণুগুলোকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে।
    তারা দেবতাকে বের করে আনার আর তাকে তার জীবাণুর বিষে বন্দী করার একটা নতুন ফন্দি খুঁজে পেয়েছে।
    তা হলো তাঁর  হৃদয়  পেরেক দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করা,
    যেখানে মানুষ তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে,
    অস্বাস্থ্যকর যৌনতার মুখোশের আড়ালে,
    অসুস্থ নিষ্ঠুরতার তাঁর সেই অশুভ চেহারায়
    যখনই তাঁর ইচ্ছা হয়  মানবসমাজকে পাগল করে দেন
    ঠিক এখন যেমন করছেন।
    .
    তিনি বিশুদ্ধতার চেতনা এবং চেতনাকে কাজে লাগিয়েছেন যা আমার মতই অকপট থেকে গেছে সব মিথ্যা দিয়ে গলা টিপে মারার জন্য  আবির্ভাব হয়েছে তাঁর যা তিনি মহাকাশের মাধ্যমে সর্বজনীনভাবে ছড়িয়ে দেন আর এই কারণেই হ্যালুসিনেশনে ভুগছেন এমন ব্যক্তির জন্য অঁতনা আতো’র  ‘মোমো’ নেওয়া যেতে পারে ।
    —আপনি কী বলতে চাইছেন মসিয়ঁ আতো ?
    —- আমি বলতে চাইছি  যে আমি এই বনমানুষকে চিরকালের জন্য শেষ করার উপায় খুঁজে পেয়েছি এবং যদিও কেউ আজকাল ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না কিন্তু সবাই এখন  মানুষকে আরও বেশি করে বিশ্বাস করে। সুতরাং এখন মানুষ হিসাবে আমাদের নির্ণয় নিতে হবে কেমন করে  তাকে হীনবীর্য করা  যায় ।
    —কেমন করে ?

    —কেমন করে মানে কী ?
    কেউ আপনাকে যেভাবেই নিয়ে যাক না কেন আপনি উন্মাদ, লোহার শেকলে বেঁধে ফেলার জন্য প্রস্তুত।
    — তাকে আবার  ময়নাতদন্তের টেবিলে শেষবারের মতন রেখে, তার দেহকাঠামো নতুন করে গড়তে হবে।
    আমি বলতে চাই, তার অ্যানাটমি ভেঙে গড়তে হবে।
    মানুষ অসুস্থ কারণ সে খারাপভাবে নির্মিত।
    মরণশীল প্রাণীদের যে চুলকানিতে সে ভোগে,  তার সেই আস্তরণ  ছিঁড়ে ফেলার জন্য  তাকে  খুলে ফেলতে হবে আর তার জন্য আমাদের মনকে তৈরি করতে হবে,
    ঈশ্বর
    আর ঈশ্বরের সাথে
    তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ।
    কারণ তুমি চাইলে আমাকে বেঁধে রাখতে পারো,
    কিন্তু একটি অঙ্গ ছাড়া আর কিছুই অকেজো নেই।
    যখন তুমি তাকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গবিহীন শরীরে পরিণত করবে,
    তখন তুমি তাকে তার সমস্ত স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তি দেবে
    এবং তাকে তার প্রকৃত স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবে।
    .
    তুমি তাকে আবার ভুল ছন্দে নাচতে শেখাবে
    নাচঘরের উদ্দাম হইহুল্লোড়ে
    আর এই ভুল  হবে তার আসল জায়গা।
                               —-----------XXXXXX—-------------

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:b42b:f4bf:3b45:46e7:f4b2 | ১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৫২740512
  • অঁতনা আতো’র প্রত্যাখ্যাত কবিতা সম্পর্কে মরিস ব্লাশোঁ 
    মলয় রায়চৌধুরীর 
    এক
    মরিস ব্লাশোঁ (  ২২ সেপ্টেম্বর ১৯০৭ – ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৩) ছিলেন একজন ফরাসি লেখক, দার্শনিক ও সাহিত্য সমালোচক। জিল দ্যলুজ, মিশেল ফুকো, জাক দেরিদা ও জঁ-ল্যুক নঁসির মতো উত্তর-গঠনবাদী দার্শনিকদের ওপর তার কাজের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। 
    .
    ব্লাশোঁ সম্পর্কে অধ্যাপক সুমিত চক্রবর্তী লিখেছেন, “ফরাসি দার্শনিক মরিস ব্লাঁশো তাঁর ‘স্পেস অব লিটারেচার’ প্রবন্ধে সাহিত্যিক বা লেখকের পরিসর বিষয়ে একটা ভারী চমৎকার চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। তিনি লিখছেন কী ভাবে সাহিত্যিক সর্বদাই রয়েছেন এক রকম নির্বাসনে। হেঁটে বেড়াচ্ছেন একটা জনহীন মরুভূমির ভিতর। এই মরুভূমিকে ব্লাঁশো বলছেন একটা ‘প্রিভিলেজড জ়োন’ যেখানে আর কেউ ঢুকতে পারছেন না। লেখকের নিভৃত এই পরিসরে রয়েছে শুধুমাত্র স্বাধীনতা আর একাকিত্ব। এই মরুভূমি ক্রমাগত হয়ে উঠছে লেখকের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। তিনি রয়ে যাচ্ছেন এই অজান্তে তৈরি হয়ে ওঠা একাকিত্বের সাম্রাজ্যে। আর তিনি যা লিখছেন? প্রতিটি শব্দ, বাক্য, চিন্তা লেখা হয়ে যাওয়া মাত্রই তা হয়ে উঠছে অন্য কোনও সত্তার প্রকাশ, শব্দ হয়ে পড়ছে শূন্যগর্ভ। লেখক নিজের কল্পনাকে, নিজের চিন্তাকে বেঁধে উঠতে পারছেন না তাঁরই লেখা শব্দের ভিতর। ক্রমাগত তৈরি হয়ে চলেছে লেখার সঙ্গে লেখকের অনিবার্য দূরত্ব। ব্লাঁশো বলছেন, সাহিত্যকর্মের নির্যাসকে সময়ের গ্রাস থেকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় এই দূরত্ব। লেখার উপজীব্য লুকিয়ে রয়েছে তার অদৃশ্য হওয়ার ভিতরে, লেখকের অদৃশ্য হওয়ার ভিতরে। এই শূন্যতাই জন্ম দেয় ‘টাইমলেস মাস্টারপিস’-এর।তার মানে কি লেখক কোনও সামাজিক জীব নন? তিনি কি প্রতি দিনের বাইরের এক জন মানুষ? নিশ্চয়ই তা নয়। এই প্রতি দিনের ভিতর থেকেই তিনি সংগ্রহ করছেন তাঁর চিন্তার রসদ, এখানেই ক্রমাগত বুনে চলেছেন তাঁর কল্পনার একান্ত জগৎ। তার পর কখন, অজান্তেই ঢুকে যাচ্ছেন তাঁর মরুভূমির ভিতর। এই যে মরুভূমির কথা ব্লাঁশো বলছেন, তা কিন্তু লেখকের স্বেচ্ছাকৃত নয়, এই পরিসর তৈরি হয়ে যাচ্ছে তাঁর অজান্তেই। ভিতর-বাহিরের বোধ তাঁর ভিতর তৈরি হচ্ছে না, ভিড় করে আসা শব্দেরা আপনা আপনিই তৈরি করে দিচ্ছে এই বিচ্ছেদ।”
    .
    দুই
    নিজের তত্ব ব্লাশোঁ প্রয়োগ করেছেন অঁতনা আতো’র এক গুচ্ছ প্রত্যাখ্যাত কবিতার ক্ষেত্রে । ব্লাশোঁ লিখেছেন, “আতো’র বয়স যখন সাতাশ বছর তখন তিনি একটি পত্রিকায় কিছু কবিতা পাঠান। এই জার্নালের পরিচালক বিনয়ের সাথে সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেন। আতো তারপর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন কেন তাঁর পক্ষপাত রয়েছে এই ত্রুটিপূর্ণ কবিতাগুলির প্রতি : কারণ তিনি চিন্তার এমন নির্জনতায় ভুগছেন যে তিনি তাঁর কেন্দ্রীয় অনস্তিত্ব থেকে ফর্মগুলোকে পরিত্যাগ করতে পারবেন না, তা যতই অপর্যাপ্ত হোক না কেন।
    .
    এইভাবে পাওয়া কবিতাগুলোর  মূল্য কী ? আতো ও সম্পাদকের চিঠির আদান-প্রদান হয়েছিল, এবং সম্পাদক জাক রিভিয়ে হঠাৎ করে এই অপ্রকাশ্য কবিতাগুলি সম্পর্কে আতোর লেখা চিঠিগুলি প্রকাশ করার প্রস্তাব দেন (কিন্তু এবার সম্পাদক জানান যে উদাহরণ  হিসাবে চিঠির সঙ্গে কবিতার অংশ তিনি প্রকাশ করবেন )। আতো তা মেনে নেন, এই শর্তে যে কবিতায় কোনও পরিবর্তন করা চলবে না। তার ফলে জাক রিভিয়ের সাথে আদান-প্রদান করা আতোর চিঠি আর কবিতা, যা এখন বিখ্যাত , তা এক মহান তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হয়ে উঠল । ব্লাশোঁ প্রশ্ন তুলেছেন, জাক রিভিয়ে কি এই অসঙ্গতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন? তিনি যখন কবিতাগুলোকে অপর্যাপ্ত এবং প্রকাশের অযোগ্য বলে বিবেচনা করেছিলেন, সেগুলি যখন তাদের অপ্রতুলতার অভিজ্ঞতার বর্ণনার সঙ্গে প্রকাশিত হলো, তখন তা আর প্রকাশের অযোগ্য রইলো না। যেন তাদের মধ্যে কী অভাব ছিল, তাদের ত্রুটি, এই অভাবের প্রকাশ্য অভিব্যক্তি এবং এর প্রয়োজনীয়তার যুক্তির দ্বারা কবিতাগুলো প্রয়োজনীয় পূর্ণতার ভিত্তি পেয়ে গেল। 
    .
    কাজ হিসাবে কবিতাগুলোর পরিবর্তে, যা কিনা নিশ্চিতভাবে কাজের অভিজ্ঞতা, এবং যে প্রক্রিয়া কবিতাগুলো রচনার দিকে কবিকে  নিয়ে গিয়েছিল, এবং অভিজ্ঞতার কথা শুনে, যা জাক রিভিয়েকে আগ্রহী করেছিল, তা রচনাগুলোর তখনও পর্যন্ত অনামা একজন কবির, আনাড়িভাবে লেখা, অস্পষ্ট ছাপ গড়ে তুলেছিল । আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ব্যর্থতা, যা আতোর প্রতি আলোচকদের  তখনও ততটা আকৃষ্ট করতে পারেনি, যতটা পরে কবিতা আর চিঠিগুলো সম্পর্কে যাঁরা লিখবেন এবং যাঁরা পড়বেন তাঁদের মনের একটি কেন্দ্রীয় ঘটনার উপলব্ধিযোগ্য লক্ষণ হয়ে উঠবে,  যার ওপর আতোর ব্যাখ্যাগুলো একটা আশ্চর্যজনক আলো ফেলবে, আর ফেলেছেও। ফলে  আমরা , এমন একটি ঘটনার সীমানায় পৌঁছে যাই যার সাথে সাহিত্য এবং এমনকি শিল্পও যুক্ত বলে মনে হয়: যেন সেগুলো কবিতা নয়, যদি না এটির কৌশল বা "বিষয়" হিসাবে এদের  কবিতা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া ও উদ্দীপনা আমাদের কাছে  উপলব্ধ হয়, আবার অনেক সময়ে তা না জানার কারণে বাতিল করতে হয়।
     .
     আমরা এখানে রিল্কের চিঠিটির প্রসঙ্গ তুলতে পারি, যা পনেরো বছর বা তারও আগে লেখা: ‘যত এগিয়ে, এবং যতো বেশি ব্যক্তিগতভাবে , একজন যায়, তত বেশি অনন্য হয়ে ওঠে জীবন । শিল্প হিসাবে একটি কাজের এই অনন্য বাস্তবতা প্রয়োজনীয়, যা অকাট্য, চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট অভিব্যক্তি। তাতেই রয়েছে অসামান্য সাহায্য, যা কাজটাকে তৈরি করতে কবি বা শিল্পীকে বাধ্য করে।
    .
    এটা আমাদের সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যা করে যে আমাদের নিজেদের সবচেয়ে চরম অগ্নিপরীক্ষায় পুড়তে হবে, তবুও, মনে হয়,  কাজটায় নিজের মাথা পুরোপুরি গোঁজার  আগে ,  একটি শব্দের শ্বাসও সামনে আনা উচিত নয় , এমনকি তাদের সম্পর্কে বলাবলি করে  তাদের হালকা করা উচিত নয়, কেননা তা অনন্য , যা অন্য কেউ বুঝতে পারবে না বা বোঝার অধিকার নেই। এই ধরণের উড়াল যা আমাদের কাছে অনন্য, কেবলমাত্র আমাদের কাজের মধ্যে নিজেকে বোঝানোর মাধ্যমে বৈধ হয়ে উঠতে পারে, যাতে তার নিজস্ব নিয়মে আসল নকশার স্বচ্ছ শিল্পকর্মটি দৃশ্যমান হয় ও  প্রকাশ করা যায়। রিল্কে তার মানে বলতে চেয়েছেন , কাজটি যে অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কাছে আসে  তা সরাসরি প্রকাশ করা উচিত নয় : এই চরম অগ্নিপরীক্ষার মূল্য এবং সত্য কেবল তখনই পাওয়া যায়  যখন এটি সেই কাজের মধ্যে চাপা দেয়া থাকে  যেখানে এটি একই সঙ্গে দৃশ্যমান-অদৃশ্য, শিল্পের সুদূর দিবালোকের প্রতিভায়। কিন্তু প্রশ্ন হল রিলকে নিজে কি সবসময় এই গাম্ভীর্য বজায় রাখতেন? এবং তিনি কি তাকে রক্ষা করার সময় একই সঙ্গে ভেঙে ফেলার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে প্রয়াস করেননি ?  অধিকন্তু রিল্কে জেনেছিলেন যে এই ভাঁড়ার ভাঙার ক্ষমতা তাঁর বা কারও নেই। তিনি কি  কেবল এটির সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য তর্ক দিয়েছেন যে এই ধরণের উড়াল যা আমাদের কাছে অনন্য। “যা  চিন্তা করা হয়েছে তাকে ভাবা যে অসম্ভব” তা জাক রিভিয়ের বোঝাপড়া, মনোযোগ এবং সংবেদনশীলতায় ধরা পড়েছে।  কিন্তু সংলাপে, ভুল বোঝাবুঝির ভূমিকা সুস্পষ্ট থেকে যায়, যদিও তাকে চিহ্ণিত করা কঠিন। আতো, সেই সময়ে যদিও খুব ধৈর্যশীল, ক্রমাগত এই ভুল বোঝাবুঝির উপর নজর রাখছিলেন । তিনি  তাঁদের পত্রালাপ থেকে  আশ্বস্ত হন যে তাঁর মধ্যে যে সংগতির অভাব রয়েছে তা স্পষ্ট,  আর  মনের ভঙ্গুরতা মনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু আতো আশ্বস্ত হতে চান না। তিনি এমন ভয়ানক কিছুর সংস্পর্শে আছেন যে তিনি একে কমিয়ে ফেলতে পারেন না। তিনি অসাধারণত্ব অনুভব করেন, এবং তাঁর কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য, তাঁর চিন্তাধারার ভাঙনের সঙ্গে কবিতাগুলির  সম্পর্ক যা তিনি এই "প্রকৃত ক্ষতি" সত্ত্বেও লিখতে সফল হয়েছিলেন।
    .
    একদিকে, জাক রিভিয়ে অসাধারণ ঘটনাটির ব্যতিক্রমী ব্যাপারটাকে ভুল বোঝেন, আবার অন্যদিকে তিনি কবিতাগুলোর ‘সাহিত্যিক চরিত্রকে’ ভুল বোঝেন, কেননা মনের ভেতরকার যে চরম বৈশিষ্ট্য , যা থেকে কবিতাগুলো সৃষ্ট, সেই মনের অনুপস্থিতি থেকে কবিতাগুলো লেখা।
    .
    তিন
    .
    অঁতনা আতো যখন ঠাণ্ডা মাথায় রিভিয়েকে চিঠি লিখছেন, সেই চিঠি পড়ে অবাক হন জাক রিভিয়ে। আতো চিঠিতে যা বলতে চেয়েছেন তা এতোই স্পষ্ট যে টের পাওয়া যায় তিনি নিজেকে প্রকাশ করায় দক্ষ ।  কবিতাগুলো তাঁর চিন্তার কেন্দ্রহীনতার  ক্ষতির দিক উন্মোচিত করে, যে মানসিক বিপর্যয়ে তিনি ভোগেন।  এটি একটি অসহ্য যন্ত্রণা যা তিনি পরে তীব্র অভিব্যক্তির সাথে স্মরণ করেছেন, যেমন আতো বলেছেন: " আমি অনুপস্থিতির কথা বলছি, একটি ফোকরের মতো, এক ধরণের অতিশীতল, চিত্রহীন কষ্ট, অনুভূতিহীন, গর্ভপাতের অবর্ণনীয় দ্বন্দ্বের মতো।
    .
    তাহলে কেনই বা তিনি কবিতা লেখেন? কেন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতন নিজেকে সন্তুষ্ট রাখেন না, যিনি তাঁর জিভকে দিনানুদৈনিক আটপৌরে কাজে ব্যবহার করেন ? সবকিছুই ইঙ্গিত দেয় যে কবিতা, তাঁর জন্য সেই ধরনের ক্ষয়ের সাথে সংযুক্ত, অথচ যা অপরিহার্য এবং ক্ষণস্থায়ী চিন্তা করায় তাঁকে দিয়ে। আর এইভাবেই, মূলত, কেন্দ্রীয় ক্ষতির সাথে জড়িত, তাঁকে সেই ক্ষতি প্রকাশ করার বাহন হিসাবে   নিশ্চয়তা এবং তাকে প্রতিশ্রুতি দেয়। নির্দিষ্ট পরিমাণে, কবিতাগুলো লিখে, এই ক্ষতি নিজেই তাঁকে উদ্ধার করবে, তাঁর চিন্তাভাবনাকে যতদূর সম্ভব ফুরিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে।  সুতরাং তিনি অধৈর্য ও অহংকার সহকারে বলেছেন: " আমি সেই মানুষ যে চিন্তার সাথে তার ভাষার সম্পর্কের মধ্যে স্তম্ভিত অব্যবস্থা অনুভব করেছে l  প্রকৃতপক্ষে আমি আমার চিন্তায় নিজেকে হারিয়ে ফেলি যেমন  স্বপ্ন দেখার সময়ে লোকে নিজেকে হারিয়ে ফ্যালে কিংবা হঠাৎ করে নিজের চিন্তায় ফিরে আসে,  আবার নিজের চিন্তায় ডুবে যায়। আমি সেই লোক যে ক্ষতি লুকানোর জায়গাগুলো জানে।"
    .
    আতোর কাছে "সঠিকভাবে চিন্তা করা, সঠিকভাবে দেখা" বা এমন চিন্তাভাবনা যেগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত–সঠিকভাবে বাছাই করা আর প্রকাশ করা–সে সমস্ত ক্ষমতা তিনি জানেন যে তাঁর আছে, তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এবং যখন তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বলেন যে  “কিন্তু আপনি তো বেশ ভালোভাবে চিন্তা করেন, যদিও শব্দের অভাব  সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়”, তখন আতো বিরক্ত বোধ করেন। একটি চিঠিতে আতো লিখেছেন,”অনেক সময়ে  অক্ষমতা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমাকে অতি-উজ্জ্বল  হিসাবে দেখা হয় যখন কিনা আমার অপ্রতুলতা, আমার গভীর ঘাটতি,  কাল্পনিক নয় এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গঠিত নয় ।”  তিনি জানেন, ব্যথার অভিজ্ঞতা তাঁকে যে গভীর যন্ত্রণা দেয়, চিন্তা করা মানে ভাবা নয়, এবং যে চিন্তাগুলি তাঁর মগজে আসে তা তাঁকে অনুভব করায় যে তিনি "এখনও ভাবতে শুরু করেনি।"
    .
     এটা সেই কঠিন যন্ত্রণা যাতে আতো ফিরে যান । যেন তিনি ছুঁয়ে ফেলেছেন,  নিজেকে জানা সত্ত্বেও, একটা সকাতর ভুলের মাধ্যমে, যা তাঁকে ভেতরে-ভেতরে কাঁদায়,  যে বিন্দুতে চিন্তা সবসময় ভাবতে পারে না: এটা "শক্তিহীনতা”,  যা তাঁর চিন্তার অপরিহার্য অংশ, কিন্তু যা  একটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়, একটি ব্যর্থতা যা দ্রুত কেন্দ্রটি থেকে উজ্জ্বল আভা হয়ে ওঠে এবং তিনি যা ভাবেন তাকে তাঁর শারীরিক অবস্হা গ্রাস করে, সমস্ত স্তরে নিজেকে কয়েকটি বিশেষ অসম্ভাব্যতায় ছারখার করে দেয়। তাঁর কবিতাগুলো চিন্তার ওই অসম্ভাব্যতার সাথে যুক্ত যা চিন্তা করা হয়েছে –- এটা এমন এক সত্য যা প্রকাশ করা যায় না, কারণ এটি সর্বদা মুখ ফিরিয়ে নেয় আর কবিকে বাধ্য করে  সেই স্তরের তলায় নেমে অনুভব করতে   যেখানে তিনি সত্যিকার অর্থে এটির অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন।
    .
     এটa কেবল এক আধিভৌতিক অসুবিধাই নয়, এটি বেদনার বিদার, এবং কবিতা এই অবিরাম বেদনা, এটি "ছায়া" এবং "আত্মার রাত !," "কান্নার কণ্ঠ না থাকার ব্যাপার”। বিশ বা তারও বেশি বছর পরে লেখা একটি চিঠিতে, যখন অঁতনা আতো বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসালয়ে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছেন, আর যা তাঁকে একটি কঠিন এবং জ্বলন্ত সত্তায় পরিণত করেছে, তিনি সবচেয়ে সরলভাবে লিখেছেন :  "আমি সাহিত্যে বই লিখতে শুরু করেছি এই কথা বলার জন্য যে আমি কিছু লিখতে পারি না । আমার যখন কিছু লেখার কথা ছিল তখন আমাকে  চিন্তা করতে দেয়া হয়নি।” তারপর লিখেছেন, "আমি এই কথা বলার জন্য লিখেছি যে আমি কখনও লিখিনি,  আমি কখনও কিছু করিনি, কিছুই করতে পারিনি এবং যা কিছু করেছি, তা আসলে কিছুই নয়। আমার পুরো কাজ গড়ে উঠেছিল, আর গড়ে উঠতে পারে, কেবলমাত্র শূন্যতার ওপর”। সাধারণ জ্ঞানের লোকেরা অবাক হবে: কিন্তু কেন, যদি তাঁর লেখার কিছুই না থাকে তাহলে তিনি কি আসলে কিছুই লেখেননি?  এটা এই জন্য যে একজন লোক তখন কিছুই না-বলে নিজেকে সন্তুষ্ট করতে পারে যখন কিছুই নয় বলতে কিছুই নয় বোঝায়।  এখানে, যদিও মনে হচ্ছে এটি এমন এক মুছে যাবার প্রশ্ন  যা এতই বৈপ্লবিক যে, এটি যে বাহুল্যের  প্রতিনিধিত্ব করে,  যে বিপদের দিকে  দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেয় এবং  যে উত্তেজনাকে উস্কে দেয়, এটা দাবি করে, যেন এটা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, এমন এক প্রাথমিক কথাবার্তার সূচনা করে যার মাধ্যমে এমন শব্দ ব্যবহার করা হবে যে তা কিছুই বলে না।
    .
    প্রশ্ন হল কার কিছু বলার নেই? কেমন করে  একজন লোক নিজেকে কথা বলা থেকে রুদ্ধ করতে পারে আর নিজেকে প্রকাশ করতে পারে ? আতো বলছেন, “ আচ্ছা ! যতই যাই হোক না কেন, লিখতে চাওয়া এবং নিজেকে প্রকাশ করতে চাওয়াটা আমার নিজের দুর্বলতা এবং অযৌক্তিকতা। আমি এমন একজন মানুষ যে  অনেক মানসিক  কষ্ট পেয়েছি এবং এই কারণে আমার কথা বলার অধিকার আছে।"

     চার
    .
    এই শূন্যতার জন্য একটি যুদ্ধের বর্ণনা, যে তাঁর কাজ–স্বাভাবিকভাবে,  একটি এমন কাজই নয় যার সম্পর্কে আমি উচ্ছসিত হব এবং নিন্দা করব, তাকে অতিক্রম করে যাব আর সংরক্ষণ করব, কেননা তা নিজেই ইচ্ছা প্রয়োগ করে এর জন্ম দিয়েছ । আতো এমন এক আবেগ জাগিয়ে তুলবেন যাতে তিনি  দক্ষ ।  শুরুতে, এই শূন্যতা বোধের আগে, তিনি তখনও কিছুটা পূর্ণতা উপলব্ধি করার চেষ্টা করে গেছেন, যাকে তিনি  মনে করে ছিলেন নিশ্চিত, যা তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত সমৃদ্ধি, তাঁর অনুভূতির অখণ্ডতা এবং বিষয়গুলির ধারাবাহিকতার সাথে  নিখুঁত আনুগত্যের  সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিল আর যা তাঁর কবিতাকে স্ফটিকত্ব দিয়েছিল ।  তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে তাঁর এই “সুগভীর অনুষদ” আছে এবং সেইসাথে এটি প্রকাশ করতে সক্ষম আঙ্গিক এবং শব্দের সম্পদ আছে তাঁর কাছে। আতো বলছেন,  "যে মুহূর্তে আত্মা তার ঐশ্বর্য, তার আবিষ্কার, এই উদ্ঘাটনকে সংগঠিত করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে, সেই অচেতন মুহুর্তে যখন জিনিসটি নির্গত হওয়ার জন্য তৈরি, একটি শক্তিশালী এবং শয়তান ইচ্ছা আত্মাকে অ্যাসিডের মতন আক্রমণ করে, শব্দময়-চিত্রকল্পকে আক্রমণ করে , অনুভূতি-পিণ্ডের সাহিত্যের প্রশ্নকে আক্রমণ করে , এবং আমাকে, আমাকে, আমার জীবনের  দরজায় হাঁপাবার জন্য ছেড়ে দেয়।"
    .
    আতো যে  এখানে তাৎক্ষণিক বিভ্রমের শিকার তা বলা যথেষ্ট সহজ; সেটা খুবই সহজ; কিন্তু সবকিছুই সেইভাবে শুরু হয় যেভাবে তিনি এই অব্যবহিত অবস্থা থেকে দূরে রয়েছেন  যাকে তিনি বলছেন "জীবন"। কোনও বিলীন হতে থাকা নস্টালজিয়া নয় বা অদৃশ্য স্বপ্নকে পরিত্যাগ করে  নয়;  বরং তার বিপরীতে, এমন একটি সুস্পষ্ট বিদার দিয়ে, যা নিজের কেন্দ্রে একটি অবিরাম বাঁক-বিমুখতার দাবির পরিচয় দেয়, যা তাঁর আসল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের নৃশংস আশ্চর্যের মতো তাঁর অন্তরতম আত্মার অংশ হয়ে যায়। এইভাবে, একটি নিশ্চিত এবং বেদনাদায়ক উপস্হাপনের মাধ্যমে, তিনি আবেগের মেরুকে উল্টে দিতে পারেন আর তারপর অপসারণকে প্রাথমিকতা দেন , "তাত্ক্ষণিক পূর্ণতাকে" নয়,  যার দরুন এই অপসারণ প্রথমে সাধারণ অভাব বলে মনে হয়েছিল। যা প্রধান তা সত্তার পূর্ণতা নয়; প্রধান জিনিসটি হল বিদার এবং ফাটল, ক্ষয় এবং ধ্বংস, বিরতি এবং কুরে-খাওয়া একাকীত্ব : সত্তা তখন সত্তা নয় , এটি সত্তার অভাব, একটি জীবন্ত অভাব যা জীবনকে অক্ষম, পলাতক এবং অবর্ণনীয় করে তোলে, শুধুমাত্র  কান্নাকে রোধ করে থাকা।
    .
    সম্ভবত অঁতনা আতো, যখন তিনি ভেবেছিলেন যে তাঁর "অবিভাজ্য বাস্তবতার" পূর্ণতা আছে, তখন অন্য কিছু না করে তিনি ওই শূন্যতার দ্বাঁরা তার পিছনে প্রক্ষিপ্ত ছায়ার ঘনত্বে নিজেকে কাঁদানো ছাড়া আর কিছুই করেননি, কারণ একমাত্র জিনিস যা তাঁর মধ্যে ভরাট পূর্ণতার সাক্ষ্য দেয় তা হল প্রবল শক্তি যাকে অস্বীকার করা হচ্ছে । এটি, অস্বীকৃতির বাড়াবাড়ি যা সর্বদা সক্রিয় এবং শূন্যতার অসীম বিস্তার ঘটাতে সক্ষম ।  এটা এমন এক চাপ যা এতটাই ভয়ানক যে এটা তাঁকে ফাঁস করে দেয়, আর একই সাথে দাবি করে যে তিনি এটি তৈরি করতে এবং এর অভিব্যক্তি বজায় রাখতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করবেন। 
    .
     তবু, জাক রিভিয়ের সাথে চিঠিপত্র আদান-প্রদানের সময়, এবং যখন তিনি  কবিতা লিখে চলেছেন, তিনি প্রকাশ্যে নিজেকে নিজের উচ্চতায় তুলে আনার আশা বজায় রেখেছেন, যা এমনই এক সমতা, যে কবিতাগুলো সেই মুহূর্তেই নষ্ট হয়ে যায় যখন তিনি তাদের পুনরুদ্ধার করেন। তিনি তখন বলেন যে "তিনি কম হারে চিন্তা করছেন"; "আমি নিজের মানদণ্ডের নীচে রয়েছি, আমি তা জানি, আমি এ থেকে ভুগছি।"  পরে, তিনি লিখবেন: "আমার গভীর অনুষদ এবং আমার বাহ্যিক অসুবিধার মধ্যে এ এক বিরোধিতার যন্ত্রণা, যার কারণে আমি  মারা যাচ্ছি।" সেই মুহুর্তে, যদি তিনি উদ্বেগ ও অপরাধবোধে ভুগছেন , তবে এটি তাঁর চিন্তাভাবনার ক্ষমতার স্তরের নীচে চিন্তা করার জন্য, যা দিয়ে তিনি  তাঁর আদর্শ সততাকে রক্ষা করার  জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলেন , যাতে এটি প্রকাশ করার সময়, এমনকি একটি শব্দ দ্বারাও এটি প্রকাশ করলে, তাঁর সত্যিকারের মহত্ত্ব তাঁর নিজের সম্পর্কে পরম সাক্ষী হয়ে থাকবে। যন্ত্রণা এই সত্য থেকে উদ্ভূত হয় যে তিনি তাঁর চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে সক্ষম নন, এবং কবিতা তাঁর ভেতরে বাসা বেঁধে থাকে এই জন্য যে এই ঋণকে মিটিয়ে ফেলার আশা  রয়ে যায়, অথচ  তা সত্ত্বেও যা তাঁর অস্তিত্বের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে। জাক রিভিয়ের সাথে চিঠিপত্র পড়ে কখনও কখনও  মনে হয় যে কবিতাগুলির প্রতি রিভিয়ের যেটুকু আগ্রহ ছিল তা আতোর নিজের সমস্যা উথ্থাপনার দরুন কেন্দ্রীয় সমস্যাটির প্রতি রিভিয়ের আগ্রহ লেখার গুরুত্বকে স্থানচ্যুত করে।
    আতো কবিতা লিখছিলেন শূন্যতাবোধের বিরুদ্ধে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য লিখতেন। রিভিয়েরের সাথে চিঠিপত্রে, যদিও, তিনি সমস্যাটির সামনে নিজেকে উন্মোচিত করেছেন এবং বোঝা যায়  তিনি একে প্রকাশ করার চেষ্টা করে এবং এটি থেকে অভিব্যক্তি সংগ্রহ করে কবিতাগুলো লিখেছিলেন।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:b42b:f4bf:3b45:46e7:f4b2 | ১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৫৩740513
  • অঁতনা আতো’র নিষ্ঠুরতার থিয়েটার  : অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    আমরা থিয়েটারের ধারণাকে পতিতাবৃত্তি করে ফেলতে পারি না যার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো বাস্তবতা এবং বিপদের সাথে এর যন্ত্রণাদায়ক, যাদুকর সম্পর্ক।
    .
    এভাবে বললে, থিয়েটারের ব্যাপারে  সাধারণ মানুষের আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে, তার মানে, থিয়েটার, তার বস্তুগত  দিক থেকে, যেহেতু এটির জন্য মহাকাশে অভিব্যক্তি প্রয়োজন (আসলে একমাত্র প্রকৃত অভিব্যক্তি), এটি শিল্পের যাদুকরী উপায়গুলিকে অনুমতি দেয় এবং বক্তব্যকে জৈবভাবে এবং সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করা হবে, যেমন পুনর্নবীভূত ঝাড়ফুঁক। এই সবের ফলাফল হল যে থিয়েটারকে তার ভাষা না দেওয়া পর্যন্ত তার কর্মের নির্দিষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হবে না।
    .
    এর অর্থ হল: নির্দিষ্ট এবং পবিত্র বলে বিবেচিত পাঠ্যের উপর নির্ভর করার পরিবর্তে, পাঠ্যের প্রতি থিয়েটারের অধীনতার অবসান ঘটানো এবং অঙ্গভঙ্গির মধ্যে এক ধরণের অনন্য ভাষার ধারণা পুনরুদ্ধার করা অপরিহার্য।  কথোপকথনের বুলির অভিব্যক্তিপূর্ণ সম্ভাবনার বিপরীতে স্হানিক পরিসরের গতিশীল অভিব্যক্তির সম্ভাবনা ছাড়া এই ভাষাটিকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এবং থিয়েটার এখনও কথাবার্তার বুলি থেকে যা নিতে পারে তা হল শব্দের বাইরে সম্প্রসারণের সম্ভাবনা, পরিসর বিকাশের জন্য, সংবেদনশীলতার উপর বিচ্ছিন্ন এবং স্পন্দিত ক্রিয়া করার জন্য। এটি একটি শব্দের নির্দিষ্ট উচ্চারণের সময়।

    এখানেও হস্তক্ষেপ করে (শব্দের শুনতে পাওয়া বুলি ছাড়াও) বস্তু, গতিবিধি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং অঙ্গভঙ্গির চাক্ষুষ ভাষা, তবে এই শর্তে যে তাদের অর্থ, তাদের শারীরবৃত্তীয়তা, তাদের সংমিশ্রণগুলিকে লক্ষবস্তু হওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে, এক ধরণের নতুন বর্ণমালা তৈরি করা হবে।  একবার পরিসরের এই ভাষা, শব্দ, কান্না, আলো, অনম্যাটোপোইয়ার ভাষা সম্পর্কে সচেতন হলে, থিয়েটারকে অবশ্যই অক্ষর এবং বস্তুর সাহায্যে এটিকে সত্য হায়ারোগ্লিফগুলিতে সংগঠিত করতে হবে এবং যা মানুষের সমস্ত অঙ্গের সাথে সম্পর্কিত এবং তাদের প্রতীকবাদ এবং আন্তঃসংযোগ ব্যবহার করতে হবে।
    .
     থিয়েটার সম্পর্কে প্রশ্ন হল, বক্তৃতা, অঙ্গভঙ্গি এবং অভিব্যক্তির একটি মেটা-ফিজিক্স তৈরি করা, যাতে এটিকে “মানুষের স্বার্থে” মনোবিজ্ঞানের দাসত্ব থেকে উদ্ধার করা যায় । কিন্তু এই সমস্ত কিছুরই কোন লাভ হবে না যদি না এই ধরনের প্রচেষ্টার পিছনে একধরনের বাস্তব আধিভৌতিক প্রবণতা থাকে, কিছু অবাস্তব ধারণার প্রতি আবেদন থাকে, যা  প্রকৃতির দ্বারা সীমাবদ্ধ বা এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে চিত্রিত করা যায় না। এই ধারণাগুলো যা সৃষ্টি করে, হয়ে ওঠা এবং বিশৃঙ্খলাকে স্পর্শ করে, সবই একটি মহাজাগতিক ক্রম এবং একটি এলাকার প্রাথমিক ধারণা প্রদান করে যেখান থেকে থিয়েটার এখন সম্পূর্ণরূপে আলাদা । তারা মানুষ, সমাজ, প্রকৃতি এবং বস্তুর মধ্যে এক ধরনের আবেগপূর্ণ সমীকরণ তৈরি করতে সক্ষম।
    .
    ব্যপারটা আধিভৌতিক ধারণাগুলোকে সরাসরি মঞ্চে আনার প্রশ্ন নয়, তবে আপনি যাকে প্রলোভন বলে মনে করেন, বলতে পারেন এই ধারণাগুলোর চারপাশে বাতাসের অন্তর্নিহিততা  তৈরি করার প্রশ্ন ওঠে । এবং এর নৈরাজ্যের সাথে হাস্যরস, এর প্রতীকবাদ এবং এর চিত্রগুলির সাথে কবিতা, এই ধারণাগুলির প্রলোভনকে চ্যানেল করার উপায়গুলির একটি মৌলিক ধারণা প্রদান করে।
    .
    আমাদের এখন এই ভাষার অনন্য বস্তুগত দিক সম্পর্কে কথা বলতে হবে - অর্থাৎ, এর সংবেদনশীলতার উপর কাজ করার সমস্ত উপায় এবং উপায় সম্পর্কে ভাবতে হবে।
    .
     এটা বলা অর্থহীন  যে এতে সঙ্গীত, নৃত্য, প্যান্টোমাইম বা অনুকরণ অন্তর্ভুক্ত । স্পষ্টতই  নড়াচড়া, সুর, ছন্দ ব্যবহার করা হবে, তবে শুধুমাত্র এই তর্কে যে তারা কোনো একটি বিশেষ শিল্পের সুবিধা ছাড়াই এক ধরণের কেন্দ্রীয় অভিব্যক্তিতে একমত হতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে এটি সাধারণ ক্রিয়াকলাপ, সাধারণ আবেগ ব্যবহার করবে না, তবে একটি লাফ দেবার পাটাতনের মতো সেগুলোকে একইভাবে ব্যবহার করবে যেভাবে হাস্যরসের ক্ষয়কারী প্রকৃতিকে যুক্তির অভ্যাসের সাথে সমন্বয় করা হয় ।
    .
    কিন্তু অভিব্যক্তির সম্পূর্ণ প্রাচ্য মাধ্যমের সাহায্যে, থিয়েটারের এই বস্তুনিষ্ঠ এবং বস্তুগত ভাষা অঙ্গগুলোকে মোলায়েম করতে পারে এবং দরকারে কঠিন করতে পারে। এটি সংবেদনশীলতার দ্বারা প্রবাহিত । মঞ্চেে সংলাপের পাশ্চাত্য  ব্যবহার ত্যাগ করে,  শব্দকে অন্তঃকরণে পরিণত করা হবে। এটি কন্ঠস্বরকে প্রসারিত করে। এটি কন্ঠস্বরের কম্পন এবং গুণাবলী ব্যবহার করে। এটা বুনোভাবে ছন্দকে পায়ের নিচে পিষে দেয়।  এটা দুর্মর  শব্দ প্রয়োগ যা সংলাপকে উঁচুতে তুলতে চায়, বেহুদা করতে চায়, কব্জা  করতে চায় , সংবেদনশীলতাকে আটক করতে চায়। এটি অঙ্গভঙ্গির একটি নতুন লিরিসিজমকে মুক্ত করে যা, তার বৃষ্টিপাত বা বাতাসে এর প্রশস্ততা দ্বারা, শব্দের লিরিসিজমকে অতিক্রম করে শেষ হয়। এটি শেষ পর্যন্ত ভাষার বুদ্ধিবৃত্তিক অধীনতা থেকে দূরে সরে যায়, একটি নতুন এবং গভীর বৌদ্ধিকতার অনুভূতি প্রকাশ করে যা ইঙ্গিত এবং লক্ষণগুলির তলায় নিজেকে লুকিয়ে রাখে, বিশেষ ঝাড়ফুঁকের মর্যাদায় উত্থাপিত হয়।
    .
    এই সমস্ত আকর্ষণের জন্য, এই সমস্ত কবিতার জন্য, এবং তৈরি করা গোলকধাঁধার এই সমস্ত প্রত্যক্ষ উপায়গুলি ফালতু হয়ে যাবে যদি সেগুলো আত্মাকে শারীরিকভাবে অন্য কিছুর পরিসরে রাখার জন্য ব্যবহার না করা হয়, যদি সত্যিকারের থিয়েটার আমাদের সৃষ্টির অনুভূতি দিতে না পারে।  আমরা শুধুমাত্র একটি মুখের অধিকারী, কিন্তু যা অন্যান্য স্তরে গিয়ে সম্পূর্ণ হয় ।
    .

    এই অন্যান্য স্তরগুলি সত্যিই মন দ্বারা জয় করা হয়েছে কিনা তা খুব কম গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, বুদ্ধিমত্তা দ্বারা; এটি তাদের হ্রাস করবে, এবং এতে আগ্রহ বা অর্থ নেই। যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল যে ইতিবাচক উপায়ে সংবেদনশীলতাকে গভীর এবং প্রখর উপলব্ধির একটি অবস্থায় রাখা হয় এবং এটিই যাদু এবং আচারের বস্তু যার থিয়েটার শুধুমাত্র একটি প্রতিফলন।
    .
    টেকনিক তখন থিয়েটারকে, শব্দের সঠিক অর্থে, একটি ফাংশন বানানোর প্রশ্ন; ধমনীতে রক্ত সঞ্চালন বা মস্তিষ্কে স্বপ্নের চিত্রগুলির দৃশ্যত বিশৃঙ্খল বিকাশের মতো স্থানীয় এবং সুনির্দিষ্ট কিছু, এবং এটি একটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জড়িত, মনোযোগের প্রকৃত দাসত্বের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।
    .
    থিয়েটার আর কখনও নিজেকে খুঁজে পাবে না--অর্থাৎ, দর্শককে স্বপ্নের সত্যিকারের সূচনা দিয়ে সজ্জিত করে সত্যিকারের বিভ্রমের একটি মাধ্যম গঠন করে, যেখানে অপরাধের প্রতি তার স্বাদ, তার কামোত্তেজক আবেশ, তার বর্বরতা, তার দুঃস্বপ্ন, তার জীবনের ইউটোপিয়ান অনুভূতি এবং বস্তু, এমনকি তার নরখাদক চেহারা, যে একটি স্তরে নকল এবং অলীক নয়, কিন্তু অভ্যন্তরীণ।
    .
    অন্য কথায়, থিয়েটারকে অবশ্যই তার সমস্ত উপায়ে উদ্দেশ্যমূলক এবং বর্ণনামূলক বাহ্যিক জগতের সমস্ত দিকই নয়, বরং অভ্যন্তরীণ জগতের, অর্থাৎ আধিভৌতিকভাবে বিবেচনা করা মানুষের জন্য  পুনর্ব্যক্ত করতে হবে। শুধুমাত্র এইভাবে, আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা থিয়েটারে কল্পনার অধিকার সম্পর্কে আবার কথা বলতে সক্ষম হব। হাস্যরস, বা কবিতা বা কল্পনার কোনো মানেই হয় না যদি না, একটি নৈরাজ্যবাদী ধ্বংসের মাধ্যমে একটি অসাধারন উড়াল তৈরি হয় যা পুরো দৃশ্যটিকে গঠন করে, তারা মানুষকে, বাস্তবতা সম্পর্কে তার ধারণা এবং তার কাব্যিকতাকে জৈবিকভাবে পুনরায় জড়িত করতে সফল হয়। 
    .
    থিয়েটারকে সেকেন্ড-হ্যান্ড মনস্তাত্ত্বিক বা নৈতিক ফাংশন হিসাবে বিবেচনা করা, আর বিশ্বাস করা যে স্বপ্নের নিজেরই একটি বিকল্প কাজ রয়েছে, স্বপ্নের পাশাপাশি থিয়েটারের গভীর কাব্যিক প্রভাবকে তাহলে হ্রাস করা হয় । যদি স্বপ্নের মতো থিয়েটারও রক্তাক্ত এবং অমানবিক হয়, তবে এটি কেবল তার চেয়েও বেশি কিছু নয়, আমাদের মধ্যে অবিরাম ঘটতে থাকা দ্বন্দ্বের ধারণাকে উদ্ভাসিত করা হয় এবং অবিস্মরণীয়ভাবে শিকড় দেওয়া হয়, তা এমন একটি খিঁচুনি যেখানে জীবন ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত হয়, যার মধ্যে  সৃষ্টির সবকিছু উঠে আসে । আমাদের নির্ধারিত অবস্হানের বিরুদ্ধে নিজেকে প্রয়োগ করে; এটি ঠাসবুনোন ব্যাপার । আর সময় নষ্ট না করে কল্পকাহিনীর আধিভৌতিক ধারণাগুলিকে স্থায়ী করার জন্য যার অত্যন্ত নৃশংসতা এবং শক্তি দরকার কেননা তা প্রয়োজনীয় নীতিগুলিতে তাদের উৎস এবং ধারাবাহিকতা দেখানোর জন্য যথেষ্ট। এটি এমন হওয়ায়, দর্শক দেখতে পায় যে, নীতিগুলির সান্নিধ্যে,  যা তাদের শক্তি কাব্যিকভাবে স্থানান্তর করে, থিয়েটারের এই নগ্ন ভাষাকে (নকল নয়, আসল বাস্তব ভাষা) অনুমতি দিতে হবে, এটি মানুষের স্নায়বিক চুম্বকত্বের ব্যবহার দ্বারা, শিল্প এবং সংলাপের সাধারণ সীমা লঙ্ঘন করবে, সক্রিয়ভাবে উপলব্ধি করার জন্য, যে, যা যাদুকরীভাবে বলতে গেলে, বাস্তব অর্থে, এমন এক ধরণের  সৃষ্টি যেখানে মানুষকে স্বপ্ন এবং ঘটনার মধ্যে তার স্থান পুনরায় আবিষ্কার করতে হবে।
    .
    থিম সম্পর্কে বলতে হলে,  বলা জরুরি যে, বিষয়বস্তু তুরীয় মহাজাগতিক ঘটনা দিয়ে দর্শকদের বিরক্ত করার বিষয় নয়। চিন্তাভাবনায়  কর্মের গভীর চাবিকাঠি থাকতে পারে যার সাহায্যে পুরো দর্শনটি ব্যাখ্যা করা যায়, সাধারণভাবে দর্শকরা  উদ্বেগ প্রকাশ করে নাও করতে পারে। কিন্তু তবুও তারা অবশ্যই সেখানে থাকবে; এবং সেটাই আমাদের দরকার।
    .
    নজরকাড়া বা নাটকীয় সর্বজনীন প্রদর্শন সম্পর্কে বক্তব্য হলো যে  প্রতিটি নাটকীয় প্রদর্শনীর একটি ভৌত এবং বস্তুনিষ্ঠ উপাদান থাকবে, যা সকলের কাছে উপলব্ধিযোগ্য। কান্না, হাহাকার, অপচ্ছায়া, চমক, সব ধরণের নাটকীয়তা, নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান থেকে নেওয়া পোশাকের জাদু সৌন্দর্য; দীপ্তিময় আলোকসজ্জা, কণ্ঠের উদ্দীপনাময় সৌন্দর্য, সম্প্রীতির আকর্ষণ, সঙ্গীতের বিরল স্বর, বস্তুর রঙ, নড়াচড়ার শারীরিক ছন্দ যার ওঠা আর নামা সকলের পরিচিত গতিবিধির স্পন্দনের সাথে হুবহু মিলবে। নতুন এবং আশ্চর্যজনক এর ঠাসবুনোট উপস্থিতি বস্তু, মুখোশ, মূর্তি , আলোর আকস্মিক পরিবর্তন, দর্শকের ওপর আলোর  ক্রিয়া যা তাপ ও শীতলতার অনুভূতি জাগায়, ইত্যাদি।
    .
    মঞ্চসজ্জা সম্পর্কে বলতে হলে, থিয়েটারের সাধারণ ভাষাটি প্রয়োগ করে  দৃশ্যের চারপাশে গঠন করা হবে। তা কেবল মঞ্চে কোনও পাঠ্যের প্রতিসরণের মাত্রা হিসাবে নয়, সমস্ত নাট্য সৃষ্টির জন্য প্রস্থানবিন্দু হিসাবে বিবেচিত হবে।  এই ভাষার ব্যবহার এবং পরিচালনার মধ্যেই লেখক এবং পরিচালকের মধ্যে পুরানো দ্বৈততা বিলীন হয়ে যাবে, এক ধরণের অনন্য স্রষ্টার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে যার উপর চমক এবং কাহিনির দ্বৈত দায়িত্ব অর্পণ করা হবে।
    .
    মঞ্চের ভাষা: এটি কথ্য ভাষাকে চাপা দেওয়ার প্রশ্ন নয়, বরং স্বপ্নে পাওয়া শব্দের মতন গুরুত্ব দেওয়ার প্রশ্ন।
    .
    ইতিমধ্যে এই ভাষা রেকর্ড করার নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে, এই উপায়গুলি সঙ্গীত প্রতিলিপি বা কোনো ধরনের কোডের অন্তর্গত হলে ক্ষতি নেই।
    .
     সাধারণ বস্তু বা এমনকি অভিনেতার দেহের জন্যও, লক্ষণগুলোকে মর্যাদা দিতে হবে। এটা স্পষ্ট যে কেউ হায়ারোগ্লিফিক অক্ষর থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে, তা কেবল এই লক্ষণগুলোকে টের পাবার ফ্যাশন হিসেবে তুলে ধরার জন্য নয় ।বস্তুত তা এই ইশারাগুলোকে একটি পঠনযোগ্য ফ্যাশনে উপস্হাপন করার জন্য যা তাদের ইচ্ছামত পুনরুৎপাদন করার অনুমতি দেয় । তার আসল কাজ কিন্তু মঞ্চে সুনির্দিষ্ট এবং অবিলম্বে পাঠযোগ্য ইশারা রচনা করা।
    .
    অন্যদিকে, এই কোড ল্যাঙ্গুয়েজ এবং সঙ্গীতের উপস্হাপন কণ্ঠস্বর মেলাবার মাধ্যম হিসেবে মূল্যবান হবে।
    .
     যেহেতু এই ভাষাতে স্বরভঙ্গীর  ব্যবহার জরুরি আর মৌলিক, তাই এই স্বরধ্বনিগুলি এক ধরণের সুরেলা ভারসাম্য গঠন করবে, সংলাপের  গৌণ বিকৃতিকে ইচ্ছামত পুনরুত্পাদনযোগ্য হতে হবে।
    .
     একইভাবে অজস্র মুখোশের আকারে ধরা মুখের  অভিব্যক্তির তালিকা তৈরি করা যেতে পারে, তাই তারা শেষ পর্যন্ত তাদের নির্দিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক ব্যবহার থেকে স্বাধীনভাবে মঞ্চের এই ঠাসবুনোট ভাষায় সরাসরি এবং প্রতীকীভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
    .
    এই প্রতীকী অঙ্গভঙ্গি, মুখোশ এবং মনোভাব, এই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আন্দোলন যার অগণিত অর্থ থিয়েটারের কংক্রিট ভাষা-প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ গঠন করে, উদ্দীপক অঙ্গভঙ্গি, আবেগপ্রবণ বা স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, ছন্দ এবং শব্দের বাইরে উত্তেজিত ধাক্কাধাক্কি উপস্হাপন করতে পারবে। বাড়িয়ে-চাড়িয়ে তুলে, প্রতিফলন দ্বারা অগণিত হবে। সমস্ত আবেগপ্রবণ অঙ্গভঙ্গির ভর নিয়ে গঠিত দেহচালনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি, সমস্ত ভ্রান্ত মনোভাব, মন এবং জিহ্বার সমস্ত ত্রুটি, যার দ্বারা প্রকাশ করা হয় যা বলা যেতে পারে বাকশক্তির নপুংসকতা, এবং এতে অভিব্যক্তির একটি অসামান্য সম্পদ রয়েছে, যার সুযোগ-সুবিধা পেতে ব্যর্থ হলে চলবে না।
    .
    এছাড়াও, সঙ্গীতের একটি সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে যেখানে শব্দগুলো তাদের অক্ষরের মতো প্রবেশ করে, যেখানে সুরগুলো একত্রিত হয় এবং শব্দের সুনির্দিষ্ট প্রবেশদ্বারে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।এছাড়াও, সঙ্গীতের একটা সুনির্দিষ্ট বার্তা রয়েছে যেখানে শব্দগুলি তাদের অক্ষরের মতো খুঁজে বের করে, যেখানে সুরগুলি একত্রিত হয় এবং শব্দের সুনির্দিষ্ট পথ খুঁজে বের করে।

    বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে বলতে হলে : এগুলিকে বস্তু হিসাবে এবং সেটের অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হবে। এছাড়াও, দর্শকদের সংবেদনশীলতার উপর সরাসরি এবং গভীরভাবে কাজ করার কথা ভাবা দরকার, আওয়াজের দৃষ্টিকোণ থেকে, একেবারে নতুন আওয়াজের গুণাবলী এবং কম্পনের মধ্যে গবেষণা দরকার , যা বর্তমান সময়ের বাদ্যযন্ত্রের নেই এবং যার পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন। প্রাচীন এবং বিস্মৃত যন্ত্রের বা নতুনের উদ্ভাবন করতে হবে। গবেষণার প্রয়োজন, সঙ্গীত ছাড়াও, যন্ত্র এবং যন্ত্রপাতিগুলিতে  বিশেষ সংমিশ্রণ বা ধাতুর নতুন মিশ্রণের উপর ভিত্তি করে, একটি নতুন পরিসর এবং দিকনির্দেশক অর্জন করতে পারে, যা শ্রোতার কাছে কান ফুটো করে দেবার মতন অসহ্য। 
    .
    আলো, আলোকসজ্জার ব্যাপারে বলতে হলে,  থিয়েটারে এখন ব্যবহৃত আলোর সরঞ্জামগুলো  পর্যাপ্ত নয়। মনের ওপর আলোর বিশেষ ক্রিয়া, সমস্ত ধরণের আলোকিত কম্পনের প্রভাবগুলো যাচাই করতে হবে, আলোকতরঙ্গে, আলোর চাদরে, ফুলঝুরির মতন ছড়িয়ে পড়া আলোর নতুন উপায় খুঁজতে হবে। এখন ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলোর তৈরি আলোর রঙের  শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংশোধন করতে হবে। নির্দিষ্ট বাদ্যযন্ত্রের গুণাবলী তৈরি করার জন্য, আলোকে অবশ্যই তাপ, ঠান্ডা, রাগ, ভয় ইত্যাদির সংবেদনগুলি তৈরি করার লক্ষ্যে মিহি, ঘন এবং অস্বচ্ছতার একটি উপাদান পুনরুদ্ধার করতে হবে।
    .
    পোষাক সম্পর্কে বলতে হলে, হাল আমলের পোষাক যতটা সম্ভব পরিহার করা হবে, তবে একই সাথে এমন অভিন্ন নাট্য পোষাক হবে না  যেটি প্রতিটি নাটকের জন্য একই হবে -- অতীতের প্রতি আকর্ষণ এবং কুসংস্কারপূর্ণ শ্রদ্ধা থেকে নয়,  কারণ এটি সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট মনে হয় যে নির্দিষ্ট সময়ের পোশাক, আচারের উদ্দেশ্য, যদিও তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যমান ছিল, মনে রাখতে হবে তাদের জন্ম দেওয়া ঐতিহ্যের ঘনিষ্ঠতা থেকে এক ধরনের সৌন্দর্য আর চেহারা সংরক্ষণ করে।
    .
     প্রেক্ষাগৃহ সম্পর্কে বলতে হলে বলব যে  আমরা মঞ্চ এবং প্রেক্ষাগৃহের ধারনা বাতিল করে দিয়েছি এবং কোনো প্রকার বিভাজন বা বাধা ছাড়াই একটি একক এলাকায় থিয়েটার প্রতিস্থাপন করেছি, যা অ্যাকশনের থিয়েটার হয়ে উঠবে। দর্শক এবং দর্শকের মধ্যে, অভিনেতা এবং দর্শকের মধ্যে একটি সরাসরি যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হবে, এই ঘটনা থেকে যে দর্শকদের অভিনয়ের মাঝখানে রাখা হবে, এর ফলে তারা আচ্ছন্ন এবং শারীরিকভাবে প্রভাবিত হবে। এই ঘেরাটোপের ফলাফল, অংশত, ঘরের নিজেরই ভূমিকা থাকে। এইভাবে, বর্তমান সময়ের থিয়েটারগুলির স্থাপত্যকে পরিত্যাগ করতে হবে, আমরা  হ্যাঙ্গার বা শস্যাগার ভাড়া নেব, যেগুলিকে আমরা নির্দিষ্ট গির্জা বা পবিত্র স্থানগুলির এবং তিব্বতের নির্দিষ্ট মন্দিরগুলির স্থাপত্যের মতন  পুনর্নির্মাণ করব।
    .
    এই নির্মাণের অভ্যন্তরে উচ্চতা এবং গভীরতার বিশেষ অনুপাত প্রাধান্য পাবে। হলটি কোনও রকম ভাস্কর্য ছাড়াই চার দেয়ালে ঘেরা থাকবে এবং জনসাধারণকে ঘরের মাঝখানে, নিচতলায়, ঘুরন্ত চেয়ারে বসতে হবে যাতে তারা তাদের চারপাশে ঘটতে থাকা দৃশ্য অনুসরণ করতে পারে।  প্রকৃতপক্ষে, এটা হলো প্রথানুগত মঞ্চের অনুপস্থিতি । ঘরের চারটি মূল এলাকায় অভিনেতাদের অ্যাকশনের জন্য বিশেষ অবস্থান সংরক্ষিত থাকবে। আলো শোষণ করার জন্য ডিজাইন করা হোয়াইটওয়াশ করা প্রাচীর-পটভূমির সামনে দৃশ্যগুলি চালানো হবে। উপরন্তু, গ্যালারি ওভারহেড নির্দিষ্ট আদিম পেইন্টিংগুলির মতো হলের পরিধির চারপাশে ঘুরে বেড়াবে।
    .
    এই গ্যালারিগুলো অভিনেতাদের স্বাধীনতা দেবে, যখনই অ্যাকশনের প্রয়োজন হবে, ঘরের  একটা  বিন্দু থেকে অন্য জায়গায় যাবে, এবং অ্যাকশনটিকে সমস্ত  দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাবে৷ ঘরের এক প্রান্তে উচ্চারিত একটি কান্না মুখ থেকে অন্য মুখে চলে যাবে এবং ধারাবাহিক স্বরভঙ্গীর মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়া হবে । ক্রিয়াটি উন্মোচিত হবে, তার গতিপথকে স্তর থেকে স্তরে, বিন্দু থেকে বিন্দুতে প্রসারিত করবে; প্যারোক্সিজম হঠাৎ করে ফেটে যাবে, বিভিন্ন জায়গায় আগুনের মতো জ্বলে উঠবে।  দর্শকদের ওপর নাটকীয়তার বৈশিষ্ট্য সত্যিকারের বিভ্রম বা ক্রিয়াটির প্রত্যক্ষ ও তাৎক্ষণিক প্রভাব সৃষ্টি করবে কিন্তু ফালতু সংলাপ বলা হবে না। একটি বিশাল স্থানের উপর কর্মের এই বিস্তারের জন্য একটি দৃশ্যের আলো এবং একটি পারফরম্যান্সের বৈচিত্র্যময় আলো জনসাধারণের ওপর যতটা পড়বে ততোটা  অভিনেতাদের ওপর পড়বে -- এবং একই সাথে একাধিক ক্রিয়া বা একটি অভিন্ন ক্রিয়াকলাপের কয়েকটি ধাপ গড়ে উঠতে থাকবে। যে চরিত্রগুলি, মৌমাছির মতো একে অপরের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে, পরিস্থিতির সমস্ত আক্রমণ এবং ঝড়-বৃষ্টির উপাদানগুলির বাহ্যিক আক্রমণ সহ্য করবে, আলোকসজ্জার ভৌত উপায়, বজ্র বা বাতাস উৎপাদন করবে, যার প্রতিক্রিয়া দর্শকরা ভোগ করবে।
    .
    যাইহোক, একটি কেন্দ্রীয় অবস্থান সংরক্ষিত থাকবে যা,  সঠিকভাবে বলতে গেলে, একটি মঞ্চ হিসাবে কাজ করবে যেখানে ক্রিয়াকলাপের বেশিরভাগ অংশ কেন্দ্রীভূত হবে এবং যখনই প্রয়োজন তখন একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসার অনুমতি দেবে।
    .
    থিয়েটারে ব্যবহারের জিনিসপত্র, যেমন মুখোশ আর আনুষাঙ্গিক: ম্যানিকিনস, বিশাল মুখোশ, অদ্ভুত অনুপাতের বস্তুগুলো  চিত্রগুলির মতো একই অনুমোদনের সাথে প্রদর্শিত হবে, প্রতিটি চিত্র এবং প্রতিটি অভিব্যক্তির কংক্রিট দিকটি প্রয়োগ করবে -- বৈপরীত্যসহ যে সমস্ত বস্তুর প্রয়োজন, তাদের একইরকম রাখা হবে না এবং তাদের হুবহু শারীরিক প্রতিনিধিত্ব বাতিল করা হবে বা ছদ্মবেশী করা হবে।
    .
    সেট: কোনও সেট থাকবে না। এই ফাংশনটি যথেষ্ট পরিমাণে হায়ারোগ্লিফিক অক্ষর, রিচুয়াল পোশাক-পরিচ্ছদ, দশ ফুট উঁচু ম্যানিকিন যা ঝড়ের মধ্যে কিং লিয়ারের দাড়ির প্রতিনিধিত্ব করবে, পুরুষদের মতো লম্বা বাদ্যযন্ত্র, অজানা আকৃতি এবং উদ্দেশ্যের বস্তু দ্বারা পরিচালিত হবে।
    .

    তাৎক্ষণিকতা: কিন্তু, লোকেরা বলবে, এই থিয়েটার জীবন থেকে, ঘটনা থেকে, তাৎক্ষণিক আগ্রহ থেকে বিচ্ছিন্ন।বর্তমান এবং তার ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন। হ্যাঁ! তা ঠিক । যে কোনও ব্যাপারে সেই ব্যস্ততা থাকে,  সেই গভীরতা থাকে যা কিছু পুরুষের বিশেষাধিকার, না! জোহরে, রাব্বি সিমিওনের গল্প আমরা জানি, যিনি আগুনের মতো জ্বলছেন, তিনি আগুনের মতোই তাৎক্ষণিক। 
    .
    কাজগুলি: আমরা একটি লিখিত নাটকের অভিনয় করব না, তবে আমরা থিম, ঘটনা বা পরিচিত কাজগুলিকে ঘিরে সরাসরি মঞ্চায়নের চেষ্টা করব। রুমের প্রকৃতি এবং স্বভাবই এই চিকিৎসার পরামর্শ দেয় এবং যতো বড়োই  থিম হোক, তা  অস্বীকার করা যেতে পারে।
    .
    নাটকীয়তার অবিচ্ছেদ্য  একটি ধারণা আছে যার পুনর্জন্ম ঘটাতে হবে। সমস্যা হল স্থানের নিজস্ব সংলাপ, স্হানটিকে ভরে তোলা এবং সজ্জিত করা; পাথরের দেয়ালে বিছানো খনির মতো যা হঠাৎ করে গরম জলের ঝর্না এবং পাথরের ফুলের তোড়াতে পরিণত হয়।
    .
    অভিনেতারা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যেহেতু  তাদের  কার্যকারিতার উপর নাটকীয়তা নির্ভর করে  এবং একই সঙ্গে এক ধরণের নিষ্ক্রিয় এবং নিরপেক্ষ উপাদান, যেহেতু তারা কঠোরভাবে সমস্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগকে অস্বীকার করতে বাধ্য। এটি একটি এলাকা যেখানে কোনও সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই; এবং অভিনেতাদের মধ্যে যাঁর জন্য প্রয়োজন কেবল একটি কান্নার গুণ এবং যে অভিনেতাকে অবশ্যই তার সমস্ত ব্যক্তিগত গুণাবলী সহ একটি সংলাপ বলতে হবে, সেখানে তার স্বাধীনতাটুকু রয়েছে যা একজন মানুষকে একটি যন্ত্র থেকে আলাদা করে।
    .
    ব্যাখ্যা: নাটকীয়তা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত গণনা করা হবে, একটি কোডের মতো ( ভাষাহীনতা )। এইভাবে কোনও অঙ্গভঙ্গী হারিয়ে যাবে না, সমস্ত অঙ্গভঙ্গী একটি ছন্দ মেনে চলবে; এবং প্রতিটি চরিত্র নিছক একটি বিশেষ ধরনের হওয়ার কারণে, তার অঙ্গভঙ্গি, শারীরবৃত্তীয়তা এবং পোশাক-পরিচ্ছদ আলোর রশ্মির মতো প্রদর্শিত হবে।
    .
    সিনেমা: যা তুলে ধরা হয়, তার অশোধিত দৃশ্যায়নের জন্য, কবিতার মাধ্যমে, থিয়েটার যা নয় সেই সব ইমেজের বিরোধিতা করে। যাইহোক, কর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে, কেউ একটি সিনেমাটিক চিত্রের তুলনা করতে পারে না,  তা সে যতই কাব্যিকই হোক না কেন, চলচ্চিত্র  সীমাবদ্ধ । থিয়েটার  জীবনের সমস্ত প্রয়োজনীয়তা মেনে চলে।
    .
    নিষ্ঠুরতা: প্রতিটি দৃশ্যের মূলে নিষ্ঠুরতার উপাদান না থাকলে থিয়েটার সম্ভব নয়। আমাদের বর্তমান অবক্ষয়ের অবস্থায় দেহের চামড়া ফুঁড়ে মেটাফিজিক্সকে আমাদের মনে পুনরায় প্রবেশ করতে হবে।
    .
    জনসাধারণ: প্রথমত এই থিয়েটারের অস্তিত্ব থাকতে হবে।
    .
    প্রোগ্রাম: আমরা পাঠ্য বিবেচনা না করে মঞ্চ করব:

    ১. শেক্সপিয়রের সময়ের একটি কাজের একটি অভিযোজন, একটি কাজ যা আমাদের বর্তমান অস্থির মানসিক অবস্থার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ, শেক্সপিয়রের সেই সময়ের নাটকগুলির একটি, যেমন ‘আর্ডেন অফ ফেভারশাম’। 
    .
    ২.লিয়োঁ পল ফার্গুর চরম কাব্যিক স্বাধীনতার একটি নাটক।
    .
     ৩. জোহর থেকে একটি নির্যাস: রাব্বি সিমিওনের গল্প, যাতে সর্বদা বর্তমান সহিংসতা এবং একটি সংঘাত দেখানোর শক্তি রয়েছে।
    .
    ৪.ব্লুবিয়ার্ডের গল্পটি ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী এবং কামুকতা এবং নিষ্ঠুরতার একটি নতুন ধারণার সাথে পুনর্গঠিত হয়েছে।
    .
    ৫. বাইবেল এবং ইতিহাস অনুসারে জেরুজালেমের পতন; রক্তে-লাল রঙের ধারা এটি থেকে বেরিয়ে আসে এবং আলোতেও দৃশ্যমান । পরিত্যাগ এবং আতঙ্কের অনুভূতি গড়ে তোলে। অন্যদিকে নবীদের আধিভৌতিক বিবাদ, তারা যে ভয়ানক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন তৈরি করেছিল এবং যার প্রতিক্রিয়া শারীরিকভাবে রাজা, মন্দির, জনগণ এবং ঘটনাগুলিকে প্রভাবিত করেছিল।
    .
    ৬. মার্কুইস দি সাদের একটি গল্প, যেখানে কামোত্তেজনাকে স্থানান্তরিত করা হবে, রূপক হিসাবে উপস্হাপন করা হবে এবং চিত্রিত করা হবে, নিষ্ঠুরতার একটি হিংসাত্মক বহিঃপ্রকাশ তৈরি করতে হবে এবং গড়ে উঠবে অবশিষ্টাংশের একটি বিচ্ছুরণ।
    .
    ৭. এক বা একাধিক রোমান্টিক মেলোড্রামা যেখানে অসম্ভাব্যতা কবিতার একটি সক্রিয় এবং ঠাসবুনোট উপাদান হয়ে উঠবে ।
    .
    ৮. আমাদের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার চেতনায় এবং মঞ্চের পরিপ্রেক্ষিতে একটি আনুষ্ঠানিক পাঠ্য থেকে কী টানা যায় তার উদাহরণ হিসাবে বুখনার ওজেকের কাজ।
    .
    ৯.এলিজাবেথান থিয়েটারের কাজগুলো থেকে তাদের পাঠ্য ছিনিয়ে নেয়া হবে এবং কেবলমাত্র সময়কাল, পরিস্থিতি, চরিত্র এবং কর্মের উপাদানগুলিকে ধরে রাখা হবে।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 110.226.179.223 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:০৭740579
  • এডওয়ার্ড সাঈদের প্রাচ্যবাদের প্রেক্ষিতে অঁতনা আতো
    এডওয়ার্ড সাঈদ (১৯৩৫-২০০৩) প্রথম যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন যে, প্রাচ্যবাদ শুধু একটি আদর্শিক প্রতর্কই নয়, বরং প্রাচ্য সম্পর্কিত একটি ইয়োরোপীয় চিন্তা ও চর্চাসূত্র। সাঈদ তার Orientalism-এ লিখেছেন: Orientalism is a style of thought based upon an ontological and epistemological distinction made between ‘the Orient’ and (most of the time) ‘the Occident’. [প্রাচ্যবাদ প্রাচ্য ও (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে) প্রতীচ্যের মাঝে তত্ত্ববিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্বের বিভাজনের ওপর নির্মিত একটি চিন্তাশৈলী।] আরো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সংজ্ঞাসূত্রে ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় যে, প্রাচ্যবাদ এশিয়া বা প্রাচ্যের ওপর প্রভাব, কর্তৃত্ব ও খবরদারি ফলানোর পাশ্চাত্য ভাবনার স্বরূপ। সাঈদ এই ধারণার বীজটি সংগ্রহ করেছিলেন আন্তোনিও গ্রামসির (১৮৯১-১৯৩৭) ‘হেজিমনি’ (hegemony) ও অ-পশ্চিমা দেশের ওপর সাংস্কৃতিক মোড়লিপনা জিইয়ে রাখার পাশ্চাত্য তৎপরতা বিষয়ক মিশেল ফুকোর (১৯২৬-১৯৮৪) প্রতর্ক থেকে। 
    ভারতীয় লেখক, ও নাট্য পরিচালক রুস্তম ভারুচার মতে অঁতনা আতো একজন ওরিয়েণ্টালিস্ট কবি, ভাবুক ও নাট্যকার । ভারুচা ব্রিটিশ একাডেমির একজন  ফেলো এবং থিয়েটার ও পারফরম্যান্স স্টাডিজের  অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক । তিনি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের  ইনডিয়ান স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড অ্যাসথেটিক্সে ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছিলেন। বালি দ্বীপের নৃত্যকলার দ্বারা প্রভাবিত অঁতনা আতোর নাট্যভাবনাকে রুস্তম ভারুচা বলেছেন ওরিয়েন্টালিস্ট। 
    ১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম ইন্দোনেশিয়ার আমন্ত্রণে জাভা, বালি, সিয়াম, কুয়ালালামপুর পভৃতি স্থানে ভ্রমণ করেন। রবীন্দ্রনাথ সে দেশের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে নাচকে বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করেন। রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, মীরা দেবী, অমিয় চক্রবর্তী ও রানী মহলানবিশকে লেখা একুশটি পত্রের মধ্যে ছ’টি পত্রেই রয়েছে তাঁর সে দেশের নৃত্য দেখার অভিজ্ঞতার কথা। রবীন্দ্রনাথের মতে, সেই দেশের নাচ যেন তাদের ভাষা। নিত্য দিনের সকল কাজ কর্মের মধ্যেই অর্থাৎ চলা-ফেরা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ভালোবাসার প্রকাশ, ভাঁড়ামি  সবেতেই নৃত্য বর্তমান। বালিদ্বীপের নাচ দেখে রবীন্দ্রনাথ যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছিলেন তা তাঁর লেখনী দ্বারাই পরিস্ফুট। তিনি ওখানের নাচে লক্ষ্য করেছিলেন সমস্ত অভিব্যক্তি প্রকাশের পুরো বিষয়টাই নৃত্যছন্দে গাঁথা। সেই নাচের সমস্ত ভাব প্রকাশের মাধ্যম দেহভঙ্গির ভাষা, অর্থাৎ ছন্দের মাধ্যমে দেহের গতি-প্রকৃতির বিচিত্র ভঙ্গি সকল প্রকার ভাবকে প্রকাশ করে।  “সেদিন এখানকার  এক রাজবাড়িতে আমরা নাচ দেখছিলুম। খানিক বাদে শোনা গেল, এই নাচ-অভিনয়ের বিষয়টা হচ্ছে শাল্ব-সত্যবতীর আখ্যান। এর থেকে বোঝা যায়, কেবল ভাবের আবেগ নয়, ঘটনা বর্ণনাকেও এরা নাচের আকারে গড়ে তোলে। মানুষের সকল ঘটনারই বাহ্যরূপ চলাফেরায়। কোনো-একটা অসামান্য ঘটনাকে পরিদৃশ্যমান করতে চাইলে তার চলাফেরাকে ছন্দের সুষমাযোগে রূপের সম্পূর্ণতা দেওয়া সংগত। বাণীর দিকটাকে বাদ দিয়ে কিম্বা খাটো করে কেবলমাত্র গতিরূপটিকে ছন্দের উৎকর্ষ দেওয়া এখানকার নাচ। পৌরাণিক যে আখ্যায়িকা কাব্যে কেবলমাত্র কানে শোনার বিষয়, এরা সেইটেকেই কেবলমাত্র চোখে দেখার বিষয় করে নিয়েছে।“৩ রবীন্দ্রনাথের এই নৃত্য দেখার অভিজ্ঞতার ফলেই হয়তো কোনো কাহিনী বা নাটকের কোনো বিষয়বস্তুকে নৃত্যাভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করার ভাবনা উদ্ভূত হয়েছিল বলে ধরা যেতে পারে।                                                
           
    রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট যে অঁতনা আতো তাঁর নাটকের জন্য যে সমস্ত ব্যাপার চাইছিলেন তা বালির নৃত্যানুষ্ঠানে পেয়ে যান। কিন্তু অঁতনা আতোই প্রথম শিল্পী ছিলেন না যিনি এশিয়ান থিয়েটার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তবে তিনি একটি  বিস্তৃত পরিসরে তাঁর পরে আরও অনেকের জন্য এটি করার পথ প্রশস্ত করেছিলেন। থিয়েটারের উপর তাঁর প্রবন্ধ এবং থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির জন্য তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত তাঁর  রচনা  দ্য থিয়েটার অ্যান্ড ইটস ডাবল, প্যারিসে ১৯৩১ সালের আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে বালির নৃত্যশিল্পীদের দেখার পরে লেখা হয়েছিল। 
    অঁতনা আতো  যা দেখেছিলেন সে সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি সীমিত ছিল; অনুষ্ঠানের নোট  বিস্তারিত ছিল না। তিনি কিছু তথ্য ভুল পেয়ে থাকতে পারেন কেননা তিনি এশিয়ার নৃত্যনাট্য সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন না। তিনি প্যারিসের উপকণ্ঠে ভিনসেনেস উডসে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ প্যাভিলিয়নে মঞ্চস্থ নৃত্যনাট্যের সত্যতা যাচাই করার জন্য এবং সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিকতার জন্য স্বাধীনভাবে গবেষণা  করেননি। রুস্তম ভারুচা প্রশ্ন তুলেছেন  যে আতো কি কেবলমাত্র "প্রাচ্য থিয়েটারের সবচেয়ে লোভনীয় কল্পকাহিনীগুলির মধ্যে একটির লেখক" ছিলেন।? এটা কেমন ব্যাপার ছিল যে বালির নৃত্যনাট্যই আতোকে তাঁর ‘আত্মপ্রকাশের মুহূর্ত’-তে পৌঁছে দিয়েছিল?”  একটি সংকলনের ভূমিকায়, সুসান সন্টাগ লিখেছেন  যে আতোর তত্ত্বগুলো সম্ভবত বালির নৃত্যনাট্য দেখার পর তাঁর চিন্তায় আসেনি। পরিবর্তে, যাকে গুরুত্ব দিতে হবে তা তা হল যে “অন্য সংস্কৃতিটি প্রকৃতপক্ষে অন্য; যা অ-পশ্চিমা এবং অ-সমসাময়িক”। ফলে রুস্তম ভারুচার জন্য, ব্যাপারটা সমস্যাযুক্ত রয়ে গেছে।
    সুসান সন্টাগ লিখেছেন  যে অঁতনা আতোর "প্রাচ্য থিয়েটার" সম্পর্কে কল্পিত দৃষ্টিভঙ্গি আজও ইউরোপীয় ও মার্কিন শিল্পীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফ্যালে এবং তাদের পুরোপুরি না বুঝেই  এশীয় অভিনয় ও নৃত্যশৈলীকে অনুকরণ করতে উৎসাহিত করে। অনুপ্রেরণা, উপযোগ, ভুলবোঝা, বানোয়াট বা প্রাচ্যবাদ হিসাবে বালি দ্বীপের নৃত্যানুষ্ঠানের  সাথে আতোর প্রভাব বিষয়ক বিতর্কটি রুস্তম ভারুচা এবং সুসান সন্টাগের  আগে এবং তারপরও বহু প্রাবন্ধিক আলোচনা করেছেন। তাদের মধ্যে এল.সি. প্রনকো, পি.এ. ক্ল্যান্সি, স্টিফেন স্নো, ক্যাথি ফোলি, ইভান উইনেট, নিকোলা সাভারেস এবং রিচার্ড ফাউলার এবং ম্যাথিউ কোহেন অন্যতম ৷ ভারুচা যুক্তি দিয়েছেন যে ওরিয়েন্টাল থিয়েটার সম্পর্কে অঁতনা আতোর সংক্ষিপ্ত এবং রহস্যময় ভাবনা হল "পশ্চিমী থিয়েটার যা নয়" তা দেখানো এবং এই প্রক্রিয়ায় এশিয়াকে "অপর" হিসাবে গড়ে তোলা। রুস্তম ভারুচার মতে, পশ্চিমা থিয়েটার কী নয় তা দেখানোর জন্য বালির নৃত্যানুষ্ঠানের একটি কাল্পনিক সংস্করণ পুনর্নির্মাণ ও নির্মাণ করার পরিবর্তে, অঁতনা আতো প্যারিসে প্রচলিত থিয়েটারের অবস্হা কী ছিল তা বোঝার একটি উপায় হিসেবে বালির নৃত্যানুষ্ঠানে তা আবিষ্কার করেছিলেন এবং এইভাবে  দুটি ঐতিহ্যকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন।
    এটি শুধুমাত্র আতোর থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির তত্ত্বকে বৈধ করেনি যা তিনি সেই সময়ে প্রণয়ন করেছিলেন এবং দ্য থিয়েটার অ্যান্ড ইটস ডাবল-এ লিখছিলেন, একই সঙ্গে এটি বালির নৃত্যানুষ্ঠানকে পাশ্চাত্য অধ্যয়ন এবং অনুপ্রেরণার যোগ্য হিসাবে বৈধ করে দিয়েছিলেন। বালির নৃত্যানুষ্ঠানের প্রভাব আতোর ওপর পড়ার ফলে, পশ্চিমা থিয়েটার অনুশীলনকারীরা বালির সাথে একটি সমৃদ্ধ এবং জটিল সম্পর্ক উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে গেছে। এমনকি কোনো এশিয় নাট্যানুষ্ঠান দেখার আগে, আতো পশ্চিমা থিয়েটারের অবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং অবিরাম মৌলিক পরিবর্তনের আহ্বান জানাচ্ছিলেন। বাস্তববাদ সম্পর্কে নাটকের  আগ্রহ  দেখে হতাশ হয়ে, তাঁর চিঠি এবং প্রবন্ধগুলিতে তিনি এটিকে "মনস্তাত্ত্বিক এবং মানবিক স্থবিরতা" হিসেবে তকমা দিয়েছেন।আতোর মতে, বাস্তববাদী "জীবনের টুকরো" থিয়েটার  নিছক "মিথ্যা এবং বিভ্রম" উপস্থাপন করে।তা দর্শকদের  আকাঙ্ক্ষাকে তৃপ্ত করার জন্য  উঁকি মারা ছাড়া কিছুই নয়। শুধু ট্র্যাজেডি নয়, সব ধরনের নাটকের উপর অ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্বের আধিপত্য অব্যাহত থাকার কারণে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ইউরোপে পশ্চিমা নাট্যচর্চার অবস্হাটা মূলত লিখিত পরিবেশনের  সহায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
     থিয়েটারকে "চিত্রণ" হিসাবে কল্পনা করা হয়েছিল এবং "উনবিংশ শতাব্দীর  উপন্যাসের ছবিগুলির মতো, একটি মঞ্চ নাটকের কাহিনির আকর্ষণে যোগ করা হয়েছিল কিন্তু এর সারাংশে কিছুই করা হয়নি"। রেনে দুমালকে লেখা ১৯৩১ সালের চিঠিতে আতো ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, গত শতাব্দীতে ইউরোপীয় থিয়েটার "ব্যক্তিমানুষের মনস্তাত্ত্বিক এবং মৌখিক প্রতিকৃতিতে সীমাবদ্ধ ছিল," যেখানে "বিশেষভাবে প্রকাশের নাট্যমাধ্যমগুলো ধীরে ধীরে লিখিত রচনার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে"। এই প্রচলিত ধারণাকে প্রতিহত করার জন্য, অঁতনা আতো  শুধুমাত্র মঞ্চের কারিগরি  ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন যা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। প্যারিসের ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে বালির নৃত্যনাট্য আতোর জন্য  মঞ্চের যে কারিগরির আগল খুলে দিয়েছিল, তা আসলে, মঞ্চ দখল করে এমন সমস্ত কিছু নিয়ে গঠিত, যা একটি মঞ্চে প্রকাশ করা সম্ভব এবং বস্তুগতভাবে প্রকাশ করা যায় । শব্দের ভাষা হিসাবে প্রাথমিকভাবে মনের কাছে সম্বোধন করার জন্য আতো দর্শকদের  ইন্দ্রিয়গুলোকে উসকে দিতে চেয়েছিলেন ।বালির নৃত্যানুষ্ঠান দেখে আতোর  মনে হয়েছিল যে তাদের বার্তা প্রকাশ করার জন্য শব্দের প্রয়োজন নেই । রুস্তম ভারুচা অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন যে আতো স্পষ্টতই বুঝতে পারেননি যে তারা যে বিদেশী ভাষায় কথা বলছে আর সেসবের মানে তিনি জানেন না ।  
    অনেক বালিনিজ শব্দ আতো ও ফরাসি দর্শকরা বুঝতে পারেননি, কেননা তারা তাদের নৃত্যানুষ্ঠানে ‘কাউই’ নামে একটা প্রাচীন ভাষা ব্যবহার করছিল যা বহুকাল যাবত ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতিতে আবৃত্তির জন্য সংরক্ষিত । আতো এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন। ইউরোপীয় থিয়েটার নির্দিষ্ট  স্ক্রিপ্টে আবদ্ধ ছিল এবং সাহিত্যের একটি শাখা হিসাবে সীমাবদ্ধ ছিল –- নাটক ছিল নিছক একটি পরিবেশিত পাঠ্য। আতো অনুভব করেন যে বালির থিয়েটার থেকে উদ্ভূত হয়েছে "একটি নতুন শারীরিক ভাষার অনুভূতি, যা লক্ষণের উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয় এবং কেবল সংলাপের শব্দের উপর নয়। প্যারিস আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে বালিনিজ পরিবেশনাকে অঁতনা আতো তাঁর নাট্যতত্ত্বের বৈধতার প্রমাণ হিসাবে পেয়েছিলেন। সমসাময়িক থিয়েটারের আঙ্গিক এবং উদ্দেশ্য পুনরুদ্ধার করার জন্য বালির অনুষ্ঠান তাঁর  অনুসন্ধানকে জাগিয়ে তুলেছিল, বিশেষ করে মুক্তি দিয়েছিল প্রকৃতিবাদের স্থবির পরিণতি থেকে। শুরু থেকেই, আতো  বালির নৃত্যানুষ্ঠানকে ইউরোপীয় থিয়েটারকে পুনরুদ্ধার করার একটি উপায় হিসাবে দেখেছিলেন যা বাস্তববাদ ও প্রকৃতিবাদের জন্য  আগে চালু ছিল । আতোর বলেছেন, বালিনিজ থিয়েটার (যা তিনি প্রায়শই "প্রাচ্য থিয়েটার" এর সাথে বিনিময়যোগ্যভাবে ব্যবহার করতেন) আমাদের শেখানোর জন্য শতাব্দী ধরে  সংরক্ষিত ছিল"। সুতরাং অঁতনা আতোর দর্শনকে প্রাচ্যবাদী বা ওরিয়েন্টালিস্ট বলা যায় না।
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:০৯740580
  •  চেনচি ( Les Cenci )  শেলি ও আতো’র নাটকের সত্য ঘটনা
    চেন চি ( The Cenci ) হল ইংরেজি ভাষার কবি শেলির ‘দি সেনসি. কাব্যনাট্য অবলম্বনে লেখা অঁতনা আতো’র একমাত্র পরিচিত নাটক যা থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির নির্দেশিকা ভিত্তিক। এই সত্য ঘটনা নিয়ে আরও যাঁরা লিখেছেন তাঁরা হলেন : ফিলিপ ম্যাসিঞ্জারের নাটক দ্য আনন্যাচারাল কমব্যাট ( ১৬১৯) মামলার  বর্ণনা রয়েছে এবং ২০০ বছরের মধ্যে বিয়াত্রিচের রোমান্টিক পুনরুজ্জীবনের পূর্বাভাস দেয়  ।"লেস সেন্সি", স্তাঁদালের একটি ছোট গল্প ( ১৮৩৭ )।Béatrix Cenci , পোলিশ কবি জুলিয়াস স্লোওয়াকির কাব্যনাট্য  ( ১৮৩৯) । বিয়াত্রিচে সেনসি , ফ্রান্সেস্কো ডোমেনিকো গুয়েরাজির একটি উপন্যাস ( ১৮৫৪ )। বিয়াত্রিচে সেনসি (একটি শহরের দোকানে) ( ১৮৭১) সারাহ মরগান ব্রায়ান পিয়াট , আমেরিকান কবির একটি কবিতা । Béatrix Cenci , Astolphe de Custine-এর কবিতা।নেমেসিস , আলফ্রেড নোবেলের ট্র্যাজেডি ।বিট্রিস সেনসি , আলবার্তো মোরাভিয়ার একটি নাটক ( ১৯৫৮)। ট্রান্স। অ্যাঙ্গাস ডেভিডসন-এর গল্প ( ১৯৬৫ )। Beatriz Cenci , গনসালভেস ডায়াসের একটি পদ্য নাটক ।Beatrix Cenci , শেলি নাটকের উপর ভিত্তি করে আলবার্তো গিনাস্টেরার অপেরা । Beatrice Cenci , বার্থহোল্ড গোল্ডস্মিডের অপেরা , শেলি নাটকের উপর ভিত্তি করে লেখা। দ্য সেনসি , সেলিব্রেটেড ক্রাইমস ( ১৮৪০ ) আলেকজান্ডার ডুমার প্রবন্ধ । Legende und Wahrheit der Beatrice Cenci ( ১৯২৬), Stefan Zweig এর ছোট গল্প । দ্য সেন্সি (1951-52), হ্যাভারগাল ব্রায়ানের একটি অপেরা (শেলির নাটক থেকে ) । দ্য সেন্সি ফ্যামিলি (২০০৪),লু কেম্প পরিচালিত লিজি হোপলির একটি রেডিও নাটক ।বিয়াত্রিচে সেন্সি ( ২০০৬), আলেসান্দ্রো লন্ডেই এবং ব্রুনেলা ক্যারোন্টির সঙ্গীত নাটক । Béatrice Cenci : Telle une fleur coupée , Jean Rocchi এর একটি উপন্যাস, ( ২০০৪ )। "ফিনিস দ্য সেনসি" (1954), ইভেন্টস অ্যান্ড সিগন্যালে এফআর স্কটের একটি 17 লাইনের কবিতা ; এছাড়াও তার নির্বাচিত কবিতা (১৯৬৬) এবং সংগৃহীত কবিতায় (১৯৮১)।এ টেল ফর মিডনাইট (1955), ফ্রেডেরিক প্রকোশের একটি উপন্যাস । জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক এবং জেমস রল্ফের লেখা কানাডিয়ান অপেরা বিট্রিস চ্যান্সি (এবং শেলি নাটক থেকে অনুপ্রাণিত), গল্পটিকে উনবিংশ শতাব্দীর নোভা স্কটিয়ায় স্থানান্তরিত করে । আ বিয়াত্রিচে সেনসি , সাব্রিনা গাট্টি (ইতালীয় লেখক), ইল ট্রোনো দে পোভেরি ( ২০২০) এর কাব্যিক গদ্যের একটি অংশ। এছাড়া মূর্তি, পেইনটিঙ ইত্যাদিতে চেন চি পরিবারের কাহিনি পাওয়া যায় । 
    গল্পটা এমন যে আতো এতে যথেষ্ট নিষ্ঠুরতার উপাদান পেয়ে যান। কিংবদন্তি অনুসারে, ফ্রান্সেস্কো চেনচি তার প্রথম স্ত্রী এরসিলিয়া সান্তাক্রুজ এবং  ছেলেদের সাথে দুর্ব্যবহার করতো আর বারবার মেয়ে বিয়েত্রিচেকে ধর্ষণ করতো। লোকটা নানা অপরাধের জন্য কারাগারে বন্দী ছিল, কিন্তু তার ঘুষ আর মর্যাদার কারণে তাড়াতাড়ি ছাড়া পায়।পরিবারটা রোমে রিওনে রেগোলার পালাজো চেনচিতে বসবাস করত । একত্রে বসবাসকারী বর্ধিত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিল কাউন্ট ফ্রান্সেসকোর দ্বিতীয় স্ত্রী লুক্রেজিয়া পেট্রোনি ; বিয়াত্রিচের বড় ভাই গিয়াকোমো; এবং বার্নার্ডো, তার দ্বিতীয় বিয়ে থেকে ফ্রান্সেস্কোর ছেলে। রোমের উত্তর-পূর্বে আব্রুজি পাহাড়ের একটা ছোট গ্রাম পেট্রেলা সালটোর লা রোকায় একটি দুর্গও তাদের দখলে ছিল ।
     বাপ তাকে ধর্ষণ করে সেকথা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।বিয়াত্রিচে ছিল এরসিলিয়া সান্তাক্রুজ আর কাউন্ট ফ্রান্সেস্কো চেনচির মেয়ে। লোকটা প্রচুর সম্পদের মালিক হলেও ছিল অলস আর হিংস্র মেজাজের।  বিয়াত্রিচের বয়স যখন সাত বছর, ১৫৮৪ সালের জুন মাসে তার মা মারা যান।   
    বাপ যখন  জানতে পারল যে তার মেয়ে তার নামে নালিশ  করেছে, তখন সে বিয়াত্রিচেকে রোম থেকে দূরে লা পেট্রেলা দেল সালটোতে পারিবারিক দুর্গে বসবাস করতে পাঠায়।ছেলেরা আর বিয়াত্রিচে সিদ্ধান্ত নেয় যে  কাউন্ট ফ্রান্সেসকো থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই আর সবাই মিলে লোকটাকে খতম করার পরিকল্পনা করে। ১৫৯৮ সালে, ফ্রান্সেস্কোর প্রাসাদে থাকাকালীন সময়ে, দুই জন চাকর (যাদের মধ্যে একজন বিয়াত্রিচের গোপন প্রেমিক ) লোকটাকে মাসক খাইয়ে নেশা করিয়েছিল। বিয়াত্রিচে, তার ভাইরা এবং তাদের সৎ মা মিলে  হাতুড়ি দিয়ে ফ্রান্সেসকোকে খুন করে । যাতে মনে হয় লোকটার মৃত্যু  দুর্ঘটনায় হয়েছে, তারা লাশটিকে একটা বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দেয়।
    কাউন্টের অনুপস্থিতি কারণ খুঁজতে  পোপের পুলিশ তদন্ত করে। বিয়াত্রিচের প্রেমিককে  নির্যাতন করে খবর আদায়ের চেষ্টা হয় কিন্তু সত্য প্রকাশ না করেই সে  মারা যায় । এদিকে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অবগত এক পারিবারিক বন্ধু  ঝুঁকি এড়াতে দ্বিতীয় চাকরকে হত্যার নির্দেশ দেয়। তবুও, চক্রান্তটা জানাজানি হয়ে যায় আর চেনচি পরিবারের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয় আর  মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় । হত্যার কারণ জানতে পেরে, রোমের সাধারণ মানুষ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, যার ফলে ফাঁসি কিছুকালের জন্য স্থগিত হয় । পোপ ক্লিমেন্ট অষ্টম ,  কোনো দয়া দেখাননি আর শাস্তি মুকুব করেননি। একটা কুড়ুল দিয়ে প্রত্যেকের মাথা ধড় থেকে আলাদা করা হয় । মৃত্যুর সময়ে বিয়েত্রিচে ছিলেন শান্ত আর দোষ স্বীকার করেননি।
    বিয়েত্রিচেকে মন্টোরিওর সান পিয়েত্রোর গির্জায় সমাহিত করা হয় । বিয়াত্রিচে রোমের মানুষের কাছে অহংকারী অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে । জনগণের বিশ্বাস যে  প্রতি বছর তার মৃত্যুর বার্ষিকীর আগের রাতে, সে সান্ত'অ্যাঞ্জেলো সেতুতে তার কাটা  মাথাটি নিয়ে ফিরে আসে, যেখানে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল । 

    দর্শকদের নৈতিক পূর্ব ধারণাগুলিকে অভিভূত করার জন্য  নিষ্ঠুরতার শৈলীতে লেখা, কাউন্ট  তার পরিবারের উপর  যে অত্যাচার চালিয়েছিল, তা নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করেছেন অঁতনা আতো।নাটকটির মঞ্চোয়নে , আলো আর শব্দের আতোর দর্শন জড়িত। ১৯৩৫ সালে নাটকটির  প্রযোজনায় সেন্সি চরিত্রে আতো অভিনয় করেছিলেন। নাটকটি কেবল তার নিষ্ঠুরতা, সহিংসতা, অজাচার এবং ধর্ষণের কারণেই দর্শকদের হতবাক করেনি, বরং এর চরিত্রগুলোকে দিয়ে তিনি অদ্ভুত এবং কৃত্রিমভাবে কথা বলিয়েছিলেন। কারণ নাটকটির  তত্ত্ব , যা পরাবাস্তববাদী আন্দোলন এবং বালিনী নৃত্যনাট্য দ্বারা প্রভাবিত, চরিত্রগুলোকে বাস্তববাদী মানুষদের বদলে সর্বজনীন শক্তির প্রতিনিধিত্ব করার জন্য উপস্হাপন করেছিলেন।
    আতোর কাছে, এই প্লট ছিল পাঠ্যপুস্তক থেকে একটি বিরল অব্যাহতি। একজন নাটকীয় চিন্তাবিদ হিসাবে তাঁর প্রভাবকে অতিরঞ্জিত করা যায় না, তবে সেই একই লোকেরা যারা তাঁর তত্ত্বগুলো প্রশংসা করে প্রায়শই তাঁর নাটকগুলোকে মেনে নিতে পারে না।  সুসান সন্টাগ লিখেছেন যে "এখন থিয়েটারে কাজ করে এমন কেউই আতো’র  ধারণাগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়," তবুও তিনি আরও বলেছেন "দ্য চেনচি "খুব ভাল নাটক নয়।" আতোর দ্বারা নাটকটির মঞ্চায়ন ছিল বাণিজ্যিক ফ্লপ , ১৭ দিন মঞ্চায়নের পর বন্ধ হয়ে যায়। এবং ব্রিটিশ পরাবাস্তববাদী সাইমন ওয়াটসন টেলরের একটি ব আজে অনুবাদের কারণে, নাটকটি কার্যত ইংরেজি ভাষাভাষীদের দ্বারা উপেক্ষিত । আলোচকদের মতে নাটকটি খুবই গ্রাফিক, হিংসাত্মক এবং বিরক্তিকর, এবং  প্রায়শই এর অত্যধিক পরাবাস্তবতার জন্য সমালোচিত হয়। এটি খুব কমই মঞ্চয়ন হয়েছে কারণ দর্শকরা এটিকে অসহ্য ও  বেদনাদায়ক বলে মনে করেন।
    তিরিশ বছর পর নাটকটি নিউ ইয়র্কে মঞ্চস্হ হয় । অধ্যাপক রিচার্ড সিবার্থের নাটকটি ইংরেজিতে নতুন অনুবাদ করেন (নাটকটির প্রথম আমেরিকান অনুবাদ)। তবুও নাটকটির মঞ্চায়ন কঠিন ছিল মূলত আতো’র নাটকটি নিয়মহীন, উদ্ভট ভাষা, অস্পষ্ট চরিত্র এবং বিভ্রান্তিকর প্লট টুইস্টে ব্যবসা করে এবং এটিকে সুসংগতভাবে মঞ্চায়ন করা একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ ছিল।

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:১১740581
  • আতো’র অঙ্কনপ্রতিভা : মলয় রায়চৌধুরী
    ফরাসি নাট্যকার, সমালোচক এবং শিল্পী অঁতনা আতোকে ( ১৮৬৯- ১৯৪৮) কোনো বিশেষ শিল্পের খোপে ফেলা কঠিন । একজন আইকনোক্লাস্ট এবং যিনি স্বীকার করেন যে তিনি উন্মাদ , তিনি বিশ শতকের প্রথম দিকে পরীক্ষামূলক থিয়েটারের একটি নতুন যুগের সূচনা করতে সাহায্য করেছিলেন, দর্শকদের সমালোচনামূলক ব্যস্ততাকে, অভিনয় দেখার সময়ে জাগ্রত করার জন্য, তাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে উপস্হাপনের মর্মান্তিক আবেদনের প্রক্রিয়ার তত্ব তৈরি করেছিলেন। যে শিল্পকর্মের জনারে হাত দিয়েছেন, তাতেই রদবদল ঘটিয়েছেন। 
    তাঁর নামের সঙ্গে ইউরোপের সাধারণ পাঠকরা পরিচিত নন, বাংলা ভাষাতেও তাঁকে নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়নি, তাঁর প্রভাব কিন্তু পড়েছে নাটকে, নাটকের মঞ্চায়নে, সমালোচনায় এবং ফিল্মে ( মাদার ) ও টেলিভিশনে ( দি হ্যাণ্ডমেইডস টেল ) হিংস্রতা দেখানোয় । পর্দায় ও মঞ্চে তাঁর বর্বরতা উপস্হাপনকে বলা হয়েছে ‘বারোক’।বলা বাহুল্য যে ছবি আঁকাতেও পাওয়া যাবে মানবমুখ ও শরীরকে দোমড়ানো-মোচড়ানোর শৈলী ।  যদিও তিনি খ্যাত তাঁর সমালোচনামূলক প্রথাবিরোধী লেখাগুলির জন্য, তাঁর খ্যাতির আসল কারণ , বিশেষত ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত তাঁর  প্রবন্ধ সংকলন ‘দি থিয়েটার অ্যান্ড ইটস ডাবল’-এর বক্তব্যগুলো  বৈচিত্র্যময় । 
    জাক দেরিদা এবং  পল থিভেনাঁ ১৯৯৬ সালে আতোর আঁকা জীবনের শেষ দিকের ছবিগুলোর একটি প্রদর্শনী করেছিলেন এবং সেই উপলক্ষে আতো’র অঙ্কনপ্রতিভার বিশ্লেষণ করেছিলেন । কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত এই কাজগুলি - একই সাথে ভয়ঙ্কর এবং সুন্দর - একটি বিধ্বংসী রেকর্ড যা একজনের আত্মাকে আঁকড়ে কাগজের ওপর তাকে তুলে ধরেছে। বোঝা যায় যে  একজন শিল্পীর তার জীবনের শেষের দিকে এসে নিজেকে এবং নির্যাতিত অন্তরজগতের উথালপাথালকে  একত্রিত করার চেষ্টা করে গেছেন। আর এই ছবিগুলো আঁকার মাধ্যমে তাঁর তত্বকেও স্পষ্ট করতে চেয়েছেন ।  আতো তাঁর  জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন এক গারদ থেকে অন্য গারদে, আর তাঁর আঁকা ছবিগুলোতেও পাওয়া যায় গারদে  বন্দি একজন শিল্পীর  আর্ত চিৎকার।
     থিভেনাঁ লিখেছেন যে, গ্রাফিক শিল্পে আতো’র আগ্রহের বিকাশের পাশাপাশি তিনি ইমপ্রেশনিজম এবং ফাউভিজমের মতো শিল্প আন্দোলন এবং এদুয়ার মুঞ্চের উদ্বেগজনক, কখনও কখনও নিঃস্ব, ল্যান্ডস্কেপগুলোকে নিজের আঁকা ছবিতে বিনির্মাণের চেষ্টা করেছেন।  থিভেনা’র মতে, অভিব্যক্তির অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া ছিল আতোর প্রাথমিক আকর্ষণ। শিল্পীর গভীর, অত্যাবশ্যক চরিত্রের যোগাযোগের জন্য প্রযুক্তিগত নির্বাহ ছিল গৌণ। তাঁর পরবর্তী কাজে, এই দর্শনটি জটিল হয়ে ওঠে কারণ তিনি কখনও কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে অশোধিত কাজ তৈরি করতেন, এটিকে একটি অবিচ্ছিন্ন নৈপুণ্যের নির্মম আঘাতের কাছে জমা দিয়ে অভিব্যক্তির শক্তি পরীক্ষা করতেন দর্শকদের আঘাত দিয়ে জাগিয়ে তোলার জন্য।
     তাঁর তথাকথিত ‘পাগলামিতে পেয়ে বসার সময়ে’ আতো আশ্রয় নিতেন আঁকার। তাঁর সর্বোত্তম অভিব্যক্তি খুঁজে পেয়েছিল, লেখনকর্ম আর চিত্রের মিশেলে যা আতো ১৯৩৭ সালে আয়ারল্যান্ড ভ্রমণের সময় একটি স্নায়বিক আক্রমণের পরে তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। আতোকে পরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হলে, তাঁর ডাক্তার মানসিক অসুস্থতার প্রমাণ হিসাবে "পাগলামিতে পেয়ে বসা" উল্লেখ করেছিলেন। দেশলাই  আর সিগারেট দিয়ে পোড়ানো এবং ক্রস, ইনফিনিটি চিহ্ন এবং অন্যান্য বিমূর্ত চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা, কাগজের এই ছেঁড়া বা আধপোড়া টুকরোগুলো আতোর মগজের তীব্র চিৎকারকে রূপায়িত করেছে । থিভেনাঁ মনে করেন যে, এই ধারণা এড়ানো কঠিন যে এই আঁকাগুলো আতো’র রচনার পরিশিষ্ট নয় যতটা তাদের সমাপ্তি। তাঁর আজীবন থিম্যাটিক আগ্রহ - মানুষের দেহের নিগ্রহের সঙ্গে তার মলমূত্রের দৈবিক সংমিশ্রণ - কাগজের ওপর সমস্ত বিদ্বেষ আর ধ্বংসাত্মক মনোভাবের সাথে প্রকাশ করা হয়েছে যে ব্যাপারটা তাঁকে তাঁর নাট্য প্রযোজনায় এড়িয়ে গিয়েছিল। আতোর চূড়ান্ত কাজ, নিজেরই বিকৃত প্রতিকৃতিগুলির একটি সিরিজ।
     ‘পাগলামিতে পেয়ে বসা’ পর্বের পরে আতো পরিচিতদের প্রতিকৃতির একটি সিরিজ এঁকেছিলেন, সেইসাথে প্রতীক এবং শরীরের অংশগুলির রহস্যময় মিলনগুলি এসেছিল যেখানে একটি ম্যানিক গ্রাফিজম পৃষ্ঠাটিকে ছাড়িয়ে যায়। ১৯৪৫ সাল থেকে "বিইঙ অ্যান্ড ইটস ফিটাসেস”-এ, আমরা হাড়, অন্ত্র এবং একজন মহিলাকে জ্যামিতিক আকারে কাটাছেঁড়া অবস্হায় দেখি। বিকৃত আত্মপ্রতিকৃতিগুলো তাঁর বৈদ্যুতিক শক থেরাপির দুঃসহ যন্ত্রণার পরে তাঁর নিজের ছিন্নভিন্ন অনুভূতিকে পুনর্গঠন করার চেষ্টা বলে মনে হয়; বৈশিষ্ট্যগতভাবে, তাঁর শৈলী ছিল  নিরাময়ের কৌশল ।  বিকৃত আত্মপ্রতিকৃতিগুলো তাঁর বৈদ্যুতিক শক থেরাপির দুঃসহ যন্ত্রণার পরে তাঁর নিজের ছিন্নভিন্ন অনুভূতিকে পুনর্গঠন করার চেষ্টা বলে মনে হয়; বৈশিষ্ট্যগতভাবে, তাঁর শৈলী ছিল  নিরাময়ের কৌশল । ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৪৬ সালে আঁকা একটি আত্মপ্রতিকৃতিতে দেখা যায় আতো’র  মাথা পৃষ্ঠার মাঝখানে ঘোরাফেরা করছে, আপাতদৃষ্টিতে শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। আরেকটি আত্মপ্রতিকৃতিতে, মে মাসের ১১ তারিখে আঁকা,  তাঁর মুখাবয়ব পচে গেছে বলে মনে হচ্ছে; পেন্সিলের খোঁচা দিয়ে ছবিটাকে বিদ্ধ করেছেন ।  এটা ঠিক যে, অঁতনা আতো নামের লোকটিকে তাঁর উন্মাদনা  থেকে আলাদা করা  বিশেষভাবে কঠিন, কারণ তাঁর জ্বরে উত্তপ্ত আঁকা ছবি আর লেখাগুলো প্রায়শই তাঁর অসুস্থতা থেকে সরাসরি উদ্ভূত । 
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:২৪740583
  • অঁতনা আতো’র কবিতা : মলয় রায়চৌধুরীর অনুবাদ
    নিরংশু কবি
    নিরংশু কবি, একটি তরুণীর বুক
    তোমাকে হানা দিয়ে বেড়ায়,
    তিক্ত কবি, জীবন ফেনিয়ে ওঠে
    আর জীবন পুড়তে থাকে,
    আর আকাশ নিজেকে বৃষ্টিতে শুষে নেয়,
    জীবনের হৃদয়ে নখের আঁচড় কাটে তোমার কলম ।
    অরণ্য, বনানী, তোমার চোখ দিয়ে প্রাণবন্ত
    অজস্র ছেঁড়া পালকের ওপরে ;
    ঝড় দিয়ে বাঁধা চুলে কবি চাপেন ঘোড়ায়, কুকুরের ওপরে ।
    চোখ থেকে ধোঁয়া বেরোয়, জিভ নড়তে থাকে
    আমাদের সংবেদনে স্বর্গ উথালপাথাল ঘটায়
    মায়ের নীল দুধের মতন ;
    নারীরা, ভিনিগারের কর্কশ হৃদয়,
    তোমাদের মুখগহ্বর থেকে আমি ঝুলে থাকি ।
    আমার টাকাকড়ি নেই
    আমার টাকাকড়ি নেই কিন্তু
    …………………………………………………..
    আমি আঁতোনা আতো
    আর আমি ধনী হতে পারি
    ব্যাপকভাবে আর এক্ষুনি ধনী হতে পারি
    যদি আমি তার জন্য প্রয়াস করতুম ।
    সমস্যা হলো আমি চিরকাল টাকাকড়িকে,
    ধনদৌলতকে, বৈভবকে ঘৃণা করেছি ।
    ………………………………………………………….
    কালো বাগান
    এই কালো পাপড়িগুলো ভারতের আকাশের  ঘুর্ণাবর্তকে ঘোরাও।
    ছায়ারা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলেছে যা আমাদের সহ্য করে ।
    তোমার নক্ষত্রদের মাঝে চাষের জমিতে পথ খুলে দাও ।
    আমাদের আলোকিত করো, নিয়ে চলো তোমার নিমন্ত্রণকর্তার কাছে,
    চাঁদির সৈন্যবাহিনী, নশ্বর গতিপথে
    আমরা রাতের কেন্দ্রের দিকে যেতে চেষ্টা করি ।
    …………………………………………………………………………….
    আমি কে
    আমি কে ?
    আমি কোথা থেকে এসেছি ?
    আমি আঁতোনা আতো
    আর আমি একথা বলছি
    কেননা আমি জানি তা কেমন করে বলতে হয়
    তাৎক্ষণিকভাবে
    তুমি আমার বর্তমান শরীরকে দেখবে
    ফেটে গিয়ে বহু টুকরো হয়ে গেছে
    আর তাকে আবার গড়ে ফেলবে
    দশ হাজার কুখ্যাত পরিপ্রেক্ষিতে
    এক নতুন শরীর
    তখন তুমি আমাকে
    কখনও ভুলতে পারবে না ।
    …………………………………………………………………….
    স্নায়ু ছন্দ
    একজন অভিনেতাকে দেখা হয় যেন স্ফটিকের ভেতর দিয়ে ।
    মঞ্চের ওপরে অনুপ্রেরণা ।
    সাহিত্যকে বেশি প্রবেশ করতে দেয়া উচিত নয় ।
    আমি আত্মার ঘড়ি ধরে কাজ করা ছাড়া আর কোনো চেষ্টা করিনি,
    আমি কেবল নিষ্ফল সমন্বয়ের যন্ত্রণাকে লিপ্যন্তর করেছি ।
    আমি একজন সম্পূর্ণ রসাতল ।
    যারা ভেবেছিল আমি সমগ্র যন্ত্রণার যোগ্য, এক সুন্দর যন্ত্রণা,
    এক ঘন আর মাংসল পীড়া, এমন এক পীড়া যা বিভিন্ন বস্তুর মিশ্রণ,
    বুদবুদ-ভরা একটি নিষ্পেশিত ক্ষমতা
    ঝুলিয়ে রাখা বিন্দু নয় — আর তবু অস্হির, উপড়ে-তোলা স্পন্দনের সাহায্যে
    যা আমার ক্ষমতা আর রসাতলের দ্বন্দ্ব থেকে আসে
    শেষতমের উৎসার দেয় ( ক্ষমতার তেজের দ্বন্দ্বের মাপ বেশি ),
    আর কোনও কিছু বাকি থাকে না বিশাল রসাতলগুলো ছাড়া,
    স্হবিরতা, শীতলতা–
    সংক্ষেপে, যারা আমাকে অত্যধিক জীবনের অধিকারী মনে করেছিল
    আত্মপতনের আগে আমার সম্পর্কে ভেবেছিল,
    যারা মনে করেছিল আমি যন্ত্রণাদায়ক আওয়াজের হাতে নির্যাতিত,
    আমি এক হিংস্র অন্ধকারে লড়াই করেছি
    তারা সবাই মানুষের ছায়ায় হারিয়ে গেছে ।
    ঘুমের ঘোরে, আমার পুরো পায়ে স্নায়ুগুলো প্রসারিত হয়েছে ।
    ঘুম এসেছে বিশ্বাসের বদল থেকে, চাপ কমেছে,
    অসম্ভাব্যতা আমার পায়ের আঙুলে জুতো-পরা পা ফেলেছে ।
    মনে রাখা দরকার যে সমগ্র বুদ্ধিমত্তা কেবল এক বিশাল অনিশ্চিত ঘটনা,
    আর যে কেউ তা খুইয়ে ফেলতে পারে, পাগল বা মৃতের মতন নয়,
    বরং জীবিত মানুষের মতন, যে বেঁচে আছে
    আর যে অনুভব করে জীবনের আকর্ষণ আর তার অনুপ্রেরণা
    তার ওপর কাজ করে চলেছে ।
    বুদ্ধিমত্তার সুড়সুড়ি আর এই  প্রতিযোগী পক্ষের আকস্মিক প্রতিবর্তন ।
    বুদ্ধিমত্তার মাঝপথে শব্দেরা ।
    চিন্তার প্রতিবর্তন প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা একজনের চিন্তাকে হঠাৎ নোংরামিতে পালটে দ্যায় ।
    এই সংলাপটি চিন্তার অন্তর্গত ।
    ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়া, সবকিছু ভেঙে ফেলা ।
    আর হঠাৎ আগ্নেয়গিরিতে এই পাতলা জলের স্রোত, মনের সরু, আস্তে-আস্তে পতন ।
    আরেকবার নিজেকে ভয়ঙ্কর অভিঘাতের মুখোমুখি আবিষ্কার করা, 
    অবাস্তবের দ্বারা নিরসিত, নিজের একটা কোনে, বাস্তব জগতের কয়েকটা টুকরো-টাকরা ।
    আমিই একমাত্র মানুষ যে এর পরিমাপ করতে পারি ।
    …………………………………………………………………………………..

    ভালোবাসা
    আর ভালোবাসা? আমাদের নিজেকে পরিষ্কার করে ফেলতে  হবে
    এই বংশগত নোংরামি থেকে
    যেখানে আমাদের ভেতর নাক্ষত্রিক পোকা
    কিলবিল করে বেড়ায়
    .
    সেই অঙ্গ, যে অঙ্গ বাতাসকে পিষে মারে
    উত্তাল সমুদ্রের জোয়ারকেও
    সেগুলো আসলে এই বিরক্তিকর 
    স্বপ্নের ফালতু সুর
    .
    ওই মহিলার , আমাদের বা এই আত্মার
    আমাদের সাথে ভোজসভায় বসেছে
    আমাদের বলুন কে প্রতারিত হয়েছে,
    কুখ্যাতির এই প্রেরণাদায়িনী
    .
    যে মহিলা আমার বিছানায় ঘুমায়
    আর আমার ঘরের বাতাসে  ভাগ বসায়,
    আমার মনের কড়িকাঠে বসে
    টেবিলে পাশা খেলতে পারে
    ………………………………………………………………………………………..
    কালো কবি       
    কালো কবি, একটি কুমারীর স্তন
    তোমাকে তাড়া করে,
    বিষণ্ণ কবি, জীবন ছটফট করে
    আর শহরগুলো পুড়ে খাক হয়ে যায়,
    আর  আকাশ  চুষে নেয় বৃষ্টিকে,
    ঠিক যেমন তোমার কলম  জীবনের হৃদয়ে লেখালিখি করে ।
    .
    বনাঞ্চল, বনাঞ্চল, তোমার চোখে জীবিত,
    একাধিক ডানার ওপর;
    ঝড়ে ওড়ানো চুল নিয়ে,
    কবিরা ঘোড়ায় চড়ে, কুকুরের ওপর চড়ে।
    .
    চোখ জ্বলে ওঠে, জিভ ছোবল মারে,

    আকাশ আমাদের ইন্দ্রিয়ে ঢুকে ঢেউ তোলে
    মায়ের পুষ্টিকর দুধের মতো;
    নারীর দল, আমি তোমাদের মুখ থেকে ঝুলে আছি
    .
    আর তোমাদের কঠিন অম্লজারিত হৃদয়কে লাথাচ্ছি ।
    ……………………………………………………………………………
    রহস্যময় জাহাজ
    আমার অসুস্হ স্বপ্নগুলোকে ভিজিয়ে দেয় এমন সমুদ্রে,
    সেই প্রাচীন জাহাজ গিয়েছে হারিয়ে
    কুয়াশায় লুকিয়ে আছে তার উঁচু মাস্তুল
    বাইবেলের আর বৃন্দগানে-ভরা আকাশে।
    .
    তা কিন্তু গ্রিক যাজকদের মতন হবে না
    যারা পাতাহীন গাছের মাঝে হালকা চালে খেলা করে;
     বিদেশে তার বিরল পণ্যসম্ভার
    কখনই বিক্রি করবে না পবিত্র জাহাজ
    .
    জাহাজটা তো পৃথিবীর কোন উষ্ণ বন্দরের কথা জানে না,
    চিরকাল একা, ও কেবল একমাত্র ঈশ্বরকে জানে,
    যেমন-যেমন জাহাজটা  মহিমান্বিত, অসীম তরঙ্গে ঢেউ তুলে এগিয়ে যায় ।
    .
    রহস্যের মধ্যে ডুবে যায় তার ছুঁচালো মুখ;
    রাতে, এর মাস্তুলের বাতিগুলো জ্বলজ্বল করে
    মেরু নক্ষত্রের রহস্যময় রূপালী  নিয়ে।
    ………………………………………………………………………..
    প্রার্থনা
    আহ, আমাদের দাও জ্বলন্ত করোটিগুলো
    আকাশ থেকে বাজ পড়ে যে করোটিগুলো পুড়ছে
    পরিষ্কার করোটি, আসল করোটি,
    যেগুলো আপনার উপস্থিতির দ্বারা শুদ্ধ
    .
    আমাদের গভীর আকাশের গর্ভে পৌঁছে দাও
    যেখানে ঝরনার জলে ভরে যায় খাদ 
    আর  যেখানে ঘুর্নিজল তোমার ভাস্বর শক্তি দিয়ে 
    আমাদের পূর্ণ করে তোলে
    .
    আমাদের খেতে দাও - এই দিনটিতে প্রতিদিনের 
    বিভ্রান্তির পবিত্রতা খাওয়াও আমাদের,
    আহ, তোমার রক্তের বদলে
    আমাদের সাথে নক্ষত্র আর আগ্নেয়গিরির লাভা ভাগাভাগি করো,
    .
    আমাদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করো।  উপজাতিতে বিভক্ত করো
    তোমার হাতের অনন্ত আগুন দিয়ে
     আমাদের  জ্বলন্ত রাস্তা দিয়ে পাঠাও,
    যেখানে আমরা মৃত্যুর ওপারে গিয়ে মরতে পারবো
    .
    আমাদের মগজকে মুচড়ে বিকৃত করে দাও
    আর যেমন-যেমন আমরা নতুন ঝড়ের মুখোমুখি হবো
    আমাদের দেবত্বের পরিচয় জেনে নিয়ে,
    আমাদের বুদ্ধিমত্তায় আনন্দ করো ।
    …………………………………………………………………….
    .
    যৌনতার পাড়া
    যৌ্নতার পাড়া হঠাৎ  জীবন্ত হয়ে ওঠে
    অবাঞ্ছিত মুখ দেখা দেয়;
    ক্যাফেগুলো চোর-বাটপাড়ের, গুজগুজ-ফিসফিসে ভরা
    রাস্তার দুধার।
    .
    যৌনসঙ্গ-লোভী হাত পকেট হাতড়ায় ,
    পেটের তলায় কুঁচকি  তপ্ত হয়ে ওঠে;
    আর যখন ইচ্ছার সংঘর্ষ হয়,
    গর্তের তুলনায় মাথার দাম কমে যায় ।
    ………………………………………………………………………….
    .
    আমার সাথে কুকুরদেবতা আর তার জিভ'
    (The Umbilicus of Limbo থেকে)
    আমার সাথে আছে কুকুরদেবতা আর  তার জিভ,
    যা গলায় ফাঁস দিয়ে কেটে বসে যেতে পারে 
    চুলকানিময় বিশ্বজগতের 
    দুটো খিলানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা চামড়ার টুপিঅলাকে ।
    .
    আর এখানে রয়েছে জলের ত্রিভুজ
    যা পোকার আদলে কুঁকড়ে-কুঁকড়ে চলে,
    কিন্তু যা একটা জ্বলন্ত কুঁড়িকে
    ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুরি মারতে তৈরি।
    .
    জঘন্য এই বিশ্বজগতের  বুকের তলায়
    লুকিয়ে রেখেছে দেবী-কুক্কুরী
    পৃথিবীর স্তন এবং হিমায়িত দুধ
    যে তার ফাঁপা জিভকে  পচিয়ে দেবে ।
    .
    আর  এখানে রয়েছে হাতুড়ি-হাতে একজন কুমারী,
    পৃথিবীর গুহাগুলোকে চুরমার করার জন্য তৈরি
    সেখানে কুকুর নক্ষত্রের মাথার করোটি
    ভয়ঙ্করভাবে উঠতে শুরু করে।
    ………………………………………………………………….

    .

     
     
     
     
  • মলয় রায় চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:২৬740584
  • অঁতনা আতোর "বেঁচে থাকার নতুন প্রতিভাস" এর অংশ
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    আমি যা দেখেছি এবং বিশ্বাস করেছি সেকথাই বলি; আর কেউ যদি বলে যে আমি যা দেখেছি তা আমি দেখিনি, আমি সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেব।
    কারণ আমি একজন ক্ষমার অযোগ্য পাশবিক মানুষ আর ‘সময়’ যখন আর ‘সময়’ থাকবে না তখন পর্যন্ত থাকব।
    স্বর্গ বা মর্ত্য কেউই, যদি তারা সত্যি থাকে তবে তারা আমার ওপর চাপিয়ে দেয়া এই বর্বরতার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, সম্ভবত আমি তাদের সেবা করেছি বলে ... কে জানে?
    যে কোনো অবস্থাতেই তাদের কাছ থেকে নিজেকে ছিঁড়ে আলাদা হবে।
    আমি যা দেখি তা নিশ্চিত আছে বলে দেখি। দরকার হলে যা নেই তা তৈরি করব।
    অনেক দিন ধরে আমি শূন্যতা অনুভব করেছি, কিন্তু নিজেকে শূন্যে ছুঁড়ে ফেলতে অস্বীকার করেছি।
    আমি  ততটাই কাপুরুষ ছিলুম যতোটা কাপুরুষত্ব আমি দেখছি।
    যখন আমি বিশ্বাস করতুম যে আমি মর্ত্যকে প্রত্যাখ্যান করছি, তখন আমি জানতুম আমি শূন্যতা প্রত্যাখ্যান করছিলাম।
    কারণ আমি জানি পৃথিবীর অস্তিত্ব নেই এবং আমি জানি কীভাবে এর অস্তিত্ব নেই।
    এখন অবধি, আমার যন্ত্রণা ছিল শূন্যতা প্রত্যাখ্যান করার।
    শূন্যতা আমার মধ্যে আগে থেকেই ছিল।
    আমি জানি আমি চেয়েছিলুম  শূন্যতা আমাকে আলোকিত করুক, আর আমি নিজেকে আলোকিত হতে দিতে অস্বীকার করেছি।
    যদি আমাকে শ্মশানের চিতা বানানো হয়, তবে তা হবে এই পৃথিবীতে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় আমার সুস্থতা।
    আর আমার যা ছিল তা পৃথিবী নিয়ে নিয়েছে।
    আমি টিকে থাকার জন্য লড়াই করেছি , সেই আঙ্গিকগুলোকে (সমস্ত রূপের ) সম্মতি দেওয়ার চেষ্টা করেছি  যা দিয়ে এই পৃথিবীতে থাকার বিভ্রমের খোঁয়ারি সমস্ত বাস্তবতাকে আবৃত করেছিল।
    আমি আর বিভ্রম দ্বারা আবিষ্ট হতে চাই না.
    পৃথিবীর কাছে মরে গেছি; পৃথিবীর অন্য সবায়ের কাছে কি মরে গেছি, অধঃপতিত, শেষকালে অধঃপতিত, অধঃপতিত, শূন্যে উঠে আমি একবার প্রত্যাখ্যান করেছিলুম, আমার এমন এক  দেহ আছে যা বিশ্বের দুর্ভোগ পোয়ায় আর বাস্তবতাকে অস্বীকার করে।
    আমি এই উন্মাদ আন্দোলন যথেষ্ট পরিমাণে সহ্য করেছি যা আমাকে নামকরণ করতে বলে আর যার নামকরণ আমি করেছি আর বাতিল করেছি।
    আমাকে এটা শেষ করতেই হবে। আমাকে এই জগতের সাথে, যা আমার বেঁচে থাকার প্রতিভাস,  শেষ বারের মতন   বিচ্ছিন্ন  করতে হবে , এই সত্তার আমি আর নামকরণ করতে  পারি না কারণ যদি সে ফিরে আসে তবে আমি মহাশূন্যে পড়ে যাব, এই সত্তা আমাকে চিরকাল বাতিল করেছে।
    এটা ঘটে । আমি সত্যিই শূন্যের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, কেননা সবকিছু - এই পৃথিবীর তৈরি করা - আমাকে হতাশ করার লক্ষ্য পূরণ করেছে ।
    শুধুমাত্র যখন তুমি দেখবে  যে এই পৃথিবী তোমাকে সত্যিই ছেড়ে গেছে তখন  তুমি জানবে যে তুমি আর এই পৃথিবীতে নেই। 
    মরে গেছো, অন্যরা বিচ্ছিন্ন হয় নি: তারা এখনও তাদের মৃতদেহের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
    আর আমি জানি কীভাবে মৃতরা তাদের শবের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে ঠিক তেত্রিশ শতাব্দী ধরে আমার নকলটা অবিরাম এপাশ-ওপাশ করছে।
    সুতরাং, আর তো বেঁচে নেই, যা আছে তা আমি  দেখতে পাই
    আমি সত্যিই এই সত্তার সাথে নিজেকে সনাক্ত করেছি, এই সত্তা যা আর টিকে নেই।
    এবং এই সত্তা আমার কাছে সবকিছু মেলে ধরেছে।
    আমি এটা জানতুম, কিন্তু বলতে পারিনি, কিন্তু এখন আমি  তা বলতে শুরু করতে পারি, কারণ আমি বাস্তবতাকে পিছনে ফেলে এসেছি।
    সত্যিকারের একজন বেপরোয়া মানুষ তোমার সাথে কথা বলছে, যে লোকটা কখনও এই পৃথিবীতে বাঁচার সুখের কথা জানত না যতক্ষণ না সে এটা ছেড়ে চলে গেছে আর এটা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
    বাকিরা যদিও মারা গেছে কিন্তু তাদের আলাদা করা হয়নি। তারা এখনও তাদের শবের চারপাশে ঘোরাফেরা করে।
    আমি মৃত নই, কিন্তু আমি বিচ্ছিন্ন।

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:২৭740585
  • অঁতনা আতোর শ্রুতিনাটক : ঈশ্বরের বিচারকে বাতিল করা বিষয়ক
    মলয় রায়চৌধুরীর অনুবাদ

    টীকা : বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে তাঁর শেষ বছরগুলো কাটাবার পরে, অঁতনা আতো ১৯৪৭ সালে এই  শ্রুতি নাটক “ঈশ্বরের বিচারকে বাতিল করা বিষয়ক” লিখে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চেয়েছিলেন। যদিও কাজটি তাঁর ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির’ পর্যায়ে পড়ে, মানেহীন শব্দ, কান্না, চিৎকার এবং কণ্ঠস্বর ব্যবহার করার কথা ছিল । ফরাসি রেডিও এই শ্রুতিনাটককে দোসরা  ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ তারিখে  সম্প্রচার করার কথা ঘোষণা করে । অঁতনা আতোর এই শ্রুতিনাটক ছিল তাঁর  শেষ কাজ ।   এটা সেই সময়ের অন্তত কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোকের কাছে সমানভাবে অপ্রিয় বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ফরাসি রেডিওর নাটকীয় এবং সাহিত্যিক সম্প্রচারের প্রধান ফার্দিনান্দ পাউয়ের দ্বারা পরিচালিত, কাজটি অঁতনা আতো সেই সময়ে লিখেছিলেন যখন তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুটা সময়  একটা মানসিক হাসপাতালে কাটিয়েছিলেন যেখানে তাঁকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে খারাপ চিকিৎসা পদ্ধতি সহ্য করতে হয় । শ্রুতিনাটকটা  ততটাই খোলামেলা আর আবেগগতভাবে নগ্ন যতটা পাঠক অঁতনা আতোর কাছে আশা করতে পারেন - সমাজের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ। স্ক্যাটোলজিকাল চিত্র, চিৎকার, বাজে শব্দ, আমেরিকাবিরোধী আর ক্যাথলিকবিরোধী কথাবার্তায় ভরা লিখন-উন্মাদনা। কিন্তু তার আগের দিন অনুষ্ঠান বাতিল করে দেয়া হয়। স্টেশন ডিরেক্টর ভ্লাদিমির পোর্শে শেষ মুহুর্তে এটিকে প্রোগ্রাম থেকে ছাঁটাই করে দিয়েছিলেন। স্পষ্টতই, তিনি মলত্যাগ এবং বীর্য বা আমেরিকাবিরোধী আক্রমণ প্রসঙ্গ মোটেই পছন্দ করেননি । কিন্তু  পোর্শের প্রত্যাখ্যান প্যারিসীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল। রেনে ক্লেয়ার, জাঁ ককতো এবং পল এলুয়ারসহ অন্য কবি-লেখক-শিল্পীরা জোর গলায় এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছিলেন যার ফলে পাউই এমনকি প্রতিবাদে তাঁর চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, যদিও কোন লাভ হয়নি। এটি  তখন প্রচারিত হয়নি। অঁতনা আতো প্রত্যাখ্যানটি খুব ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেছিলেন, আর এক মাস পরে মারা যান।

    Kré ক্রে

    puc te
    পুক তে
    kréক্রে

    সবকিছু অবশ্যই
    .
    প্রস্তুত থাক
    .
    একটি চুলের পরিমাপের
    .
     পরিপূর্ণতার
    .
    শৃঙ্খলার মধ্যে
    .

    puk te
    পুক তে
    pekপেক

    li le
    লি লে
    kréক্রে

    pek ti le
    পেক তি লে


    Kruk
    ক্রুক
    প্টে

    আমি গতকাল জানতে পারলুম
    (আমি হয়তো সময় থেকে  পিছিয়ে আছি , কিংবা সম্ভবত এটা শুধুমাত্র অলীক গুজব, সেইসব কটূ মন্তব্যগুলোর মতন যা প্রস্রাবঘর আর পায়খানার মাঝে চালাচালি  করা হয়  যখন হজমকরা খাবারগুলো আরও একবার ঢালু বালতিতে ফেলে দেওয়া হয়)
    আমি গতকাল জানতে পারলুম
    আমেরিকান পাবলিক স্কুলের সেই সরকারি অনুশীলনের  সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ব্যাপার 
    নিঃসন্দেহে এই সত্যের জন্য দায়ী যে ওই দেশ নিজেকে প্রগতির এগিয়ে থাকা দূত বলে বিশ্বাস করে। 
    দেখা গেছে যে , প্রথমবার সার্বজনীন স্কুলে প্রবেশ করার জন্য 
    একটি শিশুর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা বা পরীক্ষাগুলোর মধ্যে, 
    একটা হলো ধাতুরস বা শুক্রাণু পরীক্ষা, 
    যার জন্য স্কুলে প্রবেশকারী ছোটো শিশুটিকে বলা হয় তার ধাতুরস 
    একটা বয়ামে জমা করতে 
    যাতে পরবর্তীকালে তা কৃত্রিম প্রজনন প্রচেষ্টার জন্য হাতের কাছে থাকে।
    .
    কারণ আমেরিকানরা আরও বেশি বুঝতে পারছে 
    যে তাদের পেশীশক্তি এবং সন্তানের অভাব রয়েছে, 
    অর্থাৎ শ্রমিক নয় চাই সৈনিক, এবং তারা যেকোনও মূল্যে এবং সম্ভাব্য সব উপায়ে
     সৈন্য তৈরি করে রাখতে চায় যাতে সমস্ত গ্রহগুলোর ভবিষ্যৎ যুদ্ধে পরবর্তীতে কাজে লাগে
     আর তা  আমেরিকান পণ্যের শ্রেষ্ঠত্ব, এবং সমস্ত কার্যকলাপের ক্ষেত্রে 
    আমেরিকান ঘামের ফলাফল দর্শানো যাবে 
    এবং শক্তির সম্ভাব্য গতিশীল  বলপ্রয়োগের অপ্রতিরোধ্য গুণাবলী  প্রদর্শন  করা হবে।.
    .
    কারণ প্রত্যেককে অবশ্যই উৎপাদন করতে হবে, 
    সবাইকে অবশ্যই সমস্ত সম্ভাব্য ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে 
    প্রকৃতিকে যেখানে-যেখানে সম্ভব সরিয়ে দিতে হবে, 
    একজনকে অবশ্যই মানব জড়তার জায়গায় 
    একটা প্রধান কর্মোদ্যম খুঁজে বের করতে হবে, 
    শ্রমিকদের অবশ্যই সবসময় ব্যস্ত রাখার জন্য কিছু থাকা দরকার, 
    কাজকর্মের নতুন এলাকা তৈরি করতে হবে 
    যেখানে আমরা শেষ পর্যন্ত সমস্ত নকল  পণ্যের রাজত্ব দেখতে পাব,
     সমস্ত জঘন্য কৃত্রিম বিকল্পগুলো পাবো যেখানে সুন্দর বাস্তব প্রকৃতির কোনও অবদান নেই, 
    আর সেই সমস্ত নকল বিজয়ীদের সামনে অবশেষে 
    এবং লজ্জাজনকভাবে পথ ছেড়ে দিতে হবে  
    যেখানে সমস্ত কৃত্রিম প্রজনন কারখানার শুক্রাণু  একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটাবে 
    যা থেকে পয়দা হবে সেনাবাহিনী এবং অগুন্তি যুদ্ধজাহাজ।
    আর ফলফুল দরকার নেই, আর গাছপালা দরকার নেই, 
    আর শাক-সবজি  দরকার নেই, আর কোনো ওষধি চারাগাছ দরকার নেই 
    ফলে আর কোনো খাদ্যবস্তু দরকার নেই, 
    কিন্তু তৃপ্তির জন্য নকল জিনিস, ধোঁয়ার মধ্যে, 
    বায়ুমণ্ডলের বিশেষ হাস্যরসের মধ্যে, 
    বায়ুমণ্ডলের বিশেষ অক্ষে হিংস্রভাবে আঘাত করে 
    কেড়ে নেয়া  প্রকৃতির প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে যা ভয় ছাড়া যুদ্ধের কিছুই জানে না।
    আর যুদ্ধ কতো বিস্ময়কর, তাই না?

    কেননা যুদ্ধের জন্যই তো, তাই না, 
    আমেরিকানরা ধাপে ধাপে এইভাবে নিজেদের তৈরি করছে আর প্রস্তুতি নিচ্ছে। 
    এই বুদ্ধিহীন উৎপাদনকে সমস্ত প্রতিযোগীতা থেকে আড়ালে রাখার জন্য, 
    যে প্রতিযোগীতা চারিদিক থেকে দাঁড়ালে তাকে  ব্যর্থ করা যায় , 
    একজনের অবশ্যই সৈন্য, সেনাবাহিনী, বিমান, যুদ্ধজাহাজ থাকতে হবে,
     আর তাই এই শুক্রাণু সংগ্রহ  মনে হয় 
    আমেরিকার সরকারগুলিকে চিন্তা করার দুঃসাহস যুগিয়ে  ছিল।
    কারণ আমাদের জন্য অপেক্ষা  করছে একাধিক শত্রু, আমার ছেলে, 
    আমরা, জন্মগত পুঁজিবাদী আর এই শত্রুদের মধ্যে স্টালিনের রাশিয়া, 
    যেখানে সশস্ত্র লোকেদের অভাব নেই।
    এই সব খুবই ভাল, কিন্তু আমি জানতাম না আমেরিকানরা এমন যুদ্ধবাজ মানুষ। 
    যুদ্ধ করার জন্য একজনকে অবশ্যই গুলি খেতে হবে 
    আর যদিও আমি অনেক আমেরিকানকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখেছি, 
    তাদের কাছে সবসময় ট্যাঙ্ক, বিমান, যুদ্ধজাহাজের বিশাল বাহিনী ছিল 
    যা তাদের ঢাল হিসাবে কাজ করছিল।
    আমি মেশিনগুলোকে অনেক লড়াই করতে দেখেছি 

    কিন্তু তাদের অনেক পেছনে আমি তাদের চালনা করার লোকগুলোকে দেখেছি। 
    যে সমস্ত লোক তাদের ঘোড়া, গবাদি পশু এবং খচ্চরকে 
    তাদের ছেড়ে যাওয়া শেষ বিশাল ওজনের 
    আসল মরফিন খাওয়ায় আর ধোঁয়া থেকে তৈরি বিকল্প দিয়ে প্রতিস্থাপন করে, 
    তাদের চেয়ে আমি তাদের পছন্দ করি যারা খালি মাটিপৃথিবীর প্রলাপ খায় 
    আমি বলতে চাই যেখান থেকে তাদের জন্ম হয়েছিল,
     অর্থাৎ ‘তারাহুমারা’ জন্মের সময় মাটি থেকে পিয়োট তুলে খাচ্ছে 
    আর যারা কালো রাতের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সূর্যকে হত্যা করেছে, 
    এবং যারা ক্রুশকাঠকে আছড়ে ভেঙেছে 
    যাতে ফাঁকা জায়গাগুলোর জায়গার সঙ্গে আর ক্রুশকাঠের দেখা না হয় ।
    আর তাই আপনি টুটুগুরির নাচ শুনতে পাবেন।

    টুটুগুরি

    কালো সূর্যের অনুষ্ঠান
    আর নীচে, যেন তেতো ঢালের একেবারে তলায়,
    হৃদয়ে নিষ্ঠুর হতাশায়,
    ছয় ক্রুশকাঠর  বৃত্তের ফাঁকা মাঝখানে,
    খুবই নীচের দিকে
    যেন মাতা-পৃথিবীতে গেঁথে আছে,
    মায়ের অশ্লীল আলিঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন
    তারা ঝিমোচ্ছে।
    কালো কয়লার পৃথিবীই
    একমাত্র স্যাঁতসেঁতে জায়গা
    এই ফাটলধরা পাথরে।
    অনুষ্ঠানের নিয়ম হল যে নতুন সূর্য পৃথিবীর চূড়ায় জ্বলে ওঠার আগে সাতটি বিন্দুর মধ্য দিয়ে যায়।
    আর ছয়জন পুরুষ আছে,
    প্রতিটি সূর্যের জন্য একটি,
    আর সপ্তম পুরুষ
    যে নিজেই সূর্য 
    কাঁচা অবস্হায়
    কালো আর লাল মাংস পরে আছে।
    .
    কিন্তু, এই সপ্তম মানুষ

    একটা ঘোড়া,
    একটা ঘোড়া যাকে নিয়ে যাচ্ছে একজন লোক।
    .
    কিন্তু এই ঘোড়াটাই
    আসলে সূর্য
    মানুষটা নয় ।

    .

    একটা ড্রাম এবং একটা  ট্রাম্পেটের দীর্ঘ সময়ের কাতরতায়,
    অদ্ভুত,
    সেই ছয়জন পুরুষ
    যারা শুয়ে ছিল,
    মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল ,
    সূর্যমুখী ফুলের মতন এক এক করে লাফিয়ে উঠে,
    সূর্যগুলোর মতন নয়
    কিন্তু ঘুরন্ত পৃথিবীর মতন,
    শাপলাগুলোর মতন,
    এবং প্রতিটি লাফ
    ক্রমশ মৃদু বিষণ্ণতা
    আর সংযতের মতন হয়ে উঠছিল
    .
    ড্রামের ঢমঢম আওয়াজ
    যতক্ষণ না সে হঠাৎ টগবগিয়ে ছুটে আসে, ঘুর্নির গতিতে,
    শেষ সূর্য,
    প্রথম মানুষ,
    কালো ঘোড়ার সঙ্গে একজন
    উলঙ্গ মানুষ,
    একেবারে ল্যাংটো
    এবং চিরকুমার
    ঘোড়াটায় চেপে যাচ্ছে
    .
    তারা লাফিয়ে ওঠার পরে, তারা ঘুরতে থাকা বৃত্তের চারিধারে এগিয়ে যায়
    এবং  ঘোড়ার পিছনে মাংসের রক্তক্ষরণ
    আর না থেমে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে
    শিলাপাথরের চূড়ায়
    যতোক্ষণ না ছয়জন  পুরুষ 
    ছটা ক্রুশকাঠকে
    ঘিরে রেখেছে
    পুরোপুরি ।
    এখন, এটাই অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত সারবস্তু
    ক্রূশকাঠের বিলোপ
    যখন তারা বাঁক না নিয়ে থেমেছে
    তারা উপড়ে ফেললো
    পৃথিবীর সমস্ত ক্রুশকাঠ
    এবং উলঙ্গ মানুষটা
    যে ছিল ঘোড়ার ওপরে
    তুলে ধরলো
    ঘোড়ার একখানা বিশাল নাল
    যা সে নিজের জখমের রক্তে চুবিয়ে দিলো ।
    সুবিধার সাধনা
    যেখানে সেখানে বিষ্ঠার দুর্গন্ধ
    সেখানেই অস্তিত্বের গন্ধ ।
    মানুষ না হাগলেই ভালো হতো,
    পোঁদের গর্ত না খোলা থাকলেই ভালো হতো,
    কিন্তু সে হাগা  বেছে নিয়েছে
    যেমনভাবে  সে বাঁচতে চেয়েছে
    তার বদলে বেঁচে মরে থাকার সম্মতি দিয়েছে।

    কারণ হাগবার জন্য,
    তাকে সম্মতি দিতে হবে
    যাতে তার অস্তিত্ব না থাকে,
    কিন্তু সে অস্তিত্ব খুইয়ে ফেলার ব্যাপারে  
    মনস্থির করতে পারেনি
    অর্থাৎ বেঁচে থেকে মরে যাওয়া 
    তার অস্তিত্ব । .
    মলত্যাগ ( এখানে আওয়াজ শোনানো হবে )
    অস্তিত্বের জন্য কেবল নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হবে,
    কিন্তু বাঁচতে হলে,
    একজন কেউকেটা হতে হবে,
    কেউকেটা হবার জন্য,
    একটি হাড় ধাকা জরুরি,
    যে হাড় দেখাতে ভয় পাবে না,
    আর সেই প্রক্রিয়ায় মাংস হারিয়ে ফেলবে।
    মানুষ সবসময় মাংস পছন্দ করেছে
    হাড়ের পৃথিবী তুলনায়
    কারণ আগে থাকতে শুধু মাটি আর হাড়ের লাঠি ছিল,
    আর  তার খাবার মাংস রোজগার করতে হয়েছিল,
    সেসময়ে শুধু লোহা আর আগুন ছিল
    এবং কোনও  গুগোবর ছিল না,
    আর মানুষের গু হারানোর ভয় ছিল
    কিংবা হয়তো মানুষ নিজেই গু  চেয়েছিল
    এবং, সেই জন্য, এই রক্ত বলিদান ।
    হাগবার জন্য,
    অর্থাৎ মাংস চাই,
    যেখানে শুধু রক্ত ছিল
    এবং হাড়ের আঁস্তাকুড়
    এবং যেখানে জেতার জন্য কেউই ছিল না
    কিন্তু যেখানে জীবন ছিল হারাবার জন্য
    শূন্য অনুসন্ধান মোড
    সম্পাদনা করতে
    ৎসা বলুন
    তাউ-দারি
    পেদে মলত্যাগ  করো
    এই সময়ে লোকটা উঠে পড়ে আর পালায় ।
    তারপর জন্তুগুলো তাকে খেয়ে ফ্যালে ।
    .
    ব্যাপারটা ধর্ষণ ছিল না
    ও নিজেই নিজেকে অশ্লীল খাবার হিসেবে ছেড়ে দিলো ।
    .
    খেয়ে ওর তৃপ্তি হলো,
    সে নিজেই শিখেছিল
    পশুর মত কাজ করতে
    আর ইঁদুর খেতে
    বেশ মজায় ।
    .
    আর এই নোংরা অবজ্ঞা কোথা থেকে আসে?
    .
    ঘটনা হলো  যে পৃথিবী এখনও গড়ে ওঠেনি,
    কিংবা জগতসংসার  সম্পর্কে মানুষটার কেবল যৎসামান্য ধারণা আছে
    আর তবু চিরকাল আঁকড়ে থাকতে চায়?
    .
    এই সত্য সেই তথ্য থেকে এসেছে যে মানুষ,
    আচমকা এক দিন,
    জগতসংসার সম্পর্কে চিন্তা করা
    বাতিল করে দিলো ।
    .
    তার জন্য দুটি পথ খোলা ছিল:
    একটা ঘেরাটোপহীন অসীম,
    অন্যটার ভেতরে অনন্ত ।
    .
    আর ও বেছে নিলো যার ভেতরে অনন্ত।
    যেখানে একজনকে শুধু মোচড়াতে হবে
    প্লীহা,
    জিভ,
    মলদ্বার
    কিংবা শিশ্নমুণ্ড ।
    আর ঈশ্বর, ঈশ্বর নিজেই মোচড়খানা দিলেন ।
    .
    ঈশ্বর কি কোন সত্তা?
    সে যদি তাই  হয় তবে সে গুগোবর।
    যদি সে তা না হয়
    তাহলে তার অস্তিত্ব নেই।
    .
    কিন্তু তার অস্তিত্ব আদপে নেই,
    কেবল শূন্যতা ছাড়া যা তার সমস্ত রূপ নিয়ে এগিয়ে আসে
    যার সবচেয়ে নিখুঁত চিত্রকল্প হলো
    অসংখ্য চামউকুনের একটা এগোতে থাকা দল।
    .
    “তুমি উন্মাদ না কি মসিয়ঁ আতো ? গির্জায় জনসমাবেশের কী হবে ?”
    .
    আমি গির্জার পবিত্র জল আর জনসমাবেশ অস্বীকার করি ।
    মানুষের এমন কোনও কাজ নেই,
    অভ্যন্তরীণ কামদ স্তরে,
    তথাকথিত যীশু-খ্রিস্টের
    বেদীর ওপর
    নেমে আসা ।
    .

    কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না

    আর আমি দেখতে পাচ্ছি জনসাধারণ তাদের কাঁধ নাচিয়ে আমার কথা বাতিল করছে
    কিন্তু তথাকথিত খ্রিস্ট তিনি ছাড়া আর কেউ নন
    যারা চামউকুন দেবতার উপস্থিতিতে
    দেহ  ছাড়া বাঁচতে সম্মত হলো,
    যখন পুরুষদের একটা সৈন্যবাহিনী
    ক্রুশকাঠ থেকে নেমে এলো,
    ঈশ্বর ভেবেছিলেন যে তিনি তাদের পেরেক দিয়ে গেঁথে ফেলেছেন
    তারা বিদ্রোহ করেছে,
    আর ইস্পাতের মোড়কে সজ্জিত,
    রক্ত দিয়ে,
    আগুন দিয়ে, আর হাড় দিয়ে,
    এগোতে থাকে, যা অদৃশ্য তাকে প্রকট  করে
    ঈশ্বরের বিচারকে বাতিল করার জন্য ।
    তাহলে প্রশ্ন ওঠে…..
    যা  একে গুরুতর করে তোলে
    যে আমরা জানি
    এই বিশ্বের
    শৃঙ্খলার বাইরে
    আরেকটি আছে।
    .
    সেটা কেমনতর ?
    .
    আমরা তা জানি না

    .
    সম্ভাব্য অনুমানের সংখ্যা এবং ক্রম
    এই এলাকায়
    মোটামুটিভাবে
    অনন্ত !
    .
    আর অনন্ত কী ?
    .
    সেটা আসলে আমরা জানি না !
    .
    এটা একটা শব্দ
    যা আমরা ব্যবহার করি
    আমাদের চেতনাকে
    উদ্বোধন করার জন্য
    নির্দেশ করি
    সম্ভাবনার দিকে
    পরিমাপের বাইরে,
    অক্লান্ত আর পরিমাপের বাইরে।
    .
    আর নির্দিষ্টভাবে চেতনা বলতে কী বোঝায় ?
    .
    প্রকৃতপ্রস্তাবে তা আমরা জানি না ।
    .
    তা শূন্যতা ।
    .
    একটা শূন্যতা
    যে আমরা ব্যবহার করি
    নির্দেশ করতে
    যখন আমরা কিছুই জানি না
    কোন দিক থেকে
    আমরা এটা জানি না
    আর তাই
    আমরা বলি
    চেতনা,
    চেতনার দিক থেকে,
    কিন্তু এক লক্ষ অন্যান্য পক্ষ আছে.
    .
    নয় কি ?
    .
    মনে হয় সেই চেতনা
    আমাদের মধ্যে আছে
    জড়িয়ে
    যৌন লোভের দিকে
    আর খিদে
    কিন্তু এটা পারে
    ঠিক তেমনি
    তাদের
    নেয়া হবে না
    .
    একজন বলেন,
    কেউ বলতে পারে,
    যারা বলেন
    যে চেতনা
    একটা খিদে,
    বেঁচে থাকার খিদে;
    আর সময় নষ্ট না করে
    বেঁচে থাকার খিদের পাশাপাশি,
    এটা খাবার জন্য খিদে
    যেটা প্রথমেই মনে আসে;
    যেন খাওয়ার লোক নেই
    কোনো রকম খিদে ছাড়াই;
    আর  যারা খিদেতে মরছে।
    এর জন্যও
    রয়েছে
    খিদে
    খিদে না থাকলেও লোকে খায়;
    .
    নয় কি ?
    .
    আমরা হব
    সম্ভাবনার উৎস
    আমাকে একদিন দেওয়া হয়েছিল
    একটা জোরে পাদার মতন করে
     আমি তৈরি করব;
    কিন্তু কোনও জায়গা নয়,
    সম্ভাবনাহীনতা,
    আমি কি ঠিক জানতাম এটা কী ?
    আর আমি এটা কী তা জানার দরকার মনে করিনি,
    ওগুলো ছিল নিছক শব্দ
    যা আগে থাকতে ছিল
    কিংবা ছিল না
    প্রয়োজনের 
    তাড়াহুড়োর মাঝে :
    ধারণাটাকে নির্মূল করার প্রয়োজনীয়তা,

    ধারণা আর তার কিংবদন্তি,
    আর তার জায়গায় সিংহাসনে বসাবার
    বজ্রপাতের মতন
    এই বিস্ফোরক প্রয়োজনীয়তা:
    আমার অভ্যন্তরীণ রাতের শরীরকে প্রসারিত করতে
    ভেতরকার শূন্যতা
    আমার নিজের
    যা রাত্রিকাল,
    শূন্যতা,
    চিন্তাহীনতা,
    .
    কিন্তু যা বিস্ফোরক নিশ্চিতকরণ
    আছে
    কিছু
    এর জন্য জায়গা তৈরি করতে:
    .
    আমার দেহ।
    .
    আর সত্যিই কি
    পাদের এই বিটকেল গন্ধকে অবশ্যই কমাতে হবে,
    আমার দেহের ভেতর ?
    বলতে গেলে আমার দেহ আছে
    কারণ আমার দুর্গন্ধযুক্ত পাদ আছে
    সেটা কি আমার
    ভেতরে গড়ে ওঠে ?
    .
    আমি ঠিক জানি না
    কিন্তু
    আমি জানি যে
    .
    পরিসর,
    সময়,
    আকার,
    হয়ে ওঠা,
    ভবিষ্যত,
    নিয়তি,
    অস্তিত্ব,
    অনস্তিত্ব,
    অহং,
    অহংহীনতা, আমার কাছে কিছুই নয় ;
    কিন্তু একটা জিনিস আছে
    যা আসলে একটা ব্যাপার,
    শুধু একটাই জিনিস
    যা কিছু একটা,
    এবং যা আমি অনুভব করি
    কারণ এটা 
    বেরিয়ে যেতে চায় :
    যা কিনা আমার শরীরের
    যন্ত্রণা,
    একখানা হুমকি,
    ক্লান্ত হয়  না
    আমার
    দেহের
    উপস্থিতি ;
    .
    যদিও বজ্জাত লোকেরা  প্রশ্ন তুলে আমাকে চাপ দেয়
    আর যদিও আমি দৃঢ়ভাবে সমস্ত প্রশ্ন অস্বীকার করি,
    একটি সময়-বিন্দু আছে
    যখন আমি নিজেকে বাধ্য মনে করি
    নাআআআআআ বলতে
    নাআআআআআ
    তারপর
    অস্বীকার করার জন্য ;
    আর ঠিক এই সময়টা
    আসে যখন তারা আমাকে চাপ দেয়,
    যখন তারা আমাকে চাপ দেয়
    আর যখন তারা আমাকে ঠেলে নিয়ে যায়
    বেরোবার রাস্তা অব্দি
    আমার থেকে
    পুষ্টির,
    আমার পুষ্টির
    আর তা পোষনের দুধ,
    আর তাহলে  কী অবশিষ্ট থাকে ?
    .
    আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে
    .
    আর আমি জানি না এটা একটা কাজ কিনা
    কিন্তু এইভাবে প্রশ্ন দিয়ে আমাকে কোনঠাসা করে
    অনুপস্থিতি পর্যন্ত
    এবং শূন্যতা পর্যন্ত
    প্রশ্নের
    তারা আমাকে কোনঠাসা করে
    যতক্ষণ না দেহের  ধারণা 
    আর একটা দেহ হয়ে ওঠার ধারণা
    আমার ভেতরে
    গলাটিপে শ্বাসরোধ করা হচ্ছে
    .
    আর ঠিক তখনই আমি অশ্লীলতাকে অনুভব করলুম
    .
    আর আমি পাদলুম
    ভুলবশত
    অতিরিক্ত জমেছিল বলে
    আর বিদ্রোহ হিসেবে
    যখন আমার শ্বাসরোধ করা হচ্ছিল ।
    .
    কেননা ওরা আমাকে কোনঠাসা করছিল
    আমারই দেহের সঙ্গে
    দেহের জন্য
    .
    আর ঠিক  তখনই 
     আমি সবকিছু ফাটিয়ে বেরোলুম
    যাতে আমার দেহ
    আর ছোঁয়া না যায়।
    উপসংহার
    –আর এই সম্প্রচারের উদ্দেশ্য কী ছিল মসিয়ঁ আতো ?
    —মোটামুটি  আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত এবং স্বীকৃত কিছু সামাজিক অশ্লীলতার নিন্দা করা। ভ্রূণের কৃত্রিম প্রজননের জন্য শিশুদের  দান করা  শুক্রাণুর এই নির্গমন এখনও জন্মায়নি  আর যা এক শতাব্দী বা তারও বেশি সময়ের পরে জন্মাবে ।
    —নিন্দা করার জন্য ।  এই একই আমেরিকান জনগণের মধ্যে যারা প্রাক্তন রেডইনডিয়ান মহাদেশের সমগ্র ভূপৃষ্ঠ দখল করে আছে, প্রারম্ভিক আমেরিকার সেই যুদ্ধবাদী সাম্রাজ্যবাদের পুনর্জন্ম যা পূর্বোক্ত লোকদের দ্বারা প্রাক-কলম্বিয়ান রেডইনডিয়ান উপজাতিদের অধঃপতনের কারণ হয়েছিল।

    —আপনি তো অদ্ভুত কথাবার্তা বলছেন, মসিয়ঁ আতো ।
    ১- হ্যাঁ, আমি কিছু উদ্ভট কথা বলছি। যে সমস্ত ব্যাপার আমাদের বিশ্বাস করানো হয়েছিল, তার উল্টো আসল ঘটনা হলো যে প্রাক-কলম্বিয়ান রেডইন্ডিয়ানরা এক অদ্ভুত সভ্য মানুষ ছিল এবং প্রকৃতপক্ষে তারা একচেটিয়াভাবে নিষ্ঠুরতার নীতির উপর ভিত্তি করে সভ্যতার একটি রূপ জানত।
    ২- আর নিষ্ঠুরতা বলতে কী বোঝায় তা কি আপনি সঠিকভাবে জানেন?
    ৩- এভাবে জিগ্যেস করলে বলব, না, আমি করি না।
    ৪- নিষ্ঠুরতা মানে রক্তের মাধ্যমে নির্মূল করা এবং যতক্ষণ না রক্ত প্রবাহিত হয়, দেবতা, যে কিনা মানুষের অচেতন  পশুত্বের  দুর্ঘটনা, যেখানেই এটি পাওয়া যায় নির্মূল করতে হবে।
    ৫- মানুষ, যখন সে সংযত থাকে না, তখন সে একটি কামোত্তেজক প্রাণী,
    তার মধ্যে একটি অনুপ্রাণিত শিহরন আছে,
    এক ধরনের স্পন্দন
    যেটি সংখ্যা ছাড়াই প্রাণী উৎপন্ন করে যার জন্য পৃথিবীর প্রাচীন উপজাতিরা সর্বজনীনভাবে ঈশ্বরকে দায়ী করে।
    এটি একটি সৃষ্টি বলা হয় কি আত্মা।
    শুনুন, আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে উদ্ভূত এই চেতনা আজ সারা বিশ্বে বৈজ্ঞানিক ভঙ্গিতে আরেকবার আবির্ভূত হচ্ছে যা কেবল তার অসুস্থ সংক্রামক শক্তিকে বাড়িয়ে তোলে, তা হলো অযাচারের  লক্ষণীয় অবস্থা, কিন্তু তা একটা অযাচার  যা রোগের সাথে খলবল করে,
    কারণ, ভালো লাগলে আপনি হাসুন,
    যাকে জীবাণু বলা হয়
    তা দেবতা , আর আপনি কি জানেন যে আমেরিকানরা আর রাশিয়ানরা তাদের পরমাণু তৈরি করতে কী ব্যবহার করে?
    তারা ঈশ্বরের জীবাণু দিয়ে তা তৈরি করে।
    - আপনি পাগলামি করছেন, মসিয়ঁ আতো।
    আপনি উন্মাদ।
    - আমি পাগলামী করছি না।
    আমি উন্মাদ নই।
    আমি আপনাকে বলছি, বিশ্বাস করুন,  তারা ঈশ্বরের একটা নতুন ধারণা আরোপ করার জন্য জীবাণুগুলোকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে।
    তারা দেবতাকে বের করে আনার আর তাকে তার জীবাণুর বিষে বন্দী করার একটা নতুন ফন্দি খুঁজে পেয়েছে।
    তা হলো তাঁর  হৃদয়  পেরেক দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করা,
    যেখানে মানুষ তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে,
    অস্বাস্থ্যকর যৌনতার মুখোশের আড়ালে,
    অসুস্থ নিষ্ঠুরতার তাঁর সেই অশুভ চেহারায়
    যখনই তাঁর ইচ্ছা হয়  মানবসমাজকে পাগল করে দেন
    ঠিক এখন যেমন করছেন।
    .
    তিনি বিশুদ্ধতার চেতনা এবং চেতনাকে কাজে লাগিয়েছেন যা আমার মতই অকপট থেকে গেছে সব মিথ্যা দিয়ে গলা টিপে মারার জন্য  আবির্ভাব হয়েছে তাঁর যা তিনি মহাকাশের মাধ্যমে সর্বজনীনভাবে ছড়িয়ে দেন আর এই কারণেই হ্যালুসিনেশনে ভুগছেন এমন ব্যক্তির জন্য অঁতনা আতো’র  ‘মোমো’ নেওয়া যেতে পারে ।
    —আপনি কী বলতে চাইছেন মসিয়ঁ আতো ?
    —- আমি বলতে চাইছি  যে আমি এই বনমানুষকে চিরকালের জন্য শেষ করার উপায় খুঁজে পেয়েছি এবং যদিও কেউ আজকাল ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না কিন্তু সবাই এখন  মানুষকে আরও বেশি করে বিশ্বাস করে। সুতরাং এখন মানুষ হিসাবে আমাদের নির্ণয় নিতে হবে কেমন করে  তাকে হীনবীর্য করা  যায় ।
    —কেমন করে ?

    —কেমন করে মানে কী ?
    কেউ আপনাকে যেভাবেই নিয়ে যাক না কেন আপনি উন্মাদ, লোহার শেকলে বেঁধে ফেলার জন্য প্রস্তুত।
    — তাকে আবার  ময়নাতদন্তের টেবিলে শেষবারের মতন রেখে, তার দেহকাঠামো নতুন করে গড়তে হবে।
    আমি বলতে চাই, তার অ্যানাটমি ভেঙে গড়তে হবে।
    মানুষ অসুস্থ কারণ সে খারাপভাবে নির্মিত।
    মরণশীল প্রাণীদের যে চুলকানিতে সে ভোগে,  তার সেই আস্তরণ  ছিঁড়ে ফেলার জন্য  তাকে  খুলে ফেলতে হবে আর তার জন্য আমাদের মনকে তৈরি করতে হবে,
    ঈশ্বর
    আর ঈশ্বরের সাথে
    তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ।
    কারণ তুমি চাইলে আমাকে বেঁধে রাখতে পারো,
    কিন্তু একটি অঙ্গ ছাড়া আর কিছুই অকেজো নেই।
    যখন তুমি তাকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গবিহীন শরীরে পরিণত করবে,
    তখন তুমি তাকে তার সমস্ত স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তি দেবে
    এবং তাকে তার প্রকৃত স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবে।
    .
    তুমি তাকে আবার ভুল ছন্দে নাচতে শেখাবে
    নাচঘরের উদ্দাম হইহুল্লোড়ে
    আর এই ভুল  হবে তার আসল জায়গা।
                               —-----------XXXXXX—-------------

     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন