এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • মলয়ের লেখাপত্তর

    pi
    বইপত্তর | ২৪ মার্চ ২০১২ | ২৪৪৫৬২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিশ্বজিত সেন | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৯:১৩735105
  • মলয় রায়চৌধুরীকে নতুনভাবে দেখা :বিশ্বজিত সেন


    মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা
    বাংলা সাহিত্য নিয়ে যাঁরা ভাবাভাবি করেন, তাঁদের কিছু মজার প্রবণতা আছে। তাঁরা কবিতাকে গদ্য থেকে একেবারে আলাদা করে দেখেন, ও সেই দেখা চিরস্হায়ি করতে নানাবিধ সাংস্কৃতিক প্রপেরও আয়োজন রয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেরই নাম--- কবিপ্রণাম । রবীন্দ্রনাথকে মূলত দেখা হয় কবি হিসাবে। গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ তেমন গুরুত্বপূর্ণ লোক নন। আমাকে প্রশ্ন করলে আমি বলব, গল্পলেখক রবীন্দ্রনাথই আমার কাছে সর্বাধিক গ্রাহ্য । যদিও রবীন্দ্রনাথের গল্প লেখার দর্শন আমার কাছে একেবারেই গ্রহণীয় নয়, তবু 'কবি' রবীন্দ্রনাথের চেয়ে, এই লোকটি আমার চোখে ঢের বাস্তব।
    কবিতাকে আলাদা করে দেখা, তাকে সুউচ্চ বেদিতে বসিয়ে রাখা, অহরহ গুজগুজ-ফিসফিস, আরে আজও যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে বাংলা সাহিত্যে ও মধ্যবিত্ত জনজীবনে । এ নিয়ে চিন্তা করেছি, আজও মাঝে-মাঝে করি। এ ভাবনার উৎস কোথায়?কিছুটা কি "ভারতীয় অতীত"- এর ব্যাপার রয়েছে এর মধ্যে। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত--- সবই কবিতায় । কবিকে রহস্যময় মানুষ মনে করা হত, যিনি নিজের চিন্তা-ভাবনাকে ছন্দবদ্ধ করতে সক্ষম। মনে করা হত স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর কাছে বার্তা পাঠিয়ে থাকেন। ভগবানের স্পেশাল মেসেঞ্জার তিনি, 'নট টু বি টেকন লাইটলি'। তার বহু পরে, 'ভক্তি' যুগে ভারতীয় সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কবিকে সাধক বানিয়ে কুলুঙ্গিতে লাল শালু মুড়ে রেখে দেওয়া হল।কবীর, দাদু, নানক, সুরদাস, রহিম, জয়দেব, চণ্ডীদাস । তুলসীদাসকে 'গোঁসাই' বানিয়ে তাঁরও একই হাল করা হল।'রামচরিতমানস'কে ধর্মগ্রন্হ মনে করে গদগদ আপামর হিন্দিভাষী জনসাধারণ। তার দোহায় দোহায় শব্দের যে অদ্ভুত খেলা, ভাষাকে কাদার মতো ব্যবহার করে তা থেকে বিচিত্র নানা মূর্তি গড়ে তোলা, সেদিকে দুচারজন ক্রিটিক ছাড়া কারো নজরই যায়নি প্রায়। হিন্দি সাহিত্য ঐশ্বরিক বিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে কবে একাজে হাত দেবে জানি না । আজকে ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, এ-কাজ করার সময় এসে গেছে ।
    ইংরাজপূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চল কিন্তু কবিকে অনেক সহজভাবে নিয়েছিল। কথক ও কবিয়াল ছিলেন, কবিগান ছিল। যাত্রার, পালার আসর ছিল, চণ্ডীতলা ছিল। অবশ্যই কবিকে স্পেশাল টেকনিকে দক্ষ লোক মনে করা হত; তবে সাউক বা অবতার, বা ভগবান নয় । কবির লড়াইতে তো কবিতা তৈরি হত সর্বসমক্ষে, মুখে-মুখে। আর হারজিতও ছিল। কাজেই রহস্যের সেখানে কোনো ভূমিকাই ছিল না । কবি স্পেশাল টেকনিকে দক্ষ বলে তাঁদের আদর-আপ্যায়নও হত, তবে তাঁকে একটি বেদিতে বসিয়ে তাঁর মুখের ওপর স্পটলাইট জ্বেলে রাখা ? নাঃ ! ইংরাজপূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে তা করা হত না।
    ইংরাজরা আসার পর বাংলা সাহিত্যে কবিতার রহস্যের আমদানি হয় । নিজস্ব সংস্কৃতি বলতে ইংরাজদের কিছু ছিল না। যাকে তারা নিজের সংস্কৃতি বলত, তার খুঁটিগুলো সবই ছিল গ্রিস, রোম থেকে ধার করা। গ্রিসে 'বার্ড' বা ভ্রাম্যমান কবিদের নিয়ে রহস্য গড়ার অভ্যাস প্রচলিত ছিল। ভক্তি যুগের আদলেই প্রায় বলা যায়, তাঁদের 'ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা', ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী, ইত্যাদি মনে করা হত। হোমারের স্হান গ্রিক মানসে প্রায় ঋষির জায়গাতেই ছিল, দাড়ি-টাড়ি সমেত। শেকসপিয়রও আরও কয়েকশো বছর আগে জন্মালে ঐ জায়গাতেই পৌঁছে যেতেন। আমাদের সৌভাগ্য, তিনি পরে জন্মানোর দরুন বিশ্বসাহিত্য একটি নিদারুণ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল।
    রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, সাহিত্যিক জীবনের পরবর্তীপর্বে, কবিতার বিশেষত্বের জায়গা থেকে অনেকটা সরে এসেছিলেন। যাকে সাহিত্যের বিশেষজ্ঞরা 'গদ্য কবিতা' বলেন, তা তাঁর এই বোধের সাক্ষ্য দেয়। তাঁর কিছু গদ্য কবিতা গল্পকেন্দ্রিক। সাহিত্যকর্ম ইশাবে অনেক উঁচু দরের কাজ সেগুলো। মোদ্দা ব্যাপার হল, আজ পাড়াব-পাড়ায় 'কবি প্রণাম' সত্ত্বেও সাহিত্যের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির মাঝখানের দেওয়াল ধ্বসিয়ে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। তাঁকে বাঙালি এত বেশি 'কবি' বানিয়ে ফেলেছিল যে হাত খুলে এই কাজটি করা সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। তবে কাজের মধ্য দিয়ে ঠারে-ঠারে যতটা পেরেছেন, করেছেন। বিশেষ করে ছবি আঁকার মাধ্যমে।
    কবিতাকে বা কবিকর্মকে ঘিরে একটা রহস্য সৃষ্টি করে রাখলে কবিতা কখনই সামাজিক পরিস্হিতির দলিল হয়ে উঠতে পারে না। কবিতার মিস্টিসিজমের প্রথম অসুবিধে এটা। কবিতা যদি সামাজিক পরিস্হিতির দলিল না হয়, তবে তাকে ড্রইংরুম সাজানোর ডলপুতুল বা অশ্রুমোছার রুমাল হয়ে থাকতে হয় কেবল।সেটা অবশ্য অনেকেরই মনঃপূত, বিশেষ করে যাঁরা 'সমাজ-টমাজ'কে দশ হাত দূরে রাখতে চান। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যেও লড়াই আছে, পক্ষ-প্রতিপক্ষ আছে। একটি পক্ষের বিশেষ দর্শন এটাই। কবিতার গায়ে গরম হাওয়ার ঝাপটা যেন না লাগে।
    কবিতার মিস্টিসিজমের দ্বিতীয় অসুবিধে ভাষার স্তরে। ভাষা তো একটি নদী বিশেষ। একূল-ওকূল দুকূলই সে ভাসায়। তাকে সিমিলি, মেটাফর, ছন্দবৃত্ত, মাত্রা, পয়ার ইত্যাদির গণ্ডীর মধ্যে সর্বদা বেঁধে রাখা যায় না। কবিতার নিয়মানুবর্তিতা থেকেই কবিতার মিস্টিসিজমের জন্ম। এই নিয়মানুবর্তিতার দরুনই, একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রয়োজন অনুভূত হয়, যে কবিতা 'লিখতে পারে'। যে 'পারে না', তাকে দূর করো, দাঁড় করিয়ে রাখো দরজার বাইরে। তার ভাষাটিও ব্রাত্য।
    তাই, কবিতার স্বার্থেই, কবিতার রহস্যময়তাকে ভাঙা অত্যন্ত প্রয়োজন।
    বাংলা সাহিত্যের সিরিয়াস পাঠক সম্প্রতি নড়ে-চড়ে বসেছেন। ষাটের দশকে, যে একটি তুমুল ওলোট-পালোট ঘটে গিয়েছিল বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে--- সেদিকে নজর গেছে তাঁদের। দেরিতে হলেও, এটাই কাম্য ছিল।'হাংরি আন্দোলন' নিয়ে ইতিপূর্বে 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' গোছের কথাবার্তা হয়েছে। 'হাংরি আন্দোলনকারীদের' গভীর মননশীল পঠন-পাঠন ছিল, যাকে বলা যায় ওভারভিউ। হাংরির পরেও আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন এসেছে, তবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঝাঁকুনি হিসাবে হাংরিই ছিল "প্রথম"। বাংলা সাহিত্যের অবস্হা, হাংরি আন্দোলনের আগে ছিল অকালবৃদ্ধ আফিংখোরের মতো। রবীন্দ্র ঐতিহ্য পুঁটুলি বেঁধে কোলে নিয়ে বসে ঝিমোনো আর মাঝে-মাঝে চটকা ভেঙে, "অ্যাই, গোল কোরো না বলচি, পড়াশুনো করো, পড়াশুনো..."। অথচ দেশে-বিদেশে তখন ঘটছে যুগান্তকারী ঘটনা । 'গ্রানমা' জাহাজে চড়ে বিপ্লব করতে আসা কয়েকজন যুবক হঠাৎ জয়ী হয়েছেন। ওয়াশিংটন থেকে মাত্র নব্বই মাইল দূরে দেখা দিয়েছে বিদ্রোহের পতাকা। ওদিকে ঠাসবুনোট সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্রমে ঠোঙা বানাবার কাগজ বই আর কিছু নয়। স্হিতাবস্হাকামী বাণিজ্যিক সংবাদপত্র গোষ্ঠীর প্রচণ্ড একমাত্রিক দাপট বাংলা সাহিত্যে। তার দোরগোড়ায় মাথা না ঠুকলে কেউ মানুষই হবে না, সাহিত্যিক হওয়া তো দূরে রইল।
    এইরকম সময়ে বাংলা সাহিত্যের 'পীঠস্হান' কলকাতা থেকে দূরে, পাটনা শহরে, যেখানে ঐশ্লামিক ধর্মশাস্ত্র পড়তে গিয়েছিলেন রামমোহন রায়, আর বেশ কয়েক বছর চাকরি করে গেছেন দীনবন্ধু মিত্র, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে একটি অপরিচিত গরিব পরিবারের যুবক মলয় রায়চৌধুরী আই আন্দোলনটির ছক কষেন। দাদা সমীর রায়চৌধুরী কলকাতায় সিটি কলেজে পড়েন, সেই সুবাদে যুবা বাঙালি লেখক-কবিদের সাথে আলাপ-পরিচয় । দেশ-দুনিয়ে জুড়ে উথালপাথাল সত্ত্বেও কলকাতা, ব্রিটিশের প্রিয় 'কালকুত্তা' তখনও শীতল। বামপন্হী দলগুলোর বিরুদ্ধে গান্ধীবাবার কংগ্রেস প্রতিপালিত গোপাল পাঁঠা, ইনু মিত্তিরদের দাপাদাপি; কলকাতা শীতল। কবিতা ভবন (!) থেকে 'কবিতা' বেরোয় । বুদ্ধদেব বসুর পরিশীলিত আঙুল কবি বাছাই করে, ফতোয়া দেয়। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই উপস্হিতি। এককালে...'না না অমন বলবেন না । সুকান্তও কবি। ছন্দ বোঝে। এই দেখুন আমি দেখাচ্ছি --- পতা/কায় পতা/কায় ফেরমিল/আনবে ফেব্রু/য়ারি। দেখলেন ?
    অট্টহাসি উদ্রেক করা সেই সময়। সমীর রায়চৌধুরীর 'পাটনাই' হওয়ার দরুন কলকাতার যুবক কবিদের পাটনায় আনাগোনা। এঁদের মধ্যে অন্যতম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। যাঁর বিষয়ে বাসব দাশগুপ্তকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মলয় বলেছেন, "শক্তির কবিতা সম্পূর্ণ নিজস্ব ও অসাধারণ। কেননা তিনি পাঁড় অশিক্ষিত, কোনো লেখাপড়া করেন না, এবং দর্শন, ইতিহাস, সমাজবোধ এসব ছিটেফোঁটা তাঁর মধ্যে নেই। নিজের খাঁটি বোধ থেকে তিনি লেখেন, তখন তাঁকে জীবনানন্দের পরের প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন মনে হয়।" মনে রাখা প্রয়োজন, এই সাক্ষাৎকারটি যখন দিচ্ছেন মলয়, তখনও হাংরি আন্দোলনের স্মৃতি, তজ্জনিত তিক্ততা, সব কিছু মলয়ের মস্তিষ্ককোষে উপস্হিত। কিছুই ক্ষমা করেননি। অথচ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে মলয়ের চোখা, টান-টান মূল্যায়ন। ব্যক্তিগত তিক্ততা সেখানে ছায়া ফেলেনি।
    হাংরি আন্দোলনের পরিকল্পনাপর্বে এই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে মলয় সঙ্গে পেয়েছিলেন, আর পেয়েছিলেন দেবী রায় ( হারাধন ধাড়া) কে। পাটনার সুবিমল বসাক এসে যোগ দেন কিছুকাল পরে।একটি সাহিত্য আন্দোলন, যা বাংলা সাহিত্যের হাল-হকিকত পালটে দিয়েছিল, কত সামান্যভাবে শুরু হয়েছিল, ভাবলে অবাক লাগে। প্রেস পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই মিষ্টির দোকানের বাকসো যে জব প্রেস ছাপতো, সেখানেই ছাপতে হয় হাংরি বুলেটিন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কে মলয় তখন লোয়ার গ্রেড কেরানির চাকরিতে, কত মাইনে পেতেন জানা নেই, তবে প্রায় সম্পূণফ মাইনেটাই মনে হয় হাংরি বুলেটিনের পেছনে ঢালতে হত। বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রথম কাগজ বেরোনোর আরম্ভটা এইরকম। 'শতভিষা' পত্রিকার তুলনায় 'কৃত্তিবাস' ও নিজেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজই বলত, তবে হাংরি বুলেটিনের সাথে তার ছিল মৌলিক প্রভেদ। 'কৃত্তিবাস' ছিল সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্খীদের কাগজ। তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে সুরে সুর মিলিয়ে। প্রতিষ্ঠান কখন যশ, প্রতিপত্তি, বৈভব, টাকাকড়ি, সামাজিক সুবিধার কাজে লেগে যায়, বলা তো যায় না। হাংরি বুলেটিনের উদ্দেশ্যই ছিল যুদ্ধ। আপসের জন্যে সেখানে কোনও জায়গাজমি রাখা হয়নি।
    অনেকের মতে হাংরি আন্দোলনকারীরা কয়েকটি গিমিকের আশ্রয় নিয়েছিলেন রাতারাতি খ্যাত হবার জন্য, যেমন শাদা দিস্তা কাকজ, জুতোর বাকসো ইত্যাদি রিভিউএর জন্য পাঠানো, টপলেস প্রদর্শনীর আয়োজন ( টপলেসের অর্থ যে মুন্ড বা মস্তিষ্কবিহীনও হয়, এই বোধটুকু কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের হয়নি), জীবজন্তু-জোকারের মুখোশ বিলি ইত্যাদি। 'হাংরি কিংবদন্তি'তে মলয় উদ্ধৃত করেছেন আবু সয়ীদ আইয়ুবের যে মন্তব্য, তা এ-প্রসঙ্গে দেখা যেতে পারে।কিন্তু মলয় বা তাঁর সঙ্গীরা কি জানতেন না যে প্রতিষ্ঠান ও প্রসাশন কতদূর হিংস্র হতে পারে? এ জানা সত্ত্বেও একজন চাকুরিজীবী ( মলয় ) নিজেকে এই ঝুঁকির সামনে এগিয়ে দিয়েছিলেন কেন ? শুধুই প্রচারের জন্য? না কি কিছু মূল্যবোধের ব্যাপারও ছিল ? মলয় তাঁর 'সাক্ষাৎকারমালা'র এক জায়গায় বলেছেন, 'ষাট দশকের সুস্হতা স্বাভাবিক ছিল না।' এই অস্বাভাবিক সুস্হতাকে ভালোমতো একটা ঝাঁকুনি দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। তার জন্য দুহাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি পরে চোর-ডাকাতের সঙ্গে সার বেঁধে পাটনা শহরের রাস্তায় অতিপরিচিতজনের মাঝে হাঁটা, চাকুরি থেকে সাসপেন্ড হওয়া, পঁয়ত্রিশ মাস প্রতি সপ্তাহে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো--- সবই। প্রচার পাওয়ার জন্য যদি এত করতে হয়, তাহলে তো মুশকিল। এর চেয়ে সহজ রাস্তা তো কতই ছিল। বিশেষত, 'কৃত্তিবাস' গোষ্ঠীতে তাঁর দাদার বন্ধুরাই যখন সর্বেসর্বা। সমসাময়িক অন্যান্যদের মতন একটু মিঠে ব্যবহার রাখলেই আর দেখতে হচ্ছিল না। আর, 'কৃত্তিবাস'ও তেমন-তেন বৈশিষ্টহীন ও লুপ্ত হবার পথে এগিয়েছে। সাহিত্য আন্দোলন সম্পর্কে 'কৃত্তিবাসীয়'দের সততার এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে ?
    ( দ্রষ্টব্য: কবিতীর্থ, মাঘ ১৪১০)
    বলা যেতে পারে যে 'কৃত্তিবাস' যদি সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে না টিকে থাকে তবে 'হাংরি বুলেটিন'ও তো টেকেনি। হ্যাঁ, হাংরি বুলেটিন উঠে গিয়েছিল মামলা-মকদ্দমার দরুন, অন্তর্কলহের দরুন। কিন্তু হাংরিদের ঝগড়াঝাঁটি ছিল খোলাখুলি, তাতে মধ্যবিত্তের চাপ-চাপ ঢাক-ঢাক ছিল না। মামলা-মকদ্দমার ভয়ে কেউ রাজসাক্ষী হয়েছিলেন ( সুভাষ ঘোষ,শৈলেশ্বর ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখ ), কেউ ভেবড়ে গিয়ে কলকাতার বাইরে কেটে পড়েছিলেন ( প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য প্রমুখ )। সেগুলোকে দেখার কোনও অর্থ হয় না।'হাংরি বুলেটিন' বন্ধ হবার পর অগনণ পেশিবহুল বাহু এগিয়ে এসেছে আন্দোলনের পতাকা তুলে নিতে।জেব্রা, উন্মার্গ, ফুঃ, স্বকাল, ক্ষুধার্ত খবর, জিরাফ, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, ওয়েস্ট পেপার, চিহ্ণ, প্রতিদ্বন্দী ইত্যাদি পত্রিকাও হাংরি বুলেটিনই। মলয় কোনোদিন বলেননি যে হাংরি আন্দোলনের কপিরাইট একমাত্র তাঁর। হ্যাঁ, আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও দার্শনিক প্রতিনিধি হিসাবে তাঁর কিছু বক্তব্য থাকতেই পারে, যা তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে পাঠকদের সামনে রেখেছেন।এই অধিকার থেকে তো আর তাঁকে বঞ্চিত করা যায় না। মলয়ের পরবর্তীকালীনরা হাংরি মতাদর্শকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন।এটিও একটি আন্দোলনের প্রাণশক্তির প্রমাণ। মলয়, হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর, পড়ালেখার নিজস্ব পৃথিবী গড়ে তুলেছেন, মন দিয়ে এবং চুটিয়ে বিভিন্ন শহরে চাকরি করেছেন, সংসার করেছেন, ভারতীয় জনজীবনকে দেখেছেন, জীবন থেকে শিখেছেন। আজ গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধের যে হতচকিত-করা ফসল তিনি আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তা সম্ভব হতে পেরেছে এরই দরুন। বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের গদি-আঁটা চেয়ারে বসে আঙুলে চাবির রিং ঘোরাননি মলয়। এর জন্য তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। অন্তত একটি আকাশ এমন রয়েছে, যাকে ঢেকে ফেলতে পারেনি কালো মেঘ।
    মলয়কে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটির দরুন মামলায় পড়তে হয়। কবিতাটি বর্তমানে বহুল প্রচারিত, তাই তাকে আর সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করার প্রয়োজন নেই। তবে এই কবিতাটিকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা, যদি ধরেও নেওয়া যায় যে এর পেছনে কোনো অসূয়া কাজ করছিল না, একটি কৌতুকপ্রদ মাইন্ডসেট-এর দিকে ইঙ্গিত করে। এই মাইন্ডসেটটি তদানীন্তন বুদ্ধিজীবী বাঙালির, যিনি পুজোর ছুটিতে সস্ত্রীক খাজোরাহো দেখতে যান। তাহলে মলয়ের কবিতা কেন গ্রহণীয় নয় ? মজা কেবল এই জায়গাটুকুতে নয়, অন্যত্রও আছে। "আমরা যখন অসভ্য ছিলুম তখন ওইগুলো বানিয়েছি। এখন আমরা সভ্য, এখন তো আর এসব চলতে দেওয়া যায় না ।" এও মানলাম, কিন্তু মাই ডিয়ার, ব্যাপারটা যে আদপে তা নয় একেবারেই। ব্যাপার আগাগোড়া অন্যরকম। যৌন রূপকল্প, দ্যোতক ও বিম্ব কেবল ব্যবহার করেছেন মলয়, সেগুলির মাধ্যমে নিজের কথা বলেছেন। এও চলবে না ? তাহলে শিবলিঙ্গ তুলে দিন, গৌরীপট্ট নাকচ করুন, অম্বুবাচী ব্যান করুন। কামাখ্যা মন্দিরে মা-কামাখ্যার মাসিক যেন আর না হয়। কি বলেন ? যাঁরা "অশ্লীল অশ্লীল" চিল্লিয়েছিলেন, তাঁরা সম্ভবত 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার-এর এই লাইনগুলো নজর করে দেখেননি--
    ১.
    জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে
    আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
    মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
    তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে কিছুকাল ঘুমোতে দাও শুভা
    শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
    ২.
    হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
    আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ
    মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছি না
    তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহ্যতায়
    সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব
    শিল্পর জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোবো
    কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই...
    ৩.
    এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়
    আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই
    এখন আমার হিংস্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে
    মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে
    আমি মরে যাব...
    ৪.
    ৩০০০০০ লক্ষ শিশি উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
    ঝাঁকেঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
    এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
    হিপ্নটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়
    ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখী আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
    কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার অপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি
    এই পঙক্তিগুলো একটু মন দিয়ে পড়লে বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর পক্ষে বোঝা দুষ্কর ছিল না যে নিছক যৌনতা নয়, আরো গূঢ় কোনো বোধের দ্যোতনা এই পঙক্তিগুলোয় রয়েছে।'সাত বছর আগের একদিন' কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছিলেন, "অর্থ নয় কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা নয় আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে। আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত ক্লান্ত করে। লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই..."। এই পঙক্তিগুলোকে উদ্ধৃত করে জীবনানন্দকে শবসাধক সাব্যস্ত করা অবশ্যই উচিত হবে না, অথবা ঘোর অঘোরপন্হী। তেমনই হাস্যকর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ যৌনতার বহিঃপ্রকাশ খোঁজা। আসলে মলয়ের বিরুদ্ধে যখন ষাটের দশকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অশ্লীলতার মকদ্দমা দায়ের করা হয়, তখন ষাটের দশকের 'অস্বাভাবিক সুস্হতা' রাজত্ব করছে পুরোদমে।'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে প্রবোধকুমার সান্যালের 'দেবতাত্মা হিমালয়' আর মেট্রো সিনেমার ফুটে রিফিউজি যুবতীদের শরীর নিয়ে চলছে অবাধ বাণিজ্য! পায়ের চটি ঘষটাচ্ছে রিফিউজি যুবক, 'মাই ওন সিসটার স্যার, ভেরি সুইট, ওনলি সিক্সটিন'। অথচ বাঙালি পাঠক 'কত অজানারে'র বারবেল সাহেব আর 'সখী সংবাদ' এর মিষ্টিদিদি, নতুন দিদি, এদের নিয়েই মুগ্ধ। সমাজ কোথাও নেই; সমাজের জ্ধবলাপোড়া, আর্তি, চিৎকার এগুলোও কোথাও নেই। বামপন্হীরা 'পরিচয়' পত্রিকা চালাচ্ছেন, তাতেও এন্ট্রি পারমিট নিয়ে ঢুকতে হয়। এইরকম এক সময়ে 'হাংরি বুলেটিন' এর দরকার ছিল, প্রয়োজন ছিল 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এর। মূল্যবোধ ভেঙে খানখান হওয়ার যে হরর, শিল্পপ্রতীক জোলো হয়ে যাওয়ার যে শক, তাকে যথার্থ ফুটিয়ে তুতে গেলে এই কবিতাই তো লিখতে হবে। মলয় তাই করেছিলেন।
    অবশ্য বিপদ চেনার ব্যাপারে প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের সূক্ষ্মদৃষ্টির প্রশংসা করতেই হয়। কেই বা পড়ে তখন 'হাংরি বুলেটিন', কটা লোক ? পাটনার দুই যুবক, একজন হাওড়ার, একজন বিষ্ণুপুরের, একজন শান্তিনিকেতনের, এদের বুলেটিন বেরোয়। তার জন্যও আবার এই প্রেস, ওই প্রেসের হাতে-পায়ে ধরাধরি। তাহলে? এমন কী ক্ষমতাসম্পন্ন এরা, যে ক্ষেপে উঠল গোটা কলকাতার বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রশাসন ? মলয়ের বিরুদ্ধে কেবল মামলাই নয়, তাঁকে ও অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করে অপমান করা হল চরম, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনোদিন এই জাতীয় প্রবণতা মাথা তোলার হিম্মত না করে ।
    বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন যে সমাজকে বুঝতেন না তা নয়, ভালোমতোই বুঝতেন। তাঁরাও জানতেন যে, যে-বদমায়েশি তাঁরা শিল্প, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতির সর্বত্র বিছিয়ে রেখেছেন, তা মানুষের জন্য নয় । তবে শ্রেণী স্বার্থে এর প্রয়োজন তাঁদের ছিল। যেমন ইংরেজরা, আই.সি.এস.কে লৌহ কাঠামো হিসাবে গড়ে তুলতে ছেয়েছিল, তেমনই উত্তর-স্বাধীনতা যুগের ভারতীয় পুঁজিবাদ, আমলাতন্ত্র ও তার মিডিয়া-খানসামাদের লক্ষ ছিল একটি জড়, নির্বোধ, সংবেদনহীন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে তোলা। তাদের রুচি, জীবনযাপন, মূল্যবোধ, সব কিছু হবে ছাঁচে ঢালা, সিনথেটিক। তারা হাসবে, কাঁদবে, গাইবে, সঙ্গম করবে একটি বিশিষ্ট কায়দায়। 'হাংরি প্রজন্ম'এর হুড়মুড় করে এসে পড়ায় এই গোটা গেমপ্ল্যানটি ধ্বসে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। মলয় এবং অন্যান্যদের ওপর আক্রমণ সেই কারণেই।
    প্রজাপতি-আঁকা বিয়ের কার্ডে হাংরি প্রজন্ম ধ্বনি তুলেছিল, "গাঙশালিক কাব্যস্কুলের জারজদের ধর্ষণ করো"। এই ধ্বনিটিতে অন্তর্নিহিত ছিল তদানীন্তন কাব্যধারার প্রতি বিবমিষা।
    প্রকৃতি, নিসর্গ এই ব্যাপারগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছিলো বাংলা কবিতার কলোনোয়াল রোগবিশেষ। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ ছিল একটা কমপালশান, যেমন লেখালিখি ছিল তাঁর কমপালশান। সেজন্য তাঁর লেখায় প্রকৃতি, নিসর্গ বিশেষভাবে উপস্হিত--- কবিতায়, নাটকে, উপন্যাসে। আঁকার সময়ে তিনি এগুলো বর্জন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে, বাংলা কাব্যধারায় এই ব্যাপারগুলো প্রয়োজনীয় অনুপান হয়ে ওঠে। এবং অনুপানেরও অধিক, অভ্যাস।জীবনানন্দ লেখেন 'রূপসী বাংলা'। তাতেও নিসর্গ ছিল; তবে সেই নিসর্গ, প্রকৃতির প্রতিটি কমপোনেন্ট আবহমানের বাঙালিজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেছিল।মানুষের সাথে সম্পর্কবিহীন ছিল না সেই নিসর্গ, সেই প্রকৃতি।সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, "একদা আষাঢ়ে এসেছি এখানে, মিলের ধোঁয়ায় পড়ল মনে; কালবৈশাখী নামবে যে কবে আমাদের হাত-মেলানো গানে"। এখানে মানুষের সংগ্রামকে আঁকা হয়েছে প্রাকৃতিক ঘটনার রং-তুলিতে। কিন্তু বাংলা ভাষার সেইসব কবিরা (গাঙশালিক কাব্যস্কুল) সৃষ্টি করছিলেন মনুষ্যবিহীন নিসর্গ, মানুষকে মাইনাস-করা প্রকৃতি। এ ছিল একজাতীয় পলায়নবাদ। শংকরের 'কত অজানারে' যেমন বাঙালি যুবকের বেকারত্ব থেকে পলায়ন করতে চেয়ে বারবেল সাহেবের মহানতায় বুঁদ হয়ে থাকা, বিমল মিত্রের মিষ্টি দিদি, নতুন বৌদি, ছোট বৌঠান যেমন নারী-পুরুষের স্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক ফেস করতে না চাওয়ার যুক্তি, তেমনই 'গাঙশালিক কাব্যস্কুল' ছিল মানুষের দুঃখ, শোক, রোগ, ঘা-পাঁচড়া এগুলোকে দেখতে না চেয়ে স্টুডিওর পর্দায় আঁকা চাঁদ, তারা, নদী, ফুলে বিভোর হয়ে থাকা। ঠিক তখনই মানুষের জীবনধারণ কতদূর দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল, তা দেখতে পাওয়া যায় ঋত্বিক ঘটকের ফিলমগুলোতে। সেই দৈন্য, দুর্দশা, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের প্রতিফলন এই কবিতাগুলোতে কোথাও ছিল না। কেন ? কেননা, তা করার অসুবিধে ছিল। তা করতে গেলে দীর্ঘ একটা লাফ দিতে হত, বিশেষ করে ভাষার ক্ষেত্রে।ঋত্বিক যেমন 'মেঘে ঢাকা তারা' বা 'কোমল গান্ধার' -এ গোটা ইডিয়মটিকেই ভেঙেচুরে ফেলেছিলেন, তেমনই ষাটের দশকের বঙ্গসমাজ ও মানুষেকে তুলে আনতে গেলে বাংলা কবিতার গোটা ইডিয়মটিকেই ভাঙতে হত। খানিকটা শ্রেণী পরিপ্রেক্ষিত আর কিছুটা গাড্ডায় পড়ে যাওয়ার ভয়, উভয়ে মিলে এ-কাজ করতে দেয়নি বাংলা ভাষার কবিদের। অতএব চাঁদ, তারা, নদী, ফুল, মৌমাছি...
    আরেকটি প্রশ্নও ছিল। কবি কি কেবল কবিতাই লিখবেন, না সামাজিক ভাষ্যকারও হবেন ? রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি নন, সামাজিক ভাষ্যকারও ছিলেন। জীবনানন্দও তাই ( জীবনানন্দকে নিবীঢ়ভাবে পড়লে এই ব্যাপারটি ধরা পড়ে) । কিন্তু উত্তরোত্তর সামাজিক ভাষ্যের ব্যাপারটি বাংলা কবিতা থেকে উঠে যেতে থাকে। "কবিতা কবিতাই। সামাজিক ভাষ্যটাষ্য আবার কী?" এ-জাতীয় একটী প্রবণতা বাংলা কবিতাকে পেয়ে বসতে থাকে। একে ক্রমাগত হাওয়া দিতে থাকে স্বার্থান্ধ বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান।
    খুব স্বাভাবিকভাবেই নভেম্বর ১৯৬১-এর প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি প্রজন্ম এই প্রবণতার বিরুদ্ধে ছিল। সেই দিন থেকে আজ অব্দি মলয়, সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি কোনোদিনই হাতছাড়া করেননি। 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'এ যেমন সামাজিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে তাঁর তীব্র বিবমিষা, তামনই আজও। তাঁর হালের একটি কবিতা নেওয়া যেতে পারে, 'যা লাগবে বলবেন' সংকলন থেকে । কবিতাটির নাম 'ক্ষুধার্ত মেয়ে':
    আমার আসক্তি নেই কোনো
    চলে যা যেখানে যাবি
    যার সঙ্গে শুতে চাস যা
    আমি একা থাকতে চাই
    ক্ষুধার্ত বা পেটুক মহিলা
    যে ঘোরে সবার হাতে
    খড়কুটোময় সংসারে
    তার কোনো প্রয়োজন নেই।'
    কবিতাটিতে জড়িয়ে আছে একটা ঈষৎ বোহেমিয়ান বাচনভঙ্গী। পড়লে মনে হবে কেউ একজন লিখছেন তাঁর শয্যাসঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে। এটি কিন্তু কবিতার প্রথম স্তর। দ্বিতীয় স্তরে কবিতা ও সমাজ সম্পর্কে মলয়ের দার্শনিক বোধ সন্নিহিত। শয্যাসঙ্গিনী মহিলাটি আসলে কবিতাই। অথচ সবার হাতে ঘোরার প্রবণতা তার, সে হাত স্মাগলারের হোক বা বিপ্লবীর।কবিতার লয়ালটি সন্দিগ্ধ। ওদিকে সংসার অনিত্য, অতএব তার প্রয়োজন কিসের ?
    'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতায় যে-কথা বলার জন্য মলয়কে অনেক বেশি জায়গা ব্যবহার করতে হয়েছে, 'যা লাগবে বলবেন' গ্রন্হে সেই কথাই তিনি বলেছেন অনেক সংক্ষিপ্ত পরিসরে। 'হাংরি আন্দোলন' থেকে সরে এসে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ইন্সপেক্টিং অফিসার হিসেবে ভারতের গ্রামে-গঞ্জে শহরে শহরে ঘোরা, তারপর এ.আর.ডি.সি. ও নাবার্ডের গ্রামোন্নয়ন বিশেষজ্ঞের উচ্চপদে। যদিও মলয় তাঁর এই পরিবর্তিত জীবনশৈলী নিয়ে 'হাংরি কিংবদন্তি' গ্রন্হের শেষে মশকরাও করেছেন, "ছাই-এর জায়গায় আসে টুথপেস্ট, কয়লার উনুনের বদলে গ্যাস, সর্ষের তেলের বদলে সূর্যমুখী, শার্ট-প্যান্টের বদলে সাফারি, মাদুরের স্হানে বিছানা, ঢাবার বদলে রেস্তরাঁ, দিশির জায়গায় স্কচ, কলেজস্ট্রিট ও বইপাড়ার বদলে বাংলার গ্রামশহর।" কিন্তু তবু জীবনের এই অধ্যায়টিও যে কবি হিসেবে মলয়কে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে, তাতে সন্দেহ নেই।
    'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ বাঁধন-ছেঁড়া রাগ ছিল মলয়ের কবিতার পরিচিত চিহ্ণ। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে জীবনের বহু কিছু দেখে-শুনে মলয়ের কন্ঠস্বর তেতো, অম্লকষায়, আর তার সাথে এসে জুটেছে আয়রনির অধুনান্তিক পরিহাসও। তবু তা মলয়ের কবিতাকে সর্বজনগ্রাহ্যও করে তোলে বটে।'যা লাগবে বলবেন'-এর আরও একটি কবিতাকে নেওয়া যেতে পারে, যেমন 'দ্রোহ':
    এ-নৌকো ময়ূরপঙ্খী
    তীর্থযাত্রী
    ব্যাঁটরা থেকে যাবে হরিদ্বের
    এই গাধা যেদিকে দুচোখ যায় যায়
    যাযাবর
    ঘাট বা আঘাটা যেখানে যেমন বোঝে
    ঘুরতে চাই গর্দভের পিঠে
    মাথায় কাগুজে টুপি মুখে চুনকালি
    পেছনে ভিড়ের হল্লা ।
    ব্যাস! কবিতা এইটুকুই। অথচ বাঙালি সমাজের যে একটি বিশেষ প্রবণতা, কবিকে বেদিতে বসিয়ে রাখার, তাকে কত সার্থক ভাবে ভাঙঅ হয়েছে এখানে। পাটনার অন্ত্যজ মহল্লাগুলোতে হোলির দুতিন দিন আগে থেকে চোখে-পড়া একটি সুপরিচিত দৃশ্যকে ব্যবহার করেছেন মলয়, প্রশ্নাতীত দক্ষতাসহ। তার সাথে মিশিয়েছেন তীর্থযাত্রার জন্য বাঙালি হিন্দুর চিরাচরিত আতুরতাটিকে, যাতে পোস্টমডার্ন পরিহাস আরও তীব্র হয় । আর... হাংরি মামলার সময়ে তাঁকে যে-সামাজিক অবমাননা সইতে হয়েছে, তাও উঠে এসেছে। মাত্র কয়েকটি পঙক্তির মধ্যে কত প্রসঙ্গ যে এসেছে, অথচ বলার ভঙ্গিটি এত সহজ যে ভাবাই যায় না ।
    এই সংগ্রহের আরেকটি কবিতা 'যে পার্টি চাইছেন সে পার্টিই পাবেন'।
    বিশ্বাস এক দুর্ঘটনা
    বুকপকেটে শ্রেণী
    প্রতিরোধী থাকেন জেলে
    কাজু-ফলের ফেনি
    বরং ভালো
    ভুল অঙ্কের ডানা।
    ...মোড়ল দলের পাড়ার কেউ বা
    আওড়ায় বেঘোরে
    ছাদ ঢালায়ের সমরবাদ্য
    কর্তাবাবার জানা
    মেলাবেন তিনি অন্তরীক্ষে
    মোক্ষ একখানা ।
    কবিতার শেষ দুটি পঙক্তিতে অমিয় চক্রবর্তীর 'মেলাবেন তিনি মেলাবেন', এই শান্ত, স্হিত, প্রায় ব্রাহ্ম, উত্তর-রাবীন্দ্রিক বিশ্বাসের আদলটি একেবারে বিপরীত অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে পার্টি আমলাতন্ত্রের যে প্রবল দাপত, যার দরুণ তেলে-জলে মিশ খেয়ে একেবারেই একাকার, পুতুল নাচের সুতোর শেষ প্রান্তটি ব্যক্তিবিশেষের হাতে, সেটিতে যেমন-যেমন টান পড়ছে, কাঠের পুতুলগুলো তেমন-তেমনই নাচছে; এই গোটা পরিবেশটি উঠে এসেছে কয়েকটি মাত্র পঙক্তির মাধ্যমে। মলয় বুঝিয়েছেন, যা বোঝাতে গেলে অন্তত কয়েকশো পাতার বই দরকার। আর? বিরোধীপক্ষ বলতে কিছু নেই আর। যারা বিরোধ করছে, তারাও বস্তুত নিজের-নিজের ছাদই ঢালাই করছে। সেই ছাদ ঢালাই-এর বাজনাকে মানুষ মনে করছে সমরবাদ্য।
    এত সূক্ষ্ম যাঁর ভাষার পরিমিতিবোধ, তিনি কিন্তু 'চিৎকারসমগ্র' গ্রন্হে এসে আবার অন্যরকম হয়ে যান। দড়ি ঢিলে দেন একটু, যাতে তাঁর সংবাদবাহক ঘুরতে পারে জায়গা-বেজায়গায়। 'ভাঙনের ছায়াগাছ' কবিতাটির অংশ পড়া যেতে পারে এই প্রসঙ্গে:
    হাজত থেকে ছাড়ান-পাওয়া সেই প্রৌঢ় নদী
    নাচছে দুর্গাবোঙার ফরসা কোমর জড়িয়ে
    শহর-পুরুতের গামছা কাঁধে
    তাককা হুরে
    আরে হুরে তাককা হুরে
    বোঙা আদিবাসী দেবতা-অপদেবতার সর্বনাম। দুর্গা বাঙালির আবহমানের দুর্গতিনাশিনী। তারই কোমর জড়িয়ে নাচছে হাজত থেকে ছাড়ান-পাওয়া প্রৌঢ় নদী, কাঁধে শহর-পুরুষের গামছা। তাককা হুরে, আরে হুরে তাককা হুরে, শহুরে মাস্তানদের উল্লাসধ্বনি।
    ভাঙনের ছায়াগাছ। এই ভাঙনকে সর্বদা দেখতে পাওয়া যায় না, অথচ সে তার কাজ করে চলেছে। ভাঙন বস্তুত একটি সার্বিক প্রক্রিয়া। এর দরুন সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে মজাদার মিলমিশ। বুর্জোয়ার বক্তব্য আশ্রয় করে লুমপেনের ভাষাকে।লুমপেন অ্যাডপ্ট করে বুর্জোয়ার চালচলন। এর সংস্কৃতি ঢুকে পড়ে ওর উঠোনে। ওর 'রোনাধোনা'য় শোনা যায় এর অনুরণন।
    চিৎকার করতে-করতে পড়ছে জলপ্রপাত চুলে
    ঢাউসপেট পোয়াতি অফিস-বারান্দায় আইল হাতে
    থ্যাতলানো ট্যাক্সিচালক হাওড়া স্টেশানে
    যেখানে সাপের ফণা জমা রাখতে হয়
    শহর বিষদাঁত খুলে নেয় প্রত্যেকের। ছোবলানো তো চলবেই না, ফোঁস করাও নয়। অফিস বারান্দায় ফাইল হাতে গর্ভিনী। কী প্রসব করতে চলেছে সে ? তারই মধ্যে ঝরে যেতে থাকা কেশপাশের চিৎকার। আলুলায়িত কেশপাশ বাঙালির আবহমানের সৌন্দর্য-মিথের অংশ।
    মেঝেময় ছড়িয়ে-থাকা গোঙানির টুকরো তুলে
    তারা বদলায়নি তবু আদল পালটেছে
    হে নাইলন দড়ি বাড়িতে এখন কেউ নেই
    কিন্তু বাইরে হাজার দুর্গন্ধে ভাগ-করা শহর
    কবিতাটি পড়তে-পড়তে বহু পুরোনো টার্কিশ ফিলম 'কংকারার্স অফ দি গোলডেন সিটি'র কথা মনে পড়ে। নিষ্পাপ একটি গ্রাম্য পরিবার শহরে এসে সব কিছু ধিরে-ধিরে হারাল। তার মেয়েরা হয়ে গেল বেশ্যা, পুরুষেরা অপরাধি। হাজার দুর্গন্ধে ভাগ-করা শহর--- গোল্ডেন সিটি। সোনার শহর। নারকেল দড়ির বদলে নাইলন দড়ি, সভ্যতার অগ্রগতি। বাড়িতে কেউ নেই , শূন্যতা অপরিসীম।
    কবিতাটির শেষ স্তবকে এসে মলয় দুর্বার ছুট লাগান--- এমন ছুট যে কবিতা ব্যাপারটাই দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
    কচি বালক-পাছার নধরমাংস দেবদূত
    মাখনমাখা ব্রয়লার যার শেষ খদ্দের
    চলে গেছে তিন বছর তার ব্লাউজে সেফটিপিনগাঁথা হৃদয়
    স্লুইস দরজা খুলে আলোর নারীশরীর
    যে জীবন বুকের সামনে উঁচিয়ে অচেনা পিস্তল
    তখনই সিঁড়িতে সাদা ছড়ির আওয়াজ তুলে
    গামছায় মুখ ঢেকঢ গাঁও বালিকার কান্না
    কেঁপে উঠেছে শিশুর গায়ে হাত ঠেকলে
    ভাঙন যখন সব কিছুকেই ভাঙছে, তখন কবিতাকেও সে ভাঙবে। ভাঙতে-ভাঙতে কবিতাও মুক্ত হয়ে যাবে। তখনই বোধহয় বিদ্যুৎ ঝলকের মত এক অন্য কবিতার সৃষ্টিমুহূর্ত।'ভাঙনের ছায়াগাছ' কবিতায় আমরা সেই প্রক্রিয়াটি দেখতে পাচ্ছি, চাক্ষুষ।মলয় রায়চৌধুরী থেকে বোধ হয় এক নতুন কবিকুলের সৃষ্টি হল, যাঁরা কেবল কবি নন, আপোষহীন সামাজিক ভাষ্যকারও বটে।

     
  • শুভদীপ রায় চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৯:১৭735108
  • হাংরি আন্দোলন ও সাবর্ণ ভিলা : ইতিহাসের হাতছানি- শুভদীপ রায় চৌধুরী

    সাবর্ণ গোত্রীয় রায় লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার চৌধুরীর তৃতীয়পুত্র গোপাল রায়(২৩তম বংশধর) হুগলি জেলার বালিগ্রামের উত্তরাংশের জমিদারি দেখাশোনা করতেন সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। পরবর্তীকালে জগদীশ রায় চৌধুরীর তৃতীয়পুত্র রত্নেশ্বর রায় চৌধুরী(২৫তম বংশধর) এই উত্তরাংশের জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য তিনি গঙ্গানদীর পূর্বপারের গাঁদিগ্রাম থেকে চলে আসেন অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিক অথবা অষ্টাদশ শতকের শুরুতে তিনি বালিগ্রামের উত্তরাংশে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। অতীতে এই অঞ্চলের নাম “উত্তরপাড়া” দিয়েছিলেন রায় লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার চৌধুরী। তিনিও(রত্নেশ্বর রায়) এই উত্তরপাড়া নামটাই বহাল রাখলেন। রত্নেশ্বর রায় উত্তরপাড়ায় যে বসতবাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন তা “সাবর্ণ ভিলা” নামে পরিচিত।বর্তমানে সামান্যকিছু ধ্বংসস্তূপ লক্ষ্য করা যায়। উত্তরপাড়ার  সাবর্ণভিলাতে হাংরি আন্দোলন ( বাংলা শিল্প-সাহিত্যের এক বিচিত্র আন্দোলন) বিকশিত হয়েছিল যদিও আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল পাটনা।


    উল্লেখ্য রত্নেশ্বর রায়ের পৈতৃক নিবাস কুমারহট্ট হালিশহর হলেও তিনি জমিদারির কাজকর্ম দেখার জন্য বারাকপুরের নিকট গাঁতি বা গাঁদি নামক স্থানে বসবাস করতেন। সেই অঞ্চলের গোষ্ঠীপতিও ছিলেন এবং ধার্মিক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি যে স্থানে বসতিটি নির্মাণ করেছিলেন সেই স্থানটি আজও চৌধুরীপাড়া নামে পরিচিত-

     

    ‘ব্রাহ্মণের পাকাবাড়ি বাজে ঘড়ি দরজার উপর।
    দাসদাসী কত আসি সেবে নিরন্তর।।’


    বর্তমানে এই বিশাল অট্টালিকা ভেঙে বহুতল অট্টালিকা নির্মিত হয়েছে, অতীতের ‘সাবর্ণভিলা’ সম্প্রতি লুপ্ত হলেও ইতিহাসের সাক্ষী রয়েছে উত্তরপাড়ার বিভিন্ন স্থান। বলাবাহুল্য এই ‘ভিলা’ শব্দটি সংযোজিত হয়েছে ঔপনিবেশিক মেজাজের তাগিদে। এই ভিলার প্রবেশদ্বার কাঠের গেটের বাঁদিকে ছিল ‘সাবর্ণভিলা’ ফলকটি। গেটের ডানদিকে একটি বিরাট জামরুল গাছ। বাকী গাছপালা ছিল অট্টালিকার পিছনদিকে। সাবর্ণ ভিলার প্রবেশ করলেই চওড়া পথ তারপরই দ্বিতীয় প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বারের বাঁদিকে লেখা ছিল ‘যদুনাথ-মাতঙ্গিনী মন্দির’। সেই স্থান পেরিয়ে তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হয় শরিকানা তাগিদে।


    এই সাবর্ণ ভিলা’র সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনাবলী, যা আজও ইতিহাসের প্রাচীন কাহিনী মনে করায়। উত্তরপাড়ায় এই ভিলায় থাকতেন সাবর্ণ বংশীয় শ্রী সমীর রায় চৌধুরী এবং শ্রী মলয় রায় চৌধুরী(৩৩তম)। উভয়ই প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, সেই কারণে সমীর রায় চৌধুরীর বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়রা আসতেন সাবর্ণ ভিলায়। এই ভিলাতে একসময় ফনী গাঙ্গুলী থাকতেন ভাড়ায় সপরিবার নিয়ে, আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’এর “নীরা” চরিত্রের জন্ম এই উত্তরপাড়ার অট্টালিকাতেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম বই “একা এবং কয়েকজন” সমীর রায় চৌধুরী প্রকাশ করেছিলেন, তখন দাম ছিল দুটাকা। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও সাবর্ণ ভিলাতে আসছেন বিভিন্ন তরুণ প্রজন্মের কবি সাহিত্যিকরা, বসত সাহিত্য ও কাব্যের আসর। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, দীপক মজুমদাররাও আসতেন এই আড্ডায়। সমীর রায় চৌধুরী প্রায় ২৫টির মতন গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যেমন- ‘খুলজা সিমসিম’, ‘ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি’, ‘অধুনা কবিতা বিচার’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।



    এই উত্তরপাড়ার সাবর্ণদের অন্যতম বংশধর জন্মগ্রহণ করেছিলেন যোগীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ১৮৬১ সালে যিনি পরবর্তীকালে স্বামী যোগানন্দ শ্রীশ্রীসারদাজননীর প্রথম মন্ত্রশিষ্য ছিলেন এবং শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যোগীন মহারাজকে ঈশ্বরকোটি বলেও উল্লেখ করেছিলেন। বাংলা সাহিত্য জগতে উত্তরপাড়ার সমীর রায় চৌধুরী ও মলয় রায় চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের সৃষ্টি ও কর্মকুশলতা বাংলা তথা ভারতবর্ষ ভুলতে পারবে না। ১৯৬১সালে নভেম্বর মাসে পাটনা শহর থেকে প্রথম বুলেটিন প্রকাশিত হয়, সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায় চৌধুরী, মলয় রায় চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায়। কারণ মলয় রায় চৌধুরীর কৈশোর ও যৌবনকালের বেশিরভাগ সময়ে কেটেছে পাটনা আর চাঁইবাসায়, সেখানেই গড়ে উঠেছিল শিল্পী সাহিত্যিকদের আড্ডা। বলা যেতে পারে তরুণ শিল্পীদের সাহিত্যের জমাটি আসর বসেছিল। মলয় রায় চৌধুরী ১৯৫৯-৬০ সালে চিন্তায় ক্লিষ্ট হয়েছিলেন যে শিল্প-সাহিত্যকে বাঁচানোর জন্য একটা কিছু করা প্রয়োজন। তিনি তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছিলেন- ‘আমি কলকাতার আদি নিবাসী পরিবার সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশজ এবং সেজন্যে বহু ব্যাপার আমার নজরে যেভাবে খোলসা হয় তা অন্যান্য লেখকদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।’ তার প্রধানত কলকাতার বাইরে থেকে হাঙরি আন্দোলনের কর্মকাণ্ড চালিয়েছিলেন। হাঙরি আন্দোলন মলয় রায় চৌধুরীর মানবসন্তান তাকে লালন করেছিলেন সমীর রায় চৌধুরী।


    এই সময়ে মলয় রায় চৌধুরীর লক্ষ্য পড়ে কবি জিওফ্রে চসারের ছত্রটি ‘ইন দি সাওয়ার হাঙরি টাইম’-কাব্যছত্রটি। সেখান থেকেই “হাঙরি” শব্দটি গ্রহণ করেছিলেন মলয় বাবু। প্রথম বুলেটিনটি ইংরাজিতেই ছাপা হয়েছিল কারণ সেই সময় পাটনায় বাংলা ছাপার প্রেস পাওয়া যায় নি। বুলেটিন প্রকাশনার খরচ নেবে মলয় রায় চৌধুরী, সমস্ত কিছু সংগঠিত করার দায়িত্ব নেবেন সমীর রায় চৌধুরী, সম্পাদনা ও বিতরনের দায়িত্ব নেবেন দেবী রায় এবং নেতৃত্ব দেবেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ১৯৬১-১৯৬৫ এই পাঁচবছর প্রকাশিত হয় হাঙরি আন্দোলনেরন শতাধিক বুলেটিন। আন্দোলনের ব্যতিক্রমী ভাবনা মাথায় রেখেই বুলেটিনগুলির আকৃতি অন্যরকম হয়- হ্যান্ডবিল, ফালি কাগজ, কুষ্ঠি ঠিকুজি সদৃশ কাগজ ছিল বুলেটিনের আকৃতি। বুলেটিনে লেখালেখি ও ইস্তাহার প্রকাশিত হত। বলাবাহুল্য বুলেটিন ছাড়াও পোস্টার, মুখোশ ইত্যাদি নানান রকম কিছু ব্যবহার করেছিলেন। একপাতার বুলেটিনে তাঁরা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, জীবন, ছোটোগল্প, নাটক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে লেখা ছাড়াও কবিতা, গদ্য, অনুগল্প ও স্কেচও প্রকাশ করা হত। ১৯৬২-৬৩ সালে আন্দোলনে যোগদান করেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফাল্গুনী রায়, আলো মিত্র, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর রায়, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আশোক চট্টোপাধ্যায়, ভানু চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায়, তপন দাশ, যোগেশ পাণ্ডা, অরুণেশ ঘোষ, বিজন রায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, অলোক গোস্বামী, দেবজ্যোতি রায়, নির্মল হালদার, সুব্রত রায়, অরুণ বনিক, জীবতোষ দাশ, দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, প্রিতম মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।



    হাঙরি আন্দোলনের বুলেটিনগুলি হ্যান্ডবিলের মতন প্রকাশ করায় ঐতিহাসিক ক্ষতি হয়েছিল কারণ অধিকাংশ বুলেটিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি সংগ্রাহকরের পক্ষে। কলকাতার লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি সংগ্রহ করেছেন বেশ কয়েকটি এবং ঢাকা বাংলা একাডেমিও কয়েকটি সংগ্রহ করে রাখতে পেরেছিলেন। হাঙরি আন্দোলন তখন জোরদার হয়ে উঠেছিল। এর আগে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর নেতৃত্বে ইয়ং বেঙ্গল সাংস্কৃতিক আন্দোলন ঘটলেও এর আগে বাংলা সাহিত্যে ইশতিহার প্রকাশ করে এমন কোন আন্দোলন আগে হয়নি। ফলে হাঙরি আন্দোলন সমাজে ও প্রশাসনে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। দর্পন, জনতা, জলসা ইত্যাদি পত্রিকায় বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হতে লাগল। পরবর্তীকালে যুগান্তর, দি স্টেটসম্যান, দিল্লির ব্লিৎস পত্রিকাও প্রকাশ করতে লাগল এই সম্পর্কিত খবর।


    হাঙরি আন্দোলনের প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা হল- “পোপের সমাধি”-উৎপল কুমার বসু, “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার”- মলয় রায় চৌধুরী, “সীমান্ত প্রস্তাবঃ মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আবেদন”- শক্তি চট্টোপাধ্যায়, “হত্যাকাণ্ড”-ত্রিদিব মিত্র, “হনির জন্মদিন”- সমীর রায় চৌধুরী, “উন্মাদ শহর”-দেবী রায়, “ভৎর্সনার পাণ্ডুলিপি”- বিকাশ সরকার, “হাবিজাবি”-সুবিমল বসাক, “মানুষের সঙ্গে কোন বিরোধ নেই”-ফাল্গুনী রায় ইত্যাদি। কয়েকটি বিখ্যাত গদ্য হাঙরিলিস্ট হল- “স্মৃতির হুলিয়া ও প্রতুলের মা ওমলেট অবধি” সমীর রায় চৌধুরী, “কাঠের ফুল”- ফাল্গুনী রায়, “বমন রহস্য”- বাসুদেব দাশগুপ্ত, “বিজনের রক্তমাংস”-সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।


    প্রথম বুলেটিন’র নমুনা নীচে প্রদান করা হলঃ
    WEEKLY MANIFESTO OF THE HUNGRY GENERATION
    Editor: Debi Rai               Rai  Leader: Shakti Chatterjee
    Creator: Malay Roy Choudhury
    Poetry is no more a civilising manoeuvre, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocausi, a violent and somanambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual hunger.
    Poetry is an activity of the naaissisti spirit. Naturally, we have discarded the blankely-blank school of modern poetry, the darling of the press, where poetry does not resurrect itself in an orgasmic flow, but words come up bubbling in an artificial muddle. In the prosedrhyme of these born-old half-literates you must fail to find that scream of desperation of a thing wanting to be a man, the man wanting to be spirit……………….
    (Published by Hualhan Dhara, from 269 Netaji Subhas Road, Howrah,west Bengal, India)


    মলয় রায় চৌধুরীর হাঙরি আন্দোলন মুলত বিনা বাধায় এগিয়ে যেতে পারেনি। পদে পদে বাধা এবং প্রতিঘাত এসেছে। ১৯৬৩ সালের শেষদিকে সুবিমল বসাককে পর পর দুবার কলেজস্ট্রীটের কফি হাউসে হেনস্থা হতে হয়েছে এমন কি তাকে মারতেও উদ্যত হয়েছে। ১৯৬৪সালের সেপ্টেম্বরে হাঙরি আন্দোলনের কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার হলেন, ইউনিয়ান পিনাল কোডের ১২০বি, ২৯২ এবং ২৯৪ধায়ার। গ্রেপ্তার হলেন মলয় রায় চৌধুরী, সমীর রায় চৌধুরী, দেবী রায়, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর রায়, প্রদীপ চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, রমানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এদের মধ্যে প্রথম ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয় ও কলকাতার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হয়। মলয় রায় চৌধুরী এমনই রাজরোষে পড়েছিলেন যে তাকে হাত কড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। মকদ্দমার ফলে উৎপলকুমার বসু অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হন, প্রদীপ চৌধুরী রাসটিকেট হন বিশ্বভারতী থেকে, সমীর রায় চৌধুরী সরকারি চাকুরি থেকে সাসপেন্ড হন, সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে কলকাতার বাইরে বদলি করে দেওয়া হয়, রমানন্দ চট্টোপাধ্যায় ফেরার হয়ে যান। হাঙরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা হয় ১৯৬৪ সালে তা চলে ৩৫মাস অর্থাৎ ১৯৬৭ সাল অবধি। সাম্প্রতিক কালে হাঙরি বুলেটিনে প্রকাশিত হয় মলয় রায় চৌধুরীর “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতা এবং তখন ১২০ এবং ২৯৪ ধারা তলে নিলেও ২৯২ধারায় চার্জশীট দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে। লালবাজারের কনফারেন্সরুমে মলয় রায় চৌধুরী ও সমীর রায় চৌধুরীকে জেরা করেন বিভিন্ন দপ্তরের গোয়েন্দাবিভাগ। গ্রেপ্তারের সময় প্রত্যেকের বাড়ি লণ্ডভণ্ড করা হয়েছিল এবং বইপত্র, ডায়রি, টাইপরাইটার, ফাইল যেগুলি পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল সেই গুলি তার আর ফেরত দেন নি।



    বর্তমানে প্রায় চল্লিশ বছর পরে হাঙরি জেনরেশনের আন্দোলনকে নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। “হাঙরি জেনেরেশন রচনা সংকলন” নামে বহু বই প্রকাশিত হচ্ছ। সেই বইয়ে মূল হোতা তথা হাঙরি আন্দোলনের শ্রষ্ঠা শ্রী মলয় রায় চৌধুরীর লেখা বা নামের অস্তিত্ব নেই। সই শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, বিনয়, সমীর রায় চৌধুরীর নাম নেই। এ এক ইতিহাসের বিকৃত রূপ-পরিহাস। ব্যাবসা বাণিজ্য ব্যাপারটা একটা ভয়ংকর সাংস্কৃতিক সন্দর্ভ। কিন্তু সাহিত্য মলয় রায় চৌধুরীর নাম সাহিত্যের পাতা থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তিনি নিজ প্রতিভায় বাংলা সাহিত্যে ঠাঁই পেয়েছেন। মলয় রায় চৌধুরী ২০০৪সালে “সাহিত্য আকাদমি” পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি চির প্রতিবাদী একজন সাহিত্যিক। লেখক তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মানসিকতায় সহজই এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন। সর্বভারতীয় এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে তার বরাবরবর প্রতিষ্ঠান বিরোধী বলিষ্ঠ মানসিকতাই ফুটে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত ধ্যানধারণাকে তিনি যেভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন তাতে তার বলিষ্ঠ ভাবমূর্তিই ফুটে ওঠে। তিনি আমাদের কাছে চিরদিনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসাবেই বিরাজ করবেন। কারণ তিনি আর পাঁচজন সাহিত্যিকের মতন বাজারি সাহিত্যের বাজারি উপাদানের মধ্যে যদি নিজেকে বিকিয়ে দিতে পারতেন তাহলে হয়ত আজকে তিনি ও “বুদ্ধিজীবী চূড়ামণি” হতে পারতেন।


    উপাদান:
    ১. হাওয়া ৪৯, তেত্রিশতম সংকলন, বইমেলা ২০০৬(সম্পাদক-সমীর রায় চৌধুরী)
    ২. প্রতি সন্দর্ভের স্মৃতি- মলয় রায় চৌধুরী, উৎসব সংখ্যা ২০০৪
    ৩. বঙ্গীয় সাবর্ণ কথা কালীক্ষেত্র কলিকাতা- ভবানী রায় চৌধুরী, প্রথম প্রকাশ ২০০৬
    ৪. হাঙরি কিংবদন্তী- মলয় রায় চৌধুরী, ১৯৯৭
    ৫. হাংরি আন্দোলন ও দ্রোহপুরুষ-কথা- ডঃ বিষ্ণুচন্দ্র দে, ২০১৩
    ৬. Intrepid Hungry Generation, Edited by Allan De Loach, USA-1968
    ৭. হাঙরি সাক্ষাৎকারমালা, অজিত রায় সম্পাদিত, মহাদিগন্ত প্রকাশনী, ১৯৯৯
    ৮. হাঙরি প্রজন্ম- উইকিপিডিয়া

  • বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায় | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৯:২১735109
  • বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর পৌরুষ
    -----------------------------------------
    মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে হঠাৎ লিখছি কেন? এইজন্যে নয় যে আমার বই বেরোচ্ছে, আর বইএর ব্লার্বে তিনি যাচ্ছেতাই রকমের ভালো লিখে দিয়েছেন। সে তিনি অমনিও লিখতেন। (কাজ আদায় হয়েই গিয়েছে ) আমায় স্নেহ করেন, ভালোবাসেন একটু। আমি তাঁর বেশ-বয়সের অবন্তিকাদের মধ্যে একজন। ডিট্যাচড, পড়ুয়া, চোখে চশমা আঁটা, উচ্চাশী অবন্তিকা। তিনি আমার পিতৃপ্রতিম। জাগতিকে তাঁকে তেমনই ভালোবাসি। আর অন্য এক জায়গায় তাঁকে ভালোবাসি, যেমন ক’রে তাঁর অসাধারণ উপন্যাস “ডিটেকটিভ নোংরা পরীর কঙ্কাল প্রেমিকে”, অনেক আগে মরে যাওয়া কঙ্কালকে, এক বৃদ্ধের কংকালকে, তার জীবনের কনসেপ্টকে ভালোবেসে ফেলেছিল ইন্সপেক্টর রিমা খান। কেন? সেই গণিতবিদ, উৎশৃংক্ষল কংকালের পৌরুষের জন্য। আমি এই অদ্ভুত আখ্যানটি লিখছি কারণ, কবে এই কিংবদন্তীস্বরূপ বৃদ্ধ ফট ক’রে মরে যাবেন। এখনো দেখা করিনি। ফোন করিনি। যদি মরে যান, একা ফ্ল্যাটে ছটফট করবো শোকে। সেই ভয়ে, এখন কিছু দিয়ে রাখা। টিকে যেতেও পারেন অনেকদিন আরো। ভীষণ জীবনীশক্তি। জীবনকে ভালোবেসে চুষে খাবার ইচ্ছে।
    মলয় রচৌকে দাদা বলার দূরভিলাষ হয় নি কখনো আমার। এই গ্যালিভার কেন যে লিলিপুটের সংসারে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় সারা শরীরে তাদের মই বেয়ে উঠতে দেন, সেই নিয়ে আমার এক চাপা ক্ষোভ ছিল। ইনি ভীষন পণ্ডিত। বাকি বড় বড় কবিদের মতো দূর থেকে কিছু কিছু জ্ঞানের কথা লিখলেই লোকে আশেপাশে ঘুরতো বেশী বলে আমার বিশ্বাস। তাও আমাদের মতো নতুন শিঙওলাদের, এবং আমাদের চাইতেও আরো আরো খাজা জনগণকে উনি প্রশ্রয় দেন। এই মার্কেটিঙের স্টাইলটা আমার পছন্দ নয়। কিন্তু পুরুষালী কড়া মদের মতো তীব্র আত্মবিশ্বাসে উনি যে এটা ক’রে যান, প্রচণ্ড টেক-স্যাভি, সরাসরি, আড়ালহীন প্রচার, এটাও আমার আজকাল ভালই লাগে।
    তাঁর হাত দিয়ে যে কবিতা বেরিয়েছিল, (“প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ১৯৬৩ সালে ভারতীয় কবি মলয় রায়চৌধুরী রচিত ৯০ লাইনের একটি জলবিভাজক কবিতা। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে।প্রকাশের পর সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে কবিতাটি নিষিদ্ধ করা হয়। ভারতীয় আদালতে হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তিনটি ধারায় মামলা হয় এবং মলয় রায়চৌধুরীসহ অন্যান্য আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে মামলাটি নাকচ হয়ে যায়। মামলা চলাকালীন সময়ে আমেরিকা ও ইউরোপে মলয় রায়চৌধুরীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, এবং বিভিন্ন ভাষায় কবিতাটি অনুদিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত 'মর্ডান অ্যান্ড পোস্টমর্ডান পোয়েট্রি অফ দ্য মিলেনিয়াম" সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে একমাত্র কবিতা হিসেবে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।” (উইকিপিডিয়া থেকে)), সেই কবিতা কারোর হাত থেকে বেরোনো শক্ত। সারা পৃথিবীর কবিতাপ্রেমী তা জানে। আমি আর তা নিয়ে বলি কেন। ওরকম একটা কোনদিন নামাতে পারলে বুঝতাম, হুঁ, কিছু করা গেলো। হবে না। সে আধার নেই আমার। তাই বলে ওনার এখনকার অনেক কেমন-যেন কবিতাকে লাইক টাইক দিতে পারি না। প্রয়োজনও নেই। যার এত উপন্যাস আছে, তাকে কেবা কবিতায় যাচে?
    মলয় রচৌএর উপন্যাসগুলি ভীষণ ভীষণ আণ্ডাররেটেড। বাংলা সাহিত্যে ঠিক ওরকম উপন্যাস বেশি লেখা হয় নি। ভালোয় মন্দে শুধু না, অদ্ভুত অন্য ধারার জন্য। কেন লেখা হয় নি তার বড় কারণ আমার মতে এই যে, ওরকম টেস্টোস্টেরন সম্বলিত প্রেমিক পুরুষ খুব বেশী নেই মনে হয় বাংলা সাহিত্যজগতে।
    এই জগতের ক্যাচাল আমি তেমন জানি না। কিন্তু মলয় রচৌ, মাঝে মাঝেই কাজের মেয়ে না এলে স্ত্রীএর সঙ্গে মন দিয়ে রান্নাবান্না বাসনমাজা, কাপড় কাচা ইত্যাদি করে ফেলেন। করার তো কথাই। জানি না তিনি জীবনে কতটা বিশ্বাসী অবিশ্বাসী ছিলেন সামাজিক অর্থে। খালি জানি, ইনবক্সে যখন কোন প্রশ্নের উত্তরে বলেন “বলে ফ্যাল । আজকে কাজের বউ আসেনি । বুড়ো-বুড়িকে অনেক কাজ করতে হবে । লাঞ্চে খিচুড়ি । ডিনারে প্যাটিস।”, কি ভালো যে লাগে! এই বুড়ি, যাঁকে আমি খালি ছবিতে দেখেছি, একসময়ের দাপুটে হকি খেলোয়াড়, তাঁকে এই “অ-কংকাল প্রেমিক” ভীষণ দাপটে ভালোবেসে গেছেন, এমন একটা ছবি বেশ মনে মনে আঁকতে পারি, এঁকে ভালো লাগে।
    মলয় রচৌএর উপন্যাসের পুরুষদের মতো প্রেমিক আমি বাংলা উপন্যাসে কম দেখেছি। তাঁর “ডিটেকটিভ নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক” উপন্যাসে, এক গণিতবিদ, বহুগামী অবিবাহিত পুরুষ, হঠাৎ এক স্বল্পপরিচিত সহকর্মী মহিলার “চলুন পালাই” ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গিয়েছিলেন বিন্ধ্যপর্বতের অন্য দিকে, তামিল দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। নাগরিক সভ্যতার থেকে পালাতে চেয়েছিলেন এই উচ্চশিক্ষিতা তরুণী মায়া, আর মায়ার ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকে গেছিলেন সেই গণিতবিদ। এই উপন্যাসটি ছোট্ট, গোগ্রাসে গেলার মতো, নানান ভাবে রগরগে, আর নানান ভাবে ভীষণ ভীষণ সেরিব্রাল, মস্তিষ্কপ্রবণ। এই উপন্যাসে, জঙ্গুলে জীবনে ফিরতে চাওয়া মায়ার ঋতুস্রাবকালে, তাকে নিজ হাতে ধুইয়ে দিয়েছে তার প্রেমিক। অথচ দুজনে দুজনকে ডেকেছে “আপনির” দূরত্বের পবিত্রতায়, নিজেদের স্বত্ত্বাকে আলাদা বোঝাতে, “পবিত্রতার মতো অস্পষ্ট” শব্দকে ধূলিসাৎ করেও। এই উপন্যাসটির একটি রিভিউ আমি আগেও করেছি। বিশদে যাবো না। শুধু, এই প্রেমিকের প্রতি আমার গভীর মায়া যে বলে “চাল-পোড়া তো খাওয়া যাবে না , তাই মায়া চাল দাতাকে অনুরোধ করেছিল যে আমাদের একমুঠো ভাত দিলেই চলবে, কাঁচকলা পোড়া বা কাঁঠালবিচি পোড়া দিয়ে খেয়ে নেয়া যাবে, লঙ্কার টাকনা দিয়ে । প্রায় প্রতিদিনই ভাত পেতে লাগলুম , যদিও কলকাতায় যা খেতুম তার চেয়ে অনেক কমই, কিন্তু কম খেয়ে আর রাতে না খেয়ে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল কম খাবার । আমি চাইতুম মায়া বেশি খাক, মায়া চাইত আমি বেশি খাই । আমি একদিন বলেই ফেললুম, প্রকৃত ভালোবাসা কাকে বলে জানি না, কেবল যৌনতাই জেনে এসেছি এতকাল, আপনি ভালোবাসতে শেখালেন। জবাবে মায়া বলেছিল, অতীতকে আনবেন না প্লিজ, আপনি কী ছিলেন, কী করেছিলেন, সব ভুলে যান, সমস্তকিছু মুছে ফেলুন, আমি কি কোনো স্মৃতিচারণ করেছি?”। বা যে বলে “জীবনের বাঁকবদলগুলো, যতবার ঘটেছে বাঁকবদল, সব সব সব সব নারীকেন্দ্রিক ; নারীর ইচ্ছার, নির্দেশের, দেহের, আকর্ষণের, রহস্যের মোহে । স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভাল, সান্মানিক স্নাতকে খুব-ভাল , স্নাতকোত্তরে অত্যন্ত ভাল, তাদেরই কারণে , প্রভাবে, চাপে, আদরে । চাকরিতে যোগ নারীর জন্যে উন্নতি নারীর জন্যে, চাকরি ছাড়া নারীর জন্যে , ভাসমান জীবিকা নারীর জন্যে , অবসরে পৈতৃক বৈভবে পরগাছাবৃত্তি নারীর কারণে । কে জানে, হয়তো মৃত্যুও নারীর হাতেই হবে । জীবনে নারীদের আসা-যাওয়া, সেনসেক্স ওঠা-পড়ার মতন, না ঘটলে, আমার ব্যর্থতা, ব্যথা, পরাজয়, গ্লানি, অপরাধবোধ, এ-সবের জন্যে কাকেই বা দায়ি করতুম ! কাকেই বা দোষ দিতুম আমার অধঃপতনের জন্যে ? লোভি লম্পট মাগিবাজ প্রেমিক ফেরারি হয়ে ওঠার জন্যে ? হবার, নাকি হয়ে ওঠার ? আসলে আমি একটা কুকুর । আগের সিডিতে লিখেছি, তবু রিপিট করছি শেষনির খাতিরে । যে-মালকিনির হাতে পড়েছি , সে য-রকম চেয়েছে, যে-রকম গড়েছে , তা-ই হয়েছি । সেবার কুকুর, কাজের কুকুর, প্রজননের কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর, পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপি কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, কোলের কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর, সেই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু একমাত্র কুকুর যেটাকে আমি ভালবেসেছি, তা হল মালকিনিকে উন্মাদের মতন ভালবাসার কুকুর । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল , চিরকাল তেমনই থেকে গেছে।”।
    আমি নিশ্চিত যে, মলয় রচৌও এরকমই আকাশমুখো লেজের কুকুর। তিনি প্রবলভাবে, ভিতর থেকে, লিঙ্গসাম্যে বিশ্বাসী। “অরূপ, তোমার এঁটো কাঁটা” উপন্যাসে তিনি যে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মহিলা চরিত্র বানিয়েছেন, যে লোভে লালসায়, ভালোবাসায়, প্রতিশোধে, ভীষণ রকম জীবন্ত ও অসহায়, মেয়েদের সবটুকু নিয়ে সবটুকু দিয়ে ভালো না বাসতে পারলে, রূপের মধ্যে ওরকম অরূপ, আর তার এঁটো কাঁটাসহ মচ্ছগন্ধ ধরে রাখা যায় না। এখানেই মলয় রচৌএর পৌরুষ। যে রকম পৌরুষ “দেহি পদপল্লবম উদারম” এর মতো উদাত্ত হাঁক দিতে পারতো জয়দেবের কালে, পারে একালেও। তাঁর “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” আর “ছোটোলোকের যুববেলা” তেমনই অকপট, দাপুটে, উজ্জীবিত, ভিগরস। নিজেকে বিশ্রেণীকরণ করেছেন শুধু জোর করে নয়। তিনি সেরকম হয়েও উঠেছেন। তাঁর মেজদার জন্মরহস্য পড়ে এক একবার মনে হয়েছে, সবটা বলে দেওয়া কি তাঁর ঠিক কাজ হয়েছে পরিবারের প্রতি? আবার এক একবার মনে হয়েছে, বেশ করেছেন, ঠিক করেছেন। বিহারের প্রান্তিক মানুষের জীবন, তাঁর লেখায় দারুণ উঠে এসেছে। “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” উপন্যাস যেমন লিরিক্যাল কোথাও কোথাও, তেমনই, গভীর রাজনৈতিক চেতনায় প্রোথিত। তাঁর অনেক উপন্যাসই তাই। খুব কাটাকাটা, খুব ন্যাকামোহীন, নির্মোহ, নিজের প্রতিও, নিজের নায়কদের প্রতিও, অনেকটা নায়িকাদের প্রতিও। এরকম ধারাবিবরণী বাংলায় লেখা কম উপন্যাসেই আছে। খানিকটা সমরেশ বসুর “যুগযুগ জীয়ে”তে কাছাকাছি কিছু স্বাদ পাই। তাও, এই উপন্যাসগুলি লেখার ধরণে অনেক আলাদা। আর এই সবের পরেও রচৌকে জিগালে, তাঁর সব জীবনদর্শনের মধ্যে, সব ছাপিয়ে, হয়তো কৈশোরের ভুবনমোহিনী রাণা উঠে আসবে, প্রথম চুমুর টেণ্ডারনেস নিয়ে। কিশোর পুরুষে।
    এই লেখাটা আবেগতাড়িত। খাপছাড়া। কর্মক্লান্ত দিনের শেষে রাত দেড়টা থেকে তিনটের মধ্যে আজ লিখবোই, বলে লিখে ফেলা। পরে হয়তো সংশোধন করবো আরো। উপন্যাসগুলোর, প্রবন্ধগুলোর, কবিতাগুলোর, ইদানীং লেখা ওনার কিছু কেমন-যেন-ভাল-না কবিতাগুলোও আলোচনা করা যাবে আরো কিছু। তবে এই লেখা অনেকাংশে ব্যক্তিগত ভাবের লেখা। তাই এভাবেই অকপটে লিখছি। আমার গবেষণাপত্রটি যখন শেষও হয় নি, রচৌ আমাকে তখনই খুব উতসাহ দিতেন। আমাকে নিয়ে তাঁর যে অবন্তিকা, তা তখনই লেখা। পরে যখন গবেষণাপত্রটি বেরোলো, আমার ক্ষীণ অনুরোধ থাকা সত্ত্বেও, ফেসবুকে প্রায় সাতশোবার শেয়ার হওয়া এই লেখা, এবং আরো অনেকবার শেয়ার হওয়া লেখার নানান রেফারেন্স কিছুতেই টুইটারের মুখ দেখলো না বাঙ্গালি সমাজে। অথচ টুইটার কাউণ্টই জার্নাল মেট্রিক গ্রাহ্য করে। এই অশীতিপর বৃদ্ধ তখন, না বলতেই, বহুবার, চুপচাপ, এন্তার লোককে, সংস্থাকে ট্যাগ করে, টুইট করেছেন আমার গবেষণার লিংক, বহুদিন। ভালোবাসি কি সাধে?
    আমি যখন ভুলভাল কবিতা লিখতাম, একেবারে বাজে লিখতাম, একবার ওনাকে বলেছিলাম, “এই ছাপোষা জীবন! কোথাও যাই না। চাকরি, ছেলে, আর পড়াশুনো। কবিতায় প্রেমের, পৃথিবীর, মানুষের হাওয়া লাগবে কী করে?”। উনি দুকথায় বলেছিলেন “এটা কোন কাজের কথা না। লিখে যাও। হবে”। তারপর বলেছিলাম, “এখন চাকরি, গবেষণা (গবেষণা না ছাই)। সাহিত্য বাকি পরে পড়বো”। উনি বলেছিলেন, “এটা কোন কাজের কথা না। কমবয়সে না পড়লে রেসেপটিভিটি থাকে না, এখনই পড়তে হবে”। এই দুটো আপাতঃসাধারণ কথা, ওনার গম্ভীর পৌরুষের জোরেই, আমায় পালটে দিয়েছিল অনেকটা।
    এখন হাবিজাবি যা একটু লিখি, মনের দরজা খুলে গেছে তাই। মলয় রচৌরা বাংলাভাষাকে স্পর্ধা আর সাহস এনে দিয়েছিলেন। আমাকে, আমাদের এখনো সেই সাহস ভাঙ্গিয়েই খেতে হয়। আমাকে নিয়ে লেখা সেই কবিতাটা-
    বহতা অংশুমালী, তোর ওই মহেঞ্জোদারোর লিপি উদ্ধার
    কী গণিত কী গণিত মাথা ঝাঁঝা করে তোকে দেখে
    ঝুঁকে আছিস টেবিলের ওপরে আলফা গামা পাই ফাই
    কস থিটা জেড মাইনাস এক্স ইনটু আর কিছু নাই
    অনন্তে রয়েছে বটে ধূমকেতুর জলে তোর আলোময় মুখ
    প্রতিবিম্ব ঠিকরে এসে ঝরে যাচ্ছে রকেটের ফুলঝুরি জ্বেলে
    কী জ্যামিতি কী জ্যামিতি ওরে ওরে ইউক্লিডিনি কবি
    নিঃশ্বাসের ভাপ দিয়ে লিখছিস মঙ্গল থেকে অমঙ্গল
    মোটেই আলাদা নয় কী রে বাবা ত্রিকোণমিতির জটিলতা
    মারো গুলি প্রেম-ফেম, নাঃ, ফেমকে গুলি নয়, ওটার জন্যই
    ঘামের ফসফরাস ওড়াচ্ছিস ব্রহ্মাণ্ড নিখিলে গুণ ভাগ যোগ
    আর নিশ্ছিদ্র বিয়োগে প্রবলেম বলে কিছু নেই সবই সমাধান
    জাস্ট তুমি পিক-আপ করে নাও কোন প্রবলেমটাকে
    সবচেয়ে কঠিন আর সমস্যাতীত বলে মনে হয়, ব্যাস
    ঝুঁকে পড়ো খোলা চুল লিপ্সটিকহীন হাসি কপালেতে ভাঁজ
    গ্যাজেটের গর্ভ চিরে তুলে নিবি হরপ্পা-সিলের সেই বার্তাখানা
    হাজার বছর আগে তোর সে-পুরুষ প্রেমপত্র লিখে রেখে গেছে
    মহেঞ্জোদারোর লিপি দিয়ে ; এখন উদ্ধার তোকে করতে হবেই
    বহতা অংশুমালী, পড় পড়, পড়ে বল ঠিক কী লিখেছিলুম তোকে–
    অমরত্ব অমরত্ব ! বহতা অংশুমালী, বাদবাকি সবকিছু ভুলে গিয়ে
    আমার চিঠির বার্তা তাড়াতাড়ি উদ্ধার করে তুই আমাকে জানাস
    ------------------------------------------------------
    লেখায় বানান ভুল আছে নিশ্চই। কাল ঠিক করবো। কত কথা বাদ গেলো। পরে ঢোকাবো। কিন্তু অনেক সন্তানের বৃদ্ধ পিতাকে প্রস্টেটের ওষুধ খাওয়াতে খাওয়াতে সবচে’ ছোট মেয়েটা যেমন পৌরুষের বেঞ্চমার্ক তৈরি ক’রে মনের মধ্যে সেই বেঞ্চমার্কের উপরের রাজকুমার খোঁজে, তেমনই এই অশীতিপর পিতৃপ্রতিমকে দেখি। আর যেমন ক’রে রিমা খান কঙ্কাল প্রেমিককে ভালোবাসে, ভালোবাসি এঁকে। স্বধর্মে স্থিত, অতি প্রচারমুখী, ঝপঝপ কমেণ্ট ক’রে মুশকিলে ফেলে দেওয়া স্নেহার্দ্র, প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। আমাদের খুব কাছে আছেন বলে, বড় বেশি ছোঁওয়া লেগে গেলো। দূরে চলে গেলে, মানুষ বুঝবে, গেলো কেউ। আর আমরা কেউ কেউ, একা ফ্ল্যাটে হাপসে কাঁদবো।
     
     
     
  • উদয়ন ঘোষ | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৯:২৬735110
  • উদয়ন ঘোষ : মলয় রায়চৌধুরীর পোস্টকলোনিয়াল, পোস্টমডার্ন ছোটোগল্প
    যত দিন যাচ্ছে, মলয়ের লেখা যত পড়ছি, ততই মনে হচ্ছে, তাঁকে নিয়ে মহাভারত লেখা যায় । মহাভারত অবশ্য কথার কথা, আসলে মলয় সম্পর্কে বহুবিধ কথা লেখা যায় । সেজন্য নিজের সুবিধার্থে এবং টাইম অ্যাণ্ড স্পেস ভেবে, আমি স্হির করেছি, মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে মাত্র ওই কথা লিখি, অর্থাৎ মলয়ের পোস্টকলোনিয়ালিজম এবং তাঁর পোস্টমডার্নিজম ।
    আর যে যাই ভাবুক, আমি ভাবি, এদেশে পোস্টকলোনিয়াল না হলে পোস্টমডার্ন হওয়া যায় না ।
    আদিতেই বলে রাখা ভালো, ওই পোস্টকলোনিয়ালিজম ও পোস্টমডার্নিজম সম্পর্কে আমার ধারণাকে, আমি, কিছুকাল হল, নিজের কাছে অন্তত, স্বচ্ছ করে রাখতে পেরেছি । কেননা দুটোই ঐতিহাসিক ভাববস্তুগত নির্দিষ্ট এক অবজেকটিভ কোরিলেশানে আছে । এবং দুটোই এককভাবে কোনও দর্শন, অথবা আচরণ কিংবা ঢঙ অথবা প্রবণতা নয়, তদুপরি এককভাবে এই দুই কোনও সাংস্কৃতিক অথবা পরিকাঠামোগত স্ফূরণও নয় । এবং এই দুই ওই সবকিছুর যোগফলও নয় । অথভ ওই পোস্টকলোনিয়ালিজম ও পোস্টমডার্নিজমে ওই সব তথাকথিত কোনও নির্দিষ্ট দর্শন, আচরণ, ঢঙ, প্রবণতা, সাংস্কৃতিক/পারকাঠামোগত স্ফূরণ ইত্যাদি ইতস্তত থাকলেও থাকতে পারে । কিছু গবেষক, ক্রিটিক, উৎসাহী পাঠক, অথবা ওই দুই ইজমের ধ্বজাধারী সেবক, লেখক, কিংবা সদাসর্বদা যাঁরা যে-কোনও ইজমের হঠাৎ দার্শনিক বনে যান, অথবা তদনুরূপ সমাজবিজ্ঞানী ওই দুই ইজমে, ওপরে, যা যা লক্ষণের কথা আছে -- তার সবগুলি, অথবা একাধিক, কিংবা যে-কোনও একটি লক্ষণকে ওই দুই ইজমের ধ্রুবতারা মনে করতে পারেন ।
    আমি বরাবরই ওই সব ইজম, এবং তৎসংক্রান্ত নানাবিধ টাইটেল-সাবটাইটেল, লেবেলসর্বস্বতা ইত্যাদি থেকে তফাতে থাকার চেষ্টা করি । জীবিকায় শিক্ষক হবার জন্যে, এবং ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে আমাকে কিন্তু ওই সব পড়তে হয়েছে, এবং ক্লাসে ওই সব বলতেও হয়েছে, বিশেষত তথাকথিত নন্দনতত্বের ক্লাসে । আমাকে ক্ষমা করুন, পাঠক, ক্লাসে, প্রকাশ্যে ওই সব আমি মানিও বলতে হয়েছে, বা এই ঠিক যে রস নয় প্রকার, ছত্রিশ তার অনুষঙ্গ, যেভাবে ওই সব লেখা পোয়েটিইকস সম্পর্কিত গ্রন্হাদিতে, সেভাবেই বলতে হয়েছে । নিজের কথা বলার তো স্কোপ নেই, তাই ছাত্রদের কোনও দিনই বলা হয়নি যে, ওই সব জেনেও, সাহিত্যের চুলও ছোঁয়া যায় না ।
    এমতাবস্হায় আমাকে লিখতে হচ্ছে, ওই কথা অর্থাৎ মলয় রায়চৌধুরীর পোস্টকলোনিয়ালিজম এবং তাঁর পোস্টমডার্নিজম । পাঠক অবশ্যই ভাবতে পারেন, কী দরকার ছিল এইসব ঘটা করার । স্রেফ মলয় রায়চৌধুরী কী ও কে সহজ সরল ভাষায় সরলার্থ করলেই হত !
    হত না ।
    কেননা পাঠক হিসেবে পাঠকমনকে যতটা জানি, সাহিত্যের আলোচনায় যদি ওই সব ইজম, টাইটেল, লেবেল না-থাকে, তাহলে অ্যাকাডেমিক সাহিত্য বুঝতে বড় অসুবিধে হয় । যেই লেখা হল, মলয় হাংরি জেনারেশন অন্যতম ইশ্যু, অমনি পাঠকের যা বোঝার সহজে বোঝা হয়ে গেল । কেননা পাঠকের, যে-কোনো ভাবেই হোক, ওই সব টাইটেল চোখে পড়বেই এবং মূর্ত থেকে বিমূর্ত ধারণা থেকেই যাবে, বলা উচিত জন্মও নেয় ওই সব ইজম, টাইটেল একবার মগজে ঢোকাতে পারলে । এখন, কী করি, আপনিই বলুন পাঠক, যখন পাঠক হিসেবে আমাদের মাথায় ইতিমধ্যেই ঢুকে বসে আছে ওই সব, তখন ওই সব দিয়েই কাজ করে যেতে হবে । না-হয় বযোজোর আমি ইজম টাইটেলের ফ্রেম ভেঙে গড়ে দিলাম । এবং এভাবে পাঠকমন ও আমার ভেঙে দেয়ার মধ্যে সত্যবস্তুকে রক্ষা, দুই-ই সামলালাম । হ্যাঁ, পাঠক, দু-নৌকোয় পা দিয়েই কাজটা করতে হবে । মানুষের সে-অভ্যাস ভালোই আছে -- কেননা পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র তথাকথিত অনাবিল জানোয়ার হয়ে পরক্ষণেই আবার তথাকথিত আবিল মানবিক হতে পারে । এ-কাজকেই আবার মানুষই বলর দু-নৌকোয় পা দেয়া ।
    দুই
    যাই হোক, প্রথমে পোস্টকলোনিয়ালিজমের কথা হয়ে যাক । অর্থাৎ মলয় কোথায় পোস্টকলোনিয়াল । এ-ব্যাখ্যায় আমি মলয়ের নিজস্ব ‘ভূমিকা’ তথা ‘আত্মপক্ষ’ থেকে ওঁরই কথাগুলো হুবহু লিখে যাচ্ছি : “২৯ অক্টোবর ১৯৩৭ থেকে ২ নভেম্বর ১৯৩৯ এর মধ্যে কোনো ১১ই কার্তিক, পাটনার প্রিন্স অব ওয়েল্স মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে, পৃথিবীর দিকে পা করে জন্মাবার’’’”ইত্যাদি । অথচ ক্ষণেক পরেই ওই মলয় জানাচ্ছেন, “হাসপাতালের রেকর্ড খুঁজে দেখেছিলুম ২৯ অক্টোবর -- ২ নভেম্বর ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯ বৃহস্পতিবার শুক্রবার শনিবার কারুর, ছেলে হয়নি, হলেও মরা অবস্হায়।”--- ময় রায়চৌধুরীর ‘ভেন্নগল্প’-এর দ্বিতীয় ভূমিকার ‘প্রতিবন্ধী অস্তিত্ব’ থেকে হুবহু নেয়া ( পৃ ্ঞ-ট, মার্চ ১৯৮৪ ) ।
    এখন ব্যাখ্যা সরল যে, মলয় পোস্টকলোনিয়াল, কেননা মলয় কলোনিয়াল নন, কেননা মলয় কলোনিতে জন্মাননি, কেননা পৃথিবীর দিকে পা করে জন্মাবার সুযোগ পেয়েছিলেন, কেননা পরবর্তীতে ওই হাসপাতালের রেকর্ডে, যেখানে তিনি জন্মেছেন বলে লোকশ্রুতি, সেখানে কোনও পুত্রসন্তান ( ছেলে ) জন্মাবার তথ্য নেই । অর্থাৎ মলয় পোস্টকলোনিয়াল ইন দা ট্রুয়েস্ট সেন্স অব দা টার্ম । পোস্টকলোনিয়াল না হলে নিজের প্রতিবন্ধী কলোনিয়াল অস্তিত্বকে, এবং তার পরিকাঠামোর ফ্রেম এভাবে ভাঙতে পারতেন না । মলয় এখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক, এবং উত্তরঔপনিবেশিক । ঠিক, তদুপরি বলি, মলয়ই একমাত্র, যিনি ঘোষণা করেন, “মলয় রায়চৌধুরীর কোনো গ্রন্হের কারুর কোনো কপিরাইট নেই’...কোনোরকম স্বত্ব কারুর জন্য সংরক্ষিত নয় । তা পাঠকের।” মলয় এখানে তৃণমূল গণতান্ত্রিক, অতএব উত্তরঔপনিবেশিক । বলা বেশি হোক, তবু বলি, পাঠক, এখানেই তাঁর পোস্টকলোনিয়ালিজম বুঝুন । এই পোস্টকলোনিয়াল হবার জন্যই মলয় বড় সহজে পোস্টমডার্ন হতে পেরেছেন । অবশ্য মলয় স্বয়ং মনে করেন, সাম্রাজ্যবাদে পতনের সঙ্গে উপনিবেশেরও পতন হয় । তবুও মলয়ের জন্মকালে, বাল্যকালে, কৈশোরেও কিন্তি ওই সাম্রাজ্যবাদের ঐতিহাসিক পতন ঘটেনি ।
    তিন
    এবার পোস্টমডার্নিজম পপসঙ্গে যাই, কেবল এই কথা বলে নিয়ে, মলয় যে-উত্তরঔপনিবেশিক তথা অধুনান্তিক, এ তাঁর জন্মবৃত্তান্তেই আভাসিত, কেননা সেখানে সে যৌগিক সংস্কৃতির । জন্মলাভও করেন, আবার রেকর্ড রাখেন না ।
    পশ্চিমী সভ্যতার এক শূন্যতায় পোস্টমডার্নিজম যে কেবল নঞর্থক প্রতিক্রিয়া, তা নয়, একটা প্রতিবাদের জায়গাও বটে । ১৯৭০ ও ৮০র দশকের সিনিসিজম ও হতাশার সঙ্গে সামঞ্জস্য বলেই এর চিন্তাভাবনা ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করেছে । সাধারণ মানুষের অবিশ্বাস ও পরাজিত মনোভাবের ভূমিটি, পোস্টমডার্ন তত্ব, কবিতা, শিল্প অধিকার করার, সক্ষমতাতেই মনোযোগ আকর্ষণ করে । পোস্টমডানড চিনতায়, তার অন্যতম প্রধান প্রবক্তা জাক দেরিদার ভাবনায়, পাওয়ার বা ক্ষমতা সম্পর্কেই সন্দেহ ঘনীভূত, ক্ষমতার দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার দিকে অঙ্গুলিসংকেত । দেরিদা বলেন, ক্ষমতা সবকিছুকে জোর করে এক করতে চায়, পার্থক্য অস্বীকার করে, সময় ও সময় ছাড়িয়ে জীবনশিল্পের নানামাত্রিক ব্যাখ্যাকে চেপে ধরে এক করতে চায়, প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্হাতেও এর ব্যত্যয় হয় না । পাওয়ারকে তাই অবিশ্বাস করো । মানুষের তুচ্ছতা ও ক্ষমতাহীনতাকে পোস্টমডার্ন সামনে নিয়ে আসে । অত্যাচারিত যে অত্যাচারিত, তার কারণ সমগ্র ব্যবস্হাই অনিবার্যভাবে অত্যাচার পুনরুৎপাদিত করে । পোস্টমডার্নে এ সত্যই ধ্বনিত হয়, ক্ষমতাবান অত্যাচারিতের ভালো তো মোটেও নয়, বরং খারাপ । শুধু তাই নয়, দেরিদা ও পোস্টমডার্নেরা মনে করেন, সক্রিয়তার কোনও নির্বাচন নেই, যে কোনও সক্রিয়তাই ক্ষমতার সামগ্রিকতায় আক্রান্ত হয়, কার্যকর সক্রিয়তা তাই অনৈতিক । স্বাধীনতা যদি পেতেই হয়, তাহলে প্রয়োজন ‘ডিকন্সট্রাকশান’-এর বা বিনির্মাণের । এখানেই মানুষ পোস্টমডার্নকে সঙ্গী হিসাবে পায় : কারণ জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় সে দেখে স্বাধীনতার অনুপস্হিতি, দেখে যে-কোনও রাজনৈতিক ব্যবস্হাই হোক, ফলাফল একই : হতাশা ও স্বাধীনতাহীনতা । আমাদের “বাস্তবেও অন্য প্রক্রিয়ায় প্রায় এরকমই অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় । পোস্টমডার্নের এই সাধারণ মানুষের অসহায়তা বোধের উপর গুরুত্ব দেওয়া, এখানেও তাই প্রাসঙ্গিক মানুষের তুচ্ছ হয়ে যাওয়া, মানুষের হতাশা এ-বাস্তবেও অন্যভাবে ক্রমশ মানব অস্তিত্বকে খাচ্ছে ।”
    উদ্ধৃতিটি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের । তাঁর পোস্টমডার্নিজম তত্বের ব্যাখ্যায় ওইভাবে অগ্রসর হয়ে তিনিও জানাচ্ছেন, পোস্টকলোনিয়াল না হলে পোস্টমডার্নিজমে প্রবেশ করা যায় না অবশ্য তিনি এ কথাও বলতে ছাড়েন না, কলোনিয়াল তৃতীয় বিশ্বের যে-হতাশা প্রথম বিশ্বের দ্রুত গ্লোবালাইজেশান দেখে জন্মায়, সেখানে পরোক্ষে পোস্টমডার্ন হওয়া যায়, যদিও তা খানিক পুঁথিপড়া হবে, স্পন্টেনিয়াস হবে না । এবং এখানকার মানুষদের তুচ্ছ হয়ে যাওয়া প্রথম বিশ্বের মানুষদের দেখে, দ্রুত উল্লম্ফনের দ্বারা সব তুচ্ছতাকে কাটাবার মানসিকতায় বৈদেশিক ঋণ নিয়েও -- গ্রাম্য কলকাতায় মেট্রোরেল করা, যার শুরুতেও অদূরে গ্রাম্য আচরণ, তার শেষেও ওই আচরণ, শুরুর তুল্যই, নিকটবর্তী । অথবা হায়দ্রাবাদে প্রথম বিশ্বকেও চমকে দেবার জন্য প্রস্তুত ইন্টারনেটের মহিমা, যারও অদূরে তেলেঙ্গানার কাছাকাছি ব্রাহ্মণ্য দাপট সর্বকালের গ্রাম্যতাকে ছাড়িয়ে যায়, এখনও । অর্থাৎ আধুনিকতা এখানে আধিপত্যবাদী নয়, ভঙ্গুর । তাই পোস্টমডার্ন হওয়া যায় । কেননা গ্রাম্যতার আয়রনিকাল অস্তিত্বেই বস্তুত পোস্টমডার্নিজমের আবির্ভাব ।
    আমিও এসব মানি । বলা উচিত পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ওই ভাবনাকে অভিব্যক্ত করার জন্য আমি আমারই বাক্যসমূহকে কাজে লাগাই । এবং আজ একথা স্বীকার করা আমারই দায় যে এসবই আমি, বড় সম্প্রতি, মলয় রায়চৌধুরী থেকে সম্প্রসারিত হয়েছি ।
    চার
    সমীর রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘পোস্টমডার্নিজম : অধুনান্তিকতা’ গ্রন্হের প্রবন্ধ ‘পোস্টমডার্নিজম তত্ব : মলয় রায়চৌধুরী’ আমি একাধিকবার পড়লাম । সম্প্রতি খুব মন দিয়ে এমন নিবিড় পাঠ আর করিনি । কার্যত আমি প্রকৃতই বিস্মিত হচ্ছিলাম, এমন অনাবিল প্রক্রিয়ায় এদেশে বসবাস করে কীভাবে ওই প্রবন্ধ লেখা যায় । মাইল মাইল অসহনীয় জ্ঞান তো পযেই আছে কতকাল ধরে । কবেই আমি জানিবার জানিবার গাঢ় বেদনার ভার ঘাড় থেকে নামিয়ে, বেশ বহাল তবিয়তে আছি, ওই জ্ঞান আহরণের অসহনীয় বিদীর্ণ বিস্ময় থেকে মুক্ত হয়ে । স্হির করে নিয়েছিলাম, আর ওপথে যাব না । বড় জোর প্রিয় লেখকদের গদ্য-পদ্য পড়ে যাব, তাতে হবতো বা প্রাবন্ধিকতা থেকে যেতে পারে, অথবা ওই, জ্ঞান, যা আমার সুখের চুল অব্দি ছুঁতে পারে না । তবু ওই পর্যন্তই। আমি এখন শেকসপীয়ারের সবকিছু, বিশেষত সনেট, রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস-গান-ছবি, জীবনানন্দের ও বিনয় মজুমদারের সবকিছু পড়ে যাই । ভেবেছিলাম, এভাবেই কাটিয়ে দেব আরও কিছুকাল । তারপর কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘মহাভারত’ । দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর এপিসোডে বেদব্যাসের ম্যাজিক রিয়ালিটি । তারপর মৃত্যু অথবা মস্তিষ্কের স্তব্ধতা আসা স্বাভাবিক ।
    পাঁচ
    কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, আমি স্হির করে ফেলেছি, সঙ্গে মলয় রায়চৌধুরী পড়ে যাব । এবার হুবহু মলয়ের সেই কথাগুলো লিখে যাই :-
    “আধুনিকতার কালখণ্ডটির ছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ । সাম্রাজ্যবাদের উথ্থান ও পতনের সঙ্গে ঘটেছে আর্ট ফর্ম রূপে উপন্যাসের উথ্থান ও পতন । সাম্রাজ্যবাদের পতনের সঙ্গে ফুরিয়েছে আধুনিকতা ও আধুনিকতার অবসানের সঙ্গে সম্পূর্ণ ছিতরে গেছে উপন্যাসের ফর্ম । উপন্যাসের আদি কাঠামো ভেঙে পড়ার সঙ্গে কাহিনিকেন্দ্র থেকে অপসারণ ঘটেছে নায়কের । যারা যারা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, সাম্রাজ্যবাদ, আধুনিকতা, উপন্যাস বা নায়ক, সবাই আক্রান্ত হয়েছে অধুনান্তিক কালখণ্ডে । কেন্দ্র থাকলে থাকবে পরিধি বা প্রান্ত বা প্রত্যন্ত । সাম্রাজ্যবাদের প্রান্তিক যেমন উপনিবেশ । আগেকার উপন্যাসে অন্ত্যজ ছিল প্রান্তিক । শহর যদি ক্ষমতার কেন্দ্র হয়, গ্রাম তাহলে প্রান্তিক । আমি কেন্দ্রে থাকলে তুমি হবে প্রান্তিক । পুরুষ যদি কেন্দ্র হয়, নারী হবে প্রান্তিক । অধুনান্তিকতা চাগিয়ে ওঠে কেন্দ্রের বিনির্মাণ থেকে । আধিপত্যকে তা খর্ব কর সাহিত্যে, সংগীতে, শিল্পে, নৈতিকতায়, রাজনীতিতে, সমাজে, ভাবদর্শে । বাংলা সাহিত্যে গোরার জায়গায় এসেছে চোট্টি মুণ্ডা ।”
    “সাম্রাজ্যবাদ শেষ হবার পর উত্তরঔপনিবেশিকতা গড়ে তুলেছে নিজস্ব আগ্রহের এলাকাটি, যেটি অধুনান্তিকতার উদ্বেগজনক আগ্রহের এলাকাও বটে : প্রান্তিকতা, প্রত্যন্তবাসী, অন্ত্যজ, মফসসল, অনিশ্চয়তা, বহুচারিতা, লোকসংস্কৃতি, দোআঁশলাপনা, লালিকা, রঙের ছটা, এলোমেলো চিন্তা, যৌগিক সংস্কৃতি, অনির্ণেয়তা, আকস্মিকতা, বিশৃঙ্খলা, গৃহহীনতা, ভুতুড়ে পুঁজি, প্যাসটিশ, পণ্য, বহুত্ববাদ, ঠিকেদারি শ্রমিক চুক্তি, একযোগে অনেক কাজ, অপ্রাতিষ্ঠানিকতা, রূপের বৈচিত্র্য ও অজস্রতা, তৃণমূল গণতন্ত্র, পাড়ার নান্দনিকতা ইত্যাদি। উত্তরঔপনিবেশিকতা ও অধুনান্তিকতা মনে করে ইতিহাস একরৈখিক নয়, ইতিহাস অজস্র ও স্হানিক । সাম্রাজ্যবাদ, আধুনিকতার নামে যে ইশারা ও দ্যোতকগুলো নেটিভদের ওপর চাপিয়েছিল, সেগুলোকে অধুনান্তিকতার মাধ্যমে উপড়ে ফেলে দিতে চায় উত্তরঔপনিবেশিকতা । নেলো রিচার্ডস বলেছেন যে, ইউরোপ আমেরিকায় পোস্টমডার্নিজম সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা শুরু হবার আগেই অধুনান্তিকতার আসল প্রবণতাগুলো প্রাক্তন উপনিবেশগুলোয় চোখে পড়ে । কোনো উপনিবেশের ভাষাকে অপ্রভাবিত রাখেনি ইউরোপ । আধুনিকতার নামে চাপানো সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম বিষয়ে ধারণা সবই ইউরোপের । সাম্রাজ্যবাদের শিকারটির সমস্যা, অতএব, অধুনান্তিক । তার ভাষার ভিত্তি নষ্ট হয়ে গেছে । বিচার, বিবেচনার মাধ্যম নষ্ট হয়ে গেছে । অভিব্যক্তির কাঠামো নষ্ট হয়ে গেছে । অথচ সাহিত্য ও রাজনীতিতে, উত্তরঔপনিবেশিকতা আবর্তিত হয় ভাষাকে কেন্দ্র করে, কেননা, আত্মপরিচয় অন্য কোথাও পাওয়া যায় না । দেখা যাবে যে, শিল্পে ও সাহিত্যে একই ধরণের কাজ হচ্ছে উপনিবেশগুলোয় এবং পোস্ট-ইনডাসট্রিয়াল আমেরিকায় । এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকায় অধুনান্তিকতার প্রাসঙ্গিকতা এ থেকেই টের পাওয়া যায় । সাম্রাজ্যবাদের দরুণ উপনিবেশের নেটিভদের স্মৃতিবিপর্যয় ঘটে গেছে । পোস্টমডার্ন লেখালিখি ও ছবি আঁকায় যে প্রবণতাগুলো প্রখর তা তুলনীয় স্মৃতিবিপর্যয়ের সঙ্গে ।”
    “আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি পোস্টমডার্নিস্ট প্রবণতা দেখা যাচ্ছে । কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক তা নিয়ে চলছে বিরামহীন খেয়োখেয়ি । সত্য, জ্ঞান, বৈধতার নানান রকমফের । যেমন উলফা, জেকেএলএফ, খালিস্তান, শিবসেনা, আমরা বাঙালি, ঝাড়খণ্ড, গোর্খাল্যাণ্ড, বোড়ো্যাণ্ড, উত্তরাখণ্ড, ইত্যাদির মতন ছোট ছোট ছাতার স্হানিক কেন্দ্রিকতা-বিরোধী চেতনা । যেমন ভূমিসেনা, লাচিত সেনা, কুঁয়র সেনা । যেমন অজস্র নাটকের দল । যেমন আঞ্চলিক ভাষার কবিতা । যেমন টুকরো টুকরো মহাআখ্যানবাদী মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট দল । যেমন রাজনীতিতে ক্রিমিনালদের দৌরাত্ম্য । যেমন সুমন-নচিকেতা-মৌসুমীর সংগীতের ক্ষমতাকেন্দ্র-বিরোধী গান । যেমন হাজার হাজার লিটল ম্যাগাজিন । এবং ঘরে ঘরে ‘আদর্শের শেষ’ । যেমন টিনশেড কোচিং ক্লাস শিক্ষা কাঠামো । যেমন প্রতিটি বাঙালির আঙুলে এনলাইটেনমেন্ট-বিরোধী গ্রহরত্ন । যেমন লোকনাথ বাবা, সত্য সাইবাবা, অনুকুল ঠাকুর, বালক ব্রহ্মচারী, আনন্দময়ী, দাদাজী, রজনীশ, মহেশ যোগী ইত্যাদি ধর্মের ছোট ছোট ছাতা যযা হিন্দু শুদ্রকেও প্রতিষ্ঠা দেয় । কম্যুনিটির ভাঙন এবং অ্যসোসিয়েশান সমূহের জন্ম, যে উত্তরাধুনিক বৈশিষ্ট্যের কথা কিথ টেস্টার বলেছেন, এখানে তা ঘটেছে দেশভাগের দরুণ এবং মহাআখ্যানবাদী পার্টি রাজনীতির কারণে । কৌমসমাজ ভেঙে যাবার কারণেই পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র আজ ছুতোর গয়লা নাপিত ধোপা ধুনুরি মুচি, এরা অবাঙালি।”
    “গ্রামকেন্দ্রিক নৈরাজ্য গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যেই । আধুনিকতার অসুখ সারানো যাবে কিনা বলা মুশকিল । এই যে দাদা একটু সরুন, দাদু ভাড়াটা দিন, মাসি বেগুন কত করে, বলার সময়ে আমরা যে শুধু দাদা-দাদু-মাসির সম্পর্কচ্যুতি জানতে পারি তা নয়, আমরা টের পাই কৌমসমাজ ভেঙে যাবার খবর, আমরা টের পাই কীভাবে এই শব্দগুলোর ভেতর থেকে তাদের মানে বের করে ফেলে দিয়েছে সমাজ । পোস্টমডার্নিজমকে বাঙালির দোরগোড়ায় এনেছে বঙ্গসংস্কৃতির অধুনান্তিক পার্টি রাজনীতি এবং উত্তরঔপনিবেশিক আর্থিক দুর্গতি।”
    ছয়
    এবার মলয়ের কথাগুলি নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবা যায় । প্রথমেই বলা ভালো, আমি যে লিখেছিলাম, পোস্টকলোনিয়াল না হলে কেউ পোস্টমডার্ন হতে পারে না, সেখানে মলয়ের বক্তব্য ওই পোস্টকলোনিয়ালিজম এবং পোস্টমডার্নিজম আসলে একই বস্তুকেন্দ্রের দুটি অভিব্যক্তি, পরস্পর নির্ভর অথবা পারস্পরিক কিংবা যমঝ । অবশ্য মলয় আরও লজিকালি কথাটার বিস্তার ঘটিয়েছেন । তাঁর ধারণা, সাম্রাজ্যবাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মডার্ন যুগের অবসান ঘটেছে, আধুনিকতার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে উপনিবেশেরও অবসানের লক্ষণাদি মূর্ত হয়েছে।
    মলয়, বোধহয়, ধ্রুপদী সাম্রাজ্যবাদের অবসানের মধ্যেই সাম্রাজ্যবাদের চারিত্রিক অবসান দেখেছেন । আমি অবশ্য বরাবরই নিয়ো-ইমপিরিয়ালিজম টের পাই, এখনও পাই । নিয়ো-ইমপিরিয়ালিজমের অস্তিত্ব মেনে নিলেও, মলয়ের একটি কথা তবু সত্য হয়ে ওঠে । ধ্রপদী সাম্রাজ্যবাদের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুপদী উপনিবেশেরও অবসান ঘটেছে । এটা ঠিক । এবং মলয়কে সেলাম জানাই, আমার মধ্যকার এক নিগূঢ় জিজ্ঞাসা, যার উত্তর নানা সময়ে পেয়েও আবার জিজ্ঞাসায় আক্রান্ত হয়েছে আমার মন, অর্থাৎ আমার মস্তিষ্ক, সেখানে মলয়, সম্প্রতি, তাঁর রচনাদি পাঠকালে আমার শিক্ষক হয়েছেন । অর্থাৎ যথার্থ উত্তর দিয়েছেন, যার পর আর নাই ।
    একদা আমি তিন কমিউনিস্ট পার্টির কখনও সদস্য, ককনও দরদি মেম্বার হয়ে বার বার নানা মিটিং, কংগ্রেস, পার্টি ক্লাস করে যে-প্রশ্নে মন তথা মস্তিষ্ককে জেরবার করেছি, তা হল, আমাদের দেশের রাষ্ট্রচরিত্র বিশ্লেষণে ও বৈপ্লবিক স্তর নির্ণয়ে ওই নিয়ো-ইমপিরিয়ালিজম ও নিয়ো-কলোনিয়ালিজমের ভূমিকা খুঁজতে । বার বার ভুল হয়ে গেছে । সি পি আই ও সি পি এম বাহিত হয়ে যখন নয়া-সংশোধনবাদ-বিরোধী শিবিরে গিয়েছি, তখন যেন সঠিক বৈপ্লবিক পথের দিশা পেয়ে উৎসাহিত তথা আহ্লাদে আটখানা হয়ে প্রকৃতই গৃহে বাস করেও রণাঙ্গনের মাঠে যাবার উদ্যোগ নিচ্ছিলাম । সে-সময় সংশোধনবাদী সি পি আই ও নয়া-সংশোধনবাদী সি পি এম-এর মধ্যপন্হাকে ঘৃনায় বর্জন করে যখন প্রায় গৃহত্যাগে মনস্হির করচি, এমন সময়ে আমার লেখকসত্তা, যার ভিতরে কল্পনা ও যে-কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা চরাচরের নানা সম্পর্কে আসছিল, যে-সত্তা ইহলোক স্বপ্নলোকের বর্ডার মানেনি, সে সহসা দেখল, প্রকৃত রণাঙ্গন নেই । অর্পিত তথা অ-লৌকিক রণাঙ্গন আছে কেবল । তখন ওই ধারাবাহিক সত্তা, যা একান্ত আমার, আমার চিন্তা জ্ঞানলব্ধ, পুনর্বার নয়া-উপনিবেশ ও নয়া-ফিউডাল তত্বে মনোনিবেশ করল ।
    এই সময়ে তথাকথিত তৃতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অফিশিয়াল অথবা কংগ্রেসসিদ্ধ অস্তিত্ব আসেনি । তখন নানা গ্রুপ, নানা কর্মচিন্তা মাথা তুলছিল, তার মধ্যে মতাদর্শগত বিতর্কে এক ধরণের গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাও মাথাচাড়া দিচ্ছিল । সেই উত্তপ্ত দাবানলী সময়ে আমার সঙ্গে একটি গ্রুপের যোগাযোগ ঘটে, ইতিহাসে তাদের নাম নয়া-সংশোধনবাদবিরোধী সোশ্যালিস্ট রিভলিউশানারি, সংক্ষেপে এস আর গ্রুপ । তাদের সঙ্গে দিনের পর দিন তর্কে যে জায়গায় পৌঁছেছিলাম, তার সঙ্গে মলয়ের বিশ্লেষণের গুণগত সাদৃশ্য আছে । সেই জায়গাটি হল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ক্ল্যাসিকাল ইমপিরিয়ালিজম তথা মনোপলি ক্যাপিটালিজমেরও অন্তিম সময় উপস্হিত । অতএব উপনিবেশেরও অবসান । স্তালিন তো এই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইমপিরিয়ালিজমের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক দেশগুলির উৎসাহিত মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখেছিলেন । এশিয়ায় সেই মিক্তিযুদ্ধ দুই বিশাল দেশ ভারতবর্ষ ও চিনে ততদিনের মধ্যে সূচিত হয়ে গেছে । এই বাংলার তথাকথিত এস আর গ্রুপ বলতে শুরু করেছে তখন, পঞ্চাশের দশকের শেষে, তথাকথিত স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় বুর্জোয়ার উথ্থানে, এদেশে এক উল্লম্ফনে জাতীয় বুর্জোয়ারা নয়া-সাম্রাজ্যবাদী হয়ে গেছে, অন্তত তাদের সম্প্রসারণ তথা আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে ওই তথাকথিত স্বাধীনতা সংগ্রামে । সংগ্রামান্তে, জাতীয় বুর্জোয়ার অন্যতম নেতা, তথাকথিত গণতান্ত্রক জওহরলাল নেহেরু তাঁর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়ার’ পাতায় পাতায় অনুশীলন করছেন এক বৃহৎ ভারতবর্ষ, এক উপমহাদেশের ।
    ক্ল্যসিকাল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের দ্বারা অধিকৃত কাশ্মীর, অসম ইত্যাদি ভারতীয় মেইনস্ট্রিমের অন্তর্গত না হয়েও তথাকথিত স্বাধীন ভারতবর্ষের ম্যাপে একান্ত ভারতীয় হিসেবে চিহ্ণিত করেছেন ওই ডিসকভারার । জাতীয় বুর্জোয়ার ভ্রূণেই সম্্রসারণবাদী নয়া-সাম্রাজ্যবাদীর ম্যাচিওর হওয়া । অতএব ওই এস আর গ্রুপের মতে, ভারতবর্ষের রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতা এখন সম্পপসারণবাদী বুর্জোয়াদের হাতে । অর্থাৎ এই দেশের ঔপনিবেশিক মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার ভ্রূণে শৈল্পিক বুর্জোয়া তথা নয়া-পুঁজিবাদের ম্যাচুরিটি ঘটে গেছে । সুতরাং এখন এদেশের মূল দ্বন্দ্ব পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্হার সঙ্গে সর্বহারা শ্রমিকমনস্ক জনগণের দ্বন্দ্ব । অর্থাৎ বৈপ্লবিক স্তর হল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব । ওই সব তথাকথিত পিপলস ডেমোক্র্যাটিক রিভোলিউশান ফালতু কথা -- রণাঙ্গনে এখন পুঁজিবাদ বনাম সর্বহারা ।
    মলয়কে সেলাম, প্রকৃতই সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটে গেছে । আধুনিক যুগ তার অন্তিম কালে শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে মডার্ন থাকার । কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পোস্ট-ইনডাসট্রিয়াল যুগের সূচনা মূর্ত হতে চলেছে । এবং পোস্টইনডাসট্রিয়ালিজম আসলে ইনডাসট্রিয়াল তথা মডার্ন এজের অন্তিমে উপস্হিত হয় । এবং এটি একটি গ্লোবাল উদ্যোগ ।
    সুতরাং পোস্টমডার্নিজম তার নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে নানা ঢঙে সব দেশেরই দোরগোড়ায় কমবেশি উপস্হিত । সেলাম মলয় । আপনি ঠিকই দেখেছেন ।
    সাত
    সবকিছু ছেড়ে আমি কেবল মলয়ের ‘ভেন্নগল্প’ গ্রন্হটি দেখি, কেননা পোস্টকলোনিয়াল তথা পোস্টমডার্ন চরিত্র ওই ‘ভেন্নগল্পে’ বড় স্পষ্ট, ক্লিয়ার, সমুজ্জ্বল । ভূমিকায় মলয়ও বলেছেন : ‘দেখা যাবে, এই গ্রন্হটির পাঠবস্তুগুলো কেন্দ্রহীন ; বাস্তবতাকে বিনির্মাণ করে পাওয়া স্হিতিগুলো সমন্বয়হীন ; বিষয় অথবা আঙ্গিকে ঐক্য এবং সমাপ্তি নেই এবং কাঁচামালগুলো থেকে নির্মিত হচ্ছে না কোনোকিছু ; আমি কোনো অভিপ্রায় ছাপিয়ে দিচ্ছি না । বা গড়ে দিচ্ছি না শব্দব্যূহ ।...শরীর ও মন দুটো আলাদা আলাদা ব্যাপার, এরকম সরলীকরণের মধ্যে আমি কোনো রচনাকে টানিনি । লেখাগুলো বরং ভঙ্গুরতার স্বীকৃতি হিসেবে বর্ণনাকারীর, উত্তরঔপনিবেশিক মতদ্বন্দ্বের, জটিলতার, একরকম আলাপচারিতা ।’
    এখানে আমি ওই ভূমিকায় যুক্ত করতে চাই ওই ‘উত্তরঔপনিবেশিক’-এর সঙ্গে ‘উত্তরআধুনিক’ শব্দ, যে দুই শব্দ, পূর্বেই লিখেছি, যমজ ।
    ‘ভেন্নগল্প’-গ্রন্হের প্রথম প্রকাশ কলকাতা বইমেলা ১৯৯৬ । রচনাকাল ১৯৮৩ - ১৯৯৫ । আমি ওই রচনাকালের মাঝামাঝি রচিত, ১৯৯২ সালের ‘অলৌকিক দাম্পত্য’ গল্পটিকেই কেবল ধরে মলয়ের পোস্টকলোনিয়াল, মলয়ের পোস্টমডার্ন চরিত্র বোঝার চেষ্টা করব ।
    কেননা গল্পটি প্রতিনিধিস্হানীয় । আমার কাছে অসাধারণ । গল্পটির শুরু ও শেষ অনাদি ও অন্তহীন ।এবং আসলে গল্পটির মধ্যে কোনো স্টোরি এলিমেন্ট নেই । বলা উচিত এটি গল্প নয়, গদ্য ছাড়া আর কোনও অভিধা আমার জানা নেই । মলয়ের মতে Post-colonial episodes/Texts ; সবকিছুই বিনির্মাণের পর অভিব্যক্ত । শব্দগঠন বিনির্মিত । বাক্যবিন্যাস অব্দি বিনির্মিত । এই গদ্যের কোনো কেন্দ্র নেই, অতএব কোনো গ্রহ বা উপগ্রহ নেই ।
    আট
    তবে অন্যান্য গদ্য রচনাও আলোচনার মধ্যে আনলে ভালো হতো । সময় ও সুযোগের অভাব । পরন্তু আমার স্বভাবও এই যে, আমি নানা কিছুর মধ্যে আলোচনাকে বিন্যস্ত রাখতে পারি না । আমার পক্ষে সহজ একটি দুটির মধ্যেকার কথানুসন্ধান । যেমন ধরুন, কবিতা নাটক পুরো তফাতে রাখছি আপাতত । এমনকি বলা যায় উপন্যাসও, যদিও ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসটি মাথায় থেকেই যাচ্ছে, জানি না কেন ! শুধু এটুকু জানি, মলয়ের পোস্টকলোনিয়াল তথা পোস্টমডার্ন সিনট্যাক্স নিয়ে যে ভাবনা গড়ে উঠল এই কদিনে, তাতে ওই ‘নামগন্ধ’ উপন্যসের কিছু ভূমিকা আছে । মলয়ের মালমশলা ছড়িয়ে রেখেছি চতুর্দিকে, এবার কেবল বেছে নেবার পালা । তাতে ওই ঘটল, ওই ‘অলৌকিক দাম্পত্য’ ।এই ‘অলৌকিক দাম্পত্য’-এর অন্তর্গত নয়, অথচ সঠিক বাইরেও নয়, এমনকিছু আপাত অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু যথার্থই পপাসঙ্গিক কথা হয়ে থাক ।
    মডার্ন যুগের মার্কসীয় রাজনীতির এক চমৎকার পোস্টমডার্ন অভীপ্সা আছে । গদ্যটির নাম ‘ভেন্ন’, সেখানে সীতেশের তারিখবর্জিত ডায়েরির লেখাটা :-
    “আজকাল আমাদের দেশে শ্রেণিচেতনা বলতে সাধারণত পুঁজিপতি জোতদার ধনী ব্যক্তি প্রভৃতির বিরুদ্ধে জঙ্গী মনোভাবকে বোঝানো হয়ে থাকে । এটা শ্রেণী চাতনার একটা স্হুল দিক মাত্র । আসলে শ্রেণীচেতনা হল সমাজের বস্তুবাদী বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সমাজ বিকাশের পথ অনুধাবন করে ওই মুহূর্তের প্রগতিশীল কর্তব্য নিরুপণ করার ক্ষমতা । এক্ষেত্রে মার্কসবাদের চিরায়ত তত্ব ও সংক্ষিপ্ত মূল সূত্রগুলি খুব বেশি সহায়ক হবে না । বরং মার্কসবাদী পদ্ধতির সৃষ্টিশীল প্রয়োগের মাধ্যমেই যে কোনও দেশের পরিস্হিতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সম্ভব । এবং মার্কসবাদী সমাজ বিশ্লেষণের মূল কথা হল, ঐতিহাসিক বিকাশের পটভূমিতেই যেকোনো সমাজের বিশ্লেষণ করতে হবে ।”
    ‘ভেন্ন’ গল্পটি কিন্তু ১৯৮৩ সালে লেখা । অর্থাৎ ওই আশির দশকের গোড়ার থেকেই মলয়ের পোস্টমডার্নজম কাজ করছে ।
    এখানে ‘The Name Of The Rose’, যা একটি পোস্টমডার্ন উদ্যোগ, তার লেখক উমবের্তো একোর কিছু কথায় আসি…”it ( postmodernism ) demands, in order to be understood, not the negation of the already said, but its ironic rethinking.” মলয় লিখিত ওই ডায়েরি, পাঠক বুঝুন, not the negation of the already said, but its ironic rethinking.
    নয়
    এবার সত্য সত্যই ‘অলৌকিক দাম্পত্য’র চাবিকাঠি পেয়ে গেলাম । কেননা এই গদ্য, বস্তুত, দুর্ঘটনা, যা আকছার ঘটছে, তারই ironic rethinking । দুর্ঘটনা, এখানে বাস দুর্ঘটনা, মলয়ের সৃষ্টিশীল প্রয়োগে যে-দুর্ঘটনা অলৌকিক, তাই বলে অ-লৌকিক নয় । দাম্পত্যের যে কথা এখানে আছে, তাও ironic rethinking ।এখানে বলে রাখা ভালো, মডার্ন যুগেই দাম্পত্যের শেষ দেখা গেছে । লিভ টুগেদার মডার্ন সমাজ মেনে নিয়েছে । পোস্টমডার্ন সমাজ তারই ironic rethinking দেয় বলে ধারণা করি । এক্ষণে সরাসরি মলয়ের বাক্যে আসি :-
    “কুড়ি বছর আগে শহরের উদাসীন রেল স্টেশনের সামনে চকচকে দুপুরের রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলুম ফরসা যুবতীর কাটা তর্জনী, রক্তহীন, কাচের রঙের নীলচে নখপালিশ, সোনার অলস আঙটিতে গরম পদ্মরাগমণি ঠায় জেগে…”
    এবার, এই মলয়, কে বা কী, যিনি ওই অলৌকিক তর্জনী কুড়িয়ে পেলেন ? মলয় স্বয়ং বলেছেন, ওই পদ্মরাগমণি তো আসলে চুনি, এবং---
    “যে চুনিতে আজও গ্রীষ্মকালীন কেনিয়ার বহুচারী যুবক সিংহের থাবার থমথমে গন্ধ আমাকে দু’তিনশো বছর আগে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন আরা বালিয়া বা ছাপরা থেকে আমার কেঁদো পূর্বপুরুষরা পাকানো চামড়ার চাবুক খেতে আর অর্ধাহারে থাকার জন্যে কালোদের দ্বীপে জাহাজবন্দী কেনা গোলাম হয়ে চলে গিয়েছিলেন।”
    এখানে মলয় প্রকৃতই বিশ্ববাসী তথা আবহমানকালীন । এখানে সময় ও কালের বিনির্মাণ হচ্ছে । এটি একটি পোস্টমডার্ন উদ্যোগ । আবার দেখুন, দুর্ঘটনাগ্রস্ত মলয় ও তাঁর সহযাত্রীদের, ইতস্তত মৃত, অথবা জ্ঞানরহিত স্টেজের বিনির্মাণ । যেমন :-
    “যে-দুটো রূপসী শীতল হাত আমাকে পেছন থেকে নির্লজ্জ জড়িয়ে রয়েছে, নারীর আতর মাখা বাহু, সোনার কয়েকগাছা অমৃতসরী চুড়িসহ, আজকে, কুড়ি বছর পর, এই শীতের আধো অন্ধকার সকালে, সে-হাতের দক্ষিণ তর্জনীতে সেই হুবহু আঙটি পদ্মরাগমণি । চল্লিশোর্ধ অকৃতদারকে এভাবে আকুল আঁকড়ে থাকা রহস্যময়ী বাহু, এতো শক্ত করে ধরে থাকা, আমি পেছন ফিরে দেখার চেষ্টায় ঠাহর করতে পারলুম না ।”
    এবার পাঠক দেখুন, কুড়ি বছর আগে পাওয়া তর্জনী, এখন এই দুর্ঘটনার বিনির্মাণে রূপসীর অঙ্গীভূত । এবং তর্জনীতে । রহস্যময়ী বাহু ধীরে ধীরে অলৌকিক দাম্পত্যে নিয়ে যাচ্ছে । সে এক অসাধারণ বর্ণনা । এবং সে-বর্ণনাও মডার্ন ন্যারেটিভকে বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে পোস্টন্যারেটিভ ডিসকোর্সে নিয়ে যাচ্ছে । যেমন:-
    “---ভাগ্যিস আপনি মারা গেলেন, তাই আপনার সঙ্গে এই নিবিড় পরিচয়ের সুযোগ পেলুম।” আমি বললুম ওঁকে, শীতের নিরাপদ ফিকে সকালকে শুনিয়ে, যখন আশেপাশে সবাই মরে গেছে মনে হয়, শুধু আমি বেঁচে, আমদের অমোঘ খবর কেউ জানতে পারেনি।”
    “আপনার হৃদয় স্তব্ধ হয়ে গেছে । আপনি আমার কথা ভাবছেন না । কিন্তু তবু কেন ভালোবাসছেন আমায় ?”
    “........”, আমি ওঁর আলতো করে বলা কথাগুলো শুনতে পাই । নিঃশব্দ কল্লোল হয়তো এই, অভিব্যক্তিহীন কাকলি, স্খলিত কেকা ।
    “........”, উনি অজস্র কথা বলে যেতে থাকেন ।
    “.........”, চোখ বন্ধ করে শুনি ওঁর কথাগুলি । মাথা পেছনে করে ওঁর ঠাণ্ডা ঠোঁটে আমার গাল ঠেকাই ! আমার উত্তাপ ওঁকে মুগ্ধ করে ।
    আমিও বলে যেতে থাকি ।
    -----বেঁচে থাকতে আমাকে চেয়েও দেখতেন না হয়তো আপনি ।
    -----কতোদিন ভেবেছি আপনার কাটা আঙুল আর আঙটি আপনাকে খুঁজে ফেরত দিয়ে আসব ।
    -----এখন তো আপনি আমার ভাষাও বুঝতে পারছেন না । না ?
    -----বাসে, প্রতিটি মেয়েমেনুষকে বারবার দেখেছিলুম, কিন্তু কই, দেখিনিতো আপনাকে ।
    -----আমার সৌভাগ্য, এতো লোক থাকতে আমাকেই আপনি বেছে নিলেন, এক বিচারাধীন মধ্যবয়সীকে ।”
    পাঠক, দেখুন, এখানে, মডার্ন ডায়ালগের বিনির্মাণ, যা কিনা পোস্টমডার্নিজমের অন্যতম কোয়ালিটি । এ গদ্যে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমিও আছে ।
    পোস্টমডার্নিজম তো অতীতকে, অতীতের রূপকথাকেও আহরণ করে, কিন্তু আয়রনিকালো ওই কার্য সম্পন্ন হয় । দেখুন :-
    “ব্যঙ্গমি : ওকে ফিরে যেতে হবে ।
    ব্যঙ্গমা : কোথায় ?
    ব্যঙ্গমি : লাৎখোরদের পৃথিবীতে । বিপ্লবে । সংঘর্ষে । পরাজয়ে । সেখানে হাতিশালে হাতির গু থাকে, ঘোড়াশালে পড়ে থাকে লোহার নাল । ছাদের ওপর নৌকো, সিংহাসনে গাধা, নহবতখানায় কাক, মন্ত্রণাঘরে মাকড়সা, কোষাগারে গোবর, কামারশালে নেহাইয়ের ওপর ছাইভস্ম, পালঙ্কে আরশোলা, বাঁশের সাঁকো দিয়ে তৈরি রামধনু, গেরস্ত বাড়িতে ঘরে ঘরে ধেনো-টানা মাতালচি, খোরপোষের টাকায় প্রতিপালিত রাজনীতিক, মৃতদেহের বদলে মুখাগ্নি করার তোষক ।”
    পাঠক, লক্ষ করুন, আধুনিকতাকে লাথি মেরে অধুনান্তিকতার অন্যতম লাৎখোর মলয়কে কোথায় ফিরে যেতে বলা হচ্ছে । ওই সব বিনির্মিত শব্দসমূহে আপনি অর্থ খুঁজতে পারেন, কিন্তু তাতে যেন বিনির্মিত অর্থ হয় । কেননা পোস্টমডার্নরা, স্বাভাবিক কারণেই, মডার্ন ভাষাতত্বকে অতিক্রম করে যান ।
    দশ
    পাঠক, এই ‘অলৌকিক দাম্পত্য’ গদ্যে যে-যৌনতা আছে, তাও মডার্ন যৌনতারই বিনির্মিত যৌনতা, যা পোস্টমডার্ন । এ-বিষয়ে পোস্টমডার্ন William Simon যা বলেছেন, তা শুনুন, “For many people, the sexual part of their lives will take on new and somewhat disruptive salience -- disruptive in the sense that the metaphoric richness of the sexual may have to risk real life testa, tests that involve the effort to bring one’s fantasies into one’s reality. Such efforts have commonly led either to crises or to an impoverishment of both fantasy and reality.”
    ‘অলৌকিক দাম্পত্য’ এখানেই সত্য । এ-গদ্যে ফ্যান্টাসি-রিয়্যালিটি একবার বিন্যস্ত, তন্মুহূর্তেই ডিকনসট্রাকটেড । একবার ব্যথিত, তন্মুহূর্তেই নির্বেদ ।
    আর এখানেই পোস্টকলোনিয়াল-মলয় এবং পোস্টমডার্ন-মলয়, এই বাংলায়, অদ্যাপি, সার্থক ও তুলনারহিত । সেলাম মলয় ।
    [ এপ্রিল, ২০০১ ]
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৯:৩২735111
  • ব্লাইজি সঁদরা : ট্রান্স-সাইবেরিয়ান এক্সপ্রেস

                                           

    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী                                                           

                                               

    images

    তখন আমি বেশ তরুণ ছিলুম

    আমি সবে ষোলো বছরের হবো হয়তো কিন্তু ছেলেবেলার স্মৃতি মুছে গিয়েছিল

    যেখানে জন্মেছিলুম সেখান থেকে ৪৮,০০০ মাইল দূরে

    আমি ছিলুম মসকোতে, তিনঘণ্টির হাজার মিনার

    আর সাতটা রেলস্টেশান

    আর ওই হাজার আর তিন মিনার আর সাতটা রেলস্টেশান

    আমার জন্যে যথেষ্ট ছিল না

    কারণ আমি ছিলুম গরমমেজাজ আর পাগল তরুণ

    আমার হৃদয় ইফিসিয়াসের মন্দির কিংবা

    মসকোর রেড স্কোয়ারের মতন ছিল তপ্ত

    সূর্যাস্তের সময়ে

    আর আমার দুই চোখ ওই পুরোনো রাস্তা-ধরে চলার সময়ে জ্বলজ্বল করতো

    আর আমি আগেই এমন খারাপ কবি ছিলুম

    যে আমি জানতুম না তা কেমন করে নিজের সঙ্গে বয়ে নিয়ে যাই

     

    ক্রেমলিন ছিল যেন বিরাট তার্তার কেক

    সোনার আইসিঙে সাজানো

    তার ওপরে বড়ো মাপের ভাজা কাগজিবাদামের গির্জা

    আর ঘণ্টাগুলো মধু-সোনালী…

    একজন বুড়ো সন্ন্যাসী আমাকে নোভোগোর্দের কিংবদন্তি পড়ে শোনাচ্ছিল

    আমি ছিলুম পিপাসার্ত

    আর আমি কীলকাকার বর্ণমালা পড়ার চেষ্টা করছিলুম

    তারপর তক্ষুনি রেড স্কোয়ারে উড়তে লাগলো ঈশ্বরের তৃতীয় রূপ

    উড়ে গেল আমার হাতও, যেন অ্যালবাট্রস পাখির উড়ালের শব্দ

    আর, হ্যাঁ, শেষ দিনের ওইটুকুই আমার মনে আছে

    শেষ যাত্রার

    এবং সমুদ্রের ।

     

    তবু, আমি সত্যিই ছিলুম একজন বাজে কবি ।

    আমি জানতুম না কেমন করে তা সহ্য করতে হবে ।

    আমি ছিলুম ক্ষুধার্ত

    আর সেইসব দিনগুলো আর সেইসব নারীরা সেইসব কফির দোকানে

    আর সেইসব কাচের গেলাস

    আমি গলায় ঢেলে নিতে চাইছিলুম আর ভেঙে ফেলতে চাইছিলুম

    আর সেইসব জানালা আর সেইসব পথগুলো

    আর সেইসব বাড়িগুলো আর সেইসব জীবন

    আর সেইসব ঘোড়ারগাড়ির চাকা ভাঙা ফুটপাথ থেকে ধুলো ওড়াচ্ছে

    আমি তাদের আগুনের হলকায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছিলুম

    আর আমি তাদের হাড়গোড় গুঁড়িয়ে দিতে চাইছিলুম

    আর টেনে বের করে আনতে চাইছিলুম ওই জিভগুলো

    আমাকে ওদের অদ্ভুত পোশাকের ভেতরের যে ল্যাংটো পেল্লাই শরীর

    পাগল করে তুলছিল তাদের গলিয়ে ফেলতে চাইছিলুম…

    আর দেখতে পাচ্ছিলুম রুশ বিপ্লবের লাল যিশুখ্রিস্ট আসতে চলেছেন

    আর সূর্য একটা নোংরা ঘা

    লাল গরম কয়লার মতন ফাটছে

     

    তখন আমি বেশ তরুণ ছিলুম

    আমি সবে ষোলো বছরের হবো হয়তো কিন্তু ভুলে গিয়েছিলুম কোথায় জন্মেছি

    আমি ছিলুম মসকোতে আগুনের শিখাকে খেয়ে নিতে চাইছিলুম

    আর আমার চোখে ঝলমল করার মতন যথেষ্ট মিনার আর রেলস্টেশান ছিল না

    সাইবেরিয়ায় কামানের আওয়াজ — যুদ্ধ চলছিল

    ক্ষুধা শীত প্লেগ কলেরা

    আর আমুরের কাদাটে জল লক্ষ লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল

    প্রতিটি রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে দেখছিলুম শেষ ট্রেনের ছেড়ে যাওয়া

    ব্যাস ওইটুকুই : ওরা আর টিকিট বিক্রি করছিল না

    আর সেনারা বরং চাইছিল থেকে যেতে…..

    একজন বুড়ো সন্ন্যাসী আমাকে শোনাচ্ছিল নোভোগোর্দের কিংবদন্তি

     

    আমি, একজন খারাপ কবি যে কোথাও যেতে চায়নি, আমি কোথাও যেতে পারতুম না

    আর  ব্যবসাদার লোকটার নিশ্চয়ই যথেষ্ট টাকাকড়ি ছিল

    বিদেশে গিয়ে ধনরত্ন কামাবার ধান্দায় চলেছে ।

    ওদের ট্রেন প্রতি শুক্রবার সকালে ছাড়ে ।

    শুনে মনে হতো যে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে ।

    একজন লোক কৃষ্ণ অরণ্য থেকে নিজের সঙ্গে একশো বাক্স অ্যালার্ম ঘড়ি

    আর কোকিল ঘড়ি নিয়ে যাচ্ছিল

    আরেকজন টুপির বাক্স, স্টোভের পাইপ, আর নানাধরণের

    শেফিল্ড কোম্পানির কর্ক খোলার প্যাঁচ

    আরেকজন, ম্যালমো থেকে কফিনে ভরে নিয়ে যাচ্ছিল টিনের খাবার

    আর তেলে চোবানো সার্ডিনমাছ

    আর বহু মহিলা জড়ো হয়েছিলেন

    ভাড়া করার জন্য উলঙ্গ উরুর তরুণী

    যারা কফিনও সরবরাহ করতে পারে

    সবার কাছে অনুমতিপত্র ছিল

    মনে হচ্ছিল যেন অনেক মানুষ ওই দিকে মারা যাচ্ছে

    তরুণীরা যাত্রা করছিল তাদের জন্য বরাদ্দ কম দামের টিকিটে

    আর তাদের সকলেরই ছিল ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ।

     

    এবার, এক শুক্রবার সকালে আমার যাবার পালা এলো

    তখন ডিসেম্বর মাস

    আর আমিও যাত্রা করলুম, হারবিনযাত্রী এক ধনরত্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে

    এক্সপ্রেস ট্রেনটায় আমাদের ছিল দুটো কামরায় ভরা রওরঝিম থেকে আনা

    ৩৪ বাক্স ধনরত্ন

    জার্মানির বাজে মাল “মেড ইন জার্মানি”

    লোকটা আমাকে কয়েকটা নতুন পোশাক কিনে দিয়েছিল

    আর ট্রেনে চাপার সময়ে আমি একটা বোতাম হারিয়ে ফেলেছিলুম

    —আমার মনে আছে, আমার মনে আছে, আমি অনেক সময়ে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি–

    আমি ধনরত্নের ওপরে শুয়ে রইলুম আর ওনার দেয়া

    নিকেলকরা মাউথঅর্গান নিয়ে দারুন বোধ করছিলুম

    আমি বেশ খুশ ছিলুম আর অসতর্ক

     

    যেন চোর-পুলিশের ব্যাপার

    আমরা গোলকুন্ডার ঐশ্বর্য চুরি করে নিয়ে যাচ্ছি

    আর আমরা ট্রান্স-সাইবেরিয়ানে চেপে নিয়ে যাচ্ছি

    যাতে পৃথিবীর উল্টো দিকে লুকিয়ে রাখতে পারি

    জুল ভার্নের সার্কাসযাত্রী দলকে উরালের যে চোরেরা আক্রমণ করেছিল

    তাদের থামাতে পাহারা দিচ্ছিলুম

    খুনখুজ থেকে, চিনের বাক্স

    আর মহান লামার ক্রুদ্ধ বেঁটে মোঙ্গোলদের থেকে

    আলিবাবা চল্লিশ চোর থেকে

    আর পাহাড়ের ভয়ঙ্কর বুড়ো লোকটার অনুচরদের থেকে

    আর সবচেয়ে খারাপ, সবচেয়ে আধুনিক

    বিড়ালের মতন চোরদের থেকে

    আর আন্তর্জাতিক এক্সপ্রেসের বিশেষজ্ঞদের থেকে

    আর তবু, আর তবু

    আমি ছিলুম বাচ্চা ছেলের মতন দুঃখি

    ট্রেনের ছন্দ

    যাকে আমেরিকান মনোবিদরা বলেন “ রেলপথের স্নায়ু”

    বরফজমা রেললাইনের ওপরে দরোজা কন্ঠস্বর অ্যাক্সেলের ঘষটানি

    আমার ভবিষ্যতের সোনালী সূত্র

    আমার পিস্তল পিয়ানো পাশের কামরায় তাস খেলুড়েদের গালমন্দ

    জিন নামের তরুণীর দুর্দান্ত উপস্হিতি

    নীল চশমা-পরা লোকটার করিডরে পায়চারি আর আড়চোখে আমার দিকে তাকানো

    মহিলাদের পোশাকের আওয়াজ

    আর হুইসেলের

    আর চাকাগুলোর বিরতিহীন শব্দ আকাশের গায়ে দেগে দেয়া বুনো রাস্তায়

    জানালার কাচ তুষারে ঢাকা

    প্রকৃতিবিহীন !

    আর ওইদিকে সাইবেরিয়ার সমতলভূমিতে নেমে আসা আকাশ

    দীর্ঘ অনিচ্ছুক ছায়ারা উঠে যাচ্ছে আর নামছে

    আমি ঘুমিয়ে পড়েছি

    তার্তার পশমের চাদর ঢেকে

    ঠিক আমার জীবনের মতন

    আমার জীবনে  স্কচ শালের চেয়ে বেশি উষ্ণতা দিচ্ছে না

    আর সমস্ত ইউরোপ বাতাস-চেরা এক্সপ্রেস ট্রেনের তীব্র গতি দিয়ে দেখা

    আমার জীবনের চেয়ে অর্থবহ নয়

    আমার দুঃখের জীবন

    এই শাল

    সোনায় ভরা সিন্দুকের ওপরে ছত্রাখান

    আমি  গড়াই

    স্বপ্নে

    এবং ধোঁয়ায়

    আর বিশ্বজগতে একমাত্র আলো

    একটি ফালতু চিন্তা…

     

    আমার হৃদয়তল থেকে কান্না উঠে আসে

    যদি ভাবি, হে প্রেম, আমার দয়িতার সম্পর্কে ;

    মেয়েটি বেশ নষ্ট, যাকে খুঁজে পেয়েছিলুম, ফ্যাকাশে

    এবং বিশুদ্ধ, এক বেশ্যালয়ের পেছন দিকে ।

     

    মেয়েটি ফর্সাত্বকের শিশু বেশ হাসে,

    দুঃখি, হাসে না, কখনও কাঁদে না ;

    কিন্তু কবির কুসুম, শ্বেতপদ্ম, কাঁপতে থাকে

    যখন তোমাকে ওর চোখের গভীরতায় তা দেখতে দেয় ।

     

    মেয়েটি বেশ মিষ্টি, তুমি শুনতে পাও এমনকিছু বলে না.

    দীর্ঘক্ষণের শিহরণ তুলে যখন তুমি কাছে টেনে নাও,

    কিন্তু যখন আমি ওর কাছে আসি, এখান থেকে, সেখান থেকে,

    এক পা এগিয়ে আসে আর চোখ বন্ধ করে — আরেক পা এগিয়ে আসে ।

     

    তার কারণ ও আমার প্রেম আর অন্য নারীরা

    সোনার চাদরে মোড়া বিশালদেহ আগুন

    আমার দুঃখি বন্ধু এতো একা

    ও সম্পূর্ণ নগ্ন, শরীর নেই — ও বড়োই দুঃখি ।

     

    মেয়েটি এক নিষ্পাপ ফুল, রোগা আর অপলকা,

    কবির কুসুম, করুণা-জাগানো শ্বেতপদ্ম,

    এতো শীতল, এতো একা, আর এখন এতো শুকিয়ে গেছে

    ওর হৃদয়ের কথা ভাবলে আমার কান্না পায় ।

     

    আর এই রাত আরও শত সহস্র রাতের মতন যখন রাতের ভেতর দিয়ে

    একটা ট্রেন গলে বেরিয়ে যেতে থাকে

    –ধুমকেতুর পতন হয় —

    আর একজন পুরুষ ও একজন নারী, যতোই কমবয়সী হোক, প্রেম করার আনন্দ নেয়।

     

    আকাশ যেন ভাঙা সার্কাসের ছেঁড়া তাঁবু

    ফ্ল্যাণ্ডার্সের মেছোদের ছোটো গ্রামে

    সূর্য যেন ধোঁয়াটে লন্ঠন

    আর ওপরে দোলনায় এক নারী দ্বিতীয়ার চাঁদ

    ক্ল্যারিনেট ভেরী তীক্ষ্ণ বাঁশি তালদেয়া ঢোলোক

    আর এখানে রয়েছে আমার দোলনা

    আমার দোলনা

    ওটা সবসময় পিয়ানোর কাছে থাকতো যখন আমার মা, মাদাম বোভারির মতন

    বিটোফেনের সোনাটা বাজাতেন

    আমি শৈশব কাটিয়েছি ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগানে

    স্কুল-পালিয়ে, ট্রেনগুলোকে অনুসরণ করে

    যখন ওরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে যেতো

    এখন আমি ট্রেনগুলোকে বাধ্য করেছি আমায় অনুসরণ করতে

    বাসেল-টিমবুকটু

    আতেউইল আর লঙচ্যাম্পসের মাঠের মতন ঘোড়াদের ছুটিয়েছি

    প্যারিস-নিউইয়র্ক

    এখন ট্রেনগুলো আমার পাশাপাশি ছোটে

    মাদ্রিদ-স্টকহোম

    সব হারিয়েছি ঘোড়দৌড়ের যৌথ আনন্দের খেলায়

    বেঁচেছে কেবল প্যাটাগোনিয়া, প্যাটাগোনিয়া, যার সঙ্গে আমার গভীর দুঃখের মিল

    প্যাটাগোনিয়া আর দক্ষিণ সমুদ্রে যাত্রা

    আমি রাস্তায়

    আমি চিরকাল রাস্তায় কাটিয়েছি

    আমি ফ্রান্সের ছোট্ট জিনের সঙ্গে পথে-পথে

    ট্রেন ডিগবাজি খেয়ে চার পায়ে দাঁড়ায়

    ট্রেন নিজের চাকায় ভর দিয়ে থামে

    ট্রেন চিরকাল নিজের চাকায় ভর দিয়ে থামে

     

    “ব্লাইজি, বলো, আমরা কি মমার্ত থেকে অনেক দূরে ?”

     

    অনেক দূরে, জিন, তুমি সাত দিন যাবত গড়িয়ে চলেছ

    তুমি মমার্ত থেকে অনেক দূরে, সেই পাহাড়তলি থেকে

    যেখানে তুমি বড়ো হয়েছ, সাকরে-কোয়ের যেখান ছিলে নিরালায়

    প্যারিস তার বিশাল ঝলকানিসুদ্ধ মুছে গেছে

    উড়ন্ত স্ফূলিঙ্গ ছাড়া সবকিছু মিইয়ে গেছে

    বৃষ্টি পড়ছে

    জলজঞ্জাল ফুলে ওঠে

    সাইবেরিয়া বাঁক নেয়

    তুষারের পরতের পর পরত জমতে থাকে

    আর নীল আলোয় উন্মাদনার পাগলাঘণ্টি বাজে শেষ আকাঙ্খার মতন

    ভারি দিগন্তের হৃদয়ে ট্রেনটা স্পন্দিত হতে থাকে

    আর তোমার এককীত্ব তোমায় কচুকাটা করে…

     

    “বলো, ব্লাইজি, আমরা কি সত্যিই মমার্ত থেকে অনেক দূরে ?”

     

    অশান্তি

    অশান্তির কথা ভুলে যাও

    পথের ভাঙাচোরা আর হেলেপড়া রেলস্টেশনগুলোকে

    যে টেলিগ্রাফ তার থেকে তারা ঝুলছে

    তাদের গলা টিপে ধরার জন্য হাত বাড়ানো গোমড়া স্তম্ভ

    পৃথিবীটা উন্মাদ মর্ষকামীর হাত দিয়ে বাজানো

    অ্যাকর্ডিয়ানের মতন বেড়ে দীর্ঘ হয় আবার কুঁচকে ছোট হয়ে যায়

    আকাশের চিড়ফাটল দিয়ে বুনো ইঞ্জিনগুলো উড়তে থাকে

    আর গর্তগুলোয়

    পাগলকরা চাকা কন্ঠস্বরের হাঁ-মুখ

    আর দুরবস্হার কুকুরেরা আমাদের চাকায় ঘেউঘেউ করে

    রাক্ষসদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে

    লোহায় নখ ঘষে

    সবকিছু আওয়াজ তোলে

    চাকার ঘ্যাঙঘ্যাঙে শব্দ থেকে

    সামান্য অন্যথা

    ঝাঁপায়

    নড়েচড়ে

    আমরা এক বোবা মানুষের খুলির ভেতরের ঝড়….

     

    “বলো, ব্লাইজি, আমরা কি সত্যিই মমার্ত থেকে অনেক দূরে ?”

     

    হ্যাঁ, আমরা তাইই, আমাকে বিরক্ত কোরো না, তুমি জানো, আমরা অনেক দূরে

    ইঞ্জিনের ভেতরে অতিউত্তপ্ত পাগলামি গোমরায়

    প্লেগ আর কলেরা আমাদের চারিধারে জ্বলন্ত স্ফূলিঙ্গের মতন ওড়ে

    আমরা যুদ্ধের সুরঙ্গে সরাসরি ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেছি

    ক্ষুধা, সেই বেশ্যাটা, আকাশে ছড়ানো মেঘ আঁকড়ে ধরে

    আর যুদ্ধের মাঠ ভরে যায় পচা লাশের দুর্গন্ধে

    তা যা চায় তাই করুক, তুমি তোমার কাজ করে যাও….

     

    “বলো, ব্লাইজি, আমরা কি সত্যিই মমার্ত থেকে অনেক দূরে ?”

     

    হ্যাঁ, আমরা দূরে, আমরা দূরে

    দুষ্কর্মের ভারবাহীরা ফুলেফেঁপে মরুভূমিতে নেতিয়ে পড়েছে

    এই খোসপাঁচড়ায় সেনার গরুর গলার ঘণ্টাধ্বনি শোনো

    টোমস্ক চেলিয়াবিনস্ক কানস্ক ওব টায়শেট ভের্কনে-উদিনস্ক কুরগান সামারা

    পেনজা-টুলুন

    মাঞ্চুরিয়ায় মৃত্যু

    সেখানেই আমরা নামবো আমাদের শেষ গন্তব্য

    এই যাত্রাটা ভয়াবহ

    কালকে সকালে

    ইভান উলিচের চুল পেকে গেল

    আর কোলিয়া নিকোলাই ইভানোভিচ দুই সপ্তাহ যাবত নিজের নখ খাচ্ছে…

    মৃত্যু আর দুর্ভিক্ষ যা করে তাই করো, তোমার কাজ করে যাও

    একশো ফরাসি টাকা লেগেছে — ট্রান্স-সাইবেরিয়ানে তা একশো রুবল

    বসার জায়গাকে তপ্ত করো আর টেবিলের তলায় লজ্জা ঢাকো

    শয়তানের কবজায় রয়েছে লেখবার চাবিকাঠি

    ওর গাঁটসুদ্ধ আঙুল নারীদের আপ্লুত করে

    সহজপ্রবৃত্তি

    ঠিক আছে মহিলাগণ

    তোমরা নিজেদের কাজ চালিয়ে যাও

    যতক্ষণ না আমরা হারবিনে পৌঁছোচ্ছি…..

     

    “বলো, ব্লাইজি, আমরা কি মমার্ত থেকে সত্যিই অনেক দূরে?”

     

    না, ওহে…আমাকে বিরক্ত কোরোনা….একা থাকতে দাও

    তোমার পোঁদ ঢাউস হয়ে গেছে

    তোমার পেট টকেছে আর রয়েছে তোমার প্রশংসা

    একমাত্র জিনিস যা প্যারিস তোমাকে দিয়েছে

    আর রয়েছে এক কচি আত্মা…কারণ তুমি অসুখি

    তোমার জন্য আমার কষ্ট হয় এসো আমার হৃদয়ে

    চাকাগুলো ককেন দেশের উইণ্ডমিলের মতন

    আর উইণ্ডমিলগুলো সেই ভিখারির যে নিজের লাঠি মাথার ওপরে ঘোরাচ্ছে

    আমরা শূন্যের নুলো

    আমরা আমাদের চার আঘাতের ওপর ভর দিয়ে চলাফেরা করি

    আমাদের ডানা ছেঁটে ফেলা হয়েছে

    আমাদের সাতটি পাপের ডানা

    আর ট্রেনগুলো হলো শয়তানের খেলনা

    মুর্গির খাঁচা

    এই আধুনিক জগতসংসার

    গতি কোনো কাজে লাগে না

    এই আধুনিক জগতসংসার

    ব্যবধানগুলো অনেক দূরে-দূরে

    আর যাত্রার শেষে একজন নারীর সঙ্গে একজন পুরুষের বসবাস ভয়াবহ…

     

    “ব্লাইজি, বলো, আমরা কি মমার্ত থেকে সত্যিই অনেক দূরে ?”

     

    তোমার জন্য কষ্ট হয় এখানে এসো একটা গল্প শোনাবো

    আমার বিছানায় এসো

    আমার কাঁধে তোমার মাথা রাখো

    আমি তোমাকে একটা গল্প শোনাবো…

     

    আরে এসো দিকিনি !

     

    ফিজিতে সব সময়েই বসন্তকাল

    তুমি সঙ্গম করে বেড়াও

    উঁচু ঘাসে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মাতন লাগে আর তপ্ত সিফিলিস

    কলাগাছের বাগানে বইতে থাকে

    এসো প্রশান্তসাগরের দ্বীপগুলোয়

    ফিনিক্স, মারকোয়েসাস

    বোরনিও আর জাভা

    আর বিড়ালের মতন দেখতে সেলেবেস

     

    আমরা জাপানে যেতে পারব না

    মেকসিকোতে চলো !

    উঁচু সমতলভূমি টিউলিপ গাছে ছেয়ে থাকে

    সূর্য থেকে ঝুলে থাকা আলুলায়িত চুলের মতন আঙুরলতা

    যেন চিত্রকরের ব্রাশ আর প্যালেট

    বিস্ময়করভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে ঘণ্টাধ্বনির মতন–

     

    রুশো ছিলেন সেখানে

    ওনাকে চিরকালের জন্য ঝিলমিলিয়ে রেখেছিল

    দেশটা পাখির জন্য বিখ্যাত

    স্বর্গের পাখি বেহালার পাখি

    টউকান মকিংবার্ড

    আর কালো ফুলের মধ্যে টুনটুনি পাখিরা বাসা বাঁধে

    এসো !

    আমরা অ্যাজটেক মন্দিরের রাজকীয় ধ্বংসাবশেষে প্রেম করব

    তুমি হবে আমার দেবীপ্রতিমা

    খুকিরঙা জলের ছাটে কিছুটা কুৎসিত আর সত্যিকারের অপার্থিব

    ওহ এসো !

     

    তুমি চাইলে আমরা বিমানে চেপে হাজার হ্রদের দেশের ওপরে উড়ব

    সেখানে রাতগুলো দৌরাত্মপূর্ণভাবে দীর্ঘ

    ইঞ্জিনের আওয়াজে আমাদের প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষরা ভয় পাবেন

    আমি নামবো

    আর ম্যামথের জীবাশ্ম দিয়ে গড়ে তুলব বিমান রাখার হলঘর

    আদিম আগুন আবার জাগিয়ে তুলবে আমাদের ক্ষীণ প্রণয়

    রুশদেশের চায়ের কেটলি

    আর আমরা সাধারণ মানুষের মতন মেরু অঞ্চলে সংসার পাতবো

    ওহ এসো !

    জিন জিনেট আমার খুকি আমার মাটির-পাত্র আমার পাদ

    আমার আমি মা পুপু পেরু

    পিপি কোকিল

    ডিঙডিঙ আমার ডঙ

    মিষ্টি শুঁটি মিষ্টি মাছি মিষ্টি ভ্রমর

    চিকাডি বেডি-বাই

    ছোট্ট পায়রা আমার প্রেমিকা

    ছোট কুকি-নুকি

    ঘুমোচ্ছে ।

     

    মেয়েটা ঘুমোচ্ছে

    আর সারা দিন পেটে কিছু পড়েনি

    স্টেশনে দেখা সেই সব মুখগুলো

    যাবতীয় ঘড়িগুলো

    প্যারিসের সময় বার্লিনের সময় সেইন্ট পিটার্সবার্গের সময় সেইসব স্টেশনের সময়

    আর উফাতে কামানদাজের রক্তাক্ত মুখ

    আর গ্রোন্ডোর অবাস্তব আলোজ্বলা ঘড়ির কাঁটা

    আর ট্রেন চলেই চলেছে শেষহীন

    রোজ সকালে তুমি তোমার ঘড়ি মিলিয়ে নাও

    ট্রেন এগোয় আর সূর্যের সময় ফুরোয় কোনো কাজে লাগে না ! ঘণ্টাধ্বনি শুনি

    নোট্রেদামের বিরাট ঘণ্টা

    সন্ত বার্থোলোমিউ দিবসে লুভরের তীক্ষ্ণ ঘণ্টাধ্বনি

    নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির বৈদ্যুতিক ঘণ্টাধ্বনি

    ভেনিসের ইতালীয় ঘণ্টাঘরের বাজনা

    আর বাজতে থাকে মসকোর ঘণ্টা, লাল সিংহদ্বারের ঘড়ি

    যা আমার জন্য সময় জানাতো যখন আমি একটা অফিসে কা্জ করতুম

    আর আমার স্মৃতিগুলো

    ট্রেন বিদ্যুৎচমকের মতন গোলঘরে প্রবেশ করে

    চলতে থাকে ট্রেন

    গ্রামোফোনে বেজে ওঠে ছোট্ট ভবঘুরে কুচকাওয়াজ

    আর জগতসংসার, প্রাগের ইহুদিপাড়ার ঘড়ির কাঁটার মতন

    পাগল হয়ে পেছন দিকে যেতে থাকে

     

    বাতাসের সতর্কতা উড়িয়ে

    ঝড় উঠেছে

    আর ট্রেনগুলো প্যাঁচালো রেললাইনে ঝড় তোলে

    নারকীয় খেলনা

    এমন ট্রেন আছে যাদের কখনও পরস্পরকে দেখা হয় না

    অন্যগুলো হারিয়ে যায়

    স্টেশানমাসটাররা দাবা খেলে

    ব্যাকগ্যামন

    শুট পুল

    ক্যারামের টুসকি

    প্যারাবোলা

    রেললাইনের প্রণালী হলো নতুন ধরণের জ্যামিতি

    সাইরাকিউজ

    আরকিমিডেস

    আর যে সৈন্যরা তাঁকে কোতল করেছিল

    আর ছিপনৌকা

    আর রণতরী

    আর বিস্ময়কর যন্ত্র যা উনি আবিষ্কার করেছিলেন

    আর যাবতীয় কোতল

    প্রাচীন ইতিহাস

    আধুনিক ইতিহাস

    জলঘুর্ণি

    জাহাজডুবি

    এমনকি টাইটানিকও যার বিষয়ে কাগজে পড়েছিলুম

    এতো চিত্রকল্পের জমায়েত আমি আমার কবিতায় আনতে পারছি না

    কেননা আমি এখনও সত্যিকারের খারাপ কবি

    কারণ ব্রহ্মাণ্ড আমার ওপর দিয়ে দ্রুত চলে যায়

    আর ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা পড়ার ব্যাপারে বীমার জন্য গা করিনি

    কেননা আমি জানিনা কেমন করে তা সারাটা পথে বয়ে নিয়ে যেতে হবে

    আমি বেশ ভয়ে আছি

    আমি ভিতু

    জানি না কেমন করে সারাটা পথ বয়ে নিয়ে যেতে হবে

    আমার বন্ধু শাগাল-এর মতন আমি যুক্তিবর্জিত ছবির সিরিজ আঁকতে পারি

    কিন্তু আমি প্রসঙ্গবিন্দু লিখে রাখিনি

    “আমার অজ্ঞতা ক্ষমা করুন

    ছন্দের প্রাচীন খেলা ভুলে গেছি বলে ক্ষমা করে দিন”

    গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার যেমন বলেছেন

    যুদ্ধ সম্পর্কে যদি কিছু জানতে চাও তাহলে ক্রোপোটকিনের ‘স্মৃতিকথা’ পড়ো

    কিংবা নৃশংস ছবিসহ জাপানি সংবাদপত্র

    কিন্তু বইয়ের তালিকা তৈরি করে কীই বা হবে

    হাল ছেড়ে দিই

    লাফিয়ে ফিরে আসি আমার নাচতে থাকা স্মৃতিতে…

     

    ইরকুটস্কে যাত্রা হঠাৎ মন্হর হয়ে যায়

    সত্যি বলতে টেনে নিয়ে যেতে থাকে

    বাইকাল হ্রদের বাঁকে আমাদেরটাই ছিল প্রথম ট্রেন

    গাড়িটা লন্ঠনের আলোয় আর পতাকায় সাজানো ছিল

    আর দুঃখি গান “ঈশ্বর জারকে রক্ষা করুন” শুনে আমরা স্টেশন ছাড়লুম

    আমি যদি চিত্রকর হতুম এই যাত্রার শেষে প্রচুর হলুদ আর লাল রঙের ঝাপটা মারতুম

    কারণ আমার মনে হয় আমরা সবাই যৎসামান্য উন্মাদ

    আর সেই ছেয়েথাকা সন্মোহন আমার সহযাত্রীদের ক্লান্ত মুখ রক্তাভ করে তুলছিল

    আমরা যখন মোঙ্গোলিয়ার কাছাকাছি

    তা দাবানলের মতন গর্জন করছিল ।

    ট্রেন মন্হর হয়ে গিয়েছিল

    আর চাকার অবিরাম ঘষটানিতে আমি শুনতে পেলুম

    এক শাশ্বত প্রার্থনার

    উন্মাদ ফোঁপানি আর চিৎকার

     

    আমি দেখলুম

    আমি দেখলুম শেষ পূর্বপ্রান্ত থেকে যে শব্দহীন কালো ট্রেনগুলো ফিরে আসছে

    তারা যেন মায়াপুরুষ

    আর আমার চোখদুটো, গাড়ির পেছনের আলোর মতন,

    তখনও ট্রেনগুলোর পিছু ধাওয়া করেছে

    টালগাতে ১০০০০০ আহত লোক মারা যাচ্ছে অথচ কোনো সাহায্য আসছে না

    আমি ক্র্যাসনোইয়ার্সকের হাসপাতালে গেলুম

    আর খিলোকে আমাদের সঙ্গে সৈন্যদের এক সারির সঙ্গে দেখা হলো

    যারা পাগল হয়ে গেছে

    আলাদা করে রাখাদের দেহে দেখলুম জখমের হাঁ-মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে

    আর কেটে ফেলা অঙ্গগুলো চারিদিকে নাচছে কিংবা কাঁচা বাতাসে উড়ছে

    তাদের মুখমণ্ডলে আর হৃদয়ে ছিল আগুন

    জানালায় টোকা দিয়ে বাজনা বাজাচ্ছিল মূর্খ আঙুলগুলো

    আর ভয়ের চাপে এমনই চাউনি যা থেকে ফেটে বেরোবে নালি-ঘা

    স্টেশনগুলোয় ওরা মোটরগাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল

    আর আমি দেখলুম

    ষাটটা ইঞ্জিন তপ্ত দিগন্তের তাড়া খেয়ে দৌড়োচ্ছে

    আর বেপরোয়া কাকেরা

    উধাও হয়ে যাচ্ছে

    পোর্ট আর্থারের দিকে

     

    শিটাতে পেলুম কয়েক দিনের বিশ্রাম

    পাঁচ দিনের বিরাম ততোক্ষণ ওরা রেললাইন পরিষ্কার করছিল

    আমরা মিস্টার ইয়াঙ্কেলেভিচের বাড়িতে আশ্রয় নিলুম যিনি

    ওনার একমাত্র মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাইলেন

    তারপর যাবার সময় এলো ।

    এখন আমিই পিয়ানো বাজালুম আর আমার দাঁতে ব্যথা করছিল

    আর যখনই চাই আমি আবার দেখতে পাই সেই নিঃশব্দ ঘর আর ভাঁড়ার আর

    ওনার মেয়ের দুই চোখ যে আমার সঙ্গে প্রতিরাতে শুচ্ছিল

    মুসোর্গস্কি

    আর হ্যুগো উল্ফের জার্মান গীতিকবিতা

    আর গোবি মরুভূমির বালিয়াড়ি

    আর খাইলারে শাদা উটদের একটা যাত্রীদল

    আমি দিব্যি করে বলতে পারি ৩০০ মাইলের বেশি মোদোমাতাল ছিলুম

    কিন্তু আমি পিয়ানো বাজাচ্ছিলুম — এসবই দেখেছি

    যাত্রায় বেরোলে তোমার উচিত চোখ বন্ধ করে নেয়া

    আর ঘুমিয়ে পড়া

    আমি ঘুমোবার জন্যে পাগল হয়ে যাচ্ছিলুম

    চোখ বন্ধ করে গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারি আমি কোন দেশে

    আর কোন ধরণের ট্রেন যাচ্ছে তা শুনে বলে দিতে পারি

    ইউরোপের ট্রেনগুলো ৪/৪ যখন কিনা এশিয়ার ট্রেন ৫/৪ কিংবা ৭/৪

    অন্যগুলো ঘুমপাড়ানি গানের সুর তুলে যায়

    আর কয়েকটা এমন যাদের চাকার একঘেয়েমি আমাকে

    মাতেরলিঙ্কের কঠিন গদ্য মনে পড়ায়

    চাকাগুলোর খণ্ডিত উচ্চারণের মানে আমি বুঝতে পারছিলুম

    আর সৌন্দর্যের সন্ত্রাসের উপাদানকে একত্রিত করতে পারছিলুম

    যার আমি মালিক

    আর যা আমাকে চালিয়ে নিয়ে যায়

     

    সিৎসিহার আর হারবিন

    অতোটাই আমি যেতে পারি

    শেষ স্টেশন

    ওরা রেড ক্রসের দপতরে আগুন ধরিয়ে দেবার পর

    হারবিনে আমি ট্রেন থেকে নামলুম

     

    ও প্যারিস

    পরম উষ্ণ আরামগেহ তোমার পথগুলোর মোড়ের ফুলকি

    আর তার ওপরে হেলে থাকা বাড়িগুলো পরস্পরকে তাপ দেয়

    ঠাকুমা-দিদিমার মতো

    আর এখানে রয়েছে লাল সবুজ সমস্ত রঙের পোস্টার আমার অতীতের মতন

    এক কথায় হলুদ

    ফ্রান্সের উপন্যাসের গর্বিত রঙ হলো হলুদ

    বড়ো শহরগুলোয় যখন বাস যায় আমি তাতে হাত ঘষি

    সঁ-জারমেঁ-মমার্ত রুটে যা আমাকে নিয়ে যায় ছোটো পাহাড়তলিতে

    নিচের মোটরগুলো যেন সোনালি ষাঁড়

    সন্ধ্যায় গরুগুলো সাকরে-কয়েরে চরে বেড়ায়

    ও প্যারিস

    প্রধান স্টেশন যেখানে অস্হিরতার মোড়ে আকাঙ্খাগুলো নামে

    এখন কেবল রঙের দোকানে দরোজায় ছোট্ট আলো জ্বলছে

    ইনটারন্যাশানাল পুলম্যান আর গ্রেট ইউরোপিয়ান এক্সপ্রেস কোম্পানি

    তাদের পুস্তিকা আমাকে পাঠিয়েছে

    এটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গির্জা

    আমার বন্ধুরা আছে যারা আমাকে রেলিঙের মতন ঘিরে থাকে

    ওরা ভয় পায় যে আমি চলে গেলে আর ফিরবো না

     

    প্যারিস

    যে নারীদের সঙ্গে  পরিচিত হয়েছি তারা দিগন্তে আমার চারিধারে দেখা দেয়

    বৃষ্টিতে দুঃখি লাইটহাউসের মতন দেখতে তাদের হাত বাড়িয়ে দেয়

     

    বেলা, অ্যাগনেস, ক্যাথারিন, আর ইতালিতে আমার ছেলের মা

    আর সেই মেয়ে যে আমেরিকায় আমার প্রেমের মা

    অনেক সময়ে হুইসিলের কান্না আমাকে ছিঁড়ে ফ্যালে

    মাঞ্চুরিয়াতে একটি গর্ভ স্পন্দিত হচ্ছে, যেন জন্ম দিতে চলেছে

    আমার ইচ্ছেকে

    আমার ইচ্ছে যে আমার কখনও যাত্রা করা উচিত হয়নি

    আজকের রাতে এক গভীর প্রেম আমাকে পাগল করে তুলছে

    আর আমি ফ্রান্সের ছোট্ট জিনের কথা ভুলতে পারছি না ।

    এক দুঃখের রাতে তার সন্মানে এই কবিতাটা লিখছি

    জিন

    কচি গণিকা

    আমি বড়ো দুঃখি বড়ো দুঃখি

    ফুরিয়ে যাওয়া যৌবনকে মনে আনার জন্য যাচ্ছি লাপাঁ অ্যাগাইল

    কয়েক গেলাস মদ খাবো

    আর বাসায় ফিরবো একা

     

    প্যারিস

    তুলনাহীন মিনার আর মহান ক্রুশকাঠ আর চাকার শহর



     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৯:৩৫735112
  • জাঁ জেনে : চোরের জার্নাল : 

    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    যারা জেল খাটে তাদের পোশাক গোলাপি আর শাদা ডোরাকাটা । যদিও আমার হৃদয়ের ওসকানিতে আমি সেই জগৎ বেছে নিয়েছি যেখানে আহ্লাদিত হই, আমি অন্তত সেখানে সেই সমস্ত মর্মার্থের ইশারা খুঁজে পাবার ক্ষমতা রাখি, যা আমি জানতে চাই : ফুল আর দণ্ডিতদের মাঝে একটা কাছাকাছি সম্পর্ক আছে । প্রথমটার যেমন অপলকাভাব আর সূক্ষ্মতা, তেমনই প্রকৃতির, যেমন দ্বিতীয়টার নির্দয় সংবেদনহীনতা । যদি আমাকে একজন দণ্ডিতের -- কিংবা অপরাধীর বর্ণনা করতে হয় -- আমি তাকে ফুলে এমনভাবে সাজাবো যে সে তার তলায় চাপা পড়ে যাবে, সে নিজেই ফুল হয়ে উঠবে, বিশাল আর নতুন ফুল । যাকে আমি পাপ বলে জানি তার জন্য, আমি আরামে এক অভিযানে বেরোলুম যা আমাকে কারাগারে পৌঁছে দিলো । যদিও তারা সব সময়ে সুপুরুষ নয়, যে মানুষেরা পাপে পর্যবসিত,  তাদের  পৌরুষের প্রচুর সততা থাকে । তারা নিজে থেকেই, কিংবা কোনও অঘটনের কারণে, যা তাদের জন্য বাছাই করা হয়েছে, তারা বিনা নালিশে কলঙ্কের, ঘৃণ্য ঘটনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, যেমন প্রেমে, যদি তা গভীর হয়, মানুষকে তার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দ্যায় । যৌনতার খেলা এক নামহীন জগতকে ফাঁস করে, যা প্রেমিকদের রাতের ভাষায় প্রকাশিত হয় । সেই ভাষাকে লিখে রাখা যায় না । তা রাতের বেলায় কানে-কানে কর্কশস্বরে ফিসফিস করে বলা হয় । ভোর বেলায় তা লোকে ভুলে যায় । তোমাদের জগতের সদগুণকে প্রত্যাখ্যান করে, অপরাধীরা এক নিষিদ্ধ ব্রহ্মাণ্ডকে আশাহীনভাবে সঙ্গঠিত করার জন্য একমত হয় । তারা তার ভেতরে বসবাস করার জন্য আত্মসমর্পণ করে । সেখানকার হাওয়ায় বমি পায় : তারা তবু সেখানে শ্বাস নিতে পারে । কিন্তু -- অপরাধীরা তোমার ধরাছোঁয়ার বাইরে-- যেমন ভালোবাসায়, তারা পেছন ফেরে আর আমাকেও জগতসংসার আর তার আইনকানুন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্য করে । তাদের ঘাম, বীর্য, আর রক্তের গন্ধ । সংক্ষেপে, আমার দেহকে আর আমার তৃষ্ণার্ত আত্মাকে তা একনিষ্ঠতা উপহার দ্যায় । তাদের জগতের এই যৌনতার দরুন আমি অশুভের প্রতি আকৃষ্ট হই । আমার দুঃসাহসিক অভিযান, কখনও দ্রোহ বা অবিচারের অনু্ভূতির দ্বারা প্ররোচিত হয়নি, তা যেন এক দীর্ঘ সময়ের সঙ্গম, দুঃসহ, অদ্ভুত, যৌন উৎসব ছিল ( কাল্পনিক উৎসব যা কারাগারে নিয়ে যায় আর যাকে আগাম অনুমান করা যায় ) । যদিও তা অনুমোদিত, আমার দৃষ্টিতে তার ন্যায্যতা প্রতিপাদনও, জঘন্য অপরাধের, তা হবে অত্যন্ত অবক্ষয়ের নিদর্শন ।    সেই চরম বিন্দু যেখানে পুরুষদের জুগুপ্সাকে নিয়ে যায়, তাকে আমার মনে হতো বিশুদ্ধতার আদর্শ জায়গা, অর্থাৎ, সবচেয়ে ঘোলা প্রেমাত্মক সাদৃশ্য,  যেখানে উদযাপিত হয় মেকি বিয়ে ।    তাকে সুরে বাঁধবার ইচ্ছায়, আমি ব্যবহার করি স্বাভাবিক সংবেদনের আঙ্গিকে আমাকে দেয়া উপহার, যা দণ্ডিতের চেহারায় আগে থেকেই উত্তেজিত করে তোলে । ব্যাপারটা জাগিয়ে তোলে, তার রঙে আর তার বন্ধুরতায়, এক ধরণের ফুল যার পাপড়িগুলো কিছুটা কোঁকড়া, যার বর্ণনা আমার পক্ষে যথেষ্ট, শক্তিমত্তার ধারণাকে লজ্জার জুড়িদার করা ; লজ্জা যা কিনা প্রাকৃতিক স্তরে অত্যন্ত অপলকা আর মহার্ঘ । এই অনুষঙ্গ, যা আমাকে আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলে, তা নিজের সম্পর্কে অন্য কোনো মনের কথা প্রস্তাব করবে না, আমার মন তা এড়াতে পারে না । এইভাবে আমি আমার কোমলতা দণ্ডিতদের উপহার দিয়েছি ; আমি তাদের মনোরম নামে ডাকতে চেয়েছি, তাদের অপরাধকে অভিহিত করতে চেয়েছি, শালীনতার কারণে, সূক্ষ্ম রূপকে ( যার আড়ালে আমি জানতে পারতুম না খুনির বৈভবী পৌরুষ, তার লিঙ্গের হিংস্রতা ) । এই ছবির মাধ্যমে আমি কি তাদের গিয়ানার পেনাল কলোনিতে কল্পনা করতে পারিনা : সবচেয়ে পালোয়ান, মাথায় শিঙ, সবচেয়ে কঠিন, মশারির ঢাকনার আড়ালে ? আর আমার ভেতরের প্রতিটি ফুল এমন এক বিষাদ ছড়ায় যে তার সবই দুঃখ আর মৃত্যুর নিদর্শন । এইভাবে আমি ভালোবাসা চাইলুম,  যেন তা বন্দিশিবিরের ব্যাপার । আমার প্রতিটি  কামেচ্ছা আমাকে তার আশায় আকৃষ্ট করলো, তার একটা আভাস আমায় দিলো, আমাকে অপরাধীদের উপহার দিলো, তাদের কাছে আমাকে উপহার দিলো কিংবা আমাকে অপরাধ করার জন্য অনুপ্রাণিত করলো । যখন আমি এই বইটা লিখছি, শেষ অপরাধীরা ফ্রান্সে ফিরছে । সংবাদপত্রে সেই খবর প্রকাশিত হচ্ছে । রাজার উত্তরাধিকারীরা এক শূন্যতায় ভোগে যদি তাকে অভিষেক থেকে প্রজাতন্ত্র বঞ্চিত করে । বন্দিশিবিরের সমাপ্তি আমাদের জীবন্ত মননকে পৌরাণিক অতল জগতে উত্তীর্ণ হওয়ায় বাধা দ্যায় । আমাদের সবচেয়ে নাটকীয় আন্দোলনকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে । আমাদের অভিনিষ্ক্রমণ, নৈপূণ্য, সমুদ্রের পথে মিছিল, মাথা নত করে ক্রিয়ান্বিত হয়েছিল । ফিরে যাওয়া, সেই একই মিছিলের প্রত্যাবর্তন, তা অর্থহীন হয়ে গেছে । আমার অন্তরজগতে, বন্দিশিবিরের ধ্বংস হয়ে দাঁড়িয়েছে শাস্তির শাস্তি : আমাকে খোজা করা হয়েছে, আমি আমার কলঙ্ক থেকে কর্তিত । আমাদের স্বপ্নকে তাদের গৌরব থেকে মুণ্ডহীন করার ব্যাপারে উদাসীন, ওরা আমাদের আগেই ঘুম ভাঙিয়ে দ্যায় । পেনাল কলোনির তুলনায় দেশের কারাগারগুলোর নিজেদের ক্ষমতা থাকে : পেনাল কলোনির মতো তা  নয় । তা ছোটোখাটো । তাতে সেরকম সৌষ্ঠব, কিছুটা বিনীত মহিমা নেই । আবহাওয়া সেখানে এমন গুমোটভরা যে তোমায় নিজেকে হিঁচড়ে বেড়াতে হবে । তুমি হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াও । দেশের কারাগারগুলো বেশ উঁচু, আরও অন্ধকার আর কড়া মেজাজের ; পেনাল কলোনির ধীর, বিষণ্ণ যন্ত্রণাবোধ ছিল চরম দুর্দশার নিখুঁতভাবে কুসুমিত হবার জায়গা । তাই এখন দেশের জেলগুলো, বজ্জাত পুরুষে ফেঁপে ওঠা, পোশাক কালচে, অনেকটা রক্তের মতন, যা কার্বনিক গ্যাস দিয়ে ভেজানো । ( আমি “কালচে” লিখেছি । দণ্ডিতদের পোশাক -- যারা ধরা পড়েছে, বিচারাধীন, এমনকি জেলবন্দিরাও, আমাদের নামকরণের জন্য যে শব্দগুলো বেছে নিয়েছে তা বেশ অভিজাত -- আমার ওপরে শব্দটা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে : পোশাকগুলো সাদাসিধে বাদামি রঙের ।) আমার হ্যাংলামি তাদের জন্য।  আমি জানি পেনাল কলোনি হোক বা দেশের কারাগার, তা প্রায়ই ব্যঙ্গাত্মক অনুকরণের মতন হয়।  আওয়াজ-করা ভারি কাঠের জুতোয়, শাস্তি-পাওয়া লোকগুলো সব সময়েই যেন ভার সামলাতে পারে না । মাল নিয়ে যাবার ঠেলাগাড়ির সামনে  হঠাৎ বোকার মতন ভেঙে পড়ে । কোনো পাহারাদারের উপস্হিতিতে ওরা মাথা নামায়, আর হাতে ধরে থাকে খড়ের তৈরি রোদ থেকে মাথা বাঁচাবার বড়ো টুপি -- যা কমবয়সীগুলো সাজিয়ে নেয় ( আমার তাই মনে হয়েছে ) পাহারাদারের অনুমতি-দেয়া চুরি করা গোলাপফুলে -- কিংবা বাদামি কাপড়ের বেরেটুপি। ওরা হতভাগা, বিনয়ের অভিনয় করে । যদি তাদের মারধর করা হয়, তাদের মগজে কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই কঠিন আকার নেবে : যারা ভিতু, তারা গুটিসুটি কেটে পড়ে, ভয় পাওয়া, কেটে পড়া, এগুলো হলো -- যখন সবচেয়ে কঠিন অবস্হায় রাখা হয়, বিশুদ্ধ ভয় আর কেটে পড়া-- তাদের শক্ত করে তোলা হয় “সুসিক্ত” করার মাধ্যমে, যেমন নরম লোহাকে শক্ত করা হয় সুসিক্ত করা হয় । এসব সত্বেও তারা চাটুকারিতা বজায় রাখে । যদিও আমি বিকলাঙ্গ আর দুর্ঘটনাগ্রস্তদের দুরছাই করি না, যারা সুপুরুষ অপরাধী,  আমার নমনীয়তা তাদের আকর্ষণ করে ।

     

    অপরাধ, আমি নিজেকে বললুম, পিলোরগে বা অ্যাঞ্জেল সান-এর মতন নিখুঁত সফলদের গড়ে তোলার আগে তাকে বহুকাল অপেক্ষা করতে হয় । তাদের সংহার করার আগে ( শব্দটা নিষ্ঠুর ) জরুরি হলো একযোগে কিছু ঘটনার সংশ্লেষ : তাদের মুখের সৌন্দর্য, তাদের দেহের শক্তি আর সৌষ্ঠব আর তার সঙ্গে যোগ করতে হবে অপরাধ সম্পর্কে তাদের প্রবৃত্তি, পরিস্হিতি যা অপরাধীকে গড়ে তোলে, অমন অদৃষ্ট বেছে নেবার নৈতিক প্রাণশক্তির ধারণক্ষমতা, আর সব শেষে, শাস্তি, তার নিষ্ঠুরতা, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য যা একজন অপরাধীকে তাতে গৌরবান্বিত বোধ করার অধিকার দ্যায়, আর, এই সমস্ত কিছু ছাপিয়ে, অন্ধকারের এলাকাগুলো । নায়ক যদি রাতের সঙ্গে লড়াই করে জিতে যায়, তাহলে তার কাছে থেকে যায় বিজয়ের টুকরো-টাকরা ! সেই একই সংশয়, খোশমেজাজ পরিস্হিতির একই কেলাসন, একজন খাঁটি গোয়েন্দার সফলতাকে দিশানির্দেশ দ্যায় । আমি উভয়কেই সন্মান করি । কিন্তু আমি তাদের অপরাধকে ভালোবাসি, তার জন্য যে শাস্তি বরাদ্দ, “সেই পেনালটি” ( আমার মনে হয় না তারা এর আগাম আঁচ করেনি। তাদের একজন, প্রাক্তন মুষ্ঠিযোদ্ধা লেডো, হাসিমুখে তদন্তকারীদের জবাব দিয়েছিল : “আমার অপরাধগুলো ? সেগুলো করার আগে হয়তো আমি তা নিয়ে অনুতাপ করতুম” ) যাতে আমি তাদের সঙ্গে যেতে চাই , যাইই হয়ে যাক না কেন, আমার ভালোবাসা উপচে পড়বে।

     

    এই জার্নালে আমি অন্য কারণগুলো লুকোতে চাই না, যা আমাকে চোর বানিয়েছে, সবচেয়ে সহজ কারণ হলো ক্ষুধা, যদিও দ্রোহ, তিক্ততা, ক্রোধ কিংবা তেমন ধরণের ভাবপ্রবণতা আমার বাদবিচারে ঢোকেনি । গোঁড়ামিভরা যত্নে, “ঈর্ষান্বিত যত্নে”, আমি আমার দুঃসাহসিক অভিজানের খাতিরে নিজেকে গড়ে তুললুম, যেমনভাবে কেউ তার বিছানা বা ঘরকে ভালোবাসাবাসির আগে সাজায় ; অপরাধ করার  জন্য আমি ছিলুম গরম । আমার উত্তেজনা হলো এক থেকে আরেক জনের মাঝে দোল খাওয়া । তাকে বাতিল করে আমার যে কতো বড়ো ক্ষতি হয়েছে তা আমি গোপনে আবার কল্পনা করি, নিজের অন্তরে আর কেবল একা নিজের জন্য, গিয়ানার পেনাল কলোনির চেয়েও পঙ্কিল এক পেনাল কলোনি। আমি বলব যে দেশের কারাগারগুলোকে বলা চলে “ছায়াময়”। পেনাল কলোনিতে রয়েছে চড়া রোদে। সেখানে সবকিছু ঘটে নিষ্ঠুর আলোতে,  যাকে  আমি প্রাঞ্জলতার নিদর্শন হিসাবে বেছে নেয়া ছাড়া আর কিছু বলতে পারব না ।

     

    আমি সেই সাহসকে হিংস্রতার নাম দেবো,  যা অলস হয়ে অপেক্ষা করছে আর বিপদের অঙ্কশায়ী । তা দেখা যেতে পারে এক চাউনিতে, হাঁটাচলায়, এক হাসিতে, আর তোমার মধ্যেই যা আছে তা ফলত মুচড়ে ওঠে । তা তোমাকে কাবু করে ফ্যালে । হিংস্রতা হলো এক প্রশান্তি যা তোমাকে বিপর্যস্ত করে । বলাবলি করা হয় : “লোকটার আভিজাত্য আছে !” পিলোরগের অপলকা বৈশিষ্ট্য ছিল উদ্দাম হিংস্রতার । স্তিলিতানোর একটি মাত্র হাতের হিংস্রতার অভিসন্ধি, স্রেফ টেবিলের ওপরে রাখা, স্হির, নীরবতাকে বিঘ্নিত করেছে আর তা বেশ বিপজ্জনক । আমি চোরেদের আর কুটনিদের সঙ্গে কাজ করেছি, যাদের কর্তৃত্ব আমাকে তাদের ইচ্ছের কাছে ঝুঁকিয়েছে, কিন্তু কয়েকজনই সত্যিকারের সাহসী হিসাবে প্রমাণ করতে পেরেছে নিজেদের, তাদের মধ্যে যে জন সবচেয়ে বেশি সাহসী ছিল -- গি -- সে ছিল হিংস্রতাহীন । স্তিলিতানো, পিলোরগে আর মিশাই ছিল ভিতু । জাভাও তাই । এমনকি যখন বিশ্রাম নিচ্ছে, স্হির আর হাসিমুখ, তাদের চোখে, নাকের ফুটোতে, হাঁ-মুখে, হাতের তালুতে আর হাতে ধরা পড়তো, ফুলে ওঠা ঝুড়ি, সোয়েটার কিংবা ডেনিমের তলায় পেশির নিষ্ঠুর ঢিবি, এক উজ্বল আর নিরানন্দ ক্রোধ, দেখে মনে হতো আবছায়া।

    কিন্তু, প্রায় সব সময়েই, ব্যাপারটাকে  চিহ্ণিত করার মতো কিছু নেই, স্বাভাবিক ইঙ্গিতের অনুপস্হিতি ছাড়া । রেনের মুখ প্রথম দর্শনে মনোরম । ওর নিচু বেঁকা নাক দেখে মনে হতো যেন চতুর দুর্বৃত্ত, যদিও ওর মুখের সীসার মতন ফ্যাকাশে উদ্বেগ তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলবে ।  ওর চোখদুটো ক্ষর, ওর ঘোরাফেরা শান্ত আর অসন্দিগ্ধ । স্নানের ঘরে ও ঠাণ্ডা মাথায় সমকামীদের পিটুনি দ্যায় ; তাদের পোশাক তল্লাসি করে, যা পায় কেড়ে নেয়, অনেক সময়ে, শেষ বার্তা হিসেবে, গোড়ালি দিয়ে পোঁদে লাথি মারে । আমি ওকে পছন্দ করি না, কিন্তু ওর ঠাণ্ডা মেজাজ আমাকে ওস্তাদি শেখায় । ও গভীর রাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে, পেচ্ছাপখানা, বাগান, ঝোপঝাড়, শঁজে লিজের গাছের তলায়, স্টেশনগুলোর কাছে, পোর মাইলোতে, বোয় দ্য বুলোনে ( সব সময়ে রাতের বেলায় ) এমন এক গাম্ভীর্য নিয়ে থাকে যা থেকে কল্পনাপ্রবণতা একেবারে বাদ । যখন ও ফেরে, ভোর দুটো বা তিনটের সময়ে, আমার মনে হয় আমি দুঃসাহসিক অভিযানে ফুলেফেঁপে উঠেছি । ওর দেহের প্রতিটি অঙ্গ, যা নিশাচরের, ওর কাজে অংশ নেয় : ওর হাত, ওর বাহু, ওর পা , ওর ঘাড়ের পেছন দিক । কিন্তু ও, এই সমস্ত বিস্ময় সম্পর্কে অনবহিত, আমাকে সেগুলো সম্পর্কে সোজাসুজি  বলে । পকেট থেকে বের করে আঙটি, বিয়ের আঙটি, ঘড়ি, সন্ধ্যাবেলাকার লুটের মাল। একটা বড়ো কাচের পাত্রে রাখে যা তখনই ভরে উঠবে । রাস্তায় পায়ুকামীদের বা তাদের কাজ কারবার দেখে ও অবাক হয় না, তা বরং ওর কাজকে সাহায্য করে । ও যখন আমার বিছানায় বসে, আমি উৎকর্ন হয়ে উঠি, ওর অভিযানের টুকরো টাকরা শোনার জন্য : জাঙিয়া পরা একজন অফিসার যার মানিব্যাগ ও চুরি করেছিল সে তার আঙুল তুলে চিৎকার করেছিল : “বেরিয়ে যাও !” রেনে ব্যাটা বিজ্ঞের উত্তর : “তুই কি মনে করিস তুই সৈন্যবাহিনীর কেউ ?” বুড়ো লোকের খুলিতে একখানা কড়া ঘুষি । সে লোকটা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল যখন রেনে, বেশ উত্তেজিত, দেরাজ খুলে একগাদা মরফিনের শিশি পেয়েছিল । অনেক গল্প, যেমন, যে সমকামীর পয়সাকড়ি ছিল না আর যাকে ও নিজের সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করেছিল । আমি এইসব ঘটনা শুনি বেশ একাগ্র হয়ে । আমার অ্যান্টওয়ের্পের জীবন মজার হয়ে ওঠে, ঋজু দেহের কাঠামোয়, আমার পুরুষালি ধরনধারন অনুযায়ী । আমি রেনেকে উৎসাহ দিই, আমি ওকে পরামর্শ দিই, ও আমার কথায় কান দ্যায় । আমি ওকে বলি যে নিজে প্রথমে কথা বলবে না । “লোকটাকে তোমার কাছে আসতে দাও, তাকে ঝুলিয়ে রাখো । অবাক হবার ভান করো, যখন সে বলবে, নাও করো। কার কাছে বোবা সাজতে হবে তা আঁচ করে নিও ।”

    প্রতি রাতে আমি তথ্যের অংশবিশেষ যোগাড় করি । আমার কল্পনা তাতে হারিয়ে যায় না । আমার উত্তেজনার কারন আমি নিজের মধ্যে শিকার আর অপরাধী উভয়ের ভূমিকা খুঁজে পাই। সত্যি বলতে কি, আমি নিঃসরণ করি, রাতের বেলায় আমি আমার থেকে পয়দা হওয়া শিকার আর অপরাধীকে উদ্ভাবন করি ; আমি তাদের দুজনকে একই জায়গায় আনি, আর সকালের দিকে আমি জানতে পেরে উৎফুল্ল হই যে শিকার মৃত্যুদণ্ডের আদেশের মুখে পড়েছিল আর অপরাধীকে পাঠানো হচ্ছিল পেনাল কলোনিতে বা আরেকটু হলে গিলোটিনে চাপানো হচ্ছিল । এই ভাবে আমার উত্তেজনা আমার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, যা গিয়ানার পেনাল কলোনি ।

    ওরা না চাইলেও, এই লোকগুলোর ভাবভঙ্গী আর নিয়তি ঝঞ্ঝাময় । তাদের আত্মা এমন হিংস্রতা সহ্য করে যা তারা চায়নি আর যাকে তারা মানিয়ে নিয়েছে । যাদের স্বভাবগত পরিবেশ হিংস্রতার, অথচ তারা নিজেদের কাছে সহজ-সরল । এই দ্রুত আর ধ্বংসাত্মক জীবনকে যে গতিবিধিগুলো গড়ে তোলে তা সরল আর সরাসরি, একজন নামকরা নকশাকারের আঁকা রেখার মতন পরিষ্কার -- কিন্তু যখন রেখাগুলো চলন্ত অবস্হার মুখোমুখি হয়, তখনই ঝড় ওঠে, বিদ্যুতে তারা মারা পড়ে কিংবা আমি বিপদে পড়ি । তবু, তাদের হিংস্রতার সঙ্গে আমার হিংস্রতার কীই বা তুলনা, যার মানে তাদের হিংস্রতাকে মেনে নেয়া, তাকে আমার করে তোলা, তাকে আমার ইচ্ছে অনুযায়ী গড়ে নেয়া, তাকে থামিয়ে দেয়া, তাকে ব্যবহার করা, তাকে আমার ওপরে চাপিয়ে নেয়া, তাকে জানা, তাকে অনুমান করা, তার অনিষ্টপাতকে অনুধাবন আর উপলব্ধি করা ? কিন্তু যা আমার ছিল, আমার আত্মরক্ষার জন্য অভিলাষিত আর জরুরি, আমার বলিষ্ঠতা, আমার অনমনীয়তা, তাদের হিংস্রতার তুলনায়, যা তারা একটা অভিশাপের মতন পেয়েছে, যুগপৎ অন্তরজগতের আগুন আর বহির্জগতের আলো, যা তাদের পুড়িয়ে ছারখার করে আর আমাদের উদ্ভাসিত করে ? আমরা জানি যে তাদের অভিযানগুলো বালকসুলভ । তারা নিজেরা মূর্খ । তারা তাস খেলার হারজিত নিয়ে খুন করার জন্য বা খুন হবার জন্য তৈরি থাকে, যখন একজন প্রতিপক্ষ -- কিংবা তারা নিজেরা -- জোচ্চুরি করছিল । তা সত্বেও, অমন লোকেদের ধন্যবাদ, বিয়োগাত্মক ঘটনা সম্ভব হয় ।

    এই ধরণের সংজ্ঞা -- বহু পরস্পরবিরোধী উদাহরণ দিয়ে -- হিংস্রতা সম্পর্কে তোমাকে অবহিত করছি।  আমি এমন শব্দ প্রয়োগ করব না কোনো ঘটনার নায়ককে তুলে ধরার খাতিরে, বরং তারা আমার সম্পর্কে কিছু  বলুক । আমাকে বুঝে ওঠার জন্য, কুকর্মে পাঠকের অংশগ্রহণ জরুরি । তবু আমি তাকে সতর্ক করে দেবো যখনই আমার ভাবোচ্ছাস আমার পদক্ষেপকে টলমলে করে তোলে ।

    স্তিলিতানো ছিল দীর্ঘদেহী আর পালোয়ান । ওর চলনভঙ্গী ছিল একযোগে নমনীয় আর গোদা, প্রাণবন্ত আর ঢিমেতালে, সর্পিল ; লোকটা ছিল চটুল । আমার ওপরে ওর ক্ষমতার বেশির ভাগ -- আর বারিও চিনোর বেশ্যাদের ওপর -- কারণ হলো এক গাল থেকে আরেক গালে চালান করা ওর মুখের লালা, যা ও অনেকসময়ে হাঁ-মুখের সামনে আনতো পরদা টানার মতন । “কিন্তু কোথা থেকে এতো থুতু যোগাড় করে,” আমি নিজেকে জিগ্যেস করতুম, “কোথা থেকেই বা আনে? আমার তো কখনও ওর মতন তেলালো আর রঙিন হবে না । তা হবে পাকানো কাচের মতন মামুলি, স্বচ্ছ আর অপলকা ।” আমার পক্ষে কল্পনা করা স্বাভাবিক ছিল যে ওর লিঙ্গটা কেমন হবে যদি আমার সুবিধার জন্য তাতে অমন সুন্দর একটা জিনিস মাখায়, ওই দামি মাকড়সার তন্তু, এমন এক পাতলা-জাল যা আমি গোপনে প্রাসাদের আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করেছি । ও একটা পুরোনো ধূসর টুপি পরতো যার সামনে দিকটা ভাঙা । যখন ও সেটা আমাদের ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলতো, তা হঠাৎ হয়ে উঠতো যেন বেচারা কোনো ডানা কাটা মরা পায়রার মতন, কিন্তু যখন ও ওটা পরে নিতো, কান পর্যন্ত টেনে নামিয়ে, টুপির অন্য কিনারাটা ওপর দিকে উঠে যেতো আর দেখা যেতো ওর গৌরবান্বিত সোনালি চুল । ওর উজ্বল চোখের কথা যদি বলতে হয়, নম্রভাবে নামানো -- তবু স্তিলিতানো সম্পর্কে বলতে হবে : “ওর হাবভাব অবিনয়ী” -- যার ওপরে চোখ বন্ধ হয়ে আসতো আর চোখের পাতা এতো সোনালি, এতো উজ্বল আর ঘন, যে তা সন্ধ্যার ছায়া আনতো না বরং নিয়ে আসতো শয়তানের ছায়া। মোটের ওপর, কী মানে হয় যখন একটা দৃষ্টি আমাকে বন্দরের কাছে টলমলিয়ে দ্যায়, আমি দেখি জাহাজের পাল, একটু একটু করে, থেকে-থেকে, ছড়িয়ে পড়ে আর মাস্তুলের ওপর পর্যন্ত কষ্ট করে উঠে যায়, প্রথমে ইতস্তত, তারপর সুসংকল্পিত, যদি এই বিচলনগুলো স্তিলিতানোর প্রতি আমার প্রেমের বিচলনের প্রতীক না হয় তাছাড়া আর কীই বা হবে ? ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল বারসেলোনাতে । ও ভিখারি, চোর, পরী আর বেশ্যাদের জমঘটে বসবাস করছিল। ও ছোল সৌম্যকান্তি, কিন্তু এটা দেখার ছিল যে আমার অধঃপতনের সঙ্গে ওর সৌন্দর্যের কতোটা যোগাযোগ । আমার পোশাক ছিল নোংরা আর ছেঁড়া । আমি ছিলুম শীতে কাতর আর ক্ষুধার্ত। এই সময়টা ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে দৈন্যপীড়িত ।

    ১৯৩২. স্পেন সে সময়ে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ইঁদুর-ছুঁচোয়, তার ভিখারিতে । তারা গ্রাম থেকে গ্রামে যেতো, আন্দালুসিয়াতে কেননা জায়গাটা উষ্ণ, ক্যাটালোনিয়াতে কেননা জায়গাটা ধনী অধ্যুষিত, কিন্তু পুরো দেশটা ছিল আমাদের জন্য অনুকূল । ফলে আমি ছিলুম একটা উকুন আর সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলুম । বারসেলোনাতে আমরা কালে মেদিওদিয়া আর কালে কারমেন-এ ঘুরে বেড়াতুম । অনেক সময়ে আমরা বিনা চাদরের বিছানায় ছয়জন শুতুম, আর সকালে উঠে বাজারে যেতুম ভিক্ষা করার জন্য । আমরা দল বেঁধে বারিও চিনো ছাড়তুম আর ছড়িয়ে পড়তুম প্যারালেলোতে, হাতে বাজারের সাজি নিয়ে, কেননা বাড়ির বউরা পয়সার বদলে একটা পেঁয়াজ বা শালগম দিতেন । দুপুরে আমরা ফিরতুম, আর কুড়িয়ে বাড়িয়ে পাওয়া সবজি দিয়ে সুপ বানাতুম । ইঁদুর-ছুঁচোর জীবনের কথাই বলব । বারসেলোনাতে আমি পুরুষদের জুটি দেখতে পেতুম যার দুজনে মধ্যে একজনের ভালোবাসা বেশি সে অন্যজনকে বলত:

    “আজকে সকালের সাজিটা আমি নিয়ে যাবো।”

    সে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যেতো । একদিন সালভাদোর আমার হাত থেকে সাজিটা আলতো করে টেনে নিয়ে বলল, “আমি তোমার হয়ে ভিক্ষা চাইতে যাবো।”

    বাইরে তুষার পড়ছিল । ও বরফজমা ঠাণ্ডা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল, ছেঁড়া আর ফর্দাফাঁই জ্যাকেট পরে -- পকেটগুলো ছেঁড়া আর ঝুলন্ত -- আর তেলচিটে ময়লায় অনমনীয় শার্ট । ওর মুখটা ছিল গরিব আর দুঃখি, ছলনাভরা, ফ্যাকাশে আর নোংরা, কেননা ঠাণ্ডার দরুন আমরা কখনও ধুতুম না । দুপুরবেলায়, ও সবজি নিয়ে ফিরলো আর কিছুটা চর্বি । এখানে আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করব এক ধরণের ক্ষতের দিকে -- ভয়াবহ, কেননা বিপদ সত্বেও আমি উত্তেজিত করে দিতে পারতুম -- যার মাধ্যমে আমার সামনে মেলে ধরা হতো সৌন্দর্য । আর তীব্র -- ভাতৃসুলভ -- ভালোবাসা আমার দেহকে তাতিয়ে তুললো আর টেনে নিয়ে গেলো সালভাদোরের কাছে । ওর পেছন পেছন হোটেল ছেড়ে, আমি ওকে দেখতুম একজন মহিলাকে মিনতি করছে । আমি ফরমুলাটা জানতুম, কেননা আমি নিজের জন্য আর অন্যের জন্য ভিক্ষা করেছি : এতে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে হিতৈষিতা মিশ খায় ; ঈশ্বরের সঙ্গে গরিব লোকটাকে মেলায় ; ব্যাপারটা হৃদয় থেকে বেরোনো এমন এক নিরহঙ্কার যে আমার মনে হয় তা থেকে সরাসরি সুগন্ধের প্রকাশ ঘটে, ভিখারির হালকা শ্বাস যে তা উচ্চারণ করে । সারা স্পেন জুড়ে সে-সময়ে ওরা বলতো: 

    “ঈশ্বরের জন্য।”

    ওর কথা শুনতে না পেলেও, আমি বুঝতে পারতুম যে প্রতিটি দোকানে, প্রতিটি গৃহবধূর কাছে এই কথাটাই ওগরাচ্ছা সালভাদোর । কোটনারা যেমন নিজেদের বেশ্যার দিকে নজর রাখে আমি ওর ওপর নজর রাখতুম, কিন্তু হৃদয়ে ওর জন্য কোমলতা পুষে ! এইভাবে, স্পেন আর আমার ভিখারির জীবন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো অপমানের মহিমার সঙ্গে, কেননা তার জন্য দরকার ছিল গর্ববোধ ( অর্থাৎ, ভালোবাসার ) ওই সমস্ত নোংরা, ঘৃণ্য প্রাণীদের সুশোভিত করার জন্য । দরকার ছিল কর্মদক্ষতার, যা আমি একটু-একটু করে হাসিল করলুম । যদিও তোমাকে এর কায়দা আমি ঠিকমতন বলতে পারবো না, অন্তত এটুকু বলতে পারি যে আস্তে আস্তে আমি নিজেকে বাধ্য করলুম এই দুস্হ জীবনকে স্বেচ্ছাকৃত প্রয়োজনীয়তা হিসাবে মেনে নিতে । ব্যাপারটা যা আমি ঠিক তাই মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছু ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করিনি, আমি একে উঁচুতে তুলিনি, মুখোশ পরাইনি, বরং উল্টোটা, আমি এর অপরিচ্ছন্নতাকে হুবহু সত্যাপন করতে চেয়েছি, আর সবচেয়ে নোংরা নিদর্শনগুলো আমার কাছে হয়ে উঠলো জাঁকজমকের নিদর্শন ।

    এক সন্ধ্যায়, আমি আতঙ্কিত বোধ করলুম, যখন পুলিশের হানার পর আমার খানাতল্লাস করা হচ্ছিল -- আমি সেই সময়ের কথা বলছি যা এই বইয়ের শুরুতে লেখা ঘটনাগুলোর আগের -- অবাক গোয়েন্দা আমার পকেট থেকে টেনে বের করলো, অন্যান্য টুকিটাকির মধ্যে, ভেসলিনের একটা টিউব । আমরা এটা নিয়ে ঠাট্টা করতুম কেননা ভেসলিনটা ছিল মেনথল দেয়া । পুরো নথি দপতর, সেই সঙ্গে আমিও, যদিও কষ্ট করে, এইভাবে হাসিতে মুচড়ে উঠলুম :

    “তুমি এটা নাকে শোঁকো ?”

    “দ্যাখো, তোমায় আবার না সর্দিকাশিতে ধরে । তুমি তোমার জুড়িকে হুপিং কাফ দিয়ে ফেলবে।”

    আমি ভাসা-ভাসা অনুবাদ করলুম, প্যারিসের একজন জোচ্চোরের ভাষায়, সুস্পষ্ট আর বিষাক্ত স্প্যানিশ প্রবাদের বিদ্বেষপরায়ন বিড়ম্বনাটুকু । ব্যাপারটা একটা ভেসলিন টিউবের যার পেছন দিকটা মোড়া ছিল । যার মানে দাঁড়ায় যে তা ব্যবহার করা হয়েছে । পুলিশ হানায় পুরুষদের পকেট থেকে যে সমস্ত চমৎকার টুকিটাকি বের করা হয়েছিল, এটা ছিল তার মধ্যে অপমানের নিখুঁত প্রতীক, যা বেশ সাবধানে লুকিয়ে রাখা হয়, তবু তা গোপন মহিমার চিহ্ণ, যা আমাকে পরে অবমাননা থেকে বাঁচিয়েছে । যখন আমাকে লকআপে পোরা হলো, আর আমি আমার তেজোময়তা ফিরে পেলুম যাতে গ্রেপ্তারির দুর্ভাগ্য কাটিয়ে উঠতে পারি, ভেসলিনের টিউবের ছবিটা আমাকে ছেড়ে যায়নি । পুলিশের লোকটা আমাকে ওটা বেশ ক্রুরভাবে দেখিয়েছিল, যাতে তারা তাদের প্রতিশোধস্পৃহায়, ঘৃণায়, অবমাননায় আহ্লাদে আটখানা হতে পারে । কিন্তু, দ্যাখো দ্যাখো ! সেই নোংরা, অপকৃষ্ট জিনিসটা যার উদ্দেশ্য দুনিয়ার কাছে মনে হয়েছিল -- পৃথিবীর ওই প্রতিনিধি জমঘটের কাছে যা কিনা পুলিশের দল আর, তাছাড়া, ওই বিশেষ পুলিশের স্প্যানিশ দলটা, মুখে রসুনের দুর্গন্ধ, গায়ে ঘাম আর তেলের, কিন্তু দেখতে শাঁসালো, পেশি বেশ পালোয়ানি আর নিজেদের নৈতিক চালচলনে অটল -- অত্যন্ত জঘণ্য, আমার কাছে হয়ে উঠলো বেশ মহার্ঘ । যেসব জিনিস আমার কোমলতাকে ফাঁস করে তাদের থেকে আলাদা, এই জিনিসটা মোটেই অলৌকিক মহিমাদীপ্ত ছিল না ; তা পড়ে রইলো টেবিলের ওপরে ভেসলিনের ধূসর টিউব হয়ে, ভাঙা আর বিবর্ণ, যার বিস্ময়কর বিচক্ষণতা, আর কারাগারের মহাফেজখানায় মামুলি জিনিসপত্রের সঙ্গে তার অত্যাবশ্যক সংগতি ( বেঞ্চ, কালির দোয়াত, নিয়মের বই, মাপার স্কেল, দুগন্ধ ), সাধারণ উদাসীনতার মাঝে, আমাকে মর্মপীড়িত করতে পারতো, যদি না টিউবের ভেতরের মাল আমাকে মনে করিয়ে দিতো একটা তেলের কুপির কথা ( হয়তো তার প্রাণবন্ত বৈশিষ্ট্যের জন্য ), রাতের বেলায় একটা কফিনের পাশে রাখা।

    তা বর্ণনা করার জন্য, আমি আরেকবার একটা ছোটো লক্ষ্যবস্তু গড়ে তুলি, কিন্তু এই ছবিটা তাতে ঢুকে পড়ে : ল্যাম্পপোস্টের তলায়, যে শহরে বসে আমি লিখছি, একজন বুড়ির ম্লান মুখ, গোল, ছোটো, চাঁদের মতন, খুবই ফ্যাকাশে ; বলতে পারছি না আমি দুঃখ পেয়েছিলুম নাকি ভণ্ড সেজেছিলুম । বুড়ি এগিয়ে এলো আমার দিকে, বলল যে ও ভীষণ গরিব আর কিছু পয়সা চাইলো। ওই চাঁদামাছের মতন মুখের ভদ্রতা আমাকে তক্ষুনি বলল : বুড়িটা এখনই কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছে ।

    “বুড়িটা চোর”, আমি নিজেকে বললুম । আমি যখন ওর কাছ থেকে চলে যাচ্ছি, এক ধরণের  তীব্র ভাবাবেশ, আমার অন্তরের গভীরে ঘুমিয়ে, আর তা আমার মনের কিনারায় নয়, আমাকে ভাবতে প্ররোচিত করল যে হয়তো বুড়িটা আমার মা যার সঙ্গে আমার এখন দেখা হলো । আমি তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানি না যিনি আমাকে দোলনায় ফেলে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু আশা করলুম যে রাতের বেলায় যে ভিক্ষা চাইছিল সেই বুড়িই আমার মা ।

    “যদি তিনিই হতেন তাহলে কী হতো?” আমি বুড়ির থেকে দূরে যেতে যেতে ভাবতে লাগলুম । ওহ! যদি তাই হতো, আমি ওনাকে ফুলে ঢেকে দিতুম, গ্ল্যাডিওলি আর গোলাপে, আর চুমু দিয়ে ! ওই চাঁদ-মাছ চোখের ওপরে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে ফোঁপাতুম, ওই গোল, বোকা মুখের ওপরে ! “কিন্তু কেন”, আমার ভাবনা এগিয়ে চললো, “ কেনই বা তা নিয়ে কাঁদবো?” আবেগপ্রবণতার এই গতানুগতিক ছাপ আমার মগজ থেকে সরে যেতে বেশিক্ষণ লাগলো না, তার জায়গায় অন্য ব্যাপার এলো, সবচেয়ে নোংরা আর নিকৃষ্ট, যাকে আমি মর্মার্থের ক্ষমতা দিলুম চুমুর, কিংবা কান্নার কিংবা ফুলের ।

    আমি ভাবলুম, “আমি ওনার কাঁধে মাথা রেখে আবোলতাবোল বলতে পারলে আনন্দিত হবো”, ভেসে যাবো ভালোবাসায় ( এক্ষুনি যে গ্ল্যাডিওলি ফুলের কথা বলেছি তা কি বাচ্চার লালার কথা মনে পড়ায় ? )। ওনার চুলেতে লালা ফেলবো কিংবা ওনার হাতে দুধ ওগরাবো । কিন্তি আমি সেই চোরকে আদর করতে চাইবো যা আমার মা ।

    ভেসলিনের টিউব, যা আমার লিঙ্গকে তেলালো করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করি কিংবা আমার প্রেমিকদের লিঙ্গ, তাঁর মুখ মনে পড়িয়ে দিল যিনি, এক স্বপ্নবিহ্বলতার সময়ে যা শহরের অন্ধকার গলিতে ঘোরাফেরা করতো, তিনি ছিলেন মায়েদের মধ্যে সবচেয়ে অভীষ্ট । তা আমাকে আমার গোপন আনন্দগুলোর জন্যে গড়েপিটে তৈরি করেছিল, এমন সমস্ত জায়গায় যা অসম্বদ্ধ তুচ্ছতার, যা হয়ে উঠেছিল আমার খেয়ালখুশির শর্ত, এই যেমন আমার বীর্যের ছিটেফোঁটা লাগা রুমাল প্রমাণ করে । টেবিলের ওপরে শুয়ে, তা ছিল পুলিশের বিরুদ্ধে আমার ওড়ানো অদৃশ্য বিজয়কেতন । কারাগারের এক কুঠুরিতে । আমি জানতুম যে আমার ভেসলিনের টিউবটা সারারাত ধরে অপমানের মুখে পড়বে -- চিরকালীন উপাসনার উলটো ব্যাপার -- একদল সশক্ত, সৌম্যকান্তি, খসখসে কন্ঠে পুলিশের । এমনই তারা পালোয়ান যে তাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল লোকটা সবকয়টা আঙুল মোচড়ায়, তা থেকে ফেটে বেরোবে, প্রথমে একটা ঠুসকি পাদ, ক্ষণিক আর পচা, গঁদের একটা ফিতে বেরিয়ে আসতে থাকবে হাস্যকর নৈঃশব্দে । যাই হোক, আমি জানতুম যে এই ছোটো আর বিনয়ী বস্তুটা ওদের বিরুদ্ধে নিজেই লড়ে যাবে ; তার সামান্য উপস্হিতি দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত পুলিশকে বেশ চটিয়ে ফেলতে পারবে ; জিনিসটা নিজের দিকে টেনে আনবে অপমান, ঘৃণা, শাদা আর বোবা ক্রোধ । হয়তো জিনিসটা সামান্য বিদ্রুপ করবে-- বিয়োগান্ত নায়কের মতন যে দেবতাদের চটিয়ে মজা পায় -- তার মতনই অবিনাশী, আমার আনন্দে আত্মসমর্পিত, আর গর্বিত । আমি ফরাসি ভাষার নতুন শব্দে গান গাইতে চাইবো । কিন্তু আমি তার জন্য লড়তেও রাজি, তার সন্মানে সর্বসংহারের অনুষ্ঠান করতেও রাজি আর কোনো একটা গ্রামকে গোধুলীবেলায় লাল নিশান দিয়ে সাজিয়ে তুলতে চাইবো ।

    কোনো নৈতিক কাজের সৌন্দর্য নির্ভর করে তার প্রকাশ করার মধ্যে । একথা বলা যে এই জিনিসটা সুন্দর তার মানে হলো যে তা সত্যিই সুন্দর । তাকে প্রমাণ করে দেখাতে হবে । এটা হলো ছবির করণীয় কাজ, অর্থাৎ, বাস্তব জগতের প্রভার সঙ্গে তার একাত্মতা । কাজটা সুন্দর হবে যদি তা প্ররোচিত করে, আর আমাদের কন্ঠে বিকশিত হয়, গান । অনেক সময়ে যে চেতনার সাহায্যে আমরা একটা বিখ্যাত কুকর্মের কথা ভেবেছি, প্রকাশ করার ক্ষমতার জন্য জরুরি তাকে জ্ঞাপন করা, আমাদের গান গাইতে বাধ্য করা । এর মানে হলো প্রতারণা ব্যাপারটা সুন্দর হবে যদি তা আমাদের দিয়ে গান গাওয়ায় । চোরদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে তা যে আমাকে আবার নৈতিক জগতে নিয়ে গিয়ে ফেলবে, তা নয়, আমি ভাবলুম, তার ফলে আমি আরেকবার নিজেকে সমকামীতার জগতে পাবো । আমার গায়ে যতো জোর বাড়ে, আমি আমার শুভ হয়ে উঠি । আমি হুকুম জারি করি। পুরুষদের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য বলতে আমি বুঝি একটা মুখের আর শরীরের সমন্বয়পূর্ণ বৈশিষ্ট্য আর তার সঙ্গে অনেক সময়ে যোগ করতে হয় পুরুষালি চারুতা ।  সৌন্দর্যের সঙ্গে তখন যোগ হয় দুর্দান্ত সৌষ্ঠব, প্রবলপ্রতাপ আকার-ইঙ্গিত। আমরা মনে করি তারা নির্ধারিত হয় বিশেষ নৈতিক আচরণের মাধ্যমে, আর নিজেদের ভেতর তেমন সদগুণ চর্চা করে যা আমাদের শুকনো মুখ আর অসুস্হ শরীরকে সেই ওজস্বিতা দেবে যা প্রেমিকদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে থাকে । হায়, এই সমস্ত সদগুণ, যা তাদের কখনও থাকে না, তা আমাদের দুর্বলতা ।

    এই যে আমি লিখতে বসেছি, আমি আমার প্রেমিকদের নিয়ে ভাবি । আমি তাদের আমার ভেসলিন মাখিয়ে দিতে চাইবো, সেই মোলায়েম, মিহি মেনথলগন্ধ জিনিসটা ; আমি চাইবো তাদের পেশিগুলো স্নান করুক স্বচ্ছ হালকা জিনিসটায় যেটা ছাড়া সবচেয়ে সৌম্যকান্তির সাধনীটিও কম প্রণয়োদ্দীপক ।

    যখন কোনো প্রত্যঙ্গ বাদ দেয়া হয়, বলা হয় যে অন্য অঙ্গটা তখন শক্তপোক্ত হয়ে বেড়ে ওঠে। আমি আশা করেছিলুম যে স্তিলিতানোকে যে হাতটা খোয়াতে হয়েছিল তার প্রাণক্ষমতা ওর লিঙ্গে একত্রিত হবে । অনেককাল যাবত আমি কল্পনা করেছি একজন সারবান সদস্যের, সোঁটার মতন, যা সবচেয়ে সাংঘাতিক অর্ন্তদৃষ্টির ক্ষমতা রাখে, অথচ যা আমাকে প্রথমে উৎসুক করলো তাহলো এই যে স্তিলিতানো আমাকে ব্যাপারটা জানতে দিলো : মামুলি ভাঁজের দাগ, যদিও আশ্চর্যজনকভাবে বাঁ পায়ে, ওর নীল ডেনিম ট্রাউজারে । এই ব্যাপারটা আমায় দুঃস্বপ্নে দেখা দিতো যদি না স্তিলিতানো উদ্ভট মুহূর্তগুলোয়, ওর হাত জায়গাটায় না রাখতো, আর যদি না ও, মহিলারা যেমন সৌজন্য দেখান, ভাঁজের দাগটা দেখিয়ে নখ দিয়ে কাপড়ের ওপর চিমটি কাটতো। আমার মনে হয় না ও কখনও আত্মাভিমান হারিয়েছে, কিন্তু আমার কাছে ও থাকতো বিশেষভাবে প্রশান্ত । নির্লজ্জের মতন হেসে, যদিও বেশ নিস্পৃহ, ওকে আমার আদর করার পানে চেয়ে থাকতো । আমি জানতুম ও আমাকে ভালোবাসবে ।

    হাতে সাজি নিয়ে সালভাদোর, আমাদের হোটেলের চৌহদ্দি পেরোবার আগে, আমি এমন উত্তেজিত বোধ করছিলুম যে রাস্তাতেই ওকে চুমু খেলুম, কিন্তু ও আমাকে ঠেলে এক পাশে সরিয়ে দিলো :

    “তোমার মাথা খারাপ ! লোকেরা ভাববে আমরা গাণ্ডু !”

    ও ফরাসিভাষা ভালোই বলতে পারতো, পেরিপিয়াঁয় আঙুর ক্ষেতে কাজ করার সময়ে শিখেছিল। গভীর আঘাত পেয়ে আমি পেছন ফিরলুম । ওর মুখ বেগুনি হয়ে উঠলো। ওর গায়ের রঙ ছিল শীতের বাঁধাকপির মতন । সালভাদোর হাসলো না । ও মর্মাহত হয়েছে টের পেলুম । “আমি এরকম ব্যবহারই পাই”, ও নিশ্চয়ই ভেবেছিল, “সাতসকালে উঠে তুষারের মধ্যে ভিক্ষা করার বদলে। ও জানেই না কেমন আচরণ করতে হয়।” ওর চুল ভিজে গিয়েছিল আর জটপাকানো। জানালার ভেতর থেকে, মুখগুলো আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল, কেননা হোটেলের একতলায় একটা কাফে ছিল যা ফুটপাত পর্যন্ত প্রসারিত, যার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো ওপরের ঘরে যাবার জন্য। আস্তিনে মুখ পুঁছে সালভাদোর ভেতরে চলে গেলো । আমি ইতস্তত করছিলুম । তারপর ওর পেছন পেছন ঢুকলুম । আমার তখন কুড়ি বছর বয়স । যদি নাকের ডগায় একটা ফোঁটা চোখের জলের মতন অনাবিল হয় তাহলে কেনই বা তা একই আগ্রহে চেটে নেবো না ? আমি আগে থেকেই যথেষ্ট জড়িয়ে পড়েছিলুম নীচকুলোদ্ভবদের পুনর্বাসনে । যদি না বেয়াড়া সালভাদোরের ভয়ের ব্যাপার হতো, আমি কাফেতেই ওকে চুমু খেতে পারতুম । ও, যদিও, নাকের জল ফেলছিল, আমি বুঝতে পারলুম ও নিজের শ্লেষ্মা গিলছিল । হাতে সাজি নিয়ে, ভিখারি আর ভবঘুরে নিরাশ্রয়দের পাশ কাটিয়ে ও রান্নাঘরের দিকে এগোলো । আমার আগে-আগে ।

    “তোমার সঙ্গে ব্যাপারটা কি বলোতো ?” আমি বললুম ।

    “তুমি লোকেদের মনোযোগ আকর্ষণ করছ।”

    “তাতে দোষের কি?”

    “লোকে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ওইভাবে চুমু খায় না । আজ রাতে, তুমি যদি চাও…”

    ও ঠোঁট ফাঁক করে এমনভাবে কথাগুলো বললো মনে হলো তা কমনীয়তাহীন আর সেই সঙ্গে একইরকম অবজ্ঞার সুরে । আমি শুধু আমার কৃতজ্ঞতা জানাতে চেয়েছিলুম, আমার দারিদ্রের স্নেহে উষ্ণতা দিতে চেয়েছিলুম ।

    “কিন্তু তুমি কি ভাবছিলে ?”

    কেউ একজন ওর সঙ্গে ধাক্কা খেলো আর দুঃখ প্রকাশ করলো না, ওকে আমার থেকে আলাদা করে দিলো । আমি ওকে রান্নাঘরের ভেতর পর্যন্ত অনুসরণ করিনি ।আমি স্টোভের কাছে একটা ফাঁকা বেঞ্চে গিয়ে বসলুম । যদিও আমি সতেজ সৌন্দর্যের প্রশংসা করি, আমি এখন আর মাথা ঘামালুম না যে এই গেরস্হ ধরণের লোকটাকে ভালোবাসার জন্যে নিজেকে কেমনভাবে উপস্হিত করব ; এমনই এক দারিদ্র্যপীড়িত ভিখারি যার ওপর কম সাহসীরাও তর্জন-গর্জন করতে পারে, কেমন করেই বা ওর তেকোনা পাছাকে আদর করতে পারবো...আর যদি, দুর্ভাগ্যবশত, ওর সাধনীটা প্রণয়োদ্দীপক হয় ?

    বারিও চিনো জায়গাটা, সে-সময়ে, ছিল একধরণের আস্তানা যেখানে স্পেনের লোকেরা কম আর বিদেশিরা বেশি ভিড় করতো, তাদের সব কয়টা ছাঁটাই মাল । আমরা অনেকসময়ে কাগজি-বাদাম সবুজ পোশাক পরতুম কিংবা নার্সিসাস-হলুদ রেশমের শার্ট আর ছেঁড়া ক্যাম্বিশ জুতো, আর আমাদের চুল এমন পেছন দিকে চেকনাই দেয়া থাকতো যে মনে হতো তাতে চিড় ধরবে । আমাদের কোনো নেতা ছিল না বরং পরিচালক ছিল । আমি বলতে পারছি না কেমন করে তারা অমন ক্ষমতা পেলো । বোধহয় আমাদের সামান্য মালপত্রের ভালো দাম যোগাড় করতে পারতো বলে । ওরা আমাদের সমস্যার খেয়াল রাখতো আর কাজকারবারের ব্যাপারে খবর দিতো, তার জন্য ওরা মোটামুটি একটা অংশ নিতো । আমরা ঢিলেঢালা দল গড়িনি, কিন্তু সেই বিরাট নোংরা বিশৃঙ্খলায়, যে পরিবেশে তেলকুটে দুর্গন্ধ, পেচ্ছাপ আর গুয়ের ছড়াছড়ি, কয়েকজন বাজে আর ইতর লোক নিজেদের চেয়ে চালাক-চতুরদের ওপর বেশি নির্ভর করতো। কলুষ আর কল্মষ আমাদের যুবকদের সঙ্গে ঝিলমিলিয়ে উঠতো আর হাতেগোণা কয়েকজনের রহস্যময় প্রতিভা, যারা সত্যিই স্ফূলিঙ্গ ছড়াতো, যুবকেরা যাদের দেহ, চাউনি আর ইশারা-ইঙ্গিত এমন এক চৌম্বকশক্তিতে আকর্ষণীয় ছিল যে আমাদের করে তুলতো তাদের শিকারী । এই ভাবেই আমি ওদের একজনের দ্বারা টলে গিয়েছিলুম । এক হাতের স্তিলিতানো সম্পর্কে লেখার জন্য আমি কয়েক পৃষ্ঠা অপেক্ষা করবো । শুরুতেই বলে ফেলা যাক ওর কোনো খ্রিস্টধর্মী মূল্যবোধ ছিল না । ওর পুরো ধীশক্তির, ওর পুরো ক্ষমতার, উৎস ছিল ওর দুই উরুর ফাঁকে । ওর লিঙ্গ, আর যা তাকে সম্পূর্ণ করে, সম্পূর্ণ যন্ত্রপাতি, এতোই সুন্দর ছিল যে আমি তাকে সৃজক অবয়ব বলতে পারি । যে কেউ মনে করতে পারতো যে ও মরে পড়ে আছে, কেননা ও কদাচিৎ, আর বেশ ধীরেসুস্তে, উত্তেজিত হতো : ও কেবল দেখতো । অন্ধকারে ভালোভাবে বোতামদেয়া অবস্হায় ও নিষ্পাদনের জন্য তৈরি হতো, যদিও কেবল এক হাতে বোতাম পরানো, যে আলোকময়তায় জিনিসটার বাহক উজ্বল হয়ে উঠবে ।

    সালভাদোরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছয় মাস বজায় ছিল । এটা সবচেয়ে মোহক ভালোবাসা ছিল না, ছিল বহুপ্রসূ ভালোবাসাগুলোর অন্যতম । আমি ওই অসুস্হ দেহ, ধূসর মুখ, আর কয়েকটা চুলের হাস্যকর দাড়ির লোকটাকে ভালোবাসার জন্য নিজেকে বাগ মানিয়ে নিয়েছিলুম । সালভাদোর আমার যত্ন করতো, কিন্তু রাতের বেলায়, মোমবাতির আলোয়, আমি হুকুন বাছতুম, আমাদের পোষা প্রাণী, যেগুলো বাসা বাঁধতো আমাদের ট্রাউজারের খাঁজে-খাঁজে । উকুনগুলো আমাদের সঙ্গে বসবাস করতো । আমাদের জামাকাপড়কে প্রাণবন্ত করতো, এক উপস্হিতি, আর যখন ওরা বিদায় নিতো, আমাদের পোশাক হয়ে যেতো প্রাণহীন । আমরা জানতে চাইতুম -- আর অনুভব করতে -- যে এই আধা-স্বচ্ছ পোকাগুলো ঝাঁক বেঁধে রয়েছে, যদিও পোষা নয়, ওগুলো আমাদের জীবনের এমন অংশ হয়ে গিয়েছিল যে তৃতীয় কোনো লোকের উকুন আমাদের বিতৃষ্ণা জাগাতো ।  আমরা ওগুলোকে তাড়াতুম কিন্তু দিনের বেলায় ভাবতুম ডিমগুলো থেকে কচি উকুন বেরিয়েছে । ওগুলোকে নখে পিষে মারতুম, কোনোরকম বিতৃষ্ণা আর ঘৃণা ছাড়াই । লাশগুলোকে ফেলে দিতুম না -- বা অবশিষ্টাংশ -- জঞ্জালে ; ওগুলোকে পড়ে যেতে দিতুম, আমাদের রক্তে রক্তাক্ত, আমাদের অপরিচ্ছন্ন জাঙিয়ায় । আমাদের উন্নতির একমাত্র প্রমাণ ছিল উকুনগুলো, উন্নতির পাতালের নিদর্শন, কিন্তু ব্যাপারটা যুক্তিযুক্ত ছিল এই কারণে যে আমাদের অবস্হা একটা অপারেশান করতে পারলো যা ন্যায্যতা প্রমাণ করে, যে আমরা, একই শর্তে, আমাদের অবস্হার চিহ্ণগুলোকে ন্যায্যতা দিচ্ছি । উকুনগুলো ছিল দামি, কেননা আমাদের অবসানের জরুরি জ্ঞানের জন্য এই মণিরত্নগুলোকে, বলা যেতে পারে, আমাদের বিজয় । তারা চিল একযোগে আমাদের গৌরব ও লজ্জা । আমি বহুদিন একটা ঘরে থাকতুম যাতে জানালা ছিল না, কেবল দালানে একটা ঘুলঘুলি, যেখানে, সন্ধ্যাবেলায়, পাঁচটা চোটো মুখ, নিষ্ঠুর আর কোমল, হাসতো কিংবা গুমোট জায়গাটাকে আঁটার অযোগ্য করে তুলতো, টপটপে ঘাম ফেলে, ওই পোকাগুলো শিকার করতো যেগুলোর সুকৃতিতে আমরা অংশ নিয়েছি । ভালো ছিল যে অমন দুর্দশার গভীরে, আমি ছিলুম গৃহস্হের মধ্যে সবচেয়ে গরিবের প্রেমিক । আমি তাই পেয়েছিলুম এক বিরল সুবিধা । মুশকিল হতো বটে, কিন্তু আমার প্রতিটি বিজয় -- আমার নোংরা হাত, গর্বে মেলে ধরা, আমার দাড়ি আর দীর্ঘ চুলকে সদম্ভে প্রকাশ করতে পারতো -- আমাকে দিতো শক্তি -- কিংবা দুর্বলতা, আর এখানে দুটো ব্যাপারই এক-- কেননা বিজয় অনুসরণ করে, যা আমাদের ভাষায় বলা হতো অপমানপূর্ণ হতাশা । তবু, আমাদের জীবনে আলো আর প্রতিভা জরুরি হওয়ার কারণে, শার্শি আর জঞ্জালের ভেতর দিয়ে একটা সূর্যরশ্মি আসতো আর ঢুকে পড়তো নিষ্প্রভতায় ; এই উপাদানগুলোর জন্য আমাদের ছিল শিশির জমে তৈরি তুষার, মেঝের ওপরে বরফের পাতলা প্রলেপ, যদিও তারা দুর্যোগ সৃষ্টি করতে পারে, আমাদের কাছে যথেষ্ট ছিল, আনন্দের উৎস, যার চিহ্ণ, আমাদের ঘরে অনন্বিত : ক্রীসমাস আর নববর্ষ উৎসব সম্পর্কে আমরা যেটুকু জানতুম তা হল তার সঙ্গে যাকিছু থাকে আর যা উল্লাসিত লোকদের কাছে প্রিয় : তুষার ।

    নিজেদের ক্ষতকে চর্চা করাটাও ভিখারিদের কাছে বাড়তি পয়সা রোজগারের একটা উপায় --- যার ওপর নির্ভর করে জীবন চালানো যায় --- যদিও তারা হয়তো এই পথে চলে যায় তাদের দারিদ্র্যের হালতের  আলস্যের দরুণ, গর্বে মাথা তুলে দাঁড়ানো, অবজ্ঞাকে পরোয়া না করে, সেই জিনিসটা হলো পুরুষালি সততা । নদীতে পাথরের মতন, গর্বও ভেঙে পড়ে আর অবহেলায় চূর্ণ হয়, ফেটে যায় । আরও অপমানে প্রবেশ করলে, গর্ববোধ উন্নত হবে ( যদি সেই ভিখারিটা আমি হই ) যখন আমি জানি -- শক্তি বা দুর্বলতা -- অমন অদৃষ্টের সুযোগ নেবার জন্য । এটা খুবই জরুরি, যেমন এই কুষ্ঠরোগ আমাকে কাবু করছে, আমাকেও তাকে কাবু করতে হবে আর, শেষে, আমাকে জিততে হবে । তাহলে কি আমি ক্রমশ  করে জঘন্য হয়ে উঠবো, বেশির থেকে বেশি, বিতৃষ্ণার পাত্র, সেই অন্তিম বিন্দু পর্যন্ত যা এখনও অজানা কিন্তু যা এক নান্দনিকতা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে আর সেই সঙ্গে নৈতিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে ? বলা হয় যে কুষ্ঠরোগ, যার সঙ্গে আমি আমাদের অবস্হার তুলনা করি, টিশ্যুগুলোতে চুলকানির সৃষ্টি করে ;  রোগি নিজেকে চুলকাতে থাকে ; তার লিঙ্গোথ্থান হয় । স্বমেহন হয়ে দাঁড়ায় পৌনোঃপুনিক । তার নিঃসঙ্গ যৌনতায় কুষ্ঠরোগি নিজেকে সান্তনা দ্যায় আর নিজের রোগের স্তবগান গায় । দারিদ্র্য আমাদের ঋজু করেছে । সারা স্পেন জুড়ে আমরা এক গুপ্ত ব্যাপার বয়ে বেড়িয়েছি, ঔদ্ধত্বের সঙ্গে মিশেল না দেয়া অবগুন্ঠিত চমৎকারীত্ব । আমাদের অঙ্গভঙ্গী হয়ে উঠলো নম্র থেকে আরও নম্র, মিনমিনে থেকে আরও মিনমিনে, যেমন যেমন আমাদের নীচাবস্হার স্ফূলিঙ্গ আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য আরও দীপ্ত হতে থাকলো । এইভাবে আমার ভিখারির চেহারাকে মহিমায় মুড়ে তোলার জন্য আমার মধ্যে বিকশিত হলো বিশেষ কর্মদক্ষতা । ( আমি এখনও সাহিত্যিক প্রতিভার কথা বলিনি ।) এটা একটা কাজে লাগাবার শৃঙ্খলা বলে আমার মনে হয়েছে আর এখনও তার দরুণ আমি মৃদু হাসি হাসতে পারি সবচেয়ে নম্র পেঁকোদের মাঝে, তা মানুষ হোক বা জিনিসপত্র, এমনকি বমিও, এমনকি যে লালা আমি আমার মায়ের মুখের ওপর উগরে আবোলতাবোল বকতে পারতুম, এমনকি তোমার গু-পেচ্ছাপ । ভিখারি হবার অবস্হানের ধারণা আমি আমার মধ্যে সংরক্ষণ করে রাখবো ।

    আমি হতে চেয়েছিলুম মহিলাদের মতন যাঁরা, বাড়িতে, লোকেদের দৃষ্টির আড়ালে, নিজের মেয়েকে সামলে রাখে, এক ধরণের বীভৎস কদাকার দানব, বোকা আর শ্বেতাঙ্গ, যে চার পায়ে ঘোঁৎঘোৎ করে বেড়ায় । মা যখন জন্ম দিয়েছিলেন, তখন ওনার বিষাদ সম্ভবত এমন ছিল যা তা তাঁর জীবনের একমাত্র সারসত্তা হয়ে উঠেছিল । উনি এই দানবকে ভালোবাসবার নির্ণয় নিলেন, তাঁর পেট থেকে যে কদর্যতা বেরিয়ে এসেছিল, শ্রমের দ্বারা সুসম্পন্ন, আর তাকে ভক্তিভরে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন । তাঁর নিজের ভেতরে তিনি এক বেদিকে সাজিয়ে তুলেছিলেন যার ওপরে তিনি দানবের ধারণাকে সংরক্ষণ করেছিলেন । স্নেহে উৎসর্গ করে, আলতো হাতে, তাঁর প্রতিদিনের পরিশ্রমে তাতে কড়া পড়ে গিয়ে থাকলেও, আশাহীনের স্বেচ্ছাকৃত উদ্দীপনায়, তিনি নিজেকে পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিলেন আর পৃথিবীর বিরুদ্ধে তিনি দাঁড় করিয়ে দিলেন দানবটাকে, যা জগতের আর তার ক্ষমতার সমানুপাত নিয়ে নিলো । দানবকে বনিয়াদ করে নতুন রীতিনীতি প্রতিপাদন করা হলো, যে রীতিনীতি কে অবিরাম লড়ে যেতে হয়েছে জগতের পরাক্রমের সঙ্গে যা তাঁকে বিদ্ধস্ত করতে এগিয়ে এসেছে কিন্তু থেমে গেছে তাঁর বাসার দেয়ালের কাছে পৌঁছে যেখানে তাঁর মেয়ে অবরুদ্ধ ছিল ।

    কিন্তু, অনেকসময়ে চুরি করা দরকার ছিল, আমরা জানতুম সাহসের সুস্পষ্ট পার্থিব সৌন্দর্যের কথা । ঘুমোতে যাবার আগে, সরদার, মানে দলের কর্তা, আমাদের পরামর্শ দিতো । যেমন ধরা যাক, আমরা জাল কাগজ নিয়ে নানা কনসুলেটে যাবো যাতে আমাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হয় । দেশের দূত, আমাদের দুঃখকষ্ট আর দুর্দশায় প্রভাবিত হয়ে বা চটে গিয়ে, আমাদের টিকিট কেটে দেবেন সীমা পর্যন্ত । আমাদের নেতা সেগুলো বারসেলোনা স্টেশানে বিক্রি করে দেবে । সে আমাদের বলতো গির্জায় কেমন করে চুরি করতে হবে -- যা স্পেনের লোক করতে সাহস পায় না -- কিংবা বড়োলোকদের ভিলায় ; আর ও নিজে নিয়ে আসতো নেদারল্যাণ্ড আর ইংরেজ নাবিকদের যাদের কাছে আমরা খুচরো পয়সার জন্য গাণ্ডুগিরি করতুম ।

    এইভাবে আমরা কখনও চুরি করতুম, আর প্রতিটি লুটতরাজ আমাদের কিছুদিনের জন্য খোলা জায়গায় স্বাস নিতে দিতো । রাতের তৎপরতার জন্য আমাদের আগে থেকে খবর রাখতে হতো অস্ত্রশস্ত্রের । ভয়ের চোটে তৈরি স্নায়বিক দুর্বলতা, আর অনেক সময়ে উদ্বেগ,  ধার্মিকের মতন মেজাজ গড়ে তোলে । সেরকম সময়ে আমি সামান্য দুর্ঘটনাতেও অশুভের সংকেত পেতুম । সুযোগের ইশারা হয়ে ওঠে অনেক ব্যাপার । অজানা ক্ষমতাগুলোকে আমি জাদুমুগ্ধ করে দিতে চাই যার ওপর আমাদের অভিযানের সফলতা নির্ভর করে । আমি নৈতিক কাজ দিয়ে তাদের জাদুমুগ্ধ করতে চাই, মূলত দান-খয়রাতের মাধ্যমে । আমি ভিখারিদের বেশি করে আর হাত খুলে দিত চাই, আমি বুড়ো লোকেদের আমার আসন ছেড়ে দিই, আমি একপাশে সরে দাঁড়াই যাতে তারা যেতে পারে, আমি অন্ধদের রাস্তা পার হতে সাহায্য করি, আরও কতো কি। এইভাবে, মনে হয় আমি মেনে নিই যে চুরিচামারির কাজের ওপর একজন দেবতার শাসন কাজ করে যাঁর কাছে নৈতিক কাজ গ্রহণযোগ্য । এই প্রয়াসগুলো হলো সুযোগের ওপরে জাল ফেলার কাজ যাতে এই দেবতা, যার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না, জালে ধরা পড়বে, আমাকে ক্লান্ত করবে, বিঘ্ন সৃষ্টি করবে আর ধার্মিক মনঃস্হিতি তৈরি করতে সাহায্য করবে । চুরি করার ব্যাপারে তারা আনুষ্ঠানিক কাজের গাম্ভীর্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে । তা সত্যিই অন্ধকারের হৃদয়ে অনুষ্ঠিত হয়, তার সঙ্গে যোগ হব যে তা রাতে হলে ভালো, যখন লোকেরা ঘুমোয়, এমন জায়গা যা বন্ধ আর হয়তো কালোর মুখোশে ঢাকা । পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে হাঁটা, নৈঃশব্দ্য, দিনের বেলাতেও যে অদৃশ্যতা আমাদের দরকার হয়, হাতড়ানো হাতের অন্ধকারে ইশারা কোনো আসন্ন জটিলতা বা সতর্কতার । কেবল একটা দরোজার হাতল ঘোরানোতেও দরকার হয় অনেকগুলো প্রক্রিয়া, প্রতিটি পলকাটা মণিরত্নের মতন দীপ্তিমান । যখন আমি সোনা খুঁজে পাই, তখন মনে হয় আমি তা মাটির তলা থেকে বের করেছি ; আমি বহু উপমহাদেশকে, দক্ষিণ-সমুদ্রের দ্বীপগুলো লুট করেছি ; আমাকে নিগ্রোরা ঘিরে রেখেছে ; তারা আমার অসুরক্ষিত দেহকে বিষমাখানো বর্শা দিয়ে খোঁচা দেবার হুমকি দ্যায়, কিন্তু তখন সোনার সততা কাজ করা আরম্ভ করে, আর আমাকে দারুণ একটা বলিষ্ঠতা পিষে ফ্যালে কিংবা উল্লসিত করে । বর্শাগুলো নামানো হয়, নিগ্রোরা আমাকে চিনতে পারে আর আমি উপজাতির একজন সদস্য হয়ে যাই । 

    নিখুঁত কাজ : ভুল করে আমার হাত সৌম্যকান্তি এক ঘুমন্ত নিগ্রোর পকেটে ঢুকে যায়, আমার আঙুলে তার শক্ত হতে থাকা লিঙ্গ অনুভব করি আর হাত বের করে তার পকেট থেকে চুরি করা সোনার মুদ্রা আবিষ্কার করি -- বিচক্ষণতা, ফিসফিসে কন্ঠস্বর, উৎকর্ণ কান, অদৃশ্য, কোনো দোসরের স্নায়বিক দুর্বল উপস্হিতি আর তার ইশারা বুঝতে পারা, সবকিছু আমাদের নিজেদের মধ্যে কেন্দ্রিত করে, আমাদের একজুট করে, আমাদের করে তোলে উপস্হিতির নাচের দল, যা গি-এর মন্তব্য ভালো ব্যাখ্যা করে :

    “তুমি অনুভব করো যে তুমি জীবন্ত।”

    কিন্তু আমার অন্তরজগতে, এই সামগ্রিক উপস্হিতি, যা আমার মনে হয় কাজের গাম্ভীর্যকে অসাধারণ ক্ষমতার বোমায় পালটে দিয়েছে, তা যেন এক অন্তিক ভালোথাকা--- লুটতরাজ, যখন চলছে, সব সময়ে মনে হয় এটাই শেষ, এমন নয় যে তুমি ভাবো যে এর পর আরেকটা করবে না -- বস্তুত তুমি ভাবোই না -- বরং অমন অহং-এর একত্রীকরণ হতে পারে না ( জীবনে তো নয়ই, কেননা একে আরও চাপ দিলে জীবন থেকে কেটে পড়তে হবে ) ; আর কাজের এই একতা যা বিকশিত হয় ( যেমন গোলাপফুল তার দলমণ্ডল মেলে ধরে ) তা সচেতন ইঙ্গিত-ইশারার, তাদের নৈপূণ্য সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী, তাদের দুর্বলতা সম্পর্কেও আর তবু কাজটায় যে হিংস্রতা আছে, এখানেও তাকে ধার্মিক আচার-আচরণের মূল্য দ্যায় । প্রায়ই আমি তা কাউকে উৎসর্গ করি । প্রথমবার ছিল স্তিলিতানো যার অমন সন্মান ছিল প্রাপ্য । আমার মনে হয় ওর দ্বারাই আমি অভিষিক্ত হয়েছিলুম, মানে, ওর দেহ সম্পর্কে আমার আবেশ আমাকে পিছিয়ে আসতে দ্যায়নি। ওর সৌন্দর্যের প্রতি, ওর খোলাখুলি দুর্বিনয়ের প্রতি, আমি প্রথম দিকের চুরিগুলো উৎসর্গ করেছিলুম । ওই অসাধারণ বিকলাঙ্গের এককত্বও, যার হাত, কবজির কাছ থেকে কাটা, কোথাও পচছে, কোনো চেস্টনাট গাছের তলায়, ও আমাকে তাইই বলেছিল, মধ্য ইউরোপের জঙ্গলে । চুরি করার সময়ে, আমার শরীর ফাঁস হয়ে যায় । আমি জানি তা আমার ইশারা-ইঙ্গিতে ঝলমল করে । পৃইবী আমার সমস্ত চলাফেরা সম্পর্কে একাগ্র, যদি তা আমায় ল্যাঙ মারতে চায় । সামান্য ভুলের জন্য আমাকে বড়ো খেসারত দিতে হবে, কিন্তু যদি ভুল হয়ও আর আমি তা সময়মতো টের পাই, তাহলে আমাদের বাপের আস্তানায় সবাই আহ্লাদে আটখানা হবে । কিংবা, যদি ফেঁসে যাই, তাহলে বিপর্যয়ের পর বিপর্যয় আর তারপর কারাগার । কিন্তু বুনো অমার্জিতদের ক্ষেত্রে, যে দণ্ডপ্রাপ্ত পালাবার ব্যবস্হা করার ঝুঁকি নেয় সে তাদের সঙ্গে সেই উপায়ে দেখা করবে যা আমি সংক্ষেপে আমার অভ্যন্তরিক অভিযানে বর্ণনা করেছি । যদি অচেনা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে, সে প্রাচীন উপজাতিদের পাহারা-দেওয়া কোনো মাল পাচারকারীর মুখোমুখি হয়, তাহলে তারা তাকে মেরে ফেলবে কিংবা বাঁচাবে । আদিম জীবনে ফিরে যাবার জন্য আমি দীর্ঘ, বহু দীর্ঘ পথ বেছে নিয়েছিলুম । যা আমি সবচেয়ে আগে চাই তা হল আমাদের জাতির দ্বারা নিন্দা ।

    সালভাদোর আমার কাছে গর্ববোধের উৎস ছিল না । ও যখন চুরি করতো, ও কেবল দোকানগুলোর সামনের জানলার তাক থেকে মামুলি জিনিস তুলে নিতো । রাতের বেলায়, যে কাফেতে আমরা সবাই জড়ো হতুম, ও আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সৌম্যকান্তির পাশে দুঃখি মুখে সেঁদিয়ে যেতো । অমন জীবন ওকে হাঁপিয়ে তুলতো । যখন আমি ঢুকতুম, আমি ওকে কুঁজো হয়ে বসে থাকতে দেখে লজ্জা পেতুম, কোনো বেঞ্চে বসে, ওর কাঁধ সবুজ আর হলুদ সুতির কাঁথায় জড়োসড়ো, যেটা গায়ে জড়িয়ে ও শীতকালে ভিক্ষা করতে বেরোতো । ও একটা পুরোনো কালো শালও গায়ে জড়াতো, যেটা আমি নিতে চাইনি । সত্যিই, যদিও আমার মন সহ্য করতো, এমনকি চাইতো, নম্রতা প্রকাশ করি, কিন্তু আমার তেজি দেহ তা প্রত্যাখ্যান করতো । সালভাদোর দুঃখি, চাপা গলায় বলতো :

    “তুমি কি চাও আমরা ফ্রান্সে ফিরে যাই ? আমরা গ্রামের দিকে কাজ করবো।”

    আমি বললুম, না । ও আমার অপছন্দ বুঝতে পারেনি -- না, আমার ঘৃণা -- ফ্রান্সের প্রতি, এমন নয় যে আমার অভিযান, যদি বারসেলোনায় থেমে যায়, গভীরভাবে চলতেই থাকবে, বেশি বেশি করে গহনভাবে, আমার অন্তরজগতের প্রত্যন্ত এলাকায় ।

    “কিন্তু আমি সব কাজ করে দেবো । তোমাকে কষ্ট করতে হবে না ।”

    “না।”

    আমি ওকে ওর আনন্দহীন দারিদ্র্যে ওর বেঞ্চে ফেলে চলে যেতুম । আমি স্টোভের কাছে যেতুম কিংবা মদের জমায়েতে আর দিনের বেলায় কুড়িয়ে পাওয়া সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ফুঁকতুম, একজন দাঁত-খেঁচানো আন্দালুসীয়ের সঙ্গে, যার নোংরা শাদা পশমের সোয়েটার ওর ধড় আর পেশিকে ফুলিয়ে তুলতো । নিজের দুহাত কচলে, যেমন বুড়োরা করে, সালভাদোর ওর বেঞ্চ ছেড়ে সার্বজনিক রান্নাঘরে ঢুকে সুপ তৈরি করতে আরম্ভ করতো কিংবা গ্রিলের ওপরে একটা মাছ বসিয়ে দিতো । একবার ও প্রস্তাব দিলো যে হেউলভাতে যাওয়া যাক কমলালেবু তোলার মজুরের কাজ করতে । তখন সন্ধ্যা আর ও অনেকের কাছে অপমানিত হয়েছিল, আমার হয়ে ভিক্ষা করার জন্যে অনেক ধমক খেয়েছিল, তবুও আমাকে ভর্ৎসনা করে ক্রিয়োলায় আমার যৎসামান্য সফলতার কথা বলতে পারলো । 

    “সত্যিই, তুমি যখন কোনো খদ্দেরকে বেছে নাও, তোমার উচিত তাকে পারিশ্রমিক দেওয়া।”

    আমরা হোটেলের মালিকের সামনেই ঝগড়া করছিলুম, যে আমাদের বাইরে বের করে দিতে চাইছিল । সালভাদোর আর আমি তাই ঠিক করলুম পরের দিন দুটো কম্বল চুরি করবো আর দক্ষিণে যাবার মালগাড়িতে লুকিয়ে রাখবো । কিন্তু আমি এমন চালাক-চতুর ছিলুম যে সেদিন সন্ধ্যাতেই একজন কাস্টমস অফিসারের হাফকোট গেঁড়িয়ে আনলুম । যখন ডক দিয়ে যাচ্ছিলুম, যেখানে ওদের পাহারাদাররা থাকে, একজন অফিসার আমাকে ডাকলো । সে যা চাইলো আমি তাইই করলুম, সান্ত্রি কুঠরির ভেতরে । বীর্যপাতের পর ( সম্ভবত, আমাকে সেকথা বলার সাহস ছিল না লোকটার, ও একটা ফোয়ারার কাছে ধুতে চলে গেলো ), এক মুহূর্তের জন্য ও আমাকে একা ছেড়ে গিয়েছিল, সেই ফাঁকে আমো ওর পশমের বড়ো কালো উর্দি নিয়ে কেটে পড়লুম । আমি হোটেলে ফেরার আগে সেটা পরে নিলুম, আমি আমি জানতুম দ্ব্যর্থকতার মজা, তখনও পর্যন্ত বিশ্বাসভঙ্গের আনন্দ নয়, যদিও যে প্রতারণামূলক বিভ্রান্তি আমাকে বুনিয়াদি পরস্পরবিরোধিতাকে অস্বীকার করতে বাধ্য করবে তার বিরচন  ইতিমধ্যে আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । কাফের দরোজাটা খোলার সময়ে সামনেই দেখলুম সালভাদোর । ভিখারিদের মধ্যে ও ছিল সবচেয়ে বিষণ্ণ । ওর মুখের বৈশিষ্ট্য, এমনকি গঠনবিন্যাস ছিল অনেকটা কাঠের গুঁড়োর মতন যা দিয়ে কাফের মেঝে ঢাকা থাকতো । তক্ষুনি আমি স্তিলিতানোকে দেখতে পেলুম জুয়াড়িদের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে । আমাদের চোখাচোখি হলো । ওর চাউনি আমার দিকে রইলো কিছুক্ষণ, একটু লজ্জিতও হলো । আমি কালো উর্দিটা খুলে ফেললুম, আর সবাই মিলে সেটা নেবার জন্য দরাদরি আরম্ভ করে দিলো । তাতে অংশ না নিয়ে স্তিলিতানো তাকিয়ে থাকলো তুচ্ছ দর-কষাকষির দিকে ।

    “যদি চাও, তাহলে তাড়াতাড়ি করো,” আমি বললুম । “তোমরা মনোস্হির করো, কাস্টমসের লোকটা নির্ঘাৎ আমার খোঁজে আসবে ।”

    তাস-খেলুড়েরা তৎপর হয়ে উঠলো । ওরা সবাই এরকম অজুহাতের ব্যাপার জানে । যখন তাসের শাফল আমাকে ওর দিকে নিয়ে এলো, স্তিলিতানো ফরাসি ভাষায় বলল :

    “তুমি প্যারিস থেকে ?”

    “হ্যাঁ । কেন ?”

    “না, এমনিই, কোনো কারণ নেই ।”

    যদিও ও-ই প্রথম এগিয়ে এসেছিল, আমি জানতুম, যখন উত্তর দিলুম, একজন অন্তমূখী মানুষের মরিয়া আচরণের ইঙ্গিত-ইশারা, যখন সে কোনো যুবককে চায় । আমার বিভ্রান্তিকে লুকোবার জন্য, আমি শ্বাসরুদ্ধ হবার ভান করলুম, আমার চারপাশে মুহূর্তটার হইচই ছিল । ও বলল, “নিজের জন্যে তুমি বেশ ভালোই কাজ করছ।”

    আমি বুঝতে পারলুম যে এই প্রশস্তি বেশ চালাকি করে দেয়া হলো, কিন্তু ভিখারিদের মাঝে কতো সৌম্যকান্তি যে স্তিলিতানো ছিল ( আমি তখনও ওর নাম জানতুম না ) ! ওর একটা হাতে বেশ বড়ো ব্যাণ্ডেজ বাঁধা আর বুকের কাছে ঝোলানো, কিন্তু আমি জানতুম ওই হাতটা ওর নেই । স্তিলিতানোকে কাফে বা রাস্তায় কোনোটাতেই ঘন ঘন দেখা যেতো না ।

    “উর্দিটার জন্য কতো দাম দিতে হবে ?”

    “তুমি আমাকে এর দাম দিতে চাও ?

    “কেন দেবো না ?”

    “কিসের মাধ্যমে দেবে ?”

    “তুমি কি ভয় পাচ্ছো ?”

    “তুমি কোথা থেকে এসেছো ?”

    “সার্বিয়া । আমি ফরাসি সৈন্যবাহিনীর লোক । আমি বাহিনী থেকে পালিয়ে এসেছি।”

    আমি স্বস্তি পেলুম । বিপর্যস্ত । যে আবেগ আমার মধ্যে গড়ে উঠলো তা এক শূন্যতার, যাতে ভরে গেল বিয়ের দৃশ্যের এক স্মৃতি । নাচের হলঘরে সৈন্যরা দলবেঁধে নাচছিল, আমি ওদের ওয়ালৎজ নাচ দেখছিলুম । সে সময়ে আমার মনে হচ্ছিল দুজন সৈনিকের অদর্শন সেখানে সামগ্রিক । ওরা আবেগে বয়ে যাচ্ছিল । যদিও প্রথম দিকে ‘রামোনা’ পর্বে তাদের নাচ ছিল অপাপবিদ্ধ, কিন্তু তাইই কি থাকবে আমাদের উপস্হিতিতে, ওরা হাসি বদল করে বিয়ে করে নিলো, যেমন প্রেমিক-প্রেমিকারা আঙটি বদল করে ? অদৃশ্য যাজকদের অনুজ্ঞা সত্বেও সৈন্যরা উত্তর দিল, “আমি দায়িত্ব গ্রহণ করছি।”   প্রত্যেকে ছিল দম্পতি, উভয়ই মুখের ওপরে কালো জাল ঢেকে আর এক উর্দি ( শাদা চামড়া, কাঁধের লাল আর সবুজ দড়ি )। ওরা থেমে-থেমে পরস্পরের কোমলতা আর স্ত্রীসুলভ শিষ্টতা অদলবদল করছিল । আবেগকে উঁচু স্তরে বজায় রাখার জন্য, ওরা নিজেদের নাচকে ধিমেতালে করছিল, যখন কিনা তাদের লিঙ্গ, দীর্ঘ কুচকাওয়াজে ক্লান্ত, পরস্পরকে রুক্ষ ডেনিমের ব্যারিকেডের আড়াল থেকে বিপজ্জনকভাবে ভয় দেখাচ্ছিল আর চ্যালেঞ্জ করছিল । পালিশ-করা চামড়া তৈরি শিরস্ত্রাণের মুখাবরণে ঠোকাঠুকি লাগছিল । আমি বুঝতে পারছিলুম স্তিলিতানো আমাকে আয়ত্ত করতে চাইছিল । আমি সেয়ানার খেলা খেলছিলুম: 

    “তা থেকে প্রমাণ হয় না যে তুমি দাম দিতে পারবে।”

    “আমাকে বিশ্বাস করো।”

    অমন কঠিন মুখ, অমন শক্তপোক্ত দেহের মানুষ, আমাকে বলছে বিশ্বাস করতে । সালভাদোর আমাদের দেখছিল । ও আমাদের বোঝাপড়া সম্পর্কে জানতো আর টের পেলো যে আমরা ওর ওর একাকীত্বের, সর্বনাশের নির্ণয় নিয়ে ফেলেছি । কোপনস্বভাব আর বিশুদ্ধ, আমি ছিলুম জীবনে ফিরিয়ে দেয়া পরীর দেশের নাটক । যখন ওয়ালৎজ নাচ থামলো, সৈন্য দুজন নিজেদের থেকে দূরে সরে গেলো । আর জাঁকজমকভরা ও বিহ্বল দুটি অর্ধাংশের প্রত্যেকে ইতস্তত করলো, আর, অদর্শন এড়ানোর আনন্দে, চলে গেলো, মাথা নামিয়ে, পরের ওয়ালৎজের জন্য কোনো যুবতীর দিকে ।

    “দাম দেবার জন্য আমি তোমাকে দুদিন সময় দেবো,” আমি বললুম । “আমি মালকড়ি চাই। আমিও সৈন্যবাহিনীতে ছিলুম । পালিয়ে এসেছি । তোমার মতন।”

    “তুমি পেয়ে যাবে ।”

    আমি উর্দিটা দিয়ে দিলুম ওকে । ও নিজের একটা হাতে নিলো আর আমাকে ফেরত দিয়ে দিলো। ও মৃদু হাসলো, যদিও উদ্ধতভাবে, আর বলল, “ওটা গুটিয়ে ফ্যালো।” আর তার সঙ্গে  রহস্যোচ্ছলে যোগ করলো, “ততক্ষণে আমি একটা গুটিয়ে নিই ।”

    অভিব্যক্তিটা সকলেই জানে : “স্কেটিংবোর্ড গুটিয়ে ফেলা ।” চোখের পাতা না ফেলে, ও যা বলল আমি তাই করলুম । উর্দিটা হোটেল মালিকের মালপত্র লুকোবার জায়গায় তক্ষুনি লোপাট হয়ে গেলো । হয়তো এই মামুলি চুরি আমার মুখকে উজ্বল করে থাকবে, কিংবা স্তিলিতানো ভালো সাজার অভিনয় করছিল ; ও যোগ করলো : “তুমি তাহলে বেল-অ্যাব-এর একজন প্রাক্তনীকে মদ খাওয়াচ্ছো ?”

    এক গেলাস মদের দাম দুই সউ । আমার পকেটে ছিল চারটে, কিন্তু আমি সেগুলো সালভাদোরকে ধার দিলুম যে আমাদের দেখছিল ।

    “আমি কপর্দকশূন্য,” স্তিলিতানো গর্বভরে বলল ।

    তাস খেলুড়েরা নতুন গোষ্ঠী তৈরি করছিল যার দরুণ কিছু এক মুহূর্তের জন্যে আমি সালভাদোর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলুম । আমি দাঁতের ফাঁকে বিড়বিড় করলুম, “ আমার কাছে চার সউ আছে আর আমি সেগুলো তোমাকে পাচার করে দিচ্ছি, কিন্তু দাম তোমাকেই দিতে হবে ।”

    স্তিলিতানো মৃদু হাসলো । আমি পরাজিত । আমরা একটা টেবিলে বসলুম । ও সৈন্যবাহিনীর কথা বলা আরম্ভ করেছিল, কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে, কিন্তু অন্য কথা বলা শুরু করলো।

    “আমার কেমন মনে হচ্ছে আমি তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি।”

    আমার কথা বলতে হলে, আমি স্মৃতিতে সবকিছু ধরে রেখেছিলুম।

    আমার অদৃশ্য দড়িদড়া আঁকড়ে ধরা জরুরি ছিল । আমি কূজন করতে পারতুম । শব্দাবলী, কিংবা আমার স্বরভঙ্গী, কেবল আমার আকুলতাকে  প্রকাশ করতে পারতো না, আমি শুধু গান শোনাতে পারতুম না, আমার কন্ঠ থেকে বেরোতে পারতো বুনো প্রণয়খেলার ডাক । হয়তো আমার ঘাড়ে শাদা পালকগোছা গজিয়ে উঠেছিল । একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা সব সময়ে সম্ভব। আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রূপান্তরিত আকৃতি ।  আতঙ্ক আমাকে রক্ষা করলো।

    আমি আকৃতির রূপান্তরের ভয়ে বসবাস করেছি । পাঠককে পুরো সচেতন করার জন্য, তারা দেখছে যে প্রেম আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছে -- এটা কেবল বাগ্মীতার ব্যাপার নয় যার জন্য তুলনা দরকার -- বাজপাখির মতন -- সবচেয়ে সূক্ষ্ম ভীতির জন্য আমি কাছিমঘুঘুর উদাহরণ ব্যবহার করি । জানি না সেই মুহূর্তে কেমন অনুভব করেছিলুম, কিন্তু আজকে আমি যা চাই তা হলো স্তিলিতানো সম্পর্কে আমার কল্পনাশক্তি, কেননা আমার দুর্দশার তুলনা করা যায় একটা নিষ্ঠুর পাখি আর তার শিকারের পারস্পরিক সম্পর্কের সঙ্গে । ( আমি যদি আমার ঘাড় মৃদু কূজনে ফুলে ওঠা অনুভব না করতুম তাহলে আমি বরং লালবুক রবিনপাখির কথা বলতুম)।

    এক বিদকুটে প্রাণী দেখা দেবে যদি আমার প্রতিটি আবেগ একটা পশু হয়ে দেখা দ্যায় : আমার ঘাড়ে কেউটের  ক্রোধ হিসহিস করে ; সেই একই কেউটে আমার লিঙ্গকে ফোলায় ; আমার বিনয়ের অভাব থেকে পয়দা হয়েছে আমার ঘোড়াগুলো আর নাগরদোলা….এক কাছিমঘুঘুর যার খসখসে স্বর আমি ধরে রেখেছি, যা স্তিলিতানো লক্ষ্য করেছিল । আমি কাশলুম।

    প্যারালেলোর পেছনে একটা ফাঁকা জায়গা ছিল যেখানে মাস্তানরা তাস খেলতো। ( প্যারালেলো হলো বারসেলোনার একটা অ্যাভেনিউ যা বিখ্যাত রামব্লাসের সমান্তরাল। আই দুই প্রশস্ত রাস্তার মাঝে, আক অন্ধকার, নোংরা, সরু গলি গযে তুলেছে বারিও চিনো জায়গাটাকে ।) মেঝেতে বসে, ওরা তাস-টাস খেলতে থাকে ; ধুলোর ওপরে চারচৌকো কাপড় বিছিয়ে তাসগুলো সাজিয়ে রাখে । এক তরুণ জিপসি তার মধ্যে একটা খেলা চালাতো, আর আমি আমার পকেটের কয়েকটা সউয়ের ঝুঁকি নিলুম। আমি জুয়াড়ি নই । ধনীদের ক্যাসিনো আমাকে আকৃষ্ট করে না । বিজলিবাতির ঝাড়লন্ঠনে আমি সিঁটিয়ে যাই । মার্জিত জুয়াড়ির মেকি ঘনিষ্ঠতা দেখে আমার বমি পায় । আর বল, রুলেট আর ছোট্টো ঘোড়াগুলো নিয়ে খেলার অসম্ভাব্যতা আমাকে অনুৎসাহিত করে, কিন্তু আমার ভালো লাগতো মাস্তানদের ধুলো, নোংরা আর চালবাজি ।

    আমি সামনে দিকে ঝুঁকে জিপসিটাকে পাশ থেকে দেখলুম, বালিশে চাপা, কোনও বেদনার কারণে। আমি ওর দৈহিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে দেখি ওর মুখবিকৃতি, কিন্তু ওর ব্যথার প্রভাও। আমি এটা প্রায়ই দেখেছি রাস্তায় বসে থাকা ছোঁড়াদের তেলচিটে মুখে । এখানকার পুরো জনসমপ্রদায় জেতা কিংবা হারার সঙ্গে যুক্ত । প্রতিটি উরু ক্লান্তি কিংবা উদ্বেগে কাঁপছে । সেইদিনকার আবহাওয়া ছিল আশঙ্কাজনক । আমি তরুণ স্পেনিয়দের যৌব অধীরতায় আটক পড়ে গিয়েছিলুম । আমি খেললুম আর জিতলুম । আমি প্রত্যেকটা দান জিতলুম । খেলার সময়ে আমি একটাও কথা বলিনি । তাছাযা, জিপসিটা ছিল আমার অচেনা । নিয়ম অনুযায়ী জেতা টাকাকড়ি নিয়ে আমার কেটে পড়ার কথা । ছেলেটাকে দেখতে আতো সুন্দর যে ওইভাবে ওকে ছেড়ে কেটে পড়াটা হবে সৌন্দর্যের অবহেলা । ও হঠাৎ দুঃখি হয়ে উঠলো, গরম আর অবসাদের মাঝে দাঁড়িয়ে ও মুখ নত করে নিয়েছিল । আমি দয়া করে ওকে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিলুম। আচমকা অবাক হয়ে, ও সেগুলো নিয়ে নিলো আর আমাকে ধন্যবাদ জানালো ।

    “হ্যালো, পেপে,” একজন পাগলাটে কালচে চেহারার খোঁড়া লোক ডাক দিয়ে উঠলো আমার পাশ দিয়ে লেংচে যেতে যেতে ।

    “পেপে,” আমি নিজেকে বললুম, “ওর নাম পেপে।” জায়গাটা ছাড়লুম, কেননা আমি ওর কৃশকায়, প্রায় নারীসুলভ কমনীয় ছোটো হাত দুটো দেখেছিলুম । কিন্তু সবে কয়েক পা এগিয়েছি চোর, বেশ্যা, ভিখারি আর পায়ুকামীদের ছেড়ে, কেউ একজন আমার কাঁধে হাত রাখলো । ও ছিল পেপে। ও খেলা ছেড়ে চলে এসেছে। ও আমাকে স্প্যানিশে বলল :

    “আমার নাম পেপে।”

    “আমি হুয়ান।”

    ‘চলো, মদ খাওয়া যাক।”

    ও আমার চেয়ে লম্বা ছিল না । ওর মুখ, যা আমি ওপর থেকে দেখেছিলুম যখন ও মাটিতে বসেছিল, কম পুষ্ট মনে হলো । দেহ কাঠামো সুশীল ।

    “ছেলেটা একটা মেয়ে,” আমি ভাবলুম, ওর কোমল হাতের কথা মনে করে, আর আমি অনুভব করলুম ওর সঙ্গ আমাকে বিরক্ত করবে । ও এখনই ঠিক করে নিলো যে টাকাটা আমি জিতেছিলুম তা মদ খেয়ে ওড়াবে । আমরা শুঁড়িখানাগুলোয় চক্কর মারলুম, আর যতোক্ষণ একসঙ্গে ছিলুম ওকে বেশ কমনীয় লাগছিল । ওর পরনে ছিল, শার্টের বদলে, নিচু গলা নীল জার্সি। খোলা জায়গাটা থেকে দেখা যাচ্ছিল একটা মোটা ঘাড়, ওর মাথার মতনই চওড়া । যখন ও মাথা ঘোরালো, বুক না ঘুরিয়ে, একটা মোটা পেশিতন্তু জেগে উঠলো । আমি ওর দেহটা কল্পনা করার চেষ্টা করলুম, আর, কোমল প্রায় নরম হাত সত্বেও, মনে হলো তা বেশ পুরুষ্টু, কেননা ওর উরুগুলো ট্রাউজারের পাতলা কাপড়কে ভরে দিয়েছিল। আবহাওয়া ছিল উষ্ণ । ঝড় ওঠেনি । আসপাশের তাস খেলুড়েদের স্নায়ুচাপ হয়ে উঠেছিল তীব্র । বেশ্যাগুলোকে মনে হচ্ছিল গাগতরে ।ধুলো আর রোদ ছিল কষ্টকর । আমরা তেমন মদ খাইনি, খেলুম লেমোনেড । আমরা হকারদের কাছে বসলুম আর মাঝেসাজে এক-আধটা কথা বললুম । ও হাসি বজায় রেখেছিল, একধরনের ক্লান্তিময়তায় । মনে হচ্ছিল ও আমাকে প্রশ্রয় দিতে চাইছে । ও কি সন্দেহ করছিল যে ওর সুন্দর মুখ আমার ভালো লেগেছে ? আমি জানতে পারলুম না, কিন্তু ও আর এগোলো না । তাছাড়া, আমারও ওর মতন একই ধূর্ত চাউনি ; ভালো পোশাক পরে যারা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তাদের কাছে আমি বোধহয় অমঙ্গলের সংকেত হয়ে দেখা দিয়েছি ; ছেলেটার যৌবন আর কলুষ আমার মতনই, আর আমি ছিলুম ফরাসি । সন্ধ্যার দিকে ও জুয়া খেলতে চাইলো, কিন্তু সব জায়গাগুলো দখল হয়ে গিয়েছিল বলে দেরি হয়ে গিয়েছিল । আমরা খেলুড়েদের আসেপাশে ঘুরে বেড়ালুম । বেশ্যাগুলোর গা ঘেঁষে ও যখন যাচ্ছিল, পেপে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করলো ওদের সঙ্গে । কাউকে-কাউকে চিমটি কাটলো । গরম হয়ে উঠছিল অসহ্য । আকাশ আর মাটি হয়ে উঠেছিল ঘনিষ্ঠ । ভিযের স্নায়ুচাপ বিরক্তিকর লাগছিল । জিপসি ছোঁড়াটার ওপর ছেয়ে গিয়েছিল ধৈর্যচ্যুতি কেননা ও নির্ণয় নিতে পারছিল না কোন খেলাটায় যোগ দেবে । নিজের পকেটের টাকাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল । হঠাৎ ও আমার বাহু আঁকড়ে ধরলো ।

    “এসো !”

    প্যারালেলোতে কয়েক পা দূরে একটা বিশ্রামাগারে ও আমাকে নিয়ে এলো । সেটা চালাচ্ছিল বুড়িরা । হঠাৎ অমন নির্ণয়ে অবাক হয়ে আমি জিগ্যেস করলুম :

    ‘কী করতে চলেছ তুমি ?”

    “আমার জন্য অপেক্ষা করো ।”

    “কেন ?”

    ও স্প্যানিশ একটা শব্দ ব্যবহার করে উত্তর দিলো যা আমি বুঝতে পারলুম না । সে কথা ওকে বললুম, এক বুড়ির সামনে, যে তার দুটো সউয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল, শুনে হাসিতে ফেটে পয। ছোঁড়াটা আর স্বমেহনের ইঙ্গিত করলো । যখন ও বেরিয়ে এলো, ওর মুখে রঙ ধরে গিয়েছিল । ও তখনও হাসছিল ।

    “এখন সব ঠিক আছে । আমি তৈরি ।”

    ঘটনাটা থেকে আমি শিখলুম যে, বড়ো দাঁও মারার আগে, খেলোয়াড়রা ওখানে ঢুকে স্বমেহন করে যাতে নিজেদের শান্ত করে খেলতে পারে । আমরা জুয়ার জমঘটে ফিরে গেলুম । পেপে একটা গোষ্ঠীকে বেছে নিলো । ও হেরে গেলো । ওর কাছে যতো টাকা ছিল সব হেরে গেলো । আমি ওকে থামাতে চেষ্টা করেছিলুম ; ততক্ষণে সব হেরে বসে আছে । খেলার যেমন নিয়ম, যে লোকটা টাকাকড়ি ধার দিচ্ছিল বা জমা রাখছিল তাকে বলল তহবিল থেকে ওকে পরের খেলার জন্য ধার দিতে । লোকটা প্রত্যাখ্যান করলো । আমার তখন মনে হলো যা বৈশিষ্ট্যে জিপসির ভদ্রতা গড়া তা টকে গেল, যেমন দুধ ছানা কেটে যায়, আর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো যেরকম ক্রোধ আমি আগে কারোর দেখিনি । জিপসি ছেলেটা মহাজনটার টাকাকড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তুলে নিলো । মহাজন ওর পেছনে ছুটে লাথি মারার চেষ্টা করলো । পেপে পাশ কাটিয়ে নিলো । ও টাকাগুলো আমার হাতে দিলো, কিন্তু যতোক্ষণে আমি সেগুলো পকেটে রাখতে যাবো ছোঁড়াটার ছুরি বেরিয়ে এসেছে । ছুরিটা ও বসিয়ে দিলো মহাজনের বুকে, একজন ঢ্যাঙা, তামাটে লোক, যে পড়ে গেলো মাসটিতে আর যে, তার ত্বকের তামাটে রঙ সত্বেও, ফ্যাকাশে হয়ে গেলো, গুটিয়ে গেলো, ছটফট করে ধুলোর ওপরে মরে গেলো । জীবনে প্রথমবার আমি কাউকে পটল তুলতে দেখলুম । পেপে সেখান থেকে অদৃশ্য  হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু যখন আমি লাশ থেকে দৃষ্টি ঘোরালুম, ওপর দিকে চাইলুম, সেখানে, মুখে মৃদু হাসি নিয়ে, দাঁড়িয়ে রয়েছে স্তিলিতানো । সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে । মৃত লোকটা আর সৌম্যকান্তি মানুষেরা যেন একই সোনালি ধুলোতে মিশে গেছে, পৃথিবীর সব জায়গা থেকে এসে উপস্হিত নাবিক, সৈন্য, মাস্তান আর চোরেদের সঙ্গে । পৃথিবী আর ঘুরছিল না : স্তিলিতানোকে নিয়ে তা সূর্যের কাছে কাঁপছিল । একই সময়ে আমি পরিচিত হলুম মৃত্যু আর ভালোবাসার সঙ্গে । এই দর্শনশক্তি, যদিও ক্ষণিকের, তবু আমি সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলুম না কেননা আমার ভয় ধরে গিয়েছিল যে আমাকে পেপের সঙ্গে দেখে মৃত লোকটার বন্ধুরা আমার পকেটে রাখা টাকাকড়ি কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু আমি যখন কেটে পড়ছি, আমার স্মৃতি জীবন্ত হয়ে উঠলো আর পরবর্তী দৃশ্যের কথা মনে পড়িয়ে দিলো, যা আমার মনে হয়েছিল সমারোহপূর্ণ : “হত্যাটা, এক সৌম্যকান্ত বালকের দ্বারা, একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষকে যার রোদেপোড়া ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যেতে পারে, মৃত্যুর রঙ ধরে গেলো, আর তা আরাম করে দেখলো একজন দীর্ঘদেহী ফর্সা লোক যার সঙ্গে আমি সম্প্রতি গোপনে বাগদত্ত হয়েছি।” আমার চাউনি ওর দিকে দ্রুত হলেও, আমার হাতে সময় ছিল স্তিলিতানোর পালোয়ানি পৌরুষকে স্বীকার করা আর দেখা, দুই ঠোঁটের মাঝে, আধখোলা মুখে, একটা শাদা, থুতুর গোলা, শাদা পোকার মতন মোটা, যা ও ঘোরাচ্ছিল, ওপর থেকে নিচে যতক্ষণ না তা ওর হাঁ-মুখ ঢেকে ফেলছে। ও ধুলোর ওপরে খালি পায়ে দাঁড়িয়েছিল । ওর ঠ্যাঙ ঢাকা ছিল ছেঁড়া নোংরা ফ্যাকাশে ডেনিম ট্রাউজারে। ওর সবুজ শার্টের হাতা ছিল গোটানো, তার একটা ওর কাটা হাতেরর ওপর পর্যন্ত ; কবজিটা, যেখানে সেলাই করা চামড়ায় একটা ফ্যাকাশে গোলাপি ক্ষতচিহ্ণ দেখা যাচ্ছিল, তা ছিল সঙ্কুচিত।

    বিয়োগাত্মক আকাশের তলায়, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক ভূচিত্র পার হয়ে যাবার ছিল যখন রাতের বেলায় স্তিলিতানো আমার হাত ধরলো । কী ছিল সেই তরল জিনিসটার বৈশিষ্ট্য যা ওর কাছ থেকে আমার কাছে ধাক্কা দিয়ে চালান করা হতো ? আমি বিপজ্জনক নদীতীরে হেঁটেছি, উদয় হয়েছি বিষণ্ণ সমভূমিতে, শুনেছি সমুদ্রের আওয়াজ । যখন সিঁড়িবদল হলো, বলা চলে আমি ওকে ছুঁইনি : ও ছিল জগতের ওস্তাদ । সেই সংক্ষিপ্ত মুহূর্তগুলোর স্মৃতি নিয়ে, আমি তোমাদের কাছে বর্ণনা করতে পারি, শ্বাসহীন উড়াল, অনুসৃতি, পৃথিবীর সেই সব দেশের যেখানে আমি কখনও যাবো না ।

                                           

                                           

                                                                                                                                               
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৯:৩৭735113
  • জাঁ জেনে’র কবিতা ( ১৯১০ - ১৯৮৬ )  ‘শবযাত্রার কুচকাওয়াজ’

    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    এক কোনে আবদ্ধ, একটুখানি রাত রয়ে গেছে।

    আমাদের ভিতু আকাশে নির্মম আঘাতে স্ফূলিঙ্গ উগরে

    ( নৈশব্দের গাছেরা কিছু দীর্ঘশ্বাস ঝুলিয়ে রেখেছে )

    এই শূন্যতার শীর্ষে গরিমার এক গোলাপ জেগে।

    ঘুম বড়োই বিশ্বাসঘাতক যেখানে জেলখানা আমায় নিয়ে এসেছে

    যদিও আমার গোপন দালানে বেশ আস্পষ্টভাবে

    ওই অহংকারী ছোঁড়া গভীরভাবে নিজের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে

    নাবিকদের আলোয় ঝলমলিয়ে যারা শব-সুন্দরী  গড়ে তোলে ।

     

    ও আমাকে নিজের ভেতরে শেকল পরিয়ে রাখে

    জেলখানার এই কুড়ি বছর বয়সী পরিদর্শক

    আর ও আমায় চিরকালের জন্য শেকল পরিয়ে রাখে !

    একটিমাত্র ইঙ্গিত, ওর চোখ, দাঁতে চুল চিবোয় :

    আমার হৃদয় খুলে যায়, আর পরিদর্শক, উৎসবময় উল্লাসে

    আমাকে নিজের অন্তরে জেলবন্দী করে ।

    এই অসূ্য়াভরা দরোজা আবার বন্ধ হবার সুযোগ পায় না

    অনেক বেশি দয়ায়

    আর তুমি তো ইতোমধ্যেই ফিরেছো । তোমার পরিপূর্ণতা আমাকে আতঙ্কিত করে

    আর আমি আজকে শুনতে পাই আমাদের ভালোবাসা বর্ণিত হচ্ছে

    তোমার মুখে যা গান গায় ।

    এই ছোরামারা ট্যাঙ্গো যা জেলখুপরি শুনতে পায়

    বিদায়বেলার এই ট্যাঙ্গোনাচ ।

    তাহলে কি তুমি, হে প্রভূ, এই উজ্বল বাতাসে ?

    তোমার আত্মা গোপন পথে এগিয়েছে

    দেবতাদের থেকে পার পাবার জন্য ।

     

    যখন তুমি ঘুমোও রাতের আস্তাবল ভেঙে ঘোড়ারা 

    তোমার চ্যাটালো বুকে নামে, আর জানোয়ারগুলোর টগবগ

    অন্ধকারকে ছত্রভঙ্গ করে তোলা যেখানে ঘুম নিজের

    ক্ষমতার যন্ত্র চালায়, আমার মগজ থেকে ছিঁড়ে

    একটুও শব্দ না করেই ।

    ঘুম অনেক শাখা তৈরি করে

    তোমার পা থেকে ফুল

    তাদের কান্নায় কন্ঠরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে আমি ভয় পাই ।

    তোমার মোলায়ের পাছার বাঁকের ওপরে, মিলিয়ে যাবার আগে

    তোমার শাদা ত্বকে তা নীলাভ।

    কিন্তু একজন জেল পরিদর্শক কি তোমাকে জাগিয়ে তুলতে পারে, আমার কচি চোর

    যখন তুমি তোমার হাত ধুয়ে নাও ( ওই পাখিগুলো তোমার দস্তানায়

    ডানা ঝাপটায়, একশো দুঃখের ভারে )

    তারপর তুমি নির্দয়ভাবে নক্ষত্রদের আলোকরশ্মিকে ছারখার করে দাও

    তোমার কাঁদতে-থাকা মুখের ওপরে ।

    তোমার শোকেভরা অবশিষ্টাংশে

    মহিমাময় অঙ্গভঙ্গী ধরে রাখা হয়

    তোমার হাত যেটা একে ছুঁড়ে দিয়েছিল, রশ্মি দিয়ে বীজ পুঁতেছিল।

    তোমার গেঞ্জি, তোমার শার্ট, আর তোমার কালো বেল্ট

    আমার জেলখুপরিকে অবাক করে আর আমাকে হতবুদ্ধি করে তোলে

    তোমার সুন্দর হস্তিদন্তের সামনে ।

     

    সারাদিনের সুন্দর রাতগুলো

    পিলর-এর অন্ধকার

    তোমার কালো পাকের ভেতরে

    আমার ছুরি জাল করা হয় ।

    ঈশ্বর, এখানে আমি উলঙ্গ

    আমার ভয়ঙ্কর লুভরেতে ।

    কেউ চিনতে পারে না

    তোমার বন্ধ মুঠো আমায় খুলে দ্যায় ।

    আমি ভালোবাসা ছাড়া কিছু নই

    আমার সমস্ত শাখা জ্বলে

    যদি আমি দিনটাকে অন্ধকার করে দিই

    তারপর আমার ভেতরের ছায়া নিজেকে গুটিয়ে নেয় ।

    বিশুদ্ধ হাওয়ায় এটা সম্ভব

    আমার শুকনো দেহ গুঁড়িয়ে ধুলোয় মেশার জন্য

    দেয়ালে পিঠ দিয়ে

    আমি বিদ্যুতের চমকের দখল নিই ।

    হৃদয় আমার সূর্য

    মোরগের ডাকে চৌচির হয়ে যায়

    ঘুম কখনও সাহস দেখায় না

    এখানে তার স্বপ্নগুলোকে উথলে দিতে।

    আমার আকাঙ্খায় শুকিয়ে যাওয়া

    আমি স্তব্ধতাকে মেরামত করে দিই

    পাখিদের আগুন দিয়ে

    যা আমার গাছ থেকে জেগেছে ।

     

    নিষ্ঠুর প্রকৃতির মনে হয় এমন মহিলাদের থেকে

    তাদের খবরিয়ারা গয়না পরে থাকে ।

    গলির এই ছিঁচকে চোরগুলো রাতের বেলায় জেগে ওঠে

    আর তাদের ইশারা পেয়ে তুমি সাহসে বেরিয়ে পড়ো।

    অমন এক কচিখোকা, নিজের মায়াময় পোশাকে কাঁপে

    ও ছিল আমার কাছে পাঠানো দেবদূত, যার আলোময় দিশা

    আমি অনুসরণ করি বিভ্রান্ত হয়ে, যাত্রায় পাগল হয়ে

    এই জেলখুপরি পর্যন্ত যেখানে তার প্রত্যাখ্যান ছিল জ্যোতির্ময়।

    যখন আমি অন্য সুরে গাইতে চাইলুম

    আমার পালক আলোকরশ্মিতে জড়িয়ে পড়লো

    এক ঝিমধরা শব্দে, মাথা নিচু করে

    আমি বোকার মতন পড়ে গেলুম, এই ভুলের মাশুল হিসেবে

    এই খাদের তলায় ।

     

    আর কিছুই গোলমাল

    বাধাবে না অনন্তকালীন ঋতুতে

    যেখানে আমি নিজেকে আটক আবিষ্কার করছি ।

    একাকীত্বের স্হির জলাশয়

    আমাকে পাহারা দেয় আর জেলখানা ভরে রাখে ।

    আমি চিরকালের জন্য কুড়ি বছর বয়সী

    তোমাদের নিরীক্ষণ সত্বেও ।

    তোমাদের মন রাখতে, ওহ বধির সৌন্দর্যের অনাথ

    মারা না যাওয়া পর্যন্ত আমি পোশাক পরে থাকবো

    আর তোমার আত্মা তোমার মুণ্ডকাটা ধড়কে ছেড়ে গিয়ে

    আমার ভেতরে খুঁজে পাবে এক শাদা আশ্রয় ।

    ওহ একথা জানতে পারা যে তুমি আমার মামুলি ছাদের তলায় শোও!

    তুমি আমার মুখ দিয়ে কথা বলো

    আমার চোখ দিয়ে দ্যাখো

    এই ঘর তোমার আর আমার কবিতা তোমার।

    যা ভালো লাগে তার জন্য আরেকবার বেঁচে নাও

    আমি নজর রাখছি ।

     

    হয়তো তুমিই ছিলে সেই দানব যে কেঁদেছিল

    আমার উঁচু দেয়ালের পেছনে ?

    রেশমি ফিতের চেয়েও মোলায়েম তুমি ফিরে এসেছো

    আমার দৈব দুর্বৃত্ত

    এক নতুন মৃত্যুর মাধ্যমে নিয়তি আবার তছনছ করে

    আমাদের নিরানন্দ ভালোবাসাগুলো

    কেননা তুমিই তো ছিলে আবার, পিলর, মিথ্যা বোলো না

    এই চুরিকরা ছায়াগুলো !

     

    যে খোকাটাকে আমি খুঁজছিলুম

    বাচ্চাদের মধ্যে খেলছে

    নিজের বিছানায় মরে পড়ে আছে, একা

    এক রাজকুমারের মতন ।

    নিজের আলতো পায়ে ইতস্তত করে

    এক মহিমা ওর পায়ে জুতো পরায়

    আর দেহ ঢেকে দ্যায়

    রাজকীয় পতাকায় ।

    হাতে গোলাপ ধরে-থাকা মিষ্টি ভঙ্গীতে

    শবগুলো কে যে হাত লুটপাট করছিল তা চিনতে পারলুম।

    একজন সেনা অমন কাজ করবে না

    যা তুমি, একা, করেছিলে

    আর তুমি তাদের মধ্যে নেমে গেলে

    ভয়ও পেলে না

    পশ্চাত্তাপও নয় ।

    তোমার দেহের মতন

    একটা কালো গেঞ্জি তোমার আত্মাকে দস্তানায় ঢুকিয়ে রাখলো

    আর যখন তুমি নির্দিষ্ট সমাধিকে অপবিত্র করলে

    তুমি ছুরির ডগা দিয়ে খোদাই করে দিলে

    শব্দ আন্দাজ করার ধাঁধা

    বিদ্যুৎ দিয়ে নকশাকাটা ।

    আমরা তোমার উথ্থান দেখেছি, উন্মাদনায় বয়ে যাওয়া

    নিজের চুলে ঝুলছ

    লোহার মুকুটে

    মুক্ত-বসানো ফিতেয় আর বাসি গোলাপে

    জীবন্ত ধরবার জন্যে মোচড়ানো হাত ।

    তোমার মৃদু হাসি আমাদের দেখাবার জন্য সবেই ফিরেছ

    তুমি দ্রুত উধাও হয়ে গেলে আমার মনে হয়

    আমাদের কিছু না জানিয়ে, তোমার ঘুমন্ত গরিমা

    আরেক মুখের সন্ধানে অন্যান্য আকাশে ঘুরে বেড়িয়েছে।

    পথচলতি এক বালককে লক্ষ করি

    তোমার সুগঠিত দেহের ঝলক

    আমি তার মাধ্যমে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি

    কিন্তু তার এক সামান্য ইশারা

    তার কাছ থেকে তোমাকে উধাও করে দিলো

    আর তোমাকে আমার কবিতায় ছুঁড়ে ফেললো

    যেখান থেকে তুমি পালাতে পারবে না ।

    কোন দেবদূত তাহলে

    তোমাকে পাশ দিয়ে যাবার অনুমতি দিলো

    অকাতরে বস্তুর ভেতর দিয়ে যেতে

    হাত দিয়ে বাতাসকে দুফাঁক করে

    ক্ষেপণাস্ত্রের ডগার সূক্ষ্ম ঘূর্ণনের মতো

    যা নিজের দামি পথ খুঁজে নিজেই তাকে নষ্ট করে ?

    তোমার পালাবার সংকীর্ণতা আমাদের নিরানন্দ করেছিল ।

    এক দ্যুতিময় পিছুটান তোমাকে আমাদের আলিঙ্গনে এনে দিয়েছিল।

    তুমি আমাদের গলায় টোকা মেরে আমাদের মন ভরাতে চাইলে

    আর তোমার হাত ছিল ক্ষমাময়

    কামানো চুলের দরুণ ।

    কিন্তু তুমি আর দেখা দাও না, ফর্সা খোকা যাকে আমি খুঁজি।

    আমি কোনো শব্দে হুঁচোট খাই আর তোমাকে তার বিপরীতে দেখি।

    তুমি আমার কাছ থেকে সরে যাও, কবিতা আমাকে রক্ষা করে।

    কান্নার কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে আমি বিপথগামী হই ।

    তোমাকে ধরার জন্য আকাশ নানা ফাঁদ পেতেছিল

    করাল আর নতুন, মৃত্যুর সঙ্গে ষড় করে

    এক অদৃশ্য সিংহাসন থেকে নজর রাখছিল

    সুতোগুলো আর গিঁটগুলো

    সোনার ববিনে পরানো ।

    আকাশ এমনকি মৌমাছিদের যাত্রাপথ ব্যবহার করেছিল

    কতোরকমের রশ্মি আর কতোরকমের সুতোর পাক খুলে

    যে সেষ পর্যন্ত ওকে গোলাপের সৌন্দর্য ধরে ফেললো :

    ছবিতে দেখানো এক শিশুর মুখ ।

    এই খেলা যদি নিষ্ঠুর হয় তাহলে আমি নালিশ করব না

    তোমার সুন্দর চোখ খুলে ফেলার জন্য

    দুঃখের এক গান তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেল

    অতো সন্ত্রাসকে আয়ত্ত করে

    আর এই গান, হাজার বছরের জন্য

    তোমার কফিনকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ।

    দেবতাদের ফাঁদে আটক, তাদের রেশমিসুতোয় কন্ঠরুদ্ধ

    কেন আর কেমন করে না জেনেই তুমি মারা গেলে ।

    তুমি আমাকে ছাপিয়ে জিতে গেছ

    কিন্তু সাপসিঁড়ি লুডোখেলায় হেরে গেছ

    যেখানে আমি তোমাকে ধর্ষণ করার সাহস দেখাই

    ওগো আমার পলাতক প্রেমিকা ।

    কালো সেনারা তাদের বন্দুক নত করলেও

    তুমি ওই বিছানা ছেড়ে পালাতে পারো না যেখানে লোহার মুখোশ

    তোমাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে -- কিন্তু হঠাৎ তুমি উঠে দাঁড়াও

    নড়াচড়া না করেই পেছনে পড়ে যাও

    আর নরকে ফেরো ।

     

    ১০

    আমার ভালোবাসার কালকুঠুরি

    তোমার স্পন্দিত ছায়ায়

    আমার চোখ, আচমকা, এক গোপনকথা আবিষ্কার করেছে ।

    আমি কতো রকম শোয়া শুয়েছি তা জগত জানে না

    যেখানে সন্ত্রাস নিজেই গিঁট পাকায় ।

    তোমার অন্ধকার হৃদয়ের দর-দালানগুলো আঁকাবাঁকা পথ

    আর তাদের জড়োকরা স্বপ্নগুলো স্তব্ধতাকে সঙ্গঠিত করে

    কবিতার সঙ্গে মিল আছে এমন এক যান্ত্রিক প্রক্রিয়া

    আর তার হুবহু তীব্রতা ।

    আমার চোখ আর আমার কপাল থেকে

    তোমার রাত কালির বন্যা বয়ে যেতে দ্যায়

    এমন ঘন পালক যার ওপরে আমি এখানে শুই

    নিয়ে আসবে কুসুমিত নক্ষত্রদের

    যেমন কেউ গোলাগুলির বেড়াজালে দেখতে পায় ।

    আমি তরল অন্ধকারের দিকে এগোই

    যেখানে অবয়বহীন ষড়যন্ত্রেরা

    ধীরে ধীরে আকার পাওয়া আরম্ভ করে ।

    কেনই বা আমি সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করব ?

    আমার সমস্ত অঙ্গবিক্ষেপ ভেঙে টুকরো হয়

    আমার আমার কান্নাগুলো

    খুবই সুন্দর ।

    আমার চাপা দুর্দশা থেকে শুধু তুমিই জানতে পারবে

    দিনের মেলে দেয়া অদ্ভুত সৌন্দর্যগুলো ।

    ওদের হাজার রকমের ভেলকিবাজির পর

    যে বজ্জাতদের কথা আমি শুনি

    খোলা বাতাসে ভিড় জমায় ।

    পৃথিবীতে তারা একজন কোমল প্রতিনিধি পাঠায়

    এক শিশু যে কারোর পরোয়া করে না, আর নিজের যাত্রাপথ চিহ্ণিত করে

    অনেকরকমের চামড়া ফাটিয়ে

    আর ওর খোশমেজাজি বার্তা

    এখানে পায় নিজের জাঁকজমক ।

    কবিতাটা পযে তুমি লজ্জায় ফ্যাকাশে হয়ে যাও

    অপরাধী অঙ্গভঙ্গী দিয়ে একজন বয়ঃসন্ধির লেখা

    কিন্তু তুমি কখনও জানতে পারবে না

    মৌলিক গিঁটগুলোর কোনও ব্যাপার

    যা আমার মলিন ক্রোধের ফসল

    কেননা ওর রাতে যে গন্ধগুলো গড়াচ্ছে তা খুবই তীব্র।

    ও সই করবে পিলর আর ওর মহিমান্বয়ন হবে

    গোলাপ-স্রোতের উজ্বল ফাঁসিমঞ্চ

    মৃত্যুর সুন্দর কর্মফল ।

     

    ১১

    সম্ভাবনা -- সবচেয়ে মহার্ঘ সম্ভাবনা !

    প্রায়ই আমার পালককে তৈরি করতে বাধ্য করেছে

    আমার সমস্ত কবিতার হৃদয়কেন্দ্র

    সেই গোলাপ যার ওপরে শাদা শব্দে লেখা মৃত্যু

    বাহুর ফেট্টিতে নকশা করা

    যে কালো যুদ্ধাদের আমি ভালোবাসি তাদের নাম।

    আমার রাতের ভেতর দিয়ে কোন বাগানই বা ফুল ফোটাতে পারে

    কোন যন্ত্রণাময় খেলা এখানে হয় যে

    এই কেটে নেয়া গোলাপ থেকে পাপড়ি ছেঁড়া হয়

    আর কে তাকে নিঃশব্দে ফাঁকা কাগজে নিয়ে যায়

    যেখানে তোমার হাসি তাকে অভিবাদন করে ?

    কিন্তু মৃত্যুর ব্যাপারে বিশেষকিছু আমি জানি না

    মেয়েটির বিষয়ে এতো কথা বলার পরও

    আর গুরুতর উপায়ে

    তাহলে মেয়েটি আমার ভেতরেই বাস করে

    যাতে সহজে জেগে উঠতে পারে

    আমার আমার আবোলতাবোল থেকে বইতে পারে

    অন্তত আমার শব্দগুলো ।

    মেয়েটির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না

    বলা হয় যে ওর সৌন্দর্যের ইন্দ্রজাল

    অনন্তকালকে খেয়ে ফ্যালে

    কিন্তু এই বিশুদ্ধ বিচরণ পরাজয়ে বিদীর্ণ হয়

    আর এক বিয়োগান্তক বিশৃঙ্খলার গোপনীয়তাকে ফাঁস করে ।

    অশ্রুবিন্দুর আবহাওয়ায় ঘুরে বেড়িয়ে ফ্যাকাশে

    মেয়েটি খালি পায়ে আসে ফুৎকারে আত্মপ্রকাশিত হয়ে

    আমার উপরিতলে যেখানে ফুলের এই তোড়াগুলো

    আমাকে শেখায়  মৃত্যুর

    কন্ঠরোধী কোমলতা।

    আমি নিজেকে তোমার আলিঙ্গনে ছেড়ে দেবো, হে বর্ণোজ্বল মৃত্যু

    কেননা আমি জানি কেমন করে আবিষ্কার করতে হয়

    আমার উন্মুক্ত শৈশবের চলমান চারণভূমি

    যেখানে তুমি আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে যাবে

    অপরিচিত লোকটার ফুলেফুলে সাজানো লিঙ্গের কাছে ।

    আর এই শক্তিতে বলবান, হে রানি, আমি হবো

    তোমার ছায়াদের নাটকের গোপন মন্ত্রী ।

    মিষ্টি মৃত্যু, আমাকে নাও, আমি তৈরি

    এই যে আমি এখানে, আমি যাচ্ছি

    তোমার নিরানন্দ শহরে ।

     

    ১২

    একটা শব্দে আমার কন্ঠস্বর হুঁচোট খায়

    আর অভিঘাত থেকে তুমি উৎসারিত হও

    এই অলৌকিকতার জন্য ততোটা উৎসাহী

    যতোটা তুমি তোমার অপরাধগুলোর জন্য !

    কেই বা তাহলে অবাক হবে

    যখন আমি আমার নথিগুলো খুলে ধরব

    যাতে পূঙ্খানুপূঙ্খভাবে অন্বেষণ করা যাব

    শব্দের ঝোপঝাড়গুলো ?

    আমার হাতে আরও দড়ি ধরিয়ে দেবার জন্য বন্ধুরা লক্ষ রাখে

    জেলখানার ছড়ানো ঘাসে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো ।

    তোমার জন্য, এমনকি তোমার বন্ধুত্বের জন্য

    আমি পরোয়া করি না ।

    আমি এই সৌভাগ্যকে আগলে রাখি

    যা বিচারকরা আমাকে দেন ।

    এটাকি তুমি, অন্য আমি, তোমার রুপোর চটি ছাড়াই

    সালোম, যে আমাকে একটা গোলাপ কেটে এনে দ্যায় ?

    এই রক্তাক্ত গোলাপ, শেষ পর্যন্ত তার ব্যাণ্ডেজ থেকে খোলা

    তা কি মেয়েটির, নাকি এটা জাঁ জেনের মাথা ?

    উত্তর দাও পিলর ! তোমার চোখের পাতাকে পিটপিট করতে দাও

    আমার সঙ্গে তির্যক কথা বলো, তোমার গলায় গান গাও

    তোমার চুলের কাছে কাটা আর গোলাপঝাড় থেকে পড়ে যাওয়া

    হুবহু শব্দে, হে আমার গোলাপ

    আমার প্রার্থনাকে মেনে নাও ।

     

    ১৩

    হে আমার কারাগার যেখানে আমার বয়স না বাড়লেই আমি মারা পড়ি

    আমি তোমাকে ভালোবাসি ।

    জীবন, মৃত্যু দিয়ে সাজানো, আমাকে শুষে নেয় ।

    তাদের ধীর কঠিন ওয়ালৎজ উল্টোদিকে নাচা হয়

    প্রত্যেকে নিজের মহিমান্বিত কার্যকারণের পাক খোলে

    অন্যের বিরোধীতায় ।

    তবু, আমার অনেকটা জায়গা আছে, এটা আমার সমাধি নয়

    আমার জেলখুপরি বেশ বড়ো আর আমার জানালা অতিবিশুদ্ধ ।

    আবার জন্ম নেবার জন্য অপেক্ষা করছি জন্মের আগের রাতে

    আমি নিজেকে তেমনভাবে বাঁচার অনুমতি দিয়েছি যাতে আমাকে

    মৃত্যু চিনতে পারে

    উচ্চতর ইশারার মাধ্যমে ।

    আকাশ ছাড়া আর সকলের জন্য আমি আমার দরোজা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছি

    আর আমি কেবল বন্ধুত্বপূর্ণ মুহূর্তের অনুমতি দিই

    খোকা চোরগুলোকে যাদের ফিসফিসানিতে আমার কান গুপ্তচরগিরি করে

    নিষ্ঠুর আশায়, আমার সাহায্যের ডাকের জন্য

    তাদের সমাপ্ত গানের মাধ্যমে ।

    যদি আমি ইতস্তত করি আমার গান নকল নয়

    কেননা আমি আমার গভীর মাটির তলায় খোঁজ করি

    আর আমি প্রতিবার একই ধ্বনন নিয়ে উঠে আসি

    জীবন্ত কবর দেয়া ঐশ্বর্যের টুকরো-টাকরা

    যা জগতের আরম্ভ থেকে ছিল ।

    যদি তুমি দ্যাখো আমার টেবিলের ওপরে ঝুঁকে আছি

    সাহিত্যে বরবাদ আমার মুখাবয়ব

    তাহলে বুঝবে যে এটা আমাকেও পীড়িত করে

    এই ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক কাজ

    আবিষ্কার করার স্পর্ধা

    সেই লুকোনো সোনার

    এই প্রচুর

    পচনের তলায় ।

    এক আনন্দময় জ্যোতি আমার চোখে উদ্ভাসিত হয়

    যেন উজ্বল ভোরবেলায় এক জাজিম

    পাথরের ওপরে বেছানো 

    তোমার চলাফেরায় বাধা দেবার জন্য

    গোলোকধাঁধা জুড়ে

    কন্ঠরুদ্ধ দর-দালানগুলোতে

    তোমার চৌকাঠ থেকে

    ভোরের

    সিংহদ্বার পর্যন্ত ।

     

    ( কবিতাটি মরিস পিলর [ Maurice Pilogre ] নামে একজন নামকরা অপরাধীকে উদ্দেশ্য করে। জেলে তার সঙ্গে জাঁ জেনের পরিচয় ।  ১৯৩৯ সালে গিলোটিনে তার মাথা কাটা হয়েছিল । মরিস পিলর হাসিমুখে গিলোটিনে মাথা দিয়েছিল ; রাষ্ট্রপতির ক্ষমাভিক্ষা চায়নি । )

  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৯:৩৭735114
  • জাঁ জেনে’র কবিতা ( ১৯১০ - ১৯৮৬ )  ‘শবযাত্রার কুচকাওয়াজ’

    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    এক কোনে আবদ্ধ, একটুখানি রাত রয়ে গেছে।

    আমাদের ভিতু আকাশে নির্মম আঘাতে স্ফূলিঙ্গ উগরে

    ( নৈশব্দের গাছেরা কিছু দীর্ঘশ্বাস ঝুলিয়ে রেখেছে )

    এই শূন্যতার শীর্ষে গরিমার এক গোলাপ জেগে।

    ঘুম বড়োই বিশ্বাসঘাতক যেখানে জেলখানা আমায় নিয়ে এসেছে

    যদিও আমার গোপন দালানে বেশ আস্পষ্টভাবে

    ওই অহংকারী ছোঁড়া গভীরভাবে নিজের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে

    নাবিকদের আলোয় ঝলমলিয়ে যারা শব-সুন্দরী  গড়ে তোলে ।

     

    ও আমাকে নিজের ভেতরে শেকল পরিয়ে রাখে

    জেলখানার এই কুড়ি বছর বয়সী পরিদর্শক

    আর ও আমায় চিরকালের জন্য শেকল পরিয়ে রাখে !

    একটিমাত্র ইঙ্গিত, ওর চোখ, দাঁতে চুল চিবোয় :

    আমার হৃদয় খুলে যায়, আর পরিদর্শক, উৎসবময় উল্লাসে

    আমাকে নিজের অন্তরে জেলবন্দী করে ।

    এই অসূ্য়াভরা দরোজা আবার বন্ধ হবার সুযোগ পায় না

    অনেক বেশি দয়ায়

    আর তুমি তো ইতোমধ্যেই ফিরেছো । তোমার পরিপূর্ণতা আমাকে আতঙ্কিত করে

    আর আমি আজকে শুনতে পাই আমাদের ভালোবাসা বর্ণিত হচ্ছে

    তোমার মুখে যা গান গায় ।

    এই ছোরামারা ট্যাঙ্গো যা জেলখুপরি শুনতে পায়

    বিদায়বেলার এই ট্যাঙ্গোনাচ ।

    তাহলে কি তুমি, হে প্রভূ, এই উজ্বল বাতাসে ?

    তোমার আত্মা গোপন পথে এগিয়েছে

    দেবতাদের থেকে পার পাবার জন্য ।

     

    যখন তুমি ঘুমোও রাতের আস্তাবল ভেঙে ঘোড়ারা 

    তোমার চ্যাটালো বুকে নামে, আর জানোয়ারগুলোর টগবগ

    অন্ধকারকে ছত্রভঙ্গ করে তোলা যেখানে ঘুম নিজের

    ক্ষমতার যন্ত্র চালায়, আমার মগজ থেকে ছিঁড়ে

    একটুও শব্দ না করেই ।

    ঘুম অনেক শাখা তৈরি করে

    তোমার পা থেকে ফুল

    তাদের কান্নায় কন্ঠরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে আমি ভয় পাই ।

    তোমার মোলায়ের পাছার বাঁকের ওপরে, মিলিয়ে যাবার আগে

    তোমার শাদা ত্বকে তা নীলাভ।

    কিন্তু একজন জেল পরিদর্শক কি তোমাকে জাগিয়ে তুলতে পারে, আমার কচি চোর

    যখন তুমি তোমার হাত ধুয়ে নাও ( ওই পাখিগুলো তোমার দস্তানায়

    ডানা ঝাপটায়, একশো দুঃখের ভারে )

    তারপর তুমি নির্দয়ভাবে নক্ষত্রদের আলোকরশ্মিকে ছারখার করে দাও

    তোমার কাঁদতে-থাকা মুখের ওপরে ।

    তোমার শোকেভরা অবশিষ্টাংশে

    মহিমাময় অঙ্গভঙ্গী ধরে রাখা হয়

    তোমার হাত যেটা একে ছুঁড়ে দিয়েছিল, রশ্মি দিয়ে বীজ পুঁতেছিল।

    তোমার গেঞ্জি, তোমার শার্ট, আর তোমার কালো বেল্ট

    আমার জেলখুপরিকে অবাক করে আর আমাকে হতবুদ্ধি করে তোলে

    তোমার সুন্দর হস্তিদন্তের সামনে ।

     

    সারাদিনের সুন্দর রাতগুলো

    পিলর-এর অন্ধকার

    তোমার কালো পাকের ভেতরে

    আমার ছুরি জাল করা হয় ।

    ঈশ্বর, এখানে আমি উলঙ্গ

    আমার ভয়ঙ্কর লুভরেতে ।

    কেউ চিনতে পারে না

    তোমার বন্ধ মুঠো আমায় খুলে দ্যায় ।

    আমি ভালোবাসা ছাড়া কিছু নই

    আমার সমস্ত শাখা জ্বলে

    যদি আমি দিনটাকে অন্ধকার করে দিই

    তারপর আমার ভেতরের ছায়া নিজেকে গুটিয়ে নেয় ।

    বিশুদ্ধ হাওয়ায় এটা সম্ভব

    আমার শুকনো দেহ গুঁড়িয়ে ধুলোয় মেশার জন্য

    দেয়ালে পিঠ দিয়ে

    আমি বিদ্যুতের চমকের দখল নিই ।

    হৃদয় আমার সূর্য

    মোরগের ডাকে চৌচির হয়ে যায়

    ঘুম কখনও সাহস দেখায় না

    এখানে তার স্বপ্নগুলোকে উথলে দিতে।

    আমার আকাঙ্খায় শুকিয়ে যাওয়া

    আমি স্তব্ধতাকে মেরামত করে দিই

    পাখিদের আগুন দিয়ে

    যা আমার গাছ থেকে জেগেছে ।

     

    নিষ্ঠুর প্রকৃতির মনে হয় এমন মহিলাদের থেকে

    তাদের খবরিয়ারা গয়না পরে থাকে ।

    গলির এই ছিঁচকে চোরগুলো রাতের বেলায় জেগে ওঠে

    আর তাদের ইশারা পেয়ে তুমি সাহসে বেরিয়ে পড়ো।

    অমন এক কচিখোকা, নিজের মায়াময় পোশাকে কাঁপে

    ও ছিল আমার কাছে পাঠানো দেবদূত, যার আলোময় দিশা

    আমি অনুসরণ করি বিভ্রান্ত হয়ে, যাত্রায় পাগল হয়ে

    এই জেলখুপরি পর্যন্ত যেখানে তার প্রত্যাখ্যান ছিল জ্যোতির্ময়।

    যখন আমি অন্য সুরে গাইতে চাইলুম

    আমার পালক আলোকরশ্মিতে জড়িয়ে পড়লো

    এক ঝিমধরা শব্দে, মাথা নিচু করে

    আমি বোকার মতন পড়ে গেলুম, এই ভুলের মাশুল হিসেবে

    এই খাদের তলায় ।

     

    আর কিছুই গোলমাল

    বাধাবে না অনন্তকালীন ঋতুতে

    যেখানে আমি নিজেকে আটক আবিষ্কার করছি ।

    একাকীত্বের স্হির জলাশয়

    আমাকে পাহারা দেয় আর জেলখানা ভরে রাখে ।

    আমি চিরকালের জন্য কুড়ি বছর বয়সী

    তোমাদের নিরীক্ষণ সত্বেও ।

    তোমাদের মন রাখতে, ওহ বধির সৌন্দর্যের অনাথ

    মারা না যাওয়া পর্যন্ত আমি পোশাক পরে থাকবো

    আর তোমার আত্মা তোমার মুণ্ডকাটা ধড়কে ছেড়ে গিয়ে

    আমার ভেতরে খুঁজে পাবে এক শাদা আশ্রয় ।

    ওহ একথা জানতে পারা যে তুমি আমার মামুলি ছাদের তলায় শোও!

    তুমি আমার মুখ দিয়ে কথা বলো

    আমার চোখ দিয়ে দ্যাখো

    এই ঘর তোমার আর আমার কবিতা তোমার।

    যা ভালো লাগে তার জন্য আরেকবার বেঁচে নাও

    আমি নজর রাখছি ।

     

    হয়তো তুমিই ছিলে সেই দানব যে কেঁদেছিল

    আমার উঁচু দেয়ালের পেছনে ?

    রেশমি ফিতের চেয়েও মোলায়েম তুমি ফিরে এসেছো

    আমার দৈব দুর্বৃত্ত

    এক নতুন মৃত্যুর মাধ্যমে নিয়তি আবার তছনছ করে

    আমাদের নিরানন্দ ভালোবাসাগুলো

    কেননা তুমিই তো ছিলে আবার, পিলর, মিথ্যা বোলো না

    এই চুরিকরা ছায়াগুলো !

     

    যে খোকাটাকে আমি খুঁজছিলুম

    বাচ্চাদের মধ্যে খেলছে

    নিজের বিছানায় মরে পড়ে আছে, একা

    এক রাজকুমারের মতন ।

    নিজের আলতো পায়ে ইতস্তত করে

    এক মহিমা ওর পায়ে জুতো পরায়

    আর দেহ ঢেকে দ্যায়

    রাজকীয় পতাকায় ।

    হাতে গোলাপ ধরে-থাকা মিষ্টি ভঙ্গীতে

    শবগুলো কে যে হাত লুটপাট করছিল তা চিনতে পারলুম।

    একজন সেনা অমন কাজ করবে না

    যা তুমি, একা, করেছিলে

    আর তুমি তাদের মধ্যে নেমে গেলে

    ভয়ও পেলে না

    পশ্চাত্তাপও নয় ।

    তোমার দেহের মতন

    একটা কালো গেঞ্জি তোমার আত্মাকে দস্তানায় ঢুকিয়ে রাখলো

    আর যখন তুমি নির্দিষ্ট সমাধিকে অপবিত্র করলে

    তুমি ছুরির ডগা দিয়ে খোদাই করে দিলে

    শব্দ আন্দাজ করার ধাঁধা

    বিদ্যুৎ দিয়ে নকশাকাটা ।

    আমরা তোমার উথ্থান দেখেছি, উন্মাদনায় বয়ে যাওয়া

    নিজের চুলে ঝুলছ

    লোহার মুকুটে

    মুক্ত-বসানো ফিতেয় আর বাসি গোলাপে

    জীবন্ত ধরবার জন্যে মোচড়ানো হাত ।

    তোমার মৃদু হাসি আমাদের দেখাবার জন্য সবেই ফিরেছ

    তুমি দ্রুত উধাও হয়ে গেলে আমার মনে হয়

    আমাদের কিছু না জানিয়ে, তোমার ঘুমন্ত গরিমা

    আরেক মুখের সন্ধানে অন্যান্য আকাশে ঘুরে বেড়িয়েছে।

    পথচলতি এক বালককে লক্ষ করি

    তোমার সুগঠিত দেহের ঝলক

    আমি তার মাধ্যমে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি

    কিন্তু তার এক সামান্য ইশারা

    তার কাছ থেকে তোমাকে উধাও করে দিলো

    আর তোমাকে আমার কবিতায় ছুঁড়ে ফেললো

    যেখান থেকে তুমি পালাতে পারবে না ।

    কোন দেবদূত তাহলে

    তোমাকে পাশ দিয়ে যাবার অনুমতি দিলো

    অকাতরে বস্তুর ভেতর দিয়ে যেতে

    হাত দিয়ে বাতাসকে দুফাঁক করে

    ক্ষেপণাস্ত্রের ডগার সূক্ষ্ম ঘূর্ণনের মতো

    যা নিজের দামি পথ খুঁজে নিজেই তাকে নষ্ট করে ?

    তোমার পালাবার সংকীর্ণতা আমাদের নিরানন্দ করেছিল ।

    এক দ্যুতিময় পিছুটান তোমাকে আমাদের আলিঙ্গনে এনে দিয়েছিল।

    তুমি আমাদের গলায় টোকা মেরে আমাদের মন ভরাতে চাইলে

    আর তোমার হাত ছিল ক্ষমাময়

    কামানো চুলের দরুণ ।

    কিন্তু তুমি আর দেখা দাও না, ফর্সা খোকা যাকে আমি খুঁজি।

    আমি কোনো শব্দে হুঁচোট খাই আর তোমাকে তার বিপরীতে দেখি।

    তুমি আমার কাছ থেকে সরে যাও, কবিতা আমাকে রক্ষা করে।

    কান্নার কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে আমি বিপথগামী হই ।

    তোমাকে ধরার জন্য আকাশ নানা ফাঁদ পেতেছিল

    করাল আর নতুন, মৃত্যুর সঙ্গে ষড় করে

    এক অদৃশ্য সিংহাসন থেকে নজর রাখছিল

    সুতোগুলো আর গিঁটগুলো

    সোনার ববিনে পরানো ।

    আকাশ এমনকি মৌমাছিদের যাত্রাপথ ব্যবহার করেছিল

    কতোরকমের রশ্মি আর কতোরকমের সুতোর পাক খুলে

    যে সেষ পর্যন্ত ওকে গোলাপের সৌন্দর্য ধরে ফেললো :

    ছবিতে দেখানো এক শিশুর মুখ ।

    এই খেলা যদি নিষ্ঠুর হয় তাহলে আমি নালিশ করব না

    তোমার সুন্দর চোখ খুলে ফেলার জন্য

    দুঃখের এক গান তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেল

    অতো সন্ত্রাসকে আয়ত্ত করে

    আর এই গান, হাজার বছরের জন্য

    তোমার কফিনকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ।

    দেবতাদের ফাঁদে আটক, তাদের রেশমিসুতোয় কন্ঠরুদ্ধ

    কেন আর কেমন করে না জেনেই তুমি মারা গেলে ।

    তুমি আমাকে ছাপিয়ে জিতে গেছ

    কিন্তু সাপসিঁড়ি লুডোখেলায় হেরে গেছ

    যেখানে আমি তোমাকে ধর্ষণ করার সাহস দেখাই

    ওগো আমার পলাতক প্রেমিকা ।

    কালো সেনারা তাদের বন্দুক নত করলেও

    তুমি ওই বিছানা ছেড়ে পালাতে পারো না যেখানে লোহার মুখোশ

    তোমাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে -- কিন্তু হঠাৎ তুমি উঠে দাঁড়াও

    নড়াচড়া না করেই পেছনে পড়ে যাও

    আর নরকে ফেরো ।

     

    ১০

    আমার ভালোবাসার কালকুঠুরি

    তোমার স্পন্দিত ছায়ায়

    আমার চোখ, আচমকা, এক গোপনকথা আবিষ্কার করেছে ।

    আমি কতো রকম শোয়া শুয়েছি তা জগত জানে না

    যেখানে সন্ত্রাস নিজেই গিঁট পাকায় ।

    তোমার অন্ধকার হৃদয়ের দর-দালানগুলো আঁকাবাঁকা পথ

    আর তাদের জড়োকরা স্বপ্নগুলো স্তব্ধতাকে সঙ্গঠিত করে

    কবিতার সঙ্গে মিল আছে এমন এক যান্ত্রিক প্রক্রিয়া

    আর তার হুবহু তীব্রতা ।

    আমার চোখ আর আমার কপাল থেকে

    তোমার রাত কালির বন্যা বয়ে যেতে দ্যায়

    এমন ঘন পালক যার ওপরে আমি এখানে শুই

    নিয়ে আসবে কুসুমিত নক্ষত্রদের

    যেমন কেউ গোলাগুলির বেড়াজালে দেখতে পায় ।

    আমি তরল অন্ধকারের দিকে এগোই

    যেখানে অবয়বহীন ষড়যন্ত্রেরা

    ধীরে ধীরে আকার পাওয়া আরম্ভ করে ।

    কেনই বা আমি সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করব ?

    আমার সমস্ত অঙ্গবিক্ষেপ ভেঙে টুকরো হয়

    আমার আমার কান্নাগুলো

    খুবই সুন্দর ।

    আমার চাপা দুর্দশা থেকে শুধু তুমিই জানতে পারবে

    দিনের মেলে দেয়া অদ্ভুত সৌন্দর্যগুলো ।

    ওদের হাজার রকমের ভেলকিবাজির পর

    যে বজ্জাতদের কথা আমি শুনি

    খোলা বাতাসে ভিড় জমায় ।

    পৃথিবীতে তারা একজন কোমল প্রতিনিধি পাঠায়

    এক শিশু যে কারোর পরোয়া করে না, আর নিজের যাত্রাপথ চিহ্ণিত করে

    অনেকরকমের চামড়া ফাটিয়ে

    আর ওর খোশমেজাজি বার্তা

    এখানে পায় নিজের জাঁকজমক ।

    কবিতাটা পযে তুমি লজ্জায় ফ্যাকাশে হয়ে যাও

    অপরাধী অঙ্গভঙ্গী দিয়ে একজন বয়ঃসন্ধির লেখা

    কিন্তু তুমি কখনও জানতে পারবে না

    মৌলিক গিঁটগুলোর কোনও ব্যাপার

    যা আমার মলিন ক্রোধের ফসল

    কেননা ওর রাতে যে গন্ধগুলো গড়াচ্ছে তা খুবই তীব্র।

    ও সই করবে পিলর আর ওর মহিমান্বয়ন হবে

    গোলাপ-স্রোতের উজ্বল ফাঁসিমঞ্চ

    মৃত্যুর সুন্দর কর্মফল ।

     

    ১১

    সম্ভাবনা -- সবচেয়ে মহার্ঘ সম্ভাবনা !

    প্রায়ই আমার পালককে তৈরি করতে বাধ্য করেছে

    আমার সমস্ত কবিতার হৃদয়কেন্দ্র

    সেই গোলাপ যার ওপরে শাদা শব্দে লেখা মৃত্যু

    বাহুর ফেট্টিতে নকশা করা

    যে কালো যুদ্ধাদের আমি ভালোবাসি তাদের নাম।

    আমার রাতের ভেতর দিয়ে কোন বাগানই বা ফুল ফোটাতে পারে

    কোন যন্ত্রণাময় খেলা এখানে হয় যে

    এই কেটে নেয়া গোলাপ থেকে পাপড়ি ছেঁড়া হয়

    আর কে তাকে নিঃশব্দে ফাঁকা কাগজে নিয়ে যায়

    যেখানে তোমার হাসি তাকে অভিবাদন করে ?

    কিন্তু মৃত্যুর ব্যাপারে বিশেষকিছু আমি জানি না

    মেয়েটির বিষয়ে এতো কথা বলার পরও

    আর গুরুতর উপায়ে

    তাহলে মেয়েটি আমার ভেতরেই বাস করে

    যাতে সহজে জেগে উঠতে পারে

    আমার আমার আবোলতাবোল থেকে বইতে পারে

    অন্তত আমার শব্দগুলো ।

    মেয়েটির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না

    বলা হয় যে ওর সৌন্দর্যের ইন্দ্রজাল

    অনন্তকালকে খেয়ে ফ্যালে

    কিন্তু এই বিশুদ্ধ বিচরণ পরাজয়ে বিদীর্ণ হয়

    আর এক বিয়োগান্তক বিশৃঙ্খলার গোপনীয়তাকে ফাঁস করে ।

    অশ্রুবিন্দুর আবহাওয়ায় ঘুরে বেড়িয়ে ফ্যাকাশে

    মেয়েটি খালি পায়ে আসে ফুৎকারে আত্মপ্রকাশিত হয়ে

    আমার উপরিতলে যেখানে ফুলের এই তোড়াগুলো

    আমাকে শেখায়  মৃত্যুর

    কন্ঠরোধী কোমলতা।

    আমি নিজেকে তোমার আলিঙ্গনে ছেড়ে দেবো, হে বর্ণোজ্বল মৃত্যু

    কেননা আমি জানি কেমন করে আবিষ্কার করতে হয়

    আমার উন্মুক্ত শৈশবের চলমান চারণভূমি

    যেখানে তুমি আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে যাবে

    অপরিচিত লোকটার ফুলেফুলে সাজানো লিঙ্গের কাছে ।

    আর এই শক্তিতে বলবান, হে রানি, আমি হবো

    তোমার ছায়াদের নাটকের গোপন মন্ত্রী ।

    মিষ্টি মৃত্যু, আমাকে নাও, আমি তৈরি

    এই যে আমি এখানে, আমি যাচ্ছি

    তোমার নিরানন্দ শহরে ।

     

    ১২

    একটা শব্দে আমার কন্ঠস্বর হুঁচোট খায়

    আর অভিঘাত থেকে তুমি উৎসারিত হও

    এই অলৌকিকতার জন্য ততোটা উৎসাহী

    যতোটা তুমি তোমার অপরাধগুলোর জন্য !

    কেই বা তাহলে অবাক হবে

    যখন আমি আমার নথিগুলো খুলে ধরব

    যাতে পূঙ্খানুপূঙ্খভাবে অন্বেষণ করা যাব

    শব্দের ঝোপঝাড়গুলো ?

    আমার হাতে আরও দড়ি ধরিয়ে দেবার জন্য বন্ধুরা লক্ষ রাখে

    জেলখানার ছড়ানো ঘাসে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো ।

    তোমার জন্য, এমনকি তোমার বন্ধুত্বের জন্য

    আমি পরোয়া করি না ।

    আমি এই সৌভাগ্যকে আগলে রাখি

    যা বিচারকরা আমাকে দেন ।

    এটাকি তুমি, অন্য আমি, তোমার রুপোর চটি ছাড়াই

    সালোম, যে আমাকে একটা গোলাপ কেটে এনে দ্যায় ?

    এই রক্তাক্ত গোলাপ, শেষ পর্যন্ত তার ব্যাণ্ডেজ থেকে খোলা

    তা কি মেয়েটির, নাকি এটা জাঁ জেনের মাথা ?

    উত্তর দাও পিলর ! তোমার চোখের পাতাকে পিটপিট করতে দাও

    আমার সঙ্গে তির্যক কথা বলো, তোমার গলায় গান গাও

    তোমার চুলের কাছে কাটা আর গোলাপঝাড় থেকে পড়ে যাওয়া

    হুবহু শব্দে, হে আমার গোলাপ

    আমার প্রার্থনাকে মেনে নাও ।

     

    ১৩

    হে আমার কারাগার যেখানে আমার বয়স না বাড়লেই আমি মারা পড়ি

    আমি তোমাকে ভালোবাসি ।

    জীবন, মৃত্যু দিয়ে সাজানো, আমাকে শুষে নেয় ।

    তাদের ধীর কঠিন ওয়ালৎজ উল্টোদিকে নাচা হয়

    প্রত্যেকে নিজের মহিমান্বিত কার্যকারণের পাক খোলে

    অন্যের বিরোধীতায় ।

    তবু, আমার অনেকটা জায়গা আছে, এটা আমার সমাধি নয়

    আমার জেলখুপরি বেশ বড়ো আর আমার জানালা অতিবিশুদ্ধ ।

    আবার জন্ম নেবার জন্য অপেক্ষা করছি জন্মের আগের রাতে

    আমি নিজেকে তেমনভাবে বাঁচার অনুমতি দিয়েছি যাতে আমাকে

    মৃত্যু চিনতে পারে

    উচ্চতর ইশারার মাধ্যমে ।

    আকাশ ছাড়া আর সকলের জন্য আমি আমার দরোজা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছি

    আর আমি কেবল বন্ধুত্বপূর্ণ মুহূর্তের অনুমতি দিই

    খোকা চোরগুলোকে যাদের ফিসফিসানিতে আমার কান গুপ্তচরগিরি করে

    নিষ্ঠুর আশায়, আমার সাহায্যের ডাকের জন্য

    তাদের সমাপ্ত গানের মাধ্যমে ।

    যদি আমি ইতস্তত করি আমার গান নকল নয়

    কেননা আমি আমার গভীর মাটির তলায় খোঁজ করি

    আর আমি প্রতিবার একই ধ্বনন নিয়ে উঠে আসি

    জীবন্ত কবর দেয়া ঐশ্বর্যের টুকরো-টাকরা

    যা জগতের আরম্ভ থেকে ছিল ।

    যদি তুমি দ্যাখো আমার টেবিলের ওপরে ঝুঁকে আছি

    সাহিত্যে বরবাদ আমার মুখাবয়ব

    তাহলে বুঝবে যে এটা আমাকেও পীড়িত করে

    এই ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক কাজ

    আবিষ্কার করার স্পর্ধা

    সেই লুকোনো সোনার

    এই প্রচুর

    পচনের তলায় ।

    এক আনন্দময় জ্যোতি আমার চোখে উদ্ভাসিত হয়

    যেন উজ্বল ভোরবেলায় এক জাজিম

    পাথরের ওপরে বেছানো 

    তোমার চলাফেরায় বাধা দেবার জন্য

    গোলোকধাঁধা জুড়ে

    কন্ঠরুদ্ধ দর-দালানগুলোতে

    তোমার চৌকাঠ থেকে

    ভোরের

    সিংহদ্বার পর্যন্ত ।

     

    ( কবিতাটি মরিস পিলর [ Maurice Pilogre ] নামে একজন নামকরা অপরাধীকে উদ্দেশ্য করে। জেলে তার সঙ্গে জাঁ জেনের পরিচয় ।  ১৯৩৯ সালে গিলোটিনে তার মাথা কাটা হয়েছিল । মরিস পিলর হাসিমুখে গিলোটিনে মাথা দিয়েছিল ; রাষ্ট্রপতির ক্ষমাভিক্ষা চায়নি । )

  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৯:৩৯735115
  • জাঁ জেনের কবিতা 

    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    রণতরী

    একজন মুক্ত কয়েদি, জেদি আর ভয়ঙ্কর, ছুঁড়ে ফেলে দিলো

    পাটাতনের ওপরে একজন কেনা-গোলাম নাবিককে

    কিন্তু তরোয়ালের এক ঝটকায়

    কোটনা, দক্ষিণের ক্রস

    আর খুনি. উত্তরমেরু

    আরেকজনের কান থেকে 

    তার সোনার মাকড়ি হাতিয়ে নিলো ।

    সবচেয়ে সুন্দর হলো তারা

    যাদের চরিত্রে আছে অদ্ভুত গোলমাল ।

    গিটার বেজে ওঠে সুরে ।

    সমুদ্রের ফেনা থুতুকে ভিজিয়ে দ্যায় ।

    আমরা কি একজন পাশার 

    মুখ থেকে

    ফেলে দেয়া মানুষ ?

    «

    ওরা আমাকে পিটুনির কথা বলে আর আমি তোমার ঘুষির আওয়াজ শুনি।

    কে আমাকে গড়িয়ে নিয়ে যায়, হারকামোন, আর আমাকে সেলাই করে দিলো

    তোমার পরতের সঙ্গে ?

    «

    সবুজ-বাহু হারকামোন, উড়ন্ত রানি

    তোমার রাতের গন্ধে

    আর বনানি জেগে ওঠে

    তার নামের আতঙ্কে

    এই দুঃখি কয়েদি গান গায়

    আমার রণতরীতে 

    আর ওর গান

    আমাকে বিধ্বস্ত করে।

    «

    দাঁড়গুলো শেকল আর লজ্জার ভারে 

    ফেননিভ, নৌডাকাত, সমুদ্রের এই ষাঁড়গুলো

    আর তোমার অঙ্গভঙ্গী হাজার বছরের পরিশ্রমে

    তোমার স্মৃতিকে মনে পড়ায়

    আর নৈঃশব্দ

    রয়েছে তোমার স্পষ্ট চোখের রাতে ।

    «

    মৃত্যুর সুতো দিয়ে

    এই রাতের অস্ত্রগুলো

    মদে পক্ষাঘাতগ্রস্ত আমার বাহুকে ধরে নিয়ে গেল

    নাসারন্ধ্রের নীলাভ

    বিপথগামী গোলাপের চালনায়

    যেখানে ঝোপের তলায় কাঁপতে থাকে এক সোনালী হরিণী

    আমি নিজেকে অবাক করে তুলি আর নিজেকে হারাই

    তোমার পথ ধরে

    অবাক নদী

    কথাবার্তার শিরা থেকে বয়ে যায় ।

    «

    এই চিন্তাগুলো যা তুমি পাহারা দাও তার গন্ধ আমার রসনায়

    দুই মোড়া বাহুতে তোমার জুলফিতে বাঁধা 

    তোমার সোনার তলপেট খুলে দাও যাতে তাদের দেখতে পাই

    তোমার  নুন মাখানো বুকের মধ্যে।

    «

    এখানে একটা কুপি জ্বলে

    আমার আধখোলা কফিনের ওপরে

    ভিজে ফুলে সাজানো

    আর তাদের দেখতে থেকে

    যেগুলো ডুবে গেছে  ।

    «

    একটা ইঙ্গিত করো, হারকামোন

    তোমার বাহুকে একটু ছড়িয়ে দাও

    আমাকে পথ দেখাও

    যে পথে তুমি উড়ে যাবে ।

    তুমি ঘুমোও কিংবা মারা পড়ো

    কিন্তু তুমি আবার যোগ দেবে

    এই পাগলিটার সঙ্গে

    যেখানে  শেকলখোলা

    কেনা-গোলাম নাবিকরা ওড়ে

    আমার মতন ফিরে আসে

    কারাগারে, বন্দরে

    অসাধারণ পাতালকুঠুরিতে

    উষ্ণ মদ খেয়ে টলমল করতে করতে ।

    «

    যে সুরেলা পাদ তুমি চেপে যাও

    একদল রোগা কোটনাকে সবুজ ফুলে কারারুদ্ধ করে দ্যায়

    নাসারন্ধ্র ফোলা, আমরা ওদের জন্য অপেক্ষা করবো

    আর পৌঁছোবো ওদের কাছে

    ঢাকা দেয়া রথে ।

    «

    আমার শৈশব রাতের ওপরে সবেমাত্র বেছানো

    জ্বলতে থাকা কাগজে, এই রেশমকে মিশিয়ে

    যা এক মোটা কোটনা  পিঙ্গলরঙা দ্যুতিতে মেলে ধরেছে

    বহুদূরের শান্ত বাতাসে

    আমার শরীর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল।

    «

    তা সত্তেও, হরিণী ধরা পড়ে তার পাতার ফাঁদে

    ভোরবেলায় জেগে ওঠে, এক স্বচ্ছ বিদায়

    «

    তোমার চোখের মধ্যে দিয়ে চলে যায়, তোমার স্ফটিক, আর প্রেমে পড়ে

    সমুদ্রে একবিন্দু চোখের জল পড়ার পর, স্বাগত জানায় ।

    «

    বিপদে-পড়া একজন চোর, একজন চোর সমুদ্রে গেছে।

    আর লোহার মুখ নিয়ে কতো কালো হারকামোন

    ফিতে আর চুল ওকে টেনে কাদায় নামায়

    কিংবা সমুদ্রে ? আর মৃত্যুর ?

    তার ভাঙাচোরা গম্বুজকে সাজায়

    পতাকার সেলাই-করা সুতোয়

    মজায় হাসে কোটনাটা ।

    মৃত্যু, যদিও, চালাক

    আমি ঠাট্টা করার সাহস পাচ্ছি না ।

    «

    আমাদের গল্পের অতলে আমি ঘুমন্ত লাফ দিই

    আর তোমার গলা দিয়ে নিজেকে কন্ঠরুদ্ধ করি

    বেচারা সুগন্ধিত হারকামোন ।

    মিষ্টি-মটরের মতন এক সমুদ্রে

    মৃত্যু থেকে চুরি করা তোমার কেবিন-বয় সাহায্যের ডাক দ্যায়

    মুখে তার পরিষ্কার ফেনা

    আকাশের কালো সৈন্যরা যা ছিঁড়ে ফেলেছে

    ফিরে গেছে ওই জলে ।

    ওরা তাকে ফেনা আর মখমল জলপানায় সাজায়।

    প্রেম তাদের পাগড়ি-পরা লিঙ্গকে নাচায়

    ( হরিণী, নীলাভ আর ফুটন্ত গোলাপকে সামলায় )

    দড়িদড়া আর দেহগুলো গিঁটে শক্ত হয়ে গেছে ।

    আর রণতরী নিরেট হয়ে উঠছিল ।

    এক বিহ্বল শব্দ

    জগতের শেষ প্রান্ত

    সুন্দর ব্যবস্হাকে শেষ করে দিলো ।

    আমি দেখলুম প্রবেশপথ কামড়ে ধরছে

    বেড়ি আর জরি ।

    «

    হায়, আমার কয়েদি-হাত না মরেই মারা গেছে ।

    বাগানগুলো বলে না হরিণীকে কোথায়  পরানো হচ্ছে

    তুষারের পোশাক, আমার মহিমায় নিহত

    ফেনার আলখাল্লায় ভালো করে পোশাক পরানো যেতো ।

    «

    কারাগার যা আমাদের ধরে রাখে তা পিছিয়ে যায় ।

    নিজের বিপর্যয়ে চিৎকার করে

    তোমার আঙুরলতায় এক নিশ্চল মুঠি

    তোমার পাতাগুলোয় জড়িয়ে ধরে

    তোমার শীতল সাজানো কন্ঠস্বরের

    মূল পর্যন্ত

    হারকামোন ।

    চলো ফ্রান্সকে আমাদের রণতরীতে ছেড়ে দিই..

    আমি যে কেবিন-বয় ছিলুম নিশ্চয়ই বজ্জাতদের আনন্দ দিয়েছে।

    আমি অসাধারণ ফাঁসুড়ের সামনে দাঁড় বাইছিলুম

    এই হাসিমুখ সৌন্দর্য আমাকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করেছিল

    যেমনভাবে ফুলগুলো জড়িয়ে ধরে

    ( রোকেটের সেই গোলাপফুল, জংলিঘাসের ফাঁস খুলে )

    আর ওর ঢাকনার তলায় গড়ে তুলেছে

    এক আদরের কুঞ্জবন যেখানে গায়ক পাখিরা ওড়ে ।

    মৃদু গানের সুরে পালিয়ে গেলো হরিণী

    একজন রণতরীর কেনা-গোলাম নাবিকের ওপরে ঝুঁকে

    স্বপ্নগুলো ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে চলে গেলো।

    «

    গাছের নীল শাখাগুলো

    নুন থেকে আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে । 

    আমার নিঃসঙ্গতা গান গায়

    আমার রক্তের শুকতারাকে শুনিয়ে

    সোনার বুদবুদে ভরা হাওয়া 

    আমার ঠোঁট চিপে গান বের করে ।

    «

    প্রেমের এক বালক গোলাপি পোশাক পরে

    নিজের বিছানায় মোহসঞ্চারী অঙ্গবিক্ষেপ করছিল ।

    মার্সাইয়ের এক ফ্যাকাসে মাস্তান, তার দাঁতে নক্ষত্র

    আমার সঙ্গে প্রেমে হেরে গেলো ।

    আমার হাত আফিমের বস্তার চোরাচালান করছিল

    বিপর্যয়ের ভার -- আর ঘন জঙ্গল থেকে

    পরের পর চারণভূমিতে

    ছিল ভ্রাম্যমাণ পথ

    তোমার চোখের আলোয়

    তোমার হাত পুনরাবিষ্কার করার জন্য

    তোমার পকেটগুলো, ঈগলের বাসা

    আর সেই বিখ্যাত জায়গা যেখানে  নৈঃশব্দ তুলে নিয়ে যায়

    অন্ধকারের ঐশ্বর্য ।

    বাতাসের বিরুদ্ধে আমার হাসি নিজেকে ভাঙচুর করছিল ।

    আমি বিরক্ত হয়ে আমার ঘেয়ো মাড়ি উৎসর্গ করি

    কারাগারের মশার ডিমগুলোকে

    যেখানে আমাকে সম্প্রতি ঢোকানো হয়েছে ।

    «

    দেয়ালের ওপরের ছায়ায়, যা থেকে নৌচালক--

    নুনে ক্ষয়ে যাওয়া ওর নখ

    যদিও আমার মাপের লম্বা

    রক্তাক্ত হৃদয়ের মাঝে চিন্তাকে বিভ্রান্ত করছিল

    পরিলেখগুলো, অস্ত্র নামিয়ে রেখে

    আমাদের কান্না হায়

    তার কাছে দুর্বোধ্য 

    যে রাতের বেলায় লড়তে পারে না

    যেখানে শব্দগুলো নেকড়ে---

    ঝকঝকে নখ কি অনুমতি দেবে

    আমার উন্মাদ চোখ যা গিলে ফেলতে চাইছে, তাকে

    হাড় পর্যন্ত মাংস তুলে নেয়া
    অ্যান্দোভোরান্তের নাম ?

    «

    গর্বিত লোকটা 

    যে লজ্জায় ভুগছিল

    তাকে কাছাকাছি ধরে রেখেছিল একজন কাউন্টের সদস্যদল ।

    ওরা তাকে হাঁটু আর ঘুষি মেরে পিটুনি দিচ্ছিল।

    বজ্রাহত লোকেরা আমাদের চারপাশে গড়াগড়ি দিচ্ছিল ।

    ( আলোয় উজ্বল হাঁটু, কাদায়

    হাঁটু থেকে হাঁটুতে, ডেকের ওপরে ছড়াচ্ছিল

    হাঁটু, জলেতে যে ঘোড়াগুলো মাথা তুলছিল

    বেঁকা হাঁটু, নাবিকদের হইচই )

    সূর্য গোলাপ পাপড়ি ছড়াচ্ছিল দ্বীপপূঞ্জে ।

    জাহাজ পাক খাচ্ছিল রহস্যময় মাইলের পর মাইল ।

    নিচু গলায় ওরা হাঁকছিল

    এক ঘোষণা যেখানে চুমু পাগলের মতন ফেরাফিরি করছিল 

    বিশ্রাম নিতে অসমর্থ । ফেনার ওপরে

    আমার ভেতরে এক স্হির জলরাশি ছড়িয়ে দিচ্ছিল

    ঠুনকো প্রতিবিম্বটাকে

    যা এক অবিনাশী কেবিন-বয়ের ।

    «

    তোমার দাঁত, প্রভু, তোমার চোখ, আমাকে ভেনিসের কথা বলো !

    তোমার কঠিন ঠ্যাঙের গর্তে ওই পাখিগুলো !

    আমার আলস্য তোমার পায়ের শেকলকে

    আমাকে এখানে ব্যবহার করার জন্য

    ভুলের চেয়েও ভারি করে তোলে !

    «

    বালিশের কিনারা মিটিমিটি হাসে আর পর্দাগুলো যেন ইঁদুর ।

    শার্শি থেকে তুমি আঙুল দিয়ে বাষ্প সংগ্রহ করো ।

    তোমার কোমল ঘুম নিজেকে গিঁটে বেঁধে ফেলছে

    আর তোমার মুখ কুঁচকে যায়

    যখন তোমার সুন্দর চোখ উধাও হয়ে যায়

    সমুদ্রের ছাদের ওপরে ।

    «

    ফাটা ঠোঁটের কিনারায়

    একটা ছেলে যে ঢেউ আর বাতাসে খাপ খায়

    নিশানগুলোর ভেতর দিয়ে অদ্ভুতভাবে বেরিয়ে যায়

    আমি প্রায়ই দেখেছি একটা সিগারেটের মোচড়

    আমার মেয়েলি স্কার্টের ভেতরে ।

    কুড়ি বছর বয়সী এক কেনা-গোলাম নাবিক

    যাকে নিয়ে মশকরা আর  ঠাট্টা করা হয় 

    দেখলো নিজেই মরছে

    নৌকোর দেয়ালে গেঁথে দিয়ে ।

    «

    হারকামোন, তুমি কি ঘুমোও, তোমার মুণ্ডু ঘোরানো

    তোমার মুখ জলেতে, স্বপ্ন দেখে ফিরেছে কি ?

    তুমি আমার বালির ওপরে হাঁটো যেখানে ভারি ফলগুলো ঝরে পড়ে

    যখন কিনা অদ্ভুতভাবে তোমার মখমল অণ্ডকোষ

    আমার চোখে ফেটে পড়ে

    এক ইন্দ্রজালিক গাছের ফুলে-ফুলে কুসুমিত ।

    তোমার রুদ্ধকন্ঠের স্বরে মরে যাওয়া সম্পর্কে যা আমি ভালোবাসি

    তা হল এই আঁটো ক্যানেস্তারায় গরম জল ফুটতে থাকা ।

    অনেক সময়ে তুমি বলো একটা শব্দ আর তার মানে হারিয়ে যায়

    যদিও যে কন্ঠস্বর তা ওগরায় তা বেশ ফুলে ওঠে

    যা এই আহত কন্ঠস্বরে ভেঙে পড়ে ।

    «

    তোমার থুতনি থেকে কুষ্ঠরক্তের বন্যা বইতে থাকে

    কোনো যোদ্ধার ক্রোধের চেয়েও ভয়ানক

    আমার গর্বিত ম্যানড্রিন ।

    «

    সবে মাত্র জোড়া লাগানো হয়েছে

    এমন গাছের শাখাগুলো

    আমি অন্য ফুলেদের থেকে চুরি করেছি

    যাদের পা একসময়ে দৌড়োতো

    আমার বাগানে হাসতে-হাসতে

    যেখানে পড়ে আছে আমার ছায়া

    গোলাপগুলোকে স্নান করাচ্ছে

    আমার গায়ে ছেটাচ্ছে জলরাশি ।

    «

    ( একমুঠো চারাডাঁটা, উথ্থিত দলমণ্ডল

    পালকের দলমণ্ডল আর নেতৃত্বের সদস্যরা )

    তাদের দ্রুত আদরে এক মারাত্মক বাতাসের আওয়াজ

    জল পড়ে যায়

    আমার গোড়ালির ধাক্কায় ।

    «

    গলির ভেতর থেকে, গরম ফুলগুলো

    সন্ধ্যাবেলায় ছেড়ে চলে যায়

    আমি একা, স্যাঁতসেতে পতাকায় মোড়া

    তোমাদের মধ্যে কে আমাকে খুলে দেবে

    এই স্যাঁতসেতে ভাঁজগুলো থেকে

    যেগুলো নির্দয় আগুনের ?

    «

    তোমার হাসির মতন কোনো শীতল দেশ কি আছে ?

    তোমার জিভ চেটে নিচ্ছে প্রবালের ওপরের তুষার

    জলের পানার নুন আর তলপেটের নীলাভ

    আর জলতরঙ্গের মতন তোমার স্পন্দিত দেহের গান ।

    «

    হরিণীকে  অনুসরণ করার জন্য

    আমি যেতে যেতে খেলাটা তৈরি করি।

    একজন উত্তেজিত রানি, নির্বাসিত আর বেশ মিষ্টি

    প্রতিটি পদক্ষেপে যে কুমারীত্ব হারিয়েছে

    তাকে  জটিলতামুক্ত করেছে

    এক হরিণীর ভিজে পোশাক ।

    শ্রদ্ধায় জমে বরফ

    আমি তোমার মুখের রেখায় দেখি

    সমুদ্রের তীরে শেকলবাঁধা রানি ।

    ঘুমোও, সুপুরুষ হারকামোন

    যে খুনি গিরিসঙ্কট পেরিয়ে যায়

    আমার ডানা-লাগানো জুতো পরে ।

    «

    সেই ভঙ্গুর মুহূর্তে যখন সবকিছু সম্ভব ছিল

    আমরা হাঁটছিলুম অবাক অথচ

    শান্তিময় নীলাভে ।

    রণতরীর বিশৃঙ্খলা এক সৌন্দর্যের

    মিষ্টতার চেয়ে কম অদ্ভুত

    এক মোহমুগ্ধ গ্রাম

    এক বিষাদের বাতাস

    তার উৎসবগুলোকে নিয়ে

    ( তুষার পড়ছিল, কি যে শান্তি

    এই স্হির ঝড়েতে ! )

    ভায়োলিনের আর ওয়ালৎস নাচের ।

    বাহু এগিয়ে দ্যায় নিরানন্দ দেহজ্যোতিতে

    মেয়েটির ছিল পবিত্র বোঝা

    মাস্তুলের, থামের, দড়ির আর ধড়ের ।

    ওর পাতলা ত্বকের তলায় ও মুচড়ে উঠছিল ।

    আকাশ তার খ্রিস্টবন্দনা গাইছিল

    আর আমাদের হৃৎস্পন্দন গুনছিল ।

    এই ভয়ানক ব্যবস্হার অনমনীয়তা বেশ কঠিন

    যেখানে কাঁপছিল সৌন্দর্য ।

    আমরা প্রাসাদগুলোর ভেতরে নিঃশব্দে চলাফেরা করলুম

    যেখানে মৃত্যু বিধিসন্মত  জীবন কাটিয়েছে ।

    আমার আর ইচ্ছে ছিল না, গায়ে জোরও ছিল না

    বাতাসে উঠে পড়ার, তার দরকারই বা কি ?

    সবচেয়ে সুন্দর বন্ধুরা

    পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে

    আর সমাধিগুলো

    বাতাসের সঙ্গে ।

    «

    আর সেই সব উজ্বল শিশুরা নৌকোর পালে উড়ছিল ।

    পুরো গতিতে, স্বপ্ন তোমাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল

    পাক খেয়ে সরে যাচ্ছিল ।

    ছেঁড়া মালাটা ছিল প্রেমের গিঁটে বাঁধা

    মৃত্যুর পায়ের সঙ্গে

    আর মৃত্যুকে করা হয়েছিল প্রতারিত ।

    আমি অনুভব করলুম এক আতঙ্কময় নিশ্চল মুহূর্ত

    কেননা আমি এই সুন্দর ছলনাময় জগতের কথা জানতুম

    যাকে ধরে রেখেছে অনন্তকাল

    বেশি কঠিন আর বেশি ঘন

    মিশরের তুলনায়

    কম নোংরা নয় ।

    গিঁট দিয়ে গলা টিপে মেরে ফেললো ওরা কয়েকটা ষাঁড়কে

    তিনজন মানুষের তৈরি

    আর নোনা বাতাসের হাত

    তাদের পাপকে মাফ করে দিয়েছে ।

    রণতরীটা ছিল একটা নাগরদোলা

    এক সন্ধ্যার ক্রোধে ভেঙে ফেলা ।

    আর তবু কিন মহিমা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো !

    জাঁকজমকভরা স্মৃতিস্তম্ভ :

    দেহের জন্য সাধারণ কফিনও নেই

    স্বপ্নের মাঝে 

    আমাদের যত্নে সুবাসিত করা হয়েছিল !

    তোমার স্পঞ্জের হাত দিয়ে টেপো

    বের করে আনো তোমার ভালোবাসার আঙুলগুলো ।

    আমি জানি কেমন করে ফিরে আসতে হয়

    আঙ্গিকহীন পরিবর্তনে ।

    যদি তুমি তোমার পোশাককে ছোঁও

    আমার আঙুলের ডগায় কুয়াশা জমে যাবে

    তুমি আমাকে নীল বাতাস থেকে বিগলিত করে আনো, পশু

    আর বদলে দাও অশ্রুবিন্দুতে

    তোমার অদ্ভুত অক্ষিগোলক থেকে ঝরে পড়ে

    তোমার শুকনো পায়ে

    তোমার থেকে আমার বাঁধন খুলে দ্যায়

    আমার হরিণী ।

    «

    উত্তাপ এমন গোলাপি, তোমার গালে বাতাস করো

    নৈঃশব্দকে স্ফীত করে তোলে এক দীর্ঘশ্বাস ।

    ধীরেসুস্তে চলমান ছায়ায় বাসা বানায় কাঁটাগাছ

    তাই আমি একা থাকি ।

    কে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে আসে, রাত্রি ?

    তোমার বনানীর ওপরে বাঁধা

    অসংলগ্ন এক নৌকো 

    আকাশে জেগে ওঠে ।

    হে অবলা হরিণী,

    তোমার কানের কথা শুনতে পায়

    শাখাদের অনুচ্চ মর্মর

    যেমন সে সোনালী বাতাসের গান শোনে

    বরফকে ভেঙে ফেলছে...

    «

    যারা বিষ দ্যায় তাদের দল দড়ি থেকে ঝুলছে

    অপরাধীরা পরস্পরের পোঁদ মারছে 

    বয়সের তফাত ঘুচিয়ে ।

    পরম ক্লান্তি থেকে এক ঘুমন্ত শিশু

    উলঙ্গ ফিরে এলো, বমি-করা বীর্যে নোংরা ।

    নৌকোর পালের সবচেয়ে হৃদয়-বিদারক কান্না

    তীর ছাড়ার জন্য তৈরি হয়েছিল

    কোনো নক্ষত্রের বিন্দুর মতন

    যখন এক বালকের হৃদয় আর ঠোঁট

    আমার কাঁধে বিশ্রাম নিচ্ছিল

    যেন আমাকে মুকুট পরিয়ে দিচ্ছে

    আর সম্পূর্ণ করছে ভাঙচুরগুলো ।

    তোমার দেশ খুঁজে পাবার  প্রয়াস আমার বিফলে গেলো ।

    পূতিগন্ধময় আর একান্তবাসী আমার মাথা ডুবে যাচ্ছিল

     সুগন্ধিত স্বপ্নের সমুদ্রের তলদেশে

    আমি জানি না কতোটা অবিশ্বাস্য গভীরতায় ।

    আচমকা এক গ্রিক বাগবিতণ্ডায় দুলে উঠলো জাহাজ

    আর শেষ হাসি হেসে

    আমি তা মুছে ফেললুম ।

    গালাগালের আকাশে ফুটে উঠলো প্রথম নক্ষত্র ।

    সেই রাত ছিল যার নাম

    নৈঃশব্দ, আর চিৎকার

    এক সুপুরুষ কেনা-গোলাম নাবিকের

    যে জায়গাটা জানতো

    আমাদের অসন্তুষ্ট কুঞ্জবনে

    যেখান হরিণী কেঁদে ফ্যালে

    রাতের এক প্রাণী, যার অলস ট্রাউজার

    আমার ফাঁকা নৌকোর জন্য পতাকা নামিয়ে নিলো ।

    আমার নীল হাতের মুঠোয় জলের গোলাপ বন্ধ হলো ।

    ( ইথার স্পন্দিত হলো অনুগত হয়ে

    আমার লিঙ্গের লাফালাফিতে ।

    এই প্রাসাদগুলো ঝুলে আছে রাতের মখমলে

    যার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করলো আমার শিশ্ন

    আর তুমি চলে গেলে নিঃসঙ্গ

    সরাসরি উলঙ্গ নক্ষত্রের দিকে ঝাঁপিয়ে

    শীতল বনপথে দ্রুত ঘুরে বেড়াতে লাগলে )

    হারকামোন, তুমি নিজেকে আকাশে ছড়িয়ে দাও !

    আর ক্ষুব্ধ হয়ে, উজ্বল আকাশ ঢেকে যায়

    মজার ইশারায় ।

    «

    গান গাইছিল একজন আমোদপ্রিয়

    রণতরীর স্বর্গ থেকে

    বরফজমাট নক্ষত্র থেকে

    সৌরজগতের জন্য ।

    «

    স্বর্গে  আর শাশ্বত রাতে আরোহণ করে

     যে রণতরীকে আকাশের বিশুদ্ধ বিষাদ আটকে দিয়েছে

    একজন কুমারীর পায়ের কাছে সে নিজের মৌমাছিদের ডাকছিল ?

    «

    নক্ষত্রেরা, আমি তোমাদের বমি করি, আর আমার যন্ত্রণাও একইরকম

    হারকামোন, তোমার মৃত ঝুলন্ত হাতের মতন ।

    তোমার পাদুটো আর বাহু দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরো

    ওহ আমার এলোমেলো গোলাপ

    কিন্তু তোমার ডানা আবার বন্ধ করো ।

    আমরা পেছনে কিছু ফেলে যাবো না

    কোনো নথি, কোনো দড়ি, কোনো সূত্র

    চলো লাফিয়ে উঠি রথে

    আমি শুনতে পাচ্ছি তোমার

    পাতলা গেঞ্জির তলার স্পন্দন ।

    «

    কিন্তু আমার আর আশা নেই

    ওরা আমার থেকে  ডাঁটাগুলো ছেঁটে ফেলেছে ।

    বিদায় সতেরো বছর থেকে 

    কুড়ি বছরের ফেনা

    এই সন্ধ্যার ফেনাদের বিদায় ।

    «

    চাঁদ পর্যন্ত সমুদ্রযাত্রা

    নাকি সমুদ্র আমি জানি না

    গোলাপি গলার হারকামোন

    ফাঁসির দড়িতে বাঁধা ।

    «

    ওহ আমার কোতলকরা সৌন্দর্য, তুমি হেঁটে যাও

    সমুদ্রের তলদেশে

    প্রতিটি পদক্ষেপ তোমাকে নিয়ে যায়

    তোমার তীব্র সুগন্ধের ঢেউয়ের ওপর দিয়ে

    যা কুঁকড়ে যায় আর পতাকা ওড়ায়

    যেমন যেমন তুমি অতিক্রম করো

    খিলানগুলোর গোলোকধাঁধা ।

    «

    তোমার পুকুরের জলে, কালো উলুখাগড়া অনুসরণ করে

    তোমার ধড় আর তোমার বাহু থেকে

    মৃত্যু সম্পর্কিত গুজবের জট পাকিয়ে

    ঘোড়াদের চেয়েও শক্তিশালী

     পরস্পরের সঙ্গে বিজড়িত

    একজন রানির

    জঙ্ঘায় ।

     

    টীকা : রণতরী অর্থাৎ পায়ু ; জেনেকে যে মেত্রে পেনাল কলোনিতে পাঠানো হয়েছিল সেখানে মাঠের মাঝখানে একটা রণতরীর মডেল ছিল কয়েকদিদের নাবিকের শিক্ষানবিশীর জন্য । যাদের গায়ে জোর ছিল তারা এই রণতরীতে কমজোরদের পায়ুসঙ্গম করতো  । হারকামোন ছিল মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কয়েদি । কোটনা অর্থাৎ সমকামিদের মধ্যে যে সক্রিয়। সোনালী হরিণী অর্থাৎ কচি ছেলে, যা মেত্রে কলোনিতে জেনেকে মনে করা হতো । সুগন্ধের প্রসঙ্গ সমকামের সময়ে ব্যবহার করা সুগন্ধ, যেমন মেনথল দেয়া ভেসলিন । সৌন্দর্য সব সময়ে সৌম্যকান্তি পুরুষের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত । হাতের তালু অর্থাৎ সমকামের জন্য ফোসলানো । অবিনাশী অর্থাৎ ধর্ষণ । সিগারেট স্ল্যাঙ হিসাবে ব্যবহৃত লিঙ্গের কথা বলতে । ম্যানড্রিন শব্দটা দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে-- একজন দুর্ধর্ষ দস্যু ছিল ম্যানড্রিন নামে আর পেনাল কলোনিতে লেদ মেশিনের ব্লেডকে বলা হতো ম্যানড্রিন ।

  • দেবজ্যোতি রায় | 223.177.62.180 | ১১ নভেম্বর ২০২১ ১৯:৫০735117
  • দেবজ্যোতি রায়-এর  ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ আর ‘নষ্ট আত্মার নোটবই’ : মলয় রায়চৌধুরী

    মানুষ ক্রোধ, গ্লানি, দুঃখ, ভয়, স্পৃহা, বিষণ্ণতা, যন্ত্রণা, হতাশা, দুর্যোগ ইত্যাদিতে ছেয়ে থাকার  সময়ে যদি লেখালিখি বা ছবি আঁকাকে তা প্রকাশের মাধ্যম করেন তখন তিনি নিছক সাহিত্য-শিল্প করেন না, ফিকটিশাস ব্যাপার ছকতে পারেন না । তা এমন এক মানসিক রাসায়নিক বিক্রিয়া যা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই উদ্ভূত, যেমন পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’, অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’, লুই ফার্দিনাঁ সিলিনের ‘জার্নি টু দি এণ্ড অফ দি নাইট’ , মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’, সালমান রুশডির ‘দ্য সাটানিক ভারসেস’, হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’, মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ‘বাতাসে বারুদের গন্ধ’, সন্তোষ রাণার ‘রাজনীতির এক জীবন’, বিমল সিংহের ‘লংতরাই’, আরভিঙ হায়ওয়ের ‘ব্ল্যাক বয়েজ অ্যাণ্ড নেটিভ সানস’, রিচার্ড রাইটের ‘ব্ল্যাক বয়’ ইত্যাদি ।   সাহিত্য হয়তো সান্ত্বনা দিতে পারে, কিন্তু প্রতিটি পাঠক সান্ত্বনার জন্য পড়েন না ।

    দেবজ্যোতির প্রথম বইটা, যদিও প্রকাশক বলেছেন উপন্যাস, তা কিন্তু নয়, ফিকশান নয়। এটিকে বলা যায় বিলডুংসরোমানের একটি উপবর্গ ; ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সমাজে  মিথ্যার পুনরাবৃত্তি,  সমস্ত অশোভনতা, মেলোড্রামা এবং দৃষ্টিভঙ্গির ক্লাস্ট্রোফোবিয়া প্রকাশ্যে আনতে চেয়েছেন দেবজ্যোতি, দেখিয়েছেন ঘৃণা, ভয় এবং হিংস্রতা আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিকে কীভাবে পঙ্গু করেছে এবং  এখনও পুরানো মিথ্যার পুনরাবৃত্তি  অব্যাহত,  খুনোখুনি ও হুমকির শেষ নেই । এই মনোভাবকে প্রকাশ করার জন্য দেবজ্যোতি বাহন করেছেন একটি দ্রুতগামী  বেপরোয়া গদ্যের । তাঁর দ্বিতীয় বইটিতে, ‘নষ্ট আত্মার নোটবই’ আছে তেমনই ছোটো-ছোটো গদ্য, নাটক ও ফিকশান; এবং তাতেও তিনি একজন ক্রুদ্ধ লেখক, যাঁর গদ্যে গড়ে উঠেছে উষ্মার ভাপ । দেবজ্যোতির গদ্যকে, দ্বিতীয় বইটির প্রকাশক বলেছেন ‘ভাষা সন্ত্রাস’ এবং তা লেখকের সচেতন প্রয়াস।

    রাগ হল একটি নেতিবাচক আবেগ—এটাই আমাদের শেখানো হয়েছে এবং আমাদের সংস্কৃতি তা বিশ্বাস করে।  রাগ কি "খারাপ"?  যখন মনে করা হয় যে রাগ প্রায়শই মানসিক বা শারীরিক ব্যথার প্রতিক্রিয়া, এবং বিষণ্নতা, যন্ত্রণা, দুঃখ, ভয় এবং হতাশার মতো সম্ভাব্য গৌণ আবেগগুলোকেও তার আওতায় আনে, তখন রাগ একটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া বলে মনে হয় । রাগ, হতাশার বিপরীতে, শক্তিতে পূর্ণ - আপনার নাড়ি দ্রুত হয়, আপনার শরীর উত্তপ্ত হয় এবং আপনি কিছু করতে চান, যেকোনো কিছু করতে। যখন সমস্ত শক্তি ইতিবাচকভাবে পরিচালিত হয়, তখন শুভত্ব জাগ্রত হয় । ক্রোধ একটি লাগামহীন, শৃঙ্খলাহীন  শক্তিমত্তা । এই কারণেই আমরা মোকাবেলা করার,  এবং রাগ পরিচালনা করার বিষয়ে কথা বলি। যদিও রাগের বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে, , মূলত দুটি ধরণের : দ্রুত, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, যা আপনাকে চিৎকার করতে বা নিঃশব্দে বদলা নিতে উৎসাহিত করে । কিন্তু যখন  হতাশাজনক শক্তি আপনাকে কাবু করে তখন ফোড়ার মতন,  ব্যথা থেকে জন্ম নেয় গভীর রাগ। উভয় ধরনের রাগ ধ্বংসাত্মক হতে পারে, আবার ইতিবাচক, গঠনমূলক  হতে পারে। লেখা বা আঁকার মাধ্যমে,  মানুষ রাগের কারণগুলোর প্রক্রিয়াকরণ করে। কেউ কেন রাগান্বিত তা একবার জানলে, সে তাকে নিয়ন্ত্রণে আনবে। সে তার প্রতিক্রিয়াগুলো পরীক্ষা করতে পারে এবং প্রকাশভঙ্গী বেছে নিতে পারে। সে রাগ থেকে শিখতে পারে এবং  হতাশা বা ক্ষতি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারে। রাগ, এমন একটি আবেগ হয়ে ওঠে যা তাকে জাগিয়ে তোলে এবং  নিজের প্রতি মনোযোগ দিতে বাধ্য করে। এই মনোযোগস্পৃহা থেকে লেখা হয়েছে ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’।

    লেখালিখি বা আঁকা কি  রাগ প্রকাশ করার একটি উপায় হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে? কেনই বা হবে না ! লেখালিখি বা আঁকা এমন একটি পাত্র হতে পারে যেখানে একজন মানুষ তার  কোনও বিশেষ কিংবা সমস্ত আবেগ ঢেলে দিতে পারেন। আবেগগত, আধ্যাত্মিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে একজন লেখক বা চিত্রশিল্পীর পক্ষে সে কে এবং সে কী তা সে নিজে ছাড়া অন্য কারো পক্ষে গড়ে তোলা আক্ষরিক অর্থে অসম্ভব। সর্বোপরি, তার অন্য কোনও আধার-আধেয় নেই। প্রকৃতপক্ষে, তার তরফ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে দমিয়ে দেবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, সে এই ধরনের একটি মানসিক বিনিয়োগ করতে চায় বা ঘটায়।  কারণ, সম্পূর্ণ কাজটা একই সাথে প্রতিটি পাঠক বা দর্শকের জন্য একটি আয়না, যারা তা পড়েন বা দ্যাখেন, একথা দস্তয়েভস্কি অনেক আগেই বলেছেন। একজন রাগান্বিত পাঠক বা দর্শক পাঠবস্তুতে বা পেইনটিঙে রাগকে ঠিক তার নিজের মাত্রায় আবিষ্কার করে। একজন হতাশাগ্রস্ত পাঠক বা দর্শক তার বিচ্ছিন্নতা এবং দুঃখের সঙ্গে মিল খুঁজে পায়। তবে একথা স্বীকার করতে হবে যে  সমস্ত লেখালিখি বা ছবিআঁকা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নয়। দেবজ্যোতির ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ বইটির স্বর বিশেষভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যার দরুন লেখকের মনোভাব ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি সরাসরি পাঠকের মর্মে চালান করা যায় ।  এই স্বর সরাসরি শ্রোতা এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কিত। দেবজ্যোতি এই বইতে রাগান্বিত স্বর যে ভাবে প্রয়োগ করেছেন যে টের পাওয়া যায় উনি এই স্বর অর্জনের জন্য  প্রাসঙ্গিক শব্দভাণ্ডারও ব্যবহার করেছেন। 

    দেবজ্যোতি রায় ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’  আর ‘নষ্ট আত্মার নোটবই’  আমাকে পাঠিয়েছিলেন ২০২০ সালের অক্টোবরে । এক বছরের বেশি হয়ে গেল, বই দুটো সম্পর্কে আমার ভাবনা গোছাতে । প্রথম বইটাকে প্রকাশক কোয়ার্ক পাবলিশার্স বলেছেন ‘শর্ট নভেল’ । আগেই বলেছি বইটা তা কিন্তু নয় ।  একটি ধারণা, রূপক বা মডেলের সাহায্যে নতুন ধারণা, ছবিপ্রবাহ বা বিশ্বাস প্রকাশ করতে সক্ষম হওয়া দেবজ্যোতি রায়ের নিজের অধিকারে একটি কৃতিত্ব। পুরো বই জুড়ে, লেখকের উষ্মা । তিনি হয় সবে চাপা আবেগে ক্ষতবিক্ষত বা যাপিত জীবন থেকে টেনে এনেছেন এমন বহু অভিজ্ঞতা যা তাঁকে বাধ্য হয়ে সহ্য করতে হয়েছে। লেখক স্পষ্টভাষী, বলপ্রবণ এবং মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর । দেবজ্যোতি রায় তাঁর  জীবন-জ্বর, লাগামহীন প্রতিবাদকে একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য কৌশলে পরিণত করেছেন, একটি কথ্য ভাষা, রাগ এবং উপহাসের ভাষার সাথে পরিশীলিত বাংলা গদ্যকে মুচড়িয়ে নিজেকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন এই বইতে। রাগ প্রবাহিত জলের মতো,  যতক্ষণ কেউ তাকে প্রবাহিত হিসাবে নেয় ততক্ষণ  কিছু ভুল ঘটার সম্ভাবনা কম । ঘৃণা স্থির জলের মতো, সেই রাগ যা কেউ  নিজে অনুভব করার স্বাধীনতায় পেয়েছে, এবং পাঠক বা দর্শককে টেনে এনেছে তাতে । সেই জল যা লেখক বা ছবি-আঁকয়ে এক জায়গায় জড়ো করে ভুলে যাওয়ার জন্য রেখেছিলেন। স্থির জল হয়ে ওঠে নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত, রোগের ডিপো, বিষাক্ত, প্রাণঘাতী এবং এটাই লেখক বা ছবি-আঁকিয়ের ঘৃণা।  

    দ্বিতীয় বইটির ভূমিকায় সাত্ত্বিক নন্দী লিখেছেন, “লেখক ( মূলত ) তাঁর নিজের জীবনটিকেই লেখেন এবং লেখার ভাষাটি তুলে আনেন সেই জীবন থেকেই।” কথাটা অনেকের বেলায় খাটে, দেবজ্যোতির বেলাতেও খাটে । কিন্তু  নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকে লেখালিখি করেছেন জোতদারদের ভাষায় ; ভাষা সম্পর্কে তাঁরা চিন্তা করেননি । দেবজ্যোতি রায়ও দুটি বইতে একইরকম গদ্যবিন্যাস প্রয়োগ করেননি । দ্বিতীয় বইটিতে যেহেতু নিজের সম্পর্কে বলছেন না, তাই তাতে রোষাভাসের তাপ তেমন স্ফূলিঙ্গ ছড়ায়নি । একই রকম লেখনশৈলীও উচিত হতো না । কেননা প্রতিটি বিষয়ে একইরকম গদ্য লেখককে খেলো করে দিতে পারে -- লেখক নিশ্চয়ই দাবি করেন না যে “আমি সারাটা জীবন দিয়ে বিশেষ ভাষা আবিষ্কার করেছি”।

    প্রথম বইটিতে, আত্মবিনির্মাণের মাধ্যমে, নকশাল আন্দোলনে তাঁর যোগ, আন্দোলনের ও বামপন্হী ভাবধারার ভাঙনে দেবজ্যোতি রায় নিজের ভাঙনকে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাঁর  সামাজিক জগতকে বিভিন্ন আত্মজৈবনিক সমতলে উদ্ভাসিত অথবা কলঙ্কিত হিসাবে উপস্থাপন করার প্রয়াস করেছেন,  যেখানে বিভিন্ন ঘটনা উল্লম্বভাবে না হয়ে অনুভূমিকভাবে সংযুক্ত হয়ে এগিয়েছে । দেবজ্যোতির গদ্য-শৈলীটি পাঠবস্তু হিসাবে আকর্ষণীয় কারণ এটি  সহজাত মূল্যবোধ এবং গুণাবলীকে ছাপিয়ে গেছে অথচ যা তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন তাকে ধরে রেখেছেন আদ্রেনালিনের রসায়নে এবং তা  দ্রুত সরাসরি উপস্হাপন করার চেষ্টা করেছেন । জ্ঞানতত্বের ব্যাখ্যাকাররা একে বলবেন ‘প্যাশনেট’। হাইডেগার মনে করেন, ভাষাই সার্বভৌম, মানুষ নয়; সত্তা হিসেবে মানুষ ভাষার মধ্যেই প্রকাশিত হয়ে ওঠে। ভাষার ভেতরে মানুষের বিশুদ্ধ প্রকাশ তখনই সম্ভব, যখন মানুষ ভাষার সত্তার ওপর শ্রদ্ধাশীল থাকে এবং সে তখনই প্রকৃতপক্ষে শ্রদ্ধাশীল, যখন সে ভাষার ভেতরে সত্যিকার অর্থে কান পেতে তার অন্তর্গত কথনে আস্থাশীল হয়ে ওঠে। দেবজ্যোতি রায় তাঁর আত্মকথনে আস্হাশীল তো বটেই, সেই সঙ্গে প্রয়োগ করেছেন নিজের যাপিত জীবন থেকে তুলে আনা কান্নার, যন্ত্রণার, ষড়যন্ত্রের, পরাজয়ের, বিশ্বাসঘাতকতা ও ধ্বংসের ছবিগুলো ।

    জার্মান কবি হোল্ডারলিন বলেছিলেন, “যদি তোমার মস্তিষ্ক এবং হৃদয় থাকে তাহলে কেবল একবারে একটি বা অন্যটি দেখাও,  তুমি দুটিকেই একসঙ্গে দেখিও না ; একটার  জন্য তুমি কৃতিত্ব পাবে ।” আবেগ ও বুদ্ধির মধ্যে এমন বিচ্ছেদ  কার্যকর করতে পেরেছেন দেবজ্যোতি তাঁর ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ বইতে। দেবজ্যোতির ক্রোধ খাঁটি, তা নিছক সাহিত্যিকতা নয়, বিদ্বেষ নয়, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা নয় । পেছন ফিরে  নিজের দৃষ্টিতে, তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে তিনি এমনই একজন মানুষ যাঁর নির্মাণ-স্বভাব সব কিছুর বিপরীতে । নসটালজিয়াকে ছাঁটাই করতে পেরেছেন তিনি । যদিও আধুনিক অবস্থা, ঔপনিবেশিকতা, দাঙ্গা, নকশাল গণহত্যা, বামপন্হীদের পচন, পরিবেশগত ধ্বংস এবং মানুষের শোষণ, এগুলো, আশ্চর্য মনে হলেও, মানুষের স্মৃতির কৃতিত্ব এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি দ্বারা গঠিত --   ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকদের (সবচেয়ে বিশিষ্ট থিওডর অ্যাডর্নো) পরিভাষা যৎসামান্য ধার করেই বলছি,  হতাশা এবং নিন্দাবাদের, দেবজ্যোতি রায়ের ভাঙন-সন্দর্ভ ভিন্ন কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে - মানবজাতির মনভোলানো ফাঁদগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে। যদিও অ্যাডর্নো বুর্জোয়া মূল্যবোধ এবং নিয়ম-কানুন নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে অনুশোচনা করেছিলেন, দেবজ্যোতির গদ্যপ্রবাহে তেমন কোনও নস্টালজিয়ার উপাদান নজরে পড়েনি। দেবজ্যোতি রায়  লুই ফার্দিনাঁ সেলিনের  অ-আলোচনাযোগ্য, কঠিন এবং দুর্ভেদ্য নিহিলিজমকে এড়িয়ে এক টুকরো অনির্বচনীয় মেঘের সন্ধান করেছেন। প্রত্যাখ্যান করেও করছেন না । অবশ্য ওই অনির্বচনীয় মেঘ যে কোথায় তা আমি চাকুরিজীবনে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েও খুঁজে পাইনি ।

    আলালের ঘুরের দুলাল থেকেই বাংলা সাহিত্যের একটি দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার কারণে লেখকরা সমাজকে নানা উপায়ে খোঁচা মেরেছেন, আক্রমণ করেছেন তাঁদের অপছন্দের ভ্রষ্ট সমাজ ও তার প্রকোপে দূষিত মানবতাকে । তা  একটি মূল সাহিত্যিক কৌশল হিসাবে নানাভাবে প্রয়োগ ও ব্যবহার করা হয়, বাংলা গদ্যের উন্মেষকালের বক্র-ব্যঙ্গ থেকে শুরু করে সুভাষ ঘোষের ‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট’,  নবারুণ ভট্টাচার্যের ফ্যাতাড়ুর রোমান্টিক বিদ্রুপ আর সুবিমল মিশ্রের কাট-আপ পদ্ধতি ও হরফ-ব্যঙ্গের ধারার সাথে যা অব্যাহত রয়েছে, যদিও তাঁদের রচনায় পাওয়া যায় নির্মিত সাহিত্যিকতা---- তফাতটা এই যে দেবজ্যোতি রায়ের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া, আমাদের দেশের গুয়ে চোবানো অধঃপতন উপস্হাপনের প্রয়োজনে, পাঠবস্তুকে আধুনিকতা পরিত্যাগ প্রক্রিয়া হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ বইতে। প্রচলিত বুর্জোয়া পাল্প ফিকশান সাহিত্যের বিপরীতে, দেবজ্যোতি রায় তাঁর এই স্মৃতি-বিপর্যয়ে জীবনের উচ্চতর মূল্যবোধ, নৈতিকতা বা উদ্দেশ্যগুলিকে পাঠকদের কেবলমাত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চান না, সেই সঙ্গে জীবনকে চিত্রিত করতে চেয়েছেন যেমনটি তিনি উপলব্ধি করেছেন: সম্পূর্ণ অর্থহীন, প্রহসন হিসাবে, সমস্ত মান-লঙ্ঘন হিসাবে এবং বিপ্লবের হইচইকে একটি কেলেঙ্কারি হিসাবে---চারু মজুমদারের পথ থেকে নানা দিকে চলে যাওয়া ফ্যাঁকড়ার ভুলভুলাইয়াগুলোকে তেড়ে ঝাড় দিয়েছেন। দেবজ্যোতির এই বইটা  পড়ার সময়, বঙ্গসমাজের একজন বিপর্যস্ত নিন্দুকের কল্পনা করা সহজ, একজন বিপ্লব-বিধ্বস্ত, যে কিনা সৃজনশীল লেখক, কবিতাও লিখেছে একসময়ে, হয়তো গভীর রাতে এই বইটি এবং অন্য বইয়ের পাঠবস্তুগুলোকে উন্মাদের ঘোরের মধ্যে লিখে গেছেন। আরও সুনির্দিষ্টভাবে, দেবজ্যোতি যে ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত তার মধ্যে একটি নতুন উপাদান আনতে চেয়েছেন, তা হলো বাক্যের সক্রিয় বল, অর্থাৎ গতিশক্তি।   

     যখন নাকতলায় ছিলুম তখন উনি পাঠিয়েছিলেন কবিতার বই, ‘নষ্ট আত্মার নোটবই’তে কবিতার বই দুটির নাম দেয়া আছে : ‘নির্মম বর্শার গান’ আর ‘স্বর’।  দেবজ্যোতি  একাকী মানুষের ঘা-পূঁজ-আঘাত-চোট-জখম-ফোড়ার চারপাশে বিনয় মজুমদার-বর্ণিত হাত বুলিয়ে বুঝতে ও বোঝাতে চেয়েছেন । তিনি তাঁর সময়ের বঙ্গজীবনের ভয়াবহতা ও অর্থহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে করতে এগিয়েছেন--- অথচ, ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ বইতে তিনি জীবনানন্দের সেই লাইনগুলো ব্যবহার করেছেন যেগুলোর জন্য উৎপলকুমার বসু বলেছিলেন, ‘জীবনানন্দ কয়েকটি উপাদানকে অবলম্বন করেছিলেন, যেমন মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা’ । কিন্তু দেবজ্যোতি বইটার পর্বগুলো যেভাবে ভাগ করেছেন, তাতে স্পষ্ট হয় যে তাঁর ভাবনা ওই উদ্যমহীনতার বিরুদ্ধে, প্রচেষ্টা বানচাল করার বিরুদ্ধে । পর্বগুলো এরকম : ১) শুরুর কথা ; ২) বুকের মধ্যিটাই তো আকাশ ; ৩ ) আর আমরাও তখন আন্তোনিও জাসিনটোর ‘সেই মানুষ’; ৪) তখন যৌনাঙ্গ দিয়েও অনুভব করেছি আমি ‘বিপ্লব’; ৫ ) কী অসাধ্য সাধনাই না করেছে ; ৬ ) কিন্তু দেখ এ-কেমন তাই বলে ফল ভুগতে হচ্ছে ; ৭ ) অলৌকিক থানার শিং-ওলা বড়বাবু, মেজবাবু ইত্যাদি ; ৮ ) রঙে-রঙে আকাশকে রাঙিয়ে সেই আগুনের গোলকটাই নেমে যাচ্ছে দেখ নদীর ভিতর ; ৯ ) আতঙ্কের ঘন হাতছানি পড়াশুনো করতে হবে ; ১০ ) দু’জন পার্টি কমরেড মাটি কামড়ে পড়ে আছেন ; ১১ ) কানুদারা হাত ধুয়ে ফেললেন ; ১২ ) সবচাইতে বড় বিষয় সেসময় পার্টির পুনর্গঠন ; ১৩) দু’জন স্বপ্নদর্শী এল কলকাতায় ছ’জন স্বপ্নদর্শীর কাছে ; ১৪ ) গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা হল আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখতে স্বপ্নে পাওয়া অনুপম দৈবাস্ত্র ; ১৫ ) হাতিদের সঙ্গে জঙ্গলে সারারাত এবং ভোরে ‘ইউরেকা’ ; ১৬ ) ‘৭৩ থেকে ‘৭৬ এইসব বন্ধুরাই লালন করেছে আমাকে ; ১৭ ) মাইক্রোফোনের সামনে নিজেকে ; ১৮ ) সহজ লোকের মত ; ১৯ ) ভাষা নিয়ে আরো দু’চারটে কথা; ২০ ) সেই তীব্র বিপ্লবী দার্শনিক ; ২১ ) অমৃতের পুত্রদের এইসব ; ২২ ) অমৃতের পুত্রদের এইসব [ ২ ] এবং  ২৩ ) মৃত্যুর সঙ্গে দীর্ঘ রমণ-ক্রিয়া আমার এবং এক নদীর কেচ্ছা ।

    দেবজ্যোতি রায়ের অন্য বইটা, ‘নষ্ট আত্মার নোটবই’কে বলা হয়েছে ‘কাউন্টার প্রোজ’, যাতে রয়েছে দুটি ছোটো ফিকশান, একটি নাটক এবং দশটি গদ্য । গদ্যগুলোকে বলা যেতে পারে প্রথম বইটার সম্প্রসার । 

    আমি একটু আগেই ছবি আঁকায় উদাহরণ দিয়েছিলুম পাবলো পিকাসোর গুয়ের্নিকার। পিকাসোও সারা জীবন একই শৈলীতে আটকে থাকেননি । যাই হোক,   স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে গুয়ের্নিকাতে বোমা হামলার প্রতিক্রিয়ায় পিকাসো এটি এঁকেছিলেন। গুয়ের্নিকা একটি শহর ছিল যার কোনও সামরিক মূল্য ছিল না এবং বোমা হামলা ছিল মূলত ফ্যাসিস্টদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ অনুশীলন, এমন একটি প্রশিক্ষণ অনুশীলন যার ফলে শহরের অর্ধেকেরও বেশি ধ্বংস হয়ে যায় এবং জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ আহত বা নিহত হয়।  সেখানে একজন মহিলা তার মৃত সন্তানের জন্য শোক করছেন, একজন মৃত বা মৃত ব্যক্তি একটি ভাঙা তলোয়ারকে আঁকড়ে ধরে আছেন, একটি ঘোড়া ব্যথায় চিৎকার করছে এবং একটি জ্বলন্ত দালানের ভিতরে আটকা পড়েছেন একজন ব্যক্তি। ছবিটি অস্বাভাবিক এবং বিকৃত উপায়ে আঁকা হয়েছে, যা তাদের মধ্যে ব্যথা এবং আতঙ্কের অনুভূতি বাড়িয়ে তোলে। পিকাসোর একটি একরঙা  প্যালেটের পছন্দও চিত্রকলার মধ্যে নাটকীয় তীব্রতা এবং বিষণ্ণ মেজাজ গড়ে তুলেছে। পিকাসো আপাতদৃষ্টিতে গুয়ের্নিকা বোমা হামলার দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তাঁর চিত্রকর্ম এই ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করে যে যুদ্ধ ব্যাপারটা বীরত্বপূর্ণ এবং মহৎ। দেবজ্যোতি রায়ের ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ এর গদ্যপ্রবাহ পিকাসোর পেইনটিঙটির মতনই, অভিজ্ঞতার প্রচুর টুকরো-টাকরায় জোড় দেয়া ।

    দেবজ্যোতি রায় কার্যত সকলের প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব বজায় রেখেচেন। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও, তিনি  যে-কোনও মানদণ্ডে একজন রহস্যময় মানুষ এবং সেইজন্য তিনি একজন অত্যন্ত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বও বটে। যদি আমরা লোকেদের গালগল্পের পরিবর্তে তাদের কাজ এবং কৃতিত্বের ভিত্তিতে বিচার করি তবে এই জাতীয় বিশ্লেষণ দেবজ্যোতির ক্ষেত্রে কাজে দেবে, কেননা লিটল ম্যাগাজিনের জগতেও তিনি উপেক্ষিত-অবহেলিত । অবশ্য লেখকের চরিত্র নয়, তার সৃষ্ট কাজকেই আমরা বিচার করব। কোনও সন্দেহ নেই যে তাঁর ‘নরকের থেকে একটুকরো মেঘ’ বইটি বাংলাসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ । কলকাতার সাহিত্য পরিমণ্ডলের বাইরে থাকেন বলে সমাদৃত হবার সুযোগ পায়নি তাঁর লেখালিখি । নয়তো তাঁর বইটাকে চার্লস বুকোস্কির ‘দি পোস্ট অফিস’, টমাস পিনচনের ‘গ্র্যাভিটিজ রেনবো’র সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে নেয়া যেতে পারতো ।

    দেবজ্যোতি রায় ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ বইতে যা করেছেন তা লুই ফার্দিনাঁ সিলিনের প্যারোডি, বিল্ডুংস্রোমান এবং পিকারেস্ক প্রয়োগের সঙ্গে তুলনীয় । নিঃসন্দেহে তা একটি অত্যন্ত উদ্ভাবনী মিশ্রণ - এবং পাঠক প্রথম লাইন থেকে লক্ষ্য করেন যে বইটা তো উপন্যাস নয়, তা সম্পূর্ণ নতুন কিছু । বইটা যেন একটা বিবৃতি, স্বাধীনতার ঘোষণা, ভবিষ্যতের একটা জানালা। বইটার উদ্ভাবনী গদ্যবিন্যাস, সারগ্রাহী শব্দভাঁড়ার, এবং বিশেষ করে, এর উন্মত্ত গতি পাঠকদের ক্ষেপিয়ে তুলবে । কিন্তু বইটার অসংবৃত বিষয়বস্তুর  জন্য তা সংগতিপূর্ণ । বইটা খুব খোলামেলা লেখার একটি নতুন আঙ্গিকের সাক্ষ্য দেয়, একটি কথ্যকে নিশ্চিত করার নিয়মগুলিকে ভেঙে দেয়। : 


     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.181.187.173 | ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:০৩735173
  • হাংরি আন্দোলনে লেখা আমার নাটক আর পরের কাব্যনাট্য – মলয় রায়চৌধুরী

    হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমি তিনটি নাটক লিখেছিলুম, ‘ইল্লত’ ( ১৯৬৩ ), ‘নপুংপুং’ ( ১৯৬৪ ) এবং ‘হিবাকুষা’ ( ১৯৬৫ ) ; এর পর আর নাটক লিখিনি। ‘ইল্লত’ নাটকটা ‘গন্ধর্ব’’ পত্রিকা ছাপবে বলে নিয়েছিল, সম্ভবত হাংরি আন্দোলনের কুপ্রচারিত হওয়ার কারণে নৃপেন সাহা পাণ্ডুলিপি বছরখানেকের বেশি সম্পাদকীয় দপতরে রেখে, শেষ পর্যন্ত পেছিয়ে যান । তারপর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় নাটকটা দিয়েছিলেন ‘বহুরুপী’ পত্রিকার কুমার রায়কে, তিনি ‘এ কি আবোল-তাবোল’ বলে সন্দীপনকে ফেরত দিয়ে দিয়েছিলেন । শেষে আমি নিজেই ‘জেব্রা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলুম । নাটকগুলো আমি পাঠবস্তু হিসাবে লিখেছিলুম, অভিনয়বস্তু হিসাবে নয় ; পরে কাব্যনাটকও লিখেছি পাঠবস্তু হিসাবে, অভিনয়বস্তু হিসাবে নয় । ষাটের দশকে নাটকের আঙ্গিকে কেন্দ্রহীন ন্যারেটিভ উপস্হাপন হয়তো সেসময়ের সম্পাদকদের বিদকুটে-ভাবনা মনে হয়ে থাকবে । বস্তুত কাব্যও একদা রাজাকে এবং জনগণকে শোনাবার জন্য লেখা হতো ; এখন লেখা হয় পাঠক একা মনোযোগ দিয়ে পড়বেন বলে । আমিও আমার নাটক নিয়ে তেমন ভাবনাই ভেবেছিলুম ।


    ‘ইল্লত’ নাটকটা আগরতলার একটি দল মঞ্চস্হ করেছিল, কেমন হয়েছিল ঠিক জানি না। গোবরডাঙার একটি দল নব্বই দশকে মঞ্চস্হ করবে বলে আমার নাকতলার বাড়িতে এসে আলোচনা করেছিল, আমি তাদের জানিয়ে দিয়েছিলুম যে নাটকটা পাঠের জন্য, অভিনয় হতে পারে কিনা জানি না, তোমরা যেমনভাবে ইচ্ছে অভিনয় করতে পারো । নাটকটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে তারা মঞ্চস্হ করার নির্ণয় নিয়েছিল । কিন্তু সিপিএম-এর ক্যাডারদের হুমকিতে মহড়া বন্ধ করতে হয় ,ক্যাডারদের ধারণা ছিল নাটকটা সরকারবিরোধী, এবং নাটকের ‘ডোডোন’ চরিত্রটি মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর প্রতিরূপ , কেননা ‘ডোডোন’ বেশিরভাগ সময় নিজের চেয়ারে ঘুমোয় আর আচমকা জেগে উঠে চাবি মারে । অথচ ‘ইল্লত’ আমি লিখেছিলুম কংগ্রেসি নরকের সময়ে, ষাটের দশকে। নাটকগুলো লিখলেও আমি কখনও সেগুলো মঞ্চস্হ করার জন্য কোনো নাটকদলের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি ।


    ২০০৯ সালে নাটক তিনটি একত্রে ‘নাটকসমগ্র’ নামে প্রকাশ করেন ‘কবিতীর্থ’ প্রকাশনীর কর্ণধার উৎপল ভট্টাচার্য । তিরিশ বছর পর, নব্বই দশকে কাব্যনাট্য লিখেছি, যেগুলোর আঙ্গিক ও ভাবনাবিন্দুর সঙ্গে ষাটের দশকে লেখা নাটকগুলোর সংযোগ আছে । কাব্যনাটকগুলো হল, ‘ভালোবাসার উৎসব’, ‘যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের’, ‘ভরসন্ধ্যা’, এবং ‘সুর্পনখা-বাল্মীকি সংবাদ’ ।


    শৈশবে, ইমলিতলা পাড়ায়, আমাদের বাড়ির সামনে যে ফাঁকা চত্বর ছিল, সেটাই ছিল পাড়ার একমাত্র কলতলা, আর পাড়ার সকলেই জানতো যে এই কলকতলা এলাকায় গেলে পাড়ার নানা গোপন ও মুখরোচক সংবাদ আদান-প্রদান করা যাবে । যেহেতু নিবাসীরা ছিল অতিনিম্নবর্গের মানুষ, তাই তাদের কোনোরকম ইনহিবিশান ছিল না, যেমনটা বাঙালি মধ্যবিত্তের দেখা যায় । আমি জানলায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করতুম পাড়ার লোকেদের নাটক, তাদের সংলাপের ওতোরচাপান, বাদপ্রতিবাদ, অঙ্গভঙ্গী, চটে গিয়ে মারামারি, আমার পাড়াতুতো বন্ধু কপিলের দাদুর হম্বিতম্বি, উকিল হুলাসচাচার খড়ম ঠেঙিয়ে কলতলার গ্র্যানিটে এসে বকুনি, বাড়ির কর্তার হুমকিতে বালতিভরে বউদের জল চলকিয়ে যন্ত্রের মতন কেটে পড়ে আবার ফিরে এসে কেচ্ছা শোনার ধান্দা । আমাদের বাড়ির কাজের লোক শিউনন্দন কাহার বা শিউনন্নি, অভিনয় করে তুলসীদাসের ‘ ‘রামচরিতমানস’ থেকে চৌপাইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে শাসন করার কায়দা প্রয়োগ করতো ; একইভাবে বাবার দোকানের কাজের লোক রামখেলাওন সিং ডাবরের রহিম, দাদু, কবির থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমাদের উপদেশ দেবার নাটুকেপনা, এগুলো আমার স্মৃতিতে থেকে গেছে আর প্রভাবিত করেছে আমার নাটক ও কাব্যনাটক লেখার বয়ানকে ।


    শৈশবে বড়োজেঠাইমা রাতের পড়াশুনা শেষ হবার পর লন্ঠনের আলোয় আমাদের, খুড়তুতো-জাঠতুতো ভাইবোনদের গল্প শোনাতেন, কন্ঠস্বরকে চরিত্রের আচরণ অনুযায়ী উঁচুগ্রাম-নিচুগ্রামে নিয়ে গিয়ে । উনি পুরাণ, ইশপের ফেবল, আরব্য রজনী, পঞ্চতন্ত্র থেকে টুকরো-টাকরা নিয়ে নিজের মতো করে গল্প তৈরি করে নিজেই রাক্ষস, পরি, রাজপুত্র, সিন্ধবাদ, শেয়াল, বেতালের অভিনয় করতেন । ওনার কন্ঠস্বর এবং চরিত্রদের উদ্ভট কাজকারবার থেকে গিয়েছিল আমার স্মৃতিতে, আর তা আমার বিভিন্ন লেখায় ঢুকে পড়ে, নাটকে তো বটেই ।


    ইমলিতলা পাড়ায় কুলসুম আপাদের বাড়িতে, কুলসুম আপা নিজে আর ওনার বাবা দুজনেই উর্দু শের মুখস্হ বলতে পারতেন ; বলার সময়ে হাত নাড়িয়ে, অভিনয় করে, বলতেন শেরগুলো ; আমি মানে বুঝতে পারছি না জানালে, ওনারা বুঝিয়ে দিতেন । ওনাদের কন্ঠে বেশ ভালো লাগতো শুনতে । পরে জানতে পারি যে যাঁদের কবিতা ওনারা আবৃত্তি করছেন, তাঁরা উর্দু-ফারসি ভাষার বিখ্যাত কবি, জোশ মলিহাবাদি এবং ফয়েজ আহম ফয়েজের মতন প্রতিষ্ঠানবিরোধী কবি, এবং গালিব-এর গজল । ছোটোবেলায় ওনাদের বাড়িতে সময় কাটাতে ভালো লাগতো । কুলসুম আপা আর ওনার দাদি আমাদের বাড়িতে এসে মা-জেঠিমার সঙ্গে পাড়ার কেচ্ছাকাহিনির গল্প করতেন । ওনাদের সঙ্গদানের প্রভাব আমি আমার লেখালিখিতে অস্বীকার করতে পারি না ।


    দাদা সমীর রায়চৌধুরী স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে নাটকের দল করেছিলেন, বড়দির শশুরের জমিদার বাড়ির বিশাল হলঘরে অনুষ্ঠিত হতো সেসব নাটক । আমি দীর্ঘ সংলাপ মুখস্হ রাখতে পারতুম না বলে ছোটোখাটো চরিত্রে অভিনয় করতুম । বড়দি-ছোড়দি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জানতেন আর তাঁরা যা ভালো বুঝতেন সেইমতো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিতেন, হারমোনিয়াম, অর্গান, বীণা বাজিয়ে ; বড়োভাগ্নি মঞ্জু আর মেজভাগ্নি জয়াও গান গাইতে শিখছিল, তারাও হারমোনিয়াম আর সেতার বাজিয়ে সঙ্গ দিত । নাটকের জন্যে গান তাঁরাই গাইতেন, আমরা গলা মেলাতুম । দাদার বন্ধু নিরঞ্জনের ইলেকট্রিক শক লাগার পর বাল্যের নাটকদল বন্ধ করে দিতে হয়েছিল । নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে দাদার যতোটা যোগাযোগ ছিল, আমার তা ছিল না ; দাদা কমলকুমার মজুমদার-নির্দেশিত নাটকেও অভিনয় করেছেন। দাদা কিন্তু কোনও নাটক লেখেননি ।


    এর পরে আমি ছিলুম যাত্রাদলের মহড়ার দর্শক । ছোটোকাকা বা বিশেখুড়োর বাবা চিৎপুরের ছোটোফণী একবার পাটনায় আসার পর বড়োজেঠা আর তাঁর পরিচিতজনদের উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছিলেন যাত্রা দল গড়ার । ওনারা যাত্রাদল গড়ে তার মহড়া করতেন আমাদের দরিয়াপুরের নতুন বাড়িতে, কেননা বেশ কয়েকটা ঘর ফাঁকা ছিল সেসময়ে । আমি তখন কলেজে । ওনাদের মহড়া দেখতুম মাঝেসাজে একতলায় গিয়ে । ঘরেতেই রাখা থাকতো নকল দাড়ি, গোঁফ, নারীর এলোচুল, তির-ধনুক, গদা, আঙুলে ঘোরাবার চক্র, নানা রকমের রঙচঙে পোশাক । বেশ হাস্যকর মনে হতো ওনাদের মহড়া, বিশেষ করে নারী চরিত্রে যে পুরুষরা অভিনয় করতেন তাঁদের কন্ঠস্বর মেয়েদের মতো করে তোলার প্রয়াসে । মূল পালার অভিনয়ের চেয়ে বেশি টানতো আমাকে ওনাদের মহড়া । আমার নাটকগুলোর বেশ কিছু উপাদান পেয়েছি ওনাদের অ্যামেচার যাত্রাদলের মহড়া থেকে ।


    পরবর্তীতে স্নাতক স্তরে আমাদের কলেজের হিন্দি অধ্যাপক ‘লোহা সিং’ নামে একটা নাটক লেখেন, যা কলেজে প্রায়ই মঞ্চস্হ হতো, অধ্যাপক নিজেই লোহা সিং-এর ভূমিকায় অভিনয় করতেন, প্রথম দিকে জনপ্রিয় হলেও পরে সমালোচনার মুখে পড়ে, ভোজপুরি বুলি প্রয়োগের কারণে, আর ওই বুলির মানুষদের মূর্খ প্রতিপন্ন করার কারণে । নাটকটা থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয় যে সংলাপের মাধ্যমে বার্তা পৌঁছে দেবার সময়ে ইচ্ছাকৃতভাবে সাবটেক্সটে গোলমাল ঘটিয়ে দেয়া যায় । স্নাতকোত্তরে কয়েকবার অভিনয় হয়েছিল শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ আর ‘ম্যাকবেথ’, মূলত ইংরেজি বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা অংশ নিয়েছিল । আমি বাল্যে কনভেন্টে পড়লেও কলেজে পৌঁছে আমার জিভ থেকে কনভেন্টিয় ইংরেজি লোপাট হয়ে গিয়েছিল, ফলে অভিনয় করার সুযোগ পাইনি । ছোটোকাকা বা বিশেখুড়োর শালা বুড়োর সঙ্গে কলকাতার থিয়েটার-পাড়ায় কয়েকটা নাটক দেখেছিলুম, নাটকের চেয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখার শখ বেশি ছিল ওর ; তাছাড়া চুপচাপ নাটক দেখার বদলে বড্ডো বকবক করতো।


    দর্শকদের কথা চিন্তা করার পরিবর্তে, আমি মঞ্চের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্বেও, নাটক লিখেছিলুম ‘লিখিত’ নাটকে আঙ্গিক-ভাঙনের উদ্দেশে, ডিকশন নিয়ে কাজ করার উদ্দেশে, দেশভাগের ভয়ংকর অবস্হার দরুন ব্যক্তি যেভাবে ট্রান্সহিউমান বা মানবাধিক ও পোস্টইউমান বা মানবোত্তরের মিশেলে এক গোলমেলে ও ভঙ্গুর টুকরো-টাকরায় গড়া ব্যক্তিভগ্নাঙ্কে রূপান্তরিত হয়ে উঠছিল, তাকে তুলে ধরার জন্য, সেই সময়ের ও পরিসরের ব্যানাল প্রসঙ্গগুলোকে বিদ্রুপ করার জন্য, চোখের সামনে পচতে-থাকা পশ্চিমবঙ্গের ব্যবস্হাকে আক্রমণ করার জন্য, বিনির্মাণ করেছি বাক-সংলাপকে, শব্দদের কাঠামো পালটে দেবার প্রয়াস করেছি, খেলিয়েছি বোকামি ও তুচ্ছতাকে, কর্মক্রিয়ার অযথা পুনরাবৃত্তি নিয়ে, ভাঙতে থাকা কৌমের নবসংজ্ঞায়ন নিয়ে ।


    তখনও গ্রুপ থিয়েটার ছিল ম্যাক্রোলেভেলে, মূলত আইপিটিএ এবং উৎপল দত্তের দলের, কিন্তু ভিড়ের দ্বারা মর্মার্থের দখলপ্রক্রিয়া এবং শব্দান্তর ও ভাষ্যবদল আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। উৎপল দত্তের ‘কল্লোল’ দেখেছিলুম। তার আগে দাদার সঙ্গে গিয়ে দেখেছিলুম ‘রক্তকরবী’ আর ‘চাঁদ বণিকের পালা’ — নাটক দেখার বদলে শম্ভু মিত্রকে দেখাই ছিল তখন প্রধান আকর্ষণ । একবার মিছিলে উৎপল দত্তের হাতে হাংরি আন্দোলনের একটা বুলেটিন দিতে উনি, ‘ও মাই গড, হাংগড়ি জিন্নাড়িশান!’ বলে চেঁচিয়ে বুলেটিনটা দুমড়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলেন ; ওনার ব্যবহারে মনে হয়েছিল যে ভিন্ন কিংবা সমান্তরাল চিন্তার পরিসর ওনার চেতনায় নেই । তারপর তো পাড়ায় পাড়ায় গ্রুপ থিয়েটারের দল দেখা দিল এবং স্বাভাবিকভাবে বামপন্হী পচনের সঙ্গে তারাও পচতে আরম্ভ করে দিলো । শিশির ভাদুড়ি, অহীন্দ্র চৌধুরী প্রমুখের কমার্শিয়াল নাটক থেকে গণনাট্য সংঘ একশো আশি ডিগ্রি সরে গেলেও, পরে তাদের জায়গায় যে প্রমোদজগৎ দেখা দিল তা ভয়াবহ, সিনেমা আর টিভির মাধ্যমে একেবারে ভোগবাদী হয়ে উঠল দর্শকদের বিনোদপ্রিয় মননএলাকা । এ থেকে বেরোবার উপায় আছে বলে আমি মনে করিনা, কেননা সমাজে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, এবং তারা বিনোদন ছাড়া টিকতে পারে না । কিন্তু লেখক হিসাবে তাদের পাত্তা দেবার কোনো মানে হয় না ।


    বস্তুত ‘ইল্লত’ নাটকের ডোডোন চরিত্রটিকে ট্রান্সহিউমান বা মানবাধিক অর্থাৎ যন্ত্র ও মানুষের মিশ্রণ, এবং ওই নাটকের জম্বুক, রোমেশ, লোমেশ, টিকলু, ধঞ্জয়, রজন ও গণেশ চরিত্রগুলোকে পোস্টইউম্যান বা মানবোত্তর বলা যায় । ‘হিবাকুষা’ নাটকে ষাভ, শ্বস ও ঢপ চরিত্র তিনটি মানবাধিক আর মানবোত্তরের মিশেলে গড়া ব্যক্তিভগ্নাঙ্ক ; ‘হিবাকুষা’ শব্দটা জাপানি, জাপানে আণবিক বোমার পরে হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে যে জাপানিরা আক্রান্ত হবার পর বেঁচেছিল, নানা রোগবালাই আর বিকৃতি নিয়ে, তাদের বলা হতো ‘হিবাকুষা’ । ‘নপুংপুং’ নাটকে কেবল দুটি চরিত্রের সংলাপ থাকলেও মঞ্চে কেবল একটিই চরিত্র উপস্হিত থাকে, যার নাম ‘য়লম’ ; আমার নাম মলয়কে উল্টে দিয়ে ‘য়লম’ করেছি । দ্বিতীয় যার সংলাপ শুনতে পাওয়া যায় সেটি একটি স্ত্রীলোকের অর্ধাঙ্গের ডামি, দেয়ালে বসানো ।


    ‘ইল্লত’ নাটকটা প্রকাশিত হতেই হাংরি আন্দোলনের বাসুদেব দাশগুপ্ত আর সুভাষ ঘোষ সমালোচনা করে বলেছিল যে নাটকটা আয়োনেস্কোর মতন হয়ে গেছে । আমি অস্তিত্ববাদী নই, জীবনকে অস্তিত্ববাদীদের মতন অর্থহীন মনে করি না, জগতের ব্যানালিটি ব্যক্তিএকককে হতোদ্যম মনমরা হীনম্মন্য করে তোলে বলে মনে করি না, যা আয়োনেস্কোর নাটকের বনেদ । আয়োনেস্কোর মতো আমি জাঁ পল সার্ত্রের জীবনদর্শনে সমর্পিত নই । খ্রিস্টধর্মী ছাড়া কারোর পক্ষে অস্তিত্ববাদী হওয়া সম্ভব কিনা সেবিষয়ে আমার সন্দেহ আছে । আমি একজন ইন্সটিংকটিভ হিন্দু, এখন বয়স হয়ে গেছে তাই, নয়তো দোলখেলা, বাজি-ফাটানো, সরস্বতীপুজো, দুর্গাপুজো আমার ভালো লাগতো, অথচ আমি একটিমাত্র ভগবান বা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিনা, বা বলা ভালো, বিশ্বাস করে উঠতে পারি না ।


    বাসুদেব দাশগুপ্ত আর সুভাষ ঘোষ সিপিএম দলে যোগ দিয়েও দলটির ক্রমপচনের আভাস পায়নি তার কারণ ওরাও মনে করতো ইতিহাস একটি রেখা বরাবর যায়, অথচ আশির দশক থেকেই পশ্চিমবাংলায় দিকে-দিকে বিপ্লবের নামে আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল রক্তচোষার দিগ্বিজয় । কতোটা সংবেদনহীন হলে মানুষ বিধবা মায়ের মুখে নিহত ছেলের রক্তমাখা ভাত গুঁজে দেয়াকে সহ্য করতে পারে, ধর্ষণ করে হত্যা করা নারীর যোনিতে টর্চ গুঁজে দেয়া সহ্য করতে পারে ! ১৯৬৮ সালে ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকায় হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায়কে যখন বাসুদেব-সুভাষ লিখতে বলল, তখন আমার নাটকগুলো ওনাকে পড়তে দেয়নি ; দিলে, নাটক নিয়ে তখনকার নাট্যকাররা যে ভাবনাচিন্তা করছিলেন, তার প্রেক্ষিতে আমার নাটকগুলো সম্পর্কে মোহিতবাবুর মতামত জানা যেতো ।


    আয়োনেস্কোর কোনো চরিত্রই ট্রান্সহিউমান বা মানবাধিক ও পোস্টহিউমান বা মানবোত্তরের মিশেল নয়। আয়োনেস্কোর চরিত্রেরা মনে করে জীবন নিস্ফল অকিঞ্চিৎকর তুচ্ছ, তারা অধিগম্য জগতের প্রতি বিরক্ত, বার্তালাপে বিশ্বাস করে না, মনে করে মৃত্যু অতিনিশ্চিত । ‘ইল্লত’ নাটকে আমি সেরকম চরিত্র গড়ে তুলিনি, বরং অ্যানথ্রোপোসিন বা মানব্যযুগের সম্ভাবনার কথা বলেছি । ‘ডোডোন’ নামের চরিত্রটির মধ্যে একনায়কসুলভ আভাস থাকলেও সে মোটেও একজন পরামানব বা উবেরমেনশ নয়, প্রকৃত একনায়কদের মতন সেও সাইকোপ্যাথ জোকার । হাংরি শব্দটাই তো পেয়েছিলুম চসারের ‘সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্য থেকে, কেননা সেই সময়টাকে মনে হয়েছিল স্যাঁতসেতে অপ্রীতিকর টকে যাওয়া ; যাঁর বাড়ি থেকে প্রথম দিকের বুলেটিনগুলো প্রকাশিত হয়েছিল, অর্থাৎ হারাধন ধাড়া, যিনি পরে এফিডেভিট করে নিজের নাম দেবী রায় করে নিয়েছিলেন, তিনি মা-বাবা ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন হাওড়ার এঁদো বস্তির একটা ঘরে, জমিজমাহীন চাষি পরিবারের সন্তান ছিলেন । কালক্রমে তিনি আর্থিকভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, কিন্তু হতোদ্যম মনমরা হননি । তাঁকে পিছড়াবর্গের মানুষ বলেছি বলে তিনি অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ বোধ করেন , এবং বিভিন্ন প্রত্র-পত্রিকায় এব্যাপারে আমার বিরুদ্ধে অবিরাম বিষোদ্গার করেছেন ; আসলে বুঝতেই পারেননি যে সারা ভারত জুড়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইয়ের ময়দানে নেমে এসেছেন নিম্নবর্ণ ও বর্গের মানুষ ; তিনি দেবী রায় নামের আড়ালে লুকিয়ে নিজেরই ক্ষতি করে গেছেন, বিশ্বাস করেছেন ট্রিকল ডাউন থিয়রিতে, বটম আপ থিয়রিতে নয়, রোহিত ভেমুলা আর কানহাইয়া কুমারদের গর্ববোধ তাঁর কেন নেই বলা কঠিন । পক্ষান্তরে সুবিমল বসাক স্বীকৃতি দিয়েছেন নিজের পিছড়াবর্গকে, এবং তাঁদের বিভিন্ন সংগঠন দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছেন, সম্বর্ধিত হয়েছেন, স্বীকৃতি পেয়েছেন ।


    আয়োনেস্কো তো বটেই, গণনাট্য সংঘের ( আই পিটিএ ) ও বিভিন্ন ছোটোখাটো বামপন্হী গ্রুপের থিয়েটার আরম্ভ হল, যাঁরা সময়কে একরৈখিক মনে করতেন, তা থেকেও ভিন্ন ছিল হাংরি আন্দোলনের দার্শনিক বনেদ, কেননা তা নিয়েছিলুম অসওয়াল্ড স্পেংলারের ‘ডিক্লাইন অফ দি ওয়েস্ট’ গ্রন্হে বর্ণিত সময়ের সাংস্কৃতিক অরৈখিকতা ও বহুমাত্রিকতা সম্পর্কিত বক্তব্য থেকে । স্পেংলার বলেছিলেন যে, একটি সংস্কৃতির ইতিহাস একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না । আমরা তো দেখলুম, সোভিয়েত রাশিয়ার, চিনের, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর বাঁকবদল ঘটে গেল, যা গ্রুপ থিয়েটারের কর্ণধাররা আঁচ করতে পারেননি । ষাটের দশকে কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গের সমাজের অবস্হা দেখে আমার পক্ষে আশাবাদী হওয়া সম্ভব ছিল না । তিরিশ বছরে বামপন্হীরাও এমন পচে গেল যে কবিতাতেও বিষাদ, হতাশা, গ্লানি, পরাজয়বোধ, অসহায়তা, পারক্যবোধ ইত্যাদি দেখা দিল । হয়তো পাড়ার দলগুলোর নাটকেও তা দেখা দিয়ে থাকবে ।


    ইতিহাসের দর্শন নিয়ে কাজ করার সময়ে, আমি ‘বিংশ শতাব্দী’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখেছিলুম, এই বিষয়ে, তো সেই লেখার সময়ে আমার মনে হয়েছিল যে, স্পেস বা স্হানিকতার অবদান হল পৃথিবী জুড়ে হাজার রকমের ভাষার মানুষ, হাজার রকমের উচ্চারণ ও বাকশৈলী । এক দিকে এই বিস্ময়কর বহুত্ব, অন্যদিকে, সময়কে একটিমাত্র রেখা বরাবর এগিয়ে যাবার ভাবকল্পনাটি, যিনি ভাবছেন সেই ব্যক্তির নির্বাচিত ইচ্ছানুযায়ী, বহু ঘটনাকে, যা অন্যত্র ঘটে গেছে বা ঘটছে, তাকে বেমালুম বাদ দেবার অনুমিত নকশা গড়ে ফ্যালে । বাদ দেবার ব্যাপারটা, স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের ফলে, বাঙালির ডিসকোর্সটি উচ্চবর্ণের ও বর্গের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার দরুণ । আমার মনে হয়েছিল যে, ম্যাকলে সাহেবের চাপানো শিক্ষাপদ্ধতির কারণে বাঙালির নিজস্ব স্পেস বা পরিসরকে অবজ্ঞা করে ওই সময়ে অধিকাংশ কবি-লেখক-নাট্যকার মানসিকভাবে নিজেদের শামিল করে নিয়েছিলেন ইউরোপীয় সময়রেখাটিতে ।


    বাসুদেব আর সুভাষের বক্তব্য, আমি পরে টের পাই, তাদের এই ধারণার ওপর নির্ভর করে তারা বলেছিল যে, আয়োনেস্কোর জীবন যেমন ফরাসিভাষা আর রোমানিয়ান ভাষার মাঝে চিড় খাবার দরুন তাঁর নাটককে প্রভাবিত করেছে, আমার ক্ষেত্রেও বাংলা আর ইমলিতলার পাটনাই বুলি একই কাজ করেছে। বিহারে শৈশব কেটেছে বলে ওদের কথাবার্তায় খোঁচা থাকতো । যাহোক, আমার তা মনে হয়নি, কেননা তিন বছর বয়স থেকে আমি ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছি, স্কুল সংলগ্ন চার্চে প্রতি সপ্তাহে বাইবেল ক্লাস করেছি, তবু তা আমাকে একান্নবর্তী হিন্দু পরিবারের ঐতিহ্য থেকে ছিঁড়ে বের করতে পারেনি, এমনকী ব্রাহ্ম স্কুলের প্রভাবও কলেজের পর মিইয়ে গেছে । এই স্কুল দুটো যা করতে পেরেছে তা হল নাটক লেখক হিসাবে আমার আভাঁ গার্দ চেতনায় ছাপ ফেলা । এটা ঠিক যে হিন্দু, ব্রাহ্ম, খ্রিস্টান, মুসলমান এবং বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজির খিচুড়ি দিয়ে আমার যে ব্যক্তি-প্রতিস্ব নির্মিত হয়েছে তা অন্যান্য নাটক লেখকদের থেকে ভিন্ন ।


    অরূপ চৌধুরী, যিনি নাট্যাভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত, তাঁর ‘মলয় রায়চৌধুরীর নাটক ভাঙার নাটক’ প্রবন্ধে ( হাওয়া৪৯ পত্রিকা, এপ্রিল ২০০১ ) লিখেছিলেন, “ষাটের দশকে, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ট্র্যাডিশানাল নাটকের বিরুদ্ধে তৈরি হচ্ছিল অ্যাবসার্ড নাটক, ব্রেখতিয়ান থিয়েটার, লোক-নাটকের নতুন ও বিস্ময়কর ঘরানা । চারপাশে নিত্য ভেঙে পড়ছিল প্রসেনিয়াম নাটকের রূপরেখা । মলয়দা তাঁর প্রায় অতিমানবিক ক্ষমতায় আমাদের মতো উত্তর প্রজন্মের জন্য রেখে যাচ্ছেন তাঁর অসামান্য তিনটে নাটক : ‘ইল্লত’ ( ১৯৬৩ ), ‘হিবাকুষা’ ( ১৯৬৪ ) আর ‘নপুংপুং’ ( ১৯৬৫ ), যা আমাদের অভাববোধকে কিছুটা মিটিয়েছে ; যা পড়তে-পড়তে আমি বারবার তীব্রভাবে আলোড়িত হচ্ছি ।” ‘কবিতীর্থ’ প্রকাশনী নাটক তিনটিকে পুনঃপ্রকাশের সময়ে উৎপল ভট্টাচার্য তাঁর সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন যে নাটকগুলো পোস্টমডার্ন এবং এগুলো গ্রুপ থিয়েটার, অ্যাবসার্ড থিয়েটার, ব্রেখতিয় থিয়েটার ইত্যাদি বাংলা মঞ্চের বহুবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে রচিত । পোস্টমডার্ন বলা হয়েছে তার কারণ, বাংলাভাষায় আধুনিক নাটকে যে অনুশাসনটি অবশ্যমান্য ছিল তা হল নাটকটির উদ্দেশ্য প্রণোদিত হওয়া । অপরপক্ষে তাঁর তিনটি নাটকই বিষয়হীন ।”


    ওই প্রবন্ধে অরূপ চৌধুরী আরও বলেছেন, এবং আমি তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু বক্তব্যে একমত, যে, “ষাটের দশকে প্রযুক্তিবিজ্ঞানের কল্যাণে জানা হয়ে গিয়েছিল যে পারমাণবিক জগতেও রয়েছে এক অনিয়মের রাজত্ব । নিয়োফিজিক্স, মাইক্রোফিজিক্স থেকে কোয়ান্টাম ফিজিক্স সকলেই বলেছিল এক ‘লজিকাল ইমপসিবল’-এর কথা । কার্যকারণবাদের প্রচলিত ধারণা, অর্থাৎ কার্য থাকলে কারণ থাকবেই — ভেঙে পড়েছিল। শিল্পসাহিত্যেও তথাকথিত বাস্তববাদ বা যুক্তিবাদের আদরও ক্রমশ কমতে শুরু করেছিল । ‘সারফেস রিয়্যালিটি’র বদলে জোর দেয়া হতে লাগল ‘ইনার রিয়্যালিটি’র ওপরে আর তার সঙ্গে যুক্ত হল মলয়ের নাটকের ‘হাইপার রিয়্যালিটির’ জগৎ, যা এই নাটকগুলোতে দুর্দান্ত ক্র্যাফ্টম্যানসিপে প্রয়োগ করেছেন মলয় ।”


    অরূপের বক্তব্যই তুলে ধরি, যদিও আমি ওনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নই, “তাঁর হাতে তৈরি হল এক নতুন রোমাঞ্চের ভাষার ঘরানা ও খোলা আঙ্গিকের নাট্যরূপ যার ফলে ট্র্যাডিশানাল নাটকের একঘেয়েমির জাঁতাকল থেকে নতুন একটা মুক্তির স্বাদ পেলাম আমরা । সংলাপে এলো অভিনবত্ব ও অভাব্যতা । ছিল বহুরৈখিকতা ও দ্ব্যর্থকতা । ছিল আহ্লাদ ও আয়রনি । যেমন ‘ইল্লত’-এ, ‘সঅবই দেকচি ঠিকাচে’, ঘুমের ভেতর থেকে জেগে উঠে বারবার এই স্বগত ভাষণটি ছুঁড়ে দিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ছে বলদর্পী, মেগালোম্যানিয়াক ও আত্মতুষ্ট ‘ডোডোন’, আর প্রতিবারই নতুন পরিপ্রেক্ষিত ও দ্যোতনায় তৈরি হচ্ছে ত্রস্ত স্হিতাবস্হা ও হুমকির আবহাওয়া । যেমন ‘নপুংপুং’-এ ‘টোরসো’র স্তনের ঘুলঘুলির ভেতর থেকে হঠাৎ একটা রোমশ হাত ও ডাণ্ডা বেরিয়ে এসে ‘য়লম’-এর গালে ও মাথায় পড়ছে আর তৈরি হচ্ছে চমকানির ছায়াজগৎ । কোথাও কোথাও সংলাপে দেখা দিচ্ছে অফুরন্ত মজা আর ভাঁড়ামি । আর উঠে আসছে আমাদের দগদগে ও ক্ষয়িষ্ণু সমকাল । যেমন , ‘খুব কশে মাথা নাড়াও, ভোঁ ভোঁ করতে থাকলে বুঝবে ভাবছ’ ( ইল্লত ) । ‘যার হেঁচকি ওঠে সেই শুধু ভাবতে পারে’ ( ইল্লত )। ‘ওদিকে একটা ডোবা আছে সকলে তাকে সমুদ্র বলে’ ( ইল্লত ) । ‘আপনারা জানেন কোকিলের দর পঁচিশ গাবভেরেণ্ডার সতেরো টিকটিকির এক’ ( ইল্লত ) । ‘রক্ত ভেজে খাওয়ার সময়ে আমি সব সময় চোখ বুজে খাই, নইলে শালা গা গুলোয় ( ইল্লত ) ।”


    “নাটকগুলো, বিষয়বস্তুর অনুশাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত । তথাকথিত বাহ্যিক যুক্তিশৃঙ্খলা ও পরম্পর্যা রহিত । ডায়লগ সম্পূর্ণ ইন্সট্যাণ্ট । অপূর্ব কল্পিত । কথার পিঠে । খেলাচ্ছলে গড়ে উঠেছে । দর্শক বা পাঠক প্রসেনিয়ামের দূরত্ব কাটিয়ে নাটকের উপস্হাপনার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারছে । প্রসেনিয়ামের মায়াজগত ও মনোপলি ভাঙছে । চরিত্রগুলো যখন কথা বলছে, মনে হচ্ছে না একজন আরেকজনকে উত্তর দেবার জন্য কথাগুলো বলছে । মনে হচ্ছে তারা নিজের কথাটাই যেন বলে নিতে চাইছে । অনেকটা স্বগতোক্তির মতো । যেন অন্যজনের সংলাপ না থাকলেও তার সংলাপ সে বলে নিতোই । কোথাও কোথাও, বিশেষত ছোট কোনও সংলাপ থাকলে, দেখা যাচ্ছে উপস্হিত প্রত্যেকটি চরিত্রই সেই সংলাপে নিজের অভিব্যক্তি মিশিয়ে বলে নিচ্ছে । অ্যাবসার্ড নাটক, যেমন পিরানদেলোর ‘ডায়ালগ ইজ দ্য অ্যাকশান ইন ওয়র্ড’কে অস্বীকার করেছিল, ঘটনাহীনতাকে তুলে ধরার জন্য, মলয়ের নাটকে ডায়ালগ কিন্তু অ্যাকশানধর্মী । যদিও মলয়ের নাটকে ট্র্যাডিশানাল নাটকের মতো প্রত্যক্ষ ঘটনার কোনও গ্রাফিক ডিটেইলসের ধারাবিবরণী নেই, শুধু সামাজিক অবস্হান সম্পর্কে চরিত্রগুলোর টোটাল প্রতিক্রিয়ামূলক প্রতিফলন আছে, রয়েছে প্রথাবদ্ধতার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সারকাজম । ‘ইল্লত’ নাটকে গণেশ-এর দাঁড়িকমাফুলস্টপের চিহ্ণহীন দীর্ঘ মনোলগ দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেকটা শব্দ তার নিজস্ব আবেদনে পূর্ণ, একটা শব্দ আরেকটা শব্দকে আইডেনটিফাই করে একটা সম্পূর্ণ বাক্য তৈরি করছে না। শুধু সমকালীন চালু কিছু শব্দ প্রয়োগে আমাদের চারপাশের এলোমেলো, অসংগতিপূর্ণ, অস্হির ও উদ্ভট ব্যবস্হাকে চিরে-চিরে তুলে ধরছে ।”


    “আজ ওপেনএনডেড থাকাটা পোস্টমডার্নিজমের একটা বিশেষ লক্ষণ বলে মনে করা হচ্ছে যা এই নাটকগুলোতে হামেহাল দেখতে পাওয়া যায় । একটা সিকোয়েন্সের সারকিট কমপ্লিট হবার আগেই আর একটা সিকোয়েন্স গড়ে উঠছে, আর উদ্দেশ্য ও পারম্পর্যহীনভাবে শুরু হয়ে যাচ্ছে নতুন একটা সংলাপ। মনে হয় যেন যেকোনো জায়গা থেকেই নাটকগুলোতে ঢুকে পড়া যাবে ।”


    “চরিত্রগুলো মনে হয় সাতচল্লিশ-পরবর্তী দ্বিধাবিভক্ত নয়া-ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্হার এক-একটা আইডিয়ার প্রকাশ । চরিত্রগুলোর প্রজেকশানও অনির্ণেয় ও অধিবাস্তবমূলক । তাদের আত্মপরিচয় ও সামাজিক অবস্হান সম্পর্কে কোথাও স্পেসিফিক কিছু উল্লেখ নেই । প্রথাসিদ্ধ মডার্ন নাটকের পরিবেশনায় একটা চরিত্রকে আইডেনটিফাই করার জন্য যা-যা সূত্র থাকে, যেমন তার পারিবারিক ও সামাজিক পটভূমি, তার লেখাপড়া ও আর্থিক অবস্হার স্তর, জীবন-জীবিকা সেসবের কিছুই এই নাটকগুলোতে উল্লেখ নেই । পাঠক বা দর্শক নাটকগুলো পড়তে-পড়তে বা দেখতে-দেখতে নিজেরাই রিঅ্যাক্ট করবে । যেহেতু চরিত্রগুলো লিনিয়র নয়, বহুরৈখিক, সেহেতু একটা ছাঁচে বা বিশেষ একটা মতবাদ বা তত্ত্ববিশ্বের ছাতার তলায় পিটিয়ে তাদেরকে জড়ো করা যাচ্ছে না । তাদের হাবভাব, কথাবাত্রা ঠিক বাস্তবের প্রতিরূপ নয় । একটাই চরিত্রের ভেতর হাজারটা চরিত্র মিশে থাকছে । একাধিক তাদের কন্ঠস্বর । তাদেরকে বামপন্হী লাল ও দক্ষিণপন্হী নীলের ফরম্যাটে চট করে ফেলে দেওয়া যায় না, এবং এখানেই তাদের বহুরৈখিকতার স্তর কাজ করে ।”


    ‘ইল্লত’ ও ‘হিবাকুষা’ দুটো নাটকেই শেষ দৃশ্যে ইনসিডেন্টালি আমরা চারজন কৌপিনপরা ও চারজন দড়িবাঁধা লোকেদের দেখতে পাচ্ছি । ‘ইল্লত’-এ তারা কায়েমি স্হিতাবস্হা ও বাকতাল্লার বিরুদ্ধে জানায় ‘সাআআআআআআবধান’, আর ‘হিবাকুষা’য় তারা তাদের পরাস্ত অসহায় ও জন্তুবৎ নিয়তির দিকে টেনে আনে বিমূঢ় বয়স্ক ‘ষাভ’ ও’ঢপ’কে, যাদের ‘লম্বা-চওড়া জোয়ান’ ‘শ্বস’-এর শুধুমাত্র ‘ক্ষিদে’ শব্দের উচ্চারণ শুনে আঁতকে উঠে দড়ির বাড়তি ফাঁস নিজেদের হাতে নিজেদের গলায় ঢুকিয়ে হামাগুড়ি দিতে-দিতে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকে না ।”


    মনোজ নন্দী ‘মাঝি’ পত্রিকার আগস্ট ১৯৯৯ সংখ্যায় ‘ইল্লত হিবাকুষা নপুংপুং কিংবা আরেক শতাব্দীর সম্ভাবনা’ নামে একটি ছোটো আলোচনা করেছিলেন ‘নাটকসমগ্র’ বইটার । তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন নাটকগুলো অভিনয়ের জন্য রচিত না কি কেবল পাঠ করার জন্য রচিত । আমি যে কেবল পাঠ করার দিকে লক্ষ্য রেখে নাটকগুলো লিখেছিলুম, আর সেকারণে নানা ধরণের খোঁচার খেলা খেলেছিলুম, তা উনি ধরতে পেরে, অভিনয়ত্বের প্রশ্ন তুলেছেন । মনোজ নন্দী লিখেছেন, “অলঙ্কারশাস্ত্রে নাটককে বলা হয় দৃশ্যকাব্য । ‘সাহিত্যদর্পণ’-এর মতে ‘দৃশ্যঃ তত্রাভিনেয়ম’ । অর্থাৎ দৃশ্যকাব্য হল সেই কাব্য যা অভিনীত হয় । অন্যদিকে অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘In a play personages act the story’ । সুতরাং অভিনয়ত্বের দিক থেকে অনেকটাই লক্ষ্য রেখে নাটক রচনার একটা রীতি আছে । আর সেজন্য যুগে-যুগে দর্শকের রুচি ও মানসপ্রকৃতি অনুযায়ী নাটকের ভাব ও আকৃতির পরিবর্তন হয়েছে এবং রঙ্গমঞ্চের প্রকৃতি অনুযায়ী নাটকের রূপ ও রীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে । কিন্তু কবি মলয় রায়চৌধুরীর মাথার পেছনে যেহেতু নাট্যকারের শিল্পীজনোচিত কোনও জ্যোতি নেই, এবং যেহেতু শিল্প নামক তথাকথিত ভুষিমালে তাঁর এখনও হয়তো সেই পুরনো বিশ্বাসহীনতা, তাই উত্তরাধুনিক চিহ্ণিত তাঁর এসব নাটক সত্যিই একরৈখিক নয় । কোনও রূপ, রীতি ও বিষয়ের দাস নয় এরা । শুধু কিছু অনির্নেয়তা, কিছু খেলা-খেলা অন্তর্মূখী নাটকীয় দ্বন্দ্ব, শব্দ নিয়ে কিছু পরিভাষণ কিংবা পরিহাসপ্রিয়তা, আর অনির্বচনীয় নাটকীয় মনোকথন, ক্ষুধার্ত সেই বিষ বুকে নিয়ে, ছুঁড়ে দিয়েছেন তিনি সামাজিক পচন, সমস্ত ভণ্ডামি ও সভ্যতার নোনাধরা পলেস্তারার বিরুদ্ধে । রয়েছে কিছু স্হিতাবস্হা ভাঙার ইঙ্গিত — কিছু আবেগময় দৃশ্য পারম্পর্য ।”


    “তবু, পাঠ্যরূপ এ-নাটকগুলি মঞ্চে অভিনীত হতে-না-পারলে, অভিনয়কলার সঙ্গে নাট্যকলার যে-অঙ্গাঙ্গী যোগ রয়েছে, তা কি অস্বীকার করব আমরা ? নাকি এসব নাটক অভিনীত হবার মতো উত্তরাধুনিক কোনও রঙ্গমঞ্চ গঠনের আশায় আরও দিন গুণতে হবে আমাদের — এ ভাবেই ভাবব ? এখনও স্হির নিশ্চয় হতে পারিনি আমরা । তবে ‘ইল্লত’ নিয়ে নাট্যকর্মীরা যে-কোনও দিনই চিন্তাভাবনা শুরু করতে পারেন বলে মনে হয়, কেননা ক্ষুধার্তসুলভ বিকৃতি প্রায় অনুপস্হিত এই নাটকে । আর নাটকটির সব উদ্ভটতা সত্ত্বেও, শুধুমাত্র ব্যক্তিমানস ফুলে-ফেঁপে ওঠেনি, এখানে, বরং যেন প্রকাশিত হয়েছে বিদ্রুপাত্মক এক জীবনধর্মীতাই । কিন্তু ‘হিবাকুষা’ বা ‘নপুংপুং’ নিয়ে ভাবার জন্য আরও দীর্ঘ সময় দরকার আমাদের — দরকার হয়তো আরেক শতাব্দীরও । কে বলতে পারে, বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে কোনও দিন জ্বলে উঠবে না কোনও আলো — সবরকম পুলিশি প্রহরা অগ্রাহ্য করেই ।”


    আমার একটা কথা প্রায়ই মনে হয় । নাটকের মঞ্চকে আমরা রঙ্গমঞ্চ বলি কেন ? বর্তমান কালখণ্ডে রঙ্গের কোনো ভূমিকা আর আছে ? নাকি সবই চলে গেছে মধ্যবিত্তদের বিনোদনের সেবায় !


    আমার ‘ভালোবাসার উৎসব’ কাব্যনাট্যে প্রধান চরিত্র একজন যোদ্ধার, যে মঞ্চে প্রবেশ করে পায়রোটেকনিক ঝড় তুলে মারা যায়, এবং তার প্রাক্তন প্রেমিকারা প্রত্যেকে তার দেহের একটা প্রত্যঙ্গ বা অঙ্গ দাবি করে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা জুটি প্রবেশ করে সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলে, এবং একজন খোচর হিপহপ নাচতে-নাচতে ওই যোদ্ধার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে থাকে । শেষে সমবেত যুবতীরা ওই যোদ্ধার শব নিয়ে অন্তরালে চলে যায় । যোদ্ধার দেহের শেষাবধি কী হল তা নির্ণয় করার দায় পাঠকের ।


    ‘যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের’ কাব্যনাট্যে গোরস্তানে রাতের বেলায় কবরের ভেতর থেকে চরিত্ররা বেরিয়ে আসে, নিজেদের মধ্যে কথা বলে, এবং সেই দৃশ্যের একমাত্র সাক্ষী গোরস্তানের কেয়ারটেকার । বহুকাল আগে মৃতা এক যুবতীকে চিনতে পারে কেয়ারটেকারের ছেলে, যুবতীও তাকে চিনতে পারে । পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা সঙ্গমে লিপ্ত হয় । যুবতীটি ট্রান্সহিউম্যান বা মানবাধিক এবং যুবকটি পোস্টহিউম্যান বা মানবোত্তর ; তাদের সন্তান-সন্ততি মানব্যযুগ আনতে পারবে কি না তা নির্ণয়ের দায় পাঠকের ।


    ‘ভরসন্ধ্যা’ কাব্যনাট্যে একটি কদমগাছ কথা বলে, তার কাছে জড়ো হয়েছে কিছু বয়স্ক মানুষ আর কিছু যুবক যুবতী, তাদের দেশ চালাবার জন্য কল্পতরু কদম গাছের কাছে তারা অবতার প্রার্থনা করতে এসেছে । গাছটি পুরুষ ও নারীর কন্ঠে কথা বলে । ভারতে যতোগুলো রাজ্য ততোগুলো বয়স্ক মানুষ এবং যতোগুলো ইউনিয়ান টেরিটরি ততোগুলো যুবক-যুবতী । গাছটি প্রতিবার অতীত থেকে একজন করে একনায়ককে পাঠায়, যারা নিজের কৃতকর্মের গুণগান করে, যেমন হুন আত্তিলা, ক্যালিগুলা, পলপট, হিটলার, হান্টারওয়ালি এবং সবশেষে যমরাজ ও তাঁর কেরানি চিত্রগুপ্ত । জনগণের কাউকেই পছন্দ হয় না ।


    ‘সুর্পনখা-বাল্মীকি সংবাদ’ কাব্যনাট্যটিতে সুর্পনখা অভিযোগ করছেন যে তাঁর চরিত্রচিত্রণ কেন অমনভাবে করা হয়েছে, এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি প্রতিবাদ । পাঠক, সুর্পনখাকে যে ভাবে দেখতে অভ্যস্ত, তা থেকে তাঁকে বের করার প্রয়াস করে কাব্যনাট্যটা । বাল্মীকির আশ্রম থেকে কাটা নাক ফেরত নিয়ে যায় সুর্পনখা।


    আমার নাটকগুলো এবং পরবর্তীকালে লেখা কাব্যনাট্যগুলোকে আমি থিয়েটার অফ দি অ্যাবসার্ড বলব না, যে অর্থে ইউজিন আয়োনেস্কো, স্যামুয়েল বেকেট, জাঁ জেনে, আর্থার আদামভ, হ্যারল্ড পিন্টার, টম স্টপার্ড, ভাকলাভ হ্যাভেল প্রমুখের নাটককে থিয়েটার অফ দি অ্যাবসার্ড বলা হয় । আভাঁগার্দ বা জনারহীন বললে বরং কিছুটা চিহ্ণিত করা যেতে পারে । ডাডাবাদ ও পরাবাস্তববাদ সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল বলেই আমার পক্ষে সুবিধা হয়েছে এই আন্দোলনের প্রভাবকে অস্বীকার করতে । ত্রিস্তান জারা এবং আঁদ্রে ব্রেতঁর ম্যানিফেস্টো আমি অনুবাদ করেছি, গগাঁ এবং সালভাদর দালির আত্মজীবনী অনুবাদ করেছি । আমি মানি যে ডাডাবাদ এবং পরাবাস্তববাদ ভাষাকে নানা বাঁধন থেকে মুক্তি দিয়েছে । সেই আন্দোলনকারীরা নিজেদের সংস্কৃতির শত্রু হিসাবে চিহ্ণিত করেছিলেন, কিন্তু কালক্রমে ফরাসি সংস্কৃতি তাঁদের আত্মসাৎ করে নিজের কোলে ঠাঁই দিয়েছে । সংস্হাগত সংস্কৃতিকে যাঁরা ভেঙে চুরমার করতে চেয়েছেন, তাঁদের করে ফেলা হয়েছে ঐতিহ্যের অন্তর্গত । নাটকগুলো এবং কাব্যনাটক লেখার সময়ে এই ফাঁদের কথা আমার মনে ছিল ।


    বাংলা ট্র্যাডিশানাল নাটক এবং গ্রুপ থিয়েটারের নাটক যাঁদের রচনার ওপর নির্ভর করে লেখা হয়েছে, তাঁরা প্রকৃতজীবনে যা দেখেছেন, তাকেই উপস্হাপন করেছেন । পক্ষান্তরে, নাটকে ও কাব্যনাট্যে আমার ন্যারেটিভ সম্পূর্ণ নয়, তা ভঙ্গুর, কোনো ঘটনার ক্ষুদ্রাংশের সঙ্গে অন্যান্য ঘটনার ক্ষুদ্রাংশ মিশিয়ে গড়া মাকড়জাল, তা সম্ভাব্যতা-বিরোধী ও চূর্ণপ্রতিমা ; চরিত্রেরা নিটোল ব্যক্তিপ্রতিস্ব নয়, বরং একাধিক প্রতিস্বের খিচুড়ি, তারা অনিশ্চয়তার গর্ভে জন্মেছে । আমার নাটকে গতানুগতিক ‘চরিত্র’ লোকটির মৃত্যু ঘটেছে । পাঠকদের কাজ কাব্যনাটক ও নাটকগুলো পড়ে মর্মার্থ নিঙড়ে আনা, তাঁরা নাটকগুলোর অংশীদার, এমনকী চরিত্রও । নাটকগুলো অভিনয় করতে হলে অভিনেতা নিজের চরিত্র নিজেই বুঝে নেবেন, লেখক বা নাট্যপরিচালকের নির্দেশের প্রয়োজন নেই, কেননা বাস্তবজগৎ থেকে সরে গিয়ে নাটকগুলো নিজের চেতনার পরিবেশ সৃষ্টি করে নিচ্ছে । নাটকগুলো প্রশ্ন তুলছে একমেব-সত্যের ভ্রম সম্পর্কে, এবং নির্নয় করার দায় ছেড়ে দিচ্ছে পাঠকের নিজস্ব ব্যাখ্যার ওপর । অর্থাৎ উত্তর দেবার পরিবর্তে প্রশ্ন তুলছে, এবং সমাধানের দায় পাঠকের । আমি তাই কোনো নির্দিষ্ট প্লট এবং চরিত্রের ক্রমবিকাশ ঘটাইনি । বলা যেতে পারে যে আমার নাটকে আধুনিকতাবাদী “চরিত্রদের মৃত্যু” ঘটে গেছে ।


    আইপিটিএ-র নাটক থেকে যদি বাংলা মঞ্চে নাটকের আধুনিকতা মেনে নিই, তাহলে তাতে পাবো একটি কেন্দ্রিয় ন্যারেটিভ প্লট যা ক্রমে যুক্তির ধাপে-ধাপে সমায়ুনক্রমে যবনিকার দিকে এগিয়ে যায়, যেমনটা মোহিত চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত প্রমুখের কলমে ঘটতে দেখেছি । অভিনেতারা পরিচিত মানুষের চরিত্রচিত্রণ করেন, তাঁদের জীবনের ট্র্যাজেডি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব অথবা মিলনান্তক ঘটনাপ্রসঙ্গ জুড়ে গল্পরেখা বরাবর নাটকের আরম্ভ থেকে শেষ দৃশ্যের দিকে এগিয়ে যান ।


    আমি যা করতে চেয়েছি, তাহলো জগতসংসারকে এবং ব্যক্তিকে দেখার গতানুগতিক দৃষ্টিতে বিঘটন ঘটানোর প্রক্রিয়া । মানে, আমার নাটক যেন একটি অনুষ্ঠান কিংবা প্রক্রিয়া, যার দ্বারা পাঠক এবং চরিত্রেরা ( তাদের প্রকৃতপক্ষে চরিত্র বলা উচিত নয়, কিন্তু কোনো বিকল্প শব্দ খুঁজে পাইনি ), মঞ্চের জিনিসগুলো, ফাঁকা আর ভরাট জায়গা, পরস্পরের মাঝে মানসিক আদানপ্রদান বজায় রাখে । আলো ফেলার চেষ্টা করেছি চেতনায় ; অভিজ্ঞতাপ্রসূত আবেগ কিংবা সরল বিনোদনে নয় । বাস্তবের বিনির্মাণ করতে চেয়েছি, ব্যাখ্যা নয়, কিংবা পাঠকের সঙ্গে প্রামাণিক সম্পর্ক গড়ার প্রয়াস নয়, যেমনটা আধুনিক নাটক দর্শকের সঙ্গে করতে চায় । আমার নাটকের চরিত্রদের নামকরণেই স্পষ্ট হয়ে গিয়ে থাকবে যে সেগুলো কিছুটা হদিশ দিলেও পরিচিত নয়, যেমন ডোডোন ( ডোডো পাখির সঙ্গে মিল আছে, অথচ গ্রহণযোগ্য নাম নয় ), রোমেশ, লোমেশ, জম্বুক, ধূর্তক, টিকলু, ধঞ্জয়, রজন, ঢপ, শ্বস, ষাভ, টোরসো, য়লম ইত্যাদি । কেউই কিন্তু প্রট্যাগনিস্ট বলতে যা বোঝায়, তা নয় । চরিত্রগুলোর মননচূর্ণকে তুলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি নাটকে, আর দিতে চেয়েছি বিভিন্ন ভূমিকা, যেন তাদের মনস্তাত্বিক বিশৃঙ্খলা ঘটে গেছে, কিংবা আত্মসন্মোহনে ভুগছে, যেন তাদের চেতনায় আত্মপরিচয়ের অনুপ্রাণন ঝলক দিয়ে উঠছে যখন-তখন, যাকে আপাতবাস্তব বলে মনে হয় সেই স্তরে আটকে গেছে তারা, অথচ পাঠক পড়ার সময়ে বুঝতে পারবেন যে বাস্তব তো আসলে এরকম নয় । একধরণের ভিশনের মাধ্যমে চরিত্রগুলো নিজেদের অভিজ্ঞতাকে ফিরে-ফিরে মনে করার প্রয়াস করে, এবং সেগুলো সব সময়েই টুকরো-টাকরা, ভগ্নাঙ্ক, একতাহীন, অসম্পূর্ণ ।


    কাব্যনাট্যে আমি গম্ভীর দৃশ্যে ভিন্ন আর্ট ফর্ম পাশাপাশি দেবার চেষ্টা করেছি । যেমন ‘ভালোবাসার উৎসব’ কাব্যনাট্যে একজন রিপোর্টার প্রতিটি সংলাপের সঙ্গে মঞ্চে পড়ে থাকা শবের সামনে হিপহপ নৃত্য করে। ’যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের’ কাব্যনাট্যে গোরস্তানে বিঠোফেনের ‘ওড টু জয়’ এবং বব ডিলানের ‘ব্লাড অন ট্র্যাক্স’ বেজেছে । যেহেতু বিভিন্ন যুগে হত্যা করে পুঁতে দেয়া মানুষের গোরস্তান, তাই বর্তমান কালখণ্ডের সাথে কথোপকথন হয় ষষ্ঠ শতকের গুপ্তচর, আঠারো শতকের যুবতী, ১৮৬০-এর নীলবিদ্রোহে নিহত চাষি, শুয়োরের চেহারায় বারো শতকের রাজদরবারের কর্মীর, শেয়ালের চেহারায় একুশ শতকের রাজনৈতিক দলচারির— একই সময়ে তাদের সহাবস্হান, একে নাটকে জাদুবাস্তবের প্রয়োগ বলা যেতে পারে । ‘যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের’ এবং ‘ভরসন্ধ্যা’ কাব্যনাট্যে ইতিহাসের ঘৃণ্য সময়কে কেলাসিত করেছি, নাটকের ডমিন্যান্যান্ট কালচারের বিরুদ্ধে উপস্হাপন করেছি নাটকের কাউন্টার কালচার ।


    লেখক পরিচিতি:
    মলয় রায়চৌধুরী জন্ম ২৯ অক্টোবর, ১৯৩৯। বিশিষ্ট বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক। মলয় রায়চৌধুরীর ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ৪টি উপন্যাস, ১০টি সমালোচনা গ্রন্থ এবং কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে ‘শয়তানের মুখ’, ‘জখম’, ‘ডুব জলে যেটুকু প্রশ্বাস’, ‘নামগন্ধ চিৎকার সমগ্র’, ‘কৌণপের লুচিমাংস’, ‘অ্যালেন গিন্সবার্গের ক্যাডিশ গ্রন্থের অনুবাদ’ প্রভৃতি অন্যতম। শিক্ষা : পাটনার সেইন্ট জোসেফ কনভেন্টে প্রাথমিক এবং রামমোহন রায় সেমিনারিতে ম্যাট্রিকুলেশানের পর অর্থনীতিতে সাম্মানিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। মলয় রায়চৌধুরী ২০০৩ সালে অনুবাদ সাহিত্যে, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।

     
     

     
  • একক | ১০ ডিসেম্বর ২০২১ ১৬:০৮735174
  • ভাটে লিখেচি আগে,  আবার এখানেই লিখচি। মলয়বাবুর লেখা পড়ি।  মলয়বাবু অনলাইন প্রোমোশন নিয়ে সচেতন বলেই বলা।  
     
    এইরকম লম্বা লম্বা পোস্ট মোবাইলে স্ক্রল করে পড়তে গেলে স্ক্রিন হ্যাং করে। পাঠকের অসুবিধা হয়।
     
    দয়া করে ভেঙে ভেঙে পোস্ট করুন। গুরু কর্তৃপক্ষ পোস্টের শব্দসীমা বেঁধে দিলে ভালো হত। তা যখন হচ্চে না,  মলয়বাবু নিজেই একটু খেয়াল রাখলে, পাঠক হিসেবে কৃতার্থ বোধ করব। 
  • মলয় রায়চৌধুরী | 106.213.52.40 | ০২ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:০৩735280
  • ছোটোলোকের শেষবেলা : মলয় রায়চৌধুরী

     

    এক

           ছোটোবেলা আর যুববেলার সবকিছু পালটে গেছে ; ইমলিতলা পাড়ার গোলটালির চালাবাড়িগুলো হয়ে গেছে ইঁটের দাঁত বেরোনো একতলা-দুতলা । আমাদের বাড়িটা চেনা যায় না । সামনের লাল রোয়াক, যার ওপরে বসে কপিলের দাদু বাচ্চাদের গালাগাল শেখাতেন, সেখান থেকেই দেয়াল উঠে গেছে ; যারা থাকে, তারা উঠোনে গরু পুষেছে, দেয়ালময় ঘুঁটে দেয়া, খোলা ছাদ নেই, ঘর উঠে গেছে, বাঁদরগুলোর দল শহর ছেড়ে চলে গিয়ে থাকবে । কপিলের প্রজন্মের কেউ বেঁচে নেই, আর নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা আমার নাম জানে ভুখি পিঢ়ি আন্দোলনের সংবাদ পড়ে । গলির ভেতরের চালাবাড়িগুলোও ইঁটের ; সব নতুন মুখ । চোর-ডাকাতদের শুয়োর মারবার আর গাঁজার ঝোপের বস্তিতে উঠেছে একতলা বাড়ি । মহাদলিতদের পাড়া দখল করে নিয়েছে মধ্যবিত্ত মধ্যজাত চাকুরে পরিবার । কুলসুম আপাদের বাড়ি ভেঙে শিয়া মুসলমান চারতলা আবাসন , মহিলারা বোরখায় । নাজিম-কুলসুম আপারা অন্য কোথাও চলে গেছে । কুলসুম আপা, আভাসে মনে হলো, আরব দেশে চলে গেছেন । মসজিদটায় কেউ আর খেলতে ঢোকে বলে মনে হলো  না, কেমন যেন ঘিঞ্জি আর নোংরা, যদিও বিশাল মিনার উঠেছে । ইমলিতলায় বাবা-জেঠার প্রজন্মের কেউই নেই, আমার প্রজন্মেরও কেউ নেই । পুরোপুরি অপরিচিত আমার নিজের ছোটোবেলার পাড়া ।

              ছোটোবেলার ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন রায় সেমিনারি হয়ে গেছে বিশাল, ইউনিফর্ম পরতে হয় ছাত্রছাত্রীদের, দুটো শিফট হয়, বাংলামাধ্যম উঠে গেছে, ব্রাহ্ম ধর্মের প্রভাব ফুরিয়ে গেছে ; ব্রাহ্ম কবি-লেখকদের বাংলা বই আর সম্পাদিত পত্রিকাগুলো আর নেই । পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা বিভাগ আছে কেবল পিএইচডি করার জন্য ।

              যুববেলার দরিয়াপুরও পালটে গেছে, আমাদের বাড়িটা তিনতলা পর্যন্ত দাদার বড়ো ছেলের ফোটোর জিনিসপত্রে ঠাশা, এখন বাবার স্টুডিও নেই, ক্যামেরায় ফোটোতোলার দিনকাল বিদায় নিয়েছে, ছোটো ক্যামরাও লাখ খানেকের বেশি দাম, বেশির ভাগ কাজ কমপিউটারে। বাবা এই পরিবর্তন দেখে যেতে পারলেন না । সামনের বারান্দা ভেঙে ফেলা হয়েছে । ওই বাড়িতে দাদার ছেলে থাকে না । শশুরের দেয়া ফ্ল্যাটে কদমকুঁয়ায় থাকে । আমার আর ছেলে-মেয়ের কোনোকিছুই সেখানে নেই। পাশের চুড়িঅলা, যার কাছে মা মুর্গি রাঁধতে শিখেছিলেন, জায়ফল দিয়ে, তার পরিবার চলে গেছে পাকিস্তানে । চুড়ির দোকানের ওপরে শিখ সরদার থাকতেন, যিনি প্রতি রাতে একজন বেশ্যাকে নিয়ে ফিরতেন, তিনি বহুকাল আগে মারা গেছেন । বাড়ির মালিক, যার পাশেই ছিল বাঁশের আড়ত, চারতলা বাড়ি তুলে ভাড়া দিয়েছে । সামনের কবরমাঠের জায়গায় সুন্নি মুসলমানদের বাড়ি আর দোকান । আল্লু মিয়াঁ আর ওর বারবার বিয়ে-দেয়া মেয়েদের খবর জানে না কেউ ।

            উত্তরপাড়ার সাবর্ণভিলা ভেঙে আবাসন তৈরি হয়েছে । আমি, দাদা, বড়দি, ছোড়দি, ডলি, মনু আমাদের অংশ বিক্রি করে দিয়েছি । যারা থাকে তারা আমার দুর্নামের সঙ্গে পরিচিত বলে দেখতে এসেছিল । আমি কাউকেই চিনতে পারলুম না । কাকাবাবু, মানে বিশেখুড়োর কোতরঙের জমিজমা আর বাড়ি বেচে দিয়েছে ওনার পোষ্যকন্যা ; কে জানে কোথায় চলে গেছে ! পাণিহাটিতে মামার বাড়ির অর্ধেকের বেশি, পুকুর আর জমিজমাসুদ্দু, বেচে দিয়েছিলেন ছোটোমামা ; সেই জায়গায় আবাসন উঠেছে । ‘নিলামবাটি’ লেখা পাথরটা আছে, একটা বাড়ির দরোজার সামনে, কিন্তু সেটায় দাদামশায় থাকতেন না । দাদামশায় যে সমবায় ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেখানকার দেয়াল থেকে ওনার ফোটো গুদামঘরে চালান করা হয়েছে । পাণিহাটির মোচ্ছবতলা, চৈতন্যদেব বিশ্রাম নিয়েছিলেন বলে খ্যাত, এখন মনে হয় বোষ্টমদের নিয়মিত উৎসবের প্রাতিষ্ঠানিক জমঘট।  এখন পাণিহাটি থেকে ভুটভুটি যায়, কেবল ওপারে কোন্নোগরে নয়, বিভিন্ন জায়গায় ।  ছোটোবেলায় দাঁড়-বাওয়া নৌকো করে কোন্নোগর থেকে পাণিহাটি যেতুম । কোন্নগরে বড়জেঠিমার বাপের বাড়িতে কেউই আর নেই, তবে জগদ্ধাত্রী বারোমেসে মন্দির আছে ; সেখানকার কেউই চিনতে পারলো না আমাকে । ওনারাও অনেকটা জমি বিক্রি করে দিয়েছেন, যার ওপর আবাসন উঠেছে । বড়োজেঠিমার ভাইঝি আলো, সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, তাইই ছিল, দাদা বিয়ে করতে চায়নি, কেননা দাদা চাইবাসায় এক বিবাহিতা যুবতীকে ভালোবাসতো, পরে যার এক বোনকে দাদা বিয়ে করেছিল — ব্যাপারটা আছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়-এর উপন্যাস ‘কিন্নর কিন্নরী’তে ।

     

             আমি নাকতলার ফ্ল্যাট বিক্রি করে চলে এসেছি মুম্বাই । ওই পাড়ায়, ওই ফ্ল্যাটে, ওই পরিবেশে জীবন কাটানো, এই বয়সে অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল ।ছেলের এক বেডরুম ফ্ল্যাট আছে মুম্বাইতে । বুড়ো-বুড়ি চালিয়ে যাচ্ছি যেমন-তেমন ।  দাদা মারা গেছে । দাদার সাহিত্যিক বন্ধুরাও মারা গেছে । আমার ছোটোবেলার স্কুলের বন্ধু সবাই মারা গেছে, তরুণ শুর যুববেলাতেই লিউকোমিয়ায় মারা গিয়েছিল, বারীন গুপ্ত মারা গিয়েছিল মাথায় রক্তক্ষরণের দরুণ, সুবর্ণ উপাধ্যায়-এর সঙ্গে শেষ দেখা কলকাতায় পাঁচ বছর আগে – প্রোস্টেটের ভুল অপারেশনে রক্ত ঝরে, বলেছিল বেশিদিন বাঁচবে না । স্কুলের বন্ধু রমেণ ভট্টাচার্য আর অনিমেষ গুপ্ত নাকতলার কাছেই থাকতো, বাঁশদ্রোণী বাজারে দেখা হতো প্রায়ই, শুনেছি মারা গেছে । যুববেলার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র কয়েকজন টিকে আছে । সাহিত্যিক সঙ্গীদের মধ্যে টিকে আছে সুবিমল বসাক, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, দেবী রায় আর ত্রিদিব মিত্র-আলো মিত্র।সুবিমল মাঝে-মধ্যে ফোন করে । স্ত্রী মারা যাবার পর সুবো আচার্য পুরোপুরি অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের সেবায় লেগে আছে ; ‘নারী নরকের দ্বার’ বলে ছেলেদের বিয়ে দেয়নি । প্রদীপের স্ত্রী মারা গেছে ; প্রদীপের দুটো চোখই খারাপ । ত্রিদিব বাড়ি করেছে হাওড়ায় । সুবিমল বাড়ি করেছে বেলঘরিয়ায়, দুই ছেলে, নাতি-নাতনি নিয়ে থাকে । দেবী রায় ফ্ল্যাট কিনে হাওড়ায় কোথাও থাকে ; স্ত্রী মারা যাবার পর সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। শৈলেশ্বর ঘোষ অপারেশান থিয়েটারে মারা গেছে, ওর স্ত্রী, মেয়ে-জামাই সবাই মারা গেছে, সুন্দর বাংলোবাড়ি একেবারে ফাঁকা, ভুতুড়ে । সুভাষ ঘোষ মারা গেছে ; এখন বাড়িতে ঢুকতেই সামনে সুভাষের বিশাল ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, আগে ছিল জ্যোতি বসুর ছবি ।অবনী ধর আর বাসুদেব দাশগুপ্ত অশোকনগরে মারা গেছে । অরুণেশ ঘোষ জলে ডুবে মারা গেছে ; হয়তো আত্মহত্যাও করে থাকতে পারে । অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় মারা গেছে দিল্লিতে । উত্তরবঙ্গের হাংরি আন্দোলনকারী অলোক গোস্বামী আর রাজা সরকার কলকাতায়, দেবজ্যোতি রায় উত্তরবঙ্গেই আছে। ত্রিপুরা থেকে অরূপ দত্ত চলে এসেছে কলকাতায় ।

              বড়দি-ছোড়দির বিশাল জমিদারি বাড়ি, ‘সিলভ্যান হাউজ’, গেট দিয়ে ঢুকতেই দুইধারে ছিল বকফুল গাছের সারি, ফুলের বাগান, সব উধাও । সেখানে বিশাল আবাসন উঠেছে ।  কোটিপতি হয়ে ভাগ্নে পাটনা ছেড়ে চলে গেছে বিহারের বাইরে, লালু যাদবের স্যাঙাতদের কিডন্যাপগ্যাঙের ভয়ে । ভাগ্নি জয়ার ছেলে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের চ্যানেল চালায়, নিজেও ভালো গায় ।

            পিসেমশায় তিনকড়ি হালদার, ওনাকে নিয়ে আমার একটা গল্প আছে “অপ্রকাশিত ছোটোগল্প” বইতে, আহিরিটোলার বাড়ি শরিকরা বিল্ডারকে দিয়ে দেবার ফলে ওই বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন, পকেটে যে চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল তাতে লেখা, “আনন্দধারা বহিছে ভূবনে” । পিসেমশায়ের ছেলেদের ঠাকুমা একটা জমি দিয়েছিলেন হিন্দমোটরে, সেখানে ভাইয়েরা একটা করে ঘরে থাকে, আর আরেকটা ঘর রান্নার কাজে লাগে । সবচেয়ে বড়ো ভাই অজয় হালদার মানে সেন্টুদার বিয়ে দিয়েছিল দাদা দ্বারভাঙ্গার এক ঘি ব্যবসায়ীর মেয়ের সঙ্গে ; ঘি আর দিশি বিহারি মদ ঠররা খেয়ে ঘরজামাই সেন্টুদা সেখানেই মারা গেছে । পরের দিকে দাদার সঙ্গে কোনো কারণে সেন্টুদার বনিবনা ছিল না বলে পাটনায় এলে সেন্টুদা উঠতো দিদিদের বাড়ি । ছোটোবেলা আর যুববেলার কলকাতার বহু রাস্তার নাম পালটে গেছে, মামলার সময়ে ঘুরে বেড়াতুম সেই সব রাস্তায় ।

            নাগপুরে শশুরবাড়িও ভেঙে ফেলে তার মুসলমান মালিক, আমার মামাতো শালাদের মোটা টাকা দিয়ে, সেখানে হজ যাত্রীদের জন্য আশ্রয় তৈরি করছে, পাশেই নিজের জমিতে বিশাল মসজিদ তুলেছে যাতে এক সঙ্গে এক হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারে । আমার স্ত্রীর এক মুসলমান বন্ধু, প্রতিবেশি বাড়ির মেয়ে, হিন্দু যুবককে বিয়ে করে নাম পালটিয়ে মুম্বাইতে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে থাকে । যে শালির আমি পাটনায় বিয়ে দিয়েছিলুম, সে, তার স্বামী পরপর মারা যাবার দরুন তাদের লেক গার্ডেনসের বাড়ি ভেঙে ফেলে ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছে । 

    দুই

             আজকে, এখন, মুম্বাইতে এসে, আয়না দেখা ছেড়ে দিয়েছি, বাইরে বেরোলেও চুল আঁচড়াই না,  পায়জামায় পেছনদিকে ছেঁড়া থাকলেও তাই পরেই বেরোই, কেননা কেউই আমার পেছন দিকে তাকানো দরকার মনে করে না,  নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের গাড়ি পার্ক করার বেসমেন্টে অটোরিকশায় বসে টের পাচ্ছি যে স্মৃতি একেবারে ধুলোপড়া ত্যাবড়ানো,  স্ফটিক-স্বচ্ছ নয়, আমার, আমার আসেপাশের মানুষদের, অনেকের দেহে শ্মশানে জলভরা হাঁড়ি পড়ার শব্দসহ, বিজলি-চুল্লীতে চর্বি ফাটবার শব্দসহ, হুকবোতামের ছেদ-যতি-সেমিকোলনসহ, বয়স্ক-অল্পবয়স্ক ঘটনা নিজস্ব চরিত্র নিয়ে  উদয় হচ্ছে, আর যা ভুড়ভুড়ি কেটে ভেসে উঠছে, সেগুলোই, তড়িঘড়ি, উবে যাবার আগে, লিখে ফেলব, শাড়ির ভাঁজে পাট করে রাখা সুমিতা চক্রবর্তীর গ্রীষ্মশীত, রাতে ওনার বাগানের গাছেরা নিজেদের পরিচর্যা করতো, আমি ওনার সাম্যবাদী কিউবার লঝঝড় মোটরগাড়িতে, “আমি তোর অ্যামেচার বান্ধবী” ; তারপর যখন বুড়ি থুথ্থুড়ি, “কলকাতায় সবাই পার্টিকর্মী, দৃশ্য বা অদৃশ্য ঝাণ্ডা হাতে।” “শুধু কমিউনিস্টরাই বলতে পারবে কেন কমিউনিজম ফেল মারলো।” “মানববোমারা মরতেই থাকবে, এর আর শেষ নেই, দেখেনিস ।” “হিরোহিতোর সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করুন বা হিটলারের সঙ্গে, সুভাষচন্দ্র বোস আমার হিরো, আমার স্বপ্নের প্রেমিক ।” “লিখতে বসে সবচেয়ে আগে ভুলে যাবি তোর স্কুল-কলেজের ভাষা-শিক্ষকদের, নয়তো এগোতে পারবি না ।”  “বাঙালি মার্কসবাদীরা, যারা নিহিলিজমের বিরোধিতা করতো, তারাই পশ্চিমবঙ্গে নিহিলিজম ডেকে আনলো।” “অনুসরণকারীরা পিঠে ছোরা মারে কেন জানিস ? তারা তো পিছন থেকে অনুসরণ করে।” “ভিতুরা ভয়ার্ত কবিতার তত্ব বানায় আর সেই তত্বকে সমর্থন করে পরাজিতরা।” “আত্মহত্যার কোনো কারণ হয় না।” এখন একমাত্র রুটিন হল রাতে টয়লেটে পেচ্ছাপ করতে যাওয়া, প্রস্টেটের ঘড়িধরা চাপে ।

             নাড়ি তৈরির ম্যাজিক শুধু নারীই তো জানে। সেক্স করার সময়ে বার বার “আই হেট ইউ” বলার উপাদেয় রহস্য । আমি আগের জন্মে ঘুর্ণিঝড় ছিলুম পরের জন্মে গোরস্হান হবো ।   বহু ঘটনা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবে, যেতে দিতে হবে, পাশাপাশি গুরুত্বহীন ঘটনা হঠাৎই ঘা দিয়ে নিজেকে জাহির করবে , যাই হোক, সময়ের ধ্যাবড়া অনুক্রম জরুরি বলে মনে হয় না  । চাকুরিসূত্রে ভারতের এতো গ্রাম আর শহর ঘুরেছি যে হাতির পিঠে চেপে কোন গ্রামে গিয়েছিলুম, কোথায় উটের দুধ খেয়েছিলুম যেমন স্মৃতি থেকে ঝরে গেছে, তেমনই কোন নদীর পাশ দিয়ে মাথার ওপর ট্যুরের ক্যাঁদরা চাপিয়ে কোন গঞ্জে গিয়েছিলুম, মনে করতে পারি না, অথচ ঘটনাগুলো ঝাপসা হয়নি আজও ; অমন অজস্র টুকরো-টাকরা, বহুগ্রাম জলহীন বলে কেমন করে শিখে গিয়েছিলুম টয়লেট পেপারের রোল সঙ্গে রাখতে, আলের ওপরে বসে হাগতে, জল না খেয়ে বহুক্ষণ টিকে থাকতে । কে বলেছিল, “মাতৃভূমিতে শুধু গরিবরাই মরে?” মনে নেই । কে বলেছিল, “রাস্তার কুকুরদের কান নিয়ে জন্মেছিস?” মনে নেই । কে বলেছিল, “তুই বামপন্হী? শুনলেই সন্দেহ হয় তোর বাপ সোভিয়েত রুবল খেয়েছে !” মনে নেই । কে বলেছিল, “তোর ডানদিকে সিঁথে কাটা উচিত।” মনে নেই । কে বলেছিল “ঈশ্বরপ্রদত্ত বলে কিছু হয় না ?” মনে নেই । কে বলেছিল, “রাষ্ট্র চিরকাল লিবার্টি ইকুয়ালিটি ফ্র্যাটারনিটির বিরোধিতা করবে”, মনে নেই । কে বলেছিল, “লাথি না খেলে বিজ্ঞ হওয়া যায় না”, মনে নেই। কে বলেছিল, “ফাংশানাল লিঙ্গ না থাকলে জিনিয়াস হওয়া যায় না”, মনে নেই।       

              ১৯৬৪ সালে যখন পুলিশ কমিশনারের কাছে জানতে পারলুম যে আমার বিরুদ্ধে নালিশকারীদের তালিকায় সন্তোষকুমার ঘোষ আর আবু সয়ীদ আইয়ুব আছেন, শুনে বুঝতে পারলুম যে ছিপে ঠিক-ঠিক বঁড়শিই বেঁধেছি ।  ১৯৬২ সালে কলেজ স্ট্রিটে একটা মিছিলে উৎপল দত্তের হাতে হাংরি বুলেটিন দিতেই উনি আঁৎকে বলে উঠলেন, “হাংগরি জিন্নাড়িশন”, লিফলেটটা দুমড়ে ফেলে দিলেন রাস্তায়, দেখে, অন্য একজন মিছিলকারী সেটা তুলে পড়তে আরম্ভ করলে, চেয়ে নিয়ে বললুম, আপনার জন্যে নয় ।     ১৯৬৩ সালে গল্পকার শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাওড়ার বাড়িতে গিয়েছিলুম । বললেন, “ওহে, একেবারে তোলপাড় করে ফেলেছ যে, ক্ষমতাবানদের চটিয়ে দিচ্ছ, তারা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে, জানো কি ?” বলেছিলুম, যা করার তা তো করে যেতে হবে, ডিরোজিও তো যা করার তাই করে গেছেন। জানি না কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকরা কেন শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেপে দিলে । উদয়ন ঘোষ, শান্তি লাহিড়ির মতন ওনারও দুর্বলতা ছিল সন্দীপন, শক্তি, সুনীলের সঙ্গে চিপকে থেকে  আনন্দ পাবার ।

              ১৯৭১ সালে শঙ্খ ঘোষ একটা  প্রবন্ধ লিখেছিলেন, “শব্দ আর সত্য” শিরোনামে, ১৯৭১ সালে, রিমেম্বার ১৯৭১ সালে । কী লিখেছেন শুরুতেই তাঁর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক গদ্যে ? লিখেছেন, রিমেম্বার ১৯৭১ সালে, যে, “কবিতা লেখার অপরাধে এই শহরের কয়েকজন যুবককে যে একদিন হাজতবাস করতে হয়েছিল, এটা আজ ইতিহাসের বিষয়।”  ২৮ ডিসেম্বর ১৯৬৫ সালে আমার এক মাসের কারাদণ্ডের আদেশ হয়ে গিয়েছিল তা উনি ১৯৭১ সালে জানতেন না ! পঁয়ত্রিশ মাস ধরে আদালতের চক্কর কাটতে হয়েছিল, তা উনি ১৯৭১ সালে জানতেন না, জানতেন কেবল একদিনের হাজতবাস । কী বলব ? হাংরি আন্দোলনের যাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন, আবু সয়ীদ আইয়ুবের পর শঙ্খ ঘোষ, আর বাহুল্য বলা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম করতে হয় । শঙ্খবাবু  শৈলেশ্বর ঘোষকে টেনে নিয়ে গেছেন প্রতিষ্ঠানের কয়েদখানা বাংলা অ্যাকাডেমিতে । শঙ্খবাবুর সঙ্গে আমার একবারই দেখা হয়েছে, ওই বাংলা অ্যাকাডেমিতেই, হ্যাণ্ডশেকের জন্যে হাত এগিয়ে দিয়ে বলেছিলুম, আমার নাম মলয় রায়চৌধুরী, শুনে, নিজের কানে মনে হল যেন বলছি, আমি মিশরের ফ্যারাও দ্বিতীয় র‌্যামাসেজ । আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমেরিকায় বসে ভাবছিলেন মলয়টা কলকাতার সবকিছু লুটেপুটে খেয়ে ফেললো আর আমেরিকা থেকে ফিরে ‘আত্মপ্রকাশ’ নামে একটা তড়িঘড়ি উপন্যাস লিখেছিলেন সাগরময় ঘোষের হুকুমে যাতে ভয়ের চোটে লেখেননি যে বেশ্যালয়ে গিয়ে কী করতেন আমি কিন্তু উকিলের জানলা দিয়ে দেখেছি ষাটের দশকে পুরো কৃত্তিবাসের দল ঢুকছে অবিনাশ কবিরাজ লেনে, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় শকুনের কাঁধ উঁচু করে ।

              ১৯৭২ সালে, চেন্নাইয়ের গিণ্ডিতে একটা জ্যান্ত কেউটে সাপকে আমার হাতে জড়াতে দিয়েছিল পার্ক কর্তৃপক্ষ, ওঃ কি ঠাণ্ডা, নিজের সম্পর্কে ইপিফ্যানির গর্ব হয়েছিল । তারপর একটা পাইথনকে গলায় ফেলে দিল উত্তরীয়ের মতন করে, কী যে আনন্দ হয়েছিল, এই হল আমার সম্বর্ধনার সত্যিকারের উত্তরীয় । আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বলেছিল, ব্রাহ্মণ হয়ে জ্যান্ত সাপে হাত দিলেন, দেখুন বংশরক্ষা হয় কিনা । কী করেই বা কারাগারে আটক সাপদুটোর বংশরক্ষা হবে, বললুম তাকে, ছোবল দিয়ে ।    ১৯৭৫ সালে ফালগুনী রায়ের সঙ্গে শেষবার দেখা । পাটনায় অফিসে এসেছিল, তখন আমার লেখালিখি আঙুল ছেড়ে উধাও, বলল, সবাই আলাদা হয়ে গেছে, ও এখন দীপক মজুমদারের সঙ্গে, মাদক আর সোনাগাছি নিয়ে ভালোই আছে । হাংরি আন্দোলনের সময়ে প্রায়ই পাটনায় আসত ফালগুনী, ওর জামাইবাবু ছিলেন আমার ইকোনমিক্সের অধ্যাপক, অত্যধিক মোটা আর বেঁটে, রিকশায় চাপার আগে নাড়িয়ে দেখে চাপতেন, তা দেখে হাসতুম বলে চটা ছিলেন আমার ওপর, ফালগুনীর দিদি এসে আমার মাকে বলে গিয়েছিলেন যে, আমি ফালগুনীকে কুপথে নিয়ে গিয়ে নষ্ট করে দিয়েছি । ফালগুনীর প্রেমিকার বিয়ে হয়েছিল পাটনায়, ওর জামাইবাবুর বাড়ির কাছেই প্রেমিকা থাকতো লোহানিপুর পাড়ায় । আমরা দুজনে পাটনার গুলফি ঘাটে গিয়ে কিংবা গোলঘরের ওপরে বসে সরকারি দোকান থেকে কেনা গাঁজা-চরস ফুঁকতুম, মহেন্দ্রুঘাটে বসে ঠররা খেতুম । ফালগুনীর মৃত্যুর খবর পেয়েছিলুম লখনউ থাকতে ।

              ১৯৮৯ সালে মেয়ে অনুশ্রীর গোদরেজ টাইপরাইটার খারাপ হয়ে যেতে অনেক খুঁজেপেতে একজন মেকানিকের বাড়ির ঠিকানা পেয়েছিলুম । তখন থাকতুম সান্টাক্রুজে আর মেকানিক থাকতেন জুহুর গোয়ানিজ কলোনিতে । এখন অবশ্য সেই সান্টাক্রুজ-জুহু আর নেই, ধনীদের বিশাল অট্টালিকা আকাশে উঠে গেছে সর্বত্র। মেকানিকমশায়  যেদিন সারিয়ে দেবেন বলেছিলেন, সেই দিন আমি টাইপরাইটারটা নেবার জন্যে ওনার কুঁড়েঘরে গিয়ে অপেক্ষা করছিলুম, ওনার বুড়িবউ বললেন, এক্ষুনি এসে যাবে । আমার মুখ দাড়ি-গোঁফে ঢাকা, নাম এম আর চৌধারী । গাউনপরা বিশালবপু বুড়ি চুপচাপ বসেছিলেন । সামনের বাড়িতে গিটার বাজিয়ে হইচই গান গাইছিল যুবক-যুবতীরা । গোয়ানিজ বুড়ি হঠাৎ বলে উঠলেন, “এই প্রটেস্ট্যান্টগুলো আর হিন্দুগুলো, অত্যন্ত নোংরা আর ডিসিপ্লিনহীন, তাই তো দেশটার এমন অবস্হা, যখন ব্রিটিশরা ইনডিয়ায় ছিল আর পোর্তুগিজরা গোয়ায় ছিল তখন এদের এরকম দৌরাত্ম্য ছিল না ।” নিজেকে ফাঁস করলে বুড়ি মুষড়ে পড়বে ভেবে মুখ বুজে রইলুম ।     ২০০০ সালে কাণ্ডিভিলি মুম্বাইতে হার্ট অ্যাটাকের পর প্রতিদিন সকালে জগার্স পার্কে হাঁটতেযেতুম, সেখানে লাফটার ক্লাবের বুড়ো সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় হল । সকলের মতন আমিও ওয়ান টু থ্রি হলেই ওপরে দুহাত তুলে জোরে-জোরে অকারণে হাসতুম, এছাড়া আর বুড়ো বয়সে হাসির সুযোগ নেই । একজন গুজরাটি আমার সঙ্গেই ফিরতেন, কী করেন জিগ্যেস করতে বলেছিলুম অবসর নিয়েছি, যা পেনশন পাই তাতেই চালাই। উনি কী করেন জিগ্যেস করতে বললেন যে, “সকালে-বিকেলে ক্লায়েন্টদের কুকুর হাগাতে নিয়ে যাই আর রাতের বেলায় মদ খেয়ে কবিতা লিখি, মাসে পঞ্চাশ হাজার হয়ে যায়।”

             —কুকুর হাগাতে ?

             —হ্যাঁ, কারোর তো সময় নেই, সবাই এ-শহরে টাকার ধান্দায় ছুটছে ।

             —আপনি তাদের কুকুরগুলোকে  সকাল-বিকেল হাগাতে নিয়ে যান ?

             —হ্যাঁ, সকাল পাঁচটা থেকে শুরু করি । কোন কুকুর কখন হাগতে প্রেফার করে প্রথম কয়েক দিনেই জেনে যাই, ক্লায়েন্টরাও আইডিয়া দেন ওদের হাগবার-মোতার সময়ের ।

             —কিরকম চার্জ করেন ?

             —কুকুরের ব্রিডের ওপর নির্ভর করে । রটউইলার হলে হাজার পাঁচেক প্রোপোজ করি, তারপর তিন হাজারে সেটল করি । অন্য ব্রিডের হলে কম নিই । তবে আমি নিজেকে ডগ ট্রেনার বলি, কুকুরগুলোকে আধঘণ্টা খেলাতেও হয় ।

            —একদিন আপনার কবিতা শুনব ।

            —আসবেন, ড্রিংক করেন তো ?

            —না, আপাতত বন্ধ, হার্ট অ্যাটাক থেকে সবে উঠেছি ; হার্ট অ্যাটাকের সময়েও হাগা পায়, বীর্য বেরিয়ে আসে । আত্মহত্যাকারীদের যেমন হয়, গু আর বীর্য বেরিয়ে আসে । আত্মহত্যাকারিনীদের কি কিছু বেরিয়ে আসে ?

             কুকুর হাগানোর সঙ্গে কবিতার যোগাযোগ আছে জেনে বেশ ভাল্লাগলো । কবিদের রেটও ব্রিড অনুযায়ী।

    তিন

              ২০০৭ সালে আমস্টারডমের ডি ওয়ালেন খালপাড়ে গাইড মিস মারিসকা মাজুরের সঙ্গে আমরা একদল বিদেশী পর্যটক বেশ্যালয় দেখতে বেরিয়েছিলুম । মারিসকা এককালে নিজেও যৌনকর্মী ছিলেন । রেড লাইট শব্দটা এই বেশ্যালয় থেকেই ছড়িয়েছে । নেপোলিয়ানের আইনি অনুমতিপ্রাপ্ত বেশ্যালয়, মানুষের চেয়েও বড়ো কাচের শোকেসে লাল আলো জ্বেলে অপেক্ষা করছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসে জড়ো হওয়া যৌনকর্মীরা, রেট, সময় এবং পদ্ধতি বাঁধা ; তার বাইরে কিছু করতে চাইলে দরাদরি করতে হবে । প্রতিটি ঘরে লাল আলো । যে ঘরে নীল রঙের আলো সেঘরে অপেক্ষা করছে পুরুষ যৌনকর্মী । খালপাড়ে নানা রকমের যৌনকর্মের আর যৌনবস্তুর দোকান, ঘুরে-ঘুরে দেখলুম । চাবুক, চেস্টিটি বেল্ট, লিঙ্গের আকারের সিটঅলা সাইকেল, পর্নোগ্রাফির বই আর ফিল্ম, গাঁজা ফোঁকার দোকান, আবসাঁথ খাবার রেস্তরাঁ ইত্যাদি । দেখতে-দেখতে এগোচ্ছিলুম । হঠাৎ একজন মধ্যবয়সী হোঁচোট খেয়ে পড়ল আমাদের সামনে, ওপরে মুখ তুলে চলার ফল । মারিসকা মাজুর তাকে দুহাত ধরে টেনে তুলে দেখালেন রাস্তার ওপর ব্রোঞ্জের একটা ভাস্কর্য, অজস্র মানুষের চলার দরুণ চকচকে হয়ে গেছে । ভাস্কর্যটা হলো একজন পুরুষের ডান হাত একটি যুবতীর বাঁদিকের মাই টিপছে, ব্যাস ওইটুকুই, হাত আর একটা মাই । মারিসকা বললেন, আগে এই ভাস্করের নাম জানা যায়নি, এখন জানা গেছে ওনার নাম রব হজসন, লুকিয়ে ভোররাতে পুঁতে দিয়ে গেছেন।           

            ১৯৬১ সালে একবার খালাসিটোলায় পাশের লোকটা হাতে গেলাস নিয়ে কাঁদছিল দেখে আমারও কান্না পেয়ে গিয়েছিল ; পিসেমশায় খালাসিটোলায় গেলে নির্ঘাৎ কাঁদতেন, মা ওগো মা, বলে বলে কাঁদতেন; তারপর যেতেন সোনাগাছি । আমিও কেঁদে নিয়েছিলুম, পিসতুতো দাদা সেন্টুদার সঙ্গে অবিনাশ কবিরাজ লেনে  গিয়েছিলুম; সেন্টুদা বলেছিল, এখানেও স্কুল ফাইনাল, বিএ, এমএ করতে-করতে এগোতে হয়, সব শিখিয়ে দেবো তোকে, নিরোধ জানিস তো নিরোধ, সঙ্গে নিয়ে আসবি, ঠোঁটে চুমু খাবি না, ওখানে চাটবি না, দিনে-দিনে আসবি, দিনে-দিনে চলে যাবি, কেউ দেখতে পাবে না, রেটও দুপুর বেলায় হাফ, তখন কেউ শ্যাম্পু করা চুল আঁচড়ায়, কেউ পায়ের নখে নেলপেলিশ লাগায়, কেউ বারান্দায় বসে হাই তোলে, দিল খুশ হয়ে যাবে, ইচ্ছে করলে তুই পায়ে নেলপালিশ লাগিয়ে দিতে পারবি, চুল আঁচড়ে দিতে পারবি, এমনকি সেক্স করার আগে যদি গিল্টি ফিল করিস তাহলে সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিতে পারবি, কালবৈশাখির ঝড় উঠলে আহিরিটোলা ঘাটে নেমে দুজনে চান করার ভান করতে পারবি ।     ১৯৬৪ সালে যখন হাংরি মামলায় গ্রেপ্তার হলুম তখন বড়োজেঠিমা বলেছিলেন, যারা পরীর গপপো জানে, যারা দত্যিদানোর গপপো জানে, যারা পুরাণের ভগবানদের গপপো জানে, তাদের কাছে নোংরা বই,  নোংরা গপপো বলে কিছু হয় না, কোনো বইকেই অচ্ছেদ্দা করা উচিত নয়, পুরাণের গপপো পড়লেই জানা যায় আমরা কোনো একজনের মতন ওই সব গপপোতে লুকিয়ে আছি, আমরা কি মহাভারতের গল্পতে নেই ? আছি, আছি রে আছি ।

              ১৯৬৩ সালে অ্যালেন গিন্সবার্গ যখন পাটনায় আমাদের বাড়িতে ছিল, একটা শতচ্ছিন্ন বই পড়তে দিয়েছিল, ওর পড়া হয়ে গিয়েছিল বইটা, “জার্নি টু দি এন্ড অফ দি নাইট”, লুই ফার্দিনাঁ সেলিন-এর লেখা, কালো রঙের মলাট, দারুন উপন্যাস। পরে সেলিন সম্পর্কে খোঁজখবর করে জানতে পেরেছিলুম যে লোকটা ঘোর ইহুদি-বিদ্বেষী ছিল আর ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্যামফ্লেট ছাপিয়ে গালমন্দ করতো । গিন্সবার্গের বাবা-মাও ইহুদি, তবু, উপন্যাসটা অসাধারণ বলে, গিন্সবার্গের মনে হয়েছিল, আমার পড়া উচিত । বইটা সুভাষ ঘোষকে পড়তে দিয়েছিলুম তারপর কী হলো কে জানে, ওরা মুচলেকা লিখে, দলবেঁধে ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার্ত খবর, ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ থেকে আমায় ভেন্ন করে দিলে, কেন কে জানে ! । দলটার ত্রিদিব মিত্র নাম দিয়েছিল “মুচলেকাপন্হী”, ত্রিদিব আর আলো মিত্রকেও বাদ দিয়েছিল রাজসাক্ষীরা । আমিও ১৯৬৭ সালে কেস জিতে ছেড়ে দিলুম ওদের ‘গরিব-হওয়া-ভালো’ সঙ্গ । এই হওয়া, হয়ে-ওঠা যে কি জিনিস তা আজও বুঝুনি ।     ১৯৬৬ সালে বাসুদেব দাশগুপ্তকে দিয়েছিলুম লেনি ব্রুসের লেখা “হাউ টু টক ডার্টি অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল” বইটা । ১৯৬৮ সালে, যখন আমি লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছি, কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের পত্রিকা “গল্পকবিতায়” বাসুদেব দাশগুপ্ত লিখেছিল “লেনি ব্রুস ও গোপাল ভাঁড়কে” । বাসুদেবের লেখাটা আমার পড়া হয়নি । কোনো কিছুই আর পড়তে ভালো লাগে না ।        

                ১৯৯৪ সালে প্রথম উপন্যাস লিখলুম, “হাওয়া৪৯” পত্রিকার জন্যে, “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস”, পাটনাইয়া বন্ধুদের নিয়ে । আমি প্রুফ দেখতে একেবারেই পারি না । দাদা কৃষ্ণগোপাল মল্লিককে বললেন প্রুফ দেখে দিতে । কৃষ্ণগোপাল ডেকে পাঠালেন ওনার বাড়িতে, বললেন, “টাকার ব্যাগটা অতনু রেখেছিল আলমারির ওপরে, বাড়ি ছেড়ে যখন চলে যাচ্ছে, তখন ব্যাগটা খাটের তলায় গেল কি করে ?” বার-বার চোখ চলে যাচ্ছিল মেঝেয়, ওনার পড়াশুনার টেবিলের পাশে মাকে চেন দিয়ে বেঁধে রেখেছেন, তিনি মাটিতে বিছানায় শুয়ে, চেন বাঁধা । বললেন, “প্রথম এসেছো তো, তাই অবাক হয়ে গেছো, আমার মায়ের খাই-খাই ব্যারাম, তাই বেঁধে রাখতে হয়ে।” শুনে, গায়ের লোম বেয়ে শিরশিরে হাওয়া বয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমহার্স্ট স্ট্রিটে এসে আচমকা ফুঁপিয়ে উঠলুম ।  

            ওই সময় নাগাদই এডওয়ার্ড সাইদ এসেছিলেন কলকাতায়, নেতাজি ভবনে, সৌগত বসুর ডাকে, বক্তৃতা দিতে । বক্তৃতা দিতে-দিতে সাইদ বার বার প্রতিষ্ঠানবিরিধিতার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করছিলেন । আমি বসে ছিলুম পেছনের সারিতে কেননা সামনের সারি ছিল কলকেতিয়া কেঁদোদের জন্য । আমন্ত্রিতরা, বলা বাহুল্য, সবাই ছিল কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার চাঁই । প্রশ্নোত্তরের সুযোগ আসতেই আমি বললুম যে, “স্যার, আপনি এতোক্ষণ প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা বলছিলেন, অথচ এখানে তো সামনের সারিগুলোয় বসে আছেন পশ্চিমবাংলার তথা ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক কর্তারা ।” সৌগত বসু, আশা করেননি যে এরকম একটা প্রশ্ন কেউ ছুঁড়ে দিতে পারে । উনি তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন যে, “এই কনট্রোভার্সি ডিসকাস করার মতো আমাদের হাতে সময় নেই, পরের বার উনি আসলে আমরা বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করব ।”   

    চার

            ১৯৮৮ সালে যখন নাকতলার ফ্ল্যাটটা কিনলুম, মাত্র দু লাখ টাকায়, তখন ওই মাপের ফ্ল্যাট মুম্বাইতে কম করে হলেও পঁচিশ লাখ, তাই লোকে যেভাবে আলুপটল কেনে, কিনে নিলুম, সাত পাঁচ না ভেবে । আসলে একটুকরো পশ্চিমবঙ্গ কিনেছিলুম, চারিদিক খোলা, অথচ কোনো বাড়ি থেকে কেউই দেখতে পাবে না যে আমি অনেক সময়ে ল্যাংটো হয়ে থাকি, সলিলা চেঁচামেচি করলেও ল্যাংটো থাকতে ভাল্লাগে । বাড়ির পেছনে পলাশের জঙ্গল, গাছে-গাছে কতো রকমের পাখি যাদের অধিকাংশকে চিনি না, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার পক্ষী সংখ্যার সঙ্গে মিলিয়ে দেখি পাখিগুলোর নাম কী হতে পারে, পেছনে বিশাল পুকুর, পুকুরে মাছেরা চাঁদের আলোয় ঘাই মারে, দিনের বেলায় পানকৌড়িরা মাছ খেতে নামে, উড়ে গিয়ে নারকেল গাছে জাপানি পাখার মতন ডানা ছড়িয়ে শোকায়, অনেক সময়ে পলাশের বনে শেয়াল আসে, শেয়ালের ডাক শোনা যায় রাতে, প্রচুর বেঁজি, বাড়ির সিঁড়িতে সাপ লুকিয়ে থাকে, মশারির ওপর ফ্যানের ব্লেডে লেগে জোনাকিরা ঝরে পড়ে, দূরে দেখা যায় কালবৈশাখীর মেঘ এদিকেই আসছে । হায়, সব ক্রমশ উধাও হয়ে গেল, পলাশগাছগুলো কেটে ফেলা হল, পুকুর হয়ে গেল জঞ্জাল ফেলার ডোবা, তার পাশে বাঁশের আড়ত, মেট্রো রেল এলো, বাড়ির পর বাড়ির পর দেশলাই-বাড়ি, তারপর পশ্চিমবঙ্গের পাড়া-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হলো একটু-একটু করে, বাড়ির সামনেই, প্রথম দিনেই, কচ্ছপ কেটে বেআইনি মাংস বিক্রি, কেনার জন্য কী ভিড় আর ঠেলাঠেলি, তারপর কমরেডরা এলেন পুজোর চাঁদা চাইতে, তাদের মনের মতন না হওয়ায়, একজন হুমকি দিয়ে গেল দুর্গাপুজো-কালীপুজোয় এই বাড়ির ছাদে চারটে লাউডস্পিকার লাগানো হবে ।

             মেজমাসির সঙ্গে নিমতায় দেখা করতে গেলে বলেছিলেন, “ওখানে ফ্ল্যাট কিনেছিস ? আনওয়ার শা থেকে গড়িয়া পর্যন্ত তো রিফিউজিদের  জঞ্জাল-পাবলিকে ঠাশা !” মেজমাসি রিফিউজিদের ওপর চটা ছিলেন কেননা তারা ওনার পুকুর থেকে মাঝরাতে মাছ ধরে নিয়ে চলে যেতো, সুপুরিগাছ থেকে সুপুরি আর নারকেল গাছ থেকে নারকেল পেড়ে নিয়ে যেতো । মেজমাসি মারা গেছেন ; ওনাদের জমিজিরেত পুকুর আর নেই নিমতায় ; ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে ।   ২০০০ সালে পাঁচ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট বেচে দিলুম, পঞ্চাশ বছরের পুরোনো ফ্ল্যাট। বেচে, ১৯৮৮ সালে করা নিজের বোকামি থেকে মুক্ত হওয়া গেল । বেচার দু বছর পর গিয়েছিলুম ওই পাড়ায়, দেখলুম আর শুনলুম পাড়ার ছেলেরা ক্রেতার সঙ্গে আপোষ করতে না-পেরে বারান্দার কাচে ঢিল মেরে-মেরে ভেঙে দিয়েছে, যিনি কিনেছেন তিনি কাগজ সেঁটে রোদবৃষ্টি থামাচ্ছেন । ক্রেতা ‘সিপিএম করতেন’ ; হয়তো পালটি খেয়ে ঘাসফুলে যাননি ।

            নাকতলায় অতিতরুণ কবি সুশান্ত দাশ আর কমরেড-কবি গৌতম নিয়োগী ১৯৯৫ সালে আমাকে ওদের পাড়ায় আবিষ্কার করে অবাক, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে মেলাতে পারছিল না আমাকে, ভেবেছিল শতচ্ছিন্ন পোশাকে একজন টিংটিঙে ভবঘুরেকে দেখবে, নাকে শিকনি চোখে পিচুটি, চামড়ায় চামউকুন, চুলে মৌমাছির চাক, দেখবে বাড়ি একেবারে আঁস্তাকুড়, কাকেরা শকড়ি খুঁটে খাচ্ছে । অফিসের বদান্যতায় কেনা সিনথেটিক কার্পেট, সোফা, টিভি ইত্যাদি দেখে আরও ঘাবড়ে গিয়ে থাকবে, রাজা সরকার আর অলোক গোস্বামীর মতন । তারপর যখন অফিস-প্রধানের কাজ করতে আরম্ভ করলুম, তখন অফিসের গাড়ি নিতে আসতো আর ফিরতুম তাতে । তবে গৌতম-সুশান্তর সঙ্গে পরিচয়ের পর পাড়ার লোকে আমাকে সিঁড়ির ওপরের পাদানিতে চাপিয়ে দিয়েছিল । সুশান্তর মা ছিলেন সিপিএম সমর্থক, দেয়ালে “গণশক্তি” সাঁটা হতো প্রতিদিন । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গদিতে বসার পর বললেন, সিপিএম তো আমাদের জন্য কিছুই করল না, সেই দেশভাগের সময়ের দুবেলা দুমুঠোর দারিদ্র্যেই পড়ে আছি। ভাতের হোটেল খুলে সংসার চালাতেন, আমরাও আনিয়ে খেতুম মাঝে-সাজে, রান্নার হাত খুবই ভালো।

             পশ্চিমবাংলার টেকটনিক প্লেটে যখন ধ্বস নামছিল, তখনই মুম্বাই চলে এলুম, শীতের পোশাক, বইপত্র আর আসবাব বিলিয়ে দিয়ে, গাড়িটা বেচে দিয়ে । বেচে,  গাড়িকেনার বোকামি থেকে ছাড়ান পেলুম। বইপত্র নিতে কোনো লোকাল গ্রন্হাগার রাজি হল না, শেষে সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য ওর অ্যামবাসাডর গাড়ির ডিকিতে ভরে-ভরে কয়েক খেপে নিয়ে গিয়েছিল । তারপর মা-মাটি-মানুষ করতে গিয়ে সিনডিকেটের হাতে এমন প্যাঁদানি খেয়েছিল সপ্তর্ষি যে ভেলোরে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল; কিন্তু ভেলোরের প্রভাবে এখন যিশুখ্রিস্টের গুণগান করে বেড়ায়, কেউ-কেউ বলে খ্রিস্টান হয়ে গেছে । সিনডিকেটের লোকেরা আমার দেয়া বইগুলোও অন্য বইপত্রের সঙ্গে ছিঁড়েখুড়ে নষ্ট করে দিয়েছিল । নাকতলা, শ্রীপল্লী, যাদবপুরের যে লাইব্রেরিগুলোয় বই দিতে চেয়েছিলুম, তারা টিটকিরি মেরে বলেছিল, হেঁঃ হেঁঃ, কবিতার বই, এসব কে পড়ে মশায়, আপনি একটা র‌্যাক দান করলেও ওসব বই রাখার জায়গা আমাদের নেই । নবারুণ ভট্টাচার্য তাই বলেছিলেন এই চুতিয়াদের ‘দেশ’ আমার নয়, উনি বোধহয় স্তালিনের সোভিয়েত রাষ্ট্রকে নিজের দেশ মনে করতেন ।

              শীতের পোশাক, ডবল-ব্রেস্ট স্যুট, সিঙ্গল-ব্রেস্ট স্যুট, থ্রিপিস স্যুট, টেরিউলের প্যাণ্ট, উলের সোয়েটারগুলো, ফুলশার্ট, সবই দিয়ে দিলুম পাড়ার বিহারি ধোপাকে । বললে, উঁচু জাতের লোকেরা এগুলো আমাদের গাঁয়ে পরতে দেবে না, ওদের মধ্যে যারা একটু গরিব তাদেরই বেচবো এগুলো । বেচে আমাদের পরার মতন সোয়েটার-চাদর কিনে মা আর বউকে দিয়ে আসবো । দোকান বন্ধ করে চলে গিয়েছিল পনেরো দিনের জন্যে, পাড়ার অনেকের জামা-কাপড় প্রেস করার জন্যে বাসায় রেখে কেটে পড়েছিল

              নিচেতলার ফ্ল্যাটমালিক ফণীবাবুর কাছে গ্যারেজ ভাড়া নিয়ে গাড়িটা রাখতুম ; একদিন গ্যারাজ খুলে দেখি গাড়ি থই-থই-গুয়ে ভাসছে ; নিচেতলার ভাড়াটেরা স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলে-ফেলে গু বেরোবার পথ বন্ধ করে দিয়েছে । কর্পোরেশান বললে পার্টি অফিসে যান, কর্মিদের সেখানেই পাবেন । পার্টি অফিস যিনি সামলাচ্ছিলেন তিনি বললেন, বাড়ির ভেতরের কোনো কাজের দায়িত্ব আমাদের নয়, ধাঙড়দের দিয়ে পরিষ্কার করান, বাঁশদ্রোণী বাজারে ভোরবেলা যে ধাঙড়রা কাজ পাবার জন্যে বসে থাকে তারা বলল, ও কাজ আমাদের নয়, মেথরদের কাজ, গাঙ্গুলিবাগানে মেথর কলোনিতে গেলুম, বাসিন্দারা বলল, ওরা শুধু ম্যানহোলের কাজ করে, গুয়ের কাজ করে না । অগত্যা ডাণ্ডালাগানো দুটো সুইপার কিনে, আমি খালি গায়ে গামছা পরে, সলিলা ব্লাউজ-শায়া পরে, গুয়ের পাঁক ঠেলে-ঠেলে, তিনতলা থেকে জলের পাইপ নামিয়ে গুয়ের ইঞ্চি দুয়েক হলুদ-সবুজ-কালচে চাদরকে পথে বের করে নর্দমায় ঢোকালুম । শিবুর চায়ের দোকানে তখন বামপন্হী দর্শকের পাল, শিবু অবশ্য হাওয়া বুঝে তৃণমূলে চলে গিয়েছিল । নর্দমার মুখটা গ্যারেজের কোনেই ছিল বলে রাস্তা নোংরা করতে হয়নি । মানুষের গু ধোবার ধান্দায় সেদিন দুপুরে তো রান্না হয়নি, পার্ক স্ট্রিটে মোক্যামবোতে লাঞ্চ আর হুইস্কি খেতে গেলুম। জানি না আর কোনও সাহিত্যিকের দু-ইঞ্চি পুরু গু ধোবার অভিজ্ঞতা আছে কিনা । সেই যে হয়ে-ওঠা, এটা বোধ হয় মহাপুরুষ আর মহানারী  হয়ে ওঠায় উত্তরণ ।

              নাকতলার লেটারবক্স পাড়ার আরেকটা ঝামেলা ছিল যখন-তখন মোহোল্লা কমিটির এক কমরেড ক্লাবের মাঠে তাঁবু খাটিয়ে, ভিয়েন বসিয়ে, লাউডস্পিকার লাগিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অনুকুল ঠাকুরের শিষ্যদের দিয়ে বিটকেল বেসুরো গান গাওয়াতেন, খাবার জন্যে কি-ভিড় কি-ভিড়, তারপর মাঠময় স্টায়রোফোমের এঁটো থালা । এই গডম্যান জিনিসটা কিছুতেই বুঝতে পারি না ; যতোগুলো গডম্যানের কথা শুনি সকলেই তো পিঁজরেপোলের মালিক । বিজেপি এসে গডম্যানদের আর দ্যাখে কে ! মাঠের মাঝখানে একসময় পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের লেটারবক্স ছিল বলে পাড়াটার নাম লেটারবক্স, কোনো এক সময়ে মাঠের একপাশে কেবল আমাদের বিল্ডিঙটাই ছিল ।    হাংরি আন্দোলনের সুবো আচার্য গডম্যানের ওই প্রাতিষ্ঠানিক পিঁজরেপোলে ঢুকে চোপোররাত্তির অনুকুল ঠাকুরের গুণগান করে বেড়ায় । সুবোর বাড়ি বিষ্ণুপুরে গিয়েছিলুম আমি সুবিমল আর ত্রিদিব, তখন ও ত্রিপুরার গোপন ডেরা থেকে ফিরেছে, কেননা আমার বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়ে গেছে, সে ছিল এক ভিন্ন সুবো আচার্য, বিষ্ণুপুরে ঘোরাঘুরি করে ধানখেতের ভেতর দিয়ে ল্যাংটোপোঁদে চারজনে একটা নদী পার হয়েছিলুম মাথায় পোশাক চাপিয়ে, গাছতলায় ল্যাংটোপোঁদে চারজনে গাঁজা টেনেছিলুম । এখন সুবো অনিশ্চয়তাকে এতো ভয় পায় যে কথায় কথায় গুরুদেব গুরুদেব ভজন গায় অথচ আগে ওর গুরুদেব ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । “সুনীল বলেছে মলয় লিখতে জানে না”, সেকথা জানিয়েছিল আমাকে।  প্রদীপ চৌধুরী বলেছিল, ওটা সুবো আচার্যের ডিএনএতে রয়ে গেছে, গুরু, মন্ত্র, মনুসংহিতা, রক্ষণশীলতা ইত্যাদি, বংশানুক্রম অবদান ।

    পাঁচ

                    নাকতলায় একদিন টেলিফোন পেলুম, “মলয়, আমি উদয়ন বলছি, উদয়ন ঘোষ, আপনাদের পাড়ায় এসে গেছি, রিকশঅলাকে বলবেন ট্রান্সফরমার স্ট্যাণ্ড” । ২০০১ সালে আমার ছোটোগল্প নিয়ে একটা প্রবন্ধে উদয়ন  লিখেছিলেন, “যত দিন যাচ্ছে, মলয়ের লেখা যত পড়ছি, ততই মনে হচ্ছে, তাঁকে নিয়ে মহাভারত লেখা যায়।” তখনও পর্যন্ত ওনার সঙ্গে আমার সামনাসামনি দেখা হয়নি । ভাবলুম, যাক, কেদার ভাদুড়ির মতন আরেকজনকে পাড়ায় পাওয়া গেল মোদো-আড্ডা দেবার জন্য । একটা পিটার স্কটের বোতল কিনে হাজির হলুম, দেখি উদয়ন শয্যাশায়ী, মন খারাপ হয়ে গেল । আমায় দেখে বিছানা থেকে ধড়মড় করে উঠতে যাচ্ছিলেন, বারন করলেন ওনার স্ত্রী । হাঁপানিতে ধরেছে, লিখতে পারছেন না বলে ডিপ্রেশান, নানা রকম যন্ত্রপাতি ওনার বিছানা ঘিরে। আড্ডা হল কিছুক্ষণ, আমি যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে বই ছাপাবার টাকা দিয়েছিলুম, উনিও দিয়েছিলেন, আমাদের দুজনের একই অভিজ্ঞতা । মাঝে-মাঝে যেতুম, উনি শয্যাশায়ী । ওনার আর শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আর শান্তি লাহিড়ীর একই অবস্হা, পঞ্চাশ দশকের তিনতিকুড়ি কবি-লেখকদের সঙ্গে চিপকে থেকে গর্ব বোধ করার দরুন নিজের লেখার সময় দুমড়ে ছোটো করে ফেলতে হয়েছিল । একদিন উদয়নের মেয়ের টেলিফোন পেলুম যে মারা গেছেন ।

              ২০১৪ সালে যখন “নখদন্ত” বইটার নতুন সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন কাকে দিয়ে করানো হবে জানতে চাইলেন গুরুচণ্ডালীর কর্ণধার ঈপ্সিতা পাল, আমি বলেছিলুম, বইমেলায় যারা জিনিসপত্র ফিরি করে বেড়ায়, তাদের কাউকে দিয়ে । তেমনই একজনকে দিয়ে করিয়েছিলেন উনি । কলকাতায় থাকতে তরুণ কবিদের দেখেছি আগের দশকের কোনো টাকমাথা বা চুলে কলপদেয়া কাঁধে-চাদর কবি বা লেখককে দিয়ে “মোড়ক উন্মোচন”এর অনুষ্ঠান করিয়ে গদগদ হন, যেন ফুলশয্যায় কনডোমের প্যাকেট খোলাচ্ছে । আমার মনে হতো এইসব তরুণ কবি সারাটা জীবন অন্যের চিন্তাজগতে বসবাস করে কাটাবে, বেঁচে থাকার চারিদিকে যে সন্ত্রাস আর নোংরামি, তার সঙ্গে এদের পরিচয় হবে না কখনও । একজন ফিরিঅলাকে দিয়ে বইয়ের “মোড়ক উন্মোচন” করিয়ে কী যে আনন্দ কী বলব । 

             ১৯৯৬ সালে নাকতলায় বেশ আনন্দ হয়েছিল পাটনার এক ফুচকাঅলাকে দেখে, ফুচকা ভেজে, মশলা নিয়ে রোজ ময়দানে বিক্রি করতে যেতো । “পাটনাইয়া ফুচকাই বেচো, নাকি মশলায় অদল-বদল ঘটিয়েছো?” জিগ্যেস করতে বলেছিল, মিষ্টি সামান্য বেশি খায় বাঙালিরা, বাদবাকি পাটনাইয়া, পুরো কলকাতায় যতো ফুচকাঅলা আছে সবাই ভোজপুরি, বিহার আর পূর্ব উত্তরপ্রদেশের, তাই যতো ফুচকা বিক্রি হয় সব পাটনাইয়া । আমাকে কেউ যদি জিগ্যেস করে আপনার কী খেতে সবচেয়ে ভালো লাগে, তাহলে আমি ইলিশ-চিংড়ির কথা বলব না, ফুচকার কথা বলব । ফুচকায় আইরিশ ক্রিম ভরে খেতে দারুণ । যদি আমিষের কথা জিগ্যেস করে কেউ তাহলে বলব যে সুইডেনের আইকিয়ার মিট বল খেতে সবচেয়ে ভালো লাগে, গোরু-শুয়োরের মাংসকে জানিনা কী ভাবে স্পঞ্জের মতন নরম করে তোলে, এক ইউরোতে দশটা মিট বল, এক প্লেট আলুভাজা, একটা তিনকোনা প্যাসট্রি আর কফি, প্রতি রবিবার সকালে, আহা, আহা, আহা, তারপর আর লাঞ্চ করার প্রয়োজন হয় না । তবে ইউরোপের মাংসের প্রিপারেশন ভালো লাগে না, মনে হয় কাঁচা, অনেক সময়ে রক্ত বইতেও দেখেছি প্লেটের ওপর । হাংরি আন্দোলনের সময়ে শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ গোরুর মাংস খেতে চাইত না, বেঁচে থাকলে বিজেপি দলের কর্মী হতে পারতো ।

             ১৯৬৬ সালে অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায়কে তাক লাগিয়ে দেবার জন্যে দরিয়াপুরে আমার ঘরে একটা পেইনটিঙ তৈরি করে রেখেছিলুম ওরা দুজনে কাঠমাণ্ডু থেকে ফিরলে দেখাবো বলে, নাম দিয়েছিলুম “পেইনটিঙের ভাষাকে আক্রমণ” । কাজটা ছিল একটা সাদা কার্ডবোর্ডে আমার নুনুর চারিপাশের জমানো বাল, যাকে হিন্দিতে বলে ঝাঁট, আঠা দিয়ে সেঁটে তৈরি আমার আত্মপ্রতিকৃতি । ওরা দুজনে দেখেই থ, করুণা বললে, “শালা একেবারে ক্লাসিকাল আর্ট, যেন ইউলিসিস, বেনারস নিয়ে যাবো, হিপিগুলো দেখেই লেড়িয়ে যাবে, দশ-পনেরো ডলারে ঝেঁপে দেবো, বুঝলে, তোমার ইন্সটলেশান আর্ট পৌঁছে যাবে ইউউউউউ এসসসসসস এএএএএএএএ”। করুণা চুলগুলোতে  উপযুক্ত রঙ লাগিয়ে মুখকে আকর্ষক করে তুলল । ওদের সঙ্গে আমিও গেলুম বেনারস, কোর্টে কেস কবে উঠবে ঠিক নেই, সুবিমল বসাক যোগাযোগ রেখেছে হাইকোর্টের অ্যাডভোকেটের সঙ্গে । বেনারসে যাবার লোভ করুণাই দেখিয়েছিল, “গাঁজা-চরস-আফিম মিশিয়ে চারমিনারে পুরে ফোঁকো আর হিপিনীসেক্স করো, একজন মোটা হিপিনী আছে, যাকে কেউ সঙ্গিনী করতে চায় না, এক ব্যাটা হিপি তাকে বেনারসে ছেড়ে আরেকজনকে নিয়ে চলে গেছে, তাকে পাইয়ে দেবো, অনিল ওর নিউড আঁকতে ডাকবে, তখন চাক্ষুষ করে নিও।” দেখলুম মোটা হিপিনীকে, ম্যাডেলিন করিয়েট, পোশাকহীন, ঝলমলে হলুদ আলোয়, অনিলের স্টুডিওতে, আর আবার শুরু হল আমার লুচ্চাপ্রেমিক অ্যাডভেঞ্চার, “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা”। করুণা তিরিশ বছর আগে, অনিল দশ বছর আগে মারা গেছে।

             ১৯৪৭ সাল থেকে, কী খাবো আর কী খাবো না তা প্রকাশ করার স্বাধীনতা আমিও নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলুম । কুমড়ো, ঝিঁঙে, ধুঁধুল, কুচোপোনা, মৌরলা, ট্যাঙরা, বিউলির ডাল আমি ইমলিতলায় খেতুম না । দরিয়াপুরে রান্নার বউ রাখলুম ১৯৭০ সালে আর সবকিছুই খাওয়া আরম্ভ করলুম, কেননা রান্নার বউ ছিল বরিশালের আর আমি তাকে বলতুম ধুঁধুলে গোটা  মশলা দাও আর কিমা দিয়ে রাঁধো, কুমড়োয় হিং ফোড়ন আর প্রচুর টোম্যাটো দাও, ঝিঁঙেতে রসুন দাও আর কাবলি ছোলা বাটা, বিউলির ডালে আস্ত রসুনকোয়া, বড়ি আর পালংশাক। সেই থেকে রান্নার রেসিপির একটা বই লেখার পরিকল্পনা মাথায় ঠাঁই করে নিয়েছে । ঠাকুমা ঠিকই বলতেন যে রান্নায় উচিত মশলা দিতে জানলে পাথরের টুকরোর তরকারিও খাওয়া যায় । আমি আসলে বেশ পেটুক । নোলা-সকসকে মানুষ বলতে যা বোঝায়। খিদে না থাকলেও ভালো খাবার দেখলে বা স্কচ বা সিঙ্গল মল্ট  দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে । খিদে ব্যাপারটা মনের স্হিতি, পেটের নয়।

    ছয়

                 ১৯৭৯ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে সিনিয়ার অ্যানালিস্ট হিসেবে অ্যাগ্রিকালচারাল রিফাইনান্স অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট কর্পোরেশানের লখনউ দপতরে যোগ দিয়ে  কয়েকদিন স্টেশানের কাছে হোটেলে ছিলুম আর প্রতিদিন রাতে ওল্ড মংক খেয়ে পাঞ্জাবি সরদারের দোকানে পুরো চিকেন তন্দুরি খেতুম কুড়ি টাকায় । আরও চারজন সিনিয়ার অ্যানালিস্ট, সকলেই ধনী চাষিবাড়ির কৃষি-বিজ্ঞানী, আবদুল করিম, শেট্টিখেড়ে প্রভাকর, ডক্টর কুরকুটে আর মদন মোহন যোগ দিলে, যতোদিন না বাড়ি পাচ্ছি,  আমাদের থাকার ব্যবস্হা হল উত্তরপ্রদেশ ভূমি বিকাশ ব্যাংকের গেস্ট হাউসে । রান্নার ব্যবস্হা নিজেদের। প্রভাকর সম্পুর্ণ শাকাহারি, পেঁয়াজ রসুনও খায় না, আর করিমের আমিষ না হলে চলবে না । সিদ্ধান্ত হল একদিন প্রভাকর রাঁধবে একদিন করিম । আমরা বাসন মাজবো, ঝাড়ু দেবো, পোঁছাপুছি করব চারটে ঘর আর ড্রইং রুম । এই চাকরিতে প্রথমেই যেতে হয়েছিল হিমালয়ের তরাইতে আর্টেজিয়ান কুয়োগুলোকে কাজে লাগাবার প্রজেক্ট তৈরির কাজে, তার আগে জানতুম না যে মাটির তলা থেকে কনকনে ঠাণ্ডাজল আপনা থেকে ফোয়ারার মতন বেরোতে থাকে । রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরিটা না ছাড়লেই ভালো হতো ; ষাট হাজার টাকা পেনশন বেশি পেতুম ।

             করিমের মাংস রাঁধা দেখে আমাদের মাংস খাওয়া টঙে উঠল । মাংস কিনে এনে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জলে ভিজিয়ে রাখত যাতে শেষ রক্ত ফোঁটাও বেরিয়ে যায়, তবুও খেলুম মাংস, তাতে সজনে ডাঁটা মুলো বেগুন দেয়া । মাংসের সাম্বর, হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি আর হালিম রাঁধা অন্ধ্রের আবদুল করিমের কাছে শিখলুম । ওকে তারিফ করে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি আর হালিম রাঁধায় টেনে নিয়ে গিয়ে আমাদের স্বস্তি । মুর্গি কিনে এনে করিম তাকে উনুনে ঝলসে নিতো যাতে রক্তের রেশ না থাকে ।  আর তার ফলে গ্যাসের উনুন থেকে আগুন বেরোনো চৌপাট হয়ে যেতো ।  অবসর নেবার পর নাভি পর্যন্ত পাকা দাড়ি নিয়ে করিম পাঁচবেলা নামাজ পড়তো, অন্ধ্রের গ্রামে একটা বাড়ি করেছিল সাতটা ঘরের, বিশাল বাংলো, ভেবেছিল বউ আর নাতিপুতি নিয়ে থাকবে, তা বউটাই মারা গেল ক্যানসারে । একটাই ছেলে হাসন্যায়েন হিন্দু মেয়ে বিয়ে করে থাকতে চায়নি বাপের সঙ্গে । লখনউ থাকাকালে করিম যেখানেই ট্যুরে যেতো, আমার ছেলের জন্য কোনো উপহার সেই জায়গা থেকে আনতো, নাকতলার ফ্ল্যাট বেচার সময়ে সবই পাড়ায় বিলি করে দিতে হয়েছে ।

             প্রভাকর ব্রেকফাস্টে দোসা সাম্বর বা ইডলি বানিয়ে দিতো । দোসা ইডলি আর সাম্বর বানাতে শিখে গেলুম, শিখে ফেলার পুরস্কার হিসেবে ও কর্ণাটকে নিজের গ্রাম থেকে একটা দোসা বানাবার চাটু এনে দিয়েছিল, যা এতো ভারি যে এখন আর তুলতে পারি না । তিন মাস পরে ইন্দিরানগরে বাংলোবাড়ি পেয়ে নতুন আস্তানায় গিয়ে পাটনা থেকে সলিলা, ছেলে-মেয়ে আর জিনিসপত্র নিয়ে এলুম । যে বাংলো পেয়েছিলুম, তাতে প্রচুর সাহায্য পেলুম চার কৃষি বিজ্ঞানী বন্ধুর, নিজে চাষ করার, বাগান করার, এমনকি ঘাস লাগাবার। আর প্রচুর বই, চাষবাসের বই, কিছুই জানতুম না আগে । সেই থেকে আমার মস্তিষ্ক হয়ে গেছে ক্যালাইডোস্কোপিক । নতুন চাকরিটাও এমন যে গ্রামে-গ্রামে চাষের উন্নতির রিপোর্ট দিতে হতো । গোরু, ছাগল, মোষ, বলদ, ষাঁড়, শুয়োর, হাঁস, মুর্গির যে কতো রকম প্রজাতি হয় সেই প্রথম জানলুম । মোষ-ষাঁড়-শুয়োরের সিমেন বের করার টেকনিক, সেই সিমেন মাদিদের যোনিতে পোরার টেকনিক, দেখতে দেখতে বেশ উত্তেজনা হতো । তার আগে তো দূর থেকে বাজরা আর জোয়ার খেতের তফাত টের পেতুম না।এই নতুন চাকরির দরুন সাহিত্যের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল । পাটনায় থাকতে তো চাষবাসের কিছুই জানতুম না, একটা গাছে এলাচ কোথায় হয় তা জানতুম না ।

             ১৯৫০ সাল থেকেই ঠাকুমা গরমকালে কেবল একটা গামছা কোমরে জড়িয়ে উত্তরপাড়ার খণ্ডহরে ঘুরে বেড়াতেন, ভাড়াটেদের সঙ্গে গ্যাঁজাতেন, ওনার মাইদুটো শুকিয়ে আমসি হয়ে গিয়েছিল । যখনই যেতুম কিংবা ঠাকুমা পাটনায় আসতেন, বলতুম, “তোমার মাই নিয়ে খেলবো” । ঠাকুমার মাইয়ের বোঁটা দুটো দুহাতে ধরে জুড়ে ছেড়ে দিতুম আর বলতুম, “ঝমমমম”। ঠাকুমা বলতেন, যথেষ্ট বয়েস হয়েছে তোর, “এবার বে-থা কর আর বউয়ের মাই নিয়ে ঝম ঝম কর দিকিনি।” বলতুম, “বউয়ের মাই তো আর তোমার মতন হবে না যে এক বোঁটার সঙ্গে আরেক বোঁটাকে মেলাবো।” ঠাকুমা বলতেন, “আমার মাইও এককালে তোর বড়োজেঠিমার চেয়ে পেল্লাই ছিল, বুঝেছিস, তোর দাদুর কতো গর্ব হতো।” ঠাকুমা মারা যাবার চার বছর পরে বিয়ে করলুম, নয়তো ওনাকে বলতুম, আমিও আমার বউয়ের মাই নিয়ে গর্ব করি , তোমাকে দেখাতে বলব একদিন ।

             ২০১০ সালে মালাডের ইনঅরবিট মলের ফুড কোর্টে বসে অপেক্ষা করছিলুম এক দম্পতির, সেদিন তাদের বিবাহবার্ষিকী, খাওয়াবে বলে কয়েকজনকে ডেকেছে । প্রায় সকলেই পৌঁছে গিয়েছিলুম । একজন যুবতী এগিয়ে এলো আমার দিকে, দুহাতে বিয়ের মেহেন্দি, এক হাতে প্লাস্টিকের চালুনি, আরেক হাতে বাঙলা পাঁজি আর দামি ব্যাগ । ইংরেজিতে আমাকে বলল, স্যার আপনাকে বাঙালি বলে মনে হচ্ছে, আমি এই ফোরটিন গ্রিনস কিনতে বেরিয়েছি কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না, ক্রফোর্ড মার্কেটেও পাইনি; আপনি কাইন্ডলি বলতে পারবেন কি যে এই গ্রিনগুলো কোথায় পাবো ? জিগ্যেস করে জানলুম ও কানপুরের মেয়ে, বিয়ে করেছে বাঙালি যুবককে, শশুর-শাশুড়িকে ইমপ্রেস করার জন্য চোদ্দশাক খুঁজে বেড়াচ্ছে । চালুনিটা করওয়া চৌথের জন্যে । পাঁজি খুলে দেখলুম শাকের নাম দেয়া আছে, ওলপাতা, কেঁউ, বেতো, সরিষা, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাটপাতা আর সুষণী । বললুম, এই ফোরটিন গ্রিনসের কথা আমি নিজেই আগে জানতুম না, আমাদের বাড়িতে যে চোদ্দশাক হতো তাতে পালংশাকের সঙ্গে নটে, ধনে, সোয়া, লাউ, কুমড়ো, পালং, কলমি, যার কোনোটাই এই লিস্টে নেই । আমার স্ত্রী যুবতীটিকে বলল, পালংশাক কিনে নাও আর যা-যা গ্রিনস পাওয়া যাচ্ছে কিনে নাও আর তা শ্রেডিং করে রেঁধো, তোমার ইনলজ আনন্দিত হবেন । নিজেরা যে বাঙালিত্ব ছেড়ে দিয়েছি একজন অবাঙালী যুবতীকে তা করতে দেখে, করুণার ভাষায়,  লেড়িয়ে গেলুম ।

             মুম্বাই থেকে ফিরে সুভাষ ঘোষের বাড়ি চন্দননগরে গিসলুম ১৯৯৬ সালে, বহুকাল পর দেখা করার ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে পারিনি বলে, স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখি সিপিএম-এর মিছিলে ঝাণ্ডা নিয়ে স্লোগান দিতে-দিতে যাচ্ছে সুভাষ ঘোষ, মন খারাপ হয়ে গেল । ওর বাড়ি গিয়ে দেখি বারান্দার এক কোণে সিপিএম-এর ঝাণ্ডার স্তুপাকার গোছা, ভেতরের ঘরে দেয়ালে ঝুলছে জ্যোতি বসুর ছবি, মনে হল ওর বাড়ি আসা বড্ডো ভুল হয়ে গেছে । প্রতিষ্ঠানবিরোধী ঢুকে গেছে প্রতিষ্ঠানের খাঁচায় । অবশ্য যখন ও মুচলেকা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিল, তখনই হদিশ পেয়েছিলুম যে ও একা লড়তে ভয় পায়, ওর চাই মিছিলের আশ্রয়, ওর চাই কফিহাউসের তরুণদের জমঘট । বলল, “মফসসলে থাকলে বুঝতে এসব না করে টিকে থাকা কতো কঠিন”। নিজের বউ কণক ঘোষকেও হাংরি আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছে, যদিও কণক ঘোষের লেখার স্তর বাচ্চাদের  । এদিকে সিপিএমের লুম্পেনরা তখন গ্রামে-গ্রামে অবর্ণনীয় অত্যাচার চালাচ্ছে, বাড়ি-ধানের গোলা পোড়াচ্ছে, মুণ্ডু নিয়ে ফুটবল খেলছে, পেট্রল ঢেলে মানুষ পোড়াচ্ছে, মানুষদের জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে দিচ্ছে, সুভাষের লেখায় তাদের দেখা মেলে না।

             মুম্বাই থেকে ফিরে ১৯৯৫ সালে প্রদীপ চৌধুরীর বাড়ি গিসলুম, দাদাকে আমাকে সলিলাকে শ্যাম্পেন খাওয়াবার নেমন্তন্ন করেছিল, শুনেছিলুম ফি বছর ফ্রান্সে কবিতা পড়তে যায় । শ্যাম্পেনের বোতলে ভরে দিশি বাংলা খাওয়ালো, ভেবেছিল আগে শ্যাম্পেন খাইনি কখনও । বহুকাল পর পুরোনো প্রদীপকে পেয়ে গেলুম, দেশ-বিদেশ ঘুরেও টসকায়নি, দি সেম ওল্ড কুমিল্লা ব্লোক, জিভের আড় ভাঙেনি । “হাওয়া ৪৯” পত্রিকায় প্রদীপ সম্পর্কে একটা লেখা লিখেছিলুম, প্রদীপের রাস্টিকেশানের যাবতীয় ডকুমেন্টসহ, প্রদীপ বলেছিল আমার গদ্যটার মতন আর কেউ ওকে বিশ্লেষণ করতে পারেনি । কিন্তু মুচলেকাপন্হীরা ওকে একঘরে করে দিতে পারে এই ভয়ে, লেখাটার সঙ্গে দেবার জন্যে একটা ফোটো তুলিয়ে দিয়ে গেল, যেন আমাকে লাথি দেখাচ্ছে । ওই ফোটোসহ ছেপে দিয়েছিলুম গদ্যটা । জানি না রাজসাক্ষীদের ও কেন এতো ভয় পেতো । তাদের অন্তর্ধানের পর পুরোনো প্রদীপ খোলোশ থেকে বেরিয়ে এসেছে । অভিমন্যু সিংহের সাইটে ইনটারভিউ দিয়ে যে ফোটো দিয়েছে তাতে প্রদীপের গলায় ঝুলছে বিজেপির পদ্মফুল ।

            মুম্বাই থেকে ফিরে ১৯৯৬ সালে শৈলেশ্বর ঘোষের বাড়ি গিসলুম, বেশ অনেকখানি জায়গা নিয়ে বাড়ি, পাঁচিলের গা ঘেঁষে দেবদারুর সারি বসিয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও পত্রিকার মলাটে ভিকিরির ছবি কেন, জিগ্যেস করতে বলল, ‘পাতা ফুঁকবে নাকি’ । আলমারি জুড়ে কেবল নিজের বই, সারি-সারি । মারা গেল অপারেশান থিয়েটারে । একে-একে মারা গেল ওর বউ, জামাই, মেয়ে । কিন্তু প্রচুর এনটিটি পয়দা করে গেছে ওর লেখাপত্তর সামলাবার ।

            আমি তো চিনতুম না, তাই প্রদীপ চৌধুরী বলেছিল শৈলেশ্বরের বাড়ি নিয়ে যাবে । যেদিন যাবার সেদিন গাপ মেরে শৈলেশ্বরকে আগাম খবর দিয়ে এলো, যাতে ও তৈরি থাকে। আমি আর দাদা ওর অপেক্ষায় গড়িয়ার বাস ডিপোয় দাঁড়িয়ে রইলুম ঘণ্টা দুয়েক । পরের দিন নিয়ে গিয়েছিল । মারা যাবার কয়েকদিন আগে শৈলেশ্বরের মেয়ে জীজা ঘোষ চিঠিতে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছে যে, যে-পত্রিকায় মলয় রায়চৌধুরী আর সমীর রায়চৌধুরীর লেখা থাকবে তাতে যেন ওর বাবার লেখা প্রকাশ না করা হয় । মন্দ নয়, মারা যাবার আগে মুচলেকা-লেখক মেয়েকেও রাজসাক্ষ্যের দুর্গন্ধ মাখিয়ে যেতে পেরেছে। বেচারি । অনেক বকাসুর চেহারার অ্যাণ্ডাবাচ্চাও ছেড়ে গেছে আমার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করার জন্য।

            মুম্বাই থেকে ফিরে ১৯৯৬ সালে অবনী ধরের গল্পগুলো নিয়ে একটা বই যাতে বেরোয় তার চেষ্টা  করলুম । বাসুদেব, সুভাষ, শৈলেশ্বর, প্রদীপ কেন যে অবনী ধরের গল্পগুলো নিয়ে বই করতে চায়নি জানি না। অবনীও, সোনাগাছিতে বাসুদেবের সঙ্গে গিয়ে বেবি-মীরা-দীপ্তির সঙ্গে শোবার আর ধেনো টানার খরচাপাতি করেছে, বই বের করার কথা ভাবেনি । অবনীর বই বের করার প্রস্তাবটা দিতেই রাজি হয়ে গেল শর্মী পাণ্ডে, আমি একটা ভূমিকা লিখে দিলুম । বাচ্চা হচ্ছে না বলে শর্মী পাণ্ডের তখন বেজায় মন খারাপ, নানা হাসপাতালে নানা টেস্ট করিয়ে চলেছে, বেশ ব্যস্ত । তা সত্বেও আগ্রহ নিয়ে বের করে দিল বইটা । অবনী ধর এক কপি দিতে এসেছিল আমায়, বলল বইটার নাম “ওয়ান শট” এর বদলে “ওয়ান সট” হয়ে গেছে। বললুম শর্মীও বোধহয় আমার মতন ঘটি । বইটা বের করার পূণ্য হিসেবে একটা সুন্দর বাচ্চা পেয়েছে শর্মী, নাম রেখেছে “রূপকথা” । দারুণ । অবনী ধর  যে মারা গেছে তা ওর ছেলের টেলিফোনে জেনেছিলুম।

    সাত

             ১৯৪৪ সালে ইমলিতলার গঞ্জেড়িরা কেউই বিশ্বাস করতে চায়নি যে ধবধবে শাদা শুয়োর হয় আর তার মাংস খেতে দিশি কালো শুয়োরের চেয়ে ভালো, ওরা ভেবেছিল আমি ইয়ার্কি করছি, “হাঃ হাঃ হমনিকে বুড়বক সমজ লইল কা ববুয়া” । আমি তাই আর ওদের ভুল ভাঙাইনি যে সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে না ; জানি ওদের নাতিরা স্কুলে যেতে আরম্ভ করলে পাকা ভুরু কুঁচকে বসে থাকবে ।

             ১৯৬৫ সালে বেনারসে আমার “জখম” কবিতার হিন্দি অনুবাদ, যা কাঞ্চনকুমার করেছিল, তা লুকিয়ে সরকারি প্রেসে ছাপানোর ব্যবস্হা করে দিয়েছিলেন হিন্দি আর মৈথিলি ভাষার কবি নাগার্জুন । বাঁধানো অবস্হায় বইটা হাতে নিয়ে দেখলুম সাজাবার সময়ে কবিতার লাইন একেবারে ওলোট-পালোট হয়ে গেছে । এই-ই হল আমার কবিতার ফর্ম, বললুম নাগার্জুনকে, যেখান থেকে ইচ্ছে লাইন তুলে যেখানে চান বসিয়ে নিন, টোটাল কবিতায় কোনো হেরফের হবে না, আপনার বৌদ্ধধর্মের চত্বারি আর্যসত্যানি দুঃখই তো কবিতাটার বনেদ । ১৯৯৮ সালে মারা গেছেন নাগার্জুন ।

            ১৯৯৯ সালে ঈশ্বর ত্রিপাঠী এসেছিলেন নাকতলার ফ্ল্যাটে, একহাজার টাকা নিয়ে, আমাকে পুরস্কৃত করতে চান, ‘প্রমা’ পত্রিকায় প্রকাশিত আমার “উত্তরদার্শনিকতা” প্রবন্ধ পড়ে এতোই অভিভূত । আমি পুরস্কার নিই না বলে ওয়ান-টু-ওয়ান পুরস্কার দিতে এসেছিলেন, যাতে কেউ জানতে পারবে না, অথচ পুরস্কারও দেয়া হবে । টাকার তোড়াটা উনি সোফার কুশনের তলায় রেখে চলে যেতে চাইছিলেন । বললুম, আমি তো রামকৃষ্ণ নই, বইবাজারের কেষ্টবিষ্টুও নই,  লেখার জন্যে পুরস্কার নিই না, সম্বর্ধনা নিই না । উনি মুষড়ে পড়লেন, তুলে নিলেন টাকাটা আর কোনো কথা না বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন । ওনার মৃত্যুর খবর পেয়েছি বেশ দেরিতে । “কবিতা পাক্ষিক” পত্রিকার প্রভাত চৌধুরীও সম্বর্ধনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আবার বলতে হল যে, আমি এই সবেতে নেই । হয়তো ওনার পছন্দ হয়নি ; তারপর থেকে ওনার পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয় না ।

            ইমলিতলার গঞ্জেড়িদের জমায়েতে ইঁদুর পুড়িয়ে খাওয়া হতো ; ১৯৪৫ সালে আমি পুরোটা খাইনি, বমি করে ফেলব আঁচ করে, তবু একটুকরো মুখে দিয়ে চেখেছিলুম, বিটকেল সোঁদা গন্ধ, চেখে বমি করলুম । দাদা খেয়ে দেখেছিল, তাড়ি দিয়ে । তাড়ি আর ঠররা খাবার ট্রেনিঙ তো ইমলিতলায় । এখন যারা থাকে তারা হয়তো আংরেজি শরাব খায় ।

            ১৯৬২ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সহকর্মী শিউচন্দরের বাড়িতে ওর গ্রাম ছপৌলিতে গিয়েছিলুম। ওদের অনেক জমিজিরেত, ছাগল বলদ গোরু মোষ ঘোড়া । আমায় একটা ঘোড়ানীর পিঠে বসিয়ে, ঘোড়ানীর পিঠে জিন ছিল না, ঘোড়াটাকে শিস দিয়ে ওরা নিয়ন্ত্রণ করছিল, আমার লিঙ্গের তলায় ঘষটানি লেগে দাঁড়িয়ে গেল, ব্যাটারা জানতো কি হতে চলেছে, তাই শিস দিতে থাকলো, আর আমার বীর্যপাত ঘটা আরম্ভ হলে ঘোড়ানীর গলা জড়িয়ে ধরলুম, ঘোড়ানীর সঙ্গে এভাবে প্রেম করে  ব্যক্তিগত প্রেমের ইতিহাস তৈরি করলুম। শিউচন্দর মারা গেছে কুড়ি বছর আগে । রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছিল নোটের বিষাক্ত গন্ধ আর ছোঁয়াচে রোগের জন্য ।

              রাতে শিউচন্দরদের বারদেউড়ির যে ঘরে আমাকে শুতে দিয়েছিল, হঠাৎ তার মধ্যে একজন বিহারি যুবতীকে ঠেলে দিয়ে শিউচন্দরের বাবা বললে, “লে রে ববুয়া, দেশি ঘোড়ি পর চঢ়” । মেয়েটার গন্ধে আমার হাড়-হিম করা ভয় দেখা দিল, দরোজা খুলে বললুম, যাও এক্ষুণি পালাও । ভিতু ছিলুম বেশ । যৌনকর্মে নারীও ভীতির কারণ হতে পারে ।

              ১৯৮৯ সালে মুম্বাইতে ফিয়াট গাড়ি কিনেছিলুম অফিস থেকে লোন নিয়ে । ড্রাইভ করতে বেরিয়ে রিভার্স করার সময়ে একটা ট্রাককে ধাক্কা মারলুম, গাড়ির পেছন দিক চুরমার । ডিলারের কাছে নিয়ে যেতে, বলল, প্রথম গাড়ি কিনে ড্রাইভ করতে বেরিয়ে শতকরা পঁচাত্তর ভাগ লোক অমন দুর্ঘটনা ঘটায়, আপনার ভাগ্য যে সামনে থেকে কাউকে ধাক্কা মারেননি ।

            ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত সান্টাক্রুজের ফ্ল্যাট থেকে নারিমন পয়েন্ট পর্যন্ত প্রত্যেক দিন সকালে আধ ঘন্টায় পৌঁছে যেতুম, মেরিন ড্রাইভে বসে হাওয়া খেতুম । নানা জায়গায় বেড়াতে যেতুম । এখন মুম্বাইতে এতো গাড়ি যে চালানো অসম্ভব, এখন সান্টাক্রুজ থেকে নারিমন পয়েন্ট যেতে তিনচার-ঘণ্টা লাগে। ১৯৯৫ সালে কলকাতায় গিয়ে গাড়ি চালাতে বেশ মুশকিল হতো কেননা নাকতলায় থাকতুম গলির ভেতরে আর সিপিএম দলের পাবলিক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গ্যাঁজাতো, গাড়ি দেখেও সরে যেতো না, কেউ-কেউ বলতো, “বাঞ্চোৎ গাড়ি দেখাতে এসেছে”, অর্থাৎ রিফিউজিদের মার্কসবাদ ব্যাখ্যা, এরাই পুরো পশ্চিমবাংলাকে ডুবিয়ে দিয়েছে ; লোকগুলো বুঝতেই পারেনি যে কিছুদিনেই গদি থেকে উৎখাত হয়ে যাবে । প্রায়ই ক্লাচ খারাপ হতো । বেচে দিলুম গাড়ি ।

             ২০০০ সালে নাকতলার ফ্ল্যাটও বেচে দিলুম, এমনই একজনকে যে নিজের নামের মাঝখানে “হার্মাদ” লিখে সিপিএম করতো । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গদিতে বসতেই, সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে তৃণমূলে পালিয়েছে । বললুম, কি, শেষ পর্যন্ত হার্মাদকে হমদর্দ করে ফেললেন, তৃণমূলে যোগ দিলেন ; প্রত্যুত্তরে উনি হেঁঃ হেঁঃ দিয়ে নিজের ক্ষুদ্রতা মুখময় ছড়িয়ে দিলেন । বিল্ডিংটা ছিল পঞ্চাশ বছরের পুরোনো ।

            ২০১৬ সালের ঘটনা, আরেকজন হার্মাদকে নিয়ে, তিনি চিরঞ্জীব বসু, নামের মাঝে ‘হার্মাদ’। জীবনানন্দের “অন্ধকার” কবিতা থেকে এই উদ্ধৃতি দিয়েছিলুম ফেসবুকে : “আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর।” চিরঞ্জীব মন্তব্য করলেন, “আপনি এতো আধুনিক কিন্তু বাল ‘ভিতর’ লেখেন কেন ?” আরও অনেকের মন্তব্য ছিল, সকলেই ভেবেছেন, লাইনটা আমার । বুঝতে অসুবিধে হল না যে জীবনানন্দকে পড়াও ছেড়ে দিয়েছে বাঙালি পাবলিক । মন্তব্যগুলো পড়ে “কল্কি” পত্রিকার তরুণী সম্পাদক কৃতী ঘোষের উক্তিটা মনে পড়ে গেল, ‘ঝাঁট জ্বলে যায়। আচ্ছা, মেয়েদের কি ঝাঁট হয় ? কেমন যেন আনরোমান্টিক । তার চেয়ে লোমনাশক লাগিয়ে জায়গাটায় আলতা মাখিয়ে রাখলে শরীর বেয়ে গান বইতে থাকবে ।

             ২০০০ সালে মুম্বাইতে দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাকের পরে যখন নানাবতী হাসপাতালে থিতু হলুম, কার্ডিওলজিস্ট আমার স্ত্রীকে বললে, তিন লাখ টাকা তাড়াতাড়ি যোগাড় করুন, বাই পাস করতে হতে পারে। প্রথম হার্ট অ্যাটাকের পর অ্যানজিওপ্লাস্টি করিয়েছিলুম । তিন লাখ টাকা চাইলেই তো আর পায়খানা বা পেচ্ছাপের মতন হাসপাতালে জমা দেয়া যায় না । কলকাতা পাড়ি মারলুম । প্রভাত চৌধুরী আমার হার্ট অ্যাটাকের খবর শুনে ভূমেন্দ্র গুহকে নিয়ে এলো, তার আগে আমার সঙ্গে ভূমেন্দ্র গুহর পরিচয় ছিল না । উনি এক মাসেই সারিয়ে তুললেন, বাংলায় প্রেসক্রিপশান লিখে দিতেন, আমার জন্য ওয়েইং স্কেল আর ব্লাড প্রেশার মেশিন কিনে এনে দিয়েছিলেন ; পরিবর্তে আমি মাছ ভাজা আর স্কচ খাওয়াতুম । প্রতি সপ্তাহে একবার দেখতে আসতেন । হঠাৎ আসা বন্ধ করে দিলেন । হয়তো শরীর খারাপ হয়েছে ভেবে,ওনার বাড়ি গিয়েছিলুম, ভালো ব্যবহার করলেন না, প্রেসক্রিপশান-রিপোর্ট ইত্যাদি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন । চুপচাপ ফিরে এলুম, মনখারাপ করে । একবার মদের ঘোরে বলেছিলেন যে সরকারি হাসপাতালে এক্স রে করে করে ওনার শুক্রকীটগুলো বাঁচে না, তাই আর বাচ্চা হয়নি । দাদা পরে খবর নিয়ে জানতে পারল যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভূমেন্দ্র গুহকে  বলেছেন, “মলয়ের জন্য অতো করার কি আছে, ওর তো কোনো সাহিত্যিক গুণই নেই।” এই একই কথা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন মারাঠি লেখক-অনুবাদক অশোক সাহানেকে, মারাঠি নাট্যকার দিলীপ চিত্রেকে, ইংরেজি কবিতা লিখিয়ে আদিল জুসসাওয়ালাকে । আর অ্যালেন গিন্সবার্গকে তো বটেই ।

             ভূমেন্দ্র গুহর মৃত্যুর খবর জেনেছি ফেসবুকে ।

             ১৯৬২ সালে “ইল্লত” নামে একটা নাটক লিখেছিলুম, পড়ে প্রশংসা করেছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উনি “বহুরূপী” পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য দিলেন । বেশ কিছুকাল রেখে কুমার রায় বললেন, “আবোল-তাবোল হয়েছে, কোনো কল্পনা নেই, আধুনিকতার ছায়া নেই”। ফেরত নিয়ে “গন্ধর্ব” পত্রিকার নৃপেন সাহাকে দিলুম । উনি পড়ে বললেন ছাপবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাপলেন না, পাণ্ডুলিপি ফেরত নিয়ে আসার সময়ে দেখলুম ওর ওপরে চায়ের কাপ বা বিয়ারের বোতল রেখেছিলেন, টাকনা রেখেছিলেন । আমার পাণ্ডুলিপির প্রথম  রিজেকশান । ফেরত নিয়ে নিজে একটা পত্রিকা বের করলুম, “জেব্রা” নামে, আর তাতে প্রকাশ করলুম । সুভাষ আর বাসুদেবের হিংসে হল নাটকটা পড়ে । আমার লেখা উতরেছে কিনা জানার প্রধান মাপকাঠি ছিল হাংরি আন্দোলনের চার-চৌকড়ির হিংসে । ওদের দাঁতক্যালানে হিংসুটে হাসি দেখে বুঝলুম যে নাটকটা তাহলে ভালোই লিখেছি ।

             বহুকাল পরে, ‘চন্দ্রগ্রহণ’ পত্রিকার সম্পাদক প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়, যিনি পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় নামে গল্প-উপন্যাস লেখেন, ‘গাঙচিল’ নামে এক প্রকাশন সংস্হার সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার প্রকাশিত বইগুলো আরেকবার প্রকাশ করার তোড়জোড় করেছিলেন । কোন লেখাগুলো প্রকাশ করতে হবে আমি তার তালিকা তৈরি করে দিয়েছিলুম । সংস্হার কর্ণধার অধীর বিশ্বাস ২০১৬ সালে একটা প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করে, আর কোনও সংকলন প্রকাশ করলেন না । অথচ তিনি তিনটি উপন্যাস আর সাক্ষাৎকারসমগ্র ইতিমধ্যে কমপোজ করিয়ে ফেলেছিলেন । দেড় বছর ফেলে রাখার পর বললেন আর আমার বই বের করবেন না । প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় ডিটিপি করার খরচ দিয়ে সিডিগুলো কিনে নিলেন অধীর বিশ্বাসের কাছ থেকে । আমার বেশ অপমানজনক মনে হয়েছিল ব্যাপারটা । উনি আর প্রকাশ করতে চাইলেন না কেননা যেসব এনটিটি আমার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করার জন্য বকাসুর এণ্ডাবাচ্চা ছেড়ে গেছে তারা অধীর বিশ্বাসের ঘাড়ের ওপর পচা লাশের  গন্ধ ছড়াতে আরম্ভ করেছিল। জানতে পারলুম, যে-সংবাদপত্র গোষ্ঠিকে লোকে প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে, তাদের খোচরদের চাপে উনি আর এগোননি, এদিকে উনি সুবিমল মিশ্র, সুভাষ ঘোষের বই বের করতে কিপটেমি করেননি । একদিক থেকে এটাকেও রিজেকশান বলতে হবে । রিজেকশানও আনন্দদায়ক হতে পারে, কেননা তা লেখকের বিরুদ্ধে তৈরি প্রাতিষ্ঠানিক ঘোঁটকে সহজেই ফাঁস করে ।

              ১৯৯০, ১৯৯৭, ২০০০ সালে সবসুদ্ধ তিনবার অ্যানজিওগ্রাফি করিয়েছি, ১৯৯৭ সালে একবার অ্যানজিওপ্লাস্টি । প্রতিবার নুনুর চারিধারের জঙ্গল পরিষ্কার করেছে একজন নার্স । তারপর অ্যানজিওগ্রাফি আর অ্যানজিওপ্লাস্টি করার সময়ে নুনু নিয়ে এদিক ওদিক নাড়াচাড়া করেছে কয়েকজন যুবতী নার্স । তাদের আচরণ দেখে মনে হতো যে নানারকম নুনু নিয়ে স্হাপত্য গড়ার অভ্যাস হয়ে গেছে । তাদের হাতে পড়ে নুনুর চরিত্রে বদল ঘটে গিয়েছিল, তা আর লিঙ্গ ছিল না ; হাসপাতাল থেকে ফিরে নুনুর লিঙ্গ হয়ে উঠতে কয়েকমাস লেগে গিয়েছিল ।

             ১৯৯৭ সালে যখন কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলুম প্রায় কুড়ি দিন, সেখানে যে ধরণের কাণ্ডকারখানা হতো তা লিখেছি “নামগন্ধ” উপন্যাসে । আমি সেসময়ে অফিসপ্রধান ছিলুম, আর বিকেলে একজন অফিসারকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করানো হয়েছিল, হেপাটাইটিস-বিতে আক্রান্ত, তার স্বাস্হ্য কেমন আছে জানাবার জন্য মাঝরাতে অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ইনচার্জ ফোন করেছিল, ঘুমের ঘোরে ফোন তুলতে গিয়ে পড়ে গেলুম আর বাঁদিকের কানটা খাটের কোনায় লেগে রক্তারক্তি হয়ে গেল, রক্তচাপ নেমে গেল, সলিলা ট্যাকসি ডেকে ওই হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিলে । কান সেলাইয়ের পর ডাক্তাররা বললেন, ইসিজি নেয়া হয়েছে, এনার হার্টে ব্লকেজ আছে মনে হচ্ছে । ফলে প্রথমে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি আর তারপর অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি । আই সি ইউতে, প্রত্যেকদিন কোনো-না-কোনো যুবতী নার্স লাঞ্চ আর ডিনার খাইয়ে যেতো, অতি যত্নে, হাসপাতালটায় মেয়েগুলোকে বলে সেবিকা । মুখের ভেতরে একজন কচি যুবতীর আঙুলের স্পর্শেই বোধহয় পনেরোদিনে চনমনে হয়ে গেলুম । মনে হতো, এদের  জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকার মতন আনন্দ আর নেই, এদের সঙ্গে সেক্স করা যায় না, জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ফোঁপানো যায় ।

              ১৯৮৮ সালে মারাঠি কবি অরুণ কোলাটকর বলেছিলেন ওনার বাড়ি যে গলিতে তার মোড়ে একটা ‘নেকেড স্ট্যাচু’ আছে । বাস থেকে নেমে নেকেড স্ট্যাচু আর নংগা মুর্তি জিগ্যেস করে ঘণ্টাখানেক ঘুরেও যখন হদিশ পেলুম না তখন একজনকে জিগ্যেস করলুম অরুণ কোলাটকর কোথায় থাকেন ? সে বলল, মারাঠি কবি তো ? চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি । কোলাটকর মারা গেছেন ২০০৪ সালে । বিয়ে করেছিলেন একটি পার্সি যুবতীকে । বাচ্চা হলে সে অসুবিধায় পড়বে বলে বাচ্চা হয়নি ওনাদের । একটা ছোট্ট ঘরে থাকতেন । সবকিছু খাটের তলায়, টেনে বের করলে ডাইনিং টেবিল, লেখার টেবিল । ঘরের চৌকাঠে বসে কবিতা লিখতেন । কারোর সঙ্গে বিশেষ মিশতেন না ।

             যে বছর জন্মেছিলুম, ১৯৩৯ সালে, সেই বছরে জন্মের এক মাস আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে, সংসারে টানাটানি, রাতে অন্ধকার । বাড়ির সবাই আমার জন্মকে দুষেছিল, দ্বিতীয় যুদ্ধ আর বোমার ভয় আর অনটন আনার জন্য, কলকাতা থেকে আত্মীয়-জ্ঞাতিরাও এসে উঠেছিল আমাদের বাড়িতে । বড়জ্যাঠা তখন থেকেই লুঙ্গির চারখুঁটে গিঁট বেঁধে মুসল্লাপুর হাট থেকে ঝড়টি-পড়তি সব্জি কেনা আরম্ভ করেছিলেন, সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে ঝুলিয়ে আনতেন । ইমলিতলার বাড়িতে বিজলিবাতি ছিল না, কলের জলও ছিল না । সকলকে রাস্তার কলে গিয়ে স্নান করতে হতো, খাবার জল ভরে আনতে হতো ।

                ইমলিতলা পাড়া ছাড়ার কয়েক বছর পরে ওই পাড়ায় গেলে অনেকে আমাকে চিনতে পারছিল না, কিন্তু পাড়ার চারটে কুকুর, মোতি, টাইগার, ভুতুয়া, দিলের, বুড়ো হয়ে লোম প্রায় উঠে গেছে, আমাকে দেখেই ছুটতে-ছুটতে এসে ল্যাজ নাড়ানো আরম্ভ করে দিয়েছিল । চারটে কুকুরই মারা গেছে ; ওদের পুঁতে দেয়া হয়েছে গঞ্জেড়িদের মাটির উঠোনে ।   ১৯৬৬ সালে বড়োজ্যাঠা মারা যাবার পর কিছুদিন ইমলিতলার বাড়িতে একা ছিলেন বড়জেঠিমা, স্টোভে রান্না করতেন, হরি হে হরি হে হরি হে বলে বলে স্টোভে পাম্প করতেন, ১৯৭৯ সালে একদিন স্টোভ ফেটে বেশ পুড়ে গিয়েছিলেন । দশ বছর পর ইমলিতলায়, নিজের পরিচয় দেবার আগে, কপিলের চাচিকে জিগ্যেস করেছিলুম, এই বাংগালি লোগ কোথায় চলে গেল । কপিলের চাচি, চিনতে পারেনি আমাকে, বলেছিল, ভস্মাসুরের বংশ, সবাই নিজের দৃষ্টিতে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেছে । রাক্ষসের বংশ ! বাঙালিরা যাকে বলে ভস্মলোচন, তাকে বিহারিরা বলে ভস্মাসুর ।     ইমলিতলার বাড়িতে একটা ফোটো ছিল বড়ো জ্যাঠাইমার, দুহাতে ব্লাউজ দুদিকে মেলে আছেন, টপলেস দেখিয়ে, কেননা ওনার মাপের মাই আর কারোর ছিল না বাড়িতে, পাড়াতে শুধু কালুটুয়ার চাচির ছিল, তামাটে, জেঠিমার মতন গোলাপি-ফর্সা নয় । কে তুলেছিল জানি না, হয়তো বাবা, হয়তো কোনও কাকা, হয়তো মেজ-জ্যাঠা । ফোটোটা যদি সঙ্গে থাকতো তাহলে নন্দনতাত্ত্বিক আবু সয়ীদ আইয়ুবকে দেখাতে পারতুম, “এই দেখুন স্যার, আমার বড়োজেঠিমা” । বুঝতে পারতেন আমি কেমনধারা পরিবারের প্রডাক্ট ।

    আট

              আমি আরেকবার প্রেমে পড়ে দুর্ভোগের জাঁতিকলে আটকাতে চাইনি বলে সলিলার সঙ্গে পরিচয়ের তিন দিনের মাথায়, ১৯৬৮ সালে বলেছিলুম,আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই, এ-ব্যাপারে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে । ও বলেছিল মামাদের সঙ্গে । মনোনয়নে ইপিফ্যানির গর্ব হল । ১৯৬৮ সালে সলিলাদের বাড়িতে সাজানো কাপ আর শিল্ড দেখে প্রশ্ন করে জেনেছিলুম, ওগুলো সলিলার, হকি খেলে পাওয়া, স্টেট প্লেয়ার ছিল, কালার হোল্ডার, ম্যাচ জিতলে কাপে রাম ভরে খেতো । বেশ আনন্দ হয়েছিল যে টিপিকাল বাঙালি মেয়ের মতন নয় ।

              ইমলিতলার বাড়িতে মা বেশির ভাগ সময়ে রান্নাঘরে, দুটো মাটির উনোনে রান্না করছেন, বাসন-কোসনের বিশেষ শব্দ নেই । রান্নার কতো রকমের সুবাস । রাতে কেরোসিনের লম্ফ জ্বেলে রান্না, উনোনের আলোয় মায়ের গনগনে মুখ । ঝুলকালি ভুষো পড়ে রান্নাঘর এতো অন্ধকার যে ছয়মাস অন্তর রামরস দিয়ে রঙ করানো হতো। সব ঘরের চেয়ে রান্নাঘরকে মা বেশি ভালোবাসতেন । জ্যাকসন পোলকের বহু আগেই মা রান্নাঘরের দেয়ালে অমন তুলিহীন পেইনটিং এঁকেছিলেন’কড়াই থেকে দেয়ালে ছিটকে লাগা হলুদ-লংকার দরানি । কোনো ধার্মিক অনুষ্ঠান না হলে মা সিঁদুর পরতেন না, সলিলাকেও পরামর্শ দিয়েছিলেন যে প্রতিদিন সিঁদুর পরলে চুল পেকে যায় আর ঝরে পড়ে, তাই পরার দরকার নেই, শাঁখা-ফাঁকাও দরকার নেই । ফলে সলিলা সিঁদুর-শাঁখার পাট চুকিয়ে দিয়েছে বিয়ের পর-পরই । কিন্তু কোনো বাঙালি বামুন পরিবার আমাদের বাড়িতে ভিজিট দিতে আসছে শুনলেই একটা টিপ আর সিঁদুর পরে নেয়, কেননা কেউ-কেউ কথা শোনাবার সুযোগ ছাড়ে না ।

            বউদির শালীরা, যারা দাদার বাড়ির কাছে বাঁশদ্রোণীতে থাকে, তাদের রক্ষণশীল টিটকিরির ভয়ে সলিলা বেশ কিছুকাল দাদার বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। যখন নাকতলার ফ্ল্যাট বেচা ফাইনাল করে ফেলেছি, তখন দাদাকে বলেছিলুম, তোমার ওপরতলাটা আমাদের ভাড়া দাও, আমি মার্কেট রেটই দেবো, তা বউদি বললেন, কোথাও একতলা ভাড়া করে থাকগে যাও । অগত্যা চলে এলুম মুম্বাই । দাদার ছোটো ছেলে বিটু দাদার কাছে জানতে চেয়েছিল যে কেন আমাদের ওপরতলাটা ভাড়া দেওয়া হয়নি, উত্তরে দাদা ওকে বলেছিল, পরে প্রবলেম হতো । দাদার বোধহয় ভয় ছিল যে যেহেতু পাটনার বাড়ির ওপর আমি আর আমার ছেলে-মেয়েরা কোনো দাবি-দাওয়া জানাইনি, তাই ওপরতলায় থাকলে হয়তো ছাড়তে চাইবো না । ওপরতলায় থাকলে দাদাকে বাজে মারোয়াড়ি হাসপাতালে ভর্তি হতে দিতুম না, তাড়াতাড়ি মৃত্যুর পথে যেতে দিতুম না ।

             ১৯৫০ সালে রামমোহন রায় সেমিনারিতে ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি খেলায় আমার মাথা ফেটে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলুম, সেই দাগ এখনও আছে । আক্রান্ত হবার চিহ্ণ । বিরূপ সমালোচনা পড়ে কপালের দাগটায় হাত বুলিয়ে আলোচককে ভুলে যাই ।  বাবা যখন মারা গিয়েছিলেন, শ্রাদ্ধের সময়ে আমি ন্যাড়া হইনি । কিছুকাল পরে বাবার জন্য এতো মনকেমন করছিল যে একটা সেলুন দেখতে পেয়ে সোজা ঢুকে  গিয়ে ন্যাড়া হয়েছিলুম, আর ফেরার সময়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কেঁদেছিলুম । পথচারীদের মাঝে দাঁড়িয়ে কেঁদে, ভালো লেগেছিল, যা সমবেত শোকের কান্নায় হয় না । আমি পাটনা থেকে লখনউ চলে যাবার পর দাদা সপরিবারে পাটনায় চলে এসেছিল। বড়ো ছেলে পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করতে পারেনি বলে তাকেই দোকানে বসিয়ে দিয়েছিল । বাবা আমার কাছে চলে এসেছিলেন লখনউতে । মা লখনউতে মারা যেতে বাবা পাটনায় কিছুদিনের জন্য ফিরে গিয়েছিলেন, তারপর কোতরঙের ভদ্রকালীতে  ছোটোকাকা বা বিশেখুড়োর বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে শেষজীবন কাটাবেন ভেবে । ছোটোকাকা বেশ প্যাঁচালো মানুষ ছিলেন, বাবার কেনা জমিজিরেত ঠাকুমাকে দিয়ে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছিলেন । শেষে পাটনার বাড়িও ছোটোকাকা বাবাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে পারেন আঁচ করে দাদা বাবাকে পাটনায় নিয়ে চলে যান । আমি বাবাকে মুম্বাইতে নিয়ে আসিনি এটা আমার জীবনের একমাত্র রিগরেট হয়ে থেকে গেছে ।

          আমার বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী জন্মেছিলেন বর্তমান পাকিস্তানের লাহোর শহরে, ১৯১২ সালে । পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিংহ সম্পর্কিত গালগল্পে প্রভাবিত হয়ে ঠাকুমা বাবার অমন নাম রেখেছিলেন। রঞ্জিত সিংহ জন্মেছিলেন ১৩ই নভেম্বর ১৭৮০ । বাবাও জন্মেছিলেন ১৩ই নভেম্বর । ছয় ভাই আর এক বোনের মধ্যে বাবা ছিলেন তৃতীয় বা সেজ ভাই । অন্যান্য ভাইদের পোশাকি আর ডাক নাম দুটিই থাকলেও, বাবার ওই একটি নামই ছিল, রঞ্জিত । ঠাকুর্দার আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় । ১৭০৯ সালে উত্তরপাড়া শহরটির পত্তন করেছিলেন দাদুর পূর্বপুরুষ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী ।

            ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী, পোরট্রেট আঁকতে পারতেন, এবং সেই সূত্রে তিনি বিভিন্ন রাজপরিবারের ডাকে সপরিবারে ভারতের এক রাজ দরবার থেকে আরেক রাজ দরবারে চলে যেতেন । লাহোরে গিয়ে তিনি ড্যাগেরোটাইপ ক্যামেরায় ফোটো তুলতে শেখেন, যাতে ফোটো তুলে তা থেকে ছবি আঁকতে সুবিধা হয় এবং রাজ পরিবারের মহিলাদের এক নাগাড়ে বসে থাকতে না হয় । সেসময়ে মেয়ো স্কুল অফ আর্টসের অধ্যক্ষ এবং লাহোর মিউজিয়ামের কিউরেটার ছিলেন রাডিয়ার্ড কিপলিঙের বাবা জন লকউড কিপলিঙ, যাঁর সঙ্গে পরিচয়ের ও তাঁর অধীনে কাজ করার সূত্রে তাঁর কাছ থেকেই তিনি ফোটো তোলা শেখেন । ফোটো তোলা হতো সরাসরি ব্রোমাইড পেপারে । পরে, কাচের প্লেটে নেগেটিভ ফিল্ম তোলা হতো, সেই নেগেটিভকে রসায়নে চুবিয়ে রেখে ফোটো গড়ে উঠত; তারপর সেই প্লেটের ওপর ফোটোর কাগজ রেখে, প্রয়োজনীয় আলো দেখিয়ে ফোটো প্রিন্ট করা হতো, আর সেই প্রিন্টকে রসায়নে চুবিয়ে, শুকিয়ে, স্হায়ীত্ব দেয়া হতো ।  

             ড্যাগেরোটাইপ ক্যামেরা ছিল বেশ ভারি ; বাইরে গিয়ে ফোটো তুলতে হলে তাকে বয়ে নিয়ে যাবার লোক দরকার হতো । বাইরে তোলা হচ্ছে বলে একসঙ্গে অনেকগুলো তুলে যেটা ভালো হল সেটা থেকে ফোটো তৈরি করা হতো । ফোটো তোলা হতো ক্যামেরা স্ট্যাণ্ডের ওপরে ক্যামেরা রেখে । ফোটো তোলার সময়ে হাত দিয়ে লেন্সের ঢাকনা খুলে, ‘স্মাইল প্লিজ’ বলে দু’এক সেকেণ্ডে আবার লেন্স পরিয়ে দেয়া হতো । স্টুডিওতে ফোটো তুলতে হলে প্রথম দিকে কুঁজোর মাপের হাজার-দুহাজার ওয়াটের বাল্বের আলোয় ফোটো তুলতে হতো, পরে অবশ্য বাল্বের মাপ ছোটো হয় । এখন প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়েছে যে ড্যাগেরোটাইপের ঝঞ্ঝাটকে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক । বাবা এই ডিজিটাল প্রযুক্তি দেখে যেতে পারলেন না । শৈশবে তাঁকে দেখতুম শহরের বাইরে ফোটো তুলতে যাচ্ছেন কাজের লোক রামখেলাওন সিংহের কাঁধে ক্যামেরার বাক্স চাপিয়ে, নিজে ক্যামেরা তিন-ঠেঙে স্ট্যান্ড আর মাথায় চাপা দেবার কালো মোটা কাপড় । বাবা মারা যাবার পর যখন পাটনার বাড়ি ছেড়ে চলে আসলুম, দেখেছিলুম তিনতলার একটা ঘরে থাক-থাক কাচের প্লেট, কড়িকাঠ থেকে র‌্যাকে সাজানো । ইতিহাসবোধ না থাকলে যা হয়, আমি বা দাদা আমরা কেউই সেগুলো সংরক্ষণের প্রয়াস করিনি । দাদার ছেলেরা কাচঅলাকে ওজন দরে বিক্রি করে দিয়েছে ।

             দাদুর ছেলেরাও ফোটো তোলা আর ছবি আঁকায় সড়গড় হলে দাদু ১৮৮৬ সালে ফোটোগ্রাফির ভ্রাম্যমান ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন, এবং সংস্হাটির তিনি নাম দেন ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’ । হুগলি জেলায় গঙ্গা নদীর ধারে উত্তরপাড়ার পাশে এখন যেখানে বালি ব্রিজের সংলগ্ন ফ্লাইওভার, তখন একটা রাস্তা ছিল, সেখানে একটা দপতর খুলে নকাকাকে চালাতে বলেছিলেন । কিন্তু নকাকা তা সামলাতে পারেননি, স্ত্রীর সঙ্গে অবনিবনার দরুণ হঠাৎ বৈরাগ্যে আক্রান্ত হবার কারণে ।  দাদুর অমন ঘোরাঘুরির কারণে বড়জেঠা, মেজজেঠা, বাবা, পিসিমা আর নকাকার স্কুলে পড়া হয়ে ওঠেনি । দাদু হঠাৎ মারা যাবার পর তাঁর ছেলেরা পাটনায় থিতু হতে বাধ্য হন এবং তখন নতুনকাকা আর বিশেখুড়ো মানে ছোটোকাকাকে স্কুলে ভর্তি করা হয় । নতুনকাকা নিয়মিত স্কুল করলেও ছোটোকাকার আগ্রহ না থাকায় তিনি পড়াশোনা ত্যাগ করেন । জেঠাকাকাদের যেটুকু পড়াশোনা হয়েছিল তা রাজদরবারগুলোর শিক্ষকদের অবদান । দাদু সংস্কৃত আর ফারসি লিখতে-পড়তে পারতেন । বাবা ইংরেজি ভাষা আয়ত্ব করে ফেলেছিলেন ।

             দাদু বিভিন্ন সময়ে আফগানিস্তানের কাবুল-কান্দাহার এবং পাকিস্তানের বাহাওলপুর, চিত্রাল, হুনজা, ফুলরা, মাকরান ও লাহোরে  ছিলেন। আফগানিস্তানে ব্রিটিশদের যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর লাহোরে চলে যান । বড়জেঠার মুখে শুনেছি যে বাহাওলপুরের সেই সময়ের ডাকটিকিটে আমিরের পোরট্রেট ছিল দাদুর আঁকা । ওই অঞ্চলের ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদির মাংস আর শুঁটকিমাংস খাওয়ার সঙ্গে ঠাকুমা আর বাবার ভাইরা নিজেদের মানিয়ে নিলেও বাবা পারেননি, এবং তিনি সারা জীবন শাকাহারী হয়ে যান । বাবার মুখে শুনেছি যে বাজারে ঝোলানো গোরু, মোষ, ইয়াক আর কাটা উটের মাংস দেখার পর উনি আর মাংস খেতে পারতেন না, তাই নিরামিশাষী হয়ে যান । দুম্বা  একরকমের ভেড়া যার ল্যজের জায়গায় বাড়তি মাংস গজায়, আর বাড়তি লেজের মাংস, বড়জেঠার বক্তব্য অনুযায়ী, ছিল খুবই সুস্বাদু ।

             ফোটোগ্রাফির সূত্রেই দাদুর সঙ্গে উত্তর চব্বিশ পরগণার পাণিহাটি-নিবাসী আমার দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় হয়েছিল । কিশোরীমোহন ছিলেন ম্যালেরিয়া রোগের উৎস আবিষ্কারক রোনাল্ড রসের সহগবেষক । রোনাল্ড রস স্বদেশে ফিরে যাবার পর কিশোরীমোহন ম্যালেরিয়া রোগের কারণ ও তা প্রতিরোধ করার জন্য গ্রামে-গঞ্জে ম্যাজিক লন্ঠনে স্লাইড দেখিয়ে প্রচার করতেন । এই স্লাইডগুলো তৈরি করে দিয়েছিলেন দাদু । কিশোরীমোহন তাঁর বড় মেয়ে অমিতার সঙ্গে বাবার বিয়ে দেন । বিয়ের সময়ে মায়ের বয়স ছিল ১৪ বছর আর বাবার ১৮ বছর । কিশোরীমোহন সম্পর্কে উইকিপেডিয়া আর নেটে অন্যত্র তথ্য আছে । বাবা নিজে শাকাহারী হলেও মাকে বাধ্য করেননি তাঁর আহারের রুচি অনুসরণ করতে ; আমি আর দাদা দুজনেই আমিষাশী । দাদু প্রতি বছর দুর্গা পুজোর সময়ে উত্তরপাড়া ফিরে যেতেন ; ছেলেদের বিয়ে দেয়ার কাজটাও সেরে নিতেন সেই সময়টুকুর মধ্যে ।

             দ্বারভাঙ্গা মহারাজের পরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার জন্য ডাক পড়লে দাদু সপরিবারে পাটনায় যান, আর সেখানেই হৃদরোগে মারা যান । পুরো পরিবার নির্ভরশীল ছিল দাদুর ওপর ; তিনি মারা যেতে ঠাকুমা বিপদে পড়েন । পাটনায় তাঁরা একটি মাটির দেয়ালের ওপর টালির চালার বাসা ভাড়া করে বিভিন্ন উপায়ে টাকা রোজগারের চেষ্টা করেন, কিন্তু কিছুতেই সফল না হতে পারায় বাবা দাদুর প্রতিষ্ঠিত সংস্হা ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’ এর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ছবি আঁকা আর ফোটো তোলার একটি স্হায়ী দোকান চালাবাড়ির কাছেই, বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে, খোলেন । ঠাকুমার জাঠতুতো ভাই কলকাতা মিউজিয়ামের সহকিউরেটার লেখক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুপারিশে বড়জেঠা  পাটনা মিউজিয়ামে চতুর্থ বর্গের একটি চাকরি পান । পরে অবশ্য তিনি নিজের যোগ্যতার দরুন পদোন্নতি পেয়ে পাটনা মিউজিয়ামের ‘কিপার অব পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার’ হয়েছিলেন। বড়জেঠা মাটির মূর্তি তৈরি করায় আর অয়েল-পেইন্টিং আঁকায় দক্ষ ছিলেন । ছোটোবেলায় ছুটির দিনে আমি মিউজিয়ামের এক থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে বেড়াতুম, চৌকাঠ ডিঙোতেই প্রাগৈতিহাসিক থেকে মহেঞ্জোদরোয়, সেখান থেকে অশোকের রাজত্বে !

             দাদু মারা যেতে, ঠাকুমা উত্তরপাড়ার বসতবাড়িতে, যা অবহেলায় খণ্ডহরের চেহারা নিয়ে ফেলেছিল,  থাকতে চলে গেলে, পরিবারের আর্থিক ভার পুরোপুরি এসে পড়েছিল বাবার কাঁধে । ঠাকুমা ছেলেদের আর তাদের বোউদের বলে দিয়ে যান যে আমার মা সংসারটাকে সামলাবেন । যেকোনো কারণেই হোক মেজজেঠা, নকাকা আর বিশেখুড়োর স্বভাব আর আচরণ এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে আমরা শৈশবে শুনতুম যে এঁরা কিছুটা অপ্রকৃতিস্হ, আধপাগল । দোকানের কাজে তাঁদের তেমন আগ্রহ ছিল না ; তাঁরা প্রকৃতই শিল্পীচরিত্রের বিপন্ন বিস্ময়ে আক্রান্ত অস্বাভাবিকতা পেয়েছিলেন । মেজজেঠা ঘুম থেকে উঠতেন দুপুরবেলা, তারপর জলখাবার খেতেন কোনো দোকান থেকে লুচি আলুর তরকারি কিনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কখনও চুল আঁচড়াতেন না, বাড়ি ফিরে দাঁত মেজে স্নান করে বিকেলের দিকে দোকানে পৌঁছোতেন, এবং একটি ফোটোর সামনে বসে তাকে মাসখানেকে আঁকা অপূর্ব  ছবিতে দাঁড় করাতেন । নকাকা অনেক ভোরে উঠতেন, সবাইকে, শিশুদেরও ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন, স্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ কথা বলতেন না, জুতো পরার অভ্যাস ছিল না, কোরা ধুতি পরতেন, নিজের ধুতি-শার্ট নিজেই কাচতেন, কোনো এক ফাঁকে দোকানে গিয়ে বাড়িতে করার জন্য বাবার কাছ থেকে ‘কাজ’ চেয়ে আনতেন । ছোটোকাকা মাঝরাতে নিজের ঘরে ছোটোকাকিমার নানা আঙ্গিকের পোশাকহীন ফোটো তুলতেন আর দোকানে গিয়ে বাবাকে সাহায্য করার নাম করে ডার্করুমে ঢুকে সেই ‘অপ্সরা’ ফোটোগুলো প্রিন্ট করে নিতেন । উনি যখন উত্তরপাড়ায় পাকাপাকি চলে গেলেন তখন তাড়াহুড়োয় অ্যালবামগুলো নিয়ে যেতে ভুলে যান । আমি আর পিসতুতো দাদা সেগুলো আবিষ্কার করেছিলুম । ছোটোকাকা ৯০ বছর বয়সে মারা যান, নিঃসন্তান ; উত্তরপাড়ার বাড়ির অংশ ছোটো শালার প্রথম পক্ষের মেয়েকে দিয়ে গেছেন ।        

     নয়

             বাবা ভোরবেলা বেরিয়ে যেতেন আর ফিরতেন বেশ রাত করে । ফোটো তোলা, জিনিসপত্র বিক্রি আর ডার্করুমের কাজ তাঁকে একা করতে হত বলে ভোরবেলা জলখাবার খেয়ে সোজা গিয়ে ডার্করুমে ঢুকতেন, তারপর রাতে দোকান বন্ধ করার পর আবার ঢুকতেন ডার্করুমে । বিহারে সেসময় তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, তাই কাজ পেতে অসুবিধা হতো না । মা আর বাবা দুজনের চরিত্রেই যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তা হল সবায়ের সঙ্গে মানিয়ে চলা । বাবা বাড়ির প্রধান রোজগেরে হলেও নিজের ভাইদের আর তাদের ছেলে-মেয়েদের, মানে আমাদের জাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোনদের, সমান চোখে দেখতেন। বড়জেঠা ইমলিতলা বাড়ির ট্যাক্স দিতেন আর সবজি কিনতেন, বাবা বাদবাকি সমস্ত খরচ করতেন, ঠাকুমাকে টাকা পাঠাতেন, উত্তরপাড়ার বাড়ির ট্যাক্স দিতেন । চালগমের দোকানদারকে মাসে একবার, মায়ের তৈরি ফিরিস্তির কাগজ, দোকানে যাবার পথে বাবা দিয়ে যেতেন আর সে ইমলিতলার বাড়িতে পাঠিয়ে দিত । পরিবারের সদস্যদের পোশাকের জন্য বাবা দর্জিকে বলে রেখেছিলেন, তার দোকানে গিয়ে মাপ দিয়ে দিতে হতো, সে তৈরি করে বাড়ি পাঠিয়ে দিত । একইভাবে ছিল জুতোর দোকানের সঙ্গে বন্দোবস্ত । চুল কাটার জন্য মাসে একবার নাপিত আসত, পরে বাবার কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে নিত ।

             ইমলিতলার বাড়িতে বাবা-মা-দাদা-আমি যে ঘরটায় থাকতুম সেটাই ছিল বাড়ির সবচেয়ে ছোটো ঘর । লন্ঠনের আলোয় পড়াশুনা করতে হতো । চেয়ার-টেবিল ছিল না, দোকানের মালপত্র যে প্যাকিংবাক্সতে আসত তার ওপর চাদর পেতে বই রাখার ব্যবস্হা ছিল । পাড়ার কুসঙ্গ-কুখ্যাতির প্রভাব দাদার ওপর পড়তে পারে অনুমান করে ম্যাট্রিক পাশের পর ১৯৪৯ সালে দাদাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল পাণিহাটিতে থেকে কলকাতায় পড়াশোনা করার জন্য । কলকাতায় দাদা সিটি কলেজে ভর্তি হন । কলেজে বন্ধু হিসেবে পান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, আনন্দ বাগচী প্রমুখ তরুণ কবিদের । দাদা বিহার সরকারের মৎস্য বিভাগে চাকরি পেলে তাঁর পোস্টিঙের জায়গায় বন্ধুরা একা বা দলবল নিয়ে পৌঁছোতেন । ছোটোবেলায় আমি একবার তাড়ি খেয়েছিলুম, মানে পাড়ার এক সর্বজনীন দাদু খাইয়ে দিয়েছিল । মুখে তাড়ির গন্ধ পেয়ে মা আমায় আমাদের ঘরে শেকল তুলে বন্ধ করে দিয়েছিলেন ; বাবা রাতে বাড়ি ফিরলে শেকল খোলা হয় । মায়ের সব সময় আশঙ্কা ছিল যে আমরা দুই ভাইও মেজদার মতন অসামাজিক চরিত্রের মানুষ হয়ে যেতে পারি । পাড়ায় মেলামেশায় কোনো নিষেধাজ্ঞা কিন্তু ছিল না । ছোটোবেলায় চোর-পুলিশ খেলতে গিয়ে অনেকের শোবার ঘরে ঢুকে খাটের তলায় লুকোবার স্মৃতি আছে ।

             ইমলিতলার বাড়িতে জলের কল ছিল না ; বড়জেঠা তো অফিস চলে যেতেন, জল ভরে এনে দেবার লোক না এলে দুপুরে বাবা যখন দোকান থেকে আসতেন, অনেক সময়ে নিজের স্নান করার জল নিজেই কল থেকে ভরে আনতেন। শীতকালেও ঠাণ্ডা জলে স্নান করতেন । দাদা আর আমি ইমলিতলায় রাস্তার কল থেকে জল ভরে এনেছি, রাস্তার কলে স্নান করেছি । বাবার নির্দেশ ছিল যে বাড়ির সব কাজ আমাদেরও করতে হবে, প্রয়োজনে কয়লা ভাঙা আর উনোন পরিষ্কার, জঞ্জাল ফেলে আসাও । বাবা রাস্তার কলে স্নান করতে লজ্জা পেতেন । ২০০৫ – ২০০৮ নাগাদ আমি কলকাতার রাস্তা থেকেও খাবার জল ভরে আনতুম পেপসির বোতলে করে, কেননা তিন তলায় কোনো ভারি জলের টিন নিয়ে বা মিনারাল ওয়াটারের বড়ো বোতল নিয়ে রিকশাঅলা উঠতে চাইত না । মাঝে-মাঝে দাদার বাড়ি গিয়ে দুটো থলেতে পেপসির বোতলে জল ভরে আমি আর আমার স্ত্রী সলিলা রিকশা করে নিয়ে আসতুম নাকতলার বাড়িতে। এই সমস্ত অসুবিধার জন্যেই নাকতলার ফ্ল্যাটটা বেচে মুম্বাইতে একরুমের ফ্ল্যাটে চলে আসতে হয়েছে ।

             বাবা চিরকাল শাদা পাঞ্জাবি, ধুতি আর পায়ে পামশু পরতেন । তাঁর ভাইয়েরা শাদা ছাড়া অন্যান্য রঙের শার্ট বা পাঞ্জাবি পরলেও বাবার পোশাকের অন্যথা হতো না, শীতকাল ছাড়া, যখন উনি নস্যি রঙের শাল গায়ে দিতেন, বা ওই রঙের উলের পাঞ্জাবি পরতেন । দোকানে যাবার তাড়ায় বাবার দ্রুত হাঁটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল । ইমলিতলায় থাকতে দুবার ওনার পা দোকানে যাবার পথে  ভেঙে গিয়েছিল ; বাবার পা ভাঙা মানে আর্থিক দিক থেকে বেশ বিপজ্জনক অবস্হা ; দাদাকে গিয়ে দোকানে বসতে হত । উত্তরপাড়া থেকে চাকুরিহীন কোনো জ্ঞাতির ছেলেকে নিয়ে এলেও তাদের অবাঙালি পরিবেশে মানিয়ে নিতে এতই অসুবিধা হত যে কয়েক দিনেই তারা ফেরত চলে যেত । পরে দরিয়াপুরে গিয়ে বাবার যখন আরেকবার পা ভেঙেছিল তখন আমি দোকানদারি করেছি । গরিব হলে যা হয়, গতি কেবল সরকারি হাসপাতাল, সেখানে কিউ, কেননা প্রায়ভেটে কোনো নার্সিং হোম ছিল না সেসময়ে ; এখন তো প্রতিটি রাস্তায় একজন করে হাড়ের ডাক্তার । বড়জেঠির এক বান্ধবীর স্বামী ছিল ছুতোর ; ওনার পা ভেঙে যেতে, জেঠিমার বান্ধবীর  কথামতো বাবার পায়ে বসাবার জন্য ছুতোরকে দিয়ে কাঠের খাপ তৈরি করিয়ে পায়ে বেঁধে রাখার ব্যবস্হা হয়েছিল । প্রথমবার বানিয়ে দেয়া খাপটা দ্বিতীয়বার কাজে লেগে গিয়েছিল ।

             বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে যে দোকান ছিল সেই বাড়ির মালিক উঠে যাবার নোটিস দিলে বাবা পড়েন মহাবিপদে । বিকল্পের সন্ধানে বেরিয়ে তিনি তখনকার বারি রোডে দরিয়াপুরে একটা চালাবাড়ি কেনেন ; সেটা ছিল একজন কামারের হাপর-বসানো ঘর, পেছনে আর পাশে সামান্য জমিতে গাঁজাগাছের ঝোপ । এই এলাকাটাও সেসময়ে গরিবদের পাড়া ছিল, ধারণার অতীত দুস্হ সুন্নি মুসলমানদের পাড়া । বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে যে দোকান ছিল তার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা চলে বেশ কয়েকবছর ; সেই সুযোগে দরিয়াপুরে দোকানঘর তৈরি করে ফেলা হয় । তৈরি হয়ে গেলে পুরোনো দোকানের পাট গুটিয়ে বাবা চলে আসেন দরিয়াপুরে । ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’-এর খ্যাতির কারণে পুরোনো খদ্দেররা দরিয়াপুরে আসত । এখন এই সংস্হা চালায় দাদার বড় ছেলে হৃদয়েশ, জাপানি কোম্পানির প্রস্তাবমতো দোকানের নাম পালটে ফেলেছে ।

             দরিয়াপুরে যখন দোকান তৈরি হচ্ছিল তখন আমি ওই বাড়িতে একা থাকতুম, কেননা ইমলিতলার প্রাত্যহিক মাতালদের চেঁচামেচি আর ঝগড়াঝাঁটির দরুন পড়তে বসে বেশ অসুবিধা হত । তাছাড়া দরিয়াপুরে ইলেকট্রিসিটি ছিল, কলের জল ছিল। ছোটোদের হাতখরচের জন্য বাবা টাকা দিতেন না ; বলতেন যার যা চাই জানিয়ে দাও, কিনে এনে দেব । স্কুলের বাৎসরিক ফলাফলের রিপোর্টে বাবা কখনও কাউকে ‘গুড’ দিতেন না । নব্বুইয়ের কোঠায় মার্কস পেলেও দিতেন না ; বলতেন আরও বেশি পেতে হবে । দরিয়াপুরের বাড়িতে একা থাকলে আমার চরিত্রদূষণ ঘটতে পারে অনুমান করে বছরখানেক পরে মা আর বাবা রাতে শুতে আসতেন । মা টিফিন ক্যারিয়ারে করে রাতের খাবার আনতেন । দিনের বেলা ইমলিতলায় গিয়ে খেতে হতো । দরিয়াপুরের বাড়িতে একা থাকার সময়ে বন্ধুদের নিয়ে কিঞ্চিদধিক চরিত্রদূষণ যে ঘটত না তা বলা যাবে না ।

             বাবা আর মা দুজনেই মন্দিরে গিয়ে পুজো দেয়া বা তীর্থকর্ম করা ইত্যাদিতে আগ্রহী ছিলেন না ; আমার মনে হয় কাজের চাপে উনি সংস্কারমুক্ত করে ফেলেছিলেন নিজেকে । পরে দোকানের কাজ ছেড়ে দেবার পর বাবা হিন্দুধর্ম আর ঈশ্বর দেবী-দেবতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন । আমি কখনও বাবা-মাকে তীর্থক্ষেত্রে বেড়াতে যেতে দেখিনি ।   জেঠা-কাকারাও কেউ আগ্রহী ছিলেন না ; পাটনার বাইরে যেতে হলে তাঁরা যেতেন কেবল দেশের বাড়ি, অর্থাৎ উত্তরপাড়ায় । তবে বাবা নিয়মিত পৈতে বদলাতেন, একাদশীর দিন লুচি খেতেন । কালীঘাটের কালী আমাদের পারিবারিক দেবতা, যেহেতু তা আমাদের কোনো পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত, সেকারণে বাড়িতে পারিবারিক দেবতা আর তার সেবাযত্ন করার প্রয়োজন হতো না । গলায় মালার মতন ঝুলিয়ে পৈতে পরতেন বড়জেঠা আর ছোটোকাকা, যদিও খাওয়ার কোনো নিষেধ মানতেন না, মেজজেঠা কখনও পৈতে পরতেন আবার কখনও কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে দিতেন ।  দাদার আর আমার ছোটোবেলায় পৈতে হয়েছিল বটে কিন্তু আমরা বছর শেষের আগেই স্বরূপে এসে জলাঞ্জলি দিয়েছিলুম । পৈতেহীন হবার কারণে বাবা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন বলে মনে হয় না ; এই প্রসঙ্গে কখনও কোনো কথা তোলেননি।

            মা, বাবা এবং শিক্ষক, যে তিনজন মানুষ ব্যক্তিজীবনের অভিমুখ গড়ে দেয়, আমার জীবনে মা আর বাবার ভূমিকাই প্রধান । প্রকৃত অর্থে আমি কোনো শিক্ষক সেই সময়ে পাইনি যখন তা জরুরি ছিল । প্রাইমারি স্তরে ক্যাথলিক কনভেন্টে পেয়েছিলুম সিসটার আইরিনকে আর যাযক ফাদার হিলম্যানকে । শৈশবের বইতে বর্ণিত সমস্ত জিনিস যাতে নিজের চোখে দেখে যাচাই করতে পারি তার দিকে খেয়াল রাখতেন সিসটার আইরিন আর স্বদেশ আয়ারল্যাণ্ডে গেলে অনেককিছু সংগ্রহ করে আনতেন, স্কুল সংল্গন ফার্মে নিয়ে গিয়ে ফল, ফুল, গাছ, জন্তুতের চাক্ষুষ করাতেন । ফাদার হিলম্যানের সৌজন্যে আমি কনভেন্টে ভর্তি হয়েছিলুম ; উনি ফোটো তুলতে ভালোবাসতেন আর বাবার সঙ্গে ওনার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল, আমাকে দোকানে দেখতে পেয়ে সাড়ে তিন বছর বয়সে নিয়ে গিয়ে ট্রানজিশান ক্লাসে ভর্তি করে দেন; সপ্তাহে একদিন চার্চে বাইবেল ক্লাসে নিয়ে গিয়ে ওল্ড আর নিউ টেস্টামেন্টের কাহিনি শোনাতেন । পরে যখন ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন সেমিনারিতে ক্লাস সিক্সে গিয়ে ভর্তি হলুম, কোনো শিক্ষকের সঙ্গে নৈকট্য গড়ে উঠল না ; এই স্কুলে যিনি আমাকে বাংলা সাহিত্যে আগ্রহী করলেন, তিনি গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তী , আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসের সুমিতাদি।

             মা আর বাবার কাছ থেকে যা পেয়েছি তা হল সততা, নিজের বিশ্বাসের সমর্থনে একক লড়াই করার চারিত্র্য । বাবা দোকানদার হয়েও সৎ ছিলেন, যা আজকের দিনে অকল্পনীয় । কেবল সৎ নয়, তাঁর ছিল সৎসাহস । হাংরি আন্দোলনের সময়ে আদালতের মামলায় বন্ধুরা যখন আমার বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে রাজসাক্ষী হয়ে গেল, আর লড়াইটা আমার একক হয়ে দাঁড়াল, তখন আমি আমার চরিত্রগঠনে মা আর বাবার অবদানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলুম । বাবা কলকাতায় লালবাজারে গিয়ে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন যে অমন মকদ্দমা কেন করা হয়েছে আর তখনই জানা যায় যে কলকাতার কয়েকজন সমাজকর্তা-বুদ্ধিজীবীর নালিশ কাজ করেছে এর পেছনে, যাদের বলা হয় এসট্যাবলিশমেন্টের ধারক-বাহক । মকদ্দমা চলার সময়ে বাবা কয়েকবার পাটনা থেকে দুএক দিনের জন্য দোকান বন্ধ করে কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে আসতেন । যারা আমার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিল আর চামড়া বাঁচাবার জন্য রাজসাক্ষী বা সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেল তাদের পরিবারের কাউকে কোনো দিন আসতে দেখিনি কোর্টে ; অর্থাৎ তাঁরা তাঁদের ছেলের সাহিত্যকর্মকে সমর্থন করতে পারেননি।

             বাবা আমাদের বাড়ির ক্ষমতাকেন্দ্র হলেও ছোটোদের কাউকে শাসন করতেন না । তাঁর কাছে অভিযোগ জানালে তিনি বলতেন, “অ, ও শুধরে নেবে ।” তারপর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে বলতেন, “কী, শুধরে নিবি তো ? বড় হয়েছিস, শুধরে নিতে শেখ।” বড়জেঠা শাসন করতেন, নিজে থেকে নয়, জেঠিমা-কাকিমারা অভিযোগ করলে, কিন্তু অভিযোগ করলে তিনি বিরক্ত হতেন । বড়জেঠার দুই মেয়ের বিয়ে আমার শৈশবেই হয়ে গিয়েছিল । মেজজেঠা আর কাকাদের মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্হা করেন বাবা, তাঁদের শৈল্পিক উদাসীনতায় ওদের বয়স বেড়ে যাচ্ছিল ; তাছাড়া বিয়ের খরচের ব্যাপারটাও ছিল । মেজজেঠার এক মেয়ে মীনাক্ষী একজন বিহারি ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলে মেজজেঠা অমত জানান ; মেজজেঠার অমত হওয়ায় বাবা তাঁকে বোঝালেও তিনি রাজি হননি । বাবা তাঁর বিরুদ্ধতা করে মেজজেঠাকে অপমানিত করতে চাননি । শেষে আমাকে টাকাকড়ি দিয়ে বলেন যে ওরা কোথায় গিয়ে বিয়ে করতে চাইছে সেখানে গিয়ে সম্প্রদান করে আয় । আমার ছোটোশালী রমলা এক যুবককে বিয়ে করতে চাইলে নাগপুরে অভিভাবকরা রাজি হলেন না, তখন তার বিয়েও দরিয়াপুরের বাড়ি থেকে হল । রমলা ২০১৬ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে ।

    দশ

            দাদা যখন চাইবাসায় পোস্টেড ছিলেন সেখানে সুধীর চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে বেলার সঙ্গে পরিচয় হয়, আর দাদা পাটনায় গিয়ে বাবাকে বিয়ের কথা জানাতে তিনি তক্ষুনি রাজি হয়ে যান । দাদা আসলে ওই বাড়ির সাহিত্যানুরাগী বিবাহিতা যুবতী মন্টিদির প্রেমে পড়েছিলেন, মন্টিদি আর দাদা দুজনেই স্হিতাবস্হা বজায় রাখা মনস্হ করেন । পরিবারটির সঙ্গে যাতে চিরকালীন যোগাযোগ থাকে তাই দাদা বেলাকে বিয়ে করেন । শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাস ‘কিন্নর কিন্নরী’তে বিস্তারিত লিখেছেন এ-ব্যাপারে ।

             আমি অফিসের কাজে নাগপুরে গিয়ে কয়েকদিনের পরিচয়ের পরই রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় আর সহকর্মী সলিলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ের প্রস্তাব দিতে ওর অভিভাবকরা সেদিনেই সায় দেন । বাবাও টেলিগ্রামে অনুমোদন জানিয়ে দেন । কয়েকদিনের পরিচয়ের পরই এই বিয়েকে মা আর বাবা বলতেন, “তোদেরটা বৈপ্লবিক বিয়ে, পরিবারদের মাথা গলাতে হল না, হপ্তার পর হপ্তা রোদ-বৃষ্টি ঠেঙিয়ে প্রেম করতে হল না, ব্যাস, একজন আরেকজনকে বললি বিয়ে করব, করে ফেললি ।”

           আমি লেখালিখির চেষ্টা করছি, মায়ের কাছে সেকথা জানতে পেরে ১৯৫৮ সালে বাবা আগফা-গেভার্ট কোম্পানির একটা দামি ডায়েরি দিয়েছিলেন, আর তাতেই আমি কবিতা মকসো করা শুরু করেছিলুম । বাড়িতে ইংরেজি ভাষার পছন্দের বইয়ের সংগ্রহ গড়তে চাই জানতে পেরে বাবা বলতেন বইয়ের তালিকা তৈরি করে দিতে । বইয়ের দোকানে গিয়ে বই পছন্দ করে নিতুম আর পেয়ে যেতুম । বাংলা বই, বিশেষ করে কবিতার বই দাদা কলকাতা থেকে নিয়ে আসতেন । পরে বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকেও প্রচুর বই আর পত্রিকা পেতুম । হাংরি আন্দোলনের সময়ে কলকাতার পুলিশ আমায় গ্রেপ্তার করতে এসে আমার বইগুলো নিয়ে সারা ঘরে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলেছিল । বাবার দোকানের কাচের আলমারি ভেঙে দিয়েছিল । মায়ের বিয়ের তোরঙ্গ ভেঙে লণ্ডভণ্ড করার সময়ে ওনার বিয়ের পুরোনো বেনারসি ভাঁজ থেকে ছিঁড়ে গিয়েছিল । কিন্তু আমাকে যখন কোমরে দড়ি বেঁধে, হাতে হাতকড়া পরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাটিয়ে নিয়ে গেল পুলিশ,  তখন বাবাকে বেশ বিচলিত দেখেছিলুম, যা উনি সচরাচর হতেন না । ছোটোবেলায় আমি বাড়ি থেকে বেশ কয়েকবার পালিয়েছি ; ফিরে এসে মনে হয়নি যে বাবা বিচলিত ; উনি আমাকে এই প্রসঙ্গে কোনো কথা জিজ্ঞাসাও করতেন না । পরে, আমার মেয়ের কাছে গল্প করেছিলেন যে আমি ওনাদের না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালাতুম।

             ১৯৬৩ সালের এপ্রিলে অ্যালেন গিন্সবার্গ আমাদের দরিয়াপুরের বাড়িতে এসে ছিলেন কয়েক দিন । তিনি নানা শহরে ঘুরে বেশ কিছু ফিল্মে ফোটোম তুলেছিলেন আর সেগুলো বাবাকে দেন ডেভেলাপ করার জন্য । বাবা ডেভেলাপ করে দ্যাখেন গিন্সবার্গ কেবল নুলো, ভিখারি, দুস্হ, পথের পাশে অসুস্হ লোক, কুষ্ঠরোগি– এদের ফোটো তুলেছে । তখন গিন্সবার্গের সঙ্গে ওনার একচোট ঝগড়া হয়েছিল । বাবা গিন্সবার্গকে বলেছিলেন, “তোমরা যতই বড় কবি-লেখক হওনা কেন, আমাদের দেশটাকে এইভাবেই দেখাতে চাইবে ; কেন ? ফোটো তোলার আর কোনো বিষয় কি নেই !” গিন্সবার্গ সম্পর্কে যে গবেষকরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তাঁদের সবাইকে এই ঘটনার কথা জানালেও, কেউই নিজেদের লেখায় এই বিতর্কটা অন্তর্ভুক্ত করেননি । পরে , পাটনার বাড়িতে বা কলকাতায়, বিদেশিরা এলে আমি তাঁদের বলতুম যে ফোটো তুলে থাকলে দেশে ফিরে ডেভেলাপ আর প্রিন্ট করিও ।

             আমার মায়ের জন্ম ১৯১৬ সালে,   পানিহাটিতে । মায়ের ডাক নাম ভুল্টি ।  মায়ের বাবা, কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, পানিহাটির  রামচাঁদ ঘাট রোডে ‘নিলামবাটী’ নামে এক একান্নবর্তি পরিবারের সদস্য ছিলেন ।  কিশোরীমোহন ছিলেন, কলকাতা ও সেকেন্দ্রাবাদে, ম্যালেরিয়া রোগের কারণ নির্ণয়কারী  ও ১৯০২ সালে সেকালে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ডাক্তার রোনাল্ড রস-এর সহকারী । তাঁর অবদানের জন্য ১৯০৩ সালে দিল্লি দরবারের সময়ে কিশোরীমোহনকে সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছিল । ২০১৩ সালে প্রকাশিত তাঁদের ‘দি ফ্লাইং পাবলিক হেল্হ টুল : জেনেটিকালি মডিফায়েড মসকিটোজ অ্যান্ড ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল’ ( সায়েন্স অ্যাজ কালচার, ল্যাংকাস্টার, ইউ কে ) গবেষণাপত্রে উলি বিজেল এবং ক্রিস্টোফ বোয়েট অধ্যাপকদ্বয় জানিয়েছেন যে উপনিবেশের নেটিভ হবার কারণে কিশোরীমোহনের নাম রোনাল্ড রসের সঙ্গে সুপারিশ করা হয়নি ।    সমাজ সেবার কাজে স্ত্রীর গয়না এবং পৈতৃক সম্পত্তি বেচে, আর সঞ্চয়ের পুঁজি খরচ করে তিনি দেউলিয়া হয়ে যান, আর মায়ের বিয়ের কয়েক বছর পরই মারা যান ।

                সংসারের ক্ষমতা মায়ের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবার পর মায়ের চরিত্রে লুকোনো কিশোরীমোহন বেরিয়ে আসে । প্রায়ই দেখতুম ইমলিতলার প্রতিবেশিরা  এসে মায়ের কাছে নিজেরদের আর্থিক দৈন্য আর পারিবারিক দুর্দশার গল্প করছে, আর মা তাদের সাহায্য করছেন, পয়সাকড়ি দিয়ে তো বটেই, চাল-ডাল, পুরোনো বাসনপত্র আর ব্যবহৃত জামাকাপড় দিয়ে । মায়ের বোনেদের বিয়ে আরও গরিব পরিবারে হয়েছিল বলে পুজোয় পাওয়া শাড়ি-চটি ইত্যাদি নিজে না পরে বোনেদের বা নিলামবাটীর দুস্হ জ্ঞাতিদের পাঠিয়ে দিতেন বা যখন নিজে যেতেন তখন নিয়ে যেতেন ।  যদিও মা পরিবারের ডি ফ্যাক্টো কর্ত্রী ছিলেন, কিন্তু ইমলিতলার বাড়িতে মা-বাবা-দাদা-আমি থাকতুম সবচেয়ে ছোটো ঘরটায় । লন্ঠনের আলোয় পড়াশোনা ।

             সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকার চারিত্রবৈশিষ্ট্যের দরুণ বড়জেঠা সংসারের সমস্ত ব্যাপারে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করতেন । আমার মনে আছে, ১৯৫১ সালে যে বছর প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল, কোন দলকে ভোট দেয়া হবে তা নিয়ে আলোচনার শেষে মায়ের নির্ণয় সবাই মেনে নিয়ে ছিলেন, অর্থাৎ যার যে দলকে ইচ্ছে ভোট দেবে ।  কলকাতায় নাকতলায় থাকতে অবাক লাগত দেখে যে বাড়ির কর্তা যে দলের সমর্থক, পরিবারের সকলেই সেই দলকে ভোট দ্যায়, অথচ তারাই আবার ডাইন্যাস্টিক পলিটিক্সের তর্ক তোলে !

             স্কুলে ভর্তি হয়ে টের পাই যে মা শুদ্ধ হিন্দি জানেন না, ইমলিতলার ‘ছোটোলোকি’ বুলি দখল করে ফেলেছেন, আর তার বহু শব্দ যে শুদ্ধ হিন্দিতে অশোভন, এমনকি অশ্লীল, তা উনি অনেক পরে জানতে পারেন, যখন আমরা ইমলিতলা ছেড়ে দরিয়াপুরে সুন্নি মুসলমান পাড়ায় চলে যাই । পানিহাটিতে মেয়েদের স্কুল তখনও ছিল না বলে মা নিরক্ষর ; নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন দাদা স্কুলে ভর্তি হবার পর ।

             ইমলিতলার বাড়িতে হিন্দুত্ব সামলাবার কাজ ছিল পুজারী বাড়ি থেকে আসা বড়-জেঠিমার । সেকারণে মা এবং কাকিমারা প্রতিদিনের ধর্মাচরণ থেকে নিজেদের আর আমাদের মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন । জনৈক পাদরির আর্থিক সৌজন্যে প্রাইমারি স্তরে আমি ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিলুম ; মা ঘটিতে গরম জল ভরে আমার শার্ট-প্যান্ট আয়রন করে রাখতেন। আমার বাংলা বনেদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল বলে মায়ের নির্দেশে আমাকে ব্রাহ্ম স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করা হয়েছিল ।

                দরিয়াপুরে পাকাপাকি চলে আসার পরও ইমলিতলার সদস্যদের দায়িত্ব মা ছাড়েননি ; সপ্তাহে এক দিন গিয়ে টাকাকড়ি আর চাল-ডাল-আনাজের ব্যাপারটা সামাল দিয়ে আসতেন । গোলা রোডের এক বানিয়ার দোকানে তালিকা দিলে সে যাবতীয় জিনিস ইমলিতলা আর দরিয়াপুরে পাঠিয়ে দিত । পুজোর সময়ে পোশাকের ভেদাভেদ মেটাতে সবায়ের জন্য ছিল একই কাপড়ের শার্ট আর ফ্রক, এমনকি জেঠা-কাকারাও সেই কাপড়ের শার্ট পরতেন ।   দাদা চাকরি পাবার পর দাদার চাকুরিস্হলে গিয়ে মা মাঝেমধ্যে সপ্তাহখানেকের ছুটি কাটিয়ে আসতেন । দরিয়াপুরের বাড়িতে কাজের মাসি রান্না করে দিত । নিম্নবর্ণের হাতে রাঁধা ভাত বাবা খেতেন না বলে ভাতটা আমিই বসিয়ে দিতুম । রান্নায় মাকে সাহায্য করতে হতো বলে ডাল-তরকারিও রাঁধতে শিখে গিয়েছিলুম ।    

             হাংরি আন্দোলনের সময়ে দাদার আর আমার বন্ধুরা কোর্টে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে গেছেন শুনে মা, যিনি ছিলেন অত্যন্ত চাপা প্রকৃতির, নিজের ক্রোধ সামলাতে পারেননি । আমি তাদের চিঠি ইত্যাদি ছিঁড়ে ফেলছি দেখে বলেছিলেন, ‘সব নিয়ে গিয়ে গুয়ের ডাবায় ফ্যাল ; সব কটাই আহাম্মক, অকৃতজ্ঞ ।’  আমার আর দাদার লেখালিখি সম্পর্কে উনিই ছিলেন প্রধান উৎসাহদাত্রী । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নামে যে কবিতাটা নিয়ে মকদ্দমা হয়েছিল সেটা মা-বাবা-ঠাকুমা সকলেই পড়েছিলেন ।   হৃদরোগের লক্ষণগুলোর সঙ্গে তখন আমরা ততটা পরিচিত ছিলুম না, মাও তাঁর কষ্টের কথা বলতেন না । লখনউতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮ই নভেম্বর ১৯৮২  মারা যান ।           

             ১৯৫০ থেকে চিনতুম ফণীশ্বরনাথ রেণুকে, হিন্দি ভাষার সাহিত্যিক, যখন তিনি নেপালের রাণাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আহত হয়ে ভর্তি ছিলেন পাটনার ভোমরপোখরের নার্সিং হোমে, বড়দিদের বাড়ির ঠিক সামনে, লতিকাদি সেখানে নার্স ছিলেন, লতিকা রায়চৌধুরী, রেণু ওনার প্রেমে পড়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে করে রাজেন্দ্রনগরের ফ্ল্যাটে থাকতেন, জানতেন না আমি লেখালিখি করি । ১৯৬৪ সালে গ্রেপ্তার হবার পর জানলেন, আর হিন্দি পত্র-পত্রিকায় আমাদের নিয়ে নিয়মিত লিখলেন, যখন কিনা বাঙালা পত্র-পত্রিকা সেসময়ে আমাদের পোঁদে বাঁশ করে চলেছে। রেণু উদ্বুদ্ধ করলেন এস এইচ বাৎসায়ন অজ্ঞেয়কেও, আর উনিও আমাদের হয়ে কলম ধরলেন । রেণুর “বনতুলসী কা গন্ধ” বইতে “রামপাঠক কা ডায়েরি” নামের গদ্যে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন হাংরি আন্দোলন নিয়ে । ওনার রাজেন্দ্রনগরের বাড়িতে প্রায়ই যেতুম সন্ধ্যায় মদ খেতে, আমি নিয়ে যেতুম গাঁজা, বেশ জমতো, আমাদের আড্ডা, অনেক তরুণ হিন্দি কবি-লেখকও আসতো । সকালে পৌঁছোলে তাড়ি খাওয়া হতো, তাড়ির ওপর এলাচগুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে । রেণু মারা গেছেন ১৯৭৭ সালে । লতিকাদিকে রেণুর প্রথম পক্ষের ছেলেরা গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে মারা যান ।

             ১৯৬৫ সালে হিন্দি কবি রামধারীসিং দিনকর ডেকে পাঠিয়েছিলেন ওনার বাড়ি, রেণুর বাড়ি যাবার পথেই ওনার বিশাল বাড়ি, ১৯৬৪ পর্যন্ত এম পি ছিলেন, সবে ফিরেছেন দিল্লি থেকে, বললেন, “আমি তোদের সম্পর্কে শুনেছি আর তোদের বিপ্লবকে সমর্থন করি।” বিপ্লব শব্দটা ব্যবহার করতে শুনে কিছুটা অবাক লেগেছিল, বুঝতে পেরে উনি বললেন, উনি একজন “খারাপ গান্ধীবাদী” কেননা যখন দ্রোহ দরকার তখন গান্ধীবাদে নিজেকে বেঁধে রাখলে চলে না । বলেছিলেন, যেখানে-যেখানে বক্তৃতা দিতে ডাকবে সেখানে-সেখানে তোদের সম্পর্কে বলব।” ওনার বক্তৃতার ফলে বহু হিন্দি পত্রিকায় আমার ফোটো আর হাংরি আন্দোলনের খবর বেরোতো । দিনকর মারা গেছেন ১৯৭৪ সালে ।

             ১৯৬৪ সালে তারাশঙ্করের টালার বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলুম, তারাশঙ্করের মামারা পাটনার, ওনারা বলেছিলেন দেখা করতে, তারাশঙ্কর কথা বলতে চান আমাদের সঙ্গে । ওনাকে আমাদের বুলেটিনগুলো দিলুম । রেখে নিলেন । মেদিনীপুরে বক্তৃতা দিতে গিয়ে হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে বলে এলেন । পরে যখন রামধারি সিং দিনকরকে তারাশঙ্করের বক্তৃতার কথা বলেছিলুম, দিনকর বলেছিলেন, “ওয়হ পুরানে খেয়ালাতকে হ্যাঁয়, জানতা হুঁ উনহে।”

             ১৯৭৫ নাগাদ কলকাতায় দেবী রায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে দেবী জানালো যে অন্নদাশঙ্কর রায় আমার সঙ্গে দেখা করতে চান । জানি না ১৯৬৪-৬৫ সালে দেখা করতে চাননি কেন । আমি তখন লেখালিখি করতে পারছি না, মনেই আসতো না কোনো কথা গুছিয়ে লেখার । ওনার বাড়ি গেলুম । রফিক হায়দার নামে একজন বাংলাদেশী কবি ছিলেন ওনার বাড়িতে, কিন্তু মনে হল তিনি আমাদের আন্দোলনের কথা শোনেননি, সম্ভবত তখন কলকাতা থেকে আন্দোলন চলে গেছে উত্তরবঙ্গে আর ত্রিপুরায় । অন্নদাশঙ্কর নিজের কথাই বলে গেলেন, আমি আর দেবী শ্রোতা, কেন দেখা করতে চেয়েছিলেন বুঝতে পারিনি । ওনার কথাগুলো দেবী লিখে নিয়েছিল একটা খাতায় ।

             ১৯৪৮ সালে, প্রথম নিল ডাউন হয়েছিলুম রামমোহন রায় সেমিনারিতে, হিন্দি স্যারের ক্লাসের বাইরে বারান্দায়, বৃষ্টিতে হিন্দি বই ভিজে চুপচুপে হয়ে গিয়েছিল বলে, বলেছিলেন, “রাষ্ট্রভাষাকা সন্মান করনা সিখো গধহা কঁহিকা ।” বারান্দার বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে, তখনও জানতুম না যে ওটা রাষ্ট্রভাষা নয়, সরকারি ভাষা । গাধাদের দেখেছি বটে চুপচাপ দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে, আর ছাতামাথায় মানুষদের দিকে তাকিয়ে কান নাচিয়ে হাসছে ।

    এগারো

             ১৯৮৮ সালে, ট্যুরে যাবো বলে লখনউয়ের বাস স্ট্যাণ্ডে অপেক্ষা করছিলুম ; হঠাৎ অধস্তন এক যুবতী অফিসার যার বয়স আমার অর্ধেক কোথা থেকে উদয় হয়ে আমার হাত ধরে বলে উঠল “চলুন পালাই” । বললুম, আমি রায়বরেলি গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড মিটিং অ্যাটেণ্ড করতে যাচ্ছি । যুবতী বলল, “তাতে কী হয়েছে, আমিও যাবো আপনার সঙ্গে, অপেক্ষা করব ওদের দপতরে, মিটিং শেষ হয়ে গেলে দুজনে উধাও হয়ে যাবো কোথাও, আমার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে, তৈরি হয়েই বেরিয়েছি ।” শুনে, মাথায় আর রগে হাতুড়ির আওয়াজ শুনতে পেলুম । এই অফিসার আমারই বিভাগের, প্রায় প্রতিদিন বাংলা শাড়ি আর শাঁখা-রুলি পরে অফিসে আসে, বলল, “আপনাকে যে ভালোবাসি তা আপনার স্ত্রী জানেন ।” কোনো রকমে ছাড়ালুম । মেয়েটি আত্মহত্যা করে নিলে । নিজের কাপুরুষ চরিত্রের জন্য বেঁচে গেলুম, ওফ । বিয়ের পর আমি আর কোনো লফড়ায় ফাঁসাতে চাইনি নিজেকে, সুযোগ পেলেও, মনে হয়েছিল এবার শান্তি দরকার, তবুও নিজেই অশান্তি ডেকে এনেছি, ভেতরের লোচ্চা-লোফার কামড়ে ধরেছে ।

             ১৯৯০ সালে,হিমালয়ের তরাইতে দেশি গোরুর সমীক্ষা করতে গিয়ে এক মরা বাঘিনীর প্রেমে পড়েছিলুম, মরা বাঘিনীর গোলাপি যোনি দেখে চাঞ্চল্য ঘটছিল লিঙ্গে । রাতের বেলায় বাঁশে চিৎ করে চার পা বেঁধে বাঘিনীকে রাখা হয়েছিল এক পাঞ্জাবি শিখের গ্যারাজে । প্রচুর ওল্ড মঙ্ক টেনে শুয়ে পড়েছিলুম বাঘিনীর বুকে, মাই চুষেছিলুম, আর কাঁদছিলুম, বাঘিনীকে ভালোবেসে, বীর্য ঝরিয়ে, উত্তরণের আরাম হল।  কবিসন্মিলন পত্রিকার সহসম্পাদক শংকর চক্রবর্তী এই ঘটনা নিয়ে লেখা আমার কবিতা পড়ে ব্যোম ; মধ্যবিত্ত বাঙালির কল্পনাজগত আক্রান্ত হলে বুঝতে পারি অস্তিত্ব ফাটিয়ে চৌচির করে আত্মসন্দেহের নীহারিকাপূঞ্জ ভরে দিতে পেরেছি । আসলে তাদের অভিজ্ঞতা বেশ সীমিত, ভারতবর্ষকে দেখেছে পর্যটকের চোখ দিয়ে । এটা নিয়ে আমি একটা গল্প লিখেছিলুম, অজিত রায়ের ‘শহর’ পত্রিকায়, ‘দুধসন্দর্ভ’ নামে।

             ১৯৮০ সালে, কোমরের তলা থেকে বিকলাঙ্গ এক অপরূপ সুন্দরী তরুণী কেরানিকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে আয়া আসেনি একদিন, ও যেতো পেরামবুলেটারের মতন একটা গাড়ি করে, কী করা যায় ভেবে উঠতে পারছিলুম না, কেরানি আর বিভাগীয়প্রধানের শ্রেণি-বিভেদ বেশ দৃষ্টিকটু । অফিস ছুটির পর আরেকজন মুসলমান অফিসারই ছিলেন আমার সঙ্গে, তিনি হিন্দু তরুণীকে তুলতে চাইলেন না, বাবরি মসজিদ তখন ভাঙা হয়ে গেছে, আমি পাছার তলায় হাত দিয়ে তুলে নিলুম, মনে হল তরুণীটি ইচ্ছেকরে নিজের যোনিকে আমার লিঙ্গের সঙ্গে চেপে ধরল, ওর হুইলচেয়ার ঠেলাগাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাবার সময় আমার প্রেমিকা-নিরপেক্ষ লিঙ্গ ফুলে উঠল, তরুণীর ইশারার  জন্য আপশোষ হল । ঘটনাটা নিয়ে আমার একটা ছোটোগল্প আছে, সুকুমার চৌধুরীর ‘খনন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, ‘অনিশ্চয়তা নিয়ে দুটি গল্পের বিনুনি : একটি প্রেমের অন্যটি রঙ্গকৌতুকের’ শিরোনামে । 

             ১৯৪৯ সালে, প্রথম স্ট্যাণ্ড আপ অন দি বেঞ্চ হয়েছিলুম, ইংরেজি ক্লাসে, ওয়র্ডসওয়র্থের ড্যাফোডিল্স কবিতা ব্যাখ্যা করার সময়ে আমি সিসটার আইরিনের দেয়া শুকনো ড্যাফোডিল্স ফুল দেখিয়ে বলেছিলুম, জানি স্যার, এই যে, বইয়ের ভাঁজ থেকে বের করে । শিক্ষক বলেছিলেন, “ইয়ার্কি মারবার জায়গা পাওনি, স্ট্যাণ্ড আপ অন দি বেঞ্চ।” উনি বুঝিয়েছিলেন যে কচুরিপানার বেগুনি রঙের ফুলকে বলে ড্যাফোডিল্স। যখন ইউরোপে গেলুম তখন পথের ধারে-ধারে দেখলুম ড্যাফোডিল্স ফুল, দেখলুম লাল রঙের ফুল যাকে ইউরোপীয়রা বলে পপি, অথচ যা পোস্তগাছের ফুল নয় ।    ১৯৪৯ সালে,দরিয়াপুর পাড়ায় সন্ধ্যায় মাতাল আর গঞ্জেড়ি মাস্তানদের মারামারি চেঁচামেচি চিৎকার শুরু হতো বলে, আমি তার চেয়েও জোরে চিৎকার করে পড়া মুখস্হ করার চেষ্টা করতুম। তার ফল হতো । বাইরের চেঁচামেচি বন্ধ হয়ে যেতো । দরিয়াপুরে আমাদের বাড়িটা ছিল একটা বাতিল গোরস্তানের ধারে ; গোরস্তানের কেয়ারটেকার আল্লু মিয়াঁ ঝুপড়ি তৈরি করে নিজের দুই মেয়েকে দিয়ে রাতের বেলায় ব্যবসা করাতো, তাদের বররা দালালের কাজ করতো, মাঝে-মাঝে টাকার বাঁটোয়ারা নিয়ে শশুর আর জামাইদের ভেতর ঝগড়া হতো, অকথ্য গালাগাল । সেটা ছিল ইমলিতলার পর আমার গালাগাল শেখার উঁচু ক্লাস ।

                       ১৯৯৪ সালে সলিলা চাকরি ছেড়ে দেবার পর ওকে সঙ্গে নিয়ে ট্যুরে যেতুম, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্যে । ১৯৯৫ সালে মালদায় গিয়ে স্তম্ভিত হলুম টেরাকোটা মসজিদ দেখে, তার আগে কেউ এই মসজিদগুলোর সংবাদ দেয়নি, সকলেই বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দিরের কথা বলতো । সুবো আচার্যের বাড়ি বিষ্ণুপুরে, যখন গিয়েছিলুম তখন টেরাকোটা মন্দির দেখেছিলুম, ষোলো থেকে উনিশ শতকের মাঝে তৈরি । মালদায় গিয়ে জানলুম যে মসজিদগুলো তার বহু আগের । আদিনা মসজিদ তৈরি করিয়েছিলেন সুলতান সিকন্দর শাহ ১৩৬৪ থেকে ১৩৭৫-এর মাঝে । লোটন মসজিদ তৈরি হয়েছিল ১৪৭৫ সালে । ১৪৮০ সালে মিরশাদ খান তৈরি করিয়েছিলেন তাঁতিপাড়া মসজিদ । ১৫৩১ সালে কদম রসুল মসজিদ তৈরি করিয়েছিলেন সুলতান নুসরত শাহ ; এই মসজিদের কেয়ারটেকার একটা পায়ের ছাপ দেখিয়ে বলেছিলেন যে ওটা হজরত মোহম্মদের , শুনে পিলে চমকে গিয়েছিল, দেওবন্দিরা জানতে পারলে আস্ত খেয়ে ফেলবে লোকটাকে, সে আবার প্রতি সকালে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসতো আর সন্ধ্যায় ফিরে যেতো । মসজিদগুলো দেখতে-দেখতে শৈশবের ইমলিতলা পাড়ার মসজিদের কথা মনে পড়ছিল, তার ভেতরেও আমাদের প্রবেশ অবাধ ছিল, এই মসজিদগুলোর মতন ।

              ১৯৬৫ সালে কলেজ স্ট্রিটে ছাতার খোঁচা দিয়ে এক ভদ্রলোক বললেন, “এই, তোরা আমার বাড়ি আসিস না কেন রে”?  সুবিমল বসাক ওনার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে “আমরা যাবো যে কোনো দিন”, বলার পর উনি বললেন, “সকালের দিকে আসিস।” উনি চলে যাবার পর সুবিমল বলল, “জানো কে ? জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী।” গেলুম ওনার বাড়ি, মানিকতলায় নেমে, তারপর ধানখেতের ভেতরে আলের ওপর দিয়ে দূরে একটা চালাবাড়ি, সেরকমই নির্দেশ দিয়েছিলেন । আলের ওপর দিয়ে হাঁটার সময়ে বুঝতে পারলুম যে রাতের বেলায় সাপের ভয়ে ছাতাকে ছড়ির কাজে লাগান । ওনার বাড়িতে পৌঁছোলে, জানতে চাইলেন আমি কি-কি করেছি যে সবাই এতো চটে গেছে । সবই বললুম ওনাকে, মুখোশ, জুতোর বাক্সের রিভিউ, ব্ল্যাংক কাগজে গল্প, বিয়ের কার্ড, স্টেনসিল করা ড্রইং ইত্যাদি । বেশ হাসছিলেন শুনে, যখন শুনলেন যে জুতোর বাক্স রিভিউ করতে দিয়েছিলুম, তখন একেবারে জোরে-জোরে হাসতে লাগলেন । বললেন, “মামলা ঠুকেছে বলে বন্ধ করিসনি, তোরা না করলে কে-ই বা মুখোমুখি প্রতিবাদ করবে।” এখন ওই ধানখেতে আবাসনের পর আবাসন । বেশ কয়েকজন নামকরা কবি থাকেন সেই আবাসন-হয়ে-যাওয়া-ধানক্ষেতে । জানি না ধানক্ষেতের উড়ন্ত বাতাসের সবুজ গন্ধ তাঁরা পান কিনা ।

                   ১৯৯৮ সালে কেদার ভাদুড়ির গাঙ্গুলিবাগানের বাসায় বসে মদ খাচ্ছি, একটি তরুণ প্রবেশ করতেই গম্ভীর হয়ে গেল কেদার, আমাকে বলল, পুরোটা চোঁচোঁ করে খেয়ে বাড়ি চলে যাও, কালকে আবার বসা যাবে। পরের দিন গিয়ে জানলুম তরুণটি কেদারের প্রথম পক্ষের ছেলে । টিউশানি করবার সময়ে কচি এক তরুণীর প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক করে ফেলেছিল কেদার, তারপর তাকে বিয়ে করতে হয়েছিল, প্রথম বউকে ডিভোর্স দিয়ে । প্রথম বউয়ের ছেলে প্রতিমাসে খোরপোষের টাকা নিতে আসতো । কেদারের তরুণী বউ কখনও আসতো না গাঙ্গুলিবাগানের বাড়িতে, প্রতিবেশীদের কেউ একজন বলেছিল, “ও মা আপনার নাতনিও আছে, বলেননি তো !” তরুণী বউয়ের একটা মেয়ে হয়েছিল, তাকেও আসতে বারণ করে দিয়েছিল কেদার । কয়েক পেগের পর বলতো, “বড়ো যন্ত্রণা হে, বড়ো কষ্ট, বড়ো দুঃখ, ও শূলযাতনা তুমি বুঝবে না, কবিতায় লুকিয়ে রেখেছি, কাকেই বা বলব, কবিতাকেই বলি ।” কেদারের একটা চল্লিশ পাতার সাক্ষাৎকারে দ্বিতীয় পক্ষের বউ আর তার সঙ্গে আকস্মিক প্রেমের ঘটনার উত্তর দিতে চায়নি কেদার । কেদারের মৃত্যুর কথা জেনেছিলুম উত্তম দাশের ফোনে ।

             অশোক ফকিরের চম্পাহাটির চালাঘরে গিয়েছিলুম আমি আর সুবিমল ১৯৬৫ সালে, উনি পানের পাতায় আফিম চাটতে দিলেন, বেশ সুন্দরী বউ, অজন্তার দেয়ালে আঁকা নারীদের মতন বৌদ্ধ চোখ । ওই বউকে ফেলে অশোক ফকির এক বিদেশিনীর সঙ্গে আমেরিকায় হাওয়া । বিদেশিনী বউটা কিছুদিন আগে ইমেল করে নিজের জটাজুট সঙ্গে হরেকৃষ্ণ ছাপানো উত্তরীয় কাঁধে অশোক ফকির, ওর আর মন্দিরের ছবি পাঠিয়েছিল, গিন্সবার্গের লেখা চিঠি পাঠিয়েছিল যেগুলোর কপি আমেরিকায় অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠিয়েছিলুম । বিদেশিনী বউ বলেছিল অশোক ফকিরের আমেরিকাবাস নিয়ে একটা বই লিখেছে, কোনো পাবলিশার ছাপতে রাজি নয় । মার্কিন কনসুলেটে গিয়ে অশোক ফকির খবর যোগাড় করতো যে কারা-কারা কলকাতায় এসেছে আর কোন হোটেলে আছে । অশোক ফকিরের কারবার শুনে বাঙালি বউটার জন্যে মায়া হল । আমার লম্পট চোখ বুজলেই তার মুখ ভেসে ওঠে। আমেরিকাতেই মারা গেছে অশোক ফকির । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় অশোক ফকিরকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছেন শুনেছিলুম ।   অশোক ফকিরের দেয়া আফিম খেয়ে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ওভারব্রিজের ওপর নেচেছিলুম আমি আর সুবিমল । অনেক রাত পর্যন্ত, সেসময়ে চম্পাহাটিতে এখনকার মতন নিত্যযাত্রীদের ভিড় ছিল না, একেবারে ফাঁকা স্টেশান, প্ল্যাটফর্মগুলোও ফাঁকা, অন্ধকারে ঢাকা । এখন চম্পাহাটিতে ট্রেন এলে নিত্যযাত্রীদের ঠেলাঠেলিতে অন্ধকার উধাও হয়ে যায়, ওরা সবাই যেন আফিম চেটে দৌড়োয় ।

             ২০০৭ সালে ইউরোপে গিয়ে নানা রকমের ওয়াইন খেয়ে আমি কোনো তফাত টের পাইনি, নেশার মাত্রাটুকু টের পেয়েছি, মদের চরিত্র নয় । গীর্জাতেও যে ওয়াইন তৈরি হয় তা জানতুম না ; গীর্জার ওয়াইন আর ফরাসিদেশের নাস্তিকদের কোম্পানির ওয়াইনে তফাত টের পাইনি । এদেশে কোনো মন্দিরে মদ তৈরি হলে ধুন্ধুমার বেধে যাবে । আসলে ইমলিতলার আর খালাসিটোলার দিশি মদ ঠররা আর বাংলার কয়েকটা আস্তরণ জমে গেছে আমার জিভের ওপর । বাংলা মদকে পিসেমশায় বলতেন ধান্যেশ্বরী ।     ১৯৬৫ সালে বেনারসে একজন হিপি চরস দিয়ে হনুমান তৈরি করত আর তার ল্যাজ ভেঙে ফুঁকতে দিতো । আরেকজন হিপি গঙ্গাজলের ঘটিতে এল এস ডি মিশিয়ে আনতো, তার সামনে জিভ বের করলে সে কয়েক ফোঁটা ফেলে দিতো । গঙ্গা তখন থেকেই ভিষণ নোংরা অথচ হিন্দুরা হোলি গ্যাঞ্জেস বলে বলে দুয়েকজন হিপি ওই জলে স্নান করতো । তার আগে অ্যালেন গিন্সবার্গ ওই নোংরা জলে স্নান করে ফোটো তুলিয়ে হিপিদের জন্য পথ দেখিয়ে গেছে । পাটনায় গঙ্গার ধারে হিসি করতে বললে, গিন্সবার্গ বলেছিল, তোমার হোলি রিভার, আর তুমি বলছ তার তীরে হিসি করতে !

                    ১৯৮১ সালে লখনউতে চম্বল অঞ্চলের ট্যুরে বাবা মুস্তাকিম নামে এক ডাকাতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, যে আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিল, “জিতে রহো” । ডাকাতের আশীর্বাদের দরুণ স্হানীয় কৃষি আধিকারিক বলেছিল, চম্বলে আর কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, যে গ্রামে ইচ্ছে যেতে পারবেন । সত্যিই, বহুবার চম্বলে ট্যুরে গেছি, প্রতিটি গ্রামে লোকেরা বেশ আপ্যায়ন করেছে, জমিদাররা তাদের বাড়ির পায়খানায় হাগতে দিয়েছে ।  ১৯৮৩ সালে গোরখপুরে ট্যুরে গিয়েছিলুম, সেখানকার মন্দিরে শিবের পুজোয় ত্রিশূল উৎসর্গ করতে হয়, যা আমার অধস্তন অফিসার করতে চাইছিল । আমি বাইরে বাগানে ছায়ায় অপেক্ষা করছিলুম । আচমকা একজন জটাধারী সাধু, ঠোঁটের কোনে ছিলিমের ফেনা,  জড়িয়ে ধরে বলে উঠেছিল, “জো তুমসে দুষমনি করেগা ওয়হ তুমসে পহলে মর জায়গা ।” কারোর মারা যাবার খবর পেলে তার সম্পর্কে সন্দেহ হয়, সাধুটার কথার জন্যে হয় না ।

                              ১৯৫৫ সালে ইনফ্যানট্রির ক্যাম্পে গিয়ে ভোর রাতে উঠে কুড়ি-তিরিশজন সবাই ল্যাংটো হয়ে হাগতে যেতুম, গোল হয়ে হাগতে বসতুম, পাদবার খেলা খেলতুম, ছোঁচাতুম চা খাবার অ্যালুনিমিয়াম মগ দিয়ে, যৌথভাবে উলঙ্গ হতুম, কোনো লজ্জা-বালাই নেই, প্রাগৈতিহাসিক কালখণ্ডে ফেরার সুযোগের জন্য সকলে মিলে হইচই করতুম ।    ১৯৬১ সালে অফিসের সহকর্মী সুশীল কুমার, মণিমোহন মুখোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায় আর আমি চারজনে মিলে গিয়েছিলুম শিমুলতলায় । রাতের বেলায় একটা পাহাড়টিলায় চারজনে উলঙ্গ হয়ে ওঠার প্রতিযোগীতা করেছিলুম । সম্ভবত সুশীল কুমার জিতেছিল । পরের দিন একটা ছোট্টো পুকুর বা হাঁটুজল ডোবায় আমি, সুশীল আর অরুণ তিনজনে জলের তলায় লুকিয়ে লিঙ্গ দাঁড় করিয়ে জলের ওপরে ভাসিয়েছিলুম ; মণিমোহন চেঁচিয়ে উঠেছিল, “সাপ সাপ জলে সাপ আছে” । মণিমোহনকে সেই থেকে বলা হোতো “চপড়গাণ্ডু”; জল থেকে উঠে মণিমোহনকে বলেছিলুম, আপনাকে ওয়াটার অর্কিড দেখাতে চাইছিলুম।  “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” উপন্যাসে আছে ঘটনাটা । ওয়াটার অর্কিড প্রদর্শনীর কথা বুড়ো বয়সেও মনে রেখেছিল মণিমোহন । সুশীল লিভারের ক্যানসারে মারা গেছে, মণিমোহন কিডনির । অরুণ পাগলিয়ে গেছে ওর জামাইয়ের পাল্লায় পড়ে, ও অবশ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক পাটনায় চাকরির সময়েও পাগলিয়ে ছিল, ঘটনাটা আছে আমার ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপন্যাসে । মণিমোহনের মেয়ের সঙ্গে দাদা নিজের বড়ো ছেলের বিয়ে দিয়েছিল । অরুণের সঙ্গে দাদা বিয়ে দিয়েছিল নিজের এক শালির ।     

              ১৯৯৫ সালে মুম্বাই থেকে ফিরে সন্দীপনের সঙ্গে দেখা করতে গিসলুম ওনার চেতলার ফ্ল্যাটে, কি-নোংরা কি-নোংরা, ঘরে বসে আছেন মেঝেয়, সামনে একটা জলচৌকি, পাশে একটা থলে থেকে “আজকাল” সংবাদপত্রে জড়ো হওয়া পাঠকদের চিঠিতে চোখ বোলাচ্ছিলেন আর বাছাই করছিলেন । বললুম, লেখালিখি না করে এসব ফালতু কাজে সময় নষ্ট করছেন কেন, সামান্য টাকার জন্যে । উনি বললেন গল্পের ম্যাটার পেয়ে যাই । ভেতরে গিয়ে স্ত্রীকে কিছু বললেন, স্ত্রী সেজেগুজে বেরিয়ে গেলেন । যেমন কিপ্টে ছিলেন তেমনই, জামা-প্যান্ট পরে নিয়ে, দরোজায় তালা ঝুলিয়ে, বললেন, “চলো, সুকৃতিতে গিয়ে চা খাওয়া যাবে”। ট্যাকসির ভাড়া আমিই দিলুম, চা-কাটলেটের পয়সা আমিই দিলুম । মনে হল, এই একবার আড্ডাই যথেষ্ট, ওনার সেই উইট ফুরিয়ে গেছে, সেই যখন হাওড়ায় সাইকেলে চেপে ভোরবেলায়  দেবী রায়ের বাড়িতে হাংরি বুলেটিনের জন্যে লেখা দিতে আসতেন । সন্দীপন মারা গেছেন ২০০৫ সালে । এখন বুড়ো হয়ে টের পাই যে এই বয়সে পৌঁছে ঘরদোরের ধুলোবালি জমে থাকাটা কোনো গুরুত্বের ব্যাপার নয় ।

              ১৯৬৪ সালে হাতকড়া পরাবার সময়ে, কোমরে দড়ি বাঁধার সময়ে, পুলিশের মুখময় আলো খেলা করছিল, যেন আধুনিকতার ওপর ওদের একচ্ছত্র অধিকার, যেন এনলাইটেনমেন্ট কাকে বলে ওরাই কেবল জানে । কোমরে দড়ি বাঁধা আর হাতে হাতকড়া পরানোর ব্যাপারটা এনলাইটেনমেন্টের সঙ্গেই এসেছিল। রাস্তা দিয়ে যখন হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, পাড়ার কুকুরগুলোও আমার পেছন-পেছন কৈলাশযাত্রায় হেঁটেছিল ।                       ২০১১ সালে সৃজিৎ মুখোপাধ্যায় “বাইশে শ্রাবণ” ফিল্মে গৌতম ঘোষকে একজন পাগল হাংরিয়ালিস্ট কবি হিসাবে তুলে ধরলে, নিবারণ, যার লেখা কোথাও কেউ ছাপতে চায় না, রবীন্দ্রনাথ নামে পুলিশের এক খোচরকে, যে আবার লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক,  মোবাইলে বারবার কবিতা ছাপানোর অনুরোধ করে, সেই চারশোবিশ ফিল্ম দেখে সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছিল শুভা । কেন ? হাংরি আন্দোলনের কবিকে সৃজিৎ বদনাম করে, তাকে দিয়ে বইমেলায় আগুন ধরিয়ে, ধ্বসিয়ে দিয়েছে, তাই । না, সৃজিৎ আমার বা অন্য কোনো হাংরি কবির অনুমোদন নেয়নি, সম্ভবত এসট্যাবলিশমেন্টকে খুশ করার জন্য হাংরি আন্দোলনের কবিকে অহেতুক ঢুকিয়েছে কাহিনিতে ।  কাহিনি লেখককে অত্যন্ত অসৎ বলা ছাড়া আর কীই বা করা যেতে পারে। ফিল্মটায় যাদের নাম উল্লেখ করেছিল পরমব্রত, তাতে শৈলেশ্বরের নাম ছিল না, ও নিজের টাকলা গুরুদেবকে ধরে সৃজিৎকে দিয়ে আন্দোলনকারী হিসেবে নামটা ঢুকিয়েছিল, অথচ আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুচলেকা দিয়ে মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছিল ।

              সৃজিৎ ফিলমটায় একজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদককে পুলিশের খোচর হিসেবে দেখিয়েছে, এই ঘটনাটা সত্যি । পবিত্র বল্লভ নামে কুঁজো এক যুবক “উপদ্রুত” নামে একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করত, বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে বসত কফিহাউসে, সে ছিল পুলিশের ইনফরমার, হাংরি আন্দোলনের বুলেটিন, বই ইত্যাদি গিয়ে জমা দিত লালবাজার প্রেস সেকশানে । বাসুদেব মাঝে-মাঝে বলত বটে যে মুখোশ পাঠানো ঠিক হয়নি, জুতোর বাক্স দেয়া উচিত হয়নি, স্টেনসিল-ড্রইং কফিহাউসে বিলোনো ঠিক দেখায় না, ইত্যাদি-ইত্যাদি, কিন্তু সেই কথাগুলো যে পবিত্র বল্লভের, তা জানতে পারি যখন পবিত্র বল্লভ পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বেমালুম বলে গেল যে সে আমাকে চেনে, কফিহাউসে  আমার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে, তার কাছে আমি লেখা চেয়েছি, ইত্যাদি ।

    বারো

              ১৯৯২ সালের ৭ই ডিসেম্বর, তখন আমি মুম্বাইতে, ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেস থেকে ডান ডিকে টার্ন নিয়ে মাহিমে ঢুকবো, দেখি দু দল মানুষ লাঠি, তরোয়াল, বর্শা, বন্দুক নিয়ে মারামারি করছে, পুলিশের দেখা নেই, মানুষ তরোয়ালের আঘাতে লুটিয়ে পড়ছে দেখে আর এগোলুম না, সোজা ব্যাক করে বাড়িতে । তার আগের দিন বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছে বলে দুএক জায়গায় মারপিট হয়েছিল, কিন্তু এরকম খুনোখুনি আমি আগে দেখিনি । দাঙ্গা কাকে বলে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল । ভাগ্যিস গাড়িটা ছিল, তাই পালাতে সুবিধে হল, কেননা রাস্তায় বাস, অটো, ট্যাক্সি কিছুই দেখিনি ফেরার সময়ে, কেবল পলায়নকারীদের গাড়ি । কেন যে দাঙ্গা হয়, কেন একজন মানুষ ভিড়ের অংশ হতে রাজি হয়, অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে কাটতে বেরিয়ে পড়ে, জানি না ।

              ১৯৯৩ সালের ১২ই মার্চ, আমি ভিলে পার্লে বিল্ডিঙের অফিসের অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ইনচার্জ । অধস্তন অফিসার কয়েকজন, “বাড়িতে কাজ আছে”,  বলে ছুটি নিয়ে কেটে পড়ল । একটু পরে মহিলা অফিসাররা এসে বলল যে শহরে গোলমাল চলছে স্যার আমরা বাড়ি যেতে চাই, কী গোলমাল জানে না, বললুম ঠিক আছে, যাও । তারপর শিব সেনা করে এমন একজন এসে বলল যে, স্যার শহরে পর-পর বোমা ফাটছে, কিছু একটা গোলমাল শুরু হয়েছে, হয়তো ট্রেন-বাস সব বন্ধ হয়ে যেতে পারে । হেড অফিসে ফোন করে জানতে পারলুম যে, হ্যাঁ, পুলিশ থেকে জানিয়ে দিয়েছে নানা জায়গায় বোমা ফাটানো হয়েছে, অফিস ছুটি করে বন্ধ করে দিন । পরের দিন কাগজে পড়লুম যে সন্ত্রাসবাদীরা ষড়যন্ত্র করে বোমা ফাটিয়েছে, অনেক মানুষ মারা গেছে । তার কিছুদিন পরে জানলুম কাণ্ডটা দাউদ ইব্রাহিম নামে একজন মাফিয়ার চেলাদের, যারা ঘটনার আগেই দুবাই পালিয়েছে । ঘটনাটার কথা মনে পড়লে ভয়ার্ত মহিলাদের মুখগুলো মনে ভাসে, তাঁদের কয়েকজন বুড়ি হয়ে স্বাস্হ্যের অবনতির কারণে মারা গেছেন ।

                      আমাদের বাড়িতে, ইমলিতলায়, দরিয়াপুরে, উত্তরপাড়ায়, জোরে পাদা আর ঢেঁকুরতোলায় কোনো বিধিনিষেধ ছিল না, বড়ো-ছোটো নির্বিশেষে সকলেই জোরে পাদতো আর ঢেঁকুর তুলতো । আমি এখনও জোরে পাদি, চেপে যাই না । এই এখন লিখতে-লিখতে পাদলুম বলে ইপিফ্যানির গর্ব হলো । কলকাতায় যে সাহিত্যসভাগুলো হয়, তাতে কাউকে পাদতে শুনিনি, কেউ কেউ পোঁদ একপাশে উঁচু করে, কবিতার শ্বাস নিচ্ছে তা দেখেছি ।    ৩০শে এপ্রিল ২০০৪ সাহিত্য অকাদেমির টেলিগ্রাম পেলুম যে ওরা আমাকে পুরস্কৃত করেছে ধর্মবীর ভারতীর “সুরজকা সাতওয়াঁ ঘোড়া” অনুবাদের জন্যে । পেয়েই মাথা গরম হয়ে গেল, নিজেকে শুনিয়ে বললুম, “কোন ইডিয়ট আমার নাম সুপারিশ করেছে, স্কাউণ্ড্রেলরা তো জানে আমি এইসব সাহিত্যিক তিকড়মবাজিতে নেই”। তার আগে আর পরেও, বহু মানুষকে, যাদের ইনটেলিজেন্ট বলে চালানো হয়েছে,  তাদের মনে হয়েছে স্টুপিড । প্রত্যাখ্যান করে সঙ্গে-সঙ্গে একখানা চিঠি দিলুম সাহিত্য অকাদেমিকে জানিয়ে যে, As a matter of priciple I do not accept literary and cultural prizes, awards, lotteries, grants, donations, windfalls etc. They deprave sanity. প্রত্যাখ্যান করে, ইপিফ্যানির গর্ব হল । পুরস্কার যে প্রত্যাখ্যান করেছি তা শঙ্খ ঘোষ জানতেন না, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, তাই বুঝি, আমি জানতাম না তো ! প্রণব আবার চটে গিয়ে একটা কপি পাঠিয়েছিল ওনাকে!

                     ১৯৬৪ সালে পিসেমশায় যে উকিলকে হাংরি মামলার জন্যে বাছাই করেছিলেন, তার দপতর সোনাগাছির ঠিক উল্টো দিকে । উনি অঞ্চলের রেগুলার ভিজিটার ছিলেন বলে তাদের উকিলকে চিনতেন । পিসেমশায় বলেছিলেন, “এর মতন ফৌজাদরি উকিল সস্তায় পাবিনে।” উকিলের ঘরে বসে দেখতে পেতুম ফি শনিবার পার্বতীচরণ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পুরো কৃত্তিবাস গ্যাঙ চলেছে ভেতরে । সেন্টুদা একবার বললেন, চল চল, ওরা যে বাড়িটায় ঢুকবে তার উল্টো দিকের বাড়ির বারান্দায় উঠে ওদের কারবার দেখতে পাবি । সত্যিই তাই । উল্টোদিকের বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলুম বুদ্ধদেব বসুর বদল্যার বইয়ের প্রভাব । অর্ধেক জীবন, সম্পূর্ণ জীবন, টুকরো জীবন ইত্যাদি স্মৃতিকথায় এনারা সবকিছু চেপে গেছেন।

             ১৯৭৬ সালে ট্যুরে যাচ্ছিলুম হাজারিবাগে, একটা গাড়ি ভাড়া করে, সঙ্গে আমার অধস্তন অফিসার। অফিসের এক পিওন, তার নাম “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” আর “জলাঞ্জলি” উপন্যাসে দিয়েছি রসিক পাসওয়ান। আসলে পিওনটা ছিল রাজপুত, গোপাল সিং, কিন্তু এক পাসওয়ান মেয়েকে বিয়ে করার ফলে উঁচু জাতের পিওনরা ওর সঙ্গে মিশত না, রাজপুত-ভূমিহার অফিসাররাও ওর সঙ্গে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত । ও বলল ওকে ওর গ্রামে ড্রপ করে দিতে, আমাদের যাবার পথেই পড়বে । এক জায়গায় গাড়ি থামাতে বলে ও বলল, জঙ্গলের ভেতরে ওর গ্রামে যেতে । চললুম ওর সঙ্গে, এতো ভেতরে তো গ্রাম দেখিনি তখনও । একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে দেখলুম কিশোর-কিশোরীদের বিয়ে হচ্ছে । গোপাল সিং তখন জানালো যে ও “মালে পার্টি” করে । তখন মাওবাদীদের উদ্ভব হয়নি, মার্কসিস্ট-লেনিনিস্টদের সংক্ষেপে বলা হতো মালে । বলব না যে শুনে কিছুটা অস্বস্তি হয়নি । দেখলুম যে জোড়ায়-জোড়ায় কিশোর-কিশোরী আর যুবক-যুবতীরা বসে আছে আর তাদের বিয়ে দিচ্ছে একজন বাঙালি যুবক, ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি, কাঁধে ব্যাগ, যে বইটা থেকে মন্ত্র পড়ছে সেটা “রেড বুক” । আমি নেপাল থেকে “রেড বুক” কিনে এনেছিলুম বলে দেখেই টের পেলুম । আদিবাসী যুবক-যুবতীর বিয়ে হচ্ছে ইংরেজি মন্ত্র পড়ে । বিয়ে দিয়েই যুবকটি উধাও হয়ে গেল । গোপাল সিং ওর নাম বলতে চাইল না । আমি “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” আর “জলাঞ্জলি” উপন্যাসে এই যুবকটির নাম দিয়েছি অতনু চক্রবর্তী, অবশ্য অতনু চরিত্রে বহু পরিচিত বন্ধুসহ আমার নিজের জীবনের উপাদান আছে । গোপাল সিং ওই বিয়ের পর অফিসে ফেরেনি। আমিও অফিসে ফিরে চেপে গেলুম যে ওকে আমরা লিফ্ট দিয়েছি ।

              ১৯৬৫ সালে ডেভিড গারসিয়া নামে এক হিপি এসেছিল, গ্রিসে জুতোর দোকানে কাজ করে টাকা যা জমিয়েছিল তা নিয়েই এসেছিল, বলল, বাঙালি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে চায় । দুদিনে কোথ্থেকে পাওয়া যাবে বাঙালি প্রেমিকা । অগত্যা সোনাগাছিতে ঢুঁ, কিন্তু দুপুরে নয়, ভিজিটিং আওয়ার সন্ধ্যায় । একটা কচি মেয়েকে পছন্দ হল ডেভিডের । মেয়েটার নাম মনে আছে, বেবি । বেবি বলল, ও বাবা, এতগুলো হাঘরেকে সামলাতে পারবো না, এই সায়েব আর কোনো একজন । সকলে প্রস্তাব দিল ফষ্টিনষ্টি করতে দিতে হবে। তাতে বেবি রাজি । ঘরে ঢুকে মাটিতে পাতা বিছানায় বেবি বসতেই বাসুদেব চকাচক চুমু খেয়ে নিল জড়িয়ে।  বেবির অনুরোধে আনানো হল দু-বোতল বাঙলা । খেলুম সবাই মিলে, টনক গোলমেলে হয়ে উঠলে কে যে বেবির কোথায় হাত ঢোকাচ্ছিল তার ঠিক নেই। বিপদ দেখে বেবি বলল, তোমরা বেরোও, আমি সায়েবের সঙ্গে পিরিত করে নিই । ডেভিড বেরোলো পিরিত করে, বলল, সাচ এ টিনিউইনি কান্ট অ্যান্ড স্মল বুবস, ইট ওয়াজ ওয়ানডারফুল । বেবি বুকের ওপর আঁচল ফেলে দরোজার ফাঁক থেকে মুখ বের করে বলল, আরেকজন কে আসবে চলে এসো । ঘোষভাইদের মধ্যে একজন তড়াক করে ঢুকে গেল আর মিনিট পাঁচেকেই সেরে বেরিয়ে এলো । হাঘরেদের খরচটা আমি দিয়েছিলুম । পরে, বেবির ঘরে বাসুদেব-অবনী-শৈলেশ্বর প্রায়ই যেতো, বাসুদেবের চিঠিতে বেবির বাড়ি বদলের দুঃখও আছে ।

              ডেভিড গারসিয়াকে নিয়ে দুমকা গিয়েছিলুম, দুমকায় দাদার বাড়িতে পায়খানার সামনে যে কাঁঠালগাছ ছিল তাতে এঁচোড়ের গা্য়ে প্যান্ট-শার্ট ঝুলিয়ে পায়খানায় ঢুকতে হতো । ডেভিড বলল ওদের গ্রামে ফিরে গিয়ে ও এই ধরনের বন্দোবস্ত করবে যাতে গাছে হয়ে থাকা ফলের গায়ে পোশাক ঝোলানো যায় । ভাঙের শরবত খেয়ে আমাদের সঙ্গে দোল খেলে ডেভিড জানতে চাইল এটা কি রিলিজিয়াস ফেসটিভাল । ওকে জানালুম যে হ্যাঁ, এটা একজন পলিগ্যামিস্ট ব্ল্যাক গডের স্প্রিং সিজন সেলিব্রেট করার ফেস্টিভাল ।

              পালামৌয়ের সদর শহর ডালটনগঞ্জে দাদার বাড়িতে ছিলুম ১৯৬৭ সালে, হরিণের ঠ্যাং দিয়ে গেল একজন সাঁওতাল, বঁটি দিয়ে কেটে রান্না হলো আর মহুয়ার রুটিসহ মহুয়ার মদ দিয়ে খাওয়া হলো, আমি কলকাতা থেকে কেস জিতে পৌঁছে গিয়েছিলুম ডালটনগঞ্জে, তাই সেলিব্রেট করা হলো বিহারি স্টাইলে, যদিও এখন শহরটা ঝাড়খণ্ডে ।   ডালটনগঞ্জে পৌঁছেছি শুনে স্হানীয় কবিরা একটা আড্ডার ব্যবস্হা করেছিল, যাকে ওদের ভাষায় বলে “গোষ্ঠী”, তাতে আমি আর দাদা মহুয়ার মদ খেয়ে বেশ ভালো বক্তৃতা দিয়েছিলুম ; ওখানেই একটা প্রেসে ছাপিয়েছিলুম অশ্লীলতা সম্পর্কে ম্যানিফেস্টো, “ইন ডিফেন্স অফ অবসিনিটি” পরে যেটা নানা ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, শুনেছি গবেষক ড্যানিয়েলা লিমোনেলার কাছে। ড্যানিয়েলা ইতালীয় ভাষায় আমাদের আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করছেন, তথ্য সংগ্রহ করতে কলকাতায় এসেছিলেন ২০১৪ সালে ।   ১৯৬৯ সালে আমি আর সলিলা গিয়েছিলুম ডালটনগঞ্জে, দাদা তখন অন্য একটা বাড়িতে, পিসতুতো দাদা সেন্টুদাও ছিল; আমাদের আপ্যায়ণের জন্যে গেঁড়ি-গুগলি দিয়ে বিরিয়ানি বানিয়েছিল, তা রাত জেগে খাওয়া হলো মহুয়ার মদ দিয়ে ।

             ২০১৪ সালে বিবিসির পক্ষ থেকে ডোমিনিক বার্ন এসেছিলেন হাংরি আন্দোলন নিয়ে রেডিও প্রোগ্রাম করার জন্য । হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে উনি এতই ওয়াকিবহাল ছিলেন যে প্রশ্ন করলেন বঙ্গসংস্কৃতি, রবীন্দ্রনাথ, উনিশ শতক নিয়ে । পরে, ফোটোতে ওনার ঘামে ভেজা শার্ট দেখে সলিলা বলল, “এসিটা চালিয়ে নাওনি কেন ?” আসলে প্রতিটি ব্যাপারে অভ্যাস থাকা জরুরি ।  ১৯৭৯ থেকে গ্রামীণ উন্নয়নের ট্যুরে ইংরেজি-বাংলা-হিন্দিতে বক্তৃতা দিতে হতো। একটা গ্রামে বক্তৃতা দিচ্ছিলুম, একজন চাষি বলে উঠল, “ এই চিন্তাটা আগে আসেনি কেন মাথায়, তাহলে গ্রামের কাজ এগিয়ে যেতো, পড়ে থাকতো না বছরের পর বছর।” বলে ফেললুম, “আপেল কেন গেছ থেকে পড়ে, তা তো আমরা আগে জানতুম না, নিউটন নামে একজন সায়ের বলার পরে জানতে পারলুম।” চাষি বলল, আপেল কেন, আম, কাঁঠাল, নারকেল পেকে গেলে সবই আপনা থেকে পড়ে যায়, ভগবান সেরকমই নিয়ম করেছেন।” টের পেলুম যে নিউটন সর্বত্র চলে না, অভিকর্ষও সকলকে বোঝানো যায় না । বললুম,”ঠিকই বলেছো, যতক্ষণ না কোনো চিন্তায় পাক ধরছে ততোক্ষণ কেউই তার বিষয়ে জানতে পারে না ।”

              ১৯৬৫ সালে, সুবিমল বসাকের মাসির বাড়ি গিয়েছিলুম মুর্শিদাবাদের এক গ্রামে । রাতে মশারি টাঙিয়ে শুয়েছিলুম, সকালে দেখি মশারির চালে একটা সাপ, মশারি বেশ ঝুলে এসেছে, আমাদের নড়াচড়া আর চেঁচামেচিতে সাপটা ফণা তুললো, মশারির ভেতরে হাংরি বুলেটিন ছিল কাগজে মোড়া, সেইটে দিয়ে সাপটাকে মশারি থেকে বাইরে ছিটকে ফেললুম । আমাদের চেঁচামেচি শুনে সুবিমলের মাসি আর অন্য আত্মীয়রা জড়ো হয়েছিলেন এসে, তাঁরা সাপটার পিছু নিলেন, সেটা ঢুকে গেল এক গর্তে । বেরোলুম মশারির বাইরে । এক বৃদ্ধা চিনির কৌটো নিয়ে এলেন আর কাঠপিঁপড়ে-ভরা গাছের কাছ থেকে  সাপটা যে গাছের গোড়ায় ঢুকেছে সেখান পর্যন্ত লাইন করে চিনি ছড়িয়ে দিলেন, সাপের কোটরেও ছুঁড়লেন । দুপুরে ডেকে দেখালেন আধখাওয়া সাপ আর পিঁপড়ের ঝাঁক গাছের বাইরে, পিঁপড়েরা মাংসকণা নিয়ে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যেতে অতিব্যস্ত । প্রেমিক-প্রেমিকার মতনই সাপ আর কাঠপিঁপড়েরা পরস্পরের নৈঃশব্দে আকৃষ্ট হয়।

              ১৯৭৯ সালে আমার লিঙ্গ দিয়ে পেচ্ছাপের বদলে রক্ত বেরিয়েছিল, রক্তচাপের দরুন, টাকার পাহাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছিল, ডাক্তার বললে ট্র্যাকিকার্ডিয়া, ছাতাপড়া-হিলহিলে-তেলচিটে নোটের পাহাড়, যা জ্বালিয়ে নষ্ট করতে হতো । তারপর দুমাস ছুটি নিয়ে দুবেলা ঘুমের ওষুধ খেতুম । “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” উপন্যাসে আমি টাকার পাহাড় জ্বালানোর মারপ্যাঁচ ব্যবহার করেছি । ১৯৯৩ সালে আমি একশো কোটি, দুশো কোটি, পাঁচশো কোটি টাকার চেক সই করতুম, কল মানি মার্কেটে অফিসের হয়ে বাড়তি টাকা খাটাবার জন্যে । অতো টাকার চেকে সই করে-করে মনে হতো রাজার কুর্সিতে বসে আছি । কোটি-কোটি টাকা নষ্ট করেছি এককালে, ১৯৯৩ সালে কোটি-কোটি টাকা খাটিয়ে আয় বাড়ালুম । পরির দেশের কোষাধ্যাক্ষের মতন দিনের পর দিন কোটি-কোটি টাকার চেক সই করতুম ।

             ২০১০ সালে আমার বাঁ পা ফুলে গেল একদিন । ডাক্তারের কাছে দৌড়োলুম, ডাক্তার দেখে বলল, এই রোগ তো পুলিশ কন্সটেবল, ইশকুল-কলেজের টিচার আর ডাকপিওনদের হয়, আপনার হল কেমন করে । বললেন উরু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত মোজা পাওয়া যায়, একজোড়া কিনে আজ থেকেই পরে থাকুন, কেবল শোবার সময়ে খুলে রাখবেন । ভেরিকোজ ভেইনস আক্রমণ করেছে পায়ে । সেই থেকে ভেরিকোজ ভেইনসের মোজা পরে থাকি, উরু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত । স্বপ্নে অনেকের পোঁদে লাথি মারি, তাই হয়তো।

             ১৯৯৯ সালে প্রথম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলুম বাঁশদ্রোণী বাজারে । পাবলিক আমাকে শাক-সবজির ওপর শুইয়ে মাছের জলের ঝাপটা দিতে জ্ঞান ফিরল । অনেকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে টানাটানি করছিল বলে সলিলা কেঁদে ফেলে থামালো । তার পরেও অজ্ঞান হয়েছি প্রায় সাত বার । মাথার এম আর আই করিয়েছি । নিউরোলজিস্ট বললে, মেডিটেশান করো । বাড়িতে বসে মেডিটেশান করায় একাগ্র হতে পারি না । মন উড়তে থাকে, নানা ভাবনায়, নানা মুখশ্রিতে, নানা সংবাদে, অতীতের ঘটনায় । মেডিটেশান ছেড়ে দিতে হল ।  ছোটো গল্প-লেখিকা ঝুমা চট্টোপাধ্যায় বলল, “সখা হে, সবসময় মাথাকে জাগিয়ে রাখলে অমন রোগ তো হবেই ।”

                  ১৯৯৮ সালে, মুম্বাইতে আমার অফিস পুনম চেম্বার্সের ছাদ সাততলা থেকে একের পর এক যখন ভেঙে-ভেঙে সশব্দে নিচে নেমে আসছিল তখন আমার হাত ধরে কেবিন থেকে বের করে নিয়ে গিয়েছিলেন একজন তরুণী, যিনি প্রথম পরিচয়ে আমাকে বলেছিলেন যে ওনার জরায়ু নেই । ১৯৯৭ সালে অবসর নেবার পর আমি আরেক অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম অথচ তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেনি মীরা। বাড়িটা পড়ার ফলে উনিশজন মারা গিয়েছিল। ইনিই একমাত্র মহিলা যাঁর সঙ্গে অশ্লীল গল্প করেছি, ব্যাপারটা অবশ্য তিনিই আরম্ভ করেছিলেন, “আজকে কলা কিনিনি, বেগুন কিনেছি, কোকোনাট অয়েল কিনেছি”, আমাকে হতবাক করে । নারীর সঙ্গে অশ্লীল কথাবার্তা ! ওর সঙ্গে কথা বলার সময়ে মনে হতো এই ধনী-তনয়াকে আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিতে পারলে ভালো হতো ।

    তেরো

                            ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৬৮ বিয়ের পর ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে হনিমুন করার পরিকল্পনা করলুম শিমলা যাবার, শুনে সহকর্মী সুশীল বলল ওর গ্রাম চণ্ডীগড়ের কাছে রোপড় হয়ে যেতে, রোপড় যাবার পর ও আর ওর বউ-বাচ্চা আমাদের সঙ্গ নিল । রোপড়ে মাঠে হাগতে হতো ; আমার তো এনসিসির সময়ে মাঠে প্রতিদিন হাগার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল । সলিলার ছিল না, কিন্তু নতুন অ্যাডভেঞ্চার মনে করে মাঠে গিয়ে ভোর রাতে হেগে নিয়েছিল যে কয়দিন ছিলুম । নতুন বউ মাঠে হাগতে যাচ্ছে, গ্রামীণ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞের বউ বলে কথা।  শিমলায় গিয়ে বাস থেকে নামতেই হাঁটু পর্যন্ত ঢুকে গেল তুষারে । বাসের ছাদে রাখা ছিল বেডিং আর স্যুটকেস, তার ওপর তিন ইঞ্চের তুষার । পিছল পথে গিয়ে উঠলুম হোটেলে, সেই হোটেলের ওপর তলায় আমাদের হনিমুন স্যুট, সেখান থেকে বেরোলেই রাস্তা । দুজনে মিলে দুটো ওল্ড মঙ্ক খেয়েও শীত গেল না, তখন জড়াজড়ি করে অবিরাম সঙ্গম করলুম সারা রাত । সুশীল আর ওর বউ একটা ঘরে ছিল, বেয়ারা বলল রাতভর ওরা ঝগড়া করেছে । শিমলা থেকে ফেরার পর সুশীলের বউ একজন পাঞ্জাবির সঙ্গে পালিয়ে গেল । লোকেদের বউ পালিয়ে যায় কেন ? মনে হয় দুর্বল যৌনতা তার মুখ্য কারণ । “কৌরব” পত্রিকার কমল চক্রবর্তীর বউও কারোর সঙ্গে পালিয়ে যাবার ফলে পত্রিকাটাই রোশনাই হারিয়ে ফেলল । কমল ওর পুরো যৌনতা লাগিয়ে দিয়েছিল পত্রিকায়, বউয়ের দিকে খেয়াল দেয়নি । তবে বউ পালিয়ে গেলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেয়া সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে, বউয়ের বদলে পুরস্কার পেলুম টাক ডুমাডুম ডুম । এককালে কৌরবে লিখতুম । আর ডাক পাই না ।

             শিমলা থেকে ফেরার পথে চণ্ডীগড়ে বাসস্ট্যাণ্ডে এসে একদল পাঞ্জাবি আর হিন্দি কবিলেখকরা ঘিরে ধরল কয়েকদিন থেকে যাবার জন্যে, ওরা আমার জন্যে সাহিত্যসভা করবে, ওরা যাকে বলে “গোষ্ঠী”, মদ-মুর্গি খাবার লোভে থেকে যেতে রাজি হলুম । এদিকে লেখালিখি তখন আমাকে ছেড়ে উধাও হয়ে গেছে, সঙ্গে কবিতাও নেই । হিন্দি আর পাঞ্জাবি পত্রপত্রিকায় ছবিসহ আমার সম্পর্কে খবর পড়ে ওদের উৎসাহ । নিজেরাই যোগাড় করে ফেলেছে আমার কবিতার হিন্দি অনুবাদ । গোষ্ঠীতে একজন যুবতী কবি মাতাল হয়ে  আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, চুমু খাবার উপক্রম করেছিলেন । স্ত্রী সলিলা বেজায় খাপ্পা, যুবতীকে বলল, “সাহিত্যসভা করছেন না অন্যকিছু !” সলিলার পজেসিভনেস দেখে আহ্লাদে আটখানা হলুম ।

                             ১৯৬৭ সালে হিন্দি আর মৈথিলি ভাষার কবি রাজকমল চৌধারী, ভর্তি ছিল পাটনার রাজেন্দ্র সার্জিকাল ব্লকে, অত্যধিক মদ আর মাদকের দরুণ শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল । ওকে একটা আলাদা ঘরের ব্যবস্হা করে দিয়েছিল সরকার । হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে রাজকমল বলেছিল, “ডাক্তার বলেছে অপারেশান করা যাবে না, অপারেশান করলে পুরো হাসপাতালে গাঁজা আর চরসের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়বে।” মদ আর মাদকের লাইনে আমিই ওকে নিয়ে গিয়েছিলুম বলে প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে প্রায়ই সন্ধ্যায় ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতুম । একদিন ও বলল ওকে এক প্যাকেট কনডোম এনে দিতে। কনডোম কী করবে, শরীরের এই অবস্হায় ? বলল ওই তো নার্সকে জিগ্যেস করো, ও রাজি আছে । নার্স মাথা নেড়ে সায় দিল । পরের দিন কনডোমের প্যাকেট নিয়ে গিয়ে দেখি বিছানা খালি, নতুন চাদর আর বালিশের খোল, ওষুধ কিছুই নেই, ঘর ফাঁকা । সেই নার্সকে খুঁজে তাকে জিগ্যেস করতে সে বলল, আজ সকালেই উনি মারা গিয়েছেন, ওনার প্রথম পক্ষের স্ত্রী এসে শব নিয়ে গেছেন । কনডোমের প্যাকেটটা পাশেই গঙ্গায় ফেলে দিলুম ।

                     ১৯৮৫ থেকে যখন আবার লেখা আরম্ভ করলুম ঢাকা থেকে মীজানুর রহমান বললেন ওনার পত্রিকার জন্যে হাংরি আন্দোলন নিয়ে ধারাবাহিক লিখতে । লেখা আরম্ভ করলুম “হাংরি কিংবদন্তি” । প্রতিবছর আসতেন আমার নাকতলার ফ্ল্যাটে, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট হলেও । মীজানুর যাতে লেখাটা আর না ছাপেন তাই শামসুর রাহমানের মাধ্যমে সুনীল, শক্তি, তারাপদ অনুরোধ করলেন মীজানুরকে । উনি ওনাদের বললেন, ঠিক আছে, আপনাদের কার্টুন আর ছাপবো না, তবে লেখাটা চলবে । শামসুর রাহমান ওনাকে বললেন, “প্লিজ, ঢাকা থেকে “হাংরি কিংবদন্তি” গ্রন্হাকারে প্রকাশ করবেন না । মীজানুর “হাংরি কিংবদন্তি” গ্রন্হাকারে প্রকাশ করলেন না কিন্তু আমার উপন্যাস “নামগন্ধ” প্রকাশ করলেন ঢাকা থেকে । আমাকে নিয়ে সাংস্কৃতিক রাজনীতি কেবল পশ্চিমবাংলাতেই হয় না, তা বাংলাদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে । মীজানুর রহমান মারা গেছেন দশ বছর হল ।         ঢাকা থেকে আরেকজন নিয়মিত আসতেন, তিনি বাংলাদেশের বিদ্যাসাগর সোসায়টির প্রধান । প্রতিবার এসে বলতেন যে তাঁকে হুমকি দেয়া হচ্ছে বন্ধ করে দেবার জন্য, বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশে বিদ্যাসাগরের প্রয়োজন নেই । জানি না ওনার কী হল । আমি কলকাতা ছাড়ার পাঁচ-ছয় বছর আগেই ওনার আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ।

               ২০০৪ সালের পর থেকে আমি এক ভ্যাবাচাকা মানসিকতায় ভোগা আরম্ভ করেছিলুম ; নিজের ভেতর থেকে লাফিয়ে বেরোবার বিপজ্জনক আনন্দ ? যেন মানব-বোমা হবার জন্য তৈরি হয়ে আছি, উদ্দেশ্যহীন, কী বলব একে? রাস্তার ধারে ইঁটের ওপর বসে তেলমালিশ করাবার মতন নিঃসঙ্গতা এটা নয় । বা, হয়তো, বর্তমানে আমি সেই স্হিতিতে বসবাস করছি, যে পরিসরে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা মিলেমিশে গেছে । আমি অস্তিত্ববাদী নই যে আমার এই একাকীত্ববোধকে ‘হিউমান কাণ্ডিশন’ হিসাবে মেনে নেবো ; হিন্দু পরিবারে জন্মে একাকীত্ববোধের খ্রিস্টধর্মী ‘হিউমান কন্ডিশন’ সম্ভব বলে মনে হয় না । কিয়ের্কেগার্দ, জাঁ পল সার্ত্রে, আলবেয়ার কামু, মরিস মার্লো পন্টি, কার্ল জাসপার্স প্রমুখের ভাবনাচিন্তার সঙ্গে খাপ খায় না আমার ভাবনাচিন্তা । ১৯৯৭ সালে যে আরথ্রাইটিস হয়েছিল তার রেশ থেকে গেছে গাঁটে-গাঁটে, সবচেয়ে বেশি বুড়ো আঙুলে, যে কারণে কলম ধরে লিখতে পারি না । সইসাবুদের যাবতীয় কাজ আমার বুড়ি স্ত্রীকে করতে হয়, যে আমার চেয়ে মাত্র দু’বছরের ছোটো ।

             এখানে বলে নিই, আমি একজন ইন্সটিঙ্কটিভ হিন্দু, কেননা দুর্গাপুজো দোল কালিপুজোর সময়ে আমার প্রবৃত্তিগতভাবে ভালো লাগে, অথচ আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, মনুস্মৃতিতে বিশ্বাস করি না, ঋগ্বেদের দেবী-দেবতায় বিশ্বাস করি না, কেননা ওটা আমার ভেতরে কাজ করে না, ওটা আপনা থেকে গড়ে-ওঠা ব্লকেজ। কমিউনিস্টদের মতন আমি ভেবেচিন্তে বা বই পড়ে দেয়াল তুলিনি, বলেছি তো আমি বুদ্ধিজীবি নই । কলকাতায় অনেককে দেখেছি, “আপনি কি হিন্দু” জিগ্যেস করলে ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়, উত্তর দিতে পারে না, কেউ-কেউ বোবা সাজে, কেউ-কেউ ভেবেচিন্তে মরে যাবার পর দেহের গতি নিয়ে কথা বলে । মরে যাবার পর ? ডেড বডিও তাহলে চিন্তাভাবনা করে ! বুঝতে পারি যে তারা নিজের সম্পর্কে খতিয়ে দেখে না, নিজেকে যাচাই করে না, কেবল অন্যে কী করছে আর বলছে তা-ই নিয়ে কিচাইন ।

                       মৃত্যু সম্পর্কে, এই বয়সে যে ভীতি অনেকের হয়, তা দেখা দেয়নি এখনও । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সত্যিই ভীতি হয়েছিল, নাকি কবিতা লেখার জন্য মৃত্যুকে বিষয় করেছিলেন, মৃত্যু বিষয়ক কবিতা লিখেও তারপর চনমনে থাকতেন, মদ খাওয়াবার জন্যে আবদার করতেন । আমার তো যেন মনে হয় নিঃসঙ্গতার সঙ্গে মিশে-যাওয়া আমার বর্তমান একাকীত্বটা সহজাত, অন্তর্মুখ, স্বকীয় আত্মজ্ঞানের স্বনির্মিত ডামাডোল কারাগার, উন্মাদ প্রেমে আটক ব্যক্তিএককের মতন ; আমি যেন পুনরুদ্ধারের অযোগ্য এমন কোনো আত্মপরিসরে নিরুদ্দেশ হয়ে রয়েছি, আমাকে কেউ আর খুঁজে পাবে না । আমি নিজের বানানো স্বপ্রেমের বেদনাময় জেলখানা থেকে বেরোবার চেষ্টা করি, কয়েক দিনের জন্যে বেরোই, আবার নিঃসঙ্গতাময় একাকীত্ব কাবু করে ফ্যালে আমাকে । ইনটারনেটের অধিবাস্তব জগতে তৈরি মানব-সম্পর্কের মাধ্যমে দূর করার চেষ্টা করি নিঃসঙ্গতার একাকীত্ব ; অথচ পাঁচ হাজার বন্ধুর কেউ তো বাস্তব নয়, রক্তমাংসের নয় । তাছাড়া রক্তমাংসের মানুষ তো রয়েছে আশে-পাশে, কই কোনো রদবদল তো ঘটছে না আমার  সন্ত্রস্ত আত্মবোধে ।

             নিঃসঙ্গতার সঙ্গে একাকীত্বের পার্থক্য হল যে নিঃসঙ্গতার স্হিতি স্বীকার করে নেয় যে ব্যক্তিএককের পাশে প্রচুর লোকজন রয়েছে, কয়েকজন স্বজনও রয়েছে । অর্থাৎ সেই স্হিতিটা সাময়িক, তাকে বদলে ফেলা যায়, অন্যান্য লোকজনের সঙ্গে অর্থবহ যোগাযোগের মাধ্যমে । এমনকি ব্যক্তিএকক নিঃসঙ্গতার আনন্দ উপভোগ করতে পারে, সৃষ্টিশীল হয়ে উঠতে পারে । কিন্তু একাকীত্বকে সে উপভোগ করতে পারে না, তা আত্মপ্রেমের গিলোটিনে মাথা রাখার ফলে যন্ত্রণাদায়ক, দুর্দশাসৃষ্টিকারী, হাহাকারময় । একাকীত্বের স্হিতি ব্যক্তিএককের বাইরের নয় বলেই মনে হয় ; তা ব্যক্তিএককের মনে গড়ে ওঠে, কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। একা, আলাদা হয়ে বসে থাকার ব্যাপার নয় একাকীত্ব । একাকীত্ব হল ফোঁটায় ফোঁটায় সঞ্চারিত উপলব্ধি, বিপত্তিমূলক উপলব্ধি । শৈশব থেকে বাইরের সাময়িক নিঃসঙ্গতাগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, আর সেগুলো স্মৃতিকে খামচে ঘায়ের মতন রয়ে গেছে । বাইরের এজন্য বলছি যে সেসব নিঃসঙ্গতা ছিল সম্পর্কজনিত । ওই আত্মভঙ্গুর ঘটনাগুলোর কথা আমি মাঝে-মাঝে রোমন্হন করে নিরাময় খুঁজি, এখন স্মৃতির জাবর কেটে  দেখি ট্রমা থেকে কতোটা নিরাময় ঘটে ।

             আমি মনে-মনে ফিকশানগুলো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ছকে নিই, যেমন চোর-ডাকাতরা রাতের বেলায় পরিকল্পনা করে, তারপর যখন লিখতে বসি তখন নিজেকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে আবিষ্কার করতে থাকি, ফিকশানের চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিজের সমস্যা ভাগ-বাঁটোয়ারা করি, লিখতে বসার আগে নিজের ভেতরে হারিয়ে যাবার চেষ্টা করি, তখন মনে হয় লেখালিখিই আমার প্রেমিকা, আমার লেখার শিকড় আমার চেতনায়, কেননা আমি একই ঘরে, একই বাড়িতে, একই পাড়ায়, একই রাস্তায়, একই শহরে, একই রাজ্যে সারা জীবন কাটাইনি । যখন গাঁজা-চরসের নেশা করতুম তখন নিজের আহ্লাদের জন্যেই করতুম, এখন লেখালিখির নেশা করি নিজের আহ্লাদের জন্যেই করি, পাঠক-পাঠিকাদের সঙ্গে সেই আহ্লাদের দুঃখ-কষ্ট ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিই । কেউ মনে রাখুক, এই ভেবে লিখি না । মরে যাবার পর আমার লেখার কি হবে তা নিয়ে চিন্তিত নই । লেখা শেষ হয়ে গেলে সাপের খোলোশ থেকে বেরিয়ে আসি টাটকা ত্বক নিয়ে ।  

    চোদ্দ   

            আমি কবে জন্মেছিলুম, ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেটে ১৯৩৯ থাকলেও, জানি না, তার কারণ, পাটনার মহাদলিতদের পাড়া ইমলিতলার বাড়িতে বয়স্করা মনে করতেন, ব্যাপারটা যে জন্মেছে  তার হর্ষোল্লাসের নয়, যিনি প্রসব করেছেন তাঁর ; সুতরাং প্রসবদিন বলে কিছু হতে পারে, জন্মদিন আবার কি ? যে জন্মেছে তার তো কোনো অবদান নেই যে তার জন্মদিন নিয়ে হুজুগ করতে হবে, সে কি নয় মাস কষ্টে ভুগেছিল, সে তো দিব্বি মায়ের পেটে হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতার শিখেছে, চব্বিশঘণ্টা খেয়েছে, তারপর তার মায়ের প্রসব বেদনা উঠলে তার মা তাকে প্রসব করেছে। জীবনে কক্ষুনো সে মায়ের কষ্ট বুঝবে না । ঠিকই তো, নাড়ি শুধু মায়েদের গর্ভেই তৈরি হয় ।        প্রসবের জন্য বাড়ির বউরা যেতেন নিজের বাপের বাড়ি, প্রসবের দিনক্ষণের হিসেব রাখার দায়দায়িত্ব বাপের বাড়ির লোকেদের ; এখন তারা যদি মুকখু হয় তো কি আর করা যাবে ! তারা প্রসবের দিনটা লিখে রাখতে পারেনি ।

            আমার বাবা ছিলেন ছয় ভাই, প্রমোদ, সুশীল, রঞ্জিত, অনিল, সুনীল আর বিশ্বনাথ, এবং এক বোন কমলা । ঠাকুমা প্রসবের সময়ে নিজের বাপের বাড়ি যেতেন, কলকাতার পটলডাঙায়, বিরাট আঁতুড়ঘর ছিল সেখানে, আর সেই আঁতুড়ঘরে তাঁর পরপর ছেলে হয়েছে, মেয়ে হচ্ছে না বলে যখন ঠাকুর্দার মনখারাপ, তখন ঠাকুমা ওই আঁতুড়ঘরে মেয়ে প্রসব করেন । আমাদের আদি নিবাস, বড়িশা-বেহালা হলেও, ১৭০৯ সাল থেকে আদি নিবাস গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় চলে এসেছিল ; সেখানে “সাবর্ণ ভিলা” নামে একটা জমিদারি বাড়ি তৈরি করেছিলেন পূর্বপুরুষ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী, যে বাড়িটি শরিকি অবহেলায় এমনই পোড়োবাড়িতে রূপান্তরিত হয়েছিল, অশথ্থের শেকড়ের আলিঙ্গনে হাড়গোড়-ভাঙা যে, আবাসন তৈরির জন্য প্রোমোটারকে দিয়ে দেয়া হয়, আমিও তার ভাগ পেয়েছিলুম, ষাট হাজার টাকা ।

             বড়োজ্যাঠা, মানে প্রমোদের স্ত্রী নন্দরাণীকেও পাঠানো হয়েছিল বাপের বাড়ি হুগলি জেলার কোন্নোগরে । তাঁর মেয়ে হল, নাম রাখা হল সাবিত্রী বা সাবু । দ্বিতীয়বার প্রসবের জন্য গেলেন কোন্নোগর, আবার মেয়ে হল, ধরিত্রী বা ধাবু । ঠাকুমা হুকুম দিলেন যে নন্দরানীর আর বাপের বাড়ি গিয়ে প্রসব করা চলবে না, বড়োই অলুক্ষুণে ওনাদের আঁতুড়ঘর, ওদের বাড়ি ছেলে জন্মায় না । নন্দরাণীর ভাইয়ের বউ বাপের বাড়ি যাননি, কোন্নোগরের আঁতুড়ঘরেই পরপর দুটি মেয়ের জন্ম দিয়েছিলেন, আলো আর পূরবী, এবং তারপর আর সাহস করেননি, ভয়ে, যদি আবার মেয়ে হয় । নন্দরাণীও আর বাচ্চা প্রসব করতে রাজি হননি, কোন্নোগরে গিয়ে হোক বা ইমলিতলায়, যদি আবার মেয়ে হয় । সাবু-ধাবুর জন্মদিন বা নন্দরাণীর দুটি প্রসবের দিন মনে রাখা দরকার মনে করেননি ইমলিতলার বয়স্করা । ছেলে হল না বলে বড়োজেঠা একজন বেশ্যার কাছ থেকে দেড়শো টাকা দিয়ে মেজদাকে কিনেছিলেন ।

             মেজজ্যাঠা, মানে সুশীলের স্ত্রী করুণা আমাদের আদিবাড়ি উত্তরপাড়ার মেয়ে, তিনি প্রসবের জন্য গেলেন নিজের বাপের বাড়ি । ঠাকুমা আপত্তি করেননি, প্রসবের সময়ে করুণা বাপের বাড়ি গেলে, তিনি গঙ্গাস্নানে যাবার সময়ে একবার করুণাকে দেখে যেতেন, মাগঙ্গাকে রিকোয়েস্ট করতেন যেন করুণা অন্তত বংশরক্ষা করেন । মা গঙ্গা রিকোয়েস্ট রিফিউজ করে দিয়ে করুণাকে দিয়ে মেয়ে প্রসব করিয়েছিলেন, তাও মৃত । ঠাকুমা যাকে বলে আতঙ্কিত । স্ত্রী করুণাকে নিয়ে মেজজ্যাঠা চলে গেলেন ছাপরায় থাকতে, সেখানে তাঁর জন্য একটা ফোটোগ্রাফির দোকান খুলে দেয়া হয়েছিল । মেজজেঠিমার যখন যক্ষ্মারোগ হল তখন দোকানপাট লাটে উঠিয়ে দুই মেয়ে ডলি আর মনুকে নিয়ে পাটনায় চলে এলেন ।

             এরপর সেজভাই রঞ্জিতের স্ত্রী অমিতার পালা । ঠাকুমা নিষেধ করলেন না, কেননা আমার মায়ের বাপের বাড়ি ছিলই না, মায়ের বাবা কম বয়সে মারা যান, দিদিমা তিন ছেলে আর তিন মেয়ে নিয়ে ওঠেন গিয়ে তাঁর বাপের বাড়ি, মানে মায়ের মামার বাড়ি । বাপের বাড়ি তো আর নয়, মামার বাড়ি, ওদের ঘরের আঁতুড় ঘরে ছেলের পর ছেলে হবার রেকর্ড আছে । এবং লো অ্যাণ্ড বিহোল্ড, মা একটি ছেলে প্রসব করলেন। মামার বাড়িতে দাদার নাম রাখা হয়েছিল বাসুদেব । মামাদের দেয়া নাম, যে মামারা নিজেরাই নিজের মামার বাড়িতে থাকতেন । অমন নাম ঠাকুমার পছন্দ হল না, দাদার নাম রাখা হল সমীর, আদর করে সবাই মিনু বলে ডাকতেন ।

             বাড়ির পারিবারিক রাজনীতিতে মাকে অনেক ওপরে তুলে দিলেন ঠাকুমা, রান্নাঘর আর ভাঁড়ার ঘরের কর্তৃত্ব মায়ের, খরচের নির্দেশে দেবার অধিকার মায়ের । বলতেন, অজাতশত্রুদের মা । তখনও অজাতশত্রুর গল্প শুনিনি, লোকটা কে তাও জানতুম না, মানে বলা হয়েছিল, যার কোনো শত্রু নেই । আমরা শোত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে পৃথিবীতে এসেছি ।

             আমাকে প্রসব করার সময়ে মায়ের মামার বাড়িতে আমাদের আর তেমন সামাজিক গুরুত্ব ছিল না। ইমলিতলার বাড়ি আর মহাদলিতদের কুঁড়েঘরের সারি, ওপচানো নর্দমা, পাড়ার বাচ্চাদের গলির নর্দমায় হাগা দেখে মায়ের ভাইদের, আর তাঁদের মুখে শুনে মায়ের মামাদের,  আমাদের পরিবার সম্পর্কে ধারণাটা ঘা খেয়েছিল । ওনারা ভেবেছিলেন সাবর্ণ চৌধুরী পরিবার, বিরাট রোশনাই আর ঝালরঝোলানো ঝিকমিকে ব্যাপার হবে । সাবর্ণ চৌধুরীরা যে ষষ্ঠ শতকের অরিজিনাল সাবর্ণ চৌধুরী পুরুষটার পরের প্রজন্মে বিয়োতে বিয়োতে জ্যামিতিক লাফে তত দিনে তিরিশ হাজারে পৌঁছে গেছে, আর তাদের বেশিরভাগই দারিদ্দিরে পটকান্তি খেয়েছে,  কেউ-কেউ রিকশা চালায়, মুটেগিরি করে, তা হদিশ করতে পারেননি ওনারা। মাকে দ্বিতীয়বার পাঠাতে রাজি হলেন না বাবা । মা আমাকে প্রসব করলেন হাসপাতালে, পাটনার প্রিন্স অব ওয়েল্স হাসপাতালে । ইমলিতলার বাড়িতে কোনো আঁতুড়ঘর ছিল না, মায়ের শরীরও, আমার কারণে, সুস্হ ছিল না । হাসপাতালের সেই বিলডিঙ, যে-হাসপাতাল বাড়িতে আমাকে মা প্রসব করেছিলেন, স্বাধীনতার পর তা ভেঙে ফেলে সেখানে রাজেন্দ্র সার্জিকাল ব্লক গড়ে উঠেছে । বড়োজ্যাঠা ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হয়ে এই সার্জিকাল ব্লকে ছিলেন বেশ কয়েক মাস । আমার ছেলের মাথা ফাটলে কপালে স্টিচিঙের জন্যে গিয়েছিলুম এই হাসপাতালে ।

             —তোমরা হাসপাতালের কাগজপত্র রাখোনি ? রাখলে তো তা থেকে জানা যেত কবে কোন সালে মা আমাকে প্রসব করেছিলেন ।

            —ওসব কাগজপত্তর আবার বাড়িতে রাখে নাকি ? হাসপাতালের কাগজ, নার্সরা কতো রুগিকে ছুঁচ্ছে দিনভর, কাগজের সঙ্গে বাড়িতে আবার কোন ব্যামো ঢোকে তার কোনো নিশ্চয়তা আছে ?

            অন্তত আমার জন্মদিনের একটা পোক্ত প্রমাণের সম্ভাবনা ছিল ; কিন্তু জন্মদিনটা তো আর গুরুত্বপূর্ণ নয়, প্রসবের রুগি ভালোয়-ভালোয় বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে, তাও দ্বিতীয়বারও কোলে ছেলে নিয়ে, এই তো যথেষ্ট ।

             —তোর ভাগ্য ভালো যে মেয়ে প্রসব করেনি তোর মা ।

            নককা, অনিলের বিয়ে হল কলকাতার ভবানীপুরের সেসময়ের আধুনিকা  অমিয়ার সঙ্গে । প্রসবের জন্য তিনি গেলেন ভবানীপুরে । তাঁর মেয়ে হল, খুকু । দ্বিতীয়বার গেলেন । আবার মেয়ে হল, রাখি ।

            নতুনকাকা সুনীলের বিয়ে হল উত্তরপাড়ার মেয়ে কমলার সঙ্গে । তিনি প্রসবের জন্য বাপের বাড়ি গেলেন । মেয়ে হল, পুটি ।

             দাদা আর আমি জন্মাবার পর ঠাকুমা আর জোর দিতেন না ; ছেলেদের বলে দিয়েছিলেন যার যেখানে ইচ্ছে বউদের পাঠাও, ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, তোমরা নিজেরা বুঝো । নতুনকাকা ঠাকুমাকে বলেছিলেন, উনি অনেকগুলো বাচ্চা চান, প্রথম মেয়ের পর ওনার ছেলে তারপর মেয়ে, এইভাবে ছেলে-মেয়ের ছন্দ মিলিয়ে ছয়টা মেয়ে আর তিনটে ছেলে হল । ঠাকুমা বলেছিলেন এবার ক্ষান্তি দে, তিনটে ছেলে যথেষ্ট, এই উত্তরপাড়ার বারো ঘর-চার সিঁড়ির বাড়ি ভাগ-বাঁটোয়ারা হলে সকলের ভাগ্যে একটা করে নোনা ইঁট জুটবে ।

             ছোটোকাকা বিশ্বনাথ বিয়ে করলেন, উত্তরপাড়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন গঙ্গোপাধ্যায় পরিবার, চিৎপুরের যাত্রা দলের ছোটো ফণী নামে যিনি খ্যাত ছিলেন, তাঁদের বড়ো মেয়ে কুচির সঙ্গে প্রেম করে । ওনাদের কোনো বাচ্চা হল না । ঠাকুমা বলেছিলেন, প্রেম করে বিয়ে করলে বাচ্চা হয় না, তার ওপর এক গোত্তরের বিয়ে ; ভাড়াটের মেয়ের তো আঁতুড়ঘরও নেই । প্রসবের দিন আর বাচ্চার জন্মদিনের হিসেব রাখার ঝক্কিঝামেলা পোয়াতে হল না ওনাদের । তবে বিয়ে হয়ে যাবার পর ঠাকুমা বেয়াইকে চব্বিশঘণ্টার নোটিস দিয়েছিলেন উত্তরপাড়ার বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে বাড়ি ভাড়া নিতে । ওনারা আদপে কোথাকার লোক ছিলেন জানি না, তবে উত্তরপাড়াতেই বিভিন্ন পাড়ায় বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন ।

             ছোটোকাকার ছোটোশালী ক্ষ্যামাঙ্করী বা খেমি ফ্রকের ওপর তার উঁচু বুক আর ফ্রকের তলায় খোলতাই উরু নিয়ে গরমের ছুটিতে বেড়াতে আসতো ইমলিতলার বাড়িতে, জড়াজড়ির খেলা খেলে পরস্পরের চরিত্র আলোয় আলো করার এইটিই আমাদের প্রথম সুযোগ ছিল  । গ্রীষ্মকালে, ইমলিতলার বাড়িতে, রাতের বেলায়, ছাদে মাদুর পেতে, গড়াগ্গড় শুতুম আমরা সবাই, মাঝরাত থেকে ঠাণ্ডার জন্য পায়ের কাছে গায়ে দেবার চাদর । আমার বয়স এগারো, খেমির তেরো । সবায়ের সামনে খেমিমাসি বলে ডাকতুম । ১৯৫০ সালে, মাঝরাতে, খেমির ঠেলা, কি রে, তোর বাপ তো রোজ-রোজ টাকা রোজগার করে, দাঁত মাজার মলম বেরিয়েছে আজকাল, তাই দিয়ে দুজনে দাঁত মাজবো, তাহলে গন্ধ হবে না । আমাদের দুজনের গায়ে একটাই চাদর, আর আমাদের হাত দুজনের শরীরের রহস্য খুঁজে বেড়াতে ব্যস্ত । আমার মাথা ওর ফ্রকের তলায় , ওর হাত আমার প্যান্টুলের ভেতর । তারপর একজন আরেকজনের ঠোঁট খাওয়া আরম্ভ করলুম, আপনা থেকেই ঘটে গেল প্রথম দিন, তাই খেমি বললে, মুখ মাজার মলমের ব্যবস্হা করতে । পাকা তালশাঁসের ঠোঁট । খেমির কথা বলার ঢঙ আর বেপরোয়াভাব আমি ব্যবহার করেছি আমার  ‘অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস’ নামের ডিটেকটিভ উপন্যাসের মিলি চরিত্রে ।

             কবে খেমি আবার গরমকালের ছুটিতে আসবে, এই আশায় থাকতুম । তিনবার তিন বছর এসেছিল, প্রতিবার বুকের তাপ আর তরাই বাড়িয়ে । তারপর খবর এলো যে খেমি মায়ের দয়ায় ভুগে মারা গেছে । মায়ের দয়া ! কোন মা ? শেতলাদেবী, দক্ষিণভারতে মারিআম্মান দেবী । রোগের বেলায় দেবী কেন জানি না, রোগ সারাবার বেলায় দেবতা । সাপে কামড়ালে, কিংবা যাতে না কামড়ায়, তাই মনসাদবীকে পুজো দাও । যাতে না মহামারী আরম্ভ হয় তাই ধূমাবতীর পুজো দাও, পর্ণশবরীর পুজো দাও । আর দেবতারা সকলের স্বাস্হ্য রক্ষা করে। অশ্বিনী যমজভাইরা, ধন্বন্তরী, ধাত্রীদেবতা আয়ুর্বেদের ডাক্তার !   খেমির মা ওকে আমার মায়ের আগে প্রসব করেছিলেন, তাই খেমি অনেক কিছু জানত, শিখিয়ে দিয়েছিল, যা পরে কাজে লেগেছে আমার, নিজেকে হাঁদা-গঙ্গারাম, যা খেমি আমাকে বলত, তা আর হতে হয়নি । খেমির জন্মদিন-মৃত্যুদিন জানা হল না আমার । কুচি-খেমির মায়ের নাম ছিল বিবসনা । ভাবা যায় এরকম অতিআধুনিক নাম, যার দেহে বসন নেই ? জানি না ইনি কোন পুরাণের দেবী ।  আমাদের দুজনের গা গরম হয়ে ওঠে, সেই গরমের যোগফল দুজনের গায়ের গরমের তিনচার গুণ বেশি । আকাশে তারায় তারা, দেখা যায় সপ্তর্ষি মণ্ডল, দেখা যায় চাঁদ । ইমলিতলা ছাড়ার পর অমন পরিষ্কার আকাশ কোথাও পাইনি আর ; খেমি ওই আকাশ নিয়ে গেছে নিজের সঙ্গে আর দিয়ে গেছে ধোঁয়াটে ডিজেলের কারখানার চিমনির শ্বাসের আকাশ ।     ফিসফিস করে, খেমি অর্থাৎ মিলি : এরকম হয় বুঝি ? এই ফুলে যাচ্ছে রে, গরমও হয়ে যাচ্ছে, আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে রে, বুক ঢিপঢিপ করছে ; তোর কিছু হচ্ছে না ? মানে এখানে নয়, যেটা ধরে আছি? মনের মধ্যে কিছু? কিংবা বুকে ?    আমি হাত চালিয়ে দিতে ন্যাকড়া বাঁধা পেলুম । চাপা উত্তেজনায় বললুম, ও, নিজেরটা বেঁধে এনেছিস । কেন, চাস না যে হাত দিই ?

            খেমি বা মিলি : ধ্যাৎ বোকা, এখুন ধ্যাড়ানি চলছে, কালকে খুলব, তখন যতো ইচ্ছে হাত দিস ।

            খেমি বা মিলি ন্যাকড়া ঢিলে করতে হাত ঢোকালুম, কীরকম চটচটে । আমার হাতটা নিজের ফ্রকে পুঁছে খেমি বলেছিল, দেখলি তো ! কালকের দিনটা অপেক্ষা করতে পারলি না । তুই কিন্তু সত্যিই ষাঁড় । বড়বাজারে গিসলুম একবার, তখন দেখেছিলুম একটা ষাঁড় ওই করছে । একদম গোলাপি । কেন বলতো? তুই তো ফর্সা ।

            পরের দিন, মিলি বা খেমি আমার বাঁ হাতের মধ্যমা আঙুলটা নিয়ে বলেছিল, এইতে রাখ, শুধু রাখবি, নাড়াবি না কিন্তু, নাড়ালে কাল থেকে অন্য জায়গায় শোবো ।

             আমি আঙুলটা নাড়াতে-নাড়াতে বলেছিলুম, নাড়ালে কী হয় ?

             মিলি বা খেমি আমার বোতাম-খোলা প্যান্টে হাত ঢুকিয়ে টিপে-তিপে ফোলাতে লাগল আর বলতে লাগল, এই হয়, এই হয়, এই হয়, এই হয়, এই হয়, এটা আমার এটা আমার ।

             —কালকে দিনের বেলায় একটু দেখতে দিস ।

             —দেখে আবার কী করবি ? চুল দেখতে চাস ?

             খেমি দেখিয়েছিল, ছাদেতেই, দুপুর বেলায়, যখন সবাই ভাত খেয়ে ঝিমোচ্ছে । দেখেই বেশি ভালো লাগলো, হাত দেয়াদিয়ির চেয়ে । রগের কাছে দপদপানি ।

             খেমির আগে, ইমলিতলা পাড়ায়, কুলসুম আপার সঙ্গে একই ধরনের ব্যাপারে, আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, আমি জানতুম যে বাড়াবাড়ি করলে ছড়ে গিয়ে কষ্ট হতে পারে ; ১৯৪৯ সালে, কুলসুম আপার সঙ্গে সম্পর্কের সময়ে আমার বয়স দশ । কুলসুম আপাদের ঘরটা ছিল অন্ধকার, ছাগল হাস মুর্গিদের ঘর, তাই দেখা হয়নি, তাছাড়া উনি ছিলেন বেশ কালো ।   কুলসুম আপার চরিত্র আমি ব্যবহার  করেছি ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে । ওনারা ছিলেন শিয়া মুসলমান পরিবার. ওয়াজেদ আলি শাহের পতনের পর পাটনায় পালিয়ে এসেছিলেন, বেশ গরিব হয়ে গিয়েছিলেন, একই শতচ্ছিন্ন পোশাক দিনের পর দিন, বোরখা পরতেন না কেউ, বাড়ির বউরা বিড়ি বাঁধতেন, হাসের ডিম, মুর্গির ডিম, হাস, মুর্গি, ছাগলের বাচ্চা বিক্রি করতেন । আমাদের বাড়িতে মুর্গির ডিম সেসময়ে নিষিদ্ধ ছিল বলে ওনাদের বাড়ি থেকে হাসের ডিম আনতে যেতুম । কুলসুম আপা গালিব আর ফয়েজ আহমদ ফয়েজ শোনাতে ভালোবাসতেন, আমার মতো নির্বাক মুগ্ধ শ্রোতা আর কোথায় পাবেন, যে ওনার কালো গভীর চাউনি গোল মোটা ঠোঁট গালে টোল দেখার নেশায় বুঁদ । ওনাদের বাড়িতে যে মাংস রাঁধা হচ্ছিল তার গন্ধে শ্রোতা মোহিত হয়ে খেতে চাইলে কুলসুম আপা বাটি করে এনে খাইয়েছিলেন, বলেছিলেন বাড়িতে কাউকে বলিসনি, পাড়ায় রটে যাবে । বলিনি কখনও যে গোরুর মাংস খেয়েছি । উনি জিভ দিয়ে আমার ঠোঁট পুঁছে দিয়েছিলেন । যেদিনই মাংস রান্না হয়েছে সেদিনই ব্ল্যাকমেল করেছি ঘষাঘষি খেলার আগে ।

             একদিন হাস-মুরগির অন্ধকার ঘরে শ্রোতার প্যান্ট খুলে নামিয়ে দিলেন, নিজের চুড়িদার নামিয়ে দিলেন আর শ্রোতাকে কষে জাপটে ধরে নিজেকে ঘষতে লাগলেন । শ্রোতার ভালো লেগেছিল বেশ, তাই রোজ যেতো, যদিও রোজ হাসের ডিম কেনার দরকার হতো না । এ-ব্যাপারেও কুলসুম আপা বলেছিলেন, তোর বাড়িতে কাউকে বলিসনি যেন । একদিন কুলসুম আপা শ্রোতাকে এতো বেশি জাপটে ধরে কাঁপতে লাগলেন যে শ্রোতার নুনু ছড়ে গেল, হাঁটতে অসুবিধা হল দুদিন । ভয়ে শ্রোতা তারপর কুলসুম আপার বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল । শ্রোতার জাঠতুতো-খুড়তুতো বোনরা ডিম কিনে আনতো । মেজজ্যাঠার ছোটো মেয়ে মনু জিগ্যেস করেছিল, “ছোড়দা, ওই কেলটে কালো কুচকুচে কুলসুমটা তুই কবে ওদের বাড়ি যাবি, জানতে চায় কেন রে ?”

             ‘আমদের জন্মদিন হয় না’ এই তত্ত্ব সম্ভবত ইমলিতলা বাড়ির সৃষ্টি । ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ ও তাঁর দুই ভাই হরিনারায়ণ এবং বৈকুণ্ঠ  পর্যন্ত উত্তরপাড়ার সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশলতিকা ১৯১১ সালে ‘বংশ পরিচয়’ নামে প্রকাশ করেছিলেন অমরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যেটি বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরী সংগ্রহালয়ে সংরক্ষিত  । ঠাকুর্দার প্রজন্ম থেকে আমাদের আর্থিক ডামাডোল আরম্ভ হয়, আর ইমলিতলায় এসে তো আমরা একেবারে ফেকলু পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলুম । কাগজ দেখিয়ে ভারতীয় আম আদমির আত্মপরিচয় প্রমাণ করার প্রথা বোধহয় স্বাধীনতার পরই আরম্ভ হয়েছে । ঠাকুর্দার পরিচয় উইকিপেডিয়ায় আছে, তা থেকে জানা যায় উনি ১৯৩৩ সালে মারা যান, যে বছর দাদাকে মা প্রসব করেন । মানে, উনি নিজের বংশধরকে দেখে গিয়েছিলেন ।

               ১৭০৯ সালে উত্তরপাড়া শহরের পত্তন করেছিলেন রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী, যিনি বড়িশার একান্নবর্তি জমঘট থেকে বেরিয়ে নিজের একটা আলাদা জমিদারি চাইছিলেন । সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা ভঙ্গ কুলীন ছিল, যাদের বাড়িতে খাঁটি-বামুনরা তাদের মেয়ের বিয়ে দিত না । রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী টাকা আর জমিদারির অংশ দিয়ে গরিব ব্রাহ্মণ যুবকদের ফুসলিয়ে জামাই করে এনেছিলেন উত্তরপাড়ায় । ছোটোবেলায় দেখেছি যে আমাদের চেয়ে তাদের রমরমা বেশি । ঠাকুমার কথায়, “তোর পূর্বপুরুষরা মাগিবাজি করে আর মদ খেয়ে সব তবিল উড়িয়ে দিয়েছে, ওরা কোম্পানির কাগজ কিনে-কিনে নিজেদের তবিল বাড়িয়ে নিয়েছে ।” কোম্পানির কাগজ যে কেন দামি তা জানতুম না ।      দাদুর প্রজন্মে পৌঁছে আমাদের তবিল ফাঁকা, বারোঘর চার সিঁড়ির খণ্ডহরের ইঁটে নোনা লাগা আরম্ভ, দিনে পায়রা রাতে চামচিকেতে ছয়লাপ  । দাদু প্রথম সুযোগেই উত্তরপাড়া থেকে কেটে পড়েন । ওনার অন্য দুই ভাই খণ্ডহর ছেড়ে পালাননি, তাঁদের নাতিরা কেউ-কেউ হিন্দ মোটরে হাতুড়ি পেটার কাজে নেমে গিয়েছিল ।

               এখানে একটা ঘটনার কথা বলি । স্বাভাবিক যে দাদাকে ঠাকুমা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন । আমাকেও বাসতেন, তবে তা যে দাদার চেয়ে কম তা ওনার আচরণে টের পাওয়া যেতো । কলকাতার সিটি কলেজে পড়ার সময়ে দাদা ঠাকুমার সঙ্গে থাকতেন । হাংরি আন্দোলনে দাদার গ্রেপতারির সংবাদে ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঠাকুমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, আর তিন দিন কোমায় থাকার পর মারা যান । দাদার গ্রেপ্তারির কথা যাতে ওনার কানে না যায় তা বড়োজ্যাঠা আগে থেকেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন । কিন্তু গ্রেপ্তারির পর ব্যাংকশাল কোর্ট থেকে জামিন নেবার ব্যাপারে বাবা-কাকা-জ্যাঠা-পিসেমশায় উত্তরপাড়ার বাড়িতে একত্রিত হয়েছিলেন । এতোজনকে দেখে ঠাকুমার সন্দেহ হয় । তাঁকে জানানো হয় মামলার কথা । শোনামাত্রই তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল । ওনার শুকনো মাইয়ের বোঁটা ওপরে তুলে তার তলায় স্টেথোস্কোপ রেখে ডাক্তার ঘোষণা করেছিল, “ডেড”।

             ঠাকুমার মৃত্যুদিন মনে রাখার অসুবিধা হয় না, তার সঙ্গে জুড়ে আছে আমাদের কোর্টে দৌড়োনোর অভিজ্ঞতা । কিন্তু পরিবারের অন্য কারোর মৃত্যুদিনেরও, যেমন ঠাকুর্দার বা ঠাকুর্দার ভাইদের, জ্যাঠা-বাবার, কাকিমা-জেঠিমাদের, কোনো হদিশ নেই ।

            —মৃত্যু দিনগুলো কেন মনে রাখোনি তোমরা ?

            —তুই বোকা না গাধা ; মৃত্যু দিন মনে রাখার আবার কি দরকার ।

            —বাঃ, মৃত্যুর জন্য শোক প্রকাশ করবে না তোমরা ?

            —ওসব নাটোক-নবেলে হয় । পূর্বপুরুষরা মারা গেলে বছরে একটা দিনই তর্পণ করতে হয়, তিল-গঙ্গাজল দিয়ে, আত্মাদের অশান্তি করার মানে হয় নাকি, ওনারা যে যেখানে আছেন সেখান থেকে আমাদের সবাইকে আশির্বাদ করেন, তোকেও ।

            তার মানে, আমাদের যেমন জন্মদিন হয় না, তেমনিই, মৃত্যুদিনও হয় না । ইমলিতলার বাড়ির তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা যেমন জন্মাই না, তেমনিই আমরা মরি না । আমরা অজাতশত্রু ।

            অজাতশত্রু, জানা গেল, এই পাটনা শহরেরই লোক, রাজা ছিলেন, এই শহরের পত্তন করেছিলেন, তখন এই শহরের নাম ছিল পাটলিপুত্র । পাটলিপুত্রর ধ্বংসাবশেষ দেখতে বড়োজ্যাঠা নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের । গাইডের কাছে জানা গেল যে অজাতশত্রু ছিলেন মগধের রাজা, যিশুখ্রিস্টের জন্মের চারশো বছরেরও বেশি আগে গঙ্গার ধারে একটা ছোটো দুর্গ তৈরি করেছিলেন ।

           —পাটলিপুত্র নাম কেন ?

           —পাটলি হল এক ধরণের চাল আর পুত্র মানে ছেলে ।

           —চালের ছেলে ? অমন হয় নাকি ?

           —তা নয়, পাটলিপুত্র মানে পাটলির ছেলে, যিনি রাজা সুদর্শনের মেয়ের সন্তান ।

           —যিশুখ্রিস্টের জন্মের তিনশো বছর আগে গ্রিক ইতিহাস-লেখক লিখেছিলেন যে পাটলিপুত্র বেশ বড়োসড়ো শহর ।

           —এ তো দেখছি আমাদের জন্ম হয় না আমাদের মৃত্যু হয় না ধরণেরই গল্প, বড়োজ্যাঠা ।

           —তবে আর ইতিহাস বলেছে কেন । তুই গাইডকে জিগ্যেস কর, অজাতশত্রু কবে জন্মেছিল, কবে মারা গিয়েছিল, বলতে পারবে না ।

           আমি জিগ্যেস করা আরম্ভ করেছিলুম, গাইড আবার গল্প ফাঁদতে আরম্ভ করল ; পাটলিপুত্র ছিল একটা জলদুর্গ, গঙ্গা, গণ্ডক আর শোন নদীর তৈরি ত্রিভুজের মধ্যে, নন্দরাজত্ব, মৌর্যরাজত্ব, শুঙ্গরাজত্ব, গুপ্তরাজত্ব আর পাল রাজাদের রাজধানী । নানা জায়গা থেকে জ্ঞানীগুণিরা এখানে এসে জড়ো হতেন, যেমন এসেছিলেন চাণক্য ।

          —তাদের ছেলেরা সব বাহুবলি,ডাকাত, খুনি, চোরছ্যাঁচোড় আর রাজনীতিক হয়ে জন্মাচ্ছে ।

             বাবার ফোটোগ্রাফির দোকানের চাকর রামখেলাওন সিং ডাবর, দেয়ালে হেলান-দেয়া  বড়জ্যাঠার সাইকেলের সিটে আমাকে বসিয়ে ধরে থাকে, আরি আমি, অজাতশত্রু, হাতির ওপরে বসে রাজ্য জয় করতে বেরোই, হাতে তরোয়াল, যা ডাবরই তৈরি করে দিয়েছে, ফিলমে পাকানো লাল কাগজ মুড়ে-মুড়ে, ছড়ির মতন  । তরোয়াল ঘোরাই, হাতির পিঠে সামলাতে না পারলে রামখেলাওন সিং ডাবর হুকুম করে, ‘ঠিক সে বয়ঠিয়ে মহারাজ’ ।

              দাদা, দেখতে পেয়ে বলে ওঠে, ওঃ, আমাকে সিংহাসন দিয়েছিলেন ঠাকুমা, তুই বেদখল করে রাজত্ব চালাচ্ছিস, জানিস কি যে অজাতশত্রুর একটা হাতে কড়ে আঙুল ছিল না ; আর অজাতশত্রুর নাক উঁচু ছিল বলে প্রজারা ওনাকে বলতো পীনোন্নত ।

             দাদার সঙ্গে আমার পাঁচ বছর বয়সের তফাত, ভয় দেখাবার অধিকার আছে মনে করে এড়িয়ে যেতে ডাবর বলে, ‘হাঁ, সচ্চিমুচ্চি, লোগ কহতে হ্যাঁয়, উ চার উংগলিকে রাজা থে; হমরে বৈশালি মেঁ সবকোই জানত হ্যায়।’

             ঠাকুমাকে জিগ্যেস করা যাবে না, উনি উত্তরপাড়া ফিরে গেছেন । ক্লাসে হিসি পেলে অজাতশত্রু কেমন করে পারমিশান চাইতো তাহলে, কাকে জিগ্যেস করি ? সিসটার আইরিনের ক্লাসে আমি তো ওই ভাবেই অনুমতি চাই । কনভেন্টে কেউই পীনোন্নতর বাংলা বলতে পারবে না, অজাতশত্রুর নামই শোনেনি হয়তো মাদার সুপিরিয়র, সিসটাররা, সিসটার আইরিন আর ফাদার হিলম্যান ।

            ছোটোকাকাকে জিগ্যেস করলুম । তখনও উনি উত্তরপাড়া গিয়ে প্রেমে পড়েননি, বউ কুচিকে পাটনায় আনেননি । “আরে ধ্যুৎ, সব গাঁজাখুরি, রাজাদের নিয়ে ওদের দরবারিরা নানা গপপো ফাঁদে।”

           —আর উনি নাকি পীনোন্নত রাজা ছিলেন ?

           ছোটোকাকার হাসি, গমকে গমকে পেট চেপে ধরে হাসি, ডেকে আনল জেঠিমা আর মাকে । ছোটোকাকা ব্যাপারটা ওনাদের বোঝাতে, জেঠিমা বললেন, “নাক উঁচুদের উন্নাসিক বলে রে, আর যাদের মাইয়ের বোঁটা উঁচু, তাদের বলে পীনোন্নত, এই যেমন আমার, এই দ্যাখ, একে বলে পীনোন্নত, এখনও পীনোন্নত আছে। তুই তো অনেক কাল অব্দি পাড়ার বউদের মি খেয়ে বেড়িয়েছিস, পীনোন্নত জানিস না ?”

         —মি-এর উঁচু বোঁটাকে বলে পীনোন্নত ? সুদামিয়ার, কপিলের মায়ের, কৃষ্ণন্নার মায়ের, কালুটুয়ার চাচির, বিরজুর মায়ের, মুনসিজির বউয়ের সকলের মি-ই তো পীনোন্নত । দাদা আমাকে পিটুনি খাওয়াবার জন্যে বলেছে, তার মানে !

         আমার মায়ের বুকে পর্যাপ্ত দুধ হতো না বলে আমি পাড়ার নার্সিং মাদারদের কোলে পৌঁছে যেতুম ছোটো বেলায় । জেঠিমার কথায়, আমি ভোরবেলা উঠেও কান্না জুড়তুম, “মি খাবো, মি খাবো”, আর ছোড়দি, ধরিত্রী,  কোলে করে নিয়ে যেতো পাড়ার কোনো বাড়িতে আর সঁপে দিত তার কোলে ।

           অজাতশত্রুর কড়ে আঙুল ছিল কিনা তার ফয়সালা করার জন্য দুপুরে, বাবা যখন দোকানের কাজ সেরে লাঞ্চ খেতে এসেছেন, তখন জিগ্যেস করলুম ওনাকে । বাবা খেতে বসে গম্ভীর মুখে বললেন, “মা তোদের অজাতশত্রু খেতাব দিয়ে ভালো কাজ করেনি, অজাতশত্রুটা বাজে লোক ছিল, নিজের বাবা বিম্বিসারকে জেলে পুরে খুন করেছিল, কাকার রাজ্য কাশি আক্রমণ করে তাকে হারিয়ে দিতে, কাশির রাজা নিজের মেয়ের সঙ্গে অজাতশত্রুর বিয়ে দিয়ে দিলে, আর কাশি রাজত্বও দিয়ে দিলে, নিজের খুড়তুতো বোনকে বিয়ে করে নিলে, ছি ছি । ষোলো বছর যুদ্ধ করে গঙ্গার ওপারে লিচ্ছবিদের রাজত্ব দখল করে নিলে, এখন যাকে হাজিপুর বলে, নিজের ভাইদের রাজত্ব আক্রমণ করে সেগুলো দখল করে নিলে, অতো রক্তপাত ভালো নয় ।” বাবা শাকাহারি, তাই রক্তপাতের বিরুদ্ধে ।

           ডাবর বলেছিল, হাজিপুরের কলাকে বলে চিনিয়া কেলা, সবচেয়ে ছোটো মাপের কলা, অজাতশত্রুর ভয়ে কলাগুলো নাকি ছোটো আর একটু টোকো হয়ে গিয়েছিল ।

           —তাহলে বৈশালী আর মুজফফরপুরে এতো ভালো মিষ্টি লিচু কী করে হয় ?

           —চিন থেকে এনেছিল একজন পরিব্রাজক, তাই ওখানকার লিচুকে বলে শাহি লিচু, চায়না লিচু , আম্রপালী নামে একজন সুন্দরী ছিল, তার ছোঁয়া পেয়ে ওখানকার লিচু মিষ্টি।

           ঠাকুমা পাটনায় এলে বলেছিলুম, তুমি আমাদের অজাতশত্রু খেতাব ফেরত নাও ; বাবা বলেছে লোকটা বাজে ছিল। ঠাকুমা বললে, তোর দাদু তোর দাদাকে সমীর নাম দিয়ে গেছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে তোর নাম তোর বাপ রেখেছে মলয়, আর কি, এই নামেই বংশের মুখ উজ্জ্বল কর ।

           —বংশের মুখ উজ্জ্বল ? সেটা কী ?

           —বড়ো হলে টের পাবি, অন্য লোকেরা যদি তোকে হিংসে করে তাহলে বুঝবি বংশের মুখ উজ্জ্বল করতে পেরেছিস । ।

           ঠাকুমা মারা গেলেন বলে আর বলার সুযোগ হয়নি যে, বড়ো হয়ে মুখ যা করেছি, বাড়ির লোকে তাকে মুখ উজ্জ্বল মনে করলেও, ব্যাঁকা মানুষরা তা মনে করে না । তারা নানারকম লেখালিখি করে, হিংসে করে ।

           বলেছিলুম, তুমি তোমার ছেলেদের ডাকনাম রাখোনি কেন ? ঠাকুমা বললে, “কেন ? তোর জ্যাঠাকে খোকা বলে ডাকি এখনও, তোর মেজজ্যাঠাকে মেজখোকা বলি, তোর বাপকে রঞ্জা বলি, তারপর আর কারোর ডাকনাম রাখিনি । তোর বাপের নাম তো মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর নামে রেখেছিলুম, যখন তোর বাপকে প্রসব করেছিলুম, তখন লাহোরে থাকতুম, রঞ্জিত সিং এক-চোখ অন্ধ ছিল, ওর অনেকগুলো বউ ছিল, বাঁদিও ছিল, তাই বলে তোর বাপের রঞ্জিত খেতাব কি ফিরিয়ে নেবো ?

          —বাঁদি কি ?

          —যে বউদের লোকে বিয়ে করে না কিন্তু তাদের নিজের বাড়িতে বউদের মতন  রাখে । অজাতশত্রুরও অনেকগুলো বউ আর বাঁদি ছিল ।

          —দারুণ ব্যাপার ; আমিও বড়ো হলে অনেকগুলো বাঁদি রাখব ; বাচ্চা হলে বাঁদিদের দুধ খেতে পারব।

          —তা রেখো, কিন্তু আমার বারো ঘর চার সিঁড়ির সাবর্ণ ভিলায় এনোনি তাদের ।

          আমার অজাতশত্রু হবার শখের এখানেই ইতি । ঠাকুমাকে বললুম, “অজাতশত্রু কতোদিন রাজত্ব করেছিল লোকে হিসেব রেখেছে, ওর বাবা বিম্বিসার কতোদিন রাজত্ব করেছিল তার হিসেব রেখেছে লোকে, কিন্তু ওদের জন্মদিনের আর মৃত্যুদিনের হিসেব রাখেনি । তুমিও কবে তোমার ছেলেদের প্রসব করেছিলে তার হিসেব রাখোনি।”

    পনেরো

            ঠাকুমা জেনে যেতে পারেননি যে এখন একজন লোক যে আসলে সেই লোকটাই, তা প্রমাণ করার জন্য কতো কাগজপত্র সামলে রাখতে হয়, হাসপাতালের বার্থ সার্টিফিকেট, কর্পোরেশানের বার্থ সার্টিফিকেট, ভোটার কার্ড, র‌্যাশান কার্ড, আধার কার্ড, টেলিফোনের বিল, পাসপোর্ট, ইলেকট্রিক বিল । ভাগ্যিস বিম্বিসার আর অজাতশত্রুর সময়ে ওসব বালাই ছিল না ।

            বড়ো জ্যাঠা মারা যেতে জেঠিমার পেনশন তুলতে গিয়ে কি হ্যাঙ্গাম; হাতেখড়ির মতন কষ্ট করে শেখা কম বয়সের সইয়ের সঙ্গে বুড়ি বয়সের সই মেলে না, পঁয়তাল্লিশ টাকা পেনশন তোলার জন্য আদালতে গিয়ে এফিডেভিট করতে হয়েছিল যে উনিই নন্দরানি, বড়োজ্যাঠার বউ । আজকালকার মতন, কোনও কাগজে বড়োজ্যাঠাও জন্মাননি, বড়োজেঠিমাও জন্মাননি । বড়োজ্যাঠার চাকরি ছিল পাটনা মিউজিয়ামে মূর্তিদের আর পেইনটিঙগুলোর ঝাড়াই-পোঁছাই, যার জন্য কোনো কাগজের দরকার হয়নি, ধ্যুৎ ভাল্লাগে না বলে মাঝে চাকরি ছেড়ে দিলেও, কিউরেটার বাড়িতে লোক পাঠিয়ে বাবা-বাছা করে আবার চাকরিতে বহাল রেখেছিল, অথচ বড়োজ্যাঠা চাকরি পেয়েছিলেন ঠাকুমার জাঠতুতো দাদার সুপারিশে, তিনি কলকাতা মিউজিয়ামের অ্যাসিস্ট্যাণ্ট কিউরেটার ছিলেন, লেখক ছিলেন, ওনার নাম ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় । ইংরেজরা যাবার পরে বড়োজ্যাঠার চাকরির নাম হয়ে গেল কিপার অফ পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার, মাইনেও বেড়ে গেল, রিটায়ার করার সময়ে নব্বুই টাকা ।      মিউজিয়ামে বড়োজ্যাঠা একটা ঘর পেয়েছিলেন, গরমকালে ঘরের কল খুলে দিয়ে মেঝেয় জল ভরে দিতেন আর দুপুরে ইজি চেয়ারে শুয়ে নাক ডাকতেন । অফিস যেতেন পাঞ্জাবির ওপরে ধুতি, মাথায় হ্যাট, সাইকেলে তিন কিলোমিটার । আমার স্কুলের ছুটি পড়লে আমি ওনার সাইকেলের পেছনে ক্যারিয়ারে বসে চলে যেতুম ওনার অফিসে, দুপুরে খাবার জন্য টিফিনের কৌটো নিয়ে । টিকিট না কেটেই সারা মিউজিয়াম ঘুরে বেড়াতুম ।    বড়োজ্যাঠা অনেকসময়ে আমাকে সঙ্গে করে ঘরগুলোয় নিয়ে গিয়ে দেখাতেন কোনটা কার মূর্তি, কোন জিনিস কতো হাজার বছর আগেকার । একজন অপ্সরার মাই আর একজন গলাকাটা পুরুষের মূর্তির নুনু চকচকে ছিল, কেন তা জানতে দেরি হয়নি, দেখি মহিলা দর্শকরা গলাকাটা মূর্তির নুনুতে হাত দিয়ে টুক করে কেটে পড়ছে, আর একই কাজ করছে পুরুষ দর্শকরা অপ্সরার মাইতে হাত বুলিয়ে । আমি অপ্সরার মাইতে হাত দিতে পারতুম না, কেননা আমার হাত পৌঁছোত না । খেমির মাই অপ্সরাদের চেয়ে ছোটো ছিল; কুলসুম আপার মাই অপ্সরাদের চেয়ে কালো ।

             বড়োজ্যাঠার টয়লেটে গিয়ে প্যান্টুলের বোতাম খুলে দেখেছিলুম, শ্বেতপাথরের গলাকাটা মূর্তির চেয়ে আমার নুনু বড়ো । গলাকাটা মূর্তি, পরে বলেছিলেন বড়োজ্যাঠা, আলেকজাণ্ডারের । শুনে বেশ ভালো লেগেছিল ; তার মানে আমিও আমার নুনু নিয়ে পৃথিবী জয় করতে যেতে পারব । খেমি যদি বেঁচে থাকত তাহলে ওর মাইও হাতের পালিশ খেয়ে অপ্সরার মতন চকচকে আর বড়ো হতো, পীনোন্নত । কিন্তু ওর তো বিয়ে হয়ে যেত, ওর বরকে লুকিয়ে খেমির মাইয়ে হাত বোলাতুম, ওর ঠোঁট চেবাতুম, তালশাঁসের মতন খেতুম ।   বড়োজ্যাঠা মারা গেছেন, আমরা সেই দিনকার ঘটনা জানি । তবে তারিখটা কেউ মনে রাখেনি । বড়োজ্যাঠার জন্মদিন নেই, বড়োজ্যাঠার মৃত্যুদিন নেই । আলেকজাণ্ডারেরও নেই । বড়োজেঠা যেদিন মারা গেলেন, বাবা আমাকে অফিস থেকে ডেকে পাঠালেন জরুরি কাজ আছে, জানিয়ে । বাড়ি ফিরে দেখি কেবল নকাকিমা রয়েছেন, বললেন তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, তোকে এক্ষুনি দিদিদের বাড়ি যেতে হবে । খেয়ে নিয়ে দিদিদের বাড়ি ছোটালুম সাইকেল । গিয়ে দেখি বড়োজেঠাকে বাঁশের মাচানে বেঁধে ফেলা হয়েছে । আমাকে যেতে হবে মুখাগ্নি করতে । সেই প্রথম শবকে ঘি মাখানো, পুরুত সতীশকাকার হুকুম অনুযায়ী মন্ত্র বলা আর কুশকাঠি-শরকাঠিতে আগুন ধরিয়ে মুখাগ্নি করার অভিজ্ঞতা, চিতাকে ঘিরে কাঁধে হাঁড়ি নিয়ে ফেলে দেয়া। শ্মশানে দাঁড়িয়েই কান্না পেয়ে গেলো, কাঁদলুমও, সতীশকাকা বললেন, হ্যাঁ, একে বলে শ্মশানবৈরাগ্য । হিন্দু মারা গেলে তার জ্বলন্ত দেহ থেকেও শেষবারের মতন শব্দগুলো পোড়া কাঠের সঙ্গে আকাশে ওড়ে, যাদের শব গোর দেয়া হয় তারা এই শেষ শব্দের গুঞ্জনের আহ্লাদ থেকে বঞ্চিত ।

              আমার এখন তিনটে জন্মদিন ; এগারোই কার্তিক, মায়ের বক্তব্য অনুযায়ী । উনত্রিশে অক্টোবর, স্কুলের সার্টিফিকেট অনুযায়ী । দোসরা নভেম্বর, ফাদার হিলম্যানের নির্ণয় অনুযায়ী । তিনদিন শুভেচ্ছা পাবার জন্য জন্মদিনের আর কীই বা চাই ।

              আমাদের বাড়িতে জন্মদিনকে উৎসব করায় আমার স্ত্রী সলিলার ভূমিকা আছে ; আমার মেয়ে হলে তার জন্মদিন পালন করা আরম্ভ হয় । তার আগে জন্মদিন যে অনুষ্ঠান হিসেবে আমোদ-আহ্লাদ করার দিন তা জানতেন না কেউ । মেয়ের জন্মদিন পালন করা আরম্ভ হলে দোসরা নভেম্বরকে আমার জন্মদিনের স্বীকৃতি দিয়ে খানাপিনার ব্যবস্হা আরম্ভ হয় । রেস্তরাঁয় গিয়ে ককটেল পার্টি করার সেই সূত্রপাত। এমনকি জন্মদিনে যে কেক কাটতে হয়, মোমবাতি নিভিয়ে হ্যাপি বার্থডে টু ইউ গাইতে হয়, তারও ।

    ষোলো             

             বড়োজ্যাঠার দুই মেয়ে, সাবিত্রী আর ধরিত্রীর বিয়ে আমার শৈশবেই হয়ে গিয়েছিল, তার কোনো স্মৃতি ধরে রাখতে পারিনি । মেজজ্যাঠা আর কাকাদের মেয়ের বিয়ের ব্যবস্হা করেছিলেন বাবা, কেননা তাঁদের শৈল্পিক উদাসীনতায় ওদের বয়স বেড়ে যাচ্ছিল ; তাছাড়া বিয়ের খরচের ব্যাপারটাও ছিল । মেজজ্যাঠার ছোটো মেয়ে মনু বা মীনাক্ষী একজন বিহারি ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চাইলে, মেজজ্যাঠা অমত জানান । মেজজ্যাঠার অমত হওয়ায়, বাবা তাঁকে বোঝানো সত্ত্বেও তিনি রাজি হননি ; তাঁর বিরুদ্ধতা করে বাবা নিজে অংশ নিতে চাননি, আমাকে টাকাকড়ি দিয়ে বলেন, “ওরা কোথায় গিয়ে বিয়ে করতে চাইছে, সেখানে গিয়ে সম্প্রদান করে আয়।” সে এক মজার অভিজ্ঞতা, যেতে হয়েছিল খুসরুপুর নামে একটা ধাদ্ধাড়া গোবিন্দপুরের মন্দিরে, গিয়ে দেখি, সার বেঁধে বিয়ে হচ্ছে চত্ত্বরে । আমাকে একটা গোলাপি ধুতি দেয়া হয়েছিল, প্যাণ্ট খুলে পরে নিয়েছিলুম, তারপরে সম্প্রদান, বাঙালিদের বিয়ের মতন নয়, বা শহুরে বিহারিদের বিয়ের মতন নয় । ফেরার সময়ে পাটনা স্টেশানে নেমে রঙিন ধুতি খুলে প্যান্ট পরে নিয়েছিলুম ।

             মা মারা যান লখনউতে আমার কাছে থাকার সময়ে, ১৯৮২ সালের ১৮ই নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে । বাবা মারা যান পাটনায়, ১৯৯১ সালের ৮ই অক্টোবর, তখন তিনি কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন আর দোকান চালানো আরম্ভ করেছে দাদার বড়ো ছেলে টোটোন বা হৃদয়েশ । আমার এটাই প্রধান রিগরেট যে বাবাকে আমি মুম্বাইতে নিয়ে আসিনি, তখন তো আমি মুম্বাইতে চাকরি করছি, বেশ বড়ো ফ্ল্যাট পেয়েছি সান্টাক্রুজে, আশেপাশে নামকরা হাসপাতাল । মায়ের মৃত্যু সম্পর্কেও রিগরেট থেকে গেছে যে প্রতিবেশী হায়দার আলিকে না জানিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করেছিলুম । নবাব পরিবারের হায়দার আলির প্রভাব ছিল সরকারি হাসপাতালে, আর লখনউতে সেসময়ে প্রাইভেট হাসপাতালের তুলনায় সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি আধুনিক ছিল, ডাক্তাররা ছিল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ।

              আমার চরিত্রগঠনে বা বিগঠনে খাঁটি অবদান মহাদলিতদের পাড়া ইমলিতলা ; সেখানকার অভিজ্ঞতা আমাকে শিক্ষিত করে তুলেছে, শিখিয়েছে মানসিক-ঔদার্য, সারগ্রাহীতা, তার প্রতিটি বাসিন্দা ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী, বেপরোয়া, গোলমালকারী, স্হিতাবস্হাবিরোধী, যারা নিজেদের বলতো “দুনিয়াকা নাসুর”, মানে পৃথিবীর এমন নালি-ঘা যা সারে না, প্রথমে বিদেশি ও পরে স্বদেশি সরকার তাদের জীবনযাত্রার লড়াইকে মনে করেছে প্রতিরোধ-প্রতিবাদ, মনে করেছে মৌরসি-পাট্টার শত্রু, তাদের মনে করেছে বিপজ্জনক, অথচ তা ছিল ওদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা । জীবনকেচ্ছা প্রায় প্রতিদিনই ঘটতো ইমলিতলা পাড়ায় কিন্তু সেসব নিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের মতন কেউই খিক-খিকে হাসি হাসতো না ।

             আর অবশ্যই বাড়ির-দোকানের দুই কাজের লোক, শিউনন্নি আর ডাবর । ১৯৫৫ সালে  বি এন কলেজের ছাত্র ইউনিয়ানের জুলুসে আমি সামনের দিকে হাঁটছিলুম, আমার আর তরুণ শুরের হাতে ব্যানার, কোথা থেকে ডাবর ছুটে এসে আমার হাত ধরে বলল, “ই সব মত কিজিয়ে, মারে যাইয়েগা।” কয়েকদিন আগেই পুলিশের গুলিতে দীনানাথ পাণ্ডে নামে এক ছাত্র মারা গিয়েছিল, অকারণেই পুলিশ গুলি চালিয়েছিল, কেননা ছাত্রদের দাবি ছিল বাসের সংখ্যা আর সময় বাড়ানোর ।  প্রতিবাদ করতে বেরিয়েছিলুম আমরা, দাবি ছিল জুডিশিয়াল এনকোয়ারির । শেষে নেহেরুকে এসে বক্তৃতা দিয়ে ছাত্রদের শান্ত করতে হয়েছিল ; মুখ্যমন্ত্রী এস কে সিং অবস্হা সামলাতে হেগে ফেলার পর । তখনই নেহেরুকে একেবারে সামনে থেকে দেখেছিলুম । হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল বেশ উন্নাসিক মানুষ ।

             আমি আমার সহ্যশক্তি আর যুঝে যাবার ক্ষমতা ইমলিতলা পাড়া থেকেই পেয়েছি : হাতকড়া, কোমরে দড়ি, জেলহাজত, শত্রুদল, কুখ্যাতি, অপমান, অপপ্রচার, বিরোধিতা, কটূ মন্তব্য, বিশ্বাসঘাতকতা ।          ইমলিতলাতেই জেনেছি, প্রতিটি নারীর দেহে নিজস্ব সুগন্ধ থাকে যা শহুরে মহিলারা পারফিউম মেখে নষ্ট করে ফ্যালে , পারফিউম জিনিসটা তাই আমার পছন্দও নয় , পাড়ার সকলের বাসার মতনই আমাদের বাড়িতেও কলিং বেল ছিল না, বাড়ির কারোর সঙ্গে দেখা করতে হলে তার নাম ধরে ডাকতে হতো , নাম ধরে ডাকার এই বাচনিক সম্পর্ক হারিয়ে গেল ইমলিতলা ছাড়ার পর , ইমলিতলার দিনগুলো নিজস্ব রঙে আর গন্ধে দেখা দিতো, রাতগুলো দেখা দিতো কেরোসিন লন্ঠন আর রেড়ির তেলের লম্ফর শিখায় । কাউকে কখনও সোনার গয়না পরতে দেখিনি ইমলিতলায়, রুপোর গয়না কেবল বিয়েতে । আমি সোনার আঙটি পেয়েছিলুম আমার উপনয়নে, যা আমি খুলে পরিয়ে দিয়েছিলুম আমার প্রথম আর শেষ রোমান্টিক প্রেমিকাকে, সে পরে ওই আঙটি পরিয়ে দিয়েছিল তার নতুন প্রেমিককে, যাকে সে বিয়ে করেছিল আর পরে ডিভোর্স দ্যায় ; জানিনা সেই আঙটির কী হল শেষ পর্যন্ত, কেননা ওর বর ছিল স্মাগলার । স্মাগলারকে বিয়ে করে ওর বিখ্যাত বক্তব্য মনে রেখেছি, “টাকা হল ডলারের বেজন্মা বাচ্চা”।          ইমলিতলার মসজিদে লাউডস্পিকার ছিল না ; রমজানের সময়ে একজন ফকির ভোর রাতে গান গাইতে-গাইতে যেতো যাতে পাড়ার মুসলমান পরিবারের সদস্যদের ঘুম ভেঙে যায় । সেই ফকিরের এক হাতে সাপের মতন ব্যাঁকা ছড়ি আর অন্য হাতে লাউয়ের মোটা খোসা শুকিয়ে তাতে লোবানের ধোঁয়া।

             মা, বাবা আর শিক্ষক, যে তিনজন মানুষ ব্যক্তিজীবনের অভিমুখ গড়ে দ্যান, আমার জীবনে মা আর বাবার ভূমিকাই প্রধান । প্রকৃত অর্থে প্রাইমারি স্তরে কনভেন্ট ছাড়া, রামমোহন রায় সেমিনারি স্কুলে এবং পরে কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমি কোনো শিক্ষকের নৈকট্য এবং পথনির্দেশ ও বন্ধুত্ব পাইনি, সমাজে শিক্ষকের অবদানের অবনমন তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়ে থাকবে । এখন তো শিক্ষকতা ব্যবসায়ের পর্যায়ে চলে গেছে । স্কুল শিক্ষকরা স্কুল ছেড়ে কোচিং আর প্রাইভেটে পড়ানোয় বেশি রোজগার করছেন । রামমোহন রায় সেমিনারিতে আমি ক্রমশ মূর্খ হয়ে যাচ্ছিলুম ; বেঁচে গিয়েছিলুম উঁচু ক্লাসের ছাত্রী আর স্কুলের লাঞ্চ পিরিয়ডের সময়ের গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তীর কারণে ; সিসটার আইরিনের পর উনিই আমার প্রকৃত শিক্ষক । সিসটার আইরিন আর নমিতা চক্রবর্তীকে মনে করলেই আঁচ করতে পারি যে ওনাদের অস্তিত্বে কোথাও অবিনশ্বরতা ছিল, যার কিছুটা ধুলো আমায় মাখিয়ে দিয়ে গেছেন ওনারা  ।

             কনভেন্ট বা ক্যাথলিক ইশকুলে  ভর্তি হবার ঘটনাটাও ঐন্দ্রজালিক কেননা স্হানীয় ক্যাথেড্রালের যাযক ফাদার হিলম্যান, যিনি প্রচুর ফোটো তুলতেন, প্রায়ই আসতেন বাবার ফোটোর দোকানে, ওনার তোলা ফোটো ডেভেলাপ ও প্রিন্ট করাবার জন্য আর উনি বলতেন ভারত হল রামধনুর সাতটি রঙের বিস্ফোরণ । বাবার সঙ্গে ওনার প্রায় বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল । একদিন বাবা আমাকে দোকানে নিয়ে গিয়েছিলেন, খেলছিলুম, অসিযুদ্ধ করছিলুম অদৃশ্য দৈত্য-দানবদের সঙ্গে, সেসময়ের বক্স ক্যামেরায় ব্যবহৃত ফোটোর নেগেটিভের আস্তরণ, লম্বা লাল রঙের কাগজ দিয়ে পাকানো লাঠি নিয়ে, যা বাবার দোকানের কাজের লোক রামখেলাওন সিং ডাবর তৈরি করে দিয়েছিল। সেসময়ে ডিজিটাল ফোটোগ্রাফি আবিষ্কার হয়নি, শৌখিন ফোটো-তুলিয়েরা ক্যামেরাগুলো দিয়ে সাধারণত বারোটা বা ষোলোটা সাদা-কালো ফোটো তুলতো । ফিল্মের রিলগুলো হতো কাচকড়ার আর তার ওপরে লাল কাগজের আস্তরন । ফাদার হিলম্যানের মতন ধবধবে ফর্সা মানুষ আমি তার আগে দেখিনি ; মানুষের গায়ের রঙ এরকমও হয়, জেনে অবাক লেগেছিল ; ওনার পোশাকও এমন যে পুরো শরীর শাদা কাপড়ে ঢাকা, শুধু হাত দুটো বেরিয়ে, চুল সোনালী, চোখ কটা, এরকম চুলও দেখিনি আগে ।

             ফাদার হিলম্যান বাবাকে বলেন, “একে স্কুলে ভর্তি করেননি কেন এখনও ? এই বয়সে যা পড়বে স্মৃতিতে আজীবন থেকে যাবে ।” বাবা জানান, “কোনো স্কুলে তো এতো ছোটো বাচ্চাকে ভর্তি করা হয় না, আর কনভেন্টে পড়াবার সামর্থ আমার নেই, কেননা আমার আর আমার ভাইদের খরচের পর কিছুই বাঁচে না । আমার বড়ো ছেলে যে সরকারি স্কুলে পড়ে সেখানেই একে ভর্তি করব দুই বছর পরে।” ফাদার হিলম্যান বাবাকে বলেছিলেন. কনভেন্টে এতো ছোটো বাচ্চাদের একটা ক্লাস আছে, তার নাম ট্র্যানজিশান ক্লাস, আপনি কালকে একে নিয়ে আসুন আমি ভর্তি করে নেবো, নেভি ব্লু হাফপ্যান্ট, শাদা হাফ শার্ট আর নটিবয় শুজ কিনে নিন আজকে, টাই স্কুল থেকেই দেয়া হয়, ফিসের কথা ভাববেন না, মুকুব করার ক্ষমতা আমারই । সেদিনই বিকেলে স্কুলের ড্রেস কিনে দিলেন বাবা, এতো বাবুলাট পোশাক আগে পরিনি কখনও, জুতো পরে বাড়িতে গটগটিয়ে হেঁটে দেখালুম সবাইকে । রান্নাঘরের সারাদিনের কাজ সত্ত্বেও মা ঘটিতে গরম জল ভরে শার্ট-প্যান্ট ইস্তিরি করে দিতেন ।

             পরের দিন সকাল নটায় গিয়ে ভর্তি হয়ে গেলুম কনভেন্ট স্কুলে । জন্মদিন নির্ধারণ করলেন ফাদার হিলম্যান, দোসরা নভেম্বর । ভর্তি হয়ে টের পেলুম যে ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বললে শাস্তি পেতে হয় । ইংরেজি কেন, আমি তখন বাংলা আর হিন্দিও ভালো করে বলতে পারতুম না । চুপ থেকে, মাথা নেড়ে, কাজ চালাতে চালাতে রপ্ত হল ভাঙা-ভাঙা ভাষা । ফাদার হিলম্যান ছিলেন জার্মান, কিন্তু ইংরেজি আর হিন্দিতে কথা বলতে পারতেন ।          ভর্তি করিয়ে বাবা বলেছিলেন, “দুপুরে রাম খেলাওন সিং ডাবর টিফিন নিয়ে আসবে, আর ছুটির সময়ে ওর সাইকেলে করে বাড়ি ফিরবি । রোজই রামখেলাওন নিয়ে আসবে আর নিয়ে যাবে, কাল থেকে টিফিন নিজের সঙ্গে আনবি ।” এই স্কুলটা দাদার পাটনা কলেজিয়েট স্কুল থেকে আলাদা ; দাদার স্কুলে ঢুকেই দুধারে দুতলা ক্লাসবাড়ি, মাঝখানে সোজা পিচরাস্তা, বাড়ির পেছন দিকে দুটো বিশাল খেলার মাঠ, যেখানে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা হয়, আমি ওই মাঠে স্কুটার চালাতে শিখেছিলুম । ক্যাথলিক স্কুলে ঢুকেই একজন বউয়ের পাথরের মূর্তি, তার কোলে বাচ্চা, পেছনদিকে একজন লম্বা-দাড়ি মানুষ দাঁড়িয়ে, তার পায়ের কাছে দুটো ভেড়ার বাচ্চা । পরে ফাদর হিলম্যান হিন্দিতে জানিয়েছিলেন যে মাদার মেরির কোলে যিশু আর পেছনে সেইন্ট জোসেফ । মাদার মেরি ভার্জিন আর যিশুর বাবা হলেন ঈশ্বর স্বয়ং, মাদার মেরির বিয়ে হয়নি কেননা ঈশ্বরের সঙ্গে তো বিয়ে হতে পারেনা । ভার্জিন বলতে যে কী বোঝায় তার জ্ঞান হয়েছিল পরের স্কুল রামমোহন রায় সেমিনারিতে গিয়ে ।

             কনভেন্টের গেটের ভেতর ঢুকলে বাঁদিকে একটা সবুজ ঘাসের মাঠ, ছাত্র-ছাত্রীরা খেলছে, ডানদিকে ফুলের বাগান। যে ছাত্র-ছাত্রীরা খেলছে, কয়েকজনের গায়ের রঙ ফাদার হিলম্যানের মতন ফর্সা, চুলও সোনালী, কালো তো নয়ই । কেউই ওই বাগানে যাচ্ছে না, ফুল তুলছে না দেখে অবাক লাগল । ইমলিতলার ছেলেরা দেখতে পেলে সব ফুল উজাড় করে তুলে নিয়ে গিয়ে দুর্গামাতার মন্দিরের সামনে  বিক্রি করতে বসে যেতো, বিক্রি না করলেও চিবিয়ে মুচড়ে নষ্ট করে হাহা হিহি হাসতো সবাই মিলে । দাদার স্কুলে মাঠগুলো কনভেন্টের মাঠের চারগুণ বড়ো, তাতে বিশেষ ঘাস নেই । কনভেন্টের মাঠের মাঝখানে একটা গাছ, তার তলায় অজস্র ছোটো-ছোটো সাদা ফুল পড়ে রয়েছে, সেগুলোও কেউ তুলছে না । বাবা বলেছিলেন, ওটা বকুল ফুলের গাছ । তার আগে আমি বকুল ফুল দেখিনি ; ডানদিকের বাগানে যে ফুলগুলো হয়ে আছে সেগুলোও দেখিনি আগে । বাড়িতে দেখেছি শুধু গ্যাঁদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা, বেলি, জবা আর জুঁইফুল, যখন বড়োজেঠিমা সত্যনারায়ণ পুজোর ব্যবস্হা করেন সংক্রান্তির দিন তখন; রামখেলাওন সেসব ফুল গিয়ে গঙ্গায় ফেলে আসে । কনভেন্টের ফুল গাছেই শুকিয়ে ঝরে যায় ।

              ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতেই, ছাত্র-ছাত্রীরা, কোথায় সবাই এতক্ষণ ছিল জানি না, ছুটে এসে ডানদিকের বকুলগাছের মাঠে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ; ছোটোরা সামনে আর বড়োরা পেছনে, পাঁচটা সারি। একজন সিসটার, তিনিও ধবধবে সাদা, আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে একটা সারির সামনের দিকে ছোটোদের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দিলেন আর আমার হাত দুটো নিয়ে হাতজোড় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন । সিসটাররা আর ফাদার হিলম্যান আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে মুখ করে ইংরেজিতে গানের মতন করে কথা বলা আরম্ভ করলেন আর ছাত্র-ছাত্রীরা সকলে তাঁদের সঙ্গে সেগুলো বলতে লাগল । প্রতিদিন শুনে-শুনে একসময়ে মুখস্হ হয়ে গেলে আমিও বলতুম, কিন্তু তখন মানে জানতুম না, জানতুম না যে একে বলে প্রেয়ার বা প্রার্থনা। না জেনে যে ঈশ্বরের বন্দনা গান গেয়েছি, জানার পর যাঁর সম্পর্কে আমি আজও কিছুই জানি না, তার প্রার্থনাটা এরকম :-

                     আওয়ার ফাদার ইন হেভেন

                     হোলি বাই ইয়োর নেম

                     ইয়োর কিংডাম কাম

                     ইয়োর উইল বি ডান অন আর্থ অ্যাজ ইন হেভেন

                     গিভ আস টুডে

                     আওয়ার ডেইলি ব্রেড

                     অ্যাণ্ড ফরগিভ আস আওয়ার সিনস

                     অ্যাজ উই ফরগিভ দোজ

                     হু সিন এগেইনস্ট আস

                     ডু নট ব্রিং আস টু দি টেস্ট

                     বাট ডেলিভার আস ফ্রম ইভিল

                     আমেন ।

             প্রার্থনা শেষ হতেই সবাই নিজের ক্লাসের দিকে দৌড়োলো । আমাকে একজন সিসটার হাত ধরে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে সেই ঘরে যে সিসটার তখনই এসেছিলেন, তাঁকে কিছু বললেন ।

             ‘সিন’ ব্যাপারটা যে কি তা তখন জানতে পারিনি, এখনও জানি না । এখন যা জানি তার নাম গিল্ট।

             স্কুলে আমার ট্র্যানজিশান ক্লাসের শিক্ষিকা ছিলেন সিস্টার আইরিন, আমার প্রথম ক্রাশ, যাঁকে পরে সেকেন্ড স্ট্যাণ্ডার্ডেও পেয়েছিলুম । উনি এসেছিলেন আয়ারল্যাণ্ড থেকে । ফাদার হিলম্যানের মতন উনিও ধবধবে ফর্সা, কিন্তু ওনার মাথা পুরোপুরি ঢাকা, শরীরও শাদা কাপড়ে ঢাকা । ওনার চোখের তারা কালো আর গভীর ছিল, দাঁত ঝকঝকে সাদা, ঠোঁট গোলাপি । প্রথমদিন উনি নিচু হয়ে আমার মুখের কাছে মুখ এনে যা বলেছিলেন তা আমি বুঝতে পারিনি ; মনে আছে সিসটার আইরিনের চোখের তারায় আমার প্রতিচ্ছবি । উনি কয়েকটা পুস্তিকা আর একটি বই দিলেন, সবই ব্রিটেনে ছাপা, কার্ডও দিলেন একগোছা। মনে আছে, সেগুলো ছিল যিশুখ্রিস্টের, মাদার মেরির আর সান্টাক্লজের । বইটিতে প্রায় প্রতিটি পাতায় ছবি আঁকা ছিল । অন্য একটা পুস্তিকায় প্রতিটি পাতায় একটা করে ইংরেজি অক্ষর ছিল, সেগুলোর দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে সবাই সময় কাটাচ্ছিল, সিস্টার আইরিন আমার হাত থেকে পুস্তিকাটা নিয়ে খুলে ইশারায় দেখালেন যে সবাই যা করছে আমিও যেন তাই করি । পাতা উল্টে অক্ষর আর সঙ্গের ছবিগুলো দেখলুম ।

           পরে আরেকটা রঙিন পুস্তিকা খুলে সিসটার আইরিন নিজেই শোনাতে লাগলেন, পরের ক্লাসে যাকে নার্সারি রাইম বলে জেনেছি, “হে ডিডল ডিডল, দি ক্যাট অ্যন্ড দি ফিডল, দি কাউ জাম্পড ওভার দি মুন, দি লিটল ডগ লাফড টু সি সাচ স্পোর্ট, অ্যান্ড দি ডিশ র‌্যান অ্যাওয়ে উইথ দি স্পুন।” আরেকটা, “পিটার পিটার পাপ্মকিন ইটার, হ্যাড এ ওয়াইফ অ্যাণ্ড কুড নট কিপ হার, হি পুট হার ইন এ পাম্পকিন শেল, অ্যাণ্ড দেয়ার হি কেপ্ট হার ভেরি ওয়েল।” এই দুটো আমার মনে থাকার কারণ পরের ক্লাসেও এগুলো সবাই মিলে আবৃত্তি করতে হয়েছে, অভিনয় করে, আর তিন দশক পরে আমার মেয়েকে যখন এই স্কুলে ভর্তি করি, তখন তাকেও একই নার্সারি রাইম মুখস্হ করতে হয়েছে, অথচ ততদিনে পুরো স্কুলে কেরালিয় সিসটারদের নিয়ন্ত্রণ, বিদেশিনী কেউ নেই । পরের ক্লাসে এবিসিডি শিখতে হয়েছিল গেয়ে গেয়ে । ওয়ান টু থ্রি ফোরও গেয়ে । একটা নার্সারি রাইম মনে আছে, যেটা পরেও কাজে লাগত, “থার্টি ডেজ হ্যাথ সেপ্টেম্বর, এপ্রিল জুন অ্যাণ্ড নভেম্বর, থার্টি ওয়ান দি আদার্স ডেট, এক্সেপ্ট ইন ফেব্রুয়ারি টোয়েন্টি এইট, বাট ইন লিপ ইয়ার উই অ্যাসাইন, ফেব্রুয়ারি টোয়েন্টি নাইন।” তখন এগুলোর মানেই বুঝতে পারতুম না । নার্সারি রাইমের ছন্দ মনের ভেতরে বিরক্তির বীজ হয়ে থেকে গিয়েছিল, যে কারণে কবিতা লিখতে আরম্ভ করে ছন্দ ব্যাপারটাকে পছন্দ হতো না । দাদা শিখিয়েছিল গুণে-গুণে পয়ার ছন্দে লেখার কায়দা, কিন্তু তাতে আমি স্পিড বা গতি খুঁজে পাইনি ।

             বাংলা “আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি, যদুমাস্টার শশুর বাড়ি, রেলকম ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম”, আমার জাঠতুতো-খুড়তুতো বোনেরা মাটিতে হাঁটুমুড়ে বসে খেলতো, হাঁটুতে চাপড় মেরেমেরে, এক একটা হাঁটু আউট হয়ে গেলে যার হাঁটু বাঁচতো সে জিতে যেতো । সেরকমই, “ঝাঁকড়া চুলে তালগাছ তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই, আমার মতো পড়া কি তোর মুখস্হ হয় নাই, দাঁড়িয়ে আছিস কান ধরে ঠায়, একটুখানি ঘুমায় না তোর পণ্ডিত মশাই”, এটাও ছিল ওদের খেলা, কে এক পায়ে কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, যে সবচেয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতো সে জিতে যেতো । এগুলো তাই আমার কখনও নার্সারি রাইম মনে হয়নি।

           কনভেন্ট স্কুলে, টিফিনের সময় গেটের কাছে  ছোট্ট দরোজা দিয়ে রামখেলাওন আমাকে টিফিনকৌটো এগিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করল, “ইংরেজিতে কথা বলতে শিখে গেছেন তো, এবার থেকে আমার বাড়িতে টাকা পাঠাবার মানি অর্ডার আপনি ভরে দেবেন ।” আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়েছিলুম । স্কুলে  টিফিন খাবার হলঘরে ঢুকে খালি জায়গা দেখে খেতে আরম্ভ করেছিলুম ; অন্য ছাত্ররা প্রায় সবাই ইংরেজিতে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। একটা মেয়ে আমার পাশে এসে বসে ফিসফিসিয়ে বলল, হিন্দিতে, ও ইংরেজি বলতে পারে না, এমন করে হিন্দিতে কথাগুলো বলল, যে মনে হল বাঙালি, আমি বাঙলাতেই জিগ্যেস করলুম, “তোর নাম কী” । হাসি ফুটল ওর মুখে, ওর নাম নন্দিতা, ন্যানডি । আমিও আমার নাম বললুম । ন্যানডি বলেছিল, “ওঃ, তোর নাম ময়লা !”  ফিসফিসিয়ে কথা বলার সম্পর্ক তৈরি হল আমাদের । এই সম্পর্ক বহুদিন বজায় ছিল, তার কারণ নন্দিতাও কনভেন্ট ছেড়ে আমার সঙ্গেই রামমোহন রায় সেমিনারিতে গিয়ে ভর্তি হয়েছিল । সেখানে গিয়ে আমাকে ময়লা নামে ডাকার ফলে বেশ কয়েকজন সহপাঠী ময়লা বলে ডাকতো । ধনী পরিবারের ছিল নন্দিতা, হাইকোর্টের জজ ছিলেন ওর ঠাকুর্দা, টিফিনে আনতো অমলেট-টোস্ট আর স্যালাড, প্রতিদিন, তাই আমার আলুছেঁচকি বা আলুপটল বা টমেটো-কুমড়োর সঙ্গে রুটি ওর খেতে ভালো লাগত, যেমন আমার লাগত ওর অমলেট-টোস্ট-স্যালাড । আমরা দুজনে কনভেন্ট ছেড়েছিলুম আর রামমোহন রায় সেমিনারিতে গিয়ে বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি হয়েছিলুম একই কারণে, ভারত স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল আর আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, ইংরেজির দাপটে আমাদের জিভ থেকে খসে-খসে ভুল পথে চলে যাচ্ছিল।

            টিফিনের পরের ক্লাসে ফাদার হিলম্যান এসে আমাদের নিয়ে চললেন স্কুল সংলগ্ন গীর্জায়, বাইবেল ক্লাস করার জন্য । গীর্জার ছাদ অনেক উঁচু, বিরাট হলঘর, দুপাশে বসার বেঞ্চ আর সামনে টেবিল, চারিদিকের দেয়ালে সন্তদের ছবি, তাদের সকলের মাথার পেছনে গোল জ্যোতি, আরও ওপরে, রঙিন কাঁচ দিয়ে তৈরি ভেড়া, দাড়িওলা মানুষ, ঘোমটা-দেয়া বউ, আরও নানা রঙের নকশা । একেবারে সামনে একজন মানুষের মূর্তি, তার হাতে পেরেক মেরে আর দুই পা জোড়া করে পেরেক মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে । দেখে, সবচেয়ে প্রথমে আমার মনে হয়েছিল, এই ভাবে হাতে-পায়ে পেরেক ঠুকে কি একজন মানুষকে ঝুলিয়ে রাখা যায়, লোকটা কি খসে পড়বে না, লোকটা তো কাঠের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা নেই !

            ফাদার হিলম্যান একবার ইংরেজিতে, আরেকবার হিন্দিতে বুঝিয়ে বললেন যে যাঁকে অমনভাবে দেখা যাচ্ছে তাঁর নাম জিজাস খ্রাইস্ট, আর তার গল্প, তার বলা কথাগুলো, তিনি প্রতিদিন আমাদের শোনাবেন । যে কাঠে ওনাকে বিঁধে রাখা হয়েছে তার নাম ক্রস । আমাদের বললেন, হাতজোড় করে এক বুড়ো আঙুলের ওপর আরেক বুড়ো আঙুল রেখে ক্রস তৈরি করে টেবিলের ওপরে রেখে ওনার গল্প শুনতে । উনি একথাও বললেন যে টিফিনের পর সকলেরই একটু ঘুম পায়, তাই এই বাইবেলের গল্পের ক্লাস, ঘুম পেলেও ক্ষতি নেই । তারপর ওপরে রঙিন কাচে গড়া সন্তদের নাম বললেন ; প্রতিদিন বলতেন বলে মনে রয়ে গেছে, আরও মনে থেকে গেছে এইজন্য যে পাড়ার শিয়া মুসলমান পরিবারের মেয়ে কুলসুম আপাকে যখন কনভেন্ট স্কুলের আর সন্তদের বিষয়ে গল্প করেছিলুম, তখন উনি বলেছিলেন যে ওই সন্তরা ইসলাম ধর্মেও আছে, কিন্তু নামগুলো উচ্চারণ করা হয় আরবিতে, যেমন এনোখ হল ইদ্রিস, নোয়া হল নুহ, অ্যাব্রাহাম হল ইব্রাহিম, জেকব হল ইয়াকুব, অ্যারন হল হারুন, মোজেস হল মুসা, ডেভিড হল দাউদ, জোনা হল ইউনুস, জন হল ইয়াহায়া, জিজাস খ্রাইস্ট হল ইসা মসিহ । বেশ ভালো লেগেছিল শুনে, কনভেন্ট আমার আর কুলসুম আপাদের বাড়ির মাঝে সেতুবন্ধনের কাজ করেছে যেন ।

             পরে আজব লাগত যে জেকব লোকটার নামেই পাকিস্তানের ইয়াকুব খান, জন লোকটার নামে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান । ডেভিড লোকটার নামে মাফিয়া-নেতা দাউদ ইব্রাহিম । ফাদার হিলম্যান এসব গল্প জেনে যেতে পারলেন না । দাউদ ইব্রাহিম দাঙ্গা, ডাকাতি, র‌্যানসাম, হুমকি, চোরাচালান করেও হিরো, ফিলমের পর ফিলম হয়ে চলেছে, খবরের কাগজের পাতা জুড়ে, টিভির পর্দাজুড়ে তাকে নিয়ে হইহই রইরই, আর গরিবগুলো দুটো রুটি চুরি করলেই প্যাদানির নাম গঙ্গারাম, লকআপে মৃত্যু । আসলে নিজের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা খিদে প্রকাশ করার জন্যে শিক্ষা দরকার, চাকরি না পেলেও ক্ষতি নেই, যেমন দাউদ ইব্রাহিম, যৎসামান্য শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে পোঁদে বাঁশ করে দিতে পেরেছে । মানুষ “শব্দ” আবিষ্কার করেছে মৃত্যুদণ্ড লেখার জন্য ; তারপর মৃত্যুদণ্ড লিখে কলমের নিব ভেঙে ফেলার খেলা, এদিকে কলম কবেই তামাদি হয়ে গেছে, টিকে আছে কেবল মৃত্যুদণ্ড লেখার জন্য ।

    সতেরো

             কুলসুম আপার গভীর প্রভাব থেকে গেছে আমার জীবনে ; কবিতার জগতে প্রবেশ ওনার মাধ্যমেই। কনভেন্টের গির্জায় গাওয়া গান যেমন শৈশবে বুঝতে পারতুম না, অথচ শুনতে ভালো লাগতো, তেমনি কুলসুম আপার বলা কবিতা বুঝতে পারতুম না, অথচ ওনার গলায় শুনতে ভালো লাগত । রামখেলাওন সিং ডাবর রহিম, দাদু, কবীরের কিছু-কিছু দোহা জানত আর আমাদের শাসন করার জন্য সেগুলো সময়মতন বলত ; শিউনন্দন কাহার বা শিউনন্নি নামে বাড়ির কাজের লোক তুলসীদাসের রামচরিতমানস মুখস্হ বলতে পারত, শিউনন্দনও রামচরিতমানস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে শাসন করত আমাদের । শিউনন্নি বজরংবলীর ভক্ত ছিল, বিয়ে করেনি, পাড়ার আখাড়ায় গিয়ে কুস্তি লড়ত, মুগুর ভাঁজত, চেহারা ছিল কুস্তিগীরের, অনেক বয়সে বিয়ে করেছিল, যাকে বিয়ে করেছিল তার দুটো বাচ্চা ছিল আগের পক্ষের । শিউনন্নি আমাকে ওর কুস্তি লড়ার আখাড়ায় নিয়ে গিয়েছিল আমার বয়সীদের সঙ্গে কুস্তি লড়ে স্বাস্হ ফেরাবার জন্য, কেননা আমি রোগাটে ছিলুম । কুস্তি শেখার ড্রেস, মানে ল্যাঙোট, মায়ের কাছ থেকে দাম চেয়ে নিয়ে কিনে এনেছিল শিউনন্নি । ল্যাঙোট পরা বেশ কঠিন ছিল ওই বয়সে, কয়েকবার পেছনে নিয়ে গিয়ে সামনে এনে বাঁধতে হয় । কুস্তি শিখতে অসুবিধা ছিল না, অসুবিধা হতো কুস্তির আখাড়ার গেরুমাটি গা থেকে ধুয়ে তোলবার জন্য রাস্তার কলে গিয়ে স্নান করার, পাড়ার বউদের জল ভরা হয়ে গেলে তারপর আমার পালা, যদিও শিউনন্নি আমাকে কলের তলায় ঠেলে দিত যাতে স্নানটা সেরে ফেলতে পারি । কয়েকটা রবিবারের পরই পালোয়ান হবার উচ্চাকাঙ্খা ছেড়ে দিতে হলো । কুস্তির প্যাঁচ কাজে দিত যখন পাড়ার কারোর সঙ্গে লাট্টু বা গুলি খেলা নিয়ে বচসা আরম্ভ হতো ।

             সাঁতারও পুরো শেখা হয়ে ওঠেনি আমার । মামার বাড়িতে দাদা যখন ছিল, ১৯৫১ সালে,একবার পুকুরে শেখানোর চেষ্টা করেছিল, পুরো শেখার আগেই পাটনা ফিরতে হয়েছিল । দাদা মামার বাড়ি ছেড়ে উত্তরপাড়ায় থাকতে চলে গেলে, ১৯৫৩ সালে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে গিয়ে শেখানোর চেষ্টা করেছিল, তা সত্ত্বেও শেখা হয়ে ওঠেনি । আরেকটু হলে তলিয়ে যাচ্ছিলুম, তাই ।

             ডাবর আর শিউনন্নির উদ্ধৃতি শুনতুম, কিন্তু পরোয়া করতুম না, কিন্তু গালে টোল ফেলে কুলসুম আপার কবিতা বলায় এমন আবহ গড়ে উঠত যেন উনি কবিতার মধ্যে দিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে চলেছেন । ফয়েজ আহমদ ফয়েজ আর গালিব ছিল ওনার প্রিয় কবি। কুলসুম আপা ইশতিমালিয়তের কথা বলতেন, যা পরে জেনেছিলুম, সাম্যবাদ ; ইশতিরাকিয়াতের কথা বলতেন, যা পরে জেনেছিলুম, সমাজবাদ ; মাসাওয়াতের কথা বলতেন যা পরে জেনেছিলুম সকল মানুষকে সমান মনে করা । ওনাদের পরিবারের কারণেই ইমলিতলা পাড়ায় দেশভাগের দাঙ্গার কোনো প্রভাব পড়েনি। স্কুল থেকে পাওয়া দুটো কার্ড উনি চেয়ে নিয়েছিলেন, একটা মুসার অন্যটা ইসা মসির ।

           কুলসুম আপার স্মৃতি জেগে উঠলেই ফয়েজের এই বিখ্যাত কবিতাটা মনে পড়ে যায়, যদিও কুলসুম আপা বেশির ভাগ প্রেমের কবিতা শোনাতেন :

           “মাতা-এ-লৌহ-ও-কলম ছিন গয়ি তো ক্যা গম হ্যায়

            কি খুন-এ-দিল মেঁ ডুবো লি হ্যায় উংগলিয়া ম্যায়নে

            জুবাঁ পে মোহর লগি হ্যায় তো ক্যা, কি রখ দি হ্যায়

            হর ইক হলকা-এ-জঞ্জির মেঁ জুবাঁ ম্যায়নে”

            যৌনতা ও স্পন্দিত ছোঁয়ার মাধ্যমে একজন কৌতূহলী বালকের মর্মে কবিতার গভীর ছাপ রেখে দেবার প্রথম শিক্ষাও কুলসুম আপার কাছে পেয়েছিলুম, আর বহুকাল পরে, তাঁর স্মৃতিতে, তাঁর খোঁজে ইমলিতলা পাড়ায় গিয়ে তাঁকে না পেয়ে, লিখেছিলুম এই কবিতাটা, “প্রথম প্রেম : ফয়েজ আহমদ ফয়েজ” শিরোনামে । কবিতাটার প্রথম লাইনটা মনে ছিল, এতোবার উনি শুনিয়েছিলেন, লেখার সময়ে ফয়েজের সংকলন থেকে বাকি অংশটা সংগ্রহ করেছিলুম :-

                    গরমের ছুটিতে খালি-গায়ে  যখন নাজিমদের বাড়িতে

             লুডো খেলতে যাই, কুলসুম আপা রাস্তা পেরোবার ঢঙে

             বাঁদিক-ডানদিক তাকিয়ে দুহাতে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দ্যান

             আমার অন্ধকার স্যাঁতসেতে ঘরে এক হ্যাঁচকায় টেনে নিয়ে ।

                     আমি বলি, ‘ভোজপুরি বলবেন, আমি উর্দু বুঝতে পারি না ।’

                     উনি বলেন, ‘তুই চোখ বোজ, তাহলেই বুঝতে পারবি,

             এ তো খুব সহজ রে ।’ আমি চোখ বুজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি

             একগাদা হাঁসমুর্গির মাঝে ।

                     কুলসুম আপা বলেন, ‘মুঝে দে দে রসিলে হোঁঠ, মাসুমানা

             পেশানি, হসিঁ আঁখেঁ কে ম্যায় একবার ফির রঙ্গিনিয়োঁ মেঁ

             গর্ক হো জাউঁ…’

                     আমি বলি, ‘ধ্যাৎ, কী করছেন কী, আমার লজ্জা করে।’

                     উনি ওনার কালো মোটা ঠোঁটে বলতে থাকেন, ‘মেরি হস্তিকো

             তেরি ইক নজর আগোশ মেঁ লে লে হমেশা কে লিয়ে

             ইস দাম মেঁ মহফুজ হো জাউঁ জিয়া-এ হুস্ন সে জুল্মত-এ দুনিয়া

             মেঁ ফির না আউঁ…’

                     আমি বলি, ‘আঃ, ছাড়ুন না, এরকম করছেন কেন আপা ?’

                     উনি বলেন, ‘গুজিশতাঁ হসরতোঁ কে দাগ মেরে দিল সে

             ধুল জায়েঁ…’

                     আমি বলি, ‘ না না না…’

                     আপা ওনার ঘুমন্ত কন্ঠস্বরে, ‘ম্যায় আনে ওয়ালে গম কি

             ফিকর সে আজাদ হো জাউঁ মেরে মাজি ও মুস্তকবিল সরাসর

             মাভ হো যায়েঁ মুঝে ওয়হ ইক নজর, ইক জাভেদানিসি

             নজর দে দে ।’

                     আমি বললুম, ‘রোজ রোজ এরকম করেন কেন ?’

                     উনি বললেন, ‘তবে যে তুই বলছিলিস উর্দু বুঝতে পারিস না !’

             এখন জানি পেশানি মানে কপাল,  গর্ক মানে ডুবে যাওয়া, রঙ্গিনিয়োঁ মানে অলঙ্কৃত, হস্তি মানে অস্তিত্ব, আগোশ মানে আলিঙ্গন, দাম মানে ফাঁদ, মহফুজ মানে সঞ্চিত, জিয়া-এ-হুস্ন মানে সৌন্দর্য্যের আলো, জুল্মত-এ-দুনিয়া মানে অত্যাচারী জগত, গুজিশ্তা মানে অতীত, হসরতে মানে দুঃখ প্রকাশ, মুস্তকবিল মানে ভবিষ্যত, মাভ মানে মুগ্ধতা, সরাসর মানে পুরোপুরি, জাভেদানি মানে অনন্তকালীন । কবিতা কিন্তু তখনও আমাকে আকৃষ্ট করেনি, আকৃষ্ট করেছিল কুলসুম আপার বড়ো-বড়ো চোখ, গালের টোল আর বুকের দেহতাপ । কবিতা বলতে বাড়িতে সকলের ধারণা ছিল গান । কবিতার কোনো বই ছিল না ইমলিতলার বাড়িতে, বস্তুত কোনো বইই ছিল না । উত্তরপাড়ার খণ্ডহরে ফারসি আর সংস্কৃতভাষার বই ছিল, ঠাকুর্দার সময়কার । ঠাকুর্দার আগের পূর্বজদের তালপাতায় লেখে পুঁথি ছিল, আমাদের ইতিহাসবোধ না থাকায়, সেগুলো উত্তরপাড়া থেকে পাটনায় নিয়ে আসিনি, শরিকরা গেঁড়িয়ে বেচে দিয়া থাকবে ।

             কুলসুম আপাদের বাড়িতে রাস্তার সামনে বিড়ি-সিগারেটের যে ঘুপচি দোকানঘর ছিল, সেখানে বসে পরিবারের সবাই বিড়ি বাঁধত । আমার বিড়ি বাঁধার শিক্ষাও ওনাদের পাশে বসে ওই ঘরে । আরেকটা ব্যাপার জেনেছিলুম, ওনাদের দোকানের ঘরে ফ্রেমে বাঁধানো একটা মন্দিরের ছবি, আমি একদিন বলেছিলুম, তোমরা তো মুসলমান, মন্দিরের ছবি টাঙিয়েছ কেন ? কুলসুম আপার আব্বু বলেছিলেন, ওটা মন্দির নয়, ওটা আমাদের তীর্থক্ষেত্র কারবালা, পয়গম্বরের নাতি ইমাম হোসেনের সমাধি, যেমন তোদের কাশি । কুলসুম আপার দাদা মানে ঠাকুর্দা ওই তীর্থ করতে গিয়ে ছবিটা এনেছিলেন, নজাফ নামে একটা তীর্থ থেকে কারবালা পর্যন্ত তিরিশ ক্রোশ, মানে ষাট মাইল, হাঁটতে হয়েছিল, হাজার-হাজার তীর্থযাত্রীর সঙ্গে, রাতে রাস্তার ধারে ঘুমোতো সবাই । আরেকটা ছিল ফ্রেমে বাঁধানো সোনালী রঙের টিনের ডানাঅলা উড়ন্ত ঘোড়া, যার মুখটা মেয়েদের মতন ; ঘোড়াটার নাম ওনারা বলেছিলেন বুরাক, যাতে চেপে পয়গম্বর মক্কায় গিয়েছিলেন ।

             কুলসুম আপাদের বাড়িতে সময় কাটাতে ভালো লাগত তার কারণ আমাদের বাড়িতে দাদা আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো, ওনার নিজের বন্ধুদের দল ছিল, বাঙালিদের পাড়া কদমকুঁয়ায় । মেজদা আমার চেয়ে তিন বছরের বড়ো, পাড়ার যে-সব ছেলেদের বখাটে বলে মনে করা হতো, মেজদার বন্ধু ছিল তারা, আমাকে তাই মেজদা পাত্তা দিত না । বড়োজ্যাঠার দুই মেয়ে আমার চেয়ে অনেক বড়ো, তাঁরা বিয়ে হয়ে শশুরবাড়ি চলে গিয়েছিলেন । অন্য বোনেরা সকলেই আমার চেয়ে বেশ ছোটো, ওরা নিজেদের মেয়েলি খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো । বাড়িতে নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্য পাড়ার সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে চোর-পুলিশ, গুলি বা লাট্টু বা ড্যাঙগুলি খেলতুম কখনও-সখনও। গু আর পাঁকের নর্দমায় লাট্টু বা গুলি পড়ে গেলে তুলে নিয়ে কলের জলে ধুয়ে নিতুম, অনেক সময়ে জাঠতুতো বা খুড়তুতো বোনেরা দেখে ফেললে বড়োজেঠিমাকে নালিশ করতো আর শুদ্ধ হবার জন্যে আমাকে সন্ধ্যাবেলায় ঠাণ্ডাজলে চান করতে হতো ।

             মনে পড়ছে, কুলসুম আপার সঙ্গে আমার যৌন সম্পর্কের কথা কেবল ঠাকুমাকে বলেছিলুম কেননা কেবল ওনার সঙ্গেই গোপন ব্যাপার শেয়ার করতে পারতুম । শুনে উনি বলেছিলেন, জীবনে আর কখনও একথা কাউকে বলিসনি, আমাকে বলেছিস বলেছিস, আর কারো কানে যেন না যায় । খেমির কথা চেপে গিয়েছিলুম ওনার কাছে, কেননা খেমির বেলায় কোনো অপরাধবোধ ছিল না । প্রথম রোমান্টিক প্রেমিকার বেলাতেও অপরাধবোধ ছিল না, তবুও ঠাকুমাকে বলিনি ।

                                      আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে । পাঁচ বছর বয়সে মা আমাকে ইমলিতলার একটা ঘরে শেকল তুলে বিকেল থেকে বন্ধ করে রেখে দিয়েছিলেন, তার কারণ পাড়ায় আমাকে তাড়ি খাইয়ে দিয়েছিল, ‘পি লে পি লে, কুছ না হোতউ’ বলে । ইমলিতলার অন্য বিহারি বাচ্চাদের সঙ্গে আমিও দু-ঢোঁক খেয়েছিলুম, আর তাড়ির গন্ধে ধরা পড়ে গিয়েছিলুম । তাড়ি খাবার জন্য মা শাস্তি দেননি, দিয়েছিলেন যাতে আমি মেজদার মতন কুসঙ্গে পড়ে কুপথে না যাই । ইমলিতলায় বিজলিবাতি ছিল না । অন্ধকার ঘরে রাত দশটা পর্যন্ত একা বসেছিলুম এক কোণে । বাবা রাতে কাজ থেকে ফিরলে শেকল খোলা হয়েছিল । হয়তো এই ঘটনার আর এই রকম আরও কিছু ঘটনার চাপে আমি ক্রমশ অমিশুকে, হিন্দু-নাস্তিক, অন্তর্মুখ, অন্তেবাসী, সীমালঙ্ঘনকারী, দ্রোহী হয়ে গিয়ে থাকব ; গ্রন্হকীট হয়ে গিয়ে থাকব । আত্মসন্ত্রস্ত থাকার উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার বীজ পোঁতা হয়ে গিয়ে থাকবে মনের ভেতরে ।

             ক্যাথলিক স্কুলে ফিরি । একদিন ক্লাসের সবাইকে রাস্তার অন্য পারে একটা বাগানে নিয়ে যাওয়া হল , সেটার নাম ফার্ম, সেখানে দেখলুম সাদা রঙের শুয়োরদের লোহার জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে একটা জায়গায়, তার আগে আমি সাদা রঙের শুয়োর দেখিনি, বাচ্চা শুয়োর যাদের আস্ত পুড়িয়ে ‘সাকলিং পিগ’ রান্না হয় ক্রিস্টানদের ভোজে । নন্দিতা বলেছিল, এই শুয়োরগুলো সিসটাররা খায়, এদের গা্য়ে এতো চর্বি যে চোখ বুজে আসছে, এর সসেজ খুব ভালো হয় খেতে, একদিন তোকে খাওয়াব । ইমলিতলায় গঞ্জেড়ি-জমঘটে কালো ছোটো মাপের শুয়োর এনে কানাগলির লোকেরা খায় জানি, পুড়িয়ে খায়, সেগুলোকে দেখে নোংরা লাগত । আমরা বাচ্চা শুয়োরদের সঙ্গে খেলার জন্য একটা আলাদা ঘেরায় ঢুকলুম, বেশ লাগছিল জড়িয়ে ধরতে, নাদুস-নুদুস ফর্সা শুয়োর । দেখলুম বিদেশি গোরু, কখনও দেখিনি আগে এতো বড়ো গোরু, বাঁটও অনেক বড়ো, দুধে ভর্তি মনে হল । তার মানে খাঁটি দুধ খায় সিসটার আইরিন আর ফাদার হিলম্যান ; আমাদের বাড়িতে রাজু গোয়ালা দুধ দিতে আসে যখন, মা ওকে জিগ্যেস করেন, আজকে কতোটা জল মিলিয়েছিস, জল মেলালে নোংরা জল মেলাবি না, কলের পরিষ্কার জল মেলাবি ।

             ফার্মে দেখেছিলুম কালো রঙের, প্রায় শকুনের মতন মাথা, ততই বড়ো পাখি, ওড়ে না, জাল দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায় । ন্যানডি বলেছিল, ওগুলো টার্কি পাখি, খ্রিসমাসের বড়োদিনে যে ভোজ হয় তাতে খায়, বেশ নরম আর ভালো খেতে । ফার্মের মুর্গিগুলোও বড়ো মাপের । আমাদের ইমলিতলার বাড়িতে মুর্গির ডিম আর মুর্গি খাওয়া বারণ । নন্দিতার বাড়িতে কিছুই বারণ নয় । ওর টিফিনের দৌলতে প্রায় রোজই মুর্গির ডিমের অমলেট খেয়েছি ।

             ফাদার হিলম্যানের কাছে যিশুখ্রিস্টের গল্প শুনে আমি একদিন প্যাকিং বাক্সের দুটো কাঠ পাড় দিয়ে বেঁধে ক্রুসকাঠ বানিয়ে ইমলিতলার সমবয়সী বন্ধুদের নিয়ে পাড়ার গলিতে ঘোরা আরম্ভ করেছিলুম । পছনে যারা অনুসরণ করছিল তারা নিজেরাই “হিপ হিপ হুররে” স্লোগান দেয়া আরম্ভ করল, কেননা পাড়ার ফুটবল দল, কাবাড্ডি দল বা কুস্তিগির জিতলে এই ভাবেই স্লোগান দেয়া হতো । স্লোগান দিতে-দিতে দলবল নিয়ে বিরজুর বাড়ির কাছে পৌঁছোলে দেখলুম ওর মা মুখ গোমড়া করে বসে আছে, অন্যদের মতন আমায় দেখে হাসলেন না, আমি কী হয়েছে জানতে চাইলে বললেন ওনার ছোটো ছেলে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল খাটতে চলে গেছে, ছোলা ভেজে বিক্রি করার মতন কাঠ নেই । আমি ওনাকে ক্রুসকাঠ পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়ে দিলুম, উনি জানতে চাইলে যতোটা পারি জিজাস খ্রাইস্টের গল্প বললুম, উনি শুনে বললেন, তুইই আমার ‘জিজুয়া’ । স্কুল থেকে ফিরে প্রতিদিনই জিজাসের ‘জুলুস’ বের করতুম দুটো কাঠ দড়ি দিয়ে বেঁধে আর নানা গলি ঘুরে দিয়ে আসতুম বিরজুর মাকে ।

             স্ট্যাণ্ডার্ড ফোরে উঠলুম ভারতের স্বাধীনতার সময়ে । কনভেন্টের মাঠে বিশাল সিল্কের ঝাণ্ডা টাঙানো হলো । সবাইকে এক প্যাকেট করে খাবার দেয়া হল । কিন্তু লক্ষ্য করলুম যে ফর্সা-সোনালী চুল ছাত্রীরা নেই, সিস্টার আইরিন আর ফর্সা সিসটাররা নেই, ফাদার হিলম্যানও নেই । বাড়ি ফিরে বাবাকে জিগ্যেস করতে উনি বলেছিলেন যে ওনারা আর ইনডিয়ায় থাকতে চান না, এতো দাঙ্গা আর গণ্ডোগোল হয়েছে আর চলছে, ওনারা নিরাপদ মনে করেননি, নিজেদের দেশে চলে গেছেন । শুনে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল । কনভেন্টে আর ভালো লাগছিল না । বাবা-মা নির্ণয় নিলেন যে আমার বাংলা কথাবার্তায় বিটকেল ইংরেজি আর পাটনাই হিন্দি বুলি ঢুকে গেছে, আমকে এবার বাংলা মাধ্যম স্কুলে দেয়া হবে, দাদার স্কুলে নয়, দাদার স্কুলে হিন্দি আর ইংরেজিতে পড়ানো হয় । স্বাধীনতার পরের বছর ভর্তি হলুম গিয়ে রামমোহন রায় সেমিনারিতে।

    আঠারো

             বাংলা মাধ্যমের একটাই স্কুল ছিল পাটনায়, রামমোহন রায় সেমিনারি, ভর্তি হয়ে গেলুম । ভর্তির সময় আমার জন্মতারিখের কথা মনে পড়ল বাবা-মার, কেননা এই জন্মতারিখ ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেটে থাকবে । কনভেন্টে ভর্তির সময়ে জন্মদিন নিয়ে ভাবেনি কেউ ; ফাদার হিলম্যান জন্মতারিখ জানতে চেয়েছিলেন, বাবা ওনাকে বলেছিলেন, আমার বড়োছেলের পাঁচ বছর পর ও জন্মেছে, শীতকালে, বোধহয় তখন নভেম্বর মাস । ফাদার হিলম্যান আমার জন্মদিন ধার্য করলেন দোসরা নভেম্বর ১৯৩৯ ।

            রামমোহন রায় সেমিনারিতে ভর্তি হবার সময়ে সেই বছরের পাঁজি খুলে দেখা গেল যে দোসরা নভেম্বর পড়ছে অমাবস্যা, ১৯৩৯-এর বছর নয়, যে বছর ভর্তি হতে গেলুম সেই বছরের পাঁজি দেখে । ২৯ অক্টোবর সব দিক থেকে ভালো পাওয়া গেল, পুরুতমশায় সতীশ ঘোষালও বললেন, এই দিনটা অনেক শুভ। ব্যাস, আমার জন্মদিন ধার্য হয়ে গেল ২৯ অক্টোবর ।

            কনভেন্টে ছিলুম স্ট্যাণ্ডার্ড ফোরে । ইংরেজিতে কথা বলতে পারার দরুন রামমোহন রায় সেমিনারিতে ভর্তি হয়ে গেলুম ক্লাস সিক্সে, বাংলা মিডিয়ামে । বড়ো হয়ে গিয়েছিলুম বলে  ডাবরকে পৌঁছে দেবার আর নিয়ে আসার কর্তব্য থেকে মুক্তি দেয়া হল । বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় দেড় কিলোমিটার, হেঁটেই যাতায়াত করতে লাগলুম, কী শীত কী বর্ষা । বর্ষাকালে ভিজে-ভিজেই ইশকুলে যেতুম, তখন কিন্তু অমন ভিজলে জ্বর হতো না । জ্বরজারি হবার জন্যেও বোধহয় যৎসামান্য পয়সাকড়ি হওয়া দরকার ।এই ইশকুলের কোনো ইউনিফর্ম ছিল না, এখন হয়েছে শুনি । তখন বাড়ির পোশাক পরেই স্কুলে যাওয়া যেতো ; ইচ্ছে হলে ইস্তিরি করা পোশাকে, নয়তো যার যেমন ইচ্ছে । আমার কনভেন্টের পোশাক যতোদিন চলেছিল ততোদিন ওই পোশাকেই যেতুম । ভর্তির সময়ে বাঙালি কেরানিবাবু, যাঁর ছেলে রতন আমাদের ক্লাসে পড়তো, বলেছিলেন, “এই স্কুল অনেক পুরোনো, ১৮৯০ সালে ব্রাহ্মসমাজের স্হাপন করা, ওপরে ওই দুই ছাত্রের ফোটো দেখছো, ওরা ১৯৪২ সালের অগাস্ট ক্রান্তির সময়ে রাজ্যের অ্যাসেমব্লি ভবনে জাতীয় পতাকা টাঙাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যায়, ক্লাস নাইনের উমাকান্ত প্রসাদ সিনহা আর রামানন্দ সিংহ, অমন ডাকাবুকো হতে হবে তোমাকেও।” ইশকুলে যাবার পথে আর ফেরার পথে রাস্তার ইঁটে নটি  বয় শু দিয়ে লাথি মেরে-মেরে ডাকাবুকোপনা ফলাতুম ।

             এই কেরানিবাবুর সামনে, ১৯৫১ সালে, শাস্তি পেয়ে, ওনার ঘরে, সারাদিন ঠায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল, দেয়ালে হেলান দেবারও অনুমতি ছিল না । এই শাস্তি ছিল আরেক ধরণের ডাকাবুকোভাব দেখাবার ফল । কয়েকজন সহপাঠী ক্লাসের একটি মেয়েকে বিরক্ত করছিল বলে আমি জিওমেট্রি বক্স খুলে কম্পাস হাতে মোকাবিলার চেষ্টা করতে গিয়ে আহত করে দিয়েছিলুম দুজনকে । ইশকুল ছুটি হয়ে যাবার পর বিভিন্ন ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা চলে গিয়েছিল, সন্ধ্যাও নেমে এসেছিল, শীতের সন্ধ্যায় অন্ধকারও ঘনিয়ে আসছিল, কেরানিবাবু চলে গিয়েছিলেন, একাই দাঁড়িয়েছিলুম, ভয়াবহ একাকীত্বের মাঝে, তারপর হেডমাস্টার ক্ষেত্রমোহন পোদ্দার মশায় স্কুল সংলগ্ন কোয়ার্টার থেকে এসে বাড়ি যাবার অনুমতি দিলেন । কনভেন্টে নানরা কখনও একা বোধ করতে দেননি, যদিও ইংরেজিতে কাজ চালাবার মতন সড়গড় হতে সময় লেগেছিল, তবুও ।

             রামমোহন রায় সেমিনারিতে, সবকটা ক্লাসঘরের বাইরে কালো বোর্ডে লেখা ছিল সেটা কোন ভাষার মিডিয়ামের কোন ক্লাস । আমি বাংলা মিডিয়ামের ক্লাস সিক্স বোর্ড দেখে পেছনের দিকে একটা সিটে বসতে যাচ্ছিলুম, একজন সহপাঠী বললে, তুই নতুন এসেছিস বোধহয়, এটা আমার সিট, তুই সামনের বেঞ্চে চলে যা। ক্লাসের দুটি সারিতে মেয়েরা, প্রায় সকলেই শাড়ি পরে, কয়েকজনের বয়স ছেলেদের তুলনায় বেশি ।এই স্কুলে ঘণ্টা বাজলে ক্লাস ঘরেই প্রেয়ার আরম্ভ হল, বাংলায় প্রার্থনা, কাউকে হাত জোড় করতে হলো না, বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী ক্লাস ফোর থেকে পড়ছে বলে তাদের মুখস্হ, গাইতে অসুবিধে হলো না, গলা ছেড়ে গাইতে লাগল সবাই, মনে হচ্ছিল স্কুলবাড়িটাই যেন গাইতে আরম্ভ করেছে । এই গান সম্পর্কে পরে আমাকে বোঝান ক্লাস নাইনের নমিতা চক্রবর্তী, যিনি সেসময়ে স্কুলের বাংলা লাইব্রেরির গ্রন্হাগারিকের দায়িত্বও টিফিনের সময় পালন করতেন । জীবনে প্রথমবার, ক্লাস সিক্সে আমি রবীন্দ্রনাথের গান আর কবিতার কথা শুনলুম ওনার কাছে । এখন স্কুলটির দুটো ভাগ হয়ে গেছে, সিনিয়ার আর জুনিয়ার; শুনেছি যে কেবল জুনিয়ার বিভাগেই প্রার্থনাটি সীমিত :-

                     আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর ।।

                     মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগন মাঝে

                     বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে ।।

                     গ্রহতারক চন্দ্রপতন ব্যাকুল দ্রুত বেগে

                     করিছে পান, করিছে স্নান, অক্ষয় কিরণে ।।

                     ধরণী পরে ঝরে নির্ঝর, মোহন মধুশোভা

                     ফুলপল্লব-গীতবন্ধ-সুন্দর বরণে ।।

                     বহে জীবন রজনীদিন চিরনূতন ধারা

                     করুণা তব অবিশ্রাম জন্মে মরণে ।।

                     স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি কোমল করে প্রাণ,

                     কতো সান্ত্বন করো বর্ষণ সন্তাপ হরণে ।।

                     জগতে তব কী মহোৎসব বন্দন করে বিশ্ব

                     শ্রীসম্পদ ভূমাস্পদ নির্ভয়শরণে ।।

             আমার পাশে দাঁড়িয়ে যে ছেলেটা গাইছিল, তার নাম তরুণ শূর, বেঁটে, দোহারা, কালো তেল চুকচুকে চেহারা, গলায় যেন কিছু আটকে আছে বলে মাঝে-মাঝে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে, তার মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের বন্ধুত্ব বজায় ছিল, তাকে গানটা এতো খটমট কেন, আর গানটার মানে কী, জিগ্যেস করতে, বলেছিল, ওসব জেনে কী করবি, গাইতে হয় গেয়ে যা, এটা পরীক্ষায় আসে না, এটা বেমমোদের গান, রবিবাবুর লেখা ।

              —রবিবাবু আবার কে ?

              —রবিবাবু জানিস না ? ওই যিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন, লম্বা দাড়ি আর চুল ।          

              বুঝতে পারলুম, স্কুলটা ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত, তাই এই গান ।  এই প্রার্থনার মাধ্যমে আমি গলা ছেড়ে গান গাইবার সাহসও জুটিয়ে ফেলেছিলুম।  আরও দুজন সহপাঠী বারীন গুপ্ত আর সুবর্ণ উপাধ্যায়, আমরা চারজন মিলে দরিয়াপুরের ফাঁকা বাড়িতে একসঙ্গে জড়ো হলে বাংলা হিন্দি গানের আসর বসিয়ে ফেলতুম । কিন্তু বড়োজ্যাঠা আর ঠাকুমা যদি জানতে পারেন যে আমি বেমমোদের স্কুলে ভর্তি হয়েছি, রবিবাবুর গান গাইছি, তাহলে গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে স্নান করাবেন, বাবাকেও নির্ঘাত গঙ্গাস্নান করাবেন, নতুন পৈতে পরাবেন ।

             ইমলিতলার বাড়িতে, পাটনায়, উত্তরপাড়ার বসতবাটিতে আর মামার বাড়ি পাণিহাটিতে, রবিঠাকুর নিষিদ্ধ ছিলেন ; তাঁর লেখা আর গানের প্রবেশাধিকার ছিলনা বাড়িতে । পাটনা আর উত্তরপাড়ায়, ঠাকুমা আর বড়োজ্যাঠা-জেঠিমার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার সাহস বয়স্কদেরও ছিল না । রবিঠাকুর লোকটি যে ঠিক কে, আর কেনই বা তাঁর নাম বা কাজ মুখে আনা যাবে না সে কৌতূহল নিরসনের প্রয়াস বড়োরাও করতেন না ।

            রবিবাবু লোকটিই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তা আমরা ভাইবোনরা, ইমলিতলায় টের পাই, আমি এই ব্রাহ্ম স্কুলে ভর্তি হবার দরুণ । রবিবাবুদের সম্পর্কে উষ্মার বীজ দাদু-ঠাকুমা বয়ে এনেছিলেন রাওলপিণ্ডি লাহোর কোয়েটা কোনো এক শহর থেকে । প্রথম আভাস মেলে একটি গানকে কেন্দ্র করে। বড়দি-ছোড়দি পণ্ডিত বুলাকিলালের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতেন । বড়োজেঠিমা সংক্রান্তির দিন ইমলিতলার বাড়িতে সত্যনারায়ণের পুজো করতেন আর সেই উপলক্ষে ব্রাহ্মণ সমাবেশ হতো । পুরুতমশায় সতীশ ঘোষালের চাঁদ সদাগর হিতোপোদেশ শেষ হলে দিদিরা ঈশ্বর বন্দনার গান গাইতেন, ব্রজভাষা বা হিন্দি বা সংস্কৃতে । পুরুতমশায়ের অনুরোধে পণ্ডিত বুলাকিলাল একটা বাংলা ঠুংরি, সিন্ধু ভৈরবী রাগিনীতে, শিখিয়েছিলেন ছোড়দি সাবিত্রীকে । ছোড়দি সেতার বাজিয়ে গেয়েছিলেন, সঙ্গতে পণ্ডিতজি:-

                             কে ভুলালে হায়

                             কল্পনাকে সত্য করি জান, এ কি দায়,

                             আপনি গড়হ যাকে

                             যে তোমার বশে তাঁকে

                             কেমনে ঈশ্বর ডাকে কর অভিপ্রায় ?

                             কখনো ভূষণ দেও, কখনো আহার ;

                             ক্ষণেকে স্হাপহ, ক্ষণেকে করহ সংহার ।

                             প্রভূ বলি মান যারে, সন্মুখে নাচাও তারে–

                            হেন ভুল এ সংসারে দেখেছ কোথায় ?

             গান শেষ হলে বড়োজ্যাঠা আর পুরুতমশায় দুজনেই দুষলেন পণ্ডিতজিকে, অমন ম্লেচ্ছ গান শেখাবার জন্য । পণ্ডিতজি তর্ক দিয়েছিলেন যে শহরের বহু গণ্যমান্য পরিবারে তিনি এই গান শিখিয়েছেন । তাঁকে জানানো হয়েছিল যে তারা ম্লেচ্ছ । ইমলিতলা পাড়ার কাউকে কিন্তু কখনও ম্লেচ্ছ তকমা দেয়া হতো না । গানটা ভুলেই যেতুম, যদি না রামমোহন রায় সেমিনারিতে ভর্তি হতুম । এই স্কুলে প্রতিবছর ভাদ্রোৎসব হতো, কোনও এক রবিবারে, ছাত্রছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকারা নৃত্যগীত ও নাটকের সন্ধ্যানুষ্ঠানে অংশ নিতেন, এবং অভিভাবকদের বলা হতো সেই অনুষ্ঠান দেখার জন্য । আমাদের বাড়ি থেকে মা-কাকিমারা আর বড়দি-ছোড়দি ছিলেন দর্শকাসনে । তাঁদের স্তম্ভিত আর আনন্দিত করে এই গানটি গেয়ে অনুষ্ঠানের সূত্রপাত হয়েছিল । ক্ষেত্রমোহন পোদ্দার যতকাল হেডমাস্টার বা প্রিন্সিপাল ছিলেন, ততদিন এই অনুষ্ঠান হতো ; তাঁর অবসরের পর, হিন্দিভাষীদের সংখ্যাধিক্যে, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বসন্ত উৎসব ।

            পুরুতমশায়-বড়োজ্যাঠার গানটি সম্পর্কে উষ্মার কারণ জানতে পারি বাবাকে জিগ্যেস করে । দাদু-ঠাকুমা যে-সময়ে লাহোর ইত্যাদি অঞ্চলে ট্যুর করে বেড়াচ্ছেন, সে-সময়ে ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক নবীনচন্দ্র রায়ও ওই অঞ্চলে প্রচারে গিয়েছিলেন, এবং তাঁর মতাদর্শ, দাদু ও আরও কয়েকজন, বাঙালি ও পাঞ্জাবি, মেনে নিতে পারেননি। দাদু-ঠাকুমা নিজেদের গোঁড়ামি চাউর করে দিতে পেরেছিলেন বড়োজ্যাঠার মনে, আর বড়োজেঠিমা তো এসেইছিলেন পুরুতবাড়ি থেকে ।

            আমার শৈশবে পাটনার অধিকাংশ বাঙালি এলিট পরিবার ছিলেন ব্রাহ্ম, আদিধর্মের ব্রাহ্ম । পণ্ডিত নবীনচন্দ্র রায় সেই অংশেরই প্রতিনিধি ছিলেন । দাদু যখন আপার ইনডিয়ায় ছিলেন, তখনই পাঞ্জাব হাইকোর্ট আর ব্রিটেনের প্রিভি কাউন্সিল রায় দিয়েছিল যে আদি ধর্মের বা ‘আনুষ্ঠানিক’ ব্রাহ্মরা হিন্দু নয় । কেশবচন্দ্র সেনের নববিধান ব্রাহ্মরা ছিলেন ‘আনুষ্ঠানিক’ । প্রথমত, একান্নবর্তী পরিবারের গৃহকর্তা ও কর্ত্রীর ধার্মিক গোঁড়ামি এবং দ্বিতীয়ত বাঙালি এলিটসমাজ থেকে দূরত্বের কারণে, টুকরো হতে থাকা যাবতীয় ব্রাহ্মদের ‘বেমমো’ তকমা দিয়ে পরিত্যাজ্য করে দিয়েছিল ইমলিতলার বাড়ি। রামমোহন রায়ের লেখা ব্রহ্মসঙ্গীত সম্পর্কে সেকারণেই উষ্মা। ‘বেমমোদের’ হেয় করার বীজ আমার মাও এনেছিলেন পাণিহাটির ওনার মামার বাড়ি থেকে । তার কারণ সেকালের স্নাতকোত্তর, মায়ের মামারা বা আমার দাদুরা, ব্রাহ্মদের বিরোধীতা করতেন, কারণ ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের বিরোধিতা করে ব্রাহ্মসমাজের প্রায় প্রতিটি ট্রাস্টি ইংলণ্ডেশ্বরকে সমর্থন করে বিদ্রোহী সেপাইদের কড়া শাস্তি দাবি করেছিলেন ; ১৮৭১ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁরা প্রথমে ব্রাহ্ম, তারপর ভারতীয় । ১৮৭২এর ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী একজন ব্রাহ্মকে লিখে দিতে হয় যে, “আমি হিন্দু বা মুসলিম বা খ্রিস্টান বা ইহুদি নই ।” মায়ের মামার বাড়ির লাইব্রেরিঘরে উনিশ শতকের মনীষীদের ছবি টাঙানো থাকতো, কিন্তু নোবেল প্রাইজ পাবার পরও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি টাঙানো হয়নি । মায়ের বড়োমামা অনাদিনাথ চট্টোপাধ্যায় বলতেন যে, “রবিবাবু ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে বিকৃত করেছেন” ; যতোদিন তিনি বেঁচেছিলেন, ওই বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কদর হয়নি ।

            বাবা দরিয়াপুরে চলে আসার পর,  কালক্রমে কাকারা কোতরঙ আর উত্তরপাড়ায় চলে যাবার পর, মেজো জেঠিমাও তখন মারা গেছেন, ইমলিতলার বাড়ি প্রায় ভুতুড়ে হয়ে গিয়েছিল বলে বড়োজ্যাঠা আর জেঠিমা দিদিদের বাড়িতে থাকতে চলে গিয়েছিলেন । দিদিদের বাড়িতে প্রায়ই গানের আসর বসত । ক্লাস নাইনের পর আমি বড়ো একটা যেতুম না, ভাইফোঁটা ছাড়া । কেননা গেলেই দিদিরা বলতেন, তোর বিষয়ে অনেককথা কানে আসছে । বড়োজেঠিমা বলতেন, কুপথে যেওনি বাপু ।

            একবার বড়োজ্যাঠা দিদিদের বাড়িতে ওনার পরিচিতদের ডেকেছিলেন সত্যনারায়ণ পুজোর সান্ধ্যবাসরে । গিয়ে দেখি হলঘরে কার্পেটে বসে গান গাইছে বড়ো ভাগ্নি মঞ্জু, ওর সামনে ‘গীতবিতান’ খোলা,  ছোড়দি সেতার বাজাচ্ছেন, হারমোনিয়ামে বড়দি আর তবলায় সঙ্গত দিচ্ছেন বৃদ্ধ বুলাকিলাল । ইজিচেয়ারে চোখ বুজে গান শোনায় বিভোর বড়োজ্যাঠা । বড়োজেঠিমা দেয়ালে ঠেসান দিয়ে হাতজোড় করে বসে আছেন। গানটা এই, গীতবিতান পূজা পর্যায় থেকে, এখন সর্বত্র গেয়, ব্রহ্মসঙ্গীত :

                                            অন্তর মম বিকশিত করো

                                                    অন্তরতর হে ।

                                           নির্মল করো, উজ্জ্বল করো

                                                   সুন্দর করো হে ।

                                           জাগ্রত করো, উদ্যত করো,

                                                  নির্ভয় করো হে ।

                                 মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে ।

                                            অন্তর মম বিকশিত করো

                                                 অন্তরতর হে ।

                                            যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে

                                              মুক্ত করো হে বন্ধ,

                                            সঞ্চার করো সকল মর্মে

                                              শান্ত তোমার ছন্দ ।

                                 চরণপদ্মে মমচিত্ত নিস্পন্দিত করো হে,

                                        নন্দিত করো, নন্দিত করো,

                                             নন্দিত করো হে ।

                                       অন্তর মম বিকশিত করো

                                              অন্তরতর হে ।

             বাড়ির বয়স্কদের অজান্তে, রবীন্দ্রনাথ, রবিবাবু থেকে রবিঠাকুর হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে পৌঁছে আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে গিয়েছিলেন । ভারতীয় সংবিধান লাগু হবার পর, সমাজে ক্রমশ ক্ষমতা-নকশায় রদবদল ঘটতে থাকে, পাটনার সমাজকর্তাদের আসন থেকে বিদায় নিতে থাকেন ব্রাহ্মরা । ব্রাহ্মমন্দির মেয়েদের স্কুল, যে স্কুলে আমার জাঠতুতো-খুড়তুতো বোনেরা পড়ত, তা বন্ধ হয়ে যায়, মন্দির ভেঙে মার্কেট কমপ্লেক্স গড়ে ওঠে । বিধানচন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠিত তাঁর বাবা-মায়ের নামাঙ্কিত মেয়েদের হাতের কাজ শেখার সংস্হা “অঘোর-কামিনী বিদ্যালয়” অবহেলায় ধুঁকতে থাকে । অথচ কেবল আমাদের আর আত্মীয়দের বাড়িতেই নয়, ব্রহ্মসঙ্গীত ওপরতলা থেকে চুয়ে গরিব বাঙালিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল । পাণিহাটিতেও, একান্নবর্তী পরিবার যখন ভেঙে গেল, দাদুদের প্রজন্মের তিরোধানের পর, রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন । অবশ্য ততদিনে রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে গিয়েছিল পণ্যায়নের অন্তর্গত ।          

    উনিশ

                   আমাকে নিজেকে কিছু একটা হয়ে উঠতে হবে, সেই হয়ে ওঠার জন্যে থাকা প্রয়োজন দার্শনিক পরিকল্পনা এবং স্বপ্ন, তাকে বাস্তবায়িত করার মতন প্রজ্ঞা ও ক্ষমতা, এই ধরণের ভাবনাচিন্তা ভারতবর্ষে ইংরেজরা আসার আগে ছিল না । ব্যক্তির হয়ে ওঠার তত্ত্বটা ইউরোপের, খ্রিস্টধর্মের । অতীত বাঙালিসমাজের পৃষ্ঠভূমিতে যে নামগুলো আমরা পাই, এবং যাঁদের আমরা মনে করি “হয়ে উঠেছিলেন”, যেমন অদ্বয়বজ্র, ক্রমদীশ্বর, ইন্দ্রভূতি, অতীশ দীপঙ্কর, চৈতন্যদেব, জগৎমল্ল, জহুরি শাহ প্রমুখ, তাঁরা কেউই নিজেদের কিছু একটা “হয়ে ওঠার”, অথবা প্রতিস্ব নির্মাণের, অথবা সাবজেক্টকে অবজেক্ট জগৎ থেকে পৃথক ও স্বনির্ভর মনে করার, কিংবা ব্রহ্মাণ্ডপ্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি নামের কৃত্রিম জ্ঞানপরিধির কথা চিন্তা করেননি । তাঁদের তত্ত্ববিশ্বে তা সম্ভব ছিল না । তাঁদের আমরা যে কারণে জানি ও শ্রদ্ধা করি, ইউরোপীয় তত্ত্ববিশ্বে নির্মিত হলে তা সম্ভব হতো না ।

             ব্যক্তিসৃজনশীলতা ও ব্যক্তিস্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্পর্কিত ইউরোপীয় মননবিশ্বের বাইরে বেরিয়ে, প্রজ্ঞাকে কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসেবে আঁকড়ে না থেকে, ব্যক্তির কাজকে সমাজসৃজনরূপে কীভাবে আবার প্রতিষ্ঠা দেয়া যায়, আমার পক্ষে, কলেজে ঢোকার সময়ে তো বটেই, এখন সাতাত্তর বছর বয়সে পৌঁছেও, ভেবে কুলিয়ে ওঠা অসম্ভব । প্রাক ইংরেজ যুগের প্রকৃতি ও প্রকৃতিসঞ্জাত অজস্র দেবীদেবতাকে তাঁদের সিংহাসন থেকে তুলে ফেলে দিয়ে, ব্যক্তিমানুষকে অস্তিত্বের কেন্দ্রে বসিয়েছে ইউরোপীয় দর্শন । গ্রামীণ উন্নয়নের কাজে সারা ভারতে ঘোরাঘুরি করে, সাধারণ ভারতীয়দের দেখে এখন টের পাই কী ভয়ংকর সংকট তৈরি করে দিয়ে গেছে ইউরোপীয় দর্শন । পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির সমাজ এখন ইউরোপীয় দর্শনে নির্মিত প্রতিস্বের ব্যক্তিএককে গড়া । আমার শৈশব যেহেতু ব্যক্তিএকক নির্মাণের কারখানায় গড়ে ওঠেনি, ইমলিতলা আর রামমোহন রায় সেমিনারি ইশকুলকে তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলতে পারি যে ব্যাপারটাকে আমি বেশ দূরত্ব থেকে অনুধাবন করতে পারি । তার মানে এই নয় যে আমি নিজস্ব একটা দার্শনিক স্হিতি গড়ে তুলেছি । আমার সাহিত্যকর্ম, সাহিত্যের প্রচলিত ধারণাকে ছাপিয়ে বৃহত্তর এলাকায় একারণেই প্রবেশ করে ।

             সনাতন বাঙালিসমাজে যাঁরা কিছু হয়ে উঠেছিলেন বলে এখন আমরা মনে করি, যাঁদের নাম আমি একটু আগে উল্লেখ করেছি, কিংবা বাউল, ফকির, সন্ন্যাসী, যা ইউরোপে ছিল না, নেই, তাঁরা এবং তাঁদের কাজকর্ম, আমরা সমাজ বলতে এখন যা বুঝি, তার বাইরে ঘটেছে । অর্থাৎ নিজের সামনে “অপর” মানুষকে দাঁড় করিয়ে নিজেদের “হয়ে ওঠা” প্রতপন্ন করতে হয়নি তাঁদের । তার মানে ইউরোপীয় স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্যে আসেপাশে লোকজন দরকার । ঠিক যেমন নেতা “হবার” জন্যে সভায় বক্তৃতা জরুরি ; লেখক “হবার” জন্য পুরস্কার ; কবি “হবার” জন্যে সম্বর্ধনা ।

             নিজের কাছে নিজে সৎ হওয়া ছাড়া আর কোনোকিছু কেনই বা হতে যাবে মানুষ ? অপরের জন্যে কিছু করা, এবং নিজের “হবে ওঠার” জন্যে নিজের সামনে অপর বা অপরদের দাঁড় করানো, দুটো একেবারে আলাদা ব্যাপার । অপরদের নিজের মালমশলা মনে করাটা মোনোসেন্ট্রিক, ইউনিপোলার, ইউনিলিনিয়ার । কেবল মানুষ নয়, সমস্ত ধারণাই দেখা যায় তাদের অপরের বিপরীতে নির্মিত । আমি বড়ো হয়ে “অমুক হবো” ভাবতে গেলে শৈশব থেকে আমার সামনে তমুক-তুসুক থাকা জরুরি । সবাই সৎ হলে কারোর আর আলাদা ভাবে সৎ হবার দরকার হয় না । ভাবনাটাই আসবে না মাথায় । সত্যি কথা বলতে কী, হয়ে ওঠার খপ্পরে পড়লে, বাঙালির আর সনাতন বাঙালিত্ব টেঁকে না ।

             চাকরি করার সময়ে দেখেছি, একজন নবযুবক অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সতত চিন্তিত থাকে কীভাবে ম্যানেজার “হবে”, ম্যানেজার “হয়ে গেলে” অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনেরাল ম্যানেজার, ডেপুটি জেনেরাল ম্যানেজার, জেনেরাল ম্যানেজার, চিফ জেনেরাল ম্যানেজার ইত্যাদি “হবার” চিন্তায় বিভোর থাকে । অবসরপ্রাপ্তি ঘটলেই যাবতীয় “হওয়াহয়ির” হাওয়া বেরিয়ে যায় । কবি-লেখকরা দেখি একইভাবে নানা পুরস্কারের সিঁড়ি বেয়ে কবি থেকে সুপারকবি “হবার” দিকে দৌড় দ্যান । প্রতিস্ব ব্যাপারটাই শেষে ফালতু হয়ে দাঁড়ায় । এ প্রসঙ্গে বলা চলে যে, ইংরেজরা আসার পর, বাঙালি ভাবুক ও শিল্পীসাহিত্যিক “চেতনা” নিয়ে যে সমস্ত গর্ব প্রদর্শন করেছেন, তার পৃষ্ঠভূমিটি ছিল দান-বিলোনো বলবান উপনিবেশবাদীর এবং অধীনস্হ সহজবশ্য গ্রাহীর । অনুশাসন কাঠামোটাই তো হেলেনিক । সে অনুশাসনের উৎসসূত্র ইউরোপের জ্ঞানভাণ্ডার, এবং ওই জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল তাঁদের শাসনক্ষমতা । তাঁদের জ্ঞানকাঠামো দিয়ে, তাঁদের নির্মিত বাস্তব দিয়ে তাঁরা জ্ঞানী, মনীষী, পপতিভাবান, নায়ক, ভাবুক, দার্শনিক ইত্যাদি চিহ্ণিত করার নকশাজাল বানিয়ে দিয়েছিলেন । ওই সমস্তের কোনোকিছু “হবার” স্বপ্ন কারোর থাকলে, তাঁকে ক্ষমতাজালটিকে মেনে নিয়ে, নিজের প্রতিস্বকে সেইমত নথি করাতে হবে । বলাবাহুল্য যে আমি শৈশব থেকে ওই ক্ষমতাজালটিকে অস্বীকার করার চেষ্টা করে গেছি, প্রান্তিক থেকেছি ।

             প্রান্তিকতার কারণে, যা আমার “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” পড়লে জানা যাবে, ইংরেজরা আর ভারতীয় জাতিয়তাবাদীরা ভূমিপুত্রদের পিটিয়ে নিজেদের প্রতিবিম্ব বানাবার যে বিশাল জাল ফেলেছিল, তাতে ধরা দিতে অস্বীকার করার প্রবৃত্তি আমার আপনা থেকেই গড়ে উঠেছিল । যে দার্শনিকতা সবাইকে পিটিয়ে সমান করতে চায়, সেখানে বাউল, ফকির, সাধু-সন্ন্যাসীর উদ্ভব ঘটে না । ইংরেজদের সরবরাহ করা বাঙালি আত্মপরিচয়ের জগৎটিতে, আমাদের ইমলিতলার একান্নবর্তী পরিবারটি, তার অদ্ভুত ও অযাচিত প্রান্তিকতার দরুণ, প্রবেশ করার সুযোগ পায়নি । তা ছিল “নতুন”, এবং যাঁরাই সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরাই আশ্রয় নিয়েছেন অবধারণাটিতে । অবধারণাটি বিশাল সময়প্রবাহে একটি প্রাথমিক মুহূর্ত চিহ্ণিত করতে চেয়েছিল, এবং তাতে শামিল হয়েছিলেন, কেন্দ্রস্হানীয় বাঙালি ; যখন কিনা আমাদের পরিবার ছিল প্রান্তিক।

            একজন মানুষের এই আকাঙ্খা যে, “আমি অমুক হবো”, অনিশ্চয়তার এলাকায় লুকিয়ে থাকে । কিছু একটা “হতে চেয়ে” সফল হতে হলে তো নিখুঁত হতে হবে । সর্বজনীনতার কারখানায় গড়া নিখুঁত । নিখুঁত হবার প্রধান বাধা অনিশ্চয়তা । আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে অমন অনিশ্চয়তার পরিমণ্ডলে । যা অনিশ্চিত তা অন্যরকম । যারা অন্যরকম তারা অপর । তারা ব্যবস্হাটিতে খাপ খায় না । অপর হতে হবে এই ভাবনা অপর লোকটি ভাবে না নিশ্চয়ই । আমি জানতুম যে আমি মিসফিট, গোলমাল সৃষ্টিকারী, স্হিতাবস্হার বিরোধী ; কিন্তু তাই বলে নিজেকে অপর ভাবিনি । কুলসুম আপাদের পরিবারকে অপর মনে হয়নি । পাড়ার মহাদলিতদের অপর মনে হয়নি । তারা নানা জীবিকার মাধ্যমে সংসার চালিয়েছে, যেমন বাবা ফোটোর দোকানের মাধ্যমে চালিয়েছেন ইমলিতলা, দরিয়াপুর আর উত্তরপাড়ার সংসার । ফলে আমার জীবনকে একটি ইউনিলিনিয়ার গল্পে বেঁধে ফেলা কঠিন । একজন মানুষের জীবনী সেহেতু বিভিন্ন লেখকের হাতে বিভিন্ন হতে বাধ্য । কেননা সময়প্রবাহ মালটিলিনিয়ার, এই ধারণা আমি ১৯৫৯ সালে পেয়েছিলুম অসওয়াল্ড স্পেংলারের “ডিক্লাইন অফ দি ওয়েস্ট” বই থেকে । কেন্দ্র থেকে বৃত্তপরিধির দিকে যে পরিবর্তনশীল রেখাগুলো টানা যায় তা অসংখ্য, তা গোনা যায় না । কেউ যদি হয়ে ওঠার বা আকাঙ্খাপূর্তির কাহিনি বাঁধতে চান, তাহলে ওই অজস্র পরিবর্তনশীল রেখা থেকে যে কোনো একটি বেছে নিয়ে বৃত্তের মাঝখান থেকে বেরিয়ে পরিধিতে পৌঁছোবার গল্প লিখতে হয় । অথচ যতোগুলো পরিবর্তনশীল রেখা সম্ভব ততোগুলো গল্প দিয়ে তো লোকটা গড়ে উঠেছে ।

             ধরা যাক শৈশব থেকে আমি বহু প্রাণী ও বস্তুর দিকে কেবল তাকিয়েছি, তাকাই, কারণে-অকারণে । শুধুমাত্র তাকাবার ইতিহাস আছে আমার । শুধুমাত্র স্পর্শের ইতিহাস আছে । কথা বলার ইতিহাস আছে । শোনার ইতিহাস আছে । সাক্ষাতের ইতিহাস আছে । বহু বাড়িতে ঢোকার আর বেরোনোর ইতিহাস আছে । হাঁটার ইতিহাস আছে । পোশাক পরার ইতিহাস আছে । চুল কাটার ইতিহাস আছে । তা থেকে কী-কী ছাঁটাই করে আমি আমার “হয়ে ওঠার” গল্প লিখব ? যে গল্পই লিখি না কেন, তা হবে সময়ের প্রতি একচোখোমি। স্হান বা স্পেসকে গুরুত্বহীন করে দেবে, এমন গল্প ।

             “হয়ে ওঠার” একটা পথ হিসাবে দাদা, কলকাতায় বহুকাল কাটিয়েছে,  বলল কলেজে ইকোনমিক্স আর ম্যাথামেটিক্স নিয়ে পড় । কলেজে ভর্তি হয়ে গেলুম আর ভর্তি হয়ে বুঝলুম ম্যাথামেটিক্স ব্যাপারটা আমার আয়ত্বের বাইরে তো ছিলই, ইকোনমিক্সেও গণিত লুকিয়ে আছে, তার নাম ইকনোমেট্রিক্স ।

    কুড়ি

             ১৯৫৬ সালে এই বেড়া টপকে বেরিয়ে ইকোনমিক্সে স্নাতক পড়তে ঢুকলুম । মুখস্হ করতে আমি কোনো কালেই পারি না, তাই একটা বই ধরে-ধরে পুরোটা কয়েকবার লিখে নিতুম যাতে মনে থাকে । এই লেখালিখির দরুণ আকর্যণ করতে পারলুম নেপালি সহপাঠিনী ভূবনমোহিনী রাণা নামে মোটা কাচের চশমা পরা মোঙ্গোল সুন্দরীকে ; তার খাতাগুলো দরকার। দুজনে বন্ধু হয়ে গেলুম, আমার চুমু খাবার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল ভূবনমোহিনী, ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে যার নাম রাণো । ওর জন্যে ইংরেজিতে একটা কবিতা লিখেছিলুম, সেটাই আমার শেষ ইংরেজি কবিতা । মেয়েরাও যে মদ খায় তা ভূবনমোহিনীকে চুমু খেতে গিয়ে টের পাই । পরে ঘটনাটা হিন্দি লেখক ফণিশ্বরনাথ রেণুকে বলতে, উনি বলেছিলেন, কী করেছ কি, জানো কি রাণারা নেপালে কতো ক্ষমতাবান, জানতে পারলে তোমায় জ্যান্ত পুঁতে দেবে । আমি ভূবনমোহিনীকে তাড়ি খাইয়েছিলুম । চুমুর প্রতিদানে ওর জন্যে ‘এক্সচেঞ্জ এ কিস’ নামে এই কবিতাটা লিখেছিলুম :

                       লেট ইওর পারফিউমড হ্যালো

                       ফল ফর এ ফিউ সেকেণ্ডস

                       টু এনাবল মি ইন পিকিং আপ

                       দি মেমরি অফ ইওর গ্ল্যানসেস

                       ইউ লেফ্ট ইন দি নোটস আই লেন্ট ইউ

                       নট ফর নাথিং ! অ্যাট লিস্ট ইউ শুড

                       এক্সচেঞ্জ এ কিস, ইভন ফ্লাইং উইল ডু ।

             ভূবনমোহিনী রাণা একমাত্র যুবতী যে আমাকে চুমু খাবার প্রতিদানে চড় মেরেছিল, কষে চড় । ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে লিখেছি ঘটনাটা । ফরাসি যুবতীকে চুমু খাবার ইচ্ছে পুরো হলো না, ওদের চুমুতে ফরাসি ভাষার নাকিসুর বাজনা থাকে বলে জানিয়েছিল উলিয়াম গথ নামে এক হিপি, কাঁচা মাছের সুবাস থাকে, কাঠমাণ্ডুতে একজনও ফরাসী যুবতী হিপি পাইনি, নইলে নির্ঘাৎ চুমু খেতুম, কচি ডাবের জল খাবার মতন করে, যে ভাষার সঙ্গে পরিচয় নেই সেই ভাষার যুবতীদের যোনি থেকেও গোপন সঙ্গীত ভেসে বেড়ায়, এটা আমার অভিজ্ঞতা।

             স্নাতকস্তরে দ্বিতীয় হয়ে বেরোলুম ১৯৫৮ সালে । ১৯৫৯ সালে বাংলায় লেখা কবিতায় বাবার দেয়া ডায়েরির পাতা ভরে উঠেছিল, যা ইচ্ছে লিখছিলুম, বেপরোয়া হয়ে, ইমলিতলার বেপরোয়াভাব চলে এসেছিল কবিতা লেখাতেও ।         স্নাতকোত্তরে ইকোনমিক্সে স্পেশাল পেপার নিলুম মনিটারি থিয়োরি, আর সেখানেও গণিতের ভুত পিছু ছাড়লো না । ১৯৬০ সালে স্নাতাকোত্তরেও দ্বিতীয় হলুম । আমার মতন আমার প্রিয় দুই অধ্যাপক, ডক্টর আর এন ত্রিপাঠী আর ডক্টর জে এন সিনহার মনও খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার ফলাফলে । জীবনে পরীক্ষায় প্রথম হওয়া আর হলো না । নমিতাদির চাপানো মার্কসবাদ তখন মাথায় পোকা হয়ে ঘুরছে, হয়তো কুলসুম আপার প্রভাবও থাকতে পারে, ইমলিতলার জীবন তো বটেই। ডক্টর জে এন সিনহা একবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অফিসে এসেছিলেন জমিদারি বণ্ড ভাঙাবার জন্যে, আমাকে দেখে বললেন, “ইকোনমিক্স পড়ে শেষে এই কাজ করতে হচ্ছে!”         ওই সময়টা, ১৯৫৬ সালে ইনটারমিডিয়েট পাশ করে বেরিয়ে স্নাতকোত্তর হওয়া পর্যন্ত, আমি জীবনকে যতোটা পারা যায় জটিল করে তোলার চেষ্টা করে গেছি, যৌনতা, মাদক,যৌনতা, মাদক,যৌনতা, মাদক, যৌনতা, যখন কিনা সহপাঠীরা সবাই স্নাতক পড়তে ঢুকেই আরম্ভ করে দিয়েছে আইপিএস আইএএস আইএফএস, নিদেন স্টেট সার্ভিস কমিশনে ঢুকে যেতে । অনেকেই মাঝপথে পড়ে ছেড়ে আইপিএস আইএএস “হয়ে” গেল, আমি যখন স্নাতকোত্তর পাশ করলুম তখন ওরা প্রায় সবাই ঘুষের প্রাসাদ খাড়া করে ফেলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দরোজা দিয়ে বেরিয়েই ঘুষ নিতে পারা চাড্ডিখানি কথা নয় । আমার কোনো উচ্চাকাঙ্খা ছিল না, হবি ছিল না, পার্কে দৌড়োনো ছিল না, রোয়াকে বসে মেয়েদের সিটি বাজানো ছিল না । ছিল না ছিল না ছিল না ছিল না । অতীত জিনিসটাই যেন পচধরা । অতীতের কিছু ঘটনা থেমে যায়, কিছু ঘটনা চলতেই থাকে চলতেই থাকে চলতেই থাকে ।

                 কলকাতার পুলিশ কমিশনার আমাকে বলেছিলেন, “সো ইউ আর দি টপ ডগ” । তখন “টপ ডগ” এর মানে জানতুম না বলে খারাপ লেগেছিল, মনে করেছিলুম কুকুর বলছেন । উকিলকে কথাটা বলতে উনি যখন মানে বোঝালেন তখন মন্দ লাগেনি । তবে উকিল বলেছিলেন যে, “পুলিশ কমিশনারের কথা থেকে মনে হচ্ছে আপনাকে একাই কেস লড়তে হবে ।”

                      দরিয়াপুরের দেয়াল আলমারি জুড়ে আমার ব্যক্তিগত গ্রন্হাগার বন্ধুদের ঈর্ষার ব্যাপার হয়ে উঠল। বিরল বই থাকলে নানান কিসিমের বন্ধুরা জুটে যায় । পুস্তক মহল থেকে সাম্প্রতিক ইংরেজি বই কিনে আনতুম আর বাবা বিল পেমেন্ট করে দিতেন । আমার মামলার সময়ে আমার অনুপস্হিতিতে অনেক বই চুরি হয়ে গিয়েছিল, মার্কুইস ডি সাডের “হানড্রেড টৌয়েন্টি ডেজ অফ সোডোম”, হ্যাভলক এলিসের “কমপ্লিট ওয়র্কস”, জঁ জেনের “আওয়ার লেডি অফ দি ফ্লাওয়ার্স”, ম্যালকম এক্সের জীবনী, ডস্টয়েভস্কির “কমপ্লিট ওয়র্কস”, বিট আন্দোলনের পত্র-পত্রিকা, অভিধানগুলো, অনেক বই ।        অনেক জীবন একই সঙ্গে অনেক আমি, জিততে হবে অথচ জানি না কি জিততে হবে, পারতে হবে অথচ জানি না কি পারতে হবে, পৌঁছোতে হবে অথচ জানি না কোথায় পৌঁছোতে হবে, কারণ নেই, মগজে মৌমাছির ঘামগান, জীবনের মানে খুঁজতে চোখ বুজে লাফিয়ে-পড়া, হয়তো, হতে পারে, পোশাকের আগ্রহ ছিল না, নিয়মিত কাচার দরকার ছিল না, জুতোর আগ্রহ ছিল না, নিয়মিত পালিশের দরকার ছিল না, হাতঘড়ির আগ্রহ ছিল না, কেবল মনে হচ্ছিল দেশে-দেশে স্টুপিডরা রাষ্ট্রকে চালায়, ইমলিতলার লোকগুলো সপরিবারে গরিবই থেকে যাবে হাজার বছর । মনুস্মৃতির পাহাড় মাথায় চাপিয়ে লোকে কী করে সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখে জানি না, ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গীয় আঁতেলদের কোনো ধারণাই নেই , স্বাধীনতার ছয়টা দশক পেরিয়েও গ্রামগুলো জাতিপ্রথা দিয়ে ভাগবাঁটোয়ারা করা, জলভরার কুয়ো আলাদা, উঁচু জাতে প্রেম করলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয় বা কোতল করা হয়, কলেজে তারা ব্র্যাণ্ডেড জুতো, পোশাক, চশমা, পারফিউমসহ গেলে ধনী উঁচুজাতের আক্রমণে পড়ে, যুবতীরা নখপালিশ লাগিয়ে মুখ ব্লিচিং করে গেলে কুকথা শুনতে হয় । তাই আমার কাছে লেখালিখি আর সাহিত্য-শিল্প এক জিনিস নয় । আমি লেখালিখির শুরু থেকেই নিজেকে যাচাই করে নিয়েছিলুম।

    একুশ

                    দরিয়াপুরে, রান্নাঘরে মায়ের কষ্ট কমাবো ভেবে, মা এবার জীবন উপভোগ করুন ভেবে, ইনডেন গ্যাস সিলিণ্ডার কিনে দিলুম, ফ্রিজ কিনে দিলুম যাতে রোজ না রান্না করতে হয়, যাতে ওনার প্রিয় মাছের স্টক করে রাখতে পারেন, রাইস কুকার কিনে দিলুম যাতে ভাতের দিকে তাকিয়ে ঠায় বসে থাকতে না হয়, প্রেশার কুকার কিনে দিলুম যাতে রান্না তাড়াতাড়ি হয় । এই জিনিশগুলোকে রপ্ত করতে মায়ের অনেকদিন লেগে গেল, প্রায় বছর চারেক, ভয় পেতেন ওগুলোকে ; যুক্তি দিতেন যে ওগুলোর দরুণ রান্নায় স্বাদ হয় না । গ্যাস থাকতেও মা কয়লার উনুনের সামনে উবু হয়ে বসে রান্না করতে ভালোবাসতেন, পরে আমাকে বলতেন গ্যাসটা জ্বালিয়ে দিয়ে যা, নিভিয়ে দিয়ে যা । ফ্রিজ খুলতেন দূর থেকে একটা তোয়ালে দিয়ে হাতল ধরে, যদি শক মারে তার ভয়ে । প্রেশার কুকারের সিটির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে পুড়িয়ে ফেলতেন । রাইসকুকার কোনোদিন ব্যবহার করলেন না । তবু মায়ের আনন্দ হল যে ওনার শ্রম কমাবার জন্য খেয়াল রেখেছি, বুড়ি বান্ধবীরা বেড়াতে এলে তাদের দেখাতেন । রান্নাঘর থেকে মাকে বের করে আনার জন্যে শেষে রান্নার বউ রাখতে হল, তারও যথেষ্ট বয়স হয়েছিল, তবু সিলিণ্ডারের গ্যাস, ফ্রিজ, প্রেশার কুকারে সড়গড় । পাটনা শহরে টিভি আসতেই, তখন শাদা-কালো, রঙিন হয়নি, মায়ের জন্যে একটা টেলিরামা টিভি কিনেছিলুম, প্রোগ্রাম সরকারি হলেও, দেখে আনন্দ পেতেন আর পাড়ার যতো বাচ্চারা, বেশিরভাগই দরিয়েপুরের মুসলমান পরিবারের, এসে জড়ো হতো ওনার চারিধারে মেঝের ওপর ।

            মা বলেছিলেন, একটা গাড়ি কেন এবার, লোকেদের বাড়ি যাই । কিন্তু কেনা হয়নি, পাটনার বাড়িতে গ্যারাজ তৈরির জায়গা ছিল না । কিনলুম বটে, ফিয়াট, পরে মুম্বাইতে, নাবার্ডে অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনেরাল ম্যানেজার হয়ে, অফিস থেকে লোন নিয়ে । মা আর বাবা দুজনেই তখন মারা গেছেন । যখন লখনউতে বদলি হয়ে গেলুম তখন লখনউয়ের হেড পোস্টঅফিসে গিয়ে প্রতি শনিবার মাকে এসটিডিতে ফোন করতুম; পোস্ট অফিসে বুক করে অনেকের সঙ্গে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে হতো, আধঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে ডাক আসতো । এখনকার মতন মোবাইল হলে মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন দুবেলা কথা বলা যেতো । 

                    উত্তরপাড়ার চিলেকোঠার ঘরে, কলকাতায় পড়াশুনার সময়ে আস্তানা নিয়েছিল দাদা, বইয়ের স্তুপ, বন্ধুদের গ্যাঞ্জাম, সিগারেটের ধোঁয়া, আমি গিয়ে পড়েছি অনেক সময়ে, পরিচিত হয়েছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, আনন্দ বাগচির সঙ্গে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে মনে হতো ঘরণী টাইপের মানুষ । তার আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমাদের দরিয়াপুরের বাড়িতে এসে পাটনার ঠররা খেয়ে বারান্দায় বমি করে গেছেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলে গেছেন ওনাকে পাঠালে উনি আমার লেখা প্রকাশ করার ব্যবস্হা করবেন । দাদা চাকরি পাবার পর ধানবাদে থাকার সময়ে দীপক মজুমদারের সঙ্গে আড্ডায় উনি বলেন “ফিলজফি অফ হিসট্রি” পড়তে, দীপক মজুমদারকে দেখেছি ধানবাদে দাদার বাসন মাজছেন । দীপক মজুমদারকে মনে হয়েছে চাষি টাইপের মানুষ । ওনার বলা বিষয়ে বই পড়া আরম্ভ করি, আর লিখে ফেলি “ইতিহাসের দর্শন” যা পরে “বিংশ শতাব্দী” পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল, সম্পাদক যদি জেনে যেতেন আমার বয়স কতো তাহলে ছাপতেন কিনা সন্দেহ । তারপর নমিতা চক্রবর্তীর প্ররোচনায় আরম্ভ করলুম মার্কসবাদ নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ, যা বিমান মজুমদারের ছেলে, দাদার বন্ধু বুজলুদাকে পড়তে দিলে, বললেন, বই করে ফেলতে পারিস ।

             দাদা কলকাতার কলেজে পড়ার সময়ে প্রায়ই যেতুম উত্তরপাড়া, পাণিহাটি, কোন্নোগর আর আহিরিটোলা । পাণিহাটি থেকে আহিরিটোলা যেতে হলে শেয়ালদা স্টেশান হয়ে যেতে হতো । শেয়ালদা স্টেশান তখন উদ্বাস্তুদের ভাঙা সংসারে ছয়লাপ, কলকাতার রাস্তায় মিছিল, বাস-ট্রাম পুড়ছে, দেখে মনে হতো কেউ শোনার নেই । সেসময়ে সদ্য-সদ্য ট্র্যাজেডি থেকে জন্ম হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের, আর নিজেকে মনে হতো শেকসপিয়ারের ট্র্যাজেডিগুলোর ভাঁড়দের মতন, কিং লিয়ারের ফুল, হ্যামলেটের কবরখুঁড়িয়েরা, ওথেলোর ক্লাউন, ম্যাকবেথের পোর্টার, অ্যাজ ইউ লাইক ইটের টাচস্টোন, টুয়েল্থ নাইটের ফেসটে । কলকাতার ওই সময়ের  দুর্দশার জোয়ারের ঢেউগুলোকে আমি ধরার চেষ্টা করেছি আমার ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে । মানুষের পীড়া দুর্ভোগ বাঁচার লড়াইয়ের যন্ত্রণা দেখে, তাদের অসহায় গোঙানি শুনে, নিজের ব্যর্থতা অনুভব করা সহজ হয়, টের পাওয়া যায় যে আমি একটা গাছের পাতাও নড়াবার সামর্থ রাখি না । শহরের হাওয়ায় তাদের বিলাপ আজও অভিশাপ হয়ে ভেসে বেড়ায় । নিজেকেই প্রশ্ন করি, কী করা যেতে পারে ? কলম দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় বিষের চোলাই !

             দাদার সব বন্ধুদের দেখেছি তো ! কাউকেই মনে হয়নি দাদার মতন আর আমার মতন মিসফিট, গোলমালকারী, স্হিতাবস্হাবিরোধী ইমলিতলা-মার্কা ইনসেন টাইপের ; ওনাদের উচ্চাকাঙ্খা সাহিত্যকে আঁকড়ে কেরিয়ার করার  । অথচ আমার আর দাদার মতন ইমলিতলাপন্হী ইনসেন না হলে আন্দোলন গড়ে তোলা যাবে না । এনাদের বহু বাক্যের সঙ্গে মুখের দুর্গন্ধ লেগে থাকে, পায়োরিয়ার, বদহজমের, বায়ুর, দাঁতের ফাঁকে পচা ছাগলের, শব্দের অর্ধেক মানে তাতেই আটকে যায় । পরে এনাদের কাজকারবার দেখে পায়খানাগুলো পর্যন্ত লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে টাকা টাকা টাকা টাকা টাকা টাকা টাকা টাকা টাকা টাকা টাকা টাকা । আর সেই মোক্ষম দর্শন । টাকা হল ডলারের বেজন্মা বাচ্চা । ওনাদের সমবেত বা একক  কাজকারবার দেখে মনে হয়েছে, আমি বোধহয় একরকম স্টুপিড গর্ববোধে ভুগি, সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে, যাকে অ্যালেন গিন্সবার্গ বলেছিল “নাঈভ”, যার দরুন পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্হান, প্রেমে লাথি, বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতা, জোচ্চুরি, টাকা হাপিশ। পৃথিবীর সঙ্গে আমিও পাক খাই । ওহ, বলতে ভুলে গেছি, দাদার রোলেক্স ঘড়িটা এক বন্ধু হাপিশ করে দিয়েছিল চাইবাসায়, তারপর থেকে দাদা ঘড়ি পরা ছেড়ে দিলো ।

             পশ্চিমবঙ্গ কি সেই পঞ্চাশ-ষাটের ট্র্যাজেডি থেকে বেরোতে পেরেছে ? না, পারেনি, জানি না কখনও পারবে কিনা । তা থেকে গেছে, স্হায়ী বিশৃঙ্খলা, অকারণ ক্রোধ, অরাজকতা, নৃশংসতা, গণধর্ষণ, নারীপাচার  আর ঘৃণা নিয়ে । ওপর থেকে চুয়ে-চুয়ে পৌঁছে গেছে নিচের তলায়, যেখানে সামান্য কিছু নড়ে উঠলেই মানুষ ভয়ে আঁৎকে ওঠে, আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, প্রতিপক্ষ থাকুক বা না থাকুক । যারা নায়ক হয়ে উঠতে চেয়েছিল তারাও কালক্রমে খোলোশ থেকে বেরিয়ে নির্মল জোকারের চেহারার সঙ্গে জনগণের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে , জনগণ জোয়ারের সঙ্গে আসে ভাটার সঙ্গে যায়, তাদের জানা নেই যে শহর আর শহরতলিগুলো থেকে সৌন্দর্য্য কবেই পালিয়েছে, কেউই আর প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে পারে না, বহু পরিবার ওই ট্র্যাজেডিকে পারিবারিক স্মৃতির আনন্দের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে, মাছের বদলে সেই আনন্দে তারা নিয়ে এসেছে বিরিয়ানি, স্টিউ, সসেজ, পাস্তা, হ্যামবার্গার, হটডগ — মাছেরাও বিদায় নিচ্ছে এক-এক করে, তৈরি হয়েছে চাষের মাছ, বিয়েতে টকটকে লাল ধুতি আর উত্তর ভারতের শেরোয়ানির মতন, যেগুলো কবি অজিত দত্তের মেয়ে শর্বরী দত্তের অবদান ।

    বাইশ

              প্রথম উপন্যাস ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ লেখার সময়ে নমিতা চক্রবর্তীকে যেমন দেখেছি তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলুম মানসী বর্মণ নামের চরিত্রে । ওই উপন্যাসেই বারীন গুপ্তের মহেন্দ্রু মোহোল্লার বাড়ি আর পাড়া ব্যবহার করেছি অতনু চক্রবর্তীর বেলায় । রাঘব আর রমা চরিত্র হল আমার সহকর্মী সুশান্ত চক্রবর্তী আর টেলিফোন অপারেটার রত্না আতর্থী । অরিন্দম চরিত্রটা সহকর্মী অরুণ মুখোপাধ্যায়ের আদলে, যে পরে দাদার শালিকে বিয়ে করে, ও সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিল বিবাহিতা মহিলার প্রেমে পড়ে, যে ওকে নিজের সঙ্গে শুতে দিলেও যৌনকর্ম করতে দিচ্ছিল না । মৌলিনাথ চরিত্রটা হল সহকর্মী মণিমোহন মুখোপাধ্যায়, যার মেয়ের সঙ্গে দাদার ছেলের বিয়ে হয় । আর আছে বিহারের জাতপাতের লড়াই, মাওবাদি-লেনিনবাদিদের লড়াই ।

              ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপন্যাসে মিজোরামের উল্লেখ না থাকলেও, পার্থসারথী চৌধুরী, আইএএস, ধরে ফেলেছিলেন যে জুডি-জুলির সঙ্গে অতনুর যৌনজীবনের ঘটনা মিজোরামে ঘটেছে । আমাকে আরও জেরা করেছিলেন জানার জন্য যে ওগুলো আমার জীবনের ঘটনা কিনা । পার্থসারথী চৌধুরীর কসবার বাড়ি গিয়েছিলুম একবার, উনি ম্যাজিশিয়ান পি সি সরকারের জামাই । পাত্র বইপত্র পড়তে ভালোবাসে শুনে পি সি সরকার একঘর বইসুদ্দু একটা বাড়ি দিয়ে দিয়েছিলেন পার্থসারথীকে । সারাদিন বইয়ে মলাট দেয়া, নম্বর দিয়ে তালিকা তৈরি করা, আলমারি অনুযায়ী সাজানোয় এমন জড়িয়ে গিয়েছিলেন যে তাঁর লেখার অভ্যাস চলে গিয়েছিল । বলেছিলেন, তোমার লেখা কোনো বই কখনও দরকার হলে বোলো, সব আছে আমার কাছে । এতো তাড়াতাড়ি মারা গেলেন যে যখন রচনাসংগ্রহের জন্যে  দরকার তখনই উনি নেই ।

              ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ পড়ে একদিন লাল টিশার্ট আর জিনস পরে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এসে হাজির । নিজে ফিকশান লিখলেও, আমার উপন্যাসের ঘটনাগুলোকে সত্যি মনে করে ‘আজকাল’ দৈনিকের জন্য ফিচার লিখতে চান । বললুম বাঙ্গালোরে যান, পাবেন হয়তো, তখন অবশ্য বেঙ্গালুরু হয়নি । ফিরে এসে বললেন, কিছুই ঘটেনি ওখানের রিজার্ভ ব্যাঙ্কে । বললুম, আপনিও তো উপন্যাস লেখেন, আমি তো পড়ার পর খুঁজতে যাই না, কোনো পাঠকই যায়না । ক্রুদ্ধ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ‘আজকাল’ দৈনিকে লিখলেন, বিয়েতে উপহার দেবার জন্য ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপযুক্ত বই ।

              স্নাতক পড়ার সময়ে সহপাঠী রাজনারায়ণ দাসের ডাকে গেলুম ওর চিলতে ঘরে, পাটনা মার্কেটের পেছনে, ঘরের আলো নিভিয়ে একটা টেলিস্কোপ দিয়ে বলল, দ্যাখো জানলা দিয়ে । দেখলুম দুজন চিনা যুবতী, ভারতীয় চিনা, পোশাক খুলে, এখন যাকে বলে, লেসবিয়ান প্রেম, তাই করছে । রাজনারায়ণ বলল, দেখলি তো, চিনা মেয়েদের স্লিট হরাইজনটাল হয়, ভারতীয় মেয়েদের মতন ভার্টিকাল নয় । আমি কেবল ওদের গোলাপি মাই আর চুলহীন যোনি দেখে উত্তেজনা সামলাচ্ছিলুম । রাজনারায়ন এম এ পড়া ছেড়ে দিয়ে আইপিএস হয়ে চলে গিয়েছিল, দ্বারভাঙ্গা বিলডিঙের গেটে সরকারি গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের মনে করিয়ে দিত যে ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপরতলায় আর আমি তার বাইরে, ফেকলু, উচ্চাকাঙ্খাহীন।

             উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মুসলমান যুবতীর মুখ দেখার লোভে স্নাতক ক্লাসের বন্ধুনি ভূবনমোহিনী রাণাকে পটিয়েছিলুম, ওদের হোস্টেলে  উম্মা হাবিবা নামে একজন সুন্দরী ধনী বাড়ির যুবতী আছে শুনে । উচ্চবিত্ত ছাত্রীরা সেময়ে বোরখা পরত । হোস্টেলের গেটের কাছে এসে উম্মা হাবিবা বোরখার নকাব মাথার ওপর তুলতে ওর লিপ্সটিক বোলানো ঠোঁট আর সুর্মামাখা গভীর চোখ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলুম, বেশ ফর্সা, অত্যন্ত ফর্সা, বলেছিল, “দেখ লিয়া ?” আমি বলেছিলুম “জি”। আর মনে হয়েছিল, আহা, এই মেয়েটা যদি কুলসুম আপা হতো একে নির্ঘাৎ প্রেম নিবেদন করতুম, লিঙ্গের চামড়া ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই হয়ে গেলেও ছাড়তুম না একে, মার খেলেও, দাঙ্গা হলেও,  ছাড়তুম না ।

                 ১৯৬৪ সালে লালবাজারে পুলিশ কমিশনার বলেছিলেন, “আপনারা সাহিত্য করছেন নাকি হ্যাণ্ডবিলে দাঁতের মাজন বিক্রি করছেন ।” একফালি কাগজে কবিতা ছাপিয়ে যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিলি করা যায়, দাঁতের মাজনের প্রচারের মতনই, তা ওনার ধারণায় ছিল না । সেসময়ে কোনো সাহিত্যিকেরই ছিল না, ব্যাপারটা ওনাদের মতে “শিল্পের দেবীকে পথের মাঝে নামিয়ে আনা”। কেবল ভাষাকে আক্রমণ করিনি, তার প্রণালীকেও আক্রমণ করেছি ।

             ২০০০ সালে ইমলিতলা পাড়ায় দাদার ছোটোবেলাকার বন্ধু বদ্রি পাটিকমার হয়ে গেল বাহুবলি, কেমন করে লোক যোগাড় করে লন্দিফন্দি করে রাজনৈতিক দলে সেঁদিয়ে ও পকেটমার থেকে নেতা হয়ে গেল সে এক রহস্য ; নেতারা নিজে কিছু করে না, ওকে দেখে টের পেয়েছি, সবকিছুর জন্য লোক আছে, পেঁদাবার, লোপাট করার, খুন করার, এমনকি ছুঁচিয়ে দেবার। আহা, বদ্রি পাটিকমারের সঙ্গে যদি জীবন অদল-বদল করে নেয়া যেতো । “হয়ে ওঠা” স্পষ্ট হতো ।

             বুজলুদাকে জিগ্যেস করেছিলুম, কে পড়বে আমার বই ?

             —কেন ? রবীন্দ্রনাথ যেমন খামে ভরে-ভরে একে-তাকে বই পাঠাতেন, তুইও পাঠাবি ।

             জনে-জনে পাঠাবার এই আইডিয়াটা বেশ ভালো লেগেছিল । হাংরি আন্দোলনের সময়ে কাজে লাগিয়েছিলুম , লিফলেট কার্ড আর প্যামফ্লেট ছাপিয়ে বিলি ।

             বইয়ের জন্য, লেখালিখির জন্যে টাকা তো দরকার । শিলঙে একটা কলেজে দরখাস্ত করে অধ্যাপনার চাকরি পেলুম, ইকোনমিক্স পড়াবার জন্য । তখন “বঙাল খেদা” চলছিল, বাবা বললেন, ‘পাটনাতেও খুঁজে দ্যাখ না কোনো চাকরি পাওয়া যায় কিনা, এখানে তো তোর দাদাও নেই, তুইও চলে যাবি, আমাদের জ্বরজারি  অসুখ-বিসুখ হলে কে দেখবে ?’ স্কুলের সহপাঠী নেপালের দাদা সমরেন্দ্র চক্রবর্তী, রামমোহন রায় সেমিনারিতে আমার চেয়ে দু’ক্লাস উঁচুতে, একদিন এসে বলল, ‘তুমি এই কাগজটায় সই করে দাও দিকিনি, চাকরির দরখাস্ত লিখেই এনেছি, আমার অফিসে লোক নেয়া হচ্ছে, নতুন অফিস খুলবে, বেশি লোকেরা জানে না, কাউকে বোলো না যেন ।’ আমার অফিস মানে রিজার্ভ ব্যাংক, উনিও নোট পোড়াবার দপতরে তখন, দুপুর বেলাতেই ছুটি হয়ে যায়, তারপর টিউশানি করে বেড়ান, সংসার ওনাকেই চালাতে হয়, বাবা ওনার ছোটোবেলায় আত্মহত্যা করেছিলেন, কোনো বিদেশি কোম্পানির ওষুধ জাল করে বিক্রির জন্য ধরা পড়েছিলেন ।

             খড়ি-স্লেটের  কৃষ্ণগহ্বরের আহ্লাদ শুষে নিচ্ছিল আমাকে, বইয়ের হাঙরেরা আমার ছাড়ানো দেহ থেকে মাংসের টুকরো ছিঁড়ে-ছিঁড়ে আনন্দে ভোগাচ্ছিল আমায়, অক্ষরের জোঁকেরা চামড়ায় বসে রক্ত চুষে আমার হরমোন বাড়িয়ে তুলছিল । চোখ, কান আর জিভ দিয়ে লেখা আরম্ভ করলুম । আর পড়া, বই বই বই বই বই বই, বাছবিচার নেই, এ-বই, সে-বই, অমুক বই, তমুক বই, জ্ঞান জ্ঞান জ্ঞান জ্ঞান । আরেক লাইন, আরেক বাক্য, আরেক প্যারা, বেঁচে থাকার আনন্দ আর দুঃখ, সারাজীবন বেঁচে থাকার ইচ্ছে। আমি শব্দপূঞ্জ আর অ্যাকশানের মাঝে ঝুলছিলুম, শান্তিময় আরামপ্রদ জীবন অসম্ভাব্যতার পথে ছুটতে লেগেছিল, জীবনের এক চতুর্থাংশ কাটিয়ে সব কিছুই জানা হয়ে গিয়েছিল, কৌতুহলে লুকোনো নোংরামি অনৈতিকতা অবৈধতা থেকে আরম্ভ করে অনিশ্চয়তার ভীতি পর্যন্ত, ফুরিয়ে গিয়েছিল অজ্ঞানতার পর্ব ।

             বাবাকে তো প্রতিদিন দেখছিলুম, নিজেকে শিল্পী বলে মনে করছেন না, মনে করছেন, তাঁর কাজ হল মৃতদের প্রাণ দেয়া যা পেয়ে তাদের বংশধরদের আহ্লাদ হয়, কিন্তু এও দেখছিলুম যে শিল্পীদের মতন মানসিক-শারীরিক অসুস্হতায় আক্রান্ত হয়ে ওনার স্বাস্হ্য ভেঙে পড়ছে ক্রমশ । উনিও যেন প্রতিটি ছবিতে বিষের চোলাইকারীর ভূমিকা নিচ্ছেন, যা আমি তখন করছিলুম আমার ডায়েরিতে আর নোটখাতার পাণ্ডুলিপিতে । এখন যখন জীবনের বাঁকবদলগুলোর কথা ভাবি, মনে হয় যেন তা কয়েক বছর অন্তরই ঘটেছে ।

              সিনেমা দেখার অভ্যাস ছেড়ে যেতে লাগল, কেননা সিনেমা তো দেখতুম যৌন আবেদনের জন্যে, শ্বেতাঙ্গিনীর উরু আর ক্লিভেজের আকর্ষণে, সত্যজিৎ রায় ঋত্বিক ঘটক মৃণাল সেন আকিরো কুরোসাওয়া ফগেদেরিকো ফেলেনি রোমান পোলানস্কি ইঙ্গমার বার্গম্যান জাঁ লুক গোদার লুই বুনুয়েল ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো ফেদেরিকো ফেলিনির জন্য নয় । সাবটাইটেল দেয়া ফিল্ম আমি দেখতে পারি না ; পড়া আর ফ্রেম দেখা আর শোনা এক সঙ্গে তিনটে ব্যাপার সম্ভব হয়নি কখনও ।

              অড্রে হেপবার্ন, ব্রিজিত বার্দো আনা কারিনা মারিনা ভ্লাদি বেরুয়াদেতে লাফোঁ ক্লদ জেড জিন মোরেয়া ভেরগানো মারিয়ন কিকা মারখাম শার্লি আমাগুচি মিসা উয়েহারা অ্যানিটা একবার্গ জিউলিয়েতা মাসিনা সান্দ্রা মিলো ক্লদিও কার্দিনাল অনুক আইমি ক্যারোল বোক অ্যানজেলা মোলিনা ক্যাথারিন দেনেউভ সোফিয়া লোরেন এলিজাবেথ টেলর আরও কতো আরও কতো আরও কতো আরও কতো , তাদের ঠোঁট নড়া দেখলে আমি পায়ের ওপর পা রেখে লিঙ্গকে সামাল দিই ।

             কাজলচোখ গাঢ় ভুরু মিষ্টি হাসি কাঁপানো ঠোঁট সুচিত্রা সেন সাবিত্রী দেবী সুপ্রিয়া চৌধুরী সন্ধ্যা রায় মাধবী মুখার্জি আরও কতো আরও কতো আরও কতো । নিজেকে সামাল দিই ।

             স্তনের ভাঁজ কাঁচা গোলাপি ঠোঁট দীর্ঘ উরু শিফন শাড়ি মধুবালা মীনাকুমারী নিম্মি নার্গিস শ্যামা মীনা শোরে রেহানা কুলদীপ নায়ার গীতাবালি নূতন সুরাইয়া আশা পারেখ সাধনা মুমতাজ ওয়াহিদা রহমান হেলেন নলিনী জয়ন্ত বীনা রায় বৈজয়ন্তিমালা মালা রায় আরও কতো আরও কতো । নিজেকে সামাল দিই ।

             ফিল্ম পরিচালকদের ভাবনাচিন্তার সঙ্গে আমার লেখালিখির কোনো যোগসাজস কখনও গড়ে ওঠার সুযোগ পায়নি, নিজের মগজে যা আসে তাই কলমে চলে আসে । কলম চাইলে মগজ তাকে ইরটিক হয়ে ওঠার বন্দোবস্ত করে দ্যায় । আমার তো বিশ্বাস নেই, যা আছে তা প্রত্যয় । সমসাময়িকদের বিরুদ্ধে আমি একাই দাঁড়িয়ে থেকেছি, কোনো ফিল্ম নয়, বই নয়, নির্দেশ নয়, তত্ত্ব নয় । জানতুম ইর্ষনীয়-গন্তব্যে শত্রুসংখ্যা বাড়বে, এও জানতুম যে লড়ে যেতে হবে । নমিতা চক্রবর্তী উত্তর দিতে পারেননি যখন ওনার দেয়া তোড়া-তোড়া পত্রিকা হাতে নিয়ে জানতে চেয়েছিলুম যে সোভিয়েত দেশের এতো চকচকে প্রচারের কাগজপত্র কেন, প্রপাগাণ্ডা কেন, গোপনীয়তা কেন ? তা সত্ত্বেও যেতুম ওনার ফ্ল্যাটে, প্রেম আমার জীবনের প্রধান সমস্যা বলে, ভালোবাসা পাবার ধান্দায় লালায়িত বলে । কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর আকর্ষণ স্তালিনের ছাড়া গোখরোদের কামড়ে ততদিনে  হাপিশ ।

      তেইশ      

               আমার যাবতীয় কাজকারবারের, যাকে কলকাতার লোকে সেসময়ে বলত বোহেমিয়ান জীবন, তার উৎস হল ইমলিতলা ; বাঙালির দৃষ্টিতে সকলেই সেখানে বোহেমিয়ান । ক্রোধ আর অসহায়তার আগ্নেয়গিরির উৎসও ইমলিতলা । ওই পাড়ার গড়ে দেয়া সামুরাইরা আমার মগজে যুদ্ধ আরম্ভ করে দিয়েছিল, উপলব্ধিদের ফাটিয়ে চৌচির করে বেরিয়ে পড়তে চাইছিল জীবন, বুঝে গিয়েছিলুম যে লেখালিখি ওপিনিয়নেটেড হওয়া জরুরি । বলতে হলে বলতে হয়, পৃথিবীর জন্মই তো হয়েছে বিশ্বজাগতিক সন্ত্রাস থেকে। আর আমার লেখালিখি তো আপামর জনসাধারণকে খুশি করার জন্য নয় । মৌমাছির কথা ভাবলে কেবল তার গুনগুন আর মধুর কথা ভাবলেই তো হবে না, তার হুলের কথাও মনে রাখতে হবে । আপনি যদি মনে করেন যে আপনার বিশ্বাসই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ, তাহলে রক্তের বহু নদী বইতে থাকবে, আর তাতে ভেসে যাবে আপনার ঘৃণার শবের পর শবের পর শব ।

              ইমলিতলা থেকে দরিয়াপুরে যাবার পর, দাদার বিয়ে হয়েছে, নতুন বউ এসে তো খাটা পায়খানায় হাগবে না, তাই ফ্লাশ-পায়খানা তৈরি হল, একতলা-দুতলায়, দাদা একতলার দরোজায় ভেতরের দিকে আয়না লাগিয়েছিল, যাতে হাগতে-হাগতে নিজেকে দেখা যায়, হাতেমাটির জন্যে গঙ্গামাটির বদলে লাক্স টয়লেট সাবান । বিহারি বন্ধুদের তো বটেই বাঙালি সহপাঠীদেরও অনেকের বাড়িতে খাটা পায়খানা ছিল বলে আমাদের পায়খানা দেখতে আসতো, একটু হেগে নেবার অনুমতি চাইতো । ইমলিতলার বাড়িতে হেগো হয়ে যাবার যে বিধিনিষেধ ছিল তা তামাদি হয়ে গেল, পোশাক পরেই হাগো, নো প্রবলেম, হেগো বলে গঙ্গাজল ছেটাবার আর দরকার নেই । একের পর এক সীমার পাঁচিল ভেঙে পড়ছিল, আপনা থেকেই, আর সেই ভাঙনের স্রোতে বাড়ির সবাই শামিল ছিলুম, মা, বাবা, দাদা, আমি, সবাই । মুর্গির ডিম, মুর্গির মাংস, বিনা-আঁশের মাছ, তাড়ি খেয়ে মদ খেয়ে গাঁজা টেনে বাড়ি ফেরা, যা-যা বারণ ছিল তা লোপাট হয়ে গেল। তরুণ শূরের টাকায় মহঙ্গুর দোকানে বসে চেবাতুম বটের, বগেড়ি, কোয়েল, চাহা পাখির দেহ, পায়রার ঠ্যাং। পায়রা খেয়ে তরুণ বলত এই মাংস বড্ডো গরম, আজকে শালা কয়েক বার হাত মারতে হবে গরম বের করার জন্যে ।

             পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল । বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো অধ্যাপককে পেলুম না যিনি আমায় লেখালিখি করতে আগ্রহী করবেন । রামমোহন রায় সেমিনারীর চেয়েও গোলমেলে অবস্হা। যাঁরা বিভিন্ন কলেজে সেসময়ে বাংলা পড়াতেন, তাঁরা কেউই বাংলা ভাষাসাহিত্যে স্নাতকোত্তর ছিলেন না । সায়েন্স কলেজে রমাপতি ঘোষ ছিলেন রসায়নের শিক্ষক, বি এন কলেজে রঙিন হালদার ছিলেন মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক, পাটনা কলেজে ত্রিদিব চৌধুরী ছিলেন ইতিহাসের শিক্ষক । বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের বাংলাভাষা আর সাহিত্য পড়াবার দায়িত্ব এই জন্যে দিয়েছিল যে প্রথমত তাঁরা বাঙালি, এবং দ্বিতীয়ত তাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজের বিষয়টিতে স্নাতকোত্তর । যে বছর আমি বি এন কলেজে ভর্তি হলুম সে-বছর রামমোহন রায় সেমিনারি থেকে বিজয় কর্মকার বাংলার অধ্যাপক হয়ে এলেন। তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা দেয়াতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন, ব্রাহ্ম যুবক-যুবতীদের বিয়ে দেয়া, মাঘোৎসব-পৌষোৎসব তদারকি করা ইত্যাদি । কলেজে দ্বিতীয় বছরে বাংলার অধ্যাপক হয়ে এলেন জীতেন্দ্রনাথ ঘোষ, পণ্ডিচেরিপ্রেমি, যিনি ছাত্রদের জান্তব আস্ফালন দেখে প্রথম থেকেই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, তিনি কতো তাড়াতাড়ি আমাদের চাষাড়ে কলেজ ছেড়ে ভদ্রছেলেদের কলেজে চলে যাবেন তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন । রবীন্দ্রনাথের পর যে তোলপাড় ঘটে গেছে বাংলা কবিতা ও গল্প-উপন্যাসে তার সঙ্গে জীতেন্দ্রনাথ ঘোষ নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। সিলেবাস বানাতেন রমাপতি ঘোষ, রঙীন হালদার, ত্রিদিব চৌধুরী প্রমুখ, যাঁরা তিরিশের কবিদের পছন্দ করতেন না । পুলিশ যখন হাংরি আন্দোলনের কারণে আমাকে গ্রেপ্তার করে তখন জীতেন্দ্রনাথ ঘোষ জনে-জনে বলে বেড়াতেন, “মলয় যে অধঃপতনে যাবে তা জানতাম।”

             বারীন চাকরি পেয়ে গেছে মার্টিন অ্যাণ্ড হ্যারিস নামে জিৎপল-সৎপলদের কোম্পানিতে, তরুণ শূর পেয়ে গেছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে স্নাতক হবার পরেই । অধ্যাপক ত্রিপাঠি, যিনি আমার স্পেশাল পেপারের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন, বললেন পিএইচ ডি করতে, বসে থাকার চেয়ে ভালো, একটা সিনপসিস উনিই তৈরি করে দিয়েছিলেন ; ছেড়ে দিলুম । রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরিটা পেয়ে গেলুম, বেশ সহজেই । কিন্তু চাকরিতে ঢুকেই বুঝলুম প্রচণ্ড চাপের কাজ, যেখানে টাকার পাহাড় গোনা হয়, যেখানে অজস্র খুচরো পয়সা বেলচা দিয়ে থলের ভেতরে ঢুকিয়ে ওজন হয় । তবে চাকরি পেয়ে সুবিধা এই হল যা দাদার পোস্টিঙের শহরে যখন ইচ্ছে চলে যাওয়া যায়, বাবার কাছে টাকা চাইতে হয় না ।

             চাইবাসায় দাদার চালাবাড়িটা ছিল একটা পাহাড়টিলার ওপরে, দেখা যেতো দূরের উপজাতি গ্রামগুলো, চালাবাড়ির সামনে নিচের পথ দিয়ে সার বেঁধে কাঁখে মাটির হাঁড়িতে জল ভরে নিয়ে যাচ্ছে উপজাতি যুবতীরা, রাতের বেলায় উড়ন্ত জোনাকিতে ভুতুড়ে পরিবেশ, শুকনো পাতার গন্ধ, রোরো নদীর জলপ্রবাহের শব্দ, মহুয়া ফুলের ফিকে সুবাস, টিলার ওপর রাখা কেরোসিনের লম্ফও অন্ধকারে হয়ে উঠতো চাঁদের সোডিয়াম ভেপার আলো, দূরে শালের জঙ্গল । একা বসে চিন্তা করার অফুরন্ত অবসর । এখানে আমি আমার পাণ্ডুলিপির গভীর কন্ঠস্বর শুনতে পেতুম । বসে-বসে মনে হতো, গুহানিবাসীরা তো জানতোই না কাকে বলে পঙ্কিলতা আর কাকে বলে বিশুদ্ধতা । ইমলিতলায় দেখেছি গরিব মানুষ ধনীর আনন্দকে ভয় পায়, যেন কোনো বৈভবশালীর বাড়িতে আচমকা ঢুকে পড়েছে ; তাদের কাছে আনন্দ বলতে ছিল সমাজ-বহির্ভূত হওয়ার আহ্লাদ । আসলে যারা বিপথগমণের কথা বলে তারা সঠিক পথের হদিশ দিতে পারে না । নিমডির টিলায় রাতের অন্ধকারে বসে আমি উপভোগ করতুম পেরুর মাচু পিচু, রোমের কলোসিয়াম, আথেন্সের পারথেনন, নালান্দার ধ্বংসাবশেষের আ্হ্লাদ ।

             দাদার সঙ্গে, দাদার বিয়ের কয়েক বছর আগে থেকেই, ভারতবর্ষ আর পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতুম, নেহেরুর সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে, পশ্চিমবাংলার ডামাডোল নিয়ে। তখন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কৃষিসেচ পথঘাট নির্মাণ ছোটো আর মাঝারি ইনডাস্ট্রি থেকে সরে গিয়ে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শুরু হয়েছে অনেকটা বোম্বাই মডেলের দিকে, বড়ো ইনডাস্ট্রির দিকে, সমাজসেবার খাতে কমিয়ে দেয়া হয়েছে খরচ এদিকে কৃষি এলাকায় ব্যর্থতা আর খরার জন্য খাবার জিনিসের দাম চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে বড়ো ইনডাস্ট্রিগুলো ওপড়াতে আরম্ভ করেছে উপজাতিদের । উত্তরঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের ভয়াবহ ছবি গড়ে উঠছিল আমাদের সামনে । কলকাতা থেকে দাদার যে বন্ধুবান্ধব চাইবাসায় দাদার বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসতো তারা সকলেই ছিল ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ মানসিকতার যুবক যা পরে জেনেছি বুদ্ধদেব বসুর কবিতাভবনের ফসল, স্হিতাবস্হাপন্হী । তাঁদের অনেকের সঙ্গেই মতের মিল হতো না আমার ।

             সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, দীপক মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী প্রমুখের সঙ্গে দাদার মাধ্যমে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল আমার । শংকর চট্টোপাধ্যায় কালো ট্রাউজার আর কালো শার্টে মনে হতো জেমস বণ্ড টাইপের মানুষ । উৎপলকুমার বসুকে মনে হতো কর্পোরেট বোর্ডের সদস্য টাইপের । অরণ্যের দিনরাত্রী ফিল্মে রবি ঘোষ তারাপদ রায়ের ভূমিকায়, আমারও তাই মনে হয়েছে, রবি ঘোষের চরিত্র টাইপের । হাংরি আন্দোলনে গ্রেপ্তার হবার আগে একমাত্র শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় একটা পোস্টকার্ড লিখে আভাস দিয়েছিলেন যে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আরম্ভ হয়েছে ।

             শক্তি চট্টোপাধ্যায় তর্কে অংশ নিতেন না নিজের ‘কুয়োতলা’ উপন্যাস নিয়ে ব্যস্ত । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার ডায়েরির কবিতাগুলো সম্পর্কে পজিটিভ রেসপন্স দিলেন বলে দাদা কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে ওনাকে কৃত্তিবাস পত্রিকার জন্য কবিতা দিলেন, সেগুলো ১৯৫৯ সালে ছাপা হয়েছিল । আমি প্রচলিত কবিতার মতো লিখতে চাইছিলুম না, গতি আনতে চাইছিলুম, পরে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে পাঠিয়েছিলুম, বইয়ের নাম রেখেছিলুম “শয়তানের মুখ’ ওনার পছন্দ হয়নি, আসলে কনভেন্ট স্কুলের স্যাটান থেকে গিয়েছিল আমার মগজে, আসেপাশে লোকেদের দেখে আমার মনে হতো তারা শয়তানের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। আমি ঔপনিবেশিক নন্দন-বাস্তবতা থেকে, মানে কলোনিয়াল ইসথেটিক রেজিম থেকে, বেরোতে চাইছিলুম ।

             “মার্কসবাদের উত্তরাধিকার” নামে যে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলুম, সেটা শক্তি চট্টোপাধ্যায় পাটনায় এলে ওনাকে দিয়েছিলুম আর টাকাও দিয়েছিলুম বইটা ছাপাবার জন্য । বইটার প্রূফ না দেখে উনি মাত্র কয়েক কপি বের করেছিলেন, দেখে আমার মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছিল, আর ওনার উল্টোডাঙার বস্তিবাড়ির সামনে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলুম । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দাদাকে বলেছিলেন, তুই আমাকে দিলেই পারতিস, শক্তির চরিত্র তো তুই ভালো করেই জানিস । “শয়তানের মুখ” কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে বের করার জন্য রেখে নিলেন উনি, বললেন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দেবেন । “শয়তানের মুখ” বেরোবার পর উনি আমার বিরুদ্ধতা আরম্ভ করলেন, কেননা তখন হাংরি আন্দোলনের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র ।

             দাদা আর আমি বুঝতে পারছিলুম যে কলকাতায় আমাদের পরিচিতি নেই বলে দাদার এই বন্ধুদের ওপর নির্ভর করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী খোলাখুলি প্রকাশ করা কঠিন, তাই নিজস্ব মুখপত্র দরকার । এরা সবাই আখের নিয়ে চিন্তিত, খ্যাতির জন্য লালায়িত, পরস্পরের বিরোধিতা করতে চায় না, বিতর্ক এড়িয়ে ভাই-ভাই ক্লাব গড়ে তোলে । একজন ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, আরেকজন করে না, তবু তর্ক করে না ।

             উত্তরঔপনিবেশিক ভারতে সময়ের তুলনায় স্হানিকতা যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, ঔপনিবেশিক ইংল্যাণ্ডের পোঁ-ধরে থাকলে চলবে না, ভারতের সমাজের দিকে তাকিয়ে গড়তে হবে একটা গতিময় আন্দোলন, তা আমরা দু-জনে টের পাচ্ছিলুম, কিন্তু কলকাতায় আমাদের ঘাঁটি দরকার । দাদা শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে রাজি করাতে পারলেন, সম্ভবত তখন শক্তি চট্টোপাধ্যায় দাদার যে কোনো প্রস্তাবেই রাজি হয়ে যেতেন কেননা উনি দাদার শালি শীলার সঙ্গে গভীর প্রেমে পড়েছিলেন আর দাদার চাইবাসার বাড়িতেই থাকতেন, দাদা ট্যুরে গেলে দাদার শশুরবাড়িতে গিয়ে থাকতেন । একবার সুনীল-সন্দীপন চাইবাসায় শক্তির খোঁজে এসে দাদার শশুরবাড়িতে উনি ঘাঁটি গেড়েছেন দেখে বলে ওঠেন, “কিরে শালা, এখানে ইস্টিশান পুঁতে ফেলেছিস?”

             ১৯৬০ সালে একটি লিটল ম্যাগাজিনে আমি হারাধন ধাড়া নামে একজন তরুণ লেখকের নাম-ঠিকানা পেলুম আর মনে হল এই নামটির একটি নিজস্ব প্রতিভা আছে, এই ধরণের নামের কবি বা লেখক এখনও স্বীকৃতি পান না । ১৯৬১ সালে তাঁর হাওড়ার বাড়িতে, যা বস্তিবাড়ি ছিল, গিয়ে ডেকে আনলুম পাটনায় । দাদাও শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে ডেকে আনল পাটনায় । আমাদের চারজনের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় তুলনামূলকভাবে কলকাতায় বেশি পরিচিত । আমি আর দেবী রায় তো একেবারেই অখ্যাত ছিলুম ।

             “ইতিহাসের দর্শন” আর “মার্কসবাদের উত্তরাধিকার” লেখার সময়ে আমি অসওয়াল্ড স্পেংলারের দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলুম । ততো দিনে স্তালিনের অত্যাচারের ঘটনাগুলো আশঙ্কা তৈরি করে ফেলেছে। চিনের সিংকিয়াং আর তিব্বত দখলও মার্কসবাদ সম্পর্কে সন্দেহের কারণ হয়ে উঠেছে । হাংরি আন্দোলন চলাকালীনই চীন ভারত আক্রমণ করে বসল, তাও বিভ্রান্ত করার জন্য ছিল যথেষ্ট । কলকাতায় তখন চীনকে সমর্থন করে মার্কসবাদীদের লেখালিখির চল, এখন তারা অনেকেই করে-কম্মে নিয়েছে, মার্কসবাদ গেছে চুলোয়, সকলেই বুঝে গেছে যে “প্রগতি” হল সবার চেয়ে ভূয়ো তত্ত্ব । প্রথমে দলের দুটো টুকরো হল, তারপর অজস্র ভাগাভাগিতে জড়িয়ে পড়ল, বোঝা গেল না যে একই স্বপ্নের এতোগুলো ন্যারেটিভ কেন । “ইতিহাসের দর্শন” লেখাটার ফাইল-কপি কলকাতা পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করতে এসে “রাষ্ট্রবিরোধী” রচনা মনে করে বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে গিয়েছিল, কেননা আমার বিরুদ্ধে ১২০ ( বি ) ধারাতেও এফআইআর ছিল । এই ধারাটা যোগ করা হয়েছিল কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়ার সুবিধার জন্য ।

             আমার বাবা নেহেরু আর গান্ধীকে পছন্দ করতেন না । তার রেশ শৈশব থেকে চুয়ে আমার মধ্যেও ঢুকে গিয়েছিল । খ্যাতিমানদের সন্দেহ করার বীজ বাবা পুঁতে দিতে সফল হয়েছিলেন আমার আর দাদার মনে । এমনকি যারা সোভিয়েত দেশে সোভিয়েত টাকায় গিয়েছিল, সে তারা যতোই নামকরা কবি-লেখক-নেতা  হোক, সন্দেহ থেকে তাদের বাদ দিতে পারিনি । তারা যে “আশাবাদ”-এর বুকনি কপচাতো তাকে মনে হতো বই-পড়া মুখস্হ বুলি ।

             দাদার সঙ্গে আলোচনা করেছিলুম স্পেংলারের দর্শন নিয়ে আর আন্দোলনের নামকরণ নিয়ে চিন্তা করছিলুম । স্নাতকস্তরে ইংরেজি কোর্সে জিওফ্রে চসার ছিলেন, তাঁর একটা লাইন বেশ স্ট্রাইক করেছিল, “ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম” । হারাধন ধাড়া আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় রাজি হলেন যে আমাদের আন্দোলনের নাম রাখা হোক “হাংরি জেনারেশন “ বা “হাংরি আন্দোলন” । ঠিক হল আমি আর দাদা খরচ দেবো, হারাধন ধাড়ার বাড়ির ঠিকানা দেয়া থাকবে যাতে আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারেন । ঠিক হল এক পাতার বুলেটিন প্রকাশ করা হবে । বিলি করবে হারাধন ধাড়া, বিক্রি করা হবে না । শক্তি চট্টোপাধ্যায় বললেন, সুনীলকে আপাতত জানাবার দরকার নেই, উনি আঁচ করে নিয়েছিলেন যে আমার মতামতের সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরোধ অনিবার্য, তা এড়াতে চাইছিলেন । বর্ষাকালে নদীরা যুবক হয়ে ওঠে, আর কোনো-কোনো লোক বৃষ্টি-বাদলার ভয়ে বুড়িয়ে যায় । কেবল মধ্যবিত্তরাই কেন কবিতা লেখে !

     চব্বিশ

             স্পেংলার বলেছিলেন যে একটি সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়; তা হল জৈব-প্রক্রিয়া এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না । যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে । কিন্তু ঠিক সেই সময় থেকে একটি সংস্কৃতির অবসান আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন । আমার মনে হয়েছিল, দেশভাগের পর এবং ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় । বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতিতে একটা হ্যাঁচকা-টানের আন্দোলন জরুরি ।

             “ইতিহাসের দর্শন” লেখার সময়ে এডওয়ার্ড গিবনের ‘দি হিসট্রি অফ দি ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অফ দি রোমান এমপায়ার’ বইয়ের এই কথাগুলো বেশ স্ট্রাইক করেছিল, যদিও তিনি রোম সাম্রাজ্যের পতনের কারণ দর্শিয়েছিলেন, কিন্তু কথাগুলো আমাদের সমাজের ক্ষেত্রেও লাগসই । সেগুলো হল,  এক ) সম্পদ বৃদ্ধির বদলে বৈভব প্রদর্শনের আদিখ্যেতা ; দুই ) যৌনতার বিকৃতি আর অবসেশন ; তিন ) আর্ট ব্যাপারটা আকস্মিক হয়ে ওঠে, মন ভোলাবার চেষ্টা, সৃজনশীলতার দিকে দৃষ্টি দেয় না কেউ ; চার ) ধনী আর গরীবের মধ্যে অসেতুসম্ভব পার্থক্য ; এবং পাঁচ ) রাষ্ট্রকে চুষে জোঁকের মতন লিপ্টে থাকার নেশা ।

             স্পেংলারের এই ভাবনা নিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৬২ সালে, বিনয় মজুমদারের বই “সম্প্রতি” পত্রিকায় রিভিউ করার সময়ে “ক্ষুৎকাতর আক্রমণ” নামে একটা প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, কিন্তু তার আগেই দাদা সমীর রায়চৌধুরী ওই একই শিরোনামে অতুল্য ঘোষের পত্রিকা “জনসেবক”-এ একটা নিবন্ধ লিখেছিলেন, “জনসেবক” সংবাদপত্রের রবিবারে পাতার সম্পাদক ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ; দাদার এই নিবন্ধটা পরে হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল । শৈলেশ্বর ঘোষ, মুচলেকা দিয়ে রাজসাক্ষী হবার পর নানা জায়গায় লিখে বেড়িয়েছিল যে আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আইডিয়া চুরি করে হাংরি আন্দোলনের তত্ত্ব গড়েছি । পরে বকাসুর চেহারার সব্যসাচী সেন নামে এক পাতিবুর্জোয়া ছোকরা , শৈলেশ্বরের শিষ্য, নানা পত্রিকায় এই ধুয়ো গে্য়ে চলেছে । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পড়াশুনা নিয়ে এনাদের জ্ঞান সম্পর্কে আমার বলার কিছু নেই, কেননা স্পেংলার সম্পর্কে এনাদের এলেম যে ইশকুল মাস্টারের পার্টিকর্মী হয়ে ওঠার চৌহদ্দিতে আটক তা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ওলোটপালোট থেকে টের পাওয়া যায় ।

             এখানে বলার যে ইউরোপের সাহিত্য আর ছবি আঁকার আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক বনেদের ওপর, অর্থাৎ আন্দোলনগুলো ছিল টাইম-স্পেসিফিক বা সময়কেন্দ্রিক । কল্লোল গোষ্ঠী এবং কৃত্তিবাস গোষ্ঠী তাঁদের ডিসকোর্সে যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলোও ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক নন্দন-বাস্তবতার চৌহদ্দির ভেতরে, কেননা সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্হনা-নির্ভর, এবং তাদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত । সমায়ানুক্রমী ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে, তার সন্দর্ভগুলো পুর্বপুরুষদের তুলনায় নিজেদের উন্নত মনে করে, এবং স্হানিকতা ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে । যে কারণে হারাধন ধাড়ারা গ্রাহ্য হন না, তাঁদের এফিডেভিট করে দেবী রায় হতে হয় ।

             পাটনায় বাংলা প্রেসগুলো কেবল বিয়ে, অন্নপ্রাশন, পৈতে আর শ্রাদ্ধর কার্ড ছাড়া আর কিছু ছাপত না, আমার লেখা প্রথম বাংলা ম্যানিফেস্টো পাটনায় ছাপানো যাচ্ছে না দেখে আমি ইংরেজিতে একটা কবিতার ম্যানিফেস্টো লিখে ছাপালুম ১৯৬১ সালের নভেম্বরে আর তাড়া বেঁধে পাঠিয়ে দিলুম হারাধন ধাড়ার হাওড়ার বস্তিবাড়ির ঠিকানায় । নিজেও কয়েকজনকে ডাকে পাঠালুম । কলকাতায় বিলি করা মাত্রই হইচই আরম্ভ হল, যাকে বলা যায় আশাতীত প্রতিক্রিয়া ।

             প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি আন্দোলন চেষ্টা করল “সময়তাড়িত চিন্তাতন্ত্র” থেকে সম্পূর্ণ আলাদা “পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্র” গড়ে তুলতে । সমায়ানুক্রমী ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে-মননসন্ত্রাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মধ্যে ইতিহাসগত স্হানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় । গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ । ঠিক এই কারণেই, ইউরোপীয় সাহিত্য আর ছবি আঁকার আন্দোলনগুলো খতিয়ে যাচাই করলে দেখা যাবে যে ব্যক্তিপপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো । কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখব যে পুঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে সমসাময়িক শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন ; কতো লজ্জার যে অলোক সরকার সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেলেন এখন ২০১৬ সালে ! প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীও সীমিত হয়ে গেছে দু-তিনজন মেধাস্বত্ত্বাধিকারীর নামে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর কৃত্তিবাসের ব্রাণ্ড নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি ওই পুঁজি আর দাপটের ভাগবাঁটোয়ারার ঝগড়া ।

             প্রথম বুলেটিন থেকেই তখনকার প্রাতিষ্ঠানিক সন্দর্ভের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রতিসন্দর্ভের সংঘাত আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল এবং তার মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রতিটি বুলেটিন, স্টেনসিল-করা ড্রইং, পোস্টার, কোলাঝ, কার্ড, মুখোশ বিলি করার পর-পরই, যা আমি জানতে পারি বহু পরে, কাউনসিল ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর সচিব এ বি শাহ, পি ই এন ইনডিয়ার অধ্যক্ষ নিসিম এজেকিয়েল, এশিয়া সোসায়টির বনি ক্রাউন, ইলাসট্রেটেড উইকলির সম্পাদক খুশওয়ন্ত সিং, এবং ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা পুপুল জয়াকরের কাছ থেকে । আমার বিরুদ্ধে আবু সয়ীদ আইয়ুব যে ভীষণ খাপ্পা তা এ বি শাহ জানিয়েছিলেন, তাই দেখা করতে গিয়েছিলুম সয়ীদ সায়েবের সঙ্গে ; উনি এমন ভান করলেন যেন কিছুই জানেন না, এদিকে ওনার কাছে তখন অ্যালেন গিন্সবার্গের লেখা চিঠি একের পর এক পৌঁছে গেছে, যা ওনার মেজাজ আরও বিগড়ে দিয়েছিল। অ্যালেন গিন্সবার্গকে ৩১ অক্টোবর ১৯৬৪ যখন আবু সয়ীদ আইয়ুব এই চিঠিটি লিখছেন তখন লালবাজার পুলিশ সাক্ষাীসাবুদ যোগাড় আর মামলা সাজানোয় ব্যস্ত :

    Dear Mr. Ginsberg,

             I am amazed to get your pointlessly discourteous letter of 13th. That you agree with the communist characterization of the Congress For Cultural Freedom as a fraud and bullshit intellectual liberal anti-communist syndicate, did not, however, surprise me ; for I never thought the Congress had any chance of escaping your contempt of everything ‘Bourgeois’ or ‘respectable’.

             If any Indian litteratur or intellectual come under police repression for their literary or intellectual work, I am sure the Indian Committee For Cultural Freedom would move in the matter without any ungraceful prompting from you. I am glad to tell you that no repression of that kind has taken place here currently. Malay Roychoudhury and his young friends of the Hungry Generation have not produced any worthwhile work to my knowledge, though they have produced and distributed a lot of self advertising leaflets and printed letters abusing distinguished persons in filthy and obscene language ( I hope you agree that the word “fuck” is obscene and “bastard” filthy at least in the sentence “Fuck the bastards of the Gangshalik School of poetry”, they have used worse language in regard to poets whom they have not hesitated to refer to by name ). Recently they hired a woman to exhibit her bosom in public and invited a lot of people including myself to witness this wonderful avant garde exhibition. You may think it as your duty to promote in the name of cultural freedom such adolescent pranks in Calcutta from halfway around the world. You would permit me to differ from you in regard to what is my duty.

             It was of course foolish of the police to play into the hands of these young men and hold a few of them in custody for a few days ( they have all been released now ) thus giving the publicity and public sympathy — publicity is precisely what they want to gain through their pranks.

             I do not agree with you that it is the prime task of the Indian Committee For Cultural Freedom to take up the cause of these immature imitators of American Beat Poetry. I respect your knowledge of European literature but can not permit myself to be guided by your estimation of writers in my language — a language of which you choose to remain totally ignorant.

             With all good wishes in spite of your grave disagreements and in admiration of some of your wonderful poems.

    Yours Sincerely

    Abu Sayeed Ayyub

                 জবাবে অ্যালেন গিন্সবার্গের ৬ই অক্টোবর ১৯৬৪-এর চিঠিখানায় চোখ বোলান এবং আবু সয়ীদ আর অ্যালেনের চিন্তাপার্থক্য থেকে আঁচ করুন বাংলা সাহিত্য কেন ইউরোপের সাহিত্যকে টক্কর দিতে পারেনি রবীন্দ্রনাথের পর থেকে। আবু সয়ীদ আইয়ুবকে মিথ্যাবাদীও বলা চলে কেননা প্রথমত কারোর বিরুদ্ধেই মামলা তুলে নেয়নি পুলিশ তখনও পর্যন্ত, এবং দ্বিতীয়ত, কোনো নারীর টপলেস প্রদর্শনী করা হয়নি, টপলেস অর্থে মস্তিষ্কহীন কথাটা তাঁকে স্ট্রাইক করেনি সম্ভবত । বলা বাহুল্য আবু সয়ীদ, গিন্সবার্গের চিঠি পাবার পরও কুটোটি নাড়েননি, নাড়বেন কি করে যখন উনি নিজেই একজন নালিশকারী । তবে এটা ফাঁস হয়ে যায় যে আবুসয়ীদ আইয়ুব সায়েবদের কমিটির পত্রিকা ‘কোয়েস্ট’ আমেরিকার সিআইএর টাকা খায়, আর বদনাম হবার ফলে মামলার কাছাকাছি পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায় ।

    Dear Mr Sayeed,

             Obviously my note to you was stupidly peremptory or short witted and am sorry it got your goat, possibly or probably I deserve to be put down for the irritant discourtesy of my writing & the presumption in it, telling you what to do, etc. butting in where it is not my affair and possibly ignorant of the quality of the texts. And chiding a senior. For which I do wish to apologize, offering as excuse that I wrote in great haste — many letters on the same subject the same afternoon — and that the situation that I understand it is a little more threatening to the young scribes than you understand to be. May be it is settled a lot after I wrote. But from what I understood, from letters from Malay as well as Sunil Ganguly & Utpal Basu ( and the latter two seemed to be mature in judgement ) ( Malay I like as a person & do actually admire the liveliness of his englished manifestos — to my mind a livelier prose wit than any other Indian English writing ) ( tho I realise he is inexperienced & impetuous and part of the charm is the naivete of the manifestos, or better, innocence in them. ( this simply being a matter of gut taste preference intuition & certainly not the sort of literary matter to be settled by police action ) : the police situation at one time was that not only Malay but his brother Samir ( an excellent young philosopher ) as well as Debi Roy as well as two boys I never met Saileswar & Subhash Ghose were all arrested. Then let out on bail. In addition a general police investigation, and according to Utpal, “Those arrested are already suspended from their jobs & if they are convicted they may lose it.” Further Ananda Bazar Patrika, Jugantar, Janata and other Bengali papers fanned the fire against “obscene literary conspiracy.” Simultaneously the Supreme Court judgement of ‘Lady Catterley’ as obscene also, has, according to a clipping I read from Times of India “led many people to complain about the lewdness in the writings of many Bengali poets and novelists. Says Basu, “impossible to get another job if one is lost.” The arrested five were tied and locked up for one or two days each. Utpal Basu was detained by police and questioned for five hours. I understand also that Sunil was questioned by police. As far as I know it is still not decided whether or not the police will actually prosecute, and that decision will depend on the support given to the younger writers by older established writers and Cultural groups like Congress ( for Cultural Freedom ). Everyone I hear from has said the Congress has not spoken up in any way. All told, the situation, whether or not one approves of the literary quality of the texts, is much more threatening than I would gather from your letter. My own experience of the bureaucratic complications of police investigations in India — it’s endless and Kafkian grimness — led me to a much less light hearted view of the matter than yourself. As you may remember I was followed for months in Benares, visited by the police, threatened by Marxists, given a ten day quit India notice on vague charges of distributing obscene literature & corrupting the young. It took intervention by friends in Home Ministry in Delhi & a letter from Indian Consulate in NY to begin to straighten it out. So I have no confidence that a dismal legal process on literary matters once started, is so easily to be dismissed. Particularly where young apolitical inexperienced enthusiasts are concerned.

             I don’t agree with you at all in your evaluation as obscene and filthy the sentence “Fack the bastards of the Gangshalik school of Poetry.” Not that I even know which school that is. But it’s common literary parlance both in speech and published texts from cafes of Paris or Calcutta to old manifestos by Tristan Tzara. The style, the impetuousness, the slight edge of silly ill-will, the style of “Burn the libraries”, an old charming XX century literary cry. I don’t really feel very “shocked” to hear that they let a lady show people her breasts in public. Do you seriously find that offensive ? I suppose it’s a little bit against the law — of course they had a woman completely naked on the balcony last year of the Edinburgh Festival — brightest moment of the Fete I hear tell — Yes certainly I do approve. However, I didn’t think myself nor “promote” it from halfway around the world. And I don’t really think that mere publicity is the deepest motive one can find in such typical Dada actions. In that I think you are really doing them an injustice, however low you grade their literary productions. Because after all there is considerable difference of opinion, as to the literary quality. Ferlinghetti, who does not know these writers is publishing a self-translated section of writings by Malay, Sunil & Basu in his City Lights Journal. The texts were collected by Mrs Bonnie Crown of the Asia Society, who found them as interesting as any translated texts she had been able to collect. The magazine “Kulchur” here — which has considerable avantgarde circulation — also reprinted three of the Manifestos in question ( on prose, poetry and politics ) earlier this year. This is independent of my correspondence with anyone.

             In sum, what I do know of translation of the poetry & manifestos of Malay & the other poets arrested or questioned by the police, was pleasing. So, despite half a world difference, and acknowledging your greater familiarity with the literature, I must claim my prerogative as poet and  also as critic ( since I edited and acted as agent here for such unpublished writers as Kerouac & Burroughs & Artaud as well as several differing schools of US poetry ) to stand by my intuition and say I do definitely see signs of modern life well expressed in their works. Not claiming they are geniuses or even great — simply that in certain precise areas dissatisfaction with their society, they do well reflect their thoughts, and reflect uniquely — their other contemporaries & seniors being more interested in classical piety or sociological “mature” formulations, Marxism Humanism etc. I don’t think it would be correct to term them Beatnick much less Beatnick imitators, since that’s primarily a journalistic stereotype that never even fit the US supposed “Beatnicks”.

             Regarding the Congress ( for Cultural Freedom ) I stand by my fear that it is 1) possibly supported by Foundation funds connected with US government, 2) Less alert to dangers of suppression within the Western world and allies than within the Iron Curtain. In the US we have been all these years undergoing a siege of legal battles over stage works, books, movies, poetry etc. which has nearly crippled the public activity of Avangarde. I contacted the US Committee head Mr A. Beichman who said himself, the Congress is only a skeleton group in the US now inactive. And this year I had to contact John Hunt from NY to move the Congress to defend Olympia Press in Paris. There is a lag. My criticism was more just than you will allow, the overstated.

                OK Best of Conscience —- Allen

                 অমনধারা সংঘাত ইতোপূর্বে ঘটেছিল পশ্চিমবাংলার সংস্কৃতিতে । ইংরেজরা সময়কেন্দ্রিক মননবৃত্তি আনার পর প্রাগাধুনিক পরিসরমূলক বা স্হানিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাঙালি ভাবুকের জীবনে ও তার পাঠবস্তুতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি আর ছটফটানি, রচনার আদল-আদরায় পরিবর্তনসহ, দেখা দিয়েছিল, যেমন ইয়ং বেঙ্গল সদস্যদের ক্ষেত্রে, এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও আরও অনেকের ক্ষেত্রে । একইভাবে হাংরি আন্দোলন যখন সময়কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক চিন্তাতন্ত্র থেকে ছিঁড়ে আলাদা হলো, উত্তরঔপনিবেশিক আমলে আবার স্হানিকতার চিন্তাতন্তন্ত্রে ফিরে যাবার চেষ্টা করলো, তখন হাংরি আন্দোলনকারীদের জীবনে, কার্যকলাপে ও পাঠবস্তুর আদল-আদরায় অনুরূপ ঝাঁকুনি, ছটফটানি ও সমসাময়িক নন্দনকাঠামো থেকে নিষ্কৃতির প্রয়াস দেখা দিলো । তা নাহলে আমি সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতি, ধর্ম, উদ্দেশ্য, স্বাধীনতা, দর্শনভাবনা, ছবি-আঁকা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে ইস্তাহার প্রকাশ করব কেন !

    পঁচিশ

             হাংরি মামলার আগে থেকেই পত্র-পত্রিকায় আমাদের, বিশেষ করে আমাকে, লক্ষ্য করে নানা মন্তব্য, চুটকি, সংবাদ, কার্টুন বেরোতে আরম্ভ করেছিল, যুগান্তর, অমৃত, দর্পণ, জনতা, চতুষ্কোণ, আনন্দবাজার, স্টেটসম্যান ইত্যাদি । যাঁরা ওগুলো লিখেছিলেন, এখন বুঝতে পারি, তাঁদের পড়াশুনা তেমন ছিল না, বেশির ভাগই হাফলিটারেট সাংবাদিক যারা নিজেদের সবজান্তা মনে করে । বঙ্গসংস্কৃতিকে যে আক্রমণ করা হচ্ছে, এটুকু বুঝে উঠতে পারেননি এনারা ।

             ‘দর্পণ’ পত্রিকায় গৌরকিশোর ঘোষেরও অংশীদারি ছিল শুনে ওনার সঙ্গে একটা ফয়সালা করতে গেলে, উনি ওনার বরানগরের বাড়িতে লুচি আলুরদম সহযোগে তর্কাতর্কির আহ্বান জানালেন । খবর দিয়ে গেলুম একদিন সকালে, আমি ত্রিদিব করুণা অনিল । ‘দর্পণ’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল যে আমাদের আন্দোলন বিদেশিচিন্তায় প্রভাবিত । ত্রিদিব করুণা অনিল তর্ক করে গেল সুররিয়ালিজমের প্রভাব, সনেট রচনা, কবিতা আর উপন্যাসের ফর্ম, চিত্রকল্প ইত্যাদি । আমি ওই তর্কে না গিয়ে কেবল আলুর দমের আলুর প্রশংসা করে গেলুম । কিছুক্ষণ পরে উনি বুঝতে পারলেন যে কোন দিকে তর্কটা নিয়ে যাচ্ছি, কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভালো চাল দিয়েছো, এবার তোমাদের একদিন লাঞ্চ খাওয়াবো । আমি বললুম, হ্যাঁ দাদা, আলু আমাদের দেশের নয়, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আয়ারল্যাণ্ড গিয়ে সেখান থেকে ভারতে এসেছে বেশিদিন হয়নি, ওয়ারেন হেসটিংস প্রথম চাষ আরম্ভ করেছিলেন নৈনিতালে আর এখন তো আলু ছাড়া বাঙালির কোনো রান্না হয় না, আলুপোস্তও এই সেদিনকার।

             ‘জনতা’ পত্রিকার দপতরে গিয়েছিলুম একটা হেস্তনেস্ত করার জন্যে, কেননা ওই পত্রিকায় প্রথম পাতায় কয়েক সপ্তাহ জুড়ে “পুলিশের নাকের ডগায় হাংরিরা এই করছে ওই করছে” লিখে-লিখে তাতানো হচ্ছিল । ওদের দপতরে তখন ছাপার কাজ তদারক করছিল পেটমোটা একজন মধ্যবয়সী, তাকে বললুম যে সম্পাদক বা মালিকের সঙ্গে দেখা করতে চাই, আমার নাম মলয় রায়চৌধুরী । উনি বললেন, দাঁড়ান ডেকে দিচ্ছি, বলে চলে গেলেন । প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষার পরও উনি না আসায় প্রেসের এক কমপোজিটারকে জিগ্যেস করলুম, সম্পাদক কোথায় বসেন । সে বলল, উনিই তো সম্পাদক, আপনাদের দেখেই পালিয়েছেন ।

             হাংরি আন্দোলনের কাউন্টার ডিসকোর্সের সঙ্গে তখনকার আধিপত্যবাদী ডিসকোর্সের সংঘাত গুরুতর হয়ে উঠেছিল ১৯৬৩ থেকে, যখন আমরা “হাংরি জেনারেশনের পক্ষ থেকে” “দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন” ছাপানো কাগজের মুখোশ, রাক্ষস, জোকার, জন্তু-জানোয়ার, মিকিমাউস, দেবতা ইত্যাদির, পাঠালুম বা বাড়িতে চিঠির বাক্সে ফেলে এলুম, মুখ্য ও অন্যান্য মন্ত্রীদের,  মুখ্য ও অন্যান্য সচিবদের, জেলা শাসকদের, সংবাদপত্র মালিক ও সম্পাদকদের, বাণিজ্যিক লেখকদের, তখন বঙ্গসমাজের উচ্চবর্গীয় “সংস্কৃতিমান” অধিপতিরা আসরে নামলেন । এর পর তাঁদের মাথায় বোমা ফাটল যখন বিয়ের কার্ড পোঁছোলো তাঁদের ঠিকানায়, কোনায় হলুদ মাখানো, কার্ডে লেখা “ফাক দি বাস্টার্ডস অফ গাঙশালিক স্কুল অফ পোয়েট্রি” । যাঁদের পাঠানো হয়েছিল তাঁরা অনেকেই ভেবেছিলেন যে তাঁরাই গাঙশালিক স্কুল অফ পোয়েট্রির কবি বা ফেলোট্র্যাভেলার । মুখোশের আর কার্ডের আইডিয়া আর খরচ আমার, সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ কফিহাউসে আগেই গেয়ে রেখেছিল । এখন অনেকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী তকমা দিয়ে আনন্দ পান, তাঁরা মন্ত্রী-আমলাদের অমন মুখোশ পাঠিয়ে দেখান না একটু । যাকগে, মুখোশ আর কার্ডের আইডিয়া আর খরচ আমার শুনে খচে বোম হয়ে গিয়েছিলেন, কে জানেন, সেই নিরীহ লোকটি, যাঁর নাম আবু সয়ীদ আইয়ুব । পুলিশ কমিশনার আমাকে আর আমার বাবাকে বলেছিলেন যে কলকাতার দুজন লোক জোর দিয়েছেন যাতে আমার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেয়া হয়, তাঁরা হলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব আর সন্তোষকুমার ঘোষ ।

             অফিসের কাজে ১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি থাকতে হয়েছিল কলকাতায় মাসতিনেক, ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটের গেস্ট-হাউসে, বিকেলে যেতুম কফিহাউসে আড্ডা দিতে, তখনই, ১৯৬৩ সালে, সুভাষ আর শৈলেশ্বরের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় । বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ১৯৬২ সালে ।গেস্ট হাউসে থাকার দরুণ পুরো মাইনেটাই বেঁচে যেতো আর তা হাংরি বুলেটিন ইত্যাদি ছাপানোর কাজে লাগাতুম । ছুটিছাটায় যেতুম হিন্দি কবি-লেখক রাজকমল চৌধুরীর কাগজের অফিসে, হ্যাশিশ ফুঁকতে, রাজকমল পাশাপাশি বাংলা উপন্যাসও অনুবাদ করে রোজগার করতো, তার কারণ ওর বাবা যে মেয়েটার সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়েছিল তার আত্মীয়ের প্রেমে পড়ে দুটো এসট্যাবলিশমেন্ট চালাতে হচ্ছিল ওকে। অমন একদিন হ্যাশিশ ফুঁকে ট্রামে চেপে গড়িয়াহাটে নেমে সামনেই দেখি আমার প্রথমম প্রেমিকা, কাঁথাস্টিচ শাড়িতে, আমাকে দেখে চমকে সামলে নিয়ে এগিয়ে এলো । জানালো একজন স্মাগলারকে বিয়ে করেছে ; প্রথমে বলল ওর আস্তানা যাদবপুরে এইটবি বাস স্ট্যাণ্ডের পেছনে, তারপর ট্যাক্সি ডেকে ড্রাইভারটাকে বলল নিউ আলিপুর যেতে । গেলুম । রাতভর থাকলুম । স্মাগলিঙের সোনার বিসকুট দেখলুম। বিদেশী হুইস্কি খেলুম । একসঙ্গে শুলুম, কিন্তু আমার লিঙ্গ দাঁড়ালো না, অশেষ ভাগ্য, অশেষ ভাগ্য, ঠিক সময়ে লিঙ্গের প্রত্যাখ্যান । প্রেমিকার খেতাব পেলুম “এরেকটাইল ডিসফাংশানের প্রেমিক।”

             গেস্ট হাউসে থাকার দরুণ যে টাকা জমছিল, তাই দিয়ে মুখোশ কিনে, ছাপিয়ে, বিলি করা হল, পাঠানো হলো । বিয়ের কার্ডে “ফাক দি বাস্টার্ডস অফ গাঙশালিক স্কুল অফ পোয়েট্রি” ছাপিয়ে পাঠৈআনো হলো । যে লেখাগুলো জড়ো করেছিলুম সেগুলো একত্রিত করে হাংরি বুলেটিন প্রকাশিত হল, আমি কলকাতা ছাড়ার পর, প্রদীপ চৌধুরী ছাপিয়েছিল ওর চেনা প্রেসে, উডকাট দিয়ে প্রচ্ছদ তৈরি করে দিয়েছিল সুবিমল বসাক, পিসেমশায়ের বাড়ির ঠিকানায় দাদাকে প্রকাশক করে । যেমন বিনে পয়সায় বিলোনো হয়, তেমনই বিলোনো হল । কলকাতায় কার্পেট বমিং আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, এলিট কবি-লেখকদের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত শেয়ালজ্ঞানী ঠেকগুলোয় রীতিমতো হল্লাবোল।

             “যুগান্তর” সংবাদপত্রে ১৭ই জুলাই ১৯৬৪ “সাহিত্যে বিটলেমি” শিরোনামে একটা খবর বেরোয়, তাতে স্টাফ রিপোর্টার স্পষ্টভাবে পুলিশকে ওসকাতে চেয়েছিলেন । আমি যুগান্তর দপতরে গিয়েছিলুম ওই সাংবাদিকের খোঁজে, কিন্তু কেউই বলতে চাননি যে বানানো খবরটা কার লেখা । পরে কৃষ্ণ ধর পরপর দু’দিন প্রধান সম্পাদকীয় লিখেছিলেন হাংরি আন্দোলনের সমর্থনে । ওনাকে আমি বলেছিলুম, যদিও ইংরেজিতে, যে আমাদের সাহিত্যিক ক্ষুধা যৌনতার নয়, তা হল ন্যারেটিভের ডিক্যাননাইজেশানের, আঙ্গিকমুক্তির, যুক্তিভঙ্গের, ডিন্যারেটিভাইজেশানের, অনির্ণেয়তার, চিন্তার আকরণের, অপরত্ববোধের, প্রতাপবিরোধিতার, প্রতিস্পর্ধার, বাচনিক নির্মিতির, সত্তাজিজ্ঞাসার, প্রান্তিক-স্বাতন্ত্রের, উপস্হাপনের ব্যাঞ্জনার, অন্তর্ঘাতের ।

             আমি গ্রেপ্তার হলুম ৪ঠা সেপ্টেম্বর ১৯৬৪, পাটনায়, কলকাতা থেকে দুজন শাদা পোশাকের পুলিশ অফিসার এসেছিল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে, ওরা আমার অফিসে এসে হাজির, অফিস প্রধানের ঘরে ঢুকতে উনি বললেন, আপনি এই দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে বাইরে গিয়ে আলাপ করুন, আপনার সঙ্গে এনাদের কাজ আছে । নিচে রাস্তায় যেতেই দুজনে দুদিক থেকে আমার কাঁধ খামচে বলে উঠল, আপনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে, আপনার বাড়িতে নিয়ে চলুন । রিকশ ডেকে দুজনে দুদিক থেকে ধরে রইলো আমাকে, সম্ভবত ভাবছিল যে পালিয়ে যাবো । বাড়ি পৌঁছে দেখি স্হানীয় থানার পুলিশ ঘিরে ফেলেছে বাড়ি, পাবলিক জড়ো হয়ে গেছে মজা দেখতে । রিকশঅলাটা দাঁড়িয়েছিল, বাবা ভাড়া মিটিয়ে দিলেন । আমার জান্তব প্রবৃত্তির বিকাশ সম্পর্কে বাবা সঠিক অনুমান করে ফেলেছিলেন বহু আগেই ।

             পুলিশ অফিসারদের একজন, পরে যার নাম জেনেছি বারোড়ি, সে পেপারওয়েট তুলে আচমকা বাবার দোকানের আলমারির কাচ ভেঙে ফেলল ; বাবা বললে, ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ তো ওর ঘরে গিয়ে তল্লাসি করুন না, জবাবে বারোড়ি বললে, আমরা পুরো বাড়িতে তল্লাশি চালাবো ।  ওপরতলায় যেতে খাটের তলা থেকে মায়ের ট্রাঙ্ক টেনে তালা ভেঙে ফেলে লণ্ডভণ্ড করা আরম্ভ করল, মায়ের বিয়ের বেনারসি পুরোনো ভাঁজ থেকে ছিঁড়ে গেল, আর আমি দেখতে পেলুম শ্রেয়াকণার চিঠি আর ফুলটুকে দেয়া আমার কার্ড ছিটকে বেরিয়ে এলো । তিন তলায় গিয়ে উনিশ শতক থেকে সংগ্রহ করা ফোটোর প্লেটের একটা র‌্যাক একটানে ফেলে দিল, এখন ওসব ফোটো সংগ্রাহকদের কাছে বেশ দামি । অবশ্য পরে দাদার ছেলেরা অন্য তাকের প্লেটগুলোকে অকেজো মনে করে সের দরে বেচে দেবে ।

             টানাহেঁচড়া করে পুলিশ আমার ঘরে ডাঁই করে জড়ো করে ফেলল অনেককিছু, যা পরে মামলায় লাগবে না আর যা ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবে, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের আমাকে লেখা চিঠির দুটি ফাইল, একটায় ষাটটা অন্যটায় চল্লিশটা চিঠি ; আমার কবিতা নাটক ছোটোগল্পের পাণ্ডুলিপি ; আমার দুটো ডায়েরি, ইংরেজি আর বাংলা ; হাংরি আন্দোলনের বিভিন্ন বুলেটিনের বাণ্ডিল ; পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে সমালোচনা করে আমার পুস্তিকার বাণ্ডিল ; প্রচ্ছদে ব্যবহার করার জন্য দুটো ব্লক, মেকসিকোর চিত্রকরের আঁকা ; এভারগ্রিন রিভিউ-এর কপি ; সন্দীপনের উপহার দেয়া ‘বিজনের রক্তমাংস’ ; প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত ‘স্বকাল’ ; ছোটোগল্প লেখা তিনটে খাতা ; প্রকাশিত ‘ইতিহাসের দর্শন’ লেখার ফাইল কপি ; যৌনতা সম্পর্কে একটি বই ; ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত ‘উন্মার্গ’ পত্রিকার কপি ; হিন্দি পত্রিকা ‘লহর’ যাতে আমার সম্পর্কে প্রবন্ধ বেরিয়েছিল ; একটা করোনা টাইপ রাইটার ; দাদা সমীর রায়চৌধুরীর কাব্যগ্রন্হ ‘জানোয়ার’-এর সব কয়টি কপি । এগুলোর মধ্যে কেবল আমার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার পাণ্ডুলিপি আদালতে পেশ করেছিল সরকারি উকিল । বাকি সব নিপাত্তা । সাক্ষী হিসাবে রাস্তা থেকে তিনজন ঝাড়ুদারকে ধরে নিয়ে এলো কলকাতার পুলিশ ।

             হাতে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশের দল রাতে নিয়ে চলল বাঁকিপুর বা পিরবহোর থানায়, সোজা লকআপে, অন্ধকার, আলো নেই, পাশের লকআপে বেশ্যার দলের চেঁচামেচি, লকআপে সাত-আটজন কয়েদি, নানা অভিযোগে, ডাকাতি আর খুনও । ফুলপ্যান্টের ভেতরে ইঁদুর ঢুকে এলো, পা ঝেড়ে বের করলুম, বাড়ি থেকে খাবার এসেছিল, কিন্তু একে অন্ধকার, তায়ে লকআপের অভিজ্ঞতা, খাওয়া গেল না । সকালে স্হানীয় খবরের কাগজে গ্রেপ্তারির খবর শুনে নমিতা চক্রবর্তী সাহস যুগিয়ে গেলেন, বহুদিন পর ওনাকে দেখলুম, চোখে চশমা, টিচারি শুরু করেছেন, আমার নকাকিমা যে স্কুলে পড়ান সেখানে। নমিতাদি বেঁচে থাকলে জানতে চাইতুম, ভেঙে পড়া সোভিয়েত রাশিয়ায় কোথা থেকে এতো মহাকোটিপতি আর মহাচোরাকারবারী আচমকা উদয় হল, এতো ভিকিরি, এতো ছিঁচকে চুনোপুঁটি !

             হাগবার জন্য কোমরে দড়ি পরিয়ে হাগতে পাঠানো হলো, ঘুড়ি ওড়ানোর মতন করে ঢিল দিয়ে লাটাই ধরে থাকলো একজন কন্সটেবল আর আমি হাগতে গেলুম, চারিদিকে কয়েদিদের গু, জল পড়ে চলেছে কল থেকে, পোঁদ এগিয়ে ছুঁচিয়ে নিলুম ।  আবার হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে কয়েদিদের সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে ফৌজদারি আদালত। বাবা বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেকে এনেছিলেন, যিনি হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন । কলকাতার পুলিস রিমান্ড চাইছিল । বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দিয়ে বললেন কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে আত্মসমর্পণ করতে । বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন লেখিকা এনাক্ষী ব্যানার্জি আর মীনাক্ষী মুখার্জির বাবা । বাড়ি এসে নিজেকে নবীকরণ করে পৌঁছোলুম উত্তরপাড়ায়, পেছন-পেছন বড়োজ্যাঠা আর বাবা । দাদাও চাইবাসায় গ্রেপ্তার হয়ে চাইবাসা থেকে এসে পৌঁছোলো । জমায়েত দেখে, দাদা গ্রেপ্তার হয়েছে শুনে ঠাকুমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল । অন্যান্য জেঠা-কাকারা আর পিসেমশায় এসে পৌঁছোলেন ।

             ব্যাংকশাল কোর্টে সারেন্ডার করে জানতে পারলুম দেবী রায়, সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষও গ্রেপ্তার হয়েছে । জামিনের পর আদালত বলল লালবাজারে গিয়ে প্রেস সেকশানে হাজিরা দিতে । লালবাজারে হাজিরা দিতে গিয়ে কফিহাউসে পুলিশ ইনফরমারদের কথা জানতে পারলুম, যারা হাংরি আন্দোলনের বুলেটিন বই পত্রিকা এনে-এনে জড়ো করেছে প্রেস সেকশানে । আশ্চর্য যে মুখের দিকে তাকিয়েও কেন বুঝতে পারিনি যে অমুক লোকটা, যে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে সে ইনফরমার, তমুক যুবক যে আমার কাছ থেকে বুলেটিন চেয়ে নিয়ে গেল, সে পুলিশের খোচর । মামলার সময় যখন এরা কাঠগড়ায় আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ালো তখন টের পেলুম । সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষের মুখের দিকে তাকিয়েও কি কখনও জানতে পেরেছিলুম যে ওরা পিঠে ছুরি মারবে । অবশ্য আঁচ করা উচিত ছিল, কেননা ওরা দুজনেই লালবাজারে  ইন্সপেক্টরের হম্বিতম্বিতে কেঁদে একশা , সেই ইন্সপেক্টর অনিল ব্যানার্জি, পরে নকশাল বিনাশে নাম করেছিল।

            আঘাত তো লোকে করবেই, কিন্তু সব আঘাতে আদর করে হাত বোলানো যায় না । বেশির ভাগ আঘাতের দাগ দেহের চামড়ায় পুষে রাখতে হয় ।

    ছাব্বিশ

            মামলার সময়টা বেশ খারাপ গেছে, কলকাতায় মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, সাসপেন্ড হবার দরুণ মামলার খরচ, যাতায়াতের খরচ আর খাবার খরচ সামলানো কঠিন হয়ে গিয়েছিল । একই শার্ট-প্যাণ্ট প্রায় পনেরো দিন পরে চালিয়েছি । সবসুদ্ধ পঁয়ত্রিশ মাস মামলা চলেছিল । উত্তরপাড়ার খণ্ডহরে থাকা যেতো কেসের ডেটের মাঝে হাতে সময় থাকলে, কেননা তখন সেরকমভাবে ইলেকট্রিক ট্রেন শুরু হয়নি আর প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কোনো নির্ধারিত সময় ছিল না । সুবিমল বসাকের জেঠার স্যাকরার দোকানে বৈঠকখানা পাড়ায় থাকতুম মাঝেমধ্যে আর হাগতে যেতুম শেয়ালদায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে, রাস্তার কলগুলো এতো নিচু যে তার তলায় প্রায় শুয়ে স্নান করতে হতো । ফলে প্রতিদিন স্নানের অভ্যাস ছাড়তে হয়েছিল । শহরে যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই তাদের কাছে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল হাগা, কোথায় গিয়ে হাগা যায় । তখন তো সুলভ শৌচালয় আরম্ভ হয়নি । আহিরিটোলায় রাতে থাকতে পেলে অন্ধকার থাকতে গঙ্গার পাড় ছিল সবচেয়ে সহজ । এটা সেন্টুদার শেখানো ; পিসেমশায়ের আটজন বাচ্চা আর একটা পায়খানা, গঙ্গার পাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে হাগা পেলে পায়জামা বা প্যান্ট নামিয়ে হেগে নাও আর গঙ্গায় পোঁদ ঠেকিয়ে ছুঁচিয়ে নাও । হাগা পেলে হেগে নেওয়ার মতন আর কোনও আনন্দ নেই । সেন্টুদা পরামর্শ দিয়েছিল যে রাতে হোটেলে থাকার চেয়ে ভালো জায়গা হলো অবিনাশ কবিরাজ লেনের কোনো ঘরে কাউকে সারা রাতের জন্যে প্রেমিকার দাম দেয়া । কিন্তু সেখানেও তো ভোরবেলা উঠে হাগার সমস্যা । সেখানে রাত কাটালেও হাগতে ছুটতে হতো বড়োবাজারে হিন্দি পত্রিকা “জ্ঞানোদয়” এর সম্পাদক শরদ দেওড়ার মারোয়াড়ি গদিতে । এই গদিতে শুয়েও রাত কাটিয়েছি, যতো রাত বেড়েছে ততো শোবার লোকের ভিড় বেড়েছে, কেননা বাইরে থেকে যে ব্যাবসাদাররা কলকাতায় আসতো তারা মারোয়াড়িদের গদিতে শোয়া পছন্দ করতো ।

             বাদবাকি সকলের বিরুদ্ধে আরোপ তুলে নিয়ে, ৩রা মে ১৯৬৫ আমার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করল পুলিশ । তার সঙ্গের নথিগুলো থেকে জানতে পারলুম হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্রব অস্বীকার করে মুচলেকা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছে সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ, মামলা থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য । এও জানলুম যে আমার বিরুদ্ধে পুলিশের হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আর উৎপলকুমার বসু, এঁরাও নিজেদের হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্রব অস্বীকার করেছেন । উৎপল চাকরি খুইয়ে গিন্সবার্গের সুপারিশে ইংল্যাণ্ডে চাকরি পেয়ে চলে গেলেন । সুভাষ আর শৈলেশ্বর আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে ক্ষান্ত দেয়নি, একের পর এক লেখায় হাংরি আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করে গেছে, সময়ের সঙ্গে তাল দিয়ে আমার প্রতি ঘৃণার মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে, এমনকি নিজের বউ-বাচ্চাদেরও এ-ব্যাপারে ট্রেনিং দিয়ে গেছে ; ফলে ওদের নিজেদের মরচে-পড়া ছোরাগুলোই অকালে রোগ হয়ে ওদের বুকে বিঁধেছে।

            দীপক মজুমদার আমার সমর্থনে একটা স্টেটমেন্ট লিখেছিলেন, এবং বহু সাহিত্যিকের কাছে গিয়েছিলেন তাতে সই করানোর জন্য । কেউ রাজি হননি । কেবল আনন্দ বাগচি সই করেছিলেন । “প্রথম সাড়া জাগানো কবিতা” সম্পাদনার সময়ে আনন্দ বাগচি আমার “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতাটা তাতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন ।  উৎপলকুমার বসু থাকতেন রয়েড স্ট্রিটে, দোতলায়, সাজানো-গোছানো ঘর, কিন্তু রাতে শোবার অনুমতি দিতেন না । হাংরি আন্দোলনের দরুণ ওনার চাকরি চলে যাবার পর, গিন্সবার্গের সুপারিশে লণ্ডনে চাকরি পেয়েছিলেন । পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিকেশানের প্রয়োজনের কারণে হয়তো পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেন । সম্প্রতি বিবিসি রেডিওর ডোমিনিক বার্ন ভারতে এলে তাকে সাক্ষাৎকারে নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী বললেও, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভয়ে, এবং সম্ভবত আনন্দ পুরস্কার আর অকাদেমি পুরস্কার পাবার জন্য, হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত কবিতা “পোপের সমাধি” বাদ দিয়ে দিয়েছেন “শ্রেষ্ঠ কবিতা” থেকে ।

            ৪ঠা সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ থেকে ২৮শে ডিসেম্বর ১৯৬৫ পর্যন্ত কাফকায়েস্ক জগতে আমার চলছিল তারিখের পর তারিখ, পেশকারের সোনার দাঁত, উকিলের ফিস, ইনভেস্টিগেশান অফিসারের মুচকি হাসি, তারিখের পর তারিখ, পেশকারের সোনার দাঁত, উকিলের ফিস, ইনভেস্টিগেশান অফিসারের মুচকি হাসি, তারিখের পর তারিখ, পেশকারের সোনার দাঁত,উকিলের ফিস, ইনভেসটিগেশান অফিসারের মুচকি হাসি, তারিখের পর তারিখ, পেশকারের সোনার দাঁত, উকিলের ফিস, ইনভেস্টিঘেশান অফিসারের মুচকি হাসি, তারিখের পর তারিখ, পেশকারের সোনার দাঁত,উকিলের ফিস, ইনভেস্টিগেশান অফিসারের মুচকি হাসি, ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামের ঘর্মাক্ত পরিশ্রম কখনও থামবে না এরকম এক পাগল করা প্রক্রিয়া ।

            সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায় ছাড়া সকলেই কেটে পড়ল আমার পাশ থেকে । আমার বিরুদ্ধে সাক্ষীদের কথা কফিহাউসে চাউর হয়ে গেলে জ্যোতির্ময় দত্ত, সত্রাজিৎ দত্ত আর তরুণ সান্যাল নিজেরা যোগাযোগ করে আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে রাজি হলেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রথমে রাজি ছিলেন না, যেই শুনলেন যে শক্তি, সন্দীপন, উৎপল আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, উনি তক্ষুনি রাজি হয়ে গেলেন, ওনাদের উচিত শিক্ষা দেবার জন্য, কেননা সুনীলকে না জানিয়ে ওনারা হাংরি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সন্দীপনকে সুনীল এর জন্য ক্ষমা করতে পারেননি আর গোপনে আমার বিরুদ্ধে প্রচার করে গেছেন, ভারতে বা বিদেশে কেউ আমার কথা জানতে চাইলে “ও তো লিখতেই জানে না” বলে উড়িয়ে দিতেন।

            সুনীল যে হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে কতো চটে গিয়েছিলেন তা ১০ই জুন ১৯৬৪ তারিখে আয়ওয়া থেকে আমায় লেখা চিঠির এই অংশটুকু থেকেই স্পষ্ট হবে: “চালিয়ে যাও ওসব আন্দোলন কিংবা জেনারেশনের ভণ্ডামি । আমার ওসব পড়তে কিংবা দেখতে মজাই লাগে । দূর থেকে । সাহিত্যের ওপর মৌরসি পাট্টা বসাতে এক-এক দলের অত লোভ কী করে আসে, কী জানি । তবে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো । আমাকে দেখেছ নিশ্চয় শান্তশিষ্ট, ভালো মানুষ । আমি তা-ই, যদিও গায়ে পদ্মাপাড়ের রক্ত আছে । সুতরাং, তোমাদের উচিত আমাকে দূরে-দূরে রাখা, বেশি খোঁচাখুঁচি না করা । নইলে হঠাৎ উত্তেজিত হলে কী করব বলা যায় না । জীবনে ওরকম উত্তেজিত হয়েছি পৌনে একবার । গত বছর । দু-একজন বন্ধুবান্ধব ও-দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশন গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি । এখনও সেক্ষমতা রাখি, জেনে রেখো । তবে এখনও ইচ্ছে নেই ও-খেলাঘর ভাঙার।”

            মনের ভেতরে সুনীলের যে বিষক্রিয়া চলছিল তা পাঁচ দিন পর ১৫ জুন ১৯৬৪ তারিখে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা এই চিঠির বিষাক্ত অংশটি থেকে টের পাওয়া যায়, “আপনি মলয়কে এত পছন্দ করছেন—কিন্তু ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে আপনি নিশ্চয়ই মনে-মনে বিশ্বাস করেন না । আমি চলে আসার পরও আপনি হাংরির পৃষ্ঠপোষকতা করছেন — হিন্দি কাগজের জন্য আপনি কি একটা লিখেছিলেন — তাতেও হাংরির জয়গান । ভাবতে খুব অবাক লাগে — আপনার মতো অ্যাবস্ট্র্যাক্ট লেখক কি করে ইলাসট্রেটেড উইকলিতে ছবি ছাপাটাও উল্লেখের ব্যাপার মনে করে । এগুলোই হাংরির গোঁজামিল । এই জন্যই এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক থাকতে বারবার দুঃখ পেয়েছি, দুঃখ থেকে রাগ, রাগ থেকে বিতৃষ্ণা । একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আমি হাংরির কখনও প্রত্যক্ষ ভাবে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করিনি, ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করিনি । পারতুম । করিনি, তার কারণ, ওটা আপনাদের সখের ব্যাপার এই ভেবে, এবং আপনারা ওটাকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছিলেন কৃত্তিবাস বা সুনীলের প্রতিপক্ষ হিসাবে । সে হিসেবে ওটাকে ভেঙে দেওয়া আমার পক্ষে নীচতা হত । খুবই । বিশ্বাস করুন, আমার কোনো ক্ষতির কথা ভেবে নয়, আপনার অপকারের কথা ভেবেই আমি আপনার ওতে থাকার বিরোধী ছিলুম । এটা হয়তো খুব সেন্টিমেন্টাল শোনালো, যেন কোনো ট্রিক, কিন্তু ও-ই ছিল আমার সত্যিকারের অভিপ্রায়।” এই চিঠিটা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ।

            সন্দীপন যখন কফিহাউসে বসে বলতেন, ইনসাইড জব, ইনসাইড জব, ইনসাইড জব, তখন বুঝতে পারিনি কী বলতে চাইছেন ।    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে ১৯৬১ সালে জিগ্যেস করেছিলুম, “আপনার আর শক্তিদার মাথার পেছনটা চ্যাপ্টা অথচ সুনীলদার গোল কেন?” জবাবে উনি বলেছিলেন, “ওই বাড়তি অংশে ওর শাওলিন সিক্রেট আছে।” সন্দীপনের চেতলার বাড়িতে জিগ্যেস করেছিলুম, “শুধু মাগি-মরদ নিয়ে লেখেন কেন ? কর্পোরাশানের যে বিভাগে কাজ করেন তা তো ঘুষখোরদের আড়ত, সেসব দেয়া-নেয়া নিয়ে লেখেন না কেন ?” উনি বলেছিলেন, “তা লিখলে, পেনশান বন্ধ হয়ে যাবে।”

    সাতাশ

            সুনীলের আমাকে এতো ভয় পাবার কারণ আমি আজও ডেসিফার করতে পারিনি, আমি তো সেসময়ে ছিলুম একজন নাম-না-জানা প্রবাসী, হারাধন ধাড়া নামে যুবকটি তার চেয়ে বেশি অখ্যাত, তারা একটা আন্দোলনের আওয়াজ দিলো আর তাতেই ভয় পেয়ে গেলেন কৃত্তিবাসের সম্পাদক, ভাবলেন ব্যক্তিগত স্তরে তাঁকে বিস্হাপিত করার চেষ্টা হচ্ছে ! আমি নিশ্চিত যে সুনীল এই ধরণের চিঠি উৎপলকেও লিখে থাকবেন । আসলে একজন লোক কী ভাবছে তা শোনবার মতন ক্ষমতা তখনও পর্যন্ত গড়ে তুলতে পারিনি ।

            ২৮শে ডিসেম্বর ১৯৬৫ আমাকে দুশো টাকা জরিমানা অনাদায়ে একমাসের কারাদণ্ড দিলেন প্রেসিডেন্সি ম্যাজিসট্রেট ।  আমার পক্ষের কোনো সাক্ষ্যকে পাত্তা দিলেন না তিনি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষ্যকেও নয় ; হয়তো তখন যদি পরবর্তী কালের মতন সুনীল সে সময়ে বিখ্যাত হতেন তাহলে জজ সায়েবের দ্বিধা হলেও হতে পারত। গুরুত্ব দিলেন আমার বিরুদ্ধে যারা সাক্ষ্য দিয়েছিল তাদের সাক্ষ্যকে। জজ সায়েব যে দুশো টাকা জরিমানা করেছিলেন তা ছিল সর্বোচ্চ । আমি চাকরিতে তখন মাইনে পেতুম ১৭০ টাকা, গ্র্যাজুয়েট ছিলুম বলে।

            জজ সায়েব “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতাটা নিজেই এভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন, বোঝা যায় সেসময়ে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের সাহিত্যিক মূল্যবোধে, তা সে জজ অমলকুমার মিত্র হোন বা আবু সয়ীদ আইয়ুব, কোনও পার্থক্য ছিল না । জজ সায়েবের বক্তব্য পড়লে স্পষ্ট হবে : It appears to be per se obscene. In bizarre style it starts with restless impatience of a sensuous man for a woman obsessed with uncontrollable urge for sexual intercourse followed by a description of vagina, uterus, clitoris, seminal fluid, and other parts of female body and organ, beasting of man’s innate impulse and conscious skill as to how to enjoy a woman, blaspheming God and profaning parents accusing them of homosexuality and masterbation, debasing all that is noble and beautiful in human love and relationship. It is a piece of self analysis and eroticism in autobiographical or confessional vein when the poet engages himself in mercilessly obnoxious and revolting self-degradation and resorts to sexual vulgarity to a degree of perversion and morbidity far exceeding the customary and permissible limits of candour in description or representation. It is patently offensive to what is called contemporary community standards. Its predominant appeal to an average man considered as a whole is to prurient interest, in a shameful or morbid interest in nudity, sex and excretion. Considering its dominant theme it is dirt for dirt’s sake, or, what is commonly called, hard core pornography suggesting to the minds of those in whose hands it may fall stinking wearisome and suffocating thoughts of a most impure and libidinous character and thus tending to deprave and corrupt them without any rendering social or artistic value and importance. By no stretch of imagination can it be called, what has been argued, an artistic piece of  erotic realism opening up new dimension of contemporary Bengali literature or a kind of experimental piece of writing, but appears to be a report of a repressed or a most pervert mind who is obsessed with sex in all its nakedness and thrives on, or revel, in utter vulgarity and profanity preoccupied with morbid eroticism and promiscuity in all its naked ugliness and uncontrolled passion for opposite sex. It transgresses public decency and morality substantially, rather at public decency and morality by its highly morbid erotic effect unredeemed by anything literary or artistic. It is an affront to current community standards of morality and decency. The writing viewed separately and as a whole treats with sex, that great motivating force of human life, in a manner that surpasses the permissible limits judged from our community standards, and as there is no redeeming social value or gain to society which can be said to preponderate, I must hold that the writing has failed to satisfy the time honoured test. Therefore it has got to be stamped out since it comes within the purview of Section 292 of Indian Penal Code. Accused is accordingly found guilty of the offence punishable under Section 292 of Indian Penal Code, is convicted thereunder and sentenced to pay a fine of Rs. 200/- , in default simple imprisonment for one month. Copies of the impugned publication seized be destroyed.

             সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও, যদিও তিনি শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হয়ে, দাদার অনুরোধে,  ৫ই নভেম্বর ১৯৬৫ আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, সাক্ষ্য দিয়ে ফেরার পর দাদাকে ৯ই নভেম্বর যে চিঠিটা লিখেছিলেন তার গুরুত্বপূর্ণ অংশটি  জজ সায়েব আর আবু সয়ীদ আইয়ুবের সাহিত্যিক মানসিকতা থেকে ওনার বিশেষ পার্থক্য দেখি না : “সাক্ষীর কাঠগড়ায় মলয়ের কবিতা আমাকে পুরো পড়তে দেওয়া হয় । পড়ে আমার গা রি-রি করে । এমন বাজে কবিতা যে আমাকে পড়তে বাধ্য করা হল, সে জন্য আমি ক্ষুব্ধ বোধ করি — আমার সময় কম, কবিতা কম পড়ি, আমার রুচির সঙ্গে মেলে না এমন কবিতা পড়ে আমি মাথাকে বিরক্ত করতে চাই না । মলয়ের তিন পাতা রচনায় একটা লাইনেও কবিতার চিহ্ণ নেই ।” বুড়ো বয়সে জানতে পেরেছিলেন নিশ্চয় যে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা বহু ওয়েবপত্রিকায় ছড়িয়ে পড়েছে, নেটে কবিতাটা নিয়ে দশ বছর যাবত তর্কাতর্কি চলছে ।

            চিঠিটির পরের অংশে তিনি যা লিখেছিলেন তা আরও ভয়ঙ্কর : “যাই হোক, তবু আমি বেশ স্পষ্ট গলাতেই দুবার বলেছি ওর ঐ কবিতা আমার ভালো লেগেছে । এর কারণ, আমার কোনো মহত্ব নয়— আমার সাধারণ, স্বাভাবিক, সীমাবদ্ধ জীবন । যে কারণে আমি আনন্দবাজারে সমালোচনায় কোনো বাজে বইকে ভালো লিখি — সেই কারণেই মলয়ের লেখাকে ভালো বলেছি ।” দেশ-আনন্দবাজারে কতো-কতো বই তিনি আলোচনা করেছেন, সব আলোচনাই তাহলে গুয়েগোবরে ব্যাপার !

            সিটি লাইটস বুক স্টোরের মালিক ও বিট আন্দোলনের কবি লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি ওনার পত্রিকা সিটি লাইটস জার্নালে প্রকাশ করতে চাইছিলেন বলে ওনাকে একটা কপি পাঠিয়েছিলুম, পড়ে উনি ২৬ মার্চ ১৯৬৬ তারিকে এই চিঠিটা লিখেছিলেন আমাকে:-

    Dear Malay,

            I have received the legal decision on your case, and thank you very much for sending it. I find it laughable. I want to publish it together with your poem ‘Stark Electric Jesus’ in the next ‘City Lights Journal’ which will be out this coming summer, and I enclose a small payment immediately, since I know you must need it desperately. I am sending a copy of this letter to Howard McCord. Perhaps he knows the answers to the following questions and will send them to me rightaway since time is of the essence, and it may take some time to get a reply from you. I think it is a wonderful poem, and I will certainly credit McCord for having first published it. Bravo.

            Allen is in NY and his new address is 480 East, !0 Street ( Apt 4c ), New York, NY.

           I need to know the answers to the following questions : 1) Was the poem first written in Bengali and was it the Bengali or the English version which was seized and prosecuted ? 2) Is this your own translation, or whose is it ? 3) Do you wish me to use the typewritten copy of the poem which you sent me last year, or the version printed by McCord ? ( I find differences ).

           Let me hear as soon as you can. Holding the press. And good luck. I hope you are still able to survive. With Love

                                                                                    Lawrence Ferlinghetti

            আমি কলকাতা হাইকোর্টে রিভিশন পিটিশান করলুম । হাইকোর্টের জন্য আমি পেলুম সদ্য ইংল্যাণ্ড থেকে ফেরা ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়কে, যিনি হাংরি আন্দোলনের মামলার সংবাদ লণ্ডনের কাগজগুলো থেকে পেয়েছিলেন । তিনি যোগাযোগ করিয়ে দিলেন বিখ্যাত ক্রিমিনাল লইয়ার মৃগেন সেনের সঙ্গে । হাইকোর্টে শুনানি হল ২৬ জুলাই ১৯৬৭ আর বেকসুর খালাস হলুম, এই আদেশে: I hold first that the substance of any offence under Section 292 IPC could not have been explained to the petitioner in this case, and secondly, that the finding of the learned Magistrate that the petitioner circulated any obscene matter is not based on any evidence whatsoever. This rule accordingly is made absolute. The order of conviction and sentence passed on the petitioner is set aside and he is acquitted. Fine, if paid, be refunded. ।

              হাইকোর্টে রেহাইয়ের পর কেবল একজন সাহিত্যিকের চিঠি পেয়েছিলুম, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের, ৩০ জুলাই ১৯৬৭ তারিখে লেখা, আর কারো নয়, মুচলেকাপন্হীদের তো নয়ই, এই চিঠিটার জন্যে সন্দীপনকে ক্ষমা করে দিয়েছিলুম :

    প্রিয় মলয়,

             হাইকোর্টের রায় পড়ে তোমাকে মনে-মনে তৎক্ষণাৎ কনগ্র্যাচুলেট করেছি । একটা মামলা হওয়া দরকার ছিল, কাউকে না কাউকে এরকম মামলার আসামী হতেই হত । সীমাবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এর ফলাফল আধুনিক সত্য-সাহিত্যের পক্ষে যথেষ্ট ভালো হবে, মনে হয় ।

             কৃতিত্ব সবটাই তোমার একার, তবু, লেখক নামের যোগ্য সকলেই একে পুরস্কার বলে মনে করবে ও ভাগ নিতে চাইবে । ব্যক্তিগতভাবে আমি পুরস্কৃত হওয়ার আনন্দ পেয়েছি ।

                                                                                                      প্রীতিসহ

                                                                                                  সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

     আঠাশ

              ১৯৬৫এর ওই সময় থেকে ১৯৬৭এর রেহাই পর্যন্ত আমাকে ফ্যা-ফ্যা করে বেড়াতে হয়েছে । রেহাই পেয়ে চাকরি ফিরে পেলুম । চাকরি পেয়ে করুণাশঙ্কর রায়ের মাধ্যমে হাইকোর্টের ব্যারিস্টার মৃগেন সেন ও তাঁর টিমকে নগণ্য ফিস দিতে পারলুম । করুণাশঙ্কর রায় প্রদেয় ফিস প্রায় মুকুব করিয়ে দিয়েছিলেন, নয়তো মৃগেন সেনের যা ফিস ছিল তা আমার পক্ষে দেয়া অসম্ভব হতো ।

             আমার মামলা  যখন ব্যাংকশাল কোর্টে সাবজুডিস রয়েছে, সেসময়ে আগবাড়িয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কৃত্তিবাস পত্রিকায় এই সম্পাদকীয়টি লিখলেন, দাদার মতে উনি এটা লিখেছিলেন আনন্দবাজার এসট্যাবলিশমেন্টকে সন্তুষ্ট করার জন্য, কেননা ব্যাংশাল কোর্টে মামলা চলার সময়ে তো বুলেটিন বেরোনো বন্ধ হয়ে গেছে, মুচলেকাপনন্হীরা  যে-যার কেটে পড়েছে, আমার বিরুদ্ধে জোট বেঁধে ষড়যন্ত্র আরম্ভ করেছে:

             “হাংরি জেনারেশান। অনেকেই প্রশ্ন করছেন বলে আমরা লিখিতভাবে জানাতে বাধ্য হলুম যে হাংরি জেনারেশান নামে কোনো প্রতিষ্ঠান বা আন্দোলনের সঙ্গে কৃত্তিবাস সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্কিত । ঐ প্রকার কোনো আন্দোলনে আমরা বিশ্বাস করি না । কৃত্তিবাসের নামও যুক্ত করতে চাইনি কখনও । ‘হাংরি’ নামে অভিহিত কোনো-কোনো কবি কৃত্তিবাসে লেখেন, বা ভবিষ্যতে অনেকে লিখবেন, কিন্তু অন্যান্য কবিদের মতোই ব্যক্তিগতভাবে, কোনো দলের মুখপাত্র হিসেবে নয় । সংঘবদ্ধ সাহিত্যে আমরা আস্হাশীল নই । পরন্তু বাংলাদেশের যে কোনো কবির প্রতিই কৃত্তিবাসের আহ্বান । হাংরি জেনারেশানের আন্দোলন ভালো কি খারাপ আমরা জানি না । ঐ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ বা পরিণাম সম্পর্কে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। এ-পর্যন্ত ওদের প্রচারিত লিফলেটগুলিতে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি চোখে পড়েনি । নতুনত্ব-প্রয়াসী সাধারণ রচনা । কিছু-কিছু হাস্যকর বালক ব্যবহারও দেখা গেছে । এছাড়া সাহিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি ক্রিয়াকলাপ বিরক্তি উৎপাদন করে । পিজিন ইংরেজিতে সাহিত্য করার লোভ উনিশশো ষাট সালের পরও বাংলাদেশের একদল যুবক দেখাবেন — আমাদের কাছে কল্পনাতীত ছিল । তবে ঐ আন্দোলন যদি কোনোদিন কোনো নতুন সাহিত্যরূপ দেখাতে পারে — আমরা অবশ্যই খুশি হবি ।”

             ব্যাংকশাল কোর্টে আমার উকিল চণ্ডীচরণ মৈত্র সম্পাদকীয়টা পড়ে বলেছিলেন, একটা কনটেম্পট অফ কোর্ট মামলা ঠুকে দিতে । তা সম্ভব ছিল না, কেননা মনের মধ্যে আমার বিরুদ্ধে জোঁক-কাঁকড়াবিছে পুষে রাখলেও উনি আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ।

             পরেও, ইংরেজি ভাষার ভারতীয় ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষের স্ত্রী ডেবোরা বেকার যখন গিন্সবার্গ আর অরলভস্কিকে নিয়ে ‘দি ব্লু হ্যাণ্ড’ বইটা লেখার জন্যে  হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে সুনীলের কাছ থেকে তথ্য চাইলেন, ডেবোরা বেকারকে আমাদের কাছে না পাঠিয়ে ভুলভাল তথ্য সরবরাহ করেন সুনীল, আমার সম্পর্কে তো বটেই। আমার ওপর ওনার রাগ বুড়ো বয়সেও যায়নি । কৃত্তিবাসের জন্যে আমার কাছে কবিতা চাননি কখনও । উনি পঞ্চাশ বছর আমার কাছে কবিতা চাননি

             মামলা চলার সময়ে, আর তার পরও অনেকে বলতো, আরে মামলা চলছে তো কি হয়েছে, অমন মামলা তো ফৌজদারি আদালতে চলতেই থাকে । জবাবে আমি বলতুম যে, বাঞ্চোৎ, কলকাতা শহরে বাড়ি আছে, মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে, দুবেলা খাবার ব্যবস্হা আছে, তাই অমন কথা বলতে পারছিস । রাতে থাকার ঠাঁই নেই, পাইস হোটেলে খেয়ে-খেয়ে পেটের অবস্হা তথৈবচ, সকালে উঠে কোথায় হাগতে যাবো, খিদে পেলে জলখাবার খেয়ে বাসভাড়া খরচ করে কোর্ট পর্যন্ত হাঁটবো, দিনের পর দিন একটা শার্ট-প্যান্ট পরেই কাটাবো, ঘামে গেঞ্জির অবস্হা এমন যে খুলে জঞ্জালের গাদায় ফেলে দিতে হবে, সামলাবার জন্যে কাউকে ধরে খালাসিটোলায় ধেনো টানবো বা গাঁজা ফুঁকবো, এগুলো ফেস করতিস তো বুঝতিস । মামলার সময়ে দুজন কেবল সাহায্য করেছিলেন, কমলকুমার মজুমদার, খালাসিটোলার কাছে একটা একশো টাকার নোট দিয়ে, যদিও আমার সঙ্গে ওনার তেমন পরিচয় ছিল না, বলেছিলেন, “তুমি তো জুলিয়াস সিজার হে।” তখন ভেবেছিলুম যে কলকাতায় চারিদিকে আমাকে নিয়েই আলোচনা চলছে বলে কথাটা বললেন । মামলার সময়ে যখন বন্ধুরা সাক্ষী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ালো তখন টের পেলুম যে কেন বলেছিলেন জুলিয়াস সিজার। আরেকজন, অশোক মিত্র, আই এ এস, ওনার বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, সেই রাতের ভালোমন্দ খাবার খাওয়ার জন্যে ।

             ব্যাংকশাল কোর্টে মামলা শেষ হবার আগেই বাসুদেব, সুভাষ, শৈলেশ্বর আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিল । সুবো আচার্য প্রদীপের সঙ্গে ত্রিপুরায় পালিয়ে গিয়েছিল ; প্রদীপ গ্রেপ্তার হতে ত্রিপুরার এক গ্রামে  গিয়ে স্হানীয় কবির বাড়িতে লুকিয়ে ছিল সুবো । ব্যাংকশাল কোর্টে আমার দণ্ডাদেশ হবার পর ফিরেছিল । ত্রিদিব মিত্রর চিঠি থেকে জানতে পারলুম ওরা “ক্ষুধার্ত” নামে একটা পত্রিকা বের করার তোড়জোড় করছে যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমাকে, দেবী রায়কে, ত্রিদিব মিত্রকে, আলো মিত্রকে, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, শম্ভু রক্ষিত আর সুবিমল বসাককে বাদ দেয়া । এদিকে বাসুদেব আর সুভাষ তখন “মানবতা” “সৌহার্দ্য” “বিশ্বপ্রেম” ইত্যাদি নিয়ে বুকনি ঝেড়ে বেড়াচ্ছে, অথচ নিজের পত্রিকা থেকে বন্ধুদেরই বাদ । জানিনা কেমনধারা মানবতাবাদ ছিল সেটা । পরে ওরা নিজেদের চারিপাশে অনেক চেলা যোগাড় করে ফেলেছিল, নিজেদের বউদেরও হাংরি আন্দোলনের অন্তর্গত করে ফেলেছিল । সম্ভবত ওদের মানবতাবাদ ছিল পরিবারতান্ত্রিক, যা কিছুকাল পরেই দেখা দিল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে । ঘোষভাইরা গোরু-শুয়োরের মাংস খেতে চাইতো না, আমরা খাবার পরিকল্পনা করলেই কেটে পড়তো । ১৯৬৪ সালে একবার হাওড়া স্টেশানে লোকাল থেকে শৈলেশ্বরকে নামতে দেখে চেঁচিয়ে ডাকলুম ওকে, ও আমাকে দেখতে পেয়েই প্ল্যাটফর্মের অন্য দিকে যে ট্রেনটা ছাড়ছিল তাতে উঠে পড়ল ।

            হাইকোর্টে কেস ঝুলে থাকার সময়ে কলকাতা থেকে পাটনা ফিরলুম, কেননা রিভিশন পিটিশনের শুনানি কবে হবে তার নিশ্চয়তা নেই, একমাসে হতে পারে আবার চার বছরও লাগতে পারে । একাকীত্বকে সম্ভবত উপভোগ করা শুরু করেছিলুম, কিংবা তখন থেকে একাকীত্ব আমার মগজের দখল নিয়ে নিয়েছিল । জীবনানন্দ কী করে একাকীত্বকে সামলাতেন ? কবিতার পর কবিতা, উপন্যাসের পর উপন্যাসে লুকিয়ে ফেলতেন ।

             শরীরও খারাপ হয়ে আসছিল, কলকাতায় কোর্ট আর এর বাড়ি তার বাড়িতে রাত কাটিয়ে,  পাইস হোটেলে খেয়ে । জ্বর দেখা দিচ্ছিল মাঝে-মধ্যে । বাড়ির ডাক্তার অক্ষয় গুপ্তকে দেখাতে গেলুম । উনি স্হানীয় আর কলকাতার কাগজপত্রে আমার সম্পর্কে খবর পড়ে, ছবি দেখে, নাড়ি দেখার বা জিভ দেখার বা রক্ত পরীক্ষা করার কথা বললেন না । সোজা পেনিসিলিন অয়েল ইনজেকশান প্রেসক্রাইব করে দিলেন । যে কমপাউণ্ডারের কাছে একদিন অন্তর পোঁদে ইনজেকশান নিতে যেতুম সে জিগ্যেস করল, এই রোগ বাধালেন কী করে ?

           —এই রোগ মানে কী রোগ ?

           —যৌন রোগ ?

           —ওহ, আর ইনজেকশান দিতে হবে না ।

           অক্ষয় ডাক্তার ধরেই নিয়েছিলেন যে আমি নির্ঘাৎ যৌন রোগ বাধিয়েছি ।

    উনত্রিশ

            পাটনা ফিরেছি জানতে পেরে অফিসের দুই সহকর্মী এরিক পেজ আর মামুদ জোহের দেখা করতে এসে বলল, আরে, মন খারাপ করার কি আছে, কলকাতার বন্ধুরা ল্যাঙ মেরেছে তো কি হয়েছে, আমরা তো আছি, চল, আমরা যাচ্ছি ট্রিপে, তুই তো যাসনি কখনও, ভালো ছেলে সেজে এড়িয়ে যেতিস, চল, মন ভালো হয়ে যাবে । এরিক পেজ আর মামুদ জোহেরদের দলটার কথা আমি লিখেছি “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” উপন্যাসে । ওদের একটা নারী-নারকো গ্যাঙ বা না-না গ্যাঙ ছিল । আমি ওদের কথায় রাজি হয়ে গেলুম অংশ নেবার জন্যে, কিন্তু জানিয়ে দিলুম যে আমি টাকাকড়ি দিতে পারব না, হালত একেবারে খাস্তা । অতনু চরিত্রের ওপর চাপিয়ে দিয়েছি এই ঘটনা সংক্রান্ত আমার নিজের অভিজ্ঞতা ।

            মামুদ জোহেরের ছিল জানলায় সানফিল্ম লাগানো ফিকে নীল রঙের ম্যাটাডর ভ্যান, ড্রাইভারের পেছনে সানমাইকার দেয়াল । পেছনে কি চলছে দেখা যায় না । পেছনে, দুদিকের সিট টানলে সোফা কাম বেড । ম্যাটাডরে ফার্সট এইড বাক্সে অ্যালুমিনিয়াম পাত, চামচ, ডিস্টিলড জল, সুঁই নেবার পিচকিরি, কাঁচি, লাইটার, টয়লেট পেপার, তুলো, বিদেশি কনডোম । শনিবার-শনিবার ওদের দলটা হল্লাবোল করতে বেরোতো । কেরানি, অফিসার, নোট এগজামিনার অনেকে ছিল ওদের দলে। সন্ধে নাগাদ কোনো হাফগেরস্হ যুবতীকে এই কড়ারে তুলে আনতো যে কয়েকজন তার সঙ্গে ম্যাটাডরের বিছানায় রতিভ্রমণ করবে তারপর তার আস্তানায় ছেড়ে দেয়া হবে কাজ শেষে । আমি ওদের দলে এতোকাল যোগ দিইনি কেননা লেখালিখির পক্ষে ব্যাপারটা বেশ ডিসট্র্যাকটিং । লেখালিখি মগজ থেকে প্রায় উবে গিয়েছিল ; রাজসাক্ষী শৈলেশ্বর, সুভাষের প্রতি সেসময়ে ঘৃণায় কলম ধরার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছিল । ক্রমশ লেখালিখিই ছেড়ে গেল, কেবল আমার নয়, ত্রিদিব মিত্র, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়েরও । বেনারসের বাঙালিদের বাংলা বুলিতে করুণা “ক্ষুৎকাতর সানপাকু” নামে আত্মজীবনী লেখা আরম্ভ করেছিল । ১৯৭০ নাগাদ করুণা-অনিল যখন নকশাল আন্দোলনের দিকে ঝুঁকলো, তখন পুলিশ ওদের আস্তানা আর স্টুডিওর সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল, ওরা অবশ্য তার আগেই বেনারস ছেড়ে পালিয়েছিল।

            মামুদ জোহের ভোরবেলা ভ্যান নিয়ে হাজির, রাজগিরে সবাই মিলে যাওয়া হবে, “ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান” খেলতে আর মদমাংস খেয়ে হুল্লোড় করতে । গাড়ি চলল গোলঘরের দিকে, গোলঘরের পেছনে এক ঘিঞ্জি গলিতে, বেশ গরিব এলাকা দেখেই টের পাওয়া যায়, কালচে কাঠ, ফ্যাকাশে প্লাসটিক, ত্যাবড়ানো টিনের দেয়াল,পুরোনো বাঁশের খুঁটি, আধপচা কাতাদড়ি, খরখরে চুনবালি, চটের পর্দা, উদাসীন বুড়ো, টিন নিয়ে গঙ্গার পাড়ে হাগতে চলেছে যুবক, দাঁতনরত লাল ল্যাঙোট-পরা ষণ্ডা ।

           “একজনকে পিক আপ করতে হবে”, বলে মামুদ জোহের চলে গেল বস্তিটার ভেতরে, আর মিনিট পনেরো পরে ফিরে এলো, কালো কাকেশ্বরী কুচকুচে, মানে এতো কালো এর আগে দেখেছি বলে মনে হয় না, ছিপছিপে এক যুবতীকে সঙ্গে নিয়ে, দুহাত ভরা প্লাসটিকের আসমানি চুড়ি, নাকে ফিরোজা পাথরের বা নকল ফিরোজার নাকছাবি, কালো শিফনের শাড়ি, আসমানি ব্লাউজ, চুলে চাঁপা বেলির মালা, চোখে কাজল বা আইলাইনার চোখ দুটোকে বড়ো দেখাবার জন্যে । সত্যিই, ব্যাংকশাল কোর্টে দিনের পর দিন হাজিরা দিয়ে আর শেষে সাজা পেয়ে, মনে হল যে এই মেয়েটার সঙ্গ কিছুক্ষণের জন্য আমার দরকার । এরকম একটা নোংরা বস্তিতে থেকেও মেয়েটা কতো টাটকা উচ্ছল প্রাণবন্ত সপ্রতিভ চনমনে, যা আমার সেসময়ে বড়োই দরকার ছিল ।

            গাড়িতে ঢুকে আমাদের দুজনের মধ্যে ঝপাং করে বসে পড়ল মেয়েটা, ওর ছোঁয়াচে প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে অনুসন্ধিৎসু । মামুদ জোহের মেয়েটিকে হিন্দিতে বলল, ও বাঙালি, তুই ওর সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে পারিস ।

            —আপনাকে দেখিনি তো আগে কখনো, কোলের ওপর উড়িষ্যার পিপলিগ্রামের ছিটকাপড়ের রঙিন কাঁধব্যাগ নামিয়ে বলল মেয়েটা, কথায় খাঁটি বিহারি টান ।

           — না, ও এই প্রথমবার আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে, আগে আমাদের মনে করত লম্পট, এখন কলকাতায় নানা কাজকারবার করে আমাদের রাস্তায় চলে এসেছে, ওর নাম মলয়, মলয় রায়চৌধুরী, তুই তো মুকখু, কাগজ পড়িস না, নয়তো হিন্দি ধর্মযুগে আর এখানকার সার্চলাইট খবরের কাগজে ওর ফোটো আর খবর দেখতে পেতিস, বলল মামুদ জোহের, হিন্দিতে ।

           — আর আমার নাম শেফালি, সবাই আমাকে টু বলে ডাকে । তারপর দুহাতে আমার বাঁ হাতটা ধরে বলে উঠল, আরে, তোমার হাত কতো নরম, তোমার কি হাত ঘামে ? মেয়েটার ছোঁয়ায় আমার প্রায় কান্না পেয়ে গিয়েছিল, সামলে নিলুম, বললুম, তোমার কথায় অমন হিন্দি টান কেন ?

             শেফালি বলল, ওর বাবা বিহারি আর মা বাঙালি, কলকাতার চটকলে ওর বাবা মজুর ছিল, বাবার সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল মা, তারপর যোগ করল, মা কিন্তু বামুন বাড়ির মেয়ে, হুঁ, বাবারা দেওঘরের বাউড়ি।

           —দেওঘরের বাউরিদের কথা জানি, পাণ্ডাদের ফাইফরমাস খাটতো, রান্নাবান্না করত আর যা বাঁচত তা খেতো, বললুম আমি। বললুম না যে কলকাতা থেকে যে সাব ইন্সপেকটার আমাকে গ্রেপ্তার করতে এসেছিল সেও ছিল বাউরি বা বারোড়ি ।

           —আর এখনকার দিনে তোমরা আমাদের খাও, না ? অদ্ভুত লাগল শুনে, এরকম ছটফটে মেয়ে তো কলকাতার  বেবিও ছিল না, যার কাছে ডেভিড গারসিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলুম আমরা ।

           মামুদ জোহের বুঝতে পারল মেয়েটার কথা, জবাবে বলল, মিলনে পর খা লেতা হুঁ, সর সে পাঁও তক।

          “হুরররররররররে” বলে চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা, আর আমাদের দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে নিজের দিকে টানল । মামুদ জোহের বলল, কি করছিস কি, আরেকটু হলেই অ্যাকসিডেন্ট হতো।

           রাস্তার ধুলো জানলা দিয়ে এসে মেয়েটার মুখে চুলে ভুরুতে ছেয়ে গিয়েছিল । বললুম, তোমার ভুরু, চোখের পাতা আর চুলে ধুলো জমছে । আমার কথা পুরো হবার আগেই মেয়েটা ওর মুখ আর মাথা মুছে ফেলল আমার বুকে, আমি স্তম্ভিত, বলা যায় স্পর্শমুগ্ধ, জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে হচ্ছিল, চুমু খাবার ইচ্ছে হচ্ছিল, মেয়েটার মুখ থেকে মাছের গন্ধ পেলুম, মাছের গন্ধের চুমুর মতন চুমু হয় না । সামলাতে না পেরে, আচরণে যোগানো সাহসে, জড়িয়ে ধরে খেয়েই ফেললুম চুমু । একটা চুমুতেই যেন ব্যাংকশাল কোর্টের ভুত নেমে গেল।

            —নট অ্যালাউড, নট অ্যালাউড, বলে উঠল মামুদ জোহের, ইউ হ্যাভ টু উইন হার ইন টুডেজ গেম।

            —আনাড়ি হ্যায় বেচারা, জানে দো, জানে দো, মুঝে প্যার সে বহুত প্যার হ্যায়, জোহেরকে বলল মেয়েটা । তারপর আজকে কতোজন, কোথায় যাওয়া হচ্ছে, কোঅর্ডিনেটর কে ইত্যাদি জিগ্যেস করায় বুঝতে পারলুম যে না-না গ্যাঙের কাজকারবারের সঙ্গে মেয়েটা পরিচিত, প্রায়ই একে সঙ্গে নিয়ে ফুর্তি করতে বেরোয় মামুদ আর এরিক পেজরা । মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছিলুম কেমনতর হাফগেরস্হ যৌনকর্মী ।

            —কি দেখছো গো অমন করে ? জিগ্যেস করে শেফালি বা টু আচমকা আমার নাকে নাক ঠেকিয়ে বলে উঠল, আমাকে দেখছো তো, কখনও এরকম কালো রঙের রাধা দ্যাখোনি, না ? এই নাও, দ্যাখো । তারপর বলে উঠল, তুমি প্রেম-টেম করোনি এখনো ?

           —আরে উ লন্দিফন্দি কা গুরু হ্যায়, এক নম্বরকা লুচ্চা-লফংগা। বলে উঠল মামুদ জোহের ।

           —লন্দিফন্দি । চোখে চশমা, এরকম প্যাংলা চেহারা দেখে তো মনে হয় না তুমি লন্দিফন্দির মানুষ । দেখবো অখন একদিন, তোমার চান্সও আসবে, পালিয়ে তো আর যাচ্ছি না, বলল শেফালি ।

          —আমরা কোথায় যাচ্ছি ? কেমনধারা বন্দোবস্ত ? জানতে চাইল কালো মেয়েটা, কৃষ্ণকলি কোনো মেয়ের নাম হলে এর নাম তার চেয়েও কালো কিছু হবে, এতো কালো তবু আমার নিরাময়ের কাজ করছিল মেয়েটা, ভুলিনি আজও, কাউকে-কাউকে নিখুঁত মনে থাকে, কৌমার্যের বিকার থেকে মুক্ত করে দ্যায় তারা, রক্ষণশীলতার ভয় থেকে যে ক্লীবত্ব জন্মায় তা থেকে ছাড়িয়ে আনে, যৌনবিকারই সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করে তোলে, তাই হয়তো জমিদারদের ছিল বৌবাজার, রক্ষিতা, সম্রাটদের ছিল বাঁদি, ক্রীতদাসী । আমার পক্ষে অ্যাডজাস্ট করা কঠিন হয়ে চলেছে চারিদিকের ঘটনার সঙ্গে ।

          জোহের আগেই জানিয়ে দিয়েছিল যে প্রথমে রাজগিরে গিয়ে সবাই জড়ো হবে দেবেন্দরের বাবার পেল্লাই বাড়িতে, সেখানে এক রাত হইচই করে কাটিয়ে পরের দিন খেলতে যাওয়া হবে নালান্দার ধ্বংসাবশেষে । তখনও নালান্দার ধ্বংসাবশেষকে এখনকার মতন সাজিয়ে তোলা হয়নি । শেফালি ঢুকে যাবে আগে, তারপর পুরো দলটা ঢুকে ওকে খোঁজার চেষ্টা করবে । যে প্রথম খুঁজে পাবে তার সঙ্গেই রাতটা কাটাবে শেফালি, দেবেন্দরের রাজগিরের বাড়ির পালঙ্কে, অন্য সবাই মদ-মাংস খেয়ে মাতলামি করবে, কিংবা গ্রাম থেকে দেবেন্দর কয়েকজন বউকে এনে রেখেছে, ওদের বাড়ির পুরুষদের রাখেল, তাদের সঙ্গে ইচ্ছে করলে শুতে পারে ।

          আমি মেয়েটার কাছ থেকে যা পাবার পেয়ে গিয়েছিলুম, নালান্দার ধ্বংসাবশেষের ভেতরে ঢুকে ছায়ায় বসে রইলুম আর দেখলুম সহকর্মীদের দৌড়ঝাঁপ, শেফালিকে খুঁজতে হন্যে হয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে । অভিজিৎ জিতেছিল । আমি কেবল গেঁজিয়ে ছিলুম মেয়েটার সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে । পরের বার ওরা খেলতে গিয়েছিল শোনপুর মেলায়, আমি যাইনি, কেননা খেলাটা বেশ ক্লান্তিকর, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দুদিন ধরে হেদিয়ে বেড়ানো । শোনপুর মেলায় যে জিতেছিল সেই সহকর্মী যৌন-নৌকোবিহারের নৌকো থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল ।   

    তিরিশ      

             হাতে তো অফুরন্ত সময়, ব্যাংকশাল কোর্টে সাজা আর হাইকোর্টে কেস ওঠার সময় পর্যন্ত । হাংরি আন্দোলন সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল দুজন আর্টিস্টের সঙ্গে, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় আর অনিল করঞ্জাই। ওরা বেনারসে থাকত । ওদের ডাকে চলে গেলুম বেনারসে, হিপি-হিপিনীদের জমঘটে । গাঁজা, চরস, আফিম, এলএসডি মাখানো ব্লটিং পেপার । করুণানিধান বললে, হ্যাঁ-হ্যাঁ, হিপিনীদের, যাদের পুরুষ সঙ্গী নেই তাদের চুমু খাবার প্রস্তাব দিতে পারো, ওদের কাছে এলএসডি ক্যাপসুলও পাবে বাহাত্তর ঘণ্টার ট্রিপের, তখন তোমার সঙ্গে হিপিনীটা কী করছে টের পাবে না । আমি চাইছিলুম ফরাসি বা জাপানি কোনো যুবতীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে । করুণা বললে, সবকটা মার্কিন মেয়ে, যেসব ছেলেগুলো ভিয়েতনাম যুদ্ধ এড়াতে নানা ক্যারদানি করেছে তাদের সঙ্গে পোঁ ধরে এসেছে আর বদলা-বদলি করেছে বা ছেড়ে দিয়েছে । করুণার সুবিধে ছিল যে ও ইংরেজি জানতো না, হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে দোভাষী থেকে প্রেমিকে পালটে নিতে পারতো নিজেকে। দ্বিতীয়ত গাঁজা, চরস আর আফিম মিশিয়ে করুণা একটা কনককশান তৈরি করে চারমিনারে ভরে বেচতো হিপিদের, আর হিপিরা তা পাবার জন্যে ওর করায়ত্ত হয়ে গিয়েছিল বলা যেতে পারে । আমি এর কিছুটা হদিশ দিয়েছি “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসে।

             নতুন ধরণের প্রেমের সঙ্গে পরিচিত হলুম, যেখানে দুপক্ষই জানে যে এই সম্পর্কের নিশ্চিত এক্সপায়ারি ডেট আছে, সারা জীবন বইতে হবে না, মন ভরে গেলে ছেড়ে দাও, বাতাসে যৌবনের মাংসল মাদকের গন্ধ । আমাকে এই পরিস্হিতি ক্রমশ গিলে ফেলতে আরম্ভ করেছিল, সাপের মতন একটু একটু করে গোলাপি অন্ধকারে, স্নান না করা দেহের সুবাস আর বহুদিন না-কাচা পোশাকের সোঁদা স্বর্গীয় সুষমা । সবচেয়ে ভালো লেগেছিল একজন হিপিনীর বগলের সোনালী চুল ; আগে ধারণা ছিল না যে বগলের চুলও সোনালী হয়, চুলের গহ্বরে ভালোবাসার নাচ, গর্ভনোরিধক বড়ি না বেরোলে বোধহয় যুবতীরা হিপিনী হয়ে বাড়ি ছাড়তো না । হিপিনীসঙ্গ করে যে সারকথা মগজে ঢুকেছে তা হলো দুটো দেহের মাঝে পারফিউম ব্যাপারটা  বিকৃতির দেয়াল ।

            করুণা-অনিল যখন কাঠমাণ্ডু থেকে ফিরে আমাকে ওদের সঙ্গে বেনারসে নিয়ে গিয়েছিল, মোটা যুবতী ম্যাডেলিনের সঙ্গে সময় কাটিয়ে, আর তার আগে কাঠমাণ্ডুতে ক্যারল নোভাকের সঙ্গে স্লিপিংব্যাগে ঢুকে বুঝতে পেরেছিলুম যে লেখালিখি সম্পর্কে হিপিদের তেমন আগ্রহ নেই যেমন ছিল বিটনিকদের, যদিও বিট আন্দোলনের ফলেই ওদের আবির্ভাব, সাইকেডেলিক সঙ্গীত, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধীতা, যৌনবিপ্লব, মাদক বিশেষ করে গাঁজা, এল এস ডি আর ম্যাজিক মাশরুম, হিন্দু আর বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহ, খ্রিস্টধর্মকে পরিত্যাগ, ভালো খাওয়া, গান্ধির অহিংসা, সাংস্কৃতিক মতবিরোধ ইত্যাদির জন্যে সেসময়ের বেনারস আর কাঠমাণ্ডু ছিল উপযুক্ত শহর । শহরবাসীরা তাদের কাজকারবার নিয়ে চিন্তিত ছিল না, এমনকি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চুমু খেলে, জড়িয়ে ধরলেও গা করতো না কেউ। এখন অবশ্য ভয়ংকর অবস্হা । সেসময়ে করুণা একজন যুবতীর সঙ্গে গঙ্গার অপর পাড়ে চড়ায় গিয়ে খড়ের ছাওয়া-পোঁতা বাঁশের খুঁটির কুটিরে থাকতো, দুজনেই একেবারে উলঙ্গ, “প্রিহসটরিক লাইফে”, অবাক হয়ে গিয়েছিলুম নৌকো থেকে নেমে। করুণা উলঙ্গ জীবনের ফোটোও তুলেছিল একাধিক, নিজের বউকেও দেখিয়েছিল সেসব । ওর বউ সম্ভবত বিরোধিতা করেনি, নিয়মিত রোজগার হচ্ছে মনে করে, কেননা করুণা তার আগে বইয়ের মলাট এঁকে টায়েটুয়ে সংসার চালাতো ।

             কলকাতা থেকে, ব্যাংকশাল কোর্টে সাজা পেয়ে আর হাইকোর্টে রিভিশন পিটিশন করে, আমি পাটনায় ফিরে আসার কিছুদিন পর করুণা কাঠমাণ্ডু থেকে আহ্বান পাঠালো, “শিগগির চলে এসে অফুরন্ত চরস আর মেয়েছেলে, খামের ভেতরে কিছুটা আফগানি চরস আছে”। খামের ভেতরে ছিল হাই কোয়ালিটি চরস । এখন হলে তো জেল হয়ে যেতো । তখন সরকারি দোকানে সত্যমেব ছাপমারা পুরিয়াতে পাওয়া যেতো, অ্যালেন গিন্সবার্গ যখন এসেছিল, ওকেও নিয়ে গিয়েছিলুম সরকারি দোকানে ।

            কাঠমাণ্ডু যাবার আগে রাজকমল চৌধুরী, হিন্দি কবি, আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওর গ্রামে মাহিষিতে। ফণিশ্বরনাথ রেণু বলেছিলেন, ওর গ্রামে ছিন্নমস্তাদেবীর পুজোর সময়ে যেও, একেবারে পাগল হয়ে যাবে । সত্যিই উন্মাদনা । পুজোর সময়ে মোষ বলি দেয়া হয়েছিল, যারা মানত করেছিল, সকলেই মোষ বলি দেবার জন্য এনেছিল, দেখে আমার বমি পাবার যোগাড়, রাজকমলের দেয়া পানীয় খেয়ে সামলালুম, আর সবাই মৈথিলি গান গাইতে-গাইতে গায়ে-মুখে রক্ত মেখে যেভাবে নাচছিল, আমিও দু’হাত তুলে নাচলুম । পানীয় আর নাচের দৌরাত্ন্যে সন্ধ্যাবেলা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলুম, এরকম সমবেত ফ্রি ফর অল নাচ, আগে  নাচিনি কখনও ।

            অ্যালেনের কথাটা আগে বলে নিই তারপর কাঠমাণ্ডুতে করুণার আস্তানায় যাবো । গিন্সবার্গ এসেছিল ১৯৬৩ সালের এপ্রিল মাসের গরমে, মাথায় সিঁদুরের টিপ, গঙ্গায় স্নান করে, কাঁধে গামছা, আর বাবাকে হিন্দিতে জিগ্যেস করেছিল, “মলয় হ্যায়” । রোদে পুড়ে ওর গায়ের রঙ তামাটে হয়ে গিয়েছিল বলে বাবা ভেবেছিলেন কোনো সন্ন্যাসী, কেননা মাঝে আনন্দমার্গের কয়েকজন সন্ন্যাসী এসে ঢুঁ মেরেছিল ওদের পত্রিকায় আমার লেখার জন্য, তখন তাদের ভাগিয়েছিলুম । বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন, অ্যালেন নিজের পরিচয় দিতে, নিয়ে গেলুম ওপরে আমার ঘরে । সত্যি বলতে কি তখনও পর্যন্ত আমি বিট আন্দোলনকারীদের বিষয়ে তেমন জানি না, গিন্সবার্গের নাম দাদার কাছে শুনেছি, কাগজে পড়েছি, কিন্তু “হাউল” কবিতার কথা শুনিনি । “হাউল” আর “ক্যাডিশ” আমাকে পাঠিয়েছিল লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, গিন্সবার্গ ফিরে যাবার পর, “ক্যাডিশ”এর লঙ প্লেইং রেকর্ডও পাঠিয়েছিল, যেটা শুনে অনুবাদ করতে সুবিধা হয়েছিল । ম্যাগাজিন ইত্যাদি পরে পাঠিয়েছিল হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড, আর সেই সূত্রে বেশ কয়েকজন সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গিয়েছিল যারা আমার লেখা প্রকাশ করা আরম্ভ করেছিল ।

            গিন্সবার্গ যখন এসেছিল তখন আমাদের বাড়িতে ডাইনিং টেবিল আর বসবার সোফাসেট ছিল না । আমার ঘরে সিলিং ফ্যান ছিল না । মা ওকে মেঝেয় আসন পেতে খেতে দিতেন আর ওর সঙ্গে বাংলা-হিন্দিতেই কথা বলতেন, গরম বলে সামনে বসে হাতপাখায় হাওয়া করতেন । পাটনা দেখার জন্য রিকশা ভাড়া করলুম ; গিন্সবার্গ বলল, এই রিকশাঅলাটা আমার বাবার বয়সী, একে দিয়ে রিকশা টানিয়ে তাতে বসে থাকতে বেশ অপরাধ হচ্ছে । রিকশঅলাকে আমার পাশে বসিয়ে নিজেই রিকশ টানতে আরম্ভ করল, কিছুটা যাবার পর রাস্তায় একজন কন্সটেবলকে দেখে রিকশঅলা বলল, বাবু ওই দেখুন সামনে, আপনি চালাচ্ছেন দেখে ও যদি ধরে তাহলে লাইসেন্স তো যাবেই, হাজতেও পুরে দিতে পারে ।

           আমরা স্তুপের আকারের গোলঘরে গেলুম ; স্তুপটা ২৯ মিটার উঁচু, ১২৫ মিটার চওড়া, ওপরে উঠতে ১৪৫টা সিঁড়ির ধাপ। গোলঘর তৈরি হয়েছিল ১৭৮৬ সালে, ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষে লক্ষ-লক্ষ মানুষ বাংলা আর বিহারে মারা যাবার পর, চাল-গম রাখার জন্য, গিন্সবার্গ যখন এসেছিল তখনও চাল-গম মজুত করা ছিল গোলঘরের ভেতরে । এখন অবশ্য বিনোদনের জন্য ব্যবহার করা হয়। গোলঘরের ভেতরে প্রথমে ঢুকতে দেয়নি কেয়ারটেকার । আমি বললুম যে উনি বিদেশী, তখন ঢুকতে দিল । গিন্সবার্গ ওর “সানফ্লাওয়ার সূত্র” কবিতাটা আবৃত্তি করল । গোলঘরের ভেতরে চেঁচালে একুশবার প্রতিধ্বনি হয়, অবাক গিন্সবার্গ বলল, টেপরেকর্ডার আনলে ভালো হতো । আমার কাছে ছিল না যে পরের দিন এসে রেকর্ড করব। আমাকেও আবৃত্তি করতে বলল আমার কবিতা । আমি আমার কবিতা মুখস্হ রাখতে পারি না । “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতার শেষ চার লাইন যতটুকু মনে ছিল আবৃত্তি করলুম । গিন্সবার্গ বলল, তোমার কন্ঠস্বর আবৃত্তির জন্য বেশ ভালো, রেকর্ড করো না কেন । বললুম না যে গ্যাঁটে তেমন কড়ি থাকে না। গোলঘরের ওপরে উঠলুম, গঙ্গা, গঙ্গার ওপার আর পুরো পাটনা শহর দেখল গিন্সবার্গ । ওপর থেকে বা বাইরে থেকে গোলঘরের ফোটো তুলল না কোনো । আমি নিজেকে কখনও তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনি বলে বিখ্যাত লোকেদের পাশে দাঁড়িয়ে ফোটো তোলানো হয়ে ওঠেনি ।

            পরের দিন গেলুম গঙ্গার পাড়ে, মহেন্দ্রু ঘাটে, তখনকার দিনে বাচ্চাবাবুর জাহাজ ওই ঘাট থেকে ওপারে শোনপুরে যেতো, এখন তো গঙ্গার ওপর পোল তৈরি হয়ে গেছে, বাচ্চাবাবুর জাহাজও চলে গেছে অন্য কোথাও । কিছুক্ষণ জাহাজে ঘোরাফেরা করার পর ফেরার রাস্তায় ভিকিরিদের আস্তানাগুলোর ফোটো তোলা আরম্ভ করল গিন্সবার্গ, খোঁড়া, নুলো, জটাজুট, কুষ্ঠরোগি, রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে থাকা প্যাংলা চেহারার লোক, ইত্যাদি । ফিরে, ফিল্মটা বাবাকে ডেভেলাপ করতে দিয়েছিল । বাবা ডেভেলাপ করার পর পুরো ছত্রিশটা ছবি দেখে খেপে গেলেন, গিন্সবার্গকে বললেন, তোমরা বিদেশিরা কবি হও বা ট্যুরিস্ট, ইনডিয়ায় এসে কেবল এই সবই দেখতে পাও, ভালো কিছু দেখতে পাওনা, ফিরে গিয়ে এগুলো নিয়ে ব্যবসা করবে। গিন্সবার্গকে পরে আমি বললুম যে এবার তোমার ফিল্ম অন্য দোকানে ডেভেলাপ প্রিন্টিং করতে দিও । গিন্সবার্গ ছবি তুলে ডেভেলাপ করিয়ে তাড়াগুলো পাঠিয়ে দিতো ওর সৎমাকে, তিনি ওর পাঠানো যাবতীয় জিনিস দেশ অনুযায়ী আলমারিতে সাজিয়ে রাখতেন, তাই কিউরেটার বিল মরগ্যান, যে আমার সঙ্গে নাকতলায় দেখা করতে এসেছিল, তার সুবিধা হয়েছিল । তবে বাবা যা আঁচ করেছিলেন দেখলুম তা সত্যি, ওর “ইনডিয়া জার্নালস” বইতে ওই সমস্ত নুলো, খোঁড়া, জটাজুটদের ফোটো পাতার পর পাতায় ।

           তার পরের দিন ওকে নিয়ে গেলুম পাটনা মিউজিয়ামে, কতো বছর পর, মিউজিয়ামের ঘরগুলো আমার চেনা, এখানে বড়োজ্যাঠা চাকরি করতেন, গিন্সবার্গ ঘুরে-ঘুরে দেখলো । মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে খুদাবক্স লাইব্রেরি । হাতে লেখা ফার্সি বইগুলো দেখলো গিন্সবার্গ । অবাক হয়ে গেল দেখে যে আকবরের সমাধির বাইরে তিনটে মাছের দেহ আর তার একটা মাথার যে ড্রইং ও নিজের খাতায় তুলে এনেছে তা খুদাবক্স লাইব্রেরির একটা বইয়ের মলাটে রয়েছে, গ্রন্হাগারিক জানিয়েছিল যে বইটা আকবরের লেখা “দীন-ই-ইলাহি”। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান সহপাঠীরা আকবরের এই বইটার প্রসঙ্গ উঠলেই কটু সমালোচনা করত ।

            পাটনায় ওকতাভিও পাজও এসেছিলেন, আমাদের বাড়ি, কিন্তু তাঁর সঙ্গে ডিসট্রিক্ট ম্যাজিসট্রেট আর পুলিশের গাড়ি থাকায় কোনো সাহিত্য আলোচনা হয়নি । উনি চা-বিস্কুটও খেতে চাইলেন না, হয়তো রাষ্ট্রদূতের প্রোটোকল । বাড়িতে পুলিশের গাড়ি আর কয়েকজন বন্দুকধারী দেখে পাড়ার লোকে ভেবেছিল, “ফির সে সরকারকে খিলাফ কুছ লিখা হোগা।” ওকতাভিও পাজ কলকাতায় গিয়ে আমাদের খোঁজ করেছিলেন । বাইরে থেকে কবি-লেখকরা কলকাতায় এলে কনসুলেটগুলো আনন্দবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করত, আর সন্তোষকুমার ঘোষ তাদের পাঠিয়ে দিতেন নিজের পেটোয়া তরুণ কবি-লেখকদের কাছে; পরে এই একই ট্যাকটিক ধরেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নিজের একটা পেটোয়া ব্যাটালিয়ানই তৈরি করে ফেলেছিলেন ।

             মুম্বাই যখন বোম্বে ছিল, তখন এদোয়ার্দো কার্দেনাল-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ; উনি এসেছিলেন ভারত সরকারের অতিথি বিদেশি কবিদের দলের সঙ্গে । আমি কেবল ওনার নামই জানতুম । প্রথমে এয়ারপোর্টে আর তারপর ওনার হোটেলে গিয়ে দেখা করেছিলুম । বলেছিলেন লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির ‘সিটি লাইটস জার্নাল’-এ আমার কনট্রোভার্সিয়াল কবিতাটা পড়েছেন । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার অনুবাদ  ‘স্টার্ক ইলেকট্রিক জিজাস’ প্রকাশিত হয়েছিল আরও কয়েকটা কবিতার সঙ্গে । আমি তখনও ওনার কবিতা বিশেষ পড়ে উঠিনি । ভারত সরকারের প্রতিনিধি তাগাদা দিতে উঠে পড়তে হয়েছিল ।

            আশির দশকে লখনউ-মুম্বাইতে থাকার সময়ে শিলিগুড়ির অলোক গোস্বামী আর রাজা সরকার যোগাযোগ করেছিলেন, জানিয়ে যে কলকাতায় মরে-যাওয়া হাংরি আন্দোলনকে তাঁরা উত্তরবঙ্গে জিইয়ে তুলেছেন, “কনসেনট্রেশান ক্যাম্প” আর “ধৃতরাষ্ট্র”  পত্রিকার মাধ্যমে । উত্তরবঙ্গে তাঁরা দুজনে এবং মনোজ রাউত, সমীরণ ঘোষ. পল্লবকান্তি রাজগুরু, চন্দন দে, বিজয় দে, সমর রায়চৌধুরী, শ্যামল সিংহ, দিবাকর ভট্টাচার্য, ত্রিদিব চক্রবর্তী, দীপঙ্কর কর, প্রবীর শীল, রতন নন্দী, কিশোর সাহা, কুশল বাগচি, সুমন্ত ভট্টাচার্য, মলয় মজুমদার প্রমুখ বেশ হইচই ফেলে দিয়েছেন । তাঁরা যে হাংরি আন্দোলনের পালে নতুন হাওয়া আনছেন তা সহ্য হল না শৈলেশ্বর ঘোষের, উত্তরবঙ্গে গিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে পত্রিকাগুলোর বারোটা বাজিয়ে দিলে । শৈলেশ্বরের মনে হয়ে থাকবে যে উত্তরবঙ্গের যুবক কবি-লেখকরা সব লুটেপুটে খেয়ে নিচ্ছে, হাংরি আন্দোলন বুঝি বেহাত হয়ে গেল । সুভাষ ঘোষকেও পিটুনি খেতে হয়েছিল শৈলেশ্বর ঘোষের চামচাদের হাতে, একই কারণে । মানে ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকাও দুই ভাগ হলো ।

            যাক, এবার ফিরে আসি করুণার কাঠমাণ্ডু নিমন্ত্রণে । বাচ্চাবাবুর জাহাজে করে শোনপুর, সেখান থেকে ট্রেনে করে রকসওল । ট্রেনটা ছিল অন্ধকার, একজন হুঁশিয়ারি দিয়ে গেল ‘সবকোই আপনা সামান অপনে সাথ রখিয়ে’ । সামান বলতে থলেতে দুটো প্যান্ট দুটো বুশশার্ট আর টুথব্রাশ-পেস্ট, চুমু খাবার সুযোগ পেলে রোজ দাঁত মাজতে হবে বলে, ওয়াচ পকেটে টাকা । সঙ্গে ছিল দাদা সমীর, সুবিমল বসাক আর বেনারসের কাঞ্চনকুমার মুখোপাধ্যায় যে পরে নকশাল আন্দোলনে যোগ দেবার ফলে প্রথমে বেনারসের আর পরে কলকাতা পুলিশের নেকনজরে পড়েছিল । ওর ছোটোভাই ছিল কলকাতা পুলিশে, ওর নকশাল সক্রিয়তার জন্য ভাইকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছিল । হাংরি আন্দোলনের সময়ে যখন মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না তখন কাঞ্চনের ভাইয়ের পুলিশ কোয়ার্টারে, ভবানী ভবনের পেছনে, দু’রাত কাটিয়েছিলুম।

    একত্রিশ

             রকসওলে পৌঁছে এক্কাগাড়িতে চেপে আন্তর্জাতিক গেট পেরিয়ে ঢুকলুম বীরগঞ্জে ; কাঠমাণ্ডু যাবার বাসের টিকিট আগেই কিনে নেয়া হলো যাতে না পেছনে বসতে হয় । ভারতের দিকের রাস্তাটা একেবারে উবড়োখাবড়া, এখন জানি না কেমন । তবে নেপালে ঢুকে বোঝা গেল ওদের রাস্তাটা ভালো । হাতে সময় ছিল বলে গহওয়া মাই মন্দির দেখতে গেলুম, দুর্গার মন্দির ছিল সম্ভবত, সেখানে ছায়ায় বসে, বেরিয়ে রেস্তরাঁয় খেয়ে বাসে চাপলুম । শোনপুর থেকে ভোজপুরি বুলিতে কথা আরম্ভ হয়েছিল তা চলল বীরগঞ্জ পেরিয়ে অমলেখাগঞ্জ আর হেতারতা পর্যন্ত, সর্বত্র মারোয়াড়িরা ব্যবসা দখল করে ফেলেছে, কর্মচারীরা বিহারি, নেপালিদের কথায় মধেশি । বাসে কাঞ্চনের বমি হল কয়েকবার, ওর পেছনের একজন নেপালি বউ ওর কাঁধে হাত দিয়ে পেছন ফিরে হাঁ করতে বললে কাঞ্চন কোনো প্রশ্ন না তুলে বউটার দেয়া সাদা গুঁড়ো খেয়ে নিল, বউটা বলল, আর বমি হবে না । নেশার কিছু ছিল সম্ভবত, কেননা কাঞ্চন তারপর সারাটা পথ ঝিমিয়েছে, নদীর পাশ দিয়ে,  ত্রিভূবন রাজপথের দৃশ্য দেখার সুযোগ পায়নি ।

            করুণা অপেক্ষা করছিল বাসস্ট্যাণ্ডে, ওর পেছন-পেছন আমরা চললুম, গিয়ে ঢুকলুম একটা বিরাট চালাবাড়ি চত্ত্বরে, তিনতলা চালাবাড়ি চত্ত্বর, প্রায় একশো মিটার দৈর্ঘ্য আর পঞ্চাশ মিটার প্রস্হ, একটা সিংহদ্বার দিয়ে ঢুকতে হল, যেটা সব সময় খোলাই থাকে, কখনও হয়তো খোলা-বন্ধর রেওয়াজ ছিল। বাঁশের পাকানো সিঁড়ি দিয়ে উঠলুম দুতলায়, করুণা আগেই বন্দোবস্ত করে রেখেছিল একটা ঘর, মেঝেতে খড়ের ওপর চাদর পাতা বিছানা, বালিশ নেই, ভাড়া মাথাপিছু মাসে একটাকা । পাড়াটার নাম ঠমেল । চারিদিকে সরু-সরু গলি, বেরোতে আর ঢুকতে গোলমাল হয়ে যেতো অনেক সময়ে । বাড়ি চত্ত্বরে একশো জনেরও বেশি ভাড়াটে, তার মধ্যে হিপি-হিপিনীই বেশি । করুনা জানালো, হাংরি আন্দোলনের নাম করে নেপালি সাহিত্যিক বাসু শশীর সঙ্গে বন্দোবস্ত হয়ে গেছে, আমাদের খাবার খরচ নেপালি সাহিত্যিকদের সংস্হা দেবে, থাকার খরচ আমাদের যার-যার । একটা রেস্তরাঁয় গিয়ে খেতুম আর রেজিস্টারে সই করে দিতুম । তবে প্রতিদিন রেস্তরাঁয় খাবার দরকার হতো না, কেননা পাটন, ভক্তপুর, ভরতপুর, পোখরা ইত্যাদি জায়গা থেকে কবিতা পাঠের বা আড্ডার নেমন্তন্ন আসতো, রাতে থেকেও যেতে হতো কখনও-সখনও ।

            কাঠমাণ্ডু থেকে বিভিন্ন্ জায়গায় যাতায়াতের জন্যে পেয়ে গিয়েছিলুম একজোড়া হিপি-হিপিনী, তারা একটা ম্যাটাডর ভ্যান লিজ নিয়ে স্কুলের বাচ্চাদের বিনি পয়সায় স্কুলে পৌঁছে দিতো, আমাদেরও পৌঁছে দিতো বিভিন্ন শহরে কবি-লেখকদের জমঘটে । পড়তুম “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার”-এর ইংরেজি অনুবাদ “স্টার্ক ইলেকট্রিক জিজাস” চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে । নেপালি ভাষায় অনুবাদও করেছিল রমেশ শ্রেষ্ঠ নামে একজন কবি, সে এখন ব্যাংককে থাকে, একজন থাই যুবতীকে বিয়ে করে । থাইল্যাণ্ডের খাবারের বেশ প্রশংসা করে অনেকে, আমার কিন্তু বিস্বাদ লাগে । তার চেয়ে মুম্বাইতে মহেশ লাঞ্চ হোমের অক্টোপাসের বড়া খেতে ভালো লাগে।

            কবিতা পাঠের আসরগুলোয় নানা রকমের চোলাই করা নেপালি আর নেওয়ারি দিশি মদ খাবার সুযোগ হয়েছে, খেয়ে মাতাল হবার সুযোগ । যেমন রাক্সি, বেশ নেশা হয়, ভোদকার মতন স্বচ্ছ, চাল পচিয়ে তৈরি, খেতে অনেকটা জাপানি সাকের মতন, জাপানে যাইনি যদিও, সাকে খেয়েছি থাইল্যাণ্ডে । তারপর আরা, চাল ভুট্টা গম পচিয়ে । আয়লা, চাল আর জোয়ার পচিয়ে । ছাং, জানি না কি পচিয়ে । তোংবা, জোয়ার পচিয়ে । আয়লা হল নেওয়ারি মদ, কবি পারিজাতের বাড়িতে খেয়েছিলুম, উনি নেওয়ারি, শিলিগুড়িতে ওনার মূর্তি আছে । মোষের কাঁচা মাংস খেয়েছি কয়েক জায়গায়, হরিণের মাংসের আচার । আর হ্যাশিশ তো বটেই, প্রায় প্রতিদিন, যে কোনো মন্দিরে সন্ধ্যাবেলায় গিয়ে বুড়োদের জমায়েতে বসলেই, ছিলিম ঘুরে চলে আসতো, তিনচার ফুঁক দিলেই আকাশে ওড়া আরম্ভ ।

            সুবিমল বসাক, কাঞ্চন আর দাদা ফিরে যাবার পর আমি থেকে গিয়েছিলুম । করুণা বলেছিল ওদের চলে যেতে দাও, তোমার কথা এখানে চাউর করে রেখেছি, অনেকে টাইম ম্যাগাজিনের খবর জানে আর গিন্সবার্গের বন্ধু শুনে তোমার বসার সিংহাসন তৈরি করে রেখেছে । বাড়িটার সিঁড়ি এমন ছিল যে হ্যাশিশের নেশা করে ফিরে অনেক সময়ে টের পেতুম না কোন পাক দিয়ে কোন তলায় উঠে যাচ্ছি । একবার এরকম পাক দিয়ে উঠলুম আর নামলুম, কয়েকবার অমন ওঠানামার পর একটা ঘরের দরোজার নোংরা পর্দা থেকে একজন লাল-ব্লাউজ যুবতীর হাত আমায় ভেতরে টেনে বলল, প্রতিদিন দরোজা ওব্দি আসো আর ফিরে যাও কেন ; তার টানে আর আমার হ্যাশিশাক্ত টলমলে শরীর গিয়ে পড়ল স্বাস্হ্যবতী নেপালিনীর বুকের ওপর । দেখে বুঝলুম ওটা যৌনকর্মীদের দিশি মদের ঠেক ; মদ খাবার মতন অবস্হা ছিল না, যুবতীর গায়ের গন্ধে টেকা দায়, বুকে মুখ গুঁজে একটা নেপালি টাকা দিয়ে বেরিয়ে এলুম । মোঙ্গোলয়েড তরুণীদের আমার চিরকাল ভালোলাগে ।  পরের দিন হুঁশ এলে ঘরটা আর খুঁজে পাইনি, গোটাকতক সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেও ।

             করুণা পরিচয় করিয়ে দিল কয়েকঘর হিপি-হিপিনীর সঙ্গে, যারা গিন্সবার্গের আর ফেরলিঘেট্টির ভক্ত, ‘সিটি লাইটস জার্নাল’ এর কথা জানে । ওদের ঘরে আড্ডা মারার, হ্যাশিশ ফোঁকার আর এলএসডি ভেজানো ব্লটিং পেপার খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকার স্বাধীনতা পেয়ে গেলুম । একজন ছিল নিউমেরোলজিস্ট, সে বলল আমার নামের যোগফল হল এক, তাই সব ব্যাপারেই তুমি প্রথম সুযোগটা পাবে । সেইদিন রাতেই একটা স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে টেনে নিল আমাকে জনৈকা হিপিনী, তার নাম ক্যারল নোভাক, ঢুকে গেলুম আর একে আরেকের মাথার দিকে পা করে শুয়ে পড়লুম। এটাই আমার জীবনে বিদেশিনীর প্রথম মুখমেহন । করুণা আমাদের দুজনের জন্যে একটা ঘর ভাড়া করে দিলো, আমি আরেকবার হয়ে গেলুম “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসের শিশির দত্ত আর ক্যারল নোভাক হয়ে গেল ম্যাডেলিন করিয়েট । জীবনে যৌনতার আহ্লাদ শিখিয়ে গেছে ক্যারল নোভাক আর ম্যাডেলিন করিয়েট। “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসে ম্যাডেলিন করিয়েটের মুখে রসুনের ট্যাবলেট খাবার গন্ধের কথা লিখতে ভুলে গেছি । রসুনের স্বচ্ছ ট্যাবলেট, প্রতিদিন একটা ।      

             মার্কিন যুবতীটি,  ক্যারল নোভাক, আমার ‘ভালোবাসার উৎসব’ কাব্যনাট্যে অন্তর্ভুক্ত করেছি । হাংরি আন্দোলনে বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতার পর একজন বন্ধুনি পাওয়া গিয়েছিল, যার সঙ্গে করুণার ভাষায় ‘চিউউইংগামের মতন’ চিপকে যেতে পেরেছিলুম । দাদা, সুবিমল ওরা চলে গিয়েছিল বলে আরও ফ্রি ফিল করা শুরু করেছিলুম । ফেমিনিজম বা নারীবাদ ব্যাপারটা ওর কাছেই প্রথম জেনেছিলুম, বডিস পরত না, বলত “উওমেন অন টপ”। প্রেমহীন ভালোবাসা, অসাধারণ অভিজ্ঞতা, কোনো প্যানপানানি নেই । বাঙালি প্রেমিকা সংসর্গের সময়ে বলত, “ভালোবাসি, তোমায় ছাড়া বাঁচবো না, এরকম কথা বলো না কেন এই সময়ে, ভাল্লাগবে” । ক্যারল বলত, “জন্তুদের মতন জান্তব আওয়াজ করো না কেন, আমি যেমন করছি”। দুটোর কোনোটাই সম্ভব হয়নি আমার দ্বারা । বলতো, “চুমু খাবার মতন শ্বাসপ্রক্রিয়া আর দ্বিতীয়টি নেই, ঠিক যেন সার্জিকাল ভেন্টিলেটার ।”

             করুণা একজন আফ্রকান আমেরিকান যুবতীর সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়েছিল, যার পেইনটিঙের গ্যালারি ছিল, সেখানে প্রদর্শনী করলেও করুণার ছবি বিক্রি হয়নি, অনিলের কয়েকটা ছবি বিক্রি হয়েছিল । কেমন করে যে করুণা যুবতীদের আকর্ষণ করতে পারতো তার ক্লুটা জানতে পারিনি । করুণা ওর পেইনটিঙগুলো জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দিলে, সেই আগুন ঘিরে রাক্সি খেয়ে নাচলুম আমরা আর সমবেত হিপি-হিপিনীরা, করুণা সকলের কপালে ছাইয়ের তেলক কেটে দিল । সকলে মিলে এলভিসের ‘জেল হাউস রক’ গাইতে গাইতে ঠমেলে ফিরল, গানটার পঁয়তাল্লিশ আর পি এম রেকর্ড ছিল আফ্রিকান-আমেরিকান যুবতী গ্যালারিস্টের কাছে ।

             ক্যারল দেশে ফিরে গেলে আমিও ফিরলুম, চিনে ছাপানো মাও-এর একখানা রেডবুক কিনে । ক্যারলের সঙ্গে হুটোপাটিতে আমার চশমা ভেঙে গিয়েছিল । অনিল-করুণা থেকে গেল আরও মাসখানেকের জন্যে । কাঠমাণ্ডুর গ্যাঞ্জামে আর জীবনকাটানোয় আমার লেখালিখি আমাকে প্রায় ছেড়ে চলে গিয়েছিল, হাইকোর্টের রায়ের অপেক্ষা করতে হচ্ছিল । ক্যারলের সংস্পর্শে এটুকু তো জানলুম যে প্রেম সবসময় বিট্রে করে না,  ভালোবাসা থেকে যতো পারা যায় শুষে নিয়ে নিজেকে সন্তুষ্ট করে তোলা যায় ।  সমস্যা হলো যে প্রথম যৌবনে, শরীরের মতন পেলেও,  মনের মতন প্রেমিকা পাইনি, বোধহয় এই দুর্ভোগে প্রথম যৌবনে সকলেই ভোগে, তারপর শিক্ষিত হয়ে এগোয় । আসলে আমি কীভাবে বাঁচবো, কীভাবে থাকব, কীভাবে লিখব, তাতে তো কারোর মাথা গলাবার দরকার নেই ।          

             অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান কাঠমাণ্ডু থেকে পাটনা হয়ে বেনারস ফিরল, আমিও চুলের ইন্সটেলাশান আর্ট নিয়ে ওদের সঙ্গ নিলুম। আমার ভয় ছিল যে অনিল না আমায় একটা পেইনটিং উপহার দিয়ে বসে, কেননা দরিয়াপুরের বাড়িতে উপযুক্ত দেয়াল ছিল না, দোতলায় আমার ঘরে ছাদ থেকে জল চুয়ে দয়নীয় অবস্হা, তার ওপর সারাদিন ট্রাক আর বাস যাতায়াতের ধুলো । যাক, দেয়ালের অবস্হা দেখে অনিল বুঝতে পেরে গিয়েছিল যে মলয়কে ছবি দিলে বেশিদিন টিকবে না । বেনারসে পেইনটিং গোছা বেঁধে নিয়ে গেল বটে কিন্তু নকশাল আন্দোলনের প্রতি ওদের দুর্বার টানের ফলে স্টুডিওতে পুলিশ ঢুকে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল । অনিল পালালো দিল্লি হয়ে আমেরিকা আর করুণা দাড়িগোঁফ কামিয়ে সতীশ নাম নিয়ে ১৯৭১ সালে  চলে এলো পাটনা ; দাদা ওকে একটা রঙিন মাছের দোকান খুলে দেবার পর বউ বাচ্চাকে নিয়ে চলে এসেছিল ।

           সুবিমল বসাকের টেলিগ্রামে আর স্টেটসম্যান সংবাদপত্রে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা থেকে রেহাইয়ের খবর পেলুম । অফিস বলল, রায়ের কপি জমা দিতে । কলকাতা থেকে রায়ের কপি এনে অফিসে জমা দিলুম। মামলায় জিতে যাবার পর লেখালিখি প্রায় ছেড়ে গেল, অথচ মুচলেকাপন্হীরা তখনও প্রচার করে চলেছে যে, “মলয় লেখালিখিকে কেরিয়ার করতে চাইছে।”

    বত্রিশ

             চাকরি ফিরে পেয়ে সুবিধে এই হল যে ভিন্ন বিভাগে পৌঁছোলুম, গ্রামীণ উন্নয়নের বিভাগে, অবিরাম ট্যুর করার বিভাগে, আরম্ভ হল আমার নতুন অভিজ্ঞতা, তার আগে চাষবাস সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না আমার, জোয়ার আর বাজরা গাছের তফাত জানতুম না, দুটো বলদ না একটা পুং-মহিষ বেশি ওজন টানতে পারে জানতুম না, টিউবওয়েলের রকমফের জানতুম না, জলের গভীরতার সমস্যা জানতুম না, নদীর নিলামের কথা জানতুম না, বঁধুয়া মজুরের দয়নীয় অস্তিত্বের কথা জানতুম না, হাতের কাজে জাতিপ্রথার প্রভাব জানতুম না, তাঁতশিল্পের রাজনীতি জানতুম না, আলু সংরক্ষণের আর পচে নষ্ট হবার দলাদলি জানতুম না, চাষির আত্মহত্যার কারণ আর ফলাফল জানতুম না, বন্ধক জমিতে চাষ আর ফসল ভাগাভাগি জানতুম না, কফি চাষে যুবতীদের যৌনশোষণ জানতুম না, খনিজের কারণে উপজাতিদের উৎখাতের ফলাফল জানতুম না, কতো রকমের গোরু আর ছাগল হয় জানতুম না, মাছের জাল বোনা আর মহাজনদের প্যাঁচপয়জার জানতুম না, সিলকের শাড়ি বোনায় ধর্মের রাজনীতি আর কোরিয়া-চিনের চোরাচালান জানতুম না, বিডিও দপতরে গরিবদের ল্যাঙ মারার গলিঘুঁজি জানতুম না, ঠিকেদারদের বদমায়েসি কেবল কাগজে পড়েছিলুম প্রকৃতপক্ষে তা কী ভয়ানক জানতুম না, নদীতীরের বালিচুরির নেটওয়র্ক জানতুম না, গ্রামের মহাজনদের ঋণ দিয়ে ফাঁদে ফেলার টেকনিক কেবল গল্পের বইতে পড়েছিলুম কিন্তু তার সঙ্গে রাজনীতির যোগাযোগ জানতুম না, কিশোরীরা সকালে মাঠে হাগতে গেলে তাদের ধর্ষণ করা হয় আর তারা তা চেপে যেতে বাধ্য হয় জানতুম না, একজন যুবতীকে কিনে এনে বাড়ির সব কয়টা পুরুষের স্ত্রী করে রাখা হয় জানতুম না, আরও কতো কি জানতুম না, আকাট ছিলুম, আকাট, বই-পড়া আকাট । লেখালিখি ছেড়ে যাবার, বা বলা যায়, রাইটার্স ব্লকে আক্রান্ত হবার, এটাও একটা কারণ, যে, আমি নিজের মূর্খতার সামনাসামনি হলুম, বুঝতে পারলুম যে ভারতবর্ষকে জানি না, একেবারেই জানি না । অভিজ্ঞতার লাথি খেয়ে ক্রমশ অন্য মলয় রায়চৌধুরী হয়ে উঠলুম, বস্তুত লুকিয়েই ফেললুম নিজেকে, দাড়ি-গোঁফ বাড়িয়ে এম. আর. চৌধারী নামের মধ্যে ।

             চাষিদের জীবন সম্পর্কে যেটুকু জানতুম তা সহপাঠীদের গ্রামে গিয়ে যতোটুকু জানা যায়, বুঝলুম যে লেখালিখি নিয়ে এতো বেশি শহুরে সময় কাটিয়েছি যে নিজের দেশে নিজেই আমি আগন্তুক, বই-পড়া জ্ঞানের বিভ্রমে আটক থেকে প্রকৃত ভারতবর্ষকে দেখা আর জানা হয়ে ওঠেনি, শহরে বসে কল্পনাজগতকে সীমিত রেখেছি শব্দে-বাক্যে, নিজেকে আবিষ্কার করা শুরু হলো, ছিটকে পড়লুম অপার বিস্ময়ের ব্রহ্মাণ্ডে ।বই পড়ে পাওয়া জ্ঞানের সঙ্গে কোরিলেট করা আরম্ভ করলুম সমাজে ঘটতে থাকা চাপান-ওতোরের । আমার ফিকশান “নখদন্ত”, “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস”, “জলাঞ্জলি”, “নামগন্ধ”, “অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস”, “ঔরস” উপন্যাসগুলোর, এবং “অপ্রকাশিত ছোটোগল্প” বইয়ের  কয়েকটা গল্পের বীজ, ঘোরাঘুরির চাকরি থেকে পাওয়া, প্রবন্ধ লেখার ধারাও পালটে গেল ঘোরাঘুরি থেকে পাওয়া ভারতীয় জীবনধারার সত্যকে উপলব্ধি করার পর। কমিউনিস্ট কর্মীরা আগেকার দিনে গ্রামে গিয়ে কাজ করতো বলে অনেককিছু জানতে পারতো, কিন্তু গ্রামে-গ্রামে দলটা পৌঁছে গিয়ে কর্মীদের চরিত্র পালটে ফেলল ।

             লিখতে বসে ভুলে যেতে পারি, তাই প্রথমেই অবুঝমাড় নামে ছত্তিসগড়ের একটা ঘন জঙ্গলের কথা বলে নিই, যার পৃষ্টপট “ঔরস” উপন্যাসে ব্যবহার করেছি । নারায়ণপুর, বিজাপুর আর বস্তার এই তিন জেলার জঙ্গল এলাকা হল অবুঝমাড় । আমার সহযোগী অফিসারের কথায়, যে, ওই অঞ্চলে ‘সালফি’ নামে একরকমের মদ হয় যা ভারতে আর কোথাও পাওয়া যায় না, কেননা খেজুর গাছের মতন দেখতে যে গাছ থেকে সালফি নামানো হয়, সে-গাছ কেবল ওই জঙ্গলেই হয়, শুনে, সালফি খাবার লোভে যাবার ইচ্ছে হল, যদিও কয়েকজন সহকর্মী ভয়ও দেখিয়েছিল যে মাওবাদীরা কিডন্যাপ করে নিতে পারে । তাছাড়া, জানতে পারলুম, শহরে যাকে আমরা উন্নয়ন বলে মনে করি, তার কোনো প্রয়োজন গোঁড় আর মাড়িয়া উপজাতিদের নেই, বহু শব্দই নেই তাদের ভাষায়, যেমন আনন্দ, দুঃখ, গ্লানি, দারিদ্র্য, সফলতা; মাওবাদীরা ওদের জীবনে ঢুকে ছত্তিশগড়হি, হিন্দি আর তেলেগু শব্দ ঢোকাতে আরম্ভ করেছে । বিপ্লবের মার খেয়ে ভাষাও বিলুপ্ত হয়ে যায় ।

              গ্রামীণ উন্নয়নের কাজে বেরিয়ে, এমন একদল মানুষের কথা শুনলুম যাদের কোনো পার্থিব জিনিসের প্রয়োজন নেই । তীর, ধনুক, আর লাঠিই যথেষ্ট ছিল ; বাসা বলতে জঙ্গলের গাছের খুঁটিতে ডালপালা বিছিয়ে ঝুপড়ি । এখন অঞ্চলটা মাওবাদীদের দখলে, আমি যখন গিয়েছিলুম, মাওবাদীরা ছত্তিশগড়ে এতোটা ভেতরে ঢোকেনি । সরকারি কর্মী আর অফিসার ছাড়া সাধারণ মানুষের জন্যে অবুঝমাড় ছিল নিষিদ্ধ এলাকা, কেননা আশির দশকে বিবিসি আদিবাসীদের ঘোটুলের ফিল্ম তুলে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিল, আর ভারত সরকার সেকারণে বেশ অপমানিত বোধ করেছিল। সেসময়ে ঘোটুল বা নগ্ন যুবক-যুবতীদের পারস্পরিক পরিচয়ের হলঘর ধরণের ঝোপড়ি ছিল, সঙ্গমের বাধানিষেধ ছিল না, তাদের মতে প্রেম বা যৌনতা কেনই বা একজনের সঙ্গে সম্পর্কে সীমাবদ্ধ থাকবে, যৌনক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে তারা বিয়ারবহোতি নামে একটা লাল টকটকে পোকা খায়, পরে কালেকটার বলেছিল ওই পোকার নাম ট্রমবিডাইডা, নারায়ণপুরের একআধটা দোকানে শুকনো পোকা পাওয়া যায় ।   

             এই ভারতবর্ষের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না । অবুঝমাড়ে সবকিছুই বিনিময়ের মাধ্যমে, ইকোনমিক্সের কোনো অস্তিত্ব নেই, শব্দভাঁড়ার ছাড়া । রায়পুর এয়ারপোর্টে নেমে হোটেলে রাত কাটিয়ে পরের দিন নারায়ণপুরের বাস ধরেছিলুম, বাসটার নাম ছিল নৌকরওয়ালা বাস, কেননা দুটো ব্লক নিয়ে সদ্য তৈরি নারায়ণপুর জেলা সদরে যাদের পোস্টিং হয়েছিল তারা প্রায় সকলেই থাকত রায়পুরে । বাসের কনডাকটার সকলের কাছে অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার নিয়ে গিয়ে সই করিয়ে নিল, মাসের শেষে টাকাটা নেবে । আমরা দুজনেই কেবল বাসভাড়া দিলুম । নারায়ণপুরের  রামকৃষ্ণ আশ্রমে থাকার ব্যবস্হা হয়েছিল ;ওনাদের ইশকুলের বীরবল মাড়িয়া নামে এক প্রাক্তন ছাত্রকে গাইড হিসেবে পেয়ে, তার মোটর সাইকেলের পেছনে বসে এগোলুম আমরা । কুরসুনার গ্রামের মুখে, জঙ্গলের ভেতরে ঢোকার আগে কেন্দ্রিয় রিজার্ভ পুলিশকে আমাদের আইডি আর কালকটরের অনুমতির চিঠি দেখাতে হলো ।

             বীরবলের কথা অনুযায়ী অবুঝমাড়িয়াদের দেবী হল কাকসার, বস্তারের দেবী হল দান্তেশ্বরী, গোঁড়রা পুজো করে মেঘনাদকে— জানি না এই মেঘনাদ রামায়ণের মেঘনাদ কিনা— বৈগারা পুজো করে রাসনাভাকে ; যতোটা বুঝলুম, দান্তেশ্বরী ছাড়া অন্য দেবী-দেবতাদের নির্দিষ্ট প্রতিমা নেই। জঙ্গলটা চার হাজার একর জুড়ে, তিরিশটা জনবসতি আছে যাকে গ্রাম বলে চালানো যায়, ইংরেজদের সময়ে শেষ সারভে আর সেনসাস হয়েছিল । গ্রামগুলোয় বিজলি নেই, খাবার জল নেই, বাজার-দোকান নেই, শহুরে খাবার নেই, চাল-ডাল নেই, ইশকুল যেটা আছে তাকে বলা যায় মোবাইল, রামকৃষ্ণ আশ্রমের, কারোর অসুখ-বিসুখ হলে মৃত্যু ছাড়া কোনো বিকল্প চিকিৎসা নেই । মরে গেলে গোর দেয়া হয়, পিরামিডের আকারের কিন্তু ধাপ-দেয়া গোরের ওপর চিহ্ণ হিসেবে কাপড় বেঁধে দেয়া আছে, কয়েকটা লাল, সেগুলো মাওবাদীদের । পাকা রাস্তার পর দেখা গেল গেরুমাটির পথ, একটু এগিয়ে দেখলুম, একটা তোরণ, তাতে সবুজের ওপর সাদা দিয়ে লেখা, “ভারতীয় সেনা ওয়াপস যাও, বস্তরওয়াসি বাহরি নহিঁ হ্যায় : জঙ মত লড়ো।” তার পেছন দিকে লেখা, “বস্তরকে যুবায়োঁ, সরকারকে নাজায়জ জঙকে খিলাফ জনয়ুধ মে সামিল হো যাও।”

             যে জন্যে এসেছি, সেই সালফি মদের দেখা নেই, গ্রামবাসীদেরও দেখা নেই । আরেকটু এগিয়ে দুটো নিচু-ছাদ চালাঘরের দেখা মিলল, পেছনে খেজুর গাছের মতন একটা চাঁচা গাছে হাড়ি ঝুলছে দেখে বুঝলুম ঠিক জায়গায় এসে গেছি । রোগাটে কয়েকজন পুরুষ, প্রায় উলঙ্গ আর কায়েকজন নারী, বুকে কাপড়ের বালাই নেই, কয়েকটা বাচ্চা যারা কখনও চুল আঁচড়ায়নি, সকলেই সালফির নেশায় নিজস্ব জগতে । একজনের কাছে সালফির হাড়ি ছিল । বীরবল নিজেদের ভাষায় তাকে কিছু বলার পর একটা মিনারাল ওয়াটারের বোতলে সালফি ভরে নিল । আমি একটা কুড়ি টাকার নোট দিতে লোকটা হাত নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু বলতে বীরবল জানালো ও টাকা নেবে না, সালফি বিক্রির জিনিস নয় । আমরা আরও এগিয়ে হিকানোর গ্রাম আর পেণ্ডা খেতি বা ঝুম চাষ দেখে ফিরে এলুম, ফেরার পথে সালফি খেয়ে ঝিমোতে লাগলুম। সালফির নেশা একেবারে আলাদা, এর আগে যতো রকম নেশা করেছি, সালফি তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, বীরবল মাড়িয়ার কথায়, সালফি খাবার পর লোকে আকাশের মেঘ হয়ে যায় । রাতভর মেঘ হয়ে পড়ে রইলুম বিছানায় ।

             দেশভাগের দরুণ নমঃশূদ্রদের যে কী নিদারুণ অবস্হায় পড়তে হয়েছিল, আর তার রেশ যে কবে শেষ হবে বলা কঠিন । নারায়ণপুরে গণেশচন্দ্র সরকার নামে এক স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যিনি আছেন আমার ‘ঔরস’ উপন্যাসে, মরিচঝাঁপির ৩১শে জানুয়ারি ১৯৭৯এর অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন, বিয়ে করেছিলেন নিজের চেয়ে প্রায় সাত-আট বড়ো এক যুবতীকে, যাকে ১৯৭১ সালে রেপ করেছিল পাকিস্তানি রাজাকররা, আর তার বাচ্চাকে অ্যাবর্ট করতে দেননি, নারায়ণপুরের আগে মালকানগিরিতে থাকতেন । নমঃশূদ্র বাঙালিদের দেখেছি হিমালয়ের তরাই অঞ্চলেও, তাদের যে জমি দেয়া হয়েছিল তা দখল করে নিয়েছে পাঞ্জাবি জাঠরা, বাঙালিরা আবার ভিকিরি । একই অবস্হা দেখেছি বিহারের মোতিহারিতে, প্রায় বেশিরভাগ লোকই হয়ে গেছে বিহারি, রিকশ চালায় বা ঠেলাগাড়ি টানে বা দিনমজুরি করে । যে নমঃশুদ্রদের গড়চিরোলি, বালাঘাট, ভাণ্ডারা, রাজনন্দগাঁও পাঠানো হয়েছিল, তারা হয়ে গেছে মারাঠি । আমি ওই জায়গাগুলোয় গেছি বলে জানি, এ ছাড়াও ভারতে হয়তো বহু জায়গায় পাঠানো হয়েছিল তাদের । আমি একটা ব্যাপার কমিউনিস্ট দলটার বুঝতে পারি না, একদিকে নমঃশুদ্রদের আন্দামান দ্বীপে যেতে দেয়া হল না, আবার আরেক দিকে তাদের মরিচঝাঁপিতে বসত গড়তে দেয়া হল না, স্ট্রেঞ্জ ।

             মুঙ্গের, যেখানে কাট্টা-তামঞ্চা তৈরি হয় ঘরে-ঘরে, সে শহরে গিয়েছিলুম চাষীদের অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে, তখন ইন্দিরা গান্ধির এমারজেন্সি চলছে । কৃষি বিভাগের অধিকর্তা আমাদের নিতে এসেছিল স্টেশানে, ওনার জিপে বসে থানার সামনে দিয়ে যেতে-যেতে দেখি সামনের বারান্দায় গোটা আষ্টেক মানুষকে ল্যাঙটো করে উল্টো টাঙিয়ে রাখা হয়েছে । পুলিশ এতোদিন ওদের গায়ে হাত দেয়নি স্হানীয় মাফিয়া বলে বেশ রমরমা ছিল ওদের । সুযোগ পেয়েই প্রতিশোধ নিতে নিমে পড়েছে । কৃষি অধিকর্তা বলল যে সরকারি গাড়িতে করে গ্রামে যাওয়া যাবে না, মানুষ এতো ভয়ে আছে যে সরকারি গাড়ি দেখতে পেলেই দূর থেকে পালাবে । কী আর করা যায় ! মহাজনদের একদিন ডেকে পাঠালুম আর বোঝাবার চেষ্টা করলুম, তারা মাথা নেড়ে গেল । পরের দিন ব্যাংক ম্যানেজার আর সহকারী কৃষিঋণ সমিতির সচিবদের ডেকে পাঠিয়ে বোঝালুম । তারাও মাথা নেড়ে চলে গেল । পরের দিন ফেরার সময়ে দেখলুম আরেকদল যুবককে একই ভাবে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে । এইসব টাঙানো লোকগুলোই পরে লালু যাদবের দলে ভিড়েছে ।

            মুর্শিদাবাদের এক গ্রামে গিয়েছিলুম কৃষিঋণ সমিতির বন্ধক নেয়া জমিজমার খতিয়ান যাচাই করতে। গ্খাতা ওলটাতে-ওলটাতে দেখি তার মাঝে রাখা রয়েছে দাউদ ইব্রাহিম আর ওসামা বিন লাদেনের ছবি । মুখ না তুলে পাতা উল্টে গেলুম । সমিতির সচিব বললেন ‘আপুনাদের জইন্য চা আনি’, বলে কেটে পড়লেন। কারোর কাউকে ভালো লাগে যদি তো করার কিছু নেই । তখনও ওসামা বেঁচে ।

             বিহারের বাঢ় শহরে গিয়েছিলুম ইন্সপেকশনে, নথি পরীক্ষা করছি, সামনের বারান্দায় একজন যুবতী সেজেগুজে নাচা আরম্ভ করে দিল, “অভি না যাও চোদ কর কি দিল অভি ভরা নহিঁ” । সামনের দরোজাটা বন্ধ করে দিতে বললেও কারোর কানে গেল না কথাটা । নিজেই বন্ধ করলুম উঠে । লাঞ্চের সময়ে নিচে নেমে একটা ছেঁদো হোটেলে ভাত-ডাল-আলুভাজা খাচ্ছি যখন, পিওনটা এসে ফিসফিস করে বলল, “স্যার ওই রণ্ডিটাকে শাখা অধিকর্তা আগে থেকে শিখিয়ে দিয়েছিল যে আপনারা ইন্সপেকশানে আসছেন,  টোপ ফেলে আপনাদের মন অন্য দিকে ঘোরাতে চেয়েছে, অনেক ঘাপলা আছে শাখায়, চাষিরা এলে তাড়িয়ে দেয়।” যে হোটেলে সন্ধ্যাবালা উঠেছিলুম, সেখানেও কয়েকটা বেশ্যাকে নিয়ে হাজির । যখন বললুম যে “ওই রণ্ডিদের সঙ্গে শুয়েও আমি যা রিপোর্ট করার তাই করব”, তখন শাখা অধিকর্তা হাঁটু গেড়ে হাতজোড় করে কাঁদতে আরম্ভ করল । আত্মম্ভরিতা উপভোগেরও কষ্টের দিক আছে ।

             ডিটেকটিভ বই “অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস” বইতে আমি কর্ণাটক-অন্ধ্রপ্রদেশের সীমান্তের একটা উপজাতি অধ্যুষিত জঙ্গল এলাকার উল্লেখ করেছি, যেখানে গিয়ে পরস্পরের অচেনা যুবক-যুবতী  বাসা বাঁধে, আমি অফিসের কাজে গেছি ওই উপজাতিদের উন্নতি করার ধান্দায় । যুবকরা সাধারণত কলা পেঁপে লেবু ইত্যাদির চাষমালিকদের দিনমজুর, ঋতুতে, নয়তো বেকার । উচ্চাকাঙ্খীরা ব্যারেটাইস আর অন্যান্য খনিতে কাজ করতে গিয়ে রোগ নিয়ে ফেরে । জঙ্গলের অধিবাসীরা কেউ কখনও ভোট দেয়নি, কারোর কোনো আইডেনটিটি কার্ড নেই । কাঁঠালবিচি, কুমড়ো, কাঁচাকলা পুড়িয়ে খায় । আমার  রিপোর্ট কোনো কাজে আসেনি, কেননা জঙ্গল আর বাগানগুলোর মাটির তলায় খনিজের আবিষ্কারের ফলে লোপাট হয়ে গেছে কলা কাঁঠাল লেবু পেঁপের বাগানগুলো ।

    তেত্রিশ

             আমার আরেক ধাপ ওপরে ওঠা পাওনা হয়ে গিয়েছিল বলে অফিস পাঠালো নাগপুর অফিসে তিন মাসের জন্য । সেখানে আলাপ হকি খেলোয়াড় সলিলার সঙ্গে, আরেকজন যুবতী সুলোচনা নাইডুর মাধ্যমে, কয়েক দিনের পরিচয়ের পরই বললুম, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই, আপনার বাড়িতে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে । ওর বাবা ওর শৈশবে দুই বোন আর পোয়াতি স্ত্রীকে ওদের মামার বাড়িতে রেখে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন, সেই থেকে তিন বোন মামার বাড়িতে মানুষ । অতএব মামাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলুম।   বড়োমামা, যিনি অভিভাবক, তিনি ছিলেন না, মেজমামা ছিলেন, তিনি আমার প্রস্তাবে কান দেওয়ার বদলে নিজের বন্দুকের আলমারি খুলে আটটা গান, রাইফেল দেখালেন, কয়েকটার নাম মনে আছে, মজার প্যাটার্ন বোল্ট অ্যাকশান রাইফেল, এসএমএলই প্যাটার্ন ব্রিটিশ রাইফেল, মোজিন ন্যাজেন্ট প্যাটার্ন বোল্ট রাইফেল, বারো গেজ পাম্প অ্যাকশান শটগান, সাবোট স্লাগ হানটিং গান ইত্যাদি, ওনার বাবার । দেয়ালে টাঙানো, হরিণ, লেপার্ড ইত্যাদির মাথা দেখালেন, শিকারের গল্প করলেন ।

             বৈঠকখানায় দেখলুম থরে-থরে ইংরেজি পেপারব্যাক যার ওপর ধুলোর আস্তরণ, কেউ কখনও পড়তো হয়তো ওগুলো । কোনও বাংলা বই বা পত্রিকা নেই । আমি যে লেখালিখির সঙ্গে জড়িত তা সলিলাকে বলিনি, সুলোচনা নাইডু হিন্দি পত্রিকায় আমার সম্পর্কে সংবাদ আর ফোটো দেখিয়েছিল । ওদের বাড়িতে কেউই ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেননি । তবে পরে নাগপুরের কারোর সঙ্গে দেখা হলে তিনি জানতে চান, “এখনও রাইটিং করেন ? ইংলিশে লেখেন না কেন ? ইংলিশে লিখলে ইনকাম ভালো হয় ।” বলে ফেলি, “আমি কেবল স্কটল্যাণ্ডের মদ খাই, ওইটুকুই যা ইংলিশ জ্ঞান আমার।”

             পরের দিন আবার যেতে হলো, বড়োমামা-মেজমামা ইতিমধ্যে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিয়ে থাকবেন, আমাকে আমার উৎস প্রমাণের জন্য পাটনায় টেলিগ্রাম করতে বললেন । আমি পাটনায় বাবাকে আর চাইবাসায় দাদাকে টেলিগ্রাম করলুম । আমার দেদোল স্বভাবের  সঙ্গে মা অতিপরিচিত ছিলেন, সুতরাং চাইছিলেন, যেকোনো একজন মেয়েকে বিয়ে করে হাজির হই। আমার টেলিগ্রাম পেয়ে পিসতুতো দাদা সেন্টুদাকে দাদার কাছে পাঠিয়ে দিলেন, একটা ইনটারেসটিং চিঠি দিয়ে, যে চিঠির প্রধান বক্তব্য ছিল “সিন্দুর পরিয়ে নিয়ে এস, বুঝলে” । লাইনটানা কাগজে লেখা তারিখহীন চিঠিটা দাদা “হাওয়া৪৯” পত্রিকার এপ্রিল ২০০১ সংখ্যায় মায়ের হাতের-লেখাসহ ছেপেছিল :

    কল্যানীয়

    বাশুদেব আশা করি তুমি ও বেলা নিশ্চয়ই গিয়ে পৌঁছিয়েছ তুমি দাঁড়িয়ে থেকে মলয়ের বিয়ে দাও এবং বাসি বিয়ে দিয়ে সিন্দুর পরিয়ে নিয়ে এস ।

    কারণ এখানে মেজজাঠা তোমাদের শয্যাশায়ি তোমরা এলে দেখতে পাবে এবং বাবুর শরীর খুব খারাপ ।

    অতএব তুমি সমস্ত কাজ সেরে বৌ নিয়ে এস তোমাদের আসার অপেক্ষায় রহিলাম । তোমরা সকলে আমাদের শুভ আশীর্ব্বাদ নাও । সিন্দুর পরিয়ে নিয়ে এসো বুঝলে ? ।

                                                                                          ইতি

                                                                                          মা

             মা বলেছিলেন ‘সিন্দুর পরিয়ে নিয়ে এসো’, মানে বিয়ে করে না আনলেও যেন সিঁদুর পরে আসে। কিন্তু সলিলা সিঁদুর আর শাঁখা-পলা ইত্যাদি বিয়ের পর পরত না কখনও, হকি খেলোয়াড় ওর মধ্যে এমন ভাবে সেঁদিয়ে ছিল যে টিপিকাল মধ্যবিত্ত বাঙালি গৃহবধুর মতো আচরণ করতে পারেনি । পরে দেবী রায়ের স্ত্রী মালা একটা অষ্টধাতুর নোয়া তৈরি করিয়ে প্রেজেন্ট করেছিলেন, সেটাই পরে সারাজীবন চালিয়ে দিলে । মা আর বলতেন না কিছু, কেননা উনি নিজেই প্রতিদিন সিঁদুর পরতেন না, চুল উঠে যাবার ভয়ে ।

             আমার টেলিগ্রাম যেদিন পাটনায় পৌঁছেছিল সেইদিনই মেজজ্যাঠা মারা যান । ছেলে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে চাইছে, এই সুযোগ যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায়, তাই দাদাকে পাঠানোর ব্যবস্হা, নয়তো অশৌচ ইত্যাদির আচারে পড়লে দেরি হয়ে গেলে ছেলে হয়তো মত পালটে ফেলতে পারে, ভেবেছিলেন বাবা-মা । দাদা নাগপুরে এসে একদিনের দেখা দিয়ে চাইবাসা ফিরে গিয়েছিল বৌদি আর  মেয়ে হনিকে আনতে, সেন্টুদার কাছ থেকে জেনে গিয়ে থাকবে মেজজ্যাঠার মৃত্যুর কথা । নাগপুরে সলিলার মেজ মামার মেয়ে বেলার বিয়ে আর কয়েক দিন পরেই হবার ছিল ; সলিলার ছোটো বোন রমলা চাইছিল যে আগে ওর বিয়ে হোক তারপর সলিলার, অর্থাৎ আমি রমলাকে বিয়ে করি । দুই বোনের ঝগড়ার মাঝে বড়ো মাইমা চাইলেন যে তাঁর বড়ো মেয়েকে আমি বিয়ে করি । আমি ভাবছিলুম যে পার্টিশানের আড়াল থেকে একটা সুন্দর মুখ উঁকি মেরে আমাকে দেখছিল, বেলার বোন নিলীমা, গণ্ডোগোল হলে তাকেই বিয়ে করে নিয়ে যাবো । আমি ওনাদের তর্কাতর্কি এড়াতে হোটেলে চলে এসেছিলুম, সলিলা এসে ডেকে নিয়ে গেল, ফাইনাল করার জন্যে । শেষ পর্যন্ত কার্ড ছাপানো হল আমার আর সলিলার বিয়ের, চোঠা ডিসেম্বর ১৯৬৮ ।

             বিয়ের দুদিন আগে দাদা, বৌদি আর মেয়ে হনির সঙ্গে নিজের শাশুড়িকে নিয়ে পৌছোলো । মামার মেয়ে বেলার বিয়ের পরে ওদের পিঁড়ি আর আগুন আমরা শেয়ার করে সংক্ষিপ্ত রিচুয়ালের বিয়ে করলুম। বিয়ে করে পাটনায় গেলুম না, গেলুম চাইবাসায় আর আমাদের ফুলশয্যা হল সেই ঘরটায় যে ঘরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রেমিকা শীলাকে অন্ধকারে চুমু খেয়েছিলেন, তার বর্ণনা আছে “কিন্নর কিন্নরী’সহ বেশ কয়েকটা গল্প-উপন্যাসে। চাইবাসা থেকে পাটনা রওনা দিলুম আমি দাদা বৌদি হনি আর সলিলা । পাটনায় গিয়ে মেজজ্যাঠার মৃত্যু সংবাদ পেলুম । মেজজ্যাঠার মেয়ে ডলি চলে এসেছিল কলকাতা থেকে, বলল, “তুমি আর সময় পেলে না, এতোকাল অকাজ-কুকাজ যা চেয়েছো নিজের ইচ্ছেতে করেছো, বাবা তোমায় কতো ভালোবাসতো, আর একটা বছর পরে বিয়ে করলেই পারতে।” ডলি এতোই চটে গিয়েছিল যে তারপর সম্পর্ক-বিচ্ছেদ করে দিয়েছে ।যেদিন সলিলার বউভাত সেই দিনই মেজজ্যাঠার শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণ ভোজন । সকলেই শ্রাদ্ধ আর বিয়ের ভোজ একই দিনে খেয়ে গেলেন । মৃত্যু দিয়ে নতুন করে জীবন আরম্ভ করলুম । স্বাভাবিক যে চাইবাসা বা পাটনায় কোনো বিয়ের রিচুয়াল হয়নি ; সলিলার মতে, আমরা অর্ধেক বিয়ে-করা আর অর্ধেক লিভ-ইন ।

             ১৯৭০ সালে সলিলা ওর কুকুর সুজিকে নিয়ে এলো পাটনায়, কেননা নাগপুর থেকে সবাই লিখছিল যে সুজিকে রাখা যাচ্ছে না, সলিলার অবর্তমানে ছোটো বোন রমলা ওকে সামলাতে পারছে না। পাটনার বাড়িতে সুজির খেলবার জায়গা ছিল না, সর্বত্র সিমেন্টের মেঝে, কুকুরটার মন খারাপ হয়ে কাঁদতো, আমি চান করিয়ে দিতুম পছন্দ হতো না, শেষে আবার নাগপুরে রেখে এলো সলিলা । নাগপুরে বছরখানেক থাকার পর একদিন উধাও হয়ে গেল, আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, সলিলার বাবাকে যেমন আর খুঁজে পাওয়া যায়নি ।

              ১৯৫৩ নাগাদ দরিয়াপুরের বাড়িতে একটা দিশি কুকুরের বাচ্চা এনেছিলেন ছোটোকাকার শালা যাঁকে বুজিদা বলে ডাকতুম, আমি কুকুরটার নাম দিয়েছিলুম রব, আর একটা পদবিও দিয়েছিলুম, লিংচিপুলু, ওকে ডাকতে হলে পুরো নামে, মানে রব লিংচিপুলু বলে ডাকতে হতো । পাঁচ-ছয় বছরেই বুড়ো হয়ে গিয়ে কুকুরটা উধাও হয়ে গেল একদিন ।   রব লিংচিপুলুর জন্যে পাঁঠার ছাঁট মাংস কিনে আনতুম, পাড়ায় একজন পাগল থাকতো, বাঙালি বাড়ির, তাকে বোধহয় মাংস খেতে দেয়া হতো না বাড়িতে, পোশাক দেখেই টের পেতুম যে লোকটা অবহেলায় ভুগছে, রব লিংচিপুলুর ছাঁট মাংস খেতে আসতো প্রতি রবিবার ; বাড়িতে রাঁধা মাংস দিলে খেতো না, বলত ওরকম টেস্টি মাংস খেতে পারি না । কোতরঙের বাড়িতে ফিরে বুজিদাও মারা গেছে তিরিশ বছর আগে ; সেই জমিটাও ঠাকুমার দেয়া ।

             পাটনার চাকরি বদলে অ্যাগ্রিকালচারার রিফাইনান্স অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট কর্পোরেশানের লখনউ শাখায় চলে গেলুম, সেখানে যে বাংলো পেলুম , পেছনের জমিতে আরম্ভ করলুম চাষবাস, নিজের চোখে দেখার জন্য বেগুন, আলু, ঢ্যাঁড়স, ভুট্টা, পেঁয়াজ, রসুন, কপি, ধনে, মৌরি, মুলো, গাজর আর পেয়ারা, কুল, কলা, পেঁপে, সজনে, লাউ, কুমড়ো, ঝিঙে ইত্যাদি । সামনের জমিতে লাগালুম বারমুডা ঘাস যা কাটাকাটির বালাই নেই, কার্পেটের মতন, তার চারিধারে নানা রঙের গোলাপ, চাঁপা, বেলি, যুঁই আর হ্যাঁ, লজ্জাবতী লতা। চাষের জন্যে বই প্রচুর পড়তুম যাতে ট্যুরে গিয়ে বোকার মতন কথা না বলে ফেলি চাষিদের কাছে । “নামগন্ধ” উপন্যাসে পশ্চিমবঙ্গে আলুচাষীদের জীবন নিয়ে লিখতে গিয়ে কাজে দিয়েছে চাষের আর বইয়ের জ্ঞান । অফিসের অনেকে আসতো আমার বাগান দেখতে । বাবা-মা যখন এসেছিলেন, ওনাদের এতো ভালো লেগেছিল যে, বলেছিলেন, বাংলোটা কিনে নে, তারপর দাম শুনে মুষড়ে পড়েছিলেন । লখনউ থেকে বিভিন্ন কাজে ট্যুরে গেছি, মাটি থেকে আপনা থেকে বেরোনো আর্টেজিয়ান স্রোত যেমন দেখেছি, তেমনই তরাইয়ের বাঙালি উদ্বাস্তুদের দুর্দশা, হিমালয়ের জংলি গোরু যারা দুধ এতো কম দেয় যে পোষা যায় না, লোকে পাহাড় থেকে ধরে এনে খেতো, তাও তো এখন বন্ধ হয়ে গেছে ।

             আমার মেয়ে আর ছেলে তখন ছোটো ছিল, ওরাও গাছেদের চরিত্র বোঝার চেষ্টা করত, খুরপি হাতে সাহায্য করতো আমাকে । মেয়ে নিজেই সাইকেল চালিয়ে ইশকুল যেতো আর ছেলের ইশকুল অনেক দূরে ছিল বলে রিকশায় গাদাগাদি করে যেতো আসতো । যে রিকশাঅলা ওদের ইশকুলে নিয়ে যেতো সে-ই ট্যুরে যাবার সময়ে আমাকে রাত-বিরেতে ট্রেনে তুলে দিতে নিয়ে যেতো, শিউনন্নির মতন পালোয়ান ছিল । সেসময়ে বহু জায়গায় ট্যুরে গেছি যেখানে হোটেল নেই ; বরইলিতে এক মুসলমান যুবকের বাড়ি ছিলুম, যতোদিন ছিলুম প্রতিদিন নিজের একটা করে মুর্গি জবাই করে আমাকে খাইয়েছে । আলিগড়ে যখন গিয়েছিলুম সদ্য দাঙ্গা থেমেছে, উঠেছিলুম বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে, আমার সহযোগী ভাবতো যে গোরুর মাংস খাইয়ে দিচ্ছে, তাই খাবার অসুবিধা হতো, একদিন বলতে বাধ্য হলুম যে মিস্টার শ্রীবাস্তবের জন্যে মুর্গি রাঁধলে ভালো হয় । লখনউতে উত্তম দাশ এসেছিলেন স্ত্রী মালবিকাকে নিয়ে, দেবী রায় সস্ত্রীক এসেছিলেন, পার্থসারথী এসেছিলেন, কলকাতার খবর নিয়ে । ওনাদের কথাবার্তা শুনে মনে হল যে কিছু মানুষ আমাকে চিরকাল ঘৃণা করবে, ঘৃণার মাধ্যমে মরণোত্তর আয়ু দিয়ে যাবে । শেষবেলায় টের পাই যে কলকাতায় থাকলে উন্মাদ হয়ে যেতুম ।

             আমি দুটো গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ডাইরেকটর ছিলুম লখনউ থাকতে, রায়বরেলি আর ফৈজাবাদ । ফৈজাবাদে কর্মীরা ঘেরাও করেছিল মাইনে বাড়াবার দাবী জানিয়ে । রায়বরেলির বোর্ডে একজন টুপি-পরা কংগ্রেস নেতা ছিলেন যিনি প্রায়ই বলতেন কিছু দরকার থাকলে বলবেন, দিল্লিকে বলে করিয়ে দেবো, মানে গান্ধি পরিবারকে । ফৈজাবাদে গিয়ে রামের জন্মভূমি বা বাবরি মসজিদ দেখলুম, তখনও বিজেপি ওটা ভেঙে ফ্যালেনি, ভেতরে ঢোকার আগে পুলিশ কন্সটেবল বলল, চামড়ার বেল্ট আর জুতো খুলে ঢুকুন, অর্থাৎ পুলিশ কর্মীরও রাম সম্পর্কে ভীতি গড়ে উঠেছিল, ভেতরে একটা টেবিলের ওপর রাম-সীতার মূর্তি, তাতে গ্যাঁদাফুলের মালা, একটা থাম অবশ্য কালো পাথরের ছিল, কোনো পুরোনো স্ট্রাকচারের । যখন দেখেছিলুম তখন ধারণা করতে পারিনি যে কিছুকাল পরে ঝোপঝাড়ে ঘেরা এই পোড়ো বাড়িটা নিয়ে এতো হ্যাঙ্গাম হবে । একেবারে ফাঁকা ছিল, একজনকেও পুজো দিতে দেখিনি, তার চেয়ে অযোধ্যার অন্য মন্দিরগুলোয় প্রচুর লোক পুজো দিচ্ছে দেখলুম । আর চারিদিকে বাঁদরের দল । রামায়ণে বানরসেনা আছে বলে কেউ কি কখনও এই শহরে বাঁদরদের এনেছিলেন ? হনুমান আর কাঠবিড়ালি কিন্তু একটাও দেখতে পাইনি সেসময়ে ।

             লখনউতে স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে আমি সবাই মিলে সবজি কুটতুম, চিংড়ি মা্ছ বাছতুম । কলকাতার মতন মাছ কেটে পরিষ্কার করার ব্যাপার লখনউয়ের বাজারে ছিল না । প্রভাকর এসে যদি দেখতো যে মাছ কোটা-বাছা চলছে, তক্ষুনি নাকে রুমাল চাপা দিয়ে পালাতো । আবদুল করিমের বাড়ি দিয়ে আসতো আমার ছেলে, মাছ বা মাংস রাঁধা হলে । করিম ট্যুরে গেলে আমার ছেলের জন্যে নানা জিনিস কিনে আনতো, এমনকি অ্যানটিক টেবিল, বই রাখার র‌্যাক ইত্যাদি । শেষ পর্যন্ত কোনো আসবাবই আর রইলো না, সবই বিলিয়ে দিয়েছি একের পর এক । এখন মনে হয়, বিদেশ থেকে আনা টুকিটাকি জিনিসগুলো কিনে আনা উচিত হয়নি, সবই ফালতু, ধুলোর চাদরে তাদের চেনা দায় । সাকিন পালটেছি আর যা পেরেছি বিদেয় করেছি ।

             লখনউতেই মা মারা গেলেন, কী হয়েছে সঠিক বলতে পারতেন না, হৃদরোগের ডাক্তারও ধরতে পারেনি । সেসময়ে ডাক্তারির এতোটা উন্নতি হয়নি, আমাদের জ্ঞানও বেশ সীমিত ছিল, এখন বহু কিছু নিজের অসুখের জন্য জেনে ফেলেছি । তখন মুম্বাইতে থাকলে মায়ের সঠিক চিকিৎসা হতে পারতো হয়তো। মা হাসপাতালে মারা যেতে দাদাকে তক্ষুণি টেলিফোন করে দিয়েছিলুম, দাদা পাটনা থেকে এসে মুখাগ্নি করে ফিরে গেল । শ্মশানে পুরুতের দরকার হয়, কোনো বাঙালি পুরুতকে চিনতুম না, কেননা ধর্মকর্ম তো আমি বা আমার স্ত্রী কেউই করতুম না, ফলে পঞ্চানন ভট্টাচার্য বা চ্যাটার্জি নামে অফিসের এক কর্মীকে ডেকে এনেছিলেন আমার প্রতিবেশি হায়দার আলি, দাদা তার নির্দেশমতো মুখাগ্নি করল । বুঝতে পারলুম যে মৃত্যুর সঙ্গে আমার একটা সৃজনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ।

            খুবই অদ্ভুত যে মায়ের মৃত্যুতে আমার রাইটার্স ব্লক সেরে গেল আর ঠিক এই সময়েই ঢাকা থেকে একাধিক পত্রিকায় কবিতা দেবার অনুরোধ আসতে লাগল । আমার কাব্যগ্রন্হ, উত্তম দাশের মহাদিগন্ত প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল, “মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর”-এর প্রায় সব কবিতাই প্রথমে ঢাকার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । এই কাব্যগ্রন্হের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন যোগেন চৌধুরী । হাংরি আন্দোলনের সময়কার কবিতা থেকে একেবারে আলাদা, উত্তরপ্রদেশের খুংখার ঘটনায় প্রভাবিত কবিতা ।আমার বই পড়বার ঝোঁকও নির্দিষ্ট রইল না, ভারতীয় সমাজকে বুঝতে পারার মতন বই বেশি পড়া আরম্ভ করলুম, অফিসেও প্রচুর সময় হাতে থাকত বই পড়ার, অধস্তন অফিসারদের বললে তারা বইপত্র যোগাড় করে এনে দিতো ।   

             লখনউ থেকে পৌঁছোলুম নাবার্ডের হেড অফিসে, মুম্বাইতে, তখন ছিল বোম্বে, কনট্র্যাক্ট কিলারদের, এনকাউন্টার স্পেশালিস্টদের আর কিলডদের শহর, যাদের দুপক্ষই একই কারণে শহরটাকে ভালোবাসে, টাকা টাকা টাকা টাকা উপভোগ উপভোগ উপভোগ উপভোগ, একেবারে অবাস্তবতার জগত, প্রতিটি সম্প্রদায় নিজেদের অতীতে ফিরে যেতে চাইছে, হত্যা আর লুটমারের গৌরবের কালখণ্ডে। এখন তা থেকে উতরোতে পেরেছে । এই শহরের গরিবদের অবস্হা অবর্ণনীয় । ইমলিতলায় আমরা গরিব ছিলুম, প্রতিবেশীরা আরও গরিব ছিল, কিন্তু কেউই তাকে দুর্ভাগ্য বলে মনে করত না, আমার মাকে কখনও দেখিনি কাউকে ঈর্ষা করতে । এই শহরে দুর্ভাগারা ভাগ্য ফেরাতে আসে, যুবক-যুবতীরা ভাগ্য ফেরাবার ধান্দায় ধর্ষণকেও মেনে নেয় । হ্যাঁ, যুবকরাও চাকরির জন্য ধর্ষিত হতে রাজি হয়।

             মেট্রপলিসগুলো শিখিয়ে দ্যায় কেমন করে ভিড় থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবে আর আলাদা হবার প্রক্রিয়ায় কেমন করে নিজেকে দুর্ভেদ্য করে তোলা যায় । আমি টের পেয়ে গিয়েছিলুম যে আমি দুর্ভেদ্য, আমি সমগ্র মানবসভ্যতাকে নিজের ভেতরে নিয়ে ঘুরে বেড়াই ; মানবসভ্যতার জন্যে এটাই সবচেয়ে আনন্দের যে প্রকৃতিজগত মানবসভ্যতার তোয়াক্কা করে না । মুম্বাইয়ের সংবাদপত্রে ধনীদের অসুখের খবর এমনভাবে ছাপা হয় যেন অসুখও এক ধরণের বৈভবশালী প্রাণী । এদিকে গরিবরা হল অবহেলার ক্রীতদাস, মানুষ রাস্তার ধারে রেল লাইনের ধারে সকলের সামনে হাগতে বসে, তাতে কারোরই কিছু এসে যায় না, এই শহরে কতো রকমের যে “অপর” রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই । গণতন্ত্র ব্যাপারটা এখানে অ্যাননিমাস ।

             মুম্বাইতে এসেই বাস্তব জগতকে নিংড়ে ফিকশান বের করার কায়দা আবিষ্কার করলুম । এই শহরে প্রেম এমন পর্যায়ে পৌঁছেচে যে তা মানুষ-মানুষীর পরস্পরের অবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে ; যতদিন দৈহিক অবিশ্বাস ততোদিন ভালোবাসা, সম্পর্কের মাঝে চাই কনডোম সুরক্ষা, প্রেমিক জানে না প্রেমিকার দেহে কোন রাক্ষস আছে, তেমনই প্রেমিকা জানে না প্রেমিকের লিঙ্গে কোন রোগের রাক্ষস ওৎ পেতে আছে । “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” উপন্যাসের চরিত্ররা পাটনার হলেও জ্ঞান নিংড়ে পেয়েছি মুম্বাইতে । ‘জলাঞ্জলি” উপন্যাসে চরিত্রদের নিয়ে গেছি পাটনা থেকে কলকাতায় । “নামগন্ধ” উপন্যাসে চরিত্রদের কলকাতা থেকে নিয়ে গেছি পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে, আলু চাষিদের দুর্দশা আর কোল্ড স্টোরেজে আলু রাখার রাজনীতি নিয়ে । “ঔরস” উপন্যাসে নিয়ে গেছি মাওবাদি অধ্যুষিত ঝাড়খণ্ড আর অবুঝমাড়ে । “আলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যা” ডিটেকটিভ উপন্যাসে কলকাতা থেকে নিয়ে গেছি অন্ধ্রপদেশ-কর্নাটকের সীমান্তের উপজাতি অঞ্চলে । এগুলো সবই ট্যুরের চাকরিতে পাওয়া অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেশানো কল্পনা । “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসে বেনারস আর কাঠমাণ্ডুতে পাওয়া হিপিসঙ্গের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশিয়েছি কল্পনা । “নখদন্ত” সাতকাহনে পাটচাষ আর চটকলের রাজনীতি নিয়ে পশ্চিমবাংলায় ট্যুরে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মিশেল দিয়েছি সংবাদপত্রে পাওয়া ঘটনা, নিজের নোটবইয়ের টুকরো-টাকরা, তখন হাতে কলম ধরে লিখতে পারতুম । এই বইগুলোর পর আমি কল্পনানির্ভর ফিকশান লেখা আরম্ভ করলুম, “জঙ্গলরোমিও”, “নেক্রোপুরুষ” আর “লাবিয়ার মাকড়ি” । আরেকটা উপন্যাস লিখেছিলুম “অমৃতলোক” পত্রিকায়, তার নাম আমি ভুলে গেছি, কপিটাও জোগাড় করতে পারিনি, উপন্যাসটা ছিল “জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা” আর “গহ্বরতীর্থের কুশীলব”-এর ঢঙে, জাদুবাস্তব।

             “অমৃতলোক” পত্রিকার কথা মনে আসতে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল । ১৯৯৫ সালে কলকাতায় রটে যায় যে মলয় রায়চৌধুরী মারা গেছেন । ব্যাস লিটল ম্যাগাজিনে শোক প্রকাশ করার ঢেউ উঠলো, “অমৃতলোক” পত্রিকায় বেশ বড়ো করে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন সমীরণ মজুমদার । আমি মুম্বাই থেকে ফিরে তখন ছিলুম দাদার বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে । একদিন শক্তি চট্টোপাধ্যায় এসে হাজির, বললেন, “সংবাদটার সত্যতা যাচাই করতে এলাম, তুমি এখানে ইজিচেয়ারে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছো আর তোমার বন্ধুরা তোমার মৃত্যুর খবরে খালাসিটোলায় উৎসব করছে । যাক বেঁচেবর্তে আছো, সেলিব্রেট করার জন্য মদ খাওয়াও।” বললুম একদিন যাবো স্মিরনফ নিয়ে আপনার বাড়িতে । গিয়েছিলুম, দাদা আর প্রদীপও সঙ্গে । মীনাক্ষীও সঙ্গ দিলেন আমাদের, ওনার শ্যাম্পেন খাবার গেলাস এনে । ভালোমন্দ খাইয়েছিলেন শক্তি । সন্দীপনের মতন কিপটেমি করেননি ।

             অনুবাদে হাত দিয়েছি বেশ দেরিতে । প্রথম অনুবাদ করেছিলুম “হাউল”, আমেরিকার একটা বাংলা পত্রিকার অনুরোধে, নাম ভুলে গেছি, অ্যালেন গিন্সবার্গ তখন ইউ ইয়র্কে । তারপর অনুবাদ করেছিলুম গিন্সবার্গের “ক্যাডিশ” । এই কবিতাটা অনুবাদ করতে সাহায্য নিয়েছিলুম গিন্সবার্গের নিজের আবৃত্তি-করা তেত্রিশ আর পি এম গ্রামোফোন রেকর্ডের, যাতে প্রতিটি লাইনের শ্বাসাঘাত ধরতে পারি, কেননা বাঙালির কথা বলার শ্বাসাঘাতের সঙ্গে মার্কিন ইংরেজির শ্বাসাঘাতের বেশ তফাত আছে । ২০০৯ সালে কলকাতা ছাড়ার সময়ে এই গ্রামোফোন রেকর্ডটা আর এজরা পাউণ্ডের কন্ঠে স্বরচিত কবিতা পাঠের রেকর্ড দিয়ে দিয়েছিলুম শুভঙ্কর দাশকে, ওরা স্বামী-স্ত্রী আমাকে পছন্দ করতো ; তবে ওদের মেয়ে রূপকথাকে আমি আর আমার স্ত্রী এখনও দেখিনি, শুনেছি বাচ্চাটা খুবই সুন্দর হয়েছে । আমেরিকা থেকে গিন্সবার্গ ট্রাস্টের বব রোজেনথাল আর গিন্সবার্গ আরকাইভের কিউরেটার বিল মরগ্যান গিন্সবার্গ সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করতে কলকাতায় এলে শুভঙ্করকে বলেছিলুম গাইড করতে । নিজের আরকাইভ এক মিলিয়ন ডলারে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে বিক্রি করে দিয়েছেন গিন্সবার্গ, তার অর্ধেক সৎ-মাকে দিয়ে গেছেন ।

             ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিবিসির জো হুইলার আর “নার্কোপলিস”এর লেখক জিত থাইল এসেছিলেন গিন্সবার্গ সম্পর্কে আমার সাক্ষাৎকার নিতে । কলকাতায় যাওয়া সম্ভবপর ছিল না বলে শান্তিনিকেতনের ইংরিজির ছাত্রী ঋতুশ্রী সেনগুপ্তকে বলেছিলুম টিমটাকে গাইড করতে । আমার নানা রোগের কথা শুনে জিত থাইল বললে, “ইওর ব্যাড কর্মা, ইট অলওয়েজ টেকস রিভেঞ্জ।” নিজে চিনাদের আফিমের আড্ডায় বাইশ বছর কাটিয়ে জ্ঞান দেবার মতন উপলব্ধি হয়েছে, আর বইটা বেস্ট সেলার হওয়ায় প্রচুর টাকা, বাড়ি, গাড়ি করে ফেলতে পেরেছে । অরবিন্দ প্রধান আমাকে বলেছিল, “আপনি বাংলায় লেখা ছেড়ে ইংরেজি ধরুন না।” ইংরেজিতে লেখার মতন শব্দভাঁড়ার তো নেই যে লিখব ।

            আমি তাঁদেরই অনুবাদ করেছি আর সেই সব বিদেশি সাহিত্যিক আর ছবি-আঁকিয়ে সম্পর্কে লিখেছি যাঁদের ভেতরে ইমলিতলার ইনস্যানিটি ছিল, যাঁরা মিসফিট ছিলেন , যাঁরা আমার ইয়ারদোস্ত  । পল গগাঁ আর দালির আত্মজীবনী অনুবাদ করেছি, জাঁ ককতোর দীর্ঘ কবিতা ‘ক্রুসিফিকেশান”, উলিয়াম ব্লেকের “স্বর্গ ও নরকের বিবাহ”, ব্লাইজি সঁদরার “ট্রান্সসাইবেরিয়ান এক্সপ্রেস”, ত্রিস্তান জারার ডাডাবাদী কবিতা আর ডাডাবাদী ইশতেহার, স্যুররিয়ালিস্ট ইশতেহার অনুবাদ করেছি । শার্ল বদল্যার, জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো আর অ্যালেন গিন্সবার্গের জীবনী লিখেছি । আলোচনা করেছি জেমস জয়েস, মার্সেল প্রুস্ত, আনা আখমাতোভা, জাঁ জেনে, চার্লি চ্যাপলিন, আদুনিস, পাবলো পিকাসো, ওকতাভিও পাজ, কার্লস ফুয়েন্তেস, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ প্রমুখ সম্পর্কে । বিট মহিলা কবিদের অনুবাদ করেছি, যাঁদের সংবাদ এতোকাল বাংলা ভাষায় এসে পৌঁছোয়নি।

             ছেলে আর মেয়ে দুজনেই সপরিবারে বিদেশে, তাতে সুবিধা এই যে সিঙ্গল মল্ট, স্কচ আর আবসাঁথ নিয়মিত পাই, তবে করোনার কোপে তাদের আসা-যাওয়া আপাতত বন্ধ । বুড়ো-বুড়ি দুজনে মুম্বাইয়ের এক বেডরুমের ফ্ল্যাটে একে আরেকজনকে ঠেকনো দিয়ে আছি। দেয়ালের পাপড়ি খসে পড়েছে, ঘায়ের পেইনটিঙ প্রতিটি দেয়ালে-সিলিঙে, হাইওয়ের ওপর বলে ধুলোয় ধুলো ; করা যাবে না কিছুই, উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি হাঁপানি, প্রোস্টেট, হার্নিয়া, হাই ব্লাডপ্রেশার, অ্যানজাইনার ব্যথা, ভেরিকোজ ভেইনস, গ্লকোমা, আঙুলে আরথ্রাইটিস, অজ্ঞান হবার সিনকোপি । চিকিৎসার জন্যে এক-একজন ডাক্তারের কাছে এক-একটি অঙ্গ দিয়ে দিয়েছি;  যখন যার ডাক পাই তার কাছে গিয়ে হাজিরা দিই ।

             আর তো কলম ধরে লিখতে পারি না । ব্যাঙ্কের চেকে সই করতে হয় স্ত্রীকে । এক আঙুলে টাইপ করে কমপিউটারে লিখে চলেছি যতো দিন পারি । ফেসবুকে অজস্র বান্ধবী, হাইপাররিয়াল, যারা অবিরাম লেখার জন্য উৎসাহিত করে, ছোটোলোকের শেষবেলায় যৌবন ফিরিয়ে আনতে প্ররোচিত করে, যেন সাহিত্য জগতের বাইরে  ঈথারের মহাবিশ্ব, কোনও দেশের সীমাকে মান্যতা দিতে চায় না ।

     
     
  • অজিত রায় | 106.213.52.40 | ০২ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:১১735281
  • নষ্ট তৈজসে সমলৈঙ্গিক গিল্টি

    অজিত রায়

    কলকাতা-কেন্দ্রিক ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যের এঁদো কপচাবাজি এবং তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে তার ভেতরকার মালকড়ি ফাঁস করে দিতে আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগে দানা বেঁধেছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম আভাঁগার্দ আন্দোলন ----- হাংরি জেনারেশন।  যা ছিল আক্ষরিক অর্থেই কলকাতার বাইরের কবি-লেখকদের নয়াল সংযোজন।  তাঁরা এসেছিলেন এমন এক মিলিউ থেকে যেখানে বাংলার তথাকথিত ভদ্রায়তনিক সংস্কৃতির কোনও শিস-ই গজাবার নয়।  জীবনের অনেকরকম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় যেখানে।  হাংরি সাহিত্যের কলিন অধ্যয়নে এই প্রেক্ষাপটটি সর্বাগ্রে মাথায় রাখতে হবে।  এই হাঙ্গামার প্রধান স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীর শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল বিহারের ভয়ঙ্কর কুচেল অধ্যুষিত বাখরগঞ্জ বস্তিতে।  তাঁর টায়ার ছোটবেলা অতিক্রান্ত মুসলিম অধ্যাসিত দরিয়াপুর মহল্লায়।  সেই অস্বাচ্ছন্দ্য, অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে করে মলয়ের বেড়ে ওঠা।  সংস্কৃতির একেবারে নিচেকার পাদানি থেকে আসা, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে ওঠার প্রতিটি মানুষী শঠতার সাক্ষী, স্পেঙলারের সংস্কৃতি ও অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্ত্বে তা-খাওয়া একজন বাইশ-তেইশ বছরের কৃষ্টিদোগলা বা কালচারাল বাস্টার্ড লেখালেখির মাঠে এলে যা ঘটবে, সেটা তো রফা হয়েই ছিল।
     
     
    ১৯৫৯-৬০।  বৃটিশবীর্যিত মুলুকের পোঁদে গাঁড়সা পুঁতে গাদি সামলাচ্ছেন নেহেরু।  দেশের দুই প্রান্তে পার্টিশানের টসটসে পাঁচড়া।  পুব পাকিস্তান থেকে আগত অন্যৎপুষ্ট মানুষের কিছু থোপনা তখনও আনলোড হচ্ছে শেয়ালদার টেসেলেটেড চাতালে।  হাভাতে মানুষের কেরবালা বিধানবাবুর গড় জুড়ে ছিৎরে পড়ছে।  দেশভাগের সময় পুব বাঙলা থেকে যে কিশোরগুলো বাবা-মায়ের কড়ে ধরে কলকাতায় এসেছিল, তারা এদণ্ডে গাগতরে বেতর, কিন্তু বয়সে ও মগজে সাজোয়ান।  দেশভাগের খসা চোকলা।  কাঁধের চিক্কুটে ঝোলায় কবিতার লাজুক খাতা আর কলা-ওঠা টিনের সুটকেশ ঢুয়ে কলকাতার রাস্তায় গলিঘুঁজিতে এক রাত্তির হিল্লের মনসুবায় চোখমুখ কালিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর সাঁঝের আলা মদ্দিম হলে সারমেয় অধ্যাসিত ফুটপাতে, হয়ত-বা কোনও দয়াল বন্ধুর ঘাড়ে অথবা গেরস্ত বাড়ির হেঁসেল-ঠোরে রাত গুজরান।  ইহাদের প্রত্যেকের বুকে কবিতা নামের পিলপিলে গণ্ডুপদটি ক্ষণে ক্ষণে ঢসন মারে।  ইহারা সকলে প্রবল কবিতা-পিশাচ।  পিশাচ, কেননা ইহাদের মাঘার ঘিলুতে জবরদস্ত পুঁজরক্ত যাহা গোপন আঁধারে কলম দিয়া চোয়ায় আর দেউলের দেউটি সহসা নিভায়।
     
     
    ষাটোত্তর গরদিশের দিনগুলি।  গেরস্তের জবরদখল-করা হেঁসেলে আচকা নোটিশ হয়ে গেল।  ভাঙা আয়না, দাঁড় টুনানো চিরুনি, তেলের শিশি, জীর্ণ ফতুয়া, কলা-ওঠা টিনের সুটকেশ আর লজ্জাবতী কবিতার ধুকড়ি নিয়ে পথে দাঁড়াল সুভাষ।  সুভাষ শলা করল, ----- শৈল, চ, দুজনে মিলে একটা ঘর নিই।  টালায় ১৬-বি শ্যামচরণ মুখার্জি স্ট্রিটের একতলায় দুর্গন্ধ-পীড়িত ফালি-খানেক ঘর যোগাড়ও হয়ে গেল।  খিড়কির পাল্লা সরালেই ড্রেনের ধারে পাছা ঝুলিয়ে নিত্যকর্মে ব্যস্ত কৃশগাঁড় বিভীষিকা।
     
     
    সুভাষের গেরামের ইশকূলে কমপয়সার চাকরি।  দু-বেলা যুৎসই অন্ন জোটে না বটে, কিন্তু গদ্যের হাতটি খাসা।  তাহাতে ড্যাশ ও হাইফেনের যাচাই ভুরিভোজ।  শৈলেশ্বরেরও মতিগতি উনিশবিশ।  অল্প পড়াশোনা।  ভাঙাচোরা ফ্যামিলির ছেলে।  অশহুরে, তথা জন্মলব্ধ সারল্য ও সততা।  ফলে মানিকজোড় হতে সূর্যঘড়ি লাগেনি।  দুজনেই টিউশানি ধরে, আর ছাড়ে।  হপ্তায় দু-দেড় দিন ভিজিট, আর চার-পাঁচদিন একুনে নাগা।  ফলে আট থেকে দশদিনের মাথায় জবাব হয়ে যায়।  খাওয়ার পয়সা নেই।  বৃদ্ধ পিতা পঙ্গুত্বের লেংগি খেয়ে খাটের প্রাণী।  ছাত্র-রাজনীতির গাজোয়ারি-প্রসূত 'লম্বা' হাঁকন বাবদ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নীমসম্বন্ধ।  ফলে, দিনগুলি বেজায় নড়বড়ে, জীবনযাত্রা ধূরিপথহীন।  সাহিত্য করা তো দূর অস্ত, সাহিত্যের জিগির-মাত্রে পিছদাঁড়ায় কাঁপন।  ডাইনির ছমছমে খিখি অষ্টপ্রহর।  ক্কচিৎ পকেটে বাড়তি খুচরো জুটলে শ্যালদার চোরা-হোটেলে জলের সঙ্গে পাঞ্চ করে, ভরদুপুরে কান্ট্রি-লিকার।  শ্যামবাজারের জন্তা হোটেলে ছ'আনায় ভরপেট খানা।  লেটনাইটে ঘুমের ধাক্কায়, বাড়ি।  একজনের ঘুম জুটত, অন্যজনের জুটত না।  শৈলেশ্বরের ছিল ইনসোমনিয়ার ব্যামো।  সারা-সারারাত মরা মাছের নিস্পন্দ চাউনি সিলিং-পানে।
     
     
    সুভাষরা একসময় ক'জন বন্ধু মিলে 'এষণা' নামে একটা কাগজ বের করত।  খুবই পাতি, অতীব বালখিল্য সে কাগজ।  সুভাষ-বাদে অন্যরা সবাই মামুলি মাস্টারবেট-করা লেখক, মানে পার্ট-টাইম।  অল্প খিঁচে নিল, ব্যস, সাহিত্যের বাঘ মারা হয়ে গেল।  আপিসে-আপিসে কেরানিগিরি, আর রোববার সকালে পাঁচ পয়সায় আধ প্যাকেট ক্যাপস্টান কিনে শ্যামবাজার কফিহাউসে ধুন্ধুমার আড্ডা।  কফির কাপ আর তামাকের কড়া ধোঁয়ায় বাঙালির বেড়ে বাফুনারি।  শৈলেশ্বর-সুভাষরা ইন্টেলেকচুয়াল নয়, গেঁয়ো বুদ্ধি, গেঁয়ো কথাবার্তা।  অপরপ্রান্তে, ধাউড়দের মুখে বিদিশি বই, ফরেন-কলমচিদের রেফারেন্স।  ইনজিরির ছররা।  দুজনের মধ্যে শৈলেশ্বরের বুদ্ধি একটু খোলা, মওকা বুঝে, সময় থাকতে কাগজটাকে নিজের হেফাজতে নিল।  কাপ্তানি সুভাষের, কিন্তু কলকাঠি শৈলর হাতে।  অবশ্য, চারটে মাত্র ইস্যুই হাপিস হয়েছিল 'এষণা'র।। হাংরি জেনারেশান সাহিত্যের ঐ ছিল গর্ভ-সূচনা।  অচিরেই এষণার ছাদনায় এসে ভেঁড়ে প্রদীপ আর সুবো।
     
     
    এবং আরও একজন।  বছরটা ১৯৬৩।
     
    ছেলেটির বয়স কুড়ি।  রুজির যোগাড়ে গোড়ার দিকে থাকত কলকাতায়।  টালা ব্রিজের কাছে খেলাত বাবু লেনে।  বারোঘর এক উঠোনের একটি পোড়া বাড়িতে।  সারাদিন রুজির খোঁজে, ফিরত রাত নিবিড়ে।  পড়ে ন্যুনাধিক একটা হিল্লে হলে, অশোক নগরের উদ্বাস্তু কলোনিতে পাকাপোক্ত নোঙর।  সেও ছিল দেশভাগের ঠাঁটা চোকলা।  ডাঁসা বাঙাল।  জিরজিরে শরীর।  উপদ্রুত মন।  চাঁচাড়ি-ঘেরা তার এক-কাটরা বাড়ি।  ছেঁড়া শাড়ির গাঁঠরি।  বাতায় ঠোঁসা সরষে তেলের শিশি।  একটিপ তেল মেখে, শ্যালো টিপে দু-বালতি জলে স্নান সেরে ও গামছায় সর্বাঙ্গ মুছে, ভাঙা আয়নার সামনে ব্যাকব্রাশে টেরি চিরে দরমার দরজা ভেজিয়ে এক রোববার সে ঐ 'এষণা'র ঠেকে।  লেট এন্ট্রি।
     
    ছেলেটির নাম বাসুদেব দাশগুপ্ত।
     
     
    হালিতেই সে ঝুলি থেকে বের করে এগিয়ে দ্যায় একটি লিটল ম্যাগাজিন।  পবিত্র বল্লভ সম্পাদিত 'উপদ্রুত'।  তাহাতে একটি দীর্ঘ গদ্য, ---- নাম 'রন্ধনশালা'।  সে বলেছিল, 'গল্প'।
     
    বাসুদেব 'রন্ধনশালা' রচনা করেন একষট্টিতে।  তেষট্টিতে সেটি ম্যাগাজিনে কৃষ্ণহরফ পায়।  গদ্যটি গ্রন্থত্ব লাভ করে উৎপলকুমার বসুর হেফাজতে, ১৯৬৫-তে।  শুধু এই রন্ধনশালার কথাই যদি বলতে হয়, এবং ১৯৬৩-র প্রথম আলোকনের সালটিকেই যদি ধরতে হয়, বলব, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের সহস্র সহস্র বছরের সর্বঅস্তিত্বগ্রাসী ক্ষুধার এ-তুল্য বহিঃপ্রকাশ এবং তার এহেন গ্রাম্য আদিম রাস্টিক তথা অস্বস্তিকর ভাষায় আত্মপ্রকাশ একটা বড়সড় তহেলকার চেয়ে বিন্দুমাত্র উনিশ ছিল না।  এ ছিল এমন লেখা, যা পড়ার পর, বাংলা সাহিত্যের পাঠক আগের যা-কিছু পড়া সমস্ত হকহকিয়ে বমি করে দ্যায়।  বাংলা গদ্যের শেলফ প্রায় খালি হয়ে যায় রন্ধনশালা পৌঁছনোর পর।
     
     
    রন্ধনশালার হব্যাশে সেদিন আকখা কলকাতা তোলপাড়।  খাসির ল্যাজ তুলে যাঁরা মাংসের বহর আন্দাজাতে পটু, সেইসব ঘোড়েল সমালোচকেরা অব্দি রচনাটিকে ফ্রানজ কাফকা, লুই ফার্দিনান্দ সিলিন এবং গিন্সবার্গ-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন।  বাসু-বন্ধু শৈলেশ্বর কবুল করেছিলেন : ইমাজিনেটিভ সাহিত্যের এহেন উদাহরণ বাংলাভাষায় খুব বেশি নেই।  বাস্তব অভিজ্ঞতাই লেখকের পা রাখার জায়গা, তারপরই বাসুদেব পাঠককে নিয়ে যান এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে।
     
     
    আসলে, শৈলেশ্বর জানাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে যে ছোটলোক বা সংখ্যালঘুর মনোভাব কাজ করছিল, রন্ধনশালা ও তৎ-পরবর্তী গদ্যসমূহে সেটাকেই ঝাড়বাতির তলায় মেলে ধরেছিলেন বাসুদেব দাশগুপ্ত।
     
     
    শৈলেশ্বর-বাসুদেব-সুভাষ-প্রদীপ-সুবো ----- এঁরা প্রত্যেকে ছিলেন একে-অপরের মতো, একই পেরিফেরির জীব। প্রত্যেকের জীবনের ব্ল্যাক-কমেডি উনিশবিশ একই খেপের।  চোখের সামনে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেশভাগ, রক্ততোলা বেবুঝ দাঙ্গা, যুবতীর অস্মিতা-হরণ, লাখো মানুষের বুকে ভুখা ত্রাস, জঠরে জঠরে কান্না।  প্রায় প্রত্যেকের বাল্য ও যৌবন অস্বচ্ছন্দ, নিহায়ৎ গরিব, ছোটলোক আর অশিক্ষিত ফ্যামিলি থেকে আগত, বুকে অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে কোলদাবা করে বেড়ে ওঠা।  আধুনিকতা নাম্নী সালংকরা পিশাচিনির পাছায় এঁরা চুমু খেতে পারেননি।  প্রত্যেকে কমবেশি লিজলিজে, ঘরকুনো, আত্মভুক।  ফলত, পরস্পরের বন্ধুত্ব সামীপ্য পেতে দেরি হয়নি।  সেই বন্ধুত্বের তলা ও তলানি ছিল কঠিন সিলেবেলে গাঁথা।  পাঁচজনের মধ্যে একটা সমকামী-সুলভ এঁঠেল প্রেম, ভাষান্তরে 'আত্মা-বিনির্মিত নির্বাক সম্পর্ক' ডেভালপ করেছিল।  এঁরা একে-অপরের নেশাতেই বিভোল থাকতেন।  এঁরা কে কত বড় লেখক ছিলেন, আদৌ ছিলেন কিনা, সেটা বড় কথা নয়।  বড় যেটা হলো, এঁরা অন্যদের মতো ফাঁপা-বুলি বা False Note লিখতেন না, নিজেরা ভুগে লিখতেন।  এঁদের লেখালেখির পেছনে একটিই আর্জি ছিল ----- পৃথিবীর সেই আদিতম মন্ত্রটি ------ 'আত্মানং বিদ্ধি' (know thyself), নিজেকে জানো।  অধ্যাত্মবিদ্যার এই মূল কথা রবীন্দ্রনাথেও প্রতিধ্বনিত ----- "অসীম যিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা / মানুষের সীমানায়, / তাকেই বলে 'আমি'।"  আমি-র দুটো ডানা ---- শরীর আর মন।  প্রথমটি লোকাল, দ্বিতীয়টি গ্লোবাল।  উভয়ে মিশে গ্লোকাল।  এই দুই ডানাবিশিষ্ট যানে আরূঢ় হয়ে চলে আমি-র জীবনযাত্রা, জার্নি অফ লাইফ।  শরীরে ভর করে মহামনের সঙ্গে মনের যোগবন্ধনের প্রচেষ্টা।  হাংরি লেখকদের সরাসরি একটাই বিষয় ছিল ---- এঁদের লেখার বিষয় ছিল 'আমি'।  সেখানে কোনো মেকি অবগুণ্ঠন ছিল না।  বনেদি সমালোচকদের চোখে এঁরা 'নিরক্ষর' বলে দাগায়িত হলেও, মনে রাখতে হবে এঁরা কোনরকম ধান্দাবাজিতে না ঢুকে, যৎসামান্য সংঘশক্তি নিয়ে এবং 'নিজেদের জীবনচর্চাকে কাঁচামাল হিশেবে ব্যবহার করে' লেখালেখি করতেন।  যা অচিরেই, প্রতিষ্ঠান এমনকি প্রশাসনের বুকেও মৃদু হাড়কাঁপ ধরিয়ে দিয়েছিল।
     
     
    পাঠক, এই এঁরা, যাঁদের কথা আপনি পড়ছেন, এঁদের একজন যা ভাবতেন, সকলে তা ভাবতেন।  এঁরা একই হারে চলমান বাংলা কবিতা আর গদ্যকে অ্যানিমিক ভাবতেন।  দেশভাগের আগে ও পরে সবুজপত্র, দেশ, কল্লোল, কবিতা, পরিচয়, পূর্বাশা প্রভৃতি 'শহুরে বাঙালি মানসের সমৃদ্ধ ও প্রত্যয়পূর্ণ চিন্তাক্ষেত্র' নামে পরিচিত ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যবাজির যে ধারা বাংলা সাহিত্যকে অবক্ষয় আর প্যানপ্যানানির চূড়ান্তে এনে ছেড়েছিল, তার বিরুদ্ধে ষাট দশকের গোড়ায় এইসব হাংরি লেখকরাই হেনেছিলেন প্রথম ও সর্বাধিক জবরদস্ত ধাক্কা।  সে-কারণে প্রতিষ্ঠানের ক্যামপ্রাডর নমস্যদের বিগ্রহে মাটি খসে খড় বেরিয়ে যেতে দেখা গেছিল।  মাত্র দু-আড়াই জন কবি আর লেখককে এঁরা, বাসু-শৈলরা নিজেদের মতো করে 'আবিষ্কার' করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে জীবনানন্দ, ------ যিনি, বিদ্যায়তনিক উলেমাদের চোখে, এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যারা কবিতায় দূরে থাক 'ভদ্দরসমাজে' পর্যন্ত অচল।  সুতরাং, কফিঘরের আঁতেল ধোঁয়ায় ঘুরপাক না খেয়ে, এঁরা বুঁদ থাকতেন জীবনানন্দেই।  আর একজন এঁদের কিছুটা সমীহ আদায় করেছিলেন, তিনি মানিক বাড়ুজ্জে।  তিনি নাকি মানুষের ভিৎরি ফাঁপা অর্থহীন অঞ্চলকে ভারি সুন্দর ঢঙে ফাঁস করতে পারতেন, এঁদের মতে।  কিন্তু, পরে কমিউনিজমের 'কুচক্করে' ফেঁসে তাঁর লেখার ধার ও বহুমাত্রিকতা খসে পড়ে, এঁদের মতে।  একমাত্রিকতাই অবশ্য বামবাজ লেখকদের আগমার্ক ছিল, সেও এঁরা বুঝতেন।  এঁরা আরও টের পেয়েছিলেন যে সুভাষ মুখুজ্জের কবিতাগুলো আসলে শিশুতোষ ছড়া, আর সময় সেনীয় সাহিত্য স্রেফ শহুরে ধাউড়বাজি।  সন্দীপন চ্যাটার্জীর বিশেষত 'বিজনের রক্তমাংস' এঁদের ভালো লেগেছিল, কিন্তু অচিরেই যখন ফাঁস হয়ে গেল সন্দীপন আসলে স্প্যানিশ দার্শনিক উনামুনোর দ্যাখাদেখি লেখায় অসুস্থতার প্র্যাকটিস ওরফে ভাঁড়ামি করছেন, তখন এঁদের অ্যাবাউট টার্ন শুরু হয়ে যায়।  এঁরা এও খোঁজ পেয়েছিলেন, যে, লেখার সার্টিফিকেটের জন্য যাঁরা বুদ্ধদেব বসু, বিমল কর আর 'দেশ'-এর দোরে ধন্না লাগাতেন, সেই রোম্যান্টিকদের অন্যতম শিরোমণি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়।  এঁরা সবই বুঝতেন, শুধু ঠিকঠাক সমঝে উঠতে পারতেন না শক্তি চ্যাটার্জীকে।  হ্যাঁ, এঁদের মতে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটু বেশিই 'খেলেছেন'।  শক্তির কোন কোন কবিতা এঁদের চমকে দিত।  তারপরেই কোন লেখা মনে হতো এক্কেবারে 'পাইল করা মাল'।  কী ব্যাপার??  কফিহাউসে কানাঘুষো খবর উড়েছিল, কোন এক উঠতি কবির কবিতার খাতা নাকি শক্তির ব্যাগ থেকে খোয়া গেছে।  তারপর থেকেই নাকি অমন চেকনাই শক্তির কবিতায়।  ধন্দ কাটে না।  বর্ধমানের দামোদরে একদিন উদোম হয়ে নাইতে নেমেছেন শৈলেশ্বর, বুকজলে দাঁড়ানো উৎপলকুমার বসুকে জিগোলেন, 'কী দাদা, কথাডা কি সত্যি?'  উৎপলও কেমন, রহস্যমতন হেসে জানালেন, 'আমিও তো ভাই আপনাদের মতোই শুনছি।' ------ বলেই ডুব।
     
     
    এবার সংক্ষেপে বুঝে নেওয়া যাক হাংরি-তোড়ফোড়ের প্রেক্ষাপট, বা সময়ের ডিম-লেয়ারটা।  অর্থাৎ কলকাতা বা হুগলি-চত্ত্বরের সন্নিহিত এলাকায় সেসময় কী-এমন ঘটেছিল যার দরুন ডাল-ভাত খাওয়া বাঙালি বাড়ির কিছু যুবা অমন-একটা ভাব-ঘূর্ণির ঝড়ে একজাই ক্ষেপে উঠল, ----- তার প্রেক্ষিতটা।
     
     
    দেশভাগ হলো, 'স্বাধীনতা' নিয়ে শাঁখ-আবির হলো ----- আর তার পরপরই কবিরা কড়ে আঙুল ফাঁসিয়ে বাংলা কবিতার ন্যাড় আটকে দিলেন।  তাঁরা পাল্লা দিয়ে মেতে উঠলেন 'শহিদপ্রণাম' আর 'নয়া শপথ' গোছের টাইমপাশে।  পাশাপাশি অবশ্য বাংলা কবিতার পালে রোম্যান্টিক হওয়া লাগালেন রাম বসু, বটকৃষ্ণ দে।  তখন তো এমনি, নতুন কবি মাত্রেই রোম্যান্টিক আর তাতে কড়ারি তামা-তুলসী নিয়ে উঠে আসছে একটি নাম ----- দেবদাস পাঠক।  পুরনো কবিদের মধ্যে অজিত দত্ত, প্রমথনাথ বিশী, বনফুল আর খুব করে দাপাতে লেগেছেন প্রেমেন মিত্তির।  জীবনানন্দ বাদে অচিন্ত্যকুমার, শামসুর রাহমান, বিরাম মুখো, গোবিন্দ চক্কোত্তি, দীনেশ দাসদেরও হেব্বি বোলবালা।  উদিক থেকে আবার স্তবকান্তরে ছন্দান্তর ঘটিয়ে কবিতায় বিরল ছোঁক এনে দিয়েছেন নীরেন চক্কোত্তি।  চলছে পঞ্চাশের খেলা।  দ্যাখাদেখি কল্যাণ সেনগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তরাও নেমে পড়লেন আসরে।  বিজ্ঞপ্তি দেওয়া শুরু হলো যে 'আচ্ছে দিন' ফিরে আসছে বাংলা কবিতার।  যুদ্ধ-দাঙ্গা-দেশভাগ-রিফিউজি সমস্যা কাটিয়ে কবিতার স্বাস্থ্যে রিটার্ন আসছে নুরানি দ্যুতি।  শবেবরাত।  আখেরি চাহার শুম্বা।
     
     
    আসলে ঘটনা ছিল বিলকুল উলোট।  আসলে চল্লিশ-পঞ্চাশ থেকেই বাংলা কবিতা পাঠক লস করতে শুরু করেছিল।  শঙ্খ-সুনীল-শক্তি-ফণীভূষণদের আসরে নামতে সামান্য লেট, এমন দিনে, ৫০-এর শুরুতেই বুদ্ধদেব বসু রটিয়ে দিলেন :'ছন্দ, মিল, স্তবকবিন্যাসের শৃঙ্খলা, এ-সব বন্ধনেই কবির মুক্তি।'  বুদ্ধিবাদী এনজয়মেন্টের ব্রেকিং নিউজ।  পঞ্চাশের লক্ষ্মীঘরানার ফোকাসবাজ কবিরা সেটা ঝপসে গিলে ফেললেন।  বিষয়ে ন্যাকাচিত্তির রোমান্টিকতা আর আঙ্গিকে রকমারি বেগুনপোড়া এনে তাঁরা 'ফাটিয়ে' দিতে চাইলেন বাংলা বাজার।  আলোক সরকার এসময় আঙ্গিকে আর শব্দের বিন্যাস নিয়ে এত কসরৎ করেন যে প্রতিটি কবিতা থেকে ক্র্যাকের পড়পড় শব্দ বেরুতে থাকে।  উপরন্তু, আনন্দ বাগচী রবীন্দ্র-গানের ফাটা রেকর্ডগুলো বাজিয়ে বাজিয়ে পাঠকের মূত্রপুটের বেঁটে দুববো ঘাসে মাচিশ ধরিয়ে দিলেন।  এসব করে পঞ্চাশের কবিরা এই ভেবে স্বমেহনের তৃপ্তি লাভ করলেন যে বাংলা কবিতায় 'প্রগাঢ় প্রতীতির সুর' দেখা দিয়েছে আর স্পষ্ট হয়েছে তার এক্সপোজ-ভঙ্গি।  কিন্তু এতে পাঠ্য-পাঠকের জগদ্দল সমস্যাটাই আরও বুকবাড়া পেল।  বিষয়ের গরিমা বাতায় ঠুঁসে স্রেফ আঙ্গিকের প্রাকটিস যে বাংলা কবিতার পক্ষে অশুভ হতে পারে তা যেন কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিলেন।  সময়টা ছিল ৫০-এর মাঝামাঝি, বাংলা কবিতা তার সহজ-সুগম পথ ছেড়ে অচিরেই ন্যাকানাদা লিরিক আর আঙ্গিক-সর্বস্ব শব্দচচ্চড়ি হয়ে উঠল।
     
     
    ফলে, অনিবার্যভাবেই ষাটে ঘটল সর্বস্তরিক তোড়ফোড়।  ষাট, কেবলমাত্র একটি সময়-চিহ্ন নয়, সময়ের শান্তশায়ী বুকে একটি পিরেনিয়াল আঁচড়, এক প্রবল ঘূর্ণাবর্ত ----- সত্তর ক্রশ করে আশিতে এসে যার পরিক্রমা সমিল হয়।  বাংলা কবিতাধারায় ঐ ন্যাকাচিত্তির কলাকৈবল্যবাদ আর লিরিকবাজির প্র্যাকটিসের খেলাপে প্রচণ্ড অনাস্থা আর বিরক্তি গনগনে অমর্ষ হয়ে আছড়ে পড়েছিল ষাটের ঐ হো-হাঙ্গামার দিনে, যখন প্রকাশ্য ডে-লাইটে ফুটপাথের হাঁড়িকাঠে গলা-ফাঁসানো পঞ্চাশিয়া কবিতার হালাল প্রত্যক্ষ করেছিল কলকাতা।  ন্যাকাচোদা ধুতি-কবিদের ফুল-দুববো কালচারের বিরুদ্ধে আধপেটা ছোটলোক ভবঘুরে বাউণ্ডুলে গাঁজাখোর চুল্লুখোর চরসখোর রেন্ডিগামী কবিদের তীব্র সাব-অলটার্ন আর ডায়াসপোরিক কাউন্টার কালচার চাক্ষুষ করেছে দিনদাহাড়ে ব্যাংক-রবারির ফিলমি কারকিতে।  ছোটলোকদের ওই ধরদবোচা অ্যাকশানে গাঁড় ফেটে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানের ধামাধরা ক্লিন-শেভড পাউডার-পমেটমপ্রিয় পঞ্চাশের কবিদের।  তাঁদের ভীতি সাব্যস্ত হয় যখন বাসুদেব দাশগুপ্তর 'রন্ধনশালা'কে চালিয়ে দেওয়া হয় 'বিবর'-এর ব্রিডিং ক্যাপসুল হিশেবে।  অন্যদিকে, কবিতার ক্ষেত্রে, মলয়-শৈলদের ঐ ভয়-পাওয়া কাউন্টার-অ্যাটাক দানা পেয়েছিল শঙ্খ ঘোষের এই শব্দগুচ্ছে : 'আত্ম অস্তিত্বের গূঢ়মূল আবিষ্কার, মৃত্যুর বোধ, অসুন্দর শয়তান আর পাপের ধ্যান একদল কবিকে একটি বিচ্ছিন্ন কুঠুরির মধ্যে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।'  এমনকি, সন্ত্রাসের পাল বুদ্ধদেবের হিক্কে-তোলা বোদলেয়রী বাতাবরনকে উচ্ছ্বাসভরে স্বাগত জানিয়ে ফেলেছিল।  এতে-করে পঞ্চাশের ল্যাসল্যাসানি ধরা তো পড়েই যায়, চল্লিশের কন্ডোমফোলা ফক্কাবাজিও ফাঁস হয়ে যায় একই লপ্তে।
     
     
    সাহিত্যের আখড়ায় গোষ্ঠীতন্ত্র নয়াল কিছু নয়।  সাহিত্য নিয়ে আড্ডা, হুজুগ আর বাওয়াল যুগে যুগে।  সেই কোন ১৯০৫ থেকে পয়লা বিশ্বযুদ্ধের শেষ অব্দি লন্ডনের ব্লুমসবেরি মহল্লার এক থুত্থুড়ে কোঠায় ফি বেস্পতি সাঁঝে জমা হতেন সস্বামী ভার্জিনিয়া উলফ, রজার ফ্রাই, ক্লাইভ বেল, জন মেনার্ড কিন্স, ই এম ফর্স্টার, লিটন স্ট্র্যাচি, ডানকান গ্রান্ট প্রমুখ বুদ্ধিজীবীরা।  ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে ঐ আড্ডাবাজরা 'ব্লুমসবেরি গ্রূপ' নামে বিখ্যাত।  মোটামুটি ঐ ধাঁচেরই ছিল বাংলার বিনয় সরকার, সুনীতি চাটুজ্জে, সতীশচন্দ্র মুখুজ্জেদের 'ডন সোসাইটি'; এবং কিছু পরে প্রেমেন্দ্র-অচিন্ত্য-মানিক-প্রমুখের 'কল্লোল গোষ্ঠী'।  যদিও জাতে ও চরিত্রে কিঞ্চিৎ আলাদা, কিন্তু তিনটিই ছিল নিছক আড্ডা-বিশেষ।  সাহিত্যের আড্ডা।  যা পরবর্তী কালে সাহিত্যের কিছু খাস সামিয়ানায় ঠেক পেতে কলকাতার কফি হাউসে আরও-অঙ্ক-কষে হতো, এবং যা এখন আরো-অন্যভাবে, অন্যত্রও হয়।  বুকফেয়ার, নন্দনচত্ত্বরে, ইভন ফেসবুকে এবং ব্লগে।  কিন্তু সাহিত্য তথা শিল্পে সেরম বাওয়াল ওরফে মুভমেন্ট যদি কিছু হয়ে থাকে, আমাদের রামায়ণ-মহাভারত-চৈতন্যের লীলাখেলা-সমূহ বাদ দিয়ে, তাহলে তার বিসমিল্লা ধরতে হয় ১৮৩০-এর ফরাসি বোহেমিয়ানদের হুল্লোড় থেকেই।  তথাকথিত প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আন্দোলনের ঐ ছিল সাড়াজাগানো পয়লা ভেঁপু।  এবং পরবর্তী কালে সারা পৃথিবী জুড়ে সেই বিগউল ফোঁকা অব্যাহত থাকে।  ফলে, মার্কিন ইন্টেলেকচুয়ালদের মাথায় হঠাৎ 'Angry' ঠাপ্পাটা দেখে তেমন হাসি নির্গত করার কারণ ছিল না বিশুদ্ধবাদীদের।  কারণ ঐ মার্কিন অ্যাংরিরা এতখানিই বাগী আর রাগী ছিল যে নিজেদেরকে 'ইন্টেলেকচুয়াল' বলতেও ওরা রীঢ়া বোধ করত।  ওরা নিজেদের জাহির করত 'Anti-Intellectual' বলে।  আসলে, জ্যাক কেরুয়াক, লরেন্স ফেরলিংগোটি, অ্যালেন গিন্সবার্গ, গেগরি করসো, ই ই কামিংস, কেনেথ রেকথ, হেনরি মিলার প্রভৃতি আমেরিকান কবি-লেখকদের, তথাকথিত সামাজিক ধ্যানধারণার প্রতি প্ৰচণ্ড রকমের অনীহা ও আক্রোশ থেকে গড়ে ওঠা ঐ গোষ্ঠী নিজেদের জাহির করত 'বিট' বলে।  বিট মানে হেরো, পরাস্ত, হতাশ, গাণ্ডু আর এইরকম আরও কিছু।  'অ্যাংরি' কথাটা তো খচমচ করত চল্লিশের দশকের জ্যাজ বাজিয়েদের ঠেকে।  তাছাড়া, মোটামুটি ঐ সময়েই ইংল্যান্ডের একদল তিক্ত-বিরক্ত-রাগী লেখক সেখানকার গঙ্গাজলী সাহিত্যকে লাথিয়ে রাতারাতি দাগি হয়েছিলেন 'Angry Young Men' নামে।  অ্যাংরিরা ছিলেন জন ওয়েন, জন ব্রেন, কিংসলি অ্যামিশ প্রমুখ।  অ্যাংরি আর বিটরা একসময় একটা জয়েন্ট অ্যান্থলজিও বের করে।  যে-কারণে ঐ দুই বাওয়াল-পার্টিকে অভিন্ন ভেবে কিছু মানুষ চরম ভুল করেছিল।  কিন্তু, ভুল তো ভুলই।  আসলে হয়েছিল কি, কেরুয়াকের সুহৃদ হারবার্ট হাংকি তখন কুচেল দুনিয়ায় গহন চলাফেরায় মগ্ন এবং তাঁকে ছিঁচকে চোর, মাস্তান আর মাতাল-গাঁজাখোর বলে চেনানোর জন্যে 'বিট' খিস্তিটা চালু ছিল।  এবং, খুব অবান্তর হবে না যদি ধরা হয় কেরুয়াক উক্ত লিংক থেকেই শব্দটা গেঁড়িয়েছিলেন।
     
     
    এই বিটদের সঙ্গে বাঙালি যুবাদের হাংরি হাঙ্গামাকে গুলিয়ে ফেলার বেওকুফি বা ধাউড়বাজি ঠিক হবে না।  আবার 'হাংরি'র স্রোত-সূত্র যে 'ক্ষুধার্ত' বা 'কাঙাল' ---- এটা ঠিক না।  কেননা, প্রতিষ্ঠান বিরোধীরা কখনই মার্কামারা হতে রাজি নয়, তারা হামেহাল শেষধাপের জন্য ত্বরায়।  আর, ধাপগুলো হলো অবিরাম নিচের দিকে, ঘাস আর মাটির দিকে।  'মার্কা' ব্যাপারটা মৌলবাদের লক্ষণ।  প্রতিষ্ঠানের কারকিত।  যেমন আমাদের পৌরাণিক নামগুলো।  সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী, জল, বায়ু, শিব, কৃষ্ণ, রাম, সীতা প্রত্যেকেরই হাজারটা করে নাম।  পাড়ার মাস্তান থেকে শুরু করে লোকসভার মেম্বার, এঁদের অনেকগুলো করে নাম।  যত গুণের ঘাট, তত নামের বাড়।  তাছাড়া, এটাও ফ্যাক্ট, যে, ব্যক্তিকে অভিধায়িত করার জন্য যেসব শব্দকলাপ আমাদের চারপাশে ডাঁই করা আছে, এখনও, সবই সেই ব্রিটিশ মাস্টারবেশিয়ানদের নিচুড়ে-যাওয়া বইপত্র, ডিক্সনারি আর আধুনিকতাবাদী বুকনি-বীর্য থেকে হাসিল।  আসলে কিন্তু, শেষ বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার যে হালচাল, রাজনীতিক-আর্থিক অবস্থা, তাতে সেরকম মর্ডানিস্ট স্পেশেলাইজড ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সারবীজ সব পচে-হেজে গেছে।  এখন আধুনিকতা ব্যাপারটাই একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর ও ধাপ্পাবাজ।
     
    যাই হোক।  বলবার কথা এই, হাঙ্গামার শরিকরাও যেভাবে দাবি করেছেন, ---- হাংরি, আর-পাঁচটা সাহিত্য আন্দোলনের মতোই, পূর্বাপর স্বমেহিত ছিল, তাতে কোনো বাহ্যিক ক্যাটালিটিকের কলকাঠি ছিল না।  যে-কারণে এই হাঙ্গামার আবির্ভাব-কালটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।  পঞ্চাশের শেষে, বিশেষত ষাটের দশকের শুরুশুরুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় একই ধাঁচে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ব্যাপক অনাস্থা আর বিক্ষোভ দেখা দেয়।  তাদের নিজ-নিজ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র, সমাজ, চালু ধর্মীয় নীতিকানুন, আর্থিক বন্দোবস্তি আর কালচারাল বাতাবরন তামাম-কিছু ঐ নাগর-যুবাদের কাছে চরম অসহনীয়, সুতরাং পরম ত্যাজ্য ও বর্জনীয় ঠাহর হতে থাকে।  প্যারিস, বার্লিন, প্রাগ্ব থেকে বার্কলি, জাকার্তা, কলম্বিয়া, পিকিং ----- বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা প্রবল বাগী ও তোড়ফোড়-প্রবণ হয়ে ওঠে।  লিহাজা, বিক্ষোভের ঐ চোনা সাহিত্যের জলকেও লোনা করে ফেলবে, এ তো অতি লাজিম কথা।
     
     
    বিশেষত, দেশভাগটা বাঙালির সত্যিকারের পাইন মেরে দিয়েছিল।  ঐ প্রেক্ষাপটে, যখন নিত্যনতুন মৃত্যুপদ ও ভীতিপদ বাঙালির বত্রিশ ইঞ্চি পোস্তবাটা-বুক ক্ষণে ক্ষণে ভেবড়ে দিচ্ছে, মুহুর্মুহু মূক করে দিচ্ছে আস্ত-একটা বাতেল্লাবাজ জাতিকে, চেতনা সন্ত্রস্ত ও দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে, নালা থেকে ভাত কুড়িয়ে খাচ্ছে অনাহারী নেড়ি ও মানুষের ছা, ------ আমরা তখনও অবিশ্বাস্য নজরে দেখতে পাই হাজার বছরের ঝরঝরে মূল্যবোধগুলো বাঙালির জীবনে নতুন ধারণার পথ দেখাবে বলে, তখনও, রক্তচক্ষু মেলে দাঁড়িয়ে!  নতুন শক্তি জীবনকে পথ দেখাতে চায়, তখনও।  ঐ রক্তচক্ষুগুলো কাদের??  কোটি কোটি মূক ও মূঢ়ের বেদনাকে মূর্ত ধ্বনিতে তবদিল করতে উঠে আসে অই, কারা???  আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাঙলা মায়ের আনাচ-কানাচ থেকে, অন্ধগলি আর ঘুঁজিপথ থেকে বেরিয়ে আসছে অশিক্ষিত নিরক্ষর অর্ধ-নিরক্ষর ভাঙা-ভাষা ভাঙা-বানানের একগুচ্ছ অন্ত্যজ, অপর, সাব-অলটার্ন, ডায়াসপোরিক ছোটলোক।  নপুংসক বুর্জোয়া শ্যাল-কুত্তায়  নুচে খাবে বাংলা সাহিত্যকে, তার আগেই টিনের সুটকেশ, ভাঙা মগ, ছেঁড়া পাজামা, নোংরা গেঞ্জি ও বিষ্ঠা-লাঞ্ছিত মুর্দাফরাসের কেরবালা হা-রেরে তরিবতে ধেয়ে এলো বাংলা সংস্কৃতির মূল বিতর্দির দিকে।  গোড়ার দিকে এদের পিওর লাথখোর বলে মনে হবে, এদের ভাষা গেঁয়ো আর এদের কথাবার্তা অশ্লীল স্ল্যাং-মাফিক মনে হবে, ----  সেটা একরকম রফা।  মৃতের চিতায় অগ্নি-অস্তিত্বের ঐ ছিল পূর্বাভাস।
     
     
    হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ছিল, নাকি হুজুগ?  হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা কে?  ----- এই দুটি বিতর্ক এত এত দফা এত এত এত ভাবে দলিত মর্দিত ধর্ষিত হয়েছে যে তাকে এখন কেঁদেই বাঁচতে দেওয়া উচিত।  বিশেষত দ্বিতীয় প্রশ্নটি।  জঙ্গল মে মোর নাচা, কিসনে দেখা?  প্রত্যেকে বলে আমি, আমি, আমি।  অক্ষরের গোলামি থুয়ে অক্ষরের মালিক হওয়ার সাধ, প্রত্যেকের।  তাঁরা মেতে উঠেছেন অন্ধকারে, অহংকারে, ব্যক্তিগত আরোপে, আমিত্বের বহ্বাস্ফোটে।  আমি, আমি, আমি।  আয়ে গওয়া হরামিয়ন সব, একে মারে যান আফত-মা হ্যায়। ----- বিতর্কটি এখন যেন এই বলছে, কঁকিয়ে, ----- এবং খাবি খেয়ে মরছে।
     
     
    ১৯৬২।  'সম্প্রতি' পত্রিকার থার্ড সংকলনে বিনয় মজুমদারের 'ফিরে এসো চাকা'র সমীক্ষা বেরুল 'হাংরি জেনারেশন সংক্রান্ত প্রস্তাব' শিরোনামে।  লেখক : শক্তি চট্টোপাধ্যায়।  অনেকের ধারণা, বাসু-সুভাষ-শৈলরাও খেয়েছিলেন, যে, এই লেখা থেকেই হাংরি জেনারেশন নামের সূত্রপাত।  ধারণাটা কিছু বাতাসও পেয়েছিল ১৯৬৪-৬৫ সালে হাংরি মামলায় 'this literary movement was started by me' বলে শক্তির স্টেটমেন্ট জমা পড়ায়।  হাংরি গোষ্ঠীর এককালীন গড়িমসি সদস্য সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও নাকি ঐ মর্মে বয়ান রুজু করেছিলেন।  কিন্তু শক্তির এ লেখা তো বেরিয়েছিল বাষট্টি সনে; অথচ, ১৯৬১ সনের নভেম্বর-ডিসেম্বরেই ছেপে গিয়েছিল 'হাংরি জেনারেশন' নামে ১/৮ ডবলক্রাউন সাইজের ইস্তেহারটি, তাতে বার্জাস টাইপে পরিষ্কার ছাপা হয়েছিল : স্রষ্টা মলয় রায়চোধুরী, নেতা শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদক দেবী রায়।
     
     
    আসলে, পরে জানা যায়, হাংরি জেনারেশন ছিল এমনই এক চ্যাংমাছ, কারো একার মুঠোয় বেশিক্ষণ ধরা থাকেনি।  হাঙ্গামার ধূসর সূচনালগ্নের আরেক শরিক, বিলেত-রিটার্ন কলেজ-প্রভাষক উৎপলকুমার বসু পরবর্তীতে (১৯৯৪) জানালেন : "হাংরি জেনারেশন সেভাবে কোন সংগঠিত আন্দোলন ছিল না।  যার খুশী, যেখান থেকে পারে হাংরি জেনারেশন নাম দিয়ে বুলেটিন বের করে বাজারে ছেড়ে দিত।  এই আন্দোলন ছিল অনিয়ন্ত্রিত।  কতকগুলো ফতোয়া মলয় সমীর শক্তি লিখেছিল।  এগুলোর নিচে অনেকের নাম বসিয়ে দেয়া হ'ত।  বহু ক্ষেত্রেই যাদের নাম দেওয়া হচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসাও করা হঁ'ত না।  ..... হাংরিদের সেভাবে কোন কাগজও ছিল না।  হয়ত ত্রিপুরা থেকে একটা কাগজ বেরল, নাম দিয়ে দিল ---- হাংরি জেনারেশন বুলেটিন নম্বর ১২।  হয়ত তার ১০ বা ১১ বেরোয়নি।"
     
     
    আসলে, ১৯৬২-৬৩ সনে পশ্চিম বাংলার সাহিত্যে এই বাওয়ালমুখী পালাবদলের তীব্র চাগাড়ে দুটি প্রধান উপ-কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল কলকাতা শহরের বুকে।  একটি কেন্দ্রের মধ্যমণি ছিলেন বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং সুবো আচার্য।  অপর কেন্দ্রে ছিলেন মলয় রায়চোধুরী, সমীর রায়চোধুরী, দেবী রায় এবং সুবিমল বসাক।  উভয় কেন্দ্রের সদস্যরাই, কমবেশি, তথাকথিত ছোটলোক, গরিব আর অশিক্ষিত ফ্যামিলি থেকে আগত।  এবং প্রত্যেকের বয়স ছিল বিশ-পঁচিশের কোঠায়।  যে-বয়সে যত আলো পড়ে, তত ভয় কমে।  উপকেন্দ্র যেহেতু দুটি, সুতরাং দু-রকমের হাংরি বাওয়াল শুরু হয়েছিল।  একটা, শৈল-বাসু-সুভাষদের বস্তি-কলকাতার 'ছোটলোকি' বাওয়াল; এখানে যে-দলের নাম দেওয়া যাক হাংরি -- 'এ' গ্রূপ।  অন্যটা মলয়-সুবিমলদের ডায়াসপোরিক বাওয়াল, অর্থাৎ 'বি'-গ্রূপ।  দ্বিতীয় গ্রূপের সর্বময় কর্তা ছিলেন পাটনার ছোটলোক আর কুচেল অধ্যুষিত দরিয়াপুর মহল্লার নামচিন ষ্টুডিওঅলা রঞ্জুবাবুর ছোটছেলে বিশ বছরের ফনকু ওরফে ফনা, অথবা ইমলিতলার মুল্লু খান ওরফে মলয় রায়চোধুরী, সেটা জোরও ধরেছিল মলয়ের জোরদার ইস্তেহারি ভাষার চটকে, অপেক্ষাকৃত বেশি;  আর, তাঁদের সে-টিমও ছিল বেশ ভারি।  বহু পুরনো জ্ঞানপাপী সে-দলে ভিড়েছিল।  'এ' গ্রূপ এই 'বি' গ্রূপের নাম দিয়েছিল 'চুলকে দেওয়া হাংরি জেনারেশন'।  প্রথম গ্রূপটি মলয়কে 'মফসসলের অজ্ঞাত গাড়োল' বলেও চালাতে চেয়েছিল ব্যক্তিগত আক্রোশবশত।  তাঁরা, প্রত্যেকে ছিলেন, কেউ কেউ ছদ্মভাবে, মলয়ের বিরোধীপক্ষ।  বিশেষত আশির দশকে পুনরুত্থিত মলয়ের নিজেকে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে চালানো, কিছু-কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ইতিহাস-বিকৃতি এবং মাত্রাতিরিক্ত আত্মপ্রচারে দাগা পেয়েই প্রথম গ্রূপটির গোসা ধরতামাশি পেয়েছিল এবং তাঁরা পাগলের মতো ক্ষেপে উঠেছিলেন।  সুতরাং প্রথম দলটির ঐ পাঁচ শরিক যাঁরা আন্দোলন-চলাকালীন, ষাটের দশকে যা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাননি, আশি ও তৎ-পরবর্তী পিরিয়ডে মলয়ের মতই, নিজেদেরকে 'হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা' হিশেবে প্রচার করা শুরু করে দেন।  দায়িত্ব না নিয়ে একটু হাস্যচ্ছলে বলি, হাংরি লেখকদের মধ্যে কেউ আধুনিকতাবাদীদের মতো 'ডক্টরেট' ছিলেন না, ----- সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, মনোবিজ্ঞান কোন কিছুতেই একজনও 'উলেমা' ছিলেন না বলে এহেন পারস্পরিক কাদাহোলি।  আমি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কুম্ভলস চাই না, অতএব কোন্দলটি এড়িয়ে যাচ্ছি।
     
     
    এ-কথা ঠিক যে হাংরি কোন ইজম ছিল না।  ছিল একটা স্টাইল বা আইডিয়া।  আরও বলতে পারি, একটা ঘটনা, বাংলাভাষায় সেভাবে যা আগে কখনো ঘটেনি।  বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন অনাদৃত এক উপদ্রুত এলাকা থেকে বিশাল এক ঢেউ, উঠে এসে, আছড়ে পড়েছিল এজি-গোয়িং সাহিত্যের ল্যাসলেসে মসৃণ চত্ত্বরে।  সমাজের একেবারে নিচুতলার ভাষা ও ভাবনাকে সাহিত্যের কাছাকাছি নিয়ে আসার, পক্ষান্তরে বাংলা সাহিত্যের লিরিকফুলের বাগানকে তছনছ করে নতুন প্রতিমান প্রতিষ্ঠার তাগিদে হাংরি ছিল প্রথম আর তখনো-অব্দি একলোতা বৈপ্লবিক সমীহা।
     

     
     
     
      
     
     
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 106.213.52.40 | ০২ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:১৫735282
  • স্লেভ
    মলয় রায়চৌধুরী
    মিশরের পিরামিডগুলো দেখতে বারবার আসি
    মনে হয় হারানো কাউকে খুঁজি, কাকে,
    দু-আড়াই হাজার বছর আগের কোনো স্লেভ
    মমি হয়ে শুয়ে আছে, ধুলোর তবকে মোড়া
    তাকে নয়, আসলে মৃত্যুকে খুঁজি, তার মতো আরো অনেকের
    নয়তো জাদুঘরে কেন যেতে ইচ্ছে করে
    সবই তো প্রাচীন মৃত ইতিহাসে আবছা ধুলোট
    সেখানেও মমিটির দিকে চেয়ে দেখি বহুক্ষণ
    মনে হয় চিনি তাকে, মৃত্যুকে কতোভাবে চিনি
    কোমরে হাত রেখে মহেঞ্জোদারোর কিশোরীটি
    যে যুবতীকে কান কেটে উপহার দ্যান ভ্যান গঘ
    মদিগলিয়ানির নগ্ন যুবতীরা, বদল্যারের জাঁ দুভাল
    উড়ন্ত সারসদল ফিরে যাচ্ছে আকাশ গোলাপি করে
    কোথায় মারা যায় তারা, কোথায় মারা যায় তিমিমাছ
    ডায়নোসরদের পাথুরে কঙ্কাল ছুঁয়ে দেখি
    কোটি-কোটি বচ্ছর আগের মৃত্যু
    কেন তারা হারিয়ে গিয়েছে জানতে পারেনি কেউ
    অ্যাজটেকদের পিরামিডগুলো দেখতে আসি বারবার
    দেবতাকে হৃৎপিণ্ড কেটে উপহার দিত
    রক্ত খেতে ভালোবাসতো তাদের ঈশ্বরেরা
    আনন্দ উৎসবে মেতে, বুক থেকে ছিঁড়ে তখনও
    নাচছে হৃৎপিণ্ডখানা, মৃত্যুর আহ্লাদে বিভোর
    আসলে মৃত্যুকে খুঁজে ফেরে সকলেই
    শেষে পায় নিজের শরীরে, মৃত্যুর ক্রীতদাস
    তার বোধ মৃত্যুই লুপ্ত করে দিয়ে চলে গেছে
    সে তখন মৃত্যু সম্পর্কে বোধশক্তিহীন
    মাছি উড়ছে তার শবদেহটির ঠোঁটে
    ডানায় মৃত্যুর গান নিয়ে
     
     
     
     
     
     
     
    •  
       
  • গোবিন্দ ধর | 106.213.52.40 | ০২ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:১৮735283
  • মলয় রায়চৌধুরীর সাহিত্যিক মূল্যায়ন

    গোবিন্দ ধর

    মলয় রায়চৌধুরীর নাম উচ্চারণ করলে অনেকেরই মনে পড়ে যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের এই লাইনখানা : “আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।” হ্যাঁ, বাংলা সাহিত্যের নিস্তরঙ্গ আবহে মলয় রায়চৌধুরী আকাশের দেবতার কটাক্ষের মতো বজ্রবিদ্যুৎসহ নেমে এসেছিলেন এবং তোলপাড় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন । তিনি যোদ্ধাদের পরিবারের সন্তান, যা বাঙালি সাহিত্যিকদের পারিবারিক ইতিহাসে বিরল । তাঁর পূর্বপুরুষ পঞ্চানন ছিলেন আফগান ঘোড়সওয়ার বাহিনীর প্রধান এবং শৌর্য প্রদর্শনের জন্য ‘সখত খান’ উপাধিতে ভূষিত হন । তাঁর আরেক পূর্বপুরুষ, লক্ষ্মীকান্ত, যাঁর সময় থেকে তাঁরা গঙ্গোপাধ্যায় থেকে রায়চৌধুরী হলেন এবং কলকাতা সংলগ্ন সুন্দরবন অঞ্চলের জায়গির পেলেন, ছিলেন মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য । কার্তিক মাসে জন্মগ্রহণ করে মলয় পেয়েছেন সমুদ্রগুপ্ত-নন্দিত ষড়াননের দক্ষতা । তিনি সবায়ের থেকে ভিন্ন ।

     

    অত্যন্ত কম পরিসরে উৎপলকুমার বসু স্পষ্ট করে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে মলয় রায়চৌধুরীর ভূমিকা । তিনি বলেছেন, “ মলয় রায়চৌধুরী এখনকার বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট নাম । তিনি ছয়ের দশকে লিখতে শুরু করেন এবং এখনও লিখছেন । তাঁর কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, ইস্তাহার ও Polemics এর সমগ্র সংগ্রহ প্রকাশিত হলে একটি প্রয়োজনীয় কাজ হবে বলে আমার ধারণা । তিনি সাহিত্যিক নন । অর্থাৎ ‘সাহিত্যের সেবক’ বললে আমাদের স্মরণে যে-ছবিটি ভেসে ওঠে, তাঁকে সেই শ্রেণিতে ফেলা যাবে না । বাংলা সাহিত্য তাঁর হাতে যতটা না পূজিত হয়েছে --- আক্রান্ত হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি । সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে মলয় রায়চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই যুদ্ধে নেমেছিলেন । তাঁর তাত্বিক প্রস্তুতি ছিল । এবং তথাকথিত বাংলা ‘সংস্কৃতি’-র ঘরে তাঁর লালন পালন নয় বলে ওই কালচারের পীঠভূমিগুলিকে অবজ্ঞা করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন ।”

     

    মলয় রায়চৌধুরী, যাঁকে কলিম খান বলেছেন ‘রাজদ্রোহী রাজকুমার’ তাঁর সাহিত্যিক অবদান  মূল্যায়ন করা সাহসের ব্যাপার । বহু পাঠক তাঁর নাম শুনেছেন অথচ তাঁর বইপত্র পড়েননি ; তাঁদের অনেকে তাঁর নামের মহিমায় এতোই আতঙ্কিত যে তাঁর বিরুদ্ধে কয়েক লাইন লিখে বা ফেসবুকে মন্তব্য ভাসিয়ে দায়িত্ব সমাধা করে ফেলেন । তার প্রধান কারণ হাংরি আন্দোলনের সময়ে তাঁর যে কুখ্যাতি বাংলায় ছড়িয়েছিল এবং সুখ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়েছিল, তার জোয়ারে বহু পাঠকের মেধার নৌকাডুবি হবার সম্ভাবনা থাকে । মলয় রায়চৌধুরী যেন পৌরাণিক যুগের দেবতা, যাঁর সম্পর্কে যথেচ্ছ ধারণা গড়ে নেয়া যায় । আমরা শুনে এসেছি, পৌরাণিক দেবতারা ছিলেন ইন্দ্রিয়পরায়ণ, কামাসক্ত, অজাচারী, বহুপত্নীক ও ব্যভিচারী। দেবসভায়  যখন অপ্সরারা নাচতেন, তখন দেবসভা মুখরিত হয়ে থাকত অপ্সরাদের নাচগানে। মলয়ের কবিতার অবন্তিকাদের মতো যেন ছিলেন উর্বশী, মেনকা, রস্তা, তিলোত্তম, ঘৃতাচী, মুকেশী, মঞ্চঘোষা, অলম্বুষা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুবাহু, মুপ্রিয়া, সরসা, পঞ্জিকাস্থল ও বিশ্বাচী। মলয়ের হাংরি এবং পোস্টমডার্ন জগতের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে তাঁরা পারদর্শিনী। তাঁদের সৌন্দর্য ও যৌন আবেদন কল্পনা করে নিতে হয়। মলয়ের অবন্তিকাদেরও তেমনই কল্পনা করে নিতে হয়। তাঁরা ছিলেন স্বর্গের স্বাধীন নারী, যেমন মলয়ের হাংরি কবিতার শুভা এবং পোস্টমডার্ন প্রেমের কবিতার অবন্তিকারা। মর্ত্যলোকের অবন্তিকারা স্বর্গের অবন্তিকাদের টক্কর দিতে পারে । 

     

    কেবল প্রেমের কবিতা নয়, মলয়ের অন্যান্য কবিতা, কাব্যনাট্য, উপন্যাস ও ছোটোগল্পেও চরিত্রেরা বহুমাত্রিক, কোনও চরিত্রকে একটি পাত্রে ঢেলে ফিট করা যাবে না । এরকম একজন সাহিত্যিকের রচনা পড়ে পাঠকের অস্বস্তি হতেই পারে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমেরিকা থেকে মলয় রায়চৌধুরীকে মাস্তানসুলভ হুমকি দিয়ে লিখেছিলেন যে তাঁর “গায়ে পদ্মাপাড়ের রক্ত আছে”। ফিরে এসে মলয়ের বিখ্যাত কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ সম্পর্কে সমীর রায়চৌধুরীকে লিখেছিলেন যে কবিতাটি পড়ে তাঁর “গা রি-রি করে উঠেছিল।” মানুষ গোড়া থেকেই তার দেবতাকে নিজের স্বরূপে কল্পনা করে নিয়েছিল। সেজন্য মানুষের যে সব দোষ-গুণ আছে, তার দেবতাদেরও তাই ছিল। মলয় রায়চৌধুরীকে পাঠক মনে-মনে দেবতার স্হানে বসিয়ে ঈর্ষা করেছেন, তাঁর ক্ষমতায়, পাণ্ডিত্যে, ভাষানির্মাণে, গদ্যবিন্যাসে, প্লটবিনির্মাণে এবং খোলাখুলি নিজের কথাবার্তা উপস্হাপনে। ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি একটি মাইলস্টোন, বাংলা কবিতায় এবং মলয়ের সাহিত্যজীবনে। পনেরোজন তাঁর এই কবিতাটি ইউটিউবে আবৃত্তি করেছেন । জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায় যথার্থ বলেছেন যে এই কবিতাটি মলয়ের ক্ষতিও করেছে, কেননা বহু পাঠক মলয়কে এই কবিতাটি দিয়ে চেনেন । শীতল চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন যে মলয়ের এই কবিতাটি পরের দশকের কবিদের প্রভাবিত করেছে, এমনকী জয় গোস্বামীকেও। কবিতাটি নিয়ে ফিল্ম করেছেন মৃগাঙ্ক গঙ্গোপাধ্যায় ।

     

    পরবর্তীকালে তাঁর কবিতায় যে বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে, তা চিহ্ণিত করতে পেরেছেন বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায় যিনি বলেছেন মলয়ের সাহিত্যে পৌরুষের উপস্হিতির কথা ; এবং সোনালী মিত্র, যিনি মলয় রায়চৌধুরীর জীবনের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে মলয় পুরাণ-বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের মতো । সোনালী মিত্র বলেছেন, জীবনের কোনো ঘটনা লুকোছাপা করেননি মলয় । মুসলমান যুবতী কুলসুম-এর সংসর্গ যেমন স্বীকার করেছেন, তেমনই সেই তরুণীর কথা যিনি মলয়কে সঙ্গে নিয়ে ইলোপ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং প্রত্যাখ্যাত হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন অথবা সেই ডিভোর্সি যুবতীর কথা, যিনি মলয়ের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিনই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর ইউটেরাস নেই । এই মহিলারাই মলয়ের অবন্তিকা হয়ে দেখা দিয়েছেন । ফলে, আমরা পাই তাঁর নতুন পর্বে অকল্পনীয় বাকপ্রতিমা, নিজের মাথা কেটে প্রেমিকাকে উপহার দেবার প্রস্তাব । “মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো” কবিতাটি ইউটিউবে আবৃত্তি করেছেন দশজন তরুণী । সমীর রায়চৌধুরী মলয়ের অবন্তিকা সম্পর্কিত কবিতা আলোচনাকালে দর্শিয়েছেন যে অবন্তিকা নামের যুবতীরা বনলতা, নীরা, সুপর্না, গায়ত্রী নন । মলয়ের নারী একজন পোস্টমডার্ন নারী । বাংলা কবিতার ইতিহাসে মলয় রায়চৌধুরীই প্রথম, যিনি ‘আভাঁগার্দ’ কবিতা লিখেছেন ।

     

    মলয় রায়চৌধুরীর বাল্যস্মৃতি “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” পড়ে আমরা জানতে পারি যে তাঁর শৈশবের ইমলিতলা পাড়া ছিল পৌরাণিক দেবী-দেবতার পাড়া, সেখানে জাতিপ্রথার এবং ধর্মের বাঁধন ছিল না। শুভশ্রী দাস সেকারণে বইটির ঘটনাবলীকে বলেছেন জাদুবাস্তব । “ছোটোলোক” কেন ? সেকথা বলেছেন অরিজিৎ সব্যসাচী দাশ, “"ছোটলোক"। ঠিক সেজন্যই যেন তাঁরা ছিলেন, ইমলিতলায় আলাদা, দরিয়াপুরে আলাদা, পাটনার বড়লোক বাঙালিদের চেয়ে আলাদা, পেনিটিতে আলাদা, আহিরিটোলায় আলাদা, যে উদ্বাস্তুরা গোলা রোডে আর ভোমরপোখরে এসেছে তাদের চেয়ে আলাদা, যারা কলকাতায় থাকে তাদের চেয়েও আলাদা।”  অভিনব সেই ইমলিতলা পাড়া, যেখানে অন্ত্যজদের সঙ্গে মলয় ও তাঁর দাদা ইঁদুর পোড়া, শুয়োরের মাংস, ছাগলের থনের ঝোল খেয়েছেন তাড়ি, বাংলা মদ, গাঁজা সহযোগে । যে পাড়ায় এক বৃদ্ধ মলয়দের রকে বসে শিশুদের অশ্লীল গালাগাল শেখান । উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্য না হয়েও মলয় সেই অভিশপ্ত জীবনের ভয়াবহতা একটামাত্র কবিতার মাধ্যমে যে প্রকাশ করতে পেরেছেন তা ব্যাখ্যা করেছেন সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, ‘কে একজন ঝুলছে’ কবিতায় । 

     

    ইমলিতলার ছোটোলোক পাড়ার নিবাসী হয়েও কী ছিল না সেই বাড়িতে ! উত্তরপাড়া থেকে আনা সাবর্ণ চৌধুরীদের ইরানি আতরের আলমারি, কোলাপসিবল গেটের মতন গড়গড়া, সোনালী ফ্রেমের বিশাল আয়না, এইচএমভির চোঙাঅলা গ্রামোফোন, গহরজানের সময় থেকে রকর্ড, বীণা, অরগ্যান, হারমোনিয়াম, সেতার, দেয়ালে টাঙানো বাঘ, হরিণ, নেকড়ের মুখ । তাঁর মেজদাকে তাঁর বড়ো জ্যাঠা এক বেশ্যার কাছ থেকে দেড়শো টাকায় কিনেছিলেন । কোনো সাহিত্যিকের পরিবারে এরকম অভিজ্ঞতা সঞ্চিত বলে মনে হয় না । বাংলার বাইরে বসবাস করেও বাংলার প্রতি মলয়ের ভালোবাসা পরিলক্ষিত হয় বাংলার ইতিহাস নিয়ে লেখা তাঁর জাদুবাস্তব উপন্যাস ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’ ; বাংলার ইসলামি শাসকরা বঙ্গদেশকে বলতেন জিন্নতুলবিলাদ, অর্থাৎ মর্ত্যের স্বর্গ । তিনি একটি কবিতায় বলেছেন যে আবার জন্মাতে চান, কিন্তু অবিভক্ত বাংলায়, তাই দুই বাংলার মানুষের ভাষা হয়ে জন্মাতে চান । পশ্চিমবাংলার বামপন্হী শাসনের সময়কালকে ফুটিয়ে তুলেছেন ‘গহ্বরতীর্থের কুশীলব’ নামের জাদুবাস্তব বড়ো গল্পে ।

     

    এই প্রসঙ্গে অনুপম মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “মলয় রায়চৌধুরীর স্বাভাবিক বিরোধাভাসটা এই যে, তিনি নিজেকে ছোটলোক ইত্যাদি দাবি করেও, বাঙালির সামগ্রিক হড়কে যাওয়ার কবন্ধ শরিক হননি, বিশেষ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক খুড়োর কলে নিজেকে জুড়ে ফেলেননি, বরং নিজেকে সারা পৃথিবীর সাপেক্ষে জায়মান লেখক করে তুলতে পেরেছেন। তাঁর উপন্যাস এবং কবিতা এবং প্রবন্ধকে প্রাদেশিক চেতনার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়া যায়। এটা এই মুহূর্তে জীবিত দ্বিতীয় কোনো বাঙালি সাহিত্যিক সম্পর্কে আমি বলতে পারছি না। এটা আমার অজ্ঞতাপ্রসূত হলেও, দৃঢ় ধারণা, এবং কোনো প্রশংসাবাক্য নয়। একজন লেখকের জীবনে প্রায়ই এটা ঘটে যে, তিনি নিজের জন্য একটি লাগসই ভাবমূর্তি বেছে নিলেন, কিন্তু নিজেকে সেই মাপে ঢালতেই পারলেন না। মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। তিনি নিজেকে বিহারের ইমলিতলা থেকে উঠে আসা ছোটলোক হিসাবে পেশ করতে চাইলেন, কিন্তু হাড়ে হাড়ে বোঝা গেল এই লেখকটি সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বংশপরিচয়েই অধিক মানানসই, কারণ, মলয়ের মধ্যে যে আভিজাত্য আছে, যে আত্মসচেতন উদাসীনতা আছে, তা গত ১০০ বছরের বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট দুর্লভ, তাঁর মধ্যে অস্তিত্বের উৎকণ্ঠা থাকলেও বাংলা বাজারের ইতরতা নেই, প্রান্তিকতা যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা স্বরচিত।”

     

    মলয়ের নিরীক্ষামূলক আখ্যান ‘নখদন্ত’ সম্পর্কে শর্মিষ্ঠা ঘোষ বলেছেন, “ডিকনস্ট্রাকশন করেছি আমার সাধ্য অনুযায়ী , ইউনিটি অব টাইম প্লেস অ্যাকশান মান্য করল কি করল না ভাবা বাদ দিয়ে বা ফার্স্ট পার্সন ন্যারেটিভের একটি বিপজ্জনক প্রবণতা , নিজ মতবাদের প্রতিফলন কাহিনী থ্রেডকে প্রভাবিত করতে পারে এই আশঙ্কা সাময়িক ভাবে সরিয়ে রেখে । রোমান এ ক্লেফ না বিলডানসরোমান তর্কাতর্কির পরেও যে সংবেদনশীলতা ভিখারি পাসওয়ান কেসের আগে পরে একটি তৃতীয় নয়নের উপস্হিতি মহাকালের দৃষ্টি না এড়ানো নেমেসিস হয়ে আসে তা অস্বীকার করা যায় না ।” মলয়ের ছোটোগল্পকে উদয়ন ঘোষ, যিনি একদা কমিউনিস্ট ছিলেন, তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন “পোস্টমডার্ন ও পোস্টকলোনিয়াল”।

     

    মলয় রায়চৌধুরী তিনটি উপন্যাস বেশ বিখ্যাত, যাকে আলোচক সমীর সেনগুপ্ত, অজিত রায়, কৌস্তুভ দে সরকার, সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন ট্রিলজি -- ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, জলাঞ্জলি ও নামগন্ধ । এই তিনটি উপন্যাসকে মলয় আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন ঔরস এবং প্রাকার পরিধিতে । মলয় রায়চৌধুরী রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভালো চাকুরি ছেড়ে নাবার্ডে গ্রামীণ উন্নয়ন আধিকারিকের চাকরি নেন, ভারতের গ্রামজীবন দেখার লোভে এবং সেই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উপন্যাস ও গল্প লেখার অভিপ্রায়ে । এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের কারণে তিনি কলকাতার বন্ধুদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন । ভালোই করেছিলেন । আমরা অবশ্য দেখেছি তিনি অনুযোগ করেছেন যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরি ছাড়ার ফলে তাঁর মাইনে এবং পেনশন অনেক কমে গেছে। সাহিত্যের খাতিরে সেই ক্ষতি এমন কিছু নয় ।

     

    উপন্যাসগুলোতে মলয় রায়চৌধুরী অসাধারণ বর্ণনায় উপস্হাপন করেছেন বিহারে জাতিপ্রথার কারণে ধ্বংসযজ্ঞ, পশ্চিমবাংলায় চাষের, তাঁতের, কোল্ড স্টোরেজের নোংরা রাজনীতি, উদ্বাস্তুদের নিয়ে নেতাদের ছেলেখেলা,  অবুঝমাঢ়ে আদিবাসীদের কোনঠাশা জঙ্গলজীবন । অলোক গোস্বামী ব্যক্তি মলয়কে অপছন্দ করেও প্রশংসা করেছেন মলয়ের দৃষ্টিপ্রতিভা ও গদ্যনির্মাণকে । অজিত রায় এবং সমীর সেনগুপ্ত মলয়ের প্লটনির্মাণকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন তাঁর প্রথম পৃষ্ঠায় সন্ত্রাস ও শেষে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটানোর টেকনিকের কথা যা পাঠকদের হতবাক করে দেয়। ‘ঔরস’ উপন্যাস প্রসঙ্গে রঞ্জন রায় লিখেছেন, “দু'দিন ধরে কোনরকমে নাওয়া-খাওয়া সেরে একটানা পড়ে শেষ করলাম --"ঔরস" উপন্যাস। অসাধারণ লেগেছে। হয়ত মলয়বাবুকে নিয়ে কিছু পূর্ব ধারণার কারণে এমন গদ্যরচনা আসা করিনি। এটি উপন্যাসের ভঙ্গিমায় একটি সোশিও অ্যান্থ্রপলজিক্যাল বয়ানকথা। আমি বীজাপুর, নারায়নপুর, কোন্ডাগাঁও, বস্তার, দন্তেওয়াড়া সুকমা গেছি। অবুঝমাড়ে ঢুকি নি । বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট পড়েছি যাতে শহুরে মানুষের রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল।

    এই প্রথম 'অবুঝমাড়' নিয়ে একটি অথেন্টিক লেখা পড়লাম, তার প্রকৃতি, বনসম্পদ ও মানুষ নিয়ে । আশি পেরোনো মলয়বাবু কবে এসব এমন নিবিড় করে দেখলেন? আমি মাথা নোয়ালাম। যারা পড়েন নি পড়ে ফেলুন; ঠকবেন না -- গ্যারান্টি!” বলা বাহুল্য যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নোট পোড়াবার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি যেমন আমাদের দিয়েছেন ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপন্যাস, তেমন নাবার্ডের গ্রামীণ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসাবে দিয়েছেন, ‘নামগন্ধ’, ‘ঔরস’ ও ‘প্রাকার পরিখা’ ।


    মলয় নিজেকে বিস্তারিত করেছেন বিভিন্ন জনারে, যেমন রহস্যোপন্যাস “নোরা পরীর কংকাল প্রেমিক”, “ভ্যান গগের কান”-এ, তেমনই ইরটিক উপন্যাস লিখেছেন “অরূপ তোমার এঁটোকাটা” নামে । বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “উপন্যাসের  নামটা আমাকে বুঝতেই দেয়নি ভিতরের খনিজের উপস্থিতি। বুঝিনি এই অতি সংক্ষিপ্ত উপন্যাসের প্রতিটি লাইন এক বিরল জীবনদর্শনের মুখোমুখি করে দেবে আমাকে। এক অন্য ধরণের সত্যানুসন্ধান , সাধারণ খুনের মামলার প্রেক্ষাপটে যা এক যুবক-যুবতীর উৎকেন্দ্রিক আরণ্যক ভালোবাসা থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে। সবটুকু মিলিয়ে বলা যায় যে এরকম প্রেমের উপন্যাস, যা কিনা অনেকগুলি বহুমুখী সত্যের ভিত্তিতে তৈরি করা বহুভূজের মধ্যে আমাদের এক অন্যরকম জীবনচেতনার মুখোমুখি করে দেয়, খুব বেশী লেখা হয় নি বাংলা ভাষায়। বিষয়বৈচিত্র্য ও সাহসী মনোজ্ঞ বর্ণনায় এই উপন্যাসটি বড্ড আলাদা, উৎকেন্দ্রিক, ঠিক এর লেখকের মতোই। পড়ে দেখতে পারেন সময় করে। মনের জটগুলো খুলে যাবে (অন্ততঃ আমার তো গেছে), আলো আসবে মনে।”

     

    ইরটিক উপন্যাস ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” আলোচনায় অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,স্থির কেন্দ্র, ঘুর্ননের আপাত স্থির বিন্দু--- যাকে জন অ্যাশবেরী  'আ হিম টু পসিবিলিটি' বলে থাকেন, তা এই নভেলাতে ঘেপ্‌টে আছে জটিল এক কেমোফ্ল্যাজে। তিনটি ভিন্ন ডেমোগ্রাফির তিন কথককে উপস্থিত করে যে আখ্যানের বুনন তার স্থির কেন্দ্র দুটিঃ এক-  পোস্ট কোলোনিয়াল ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত। ভারতবর্ষ, তরুণতর মেধাবী বাঙ্গালীর রাজনৈতিক সচেতনতা আর তার  উত্তাল অভিমুখ; দুইঃ গ্লোবাল কানেকশন- আমেরিকার হিপ্সটার আন্দোলনের তরঙ্গ। সেই তরঙ্গ মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছিল, ষাট থেকে সত্তরের  প্রথম ভাগে- নেপাল থেকে বারানসী। গুরু থেকে গাঞ্জা। বেলাগম সেক্স। তুলকালাম মাদক। অব্যর্থ শূন্যের ভেতর অনিশ্চিত জীবনের মানে খোঁজা। ভারত তখন  হয়ে উঠেছে ঘরছাড়া হিপিদের হতাশ-নিরঞ্জন অভয়াক্ষেত্র- ইহমুক্তি খুঁজতে আসা শয়ে শয়ে মার্কিনি তরুন-তরুণী বারানসীর গলিতে গলিতে। এই বেনারসকেই বেছে নিয়েছেন মলয় তার নভেলার স্থানিক পট হিসেবে। কলকাতা থেকে বিকেন্দ্রীকরণ । আবার কলকাতা ও প্রবাস, বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্র ও প্রান্তিক, এই দুই বাইনারি ছাপিয়ে তা মলয়ের আত্মজৈবনিক প্রয়াসও। ষাটের দশক। সত্তরের প্রথম ভাগ।  বিটরা এসে যাবেন, কারণ- মলয় ও হাংরিদের  বিট-কানেকশন ও মিথ পর্যায়ের। মলয় আমাকে এক  সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন- হাংরিরা নয়, বরং বিটরাই অনেকভাবে  হাংরিদের প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন। ইতিহাস, দর্শন, মনোবিশ্লেষণ, ক্র্যাফট ও  কৌশলের নিরিখে এটি, হতে পারে, মলয় রায়চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ ফিকশন কাজ ।”

     

    উপন্যাসগুলো সম্পর্কে সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আলোচনার শুরুতেই বলেছেন, “মলয় রায়চৌধুরীর  উপন্যাসের বিষয়, ভাষা ও নির্মাণকে বুঝতে চাইলে সবার আগে পাঠককে সরে আসতে হবে উপন্যাস-পাঠের প্রচলিত অভ্যাস থেকে।  মলয় খুব সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন আমাদের চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণের ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা উপন্যাস-ভাবনাকে। মলয়ের বয়ন-বুনন পদ্ধতি ও ভাষাতাত্ত্বিক সন্দর্ভ, বাংলা ও বিহারের প্রকৃতি, সমাজ ও ব্যক্তিমানুষের পারস্পরিক সম্পর্কসমূহের দ্বান্দ্বিক সমগ্রতাকে এবং তাদের পরিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে অবিচ্ছিন্ন করে তুলতে চেয়েছে--- চারপাশের বাস্তবের সমালোচনা করতে-করতে ও তাকে অতিক্রম করে শিল্পের নিজস্ব বাস্তব নির্মাণ করতে-করতে।তার ফলে মলয়কে সবার আগে ভাঙতে হয়েছে প্রথাগত ইউরোপীয় কোড বা সংকেতগুলিকে। এমনকি, সেই সঙ্গে, তাঁকে সমালোচনা করতে হয়েছে, অতিক্রম করে যেতে হয়েছে, ইউরোপ থেকে আসা প্রধান আধুনিকোত্তরবাদী সন্দর্ভগুলির প্রশ্নহীন বশ্যতা ও উপযোগিতার মানসিকতাকেও। অনিবার্য পরিণতি হিসাবে মলয়ের উপন্যাস তিনটিতে এমন এক নতুন, এতদিন আমাদের সামনে অনাবিষ্কৃত, ভারতীয় বাস্তবতার সন্ধান পাই, যাকে ঔপনিবেশিক চৈতন্য-কাঠামোর পরিসীমার মধ্যে ধারণ করা সম্ভব ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষিত মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের কয়েক শতাব্দীর ধারাবাহিকতা আবিশ্বে যে-নিষ্ঠুরতা ও সাংস্কৃতিক আক্রমণ-অবক্ষয়ের জন্ম দিয়েছে--- তাকে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন বলেই মলয়কে এই রাস্তায় হাঁটতে হয়েছে। অন্যদিকে আবার, মলয়ের বয়ন-বুনন পদ্ধতি ও ভাষাতাত্ত্বিক সন্দর্ভ কিন্তু যান্ত্রিকভাবে ইউরোপকে প্রত্যাখ্যান করে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বয়ান বা টেক্সটের মধ্যে পাঠককে সীমাবদ্ধ রাখার বার্তা প্রেরণ করে না। পক্ষান্তরে তাঁর বয়ন-বুনন পদ্ধতি ও ভাষাতাত্ত্বিক সন্দর্ভ ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্ব এবং ভারতীয় স্বাধীন অভিজ্ঞান অনুসন্ধান ও সৃষ্টির আবেগ ও স্পন্দনশীলতার দ্বান্দ্বিক সংশ্লেষের পরিণতি। মলয় তাঁর নিজের মতো করে, তাঁর উপন্যাস তিনটিতে ধারাবাহিকভাবে, ঔপনিবেশিকতার দায়মোচনের প্রক্রিয়াকে বিকশিত করে তুলেছেন। তা করতে-করতে তাঁর উপন্যাসের বয়ান একই সঙ্গে ধারণ করেছে আধিপত্যকামী কেন্দ্রীয় ব্যবস্হাসমূহ ও তাদের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে-থাকা প্রান্তীয় শক্তিসমূহের দ্বান্দ্বিকতাকে এবং ওই কেন্দ্রীয় ব্যবস্হাসমূহ থেকে উৎপন্ন মহাসন্দর্ভ ও প্রান্তীয় বর্গের প্রতিদিনের যাপিত জীবনের গভীর থেকে উৎসারিত বিকল্প সন্দর্ভের দ্বান্দ্বিকতাকে।”

     

    এলেক্ট্রা কমপ্লেক্স নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন ‘আঁস্তাকুড়ের এলেক্ট্রা’ উপন্যাস । মানুষের বিস্টিয়ালিটি নিয়ে লিখেছেন ‘জঙ্গলরোমিও’ উপন্যাস । তরুণীদের স্বেচ্ছাকৃত অরগ্যাজমের আগ্রহ নিয়ে লিখেছেন ‘লাবিয়ার মাকড়ি’ উপন্যাস । নেক্রোফিলিয়া, পেডোফিলিয়া, এক্সিবিশনিজম, ফ্রটারিজম, সেক্সুয়াল স্যাডিজম, পাইরোমেনিয়া, ক্লেপটোম্যানিয়া ইত্যাদি মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত পুরুষদের মৃত নারীদের ধর্ষণ করার প্রবৃত্তি নিয়ে লিখেছেন ‘নেক্রোপুরুষ’ । মলয়ের অনুবাদের কাজও প্রশংসার্হ ; তিনি যে কেবল প্রখ্যাত কবি বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো, ভেরলেন, জাঁ জেনে, অঁতনা আতো, উইলিয়াম ব্লেক, ব্লাইজি সঁদরা, জাঁ ককতো, গিন্সবার্গ, সুররিয়ালিস্ট কবিদের অনুবাদ করেছেন, তাই নয় ; তিনি পাকিস্তানি, উইঘুর, তিব্বতি, ইরানি, নাগা, মিজো কবিদেরও অনুবাদ করেছেন । জীবনী লিখেছেন র‌্যাঁবো, বোদলেয়ার, জেমস জয়েস, হেনরি মিলার, গিন্সবার্গ ও বিনয় মজুমদারের ।

     

    মলয় রায়চৌধুরী এখন আশির কোঠায় । আঙুলে আরথ্রাইটিস হবার পর এই বয়সে কমপিউটার শিখে নিয়েছেন। আমরা চাইবো তিনি এইভাবেই আমাদের মাঝে সক্রিয় থাকুন ।

  • গোবিন্দ ধর | 106.213.52.40 | ০২ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:২৪735284
  • ভাদ্র-আশ্বিন ১৪২৮, দুই মাস প্রশ্নোত্তরে মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গোবিন্দ ধর

    গোবিন্দ : আপনি প্রচুর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন । দুটি সংকলন আছে আপনার সাক্ষাৎকারের। কিন্তু বেশিরভাগ প্রশ্নকর্তা হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন । আপনার জীবন, চিন্তাধারা, অভিজ্ঞতা ও গ্রন্হাবলী নিয়ে বিশেষ প্রশ্ন কেউ করেননি । আমি সেই ধরনের প্রশ্ন করতে চাই, যা অন্যেরা করেননি । আপনার শৈশব কেটেছে পাটনার ইমলিতলা নামে এক অন্ত্যজ বস্তিতে, সেখানে কৈশোরে কুলসুম আপা নামের এক কিশোরীর সঙ্গে আপনার জীবনে যৌনতার প্রথম পরিচয় । তা কি প্রেম ছিল ? আপনার ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ হিসাবে কি কাজ করেছিল ঘটনাটা ?

    মলয় : না, তা প্রেম ছিল না । উনি আমাকে গালিব আর ফয়েজের কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আর নিজেই এগিয়ে এসে সংসর্গ পাতিয়েছিলেন । ইমলিতলা পাড়া ছিল চোর,ডাকাত, পকেটমার অধ্যুষিত গরিব দলিতদের পাড়া, তাদের বাড়িতে অবাধে ঢুকে পড়া যেতো । কুলসুম আপাদের বাড়িতেও, এমনকী ওদের শিয়া মসজিদের ভেতরেও খেলা করার সময়ে ঢুকে লুকিয়েছি, নামাজ পড়ার মাদুরের পেছনে লুকিয়েছি । এখন ভারতীয় সমাজ এমন স্তরে পৌঁছেচে যে অমন বাল্যকাল অভাবনীয় মনে হবে । আমার ধর্মনিরপেক্ষতা বা ব্যাপারটাকে যা-ই বলো, ওই পাড়াতেই সূচিত হয়েছিল । দাদা সমীর রায়চৌধুরী এই অভিজ্ঞতাকে বলেছেন একলেকটিক ।  রামমোহন রায় সেমিনারি ব্রাহ্ম স্কুলে পড়ার সময়ে আমার ক্রাশ ছিলেন গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তী, যাঁর প্রভাবে আমি মার্কসবাদে আকৃষ্ট হয়েছিলুম । আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে এনার নাম সুমিতা চক্রবর্তী । উনি আমাকে ব্রাহ্ম কবি-লেখকদের রচনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ।

    গোবিন্দ : সেই পাড়ায় আপনারা নাকি পোড়া ইঁদুর, শুয়োরের মাংস, ছাগলের নাড়িভূঁড়ির কাবাব, তাড়ি, দিশি মদ, গাঁজা ইত্যাদি খেতেন । বাড়িতে তার জন্য পিটুনি খেতেন না ?

    মলয় : দাদা বলতো বাড়িতে বলবি না, মৌরি খেয়ে নে । কিন্তু মুখে গন্ধ শুঁকে মা টের পেয়ে যেতেন আর বকুনি দিতেন । কিন্তু পাড়ার লোকেদের টানে আবার অমন কাণ্ড করতুম । এই সমস্ত কারণে দাদা ম্যাট্রিক পাশ করার পর বাবা  ওনাকে কলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, আর নিজে একটা ঝোপড়ি কিনে দরিয়াপুর নামে সুন্নি মুসলমান পাড়ায় বাড়ি করেন। আমি সেই বাড়িতে একা থাকতুম । আমার বাল্যস্মৃতি ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ আর ‘ছোটোলোকের যুববেলা’ পড়লে জানতে পারবে নানা ঘটনা । সিটি কলেজে দাদার সহপাঠী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । চাইবাসা আর ডালটনগঞ্জে দাদা মৎস্য বিভাগে পোস্টেড থাকার সময়ে প্রচুর মহুয়ার মদ খেয়েছি। দাদা হরিণের মাংস খাবারও ব্যবস্হা করে দিতেন । কতো রকমের মাছ যে খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই ; গেঁড়ি-গুগলির বিরিয়ানিও খেয়েছি । তবে সবচেয়ে কড়া মদ হলো সালফি, অবুঝমাঢ় জঙ্গলের উপজাতিরা খায় । সালফি গাছ অনেকটা খেজুরগাছের মতন, খেজুরের মতনই রস বের করে, অবশ্য বেশ গাঢ়, ওদের দুবেলার নেশা আর ভোজনপর্ব তাতেই হয়ে যায় । ওখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘ঔরস’ নামে আমার একটা উপন্যাস আছে ।

     

    গোবিন্দ : ওই পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন ? গরিব নিম্নবর্ণের বিহারি ছেলে-মেয়ের সঙ্গে ?

    মলয় : হ্যাঁ, তাছাড়া আর কাদের সঙ্গে খেলবো ? স্কুলে ভর্তি হবার পরও ওদের সঙ্গে খেলাধুলা করতুম । স্কুলের বন্ধুরা কেউ ইমলিতলায় আসতো না । এমনকি তথাকথিত সংস্কৃতিবান বাঙালিরাও ইমলিতলা পাড়া এড়িয়ে চলতেন । ছোটোবেলায় নর্দমা থেকে লাট্টু, ড্যাঙ্গুলি, মার্বেল, রবারের বল কাঠি দিয়ে তুলে রাস্তার কলের জলে ধুয়ে নিয়ে খেলতুম । নর্দমাগুলো ছিল অত্যন্ত নোংরা, তাতে পাড়ার বাচ্চারা হাগতো । বাড়িতে জানতে পারলে বড়োজেঠিমা গায়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে দিতেন । বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই যে হাংরি আন্দোলনে এই পাড়ার অবদান কতোটা ।

    গোবিন্দ : আপনার নাকি এক জাঠতুতো ভাই ছিল যাকে বড়োজেঠামশায় এক বেশ্যার থেকে কিনেছিলেন ?

    মলয় : হ্যাঁ, ছিল । মেজদা । অনেককাল পর্যন্ত জানতুম না যে মেজদাকে কেনা হয়েছিল । মেজদা যখন জানতে পারল তখন বাংলায় কথা বলা বন্ধ করে কেবল হিন্দিতে কথা বলতো। পাড়ার প্রভাবে গুণ্ডা হয়ে গিয়েছিল । কম বয়সে মারা যায় । তবে মেজদার দাপটের দরুণ কেউ আমাদের ঘাঁটাতো না । 

    গোবিন্দ : আপনি নিজেই নিজের ইনটারভিউ নিয়েছিলেন শুনেছি । কাদের ছিল অমন প্রস্তাব ?

    মলয় : চন্দননগরের ‘দাহপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক কমলকুমার দত্ত’র আইডিয়া ছিল । দাহপত্রতে প্রকাশিত হবার পর পুস্তিকার আকারে ২০০৪ সালে বইমেলায় বেরিয়েছিল। পুস্তিকাটার নাম দেয়া হয়েছিল ‘প্রতিস্ব পরিসরের অবিনির্মাণ’ । প্রচ্ছদে পোরট্রেট এঁকে দিয়েছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী । এবার চান্স পেলে অন্যরকম আত্ম-প্রশ্ন তুলবো ।

    গোবিন্দ : হাংরিদের বোহেমিয়ান বলা হয় কেন ?

    মলয় : বাঙালির সনাতন সমাজের অনুশাসনে খাপ না খেলে ব্যক্তির আউল, বাউল, ফকির, সাধু, সন্ন্যাসী, বহুরুপী, বৈরাগী ইত্যাদি হবার সুযোগ ছিল, এখনও আছে । ঘটনাটাকে প্রাকৃতিক বলে মেনে নিতো সমাজ । এই কারণেই বোহেমিয়ান নামে কোনো ভাবকল্প বঙ্গসমাজে ছিল না । অথচ আধুনিকতাবাদী ও নবজাগৃতিবাদী ইউরোপে, সংস্কৃতি ব্যাপারটার উদ্ভবের দরুণ, যারা সমরূপতায় খাপ খায় না, তাদের বেয়াদপি সামলাতে ঘোর ঝামেলায় পড়েছে সমাজ । তাদের লাইনে এনে সংস্কৃতিবান করার জন্য  অনুভব করেছে একটি আধিপত্যবাদী নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা । সনাতন সমাজে যা ছিল স্বাভাবিক তা হয়ে গেল অস্বাভাবিক । যে খাপ খায় না সে ‘অপর’ । ইউরোপের নতুন ব্যবস্হা অনুযায়ী তাদের সংশোধন, দোষত্রুটিমুক্ত করে নেবার ফন্দিফিকির তৈরি করা হলো । ফলে সামাজিক স্হিতি আনতে রাষ্ট্র হয়ে উঠলো জরুরি । রাষ্ট্র তার সংস্হাগুলোর মাধ্যমে লাটের পর লাট একই রকম মানব উৎপাদনের কারখানা হয়ে গেল । যারা সেই ফ্রেমওয়র্কের বাইরে, তাদের ‘বোহেমিয়ান’ তকমা দেবার চল শুরু হলো । এদেশে তাদের নকল করা আরম্ভ করলো সমাজের কর্তারা ।

    গোবিন্দ : নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্প-উপন্যাস আলোচনার সময়ে প্রবুদ্ধ ঘোষ বলেছেন নবারুণ সমাজ নিয়ে ভাবতেন । হাংরিরা আত্মচিন্তার লেখা লিখতেন । আপনি কী বলবেন ?

    মলয় : প্রবুদ্ধ ঘোষ একটা হাংরি বুলেটিন পড়ে নিজস্ব ধারণা গড়ে নিয়েছেন । উনি হাংরিদের রাজনীতি বিষয়ক, ধর্ম বিষয়ক, অশ্লীলতা বিষয়ক ইশতাহারগুলো পড়েননি । তাছাড়া আমি ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি সমাজের, বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমার প্রবন্ধগুলোতে,  ‘পোস্টমডার্ন কালখণ্ড ও বাঙালির পতন’ পুস্তিকায় যেটা প্রকাশ করেছিলেন সুকুমার রায়, ‘খনন প্রকাশনী, থেকে এবং আমার প্রবন্ধ ‘উত্তরদার্শনিকতা’তে যা প্রমা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । দুটো প্রবন্ধই আমার প্রবন্ধসংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ডে আছে । বইটা মুর্শিদ প্রকাশ করেছে আবিষ্কার প্রকাশনী থেকে । আসলে, কৌম-নিরপেক্ষ ব্যক্তি হতে পারে না । সে নানারকম কৌমের অন্তর্গত । যেমন একজন বাংলাদেশি মানুষ একই সঙ্গে বাংলাভাষী কৌম, ইসলামি কৌম, সুন্নি কৌম ইত্যাদির অন্তর্গত– সে ইংল্যাণ্ডে গিয়েও বাঙালি হোটেল খোঁজে, বাঙালিদের আড্ডা খোঁজে । প্রবুদ্ধ ঘোষ, মনে হয়, আমার কোনও প্রবন্ধের বই আর উপন্যাস পড়েননি , যতোটা উনি নবারুণ ভট্টাচার্য পড়েছেন।

     গোবিন্দ:  :  আপনারা, হাংরিরা, শুনেছি যৌনকর্মীদের পাড়ায় যেতেন । ‘কৃত্তিবাসের’ কবি-লেখকরাও যেতেন অথচ তা স্বীকার করেননি নিজেদের জীবনীতে ; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওনার ‘অর্ধেক জীবন বইতে চেপে গেছেন । ওনারা বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ার পড়ে আর আপনাদের সংবাদ পড়ে হাংরিদের নকল করা আরম্ভ করেন বলে মনে হয় । সুনীলের এই ‘হিমযুগ’ কবিতা পড়লে আপনাদের আর সোনাগাছির প্রভাব স্পষ্ট হয়ে যায়। উনি লিখেছিলেন,“শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদূর চলে গিয়ে ফিরে আসি শরীরের কাছে/কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে-/শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোঃস্নার মতো যোনি/মধুকূপী ঘাসের মতন রোম, কিছুটা খয়েরি/কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে-/আমার নিশ্বাস পড়ে দ্রুত, বড়ো ঘাম হয়, মুখে আসে স’তি/কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।/নয় ক্রুদ্ধ যুদ্ধ, ঠোঁটে রক্ত, জঙ্ঘার উত্থান, নয় ভালোবাসা/ভালোবাসা চলে যায় একমাস সতোরো দিন পরে/অথবা বৎসর কাটে, যুগ, তবু সভ্যতা রয়েছে আজও তেমনি বর্বর/তুমি হও নদীর গর্ভের মতো, গভীরতা, ঠান্ডা, দেবদূতী/কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।/মৃত শহরের পাশে জেগে উঠে দেখি আমার প্লেগ, পরমাণু কিছু নয়,/স্বপ্ন অপছন্দ হলে পুনরায় দেখাবার নিয়ম হয়েছে/মানুষ গিয়েছে মরে, মানুষ রয়েছে আজও বেঁচে/ভুল স্বপ্নে, শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোৎস্নার মতো যোনী/তুমি কথা দিয়েছিলে…../এবার তোমার কাছে হয়েছি নিঃশেষে নতজানু/কথা রাখো! নয় রক্তে অশ্বখুর, স্তনে দাঁত, বাঘের আঁচড় কিংবা/ঊরুর শীৎকার/মোহমুগ্ধরের মতো পাছা আর দুলিও না, তুমি হৃদয় ও শরীরে ভাষ্য/নও, বেশ্যা নও, তুমি শেষবার/পৃথিবীর মুক্তি চেয়েছিলে, মুক্তি, হিমযুগ, কথা দিয়েছিলে তুমি/উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।”

    মলয় : কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবিদের কবিতায় বাঁকবদল ঘটেছিল হাংরি আন্দোলনের প্রভাবে। শরৎ মুখোপাধ্যায়ও হাংরি আন্দোলনের প্রভাবে অমন অভিজ্ঞতার কবিতা লিখেছিলেন, এই যেমন, কৃত্তিবাসের ষোল নম্বর সংকলন সম্বন্ধে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘ষোল নম্বর সংকলনে কৃত্তিবাস ফেটে বেরুল। তারিখ ১৩৬৯ চৈত্র। কবিত্বের খোলস ছেড়ে একদল অতৃপ্ত যুবকের অকস্মাৎ বেরিয়ে পড়ার জন্যে  প্রচন্ড অস্বস্তি ও বেগের প্রয়োজন ছিল। অ্যালেনদের সাহচর্য তা জুগিয়েছিল আমাদের । ঘামে নুন, যোনিদেশে চুল( পৃঃ ৫), দেখেছি সঙ্গম ঢের সোজা, এমনকি বেশ্যারও হৃদয়ে পথ আছে ( পৃঃ ২২)  , যোনির ঝিনুকে রাখা পোকাগুলি মুক্তা হয়ে গিয়েছে বিস্ময়ে ( পৃঃ ৪৫),আসলে যে কান্ড ঘটেছিল সব কবিদের  বুকের মধ্যে তা হল প্রচন্ড বিরক্তি থেকে উদ্ভুত ধ্বংস করার ইচ্ছে – সৃষ্টির নামান্তর – যা কিছু পুরনো পচা, ভালমন্দ সোনারুপোর খনি, এমনকি নিজেদের শরীর ও অস্তিত্ব – সর্বস্বের সর্বনাশ। “ ( শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় , কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কৃত্তিবাস পঞ্চবিংশ সংকলন, ১৯৬৮)। তারিখগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে ওনারা হাংরিদের টেক্কা দেবার চেষ্টা করছেন ।

    গোবিন্দ : ওনাদের গোষ্ঠীতে শরৎকুমার কিন্তু স্পষ্টবক্তা ছিলেন, যা ভাবতেন তাই লিখতেন। বীজেশ সাহার ‘মাসিক কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় উনি লিখেছিলেন, ( কৃত্তিবাস, এপ্রিল-জুন, ২০১৭ ) : “শঙ্খ ঘোষ মহাশয় কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার গ্রহণ করলেন । কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাত থেকে তিনি অন্য একটি পুরস্কার নিতে অসন্মত হন, কারণ তিনি ছিলেন হিন্দুবাদী, বিজেপি পার্টির নেতা । শঙ্খ ঘোষ যে সিপিএম-সিপিআই দলের সমর্থক এ কথা আমরা আগেই জানতাম, কিন্তু একথা জানতাম না প্রধানমন্ত্রী পদ পেলেও পার্টির নামের দুর্গন্ধ মোছে না। কবি হিসেবে শঙ্খ ঘোষকে আমি পঞ্চাশ দশকের প্রধানতম কবি বলতে চাই না । আমার মতে, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রধানতম কবি । তারপর প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত এবং আলোক সরকার ।”

    মলয় : শঙ্খ ঘোষ লোকটি সত্যিই অদ্ভুত ছিলেন । ‘শব্দ ও সত্য’ নামে একটা প্রবন্ধ ১৯৭১ সালে লিখেছিলেন, অথচ জানতেন না যে মামলাটা আমার বিরুদ্ধে হয়েছিল, পঁয়ত্রিশ মাস ধরে, আর আমার সাজা হয়েছিল । আমি অনুবাদের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলুম, তা উনি বিশ্বাস করেননি, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়কে বলে আমার চিঠির কপি আনিয়েছিলেন । আসলে শৈলেশ্বর ঘোষ ওনাকে যা বোঝাতো উনি তা-ই বুঝতেন । সমরজিৎ সিংহ তো লিখেছেন যে যখন শ্যামবাজারে থাকতেন তখন দেখতেন শৈলেশ্বর প্রতিদিনই শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে গিয়ে বসে আছেন। শৈলেশ্বর যে শেষ জীবনে তৃণমূলের পার্থ চ্যাটার্জির সঙ্গে পুরস্কারের আশায় মেলামেশা আরম্ভ করেছিলেন, তাও শঙ্খ ঘোষের ওসকানিতে । শম্ভু রক্ষিত একবার চটে গিয়ে শঙ্খবাবুকে জিগ্যেস করেছিল, আপনি গয়লাঘোষ না কায়েত ঘোষ, তার কারণ শৈলেশ্বর আর সুভাষ ছিল গয়লাঘোষ।

    গোবিন্দ : শুনেছি, হাংরি আন্দোলনের প্রচার-প্রসার চেপে দেবার জন্য সেই সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘কবিতা-ঘন্টিকী’, প্রতি ঘণ্টার কবিতা-পত্রিকা৷৷ 

    মলয় : হ্যাঁ । ২৩ বৈশাখ ১৩৭৩, ৭ মে ১৯৬৬ সকাল দশটায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘কবিতা-ঘন্টিকী’, প্রতি ঘণ্টার কাব্যপত্র৷ তারিখ দেখেই তো বোঝা যায় যে হাংরি আন্দোলনের বুলেটিনগুলোর আর সংবাদপত্রের খবরের দামামাকে চেপে দেবার চেষ্টা ।

    গোবিন্দ : সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আপনাদের হাংরি আন্দোলনে । উনি প্রতিষ্ঠানবিরিধী হিসাবে নিজেকে প্রচার করতেন, অথচ আপনার বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে আন্দোলন ত্যাগ করেন।

    মলয় : হ্যাঁ ।  ১৯৮৭ সালে সুমিতাভ ঘোষালকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি হারি আন্দোলনের সঙ্গে ভীষণভাবেই জড়িত ছিলাম । হাংরি আন্দোলনের আদর্শ — আমার ভালো লেগেছিল, এবং আমি তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম বলেই আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম । এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই । কিন্তু পরের দিকে ওরা আমাকে না জানিয়ে আমার নামে পত্রিকা টত্রিকা বার করে । যা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল । তখন আমি কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । কিন্তু এই হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন সুনীল আমেরিকায় । এই আন্দোলনকে সুনীলের অসাক্ষাতে একটা ক্যু বলতে পারা যায় ।প্রতিষ্ঠানের লোভ আমার কোনোদিনই ছিল না । বাংলাদেশে যদি কেউ আগাগোড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ভূমিকা পালন করে থাকে তবে তা আমি । আমার ‘বিজনের রক্তমাংস’ গল্পটি বেরোনোর পর থেকে আমার সে ভূমিকা অব্যাহত ।আমি মনে করি ওরকমভাবে দল পাকিয়ে সাহিত্য হয় না । একজন লেখক নিজেই অতীত, নিজেই ভবিষ্যত, নিজেই সমাজ, নিজেই সভ্যতা, এবং নিজেই সবকিছু । সাহিত্য সৃষ্টিতে দলের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ।আমি মুচলেকা দিয়েছিলাম তার দুটো কারণ । এক, আমি পুলিশকে ভীষণ ভয় পাই, আর দুই, আমার বউ আমাকে জেলে যেতে বারণ করেছিল । বউ বলল, যে একেই তো তোমার মতো মদ্যপকে বিয়ে করার জন্য আমার আত্মীয় পরিজনরা সব আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছে । তার ওপর তুমি যদি জেলে যাও তাহলে সোনায় সোহাগা হবে । সেই জন্যে আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করি ।” সন্দীপনের নামে কোনও বুলেটিন প্রকাশিত হয়নি । উনি বরং দেবী রায়কে চিঠি লিখে নির্দেশ দিতেন কী-কী করা উচিত ।               

    গোবিন্দ : আপনার অভিজ্ঞতার কথা বলুন । বিদেশে গিয়ে যৌনকর্মীদের পাড়ায় গেছেন ?

    মলয় : না, সোনাগাছির কথা কেবল সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, হাংরি বুলেটিনে । আমার মামলার সময়ে সিনিয়র উকিল চণ্ডীচরণ মৈত্র’র চেম্বার ছিল সোনাগাছিতে ঢোকার অবিনাশ কবিরাজ লেনের ঠিক উল্টো দিকে । উকিলের জানলা দিয়ে দেখতে পেতুম শনিবার সন্ধ্যায় পার্বতীচরণ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পুরো কৃত্তিবাস বাহিনী ঢুকছে সোনাগাছিতে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া । মোড়ের পানের দোকান থেকে গোড়ের মালা আর বাংলা মদের কয়েকটা বোতল নিয়ে ঢুকতো। ওদের যৌনকবিতাগুলো সোনাগাছির মেয়েদের সঙ্গে মাঝরাত কাটানোর অভিজ্ঞতায় ভরপুর। বাঙালি বাড়ির বউরা তখন ওসব যৌন-আঙ্গিক অ্যালাউ করতো না  বলে মনে হয়  ।

    গোবিন্দ : আপনি ? আপনারা ?

    মলয়: আমার পিসেমশায় যাওয়া আরম্ভ করেন । ওনার দেখাদেখি ওনার বড়ো ছেলে অজয় বা সেন্টুদা ঢুঁ মারা আরম্ভ করেন । সেন্টুদা আমাকে ওই পাড়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন । দুপুর বেলায় রেট কম থাকে বলে সেন্টুদা দুপুরে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন । হাংরিদের মধ্যে শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, অবনী ধর রেগুলার যেতো, প্রৌঢ় বয়সেও, ওদের পরস্পরের চিঠিতে পাবে ওদের প্রিয় যৌনকর্মী বেবি, মীরা, দীপ্তির নাম । সবচেয়ে ভীতিকর হল কোনও যৌনকর্মীর প্রেমে পড়া। এখন তো আলো ঝলমলে অন্য চেহারা নিয়ে ফেলেছে এলাকাটা । আধুনিকা যৌনকর্মীরা জিনস-স্কার্ট পরে রাস্তার মাঝখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন, স্টাইলে সিগারেট ফোঁকেন । বিদেশে  যৌনকর্মীদের পাড়ায় গিয়ে দেখে বেড়িয়েছি কিন্তু কারোর সঙ্গে শুইনি, কেননা যৌনরোগকে আমার ভীষণ ভয় । বোদলেয়ারের জীবনী পড়ে আরও আতঙ্কিত হই । বিদেশিনীদের কাছে সারা পৃথিবী থেকে খদ্দেররা যায় । ভিয়েৎনামের যুদ্ধের কারণে থাইল্যাণ্ড হয়ে গিয়েছিল যৌনকর্মীদের বিরাট বাজার ; কাঁচের দেয়ালের ওইদিকে মেয়েরা বুক খুলে আর জাঙিয়া পরে খদ্দের ডাকতো । আমস্টারডামে একটা পাড়া ছিল যার গলিগুলোতে বিশাল কাচের জানলার সামনে প্রায় উলঙ্গ মেয়েরা ফিকে লাল আলোয় বসে থাকতো আর নীল আলো জ্বললে বুঝতে হতো সমকামীদের ডাকছে। পাড়ার বাড়িগুলো তৈরি হয়েছিল নেপোলিয়ানের হুকুমে । গলিগুলো এতো সরু যে দোতলায় আসবাব তুলতে হলে দড়ি বেঁধে তুলতে হয় । চারিদিকে খাল । সৈন্যরা নৌকো করে এসে রাত কাটাতো । গাঁজার দোকানকে ওরা বলে কাফে । যৌনতার নানারকমের খেলনা আছে নারী আর পুরুষের জন্য । নাটক অভিনীত হয়, সঙ্গম করার ।

    গোবিন্দ : আপনার আত্মজীবনীতে এসব এসেছে ?

    মলয় : হ্যাঁ, ‘ছোটোলোকের শেষবেলা’তে এসেছে । তাছাড়া ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে আমি ওই সময়ের সবাইকে আর ঘটনাগুলোকে তুলে এনেছি । উপন্যাসটা প্রতিভাস প্রকাশিত ‘তিনটি নষ্ট উপন্যাস-এর অন্তর্ভুক্ত । মামলার সময়ে আমার শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে যেতে পাটনায় ফিরে গিয়েছিলুম আর আমাদের পারিবারিক ডাক্তার অক্ষয় গুপ্ত সংবাদপত্র পড়ে ধরে নিয়েছিলেন যে আমার যৌনরোগ হয়েছে আর বরাদ্দ করেছিলেন পেনিসিলিন অয়েল ইনজেকশান । জানতে পেরে পরের দিনই কমপাউণ্ডারকে বলেছিলুম, আর দিতে হবে না, ও-রোগ আমার হয়নি, হবে না ।

    গোবিন্দ : আপনার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে আপনার আর আপনার দাদার বন্ধুরা চরিত্র । সমালোচিত হয়েছেন সেকারণে ?

    মলয় : হ্যাঁ । অমিতাভ প্র্রাজ লিখেছিল, পড়ে দেখতে পারো, অমিতাভ প্রহরাজ সমালোলোচনা করেছেন এইভাবে, “মলয়দা মানে মলয় রায়চৌধুরীর রাহুকেতু উপন্যাসের জন্য গান্ধী বার্থডের আগের রাতের রামের মতো বিক্রী হচ্ছে। সামান্য উল্টেপাল্টে পড়া হলো আর স্বাভাবিকভাবেই বেশ ঝাঁঝালো কথা-প্রতিকথা জমে উঠলো। একভাবে বলতে গেলে মলয় রায়চৌধুরীর “রাহুকেতু” দিয়ে লেখামোর প্রথম সেশানের বৌনি হলো। মলয়দা বিজ্ঞাপনে যা বলেছিলেন তা অতি সত্য। এতে রক্তমাংসের সুনীল শক্তি সন্দীপন দীপক খুব প্রবলভাবে আছেন। সুনীল হয়েছেন অসীম গাঙ্গুলী, শক্তি হরিপদ রায়, সন্দীপন প্রদীপন চ্যাটার্জী যার অফিসের নাম নৃপতি চাটুজ্জে। কৃত্তিবাস হয়েছে রামায়ণ নট্ট কোম্পানি, আনন্দবাজার মহাভারত নট্ট কোম্পানি। সুনীল কখনো কখনো রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী। মলয়দা নিজে রাহুল, সমীরদা অনিকেত। উপন্যাসের শুরুই রাহুলকে পুলিশের গ্রেফতার ও তার পেছনে নেপথ্য কাহিনী নিয়ে। সুনীলের মার্গারিটারও উল্লেখ রয়েছে। সুনীল বা অসীম আইওয়া থেকে ফিরে এলে রাহুলের কাছে একটা টেলিগ্রাম আসে “অধিকারী হ্যাজ কাম ব্যাক। এ বিগ কনস্পিরেসি ইজ গোইং অন। – সিংহবাহিনী “। রাহুল প্রথমে বুঝতে পারেনি কে টেলিগ্রামটি পাঠিয়েছে। কিন্তু যারা সময়ের ওই চত্বরটি নিয়ে কিঞ্চিত নাড়াঘাঁটা করেছেন তাঁদের “সিংহবাহিনী” বললেই সেই চরম রঙীন চরিত্রটির কথা মনে পড়বেই। ওয়ান এ্যান্ড অনলি কে জি বা কৃষ্ণগোপাল মল্লিক, যিনি নিজেও এসেছেন পরে কাহিনীতে। এইরকম ছোটখাটো এ্যানেকডোটসে ভর্ত্তি রাহুকেতু। আর বিতর্কিত ঘটনার তো আস্ত শপিং মল রয়েছে ওতে। সে রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী রাহুলকে ডেকে থ্রেট দেওয়া বা রাহুলের পালটা বলা “আপনার প্রথম বই এর সমস্ত খরচ তো আমার দাদা অনিকেত দিয়েছিলেন”। বা দেবী রায়কে তার প্রকৃত নাম হারাধন ধাড়া বলে ডেকে মস্করা করা, ইত্যাদি অগুন্তি রেফারেন্সের ছড়াছড়ি। ফলে হয়তো মলয়দার কাম্য ছিল না, কিন্তু একটা রগরগে স্ক্যান্ডাল কোশেন্ট উপন্যাসটির সঙ্গে জুড়ে গেছে। আমি বইটি নিয়ে কিছুটা বক্তিমে করলাম এই কারনেই যে এটি লেখামোর প্রথম সেশানের সূচনাবিন্দু। আমার মলয়দার কাছে দুটি অতি বিনীত প্রশ্ন আছে, ধৃষ্টতা মাফ করবেন, এক) এই লেখাটা ওনাদের জীবদ্দশায় কি বের করা যেত না? কারন মৃতদেহ প্রতিবাদ করতে পারে না, দুই) নামগুলো যখন কাল্পনিক নামই দিলেন, তখন ও দিকে অসীম, হরিপদ রায়, নৃপতি চাটুজ্জে ইত্যাদি ধরনের নাম আর আপনার বা আপনার দাদার নাম রাহুল বা অনিকেতের মতো স্মার্ট ফিল্মি হীরো টাইপের কেন? এটা কি নামকরন থেকেই দুটো পৃথক ক্লাস বা শ্রেণী বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা? যদি তাইই হয় তাহলে ‘দেবী রায়কে ওরা ইচ্ছে করে হারাধন ধাড়া বলে ডেকে মর্ষকামী আনন্দ পেত’ বলে ওদের খিস্তি দিলেন কেন? সেই একই মর্ষকামীতার দোষে তো তাহলে আপনিও দুষ্ট লেখাটির প্রথম পাতা থেকে, যেখানে নামকরণ করেছেন, এমন কি অসীম ওরফে সুনীলের ঠিকানা বলতে গিয়ে বলেছেন ওঝাপুর। মলয়দা, আপনি বয়োঃজ্যেষ্ঠ পণ্ডিত মানুষ, লেখক হিসেবেও অত্যুচ্চ মানের, আপনাকে সরাসরি মুখের ওপর হয়তো কেউ কিছু বলবেনা। আপনার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলি, একটা অতি অপ্রিয় সত্যি যে লুকিয়ে নয় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। রাহুকেতুর এই গরম কেকতুল্য বিক্রীর পেছনে কিন্তু সেই সুনীল, শক্তি, সন্দীপন, কৃত্তিবাস প্রমূখেরাই রয়েছে। লেখাটা কাঁচু, মাচু আর পাঁচুকে নিয়ে হলে এই চাহিদা হতোনা। তবে এটা অনস্বীকার্য যে ফিকশান ন্যারেটিভে আপনার নিজস্ব তকনিক ও প্রকরণ অসামান্য, যার ফলে এক সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিকের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও রিডেবিলিটি খুবই হাই, এক বিরল কম্বো। যদিও সেটা বিচার করার যোগ্যতা হয়তো আমার নেই, ঔদ্ধত্য ক্ষমা করবেন।”

    গোবিন্দ : কুলসুম আপা, তারপর এই ধরণের জীবনযাত্রা, আপনার নিজেকে কলুষিত মনে হয়নি? ইমলিতলা পাড়ায় থাকলেও, আপনার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্য হিসাবে, ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হিসাবে, আপনার মূল্যবোধ তো মধ্যবিত্ত বাঙালির ? সেই প্রেক্ষিতে নিজের মূল্যায়ন করে মনে হয়নি যে অধঃপতনের পথে যাত্রা করছেন ?

    মলয় : না হয়নি । বলতে গেলে ইমলিতলা পাড়াই ছিল আমার মূল্যবোধ গড়ে ওঠার বনেদ। ওই পাড়ায় দোল খেলার দিন অন্ত্যজ বউরা কেউ নিষেধ মানতো না, আমার বয়ঃসন্ধিতেও তারা জড়িয়ে চুমু খেয়ে উত্তেজিত করে দিতো । রঙের বদলে নর্দমার জল, গোবর-গোলা জল ঢেলে দিত গায়ে । মুখে গোবর মাখিয়ে দিতো । এমন পাড়া ছিল যে গয়লাটাও দুধ দিতে এসে আমার মা, জেঠিমার নাম ধরে ডাকতো । বাড়ির মধ্যে একটা কুয়ো ছিল, তার চারিধারে বিহারি বউরা ওদের পরিবারের কারোর বিয়ের সময়ে এসে এমন গান গাইতো যাকে লোকে বলবে অশ্লীল ।

    গোবিন্দ : যেমন ?

    মলয় : যেমন, বাঙলায় বলছি, পাটনাইয়া মগহি গানের বাঙলা । এবার নে মশারি টাঙা, শশা, বেগুন, তেল মাখিয়ে নে, নইলে চিৎকার করে পাড়া মাথায় করবি । এরকম নানা গান । বড়ো জেঠা তাই কুয়োটা বন্ধ করিয়ে দিয়েছিলেন ।

    গোবিন্দ : অর্থাৎ আপনি গ্রামের মানুষ নন, শহরের মানুষ । তবু আপনার বইতে, যেমন ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’, ‘নামগন্ধ’, ‘জলাঞ্জলি’, ‘ঔরস’ ইত্যাদি উপন্যাসে গ্রাম এসেছে বিপুলভাবে । কেমন করে আপনি বর্ণনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুললেন ? ‘ঔরস’ উপন্যাসে আপনি অবুঝমাঢ়ের মাওবাদী এলাকা ডিটেলে বর্ণনা করেছেন ।

    মলয় : চাকুরিসূত্রে সারা ভারতের গ্রামগঞ্জ ঘুরেছি,  চাষি, তাঁতি, জেলে, কামার, কুমোর, খেতমজুর, নৌকোর ছুতোর আর নিম্নবর্ণের মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি ক্ষেত্রসমীক্ষায় । অধিকাংশ চরিত্র পেয়েছি সমীক্ষার সময়ে । তার আগে যখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কে চাকুরি করতুম তখন সহকর্মীদের গ্রামে গেছি । রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরিটা ছেড়ে এআরডিসিতে গেলুম, সেখান থেকে নাবার্ড। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকুরিটা ছেড়েছিলুম গ্রামের জীবন আর মানুষ দেখার লোভে । এখন তো আমার যা পেনশন তার চেয়ে বেশি পেনশন পায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পিওন । তবে প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছিলুম তখন। পশ্চিমবাংলায় সিপিএমের ভয়ে অনেকে কথা বলতে চাইতো না বলে দাড়ি বাড়িয়ে অবাঙালি এম আর চৌধারী হয়ে গিয়েছিলুম, হিন্দিতে কথা বলতুম । ট্যুরের সময়ে বহু গ্রামে আমার স্ত্রীকেও নিয়ে গেছি যাতে গ্রামের গরিব পরিবারের অন্দরমহলের খবর পাই। 

    গোবিন্দ : আপনার স্ত্রী রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় ছিলেন ?

    মলয় : হ্যাঁ । অনেক কাপ আর শিল্ড ছিল ওদের বাড়িতে । শীতের সময়ে ওরা ওল্ড মঙ্ক রাম খেয়ে খেলতো ।

    গোবিন্দ : কোনও বিশেষ  স্মৃতি? 

    মলয় : প্রচুর স্মৃতি জমে আছে, লিখেছিও কিছু-কিছু । সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো হিমালয়ের তরাইতে খাঁটি ভারতীয় গরু আছে কিনা তার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এক মরা বাঘিনীর স্মৃতি, যার রক্তাক্ত যোনিও আকর্ষণ করেছিল । স্হানীয় লোকেরা, সকলেই হিন্দু, বাঘিনীর মাংস-হাড় ইত্যাদি সংগ্রহের জন্যে কাড়াকাড়ি করেছিল। একজন আমাকে আর আমার সহকর্মীকে রেঁধে খাইয়েছিল । ইঁদুর খেয়েছি শৈশবে, বাঘ খেলুম যৌবনে । ঘোরাঘুরির চাকরির আগে জানতুম না কতোরকমের গরু, ছাগল, শুয়োর, মুর্গি, হাঁস, চাল, আলু, সবজি ইত্যাদি হয়। জলসেচের কতোরকমের ব্যবস্হা আছে আর কোন ফসলে কখন কীরকম জলসেচের দরকার হয় কিছুই জানতুম না। যেখানে-সেখানে ঘুমোবার আর বনবাদাড়ে হাগার স্মৃতি আছে । অজ পাড়াগাঁয়ে গেলে হাগতে যেতে হতো আখখেতে, ধানখেতে, গাছের আড়ালে, নদীর ধারে । দাদার যখন দুমকায় পোস্টিঙ হয়েছিল তখন পায়খানাটায় দরোজা ছিল না, কিন্তু তার সামনে একটা কাঁঠালগাছ আড়ালের কাজ করতো। গাছে ঝুলে থাকা এঁচোড়ে হিপিরা নিজেদের পোশাক ঝুলিয়ে হাগতে যেতো। আমি তো এনসিসির ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডে ছিলুম । দল বেঁধে সাতসকালে সবাই মিলে গোল হয়ে বসে হাগার অভিজ্ঞতা ছিল । বিয়ের পর পাঞ্জাবে এক বন্ধুর গ্রামে গিয়েছিলুম, সেখানে গিয়ে আমার শহুরে হকি-খেলোয়াড় বউকেও খেতে হাগতে যেতে হতো ।

    গোবিন্দ : হাংরি আন্দোলনের সময়কার স্মৃতি ?

    মলয় : লিখেছি তো ? পড়োনি ? এটা পড়ো । “হাতে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশের দল রাতে নিয়ে চলল বাঁকিপুর বা পিরবহোর থানায়, সোজা লকআপে, অন্ধকার, আলো নেই, পাশের লকআপে বেশ্যার দলের চেঁচামেচি, লকআপে সাত-আটজন কয়েদি, নানা অভিযোগে, ডাকাতি আর খুনও । ফুলপ্যান্টের ভেতরে ইঁদুর ঢুকে এলো, পা ঝেড়ে বের করলুম, বাড়ি থেকে খাবার এসেছিল, কিন্তু একে অন্ধকার, তায়ে লকআপের অভিজ্ঞতা, খাওয়া গেল না । সকালে স্হানীয় খবরের কাগজে গ্রেপ্তারির খবর শুনে নমিতা চক্রবর্তী সাহস যুগিয়ে গেলেন, বহুদিন পর ওনাকে দেখলুম, চোখে চশমা, টিচারি শুরু করেছেন, আমার নকাকিমা যে স্কুলে পড়ান সেখানে। নমিতাদি বেঁচে থাকলে জানতে চাইতুম, ভেঙে পড়া সোভিয়েত রাশিয়ায় কোথা থেকে এতো মহাকোটিপতি আর মহাচোরাকারবারী আচমকা উদয় হল, এতো ভিকিরি, এতো ছিঁচকে চুনোপুঁটি! হাগবার জন্য কোমরে দড়ি পরিয়ে হাগতে পাঠানো হলো, ঘুড়ি ওড়ানোর মতন করে ঢিল দিয়ে লাটাই ধরে থাকলো একজন কন্সটেবল আর আমি হাগতে গেলুম, চারিদিকে কয়েদিদের গু, জল পড়ে চলেছে কল থেকে, পোঁদ এগিয়ে ছুঁচিয়ে নিলুম । আবার হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে কয়েদিদের সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে ফৌজদারি আদালত। বাবা বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেকে এনেছিলেন, যিনি হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতেন । কলকাতার পুলিস রিমান্ড চাইছিল । বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দিয়ে বললেন কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে আত্মসমর্পণ করতে । বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন লেখিকা এনাক্ষী ব্যানার্জি আর মীনাক্ষী মুখার্জির বাবা । বাড়ি এসে নিজেকে নবীকরণ করে পৌঁছোলুম উত্তরপাড়ায়, পেছন-পেছন বড়োজ্যাঠা আর বাবা । দাদাও চাইবাসায় গ্রেপ্তার হয়ে চাইবাসা থেকে এসে পৌঁছোলো । জমায়েত দেখে, দাদা গ্রেপ্তার হয়েছে শুনে ঠাকুমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল । অন্যান্য জেঠা-কাকারা আর পিসেমশায় এসে পৌঁছোলেন। ব্যাংকশাল কোর্টে সারেন্ডার করে জানতে পারলুম দেবী রায়, সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষও গ্রেপ্তার হয়েছে । জামিনের পর আদালত বলল লালবাজারে গিয়ে প্রেস সেকশানে হাজিরা দিতে । লালবাজারে হাজিরা দিতে গিয়ে কফিহাউসে পুলিশ ইনফরমারদের কথা জানতে পারলুম, যারা হাংরি আন্দোলনের বুলেটিন বই পত্রিকা এনে-এনে জড়ো করেছে প্রেস সেকশানে । আশ্চর্য যে মুখের দিকে তাকিয়েও কেন বুঝতে পারিনি যে অমুক লোকটা, যে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে সে ইনফরমার, তমুক যুবক যে আমার কাছ থেকে বুলেটিন চেয়ে নিয়ে গেল, সে পুলিশের খোচর । মামলার সময় যখন এরা কাঠগড়ায় আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ালো তখন টের পেলুম — তাদের নাম পবিত্র বল্লভ আর সমীর বসু । সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষের মুখের দিকে তাকিয়েও কি কখনও জানতে পেরেছিলুম যে ওরা পিঠে ছুরি মারবে । অবশ্য আঁচ করা উচিত ছিল, কেননা ওরা দুজনেই লালবাজারে ইন্সপেক্টরের হম্বিতম্বিতে কেঁদে একশা , সেই ইন্সপেক্টর অনিল ব্যানার্জি, পরে নকশাল বিনাশে নাম করেছিল। আঘাত তো লোকে করবেই, কিন্তু সব আঘাতে আদর করে হাত বোলানো যায় না । বেশির ভাগ আঘাতের দাগ দেহের চামড়ায় পুষে রাখতে হয় । মামলার সময়টা বেশ খারাপ গেছে, কলকাতায় মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, সাসপেন্ড হবার দরুণ মামলার খরচ, যাতায়াতের খরচ আর খাবার খরচ সামলানো কঠিন হয়ে গিয়েছিল । একই শার্ট-প্যাণ্ট প্রায় পনেরো দিন অনেক সময়ে এক মাস, পরে চালিয়েছি । সবসুদ্ধ পঁয়ত্রিশ মাস মামলা চলেছিল । উত্তরপাড়ার খণ্ডহরে থাকা যেতো কেসের ডেটের মাঝে হাতে সময় থাকলে, কেননা তখন সেরকমভাবে ইলেকট্রিক ট্রেন শুরু হয়নি আর প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কোনো নির্ধারিত সময় ছিল না । সুবিমল বসাকের জেঠার স্যাকরার দোকানে বৈঠকখানা পাড়ায় থাকতুম মাঝেমধ্যে আর হাগতে যেতুম শেয়ালদায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে, রাস্তার কলগুলো এতো নিচু ছিল যে তার তলায় প্রায় শুয়ে স্নান করতে হতো । ফলে প্রতিদিন স্নানের অভ্যাস ছাড়তে হয়েছিল । শহরে যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই তাদের কাছে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল হাগা, কোথায় গিয়ে হাগা যায় । তখন তো সুলভ শৌচালয় আরম্ভ হয়নি । আহিরিটোলায় রাতে থাকতে পেলে অন্ধকার থাকতে গঙ্গার পাড় ছিল সবচেয়ে সহজ । এটা সেন্টুদার শেখানো ; পিসেমশায়ের আটজন বাচ্চা আর একটা পায়খানা, গঙ্গার পাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে হাগা পেলে পায়জামা বা প্যান্ট নামিয়ে হেগে নাও আর গঙ্গায় পোঁদ ঠেকিয়ে ছুঁচিয়ে নাও । হাগা পেলে হেগে নেওয়ার মতন আর কোনও আনন্দ নেই । সেন্টুদা পরামর্শ দিয়েছিল যে রাতে হোটেলে থাকার চেয়ে ভালো জায়গা হলো অবিনাশ কবিরাজ লেনের কোনো ঘরে কাউকে সারা রাতের জন্যে প্রেমিকার দাম দেয়া । কিন্তু সেখানেও তো ভোরবেলা উঠে হাগার সমস্যা । সেখানে রাত কাটালেও হাগতে ছুটতে হতো বড়োবাজারে হিন্দি পত্রিকা “জ্ঞানোদয়” এর সম্পাদক শরদ দেওড়ার মারোয়াড়ি গদিতে । এই গদিতে শুয়েও রাত কাটিয়েছি, যতো রাত বেড়েছে ততো শোবার লোকের ভিড় বেড়েছে, কেননা বাইরে থেকে যে ব্যাবসাদাররা কলকাতায় আসতো তারা মারোয়াড়িদের গদিতে শোয়া পছন্দ করতো । বাদবাকি সকলের বিরুদ্ধে আরোপ তুলে নিয়ে, ৩রা মে ১৯৬৫ আমার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করল পুলিশ । তার সঙ্গের নথিগুলো থেকে জানতে পারলুম হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্রব অস্বীকার করে মুচলেকা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছে সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ, মামলা থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য । এও জানলুম যে আমার বিরুদ্ধে পুলিশের হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আর উৎপলকুমার বসু, এঁরাও নিজেদের হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্রব অস্বীকার করেছেন । উৎপল চাকরি খুইয়ে গিন্সবার্গের সুপারিশে ইংল্যাণ্ডে চাকরি পেয়ে চলে গেলেন । সুভাষ আর শৈলেশ্বর আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে ক্ষান্ত দেয়নি, একের পর এক লেখায় হাংরি আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করে গেছে, সময়ের সঙ্গে তাল দিয়ে আমার প্রতি ঘৃণার মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে, এমনকি নিজের বউ-বাচ্চাদেরও এ-ব্যাপারে ট্রেনিং দিয়ে গেছে ; ফলে ওদের নিজেদের মরচে-পড়া ছোরাগুলোই অকালে রোগ হয়ে ওদের বুকে বিঁধেছে।”

    গোবিন্দ : হাংরি মামলা নিয়ে প্রচুর পরস্পরবিরোধী কথা শোনা যায় ।

    মলয় : তুমি অলোক গোস্বামীর সম্প্রতি প্রকাশিত বই মেমারি লোকাল পড়ে দেখো, ব্যাপারটা অন্তত কিছুটা  স্পষ্ট হবে । অলোক লিখেছেন, “অরুণেশের ( ঘোষ ) ব্যাগে আচমকা পেয়ে গিয়েছিলাম ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকার সেই সংখ্যাটি। কিন্তু অরুণেশদা কিছুতেই দেবেন না পত্রিকাটা, ভালো কইরে বোঝার চেষ্টা করো হাংরি ফিলজফিটারে। আগেই এই সব ল্যাখা পড়লে সব গুলায় যাবে।কিন্তু আমাকে রুখিবে কে! প্রায় জবরদস্তি ম্যাগাজিনটা কেড়ে নিয়ে কোচবিহার থেকে মাথাভাঙ্গা যাত্রাপথে ভিড় বাসের মেঝেতে বসে পত্রিকাটা শেষ করেছিলাম। এবং স্বীকার করতে বাধা নেই, সত্যিই মাথার ভেতরটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। সেদিন জেনেছিলাম শৈলেশ্বর ঘোষ রচিত ‘তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি শূণ্য বিছানায়’ কবিতাটা নয় বরং মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটাকেই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। জেনেছিলাম, হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট মলয়ের নেতৃত্বেই ঘটেছিল এবং কেসটাও সাজানো হয়েছিল মলয়েরই বিরুদ্ধে।”

    গোবিন্দ : হাংরিদের মধ্যে আর কারা বিদেশে গিয়েছিলেন ?

    মলয় : প্রদীপ চৌধুরী বেশ কয়েকবার প্যারিসে গিয়েছিল । ভালো ফরাসি ভাষা জানতো । কবিতা লিখতো ফরাসি ভাষায়, ফরাসি কবিদের বাংলায় অনুবাদ করতো, জ্যাক কেরুয়াক সম্পর্কে ফরাসি ভাষায় বই আছে ওর । কিন্তু হাংরিদের কবিতা ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেনি । প্যারিসে গিয়ে বক্তৃতাও দিয়েছে । বোদলেয়ার ভেরলেনের জীবনী পড়ে গিয়েছিল যৌনকর্মীদের পাড়া লাতিন কোয়ার্টারে, সেখানে দুজন দীর্ঘাঙ্গিনী যৌনকর্মী ওর টাকাকড়ি কেড়ে নিয়েছিল ; তারপর থেকে ফরাসি বন্ধুদের সঙ্গে যেতো । ও থাকতো সেই হোটেলটায় যেখানে গিন্সবার্গ, বারোজ, কেরুয়াক আর অন্য কবিরা থাকতো । প্রদীপের একটা কবিতা নিয়ে একজন ব্যালেরিনা প্যারিসের মঞ্চে ব্যালে অভিনয় করেছিলেন ।

    গোবিন্দ : আপনাদের ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে একটা হাংরি ফিল্ম হওয়া উচিত ছিল ।

    মলয় : ভবিষ্যতে কেউ করতে পারে হয়তো । ইউরোপ-আমেরিকার কবি-লেখকদের নিয়ে তো হয়েছে । সুপ্রীতি বর্মণকে বলেছিলুম । উনি বললেন, প্রথমে আলোচনা করে স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হবে, তারপর বাজেটের ব্যাপার আছে । সুপ্রীতি বর্মণ লিখেছেন, “ এটাই ওনার স্বকীয়তা । আর আমার যৌনতার শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি ওনার কবিতাসমগ্রের আলোচনা । তাই অশ্লীলতা নয় এটা একটা সাধনার মোক্ষপ্রাপ্তি আমার কাছে।” ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার কাঠামো নিয়ে মৃগাঙ্কশেখর একটা ফিল্ম করেছে পাঁচ হাজার টাকায়, দেশ-বিদেশে পুরস্কারও পেয়েছে । জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটির একক পারফরমেন্স করেছিলেন স্নাতকোত্তর ছাত্র সৌরদীপ রায় । ঢাকা নিবাসী তারেক হায়দার চৌধুরী লিখেছিলেন, “হাংরি মুভমেন্টের কথা উঠে এসেছে চলচ্চিত্রেও। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘বাইশে শ্রাবণ’ চলচ্চিত্রের নিবারণ চক্রবর্তীর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? নিবারণরূপী গৌতম ঘোষকে সৃজিত হাজির করেছিলেন একজন হাংরিয়ালিস্ট কবির চরিত্রে। উদ্ধত, অহংকারী আর খ্যাপাটে নিবারণ সিস্টেম নিয়ে বললেন- একটা পচে যাওয়া সিস্টেম, প্রত্যেকটা মানুষ পঁচে যাওয়া। কয়েকটা লাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।” এই সিস্টেমের সাথে হাংরি প্রজন্মের দ্বন্দ্ব ছিল প্রকাশ্য।” তবে আমার মনে হয়, সৃজিতের ফিল্মটা হাংরি আন্দোলনকে বদনাম করেছে বেশি । হাংরিরা কেউই ওই নিবারণ চক্রবর্তী টাইপ ছিল না ।

    গোবিন্দ : সবাই প্রায় সেকথা বলেন । মৃগাঙ্কর ফিল্মটা আমি দেখিনি ।

    মলয় : ফিল্মটা সম্পর্কে অনুপম মুখোপাধ্যায় এই চিঠিটা মৃগাঙ্ককে লিখেছিলেন, আর তাতে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল । অনুপম লিখেছিলেন, “মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে যেটা করেছে, তোমাদের ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রেও সেটাই করেছে, আমার মনে হয়, তবে সেটা বুঝতে বঙ্গবাসীর সময় লাগবে। অবিশ্যি উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিল। কবিতার তুলনায় সিনেমা অনেক তাৎক্ষণিক ফলাফল দর্শায়। কিন্তু এই সিনেমা, বাস্তবিকই, আপামরের অগোচরে রয়ে গেছে। সেটাই প্রত্যাশিত। এবং এই চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক। বঙ্গীয়, কিন্তু বাঙালি একে আমি বলব না। তোমাদের এই সিনেমাটি আদতে সিনে-কবিতা। একটি শিল্প মাধ্যম তখনই নিজেকে অতিক্রম করে, যখন তার মধ্যে আরো এক বা একাধিক শিল্পমাধ্যমের যোগসাজশ দেখা যায়, এবং সেটা সার্থক হয়। এই সিনেমায় সার্থক কবিতা হয়েছে।একটি কবিতায় আজকাল আমরা দৃশ্য ও শ্রাব্যের একটা দুর্দান্ত নাগরদোলা আশা করি, আমাদের জীবনের সঙ্গে তবেই সেটা যায়, যেখান থেকে সহসা ছিটকে পড়তে হয় না। মলয়দার কবিতাটা আমাদের ঠিক সেটাই দিয়েছিল। একের পর এক দৃশ্য, যেটাকে আমরা চিন্তার বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছি। তোমরাও সেটাই দিয়েছ। কাহিনির ধার ধারোনি। আমার দেখা সবচেয়ে গল্পহীন বাংলা সিনেমা এটা। টেকনিকালি কব্জির জোর প্রতিটি শটেই দেখতে পেয়েছি। কোনোরকম স্পেশাল এফেক্ট ছাড়াই ম্যাজিক করেছে ক্যামেরা। রঙের ব্যবহার অসামান্য। ভায়োলেন্স আর সেক্স যে এই ছবিতে একবারও ভালগারিটির ধারেকাছে যায়নি, সেটাই সবচেয়ে বড় কারিগরি সাফল্য। সেক্সের ব্যবহার তো কসমিক হয়েছে। তোমার লিঙ্গ যে এমন ঈর্ষনীয়রকমের বড়, জেনে চমকে গেছি। নিজেকে এমন সাহসে সঙ্গে ব্যবহার করলে, নারী চরিত্রের বেলায় সেটা হল না কেন? একটা পেনিট্রেশন থাকলে কোনোরকম প্রেজুডিসের ধারেকাছেই থাকতে না তো! অবিশ্যি অমন অভিনেত্রী পাওয়াটাও একটা চাপ, সেটা বুঝি। আন্ডারগ্রাউন্ড সিনেমায় কেউ ওই রিস্ক কেন নেবে! তুমি নিজে যেটা করেছ ।স্যালুট রইল।এই ভায়োলেন্স কি বাঙালি নিতে পারবে? আমার অনেক সময় বার্গম্যানের ‘পার্সোনা’-র সেই ওপেনিং শটগুলো মনে পড়ে গেছে। আমি চমকাইনি, তবে চুপিচুপি বলে রাখি, ব্যোমকে গেছি। এই তো চাই নন্দীগ্রামের দেশে! এই তো চাই, যেখানে পারিবারিক বা জননৈতিক দ্বন্দ্বের ফয়সালা করে দেয় অস্ত্র। যেখানে ব্লগারের রক্তে মাটি ততটা ভেজে না, যতটা আমাদের বিবেক। স্রেফ বলি, একটা অভিজ্ঞতা পেলাম। সারাজীবন যে ভুলব না, কথা দিতেই পারি। জন্মান্তরের কথাটা দিতে পারছি না। পরের জন্মে যেন এমন আত্মাকাঁপানো ছবির দরকার না হয়। যেন নতুন সত্যযুগে কম্পিত আত্মাকে সঙ্গে রেখেই জন্মাই।

    গোবিন্দ : আসামের যুগশঙ্খ পত্রিকার সাংবাদিক বাসব রায় ২০১৮ সালে পুজোর সময়ে একটা ইনটারেসটিঙ পোস্ট দিয়েছিলেন । এই যে, এটা, “বাসব রায়-এর টাইমলাইন থেকে, পোস্টের নাম “মলয়ের জায়গা”। পড়ে দেখুন । “এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আত্মীয়-পরিজনের বাইরে আমি যাঁর নাম প্রথম শুনেছি, তিনি, মলয় রায়চৌধুরী। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ নন, মলয় রায়চৌধুরী। আমি যখন বড় হচ্ছি, ওই ১৯৬৬ থেকে, চারপাশে শুধু একজনের কথাই চর্চিত, তিনি, মলয় রায়চৌধুরী। ১৯৬৪ সালে মলয় নেমে আসছেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সিঁড়ি দিয়ে, একা। আর ধীরে ধীরে তিনি চর্চায় চলে আসছেন কলকাতা সন্নিহিত অঞ্চলের। তখন বেহালা, যেখানে আমার ছোটবেলা কেটেছে, কলকাতার মধ্যে ছিল না। বেহালার সাবর্ণপাড়ার দ্বাদশ মন্দিরের চাতালে কিংবা শখেরবাজার মোড়ের আড্ডায় শুধুই মলয়। তো আমি মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে বড় হয়েছি বললে সম্ভবত অত্যুক্তি হয় না। ইস্কুলে যাই, সেখানে শিক্ষকরা আলোচনা করেন মলয়কে নিয়ে ; ঘরে ফিরি, দাদা-কাকারা আলোচনা করেন মলয়কে নিয়ে ; একটু সন্ধ্যায় পাড়ার কালভার্টেও আলোচনার একটাই বিষয় – মলয়। মলয়-বাসুদেব-ফাল্গুনী-শৈলেশ্বর-সুবো-সুবিমল-দেবী-অবনী-প্রদীপ প্রমুখ তখন আমাদের ঘরের ছেলে। তাঁদের লেখা যেখান থেকে হোক সংগ্রহ করে পড়ছেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। এই আবহে আমি বড় হয়েছি। আর তাই মূলধারার সাহিত্যের প্রতি কখনো আগ্রহ বোধ করিনি। ১৪-১৫ বছরের মধ্যেই আমি পড়ে নিয়েছি ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ বা ‘চর্মরোগ’। এবং সেখান থেকেই এই প্রতীতী সম্ভবত জন্মে যায় যে সাহিত্য বলতে এসবই, বাস্তবতা-জীবন-অন্ত্যজ-প্রান্তিক স্বর ছাড়া সাহিত্য হয় না। এর বেশ কিছু পড়ে যখন আনন্দবাজারীয় লেখালিখি পড়তে গেছি, হাসি পেয়েছে। বাজারি আনন্দের প্রকাশিত সাহিত্য ওই সুখী মধ্যবিত্তের জন্য। সেখানে একটা কৃত্রিম ভাষা, নাটকীয় কিছু শব্দের সমাহার। সেখানে জীবন, অন্তত আমি, কখনো খুঁজে পাইনি। অথচ শিক্ষিত বাঙালি ওইসব পড়েই নিজেকে এলেমদার, পণ্ডিত মনে করেছে, করে।আর ঠিক এখানেই মলয় ধাক্কা মারেন। বাংলা গদ্যের রীতি ঠিক কী হবে তা সম্ভবত ঠিক হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, যে লিখলে ওই জোব্বা পরা বুড়োর মতোই লিখতে হবে। এবং এরপর যাঁরা লিখতে এসেছেন, যেমন শরৎ-তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতি-শরদিন্দু থেকে হালের সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশরা, কেউ ওই গদ্যের বাইরে যেতে পারেননি। বিষয় যাঁর যেমনই হোক, গদ্যের রীতি বা ভাষার আঙ্গিক ও প্রকরণ সেই রাবিন্দ্রিক। এবং বাজার বা বাংলা সাহিত্যের কলকাত্তাইয়া প্রতিষ্ঠান এই গদ্যকেই প্রমোট করেছে। পাঠকও খুশি থেকেছেন এই গদ্য পড়ে। এর বাইরে না লেখক না পাঠক কেউই ভাবতে পারেননি। মলয় রায়চৌধুরী ঠিক এই জায়গাটাকেই ধাক্কা দিয়েছিলেন। তাঁর বহুচর্চিত কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ থেকে হালের ‘ছোটলোকের ছেলেবেলা’ লেখাতেও ওই ধাক্কা স্পষ্ট। লেখালিখিতে বাস্তবতা-জীবন যেমন মলয় রায়চৌধুরী প্রথম বাংলা সাহিত্যে এনেছেন, ঠিক তেমনই গদ্যের ভাঙচুর তাঁর লেখাতেই আমরা প্রথম দেখতে পেয়েছি। আর এজন্যই প্রতিষ্ঠান তাঁকে ব্রাত্য করে রেখেছিল, হয়তো-বা এখনও করেই রেখেছে। মলয়ের প্রথম প্রকাশিত বই সম্ভবত ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’। সেখানে মলয় কী লিখেছেন তা এখানে আলোচ্য নয়। বলার কথা হল, মলয় হাফ লিটারেট সাহিত্যিক নন, পড়াশোনা করেই লিখতে এসেছিলেন। আর সেজন্য মলয়ের লেখালিখি যতটা না আবেগের তার চেয়ে অনেক বেশি মেধাজারিত। কোনো এক সাক্ষাৎকারে মলয় জানিয়েছেন যে বৈদ্যুতিক ছুতার লিখতে লেগেছিল তিন মাস। কেন? না, প্রতিটি শব্দ অনেক চিন্তা করে বসাতে হয়েছে।‘তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম’—এই লাইন মলয়কে লিখতে হয়েছে, বাংলাভাষাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য। আর কে না জানে ‘ভাষাকে যে আক্রমণ করে সে-ই ভাষাকে বাঁচায়।’ মিথ্যে না বলতে কী, রক্তরস কমে যাওয়া বাংলাভাষাকে ওই মলয় রায়চৌধুরীই প্রথম আক্রমণ করেন। তাঁর সেই শক্তি ছিল বলেই প্রতিষ্ঠান তাঁকে উঠোনে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। বরং মলয়দের শক্তি পাঠক-সহ-প্রতিষ্ঠানকে গ্রাস করে নিতে পারে ভেবেই তাঁরা সম্মিলিত আক্রমণের সামনে পড়েন। যার ফলশ্রুতি কিছু বই নিষিদ্ধ, মামলা, মলয় দোষী সাব্যস্ত এবং তারপর ১৯৬৭ সালে মামলায় জয়।এর ফলে মলয়ের কী হয়েছে সে বিচার অন্যরা করবেন, বাংলাভাষার যে বিপুল ক্ষতি হয়ে গেল তা অনস্বীকার্য। কেননা মলয় তো বটেই, ইদানীং অজিত রায়-রবীন্দ্র গুহ-রণবীর পুরকায়স্থরা তুলে আনছেন যে নিচুতলার সংস্কৃতি, জীবনযাপনের শৈলী, আচার-আচরণ, ক্রোধ-আনন্দ, প্রেম-ভালোবাসা… অসম্ভব দরকারি ছিল বাংলা সাহিত্যে। এগুলো বাদ দিয়ে সাহিত্য যেন একেবারে ম্যাড়ম্যাড়ে। মলয় রায়চৌধুরী প্রথম এই ভাবনা এনেছিলেন বাংলা সাহিত্যে। কী? না, নিজেকে সাংস্কৃতিক জারজ ঘোষণা করে সরাসরি বলেছিলেন, অন্ত্যজ-প্রান্তিক স্বর উঠে আসা উচিত সাহিত্যে। এবং তা হবে সরাসরি। সেখানে কোনো ফাঁকি থাকবে না। আর তাই, মলয় রায়চৌধুরীর, ঠিক এই জায়গায় কাল্ট ফিগারের সম্মান প্রাপ্য।মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, ভবিষ্যতেও লিখবেন, মলয় হলেন বাংলা সাহিত্যের জায়মান কিংবদন্তি, যাঁকে আনগ্ন শুষে নিলেও শেষ হয় না। কবি-প্রাবন্ধিক-উপন্যাসকার যেভাবেই তাঁকে অভিহিত করা হোক না কেন, কোনোটাই মলয় সম্পর্কে শেষ কথা নয়।আর তাই একটা লেখায় সমগ্র মলয় রায়চৌধুরীকে ধরা আমি তো আমি, শিবের বাপেরও অসাধ্য কাজ! আর তাই আমি অন্য দু-একটি কথা বলি। মলয়ের উদ্যোগে হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সকলে একে অচ্ছু্ৎ ঘোষণা করেছিলেন। আজ হাংরি আন্দোলনকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী আন্দোলনের মর্যাদা পাচ্ছে। আর তাই বিখ্যাতরা যেভাবেই হোক হাংরির ঝোল নিজের কোলে টানতে ব্যস্ত। শৈলেশ্বর ঘোষ হাংরি-মামলার পর মুচলেকা দিয়েছিলেন, সবাই জানেন। পরে তিনিই হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে কলার তুলে হাঁটতে শুরু করেন, আমি দেখেছি। আপাত-ঋষি শঙ্খ ঘোষ এমনভাবে এতদিন লেখালিখি করেছেন যে হাংরি শব্দটাই শোনেননি বা শুনলে তাঁর হার্টফেল হবে। তো তিনি সম্প্রতি একটি হাংরি সংকলনে নিজের কবিতা রেখে যার-পর-নেই আহ্লাদিত। সৌজন্য শৈলেশ্বর ঘোষ। সাহিত্যিক-সততায় মলয় রায়চৌধুরীর পক্ষে আদালতে কথা বলে অনেকটা আলো পেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তো তিনিই আমাকে রেকর্ডেড ইন্টারভিউতে বললেন ২০০৬ সালে যে ‘হাংরি আন্দোলনের জন্য মলয় ঠিক আমার আমেরিকা-বাসের সময়টাই বেছে নিয়েছিল।’ তো তাতে কী হল? সুনীল, ‘আমি থাকলে ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই আমার হাতে থাকত।’ এখান থেকে বোঝা যায়, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যেভাবেই হোক নাম জড়ানোর কী আকুল প্রচেষ্টা সুনীলের! ছো…আর এই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই কৃত্তিবাস-এ মলয়ের কবিতা ছাপাননি। সাহিত্যিক সততা আর কাকে বলে! যে কোনো আন্দোলনের একটা প্রকরণ আছে। আছে একটা স্ফুলিঙ্গ। আন্দোলনকে যত দমিয়ে রাখা হয় ততই আন্দোলনের অন্তঃশক্তি বাড়ে। আর সেটা হাংরি মুভমেন্টের ক্ষেত্রেও সমান সত্য। আজও যখন কেউ ‘ছোটলোক’-এর সংস্কৃতি তুলে আনেন কবিতায়-গদ্যে, আমরা বলি বাঃ তুই তো হাংরিদের মতো লিখছিস। এবং সত্তরের অরুণেশ, আটের অজিত রায়, নয়ের রাজা সরকার, শূন্য দশকের বিকাশ সরকার, প্রথম দশকের তিস্তা, কিংবা বেশ আগের রবীন্দ্র গুহ, নবারুণ ভট্টাচার্য (যদিও কৃত্রিম ভাষা), দেবীপ্রসাদ সিংহ, সমরজিৎ সিংহ (গদ্য), আফসার আহমেদ, দুলাল ঘোষ, অলোক গোস্বামী, এমনকি স্বপ্নময় চক্রবর্তীও ; হালের কান্তারভূষণ নন্দী, মৃণালকান্তি দেবনাথ, ধীরাজ চক্রবর্তীরাও জেনে বা না-জেনে সেই হাংরিদের লিগ্যাসি হয়ে উঠেছেন। এঁরা ভেঙে ফেলেছেন মূলধারার বাংলা সাহিত্যের যাবতীয় ফর্ম, তাঁদের লেখায় উঠে আসছে অন্ত্যজ জীবনযাপন, প্রেম, ক্রোধ, দুঃখ, আনন্দের কথা। এখানেই মলয় রায়চৌধুরী অমর হয়ে যান। শেষ কথাটা হল, আমার প্রথম সন্তান জন্মানোর পর, এক মধ্যরাতে, বউ, একটু হেসে, বলে, ‘শুধু এই ল্যাওড়াটা দিয়া তুমি বাবা হইয়া গেলা।’ ‘এসব তুমি কী বলছ!’‘কেন করতে পারলে কইতে পারুম না?’তখন আমার মলয় রায়চৌধুরীর কথা মনে পড়ল।

    মলয় : বাসব বলেছেন আমরা বাংলা ভাষায় “অপর” সাহিত্যের পথনির্দেশক ।

    গোবিন্দ : দারুণ ।

    মলয় : অনেক কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে । গবেষকরা একত্র করছেন । ‘বর্তমান’ পত্রিকার সহসম্পাদক পার্থ মুখোপাধ্যায় যেটা লিখেছিলেন সেটা পড়ে দ্যাখো : “কোনো কোনো লেখক থাকেন সব দেশে সব কালেই, সময়ের চাপ যাঁকে/যাঁদের সইতে হয় সবথেকে বেশি — হয়তো বা সময়ের থেকে তাঁরা বেশ খানিকটা এগিয়ে থাকেন, এগিয়ে ভাবেন বলেই। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, কালে তো অবস্থাটা আরো একটু বেশিই ঘোরালো, কারণ এখানে তাঁদের সামাল দিতে হয় সময়ের চাপকে এটা যেমন ঘটনা, তেমনি, সেইসঙ্গে নিজস্ব নির্মাণের প্রক্রিয়ার চাপটাও এক্ষেত্রে, বলা বাহুল্য , সমান কার্যকরী রয়ে যায়। এ দুইয়ের সমান চাপ ব্যক্তি মানুষটিকে, অর্থাৎ যিনি নিজের মতো করে ভাবতে চেষ্টা করবেন, স্রোতের সামান্য বিপরীতে হলেও দাঁড়িয়ে , তাঁকে /তাঁদের সর্বদা যে সিধে থাকতে দেয় না, অনবরত চেষ্টা করে নুইয়ে দিতে, এ আমরা প্রায়শ দেখেছি তো বটেই, দেখি ও দেখবও। দেখব কারণ, এই দেখাটাকেই বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে ঔপনিবেশিক ও তথাকথিত উত্তর-ঔপনিবেশিক ভাবনার ইতিহাস তার নিজস্ব নির্বিকার নিয়মে নির্মাণ করে থাকে । এই ভয়াবহ বিভিন্নমুখী চাপ স্ব-অভিমুখী একজন ব্যক্তি মানুষকে তুবড়ে দুমড়ে কীভাবে মাপমতন করে নিতে চায় তার নিদর্শন আমাদের চারপাশে আমরা প্রতিনিয়ত যেমন দেখি , তেমনি কাউকে কাউকে এমনো আবার দেখা যায় যিনি বা যাঁরা এই চাপকে হয়তো সর্বতোভাবে ঠেকাতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু সেই না পারাটাকেও যে কীভাবে নিজের হয়ে-ওঠার প্রক্রিয়ার অন্তর্গত করে নেওয়া যায় তার জন্যে নিরন্তর প্রচেষ্টা , হ্যাঁ, প্রচেষ্টাই বলা যাক, চালান। তবে কিনা আমাদের এই কর্তাভজা কালে, যখন শাসকের সংস্কৃতিহীনতার সাংস্কৃতিক বারফট্টাইকেও আমাদের মানতে বাধ্য করা হয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা সংস্কৃতির মূলধারা বলে, তখন, এঁদের দেখা মেলে বটে তবে কিনা হরদম মোটেই নয়। গত শতকের শেষ-সত্তর থেকে আশির দশকের গোড়ায় আমরা যখন সদ্য হাংরি প্রজন্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠছি তখন একটি নাম আমাদের চারপাশে সসম্ভ্রম কিছু বা ভীতির সঙ্গে উচ্চারিত হত, সে নাম মলয় রায়চৌধুরীর। তাঁর মাত্রই দু-একটি লেখার সঙ্গে (বই নয়) পরিচয় তার আগে আমাদের একেবারে যে হয়নি তা নিশ্চয় নয়, কিন্তু মূলত যেটা হয়েছিল তা হল উক্ত আন্দোলন-জনিত হইচই সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল হওয়া। এবং যা হবার হয়, আমাদের চোখ এবং মন দুই-ই ধাঁধিয়ে যায়।তখনো ক্ষুধার্ত প্রজন্মের নামবাহী কিছু পুরনো পত্র-পত্রিকা মিলত এখানে-ওখানে। চোখ ও মন দুইয়েরই সচকিত হবার যথেষ্ট কারণ , বলা বাহুল্য, নিহিত ছিল তাইতেই। তবে যেটা ভেবে তখন সত্যিই অবাক লাগত সেটা হল, আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বলে খ্যাত অন্যান্যদের লেখা ও বইপত্র যদি বা মেলে, এমনকী কিছু পুরনো পত্র-পত্রিকাও, তাহলে এই একজনের কিছু লেখা বা বইপত্র একেবারেই মেলে না কেন !যাই হোক, মোদ্দা বিষয়টা যেটা তা হল, মলয় রায়চৌধুরী নামে ব্যক্তি-সাহিত্যিক তথা চিন্তককে তখনো আমরা চিনি না বলাই ভালো ; চিনব আরো পরে, আটের একদম শেষ , না, নয়ের গোড়াতেই সম্ভবত, যখন শিবনারায়ণ রায় কলকাতায় ফিরে এসেছেন, শুরু হয়েছে ‘জিজ্ঞাসা’ নামে একটি যথেষ্টই গম্ভীর দর্শন কিন্তু আকর্ষণীয় পত্রিকা ; কেবল তা-ই নয়, তাঁর সঙ্গে আমাদের মতন নেহাৎই এলেবেলে আর অপাংক্তেয়দেরও আড্ডা জমছে, মাঝেমধ্যে হলেও। এবং তখনো, আগেই বলেছি যে , আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ ; সে বই ১৯৮৫ সালে বেরোলেও আমরা অন্তত পড়িনি তখনো। জানতামও না ইকনমিকসে স্নাতকোত্তর মলয় ব্যাঙ্ক নোট পুড়িয়ে নষ্ট করার জীবিকা দিয়ে আরম্ভ করে ঢের দিন হল গ্রামোন্নয়ন বিশেষজ্ঞের চাকরিতে কেবল যোগই দেননি, সেইসূত্রে বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে গাঁয়ে–গঞ্জে চাষি-জেলে-তাঁতি-হস্তশিল্পীদের সঙ্গ করেছেন শুধু নয়, সবথেকে বড় কথা, ভারত বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ নামে ভূখণ্ডটিকে হাতের তালুর মতো চেনবার সুযোগ পেয়েছেন — যা যতদিন যাবে ছায়া তো ফেলবেই , সেই সঙ্গে তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেবে (ও নিয়েছে) ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’, ‘জলাঞ্জলি’, ‘নামগন্ধ’, ‘রাহুকেতু’-র মতো উপন্যাসের পাশাপাশি এমনকী ‘নখদন্ত’ বা ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’-র মতো স্তরে স্তরে, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে-চিনিয়ে দেওয়া যায় এমনভাবে বিন্যস্ত অথচ আপাত-এলোমেলো গ্রন্থরাজিও — যা আমাদের সযত্ন-লালিত সাহিত্য-সংস্কৃতি তো বটেই, এমনকী আমাদের রক্তের অভ্যন্তরে প্রোথিত থাকা গোটা হয়ে-ওঠার ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক জীবনধারণারও শিকড় অবধি আমূল নড়বড়ে করে ফেলার স্পর্ধা দেখাবে।এবং কথা হচ্ছে, এইটা করতে গিয়ে তিনি, মলয়, আদ্যন্ত যেটা করেন/করেছেন তা হল, নিজের সময় ও সমকালকে তো বটেই, এমনকী নিজের সামাজিক অবস্থানকেও সেই সঙ্গে, কতকগুলো মূল প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, যা একই সঙ্গে আমাদের, পাঠকদের মনোসামাজিক ভিতকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে। যেমন ধরা যাক , মলয় কেবল নিজেকে কালচারাল বাস্টার্ডই বলেননি, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেও আত্মজীবনীর পাতায় নিজের পরিবারের এমন কিছু বাঁক তুলে দিয়েছেন যা অবশ্যম্ভাবীভাবে সঙ্গেসঙ্গেই ঔপনিবেশিক মনোসামাজিক ভূমিতে আজন্ম লালিত পারিবারিক ধারণার কেন্দ্রে গিয়ে আঘাত করে (যেমন , ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’-য় সটান বলে দেওয়া, যে, তাঁর জ্যাঠতুতো ভাই তাঁর জ্যাঠামশাইয়ের নিজের ছেলে নয়, তাকে এক বেশ্যার কাছ থেকে কেনা হয়েছিল। কুলসম আপার ঘটনাটাও অবশ্যই এই পর্যায়েই পড়বে।) ; এবং করে যেহেতু, ফলে সব মিলিয়ে তাঁকে বাংলা সাহিত্যের মূল ধারায় আজও ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না। কেবল তা-ই নয়, এর অভিঘাতেই ২০১৫-তে এসেও মলয়কে জানাতে হয়, ‘এতকাল পাঠকরা আমার বইপত্র খুঁজেও পেতেন না। তাঁদের দৃষ্টিতে আমার মামলাটাই জীবন্ত ছিল।’ বা আশির দশকের শেষের পর্বেও তাঁর অভিজ্ঞতা বলে , ‘কলকাতার সম্পাদকরা ভয়ে সিটিয়ে থাকত, ওই অশ্লীল কবিতার ভয়ে…’ একদিকে অবস্থা ছিল এই, আবার অন্য দিকে ক্ষুধার্ত প্রজন্মের এমন একটা বাজার তৈরি করে তোলে যেখানে মলয় কী বলেন বা ভাবেন নয়, বরং আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের একদা কর্মকাণ্ড বা ওইসব তথাকথিত-যৌন অনুষঙ্গগুলি, যেগুলি মলয়রা সেদিন তাঁদের কবিতায়/লেখায় ব্যবহার করছিলেন। এই দিকটিকেই ফণিশ্বরনাথ রেণু হাংরি মামলা চলার সময় মলয়ের কাছে চিহ্নিত করেছিলেন এইভাবে যে, ‘এই যে তোমার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নিয়ে অবসিনিটি আর সাবভারশানের মামলা আরম্ভ হল তো , তুমি দেখবে তুমি ক্রমশ ওই অশ্লীলতার জন্যই পাঠকদের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েটেড হয়ে যাচ্ছো ; শুঁটকি মাছের গন্ধ আমাদের ভালো লাগে, টাটকার থেকেও বেশি টানে।’ বা গিন্সবার্গ বলেছিলেন, ‘এত কবিতা লিখছি, তবু সবাই কবিতার চেয়ে আমি কী করে বেড়িয়েছি তাতে ইন্টারেস্টেড।’ স্বাভাবিক। স্বাভাবিক যে-মানসিকতা উপরিউক্ত এই বাজারটা নির্মাণ করে তিলে তিলে, করে এবং শৈশব থেকেই আমাকে-আপনাকে ঝুঁটি ধরে তার অধীনে নিয়ে গিয়ে ফেলে প্রশ্নাতীত ক্ষমতার আঙুলে, তার দৃষ্টিকোণ থেকে।কেউ কেউ বলবেন হয়ত এখন অবস্থা বদলেছে , অন্তত উপরের দিক থেকে হলেও খানিকটা, কিন্তু বাংলা কবিতা বলুন বা গদ্যের মূল যে ভাবনাধারা, তার ক্ষেত্রে সে বদল, পাঠক জানেন, তা-ও ওই ওপর ওপর, এবং ওই খানিকটাই। হ্যাঁ, আর তাই এখন আর মলয়ের লেখাকে সেই অর্থে অশ্লীল হয়ত বলা হয় না ঠিক কথা, কিন্তু মলয় কি সেই অর্থে আবার যাকে বলে বহুলপঠিতও বটে ? এখনও ? না হলে, কেন নন ?নন কারণ, মলয় কিন্তু সেই অর্থে যাকে বলে সাহিত্য/লেখালেখিকে দেখার যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্মাণ করে দেওয়া অ্যাটিট্যুড, যাকে আমাদের দেশে আমাদের তদবধি প্রচলিত দেখার চোখকে ধ্বংস করে সেই উপনিবেশ পর্বের গোড়াতেই তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল, এবং যত দিন গেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা কিছু সামান্য বিবর্তিত হয়েছে মাত্র, এবং একই সঙ্গে বিশেষ করে দাঁতে-নখে আরো আক্রমণাত্মক ও সার্বিক হয়ে উঠেছে, তাকে মান্য করে নিজের রচনার ভাবনা কাঠামোকে নির্মাণ করেননি/ করেন না। বরং আমরা যে প্রশ্নের কথা বলছিলাম, তাকে সেই প্রশ্নেরই সম্মুখীন করে দেন। যে ভূমি থেকে ২০১৭-তে এসেও তিনি এরকম বলেন যে, ‘আমি মূলত সমাজের পর্যবেক্ষক এবং নিজের মতামত উপস্থাপন করি।’ কেবল তা-ই নয়, এই জায়গা থেকেই আরো বলার যে, মলয়ের উপন্যাস, গল্প , প্রবন্ধ , কবিতা সমূহ বিপজ্জনক ; কারণ, মলয় যা লেখেন তার অনেকটাই বিস্ফোরক রকম ইন্সটিঙ্কটিভ। তাঁর লেখা, তা সে যে গোত্রেরই হোক, স্পষ্ট একটা রক্তান্তর্গত রাজনৈতিক মতামত বহন করে। এবং এই বহন করাটাকে মলয়, আরো অনেকের মতো , ভাষার আচ্ছাদনে আড়াল তো করেনই না, বরং, সেই ভাষার অস্ত্রেই, তাকে হা-হা রকম হাটখোলা করে মেলে ধরেন। আর এটা তিনি করেন যেহেতু নিজের ইন্সটিঙ্কটে নিহিত রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই, নিজস্ব নির্মাণের পাথেয়, কিম্বা বলা যাক উপাদান তিনি যেহেতু সংগ্রহ করে নেন এর অভ্যন্তর থেকেই, ফলে, ১৯৯৫-এ কলকাতায় এই নিবন্ধকারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর সটান ছোবল তুলতে বাধে না, যে, ‘কে প্রলেতারিয়েত ? তুমি, না যারা এটা পড়বে— কারা ? যাদের বাড়ির ভেতরেই পায়খানা থাকে, তাদের প্রলেতারিয়েত বলা যায় না।’ কেবল তা-ই নয়, নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁকে ভুরু কুঁচকে বলতে হয়, ‘বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারগুলো , যিনি বা যাঁরা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তা একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন যোগাবার জন্যে নেওয়া… প্রায় সবই মোটিভেটেড। সকলেই মোটামুটি একটা হাংরি ইমেজ নির্মাণ বা অবিনির্মাণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছেন। …অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা, নিজেদের ডিসকোর্সকে জায়গা করে দিতে চেয়েছেন।’অর্থাৎ মলয় চিহ্নিত করেছেন কীভাবে তাঁর পরের প্রজন্ম , তৎকালীন সময় থেকে দূরে/পরিবর্তিত কালে বসেও, অন্তর্গত সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের চাপের সৃষ্টি হিসাবে সেই সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানের স্বার্থকেই বজায় রাখবার দায় থেকে গৃহীত হাংরি ইমেজকে খাড়া রাখবার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালন করছে যেমন একদিকে, তেমনি অন্যদিকে হাংরি আন্দোলন নামে এক বিস্ফোরণের চরিত্রকেও এই ক্ষমতার চোখ এবং মন দিয়েই দেখতে ও পড়তে মগ্ন থাকছে। এই অবস্থা ও অবস্থানের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারাকে মলয় বলছেন পীড়া, যে পীড়াকে, মলয়ের স্পষ্ট বক্তব্য , ‘শেয়ার করা যায় না।’ এবং শুধু তা-ই নয় , এই পীড়াই তাঁকে যে এম আর চোওধারি নামে আরেক অস্তিত্বকেও খাড়া করতে বাধ্য করেছে তা-ও মলয়ের বয়ানেই আমরা জানতে পারছি। এটা একটা দিক, আর অন্য দিকে এই এখান থেকেই জাত হয় সেই পরিস্থিতি যেখানে মলয় বলেছেন, ‘গ্রহণ-বর্জনের বৈভিন্ন্যের নিরন্তর টানাপোড়েনে পাঠকৃতি-বিশেষ তার নিজের পরিসর অহরহ গড়ে নিতে থাকে। তার কিনারায় গালে হাত রেখে বসে থাকা ছাড়া আমার কিছু করার নেই।’ এবং এইখানেই মলয় নিজের জন্যে ‘ফালচার’-শীর্ষক এক বর্গ নির্মাণ করে নেন — যার গভীরে নিহিত থাকে একটা ‘ইরর‍্যাশন্যালিটি’, যাকে আবার নির্মাণ করছে , মলয় বলছেন, ‘পাশাপাশি মিশনারি স্কুল আর ব্রাহ্ম স্কুল’-এর যাদু-বাস্তবতা — যে বাস্তবতাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে মলয় লিখছেন, ‘আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিলেন, ব্রাহ্ম বলে। পিরিলি বাউনদের বজরা উত্তরপাড়ার গঙ্গায় ভাসলে স্নান অর্ধসমাপ্ত রেখে ঠাকুমার পালকি ফিরে আসত। সিনেমা দেখা নিষিদ্ধ ছিল কেননা তা লোচ্চাদের তামাসবিনি।’ এবং এইখানেই ‘প্রাক-ঔপনিবেশিক সাবটেরানিয়ান এথনিক বাঙালিয়ানা’ আর মিশনারি স্কুলের মূল্যবোধের মধ্যে সংঘাতটা বাধে, এবং মলয়ের রক্তান্তর্গত রাজনীতির ভাবনা-বিশ্ব তথা দেখার-চোখ গড়ে ওঠে। এই দেখার চোখটাই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর মতো লেখা, ‘শয়তানের মুখ’ বা ‘জখম’-এর মতো হাড় অব্দি চমকে দেওয়া কাব্যগ্রন্থ, ‘নপুংপুং’,’ইল্লত’,’হিবাকুষা’-র মতো নাটক বা রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে ম্যানিফেস্টোগুলি, যা মলয় রায়চৌধুরী নামক ব্যক্তিটিকে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্ণধারদের বিপরীতে গলিয়াথের বিরুদ্ধে ডেভিডের মতো বিপজ্জনক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে অশ্লীলতার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার পর প্রথম একজন কবির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের মামলা/তকমা ঝুলিয়ে দেয় (সে অভিযোগ অবিশ্যি পরে তুলে নেওয়া হয়েছিল। তবু)। এবং সম্ভবত এইখান থেকেই অদ্যাবধি মলয়ের বই যত না, বেশি আলোচিত হয়েছেন মলয় নিজে—হয়েছেন কারণ, মলয় যে নিজেকেই লেখার বিষয় করেছেন। করেছেন নিজের সামান্য-টিল্টেড দেখার চোখকেই, যে চোখ দ্যাখে ‘কোরা মার্কিন কাপড়ের পুঁটুলিতে রাজপথ থেকে ছেঁকে তোলা মানবলাবণ্য’ (মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর ) বা যে চোখের দৃষ্টিশক্তির অভ্যন্তরে নিহিত থাকে ‘গহ্বরতীর্থের কুশীলব’ কিম্বা ‘ঘোগ’-এর ভাষা-বাস্তবতার শিকড়। বিষয়কেন্দ্রহীন মুক্ত সূচনা ও মুক্ত সমাপ্তির মধ্যবর্তী পর্বে লজিক্যাল সিকোয়েন্স-বর্জিত ছেঁড়া ছেঁড়া চিত্রকল্পে গেঁথে তোলা এই যে সব পাঠবস্তু , যাদের হাঁ-মুখে নির্বিচারে ঢুকে যায় দলা পাকিয়ে ওঠা রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি মথিত আমাদের গোটা সমসময় , যার সম্মুখবর্তী না হলে বোঝাই যায় না কেন, কোন জায়গা থেকে বাজার নামক প্রধান ডিসকোর্সের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মলয় বলেন তিনি কবিতাকে, লেখালেখিকে জীবনে ফিরিয়ে দিতে চান ( অনেকটা ক্ষেত্রে দিয়েওছেন। অন্তত ‘যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের’, ‘ভালোবাসার উৎসব’-এর মতো লেখা বা ধরা যাক ‘রাহুকেতু’-র মতো উপন্যাসটি পড়ে উঠলে বেশ টের পাওয়া যায়), এবং কেন আজও মলয়ের লেখালেখি নিয়ে যে কোনো আলোচনার কেন্দ্রে ঘুরেফিরে এসে যায়ই হাংরি প্রসঙ্গ এবং তৎসংক্রান্ত ডিবেটগুলি, যা , নিহিত উত্তেজনার কারণেই অনেকটা , মুহূর্তে পাঠকের নজরের লক্ষ্যবিন্দুকে গ্রাস করে এমনকী যখন স্বয়ং মলয় বলেই দিচ্ছেন যে তিনি মলয় রায়চৌধুরী হিসেবেই পরিচিত হতে চান, হাংরি বা অ-হাংরি হিসেবে নয় , তখনো গোটা আলোচনাটিরই ভরকেন্দ্রকে, ক্ষমতার ইচ্ছে/স্ট্রাটেজি-মতো , বাধ্যতামূলক ভিন্নমুখী করে দিয়ে। মলয় রায়চৌধুরীর লেখালেখি সম্পর্কে তা-ই আপাতত কথা রয়ে যায় একটাই , যে, তিনি আমাদের মানসিকতার গভীরে বাজারি আঙুলে আমূল প্রোথিত করে দিতে চাওয়া মানসিকতাটাকেই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তার প্রেক্ষিতেই নিজেকে যাচিয়ে দেখতে চান। এই চাওয়াটাই মলয়কে প্রতি মুহূর্তে যেমন সমকালীন রাখে, বিপজ্জনক হিসাবে প্রতিভাত করে, তেমনি আদ্যন্ত সচেতন নিজস্বতায় জারিতও করে নিঃসন্দেহে। তাঁর গল্প-উপন্যাস বলুন বা কবিতা, নাটক কিম্বা কাব্যনাট্যগুলি, সাক্ষাৎকার ও প্রবন্ধ অথবা আত্মজীবনী — সবের মধ্যেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে থাকেন সেই মানুষটি, উত্তর-ঔপনিবেশিক আধুনিকতার বিষ-আঙুল যাঁর ভাবনা-কেন্দ্রে কোনো রদ-বদলই ঘটাতে পারেনি, বরং নিজেই সামান্য হলেও বদলে গেছে — এই যা !

    গোবিন্দ : চমৎকার মূল্যায়ন ।

    মলয় : ২০১৮ সালে জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায় আমার জাদুবাস্তব গল্প ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’ আলোচনার সময়ে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ মারফত আমার ক্ষতিকর ব্র্যাণ্ডিং নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন । সয়ে যাবার পর ভাবলাম, জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা নামের কাহিনির বুনন ও বাঙালি ‘পলিটি’ সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরীর ভাবনাচিন্তা নিয়েই লিখি । মুসলমান শাসকরা বঙ্গদেশকে বলতেন জিন্নত-উল-বিলাদ। অর্থাৎ মর্ত্যের স্বর্গ। কিন্তু গল্পের প্রেক্ষাপট অখণ্ড বাংলা নয়, মূলত পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে। উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনৈতিক, প্রসাশনিক, শিক্ষাব‍্যবস্থা ইত‍্যাদির কঙ্কালটা চোখের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়াই মলয়ের ঝুলির এই আড়ালে অরূপকথনের লক্ষ্য।‘যাতুধান তরফদার…. এই দেশের এক অতি বৃদ্ধ শকুন, এককালের বিশাল পরিবারের অভিজ্ঞ কুলপতি, যার পরিবারে যুবক নাতি শিলাদ ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই।’…….উত্তর-ঔপনিবেশিক পশ্চিমবাংলায় ক্রমশ ভেঙে পড়ছে একান্নবর্তী পরিবারগুলো । টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে পরিবারগুলোর গঠন ও সামাজিক দায়দায়িত্ব এবং মূল‍্যবোধ। যৌথ-পরিবারের শেষ উত্তরাধিকারী মলয় রায়চৌধুরীর কি দীর্ঘশ্বাস পড়েছে যাতুধান তরফদারের বুকের বিদার থেকে ? তাঁর ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ কি প্রতিফলিত এই অরূপকথনে ? জানি না। কিন্তু প্রাক-ঔপনিবেশিক সাবটেরানিয়ান এথনিক বাঙালিয়ানা যে আর সম্ভব নয় সেটা মলয় রায়চৌধুরীর’ বিভিন্ন প্রবন্ধে আমরা পড়েছি । খোপ-বাড়ির খোপে খোপে বাস করা বাঙালির চিন্তা জগতেও যে দৈন্যতা প্রকট হয়ে উঠেছে এই ব‍্যাপারেও মলয় রায়চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধগুলোতে বিশ্লেষণ করেছেন, বিশেষ করে তাঁর ‘উত্তরদার্শনিকতা’ প্রবন্ধে। মলয় রায়চৌধুরী, স্বীকার করেন যে, লেখালেখি ঘরের দরজা জানলা এঁটে সাধনা নয়। মানুষ ও সমাজবর্জিত হয়ে চিন্তাজগতে ঢেউ তোলা নয়। তাতে সাহিত্য খন্ডিত বা একপেশে হয়ে পড়ে, তাতে আর যা হোক সমাজের আসল চিত্রটি প্রতিফলিত হয় না। লেখক-শিল্পী যত মানুষের সাথে মিশবেন, যত সমাজের আনাচে কানাচে পৌঁছাবেন তত পুষ্ট হবে তার অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার ইরিটেশনেই নির্মিত হবে সাহিত্য, শিল্প। মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে উৎপলকুমার বসু লিখেছেন যে, ‘বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণকারী প্রবণতা লক্ষ করি । কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন — “লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে ।” বলা বাহুল্য, তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি । তিনি বলেছেন, “পলিটি”-র কথা । আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব — মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন ।’‘জিন্নতুলবিলাদ’ সম্পর্কিত কাহিনি জুড়েই লেখকের এই অভিজ্ঞতা বা শিলাদের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক মননের জার্নিটা স্পষ্ট। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ, দিন-রাত, জঙ্গল-নদী, আন্ডার গ্রাউন্ড-মাল্টিপ্লেক্স, বেশ‍্যাপল্লী-ক্লাসরুম ইত্যাদি সময় পরিবেশ ও অবস্থানের যে বর্ণনা আমরা পাই এবং তার সাথে সাথে যেভাবে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের প্রকৃতি তা যে মোটেই ভাববিলাসে লিখিত নয়, এইটুকু স্পষ্ট বুঝে নেওয়া যায়। ঘটনা, পরিবেশ ও চরিত্রের এই নিঁখুত নির্মাণ বা শার্পনেস্ স্পষ্ট করে দেয় যে এ সবই লেখকের অভিজ্ঞতালব্ধ। আমরা জানি যে গ্রামোন্নয়ন অফিসারের চাকুরিতে তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার, গ্রামে-গঞ্জে চাষি, তাঁতি, জেলে, ছুতোর, খেতমজুর ইত্যাদি মানুষের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখেছেন । গল্পকার উত্তরঔপনিবেশিক বাঙালির বাস্তবজীবনকে অনবরত স্ক‍্যানিং করে গেছেন। পাঠবস্তু নির্মাণে তাই কোনো বাছবিচার নেই। নেই নেকুপুসু মার্কা শ্লীল-অশ্লীলের দ্বন্দ্ব। গল্পের সাবজেক্ট পজিশনেও তাই বহুত্বের যথেচ্ছাচার স্পষ্ট। গল্পের হাঁ-মুখে সেঁধিয়ে গেছে বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, সন্ত্রাসবাদ, যৌনতা ইত্যাদি । অনায়াসে সবকিছুকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে পাঠবস্তুটি। কখনো পাশাপাশি আবার কখনও বা একটার সাথে আর একটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে অবস্থান করছে। পাঠককে যে সবসময় পাকগুলো খুলে খুলে পড়তে হবে এমনও নয়। পাঠবস্তুটি সবকিছু গলাধঃকরণ করে নিজেই একটা আলাদা সাবজেক্ট-বহুত্ব গড়ে তুলেছে। সবজিগুলো তাই তাদের একই খেতে উৎপাদিত হয়েই খুশি। অথচ কনট্রাস্টটি হলো পাঠবস্তুটি যখন বহুধায় বিভক্ত তখন শিলাদকে সামনে রেখে গল্পকার মলয় রায়চৌধুরী নির্মাণ করে গেছেন ব‍্যক্তির নিজস্বতা বা ইউনিকনেস। একদিকে গল্পের কৌম-পরিসর বাড়িয়েছেন, খুলে দিয়েছেন পাঠবস্তুকে। অপরদিকে ব‍্যক্তিকে একক হিসাবে ধরে ব‍্যক্তির ভালোলাগা, মন্দলাগা, সাদা কালো ধলো দিয়ে নির্মাণ করেছেন ব‍্যক্তির নিজস্বতা। সামাজিক জীব হয়েও ব‍্যক্তি এককের নিজস্বতা বা ইউনিকনেস নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন পুরো অরূপকথন জুড়ে। .যৌনতা এবং জাতিপ্রথার দ্বন্দ্ব এসেছে এভাবেই, স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। জীবনের অংশ হিসেবে নয়, সমাজের সদস্যদের জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য ক্রিয়া হিসাবে। ইয়েস্ দ‍্যাট্ .স্বমেহনকে মলয় রায়চৌধুরী একবারো যৌনক্রিয়ার মধ্যে ফেলেননি। এটা আমার বেশ আবাকই লেগেছে, বরঞ্চ মাছ-শিলাদ খোঁজ করছে সমকামী সঙ্গীর। ‘মাছসমাজে সমকামের গোপন গোষ্ঠীটার সাকিন-ঠিকুজি জানলে কিছুটা অন্তত দুঃখামৃত বেরিয়ে যেত।’ যৌনতা নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর এই দ্বিধাহীন স্পষ্ট ও বহুরৈখিক ভাবনার পরিচয় পাই হাংরি আন্দোলনের সময় থেকেই। তার বিখ্যাত কবিতা ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত যৌনচেতনা। এই কবিতাটির উপর অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল। যদিও আমার মনে হয় প্রশাসনের কাছে এই অশ্লীলতার অভিযোগটি করার উদ্দেশ্য ছিল যেনতেন প্রকারেণ একটা অভিযোগ খাড়া করা। কোমরে দড়ি বেঁধে ঘোরানোর মানসে করা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ধোপে টিকবে না দেখে, এবং সেই অভিযোগটা আদালতে এনে ফেললে নিজেদেরই নিম্নদেশ বস্ত্রহীন হবে দেখে, অশ্লীলতার অভিযোগটিকেই ভেসে যাওয়া খড়খুটো হিসাবে ধরা। যদিও এই অভিযোগটিতে মলয় রায়চৌধুরীর লাভ হয়েছিল প্রচুর, ও ক্ষতিও। মামলা চলাকালীন সময়ে মলয় রায়চৌধুরীর নিঃসঙ্গে, কপর্দকহীন, অসহায় ও অসহ্য জীবনের কথা মাথায় রেখেও বলব এই অভিযোগ রাতারাতি মলয় রায়চৌধুরীকে হেডলাইন বানিয়ে ফেলেছিল। দেশে ও বিদেশেও। এই একটি কবিতা মলয় রায়চৌধুরীকে খ‍্যাতির চূড়ায় টেনে তুলেছে, তাঁকে মিথ বানিয়ে তুলেছে। এই ব‍্যপারটা আমরা সবাই জানি, নতুন করে আর কিছু বলার নেই। হাংরি আন্দোলন ও ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নিয়েও কোনো একদিন আমার মতামত লিখব কোথাও। দীর্ঘ প্রস্তুতি ও চিন্তা ভাবনা সত্ত্বেও কীভাবে একটা ছোট্ট ভুল এক আলোকবর্ষ দূরত্বের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল বলব সেটাও কোনো একদিন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে গ্রেপ্তারি ও কবিতাকেন্দ্রিক মামলা, এই ঘটনাটি মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষতিও করেছে প্রচুর এবং করে চলেছে আজও । ব‍্যক্তি মলয় রায়চৌধুরীর কথা অনুমান করতে পারি, কিন্তু সৃষ্টিশীল মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষতিটা অপরিসীম। মলয় রায়চৌধুরীকে মিথ বানিয়ে আর ওই একটি কবিতাতে মগজ নয় শুধু হাত সেঁকেই মলয় রায়চৌধুরীকে পাঠক-পাঠিকারা স‍্যালুট ঠোকে বারংবার। এই প্রসঙ্গে জিন্নতুলবিলাদে একটি চরিত্রের উক্তি প্রসঙ্গিক: ‘আমাকে কেউ শ্রদ্ধাভক্তি করে না, ওরা জাস্ট আমার কংকালটাকে ভয় পায়। কেননা কংকালটা হল আমার রাজনৈতিক জীবনের কিংবদন্তি।’ মলয় রায়চৌধুরীর রচনাগুলোর আগে-আগে ছোটে ওনার কিংবদন্তি । অথচ ওনার লেখা পড়ে যেটুকু বুঝেছি, প্রায় শতাধিক বই আছে ওনার, উনি বারবার চেয়েছেন বা মনে করেন, লেখক নয়, রচনা-বিশেষের গুরুত্ব থাকা উচিত পাঠকের কাছে। অথচ ওনার ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উল্টোটাই। সাধারণ পাঠক-পাঠিকা ওনার অন্য লেখা পড়েন না বা পড়তে চান না, ওই একটা কবিতা দিয়েই দূর থেকে মেপে নিতে চান মলয় রায়চৌধুরীকে। অথচ যখন তিনি বারবার বদলে ফেলছেন তাঁর গদ্যের ডিকশন, কবিতার ফর্ম, সিরিয়াস পাঠক ছাড়া খেয়াল করেন না সেটা।একইসাথে ধর্মের নামে নষ্টামিকে তুলে ধরতেও তিনি পিছহাত নন। ধর্মকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপও করেছেন অনায়াসে। অবলীলায় আঘাত করেছেন ধর্মের অচলায়তনে। ‘ওকে পোড়ালে ও হিঁদু হয়ে যেত আর পুঁতে দিলে মোচোরমান, তাই ওকে ওভাবে ফেলে দিয়েছে। ওর মড়া বদ-ভাবনার বাতাসে ভরা, খেলেই তোর বায়ু রোগ হতো। আর উড়তে পারতিস না।’ অবশ্য ধর্মের নামে বিভিন্ন অমানবিক অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি চিরদিনই সোচ্চার। হাংরি আন্দোলনের সময়েও তাই দেখি আলাদা ভাবে ধর্ম নিয়ে ইশতাহার । শিলাদকে তার দাদু বলছে, ‘এই যে শঙ্কর, রামানুজ, বল্লভাচার্য, শ্রীধরস্বামী, নিম্বকাচার্য, মাধবাচার্য, কেবলভক্তি, বলদেব বিদ্যাভূষণ, মধুসূদন সরস্বতী, ওনারা তো তোর-আমার জন্যে ভগবানের কথা ব্যাখ্যা করেননি; করেছেন নিজেদের আর চেলাদের জন্যে।’ এইভাবেই ধর্মের মুলো ঝুলিয়ে চলছে অবিরত ধর্মের গুরুঠাকুরদের ব‍্যবসা। বংশপরম্পরায় বসে খাওয়ার সুবন্দো‍বস্ত। রাজতন্ত্র আর ধর্ম চিরদিনই হাতে হাত মিলিয়ে হেঁটেছে। একজন আর একজনকে পুষ্ট করে ক্ষমতা বাড়িয়েছে দুজনরেই, যাতে নিশ্চিন্তে ভোগবিলাসে দিন কেটে যায় এবং রাত। ‘লর্ড মাত্রেই তাদের পি.এ., পি.এস., স্ত্রী ছেলে মেয়ের জন্যে অনেক কিছু করে, যাতে তারা কয়েক পুরুষ বিলাস বৈভব ক্ষমতায় থাকে।’ এই কথাটি এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের জীবনের সত্য । টকে যাওয়া রাজনীতি আর সমাজের পচনশীল শবগুলোর ভিতরেও গলা পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিতে তাঁর আপত্তি নেই। ছিঁড়ে ছিঁড়ে টেনে আনেন বঙ্গসমাজের পচা-মাংসের টুকরো, পচে-যাওয়া নাড়িভুঁড়ি। এখানে ‘অপার্টি’ শব্দটির প্রয়োগ বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। তুমি আমার দলের নও, মানে তুমি ‘অপর’, দি আদার । বিরোধী পার্টি আবার কী বস্তু? খায় না মাথায় দেয়? সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের গুরুত্ব অপরিসীম, কে বলল? ওসব বইয়েতে লেখা থাকে, বাস্তবে নয়। ‘সেই থেকে ফিবছর মেমননের স্মৃতিতে একদল পাখি জেতে আর আরেকদল হারে।’ সুবিধাবাদী রাজনীতির মুখোশ খুলেছেন তিনি অনায়াসেই। ‘এই যেমন কাশ্মীরে বোমাবাজদের সম্পর্কে যে ধরনের ভাষ্য দেয়া হয়, ত্রিপুরার বোমাবাজদের সম্পর্কে তার চেয়ে গরম ভাষ্য দেয়া হয়। কেননা ত্রিপুরায় ভাষ্যকারের মেসো-জ্যাঠা-কাকা-মামা থাকে। কাশ্মীরে ভাষ্যকারের কেউ থাকে না।’

    সংবাদমাধ‍্যমের দ্বিচারিতা, নিজেদের লাভের কথা মাথায় রেখে মিথ্যা খবর তৈরি করাকেও তিনি মোটেই ভালোভাবে নেননি। ‘আপনার অবৈধ প্রেম যাতে ব্রেকিং নিউজ হয় তার জন্যে নিউজ চ্যানেলদের বলে দেব, সে বাবদ এক্সট্রা দিতে হবে না, বিজ্ঞাপন থেকে কভার করে নেব।’হাংরি আন্দোলনের সময় দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগটা চেপে গিয়ে অশ্লীলতার অভিযোগটা সামনে আনা। হাংরি মানে যে কবি ও কবিতার (সৃষ্টিশীলতা) সর্বগ্রাসী ক্ষুধা, সর্বগ্রাস, অনেক দিন খেতে না পাওয়া মানুষের মতো গোগ্রাসে খেয়ে ফেলা সবকিছুই, খাওয়ার নিয়ম নীতি শিষ্টাচার কিছুই না মেনে। কবিতার পাঠবস্তুটি কখনো কোনকিছুতে বাছবিচার করবে না, তার প্রকান্ড হাঁ-মুখে তলিয়ে যাবে সবকিছুই। থাকবে না কোনো বাইনারি বৈপরীত্য, হ‍্যাঁ-না, ঠিক-ভুল, ন‍্যায়-অন‍্যায়, শ্লীল-অশ্লীলের দ্বন্দ্ব, এটাকে সম্পূর্ণ না জেনে, না বুঝে প্রচার করা হল হাংরি আন্দোলন মানে না খেয়ে, খালি পেটে কবিতা লেখা । তারসাথে নেশা করা, যৌনক্ষুধা ইত্যাদির মশালাদার খবর তো আছেই। সেই সময়ের সংবাদপত্রের পাতা ওলটালেই চোখে পড়বে নানা রকমের রসালো গালগল্প তৈরি করেছে লেখক-সাংবাদিকরা । জ্যোতির্ময় দত্ত লিখেছিলেন, ‘বাংরিজি সাহিত্যে ক্ষুধিত বংশ’ । প্রশাসনের মিথ্যা আশ্বাস আর মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ভুলিয়ে রাখার এক ওয়েস্টবেঙ্গলসম দক্ষতা এড়িয়ে যায়নি গল্পকারের চোখ থেকে। হাংরি আন্দোলনের সময় প্রশাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার এটাও ছিল একটা মস্ত কারণ। হাংরি আন্দোলনের পরপরই পশ্চিমবঙ্গে ঘটে গেছিল নকশাল আন্দোলন। দেবেশ রায় এই দুটি আন্দোলনে একই বিশ্ববীক্ষার কথা বলেছিলেন । অথচ দুটোর উদ্দেশ্য, প্রস্তুতি ও গভীরতা সম্পূর্ণ আলাদা । হাংরি আন্দোলন যেখানে দেশভাগোত্তর বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সংস্কৃতি, ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্যে স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে আঘাত হানার চেষ্টা করেছিল , সেখানে নকশাল আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল মার্কসীয় পন্হায় রাজনৈতিক ক্ষমতাদখল । হাংরি আন্দোলনে ক্ষমতার বিরুদ্ধে যে জেহাদ তার কারণ মূলত প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং শিল্প ও সাহিত্যকে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের বাণিজ্যিক প্রয়াস। শিল্প ও সাহিত্যের পায়ে ভিক্টোরিয়ান মূল‍্যবোধের বেড়ি পরিয়ে দেওয়া। তাছাড়া শিল্প ও সাহিত্যজগতের মানুষের মধ্যে এসেছিল জাড্যের উদাসীন স্থিতাবস্থা। সমাজবিমুখ হয়ে সাহিত্য ও শিল্পের বাজার আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । ভাবনাতেও এসে গেছিল দৈন্য। কোনো নতুন আইডিয়া নেই। শুধু কালিতে কালি বুলিয়ে সুখী সুখী নির্মাণই ছিল শিল্প ও সাহিত্য সাধনা। এরসাথে যুক্ত হয়েছিল ক্ষমতার পদলেহন করে স্বীকৃতি যোগাড়। ঠিক এই জায়গাতেই আঘাত হেনেছিল হাংরি আন্দোলন। যদিও অ্যাবস্ট্রাক্ট সিস্টেমের নি-জার্ক প্রতিক্রিয়ায় আজও কোনো হেলদোল নেই। হাংরি একটা কামড় দিতে পেড়েছিল সেই পচাগলা মাংসে। হাংরি আন্দোলনে আন্ডারগ্রাউন্ড বা চোরাগোপ্তা পথের কোনো স্থান ছিল না। যুদ্ধটা সামনাসামনি। আর ক্ষমতার উৎস বন্দুকের নল নয়, কলম-তুলি। যা মুখোশ খোলে, রক্ত খায় না। ‘ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে দেখল জঙ্গিলা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের গুপ্ত গুলছররা চলছে।’….নকশাল আন্দোলন ছিল অপরদিকে চোরাপথে গেরিলা কায়দায় আঘাত হানা, এখন মাওবাদীরা জঙ্গলে লুকিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়াস করছেন, ভারতের জাতিপ্রথার কোনো বিশ্লেষণ তাঁরা করেন না । গল্পকার যে এই চোরাগোপ্তা পথে মানুষখুনের আন্দোলনগুলিকে ভালো ভাবে নেননি তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই গল্প থেকে। ‘সবাই ইংরেজিতে কথা বলছিল, তর্কাতর্কি করছিল, চাপানউতর করছিল; মনে হল ওটাই জঙ্গিলাদের পিতৃভাষা।’ মার্কসবাদকে সামনে রেখে দেশে দেশে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে সবচেয়ে ভুল ছিল, আঞ্চলিক বা নিজস্ব সমস্যাকে বিচার বা বিশ্লেষণ না করে সবকিছুকেই মার্কসবাদের আলোকে ফেলা। অর্থাৎ এখানেও যেন সেই ধর্মের মতো গোঁড়ামি। নিজস্ব চিন্তাভাবনা নয়, নিজের সমাজকে চিনে বিচার বিশ্লেষণ নয়, ধর্মগ্রন্থের মতো একটি বইয়ের কথাগুলিকে চিরসত‍্য ধরে তা প্রশ্নহীন আনুগত্যে পালন করে যাওয়া। ‘মনে হল ওটাই জঙ্গিলাদের পিতৃভাষা’-র মধ্য দিয়ে গল্পকার যেন এটাই বোঝাতে চাইলেন যে, কীভাবে আন্দোলনকারীরা নিজেদের ভারতীয় আইডেন্টিটি ভুলে গিয়ে, নিজেদের চিন্তাভাবনার পরিসরটাকে শূন্য করে ক্রমাগত কপচে যায় মুখস্থ করা বুলি। আর অ্যাকশন্ ঠিক সেই আদি অকৃত্রিম পথেই। নিজস্ব পথ আবিস্কারের কোনো চেষ্টা নেই। শুধু সমাজ-বদলকারীদের নয়, সুখী সামাজিক মানুষদের শ্রেণিবিভাজন’টাও তিনি ধরেছেন নিপুণভাবে। ‘রয়েছে যবাক্ষারজান জলের নিচড়া বর্গ, রোদবৃষ্টিমাখা জলের উচড়া বর্গের সঙ্গে মাঝামাঝি জলের নিচড়া বর্গ। অতি নিচড়া বর্গের গায়ে আঁশ নেই চোয়াল নেই ডানা নেই, তলানি খায়। নিচড়া বর্গের গায়ে হাড় নেই, সবই কার্টিলেজ, কানকোর জায়গায় খড়খড়ি; জলের বেসমেন্টে নামলে চোখের তলায় গর্ত দিয়ে শ্বাস নেয়। আর উচড়া বর্গ তো রোদের পাউডার চাঁদের ক্রিম আর শিশিরের পারফিউম মেখে চোপরদিন গোমরে ঝিকিমিকি।’ এই বিভাজনকে বৈচিত্র্য মেনে মানুষ’ও বেশ খুশি। তাই সুখী খুশি কানে যদি কেউ নতুন কিছু শোনাতে যায় শোনে না, ভাবতেও চায় না, শুনতেও। ‘রঙিন কাউকে দেখলেই ওদের পোঁদে হিং জমে’। চিরদিনই নতুন কিছু যাঁরা জানাতে চেয়েছেন মানুষকে, তাঁদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘রঙিন বলে ওই সব বর্গের মাছেরা কেউই শিলাদকে নিজেদের লোক বলে মনে করে না, অথচ খুব হিংসে করে।’এই অরূপকথনে সাম্রাজ্যবাদীশক্তির দাদাগিরিকেও তিনি শিলাদের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। ‘এই বোটকা মালটা কোত্থেকে এল রে সুনন্দা, আমেরিকা না ইজরায়েল? সেই বুড়ো বাঘটার এলাকা গায়ের জোরে জবরদখল করে বসে আছে।’ হয়তো উপনিবেশের রঙ পাল্টে গেছে, ‘নিজেকে আলেকজান্ডার কিংবা দারিয়ুস ভাবছে, মুতে-মুতে জবরদখল আর পাকাপাকি রাজ্যপাট, হাঃ হাঃ হাঃ…’ এখন লক্ষ্য অর্থনৈতিক উপনিবেশ স্থাপন। কিন্তু তার এফেক্ট একই। অসংখ্য হাড়জিরজিরে মানুষের লাশের উপর গুটিকয় নাদুসনুদুস মানুষের ভুড়ি ভুড়ি ভুরিভোজ। ‘দ্যাখে কি, গির্গিটবোমা অ্যানোলের পচাগলা লাশের মোরব্বা চেখে-চেখে খাচ্ছে মার্কিন কানিমাগুর আর ব্রিটিশ পাঁকাল।’

    পশ্চিমবঙ্গের পুঁথিনির্ভর শিক্ষকমুখী শিক্ষাব‍্যবস্থার হাল যে কতখানি করুণ তা আর নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। এটা যেন ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে, সবাই মানে তবু হরিদাসের গোয়াল খালি থাকে না। উপায়ও নেই। যেন তেন প্রকারেণ চাই ডিগ্রি, পরীক্ষায় পাশ করাটাই সাফল্যের খতিয়ান। শিক্ষা? সেটা আবার কী স‍্যার? ‘শিমুল-পলাশের ডালে-ডালে ঠাকুরাল-বাঁদর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছাত্র পড়ানো দেখছিল শিলাদ। প্রগতিশীল বাঁদর স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেশ হোঁতকা-হোঁতকি রাঙা পোঁদা রাঙামুখো। কারোর চতুর্থ হাতে বিপত্তারিণির হর্তুকি, কারোর তৃতীয় হাতে জয় বজরংবলির মাদুলি, কারোর দ্বিতীয় হাতে রুপোর চেনে মাকলা-বাঁশের শেকড় বাঁধা। ছাত্র-ছাত্রীরা রোগা টিংটিঙে।’….শিক্ষকরা নিজেরাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আর তারাই দেয় বিজ্ঞানের শিক্ষা। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে-পড়া ছেলেমেয়েরা আসে ফ্রি স্কুলে শিক্ষা নিতে। বাড়িতে ঠিকঠাক খেতেও পায় না। অপুষ্টি শরীরে ও মনে, আর তারাই মুখস্থ করে বাড়ি ফেরে ভিটামিন কাহারে কয়। এই দূরাবস্থা থেকে আজ আশার আলো স্কুলে-স্কুলে মিড-ডে মিল প্রকল্প। এই গল্পটি যখন লেখা হচ্ছে তখন মিড-ডে মিল চালু হয়নি। তাই গল্পকারের তর্জনী নিক্ষেপ সফল। অবশ্য শুধু সরকারি ফ্রি স্কুল নয়, ঝাঁ চকচকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষাব‍্যবস্থাও যে খুব ভালো এমনও নয়। সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব‍্যবস্থার মূল লক্ষ্যই হলো নাম্বার, আরো নাম্বার, আরো আরো নাম্বার। নো ইনোভেশন ওনলি মুখস্থং নোটং। উদাসীন পৃথিবীটা আমাকে লাথিয়ে-লাথিয়ে আমারই স্বাধীনতায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে, আর আমি, পাখনা চাপড়ে বিলাপ করতে বাধ্য হচ্ছি। সম্ভাবনার সুযোগ সুবিধের মধ্যেই আমাকে কাৎ মেরে-মেরে খতিয়ে বেরোতে হবে। না কি?’ প্রশ্ন করতে বাধ‍্য হই নিজেকে, আর উত্তর? ‘নিজেকে নিজের কাছে, নিজের বাছবিচারের সম্ভবানার কাছে, বেঁচে থাকার খামখেয়ালি অথচ নির্বিকার স্রোতের কাছে, নিজেকে পরাজিত লাগে, হেরো, পরাভূত।’”

    গোবিন্দ : কবিতাটা একইসঙ্গে আপনার পক্ষে ও বিপক্ষে গেছে, এই তর্ক কিন্তু সত্যি ।

    মলয় : ইউটিউবে অনেকে আমার এই কবিতাটা আবৃত্তি করেছেন । মহিলা কবি ও ঔপন্যাসিক মোহনা সেতু আবৃত্তি করার পর লিখেছেন, “যদি আমায় জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি সবথেকে বেশি কোন কবিতা পড়েছি তবে আমি দুইটা কবিতার নাম বলব। এক. বিদ্রোহী ; দুই. প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার। ৯০ লাইনের দীর্ঘ কবিতা মুখস্ত হয়ে গিয়েছে পড়তে পড়তে। অবশ্য এই কবিতা কোনো পুরুষেরই। আমি যেহেতু সমপ্রেমী না সেহেতু একজন নারীকে যোনী মেলে ধরার কথা বলতে পারি না। কিন্তু কবিতাটি আমার এত পছন্দ যে এসমস্ত কিছুকে পাত্তা দিলাম না। “কেউ কথা রাখেনি ” কবিতা যখন আমিসহ অনেক নারী পাঠ করতে বলি, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ, এখনো সে যেকোনো নারী— তখন এই কবিতায় বাধ্যবাধকতা থাকার কথা না।” 

    গোবিন্দ : আপনার বহু কবিতা ইউটিউবে পাঠ করেছেন অনেকে । আপনিও অনেক কবির কবিতা পাঠ করেছেন । তাঁদের মধ্যে অনেকে সম্ভবত বর্তমান প্রজন্মে সদ্য লিখতে এসেছেন । আপনি যে নতুন কবিদের উৎসাহ দেন তা সকলেই স্বীকার করেন ।

    মলয় : এই কবিতাটা এ-পর্যন্ত ইউটিউবে আবৃত্তি করেছেন, মোহনা সেতু ছাড়া, শিবাশীস দাশগুপ্ত, তনুময় গোস্বামী, অ্যালেন সাইফুল, রাজা মুখার্জি, সন্ধি মুহিদ, রাজীব চৌধুরী, নুর হোসাইন, দেবাশীস ভট্টাচার্য, আদিত্য শুভ, শশীপ্রসাদ শীল, কৌস্তুভ গাঙ্গুলি, আদিত্য অনাম আর দীপ সেন । আরেকটা কবিতা, ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো’, সেটাও ইউটিউবে এ-পর্যন্ত আবৃত্তি করেছেন সুস্মিতা বোস, শারমিন সুবহা, মিতালী সেন, মোহনা সেতু, সাদিয়া সোবহান সারা, সিলভিয়া নাজনীন এবং মৌ মধুবন্তী ।

    গোবিন্দ : আপনার প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতা বিদেশে যতো বিখ্যাত, এখানকার অধ্যাপকরা ততোই এড়িয়ে চলেন, দেখেছি । বরং বাংলাদেশের তরুণ কবিরা এই কবিতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন ।

    মলয় : তা সত্যি। ইউরোপের ভাষাগুলোতে অনুবাদ হয়েছে, তুর্কি আর আরবিতেও হয়েছে । তুর্কিতে দুবার অনুবাদ হয়েছে, প্রথমবার করেছিলেন পেলিন আবায় নামে একজন যুবতী। ভাবতে পারো ? মুসলমান-প্রধান দেশে একজন তরুণী এই কবিতাটা অনুবাদ করেছিলেন ? পশ্চিম বাংলার কবি-ঔপন্যাসিক অনুপম মুখোপাথ্যায়ের এই কথাগুলো থেকে কারণ কিছুটা খোলোশা হয়, উনি বলেছেন, “ মলয় রায়চৌধুরী। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে তিনি বাংলা সাহিত্যের একমাত্র জীবিত আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক। প্রায় একাই জ্বলে থাকা আগুন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় দু-দশক হয়ে গেল। আমার এই সম্পর্ক থেকে পাওয়ার ভাগটা এতই বেশি, এত কিছুই শিখেছি তাঁর কাছে, এটাকে প্রায় একতরফা সম্পর্কই বলা যায়। এখনও তিনি লেখায় সমান সক্রিয়। এমনকি, হয়ত আগের চেয়েও সক্রিয় ও সজীব মনে হচ্ছে তাঁকে আমার আজকাল। আসন্ন শারদীয়ায় আপনারা একাধিক পত্রিকায় তাঁর করা অনুবাদ পাবেন, পত্রিকাগুলোর ঠিকানা নিজেই বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন। হয়ত এই মুহূর্তেই একটা উপন্যাস লিখছেন, যেটা পড়ার পরে আমাদের অনেক কিছু নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আত্মপ্রচারে তিনি একটা নতুন দিকই খুলে দিয়েছেন, যেদিকটাতে পা রাখার ফলে আমাকেও অনেকে আজ চেনেন। প্রতিষ্ঠান নয়, নিজেই নিজেকে বহন করেন এই লেখক। বন্ধুর বদলে শত্রু কুড়িয়ে চলা এই লেখক। এই কবি। 

    গোবিন্দ : যথার্থ বলেছেন অনুপম । মেইনস্ট্রিম সাহিত্যে আপনার শত্রুসংখ্যা বেড়ে চলেছে পশ্চিমবাংলায় । শক্তি চট্টোপাধ্যায় পুলিশের কাছে দেয়া স্টেটমেন্টে লিখেছিলেন, “আমার মতে মলয় রায়চৌধুরীর রচনাগুলো মানসিক বিকৃতিতে পরিপূর্ণ এবং তার ভাষা নোংরা । মলয় রায়চৌধুরীর লেখা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ শিরোনামের কবিতাটির ঘোর নিন্দা করেছি ।” অথচ সেই সময়ে ঔপন্যাসিক রবীন্দ্র গুহ লিখেছিলেন, “আমি, সমীর রায়চৌধুরী ও সুবিমল বসাক তিনজনে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে হাংরির সেই সংখ্যাটি থেকে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ পড়েছি । পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দারুন আলোড়ন । পুলিশ অনেক দিন থেকেই ফাঁদ পেতে ছিল । কয়েক কপি সংগ্রহ করে দৌড়োল লালবাজার থানায় জমা দিতে । শুরু হল ধরপাকড় । লাথানি । হেনস্হা । অনেকেই কলকাতা থেকে পালাল । কেউ কেউ মুচলেকা দিয়ে ‘আজকাল’ এবং ‘আনন্দবাজারের’ তু-তু চাকর হয়ে গেল । যুদ্ধের ময়দানে দ্রোহপুরুষ মাত্র তুমি । অত হুজ্জোতের মধ্যেও আমি শুধিয়েছিলাম — ‘কেমন লাগছে ?’ তুমি উল্লাস করে হেসেছিলে । বলেছিলে — “এভারেস্টের চুড়োয় একটি মাত্র সিংহাসন, আমি মলয় রায়চৌধুরী, সেখানে বসে আছি ।” অমিয় দেবনাথ লিখেছিলেন, “কবিতাটা পোষ্ট করার পর আমার মিনিমাম ৫০ জন বন্ধু বিচ্ছেদ ঘটেছিলো। সেদিন পৈশাচিক আনন্দ পেয়েছিলাম।”

    মলয় : কী আর বলবো, বলো ! এটা পড়েছো, অনিন্দ বড়ুয়ার অনুবাদ করা, “চট্টগ্রামের ভাষায় “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার?—–অ-খোদা মরি যাইয়ুম যাইযুম/আঁর চঁ’ড়া জ্বলি যারগই আঠাইট্যা ঠাডারে/আঁই কী গউজ্জুম কডে যাইয়ুম/অ’মারে কিচ্ছু গম ন লাগের/লেয়-পড়া বেগ্গুন লাথি মারি/ যাইয়ুমগই শুভা/শুভা আঁরে তোঁয়ার তরমুজ-কঅরর/ ভিতরে ঘইলতা দ’/ঘুটঘুইট্টা আঁধারত খইর খইর/ মশারির লুডি পইজ্জা ছামাত/বেক নাকল তুলি নিবার পর শেষ/ নাকলঅ আঁরে ফেলাই যারগই/আঁইত আর ন পারির,/মেলা কাঁচ ভাঙি যারগই আঁই জানি/ শুভা, হেডা মেলি ধর,/শান্তি দ শিরা বেগ্গুনে চৌগরপানি/ আনি লই যারগই কইলজার ভিতরে/আদিকাইল্যা ব্যারামে পুঁচি যারগই/ মগজর হাঁছোড়াইন্যা অউনর ফুঁয়া /অ’মা, তুঁই আঁরে কঙ্কাল সিবে কিল্লাই জনম ন’দ?/তইলে ত আঁই দুইকুটি অলোকবর্ষ/ ভগবাইন্যার পোঁদত চুম খাইতাম/এয়াত কিচ্ছু ভালা ন লাগের আঁত্তে/ কিচ্ছুই ভালা ন লাগের/উগ্যাত্তুন দু’য়া চুম দিলে উর্বিষ লা’য়/জোরগড়ি চুইদত্তাম যাই কতবার / ইয়াপোয়ার নাম প’ড়ি/গম কামন ফিরি গেইগই….” আর কায়েস মাহমুদ স্নিগ্ধ করেছেন নোয়াখালির ভাষায়, “ওরে মারে মরি যাইয়ুম মরি যাইয়ুম মরি যাইয়ুম।/আঁর সামবা জ্বলি যারগই দারুয়ার আগুনে।
    আঁই কিত্তাম, কোনায় যাইতাম কইতাম হারি না,/ দিলের ভিত্রে শান্তি আইয়ে না এক্কানাও।/ এগিন হুঁথি মুঁতিত লাইত্থাই চলি যাইয়ুম রে শুভা।/শুভা আঁরে এক্কানা তোঁর ভিত্রে চলি যাইতে দে, গেঁডিত গেঁডিত আঁডি যাইতে দে।/ আন্দারের ভিত্রে রাইত নামাইন্না আন্দারের ভিত্রে মশাইর টানাইন্না ছামার মইদ্যে,/বেজ্ঞিন নাও চলি গেসে, অন এই নাওগাও চলি যারগই গাঁডের কিনারের তুন।/উফঃ আর হারি না রে, লাগে য্যান খালি গেলাস বাংগের।/ শুভা ভোদা খুলি আঁর দুয়ারে খাড়া, সুখ দে শুভা, তোরে সুদি।/গিরার গিরার কান্দন খালি চলি আইয়ের আঁর দিলের গোড়াত।/বিমারে বিমারে হঁসি গেসে আঁর গিলু বরা গরম ঠাডা।/এরে মা, তুঁই আঁরে খালি আড্ডিত কেন হ্যাডে লইলি না?/
    গোসত দিসত গাত, নইলে তো দুই কুটি সন ঠাউরের হোন্দে চুম্মাচুম্মি কইত্তাম, ওরে মা।/
    আঁর বালা লাগে না, আঁর আর কিছুই বালা লাগে না।/ গন গন চুম্মাইলে আঁর গা গিনগিনায়,/সুদতে সুদতে বেডিরে থুই রঙ তামশাত চলি আইসি ম্যালা দিন/ আঁর কইবতার ঠকঠকাইন্না খাড়াইন্না হ্যাডায়।/এগিন কিয়া অইতে আছে, কিয়া অইতে আসে আঁর সিনার বিত্রে ওরে ঠাউর/বেজ্ঞিন বাংগি গুড়াগুড়া করি হালামু, বাংগি হালামু এরে মাদারচোতের হুত/বাংগি হালামু তোগো ডঙের নাচন কোন্দন/আঁই কইদিলাম উডাই আনমু শুভারে, আঁর শুভা, আঁর শান্তির শুভা।/ হেতিরে গুঞ্জাই থোনের তুই কোনাইগার মাংতার হুত হালা?


    গোবিন্দ: অভাবনীয় ! বাংলাদেশে  আপনি জনপ্রিয় কবি, আলোচক, ঔপন্যাসিক । ২০০৮ সালে নির্ঝর নৈঃশব্দ আপনার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা সামহোয়ার ব্লগে পোস্ট করার পর যে বিতর্ক আরম্ভ হয়েছিল, তা আজও চলছে । এ পর্যন্ত পছন্দ করেছেন ৩৪৭ জন, মন্তব্য করেছেন ১০৪ জন।বাংলাদেশের মহিলা গল্পকার ২০০৮ সালেই লিখেছিলেন, “ আমি একজন কবিতার পাঠক হিসেবে বলতে চাই কবিতাটি আমার কাছে অসাধরণ মনে হয়েছে। শ্লীলতা কিংবা অশ্লীলতা বিচার করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। যার বদহজম হবে সে পড়বে না। যার সহ্য করার ক্ষমতা আছে সে পড়বে।” ২০১০ সালে বাংলাদেশের কবি অমিত চক্রবর্তী লিখেছিলেন, “সময়কে অতিক্রম করা কবিতা এটি।যারা নিন্দা করেছেন তাদের বলছি কবিতা শব্দ শালীনতা বা ভাবসৌন্দর্য্য নয়।কবিতা কবির একান্ত অনুভুতি।ফিল করতে না পারলে পড়বেন না কিন্তু মলয় রায় চৌধুরীর কবিতা নিয়ে মন্তব্য করার স্পর্ধা বর্জন করবেন।” ওই বছরই হাসান মাহবুব লিখেছিলেন, “প্রথমত, শারিরীক যন্ত্রণা নিয়া এই কবিতাটা লেখা হয় নাই। এটা তার চেয়েও বেশি কিছু। তবে প্রকাশভঙ্গি দেখে মানুষ ভুল বুঝতে পারে। আর যেসব শব্দের উদাহরণ তুমি দিছো অরণ্যরে কবি কিন্তু সেই টাইপ শব্দ ইউজ করেনাই। যোনী না লিখে তো অন্য কিছুও লিখতে পারতো, তাইনা? অথবা স্তনের পরিবর্তে অন্যকিছু? অমিত ঠিকই বলসে, ফিল ইট। এটা শারিরীক কামনা বাসনার কবিতা না। এটা এক অসহনীয় যন্ত্রনার বহিঃপ্রকাশ।” 

    মলয় : ফেসবুকে দেখি আজকাল আমার কবিতা অনেকে পোস্ট করেন । আমার উপন্যাসও আলোচনা করেছেন অনেকে, সম্ভবত ইনটারনেট আসার সুবিধার কারণে ।  আমার উপন্যাস “অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস’ অবলম্বনে বাংলাদেশের কবি আসমা অধরা একটা কবিতা লিখেছিলেন। ওই উপন্যাসে নায়ক নিজেকে নানা রকমের কুকুরের সঙ্গে তুলনা করেছে। কবিতাটা এরকম, “বুকের মধ্যিখানে নিঁখুত জীপার/খুলে দেখিয়ে দেয়া যেত লাঙ্গলের ফলা/করেছে এফোঁড়ওফোঁড় হৃদবিন্যাস/অযথা জমে থাকা টক্সিন ক্রমেই লাম্প/অথচ স্ফটিক স্বেদবিন্ধুতেও তেমনি পয়জনাস!/মেঘের জলদ কি জানে অক্সিটোসিন,/ব্যাপক জাগরণ কালীন ঘুম?/ক্ষরণ ও মন্থনে কার্ডিওভাস্কুলেশন;/যে কুকুর আঁচড়ে দেয় ত্বক ও শিরাবিন্যাস/তাকে বলি কানে কানে, শেফার্ড নয়, পুডল ভালোবাসি!”

    গোবিন্দ :ফেরলিংঘেট্টি, যিনি অ্যালেন গিন্সবার্গের হাউল আর ক্যাডিশ প্রকাশ করেছিলেন, আপনাদের কবিতা ওনার পত্রিকায় ছেপেছিলেন, তিনি নাকি আদালতের রায় পড়ে লিখেছিলেন, ভুল ইংরেজিতে হাস্যকর আদেশ ।

    মলয় : লোয়ার কোর্টে আমাকে সাজা দেবার কারণ হিসাবে জজসাহেব লিখেছিলেন,”Applying the test to the offending poem and realising it as a whole, it appears to be per se obscene. In bizarre style it starts with restless impatience of a sensuous man for a woman obsessed with uncontrollable urge for sexual intercourse followed by a description of vagina, uterus, clitoris, seminal fluid, and other parts of the female body and organ, beasting of the man’s innate impulse and conscious skill as to how to enjoy a woman, blaspheming God and prefaing parents accusing them of homosexuality and masterbation, debasing all that is noble and beautiful in human love and relationship. In a piece of self-analysis and eroticism in autobiographical or confessional vein when the poet engages himself in a mercilessly obnoxious and revolting self-denigration and resortage of sexual vulgarity to a degree of perversion and morbidity far exceeding the customary and permissible limits of candour in description or representation. It is patently offensive to what is called contemporary community standards. It’s predominant appeal to an average man considered as a whole is to prurient interest, in a shameful or morbid interest in nudity, sex and excretion. Considering it’s dominant theme it is dirt for dirt’s sake, or, what is commonly called hardcore pornography, suggesting to the mind of those in whose hands it may fall stinking wearysome and suffocating thoughts of a most impure and libidinous character and thus tending to deprave and corrupt them without any rendering social or artistic value and importance. By no stretch of imagination can it be called, what has been argued, an artistic piece of erotic realism opening up new dimension to contemporary Bengali literature or of a kind of experimental piece of writing, but appears to be a report of a repressed or a more pervert mind who is obsessed with sex in all it’s nakedness and thrives on, or revel, in utter vulgarity and profanity preoccupied with morbid eroticism and promiscuit in all it’s naked ugliness and uncontrolled passion for opposite sex. It transgresses public decency and morality substantially, rather at public decency and morality by it’s highly morbid erotic effect unredeemed by anything literary or artistic. It is an affront to current community standards of decency or morality. The writing viewed separately and as a whole treats with sex, that great motivating force in human life, in a manner that surpasses the permissible limits judged from our community standards and as there is no redeeming or social value or gain to society which canbe said to preponderate, I must hold that the writing has failed to satisfy time-honoured test. Therefore, it has got to be stamped out since it comes within the purview of Section 292 of Indian Penal Code. Accused is accordingly found guilty of the offence Under Section 292 Indian Penal Code and is convicted thereunder and sentenced to pay a fine of Rs. 200/- in default simple imprisonment for one month. Copies of the impugned publication seized be destroyed.”

    গোবিন্দ : অ্যালেন গিন্সবার্গ আপনাদের পাটনার বাড়িতে কতো সালে এসেছিলেন ? আপনি ওনার হাউল আর ক্যাডিশ অনুবাদ করেছিলেন । শিলচরের কবি বিকাশ সরকারের কাছে শুনেছি ওনার ‘লেখাকর্মী’ পত্রিকায় ক্যাডিশ প্রকাশিত হয়েছিল । বিকাশ সরকারের সঙ্গে কেমন করে যোগাযোগ হলো ?

    মলয় : হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে আর গিন্সবার্গ পাটনায় এসেছিলেন ১৯৬৩ সালে । উত্তরবঙ্গে যখন হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হলো তখন থেকেই বিকাশের সঙ্গে আমার যোগাযোগ। বিকাশ বেশ কয়েকটা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা প্রকাশ করেছিলেন । ‘থাবা’, ‘বিচিত্রবিশ্ব’, ‘জনপদ সমাচার’, ‘সময়প্রবাহ’, তারপর যুগশঙ্খতে যোগ দিতে ২০০৪ সালে চলে গেলেন গুয়াহাটি । ২০১৫ সাল থেকে কলকাতায় আছেন । ‘বিচিত্রবিশ্ব’ পত্রিকায় আমার বহু কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ; যুগশঙ্খতেও প্রকাশিত হয়েছে । প্রকাশ কর্মকার যখন এলাহাবাদে ছিলেন আর আমি ছিলুম লখনউতে তখন আমরা দুজনে মিলে একটা বুলেটিন বের করতুম । তাতে থাকতো প্রকাশ কর্মকারের ড্রইঙ আর আমার কবিতা । এগুলো বিকাশ রিপ্রিন্ট করেছিল ‘বিচিত্রবিশ্ব’ পত্রিকায়, সব হারিয়ে ফেলেছি । লেখাকর্মী পত্রিকার ওই কপিটা গিন্সবার্গের সংগ্রহশালার কিউরেটার বিল মর্গান এসে নিয়ে গিয়েছিলেন ।

    গোবিন্দ : উত্তরবঙ্গের হাংরি আন্দোলনে বিকাশ সরকার ছিলেন ?

    মলয় : হ্যাঁ, ছিল বলেই তো যোগাযোগ হয়েছিল । তখন উত্তরবঙ্গ থেকে বেশ কয়েকটা হাংরি পত্রিকা প্রকাশিত হতো । অনুভব সরকারের ‘টার্মিনাস’, জীবতোষ দাশের ‘রোবোট’, সুব্রত রায়ের ‘হাংরি ২১০০’, মনোজ রাউতের ‘ধৃতরাষ্ট্র’, রাজা সরকারের ‘কুরুক্ষেত্র’, অলোক গোস্বামীর ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’, অরুণেশ ঘোষের ‘জিরাফ’ ইত্যাদি । ওরা বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল । শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ মিলে ওদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করে ভণ্ডুল করে দিয়েছিল। উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন নিয়ে আলোচনার সময়ে বিকাশকে কেন বাদ দেয়া হয়, জানি না। অলোক গোস্বামীর ‘মেমারি লোকাল’ স্মৃতিকথাতেও বিকাশ সরকারের কোনও উল্লেখ নেই । অবশ্য সাধারণ পাঠকরা তো আমার নাম শোনেনি, বই পড়েনি । কীই বা বলি । সম্প্রতি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর দুটো কবিতা পোস্ট করেছিলুম ; দেখলুম ওনার মতো প্রতিভাবান কবির নাম শোনেনি অনেকে । 

    গোবিন্দ : ফেসবুকে সুতীর্থ দাশ-এর মতন পাঠকও আছেন, জানি না এপারের না ওপারের । উনি লিখেছেন, “স্বীকার করছি পড়ি নি, কারণ মলয় রায়চৌধুরী সুনীল-সমরেশ – শীর্ষেন্দু” দের মতো জনপ্রিয় নন, বা পুজোসংখ্যা, আলোচনাসভা, পত্রিকার সাহিত্যপাতার প্রথমে নাম থাকে না। আমার কথাই বলছি – আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হয়েও অনার্স পাশ করার পরেও জানতাম না মলয় রায় চৌধুরী কে, বা হাংরি আন্দোলন কী ? সত্যি বলতে আপনার নাম প্রথম শুনেছি ” বাইশে শ্রাবণ” চলচ্চিত্রে। তারপর ” আধুনিক কবিতার ইতিহাস ” বইয়ের শেষে বর্ণানুক্রমিক সূচী খুঁজে আধ পৃষ্টা লেখা পেয়েছি মলয় রায় চৌধুরী সম্বন্ধে। এই দশার কারণ- আমাদের চিনিয়ে দেয়া হয় না, আমরা কাগজ পড়ে যাদের বড় বড় ছাপানো ছবি দেখি তাদেরই চিনি। আমরা পাঠ্যসূচির তালিকাভুক্ত লেখকদের গল্প কবিতা উপন্যাস অপন্যাসই গিলি। আমাদের শিক্ষকগণ সিলেবাসের লক্ষণরেখা অতিক্রম করে বাইরে যান না, কোনো প্রশ্ন করলে রেগে ওঠেন। রাত পোহালে এম এ পরীক্ষা দিচ্ছি । আমাদের অনেকের বাড়িতে বাংলা অভিধান পর্যন্ত নেই, মলয় রায় চৌধুরী নামটা আমাদের কানে পৌঁছানোর আগেই আমরা হয়তো বিদ্যালয়মহাবিদ্যালয়ে হাজিরা খাতা বগলদাবা করে সাহিত্য পড়াতে যাবো। এটা শপিংমলের যুগ, যেটা সাজানো থাকে সেটাই আমাদের চোখে পড়ে…ক্ষমা করবেন…আমরা আপনাকে চিনতে পারি নি, আরো এক শতাব্দী পেরোলে চিনতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে….

    মলয় : এটা পড়েছিলুম । আমারই একটা পোস্টে ইনি এই মন্তব্য করেছিলেন । আমি লিখেছিলুম, “৫০০০ ফেসবুক বন্ধু । ১০০ জনের মতন কেবল আমার একটা-দুটো বই পড়েছেন । ৪৯০০ জনকে “আমার কোন বই পড়েছেন” জানতে চাইলে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ ছাড়া আর কিছু বলতে পারেন না ।”

    গোবিন্দ:  শান্তনু বেজ নামে একজন লিখেছেন, “মলয়দা, জানেন আজ অধিকাংশ মিথোস্ক্রিয়া অভ্যাস করে। কেউ আর স্বভোজী নয়। অনেকেই আপনার হাতটা চাইছে তাদের চুলকানি পিঠে আসুক। অনেকেই আপনার উপস্থিতি চাইছে তাদের ইনবক্সে। কি দারুন ভাবে চাওয়া হচ্ছে, একজন অসুস্থ আশির মানুষের কাছ থেকে উৎসাহের “ৎ” টুকু। আমরা যারা, লিখি সবাই আর নির্মোহ নেই। আমরা আজ সবাই সঙ্ঘদোষ চাইছি। সঙ্গদোষ নয়। তাই, তুমি আমার না পড়লে, আমি পগাড় পার। জানি তুমি আমারও কিছু লেখা পড়োনি। আর লিখেছি যা তাতে একটা বাজারের চালান কোনমতে ভরপুর হতে পারে। আর আমিও তোমার গল্প সংগ্রহ, নেক্রপুরুষ এবং মধ্যবর্তীর ধারাবাহিক লেখা ছাড়া বিশেষ কিছুই পড়িনি। কিন্তু, একটা রাস্তা রাস্তা মনে হয়েছে। …. আমি বিশ্বাস করি যে কবি উৎসাহ শব্দে অনুঘটক খুঁজে কবিতা বা তার কাজকর্ম করে, তার বাঁদরের মই সংক্রান্ত অঙ্কটি খুব প্রিয় …একটা কবির শুধু মাত্র একলা হয়ে যাওয়া দরকার, এটাই আমি শিখেছি একজন অগ্রজ কবির কাছ থেকে। আর এটাই আমার শ্রেষ্ঠ ঐ “ৎ ” বলে মনে করি।আমি আপনাকে বিশেষ পড়িনি। কিন্তু, পড়বো। আর, আমি মাচা এবং খাঁচা এই দুটি শব্দকে ঘেন্না করি …ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন মলয়দা।”

    মলয় : হোসেন মোতাহার নামে একজন বেশ ইনটারেস্টিং কথা লিখেছেন, “মীজানুর রহমান চৌধুরীর ত্রৈমাসিক পত্রিকা দিয়া আপনার লেখার লগে পরিচয় আমার। হাংরির কিংবদন্তী পুরুষ আপনে। প্রচণ্ড আলোড়িত হৈসিলাম।প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানের পোঁদে লাত্থি দেওনের সাহস আপনের থিক্যা পাইসিলাম। তথাকথিত বামেরে চিনসি আপনেরে দিয়া। উৎপলদত্ত আপনেগরে হাংড়ি বইল্যা টিটকারি মার্সিল। সুনীল্যা আপনেরে পদ্মাপাড়ের রক্তের গরম দেখাইসিল। দমেন নাই।এখুনে এই ফিড়িং ফিড়িং ফকিন্নি ফেসবন্দুর কাছ থিকা কী ঘোড়ারডিম আশা করেন ! যন্ত্র চালাইবো না বই পড়বো?” গোবিন্দ, তুমি জানো কি না জানি না, মীজানুর রহমান আমার “নামগন্ধ” উপন্যাস প্রকাশ করেছিলেন । কলকাতায় আমার বাসায় এসে বলেছিলেন যে কোনো পত্রিকাই বইটা আলোচনা করতে চায় না । “হাংরি কিংবদন্তি” বই করে বের করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সুনীলরা শামসুর রাহমানের মাধ্যমে চাপ দিয়ে প্রকাশ করতে দেননি ।

    গোবিন্দ : আপনার বিরোধিতার জন্যই  পঞ্চাশের কবিরা বিরোধ করেছিলেন, নাকি ?

    মলয় : সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আর উৎপলকুমার বসু যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তা ঠিক আমার বিরুদ্ধে নয় । পড়ে দেখতে পারো।

    গোবিন্দ : বাই দ্য ওয়ে, সন্দীপন তাঁর সাক্ষ্যে কবিতাটি সম্পর্কে বলেছিলেন – “পড়ে মনে হয়, একজন যুবকের স্বীকৃতি। তার আইডেনটিটি আবিষ্কারের চেষ্টা। সে জানতে চাইছে সে কে। এটা একটা নতুন ধরণের সাহিত্য প্রচেষ্টা, একটা এক্সপিরিমেন্ট। এরকম সাহিত্য-প্রচেষ্টা বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষের জন্য দরকার। এরকম ৯৯৯টা লেখা হওয়ার পর হয়তো একজন জিনিয়াস জন্মাতে পারে। সাহিত্যের জন্য এক্সপিরিমেন্ট খুবই দরকার।

    প্রসিকিউটর :আপনি কি লেখাটাকে ইম্‌মরাল বলেন?

    সন্দীপন : আমি মনে করি সাহিত্যে সে সব প্রযোজ্য নয়।

    প্রসিকিউটর  : এটা পড়ে আপনার মনে কোনো ডিপ্রেভিং এফেক্ট হয়েছিল কি?

    সন্দীপন : না, সেসব হয়নি।

    বিচারক অমল মিত্র – ডু ইউ কনসিডার দি অ্যাকিউসড পোয়েট এ পায়োনিয়ার ইন দিস ফিল্ড?

    সন্দীপন : আমি যেটা বলতে চেয়েছি তা হল এই কবিতাটি নতুন। এটা সার্থক বা ভালো কবিতা কিনা জানি না। সাহিত্যে নতুন-নতুন এক্সপিরিমেন্ট দরকার। সেই হিসেবে কবিতাটি ঠিক দরকার ছিল।

    উৎপলকুমার বসুর প্রসঙ্গে আসি। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয়, ‘এটা পড়ে আপনার কী ইমপ্রেশান হয়েছিল’, 

    উৎপল বলেন – এটা আমার সম্পূর্ণ নতুন ধরণের কবিতা মনে হয়েছিল। এক্সপিরিমেন্টাল। তাছাড়া এটা অ্যাংগুইশড ও অ্যাংরি লেখা। হাংরি লেখা।

    প্রসিকিউটর : অ্যাংরি? অ্যাংগুইশড?

    উৎপল : উত্তেজনা ধরে রাখার কবিতা। যেন একটা নাগরিক টেনশন। টেনশনের মাঝে লেখা। … কবির এক বিশেষ মানসিক অবস্থা চিত্রিত করার জন্য সেই অ্যাংগুইশড অবস্থার কবিতা। কবিতাটা একটা সেন্স ওব এগজিসটেনশিয়াল ডিসগাস্ট ক্যারি করে।

    প্রসিকিউটর : এটা কি আপনার ডিবচিং মনে নয়?

    উৎপল : না। সেরকম কিছু নয়। ডিসগাস্ট ক্যারিইং।

    ম্যাজিস্ট্রেট :’ডিসগাস্টটা আসছে কোত্থেকে? তা কি সামাজিক। না কবির নিজের’ ? 

    উৎপল : তা জানিনা। কবি তো সমাজেরই মানুষ। তবে যেমন-যেমন কবিতাটা এগিয়েছে, কবির ব্যক্তিগত ডিসগাস্ট এসে পড়েছে। কবিতাটা সফল।

    মলয় : এখান তরুণতম প্রজন্ম আমার বইপত্র পড়ছে । কলকাতার কবি সুনন্দা চক্রবর্তী অবশ্য বলেছেন, “এ কবিতাটা আমি আজ ইস্তক যতবার পড়েছি, ততবার ভিন্ন উপলব্ধি হয়েছে।” ইনটারনেটে তরুণ সান্যালের একটা চিঠি আছে, আমাকে লেখা, তাতে উনি এই কবিতার একটা আইনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, সেটা এরকম, “আপনার ডিফেন্সে মূল প্রশ্ন হওয়া উচিত : ১ ) আধুনিক জীবনে ব্যক্তিত্বের খণ্ডীকরণ মাতৃগর্ভে প্রত্যাবর্তনের তৃষ্ণা জাগরুক করতে পারে, সাক্ষ্য হিসেবে ভুরি-ভুরি সমাজতাত্বিকের রচনা কোট করা যায় । যেমন সাহিত্য ও সময়ের দ্বন্দ্বে ব্যক্তিমানুষের মনঃরূপায়ণ ফ্র্যাগমেন্টেশন অফ পার্সোনালিটি ইত্যাদি, এবং সামাজিক এলিয়েনেশন। ক) অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের বিপুল বিস্তার ; খ ) সামাজিক পরিবর্তনের অতি দ্রুতগতি এবং ; গ ) ক্ষমতার মুখোমুখি অসহায়তা — ব্যক্তিকে সত্যই চূর্ন করছে । এসট্রেঞ্জ করছে, স্ট্রেনজার করছে । আপনার রচনাকে আমি সবরকম ওই এসট্রেনজমেন্টের রূপায়ণ বলে দেখতে ভালোবাসি । শুভা হল যেন পিতামহকথনের সত্যযুগ, গোলডেন এজ — আধুনিক সাইকোঅ্যানালিস্টের কাছে নিশ্চিন্তিবোধের সিমবায়োটিক রমণী । এদিকে অ্যাপ্রোচ করা ভালো — এতে আমাদের দেশে আইন-আদালতে একটা উদাহরণও স্হাপন করা যায় । ২ ) অশ্লীলতার সংজ্ঞা এবং অশ্লীলতা সম্পর্কিত বাংলা রচনায় কীভাবে এবং কোথায় দেখা যাচ্ছে তার উদাহরণসহ ডিফেন্সে এসট্যাবলিশমেন্টের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানো যায় । ৩ ) আপনাদের রচনা সাহিত্যকর্মীদের মধ্যেই একমাত্র বিতরণ হয় বলে স্বীকৃত ।”

    গোবিন্দ : শুনেছি অধ্যাপকরা এই কবিতা নিয়ে এমফিল ও পিএইচডি প্রস্তাব সহজে অনুমোদন করেন না । তার কারণ আপনাদের বইপত্র সহজে পাওয়া যায় না এবং আলোচনাও বিরল । গবেষণা করতে হলে গাইড চাই তো ?

    মলয় : তরুণরাই এখন গাইড । যেমন সুকান্ত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক শুভশ্রী দাস, আমার লেখায় জাদুবাস্তবতা নিয়ে গবেষণা করছেন । শিউলি বসাক করছেন । রূপসা দাশ করেছেন । বিষ্ণুচন্দ্র দে আর উমাশঙ্কর বর্মা অলরেডি পিএইচডি করেছেন ।

    গোবিন্দ  : পশ্চিমবাংলার কবি তৈমুর খান বলেছেন, “ বাংলা কবিতার হাতেখড়ি থেকেই বাংলা সাহিত্যে একটা গর্জন শুনেছিলাম, সেই গর্জনের নাম মলয় রায়চৌধুরী (জন্ম ২৯ অক্টোবর ১৯৩৯)। ১৯৯১ সালে একবার বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতায় এসে বাঁশদ্রোণীতে কলিম খানসহ এই চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়ের (সমীর ও মলয় রায়চৌধুরীর) সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেদিন অনেকগুলো বইপত্রও আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ভারী ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে সেই গর্জনগুচ্ছের কাছে নিজেকে বসিয়েছিলামও। অনেকদিন কেটে গেল। অনেক জলও গড়াল। অনেক নির্ঘুম রাতে অনুভব করি —“চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেআমি আর পার্ছি না, অজস্র কাচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে”(প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার)কবিতার “আমি” আমার আমিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। যে পর্যাপ্ত আদিমতা নিয়ে, অস্থিরতা নিয়ে, শূন্যতা ও যৌনতা নিয়ে আমি জেগে উঠতে চেয়েছি, এই কবিতা যেন তারই মূলে তরঙ্গাঘাত করে ঠেলে দিয়েছে আমাকে। পোস্ট মডার্ন কখনোই বুঝতে চাইনি। তার ব্যাকরণও আমার দরকার হয়নি। শুধু এক মুক্তির পক্ষতাড়না শিল্প ও জীবনাচারকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কী উল্লাস, কী আত্মক্ষরণ, কী অভিব্যক্তির মোক্ষম বিস্ময় যা আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। এক আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আমার ঘুম ও জাগরণ, আমার প্রেম ও যৌনাকাঙ্ক্ষা, আমার পূর্ব ও উত্তরজন্মের মহানির্বাণ ব্যাপ্ত হয়ে ওঠে।“শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও”না, শুভার কাছে শুধু শান্তি চেয়েই জীবনের সমূহ প্রয়াসকে পরিচালনা করা যায় না। তরুণ গড়ুরের ক্ষুধাকে নিবৃত্তি দেওয়া যায় না। দেহবাদের চরম সীমানা পেরিয়ে গেলেও শব্দহীন কিছু কঁকানি আর মৃত্যুর সদর্থক চৈতন্যও খেলা করে। অসাম্ভাব্যতার ভেতর নিরর্থক জৈবক্রিয়ার সঞ্চারী বিন্যাস আত্মনিবিষ্ট সান্নিধ্যকেই ইংগিত করে। তাই শেষ পর্যন্ত “ন্যাংটো মলয়কে” দেখতে পাই। “মলয়” আমাদেরই অভিন্ন সত্তার ব্যাপ্তি।ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, কবি, অনুবাদক, সাংবাদিক এবং হাংরিয়ালিজম্ ও পোস্ট মডার্নিজম্ এর রূপকার মলয় রায়চৌধুরীকে এক বহুমুখী উত্থান ও জীবনপর্যটক বলেই মনে হয়েছে আমার। পরিবর্তনশীল জগতের প্রবহমান অস্তিত্ব নিয়ে তিনি ঝংকৃত ও পরিব্যাপ্ত। শুধু কুশলী শিল্পী হিসেবে নয়, শিল্প ভাঙার শিল্পী হিসেবেও। তিনি কখনোই নিয়ন্ত্রিত ও সীমায়িত হতে চাননি। সামাজিক হয়েও সমাজমননের অভ্যন্তরে বিরাজ করেন। শরীরবৃত্তীয় পর্যায়গুলি সক্ষমতার সঙ্গে লালন করেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর লেখায় ফিরে আসে মগ্নচৈতন্যের অবধারিত ক্রিয়াকলাপ। প্রজ্ঞানাচারী বৈভাষিক মিথলজি । প্রথম কাব্যগ্রন্থ “শয়তানের মুখ” জলবিভাজিকার ক্রমিক বিন্যস্ত থেকে উঠে আসে সত্তার বহুমুখীন পর্যায়। ঐতিহ্যকে ভেঙে ঐতিহ্য গড়া, আবার তাকে অস্বীকার, ক্রমবর্ধমান এই প্রবাহ থেকেই তাঁর লক্ষ্যহীন লক্ষ্য। অনুবাদের ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন — উইলিয়াম ব্লেক, জাঁ ককতো, সালভাদোর দালি, পল গঁগা, ব্লাইজি সঁদরা, ত্রিস্তান জারা, অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, পাবলো নেরুদা এবং ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা। প্রতিটিতেই স্বকীয়তার ছাপ স্পষ্ট ।তবু নিজের কাজের জন্য তিনি প্রশংসা, পুরস্কার কিছুই গ্রহণ করেননি। সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি জানেন সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা। এই মাহাত্ম্য তাঁকে আরও সুউচ্চতা দান করেছে।মলয় রায়চৌধুরী আমাদের যে আবহাওয়ায়, যে মৃত্যুতে, যে বেঁচে ওঠার মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে আছেন, তার প্রতিটি বোধেই আমরা আজ তাঁকে উপলব্ধি করতে পারি।”নন্দিতা দেবসিংহ নামে এক তরুণী জানিয়েছেন যে এই কবিতা পড়ে ওনার বাবা ওনার নাম রেখেচিলেন নন্দিতা, বক্তব্যের সত্যিমিথ্যা জানি না, তবে এরকম প্রতিক্রিয়াও বর্তমান সময়ের তরুণীদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ।

    মলয় : সত্তর দশকের কবি দেবযানী বসু এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “’প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কাব্যের জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে পোরা হয়েছিল। তিনি অশ্লীলতার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।যুগের সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই কাব্যের অশ্লীলতা এখন আর অশ্লীল নেই। প্রকট যৌনতায় কবিতার রহস্যময়তা মার খায়। রহস্যময়তা বজায় রাখার দাবি মিটিয়ে অশ্লীলতা আনা খুব সহজ কাজ নয়।”

    গোবিন্দ : সত্তরের পর থেকে আপনি একটা উচ্চতা পেয়েছেন । কেন জানেন ? বাংলাদেশ সৃষ্টি এবং রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাভাষার প্রতিষ্ঠা । বাংলাদেশে টাইপরাইটার বর্জন করে কমপিউটার চালু করেছিল, বাংলা ফন্টও বাংলাদেশের আবিষ্কার । এখন তো অভ্র না হলে লেখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় । পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট কমপিউটার ঢুকতে দেয়নি । এই ব্যাপারে ভারতে বাঙালিরা পিছিয়ে পড়েছে।

    মলয় : হ্যাঁ । মোইন রিয়াদ নামে উইকিপেডিয়ার জনৈক বাংলাদেশি সম্পাদক উইকিতে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নামে একটা আলাদা পেজ খুলে দিয়েছেন ।

    গোবিন্দ : আপনারা বেনারস আর কাঠমাণ্ডুতে হিপি-হিপিনীসঙ্গ করেছিলেন শুনেছি । গাঁজা, চরস, হ্যাশিশ, আফিম, মেসকালিন, এলএসডি ইত্যাদি টেনে নেশা করার সুযোগ হয়েছিল ।

    মলয় : আমার ইরটিক উপন্যাস ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ পড়লে তোমার আইডিয়া হবে। হিপি-হিপিনীরা আসতো হিচহাইক করে যাকে ওরা বলতো হিপি ট্রেইল । আমেরিকা থেকে অ্যামস্টারডমে গিয়ে, ইউরোপের দেশগুলো হয়ে তুর্কি, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ভারতের বেনারস । তারপর বেনারস থেকে কাঠমাণ্ডু । আফগানিস্তান থেকে আনতো আফিম- চরস আর পাকিস্তান থেকে গাঁজাফুলের গুঁড়ো যাকে ওখানে বলতো গর্দা । এলএসডি আনতো ক্যাপসুলে আর ব্লটিঙপেপারে ভিজিয়ে । আশির দশকে আমেরিকার চাপে সব দেশে মাদক নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, যদিও এখন খোদ আমেরিকাতেই নানা রকমের গাঁজার দোকান হয়েছে। সেদিন প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় ফোন করে বলছিল যে যৌবনে এলোমেলো জীবন কাটিয়েছিলুম বলে এখন আমায় নানা রোগে ভুগতে হচ্ছে ।

    গোবিন্দ : কলকাতায় কবিদের কাছে খালাসিটোলার এতো নামডাক । আপনি যেতেন ? 

    মলয় : ওখানেও প্রথমবার গেছি সেন্টুদার সঙ্গে । পরে লেখক বন্ধুদের সঙ্গে । অবনী ধর একটা টেবিলে উঠে জীবনানন্দের জন্মদিনে নেচেছিল, সেটা ‘অমৃত’ পত্রিকায় আর ‘দি স্টেটসম্যান’ সংবাদপত্রে খবর হয়েছিল । ক্লিন্টন বি সিলি ওনার জীবনানন্দ বিষয়ক ‘এ পোয়েট অ্যাপার্ট’ বইতে ঘটনাটার উল্লেখ করেছেন । তখনকার দিনে খালাসিটোলার বাইরে গাঁজা-চরস-আফিমের একটা সরকারি দোকান ছিল ; সেখান থেকে একটা পুরিয়া কিনে এগোতেই কমলকুমার মজুমদারের সামনাসামনি হই ; টাকার টানাটানি আর মামলার খরচ জানতে পেরে উনি আমাকে একটা একশো টাকার নোট দিয়েছিলেন। সুভাষ ঘোষ অবশ্য খালাসিটোলার বদলে পছন্দ করতো সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে ‘অম্বর’ বার । 

    গোবিন্দ : আপনি জীবনী লিখেছেন বা জীবন ও শিল্প বিশ্লেষণ করেছেন এবং অনুবাদ করেছেন  বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো, অ্যালেন গিন্সবার্গ, পল ভেরলেন, সালভাদোর দালি, পল গঁগা, জাঁ জেনে, মায়াকভস্কি, জীবনানন্দ দাশ, নজরুল ইসলাম, দস্তয়েভস্কি, জাঁ-লুক গোদার প্রমুখের । মনে হয় আপনি যেন এঁদের প্রতি আকৃষ্ট,  আপনার জীবন ও চরিত্র ও লেখালিখির সঙ্গে এনাদের মিল আছে বলে ? তা কি স্বীকার করেন ?

    মলয় : এটা ঠিক যে এনারা আমাকে আকর্ষণ করেছেন । বোদলেয়ারের আর জীবনানন্দের মতন আমিও একজন পথচর, যদিও করোনা ভাইরাসের কারণে আর বয়সের দরুণ আজকাল আর বেরোই না, কিন্তু আমি জেমস জয়েস, মার্সেল প্রুস্ত, হেনরি মিলার, হুলিও কোর্তাজার, ফুয়েন্তেস, শিবনারায়ণ রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, আনা আখমাতোভা, ওসিপ ম্যানডেলস্টাম, পিকাসো, মার্কেজ, সিলভিয়া প্লাথ,মালার্মে, পাবলো নেরুদা, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, ফালগুনী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ প্রমুখকে নিয়েও লিখেছি ; এমনকী আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান গল্পকার  হায়মেওস্ট স্টর্মকে নিয়েও লিখেছি। শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পর্কে আমার প্রবন্ধে কিন্তু গালমন্দ করিনি, যেমনটা উনি আমাকে প্রাণ ভরে দিয়ে গেছেন । 

    গোবিন্দ : শৈলেশ্বর ঘোষ যে হাংরি রচনা সংকলিত করেছেন তা থেকে আপনি, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, আলো মিত্র, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই পমুখদের বাদ দিয়েছেন, উত্তরবঙ্গের হাংরি আন্দোলনকারীরাও বাদ গেছেন। আপনিও নাকি ওনাদের বাদ দিয়েছেন ?

    মলয় : না, আমি কাউকে আমার সম্পাদিত সংকলন থেকে বাদ দিইনি । বস্তুত হাংরি বুলেটিন আর জেব্রা পত্রিকা ছাড়া আমি কোনও হাংরি সংকলন সম্পাদনা করিনি । আসলে শৈলেশ্বর-সুভাষ আমার মামলায় রাজসাক্ষী হবার দরুন অপরাধবোধে ভুগতেন, এটা কমন ক্রিমিনাল সাইকোলজি।

    গোবিন্দ : বাঙালি মহিলা কবিদের প্রতি আপনার পক্ষপাত দেখা যায় । আপনি যশোধরা রায়চৌধুরী, সোনালী চক্রবর্তী, বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায়, সোনালী মিত্র, জয়িতা ভট্টাচার্য, মিতুল দত্ত, শ্রীদর্শিনী মুখোপাধ্যায়, আসমা অধরা, মুনীরা চৌধুরী প্রমুখের নাম উল্লেখ করেন, কয়েকজনের বইয়ের ভূমিকাও লিখেছেন । তরুণ পুরুষ কবিদের নিয়ে আপনি আশাবাদী নিশ্চয়ই। কিন্তু পিঠ চাপড়ানোর একটা রেওয়াজ চলছে। এতে সাহিত্যের লাভক্ষতি কি তেমন হচ্ছে? 

    মলয় : পিঠ চাপড়ানি তো ভালোই । আমার মামলার সময়ে পিঠচাপড়ানি পেলে কাজে দিতো । তার বদলে আমি পেয়েছিলুম কেবল টিটকিরি, আক্রমণ, বিদ্বেষ । সংবাদপত্রগুলো যা ইচ্ছে তা-ই লিখতো। বুদ্ধদেব বসু আমার নাম শুনেই আমাকে ওনার দরোজা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন । আবু সয়ীদ আইয়ুব আমার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা চিঠি লিখেছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গকে । এমনকী বন্ধুরাও আমাকে অপছন্দ করতো । শৈলেশ্বর ঘোষ মারা যাবার পর ওর শিষ্যরা আমার বিরুদ্ধে লিখে চলেছে । ঢাকায় একটা বই বেরিয়েছে কবি প্রকাশনী থেকে, তাতে মোস্তাফিজ কারিগর আর  সৌম্য সরকার নামে দুজন আমাকে আক্রমণ করেছেন, আমার বইপত্র না পড়েই । তরুণরা তো নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, নতুন ভাবনা নতুন আঙ্গিক আনার প্রয়াস করছে,  যদিও বয়সের কারণে আমি এখন আর অতো পড়ার অবসর পাই না । আমার পছন্দ হলে আমি প্রশংসা করি ; তা অন্যের পছন্দ নাও হতে পারে। মুনীরা চৌধুরীর কবিতা পড়েছ ? অসাধারণ প্রতিমাভাঙনের কাজ আছে ওনার কবিতায় — সুইসাইড করেছিলেন জলে ডুবে ।

    গোবিন্দ :প্রায় সকল প্রকাশক, লেখক যখন পাঠক-শূন্যতা টের পান তখন কেউ কেউ একেকটি মেলায় কোনও কোনও বইয়ের দ্বিতীয় তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ হওয়ার বিজ্ঞাপন দেন। এটা তাহলে পাঠকশূন্যতা নয় ? নাকি অন্য কোন যাদুবলে একজন লেখক পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠেন? কিংবা একজন প্রকাশক পাঠকের চাহিদা সত্যি সত্যি অগ্রীম ধরে নিতে পারেন? 

    মলয় : অনেকের বই বিজ্ঞাপনের জোরে বিক্রি হয়, অনেকের বই পাঠকের মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে । অনেকের বই আবার সাংস্কৃতিক রাজনীতির কারণে বিক্রি হয় না । প্রকাশককে হুমকি দেয়ায় অনেকের বই আটকে যায়।  পাঠকের অভাব আছে বলে আমার মনে হয় না । যাঁরা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনা থেকে বই প্রকাশ করেন তাঁদের অসুবিধা হলো কলেজ স্ট্রিটে বিক্রির ব্যবস্হা না থাকা । যাঁরা কলকাতার বাইরে থাকেন তাঁদের তো একেবারে সুযোগ-সুবিধা নেই । তবু তাঁদের প্রকাশ করা বইয়েরও পাঠক আছে । দাদা ‘হাওয়া৪৯’ পত্রিকা প্রকাশ করার সময়ে যে বইগুলো বের করেছিল সেগুলোর ভালোই চাহিদা ছিল । এখন ‘হাওয়া৪৯’ সম্পাদনা করে মুর্শিদ । ও আবিষ্কার প্রকাশনী খুলেছে, ওর বের করা বইগুলো ভালোই বিক্রি হয়, ও বিভিন্ন মেলাতেও অংশ নেয় । 

    গোবিন্দ :  পারিবারিক কোনও স্মৃতি?

    মলয় : আমাদের বসতবাড়ি ছিল হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় । আমরা সাবর্ণ রায়চৌধুরী বলে বাড়ির নাম ছিল সাবর্ণ ভিলা, তিনশো বছরের পুরোনো বাড়ি । অবশ্য আদি নিবাস বলতে হলে লক্ষীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা বলতে হয়, যিনি যশোরে মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য ছিলেন, মোগলদের কাছ থেকে রায়চৌধুরী উপাধি আর কলকাতার জায়গিরদারি পেয়ে চলে আসেন । সাবর্ণ ভিলা হয়ে গিয়েছিল খণ্ডহর । আমার খুড়তুতো বোন পুটিকে ওর বাবা প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে অনুমোদন না করার দরুন পুটি সবচেয়ে বড়ো ঘরের কড়িকাঠ থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করে নিয়েছিল । আর তার পরদিনই ঘরটা  ওপরের স্ট্রাকচারসহ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। বস্তুত ব্যাপারটা ছিল যেন সাবর্ণ ভিলার আত্মহত্যা । পুটির আত্মহত্যা আমি ভুলতে পারিনি । এক্ষুনি তোমাকে পিসেমশায়ের কথা বলছিলুম, উনিও মাঝরাতে আহিরিটোলার বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন ; ওনার পকেটের চিরকুটে লেখা ছিল ‘আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে’ । বিশাল বাড়িটা ভাঙাচোরা অবস্হায় থাকার দরুণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে  দাদার বন্ধুদের পরামর্শে কয়েকজন শিক্ষার্থী মুক্তিযোদ্ধাকে ঠাঁই দিতে সুবিধা হয়েছিল । 

    গোবিন্দ : আপনার কলেজ জীবনের গল্প বলুন? তখনকার বিশেষ স্মৃতি? 

    মলয় : আমি পড়তুম পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে । আইএ পড়ার সময়ে যোগ দিয়েছিলুম ন্যাশানাল ক্যাডেট কোর-এ, বন্দুক-পিস্তল চালানো আর নানা জায়গা দেখার লোভে । থ্রিনটথ্রি আর বাইশ বোরের রাইফেল চালিয়েছি । তখনকার পিস্তলগুলো বেশ ভারি হতো । থ্রিনটথ্রিতে প্রতিবার বুলেট ভরতে হতো, এখন কালাশনিকভ থেকে বুলেট বেরোয় চেপে রাখা পেচ্ছাপের মতন । ওই সময়েই আমার বন্ধু তরুণ শুরের মামার ট্রাকে করে নানা জায়গায় গেছি, যেখানে ট্রাকগুলো মাল নিয়ে যেতো । আমরা বসতুম ড্রাইভারের পাশে আর শুতুম ড্রাইভারের পেছনের বেঞ্চে । ওরা চালাতো রাতের বেলায় আর ঘুমোতো দিনের বেলায় । রুটে কোথায় কোথায় গ্রামের বউরা টাকা কামাবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে তা ওরা জানতো, আর নেমে, তেরপল বিছিয়ে শট মেরে আসতো । বউগুলো বেশ্যা নয়, বাড়ির বউ ; কম বয়সী মেয়েরাও থাকতো । দেদার কান্ট্রি লিকার আর তন্দুরি মুর্গি খেতো, আমরাও খেতুম ওদের সঙ্গে । পুলিশ আর অকট্রয় কর্মীদের ঘুষ নেয়া দেখতুম । তরুণের মামা আলাদা করে ঘুষের টাকা দিয়ে দিতেন ড্রাইভারদের । 

    গোবিন্দ :পরিবারের কেউ মুক্তিযুদ্ধের সাথে কোনভাবে যুক্ত ছিলেন? 

    মলয় : পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা কবি-লেখকদের আশ্রয় দেয়া আর লুকিয়ে রাখাকে যদি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যোগাযোগ মনে করো, তাহলে ছিল ।

    গোবিন্দ : আপনার গল্প উপন্যাসে দেশভাগ,মুক্তিযুদ্ধ কিরকম এসেছে? 

    মলয় : দেশভাগ এসেছে আমার কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে । ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে পাবে দেশভাগে চলে আসার পর একজন বামপন্হীর দ্রোহ আর শেষ পর্যন্ত তার পরিবর্তন । ‘ঔরস’ উপন্যাসে পাবে ১৯৭১-এর বীরাঙ্গনা আর সন্তানকে কেমনভাবে আশ্রয় দিয়েছিলেন, বিয়ে করেছিলেন এক স্কুল শিক্ষক । ‘নখদন্ত’ কাহিনির পোস্টমডার্ন স্ট্রাকচারে পাবে । বহু কবিতায় পাবে।

    গোবিন্দ :আপনার সাহিত্যে দেশ ভাগের প্রভাব কতটুকু? কিংবা এই বিষয়টি কেমন করে আসে? 

    মলয় : নিজস্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া আমি লিখতে পারি না, যদিও চেষ্টা করি । সেজন্য দেশভাগ যেটুকু এসেছে তা দেখে। আমি তো পূর্ববঙ্গের মানুষ নই । পঞ্চাশের দশকে শেয়ালদায় উদ্বাস্তুদের ভয়ঙ্কর অবস্হা নিজের চোখে দেখার দরুনই আমি আর দাদা আন্দোলনের কথা ভেবেছিলুম । দেশভাগে যে নিম্নবর্ণের উদ্বাস্তুরা এসেছিলেন তাঁদের সঙ্গে মিশেছি হিমালয়ের তরাইতে, মানা ক্যাম্পে, ছত্তিসগঢ় আর মধ্যপ্রদেশে, মোতিহারিতে, মহারাষ্ট্রে । এনারা এসেছেন আমার লেখায় । এখন মরিচঝাঁপি নিয়ে একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখার তোড়জোড় করছি ।

    গোবিন্দ :পরিবারের কেউ মুক্তিযুদ্ধের সাথে কোনভাবে যুক্ত ছিলেন? 

    মলয় : পরিবার বলতে তো বাবা-মা-দাদা আর আমি । কেউই সরাসরি যুক্ত ছিলুম না।

    গোবিন্দ :বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কিংবা মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিরা এত আন্তরিক কেন ছিলো? 

    উত্তর : সিমপল । বাঙালি বলে । 

    গোবিন্দ :দেশভাগের ফলে আমাদের বাংলা সাহিত্যের উপর কিরকম প্রভাব পড়ে? 

    মলয় : আমার মনে হয় সেইভাবে পড়েনি যেমনটা বিশ্বযুদ্ধ, সোভিয়েত শাসন ফেলেছে ইউরোপের লেখায় বা লাতিন আমেরিকার ইতিহাস ফেলেছে স্প্যানিশ সাহিত্যে ।

    গোবিন্দ  :বাঙালি জাতির জীবনে কাঁটাতার নিশ্চয়ই খণ্ডিত জাতিসত্তার জন্ম দিয়েছে? নাকি এর প্রভাব শুধু শিল্পসাহিত্যেই বাস্তবে কিছুই নয়?

    মলয় : বলা কঠিন । বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ক্রমশ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন, মূলত সউদি আরব, পাকিস্তান, তুর্কি ইত্যাদি দেশের প্রভাবে । এখন আফগানিস্তান একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে । এপার বাংলায় আর ত্রিপুরায় বিজেপি জিতলেও বাঙালিরা সেইভাবে হিন্দুত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি । লেখকরা অবশ্য একটা পৃথক সেকুলার মিলনক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছেন ।

    গোবিন্দ :হাংরি উত্থানের দিনগুলোর অর্জন বলুন? 

    মলয় : আমি আর কী বলব । লেখক-পাঠক হিসাবে এই বিশ্লেষণ তো তোমাদের করা দরকার।

    গোবিন্দ : তবু প্রথমটা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই ।

    মলয় : এই বিষয়ে আমার লেখা থেকে কিছুটা পড়ো । ১৯৫৯-৬০ সালে আমি দুটি লেখা নিয়ে কাজ করছিলুম । একটা হল ইতিহাসের দর্শন  যা পরে বিংশ শতাব্দী  পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।অন্যটি মার্কসবাদের উত্তরাধিকার  যা পরে গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হয়েছিল, এবং যার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।এই দুটো লেখা নিয়ে কাজ করার সময়ে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা আমার মাথায় আসে। হাংরি আন্দোলনের হাংরি শব্দটা আমি পেয়েছিলুম ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসার-এর ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম  বাক্যটি থেকে। ওই সময়ে, ১৯৬১ সালে, আমার মনে হয়েছিল যে স্বদেশী আন্দোলোনের সময়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তরঔপনিবেশিক কালখণ্ডে ।উপরোক্ত রচনা দুটির খসড়া লেখার সময়ে আমার নজরে পড়েছিল অসওয়াল্ড স্পেংলার-এর লেখা দি ডিক্লাইন অব দিওয়েস্ট  বইটি, যার মূল বক্তব্য থেকে আমি গড়ে তুলেছিলুম আন্দোলনের দার্শনিক প্রেক্ষিত। ১৯৬০ সালে আমি একুশ বছরের ছিলুম। স্পেংলার বলেছিলেন যে একটি সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়; তা হল জৈব প্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে । কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় থেকে আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তা-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন । আমার মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে ও প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় । এখানে বলা ভালো যে আমি কলকাতার আদিনিবাসী পরিবার সাবর্ণ চৌধুরীদের  বংশজ, এবং সেজন্যে বহু ব্যাপার আমার নজরে সেভাবে খোলসা হয় যা অন্যান্য লেখকদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয় ।ওই চিন্তা-ভাবনার দরুণ আমার মনে হয়েছিল যে কিঞ্চিদধিক হলেও, এমনকি যদি ডিরোজিওর পর্যায়েরও না হয়, তবু হস্তক্ষেপ দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন । আমি আমার বন্ধু দেবী রায়কে, দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে, আমার আইডিয়া ব্যাখ্যা করি, এবং প্রস্তাব দিই যে আমরা হাংরি নামের একটা আন্দোলন আরম্ভ করব । ১৯৫৯ থেকে টানা দুবছরের বেশি সে-সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় দাদার চাইবাসার বাড়িতে থাকতেন । দাদার শ্যালিকা শীলা চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমিক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্হ হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য-এর প্রেমের কবিতাগুলো শীলার প্রেমে লিখিত । দাদার চাইবাসার বাড়ি , যা বর্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্যতম শহর তখন ছিল বনাঞ্চল। দাদার চালাঘরটি ছিল নিমডি নামে সাঁওতাল-হো অধ্যুষিত গ্রামের পাহাড় টিলার ওপর, যা সে-সময়ে ছিল তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি উপন্যাসটির পটভূমি ও চরিত্র সবই চাইবাসা-কেন্দ্রিক; তাঁর সন্তু হল দাদার শ্যালক সন্তু এবং কাকাবাবু হল সন্তুর কাকাবাবু। সে যাই হোক, ১৯৬১ সালে যখন হাংরি আন্দোলনের প্রথম বুলেটিন প্রকাশিত হয় , এবং ১৯৬২ সালে বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত, আমারা ওই চার জনই ছিলুম আন্দোলনের নিউক্লিয়াস।ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের বনেদেরব ওপর, অর্থাৎ আন্দোলনগুলো ছিল টাইম স্পেসিফিক বা সময়-কেন্দ্রিক । কল্লোল গোষ্ঠি এবং কৃত্তিবাস গোষ্ঠী তাঁদের ডিসকোর্সে যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলোও ছিল কলোনোয়াল ইসথেটিক রিয়ালিটি বা ঔপনিবেশিক নন্দন-বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেননা সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্থনা নির্ভর এবং তাদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত । সময়ানুক্রমী ভাবকল্পের গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদের পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে , এবং স্হানিকতা ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে। ১৯৬১ সালের প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি আন্দোলন চেষ্টা করল সময়তাড়িত চিন্তাতন্ত্র  থেকে পৃথক পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্র  গড়ে তুলতে । সময়ানুক্রমী ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে মননসন্ত্রাস তৈরি করে, তার দরুণ প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসাবে নিরুপণ করা হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্হানাঙ্ক নির্ণবের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্বসৌধ নির্মাণ । ঠিক এই জন্যই, ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে যাচাই করলে দেখা যাবে যে, ব্যক্তি-প্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো।কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখব যে পুঁজি-বলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে সমসাময়িক শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন । এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীও সীমিত হয়ে গেছে দুতিনজন মেধাসত্বাধিকারীর নামে । পক্ষান্তরে, আমরা যদি ঔপনিবেশিক নন্দনতত্বের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবি, তাহলে দেখব যে পদাবলী সাহিত্য নামক স্পেস বা পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব বা শাক্ত কাজ; মঙ্গলকাব্য নামক ম্যাক্রো-পরিসরে  পাবো মনসা বা চণ্ডী বা শিব বা কালিকা বা শিতলা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর । লক্ষণীয় যে প্রাকঔপনিবেশিক কালখণ্ডে এই সমস্ত মাইক্রো-পরিসরগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ , তার রচয়িতারা নন । তার কারণ সৃজনশিলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বের ফসল। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিটি উপনিবেশে গিয়ে এই ফসলটির চাষ করেছে। ইতিহাসের দর্শন নিয়ে কাজ করার সময়ে আমার মনে হয়েছিল যে স্পেস বা স্হানিকতার অবদান হল পৃথিবী জুড়ে হাজার রকমের ভাষার মানুষ, হাজার রকমের উচ্চারণ ও বাকশৈলী, যখন কিনা ভাষা তৈরির ব্যাপারে মানুষ জৈবিকভাবে প্রোগ্রামড । একদিকে এই বিস্ময়কর বহুত্ব; অন্যদিকে সময়কে একটিমাত্র রেখা-বরাবর এগিয়ে যাবার ভাবকল্পনাটি, যিনি ভাবছেন সেই ব্যক্তির নির্বাচিত ইচ্ছানুযায়ী , বহু ঘটনাকে, যা অন্যত্র ঘটে গেছে বা ঘটছে, তাকে বেমালুম বাদ দেবার অনুমিত নকশা গড়ে ফ্যা।এ । বাদ দেবার এই ব্যাপারটা, আমি সে-সময়ে যতটুকু বুঝেছিলুম, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্হায়ি বন্দোবস্তের ফলে বাঙালির ডিসকোর্সটি উচ্চবর্ণের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় , যার ফলে নিম্নবর্গের যে প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্স বাঙালির সংস্কৃতিতে ছেয়ে ছিল, তা ঔপনিবেশিক আমলে লোপাট হয়ে যাওয়ায় । আমার মনে হয়েছিল যে ম্যাকলে সাহেবের চাপানো শিক্ষাপদ্ধতির কারণে বাঙালির নিজস্ব স্পেস বা পরিসরকে অবজ্ঞা করে ওই সময়ের অধিকাংশ কবিলেখক মানসিকভাবে নিজেদের শামিল করে নিয়েছিলেন ইউরোপীয় সময়-রেখাটিতে । একারণেই, তখনকার প্রাতিষ্ঠানিক সন্দর্ভের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রতিসন্দর্ভের সংঘাত আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল প্রথম বুলেটিন থেকেই, এবং তার মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রতিটি বুলেটিন প্রকাশিত হবার সাথে-সাথে, যা আমি বহু পরে জানতে পারি , কাউনসিল ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর সচিব এ বি শাহ , পি ই এন ইনডিয়া-র অধ্যক্ষ নিসিম এজেকিয়েল, এবং ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা পুপুল জয়াকার-এর কাছ থেকে। অমনধারা সংঘাত বঙ্গজীবনে ইতোপূর্বে ঘটেছিল । ইংরেজরা সময়কেন্দ্রিক মননবৃত্তি  আনার পর প্রাগাধুনিক পরিসরমূলক বা স্হানিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাঙালি ভাবুকের জীবনে ও তার পাঠবস্তুতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি আর ছটফটানি , রচনার আদল-আদরায় পরিবর্তনসহ, দেখা দিয়েছিল, যেমন ইয়ং বেঙ্গল  সদস্যদের ক্ষেত্রে ( হেনরি লুইভিভিয়ান ডিরোজিও, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ) এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও আরও অনেকের ক্ষেত্রে । একইভাবে, হাংরি আন্দোলন যখন সময়কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক চিন্তাতন্ত্র থেকে ছিঁড়ে আলাদা হয়, উত্তরঔপনিবেশিক আমলে আবার স্হানিকতার চিন্তাতন্ত্রে ফিরে যাবার চেষ্টা করেছিল, তখন আন্দোলনকারীদের জীবনে, কার্যকলাপে ও পাঠবস্তুর আদল-আদরায় অনুরূপ ঝাঁকুনি, ছটফটানি ও সমসাময়িক নন্দনকাঠামো থেকে ষ্কৃতির প্রয়াস দেখা গিয়েছিল । তা না হলে আর হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতি, ধর্ম, উদ্দেশ্য, স্বাধীনতা, দর্শনভাবনা, ছবিআঁকা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে ইস্তাহার প্রকাশ করবেন কেন ?

    গোবিন্দ : আপনি পড়েছেন কী না জানি না । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আত্মজীবনী ( ২০০২ ) “অর্ধেক জীবন” গ্রন্হে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন, “দেশে ফেরার পর বেশ কিছু বন্ধুর উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলেও বন্ধুত্বের ব্যাপারেই জীবনের প্রথম চরম আঘাতটাও পাই এই সময় । এর দু-এক দিনের মধ্যেই হাংরি জেনারেশনের সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ।  সমীর কলেজ জীবন থেকেই আমার বন্ধু, চাইবাসা-ডালটনগঞ্জে তার বাড়িতে কত দিন ও রাত কাটিয়েছি, বন্ধুকৃত্যে সে অতি উদার, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্হের প্রকাশকও সমীর । মলয়কেও চিনি তার ছোটবয়স থেকে । হাংরি জেনারেশন আন্দোলন শুরু হয় আমার অনুপস্হিতিতে ও অজ্ঞাতসারে । সেই সময়কার ইংল্যাণ্ডের অ্যাংরি ইয়াং মেন আর আমেরিকার বিট জেনারেশন, এই দুই আন্দোলনের ধারা মিলিয়ে সম্ভবত হাংরি আন্দোলনের চিন্তা দানা বেঁধেছিল, হয়তো অ্যালেন গিন্সবার্গের প্রেরণাও ছিল কিছুটা এবং মুখ্য ভূমিকা ছিল মলয়ের । যেসব বন্ধুদের সঙ্গে আমার প্রতিদিন ওঠাবসা, তারা একটা নতুন কিছু করতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ আমাকে বাদ দিয়ে ? এর কী কারণ থাকতে পারে, তা আমি কিছুই বুঝতে পারিনি । বন্ধুদের কাছে আমি অসহ্য হয়ে উঠেছি, কিংবা আমার হাতে নেতৃত্ব চলে যাওয়ার আশঙ্কা ? একটা গভীর বেদনাবোধ আমি লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম । আমার ফেরার কয়েক দিনের মধ্যেই কাকতালীয়ের মতন পুলিশ গ্রেপ্তার করে সমীর ও মলয়কে । তাতে কয়েকজন মনে করল আমিই ওদের ধরিয়ে দিয়েছি । যেন দমদমে পদার্পণ করেই আমি পুলিশ কমিশনারকে টেলিফোনে আদেশ করেছি, ওই কটাকে ধরে গারদে পুরুন তো ! পুলিশি তৎপরতার সূত্রপাতেই হাংরি জেনারেশনের প্রথম সারির নেতারা সবাই পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে জানিয়ে আসে, ভবিষ্যতে ওরা ওই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না । সমীরও ছাড়া পেয়ে যায়, মামলা হয় শুধু মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে, অশ্লীলতার অভিযোগে । সেই সময় মলয় খানিকটা একা হয়ে পড়ে । মামলা ওঠার আগে মলয় আমার বাড়িতে এসে অনুরোধ জানায় আমাকে তার পক্ষ নিয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে । আমি তৎক্ষণাত রাজি হয়ে জানিয়েছিলাম পৃথিবীর যে কোনো দেশেই সাহিত্যের ব্যাপারে পুলিশের হস্তক্ষেপের আমি বিরোধিতা করব ।”

    মলয় : না, ওনার বইটা পড়িনি । তবে ওনার বক্তব্যটা জানি । সুনীল কেমন করে ভেবেছিলেন যে আমার মতন একজন অখ্যাত পাটনাইয়া যুবক, যে আবার ওনার বন্ধুর ছোটো ভাই, তাঁকে বাদ দেবার কথা ভাববে ? আমি তো ছিলুম ফেকলু পাটনাইয়া । ওনার “সুনীলকে লেখা চিঠি” বইটা পড়ে দেখতে পারো । আমি ওনাকে নেতৃত্ব নিতে বলেছিলুম, কিন্তু উনি সাড়া দেননি । উনি এতোটাই চটে ছিলেন আমার ওপর যে দাদাকে লিখেছিলেন, “সাক্ষীর কাঠগড়ায় মলয়ের কবিতা আমাকে পুরো পড়তে দেওয়া হয় । পড়ে আমার গা রি-রি করে। এমন বাজে কবিতা যে আমাকে পযতে বাধ্য করা হল, সে জন্য আমি ক্ষুব্ধ বোধ করি — আমার সময় কম, কবিতা কম পড়ি, আমার রুচির সঙ্গে মেলে না — এমন কবিতা পড়ে আমি মাথাকে বিরক্ত করতে চাই না । মলয়ের তিন পাতা রচনায় একটা লাইনেও কবিতার চিহ্ণ নেই ।” এই চিঠিটা ইনটারনেটে বহু সাইটে আছে। সুনীল আমার ওপরে চিৎকার করে বলেছিলেন, “আমি কি শক্তির থুতু চাটবো ?”

    গোবিন্দ : ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা সম্পর্কে ?

    মলয় : হ্যাঁ । উনি বেঁচে থাকতেই টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে তরুণতম প্রজন্মের কাছে কবিতাটা আইকনিক হয়ে গেছে, পৃথিবীর নানা ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, ফিল্ম হয়েছে । হাংরি আন্দোলনের খ্যাত বা কুখ্যাতি উনি আমারিকায় থাকতে শুনেছিলেন, তাই ভাবছিলেন কলকাতায় সবই বুঝি দখল হয়ে গেল । যুগশঙ্খ পত্রিকায় বাসব রায়কে দেয়া সাক্ষাৎকারে উনি বলেছিলেন, “মলয় আমার অনুপস্হিতির সুযোগ নিয়েছিল” । আরে, আমি তো তখন অখ্যাত । ওনার উপস্হিতিতেও যা করতুম ওনার অনুপস্হিতিতেও তাই করেছি । 

    গোবিন্দ : উনি আমেরিকা থেকে আপনাকে আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন শুনেছি ।

    মলয় : হ্যাঁ । দুটো চিঠিই নেটে নানা সাইটে পাবে । ১০ই জুন ১৯৬৪ সালের চিঠিতে আয়ওয়া থেকে আমাকে যে চিঠিটা লিখেছিলেন, তার একটা প্যারা এরকম, “চালিয়ে যাও ওসব আন্দোলন কিংবা জেনারেশনের ভণ্ডামি । আমার ওসব পড়তে কিংবা দেখতে মজাই লাগে । দূর থেকে। সাহিত্যের ওপর মৌরসি পাট্টা বসাতে এক-এক দলের অত লোভ কী করে আসে, কী জানি । তবে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো । আমাকে দেখেছ নিশ্চয় শান্তশিষ্ট, ভালো মানুষ । আমি তাই-ই, যদিও গায়ে পদ্মাপাড়ের রক্ত আছে । সুতরাং তোমাদের উচিত আমাকে দূরে-দূরে রাখা, বেশি খোঁচাখুঁচি না করা । নইলে হঠাৎ উত্তেজিত হলে কী করব বলা যায় না ।”

    গোবিন্দ: উনিই তো আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্হ “শয়তানের মুখ”-এর প্রকাশক । আপনার তো কবিতা লিখে সাহিত্যে হাতেখড়ি। আড্ডার দিনগুলোর কথা শুনবো? 

    মলয়  : না, আমি প্রথমে প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করেছিলুম । আমার ধারাবাহিক গদ্য ‘ইতিহাসের দর্শন’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল । তারপর লিখি ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ । এই বিষয়গুলো নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা হতো না । দাদার বন্ধুদের সঙ্গে হতো, দীপক মজুমদার আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে । সিপিএম সরকারে আসার পর সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত রাজনীতিতে আগ্রহী হয় । সুনীল আমার প্রথম কবিতার বইয়ের প্রকাশক হলেও হাংরি আন্দোলনের পর কৃত্তিবাস পত্রিকার জন্য আমার কাছে কখনও লেখা চাননি । এমনকি দাদা সমীর রায়চৌধুরীর কাছেও কবিতা চাননি অথচ দাদা ওনার প্রথম কবিতার বই “একা এবং কয়েকজন” বইটা নিজের প্রথম মাইনের টাকায় ছেপেছিল । কৃত্তিবাস ছাপাবার খরচও দাদা দিতো, “সুনীলকে লেখা চিঠি” বইটা পড়লে জানতে পারবে । দাদা অবসর নিয়ে কলকাতায় এসে “হাওয়া৪৯” নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ আর সম্পাদনা আরম্ভ করেন ; তাতে সুনীল কোনও লেখা কখনও দেননি । সম্ভবত প্রতিটি লেখার জন্য উনি টাকা নিতেন বলে ।

    গোবিন্দ  :কি করে মনে হলো কবিতার পাশাপাশি গল্প উপন্যাসও আপনার বিষয়?

    মলয়  : না, না । উপন্যাস আর গল্প লেখা আরম্ভ করেছি বেশ দেরিতে । গল্প আশির দশকে আর উপন্যাস নব্বুই দশকে । আমার প্রথম উপন্যাস ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ । তবে আমি সব জনারের উপন্যাস লিখেছি, এমনকী ডিটেকটিভ আর ইরটিক উপন্যাসও । অভিজ্ঞতা প্রচুর জমেছিল সারা ভারত ঘোরাঘুরি করে, বন্ধুবান্ধব-বান্ধবীও ছিল, তাদের নিয়ে প্রথমে লেখার ইচ্ছে হয়েছিল। ঔপন্যাসিক বা গল্পকার হবো ভেবে সেসব লিখিনি । প্রতিভাস থেকে আমার উপন্যাস সংকলন বেরিয়েছে “তিনটি নষ্ট উপন্যাস” নামে, তাতে যে প্রথম উপন্যাস আছে “ঔরস” নামে, সেটা সম্পর্কে গুরুচণ্ডালী সাইটে রঞ্জন রায় লিখেছিলেন,”দু’দিন ধরে কোনরকমে নাওয়া-খাওয়া সেরে একটানা পড়ে শেষ করলাম –“ঔরস” উপন্যাস। অসাধারণ লেগেছে। হয়ত মলয়বাউকে নিয়ে কিছু পূর্ব ধারণার কারণে এমন গদ্যরচনা আসা করিনি। এটি উপন্যাসের ভঙ্গিমায় একটি সোশিও অ্যান্থ্রপলজিক্যাল বয়ানকথা।আমি বীজাপুর, নারায়নপুর, কোন্ডাগাঁও, বস্তার, দন্তেওয়াড়া সুকমা গেছি। অবুঝমাড়ে ঢুকি নি । বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট পড়েছি যাতে শহুরে মানুষের রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল।এই প্রথম ‘অবুঝমাড়’ নিয়ে একটি অথেন্টিক লেখা পড়লাম, তার প্রকৃতি, বনসম্পদ ও মানুষ নিয়ে । আশি পেরোনো মলয়বাবু কবে এসব এমন নিবিড় করে দেখলেন? আমি মাথা নোয়ালাম। যারা পড়েন নি পড়ে ফেলুন; ঠকবেন না — গ্যারান্টি!”

    গোবিন্দ : আরেকটু বিশদ করুন । 

    মলয় : আমি একটা প্রবন্ধে আমার লেখালিখি নিয়ে লিখেছিলুম । তোমাদের কাছে সহজে পৌঁছোয়না বলে কথাগুলো আবার বলি, প্রবন্ধটা থেকেই বলি,”দেখি খুল্লামখুল্লা লেখার চেষ্টা করে কতোটা কি তুলে আনতে পারি! উপন্যাস লিখতে বসে ঘটনা খুঁড়ে তোলার ব্যাগড়া হয় না। জীবনকেচ্ছা লিখতে বসে কেচ্ছা-সদিচ্ছা-অনিচ্ছা মিশ খেয়ে যেতে পারে, তার কারণ আমি তো আর বুদ্ধিজীবি নই। জানি যে মানুষ ঈশ্বর গণতন্ত্র আর বিজ্ঞান হেরে ভুত…..বাঙালি সাহিত্যিকদের চাঁদমারি ভাগ্য যে তাঁদের ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় না। বাংলা পাল্প ফিকশন হলো ঘোলা জলের আয়নায় মুখদর্শন । সাহিত্যজগত থেকে ছিঁড়ে নিজেকে আলাদা না করলে লেখালিখি করা যায় না । আমি সাহিত্যিক লাউডগাগিরিতে ভুগি না, বুঝলেন তো! আমার লেখালিখি নিছক সাহিত্য নয়। গণপাঠককে আনন্দ দেবার জন্য নয় তা। পাঠককে চৌচির করে তার ভেতরে সমাজরাষ্ট্রের গুগোবর ভরে দেবার জন্য। আর আমি শিল্প ব্যাপারটার বিরুদ্ধে , কেননা আমাকে সারিয়ে প্রাচীন গ্রিক হেলেনিক সমাজের যোগ্য করে তোলা যাবে না। আমি চাই না যে আমার শবযাত্রায় কবি লেখকরা ভিড় করুক। একজনকেও চাই না…আমি লেখালিখি বেছে নিইনি, লেখালিখি আমাকে বেছে নিয়েছে । প্রথম আদিম মানুষ যেমন পাথরের ছোরা আবিষ্কার করেছিল তেমনই আমি নিজের লেখালিখির অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছি।”

    গোবিন্দ :এ যাবৎ পেয়েছেন অনেক সম্মান।লিখেছেন অনেক গল্প।প্রকৃতপক্ষে বাংলা সাহিত্যের অবস্থান কোন জায়গায়? 

    মলয় : সম্মান আবার কোথায় পেলুম ? কেবল তো জুতো-লাথি খেয়েছি । বাংলা সাহিত্যের অবস্হান খুবই উঁচু জায়গায় । দুর্ভাগ্যবশত অনুবাদকের অভাব । রবীন্দ্রনাথকেও নিজে অনুবাদ করে ইউরোপীয়দের পড়াতে হয়েছিল । এই বইটা পড়েছো ? ”সাতটা ক্ষুধার্ত পত্রিকার সংকলন” ( সম্পাদনা: শৈলেশ্বর ঘোষ , প্রকাশক: দে’জ পাবলিশিং। এতে আমার চোদ্দপুরুষকে গালমন্দ করা হয়েছে । বইটা প্রকাশের ব্যবস্হা করে দিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ । ‘শব্দ ও সত্য” নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, একটু আগে বলেছিলুম, পড়ে মনে হবে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি, জেল-জরিমানা হয়নি ।

    গোবিন্দ  :প্রেম নিয়ে আপনার ভাবনা? 

    মলয় : যা জয়দেব, বিদ্যাপতি, ভারতচন্দ্রের, রবীন্দ্রনাথের, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, বোদলেয়ারের ।

    গোবিন্দ :আপনার প্রেমিকাদেরকে অনেক কবিতা আছে।বলুন।

    মলয় : হ্যাঁ । কীই বা বলব । সবই তো রোমিও বলে দিয়েছিল জুলিয়েটকে আর বোদলেয়ার বলেছিলেন জাঁ দুভাল, মাদাম সাবাতিয়ে, মাদাম দোব্রুঁকে ।

    গোবিন্দ :কী লিখি কেন লিখি?

    মলয় : যা ইচ্ছা হয় লিখি । কী, কেন ইত্যাদি ভাবি না । তবে কী পড়ি আর কেন পড়ি তা বলা যায়।

    গোবিন্দ : হাংরি আন্দোলন কি সে অর্থে সফল বলে সমীর রায়চৌধুরী কিংবা আপনিও মনে করেন? 

    মলয় : এসব তোমরা ভাববে ।

    গোবিন্দ ::এই সময় দাঁড়িয়ে কি মনে হয় হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজন ছিলো?

    মলয়  : ছিল নিশ্চয়ই, তা নয়তো হলো কেন ?

    গোবিন্দ :কবিতায় শ্লীল অশ্লীল শব্দোচ্চারণের সুস্পষ্ট কোন নিধি নিষেধ হয়? 

    মলয় : ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রে শ্লীল-অশ্লীলের উল্লেখ বা বর্গীকরণ নেই । ওটা ইসলাম আর প্রোটেস্ট্যান্ট ভিকটোরিয় খ্রিস্টধর্মীদের আমদানি । মনে হয় তা থেকে আমরা শামুকের গতিতে মুক্ত করতে পারছি আমাদের কাজগুলোকে । আমাদের অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী কাব্যরস নয় প্রকার। যথা: (১) আদি, (২) বীর, (৩) করুণ, (৪) অদ্ভুত, (৫) হাস্য, (৬) ভয়ানক, (৭) বীভৎস, (৮) রৌদ্র এবং (৯) শান্ত। আদিরসই তো ইরটিসিটি নিয়ে । আদিরস (the erotic) হলো নায়ক-নায়িকার অনুরাগবিষয়ক ভাব । ম্যাকলের সিলেবাস আমাদের ওপরে চেপে গেল আর আমাদের আদিরস লোপাট হয়ে গেল । এমনকি, কবিয়ালদেরও আমরা ছোটোলোক দেগে সাহিত্য থেকে ছাঁটাই করে দিলুম । একবার আলোচনায় তথাগত চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, আমি তথাগতর বক্তব্য পুরোটা কোট করছি, “আদিরস মানে শৃঙ্গাররস। আদিরস মানে অশ্লীলের সমার্থক, এই ব্যপারটা খুব সম্ভব উনিশশতকেই হয়েছে ।কাব্যশাস্ত্রের ১০টি রস
    ১. শৃঙ্গার: শৃঙ্গ শব্দের অর্থ হলো কামেদেব। শৃঙ্গের আর (আগমন) হয় যাতে, তাই শৃঙ্গার। এর অপর নাম আদিরস। নরনারীর দৈহিক সম্ভোগের ইচ্ছায় যে অনুরাগের সৃষ্টি হয়, তাকেই শৃঙ্গার একেই বলা হয়। প্রেমপ্রকাশ কাব্যে এই রসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।


    ২. বীর: দয়া, ধর্ম, দান এবং যুদ্ধের নিমিত্তে এই রসের উদ্ভব হয়। এর প্রত্যেকটির ভিতরে জয় লাভের ভাব থাকে। যার দ্বারা প্রতিকুল পরিবেশকে পরাজিত করে জয়ী হওয়ার উদ্দীপনা প্রকাশ করা হয়। একই সাথে এতে থাকে বীরোচিত প্রতীজ্ঞা। ভয়ানক, শান্ত রস বিরোধী। যেমন−
    বারিদপ্রতিম স্বনে স্বনি উত্তরিলা
    সুগ্রীব; “মরিব, নহে মারিব রাবণে,
    এ প্রতিজ্ঞা শূরশ্রেষ্ঠ, তব পদতলে!
    -মেঘনাদ বধ, সপ্তম সর্গ। মধুসূদন


    ৩. করুণ: আকাঙ্ক্ষা নষ্ট হলে, অকল্যাণ হলে, প্রিয়জন বিয়োগ ইত্যাদিতে এই রসের সৃষ্টি হয়। মূলত শোকের ভাব এতে প্রকাশ পায়। শৃঙ্গার এবং হাস্যরস এর বিরোধী। যেমন−
    কাঁদিলা রাক্ষসবধূ তিতি অশ্রুনীরে
    শোকাকুলা। ভবতলে মূর্ত্তিমতী দয়া
    সীতারূপে, পরদুঃখে কাতর সতত,
    কহিলা− সজল আঁখি সখীরে;−
    “কুক্ষণে জনম মম, সরমা রাক্ষসি!
    -মেঘনাদ বধ, নবম সর্গ। মধুসূদন


    ৪. রৌদ্র: ক্রোধ রস থেকে এই রস উৎপন্ন হয়। ক্রোধের উগ্রতা এবং ভয়ঙ্কর রূপ হলো এই রস। এই কারণে ক্রোধকে এর স্থায়ীভাব হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অলঙ্কার শাস্ত্রে একে রক্তবর্ণ ও রুদ্রদৈবত নামে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন−
    “কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি,
    বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
    কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
    -মেঘনাদ বধ, তৃতীয় সর্গ। মধুসূদন


    ৫. অদ্ভুত: আশ্চর্যজনক কোনো বিষয় থেকে উদ্ভুত বিস্ময়কর ভাবই হলো অদ্ভুত রস। সাধারণ অলৌকিক কোনো বিষয়কে এই রসকে উজ্জীবিত করা হয়। [বিস্তারিত: অদ্ভুতরস]

    ৬. ভয়ানক: ভয় থেকে এই রসের উদ্ভব। বিপদজনক বা ভীতিপ্রত কোনো বিষয় থেকে মনে যে ভাবের সঞ্চার হয়, প্রকাশই ভয়ানক।

    ৭. বীভৎস: কোনো কুৎসিৎ বিষয়ের প্রতি ঘৃণা থেকে বিভৎস রসের সৃষ্টি হয়।

    ৮. হাস্য: কৌতুকজনক বাক্য বা আচরণ থেকে এই রসের উদ্ভব হয়।

    ৯. শান্ত: চিত্তকে প্রশান্ত দেয় এমন ভাব থেকে শান্ত রসের উদ্ভব হয়।

    ১০.বাৎসল্য: সন্তানের প্রতি স্নেহের যে ভাবের উদ্ভব ঘটে, তাই বাৎসল্য রস।

    গোবিন্দ : আপনার কি এখন মনে হয় যে হাংরি বুলেটিনগুলোতে আমাদের আদিরস বা শৃঙ্গাররস আলোচনা করলে আপনাদের আক্রমণ করার আগে সমালোচকরা দুবার ভাবতেন ।

    মলয় : সমালোচকরা হয়তো পিছু হটতেন কিন্তু আক্রমণ করা ছাড়তেন না । আমার উকিল ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আদিরসের প্রয়োগ নিয়ে তর্ক দিয়েছিলেন কিন্তু জজসাহেব তাকে স্বীকৃতি দেননি । প্রধান আক্রমণ ছিল যে আমরা ছোটোলোক বর্গ থেকে এসে সাহিত্যের আঙিনায় ঢুকে পড়ে তিরিশ থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত সাহিত্যের মানদণ্ডকে ভেঙে ফেলছি, সাহিত্যিক মূল্যবোধ দখল করে নিতে চাইছি । তুমি জানো না বোধহয়, দেবী রায় ছিলেন কৈবর্ত্য পরিবারের, উনিই বুলেটিনগুলো ওনার হাওড়ার বস্তিবাড়ি থেকে প্রকাশ করতেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় থাকতেন উল্টোডাঙার বস্তিতে । সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অবনী ধর ছিলেন উদ্বাস্তু পরিবারের । আর আমার কথা তো বলেইছি, পাটনার অন্ত্যজপাড়া ইমলিতলা থেকে ।

    গোবিন্দ :  ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২১এর আনন্দবাজার পত্রিকায় অভীক সরকার লিখেছেন, ‘আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি’। কৃশকায় একটি কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৭২ সনে (১৯৬৬) মধ্যচৈত্রে। কবিতার সংখ্যা ৭১। কবির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বইটি দৈবাৎ আমার হাতে আসে, বাবার বইপত্রের মধ্য থেকে। তখন আমার মেরেকেটে ১৫ বছর। সত্যি বলতে কি, আমার পুরো জীবনটাই লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল ওই কবিতাগুলো। সেই থেকে আজীবন ওই কাব্যগ্রন্থটি আমার কাছে অভিজ্ঞতার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আজ মাঝে মাঝে ভাবি, কেন ঘটেছিল এরকম? ওই কবিতাগুলির ছত্রে-ছত্রে প্রকৃতপক্ষে লুকিয়ে আছে এক অমোঘ ডিসগাস্ট, ব্যবস্থার প্রতি রাগী এক যুবকের প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ মুষ্ট্যাঘাত, প্রচলিত সমাজ-সংসার-সংশ্লিষ্ট মূল্যবোধ আর ভণ্ডামিকে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করার গনগনে গর্জন। এক ছন্নছাড়া, প্রতিষ্ঠানবিরোধী, উদ্ধত তরুণের সঙ্গে কাব্যসংলাপে সেই যে জড়িয়ে পড়লাম, ওই কবিতা থেকে আর মন সরাতে পারলাম কই? পরবর্তী কালে, পরবর্তী জীবনে, দেশবিদেশের বহু মহৎ কবিতা বা কাব্যগ্রন্থ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, কিন্তু এই বইয়ের স্বরদ্যুতি আমার কাছে অমলিন। কেননা তীব্র ক্রোধ, তীক্ষ্ণ প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, অগ্নিভ অভিমান বহুক্ষেত্রেই কাব্যসংরূপে ততটা সার্থক হতে পারে না। প্রতিবাদী কবিতায় সারা বিশ্বজুড়েই প্রায়শই প্রতিবাদের অনুপাত এত বেশি হয়ে ওঠে যে, কবিতা বিষয়টাই বনবাসে চলে যায়। এ ক্ষেত্রে জাদুবলে সুনীল অকল্পনীয় এক আধুনিক কাব্যভাষাকে রপ্ত করেছেন। যেখানে নির্ধারিত ছন্দে অথবা গদ্যস্পন্দে ব্যক্তিজীবনের রাগ, দুঃখ, হতাশা, কল্পনা, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, বাস্তব-পরাবাস্তব, প্রেম, যৌনতা, রিরংসা, একাকিত্ব আর অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার স্নায়ুকম্পনগুলিকে অত্যাশ্চর্য রুক্ষনৈপুণ্যে প্রকাশ করা যায়। একটু ভেবে দেখলে মনে হয়, পরবর্তী কালপর্বের অতি তরুণ কবিদের কাব্য উচ্চারণে এই কেতাবের স্বরক্ষেপ প্রভাব ফেলেছে। ভাস্কর চক্রবর্তী, শামসের আনোয়ার কিংবা সুব্রত চক্রবর্তীর গোড়ার যুগের কবিতার দিকে তাকিয়ে দেখুন।” আপনার কি মনে হয় যে অভীক মজুমদার ইচ্ছাকৃতভাবে শৈলেশ্বর ঘোষ, ফালগুনী রায়, সুবো আচার্য, ত্রিদিব মিত্র, প্রদীপ চৌধুরী এবং আপনার নাম আলোচনা থেকে বাদ দিয়েছেন?

    মলয় : উনি লিখে থাকলেও বিভাগীয় সম্পাদক নামগুলো ছাঁটাই করে দিয়ে থাকবেন । কিংবা অভীক মজুমদারমশায়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল অমন করে লিখতে । একে আনন্দবাজার, তায় সুনীলকে বলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানবিরোধী । কবিতাগুলো সুনীল লিখেছিলেন হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার পর । বস্তুত হাংরি আন্দোলন ওনার কবিতার ধারাই পালটে দিয়েছিল ।

    গোবিন্দ : আপনাদের আন্দোলনের প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মহিলা কবিদের লেখায় দেখা গেছে। আলোচকরা তাও স্বীকার করতে চান না । তাকে পঞ্চাশের কবিদের প্রভাব বলে চালান । যেমন কবি যশোধরা রায়চৌধুরী তাঁর ব্লগে লিখেছেন, “বাঙালির রচিসংস্কৃতির অবদমিত যৌনবোধের প্রকাশ যখন কবিতার মানক, জীবনানন্দীয় কুয়াশায় যখন তরুণ কবিরা আচ্ছন্ন, তখনি কৃত্তিবাস আন্দোলন আনল ভাংচুরের পালা। মেধার সরণি ছেড়ে আত্মজৈবনিকের , স্বীকারোক্তির নতুন দিগন্ত খুললেন এই আন্দোলনের পুরোধা প্রধান পুরুষ কবিরা ।  সুনীল-শরৎ-শক্তি-তারাপদ… পাশাপাশি তুষার রায়, বেলাল চৌধুরী তন্ময় দত্তরা। সেই মুহূর্তের অ-প্রাতিষ্ঠানিকতার শেষ কথা এই কবিদের হাত থেকে বেরিয়ে আসা তাজা স্বতঃস্ফূর্ত কবিতাগুলি। বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘস্থায়ী এক প্রভাব। কবিতায় মেয়েদের পদচারণা তখন যথেষ্ট সীমিত।” অথচ পঞ্চাশের কবিদের প্রভাবিত করেছিল হাংরি আন্দোলন, তা উনি উল্লেখ করেননি । আপনাদের পরের কয়েকজন মহিলা কবিকেও হাংরি আন্দোলন বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। মিতুল দত্ত’র ‘দুর্বার জন্য কবিতা’ পযে দেখুন, “…….যেভাবে বুক দুটোকে বেঁধে রাখিস/মনে হয় ওরা তোর মেয়ে/একটুখানি ঢিলে দিলে বেয়াড়া অসভ্য হয়ে/ডেকে আনবে পাড়ার ছেলেদের/স্নানের সময় যেই খুলে দিস/হুটোপাটি করে ওরা স্নান করে/কেউ কাউকে একটু কষ্ট না দিয়ে/যে যার মতো একা ।”

    মলয় : জানি । দেবারতি মিত্র লিখেছিলেন, ““অসম্ভব অনুরক্তা শিশুসুলভতা নিয়ে/ অচেনা আশ্চর্‌য এক লালচে কিসমিসরঙা/ ফুলের কোরক মুখে টপ করে পোরে, / মাতৃদুধের মত স্বাদু রস টানে/ ক্রমে তার মুখে আসে/ ঈষদচ্ছ অনতিশীতোষ্ণ গলা মোম/ টুপটাপ  মুখের গহবরে ঝরে পড়ে/ পেলিকান পাখিদের সদ্যোজাত ডিম ভেঙে জমাট কুসুম নয়/ একটু আঁষটে নোনতা স্বচ্ছ সাদা জেলি “ ( পৃথিবীর সৌন্দর্য একাকী তারা দুজন)। মল্লিকা সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, ““নারীর জরায়ুজমি লাঙল চাইছে/যদি অসমর্থ হই, ভাড়া করে, নিয়োজিত করে/অথবা যে কোনভাবে বীজ এনে দেব “। কিংবা ““মশারি গুঁজে দিয়ে যেই সে শোয় তার/স্বামীর কালো হাত হাতড়ে খুঁজে নিল/দেহের সাপব্যাং, লাগছে ছাড় দেখি/ক্রোধে সে কালো হাত মুচড়ে দিল বুক/বলল, শোন শ্বেতা, ঢলানি করবে না…”(স্বামীর কালো হাত)। রমা ঘোষ লিখেছেন, ““কুড়িয়ে পেলাম ঘুর্নিবীজ বলা যায় না/আমার কত সুখ হয়েছে বলা যায় না/ঘুমের মধ্যে তোমার বাকল জড়িয়ে ছিলাম/ঘুম ভাঙতে তোমার শিকড় নিচ্ছি টেনে/তলিয়ে যাচ্ছি তোমার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছি, নীতা!…/রাত্রি দুটোয় আমায় তুমি পড়বে ঝুঁকে/বটের নিবিড় গাঢ় আঠায় কপাল ওষ্ঠ/ক্ষুধাই শুধু বুঝতে পারে স্তনবৃন্তের সুধা!”( ঘুর্নিবীজ)। সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কাটাকুটি খেলতে গিয়ে বরাবর ভুল ঘরে ভুল গোল্লাগুলি/বসিয়েছ । দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছ নিজের দুই ঠোঁট।/জ্যান্ত শুক্রবীজগুলি মুখে শুষে নাও আজ আর থুৎকারে/থুৎকারে ছুঁড়ে ফেলে দাও প্রাণহীন মরা –কুকুরের মতো।” (শুক্রস্হান )। চৈতালী চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “যার কোন উত্থানপতন নেই, আমি সেই/ছাতাপড়া অঙ্গটিকে গড় না করতেই পারি/যদ্যপি সে আমার স্বামীর।/শেষ জলবিন্দুটিকে, নিঃশেষ, না পাই, তো/যাঞচা করতে পারি অন্য মেঘ/যদি অহল্যাও হই, ইন্দ্রের কাছে যাব, বার বার/পাষাণ হব না ।”( একটি শারীরিক কবিতা)।

    গোবিন্দ :হাংরি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কবিতার বাঁক বিশ্লেষণ করেন প্লীজ? 

    মলয় : আমার যে সাক্ষাৎকারের বই বেরিয়েছে প্রতিভাস থেকে, তাতে পাবে । তালিকাটা দীর্ঘ।

    গোবিন্দ :হাংরি আন্দোলনে কারা যুক্ত হয়েছিলেন?এখনো কি তাদের উচ্চারণে হাংরি আন্দোলনের ছাপ আছে? 

    মলয় : অনেকে । অনেকে । তিরিশ-চল্লিশজন । ১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনে যোগদান করেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন দত্ত, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । অনিল করঞ্জাই এবং করুণনিধান মুখোপাধ্যায় ছিলেন চিত্রকর । সত্তর দশকের শেষে যাঁরা পুনরায় আন্দোলনটিকে জিইয়ে তোলার চেষ্টা করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অরুণেশ ঘোষ, অরণি বসু, অরুণ বণিক, অলোক গোস্বামী, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্য মালাকার, কিশোর সাহা, জামালউদ্দিন, জীবতোষ দাশ, দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নির্মল হালদার, দেবজ্যোতি রায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, প্রিতম মুখোপাধ্যায়, বিজন রায়, রবিউল, সমীরণ ঘোষ, রতন নন্দী, রাজা সরকার, সত্যেন চক্রবর্তী, সৈকত রক্ষিত, সুব্রত রায়, সুব্রত চক্রবর্তী, রসরাজ নাথ, সেলিম মোস্তফা, শঙ্খপল্লব আদিত্য, সুভাষ কুন্ডু , স্বপন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । এখনও লেখায় টিকে আছি আমি আর পরের প্রজন্মের  কয়েকজন । আর যে দুয়েকজন বেঁচে আছেন, তাঁরা লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছেন বা স্বাস্হের কারণে লিখতে পারেন না ।

     
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 106.213.52.40 | ০২ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:৩১735285
  •  
    •  
     
     

    কথা চালিয়ে যাবার কথা বলে, সেই ষাটের দশকেই বুদ্ধি বেশ্যাদের গোড়ায় তীব্র আঘাত করেন হাংরিয়ালিস্ট কবি সাহিত্যিকরা। হাংরি মুভমেন্টের গতি প্রকৃতি থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া যায়, এক্টিভিস্টরা মুখোশের অবয়ব থেকে নিজেকে মুক্ত করবার জন্য সব ধরনের ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন। কী ভাষায় কী সামাজিক সন্ধিতে সব স্থানেই তারা তাদের আমি কে একটা বহুআমির প্রকৃতে উপস্থাপন করবার নিবিষ্ট চেষ্টা করেছেন। হাংরি মুভমেন্ট এতোটা দ্রুতই ছড়ায় যে তরুণরা প্রবলভাবে এতে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কারণ, সে সময় পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্বেও বামপন্থী কবিরা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। শ্রমিকের ভাষা ঢং রংকে তারা নিজেদের সাহিত্যে প্রয়োগ করেনি। র ফর্মটা আসলে সবসময় উপেক্ষিত থেকে যায়। এই কাজটি প্রথম করেন হাংরিয়ালিস্ট সাহিত্যিকরা। অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্রদের যা কিছু এই বঙ্গে পাওয়া যায় কিংবা আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের হাতে এসে পৌঁছায় তা থেকে অন্তত এই বিষয়টিই স্পষ্ট হয়।

    একটা বিষয় না বললেই নয়, বাংলাদেশের লিটল ম্যাগগুলোয় কিংবা স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রকাশনাগুলোয় এর বহুবিধ সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। অন্তত আমি পেয়েছি। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন কবির লেখায় ‘র’ ফর্মকে প্রকটভাবে দেখা যায়। তাহলে কি হাংরিকে একটা সচল মুভমেন্ট বলা যেতে পারে? অন্তত আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, হ্যাঁ। কারণ হাংরির বুলেটিন, প্রকাশান যে কেউ করবার এখতিয়ার রাখতেন। তাছাড়া হাংরি কোনো প্রাইভেট প্রোপার্টি ছিল না। যেমনটা আমাদের ব্রিটিশ বেনিয়ারা শিখিয়েছিলেন। পশ্চিমের চাপানো অবয়বকে রূঢ়ভাবে ভাঙচুর করবার একটা পায়তারা ছিল। ছিল আপনাকে তুলে আনবার ইচ্ছা!

    তবুও মনের কোণে অসংখ্য প্রশ্ন থেকেই যায়। হাংরি মুভমেন্টের কিংবদন্তী মলয় রায়চৌধুরীর কাছ থেকেই জানতে চাই সেসব প্রশ্নের উত্তর। তাই বোকাবিডির হয়ে মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান স্বাধীন।

    পুরো সাক্ষাৎকারটি হুবুহু তুলে ধরা হলো।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: হাংরি কি দাদাইজমের একটা নতুনরূপ?

    মলয় রায়চৌধুরী: সমস্যা হলো যে বাংলাদেশে হাংরি আন্দোলনকারীদের বই বহুকাল যায়নি। এখন যাচ্ছে। তাও সবায়ের বই পৌঁছোয়নি। অনেকে ইনটারনেট থেকে মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি করে নিয়েছেন। হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে। অর্থাৎ ষাট বছর আগে। অথচ বইপত্র পৌঁছোয়নি। তার মানে যিনি খবর পাচ্ছেন তিনি নিজের মনে ভাসাভাসা ধারণা গড়ে নিয়েছেন। ডাডা আন্দোলনের পর ইউরোপ-আমেরিকায় আরও বহু আন্দোলন হয়েছে, পশ্চিমবাংলাতেই হয়েছে নিম-সাহিত্য, শাস্ত্রবিরোধী, শ্রুতি ইত্যাদি আন্দোলন। এমনকি পরাবাস্তববাদ আন্দোলনকেও ডাডা আন্দোলনের নতুন রূপ বলা হয় না। ত্রিস্তান জারার রচনার সঙ্গে যেমন আঁদ্রে ব্রেতঁর রচনার ভাবনাধারার মিল নেই, তেমনই ওনাদের ভাবনাধারার সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকারীদের মিল নেই। তুমি ফালগুনী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, শম্ভু রক্ষিত, সুভাষ ঘোষ, অরুণেশ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখের রচনা ডাডাবাদীদের পাশাপাশি রেখে পড়ে দেখতে পারো, তাহলেই টের পাবে। আমার প্রায় দুশোটা বই আছে, কবিতা, ছোটগল্প, স্মৃতিকথা, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ ইত্যাদি নিয়ে। এর মধ্যে কয়টা যে বাংলাদেশের পাঠকের কাছে পৌঁছেচে তা জানি না। তার ফলে অমন ধারণা তৈরি হয়েছে। এখন অবশ্য ঢাকার কয়েকজন প্রকাশক আমাদের বই প্রকাশ করায় আগ্রহ দেখিয়েছেন। সংগ্রহ করে পড়লে স্পষ্ট হবে ধারণা।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: হাংরি আন্দোলনকে কেন ইন জেনারেল ভিত্তি দেয়া যায়নি?

    এখনো যে কবিতা আমাদের মন আর মগজকে আক্রান্ত করে, নিজেকে দাঁড় করায় নিজেরই প্রতিবিম্বের সামনে! মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা, প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার।

    মলয় রায়চৌধুরী: ঠিক কী বলতে চাইছ বুঝতে পারলুম না। হাংরি আন্দোলন নিয়ে তো প্রচুর পিএইচডি আর এম ফিল হয়েছে, হয়ে চলেছে। ভারতের অন্যান্য ভাষায় এই আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা হয়েছে। কেবল আমার কবিতা নিয়েও একজন ডক্টরেট করেছেন। জার্মানিতে ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএই্চডি করেছেন হাংরি আন্দোলন নিয়ে। হ্যাঁ, বলা যায় যে বাণিজ্যিক প্রচার হয় না কেন! তার কারণ পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতিক রাজনীতি। তাছাড়া হাংরি আন্দোলনকারীরা কোনও সংবাদপত্রে আর রাজনৈতিক দলের আশ্রয় নিতে চায়নি। যারা নিয়েছে তাঁরা নিজেরাই আন্দোলন ত্যাগ করেছিলেন; যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখ। বিনয় মজুমদার কিন্তু আন্দোলন ত্যাগ করেননি; একটা সাক্ষাৎকারে উনি আপশোষ করেছেন যে আন্দোলনের নেতা হবার কথা ছিল ওনার কিন্তু ওনাকে নেতা করা হয়নি। ওনার ভুট্টা সিরিজের কবিতাগুলো তো হাংরি আন্দোলনের কবিতা। বিনয় তাই উপেক্ষিত ; ওনাকে অকাদেমি পুরস্কার দেয়া হয় জীবনের শেষ পর্বে। আরেকটা কারণ হল কয়েকজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। আমার বিরুদ্ধে পঁয়ত্রিশ মাস ধরে মামলা হয়েছিল; প্রদীপ চৌধুরীকে বিশ্বভারতী থেকে রাস্টিকেট করা হয়েছিল, উৎপলকুমার বসুকে যোগমায়া দেবী কলেজের অধ্যাপকের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল; সুবিমল বসাক আর দেবী রায়কে সরকারি চাকরিতে কলকাতার বাইরে ট্রান্সফার করে দেয়া হয়েছিল। ক্লিন্টন বি সিলির জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্থ ‘এ পোয়েট অ্যাপার্ট, বইটা পড়লে জানতে পারবে,  হাংরি আন্দোলনকারীরা খালাসিটোলায় জীবনানন্দের যে জন্মদিন পালন করেছিল, তার বর্ণনা। উনি ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ তারিখে প্রকাশিত সংবাদ তুলে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মে জীবনানন্দের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। একই খবর প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায়। সেদিন সন্ধ্যায় জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন পালনের জন্য  টেবিলে উঠে পড়েছিলেন হাংরি আন্দোলনের গল্পকার অবনী ধর  নাচের সঙ্গে গাইতে লাগলেন একটা গান, যা তিনি জাহাজে খালসির কাজ করার সময়ে গাইতেন, বিদেশি খালাসিদের সঙ্গে। উপস্থিত সাংবাদিকরা,  ভেবেছিলেন গানটা আবোল-তাবোল, কেননা ইংরেজিতে তো এমনতর শব্দ তাঁদের জানা ছিল না।  তাঁরা গানটাকে ভেবেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের বজ্জাতি, প্রচার পাবার ধান্দা। ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ শিরোনামে ঠাট্টা করে দুই পাতা চুটকি লেখা হয়েছিল, অবনী ধরের কার্টুনের সঙ্গে। ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ তকমাটি যিনি ব্যবহার করেছিলেন তিনি জানতেন না যে এই শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন গারট্রুড স্টিন এবং বিশ শতকের বিশের দশকে প্যারিসে আশ্রয় নেয়া আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, টি. এস. এলিয়ট, জন ডস প্যাসস, ই ই কামিংস, আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ, হার্ট ক্রেন প্রমুখকে বলা হয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’-এর সদস্য। অবনী ধর-এর নামের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন। যাঁরা তাঁর নাম শোনেননি এবং ওনার একমাত্র বই ‘ওয়ান শট’ পড়েননি, তাঁদের জানাই যে ছোটোগল্পের সংজ্ঞাকে মান্যতা দিলে বলতে হয় যে অবনী ধর ছিলেন হাংরি আন্দোলনের অন্যতম ছোটো গল্পকার। 

    গানটা এরকম, মোৎসার্টের একটা বিশেষ সুরে গাওয়া হয়:

     

    জিং গ্যাং গুজিং গ্যাং গু।

    জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,

    জিং গ্যাং গুজিং গ্যাং গু।

    হায়লাওহ হায়লা শায়লাহায়লা শায়লাশায়লা উউউউউহ,

    হায়লাওহ হায়লা শায়লাহায়লা শায়লাশায়লাউহ

    শ্যালি ওয়ালিশ্যালি ওয়ালিশ্যালি ওয়ালিশ্যালি ওয়ালি।

    উউউমপাহউউউমপাহউউউমপাহউউউমপাহ।

     

    ১৯২০ সালে, প্রথম বিশ্ব স্কাউট জাম্বোরির জন্য, রবার্ট ব্যাডেন-পাওয়েল, প্রথম বারন ব্যাডেন-পাওয়েল (স্কাউটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা) সিদ্ধান্ত নেন যে একটা মজার গান পেলে ভালো হয়, যা সব দেশের স্কাউটরা গাইতে পারবে; কারোরই কঠিন মনে হবে না। উনি মোৎসার্টের এক নম্বর সিম্ফনির ইবি মেজরে বাঁধা সুরটি ধার করেছিলেন। গানটা স্কাউটদের মধ্যে তো বটেই সাধারণ স্কুল ছাত্রদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়েছিল। এই রকমই ছিল তখনকার প্রতিক্রিয়া।

     

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: আন্দোলনটা ধপ করে জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল?

    মলয় রায়চৌধুরী: বাংলাদেশে বসে সম্ভবত এরকম একটা ধারণা হয়ে থাকবে। মামলা হবার দরুন আমি বন্ধু-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলুম। কিন্তু হাংরি আন্দোলনের পত্রিকা তো নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। আমার মতন অরগ্যানাইজিং কেপেবিলিটি ছিল না বলে সেই সব পত্রিকা তেমন প্রচারিত হয়নি। প্রদীপ চৌধুরীর ‘ফুঃ’ পত্রিকা গত বছর ওনার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত নিয়মিত ‘ক্ষুধার্ত’, ‘ক্ষুধার্ত খবর’ প্রকাশ করেছেন। ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকার সব কয়টা সংখ্যা নিয়ে ভারতের সাহিত্য অকাদেমী থেকে সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। আমি ‘জেব্রা’ পত্রিকা প্রকাশ করতুম। সেগুলো নিয়ে গত বছর প্রকাশিত হয়েছে ‘অখণ্ড জেব্রা’, সমীরণ মোদকের সম্পাদনায়, ঢাকায় তক্ষশীলাতে পাওয়া যায়। সুবিমল বসাক সম্পাদিত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, দেবী রায় সম্পাদিত ‘চিহ্ণ’, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত ‘উন্মার্গ’, অরুণেশ ঘোষ সম্পাদিত ‘জিরাফ’ পত্রিকার সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করেছেন সমীরণ মোদক, একত্রে সংকলিত করার জন্য, কিন্তু প্রকাশক পাচ্ছেন না। শিলিগুড়ি, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি থেকে আশির দশক জুড়ে অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার, মনোজ রাউত, মলয় মজুমদার, সমীরণ ঘোষ, জীবতোষ দাশ প্রমুখ প্রকাশ করতেন ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’, ‘রোবোট’, আর ‘ধৃতরাষ্ট্র’ — কলকাতা থেকে দূরে বলে তেমন আলোচিত হয়নি। এই যে আমি এতোগুলো পত্রিকার নাম বললুম, আমি নিশ্চিত যে তোমার চোখে পড়েনি ; সম্ভবত এনাদের রচনাও পড়োনি। তাই মনে হতে পারে যে জ্বলেই নিভে গেল। তিন বছর আগে পেঙ্গুইন র‌্যানডাম হাউস থেকে হাংরি আন্দোলনকারীদের নিয়ে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে একটা বই বেরিয়েছে, মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরীর লেখা; ইংরেজিতে আরেকটা বই বেরিয়েছে বৈদ্যনাথ মিশ্র এবং রাহুল দাশগুপ্তর সম্পাদনায়, ‘লিটারেচার অফ হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট – আইকনস অ্যাণ্ড ইমপ্যাক্ট’ নামে। গতবছর অলোক গোস্বামীর স্মৃতিচারণ প্রকাশিত হয়েছে, ‘মেমারি লোকাল’ নামে। বাসুদেব দাশগুপ্ত আর সুভাষ ঘোষকে নিয়ে প্রায় পাঁচশো পাতার দুটো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে ‘মানুষের বাচ্চা’ পত্রিকা। ওদের দুজনের রচনাসমগ্র প্রকাশ করেছে গাঙচিল প্রকাশনী। সুবিমল বসাকের রচনাসমগ্র দুই খণ্ডে প্রকাশ করেছে সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী। অরুণেশ ঘোষকে নিয়ে ছয়শো পৃষ্ঠার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে কবিতীর্থ পত্রিকা। শৈলেশ্বর ঘোষকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে ‘কারুবাসনা’ পত্রিকা। এবাদুল হক আমাকে নিয়ে ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকার দুটো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। জানি না এই বই আর পত্রিকাগুলো বাংলাদেশে যায় না বলে তোমার মনে হয়ে থাকবে ধপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল।

    তুমি যদি ইউটিউব দ্যাখো তাহলে সবচেয়ে পঠিত যে কবিতাটা পাবে তা হল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ আর আমার সাম্প্রতিক কবিতা ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো’। আলোচনা অবিরাম হয়ে চলেছে। 

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: মলয় রায়চৌধুরীর চোখে হাংরি আন্দোলনের সময়কার সামাজিক বাস্তবতা এবং ইজম কনফ্লিক্টটা কেমন ছিল? 

    মলয় রায়চৌধুরী: এটা দুচার লাইনে ব্যাখ্যা করা যায় না। তুমি আমার সাক্ষাৎকারসমগ্র ‘কথাবার্তা সংগ্রহ’ আর ‘হাংরি কিংবদন্তি’ বইদুটো পড়ে দেখতে পারো। প্রকাশক কলকাতার প্রতিভাস। ঢাকায় পাওয়া যায়। অবশ্য সাত-আটশো টাকা দাম বলে পাঠকের নাগালের বাইরে থেকে গেছে।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: আমরা শুনেছি একটা ইশতেহারের মাধ্যমেই সূচনা হয়েছিল হাংরি আন্দোলন। আসলে ইশতেহারে কী লেখা হয়েছিল যা সে সময়কার তারুণ্যকে নাড়া দিয়েছিল?

    মলয় রায়চৌধুরী: হ্যাঁ, প্রথম দিকে হ্যাণ্ডবিলের মতন এক পাতার বুলেটিন বা ইশতেহার প্রকাশ করা হতো আর তা বিলিয়ে দেয়া হতো কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মাঝে। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল ইংরেজি ম্যানিফেস্টো আর ১৯৬২ সালের শুরুতে বাংলা ম্যানিফেস্টো । পত্রিকা বের করলে পাঠকের কেনবার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হতো। এক পাতার বুলেটিন পাঠকের কাছে সহজে পৌঁছে যেতো, প্রায় প্রতি সপ্তাহে । এইভাবে পৌঁছে যাওয়াটাই সাড়া ফেলার প্রধান কারণ । সংবাদপত্রে খবর, কার্টুন, ছবি ইত্যাদি বেরোবার ফলে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল । যুগান্তর সংবাদপত্রে পরপর দু’দিন প্রধান সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল । আন্দোলন যেভাবে দ্রুত সাড়া ফেলেছিল, তরুণরা আপনা থেকেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন । পঁয়ত্রিশ-চল্লিশজন ছিলেন প্রথম কয়েক বছর । তারপর পুলিশের হস্তক্ষেপের কারণে অনেকে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এবং আন্দোলন থেকে দূরত্ব গড়ে নিয়েছিলেন । আমার ‘হাংরি কিংবদন্তি’ বইটায় তুমি প্রায় সব কয়টা ইশতেহারের কপি পাবে । তক্ষশীলা, বিদিত, পাঠক সমাবেশ, বাতিঘরকে বললে আনিয়ে দেবে ।

    হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকরা বলেছেন কথা চালিয়ে যাবার কথা। বলেছেন যে কথার শেষ নেই। নিয়েছেন শব্দার্থের ঝুঁকি। রচনাকে মুক্তি দিয়েছেন আত্মমনস্কতা থেকে। হাংরি জেনারেশনের এই কৌম মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন পরবর্তীকালের কবি-লেখকরা। এই প্রভাব সামাজিক স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়ের হাংরিয়ালিস্ট প্রভাব পরবর্তিতে বাংলা সাহিত্যের লেখনীতে কী ধরনের বিশেষত্ব দিয়েছে?

    মলয় রায়চৌধুরী: এই প্রশ্নের উত্তর অভিজিত পালের একটা প্রবন্ধে দেয়া আছে, ‘ভূবনডাঙা’ সাইটে। তোমার প্রশ্নের উত্তরের জন্য সেটা থেকে খানিকটা তুলে দিচ্ছি। অভিজিত লিখেছেন, বাংলা সাহিত্যে ষাটের দশকের হাংরি জেনারেশনের ন্যায় আর কোনও আন্দোলন তার পূর্বে হয় নাই। হাজার বছরের বাংলা ভাষায় এই একটিমাত্র আন্দোলন যা কেবল সাহিত্যের নয় সম্পূর্ণ সমাজের ভিত্তিতে আঘাত ঘটাতে পেরেছিল, পরিবর্তন আনতে পেরেছিল। পরবর্তীকালে তরুণ সাহিত্যিক ও সম্পাদকদের সাহস যোগাতে পেরেছে। তাঁদের অবদান,

    (১) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা সাহিত্যকে পণ্য হিসাবে চিহ্ণিত করতে অস্বীকার করেছিলেন। কেবল তাই নয়; তাঁরা এক পৃষ্ঠার লিফলেট প্রকাশ করতেন ও বিনামূল্যে আগ্রহীদের মাঝে বিতরণ করতেন । তাঁরাই প্রথম ফোলডার-কবিতা, পোস্ট-কার্ড কবিতা, ও পোস্টারে কবিতা ও কবিতার পংক্তির সূত্রপাত করেন। পোস্টার এঁকে দিতেন অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায়। ফোলডারে স্কেচ আঁকতেন সুবিমল বসাক। ত্রিদিব মিত্র তাঁর ‘উন্মার্গ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিজে আঁকতেন। পরবর্তীকালে দুই বাংলাতে তাঁদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

    (২) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। তাঁদের আগমনের পূর্বে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করার কথা সাহিত্যিকরা চিন্তা করেন নাই। সুভাষ ঘোষ বলেছেন, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ সরকার বিরোধিতা নয়, সংবাদপত্র বিরোধিতা নয়; হাংরি জেনারেশনের বিরোধ প্রচলিত সাহিত্যের মৌরসি পাট্টাকে উৎখাত করে নবতম মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার। নবতম শৈলী, প্রতিদিনের বুলি, পথচারীর ভাষা, ছোটোলোকের কথার ধরণ, ডিকশন, উদ্দেশ্য, শব্দ ব্যবহার, চিন্তা ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সরকার সত্বেও বামপন্থী কবিরা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে নিষ্কৃতি পান নাই। শ্রমিকের কথ্য-ভাষা, বুলি, গালাগাল, ঝগড়ার অব্যয় তাঁরা নিজেদের রচনায় প্রয়োগ করেন নাই। তা প্রথম করেন হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগন; উল্লেখ্য হলেন অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখ। সুবিমল বসাকের পূর্বে ‘বাঙাল ভাষায়’ কেউ কবিতা ও উপন্যাস লেখেন নাই। হাংরি জেনারেশনের পরবর্তী দশকগুলিতে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবিদের রচনায় এই প্রভাব স্পষ্ট।

    (৩) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের তৃতীয় অবদান কবিতা ও গল্প-উপন্যাসে ভাষাকে ল্যাবিরিনথাইন করে প্রয়োগ করা। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ও গল্প-উপন্যাস। মলয় রায়চৌধুরী সর্বপ্রথম পশ্চিমবাংলার সমাজে ডিসটোপিয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। বামপন্থীগণ যখন ইউটোপিয়ার স্বপ্ন প্রচার করছিলেন সেই সময়ে মলয় রায়চৌধুরী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ডিসটোপিয়ার দরবারি কাঠামো। উল্লেখ্য তাঁর নভেলা ‘ঘোগ’, ‘জঙ্গলরোমিও’, গল্প ‘জিন্নতুলবিলদের রূপকথা’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ ইত্যাদি। তিনি বর্ধমানের সাঁইবাড়ির ঘটনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে লেখেন ‘আরেকবারে ক্ষুধিত পাষাণ’। বাঙাল ভাষায় লিখিত সুবিমল বসাকের কবিতাগুলিও উল্লেখ্য। পরবর্তী দশকের লিটল ম্যাগাজিনের কবি ও লেখকদের রচনায় এই প্রভাব সুস্পষ্ট।

    (৪) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের চতুর্থ অবদান হলো পত্রিকার নামকরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। হাংরি জেনারেশনের পূর্বে পত্রিকাগুলির নামকরণ হতো ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’, ‘শতভিষা’, ‘পূর্বাশা’ ইত্যাদি যা ছিল মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ পত্রিকার নামকরণ করলেন ‘জেব্রা’, ‘জিরাফ’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘উন্মার্গ’, ‘প্রতিদ্বন্দী’ ইত্যাদি। পরবর্তীকালে তার বিপুল প্রভাব পড়েছে। পত্রিকার নামকরণে সম্পূর্ণ ভিন্নপথ আবিষ্কৃত হয়েছে।

    (৫) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনে সর্বপ্রথম সাবঅলটার্ন অথবা নিম্নবর্গের লেখকদের গুরুত্ব প্রদান করতে দেখা গিয়েছিল। ‘কবিতা’, ‘ধ্রুপদি’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’ ইত্যাদি পত্রিকায় নিম্নবর্গের কবিদের রচনা পাওয়া যায় না। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের বুলেটিনগুলির সম্পাদক ছিলেন চাষি পরিবারের সন্তান হারাধন ধাড়া। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ তৎকালীন কবিরা তাঁর এমন সমালোচনা করেছিলেন যে তিনি এফিডেভিট করে ‘দেবী রায়’ নাম নিতে বাধ্য হন। এছাড়া আন্দোলনে ছিলেন নিম্নবর্গের চাষী পরিবারের শম্ভু রক্ষিত, তাঁতি পরিবারের সুবিমল বসাক,  জাহাজের খালাসি অবনী ধর, মালাকার পরিবারের নিত্য মালাকার ইত্যাদি। পরবর্তীকালে প্রচুর সাবঅলটার্ন কবি-লেখকগণকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে দেখা গেল।

    (৬) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো রচনায় যুক্তিবিপন্নতা, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোনোর প্রবণতা, আবেগের সমউপস্থিতি, কবিতার শুরু হওয়া ও শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না দেয়া, ক্রমান্বয়হীনতা, যুক্তির দ্বৈরাজ্য, কেন্দ্রাভিগতা বহুরৈখিকতা ইত্যাদি। তাঁদের আন্দোলনের পূর্বে টেক্সটে দেখা গেছে যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতন যুক্তি ধাপে-ধাপে এগোতো, কবিতায় থাকতো আদি-মধ্য-অন্ত, রচনা হতো একরৈখিক, কেন্দ্রাভিগ, স্বয়ংসম্পূর্ণতা।

    (৭) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে লেখক-কবিগণ আশাবাদে আচ্ছন্ন ছিলেন মূলত কমিউনিস্ট প্রভাবে। ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁরা বিচ্ছিন্ন ছিলেন। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ প্রথমবার হেটেরোটোপিয়ার কথা বললেন। হাংরি জেনারেশনের কবি অরুণেশ ঘোষ তাঁর কবিতাগুলোতে বামপন্থীদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। হাংরি জেনরেশনের পরের দশকের কবি ও লেখকগণের নিকট বামপন্থীদের দুইমুখো কর্মকাণ্ড ধরা পড়ে গিয়েছে, বিশেষ করে মরিচঝাঁপি কাণ্ডের পর।

    (৮) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে কবি-লেখকগণ মানকে সুনিশ্চিত করতে চাইতেন, পরিমেয়তা ও মিতকথনের কথা বলতেন, কবির নির্ধারিত মানে থাকত এবং স্কুল কলেজের ছাত্ররা তার বাইরে যেতে পারতেন না। হাংরি জেনারেশনের লেখকগণ অফুরন্ত অর্থময়তা নিয়ে এলেন, মানের ধারণার প্রসার ঘটালেন, পাঠকের ওপর দায়িত্ব দিলেন রচনার অর্থময়তা নির্ধারণ করার, প্রচলিত ধারণা অস্বীকার করলেন। শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার সঙ্গে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

    (৯) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে ‘আমি’ থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক আমি থাকতো, লেখক-কবি ‘আমি’র নির্মাণ করতেন, তার পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ড থাকতো, সীমার স্পষ্টিকরণ করতেন রচনাকার, আত্মপ্রসঙ্গ ছিল মূল প্রসঙ্গ, ‘আমি’র পেডিগ্রি পরিমাপ করতেন আলোচক। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ নিয়ে এলেন একক আমির অনুপস্থিতি, আমির বন্ধুত্ব, মানদণ্ড ভেঙে ফেললেন তাঁরা, সীমা আবছা করে দিলেন, সংকরায়ন ঘটালেন, লিমিন্যালিটি নিয়ে এলেন।

    (১০) হাংরি  জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে শিরোনাম দিয়ে বিষয়কেন্দ্র চিহ্ণিত করা হতো। বিষয় থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক মালিকানা ছিল, লেখক বা কবি ছিলেন টাইটেল হোলডার। হাংরি জেনারেশনের লেখক-কবিগণ শিরোনামকে বললেন রুবরিক; শিরোনাম জরুরি নয়, রচনার বিষয়কেন্দ্র থাকে না, মালিকানা বিসর্জন দিলেন, ঘাসের মতো রাইজোম্যাটিক তাঁদের রচনা, বৃক্ষের মতন এককেন্দ্রী নয়। তাঁরা বললেন যে পাঠকই টাইটেল হোলডার।

    (১১) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচিত হতো ঔপনিবেশিক মূল্যবোধ অনুযায়ী একরৈখিক রীতিতে। তাঁদের ছিল লিনিয়রিটি, দিশাগ্রস্ত লেখা, একক গলার জোর, কবিরা ধ্বনির মিল দিতেন, সময়কে মনে করতেন প্রগতি। এক রৈখিকতা এসেছিল ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থের কাহিনির অনুকরণে; তাঁরা সময়কে মনে করতেন তা একটিমাত্র দিকে এগিয়ে চলেছে। আমাদের দেশে বহুকাল যাবত সেকারণে ইতিহাস রচিত হয়েছে কেবল দিল্লির সিংহাসন বদলের। সারা ভারত জুড়ে যে বিভিন্ন রাজ্য ছিল তাদের ইতিহাস অবহেলিত ছিল। বহুরৈখিকতারে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘মহাভারত’। হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকগণ একরৈখিকতা বর্জন করে বহুরৈখিক রচনার সূত্রপাত ঘটালেন। যেমন সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ উপন্যাস, মলয় রায়চৌধুরীর দীর্ঘ কবিতা ‘জখম’, সুভাষ ঘোষের গদ্যগ্রন্থ ‘আমার চাবি, ‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট’ ইত্যাদি। তাঁরা গ্রহণ করলেন প্লুরালিজম, বহুস্বরের আশ্রয়, দিকবিদিক গতিময়তা, হাংরি জেনারেশনের দেখাদেখি আটের দশক থেকে কবি ও লেখকরা বহুরৈখিক রচনা লিখতে আরম্ভ করলেন।

    (১২) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে মনে করা হতো কবি একজন বিশেষজ্ঞ। হাংরি জেনারেশনের কবিরা বললেন কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য। পরবর্তী প্রজন্মে বিশেষজ্ঞ কবিদের সময় সমাপ্ত করে দিয়েছেন নতুন কবির দল এবং নবনব লিটল ম্যাগাজিন।

    (১৩) ঔপনিবেশিক প্রভাবে বহু কবি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতেন। ইউরোপীয় লেখকরা যেমন নিজেদের ‘নেটিভদের’ তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ কবিতা, শ্রেষ্ঠত্ব, বিশেষ একজনকে তুলে ধরা, নায়ক-কবি, সরকারি কবির শ্রেষ্ঠত্ব, হিরো-কবি, এক সময়ে একজন বড়ো কবি, ব্র্যাণ্ড বিশিষ্ট কবি আইকন কবি ইত্যাদির প্রচলন ছিল। হাংরি জেনারেশন সেই ধারণাকে ভেঙে ফেলতে পেরেছে তাদের উত্তরঔপনিবেশিক মূল্যবোধ প্রয়োগ করে। তারা বিবেচন প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা সরিয়ে দিতে পেরেছে, কবির পরিবর্তে একাধিক লেখককের সংকলনকে গুরুত্ব দিতে পেরেছে, ব্যক্তি কবির পরিবর্তে পাঠকৃতিকে বিচার্য করে তুলতে পেরেছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার কথা বলেছে। সার্বিক চিন্তা-চেতনা ও কৌমের কথা বলেছে। তাঁদের পরবর্তী কবি-লেখকরা হাংরি জেনারেশনের এই মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন।

    (১৪) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শব্দার্থকে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচলন ছিল। রচনা ছিল কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন। হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকরা বলেছেন, কথা চালিয়ে যাবার কথা। বলেছেন যে, কথার শেষ নেই। নিয়েছেন শব্দার্থের ঝুঁকি। রচনাকে মুক্তি দিয়েছেন আত্মমনস্কতা থেকে। হাংরি জেনারেশনের এই কৌম মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন পরবর্তীকালের কবি-লেখকরা। এই প্রভাব সামাজিক স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

    (১৫) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত ছিল ‘বাদ’ দেবার প্রবণতা; সম্পাদক বা বিশেষ গোষ্ঠী নির্ণয় নিতেন ‘কাকে কাকে বাদ দেয়া হবে’। হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সাংস্কৃতিক হাতিয়ার ছিল “এলিমিনেশন”। বাদ দেবার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে তাঁরা নিজেদের আয়ত্বে রাখতেন। হাংরি জেনারেশনের সম্পাদকরা ও সংকলকরা জোট বাঁধার কথা বললেন। যোগসূত্র খোঁজার কথা বললেন। শব্দজোট, বাক্যজোট, অর্থজোটের কথা বললেন। এমনকি উগ্র মতামতকেও পরিসর দিলেন। তাঁদের এই চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য পরবর্তীকালের সম্পাদক ও সংকলকদের অবদানে স্পষ্ট। যেমন, অলোক বিশ্বাস আটের দশকের সংকলনে ও আলোচনায় সবাইকে একত্রিত করেছেন। বাণিজ্যিক পত্রিকা ছাড়া সমস্ত লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রে এই গুণ উজ্বল।

    (১৬) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত একটিমাত্র মতাদর্শকে, ইজমকে, তন্ত্রকে, গুরুত্ব দেয়া হতো। কবি-লেখক গোষ্ঠীর ছিল ‘হাইকমাণ্ড’, ‘হেডকোয়ার্টার’, ‘পলিটব্যুরো’ ধরণের মৌরসি পাট্টা। হাংরি জেনারেশন একটি আন্দোলন হওয়া সত্বেও খুলে দিল বহু মতাদর্শের পরিসর, টুকরো করে ফেলতে পারলো যাবতীয় ‘ইজম’, বলল প্রতিনিয়ত রদবদলের কথা, ক্রমাগত পরিবর্তনের কথা। ভঙ্গুরতার কথা। তলা থেকে ওপরে উঠে আসার কথা। হাংরি জেনারেশনের পরে সম্পূর্ণ লিটল ম্যাগাজিন জগতে দেখা গেছে এই বৈশিষ্ট্য এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রভাব।

    (১৭) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত দেখা গেছে ‘নিটোল কবিতা’ বা স্বয়ংসম্পূর্ণ এলিটিস্ট কবিতা রচনার ধারা। তাঁরা বলতেন রচনাকারের শক্তিমত্তার পরিচয়ের কথা। গুরুগম্ভীর কবিতার কথা। নির্দিষ্ট ঔপনিবেশিক মডেলের কথা। যেমন সনেট, ওড, ব্যালাড ইত্যাদি। হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ নিয়ে এলেন এলো-মেলো কবিতা, বহুরঙা, বহুস্বর, অপরিমেয় নাগালের বাইরের কবিতা। তাঁদের পরের প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মাঝে এর প্রভাব দেখা গেল। এখন কেউই আর ঔপনিবেশিক বাঁধনকে মান্যতা দেন না। উদাহরণ দিতে হলে বলতে হয় অলোক বিশ্বাস, দেবযানী বসু, ধীমান চক্রবর্তী, অনুপম মুখোপাধ্যায়, প্রণব পাল, কমল চক্রবর্তী প্রমুখের রচনা।

    (১৮) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল স্থিতাবস্থার কদর এবং পরিবর্তন ছিল শ্লথ। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ পরিবর্তনের তল্লাশি আরম্ভ করলেন, প্রযুক্তির হস্তক্ষেপকে স্বীকৃতি দিলেন। পরবর্তী দশকগুলিতে এই ভাঙচুরের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যেমন কমল চক্রবর্তী, সুবিমল মিশ্র, শাশ্বত সিকদার, সুব্রত সেন, দেবজ্যোতি রায় ও নবারুণ ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে; তাঁরা ভাষা, চরিত্র, ডিকশন, সমাজকাঠামোকে হাংরি জেনারেশনের প্রভাবে গুরুত্ব দিতে পারলেন।

    (১৯) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে নাক-উঁচু সংস্কৃতির রমরমা ছিল, প্রান্তিককে অশোভন মনে করা হতো, শ্লীল ও অশ্লীলের ভেদাভেদ করা হতো, ব্যবধান গড়ে ভেদের শনাক্তকরণ করা হতো। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা সংস্কৃতিকে সবার জন্য অবারিত করে দিলেন। বিলোপ ঘটালেন সাংস্কৃতিক বিভাজনের। অভেদের সন্ধান করলেন। একলেকটিকতার গুরুত্বের কথা বললেন। বাস্তব-অতিবাস্তব-অধিবাস্তবের বিলোপ ঘটালেন। উল্লেখ্য যে বুদ্ধদেব বসু মলয় রায়চৌধুরীকে তাঁর দ্বারে দেখামাত্র দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালের লিটল ম্যাগাজিনে আমরা তাঁদের এই অবদানের প্রগাঢ় প্রভাব লক্ষ্য করি।

    (২০) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল ইউরোপ থেকে আনা বাইনারি বৈপরীত্য যা ব্রিটিশ খ্রিস্টানরা ধারণ করেছিল তাদের ধর্মের ঈশ্বর-শয়তান বাইনারি বৈপরীত্য থেকে। ফলত, দেখা গেছে ‘বড় সমালোচক’ ফরমান জারি করছেন কাকে কবিতা বলা হবে এবং কাকে কবিতা বলা হবে না; কাকে ‘ভালো’ রচনা বলে হবে এবং কাকে ভালো রচনা বলা হবে না; কোন কবিতা বা গল্প-উপন্যাস  উতরে গেছে এবং কোনগুলো যায়নি ইত্যাদি। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা এই বাইনারি বৈপরীত্য ভেঙে ফেললেন। তাঁরা যেমন ইচ্ছা হয়ে ওঠা রচনার কথা বললেন ও লিখলেন, যেমন সুভাষ ঘোষের গদ্য গ্রন্থগুলি। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন বহুপ্রকার প্রবণতার ওপর, রচনাকারের বেপরোয়া হবার কথা বললেন, যেমন মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী ও শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা। যেমন মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা ও ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাস। যেমন সুবিমল বসাকের বাঙাল ভাষার কবিতা যা এখন বাংলাদেশের ব্রাত্য রাইসুও অনুকরণ করছেন। হাংরি জেনারেশনের পরের দশকগুলিতে তাঁদের এই অবদানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, এবং তা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে।

    (২১) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল আধিপত্যের প্রতিষ্ঠার সাহিত্যকর্ম। উপন্যাসগুলিতে একটিমাত্র নায়ক থাকত। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ আধিপত্যের বিরোধিতা আরম্ভ করলেন তাঁদের রচনাগুলিতে। বামপন্থী সরকার থাকলেও তাঁরা ভীত হলেন না। হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সেকারণে ছিল খণ্ডবাদ বা রিডাকশানিজমের গুরুত্ব। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন কমপ্লেকসিটিকে, জটিলতাকে, অনবচ্ছিন্নতার দিকে যাওয়াকে। যা আমরা পাই বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, মলয় রায়চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ প্রমুখের গল্প-উপন্যাসে। পরবর্তী দশকগুলিতে দুই বাংলাতে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

    (২২) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল গ্র্যাণ্ড ন্যারেটিভকে। হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন মাইক্রো ন্যারেটিভকে, যেমন সুবিমল বসাকের ‘দুরুক্ষী গলি’ নামক উপন্যাসের স্বর্ণকার পরিবার, অথবা অবনী ধরের খালাসি জীবন অথবা তৎপরবতী কঠিন জীবনযাপনের ঘটনানির্ভর কাহিনি। পরবর্তী দশকগুলিতে দেখা যায় মাইক্রোন্যারেটিভের গুরুত্ব, যেমন গ্রুপ থিয়েটারগুলির নাটকগুলিতে।

    (২৩) হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ নিয়ে এলেন যুক্তির ভাঙন বা লজিকাল ক্র্যাক, বিশেষত দেবী রায়ের প্রতিটি কবিতায় তার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। পরের দশকের লেখক ও কবিদের রচনায় লজিকাল ক্র্যাক অর্থাৎ যুক্তির ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। যেমন সাম্প্রতিক কালে অগ্নি রায়,  রত্নদীপা দে ঘোষ, বিদিশা সরকার, অপূর্ব সাহা, সীমা ঘোষ দে, সোনালী চক্রবর্তী, আসমা অধরা, সেলিম মণ্ডল, জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়, পাপিয়া জেরিন প্রমুখ।

    (২৪) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে রচনায়, বিশেষত কবিতায়, শিরোনামের গুরুত্ব ছিল; শিরোনামের দ্বারা কবিতার বিষয়কেন্দ্রকে চিহ্ণিত করার প্রথা ছিল। সাধারণত বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত এবং সেই বিষয়ানুযায়ী কবি কবিতা লিখতেন। শিরোনামের সঙ্গে রচনাটির ভাবগত বা দার্শনিক সম্পর্ক থাকতো। ফলত তাঁরা মৌলিকতার হামবড়াই করতেন, প্রতিভার কথা বলতেন, মাস্টারপিসের কথা বলতেন। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ শিরোনামকে সেই গুরুত্ব থেকে সরিয়ে দিলেন। শিরোনাম আর টাইটেল হোলডার রইলো না। শিরোনাম হয়ে গেল ‘রুবরিক’। তাঁরা বহু কবিতা শিরোনাম র্বজন করে সিরিজ লিখেছেন। পরবর্তী দশকের কবিরা হাংরি জেনারেশনের এই কাব্যদৃষ্টির সঙ্গে একমত হয়ে কবিতার শিরোনামকে গুরুত্বহীন করে দিলেন; সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলেন যার একটিতেও শিরোনাম নেই।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: ফ্রয়েডীয় মনোবীক্ষণ কি কোনো ভাবেই হাংরি মুভমেন্টের গভীরতাকে সরলীকরল করতে পারে?

    মলয় রায়চৌধুরী: ফ্রয়েড সম্পর্কে জীবনানন্দের বক্তব্য পড়েছ? মাল্যবান উপন্যাসে মাল্যবান বলছে, “স্বপ্নের কী জানেন ফ্রয়েড? ভিয়েনা শহরে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে স্নায়ুরোগীদের স্বপ্ন নিয়ে কোনো স্বপ্নতত্ত্ব বানানো যায় না। চড়কের মাঠে কোনোদিন তো আর যাবেন না ফ্রয়েড সাহেব, স্বপ্নের আর কী বুঝবেন।” এই প্রসঙ্গে গৌতম মিত্র বলেছেন, “কী ভয়ঙ্কর রকমের আধুনিক একজন চিন্তক জীবনানন্দ দাশ ভেবে অবাক হই। ঠিক এখানেই ফ্রয়েডেরই শিষ্য কার্ল গুস্তাভ ইয়ুংও ফ্রয়েডের থেকে আলাদা হয়ে যান। ইয়ুংও মনে করেন, শুধু ব্যক্তি নির্জ্ঞান নয়, স্বপ্নের ক্ষেত্রে যৌথ নির্জ্ঞানেরও একটি ইতিবাচক ভূমিকা আছে। আর সেজন্যই কি জীবনানন্দ চড়কের ইঙ্গিত করেন? ফলিত বিজ্ঞানের ফ্রয়েড থেকে তত্ত্ব বিজ্ঞানের ইয়ুং বেশি কাছের।” হাংরি আন্দোলন একটা যৌথ মুভমেন্ট, তাকে ফ্রয়েডের তত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা ভুল হবে; তাছাড়া ফ্রয়েড বিশ্লেষণ করেছেন পাশ্চাত্য দৃষ্টিতে যার সঙ্গে প্রাচ্যের কৌম-মননের বিস্তর ফারাক।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: আমরা দেখেছি সে সময় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদোর দালি পরাবাস্তব চিত্রকাণ্ড নিয়ে মেতে আছেন। অথচ তার চিত্রগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দাদাইজমের শিকড় পাওয়া যায়। ইজম কেন্দ্রিক সুন্দর নির্মাণ কিংবা আঁকবার চেষ্টাটা কি হাংরি আন্দোলন ভেঙে দিয়েছিলো? হতে পারে সেটি কবিতায়, গদ্যে কিংবা আঁকা ছবিতে। বাস্তবতা তো কবিতার মতো সুন্দর না, আঁকা ছবির মতো কালার কনট্রাস্টে ভরা না! আপনার অভিমত কী?

    মলয় রায়চৌধুরী: পরাবাস্তববাদের নেতা আঁদ্রে ব্রেতঁ দালির পেইনটিঙগুলো পরাবাস্তব প্রদর্শনী থেকে বের করে ফেলে দিয়েছিলেন। তা জানো? অথচ দালি নিজেকে বলেছেন পরাবাস্তববাদী, ডাডাবাদী নয়। দালির পেইনটিঙ সুন্দর নয় বলতে চাইছ? ভাউল ধারণা। তাহলে পিকাসোকে কী বলবে। আমি ইউরোপে গিয়ে ওনাদের পেইনটিঙ দেখেছি আর হর্ষ অনুভব করেছি। হাংরি আন্দোলনে কয়েকজন পেইনটার ছিলেন, যাদের মধ্যে অনিল করঞ্জাই অগ্রগণ্য। ওনাকে নিয়ে ইংরেজিতে একটা বই বেরিয়েছে ২০১৮ সালে, জুলিয়েট রেনল্ডস-এর লেখা, ‘রোডস অ্যাক্রস দ্য আর্থ’ নামে। আমি নিশ্চিত যে এই বইটাও বাংলাদেশে যায়নি। বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি যদি হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত বইগুলো ওনাদের লাইব্রেরিতে রাখেন তাহলে ওখানকার পাঠকদের সুবিধা হবে। তোমরা অনুরোধ করে দেখতে পারো।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: হাংরি মুভমেন্ট নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার যখন সরব তখন আমেরিকা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয় রায়চৌধুরীকে লিখে পাঠালেন, “কলকাতা শহরটা আমার, ফির গিয়ে আমি ওখানে রাজত্ব করব। দু’একজন বন্ধুবান্ধব ওই দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশন গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি। এখনও সে ক্ষমতা রাখি। লেখার বদলে হাঙ্গামা ও আন্দোলন করার দিকেই তোমার লক্ষ্য বেশি। যতো খুশি আন্দোলন করো, বাংলা কবিতার এতে কিছু এসে যায় না।”  সুনীলের এই বক্তব্য জানবার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল? কিংবা আপনার সহযোদ্ধা কবি-বন্ধুদের কী বলেছিলেন?

    মলয় রায়চৌধুরী: আমার চিঠির জবাবেই সুনীল ওই চিঠিটা আমাকে লিখেছিলেন। উনি ভেবেছিলেন ওনার অবর্তমানে আমরা বাংলা সংস্কৃতির দখল নিয়ে নিচ্ছি। ওই সময়েই উনি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসুকে লিখেছিলেন হাংরি আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যেতে। ওনার মনে হয়েছিল ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার বিরুদ্ধে খাড়া করা হয়েছে হাংরি আন্দোলনকে। কিন্তু কৃত্তিবাস তো ছিল একটা পত্রিকা, ফিরে এসে আবার শুরু করে চালিয়েছেন মৃত্যু পর্যন্ত। আমরা খুব হাসাহাসি করেছিলুম ওনার চিঠি পড়ে। শক্তিকে নেতা করা হয়েছিল বলে সুনীল চটে গিয়েছিলেন। আমেরিকা যাবার আগে আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে উনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন. “আমি কী শক্তির থুতু চাটবো?”  ফিরে এসে ‘যুগশঙ্খ’ পত্রিকায় বাসব রায়কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মলয় আমার আমেরিকাবাসের সুযোগটা নিয়েছিল’। যে-কোনো আন্দোলনের জন্ম হয় কোনো না কোনো আধিপত্যপ্রণালীর বিরুদ্ধে। তা সে রাজনৈতিক আধিপত্য হোক বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক, নান্দনিক, ধার্মিক, সাহিত্যিক, শৈল্পিক ইত্যাদি আধিপত্য হোক না কেন। আন্দোলন-বিশেষের উদ্দেশ্য, অভিমুখ, উচ্চাকাঙ্খা, গন্তব্য হল সেই প্রণালীবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে পরিসরটিকে মুক্ত করা। হাংরি আন্দোলন কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প ছিল না, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁকে না জানিয়ে তাঁকে বাদ দেবার জন্যেই এই আন্দোলন। তাঁর ধারণা ভুল ছিল। যে-কোনো কবি বা লেখক, ওই আন্দোলনের সময়ে যিনি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করেছেন, তাঁর খুল্লমখুল্লা স্বাধীনতা ছিল হাংরি বুলেটিন বের করার। বুলেটিনগুলোর প্রকাশকদের নাম-ঠিকানা দেখলেই স্পষ্ট হবে (অন্তত যে কয়টির খোঁজ মিলেছে তাদের ক্ষেত্রেও) যে, তা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্নজন কতৃক ১৯৬৩’র শেষ দিক থেকে ১৯৬৪ এর প্রথম দিকে প্রকাশিত। ছাপার খরচ অবশ্য আমি বা দাদা যোগাতাম, কেননা, অধিকাংশ আন্দোলনকারীদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসুও নিজের খরচে বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ হাংরি বুলেটিন কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না। এই বোধের মধ্যে ছিল পূর্বতন সন্দর্ভগুলোর মনোবীজে লুকিয়ে-থাকা সত্বাধিকার-বোধকে ভেঙে ফেলার প্রতর্ক। সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা আসার আগে বঙ্গদেশে পারসোনাল পজেশান  ছিল, কিন্তু প্রায়ভেট প্রপার্টি  ছিল না। ইউরোপীয়রা বাঙালিকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পেরেছিল, এবং তা করার পরই ব্যক্তিমানুষ প্রকৃতির মালিকানা দাবি করার যোগ্য মনে করা আরম্ভ করেন নিজেকে। হাংরি আন্দোলনের সময়ে সুবিমল বসাক, হিন্দি কবি রাজকমল চৌধুরীর সঙ্গে, একটি সাইক্লোস্টাইল-করা ত্রিভাষিক (বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি) বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন, তদানীন্তন সাহিত্যিক সন্দ্যফের প্রেক্ষিতে হাংরি প্রতিসন্দর্ভ যে কাজ উপস্থাপন করতে চাইছে তা স্পষ্ট করার জন্যে। তাতে দেয়া তালিকাটি থেকে আন্দোলনের অভিমুখের কিছুটা হদিশ মিলবে:

    প্রথাগত সাহিত্য সন্দর্ভ

    হাংরি প্রতিসন্দর্ভ

    প্রাতিষ্ঠানিক

    শাসক সম্প্রদায় (টিরানি)

    ভেতরের লোক (অন্দরুনি)

    এলিটেতর সংস্কৃতি (ঢাকোসলা)

    তৃপ্ত

    আসঞ্জনশীল

    লোকদেখানো (দিখাওয়া)

    জ্ঞাত যৌনতা (পরিচিত )

    সিশিয়ালিস্ট

    প্রেমিক (দুলারা)

    একসট্যাসি

    নিশ্চল (আনমুভড)

    ঘৃণার কামোফ্লাজ

    আর্ট (ফিল্ম)

    শিল্প

    রবীন্দ্রসঙ্গীত (সুগমসঙ্গীত)

    স্বপ্ন (ড্রিম)

    শিষ্ট ভাষা (টিউটর্ড)

    রিদিমড (দায়মুক্ত)

    ফ্রেমের মধ্যে

    কনফরমিস্ট (অনুগত)

    উদাসীন (ইনডিফারেন্ট)

    মেইনস্ট্রিম (মূলস্রোত)

    কৌতুহল

    আনন্দ (এন্ডোক্রিন)

    পরিণতি অবশ্যম্ভাবী

    সমাপ্তি প্রতিমা (আনুষ্ঠানিক)

    ক্ষমতাকেন্দ্রিক (সিংহাসন)

    মনোহরণকারী (এনটারটেইনার)

    আত্মপক্ষ সমর্থন

    আমি কেমন আছি (একপেশে)

    প্রতিসম

    ছন্দের একাউন্ট্যান্ট

    কবিতা নিখুঁত করতে কবিতা রিভাইজ

    কল্পনার খেলা

    প্রতিষ্ঠানবিরোধী

    শাসকবিরোধী (প্রটেস্টার)

    বহিরাগত (হামলাবোল)

    জনসংস্কৃতি

    অতৃপ্ত

    খাপছাড়া (ব্রিটল)

    ছামড়া ছাড়ানো ( বোন)

    অজ্ঞাত যৌনতা (অপরিচিত)

    সোশিয়েবল

    শোককারী (মোর্নার)

    অ্যাগনি

    তোলপাড় (টার্বুলেন্ট)

    খাঁটি ঘৃণা

    জনগণ (সিনেমা)

    জীবনসমগ্র

    যে কোনো গান

    দুঃস্বপ্ন (নাইটমেয়ার)

    গণভাষা (গাট ল্যাংগুয়েজ)

    আনরিডিমড (দায়বদ্ধ)

    ফ্রেমহীন (কনটেসটেটরি)

    ডিসিডেন্ট (ভিন্নমতাবলম্বী)

    এথিকসসংক্রান্ত

    ওয়াটারশেড (জলবিভাজিকা)

    উদ্বেগ

    উৎকন্ঠা (অ্যাড্রেনালিন)

    উন্মেষের শেষ নাই

    সতত সৃজ্যমান (উৎসব)

    ক্ষমতাবিরোধী (সিংহাসনত্যাগী)

    চিন্তাপ্রদানকারী (থটপ্রোভোকার)

    আত্মআক্রমণ

    সবাই কেমন আছে

    অসম্বদ্ধ (স্ক্যাটার্ড)

    বেহিসাবি ছন্দ খরচ

    জীবনকে প্রতিনিয়ত রিভাইজ

    কল্পনার কাজ

     

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: ’৬৫ সালে নিজের দাদার সাথে আপনিসহ ৬ জন কবি গ্রেপ্তার হন। বাংলা সাহিত্য ইতিহাসের এই বিরল ঘটনার পর হাংরি মুভমেন্ট কোন পথে ধাবিত হয়েছিল?

    মলয় রায়চৌধুরী: সবাই ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। মামলাটা কেবল আমার বিরুদ্ধে হয়েছিল, প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার বিরুদ্ধে, পঁয়ত্রিশ মাস। কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। চাকরি থেকে সাসপেণ্ড ছিলুম বলে টাকাকড়িরও টানাটানি ছিল, এক বেলা খেয়ে চালিয়ে দিতুম। কিন্তু আন্দোলনের পত্রপত্রিকা নিয়মিত বেরোতো তা তো এক্ষুনি উল্লেখ করেছি। এক পাতার বুলেটিন ছাপানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কেননা প্রেসগুলো হাংরি শুনলেই ভয় পেতো। বই-পত্রিকা ছাপাতুম বহরমপুরের একটা প্রেসে। মামলার পর হাংরি আন্দোলনের প্রভাবে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে লিটল ম্যাগাজিনের কবিতা ও গদ্যের সৃজনশীলতায়।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: আন্দোলন সংশ্লিষ্ট তরুণ কবিদের হাংরি জেনারশন বলে সম্বোধন করা হলো। তো এই জেনারেশন হাংরি মুভমেন্টের মাধ্যমে আসলে কী অর্জন কিংবা কী তুলে ধরতে চাইছিলো?

    মলয় রায়চৌধুরী: ওই তো, অভিজিত পালের লেখাটায় সবই তো বলা হয়ে গেছে।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: কোনো কারণে কি এই আন্দোলন জনবিচ্ছন্ন ছিল? থাকলে সেটি কী? কিংবা এই আন্দোলনকে দালাল শ্রেণির মানুষ সাধারণের বিপরীতে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছিল?

    মলয় রায়চৌধুরী: জনসাধারণের সঙ্গে সাহিত্য আন্দোলনের যোগাযোগ কোনো দেশেই হয়নি কখনও। এক পাতার বুলেটিনে যা করা গিয়েছিল তাই যথেষ্ট। আমাদের বইপত্র কোনোকালেই কমার্শিয়াল ছিল না। বড়ো প্রকাশকরা আগ্রহ দেখায়নি, আজও দেখায় না । আমার বিরোধী লেখক-কবিতে এখনও কফিহাউস ছেয়ে আছে। তাদের যদি দালাল বলো তো আমার আপত্তি নেই।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। হাংরি আন্দোলন সূত্রপাত হওয়ার আগেকার মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে জানতে চাই। কেমন ছিল ২১ বছরের তরুণ মলয় রায়চৌধুরী?

    মলয় রায়চৌধুরী: আবার একই কথা বলতে হচ্ছে। আমার স্মৃতিকথাগুলো পোঁছিচ্ছে না বাংলাদেশে। তুমি যোগাড় করতে পারলে আমার ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা; ছোটোলোকের যুববেলা’ আর ছোটোলোকের শেষবেলা পোড়ো। যদি চাও তো তোমার সাইটে ‘আমার জীবন’ প্রকাশ করতে পারো, তাতে সব পাবে। বলো তো পাঠিয়ে দিই।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: আর আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়বার পর একজন মলয় রায়চৌধুরীকে আপনি নিজে কীভাবে খণ্ডন করবেন?

    মলয় রায়চৌধুরী: খণ্ডন করতে যাবো কেন? সব আন্দোলনই তার সময়ের প্রডাক্ট। এখন কেউ কি মহাকাব্য বা মঙ্গলকাব্য লেখে? লেখে না ,কারণ ওগুলো ছিল তাদের সময়ের প্রডাক্ট। মলয় রায়চৌধুরীর লেখালিখি সম্পর্কে জানতে হলে তুমি গোটাকতক বই অন্তত পড়ো। তাহলে নিজেই টের পাবে।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: হাংরি মুভমেন্ট পরবর্তি সময়ে হাংরি জেনারেশনের অবস্থানটা সামাজিকভাবে কেমন ছিল? মানুষ কীভাবে গ্রহণ করেছিল তাদের?

    মলয় রায়চৌধুরী: বললুম তো, জনসাধারণের স্তরে সৃজনশীল সাহিত্য সেইভাবে পৌঁছোয় না যেমন যায় কমার্শিয়াল লেখা বা পাল্প ফিকশান। এই যে ষাট বছর পর তুমি হাংরি আন্দোলনে আগ্রহী, এটাই তো প্রমাণ যে আন্দোলন একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্হান গড়ে ফেলতে পেরেছে।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: হাংরি আন্দোলনে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বটা কেমন ছিল? আন্দোলনটা চিমসে যাওয়ার পর শক্তির সমাজ এবং আত্ম পরম্পরাটা কেমন দেখেছেন?

    হাংরিয়ালিস্ট কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়

    মলয় রায়চৌধুরী: শক্তি ওই এক বছরই ছিলেন। শক্তি ছেড়ে যান কারণ উনি দাদার শ্যালিকা শীলার সঙ্গে প্রেম করতেন। দাদার চাইবাসার বাড়িতে তিন বছর ছিলেন, প্রেম করবার সময়ে। শক্তির কাব্যগ্রন্থ ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্যর’ কবিতাগুলো শীলাকে নিয়ে লেখা। দাদার শশুরবাড়ি চাইবাসায়। দাদার শশুর একজন মাতাল আর বেকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাননি। শক্তি ভেবেছিল আমি আর দাদা বিরোধিতা করেছি বলে শীলার সঙ্গে ওনার বিয়েটা ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছে। ব্যাস চটে গেলেন আমার আর দাদার ওপর। বদলা নিলেন কাঠগড়ায় সরকারি সাক্ষীর রূপে দাঁড়িয়ে।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: ‘The Decline of the West’ বইটি হাংরি মুভমেন্টের সাথে কীভাবে জড়িয়ে গেল? একইসাথে জানতে চাইছি হাংরির দার্শনিক অবয়বটা আসলে কী?

    “History exists only as the history of something. IT we are referring to the history of the great Cultures, then nation is the thing moved. State, status, means condition, and we obtain our impression of the State when, as a Being in moved Form flows past us, we fix in our eyes the Form as such, as something extended and timelessly standing fast, and entirely ignore direction and Destiny.”

    মলয় রায়চৌধুরী: অসওয়াল্ড স্পেঙলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট বইটা পড়ার পরই আমার ধারণা হয় সমাজ কী ভাবে কাজ করছে ভারতে, বিশেষভাবে পশ্চিমবাংলায়। সেই সময়ে আমি ইতিহাসের দর্শন নামে একটা ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখছিলুম বিংশ শতাব্দী পত্রিকায়। অসওয়াল্ড স্পেঙলার বলেছেন, একটি সংস্কৃতি কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা লিনিয়র নয়, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়। তা হল জৈবিক প্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশ কোন দিকে কার বাঁকবদল ঘটবে, তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করতে থাকে; তার নিত্য নতুন স্ফূরণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় থেকে আরম্ভ হয়, যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তা-ই ‘আত্মসাৎ’ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন। আমার মনে হয়েছিল, দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ঙ্কর অবসাদের মুখে পড়েছে। কলকাতা থেকে পাণিহাটি যাবার সময়ে (দাদা সমীর পাণিহাটিতে মামার বাড়িতে থেকে কলকাতার সিটি কলেজে যাতায়াত করতেন) আমি আর দাদা উদ্বাস্তুদের অসহায় জীবন প্রত্যক্ষ করতুম প্রতিদিন, কলকাতার পথে দেখতুম বুভুক্ষুদের প্রতিবাদ মিছিল। ক্ষোভ, ক্রোধ, প্রতিবাদ প্রকাশ করার জন্য আমাদের দুজনের মনে হয়েছিল হাংরি আন্দোলন জরুরি। আমার মনে হয়, তাঁরা না করলেও অন্যেরা এই ধরণের আন্দোলন করত, প্রতিষ্ঠানকে নাস্তানাবুদ করত। আমি ওই সময়টাকে ধরার চেষ্টা করেছি ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে; বইটা ঢাকায় পাওয়া যায়।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: হাংরির ঢেউ বাংলাদেশেও এসেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে আশির দশকের কবিদের লেখনীতে কদাচিৎ আঁচ পাওয়া যায়। কারণ তখন বাংলাদেশের যুব সমাজ একটা বিশৃঙ্খল আর স্বৈরাচারী শৃঙ্ক্ষলে আটকা পড়েছিল। ফলে সে সময় কবিরা শিল্পীরা একাট্টা হয়ে লড়তে থাকে। আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন, বাংলাদেশের আশির দশকের সাহিত্য?

    মলয় রায়চৌধুরী: বাংলাদেশের সাহিত্যে আঁচের ব্যাপারটা জানি না। তোমার মুখেই প্রথম শুনছি।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: এটা বলার অবশেষ থাকে না যে, হাংরি জেনারেশন দেশ ছাড়িয়ে মহাদেশে তার ঢেউ খেলিয়ে দিয়েছে। হাংরিয়ালিস্টদের রুখতে রাষ্ট্রযন্ত্র তার কূটকৌশলের প্রকাশ ঘটিয়েছে। তো, হাংরিকে আপনি কতোটা সমাজবান্ধব আন্দোলন বলে মূল্যায়ন করবেন?

    মলয় রায়চৌধুরী: ওসব মূল্যায়ন তোমরা করবে, সমাজ-বিশ্লেষকরা করবেন। ওটা আমার কাজ নয়।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন: সবশেষ জানতে চাই, হাংরিয়ালিস্ট যদি একটি মতবাদ হয়ে উঠে তবে বাংলাসাহিত্যে এর প্রভাব এবং বর্তমান সাহিত্যে এর মেলবন্ধনটা কী? 

    মলয় রায়চৌধুরী: যে-কোনো আন্দোলনের জন্ম হয় কোনো না কোনো আধিপত্যপ্রণালীর বিরুদ্ধে। তা সে রাজনৈতিক আধিপত্য হোক বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক, নান্দনিক, ধার্মিক, সাহিত্যিক, শৈল্পিক ইত্যাদি আধিপত্য হোক না কেন। আন্দোলন-বিশেষের উদ্দেশ্য, অভিমুখ, উচ্চাকাঙ্খা, গন্তব্য হল সেই প্রণালীবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে পরিসরটিকে মুক্ত করা। হাংরি আন্দোলন কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প ছিল না, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁকে না জানিয়ে তাঁকে বাদ দেবার জন্যেই এই আন্দোলন। তাঁর ধারণা ভুল ছিল। যে-কোনো কবি বা লেখক, ওই আন্দোলনের সময়ে যিনি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করেছেন, তাঁর খুল্লমখুল্লা স্বাধীনতা ছিল হাংরি বুলেটিন বের করার। বুলেটিনগুলোর প্রকাশকদের নাম-ঠিকানা দেখলেই স্পষ্ট হবে (অন্তত যে কয়টির খোঁজ মিলেছে তাদের ক্ষেত্রেও) যে, তা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্নজন কতৃক ১৯৬৩-র শেষ দিক থেকে ১৯৬৪ এর প্রথম দিকে প্রকাশিত। ছাপার খরচ অবশ্য আমি বা দাদা যোগাতাম, কেননা, অধিকাংশ আন্দোলনকারীদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসুও নিজের খরচে বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ হাংরি বুলেটিন কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না। এই বোধের মধ্যে ছিল পূর্বতন সন্দর্ভগুলোর মনোবীজে লুকিয়ে-থাকা সত্বাধিকার-বোধকে ভেঙে ফেলার প্রতর্ক।

    সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা আসার আগে বঙ্গদেশে পারসোনাল পজেশান  ছিল, কিন্তু প্রাইভেট প্রপার্টি  ছিল না।

    ইউরোপীয়রা বাঙালিকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পেরেছিল, এবং তা করার পরই ব্যক্তিমানুষ প্রকৃতির মালিকানা দাবি করার যোগ্য মনে করা আরম্ভ করেন নিজেকে।

    হাংরি আন্দোলনের কোনো হেডকোয়ার্টার, হাইকমাণ্ড, গভর্নিং কাউন্সিল বা সম্পাদকের দপতর ধরণের ক্ষমতাকেন্দ্র ছিল না, যেমন ছিল কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস ইত্যাদি পত্রিকার ক্ষেত্রে, যার সম্পদক বাড়ি বদল করলে পত্রিকার ক্ষমতাকেন্দ্র সেই বাড়িতে চলে যেত। হাংরি আন্দোলন কুক্ষিগত ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারণাকে অতিক্রম করে প্রতিসন্দর্ভকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রান্তবর্তী এলাকায়, যে কারণে কেবল বহির্বঙ্গের বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক ছাড়াও তা হিন্দি, উর্দু, নেপালি, অসমীয়া মরাঠী ইত্যাদি ভাষায় ছাপ ফেলতে পেরেছিল। হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্যের ভাষা আসলে ভূমিকম্পের মতো। সেই ভূমিকম্প প্রচলিতের ভিতে আঘাত করেছিল, ক্ষত সৃষ্টি করেছিলো। যার আফটার এফেক্টে একপ্রকার উপকার হয়েছে বাংলা সাহিত্যের। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ সমালোচনায় শৈলেন সরকার বলেছেন, “হাংরি-র পুরনো বা নতুন সব কবি বা লেখকই কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করেছেন অবদমিতের ভাষা। এঁদের লেখায় অনায়াসেই চলে আসে প্রকৃত শ্রমিক-কৃষকের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দাবলি। ভালবাসা-ঘৃণা বা ক্রোধ বা ইতরামি প্রকাশে হাংরিদের কোনও ভণ্ডামি নেই, রূপক বা প্রতীক নয়, এঁদের লেখায় যৌনতা বা ইতরামির প্রকাশে থাকে অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ— একেবারে জনজীবনের তথাকথিত শিল্পহীন কথা।’’ এইধরণের সাহিত্য বোধের প্রয়োজন এখনও ফুরায়নি।

    মুক্তচিন্তা-বাকস্বাধীনতা এসব শুধু টার্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, মত প্রকাশের অধিকার আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। এখনকার এই প্রচলিত সাহিত্যচর্চা সমাজকে কতোটা পরিবর্তন করতে পারছে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। বস্তুত সেই থ মেরে থাকা অবস্থা সাহিত্যে আজো কাটেনি, সাহিত্য এখনও কর্পোরেট দাসত্বে আটকে আছে। বিভিন্ন বাধ্যবাধকতায় লেখকের স্বাধীনতা এখন খাঁচায় বন্দী। এখনও মাঝে-মধ্যে কিশোর-তরুণরা এখান-সেখান থেকে নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে গর্বিত হন। ফেসবুকে হাংরি জেনারেশন নামে তরুণদের কয়েকটা গোষ্ঠী নজরে পড়েছে। 

  • মলয় রায়চৌধুরী | 106.213.52.40 | ০২ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:৩৩735286
  • ‘যুগান্তর’ সংবাদপত্রে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে প্রধান সম্পাদকীয়, ১৯ জুলাই ১৯৬৪

     

    যুগান্তর’ সংবাদপত্রে হাংরি আন্দোলন নিয়ে প্রধান সম্পাদকীয়
    কলকাতা, ১৯ জুলাই ১৯৬৪
    হাংরি আন্দোলন মামলা রুজু হবার আগে ।
    দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় লেখা প্রধান সম্পাদকীয় ।
    শিরোনাম : ‘আর মিছিলের শহর নয়’

    “বাংলাদেশে দলাদলিতে দীর্ণ বিশ্বাসহীন রাজনীতি আজ নিজের মস্তক চর্বণ করিতে ব্যস্ত । এই আবহাওয়ার জন্যই কি সমাজে এক ধরণের নিরাশাবাদ জন্মলাভ করিতেছে, যার চেহারা ড্রেনপাইপ মস্তানি, যার আওয়াজ রাস্তার রোমিওদের শিস এবং সাহিত্যের ‘ক্ষুৎকাতরতার’ মধ্যে ভয়াবহভাবে প্রকাশ পাইতেছে ? কাজেই ইহা আশ্চর্য নয়, এই সব বিকৃতির উপাসকরা যারা ‘হাংরি জেনারেশন’ নাম ধারণ করিয়াছে, তারা পরম শ্রদ্ধাহীন অবজ্ঞায় ‘গণিকার মৃতদেহ ও গর্দভের লেজের মাঝে কোথাও’ রাজনীতিকদের স্হান নির্দেশ করিতে চাহিতেছে । কলিকাতার ক্ষুধার্ত ছেলেরা এই ধিক্কার দিতেছে এবং আত্মধিক্কারের মধ্যে বন্দী হইতেছে, ইহা কি বন্ধ্যা রাজনীতিকদের প্রায়শ্চিত্ত অথবা অসুস্হ সমাজের অভিশাপ ?”

  • মলয় রায়চৌধুরী | 106.213.52.40 | ০২ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:৪৭735287
  •  
     

     

    LETTERS TO MALAY ROYCHOUDHURY

    Introduced by Gargi Ghosh Dastidar

    (These letters are of immense importance to readers and researchers of The Hungry Generation Movement which took place in Bengali literature during the sixties. Tridib Mitra, one of the eminent members of the movement had edited and published these letters when the movement became famous throughout the world. Only 200 copies were published, as the legend goes, and it has become impossible to trace out a copy, except for in Subimal Basak’s Archive at 22/6 Verner Lane, Kolkata 700 056, and Sandip Dutta’s Hungryalist Archive at 18M Tamer Lane, Kolkata 700 009.

    In view of growing interest evinced by M. Phil. and Ph.D. students of various Universities, I have decided to place it on the Web. The cover of the collection was designed by Argentinian artist Carlos Coffen, which was facilitated by Margaret Randall, the then editor of El Corno Emplumado. As we all know, Malay Roychoudhury has declared that nobody holds the copyright of his collections and works.

    The Hungryalist Movement was launched in November 1961 from Patna town by Samir Roychoudhury, Shakti Chattopadhyay, Malay Roychoudhury and Debi Roy [also known as Haradhon Dhara]. They got the word ‘Hungry’ from Geoffrey Chaucer’s line “In the Sowre Hungry Tyme”. They felt at that time that the post-colonial dream of a new, ecstatic, resurgent India had turned sour, and we were hurtling towards a nightmare; the Indian ‘time’ had been engulfed in gradual putrefaction leaving a sour taste in Bengali discourse. This idea was given a premise based on what Oswald Spengler had explained in ‘The Decline of the West’. Spengler had seen history not as a linear progression, but as the flowering of a number of self-contained cultures, each with a characteristic spiritual tone, or conception of the space within which they are to act. Spengler had also argued that cultures go through a self-contained process of growing, going through their seasons, and perishing. The Hungryalist quartet thought that Bengali culture had reached its zenith during 19th Century Renaissance, and it was on its way to metamorphosis through insatiable hunger for outside inputs.

    The movement took on, and about 35 poets, writers and artists joined the counter-cultural happening. The movement got world-wide publicity and the participants came in contact with writers and editors of various languages. Their letters etc. may be found archived in the personal collections of foreign poets and editors at Universities. Here are the ‘Hungryalist Letters’from:

    Robert Kelly, Allen Ginsberg, Howard McCord, Margaret Randall, Carol Berge, Daisy Aldan, Lawrence Ferlingheti, Octavio Paz, Ameeq Hanfee, Gordon Lasslett, Dan Georgakas, Carl Weissner, Rajkamal Choudhury, George Dowden, and Ida Spaulding). Link: http:/thewastepaper.blogspot.com

    A Few Words

    Dear Reader, here are 23 letters to you from 15 militant voices of the world .Read them, for they are addressed to Malay Roychoudhury, the most uncomfortable and dangerous poet of Bengal and of this equally dangerous planet.

    I decided to sew a bunch when I last visited Malay, and found thousands of letters dumped in a trunk lying in a corner of his room. Most of those letters are in Bengali. I had little time and could not go through all of them. I would like to edit a Bengali bunch later as I have found them to be of the most burning breathings I have ever encountered.

    In this collection you will find letters from those persons only whom I have heard of, and am Damn fascinated for. Maybe it is idiosyncratic. But take it easy: in that trunk there might be more interesting letters from these 15 voices themselves. These beautiful letters, stepped up chronologically, are going to expose to you not only the personality of the writer but the gradual development of Malay’s personality as well.

    Calcutta

    26th January, 1968 Tridib Mitra

    Robert KellyBard CollegeAnnandale-on-HudsonNew York

    April 1964

    Dear Malay,

    Your letter gave me much pleasure, the touch of the exciting things that are happening, you happening them, where you are. (& of course how could your letter not excite me, even if in the wrongest way, coming as it does from a country I am forever visiting obliquely, tangentially, like the moth around the big white glass ball in my kitchen that holds an electric light; a light he can never get to, but move always, in crazy tangents, around the globe that both reveals & cancels the light itself. I mean the phantasm that India is in my spirit, in my balls wd say, Konarak, the weight of the body swayed, endangered, balanced! Made me move, forwards & backwards, for its own highest purposes. It seems to me India knows the body & makes and makes a great pretence of non-cherishing it, only to stimulate truly our investigations of it. But I understand that it must be hateful to you to be praised for India, yet how can I get that music out of my head, if I wanted to, to write to you clearly? I cant, & that’s all there is to it. We are where we are, in all ways, with all that means.

    I hear you, via Margaret & obliquely via Ginsberg, & from your manifestoes & from your own good letter. A letter I am slow in answering, forgive me, the rush of busy-ness, all things asswise and sublime at once, the push of all that’s on.

    I’m not a professor; I’m low ranking teacher at a small college in the Hudson Valley, a beautiful place, trees & river & skies, for me who have lived all my life in NY, the city, The City. Teaching is job, you understand, often a joyful one, that sustains me while I write. Often an anguish of short time. I’m 28, a poet. OK.

    I’m sending you a copy of the first issue of MATTER, a newsletter of poetry, I edit here, & will send you copies of TROBAR, of which I am the co-editor---that is published in New York.

    Do you write poetry in English at all? Please let me see some, if so.

    Thank you again for your letter, & don’t let my delay in answering put you off. Keep well. Our spring has come, wet& warm, just now not a breath of wind, a great stillness.

    Love

    Robert

    (Gargi’s note: Margaret refers to Margaret Randall). Link: en.wikipedia.org/wiki/Robert_Kelly_(poet)

    ************************************************************************

    Allen Ginsberg, 704 East, 5th StreetNew York

    28 September, 1964

    Dear Malay,

    I saw clippings from BLITZ, Sept 19, 1964 p6 and also I think Calcutta STATESMAN 17 September 1964 that you were arrested as well as Samir and two boys named Ghosh whom I don’t know, for your HUNGRY GENERATION manifestoes. Are these the same as were printed in the issue of KULCHUR#15? As soon as I read about it, I racked my brain what I could do to help, and so today wrote a whole bunch of letters to the following:-

    A.S.Raman, Editor, Illustrated Weekly, Dr. Dadabhai Naoroji RoadBombay.

    Sharad Deora, Editor,Gyanodaya, 18 Brabourne RoadCalcutta.

    Abu Sayeed Ayub, Editor, Quest ( sent message to him indirectly), and member of Indian Congress for Cultural Freedom.

    Shyam Lall, Editor, Times of IndiaNew Delhi.

    Khushwant Singh, novelist and member of Congress for Cultural Freedom, 49 East Sujan Singh RoadNew Delhi.

    I also wrote to Jyoti Dutta and phoned Lita Hornick of KULCHUR. I asked them, the Indians above all, what they could do to help you, suggested they activate the congress for Cultural Freedom as this sort of thing is the proper activity of the Congress and Quest magazine, and told them that the manifestoes were printed here in CITY LIGHTS JOURNAL and KULCHUR, and were not obscene. So the whole mess was scandalous bureaucratic illiteracy. Please if you need literary help or advice do try to contact these people for support. And in addition perhaps ask for advice/help from Mrs. Pupul Jayakar, 130 Sundar Nagar, New Delhi---she was our protectress in India, we stayed with her, she’s a friend of Indira Gandhi and others. I also notified Bonnie Crown here in New York, the Asia Society, 112E 64 Street, NYC---she commissioned poetry to be translated by Sunil and others and that pack of poems plus your rhythms etc. will be printed together by CITY LIGHTS. She can send you a letter on her official stationary saying your manifestoes are known, published and respected in US and not considered obscene. I will also enquire of Mr. S.K.Roy, the Indian Consul General here in New York who I do not know what he can do at this distance.

    If there is anything you want me to do let me know. Write me and let me know what the situation is and what is the cause of the trouble. In judging from BLITZ I suspected jealous ideological Marxists or something. Are you ruined at the bank?? I hope not. Regard to your family. Get the Congress for Cultural Freedom to supply you with a good lawyer who’ll take no fee. If the Indian Congress doesn’t cooperate, let me know, we’ll explain to the European office. Who are the Ghosh brothers? The manifestoes on prose and politics are pretty funny. I thought they were a little literary-flowery, but they MUST HAVE HIT SOME MENTAL NAIL ON THE HEAD. Good Luck.

    Jai Ram

    Allen Ginsberg

    (Gargi’s note: None of the Indians excepting for Mrs Pupul Jayakar helped. Jealousy was from non-Marxist quarters. Ghosh brothers were Subhash and Saileshwar who became prosecution witnesses).

    ************************************************************************Allen Ginsberg, 704 East 5th Street, NYC

    January 11, 1965

    Dear Malay,

    Enclosed copies of letters from KULCHUR, from Abu Sayeed ayub ( 3 letters in answer to mine---each letter 2 pages) and one from A.B.Shah---Congress in Bombay. You should follow their letter up. Congress office in Paris has been contacted & they will probably send some note, notice to the Indian Committee.

    I answered some of your letters via Utpal---I sent copies of these letters, also, to show Sunil, Jyoti, etc.

    CITY LIGHTS JOURNAL#2 is on its way to you.

    That Jyoti, Sunil, Sandipan & your self are all working at slight cross-purposes is making things difficult. I suppose they are embarrassed by your ‘brashness’ (as TIME magazine might term it) or your slight edge of naievette as I would term it. However, if it is possible to reconcile with them & put up a united front it would be best for everybody’s safety. Best thing is to stop all cutty gossip, for it is only mainly gossip that Abu Sayeed is using as an excuse. Obviously they also were questioned by the Police, and so, feel a common threat with you. Don’t get angry at them---just work out a basis where you can all defend each other---and try you now---the only present basis (since there seems to be some literary disagreement) being freedom of literary expression.

    They all don’t want to be grouped as Hungry exclusively apparently, and they may resent or be scared or not want you to lump them all under your Hungry banner. And this is natural. Once a MOVEMENT gets name and publicity it is also a drawback as I’ve found. Also, the name is irrelevant & a drag sometimes to one’s individuality. See the first sentence of my letter to Shakti, Feb10,1963 that was published in a Hungry type magazine in Bengali.

    Best not to get angry at anyone---Jyoti, Abu Sayeed---even the police. Think carefully & coolly & get all working together if it is possible. I leave for Cuba in a week and will be back in 2 months.

    Love & Happy New Year

    Allen

     

    (Gargi’s note:Shakti Chattopadhyay, Utpalkumar Basu and Sandipan Chattopadhyay were members of the Hungryalist movement. Jyoti Dutta and Sunil Gangopadhyay were Establishment writers who attacked the Hungryalists in news-weeklies and funky magazines in an unbecoming fashion).

    Links: Utpal:

    Sandipan: www.kaurab.com/front-page-files/sandipan.html

    en.wikipedia.org/wiki/Sandipan_Chattopadhyay

    Sunil: www.sunilgangopadhyay.com/sunil1a.html

    Shakti:en.wikipedia.org/wiki/Shakti_Chattopadhyay

    ***********************************************************************

    Howard McCord304 Oak StreetPullmanWashington.

    22 May 1965

    Dear Malay Roychoudhury:

    I have enjoyed very much reading your letter and coming in contact with your thoughts. Artaud, Genet, Burroughs:yes.They are the dialecticians of chaos presiding at the dissolution of the west. They describe, with joy and exactitude, the destruction in which they are themselves involved. Burroughs, to me, is a man performing an autopsy on himself. They are all quite mad, and therefore speak the truth. We can only trust the mad anymore. The West began to die around 1750, and it has been the function of poets to recite, in series, the long funeral oration. William Blake began it. Goethe, Baudelaire, Lautremont, Rimbaud, Huysmans(unknowingly), Pound, Eliot, Crane, and all the other familiar names have continued the chant. We are their heirs, and perhaps the culmination, for our anguish and despair, the aesthetic suicide of which we are capable, may mark the end. Perhaps it will go on. Sometimes it seems as though it is the plan for it to go on.

    The inadequacy of my coming, touristic encounter with India is deeply felt. I am not an Indian, I will not become one in two months of hurrying through the landscape. I will be richer only by the validity of my meetings, the openness I can maintain. Here in my own country I am alien enough, separated from the culture by an aversion to much of it, by a self-imposed identification with the Mexican part of my life (perhaps it is as if you felt yourself drawn to Tibet), by a long-standing estrangement from its more common goals. I identify most closely with the folk of the southwestern deserts---the American Indians---Apache, Navajo, Pueblo, Hopi, Zuni, Yaqui, Tarhumara, Comancha---and the ranchers. (My family has for a century run cattle ranches in TexasNew Mexico and Arizona---all poor people in a poor land). My wife is Mexican, my second language is Spanish: my children, blond & blue-eyed though they be, are technically mestizos---the mixed-blood that is the strength and heart of Mexico. And here I sit, perfumed with education, owning not an acre of ground, lost from the desert, 2000 miles from Mexico, a poet in my decadence and reality. My children are apt to be technicians, I pray they will be artists.

    I have plans, most vague and tenuous, for a book of Contemporary Indian Poetry. University published. Likely no money would come of it, but some passing fame. I ask now for some of your poems for this nebulous enterprise, and your aid in contacting other Indian poets.

    From the foregoing you can see some of the difficulty in raising money from letters in the USA. Raising money per se is not to hard. It is raising it in a way that feels decent that is difficult.

    Such fantastics we are!

    I look forward to seeing the poem that has been the cause of all your trouble. I envy you for your courage, for the more I understand about contemporary Indian society, the greater your courage and daring seem.There are no longer any words we can not use in literature, nor any scenes we can not describe. Our only constraint lies in the definition of hard-core pornography where the obvious intention lies in the excitation of base impulses without any redeeming social features. The change in the last ten years has been tremendous. I remember first reading Miller’s TROPICs in their prohibited Paris editions and actually worrying about official interference were the fact of my reading known. Now the TROPICs are available everywhere and professors use them in discussion groups (though not in class here, perhaps elsewhere). It would be stupid of me to laugh or denigrate Indian society in which movies, for example, may not show kissing or the like, and in which mention of the sexual organs is prohibited. I do not like censors or censorship, but I do not expect Indian censorship to cease with my dislike. You have a hard, long battle before you, for a society of great and unyielding complexity must be moved before you are free. If free you must be. And I suppose you must. But may I say, from the point of view of one who can say in print fuck, shit, cunt, prick, whatever, describe scenes of fellatio, cunnelingus, hetero (Praise God) sexual intercourse or homosexual intercourse, and all (Please pardon my spelling, for I have been drinking very much). My bloody prose style suffers!

    That saying these things is not very important. I have one poem in which the cunts of women are sweet and moist as peaches, and one other in which ‘the fuck of voices’ appears as an image. Henry has more, and we ought to be able to say these words, because the mind is like the penis, coming out of the spinal column, sewn to the belly, hard as sugarcane, it talks.

    But I will say that there is more. That the societal context is more, that the identity of speaker and spoken to is more. (As I could not honestly, without compunction, use Fuck in conversation with my parents). For they do not so much respond to it as they are defended by it, and do not hear. (So for me Kandel’s POEMS FOR PERVERTS misses, collapses; fatigues itself). What must we use to drive the mule? WE SHALL SAY ANY WORD.

    WHEN ANY WORD NEEDS SAYING.

    This is an oblique way of saying that I do not trust EVERGREEN REVIEW. There is the stink of money about that magazine. Money that comes from the hard-on, the erection (it is the intellectual’s PLAYBOY, complete with airbrushed nudes. Something coy, cute, cloying---and dead). Hard words for a magazine that has published great writers like Eastlake………

    Send me a translation of your poem: for obviously, I have worked myself into a blew-eyed stupor about the problem.

    I see you as trying to survive an artist in a society 70 years detained. India is strangely Victorian in its public morals. (How did this come about? Considering Khajuraho, etc.?) Were the English that potent? Or is it Muslim? Hindu? Who digs the mithuna couples now save us degenerate foreigners? All right. The pattern: woman’s position in marriage/household: the corporate family (security at the cost of independence?), the precarious economy (do not rock boats, ever), the tension with the West. The civil service.

    Now I must go to bed.

    Next day:

    The questions still seem to be here.And tomorrow I must lecture three hours on Epictetus, the Enchiridon, and stoic philosophy. Later in the week a special lecture on Blake’s THE MAARRIAGE OF HEAVEN AND HELL (which I contend is the first modern poem, the very beginning of all of us). It is so fine. I am translating it into Spanish for the Goosetree Press, which will publish it next year, with fragments from Blake’s drawings. So, I best get busy and to work.

    Best wishes. And I hope that we can meet. Write again soon, please.

    Howard McCord

    (Gargi’s note: Prof McCord had come down to India and had met Malay, Subimal Basak, Debi Roy and Tridib Mitra. To meet Malay’s trial expenses during 1965-66 he arranged publication and sale of Malay’s poem ‘Stark Electric Jesus’ in three ditto editions with verifax cover showing the Sorcerer of the Trois Freres). Link:

    .***********************************************************************

    Margaret Randall, Mexico City

    June 17, 1965

    Dear Malay,

    Please, please excuse so much time without writing, and now that I finally am able to sit down to write, this jumpy typewriter is driving me out of my mind. The man promised to come this week to fix it but this is Mexico (land of ‘manana’) etc!. How are things going for you---the trial; your case, the things taken from you and your friends, etc.??? All over the world, through EL CORNO, people write asking about you and wish you well, it has caused an international scandal among people in the arts, at least. I hope for good news, please write!!!

    And the book with Carlos Coffeen’s drawing on the cover---did it come out???

    Under separate cover and by regular surface mail I have sent you two copies of our 13 in which I printed your letters. Hope they arrive one of these days and in good shape. Naturally: when the issue was printed I sent you a copy, but it must have gone astray. I don’t know why Samir Ray received his and you didn’t.

    Here we are in deep problems with the magazine. No money, for one thing, and tremendous work. Just when EL CORNO seems to have become a world wide interest spiritually and literally, it faces a quick death financially. The change of government here in Mexico in December has thrown us into utter gloom. All our base patronage was cut out from under us, and we were faced with stopping publication altogether, and so we had turn to a thousand improvised plans to get us through. At the moment we are having a giant art show (more than 50 painters and other artists have donated works to sell for the benefit of the magazine). The show opened at a local gallery a week and a half ago. So far we have sold 18 works, keeping the linotype purring at least through the first part of 15. 15 is now at press and we hope to get through all of it, fingers crossed. I’ll try to use your poem first part of next year, but it isn’t at all sure. We have so much work at hand and so little space and money. In reality, space and money are the same thing!

    Otherwise we are fine. Working like hell! Translating; writing, praying, trying to keep the mag going. Learning daily from our children (now there are three), the youngest is a year old today!

    Be well. Write. Good luck with the court case!

    Love

    Margaret Randall

    (Gargi’s note: A drawing of Carlos Coffeen was used for Malay’s first Bengali poetry collection ‘Shoytaner Mukh’(1963). Samir Ray was editor of Bengali literary quarterly ‘Mahenjodaro’.) Link:

    ************************************************************************

    Allen Ginsberg, c/o City lights, 261 Columbus, SF, Calif

    July 11, 1965

    I have been wandering around from Moscow to Havana to Warsaw to Prague & thus didn’t get your letter of Jan 29th, much of which is obsolete by now?

    I have gotten so many conflicting letters & gossip from every body, I actually have no idea who’s doing what to who in India. Is your trial over or not, & what’s what? I’ve done all I can from here.

    I went to Cuba, as judge of a poetry contest ( and later got kicked out for talking too much). It was a Latin American contest, the judges (as myself) all had to be able to read Spanish. Also they’d published poetry of mine & I had friends there and I had spent years in South America. So I got invited. I’ve been back a week & leave again for San Francisco in 2 days. Then settle down to solitary poesy again. Write me news. I haven’t much time to correspond, tho, except in big emergency.

    As ever

    Allen

    (Gargi’s note: Malay’s trial continued till 1967. It is obvious that wrong signals were being sent to Ginsberg from vested interests).

    ***********************************************************************

    Carol Berge

    15 January 1966

    Dear Malay,

    Now I have the third letter from you. Now I have news for you. First of all, I have sent you books, or rather magazines, and in a separate package my own copy of ‘Lady Chatterly’---but if you don’t get my book that’s okay, since we can get them here. The magazines are for the most part just literary types, and they are a ‘test’ to see if you will indeed receive things I send you. They have no risky stuff in them. If they arrive, let me know at once.

    News: our Ed Sanders has just been arrested for pornography and is out on $500 bail. We’ve all been waiting for this move for years. This will probably not hurt him, since he is by now a national figure, and many of this country’s finest literary figures are published in his magazine, over the five years it’s been going. But it should be an interesting trial---if it gets to that stage. He is just ready to publish another issue, in which I believe your poem would be included. I’ll tell you more later.

    It is so beautiful of you to speak of love to me. Let me put my hand on your cheek and tell you something about me and about my child. Although many men have been in love with me in my small time, it is not a good idea.

    I am the kind of woman who has the innate temperament of all writers. It is not so easy for me to remain calm and easy, as the women of your country. We Americans are troubled and difficult. My ideal is to become gentle and fine and quiet, but I am not like that. I love to be active and alive and making things happen. Of course this applies to things literary, such as the group of poets

    Who need guidance and action here in New York. Now we have arranged for a new and more comfortable place for the group to read poetry (we used to be at a place called Le metro but the owners were such racists and I felt as did many others that we could and should move out). There is more news. About twenty of us made a recording which will be issued on Folkways Records soon. It is called Jazz Poets’, a category which does not always apply but was used to attract buyers. You shall have a copy if I have any way to get it to you for sure.

    I am so very glad to hear that you’re free and safe. I had worried about you. There is a good pride in your being the first to go through this ordeal. Of course, if your friend does the essay on your writings, send it along to me at once; I will go over it and give it in to AMERICAN DIALOG or another good mag, and hope they print it.

    You don’t say how old you are but I will tell you I am now in my thirties and my son is 9. He and I are both dark of hair and eyes. I am a small woman and very intense, somewhat pretty, and the boy is very beautiful, with shining eyes and tremendously strong ways. It is getting very difficult to raise him alone. What he needs is to go out into the woods the way we did this summer, and run wild a bit. But it isn’t so easy for me to make this happen. Yes, I love the countryside as much as he does. But I don’t feel safe without a man. So we go very very timidly. But this is a good city to live in. I wish you were here, so that we could share some of it with you. We too believe in love, any and all love, which is all that is worth living for. I love the writing too, as it gives us our friends. Here we have friends and in many cities of this world. JapanLondonHelsinkiCologneMexico, you know. I wish we could come there to visit you. But I too don’t see how it is possible. I have saved some money but it will have to go toward our next long summer---the boy is out of school over three months---I must find a place outside the city for us.

    But Malay---somehow I am with you---we all feel alone most of the time---‘the sanctity of the scull’---it is not easy to be a writer and a human---I think of philosophical ideas much of the time these days---how it is to live on earth in this time---how each man is the center of his world---how we move toward and away from each other---I would give you the warmth of your wishes if I could---with this New Year. O yes there is a great difference between being alone and being lonely, which you know. I have so much respect for the struggle of many of my friends, whose work is strong and true. I just wrote a book review on the book LAST EXIT TO BROOKLYN, by friend Hubert Selby Jr., which is a major book because it tells in true language about a group of so-called depraved and perverted types---and in the review I defended them and him, because those people have had no choice about how to spend their lives. They (and we) have become what they are, because of the circumstances of their birth and their experience. Of course, Selby has run into a lot of unfavorable comments on his book. And you have heard o0f the trial and subsequent suppression of magazine EROS, whose contents are obvious from the title. Well, Selby had to go through a court trial for one section of his book, called ‘Tralala’ as published in the magazine PROVINCETOWN REVIEW. I think they seized and suppressed all copies of that issue. But eventually, all such cases win out. You know, they have to. Because we writers are dealing with the medieval morality of the masses---who, after all, can use the kind of FREEDOM and LOVING , which we are able to teach them. To me, this is a prime reason for being a writer: to use this gift for a good purpose. It strikes me this is as strong a cause to work for as the Peace Foundation. How do you feel about it? Though I feel I already know your answer; of course. I would like you to send me one of these things: most important, a picture of you. Or, and, a small woodcut or print of any kind which speaks to me about ‘your’ India, and which I can put on my wall and know you are there. Tell me in your next letter about the room in which you live, or the house. Where are your parents? Who are your friends and how do they live? Let me share your in any way you can. I am absolutely your loving friend. The skin on my back says so to you. My boy Peter is your boy and your friend as well. You would find us always loving and sharing. In future I will try to be more faithful about answering your mail. I will send you some more books if you get the magazines I sent. And I will send you a photo and also a print or such, for those moments when the world seems too dry and too difficult or alone. You have our love, Malay---

    I kiss you.

    Carol Berge

    (Gargi’s note: A photograph of Carol Berge was traced out from Malay’s papers in 2003 and published in Disha Sahitya magazine). Link: www.lib.utexas.edu/taro/uthrc/00012.xml and

    ************************************************************************

    Daisy Aldan, 325 East 57 Street, New York

    February 1, 1966

    My dear Malay Roychoudhury

    A friend of yours, Howard McCord, has sent me your address. I am distressed to hear about your plight, and hope that the situation will be ameliorated as soon as possible, even though, I do not at present, agree with the kind of poetry you and your friend are writing. I think YOU ARE EXTREMELY TALENTED. I am a poet myself and Editor, and a great associate of the Avant Garde. I consider myself in the forefront of the true Avant Garde. I published a magazine called FOLDER which presented poets whose work could not be published elsewhere because of its contemporaneity. But I think what you are doing now is first of all, passé, and second of all, a debasement of the spirit and language. I also think it is all wrong for India, and that there is room for excellence and contemporaneity without debasement. However, this is just my opinion, and I am sure you have good reasons for yours. You certainly should not be persecuted for your poems.

    The major reason for this letter is to let you know that I am editing a book for Thomas Crowell called POEMS OF INDIA and I would be happy to consider some of your poems, and those of your friends. I wish to include poems of every region of India. Since the book is directed to young people, I can not publish any of the poems of the nature of the one Howard McCord published (a copy of which I have). If you wish to choose poems that do not deal with sex in this way, then I shall be more than happy to consider including them. I am eager to publish much contemporary work. Also any suggestions you may have about poems of the past which should definitely be included would be deeply appreciated. If any of your friend wishes to send me poems, then they should include a brief biography and permission for me to use.

    I will send you under separate cover, my own poems: THE DESTRUCTION OF CATHEDRALS, SEVEN:SEVEN, and A NEW FOLDER:AMERICANS:POEMS AND DRAWING, an anthology. Since it takes months for mail to get to India, I hope your answer will arrive before you receive them. All submitted poems, by the way, must be in English or translations.

    I spent four months in India last year---mostly in Bombay and gave a lot of readings of my work. I met many poets whose work I admire, among them, Padgaonkar, Karandikar, Ezekiel, Bapat, Katrak.

    I love India, and happy to be involved in this project. My best wishes to you, and I look forward to hearing from you soon.

    Fraternally,

    Daisy Aldan

    (Gargi’s note: Ms Aldan is referring to ‘Stark Electric Jesus’ published by Tribal Press with an Afterword written by Prof McCord. Nissim Ezekiel is the pioneer of Indian Poetry in English, and the rest are Marathi language poets.).

    Link: www.lib.utexas.edu/taro/uthrc/0004.xml and

    research.hrc.utexas.edu8080/hrcxtf/view?docld=ead/00004

    ************************************************************************

    Daisy Aldan, 325 East 57 Street, New York 10022NY

    February 25, 1966

    Dear Malay Roychoudhury,

    Thank you so much for answering my letter so promptly. I shall certainly do all I can to see that your booklet is publicized. I have a copy of it myself. It has some great beauties in it, but contains what I was referring to in my last letter. Perhaps I am wrong, and perhaps I am conditioned by the fact that we here in the West are so bored by now with sexual references, and no longer shocked by them. We feel that the purpose of this shock is now over, and it is the mission of the poet to give humanity hope and not to bore him with these petty sexual references, for example to the pubic hairs of one’s love. There was certainly a time for this when Apollinaire introduced this type of a technique in 1917 and our ‘Beats’, inspired by Miller, drained such words as s -t and f-k to the limit.

    I feel, as you, that the poet must be “free”, yes, but “freedom” that we mean is a consciousness. It does not abnegate inner morality based on intuition. (I am not speaking about outer moral laws). Then when one becomes truly FREE, one is also released from pettiness---of concept. This is so hard to write in a letter. Also I feel that modern man (as Krishna himself indicated), cannot be absolutely free of the earth and of men. If he becomes TOTALLY free , as you indicate, even of himself, he no longer has the need to write poetry either. This totality will only come to be in a future that is far distant---and if we poets, develop true consciousness. True consciousness also assumes a certain responsibility. Am I contradicting myself? Ask yourself deeply and truly. Malay (please forgive the first name, but I hope it is all right), what was your intention in writing about masturbation and pubic hairs? Was it because you were truly deeply expressing a Free Divine---earthly concept? Or was it to shock? Be honest with yourself. Was it to destroy Indian rigidities? Or was it a false Luciferic temptation, disgusting itself in Light?

    I do not demean your nobility, and am willing to be convinced. Once again, I am not speaking from the point of view of prudishness, heaven knows. I was one of the leaders of the American “avant garde”. But we have moved past the destructive ness into a direction of wholeness and spirit.

    “Spirit”, yes, but in a contemporary idiom. I am sending you my books. They will arrive in about four months, no doubt. Please send me your poems SOON, as time is limited as far as the publisher is concerned. The poets will receive a compensation or book for works used..

    My deepest wishes for your vindication in that disgraceful trial. What can I do for you? I am ashamed of India for this.

    With reverence,

    Daisy Aldan

    (Gargi’s note: Malay has only one publication in English: ‘Selected Poems’, published by Writers Workshop, Kolkata. The booklet being referred to by Ms Aldan may be some sort of extempore anthology churned out during the movement).Link:

    isbndb.com/d/person/aldan_daisy.html

    www.alibris.com/search/books/author/Aldan,%20Daisy

    *********************************************************************

    Lawrence Ferlinghetti

    26 March, 1966

    Dear Malay: I have read the legal decision on your case, and thank you very much for sending it. I find it laughable. I want to publish it together with your poem STARK ELECTRIC JESUS in the next ‘City Lights Journal’ which will be out this coming summer, and I enclose a small payment immediately, since I know you must need it desperately. I am sending a Copy of this letter to Howard McCord. Perhaps he knows the answers to the following questions and will send them to me right away, since time is of essence, and it may take some time to get a reply from you. I think it is a wonderful poem, and I will certainly credit McCord for having first published it. Bravo.

    Allen is in NY and his new address is: 408 East 10 Street, (Apt 4C), New YorkNY.

    I need to know the answers to the following questions: (1). Was the poem first written in Bengali and was it the Bengali or the English version which was seized and prosecuted? (2). Is this your own translation, or whose is it? (3) Do you wish me to use the typewritten copy of the poem which you sent me last year, or the version printed by McCord? (I find some differences.)

    Let me hear as soon as you can. Holding the press.

    And Good Luck. I hope you are still able to survive! With love.

    Lawrence Ferlinghetti

    (Gargi’s note: The poem was first written in Bengali and translated by Malay himself. The poem was published in City Lights Journal with an introduction on the movement written by Prof McCord, and the same matter was republished in the Hungryalist commemorative issue of ‘Salted Feathers’ edited by Dick Bakken. “Salted Feathers” featured most of the participants of the movement.). Links: en.wikipedia.org/wiki/Lawrence_Ferlinghetti

    www.citylights.com/ferlinghetti/

    www,poetsencyclopedia.com/mrchoudhury.shtml

    www.geocities.com/kavitayenkrishnadhar.html

    www.john.com/zeitgeist_spam/2007/07/index.html

    wings.buffalo.edu/ebc/presses/mill/2milltoc.html

    en.wikipedia.org/wiki/Hungry_generation

    islandhills.tripod.com/biobakken.htm

    ************************************************************************

    Robert Kelly

    5 June 1966 (birthday of Garcia Lorca)

    Dear Malay,

    How hungry we all are---and that is that Associative Energy brings prick to its house, food to our bellies, friends to our table, my hand to this paper to wish you “News and well”. I write by the light of two green candles, the smaller one moulded from the melt-wax of the larger---its wick burns faster---the wax is softer; only the hard endures, keeps enough of its divine form to let itself petrify in form, become amorphic fossil of itself ---alive in sorts if not in conditions. (Last month I finished a very long poem, weeks, in 150 Sections---it represents a non-linear structure which is nevertheless deeply committed to receiving what happens around me, to me: what emerges. Work had been started just a year before, right on the heels of that dancer Round Dances was: her body. Now there is a much shorter long poem, “Map of Annandale”). Obscenity we must finally begin to praise and pornography as such, as genre, legitimate form: too long we have hedged about with art vs pornography. Be well and strong, in the image of the body- --I look to see your poems in English.---Courage, love.

    Robert

    (Gargi’s note: The poem ‘Stark Electric Jesus’ has been reprinted and interpreted umpteenth times, and most of all influenced evangelical thinking. The idea of Jesus being Electric as well as Stark had been picked up from this poem since its translation in Western languages. Incidentally, the original Bengali poem used the word ‘Carpenter’).

    ************************************************************************

    Octavio Paz, New Delhi

    The 16th of July, 1966

    Dear Mr. Choudhury:

    Last time I was in Calcutta, I met some of your friends who talked to me about you.

    I hope I shall find an opportunity to meet you when I visit your city or whenever you get a chance to come to Delhi

    Meanwhile please accept my best regard.

    Cordially yours,

    Octavio Paz

    (Gargi’s note: Octavio Paz came to know of the movement through the media, especially TIME magazine, and came down to Kolkata (the then Calcutta), to meet the participants who had created so much turmoil in Indian literary world. A press baron directed him to another group. Paz later met Malay when he visited Patna).

    ************************************************************************

    Ameeq Hanfee, 104 Gandhi Park Colony, Indore

    26 July 1966

    My dear Malay,

    I am extremely grateful to you for your permission to translate your poem ‘Zakhm’

    into Urdu. I assure that Urdu version of your poem will do full justice to it and may even sound better than the Hindi one. The Hindi translator has done his job very well, no doubt, but at places either he or the press has not been vey careful in the use of ka! ki! ke!

    etc., as well as certain Urdu words. On the whole the Hindi version seems to be a fairly faithful reproduction of the mood, spirit and expression of the original

    I had written to Basak to send me literature of and on the Hungryalist writings and movement, and he had promised to enlighten me, but I did not get anything except his own article, the Calcutta Presidency Court judgement and the Hindi version of ‘Zakhm’. Whatever I know about your movement is through what I read in BLITZ, TIME, DHARMAYUG, MARAL, GYANODAYA, ANIMA, and LAHAR. I wish to go still deeper before venturing to write about the Hungryalists in Urdu. I am a poet and find your poetry---Hungryalist poetry---full of inspiration, freshness, fire and oxygen.

    I am looking forward to the day when we will meet and not only compare notes but also exchange heart and mind.

    I was all the more interested in ‘Zakhm’ because I found that you and I share a lot of common ground. There are so many lines in ‘Zakhm’ which express the same or similar experiences I have expressed in my long poems ‘Sindbad’, ‘Sharzad’ and ‘Shabgasht’. I must give you the credit of being more modern---rather up to date in your imagery, diction and poetic statements than I could be. Still your wound is not very different from mine.

    Let us all succeed in exploding the atom for real peace and freedom---the atom of our individual experience. After all the subterranean source is the same from which we all have our blood-lines connected.

    With admiration, regards and love

    Ameeq Hanfee

    (Gargi’s note: In fame and impact Malay’s long poem JAKHAM (Zakhm in Urdu and Hindi) had surpassed Stark Electric Jesus by 1966, and was being translated in other Indian languages. The Hindi version was translated by Kanchan Kumar under the guidance of famous poet Nagarjuna. English and German versions were printed by Carl Weissner in ‘Klactoveedsedsteen’. Margaret Randall had arranged its translation in Spanish, when she was in Mexico).

    ***********************************************************************

    Gordon Lasslett, 67 Acton StreetHurlstone Park, NSW, Australia

    August 20th, 1966

    Dear Mr. Choudhury---

    Having recently read your ‘In Defense of Obscenity’ I wish to say that I agree almost completely with you. Consider this one a fan letter!

    Magazines & books (of poetry) from India are not unknown here but they are all so very very stuffy. Could you recommend some decent titles, perhaps your own, and tell me where I could obtain them.

    The maternal side of my family has associations with India in that they were officers in the very British ‘Indian Army’. Perhaps my great grandfather kicked your great grandfather!

    How do Indians feel about migration to Australia.This is one of my ideals and I speak in favour of it whenever possible---but Australia is too ‘white’. This country is so bloody empty and in need of cultivation (pastoral as well as artwise) that one goes in to fits of manic depression to see such waste. All because a few sit on their unwritten ‘white Australia’.

    What with that, in view of Americanization and the growth of authoritarian nationalism, Asian migration is the only hope of keeping our freedom.

    Kiss the Additional Chief Presidency Magistrate

    for me

    please,

    Gordon Lasslett

    (Gargi’s note: Hungryalist bulletins and manifestoes had reached Australia via Europe. Austalian magazines could not be traced).

    Link www.bazlaz.co.uk/famtree.html

    www.poodlehistory.org/PHPHELP.HTM

    ************************************************************************

    Dan Georgakas, Box 418, Stuyvesant Station, New YorkNew York 10009

    August 23, 1966

    Dear Malay,

    Sorry to be so long about writing but you can see I have been moving around. Your ‘In Defense of Obscenity’ is a beauty. Allan Van Newkirk is going to print it in GUERILLA. Allan and I are not connected with Artists Workshop except for in the most casual way. Smyrnn Press is separate and so too is the new GURILLA.

    Karl Heinz Weissner tells me he has contacted you (at my urging), and he is tuned on by Stark Electric Jesus. I hope you will dig my own Manifesto For The Grey Generation.

    Allen and I have founded a group called The League of Revolutionary Poets: Torp. We combine politics with poetry-in-happening---action events. Example: On August 6th we attended a peace parade and hung Johnson in effigy and flew the NLF flag. August 7th we attended the Festival of People at Artists Workshop, and held a mock trial (they had no warning) of love-dove poems, which angered many in the audience. August 9th: Anti-war poems: reading at downtown rally. August 13th: letter to paper congratulating Detroiters on letting their Greek Theatre die since any nation supporting a Vietnam atrocity could not support Gk Theatre too. New activities: war crime tribunal in Detroit, melon poetry reading in Pittsburgh, trial of love in Chicago. We seek creative vandalism. Today I read a foul story in Village Voice. Wiped my ass with it and sent it in to the paper. I am getting a squirt gun and will fill it with paint. Shoot when ready, the Grey Generation. I want to go to the opening night of the Opera when all the shitheads are there, and hurl anti-war poems from the galleries when the war-criminals enter. DADA lives. SURREALISM returns. Lasslett in Australia, Weissner in Germany. Nutall in Britain. Partisan of the world unite. Towers, open fire.

    Doubleday & Co will anthologize a poem for me. Story in homosexual magazine. Poem in communist magazine. Makes me a capitalist homosexual communist dog or a chameleon. Clifton de Berry is our man. io! ee! This is the world, begins with a BaaaaaaaaaaannnnnnnngggggggGGGGGGGGG…..’’’’’

    Wichita Vortex Sutra-----wonderful. Ginsberg reads in Washington Square on Sunday to test new law about pornography and such.

    Allen says he has sent Miller’s Sexus.

    Prices sky high in New York. Faces ugly. Squalor everywhere. But a vitality. The Blacks are beautiful. Anger. Revolution. You must stay in India and smash them. This is the age of sabotage and subversion. Smash the word. Destroy the logic. Warp the system until it snaps. Love, oxygen, semen, tullipbuds, serendipity syringes----breakthrough in the grey room---dan georgakas

    Dan

    (Gargi’s note: Over the years Mr. Georgakas became a reputed scholar of Anarchism.)

    Links: www.reuther.wayne.edu/collections/hefa_1041.htm

    en.wikipedia.org/wiki/Dan_Georgakis

    ***********************************************************************

    Carl Weissner

    24 September 1966

    Dear loving brother guru

    This finds me in the process of recovery from illness & series of bringdowns & now again working diligently on issue 4 of the mag….before the sickness had led my metabolic blues astray. I had got me a job & they had to pay me for the whole period of illness which is the only pleasant thing abt a job,…I have been able to cut costs for printing the mag down to something like 150 bucks, but still…

    Tell me: did you get yr copy of the manifesto? (I mailed two copies to Subimal Basak) and did you get my last letter? what abt the proceedings of appeal? already over? And what the outcome? favourable for you I hope!....yes will write to Donatella…..she has just sent English translation of her Ginsberg essay which appeared in ‘Studi Americani’ in Italy last year…also good letters from Carol and Dan….

    YES! BY ALL MEANS SEND THE TYPE SCRIPT OF LIFE , ARREST, TRIAL, GINSBERG, CALCUTTA!!!!! Listen:!! Gerard Malanga just sent a large and fantastic collection of poems, 4 of them dedicated to Allen! Also magnificent photos of Allen and himself! He will probably also write for KLACT abt his friendship with Allen! And Diana Di Prima sent a collection of cute short poems, all from 1957….all this will be included in KLACT 5 (spring 67)…I have also written to Allen & asked him to conyribute original work, hoping he be willing to do so…COULD YOU WRITE HIM AND TELL HIM A FEW GOOD WORDS ABOUT ME AND KLACTO PLAN AND URGE HIM TO SEND STUFF??!!!! He is at 408 East 10th Street, Apt. 4CNew YorkNY 10009

    I have not yet found time to contact the people you told me, but will do so any day now….I will concentrate on Subimal’s and your work, tho… in No 5….but may be I will also contact Howard McCord (please give me his address!)….if it shd turn out that I have space left for more Bengali/Indian in No 5…..

    DID YOU RECEIVE THE ‘ICONOLATRE’ ISSUE I SENT YOU??!!!

    Also Larry Eigner sent me more poem: today, which will be in KLACT 5…yeah, things are really swinging now!....I am also thinking of publishing George Dowden’s new great visionary poem RENEW JERUSALEM in a limited edition, sometime later this year, if I have the money….(!)…..

    The English original of yr article of course will be in KLACT, and I will translate it into German, too, and look around for possible publication in German mag…ok? O YEAH! Looking forward to translated passages from ‘JAKHAM’ plus one page in original BENGALI! GREAT! Please note: Bengali page, if possible, should be written on white sheet of paper in black ink, and should be sent whole, that is, not folded----so that it can be used for repro….

    Do you know MAHENJODARO (ed. Samir Roy, 55/4 Natabar Pal RoadHowrah)? What it is like?---and POETRY TODAY (ed. Nissim Ezekiel, The Retreat, Bellasis RoadBombay 8)? Qk. So much for this time.

    All best to you

    Love

    Carl

    (Gargi’s note: Mr. Dowden had met Subimal Basak and Pradip Choudhuri at Kolkata; he later visited Patna to meet Malay. He clothed himself in saffron robes and changed his name to Kaviraj George Dowden. Kaviraj denoting king of poets as well as herbal doctor).

    Links: findingaids.library.northwestern.edu/fedora/get/inu-ead-spec0022/inu:EADbDef11/getlistOfContents

    ************************************************************************

    Carl Weissner

    5 December 1966

    Dear malay

    The great sky is open----northern Italy washed away in vast mud & storm chaos & deluge----desperate letters from Donatella Manganotti----priceless artwork destroyed forever---and just a few minutes ago I hear in the news that they are in for yet another meterologic showdown---Bihar province like a vast dried-up cunt I gather---hunger & revolts everywhere---German government collapsed, neo-Nazi movement scoring for the gaps: Christian & Social Democrats joining forces to make a last desperate attempt at saving the old ship St. Nanana already half drowned---Hanoi set ablaze by efficient hordes of technicians of death masterminded by sick pentagon eunuchs & a corny Texan cowboy putting out fake charismatic vibrations that materialize in tons of explosives & charred remnants of Asian bodies enabling Wall Street to hang on for another fiscal year---you see how they are caught in loops and spins of lethal genetic roulette---a uniform grey generation scurrying among nuclear debris of heavily infected areas of cancerous mind like rats in terminal stage of dream withdrawl eating erogenous holes in huge chaotic setup of punch-cards that represent lives marked for Total Disposal---one more turnstile before the whole shithouse blows up---Nova Criminals wishing up dwarfed marks everywhere on this sick planet---SECONDS TO GO---you can already hear that heaving human blues heading for its irrevocable Dead Whistle Stop---so? Burning heavens, mister---nova armies conspiring across the wounded galaxies---icarus, nova-directed asteroid, due to blot out a terrestrial spot of bother the size of new york or tokio or London, on june 15, 1967---or September 13, 1968---what’s the difference---with the impact of one thousand hydrogen bombs---you see how things have grown to hitherto unimaginable bad proportions---a disarmament conference would have to include representatives of Nova, Interzone & Minraud, and there’s little chance that one could ever bomb this intergalactic gook rot to parley---and god knows how many of their agents are already operating among us disguised as word & image technicians seconds to go---we’ve got to attune our paranoiac feelers to that vast danger around us, spot them wherever they show a blind spot & stop them dead in their tracks---

    In order to achieve this we have to provide ourselves with an insight into their methods & operating schedules, and the work of Bill Burroughs & a few other semantic cosmonauts shows precisely who they are & how they operate---in supersonic patterns of sense-wave control---or long, medium, short & ultra short waves of the world---in cozy bed sitters, court-rooms, arenas, parliaments, newspapers, or gone streets---in subcutaneous offices of annexed brains around the paralyzed globe---right where you are sitting now there in Bad News Department walking in on you cool & casual with a perfunctory ‘hello there’---and metamorphosing you into an obedient Hate Virus host in a matter of seconds---if you are not fully aware---each second & if you do not know who they are & how to fight them---now---in forthcoming issue of KLACTOVEEDSEDSTEEN you will find more details & outlines of steps to be taken towards an immediate universal survival training in a peiceby Mr. Burroughs & Mr. Weissner; called LAGUERRE PARTOUT (war everywhere), precisely showing some of the hideous techniques by which the nova criminals try to mono-police & control & manipulate so-called ‘reality’ in order to subvert & takeover mind & consciousness of every single of us---

    Carl

    (Gargi’s note: During this period Mr. Weissner was quite impressed with the prose style of William Burroughs. He was, for some time, accompanying interviewer of Burroughs).

    Link: www.popsubculture.com/pop/bio-project/willium-s-buurroughs.html

    unjobs.org/authors/dan-georgakas

    ************************************************************************

    Howard McCord

    10 January, 1967

    Dear Malay,

    A joy to receive your last three letters, for I see in them your good spirits and your kindness in telling me of the various Indian drugs. I do hope things turn for the better with you from now on, and that your appeal is successful. I have sent today the copy of CITY LIGHTS JOURNAL you requested. I sent it direct to you by airmail. Yesterday I sent you a copy of my new book. Just today I received a copy of Gary Snyder’s reaction to the book, and it was wonderful. I admire him greatly as a poet, and he found my own poetry worthy and exciting, so I too am in good spirits.

    Yes, I would like some things from India: either ganja, bhang, or charas. I like the hemp/hashish derivatives of cannabis sativa (here in America the plant is generally weaker than in India, and the leaves and flowers are only smoked). But I do not care for any of the opiates. They are physiologically addictive, and depressants, additioanally, cannabis is a psychedelic. In working over your letters, I have found INDIAN MATERIA MEDICA, by A.K.Nadkarni---and it is a great store of information about Indian medicinal plants. It has an especially good section on cannabis(marijuana).

    I have just been through many of the proofs of the new SALTED FEATHERS. It has a fine production, and should be out in a month. Dick may well already have sent one of the flyers, but I enclose one also. He has also written to Ferlinghetti for permission to publish once more STARK ELECTRIC JESUS, with more money coming to you, and I hope Ferlinghetti grants his request.

    My anthology goes along---I think by Feb I shall have the manuscript finished. Most of your things---like SEJ---will be included and as soon as I have a good list of contents, I’ll send it along to you.

    I really liked the paragraph about your mother & your youth. It would make a good poem.

    Ether is probably a good bash & drunk, but I wonder if it does what LSD does. In the old days Nitrous Oxide (laughing gas---as anesthetic) also provided researchers with interesting experiences---William James for one. If, by the way, you should get into bad LSD trip, THORAZIME, a tranquilizer, is supposed to be a good antidote.

    A thick letter could probably also contain enough ganja, etc., for a cigarette or two and not be too noticeable, yes?

    Much love to you, and I hope the poem in

    FABLES AND TRANSFIGURATIONS talks.

    Howard

    (Gargi’s note: Prof McCord collaborated with Indian poet Arvindkrishna Mehrotra and edited a collection of Hungryalist writings. Their workpapers are archived in Northwestern University Library, 1935 Sheridan RoadEvanstonIllinois. SALTED FEATHERS#8/9(1967), apart from INTREPID(1968) edited by Allen de Loach, contain photographs of most of the participants of the movement)

    ************************************************************************

    Rajkamal Choudhury, Mahisi PO., (Saharsa).

    2 February, 1967

    Dear Malay

    How are you?

    Life in villageis very healthy to me. So I am here, silent, also, and happy. But to let me be in contact with all of you, all of us, be sending me magazines…..and…..

    Raj Kamal.

    (Gargi’s note: Rajkamal Choudhury is a legendary Hindi poet, who, during his Kolkata-days had come in contact with the Hungryalists, and carried the spirit to Hindi literature. He died young due to over-indulgence and experiments with psychedelics).

    Link: en.wikipedia.org/wiki/Rajkamal_Choudhary

    ************************************************************************

    Carol Berge

    March 7, 1967

    Dear Malay,

    Now I have your photo. McCord sent me a copy, or was it Dick Bakken! .Anyway, one of the friends here. You seem a fine handsome man---and I am glad to see

    Samir’s daughter as well. Your face sits opposite me, it is over my kitchen table, on the wall, so that each day when I break bread, I can share with you.

    Sometimes I don’t like being a part of a big city, but I never feel alone. This is trouble, in a way: there are always too many things to see and do: too many people and friends. The hardest thing is to be alone and do the work, too much temptation to go out and be busy. I tend therefore to be a recluse in my own way, though quite active to other eyes, in writing activities. I stay home almost all day everyday, to write or read or answer letters etc. I go out three or four nights a week, reading poetry or listening, going to dance programs, or to hear music etc.,---there are many activities within just a four-block radius of where I live.

    Yes, of course, I received your resume, didn’t I acknowledge it yet? I gave copies to McCord, to David Antin, to Joel Oppenheimer (I think), and to Bob Creely up at Buffalo (State Univ). I have no idea what might happen but all I can do is to try for you, with those friends who are academically affiliated…..I wish you so much good luck!

    Sure, I would like to have a double-volume of poems out, your poems and mine. I shall make the suggestion to Nelson Ball, Apt 422 Young St., KitchenarOntarioCanada, who publishes VOLUME 63, at University of WaterlooCanada. Nelson recently let me edit a section of New York poets for his magazine. He is also editing a series of small poetry books. Let me get him to write to you; in the meantime, you could write to him if you wish, offering him 15-18 pages of poetry for him to select from. What do you think? I had the idea of giving him two or three ‘long’ poems, each about three pages long. You might do the same. This is one of the proposition that he would be interested in the idea of double volume. I think it would be very interesting indeed & it is possible it would give us a nice public interest, and a tiny bit of money maybe. How are you doing for money these days? Are you working still? Tell me.

    What you say about always having felt that in your life there is always something pending, something big about to happen----no, my story is that I did not go anywhere or do anything at all of any importance till I was 30 years of age---so that at 30 I still looked around 22, and my mind and emotions were that of an adolescent. I’ve done all of my growing up in the last eight years. This keeps me naïve and still 10 years behind my peers in my work and my ideas. But I sure did live a fast and hectic 8 years, trying to catch up. All the work of mine that you’ve seen comes from this period. All of everything. I think it is a question of working against fate to get the world accept you on your own terms. You could call it ‘the Establishment’ too if you wanted to. Of course here we don’t have

    The desperate poverty and the simple physical argument you have in India---although I was poor as a child. But each artist constructs its irritant against which the struggle seems stronger. All of us seem ill---suited to fit into the society in most ways. I think it has always been thus, as we shall always have wars. Part of the human condition. And the artist representing the human condition has to extend to cover all of human experience somehow---the rich, the satisfied, the ugly, the lovely---all of it---you know all of it no matter where you live or how you live. And so do I, somehow….

    A friend, Wendell Metzger, a strange fine man who is a playwright, is going to be in India soon. I gave him your address so that he could contact you if he was able. He is not a part of our ‘hip’ scene as with Allen G. & our other friends, somewhat older too, but a good friend. See him if you can.

    Today I think that life mean only resisting; there seem no easy steps or solutions. I wish for too much and then I wish for the peace of no-wishing. This has been a good year until now but begins to get difficult and moody again. But my health is good and there are a few people who understand, and a few others who love me, and always the writing, so one continues. I havent any idea what sustains any of us, do you? I call it ‘The Infernal Spirit’ in my own mind sometime.That doomed flame. You will be a popular success in this country before you are accepted in your own! And how often this has been the case. US writers succeeding in England before US, and our musicians certainly find more success and response in European Opera halls, concert halls and Jazz cellers than in the slow sedentary stiff minds of their own countrymen. Stubborn!

    Write to me again soon, now I feel we’ve had some kind of long talk about the condition of being creative----at least a beginning----

    With love as always, yr friend

    Carol

    (Gargi’s note: Ms. Berge’s proposal did not succeed as Malay was suddenly suffering from writer’s block and did not write poems till 1985).

    ************************************************************************

    Ameeq Hanfee, 140 Gandhi Park Colony, Indore 1

    April 12, 1967

    My dear Malay,

    I am sorry that my correspondence stood still for the last two months or so. I found myself quite barren to create and produce anything. NO communication was possible. A very turbulent emotional and neurotic storm was raging within me. My intellect failed to play the Noah’s Ark. Somehow I am emerging out of this and feel better and fertile. It was quite an experience I never had before. Though incomplete, I find it has filled a gap. When I look back, I feel that only a storm could wash my inner self that had accumulated a lot of dirt and the wet dusters of reason could not clear it off.

    I feel it was a process of catharsis. It was like a surgical operation of the heart of my soul and the suffering and pain was because no anaesthesia was given. Now, when the wounds are healing up, I have different vision. It is a pleasure that fills me. The words break, the images crack and the expressions burst when I try them to contain this new experience---perhaps because still it is too hot. I very much doubt if LSD and other drugs can bring forth the images and ecstatic patterns that this semi-mystic experience is projecting before the inward eye. Language is a very weak vehicle to convey this

    Well I am anxiously awating the finale of your trial. It is not you but all of us on trial. It is freedom, in you, on trial.

    I am glad to hear that the Hungryalists have warmed up again and are assailing the literary scene with more vigour and virulence.

    ‘Zakhm’ is waiting to appear in print. The mag in which two of my articles and ‘Zakhm’ have been accepted for publication has been delayed and I have not been told when it will be published.

    Your suggestion that I must bring out a cyclostyled collection of my translated poems strikes me immensely. I am inclined to take to it.

    Sincerely

    Ameeq Hanfee

    (Gargi’s note: That was the only poem of Malay translated in Urdu).

    ***********************************************************************

    George Dowden, London.

    22 April 1967

    Dear Malay,

    Good to hear from you; glad you have some kind of job now. I’ve gotten together with Utpal Basu here, good bloke, but doesn’t seem to be doing any writing here; just teaching. He introduced me to the shehnai (recording: The Magical Shehnai of Bismillah Khan), which is a lovely instrument. I dig the morning raga on that recording, but not the evening one particularly. I also wrote to Dick Bakken about collecting SALTED FEATHERS, just yesterday. I am about to write to the National Library of India about Ginsberg, as you suggested. Meanwhile, if you have spare copies of any Indian mags he was in, please send, like UTTARSURI of Dec 1963, MOHENJODARO of 1963 etc. AS I said, I’ll pay---or send you things in exchange. You mentioned wanting books on Cubism, Surrealism and Dadaism---there is a good series here, which includes all of these, a book on each; the publisher is Thomas Hudson; the Cubism book is by Edward f. Fry, the Surrealism by Patric Waldberg, the Dadaism by Hans Richter. Do you have these available there? If not, I’ll get them for you and send. Let me know.

    Did RENEW JERUSALEM arrive all right? Let me hear you about it. Seeing lawyers now, wanting to safely bring out an edition here.

    America is getting worse and worse; lies and destruction, threat to the whole world. Fortunately the youth are not listening to their bullshit except to jeer at it, and as long as that goes on, can not be stopped, there is hope. If the totalitarian impetus in America gets its own way, and all the power, then all hope is gone. South America would become the next Vietnam, and so on. But think they will be stopped---though not until more blood flows.

    Let me know how you are doing. Write soon.

    Cheers,

    George Dowden

    Links: www.thing.net/~grist/golpub/golmag/gol4/dowden2htm

    www.pw.org/content/kaviraj_george_dowden_1

    ***********************************************************************

    Ida Spaulding

    July 29 1967

    Dear Malay,

    We’ve been back for a few days touring around the Peloponnesos. No news yet about where Linn will be sent----Amman seems doubtful. So in a few more days we may go to Crete. It is interesting traveling about and the children are staying well which is very fortunate. I’ll enclose some pictures: this one is at Rian at the campground there where we rented a tent----Daniel is standing, Sarah is crouched in front, it is my back and then Jane in her bikini. In the other picture you can see Castalian Spring at Delphi where purification rites were performed before visiting the Oracle.

    There is a nice shop in Athens (Monastraki) where a man who is a poet makes sandals. If you will send me a tracing of your foot on paper I will send you a pair.

    It is hot here. We are staying now in a low-cost hotel in Piraeus (Athen’s seaport) where we are near the boats---also near everything. We are right next to the public food market. It is a fascinating area---noisy, very busy. Also we got lovely fresh fruit.

    Best wishes and love

    Ida Spaulding

    Link:spaulding.blogspot.com

    ************************************************************************

     
     
     
  • | 223.229.146.32 | ১৯ জানুয়ারি ২০২২ ১৮:৪৫735394
  • আমি হাবশি বেতাল : মলয় রায়চৌধুরী

    কবি মনোহর দাস (ষোড়শ/ সপ্তদশ খ্রিষ্টাব্দ): 

    ‘নানা শাস্ত্র নানা ধর্ম আছয়ে সংসারে

    মোর শক্তি নাহি হয় এসব আচারে।

    আমি কোন ছার ধর্ম আচরণ করি

    থাকুক ধর্মের দায় মর্ম বুঝিতে নারি।

    ধর্ম যারে বলে তিনি ব্রহ্মাণ্ড বেড়িয়া

    স্থাবর জঙ্গম আদি দেখ বিচরিয়া।

    হৃদয়ে উদয় যেই সেই কার্য সার

    তাহা বিন অন্য ধর্মকর্ম কিবা সার।’

             রাজা বিক্রমাদিত্যের কাঁধ থেকে অবসর নেবার পর বটগাছে টঙে বসে আছি ; আমি হাবশি বেতাল, ঈশ্বরচন্দ্রের দেয়া  চেয়ার-টেবিল  শেকড় দিয়ে বেঁধে, পৌরাণিক যুগ থেকে, কলি দ্বাপর ত্রেতা সত্য যুগের আগে থেকে । আমার কাজ লেখা । স্হান-কাল-পাত্র বুঝি না,   গুলিয়ে ফেলি । আমি, যে কিনা হাবশি বেতাল, লেখা যে কোনদিকে এগোয় আর পেছোয় তা  নিজেই জানি না । যা  শুনি তা কবে লিখব তার ঠিক-ঠিকানা নেই, মনে পড়লে লিখি, দুশো বছর আগের কথা কাল হয়তো মনে পড়েছিল, এক হাজার বছর আগের কথা হয়তো এখন মনে পড়ল ।  ন্যারেটিভ লণ্ডভণ্ড ।  কলম কাগজ দেখতে পাই না অথচ লিখতে থাকি নিজের মনে, লিখি আর উড়িয়ে দিই ।

              গাছের তলায় একজন সিদ্দি আর তার মগ বেগমের সমাধি, তারা বাইরের জগতটা দেখতে পায়, শুনতে পায়, নিজেরাও কথা বলে, যারা সমাধি দেখতে আসে তাদের সঙ্গেও কথা বলে।অথচ সমাধির মধ্যে তারা নেই ; তাদের কবর অন্য কোথাও, খুঁজে পাওয়া যায়নি ; তারা হয়তো মিথ্যা, বানানো, অস্তিত্বহীন।

             এক পর্যটক জুটি কাল রাতে সমাধির ওপরে শুয়ে বেশ কয়েকবার সঙ্গম করেছিল, রাতভর।

             সকালে সমাধি বলছিল, তোমরা দুজন হনিমুন করতে বেরিয়েছ তো ? কাল রাতে তোমাদের ভালোবাসাবাসির আওয়াজ শুনেছি, পরিচিত শ্বাস-প্রশ্বাস আর শব্দ ; অনেকে জুটিতে মিলে হনিমুন করতে এসে রাতটা কাটিয়ে যায় এই সবুজ অঞ্চলে, খোলা আকাশের তলায়, পূর্ণিমার আলোয়, শিশিরে ; তা চার-পাঁচ হাজারের বেশি জুটির সঙ্গমের আওয়াজ জমিয়ে রেখেছি, মাঝে-মধ্যে বাজিয়ে শুনি। তারা ক্লান্তিতে পাশাপাশি শুয়ে পড়লে  তাদের বলি  গল্প শোনাতে । তোমরা দুজনে শোনাও । ফিরবে তো কাল যখন পর্যটন কোম্পানির বাস  তোমাদের সঙ্গী পর্যটকদের নিয়ে নিতে আসবে । তোমরা ভালোবাসাবাসির জন্যে থেকে গেলে, বুঝেছি, তোমাদের সঙ্গীদের হাসাহাসি আর মন্তব্য থেকে । আমাদের কালে এরকম ভালোবাসাবাসি ছিল না ;  সম্রাটদের ছিল জেনানা, আর তাতে বিয়ে করে আনা বউ, বাঁদি, রক্ষিতা, ক্রীতদাসী, লুট-করে আনা অন্য ধর্মের আর ভাষার যুবতী, সম্রাটের ঘরে পৌঁছে দেবার খোজারা ছিল । রাজা-বাদশাদের সঙ্গে শোবার আর শোয়াবার জন্য এতো যুবতী জোগাড় হতে লাগলো যে হারেমপ্রথা শুরু করা জরুরি হয়ে উঠলো।         

              কয়েকশো বছরের পুরোনো সমাধির দিকে তাকিয়ে যুবক বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন, হারেমের গল্প অনেক শুনেছি ।


              যুবতী বলল, আচ্ছা, আগেকার কালে তো লাভ জেহাদ ছিল না ; ভিন ধর্মের বউরা হারেমে থেকেও তাদের ধর্ম বজায় রাখত  । এখন ভিন ধর্মে প্রেম বা বিয়ে করলে লোকে লাভ জেহাদ বলে কেন ? ধরে দুজনকেই কচুকাটা করে !


              ঘোড়া ছুটিয়ে একজন ন্যাড়া-মাথা লম্বা টিকি লোক যাচ্ছিল, যুবতীর কথা শুনতে পেয়ে বলল, ওটা তোমাদের কালের ব্যারাম । আমি বাজিরাও পেশওয়া, আমি তো মাসতানি নামে একজন ভিনধর্মীর সঙ্গে লিভ-ইন করতুম, মাসাতানির ছেলে হলে, তার নাম রাখলুম শামশের বাহাদুর, শামশেরের ছেলের নাম রাখলুম আলি বাহাদুর । আমার হিন্দু বউ কাশিবাঈয়ের ছেলেদের নাম রাখলুম নানাসাহেব আর রঘুনাথ রাও । তরোয়াল ঘোরাতে ঘোরাতে  বাজিরাও পেশওয়া বলল, দাঁড়াও একটু পরে ফিরে আসছি । 


              যুবক বলল, তাহলে সুমন চট্টোপাধ্যায় কেন কবীর সুমন হলেন ?


              যুবতী বলল, নার্গিস বিয়ে করেছিলেন সুনীল দত্তকে । নার্গিসকে গোর দেয়া হলো আর সুনীল দত্তকে দাহ করা হলো ! তাদের মেয়েরা হিন্দু আর খ্রিস্টান বিয়ে করল । ছিলে একবার বিয়ে করল হিন্দু মেয়েকে ; সে মারা গেলে বিয়ে করল মুসলমান মেয়েকে । সেই মুসলমান মেয়ে বাড়িতে হিন্দু দেবদেবীর পুজো করে । আমাদের দেশে তো আজকাল বাঙালির পোশাক ছেড়ে লোকে গেরুয়া বা সবুজ আলখাল্লা পরছে , সবজান্তার বক্তিমে ঝাড়ছে।


             যুবক বলল, আজকাল প্রেমে পড়া বেশ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে ! মাণ্ডোয়া গিয়েছিলুম । সেখানে শুনে এলুম বাজ বাহাদুর আর রূপমতীর প্রেমের ঘটনা । তখন তো কেউ লাভ জিহাদের জিগির তোলেনি । রূপমতীকে ধর্ম পালটাতেও বলেনি বাজ বাহাদুর ।       


              সমাধি বলল,  ওই যে দেখছো, ওটা বেহুলা লক্ষিন্দরের বাসর ঘর । বগুড়া শহর থেকে দশ কিলোমিটার উত্তরে, মহাস্থান গড় থেকে দু কিলোমিটার দক্ষিণে ওটা গোকুল গ্রাম  ।  এটা বেহুলার বাসর ঘর নামে পরিচিত। অনেকে একে লক্ষ্মীন্দরের মেধ বলে । এ মন্দিরে  ষাঁড়ের প্রতিকৃতি খোদাই করা সোনার পাত পাওয়া গেছে। স্তূপটা বাসরঘর নয়।  স্তূপের পশ্চিমে আছে বাসরঘরের  স্মৃতিচিহ্ন। লখিন্দরের বাবা চাঁদ সওদাগর ছিলেন   শিবঠাকুরের ভক্ত। উনি অন্য কোন দেবতার আরাধনা করতেন না। অথচ শিবের মেয়ে মনসা ছিলেন সাপের দেবী। তার বাবা শিব তাকে বলেছিল, যদি কোন শিবের উপাসক প্রথমে তোর পুজো করে তাহলে মর্ত্যে তোর পুজো শুরু হবে । তখন মনসা চাঁদ সওদাগরকে বাছাই করে তাকে মনসা পুজো করতে বলে। কিন্তু চাঁদ সওদাগর তাতে রাজি হলো না। তখন  মনসা তাকে শাপ দেন- চাঁদ সওদাগরের প্রত্যেক ছেলে সাপের কামড়ে মারা যাবে। মনসার অভিশাপে এইভাবে একে একে লখিন্দর ছাড়া চাঁদ সওদাগরের সব ছেলেই সাপের ছোবলে মারা যায়। তাই লখিন্দরের বিয়ের সময় তার বাবা এমন বাসর ঘর তৈরি করেন যা সাপের পক্ষে ছেঁদা  করা সম্ভব নয়। তবু তাকে সাপে কামড়ায় । তার শব  ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। বেহুলা সকলের নিষেধ অমান্য করে  মৃত স্বামীর সাথে ভেলায় চড়ে বসে। তারা ছয় মাস ধরে যাত্রা করে এবং গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিতে থাকে। এই অবস্থায় মৃতদেহ পচে যেতে শুরু করে ।  বেহুলা তার শ্বশুরকে মনসার পূজা করাতে রাজি হলে লখিন্দরের প্রাণ ফিরে পায়। আসল কথা হলো, হারেমগুলো ছিল লখিন্দরের লোহার ঘরের মতন । তোমরা হয়তো জানতে চাইবে বগুড়া এখানে, এই দাক্ষিণাত্যে, কেমন করে এলো । ওই যে গাছে বসে আছেন হাবশি বেতাল, উনি স্হান-কাল-পাত্র এখানে আনতে পারেন, যখন যেদিন ইচ্ছা ।


              যুবতী বলল, আমি শোনাচ্ছি আপনাকে, দুজনে ভুত-পেত্নির অপচ্ছায়া হয়ে শুয়ে আছেন ঝড়-বৃষ্টি-রোদের মাঝে, ক্ষয়ে গেছে, ঝুরঝুরে হয়ে গেছে আপনাদের সমাধি ; আর্কিওলজির কোনো বোর্ডও নেই যে জানতে পারবো, আপনারা কারা ! ভাগ্যিস বললেন যে আপনারা দুজনে শুয়ে আছেন এই সমাধির ভেতরে ।


              সমাধির  পুরুষ  বলল, হ্যাঁ, বলব তোমাদের আমি কে, তার আগে তোমরা তোমাদের গল্প বলো, শুনি ।


              যুবক বলল, আজ্ঞে আমি নাস্তিক । আমিই লখিন্দর । আমিই রোমিও । আমিই শাহজাহান । আমি সত্যবান । আমি উত্তমকুমার । 


              যুবতী বলল, আমি নব্যনাস্তিক । আমিই বেহুলা । আমিই জুলিয়েট । আমিই মুমতাজ । আমি সাবিত্রী । আমি সুচিত্রা সেন । 


              বাদবাকি পর্যটকদের নিয়ে ফিরে যাবার বাসগুলো এসে পড়েছিল । কিন্তু সমাধির ভেতরের দুজন মানুষ কথা বলে, গল্প শোনায়, আর শুনতে চায়, জানতে পেরে, তারাও থেকে যেতে চাইল । জীবনের ল্যাঙলাথি খেয়ে, সকলেরই তো গল্প আছে, নিজেকে হালকা করার জন্যে, জ্ঞান বিলোবার জন্য । বাস থেকে নামল আমির, ওমরাহ, রাজা, বাদশা, নবাব, সম্রাট, লুটেরা, বর্গি, হারেমের খোজা, মস্তান, গাইয়ে, বাজিয়ে, নাচিয়ে, কবি, লেখক, সম্পাদক, গুণ্ডা, নেতা, চাকর, চাকরানি,পার্টি-সদস্য, আর চাকুরিহীন ছেলে-মেয়ে । তারা সবাই  ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ,বায়ার্ন মিউনিখ, ম্যানচেস্টার সিটি, আর্সেনাল, চেলসি, লিভারপুল,  জুভেন্টাস, টটেনহাম হটস্পার,  এভারটন, নেপোলি, সাউদাম্পটন, ওয়েষ্টে হ্যাম, শালকে, ইন্টার মিলান, লেস্টার সিটি, অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ, ব্রুশিয়া ডর্টমুন্ড,, পিএসজি,  ম্যানচেস্টার সিটি,  বার্সেলোনা, টটেনহ্যাম হট্সপার, মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মোহামেডান স্পোর্টিং  ফুটবল দলের দশ নম্বর জার্সি পরে আছে । তারা এসেছে অঙ্গ,  মগধ ,  কাশী,  কোশল,  বৃজি বা বজ্জি, মল্ল,   চেদি , বৎস,  কুরু, পাঞ্চাল, মৎস্য,  সুরসেন,  অস্মক,  অবন্তী,  গান্ধার আর কম্বােজ দেশ থেকে ।


                 বাস থেকে নামবার সময় ফর্সা পর্যটক যুবতী গাইতে আরম্ভ করেছিল, ‘ইয়ে দুনিয়া পিত্তল দি…’


                 সমাধির বেগম বলল, ম্যাডাম, ল্যাঙটো নাচবেন না, দশ নম্বর বডিস আর জাঙিয়া পরে নিন, নয়তো বেতাল আপনাকে ল্যাঙড়া তৈমুরের হারেমে পাঠিয়ে দিতে পারে ।


                 সমাধির  পুরুষ  বলল, তোমরা সবাই আমার সমাধি ঘিরে বোসো, গাছের ছায়ায়, তোমাদের আমি হারেমের গল্প শোনাই ; আমি তো হারেমের যুগেই জন্মেছিলুম, তাই ব্যাপারটা জানি, যদিও আমার হারেম-টারেম ছিল না ; আমার অতো সময় ছিল না রোজ একজন আধচেনা মেয়ের সঙ্গে শোবার । আমি ছিলুম যোদ্ধা । সম্রাটরা অবশ্য দিনেরাতে কুড়ি-পঁচিশবার শট মারতো ।তোমরা যখন নিজের গল্প শোনাবে তখন নামটা জানিও, মনে রাখব ।


              বাসচালক : নিশ্চয়ই স্যার ।


              সমাধি : স্যার বোলো না। সমাধিদাদা বলতে পারো বা সিদ্দিদা বলতে পারো, স্যার শব্দটা আমার বয়সের সঙ্গে মানায় না । ওকে বেগমদিদি বা বেগমবউদি বলতে পারো ।


              বাসমালিক : সমাধিদাদা, আমার তো মনে হয়, হারেমখানা নিয়ে রহস্যের যেন শেষ নেই। বাবা বলতেন, ইসলাম আসার পর বোধ হয় হারেমপ্রথার  শুরু । কিন্তু হারেমপ্রথা শুরু হয় ইরাক, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, হোমারের গ্রিস, পারস্যের পয়সাঅলাদের মধ্যে। তখনো ইসলামের উদয় হয়নি। তবে এটা ঘটনা যে আব্বাসীয় খেলাফতের সময়  হারেম ব্যাপারটা দরবারি স্বীকৃতি পায়। আব্বাসীয় খেলাফতের পর থেকে উসমানীয় খেলাফতের  সময় পর্যন্ত  হারেম  প্রত্যেক রাজারই ছিল। সেখানে অবশ্য হারেমকে হারেমখানা না বলে “সেরাগ্লিয়ো” বলতো । সেরাগ্লিয়োর সঙ্গে এদেশের সম্রাটদের হারেমখানার হুবুহু মিল । সেসব দেশেও হারেমখানায় সম্রাটের পত্নী, উপপত্নী, মা, বোন, দাদী দিদারা থাকতো । সেক্স স্লেভের সংখ্যা অবশ্য একেক রাজার সময় একেক রকম ছিল, নির্ভর করতো রাজা কতোটা সেক্স ম্যানিয়াক। যেমন সম্রাট আকবরের সময় ছিল পাঁচ হাজারেরও বেশি। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ছিল দুই হাজারেরও বেশি। সেক্স স্লেভদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা  ছিল না। চাবি-মারা পুতুলের জীবন ছিল হারেমখানায় বন্দি মেয়েদের । অবশ্য হাবশি সুলতান ইলতুৎমিশের মেয়ে রাজিয়া সুলতানা জেনানাঘর থেকে শুধু বেরই হন নি, রাজ্য পর্যন্ত চালিয়েছিলেন।  তবে বেশির ভাগ সময়ই হারেমের মেয়েদের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একটা জায়গায় বুড়ি হয়ে যেতে হতো। তাদের রাজনৈতিক অধিকার তো দূরের কথা, ব্যক্তিস্বাধীনতাও  ছিল না। 


              পর্যটক শাহ জালাল : শ্রীচৈতন্যদেবের পিতৃপুরুষের আদি ভূমি হল সিলেটের ঢাকা দক্ষিণ। যদিও মহাপ্রভুর মূল কর্মক্ষেত্র শ্রীহট্ট নয়, তবু তিনি শ্রীহট্ট থেকে পেয়েছেন একাধিক অনুগামী, আর বৈষ্ণব ধর্মাচারের প্রভাব ভারতের অন্য জায়গার তুলনায় ওই এলাকায় কম নয়। তবে সেখানে সুফিতত্ত্ব বৈষ্ণবতত্ত্ব মিলে মিশে এক । সিলেট-কাছাড়ে আউল-বাউল-মারিফতি আর পাঁচালি-কীর্তন-দেহতত্ত্বের বিপুল উৎসারণের সূত্র সেখানেই। প্রচলিত সনাতন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের সংঘাত ঘটার মত কোন পরিস্থিতি এখানে হয়নি।  


               যুবক : তাহলে শ্রীচৈতন্য কি বাঙাল ছিলেন ? প্রভু কহে, কৃষ্ণকৃপা বলিষ্ঠ সবা হৈতে। তোমারে কাড়িল বিষয় বিষ্ঠা গর্ত হৈতে। 


               পর্যটক সানি লেওনি : আমি তো সেকথাই গান গেয়ে বলছিলুম, সবই দেহতত্ব।


               বেগমবউদি : আপনি পোশাক পরে নিন, নয়তো বেতাল আপনাকে ল্যাঙড়া তৈমুরের কাছে পাঠিয়ে দেবে।


              পর্যটক সানি লিওনি : বেগমবউদি, আমার দশ নম্বর ছোটো হয়, এক্সট্রা লার্জ চাই । 


               পর্যটক মিম পালোয়ান : খোজা ছাড়া হারেম আর রাজনীতি অচল, দুটোতেই স্লেভ দরকার ।                          


               পর্যটক  আমীর উল উমরা ওয়াসিফ আলী মির্জা খান বাহাদুর:   প্রাচীন আর মধ্যযুগে রাজাদের হারেমে আর জেনানামহলে পাহারাদার ছিল খোজা পুরুষ। এখনকার ভারতের মতন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুরুষদের খোজা করার প্রথা খ্রিস্টপূর্ব আট শতকের গোড়ার দিকেও  । এখনকার মতনই খোজারা চাকর বা প্রহরী হিসেবে, খেতাবধারী বা বৃত্তিভোগী রানী আর সরকারের মাস্তান আর মন্ত্রীদের আইডিয়া-দাতার ভূমিকা পালন করত। এ প্রথা এই দেশে শুরু হয়  সুলতানি আমলের গোড়ার দিকে।  খোজারা পালোয়ান হলে রাজনৈতিক আর সামরিক কাজে লাগতো, যেমন সুলতান আলাউদ্দিন খলজির  সেনাপতি-মন্ত্রী মালিক কাফুর । বাংলায় মামলুক হাবশিদের সময়ে খোজারা নিজেদের খেলা দেখাতো, মানে, লেসবিয়ান হবার তরকিব শেখাতো। সাধারণত যুদ্ধের সময়ে বন্দি তরুণ সৈনিকদের খোজা করা হতো। আর স্লেভ পাইরেটরা দাস বাজার থেকে কেনা স্বাস্থ্যবান কমবয়সী ছেলেদের খোজা করে, শিখিয়ে-পড়িয়ে রাজারাজড়ার হারেমে বিক্রি করত। তুর্কি-মুগলদের আগে বাংলায় খোজাপ্রথার অস্তিত্ব সম্পর্কে  প্রমাণ পাওয়া যায় না। পাহারাদারদের নুনু বজায় থাকতো, এখনকার পার্টি-চামচা-খোজাদের যেমন থাকে।


              পর্যটক  রেইস উদ-দৌলা ওয়ারিস আলী মির্জা খান বাহাদুর : খেলা হবে, খেলা হবে ! ইয়ে দুনিয়া পিত্তল দি…


              পর্যটক মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর : খেলা হবে খেলা হবে ! বড়ো মনকেমন করে গো সেই ছেলেটার জন্যে যাকে আমি ভালোবাসতুম ; এদেশের লোকেরা লুকিয়ে হোমো করে, বেশ অনুন্নত দেশ ।


              বাসের ক্লিনার ইবরাহিম লোদি : খেলা হবে খেলা হবে ! ইনকিলাব জিন্দাবাদ ।


              পর্যটক হিউয়েন সাঙ বা হিউয়েন-সাং বা হুয়ান-সাং বা জুয়ানজ্যাং : এদেশের লোকেরা খুবই বোকা । এরা সাপ, প্যাঙ্গোলিন, বাদুড়, বাঁদর, কুকুর, বেরাল কিছুই খায় না, হাঃ হাঃ হাঃ । 

            পর্যটক মুর্শিদ কুলি খান : খেলা হবে খেলা হবে !

            পর্যটক বিরবল : খেলা হবে খেলা হবে ! 

            পর্যটক আলা উদ-দীন হায়দার জঙ সরফরাজ খান বাহাদুর : খেলা হবে খেলা হবে !

              পর্যটক রাজা টোডরমল : খেলা হবে খেলা হবে !


              সমাধিদাদা : এবার টপিক চেঞ্জ করুন ।


             নব্যনাস্তিক যুবতী : আমি নতুন টপিক শুরু করছি ।বুদ্ধ নিজে কোন নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চান নি। কিন্তু উনি বেঁচে থাকতেই পয়সাঅলাদের পৃষ্ঠপােষণায় সংঘ প্রচুর টাকাকড়ি যোগাড় করেছিল। তাঁর মৃত্যুর একশাে বছর পরেই তাঁর ভক্তদের মধ্যে থেরবাদী আর মহাসংঘিকদের বিরােধ প্রকট হয়ে ওঠে। তারপরে অশােকের সমর্থনপুষ্ট সংঘ থেরবাদের সমালােচক বৌদ্ধদের তাড়ায় । সম্রাটের আদেশে দেশময় স্তুপ, চৈত্য, বিহার তৈরি হয় । মহাযানী বৌদ্ধরা বুদ্ধকে দেবতা বানায়, অসংখ্য বােধিসত্ত্ব উদ্ভাবন করে, বিভিন্ন দেবদেবীকে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্ভুক্ত করে। তা না হলে হয়তাে এদেশে বৌদ্ধধর্মের কয়েক শতাব্দী ব্যাপী প্রবল জনপ্রিয়তা সম্ভব হত না। বুদ্ধ যখন শেষ পর্যন্ত বিষ্ণুর নবম অবতারে পর্যবসিত হলেন, তখন বােঝা গেল বুদ্ধের স্বকীয়তা এদেশ থেকে লােপ পেয়েছে। বৃথাই তিনি সারিপুত্তকে সাবধান করেছিলেন। হিন্দুধর্মের সর্বগ্রাসী পাচকরস বৌদ্ধধর্মকে জারণ করে অবশিষ্ট বৌদ্ধদের একটি নগণ্য সম্প্রদায় হিসেবে হিন্দু সমাজের এককোণে রেখে দিল। হিন্দুয়ানী এদেশে  ব্যাপক প্রতিষ্ঠা পাবার আগে ভারতীয় মনীষীদের মধ্যে অনেকে নাস্তিক বা নব্যনাস্তিক ছিলেন।   অর্থশাস্ত্র” আর “কামসূত্রের”র কিছু উল্লেখ-উদ্ধৃতি থেকে অনুমান করা চলে যে কোন এক সময়ে লােকায়তবাদী চিন্তা অন্তত শিক্ষিত নাগরিকদের উপরে বেশ কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল। জড়বাদী দর্শনের যে-গ্রন্থটি পরবর্তীকালে পাওয়া যায় সেটির নাম “তাপপ্লবিংহ”। এটির রচয়িতা জয়রাশী অষ্টম শতকে জীবিত ছিলেন। আন্দোলন-অভ্যুত্থান সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগৃহীত হয়েছে এবং এদের চরিত্র ও ফলাফল নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ হয়েছে ও হচ্ছে।


             পর্যটক কৌস্তুভ দে সরকার : আপনি বড্ডো সিরিয়াস টপিক শুরু করলেন । আজকাল পার্টির লোকেরা এসব আলোচনা করে না । তার চেয়ে তারা খোজা হতে ভালোবাসে ।আচ্ছা, খোজা হলেই বা । শুনেছি যে বেগমের ডাক পড়তে মাসের পর মাস লাগতো, সে খোজাদের ডেকে আঙুল করাতো, কিংবা তাদের বলতো লিঙ্গের মতন জিনিস দিয়ে আনন্দ দিতে । তখনকার দিনে ডিলডো ছিল না, কিন্ত খোজারা ডিলডোর মতন জিনিস তৈরি করে সাপলাই দিতো।


              পর্যটক মেগাসথিনিস : না, না, আলেকজাণ্ডার এদেশে হাজার হাজার ডিলডো বিলি করে গিয়েছিলেন। তক্ষশীলায় মাটি খুঁড়ে পাকিস্তরানিরা পেয়েছে ।


              পর্যটক নবীন কর : অতো বেগমদের হারেমে রেখে তাদের সেক্সুয়াল লাইফ নষ্ট করার মানে হয় না। খোজারা যদি আনন্দ দিতো তো ভালোই করতো । ডিলডো জিন্দাবাদ । হারেমের টপিকটা ইনটারেস্টিঙ । 


               সমাধিদাদা : হারেমের উল্লেখ প্রায় সব রাজপরিবারের ভেতরেই পাওয়া যায়। কেউ বলেন এটা তুর্কি শব্দ আবার কারো মতে, হারেম শব্দটা এসেছে আরবী ‘হারীম’ থেকে, যার অর্থ নিষিদ্ধ বা অলঙ্ঘনীয় সীমারেখা; এটা হলো মহিলাদের জন্য নির্ধারিত এলাকা যেখানে পুরুষদের ঢোকা বারন । তুর্কি সাম্রাজ্যেই হারেমের উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় যা পরে মোগলদের মাধ্যমে উপমহাদেশের সমাজে ঢোকে । হারেমে থাকার জন্যে কেবল মাহরামের( আরবি পরিভাষায় মাহরাম বলতে বোঝায় যাদের বিয়ে করা হারাম) প্রবেশাধিকার আছে। মানে হারেমে সবাই রাজরক্তের ছিল না । তখনকার সময়ে রাজার অনেক বউ আর উপবউ থাকবে এটাই স্বাভাবিক ছিল। নিজেদের দাস-দাসী আর বউদের বাদশা নিজের ইচ্ছেমতন ওলটাবেন-পালটাবেন-শোয়াবেন-বসাবেন  সেটাও অবাক করার ব্যাপার ছিল না। হারেমে তাই সর্বাধিক গুরুত্ব পেত আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা। অন্তঃপুরের একাংশে থাকতো বাদ্যযন্ত্র এবং হাতি, ঘোড়া ও রথের সাজসজ্জা। 


              পর্যটক সুজা উদ-দৌলা সুজা উদদীন মুহম্মদ খান :পৃথিবীর সব যুদ্ধবাজ বাদশাদের বিরুদ্ধে যেসব কথা শোনা যায় তার ভেতরে উল্লেখযোগ্য হলো যুদ্ধে জয়লাভ করার পর বিভিন্ন প্রদেশ কিংবা অঞ্চল থেকে নানান ধর্ম ও বর্ণের মেয়ে এনে নিজেদের হারেমে রাখা। মুঘল হারেমেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কখনো কখনো নাকি হারেমে মেয়েদের সংখ্যা সাত-আট হাজার ছাড়িয়ে যেত। সম্রাজ্ঞী, রাজকন্যা কিংবা বাদশার রক্ষিতারা সকলে নাকি প্রায় একভাবেই সাজগোজ করত। চুলের বেণি, ঝলমলে পোশাক আর মণিমুক্তার গয়না পরে থাকতো আর ওইসব পরেই সেক্স করতো। 


                 পর্যটক অ্যালেন গিন্সবার্গ : 


    এসো নীপবনে ছায়াবিথী তলে                                               


    এসো করো স্নান নবধারা জলে


     দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ


    পরো দেহ ঘেরি মেঘ নীল বেশ


    কাজল নয়নে যূঁথী মালা গলে


    এসো নীপবনে ছায়াবিথী তলে


    এসো করো স্নান নবধারা জলে


    আজি ক্ষণে ক্ষণে হাসিখানি সখী


    আঁধারে নয়নে উঠুক চমকিয়া


    আজি ক্ষণে ক্ষণে


    মল্লারো গানে তব মধু স্বরে


    দিক বাণী আনি বন মর্মরে


    ঘন বরিষণে জল কলকলে


    এসো নীপবনে ছায়াবিথী তলে


    এসো করো স্নান নবধারা জলে


              পর্যটক আলা উদ-দিন হায়দর জং সরফরাজ খান বাহাদুর: আইন-ই-আকবরী আর আকবরনামার লেখক আবুল ফজল মোগল হারেমকে অভিহিত করেছেন ‘শাবিস্তান-ই-খাস’ নামে। রাজপ্রাসাদের এক বিশাল অংশ জুড়ে ছিল মহল । বাগান আর ফোয়ারার দিকে মুখ করে থাকা অগুনতি কামরায় হাজার দুয়েক নারীর বাস আর তাদের প্রত্যেকের জন্যই আলাদা মহল। এছাড়া আর তিনটি প্রাসাদে বাদশার উপবউরা থাকতো। এগুলোকে বলা হতো, লেথেবার ( রবিবার), মঙ্গল (মঙ্গলবার) এবং জেনিসার (শনিবার) মহল। এই নির্ধারিত দিনগুলোতে বাদশা নির্দিষ্ট প্রাসাদে সেক্স করতে যেতেন। একটি হারেম বা অন্তঃপুরে অনেক ঘরের ব্যবস্থা থাকতো। আলাদা রান্নাঘর, আলাদা প্রহরী, আলাদা গোসলখানা, কোনো কিছুর অভাব ছিল না। 


                  যুবক : ব্রিটিশরা যখন শেষ বাদশার কেল্লা ভেঙে চুরমার করে দিলে, তখন পিলপিল করে উপবউ, বাঁদি, রক্ষিতা, স্লেভগার্ল আর তাদের হাজার কয়েক ছেলে-মেয়ে প্রাণ বাঁচাবার জন্যে দেদ্দৌড় দিয়েছিল, কিন্তু কেউই রেঝাই পায়নি।


                পর্যটক রঘু ডাকাত : আমি টপিক পালটাচ্ছি । ইংরেজ শাসনের শুরুর দিকে যখন  বংশানুক্রমিক পেশাগত স্তর থেকে উৎখাত হওয়া মানুষেরা নতুন সামাজিক অর্থনৈতিক স্তরে প্রবেশ কর‍তে পারল না, তখন আমরা সমাজ আর পেশা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে  যাযাবর হয়ে গেলুম। কিন্তু যাযাবরবৃত্তিতে তো দীর্ঘকাল জীবনধারণ করতে পারে না লোকে, আমরা বেছে নিলুম দস্যুবৃত্তি। গড়ে উঠল  ডাকাতের দল আর গ্রামে গ্রামে ডাকাতকালীর থান বা মন্দির। বাঘ যেমন বিশেষ পরিস্থিতিতে নরখাদক হয় তেমনি আমরা পেটের দায়ে পা বাড়ালুম অপরাধের পথে। যুদ্ধ বিগ্রহ মন্বন্তর কোম্পানির অত্যাচার, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে করদানে বাধ্য জমিদারের মাত্রাছাড়া জুলুমে আমরা বিদ্রোহী হলুম, আর ফিরিঙ্গিরা আমাদের বলল ডাকাত। ওরা কৃষক বিদ্রোহী আর সাধারণ ডাকাতের সাথে পার্থক্য করেনি । বাংলার অসহ্য নৈরাজ্য শান্তিপ্রিয় নিরীহ শ্রমজীবী মানুষকে ঠেলে দিলে চুরি-ডাকাতির রাস্তায় । বিনয় ঘোষ তো বলেছেন, “ডাকাতরা কি কেবল পুলিশ অভিধানের সংজ্ঞানুসারে ডাকাত? অথবা তার চেয়ে বেশি কিছু? তাদের দস্যুবৃত্তির চেতনার সঙ্গে গনমুক্তির রাজনৈতিক বিপ্লবচেতনা মিশিয়ে দিতে পারলে রঘু বিশে বদে হয়ত বিপ্লবের ছোটবড় নায়ক হতে পারত, কিন্তু তখন লালপতাকার যুগ ছিল না, কন্ঠভরা বৈপ্লবিক স্লোগানের যুগ ছিল না, কালীর যুগ ছিল তাই কালী ছিলেন বিদ্রোহ বিপ্লবের প্রতীক”। কালী তো চিরব্যতিক্রমী, প্রচন্ড তান্ডবের প্রতিমূর্তি, তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর ভেতর অনন্যা। ডাকাতেকালী উপেক্ষিত, প্রান্তিক, অন্ত্যজ ও অপরাধীদের দেবী, রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের অফুরন্ত শক্তি উৎস। ঘোর তমসাচ্ছন্ন রাতে যার ওনার আরাধনা করত তাঁরা অগ্নিযুগের সৈনিক বা অন্ধকারের পথিক । তিনি শাস্ত্রের কালীমাতা, স্নেহমহী ভবতারিণী নন, শস্ত্রের পুজারী বাঙালীর এক লৌকিক দেবী, আমার মতন ডাকাতদের আরাধ্যা হয়ে জন্ম নেন, ও মিশে যান সাধারণ সংস্কৃতির ভেতরে। জয় মা কালী কলকাত্তাওয়ালি ।


              পর্যটক হাশিম উদ-দৌলা মুহম্মদ আলীবর্দী খান বাহাদুর : হারেমের টপিকটা তো বেশ চলছিল । হারেমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর আর বাইরের লোকের পক্ষে মোগল হারেমে ঢোকা  রীতিমতো কঠিন ছিল। খোজাদের ‘নাজির’ বলা হতো । প্রত্যেক বেগমের একজন করে নাজির থাকত যাকে তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। বেগমদের কারো কোনো জিনিসের দরকার হলে তারা হারেমের কেশিয়ারকে বলত। হারেমে ব্যবহারের জন্য আলাদা কয়েন ছিল যা বাইরে পাওয়া যেত না।  হারেমের দারোগা হিসেবে নিয়োগ করা হতো  প্রৌঢ়াদের । হারেমের সর্বোচ্চ পদাধিকারী মহিলা কর্মচারী ছিল ‘মহলদার’। এরা বাদশার গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করত। মহলদারের দরুন রাজকুমারদের সঙ্গে গোলমাল বাধতো। বেচারা রাজকুমার কাউকে লাইন মেরে লুকিয়ে এক খেপ শট মেরে কেটে পড়তে চাইলেও তা পৌঁছে যেত বাদশার কানে । জাহাঙ্গির এ-ব্যাপারে ছিল ওস্তাদ। বাপের রক্ষিতাকেও লুকিয়ে শট মেরে কেটে পড়ত । উজির-আমীররা তাদের দুয়েকটা মেয়েকে মহলে ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করতো আর এর জন্য হারেমের মহলদারের সাথে মিলে নানা দুরভিসন্ধির আশ্রয়ও তারা নিত। কারণ, একবার যদি মেয়েটা  বাদশাকে সেক্সুয়ালি অ্যাট্রাক্ট করে, তো, ব্যাস, কেল্লা ফতে!


              যুবক : বেচারি জাহানারা সারাজীবন ভার্জিন রয়ে গেল ।


               যুবতী : ওকে আওরঙজেব অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছিল ;ইনডিয়ায় সেই থেকে অ্যাসিড মারা শুরু হয়েছে।


              পর্যটক নামদেও ধাসাড় : আমি টপিক পালটাচ্ছি । তিনের দশক থেকে সরকার ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের যথার্থ প্রমাণের জন্য নিম্নবর্গের আন্দোলনগুলো সমর্থন করতে শুরু করে। এই সময় এই আন্দোলনগুলোর অনেক নেতাই দেশের সব থেকে ক্ষমতাশালী দল কংগ্রেসের সঙ্গে একাত্ম হওয়াই অনেক বেশি সুবিধাজনক বলে মনে করতে শুরু করেছিলেন। এই ধরণের একটা পরিণতি খানিকটা অবশ্যম্ভাবীও ছিল, কারণ শেষ পর্যন্ত এইসব নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের ক্ষমতার আসনে বসানো, বৃহত্তর সমাজ থেকে নিজেদের পৃথক করে রাখা নয়। আর চারের দশকেই ভারতে রাজনৈতিক জাতির প্রতিনিধি হিসেবে কংগ্রেস  বাস্তবিক অর্থেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কংগ্রেসও ১৯৩৫-এর সাংবিধানিক সংস্কারে বিধিবদ্ধ প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এইসব নেতাদের গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল, ফলে একীকরণ হয়েছিল সহজ। অন্যদিকে নিম্নবর্গের জনসাধারণও সামাজিক আর অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য তাঁদের অসমাপ্ত সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যায়। কখনও তার মাধ্যম ছিল জাত-ভিত্তিক সম্প্রদায়, যদিও একেই ক্ষমতার একমাত্র আধার বলে মেনে নিতে আর রাজি ছিলেন না তাঁরা। তাই কখনও তাঁরা জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন, কখনও সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, আবার কখনও বা সরাসরি শ্রেণীভিত্তিক কর্মসূচি ও সংগঠনের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। অন্যভাবে বলতে গেলে, যে আন্দোলন এক সময় শুরু হয়েছিল ‘নিম্ন বর্ণের আন্দোলন’ হিসেবে, তা একদিন বিভিন্ন পথে চলতে শুরু করে, কারণ জাত-ভিত্তিক আত্মপরিচয়কে বিভক্ত করে,অথবা আচ্ছন্ন ,এমন অনেক নতুন আত্মপরিচয় গড়ে উঠতে, অথবা সরব হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এই আন্দোলনগুলোর মধ্যে তাই সমপ্রকৃতি অথবা একমূখীন প্রগতির খোঁজ না করে এই ধরনের জটিলতারই অনুসন্ধান করা উচিত। সেই অনুসন্ধানই উত্তর দিতে পারবে কেন অত্যন্ত সীমিত ক্ষেত্র ছাড়া এইসব নিম্নবর্ণের প্রতিবাদ ভারতীয় সমাজে প্রচলিত ক্ষমতার সম্পর্ককে ভেঙে ফেলতে সমর্থ হয়নি। 


                 পর্যটক জাফর আলী খান বাহাদুর মীর মুহম্মদ জাফর আলী খান বাহাদুর : আমি পুরোনো টপিকে ফিরছি । মোগল হারেমের যেসব নারী বিখ্যাত  তাদের মধ্যে নামকরা হলো বাবরের মেয়ে গুলবদন বেগম, সম্রাজ্ঞী নুরজাহান, শাহজাহানের বউদের একজন, মানে, মমতাজ মহল, দারাশিকোর বউ নাদিরা বেগম, আওরঙ্গজেব মেয়ে জেবুন্নেসা, শাহজাহানের মেয়ে রোশানারা আর জাহানারা আর বেচারা বাহাদুর শাহ জাফরের বউ  জিনাত মহল। বিশেষত, নূরজাহান  তো নিজের লেখা কবিতা পড়তো ;‘মুশায়েরা’ ওনার সময় থেকেই বাড়বাড়ন্ত হয়েছে । কলকাতায় জীবনানন্দ সভাগরে, নজরুল মঞ্চে, অকাদেমিতে আজকাল যে কবিতা পাঠ হয় তা নুরজাহানের কারণে । ভোজের সময় দস্তরখানের ব্যবহার, চোলি বা আধুনিক বডিসের প্রচলন, পোশাকে বোতাম, অন্তর্বাস, নৈশবেশ, কুর্তা,কামিজ আর জরির লেস চালু  করেন  নূরজাহান। সেক্সকে সুরভিত করার জন্যে নূরজাহানের   আবিষ্কার গোলাপের আতর, ‘আতরে জাহাঙ্গীরী’। নূরজাহানের স্নানঘরে বিশাল টবে গোলাপ মধ্যে গোলাপের নির্যাস, আতর, চন্দন, হলুদ চুবিয়ে রাখার চল ছিল । বউ তো রাজ্য চালাচ্ছে, এদিকে তার বর জাহাঙ্গির মাগিবাজি করে বেড়াচ্ছে ।


             পর্যটক নজম উদ-দৌলা নাজিম উদ্দিন আলী খান বাহাদুর :  জাহাঙ্গির বা সেলিমকে, আকবরের হিন্দু বউয়ের ছেলে বলে, অনেকে বলতো ফাসেক । কেন জানো ? নুরজাহানের আগে জাহাঙ্গির একজন দাসীকে  ভালোবাসতো, যাকে তার বাবা আকবরও ভালোবাসতো। তার নাম নাদিরা বেগম  শার্ফ-উন-নিসা। সে দাসী হলেও এতো সুন্দরী ছিল যে তাকে আকবর আনারকলি নাম দিয়েছিলেন । আনারকলি কোন এক বণিক বহরের সাথে ইরান থেকে  লাহোরে  এসেছিল । ব্যাপারটা ইডিপাস কমপ্লেক্সের, মানে বাপ-বেটা একই সঙ্গে একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতো । প্রেমিকার টানে বাপের হারেমে ঢুকে গিয়েছিল জাহাঙ্গির আর তার জন্য খুব মার খেয়েছিল । অবৈধ সম্পর্ক গড়ার দোষ দিয়ে  আকবরের নির্দেশে  ইটের ঘরের মধ্যে তাকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছিল। লাহোরে সরকারি মহাফেজখানায় আছে তার কবর । ফাসেক শব্দটা ফিসক শব্দ থেকে এসেছে । ‘ফিসক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অবাধ্য । বাংলাতে ‘ফাসেক’ শব্দের মানে করা হয় পাপিষ্ঠ। যে  প্রকাশ্যে  হারাম কাজ করতে অভ্যস্ত এবং তোওবা করে পাপ কাজ থেকে ফিরে আসে না, তাকে ফাসেক বলা হয়। উদাহরণঃ নিচের প্রত্যেকটা কাজই পাপ কাজ,  যার কয়েকটা জাহাঙ্গির করেছিল :


    – যে লোক মা-বাপের অবাধ্য বা তাদের হক আদায় করে না ।


    – যে লোক কোন কারণ ছাড়া জামাতে শরিক হয়না ।


    – যে লোক দাড়ি কামায় – জাহাঙ্গির দাড়ি রাখতো না ।


    – যে লোক নাভির নিচে কাপড় পরে ।


    – যে লোক বউদের হক আদায় করে না, বাড়ির লোকদের সাথে অন্যায় আর জোরজুলুম  করে ।


    – যে লোক বাড়ির মেয়েদের হিজাব-পর্দার আদেশ করে না ; জাহাঙ্গিরের বউ নুরজাহান হিজাব-পর্দা করতো না ।


    – যারা অবৈধ প্রেম-ভালোবাসায় লিপ্ত । জাহাঙ্গির প্রচুর ভালোবাসাবাসি করতো, পোস্টমডার্ন সম্রাট ছিল ।


           পর্যটক হাছন রাজা : মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে।


    কান্দে হাসন রাজার মন মনিয়া রে।।


    মায়ে বাপে বন্দি কই লা, খুশির মাঝারে।


    লালে ধলায় বন্দি হইলাম, পিঞ্জিরার মাঝারে।।


    উড়িয়া যায় রে ময়না পাখি, পিঞ্জিরাইয় হইল বন্দি।


    মায়ে বাপে লাগাইলা মায়া, মায়া জালের আন্দি।।


    পিঞ্জিরায় সামাইয়ারে ময়নায় ছটফট করে।


    মজবুত পিঞ্জরা ময়নাইয় ভাঙ্গিতে না পারে।।


    উড়িয়া জাইব শুয়া পক্ষী, পড়িয়া রইব কায়া।


    কিসের দেশ, কিসের খেশ, কিসের মায়া দয়া।।


    ময়নাকে পালিতে আছি দুধ কলা দিয়া।


    যাইবার কালে নিঠুর ময়নায় না চাইব ফিরিয়া।।


    হাসন রাজায় ডাকব তখন ময়না আয় রে আয়।


    এমন নিষ্ঠুর ময়নায় আর কি ফিরিয়া চায়।। 

              পর্যটক লাটুবাবু : সমাধিদাদা, নতুন টপিক শুরু করি বরং । নূরজাহান-এর আসল  নাম ছিল মেহেরুন্নিসা । উনিশজন যুবতীকে বিয়ে করার পর জাহাঙ্গির বিধবা মেহেরুন্নিসাকে বিয়ে করে । তিনি হয়ে ওঠেন  জাহাঙ্গীরের প্রধান বেগম । একজন বলিষ্ঠ, সম্মোহনী ও উচ্চশিক্ষিতা নারী হওয়ায় তাকে তখনকার সবচেয়ে প্রভাবশালী মহিলা ভাবা হয় । স্বামী  জাহাঙ্গীরের সেক্স, মদ, আফিমের প্রতি তীব্র আসক্তি থাকায় নূরজাহান ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন । মেহেরুন্নিসার প্রথম বিয়ে  হয় তুর্কিস্তানের  আলি কুলি বেগ এর সঙ্গে। একলা খালি হাতে বাঘ মারার জন্য তার নাম হয় শের আফগান। শোনা যায় মেহের একবার যুবরাজ সেলিমের নজরে পড়ে জান। সেলিমও অমনি খেপে উঠলো মেহেরকে বিয়ে করার জন্য। শেরের মৃত্যুর পর মেহেরকে আগ্রাতে নিয়ে আসা হয়। তখন মেহেরের বয়স তেত্রিশ। ওই বয়সেও উনি ছিলেন মারকাটারি । সাঁইত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করলেন নাছোড় জাহাঙ্গীরকে। জাহাঙ্গীর তার নাম দিলেন নুরজাহান বা জগতের আলো। জাহাঙ্গীর ছিল নামকেওয়াস্তে সম্রাট।  জাহাঙ্গীরের রাজত্যের শেষ দিকে যখন তার ছেলে খুররম আর সেনাপতি মহাব্বত খান বিদ্রোহ করেন তখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন নুরজাহান।

               পর্যটক ছাতুবাবু : সমাধিবউদি, একটা কথা বলুন যে শাহজাহানের ভালোবাসাবাসিও অদ্ভুত ব্যাপার নয়কি ? বিয়ে করলেন আর্জুমান বানুকে, ওনার ছেলের বউ নুর জাহানের ভাইয়ের মেয়ে, তবে এই নাম পালটে দিলেন শাহজাহান।  নাম রেখেছিলেন মমতাজ মহল। শাহজাহান উনিশের আর্জুমানকে বিয়ে করেন একুশ বছর বয়সে।  শাহজাহানের যৌন চাহিদা এতো বেশি ছিল যে মমতাজের সংসার-জীবন মাত্র আঠারো বছরে শেষ হয়ে যায় । এরই মধ্যে মমতাজ চোদ্দটা বাচ্চা পয়দা করেন। অন্য বেগমদেরও শাহজাহানের যৌনখোরাক মেটাতে হতো, তার ওপর উপবউ, বাঁদি, রক্ষিতা, স্লেভগার্লরা তো ছিলই ।  মমতাজ ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী। কোথাও বলা হয়েছে, মমতাজ শাহজাহানের ৩য় স্ত্রী, কোথাও বলা আছে ৪র্থ স্ত্রী। আসলে কততম স্ত্রী তা কোথাও সঠিকভাবে বলা নেই। সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের প্রেম কাহিনীতে বলা হয়েছে সম্রাট শাহজাহান মমতাজকে বাজারে দেখতে পান এবং প্রথম দেখাতেই মমতাজকে পছন্দ করে ফেলেন। কিন্তু এও শোনা যায় শাহজাহানের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগেও মমতাজের বিয়ে হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহান মমতাজের সেই স্বামীকে হত্যা করে তারপর মমতাজকে বিয়ে করেছিল। মমতাজ মারা যাওয়ার পর শাহজাহান মমতাজের আপন ছোট বোনকে বিয়ে করেন। লোকটা বোধহয় সেক্স পারভার্ট ছিল, ওর পূর্বপুরুষ ল্যাঙড়া তৈমুরের মতন।


                সমাধিবউদি : সব যুগের সব পুরুষ একই রকম । কতো মেয়েকে ফুসলিয়ে আমাদের সমাধির ওপরে পুরুষরা কুকর্ম করে গেছে তার হিসেব বটগাছের ওই হাবশি বেতালই দিতে পারবে ।


              পর্যটক আহমেদশাহ আবদালি : আমি অখন ইনটারভিন করতাসি সমাধিদাদা । চারদিকের কিছু নতুন গজিয়ে ওঠা বালের মতো ক্যারেক্টার দেখি। যার নতুন ওঠে সে তো পুলকের চোটে বালে হাত বুলায় আর ভাবে আহা কি নরম কোমল মোলায়েম! থাক আর কিছুদিন। ঠিক তখনই এইসব বাল লম্বায় বাড়তে বাড়তে এতো বড় হয় যে বালের মালিক নিজের বালে পেচায়া মইরা যায়। এদেরকে তাল দেয় আবার পুরান পাইকা তামার তার হওয়া বালের মালিক। আরে তোর এতো খাউজানি থাকলে নিজের তামার তারগুলা প্লাইয়ার্স দিয়া কাইটা আঁটি বাইন্ধা বাজারে নিয়া বেইচা দে হারামজাদা গুস্তাখ! ঘটনা হইসে পাকনা বাল গুলারে সবাই চিনে, নতুন বাল ওলারা বুঝেনা এই মুর্শিদ তোরে সুটায়া লাল করে দিবে, ব্যথায় হাঁটতেও পারবি না। এই জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার মধ্যে একটা অতি জরুরী ও একের শিক্ষা হলো, স্নেহ লুকায় রাখতে হয়। যারে স্নেহ করলেন সন্তানস্য, সে যদি সেটা বুঝতে পারে এবং নিশ্চিত হয় স্নেহের জায়গাটা তাইলেই সব শেষ। তারপর… দিনে রাতে, ঢালে বিঢালে এমন এমন ভূত ও বর্তমান ভাবে অঝরা বাঁশ দিতে শুরু করবে যা আপনি গিলতেও পারবেন না, ফালাইতেও পারবেন না। দেওয়ার মত বাঁশ যদি পছন্দ না হয়, সে নিজে টাকা খরচ কইরা আন্দামান নিকোবরে গিয়া উৎকৃষ্ট প্রজাতির ঘন ঝাড়সমেত পোক্ত কঞ্চিঅলা অভৌত, ভৌত, ইহজাগতিক, পরাবাস্তব সবপ্রকার বাঁশ প্লেনের পিঠে কইরা তুইলা বাইন্ধা আইনা এই মহান প্রয়োগ শেষ করবেন দায়িত্বের সাথে। যে তার সারা জীবনে একগাছা বাল ঠিকমতো ফালাইতে পারেনা, সেও এই কাজ এতো নিঁখুত ভাবে করবে যে আপনি তার এই মহান প্রয়োগে ব্যথা ভুইলা গিয়া খুবই আশ্চার্যান্বিত, মুগ্ধ, অভিভূত, পুলকিত, হইয়া গালে হাত দিয়া ভাববেন- আইসসালা! তাম্মায়রেবাপ! এই শাউয়াডারে যে এতো ভালো জানতাম, এতো স্নেহ করতাম, বালপাকনায় এই বয়সে এই জিনিস হিখছে কোম্মে দিয়া!


               পর্যটক শেরশাহ সুরি : আমিও টপিক চেঞ্জ করছি সমাধিদাদা । প্রায় ৫০০ বছর আগে বাগহাটির জয়পুরের বাসিন্দা বিধুভূষণ ঘোষ আর তার ভাই রঘু ঘোষ ঘন জঙ্গলের মধ্যে হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের মায়ের মূর্তি স্থাপন করে। দিনের বেলায় দুই ভাই দিনমজুরের কাজ করলেও রাতে ধনীদের বাড়িতে ডাকাতি করত। ডাকাতি করে আনা জিনিসপত্র এলাকার গরিব মানুষের মধ্যে বিলি করত। কিংবদন্তি হলো, কারো বাড়িতে ডাকাতি করার আগে রঘু ডাকাত চিঠি দিয়ে বাড়ির মালিককে জানিয়ে দিত। রঘু ডাকাতের লোকজন রাস্তা দিয়ে যাওয়া কোনও মানুষকে ধরে বেঁধে রাখত। সন্ধ্যার পর পুরোহিতকে ডেকে এনে ঢাকঢোল বাজিয়ে নরবলি ও ল্যাটা মাছের পুজো দিয়ে গলাকাটা শব মন্দিরের সামনে  পুকুরে ভাসিয়ে দিত। তারপর মহাপ্রসাদ খেয়ে ডাকাতি করতে বেরোতো। ডাকাত দলের ভয়ে দুপুরের পর থেকে সেই রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচল করত না। সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন কোনও এক সময়ে ওই রাস্তা ধরে ত্রিবেণী ফেরিঘাটে ফিরছিলেন। ওই সময়ে রঘু ডাকাতের লোকজন তাঁকে নরবলি দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে এসে বেঁধে রাখে। রাতে রামপ্রসাদকে বলি দেওয়ার  সমস্ত প্রস্তুতি সেরে ফেলা হয়ে গেছে যখন,  বলি দেওয়ার আগে মাকে একটি গান শোনানোর আর্জি করেন। সেই আর্জি মেনে রঘু ডাকাত গান শোনানোর অনুমতি দিলে রামপ্রসাদ এই গানখানা ধরেন। 


                         তিলেক দাঁড়া ওরে শমন,   


    বদন ভরে মাকে ডাকি রে ।


    আমার বিপদকালে ব্রহ্মময়ী,


    এসেন কি না এসেন দেখিরে 


    লয়ে যাবি সঙ্গে করে, তার এত ভাবনা কীরে 


    তবে তারা-নামের কবচ-মালা,


    বৃথা আমি গলায় রাখি রে 


    মহেশ্বরী আমার রাজা,


    আমি খাস তালুকের প্রজা,


    আমি কখনো নাতান, কখনো সাতান,


    কখনো বাকির দায়ে না ঠেকি রে 


    প্রসাদ বলে মায়ের লীলা,


    অন্যে কি জানিতে পারে 


    যার ত্রিলোচন না পেল তত্ত্ব,


    আমি অন্ত পাবো কীরে 


    তারপরেই রঘু ডাকাত বলির হাড়িকাঠে রামপ্রসাদের বদলে কালীমূর্তি দেখতে পায়। এরপর থেকে রঘু ডাকাত বলি বন্ধ করে রামপ্রসাদের সেবার ব্যবস্থা করে।  পরের দিন সকালে নৌকায় করে রামপ্রসাদকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে।                  


               সমাধিদাদা বলল : এবার আমি নিজেদের কথা বলি ।আমি  হাবশি সুলতান, ডাক নাম চাপু, শুয়ে আছি খুলদাবাদের এই কবরের তলায়, তবে বিশেষ লোক আসে না, আমার সৌধ দেখতে, তা আমি হাবশি বলে নয়, আমার সৌধ তেমন সুন্দর নয়, অথচ আমি কতো কি শিখিয়েছি, এদেশের লোকেদের । তোমাদের মতন বাঙালি পর্যটকের দল সপরিবারে আসে আর অবাক হয় আমার গল্প শুনে । যারা আসে তাদের সবাইকেই আমি গল্প শোনাই ।  কবরের ভেতরটা, বুঝলে, লেখকের বিছানার মতন, একা ভাবতে পারি, শতকের পর শতক ।  ১৪৯৪ সালে ক্যাথলিকদের গুরু পোপ পৃথিবীকে দুইভাগে ভাগ করে দিয়েছিল, কেপ ভের্দে থেকে সোজা লাইন টেনে পূর্ব দিকটায় লুটপাট চালাবে পর্তুগাল আর পশ্চিম দিকটায় স্পেন । স্পেনের দাস ব্যবসায়ীরা যদি আমাকে ধরে বিক্রি করতো তাহলে আমি ভারতে আসার বদলে দক্ষিণ বা উত্তর আমেরিকায় যেতুম । সেখানে গিয়ে কতোকাল যে বংশ পরম্পরায় অত্যাচার সহ্য করতে হতো তা তোমরা ভালোই জানো । এখন শুনি ডোনাল্ড ট্রাম্প নামে একজন এসেছে সেদেশের হাবশিদের নিকেশ করতে ।


              আমিই  সিদ্দি, নিগ্রো, মামলুক, মুর, নিগার,  কালা-আদমি । আমিই সেইন্ট অগাস্টিন অব হিপো, মানসা মুসা, নেলসন ম্যাণ্ডেলা, হাইলে সেলাসি, ডেসমণ্ড টুটু, কোয়ামে এনক্রুমা, অলিভার টাম্বো, কোফি আন্নান, ওয়ানগারি মাথাই, চিনুয়া আচেবে, ওলাউধা ইকুয়িনা, আবেবে বিকিলা, টেগলা লারুপ, হাইলে গেব্রসেলাসি, কেনেনিসা বেকেলে, আসবেল কিপরপ, মার্টিন লুথার কিং, বারাক ওবামা, জেসি ওয়েন্স, মোহম্মদ আলি, ফ্রেডরিক ডগলাস, তুসেইন্ট লুভেরতুরে, বুকার টি ওয়াশিংটন, ডাবলু ই বি দুবয়, ম্যালকম এক্স, পেলে, মাইকেল জর্ডান, থুরগুড মার্শাল, উসেইন বোল্ট, কার্ল লুইস, বব মার্লে, সোজোরনার ট্রুথ, হ্যারিয়েট টাবম্যান, আইডা ওয়েলস, হ্যাটি ম্যাকড্যানিয়েল, রোজা পার্কস, বিলি হলিডে, শার্লি চিশোম, করেটা স্কট কিং, এলেন জনসন সিরলিফ, ওপরা উইনফ্রে,ওয়ানগারি মুটা মাথাই, মায়া অ্যাঞ্জেলু, হুপি গোল্ডবার্গ, জ্যাকি জয়নার-কার্সি, ডেরাটু টুলু, সেরেনা উইলিয়ামস, মাইকেল জ্যাকসন, বিয়োনসে । আমিই অ্যাভেরোস, তারিক ইবন জিয়াদ, আবদ-আর-রহমান, ইবন আল-কোটিয়া, ইয়াহিয়া আল-লাইথি, আব্বাস ইবন ফিরনাস, মাসলামা আল-মাজরিথি, সইদ আল-আনদালুসি, আবু ইশহাক ইবরাহিম আল-জারকালি, আরটেফিয়াস, ইবন বাইজাহ, ইবন জুহুর, ইবন তুফাইল, ইবন আল-বাইতার, ইবন খালদুন, আবু আল-হাসান ইবন আলি আলকালাসাদি, লিও আফরিকানাস, এসতেভানিসিও, ইবন বাতুতা, ইবন হাজম, ইবন ইধারি, ইবন আরাবি, আবু বকর ইবন, টাইগার উডস, আল-আরাবি, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার ।          


              আমার এই বক্তৃতাটা শুনেছো তো ?


    I say to you today, my friends, so even though we face the difficulties of today and tomorrow, I still have a dream. It is a dream deeply rooted in the American dream.


    .


    I have a dream that one day this nation will rise up and live out the true meaning of its creed: ‘We hold these truths to be self-evident: that all men are created equal.’


    .


    I have a dream that one day on the red hills of Georgia the sons of former slaves and the sons of former slave owners will be able to sit down together at the table of brotherhood.


    .


    I have a dream that one day even the state of Mississippi, a state sweltering with the heat of injustice, sweltering with the heat of oppression, will be transformed into an oasis of freedom and justice.


    .


    I have a dream that my four little children will one day live in a nation where they will not be judged by the color of their skin but by the content of their character.


    .


    I have a dream today.


    .


    I have a dream that one day, down in Alabama, with its vicious racists, with its governor having his lips dripping with the words of interposition and nullification; one day right there in Alabama, little black boys and black girls will be able to join hands with little white boys and white girls as sisters and brothers.


    .


    I have a dream today. I say to you today, my friends, so even though we face the difficulties of today and tomorrow, I still have a dream. It is a dream deeply rooted in the American dream.


    .


    I have a dream that one day this nation will rise up and live out the true meaning of its creed: ‘We hold these truths to be self-evident: that all men are created equal.’


    .


    I have a dream that one day on the red hills of Georgia the sons of former slaves and the sons of former slave owners will be able to sit down together at the table of brotherhood.


    .


    I have a dream that one day even the state of Mississippi, a state sweltering with the heat of injustice, sweltering with the heat of oppression, will be transformed into an oasis of freedom and justice.


    .


    I have a dream that my four little children will one day live in a nation where they will not be judged by the color of their skin but by the content of their character.


    .


    I have a dream today.


    I have a dream that one day, down in Alabama, with its vicious racists, with its governor having his lips dripping with the words of interposition and nullification; one day right there in Alabama, little black boys and black girls will be able to join hands with little white boys and white girls as sisters and brothers.


    .


    I have a dream today. 


               আমরা মামলুকরা তো জন্মাই নাস্তিক হয়ে, তারপর যারা আমাদের কেনা গোলাম করে তোলে তাদের ধর্মে আমরা ধর্মান্তরিত হই । কেনা গোলামরা প্রায় সকলেই জন্মায় সর্বপ্রাণবাদী হয়ে, যাকে ক্রেতারা বলে নাস্তিকতা । আমি জন্মগতভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলুম না ; পরে হয়েছি ।   শেকসপিয়ারে আমার সংলাপ পড়েছো তো ? সেই যে বলেছিলুম : ”হুজুর, সৈনিক হলেও আমি একজন রক্তমাংসের মানুষ। ভালোবেসে যদি কেউ যুদ্ধের কাহিনি শুনতে চায় তাহলে তাকে বিমুখ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তাকে দিনের পর দিন শুনিয়েছি খুব ছোটবেলায় দেশ ছেড়ে ভেনিসে এসে কীভাবে আমি সৈনিকের বৃত্তি গ্রহণ করেছি, বিভিন্ন যুদ্ধ জয় করে কীভাবে আমি আজ ভেনিসের প্রধান সেনাপতি হয়েছি — এসব বিভিন্ন ঘটনার কথা বলেছি তাকে। কর্মসূত্রে ওর বাবার কাছে যখনই গিয়েছি, কাজ শেষ হবার পর ডেসডিমোনা আমায় টেনে নিয়ে গেছে তার মহলে। বাচ্চা মেয়ের মতো বায়না ধরেছে গল্প শোনার। যুদ্ধের বর্ণনা শুনতে শুনত আমার প্রতি ভালোবাসার যে ছবি ওর দু-চোখে ফুটে উঠত, সেটা আমার নজর এড়ায়নি। হুজুর, বিধর্মী হয়েও আমি বলছি ডেসডিমোনার ভালোবাসা পেয়ে আমি সত্যিই ধন্য। কোনও তুকতাক বা জাদুমন্ত্র নয় হুজুর, আমর বীরত্বের কাহিনিগুলো একসময় আমারই অজান্তে জয় করেছে ডেসডিমোনার হৃদয়। হে মহামান্য ডিউক, নিজের নির্দোষিতার পক্ষে আমার আর কিছু বলার নেই।”


              সিদ্দিদের মতন ওথেলো আসলে মাগরেবের কালা-আদমি ।মরোক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মরিতানিয়া, উত্তর মালি, উত্তর নিজের আর ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের লোকেরা মাগরেবি বা বার্বার । বর্তমানে মাগরেব কথাটি দিয়ে মরক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ার পুরো অঞ্চলকে বোঝানো হয়; ব্যাপকতর অর্থে লিবিয়া আর মোরিতানিয়াকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অতীতে আরবি ভাষাতে মাগরেব বলতে বোঝাতো দেশ তিনটির যেসব অংশ সুউচ্চ অ্যাটলাস পর্বতমালার উত্তরে ও ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত । 


                      সমাধিদাদা বলতে থাকে, সিদ্দিদের যে ধর্মই নির্বিশেষে বেঁধে রাখে সেগুলোর একটি কারণ হিরিয়ারু বা পূর্বপুরুষের উপাসনা। আত্মারা আকারে মৃতর মতনই বলে বিশ্বাস করা হয়। তারা পরিবারকে সমস্ত উদ্বেগের ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্য সাক্ষী হিসাবে বিবেচনা করে। জন্ম, বিয়ে এবং মৃত্যুর  অনুষ্ঠানে পূর্বপুরুষদের ডেকে আনা হয়। প্রবাসী বাবা-মায়ের আত্মা হিরিয়ারুকে ঘিরে বাড়ি সাজানো হয়েছে। এটা বাবা-মায়ের  স্মরণ , বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের যত্নের জন্য  ধন্যবাদ জানায় আর ভবিষ্যতে পরিবারের ওপর নজর রাখার জন্য অনুরোধ করে। সমস্ত আত্মীয়দের পক্ষে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া জরুরি, সুতরাং এইভাবে আত্মীয়তার সম্পর্ক রিনিউ হয় ।  পরিবারের ‘কর্থ’, মানে কর্তা, বছরে দু’বার হিরিয়ারু উপাসনা করে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নবরত্রি উৎসব চলার সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। যদি কোনও কারণে তা সম্ভব না হয় তবে এপ্রিল-মে মাসে অন্যান্য বড় উৎসব হয় – হোলির সময়ও  করা যেতে পারে।  স্পষ্টতই বাবা-মায়ের  মৃত্যুর তারিখের সাথে মেলে না কারণ সিদ্দিরা কেবল প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে। হিন্দু সিদ্দিদের সাধারণত অনুষ্ঠানটা চিহ্নিত করার জন্য বিরাট ফাংশন হয় তবে খ্রিস্টান আর মুসলিম সিদ্দিদের ততোটা নয়।       


              সমাধিবউদি বলল, তোমরা, আজকালকার বাঙালিরা, শুনেছি সঞ্জয় বেলাটঠিপুত্তের মতবাদে বিশ্বাস করো ! কোনো বাঙালিকে যদি জিগ্যেস করো “আপনি কি হিন্দু”, সে ভ্যাবাচাকা খেয়ে যাবে ! বেলাটঠিপুত্ত সম্পর্কে না জানা থাকলে আমিই বলছি । সঞ্জয় বেলটঠিপুত্ত বা সঞ্জয় বৈরতীপুত্র, গৌতম বুদ্ধের সময়ের একজন ভারতীয় অনেকান্তবাদী বা অজ্ঞাবাদী দার্শনিক ছিলেন। বিভিন্ন পালি সাহিত্যে সঞ্জয় বেলটঠিপুত্তকে পরিব্রাজক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । সারিপুত্ত আর মহামোগ্গলন নামে তার দুইজন প্রধান শিষ্য পরবর্তীকালে  গৌতম বুদ্ধের দর্শন সম্বন্ধে জানতে পেরে সঞ্জয় বেলটঠিপুত্তকে ছেড়ে দিয়ে গৌতম বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। এইসময় সঞ্জয় বেলাটঠিপুত্তের আড়াইশো শিষ্য তাঁকে ত্যাগ করে গৌতম বুদ্ধের শিষ্য হয়ে যায়। শেষ জীবনে রক্তবমির কারণে সঞ্জয়ের মৃত্যু ঘটে। সুত্তপিটকের দীঘনিকায়ের সামফলসুত্ত অনুসারে, সঞ্জয় বেলাটঠিপুত্ত কোনও দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর এড়ানোর উদ্দেশ্যে সর্বদা দ্ব্যর্থবোধক বাক্য প্রয়োগ করে সেইসকল প্রশ্নের উত্তর দিতেন, অনেকটা এখনকার বাঙালি রাজনেতার মতন। তিনি পরলোক, দেবতা, কর্মফল, মুক্তপুরুষ ইত্যাদি অধিবিদ্যা সংক্রান্ত সব প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেন, অনেকটা এখনকার বাঙালি লেখকদের মতন। পরলোক বা দেবতা বা কর্মফল বা মুক্তপুরুষের অস্তিত্ব আছে না নেই তা তিনি বলেননি বা জোর দিয়েও বলেননি যে আছে না নেই। যদিও রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, মানুষের সহজ বুদ্ধিকে ভ্রমে নিক্ষেপ করাই সঞ্জয়ের উদ্দেশ্য  ছিল, অনেকটা এখনকার বাঙালি মন্ত্রীদের মতন ।


              সমাধিদাদা বলতে আরম্ভ করল, তোমরা তো জানো না, গেরিলা লড়াই আমিই মারাঠাদের শিখিয়েছিলুম, যাকে তোমরা বলো বর্গি আক্রমণ । এই অঞ্চলে আরও কয়েকজন নামকরা সিদ্দি যোদ্ধা ছিল, যাদের বংশধররা এখনও আছে, আফ্রিকার মানুষদের মতন নেই আর, রোগাটে আর বেঁটে হয়ে গেছে, এখানকার মুসলমানদের সঙ্গে বিয়ে করে । ওদের লোকে বলে সিদ্দি, সৈয়দ থেকে সিদ্দি । সিদ্দি হল এক জাতীগত গোষ্ঠী যারা ভারত আর পাকিস্তানের কিছু অংশে বসবাস করে। এদের পূর্বপুরুষরা ছিল আবিসিনিয়ার আদিবাসি যাদের পর্তুগিজরা পাকড়াও করে গোলাম হিসেবে ভারতবর্ষে এনেছিল । ভারতের হায়দ্রাবাদ, গুজরাট আর করনাটকাতে আর পাকিস্তানের মাকরান ও করাচীতে প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ হাজার সিদ্দি থাকে, কালা আদমি। অধিকাংশ সিদ্দি সুফি মুসলিম হলেও হিন্দু আর ক্যাথলিখ খৃষ্টান আছে ।  আমার মতন ওরাও লড়াই করতো কিন্তু আগেপিছে না ভেবে এমন কাজকর্ম করতো যে শাসক হিসেবে এগোতে পারেনি । জঞ্জিরা দুর্গের আশে-পাশে নেড়ে সিদ্দিদের কবর পাবে, আরও বেশি অবহেলিত, ভাঙাচোরা । যাদের  সিদ্দিরা মনে রেখেছে তাদের মধ্যে নাম করতে হয় সিদ্দি রসুল ইয়াকুত, সিদ্দি মাসুদ, সিদ্দি আবদুল রহমান, সিদ্দি অম্বর আওয়ানি, সিদ্দি রাহিন  আর সিদ্দি সাট । নুনের করের গরমিলের দরুন সিদ্দিরা ১৬৮০ সালে সাম্ভাজি মোকাশিকে থলেতে ঢুকিয়ে জীবন্ত ফেলে দিয়েছিল সমুদ্রে, আর চটিয়ে দিয়েছিল মারাঠাদের । ব্যাস, সেই থেকে মারামারি-কাটাকাটি ।      


                সমাধিদাদা কথা বজায় রাখল, ওনার তো গলা শুকোবার সমস্যা নেই । সে যাক, একটু আগে যা বলছিলুম, পরে বর্গি নামটা আঠারো শতকের  লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদলের  হয়ে গিয়েছিল। তোমরা বাঙালিরা ওদের কাছ থেকে ধুতি পরতে শিখেছ, কেননা ঘোড়ায় চাপতে হলে দু-দিকে পা ঝোলাতে হয় । আর তুর্কিদের কাছ থেকে শিখেছ পাঞ্জাবি পরা । ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত দশ বছর ধরে বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোয় নিয়মিতভাবে লুটতরাজ চালাত বর্গিরা। বর্গিহানা এই সময় একরকম বাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। মারাঠি ধনগর জাতের লোকেরা অভিযানে যাওয়ার সময় শুধু একটা সাত হাত লম্বা বর্শা নিয়ে বের হত। আমার শেখানো গেরিলা আক্রমণকে পরে বদনাম করে দিয়েছিল ওরা ।বর্গি  শব্দটা মারাঠি বারগির শব্দের অপভ্রংশ। বারগির বলতে মারাঠা ঘোড়সওয়ারদের বোঝাত। এদের ঘোড়া আর অস্ত্রশস্ত্র জোগান দিত মোগল বা মারাঠা শাসক । বাঙালিরা তাদের সঙ্গে লড়ার বদলে গান গাইতো, এইরকম–       

     খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশেবুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে ধান ফুরোলো পান ফুরোলো খাজনার উপায় কি? আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি 

              তোমরা হয়তো জানো, যে বর্গিদের ভয়ে লুকিয়ে রাখা সোনাদানার খোঁজ এখনও হয় । যেমন ঝাড়গ্রামের কুলটিকরিতে আর পশ্চিম মেদিনীপুরে কেশিয়াড়িতে খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে। কুলটিকরি থেকে কেশিয়াড়ি যাওয়ার পথে পড়ে কিয়ারচাঁদ। এই কিয়ারচাঁদের বিরাট এলাকায় শয়ে শয়ে লম্বা, চৌকা নানা রকম পাথর পোঁতা আছে। সাধারণ ভাবে বোঝা যায় না কী এগুলো। কিন্তু লোকে বলে , ওই পাথরগুলোর সঙ্গে বর্গিদের যোগ রয়েছে। এলাকার বাসিন্দারা বলে, তারা দাদুদের কাছে শুনেছে, বর্গিদের অত্যাচারে ভয় পেয়ে স্থানীয় জমিদার সারি সারি পাথর পুঁতেছিলেন। সন্ধ্যার সময় ওই সব পাথরের গায়ে মশাল জ্বেলে বেঁধে দেওয়া হত। দূর থেকে মনে হত, মশালধারী সৈন্য গড় পাহারা দিচ্ছে।এই একটি উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় বর্গিরা কতটা আতঙ্ক তৈরি করেছিল মেদিনীপুরে। আঠারো শতকের প্রথম দিকে ওড়িশা সংলগ্ন মেদিনীপুর বারবার বর্গি হানার শিকার হয়েছে। সম্পদহানি তো হয়েছেই। প্রাণহানির হিসেব নেই। ধনগররা ছিল নিম্ন শ্রেণির মারাঠা সৈন্য। অনেক মারাঠা সেন্য বাঙালি মেয়ের প্রেমে আটক হয়ে মেদিনীপুরেই থেকে গিয়েছিল ; তাই ওই অঞ্চলে নানা ধরণের পদবি পাবে যা পশ্চিমবাংলার অন্য জায়গায় পাবে না । তোমরা কেউ কি মেদিনীপুরের ? তাহলে আমার চেয়ে ভালো জানবে ।


              নাস্তিক যুবক : বাঙালিরা তখন কী করছিল ?


              সমাধিদাদা : তখনও বাঙালিদের জন্ম হয়নি । রেডিওতে অনুরোধের আসর শুরু হবার পর ওরা জন্মেছিল ।


               সমাধিবউদি প্রসঙ্গ এগিয়ে নিয়ে যান । সেই সময় আলিবর্দি খাঁ ছিলেন বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব। তিনি বর্গির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার নানা চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্য়ন্ত কিছুই করে উঠতে পারেননি। ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে রাজমহল থেকে মেদিনীপুর ও জলেশ্বর পর্যন্ত অঞ্চলে নবাবি শাসনের পরিবর্তে বর্গিদের প্রভাব বাড়ে। বর্গিরা আচমকা ঘোড়ায় চড়ে ‘হর হর মহাদেব’ বলে গ্রামে ঢুকে পড়ত। তারপর, লুটপাঠ, অত্যাচার করে গ্রাম ধ্বংস করে পালাত।  গঙ্গারাম শাস্ত্রীর রচনায় মরাঠাদের বীভৎসতার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।


    ‘মাঠে ঘেরিয়া বরগী দেয় তবে সাড়া।


    সোনা রুপা লুঠে নেয়, আর সব ছাড়া।।


    কারু হাত কাটে, কারু নাক কান।


    একি চোটে কারু বধয়ে পরাণ।


    ভাল ভাল স্ত্রীলোক যত ধরিয়া লইয়া যায়।


    অঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলায়।


    এক জনে ছাড়ে তবে আর জনা ধরে।


    তারা সবে  ত্রাহি ত্রাহি ক্রন্দন করে।।’’


             ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বিশাল সেনাবাহিনী বাংলায় ঢোকে । বর্গি সৈন্যদলে মহারাষ্টীয় হিন্দু ছাড়াও অসংখ্য মুসলমান, পিণ্ডারি, আর তথাকথিত নিম্নবর্গীয় লুটেরা থাকতো।    নবাব আলিবর্দি খাঁ রঘুজি ভোঁসলের দক্ষ সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের গতিবিধির সংবাদ পেয়ে পাঁচেট থেকে ফিরে মেদিনীপুরের চলে আসেন। বর্গিদের অত্যাচার নেমে এল। বাধ্য হয়ে আলিবর্দি খাঁ বিশ্বাসঘাতকতা করে ভাস্কর পণ্ডিতকে খুন করালেন। তারপর এক বছর তিন মাস মেদিনীপুরের স্বস্তি। কিন্তু রঘুজি ভোঁসলে ভাস্কর পণ্ডিতকে খুনের বদলা নেবার জন্য প্যাঁচ কষছিল । সে  পনের হাজার সৈন্য নিয়ে কটক আক্রমণ করলে। পুরো ওড়িশা, মেদিনীপুর আর হিজলি পর্যন্ত এলাকা দখল করে ফেলল। বর্গিরা গ্রাম, নগর পুড়িয়ে, শস্যের ভাঁড়ারে আগুন লাগিয়ে এবং শেষে মানুষের নাক, কান আর বউদের মাই কেটে অত্যাচার শুরু করল, অনেকটা বাঙালি ক্যাডারদের মতন ।১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে আলিবর্দি প্রথম রঘুজির সঙ্গে সন্ধি করে মেদিনীপুরের কিছু অংশ, যেমন জলেশ্বর, ভোগরাই, পটাশপুর, কামার্দাচৌর  নিমক মহালগুলো আর ওড়িশার রাজস্ব আদায়ের ভার ভোঁসলে মরাঠাদের উপর ছেড়ে দেন।


             সমাধিদাদা বলল,    তবে ঠাকুর-দেবতায় বর্গিদের ছিল শ্রদ্ধা। তারা কোনও দেব-মন্দির লুট করত না।  বর্গভীমা মন্দিরের কোনও অংশে তারা হাত দেয়নি। ঠিক তেমন ভাবে সাঁকরাইল থানার পিতলকাঠি বা পাথরাকাটি  গ্রামের জয়চণ্ডী মন্দিরকে তারা নতুন ভাবে তৈরি করেছিল। মন্দিরের পাশে ছিল ভুঁইয়া রাজার গড়। রাজাদের প্রচুর ধন-সম্পদ ছিল। বর্গি হাঙ্গামায় তিনি ল্যাঙটোপোঁদা হয়ে যান। বংশধারাও লোপ পায় তাঁর। ফিরে গিয়ে দেখো, এখনও ওই এলাকায় তাঁর ভাঙা-গড়ের চিহ্ন মেলে। আর আছে রানির স্নান করার কুয়ো। বেশ কিছুদিন পরে ওই এলাকার জমিদার জয়চণ্ডীর মন্দির খুঁড়ে বর্গিদের ধনসম্পদ খুঁজেছিল । মন্দিরের ভাঙা দেওয়াল নাটমন্দিরের থাম, জমিদারের লোভের নমুনা হয়ে আছে।     তারপর বলছি, দাঁড়াও, পা চুলকোচ্ছে, কোনো পোকা বোধহয় ফাটল দিয়ে ঢুকে পড়েছে । এই এক হয়েছে, কতো রাজা-রাজড়াদের যুদ্ধে হারালুম কিন্তু এই পোকাগুলোর হাত থেকে কয়েকশো বছরেও রেহাই পেলুম না ।   আচ্ছা, তোমরা কি জানো আলিবর্দী খাঁর সমাধি কোথায় ?


              সমাধিবউদি বলতে লাগল, দাস-দাসি ধরবার দল হিসেবে বর্গিরা গেলো তো এলো পিন্ডারিরা, আমাদের গেরিলা যুদ্ধ নকল করে। পিন্ডারিরা  মোগল  আর  মারাঠা সেনাদের সঙ্গে জুটেছিল আর শেষ পর্যন্ত ১৮১৭-১৮ পিন্ডারি যুদ্ধে নিকেশ হওয়ার আগে তারা নিজেরাই  ছদ্মবেশে আক্রমণ চালাতো । তারা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতো আর  তাদের ক্ষতিপূরণ পুরোপুরি যুদ্ধের সময় তারা যে লুটতরাজ করতো সেই সব মালকড়ি নিজেদের দখলে রাখতো ।  তারা ছিল ঘোড়সওয়ার, পদাতিক আর আংশিকভাবে সশস্ত্র, বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে ওস্তাদ আর শত্রুদের অবস্থান সম্পর্কে তাদের যে নিয়োগ করতো তাকে খবর দিতো।  ঝটপট বিশৃঙ্খলভাবে মারকাট চালিয়ে যাওয়ায় তারা ছিল এক্সপার্ট, তবে ১৭৯১ সালে শৃঙ্গেরি শরদা পিঠমে পিন্ডারি অভিযানে ওরা মারাত্মক অবমাননাকর ঘটনা ঘটায়। শিবাজি পিন্ডারি দলকে তাদের শিকারী ক্রিয়াকলাপ সাবধানে  করার জন্য বিধি জারি করেন।   পিন্ডারি নেতারা বেশিরভাগই ছিল মুসলমান  তবে তারা হিন্দুদেরও দলে রাখতো।  সন্ন্যাসী আর সাধুরা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ভাড়াটে সৈন্যের কাজ করা শুরু করে পিণ্ডারিদের আটকাতো।  পিন্ডারিরা পুরো ভারতবর্ষ, দাক্ষিণাত্য আর  গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, বিহার আর ওড়িশার বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল।  পিন্ডার শব্দটা পিন্ডা থেকে নেওয়া মনে হয়, যা মাতাল হবার মাদক । এটা একটি মারাঠি নাম যা সম্ভবত একটি “ঘাসের বান্ডিল”  বোঝায়।   পিন্ডারিদের পোশাক ছিল পাগড়ি আর ল্যাঙোট,  মানে হাফল্যাঙটো । তারা সঙ্গে রাখতো পুরোনো মডেলের তালোয়ার , পায়ে চটি । তারা যে কোনও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক আধিপত্য বা রাজ্যের সঙ্গে  চুক্তি করতো আর লুটে আনা দাস-দাসিদের তাদের কাছে বিক্রি করতো । পিন্ডারিরা প্রায়শই অন্যের হয়ে মারকাট করতো আর নৃশংসতায় ছিল বেপরোয়া, অনেকটা এখনকার ক্যাডারদের মতন । 


            নব্যনাস্তিক যুবতী : বাঙালিরা কী করছিল ?


           সমাধিবউদি : বাঙালিদের তখন জন্ম হয়নি । লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের পর জন্ম হয়েছিল।


              সমাধিদাদা বলতে লাগল, আমার যুদ্ধকৌশলের আগে কিছু নোংরা পদ্ধতিও ছিল এলাকা দখলের আর সম্পদ সংগ্রহের, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঠগ সম্প্রদায় । তবে তারা কাউকে দাস হিসেবে বিক্রি করতো না, খুন করে ফেলতো ।ঠগ একটা সংস্কৃত শব্দ যা থেকে ঠগি শব্দটা উদ্ভূত। শাব্দিকভাবে এর অর্থ ধোঁকাবাজ, প্রতারক। তোমাদের অভিধানে ঠগি বলতে বিশেষ শ্রেণির এক দস্যুদলকে বোঝায় যারা পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় জড়িয়ে খুন করতো । ঠগীরা ছিল ভারতবর্ষের এক বিশেষ শ্রেণির খুনি সম্প্রদায়। এদের মতন নিষ্ঠুর আর নিপুণ খুনির দল পৃথিবীতে শুধু নয়, ইতিহাসেই বিরল।  জিয়াউদ্দীন বারানির লেখা ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ বইতে ঠগিদের কথা প্রথম জানা যায়, বইটা পেলে পড়ে দেখতে পারো, বেশ ইনটারেস্টিঙ। এই ঠগিরা উত্তরভারতে তাদের কাজকারবার শুরু করে। এরপর বহু শতক ধরে বংশ পরম্পরায় তাদের এই কর্মকান্ড চালাতে থাকে। এরা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতো, পথে যাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতো। তারপর সময়-সুযোগ বুঝে যাত্রীদের মেরে ফেলে সবকিছু লুট করতো। ১৭ আর ১৮ শতকের প্রথম দিকে ভারতের পথিকদের জন্য মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম এই ঠগি। কিন্তু বাংলায় তারা ঢোকে ১২৯০ সালের দিকে। ১২৯০ এর সুলতানী শাসনের সময় প্রায় হাজার খানেক ঠগ ধরা পড়ে । কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সুলতান তাদের কোনো রকম সাজা না দিয়ে দিল্লীতে ফিরে না আসার শর্তে, অনেকটা আপ্যায়নের সাথে নৌকায় তুলে দিয়ে ভাটির দেশে- মানে তোমাদের  বাংলায় পাঠিয়ে দেয়। আর তারপর থেকেই বাংলার জলে-স্থলে, মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে পড়ে এই খুনির দল। বাংলায় ঠগিদের ইতিহাসের শুরু তখন থেকেই। শুনেছি আজকাল নাকি দুই বাংলায় রাজনৈতিক ঠগির দল দেখা দিয়েছে । কথাটা কি সত্যি ?


                 সমাধিদাদা বলে চলে, সেই ঠগিরা নানা সাঙ্কেতিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা আদান প্রদান করতো। যেমন- ‘বাসন মেজে আনার’ কথা বলার মধ্য দিয়ে সর্দার তার এক সাঙেতকে কবর তৈরি করার নির্দেশ দিত। ‘ঝিরনী’ শব্দে খুন করার তোড়জোড় আর ‘তামাকু লাও’ শব্দের  মাধ্যমে হত্যার আদেশ দেয়া হতো। এই নির্দেশ পাওয়া মাত্রই মুহূর্তের মধ্যে ফাঁস জড়ানো হতো শিকারের গলায়।    কবর তৈরি করারে দায়িত্ব যার তাকে বলা হতো ‘বিয়াল’। শিকারকে যে ধরে রাখবে তাকে বলা হতো ‘চামোচি’। শিকার যাতে বাধা দিতে না পারে তার জন্য হাত আটকে রাখার দায়িত্ব ‘চুমোসিয়া’র। ‘চুমিয়া’ শিকারের পায়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে। ‘ভোজারা’ মৃতদেহগুলো কবরে নিয়ে যাবে । ‘কুথাওয়া’র দায়িত্ব হলো দেহগুলোর হাঁটু ভেঙে থুতনির সঙ্গে লাগিয়ে ভাঁজ করে কবরে দেওয়া। মৃতদেহ পাহারা দেয়া ও বিপদের গন্ধ পেলে জানান দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্তদের বলা হতো ‘ফুরকদেনা’। আর হত্যাকাণ্ডের জায়গাটা সাফসুতরো করে ফেলার দায়িত্ব ছিল ‘ফুরজানা’দের। সদ্য মৃত মানুষদের কবরের ওপর বসত ঠগীদের অমৃতের ভোজ। সে ভোজ আর কিছু নয়, গুড়ের ভোজ। একলা পথিক পেলেই সাদরে তাকে দলের সাথে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানাত। তাদের মতে, যে একবার এই গুড় খাবে, সে ঠগি হয়ে যাবে। ঠগিদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সব ধর্মের লোকই ছিল, যেমন এখনকার রাজনৈতিক দলগুলোতে।      


                 সমাধিবউদি এবার কথা আরম্ভ করল ।দাস প্রথার চেয়ে আরও ভয়ানক শোষণের কথা বলি, তা হল নীলচাষ আর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ।লুই বোনারড  নামের একজন ফরাসি বণিকের মাধ্যমে এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে নীলচাষ ও এর ব্যবহার প্রচলন ঘটে| আঠারো শতকের শেষ দিকে  ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে কাপড় কারখানায়  নীল এর চাহিদা শতগুণ বেড়ে যায়|  ফলে ওই সময়ে নীল চাষের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হয়ে ওঠে|  বাঙালি জমিদার আর সুদখোররা  কারবার খুলে বসে আর নদীয়া, যশোর, খুলনা, চব্বিশ পরগনা, বগুড়া, রাজশাহী, মালদা, পাবনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল  জেলায় অসংখ্য নীল কুঠি গড়ে ওঠে|  ফরাসি, ডাচ, পর্তুগিজ, দিনেমার, দেশের ধনিক গোষ্ঠী দলে দলে বাংলাদেশ পাড়ি জমায়|   ইংরেজরা  নীল উৎপাদনের জন্য বাংলায়  শোষণ প্রক্রিয়া চালু করেছিল ; জবরদস্তি   চুক্তির প্রচলন করেছিল|  এই  চুক্তির পরিণতিতে কৃষকরা হয়েছিল ভূমিদাস|১৮১০ থেকে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত বাংলায় নীল চাষ উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল|  কৃষকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলো । লাভের পরিমাণ কমে গেলে নীলকররা কারখানাগুলো বিক্রি করতে বাধ্য হয়| ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে  নীলের উৎপাদন কমে যাওয়ায়  নীলকররা এই ব্যবসা বন্ধ করে দেয়| 


               সমাধিদাদা বলল, আরে, তোমরা আমার গল্প তো শুনছোই না । আমি জন্মেছিলুম আবিসিনিয়ার হারার নামে এক জংলি গ্রামে, ১৫৪৮ সালে, আদাল সুলতানদের রাজ্যে । আমার মতনই এক অস্হির আত্মা ইউরোপে নরকে এক ঋতু কাটিয়ে হারারেতে এসেছিল, তার নাম জঁ নিকোলা আর্তুর র‍্যাঁবো, কবি, সেও দাস ব্যাবসা আর বন্দুকের চোরাচালান করত সুলতানের জন্য, অবশ্য আমার জন্মের অনেক পরে । যাই হোক, তোমরা ফিরে গিয়ে সরকারকে বোলো যাতে আমার সৌধকে সারিয়ে রঙ করানো হয় । ওই আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন মুহাম্মদ আলমগিরের নকল তাজমহলকে রাঙিয়ে রাখার মানে হয় না । আমার দেয়া নাম পালটে প্রথমে আমার ছেলে ফতেহ খান শহরের নাম দিয়েছিল ফতেহপুর, তারপর খেঁকুরে মোগল  নিজের নামে এই জায়গাটা করে ফেললে আওরঙ্গাবাদ । গুজরাট থেকে সিদ্দিরা দলে-দলে আমার সৌধ দেখতে আসে ;ওরা এদেশের মানুষ হয়ে গেছে বটে কিন্তু ওদের পূর্বপুরুষরাও দাস হয়ে আফরিকা থেকে এসেছিল। ওদের সাহস নিয়ে বেশ মজার গল্প আছে, তা পরে বলবো । এখন এটুকু বলি যে, আই পি এল ক্রিকেটারদের মতন হাবশিদেরও নিলাম হতো, আমারও কয়েকবার হাতবদল হয়েছিল । ইবন বতুতার বর্ণনায় পাওয়া যায় মাত্র এক দিরহাম দিয়ে তখন বাংলাদেশ আটটি স্বাস্থবান মুরগী পাওয়া যেত, এছাড়াও এক দিরহামে পনেরোটা কবুতর, দুই দিরহামে একটি ভেড়া এবং এক স্বর্নমূদ্রারও কম মূল্যে দাস কিনতে পাওয়া যেত।ভালো কালো যুবতীদের দাম ফর্সা যুবতীদের চেয়ে অনেকসময়ে বেশি হতো, কেননা যারা যুবতী কিনতো তারা পোশাক খুলিয়ে পুরো বডি দেখে নিতো ।


               সমাধিদাদা বলতে লাগলো, জানো না বোধহয়, বাঙালিদেরও আমরা কালা আদমিরা এককালে শাসন করেছি । তোমাদের বঙ্গদেশে চতুর্দশ শতাব্দী থেকে সুলতানি শাসন ছিল, তখনই আমরা কালা আদমিরা কিছুকালের জন্য ক্ষমতা দখল করেছিলুম | সেনাবাহিনীতে বেশিরভাগ ছিল কালা পালোয়ান | সেখান থেকে তারা ক্রমশ প্রশাসনিক কর্তা হয়ে উঠল | তবে সবাইকে টেক্কা দিল একজন চতুর কালা আদমি, বরবক শাহজাদা |  বাংলার শাসক জালালউদ্দিন ফতে শাহ-র সময়ে প্রাসাদের মূল রক্ষী ছিল লোকটা| পরে সেনাবিদ্রোহ করে ছিনিয়ে নিলে ক্ষমতা | বরবক ছিল বাংলার প্রথম নিগ্রো  শাসক |  শুরু করেছিলেন নিগ্রো শাসক বংশ | তবে এই শাসন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি | নিগ্রোদের সংখ্যা ছিল আট হাজার।  বরবক শাহর ছোট ভাই হুসেইন জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে চড়ে বসে।  বাংলায় নিগ্রো শাসনকাল ছিল মাত্র ছয় বছর। এ সময় এ দেশের ইতিহাস ছিল অন্যায়, অবিচার, বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র আর হতাশার।  চারজন নিগ্রো সুলতানের তিনজনকে খুন করা হয়।   মালদাতে গৌড়ে আছে ফিরোজ মিনারের মতো  নিদর্শন, যা তৈরি হয়েছিল নিগ্রো রাজাদের আমলে | অনেক বাঙালি নিগ্রোদর মতন কালো কেন জানো ? নিগ্রোরা বাঙালিদের বিয়ে করে মিশে গেছে জনজীবনের মূলস্রোতে | বর্তমানে ভারতে প্রায় ৫০ হাজার আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আছে | তবে তারা এখন স্হানীয় ভাষা পোশাক-আচার-আচরণে এতটাই ভারতীয়, যে চেহারায় কিছু বৈশিষ্ট্য ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে এঁদের নিগ্রো পূর্বপুরুষরা কয়েকশো বছর আগে আফ্রিকা থেকে ভারতে এসেছিলেন | আমার মতন ওরাও প্রমাণ করে দেখিয়েছিল যে নিগ্রোরাও আফরিকা থেকে গিয়ে অন্য দেশে শাসক হতে পারে ।         


             সমাধিদাদা বলে চলল, তোমরা সর্বপ্রাণবাদি নাকি কোনো ধর্মানুসারী তা জানি না, কিন্তু কাছেই আছে জারজারি জারবকশ বা শাহ মুনতাজাবউদ্দিন চিশতির মজার, ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্ত সূফিদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা  ছিলেন। তাকে চোদ্দ শতকের প্রথম দিকে দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়া এই অঞ্চলে পাঠিয়ে ছিলেন । উনি সাতশো শিষ্য নিয়ে আওরঙ্গবাদে এসেছিলেন আর খুলদাবাদে  কুয়োর কাছে একজন হিন্দু রাজকন্যাকে ধর্মান্তরিত করেছিলেন বলে জানা যায়। জায়গাটাকে এখন “সোহান বাওলি” বা “ভাল লাগার জায়গা” বলা হয়। সেই রাজকন্যাকে খুলদাবাদে সাধু সমাধির কাছে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। জারিজারি বকশের সমাধি আমার সমাধি আর শহরের উত্তরগেটের মাঝামাঝি। খুলদাবাদের দরগায় উরস এর জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী আসে । তাছাড়া   শায়খ বুরহানউদ্দীন  চিশতী আর শায়খ জয়ন-উদ-দ্বীন শিরাজীর সমাধি আছে এই শহরে ।  দরবেশদের কাছে শহরটা পবিত্র আর আধ্যাত্মিক, অথচ আওরঙ্গজেব ওদের পছন্দ করত না ।   


               সমাধিবউদি বলল, তোমরা জানো নিশ্চয়ই যে আজকাল সালাফি পাকিস্তানিরা সুফি, দরবেশ, কলন্দরদের সমাধিগুলো বোমা মরে উড়িয়ে দিচ্ছে । ইরাকে আইসিসরা একই ব্যাপার করেছিল, মিউজিয়ামের সংগ্রহকে ওরা হাতুড়ি পিটিয়ে ভাঙচুর করেছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের নওশেরা রাজ্যের একটি সুফি সমাধিস্থলে তালেবান হামলা আবারো প্রমাণ করলো এ সত্য৷ হ্যাঁ, বহুত্ববাদী ইসলাম তালেবানের জন্য শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয়, তত্ত্ব হিসেবেও হুমকি৷                    


             সমাধিদাদা,যিনি মোগল সম্রাট আওরঙজেবের কবরের কাছেই বিখ্যাত ভদ্র মারুতি মন্দির রয়েছে, ইচ্ছে করলে তোমরা দেখতে যেতে পারো । লোকেরা  আশেপাশের জায়গা থেকে  হনুমান জয়ন্তী আর  মারাঠি ক্যালেন্ডার মাসে শনিবারের “শ্রাবণ” পুজো করতে আসে । সেই ফাঁকে আমার সঙ্গেও দেখা করে যায় । ভেবে দেখেছো কি, যে একই জেলার মাটির তলায় আমি আর আমার মোগল শত্রুর পরিবারের লোক শুয়ে ? মোগল পরিবারের সম্রাটটাকে যদিও আজকাল পর্যটকরা গালমন্দ করে । সম্রাট বলে কি আমার দেয়া শহরের নাম পালটে নিজের নামে করে নেবে ! সম্রাট লোকটা সুফি, দরবেশ, চিশতিদের পছন্দ করতো না, এখন মাটির তলায় শুয়ে বুঝতে পারছে কাণ্ডকারখানা । সে যাকগে । আমার জীবনের গল্পটা শোনো বরং ।    আমি মারা গিয়েছিলুম ১৩ই মে ১৬২৬ সালে । আবিসিনিয়া থেকে, আমার মতন যারা কেনা গোলাম হয়ে এদেশে দাসত্বের জন্য এসেছিল, তাদের বলতো আবসি, কবে যেন তা হয়ে গেল হাবশি । আমার তো কোনও ধর্ম ছিল না, আমরা ছিলুম অ্যানিমিস্ট বা সর্বপ্রাণবাদী । প্রকৃতির সব কিছুকেই সপ্রাণ মনে করা, সব ক্রিয়াকলাপের পেছনে প্রাণের অস্তিত্বকে অনুভব করাই হলও সর্বপ্রাণবাদ। তোমরা তো জানো সাম্প্রতিককালের উত্তর-আধুনিক নৃবিজ্ঞানীরা ক্রমশ সর্বপ্রাণবাদের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। আধুনিকতাবাদ ছিল রেনে দেকার্তের বিষয়-বস্তু দ্বৈতবাদ দ্বারা চিহ্নিত  যা সাবজেকটিভকে অবজেকটিভ থেকে আর প্রকৃতিকে আর সংস্কৃতি থেকে আলাদা মনে করতো । আধুনিকতার দৃষ্টিতে সর্বপ্রাণবাদ  হ’ল বৈজ্ঞানিকতার বিপরীত, এবং তাই  নৃতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে একে সহজাতভাবে অবৈধ তর্ক বলে মনে করেন । কিন্তু উত্তর-আধুনিক নৃবিজ্ঞানীরা আধুনিকতাবাদী অনুমানগুলি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং তাত্ত্বিক প্রস্তাব দিয়েছেন যে সম্পূর্ণ মানবসমাজ তাদের চারপাশের বিশ্বকে “অ্যানিমেটেড” করে চলেছে। এই সর্বপ্রাণবাদ, আদিম চিন্তাধারার একটি অবশিষ্টাংশের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় যে, আধুনিকতার “অ্যানিমিজম” মানবতার “পেশাদার উপগোষ্ঠী” দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে, যেমন আমাদের ক্রিয়াকলাপের একটি সীমিত ক্ষেত্রের মধ্যে বিশ্বকে একটি বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসাবে বিবেচনা করার প্রয়াস । মানুষ উল্লিখিত উদ্দেশ্য জগতের পোষা প্রাণী, গাড়ি বা খেলনার মতো উপাদানগুলির সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করে চলেছে, যা সাবজেক্ট হিসাবে স্বীকৃত। সুতরাং এই সত্ত্বাগুলি আধুনিকতাবাদীদের দ্বারা অনুধাবিত জড় বস্তু হিসাবে নয়, বরং ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে যোগাযোগের বস্তু হিসাবে পরিচিত । এই চিন্তা-পদ্ধতির লক্ষ্য হলো আধুনিকতাবাদীদের ধারণাটিকে এড়ানো,  যাঁরা মনে করেন পরিবেশ ব্যাপারটা মনুষ্যজগৎ থেকে পৃথক একটি জড় বিশ্ব নিয়ে গঠিত আর ব্যক্তির দেহ এবং আত্মা আলাদা তা দ্বৈতবাদীভাবে  আধুনিকতাবাদীদের ধারণায় রয়ে গেছে । সর্বপ্রাণবাদ ভাবনাটা ধর্মের আর নৃবিজ্ঞানের উত্তর-আধুনিক প্রক্রিয়াকে, বিশেষভাবে সংগঠিত ধর্মের আগের বিশ্বাস প্রক্রিয়াকে, গুরুত্ব দেয়। যদিও প্রতিটি সংস্কৃতির আছে তাদের নিজস্ব পুরাণ এবং রীতিনীতি, “আধ্যাত্মিক” বা “অতিপ্রাকৃতিক” দিক থেকে উত্তর-আধুনিক ভাবনার ভিত্তিগত সুত্র ধরে “সর্বপ্রাণবাদ”কে সবচেয়ে জরুরি হিসাবে মনে  করা হয়।  অ্যানিমিজম একটি দার্শনিক, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাস যে, আত্মা শুধুমাত্র মানুষের মধ্যেই নয় বরং সমস্ত বন্য প্রাণী, উদ্ভিদ, শিলা, প্রাকৃতিক ঘটনা (বিদ্যুৎ, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি) সব কিছুতে থাকে । সংগঠিত ধর্ম মানুষের অনেক ক্ষতি করেছে, তা আমি কবরের ভেতরে শুয়ে বুঝতে পারি ।


              যুবতী : মলয় রায়চৌধুরীর কাছে শুনেছি উত্তরাধুনিক সর্বপ্রাণবাদের কথা ।


               যুবক : এই মলয় রায়চৌধুরী লোকটা বুড়ো বয়সেও কেমন করে সুন্দরী যুবতীদের টানে তা বুঝতে পারি ।


             সমাধিদাদা জিগ্যেস করল, উনি কে ? উনি যদি মেশার সুযোগ পেতেন তাহলে আমাদের মাহা উপজাতির মেয়েদের নিশ্চয়ই আকর্ষণ করতেন ।তোমরা কী করেই বা জানবে যে, আমাদের মায়া উপজাতির পুরুষরা যোদ্ধা হিসেবে বিখ্যাত ছিল আর মেয়েরা তাদের বুক-পাছার কারণে ।  আমার বড়ো বোনকে কিনতে চেয়েছিল পর্তুগিজরা, মা বিক্রি করেনি তখন, বলেছিল “ওর জন্য পাঁচ মোহর দিতে হবে”, আমার বোনকে আরবদের সামনে ল্যাংটো করে দেখিয়েছিল, তখনই ওর মাই চকচকে, কুঁচকিতে পশম গজায়নি, কুমারী । কয়েক বছর পরে  সত্যিই ওকে একজন নিয়ে গিয়েছিল পাঁচ মোহরের বদলে । কুমারী হাবশি মেয়েদের এদেশের বাদশারা কিনে বাঁদি করে রাখতো, হাবশি মেয়েরা শোবার সময়ে তুর্কি, মোঙ্গোল, ইরানি মেয়েদের মতন ঢঙ করতো না, জাপটে চুষে খেতো বাদশা আর রাজাদের । 


               সমাধিবউদি বলল, ওর নাম বলি তোমাদের । ওর নাম অম্বর মালিক ; সমাধিদাদা নয় । আরেকজন মালিক ছিল,  সে হলো, বখতিয়ার খলজি । ‘মালিক গাজি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি’ নামেও ডাকা হয়, সে লোকটা ছিল খলজি উপজাতির একজন, যারা তুর্কিস্থান থেকে আফগানিস্থানে এসে বসবাস আরম্ভ করেছিল।  খলজি উপজাতি উত্তর-পূর্বের প্রায় সবকটা দখল-যুদ্ধে যোগদানকারী সেনাবাহিনীর অধিপতিদের কাজে নিযুক্ত ছিল। বখতিয়ার খিলজির সেপাইরা বিহার-বাঙলা আক্রমণ করে লুটপাট, বাড়ি পোড়ানো, নারীধর্ষণ এমন সব কুকর্ম চালিয়ে অনেক পরিবারকে মুসলমান বানিয়েছিল, যা টিক্কা-পাকিস্তানির খান সেনারাও পারেনি।আসলে বখতিয়ার খিলজির সেনাদের বেশিরভাগই ছিল দাস, মানে, কেনা গোলাম, বান্দা। তারা সুযোগ ছাড়বে কেন । বখতিয়ার খিলজির মারকাটের দরুন এদেশ থেকে বৌদ্ধধর্ম লোপাট হয়ে গেছে । তার বীরত্বের গুণগান করে বাংলাদেশের শায়র-এ-আজম আল মাহমুদ একটা কবিতা লিখেছিলেন, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ নামে, আমার সৌধে রয়েছে কবিতাটা, তোমাদের পড়ে শোনাচ্ছি, তোমরা এই ভাষায় কথা বলছিলে বলে বুঝতে পারবে —


    মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে


    মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;


    আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।


    জেগেই দেখি কৈশোর আমাকে ঘিরে ধরেছে।


    যেন বালিশে মাথা রাখতে চায় না এ বালক,


    যেন ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে মশারি,


    মাতৃস্তনের পাশে দু’চোখ কচলে উঠে দাঁড়াবে এখুনি;


    বাইরে তার ঘোড়া অস্থির, বাতাসে কেশর কাঁপছে।


    আর সময়ের গতির ওপর লাফিয়ে উঠেছে সে।


    না, এখনও সে শিশু। মা তাকে ছেলে ভোলানো ছড়া শোনায়।


    বলে, বালিশে মাথা রাখো তো বেটা। শোনো


    বখতিয়ারের ঘোড়া আসছে।


    আসছে আমাদের সতেরো সোয়ারি


    হাতে নাংগা তলোয়ার।


    মায়ের ছড়াগানে কৌতূহলী কানপাতে বালিশে


    নিজের দিলের শব্দ বালিশের সিনার ভিতর।


    সে ভাবে সে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়দৌড়। বলে, কে মা বখতিয়ার?


    আমি বখতিয়ারের ঘোড়া দেখবো।


    মা পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাসেন,


    আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।


    যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,


    আর মানুষ করে মানুষের পূজা,


    সেখানেই আসেন তিনি। খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।


    দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে


    দ্যাখো, দ্যাখো।


    মায়ের কেচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে বালক


    তুলোর ভেতর অশ্বখুরের শব্দে স্বপ্ন তার


    নিশেন ওড়ায়।


    কোথায় সে বালক?


    আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা


    মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।


    বারুদই বিচারক। আর


    স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।


               আরেকজন বাগি শায়র, তার নাম মলয় রায়চৌধুরী, সে ‘বখতিয়ারের ঘোড়ার  বংশধর’ নামে একটা কবিতা লিখেছিল, তার কবিতাও আছে আমার সৌধে, পড়ে শোনাচ্ছি তোমাদের :-


    বিহারশরিফে পৌঁছে দেখি বাস নেই ট্যাক্সি নেই


    অগত্যা এক্কাগাড়িঅলাকে বলি


    আরে টাঙ্গা, যাবি নাকি ? 


    তোর ঘোড়াকে খেতে দিস না ? এমন হাড়গিলে ? নাম কী তোর ?


    আমার নাম মিনহাজউদ্দিন শিরাজ হুজুর, বলল এক্কাগাড়িঅলা ।


    হাত দুটো লম্বাটে,  এরকম বেঁটে কেন তুই ?


    ছোটাস কেমন করে গাড়ি ?


    হুজুর জমানা পহেলে বখতিয়ার খলজি নামে তুর্কি এক লুটেরার সেনারা


    এ-তল্লাটে এসে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে মেয়ে-বউদের ইজ্জত লুটেছিল


    আমি সেই তাদের ঔরসের পয়দায়িশ–


    আর হুজুর এটা ঘোড়া নয়, এটা তো খচ্চর


    বখতিয়ারের ঘোড়ারাও এখানকার ঘোড়িদের ইজ্জত লুটেছিল


    এই বেজন্মা খচ্চর তাদের ঔরসের পয়দায়িশ


    ওরা সব কালা অকছর ভঁয়েস বরাবর ছিল


    ন্যাড়ামাথা পড়ুয়ার দল আর হাজার-হাজার বই দেখে


    নালান্দায় আগুন লাগিয়ে নেসতানাবুদ করে দিয়েছিল–


    চলুন, বসুন, বলুন কোথায় যাবেন…


              ক্রীতদাস-ক্রিতদাসীরাও কবিতা লিখে গেছেন, যেমন ফিলিস হুইটলে নামের এক কৃষ্ণাঙ্গী । ১৭৭৮ সালে এই কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসী কবি আইনত দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভ করেন। গৃহকর্তা জন হুইটলে ব্যক্তিগত উইলে তাঁর মুক্তির কথা উল্লেখ করেন। ১৭৮৪ সালে ফিলিসের স্বামী জন পিটার্স যখন গলা পর্যন্ত ঋণের দায়ে জেলে যান, অসুস্থ শিশু-সন্তানকে নিয়ে ফিলিস তখন ঘোর সংকটে। ৫ ডিসেম্বর ১৭৮৪ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে ফিলিস মারা যান। তাঁর মৃত্যুর সাড়ে তিন ঘণ্টা পর তাঁর শিশুপুত্রটিও মারা যায়। ক্রীতদাসীর সঠিক জন্মতারিখ কে মনে রাখে? তবে অন্বেষক-গবেষকবৃন্দ মনে করেন সেনেগালের কোনও অঞ্চলে সেনেগাম্বিয়ায় ৮ মে ১৭৫৩ সালে এই আশ্চর্য প্রতিভাময়ী কৃষ্ণাঙ্গ কবির জন্ম হয়েছিল। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান  কবি ও লেখক জুপিটার হ্যামনও ছিলেন একজন ক্রীতদাস। তিনিও তাঁর কবিতায় ফিলিস হুইটলের কবিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।মাত্র সাত বছর বয়সে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল দাসী-হাটে। তারপর পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগাল থেকে সে চালান হয়ে যায় উত্তর আমেরিকায়। ১১ জুলাই, ১৭৬১ সালে ক্রীতদাস-ভর্তি একটি জাহাজে মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রিটিশ-শাসিত বস্টনে। সেই জাহাজের মালিক টিমথি ফিচ, আর নাবিক ছিলেন পিটার গুইন। মা বাবা তার কিছু একটা নাম রেখেছিল হয়ত। কিন্তু দাসী-হাটের কালো বাতাসে কখন যে হারিয়ে গেছে সেই নাম। নতুন করে তার নাম রাখা হল ক্রীতদাস পারাপারের জাহাজটির নামে — ফিলিস। বস্টনের ধনী ব্যবসায়ী জন হুইটলে তাঁর স্ত্রী সুশান্নার সেবা-দাসী হিসেবে মেয়েটিকে ক্রয় করেছিলেন। প্রথা অনুসারে ফিলিসের নামের সঙ্গে যুক্ত হল হুইটলে পরিবারের পদবী। ক্রীতদাসী পেল নতুন নাম — ফিলিস হুইটলে। কিন্তু এই পরিবারে আশ্রয় পেয়ে নবজন্ম হল তার।বারো বছর বয়সে গৃহকর্ত্রী সুশান্নার বইপত্র পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে কী যে হল তার। একটা বই থেকে একটা চিঠির কিছু অংশ দেখে দেখে অবিকল দেয়ালের গায়ে লিখতে থাকে সে। না, কোনও পেনসিল বা কলম দিয়ে নয়, এক টুকরো কাঠকয়লা দিয়ে। বাড়ির অন্য এক দাসী এই খবর পৌঁছে দেয় গৃহকর্ত্রীর কানে। কিন্তু ঘরের দেয়াল নোংরা করার অপরাধে মেয়েটিকে শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা, সেদিন থেকে তাকে গৃহকর্ম থেকে অব্যাহতি দিয়ে দূরদর্শী সুশান্না ফিলিসের লেখাপড়া শেখার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেন। অতি দ্রুত সে আয়ত্ত করে বাইবেলের পাশাপাশি গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষা। ভাষা ও সাহিত্যে তার বিস্ময়কর উত্সাহ লক্ষ করে তাকে উপযুক্ত শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় আলেকজান্ডার পোপ, মিল্টন, হোমার, হোরেস এবং ভার্জিলের কবিতার সঙ্গে। এরপর ফিলিসের কাব্য-প্রতিভার চরম বিকাশ ঘটে।  ফিলিস মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, কবিতার শক্তি অপরিমেয়। কবিতা সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর চরম প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ব্যক্তিগত জীবনের কথা তিনি যথাসম্ভব কম বলেছেন। তবে একটি কবিতায় সার্বিকভাবে ক্রীতদাসদের জীবনের ওপর আলো ফেলেছেন তিনি, যেখানে প্রবল নৈরাশ্যের মধ্যেও ফুটে উঠেছে একটা আশাবাদিতার সুর, একটা উত্তরণের ইশারা ও প্রত্যয় । “আন বিইং ব্রট ফ্রম আফরিকা টু অ্যামিরিকা’ কবিতায় উনি লিখেছেন, পড়ে শোনাচ্ছি তোমাদের :


    Twas mercy brought me from my Pagan land,


    Taught my benighted soul to understand


    That there’s a God, that there’s a Saviour too:


    Once I redemption neither sought nor knew.


    Some view our sable race with scornful eye,


    “Their colour is a diabolic dye.”


    Remember, Christians, Negroes, black as Cain,


    May be refin’d, and join the’ angelic train.

              মালিক অম্বর বলতে লাগল, আমার আগেও দাসরা ইতিহাসের কবরে নিজেদের নাম রেখে গেছে । যেমন মুহম্মদ ঘুরী দিল্লিতে প্রায় ৩২ বছর রাজত্ব করেন। একমাত্র মেয়ে ছাড়া তার আর কোনো সন্তান ছিল না। তিনি তার ক্রীতদাসদের নিজের আত্মীয়ের মতো ভালোবাসতেন। কাজেই মুহম্মদ ঘুরীর মৃত্যুর পর তার ক্রীতদাস ও সুযোগ্য সেনাপতি কুতুবউদ্দীন আইবক দিল্লির সিংহাসনে  বসেন। দিল্লির সিংহাসনে তিনিই প্রথম সুলতান। কুতুবউদ্দীন আইবক মুহম্মদ ঘুরীর ক্রীতদাস হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। এ জন্য তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ইতিহাসে ‘দাস বংশ’ নামে পরিচিত। অনেকে আবার লজ্জায় একে পাঠান বা আফগান বংশের ইতিহাস বলে । আসলে ওরা ছিল মামলুক, মানে নিগ্রো । ‘মামলুক’ শব্দের অর্থ দাস।     কুতুবুদ্দিন মধ্য এশিয়ার কোথাও জন্মেছিল । তার বাড়ির লোকেরা তাকে গোলাম হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিল।  তোমরা ভেবে দ্যাখো, কুতুবুদ্দিন আইবক ছিল গোলাম, সে যাকে সুলতান করে গেল, মানে ইলতুতমিশ, সেও ছিল গোলাম বা চাকর, তার মেয়ে সুলতানা রাজিয়া  ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শাসক, সে ছিল চাকরের মেয়ে । যখনই ইলতুতমিশকে রাজধানী ছাড়তে হত, তিনি তখন তার কন্যা রাজিয়াকে শাসনভার বুঝিয়ে দিয়ে যেতেন।সুলতান ইলতুতমিশের মৃত্যুর পর তার আরেক ছেলে রোকনুদ্দিন ফিরোজ দিল্লির শাসন কেড়ে নেয় আর প্রায় সাত মাসের মত শাসন করে। ১২৩৬ সালে দিল্লির পাবলিকের  সাহায্য নিয়ে রাজিয়া সুলতানা তার ভাইকে তাড়িয়ে সিংহাসনে বসে ।  নারী হওয়ার কারণে আর পর্দাপ্রথার বিরোধী হয়ে শাসনকাজ পরিচালনা করার জন্যে উলেমা আর প্রভাবশালীদের চটিয়েছিলেন। ওনাকে বিষ খাইয়ে মারা হয়েছিল ।রাজিয়া সুলতানার সমাধি  দিল্লির বুলবুল-ই-খানা মহল্লায় আছে,  অত্যন্ত অবহেলিত ও অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় । আমার সমাধির তুলনায় বেশ নোংরা আর ভাঙাচোরা। একজন রানির সমাধির কিনা এই অবস্হা ।     রাজিয়া সুলতানা যে যুবকটিকে ভালোবাসতেন, জামালুদ্দিন ইয়াকুত, সেও ছিল একজন নিগ্রো গোলাম রাজিয়ার বিরুদ্ধে যে তুর্কি দরবারিরা ষড়যন্ত্র করেছিল তারা ইয়াকুতকেও খুন করে । ইয়াকুত ছিল তাগড়া  রাজিয়ার বডিগার্ড । তুর্কিরা কেমন হয় তা তো জানোই, বেশ গোঁড়া ; তারা বদনাম করেছিল যে রাজিয়া সুলতানাকে ঘোড়ায় চাপাবার সময়ে ইয়াকুত রাজিয়ার দুই হাতের তলা দিয়ে সুলতানাকে ধরে ঘোড়ার ওপর বসিয়েছিল । সবই তুর্কিদের বানানো গল্প । রাজিয়া সুলতানা কখনও ঘোড়ায় চাপতো না, হাতির ওপরে হাওদায় বসে যেতো । তবে ইবন বাতুতা লিখে গেছেন যে রাজিয়া সুলতানা ইয়াকুত নামের নিগ্রোকে ভালোবাসতো ।    

              মালিক অম্বরের বেগম নতুন টপিক আরম্ভ করল : ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপিনস থেকে যে শ্রমিকরা আরবদেশগুলোতে কাজ করতে যায়, সেখানে মালিকরা তাদের পাসপোর্ট নিজের কাছে রেখে নিয়ে তাদের দাস বানিয়ে ফ্যালে । বিয়ের নাম করে যুবতীদের নিয়ে গিয়ে যৌনদাসী আর চাকরানি দুইই বানিয়ে ফ্যালে, যদিও আরবগুলোর আগে থাকতে চারটে আইনি বউ থাকে । যৌনদাসীর যৌবন ফুরিয়ে গেলে নতুন যৌনদাসী আমদানি করে দেশগুলো থেকে। আরবরা অনেক এমন যুবক-যুবতীকে ফাঁসিয়ে জেলে পুরে দেয় । তাদের টাকাকড়ির জোরের কাছে গরিব দেশগুলোর আবেদন কাজে লাগে না । পাথর খোঁড়া ইত্যাদি সর্বোচ্চ শোষণমূলক এবং বিপজ্জনক ক্ষেত্রগুলোতেই বেশিরভাগ জাতিগত সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষেরা কাজ করে বলে অনুমিত হয়েছে। বহুজাতিক অপরাধ সংঘটনগুলোর সংঘটিত অপরাধকর্মগুলোর মধ্যে মানবপাচারকে অন্যতম দ্রুত অপরাধকর্ম হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন মতে, মানবপাচার হচ্ছে মানুষের অধিকারের লঙ্ঘন। সেই সাথে এটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একটি নির্দেশনার বিষয়বস্তু। মানবপাচার এবং জোরপূর্বক শ্রম থেকে সুরক্ষা দেবার ক্ষেত্রে বেলারুশ, ইরান, রাশিয়া, তুর্কি হচ্ছে জঘন্যতম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।    


               বেগমবউদি কথা বজায় রাখলেন,   দাসপ্রথার ইতিহাস অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কৃতি, জাতি এবং ধর্মজুড়ে বিস্তৃত ছিল । অবশ্য দাসদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং বৈধ অবস্থান বিভিন্ন সমাজে এবং বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ছিল। আদিম সমাজে দাসপ্রথার প্রচলন বিরল ছিল কারণ এই প্রথা সামাজিক শ্রেণীবিভাগের কারণে তৈরি হয়। দাসপ্রথার অস্তিত্ত মেসোপটেমিয়াতে প্রায় ৩৫০০ খৃস্টপূর্বে প্রথম পাওয়া যায়| অন্ধকার যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত ইউরোপে অধিকাংশ এলাকাতেই দাসপ্রথা পাওয়া যেত | ইউরোপে বাইজেন্টাইন-উসমানিদের যুদ্ধ , ওলন্দাজ, ফরাসি, স্পেনিশ, পর্তুগিজ, ব্রিটিশ, আরব এবং কিছু পশ্চিম আফ্রিকান রাজ্যের লোকেরা আটলান্টিক দাস বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। , “ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে আনুমানিক প্রায় তিন চতুর্থাংশ লোকেরাই দাসপ্রথার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।”


    দাসপ্রথা একটি অনুমোদিত সামাজিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা ছিল । এ ব্যবস্থায় বাজারে মানুষের আনুষ্ঠানিক বেচা-কেনা চলত এবং ক্রীত ব্যক্তি ক্রেতার ব্যক্তিগত সম্পত্তি রূপে কাজ করতে বাধ্য থাকত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সব শাসন ব্যবস্থাতেই দাস প্রথার প্রচলন ছিল। গবাদিপশুর ন্যায় মানুষেরও কেনা বেচা চলত। অন্যান্য প্রায় সকল দেশের মতো বাংলায়ও প্রাচীনকাল হতেই দাস প্রথা প্রচলিত হয়ে আসছিল। শুধু আইন পুস্তক ও প্রশাসনিক গ্রন্থেই নয়, এ প্রথা সব ধর্মেও স্বীকৃতি ছিল। সব ধর্মীয় পুস্তকেই ক্রীত দাসদাসীদের সাথে সদ্ব্যবহারের উপদেশ দেওয়া আছে।


              পর্যটক সাইফ উদ-দৌলা নাজাবুত আলী খান বাহাদুর :  দাসত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রথম সমাজ হলো গ্রিক সভ্যতার সমাজব্যবস্থা। গ্রিক সভ্যতার সূচনা যিশুর জন্মের আনুমানিক দুহাজার বছর আগে মাইনোয়ান যুগে। হোমারের দুই মহাকাব্য ইলিয়াড এবং ওডিসির রচনাকাল আনুমানিক ৭৫০-৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই দুই মহাকাব্যে দাসত্ব এবং দাসপ্রথার টুকরো কিছু ছবি পাওয়া যায়। হোমার বা হেসিয়ডের রচনা থেকে জানা যায় গ্রিকরা দাসপ্রথাকে জীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ধরে নিত। হোমারের যুগে গ্রিকরা ক্রীতদাস বা ঝষধাব বোঝানোর জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করত ‘অ্যানড্রোপোডন’ শব্দটি, অ্যানড্রোপোডন কথাটির মানে মনুষ্যপদবিশিষ্ট জীব বা মানুষের মতো জীব। শব্দটি এসেছিল টেট্রাপোডা শব্দের উপমা হিসাবে। টেট্রাপোডার অর্থ চতুষ্পদী গবাদি প্রাণী। পলিবিয়াস বলেছেন, জীবনের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন হলো গবাদিপশু আর ক্রীতদাস। গ্রিসের অন্যতম প্রধান দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, দাসব্যবস্থা প্রকৃতিরই নিয়ম। গ্রিসের অভিজাতদের ৩০-৪০ জন দাস থাকত। কৃষি এবং শিল্প খাতে শ্রমের চাহিদা মেটানো হতো দাসদের দ্বারা। গ্রিকদের শিল্প যখন সমুদ্র পার হয়ে রফতানি শুরু হয় তখন দাসদের প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পায়,, দাস বেচাকেনার জন্য ব্যবসা শুরু হয়। এথেন্সের দাস ব্যবসায়ীরা এশিয়া মাইনর, সিরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে দাস আমদানি করত। ফিনিসীয় দাস ব্যবসায়ীরা নিজেরাই এথেন্সের বাজারে দাস নিয়ে আসত। সিরিয়া, মিসর, আরব প্রভৃতি দেশের সঙ্গেও এথেন্স এবং অন্য গ্রিক রাষ্ট্রের দাস ব্যবসা শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে এথেন্সের অর্থনীতি পুরোপুরিই দাসশ্রমনির্ভর হয়ে পড়ে। গ্রিক ভূস্বামীরা প্রাচ্যে বিলাস ও আলস্যের জীবনযাপন করত। গ্রিকদের প্রাসাদ, সুরম্য অট্টালিকা দাসদের শ্রমেই তৈরি হয়েছিল।


              পর্যটক সরসিজ বসু : প্রাচীন রোম সভ্যতাতেও ছিল দাসপ্রথার প্রচলন। রোমান সাম্রাজ্যের বিজিত প্রদেশগুলোকে রোমে দাস সরবরাহ করতে হতো। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে গ্রিস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল ১ লাখ ৫০ হাজার দাস। খ্রিস্টপূর্ব ২য় এবং ১ম শতকে রোমসহ সারা ইতালিতেই দাস শ্রমের ব্যবহার চরম আকার ধারণ করে। দাসদের প্রধানত খাটানো হতো জমি এবং খনিতে।    পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, সিন্ধু সভ্যতা ২৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে অস্তিত্বমান ছিল। বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেছেন গ্রামীণ জনসমষ্টির মধ্যেই দাসদের অস্তিত্ব ছিল। শহরে যে এরা ছিলেন তা আরো নিশ্চিত। শহরে কমপক্ষে তিন ধরনের সামাজিক অস্তিত্ব স্বীকৃত শাসকবর্গ (পুরোহিত ও নগরশাসকরা দুটি পৃথক গোষ্ঠী ছিল কিনা তা জানা যায় না), বণিক এবং কারিগর। এই তিনটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব থেকে বোঝা যায় ভৃত্যশ্রেণী নিয়ে গঠিত একটি চতুর্থ শ্রেণীর অস্তিত্বের কথা। এই ভৃত্যেরা বেতনভোগী শ্রমিক অথবা দাসও হতে পারতেন (যুদ্ধ বন্দি, ঋণ-দাস ইত্যাদি) গৃহদাস ও ভৃত্যদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ দাস আর বেতনভোগী শ্রমিকও নিয়োগ করতেন বলেই ইতিহাসবিদদের বিশ্বাস।           বৌদ্ধযুগের সূচনার কিছুদিন আগে (খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে) কোনো মানুষ বিভিন্ন কারণে অপর একজনের সম্পূর্ণ ক্ষমতাধীন হয়ে পড়লে তাকে দাস বলা হতো। তবে দেশের আকৃতিগত বিশালতার কারণে কিছু সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠী দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, গোষ্ঠীর বাইরে যাদের বিবাহ ছিল নিষিদ্ধ। পরবর্তী যুগের রচনায় অভিজাত গোষ্ঠী শাসনতন্ত্রের ধাঁচের এই গোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্বের সাক্ষ্য মেলে। এই সম্প্রদায়গুলোতে একটা সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীই দাস বলে গণ্য হতো, ফলে এক্ষেত্রে ‘দাস’ শব্দটির শুধু বৈধ ধারণাই নয়, একটি ছদ্ম জাতিগত তাৎপর্যও ছিল। প্রভুরা অনেক সময় দাসীদের উপপত্নী হিসাবে গ্রহণ করতেন I


              পর্যটক শাশ্বত সিকদার : মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের সময় দাসপ্রথার অবসানে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ব্রাহ্মণমন্ত্রী কৌটিল্য। তিনি দাসপ্রথা উঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সম্রাট অশোকের সময় প্রথম সামাজিক বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করা হয়। অশোকের রাজত্বকালে বিচার ও ব্যবস্থা সবার পক্ষে একই করা হয়।    কম্বোডিয়ায় হিন্দু মন্দিরগুলোর মতো বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতেও দাস ছিল। খমের মন্দিরের অর্থনীতিতে প্রাধান্য ছিল দাস শ্রমের। মন্দিরে যাদের দান করা হতো তাতে স্ত্রী-পুরুষ উভয় শ্রেণীর দাসের মধ্যে শিশুরাও ছিল। দাসদের সঙ্গে ব্যবহারে সব সময় যথেষ্ট দয়া দেখানো হতো না। ভিক্ষু রাহুল তার সিংহলে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস বইটিতে সিংহলি সঙ্ঘারামগুলোতে দাসপ্রথার কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘… যে প্রাচীনকাল থেকেই স্ত্রী-পুরুষ উভয়শ্রেণীর দাসরা সঙ্ঘারামের নিযুক্ত হতেন এবং তাদের প্রতিপালনের জন্য প্রচুর পরিমাণে অর্থ গচ্ছিত রাখা হতো। সিংহলি রাজাদের হাতে ধৃত যুদ্ধবন্দিরাও এই দাসদের মধ্যে ছিলেন।


              পর্যটক অজিত রায় : বাংলার সুলতানগণ আফ্রিকা, তুরস্ক, পারস্য ও চীনদেশ হতে দাস-দাসী আমদানি করতেন বলে জানা যায়। এ ধরনের কিছু ক্রীতদাসকে মুক্তি দেওয়ার পর মন্ত্রী, প্রশাসক, এমন কি সেনাপতির পদেও উন্নীত করা হয়েছিল। পনেরো শতকের শেষদিকে আবিসিনীয় বংশোদ্ভূত দাসগণ স্বল্প কালের জন্য বাংলায় তাদের নিজস্ব শাসন ব্যবস্থাও কায়েম করেছিল। বাংলার বাজারে ১৮৩০ সাল পর্যন্তও হাবশী ও কাফ্রী নামে পরিচিত আফ্রিকান ক্রীতদাস-দাসী আমদানি করা হতো। বাংলায় সাধারণত ধনী সম্ভ্রান্ত মুসলিমগণ ও ইউরোপীয় বণিকগণ কঠোর পরিশ্রমী ও কর্তব্যনিষ্ঠ বলে খ্যাত হাবশীদেরকে দাস হিসেবে রাখত। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য পরিবহন ও কারখানা প্রহরার জন্য নিয়মিত শ্রমিকের বিকল্প হিসেবে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করত। ইউরোপীয় অধিবাসীদের মধ্যে ক্রীতদাস রাখার এমনই রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল যে, স্যার উইলিয়ম জোনস এর ন্যয় একজন মানবতাবাদী, আইনজ্ঞ ও পন্ডিত ব্যক্তিরও চারজন ক্রীতদাস ছিল।     ক্রীতদাসদের মধ্যে সবচেয়ে দামি হাবশী দাসগণ খানসামা, পাচক (বাবুর্চি), গায়ক, নাপিত, গৃহ প্রহরী ইত্যাদি হিসেবে তাদের প্রভুদের সেবায় নিয়োজিত হতো। দাসদের মধ্যে তাদের মর্যাদা এত উচুঁ ছিল যে, তাদের মালিকগণ তাদের ব্যবসা সংক্রান্ত ও গৃহ পরিচালনা বিষয়ে এবং রাজনৈতিক ব্যাপারেও তাদের সাথে পরামর্শ করতেন।


              পর্যটক শ্রীজাত পিরালী : হিন্দু মালিকগণ দাস গ্রহণের সময় তাদের গোত্রের বাছবিচার করতেন। ঐ বিবেচনায় কায়স্থ , গোয়ালা, চাষা, বৈদ্য প্রভৃতি গোত্রের দাসদের শুদ্ধ (পবিত্র) এবং শূদ্র, তাঁতি, তেলি, ডোম, বাগ্দি, কৈবর্ত, জোলা, চন্ডাল প্রভৃতিদের অশুদ্ধ (অপবিত্র) বলে মনে করা হতো। কোনো ব্রাহ্মণকে দাসে পরিণত করা ধর্মে নিষিদ্ধ ছিল। শুদ্ধ গোত্রের দাসদের ঘরের ভেতরের কাজে এবং অশুদ্ধদের বাইরের কাজে লাগানো হতো।          মুসলিম পরিবারের দাসদাসীরা মুসলমান না হলে তাদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে হতো। হিন্দু সমাজে দাসদের ক্রীতদাস বা শুধু দাস এবং যারা স্ত্রীলোক তাদেরকে দাসী বলা হতো। মুসলমান সমাজে পুরুষ দাসদের বলা হতো গোলাম বা নফর এবং স্ত্রীলোকদের বান্দি বা লৌন্ডি। লৌন্ডিরা সুদর্শনা হতো এবং তাদেরকে বাজার থেকে কেনা হতো। তাদের প্রয়োজন ছিল গার্হস্থ্য শ্রমিক রূপে নয়, বরং প্রধানত উপ-পত্নী রূপে। হিন্দু ও মুসলিম, উভয় আইন মোতাবেক, যৌন পরিতৃপ্তির জন্য ক্রীতদাসীরা ব্যবহূত হতে পারত। তাদের সন্তান সন্ততিগণও দাস-দাসী হতো, তবে আইন অনুযায়ী, তারা মালিকের জমিজমায় কিছু অধিকার অর্জন করত।    আঠারো শতকের শেষের দিকে ইউরোপে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাস প্রথার অবলুপ্তি ঘটে। দাস প্রথাধীন শ্রমিক ব্যবস্থা শিল্পায়ন ও শিল্প-বিপ্লবোদ্ভূত মানবিক নব মূল্যবোধের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ প্রতীয়মান হয়। দাস শ্রমের চেয়েও মুক্ত শ্রম অবশ্যই অধিকতর উৎপাদনমূখী ছিল। শিল্পবিপ্লবহীন বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা তখনও দাস শ্রম ও দাস শোষণ প্রথা অাঁকড়ে ছিল। তাই, সহজে দাস শ্রমের বদলে মুক্ত শ্রমের প্রবর্তন সম্ভবপর হয় নি। দাস প্রথার সমর্থনে উপনিবেশিক শাসকগণের আর একটি যুক্তি ছিল যে, হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মে এর সমর্থন রয়েছে। কিন্তু, ইউরোপে মানবতাবাদী আন্দোলনের প্রভাবে, উনিশ শতকের গোড়া থেকে, এবং গুরুতর ভাবে ১৮২০ সাল হতে, ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন সরকার দাসপ্রথা নিরুৎসাহিত করে। ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট দ্বারা যথাসম্ভব দ্রুত সব ধরনের দাস প্রথা অবলুপ্ত করার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে কলকাতার সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। 


              পর্যটক রোশনি ইসলাম : প্রাচীনকালের অধিকাংশ বড়মাপের দাস বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৪০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৭০ অব্দের মধ্যে। অর্থাৎ রোমান সাম্রাজ্যের একটি বিশেষ পর্বে। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ক্রমাগত বিদ্রোহের ঘটনা ঘটতে থাকে। যেমন : খ্রিস্টপূর্ব ১৩৬-১৩২ সময়কালে সিসিলির প্রথম যুদ্ধ, ১৩৩-১২৯ সময়কালে এশিয়াতে অ্যারিস্টোনিকাসের অভ্যুত্থান, ১০৪ থেকে ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সিসিলির দ্বিতীয় যুদ্ধ এবং খ্রিস্টপূর্ব ৭৩-৭১ সময়কালে বিখ্যাত স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ। এসব বিরাট দাসযুদ্ধ উসকে দিয়েছিল অনেক ছোট সংঘর্ষকে। যেমন : ইতালির বিভিন্ন শহর, অ্যাটিকার খনি অঞ্চল এবং ডেলস দ্বীপে ঘটে যাওয়া নানা অভ্যুত্থান। তবে স্পার্টাকাসের পরাজয়ের পর এ মাপের দাস বিদ্রোহ তার ঘটেনি।    হাইতির দাস বিদ্রোহ (১৭৯১-১৮০৩) পৃথিবীব্যাপী দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনকে শক্তি জুগিয়েছিল। ইতিহাসবিদ সিএলআর জেমস হাইতির দাস বিদ্রোহ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ইতিহাসের একমাত্র সফল দাস বিদ্রোহ।’ হাইতির দাস বিদ্রোহ ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।     আমেরিকার দক্ষিণাংশের ১১টি রাজ্যের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল দাসশ্রম। ১৮৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ মিলিয়ন। আমেরিকার উত্তরাংশে দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে সমাজ সংস্কারক উইলিয়াম গ্যারিসন, লেখক হ্যারিয়েট বিচার স্টো প্রমুখের নেতৃত্বে। ১৮৬০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন আব্রাহাম লিংকন। লিংকন আমেরিকার পশ্চিমাংশে দাসপ্রথা প্রসারের বিরোধিতা করেন। ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল শুরু হয় আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট লিংকন ‘দাসপ্রথাবিরোধী ঘোষণা’ জারির মাধ্যমে আমেরিকার দক্ষিণাংশের কনফেডারেট রাজ্যগুলোর দাসদের দাসত্ব মোচন করেন। ১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ থেকে দাসপ্রথা বিলোপ করা হয় I


             মালিক অম্বর আমার সৌধতে দাস প্রথার  নথিপত্র রয়েছে, যা থেকে প্রমাণ মেলে যে, বনেদি সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো ও গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে এ প্রথা সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিল। বাজারে মুক্ত শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর থাকায় সমাজের শক্তিশালী শ্রেণি তাদের উৎপাদন ও প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর শ্রেণির লোককে দাস বানিয়ে ফেলতো । অভিজাত শাসকশ্রেণি, তাদের পারিবারিক ও অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক পদমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদে, সুবৃহৎ কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন অনুভব করে। গণপূর্ত কাজ, যেমন সরকারি ভবন, বাঁধ, সেতু, সড়ক ও প্রধান পথের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাষ্ট্রের এক বিশাল শ্রমশক্তির প্রয়োজন ছিল। সৈন্য চলাচল ও তাদের রসদ সরবরাহের জন্যও শ্রমশক্তির প্রয়োজন ছিল। দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ ও শ্রেণিভেদ প্রথা যাদেরকে গুরুত্বহীন করে তুলেছিল প্রধানত তারাই দাস প্রথার বলি হতো। অভাবগ্রস্ত, নিঃস্ব, এতিম ও বিধবাদের অনেকেরই শেষ গন্তব্য ছিল ক্রীতদাস বাজার। দাস বাজারের অনেক ঠগ ও অপরাধী বিক্রি করার জন্য শিশুদের অপহরণ করত। আইনত ও প্রথাগতভাবে, ক্রীতদাস-দাসীরা ও তাদের সন্তান-সন্ততিরা তাদের মালিকের সম্পত্তি রূপে পরিগণিত হতো। ক্রীতদাস-দাসী হস্তান্তরযোগ্য পণ্য ছিল। তাই, অনেক মালিক তাদের উদ্বৃত্ত বা অপ্রয়োজনীয় দাস-দাসীদের বাজারে বিক্রি করে দিত।   দাস-দাসীদের আমদানি ও রপ্তানি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ খাত ছিল। বাংলার সুলতানগণ আফ্রিকা, তুরস্ক, পারস্য ও চীনদেশ হতে দাস-দাসী আমদানি করতেন বলে জানা যায়। এ ধরনের কিছু ক্রীতদাসকে মুক্তি দেওয়ার পর মন্ত্রী, প্রশাসক, এমন কি সেনাপতির পদেও উন্নীত করা হয়েছিল। পনেরো শতকের শেষদিকে আবিসিনীয় বংশোদ্ভূত দাসগণ স্বল্প কালের জন্য বাংলায় তাদের নিজস্ব শাসন ব্যবস্থাও কায়েম করেছিল। বাংলার বাজারে ১৮৩০ সাল পর্যন্তও হাবশী ও কাফ্রী নামে পরিচিত আফ্রিকান ক্রীতদাস-দাসী আমদানি করা হতো। বাংলায় সাধারণত ধনী সম্ভ্রান্ত মুসলিমগণ ও ইউরোপীয় বণিকগণ কঠোর পরিশ্রমী ও কর্তব্যনিষ্ঠ বলে খ্যাত হাবশীদেরকে দাস হিসেবে রাখত। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য পরিবহন ও কারখানা প্রহরার জন্য নিয়মিত শ্রমিকের বিকল্প হিসেবে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করত। ইউরোপীয় অধিবাসীদের মধ্যে ক্রীতদাস রাখার এমনই রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল যে, স্যার উইলিয়ম জোনস এর ন্যয় একজন মানবতাবাদী, আইনজ্ঞ ও পন্ডিত ব্যক্তিরও চারজন ক্রীতদাস ছিল। ক্রীতদাসদের মধ্যে সবচেয়ে দামি হাবশী দাসগণ খানসামা, পাচক (বাবুর্চি), গায়ক, নাপিত, গৃহ প্রহরী ইত্যাদি হিসেবে তাদের প্রভুদের সেবায় নিয়োজিত হতো। দাসদের মধ্যে তাদের মর্যাদা এত উচুঁ ছিল যে, তাদের মালিকগণ তাদের ব্যবসা সংক্রান্ত ও গৃহ পরিচালনা বিষয়ে এবং রাজনৈতিক ব্যাপারেও তাদের সাথে পরামর্শ করতেন। অভিজাত সম্প্রদায়ের হারেমে নিয়োজিত খোজাদের মধ্যে হাবশী দাসদের সংখ্যাই সর্বাধিক ছিল। 


              পর্যটক মাইকেল মধুসূদন : আঠারো ও ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার বাজারের জন্য কেবল আফ্রিকাই নয়, বরং আরব, চীন, মালয়, আরাকান ও আসাম হতেও ক্রীতদাস আমদানি করা হতো। আরব দেশ থেকে আনীত দাসদের অধিকাংশই হতো খোজা। বাংলার বাজার হতে ক্রীতদাস রপ্তানিও হতো। ইউরোপীয় বৈদেশিক উপনিবেশগুলির জন্য বাগান শ্রমিক হিসেবে বঙ্গীয় বংশোদ্ভূত দাসদের চাহিদা ছিল। দাস মুখ্যত দু’ধরনের ছিল: গার্হস্থ্য ও কৃষিকার্যাধীন। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে গুটি কয়েক দাস থাকবে সেটাই ছিল সামাজিক প্রত্যাশা। তারা পদ ও মর্যাদার প্রতীক ছিল এবং তা কেবল সম্ভ্রান্ত জমিদারের ক্ষেত্রেই নয়, মধ্যবিত্ত ও ধনী কৃষকদের বেলায়ও ছিল। হিন্দু মালিকগণ দাস গ্রহণের সময় তাদের গোত্রের বাছবিচার করতেন। ঐ বিবেচনায় কায়স্থ , গোয়ালা, চাষা, বৈদ্য প্রভৃতি গোত্রের দাসদের শুদ্ধ (পবিত্র) এবং শূদ্র, তাঁতি, তেলি, ডোম, বাগ্দি, কৈবর্ত, জোলা, চন্ডাল প্রভৃতিদের অশুদ্ধ (অপবিত্র) বলে মনে করা হতো। কোনো ব্রাহ্মণকে দাসে পরিণত করা ধর্মে নিষিদ্ধ ছিল। শুদ্ধ গোত্রের দাসদের ঘরের ভেতরের কাজে এবং অশুদ্ধদের বাইরের কাজে লাগানো হতো।    মুসলিম পরিবারের দাসদাসীরা মুসলমান না হলে তাদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে হতো। হিন্দু সমাজে দাসদের ক্রীতদাস বা শুধু দাস এবং যারা স্ত্রীলোক তাদেরকে দাসী বলা হতো। মুসলমান সমাজে পুরুষ দাসদের বলা হতো গোলাম বা নফর এবং স্ত্রীলোকদের বান্দি বা লৌন্ডি। লৌন্ডিরা সুদর্শনা হতো এবং তাদের বাজার থেকে কেনা হতো। তাদের প্রয়োজন ছিল গার্হস্থ্য শ্রমিক রূপে নয়, বরং প্রধানত উপ-পত্নী রূপে। হিন্দু ও মুসলিম, উভয় আইন মোতাবেক, যৌন পরিতৃপ্তির জন্য ক্রীতদাসীরা ব্যবহূত হতে পারত। তাদের সন্তান সন্ততিগণও দাস-দাসী হতো, তবে হিন্দু ও মুসলিম আইন অনুযায়ী, তারা মালিকের জমিজমায় নামমাত্র কিছু অধিকার অর্জন করত। কৃষি কার্যাধীন দাসের সংখ্যাই ছিল সর্বাধিক। বাজার হতে মুক্তশ্রমিক প্রাপ্তি সম্ভবপর না হওয়ায় সম্ভ্রান্ত স্তরের ও ধনী কৃষক শ্রেণির কৃষিকাজে ক্রীতদাস ব্যবহারের কোনো বিকল্প ছিল না। অতীতকাল থেকে উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলায় কৃষি কর্মোপযোগী দাস বা দাসখত লেখা শ্রমিক ব্যবহারের ব্যাপক রেওয়াজ ছিল। কেউ সম্পদবিহীন হয়ে স্বাধীন জীবন ধারণে অক্ষম হলে, ইচ্ছুক সম্পদশালী কোনো পরিবারের নিকট নিজেকে বিক্রি করত। এসব পরিবার এ ধরনের অভাগাদের কিনে তাদের ক্ষেতের কাজে লাগাত। তারা সব ধরনের কৃষিকাজ করত যথা, মাটি খনন, পানি সেচ, গো-চারণ, মাছ ধরা, নির্মাণ কাজ ইত্যাদি। শ্রমের বিনিময়ে তারা তাদের প্রভুদের কাছ থেকে খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৃদ্ধ বয়সের ভরণপোষণও পেত। অনেক ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি মহাজনদের কাছে তাদেরকে বিক্রি করে দিয়ে তাদের দেনার দায় পরিশোধ করত। দেনার কারণে দাসত্ব, আজীবন অথবা জীবনের খানিক অংশের জন্য, হতে পারত। যেসব জেলায় বিশেষভাবে কৃষিনির্ভর দাস প্রথার প্রচলন ছিল সেগুলি হচ্ছে সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও ঢাকা। 


              পর্যটক ক্যাটরিনা কাইফ :আইন কমিশনের (১৮৩৯) প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসব জেলায় প্রতি পাঁচ জনের একজনই ছিল দাস। সাধারণ দাস বাজার থেকে ক্রয় না করে সরাসরি সামাজিক উৎস হতে কৃষিনির্ভর দাস সংগ্রহের রেওয়াজ ছিল। অভাব, দুর্ভিক্ষ, নদী ভাঙন, পরিবারের উপার্জনকারী সদস্যের মৃত্যু প্রভৃতি দুর্যোগ কবলিত ব্যক্তিদের বেঁচে থাকার তাগিদে স্বেচ্ছায় দাসত্ব গ্রহণ করতে হতো। তাদের বেলায় বংশপরম্পরায় গার্হস্থ্য শ্রমিক হিসেবে থেকে যাওয়াই অবধারিত ছিল। তাদের বয়স, শারীরিক গঠন, লিঙ্গ, গোত্র, জাতি, এবং সর্বোপরি দেশের চলতি অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় তাদের মূল্য নির্ধারিত হতো। উনিশ শতকের প্রথম দিকে শিশু ও বৃদ্ধদের বাজার দর ছিল পাঁচ থেকে সাত টাকা। স্বাস্থ্যবান তরুণ দাসদের মূল্য হতো কুড়ি থেকে পঞ্চাশ টাকা। অভাব ও দুর্ভিক্ষ হলে বাজার দাসে ছেয়ে যেত এবং তখন দাম পড়ে যেত। আঠারো শতকের শেষের দিকে ইউরোপে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাস প্রথার অবলুপ্তি ঘটে। দাস প্রথাধীন শ্রমিক ব্যবস্থা শিল্পায়ন ও শিল্প-বিপ্লবোদ্ভূত মানবিক নব মূল্যবোধের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ প্রতীয়মান হয়। দাস শ্রমের চেয়েও মুক্ত শ্রম অবশ্যই অধিকতর উৎপাদনমূখী ছিল। 


              পর্যটক হুমায়ুন জা মুবারক আলী খান বাহাদুর :শিল্পবিপ্লবহীন বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা তখনও দাস শ্রম ও দাস শোষণ প্রথা অাঁকড়ে ছিল। তাই, সহজে দাস শ্রমের বদলে মুক্ত শ্রমের প্রবর্তন সম্ভবপর হয় নি। দাস প্রথার সমর্থনে উপনিবেশিক শাসকগণের আর একটি যুক্তি ছিল যে, হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মে এর সমর্থন রয়েছে। কিন্তু, ইউরোপে মানবতাবাদী আন্দোলনের প্রভাবে, উনিশ শতকের গোড়া থেকে, এবং গুরুতর ভাবে ১৮২০ সাল হতে, ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন সরকার দাসপ্রথা নিরুৎসাহিত করে। ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট দ্বারা যথাসম্ভব দ্রুত সব ধরনের দাস প্রথা অবলুপ্ত করার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে কলকাতার সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ধাপে ধাপে দাস প্রথার অবলুপ্তির জন্য ১৮৪৩ এর ‘অ্যাক্ট ফাইভ’ প্রণীত হয়। এ আইনের আওতায় দাস রাখা অপরাধমূলক ছিল না, এতে কেবল মুক্ত ব্যক্তি ও দাসের মধ্যে আইনগত পার্থক্যের অবসান ঘটানো হয়েছিল। আইনে বিধান রাখা হলো যে, কোনো আদালত কোনো দাসের ওপর কারও দাবি গ্রাহ্য করবে না। এ আইন সব দাসদের মুক্ত বলে ঘোষণা করে নি। বরং আইনে বলা হলো যে, কোনো দাস ইচ্ছে করলে তার মালিককে পরিত্যাগ করে স্বাধীনভাবে বাস করতে পারবে। দাস আমদানি ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তবে, বাস্তবক্ষেত্রে দাসপ্রথা হঠাৎ করে থেমে যায় নি। দাসপ্রথা সামাজিকভাবে ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য বিবেচিত হতে আরও কয়েক দশক লেগে যায়। মুক্ত শ্রমের ব্যবহার বৃদ্ধি, শিল্পায়নে ক্রমিক অগ্রগতি, এবং উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ হতে মানবতাবাদী আন্দোলনসমূহ দাস প্রথাকে ধীরে ধীরে জনগণের নিকট অপ্রিয় ও সমাজে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা দাস প্রথা হতে মুক্ত হয়।


              মালিক অম্বর :আমার সৌধতে আরেকটা নথি আছে, পদবি নিয়ে । আমি তো মালিক অম্বর । দুটোর কোনোটাই আমার পদবি নয় । কিন্তু নিজেদের বংশকে চিহ্নিত করে তার গৌরব প্রকাশের চিরাচরিত প্রবৃত্তি থেকে উদ্ভব হয় পদবীর যা রাজবংশ গুলির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল এবং রাজবংশ থেকে ক্রমান্বয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে যায় এই প্রথা।এই পদবী এবং উপাধি বিভিন্ন উত্তম কাজের স্বীকৃতি/পুরস্কার সরূপ রাজারা ধারণ করতেন এবং রাজ কর্মকর্তা-সৈন্য-সামন্ত-বিদ্বান ব্যক্তিদের প্রদান করতেন।এই প্রথা সাধারণ প্রজাদের মাঝে জনপ্রিয় হয় এবং তারা নিজেদের পেশা অনুসারে নামের শেষে পদবী যোগ করে। মহাভারতের যুগে কারো পদবী না থাকলেও বাঙালি রাজাদের পদবী ছিল।মহাভারতের দ্বিতীয় পর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সমুদ্র সেন এবং তার ছেলে চন্দ্র সেন পান্ডবদের হয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এবং যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে ঋত্বিকের ভূমিকা পালন করেছিলেন বীর সেন নামক ঋষি।[১] এরপর প্রথমে জৈন এবং তারপর বৌদ্ধদের প্রভাব বাঙলায় বৃদ্ধি পায় এবং হিন্দুদের ধর্মাচার জৈন-বৌদ্ধ প্রভাবান্বিত হয়।বল্লালসেন তার অদ্ভুতসাগর গ্রন্থে উল্লেখ করেন আদিপিতৃভূমি বৈদিক বৈদহ রাজ্যের (উত্তরবঙ্গ,মিথিলা,নেপালের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে গঠিত বেদে উল্লেখিত রাজ্য)এরূপ অধঃপতনে মর্মাহত হয়ে কর্ণাটলক্ষি ছেড়ে তার পূর্বপুরুষ বরেন্দ্রসেন বাঙলায় অভিযান চালিয়ে পুন্ড্র রাজ্য অধিকার করেন যেটি বরেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।এই সামন্ত রাজ্য সাম্রাজ্যে পরিণত হয় এবং সনাতন ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।প্রজারা সৎপথে চলবে রাজ্যে শান্তি বিরাজ করবে এই লক্ষ্যে বল্লালসেন কৌলিন্য এবং বর্ণ সমীকরণ করেন।সেইসময় ৩৬ পদবীর হিন্দু ছিল প্রত্যেক ৩৬ বছর পরপর তাদের কৌলিন্য নির্ধারণ করে কর্মানুসারে বর্ণ নির্ধারণ করার নিয়ম করা হয়;এই প্রক্রিয়াকে “সমীকরণ” বলে উল্লেখ করা হয় ।এভাবেই বাঙালি পদবীর পুনর্গঠন ঘটে।


              পর্যটক ওয়াল্লা জা আহমেদ আলী খান বাহাদুর :প্রাচীন কালে কোনও পদবী হতো না। এগুলির সৃষ্টি প্রায় ৮০০ বছর আগে মাত্র।বল্লাল সেন কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে পদবীর প্রচলন করেন।বাঙালিজাতির ইতিহাসে তাই সেন রাজবংশ হতে সেন পদবীই প্রথম পদবীপ্রথা হিসেবে ধরা হয়।পূর্বতন শাসক পালরা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মমতে বিশ্বাসী সে সময়ের বাঙলায় পদবী হত না কিন্তু বাঙলায় বৈদিক গোঁড়া হিন্দু খ্যাত সেন রাজবংশ দ্বারা বাঙলা অধিকৃত হওয়ার পর ধর্মান্তরিতকরণ,বাঙলার সাতটি গ্রামে ব্রাহ্মণ অভিবাসিতকরণ এবং “বর্ণ ও কৌলিন্য” প্রথার প্রচলনের ইতিহাস পাওয়া যায়।অর্থাৎ বাঙলার বর্ণভেদের উদ্দেশ্য শুধু ধর্মীয় নয় রাজনীতি একটি বড় কারণ।যেমন রাজনৈতিক কারণে বৈশ্য বর্ণকে শুদ্রে অবনমিত করা হয় যা এখনো বাঙালি সমাজে প্রচলিত।এর পেছনের কারণ হল রাজা বল্লাল সেন যুদ্ধাভিযানের জন্য বণিকদের কাছে অর্থ দাবি করেন কিন্তু বনিকরা তা নিঃশর্তে দিতে অস্বীকৃতি জানান ফলসরূপ বণিকদেরকে কৌলিন্যচ্যুত হতে হয়।বণিকদের নেতৃত্বেে ছিলেন সুবর্ণবণিক বল্লভানন্দ যার জামাতা ছিলেন অঙ্গের রাজা।বাঙলায় “ক্ষত্রিয়” (ক+ষ+ত্রি+য়/kshtriya) এর অপভ্রংশ “কায়স্ত” রুপে বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়।মিনহাজ রচিত “তবারক-ই-নাসিরি” তে লক্ষণ সেনের বংশকে খলিফার মত সম্মান করত এবং তাদের বাক্যকে ধর্মবিধান বলে হিন্দুরা স্বীকার করত বলে উল্লখ করেছেন।শিলালিপিতে তাদের বংশকে ব্রহ্মক্ষত্রিয় এবং “অদ্ভুতসাগর” গ্রন্থে বল্লাল সেনের বংশকে “কুলীন কুলশ্রেষ্ঠ” বলা আছে।

               পর্যটক জাফর আলী খান বাহাদুর মীর মুহম্মদ জাফর আলী খান বাহাদুর :বল্লাল সেনের শাসন আমলেই কৌলীন্য প্রথার শুরু। সেন রাজাদের শিলালিপি থেকে জানা যায়, তাঁরা ছিলেন চন্দ্রবংশীয় ‘ব্রহ্মক্ষত্রিয়’ ( ব্রহ্মক্ষত্রিয় বলতে তাদেরকে বোঝানো হয় যারা ব্রাহ্মণ কুলে জন্মগ্রহন করলেও পেশা হিসেবে ব্রাহ্মণ্য পেশা গ্রহণ না করে ক্ষত্রিয়ের পেশা অর্থাৎ রাজ্য শাসন এবং যুদ্ধবিদ্যাকে পেশা হিসেবে গ্রহন করে।)। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, সেনরা প্রথমে জৈন আচার্য বংশোদ্ভূত ছিলেন কিন্তু এই মত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।সেনরা কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তনের পর একটি বংশ থেকে আরেকটি বংশকে আলাদা করতে সনাতনীদের মাঝে পদবী প্রথার প্রচলন হয়।বল্লাল চরিত থেকে জানা যায় বল্লাল সেন প্রত্যেক ৩৬ বছর পর পর কর্মানুসারে বর্ণ পরিবর্তনের বিধান রাখেন কিন্তু লক্ষণ সেন এই পরিবর্তনে মনোনিবেশ করেননি।


              পর্যটক আমীর উল-উমরা ওয়াসিফ আলী মির্জা খান বাহাদুর :হাবশি বা সিদ্দি হল এক জাতীগত গোষ্ঠী যারা ভারত ও পাকিস্তানের কিছু অংশে বসবাস করে। এদের পূর্বপুরুষরা অধিকাংশরাই ছিল আবিসিনিয়ার আদিবাসি যাদের পর্তুগীজ ব্যবসায়ীরা ধরে ক্রীতদাশ হিসেবে ভারতবর্ষে নিয়ে আসে।] ভারতের হায়দ্রাবাদ, গুজরাট ও করনাটকাতে এবং পাকিস্তানের মাকরান ও করাচীতে প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ হাজার হাবশী বসবাস করে। অধিকাংশ হাবশি সুফি মুসলিম হলেও হিন্দু এবং ক্যাথলিখ খৃষ্টান হাবশিও রয়েছে।  হাবশি নামটির উৎপত্তি হয় আরবী আল-হাবশ থেকে। আরবরা আল-হাবশ বলতে বুঝাতো আবিসিনিয়াকে। ইথিওপিয়ান/ আবিসিনিয়ান জাহাজের ক্যাপ্টেনরা এই উপমহাদেশে পণ্যের সাথে কৃতদাশও নিয়ে আসত এবং বিক্রি করে দিত। হাবশিরা শারিরীক ভাবে অনেক শক্তিশালী ছিল এবং অনেক কাজ করতে পারত, তাই ধীরে ধীরে উপমহাদেশে হাবশি কৃতদাশের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই চাহিদার সুযোগ নিয়ে পর্তুগীজ নাবিক এবং ব্যবসায়ীরা আফ্রিকা থেকে কৃতদাশ ধরে নিয়ে এসে এই উপমহাদেশ বিক্রি করে মুনাফা করত।


              পর্যটক রেইস উদদৌলা ওয়ারিস আলী মির্জা খান বাহাদুর : হাবশিদের সিদ্দি নামেও ডাকা হয়। এই সিদ্দি নামটির উৎপত্তির ব্যাপারে এখনও বিশ্লেষকরা একমত হতে পারেননি। একটি মতানুশারে সিদ্দি শব্দটি আফ্রিকায় সম্মানসূচক হিসেবে ব্যবহার করে হত। শুধুমাত্র সম্মানিত আরবদের এই নামে ডাকা হত, অপরদিকে অবজ্ঞা অর্থ ব্যবহৃত হত সিদ্দি এর বিপরীত শব্দ হাফসি শব্দটি। ধারনা করা হয় তাদের অবজ্ঞা না করে সিদ্দি নামে ডাকার ফলেই অনেক জায়গায় সিদ্দি নামটি প্রচলিত আছে। অপর মতানুশারে সিদ্দি শব্দটির অর্থ আরব জানাজের ক্যাপ্টেন কর্তৃক আনিত। এই ক্যাপ্টেনদের বলা হত সাঈদ।        হাবশিদের অনেকসময় আফ্রো-ইন্ডিয়ান হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। আরবরা হাবশি বলতে জাঞ্জদের বুঝায় (আরবি জাঞ্জ শব্দের অর্থ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ) এছাড়া চীনারা আরবি ভাষার অনুবাদ করে হাবশিদের জিঞ্ঝি বা জিঞ্জি শব্দটি ব্যবহার করে থাকে।


              পর্যটক মুবারক উদদৌলা আশরাফ আলী খান বাহাদুর :আমেরিকা-ইউরোপের ঔপনিবেশিক  নায়করা দাসদাসি চালানের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে জনতার কাছে এখন খলনায়কে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং কথিত নায়কদের মূর্তি ভেঙে পানিতে নিক্ষেপ করে নিন্দার গভীরতা প্রকাশ করেছে জেগে উঠা জনগণ। দাসপ্রথা বা মানুষকে দাস বানিয়ে বিক্রি করে যারা মুনাফা অর্জন করেছে তাদের অন্যতম কলম্বাস, ভাস্কোদাগামা, রবার্ট ক্লাইভসহ অন্যদের ইউরোপের গণমানুষ এখন নিন্দার চোখে দেখছে। জনতার অপমান অপদস্ত থেকে তারা কেউই বাদ পড়েনি। মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের অন্যতম বড় শহর মিনেপলিসে পুলিশি হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জজ ফ্লয়েডকে হত্যার পর দাস ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পুনরায় গণঘৃণা জেগে উঠে। ব্রিটেনে বর্ণবৈষম্য ও কৃষ্ণাঙ্গ নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনকারীরা অন্যদের সাথে দাস ব্যবসায়ী অ্যাডওয়ার্ড কোলস্ট্রেনের মূর্তি ভেঙে গত ৭ জুন সাগরে নিক্ষেপ করেছে। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবারই কথা বলে আসছে, কিন্তু তাদের কথা কেউ কানে তুলেনি। দুর্বলের ওপর সবলের প্রভাব প্রতিপত্তি থেকেই দাসপ্রথার উদ্ভব হয়েছিল, দুর্বলতা বলতে যেমন শারীরিক দুর্বলতা বুঝায়, এ ক্ষেত্রে দুর্বলতা বলতে অর্থনৈতিক দুর্বলতাই মুখ্য বিষয় হিসেবে কাজ করেছে। শরীরের রঙ, নিরক্ষরতা ও দরিদ্রতার কশাঘাতে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষগুলোই দাসপ্রথার ভিকটিম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কথিত মালিকরা দাসের সাথে পশুর চেয়েও খারাপ আচরণ করত। যে মানুষগুলো পণ্যের মতো বাজারে বিক্রি হয়েছে তারাই দাস, বিক্রীত মানুষটি ‘মানুষ’ হিসেবে কোথাও কোনো প্রকার দাবি, অধিকার ও একজন মানুষ অন্য একজন মানুষ থেকে যে আচরণ প্রাপ্য, দাসরা সে আচরণ প্রত্যাশা করতে পারেনি। ইউরোপ ছাড়াও আরব অধ্যুষিত এলাকায় দাসপ্রথা প্রকটভাবে ছিল। দাসপ্রথা নিয়ে এখন অনেকেই অনেক কথা বলেন বটে, কিন্তু আজ থেকে এক হাজার ৫০০ বছর আগে মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ সা: ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে দাসপ্রথা নিরুৎসাহিত করেন। সৌদি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ক্রয়কৃত দাস মুক্তি পেয়েছিল। তিনি দাসমুক্তিকে ইবাদতের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। যুগে যুগে মানবতাবাদী মনীষীরা দাসপ্রথার বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন যাদের মধ্যে আব্রাহাম লিঙ্কনের নাম উল্লেখযোগ্য। কিন্তু অনেক দাস ব্যবসায়ী রয়েছে যাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছিল।


              পর্যটক সিরাজদ্দৌলা মুহম্মদ সিরাজদ্দৌলা : লেলিন বলেছেন, দাসত্ব তিনি প্রকার। প্রথমত, এক শ্রেণীর লোক স্বেচ্ছায় দাসত্ব গ্রহণ করে বিনিময়ে তার ক্ষুধার জ্বালা নিবারণসহ জীবন ধারণের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকে না। দ্বিতীয়ত, এক শ্রেণীর লোক রয়েছে যারা নিজেরা বুঝতেই পারছে না যে, তারা দাসত্ব করে যাচ্ছে বিনিময়ে আরাম-আয়াশে দিন কাটাচ্ছে, কিন্তু সত্য-মিথ্যার তারতম্য করতে পারে না; ৩. ব্যতিক্রমধর্মী এক শ্রেণীর লোক রয়েছে যারা দাসত্বকে না মেনে প্রতিবাদ করে আসছেন তারাই বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন, বিনিময়ে পাচ্ছেন জেল-জুলুম, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, এমনকি ফাঁসির দড়ি।           দাসত্ব গ্লানির ও অপমানজনক। অন্য দিকে ‘বিদ্রোহী’ জীবন অনেক কষ্টের তবে সম্মানজনক। যদিও আইন করে কৃতদাস প্রথা বা দাসপ্রথা বিলুপ্ত বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু আমাদের সমাজে কি দাসত্ব বন্ধ হয়েছে? বরং ‘মানসিক দাসত্বের’ পরিমাণ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। খেয়ে পরে একটু স্বস্তিতে থাকার জন্য, কোথাও প্রমোশনের জন্য, কোথাও পদ-পদবি পাওয়ার জন্য মানুষ বিশেষ করে আমাদের সমাজে যারা বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত তারা নির্লজ্জের মতো দাসত্ব করে যাচ্ছে। কলকাতামনস্ক কিছু বুদ্ধিজীবী আছেন যারা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রকে নিজের দেশ মনে করেন, তাদের মানসিক দাসত্ব প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে, বিশেষ করে তাদের লেখনি ও বক্তব্যে।          


                 পর্যটক যুবরাজ সেলিম :নাস্তিকবিদ্বেষীরা নাস্তিকতা নিয়ে যেসব অভিযোগ তোলেন তার কোনোটার সাথেই নাস্তিকতার কোনো যোগসূত্র নেই। তাদেরকে প্রায়ই এমন অভিযোগ তুলতে দেখা যায় যে, নাস্তিকতাই লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী কিংবা নাস্তিকতার কারণে গনহত্যা হয়! কি হাস্যকর অভিযোগ রে বাবা! এরকম গোমূর্খের মতো অভিযোগ যারা তোলেন তারা যে অত্যন্ত ভ্রমাত্মক এবং তাদের মাথাভর্তি যে মরুভূমির গরম বালু ছাড়া কিছু নেই তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।


              পর্যটক আবুল ফজল ইবন মুবারক : নাস্তিকতা মানে কি? নাস্তিকতা মানে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের অভাব বা অবিশ্বাস। ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না এমন একজন মানুষের করা খুন বা ধর্ষণের জন্য তার ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস না করাকে বা নাস্তিকতাকে দায়ী করা ঠিক ততোটাই হাস্যকর ও অর্থহীন যতোটা হাস্যকর ও অর্থহীন মূলা খায় না এমন একজন মানুষের করা খুন বা ধর্ষণের জন্য তার মূলা না খাওয়াকে দায়ী করা।


              ফকির নাজিওদ্দিন :নাস্তিকবিদ্বেষীদের নাস্তিকতার বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ তোলার পেছনে উদ্দেশ্য কি? তারা মূলত বোঝাতে চান যে, নাস্তিকতা মানবসভ্যতার জন্য খুবই খারাপ বা ভুল এবং তা কঠোরভাবে দমন করা প্রয়োজন। তারা বোঝাতে চান, একজন নাস্তিক সমাজের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ, তাই সমাজে নাস্তিকদের কোনো জায়গা নেই। মূলত, কেউ নাস্তিক হলে তাকে যেন হত্যা করা হয় নয়তো, জেলে বন্দী করে রাখা হয়। নাস্তিকদের বিরুদ্ধে সেই জুলুম নির্যাতন উস্কে দিতেই নাস্তিকবিদ্বেষীদের নাস্তিকতার বিরুদ্ধে এই অর্থহীন অভিযোগ। আমরা যদি ধরেও নেই যে নাস্তিকবিদ্বেষীদের অভিযোগটি সঠিক, আমরা যদি ধরেও নেই যে নাস্তিকতাই স্ট্যালিনের করা গনহত্যার জন্য দায়ী, তাহলে কি এটা প্রমাণিত হয় যে নাস্তিকরা ভুল বা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস না করা ভুল? ‘নাস্তিকতা মানবসভ্যতার জন্য খারাপ’ এটি প্রমাণিত হলে কি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়ে যাবে? আমরা যদি ধরেও নেই যে ইসলাম সমাজে শান্তি নিয়ে আসে আর নাস্তিকতা গনহত্যা, তাতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না।


              পর্যটক  শিশুনাগ :অঘোরী সাধু হওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। টানা ১২ বছর কঠোর সাধনার পর অঘোরী গুরুর আশীর্বাদে নিজের ধর্মীয় যাত্রা শুরু করেন অঘোরী সাধুরা। আর তখনই জন্ম হয় এক চরম সাধকের। যাঁদের বস্ত্র হয় মৃত ব্যক্তির জামা-কাপড়ের ছেঁড়া অংশ। শরীরে থাকে মৃত দেহের ছাই। এখানেই শেষ নয়, এমন সাধকদের সারা জীবন বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়, যেমন- প্রত্যেক অঘোরী সাধু কে একজন গুরুর অধীনে থাকতে হয়। গুরু যা বলেন, সেইভাবে জীবনযাপন করতে হয়। সংগ্রহ করতে হয় মৃতদেহের খুলি, যা তাঁদের সাধনার প্রধান উপকরণ।


              পর্যটক সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত : এবার জেনে নেওয়া যাক অঘোরীদের সংস্কৃতি কেমন। মূলত নদীর ধারের কোনও নির্জন শশ্মানে অথবা গভীর জঙ্গলের মধ্যে এঁদের বাস। মৃত ব্যক্তির মাংস খান এঁরা। এঁদের বিশ্বাস, এমনটা করার মধ্যে দিয়ে তাঁরা ভক্তির প্রদর্শন করছেন। কারণ মৃত্যুর পর আত্মা শরীর ছেড়ে অন্য জগতে চলে যায়। তাই যে কোনও মৃত পশুর মাংস খাওয়া আর মানুষের মাংস খাওয়ার মধ্যে কোনও পার্থক্য় খুঁজে পান না অঘোরীরা। শুধু তাই নয়, মৃতদেহ যে কাঠে পোড়ানো সেই একই কাঠে তাঁরা রান্না করে খান। এমনও বিশ্বাস আছে যে অঘোরী সাধুরা মৃতদেহের উপর বসে খুলিকে সামনে রেখে সাধনা করেন। কিন্তু বাস্তবে এমন দৃশ্য কেউ দেখেছেন কিনা তা জানা নেই।


             পর্যটক প্রভাকর বর্ধন : এঁদের সম্পর্কে যা কিছু জানা গিয়েছে, তার বেশিরভাগই প্রাচীন পুঁথিপত্রে লেখা রয়েছে। সভ্য সমাজের থেকে হাজার মাইল দূরে জীবনযাপন করা এমন সাধকদের খোঁজ পাওয়ার সত্যিই খুব কঠিন।তবে এঁদের একেবারেই যে দেখা পাওয়া যায় না, তেমনি নয়। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, এখনও আমাদের দেশের দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলে বহু অঘোরী সাধু বসবাস করেন। আর শিবরাত্রির সময় তাঁদের মধ্যে অনেকে পশুপতিনাথ মন্দিরে পুজো দিতে আসেন। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন।


             পর্যটক সিমুক সাতবাহন :হিমালয়ের ঠান্ডা আবহাওয়া হোক বা গরম- তারা প্রতিটি ঋতুতে জামাকাপড় ছাড়া থাকেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর জন্য ছোটো জিনিসগুলি নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়, যেমন পরিচ্ছন্ন থাকা এবং পোশাক পরিধান করা। অঘোরীরা বিশ্বাস করেন যে তাঁদের কাছে মানুষের সব রোগ নিরাময়ের ওষুধ আছে। তারা মৃতদেহ থেকে অসাধারণ তেল বের করে ঔষধ তৈরি করেন, যা খুব কার্যকর বলে মনে করা হয়। অঘোরী সাধুরা ঘৃণা থেকে দূরে থাকেন। কর্মের উপর ভিত্তি করে ভগবান শিবের প্রদত্ত সবকিছুই তাঁরা গ্রহণ করেন। তাঁদের মতে,পরিত্রাণের জন্য এটা প্রয়োজনীয়।


             পর্যটক যজ্ঞশ্রী সাতকর্নী : তাঁরা নিজের কাপড় ত্যাগ করলেও মৃতদেহগুলি জ্বলন্ত চিতার ছাই দিয়ে নিজের শরীর ঢেকে রাখেন। মানুষের হাড়কে গহনার মতো পরিধান করেন। বলা হয় যে অধিকাংশ অঘোরীদের তান্ত্রিক ক্ষমতা আছে। তাঁরা কালো জাদুও জানেন এবং তাঁরা যখন মন্ত্রকে উচ্চারণ করতে শুরু করেন তখন তাঁদের মধ্যে কিছু অলৌকিক ক্ষমতা আসে বলে মনে করা হয়। অঘোরীরা নারীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেন। কিন্তু তাদের ইচ্ছা না থাকলে স্পর্শ করেন না। তাঁরা শশ্মানের মৃতদেহের সঙ্গেও যৌন সম্পর্ক করেন । পর্যটক  শিশুনাগ :অঘোরী সাধু হওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। টানা ১২ বছর কঠোর সাধনার পর অঘোরী গুরুর আশীর্বাদে নিজের ধর্মীয় যাত্রা শুরু করেন অঘোরী সাধুরা। আর তখনই জন্ম হয় এক চরম সাধকের। যাঁদের বস্ত্র হয় মৃত ব্যক্তির জামা-কাপড়ের ছেঁড়া অংশ। শরীরে থাকে মৃত দেহের ছাই। এখানেই শেষ নয়, এমন সাধকদের সারা জীবন বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়, যেমন- প্রত্যেক অঘোরী সাধু কে একজন গুরুর অধীনে থাকতে হয়। গুরু যা বলেন, সেইভাবে জীবনযাপন করতে হয়। সংগ্রহ করতে হয় মৃতদেহের খুলি, যা তাঁদের সাধনার প্রধান উপকরণ।


          মোল্লা শেখ মোহাম্মদ শাহাদত : নাস্তিকবিদ্বেষীরা আসলেই বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বরে বিশ্বাস না করা একজন মানুষকে খুন/ধর্ষণের দিকে নিয়ে যায়। শাঁকচুন্নিতে বিশ্বাস না করা আপনাকে কোনদিকে নিয়ে যায়? যারা শাঁকচুন্নিতে বিশ্বাস করেন না তাদের করা যেকোনো অপরাধের জন্য কি তাদের শাঁকচুন্নিতে বিশ্বাস না করা দায়ী? স্ট্যালিন একজন নাস্তিক হয়ে একটি খুনী শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেন। তাই দাবি করা হয়, নাস্তিকতা মানুষকে খুনী বানায়। স্ট্যালিন কেবল একজন নাস্তিক ছিলেন না, তিনি একজন পুরুষও ছিলেন। সেইসূত্রে আমরা কি দাবি করতে পারি যে, একজন পুরুষের ‘পুরুষত্ব’ কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী? বা, একজন পুরুষের পুরুষত্বই তাকে খুনী বানায়? বা, পুরুষ হওয়াটা একজন মানুষের ভুল? আমি যদি কোনো ইসলামী সন্ত্রাসের জন্য ইসলামকে দায়ী করি তাহলে আমাকে যারা বলবে, ‘তিনি সহিহ মুসলিম ছিলেন না, তার অপকর্মের দায় তার, ইসলামের নয়’, ঠিক তারাই বিশ্বাস করেন এবং প্রচার করেন যে, স্ট্যালিনের অপকর্ম সমূহের জন্য তার নাস্তিকতাই দায়ী!


              পর্যটক তানসেন :আমি একজন নাস্তিক আর আমার ন্যায়পরায়ণ হওয়ার জন্য ঈশ্বর বা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই। নাস্তিকবিদ্বেষীদের সমস্যা, তারা এই বিষয়টা কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারে না যে ঈশ্বর বা ধর্মে বিশ্বাস না করে একজন মানুষ কিভাবে ন্যায়পরায়ণ হতে পারে। এই বিষয়টি বুঝার মতো মানসিক সামর্থ্য তাদের নেই। যারা নাস্তিকদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, আমার মনে হয় না তাদের অধিকাংশই এবিষয়ে কখনো গভীরভাবে ভেবে দেখেছেন যে ঈশ্বরে বিশ্বাস না করে বা কোনো ধর্মে বিশ্বাস না করে কিভাবে একজন মানুষ ন্যায়পরায়ণ হতে পারে। অধিকাংশ ধর্মবিশ্বাসী আস্তিক মনে করেন, একজন মানুষ ধর্মের কারণে ভালো খারাপের পার্থক্য বুঝতে পারেন, ঈশ্বরের ভয়ে খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারেন। সেইজন্য তারা মনে করেন, যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না বা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন না তারা যেকোনো সময় যেকোনো মানুষকে খুন করতে পারেন, নিজের মা-বোনকেও ধর্ষণ করতে পারেন। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, তাদের ঈশ্বর-বিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাসই তাদেরকে যেকোনো সময় যেকোনো মানুষকে খুন করা বা নিজের মা-বোনকে ধর্ষণ করা থেকে বিরত রাখে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, তাদের মধ্যে ঈশ্বর-বিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাস না থাকলে তারা হয়তো যেকোনো সময় যেকোনো মানুষকে খুন করতে পারেন, নিজের মা-বোনকেও ধর্ষণ করতে পারেন।


              পর্যটক অজিত বসু : বাঙালি জাতি সম্পর্কে নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি একটি মিশ্রিত জাতি এবং এ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিতম মানবগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর বহু জাতি বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছে, অনেকে আবার বেরিয়েও গেছে, তবে পেছনে রেখে গেছে তাদের আগমনের অকাট্য প্রমাণ। বৃহত্তর বাঙালির রক্তে মিশ্রিত আছে বহু এবং বিচিত্র সব নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব। দীর্ঘকাল বিভিন্ন জন ও কোমে বিভক্ত হয়ে এ আদি মানুষেরা বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করেছে, এবং একে অপরের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে শতকের পর শতকব্যাপী। জাতিতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর চারটি প্রধান নরগোষ্ঠীর প্রতিটির কোনো না কোনো শাখার আগমন ঘটেছে বাংলায়। নরগোষ্ঠীগুলি হলো নিগ্রীয়, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় ও অষ্ট্রেলীয়। মনে করা হয় যে, বাংলার প্রাচীন জনগুলির মধ্যে অষ্ট্রিক ভাষীরাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সাঁওতাল, বাঁশফোড়, রাজবংশী প্রভৃতি আদি অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই আদি জনগোষ্ঠীগুলি দ্বারা নির্মিত সমাজ ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে আর্যদের আগমনের পর। বাংলাদেশের জনপ্রবাহে মঙ্গোলীয় রক্তেরও পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙালির রক্তে নতুন করে মিশ্রন ঘটল পারস্য-তুর্কিস্তানের শক জাতির আগমনের ফলে। বাঙালি রক্তে বিদেশি মিশ্রন প্রক্রিয়া ঐতিহাসিককালেও সুস্পষ্ট। ঐতিহাসিকযুগে আমরা দেখি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবং ভারতের বাহির থেকে আসা বিভিন্ন অভিযাত্রী নরগোষ্ঠী বাঙালি জাতি নির্মাণে অবদান রাখতে। গুপ্ত, সেন, বর্মণ, কম্বেজাখ্য, খড়গ, তুর্কি, আফগান, মুগল, পুর্তুগিজ, ইংরেজ, আর্মেনীয় প্রভৃতি বহিরাগত জাতি শাসন করেছে বঙ্গ অঞ্চল এবং রেখে গেছে তাদের রক্তের ধারা। এমনকি পাকিস্তান যুগেও আমরা দেখি রক্ত মিশ্রণে চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এ শংকরত্ব আরো বেগবান হচ্ছে। এক কথায় বাঙালি একটি শংকর জাতি।


              পর্যটক কংসারি হালদার : তবে আধুনিক শংকরতার পরিবেশ থাকলেও আদি জাতি স্বত্ত্বাই বাঙালির প্রকৃত পরিচয়। বৈদিক স্তবগান-স্ত্ততিতে বাংলা অঞ্চলের কোনো উল্লেখ নেই। বৈদিকদের সর্বপূর্ব জায়গা বিহার। ঐতরীয় ব্রাহ্মণে উল্লেখ আছে যে, পূর্ব আর্যবর্তের আরো পূর্বে থাকে দস্যুরা। দস্যুদের কথা অস্তিত্ব ঘোষণা দিয়ে ঐতরীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পুন্দ্র জাতি এবং তাদের রাজধানী ’পুন্ড্রনগর’-এর কথা। বর্তমান মহাস্থান গড়ই সেই দস্যুদের রাজধানী। ঐতরীয় ব্রাহ্মণে না থাকলেও সমকালীন ঐতরীয় আরণ্যকএ বঙ্গ জাতির উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায়। ঐতরীয় রায় দিয়েছে, দস্যুরা পথভ্রষ্ট পাপী কেননা তাঁরা কোনো সত্য গ্রন্থের অনুসারী নয়। রামায়ণ ও মহাভারতে দেখা যায় যে, বঙ্গজরা পাপীতো নয়ই, বরং মিত্রতা প্রতিষ্ঠা করার মতো অতি সম্ভাবনাময় জাতি। রামায়ণে এক তালিকায় রয়েছে কোনো কোনো বঙ্গজ জাতির সঙ্গে আর্যদের মিত্রতা স্থাপিত হয়েছে। মহাভারতে ভীব কর্তৃক পুন্ডবর্ধন ও অন্যান্য কয়েকটি বঙ্গজ জাতিকে বশীভূত করার উল্লেখ আছে। বনপার্বণ গ্রন্থের তীর্থযাত্রা পর্বে পুন্ডনগরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়া গঙ্গার একাংশ করতোয়া নদীকে পবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। এমনিভাবে ধীরে ধীরে বঙ্গজ জাতিগুলি মহাভারতের যুগে এসে আর্যাবর্তের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে মর্যাদার সহিত সম্পৃক্ত হলো।


              পর্যটক ইলা মিত্র :ঐতিহাসিকযুগে এসে প্রথম বঙ্গজ জাতিসমূহের উল্লেখ পাওয়া যায় দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের সঙ্গে ভারত বিজয় অভিযানে আসা গ্রিক ঐতিহাসিকদের লেখায়। তাদের লেখায় উল্লেখ করা হয় যে, পূর্ব ভারতে শক্তিশালী রাজ্যের কথা। গ্রিক এবং অন্যান্য বিদেশি ভ্রমণকাহিনীতে উল্লেখ করা হয়েছে পূর্ব ভারতের বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রের কথা। যেমন, গৌড়, বঙ্গ, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, বাঙ্গালাবাদ, পুন্ড, বারেন্দ্রী, দক্ষিণারাড়, উত্তরা রাধামন্ডল, তাম্রলিপ্তি, পুন্ডবর্ধন-ভুক্তি, সুবর্ণবীথি, বর্ধমানভুক্তি, কঙ্কগ্রাম ভুক্তি, মেঘনা নদীর অববাহিকার কয়েকটি রাজ্য। এসব রাজ্য ও ভুক্তি বৃহৎ বঙ্গের রাজনৈতিক বিকাশধারা, এমনকি বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলার ব্যাপক অংশগ্রহণ নির্দেশ করে। চৈনিক পরিব্রাজকদের দৃষ্টিতে পুন্ড্র রাজ্যের সামুদ্রিক বন্দর তাম্রলিপ্তি ছিল একটি আন্তর্জাতিক সামদ্রিক বন্দর। অর্থাৎ আর্য সভ্যতার পাশাপাশি এবং আর্যদের আগমনের আগেই এই বঙ্গভূমিতে গড়ে উঠেছিল নানা ছোটবড় রাজ্য। মহাভারতের বীরকর্ণ, কৃষ্ণ এবং ভীমসেনা বঙ্গরাজ্যগুলি জয় করে বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। অর্থাৎ সমকালীন যুগে রাজ্যগুলির বিকাশ ও খ্যাতি ছিল এমনই যে, এগুলিকে জয় করার জন্য আর্যবর্ত থেকে এসেছিলেন ঐশ্বরিক শক্তিধর বীরেরা।


              পর্যটক ভূপাল পাণ্ডা :বাঙালি জাতি পরিচয়ের ঐতিহাসিক যুগ শুরু হয় গুপ্তযুগ (৩২০ খ্রি.- ৬৫০ খ্রি.) থেকে এবং এ যুগেই প্রথম ক্ষুদ্র রাজ্যপুঞ্জগুলিকে নিয়ে গঠিত হয় বিশাল রাজ্য। যেমন গুপ্তদের সাম্রাজ্যিক ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ক্ষুদ্র রাজ্যের বদলে বৃহৎ রাজ্য যেমন পূর্ব ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বঙ্গরাজ্য ও উত্তরাঞ্চলের গৌড় রাজ্য। বৃহৎ বঙ্গের প্রথম এবং ঐতিহাসিকভাবে সুনির্দিষ্ট এবং শক্তিশালী শাসক।  শশাঙ্ক (খ্রিস্টপূর্ব আনু ৬০০ খ্রি.-৬২৫ খ্রি.) তাঁর দক্ষ শাসনের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তখন থেকেই বাঙালি জাতিসত্ত্বার যাত্রা শুরু এবং পাল ও সেন আমলে এসে সে সত্ত্বা আরো বিকশিত হয়ে বাঙালি জাতির শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে।


              পর্যটক আজম খান : ঠিক কি নাস্তিকদেরকে যেকোনো সময় যেকোনো মানুষকে খুন করা থেকে বিরত রাখে? ঠিক কি নাস্তিকদেরকে ধর্ষণ করা থেকে বিরত রাখে? আমি একজন নাস্তিক এবং আমি মানুষকে খুন করা থেকে বিরত থাকি, আমি মানুষকে ধর্ষণ করা থেকে বিরত থাকি। কারণ আমি তা করতে চাই না। ধর্মবিশ্বাসী আস্তিকরা মনে করেন, যদি আকাশ থেকে কোনো ঈশ্বর তাদের ওপর নজর না রাখেন তাহলে তারা যতখুশি খুন যতখুশি ধর্ষণ করতে পারেন, যা আমি করতে চাই না। আমার কোনো ইচ্ছা নেই কারো শ্বাসরোধ করার, আমার কোনো ইচ্ছা নেই কাউকে যন্ত্রণা দেয়ার। আমি শান্তিপূর্ণভাবে এবং নির্ভয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আমার লক্ষ্য, আমার প্রতিবেশীদের সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করা ও তাদের সহযোগী হওয়া আর এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা যেখানে আমি নির্ভয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে পারবো এবং আমার প্রতিবেশীরাও নির্ভয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে পারবে, যাদেরকে ছাড়া আমি নির্ভয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে পারবো না। আর সেজন্য কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই।


    কাশিম খান :নাস্তিকতা কি কোনোভাবেই কোনোকিছুর কারণ? ধরুন, আমি একটি হ্রদে সাতার কাটতে চাই, তবে সেই হ্রদে সাতার কাটা নিষিদ্ধ। কেউ যদি সেই হ্রদে সাতার কাটে তাহলে তাকে ৩০০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে। সেই হ্রদে সাতার কাটার ওপর জরিমানা আরোপ করা হয়তো আমাকে সেই হ্রদে সাতার কাটা থেকে বিরত রাখবে। ঠিক একইভাবে, কোনো ঈশ্বর যদি আমাকে চুরি/খুন/ধর্ষণ ইত্যাদি অপকর্মের জন্য জাহান্নামের ভয় দেখায় তাহলে আমার দ্বারা সেইসব অপকর্ম হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। ধর্মবিশ্বাসী আস্তিকরা মনে করেন, ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস যদি একজন মানুষের দ্বারা খুন/ধর্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করে, তাহলে ঈশ্বরে অবিশ্বাস একজন মানুষের দ্বারা খুন/ধর্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে’। না, এরকম ধারণা একদমই ভুল। আমি যদি সেই হ্রদে সাতার কাটতে চাই তাহলে সেই হ্রদে সাতার কাটার ওপর জরিমানা আরোপ হওয়াটা আমাকে তা থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে। তবে, আমি যদি সেই হ্রদে সাতার কাটতে না চাই এবং সাতার কাটার জন্য যদি কোনো জরিমানা না থাকে, তাহলে জরিমানা না থাকাটা আমার মধ্যে সাতার কাটার ইচ্ছে তৈরি করবে না। আমি যদি জেনে থাকি, সেই হ্রদের নিচে প্রচুর ধনদৌলত লুকানো আছে, তাহলেই আমার সেখানে সাতার কাটার ইচ্ছা তৈরি হতে পারে। অবশ্যই কোনো বাধ্যকারী কারণ থাকতে হবে যা আমাকে বাধ্য করবে কাজটি করতে।


    যুবরাজ মুরাদ: ঈশ্বরে বিশ্বাস না করাটা কোনোকিছুর জন্যই কোনো বাধ্যকারী কারণ নয়। নাস্তিকতার মূলে কোনো নিয়ম-নীতি নেই, কোনো আদেশ-নিষেধ নেই, কোনো উপদেশাবলি নেই, কোনো বৈধতা-অবৈধতা নেই। আস্তিকরা এক বা একাধিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব দাবি করে এবং নাস্তিকরা তাদের দাবি বিশ্বাস করে না। ‘আমি কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ এবং ‘আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বর বলে কিছু নেই’, এই কথা দুটির কোনোটাই কোনো নিয়ম বা আদেশ নয়। এই কথা দুটির কোনোটাই কোনোকিছুর বৈধতা বা অবৈধতা প্রকাশ করে না। একজন নাস্তিক কি করলো না করলো তার দায়ভার নাস্তিকতার না। ঠিক যেমন একজন শাঁকচুন্নিতে অবিশ্বাসী কি করলো না করলো তার দায়ভার শাঁকচুন্নিতে অবিশ্বাস করার না।স্ট্যালিনের সমস্যা তার নাস্তিক হওয়ায় নয়, বরং একজন খুনি সর্বগ্রাসী একনায়ক হওয়ায় ছিলো!


            নাস্তিক যুবক : তত্ত্ব হিসেবে হয়তাে স্বীকার করা চলে নানা ধরনের বিশিষ্ট অভিজ্ঞতার মধ্যে একজাতের অভিজ্ঞতাকে ‘ধর্মীয় অভিজ্ঞতা নামে দেওয়া যায়। আকাশ, সমুদ্র, হিমালয়ের আনস্ত্যের সান্নিধ্যজাত বিস্ময়, প্রথম প্রেমের গভীরতার উপলব্ধি, শিল্পসৃষ্টির অভিনিবেশ ও আনন্দ, জটিল বৌদ্ধিক সমস্যার আকস্মিক বিদ্যুৎক্ষিপ্ৰ সমাধান, মাদকসেবনের কল্যাণে সেবকের চেতনায় বিবিধ অবাস্তব রূপ ও ঘটনাবলীর সাময়িকরিশমানতা—এসব বিভিন্ন জাতীয় অভিজ্ঞতা আমাদের প্রাত্যহিক খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, কাজকর্মের অভিজ্ঞতা থেকে বেশ কিছুটা অন্য ধরনের। হয়তাে বা ধর্মীয় অভিজ্ঞতা এদেরই মতাে বিশিষ্ট এবং স্মরণীয় কোন অভিজ্ঞতা যা সকলের প্রাত্যহিক জীবনে না ঘটতে পারে। কিন্তু কোন অভিজ্ঞতাকে সম্ভাব্য অভিজ্ঞতা হিসেবে মানার অর্থ নয় যে বিশ্বাসী ঐ অভিজ্ঞতার যে অর্থ আরােপ করেছেন সেটি বিনা প্ৰমাণ-পরীক্ষায় মেনে নেওয়া হচ্ছে। মদ্যপানের মাত্রা বাড়ালে মাতাল ব্যক্তি চোখের সামনের বস্তুকে দ্বিগুণিত রূপে দেখেন ; তাঁর দেখাটা মােটেই অবিশ্বাস্য নয়, শারীরবৃত্তে তার ব্যাখ্যাও মেলে, কিন্তু যে বস্তুটি তিনি দেখেছেন সেটি বাস্তবে দ্বিগুণিত হয় না। সিদ্ধিসেবী তার পায়ের নিচের পথকে ঢেউ খেলানাে ভাবতে পারেন, হাওয়ায় উজ্জীন গােলাপি হাতির লাবণ্য তাকেগৰ্দগদচিত্ত করতেও পারে, কিন্তু ফলে সমতল পথে চড়াই উৎরাই রচিত হয় না, গােলাপি হাত্তি হওয়ায় ওড়ে না। যাঁদের সচরাচর ‘মরমী’ বলা হয়। তারাই সম্ভবত ধর্মীয় অভিজ্ঞতায় সিদ্ধাঠাদের সেই অভিজ্ঞতার উপাদান নিয়ে তাদের কল্পনা নানা রূপ রচনা করে এবং অনেক সময় প্রতীকের সূত্রে কিংবা কবিতায়, গানে, ছবিতে আকার নিয়ে সেই রূপ অন্যদের কাছে পৌঁছােয়। এসব থেকে তাঁদের অভিজ্ঞতার সততা ও কল্পনার সমৃদ্ধতার পরিচয় মেলে, কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা ও কল্পনার বাইরে কোন দেবতার বা তুরীয় লােকের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে না। ধর্মীয় অভিজ্ঞতা অবশ্যই মনস্তত্ত্বের আলােচ্য বিষয়, কিন্তু ঐ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কোনাে অধিবিদ্যাত্মক প্রস্তাব দাঁড় করানাে অযৌক্তিক।


             পর্যটক স্যামুয়েল বেকেট : অবচেতনা কি?প্রায় আমি ভাবতে চেষ্টা করি ।অবচেতনা বলতে ঠিক কি বুঝায়।আমার কাছে যা মনে হয় তা হল যে কাজটি মানুষটি একে বারে ভাবনা চিন্তা ছাড়াই মনের অন্তরাল থেকে প্রাকৃতিক ভাবেই করে তাই অবচেতনা।আচ্ছা মানুষ কি সব কাজ ভেবে চিন্তেই করে নাকি অবচেতন মনে করে।আমার মনে হয় যে মানুষ সব চেয়ে বেশী কাজ করে অবচেতন মনে।প্রতিটি মানুষের থাকে একটি মন যার একটি অংশ অবচেতন।অবচেতন মন এক অদ্ভুদ অংশ যা দ্বারা মানুষ কল্পনা করতে পারে সব কিছু বাস্তব অবাস্তব সব কিছু।মানুষ হিসাবে মানুষের প্রতি প্রেম ভালবাসা আবেগ অনুভূতি এটা কি চেতন নাকি অবচেতন মনের অংশ?যে কাজটা আমার খুব বেশী জরুরী তাই হচ্ছে অবচেতন মনের কাজ।আসলে সব কাজ চেতনা নিয়ে করতে হয় না যেমনটা পৃথিবীতে সব কিছু জানতে হয় না কিছু জিনিষ অজানা থাকাই ভালো তেমনি অবচেতনা ও।মানুষ হিসাবে আমারো আছে ঐ একটি অবচেতন মন।যার মাধ্যমে আমি সৃষ্টি করে নিয়েছিলাম এক চরিত্র যার সাথে কোনদিন আমার দেখা হয় নি হয় নি কোন কথা।হয়তবা বাস্তবে তার অস্তিত্বও নাই কোন।সে শুধুই কল্পনা এটাই হচ্ছে অবচেতন মনের একটা কারসাজি।মানুষের এই অবচেতন মনের একটা বড় ভূমিকা আছে মানুষের সাথে ।এই অবচেতন মনই মানুষকে সপ্ন দেখায় বাঁচবার ।কেউ তার অবচেতন মনকে পারে না করতে অস্বীকার আমি জানি আমি কি কি আমার হ্মমতা আর জানি আমার সীমাবদ্ধতা ।অবচেতন মনেই এই কথাগুলা বলছি।প্রতিটি লাইনের আগেই জানতাম না পরের লাইন কি হবে।আমায় ঐ মন ঠিকই আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে ।আমি ভালবাসি না।প্রতিটি কাজ করছে এই অবচেতনা ।মানুষের জন্য এই অবচেতন মন সত্যিই গুরুত্বপূর্ন একটা ব্যাপার।আচ্ছা মনকে কি আদৌ দেখা সম্ভব?আমার খুব দেখতে মন চায় ।কেউ যখন তার গার্লফ্রেন্ডকে বলে যদি বল তোমাকে আমার মন খুলে দেখাতে পারি তখন আমার বলতে ইচ্ছা হয় ওরে ছাগল পারলে দেখা তো দেখি।আমার যে অদ্ভুদ ইচ্ছা গুলা আসে সবই ঐ অবচেতন মনের অংশ।এই অবচেতন মন নিয়ে থাকতে চায় যতদিন বেঁচে আছি এই ধরনীতে।


              পর্যটক আলী কাদির হাসান আলী মির্জা খান বাহাদুর :মানসিক দাসত্ব করতে শরীর খাটাতে হয় না, বরং মনমানসিকতা ও বিবেককে বিক্রি করে নিজ সত্তাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। নিয়োগকর্তার স্বার্থ রক্ষার্থে সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করা এবং মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করে বিনিময়ে শাসকগোষ্ঠীর সুদৃষ্টি অর্জন করে নিজ ও পরিবারের জন্য সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আদায় করার নামই মানসিক দাসত্ব। এ ধরনের দাসের সংখ্যা বিশেষ করে কথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ, কলকাতামনস্ক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ প্রবণতা এখন সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতিককালে কথিত বুদ্ধিজীবীদের সাথে পাল্লা দিয়ে সরকারি আমলাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য, যারা সংখ্যায় মোটেও কম নয়, মানসিক দাসত্বের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার ফলে জনগণ এখন আর সাধারণত সত্যের আলোর মুখ দেখতে পায় না।


              পর্যটক আজাদ উদদৌলা বাবর আলী খান বাহাদুর :মানুষের জন্যই সভ্যতা। গর্ব করে বুক ফুলিয়ে মানুষ দাবি করে বলে, ‘মানুষ হলো সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি’। সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির স্বীকৃতির একমাত্র উপাদান মানুষের ‘বিবেক’। অনেক পশু রয়েছে যারা অনেক চতুর বা চালাক, অনেক সাহসী, অনেক শক্তিধর। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে তারা বিবেকসম্পন্ন হয় না বলে তাদের ‘পশু’ বলা হয়। তবে মানবজাতির মধ্যে কিছু মানুষ রয়েছে যাদের কর্মকাণ্ড পশুত্বকেও হার মানায়। পশুত্ব থেকে দু’পা বিশিষ্ট মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য যুগে যুগে শতাব্দীতে সৃষ্টিকর্তা বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন যাদের কেউ অনুকরণ করে, কেউ করে না। মানুষ মাত্রই ‘বিবেক’ রয়েছে, কিন্তু পশুত্ব, লোভ, কামনা-বাসনার কাছে কোথাও কোথাও মানুষের বিবেক হার মেনে যায়, তখন কি শুরু হয় মানসিক দাসত্ব? ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ বলতে যা বোঝায় তা পৃথিবীতে এখন বিরল প্রজাতির মতোই একটি দুষ্প্রাপ্য বিষয়। মানসিক দাসত্বের কারণে মানুষ হয়ে পড়ে বিবেকবর্জিত এবং যাদের বিবেক চলে গেছে তাদের পক্ষে যেকোনো কাজ করা সম্ভব যা চার পা-বিশিষ্ট পশুরা করে থাকে।


              পর্যটক মিশেল ফুকো : নকশাল আন্দোলন কলকাতার ছাত্র সংগঠনগুলোর ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল।[৯] ছাত্রদের একটি বড় অংশ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিপ্লবী কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছিল। বিশেষত নামকরা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্ররা প্রভাবিত হয়েছিল এই আন্দোলনে। চারু মজুমদার বলেছিলেন বিপ্লবী কার্যক্রম শুধুমাত্র গ্রামাঞ্চলে চালিয়ে গেলেই চলবে না, বরং একে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। তিনি নকশালদের শ্রেণীশত্রু খতম করার নির্দেশ দেন। এ শ্রেণীশত্রুদের মধ্যে যেমন ছিল ভূস্বামী তেমনি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুলিশ অফিসার, রাজনীতিবিদ এবং আরও অনেকে। সে সময় কলকাতার সব স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নকশালপন্থী ছাত্ররা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিয়ে তার মেশিন শপে পুলিশদের সাথে লড়ার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করেছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজ ছিল তাদের সদর দফতর। তারা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডাঃ গোপাল সেন কে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল।


              পর্যটক গায়ত্রী চক্রবর্তি স্পিভাক :নকশালরা অল্পসময়ের মধ্যে ভারতের শিক্ষিত সমাজের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল। দিল্লীর “সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ” তাদের বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এরপর সরকার নকশালদের কে শক্ত হাতে দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় নকশালদের উপর প্রতি-আক্রমণের নির্দেশ দেন। পুলিশকে কিছু মানবতা বিরোধী ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল নির্বিচারে হত্যা এবং অকারণে যে কাউকে বন্দী করার ক্ষমতা। লক -আপ হত্যা, জেলবন্দী হত্যা ও ভূয়ো সংঘর্ষ দ্বারা পুলিশ বিভিন্ন সময় নকশালপন্থীদের হত্যা করেছে। এক মাসের ভেতরে সরকার পর্যটক জাক দেরিদা : নকশাল আন্দোলন দমন করেছিল। “ নকশালদের শক্ত হাতে দমন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই” ভারত সরকার এবং পুলিশের মনোভাব ছিল এমনি। তারা দেশের জনগন কে এ কথাও ভাল ভাবে বুঝিয়েছিল যে “দেশ এখন ঐ চরমপন্থীদের সাথে গৃহযুদ্ধে নেমেছে, এ যুদ্ধে গণতন্ত্রের নামে পরিহাসের কোন স্থান নেই। কেননা ঐ চরমপন্থীদের কাছে গণত্ন্ত্র মূল্যহীন”। এর ফলে দেশবাসীর কাছে নকশালদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যায়, আর তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলরা মুখ ফিরিয়ে নেয়।


             পর্যটক জাক লাকাঁ : অর্ন্তকোন্দলের কারণে আন্দোলনে ছেদ পড়ে। দলের একটি বড় অংশ চারু মজুমদারের নির্দেশিত পথের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ১৯৭১ সালে সিপিআই(এম-এল) ভেঙে দু টুকরো হয়ে যায়। চারু মজুমদারের দল থেকে সত্য নারায়ন সিং বেরিয়ে যান। ১৯৭২ সালে চারু মজুমদার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং আলীপুর জেলে নিহত হন। তাত্ত্বিক নেতা সরোজ দত্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি, সম্ভবত তাকে হত্যা করা হয়। পলিটব্যুরোর অন্যতম নেতা সুশীতল রায়চৌধুরী আত্মগোপন থাকা অবস্থায় মারা যান। প্রধান নেতৃবর্গের বড় অংশই জেল বন্দী হন। পরে নকশালপন্থী দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) বহু ধারা উপধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। অনেক বছর পরে অন্যতম প্রধান নেতা কানু সান্যাল ২০১০ সালের ২৩শে মার্চ পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ী থানার হাতিঘিষা গ্রামের নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। শারীরিক অসুস্থতা সইতে না পেরে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।


             পর্যটক জুলিয়া ক্রিস্তেভা : সম্প্রতি ২০০৯ সালের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের লালগড়ে পুলিশদের তাড়িয়ে দেয় এবং ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মিদের উপর হামলা চালায়। এ এলাকায় মাওবাদী জঙ্গীরা তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে এই অভিযোগে রাজ্য সরকার জুনের প্রথম দিকে পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান চালিয়ে লালগড় পুনরুদ্ধার করে। মাওবাদী নেতা কিষেনজি এক সাক্ষাতকারে বলেন- “তারা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন বাম এবং তাদের পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেদের জন্য মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে চায়। আর তারই শুরু হিসেবে তারা লালগড়ে ঘটনাটি ঘটিয়েছে। ১৯৭০ সালের পরে তারা আবার সংগঠিত হয়েছে আর ২০১১ সাল নাগাদ কলকাতাতে তারা সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনা করবে।  সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় এই যে, রাষ্ট্রও মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। যখন শাসকগোষ্ঠী মনে করে, মিথ্যা বলা ছাড়া জনগণকে ধোঁকা দেয়া যাবে না, তখনই রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে প্রচার শুরু করে। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রের ওপরেও জনগণের আস্থা কমে গেছে। পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রচারযন্ত্রগুলোও কোথাও সরকারের বা কোথাও মালিকের স্বার্থ রক্ষা করে, প্রয়োজনে ‘সত্য’কে জলাঞ্জলি দিচ্ছে।


                   পর্যটক ফেরাদুন জা মনসুর আলী খান বাহাদুর : ‘বিবেক’ সব সময়ই সত্যের সন্ধানে থাকে, কিন্তু ব্যত্যয় হয় তখনই যখন লোভ, বৈষয়িক প্রতিপত্তি ও চাওয়া-পাওয়ার কামনা-বাসনা মনের ভেতর গভীরভাবে বাসা বাঁধে। ‘সত্য’কে মানুষ তখনই পরিহার করে যখন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আশা আকাঙ্ক্ষা প্রকট আকার ধারণ করে। গেরুয়া পোশাক পরে ‘সাধু’ হওয়ার সংখ্যাই এখন বেশি, ‘মন’ রাঙিয়ে ‘সাধু’ হওয়া অর্থাৎ মনে-প্রাণে ‘সাধু’ হওয়ার আধিক্য এখন কোথায়? সবাই বলি ‘সত্য’ সুন্দর অথচ এই সুন্দরকেই আমরা পরিহার করি যখন মানসিক দাসত্ব আমাদের মন-মগজে বাসা বাঁধে।


            পর্যটক চারু মজুমদার : তিতুমীর ওরফে সৈয়দ মীর নিসার আলী, ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ওয়াহাবী আন্দোলন এর সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁর জন্ম  চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়া থানার হায়দারপুর গ্রামে । ১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জ করতে যান, সেখানে আরবের স্বাধীনতা-নেতা সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন আর ফিরে এসে তিতুমীর তার গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে হিন্দু জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এবং তার অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে ‘তাহ্‌বান্দ’ নামে এক ধরনের পোশাক পরতে শুরু করেন। তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় ৫,০০০ গিয়ে পৌঁছায়।তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়। ১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসতের কাছে বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তারা বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। তিতুমীর  চব্বিশ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাদের সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেন নি। ১৪শে নভেম্বর তিতুমীর ও তার চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তার বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ বা গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।


                 পর্যটক ফের্দিনঁ দ্য সোস্যুর :সিলেট ও চট্টগ্রামের ভাষা মান্য বাংলার থেকে খুব আলাদা, আমরা জানি। মান্য উড়িয়া, মান্য অসমিয়া বরং মান্য বাংলায় কথা বলা মানুষ সহজে বোঝেন। সিলেট এবং চট্টগ্রাম – এ দুটী প্রান্তিক অঞ্চল প্রাচীন এবং মধ্যযুগে দেশজ শাসনে থাকাকালীন, এই ঐতিহাসিক সময়টায় সেভাবে গৌড়ের অধীনে ছিল না। ফলে ভাষাটা মান্য বাংলার সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে ইন্টিগ্রেটেড হয়নি। মুসলমান আক্রমণের পরে ইন্টিগ্রেটেড হয়েছে রাজনৈতিকভাবে, ধর্মীয়ভাবে, কিন্তু মান্য বাংলা ভাষার সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড হওয়ার সুযোগ মেলেনি, কারণ, রাজপুরুষরা, সরকার, সবাই ফার্সি ব্যবহার করেন। এর তুলনায় মৈথিলি, অসমিয়া, উড়িয়াভাষী অঞ্চল প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের, গৌড়ের শাসনে থেকেছে, ফলে এ ভাষাগুলি মান্য বাংলার বেশি কাছাকাছি।এর তাৎপর্য হল, মধ্যযুগে তুর্ক–পাঠান–মোগল–ইরানি–আরব মুসলমান শাসনেই বাঙালি জাতির উৎপত্তি – এরকম যে একটা তত্ব বাজারে চালু আছে, সেটি সর্বৈব ভুল। জাতিগঠনের কাজ করার জন্য স্বজাতির শাসক থাকা বাঞ্ছনীয়। বরং, উপরের উদাহরণ থেকে দেখবেন, মধ্যযুগেই বাঙালি সাংস্কৃতিক একীকরণ বাধা পেয়েছে। ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় আকারে দুর্গাপুজো তো শুরুই হল সিরাজকে সরানোর পরে।


             পর্যটক নোম চমস্কি : বাঙালি শব্দটি এইভাবে চর্যার সময় থেকে ক্রমে বিবর্তিত হয়েছে। চৈতন্য নিজেকে বাঙালি বলতেন না, পুরো আন্দোলনটিই গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন নামে পরিচিত। রামমোহনও নিজেকে বাঙালি বলতেন না। এদের বাদ দিলে তো বাঙালির ইতিহাস লেখা যাবে না। অর্থাৎ গঙ্গারিডাই জাতিকেও বাঙালির মধ্যে ধরতে হবে, সেটাই যৌক্তিক। বাঙালির সংজ্ঞা নমিনাল নয়, বাঙালির সংজ্ঞা নামমাত্র নয়।বাঙালির সংজ্ঞা ভাষাবাদীও নয়। উনিশশো কুড়ি সাল নাগাদ যশোরের একদল গ্রামবাসী পুলিসের কাছে এজাহার দিতে গিয়ে বলছেন এ গ্রামে মোটে পাঁচ ঘর বাঙালি, বাকি সব মুসলমান, আমি অনেকবার সুনীল গাঙ্গুলির “আমি কি বাঙালি” বইটা থেকে উদ্ধৃত করেছি বহুবার। শরৎচন্দ্রে বাঙালি ও মুসলমানের ফুটবলের উল্লেখ আছে, সেটা শরতের সাম্প্রদায়িকতা নয়, বাঙালি শব্দের ঐতিহাসিক অর্থই বোঝায়। মধ্যযুগে এদেশের দেশজ সংস্কৃতির ধারক বাহককে বাঙালি বলতেন বিদেশী শাসক, শাসকদের এজেন্ট সুফি–পীরগণ এবং তাদের দ্বারা ধর্মান্তরিত মুসলমানেরা। বাংলার মুসলমান নিজেকে বাঙালি মনে করত না। উনিশশো পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামির উত্থান, আওয়ামি মুসলিম লিগ নামে দলটির জন্ম, এরপর পশ্চিম পাকিস্তানকে সফলভাবে চ্যালেঞ্জ করার জন্য হিন্দু ভোটের প্রয়োজনে দলের নাম থেকে মুসলিম ছেঁটে ফেলা, পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা বাংলাভাষী মুসলমানের বংগালি বলে চিহ্নিত হওয়া, হেয় এবং অপমানিত হওয়া। এবং সেই ভাষা আন্দোলন। ফলে বাঙালির একটা ভাষাবাদী সংজ্ঞা তৈরির পেছনে পাকিস্তানের, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানের বড় ভূমিকা আছে।


             পর্যটক সুকুমার সেন :বাঙালিত্ব কি, সেটা বুঝতে গেলে সর্বাগ্রে বাঙালিকে একটা fetish এ পরিণত করা বন্ধ করতে হবে। বাঙালিকে ইতিহাসের ফ্রেমে পুনর্স্থাপিত করতে হবে, বাঙালি বড় বেশি শেকড়বিচ্ছিন্নভাবে বেঁচে আছে। যেমন কালী হলেন আমাদের শক্তি উপাসনার মূর্ত প্রতীক। কালীর পায়ের তলায় শিব বা রাধাকৃষ্ণ হলেন প্রকৃতিপুরুষ দ্বৈতবাদের মূর্ত প্রতীক। এবং এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাঙালিকে দেখতে হবে, সেখানে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সৃষ্ট কালীপ্রতিমার প্রাচীনত্ব বিবেচ্য নয়, গঙ্গারিডাই বা পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে মা কালী ছিলেন কি ছিলেন না, সেটা ধর্তব্য নয়। আগেই বলেছি, চৈতন্যও নিজেকে বাঙালি বলতেন না। তাতে কিছু যায় আসে না, ওঁকে বাদ দিয়ে বাঙালি হয় না।


                নব্যনাস্তিক যুবতী : বাঙালি তাহলে কবে জন্মালো ?


                 সমাধিবউদি : দেশভাগের দিন ।


             পর্যটক হুমায়ুন আহমেদ :আধুনিক যুগের আগে জাতীয়তাবাদ ছিল না, জাতিচেতনা ছিল না, কথাটা বহুল প্রচলিত, এবং সর্বাংশে ঠিক নয়। স্টিভেন গ্রসবি বলছেন্‌ বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টেও জাতিত্ব এবং জাতিচেতনা দেখা যাচ্ছে। যাই হোক, উপমহাদেশে একটা আশ্চর্য হিস্টোরিওগ্রাফি দেখা যায়, আধুনিক শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্বের উত্থানের বহু আগে থেকেই শ্রেণীসংগ্রাম ছিল, শ্রেণীচেতনা ছিল, এরা সবাই একমত। কিন্তু বঙ্কিম এ জিনিসটা “পশ্চিম থেকে আমদানি” করার আগে জাতীয়তাবাদ ছিল না।


    পর্যটক গাজি মালিক সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুগলক শাহ: খেলা হবে খেলা হবে ।


    পর্যটক মুহাম্মাদ বিন তুগলক সুলতান মোহাম্মদ আদিল বিন তুগলক শাহ : ইনকিলাব জিন্দাবাদ :


    পর্যটক ফিরোজ শাহ তুগলক সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলক : খেলা হবে খেলা হবে ।


    পর্যটক তুগলক খান ইবন ফতেহ খান ইবন ফিরোজ শাহ সুলতান গিয়াস উদ দিন তুগলক শাহ : মরো সালে।


    পর্যটক আবু বকর খান ইবন জাফর খান ইবন ফতেহ খান ইবন ফিরোজ শাহ সুলতান আবু বকর শাহ: কৌন?


    পর্যটক মোহাম্মদ শাহ ইবন ফিরোজ শাহ সুলতান মোহাম্মদ শাহ : ইনকিলাব জিন্দাবাদ ।


    পর্যটক হুমায়ুন খান সুলতান আলাউদ্দিন সিকান্দার শাহ : কৌন কমবখত বরদাশত করনে কো পিতা হ্যায় ? হম তো পিতে হ্যায় কি য়হাঁ পর বৈঠ সকে, তুমহে দেখ সকে, তুমহে বরদাশত কর সকে….


    পর্যটক মুহাম্মদ শাহ ইবন মুহাম্মদ শাহ সুলতান নাসির উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ তুগলক : খুদা কে ওয়াস্তে পর্দা না কাবে সে উঠা জালিম, কঁহি এইসা না হো ইয়া ভি ওয়াহি কাফির সনম নিকলে, কঁহা মেয়খানে কা দরওয়াজা গালিব অর কঁহা ওয়াইজ, পর ইতনা জানতে হ্যাঁয় ওহ যাতা থা কে হাম নিকলে…হাজারো খোয়াইঁশে এইসি কে হার খোয়াইশ পে দম নিকলে, বহোত নিকলে মেরে আরমান, লেকিন ফির ভি কম নিকলে…”


    পর্যটক নুসরাত খান ইবনে ফাতেহ খান ইবনে ফিরোজ শাহ সুলতান নারিরুদ্দিন নুসরাত শাহ তুগলক : ম্যায় ভি খ্যায়েফ নহিঁ তখতা-এ-ডর সে, ম্যায় ভি মনসুর হুঁ কহ দো অঘয়ার সে, কিঁউ ডরাতে হো জিন্দন কি দিওয়ার সে, জুল্ম কি বাত কো জাহিল কে রাত কো, ম্যায় নহিঁ মানতা ম্যায় নহিঁ জানতা…


              পর্যটক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় : জাতীয়তাবাদ সর্বদাই একটি কোর্স কারেকশন হিসেবে উঠে আসে। বাঙালি, পশ্চিম–মুগ্ধ বাঙালি, হিন্দু কলেজের বাঙালি, ইয়ং বেঙ্গলের বাঙালি একটা নির্দিষ্ট পথে চলছিল। বঙ্কিম ছিলেন ইতিহাসের কোর্স কারেকশন। বঙ্কিম যখন বলছেন বাঙালির ইতিহাস চাই নইলে বাঙালি মানুষ হবে না, তখন একটা কোর্স কারেকশন করছেন। এবং বঙ্কিম ব্যক্তিগত উদ্যোগেই কাজ করেছেন, কোনও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ছিল না। হরপ্রসাদ যখন কাজ করছেন তখন, রাজেন্দ্রলাল মিত্রর এশিয়াটিক সোসাইটি পাশে ছিল, পরে ইংরেজ আশ্রিত এশিয়াটিকের বদলে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ স্থাপিত হয়েছিল, যদিও হরপ্রসাদ সে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন বৃদ্ধ বয়েসে, তার কাজকর্মে হতাশ হয়ে। ঠিকই করেছিলেন। দীনেশ সেনের কাজ স্যার আশুতোষ এবং তাঁর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছত্রছায়ায়। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক, দার্শনিক, সাংস্কৃতিক ডিসকোর্স নানা কারণে আগে গড়ে ওঠেনি, এবং সপ্তডিঙার আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্পষ্ট রূপরেখা দেওয়ার কাজ কেউ করেনি। বাংলাদেশের ‘ওরা’ আর পশ্চিমবঙ্গীয় ‘এরা’ যেটা করেছেন বাঙালির নামে, সেটাকে ভাষাবাদ বলা উচিত, বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয়। 


              নাস্তিক যুবক: বাঙালি তাহলে কবে জন্মালো ?


              সমাধিদাদা : রবীন্দ্রসঙ্গীতের গ্রামোফোন রেকর্ড হবার পর ।


                           পর্যটক বাজিরাও পেশওয়া : প্রেমে পড়েননি এমন মানুষ পৃথিবীতে বোধহয় একজনও পাওয়া যাবে না। এই প্রেমের জন্য আমি অমর । আমি মাস্তানির সঙ্গে প্রেমে পড়েছিলুম ; কিন্তু আমরা ধর্ম বদলাইনি । মাস্তানির গর্ভে আমার ছেলে মুসলমান ; কাশিবাঈয়ের গর্ভে আমার ছেলেরা হিন্দু । কেউই এই প্রেমকে লাভ জিহাদ বলেনি ।  প্রেম নিয়ে নানা তবে প্রেমে পড়ার পেছনে রয়েছে অনেক মনস্তাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক কারণ। মনোবিদ ও ব্যবহার বিশেষজ্ঞদের মতে, হরমোনের নানা কারণ, চারপাশের অবস্থান, পরিস্থিতি এসব কারো সঙ্গে মতের মিলের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রেম মানে না কোনো বাঁধা, মানে না কোনো যুক্তি তর্ক। যে কারণে দিনক্ষণ ঠিক করে কারো জীবনে প্রেম আসে না। তবে যাই হোক, প্রেম তো আসে। প্রথম প্রেম বা ভালোবাসা প্রতিটি মানুষের কাছেই একটু বেশিই স্পেশাল। অনেকে বলেন ‘চাইলেই কি প্রথম প্রেম ভোলা যায়?’। জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের কথা কেউ কোনো দিন চাইলেও ভুলতে পারে না। যে কারণে জীবনে হাজারবার প্রেম আসলেও প্রথম প্রেমের জায়গা কেউ দখল করে নিতে পারে না । এর পেছনে রয়েছে মনোবিদদের নানান ব্যাখ্যা।  গবেষকরা বলছেন, প্রথম প্রেম টিকে না উঠলে বা পরিপূর্ণতা না পেলে অনেকে পরবর্তীতে হয়তো অনেকবার প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। কিন্তু সেই সব প্রেমের অভিজ্ঞতা ছাপিয়ে মনে দাগ কেটে আছে প্রথম প্রেমের স্মৃতি। প্রথম প্রেমের মধুময় কিছু যন্ত্রণা, কিছু পাওয়া না পাওয়ার অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখে মনকে। হৃদয়ে এতোটাই জায়গা করে নেয় যে কারণে কয়েক যুগ পরও মানুষের স্মৃতি আবেগী হয়ে উঠে সেই প্রথম প্রেমের কথা মনে পড়ায়। যদি কারো প্রথম সম্পর্কে কোনো ভয়ের ঘটনা বা স্মৃতি থাকে তাহলে তো মনে থাকাই স্বাভাবিক। বিপরীতে মানুষকে ভালোবাসার কথা বলার সময় প্রত্যাখ্যান হওয়ার ভয়, তার প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে, পারিবারিকভাবে কোনো ঝামেলা হওয়ার ভয় এবং প্রেম হওয়ার পর শুরুর দিকে আশা পূরণ করা নিয়ে শঙ্কা, সম্পর্ক টিকে উঠবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি ভয়ভীতি কাজ করে। এখানে উদ্বেগই মূল বিষয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রথম প্রেম অনেকটাই ‘স্কাইডাইভ’ বা প্রথমবার আকাশ থেকে লাফ দেয়ার মতো। প্রথমবার আকাশ থেকে লাফ দেয়ার ঘটনা যেভাবে স্মৃতিতে গেঁথে যায় পরবর্তীকালের কোনো ঘটনা আর হৃদয়ে থেকে যায় না। কারণ প্রথমবার আকাশ থেকে লাফ দেয়ার সময় সর্বোচ্চ ভয় কাজ করে যা পরবর্তীতে থাকে না।         


            পর্যটক বুল্লে শাহ : ১৬ই মে ১৯৭৯, যেদিন মরিচঝাঁপিতে দন্ডকবন থেকে আগত উদ্বাস্তু বিতাড়ন শেষ হল, সেদিন আসলে কী ঘটেছিল? মরিচঝাঁপি দ্বীপ তখন ঘিরে ফেলেছে পুলিশের লঞ্চ এবং অসংখ্য নৌকো। অপারেশনের পুরো দায়িত্ব জ্যোতি বসুর উত্তর দক্ষিণের দুই ম্যান ফ্রাইডের। পেছনে পুলিশ কর্তা আর কলকাতায় বসে সরাষ্ট্র সচিব। অনাহারি, তৃষ্ণার্ত, তবু বাঁচবার স্বপ্নে মশগুল মানুষগুলো হোগলার ছাউনি-ঘেরা ঘরে। সারাদিনের পরিশ্রমে জোগাড় করা চাল কাঠের আগুনে ফুটছে। টগবগ শব্দ হচ্ছে। এই শব্দ উনুনের চার পাশে বসা বাচ্চাগুলোর কানে বিজয়ী অশ্বখুরের ধ্বনি তুলছে- । ঠিক তখনই দলীয় মস্তানরা নিঃশব্দে ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিল। মরিচঝাঁপির আকাশ রাঙা হয়ে উঠল। আগুনলাগা ঘরের চালগুলো শিশু, বৃদ্ধ মানুষগুলোকে গ্রাস করল। ওই যুবা প্রতিবাদী উদ্বাস্তু নেতাকে খুন করে ফিরে এল অন্য মস্তানদের সঙ্গে। তার মনেও পড়ল না, সর্বগ্রাসী আগুনের আলোয় নিজের পিতাকেই সে হত্যা করে গেল। নদী সমুদ্র ঘেরা মরিচঝাঁপি দ্বীপে ন্যূনতম জীবনধারণের প্রয়োজনেই কুমিরমারি থেকে পানীয় জল, চাল ইত্যাদি আনতে হত। ছোট ছোট কাঠের ডিঙি বানিয়ে উদ্বাস্তুরা তাঁদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই অলক্ষ্যে থাকা রাজনৈতিক প্রভুদের নির্দেশে রাজ্য পুলিশ ডিঙি ডুবিয়ে ওঁদের শুধু ভাতে মারাই নয়, জীবনহানিও ঘটাত। বলাই বাহুল্য এই নৌকাডুবিগুলো দেশি বা আন্তর্দেশীয় আইন-বিরোধী কাজ। পঞ্চাশটা নৌকো ভর্তি কাঠ নিয়ে মরিচঝাঁপির মানুষজন দ্বীপে ফিরছিলেন। মাঝদরিয়ায় সেই নৌকোগুলো ডুবিয়ে দেওয়া হয়। কাঠ তো গেল নদীগর্ভে। আর মানুষগুলো? কারা ওই নৌকো ডোবালো? মেলেনা উত্তর। যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন, সেই দলগুলোই, অর্থাৎ সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি-ই কি বহু বছর ধরে বলে আসেননি যে পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পাঠাবার কোনও প্রয়োজন নেই? তাঁদের নেতারাই কি দীর্ঘদিন ধরে প্রচার করেননি যে, পশ্চিমবঙ্গেই এদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার মতো পর্যাপ্ত জমি আছে? তাঁরাই কি সর্বতোভাবে উদ্বাস্তুদের বোঝাবার চেষ্টা করেনি যে, আন্দামান বা দন্ডকারণ্যে যাওয়া মানে তাঁদের সর্বনাশ হয়ে যাওয়া? অথচ মরিচঝাঁপি কেমন ছিল সেই ১৯৭০ দশকের শেষ পাদে? প্রায় ১২০ বর্গমাইল ব্যাপ্ত মরিচঝাঁপি সুন্দরবনের সুন্দরী গড়ানের বনভূমি। আর এদিকে কুমিরমারি বাগনার বিস্তৃত অংশ। এখানে সেখানে নারকেল গাছ। জলকাদায় ভরা জমিতে হোগলা আর শীর্ণকায় ছোট গাছগাছড়া। মাঝের উঁচু জমির অংশে সবুজ ঘাস। উপরে নীল আকাশ। ভরা বর্ষায় মাটির সোঁদাগন্ধ। ঝড় আর বাতাস, বন্যা আর সমুদ্রের বানভাসি আশঙ্কায় ভরা সেই প্রায় নির্জন মরিচঝাঁপির দিনরাত। এসবের কথা আশ্চর্য মায়াময়তায় ফুটে উঠেছে অমিতাভ ঘোষের ‘দ্য হাঙরি টাইড’ উপন্যাসে। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের শরিক দলগুলো নিজেদের প্রাককথন আর রাজনৈতিক উত্থানের কথা ভুলে না গিয়ে, পুলিশকর্তা আর ক্যাডারদের না নামিয়ে যদি দ্বীপটি মনুষ্যহীন না করতেন, তবে ওই মরিচঝাঁপিই আজ সমৃদ্ধিতে ভরভরন্ত হয়ে উঠতো। মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তু আগন্তুকরা আসার অল্পদিনের মধ্যেই জায়গাটা সাফসুতরো করে বাসযোগ্য করে তুলেছিল। বেশ কিছু নলকূপ বসিয়েছিল। তবে নোনা জলের জন্য সেই অতি অগভীর যন্ত্রগুলো কার্যকর হয়ে ওঠেনি। দরকার ছিল সরকারি সাহায্যের। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার তো প্রথম থেকেই বাম। তাই রায়মঙ্গল এবং আরও দু’টি নদী পেরিয়ে ওঁদের পানীয় জল এবং খাদ্য আনতে হতো। দ্বীপে ছোট ছোট গাছ ছাড়াও কিছু মোটা বেড়ের বড় গাছ ছিল। ঝড়ের কবল থেকে ওইগুলিই দ্বীপটিকে সুরক্ষা দিতে পারত। কিন্তু জীবিকার প্রয়োজনে কিছু গাছ কেটে ওঁরা ডিঙ্গি নৌকো বানিয়েছিলেন। মাটির রাস্তা ঘাট প্রস্তুত করেছিলেন। ছাউনি দিয়ে স্কুলবাড়িও তৈরি হয়েছিল। গোলমালটা লাগল ঠিক এমন সময়েই। শুরু হয়ে গেল মিথ্যাপ্রচার। বড় বড় পুলিশ কর্তার আগমন ঘটল। ফিসফিস প্রচার শুরু হলো – বিদেশী কোনও বড় শক্তি এইসব খেতে-না-পাওয়া চর্মসার মানুষগুলোকে অর্থ, অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। বড় বড় পিচের রাস্তা তৈরী করে সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশের সাহায্যে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ সুন্দরবন-সংলগ্ন মরিচঝাঁপি থেকে তার সম্প্রসারণের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। অতএব বোঝাই গেল নিরন্ন হাঘরে উদ্বাস্তুদের মরিচঝাঁপির মেয়াদ শেষ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার পুলিশ বাহিনী দিয়ে প্রায় ঘিরে ফেললো দ্বীপটিকে। নেতৃত্ব দিলেন অমিয় সামন্তদের মতো পুলিশের বড় কর্তারা। খাদ্য, পানীয় জল নিয়ে যাওয়া বন্ধ করলেন। ১৯৭৮-এর নভেম্বর মাস নাগাদ অখন্ড চব্বিশ পরগণার পুলিশের ‘সামন্ত’তন্ত্র ব্যারিকেড তৈরি করল। যাতে মরিচঝাঁপির মানুষজন বাগনা, কুমিরমারি ইত্যাদি অঞ্চল থেকে পানীয় জল আর খাদ্যসংগ্রহ করতে না পারেন। হাইকোর্ট মানবাধিকার রক্ষার্থে পুলিশের এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে রায় দিল। তখন খাদ্যপানীয় সংগ্রহের দেরি ঘটিয়ে আস্তে আস্তে মানুষগুলোর শক্তিক্ষয় করিয়ে দেওয়া হয়। হোক না আদালত অবমাননা। তারপর এল সেই ভয়ংকর দিন। মে মাসের এক গভীর রাতে দু’শো পুলিশ আর সাধারণ নৌকোয় দু’হাজার ক্যাডার দিয়ে ঘিরে ফেলা হলো মরিচঝাঁপি। আগুন দেওয়া হলো বাড়িগুলোতে। উদ্বাস্তু বোঝাই কিছু নৌকো ডুবিয়ে দেওয়া হলো। আর কিছু শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, উদ্বাস্তু নেতাকে ধরে বেঁধে আনা হল হাসনাবাদ রেলওয়ে স্টেশনে। কিছু আগুনে পোড়া মানুষ নদীর কুমীর-কামটের পেটে গেলেন। 


                     সমাধিবউদি : বাঙালিরা কী করছিল ?


                     নব্যনাস্তিক যুবতী : আজ্ঞে, বাঙালিরা তখনও জন্মায়নি । বাঙালি জন্মেছে বাংলা টিভি আসার পর।


                     পর্যটক গৌতম বুদ্ধের শিষ্য মহাবজ্রাসন :  মায়ানমার থেকে দলে দলে রোহিঙ্গা মানুষ চলে আসছেন বাংলায়।  রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসেব অনুযায়ী অগাস্টের পঁচিশ তারিখ একটি রোহিঙ্গিয়া জঙ্গিগোষ্ঠী রাখাইন প্রদেশের একাধিক থানা এবং সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালানোর পর একলক্ষ ছেচল্লিশ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গিয়া শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এঁরা বলছেন, মায়ানমারের সেনা এবং স্বঘোষিত আইনরক্ষকরা গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, মেয়েদের পাকড়াও করে ধর্ষণ করেছে।  গুলিও চালিয়েছে তারা। 


           পর্যটক ইমাদউদ্দিন মুহাম্মদ বিন কাসিম আল সাকাফি : কিন্তু আপনারা কি জানেন যে  তারাই একদিন বাঙালিদের জীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছিল ? এরাই তো মগ, বাঙালির জীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছিল এককালে। মায়ানমারের আরাকান জাতির অন্তর্গত এরা। মগ ভাষা আরাকানি ও বাংলা ভাষার মিশেল । এক সময় রাজার অত্যাচারে ওরা চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছিল। ফলে তাদের ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে মগভাষার উৎপত্তি হয়। অনুমিত। মগবর্ণমালার নাম ‘ঝা’।  মগভাষায় বড় ছেলেমেয়েকে বলে ‘চোগরি’, কিন্তু বাংলায় কিশোর-কিশোরীকে বলা হয়  ছোকরা-। আত্মীয়সূচক কিছু মগশব্দ বাংলায় ব্যবহূত হয়, যা উচ্চারণ ও অর্থে এক; আবার কোনো কোনো টিতে অর্থের কিছু তারতম্য ঘটেছে। যথা: বাবা, বাজী, মা। আঞ্চলিক বাংলায় বাবা, বাজী সমার্থক, কিন্তু মগভাষায় বাজী মানে জেঠা। মগরা ছোট মেয়েকে বলে ‘মা’, কিন্তু আঞ্চলিক বাংলায় মেয়েকে আদর করে বলা হয় ‘মা’। । আরাকানিদের মধ্যে মগরা অন্যতম প্রধান  গোষ্ঠী। এখন তারা সপরিবারে জলে ভাসছে ।


                পর্যটক কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ : ব্রিটিশ আমলে সিধু – কানহু, বিরসা মুণ্ডাদের জন্য বরাদ্দ ছিল ফাঁসির কাঠ। “পরিবর্তিত” সময়ে আপনাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার যাবজ্জীবন কয়েদের ব্যবস্থা। জেলগুলিতে চলে এক তীব্র অনাচার। বন্দীদের বরাদ্দ খাবার, তেল, সাবান, থালা, বাটি, কম্বল, ফিনাইল থেকে ওষুধ অবধি সবই চুরি করে জেল প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা; জেলকোডকে পদদলিত করে বন্দীদের উপর চলে শারীরিক পীড়ন; ইন্টারভিউ ব্যবস্থা দেখলে মনে হবে চিড়িয়াখানার জন্তু দেখা হচ্ছে; তুই–তোকারি করে কথা বলা (এমনকি বয়স্ক বন্দীদের ক্ষেত্রেও!) এখানকার নিত্য অভ্যাস। জেলের পরিভাষায় – নতুন আসা বন্দীদের ‘আমদানি’ করা হয় অথবা বেরিয়ে যাওয়া ‘খরচা’ দেওয়া হয় – এর থেকেই বোঝা যাবে কেমন মানুষের মর্যাদা পান জেলের গারদের আড়ালে থাকা বন্দী ভাই, বোনেরা! চিকিৎসা ব্যবস্থা এমনই যে সুস্থ লোকেরা এখানে অসুস্থবোধ করেন আর অসুস্থ হলে বাঁচার আসা কম; উৎকোচ সংস্কৃতির এতটাই রমরমা যে, পয়সা না দিলে এখানে কোন কাজই হয় না; সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এতোই খারাপ যে, চোর এখানে এসে ডাকাত হয়, আর ডাকাত হয় সুপারি কিলার; মদ–গাঁজা–হেরোইনের রীতিমতো ব্যবসা চলে জেলের ভিতর – এমতাবস্থায় আপনাদের মতো সেইসব বন্দীরা – যারা সংবেদনশীল, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন; ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে নয়, মানুষের অধিকার রক্ষার কারণে আন্দোলন করতে গিয়ে জেলবন্দী; তারা কেমন থাকতে পারে তা বোঝার জন্য খুব একটা কষ্ট কল্পনার আশ্রয় নিতে হয় না!


            সমাধিদাদা : বাঙালিরা কী করছে ?


            যুবক নাস্তিক : আজ্ঞে বাঙালিদের এখনও জন্ম হয়নি ।


             বটগাছের টঙ থেকে সবকটা কাগজ ওড়াতে-ওড়াতে আমি, হাবশি বেতাল, বলি : দুনিয়াতে আপনার আশেপাশে এমন আইটেম সবসময় পাইবেন, যার সাথে আপনার সর্বোচ্চ ধৈর্য্য দিয়া কথা কইতে চাইবেন, খুব কুল থাকতে চাইবেন, বলার সময় নিজেরে অটো সাজেশন দিতেই থাকবেন যে, যা কিছুই হয়ে যাক আপনি মাথা ঠান্ডা রাখবেন। কিন্তু শালার এমনই মেটেরিয়াল যে, এতো চেষ্টার পরেও জাস্ট তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে সে অত্যন্ত সফলতার সাথে আপনার পায়ের রক্ত মাথায় তুইলা দিবে। তখন সেই মাথার তালুর গরমে ভাত, রুটি, মুড়ি, পপকর্ণ, খই, লাড্ডু যাই রাখেন না কেন সব ফুটতে থাকবে টগবগায়ে।

         
         
         
         
         
         
         
         
         
         
         
       
  • মিত্রোখিন | 106.214.180.221 | ০৭ আগস্ট ২০২২ ১৮:৩৪738161
  • মিত্রোখিন আরকাইভ !
    After the Second World War that saw the Allied powers winning a trouncing victory against the Axis, ideological differences began to emerge between the USSR and USA. While the Soviets pushed Communism and Socialism in countries, the US spread democracy and capitalism through proxy civil wars in various countries. The end of World War II led to the sun finally setting on the British Empire, with countries such as India gaining independence from the British Raj and many other colonies also being freed. The end of the Second World War also witnessed the grand era of espionage led by CIA and KGB; espionage agencies of the two powers.
    Vasili Mitrokhin, a KGB spy who later defected to the United Kingdom, revealed many secret documents and information to the world through his archives called ‘Mitrokhin Archive’. In the archives, there are several chapters dedicated to India and the Gandhi family. After India gained independence in 1947, attention of the two espionage agencies diverted to India. Both the countries wanted to gain indirect control of the country, since it would give them control over a potential regional power. In the chapter ‘The Special Relationship With India’ (Part 1: The Supremacy of the Indian National Congress), Mitrokhin reveals that Joseph Stalin had a rather poor opinion of Jawaharlal Nehru, the first Prime Minister of India. According to the archives, Stalin regarded Nehru and Mahatma Gandhi as “imperialist puppets” who bowed before the British and betrayed their people, helping the British tighten their hold over India. Despite his harsh words for the PM, Nehru often praised the Communist revolution of Soviet Russia and took inspiration from it.
    After becoming Prime Minister, Nehru paid a diplomatic visit to the USSR, where each incident was ‘carefully staged’. According to Mitrokhin, the Soviets were eyeing India as a ‘playground’ for CIA and KGB agents. After Indira Gandhi (given the codename ‘Vano’ by Mitrokhin) became Prime Minister, the KGB managed to infiltrate deeper into the Indian government. Mitrokhin reveals that Indira Gandhi was given 20 million rupees in exchange for crucial information, and to the surprise of Soviet chiefs, didn’t even return the bag in which she received the money. Like Nehru, Indira Gandhi too was made to believe that the Communist revolution of Russia was a ‘beaming light’ for the world, and often praised the ‘revolutionary’ principles followed in Soviet factories which were carefully staged during her visits.
    The concerns arise when Mitrokhin claims that 7 cabinet ministers from the Congress party were elected due to Soviet funding during the regime of Indira Gandhi, while the defense minister during Nehru’s tenure (V. Krishna Menon) was also given Soviet backing. Mitrokhin Archives claim that due to Soviet backing and influence, former defense minister V. Krishna Menon purchased Soviet MiGs instead of British lightnings after his election campaign got funded by KGB in 1962 and 1967.The archives also reveal the Soviet connections of the Communist Party of India. According to Mitrokhin, the CPI was funded in multiple ways by the Soviets; and had received funds in several bizarre ways including through car windows during Delhi traffic! At several instances, the Intelligence Bureau of India had intercepted transfer of funds to the Party treasury of CPI from the USSR, to which Nehru chuckled saying that the Soviets had “underestimated” India’s intelligence. However, he didn’t realise that the Soviets had penetrated deep into Indian embassies and were extracting information via their agents. As per Mitrokhin, many Indian diplomats abroad were seduced (and later blackmailed into revealing classified information) by female KGB agents called ‘sparrows’.
    By 1972, the KGB had over 10 Indian newspapers under their payroll and had apparently planted over 3,500 articles in Indian newspapers.The Archives of Mitrokhin also claim that in the 1977 elections, campaigns of 21 non-communist leaders were financed by the KGB. Under the Nehru-Gandhi regime, espionage wasn’t uncommon in India and the country had become a playground for foreign espionage agencies.
    While countries like the UK and USA formed special committees to investigate the claims made by Mitrokhin, the UPA-1 government led by Congress party dismissed the claims and didn’t form any committee to investigate his claims. While the world looks at the archives as the most sensational counter-intelligence document, India did not perform a single enquiry into the archives. The Congress party dismissed the claims without any investigation or enquiry. There is much to be revealed about the dark history of the Grand Old Party of India, and Mitrokhin’s archives show us the tip of the iceberg of the dirty history of India’s opposition party.
  • মলয় রায়চৌধুরী | 106.215.24.94 | ৩০ আগস্ট ২০২২ ১১:৩৯738303
  • গলগণ্ড : মলয় রায়চৌধুরীর উত্তরাধুনিক নভেলা

    –বড়োমামা,  তুমি নাকি ইনডিয়ার ডেফিনিশান তৈরি করে ফেলেছো ?
    –হ্যাঁ তো । 
    –দেশকে ডিফাইন করা যায় ?
    –কেন যাবে না ভোম্বোল ? তোকে  দেশের জীবনের সংজ্ঞায়িত মুহুর্তগুলোকে একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়তে হবে। দাঁড়া, বেশ দীর্ঘ, পড়ে শোনাতে হবে আমার ডায়রি থেকে । বিন্তি, আমার কালো রঙের ডায়েরিটা এনে দে তো । 
    –এই নাও । 
    –শোনাও, শোনাও, প্লিজ ।
    –শোন, মন দিয়ে । স্বদেশের ডেফিনিশন । কাটমানি, কালোবাজার, কালোটাকা, ঘুষ, নজরানা, উৎকোচ, হাওয়ালা, স্মাগলিঙ, গরু পাচার, কয়লা পাচার, মেয়ে পাচার, গণধর্ষণ, ডাকাতি, খুন, তহবিল তছরূপ, ভর্তি কেলেঙ্কারি, নারদা, সারদা,  কর্পোরেট কেলেঙ্কারি, জালিয়াতি, নোটনকল, রোজভ্যালি, চাকরি বিক্রি, দলিল কারচুপি, জিপ কেলেঙ্কারি, এলআইসি কেলেঙ্কারি, বেনামি সম্পত্তি, টেলিকম কেলেঙ্কারি, এইচডিডব্লিউ সাবমেরিন কেলেঙ্কারি, জেএমএম ঘুষ কেলেঙ্কারি, তানসি ল্যান্ড ডিল কেলেঙ্কারি, বিটুমেন কেলেঙ্কারি, ইউরিয়া কেলেঙ্কারি, লটারি কেলেঙ্কারি, অনন্তনাগ পরিবহন সাবসিডি কেলেঙ্কারি, তেলগি স্ট্যাম্প পেপার কেলেঙ্কারি, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট, নির্বাচনে টিকিট বিক্রি, জোচ্চুরি, কাজের বরাত, নদীতটের বালি বিক্রি,  পনজিস্কিম কেলেঙ্কারি, চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারি, ফাটকা জোচ্চুরি,  কালোটাকা সাদা করা, সাংবাদিক হত্যা, শেল কোম্পানি, সত্যম কেলেঙ্কারি, কমনওয়েল্থ গেমস কেলেঙ্কারি, মাদক পাচার, জাল ওষুধ বিক্রি, ব্যাপম কেলেঙ্কারি, আদর্শ হাউসিঙ কেলেঙ্কারি, কার্টেল, সুইসব্যাঙ্কে লুকোনো টাকা, নীরব মোদি জালিয়াতি, ক্রিকেটে গড়াপেটা, ললিত মোদির ক্রিকেট কেলেঙ্কারি, বিজয় মাল্য আর্থিক কেলেঙ্কারি, বিষমদ কাণ্ড, আসল বোতলে নকল ব্ল্যাক লেবেল-শিভাস রিগাল, বেআইনি লেনদেন, এবিজি শিপইয়ার্ড ব্যাঙ্ক জালিয়াতি, রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন-রাজীব গান্ধী চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট কেলেঙ্কারি, ন্যাশানাল হেরাল্ড কেলেঙ্কারি , আলি বুদেশ, আনিশ ইব্রাহিম, দাউদ ইব্রাহিম, হাসান আলি খান, আবদুল লতিফ, হাজি মস্তান, টাইগার মেমন, ইয়াকুব মেমন, ভরদারাজন মুদালিয়ার, ছোটা রাজন, ছোটা শাকিল, বক্সার ভাদিভেলু, বীরপ্পন, হেরোইন, আফিম, কোকেন, গুণ্ডা, মস্তান, অমিত ভরদ্বাজ, মেহুল চোকশি, সয়েফ দরবার, রাজকিশোর দত্ত, রজত গুপ্ত, হরশদ মেহতা, নটওয়রলাল, শিবাজী পাঁজা, রামালিঙ্গা রাজু, জি জনার্দন রেড্ডি, আবদুল করিম তেলগি, মুখতার আনসারি, ঠগ বেহরাম, লরেন্স বিশনোই, দিলীপ বুয়া, রঞ্জিত চিমা, মায়া ডোলাস, কোলি ফয়াজ, ভিকি গোস্বামী, সান্তোখবেন জাদেজা, এম পি জয়রাজ, বিনদি জোহাল, এজাজ লাকড়াওয়ালা, করিম লালা, ভুরা মুঞ্জা, নায়িম, রবি পুজারী, মুথাপ্পা রায়, ছোটা রাজন, গোপাল রাজওয়ানি, কোতওয়াল রামচন্দ্র, আবু সালেম, অগ্নি শ্রীধর, শ্রীপ্রকাশ শুক্লা, মানয়া সুরভে, হরিশংকর তিওয়ারি, আক্কু যাদব, ডি পি যাদব, মায়া ডোলাস, আনন্দপাল সিং, নির্ভয় গুজ্জরম মণীন্দ্রপাল সিং, জালিয়াৎ, অপহরণকারী, চন্দ্রমোহন শর্মা, ধন্না সিং,এম জয়শংকর, রিপার জয়নন্দন, চন্দ্রকান্ত ঝা, মোহন কুমার, রভিন্দর কুমার, মোট্টা নাভাস, সন্তোষ পোল, রমণ রাঘব, উমেশ রেড্ডি, সতীশ, দেবেন্দ্র শর্মা, দরবারা সিং,আশারাম, ফলাহারিবাবা, এম জয়শংকর, মনিন্দরপাল সিং কোহলি, বিট্টি মোহান্তি, সুনীল রস্তোগি, উমেশ রেড্ডি, সতীশ, দরবরা সিং, তাঁতিয়া ভীল, ফুলন দেবী, কোলি ফয়াজ, ইথিক্কারা পাক্কি, জম্বুলিঙ্গম নাদার, জগ্গা জাট, সীমা পরিহার, শিবকুমার প্যাটেল, কোতওয়াল রামচন্দ্র, দেবেন্দ্র শর্মা, মান সিং, পানসিং তোমার, কিরণজিত সিং আহলুওয়ালিয়া, নভজ্যোত সিং সিধু, হংসরাজ গঙ্গারাম আহির, প্রেমচন্দ গুপ্তা, এস জগতরকশাকন, শ্রীপ্রকাশ জায়সওয়াল, নবীন জিন্দল, মধু কোডা, দাসারি নারায়াণা রাও, সুবোধকান্ত সহায়, রাডিয়া টেপ, অজয় সিং চৌতালা, পুরুষোত্তম নরেশ দ্বিবেদী, পাপ্পু কালানি, রামনিবাস গোয়েল, বালমুকুন্দ গৌতম, মায়া কোডনানি, সজ্জনকুমার, বীর সিং মাহতো, বিক্রম সিং মাজিথিয়া, রশিদ মাসুদ, জগন্নাথ মিশ্রা, ভুরা মুঞ্জা, নীললোহিতাদাসন নাদার, ফ্রানসিসকো পাচেকো, রাজু পাল, আর বালকৃষ্ণ পিল্লাই, মনোজ প্রধান, প্রবোধ পুরকাইত, গোপাল রাজওয়ানি, সাহি রাম, সুখ রাম, সুরেশ রাণা, ভি কে শশীকলা, টি এম সেলভাগণপতি, মোহম্মদ শাহাবুদ্দিন, জগদীশ শর্মা, রাধারমণ শাস্ত্রী, বিজয়কুমার শুক্লা, তাহির হুসেন সিদ্দিক, অক্ষয়প্রতাপ সিং, আনন্দমোহন সিং, অনন্তকুমার সিং, প্রভূনাথ সিং, সঞ্জীব সিং, সুরজভান সিং, মোহম্মদ সুর্তি, প্রেম খাণ্ডু থুঙ্গন, শেখর তিওয়ারি, সান্দ্রা ভেঙ্কটা ভিরাইয়া, আনন্দসেন যাদব, মহেন্দ্র যাদব, বন্যপ্রাণীর দেহাংশ বিক্রি, জুলুমবাজি, দাঙ্গা, সন্ত্রাস, সুপারি কিলিঙ, শিশু চুরি, অবৈধ গর্ভপাত, ছিনতাই, এনকাউন্টার, মিত্রোখিন পেপার্স, হিংসা, হপ্তাউসুলি, ডাকাতি, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, প্রোটেকশান মানি ।
    –আরে ! এতো দারুন ! তুমি তো পুরো দেশটা কভার করে ফেলেছো। 
    –এই কথাগুলো শুনলে আমার কিন্তু বেশ রাগ আর ঘৃণা হয় ।
    –বুঝলেন মেজকাকু,  রাগ হল এমন অনুপ্রেরণামূলক আবেগ যা একজন মানুষের মগজে এই ভাবনার জন্ম দেয় যে সে অন্যদের, অন্যকিছু, অন্যঘটনা  নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বা পারতো।সমাজকে আর সমাজের আর পরিবারের লোকেদের মধ্যে বদল ঘটাবার  ক্ষমতা তার আছে ; ব্যাপারটা তার নিজের সম্পর্কে  উচ্চ মূল্যায়নের। অর্থাৎ, দুঃখের মতো অন্য নেতিবাচক আবেগের উল্টোদিকে , যেখানে 'মোকাবিলা করার সম্ভাবনা' দৃষ্টান্তমূলকভাবে কম ।
    –তুই এমন কথা বলিস শীর্ষেন্দু ! রাগারাগির কী আছে ? সেই ঘটনাটা মনে আছে তোর ? সেই ত্রিভূবনদাস ভিমজি জাভেরির দোকানে নকল সিবিআই অফিসারদের ডাকাতি হয়েছিল , যে ঘটনা নিয়ে অক্ষয়কুমারের স্পেশাল ছাব্বিশ নামে একটা ফিল্ম হয়েছে । দু কোটি টাকার গয়না আর নগদ নিয়ে চম্পট সেই নকল সিবিআই অফিসার আজও ধরে পড়েনি ।
    –তবে ? আমাদের দেশ বলতে অমন সজ্ঞাকে গুরুত্ব দিতে হবে ।
     
    – কমলবাবু,আপনাকে একটা জলবিভাজক ঘটনা মনে করিয়ে দিই । ১২ মার্চ ১৯৯৩ তারিখে, ১২টা পরপর বিস্ফোরণ মুম্বাইকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায় আর ৭০০ জনেরও বেশি ঘায়েল হয়। ঘটনাটার নাম 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' আক্রমণ। এই বোমা হামলায় প্রথমবার আরডিএক্স  ব্যবহার হয়েছিল। গ্যাংস্টার দাউদ ইব্রাহিম কাসকর আর টাইগার মেমন আর ওদের দোসররা এই হামলার পরিকল্পনা করেছিল  বাবরি মসজিদ ধ্বংসের  প্রতিশোধ হিসাবে। বিস্ফোরণগুলো ২ ঘন্টা ১০ মিনিট ধরে ঘটেছিল ।  বিস্ফোরণে ২৭ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । দুপুর দেড়টায় বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের বেসমেন্টে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। এর পরেই কাথা বাজার, দাদারের শিবসেনা ভবন, এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিং, মাহিম কজওয়ের ফিশারম্যানস কলোনি, সেঞ্চুরি বাজার, জাভেরি বাজার, হোটেল সি রক, প্লাজা সিনেমা, হোটেল জুহু সেন্টার আর পাসপোর্ট অফিসে বিস্ফোরণ ঘটেছিল । ওরা প্রথমে শিবাজি জয়ন্তীর দিন বিস্ফোরণ ঘটাবার পরিকল্পনা করেছিল।  ৯ মার্চ দাঙ্গার জন্য পুলিশ টাইগার মেমনের দলের  গুল মোহাম্মদ শেখ ওরফে গুল্লুকে গ্রেপ্তার করার পরে পরিকল্পনাটা পালটে ফেলেছিল । গুল্লু মুম্বাইয়ের  বোমা বিস্ফোরণের  পরিকল্পনার কথা পুলিশকে বলে ফেলেছিল , কিন্তু  পুলিশ ভেবেছিল লোকটা ফালতু বকছে।  মুম্বাই পুলিশ বিস্ফোরণের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ঘটনার অপরাধিদের চিহ্ণিত করে ফ্যালে। ততোক্ষণে টাইগার মেমন, তার ভাই ইয়াকুব আর দাউদ ইব্রাহিমের ভাই আনিস ইব্রাহিমসহ বেশ কয়েকজন প্রধান আসামি  দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ইয়াকুব মেমনকে পরে ১৯৯৪ সালে গ্রেপ্তার করা হয় আর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মামলায় দাউদ ইব্রাহিম আর টাইগার মেমনসহ ৩৫ জন এখনও ফেরার। আবু সালেম, করিমুল্লাহ শেখ আর অন্য চারজনকে ২০১৭ সালে  বিশেষ আদালত এই মামলায় দোষী পায় আর তারা এখন জেল খাটছে।
    – কী করব ! তোর উচ্চারিত শব্দগুলো তো ক্রোধ আর ঘৃণাই জাগায় !
    –ইনডিয়া ইজ নট ডিফাইনেবল লাইক পাকিস্তান অর বাংলাদেশ ।  আমার ফ্ল্যাটের সামনের মারোয়াড়ি পরিবারও মাঝে-মাঝে ওদের তরকারি দিয়ে যায় । ওদের দুই ভাইয়ের একদিন হাতাহাতি হয়েছিল কে কোন ঘরে শোবে তা নির্ণয় করা নিয়ে । বড়ো ছেলের বউয়ের দুটো মেয়ের পর ছেলে চাইছিল; গর্ভবতী হয়ে গেছে সেকথা বাড়িতে বলেনি, সলিলাকে দিয়ে প্রেগনেন্সি কিট আনিয়ে শিয়োর হয়েছিল । গণেশপুজোর সময়ে তিন ঘণ্টা লাইন দিয়ে লালবাগের রাজা নামে বিখ্যাত গণেশের কাছে মানত করেও মেয়ে হলো । একই সময়ে বউটার বোনের ছেলে হয়েছিল, তৃতীয়বার ছেলে । সন্তান বদলাবদলি করে নিলো, কিন্তু ক্রমে টের পেলো ছেলেটা কথা বলতে পারে না । ইতিমধ্যে ছোটো বউটার ছেলে হওয়ায় ছোটো ছেলের কদর শশুর-শাশুড়ির  কাছে বেড়ে গেছে । ছেলে পাবার জন্য ছোটো ছেলেটার বউ রোজ সকালে সাই মন্দিরের গরুকে তুলসীপাতা খাওয়াতে যেতো । দুই ভাইয়ের মারামারির সমাধান করার জন্য ওদের বাপ রিটায়ার করে যে টাকা পেয়েছিল সেই টাকায় কাছেই একটা ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাট কিনেছে । বড়ো ছেলেকে সেখানে শিফ্ট করে দিলো ।  বড়ো ছেলেটার মেয়ে দুটো আমাদের ন্যাওটা হয়ে গিয়েছিল । আর এদিকে আসে না ।
    –যেহেতু আমাদের দেশটা এতই কলুষিত, মিথ্যা-আক্রান্ত, অস্থির, অতিরঞ্জিত আর  অন্যায্যতায় ঠাশা,  নিজের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যা অনুভব করা যায় শুধু তাই বিশ্বাস করা উচিত ।  ভারতের যে কোনও জায়গার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ ইন্দ্রিয়কে শক্তিশালী করে তোলে। এই কারণে, বাঙালিরা যদিও অদক্ষ মন্ত্রী, স্থানীয় নেতা, অধ্যাপক, আমলা, সাংবাদিক আর জোচ্চোর ব্যাবসাদারদের  সহ্য করে, কিন্তু  রবীন্দ্রসঙ্গীত , ধ্রুপদী নৃত্য, নাটক, টেলিভিশন, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, বাংলাখাবারের অযোগ্যতা সহ্য করবে না। বিশৃঙ্খলা,  দুর্যোগ আর প্রতারণার এই দেশে, কখনও কখনও শুধুমাত্র সৌন্দর্যকে বিশ্বাস করা যেতে পারে।  আনন্দ নিয়ে দর কষাকষি করা যাবে না । আর ক্ষুধার্তের কাছে  খাবারই একমাত্র স্বর্ণমুদ্রা ।
    —তুমি যখন ভেরিভিকেশানে নোট পোড়াবার অফিসার ছিলে, তখনও তো নোটের পাহাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে ।
    –হ্যাঁ, পচা, স্যাঁতসেতে, চটচটে, ছাতাপড়া, দুর্গন্ধে হাঁপিয়ে পড়ার পাহাড় । ভাগ্যিস ওই চাকরি ছেড়ে গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরিটা পেলুম । কিন্তু সেসময়ে কাউন্টিঙ মেশিন ছিল না ; হয়তো ছিল, আমাদের দেশে আমদানি হয়নি । আমার স্টাফরা হাতে গুনতো,ওদের যেকটা প্যাকেট দিতুম স্যাম্পল কাউন্টিঙের জন্য । ওদেরও হাতে আর লাংসে নানা অসুখ দেখা দিতো, যদিও অফিস থেকে অ্যাসপিরিনের কোটা ছিল । এখন আর হাতে গুণতে হয় না, মেশিনেই গোনা হয়, বড়ো মেশিন, এক লপ্তে দশ-কুড়ি হাজার গুনে প্যাকেট আর বাণ্ডিল তৈরি হয়ে যায় । আমার সময়ে নোট নষ্ট করার জন্য ইনসিনারেটরে পোড়ানো হতো, এখন নোটগুলো মেশিনে শ্রেডিঙ করে তার পাল্প তৈরি হয়।
    –সুন্দরী মেয়েরা সব সময় দেখি বিটকেল চেহারার পুরুষদের পছন্দ করে ।  
    –যেমন মেরি সেটন, যিনি ভি. কে. কৃষ্ণমেননের প্রেমে পড়েছিলেন। ওনাদের সম্পর্কের ভাঙনের ফলে ১৯৩৫ সালে কৃষ্ণমেননকে লণ্ডনের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল । ব্যর্থ প্রেমে উনি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন । মেরি সেটন  ছিলেন একজন অভিনেত্রী এবং একজন দক্ষ শিল্প, থিয়েটার, চলচ্চিত্র সমালোচক, যিনি তার সারা জীবন একজন সমাজবাদী ছিলেন, ১৯৮৫ সালে মারা যান। তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন সেটনের মেয়ে,  ভারতে পোস্টেড ছিলেন আর  বিদ্রোহে আহত হন ।  মেনন সম্পর্কে মেরি বলেছিলেন, : উনি যে কোনও ভারতীয়ের মতো নন, দূর থেকে চিকন আর অতিরিক্ত সাধারণভাবে অ্যাঙ্গুলার৷ গঠনের দিক থেকে তিনি খুব সুদর্শন পুরুষ কিনা, নাকি তিনি স্বতন্ত্র ছিলে,ন তা নির্ধারণ করা কঠিন ছিল৷ দৃষ্টি শয়তানের মতন, যখন চোখে চোখ ফেলে দেখতো, তখন ওনার বাদামের আকৃতির চোখ বাজপাখির মতো দেখাতো।
    –কৃষ্ণমেনন তো আরেকজন মেমের প্রেমে পড়েছিল, তাই না ?
    –হ্যাঁ। কৃষ্ণমেননের রাজনৈতিক পতনে,  ব্রিজেট টুনার্ড নামে একজন যুবতীর সঙ্গে তাঁর প্রেমের ভূমিকা ছিল।  দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট নেতা ডক্টর ইউসুফ দাদু'র স্ত্রী উইনি দাদু'র স্মৃতিচারণে  রয়েছে যে ১৯৪৯ সালে যখন তাঁরা মেননের সাথে দেখা করেছিলেন, তখন মেনন আর মিসেস টুনার্ড একসাথে বসবাস করছিলেন। সাংবাদিক ইন্দর মালহোত্রাও,  লিখেছেন যে মেনন-টুনার্ড ভালোবাসা-সম্পর্ক ইন্ডিয়া লিগ অফিসের সাথে যুক্ত সকলেরই জানা ছিল।
    –উনি শাকাহারি ছিলেন আর মদ খেতেন না । ছোটোবেলা থেকে ইংল্যাণ্ডে থাকার দরুন ভালো মালায়ালিও বলতে পারতেন না ।
    –মেরি সেটনই তো সত্যজিৎ রায়, সের্গেই আইজেনস্টাইন আর জওহরলাল নেহেরুর জীবনী লিখেছেন । কৃষ্ণমেননকে দেখতে অমন হলেও, শুনেছি লণ্ডনে ওনার অসংখ্য অনুরাগিনী ছিল । স্বাধীন ভারতে ঘুষ খাবার আদি পর্বটা কিন্তু মেননই শুরু করেছিলেন । ১৯৪৭-৪৮ সালে, দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে, পাকিস্তান দখল করতে চাইছে কাশ্মীর, তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ভারতের আরও কিছু জিপ গাড়ির দরকার ছিল। তখন ব্রিটেনের ভারতীয় হাইকমিশনার ভি. কে. কৃষ্ণ মেনন পুরোনো মেরামত করা ২০০০ জিপ কেনার জন্য  অর্ডার দেন ৷ ওই পুরনো  জীপ কিনতে যে দাম দেওয়া হচ্ছিল সেই  দামেই নতুন জীপ কেনা যেত আমেরিকা বা কানাডা থেকে । নাম না-জানা  যে অ্যান্টি-মিস্টান্টেসকে জিপগুলো সরবরাহ করার জন্য বরাত দেওয়া হয়েছিল, তার মূলধন ছিল মাত্র ৬০৫ পাউন্ড। কৃষ্ণমেনন এজন্য ১৭২০০০ ডলার দিতে রাজি হন ।তার মধ্যে মোট পেমেন্টের ৬৫% কোনো পরিদর্শন শংসাপত্র ছাড়াই দেওয়া হয় আর ডেলিভারি দেওয়ার সময় ২০% । বাদবাকি টাকা ডেলিভারী হওয়ার এক মাস পরে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়৷ কোম্পানিটি অবশ্য দুই বছরে মাত্র ৫৯টি জিপ সরবরাহ করে  সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে।ব্রিটেন কর্তৃক জিপগুলির অর্থ প্রদান ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ভারতকে ব্রিটিশ যুদ্ধ ঋণের অংশ হিসেবে ।  মেনন এই চুক্তিতে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন। মেনন প্রোটোকল এড়িয়ে একটি ৮০ লক্ষ টাকার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন । যদিও বেশিরভাগ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল , মাত্র ১৫৫টা জিপ ডেলিভারি করা হয়েছিল ; যদিও প্রটোকল অনুসারে মেননকে পদত্যাগ করে ভারতে ফিরে আসতে বলা হয়, তবে নেহেরু সরকারকে জিপগুলি গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন । এদিকে চুক্তির তথ্য ভারতে পৌঁছলে এখানকার সংসদ সহ গোটা দেশে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয় ।
    –বেচারা । 
    –আপনি মিত্রোখিন পেপার্সের খবর পড়েছেন ? ইনডিয়াকে আমাদের চেয়ে বিদেশিরা বেশি বুঝেছে। সোভিয়েত আমলের গুপ্তচর মিত্রোখিন যেসব কাগজপত্র রেখে গেছে তাতে দাবি করেছে যে কৃষ্ণমেননের ১৯৬২ আর ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে ওরা প্রচুর টাকা দিয়েছিল ওনাকে জেতাবার জনয় । কৃষ্ণমেনন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হয়ে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমানের বদলে তাই সোভিয়েত মিগ কিনেছিলেন ।
    –অ্যাঁ ! কী কাণ্ড !
    –তুমি যে মোটা লোকটার কথা বলছ, তারও অনুরাগিণী ওই একমাত্র যুবতী নয় । পবিত্র সরকার এতো রেগে গেছেন যে বলেছেন লোকটার  হারেম আছে । মেনন দুজন মেমের প্রেমে পড়িছিলেন । ওনার জিপ কেনার কেলেঙ্কারি তদন্ত করেছিল আয়ঙ্গার সাব-কমিটি আর ১৯৫১ সালের ৯ই এপ্রিল নেহরুর কাছে পেশ করা রিপোর্টে গোলমালের তথ্যগুলো ছিল। তদন্ত হয়েছিল ; সেসব ধামাচাপা পড়ে যায়  পরে, মেননকে কোনও পোর্টফোলিও ছাড়াই অবশ্য মন্ত্রী হিসেবে নেহরু মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মেনন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিশ্বস্ত বন্ধু হন। মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব , ইউ ভি কল্যাণম , এক সংবাদপত্রের সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, এটা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে নেহরু, কৃষ্ণমেননের মতো দুর্নীতিবাজ সহকর্মী তৈরি করেছিলেন, যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থাকাকালীন কুখ্যাত ' জীপ কেলেঙ্কারি 'তে জড়িয়ে পড়েন৷ 
    –পড়েছি, পড়েছি । মিত্রোখিন লিখেছে  যে জোসেফ স্টালিন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সম্পর্কে ভালো মতামত দেননি । স্ট্যালিন মনে করতেন  নেহেরু আর মহাত্মা গান্ধী দুজনে "সাম্রাজ্যবাদী পুতুল" , যারা ব্রিটিশদের সামনে মাথা নত করেছিল আর তাদের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, ব্রিটিশদের ভারতে তাদের দখল শক্ত করতে সাহায্য করেছিল। মিত্রোখিন আরও লিখেছে যে ইন্দিরা গান্ধীকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের বিনিময়ে দুকোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল আর সোভিয়েত গুপ্তচরদের অবাক করে দিয়ে, তিনি যে ব্যাগটিতে টাকা পেয়েছিলেন তাও ফেরত দেননি।
    –তুই জানিস না বোধহয়, জিন্নার মেয়ে কিন্তু ভারতে থেকে গিয়েছিলেন । ভারত ভাগের সলতে পাকানোয় প্রত্যক্ষ মদত ছিল জিন্নার। সেই কাজে তিনি সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু  অনুগামীদের পাশে পেলেও নিজের মেয়েকেই পাকিস্তানে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হন তিনি।উনিশ বছর বয়সেই দিনা মুম্বইয়ের শিল্পপতি নেভিল ওয়াদিয়ার প্রেমে পড়েন। তারপর অনেক ভেবেচিন্তে দু’জনে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। স্বাভাবিকভাবেই বেঁকে বসেন জিন্না। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, এ বিয়ে কোনওমতেই হতে পারে না। একজন পার্সি ছেলের হাতে মেয়েকে কিছুতেই তুলে দিতে পারেন না তিনি। দেশে তো অনেক মুসলিম ছেলে রয়েছে।দিনার জবাব ছিল এরকম— ‘বাবা, তাহলে আপনি ভারতে হাজারো মুসলিম মেয়ে থাকা সত্ত্বেও বেছে বেছে কেন একজন পার্সি রমণীকেই ঘরে আনলেন?’ দিনার মা রতনবাঈ পেটিট ছিলেন পার্সি। বিয়ের পর তিনি মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন। নাম পাল্টে রাখেন মারিয়ম। যাইহোক, দিনার স্পষ্ট জবাবের ফল ভালো হয়নি। বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। মুম্বইয়ে ফিরে নেভিলের সঙ্গে নতুন করে সংসার পাতেন। এর পরই দম্পতির কোল আলো করে জন্ম নেন নুসলি।  স্বাধীন ভারতীয় নাগরিকের পরিচয়েই বাকি জীবন কাটিয়েছেন।  ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মৃত্যু হয় তাঁর। মা’য়ের একগুঁয়ে স্বভাব অর্জন করেছেন নুসলি ওয়াদিয়া ।
    —আরে ! আপনি তো প্রথম ঘটনাটাই উল্লেখ করলেন না । 
    —সেটা আবার কী ? তুই নিজেই বল । আমার ঠিক মনে পড়ছে না ।
    —১৬ ই আগস্ট ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম লিগের সভা। বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্র হাতে সেদিন সভায় উপস্থিত ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার মুসলমান। মঞ্চে উপস্থিত ছিল হোসেন সোহরাওয়ার্দী‚ খাজা নাজিমুদ্দিন‚ ইস্পাহানি ও মুসলিম লিগপন্থী দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। সমর্থকদের উদ্দেশ্যে সোহরাওয়ার্দী সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়‚ "সেনা ও পুলিশকে সংযত করা হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম‚যা করতে পারিস কর। সভা শেষ হতেই উপস্থিত মুসলমান জনতা প্রথমে আক্রমণ করে সভা দেখতে আসা হিন্দু জনতাদের। 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' - হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে তারা দল বেঁধে ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বিভিন্ন রাস্তা ধরে। অবাধে চলে লুটপাট‚ খুন জখম‚ ধর্ষণ। ক্যানিং স্ট্রিট‚ ওয়েলেসলি স্ট্রিট‚ ধর্মতলা স্ট্রিট‚ কর্পোরেশন স্ট্রিট‚ মানিকতলা রোড আর বিবেকানন্দ রোডে গণলুঠ হয়। লুট হয় কমলালয় স্টোর্স‚ ভারতকলা ভান্ডার‚ লক্ষ্মী স্টোর্সের মতো বিখ্যাত দোকানগুলো। আক্রান্ত হয় উত্তর ও মধ্য কলকাতার হিন্দু পাড়াগুলি। গড়পাড়‚ নারকেলডাঙা‚ বেলেঘাটা‚ ফুলবাগান‚ পার্ক সার্কাস‚ কলুটোলা‚ চিৎপুর জুড়ে সন্ত্রাস চালিয়ে বেড়ায় 'মুসলিম লিডার'-রা। আর শুধু সাধারণ মানুষই না‚ তাদের আক্রমণ থেকে বাদ পড়েননি অভিনেতা ছবি বিশ্বাস‚ গণিতজ্ঞ যাদব চক্রবর্তী‚ রাজা দেবেন্দ্র মল্লিক‚ ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এস.এস.মুখার্জির মতো বিশিষ্ট বাঙ্গালিরাও। আক্ষরিক অর্থেই যেন একখণ্ড নরক নেমে আসে কলকাতার বুকে। নিহত হয় অসংখ্য হিন্দু‚ ধর্ষিতাদের সংখ্যা ছিলো অগুনতি। হিন্দুদের উপর বিজয়ের চিহ্ন স্বরূপ রাস্তার পাশে ধর্ষিতা মৃত মেয়েদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়। আক্রমণ চলল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। ভিক্টোরিয়া কলেজের লেডিজ হোস্টেল আক্রমণ করে লিগের গুন্ডারা। অন্যান্য মেয়েরা সময়মতো বাড়িতে পালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত পালাতে পারেনি চারজন ছাত্রী। হোস্টেলেই ছিল তারা।  হতভাগিনীদের উপর গণধর্ষণ চালিয়ে তাদের হত্যা করে আক্রমণকারীরা। ধর্ষণের পর তাদের স্তন কেটে নিয়ে তারপরে তাদের যৌনাঙ্গে গো-মাংস ঝোলানোর শিক ঢুকিয়ে‚ তাদের মৃতদেহগুলিকে কলেজের দোতলার একটি ক্লাসরুম থেকে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল হিন্দুদের মধ্যে ভয় সৃষ্টির জন্য। আর শুধু বাঙ্গালিই নয়‚ হিন্দু হলেই আর ছাড় ছিল না কারও। মেটিয়াবুরুজে উড়িয়া শ্রমিকদের বস্তিতে চলে আক্রমণ। কম করে ৫০০ জন উড়িয়া শ্রমিককে সেখানে হত্যা করা হয়েছিলো। অসহায় শ্রমিকদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিলো সেদিন হুগলি নদীর জল।
    —ঠিক বলেছিস । সেই থেকে কলকাতা হয়ে গেছে হত্যার শহর ।
    —দেশভাগ ! ওফ ভাবা যায় না । আমি তখন নোয়াখালিতে । কোনোরকমে বাবা-মায়ের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিলেম ।
    –তুইও পড়িসনি বোধহয়, 'ফ্রম প্ল্যাসি টু পাকিস্তান'-বইতে হুমায়ূন মির্জা লিখছেন, "পাকিস্তানের এক সময়কার প্রতিরক্ষা সচিব ইসকান্দার মির্জা, যিনি পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন, তিনি মি. জিন্নাহকে বলেছিলেন, যে মুসিলম লীগ পাকিস্তান দিল, সেই দলটাকে যেন অবহেলা করা না হয়।"  সঙ্গে সঙ্গে মি. জিন্নাহ পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন, "কে বলল মুসলিম লীগ আমাদের পাকিস্তান দিয়েছে? আমি পাকিস্তান বানিয়েছি, আমার স্টেনোগ্রাফারের সাহায্যে।"
     
    –আরে কী যে বলেন, সেই কবে পড়েছি,  খালিদ লতিফ গৌবা এক জায়গায় লিখেছিলেন যে তিনি মি. জিন্নাহকে কোনও একটা মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। "আমি জানি না কীভাবে নামাজ পড়তে হয়," জবাব দিয়েছিলেন মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ। মি. গৌবা বলেছিলেন, "মসজিদে অন্যরা যা করবে, আপনিও তাদের দেখাদেখি সেটাই না হয় করবেন।"
     
    –তুমি এটা জানো ? মি. জিন্নাহর সহকারী ছিলেন মুহাম্মদ করিম চাগলা, যিনি পরে ভারতের বিদেশ মন্ত্রী হয়েছিলেন।তিনি আত্মজীবনী 'রোজেস ইন ডিসেম্বর'-এ লিখেছেন, "একবার আমি আর মি. জিন্নাহ ঠিক করেছিলাম বোম্বের বিখ্যাত রেস্তোরাঁ 'কর্ণগ্লিয়াজ'-এ খেতে যাব। উনি দু কাপ কফি, পেস্ট্রি আর শুয়োরের মাংসের সসেজ অর্ডার করলেন। আমরা বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিলাম। হঠাৎই এক বয়স্ক দাড়িওয়ালা মুসলমান ব্যক্তি ওখানে হাজির হলেন, তাঁর সঙ্গে একটা বছর দশেকের বাচ্চা ছেলে।" "ওঁরা মি. জিন্নাহর বেশ কাছাকাছি বসেছিলেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম, ওই বাচ্চা ছেলেটি মি. জিন্নাহর সামনে রাখা সসেজের দিকে হাত বাড়াচ্ছে আর তারপরেই ছোট একটা টুকরো তুলে নিজের মুখে পুরে দিল। আমি এই বাচ্চাটার কাণ্ড দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলাম।" একটু পরে ওঁরা চলে গেলেন। তখন মি. জিন্নাহ আমার ওপরে বেশ রেগে গিয়ে বললেন, "চাগলা, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। ওই বাচ্চা ছেলেটাকে শুয়োরের মাংসের সসেজ খেতে দিলে তুমি?"
     
    –ইনডিয়াকে ডিফাইন করে কেলেঙ্কারিগুলো । তোমরা স্বীকার করো বা না করো । স্বাধীন ভারতের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি হয়েছিল ১৯৫৭  সালে । এখনকার কেলেঙ্কারিগুলোর তুলনায় মামুলি, কিন্তু সেসময়ে, সবে সংবিধান মেনে রাষ্ট্র চলতে আরম্ভ করেছে, কেলেঙ্কারিটা ছিল বোমা ফাটার মতন । অর্থমন্ত্রী, টি টি কৃষ্ণমাচারীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। জানা যায় যে, ১৯৫৭ সালের জুন মাসে পাবলিক সেক্টর লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন (এলআইসি) কলকাতা-ভিত্তিক ব্যবসায়ী হরিদাস মুন্ধ্রার মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানিতে ১.২৪ কোটি  টাকা মূল্যের জালি স্টক কিনেছিল। . এলআইসির তখন পর্যন্ত ইতিহাসে বিনিয়োগটি সবচেয়ে বড় ছিল, কিন্তু নিয়মানুযায়ী তার বিনিয়োগ কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি। ব্যবসায়িক সাংবাদিক সুচেতা দালাল তার শিল্পপতি এ.ডি. শ্রফের জীবনীতে লিখেছেন, “প্রচুর প্রমাণ ছিল,” যে মিঃ মুন্ধরা “কোম্পানিগুলোকে রক্তাক্ত করছিলেন আর বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিলেন, একই সাথে বাজারে  ফাটকা খেলে দাম বাড়াচ্ছিলেন।”
     
    –আপনিও জানেন কি না জানি না, নেহেরু যুগে, কংগ্রেস প্রায়ই শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করত, যা কখনও কখনও দল এবং সরকারকে সমস্যায় ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, যখন মুন্ধরা, একজন শিল্পপতি যিনি 1950 এর দশকে পার্টিকে অর্থায়ন করেছিলেন, আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলেন, তখন তিনি সরকারকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে এটি ফেরত দেওয়ার সময়। নেহেরু বাধ্য হয়ে এলআইসিকে তার কোম্পানির শেয়ার স্ফীত দামে কেনার নির্দেশ দেন। অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারী, যিনি স্পষ্টতই উপর থেকে নির্দেশে কাজ করছিলেন, সত্য বেরিয়ে এলে চাকরি হারান।
     
    –সবচেয়ে আগে জওয়াহারলাল নেহেরুর প্রেমের কথা বলো ! ওই মোটা লোকটা একজন যুবতীর প্রেমে পড়ে নানা গোলমাল করেছে বলে লোকেরা চেল্লাচ্ছে । নেহেরুর প্রেম নিয়ে সেসময়ে তেমন চেঁচামেচি হয়নি । ডিকি মাউন্টব্যাটেন লোকটাও কেমন ! বউয়ের সঙ্গে ওপন ম্যারেজ চুক্তি করে ফেললো যাতে দুজনে যার সঙ্গে ইচ্ছে প্রেম করতে পারে । কে কার সঙ্গে সেক্স করছে দ্যাট ইজ ইমম্যাটেরিয়াল । দেশ স্বাধীন হতে চলেছে, লক্ষ-লক্ষ মানুষ চোদ্দোপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য জায়গায় মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে, কতো বউরা-মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে, খুনোখুনিতে মারা পড়ছে হাজার-হাজার মানুষ, আর তুমি তখন একজন মেমের সঙ্গে প্রেম করছ। একটা ফোটোতে দেখেছি, মাউন্টব্যাটেন ক্যাবলার মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে আর ওর পেছনে হাসাহাসি করছে নেহেরু আর এডউইনা । নকল হাসি নয়, বুকভরা হাসির ছররা ।  জওহরলাল-এডউইনা-মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্ক পাবলিকের সামনে আসার পর্বটাও  হয়েছিল  নোংরামি ও কদর্যতার মাধ্যমে, যখন আরেক বিবাহিতা নারী আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল তার স্বামীর সাথে এডুইনার অবৈধ প্রণয়ের ব্যাপারে নালিশ জানাতে। এছাড়া এডুইনা ভালোবাসার খেলায় মেতেছিল লেসলি হাচিনসন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পীর সাথেও, যে বিষয়টা পাবলিকের নজরে এলে চারিদিকে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল।  স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশি দুঃখবিলাস করেনি মাউন্টব্যাটেন। অনেকের মতে, স্ত্রী সম্পর্কে মাউন্টব্যাটেন হয়ে পড়েছিল উদাসীন । ১৯২৯ সাল নাগাদ, মাউন্টব্যাটেন এডুইনার সাথে এক  সন্ধিচুক্তি করেছিল, যাকে ওরা বলে ‘খোলা বিয়ে’ । 
     
     
    –আপনি ওটা জানেন? ওরা যেদিন আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, সেদিনের বিদায় সভায় নেহেরু সরাসরি এডউইনাকে সবায়ের সামনে বলেছিল, আপনি যেখানেই গেছেন, আপনি সান্ত্বনা এনেছেন, আপনি আশা এবং উত্সাহ এনেছেন ; এটা কতো আশ্চর্যের বিষয় যে ভারতের জনগণ আপনাকে ভালবাসবে এবং আপনাকে নিজেদের একজন হিসাবে দেখবে এবং আপনি যাচ্ছেন বলে দুঃখিত হবে । ওদের মধ্যে প্লেটোনিক সম্পর্ক ছিল নাকি যৌন সম্পর্ক ছিল তা কেউই জানে না। তার এডউইনার মেয়ে স্বীকার করেছে যে ১৯৪৭ সালের পরেও তারা ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ওরা চিঠি আদান প্রদান করত । ১৯৬০ সালে এডউইনা মারা যান। মেয়ে লিখেছেন যে তার মা নেহেরুর সাথে বেশ উন্মাদভাবে সম্পর্কিত ছিলেন, এতটাই যে মিস্টার মাউন্টব্যাটেনও চোখ বন্ধ করতেন যেমনটি আমরা অনেক ঐতিহাসিক ছবিতে দেখতে পাই ।
     
    –হ্যাঁ, ছবি দেখেছি ।
     
    –নেহেরু সেই সময়ে একজন বিপত্নীক আর সমসাময়িক ভারতীয়দের তুলনায়  ‘আধুনিক’ ছিলেন, তাই এডউইনার সাথে একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে নিয়েছিলেন, যদিও হয়তো শারীরিক নয় কিন্তু এমন কিছু যা খুব কমই স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের আজও করতে দেয়। এডউইনার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়, যাঁকে সেই সময়ে সেরা পোশাক পরা মহিলাদের একজন হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল, যিনি জমকালোভাবে কেনাকাটা করতেন, পার্টিতে  চটকদার ছিলেন আর ওনার নৌ অফিসার ভাইসরয় স্বামী  তার চেয়ে অনেক বেশি গ্ল্যামারাস ছিলেন। স্বামী লোকটি তার স্ত্রীর সাথে খুব বেশি রোমান্টিকভাবে যুক্ত ছিলেন না । তাঁরও বহু যুবতীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। মাউন্টব্যাটেন একবার বলেছিলেন, তারা দম্পতি হলেও, দুজনেই বিছানায় অন্যদের সাথে বেশি সময় কাটিয়েছেন।
     
    – তুমি এটা বোধহয় শোনোনি ।নেহরুর আগে বা হয়তো তাঁর সাথে থাকাকালীনও, সামাজিক প্রজাপতি এডউইনার অনেক অভিজাত ইংরেজ আর আমেরিকান পুরুষদের সাথে সম্পর্ক ছিল ,এমনকি যৌন সম্পর্ক, অভিজাত থেকে মিডিয়া হাউসের মালিকদের সঙ্গে আর তাও মেয়ের জন্মের পরে।  তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে নেহরুর পক্ষে তার সাথে ফ্লার্ট করা সহজ ছিল।
     
    –আমি ইনডিয়াকে ডিফাইন করতে আরেকটা পয়েন্ট দিচ্ছি । যখন ইরফান খান, হিউ গ্রান্ট আর কেট ব্ল্যানচেটকে নিয়ে এই বিষয়ে একটা ফিল্ম তৈরি হচ্ছিল,  তখন এটার শুটিঙ ভারতের গোপন ধমকানিতে  নাটকীয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এর পরের কংগ্রেস সরকারগুলো এই ঘটনাটা লুকিয়ে রাখতে  হয়েছিল। শাসকদের ভয় ছিল গ্রামীণ ভোটব্যাংক। কিন্তু একই সময়ে তারা সম্পূর্ণভাবে বা সম্ভবত অসতর্কতার সাথে এটি অভিজাতদের কাছ থেকে আড়াল করতে ব্যর্থ হয়েছে, যাদের অবশ্য এতে কোন সমস্যা ছিল না । ওই লুকোছাপা থেকেই আরম্ভ হলো রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক দুরাচার ।
     
    –নেহেরুর ভূমিকায় ইরফান খান অসাধারণ অভিনয় করতো । কেন যে লোকটা এতো তাড়াতাড়ি মারা গেল !
     
    –এডউইনার চেয়ে কেট ব্ল্যানচেট হাজারগুণ সুন্দরী । এলিজাবেথ ফিল্মটায় কতো ভালো দেখাচ্ছিল ওনাকে। উনি তো অস্ট্রেলিয়ান, ইংরেজদের মতন ইংরেজি বলতে হয়েছিল । যাই হোক না কেন, কিন্তু  নেহরু সেসময়ে  ‘বামপন্থী’ তরুণদের প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। রাশিয়ার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নকল করে । ওনার প্রেমের গল্প, যদিও স্বর্গীয় নয়, অবশ্যই আকর্ষণীয় আর আনন্দদায়ক ।
     
    –তোকে একটা কথা মানতেই হবে । যাঁরা প্রায়ই নেহরুর যুগকে ভারতীয় গণতন্ত্রের সোনালি সময় বলে দাবি করেন তাঁদের সম্ভবত বুঝতে হবে যে দুর্ভাগ্যবশত, নেহেরুর উত্তরাধিকার আরও বেশি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বকালীন সময়ে যে পচন তৈরি হয়েছিল তা আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে পরপর কংগ্রেস সরকারের রাজত্বে । নেহেরুর উন্নয়ন বা শাসনের মডেল যা কংগ্রেস কয়েক দশক ধরে কেন্দ্র আর রাজ্যের স্তরে গর্বের সাথে এগিয়ে নিয়ে গেছে তা আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার আর দায়িত্ব নির্ধারণ করা দরকার কারণ ভারতের নাগরিকদের দুর্নীতি, অদক্ষতার জন্য বিশাল মূল্য চোকাতে হচ্ছে ।  স্বজনপ্রীতি শাসনের নেহেরু মডেলের বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে ; যে সরকারই গদিতে বসুক তারা স্বজনপ্রীতির মডেলটা দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে গেছে। এটা বললে ভুল হবে না যে আমাদের শাসন ব্যবস্থার তিনটি প্রধান অসুখের শিকড় –- দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর অদক্ষতা, নেহেরু যুগে অঙ্কুরিত  হয়ে এখন মহীরুহ হয়ে গেছে ।
     
    –স্বাধীনতার পরপরই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ভারতীয় কৃষিকে পুনরুজ্জীবিত করা আর লক্ষ লক্ষ ভারতীয়দের পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা, যাদের ক্ষুধার্ত থাকতে হচ্ছিল।“কৃষি আর লাখ লাখ মানুষের খাদ্য উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়ায় সামান্য অগ্রগতি দেখা গেছে পরে । ভারতে  খাদ্যের উৎপাদন,  প্রতি একর ফলন উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিন্তু বিপজ্জনকভাবে কয়েক বছর ধরে গোপন করা হয়েছিল।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে লক্ষ লক্ষ টন বিনামূল্যে বা ডাম্প করা খাবারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কিছু মন্ত্রীর বরং লাভ হচ্ছিল।  চল্লিশের দশকে বাংলার দুর্ভিক্ষ থেকে স্পষ্টতই, নেহরুর সময়ে   কোনও উপযুক্ত শস্যভাণ্ডার বা স্টোরেজ ব্যবস্থা ছিল না। এইভাবে দুর্ভিক্ষ,   শস্য ফটকাবাজ আর মজুতদারদের টাকার ভাঁড়ার উপচে তোলে ।
     
    –প্রকৃতপক্ষে, নেহরুর শহুরে মানসিকতা এবং গ্রামীণ ভারতের সাথে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া একটি দক্ষ শাসন মডেল স্থাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শহুরে মন প্রতিফলিত হয়। নেহরু, বেশিরভাগ ভারতীয় রাজনীতিবিদদের মতো, শহুরে ছিলেন। তাদের শহরের বাইরে রাজনীতিবিদরা পানি ছাড়া মাছের মতো। এই কারণেই কৃষিকে, যদিও হাজার হাজার পৃষ্ঠা, লক্ষ লক্ষ শব্দ, এবং বিভিন্ন বিশাল প্রকল্প, যেমন সম্প্রদায়ের উন্নয়ন বা গ্রো মোর ফুড ক্যাম্পেইন দেওয়া হয়েছে, পর্যাপ্ত কার্যকর পদক্ষেপ দেওয়া হয়নি... যেমন নেহরু পরিকল্পনা বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়েছে, এবং তা ছাড়া সাধারণ কৌশল, তারা ছোট কারিগরি স্কুল থেকে শুরু করে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পর্যন্ত শত শত বিভিন্ন প্রকল্পে চলে কিন্তু তারা তাদের অগ্রাধিকার বা লক্ষ্যে খুব বেশি অশুদ্ধ হওয়ার প্রবণতা দেখায়; বুদ্ধিবৃত্তিক এবং তারপরে কঠিন প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির ভিত্তির খুব অভাব… সম্পাদনে খুব বেশি ত্রুটি যাতে অনেক, সম্ভবত, বেশিরভাগ লক্ষ্য এবং ভার্চুয়াল ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটি ঘাটতি হয়েছে।
     
    –নেহেরু মদ-মাংস খেতেন ?
     
    –নেহেরু  ওয়াইন আর শ্যাম্পেন পছন্দ করতেন, বি.কে.নেহেরুর স্মৃতিচারণ অনুযায়ী । কমিউনিস্ট দেশগুলোর জন্য নিয়ম ভাঙতে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে  তিনি অনড় ছিলেন। নেহেরু যখন রাষ্ট্রপতি কেনেডির সাথে দেখা করতে যান, তখন বি কে নেহরুকে দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছিল, কোনও হুইস্কি বা জিন নয়; শুধুমাত্র ওয়াইন আর শ্যাম্পেন।  নেহেরু খুব অসুস্থ এবং ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তাই তিনি নিজেও শ্যাম্পেন ককটেল গিলেছিলেন । বি.কে.নেহেরু লিখেছেন যে নেহেরু সেরিন একটি বড় গ্লাস চোঁচোঁ করে খেয়ে বললেন, এর স্বাদ খুব ভাল, আরও  এক গ্লাস দাও ।
     
    –আমি একটা পয়েন্ট দিচ্ছি ।দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে, গান্ধীজির প্রাক্তন ব্যক্তিগত সচিব ভি কল্যাণম, গান্ধী জয়ন্তীর প্রাক্কালে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে আজ দেশে দুর্নীতির ক্রমবর্ধমান মাত্রার জন্য দায়ী করেছেন। এই গান্ধীবাদী, যিনি ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে কাজ করেছিলেন, দাবি করেছেন, পন্ডিত নেহেরু ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সৎ ছিলেন। মনমোহন সিংয়ের মতোই সৎ। বর্তমান দুর্নীতির জন্য আমি মনমোহন সিংকেও দায়ী করি। মনমোহন সিং ব্যক্তিগতভাবে খুবই সৎ। কিন্তু তাঁরা দুর্নীতিবাজদের  রক্ষা করেছেন। তাই আমি বলি তারা সবাই দুর্নীতিকে মদদ দিয়েছে। কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে, আপনার উচিত তাদের শাস্তি দেওয়া । কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে, তাকে, আপনার উচিত অবিলম্বে বরখাস্ত করা ।  ভারতের স্বাধীনতার এক মাসের মধ্যে, গান্ধীজি পঞ্চাশটি চিঠি পেয়েছিলেন, যার মধ্যে দশটিতে  দেশে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। কল্যাণম অভিযোগ করেছেন, তখন তিনজন ব্যক্তি খুব দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেনন, পন্ডিত নেহরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী টিটি কৃষ্ণমাচারী আর পাঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রতাপ সিং কাইরন । কিন্তু নেহেরু তাদের বরখাস্ত করেননি।  আমি এখন ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির জন্য নেহেরুকে দায়ী করি।”
     
    –বুঝলেন, আলটিমেটলি,বিউটি অ্যান্ড দি বিস্টের ব্যাপার । কিংবা ব্যাঙ আর রাজকুমারী । ওই দুজনের আর নেহেরু ও কৃষ্ণমেননের প্রেমকে অনুমোদন করে বলল, তোমরা নাস্তিক বলে হিন্দু দেবী-দেবতার খবর রাখো না । জানো, পুরাণের সূর্য আর চন্দ্রের গল্প ?  চন্দ্র দক্ষের সাতাশটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু  কামাসক্ত হয়ে সে দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে অপহরণ করে সঙ্গম করেছিল । দেবগুরু বৃহস্পতি প্রেমে অভিভূত হয়ে নিজের বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী মমতা অন্তস্বত্বা থাকা সত্বেও তার সঙ্গে সঙ্গম করেছিল। আবার ঋগ্বেদে আছে রুদ্রদেব তার নিজের মেয়ে উষার সঙ্গে অজাচারে লিপ্ত হয়েছিল। পৌরাণিক যুগে বিষ্ণুই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। কিন্তু তিনিও পরস্ত্রী বৃন্দা ও তুলসীর সতীত্ব নাশ করেছিলেন।
     
    – আচ্ছা, এই সতীত্ব নিয়ে এরকম দুশ্চিন্তা ইউরোপ-আমেরিকায় তো নেই ? ইনডিয়াকে নয়, এই ব্যাপারটা ভারতবর্ষকে ডিফাইন করে ।
     
    –আরে বোলো না ! মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে  যখন মেয়েদের নৈতিকতা সম্পর্কে শেখানো হয়, তখন প্রায়ই সহানুভূতি, দয়া, সাহস বা সততার কথা বলা হয় না। বলা হয় সতীচ্ছদ বা যোনিচ্ছদ নিয়ে । আমি কাজের সূত্রে আরব দেশগুলোতে গেছি । সতীচ্ছদের দেবতা আরব দেশগুলোতে জনপ্রিয়। তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো বা গোপন নাস্তিক হও, কোন ধর্মের তা বিবেচ্য নয়,  পুরুষরা প্রত্যেকেই সতীচ্ছদের দেবতার পূজা করে। সতীচ্ছদ, যা সবচেয়ে অপলকা অংশ, যার ওপর কুমারীত্বের দেবতা বসে আছেন, তাকে  অক্ষত রাখার জন্য যা কিছু সম্ভব করে ওদের দেশের কর্তাবাবারা৷ সতীচ্ছদের দেবতার বেদিতে,  কেবল  মেয়েদের শারীরিক পরিপূর্ণতা আর  আনন্দের অধিকারই নয়, যৌন নিষেধের মুখে তাদের ন্যায়বিচারের অধিকারকেও বলি দেয়া হয় । কখনও কখনও  তাদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়, সম্মানের নামে । অনেক পরিবার তো  তাদের মেয়েদের মেরেও ফ্যালে, জাস্ট সতীচ্ছদের দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখবার জন্য। পুরো সমাজ মনে হয় একটা পাতলা সতীচ্ছদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ।
     
    –-কোনো-কোনো বাঙালি ফ্যামিলিরও অমন ছুয়াছুত আছে । হরিয়ানা সাইডে গ্রামে তো সুহাগ রাতের পর বাড়ির বাইরে চাদর টাঙিয়ে রক্তের ছোপ দেখানো হয় পাবলিককে ।
     
    –যাকগে,  তুমি গড আর গডেসদের গল্পটা কনটিনিউ করো ।
     
    –তার চেয়ে অপ্সরাদের গল্প শোনো । অপ্সরা বলে তো আর কিছু হতে পারে না, তাই গল্পগুলো বেশ ইনটারেস্টিঙ।
     
    –আরে, কী যে বলিস ! অপ্সরা হতে পারে না তো তোমাদের পলিটিশিয়ানগুলো কাদের প্রেমে হাবুডুবে খেয়েছে আর এখনও খাচ্ছে ? টিভি আর ফিল্মের নায়িকাদের দেখেছো ? অপ্সরাদের চেয়ে সুন্দরী ।
     
    –শোনো না, বলছি তো অপ্সরাদের কাহিনি । চোখ বুজে কোনো ফিল্মের নায়িকাকে মনে করে নাও। পুরুরবা আর উর্বশীর মিলনের সবচেয়ে পুরোনো উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের সংবাদসুক্তে। সেখানে যে আখ্যান আছে, সে আখ্যান অনুযায়ী উর্বশী চার বছর পুরুরবার সঙ্গে ছিলেন, আর গর্ভবতী হবার পর উনি গায়েব হয়ে যান। শতপথব্ৰাহ্মণের কাহিনী অনুযায়ী উর্বশী কয়েকটা শর্তে পুরুরবার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে রাজী হন । প্রথম, উর্বশী যেন কোনদিন পুরুরবাকে উলঙ্গ না দেখেন, দ্বিতীয়, উর্বশীর বিছানার পাশে ছেলের মতন দুটো ভেড়া বাঁধা থাকবে আর কেউ যেম ভেড়াগুলোকে চুরি না করে। তৃতীয়,  উর্বশী একসন্ধ্যা শুধু ঘি খাবেন । অন্য কাহিনী অনুযায়ী আরও একটা শর্ত ছিল । সেটা হচ্ছে, উৰ্বশী কামাতুরা না হলে, সঙ্গম করা চলবে না। শতপথব্রাহ্মণ অনুযায়ী পুরুরবা শর্তগুলো মেনে নিতে রাজি হন।  পুরুরবা আর উর্বশী পরম সুখে অনেক বছর একসঙ্গে বসবাস করেন । কিন্তু দেবলোকে উর্বশীর অনুপস্থিতে গন্ধৰ্বরা ব্যথিত হয়ে ওঠে । গন্ধর্বরা তখন উৰ্বশীকে দেবলোকে নিয়ে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে । পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর বসবাসের শর্তগুলো তারা জানত। তাই ছলচাতুরি  করে তার শর্তগুলো ভাঙাবার উপায় বের করে। একদিন রাতে গন্ধৰ্ব বিশ্বাবসু, উর্বশীর ভেড়া দুটোকে চুরি করে । ভেড়াদের দেখতে না পেয়ে উর্বশী কাঁদতে-কাঁদতে পুরুরবাকে ভেড়া দুটোকে উদ্ধার করবার জন্য অনুরোধ করে । পুরুরবা উলঙ্গ অবস্থাতেই বিছানা থেকে  উঠে  বিশ্বাবসুকে ধরার জন্য দৌড়োয়।  এই সময় দেবতারা বজপাতের সূচনা করে বিদ্যুতের সৃষ্টি করে। বিদ্যুতের আলোকে উর্বশী পুরুরবাকে নগ্ন দেখে তৎক্ষণাৎ তাকে ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে যায়।
     
    –মুনি-ঋষিরা ল্যাংটো হয়ে শুতো ? ইনডিয়ায় তো কেউ অমন শোয় বলে মনে হয় না । আমেরিকায় শোয়, ইংল্যাণ্ডে জেমস বণ্ড শোয় ।
    –আরে, পুরোটা শোনো না । পুরুরবা তখন উর্বশীর খোঁজে সারা দেশ ঘুরে বেড়ায়। একদিন কুরুক্ষেত্রের কাছে একটা পুকুরে পুরুরবা চারজন অপ্সরার সঙ্গে উর্বশীকে স্নান করতে দেখে । পুরুরবা তাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করে। উর্বশী বলে, ’আমি তোমার সহবাসে গর্ভবতী হয়েছি। তুমি এক বছর পর আমার সঙ্গে দেখা করলে, আমি তোমাকে আমার প্রথম সন্তান উপহার দেব এবং মাত্র একরাত্রি তোমার সঙ্গে বাস করব । এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর কাল এক রাতের জন্য উর্বশী আর পুরুরবার মিলন ঘটতে থাকে। উর্বশীর চিরসঙ্গী ও চিরপ্রেমিক উর্বশীর গর্ভে মোট ছয় সন্তান হয়,  আয়ু, বিশ্বায়ু, অমাবসু, বলায়ু দৃঢ়ায়ু ও শতায়ু ।
    –তবে ? ভেবে দ্যাখো ! সামনের মারোয়াড়ি ফ্যামিলিতে একটা বউয়ের ছেলে হলো না বলে দুই ভাই মারামারি করে আলাদা হয়ে গেল !
    –নেহেরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীও কম যান না । ওনার সম্পর্কেও অনেকে নানা কথা লিখে গেছে ওনার কাছের লোকেরা ।
    –হ্যাঁ, এমারজেন্সি, অপারেশান ব্লু স্টার, ঝুপড়ির মুসলমানদের খোজা বানানো, জিপগাড়ি স্ক্যাণ্ডাল । পরে, ১৯৬৯ সালে কংগ্রেস ভাঙার পর, ইন্দিরা গান্ধী টাকার জন্য কমিউনিস্ট দেশগুলোর ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবেই, সোভিয়েতরা তাঁকে উদ্ধার করেছিল। একটু আগে কথা উঠেছিল ভাসিলি মিত্রোখিনের, যিনি কেজিবি আর্কাইভসের দায়িত্বে ছিলেন, ১৯৭১ সালের নির্বাচনের আগে মস্কো কীভাবে কংগ্রেসের কার্যক্রমে টাকা যুগিয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করেছেন। এমনকি ইন্দিরা গান্ধির ক্যাবিনেটেও সোভিয়েটের চর ছিল।
    –ইতিহাস পড়েছিস ? মুঘল আমলে ছিল নজরানা, সেটাই স্বাধীনতার পর উৎকোচ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নজরানার অ্যামাউন্ট দুর্নীতিবাজ কাজীদের  আদালতে মামলার ভাগ্য নির্ধারণ করতো । নজরানা দিতে না পারলে চাষীদের না খেয়ে মরতে হতো । অনেক সময়ে  একজন দরবারী বা মনসবদারের চতুর্থবার বিয়ে করা নির্ভর করতো নজরানার ওপর। জাহাঙ্গিরের আমলে নজরানার নোংরামি নিয়ে লিখে গেছেন নেদারল্যাণ্ডসের পর্যটকরা। ওই ব্যাপারটাই নেহেরুর বংশের লোকেরা চালিয়ে গেছে ।
    –আপনি কী জানেন, বি জি দেশমুখ, যিনি ১৯৮৬-৮৯ সালে মন্ত্রিপরিষদের সচিব ছিলেন, তিনি  আত্মজীবনীতে লিখেছেন: বোফর্স ঘটনার সূত্রপাত ইন্দিরা গান্ধীর শুরু করা প্যাঁচের  মধ্যে পড়ে । কংগ্রেস পার্টির জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য ওনার ছেলে সঞ্জয় তাকে আরও চেকনাই দিয়েছিল৷  ইন্দিরা, তিনি বলেছেন নির্বাচনের  জন্য আর দলের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য টাকা তোলা জরুরি মনে করেছিলেন। এর জন্য, তিনি রজনী প্যাটেল আর বসন্তরাও নায়েকের মতো অনুগত সমর্থকদের উপর নির্ভর করতেন। যখন ইন্দিরা ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে টাকা যোগাড়ের আরও ভাল উপায় হল বিদেশী লেনদেন থেকে কাটমানি নেয়া। সঞ্জয় গান্ধী ১৯৭২ সাল থেকে একে আরও নিখুঁত ও পরিমার্জিত করে ফেলেছিল ।
    –জানি, জানি, তুইই তো বইটা দিয়েছিলিস ।সেই যুগের আরও দু'জন সমানভাবে অপ্রতিরোধ্য সাক্ষী হলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি  ভেঙ্কটারমন এবং শিল্পপতি জে আর ডি টাটা। তার আত্মজীবনী মাই প্রেসিডেন্সিয়াল ইয়ার্স বইতে, ভেঙ্কটারমন টাটার সঙ্গে তাঁর  কথোপকথন বর্ণনা করেছেন। টাটা  বোফর্সের কাছ থেকে কংগ্রেস পার্টির কমিশনের প্রাপ্তি অস্বীকার করা কঠিন । কারণ টাটা অনুভব করেছিলেন যে ১৯৮০ সাল থেকে, শিল্পপতিদের টাকা দেবার জন্য যোগাযোগ করা হতো না । শিল্পপতিরা বুঝতে পেরেছিলেন  যে শাসক দল  কমিশন তুলছিলেন অস্ত্রচুক্তিগুলো থেকে । ব্যাপারটা তহবিল সংগ্রহের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি হয়ে গিয়েছিল, তাই বোফর্স যে ঘটবে তা জানা কথা। এই কেলেঙ্কারিতে, রাজীব আর অন্যদের বিরুদ্ধে কমিশন নেবার অভিযোগ ছিল, সুইডিশ অস্ত্র প্রস্তুতকারক বোফর্সের কাছ থেকে । ভারত যখন সেনাবাহিনীর জন্য ফিল্ডগান কিনেছিল তখন কিকব্যাক নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। রাজীব সংসদে এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। যাইহোক, নেহেরু-গান্ধীরা কখনই ব্যাখ্যা করতে পারেননি যে  বোফর্স কোম্পানি কেন মারিয়া এবং ওটাভিও কোয়াত্রোচির অ্যাকাউন্টে  ৭.৩  মিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিল। 
    –এই লোকটা স্ট্রেঞ্জ ! কোয়াত্রোচিরা এই টাকা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ব্যাঙ্কে সরিয়ে রাখা আরম্ভ করেছিল।  শেষে  চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে গিয়ে রেখেছিল । বাজপেয়ী সরকার যুক্তরাজ্য সরকারকে এই অ্যাকাউন্টটি সিজ করতে বলেছিল, কিন্তু মনমোহন সিং সরকার লন্ডনকে তা প্রত্যাহার করতে আদেশ দেয়, যার ফলে কোয়াত্রোচিরা শেষ পর্যন্ত ৭.৩ মিলিয়ন ডলার নিয়ে পালিয়ে যায়। ভারত যখন তার সেনাবাহিনীর জন্য ফিল্ডগান কিনছিল তখন কেন একজন ইতালীয় ব্যবসায়ী কমিশন খেয়েছিল ? কেন সোনিয়া গান্ধী মনমোহন সিং সরকারকে কোয়াত্রোচিদের অ্যাকাউন্ট ডিফ্রিজ করতে আদেশ দিয়েছিলেন? 
    –ওই সময়ের আরেকটা ঘটনা হলো জাতিসংঘের খাদ্য’র জন্য তেল কর্মসূচির অধীনে ইরাকি তেল বিক্রির অ-চুক্তিমূলক সুবিধাভোগীদের বিষয়ে ভলকার কমিটির রিপোর্টে । তাতে বলা হয়েছে  যে ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন কংগ্রেসকে বেশ মোটা টাকা দিয়েছিলেন । মনে রাখা দরকার যে সাদ্দাম হোসেনের ইরাক ছিল জরুরী অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর একনায়কত্বকে সমর্থনকারী দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি । 
    –ভালো বলেছো ।ওনার কাটমানির গল্প ছাড়াও প্রেমের নানা কাহিনি শুনেছি আর পড়েছি । তরুণী আর যুবতী থাকাকালে, এমনকি বিয়ের পরেও একাধিক প্রেমে পড়েছিলেন । ইন্দিরার এসব প্রেম কাহিনি পাওয়া যায় তার জীবনী লেখিকা ক্যাথেরিন ফ্রাঙ্কের  ‘দ্য লাইফ অব ইন্দিরা নেহেরু গান্ধী’ বইতে। এছাড়া পাওয়া যায় নেহেরুর সচিব এম ও মাথাইয়ের আত্মজীবনীতেও।
    –হ্যাঁ, তোর কাছেই শুনেছিলাম । ১৯৩৬ সালে ইন্দিরার মা কমলা নেহেরু মারা যাওয়ার পর ইংল্যাণ্ডে পড়াশুনা করতে যান ইন্দিরা গান্ধী। সেখানে তাঁর সাথে প্রেম হয় ফিরোজ গান্ধীর আর ১৯৪২ সালে  বিয়ে করেন তাঁকে । ফিরোজ গান্ধী ছিলেন  পার্সি । এ কারণে এ বিয়ে মেনে নিতে চাননি তার বাবা জওহরলাল নেহেরু। বিয়েতে আপত্তি ছিল মহাত্মা গান্ধীরও। তবে কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সুখের হয়নি তাদের এ বিয়ে। বিবাহ বিচ্ছেদ না ঘটলেও ১৯৫০ সালের পর আর একসাথে থাকা হয়নি ফিরোজ-ইন্দিরার। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা শেষ না করেই ভারতে ফিরে আসেন তিনি। তাঁর বাবা তাকে ভর্তি করে দেন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। সেখানে তিনি প্রেমে পড়েন এক জার্মান শিক্ষকের। ওই শিক্ষক তাঁকে জার্মান ভাষা শেখাতেন। ১৯৫০ সালে ফিরোজ গান্ধীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পর থেকে ইন্দিরা তাঁর বাবার একান্ত সহকারী হিসেবে কাজ করতেন তাঁদের ‘তিন মূর্তি ভবনে’। এখানে  তিনি প্রেমে পড়েন তাঁর বাবার সচিব এম ও মাথাইয়ের। মাথাইয়ের সাথে তাঁর প্রেম চলে প্রায় ১২ বছর। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরার যোগ শিক্ষক ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীর কাছে হেরে যান মাথাই। এসব ঘটনা ইতিহাসবিদ এস. গোপালের বইতে পাওয়া যায়। যেহেতু মাথাই দেখতে সুদর্শন ছিল না, সেদিক থেকে ধীরেন্দ্র ছিল অনেক বেশি সুদর্শন এক বিহারী যুবক। এরপর ইন্দিরার জীবনে আসেন দিনেশ সিং। সে প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রী ভবনে গিয়ে আড্ডা দিতো ইন্দিরার সাথে। তারপর থেকেই শুরু হয় প্রেম। দিনেশ সিং ছিলেন জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভার বিদেশমন্ত্রী। এর মধ্যে ফিরোজ গান্ধীর সাথে সম্পর্ক থাকাকালেই আরো একজনের সাথে প্রেম ছিল ইন্দিরার। তার নাম মোহাম্মদ ইউনুস। কে এন রাও তার ‘নেহেরু ডায়নাস্টি’ বইতে লিখেছেন, ইন্দিরার ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী মূলত ইন্দিরা-ইউনুসের ছেলে। কারণ সঞ্জয় মানেকাকে বিয়ে করায় ইউনুস ছিল ক্ষুব্ধ। একজন শিখ মেয়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে মেনে নিতে পারেনি সে। ঘটনাটি মোহাম্মদ ইউনুসের লেখা ‘পারসন, প্যাশন অ্যান্ড পলিটিক্স’ বইতেও পাওয়া যায়।  এতসব সত্ত্বেও রাজনীতিতে কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি ইন্দিরার। 
    –ধ্যুৎ, গাঁজা, পলিটিশিয়ানদের অতো সময় আছে নাকি যে প্রেম করবে !
    –আর কী জানেন ? ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত  শব্দটা একটা ফাঁকা কথা । আমাদের ইসকুল-কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর অর্থনীতির বইগুলো ফালতু । আমাদের দেশটাকে একদল  অলিগার্ক, বিগ বিজনেস আর  একটা সংকীর্ণ, স্বার্থপর, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক অভিজাতরা  হাইজ্যাক করে নিয়েছে । একটা ছোট এবং বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী যারা টাকাকড়ি লুট করার  জন্য শাসন করে । এই এলিটরা , দেশপ্রেম আর গণতন্ত্রের নামে, সমস্ত মূল্যবোধের নামে, যা একসময় প্রাচীন ভারতীয় ব্যবস্থার অংশ ছিল,  পরিকল্পিতভাবে  ধ্বংস করেছে, কোষাগার লুট করেছে, আমাদের গণতন্ত্রকে কলুষিত করেছে আর পাবলিকের মাথায় হেগেছে । 
    –আচ্ছা, সারদা কেলেঙ্কারিটা কী ব্যাপার ? ওটা কি সলভ হয়ে গেছে ? নাকি ধামাচাপা পড়ে গেছে ?
    –জানেন না ? ওটা পশ্চিমবঙ্গের একটা পনজি স্কিমের নাম । 
    –পনজি মানে ?
    –তাও জানেন না ? পনজি  হচ্ছে এক ধরনের কূট কৌশল যেখানে নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা পুরনো বিনিয়োগকারীদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। চার্লস পনজি নামের এক ব্যক্তির নাম থেকে এটা চালু হয়েছে। পঞ্জি স্কিমগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করার মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগের সর্বস্ব আত্মসাত করা। এ ধরনের স্কিম থেকে মূল পরিকল্পনাকারীই কেবল লাভবান হয়ে থাকেন। সঙ্গতভাবেই এ ধরনের ব্যবসার আইনি বৈধতা থাকে না। পঞ্জি স্কিমগুলোতে কোনো প্রকৃত পণ্য, সেবা বা ব্যবসায়িক কাঠামো থাকে না। থাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা কিছু মিথ্যা প্রতিশ্রুতি অথবা প্রস্তাবনা। সহজে অর্থ আয় করার লোভ থেকে বিনিয়োগকারীরা এর ফাঁদে পড়ে পুঁজি হারান। সাধারণ মানুষের লোভকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি বিশেষের লাভবান হওয়ার এমন পঞ্জি স্কিমের ইতিহাস বেশ পুরনো। পঞ্জি স্কিমগুলো মূলত পিরামিড আকৃতির কাঠামোর হয়ে থাকে, যার একেবারে চূড়ায় থাকে মূল পরিকল্পনাকারীরা, যারা স্কিমটি শুরু করেন। এরপর থাকে প্রাথমিক সদস্যরা। প্রাথমিক সদস্যরা নতুন সদস্য সংগ্রহ করেন, যারা তাদের নিচের ধাপে থাকে এবং এভাবে সদস্য দ্বারা সদস্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার মাধ্যমে উপর থেকে নিচের দিকে ছড়ানো একটি পিরামিড আকারের গ্রাহক অবস্থান তৈরি হয়। এই পিরামিডের যতই নিচের দিকে যাওয়া যাবে, ততই এর আকৃতিটি ছড়ানো হয়। অর্থাৎ সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। পুরো পরিকল্পনা থেকে মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রাথমিক সদস্যরাই কেবল লাভবান হতে পারেন। স্বল্পমেয়াদে মুনাফা সহ বিনিয়োগ ফেরৎ পাবার টোপ দেখিয়ে নতুন নতুন গ্রাহক তৈরি করা হয়। নতুন গ্রাহকরা মনে করেন, তারা যদি আরও কিছু গ্রাহককে ঘোষিত স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন তবে তার মুনাফা আরো বাড়বে। তবে পঞ্জি স্কিমগুলো থেকে গ্রাহকরা শেষপর্যন্ত ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন।
    –আমি বলছি, আমি বলছি । বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার সময়েই সুদীপ্ত সেন গুছিয়ে তুলছিলেন তাঁর বেআইনি কাজের ভিত। ২০০৯ সাল থেকে সেবি  সারদার উপর নজরদারি শুরু করে। ২০১১ সালে তারা রাজ্য সরকারকে সারদার সন্দেহজনক গতিবিধির কথা জানায়। ২০১২ সালে সেবি সারদা সংস্থাকে বিনিয়োগ সংস্থা হিসেবে কাজ না করতে বলে, কিন্তু সারদা তাতে সাড়া দেয়নি। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে সংস্থা ধসে পড়ার আগে পর্যন্ত কাজ চালিয়ে গিয়েছে তারা। ব্র্যান্ড তৈরির ব্যাপারে, জনমানসে সংস্থার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সারদা তথা সুদীপ্ত সেনের নজর ছিল সবচেয়ে বেশি। এ ব্যাপারে কাজে লাগানো হয়েছিল রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস ও সে দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন পরিচিত মুখকে। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ শতাব্দী রায়কে। সারদা গোষ্ঠীর মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয় তৃণমূল কংগ্রেসের তৎকালীন রাজ্যসভা সাংসদ মিঠুন চক্রবর্তীকে । তৃণমূল কংগ্রেসের আরেক সাংসদ কুণাল ঘোষকে সারদা মিডিয়া গোষ্ঠীর সিইও নিযুক্ত করা হয়। তিনি মাসে ১৬ লক্ষ টাকা বেতন পেতেন।  আরেক তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসুর সঙ্গে সারদা মিডিয়া গোষ্ঠী ছিল ঘনিষ্ঠ। তৃণমূল কংগ্রেসের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র ছিলেন সারদা গোষ্ঠীর কর্মী ইউনিয়নের শীর্ষে ছিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই সারদায় টাকা খাটানোর পরামর্শ দিতেন। কলকাতা পুলিশকে মোটর সাইকেল উপহার দিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী। রাজ্যের নকশাল অধ্যুষিত এলাকায় অ্যাম্বুল্যান্স এবং মোটর সাইকেল প্রদান করে সরকার, যা স্পনসর করেছিল সারদা গোষ্ঠী। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল সিবিআই-কে একটি চিঠি লেখেন সুদীপ্ত সেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন, বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাদের তিনি প্রচুর পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন। কুণাল ঘোষের চাপাচাপিতেই যে তিনি লোকসানভোগী মিডিয়া গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করেন, এবং তাঁর ব্ল্যাকমেলের জন্যই বাজার দরের চেয়ে কম অর্থে একটি টেলিভিশন চ্যানেল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন, সে কথাও বলেছিলেন তিনি। তদন্ত শুরুর পর তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। সিবিআই গ্রেফতার করে সৃঞ্জয় বসু, মদন মিত্র ও কুণাল ঘোষকে। জেরা করা হয় টিএমসি সহ সভাপতি তথা রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার, তৃণমূল যুব কংগ্রেসের প্রধান শঙ্কুদেব পাণ্ডা, সাংসদ শতাব্দী রায় এবং তাপস পালকে। মমতার নির্ভরযোগ্য সাথী, বর্তমান বিজেপি নেতা মুকুল রায়কেও জেরা করেছিল সিবিআই।সারদা কাণ্ডে সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হবার পর, গোটা সারদা প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ার পর, দেরাজ থেকে কঙ্কালের মত বেরিয়ে আসতে থাকে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সারদার যোগ। নাম জডায়নি, এমন কোনও নেতার সংখ্যা হাতে গোণা। আর সারা রাজ্য জুড়ে অসংখ্য তৃণমূলের ছোট-বড় নেতা কর্মীরা যে এই পঞ্জি স্কিমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাও প্রকাশ্য হতে থাকে।সারদা কেলেংকারি ফাঁস হবার পর মমতা সরকার এর তদন্তে পুলিশের এক বিশেষ তদন্তদল গঠন করে। সে তদন্তদলের শীর্ষে ছিলেন রাজীব কুমার। অভিযোগ, বিশেষ তদন্ত দল সারদার সল্টলেকে অবস্থিত অফিস থেকে বেশ কিছু জিনিস বাজেয়াপ্ত করে, যার মধ্যে ছিল একটি লাল ডায়েরি ও একটি পেন ড্রাইভ। এই দুটিতেই নাকি ছিল যেসব প্রভাশালীদের অর্থ দেওয়া হয়েছে, তাদের নাম। সিবিআইয়ের বক্তব্য সিট এই দুটি জিনিস তাদের কাছে জমা দিচ্ছে না। এ ব্যাপারে রাজীব কুমারকে সন্দেহ করে তারা। সিবিআই রাজীব কুমারের বাড়িতে তল্লাশি করতে এলে, তা প্রতিক্রিয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গণতন্ত্র বাঁচানোর দাবিতে ৪৫ ঘন্টা ধর্নায় বসেন ধর্মতলা চত্বরে। মমতার এই প্রতিক্রিয়ার পর, লাল ডায়েরি ও পেন ড্রাইভে কাদের নাম রয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ ঘোরতর হতে থাকে। 
    –আর নারদা কেলেঙ্কারি ?
    –পশ্চিমবঙ্গের দুটি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা রাজ্যের মানুষকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। এর একটি হলো সারদা এবং অন্যটি নারদ। এই দুটি আর্থিক কেলেঙ্কারি মামলায় জড়িয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল। সরদাকাণ্ডে জড়িয়ে কারাদণ্ড ভোগও করেছেন তৃণমূলের সাংসদেরা। ম্যাথিউ স্যামুয়েল এবং তাঁর সহকর্মী অ্যাঞ্জেল আব্রাহাম, এই দুই জন মিলে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ৫২ ঘণ্টা ব্যাপী একটি স্টিং অপারেশন চালান। এই ভিডিও ২০১৬ সালে জনসমক্ষে প্রকাশ্যে আসে। এই স্টিং অপারেশনে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছিল। গোপন ক্যামেরারূপী এই অস্ত্রে কিছু পরিচিত নেতাদেরই মুখ অভিযুক্ত হিসাবে জনসমক্ষে আসে। এই তালিকায় রয়েছেন, ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মদন মিত্র, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুলতান আহমেদ, অপরূপা পোদ্দার, শঙ্কুদেব পণ্ডা, আইপিএস অফিসার এস এম এইচ মির্জা প্রমুখ। এই ভিডিও ক্লিপে দেখা যায় এই তালিকাভুক্ত সবাই কিছু বিশেষ প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে টাকা নিয়েছেন। এদিকে, স্টিং অপারেশনে ব্যবহৃত ৮৫ লক্ষ টাকা ম্যাথিউ কোথা থেকে পেল, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলে, ম্যাথিউ জানান যে তিনি সাংসদ কে. ডি. সিং-এর সংস্থার থেকে পেয়েছেন। ম্যাথিউয়ের বক্তব্যকে যাচাই করতে এ বিষয়ে আবার তদন্ত শুরু হয়। এই তদন্তে, ম্যাথিউর দাবিকে খারিজ করে দেয়। এরপরে, ম্যাথিউকে অনেকবার নোটিশ পাঠানো হলেও, ম্যাথিউর তরফ থেকে কোনো প্রকারের সাড়া পাওয়া যায়নি।এরই মাঝে, একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে নারদা কান্ড নয়া মোড় নেয়। তৃণমূল দাবি করে যে, স্টিং অপারেশনের ফুটেজে তৃণমূল ত্যাগী ও বিজেপিতে যোগদানকারী মুকুল ও শুভেন্দুর ফুটেজ অনুপস্থিত। যদি বিজেপির তরফ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।উল্লেখ্য, সিবিআই-এর তরফে এই প্রথমবার নারদা মামলায় চার্জশিট পেশ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়কদের অর্থ গ্রহণের এক চাঞ্চল্যকর ভিডিও তথ্য ফাঁস করে প্রচারের আলোতে উঠে এসেছিল দিল্লির নারদ নিউজ ডট কম নামের একটি ওয়েব পোর্টাল। সেদিন তারা তৃণমূল কংগ্রেসের ওই সব নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কদের গোপনে অর্থ গ্রহণের ফুটেজ ফাঁস করে দিয়েছিল। সেই ভিডিওটি আবার কলকাতার রাজ্য বিজেপির কার্যালয়েও সেদিন ফাঁস করে দিয়েছিল বিজেপি। ওই স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা ও মন্ত্রীদের ঘরে ঘরে, হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে টাকা। তাঁরা তা গ্রহণও করছেন।  
    –আরেকটা হয়েছিল রোজভ্যালি কেলেঙ্কারি ? সেটাও পঞ্জি স্কিম ?
    –সেটা চিটফাণ্ড স্কিম । রোজভ্যালি  চিটফান্ড কাণ্ডে এবার সাজা ঘোষণার পালা। সংস্থার এক আধিকারিক অরুণ মুখোপাধ্যায়কে সাত বছরের কারাবাসের সাজা দিল নগর দায়রা আদালত। সেইসঙ্গে আড়াই লক্ষ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ৬ মাস কারাবন্দি থাকতে হবে তাঁকে। এই প্রথমবার রোজভ্যালি সংস্থার একাধিক মামলার মধ্যে একটিতে সাজা ঘোষণা হল।ভুয়ো সংস্থার আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে বেশ কয়েকটি মামলা চলছিল রোজভ্যালির। শেয়ার ডিবেঞ্চার সংক্রান্ত একটি মামলায় সংস্থার কর্ণধার গৌতম কুণ্ডু-সহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় ১৩ কোটি টাকা আর্থিক তছরূপের মামলার তদন্ত করছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট । তাদের দেওয়া চার্জশিটে ছিল ৯ জনের নামই। এরপর চার্জ গঠনের সময়ে অন্যতম অভিযুক্ত সংস্থার আধিকারিক অরুণ মুখোপাধ্যায় নিজেই কেলেঙ্কারির দায় নিজের কাঁধে নেন। ফলে তিনি একাই দোষী সাব্যস্ত হন। শুক্রবার তাঁকে ৭ বছরের জন্য কারাবাসের সাজা শোনাল নগর দায়রা আদালত। গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইতিমধ্যে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের ৪ বছর কারাবাসের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ফলে আর তিন বছর জেলে কাটাতে হবে তাঁকে।
    —ময়দা, সবচেয়ে কোরাপ্ট কারা জানেন ?
    –কারা ?
    –অনেক, অনেক । সুরেশ কলমাডি ; ওনাকে মুম্বাইতে বলা হয়  ওয়ান ম্যান আর্মি। একশো কোটি টাকার বেশি একাই গেঁড়িয়েছে কলমাডি। কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারিতে তিহার জেলে ছিল ; এখন কোথায় জানি না । দুনম্বরে, আন্দিমুথু রাজা : টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির কথা মনে আছে? হ্যাঁ,  মুথু কুখ্যাত টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে ১৭৬০০০ কোটি টাকা গেঁড়িয়েছিল । জেল-ফেল হয়নি, দিব্বি জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। তিন নম্বরে মায়াবতী :  সবাই জানে যে উনি  মুখ্যমন্ত্রীর পদের অপব্যবহার করে সফলভাবে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। তাজ করিডরে রোজগার করেছেন, নিম্নবর্ণের লোকেদের কাছ থেকে টাকা তুলেছেন, লখনউতে বিশাল পার্ক করেছেন, পুরোটা সিমেন্টের, তাতে  হাতি, ওনার আর ওনার গুরুর মূর্তিতে ছয়লাপ। চার নম্বরে  লালু প্রসাদ যাদব: জোকারি করে বেশ জনপ্রিয় । পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে তিন হাজার কোটি টাকা গেঁড়িয়েছিলেন আর জেল খেটেছিলেন । জেল মানে ফাইভ স্টার হাসপাতাল। পাঁচ নম্বরে শরদ পাওয়ার:  ভারতের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা , এককালে দাউদ ইব্রাহিমের গুরু । রামগোপাল ভর্মার ফিল্মে উনি একজন ক্যারেক্টার । জাল স্ট্যাম্প মামলায় জড়িয়ে ছিলেন যার মাধ্যমে  হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির মামলা হলেও তিনি মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পাক্কা খিলাড়ি। ছয় নম্বরে ভি কে শশিকলা:  সুপ্রিম কোর্ট  অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদের জন্য জেলে পাঠিয়েছিল । কর্নাটকের জেলে ছিল বলে তামিলদের পার্টি বেশ চটে গিয়েছিল । তারপর ধরাধরি করে জেলেই ভালো ঘর আর খাবার-দাবারের ব্যবস্হা হয় । সাত নম্বর জয়ললিতা: তামিলরা ডাকতো আম্মা । বেঁচে থাকতে ওনার বিরুদ্ধে ৪৬টা দুর্নীতির মামলা দায়ের হয়েছিল। কয়লা আমদানি কেলেঙ্কারি, তানসি জমির লেনদেন মামলার অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ,  আরও অনেক মামলায়  জড়িয়ে ছিলেন।আট নম্বরে বিএস ইয়েদুরাপ্পা: ঘুরেফিরে কর্ণাটকের  মুখ্যমন্ত্রী হয়, বেশ কয়েকটা জেলার  আকরিক লোহা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে  ছিল। দুর্নীতির দায়ে  মন্ত্রীর পদ খুইয়েছিল।নয় নম্বরে মধু কোডা: ভারতের সবচেয়ে দুর্নাম মন্ত্রীদের একজন। কোডার বিরুদ্ধে অবৈধ খনির ইজারা লাইসেন্স দিয়ে ঝাড়খণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের অভিযোগ ছিল।  ক্ষমতায় থাকাকালীন জমানো সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাকে গ্রেফতার করে জেলে পোরা হয়েছিল। দশ নম্বরে মুলায়ম সিং যাদব: আরেকজন মহা ঘোড়েল দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী যাকে  মায়াবতীর সঙ্গে তুলনা করা হয়। যখনই অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পত্তির মামলা হয়, তখনই মুলায়ম সিংয়ের নাম উঠে আসে।
    –ব্যাস দশজন ? আমি তো ভেবেছিলুম একশো জনের নাম বলবে । আচ্ছা মনমোহন সিংকে কী বলবে ? আমি তাকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করি । উনি সোনিয়া গান্ধীর  ছদ্মনামের মতো আচরণ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদকে লজ্জা দিয়েছেন। কংগ্রেসের বিপক্ষদের আক্রমণ করার জন্য  সিবিআইকে লেলিয়ে  হেয় করেছেন। অনেক কেলেঙ্কারী, অনেক বিতর্ক, কিন্তু তিনি কখনই কোন কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে করেননি। অত্যন্ত যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও উনি বোবা হয়ে সমস্ত নোংরামি সহ্য করেছেন আর একটি শব্দও বলেননি।
    –আরে ওনার কথা বাদ দাও । সবাই জানে উনি নিজেকে পরিষ্কার রাখতে সফল । কিন্তু সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ছিলেন মানিক সরকার, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী, নিজের গাড়ি-বাড়ি ছিল না । টাকার জোরে বিজেপি দখল করে নিলো ত্রিপুরা রাজ্যকে ।
    –কোরার সাইটে কোরাপ্ট কারা জানতে চাওয়া হলে একজন এই তালিকা দিয়েছে, তুই তাদের অনেককে বাদ দিয়েছিস । লোকগুলো হলো, জওয়াহারলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধি, রাজিভ গান্ধি, সোনিয়া মাইনো ( গান্ধি ), রাহুল গান্ধি, প্রিয়ঙ্কা ভদ্রা, শরদ পাওয়ার, আহমদ প্যাটেল, পি চিদাম্বরম, কপিল সিবাল, অভিষেক সংভি, কমলনাথ, সুশীলকুমার শিন্দে, দেভে গউড়া, পৃথ্বীরাজ চৌহান, বসন্তরাও দাদা পাটিল, ডি.কে. শিভকুমার, এইচ, ডি, কুমারস্বামী< হুডা, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং ।
    -–সবচেয়ে ইনটারেস্টিঙ পশ্চিমবাংলার মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর চাকরি পাওয়া। ২০১৮-তে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরেই মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারী এসএসসিতে চাকরি পেয়ে যান।  প্রথমে কোনও মেধা তালিকায় অঙ্কিতার নাম না থাকলেও ওয়েটিং লিস্টে অঙ্কিতার নাম প্রথমে চলে আসে। যার জেরে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ির ববিতা সরকারের ওয়েটিং লিস্টে নাম ২০ থেকে ২১-এ চলে যায়। চাকরি হয় ওয়েটির লিস্টে ২০ পর্যন্ত। বঞ্চিত থেকে যাওয়া ববিতা হাইকোর্টে মামলা করেন। আরটিআই করে অঙ্কিতার নম্বর জানতে চান। কিন্তু কোনও উত্তরই তিনি পাননি। শেষে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দিলে এসএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার জানান, অঙ্কিতার বিষয় ভিত্তিক এবং অ্যাকাডেমিক স্কোর ৬১।  অন্যদিকে ববিতা সরকারের পার্সোনালিটি টেস্টে অংশ নিয়েছেন। তাঁর বিষয় ভিত্তিক, অ্যাকাডেমিক এবং পার্সোনালিটি টেস্টের স্কোর হল ৭৭। অর্থাৎ বেশি নম্বর পেয়ে বঞ্চিত রয়ে গিয়েছেন ববিতা। অঙ্কিতা অধিকারী আদালতের রায়ে চাকরি খুইয়েছেন। তাঁকে ৪১ মাসের মাইনে ফেরতের নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। 
    –তোমরা আর্থিক কেলেঙ্কারির পাণ্ডাদের বাদ দিচ্ছ কেন ? ওরা তো হাওয়ালার মাধ্যমে কোটি-কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে ।
    –কারা ?
    –এক নম্বর, সত্যম কেলেঙ্কারি - ১৪০০০ কোটি । ২০০৯ সালের এই কর্পোরেট কেলেঙ্কারিটি 'ভারতের এনরন কেলেঙ্কারি' নামেও পরিচিত এবং এটিতে বি রামালিঙ্গা রাজু এবং তার সত্যম কম্পিউটার সার্ভিসেস লিমিটেডের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। কোম্পানি স্বীকার করে যে তারা ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি অ্যাকাউন্টের জালিয়াতি করেছে। দুনম্বর, বিজয় মালিয়া - নয় হাজার কোটি । একটা সময় ছিল যখন মানুষ বিজয় মালিয়াকে ‘King of good times’ বলে ডাকত, কিন্তু আজ তার নামে ভালো কোনও কথা কারোর মুখ থেকেই বের হয় না। ২০১৬ সালে, মালিয়া দেশে প্রতারণা এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরে দেশ থেকে পলাতক হয়েছিলেন এবং ব্রিটেনে আশ্রয় চেয়েছিলেন। বিজয় মাল্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের নয় হাজার কোটি টাকারও বেশি পাওনা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।তিন নম্বর, কয়লাগেট কেলেঙ্কারি – ১.৮৬ লক্ষ কোটি ।কয়লা বরাদ্দ কেলেঙ্কারি বা 'কয়লাগেট' হল একটি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি যা ২০১২ সালে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সামনে আসে। কেলেঙ্কারিটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) প্রথম প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।  তৎকালীন সরকারকে ২০০৪ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে অবৈধভাবে ১৯৪টি কয়লা ব্লক বরাদ্দ করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। যদিও CAG প্রাথমিকভাবে ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির অনুমান করেছিল, চূড়ান্ত রিপোর্টে কেলেঙ্কারির পরিমাণ ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে।চার নম্বর,  বোফোর্স কেলেঙ্কারি - ৬৪ কোটি । এটা একটি বড় অস্ত্র-চুক্তি কেলেঙ্কারি যা ১৯৮০-৯০ -এর দশকে ভারত এবং সুইডেনের মধ্যে ঘটেছিল। ১৯৮৬ সালে, ভারত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে তাদের ১৫৫ মিমি ফিল্ড হাউইটজার সরবরাহ করার জন্য সুইডিশ অস্ত্র প্রস্তুতকারক বোফর্স এবির সাথে ১৪৩৭ কোটি টাকার (প্রায়) একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। আজকের সময়ে, বোফর্স কেলেঙ্কারির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।পাঁচ নম্বর, নীরব মোদী পিএনবি ব্যাঙ্ক জালিয়াতি ১১,৪০০ কোটি ।পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রধান অভিযুক্ত নীরব মোদী ও তাঁর ভাইপো মেহুল চোসকি। আর্থিক দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার আগেই গত বছর জানুয়ারির শেষের দিকে তাঁরা দেশ ছেড়ে পালান।  ১৪ মার্চ ৪৮ বছরের নীরব মোদীকে গ্রেফতার করে স্কটল্যান্ট ইয়ার্ডের পুলিশ ভারতে আর্থিক তছরুপের অভিযোগে গ্রেফতার করে। ছয় নম্বর, অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারি- ৩৬০০ কোটি । ভারতের কুখ্যাত প্রতিরক্ষা কেলেঙ্কারিগুলির মধ্যে একটি এই প্রতারণা মামলা। এই মামলাটি ২০১০ সালের UPA সরকার এবং অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ডের মধ্যে ১২টি হেলিকপ্টার অধিগ্রহণের জন্য স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি যা ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য ভিভিআইপি দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। চুক্তিটি ৩৬০০ কোটি টাকা মূল্যের ছিল।সাত নম্বর, হাওয়ালা কেলেঙ্কারি - ১৮ মিলিয়ন ডলার । হাওয়ালা কেলেঙ্কারি ১৯৯০-এর দশকে জনসাধারণের নজরে আসে, যা এল কে আডবানি, অর্জুন সিং, যশবন্ত সিনহা এবং মদন লাল খুরানার মতো রাজনীতিবিদদের এবং আরও অনেককে ঘুষের সাথে জড়িত বলে স্পটলাইট করে। এই কেলেঙ্কারীটি জৈন ভাই নামে পরিচিত হাওয়ালা ভাইদের ঘিরে তৈরি হয়েছে। 
    –হাওয়ালা ব্যাপারটা কী ? কেমন কে অপারেট করে একটু বুঝিয়ে বলুন ? হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে একবার আঠারো মিলিয়ন ডলার লেনদেনের খবর পড়েছিলাম। হাওয়ালা কেলেঙ্কারি ১৯৯০-এর দশকে জনসাধারণের নজরে আসে, যা এল কে আডবানি, অর্জুন সিং, যশবন্ত সিনহা এবং মদন লাল খুরানার মতো রাজনীতিবিদদের এবং আরও অনেককে ঘুষের সাথে জড়িত বলে স্পটলাইট করে। এই কেলেঙ্কারিটিা জৈন ভাই নামে পরিচিত হাওয়ালা ভাইদের ঘিরে তৈরি হয়েছিল বলে শুনেছিলাম। 
    –'হাওয়ালা'  শব্দটা আরবি । এর মানে, লেনদেন।  পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা আর ভারতীয় উপমহাদেশে একদল দালাল আছে যারা পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। চিরাচরিত ব্যাঙ্ক বা অর্থব্যবস্থায় যে টাকা লেনদেন হয়, হাওয়ালা হল তার সমান্তরাল  পদ্ধতি।  আগেকার কালে টাকা বা সোনা নিয়ে অনেকখানি  রাস্তা পাড়ি দেওয়া নিরাপদ ছিল না । হাওয়ালা গোয়েন্দাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ, জঙ্গিরা নাশকতা চালাতে যে টাকাকড়ি যোগাড় করে কিংবা রাজনীতিবিদরা ভোটের সময় যে খরচ-খরচা করে, তার সিংহভাগ টাকা আসে এই কায়দায়। এদেশে তোলা ঘুষও বিদেশে যায় একই কায়দায় ।হাওয়ালায় একদল দালাল থাকে টাকা নেবার জন্য। এদের বলা হয় হাওয়ালাদার। ধরা যাক,  দুবাইয়ের হাওয়ালাদার কারও কাছ থেকে টাকা পেল। তখন সে যোগাযোগ করবে যেখানে টাকা পাঠাতে হবে, সেই দেশে নিজের এজেন্টের সঙ্গে। এ বার সেই এজেন্টকে টাকা পাঠানো হবে না, শুধু  'পাসওয়ার্ড' দেওয়া হবে। এমন একটি শব্দ, যা মনে রাখতে হবে এজেন্টকে। যে লোকটাকে এজেন্ট টাকা দেবে, তাকেও বলে দেওয়া হবে ওই শব্দ। যার হাতে টাকাটা দিতে হবে সে 'পাসওয়ার্ড' এজেন্টকে বললে তবেই এজেন্ট  গ্রাহকেকে টাকাটা দেবে। প্রতিটা লেনদেনের ক্ষেত্রে হাওলাদাররা দুই শতাংশ কমিশন নেয়। মুখে-মুখে লেনদেন হয় বলে ব্যাঙ্ক বা বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রে এর কোনও প্রমাণ থাকে না। 
    –-হ্যাঁ। সরকারের অনেক লোকসান হয় । আবার রাজনীতিকরা আর কালোবাজারিরা হাওয়ালায় বিদেশে টাকা পাঠায় ।  ভারতে হাওয়ালা লেনদেনের ছবিটা ভয়াবহ। আইআইএম ব্যাঙ্গালোরের অধ্যাপক আর বৈদ্যনাথনের মতে, ভারত গত ছয় দশকে কর ফাঁকি বাবদ দেড় লক্ষ কোটি ডলার হারিয়েছে। আর এর ৪০ শতাংশই হয়েছে হাওয়ালা লেনদেনের কারণে। হাওয়ালা অবৈধ । হাওয়ালা নিয়ে যা আইন আছে, তা খুব কড়া। কিন্তু হাওয়ালায় এত বিপুল টাকা দেওয়া-নেওয়া হয় যে, গোয়েন্দারা এখন তা বন্ধ করতে পারেনি। বিদেশে  অনেক ভারতীয় আছে, যাঁরা ব্যাঙ্ক মারফত টাকা পাঠায় না। কারণ সংশ্লিষ্ট দেশে হয়তো বেআইনিভাবে বসবাস করছে। ব্যাঙ্কে গেলে নাম-ঠিকানা দিয়ে টাকা পাঠাতে হবে। সেক্ষেত্রে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বাড়িতে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে হাওয়ালার আশ্রয় নিতে হয়। ভারতে হাওয়ালায় টাকা লেনদেন বেআইনি ঘোষিত হয়েছে দু'টো আইন মারফত। একটা হল ফেমা বা ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০০ অন্যটা প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২। 
    –ইনডিয়াকে আরেকজনের মাধ্যমে ডিফাইন করি, কী বলেন ?আগের অর্থমন্ত্রী পালানিয়াপ্পান চিদাম্বারামকে দুর্নীতি আর অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন সময় ঘুষ নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগের অর্থ আত্মসাত করেছিলেন । তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে।২০০৭ সালে অর্থমন্ত্রী থাকাকালে আইএনএক্স গ্রুপের দশ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আত্মসাত করার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। মি. চিদাম্বারামের ছেলে কার্তি চিদাম্বারামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ঐ বিনিয়োগের ছাড়পত্র পাইয়ে দেয়ায় আইএনএক্স'এর কাছ থেকে ঘুষ পেয়েছিলেন তিনি। আর্খিক লেনদেন বিষয়ক অপরাধের তদন্ত করা সংস্থা সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট অভিযুক্ত দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। ২০১৮ সালে কার্তি চিদাম্বারামকে গ্রেফতার করে সিবিআই, কিন্তু পরে তাকে জামিনে ছাড়া হয়। তিনি ভারতের দক্ষিনাঞ্চলের রাজ্য তামিল নাড়ুর একজন কংগ্রেস এমপি ।
    ––বুঝলেন,ভারতীয় রাজনীতিকদের দুর্নীতির দায়ে শাস্তি দেওয়া খুবই কঠিন। কোনো কিছুই প্রমাণ হয় না, যদি শাসকের সঙ্গে একটু আপোস করা যায়। বোফর্সে রাজীব, হাওলায় নরসিংহ রাও, সাংসদ কেনাবেচায় শিব সোরেন, নারদা-সারদা-রোজভ্যালিতে তৃণমূল, কফিন কেলেঙ্কারিতে জর্জ ফার্নান্ডেজ, সঙ্গতিহীন সম্পদে মুলায়ম সিং বা মায়াবতী, ২জি কেলেঙ্কারিতে এ রাজা-কানিমোঝি, কমনওয়েলথ গেমস দুর্নীতিতে সুরেশ কালমাদি, গুজরাট গণহত্যায় নরেন্দ্র মোদি, সোহরাবুদ্দিন শেখ হত্যায় ও বিচারপতি লোয়ার মৃত্যুতে অমিত শাহ, কেউই দোষী সাব্যস্ত হয়নি। সকলেই ধোয়া তুলসি পাতা। ব্যতিক্রম কেবল লালু প্রসাদ যাদব। কারণ তিনি আদবানির রথ রুখেছিলেন আর সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গে আপোস করেননি।
    –সবচেয়ে চুতিয়া টাইপের নিরক্ষর হল রাজনৈতিকভাবে  অশিক্ষিতরা । তারা শোনে না, কথা বলে না বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে না। তারা জীবনের দাম জানে না , বাজারে জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ছে জানে না, কারা বাড়াচ্ছে জানে না । আলু-পটলের দাম, মাছের, আটার দাম, ভাড়া, জুতো, ওষুধের দাম, সবই নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। রাজনৈতিক নিরক্ষর  লোকগুলো এতটাই বোকা যে তারা গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলে যে তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। মূর্খরা জানে না যে, তাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় পতিতা, পরিত্যক্ত সন্তান আর সর্বাপেক্ষা জঘন্য চোর, রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের কোটিপতি দোস্ত।
    –কারেক্ট । যে বউটা নিজের চটি খুইয়ে চটিটা ছুঁড়ে মারতে চেয়েছিল তাকে তারিফ করতেই হয় ।
    –হ্যাঁ, খালি পায়ে বাড়ি ফিরেছে । ওটা কিন্তু আসল ইনডিয়ার সংজ্ঞা ।
    –চটি মারার ব্যাপারটাকে নিম্নমর্ণের ক্রোধ হিসেবেও দেখা যায় । সাবলটার্ন ইনডিয়া ।
    –দুর্নীতি ভারতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে আর ভারতীয় সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেঁদিয়ে গেছে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন একাডেমিয়া, ব্যবসা, ব্যাঙ্কিং, আইন প্রয়োগকারী আর অন্য রোজকার পরিষেবাগুলোয় ঘটে যাওয়া ব্যাপক দুর্নীতি আমাদের মতন মানুষের ঘাড়ে খাঁড়ার কোপের মতন নেমে এসেছে ।সামাজিক শৃঙ্খলা দুর্নীতি  সামাজিকভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে আর অনেক ক্ষেত্রে এটা অনিবার্য আদর্শ হয়ে উঠেছে। আমি তো কলকাতা থেকে এসে ভোটার কার্ডটা ট্রান্সফার করাবার জন্য কতো দৌড়োদৌড়ি করলুম । তারপর শুনলুম যে ঘুষ না দিলে হয় না । 
    –শেষ পর্যন্ত হয়েছে ?
    –তুমি  রেশন কার্ড করিয়ে দেবার পর হয়েছে ।
    –সউদি আরবে যাচ্ছো নাকি, ছেলের কাছে ? 
    –আরে হঠাৎ টপিক পালটে ফেললে ; এখনও তো কয়লা পাচার, গোরু পাচার, আরো নানা পাচার-কাহিনি আলোচনা হয়নি তো !
    –নাহ, আর কোথাও যাবো না ; ছেলেকে অবশ্য বলেছিলুম, একটা আরবি মেয়েকে বিয়ে কর, আরবের সবাই বেশ ফর্সা আর সুন্দরী, তাহলে আমরাও হজ করতে যাবো । মক্কা-মদিনা দেখা হয়ে যাবে। ও বলেছে ও আর কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়বে না । যাকে বিয়ে করেছিল তার গায়ে বিটকেল গন্ধ আর চেপে গিয়েছিল যে ওর ইউটেরাসে সমস্যা আছে, কোনোকালে মেন্স হয় না।
    –ও বাবা, আমাদের বলেননি তো !
    –এসব আবার বলাবলির বিষয় নাকি ।
    –নাহ, আর কোথাও যাবো না । বিদেশের মরুভূমি দেখা হয়ে গেছে দুবাই, আবুধাবিতে, গ্র্যাণ্ড মসজিদ ঘোরা হয়ে গেছে । ইউরোপে তুষার দেখা হয়ে গেছে । যা-যা দেখার আর খাবার তা সেরে ফেলেছি। কতো মেমেন্টো জড়ো করা হয়েছে নানা দেশ থেকে, সেগুলো এখন সমস্যা । ধুলো পড়ে এমন হয়েছে যে চেনা যায় না। কলকাতা ছাড়ার সময়ে অনেক মেমেন্টো বিলিয়ে দিয়ে এসেছি আর আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছি। যেগুলো ফ্রিজে আটকানো ছিল সেগুলো ফ্রিজসুদ্ধ দিয়ে দিয়েছি । যৌবনে জড়ো করা সব জিনিস এখন ফালতু মনে হয়।
    –বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির প্রবণতা নিয়ে রিপোর্ট দেয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ৷ তাদের রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৪ সালে ভারতের দুর্নীতির র‌্যাঙ্কিং ছিল ৮৫ তম স্থানে । ২০২১ সালে ভারতের অবস্থান আরও কিছুটা নিচে নেমে গিয়েছে ৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সততার এই পরীক্ষায় ডেনমার্ক আর নিউজিল্যান্ড ১০০-র মধ্যে ৮৮ পেয়েছে ৷ আর ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড ৮৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসবে নিজেদের প্রমাণ দিয়েছে ৷ ভারত এই পরীক্ষায় মাত্র ৪০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে ৷ সারা বিশ্বে এই গড় ৪৩ শতাংশ৷ আর এই ক্ষেত্রে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১ টি দেশের গড় ৪৫ শতাংশ । ভারতের র‌্যাঙ্কিং এশিয়া-প্যাসিফিক গড়ের চেয়ে অনেক খারাপ । চিন ৪২ নম্বর পেয়ে ৭৮তম স্থান জায়গা করে নিতে পেরেছে৷ কোরোনা প্যানডেমিক কেবলমাত্র একটি অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য বিপর্যয়ই নয়, এটি দুর্নীতিও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ৷ 
    –আরেকটা নতুন টার্ম শুনছি, কাটমানি। সেটা কী ? 
    –তুই জানিস না ? পশ্চিমবঙ্গের সমসাময়িক পরিস্থিতি বলছে, ‘কাটমানি’ হল সেই টাকা যা কোনো সরকারি প্রকল্পের অনুমোদন দিতে বা পরিষেবা পাইয়ে দিতে জনপ্রতিনিধি, মানে দাপুটে নেতার হাতে তুলে দিতে হয়। অর্থাৎ, সরকার নির্ধারিত মোট টাকা থেকে যে টাকা ‘কাট’ করে কাজের স্বার্থে প্রভাবশালীর হাতে তুলে দিতে হচ্ছে, সেটাই ‘কাটমানি’। মোদ্দাকথা হচ্ছে কোন সরকারি অর্থ বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের মধ্যে সাহায্য হিসেবে বিতরণ করতে হলে এই উক্ত শ্রেণীর মাধ্যমে অর্থাৎ— ফুলনেতা, হাফনেতা , টেপিনেতা, ফুটিনেতা এনাদের হাতে কাটমানি হয়ে অবশেষে যতকিঞ্চিত, যার নামে সকারী খাতায় টাকাগুলো মঞ্জুর হয়েছে এর হাতে এসে পৌছায়।উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, কোনো সরকারি প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ ১০০ টাকা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি গ্রাহককে জানালেন, ওই টাকা পাওয়ার অনুমোদন পেতে তাঁকে ২৫ টাকা ‘চার্জ’ জিতে হবে। এই টাকা বেশির ভাগ সময়ই নিচু তলার রাজনীতিক থেকে উঁচু তলায় স্তরে স্তরে পৌঁছে যায়।
    –-সিন্ডিকেট ? সেটাও তো পশ্চিমবাংলার অবদান । কিন্তু ইনডিয়াকে ডিফাইন করে আই থিংক ।
    –সিন্ডিকেট নামের রাক্ষসগুলোর জনক কারা , এই প্রশ্ন তুললে দলগুলোর মধ্যে চাপানওতোর চলে । বামপন্থীরা বলে, তাঁদের জমানায় রাজারহাটে কো-অপারেটিভ ছিল ।  তৃণমূল কংগ্রেস এসে  সিন্ডিকেট ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে । তৃণমূল কংগ্রেস বলবে, তারা উত্তরাধিকার সূত্রে ব্যবস্থাটা পেয়েছে । কেন প্রতিটি দলই পশ্চিমবঙ্গে সিন্ডিকেট বা সেরকম ব্যবস্থাকে তোল্লাই দেয়, সেই প্রশ্নের উত্তর আছে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থায়। পশ্চিমবঙ্গে বড়ো শিল্প নেই, ফলে বড় মাপের কর্মসংস্থানও নেই। যা আছে,  তা প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব ।  এই অবস্থায়  রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ব্যবহার করে কনট্রাক্টরদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে একটা দল । যে হেতু পশ্চিমবাংলায় চাকরি-বাকরি নেই তাই  রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে সিন্ডিকেটে কাজ করতে হয় বেকার ছেলেদের । আবার, তাদের হাতে রাখতে চায় রাজনৈতিক দলগুলো । ফলে, সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় না দিয়ে  উপায় নেই।  এক নেতা একবার বলেছিলেন, সিন্ডিকেটের গায়ে হাত পড়লে সরকার পড়ে যাবে ।  সিন্ডিকেট থেকে বাড়ি তৈরির মাল আর শ্রমিক নিতে হয় । না নিলে বিপদ । চাকরির সমস্যার সমাধান না হওয়ায়  এই রাজনৈতিক হাতিয়ার প্রয়োগ করতে হয়। সিন্ডিকেটের নামে  জুলুম চলে। 
    –সিন্ডিকেট ব্যাপারটা ঠিক কী ? একটু বুঝিয়ে বলুন ।
    –সিন্ডিকেটের একেবারে প্রাথমিক ধাপ হল, যখন কোনও পার্টির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন প্রোমোটাররা, তাঁকে সেই ওয়ার্ডের প্রভাবশালী নেতাকে ‘প্রণামী’ দিতে হয়, মানে মোগল আমলের সেই নজরানা। কী সেই ‘নজরানা’? দমদম সংসদীয় এলাকায় জায়গা বুঝে একটা থোক টাকা, সেটা দু’লক্ষ,তিন লক্ষ কিংবা তারও বেশি হতে পারে। তারপরের ধাপ হল সিন্ডিকেটের বরাত। এখন এই মুহূর্তে দমদম এলাকায় সেই রেট চলছে ৩৫০-৩৭০ টাকা স্কোয়্যার ফিট। প্রোমোটারদের কথায়, এতে আবার রয়েছেন সেই দাদা-দিদিদেরই অনুগামীরা। তাঁদেরকে সেই টাকা দিতে হয়। তাঁরাই মূলত ইট-বালি-সিমেন্টের বরাত পান। এর অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। প্রমোটারদের চলতি কথায়, তা হল ‘সিন্ডিকেট কেনা’। এই অনুগামীদের বরাত না দিয়ে তাঁদেরকে একটা থোক টাকা দিয়ে দেওয়া হল। একেবারে কর্পোরেট কায়দায় চলে সিন্ডিকেট রাজ। কাউন্সিলরদের মধ্যেই যে সিন্ডিকেট নিয়ে বিবাদ তুঙ্গে, তা তাঁর কথাতেই স্পষ্ট। আর এরই ফায়দা লুঠছে এক শ্রেণির মানুষ।
    –সরকার কনট্রোল করলেই তো পারে ?
    –সিন্ডিকেটকে কেন কনট্রোল করা উচিত, সেই প্রশ্নের একরকম উত্তর রাজারহাটে পাওয়া গেলে অন্যরকম উত্তর পাওয়া যাবে হলদিয়ায়। এক দিকে যেমন সিন্ডিকেটের জুলুমে বাড়িটাড়ি তৈরির খরচ বেড়ে যায়, ফলে ফ্ল্যাটের দাম ন্যায্য স্তরের তুলনায় বেশি হয়, অন্য দিকে বাড়ি তৈরির গুণমানও  ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, বাজারে  চাহিদা পড়ে যায়। তার প্রভাব পড়ে কাজে, ইঁট-বালি-সিমেন্ট-লোহার  সার্বিক চাহিদায়। অন্য দিকে, হলদিয়ার অভিজ্ঞতা বলবে, এই সিন্ডিকেটের জুলুমে এক বহুজাতিক সংস্থা বন্দরের কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হল, আর তার ফলে বন্দর-বাণিজ্যের একটি বড় অংশ চলে গেল প্রতিবেশী রাজ্যে। মানে, সিন্ডিকেটের জুলুমে যে শুধু কনট্রাক্টারের ক্ষতি হয়, তাই নয়— ক্ষতি হয় পুরো  রাজ্যের । সিন্ডিকেট প্রথা কনট্রোল করা অসম্ভব হয়ে গেছে । 
    –প্রতিটি নির্বাচনের আগেই তোলাবাজি, কাটমানি ও সিন্ডিকেট নিয়ে হুঁশিয়ারি দেবে প্রশাসনের শীর্ষ মহল। বিরোধীরাও গলা চড়াবেন। ঠিক যেমন গত বুধবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের ভাবী কাউন্সিলরদের সিন্ডিকেট ও তোলাবাজি নিয়ে হুঁশিয়ারি দেন। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বদলাবে কি? আরও এক নির্বাচনের আগে সেটাই প্রশ্ন। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, গত ভোটে মমতা কাটমানির টাকা ফেরত দিতে বলার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। দিনকয়েক চুপ ছিলেন নেতা-দাদারা। শোরগোল থিতিয়ে যেতেই যে কে সে-ই! পুরভোটের পরেও তেমনটাই হতে পারে। তাঁদের অভিযোগ, পুর পরিষেবার মাধ্যমেই বছরভর সব চেয়ে বেশি টাকা কামানোর কারবার চলে। মমতাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিষয়টি তাঁর অজানা নয়। জনসভায় তিনি বলেন, ‘‘আমার এলাকায় কেউ ঘরবাড়ি করলে সমস্ত কিছু আমার থেকে কিনতে হবে, তা হবে না। কেউ ঘরবাড়ি করলেই আমাকে এত টাকা দেবে, তা-ও হবে না।
    –আর তোলাবাজি ? কতোরকমের টার্ম যে ইনডিয়াকে ডিফাইন করে তার ইয়ত্তা নেই মাইরি ।
    –জানিস না ? তোলা মানে চাঁদা । বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বা রাস্তায় গাড়িটাড়ি থামিয়ে, চাঁদা আদায় । আজকাল বাজারে চাঁদা তোলার রসিদও বিক্রি হয় । রসিদ দেখিয়ে দিলে সন্দেহ কম হয় । তবে আবদার বদলে গিয়েছে হুকুমে। খুদেদের সরিয়ে ঢুকে পড়েছে বড়রা। দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে একই সারিতে ঢুকে পড়েছে সরস্বতীও। সৌজন্যে চাঁদার জুলুম। আর তার ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সম্প্রতি হাঁসখালির ফুলবাড়িতে চাঁদার জুলুমবাজিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাসের। অভিযোগ, তাঁর অনুগামীরা এক ট্রাক চালক ও খালাসিকে গাড়ি নিয়ে তাড়া করে বেধড়ক মারধর করে। গুরুতর জখম অবস্থায় ওই দু’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। তাঁদের ‘অপরাধ’ ছিল সরস্বতী পুজোর উদ্যোক্তাদের দাবি মতো তাঁরা চাঁদা দিতে পারেননি।
    –আপনি তো গায়ক হতে চেয়েছিলেন ! ইনডিয়ার ল্যাঙ খেয়ে গেলেন ?
    –ঘায়ে খোঁচা দিও না । যারা  সাহিত্য, সঙ্গীত, ব্যবসা, রাজনীতি, খেলাধুলো, শিল্পকলা ইত্যাদিতে সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার স্বীকৃতি লাভ করে — তাদের সবচেয়ে প্রতিভাবান মনে করার কারণ নেই। আমাদের মধ্যে অগণিত মানুষ আরও বেশি গুণ সম্পন্ন হলেও, তাদের বিকাশের সুযোগ, বাজারের সমর্থন বা সম্পদের অভাবে তারা ঢাকা পড়ে যায়। যদিও সাফল্য আর প্রতিভার মধ্যে সম্পর্কটা অস্পষ্ট,  গণসমাজ একটা মেধাতান্ত্রিক আদর্শকে সমর্থন করে, যা উল্টোটায় জোর দেয়, মানে যারা সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছে, তারা সর্বদা সবচেয়ে প্রতিভাবান। এর ফল বিষময়। সফলতা  যাদের গণমানসে এড়িয়ে যায়, তারা কেবল ব্যর্থতার  আঘাতগুলোকে সহ্য করে না,  তাদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার অপমানও সহ্য করতে হয়, কারণ তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ, বাজারের  সমর্থন আর সম্পদ নেই।
    –কথাটা ঠিক । আচ্ছা গরু পাচারেও নাকি পলিটিশিয়ানদের হাত আছে ? দেশে গোমাংস বিরোধী একটা উন্মাদনা যেমন ধর্মনিরপেক্ষতার সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করছে, তেমনই খাদ্য নির্বাচনের স্বাধীনতা হরণকেও আন্তর্জাতিক কূটনীতি ভাল চোখে দেখে না। নিজের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কারও উপর চাপানো ঠিক নয়। জাতীয় স্বার্থে রাজনীতি ও কূটনীতি পরিচালিত করার বদলে ‘এক ধর্ম, এক ভাষা, এক খাদ্য’কে সামনে আনা হচ্ছে, যার অর্থ হল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহিষ্ণুতার আদর্শকে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে । সাম্প্রতিক কালে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন আর আগে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং যখন ভারতে এসেছেন, তখন তাঁদের নিরামিষ খেতে দেওয়া হল, যা রুশ ও চিনা অতিথিরা ভাল ভাবে নেননি।
    –ভোট রাজনীতির সুবিধা তোলার জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদের ব্যবহার করে শাসকদল এবং তাদের ধ্বজাধারীরা সমাজের জটিল ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং এর ফলাফল যে কী হতে পারে, সেটি সম্পর্কে তাঁদের কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। এই ঘটনাপ্রবাহ এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট স্থিতিস্থাপকতার পরিচয় দিয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ১৯৯০-এর দশকে মুসলিম মৌলবাদের জোয়ারের সময়ে ভারতীয় মুসলমানরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চরমপন্থার ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হননি। কিন্তু বর্তমানে এই মানুষেরা ক্রমাগত পক্ষপাত এবং শাসানির শিকার হচ্ছেন। এই আক্রমণ তাঁরা আর কত দিন সহ্য করতে পারবেন, তা স্পষ্ট না হলেও ভারতীয় গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিতে ভাঙন ধরানোর ফলাফল যে মারাত্মক হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
    –মুসলমানদের অবস্থাও শোচনীয়। তথাকথিত গো-রক্ষা গোষ্ঠীর লোকজন দ্বারা নির্যাতন এবং খুনের একাধিক ঘটনার পরে বর্তমানে মুসলমানদের নিধন করার জন্য খোলাখুলি ভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে। গুরুগ্রামে মুসলমানদের শুক্রবারের নমাজ পাঠ বন্ধ করার জন্য ধারাবাহিক প্রচার চালানো হচ্ছে। এই মুহূর্তে দেশের সর্বাধিক আধিপত্য বিশিষ্ট মতবাদ, ‘হিন্দুত্ব’, সম্পূর্ণ অশিক্ষিত না হলেও প্রকৃত ইতিহাসের এক অর্ধশিক্ষিত ধারণার উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে একটি উদ্ভট মতবাদ গড়ে তোলা হচ্ছে যে, বর্তমানে দেশের মুসলিম অধিবাসীরা ব্যক্তিগত ভাবে সেই সকল নৃশংসতার জন্য দায়ী যা আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে কোনও মুসলমান শাসক বা আক্রমণকারী দ্বারা করা। খ্রিস্টান জনসেবামূলক কাজ এবং বিদ্যালয়গুলির উপরে ধর্মান্তরকরণের অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু দেড়শো বছর ব্রিটিশদের ‘খ্রিস্টান’ শাসনের পরেও কেন এ দেশের মাত্র ২% মানুষ এই ধর্মাবলম্বী সে বিষয়ে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।
    –বেড়ে চলা অসহিষ্ণুতার অভিযোগে ভারতের সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, অভিনেতারা সোচ্চার হয়ে উঠছেন৷ দলমত নির্বিশেষে লেখকরা দলে দলে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন৷ অথচ সরকার এর পেছনে রাজনৈতিক চক্রান্ত দেখছে৷ হিন্দুত্ববাদীদের রোষের মুখে প্রাণ দিতে হয়েছে কর্ণাটক রাজ্যের শিক্ষাবিদ কালবুর্গি থেকে শুরু করে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে মহম্মদ আখলাককে৷ সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ, সমাজকর্মী গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর আর যুক্তিবাদী এমএম কালবুর্গী হত্যার মধ্যে  যোগাযোগ আছে, সেকথা সবাই জানে ।
    –ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কিছু না কিছু ভিন্ন সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়ের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা এবং বিয়ে হচ্ছে৷ মৌলবাদী হিন্দুরা যার নাম দিয়েছে ‘লাভ জিহাদ'৷ প্রথমদিকে নাম ছিল রোমিও জিহাদ৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা কিছুতেই এই‘লাভ জিহাদ' মেনে নিতে পারছে না৷ কেন পারছে না ? কারণ, এটা তাদের মতে, ধর্মান্তর করা ছাড়া আর কিছুই না৷ এই অভিযোগে হিন্দু-মুসলিম দম্পতির বাড়িতে গিয়ে চড়াও হচ্ছে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল বা সংঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ৷ তাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে৷
    – ‘মৌলবাদ’ শব্দটির ব্যবহার বিগত শতাব্দীতে এমন কি এই বিংশ  শতাব্দীর প্রথমার্ধেও আদৌ হয়েছিল বলে মনে হয় না। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্ৰ বা রবীন্দ্রনাথ–বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যাদের হাতে শৈশব পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছিল, তাঁরা ধর্ম, ধর্মীয় গোড়ামি, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্ম সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে বহু আলোচনা করলেও তাদের লেখায় কোথাও মৌলবাদ শব্দটি সাধারণভাবে চােখে পড়ে না। এটি অবশ্যই ঠিক যে, তাদের প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে পড়ে তারপর এমন মন্তব্য করা হচ্ছে তা নয়। উপযুক্ত গবেষক ও মনোযোগী পাঠক এ ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারবেন। তবে এতে অন্তত কোন সন্দেহ নেই যে, বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে (বিশেষত আশির দশকের শেষার্ধ থেকে, রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কের প্রসঙ্গে) বাংলা ভাষায় এই শব্দটি পূর্বেকার কয়েক শত বছরের তুলনায় এত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে যে, শব্দটির উদ্ভবই এই সময়ে ঘটেছে বলে বলা যায়।
    –আমাদের এই সংস্কৃতির ভিত্তি বা উৎস ধর্ম নয়, বরং লোকায়ত চিন্তা ও ভাবাদর্শ, যা প্রজন্ম–পরম্পরায় চলে আসছে। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত। শুধু আধুনিক লিখিত সাহিত্যে নয়, পালা, পল্লিগান, যাত্রা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রকাশ ও বিস্তার আমরা দেখি, যার মধ্যে কিছু ধর্মীয় বিষয় ও কখনো কখনো রাজপুরুষদের কাহিনি থাকলেও (মহাকবি ও শ্রেষ্ঠ নাট্যকার শেক্‌সপিয়ারের নাটকেও রাজরাজড়ার ও ভূত-প্রেতের কাহিনি আছে) মর্মবস্তুর মধ্যে যা প্রধান ছিল, তা হলো মানুষের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উদারপন্থী মতবাদ। ঐতিহাসিক সুজিত আচার্য ‘বাংলায় ইসলাম ধর্মের আদিপর্ব’ নামক রচনায় বলেছেন, এ দেশে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল তরবারির জোরে নয়, বরং সুফি মতবাদী ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা। তাঁদের মতবাদের সঙ্গে এই দেশের শোষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তাদের সহজিয়া মতবাদের অনেক সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিল। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের অনেক আগেই যে বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া মতবাদ ও বেদবিরোধী লোকায়ত দর্শন জনমনে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছিল, তার মানবিক দিক ছিল ।
    –কর্পোরেট বাজারও মৌলবাদ, তা ভুললে চলবে না ।  ধরে নেয়া হয় যে বাজারের সর্বোচ্চ ব্যবহার সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতাকে উন্মুক্ত করবে আর  ফলাফল হবে আরো ভালো পণ্য, আরো বেশি বিক্রি, আরো বেশি মুনাফা আর এজন্য সবকিছুই বৈধ। এই প্রতিযোগিতার প্রভাব কার উপর কেমন পড়লো কিচ্ছু যায় আসে না। বর্তমানের তথাকথিত 'মুক্ত বাণিজ্য'র আদর্শ এই নয়া-উদারনীতিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চায়। এই বাজার মৌলবাদে এটি প্রায় একটি বিশ্বাস হিসাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় যে বাজারের অদৃশ্য হাত সবসময়ই ভালো ফলাফল বয়ে আনবে। বাজার মৌলবাদ কার্যত পুরুষতান্ত্রিক। পুঁজিবাদ কার্যত পুরূষতন্ত্রের একটি রূপ। নারীবাদীদের অনেকেই বলেছেন পুঁজিবাদ এবং পিতৃতন্ত্র সম্পূর্ণ একদেহ না হলেও দুই-এর সম্পর্ক নিবিড়। পুঁজি আর পিতৃতন্ত্রের যৌথতায় নারীর অধঃস্থনতার আধুনিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। 
    –বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে হওয়া লোহাচুর কেলেঙ্কারির বিপুল আর্থিক দায় নিতে হল তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে। বাম আমলে চীনে আকরিক লোহা রপ্তানির জন্য নেওয়া ঋণের বকেয়া (সুদ ও আসল মিলিয়ে) বাবদ ১৮৫ কোটি ৮৩ লক্ষ ৭৩ হাজার ৫৩০ টাকা ন’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে সোমবার মিটিয়ে দিল খাদ্য দপ্তর। এই দপ্তরের অধীনস্থ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ নিগম (ইসিএসসি) ২০০৫ সালে লোহা আকরিক রপ্তানির জন্য ন’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে লোহা আকরিক রপ্তানি করা হয়েছিল। কিন্তু চীন পর্যন্ত ওই লোহা পৌঁছায়নি বলে অভিযোগ। এই ঋণ মেটানোর জন্য বিপুল চাপ ছিল খাদ্য দপ্তরের উপর। ঋণ পরিশোধ না করে কোনও উপায় ছিল না। কারণ চলতি অক্টোবর মাসের মধ্যে এই টাকা পরিশোধ না করলে ইসিএসসি-কে দেউলিয়া ঘোষণা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত। সংস্থার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলির লেনদেন বন্ধ হয়ে যেত। চলতি বছরেই এটা করা হয়েছিল। তখন খাদ্য দপ্তরের অনুরোধে ছ’ মাস অ্যাকাউন্টে লেনদেন করার অনুমতি দেওয়া হয়। সেই সময়সীমা শেষ হচ্ছে অক্টোবরে। ২০১৬ সালের নতুন কেন্দ্রীয় আইনে ‘কর্পোরেট ইনসলভেন্সি রেজুলিউশন প্রসেস’-এর মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের প্রক্রিয়া চলছিল।  সরকারি উদ্যোগে চাষিদের কাছ থেকে ধান কেনার মূল দায়িত্ব ইসিএসসি-র। নভেম্বর মাস থেকে এই কাজ শুরু হবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেলে ধান কেনার কাজই থমকে যেত। শুধু তাই নয়, দেউলিয়া ঘোষণা হওয়ার পর ইসিএসসি-র স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি নীলাম করে বকেয়া টাকা আদায় করতে পারত ব্যাংকগুলি। তাই আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও টাকা মেটাতে হয়েছে। এর জন্য নতুন করে ব্যাংক ঋণ নিতে হয়েছে নিগমকে। ঋণের গ্যারান্টার হয়েছে খাদ্য দপ্তর। গত বেশ কয়েক মাস ধরে ঋণ মেটানোর জন্য ব্যাংকগুলির সঙ্গে আলোচনা চলছিল। রাজ্য সরকার চেয়েছিল সুদ ছাড়া বকেয়া ঋণের আসল অংশটুকু পরিশোধ করতে। তা হলে ১৫৬ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা দিতে হত। কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলি তাতে রাজি না হওয়ায় একসঙ্গে প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা দিতে হল। পুরো ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তিনি বলেন, বামফ্রন্ট সরকারের সময় রাজনৈতিক মদতে চলা ‘লুটপাটের’ গুনাগার দিতে হল তাঁদের সরকারকে। লোহাচুর কেলেঙ্কারির টাকার ভাগ বামফ্রন্টের বড়-ছোট শরিকদের কাছে গিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি প্রাক্তন মন্ত্রী নরেন দে-র দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। টাকা পরিশোধ করার জেরে দপ্তরের উন্নয়নমূলক কাজ কিছুটা ব্যাহত হবে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন। লোহা আকরিক কেলেঙ্কারির তদন্তে আরও গতি আনার জন্য সিআইডি-কে খাদ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। লোহাচুর কেলেঙ্কারির মামলায় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সিআইডি একমাত্র জেরা করেছিল প্রবীণ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা নরেন দে-কে। তিনি খাদ্য দপ্তরের মন্ত্রী ছাড়াও ইসিএসসি-র চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। জ্যোতিপ্রিয়বাবু রাজনৈতিক মদতের যে অভিযোগ তুলেছেন, সেই প্রসঙ্গে নরেনবাবু এদিন বলেন, সিআইডি তো আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। আমি লিখিতভাবে তাদের নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম। সিআইডি তাতে সন্তুষ্ট হয় বলে প্রাক্তন মন্ত্রীর দাবি। নরেনবাবু দাবি করেন, তিনি যখন সমবায় দপ্তর থেকে খাদ্য দপ্তরের দায়িত্বে আসেন, তখন লোহাচুরের বিষয়টি ‘ক্লোজড চ্যাপ্টার’ হয়ে গিয়েছে। খাদ্য দপ্তরে তাঁর পূর্বসূরি প্রয়াত কলিমুদ্দিন শামসের সময়ে লোহাচুর রপ্তানির বিষয়টি হয়েছিল বলেও তিনি দাবি করেছেন। এই মামলার তদন্তে খাদ্য দপ্তর আরও গতি আনতে চাইছে। এ প্রসঙ্গে নরেনবাবু বলেন, যা ইচ্ছা তাই করুক। লোহাচুর কেলেঙ্কারির ঘটনায় সিআইডি ইতিমধ্যে আদালতে একাধিক চার্জশিট পেশ করেছে। মামলার শুনানিও চলছে। এই মামলায় তৎকালীন নিগমের শীর্ষ পদে থাকা দুই আইএএস আধিকারিক দেবাদিত্য চক্রবর্তী ও এস সি জামির গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। 
    –ইসলামী মৌলবাদকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে মুসলমানদের একটি আন্দোলন হিসেবে  যারা অতীতকে ধারণ করে এবং ধর্মের মূলে ফিরে যেতে  চায় এবং একইভাবে জীবনযাপন করে যেভাবে নবী মুহাম্মদ   ও তার সাহাবীগন জীবনযাপন করতেন। ইসলামী মৌলবাদীরা ইসলামের প্রাথমিক উৎস (কুরআন ও সুন্নাহ) এর "আক্ষরিক এবং মৌলিক ব্যাখ্যা" সমর্থন করে, এবং তাদের জীবনের প্রতিটি অংশ হতে, তাদের ধারণা আনুযায়ী "বিকৃত" অনৈসলামিক প্রভাব দূর করতে চায় ।
    —–ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচার একটি দীর্ঘ দিনের সমস্যা। মূলত এ ক্ষেত্রে ‘ট্রানজিট পয়েন্টে’র কাজ করে পশ্চিমবঙ্গ। বিএসএফ সূত্রে বলা হয়েছে, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি থেকে চোরা পথে গরু এসে পৌঁছয় পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলিতে। এর পর রাতের অন্ধকারে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা দিয়ে ওই গরু বাংলাদেশে পাচার হয়ে যায়। পাচারকারীদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, ও বিএসএফের একাংশ জড়িয়ে রয়েছে বলেও অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। তবে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টায় দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর। পাচার রুখতে সক্রিয় হয় কেন্দ্র। বিএসএফের দাবি, সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোয় আগের চেয়ে গরু পাচার অনেক কমেছে। ২০১৩-১৪ সালে প্রায় কুড়ি লক্ষ গরু পাচার হয়েছিল। বিএসএফের যুক্তি, পাট গাছের দৈর্ঘ্য সাত থেকে দশ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। ওই উচ্চতাকে কাজে লাগায় গরু পাচারকারীরা। পাটগাছের উচ্চতার কারণে ক্ষেতের ভিতর দিয়ে গরু নিয়ে পালালে চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম। রাতের অন্ধকারে দূর থেকে আলো ফেললেও ক্ষেতের মধ্যে থাকা গরুদের গতিবিধি বোঝা সম্ভব হয় না। অন্য স্থানে নজরদারি বাড়ানোয় এখন অধিকাংশ গরু পাচারের ঘটনা পাটের ক্ষেতের মধ্যে দিয়েই হচ্ছে। বিএসএফের ডিজি ডি কে পাঠক বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই পাচারকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ওই এলাকায় পাট চাষ হয়ে থাকে। তাই সীমান্ত এলাকায় পাট চাষ বন্ধ করার জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন করেছি।’’ বিএসএফ চাইছে, কেন্দ্র যেন বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আলোচনা করে পাটচাষিদের বিকল্প চাষের ব্যবস্থা করে দেয়।
    —তুই বোধহয় জানিস না, কলা গাছের ভেলা বানিয়ে গরুকে সেটার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে শুধু মাথা জলের ওপরে ভেসে থাকে। আর এভাবেই গরুগুলোকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীর জলে। গরু পাচারের অভিনব আর নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করছে গরুপাচারকারীরা। মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান সীমান্ত লাগোয়া বীরভূমের বেশ কয়েক’টি জায়গা থেকে ফের পাচার শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর অভিযোগ। সম্প্রতি মুরারই ২-এর বিডিও-র কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। লিখিত অভিযোগের পেয়ে বিডিও কৃষ্ণকান্ত ঘোষ পুলিশের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। পাচার রুখতে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীও। বাংলাদেশ লাগোয়া জেলা-সীমান্তের অর্থনীতি চার পায়ে হাঁটে, বিধানসভা ভোটের আগে সেই তত্ত্বই বীরভূমে ফের স্বমহিমায়। এলাকাবাসীর মত, সীমান্ত এলাকায় পুলিশ-বিএসএফের যৌথ নজরদারির জেরে কয়েক মাস কিছুটা হলেও গরু পাচারে ভাটা পড়েছিল। তবে পাচার কখনই থেমে থাকেনি বলে অভিযোগ। ইদানীং সেটাই আড়ে-বহড়ে বাড়তে শুরু করেছে বলে মত এলাকাবাসীর। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই বলছেন, ‘‘মুরারই-মিত্রপুর রাস্তার উপর দিয়ে দিনের আলোয় গরু হাঁটিয়ে পার করানো হচ্ছে। পুলিশকে ফোনে সে সব জানানো সত্ত্বেও তৎপরতা নজরে আসেনি।
    –কয়লা পাচার ?
    —খনি অঞ্চলে বেআইনি কয়লা খনন চলছে দীর্ঘ দিন ধরেই। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মূলত তিন পদ্ধতিতে এই কয়লা চুরি চলে। প্রথমত, ইসিএল বা ব্যক্তি মালিকানার জমিতে অবৈধ খাদান তৈরি করে কয়লা তোলা হয়। দ্বিতীয়ত, ইসিএলের বন্ধ বা চালু খোলা মুখ খনিতে গভীর সুড়ঙ্গ (র্যাট হোল) বানিয়ে কয়লা তোলা হয়। তৃতীয়ত, ইসিএলের কয়লা ডম্পার বা রেলের পরিবহণের সময়ে কয়লা নামিয়ে নেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট গঠনের পরে ইসিএল বা ব্যক্তি মালিকানার জমিতে খাদান তৈরি করে কয়লা তোলা কমেছে। কিন্তু অন্য সব পদ্ধতিতে এখনও চুরি চলছে।বারাবনির জামগ্রাম, গৌরান্ডি, মদনপুর, সরিষাতলি এলাকাতেও অবৈধ কয়লার কারবার রমরম করে চলছে বলে এলাকা সূত্রে জানা যায়। যার জেরে মাঝে-মধ্যে ধসের ঘটনাও ঘটছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। স্থানীয় তৃণমূল নেতা পাপ্পু উপাধ্যায় দাবি করেন, বামেদের সময় থেকে চলে আসা এই অবৈধ কারবার চলছে এখন কিছুটা রোধ করা গেলেও পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। পাপ্পু বলেন, “আমরা পুলিশের কাছে এই চুরি বন্ধের দাবি করেছি। তা না হলে এক দিন সবাই তলিয়ে যাব।” জামুড়িয়ার কাটাগড়িয়া জঙ্গল, পরিহারপুর ।
    —পুলিশ ধরপাকড় করে না ?
    —আরে, গরু ও কয়লা পাচার কান্ডে এবার রাজ্যের ৬ পুলিশকর্মীকে নোটিস পাঠাল সিবিআই (CBI) । তাদের মধ্যে একজন ডিএসপি পদ মর্যাদার অফিসার ও রয়েছেন। ডিসেম্বর মাসে গরু পাচারকারী তদন্তের ডিআইজি সহ বিএসএফের ৪ অফিসারকে নোটিশ পাঠায় সিবিআই। যে চারজনকে নোটিস পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ডিআইজি ছিলেন। উল্লেখ্য কয়েক মাস ধরেই কয়লা গরু পাচারকা কান্ডে তৎপর সিবিআই। দফায় দফায় সারা রাজ্য জুড়ে তল্লাশি চালাচ্ছে সিবিআই (CBI)। বর্তমানে কয়লা ও গরু পাচার নিয়ে সরগরম রাজ্য রাজনীতি। এ ভাবেই পাচার হচ্ছে কয়লা। বর্ধমান জেলার পাণ্ডবেশ্বর এলাকার বিভিন্ন খাদান থেকে সাইকেলে কয়লা চাপিয়ে ময়ূরাক্ষী নদী পেরিয়ে বীরভূমের ভীমগড় স্টেশনে নিয়ে আসা হয়। তার পর ট্রেনে যাত্রীবাহী ট্রেনে জেলার বিভিন্ন স্থানে পাচারের কয়লা নামানো হয় বলে অভিযোগ। নিত্য দিন এমন ঘটনা ঘটলেও পুলিশ-প্রশাসনকে কোনও পদক্ষেপ করতে দেখা যায় না বলেই স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি ।
    —এখন বারাবনি ও সালানপুরে কয়লা চুরির রমরমা সবচেয়ে বেশি। এর পরে জামুড়িয়া, রানিগঞ্জ, কুলটি ও আসানসোলের কিছু এলাকায় চলছে এই চুরি। সালানপুরের বনজেমাহারি, সংগ্রামগড়, ডাবর কোলিয়ারি লাগোয়া এলাকায় খাদান গড়ে কয়লা তুলছে চোরেরা। বনজেমাহারি রেল সাইডিং থেকেও কয়লা চুরি যাচ্ছে। বারাবনির রসুনপুর এলাকা থেকেও চোরেরা কয়লা কাটছে। সাইকেল, গরুর গাড়ি বা মোটরবাইকে চাপিয়ে এই কয়লা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া অবৈধ ডিপোয়। রূপনারায়ণপুরের দেশবন্ধু পার্ক লাগোয়া এলাকার কিছু বাসিন্দার অভিযোগ, চোরেরা অবৈধ কয়লা পুড়িয়ে তা বস্তাবন্দি করে জ্বালানির কাজে ব্যবহারের জন্য বিক্রি করে। সেই কয়লা পোড়ানোর জেরে দূষণে তাঁরা নাজেহাল হচ্ছেন বলে ওই বাসিন্দাদের অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দা অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “এই দূষণে শ্বাস নিতে পারি না। ঘরের দরজা-জানালা খোলা থাকলে হাঁফ ধরে যায়।” বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশকে অনেক বার বলেও কিছু হচ্ছে না।
    —কয়লা পাচার-কাণ্ডে ধৃত ইস্টার্ন কোল্ডফিল্ড লিমিটেড (ইসিএল)-এর সাত জন বর্তমান ও প্রাক্তন কর্তাকে পাঁচ দিনের সিবিআই হেফাজতে পাঠাল আদালত। বৃহস্পতিবার আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক রাজেশ চক্রবর্তী এই নির্দেশ দিয়েছেন। সিবিআই সূত্রের খবর, বর্তমান ও প্রাক্তন মিলিয়ে কোলের এই সাত ইসিএল আধিকারিককে বুধবার সকাল ১১টা নাগাদ নিজাম প্যালেসে ডেকে অনেক ক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তাঁদের জবাবে অসঙ্গতি ধরা পড়ায় গ্রেফতার করা হয়। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান ইসিএল আধিকারিক এসসি মৈত্র। পাশাপাশি, ইসিএলের তিন প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজার সুশান্ত ব্যানার্জি, অভিজিৎ মল্লিক এবং তন্ময় দাস। তন্ময় দাস আগে ইসিএলের প্রধান নিরাপত্তা আধিকারিক ছিলেন। এ ছাড়া ম্যানেজার নিরাপত্তা আধিকারিক ছিলেন মুকেশ কুমার। নিরাপত্তা আধিকারিক রিঙ্কু বেহেরা ও দেবাশিস মুখোপাধ্যায়।
    —কয়লাগেট কেলেঙ্কারি কিন্তু কয়লা পাচার কেলেঙ্কারি থেকে আলাদা । কয়লাগেট কেলেঙ্কারিতে সরকারের ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল । কয়লা বরাদ্দ কেলেঙ্কারি বা 'কয়লাগেট' হল একটি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি যা ২০১২ সালে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সামনে আসে। কেলেঙ্কারিটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) প্রথম প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।  তৎকালীন সরকারকে ২০০৪ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে অবৈধভাবে ১৯৪টি কয়লা ব্লক বরাদ্দ করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। যদিও CAG প্রাথমিকভাবে ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির অনুমান করেছিল, চূড়ান্ত রিপোর্টে কেলেঙ্কারির পরিমাণ ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে।
    –গণধর্ষণ ? 
    —১৯৯০ সালের ৩০ মে গোসাবায় একটি টীকাকরণ কর্মসূচি সেরে তিন জন স্বাস্থ্য আধিকারিকের একটি দল কলকাতায় ফিরছিলেন।এই দলে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অতিরিক্ত জেলা গণমাধ্যম বিভাগের উপ-আধিকারিক অনিতা দেওয়ান, স্বাস্থ্য মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ আধিকারিক উমা ঘোষ এবং ইউনিসেফের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন দিল্লি কার্যালয়ের প্রতিনিধি রেণু ঘোষ। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ যখন তারা ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের কাছে বানতলায় পৌঁছান তখন ৪-৫ জন যুবক স্থানীয় ক্লাবের কাছে তাদের গাড়ি থামাতে বাধ্য করে। গাড়ির চালক অবনী নাইয়া তাদের পাশ কাটিয়ে গাড়ি নিয়ে পালাতে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি উলটে যায়। এই সময় আরও ১০-১২ জনের একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়। তারা গাড়ির একজন আধিকারিককে টেনে বার করে। আগের দলটি অন্য দুই আধিকারিককে বার করে। গাড়ির চালক তাদের বাধা দিতে যান, কিন্তু ব্যর্থ হন। দলটি গাড়ির চালককে হত্যা করার চেষ্টা করে এবং গাড়িটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আধিকারিকদের কাছের একটি ধানক্ষেতে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। একজন আধিকারিক তাদের বাধা দিতে যান। ধর্ষকরা তাকে হত্যা করে। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ পুলিশ গিয়ে আধিকারিকদের নগ্ন দেহ উদ্ধার করে। তাদের ক্যালকাটা ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজের আপদকালীন বিভাগে ভর্তি করা হয়ে। প্রথম দিকে তাদের মৃত মনে করা হয়ে হয়েছিল। কিন্তু দুজন বেঁচে ছিলেন। তাদের চিকিৎসা শুরু হয়। একজন মহিলা ডাক্তার জনৈক আধিকারিকের যোনিতে একটি ধাতব টর্চ দেখে অজ্ঞান হয়ে যান। আহত ড্রাইভার অবনী নাইয়াকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার দেহে ভারী অস্থের ৪৩টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।  আক্রমণকারীরা তার পুরুষাঙ্গটি পিষে দিয়েছিল। ১৯৯০ সালের ৪ জুন, সকাল ৫টা ৪০ মিনিটে তিনি মারা যান। 
    —হাঁসখালি গণধর্ষণের কাণ্ড শুনেছিলাম ?
    –হাঁসখালি গণধর্ষণ কাণ্ডে ধীরে ধীরে নিজেদের তদন্তের জাল গুটিয়ে আনতে শুরু করে দিলো সিবিআই। হাইকোর্ট দ্বারা তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার পরই তাদের আসরে নামতে দেখা যায়। গতকাল হাঁসখালি কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত ব্রজ গোপালের বাবা তথা তৃণমূল নেতা সমরেন্দ্র গোয়ালিকে গ্রেফতার করা হয়। এদিন তাকে চার দিনের সিবিআই হেফাজতের রায় দিলে রানাঘাট মহকুমা আদালত। তবে এসকল বিষয়কেও ছাপিয়ে এদিন আদালতে তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দাবি করল সিবিআই। হাঁসখালি ধর্ষণ কাণ্ডে প্রথম থেকেই নিরুদ্দেশ ছিল মূল অভিযুক্ত ব্রজ গোপালের বাবা সমরেন্দ্র গোয়ালি। তবে শেষ পর্যন্ত সিবিআইয়ের জালে ধরা পড়ে সে। এরপর বেশ কয়েকবার সিবিআইয়ের তলবের মুখে পড়তে হয় তাকে এবং গতকাল তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। এলাকার শক্তিশালী নেতা হওয়ায় মৃত্যুর পরপরই ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া ওই কিশোরীর দেহ সৎকার করা হয়। এ ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায়, সে জন্য ধর্ষণকারীর বাবা কিশোরীর পরিবারকে মামলা না করার হুমকি দেন। ফলে ঘটনার পর চার দিন কিশোরীর বাবা কোনো কথা না বললেও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চাইল্ড লাইনের সহযোগিতায় হাঁসখালি থানায় ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করেন। ঘটনার পর পুলিশ প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করলেও গা ঢাকা দেন ধর্ষণকারীর বাবা সমরেন্দ্র গয়ালি ।
    —বর্ধমানের কালনায় গণধর্ষণের শিকার হলেন এক আদিবাসী গৃহবধূ। স্বামীর অনুপস্থিতিতে তাঁকে গভীর রাতে বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। অভিযোগ, দুষ্কৃতীদলে ছিলেন এক মহিলাও। আক্রান্ত বধূকে হাসপাতালে ভর্তি করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ইতিমধ্যে ১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে কালনা থানা সূত্রে। মঙ্গলবার গভীর রাতে ঘর থেকে কোনও কাজে বেরিয়েছিলেন মহিলা। আগে থেকেই বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিল দুষ্কৃতীরা। মহিলা বেরোতেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। গলায় ছুরি ধরে মুখ বেঁঝে নিয়ে যায় নিরালা জায়গায়। সেখানে মহিলাকে একে একে ৩ জন ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, দুষ্কৃতীদের মধ্যে ছিলেন এক মহিলাও। তার সামনেই বধূকে ধর্ষণ করে দুষ্কৃতীরা। মহিলা জানিয়েছেন, বেশ কিছুক্ষণ নির্যাতনের শিকার হয়ে রাতের অন্ধকারে কোনও ক্রমে পালিয়ে বাঁচেন তিনি। তবে চোখ বাঁধা থাকায় দুষ্কৃতীদের কাউকেই দেখতে পাননি। মহিলা বাড়ি ফিরলে তাঁকে কালনা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি করেন পরিজনরা। খবর যায় থানায়। ঘটনায় গণধর্ষণের ধারায় অভিযোগ দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। 
    —নতুন ক্যামেরা দেখানোর নাম করে এক নাবালিকাকে ফুঁসলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠল গাইঘাটায়। ধর্ষণে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে এক নাবালকের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই নাবালিকা বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আর ফেরেনি। এরপরই সেই নাবালিকার খোঁজে বের হয় তার পরিবারের লোকেরা। সেই নাবালিকার বাবা দাবি করেছেন, যে ঘরে এই ঘটনাটি ঘটেছিল সেখানে খুব জোরে গান চালানো ছিল মিউজিক সিস্টেমে। যাতে চিৎকারের আওয়াজ বাইরে না আসে। 
    —বাঞ্চোৎ বাঙালি ছোঁড়াগুলো কাউকেই ছাড়ে না !
    —২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি আদিবাসী অধ্যুষিত বীরভুম জেলার লাভপুর থানা এলাকার মধ্যে সুবলপুর গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। এর আগে, ২০শে জানুয়ারি সালিশি সভার "তলবে" অত্যাচারিতা এবং তার প্রেমিককে ধরা হয় এবং সারা দিনরাত আটকে রাখা হয়, তাদের একটি গাছে বেঁধে লাঞ্ছিত করা হয় বলে অভিযোগ। এরপর ক্যাঙ্গারু আদালত তাদের ৫০,০০০ টাকা জরিমানা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মেয়েটি যখন জরিমানা দিতে অক্ষম হয়, তখন গণধর্ষনের আদেশ দেওয়া হয়।নির্বাচিত গ্রাম পঞ্চায়েত নেতার নেতৃত্বে গ্রাম স্তরের স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠান গ্রাম সভা সালিশি সভা নামে একটি ক্যাঙ্গারু আদালতের আয়োজন করেছিল।[৪] সালিশি সভার প্রধান সুনীল সোরেনও এই ধর্ষণের সাথে জড়িত ছিল। 
     —এবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানায় এক মহিলাকে গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে (allegation of gang rape and attempt to murder at Namkhana) । প্রমাণ লোপাটে ওই মহিলার গায়ে কেরোসিন ঢেলে তাঁকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে অভিযুক্তরা ৷ হাঁসখালিতে নাবালিকাকে ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনার মধ্যেই নামখানার এই ঘটনা রাজ্যে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ৷ নির্যাতিতা ওই মহিলা বর্তমানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপ মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন । ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে নামখানা থানার পুলিশ ৷
    –অভিযুক্তরা কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখানোয় বাংলাদেশের শরিয়তপুর জেলার পুটিয়াকান্দির ১৭ বছরের এক কিশোরী ভারতে নিয়ে আসে। পরিবারের আর্থিক টানাপড়েন দূর করতে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা বাগদার হরিহরপুরে আসে সে। শরিফুল মল্লিক নামে এক যুবকে তাকে কাজ জোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ওই কিশোরী।বাগদা পুলিশ বলছে, শরিফুল মল্লিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবৈধপথে ভারতে আসে ওই কিশোরী। সেখানে যাওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) শরিফুল মল্লিক (৩৮) ও তার সঙ্গী মহসিন বিশ্বাস (২৮) কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন। গ্রামের বাসিন্দারা কিশোরীকে ধর্ষণের এই খবর থানায় পৌঁছে দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাকে উদ্ধারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তার অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের এবং দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
    —মেয়ে পাচার ?
    —-জানা যায়, এই নিয়ে ১৫ নম্বরবার বিয়ে করতে যাচ্ছিল অভিযুক্ত। এসিপি ইস্ট শুভেন্দ্র কুমার জানান , "রাহুল সরকার ওরফে রাজু ওরফে সফিয়ুল ইসলামের নামে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক থানায় অভিযোগ রয়েছে। মূলত ধর্ষণ ও অপহরণের অভিযোগ রয়েছে। শিলিগুড়ি থানা, ভক্তিনগর থানা, মেটেলি ও হলদিবাড়ি থানাতেও অভিযোগ রয়েছে। মূলত প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে মেয়েদের পাচার করত সে। জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও তিনজন মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। গোটা ঘটনার তদন্ত চলছে।" পুলিশের অনুমান এই ঘটনার পেছনে বড় কোনও পাচার চক্র জড়িত। 
    –কন্যা ভ্রূণ বা কন্যাশিশু হত্যার কারণে পাঁচ কোটি মেয়ে ভারত থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। সমস্যাটা সবচেয়ে প্রকট উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোতে, যেখানে বহু পুরুষ বিয়ে করার মতো মহিলাই পাচ্ছেন না – আর তার জেরে সারা দেশ জুড়ে জন্ম হচ্ছে সংগঠিত নারী-পাচার চক্রের। দারিদ্র্য ও অসচেতনতার সুযোগে বিয়ে করেন ৭৫টি, বিয়েকে হাতিয়ার করে পাচার করেন ২০০জন নারীকে৷ কেউ আবার পাচার করেন কিশোরীর টিকটক তারকা হবার স্বপ্নকে ভাঙিয়ে৷ উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য‌ এবং গোটা ভারতের মধ্য‌ে সংযোগের কাজ করে থাকে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্য‌ের ১৯টি জেলা রয়েছে এবং ২৩টি শহর রয়েছে যার জনসংখ্য‌া এক লক্ষেরও বেশি। সব চেয়ে বড় শহরগুলি হল, কলকাতা, আসানসোল, শিলিগুড়ি ও হাওড়া — এই শহরগুলি পাচার হয়ে যাওয়ার বড় কেন্দ্র। এই শহরগুলিতে বেশ কয়েকটি পরিচিত ‘লালবাতি’ এলাকা রয়েছে যেখানে দেহ ব্য‌বসার কথা সুবিদিত। অন্য‌ দিকে রাজ্য‌ের গ্রামের বিস্তৃত অঞ্চলে দারিদ্র, শোষণ ও বঞ্চনা এখনও রয়ে গিয়েছে। সেখানে লিঙ্গ বৈষম্য‌ রয়েছে, রয়েছে গার্হস্থ্য হিংসার বাতাবরণও। এই দারিদ্রপীড়িত সামাজিক ক্ষেত্র, যেখানে জীবনধারনের জন্য‌ স্থায়ী রোজগারের ব্য‌বস্থা নেই, তা পাচারকারীদের শিকার ধরার আদর্শ জায়গা। এই রাজ্য‌ের সঙ্গে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের আন্তজার্তিক সীমানা রয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ ও ভঙ্গুর অবস্থানের জন্য‌ এ রাজ্য‌ শুধু আন্তর্রাজ্য‌ পাচার নয় বরং আন্তর্জাতিক পাচারের উল্লেখযোগ্য‌ কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত। এক দিনে এই পরিস্থিতি গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন ধরে পাচারকারীরা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে অঞ্চল চিহ্নিত করে তাদের কাজ চালিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তাদের পাল্টা নেটওয়ার্কের মোকাবিলা করা খুবই দুষ্কর।
    —-চোলাই ?
    —-চোলাই মদ মূলত ইথাইল অ্যালকোহল। আবগারি দফতর ও চোলাইয়ের কারখানাগুলির থেকেই জানা গিয়েছে, মদের আকর্ষণ বাড়াতে ইথাইল অ্যালকোহলের সঙ্গে পিরিডিন জাতীয় জৈব খার, মিথানল, ইউরিয়া এমনকী কীটনাশক বিষও মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে আজকাল। তাতে চোলাই খাওয়ার পর অল্প সময়েই নেশায় বুঁদ হয়ে যাওয়া যাচ্ছে। নেশার বহর বা়ড়তেই বেড়ে চলেছে খদ্দেরও সংখ্যাও। কিন্তু দিনের পর দিন বিষাক্ত এই মদের জেরে শরীরে থাবা বসাচ্ছে নানা মারণ রোগ। নষ্ট হচ্ছে চোখ। এমনকী অনেক সময়ই নেমে আসছে মৃত্যু। চোলাইয়ের শিকার যাঁরা, তাঁরা অনেকেই এ সব জানেন। তবু ছাড়তে পারেন না। অনেকে আবার এ সব জানেনও না। দিনের পর দিন নেশার বিষ শরীরে ঢুকে চলেছে সামান্য সুখানুভবের হাত ধরে।গৃহস্থ বাড়ির মাটির উনুনে বড় হাঁড়িতেই চোলাই তৈরি হয়। গ্রামে নানা পদ্ধতিতে তৈরি হয় চোলাই। আগে নিম্নমানের চাল দিয়ে ভাত তৈরি করে নেওয়া হয়। তারপর তাতে বাখড় মিশিয়ে দেওয়া হয়। বাখড় হল এক ধরনের মিষ্টি যা মূলত চোলাইয়ে ইস্ট-এর কাজ করে। অর্থাৎ চটজলদি ভাত পচাতে সাহায্য করে। ভাত পচে গেলে একটি বড় হাঁড়িতে বসিয়ে তা ফের ফোটানো হয় উনুনে। ওই হাঁড়ির উপরে বসানো হয় আরও একটি হাঁড়ি। পচা ভাতের বাষ্প পাইপের মাধ্যমে ফোঁটা ফোঁটা করে জমা হয় জারিকেনে বা বোতলে। এটাই হচ্ছে চোলাই মদ বা ইথাইল অ্যালকোহল। কেউ কেউ আবার পচা ভাতের বদলে চিটে গুড় বা চিনির গাদার সঙ্গে বাখড় মিশিয়ে তৈরি করেন চোলাই। এখন নেশার বহর বাড়িয়ে এই মদের খদ্দের বাড়াতে এর সঙ্গে মেশানো হচ্ছে নানা রকমের রাসয়নিক দ্রব্য। ইউরিয়া, পিরিডিন থেকে মিথানল মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
    –ধৃতদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিলিতি ব্র্যান্ড মদের স্টিকার লাগানো বোতল ও ৩২ লিটার নকল মদ উদ্ধার করেছে আবগারি দফতর। এ ছাড়া, মিলেছে মদ তৈরির উপকরণও। জেলা আবগারি দফতরের সুপারিন্টেন্ডেন্ট শম্ভু রায় বলেন, “ধৃতেরা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিলিতি মদের বোতল জোগাড় করে তাতে নতুন করে ওই কোম্পানির স্টিকার লাগিয়ে নকল মদ ভরে বিক্রি করত। এই মদ খেলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই চক্রের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কিনা, তা দেখা হচ্ছে। আবগারি দফতরের দাবি, জেরায় ধৃতেরা জানিয়েছেন, রাহুল ও তাঁর বাবা নিজের বাড়িতে ওই নকল মদ বানাতেন। বিলিতি মদের খালি বোতল জোগাড় করতেন। বিভিন্ন মদের ব্র্যান্ডের নকল স্টিকার ও হলোগ্রামও মজুত ছিল তাঁদের কাছে। নকল মদ বানিয়ে পুরনো বোতলে নতুন করে ভরে নকল স্টিকার ও হলোগ্রাম বোতলে লাগিয়ে দেওয়া হত। লক্ষ্মণ তাঁদের বানানো মদ বিভিন্ন ধাবা ও দোকানে বিক্রি করতেন। বাঁকুড়ার ধলডাঙায় গোপাল বাঙালের একটি ধাবা রয়েছে। ওই ধাবাতেও এই নকল মদ বিক্রি হত। আবগারি দফতরের এক কর্তা জানান, এই কারবারের খবর গোপন সূত্রে পেয়ে প্রথমে লক্ষ্মণকে আটক করে জেরা করতেই তিনি সব ফাঁস করে দেন। বৃহস্পতিবার রাতে ধরপাকড়ে নামে আবগারি দফতর। প্রথমে রাহুলের বাড়িতে অভিযান চলে। সেখানে নকল মদ, মদ তৈরিতে ব্যবহৃত প্রায় ৩০ লিটার স্পিরিট, দুই লিটার ক্যারামেল-সহ বিভিন্ন উপকরণ উদ্ধার হয়। পাশাপাশি প্রায় ৬ হাজার বিভিন্ন বিলিতি মদের ব্র্যান্ডের স্টিকার ও নকল হলোগ্রাম এবং বহু পুরনো মদের খালি বোতল পান আবগারি দফতরের আধিকারিকেরা। উদ্ধার হয়েছে বেশ কয়েক বোতল দিশি মদও। 
    –পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে অধ্যাপকের বেশে রাজনৈতিক দালালরা ছাত্রভর্তিতে তোলাবাজি,পরীক্ষায় পাশ করানোর নামে অনৈতিক সুবিধা নেওয়া,ছাত্রীদের হেনস্থা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছে বামপন্থী-তৃণমূলী বুদ্ধিজীবীরা। শিলিগুড়ি কলেজের অধ্যাপক অমিতাভ কাঞ্জিলাল ছাত্রীকে পরীক্ষায় পাশ করাতে দশ হাজার টাকা চাইছেন,বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অংশুমান কর একাধিক ছাত্রীকে হেনস্থা করছেন, আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফিডেন্সিয়াল একাউন্ট এর টাকা নয়ছয়ের পরেও দিলীপ সরকারের মতো ব্যক্তি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার পদে পুনর্বহাল হচ্ছেন।
    –ভিন রাজ্য থেকে বিভিন্ন পন্য বাংলাদেশে আমদানি- রপ্তানি হয় বসিরহাটের ঘোজাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে। ইট, বালি, পাথর, ফল, ফুল, সবজি, তেল বিভিন্ন কাঁচামাল যায় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ থেকেও এদেশের বিভিন্ন রাজ্যে যায় বিভিন্ন পন্য। এই যাতায়াতের পথে বিভিন্ন ট্যাক্স দিয়ে থাকেন পণ্যবাহী ট্রাক চালকরা। টোল ট্যাক্স বা পৌরকরের মতো বিভিন্ন ট্যাক্স দিয়ে যাতায়াত করতে হয় ট্রাক গুলোকে। কিন্তু ট্রাক চালক ও খালাসিদের অভিযোগ, 'বিভিন্ন নিয়মী কর ছাড়াও নতুন করে কর ধার্য করা হয়েছে এই আমদানি রপ্তানির ট্রাকগুলোর উপর। সেখানে বসিরহাট ব্রিজ থেকে ঘোজাডাঙ্গা বর্ডার অব্দি যেতে একটা অংকের টাকা দিতে হয় ট্রাক গুলিকে। তার কোনোটিতে লেখা 'শ্রমিক ইউনিয়ন', কোনোটিতে 'কর্মহীন শ্রমিক বাঁচাও কমিটি' কোনোটি 'বর্ডার গাইড'। এই রকম বিভিন্ন নামে বিল ছাপিয়ে ট্রাক গুলির উপর থেকে কর আদায় করে বেশ কয়েকটি ছেলে। মূলত বসিরহাট থেকে ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে কল বাড়ি, কালীবাড়ি মোড় এইসব অঞ্চলগুলোতে বাঁশ ফেলে ট্রাক আটকানো হয়। এরপর ট্রাকচালকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি বিল। যদি টাকা না দেওয়া হয় তাহলে ট্রাক যেতে দেওয়া হয় না। ট্রাক চালকদের গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করা হয় বলে জানান ট্রাক চালক সুরিন্দর সিং। তবে স্থানীয় ট্রাক গুলোর ক্ষেত্রে মাসোয়ারার ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের জন্য একটি পরিচয় পত্রের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে সিন্ডিকেট। সারা বাংলা ট্রাক মালিকদের সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক সজল ঘোষ জানান, 'এই সবটাই হয় স্থানীয় প্রশাসনের সমর্থনে। পুলিশই জুলুম করে টাকা নেয়। এটা সীমান্তে আসা ট্রাক গুলোর দীর্ঘদিনের অভিযোগ। ট্রাক ড্রাইভাররা বহুবার আক্রান্ত হয়েছে। আমরা একাধিক অভিযোগ করে ফল পায়নি। তাই আজ ধর্মঘটের পথে।' সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, বিভিন্ন পণ্যের ট্রাক পিছু ভিন্ন ভিন্ন মূল্য ধার্য করা রয়েছে। খালি ট্রাক গেলে ২০০ টাকা, পাথর বোঝাই গাড়ি ১৩০০ টাকা, আলু, পটল, পেঁয়াজের মতো আনাজ বা সবজির গাড়ি পিছু ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। আরও জানা গিয়েছে, প্রত্যেকদিন ৩০০ থেকে সাড়ে ৩৫০টির বেশি পণ্যবাহী গাড়ি এখান দিয়ে যাতায়াত করে। তাহলে যদি প্রত্যেক গাড়ি থেকে গড়ে ৮০০ থেকে ১০০০ বা ১৫০০ করে টাকা নেওয়া হয় তাহলে দিনে কয়েক লক্ষ টাকা উঠছে। মাসে কোটি কোটি টাকা আদায় করছে সিন্ডিকেট। তবে সিন্ডিকেটের দাবি, 'এই টাকার একটা অংশ ভোগ করছে সিন্ডিকেট। অন্য অংশ যায় পার্টির ফাণ্ডে।' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক নেতা জানান, 'বছর খনেক আগে থেকে গরু পাচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এই নতুন ব্যবসা চালু হয়। এর নেপথ্যে রয়েছে বসিরহাটেরই এক শীর্ষ নেতা। যার অঙ্গুলি হেলনেই হয় সমস্ত কিছু। দীর্ঘদিন ধরে বসিরহাটে গরু পাচারের হোতা ছিলেন তিনি। গরু বন্ধ হতেই এই ব্যবসা শুরু করেন তিনি। সাম্প্রতিক এক বস্তা সোনার বার সমেত ধরাও পড়েছিলেন তিনি। সোনা ছাড়াও প্রশাসনের নাকের ডগায় ভিন্ন বেআইনি কারবার চালিয়ে আসছেন তিনি।' তবে এনিয়ে প্রশাসনের কাছে কোনও অভিযোগই নেই বলে জানান বসিরহাট পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার কে শবরী রাজকুমার। তবে তদন্ত করে ঘটনাটি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এনিয়ে রা বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী সায়ন্তন বসু এই ঘটনাকে তোলাবাজির লেটেস্ট নিদর্শন বলে আক্ষা দিয়েছেন। তার কথায়, 'এর আগেও সিপিএম তোলাবাজি করত তবে সেটা আন-রেজিস্টার ছিল। এখন এটা স্বীকৃত তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট রাজে পরিণত হয়েছে।' 
    –পার্কস্ট্রিট গণধর্ষণ কাণ্ড ?
    —-২০১২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পুলিশ প্রথমে মহিলার অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে । সংবাদমাধ্যমের চাপে শেষপর্যন্ত অভিযোগ দায়ের করে পার্কস্ট্রিট থানা। সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয় মহিলা সঠিক অভিযোগ করছেন না। এরপর তৎকালীন পুলিস কমিশনারও মহিলার বক্তব্যে অসঙ্গতি রয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন। তৎকালীন পুলিসকমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা সাংবাদিকদের বলেন, `নাথিং হ্যাপেনড`। তদন্তের আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ঘটনাটিকে সাজানো বলে মন্তব্য করেছিলেন।পরে অবশ্য গোয়েন্দারা ধর্ষণের প্রমাণ পান, কিন্তু তারপরেই সরিয়ে দেওয়া হয় পুলিশের গোয়েন্দা প্রধানকে।আদালতে ধৃতদের যে চার্জ পড়ে শোনানো হয়, তাতে তিন অভিযুক্ত - সুমিত বাজাজ, রুমন খান ও নাসির খান – সবার বিরুদ্ধেই গণধর্ষণ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। দুজনের বিরুদ্ধে মারধর ও হুমকির অভিযোগও রয়েছে ।মূল অভিযুক্ত কাদের খান এবং আরও একজন এখনও ফেরার রয়েছে।
    —-পার্ক স্ট্রিটের একটি পাঁচতারা হোটেলের নাইটক্লাব থেকে ওই মহিলাকে নিয়ে গাড়িতে করে বেরিয়েছিলেন অভিযুক্তরা তার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ছবি, তাদের গাড়ি থেকে পাওয়া ধর্ষণের প্রমাণ, ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়েছে পুলিশ । অন্যান্য শহরে চলন্ত গাড়িতে গণধর্ষণের কথা শোনা গেলেও কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে রাজপথে দীর্ঘক্ষণ ধরে একটি গাড়িতে গণধর্ষন করা হচ্ছে, পুলিশের নজরে পড়ছে না, আবার ভোররাতে একটা থানার কাছেই গাড়ি থেকে ধর্ষিতাকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে– এটা একটা বিরল ঘটনা । তদন্ত শুরুর আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলে দেন যে সরকারের বেকায়দায় ফেলার জন্য ঘটনাটা সাজানো হয়েছে । পুলিশ কমিশনারকে দিয়েও প্রায় একই বয়ান দেওয়ানো হয়। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে যখন ব্যাপক সমালোচনা চলছে, তখনই পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ প্রাথমিক তদন্তে গণধর্ষনের প্রমাণ পাওয়ার কথা ঘোষণা করে দেয়। মুখ্যমন্ত্রী যেটাকে সাজানো ঘটনা বলেছিলেন, সেটাকে গণধর্ষণ বলে দেওয়াতে কয়েকদিনের মধ্যেই কম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে বদলি করা হয় কলকাতার প্রথম মহিলা গোয়েন্দা প্রধান দময়ন্তী সেনকে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘সাজানো ঘটনা’ মন্তব্যের পরে কয়েকজন রাজ্যের এক মন্ত্রী ওই মহিলা যৌনকর্মী কী না – সেই ইঙ্গিতবাহী প্রশ্ন করেছিলেন। কংগ্রেসের এক মহিলা সাংসদ আবার সেই ইঙ্গিত দিয়ে বলেন যে পার্ক স্ট্রিটের ঘটনা কোনও ধর্ষণ নয়, ওই মহিলা আর তাঁর ক্লায়েন্টদের মধ্যে দরদাম নিয়ে অশান্তি করেছিলেন ।  এই মামলায় সরকারের দায়সারা মনোভাবের জন্য সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ।
    -–--সাড়ে চার বছরের বেশি পালিয়ে পালিয়ে থেকেও লাভ হল না। শেষ পর্যন্ত পুলিসের জালে ধরা পরে গেল পার্কস্ট্রিট গণধর্ষণ কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত কাদের খান ও তাঁর সঙ্গী আলি। কিন্তু কীভাবে পুলিস দুজনের খোঁজ পেল? গতমাসে পুলিস জানতে পারে বিহার-নেপাল সীমান্তের গ্রামে রয়েছে । কাদেরের পরিবারের সদস্যদের উপর নজর রাখতে শুরু করে পুলিস। তাঁদের ফোন ট্র্যাক করে পুলিস।  দেখা যায় দিল্লির একাধিক নম্বর থেকে ফোন আসছে কাদেরের বাড়িতে।বিভিন্ন মাধ্যমে দিল্লিতে টাকাও পাঠাচ্ছেন কাদেরের পরিবারের সদস্যরা। পুলিস নিশ্চিত হয় দিল্লি বা সংলগ্ন এলাকাতেই লুকিয়ে আছে কাদের আর আলি। একাধিক ফোন নম্বর ব্যবহার বাড়িতে যোগাযোগ করছে। এরপরেই গাজিয়াবাদে কাদের আর আলির ডেরার খোঁজ মেলে। সেখান থেকেই দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিস।
    —আচ্ছা । আজ এ-পর্যন্তই থাক । আবার অন্য একদিন বসা যাবে ।
    —হ্যাঁ। ততোদিনে আবার নানা কলঙ্কবাজি উঠে আসবে পশ্চিমবাংলার পেঁকো সমাজ থেকে ।
    —শুধু পশ্চিমবঙ্গের ঘটনার কথা বলছেন কেন ? বলুন ভারতবর্ষ, দ্যাট ইজ ইন্ডিয়া ।
    —কারেক্ট, কারেক্ট, থ্যাঙ্কিউ ।

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 106.215.24.94 | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:৩১738354
  • ক্ষমতা : মলয় রায়চৌধুরী
    এক
    ক্ষমতা কাকে বলে তা এই চিঠিটা পড়লে জানা যায় :
    সাগরময় ঘােষ
    প্রীতিভাজনেষু ,
    মাস দেড়েক হল সাত আটটি কবিতা আপনাকে বাড়ির ঠিকানায় রেজেষ্ট্রি করে পাঠিয়েছিলাম ; সুযােগ মতাে 'দেশ'- এ ছাপাবার জন্য। আপনার কোনাে চিঠিপত্র পাইনি। কবিতাগুলাে পাঠিয়ে আপনাকে বিব্রত করা উচিত হয়নি — বােধ করছি।
    আমার মনে হয় এখন কবিতাগুলাে কিছু কাল আমার কাছে থাকুক ; বিশেষত প্রেমের কবিতা তিনটি ( সে, তােমাকে ও তােমাকে ভালােবেসে ) ; কবিতা তিনটি নানা কারণে এখন আর ছাপাব না ভাবছি। আমার এই চিঠি পেয়ে সমস্ত কবিতাগুলাে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলে খুশি হব। পরে 'দেশ' - এ ছাপাবার প্রয়ােজন হলে আবার পাঠানাে যাবে।
    রেজেস্ট্রি করে পাঠাবার জন্য টিকিট এই সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম আশা করি ভালাে আছেন। শুভকামনা ও প্রীতিনমস্কার জানাচ্ছি।
    ইতি
    জীবনানন্দ দাশ ( ১৯৫৪ )
     
    সাগরময় ঘোষের ‘ক্ষমতা’ ছিল কবিতা নির্বাচন করে প্রকাশ করার, কিন্তু তিনি কবিতার  বোদ্ধা ছিলেন না, তাই সম্পাদকের ক্ষমতা প্রয়োগ করে কবিতাগুলো প্রকাশ করেননি । ক্ষমতা বা শক্তির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Power , যা ফরাসি শব্দ Pouvoir  এবং লাতিন শব্দ Potestas থেকে এসেছে । এর অর্থ হলো সমক্ষমতা। এককথায় ক্ষমতা বলতে অন্যকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্যকে বোঝায় , যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণকারী নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতে অন্যদের বাধ্য করে ।  আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো রাষ্ট্রের ক্ষমতা বা জাতীয় শক্তি । এককথায় এর সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ভূমিকা পালন করতে পারে একটি ছোট রাষ্ট্র সে ভূমিকা পালন করতে পারে না । ভূমিকার  এই উৎসই  শক্তি । রাষ্ট্রের আসল হাতিয়ার শক্তি । শক্তির দ্বারাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো একটি দেশ নিজের জায়গা পাকা করে নেয় । 
     
    ডুচাকেক এর মতানুসারে –––"ক্ষমতা হলো প্রত্যাশিত ফলাফল সৃষ্টির সামর্থ্য –– নিজের ইচ্ছানিযায়ী।”  হ্যান্স মরগেনথাউ এর মতে," ক্ষমতা হলো অন্যের মন আর কাজকর্মের ওপর একজন মানুষের নিয়ন্ত্রণ।”  জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেল বলেছেন " অন্যের মন ও কার্যকে নিয়ন্ত্রণ করে কাঙ্ক্ষিত ফললাভের সামর্থ্যই হল ক্ষমতা"  বর্তমানে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হলো একটি দেশের অন্যতম মানদণ্ড । শিল্পের প্রসার, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি , বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনুকূল অবস্থা, প্রযুক্তির অগ্রগতি, আণবিক বিজ্ঞানে দখল ইত্যাদি হল একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সূচকসমূহ । জনসাধারণের কল্যাণ সাধন ও জীবনযাত্রার মান-উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হারের সম্পর্ককে স্বীকার না করে উপায় নেই ।  জাতীয় শক্তির অন্যতম উপাদান হলো নেতাদের ও জনগণের মনস্তত্ত্ব । একটি জাতির মধ্যে যখন আত্মবিশ্বাস থাকবে ,  তারা নিজেদের উন্নতিতে সার্বিকভাবে সচেষ্ট হবে, তখন তাদের সামগ্রিক উন্নতি ঘটবে । এই কারণে হিটলার জার্মানিকে একটা শ্রেষ্ঠ আর্য জাতি হিসেবে প্রচার করেছিলেন। 
     
    একটা রাষ্ট্রকে তখনই শক্তিশালী বলা হবে যখন তার সামরিক শক্তির গোপন আর প্রচারিত সংবাদে অন্য দেশগুলো ভয় পাবে । এই ব্যাপারে শুধু সৈন্য সংখ্যা যথেষ্ট নয় , সামরিক বাহিনীকে জায়মান আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে তৈরি থাকতে হবে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোসিমা আর নাগাসাকির ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলে ওই দুটো শহরকে  ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল আর অজস্র মানুষকে মেরে ফেলতে পেরেছিল।  জাতীয় ক্ষমতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ ও নির্ধারিত নীতির পক্ষে জনসমর্থন সংগ্রহ সরকারের দায়িত্ব।  কূটনীতির  গুণগত দিকটা হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উপাদানগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। একটা দেশের সরকার যে পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করে, তার বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া থাকে  কূটনীতিবিদদের ওপর। শান্তির সময়ে একটা রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক আচরণের ওপর তার জাতীয় ক্ষমতার হ্রাসবৃদ্ধি যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভরশীল। বলাবাহুল্য , এই বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশে যে রাষ্ট্রদূতরা রয়েছেন তাঁদের ওপর ।  জাতীয় ক্ষমতার বিভিন্ন উপাদান একটা রাষ্ট্রের সরকার  যথাযথ ব্যবহার করতে পারছে কিনা তার ওপর সেই দেশের জাতীয় শক্তি নির্ভর করে ।
     
    ক্ষমতার রোষ দেখি প্রাচীন নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ঘটেছিল । ডক্টর অমর্ত্য সেন, নোবেল বিজয়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও দর্শনের অধ্যাপক এবং যিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, বলেছেন, নালন্দাকে ১১৯৩ সালে ধ্বংস করেছিল বখতিয়ার খিলজি । তা ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি শুরুর কিছু পরে এবং কেমব্রিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু আগে। বখতিয়ার খিলজি জ্ঞানের বোদ্ধা ছিল না ; দখলদার ছিল, ক্ষমতার আস্ফালনকারী, যার নির্দেশে বহু মানুষ সেসময়ে খুন হন বা যাঁদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয় । একইভাবে পর্তুগিজরা গোয়ায় ক্ষমতা প্রয়োগ করে স্হানীয়দের ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিল ।  আওরংজেব ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিজের ভাই দারা শুকোকে খুন করিয়ে তার শব লোপাট করে দিয়েছিল আর শিবাজীর ছেলে সম্ভাজীকে খুন করিয়ে টুকরোগুলো নিশ্চিহ্ণ করেছিল । আবু রিহান-আল-বিরুনী, পারস্যের ইতিহাসবিদ, যিনি ১০২২ খ্রিস্টাব্দে চান্দেলা রাজত্ব আক্রমণের সময়ে  গজনীর মাহমুদের সাথে ছিলেন, তিনি খাজুরাহো মন্দির এবং গজনীর মাহমুদের সেনাদের খাজুরাহো ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন। তেরো শতকে, দিল্লির মুসলিম সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবকও চান্দেলা রাজ্য আক্রমণ ও দখল করেন আর বেশির ভাগ মন্দির ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। গুজরাতে ২০০২ সালে যে দাঙ্গা হয়েছিল তাতে শাকিলা নামে এক বধুকে গণধর্ষণ করেছিল একটা উগ্র হিন্দু দলের সদস্যরা  এবং আদালত তাদের  কারাদণ্ড দিয়েছিল ; যেহেতু মসনদের ক্ষমতা ছিল হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের হাতে সেই গণধর্ষণকারীরা পরে ছাড়া পেয়ে যায় ।
     
    জনসমর্থন থাকলে রাষ্ট্রের বাইরে বেরিয়ে একজন মানুষ যে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে তা আমরা দেখেছি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ব্রিটিশ সরকারকে ভারত থেকে উৎখাত করার কাজকর্মে, আই এন এ গঠনের মাধ্যমে । তাঁর ক্ষমতাকে ভয় পেয়ে ভারতের ব্রিটিশ সরকার আর সরকারের ভারতীয় অনুগ্রহভাজনরা তাঁকে এমনভাবে লোপাট করে দিলেন, বহুকাল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস থেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করলেন, যে ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি নতুন সংজ্ঞা গড়ে দিয়ে গেলেন তিনি । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একা বাঙালির গান, সাহিত্য-ভাষা আর সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিলেন ।
     
    সমাজশাস্ত্র আর রাজনীতিতে, ক্ষমতা হল  তড়পানির সামাজিক প্রভাব, যা বিশেষ লোকেরা বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োগ করে আচরণের হুমকি খোলোশা করে । ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে একজন  লোকের দ্বারা অন্যের ওপর জবরদস্তি নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়ায় সীমিত নয় । ব্যক্তি এককও ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে ।  ক্ষমতা কাঠামোগত আদল-আদরা নিতে পারে, কেননা একজন লোক আরেকজনের ওপর দাদাগিরি ফলিয়ে ক্ষমতা প্রকাশ করতে পারে । যেমন রবিনসন ক্রুশো করতো ম্যান ফ্রাইডের ওপর । কিংবা অনুব্রত মণ্ডল করতো পুরো বীরভূম জেলার লোকেদের ওপর ।  কর্তৃত্ব অভিধা  ক্ষমতা শব্দের বদলে ব্যবহৃত হয়, যা সামাজিক কাঠামোর মাধ্যমে, হয়তো তা অবৈধ, তবু বৈধ বা সামাজিকভাবে অনুমোদিত বলে মনে করা হয়। ক্ষমতার ব্যবহার মন্দ বা অন্যায় হতে পারে, বা জনগণের ভালোর জন্য হতে পারে। ক্ষমতাকে ভালো আর  উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বা মানবতাবাদী উদ্দেশ্যপ্রাপ্তি  হিসাবেও দেখা যেতে পারে, যা অন্যদেরও সাহায্য করবে, এমনকী ক্ষমতায়ন করবে, যেমন ভোট দিয়ে বাছাই করার বা ছাঁটাই করার ক্ষমতা ।
     
    সমাজশাস্ত্র আর বিজ্ঞানে ক্ষমতা শব্দটার একাধিক প্রতিশব্দ আছে, যেমন  শক্তি, পরাক্রম,  প্রভাব, শাসন,ঘাত, কুদরত, নিয়ন্ত্রণ, বল, প্রতিপত্তি, কর্মশক্তি, অগ্নি, গুণ, আয়ত্ত, অধিকারদানের দলিল, কর্মক্ষম অবস্থা,  অধিষি্ঠত ব্যক্তি,  প্রভাবশালী ব্যক্তি, কর্তৃত্ব, অধিষি্ঠত সংস্থা,  প্রভাবশালী সংস্থা, কর্মশক্তি, বর্ধনাঙ্ক, প্রাবল্য, প্রবলতা, ত্তজস্বিতা, প্রতাপ, দপদপা, অনুবল, কেরামত, কেরামতি, অধিকার, অধিকারদান, কার্যকরতা, মোক্তারনামা, জোর ইত্যাদি ।
    Power বা ক্ষমতা অভিধাটি বিজ্ঞানেও ব্যবহার করা হয় । পদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষায় একক সময়ে সম্পাদিত কাজের পরিমাণই ক্ষমতা। এস্‌আই একক পদ্ধতির পরিমাপে ক্ষমতার একক ওয়াট। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বৈজ্ঞানিক জেমস ওয়াটের নামানুসারে ক্ষমতার একক "ওয়াট" স্থির করা হয়েছে। এক সেকেণ্ড সময়ে  এক জুল পরিমাণ কাজ করার ক্ষমতা হলো এক ওয়াট। জেমস ওয়াট নিজে ক্ষমতার একক "অশ্ব শক্তি" স্থির করেছিলেন। প্রায়শঃ বিদ্যুৎ, যা কি-না এক প্রকার শক্তি, তা "কিলোওয়াট" হিসাবে পরিমাপ করা হয়। এক কিলোওয়াট=১০০০ ওয়াট। এর মানে হলো এক সেকেন্ডে ১০০০ ওয়াট বৈদ্যুতিক শক্তি আলোতে রূপান্তরিত হওয়া। প্রতি ঘণ্টায় এক কিলোওয়াট শক্তি ব্যবহার করা হলে তা "কিলোওয়াট-ঘণ্টা" দ্বারা প্রকাশ করা হয়। বৈদ্যুতিক মিটারে এক ইউনিট বলতে এক কিলোওয়াট ঘণ্টাকে বোঝায়। এক অশ্বক্ষমতা = ৭৪৬ ওয়াট। জেমস ওয়াটের সংজ্ঞা অনুযায়ী এক সেকেন্ডে একটি ঘোড়ার ৫০০ পাউন্ড পরিমাণের ওজন মাটি থেকে এক ফুট ওপরে উত্তোলনের ক্ষমতাই  এক অশ্বক্ষমতা।
    বর্তমান জগতে যে দেশ প্রযুক্তি-বিজ্ঞানে যতো উন্নত এবং আণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পেরেছে, সেই দেশ ততো ক্ষমতাবান । পৃথিবীর মাট ৯টি দেশের হাতে এখন ৯ হাজার পরমাণু বোমা আছে - যদিও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর এ সংখ্যা আগের চেয়ে কমে গেছে। পরমাণু বোমাগুলো অনেক ক্ষেত্রে বসানো আছে ক্ষেপণাস্ত্রের মাথায়। তা ছাড়া আছে বিভিন্ন সামরিক বিমান-ঘাঁটিতে বা অস্ত্রের গুদামে।
    বিভিন্ন দেশে এখন শত শত পারমাণবিক বোমা বসানো-ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা আছে। আমেরিকান ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বসানো আছে বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, এবং তুরস্কে - সব মিলিয়ে এগুলোর সংখ্যা প্রায় ১৫০। অন্তত ১৮০০ পরমাণু বোমা আছে, যেগুলো খুব স্বল্প সময়ের আদেশে নিক্ষেপ করা যাবে। পারমাণবিক বোমা একইসঙ্গে ভয় দেখানো ও ভয় পাবার অস্ত্র হয়ে উঠেছে এবং পৃথিবীর কয়েকটি দেশকে অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান করেছে ।
     
    দুই
     
    জীববিজ্ঞানে,  আধিপত্যের শ্রেণিবিন্যাস থাকে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘পেকিং অর্ডার’। তা হল এক ধরনের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, যাকে বিভিন্ন প্রাণীর সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্যরা মান্যতা দেয় । এটা ক্ষমতার সিঁড়ি । সিঁড়ির একেবারে ওপরের প্রাণীটাকে, যেহেতু সে প্রভাবশালী আর বলশালী , তাকে কখনও কখনও ক্ষমতার ‘আলফা’ পুরুষ বা  ‘আলফা’ নারী বলা হয়, আর তার তলাকার প্রাণীরা, যারা  বশ্যতা স্বীকার করে সিঁড়ির তলাকার বিভিন্ন পাদানিতে থাকে, তাদের ‘বিটা’ পুরুষ না ‘বিটা’ নারী বলা হয়। বিভিন্ন ধরনের মিথস্ক্রিয়া, আগ্রাসন বা সরাসরি শারীরিক হিংস্রতার আনুষ্ঠানিক প্রদর্শন করে নিজের প্রজাতির ওপর যে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে সে ‘আলফা’ হয়ে ওঠে। পশুদের সামাজিক  গোষ্ঠীগুলোয়, সদস্যরা সীমিত সংস্থান আর সঙ্গমের অধিকার পাবার জন্য প্রতিযোগিতা করে । অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, প্রতিবার দেখা হলে, লড়াই করার বদলে, একই লিঙ্গের এককদের মধ্যে আপেক্ষিক পদমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, সিঁড়ির উঁচু তলার এককরা প্রায়ই সংস্থান আর সঙ্গীদের সঙ্গে সম্পর্কের সুবিধা আরও বেশি করে পায়।  
     
    পশুগোষ্ঠীতে পুনরাবৃত্তিমূলক মিথস্ক্রিয়াগুলোর ওপর ভিত্তি করে, একটা সামাজিক শৃঙ্খলা গড়ে ওঠে । এই  ক্ষমতাধর একককে একজন অধস্তন একক চ্যালেঞ্জ করে যদি হারিয়ে  জিতে যায় তাহলে নতুন একক হয়ে ওঠে গোষ্ঠীর ক্ষমতাধর আলফা আর পুরোনো আলফা চলে যায় নির্বাসনে । সিংহ ও অন্যান্য বলশালী প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায় যে নিজেরই পুরুষ সন্তান বড়ো হয়ে উঠলে তাকে গোষ্ঠী থেকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয়া হয় যাতে বুড়ো বাপকে যুবক ছেলে না হারিয়ে দিতে পারে, অর্থাৎ তারাও রাজনীতি করে। তার মানে বন্য পশুদের গোষ্ঠীতে ক্ষমতা দখল করা আর দখলে রাখা হয় মারামারি, এমনকী খুনোখুনি করে। হয়তো গুহামানবদের সমাজে  এরকম কোনও সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের রীতি ছিল । ক্রমশ সভ্য হতে থাকার দরুন মানবসমাজে ক্ষমতার সংজ্ঞায়ন পালটাতে থেকেছে ; যা নির্ভর করেছে তাদের গোষ্ঠীবদ্ধতা আর অন্য গোষ্ঠিকে আক্রমণের অস্ত্র-শস্ত্র আবিষ্কারের ওপর । ভারতে কিন্তু লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে বলশালীরা ক্ষমতা দেখায় পশুদের মতন খুনোখুনি করে, এলাকা-ছাড়া করে ।
     
    মানবসমাজে অভিপ্রেত ফললাভের সামর্থ্য থেকে ক্ষমতার উৎসার। হ্যান্স জে মরগ্যানথাউ-এর মতে, ক্ষমতা হল অন্যের বা অন্যান্যদের মন ও কাজকর্মের উপর একজন বা বহু মানুষের নিয়ন্ত্রণ। মরগ্যানথাউ 'রাজনৈতিক ক্ষমতা' বলতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারীদের নিজেদের মধ্যে এবং সাধারণভাবে তাদের সঙ্গে জনগণের পারস্পরিক নিয়ন্ত্রমূলক সম্পর্ককে বােঝাতে চেয়েছেন। আরেকজন সমাজতাত্বিক, অর্গানস্কির মতে, নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী অন্যের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত করার সামর্থ্যকে ক্ষমতা বলে। জোসেফ ফ্রাঙ্কেল-এর মতে, অন্যের মন ও কাজ নিয়ন্ত্রণ করে কাঙ্ক্ষিত ফললাভের সামর্থ্যই হল ক্ষমতা।  সুতরাং বলা যায় যে, ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক, যার মাধ্যমে কোনাে ব্যক্তি বা রাষ্ট্র ইচ্ছামতাে অন্যদের কাজ করতে বাধ্য করে। তবে মনে রাখতে হবে ক্ষমতাকে অনেকসময় প্রভাবের সঙ্গে সমার্থক বলে মনে করা হয়, বাস্তবে কিন্তু ক্ষমতা ও প্রভাব এক নয়। প্রভাবের ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছানুযায়ী কোনাে কাজ করানাের মানসিকতাকে বােঝায়, কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে ভীতি প্রদর্শনের ব্যাপার জড়িয়ে আছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শ্লেইচার-এর মতে, কাউকে ভয় দেখিয়ে বা প্রলােভনের দ্বারা পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে কোনাে কাজ করানাে বা তাকে নিজের মতে আনার সামর্থ্য হল ক্ষমতা। কলম্বাস এবং উল্ফে তাঁদের ‘অ্যান ইনট্রোডাকশান টু ইনটারন্যাশানাল রিলেশানস’ বইতে বলেছেন যে, অর্থনীতিতে সম্পদের যেমন গুরুত্ব, রাজনীতিতে ক্ষমতা বা শক্তির  গুরুত্ব সেরকম । অর্থাৎ ক্ষমতা বা শক্তি হল প্রভাব ও বলপ্রয়ােগের মিশেল ।
    সোভিয়েত ইউনিয়ান ভেঙে যাওয়া, যুগোস্লাভিয়ার টুকরো-টুকরো হওয়া, আমেরিকার ভিয়েতনাম, ইরাক, লিবিয়া, সোমালিয়া, আফগানিস্তান আক্রমণ আর রাশিয়ার ইউক্রেণ আক্রমণ, রাশিয়ার ইউরোপকে খনিজ তেল দেয়া নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি থেকে স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতিতে ক্ষমতা বা শক্তি হল গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ধারণা। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল  বিষয় হল ক্ষমতা বা শক্তি।  জাতীয় স্বার্থ ও নীতি অনুযায়ী অন্য রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন জাতীয় শক্তি বা ক্ষমতা। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অনেকাংশে ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি অনুমানের উপর ভিত্তি করে ক্ষমতার ধারণা গড়ে উঠেছে। প্রথমত, যুদ্ধ করার সামর্থ্যকে ক্ষমতা বােঝায় । দ্বিতীয়ত, ক্ষমতা কতোটা আছে। তবে আন্তর্জাতিক ক্ষমতার পরিমাপ করা সহজ নয়, কারণ বর্তমানে ক্ষমতার সঙ্গে বহু বােধগম্যহীন উপাদানও জড়িয়ে আছে । এখন  একটা রাষ্ট্র একলা নিজেকে ক্ষমতাধর হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে না, যেমন দেখা যাচ্ছে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ক্ষেত্রে । নানা দেশের নানারকম স্বার্থ জড়িয়ে থাকে ।  আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামরিক ক্ষমতার গুরুত্ব থাকলেও অর্থনৈতিক বিকাশ, প্রাকৃতিক সম্পর্ক, ভৌগােলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, জাতীয় চরিত্র ও আত্মবিশ্বাস, কূটনীতি ইত্যাদি অসামরিক উপাদানগুলো শক্তি বা ক্ষমতার বিশ্লেষণে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
    ক্ষমতার ধারণাটা  ব্যাপক। ক্ষমতা বলতে শুধু বলপ্রয়ােগ বা বলপ্রয়োগের সামরিক ভীতি প্রদর্শনকেই বােঝায় না, সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক পুরস্কার, মতাদর্শগত ঐক্য, আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে নিজের বক্তব্যের সপক্ষে অন্যকে নিয়ে আসাকেও বােঝায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাউকে কোনাে কাজ করতে বাধ্য করার সামর্থ্যকে ক্ষমতা বলা হয়। কিন্তু প্রভাব বলতে বলপ্রয়ােগ না করে অন্যকে দিয়ে কোনাে কাজ করানাে বা কাজ থেকে বিরত করাকে বােঝায়। অর্থাৎ ক্ষমতা ও প্রভাব সমার্থক নয়। ক্ষমতা হল বলপ্রয়োগ আর প্রভাবের মধ্যবর্তী সমন্বয়কারী ধারণা। এখন যেমন দেখা যাচ্ছে চীন ঋণের বোঝা চাপিয়ে ক্ষমতা আর প্রভাব দুটোই ব্যবহার করতে পারছে । 
    ক্ষমতা বা শক্তি একটা কেন্দ্রীয় ধারণা হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ক্ষমতা বা শক্তির ভিত্তিতে অতি-বৃহৎ শক্তি, বৃহৎ-শক্তি, মাঝারি-শক্তি, ক্ষুদ্র-শক্তি ইত্যাদি হিসেবে স্তরবিন্যাস করা হয়েছে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সােভিয়েত ইউনিয়ন অতিবৃহৎ শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল । কিন্তু সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বর্তমানে চীন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দুটি মহাক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সিকিউরিটি কাউন্সিলে ভিটো প্রয়োগ করার অধিকার কয়েকটা রাষ্ট্রকে বিশেষ ক্ষমতাধর করে তুলেছে । তবে বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিশ্ব-জনমতের গুরুত্ব আর তাৎপর্য বেড়েছে, কেননা অন্য দেশের বাজারে জিনিসপত্র বিক্রি করতে পারাও এখন ক্ষমতার উপাদান । ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমতার ধারণার রদবদল ঘটেছে। এখন কোনো কমজোর দেশ আক্রান্ত হলে সেখানকার রাষ্ট্রযন্ত্র মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ে না; বরং অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমবেত হয়ে তারা  প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা দেয় । বর্তমান কালখণ্ডে একটি রাষ্ট্র শান্তি, নিরাপত্তা ও জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে।
    একটা রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ওপর দাদাগিরি ফলানোর মধ্যেই রাষ্ট্রটার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ নয় । রাষ্ট্রের বিভিন্ন সিঁড়িতে বসে থাকা লোকেরা একা, আর তারা একসঙ্গে মিলেমিশে, নাগরিকদের ওপর ক্ষমতা ফলায় । লুই আলথুজার তাঁর  ‘আইডিওলজি অ্যান্ড আইডিওলজিকাল স্টেট অ্যাপারেটাসেস’ প্রবন্ধে  রাষ্ট্র আর তার নাগরিকদের মধ্যে ক্ষমতা প্রয়োগের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন । অ্যালথুজার জিজ্ঞাসা করছেন কেন প্রজারা বাধ্য, কেন লোকেরা আইন মেনে চলে আর কেনইবা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা বিপ্লব হয় না। অ্যালথুজারের মতে রাষ্ট্র হল এক ধরনের সরকার গঠন যা পুঁজিবাদের সাথে উদ্ভূত হয়। একটি রাষ্ট্র, পাঠক এখানে 'জাতি' শব্দটা প্রতিস্থাপন করতে পারেন,  'রাষ্ট্র' ধারণাটাকে বোঝার জন্য, এটা পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির দরুন গড়ে ওঠে, আর তার স্বার্থ রক্ষা করে । উনি বলেছেন, এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য, আপনি একজন মার্কসবাদী হোন বা না হোন, বিচ্ছিন্ন একক হিসেবে জাতির ধারণা পুঁজিবাদের সাথে সাংঘর্ষিক। এটাও সম্ভব যে গণতন্ত্র, একটা মতাদর্শ এবং/অথবা একটি সরকারী রূপ হিসাবে পুঁজিবাদের সাথে মিলিত, কারণ গণতন্ত্র ভুল বুঝিয়ে বলে যে সকল মানুষ সমান, আর সবায়ের সমান ক্ষমতা রয়েছে আর তাই অর্থনৈতিক শোষণের সম্পর্কের মুখে একটা মুখোশ পরিয়ে দেয়।
    অ্যালথুজার মনে করেন একটা রাষ্ট্রে বসবাসকারী লোকেরা যাতে সেই রাষ্ট্রের নিয়ম মেনে চলে তা নিশ্চিত করার জন্য দুটি প্রধান প্রক্রিয়া আছে, এমনকি যখন তা করা হয়, সেটা  তাদের শ্রেণী অবস্থানের ক্ষেত্রে তাদের সর্বোত্তম স্বার্থে মোটেই করা হয় না । প্রথমটা হল, যাকে অ্যালথুজার বলেছেন ‘দমনমূলক রাষ্ট্রীয় অ্যাপারেটাস’ , যা নাগরিকদের ওপর সরাসরি প্রয়োগ করা হয়, যেমন পুলিশ এবং ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা। এই 'অ্যাপারেটাসগুলোর' মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগ করে, যার দ্বারা নাগরিককে বা নাগরিকদের ওপর শারীরিক আর মানসিক অত্যাচার করা হয় । আলথুসার  দ্বিতীয় প্রক্রিয়াকে বলেছেন ‘মতাদর্শগত রাষ্ট্রীয় অ্যাপারেটাস’ । এগুলো এমন প্রাতিষ্ঠানিক ঘাঁটি যা মতাদর্শ তৈরি করে নাগরিকদের বিলোয়, যা  ব্যক্তি-একক (এবং গোষ্ঠী)  অনুসরণ করে, প্রকৃতপক্ষে মেনে নিতে বাধ্য হয়, আর সেই অনুযায়ী কাজ করে। এই অ্যাপারেটাসের মধ্যে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গুপ্তচর-ব্যবস্হা, ধর্ম, পরিবার, আইনি ব্যবস্থা, রাজনীতি, শিল্পকলা, সংবাদপত্র, খেলাধুলা - এমন সংগঠন যা ধারণা এবং মূল্যবোধের কাঠামো তৈরি করে, যা  ব্যক্তি হিসাবে নাগরিকদের বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে। এটাই আলথুজারের প্রধান উদ্বেগ: কীভাবে আমরা রাষ্ট্র ও তার যন্ত্রের তৈরি করা মতাদর্শগুলোকে নিজের বলে মেনে নিই , বিশ্বাস করি আর  এইভাবে পুঁজিবাদকে নিজেদেরকে অপরিবর্তনীয় বনেদ হিসাবে ভুলভাবে চিনতে বা ভুলভাবে উপস্থাপন করতে আরম্ভ করি।
    আলথুজারের বক্তব্য মতাদর্শ আর আদর্শের মধ্যে পার্থক্য দিয়ে শুরু হয়। মতাদর্শ নির্দিষ্ট, ঐতিহাসিক এবং ভিন্ন । মানুষ বিভিন্ন মতাদর্শ সম্পর্কে কথা বলতে পারে, যেমন ইসলামি মতাদর্শ, হিন্দু মতাদর্শ, গণতান্ত্রিক মতাদর্শ, নারীবাদী মতাদর্শ, মার্কসবাদী মতাদর্শ। মতাদর্শ ব্যাপারটা কাঠামোগত। আলথুসার বলেছেন যে মতাদর্শ একটা কাঠামো, যাকে লোকে 'শাশ্বত' বলে মনে করে ।  এই কারণেই আলথুসার মনে করেন যে আদর্শের কোনো ইতিহাস নেই। তিনি মার্কসবাদী ধারণা থেকে কাঠামো হিসাবে আদর্শের এই ধারণাটি গ্রহণ করেছেন, যে, আদর্শ হল ‘সুপারস্ট্রাকচারের অংশ’, তবে তিনি ফ্রয়েড এবং লাকাঁর কাছ থেকে নিয়ে মতাদর্শের কাঠামোকে অচেতনের ধারণার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। যেহেতু মতাদর্শ একটি কাঠামো, তার বিষয়বস্তু পরিবর্তিত হবে, লোকে এটা যে কোনও কিছু দিয়ে পূরণ করতে পারে - তবে এর আঙ্গিক, অচেতনের কাঠামোর মতো, সর্বদা একই থাকে।  মতাদর্শ 'অচেতনভাবে' কাজ করে। ভাষার মতো, মতাদর্শ হল একটি কাঠামো বা ব্যবস্থা, যার ঘেরাটোপে আমরা বাস করি, যা আমাদের কথা বলে, অথচ যা আমাদের এই বিভ্রম দেয়, যে, আমরা দায়িত্ববান, আর আমাদের দায়িত্ব, প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েছে । লোকেরা যে বিষয়গুলোতে বিশ্বাস করে তার বিষয়বস্তু তারা স্বাধীনভাবে বেছে নেয়, আর বিশ্বাস করার অনেক কারণ খুঁজে পেতে পারে, কেননা লোকেদের মাথায় ঘোল ঢেলে  এই ব্যাপারগুলোতে বিশ্বাস করানো হয় । যেমন ইসলামে বিশ্বাসকারী মতাদর্শ আল কায়দা, আল শবাব, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন, জামাত-ই-ইসলামি, হিজবুল মুজাহাদিন, তেহরিক-ই-ইসলামি, ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট, লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ-ই-মুহাম্মদ ইত্যাদি ।  যেমন হিন্দুদের অভিনব ভারত, অখিল ভারতীয় একহারা পরিষদ, ভাজপা, শিব সেনা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, হিন্দু মুনানি, পনুন কাশ্মীর, অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা, শ্রীরাম সেনা ইত্যাদি ।
    অ্যালথুজারের তত্বের প্রথম বক্তব্য হল এই, যে, 'মতাদর্শ  ব্যক্তিদের তাদের অস্তিত্বের বাস্তব অবস্থার সাথে কাল্পনিক সম্পর্কের  "প্রতিনিধিত্ব" করে ।' উনি প্রশ্ন তোলেন যে  কেনই বা মানুষের অস্তিত্বের বাস্তব অবস্থার সাথে এই কাল্পনিক সম্পর্ক প্রয়োজন হয় । কেন লোকেরা  বুঝতে পারে না বাস্তব আসলে কী ? আলথুজারের মার্কসবাদী উত্তর হল যে, বাস্তব অবস্থার বস্তুগত বিচ্ছিন্নতা মানুষকে এমন পরিস্হিতি তৈরি করতে প্ররোচিত করে, যা তাদের এই বাস্তব অবস্থা থেকে  বিচ্ছিন্ন  করে রাখে। অন্য কথায়, পুঁজিবাদী উত্পাদনের বস্তুগত সম্পর্কগুলো নিজেরাই বিচ্ছিন্ন, কিন্তু মানুষ এর কঠোর বাস্তবতাকে মোকাবেলা করতে পারে না, তাই তারা যুক্তি দেয়, যে, উত্পাদন সম্পর্কগুলো এতটা খারাপ নয় । এই তর্ক বা উপস্থাপনা,  তাদের বিচ্ছিন্ন-বাস্তব  অবস্থা থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে। অবস্হাটা যেন একরকমের বেদনানাশক, ওষুধের ট্যাবলেটের মতো কাজ করে, যা তাদের বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা অনুভব করা থেকে বিরত রাখে । যদি তাদের কাছে এই গল্পগুলো না থাকত, তারা উত্পাদনের প্রকৃত সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা জানতে পারতো আর  সম্ভবত বিদ্রোহ করতো ।
    আলথুজারের তত্বের দ্বিতীয় বক্তব্য হলো যে ‘মতাদর্শের একটা বস্তুগত অস্তিত্ব আছে।’ মার্কসবাদীদের জন্য সর্বদা বস্তুগত অনুশীলন, বস্তুগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের বিশ্লেষণের ভিত্তি রাখা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । মার্কসবাদীদের ধারণা সম্পর্কে কথা বলার জন্য,  তাদের উপাদান হিসাবে কথা বলতে হবে। আলথুজার দৃঢ়ভাবে দাবি করেন, যে, মতাদর্শ সর্বদা দুটি জায়গায় বিদ্যমান  - একটা যন্ত্র বা অনুশীলনে (যেমন একটি আচার, বা নির্দিষ্ট আদর্শ দ্বারা নির্দেশিত আচরণের অন্যান্য রূপ) এবং একটা বিষয়ের মধ্যে, একজন ব্যক্তির মধ্যে - যিনি, সংজ্ঞা অনুযায়ী, একটা উপাদান । জাক লাকাঁ আর দেরিদার বক্তব্য ধার করে বলা যায়, যে, আলথুজার অন্যান্য পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্ট তাত্ত্বিকদের একজন মেলবন্ধনকারী ছিলেন। তিনি ফ্রয়েড দ্বারা মন্ত্রমুগ্ধ, আবার ল্যাকাঁ দ্বারা আরও বেশি  মন্ত্রমুগ্ধ; উনি মতাদর্শ সম্বন্ধে নিজের ধারণাগুলো সরাসরি লাকাঁ থেকে নিয়েছেন। 
    আলথুজার মারা যান ১৯৯০ সালে । তাই দেখে যেতে পারেননি কেমন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সোভিয়েত রাষ্ট্র এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট দেশগুলো, প্রধানত সমগ্র সমাজে আর ব্যক্তি-নাগরিকদের ওপর ক্ষমতার ভুল প্রয়োগের কারণে । একটিমাত্র দল হয়ে উঠেছিল সর্বেসর্বা । ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গড়ে ওঠে পনেরোটা স্বাধীন রাষ্ট্র। ফলে রাশিয়া আন্তর্জাতিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকারী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হয়।  ১১ই মার্চ ১৯৯০ সালে লিথুয়ানিয়া প্রথম নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করে, সঙ্গে ইস্তোনিয়া ও লাতভিয়াও ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বাদবাকি বারোটা প্রজাতন্ত্রও পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে, ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে  স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে  প্রতিষ্ঠিত  হয়। বর্তমানে বারোটা সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র এখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে রাষ্ট্রমণ্ডলের সদস্য।
    ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু হয়েছিল জোসেফ স্তালিনের মসনদে বসার সময় থেকে। ক্ষমতা কাকে বলে জিগ্যেস করলে বলতে হবে জোসেফ স্তালিন যা করতেন, তাকে । ১৯২২ সালে লেনিন এর প্রথম স্ট্রোকের পর স্তালিন পার্টির প্রায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন এবং লেনিনকে সোভিয়ের জগত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। যার ফলে পার্টির সিনিয়র নেতারা বিরাগভাজন হন। লেনিনও ধীরে ধীরে স্তালিনের স্বেচ্ছাচারিতা, অভদ্র আচরণ, উচ্চাকাঙ্খায় ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে পরিশেষে পার্টির সর্বোচ্চ পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলার প্রস্তাব দেন। কিন্তু স্তালিনের কুটচালে তা আর কখনো সম্ভব হয়নি। জনসম্মুখে লেনিনের শেষ ইচ্ছাপত্র সম্পূনর্রূপে  কখনো প্রকাশ পায়নি। পার্টির অন্যান্য প্রভাবশালী যে নেতারা সেটা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন- তাদের পার্টি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ট্রটোস্কিকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেই থেকে শুরু হয়েছিল স্তালিনের ক্ষমতা প্রয়োগের স্বেচ্ছাচারিতা আর নিশ্বংসতা,  সেই সাথে গোপনীয়তা, যা বজায় ছিল তার ক্ষমতার শেষ দিন পর্যন্ত। স্তালিন যদি একনায়কতন্ত্রিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে মসনদে না বসাতেন, তাহলে মার্কসবাদী রাষ্ট্রগুলো হয়তো ভিন্নভাবে বিকশিত হতো ।
    সোভিয়েত ক্ষমতা কাঠামো সম্পর্কে জর্জ অরওয়েল ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে এই কথাগুলো লিখেছিলেন : “এখন আমি আপনাদের কথাটা বলব। ব্যাপারটা এই : পার্টি সম্পূর্ণভাবে নিজের স্বার্থে ক্ষমতা চায়। আমরা অন্যের ভালোর প্রতি আগ্রহী নই; আমরা শুধুমাত্র ক্ষমতা, বিশুদ্ধ ক্ষমতায় আগ্রহী. বিশুদ্ধ শক্তি বলতে কী বোঝায় আপনি এখনই বুঝতে পারবেন। আমরা অতীতের অলিগার্কি থেকে আলাদা কেননা আমরা জানি আমরা কী করছি। অন্য সবাই, এমনকি যারা আমাদের মতন ছিল, তারা ছিল কাপুরুষ ও ভন্ড। জার্মান নাৎসি আর রাশিয়ান কমিউনিস্টরা তাদের পদ্ধতিতে আমাদের খুব কাছাকাছি এসেছিল, কিন্তু তারা কখনই তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্যগুলোকে চিনতে সাহস পায়নি। তারা ভান করেছিল, সম্ভবত তারা বিশ্বাস করেছিল যে, তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে এবং সীমিত সময়ের জন্য ক্ষমতা দখল করেছে আর কোথাও একটা স্বর্গ রয়েছে যেখানে মানুষ স্বাধীন আর সমান হবে। আমরা এমন নই। আমরা জানি যে কেউ কখনও ক্ষমতা ত্যাগ করার ইচ্ছা নিয়ে তা দখল করে না। ক্ষমতা কোন মাধ্যম নয়; সেটা একটা সমাপ্তি । বিপ্লবকে রক্ষা করার জন্য কেউ স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করে না; একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব ঘটায়। নিপীড়নের জন্যই নিপীড়ন। নির্যাতনের জন্য যাদের বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। ক্ষমতা হলো  শক্তি। এখন তুমি আমাকে বুঝতে পারছ তো !”
    অভিধা হিসেবে, ক্ষমতায়ন শব্দটা আমেরিকান  সমাজ বিজ্ঞানী জুলিয়ান রাপাপোর্টের তৈরি। যদিও ক্ষমতায়ন তত্ত্বের শেকড় ইতিহাসে আরও প্রসারিত এবং মার্কসবাদী সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বের সাথে যুক্ত। এই সমাজতাত্ত্বিক ধারণাগুলো নব্য-মার্কসবাদী তত্ত্বের মাধ্যমে বিকশিত এবং পরিমার্জিত হয়ে চলেছে। ক্ষমতায়ন হল মানুষ এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বায়ত্তশাসন এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের মাত্রা। এটা তাদের নিজস্ব কর্তৃত্বে সহায়ক একটা দায়িত্বশীল আর স্ব-নির্ধারিত উপায়ে তাদের স্বার্থের সুরক্ষা করতে সক্ষম করে তোলে । এটা আসলে শক্তিশালী আর আত্মবিশ্বাসী হওয়ার প্রক্রিয়া, বিশেষ করে নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণ করা, আর নিজের অধিকার দাবি করার প্রক্রিয়া। কাজ হিসেবে ক্ষমতায়ন বলতে আত্ম-ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া আর জনগণের পেশাদার সমর্থন, দুটোই বোঝায়, যাতে তারা তাদের ক্ষমতাহীনতা এবং প্রভাবের অভাবকে কাটিয়ে উঠতে আর তাদের সংস্থানগুলোকে চিনতে এবং ব্যবহার করতে সক্ষম করে। ভারতে নিম্নবর্ণের লোকেদের ক্ষমতায়ন খুবই জরুরি আর তাই বিভিন্ন রাজ্যে দলিতেরা নিজেদের অধিকার চাইছে, আন্দোলন করছে । মায়াবতী একটা রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন দলিতদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য । ভারতের সংবিধানে দলিতদের ক্ষমতায়নের জন্য চাকুরির ও শিক্ষার কোটা দেয়া হয়েছে । মণ্ডল কমিশন অন্যান্য নিম্নবর্ণের জন্য বিশেষ কোটার দ্বারা ক্ষমতায়নের সুপারিশ করেছিলেন যাকে ভারত সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার মান্যতা দিয়েছে । তবু, দলিতদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়নি জাতিপ্রথার কারণে ।
    তিন
    সমাজে ক্ষমতার উৎস কী অথবা কীভাবে এই ক্ষমতা কাজ করে তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন তাত্ত্বিকরা মত দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করেছে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রকে। ম্যাকিয়াভেলি তার 'দ্য প্রিন্স' বইয়ে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতাকে ন্যায্যতা দিয়েছেন। অন্য দিকে থমাস হবস তার 'Leviathan' বইয়ে মানুষের খারাপ দিকগুলো ঠেকানোর জন্য একজন রাজার হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা তুলে দিতে বলেচিলেন। ইতিহাসে বেশিরভাগ  তাত্ত্বিক ক্ষমতার সাথে রাষ্ট্রের যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। কেউ কেউ ক্ষমতাকে সামাজিক কাঠামোর একটা উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, এই চিন্তাধারায় ক্ষমতা হচ্ছে এমন ব্যাপার যা কেউ নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারে আর তা ব্যবহার করতে পারে। ষাটের দশক পর্যন্ত ক্ষমতা সম্পর্কীয় তত্ত্ব দু'ভাগে বিভক্ত ছিল । একটা হলো জনগণের ওপর সরকার বা রাষ্ট্রের ক্ষমতা, অন্যটা হলো বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মার্কসীয় চিন্তাধারা। সেই তত্ত্বগুলো ছিল মূলত সামষ্টিক পর্যায়ের (Macro Level)।
    মিশেল ফুকোর ক্ষমতাতত্ব আলোচনাকালে বিনায়ক সেন বলেছেন “ক্ষমতা অর্থাৎ Power বিষয়টিকে ফুকো যেভাবে দেখেছেন, যত বিভিন্ন উপায়ে তার বিশ্নেষণ করেছেন, সেভাবে তাঁর আগে কোনো দার্শনিকই ব্যাখ্যা করেননি। মার্কস যেমন পুঁজির রহস্য-উন্মোচনের জন্য পৃথিবীজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন, ফুকোও তেমনি ক্ষমতার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর সব কথা মানতেই হবে এমন নয়। এ নিয়ে আরেক ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদার সাথে তাঁর উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। জার্মান দার্শনিক জুরগেন হাবেরমাসের সাথেও বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু সবাই এ কথা স্বীকার করেছেন যে, তাঁকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।  ক্ষমতা বিষয়ে ফুকোর আলোচনাকে (যাকে তিনি বলেছেন 'ডিসকোর্স', এ শব্দটি তাঁরই উদ্ভাবন) কয়েকটি শিরোনামে ভাবা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ম্যাক্রো ও মাইক্রো পাওয়ার, 'ডিসিপ্লিনারি' পাওয়ার, নরমালাইজিং পাওয়ার, 'বায়ো পাওয়ার' ইত্যাদি। এসব ধারণা ফুকোর বিভিন্ন পর্যায়ের লেখায় উঠে এসেছে। অর্থাৎ  ক্ষমতা প্রসঙ্গে ফুকো চিরকাল একই ভাবনা ভাবতেন না।  ক্ষমতার 'প্রাণভোমরা' ছড়িয়ে আছে নানা স্থানে, সমাজ-শরীরের সর্বত্র। বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল-ক্লিনিক, জেলখানা, বিচারালয়, পত্রিকার অফিস, টিভি চ্যানেল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-এনজিও, উপাসনালয়, পাড়ার ক্লাব, মহল্লার সংগঠন, পরিবারের ভেতরে, এমনকি ব্যক্তিসত্তার মধ্যেও। এরকম অপ্রত্যাশিত স্থানে উৎকীর্ণ হয়ে আছে ক্ষমতার ছাপ । অর্থাৎ ফুকো এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন, সর্বত্র অশুভ 'ক্ষমতা-চর্চা'র প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না করতে পারলে শুধু রাষ্ট্র-ক্ষমতা বদলে সর্বাত্মক পরিবর্তন আসবে না, বা এলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
    মিশেল ফুকোর ম্যাক্রো বনাম মাইক্রো পাওয়ার ব্যাখ্যা করে বিনায়ক সেন বলেছেন, “সাধারণত আমরা 'পাওয়ার’ বলতে রাষ্ট্র-ক্ষমতা বা রাজ-ক্ষমতাকে বুঝি । এই ক্ষমতা 'ওপর থেকে' প্রয়োগ করা হয় । এই ক্ষমতা যিনি 'রাষ্ট্রের প্রধান' (যেমন রাজা, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী), তারই শুধু চর্চার বিষয় নয়, তার অধীনস্থ রাষ্ট্র-যন্ত্র (প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান, বিধিমালা, আইন-কানুন) এই চর্চার অংশ। আধুনিক রাষ্ট্র-ক্ষমতার প্রয়োগ ও পরিধিকে ঘিরে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই এক আইনি আলোচনা গড়ে উঠতে থাকে। যাকে ফুকো বলেছেন 'লিগ্যাল-জুরিডিক্যাল ডিসকোর্স'। এই আলোচনার মূল মনোযোগ ছিল রাষ্ট্র-ক্ষমতার পরিধিকে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরূপণ করা। রাজা সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন, কিন্তু নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে যেতে পারবেন না। তেমনি, প্রজারাও সকল অধিকার ভোগ করতে পারবেন, কিন্তু নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে বাড়তি কিছু প্রত্যাশা করতে পারবে না। এভাবে রাজা ও প্রজার মধ্যে যার যার অধিকার নির্দিষ্ট করে ক্ষমতা প্রয়োগের একটি সাংবিধানিক ও আনুষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার ও নাগরিকদের যার যার অধিকার রক্ষাপূর্বক ক্ষমতা-প্রয়োগের স্বীকৃত কাঠামোকে নানা ধরনের রক্ষাকবচ দিয়ে আরো যুক্তিসিদ্ধ করে তোলা হয়েছে। আমেরিকায় যেমন ট্রাম্পের শাসনকালে প্রেসিডেন্টের প্রভূত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, ট্রাম্প তাঁর ইচ্ছামতো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেননি । সেখানে কংগ্রেস-সেনেটের অনেক নিয়ম-নীতির রক্ষাকবচ তাঁকে আটকেছে। তার ওপরে স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং সর্বোপরি সুপ্রিম কোর্টের অলঙ্ঘনীয় ছায়া ছিল।
    সাংবিধানিক বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রের বিধিমালা ও আইন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভের (আইন-প্রণয়ন, বিচার ও প্রশাসন) মধ্যে দায়িত্ব-বণ্টন, সরকারের পরিচালনা পদ্ধতি, বিভিন্ন দপ্তর-মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির ক্ষমতার ব্যবহার ও অপব্যবহার নিয়ে মাঝে মাঝেই 'টেনশন' সৃষ্টি হয় এবং তা নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। বলা দরকার, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে গড়ে ওঠা 'অধিকারের ভাষায়' (Rights based discourse) নির্মিত ক্ষমতা-প্রয়োগের এই ডিসকোর্সকে ফুকো অস্বীকার করছেন না। এই ক্ষমতা-প্রয়োগের অংশ হিসেবে মার্কস, গ্রামসি বা আলথুজার যখন 'আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারেটাস অব স্টেট'-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন, সেটিকেও ফুকো অস্বীকার করছেন না। তিনি শুধু বলছেন, সুদূর প্রাচীন বা মধ্যযুগেও রাজশক্তি যে টিকে ছিল, তা শুধু কর্তৃত্ব প্রয়োগের মাধ্যমেই অর্জিত হয়নি। আধিপত্য বিস্তার (ডমিনেশন) যেমন তাতে ছিল, তেমনি ছিল আধিপত্য-প্রয়োগের ন্যায্যতা সম্পর্কে 'সত্যের প্রচার'।
     ফুকোর 'রেজিম অব ট্রুথ' এবং গ্রামসির 'হেজিমনি' ধারণার মধ্যে মিল আছে। তবে সব রেজিম অব ট্রুথ সর্বেশ্বরতা পায় না। অর্থাৎ হেজিমনিক স্তরে যেতে পারে না। তবে সব রাজাকেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে সত্যের প্রচার করতে হয়েছে কম-বেশি। ফুকো বলেছেন, Right in the west is the king’s Right ... [The] resurrection of Roman law [in the 12th century] was the major event around which, and on whose basis, the juridical edifice which had collapsed after the fall of the Roman Empire was reconstructed.’  রোমান ল-এর পুনর্জীবনের মধ্য দিয়ে আবার মধ্যযুগের রাজ-রাজড়াদের absolute power’  প্রয়োগের আইনি ও প্রশাসনিক দিকটির সুরাহা করা হয়েছিল। কিন্তু ফুকো বলছেন, তখনও সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। যেমন, 'মহাভারত'-এর যুগে অনুশাসন-পর্বের বিষয়বস্তু ছিল, আজকের পরিভাষায়, 'গভর্ন্যান্স' বা সুশাসনের প্রয়োগ-বিধির আলোচনা। অর্থাৎ রাজা বা রাজশক্তি কীভাবে যুক্তিসঙ্গতভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করবেন, রাজার অধিকার কতটুকু, প্রজাদেরই বা অধিকার কতটুকু, তাকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে সেখানে। 
    কৌটিল্যর 'অর্থশাস্ত্র'তে অমন নির্দিষ্ট অধিকারকে বিধিমালা ও আইনের মাধ্যমে আরও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। উদাহরণত, কৌটিল্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩২ রকমের দুর্নীতি শনাক্ত করেছেন এবং তার জন্য পৃথক দণ্ডের সুপারিশ করেছেন। সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনার তাগিদ না থাকলে আবুল ফজল আইন-ই-আকবরী লিখতেন না। একই কথা বলা যায় ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা বিষয়েও। আধুনিক যুগের রাষ্ট্রতাত্ত্বিকরা যথা হবস, লক, বেন্থাম, মিল প্রমুখ যখন সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক রাজশক্তির ক্ষমতার বৈধতা, গণ্ডি বা চৌহদ্দির সীমা নির্ণয় করতে কলম ধরেছেন, সেটাও সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনার প্রয়োজনেই। সার্বভৌম (Sovereignty) যিনি, তাঁর 'ন্যায়সঙ্গত' অধিকার কতটুকু ও কী কী, এটা যেমন তাদের আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল, তেমনি প্রজাদেরও 'আইনসম্মত' অধিকার কতটুকু, সেসব আলোচনায় স্থান পেয়েছে। ফুকো বলছেন, এসব আলোচনা, ডিসকোর্স তথা সত্য-উৎপাদনের মধ্য দিয়ে মূল উদ্দেশ্যটা খোলাসা করে বলা হয়নি। লিবারেল বা কনজারভেটিভ সব ধারারই রাজনৈতিক ভাবুকরা যার যার মতো 'অধিকারের ভাষা' নির্মাণ করেছেন। কিন্তু, তাঁরা এটা করতে গিয়ে আসলে 'ক্ষমতার সম্পর্ক'কেই আড়াল করেছেন।”
    হাসনায়েন ইমতিয়াজ সাকিব, মিশেল ফুকোর ক্ষমতাতত্ব আলোচনাকালে বলেছেন, “ক্ষমতার বহুমুখী সম্পর্ক সমাজ তৈরি করে, চরিত্রায়িত করে, অতিক্রম করে অবিরত। সত্যের আলোচনার সাথে যেগুলোকে আলাদা করা যায় না, সেখানে সংগ্রহ, প্রচার ও প্রয়োগ ব্যতীত তাদের প্রতিষ্ঠিত বা কার্যকর করা সম্ভব নয়। সংগ্রহ, প্রচার ও প্রয়োগের ফলে একটা বিষয় সমগ্রভাবে সত্য হয়ে ওঠে, তাকে চেনা যায়। সত্যের আলোচনায় মিতব্যয়ীতা কাজে লাগাতে না পারলে ক্ষমতার সৌজন্যেই তাকে কাজে লাগানো যাবে না। সমাজে ক্ষমতা, অধিকার ও সত্যের ভেতরে এই সম্পর্ক বিদ্যমান এবং সুসংগঠিত।  ক্ষমতাকে আরোহী পদ্ধতিতে বিবেচনা করা উচিত, অর্থাৎ শুরু করতে হবে ক্ষমতার অসীম কলকব্জা থেকে, যাদের নিজস্ব ইতিহাস, নিজস্ব গতিপথ, নিজস্ব কৌশল আছে৷ 
    নিজস্ব গুণে মোড়া যে ক্ষমতার কলকব্জা রয়েছে, সেই কলকব্জা নিজস্ব প্রযুক্তি দ্বারা সমাজের প্রতিটি স্তরে তাকে কাজে লাগানো হয়, স্থানচ্যুত করা হয়,  অন্যান্য নিয়ম থেকে, রূপান্তর ঘটানো হয় প্রয়োজন মতো এবং ব্যবহার করা হয় প্রতিটি পদক্ষেপে। এক্ষেত্রে নিচুস্তরে প্রয়োগ করা ক্ষমতার ঘটনা, কৌশল ও কাজকর্মের ধরনকে বিশ্লেষণ করা দরকার । এই বিশ্লেষনের ফলে দেখা যাবে ক্ষমতার কর্মপদ্ধতি মূলত স্থানচ্যুত, প্রসারিত ও পরিবর্ধিত এবং ঘটনা-পরম্পরা সৃষ্টি করে কাজে লাগানোর প্রক্রিয়ায় ডুবে থাকে।  এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রকার আর সীমারেখা নিয়ে ফুকোর আলোচনার প্রসঙ্গ ও ভাবনা-জালের বিস্তার শুরু। অধিকারের নিয়ম প্রতিষ্ঠা করাই শ্রেফ ক্ষমতার লক্ষণ, নাকি তা নতুনভাবে পুর্নগঠিতও হতে পারে নব্য উপনিবেশবাদী চরিত্রের মতো, যে চরিত্রের কাজই হলো নতুন উৎপাদিত তথ্য, পণ্য ও সামগ্রী দ্বারা গোটা গোষ্ঠীর একটি মনস্তাত্ত্বিক সম্মতি আদায় করার আপ্রাণ চেষ্টা। এই আদায় করার উপায়ে শারীরিক কসরতকে মাথায় না রেখে মানসিক দাসত্বে রূপান্তর করবার যে ক্ষমতা কিংবা নতুন ভাবে জ্ঞানের কাঠামো নির্মাণের যে শক্তিবলয় এবং স্বাভাবিক একটি জ্ঞান, তা কীভাবে পরে হয়ে ওঠে ‘শক্তি ও ক্ষমতার’ উৎস,  এসব ভাবনা নিয়ে মিশেল ফুকো শুরু করেছেন তাঁর যাত্রা । 
    পার্লামেন্ট, মন্ত্রিসভা, পুলিশ, মিলিটারী, জেলখানা, আমলা ও প্রশাসক ইত্যাদি সব কিছুর দ্বারা ক্ষমতা তৈরি হতে পারে এবং এগুলোর মাধ্যমেই গণ-ইচ্ছার বাস্তবায়ন সম্ভব।কিন্তু একটা পর্যায়ে, তা যতোটা না সকল বর্গের জন্য হয়ে উঠতে পারে, তার চেয়ে বেশি তা বুর্জোয়া-পুঁজিপতি-উচ্চবর্ণ শ্রেণীর উদ্দেশ্যে হয়ে উঠে, ফলে সেখানে বুর্জোয়াদের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্য ঘটে । সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন হয়না কেননা গণতন্ত্র রূপ নেয় ‘বুর্জোয়ার ভোটের যন্ত্র’ হিসেবে। মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্ষমতাকে দেখা হয় সর্বদা দমনের যন্ত্র হিসেবে, প্রকৃত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে অধিপতি শ্রেনির হাতে। তারা সেটাকে ব্যবহার করে নিজেদের আধিপত্য রক্ষা করে। মাও-সে-তুং  এই ধরনের শ্রেণীকে বলে গিয়েছেন উপরিকাঠামো শ্রেণী, এই একই কথা মার্ক্স ও গ্রামশির কাছ থেকেও এসেছিলো। এখান থেকে এবার বিস্তৃতির যাত্রা শুরু ফুকোর। বুর্জোয়া ভাবাদর্শ পরতে পরতে যেভাবে আঁট বেঁধে থাকে, তার আদর্শ বা ভাবাদর্শ স্রেফ একটা অবস্থানেই সীমাবদ্ধ নয়, তাকে প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উৎযাপিতও করা হয়। যেখানে গ্রামসি বলছেন এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হেজিমনির প্রক্রিয়া, যার দ্বারা সামগ্রিক রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক ক্ষমতাকে বৈধকরণ করা যায়। 
    উদারনীতিবাদী ও মার্ক্সবাদী উভয়চিন্তাধারা থেকে ফুকোর ক্ষমতা বিষয়ক চিন্তা আলাদা। ফুকো মনে করেন যেখানে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির কাছে ক্ষমতা হলো সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, আইন-আদালত সেখানে মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে তা হলো নিছক রাষ্ট্রযন্ত্র। কিন্তু এর আগেও  অন্যান্য অনেক তত্ত্ব ক্ষমতার পুরো প্রক্রিয়াকে সঠিক ভাবে গড়ে তুলতে পারেনি, একটা সামগ্রিক ডিসকোর্সের মধ্যে গঠিত হয়ে সার্বিক সত্য ইতিহসের সংজ্ঞায় উপনীত হতে পারেনি , বরং তা ছিল খন্ডে খন্ডে বিভক্ত। সেখানে মিশেল ফুকো ধার করলেন ‘শৃঙ্খলা ও শান্তি’ অধ্যায়ের তত্ত্ব ও ইতিহাস। মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের সময় শাস্তির মান এবং আধুনিক গণতান্ত্রিকযুগে শাস্তির মান এক নয়। এক সময় প্রভু বা রাজার নির্দেশ মোতাবেক সমগ্র শহরজুড়ে অনুষ্ঠান আয়োজন হতো, জনগণকে সরাসরি দেখানো হতো কাউকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কাউকে গিলোটিনের নিচে রেখে মাথা কেটে ফেলা হতো কিংবা পুড়িয়ে মারা হতো। সউদি আরবে আর তালিবানি আফগানিস্তানে এখনও জনগণের সামনে কোতল করার প্রথা বজায় আছে । এটা হলো ক্ষমতার চরম আস্ফালন ।
    প্রাচীন ভারতেও তখনকার দিনে রাজার নির্দেশের বাইরে যে-কোনো কাজই শাসনের বিরুদ্ধে বা বিপরীতে কাজ ছিল। ফলে অমান্যকারীকে শূলে চড়ানো হতো। ইউরোপে  ফরাসী বিপ্লব সংগঠিত হয় মানুষকে স্বাধীনতা দেবার উদ্দেশ্যে, মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। গণতন্ত্রকে মানুষ মানসম্মত ও আদর্শ হিসেবে ধরে নিলে গণতন্ত্রের যুগ প্রতিষ্ঠিত হওয়া শুরু হয় । ফুকো বলেছেন, এই আধুনিক গণতন্ত্রের যুগে দাঁড়িয়ে শাস্তি এখনও আছে কিন্তু তা রাজার ন্যায় হিসেবে নয়। রাজার ক্ষমতা ছিল সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রের বলে, আর এখন ক্ষমতার উৎস হচ্ছে রাষ্ট্র, আইন-আদালত ইত্যাদি। আর এখানে আনুষ্ঠানিক ভিত্তি হলো নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অভিমত ও ভোট। আধুনিক যুগের মূল্যবোধ  ‘ব্যক্তির সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী’। এই যুগে শাস্তির উদ্দেশ্য ও মানও ভিন্নতর। ফুকো একটি চমৎকার বাক্য এ-প্রসঙ্গে ব্যবহার করেছেন, এখনকার শাস্তির লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে অপরাধীর ‘আত্না’ এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে “অপরাধীর চরিত্র সংশোধন”। আমাদের দেশেও কারাগারকে বলা হয় সংশোধনাগার ।
    প্রশ্ন হলো আধুনিক গণতন্ত্রের যুগে শাস্তি তবে কি এবং কেমন? ফুকো এখানে ইতিহাসের পৃষ্ঠপটে বলেছেন যে, রাজতন্ত্রের আমলে শাস্তির  ভয়াবহতার ফলে প্রজাদের মধ্যে অসম্ভব রকমের ক্ষোভ ও বিদ্বেষ দেখা যেত , ফলে প্রজাবিদ্রোহ সংগঠিত হতো। মধ্যযুগীয় শাস্তিকে রোধ করার জন্যই মানুষ বিদ্রোহে অংশ নিতো । পণ্ডিতদের দাবী ছিল যে শাস্তির উপায় যথেষ্ঠ অন্যায়মূলক এবং বিতর্কিত। ফলে বিদ্রোহ সংগঠিত হতে থাকে আর রাষ্ট্রকাঠামোয় পরিবর্তন ঘটতে থাকে এবং সাম্রাজ্যের পতন ঘটা শুরু হয়। মানুষের দাবী ছিল মানুষের শাস্তির এই উপায় শেষ করা হোক এবং প্রতিষ্ঠিত হোক একটি আইনের আদলে গঠিত মানুষের জন্য সংবিধান। ফুকোর ভাষায় এই উপায়টি হলো “শাস্তির নম্র উপায়”। এভাবে সৃষ্টি হয় গণতান্ত্রিকযুগের ‘কারাগার’। 
    ফুকোর ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’-এ  বলা হয়েছে যে, আধুনিক সমাজে হলো “শৃঙ্খলা বিধানকারী সমাজ”।  কিন্তু শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শ্রম বিভাজনের সৃষ্টি করতে হবে, নয়তো ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাতে পারবে না। এমনকি ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতারও সৃষ্টি করতে হবে। এভাবে শ্রমবিভাজন ও বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে আধুনিক সমাজ কাজের ফল অনুযায়ী একজনকে তিরস্কার বা পুরস্কার প্রদান করবে, শ্রমের বিভাজনে নেতা, বা কোনো সামঞ্জস্য না থাকলে কিংবা ঘাটতি থাকলে, সেখানে উপরিকাঠামোর ব্যক্তিবর্গ সমন্বয়-সাধন ও নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তাদের অবিরাম  তদারকি করবে। হাসপাতাল, কারাগার, বিদ্যালয়, ফ্যাক্টরী, সেনা ব্যারাক ইত্যাদিকে যে চরম ক্ষমতা দেয়া আছে তাকেই ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন ফুকো। যেমন ধরা যাক,  কারাগারের কাজকর্ম-হুকুম নিয়ন্ত্রিত হয় একজন প্রধান জেলারের দ্বারা। সে চব্বিশ ঘন্টা কর্মীদের মাধ্যমে কয়েদিদের উপর তদারকি করছে আর সেই সুপারিশ  করছে কার শাস্তির মাত্রা কতোটা হওয়া উচিত। 
    তেমনই মানসিক রোগীর হাসপাতালে যখন ডাক্তার তার মনমতো পদক্ষেপ নিয়ে  রোগীদের চিকিৎসা করছেন তখন পাগলাগারদের  ভেতরে ডাক্তার হয়ে উঠেন একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক , কারণ তার কথার ওপরে আর কেউ হুকুম দেয় না। কিন্তু শাস্তির মাত্রা শারীরিক নয়, আত্নাকে শাসন করাই হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রধান লক্ষণ। কারণ সেই শাসককে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হলে গণতন্ত্রের নির্দিষ্ট আদেশকে অন্তত টিকিয়ে রাখতে হবে। এ কারণে মিশেল ফুকো ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলছেন, সেগুলো পৃথক পৃথক ‘সমগ্র’ মাত্র, ডাক্তার বা ক্ষমতাধারী লোকটা মানসিকভাবে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চায়। ফুকোর বিশ্লেষণ অনুসারে, সমাজে প্রত্যেকে প্রত্যেককে পাহারা দিয়ে রাখছে।  উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তলাকার লোকেদের পাহারা দিচ্ছেন । যদিও এই নতুন যুগের পাহারাদারেরা আগের মতো বেত মেরে, কারাগারে বন্দী করে বা অর্থদন্ড দিয়ে শাস্তি দিচ্ছে না।  তাদের মর্জির উপর নির্ভর করছে একজন ব্যক্তির পদোন্নতি হওয়া উচিত নাকি  উচিত নয় । ‘উচিত কি উচিত নয়’ এই ডিসকোর্স  সাধারণের হাতে নেই, এর মালিক হলো উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এর মালিক হলো ওপরের কাঠামোর নিয়ন্ত্রণকারীরা। ফলে  নিজেরা যতোই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক বলে চিৎকার দিক না কেন, সাধারণ লোকেদের মাথার ওপরে সেই অদৃশ্য ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে যেখান থেকে জনগণের ওপর সবসময় নজর রাখা হচ্ছে। অর্থাৎ ফুকোর মতে , “ক্ষমতা শুধু বিচ্ছিন্ন করে, দমন করে, বিমূর্ত করে, ঢেকে রাখে, লুকিয়ে রাখে, তা মোটেই নয় বরং ক্ষমতা হলো তাই যা ‘উৎপাদন করে’। ক্ষমতা উৎপাদন করে বাস্তবতা,  নির্ধারণ করে বস্তুর বিচরণসীমা আর নির্মাণ করে সত্যের তন্ত্রসমূহ”। মানে ফুকোর ক্ষমতার  তিনটি প্রণালী রয়েছে : এক : শৃঙ্খলা, দুই : কর্মবিধি, তিন : নির্দিষ্ট মান স্থাপন। এভাবেই বুনে উঠছে  গঠনতন্ত্র, প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ক্ষমতার বেড়াজাল  সমগ্র বিশ্বজুড়ে।
    চার
    ক্ষমতা সম্পর্কে মিশেল ফুকোর বক্তব্যের সমালোচনা করে রায়হান শরিফ বলেছেন, “ক্ষমতা-প্রকৌশল, জ্ঞান, ক্ষমতা-প্রকৌশলের রুপান্তর কিংবা যৌনতার ইতিহাস — সব ক্ষেত্রেই ফুকোর তত্ত্ব বিকাশিত হয়েছে ইউরোপকে প্রেক্ষাপটে রেখে। ফুকোর এই ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তায়নের ধরনটা এমন যে প্রাচ্যের অভিজ্ঞতার  বিবরণ সেখানে একেবারে নেই । প্রাচ্যে কী ঘটেছে, কীভাবে ক্ষমতার ধারণাকে এক্ষেত্রে বুঝতে হবে, ক্ষমতা-প্রকৌশলের রূপান্তর, গতি-প্রকৃতি এখানে কীভাবে তত্ত্ব দিয়ে অনুধাবন করা যাবে, যৌনতার ইতিহাসের ক্ষেত্রেই বা প্রাচ্যের অভিজ্ঞতা কী,  অভিজ্ঞান কী — এসব বিষয়ে ফুকোর কাছ থেকে সরাসরি কোনও বক্তব্য  পাওয়া যায় না। 
    ফুকো এশিয়া আর আফ্রিকার প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে ঘটতে থাকা জাতি ও ধর্মীয় দাঙ্গাগুলোর কোনও উল্লেখ করেননি । ইউরোপ থেকে দলে-দলে খ্রিস্টধর্মী যোদ্ধারা কেন ক্রুসেডের লড়াই লড়তে গিয়েছিল তার কারণ ব্যাখ্যা করেননি । ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লেগেই আছে । বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ফলে প্রায় হিন্দুশূন্য হয়ে গেছে । পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে সুন্নিরা বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে শিয়াদের জমায়েত । গণহত্যা আর বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ছোটোখাটো লড়াই হবে চলেছে আফরিকার এই দেশগুলোতে : বুরুণ্ডি, রোয়াণ্ডা, কেনিয়া, দক্ষিণ সুদান, তানজানিয়া, উগাণ্ডা, ক্যামেরুন, সেন্ট্রাল আফরিকান রিপাবলিক, চাদ, রিপাবলিক অফ কঙ্গো, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো, জিবুতি, এরিট্রিয়া, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, ম্যাডাগাস্কার, লিবিয়া, মরোক্কো, সুদান, তিউনিশিয়া, লেসোথো, মালাউয়ি, জাম্বিয়া, বেনিন, বুরকিনা ফাসো, ঘানা, গিনি, গিনি-বিসাও, লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়া, নিজের, মালি, সিয়েরা লিয়োন, পশ্চিম সাহারা ইত্যাদি । বন্দুক, গোলাগুলি, ট্যাঙ্ক, কামান ইত্যাদি বিক্রি করে প্রাক্তন সাম্রাজ্যবাদীরা । এসব ঘটনা ফুকোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি ।
    এডওয়ার্ড সাঈদ দেখিয়েছেন পাশ্চাত্য কীভাবে প্রাচ্যকে নিন্মস্তর, অধস্তন, পশ্চাদপদ প্রতিপন্ন করতে ওরিয়েন্টালিজমকে নিজেদের মগজে-মননে গেঁথে নিয়েছিল । খুব স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন ওঠে যে ঔপনিবেশিকতার  মতন যে সাম্রাজ্যবাদী অনাচারটি প্রাচ্যের দেশে-দেশে কয়েকশো বছর ধরে চলেছে তাকে কি সার্বভৌম ক্ষমতা-প্রকৌশলের তত্ত্ব দিয়ে বোঝা সম্ভব ? উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যদি ইউরোপে ক্ষমতা-প্রকৌশল সার্বভৌম থেকে জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা-প্রকৌশলে বাঁক নিয়ে থাকে,  ঠিক সেই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়া-আফ্রিকার নানা ভূখণ্ডে যে শোষণ-শাসনের বিদেশি রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল, সেসব ভূখণ্ডের কোটি কোটি মানুষের চিন্তা-চেতনার গড়াপেটার ধরন-ধারণ কী ছিল — সে বিষয়ে ফুকো নীরব। জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা-প্রকৌশলের কোথাও এ কথা বলা নেই যে, অন্য জাতি-রাষ্ট্রকে উপনিবেশ বানাতে হবে। তবে অন্য জাতি-রাষ্ট্রকে আক্রমণের ধারণাটি সার্বভৌম ক্ষমতা-প্রকৌশলে অবশ্য উপস্থিত। তাহলে কি ধরে নিতে হবে উপনিবেশিত রাষ্ট্রগুলোতে দ্বিস্তরের ক্ষমতা-প্রকৌশল কার্যকর ছিল ? বাইরের, বা আন্তর-রাষ্ট্রের স্তরটি কি সার্বভৌম ক্ষমতা-প্রকৌশলের বলয় ? আর ভেতরের, জনগণকে গড়া-পেটার ক্ষেত্রটি জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয় ?  ফুকোর চিন্তাসূত্র ধরে এগোলে এরকম, বা এর কাছাকাছি কিছু ভাষ্য তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু এই ভাষ্যগুলো উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষের প্রকৃত অবস্থা, তাদের যাপিত-জীবনের অভিজ্ঞতার কতটা কাছাকাছি ? 
    ফুকোর তত্ত্বের বাইরে গিয়ে যদি এই কথা  বলা হয় যে, ঔপনিবেশিকতা একটা জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসন, এই অর্থে যে উপনিবেশিত বিশাল জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা থেকে তাদের নিজেদের অনেকটাই উন্মূল করে দেয়া হয়েছে। আফরিকায় তাদের ভাষা নিশ্চিহ্ণ করে দেয়া হয়েছে । বহু মানুষকে দক্ষিণ আর উত্তর আমেরিকায় তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের শেকড় থেকে কেটে ফেলা হয়েছে । শুধু তাই নয়, উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীকে, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক হেজেমোনির বলয়ে এমনভাবে গড়া-পেটা করা হয়েছে যে, উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষের ব্যক্তিমানসে পাশ্চাত্যের নানারকম প্রভাব দুর্লঙ্ঘভাবে বিরাজমান— যার  প্রকৃত ভাষ্য ফুকোর চিন্তা-প্রকল্পে অনুপস্থিত।  ইউরোপ বা আমেরিকার জনগণের অভিজ্ঞতার জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা আর উপনিবেশিত মানুষের অভিজ্ঞতার জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা এক নয়। উপনিবেশিত মানুষের মগজে-চেতনায় পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব আজও এমনভাবে কাজ করে যে পয়লা বৈশাখের বদলে নিউ ইয়ার গুরুত্ব পায়, শহরের মানুষ নিজেদের মধ্যে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলে । দেশভাগের ফলে উচ্ছেদকৃত হয়েছেন বা বাস্তুহারা হয়েছেন বহু বাঙালি, পাঞ্জাবি আর সিন্ধি। তাঁদের সন্তানরা মাতৃভাষায় কথা বলতে পারেন না, পড়াশোনা করেন হিন্দি, ইংরেজি বা যে রাজ্যে আশ্রয় পেয়েছেন সেখানকার ভাষায়। একথা ঔপনিবেশিকতার নিগড়ের অভিজ্ঞতা আছে এমন সকল জাতি-রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য সত্য। এই মানুষেরা শুধু জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয়ে গড়া-পেটা নয়, বরং ঔপনিবেশিকতাজনিত বিস্মৃতিপরায়ণতা এবং পাশ্চাত্যের হেজিমোনির বলয়ে এক ভিন্ন এবং বিশিষ্ট গড়া-পেটার অভিজ্ঞতাকে সামষ্টিক ও সামগ্রিকভাবে ধারণ করছে। এ কারণেই উত্তরঔপনিবেশিকতা সম্পর্কিত ভাবুকদের অনেকেই বিউপনিবেশয়ানের ধারণাকে সামনে আনেন—একদা উপনিবেশ ছিলো কিন্তু পরে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এমন জাতিরাষ্ট্রগুলোর প্রকৃত মুক্তি বিউপনিবেশায়ন ছাড়া সম্ভব নয়। আর বহু ভারতীয়ের জন্য বিউপনিবেশায়নও হয়ে গেছে অসম্ভব ।
    রায়হান শরিফ আরও বলেছেন, যৌনতার ইতিহাস বিষয়ে ফুকোর ভাষ্য ইউরোপকেন্দ্রিক। এই ভাষ্যকে আবার দৃঢ় করেছে তাঁর বয়ান, ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতা-প্রকৌশল, জিনিওলোজি ইত্যাদির ধারণা। এভাবে দেখলে ফুকোর যৌনতা বিষয়ক চিন্তা-প্রকল্পটিতে ইনফিনিটি রিগ্রেস (Infinity Regress) ফ্যালাসির উপস্থিতি উপলব্ধি করা যায়। তবে ফুকোর ধারণাগুলোর শক্তি হচ্ছে—এগুলোকে সন-তারিখ, কিংবা অকাট্য প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাসের নানা পরিবর্তন, রূপান্তরকে বেশ স্বচ্ছন্দ্যে ব্যাখ্যা করা চলে। 
    প্রাচ্যের ইতিহাস, বিশেষ করে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সামাজিক, ধর্মীয় রদবদল ও বিকাশ ব্যাখা করার প্রশ্নে ফুকোর ধারণাগুলো সরাসরি সাহায্য করে না।  “ব্যক্তি”কে নিছক প্রভাব  হিসেবে দেখিয়ে ফুকো ব্যক্তির এজেন্সিকে ‘নিশ্চিহ্ণ’ করে দিলেন, প্রতিরোধের ধারণাকে নাকচ করলেন । হিন্দুর বর্ণবিভাজিত সমাজের ধারণা ছাড়া একজন ভারতীয় ব্যক্তির এজেন্সির ক্ষেত্রগুলো বা এজেন্সির প্রকৃতি, সামর্থ্য, প্রতিরোধের ধারণা ইত্যাদি মার্কসবাদী মডেলে একরকম; ফুকোর মডেলে  অন্যরকম। ভিন্ন ভিন্ন গুণাগুণ, বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্যারাডাইম শিফট ঘটতে ব্যাপক প্রস্তুতির এবং সেজন্যই সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। এতে ব্যক্তির ভূমিকা থাকলেও ফুকো বলতে চান মূল নিয়ন্তা এক্ষেত্রে ব্যক্তি-পর্যায়ের বাইরে । 
    রবার্ট অ্যাডামস 'ক্ষমতায়ন'-এর যে-কোনও একটিমাত্র সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, এবং বলেছেন যে এর বিপদ হলো বিদ্যায়তনিক বা বিশেষজ্ঞদের দেয়া সংজ্ঞাগুলো অভিধার এবং সংযুক্ত অনুশীলনগুলোকে সেই সমস্ত লোকেদের থেকে কেড়ে নিতে পারে, যাদের তারা এর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করে। তবুও, তিনি শব্দটির একটি ন্যূনতম সংজ্ঞা তৈরি করেছেন : “ক্ষমতায়ন: ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং/অথবা সম্প্রদায়ের তাদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ক্ষমতা, ক্ষমতা প্রয়োগ করা এবং তাদের নিজস্ব লক্ষ্য অর্জন করা এবং সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে, ব্যক্তিগতভাবে এবং সমষ্টিগতভাবে, তারা নিজেদের এবং অন্যদের তাদের জীবনের মান সর্বোচ্চ করতে সাহায্য করতে সক্ষম।”
    আরেকটা সংজ্ঞা হল "স্থানীয় সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে একটি ইচ্ছাকৃত, চলমান প্রক্রিয়া, যার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সমালোচনামূলক প্রতিফলন, যত্ন নেওয়া এবং গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ জড়িত, যার মাধ্যমে সম্পদের সমান অংশের অভাবে পীড়িত লোকেরা সেই সম্পদগুলিতে আরও বেশি ভাগিদার হতে পারে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে" । র‌্যাপাপোর্ট-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী: "ক্ষমতায়নকে একটা প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা উচিত: যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ, সংস্থা আর সম্প্রদায়গুলো তাদের জীবনের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করে।" সমাজতাত্ত্বিক ক্ষমতায়ন প্রায়ই গোষ্ঠীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিপাদন করে যে সামাজিক বৈষম্যের প্রক্রিয়াগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া থেকে বাদ চলে যায় - যেমন অক্ষমতা, জাতি, ত্বকের রঙ, ধর্ম, জাত-পাত বা লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বৈষম্য। মনে রাখা দরকার যে পদ্ধতি হিসাবে ক্ষমতায়ন নারীবাদের সাথে জড়িত।
    ক্ষমতায়ন হল প্রান্তিক, বিশেষ করে দলিত, মানুষদের জন্য মৌলিক সুযোগ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া, হয় সরাসরি সেই ব্যক্তিদের দ্বারা, অথবা অ-প্রান্তিক অন্যদের সাহায্যের মাধ্যমে, যারা এই সুযোগগুলোতে তাদের নিজস্ব অংশ ভাগ করে নেয়। ক্ষমতায়ন সেই সুযোগগুলোকে অস্বীকার করার সক্রিয়ভাবে ব্যর্থ প্রচেষ্টাও অন্তর্ভুক্ত করে। ক্ষমতায়নের মধ্যে গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের মধ্যে দাতব্য বা কল্যাণের জন্য ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয়তা দূর করার ওপর গুরুত্ব দেয়াসুদ্ধ, স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য উত্সাহিত করা এবং দক্ষতা বিকাশ করা অন্তর্ভুক্ত, যদিও এই প্রক্রিয়াটা শুরু করা আর কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন ।
    পাঁচ
    একজন লোক তো সব ক্ষমতা নিজেই প্রয়োগ করতে পারে না, তাই সে তার বিশাল ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেয় । একান্নবর্তী পরিবারে যেমন ছিলেন কর্তা । রাষ্ট্রে যেমন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী । তাঁদের তলায় আরও শাখা-প্রশাখা । কোনও প্রতিষ্ঠানকে যথাযথভাবে পরিচালনার ব্যাপারে ক্ষমতা অর্পণ বা ডেলিগেশন একটা উল্লেখযোগ্য বিষয়। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী যত ব্যাপক হবে, ততই বেশি বেশি মাত্রায় ক্ষমতা অর্পণ এর প্রশ্ন দেখা দেবে । সুষ্ঠ প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক পরিচালনার প্রয়োজনে ক্ষমতা অর্পণ একটি প্রচলিত পদ্ধতি ।     জে. ডি . মুনি-র মতে ক্ষমতা অর্পণ হলো নিম্নতম কর্তৃপক্ষের হাতে ধাপে-ধাপে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অর্পণ । আসলে ক্ষমতা অর্পণ হল তত্ত্বাবধান আর নিয়ন্ত্রণের অধিকার সাপেক্ষে কোনও একজন পদস্থ ব্যক্তি তার অধিনস্হ ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর । অবশ্য     ক্ষমতা অর্পণ যে সবসময় উর্দ্ধতন থেকে নিম্নতনের দিকে নামবে এমন নয়, উল্টোটাও হতে পারে, আবার সমমর্যাদাসম্পন্ন ইউনিটসমূহের মধ্যেও ক্ষমতা অর্পণ ঘটতে পারে ।  ক্ষমতা অর্পণ হলো একজন প্রশাসক বা একটি সংগঠন থেকে অন্যজনের বা অন্য সংগঠনের হাতে কর্তৃত্বে হস্তান্তর । ক্ষমতা অর্পণ ওপর থেকে নিচে বা নিচ থেকে উপরে বা পাশাপাশি হতে পারে । বস্তুতপক্ষে ক্ষমতা অর্পণ এর প্রক্রিয়াকে  তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যথা:  ক ) নিম্নমুখী খ ) ঊর্ধ্বাভিমুখী গ) পার্শ্বাভিমুখী।
         একজন সেলস ম্যানেজার কর্তৃক তার বিক্রয় কর্মীদের ওপর ক্ষমতা অর্পণ,  অংশীদারগণ কর্তৃক তাদের পরিচালক মন্ডলীর ওপর ক্ষমতা অর্পণ এবং কৃষি দপ্তরে, দপ্তরের আধিকারিকদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ক্ষমতা অর্পণ এর উদাহরণ । ম্যানেজমেন্টের পণ্ডিতরা ক্ষমতা অর্পণ কে আবার চার ভাগে ভাগ করেছেন , যথা: ১) পূর্ণ বা আংশিক ,২) শর্তাধীন বা নিঃশর্ত,       ৩) আনুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক,  ৪) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ।
    ক্ষমতা অর্পণ বলতে দায়িত্ব থেকে পুরোপুরি অব্যাহতি বা চূড়ান্ত ক্ষমতার হস্তান্তর নয় । যিনি ক্ষমতা অর্পণ করেন তিনি তাঁর সমস্ত দায়িত্ব তথা ক্ষমতা অর্পণ করেন না । পরিদর্শন , তত্ত্বাবধান,  নিয়ন্ত্রণ,  পর্যালোচনা প্রভৃতি ক্ষমতাগুলো তিনি কখনোই হাতছাড়া করেন না   তিনি ইচ্ছা করলে অর্পিত ক্ষমতা ফিরিয়ে নিতে পারেন । স্টুয়ার্ট মিলের মতে ক্ষমতা অর্পণ এর অর্থ শুধুমাত্র কিছু কাজের দায়িত্ব অর্পণ নয় । এর মূল অর্থ হলো অধঃস্তন কর্তৃপক্ষকে বিচার-বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করতে দেওয়া,  বিশেষ বিশেষ সমস্যা মোকাবেলার প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত বা চিন্তাভাবনাকে সদ্ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া ।   ক্ষমতা অর্পণের মাধ্যমে সংগঠনের মুখ্য পরিচালকের কাজের চাপ অনেকটা কমানো যায় । বিশেষত, দৈনদিন কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের বোঝা কর্মীদের ওপর অর্পণ করে প্রশাসক নিজে সংগঠনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে সময় ও শক্তি নিয়োগ করতে পারেন । আধুনিককালের জটিল সাংগঠনিক ব্যবস্থায় পরিচালকের পক্ষে সবদিকে নজর দেওয়া সম্ভব হয় না । তাই চূড়ান্ত দায়িত্ব  নিজের হাতে রেখে কিছু দায়িত্ব  নিম্নস্তরের কর্মীদের হাতে ছেড়ে দিতে হয় ।     ক্ষমতা অর্পণ এর ফলে প্রশাসনে একটা গতি আসে । কাজে বিলম্ব ঘটে না। সাধারণ মানুষ পরিচালকের কার্যালয় না এসে তলাকার স্তরে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই প্রয়োজনীয় কাজ মিটিয়ে নিতে পারে ।   ক্ষমতা অর্পণ এর ফলে নিচু স্তরের কর্মীদের দায়িত্ববোধ বাড়ে এবং সেই সঙ্গে তাদের কাজ করার উৎস বাড়ে । সংগঠনের সকল সিদ্ধান্ত ওপরতলায় গ্রহণ করা হলে নিচুস্তরের কর্মীরা তাদের কাজে উৎসাহ ও উদ্যম হারিয়ে ফেলবেন । ফলে তাদের কর্মদক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে । অন্যভাবে বললে প্রধান পরিচালক যদি তাঁর অধঃস্তনদের পরিচালন কুশলতা ও গুণাবলিকে বাড়াতে চান সেক্ষেত্রে ক্ষমতা অর্পণ একটি আবশ্যিক শর্ত ।   ক্ষমতা অর্পণ এর ফলে সংগঠনের যথেষ্ট সুবিধা হয় ।  সংগঠনের কাজকে যত ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে তত সেই সংগঠনের কাজ দক্ষতার সঙ্গে,  মিতব্যয়িতার সঙ্গে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারবে ।   যে স্তর থেকে সমস্যার উদ্ভব ঘটে সেই স্তরে তাকে মোকাবিলা করা সুস্থ প্রশাসনের পক্ষে খুবই আবশ্যক।  ক্ষমতা অর্পণ এর মাধ্যমে সংগঠনের প্রতিটি স্তরের কর্মীদের হাতে উপযুক্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হলে এটা সম্ভব। ক্ষমতা অর্পণ এর ফলে কোন কাজ কে করবে, কোন কাজের জন্য কতখানি সময় বরাদ্দ করা হয়েছে, এ সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করা যায় । ফলে সংগঠনের প্রতিটি স্তরের কাজকর্ম সম্পাদনকে উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে আনা যায়  ।           
    ক্ষমতা অর্পণ এর সুবিধা বা প্রয়োজনীয়তা যাই হোক না কেন, অনেক সময় দেখা যায় উচ্চপদস্থ প্রশাসকরা ক্ষমতা অর্পণ এর ব্যাপারে হয় অনিচ্ছুক অথবা উদাসীন । তাঁরা সহজে কোনও দায়িত্ব ছাড়তে চান না । ক্ষমতা অর্পণ নেতৃত্বের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে যদি অধঃস্তনের আনুগত্যে শৈথিল্য আসে -- পরিচালকদের এই ধরনের মনোভাব ক্ষমতা অর্পণ এর ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে । আবার অন্যদিকে ক্ষমতা হাতে পেয়ে অধঃস্তন কর্তৃপক্ষ ঊর্ধ্বতনের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারে । ক্ষমতা অর্পণ যদি উর্দ্ধতনের বিরুদ্ধে একটি চক্র বা দলাদলি সৃষ্টিতে সাহায্য করে, তবে তা নিঃসন্দেহে ক্ষতিকারক । যেমন ভারতে দেখা যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সদাসর্বদা সাবধান থাকতে হয় যাতে অন্য মন্ত্রীরা তাকে ষড়যন্ত্র করে সরিয়ে না দেয় । এরকম ঘটনা আখছার ঘটে ভারতীয় রাজনীতিতে । আমরা দেখি শাসক দলের সদস্যদের কিনে ফেলে শাসক দলকে ক্ষমতাচ্যূত করা হচ্ছে ।  
    ক্ষমতা অর্পণ এর প্রতিবন্ধকতা বা অসুবিধাকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে যেমন-- ২)  সাংগঠনিক এবং ২) ব্যক্তিগত। সাংগঠনিক প্রতিবন্ধকতা বিভিন্নভাবে সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- ক) ক্ষমতা অর্পণ এর উপযোগী সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া না থাকা ; খ ) সংগঠনের মধ্যে যথাযথ যোগাযোগ বা সমন্বয়ের অভাব ; গ ) ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সংজ্ঞা ও সুনির্দিষ্ট এলাকা না থাকা ; ঘ) সঙ্গঠনের আয়তন ও কাজের প্রকৃতি ইত্যাদি । সঙ্গঠনের ক্ষেত্রে ক্ষমতা অর্পণ এর তেমন একটা প্রয়োজন থাকে না ।   ব্যক্তিগত প্রতিবন্ধকতা বলতে মূলত পরিচালকদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টিকে বোঝানো হয় । পরিচালকদের একটা সাধারণ মনস্তত্ত্ব হলো এই যে, তিনি ছাড়া সঙ্গঠন অচল হয়ে যাবে , তিনি ছাড়া সঙ্গঠনের বাদবাকি সকলে অযোগ্য। ম্যানেজমেন্টের পণ্ডিতরা বলেন,  ব্যক্তিগত প্রতিবন্ধকতা বলতে বোঝায় :  পরিচালকের ১) অহংবোধ , ২) অন্যের প্রতি অনাস্থা , ৩)  কৃতিত্ব বা ক্ষমতা হারানোর ভয় , ৪) বিরোধী শক্তি সম্পর্কে আতঙ্ক , ৫)  প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়ার ভয় , ৬) সঙ্গঠনের কর্তৃত্বের অংশীদার অন্যকে না করার ইচ্ছা , ৭) ধৈর্যহীনতা, ৮)  নেতৃত্ব চলে যাওয়ার আশঙ্কা , ৯) আবেগ সংবরণ করার অক্ষমতা, ১০)  ক্ষমতা অর্পণ কীভাবে করতে হবে সে সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, ১১)  উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে, আইনসভার কাছে ও  জনগনের কাছে দায়িত্বশীলতা।    
    ক্ষমতা অর্পণ এর ক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হলে এমন একটা উপায় উদ্ভাবন করতে হবে যাতে ক্ষমতা অর্পণ করেও পরিচালক তার কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারেন। পরিচালকের সঙ্গে অধঃস্তন কর্মীদের নিয়মিত যোগাযোগ রাখার ব্যবস্থা সঙ্গঠনের পক্ষে একটি আবশ্যিক শর্ত । পরিচালকের সঙ্গে কর্মীদের যদি নিয়মিত যোগাযোগ থাকে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর যদি কাজের রিপোর্ট ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকে,  প্রশাসক যদি সঙ্গঠনের প্রতিটি স্তরের কাজকর্ম সম্পর্কে তদারকি ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন , যদি প্রতিটি স্তরের হিসাবপত্র ও অন্যান্য পরিসংখ্যান সঠিকভাবে রাখার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে ক্ষমতা অর্পণ সফল হবে ।     ক্ষমতা অর্পণ লিখিতভাবে হওয়াই ভালো । কোন কোন ক্ষমতা অর্পণ করা হলো, পরিচালক কতখানি কৃতিত্ব নিজের হাতে রাখবেন,  কর্মীরা কতখানি স্বাধীনতা ভোগ করবেন , এগুলো লিখিত আকারে থাকা উচিত ।      ক্ষমতা যার বা যাদের ওপর অর্পণ করা হবে তাকে বা তাদের তার দায়-দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য উপযুক্ত স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র দিতে হবে । অধস্তনের উদ্যম ও কর্মপদ্ধতিকে উৎসাহিত করার প্রয়োজনে ছোটখাট ভুলভ্রান্তিগুলিকে ততটা গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো । অর্পিত ক্ষমতা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা প্রশাসক সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন । ক্ষমতা অর্পণ এর সাফল্যের পক্ষে যেটা ভীষণ জরুরী সেটা হলো, যে কোনও মূল্যে সাংগঠনিক ঐক্য বজায় রাখা এবং পরিচালক ও কর্মীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগীতার পরিবেশ সৃষ্টি করা।
    ছয়
    ক্ষমতা যে কতো ভয়ানক তা টের পাওয়া যায় প্রাচীনকালের পুরুষ শিশু-কিশোরদের খোজা করার প্রক্রিয়া থেকে ।পুরুষদের খোজা করার যে প্রথা তুর্কি আর মোগলদের মধ্যে ছিল তা যৌনক্ষমতা কেড়ে নেবার প্রথা, একজন পুরুষের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে অকেজো করে তাকে হীনমন্যতায় সারাজীবন কয়েদ করে রাখার প্রথা । যারা ক্ষমতাবান তারাই পুরুষদের যৌনক্ষমতা কেড়ে নিতো আর তাদের কাজে লাগানো হতো হারেমের যুবতীদের পাহারা দেবার জন্য । নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের জন্য যে অঙ্গটি জরুরি সেটাই কেড়ে নিয়ে পুরুষকে যৌনক্ষমতাহীন করে দেয়া হতো । মুঘল এবং অটোমান দুই জায়গার হারেমেরই খোজা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ  চরিত্র। তারা প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজকীয় হারেমে বা জেনানামহলের প্রহরী আর চাকর হিসেবে নিযুক্ত হতো। এদের কিশোর এবং শিশু অবস্থায় নিয়ে আসা হতো। তারপর তাদের ক্যাস্ট্রেশন অর্থাৎ অন্ডকোষসহ শুক্রথলি কেটে ফেলে  বিশেষ শ্রেণীর পুরুষ-প্রাণী বানানো হতো যাতে তাদের যৌনসম্পর্ক করার ক্ষমতা না থাকে। 
    শুক্রাশয় কেটে ফেলার ফলে খোজাদের জৈবিক চাহিদা থাকতো না। ফলে হারেমের নারীদের পাহারাদার ও কর্মচারী হিসেবে এদের চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ ছিল না। খোজা বা ইউনাখ [Eunuch] শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ [Eunuchus] থেকে যার অর্থ হচ্ছে শয়নকক্ষের পাহারাদার। গ্রীক শব্দ Eune অর্থ বিছানা এবং Ekhein অর্থ হচ্ছে পাহারা দেয়া। ঠিক একইরকমভাবে ল্যাটিন ভাষায় স্প্যাডো, ক্যাস্ট্রাটাস শব্দগুলোর মানেও খোজা। বাংলায়  ইউনাখদের বলা হয় ‘খোজা’। খোজা শব্দটা উর্দু, পুরো শব্দটা হল খোজা সারাহ। তবে ইউনাখ কিংবা খোজাকৃত পরুষরা কেবল মধ্যপ্রাচ্যে ছিল তা নয়। প্রাচীন চীনের অভিজাত সমাজেও এদের বিশেষ ভূমিকায় দেখা গেছে। চীনে শিশ্নচ্ছেদ (castration) বা ক্যাস্ট্রেশন ছিল একাধারে শাস্তি এবং ইউনাখ করার অন্যতম পদ্ধতি। 
     অতীত কাল থেকেই দাস শ্রেণির পুরুষ শিশুদের যত কম বয়সে সম্ভব তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্যাস্ট্রেশন করানো হত। এ ধারাই বহু-নারীর মালিকদের সমাজে প্রচলিত ছিল।  পুরুষের হারেমে নারীদের বন্দিত্ব পাকাপোক্ত করতেই খোজা নিযুক্ত করা হত।  খোজা বানাতে গিয়ে যখন বালকদের অণ্ডকোষ কিংবা পুরুষাঙ্গ কাটার সময় অথবা পরবর্তীতে জটিলতায় আক্রান্ত হতো, তখন অনেকেরই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঘটেছে। আর অণ্ডকোষ ও পুরুষাঙ্গ কর্তনের পর ক্ষত সারাতে ব্যবহার করা হতা মরুভূমির বালি। আবার অনেক সময় বালকদের মুরুভূমিতে গলা পর্যন্ত পুঁতে রাখা হতো যতদিন না ক্ষত ভালো হয়।
    খোজারা সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই প্রভাবশালী ক্ষমতাধর পুরুষের দাসত্ব করত!  প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও ইউনাখ ছিল। তবে প্রাচ্যের মতন এত প্রবলভাবে নয়। প্রাচীন মিশরেও পুরুষের অঙ্গচ্ছেদ করানোর রীতি ছিল। এক্ষেত্রে মিশরীয়রা তিনটি পদ্ধতি অবলম্বন করতো : (১) পুরুষ জননাঙ্গের অপসারন; (২) কেবল অন্ডকোষের অপসারন; এবং (৩) একত্রে পুরুষাঙ্গ ও অন্ডকোষের অপসারণ। প্রাচীন মিশরের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে পুরুষ বন্দিদের অঙ্গচ্ছেদ করে ফারাও-এর কাছে উপস্থাপন করা হত। যুগের পর যুগ ধরেই খোজারা ক্ষমতাবানদের সেবায়  নিযুক্ত থেকেছে।  কখনো কখনো ক্যাথলিক চার্চ সুরেলা কন্ঠের বালকদের দিয়ে পোপের কোরাস গাওয়ানোর জন্য  খোজা বানিয়ে রাখতো। হাজার হাজার বছর ধরেই খোজারা ক্ষমতাশীল মানুষের হয়ে দাস হিসেবে কাজ করে যেতো। শুধু হারেম পাহারা নয়,  খোজাদের  আরও অনেক কাজ করতে হতো। যেমন মালিকের বিছানা তৈরি, গোসল করানো, চুল কাটা, পালকি টানা, মলমূত্রের ডাবা বয়ে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কাজ করানো হতো।
     
    ঐতিহাসিক আর নৃতাত্ত্বিক  গবেষণা থেকে জানা যায় যে, বহুবিবাহ, বাঁদি, দাসী আর গণিমতের মাল হিসেবে লুঠ করে আনা নারীদের এক জায়গায় জড়ো করে রাখার হারেম ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কারণেই মূলত খোজা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। হারেমের নারীদের ওপর নজর রাখার জন্য খোজা-বানানো পুরুষ প্রহরী নিয়োগ করা হতো। প্রাচীন মিশরে রণাঙ্গণে বন্দি তরুণ সৈনিকদের ধরে-ধরে খোজা করে ফেলা হতো।  দাস ব্যবসায়ীরা দাস বাজার থেকে  স্বাস্থ্যবান  তরুণদের কিনে  খোজা করে,  প্রাথমিক  প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজকীয় ও অভিজাতবর্গের হারেমে বিক্রি করত। তুর্কি-মুঘল শাসনামলের আগে বাংলায় খোজা প্রথার অস্তিত্ব সম্পর্কে তেমন  প্রমাণ পাওয়া যায় না।  এটা স্পষ্ট যে, তুর্কি-মুগলরাই ভারতীয় উপমহাদেশে এবং মধ্যযুগের বাংলায় খোজা প্রথার প্রবর্তন করেছিল । 
     
    ‘খোজাকরণ উদ্বেগ’ বা ক্যাস্ট্রেশন অ্যাঙজাইটি নামে একটা তত্ব উপস্হাপন করেছিলেন সিগমুণ্ড ফ্রয়েড, যার আক্ষরিক আর উপমা উভয় অর্থেই লিঙ্গ কেটে নেবার আতঙ্ক বা খোজাকরণের ভয়। এটা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের প্রথম দিকের মনোসমীক্ষণ তত্ত্বসমূহের মধ্যে একটা । যদিও ফ্রয়েড খোজাকরণ উদ্বিগ্নতাকে সর্বজনীন মানব অভিজ্ঞতা বলে দাবী করেছেন, এই বিষয়ে খুব কম গবেষণাই  হয়েছে। এই তত্বের বেশিরভাগ গবেষণা ফ্রয়েডের সময়ে আর পরে হয়েছিল । মনোবিদদের কাছে আজকের দিনেও এটা প্রাসঙ্গিক। এই তত্ত্ব অনুসারে, একটি শিশু তার সমলিঙ্গের বাবা বা মায়ের দ্বারা ( ছেলে বাবাকে ভয় পায়) বিপরীত লিঙ্গের বাবা বা মায়ের প্রতি যৌন অনুভূতি বোধ করে ( ছেলে মায়ের প্রতি আর মেয়ে বাবার প্রতি আকর্ষিত হয়) ফলে, ছেলে তার বাবার দ্বারা  যৌনাঙ্গ নষ্ট হয়ে যাবার ভয় পায়। তত্ত্ব অনুসারে, খোজাকরণ উদ্বেগ তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে শুরু হয়, যা ফ্রয়েডের মতে ফ্যালিক স্টেজ বা লৈঙ্গিক পর্যায়। যদিও এটা পুরুষের সাথে সম্পর্কিত, তত্ত্ব অনুসারে খোজাকরণ উদ্বেগ নারী, পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই কাজ করে।
     
    ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষায়, খোজাকরণ উদ্বেগের দ্বারা মনোযৌন বিকাশের লৈঙ্গিক পর্যায়ে লিঙ্গ হারাবার অচেতন ভয় নির্দেশ করা হয় এবং সারা জীবন ধরে থাকে। ফ্রয়েডের মতে, যখন একটি পুরুষ শিশু নারী ও পুরুষ যৌনাঙ্গের পার্থক্য সম্পর্কে অবগত হয়, সে ধরে নেয় যে নারীর পুরুষাঙ্গকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে এবং সেও এব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয় যে, মাকে কামনার জন্য তার পুরুষাঙ্গও তার প্রতিদ্বন্দ্বী পিতার দ্বারা কেটে ফেলা হবে। ১৯ শতক আর তার আগে ইউরোপে অসদাচরণ করা ছেলেদের বাবার দ্বারা খোজাকরন বা অন্য কোনও ভাবে যৌনাঙ্গে আঘাত দেবার হুমকি প্রচলিত ছিল। ফরাসী লেখক মাইকেল টুরনিয়ের এর গল্পসমগ্র লে কক ডি ব্রুয়েরে (১৯৭৮) এর একটি গল্প ‘টুপিক’-এ এই ব্যাপারটি দেখা যায়, আর ফ্রয়েডও এটা বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছেন। একই সময় ডঃ কেলগ এবং অন্যরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইংরেজি ভাষাভাষী দেশসমূহের ভিক্টোরিয়ান বাবা-মায়ের দ্বারা সন্তানদের খৎনাকরণ এবং খুব প্রয়োজন পড়লে ছেলেমেয়েদের বিস্তৃত পরিসরের যৌন আচরণ বিশেষ করে হস্তমৈথুন বা পরিচারিকার সঙ্গে বেশি মেশামিশি দেখলে সেই ছেলের শাস্তিস্বরূপ খোজাকরণের ব্যবস্থা করতেন। সেইসময় অভিজাতবর্গে এটা বেশ প্রচলিত প্রথা ছিল।
     
    এই সূত্রে ফ্রয়েড ‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’-এর কথা বলেছেন । এই শব্দটি গ্রীক বিয়োগান্তক নাটক ইডিপাস রেক্স থেকে নিয়েছিলেন। এই বিয়োগান্তক নাটকে প্রধান চরিত্র ইডিপাস তার বাবাকে খুন করে আর নিজের অজান্তে তার মাকেও হত্যা করে। এই নাটকীয় ঘটনার কারণে ফ্রয়েড এই অবচেতন কামনাকে ইডিপাস কমপ্লেক্স বলে উল্লেখ করেছেন। ফ্রয়েডের মতে, ইডিপাস কমপ্লেক্স দ্বারা ছেলেদের সার্বজনীনভাবে মাকে পুরোপুরি নিজের করে পাওয়া এবং বাবাকে সরিয়ে দেবার ইচ্ছাকে বোঝায়। এই কমপ্লেক্স ফ্রয়েডের মতে মনোযৌন সম্পর্কিত বিকাশের পর্যায়ে ঘটে যা লৈঙ্গিক পর্যায় নামে পরিচিত।এটা সেই পর্যায় যখন শিশু শেখে যে তার একটি পুরুষাঙ্গ আছে এবং সেটা স্পর্শ করে সে আনন্দ পায়। সেই সাথে, শিশুটি তার বিপরীত লিঙ্গের, অর্থাৎ বাবা বা মায়ের ওপর যৌনাকাঙ্ক্ষার ব্যাপারেও সচেতন হয়। ফ্রয়েডের মতে, মায়ের প্রতি এই আকাঙ্ক্ষার অর্থ হচ্ছে সে তার সাথে যৌনসংসর্গ ঘটাতে ইচ্ছুক । এই আকাঙ্ক্ষার কারণে শিশুটি তার বাবাকে মায়ের মনোযোগ ও ভালবাসার কারণে প্রতিযোগী হিসেবে দেখে। এই প্রতিযোগিতার কারণে, বালকটি তার বাবাকে তার সাথে তার মায়ের মিলনের ক্ষেত্রে বাধা বলে মনে করে।ইডিপাস কমপ্লেক্স এর সাংঘর্ষিক ব্যাপারটা শিশুর ভেতর থেকেই তৈরি হয়। শিশু তার বাবাকে ভালবাসতে ও শ্রদ্ধা করতে জানে, তবুও মায়ের প্রতি ভালবাসার জন্য সে তার বাবাকে তার প্রতিযোগী বলে মনে করে। তাছাড়া শিশুটি এও জানে যে পরিবার থেকে বাবাকে সরিয়ে দেয়াটা ভুল। কিন্তু তবুও সে তার প্রতিযোগীকে সরিয়ে দিতে চায় যাতে সে পুরোপুরিভাবে তার মাকে পায়।  ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন, ইডিপাস কমপ্লেক্স কখনই পুরোপুরি নিঃশেষিত হয় না। তিনি বলেছেন, কামনার অনুভূতি অবশ্যই ছেলের ভেতরের সচেতনতার ফলে চাপা থাকে  । এই অবদমন হচ্ছে শিশুকে এই কমপ্লেক্স সম্পর্কিত বিরক্তিকর উদ্বেগ থেকে মুক্ত করার জন্য তার মনের কৌশল। ফ্রয়েড আরও বলেন, এই যৌনকামনা শিশুর মধ্যে তবুও থেকে যায় এবং প্রায়ই আরও পরোক্ষ এবং সঠিক আচরণের আকারে প্রকাশিত হয়। শিশুর স্বপ্নে এটা পাওয়া যায়, স্বপ্নে শিশুটি উদ্বেগহীন এবং সমাজ স্বীকৃত রীতিতেই তার অবদমিত কামনাকে নিরাপদে প্রকাশ করতে পারে।
     
    সাত
    নারীর ক্ষমতায়নকে বিভিন্ন উপায়ে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে, যার মধ্যে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা বা তাদের মতামত জানার চেষ্টা করা, শিক্ষা, সচেতনতা, সাক্ষরতা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি করা। নারীর ক্ষমতায়ন সমাজের বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে নারীদের জীবন-নির্ধারক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে ; তাদের লৈঙ্গিক ভূমিকা বা এই জাতীয় অন্যান্য ভূমিকাগুলিোকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ দেয়ার প্রয়োজনীয়তা , যা তাদের পছন্দসই লক্ষ্যগুলো উপলব্ধি  করার জন্য আরও স্বাধীনতা দিতে পারে। নারীর  স্ব-মূল্যবোধ, তাদের নিজস্ব পছন্দ নির্ধারণ করার ক্ষমতা, এবং নিজের এবং অন্যদের জন্য সামাজিক পরিবর্তনকে প্রভাবিত করার অধিকারকে আর অবহেলা করা যাবে না। ক্ষমতায়নের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত  যে ব্যাপারটা তা হলো নারীর মৌলিক মানবাধিকার, যা আরও শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তোলার চাবিকাঠি। নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর অধিকারের প্রতিষ্ঠা একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক আন্দোলনের  অংশ হিসেবে জরুরি প্রতিপন্ন হয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা নতুন-নতুন এলাকায় বিস্তার ঘটাতে  চলেছে। আন্তর্জাতিক নারী ক্ষমতায়ন দিবসের মতো দিনগুলোও গতি পাচ্ছে। কিন্তু অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও, নারী ও মেয়েরা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে বৈষম্য ও হিংস্রতার সম্মুখীন হচ্ছে। নারী-পাচার আর দাসী করে জবরদস্তি যৌনকাজে লাগানো  বড়ো সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙে যাবার পর । নারীর ক্ষমতায়ন সাক্ষরতা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অধিকন্তু, নারীর ক্ষমতায়ন বলতে নারীদের কৌশলগত জীবন বেছে নেবার ক্ষমতা বোঝায়, যা থেকে আগে তারা বঞ্চিত ছিল।
    নারীর ক্ষমতায়ন তৈরির জন্য, নারীবাদীরা নারীর  সচেতনতা বৃদ্ধির  কথা বলেছেন । চেতনা উন্নত করার দরুন, মহিলারা কেবল তাদের ব্যক্তিগত সংগ্রাম সম্পর্কেই যে কেবল জানতে পারেন তা নয় । সচেতনতা বৃদ্ধি কীভাবে  রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলির সাথে সম্পর্কিত তা জানাও জরুরি। চেতনা উন্নত করার প্রসঙ্গে প্রান্তিক ব্যক্তিদের বৃহত্তর সামাজিক কাঠামোতে কোথায় রাখা হয়েছে তা পরীক্ষা করে দেখতে এবং তাদের নিপীড়নের মূল সমস্যা চিহ্নিত করার বিষয়টির পর্যবেক্ষণ জরুরি। তাদের সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা নিজের ও অন্যান্য নারীদের সম্পর্কে ভাবতে প্রোৎসাহিত  করবে যা  ক্ষমতায়ন গড়ে তুলবে । নারীর ক্ষমতায়নের জন্য পুরুষের সঙ্গে সমতা জরুরি । লিঙ্গসমতা শুধুমাত্র একটি মৌলিক মানবাধিকার নয়, বরং একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও টেকসই বিশ্বের  প্রয়োজনীয় ভিত্তি।এর মধ্যে রয়েছে আত্মশক্তি থেকে নারীর দক্ষতা বৃদ্ধি।  নারীর ক্ষমতায়ন সাধারণত পাঁচটি প্রধান অংশে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে : সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক।
     
    ভারতীয়, বিশেষ করে বাংলার নারীর ক্ষমতায়ন আরম্ভ হয়েছিল ইংরেজরা আসার পর। উনিশশতকে জন্ম হয় এক নতুন ব্যক্তিত্বের নারী, যার সাথে মিল ছিল না তার আগের প্রজন্মের নারীদের। ইংরেজ ও ব্রাহ্মদের  শিক্ষার ফলে হিন্দু বাঙালির সমাজে দেখা দেন নতুন নারীরা।  উনিশ শতকে সামান্য সংখ্যক নারী  আলো দেখতে পায়। তারা  ব্ৰাহ্ম, দেশি খ্রিস্টান, ও ধনী হিন্দু পরিবারের,  উঁচু বর্ণ ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর। ওই আলো, শিক্ষা, তাদের বদলে দিয়েছিল ; এমন নারী দেখা দিয়েছিল বাঙলায়, যা আগে কখনো দেখা যায় নি। তার আগে বাঙলার নারী  হাজার বছর ধরে ছিল সামাজিক ক্ষমতাহীন । তার নিজের কোনো সত্তা ছিলো না । স্বাধীনতার কথা সে কখনো শোনে নি, তার কোনও স্বপ্ন ছিলো কিনা তা কেউ জানে না। পুরুষ তাকে নিকৃষ্টরূপে বঁচিয়ে রেখেছিল, বিধবা হলে আগুনে পুড়িয়েছিল, ইচ্ছেমতো গ্ৰহণ করেছিল ও ছেড়েছিল, বুড়ো বয়স পর্যন্ত একাধিক যুবতীকে বিয়ে করেছিল কেননা ঋতুস্রাব আরম্ভ হলেই মেয়েদের বিয়ে দেবার চল ছিল।  পশুকেও মূল্যবান গণ্য করতো বাঙালি পুরুষ কিন্তু নারীকে কখনো তার প্রাপ্য মূল্য দেয়নি।  তার সাথে পুরুষ কালেভদ্রে আন্তরিক সম্পর্কে এসেছে, তার শরীরকে  পরিতৃপ্ত করার প্রয়োজন মনে করেনি।  বাংলার দুটি সম্প্রদায়, হিন্দু ও মুসলমান,  ইংরেজরা আসার আগে পর্যন্ত বাস করতো গভীর মধ্যযুগীয় সংস্কারে। নারীর ক্ষমতায়ন যে সমাজকে উন্নীত করবে তা ভেবে দেখেনি তখনকার পুরুষ কর্তারা । 
     
    নারীর ক্ষমতায়নের স্লোগানটি সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয় ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত নারী সম্মেলনে। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল  নারীর ক্ষমতায়ন। বর্তমান শতাব্দীতে নারীর ক্ষমতায়ন একটা আন্তর্জাতিক বিষয়। ১৯৯৫ সালে চীনের বেইজিং এ অনুষ্ঠিত  নারী সম্মেলনে  নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে একটি বড় ধরনের রোড ম্যাপ তৈরি হয়। এটি পরবর্তীকালে নারীর ইতিবাচক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। নারী মানবসমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানবীয় জীবনযাপন প্রণালীর সাক্ষী। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রগুলো হলো পারিবারিক, সামাজিক সক্ষমতায় রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় পরিকল্পনা প্রণয়নে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে, শিক্ষা কর্মকাণ্ড, গবেষণা কর্মকাণ্ড, সৃজনশীল উদ্ভাবনী, সেবামূলক কর্ম ইত্যাদিতে।  প্রাকৃতিক, জৈবিক, সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ইতিবাচক রূপান্তরে বা বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় নারী জড়িয়ে আছে আবহমান কাল থেকেই। যে সমাজে মেয়েদের ক্ষমতায়ন যত বেশি হয়েছে, সে সমাজ তত বেশি উন্নত হয়েছে। 
    সাংবিধানিকভাবে নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে প্রায় প্রতিটি উন্নত দেশে।  ভারতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অর্থাৎ মানবিক ও সামাজিক সূচকে শহরবাসী  নারীর অংশগ্রহণ, ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য হলেও গ্রামীণ নারীরা রয়ে গেছেন ক্ষমতা বৃত্তের বাইরে। নারীর ক্ষমতায়ন সুপ্রষ্ঠিত হলে নারী প্রতিটি ক্ষেত্রে অনাবিল সুখ সমৃদ্ধি বয়ে নিয়ে আসবে সমগ্র সমাজে।  সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছ্ তবু  নারীর ক্ষমতায়ন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনও।পরিবার পরিকল্পনায় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভারতীয় নারীর অধিকার নেই বললেই চলে। ভোটদানের ক্ষেত্রে বাড়ির পুরুষরা অথবা ক্ষমতাশীন দলের মাস্তানরা নারীদের প্রভাবিত করে । আইনগত চুক্তিতে অংশগ্রহণ, বিবাহ-ধর্মীয় অধিকারসমূহ, অন্যান্য সকল অধিকার প্রতিটি বর্ণে আর বর্গে বলবৎ হলে নারীর সুকুমার বৃত্তি প্রকাশ হতে পারবে। 
     
    বর্তমান কালখণ্ডে, পশ্চিমবাংলায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে পার্থসারথি সেনগুপ্ত বলেছেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা হলেও পঞ্চায়েত রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে৷ কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী , পঞ্চায়েত স্তরে মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের থেকে এগিয়ে ঝাড়খণ্ড , রাজস্থান , উত্তরাখণ্ড , কর্নাটক , কেরালা বা অসমের মতো রাজ্য৷ কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী , পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ১২ নম্বরে৷ এগিয়ে সিকিমও৷ পঞ্চায়েত মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী , পঞ্চায়েতে মহিলাদের সর্বভারতীয় হার ৪৫ .৯৯ %৷ রাজ্যের পঞ্চায়েতগুলিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে ৪৯ .৮৮ % মহিলা৷ এই হিসেবে নিজের নির্ধারিত সংরক্ষণ সূচকের নিরিখেই পিছিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ৷ কারণ , এই রাজ্যে পঞ্চায়েতে ৫০ % আসনই মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত৷ সমাজকর্মী অনুরাধা তলোয়ারের মতে , ‘আইনগত মাপকাঠির নিরিখেও তো পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে ‘।
     
    পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যে পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত৷ এর অন্যতম কারণ পঞ্চায়েত স্তরে রাজনীতি বা সংগঠন রাজনৈতিক দলগুলির কুক্ষিগত৷ হিংসারও প্রকোপ রয়েছে৷ যা মহিলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পথে কাঁটা ৷ ইদানীং পঞ্চায়েতগুলোর স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে৷ বিডিও  অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাশালী৷ ‘অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষের কথায় , ‘সমাজের নানা ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রশ্ন করার অভ্যাসটা বরদাস্ত করা হয় না৷ নিঃসন্দেহে শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েরা এই রাজ্যে অপেক্ষাকৃত এগিয়ে রয়েছেন৷ কিন্তু , রাজনীতিতে বহু ক্ষেত্রেই মেয়েরা আসেন পুরুষের হাত ধরে৷ সেটা ডান -বাম সব রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষেত্রেই খাটে৷ রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে মেয়েরা লালপাড় শাড়ি পরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবেন , গণ্যমান্যদের হাতে ফুলের গুচ্ছ তুলে দেবেন , অভ্যর্থনায় থাকবেন আর খাওয়াদাওয়ার সময়ে পরিবেশন করবেন --- এটাই যেন আশা করা হয়৷ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী , এই রাজ্যে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের দুই তৃতীয়াংশই গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা৷ সব মিলিয়ে , মেয়েদের নিয়ে জড়তা রয়েই গিয়েছে৷
     
    কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া চর্চা কেন্দ্রের বিভাগীয় প্রধান পলা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “মাত্র একটি সূচকের হিসেবে কখনোই নারীর ক্ষমতায়নের মূল্যায়ন সম্ভব নয়৷ যেমন , কেন্দ্রীয় এই পরিসংখ্যানে ত্রিপুরায় পঞ্চায়েতে মহিলাদের প্রতিনিধিদের হার দেখানো হয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ৷ এটা কী করে সম্ভব ? ত্রিপুরা প্রথম মহিলাদের জন্য পঞ্চায়েতে ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করে৷ আরও দেখার , কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যানে বিজেপি -শাসিত রাজ্যগুলি কত নম্বরে৷ পশ্চিমবঙ্গ তো চষে বেড়াই৷ গ্রামেগঞ্জে দেখি সকালে কত মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে৷ আমরা যে অনেক দিক থেকে এগোচ্ছি , সেই সূচকগুলিও দেখা দরকার৷ ’ পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের যুক্তি দিয়েছিলেন , ‘এই হিসেব শুধু সংরক্ষিত আসনগুলির৷ আমরা মহিলাদের জন্য পঞ্চায়েতে আসন সংরক্ষণ করেছি৷ পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য রাজ্যগুলির তুলনায় মহিলারা রাজনীতির নানা ক্ষেত্রে অনেক স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশ নেন৷ এখানে পঞ্চায়েতে সংরক্ষিত আসনের বাইরেও সাধারণ আসনগুলিতে অনেক মহিলা প্রতিনিধিত্ব করেন৷ সেই সংখ্যা যোগ করলে আমরা ৫০ শতাংশ ছাপিয়ে যাব৷ ’ ঝাড়খণ্ড ৫৯ .১৮ % রাজস্থান ৫৮ .২৯ % উত্তরাখণ্ড ৫৭ .৮৩ % ছত্তিশগড় ৫৫ .১৪ % কর্নাটক ৫৩ .৪০ % কেরালা ৫১ . ৮৫ %বিহার ৫১ .৬৪ %হিমাচল ৫০ .১১ %মধ্যপ্রদেশ ৫০ %অসম ৫০ %অন্ধ্র ৫০ % সিকিম ৪৯ .৯৫ %মহারাষ্ট্র ৪৯ .৯৩ %পশ্চিমবঙ্গ ৪৯ .৯৮ % প্রতিনিধিত্বের হার ৷”
     
    লিঙ্গ ক্ষমতায়ন প্রচলিতভাবে নারীর ক্ষমতায়নকে বোঝায়, যা আজকাল উন্নয়ন এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে আলোচনার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। এটা একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্যান্য প্রান্তিক লিঙ্গ সম্পর্কিত পদ্ধতির দিকেও নির্দেশ করে। ক্ষমতায়নের এই পদ্ধতিটা আংশিকভাবে নারীবাদীরা প্রতিষ্ঠা করেছেন আর আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের উপর ভিত্তি করে আইনি ক্ষমতায়নকে কাজে লাগানো হয়েছে। মানবাধিকার ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন একটা প্রধান পদ্ধতিগত উদ্বেগ। মানব উন্নয়ন এবং সক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গি, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, এবং অন্যান্য আন্দোলনগুলো ক্ষমতায়ন নারীর অংশগ্রহণকে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসাবে মান্যতা দিয়েছে । 
     
    লিঙ্গ ক্ষমতায়ন প্রচলিতভাবে নারীর ক্ষমতায়নকে বোঝায়, যা আজকাল উন্নয়ন এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে আলোচনার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। এটা একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্যান্য প্রান্তিক লিঙ্গ সম্পর্কিত পদ্ধতির দিকেও নির্দেশ করে। ক্ষমতায়নের এই পদ্ধতি আংশিকভাবে নারীবাদের দ্বারা অবহিত করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের উপর ভিত্তি করে আইনি ক্ষমতায়নকে কাজে লাগানো হয়েছে। মানবাধিকার ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন একটি প্রধান পদ্ধতিগত উদ্বেগ।  মানব উন্নয়ন এবং সক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গি, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, এবং অন্যান্য বিশ্বাসযোগ্য পন্থা/লক্ষ্যগুলি ক্ষমতায়ন এবং অংশগ্রহণকে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসাবে নির্দেশ করে ।আমরা সবাই মিলে যখন কাউকে বা কোনো গোষ্ঠী বা বর্গকে ক্ষমতা দিই, তখন তাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি অনুভব করতে সহায়তা করি - আমরা সবাই মিলে আক্ষরিক অর্থেই তাদের ক্ষমতা দিই। আমরা সাধারণত এমন কাউকে বা গোষ্ঠীকে বা বর্গকে ক্ষমতায়ন করার কথা বলি যিনি বা যাঁরা কোনো না কোনোভাবে সুবিধাবঞ্চিত ।
     
    বহু দেশে, বিশেষ করে ক্যাথলিক খ্রিস্টান দেশগুলোতে, নারী গর্ভপাত করাবে কি না, তা নির্ণয়ের অধিকার দেয়া হয়নি । ভারতেও নারী কতো সপ্তাহের পর আর গর্ভপাত করাতে পারবে না তার আইন তৈরি হয়েছে । অর্থাৎ নারীর কাছ থেকে তার দেহের ওপরে তার অধিকারের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে ।
     
     
    আট
    হেনরি কিসিঞ্জারকে ফোর্বস পত্রিকা অনুরোধ করেছিল মানবেতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাবান সাতজন পুরুষের তালিকা তৈরি করতে । উনি তালিকা তৈরি সময়ে বলেছিলেন, “ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাবান সাত ব্যক্তির তালিকা করতে হলে ক্ষমতা শব্দটি সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। আমি এখানে এটাকে ভবিষ্যতের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং তা প্রভাবিত করার শক্তির অর্থে ব্যবহার করছি। শক্তি ছাড়া দৃষ্টি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন। দৃষ্টিবিহীন শক্তি ক্ষমতার জন্ম দেয় না। এই কারণে, আমি ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের বাদ দিয়েছি যাদের ক্ষমতা আধ্যাত্মিক, সামরিক নয়। এই যোগ্যতার সাথে, এখানে আমার তালিকা।”
    এক : জুলিয়াস সিজার  ( ১০০ - ৪৪ বিসি ) : সম্রাট, রোমান সাম্রাজ্য
    তিনি রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের জন্য সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছিলেন, এর প্রজাতন্ত্রী প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিলুপ্ত করার ভিত্তি তৈরি করেছিলেন কিন্তু একই সময়ে, একটি রোমান সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, যা ইংল্যান্ড থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যা চার শতাব্দী স্থায়ী হয়েছিল।
    দুই : কিন শি হুয়াং ( ২৫৯ - ২১০ বিসি ) : সম্রাট, একীভূত চীন
    তিনি তার প্রতিযোগীদের জয় করে যুদ্ধরত রাজ্যের তথাকথিত সময়কালের অবসান ঘটিয়েছিলেন এবং ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, চীনা রাষ্ট্র তৈরি করেছিলেন যা কিছু বাধার সাথে, আজ অবধি টিকে আছে।
    তিন : পিটার দি গ্রেট ( ১৬৭২ - ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দ ) : জার, রাশিয়ান সাম্রাজ্য
    তিনি একটি পশ্চাৎপদ রাশিয়ান সমাজকে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং এক প্রজন্মের মধ্যে এটিকে এমন এক পর্যায়ে আধুনিক করে তোলেন যেখানে এটি তার সমস্ত প্রতিবেশীদের চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
    চার : মহাত্মা গান্ধি ( ১৮৬৯ - ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ ) : নেতা, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন
    তার ভারতীয় নির্বাচনের আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি আবেদন জানিয়ে, গান্ধী তার স্বাধীনতার প্রতি ভারতের মনোযোগ সংগঠিত করেছিলেন, জাতি খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিলেন, যা বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
    পাঁচ : নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ( ১৭৬৯ - ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দ ) : সম্রাট, ফরাসি সাম্রাজ্য
    তিনি বেশিরভাগ ইউরোপ জয় করেন। যদিও বিজয়গুলি ক্ষণস্থায়ী ছিল, ফরাসি বিস্ফোরণের ফলে জাতিরাষ্ট্র ভিত্তিক ইউরোপ প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিস্তার ঘটে।
    ছয় : থিয়োডোর রুজভেল্ট ( ১৮৫৮ - ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ ) : রাষ্ট্রপতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
    তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ব্যবহার করেছিলেন আমেরিকাকে বাকি বিশ্বের সাথে যুক্ত করার জন্য এবং সফল হয়েছিলেন। তিনি রাশিয়া-জাপানি যুদ্ধের মধ্যস্থতা করেছিলেন, যা  স্থায়ী আমেরিকান প্রবেশ এবং এশিয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য চিহ্নিত করেছিল।
    সাত : ১৯৪৫ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা : আধুনিক রাষ্ট্রপতিদের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র এবং অর্থনৈতিক শক্তির অস্ত্রাগার রয়েছে যা আমেরিকাকে শান্তি এবং অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য উপাদান করে তোলে। সোভিয়েত রাষ্ট্রকে ভেঙে দুর্বল করে দিতে পেরেছে ।
    কিসিঞ্জারের সাত নম্বরটা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর ধোপে টেকে না । রাশিয়া আণবিক অস্ত্রের হুমকি দেবার পর আমরিকা আর ন্যাটো ভয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে । এ থেকে টের পাওয়া যায় যে ক্ষমতা ব্যাপারটার কোনো নির্দিষ্ট অবয়ব নেই ; তা সময়ানুযায়ী পালটাতে থাকে, পালটে চলেছে ।
    নয়
    আরেকজন আছেন বা কতোজন আছেন তা জানা নেই কিন্তু পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ মনে করে অমন ক্ষমতা আর কারোর নেই । বিভিন্ন দেশে, ভাষায়, ধর্মে তাঁর নানা নাম আছে যেমন সৃষ্টিকর্তা, ভগবান, ঠাকুর, ঈশ্বর, গড, ইষ্টদেবতা, গোপাল, দেবতা, দেবী, যহওয়েহ, পরওয়রদিগার, অকাল পুরখ, আহুরা মাজদা, হা-শেম, এলোহিম এবং আরও আজস্র নামে পরিচিত ।
     
     
  • যোষিতা | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০২:৫২738356
  • পড়লাম।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 106.215.24.94 | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১১:২৩738357
  • কলিকাতা বাতুলালয় : মলয় রায়চৌধুরীর উত্তরাধুনিক উপন্যাস
    জোব চার্নক এলেন, আর বাতুলালয়ে স্লোগান আরম্ভ হল । বাতুলালয়ের প্রথম স্লোগান। তার আগে বাতুলালয়ের মানুষ জানতো না স্লোগান বলে কিছু হয় : “জাল, জুয়াচুরি, মিথ্যা কথা ; এই তিন নিয়ে কলকাতা।”
    তারপর এলেন রবার্ট ক্লাইভ, আর পুরোনো স্লোগান পালটে নতুন স্লোগান আরম্ভ হল: রাতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকাতায় আছি ।
    তার কারণ কাগজ পনেরো শতকে ব্যাপকভাবে পাওয়া গেলেও, ইউরোপ-আমেরিকায় ১৮৫৭  সাল পর্যন্ত আধুনিক  টয়লেট পেপারের উদ্ভব ঘটেনি । ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের জোসেফ গেয়েটি  "মেডিকেটেড পেপার, ফর দ্য ওয়াটার-ক্লোজেট" বিক্রি করা আরম্ভ করেন। 
    ১৮৫৭ সাল । বাতুলালয়েই আরম্ভ হলো সায়েবদের ললাটলিখন আর তারপর থেকে দেয়ালে-দেয়ালে লেখা আরম্ভ হল দেয়াল কার । সায়েবরা টের পেয়ে গিয়েছিল, দেয়াল যার, বাতুলালয় তার । তাই একশো বছরের মধ্যেই কেটে পড়ল ওরা। যাবার সময়ে পয়দা করে গেল বাবুদের ।
    তার আগে বাতুলালয়ের বাবু মহাশয়েরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার, এস্রাজ, বীণা প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, ফুল আখড়াই, হাফ আখড়াই, পাঁচালী প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রিকালে বারাঙ্গণাদিগের গৃহে গৃহে গীতবাদ্য ও আমোদ-প্রমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের ও ঘোষপাড়ার মেলা এবং মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গণাদিগকে সঙ্গে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইতেন।
    যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন, এবং পাটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।’
    ক্ষুদ্র নবাব, ক্ষুদ্র নবাব দিব্যি দেখতে দুধে আলতার মতো রং,আলবার্ট ফ্যাশানে চুল ফেরানো, চীনের শূয়রের মতো শরীরটি ঘাড়ে-গদ্দানে, হাতে লাল রুমাল ও পিচের ইস্টিক, সিমলের ফিনফিনে ধুতি মালকোঁচা করে পরা, হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, রাজারাজড়ার পৌত্তর; কিন্তু পরিচয়ে বেরোবে হৃদে জোলার নাতি
    বাতুলালয়ের বাবুরা এলো কোথা থেকে ? সে এক জব্বর গপ্পো । বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে আজ থেকে প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে তাদের উদ্ভব। কিন্তু আধুনিক বাবু-সদৃশ জীব তথা হোমিনিডদের আবির্ভাব ঘটে ১৮৫৭ সাল থেকে প্রায় ৭০ লক্ষ বছর আগে। তারা  গাছের ওপরে বসবাস করত। ফসিল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে , তারা প্রথমে কেরানির কাজ দখল করে নিয়েছিল ।
     তাদের কলম-দোয়াত হাতিয়ার ও সরঞ্জামগুলি উন্নততর ছিল যা দিয়ে তারা লিখতে পারতো, তারা বাতুলালয় বানাতে পারত এবং বিড়ি ফোঁকার জন্য আগুনের ব্যবহার জানত। এই কাজকর্ম থেকেই ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে বুদ্ধিমান মানব নামক প্রজাতির আবির্ভাব বাতুলালয়ে ঘটে। 
    তাঁদের বাতুলতার কিছু আলাপ-আলোচনার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় এই জন্য প্রয়োজন যে তাঁরা কেমন করে কলিকাতা বাতুলালয়ের বুদ্ধিমান জীবে রূপান্তরিত হলেন তা জানতে পারবেন।

    নুরুদ্দিন মহম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ  : আমি সিংহাসন দখল নিয়ে ব্যস্ত ছিলুম বলে ইংরেজগুলো সুবে বাংলায় ঢুকে পড়তে পেরেছিল।৩৬ বছর বয়েসে  বাবা মারা যাবার ৮ দিন পর ৩০ নভেম্বর, ১৬০৫  থেকে আমার ২২ বছরের রাজত্বের শুরু। মনে রাখিস লক্ষ্মীকান্ত, জায়গিরটা আমিই তোদের দিয়েছি, যদিও সুন্দরবনের লাগোয়া বলে তোরা নিতে চাইছিলিস না । তা আমি কী করব বল ! ভবানন্দ মজুমদার ছিল আমাদের খোচর । ওকে ভালো জমিজমা দিতে হলো । তোরা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে আমাদের হেল্প করলে তিন ফসলি জমিজমা পেতিস । যারা ইতিহাস লিখবে তাদের বলে দিস যে কলকাতার জনক আসলে আমি, কেননা আমিই গ্রামগুলো তোদের দিয়েছি।
    সুবাহার ইবরাহিম খান : দ্যাখ জোব চার্ণক, জমি আমি দিচ্ছি, তোরা আবার গোয়ার পর্তুগিজদের মতন দুর্গ খাড়া করিসনি যেন  । সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলিকাতা গ্রাম তিনটে  মুঘল সম্রাটের খাসমহলের জমি, বাদশা জাহাঙ্গির সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের দিয়েছে জায়গিরটা । আমি তোকে ব্যবসা করার সুবিধে করে দিলুম । ইতিহাসে লিখতে ভুলিসনি যে কলকাতার জনক আমি ।
    বিদ্যাধর রায়চৌধুরী : কিন্তু সুবাহদার, এই গ্রাম তিনটের জায়গিরদারি তো সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের । আমাদের যৎসামান্য আয় হয় গ্রামগুলো থেকে ; প্রজারাও আমাদের ভালোবাসে । ইংরেজরা দিল্লির বাদশাকে মাত্র ষোলো হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিল করে ফেললো । আমরাই তো এই গ্রামগুলোর জনক । 
    ভিদকুন কুইসলিঙ : আমার আসল নাম সৈয়দ মীর জাফর আলী খান, ইরান থেকে এসে আলীবর্দী খানের সৈন্যদলে যোগ দিয়েছিলুম, বাংলা বিশেষ বলতে পারি না, ফারসিতে কাজ চালাই । তা যতোই প্রজারা ভালোবাসুক । তোমরা তো ক্লাইভকে তুষ্ট করতে পারোনি । সিরাজের যুদ্ধ আদ্যন্ত এক ‘বেওসা’, যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে মুনশি নবকেষ্টর মতো লোক রাতারাতি মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর হয়ে গেল। শোভাবাজার রাজবাড়ি এখন তাই বিয়ে, অন্নপ্রাশন, উপনয়নের জন্য ভাড়া দেয়া হয়। ওরা মনে করে ওরাই কলকাতার জনক । আমাকেই লোকে অযথা দোষ দ্যায় । এই নবকেষ্ট তো ক্লাইভের জন্যে মানত করে দূর্গাপুজোও করে ফেলল । নবকেষ্টর বংশধররা  জোব চার্ণককে কলকাতার জনক বলে উঠেপড়ে লেগেছিল ; হাইকোর্টে মামলায় হেরে গিয়ে এখন তারা ফিবছর সুতানুটি উৎসব চালায় ।
    মির্জা মুহম্মদ সিরাজ-উদ-দৌলা :  শোভাবাজর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব পলাশীর যুদ্ধের আগে  ছিল  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুন্সি, পরে হয়েছিল সুতানুটির তালুকদার। এর পরে ওয়ারেন হেস্টিংসের মুন্সি, তারপর ড্রেক সাহেব তেজাউদ্দীনকে কোম্পানির মুন্সির পদ থেকে সরিয়ে সেখানে বসালে নবকৃষ্ণকে।পলাশীর যুদ্ধের ফলে নবকৃষ্ণের কপাল খুলে গেল। মীরজাফর, রামচাঁদ রায়, আমীর বেগ আর নবকৃষ্ণ মিলে আমার লুকোনো কোষাগার লুঠ করে বহু কোটি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিলে। নবকৃষ্ণ কেবল টাকাই পেলো না ! বাড়তি পাওনা পেল সম্মান ও ক্ষমতা ।১৮৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির রণাঙ্গনে মীরজাফরের বেইমানির দরুণ ইংরেজ সেনপতি ক্লাইভের হাতে আমার পরাজয় ঘটলে সবচেয়ে যারা উল্লসির হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল হিন্দু বিশ্বাসঘাতকরা, নদিয়ার কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার নবকৃষ্ণ। কোম্পানির জয়কে তারা হিন্দুর জয় বলে প্রচার চালালো। ধূর্ত ক্লাইভও তাদের তেমনই বোঝালো। ক্লাইভের পরামর্শেই তারা পলাশীর যুদ্ধের বিজয়-উৎসব করার আয়োজন করলো।বসন্তকালীন দুর্গাপুজোকে তাঁরা পিছিয়ে আনলো শরৎকালে ! ১৭৫৭ সালে বহু টাকা খরচ করে শরৎকালীন দুর্গাপুজো করে তারা পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব পালন করলো ! অন্যা হিন্দু জমিদার আর ব্যবসাদাররাও মহা উৎসাহে সেই ফূর্তিতে যোগদান করলো ! হেরে গেলেও, আমিই মালিক । আমাকে কলকাতার জনক মনে করা উচিত ।
    REPORT THIS AD
    জুডাস ইসকারিয়ট : আমার আসল নাম রায় দুর্লভরাম । আমাকে কেন কলকাতার জনক মনে করা হবে না ? আমি তো বাংলার নবাবি শাসনামলের একজন কর্মকর্তা। আমি নবাব আলীবর্দী খানের অধীনে উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তা পদে ছিলুম। বাংলায় মারাঠা আক্রমণকালে আমি বাংলার নবাবের পক্ষে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। যদিও পলাশীর যুদ্ধের সময়  নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের সহযোগিতা করেছিলুম আর যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলুম।  বিশ্বাসঘাতকদের জন্যেই তো ক্লাইভ জিতেছিল । আমি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে কলকাতা দখল করে ক্লাইভের মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করে দিতো সিরাজদ্দৌলা।আমাকে কলকাতার জনক মনে করা উচিত।১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মীর কাশিম ইংরেজদের সাথে বক্সারের যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী আমার গলায় বালির বস্তা বেঁধে মুঙ্গেরের দূর্গশীর্ষ থেকে জীবন্ত দেহ নিক্ষেপ করে গঙ্গার বুকে। এভাবেই গঙ্গার বক্ষে সলিল সমাধি হয় আমার।
    দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর : বড় লোকেদের যেন একটা ধারণা ছিল যে ভাল মন্দ বিচার না করিয়া খুব খরচ করিতে পারিলেই সমাজের মধ্যে প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাইবে। মাতৃশ্রাদ্ধে নবকৃষ্ণ দেবের ন’লক্ষ টাকা খরচের পিছনে এই উদ্দেশ্য উঁকি দেয়। তাঁর মাতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে যে সভা হয় এবং যেখানে সমবেত অভ্যাগত ও পণ্ডিতগণের আবাসস্থল এবং কাঙালিদের জন্য পণ্যবীথিকা সংস্থাপিত হয়, তা থেকে উক্ত অঞ্চলের নামকরণ হয় সভাবাজার বা শোভাবাজার (পূর্ব নাম রাসপল্লি)। ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভের চেষ্টায় তিনি ‘মহারাজা বাহাদুর’ উপাধি ও ৬-হাজারি মনসবদারের পদ পান। তাঁর অধীনে আরজবেগী দপ্তর, মালখানা, চব্বিশ পরগনার মাল আদালত, তহশিল দপ্তর প্রভৃতি ছিল। পরে তিনি কোম্পানির কমিটির রাজনৈতিক বেনিয়ান হন।তিনি ও তাঁর বংশজগণ প্রায় শতাধিক বছর ধরে ক্ষমতা ও প্রভাব বহাল রেখেছিলেন।১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভে শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে দুর্গাপূজার আয়োজন করে বিজয় উৎসব পালন করেন। সেই থেকে প্রতি বৎসর শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন হয়ে থাকে। । সিরাজদ্দৌলার কোষাগার থেকে চুরি করা টাকায়  নবকৃষ্ণ দেব রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন ।পলাশির পরে কলকাতার সামাজিক সাম্রাজ্যে তিনি হয়ে উঠলেন প্রায় মুকুটহীন সম্রাট। তাঁর সামাজিক গুরুত্ব তখন রাজনৈতিক নেতাদের থেকে বেশি। এই সামাজিক গুরুত্ব লাভে তাঁকে সাহায্য করেছিল তার সরকারি পদের গুরুত্ব এবং কলকাতার কোম্পানির কর্তাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। নিজের সামাজিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তিনি কলকাতায় ডেকে এনেছিলেন উঁচুদরের কুলীনদের। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দান করেছিলেন জমি, বাড়ি ইত্যাদি। এই সবই দলপতি হওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি। দলপতি হতে প্রয়োজন ছিল বিত্ত-বৈভব প্রদর্শন। তার মাধ্যম ছিল শ্রাদ্ধ, বিয়ে বা অন্য পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অপরিমিত অর্থব্যয়। সে কালে ধনীদের দু’হাতে দানধ্যান করাকে বদান্যতা ভাবলে ভুল হবে। নবকৃষ্ণ কলকাতার দুষ্টক্ষত । আমরা জোড়াসাঁকো পরিবারই কলকাতার জনক; আমাদের ছাড়া কলকাতা অচল ।
    আজিম-উশ-শান : ঘাবড়াসনি বিদ্যাধর । ব্রিটিশ বসতি  অন্য ভূস্বামীদের আরও আটত্রিশটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা  ১৭১৭ সাল । ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে  তোদের গ্রামের জমিদারি সত্ব দিলেও, অন্য জমিদারদের কাছ থেকে ওরা বাকি গ্রামগুলো কিনতে  পারেনি। তোর টাকাকড়ি জমিয়ে রাখতে পারলি না ; সবাই একগাদা বিয়ে করে গুচ্ছের বাচ্চা পয়দা করলি । যাই হোক, সব গ্রামগুলো তো মুঘল বাদশার । তাই আমিই কলকাতার জনক, মনে রাখিস ।
    বিদ্যাধর রায়চৌধুরী : আমরা  ব্রিটিশদের এই তিনটে গ্রাম ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলুম না ।  ব্রিটিশরা মুঘল রাজদরবারে ঘুষ দিয়ে এই গ্রাম তিনটের ইজারা কেনার অনুমতি আদায়ে সমর্থ হয়েছে। এটা ১৬৯৮ সাল । আপনারা ইংরেজদের হাতে গ্রাম তিনটে তুলে দিতে বাধ্য করলেন। ওরা বার্ষিক মাত্র ১,৩০০ টাকা রাজস্বের বিনিময়ে গ্রাম তিনটের ইজারা কিনে নিলে। চুক্তিপত্রটা ফার্সি ভাষায় লেখা ; ভাগ্যিস আমাদের পরিবারে সবাই ফার্সি ভাষা জানে । আপনি তো জানেন এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা জিয়া গঙ্গোপাধ্যায়  সন্ত কামদেব ব্রহ্মচারী নামে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ছেলে লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়  ১৬০৮ সালে  মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে সুন্দরবনের লাগোয়া ভূসম্পত্তি জায়গির হিসেবে পেয়েছিলেন।  মুঘল সম্রাট আকবর আমাদের ‘রায়’ আর জাহাঙ্গির  ‘চৌধুরী’ উপাধি দিয়েছিলেন। তাই ‘রায়চৌধুরী’ আমাদের পদবিতে পরিণত হয়েছে। আমরা দাবি করি না যে আমরা কলকাতার জনক । 
    আজিম-উশ-শান : আমিই বা কী করব ? শায়েস্তা খান এর উত্তরাধিকারী সুবাহদার ইবরাহিম খান বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য আবার শুরু করতে ব্রিটিশদের ডেকে পাঠিয়েছিল। দুটো প্রধান বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে জব চার্নক নামে ওদের একজন প্রতিনিধি সুবাহদারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছিল। একটা ছিল ইংরেজদের বসতি হুগলি থেকে সুতানুটিতে স্থানান্তরের প্রস্তাবে সরকারকে অবশ্যই রাজি হতে হবে। দ্বিতীয়ত, বার্ষিক পূর্বনির্দিষ্ট ৩০০০ টাকা কর পরিশোধের বিনিময়ে কোম্পানিকে বাংলায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের অনুমতি প্রদানকারী একটি ফরমানের দ্বারা সুবাহদার তাদের অনুমতি দেবেন। সুবাহদার ইবরাহিম খান তাদের তোলা দুটো প্রস্তাবই মেনে নিলে । মনে হচ্ছে কলকাতা নামের বাচ্চাটার বাপ অনেকগুলো ।
    বিদ্যাধর রায়চৌধুরী : হ্যাঁ, জব চার্ণক মারা যাবার পর ওর জামাই  ক্যাপ্টেন চার্লস আয়ারকে আমরা ১৬৯৮ সালের ১১ই নভেম্বর কলকাতা – সুতানুটি – গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটের প্রজাস্বত্ব মাত্র ১৩০০ টাকায় একটি দলিলের দ্বারা দান করে দিতে বাধ্য হয়েছিলুম, তার কারণ আপনারা ঘুষ খেয়ে আমাদের ওপর চাপ দিয়েছিলেন । আমরা এখানকার জায়গিরদার  অথচ মুঘলরা আমাদের গুরুত্ব দিল না । দলিলটা আমরা  সই করেছিলুম আটচালা বাড়িতে, যেখানে আজও আমরা দূর্গাপুজো করি । ক্লাইভের চামচা নবকৃষ্ণদেবের অনেক আগে থেকে আমাদের পুজো হয় । আমরা ক্লাইভের পোঁদে তেল দিতে রাজি হইনি । রাজা বা মহারাজা খেতাব আমাদের দরকার পড়েনি, নবকৃষ্ণ আর কৃষ্ণচন্দ্রর মতন ।
    বেনেডিক্ট অ্যারনল্ড : আমার আসল নাম মীর মুহম্মদ কাসিম আলী খান । শোভাবাজার রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব সম্পর্কে এই কথাটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। পিতৃহীন অবস্থায় কলকাতার কাছে গোবিন্দপুরে এসে থাকতে শুরু করে। বলা ভালো, অত্যন্ত সাধারণ অবস্থা ছিল। কিন্তু বুদ্ধি ছিল প্রখর। নিজের চেষ্টায় উর্দু, আরবি, ফার্সি শিখেছিল। ইংরেজ সরকারের হয়ে কাজ করার জন্য সমস্ত রকম গুণই তার মধ্যে বর্তমান ছিল।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামান্য মুনশী হিসেবে জীবন শুরু হয় নবকৃষ্ণ দেবের। সরকারি কাজকর্মের পাশাপাশি ওয়ারেন হেস্টিংসকে ফার্সি ভাষা শেখানোর কাজ করতো। বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে রবার্ট ক্লাইভ। সিরাজের পক্ষে আছে মীরজাফর। ক্লাইভ তখন নিশ্চিন্ত ।  সময়মতো নবাবের পক্ষ ত্যাগ করল মীরজাফর। ‘ইনাম’স্বরূপ মীরজাফর নবাবের গদিতে বসল। কিন্তু পেছনে থেকে লাভবান হলো আরও দুজন।  কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণ দেব। মীরজাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইতিমধ্যেই তারা খুঁজে পেয়েছে সিরাজের গোপন কোষাগার। সবাই সেই বিপুল ধনসম্পত্তি ভাগাভাগি করে নেয়। তা সত্তেও নবকৃষ্ণের ভাগে কম কিছু পড়েনি। দেখতে দেখতে বিশাল ধনদৌলতের মালিক হয়ে গেল নবকৃষ্ণ। শুধু টাকাই নয়, এল সম্মানও। ইংরেজদের পক্ষ নেওয়ার জন্য পেল ‘রাজা বাহাদুর’ খেতাব; অতঃপর ১৭৬৬ সালে ‘মহারাজা বাহাদুর’। সবথেকে বড়ো কথা, গোটা সুতানুটি অঞ্চলের তালুকদার হয়ে গেল । সামান্য মুনশী থেকে বিশাল সাম্রাজ্য ও ধন-দৌলতের মালিক— এমনই চমকপ্রদ উত্থান রাজা নবকৃষ্ণ দেবের। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হল শোভাবাজার রাজবাড়ি । তখন সবে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়েছে। নবকৃষ্ণদেব ভীষণ খুশি। আর এখানেই ধর্মের তাসটি খেললেন চতুর ক্লাইভ। নিজে খ্রিস্টান, মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী; তা সত্তেও নবকৃষ্ণকে বোঝালেন কলকাতায় একটি বিজয় উৎসব করার জন্য। ‘হিন্দু ভাবাবেগ’ রক্ষা পেয়েছে বলে কথা ! কিন্তু কীভাবে হবে উৎসব? নবকৃষ্ণ ঠিক করলেন, দেবী দুর্গার আরাধনা করেই তুষ্ট করবেন ক্লাইভকে। শুরু করবেন বিজয় উৎসব। ১৭৫৭ সালেই নিজের নবনির্মিত ঠাকুরদালানে শুরু করলেন অকাল বোধন। শুরু হল কলকাতার দুর্গাপূজা। তাতে একশো এক টাকা দক্ষিণাও পাঠিয়েছিলেন ক্লাইভ ! বিশাল আয়োজন করে শুরু হল শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো। কালে কালে যা শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গেছে । বিশ্বাসঘাতকের পুজোতে ভোগ খেয়ে বাঙালিও সেই বিশ্বাসঘাতকতা আর কোষাগার চুরির অংশভাক। চুরির টাকা খরচ করে কলকাতার জনক হতে চাইছে ওর বংশধররা । 
    মহারাজা প্রতাপাদিত্য : মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়   নদীয়ার রাজা আর কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর। ভবানন্দ আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজবংশ শুরু করেছিল । কৃষ্ণচন্দ্রের কৃষ্ণনগরেই তাঁর জন্ম; বাবা রঘুরাম রায়। রক্ষণশীল এই হিন্দু রাজা বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় সমান ব্যুৎপন্ন ছিল। কৃষ্ণচন্দ্র ছিল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন কূটকৌশলী লোক। তার ষড়যন্ত্রে বাংলায় ইংরেজ শাসন কায়েম হয় এবং মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটে। এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ও ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা করে আর ক্লাইভের পক্ষ নিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করেছিল। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নবাব  মীর কাসেম তাকে বন্দি করে মৃত্যুদন্ড দিলে ইংরেজদের সহায়তায় ও মুক্তি পায়। ইংরেজদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের পুরস্কার হিসেবে  ইংরেজ কর্তৃক ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত হয়। তদুপরি ক্লাইভের কাছ থেকে উপঢৌকন হিসেবে পায়  পাঁচটা কামান। সে সময়ে বাংলায় যে বর্গীর আক্রমণ হতো তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ও নিজের রাজধানী ‘শিবনিবাস’ নামের জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। ক্লাইভের চামচা হিসেবে ওরা তো নিজেদের কলকাতার জনক দাবি করতেই পারে ।
    জয়চাঁদ : আমার আসল নাম নবকৃষ্ণ দেব ।পলাশীর যুদ্ধের আগে বাংলা অঞ্চলে সাতজন হিন্দু রাজা ছিল। এদের মধ্যে রাজনৈতিক দিক থেকে বিচক্ষণ নদীয়ার শাসক মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় উপলব্ধি করে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় মুসলমানদের শাসনের দিন ফুরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে ব্রিটিশদের উত্থান ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিষয়টি তিনি অন্য ছয়জন হিন্দু রাজাকেও বোঝাতে সক্ষম হন। কৃষ্ণচন্দ্র অন্য হিন্দু রাজাদের আরও বোঝাতে সক্ষম হন যে, তাদের সনাতন ধর্ম মুসলমানদের হাতে নিরাপদ নয়, বরং ব্রিটিশদের হাতে নিরাপদ। ফলে সব হিন্দু রাজার সমর্থন নিয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় হাত মেলায় রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে। ইংরেজদের সঙ্গে এই সখ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধ-ময়দানে যাওয়ার সময় কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের প্রাসাদে রাত কাটিয়েছিল । যুদ্ধের পর ইংরেজদের সঙ্গে এই সখ্য চললেও নবাব মীর কাশেমের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। এই দ্বন্দ্বের রেশ ধরেই কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে মৃত্যুদণ্ড দেন মীর কাসিম। কিন্তু ক্লাইভের বদান্যতায় বেঁচে যায় আর রাজা খেতাব পায় ।বস্থায় মারা যান উমিচাঁদ
    মার্কাস ব্রুটাস : আমাদের  পরিবারের নাম জগত শেঠ । পলাশীর যুদ্ধে একদিকে যেমন ইংরেজদের কূটকৌশল আর অস্ত্রশস্ত্র কাজ করেছিল, অন্যদিকে ঠিক তেমনিভাবে কাজ করেছিল আমার অঢেল টাকা। আমার আসল নাম মহাতাপ চাঁদ। আর  টাইটেল  জগৎ শেঠ, যার অর্থ পৃথিবীর ব্যাংকার। মূলত এই টাইটেলটা প্রথম লাভ করে আমার দাদা ফাতেহ চাঁদ। আমরা মাড়োয়ারি  পরিবার । মূলত সুদের কারবার আর ব্যাংকিংয়ে জড়িত । পলাশীর যুদ্ধের আগেই বংশ পরম্পরায় পিতামহের টাইটেল জগৎ শেঠ আমার নামে যুক্ত হয়।  য় জমিদাররা আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই খাজনা পরিশোধ করতো। আবার নবাবরাও দিল্লিতে খাজনা পাঠাতে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ইংরেজরা এদেশে আসতে থাকলে ইংল্যান্ডের মুদ্রার সঙ্গে ভারতীয় মুদ্রা বিনিময় করার প্রয়োজন দেখা দেয়। আর এ সুযোগটি গ্রহণ করি আমরা। বিশেষত ইংরেজরা ঘুষ আর দুর্নীতি বাবদ ভারতীয় মুদ্রায় যে অর্থ পেত তা ইংল্যান্ডের মুদ্রায় বা সোনা ও রত্নে বিনিময় করে দিতুম আমরা । তাই ইংরেজদের কাছে আমাদের কদর ছিল। ফলে নবাব সিরাজউদ্দৌলকে পলাশীর যুদ্ধে হারানোর ষড়যন্ত্রে ব্যাপক ভূমিকা নিই । পলাশীর যুদ্ধের পর মীর জাফরের আমলে ভালোই ছিলুম আমি, মহাতাপ চাঁদ আর খুড়তুতো ভাই  মহারাজ স্বরূপ চাঁদ। কিন্তু  মীর কাসিমের সঙ্গে খেয়োখেয়িতে জড়িয়ে পড়লে ওর বিরুদ্ধে  নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করতে বাধ্য হই। পলাশীর যুদ্ধের ছয় বছরের মাথায় ইংরেজদের কাছে  ষড়যন্ত্রমূলক একটি চিঠি লিখেছিলুম । কিন্তু চিঠিটা কেমন করে যেন  মীর কাসিমের হস্তগত হয়। এতে চটে  ওঠে  মীর কাসিম আর আমাকে মুর্শিদাবাদ থেকে তাড়ায় । এদিকে ১৭৬৩ সালে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে হেরে যায়  মীর কাসিম ।  মীর কাসিম এই অপমান মানতে পারেননি। ব্যাটা ছুটে আসে আমাদের নতুন আস্তানা মাংঘরে। মাংঘরে একটি টাওয়ারে আশ্রয় নিয়েও প্রাণ বাঁচতে পারিনি আমি।  মীর কাসিম আর ওর সৈন্যরা আমার, মহাতাপ চাঁদের, আর  স্বরূপ চাঁদসহ  পরিবারের সবার মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করে দ্যায় । এই আত্ম বলিদানের জন্যে আমি দাবি করি যে আমিই কলকাতার জনক ।  
    সুশীল চৌধুরী : ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলার নওয়াব  সিরাজউদ্দৌলা ও ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। নওয়াব কলকাতার ইংরেজ বসতি অধিকার করেন (১৮-২০ জুন ১৭৫৬) এবং ইংরেজরা তাঁর প্রকৃত ক্ষতিসমূহের প্রতিবিধান করতে অস্বীকার করলে তিনি তাদের কলকাতা শহর থেকে বিতাড়িত করেন। তিনি এ শহরের নতুন নামকরণ করেন আলীনগর। ইংরেজরা সাহায্যের আবেদন জানালে মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভ এবং ওয়াটসন-এর অধীনে অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনী উপনীত হয় এবং কলকাতা পুনর্দখল করে। নওয়াব কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু কলকাতার কাছে খুব ভোরে ইংরেজরা আকস্মিক আক্রমণ করলে নওয়াব পশ্চাদপসরণ করেন। ইংরেজরা তাঁকে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য প্রস্তাব দেয়। নওয়াব তাঁর প্রধান উপদেষ্টাবৃন্দ ও মন্ত্রীদের পরামর্শক্রমে এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির প্রধান ধারাগুলি হলো ক. নওয়াব ১৭১৭ সালের ফররুখ সিয়ারের ফরমান এ প্রদত্ত সকল সুবিধা ইংরেজদেরকে দেবেন, খ. কোম্পানির দস্তক এর আওতায় বাংলার ভেতর দিয়ে যেসব পণ্যদ্রব্য অতিক্রম করবে সেগুলির ওপর থেকে শুল্ক তুলে নিতে হবে, গ. নওয়াব বিনা বাধায় কলকাতার ইংরেজ দুর্গটিকে সুরক্ষিত করার অনুমতি দেবেন এবং ঘ. কলকাতায় ইংরেজগণ স্বাধীনভাবে মুদ্রাঙ্কন করতে পারবে। এ চুক্তির শর্তাবলি বাংলায় ইংরেজদের অনুকূলে ছিল এবং সেখানে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করেছিল। ১৭৫৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটির কাছে লিখেন যে, এ চুক্তির শর্তাবলি কোম্পানির জন্য ‘একই সঙ্গে সম্মানজনক ও সুবিধাজনক’। সিরাজউদ্দৌলার জন্য এ চুক্তি কিছুটা অপমানকর হলেও তিনি এটি মেনে নেন। তবে তিনি ইংরেজদের সামরিক বাহিনীর ভয়ে ভীত হয়ে একাজ করেন নি। তিনি বরং আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বে আসন্ন আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় আলীনগরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এ সময় তিনি খবর পেয়েছিলেন যে, আহমদ শাহ আবদালী দিল্লি ধবংস করার পর (১৭৫৬) বাংলার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। পরবর্তী ঘটনাবলি দ্বারা তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণিত হলেও সম্ভবত তিনি মনে করেছিলেন যে, ওই মুহূর্তে ইংরেজরা নয় বরং আফগানরাই ছিল তাঁর জন্য অধিকতর বিপজ্জনক। এ কারণে তিনি রাজা রামনারায়ণের নেতৃত্বে তাঁর সামরিকবাহিনীর সেরা অংশটি আফগান বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য পাটনায় প্রেরণ করেছিলেন। যদিও এ চুক্তি বেশি দিন স্থায়িত্বলাভ করে নি। এর প্রধান কারণ, ইংরেজরা এর শর্তাবলি মেনে চলে নি। ফলে চুক্তিটি ভেঙ্গে যায় এবং ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। 
    আহমদ শাহ দুররানি : আমি সুবে বাঙ্গাল আক্রমণের কথা ভাবিনি । কাফেরদের ধ্বংস করার কাজে ব্যস্ত ছিলুম । সিরাজ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে ইংরেজদের তাড়াতে হেল্প করতে পারতুম । আমি শিখ গণহত্যায় কুখ্যাত হয়ে আছি, অমৃতসরে শিখদের পবিত্র স্বর্ণ মন্দিরে হামলা করে  ধংস্ব করে দিয়েছিলুম। এছাড়াও তিনি ১৭৪৬ ও ১৭৬২ সালে হাজার হাজার শিখকে খুন করেছিলুম।আফগানিস্তানে আমাকে লোকে বলে আহমদ শাহ বাবা ।
    মার্শাল পেতাঁ : আমার নাম উমিচাঁদ । প্রকৃত নাম ছিল আমির চাঁদ। আমি একজন শিখ আর জন্মসূত্রে পাঞ্জাবের বাসিন্দা। কিন্তু কলকাতায়  দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছিলুম আর অঢেল ধনদৌলত কামিয়েছিলুম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতেও টাকা খাটিয়েছিলুম আর মুর্শিদাবাদ দরবারে কোম্পানির পক্ষে দালালি করতুম। এতে বেশ লাভবান হই । কলকাতায় অনেক ঘরবাড়ি কিনি । আরও লাভের আশায় আমিও গোপনে লর্ড ক্লাইভ আর মীর জাফরের সঙ্গে যোগ দিই।   পলাশীর যুদ্ধে নবাবকে হারিয়ে যে ধন-সম্পদ পাওয়া যাবে তার পাঁচ অংশ চেয়েছিলুম।  গোপন পরিকল্পনা ফাঁসের হুমকিও দিয়েছিলুম। ক্লাইভ ব্যাটা আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে একটি চুক্তি করেছিল । চুক্তিটার যে দুটো কপি করিয়েছিল তা জানতুম না। যার একটাতে আমাকে অর্জিতব্য সম্পদের  পাঁচ ভাগ দেওয়ার কথা লেখা থাকলেও অন্যটাতে অর্থাৎ মূল কপিতে তা লেখা হয়নি। মূল কপি ব্যাটা আমাকে দেখায়নি । আসল ঘটনা জানার পরে আমি সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলুম ।  হ্রাস পায় আমার  স্মৃতিশক্তি।  অসহায় আর করুণ অবস্থায় দশ বছর উন্মাদ ছিলুম । ওই অস্হায় ১৭৬৭ সালে মারা যাই । এই যে ইংরেজদের ঢুকিয়ে আনলুম তাতে তো প্রমাণ হয় যে আমিই কলকাতার জনক ।
    হুমায়ুন : দশম শতাব্দীতে যে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে বাংলায় সর্বশ্রেষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম বলে গন্য করা হতো, সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার তাঁদের অন্যতম । তা সত্তেও ওদের চরিত্রে ক্ষত্রিয়ের তেজ দেখে  বংশের পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়কে খান উপাধি দিয়েছিলুম । ওরা রায়চৌধুরীর বদলে খান পদবী ব্যবহার করলে ভালো করতো । আফগান সেনাদের প্রধান হয়ে পঞ্চানন তো পাঁচু শক্তিখান নামে আগ্রা, দিল্লি, লাহোর, কাবুলেও খ্যাতি পেয়েছিল । ওকে শের শা্হ সুরি ডেকেছিল ওর পক্ষের সেনাপতি হবার জন্য, কিন্তু যায়নি । অবশ্য ওদের বংশই তো কলকাতার জনক হলো ।
    পাঁচু শক্তিখান : হ্যাঁ, শের শাহ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল, যাইনি কেননা মোগল সম্রাট আমাকে সন্মান দিয়েছেন ।মারাঠারা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল ওদের সঙ্গে যোগ দিতে । ওদের গেরিলা যুদ্ধশৈলী পছন্দ ছিল না বলে যাইনি ।কে কলকাতার জনক হবে তা নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না ।
    ভোলা ময়রা : আমার নাম ভোলানাথ মোদক।  হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায় জন্মছিলুম। বাবার নাম কৃপানাথ। কলকাতার বাগবাজারে আমার মিষ্টির দোকান ছিল। পাঠশালায় সামান্য লেখাপড়া করলেও সংস্কৃত, ফারসী ও হিন্দিতে জ্ঞান ছিল। পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্র সামান্য পড়েছিলুম। কবির দল তৈরীর আগেও  বহু কবিতা রচনা করেছিলুম। কলকাতার অনেক খবরই রাখি । কলকাতার মাঝখানে এখনকার বিবাদীবাগের লালদিঘির কাছে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছারি আর গৃহদেবতা শ্যাম রায়ের  মন্দির  ছিল।  কাছারির দোল উৎসবের আবিরে দিঘির রং লাল হয়ে যেত বলে এই দিঘির নাম হয়েছিল লালদিঘি। জন অ্যান্টনি নামে এক পর্তুগিজ ভাগ্যান্বেষী সাবর্ণদের কাছারিতে কাজ করতো। তার পৌত্র অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি পরে বিখ্যাত কবিয়াল হয়েছিল।ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে এই কাছারিটা ভাড়া নেয় আর পরে কিনে নেয়। ওখানেই বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সচিবালয় মহাকরণ । আমার মনে হয় আমরা কবিয়ালরা কলকাতার জনক ।
    মোহনলাল : ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের সময় আমি সিরাজের প্রতি অবিচল বিশ্বস্ততায় যুদ্ধ করেছিলুম। যুদ্ধক্ষেত্রে মীর মদনের মৃত্যুর পরেও আমার একক চেষ্টায় যুদ্ধের গতি সিরাজের অনুকূলে ছিল। কিন্তু নিজের অদূরদর্শিতা ও মানসিক দুর্বলতার কারণে সিরাজ,  মীর জাফর প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকদের প্রভাবে যুদ্ধ বন্ধ রাখার আদেশ দেন। ফলত: নবাব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও শোচনীয় পরাজয় ঘটে। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাইনি।  যুদ্ধে আহত হই আর যখন জানতে পারি যে মীর জাফর আমাকে খুন করার জন্য তল্লাশি চালাচ্ছে, তখন গা ঢাকা দিই। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে আমার বড় ছেলে, পূর্নিয়ার নায়েব নাজিম, শ্রীমন্ত লালকে  মিরন খুন করেছিল। ছোট ছেলে হুক্কা লাল পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল। আমার বোন ছিল সিরাজের প্রণয়িনী আর আমি তাদের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ময়মনসিংহে চলে যাই। তারপর আমার অজ্ঞাতবাস পর্বের নানা কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে বাংলায়।এই কিংবদন্তিগুলোই কলকাতার জনক ।
    কানকাটা দানশা ফকির : ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর যুদ্ধে হেরে যাবার পর, সিরাজদ্দৌলা – তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও চাকর গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান আর সেখান থেকে নৌকাতে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক যাত্রা করেন। তাঁর আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছোতে পারলে ফরাসি সৈনিক মসিঁয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। শেষরক্ষা হয় নি । মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও তাতে জোয়ার ভাটার ফলে হঠাৎ করে জল কমে যাওয়ায় নাজিমপুরের মোহনায় এসে তাঁর নৌকা চড়ায় আটকে যায়। তিনি নৌকা থেকে নেমে খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের কাছে বাজারে আসেন। আমি নবাবকে দেখে চিনে ফেলি কেননা একবার নবাবের শাস্তি পেয়ে আমি একটা কান হারিয়েছিলুম। আমি নবাবের খবর জানিয়ে দিই । মীর জাফরের লোক এসে  সিরাজদ্দৌলাকে বন্দি করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে নিয়ে যায় । এর পরের দিন ৪ জুলাই  মীরজাফরের নির্দেশে তার ছেলে মিরনের তত্ত্বাবধানে মুহম্মদি বেগ নামের এক জল্লাদ সিরাজদ্দৌলাকে খুন করে করে। সিরাজের মৃত্যুর পর তার শব হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাকে কবর দেয়া হয়। মীর জাফর আমাকে জমিজমা আর  মোটা ইনাম দিয়েছিল । আমি ধরিয়ে না দিলে কলকাতার জন্ম হতো না ।
    কৌস্তুভ দে সরকার : সিরাজের কাছে হেরে গিয়ে, কলকাতা উদ্ধারে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ইংরেজদের তরফ থেকে। এক্ষেত্রেও ইংরেজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে প্রস্তাব করা হয় ক্লাইভের নাম। বিশেষ করে পণ্ডিচেরির দায়িত্বে থাকা পিগটের নামও এসেছিল এ অভিযান পরিচালনায় নেতৃত্বের জন্য; কিন্তু অল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে এমন অভিযানের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। পক্ষান্তরে হাঁপানি রোগী লরেন্সের পক্ষে বাংলার আর্দ্র-উষ্ণ আবহাওয়ায় অভিযান পরিচালনা করা অনেক কঠিন ছিল। শেষ পর্যন্ত ক্লাইভের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নেতৃত্বের দায়ভার গিয়ে উপস্থিত হয় কর্নেল জন এডলারকর্নের ওপর। তিনি পদাতিক ও নৌযুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন। পাশাপাশি বাংলার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার সাহস ও শক্তিমত্তা তার মধ্যে ছিল। এর পর ইংরেজ বাহিনী সেন্ট ডেভিডের মাটি থেকে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে। আরেক দফা সংঘাতে কেঁপে ওঠার আতঙ্কে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে প্রকৃতিতে।
    গৌতম বসুমল্লিক : বাংলায় দুর্গাপুজো প্রবর্তনের কৃতিত্ব যাঁরই হোক না কেন, কলকাতায় দুর্গার পুজো প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে, বরিষার ,বেহালা সখের বাজার অঞ্চল,  সাবর্ণ গোত্রীয় রায়চৌধুরী পরিবারের আটচালা মণ্ডপে। তখন অবশ্য কলকাতা শহরে রূপান্তরিত হয়নি, তবে মণ্ডপটি আরও একটি কারণে ঐতিহাসিক। ওই আটচালা মণ্ডপে বসেই ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুন তারিখে জোব চার্নকের জামাই চার্লস আয়ারের সঙ্গে ‘সুতানুটি’, ‘গোবিন্দপুর’ ও ‘কলকাতা’ গ্রাম তিনটির হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল রায়চৌধুরী বাড়ির তত্কালীন কর্তাদের সঙ্গে । সুতরাং ওনারাই কলকাতার জনক ।
    সুবিমল বসাক : সুতানুটী নামটা এসেছে ওই টেক্সটাইল শিল্পের বাড়বাড়ন্ত থেকে। বাঙালির কলকাতার শ্রী ইংরেজ আসার আগে কিরকম ছিল, সেটা ইংরেজরা যে দিল্লির বাদশাকে ১৬০০০ টাকা দিয়েছিল এই তিনটে গ্রাম সুতানুটী, কলকাতা, গোবিন্দপুরের প্রজাসত্ত্ব কেনার জন্য ১৬৯৮ সালে, তা দেখলে টের পাওয়া যায়। সাবর্ণদের ১৩০০ টাকা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সাবর্ণরা তো দেওয়ার মালিক নয়, মোগল আমলে সমস্ত জমিই বাদশার, লোকে প্রজাসত্ত্ব (রেভেনিউ রাইট) কিনতে পারে কেবল, তো কলকাতার সেই প্রজাসত্ত্ব কিনতে বাদশার ফরমান আনতে হয়েছিল। এঁদো জমির জন্য কে ১৬০০০ টাকা দেয়? কলকাতা যদি গণ্ডগ্রাম হত, সেযুগে এই পরিমাণ টাকার ঝুলি হাতে নিয়ে বাদশার দ্বারস্থ হত না ইংরেজ।ব্রিটিশদের আসার আগে সুতানুটি অঞ্চলের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বণিক পরিবার ছিলুম আমরা বসাকেরা। আমরা ছিলুম সুতানুটি বাজারে প্রধান বস্ত্রব্যবসায়ী। ব্রিটিশদের আসার পর আমাদের পরিবারের  সমৃদ্ধি ঘটেছিল। আমার পূর্বপুরুষ শোভারাম বসাক (১৬৯০-১৭৭৩)   কোটিপতি ব্যবসায়ী ছিলেন আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বস্ত্র সরবরাহ করতেন। গোবিন্দপুর দুর্গনির্মাণের জন্য ধ্বংস করা হলে বসাকরা উত্তর সুতানুটি হাট (বর্তমান বড়বাজার) অঞ্চলে সরে যায় । পরে মাড়োয়ারিরা আসার ফলে  বসাকেরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সুতানুটি হাটের নামও পরে বদলে  বড়বাজার হয়।  শোভারাম বসাকের উত্তরসূরি রাধাকৃষ্ণ বসাক (মৃত্যু ১৮১১) বেঙ্গল ব্যাংকের দেওয়ান হয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শহরের প্রধান ব্যবসায়িক পরিবারগুলি নগরাঞ্চলীয় সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। শোভারাম বসাক তার উত্তরসূরিদের জন্য সাঁইত্রিশটি বাড়ি রেখে গিয়েছিলেন। রাধাকৃষ্ণ বসাক কেবল বড়বাজারেই রেখে যান ষোলোটি বাড়ি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলকাতার বিকাশ শুরু হলে  বসাকদেরও পতন শুরু হয়।  বসাকদের সঙ্গে সঙ্গে সুতানুটিও কলকাতায় বিলীন হয়ে যায়।  ১৬৯০ সালে সুতানুটিতেই জব চার্ণক প্রথম এসেছিল। এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র কলকাতা শহরটিই বিকশিত হয়ে ওঠেনি, বরং ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূচনায় এখানেই ঘটেছিল। আদি কলকাতার ব্ল্যাক টাউন তথা কলকাতার সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর সুতানুটি আজও কলকাতার ইতিহাস সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের কাছে এক পরম আগ্রহের বিষয়। সুতরাং কলকাতার জনক আমরা, জোব চার্ণকের আগে থেকে যারা এখানে ছিলুম ।
    কংস নারায়ণ : ১৬ শতকে  বাংলার নবাব দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিল। বাংলা তখন স্বাধীন নবাবের হাতে। পরাক্রান্ত মুঘলদের আটকাতে তাঁরা তৈরি করলেন একশ্রেণীর হিন্দু জনশক্তি। তাঁদেরই একজন ছিলুম আমি ।আমি  নবাবদের সাহায্য নিয়েছিলুম।  নবাবী আমলে কিন্তু দুর্গাপূজা কখনও বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, অবিভক্ত বাংলার  প্রথম দুর্গা পুজোর উদ্বোধন আমি করেছিলুম । তা থেকে প্রমাণ হয় যে ষোড়শ শতকে আমি তখনকার গৌড়ের সুলতানদের কাছ থেকে প্রভূত অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সাহায্য পেতুম। সুতরাং আমার দুর্গাপূজা স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু্–মুসলমানের উৎসব হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল ইংরেজদের বাণিয়া শক্তি। যে যে হিন্দুদের হাতে অর্থ ছিল, তাঁদের হাতে কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। তাই তাঁরা গোপনে লর্ড ক্লাইভকে সাহায্য করতে শুরু করলেন। এদের পূর্বভাগে ছিলেন কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের শোচনীয় পরাজয়ের পর খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলার রাজনৈতিক শক্তির পুনর্বিন্যাস ঘটে। রাজতন্ত্র থেকে বাংলার ক্ষমতা এক লাফে চলে যায় বাণিয়াদের হাতে। সেই সময়ে কিন্তু ইংরেজরা সরাসরি ভারতে প্রবেশ করেনি। প্রবেশ করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি। আর সেই কম্পানির দৌলতে ইংরেজদের ঘাঁটি হয় কলকাতায়। ফলে তাদের সৌজন্যে কলকাতায় তৈরি হল একশ্রেণীর উচ্চবিত্ত রাজমহল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম শোভাবাজার রাজবাড়ি রাজা নবকৃষ্ণ দেব। নবকৃষ্ণ কলকাতায়  ইংরেজ শক্তিকে তেল মারার জন্য বারোয়ারি দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করেচিল। ইংরেজরা শুধু যোগদানই করেনি, রীতিমতো সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল  ছোটলাট ও বড়লাট। আমি ইংরেজদের তেল মারার জন্য দুর্গাপুজো করতুম না ।
    হাইনরিখ লুশকভ : আমার আসল নাম সৈয়দ মীর জাফর আলী খান  । আমি  ইরানি বংশোদ্ভূত। আমার বাবার নাম সৈয়দ আহমেদ নাজাফি। আমি বাবা-মা র দ্বিতীয় ছেলে। ইরান থেকে একদম নিঃস্ব হয়ে  বাংলায় এসেছিলুম ভাগ্যান্বেষণে। এখানে এসে বিহারের নায়েব আলীবর্দী খানের অধীনে চাকরি শুরু করি। অনেকেই জানেন না ইরানি ভাষায় খুব সুন্দর গান গাইতে পারতুম আমি । কিন্তু আমি ভালো বাংলা বলতে পারতুম না বলে আলীবর্দী খান নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে সিরাজউদ্দৌলাকে বেছে নেন । পলাশির যুদ্ধে আমি সেই অবহেলার বদলা নিয়েছিলুম ।
    মীর কাসেম আলী খান : মীর জাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে আমি  ক্ষমতা দখল করেছিলুম। পরে ইংরেজদের সাথে আমার বিরোধ বাধে আর বকসারের যুদ্ধে হেরে যাই ।  ইংরেজদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতুম । অচেনা অবস্থায় দিল্লীতে মারা গিয়েছিলুম । আমার মাথার কাছে পড়ে থাকা একটা পোঁটলায় পাওয়া যায় নবাব মীর কাসেম হিসেবে ব্যবহৃত আমার চাপকান। তা  থেকে লোকে জানতে পারে শবটা বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীর কাসেম আলী খান। জানি না আমার কবর কোথায় । তবে আমিই কলকাতার জনক, কেননা আসল কলকাঠি তো আমিই নেড়েছিলুম ।
    ঘনাদা : ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ট্রায়াল অব মহারাজা নন্দকুমার’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, মিডলটনের পত্রালাপ দাখিল করা হলে ওয়ারেন হেস্টিংস ঘুষ নেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হতো। ওয়ারেন হেস্টিংস, তার বন্ধু ইলাইজা ইম্পের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ বের করেছিল। মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি ওয়ারেন হেস্টিংসের জীবন ও কর্মকাল এবং কোলকাতার একটি বিতর্কিত অধ্যায়।মাত্র ২৩ বছর বয়সে সিরাজউদ্দৌলা ১৫ এপ্রিল ১৭৫৬ সালে নবাবী লাভ করেন। তার নবাবীর সময়কাল ছিল মাত্র ১ বছর ২ মাস ৮ দিন অর্থাৎ ৪৩৪ দিন। এ সময়ের মধ্যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা দু’দুবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে কলকাতা অভিযানে স্বয়ং নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ইংরেজদের পরাজিত করেছেন। পূর্ণিয়ার যুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করেছেন। প্রধান সেনাপতি মীর জাফর, সেনাপতি রাজা দুর্লভরাম, উমিচাঁদ, রাজা রায়বল্লভ, ইয়ার লতিফ, জগৎ শেঠ, ঘসেটি বেগম, ইংরেজ সেনাপতি ওয়াটসন, ওয়াটস, ক্লাইভ প্রমুখ সিরাজউদ্দৌলার নবাবীর প্রথম দিন থেকে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে বিশ্বাসঘাতকতা, রাজদ্রোহ ও দেশদ্রোহিতায় লিপ্ত থেকে নবাবকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। তাতে একদিনের জন্য তরুণ নবাবের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো আরাম-আয়েশ ভোগ-বিলাসের সময়-সুযোগ ছিল না। সিরাজউদ্দৌলাই প্রকৃতপক্ষে কলকাতার জনক । 
    খান আবদুল হাদি :আলিবর্দীর শাসনকালের শেষ দিকে স্বার্থান্বেষী মহল কীভাবে গোটা শাসনতন্ত্রকে নিজেদের হাতের মুঠোয় পুরতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল, সে সম্পর্কে সিরাজকে আমি বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলুম। সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে মীরজাফর আর খাদিম হুসেন খানের একটা বড় অঙ্কের টাকা পকেটস্থ করার বিষয়টা হাতেনাতে ধরিয়ে দিয়েছিলুম। বস্তুত এই ঘটনাবলী জানার ফলে সিরাজের ভেতরে যে অগ্নিবর্ষী একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল হয়ে উঠেছিল, তা কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল। তাই তারা সিরাজকে দুর্বিনীত, চরিত্রহীন ইত্যাদি নানা অভিধায় অভিহিত করে পলাশী যুদ্ধের পটভূমিকা নির্মাণের কাজটি বেশ জোরদারভাবেই করতে শুরু করে দিয়েছিল। সিরাজই কলকাতার জনক ।
    মীর মদন : পলাশীর আমবাগানে আমি আর মোহনলাল  দুই সেনাপতি মিলে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পক্ষে আমৃত্যু লড়াই করেছিলুম। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে অন্য বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিরা নিশ্চেষ্ট থাকলেও আমরা দুজনে ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণ করি।  প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেয়। মীর জাফর, ইয়ার লতিফ খান, রায় দুর্লভ প্রমুখ নিস্পৃহ থাকলেও আমার গোলন্দাজ বাহিনীর প্রতাপে ইংরেজ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে নবাব বাহিনীর গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও আমি আর মোহনলাল ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলুম। কিন্তু প্রধান সেনাপতি মীর জাফর সিরাজকে বোঝালো যুদ্ধ বন্ধ রাখতে। যুদ্ধ চলার সময়ে গোলার আঘাতে আমি মারা যাই । আমার অনুগত কিছু সৈনিক আমার মৃতদেহকে গোপনে মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের কাছে ভাগীরথী নদী তীরবর্তী ফরিদপুর গ্রামে কবর দে। এখনও ফরিদপুরে ফরিদ খানের সমাধির পাশে অবহেলায় সমাধিস্থ রয়েছি। এছাড়াও পলাশীর স্মৃতিসৌধের কাছে চাষজমির ভেতরে তিনটি অনুচ্চ স্মারক আছে, যা মীর মদন, নৌবে সিং হাজারি আর বাহাদুর খানের স্মৃতিতে তৈরি। পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রের আমবাগান আর নেই । একসময় প্রচুর আমগাছ ছিল। তা ছিল রানি ভবানীর আমবাগান । এখন রাস্তা হয়েছে।  এখানে সমাধিস্থ করা হয় নবাবের আরও দুই বীর কমান্ডার বাহাদুর আলী খান আর ক্যাপ্টেন নৌবে সিং হাজারিকে। বন্দুকধারী ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন বাহাদুর আলী খান। আর গোলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন নৌবে সিং হাজারি। যুদ্ধের পরপরই এখানে গোপনে তাঁদের সমাধিস্থ করা হয়েছিল। সমাধিস্থলে যাওয়ার কোনো পাকা রাস্তা নেই। পাটখেতের আল ধরে যেতে হয়।
    মোহনলাল : ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের সময় আমি সিরাজের প্রতি অবিচল বিশ্বস্ততায় যুদ্ধ করেছিলুম। যুদ্ধক্ষেত্রে মীর মদনের মৃত্যুর পরেও আমার একক চেষ্টায় যুদ্ধের গতি সিরাজের অনুকূলে ছিল। কিন্তু নিজ অদূরদর্শিতা ও মানসিক দুর্বলতার কারণে সিরাজ,  মীর জাফর প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকদের প্রভাবে যুদ্ধ বন্ধ রাখার আদেশ দেন। ফলত: নবাব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও শোচনীয় পরাজয় ঘটে। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাইনি।  যুদ্ধে আহত হই আর যখন জানতে পারি যে মীর জাফর আমাকে খুন করার জন্য তল্লাশি চালাচ্ছে, তখন গা ঢাকা দিই। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে আমার বড় ছেলে, পূর্নিয়ার নায়েব নাজিম, শ্রীমন্ত লালকে মীর মিরন খুন করেছিল। ছোট ছেলে হুক্কা লাল পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল। আমার বোন ছিল সিরাজের প্রণয়িনী আর আমি তাদের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ময়মনসিংহে চলে যাই। তারপর আমার অজ্ঞাতবাস পর্বের নানা কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে বাংলায় । আমাকে একটি কলঙ্কিত চরিত্র হিসেবেই ব্রিটিশরা তুলে ধরেছিল। অথচ আমি পলাশীর যুদ্ধে সমস্ত রকমের বিরুদ্ধাচরণকে অস্বীকার করে যেভাবে দেশের হয়ে লড়েছিলুম, সে সম্পর্কে ইতিহাস প্রায় নীরব। সিরাজের কলকাতা অভিযানকালেও (১৭৫৬) আমি যে দক্ষতা আর অসমসাহসের পরিচয় রেখেছিলুম, সেই ইতিহাসও বাঙালির কাছে তুলে ধরা হয় না। পূর্ণিয়া অভিযান এবং পূর্ণিয়ার শাসনব্যবস্থার খোলনলচে বদলাতে আমার ঐতিহাসিক অবদানের কথা ব্রিটিশরা চেপে গেছে। পলাশীর পরিপ্রেক্ষিত রচনার ক্ষেত্রে চন্দননগরকে ঘিরে ফরাসি এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির টানাপোড়েনে সিরাজকে সঠিক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে আমার আর মীরমদনদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সঠিক। ফলে জগৎ শেঠদের  মতো লোকেরা ভালোভাবেই বুঝতে পারছিল যে সিরাজ কোনো অবস্থাতেই তাদের হাতের পুতুল হবেন না। জগৎ শেঠের সঙ্গে আমার সংঘাতের স্বরূপটা বেশ ভালোভাবেই বুঝেছিল মীর জাফর। 
    শওকত জঙ্গ : আমি হলুম বাংলার নবাব আলীবর্দী খান-এর নাতি আর সিরাজউদ্দৌলার পিসতুতো ভাই।আলীবর্দী খানের ছিল তিন মেয়ে। তিন মেয়েকেই উনি নিজের বড়ভাই হাজি আহমদ-এর তিন ছেলে, নোয়াজেশ মোহাম্মদের সাথে বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের, সৈয়দ আহমদ খান সওলত জং সাথে মেজ মেয়ে মায়মুনা বেগমের আর জয়েনউদ্দিন আহম্মদের সাথে ছোট মেয়ে আমেনা বেগমের বিয়ে দেন। তিনি ছিলেন আলীবর্দী খানের মেজ মেয়ে মায়মুনা বেগমের সন্তান। আমিও চেষ্টা করেছিলুম সিরাজকে সরিয়ে সিংহাসনে বসতে । অথচ পলাশীর পর কেউ আমাকে পাত্তা দিল না । 
    শশী ঘোষ : কলকাতা বিশ্বের সব থেকে পুরনো শহরের মধ্যে অন্যতম। এমন একটা শহর যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ইতিহাস। এই ইতিহাসে রয়েছে যেমন ভালবাসা ঠিক তেমনি রয়েছে রোমাঞ্চ। ধরুন আপনার কাছে একটা টাইম ট্রাভেল মেশিন আর সেই টাইম ট্রাভেলে করে এসে পৌঁছালেন পুরনো শহরে। কলকাতায় তখন ব্রিটিশ রাজ। আপনার জানার মধ্যে শুধু ধর্মতলা আর স্রেফ কয়েকটা জায়গার নাম। বাকি অংশ শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। ধর্মতলা থেকে রাজভবন হয়ে এগোতে শুরু করলেন অফিসপাড়ার দিকে। এই জায়গা তখন শুধু নির্জন রাজপথ। কলকাতার ওয়েলেসলি প্লেস থেকে কাউন্সিল হাউজ পর্যন্ত এই রাস্তাটিকে তখন বলা হত ‘ফ্যান্সি লেন’।মনে হতেই পারে ব্রিটিশ আমলের কোনও ইংরেজের শখ বা শৌখিনতার সঙ্গে এর নিশ্চয় রাস্তার সম্পর্ক আছে। যার জন্যে এর নাম হয়েছে ‘ফ্যান্সি লেন’। তবে বলে রাখি আপনার এই মনে হওয়াটা একদমই ভুল। ইংরেজী শব্দ ফ্যান্সির সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।এই ‘ফ্যান্সি’ কথাটা এসেছে ‘ফাঁসি’ শব্দ থেকে। আঁতকে উঠলেন বুঝি! ফাঁসি। তাও প্রকাশ্য দিবালোকে। ভরা রাস্তার উপর। জনসাধারণের চোখের সামনে। বীভৎস এই ঘটনার সাক্ষী থেকেছে শহর কলকাতা! সাহেবি উচ্চারণে ‘ফাঁসি’টা হয়ে গিয়েছে ফ্যান্সি, ফলে গোটা মানেটাই ঘেঁটে ঘ ! ঐতিহাসিকরা বলছেন, ইংরেজি ‘ফ্যান্সি’ (Phancy) শব্দটি যে ‘শৌখিন’ অর্থে ব্যবহৃত হয়, এই রাস্তার নামের মানে মোটেই তা নয়। কলকাতার অন্যতম পুরনো রাস্তা এটি, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু ঘটনা। একটা সময় এর পাশ দিয়ে একটা খাল বা ‘ক্রিক’ প্রবাহিত হত বলে জানা যায়। এখন অবশ্য সেটি মুছে গেছে। আর্চডিকন হাইড তাঁর ‘প্যারোকিয়াল অ্যানালস’ এবং ‘পেরিশ অব বেঙ্গল’ বই দুটিতে সেই বর্ণনা দিয়ে গেছেন— “The creek took a half turn round this battery and kept Eastwards beneath three gated bridges, until the fences turned downwards from it at Fancy Lane.” তখন খুব বেশি দিন হয়নি ইংরেজরা কলকাতায় এসেছে। জোব চার্নক তখনও জীবিত। ডালহাউসির কাছে এখন যেখানে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট, বিলিতি আমলে একেবারেই লালদিঘির প্রায় গা-ঘেঁষা সাহেবপাড়া। গোটা জায়গাটাই ছিল জঙ্গল। লোকজন তখন এই ধারে তেমন ঘেঁষতে সাহস পেত না। লোকজন বিশেষ ছিল না বললেই চলে।চারপাশে শুধু অজস্র গাছ, আর তাঁতে লুকিয়ে থাকতো চোর-ডাকাত। সে অন্য যুগ। অন্য জগৎ। জব চার্নকের কলকাতায় তখন নতুন রাজত্ব। সাহেবদের শৌখিনতা তখন গরিব লোকদের ফাঁসি দেওয়া। অপরাধ তখন যাই থাকুক না কেন একটাই শাস্তি ফাঁসি। ১৮০০ সালের কথা। ঢেঁড়া পিটিয়ে বেড়াচ্ছে কম্পানির লোক। কী, না ব্রজমোহনের ফাঁসী হবে। ব্রজমোহনের অপরাধ একটা মুল্যবান ঘড়ি সে চুরি করেছে। যার দাম ২৫টাকা। সে ফাঁসি হবে প্রকাশ্য স্থানে কোনও চৌমাথায়। বহু লোকের সামনে। চারদিকে থেকে পিল পিল করে লোক আসছে। ফাঁসি দেখবে। আজকের ওয়েলেসলি প্লেসে তখন অনেক বড় বড় গাছ ছিল। সেখানেই বসলো মেলা। রাস্তার মোড়ে একটি গাছের কাছে তৈরি করা হয় ফাঁসির মঞ্চ। ফাঁসি হল। সবাই ইংরেজদের এই ন্যায়পরায়ণতা দেখে ধন্যি ধন্যি করল। সেই সময় থেকেই রাস্তার মাঝখানেই এইভাবে ফাঁসি দেওয়া আরম্ভ হল। অত্যন্ত লঘু অপরাধেও অনেক সময় ফাঁসি দেওয়া হত। রাস্তার ধার ঘেঁষে সার সার ঝুলে থাকত দেহ। ফাঁসি দেওয়া রাস্তাটির নামই পরবর্তীকালে হয়ে যায় ‘ফ্যান্সি লেন’ যা বর্তমান পান্নালাল রোড। ইংরেজদের মুখে মুখে ‘ফাঁসি’ শব্দটাই বদলে হয়ে গিয়েছিল ‘ফ্যান্সি’। সেই থেকেই এই নাম। পুরনো কলকাতা নিয়ে লেখায় শ্রীপান্থ বলছেন, মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি দেখে সবাই ফিরেছিলেন গঙ্গাস্নান করে।কারণ নন্দকুমার ছিলেন ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মহত্যা দেখার মহাপাপ ধুয়ে ফেলতে গঙ্গাস্নানই ছিল সামাজিক বিধান। তবে সাধারণ অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট যে রাস্তা ছিল, সেখানে মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয়নি। গলিটিতেই এখন রয়েছে রাজভবনের স্টাফ কোয়ার্টার্স। আর কিছু অফিস ও দু’একটি দোকান। এবং ব্রিটিশ আমলের চিহ্ন নিয়ে ভেঙে-পড়া পুরোনো বাড়ি। পুরনো কলকাতার এই ভয়ঙ্কর ইতিহাস অনেকেরই হয়তো অজানা। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে নন্দকুমার ছিলেন কলকাতার জনক ।
    সুপ্রীতি বর্মণ : কলকাতা শহরকে ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে ১৭৫৬ সালের জুন মাসে সিরাজ অতর্কিতে কলকাতা আক্রমণ করেন। ইতিমধ্যে কোম্পানি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছিল। ২০ জুনের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার পতন ঘটে। ফলে ভারতীয়রা শহরের দখল নেন।এরপর সেনাপতি মানিকচাঁদের হাতে দুর্গের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা রাজধানীতে ফিরে আসেন, ১২ জুলাই । কলকাতার নতুন নাম দেন – আলিনগর । এই নামটার একটা ধারা মেনেই – বর্তমান কলকাতার একটা অংশের নাম – আলিপুর ।
    আলীবর্দী খান : ১৭৫৬ সালে কলকাতায় দুর্গনির্মাণে বিরক্ত হয়ে আমার নাতি নবাব সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা আক্রমণ করেছিল। কলকাতা অধিকারের পর সিরাজ এই শহরের নাম বদল করে আমার নামানুসারে ‘আলিনগর’ রেখেছিল । ১৭৫৮ সালে ইংরেজরা কলকাতা পুনরুদ্ধার করলে পুরোনো নামটা আবার বহাল হয়। তবে সিরাজের কলকাতা দখল ছিল ইংরেজদের কাছে এক দুঃস্বপ্নের সময়। এই যুদ্ধে গোবিন্দপুর, সুতানুটি, কলকাতা ও চিৎপুরের মধ্যে কেবলমাত্র ‘হোয়াইট টাউন’ নামে পরিচিত কলকাতা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ‘ব্ল্যাক টাউন’ খুব একটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। কেবল বড়োবাজারে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল আর ইংরেজরা গোবিন্দপুর গ্রামটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। হুগলি নদীর চল্লিশ কিলোমিটার ভাটিতে ফলতায় ইংরেজরা পালিয়ে যায়। আলিনগর নাম থেকে প্রমাণিত যে আমিই কলকাতার জনক । 
    মহারাজা নন্দকুমার : পলাশীর ষড়যন্ত্রের পর নন্দকুমারকে মীর জাফর দেওয়ান নিযুক্ত করে সব সময় তাকে নিজের কাছে রাখতেন। নন্দকুমার ভূষিত ছিল মহারাজা উপাধীতে। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস এর সাজানো মিথ্যা মামলায় আসামীর কাঠগড়ায় তার বিচার হয়। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস তাকে শেষ পর্যন্ত এই বিচারের রায়ে শেওড়াগাছে ঝুলতে হয় ফাঁসী কাষ্ঠে। মহারাজ নন্দকুমারের সাথে মীর জাফরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মীর জাফর তার শেষ জীবনে যাবতীয় কাজ কর্ম নন্দকুমারের পরামর্শনুসারে করতেন। তার অন্তিম শয্যায় নন্দকুমারই তার মুখে কিরীটেশ্বরী দেবীর চরণামৃত তুলে দিয়েছিলেন।
    ধিরুভাই অম্বানি : বাঙালি বাড়ির বউরা আমার বউয়ের মতন হলে আজ পশ্চিমবাংলা অনেক ধনী রাজ্য হতো । একটা উদাহরণ দিই । দ্বারকানাথের ইংরেজ-সংসর্গ তাঁর মা বা স্ত্রী কেউই ভাল চোখে দেখেননি। দ্বারকানাথ এ ব্যাপারে স্ত্রীর মতামত অগ্রাহ্য করলে দিগম্বরী স্বামীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতেও ইতি টানেন। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে, দিগম্বরী হিন্দু পণ্ডিতদের ডেকে ম্লেচ্ছদের সঙ্গে একত্রে পানভোজন করা স্বামীর বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদের বিধানও চেয়েছিলেন। পণ্ডিতেরা নিদান দেন, ‘স্বামীকে ভক্তি ও তাঁহার সেবা অবশ্য কর্তব্য, তবে তাঁহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য্য অকর্তব্য।’ স্ত্রীর সাংসারিক দায়িত্বটুকু পালন করা ছাড়া দিগম্বরী স্বামীর সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখেননি। কাজের সূত্রে দ্বারকানাথের সঙ্গে যত বার কথা বলতে হত, তত বারই নাকি তিনি গঙ্গাজলে চান করতেন, এমন কথাও শোনা যায়। সুতরাং দ্বারকানাথই কলকাতার জনক।
    জয়িতা ভট্টাচার্য : কলকাতায় ইংরেজরা তাদের বসতির বাইরে দুর্গপ্রাচীরের মতো প্রতিরক্ষা বেষ্টনী তৈরির চেষ্টা নিলে নবাবের নির্দেশে তা ধ্বংস করা হয়। একইভাবে ফরাসিরা প্রাচীর নির্মাণ করলেও তারা নবাবকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, এটা কোনো দুর্গ না, বরং স্থাপত্যিক কাঠামোর সংস্কার করা হচ্ছে মাত্র। নবাব ফরাসিদের কথা বিশ্বাস করলেও ইংরেজদের বিশ্বাস করতে চাননি। ফলে ফরাসিরা তাদের দুর্গপ্রাচীর টিকিয়ে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করা হয় ইংরেজদের দুর্গ। তবে এখানকার মূল বাস্তবতা হচ্ছে, ইংরেজরা যে দুর্গপ্রাচীর নির্মাণ করেছে, সেটা যতটা না নবাবের বিরুদ্ধে যায়, তার চেয়ে ঢের ফরাসিদের প্রতিরোধে কার্যকর হতো। এক্ষেত্রে তার খালা ঘষেটি বেগমের চক্রান্ত করার সুযোগ হয়ে যায়। পাশাপাশি কুশলী ইংরেজ গভর্নর রজার ডেরেক পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইলেন। সব মিলিয়ে যুবক সিরাজদ্দৌলার পক্ষে এ ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনায় উপযুক্ত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়নি। ক্ষিপ্ত সিরাজদ্দৌলা এবার প্রতিটি ক্ষেত্রে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করে কলকাতার দিকে অগ্রসর হন। ইংরেজরা প্রথম থেকেই নবাবকে প্রতিরোধ করার মতো সাহস রেখেছিল; কিন্তু তাদের সামরিক ছাউনিতে উপযুক্ত সংখ্যায় সৈন্য ছিল না। এতে তাদের মনে ত্রাস সৃষ্টি হয়। তাই তারা নবাবের বাহিনীর আগমন বুঝতে পেরে কুঠি ত্যাগ করে। গভর্নর ডেরেক সপরিবারে চেপে বসেন একটি জাহাজে। এর পর পুরো কুঠি নবাবের আনুকূল্যে চলে যায়। আর কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যার গাঁজাখুরি গল্প ফাঁদা  হয় ঠিক এর পর পরই। কলকাতার পতন হলে ভারতে অবস্থানরত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসেন। দীর্ঘ বৈঠকের পর কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ছয় সপ্তাহের প্রস্তুতি চলে সেন্ট ডেভিড দুর্গে। 
    বাহাদুর শাহ জাফর : মূলত জোব চার্ণকের সহস্র দোষ ছিল এবং সুতানুটিতে যখন সে  ১৬৯০ সালে পৌঁছেছিল  তার তিনবছর পরই সে যৌনরোগের কারণে দেহত্যাগ করে তাই কখনই তাঁকে কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠাতা বলা সম্ভব নয়। এরপর ১৬৯৬সালে চার্লস আয়ার(জোব চার্ণকের জামাই) কলিকাতা কুঠীর এজেন্ট হিসাবে নিযুক্ত হয়। সেই সময় চার্লস আয়ার চক্রান্ত করে আওরঙজেবের পৌত্র পাটনা-নিবাসী আজিম উস শানের থেকে একটা সনদ নিয়ে আসে। এই সনদটি আনবার জন্য আজিম উস শানকে ষোল হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছিল কোম্পানি । তাতে লেখা থাকে যে বাংলার সকল জমিদারদের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু সাবর্ণরা এই আদেশপত্রে সাক্ষর করতে রাজি ছিলেন না তবুও সম্রাটের আদেশ মতন বড়িশার আটচালায় চার্লস আয়ারের সাথে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের প্রজাসত্ত্ব হস্তান্তরিত হয় বার্ষিক ১৩০০টাকা খাজনার বিনিময়ে। এই খাজনা ব্রিটিশ কোম্পানি ১৭৫৭ সাল অবধি সাবর্ণদের দিতো । সুতরাং কলকাতা কখনই বিক্রি করে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় বড় বর ইমারত তৈরি হলেও প্রথম ইমারতটি তৈরি হয়েছিল জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীদের আমলেই। সুতরাং সাবর্ণরা প্রজাসত্ত্ব হস্তান্তরিত করেছিল, জমিদারিসত্ত্ব নয়। এই প্রজাসত্ত্ব ছিল বাদশাহের অধীনস্থ তালুকদারের অধিকার। কেন না, অন্যান্য জায়গীরের মতন সুতানুটি, কলিকাতা এবং গোবিন্দপুরের জমিদারিসত্ত্ব বিক্রি করার অধিকার সাবর্ণদের ছিল না। সুতরাং এতদিন যারা এই বিক্রি করার গল্প সাজিয়েছেন তারা নিতান্তই ব্রিটিশ তোষণের জন্যই করেছেন এর কোন বাস্তবিক ভিত্তি নেই। সুতরাং কলকাতার জনক আজিম উস শান ।
    মীর মোহাম্মদ আলী খান : লোকে আমাকে মীরণ নামে এক ডাকে চেনে । আমি পলাশী ষড়যন্ত্রের পরবর্তী ঘটনাগুলোর প্রধানতম নায়ক। আমিই সিরাজের মূল হত্যাকারী, সিরাজের মাতা আমেনা বেগম, সিরাজের ভাই মির্জা মেহেদীকেও নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছিলুম । আমারই নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ সিরাজকে খুন করে। শুধু খুন  নয় ; সিরাজউদ্দৌলার লাশকে আমি ক্ষত বিক্ষত করে তারই প্রিয় হাতির পিঠে  বেঁধে গোটা মুর্শিদাবাদ শহর ঘুরিয়েছিলুম যাতে সবাই এই বীভৎস দৃশ্য দেখে যেনো পরবর্তীতে বাংলার বুকে বিদ্রোহ করতে না পারে।  সিরাজের মা আমেনা বেগম তার ছেলের লাশ দেখার জন্য দৌড়ে হাতির কাছে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান আর সে’সময় মীরণের স্যাঙাতরা সিরাজের মাকে কিল, চড় ও ঘুষি মেরে আবার জেলখানায় বন্দী করে রাখে। হাতিটা কিন্তু সে সময় সিরাজের লাশ তার পিঠে নিয়ে আমেনা বেগমের সামনে বসে পড়ে। আমার মৃত্যু ঘটে বজ্রপাতে। মীর জাফর তখনও বাংলার নবাব। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই পিতার কানে সে সংবাদ পৌঁছেছিল। তিনি মীরণের মৃত্যু শুনে বেঁহুশ হয়ে পড়েন। মুর্শিদাবাদে মীরণের লাশ, নিয়ে আসা হলো। কি বীভৎস বিকৃত পোড়ালাশ। পিতাকে না দেখতে দিয়ে লাশ দাফন করা হলো। এভাবেই মীরণের মৃত্যু। এটা আর কিছুই নয় আসল ঘটনাকে চাপা দেওয়ার একটা কৌশল মাত্র। মীরণকে খুন করে ইংরেজদের নির্দেশে মেজর ওয়ালস্। তবে  এই ঘটনাটা ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইংরেজরা বজ্রপাতে মীরণের মৃত্যুর মিথ্যা গল্প বানিয়েছিল।
     মোহাম্মদী বেগ : আমি ছিলুম নবাব আলীবর্দী খাঁর খাস চাকর। আলীবর্দী খাঁর আমল থেকেই তাঁর পরিবারের একজন সদস্যরূপে তাঁরই স্নেহছায়ায় আমি বেড়ে উঠি। সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গেও আমার বিশেষ সখ্যতা ছিল। সিরাজউদ্দৌলাকে মীরণের নির্দেশে হত্যা করেছিলুম আমি । আমি একটা খঞ্জর দিয়ে আঘাত করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলুম। দিনটি ছিল ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ৩’রা জুলাই। নবাব সিরাজ এ সময় আমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি । তিনি কেবল আমার কাছ থেকে দু’রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। বলাবাহুল্য  সিরাজের সেই অন্তিম ইচ্ছাও প্রত্যাখ্যান করেছিলুম।  সংসারের দাম্পত্য কলহে বদ্ধ উম্মাদ হয়ে গিয়েছিলুম আর একদিন কুঁয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করি। 
     ইয়ার লতিফ খান : আমি ছিলুম নবাব সিরাজের একজন সেনাপতি।  পলাশী ষড়যন্ত্রের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলুম। পলাশীর যুদ্ধের মাঠে আমার সেনারা মীর জাফর, রায় দুর্লভের বাহিনীর মতন কাঠের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধের পরে বখরা দেবার ভয়ে ইংরেজরা আমাকে খুন করে লাশ লোপাট করে দিয়েছিল ।
    মেহের উন নিসা বেগম : লোকে আমাকে ঘসেটি বেগম নামেই বেশি চেনে । আমি  নবাব আলীবর্দী খানের বড় মেয়ে। বিয়ে হয়েছিল নওয়াজিস মুহম্মদ শাহমাত জং-এর সাথে  যিনি  ঢাকার নায়েব নাজিম নিযুক্ত হয়েছিলেন। নিঃসন্তান হওয়ায় আমি আর আমার স্বামী সিরাজউদ্দৌলার ছোটো ভাই ইকরামউদ্দৌলাকে দত্তক নিয়েছিলুম। কিন্তু ইকরামউদ্দৌলা তরুণ বয়সে গুটিবসন্তে মারা যায়।  নওয়াজশ মুহম্মদ দুঃখে মারা যান। আমি উত্তরাধিকার সূত্রে  স্বামীর  প্রচুর সম্পদ পেয়েছিলুম । নবাব আলীবর্দী খান মারা যাবার পরে, আমি চেষ্টা করছিলুম দ্বিতীয় বোন মায়মুনা বেগমের ছেলে শওকত জংকে সিংহাসনে বসানোর। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসতে করতে সমর্থ হয়। শেষে, তিনি আলীবর্দী খানের সেনাপতি মীর জাফর, ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ আর উমিচাঁদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র করি। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা হেরে যাবার পর ইংরেজরা মীর জাফরকে নবাব বানায়।মীর জাফর, আমাকে ঢাকার জিনজিরা প্রাসেদে বন্দি করে রেখে ডিয়েছিল। কিন্তু আমাকে বিপদজনক শত্রু মনে করে, মীর জাফরের ছেলে  মীরন আমাকে ১৭৬০ সালে মুর্শিদাবাদ ফেরত নিয়ে আসার আদেশ দেয়। , মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে আমাদের নৌকো খরস্রোতা বুড়ীগঙ্গা নদীতে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক আমাকে নৌকায় তুলে বুড়ীগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে মেরে ফেলে। আমার আর্তনাদ আহাজারী নদীর কিনার থেকে নিশুতি রাতে পথচারীরা শুনতে পেয়েছিল।
    ওয়াটস : আমি কোম্পানির একজন আমলা । পলাশীর যুদ্ধে  ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল আমার। আমি পাল্কীতে করে বউ  সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে চুক্তিতে মীর জাফরের স্বাক্ষর এনেছিলুম। পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানীর কাছ থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় ইংল্যান্ডে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাই।
    প্রদোষচন্দ্র মিত্র : সাম্রাজ্যবাদের পূজারিরা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জোব চার্নককে কলকাতার ‘বাবা’র আসনে বসানোর যত অপচেষ্টাই করুন না কেন, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের এবং ভারতবর্ষের মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করবেনই। প্রসঙ্গত শেষ বার যখন চার্নক সুতানুটিতে এসেছিলেন তখন তিনি বর্তমান বেনেটোলা আর শোভাবাজারের মধ্যবর্তী মোহন টুনির ঘাটে নেমেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। তবে জোব চার্নক কলিকাতা বা গোবিন্দপুরে আসেননি, কারণ তিনি গুপ্তরোগে আক্রান্ত ছিলেন। এবং তাঁর অবস্থা ছিল বড়োই শোচনীয়। প্রায় দু’শো লোক তখন জ্বরে ও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত। তার ওপর তিনিও আক্রান্ত। শেষ বয়সটা সুতানুটিতে কাটিয়ে তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। তা হলে তাঁকে কেন কলকাতার জনক বলা হবে? তা ছাড়া কলকাতা নামের উৎপত্তি বহু প্রাচীন গ্রন্থেই পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের অনুমান, কলকাতা দু’ হাজার বছরের পুরোনো এক জনপদ। ‘আইন-ই-আকবরি’র রাজস্ব আদায়ের খতিয়ানে ‘কলিকাতা’ নামের উল্লেখ আছে। বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসাবিজয়’ কাব্যে (১৪৯৫-৯৬), কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ কলিকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। ওলন্দাজ বণিক ফান ডেন ব্রুক-এর অঙ্কিত মানচিত্রেও কলকাতার উল্লেখ রয়েছে। ‘পদ্মাবতী’র রচনাকাল আনুমানিক ১৬৪৫-৫২ সাল। সেই গ্রন্থেও কলকাতা রয়েছে। তা হলে কখনোই জোব চার্নককে কলকাতার জনক বলা যায় না। তা ছাড়া চার্নক আসার বহু আগে থেকেই কলকাতা ধীরে ধীরে শহরে রূপান্তরিত হতে শুরু করে – পাকাবাড়ি, পাকা রাস্তা, বাণিজ্যনগরীর নানান কাজও শুরু হয়ে যায় চার্নক আসার বহু আগে থেকেই। তাই এ তত্ত্ব কখনোই সমর্থনযোগ্য নয় যে জোব চার্নক কলকাতার জনক ।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 106.215.24.94 | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১১:২৬738358
  • অভিশপ্ত কবিরা – ভেরলেন, রেঁবো, মালার্মে, করবিয়ের প্রমুখ : মলয় রায়চৌধুরী
      ‘পোয়েত মদি’ ( Poète maudit ) বা ‘অভিশপ্ত কবি’ নামে ১৮৮৪ সালে ফরাসি প্রতীকবাদী ও ‘ডেকাডেন্ট’  কবি পল ভেরলেন একটি বই প্রকাশ করেছিলেন । অভিধাটি ১৮৩২ সালে প্রথম ব্যবহার করেন অ্যালফ্রেদ দ্য ভিনি ( Alfred de Vigny ) তাঁর  ‘স্তেলো’ উপন্যাসে ; তিনি বলেছিলেন ‘পোয়েত মদি’ হিসাবে চিহ্ণিত লোকগুলোকে জগতের ক্ষমতাধর মানুষেরা চিরকাল অভিশাপ দেবে।  ত্রিস্তঁ করবিয়ের (Tristan Corbière ) , জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো, স্তেফান মালার্মে, মারসেলিঁ দেবোর্দে-ভামো ( Marceline Desbordes-Valmore ) এবং আগুস্তে ভিলিয়ার্স দ্যলিজলে  আদঁকে ( Auguste Villiers de l’Isle-Adam ) পল ভেরলেন চিহ্ণিত করেছিলেন অভিশপ্ত কবি হিসাবে । এই তালিকায় তিনি নিজেকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন পুভ লেলিয়ান ( Pauvre Lélian ) ছদ্মনামে । উল্লেখ্য যে ১৮৮৪ সালে স্ত্রী মাতিলদে ভেরলেনকে আইনত ডিভোর্স করেছিলেন ।
              পল ভেরলেন তাঁকে ‘অভিশপ্ত কবি’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করার আগে ত্রিস্তঁ করবিয়ের ( ১৮৪৫ – ১৮৭৫ ) ফরাসি আলোচকদের কাছে সম্পূর্ণ অবহেলিত ছিলেন ; বহুকাল পরে এজরা পাউণ্ড ও টি. এস. এলিয়ট তাঁর কবিতা বিশ্লেষণের পর ত্রিস্তঁ করবিয়েরকে কাব্যসাহিত্যে গুরুত্ব দেয়া আরম্ভ হয় । করবিয়েরের মা, মারি-অঞ্জেলিক-আসপাসি পুয়ো’র বয়স যখন উনিশ তখন করবিয়েরের জন্ম হয় । তাঁর বাবা আঁতোয়াঁ-এদুয়া করবিয়ের ‘লে নেগরিয়ের’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন । রাজকীয় উচ্চবিদ্যালয়ে ১৮৫৮ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত পড়ার সময়ে তিনি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন এবং রিউমেটিজমের কারণে হাত-পা বিকৃত হয়ে যায় । বাড়ি থেকে অনেক দূরে স্কুলে দেবার এবং শারীরিক বিকৃতির দরুন তিনি বাবা-মাকে দোষ দিতেন । স্কুলের কড়া নিয়মনীতি ও শিক্ষদের প্রতি ঘৃণা তাঁর কবিতায় একটি বিশেষ কন্ঠস্বর গড়ে দিতে পেরেছে।করবিয়ের মারা যান যক্ষ্মারোগে, মাত্র তিরিশ বছর বয়সে । করবিয়েরের একটি কবিতা :
    বিপরীত কবি
    আরমোরিকার সাগরতীরে । একটি নির্জন মঠ ।
    ভেতরে : বাতাস অভিযোগ করছিল : আরেকটা হাওয়াকল ।
    এলাকার সমস্ত গাধা বীজসুদ্ধ আইভিলতায় তাদের দাঁত ঘষতে এসেছিল
    ফুটোয় ভরা এমনই এক দেয়াল থেকে যা কোনও জীবন্ত মানুষ
    দরোজার ভেতর দিয়ে ঢোকেনি।
    Advertisements
    REPORT THIS AD
    একা— তবু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, ভরসাম্য বজায় রেখে,
    একজন বুড়ির থুতনির মতন ঢেউখেলানো
    তার ছাদ কানের পাশে চোট দিয়েছিল,
    হাবাগবা মানুযের মতন হাঁ করে, মিনারটা দাঁড়িয়েছিল ।
              অভিশপ্ত কবি জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবোর ( ১৮৫৪ – ১৮৯১ ) কবিতার সঙ্গে পাঠকরা পরিচিত ; তাঁর ‘ইল্যুমিনেশানস’ বইটির নামকরণ করেছিলেন পল ভেরলেন । বইটি থেকে ‘শহর’ শিরোনামের গদ্যকবিতা :
    এক মহানগর যাকে এই জন্যে আধুনিক মনে করা হয় যে বাড়িগুলোর বাইরের দিক সাজানোয় আর নগরের পরিকল্পনায় প্রয়োগ করার জন্য পরিচিত উপলব্ধিগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ; তারই  আমি এক ক্ষণজীবী আর তেমন বিচ্ছিন্ন নাগরিক নই । এখানে তুমি কুসংস্কারের একটিও স্মৃতিস্তম্ভের হদিশ পাবে না । সংক্ষেপে, নৈতিকতা আর ভাষাকে সরলতম প্রকাশে নামিয়ে আনা হয়েছে ! লক্ষাধিক এই লোকজন যারা পরস্পরকে জানার প্রয়োজন অনুভব করে না, নিজেদের শিক্ষাদীক্ষা, কর্মকাণ্ড, বার্ধক্যে এতো মিল যে  তাদের আয়ু  মহাদেশের গোলমেলে সংখ্যাতত্ব যা বলেছে তার চেয়েও বেশ  কম । তাই, আমার জানালা দিয়ে, দেখতে পাই নতুন প্রেতরা শাশ্বত ঘন ধোঁয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে — আমাদের বনানীঘেরা ছায়া, আমাদের গ্রীষ্মের রাত ! — প্রতিহিংসর নতুন গ্রিক দেবতারা, আমার কুটিরের সামনে, যা আমার স্বদেশ, আমার সমগ্র হৃদয়, কেননা এখানে সবকিছুরই পরস্পরের সঙ্গে মিল আছে — ক্রন্দনহীন মৃত্যু, আমাদের সক্রিয় কন্যা আর চাকরানি, রাস্তার কাদায় বেপরোয়া ভালোবাসা আর ফালতু অপরাধ ফুঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ।  
     স্তেফান মালার্মে ( ১৮৪২ – ১৮৯৮ )  বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি ‘এ রোল অব ডাইস উইল নেভার মিস এ চান্স’ কবিতাটির টাইপসেটিং সাজানোর ও সেকারণে মর্মার্থের বহুত্বের জন্য পরিচিত হলেও, বর্তমানে খুব বেশি পঠিত নন । বলা যায় যে ‘এ রোল অব ডাইস উইল নেভার মিস এ চান্স’ ইউরোপের কবিতার ধারায় বৈপ্লবিক ঘটনা ছিল; ঘুটির চাল ডিগবাজি খেতে-খেতে এঁকে বেঁকে যেভাবে এগিয়ে যেতে পারে সেইভাবে পঙক্তিগুলো সাজিয়েছিলেন মালার্মে ।কবিতার মধ্যে সহজাত শুদ্ধতা ও পরিপূর্ণতা আনার প্রচেষ্টায়  ভাষাগত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে না পেরে তিনি প্রায়ই উদ্ভাবনী শব্দ বিন্যাস, জটিল উপমা ও পরীক্ষামূলক মুদ্রণবিদ্যা প্রয়োগ করে কবিতা লিখে পাঠকের বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। মালার্মের সাহিত্য চর্চায় সারা জীবনের গোঁ ছিল যে, পাঠকরা প্রতীকের অর্থ বুঝুক । সাহিত্য ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক তুষ্টিকে তিনি অবজ্ঞার চোখে দেখতেন । তাঁর বাড়িতে প্রতি মঙ্গলবার সাহিত্যিকদের আড্ডা বসতো, কিন্তু স্কুলে শিক্ষকতা করার দরুণ তাঁর আর্থিক অবস্হা কোনো দিনই ভালো ছিল না ।স্বাভাবিক যে পাঠকদের মনে হয়েছে তাঁর কবিতার ভেতরে ঢোকা যায় না । এখানে তাঁর ‘কবিতার আবির্ভাব’-এর বাংলায়ন দিচ্ছি
    দু:খি হয়ে পড়ছিল চাঁদ। কাঁদুনে দেবশিশুরা স্বপ্ন দেখছিল।
    শান্ত ও বাষ্পীয় ফুলের তোড়ায় তাদের তীরবাহী আঙুল
    যেন তাদের মরণাপন্ন বেহালার তার বাজছিল
    আর আকাশ-নীল ফুলের পাপড়িতে গড়িয়ে পড়ছিল স্বচ্ছ অশ্রু।
    সে ছিল তোমার প্রথম চুমুর আশীর্বাদ-পাওয়া দিন,
    আর আমি  আমার স্বপ্নের কাছে শহিদ হলুম,
    যা বিষাদের সুগন্ধীর উপর ভর করে বেঁচেছিল,
    এমনকি কোনও পরিতাপ বা দূর্ঘটনা ছাড়াই
    একটি স্বপ্নকে সেই হৃদয়ের কাছে রেখে গিয়েছে
    যে প্রথম স্বপ্নটি তুলেছিল।
    এখানে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম, পাথরে বাঁধানো রাস্তায়
    আমার চোখ নাচছিল।
    যখন তুমি চুলে সূর্যের উচ্ছাস নিয়ে, রাস্তায় আর রাতের বেলায়
    হাসিমুখে  আমার কাছে এসেছো,
    আর আমি ভাবলুম  আলোর টুপি পরা এক পরীকে দেখছি,
    যে আমার ছোটোবেলাকার ঘুমে স্বপ্নে দেখা দিত,
    আর  যার আধখোলা-মুঠো থেকে
    সুগন্ধী নক্ষত্রের দলে ঝরে পড়তো  তুষারপুঞ্জ
    গাছেদের সরু ডালে ।
             মহিলা কবি মার্সেলিন দেবোর্দে-ভামো’’র ( ১৭৮৬ – ১৮৪৯ ) জন্ম রনেঁর দুয়া তে। ফরাসি বিপ্লবের কারণে তাঁর বাবার ব্যবসা নষ্ট হয়ে যায় এবং আর্থিক সাহায্যের জন্য মায়ের সঙ্গে গুয়াদালুপ চলে যান; সেখানে তাঁর মা জনডিসে মারা যান আর ষোলো বছর বয়সী মারসেলিঁকে প্যারিসে ফিরে নাটকের দলে যোগ দিয়ে রোজগারের পথ বেছে নিতে হয় । ১৮১৭ সালে নাটকদলের একজন মামুলি অভিনেতা প্রসপার লাশান্তাঁ-ভামোকে বিয়ে করেন । ১৮১৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্হ ‘এলেজি এবং রোমান্স’ । ১৮২১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ক্রীতদাসদের নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘অ্যান্টিলেসের সন্ধ্যা’ । তাঁর ‘উদ্বেগ’ কবিতার বাংলায়ন দিচ্ছি এখানে ; ওনার নাম বাঙালি পাঠক শুনেছেন বলে মনে হয় না ; বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি সত্যিই অভিশপ্ত :
    কি যে আমাকে বিপর্যস্ত করে ? কেনই বা অপেক্ষা করব ?
    এই শহরে, বড়ো বেশি বিষাদ ; তা থেকে, প্রচুর অবসর ।
    আধুনিক সুখানুভব নামে যা চলছে
    প্রতি ঘণ্টার পেষাই থেকে আমাকে সুরক্ষিত করতে পারে না ।
    একসময়ে বন্ধুত্ব ছিল, কোনো বইয়ের আকর্ষণ
    চেষ্টা ছাড়াই ভরে তুলতো অতিরিক্ত সময় ।
    ওহ এই অস্পষ্ট আকাঙ্খার উদ্দেশ্য কি ?
    আমি তা এড়িয়ে যাই, কিন্তু উদ্বেগ আমাকে ফিরে দেখতে বলে ।
    আনন্দ যদি আমার হর্ষে ধরা না দ্যায়
    তাহলে আমি তাকে দুঃখের বিশ্রামেও পাবো না,
    তাহলে কোথায়ই বা পাওয়া যায় আমোদপ্রমোদ ?
    আর তুমি যে আমাকে যা চাইছি তা দিতে পারো,
    তুমি কি আমাকে চিরকালের জন্য ছেড়ে যাবার নির্ণয় নিয়েছ ?
    আমাকে বলো, যুক্তিতর্ক, অনিশ্চিত, বিভ্রান্তিকর,
    তুমি কি প্রেমের ক্ষমতাকে  অনুমতি দেবে আমায় দখল করতে ?
    হায়, নামটা শুনলেই আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে !
    কিন্তু যে ভয় উদ্বুদ্ধ করে তা অমায়িক আর সত্যি ।
    যুক্তিতর্ক, তোমার কাছে ফাঁস করার মতন আর কোনো গোপনীয়তা নেই,
    আর আমি ভাবি এই নামটি তোমার চেয়ে তাদের কথা বেশি বলেছে ! 
              এবার জানা যাক আগুস্তে ভিলিয়ার্স দ্যলিজলে আদঁ-র ( ১৮৩৮ -৮৯ ) কথা । ব্রিট্যানির এক অভিজাত পরিবারে জন্ম, যদিও তাঁদের আর্থিক অবস্হা ভালো ছিল না আর নির্ভর করতে হতো মায়ের কাকিমা মাদামোয়াজেল দ্য কেরিনুর দান-খয়রাতের ওপর । তার ওপর ভিলিয়ার্সের বাবার গোঁ চাপে যে তিনি মালটায় গিয়ে ফরাসি বিপ্লবের সময়ে লুকোনো গুপ্তধন উদ্ধার করবেন । ফলে তিনি জমি কিনতেন আর গুপ্তধন না পেয়ে বেচতেন । এই করে ফতুর হয়ে যান । ভিলিয়ার্সকেও ডজনখানেক স্কুল পালটাতে হয় । ১৮৫০ এর পর তিনি বেশ কয়েকবার প্যারিসে গিয়ে কাজের খোঁজ করে কিছুই যোগাড় করতে পারেননি । পাকাপাকি প্যারিসে থাকার ব্যবস্হার জন্য তাঁর এক আত্মীয়া মাসিক খরচের ব্যবস্হা করেন । তিনি ল্যাটিন কোয়ার্টারের মদ্যপ কবি-লেখকদের আড্ডায় যোগ দ্যান এবং শার্ল বোদলেয়ারের পরামর্শে এডগার অ্যালান পোর রচনাবলী পড়া আরম্ভ করেন । ১৮৫৯ সালে নিজের টাকায় প্রকাশ করেন ‘প্রথম কবিতাবলী’ । বইটা কোথাও আলোচিত হলো না । উপরন্তু তিনি লুইজি দায়োনে নামে এক বহুবল্লভা যুবতীর সঙ্গে বসবাস আরম্ভ করলেন ; তাঁর পরিবারে সদস্যদের চাপে ১৮৬৪ সালে যুবতীটিকে ছেড়ে গীর্জায় আশ্রয় নিতে হয় । ভিলিয়ার্স অনেক চেষ্টা করেও বিয়ে করার মতন যুবতী পাচ্ছিলেন না ; তিনি থিয়োফিল গতিয়েকে তাঁর মেয়ে এসতেলে সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিলে গতিয়ের তাঁকে তাড়িয়ে দিয়ে বলেন যে তিনি ভবঘুরে মাতাল অখ্যাত কবির সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চান না । অ্যানা আয়ার পাওয়েল নামে বৈভবশালী ইংরাজ যুবতীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েও প্রত্যাখ্যাত হন । শেষে তিনি এক বেলজিয় ঘোড়ার গাড়ির চালকের অশিক্ষিতা বিধবা স্ত্রী মারি দানতিনের সঙ্গে বসবাস আরম্ভ করেন আর ১৮৮১ সালে তাঁর ছেলে ভিক্তরের জন্ম হয় । কিন্তু কবিস্বীকৃতি, ভেরলেনের বইতে অন্তর্ভুক্ত হবার আগে, তিনি পাননি । এখানে ভিলিয়ার্সের  ‘স্বীকৃতি’ কবিতাটির বাংলায়ন :
    যবে থেকে আমি শব্দগুলো ভুলে গেছি, যৌবনের
    ফুল আর এপ্রিলের টাটকা বাতাস…
    আমাকে তোমার ঠোঁট দুটি দাও ; তাদের সুগন্ধি যৌতুক
    গাছেদের ফিসফিস কথাবার্তা হয়ে দেখা দেবে !
    যবে থেকে আমি গভীর সমুদ্রের দুঃখ হারিয়েছি
    মেয়েটির কান্না, তার অস্হির টান, তার মৃত্যুর আলয়…
    একটা শব্দেরও শ্বাস ফেলে না ; তা বিষাদ বা আনন্দ
    হয়ে উঠবে ঢেউদের কলকল-ধ্বনি !
    যবে থেকে আমার আত্মায় অন্ধকারের ফুল
    আত্মমগ্ন, আর পুরোনো সূর্ষেরা উড়াল নেয়…
    প্রিয়তমা আমাকে তোমার মলিন বুকে লুকিয়ে নাও,
    আর তা হয়ে উঠবে রাতের প্রশান্তি !
              কিন্তু অভিশপ্ত কবিদের তালিকায়  তাঁর গুরু শার্ল বোদলেয়ার, কোঁতেদ্য লুতিয়ামোঁ (Comte de Lautréamont ) , অ্যালিস দ্য শমবিয়ে ( Alice de Chambrier ), আঁতোনা আতো ( Antonin Artaud ), জঁ-ফিয়ে দ্যুফে ( Jean-Pierre Duprey )  প্রমুখকে যোগ করেন পরবর্তীকালের আলোচকরা ; বস্তুত পল ভেরলেনই ছিলেন সবচেয়ে বেশি অভিশপ্ত। এই কবিরা তাঁদের কবিতার জন্য অভিশপ্ত নন ;  তাঁদের জীবনের দুঃখ, বিষাদ, আর্থিক দৈন্য, পরাজয়বোধ, অবহেলা, মাদকে আসক্তি, যৌনরোগ ইত্যাদির কারণে তাঁদের মনে করা হয়েছে ‘অভিশপ্ত’। তাঁর মৃত্যুর পর Fin de siècle বা শতাব্দী শেষের কবিদের অন্যতম মনে করে হয় পল ভেরলেনকে। 
            প্রথমে পড়া যাক শার্ল বোদলেয়ারের গদ্য কবিতার বই ‘বিষণ্ণ প্যারিস’ এর একটি রচনা : 
    আমাকে তোমার চুলের দীর্ঘ, দীর্ঘ সুগন্ধ নিতে দাও, ঝর্ণার জলে পিপাসার্তের মতন আমার মুখকে সম্পূর্ণ ডুবে জেতে দাও, সুবাসিত রুমালের মতন হাতে নিয়ে খেলতে দাও, বাতাসে স্মৃতিকে উড়িয়ে দিতে দাও ।
    আমি যাকিছু দেখি তা তুমি যদি জানতে — যাকিছু আমি অনুভব করি — তোমার চুলে যাকিছু আমি শুনতে পাই ! অন্য লোকেদের আত্মা সঙ্গীতের প্রভাবে যেমন ভ্রমণে বেরোয় তেমনই আমার আত্মা ভ্রমণে বেরোয় এই সুগন্ধে।তোমার চুলে রয়েছে একটি পুরো স্বপ্ন, পাল আর মাস্তুলসহ ; তাতে রয়েছে বিশাল সমুদ্র, যেখানে অগুনতি মৌসুমীবায়ু আমাকে বয়ে নিয়ে যায় মোহিনী আবহাওয়ায়, যেখানে আকাশ আরও নীল আর আরও নিগূঢ়, যেখানে বাতাবরণকে সুগন্ধিত করে তুলেছে ফল, পাতা, আর মানুষের ত্বক।
    তোমার চুলের সাগরে, আমি দেখতে পাই দুঃখী গানে সমাহিত বন্দর, সব কয়টি দেশের কর্মঠ মানুষ সেখানে, যতো রকম হতে পারে ততো ধরণের জাহাজ, বিশাল আকাশের অলস শাশ্বত তাপের পৃষ্ঠভূমিতে তাদের স্হাপত্য দিয়ে দিগন্তকে তনূকৃত ও জটিল করে তুলেছে।
    তোমার চুলের সোহাগস্পর্শে আমি কাউচে শুয়ে কাটানো দীর্ঘ ধীরুজ সময়কে ফিরে পাই, সুন্দর জাহাজের একটি ঘরে, বন্দরের অনির্ণেয় ঢেউয়ের দ্বারা ক্রমান্বয়ে দোল খাওয়া, তাজা জলের জালা আর ফুলের টবের মাঝে ।
    আগুনের পাশে রাখা কম্বলের মতন তোমার চুলে, আমি আফিম আর চিনির সঙ্গে মেশানো তামাকের শ্বাস নিই ; তোমার চুলের রাত্রিতে, আমি দেখতে পাই অসীম ক্রান্তিবৃত্তের নীলাভ ঔজ্বল্য; তোমার চুলের ঢালের কিনারায়, আমি আলকাৎরা, মৃগনাভি আর নারিকেল তেলের গন্ধে মাতাল হয়ে যেতে থেকি ।
    আমাকে একটু-একটু করে খেয়ে ফেলতে থাকে তোমার তন্দ্রাতুর কালো বিনুনি । যখন তোমার স্হিতিস্হাপক, দ্রোহী চুল আমি চিবোতে থাকি, আমার মনে হয় আমি স্মৃতিগুলো খেয়ে ফেলছি।
              কঁতে দ্য লুতিয়ামোর ( ১৮৪৬ – ১৮৭০ ) প্রকৃত নাম ইসিদোরে লুসিয়েন দুকাস, জন্মেছিলেন উরুগুয়েতে । তাঁর জন্মের পরেই মা মারা যান ; তখন আর্জেনটিনা আর উরুগুয়ের যুদ্ধ চলছে । তাঁর বাবা, যিনি ফরাসিভাষী ছিলেন, তাঁকে তেরো বছর বয়সে প্যারিসে পাঠিয়ে দ্যান স্কুল শিক্ষার জন্য । সতেরো বছর বয়সে উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি দাঁতে, মিলটন, বোদলেয়ার এবং রাসিনে মুখস্হ বলতে পারতেন বলে শিক্ষকদের প্রিয় ছিলেন । কিন্তু নির্ণয় নেন যে তিনি নিজে ‘নিষ্ঠুরতার আনন্দবোধ’ নিয়ে কবিতা লিখবেন । ‘মালদোরোরের গান’ নামে তিনি একটি কাব্যোপন্যাস লেখেন, ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সালের মাঝে,  তাঁর এই নির্ণয়কে রূপ দেবার জন্য । নায়কের নাম মালদোরোর । বইটি ছয় পর্বে আর ষাটটি কবিতাংশে বিভাজিত । ডাডাবাদীরা, পরাবাস্তববাদীরা, বিশেষ করে সালভাদোর দালি,  তাঁর এই বইটির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । বইটির বহু দৃশ্যের এচিং করেছিলেন দালি । আমি বইটি থেকে একটি কবিতাংশ তুলে দিচ্ছি:
    আমি নোংরা । আমার সারা শরীরে উকুন । শুয়োররা, যখন আমার দিকে তাকায়, বমি করে। আমার চামড়া কুষ্ঠরোগের মামড়ি আর আঁশে ছয়লাপ, আর তার ওপরে হলুদ রঙের পুঁজ । আমার বাঁদিকের বগলে এক ব্যাঙ পরিবার বসবাস আরম্ভ করেছে, আর, তাদের কোনো একটা নড়াচড়া করলে, কাতুকুতু দ্যায় । মনে রাখতে হয় যাতে বাইরে বেরিয়ে মুখ দিয়ে কান আঁচড়াতে না আরম্ভ করে ; তাহলে সেটা মগজে ঢুকে যাবে । আমার ডানদিকের বগলে রয়েছে একটা গিরগিটি যে সব সময়ে ওদের তাড়া করে যাতে খাবার না জোটায় মারা যায় : সবাইকে তো বাঁচতে হবে । আমার পোঁদের ভেতরে একটা কাঁকড়া ঢুকে গেছে ; আমার কুঁড়েমিতে উৎসাহিত হয়ে, ঢোকার পথটা নিজের দাড়া দিয়ে পাহারা দ্যায় আর আমাকে দ্যায় অসহ্য যন্ত্রণা ।
    অ্যালিস দ্য শমবিয়ে ( ১৮৬১ – ১৮৮২ ) একুশ বছর বয়সে কোমায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তার কিছুকাল আগেই তিনি লিখেছিলেন ‘ঘুমন্ত সুন্দরী’ । তাঁর অধিকাংশ বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর । এখানে তাঁর ‘পলাতক’ কবিতাটির বাংলায়ন :
    আমরা সবাই আগন্তুক আর পৃথিবী হয়ে চলে যাই
    খেলার সময়ে উধাও আলোর নৌকোর মতো
    হালকা হাওয়ায় চুপিচুপি চুমুর আড়ালে,
    আর নীল দিগন্ত ক্রমশ বিলীন হয়ে যায় ;
    উড়ালের সময়ে যদি হলরেখার খাত গড়তে পারে তাহলে আনন্দিত
    সে চলে যাবার পরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো ;
    যে পথ সে দ্রুত যাত্রায় খুঁজতে চেয়েছিল
     কোনো ঘুর্ণিঝড় তাকে মুছে দিতে  পারে না;
    আনন্দিত, যদি অদৃষ্ট আমাদের টেনে বের করে আনে
    আমরা তবুও হৃদয় হয়ে বাঁচি যেখানে থেকেছি চিরকাল,
    সুদূর সমুদ্রতীর পর্যন্ত যে হৃদয় আমাদের অনুসরণ করে
    তাহলে এখানে এক মৃত মানুষের সমাধিকে কী বলা হবে ?
              আঁতোনা জোসেফ মারি আতো ( ১৮৯৬ – ১৯৪৮ ), যিনি আঁতোনা আতো নামে অধিক পরিচিত, ছিলেন কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, নাট্য পরিচালক এবং ইউরোপীয় আভাঁগার্দ আন্দোলনের পুরুষদের অন্যতম । ‘থিয়েটার অব ক্রুয়েলটি’ তত্বটির জন্য তিনি অধিকতর পরিচিত । যদিও তাঁর জন্ম ফ্রান্সের মার্সাইতে, তাঁর বাবা-মা ছিলেন গ্রিক । জাহাজের মালিক ছিলেন তাঁর বাবা । তাঁর মায়ের নয়টি বাচ্চা হয়েছিল, চারটি মৃত অবস্হায় জন্মায় আর দুটি শৈশবেই মারা যায় । পাঁচ বছর বয়সে আতো আক্রান্ত হন মেনেনজাইটিসে, যার দরুন কোমাটোজে ছিলেন কিছুকাল এবং বিভিন্ন স্যানাটোরিয়ামে চিকিৎসার জন্য পাঁচ বছর ভর্তি ছিলেন । ১৯১৬ সালে তাঁকে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনিতে যোগ দিতে হয়েছিল কিন্তু মানসিক অস্হিরতার কারণে ছাঁটাই হন । দীর্ঘ রোগভোগের দরুণ তাঁকে ল্যডানডাম ওষুধ ( অ্যালকোহলে গোলা আফিম ) নিতে হতো আর সেখান থেকেই তাঁর আফিমের নেশা ।সাতাশ বছর বয়সে তিনি এক গোছা কবিতা ‘নতুন ফরাসি রিভিউ’ ( Nouvelle Revue Française ) পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠান ; তা প্রত্যাখ্যাত হলেও সম্পাদক তাঁর কবিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে চিঠি লেখেন এবং বেশ কিছু সময় তাঁদের মধ্যে চিঠির আদান-প্রদান হয় । এখানে তাঁর কয়েকটা কবিতার বাংলায়ন দিলুম, কেননা তাঁর কবিতার বই সহজে পাওয়া যায় না :    
    নিরংশু কবি
    নিরংশু কবি, একটি তরুণীর বুক
    তোমাকে হানা দিয়ে বেড়ায়,
    তিক্ত কবি, জীবন ফেনিয়ে ওঠে
    আর জীবন পুড়তে থাকে,
    আর আকাশ নিজেকে বৃষ্টিতে শুষে নেয়,
    জীবনের হৃদয়ে নখের আঁচড় কাটে তোমার কলম ।
    অরণ্য, বনানী, তোমার চোখ দিয়ে প্রাণবন্ত
    অজস্র ছেঁড়া পালকের ওপরে ;
    ঝড় দিয়ে বাঁধা চুলে কবি চাপেন ঘোড়ায়, কুকুরের ওপরে ।
    চোখ থেকে ধোঁয়া বেরোয়, জিভ নড়তে থাকে
    আমাদের সংবেদনে স্বর্গ উথালপাথাল ঘটায়
    মায়ের নীল দুধের মতন ;
    নারীরা, ভিনিগারের কর্কশ হৃদয়,
    তোমাদের মুখগহ্বর থেকে আমি ঝুলে থাকি ।
    আমার টাকাকড়ি নেই
    আমার টাকাকড়ি নেই কিন্তু
    আমি
    আঁতোনা আতো
    আর আমি ধনী হতে পারি
    ব্যাপকভাবে আর এক্ষুনি ধনী হতে পারি
    যদি আমি তার জন্য প্রয়াস করতুম ।
    সমস্যা হলো আমি চিরকাল টাকাকড়িকে,
    ধনদৌলতকে, বৈভবকে ঘৃণা করেছি ।
    কালো বাগান
    এই কালো পাপড়িগুলো ভারতের আকাশের  ঘুর্ণাবর্তকে ঘোরাও।
    ছায়ারা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলেছে যা আমাদের সহ্য করে ।
    তোমার নক্ষত্রদের মাঝে চাষের জমিতে পথ খুলে দাও ।
    আমাদের আলোকিত করো, নিয়ে চলো তোমার নিমন্ত্রণকর্তার কাছে,
    চাঁদির সৈন্যবাহিনী, নশ্বর গতিপথে
    আমরা রাতের কেন্দ্রের দিকে যেতে চেষ্টা করি ।
    আমি কে
    আমি কে ?
    আমি কোথা থেকে এসেছি ?
    আমি আঁতোনা আতো
    আর আমি একথা বলছি
    কেননা আমি জানি তা কেমন করে বলতে হয়
    তাৎক্ষণিকভাবে
    তুমি আমার বর্তমান শরীরকে দেখবে
    ফেটে গিয়ে বহু টুকরো হয়ে গেছে
    আর তাকে আবার গড়ে ফেলবে
    দশ হাজার কুখ্যাত পরিপ্রেক্ষিতে
    এক নতুন শরীর
    তখন তুমি আমাকে
    কখনও ভুলতে পারবে না ।
    স্নায়ু ছন্দ
    একজন অভিনেতাকে দেখা হয় যেন স্ফটিকের ভেতর দিয়ে ।
    মঞ্চের ওপরে অনুপ্রেরণা ।
    সাহিত্যকে বেশি প্রবেশ করতে দেয়া উচিত নয় ।
    আমি আত্মার ঘড়ি ধরে কাজ করা ছাড়া আর কোনো চেষ্টা করিনি,
    আমি কেবল নিষ্ফল সমন্বয়ের যন্ত্রণাকে লিপ্যন্তর করেছি ।
    আমি একজন সম্পূর্ণ রসাতল ।
    যারা ভেবেছিল আমি সমগ্র যন্ত্রণার যোগ্য, এক সুন্দর যন্ত্রণা,
    এক ঘন আর মাংসল পীড়া, এমন এক পীড়া যা বিভিন্ন বস্তুর মিশ্রণ,
    বুদবুদ-ভরা একটি নিষ্পেশিত ক্ষমতা
    ঝুলিয়ে রাখা বিন্দু নয় — আর তবু অস্হির, উপড়ে-তোলা স্পন্দনের সাহায্যে
    যা আমার ক্ষমতা আর রসাতলের দ্বন্দ্ব থেকে আসে
    শেষতমের উৎসার দেয় ( ক্ষমতার তেজের দ্বন্দ্বের মাপ বেশি ),
    আর কোনও কিছু বাকি থাকে না বিশাল রসাতলগুলো ছাড়া,
    স্হবিরতা, শীতলতা–
    সংক্ষেপে, যারা আমাকে অত্যধিক জীবনের অধিকারী মনে করেছিল
    আত্মপতনের আগে আমার সম্পর্কে ভেবেছিল,
    যারা মনে করেছিল আমি যন্ত্রণাদায়ক আওয়াজের হাতে নির্যাতিত,
    আমি এক হিংস্র অন্ধকারে লড়াই করেছি
    তারা সবাই মানুষের ছায়ায় হারিয়ে গেছে ।
    ঘুমের ঘোরে, আমার পুরো পায়ে স্নায়ুগুলো প্রসারিত হয়েছে ।
    ঘুম এসেছে বিশ্বাসের বদল থেকে, চাপ কমেছে,
    অসম্ভাব্যতা আমার পায়ের আঙুলে জুতো-পরা পা ফেলেছে ।
    মনে রাখা দরকার যে সমগ্র বুদ্ধিমত্তা কেবল এক বিশাল অনিশ্চিত ঘটনা,
    আর যে কেউ তা খুইয়ে ফেলতে পারে, পাগল বা মৃতের মতন নয়,
    বরং জীবিত মানুষের মতন, যে বেঁচে আছে
    আর যে অনুভব করে জীবনের আকর্ষণ আর তার অনুপ্রেরণা
    তার ওপর কাজ করে চলেছে ।
    বুদ্ধিমত্তার সুড়সুড়ি আর এই  প্রতিযোগী পক্ষের আকস্মিক প্রতিবর্তন ।
    বুদ্ধিমত্তার মাঝপথে শব্দেরা ।
    চিন্তার প্রতিবর্তন প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা একজনের চিন্তাকে হঠাৎ নোংরামিতে পালটে দ্যায় ।
    এই সংলাপটি চিন্তার অন্তর্গত ।
    ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়া, সবকিছু ভেঙে ফেলা ।
    আর হঠাৎ আগ্নেয়গিরিতে এই পাতলা জলের স্রোত, মনের সরু, আস্তে-আস্তে পতন ।
    আরেকবার নিজেকে ভয়ঙ্কর অভিঘাতের মুখোমুখি আবিষ্কার করা, অবাস্তবের দ্বারা নিরসিত, নিজের একটা কোনে, বাস্তব জগতের কয়েকটা টুকরো-টাকরা ।
    আমিই একমাত্র মানুষ যে এর পরিমাপ করতে পারি ।
              ১৯৫০ সালে, কুড়ি বছর বয়সে, জাঁ ফিয়ে দুফের (১৯৩০ – ১৯৫৯ ) প্রথম কবিতার বই ‘দ্বিতীয়ের পেছনে’র পাণ্ডুলিপি পড়ে আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁর প্রশংসা করেছিলেন । এক বছর পরে তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে ভাস্কর্যে আগ্রহী হন, আর পাঁচের দশকের পুরো সময় লোহা আর সিমেন্টের কাজ করেন, সেই সঙ্গে চারকোল ও কালির কাজও করেন । ১৯৫৯ সালে ব্যক্তিগত দ্রোহ প্রকাশ করার জন্য আর্ক দ্য ত্রয়েম্ফে অজানা সেনাদের শিখায় পেচ্ছাপ করার সময়ে ধরা পড়েন আর জনগণের পিটুনি খেয়ে প্রথমে কারাগারে আর তারপর পাগলাগারদে যেতে হয় । ছাড়া পেয়ে আবার কবিতা লেখা আরম্ভ করেন এবং ‘শেষ ও উপায়’ কাব্যগ্রন্হের পাণ্ডুলিপি স্ত্রীর হাতে দিয়ে নির্দেশ দ্যান তা ব্রেতঁকে ডাকে পাঠিয়ে দিতে । বাড়ি ফিরে স্ত্রী জ্যাকলাঁ দেখতে পান যে ছবি আঁকার ঘরের কড়িকাঠ থেকে ঝুলে জাঁ ফিয়ে দুফে আত্মহত্যা করেছেন । কাব্যগ্রন্হটি থেকে ‘সম্পূর্ণ’ শিরোনামের গদ্য কবিতাটির বাংলায়ন :
             জগতসংসার সম্পূর্ণ । কে সেই লোক যে রাতকে প্রতিবার একই ফাঁদে ফ্যালে ? আমি, যদি বলা হয়, কাউকেই চিনি না আর যে আকাশ আমার ওপর মনের ঝাল মেটায়, ওর বড়ো ইঁদুরের হাত আমাকে কখনও, কখনও দেখায়নি ।
              কেউ একজন দরোজাটা খুললো : ভেতরে ছিল না কেউ, ভেতরে তার ছিল হাড় আর হাড়, আর আমি প্রতিজ্ঞা করে সবাইকে জানিয়েছি যে আমি জ্যান্ত ওর চামড়া ছাড়িয়ে নেবো ।
             জগতসংসার ভয়ঙ্করভাবে সম্পূর্ণ ছিল আর জিনিসপত্রের টানাটানি চলছিল । কেউ একজন দুঃস্বপ্নকে সাজিয়ে রাক্ষসদের আলোকিত করছিল আর তাকে বলা হচ্ছিল বর্তমান, এখন…
             এই বর্তমানগুলো আমাদের বহু সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করেছিল, আমি থেকে আমিতে, আমার থেকে আমার সঙ্গে আর অন্য অনেকের সঙ্গে, আর আমার সঙ্গে অন্য অনেকের…কিন্তু অনেকসময়ে সবচেয়ে বিচক্ষণ ভাগাভাগিও আমাদের আলাদা করতে পারে, কিন্তু মাথা কখনও, আর আমি বলতে চাই কখনও, কাঁধের ওপরে স্হিতিশীল থাকেনি ।
    দুই
              ‘অভিশপ্ত বুদ্ধিজীবীদের’ কালখণ্ডে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে যে পল ভেরলেন চল্লিশ বছর বয়সে কয়েকজন কবিকে ‘অভিশপ্ত কবি’ চিহ্ণিত করে একটা বই লিখলেন কেন ? তিনি কি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন, নাকি নিজেকে দেখতে চাইছিলেন সেই কবিদের সারিতে যাঁদের তিনি গুরুত্বপূর্ণ কবি মনে করলেও তখনকার ‘বুর্জোয়া পাঠক’ কোনও পাত্তা দিতেন না । চল্লিশ বছর বয়সে র‌্যাঁবোকে খুনের চেষ্টার দায়ে জেল খেটে ফিরেছেন, একজনকে ( অনেকের মতে নিজের মা-কে ) মারধর করার কারণে আবার জেলে গিয়েছিলেন, রোমান ক্যাথলিক হিসাবে দীক্ষা নিয়েছেন, তবু তাঁর কেন মনে হয়েছিল তাঁর মতনই কয়েকজন কবি অভিশপ্ত ? সাধারণ পাঠকের কাছে তাঁরা ছিলেন অখ্যাত, সমাজ তাঁদের প্রতি উদাসীন ছিল কেননা তাঁদের কবিতা তারা বুঝে উঠতে পারছিল না । কেবল রসপণ্ডিতরা তাঁদের কবিতায় আগ্রহী ছিলেন আর সেকারণে তাঁদের জীবন দুর্দশাপূর্ণ ছিল । উপেক্ষার, এমনকি ‘বুর্জোয়া অশিক্ষিতদের দ্বারা’ পদদলিত হবার চর্চিত বোধ, হয়তো ছিল প্রথম পর্বের আভাঁ গার্দ লেখক-কবিদের ধ্রুপদি দাবি।ফরাসিদেশের কবি-চিত্রকরদের মাঝে আত্মক্ষয়ের গৌরব প্রশংসনীয় ছিল তাঁদের নিজেদের গণ্ডিতে ।
             অভিশাপটি একই সঙ্গে যতোটা নৈতিক ও আত্মিক মনে করেছিলেন ভেরলেন, ততোটাই সামাজিক, যে মানসিকতা থেকে এই বোধের সূত্রপাত যে ‘সত্যকার শিল্পীকে’ প্রতিভার চাপ সহ্য করে ক্লেশ ও নিদারুণ-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় । চল্লিশ বছর বয়সে ভেরলেন মাতলামি, স্ত্রী ও মাকে মারধর করে, বাচ্চাকে যাতনা দিয়ে, সিফিলিসে ভুগে, বস্তিতে জীবন কাটিয়ে, ভিক্ষাবৃত্তি করে, জীবনের মর্মভেদী যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে অতিপরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন এবং কবিদের ক্ষেত্রে ‘অভিশাপ’ যে কেবল সমাজের দেয়া নয়, তাঁরা নিজেরাও এমন সমস্ত কাজকর্ম করেছেন যে প্রকৃতি তাঁদের জীবনে বিপদ ডেকে এনেছে, তাঁদের দেহ ও অন্তরজগতকে ক্ষইয়ে দিয়েছে, তা টের পেয়েছিলেন তিনি ।
              পল ভেরলেনের কাছে ‘অভিশপ্ত কবির’ প্রধান দৃষ্টান্ত ছিলেন শার্ল বোদলেয়ার ( ১৮২১ – ১৮৬৭ ) যাঁর ‘পাপের ফুল’ ( Les fleurs du mal ), ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত, ছিল উনিশ শতকের সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্হ এবং পৃথিবীর সাহিত্যে অতুলনীয় । বইটির কবিতাগুলোয় ছিল সৌন্দর্যের সঙ্গে ইতরতার বৈপ্লবিক মিশ্রণ, তাতে প্রতিফলিত হয়েছিল  চরম আধ্যাত্মিকতা যার জন্য আধুনিক যুগ বহুকাল অপেক্ষা করছিল, যা একই সঙ্গে ছিল স্বর্গে ঝড়-তোলা ও নাছোড়বান্দাভাবে  নারকীয় । মর্ত্যে নরকভোগের অভিজ্ঞতা শার্ল বোদলেয়ারের ছিল, এবং তার অধিকাংশ তাঁর নিজের গড়া নরক । লাতিন কোয়ার্টার থেকে তুলে এনেছিলেন এক শ্যামলী বেশ্যাকে, আর তার থেকে প্রেমের পাশাপাশি পেয়েছিলেন সিফিলিস । তেত্রিশ বছর বয়সে মাকে বোদলেয়ার লিখেছিলেন, “আমি প্রথম থেকেই জঘন্য।” অথচ উত্তরাধিকারসূত্রে যা টাকাকড়ি পেয়েছিলেন, তিনি সারাজীবন আরামে জীবন কাটাতে পারতেন । আঁতোনা আতোর মতন বোদলেয়ারও লডানডাম ( মদে মেশানো আফিম ) মাদকের নেশা ছাড়তে পারেননি । যে লোক নিজেকে অভিশপ্ত মনে করে, সে তার কারণ খোঁজে । বোদলেয়ারে পাওয়া যায় যিশুখ্রিস্টের উপহাস । ‘সেইন্ট পিটারের অস্বীকৃতি’ কবিতায় বোদলেয়ার বলছেন:
    আহ ! যিশু, অলিভের বাগানকে মনে করো !
    তোমার সারল্যে তুমি হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করেছিলে তার কাছে
    যে স্বর্গে রয়েছে সে হাসছিল পেরেকের শব্দে
    যেগুলো নীচ জল্লাদেরা তোমার মাংসে পুঁতে দিচ্ছিল ।
              বিশোধক যন্ত্রণাবোধের ধারণাকে বোদলেয়ার দিয়েছেন এক বিশেষ উতরাই, যা টেনেছিল পল ভেরলেনকে । ভেরলেন জানতেন যে বোদলেয়ারের নায়ক ছিলেন এডগার অ্যালান পো, যিনি, বোদলেয়ারের মতে, অত্যধিক মদ খাবার কারণে মারা যান, ‘অভিশপ্ত কবি’র সৃষ্টিক্ষমতা ও আত্মধ্বংসের ক্ষমতা দুটিই ছিল অ্যালান পোর অহংকার । বোদলেয়ারের চরস আর আফিমের নেশা ছিল যা তিনি ক্ষতিকর মনে করেও ছাড়তে পারেননি ; ‘অভিশপ্ত কবির’ যদি মনে হয় মাদক তাঁর চেতনাকে উন্নীত করছে, তাহলে তার ক্ষতিকর প্রভাবকে প্রতিভার দাম চোকানো হিসেবে তিনি মান্যতা দেবেন । এডগার অ্যালান পো, শার্ল বোদলেয়ার ও পল ভেরলেনের মাতাল-অবস্হায়-থাকা হয়ে উঠেছিল এক ধরণের আধ্যাত্মিক নিয়মনিষ্ঠা ।
             পল ভেরলেন মধ্যস্হ, মীমাংসক, শান্তিস্হাপকের বেদিতে বসিয়েছিলেন শার্ল বোদলেয়ারকে । ভেরলেন লিখেছেন, “আমার কাব্যিক অনুভূতিকে, এবং আমার গভীরে যা রয়েছে, তাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন বোদলেয়র।” একুশ বছর বয়সে ভেরলেন লিখেছিলেন, “শার্ল বোদলেয়ার উপস্হিত করতে পেরেছেন সংবেদনশীল মানুষকে, এবং তিনি তাকে উপস্হাপন করেন একটি আদর্শ হিসাবে, বা বলা যায়, নায়ক হিসাবে ।” ভেরলেন আরও বললেন যে, শার্ল বোদলেয়ার “একজন দ্রষ্টা ; তাঁর রয়েছে তীক্ষ্ণ, স্পন্দমান সংবেদন, একটি যন্ত্রণাময় নিগূঢ় মন, তাঁর ধীশক্তি তামাকে প্লাবিত, তাঁর রক্ত বিশুদ্ধ সুরাসারে প্রজ্বলন্ত ।” যেহেতু অভিশপ্ত, তাই আশীর্বাদপূত ।
               বোদলেয়ারকে নায়কের বেদিতে বসিয়ে তাঁর জীবনযাত্রা অনুকরণের প্রয়াস করলেন পল ভেরলেন । মদে চোবানো অফিমের বদলে তিনি আসক্ত হলেন আবসাঁথে । আবসাঁথে আর কিছু মেশাতে হয় না, সরাসরি পান করতে হয় এবং গাঢ় নেশা হয় । বন্ধুরা নিষেধ করলে ভেরলেন তাঁদের সঙ্গে তরোয়াল বের করে মুখোমুখি হতেন । ভেরলেনের হাতে দেশলাই দেখলে তাঁর বন্ধুরা ভয় পেতেন । স্ত্রীর চুল সুন্দর বলে তাতে আগুন ধরাবার চেষ্টা করেছিলেন । যখন ‘অভিশপ্ত কবি’ ভেরলেন লিখছেন, এবং দুঃখদুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছেন, তিনি জানতেন না যে তাঁর বেশ কিছু কবিতা সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছেচে । কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে ক্ষোভ মৃত্যু পর্যন্ত ছিল যে তাঁকে আর তাঁর কবিতাকে কেউ ঠিকমতন বুঝতে পারেনি ; তাঁর মনে হতো একজন কবির কাব্যিক প্রতিভার কারণে যে আবেগের ঝড় তাকে পুষতে হয় তা লোকে টের পায় না ; প্রথানুসরণ সত্যকার শিল্পের শ্বাসরোধ করে, তাই সীমালঙ্ঘন জরুরি হয়ে ওঠে মৌলিকতাকে আয়ত্ব করার জন্য, নয়তো কবিতা হয়ে উঠবে আহরিত ; জীবনকে আত্মাহীন হলে চলবে না, তাকে হতে হবে অকৃত্রিম ও বিশ্বাসযোগ্য ।
              বোদলেয়ার, ভেরলেন, র‌্যাঁবোর সময়ে, ইউরোপেও, অভিশপ্ত কবির যুক্তি খাটতো, কিন্তু এখন সেগুলো কিংবদন্তি মনে হয় । ইউরোপ-আমেরিকায় নৈতিক বিপথগামীতার নতুন সংজ্ঞা বাজারের চালচলনের সঙ্গে বদলাতে থাকে । এমনকি ভারতেও বোদলেয়ার বা ভেরলেনের মতন অভিশপ্ত কবির যুগ শামসের আনোয়ার ও ফালগুনী রায়ের সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে । এখন এসেছে অভিশপ্ত বুদ্ধিজীবির কালখণ্ডে । যাতে উপেক্ষার অভিশাপে না পড়তে হয় তাই কবি-লেখকরা এখন শাসকদলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে চান । পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের সময়ে যাঁরা লাল ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিল করতেন তাঁরা অনেকেই তৃণমূলের মন্ত্রীর পাশে বসে ফোটো তোলাতে কার্পণ্য করেন না। রাষ্ট্র এখন এমনই বেপরোয়া যে কাকে কোন অভিযোগে জেলে পুরে দেবে তার নিশ্চয়তা নেই । কেবল রাষ্ট্র নয়, বিভিন্ন গোষ্ঠীও বুদ্ধিজীবিদের খুন করতে ভয় পায় না । নকশাল নামে একদা বহু বুদ্ধিজীবি লোপাট হয়ে ছিলেন ; এখন ‘শহুরে নকশাল’ নামে কয়েকজনকে জেলে পোরা হয়েছে । ধর্মবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন কর্ণাটক আর মহারাষ্ট্রের কয়েকজন বুদ্ধিজীবি ।
             সমাজের যাঁরা নৈতিকতার জ্যাঠামশায়, তাঁরা সাহিত্যিকদের আত্মধ্বংসে সমাজেরই পচন দেখতে পান । বোদলেয়ার, ভেরলেন, র‌্যাঁবোর সময়ে ইউরোপের সমাজে ও রাজনীতিতে বিপুল রদবদল ঘটছিল, যা আমরা দেড়শো বছর পরে ভারতেও প্রত্যক্ষ করছি । এখন ইউরোপ আমেরিকায় ধর্মহীনতা ও যৌন-যথেচ্ছাচারকে অধঃপতন মনে করা হয় না, যা ভেরলেনের সময়ে করা হতো । ১৮৫৭ সালে বোদলেয়ারের ছয়টি কবিতাকে নিষিদ্ধ করার ঘটনা এখন ভারতীয় মাপকাঠিতেও হাস্যকর মনে হয় । ভেরলেনেরও মনে হয়ে থাকবে, যে, কবিতাগুলো কোন যুক্তিতে জনগণের নৈতিকবোধে আঘাত হেনেছে, যখন কিনা জনগণ নিজেরাই জীবনে বহু ঘটনা চেপে যায় । কলকাতায় কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন কবি অবিনাশ কবিরাজ লেনে যেতেন অথচ আত্মজীবনী লেখার সময়ে তা চেপে গেছেন । বোদলেয়ারের ছয়টা কবিতা থেকে নিষেধ তোলা হয় ১৯৪৯ সালে । অথচ তার কয়েক বছর পরেই দেখা দিয়েছিলেন আমেরিকার বিট জেনারেশনের কবিরা ; অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’ ঝড় তুলেছে । প্যারিস থেকে তার আগে ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল হেনরি মিলারের ‘ট্রপিক অব ক্যানসার’ । অতিযৌনতা, ভিক্ষাবৃত্তি, নেশা ইত্যাদি সত্বেও হেনরি মিলার নিজেকে অভিশপ্ত মনে করেননি ।
              বোদলেয়ারের নিষিদ্ধ কবিতা ‘লিথি’, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে :
    উঠে আয় আমার বুকে, নিষ্ঠুর নিশ্চেতনা
    সোহাগী ব্যাঘ্রী আমার, মদালস জন্তু ওরে
    প্রগাঢ় কুন্তলে তোর ডুবিয়ে, ঘণ্টা ভরে,
    চঞ্চল আঙুল আমার — হয়ে যাই অন্যমনা ।
    ঘাঘরায় গন্ধ ঝরে, ঝিমঝিম ছড়ায় মনে
    সেখানে কবর খোঁড়ে আমার এ-খিন্ন মাথা,
    মৃত সব প্রণয় আমার, বাসি এক মালায় গাঁথা
    নিঃশ্বাস পূর্ণ করে কি মধুর আস্বাদনে !
    ঘুমোতে চাই যে আমি যে-ঘুমে ফুরোয় বাঁচা,
    মরণের মতোই কোমল তন্দ্রায় অস্তগামী
    ক্ষমাহীন লক্ষ চুমোয় তনু তোর ঢাকবো আমি–
    উজ্বল তামার মতো ও-তনু, নতুন, কাঁচা ।
    শুধু তোর শয়ন ‘পরে আমার এ-কান্না ঘুমোয়,
    খোলা ঐ খন্দে ডুবে কিছু বা শান্তি লোটে ;
    বলীয়ান বিস্মরণে ভরা তোর দীপ্ত ঠোঁটে
    অবিকল লিথির ধারা বয়ে যায় চুমোয় চুমোয় ।
    নিয়তির চাকায় বাঁধা, নিরুপায় বাধ্য আমি,
    নিয়তির শাপেই গাঁথি ইদানিং ফুল্লমালা ;
    বাসনা তীব্র যতো, যাতনার বাড়ায় জ্বালা–
    সবিনয় হায়রে শহিদ নির্মল নিরয়গামী !
    এ-কঠিন তিক্ততারে ডোবাতে, করবো শোষণ
    ধুতুরার নেশায় ভরা গরলের তীব্র ফোঁটায়
    ঐ তোর মোহন স্তনের  আগুয়ান দৃপ্ত বোঁটায়–
    কোনোদিন অন্তরে যার হৃদয়ের হয়নি পোষণ ।
               সমালোচকদের স্বীকৃতি পাচ্ছিলেন না বোদলেয়ার, ফলে যাত্রা আরম্ভ করেছিলেন আত্মক্ষয়ের গৌরবের পথে, তাঁর কবিতা সহজে কোনো পত্রিকা ছাপতে চাইছিল না, বোদলেয়ারের মনে হচ্ছিল অস্বীকার ও যন্ত্রণালাভের মধ্যে দিয়ে তাঁর স্খালন ঘটছে, কবিতায় ইতরতার সঙ্গে সৌন্দর্যের মিশেলে গড়া তাঁর পাঠবস্তুতে তিনি তাঁর প্রতি ঈশ্বরের অবিচারের প্রসঙ্গ তুলেছেন । তিনি এডগার অ্যালান পো-কে ফরাসী পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার সময়ে পো-এর জীবনেও মদ্যপানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, যা তাঁর জন্য হয়তো জীবনবিনাশী ছিল, কিন্তু তা তাঁকে করে তুলেছিল প্রকৃত সৃজনশীল মানুষ, কেননা, বোদলেয়ারের মতে,  পো কখনও নেশাহীন প্রকৃতিস্হ থাকতে চাইতেন না । বদল্যার বলেছেন যে পো সাধারণ মানুষের মতন মদ খেতেন না, খেতেন বর্বরদের ঢঙে, মার্কিনী তেজে, যাতে এক মিনিট সময়ও নষ্ট না হয়, যেন তিনি খুন করার জন্য তৈরি, এমন একটা পোকাকে খুন করতে চাইছেন যা তাঁর ভেতরে বাসা বেঁধে আছে আর মরতে চায় না ।
             বদল্যারের মতে, মত্ততা এডগার অ্যালান পো-কে কেবল যে মহান কবি করে তুলেছে, তা নয়, তাঁকে করে তুলেছে মহান মানুষ ; পো-এর মত্ততা ছিল স্মৃতিবর্ধনের ক্রোনোট্রোপ ( সময়/পরিসর ), সাহিত্যকর্মের খাতিরে একটি সুচিন্তিত ও স্বেচ্ছাকৃত উপায়, তা মারাত্মক দুর্দশাপূর্ণ হলেও, তাঁর স্বভাবচরিত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছিল । ভেরলেন যেমন বদল্যারের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন আত্মক্ষয়ের গৌরবের কিংবদন্তি, একই ভাবে বদল্যার আত্মক্ষয়ের গৌরবের কিংবদন্তি গড়ে তুলেছিলেন এডগার অ্যালান পো-এর মাধ্যমে ।
              উনিশ শতকের ফ্রান্সে যে কবিদের রচনা আধুনিক বিশ্ব সাহিত্যকে রূপ দিয়েছে, তাঁদের প্রতি ফরাসি প্রাতিষ্ঠানিকতার দুর্ব্যবহার ব্যাখ্যার অতীত । ভেরলেন যাঁদের অভিশপ্ত কবি হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন, তাঁদের সঙ্গে ভেরলেনের জীবনযাত্রা বেছে নেয়ায় পার্থক্য আছে । আবসাঁথের নেশার প্রতি ভেরলেনের টানের কারণ তিনি তাঁর ‘স্বীকৃতি’ বইতে জানাননি, এবং আবসাঁথ খাবার পর যে সমস্ত দানবিক আচরণ তিনি করতেন তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই । অনেকে মনে করেন তাঁর বাবার পালিত মেয়ে এলিজা তাঁর সঙ্গে সঙ্গমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণে ভেরলেন হীনম্মন্যতায় ভুগতে আরম্ভ করেন এবং আত্মধ্বংসের দিকে এগিয়ে যান । পরবর্তীকালে তিনি তো যথেষ্ট রয়ালটি পেতেন এবং তা থেকে তিনি নিশ্চয়ই তাঁর পাঠকের সংখ্যাবৃদ্ধি আঁচ করে থাকবেন ।
             র‌্যাঁবোর অভিশপ্ত হবার কারণ পাওয়া যায় বাবার অনুপস্হিতিতে । তাঁদের পাঁচ ভাইবোনের কারোর জন্মের সময়ে তাঁর বাবা বাড়িতে ছিলেন না । তাঁর যখন ছয় বছর বয়স তখন তাঁর বাবা তাঁদের ছেড়ে চলে যান, ফলে শৈশব থেকে তাঁকে আর তাঁর মাকে টিটকিরি শুনতে হতো। তাঁর মা নিজেকে বলতেন বিধবা । অনুপস্হিত বাবাকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে র‌্যাঁবো ঈশ্বরনিন্দা ও খ্রিস্টধর্মকে আক্রমণ করেছেন তাঁর কবিতায় । ঈশ্বরই তাঁর ও তাঁর মায়ের দুঃখদুর্দশার জন্য দায়ি । সেই অনুপস্হিত বাবাকে তিনি প্যারিসের অগ্রজ কবিদের মধ্যে পেতে চেয়ে অবহেলিত হন । 
              ভেরলেনও জেলে থাকার সময়ে রোমান ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন, তবু তিনি ঈশ্বরভক্তি ও ঈশ্বরনিন্দার মাঝে দোটানায় পড়ে কবিতা লিখেছেন । খ্রিস্টধর্মের প্রফেটদেরও যেহেতু যন্ত্রণাভোগ করতে হয়েছে, যিশুকে ক্রূশকাঠে পেরেকে গেঁথা অবস্হায় ঝুলতে হয়েছে, তাই একজন কবিও, যে মানবসমাজের জন্য কবিতা লিখছে, তাকেও প্রফেটদের মতন অভিশপ্ত জীবন কাটাতে হবে, মনে করেছেন ভেরলেন । আঘাত পাওয়াকে তাঁরা অপরিহার্য সত্য বলে মান্যতা দিয়েছেন । রসাস্বাদন করেছেন শহিদত্বের, জাহির করেছেন তাকে । মন্দভাগ্যের সাধনা তাঁদের অন্তরজগতকে বড়ো বেশি দখল করে নিয়েছিল, বিশেষ করে ভেরলেনের । খ্রিস্টধর্মমতে মানসিক অবস্হানটি ‘ইপিফ্যানি’ । এই মনস্হতিকে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন ‘দৈব উন্মাদনা’, ইউরোপীয় রেনেসাঁর গবেষক বলেছিলেন ‘শনিআক্রান্ত স্বভাবচরিত্র’।
             যাঁরা আচমকা সেই ইপিফ্যানিতে আক্রান্ত হন, তাঁরা,  ‘বিশুদ্ধ’ অভিজ্ঞতার খাতিরে, মনের ভেতরে সন্ধান করেন সীমাহীনতার, যে পরিসরে তিনিই নিজেকে মনে করেন সর্বেসর্বা, আত্মক্ষয় তাঁর কিচ্ছু করতে পারবে না ; মাদক, যৌনতা, মৃত্যু, ধর্মহীনতা, কোনো কিছুই তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না, কেননা তিনি আত্মক্ষয়ের গৌরবে আহ্লাদিত  পরিসরের সার্বভৌম মালিক । সেই গায়ক, কবি, চিত্রকর, ভাস্কর, স্হপতির আহ্লাদের শক্তিক্ষমতা, তাঁদের যন্ত্রণাদায়ক যাত্রাপথে এগোনোয় প্ররোচিত করে ; তাঁরা জানেন যে প্রয়াস না করলে তাঁরা কিছুই নন, তাঁরা একজন ‘নেইমানুষ’ ।
             যৌনতা তাঁদের কাছে বংশরক্ষার অথবা সন্তানের জন্ম দেবার প্রক্রিয়া নয়, যেমন মাদক নয় নেশাগ্রস্ত থাকার জন্য, এগুলো তাঁদের ‘নেইমানুষ’ হতে দেয় না । বংশরক্ষা বা সন্তানোৎপাদনের যৌনতা,  ব্যক্তিঅস্তিত্বকে ধারাবাহিকতার বাইরে নিয়ে যায়, গতানুগতিকতায় বেঁধে ফ্যালে। ধারাবাহিকতাহীনতা হলো অভিশপ্ত কবিদের প্রতিদিনের জীবনের সাধারণ স্বাভাবিক ঘটনা । জনসাধারণের মাঝে একজনের সঙ্গে আরেকজনের বাধা থাকে, অনেকসময়ে দূরতিক্রম্য, ধারাবাহিকতাহীনতা থাকে, পতিত-অঞ্চল থাকে । মানুষের ব্যক্তিএকক-বোধ জন্মায় তার সামনের বস্তুপৃথিবীর জিনিসগুলোর ব্যবহারের কারণে — তাদের দরুণ বস্তুদের থেকে সে বিচ্ছিন্ন থাকে । ‘নেই-বোধ’ হলো অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা, এবং এই ধারাবাহিকতার সন্ধান করেন আত্মক্ষয়ের আহ্লাদে আক্রান্ত অভিশপ্ত কবিরা । ‘নেই-বোধ’ হলো অহং-এর সমাপ্তি, যা মানুষটি ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন, এবং সেই কারণেই আশেপাশের জনসাধারণকে সরিয়ে দিতে চাইছেন ।
             অমন মানুষটি আত্মবলিদানের গোমরে ভুগছেন কেন ? কেননা তাঁর কাছে আত্মবলিদানের গোমর হলো কেবলমাত্র ধ্বংস, তা নিশ্চিহ্ণ হওয়া নয় । আত্মবলিদানের গোমর বস্তুদের প্রতি আনুগত্যকে ধ্বংস করে ; প্রয়োজনীয় দৈনন্দিনের উপযোগীতাবাদী জীবন থেকে টেনে বের করে আনে, এবং মানুষটিকে প্রতিষ্ঠা করে দুর্বোধ্য খামখেয়ালে , স্বকীয় পবিত্রতায়, যার খোলোশা কেবল তিনিই করতে পারবেন । তাঁর এই ‘বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা’ ঘটে তাবৎ সীমাগুলোর বিদারের মাধ্যমে, যাবতীয় নিষেধ অতিক্রমের দ্বারা, যা তাঁকে একযোগে আহ্লাদ ও পীড়নের স্হিতিতে নিয়ে গিয়ে একাকী ছেড়ে  দেয় । ‘বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা’ হলো ‘নেই-স্হিতি’, এবং সেহেতু মানসিক ও দৈহিক আত্মক্ষয় সম্পূর্ণ পরিবর্তন-পরিশীলনের জন্য একান্তই জরুরি । অভিশপ্ত কবির ভেতরে-ভেতরে যে সন্ত্রাস চলছে তা অন্য কেউ তাঁকে দেখে বুঝতে পারে না ; তার জন্য তাঁর গানে, সঙ্গীতে, কবিতায়, ভাস্কর্যে, পেইনটিঙে, স্হাপত্যে, প্রবেশ করতে হবে ।
               ব্যক্তিএককের বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতার ক্রোনোট্রোপে বাস্তব জগত আর মিথ মিলেমিশে গেলে তার যে মানসিক অবস্হা গড়ে ওঠে তাকে ভেরলেনের আলোচকরা বলেছেন ‘নুমিনাস’, যে অবস্হায় ব্যক্তিএককের অন্তরজগতে নিদারুণ তোলপাড় ঘটতে থাকে, সে তখন বাইরের জগতের প্রতি উৎসাহহীন, তার মনে হয় সে বাইরের জগতের দ্বারা অবদমিত, হতোদ্যম অবস্হায় সে নিজের ভেতরে আরও বেশি করে ঢুকে যেতে থাকে, তখন সে বিপজ্জনক আত্মক্ষয়ের স্বাদ পেতে আরম্ভ করেছে, খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে, বুঝে উঠতে পারছে না ঝাঁপ দেবে নাকি ফিরে যাবে ।
             সুইডেনের নাট্যকার অগাস্ট স্ট্রিণ্ডবার্গ, যিনি খাদের কিনারায় গিয়ে ফিরে এসেছিলেন, বেশ কিছু সময় মানসিক হাসপাতালে ছিলেন, তিনি নিজের অবস্হাটা যাচাই করে বলেছিলেন যে, ‘যারা উন্মাদ হবার সুযোগ পায় তারা যথেষ্ট ভাগ্যবান’ । মার্কিন কবি জন বেরিম্যান, যাঁর বাবা শৈশবে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন, এবং যিনি বাবার আত্মহত্যার স্মৃতি থেকে কখনও মুক্তি পাননি , বলেছিলেন, ‘যে কবি অত্যন্ত ভয়াবহ মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে গেছে, যা তাকে মেরে ফেলতে পারতো অথচ যা তাকে প্রকৃতপক্ষে বাঁচতে সাহায্য করেছে, তার অদৃষ্টের প্রশংসা করা উচিত’।
        অভিশপ্ত কবির ভেতরে এক সৃজনশীল ক্ষমতা প্রবেশ করে ; সে চেষ্টা করে যায় যাতে বিস্ফোরণে সে নিজেই না উড়ে শতচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সে চেষ্টা করে কখন সৃজনশীলতার আবেগ ও সংবেদনকে প্রয়োগ করতে হবে । সব সময় একটা ভীতি কাজ করে, কেননা সৃজনশীল মানুষটি খাদের ধার পর্যন্ত যাবেনই, আবার একই সঙ্গে তাঁর ভেতর এই ভীতি কাজ করে যে তিনি বড়ো বেশি মার্জিত রুচিশীল বিবেকী সুস্হতাবিশিষ্ট স্হিরমস্তিষ্ক হয়ে উঠছেন না তো ! সাধারণ মানুষের তুলনায় সৃজনশীল মানুষ, নিজের সৃজনশীলতার সঙ্গে আপোষ করতে না পেরে খানিকটা ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ হয়ে পড়েন, এবং ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ হবার কারণে তাঁরা যখন ডিপ্রেশানে আক্রান্ত হন তখন, সাধারণ মানুষের তুলনায়, অস্তিত্বের সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে পারেন, অন্তদর্শী হতে পারেন, প্রতিক্ষেপক হতে পারেন । আমেরিকায় লেনি ব্রুস নামে একজন প্রতিসাংস্কৃতিক কমেডিয়ান ছিলেন, অশ্লীল ভাষায় সবায়ের সমালোচনা করতেন, যে কারণে তাঁকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল,  এবং তাঁর মৃত্যুর পর তা মাফ করে দেয়া হয়, তিনি উন্মাদ বুদ্ধিমত্তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, তিনি নিজেও আত্মক্ষয়ে ভোগেননি ।
             ডাক্তারি ভাষায় আত্মক্ষয়ের গৌরবকে বলা হবেছে ‘হাইপোম্যানিয়া’ । কোনো সৃজনশীল মানুষকে যদি হাইপোম্যানিয়ার স্বীকৃতি দেয়া হয় তাহলে তাঁর কাছে তা সৃজনের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি । সৃজনশীল মানুষ তাঁদের কাজের জন্য যে কাঁচা মাল ব্যবহার করেন, তা আসে তাঁদের অন্তর্জীবনের বুনিয়াদি বা আদিকালীন স্তর থেকে — যৌন কল্পনা, পূর্বপক্ষতা, আগবাড়া চারিত্র্য, বহুবিধ যৌনাঙ্গিকের ভাবনা থেকে । শৈশব থেকে মানুষের ভেতরে এই বোধগুলো কাজ করে, সে এই স্তরগুলো অতিক্রম করে যৌবনে পৌঁছোয় । বয়সের সঙ্গে সে আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, আদিম-চেতনাকে দাবিয়ে রাখতে শেখে, সামাজিক বাধানিষেধকে মান্যতা দিতে শেখে । কিন্তু সৃজনশীল মানুষ এগুলোর সংস্পর্শে থাকেন, আর তাদের বোঝার জন্য নিজের সঙ্গে লড়তে থাকেন, আর নিজের আদিম চারিত্র্যের সঙ্গে সংস্পর্শে থাকার অভিপ্রায়ে তিনি উন্মাদনা ও মতিস্হিরতার মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখে চলেন আবার কখনও বা সেই ভারসাম্য হারিয়ে অভিশপ্ত হন।
    তিন
              পল-মারি ভেরলেনের জন্ম ১৮৪৪ সালের ৩০ মার্চ উত্তরপূর্ব ফ্রান্সের মোৎসেল আর সেইলি নদীর সঙ্গমস্হল মেৎজ শহরে ।   সমরবাহিনীর ক্যাপ্টেন তাঁর বাবা নিকোলাস অগুস্তে ভেরলেন  ১৮৫১ সালে মেৎজ থেকে প্যারিসে পাকাপাকি  বসবাসের জন্য চলে যান । সেখানে পল ভেরলেনকে বোনাপার্ত উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় । স্কুলের তথ্য অনুযায়ী চোদ্দো বছর বয়সে তাঁকে দেখতে কুৎসিত মনে হতো । জীবনের প্রথম সাত বছর বাবার চাকুরির দৌলতে বিভিন্ন শহরে বসবাস করতে হয়েছিল ভেরলেনকে, যার দরুণ শৈশবে তাঁর একমাত্র বন্ধু ছিলেন তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া খুড়তুতো বোন এলিজা । এলিজার অকালমৃত্যু মেনে নিতে পারেননি কিশোর ভেরলেন ; এলিজা  ছিলেন তাঁর প্রথম প্রেম,  যদিও এলিজার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আর একটা বাচ্চা ছিল তবু ভেরলেন তাঁকে দৈহিকভাবে চেয়েছিলেন; এলিজাকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘দুর্দান্ত উৎসব’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে, এলিজার মৃত্যুর পর । 
               ১৮৬২ সালে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে  ভেরলেন প্রথমে বীমা কোম্পানির  চাকুরিতে যোগ দেন। ১৮৬৫ সালে তাঁর বাবা মারা যান । দুই বছর আইন পরীক্ষা পড়ার পর ছেড়ে দ্যান। ১৮৬৭ সালে  এলিজা মোনকোঁলের মৃত্যুর ফলে তিনি নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকেন আর বেয়াড়া হয়ে যান, বাবা-মায়ের কাছে তাঁর আবদার বেড়ে যায়, খামখেয়ালি, অব্যবস্হিতচিত্ত, স্বার্থপর, অপরিণত যুবক হয়ে ওঠেন ।  তাঁর মা মদ খাবার টাকা যোগাতেন না বলে বাড়িতে প্রায়ই ঝগড়া হতো । উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তাঁর আবসাঁথ খাবার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল । মদ্যপ অবস্হায় দু’বার মাকে খুন করার জন্য তাঁর পেছনে তরোয়াল নিয়ে দৌঁড়েছিলেন । ভেরলেনের বন্ধু তাঁদের দুজনের মাঝে গিয়ে ভেরলেনকে কাবু করেন । মাকে দ্বিতীয়বার আক্রমণের ব্যাপার চলেছিল সাত ঘণ্টা কথা কাটাকাটির মাঝে । মা পরের দিন সবকিছু ভুলে গিয়ে আদরের ছেলেকে ক্ষমা করে দিতেন ।
             শার্ল বোদলেয়ারের ‘পাপের ফুল’ ( Les fleurs du mal ) পড়ার পর পল ভেরলেনের কবিতা লেখার ইচ্ছা হয়। ১৮৬৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘মসিয়ঁ প্রুধোম’ প্রকাশিত হয় । তিনি ‘সমসাময়িক কবিতা’ ( Le Parnasse Contemporain ) পত্রিকার সম্পাদক কাতুলে মেনদেস-এর সঙ্গে দেখা করেন । পত্রিকাটিতে তাঁর আটটি কবিতা প্রকাশিত হয় । উনিশ শতকের ফ্রান্সে একদল কবি আরম্ভ করেন পারনাসিয় আন্দোলন ; নামটি নেয়া হয়েছিল অ্যাপোলো আর মিউজদের পবিত্র গ্রিক পাহাড়ের নাম থেকে । পারনাসিয়রা বিষয়বস্তু এবং শৈলীর বিস্তার প্রদর্শন করলেও, তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন কারিগরি, অশেষ সৌন্দর্য ও বস্তুনিষ্ঠাকে। রোমান্টিসিজমের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা দিয়েছিল পারনাসিয় আন্দোলন এবং তা ক্রমে প্রসারিত হয় প্রতীকবাদ ও ডেকাডেন্ট কাব্যিক ঐতিহ্যে । পারনাসিয় আন্দোলনের প্রধান কবি বলে মনে করা হয় শার্ল-মারি-রেনে লেকঁত দ্যলিজেকে, কিন্তু আন্দোলনের অংশ হিসাবে মান্যতা দেয়া হয় থিয়োদোরে দ্যবাঁভিল, অঁরি কাজালিস, ফ্রাঁসোয়া কোপি, আনাতোল ফ্রাঁসে, থিয়োফিল গতিয়ে, জোসে-মারিয়া দ্যহেরদিয়া, সালধ প্রুধোম, পল ভেরলেন ও শার্ল বোদলেয়ারকে। ১৮৬৬, ১৮৭১ ও ১৮৭৬  সালে সবসুদ্ধ নিরানব্বুইজন কবির তিনটি সংকলন প্রকাশ করেন আলফোঁসে লেমেরে, কাতুলে মেন্দেস আর লুই জেভিয়ার । এই তিনটি সংকলনের প্রকাশকে ফরাসী সাহিত্যে বাঁকবদলকারী ঘটনা বলে মনে করা হয় । তবে থিয়োফিল গতিয়ে যখন ‘আর্ট ফর আর্টস শেক’ স্লোগান দিলেন তখন পারনাসিয় কবিরা একটা বৌদ্ধিক গতিমুখ পেলেন । ভেরলেন নিজেকে পারনাসিয় আন্দোলনের একজন সদস্য বলে মনে করতেন না ।
               ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয় ভেরলেনের প্রথম কাব্যগ্রন্হ Poemes Saturniens এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্হ Gallant Parties প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে । মেনদেসের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে অন্যান্য পারনাসিয় কবি লেকঁতে দ্যলিজে, থিয়োদির দ্য বাঁভিল, লুই জেভিয়ার দ্য রিকার্দ, ফ্রাঁসোয়া সিপ্পি প্রমুখের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় এবং সুফলো রোড-এর সস্তা মদের দোকানে সবাই মিলে আড্ডা দিতেন । বিয়ারের স্বাদ সেসময়ে ভালো ছিল না বলে আবসাঁথের প্রতি আসক্ত হন ভেরলেন ও অন্যান্য কবিরা । ভেরলেন নিজেই ‘স্বীকৃতি’ বইতে জানিয়েছেন যে তিনি একবার সারারাতে দুশোবার অর্ডার দিয়ে আবসাঁথ খেয়েছিলেন । Poemes Saturniens এর “হেমন্তের কবিতা” লিখে ভেরলেন কবিদের প্রশংসা পেয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই কবিতাটির প্রথম ছয় লাইন মিত্রপক্ষের সৈন্যবাহিনী নরম্যাণ্ডি অবতরণের কোড হিসাবে বিবিসি থেকে প্রসার করেছিলেন ; প্রথম তিন লাইন পয়লা জুন আর দ্বিতীয় তিন লাইন পাঁচুই জুন :
    হেমন্তের বেহালার
    দীর্ঘ ফোঁপানিগুলো
    আমার হৃদয়কে আহত করে
    একঘেয়ে সুরের অবসাদে ।
    সমস্তকিছু শ্বাসহীন
    আর ফ্যাকাশে, যখন
    সময়ের কাঁসর বেজে ওঠে,
    আমার মনে পড়ে
    বিগত দিনগুলো
    আর আমি কাঁদি
    আর আমি চলে যাই
    এক অশুভ বাতাসে
    যা আমাকে নিয়ে যায়
    এখানে, সেখানে,
    যেন গাছের এক
    মৃত পাতা ।
              বাইশ বছর বয়সে লেখা কবিতাটির শিরোনাম যদিও ‘হেমন্তের গান’, প্রতীকবাদী অন্যান্য কবিদের মতো ভেরলেনও, র‌্যাঁবোর সঙ্গে পরিচয়ের আগে, ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’কে মান্যতা দিয়ে কবির অন্তরজগতকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন এবং তিনি যে বলতেন কবিতাকে সঙ্গীতময় হয়ে উঠতে হবে, তার পরিচয় মেলে এই কবিতায় ; তিনি বলতেন যে কবিতায় সঙ্গীতই প্রথম এবং প্রধানতম । যাঁরা কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, তাঁদের বক্তব্য, ফরাসি ভাষায় না পড়লে কবিতাটির সঙ্গীতময়তা অনুধাবন করা যায় না । এই কবিতাটির অনুকরণে উনিশ শতকের শেষ দিকে বহু কবি কবিতা লিখেছেন । এই কবিতার আনুয়ি বা অবসাদ হয়ে ওঠে ভেরলেনের কবিতার বৈশিষ্ট্য। ভেরলেনের কবিতায় ক্ষয় বা অপচয় ঘুরে-ঘুরে এসেছে । কবিতাটির ধীর লয় কবির অবসাদকে তুলে ধরার জন্য প্রয়োগ করেছেন ভেরলেন । পারনাসিয় কবিদের প্রভাবে র‌্যাঁবো ‘দি ড্রাঙ্কন বোট’ বা ‘মত্ত নৌকো’ নামে একটা কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু পরে নিজেই এই কবিতার ধারাকে সমর্থন করেননি, এবং গদ্যকবিতার দিকে ঝোঁকেন ।
              উনিশ শতকের প্যারিসে লাতিন কোয়ার্টার ছিল যেন এক বোহেমিয়ান দ্বীপ, যেখানে জড়ো হতেন অজস্র লেখক, শিল্পী, নাট্যকার আর কবিযশোপ্রার্থী । ভিক্তর য়োগো, শার্ল বোদলেয়ার প্রমুখের মতন পল ভেরলেনও বেছে নিয়েছিলেন এলাকাটা, সস্তার মদ আর বেশ্যাসঙ্গের আকর্ষণে । প্যারিসের ইতিহাসে এই সময়টাই ছিল প্যারিস কোয়ার্টারের খ্যাতি-কুখ্যাতির কারণ — এখন তা একেবারে বদলে গিয়েছে । যারা এই এলাকায় বাস করতো তাদের কাছে পাড়াটা ছিল নরক । অত্যন্ত গরিব শ্রমজীবিদের পাড়া, দুবেলা খাবার জোটেনা, অসুখে পড়লে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয় ইত্যাদি । তারা প্রধানত গ্রামাঞ্চল থেকে এসে সস্তায় থাকার জায়গা হিসাবে বেছে নিয়েছিল পাড়াটা, আর বাড়তি রোজগারের জন্য ঘর ভাড়া দিতো, বেশ্যাগিরি করতো, সস্তার মদ বিক্রি করতো । ক্রমশ তারা লেখক-কবি-শিল্পীদের চাহিদা মেটাবার জন্য সারারাতের যৌনহুল্লোড়ের ব্যবস্হা করতো । ফরাসি সাহিত্যে দেখা দিচ্ছিল রোমান্টিক ঔপন্যাসিকদের জনপ্রিয়তা, আদর্শের পরিবর্তে ‘পাপের ফুলের’ বা ‘নরকে ঋতুর’ প্রতি আকর্ষণ । ফাউস্তের জায়গা নিয়ে নিচ্ছিল মেফিসতোফিলিস । ঈশ্বর-বিশ্বাস নিয়ে দোটানায় ছিলেন কবি-লেখক-শিল্পীরা । পেত্রুস বোরেল নামে এক কবি, যিনি বোদলেয়ারের বন্ধু ছিলেন, লাতিন কোয়ার্টারে গরিব সেজে ঘুরে বেড়াতেন, তাঁকে বলা হতো “নেকড়ে বাঘে পরিণত মানুষ।”    
               ভেরলেনের মতিগতি ফেরাবার জন্য তাঁর মা তাঁর বিয়ে প্রথমে ঠিক করেন কড়া মেজাজের এক মামাতো বোনের সঙ্গে,  কিন্তু তা এড়াবার জন্য ভেরলেন পছন্দ করেন এক বন্ধুর সৎবোন,  তাঁর চেয়ে বয়সে বেশ ছোটো  সুন্দরী তরুণী মাতিলদে মত দ্য ফ্ল্যেওরভিলেকে, বিয়ে হয় ১৮৭০ সালে ; মাতিলদের সঙ্গে পরিচয়ের সময়ে যুবতীটির বয়স ছিল ষোলো, তাঁর মা-বাবা ভেরলেনকে জানান যে তাঁকে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে । ১৮৬৯ সালের জুনমাসের এক দুপুরে, মদ খাবার জন্য বন্ধু শালর্ক দ্য সিভরির মমার্তর বাড়িতে গিয়েছিলেন পল ভেরলেন । শার্ল তাঁর মা আর সৎবাবা থিওদোর মতে দ্য ফ্লেওরভিলের সঙ্গে থাকতেন । দুই বন্ধু যখন গল্প করছিলেন তখন ষোলো বছরের একটি সুন্দরী যুবতী ঘরে ঢোকেন, ভেরলেনের মতে ইচ্ছাকৃতভাবে ঢোকেন, তিনি শার্লের সৎবোন মাতিলদে মতে । ভেরলেনের কবিতা তাঁর পড়া ছিল এবং পড়ে কবিকে ভালো লেগেছিল, তিনিও ভেরলেনের প্রেমে পড়েন । বিয়ের ছয় মাসের মধ্যেই মাতিলদে গর্ভবতী হবার দরুন ভেরলেন বিষাদে আক্রান্ত হয়ে আবার লাতিন কোয়ার্টারে যাতায়াত আরম্ভ করেন ।তাঁদের একটি ছেলেও হয় ।  
             মাতিলদে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে প্রথম দুই বছর ভেরলেন তাঁকে খুব ভালোবাসতেন এবং তাঁকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছিলেন। ভেরলেনের তৃতীয় কাব্যগ্রন্হ ‘ভালো গান’-এর কবিতাগুলো  মাতিলদেকে মনে করে লেখা । কিন্তু মাঝে-মাঝে ভেরলেনের রুদ্ররূপ বেরিয়ে পড়তো আর তিনি মাতিলদের গায়ে হাত তুলতেন । একবার তিনি মাতাল অবস্হায় তাঁর ছেলে জর্জকে তুলে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন । তাঁর মা, শশুর-শাশুড়ির উপস্হিতিতেও এরকম আচরণ করতেন তিনি ।
              ভেরলেন  মিউনিসিপালিটির সরকারি চাকরিতে যোগ দেন  ১৮৭০ সালে । কিন্তু তৃতীয় নেপোলিয়ানের পতনের পরবর্তী দ্রোহের সময়ে প্যারিস-শহর ও চাকরি ছেড়ে পালান । ১৯ সেপ্টেম্বর ১৮৭০ থেকে ২৮ জানুয়ারি ১৮৭১ পর্যন্ত প্রুসিয় সেনারা প্যারিস শহর ঘিরে ফরাসিদের জব্দ করতে চায় । সমস্ত কিছুর অভাব দেখা দেয় । কবি-লেখকরা লাতিন কোয়ার্টারের যে পাড়ার পানশালায় গিয়ে আড্ডা দিতেন সেখানেের ভোজন-তালিকায় ঘোড়া, কুকুর, বিড়াল এমনকি ইঁদুরের মাংস বিক্রি হতো । নারী আর পুরুষ বেশ্যারা এই খাবার একপেট খাবার বিনিময়ে সঙ্গমে রাজি হয়ে যেতো । এই সময় খবর রটে যায় যে বিসমার্ক পরামর্শ দিয়েছেন প্যারিসের ওপরে চারিদিক থেকে কামান দাগা হোক, কিন্তু ব্লুমেনথেল তা সামলে দেন এই তর্কে যে ফরাসি সেনার বদলে সাধারণ মানুষ তাতে মারা পড়বে । ভেরলেনসহ অনেকেই, যাঁরা প্যারিস কমিউনে যোগ দিতে চাননি, তাঁরা প্যারিস ছেড়ে পালান । ভেরলেন অবশ্য কমিউনের প্রেস অফিসার হিসাবে ১৮৭০-এ কাজ করেছিলেন আর কমিউন ভেঙে যাবার পর রাস্তায়-রাস্তায় খণ্ডযুদ্ধ আরম্ভ হলে অন্যান্য কবি-লেখকদের সঙ্গে গা ঢাকা দেন  ।
              পল ভেরলেনের জীবনযাত্রা, অপরাধ আর সাধাসিধে ছলাকলাশূন্যতার মাঝে দোল খেয়েছে । স্তেফান মালার্মে ও শার্ল বোদলেয়ারের সঙ্গে তাঁকে প্রতীকবাদী কবিতার ত্রিমূর্তির অন্তর্গত করলেও, দুটি প্রতীতি প্রাধান্য পায় : প্রথম হল যে কবির অহং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ; দ্বিতীয় যে কবিতার কাজ হল চরম সংবেদন ও একক ধৃতির মুহূর্তগুলোকে অক্ষুণ্ণ রাখা । Poemes saturniens ( ১৮৬৬ ) কাব্যগ্রন্হে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, “একে মিলোর তৈরি ভেনাস বলা হবে নাকি নিছক শ্বেতপাথর ?” তাঁর কবিতায় আপাত-অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা সত্বেও, তিনি কবিতার কারিগরিতে সহজ ও সঙ্গীতময় শব্দ প্রয়োগ করে সাবধানি কারুনৈপূণ্য বজায় রেখেছেন । ফরাসি ধ্রুপদি কবিতার খোলোসের মধ্যে থেকেও ছন্দবর্জনের খেলা খেলেছেন, যেমন ১৮৭৪-এ রচিত Romances sans Paroles কবিতায় লিখেছেন :
    “আমার হৃদয়ে ক্রন্দন
    শহরে বৃষ্টি পড়ার মতো”
              মাতিলদেকে নিয়ে ভেরলেন ভালোবাসার অনেকগুলো কবিতা লিখেছিলেন Le bonne chanson ( The Good Song ) কাব্যগ্রন্হে । কয়েকটার বাংলায়ন :
    এক নারীসন্ত তাঁর জ্যোতিতে
    এক নারীসন্ত তাঁর জ্যোতিতে,
    এক গিন্নিমা তাঁর মিনারে,
    মহিমা ও ভালোবাসা
    যা মানুষের শব্দাবলীতে আছে ;
    সোনার বার্তা যা বাঁশি
    বহুদূরের বনানী থেকে বাজায়,
    অবলা গর্বের সঙ্গে বিবাহিত
    যা বহুকাল আগের মহিমাময়ীদের ;
    তার সাথে, ধরা পড়ে না এমন সৌন্দর্য
    এক তরতাজা বিজয়িনী হাসির
    যা ফুটে উঠেছে রাজহাঁসের পবিত্রতায়
    আর এক নারী-শিশুর লজ্জায় ।
    মুক্তার মতো আদল, শাদা আর গোলাপি,
    এক মৃদু অভিজাত স্বরসঙ্গতি :
    আমি দেখি, আমি এই সবকিছু শুনতে পাই
    মেয়েটির শার্লমেনিয় বংশধরের নামে ।
    আমি অধর্মের পথে গিয়েছিলুম …
    আমি অধর্মের পথে গিয়েছিলুম,
    বেদনাদায়ক অনিশ্চিত
    তোমার প্রিয় হাত  ছিল আমার পথনির্দেশক।
    তাই দূরে দিগন্তের উপর ফ্যাকাশে
    ভোরের একটি দুর্বল আশা ছড়াচ্ছিল দ্যুতি;
    তোমার দৃষ্টিতে ছিল ভোর।
    চারিদিক নিঃশব্দ, তোমার সুরেলা পদক্ষেপ ছাড়া শব্দ নেই,
    ভ্রমণকারীকে উত্সাহিত করেছো তুমি।
    তোমার কন্ঠস্বর আমাকে বলেছিল: “এগিয়ে চলো !”
    আমার ভয়ঙ্কর হৃদয়, আমার ভারী হৃদয়
    একা কেঁদেছিল দুঃখের পথযাত্রায়
    ভালবাসা, আনন্দদায়ক বিজয়ী,
    আমাদের আনন্দের বাঁধনে আবার  একত্র করেছে।
           ১৮৬৫ সালে শার্ল বোদলেয়ার সম্পর্কে লেখা দুটি প্রবন্ধে ভেরলেন জানিয়েছিলেন যে একজন কবির অন্বেষন কেবল সৌন্দর্য । কবিতা রচনায়, তিনি বলেছেন, প্রেরণা আর আবেগের যৎসামান্য স্হান থাকলেও কবির থাকা দরকার কারিকুরির সৃষ্টিশীলতা । ব্যক্তিগত আবেগকে যদি ব্যবহার করতে হয় তাহলে ছন্দ, ধ্বনি এবং চিত্রকল্পকে একত্রিত করে একটি কাব্যিক সঙ্গীত গড়ে নিতে হবে এবং সেই জগতে কোনোকিছুই আপতনিক নয় । ভেরলেনের কারিগরির ফল হল তাঁর কবিতার সঙ্গীতময়তা ; ধ্বনিরা একত্রিত হয়ে এক সুরেলা ঐকতান সৃষ্টি করে । ১৮৮২ সালে তিনি বলেছিলেন, “L’Art poetique” কবিতায়, “কবির উচিত বিজোড়-মাত্রার পঙক্তি, যথাযথ-নয়-এমন শব্দভাঁড়ার এবং প্রচ্ছন্ন চিত্রকল্প ব্যবহার করা ; রঙের বদলে অতিসূক্ষ্ম তারতম্যকে গুরুত্ব দেয়া । কবিকে ইচ্ছাকৃত ছন্দ, বৈদগ্ধ্য ও বাগ্মীতা এড়াতে হবে । কবিতা হবে হালকা, বাতাসে ভাসমান, যৎসামান্য সুগন্ধময় ও ক্ষণিক । এছাড়া সমস্তকিছু কবিতা হয়ে ওঠার পরিবর্তে হয়ে উঠবে সাহিত্য ।” 
              সমসাময়িক বাস্তববাদ এবং বাগাড়ম্বরপূর্ণ অলঙ্কার বর্জন করে অন্যান্য প্রতীকবাদী কবিদের মতো পল ভেরলেনও উদ্দীপিত করতে চেয়েছেন মেজাজ, সত্তা । তাঁর কাব্যগ্রন্হ Fetes gallantes  এর অন্তর্গত Clair de Lune ( Moonlight ) “চাঁদের আলো” কবিতাটিকে মনে করা হয় তাঁর সবচেয়ে ভালো কাজ । যেভাবে চাঁদ তার আলো সূর্য থেকে পায়, ভেরলেন চাইলেন এমন বিষয়বস্তু বেছে নিতে যা সহজে অভিগম্য নয়, তাই চাঁদের মতো পরোক্ষভাবে বিষয়বস্তুকে দীপ্ত করতে চাইলেন, যা প্রতিফলন সৃষ্টি করে ।
               ভেরলেনের কবিতাটিতে আছে মুখোশ আর নৃত্য, অভূতপূর্ব ছদ্মবেশ, আহ্লাদিত ঝর্ণাদের ফোঁপানি, চাঁদের আলো : বিশেষকিছু না বলেই কবিতাটিতে ইশারামূলক ছবির স্লাইড চলে যায় একের পর এক । ডেভিড ওইসত্রাখ ও ফ্রিদা বাওয়ের এই কবিতাটিকে নিয়ে একটি নৃত্যনুষ্ঠান করেছেন । ক্লদ দেবুসি, রেনাল্দো হাহন, পোলদোস্কি, গুস্তাভ কার্পেন্তিয়ের এবং গ্যাব্রিয়েল ফাওরে নিজেদের মতো করে সুর দিয়েছেন কবিতাটিতে । ইংরেজিতে যাঁরা অনুবাদ করেছেন তাঁরা বলেছেন কবিতাটি অনুবাদ করা কঠিন। 
    Moonlight
    Your soul is like a landscape fantasy,
    Where masks and Bergamasks, in charming wise,
    Strum lutes and dance, just a bit sad to be
    Hidden beneath their fanciful disguise.
    Singing in minor mode of life’s largesse
    And all-victorious love, they yet seem quite
    Reluctant to believe their happiness,
    And their song mingles with the pale moonlight,
    The calm, pale moonlight, whose sad beauty, beaming,
    Sets the birds softly dreaming in the trees,
    And makes the marbled fountains, gushing, streaming–
    Slender jet-fountains–sob their ecstasies.
              আমি এখানে শুভদীপ নায়কের করা বাংলা অনুবাদ দিলুম । উনি নামকরণ করেছেন ‘জ্যোৎস্না’
    জ্যোৎস্না
    ( clair de lune / Moonlight)
    তোমার অন্তর এক প্রশস্ত কল্পনার মতো
    সেখানে মুখোশ ও মুখশ্রী দুই-ই প্রজ্জ্বলিত
    বীণার তার এবং নৃত্য, যা আসলে বেদনামথিত
    তোমাকে লুকিয়ে রাখে সৌন্দর্যের আড়ালে
    সঙ্গীতকে ধীরে ধীরে করে তোলো বৃহৎ জীবন
    ভালবাসাময়, নিশ্চল ও শান্ত
    তাদের সুখের ওপর বজায় রাখো বিশ্বাস
    সেইসব সঙ্গীত তুমি ধরে রাখো জ্যোৎস্নায়
    শান্ত পরাভব সেই জ্যোৎস্না, অপূর্ব ক্লেশে বিকশিত
    পাখিদের মতো এসে বসে স্বপ্নময় গাছের ডালে
    হয়ে ওঠে ঝর্ণা, চিত্তের প্রবাহ
    ঝর্ণার ঋজুতায়, — নিজস্ব উল্লাসে
              একজন মানুষের আত্মার রুপকশোভিত ছবিতে, ‘চাঁদের আলো’ জাগিয়ে তোলে সৌন্দর্য, ভালোবাসা আর প্রশান্তির আকাঙ্খা । কবিতাটি থেকে ক্রমবর্ধমান হতাশার যে আবহ গড়ে ওঠ তাতে পাওয়া যায় ভেরলেনের আত্মমগ্নতার কন্ঠস্বর । ভেরলেন পাঠকের মনে সন্দেহ তৈরি করতে চেয়েছেন, যাতে সে ভাবতে বাধ্য হয়, বাস্তবে কি সত্যিই ভালোবাসা আর আনন্দ পাওয়া সম্ভব । প্রধান উপমাটিকে প্রয়োগ করে তিনি বলতে চেয়েছেন যে প্রত্যেক মানুষই তার অন্তরজগতে একটা ভূদৃশ্য বহন করে, আর এই ক্ষেত্রে, যে উপাদান তৈরি হয় তা হলো একই সঙ্গে সুন্দর আর আশাহীন । অস্তিত্ব এবং যা দেখা যাচ্ছে, তার বৈপরীত্য কবিতাটির গুরুত্বপূর্ণ থিম । দৈহিক সৌন্দর্য আর বিষাদের মিশ্রিত অবস্হান ভেরলেন পেয়েছেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে । তাঁর মতে, মানুষের জীবনে এবং আত্মায়, অর্থাৎ মৃত্যুর পর, তার নিখুঁত হবার প্রয়াস কখনও পুরণ হবে না । জীবনের সত্যকার সত্তা উপরিতলে পাওয়া যাবে না ।
              ভেরলেনের সযত্নে রচিত কবিতার বনেদ প্রায়শই তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতানির্ভর, নিঃসন্দেহে নাটকীয় এবং আবেগমথিত বিষয়বস্তু । তাঁর “Poemes saturniens”     প্রস্তাবনায় স্পষ্ট যে তিনি নিজের অবজ্ঞাত, দৈন্যপীড়িত, দুর্দশাগ্রস্ত নিয়তি আঁচ করতে পেরেছিলেন । এই কাব্যগ্রন্হের সব কয়টি কবিতায় তিনি তুলে ধরেছেন অসুখী থাকার স্বপূরক প্রত্যাশার একাধিক বিন্যাস । আনন্দের ক্ষণিক মুহূর্ত ভেরলেনের  সমস্ত কবিতায় ছেয়ে আছে । এমনকি “Sagesse” গ্রন্হে, যেখানে রোমান ক্যাথলিক রহস্যময়তার কথা বলেছেন, এবং বলেছেন যে তাতেই আছে সর্বোচ্চ আনন্দ, ঈশ্বরের সঙ্গে শান্তিময় আলাপনের সময়েও তিনি অধঃপতনের সময় ফিরে আসার ভয়ে আতঙ্কিত । যেহেতু যৌনতা, ঈশ্বর আর আবসাঁথ তাঁর ‘শনিআক্রান্ত নিয়তি’ থেকে মুক্তি দিতে পারেনি, তাই তাঁকে শেষ পর্যন্ত অন্য আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে, এবং তা হল ঘুম । শেষ দিকের কবিতায় বারে বারে ঘুরেফিরে এসেছে ঘুমের কথা, চিত্রকল্পগুলো ঘুমের, যেন কমনীয় ঘুমপাড়ানি গানের মনোরম ছবি — তা থেকে রঙ, হাসি, তীক্ষ্ণতা, জমকালো, মাত্রাধিক ধ্বনি বাদ দেয়া হয়েছে — কবির ক্ষতবিক্ষত মনকে ঘুমের আরামে শান্তি দিতে পারে । বেশ কিছু কবিতায় এক মাতৃমূর্তিকে পাওয়া যায় দোলনার পাশে কিংবা এক মাতৃমূর্তি লক্ষ রাখেন ঘুমন্ত কবির পাশে দাঁড়িয়ে । যে কবিতায় ঘুমের মোটিফ নেই, তাতেও কবিতার শেষের পঙক্তিগুলোয় এসেছে মুছে যাবার রিক্ততাবোধ ।
              আলোচকরা ভেরলেনকে তাঁর কবিতার শিল্পানুগ ও গভীর অনুভূতির বৈশিষ্ট্যের কারণে ফরাসী প্রতীকবাদের অগ্রদূতদের একজন হিসাবে চিহ্ণিত করলেও, তিনি তাঁর কবিতাকে ডেকাডেন্ট বা প্রতীকবাদের তকমা দিতে অস্বীকার করে বলেছেন যে তিনি নিজেকে একজন ‘ডিজেনারেট’ বা অপজাত কবি বলতে চাইবেন, কেননা তাঁর কবিতায় থাকে অহংকার ও অরাজকতার প্রবণতা ; প্রতীকবাদীদের তুলনায় তিনি প্রচলিত ভাষাকে সঙ্গীতময় করেছেন তাঁর কবিতায়। প্রকৃতপক্ষে ভেরলেনের জীবনের ঘটনাবলী ছেয়ে ফেলেছে তাঁর কবিতার গুণাগুণ ও কাব্যিক প্রতিভা । যেমন তাঁর জীবনে, তেমনই তাঁর কবিতায়, অবিরম লড়াই দেখা যায় তাঁর অন্তরজগতের সঙ্গে তাঁর ইন্দ্রিয়ের, লাম্পট্য ও পশ্চাত্যাপের । তাঁর চরিত্রকে আক্রমণ সত্বেও, ভেরলেনকে মনে করা হয় একজন সুসম্পূর্ণ কবি, যাঁর অসাধারণ প্রতিভা দেখা যায় কবিতার অঘনিভূত মাত্রায়, ইশারামূলক ও লাক্ষণিক ভাষায় এবং প্রতিচ্ছায়াময় বাক্যালঙ্কারে । ফরাসি কবিতাকে ভেরলেনই পরিভাষাগত প্রাবল্যের বাইরে বের করে আনেন এবং ফরাসী ভাষার সহজাত সঙ্গীতময়তাকে ব্যবহার করা আরম্ভ করেন । তিনি বলেছেন কবিতা হওয়া উচিত  সুখশ্রাব্য ও সন্মোহক, অস্পষ্ট ও দ্রবনীয় ; পাঠক কবিতাকে বিভিন্ন থিমে চিহ্ণিত করতে পারবেন, এমন কবিতা লেখা তিনি পছন্দ করেন না  । সেকারণেই তাঁর কবিতার অনুবাদে তাঁকে সম্পূর্ণ পাওয়া যায় না। তাঁর বক্তব্য বোঝাবার জন্য ভেরলেন কবিতার শিল্প (Art Poetique )    শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন ; আমি বাংলায়নের চেষ্টা করেছি :
     সবকিছুর আগে সঙ্গীতময়তা–
    আর এর জন্য আরও অস্বাভাবিকতা–
    অস্পষ্ট ও আরও বেশি বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া, 
    তাকে ভার বইতে হয় বা বেঁধে ফেলতে হয় তাকে বাদ দিয়ে দাও
    তাকে এমন হতে হবে যে তুমি খুঁজে বেড়াবে
    তোমার শব্দগুলোয় কোনোরকম গাফিলতি ছাড়াই :
    ধূসর গান ছাড়া প্রিয় আর কিছু নেই
    যেখানে বিচলন ও যথাযথের মিল হয় ।
    আনেকটা কালোজালের আড়ালে সুন্দর চোখের মতন, 
    অনেকটা ছড়িয়ে-পড়া দুপুরের স্পন্দনের মতন,
    অনেকটা ( যখন হেমন্তের আকাশ শোভনীয় করে তোলে )
    সুস্পষ্ট নক্ষত্রদের নীল বিশৃঙ্খলা !
    কেননা আমরা আরও বেশি চাই সূক্ষ্ম তারতম্য–
    রঙ নয়, সূক্ষ্ম তারতম্য ছাড়া কিছু নয় !
    ওহ ! কেবল সূক্ষ্ম তারতম্য নিয়ে আসে
    স্বপ্নকে স্বপ্নের মধ্যে আর বাঁশিকে শিঙায় !
    খুনির ধারালো বক্তব্য থেকে দূরে রাখো,
    নিষ্ঠুর বৈদগ্ধ  আর পঙ্কিল হাসি,
    যা নীল শূন্যতার চোখে অশ্রূজল এনে দ্যায়—
    আর মৃদু আঁচের যাবতীয় রসুনরান্না ।
    বাগ্মীতাকে ধরে তার ঘাড় মুচড়ে দাও !
    তোমার তাতে ভালো হবে, কর্মচঞ্চল মেজাজে,
    যাতে কবিতার মিলকে কিছুটা সুবিচার করা যায় ।
    যদি না লক্ষ রাখা হয়, তাহলে তা কোথায় যাবে ?
    ওহ, কে আমাদের বলতে পারে মিলের ভ্রষ্ট আচরণ ?
    কোন বধির বালক কিংবা উন্মাদ কালো মানুষ
    আমাদের জন্য বানিয়েছে এই এক পয়সার খেলনা,
    যা ফাঁপা শোনায় আর শুনে মনে হয় নকল
    সঙ্গীতকে হয়ে উঠতে দাও, অনেক বেশি করে আর সবসময় !
    তোমার কবিতা হয়ে উঠুক চলমান জিনিস
    যাকে অনুভব করে মনে হবে তা বদলে যাওয়া আত্মা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে,
    অন্য আকাশ থেকে অন্য প্রেমের দিকে ।
    তোমার কবিতাকে আনন্দময় ঘটনা হয়ে উঠতে দাও,
    অস্হির ভোরের বাতাসের মাঝে,
    যা পুদিনা আর থাইমলতার সুগন্ধ নিয়ে উড়ে বেড়ায়…
    আর বাদবাকি সমস্তই সাহিত্য ।
              ফ্রান্সে, রোমান্টিসিজমের পর, তখন রোমান্টিসিজম বলতে যা বোঝাতো, আর পারনাসিয়দের দ্ব্যর্থহীন, ধ্রুপদি, অতিরিক্ত যত্নবান,  চিত্তাকর্ষকভাবে মোহনীয় কবিতার যুগের পর, সমাজ যখন কলকারাখানার আধুনিকতাবাদী সমাজে অনিশ্চিত জীবনযাপনের মুখোমুখি হওয়া আরম্ভ করল, গ্রাম থেকে দলে-দলে পরিবার শহরে অনিশ্চিত জীবনধারায় বসবাস করতে আরম্ভ করল,তখন পল ভেরলেনের মতন কবিরা কবিতায় অনিশ্চয়তার ও অনির্ণেয়তার প্রয়োজন অনুভব করলেন । পল ভেরলেনের ‘আর্ট পোয়েটিক’ কবিতাটি বাস্তব জীবনে অনিশ্চয়তার উপস্হিতিকে কবিতায় আনতে চেয়েছে । তিনি অনুভব করলেন যে মানুষ চায় না  তাকে সীমা দিয়ে বেঁধে রাখা হোক, সে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকতে চায় । নিজের বিবাহিত জীবন এবং পায়ুকামীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও কারাগারের জীবন থেকে তেমনটাই তাঁর মনে হয়ে থাকবে । ১৮৭৪ সালে যখন তিনি বললেন, ‘প্রথম এবং সর্বাগ্রে সঙ্গীত’, তখন ফরাসি কবিতায় নতুন কিছুর কথা বললেন তিনি । ফরাসি কবিতা চিরকালই সঙ্গীতময় ছিল, কিন্তু ভেরলেনের আগে কেউ বলেননি যে সঙ্গীতই কবিতায় মূল ব্যাপার । তার আগে তো ছিলই উপলবব্ধির গভীরতা, দৃষ্টিলব্ধ অবধারণা, বাচনিক নমনীয়তা ও পারিপাট্য । ভেরলেন সঙ্গীতকে কবিতায় গৌরবান্বিত করলেন । কবিতায় সঙ্গীত অদেখা বাস্তবতা সম্পর্কে যথাযথ হবার উপায় বাতলায় এবং যে বাস্তবতা স্পষ্টভাবে প্রভাবান্বিত করে তাকে কবিতার সিংহাসনে বসায় ।
    চার
              পল ভেরলেন আদেনেস থেকে জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো নামে সতেরো বছরের এক কবিযশোপ্রার্থীর চিঠি আর চিঠির সঙ্গে তার লেখা কয়েকটি কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলেন,  আর তাকে গাড়িভাড়া পাঠিয়ে বললেন প্যারিসে চলে আসতে । ১৮৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শার্লভিল থেকে প্যারিস পৌঁছোলেন র‌্যাঁবো, সঙ্গে নিজের পাণ্ডুলিপি নিয়ে, যার মধ্যে একটি কবিতার শিরোনাম ছিল, ‘দি ড্রাঙ্কেন বোট’ বা ‘মত্ত নৌকো’ । স্টেশনে কেউ ছিল না তাঁকে আপ্যায়ন করার জন্য। ভেরলেন, তাঁর বন্ধু শার্ল গ্রস্ত-এর সঙ্গে গার দু নর্দ আর গার্দ দ্যলেস্ত-এর মাঝে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন তরুণ অতিথির জন্য । শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মমার্ততে মাতিলদের বাবা-মায়ের বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন ; পল ভেরলেন বিয়ের পর শশুরবাড়িতে থাকতেন । পথে তাঁরা খুঁজে পেলেন রোদে পোড়া গম্ভীর-মুখ, নীল চোখ, তরুণটিকে, যে, তাঁদের সঙ্গে আরদেনেসের বাচনভঙ্গীতে হ্যাঁ-হুঁ করে সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে কথা বলল ।   
              বারো বছর পরে তাঁর স্মৃতিচারণে ভেরলেন লিখেছেন যে, “তরুণটি ছিল দীর্ঘ, শক্ত কাঠামোর, খেলোয়াড়দের মতো আদরা, নিখুঁত ডিম্বাকার মুখ, যেন নির্বাসন থেকে ফেরা এক দেবদূত ; দেহের শক্ত কাঠামোর ওপরে শিশুসূলভ গালফোলা মুখ, হাবভাবে বয়ঃসন্ধি কাটিয়ে দ্রুত বেড়ে-ওঠা জবুথবুপনা ।” ভেরলেনের স্ত্রী আর শাশুড়ি তরুণটিকে বাড়িতে নিয়ে আসা যে ভালো হয়নি তা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, কিন্তু তাড়াতে পারলেন না কেননা ভেরলেনের শশুর সেসময়ে বন্ধুদের সঙ্গে শিকারে গিয়েছিলেন । এক দিনেই তাঁরা টের পেলেন যে অতিথিটি চাষাড়ে, বাড়ির বাইরে বেরিয়ে উলঙ্গ হয়ে রোদ পোয়ায়, যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছিল তাকে করে ফেলেছে নোংরা আর লণ্ডভণ্ড, যিশুর ছোটো ক্রস ভেঙে ফেলেছে, চুলে উকুন । ভেরলেন যা করতে চাইতেন অথচ করার সাহস পেতেন না, অতিথিকে সেসব করতে দেখে পুলক বোধ করছিলেন । 
              অতিথিকে বন্ধুদের আড্ডায় নিয়ে গেলেন ভেরলেন । লিয়ঁ ভালাদে নামে ভেরলেনের এক বন্ধু তাঁর আরেক বন্ধুকে লিখে জানিয়েছিলেন, “তুমি পল ভেরলেনের নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ পেলে না, ভেরলেন যে তরুণটির জন দ্য ব্যাপটিস্ট ; বড়ো-বড়ো হাতের চেটো, বড়ো-বড়ো পা, মুখ যেন তেরো বছরের বাচ্চার, চোখ দুটো নীল, আর তরুণটি ভিতু মনে হলেও, মতামত অসামাজিক মনে হলো, কল্পনাশক্তি অজানা কুকর্মে ঠাশা, বন্ধুরা তো সবাই তাকে দেখে একই সঙ্গে মুগ্ধ আর আতঙ্কিত । তরুণটি যেন ডাক্তারদের মাঝে একজন শয়তান ।” প্রকাশক গঁকুরভাইদের একজন জানিয়েছেন যে ভেরলেনের অতিথির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মনে হচ্ছিল সবচেয়ে বজ্জাত কোনো খুনির হাত । 
              মাতিলদের বাবার ফেরার আগের দিন ভেরলেনের অতিথিকে নিজের বাড়িতে কয়েকদিন রাখলেন শার্ল ক্রস ; তারপর পারনাসিয় কবি থিয়োদোর দ্যবাঁভিলের বাড়িতে চাকরানির ঘরে স্হান পেলেন । প্রথম রাতে জানলা দিয়ে নিজের ভিজে জামা-কাপড় রাস্তায় ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেললেন তরুণটি, চিনামাটির বাসন ভেঙে ফেললেন, বিছানায় কাদামাখা জুতো পরে শুলেন, আর গোপনে কয়েকটা আসবাব বেচে দিলেন । বাঁভিলও এক সপ্তাহ কাটতেই ভেরলেনকে বললেন নিজের অতিথিকে ফেরত নিয়ে যেতে । তরুণটির আচরণে একমাত্র ভেরলেনই আহ্লাদিত হচ্ছিলেন । মাতিলদেকে নিয়ে কবিতাগুলো লেখার পর ভেরলেন নতুন কবিতা লেখার সময় পাননি। তরুণটি তাঁকে ওসকাচ্ছিলেন অনভিজাতের মতো জীবন কাটাতে এবং মদে চুর হয়ে দ্রষ্টার মতো কবিতা লিখতে । তাছাড়া পল ভেরলেন পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর পায়ুকামের আদর্শ সঙ্গী, যাকে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আরেক বন্ধুর বাড়িতে রক্ষিতার মতন লুকিয়ে রাখতে হচ্ছিল। ভেরলেন তাঁর অভিজাত পোশাক ছেড়ে নামানো-টুপি আর গলায় মাফলার ধরেছিলেন, অতিথির জন্য টাকাকড়ি খরচ করছিলেন প্রচুর । তাঁদের পায়ুকামের সম্পর্ক যখন আর গোপন রইলো না তখন ভেরলেনের বন্ধুরা তাঁর পাশ থেকে সরে যেতে লাগলেন । দুজনে মিলে গুহ্যদ্বার নিয়ে একটা সনেট লিখলেন ( Sonnet du trou cul ), যার প্রথম আট লাইন ভেরলেনের এবং পরের ছয় লাইন র‌্যাঁবোর । কবিতাটা ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনেকে অনুবাদ করেছেন ; আমি পল শ্মিট-এর অনুবাদটা দিলুম এখানে :
    Hidden and wrinkled like a budding violet
    It breathes, gently worn out, in a tangled vine
    (Still damp with love), on the soft incline
    Of white buttocks to the rim of the pit.
    Thin streams like rivers of milk ; innocent
    Tears, shed beneath hot breath that drives them down
    Across small clots of rich soil, reddish brown,
    Where they lose themselves in the dark descent…
    My mouth always dribbles with its coupling force;
    My soul, jealous of the body’s intercourse,
    Makes it tearful, wild necessity.
    Ecstatic olive branch, the flute one blows,
    The tube where heavenly praline flows,
    Promised Land in sticky femininity.
              র‌্যাঁবোকে একই সঙ্গে চরস আর আবসাঁথ খাইয়ে ভেরলেন অতিথিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে, যার অন্বেষণ করছিলেন তিনি, ‘ইন্দ্রিয়গুলোর অপরিমেয় ও নিয়মানুগ বিশৃঙ্খলা’ ঘটানোর জন্য । ২১ অক্টোবর ১৮৭১ ভেরলেনের ছেলের জন্ম হলো এবং সংবাদটিতে আনন্দিত হবার বদলে ক্রুদ্ধ হলেন তিনি । মাতিলদে জানিয়েছেন যে অক্টোবর ১৮৭১ থেকে জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত ভেরলেন তাঁকে মারধর করতেন আর খুন করার হুমকি দিতেন, একদিন সত্যিই গলা টিপে ধরেছিলেন, হাতখরচ না পেয়ে । স্বামীর দুর্ব্যাবহার আর মা-বাবার কাছে লুকোতে পারলেন না মাতিলদে, কেননা মাতিলদের দেহে আঘাতের চিহ্ণ আর স্বামীর কথা জিগ্যেস করলেই তাঁর কান্না থেকে তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো নামে চাষার ছেলেটা আসার পরে কি ঘটছে মেয়ের শোবার ঘরে । জামাইয়ের পায়ুকামের প্রতি আকর্ষণের খবরও তাঁদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল । ডাক্তার ডেকে মাতিলদেকে পরীক্ষা করিয়ে মেয়ে আর মেয়ের ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন তাঁদের পারিবারিক বাড়ি পেরিজিউতে ।
              স্ত্রী চলে যাবার পর ভেরলেন বিয়েটা বাঁচানোর চেষ্টায় র‌্যাঁবোকে বললেন বাড়ি ফিরে যেতে ; সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে গেলে দুজনে আবার একত্রিত হতে পারবেন । প্যারিসে আসার ছয় মাস পরে মার্চ ১৮৭২ সালে বাড়িমুখো হলেন র‌্যাঁবো ; তিনি জানতেন যে তাঁকে ছাড়া ভেরলেনের চলবে না । মাতিলদে ছেলেকে নিয়ে প্যারিসে ফিরলেন, তাঁর মনে হলো মিটমাট হয়ে গেছে, চাষার ছেলেটা বিদেয় হয়েছে । ভেরলেনও চাকরি খুঁজতে লাগলেন । কিন্তু গোপনে চিঠি লিখতে লাগলেন র‌্যাঁবোকে, জানতে চাইলেন কেমন করে কোথায় দুজনে মিলিত হবেন । পায়ুকামর নেশায় ভেরলেনের কবিতা থেকে মিনার্ভা আর ভিনাস বিদায় নিয়েছিলেন । র‌্যাঁবোর প্রভাবে ভেরলেন তাঁর অন্তরজগতে লুকিয়ে থাকা দানবটাকে বাইরে বের করে আনার সুযোগ পেয়ে গেলেন । ভেরলেনের দানবকে সহ্য করতে না পেরে ১৮৭২ সালে মেয়ের সঙ্গে আইনি বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দিলেন মাতিলদের বাবা, তখনও ডিভোর্স প্রচলিত হয়নি । ১৮৮৪ সালে ডিভোর্স আইনসঙ্গত হলে মাতিলদের সঙ্গে ভেরলেনের ডিভোর্স হয় । মাতিলদে আবার বিয়ে করেছিলেন এবং একষট্টি বছর বয়সে মারা যান ।
            ১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বরে ভেরলেন আর র‌্যাঁবো লণ্ডন পৌঁছোলেন ; সেইসময়ে লণ্ডন ও বিশেষ করে সোহো ছিল ফরাসি কমিউনের পলাতক সদস্যদের লুকোবার পক্ষে ভালো জায়গা । কমিউনের প্রতি ভেরলেনের আগ্রহ থাকলেও র‌্যাঁবোর ছিল না । ভেরলেনকে তাঁর বুর্জোয়া মানসিক গঠন থেকে মুক্তি দেবার জন্য র‌্যাঁবো তাঁকে উৎসাহিত করলেন মুসেত এবং লেকঁত দ্যলিজের কবিতা পড়তে, ফরাসি কবিতার বারো মাত্রার ঐতিহ্য এবং ব্যালাডের আট মাত্রা অনুসরণ না করে দশ মাত্রার কবিতা লিখতে । র‌্যাঁবো তাঁকে পরামর্শ দিলেন কবিতা থেকে মানবিক কাহিনি, বাস্তববাদী ছবি আর ভাবপ্রবণ প্রতিকৃতি বাদ দিতে । পল ভেরলেনের মতে র‌্যাঁবোর ভালো লেগেছিল লণ্ডন ; তিনি ভেরলেনকে বলেছিলেন যে লণ্ডনের তুলনায় প্যারিসকে শহরতলি মনে হয়, লণ্ডনে রয়েছে কয়লা-চালিত ফ্যাক্ট্রি, টেমস নদীর ধারে জাহাজের ডক এবং সর্বোপরি একটি সাম্রাজ্যের রমরমা। ভেরলেন সেসমস্ত ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না, তিনি কেবল কচি-তরুণ র‌্যাঁবোর সঙ্গে দৈহিক মিলনেই বেশি আনন্দ পেতেন, লণ্ডনে তাঁদের যথেচ্ছাচারে বাধা দেবার কেউ ছিল না । র‌্যাঁবোর ‘নরকে এক ঋতু’ কবিতার ‘ফুলিশ ভার্জিন’ প্রসঙ্গ ভেরলেন সম্পর্কে । তাঁরা ডেরা নিয়েছিলেন কামডেনের গ্রেট কলেজ স্ট্রিটে ( এখন রয়াল কলেজ স্ট্রিট ); বাড়িটিতে একটা প্লেট লাগানো আছে যে তাঁরা দুজনে সেখানে ছিলেন । নিজেদের ‘উৎকট দম্পতি’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন র‌্যাঁবো । লণ্ডন থেকে প্যারিসে এক বন্ধুকে ভেরলেন লিখেছিলেন যে, “আমি আর ফরাসি সংবাদপত্র পড়িনা ; পড়ে হবেই বা কি?” তাঁরা দুজনে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রন্হাগারে যেতেন বটে কিন্তু পল ভেরলেন যেতেন শহরের শীত থেকে বাঁচার জন্য, যখন কিনা র‌্যাঁবো  যেতেন বিনে পয়সায় কাগজ-কলম-কালি পাওয়া যেতো বলে। বইপত্র পড়তেন । লণ্ডনের বাইরে বেড়াতে যেতেন দুজনে, ভেরলেন হ্যাম্পস্টেড হিথের কথা লিখেছেন, গ্রামাঞ্চল দেখার জন্য । র‌্যাঁবোকে ছাড়তে না পারার কারণ হিসাবে ভেরলেন লিখেছেন যে, এক ধরণের মিষ্টতা ঝলকাতো ওর নিষ্ঠুর ফিকে-নীল চোখে আর লালচে ঠোঁটের কটু ইশারায় । ইতিমধ্যে র‌্যাঁবো তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘মত্ত নৌকো’র আঙ্গিক ছেড়ে নতুন ধরণের গদ্য-কবিতার দিকে ঝুঁকছিলেন, যার পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁর ‘নরকে এক ঋতু’ আর ‘ইল্যুমিনেশান্স’-এর কবিতাগুলোতে ।
           লণ্ডন তাঁদের দুজনকেই অবাক করেছিল, আহ্লাদিত করেছিল । ভেরলেন বিস্মিত হয়েছিলেন দিগন্ত পর্যন্ত চলে যাওয়া রেলপথ আর লোহার সেতু দেখে, আর পথে-পথে নির্দয়, বারফট্টাই-মারা জনগণকে দেখে । ভেরলেন লিখেছেন লণ্ডন ছিল অতিশালীন, কিন্তু অসচ্চরিত্র হবার সব রকমের সুযোগ ছিল অবারিত, আর প্রচুর খরচ সত্বেও, তাঁরা সদাসর্বদা থাকতেন এইল, জিন আর আবসাঁথে মাতাল । আবসাঁথের সবুজ পরী র‌্যাঁবোকে ডাক দিয়েছিল ‘স্বরবর্ণ’ নামের কবিতাটি লিখতে ।
    স্বরবর্ণ
    A কালো, E শাদা, I লাল,  U সবুজ, O নীল : স্বরবর্ণ
    কোনো দিন আমি তোমার জন্মাবার কান্না নিয়ে কথা বলবো,
    A, মাছিদের উজ্বল কালো মখমল জ্যাকেট
    যারা নিষ্ঠুর দুর্গন্ধের চারিধারে ভন ভন করে,
    ছায়ার গভীর খাত : E, কুয়াশার, তাঁবুগুলোর অকপটতা,
    গর্বিত হিমবাহের, শ্বেত রাজাদের বর্শা, সুগন্ধলতার শিহরণ :
    I, ময়ূরপঙ্খীবর্ণ, রক্তাক্ত লালা, নিঃসঙ্গের হাসি
    যার ঠোঁটে ক্রোধ কিংবা অনুশোচনায় মাতাল :
    U, তরঙ্গ, ভাইরিডিয়ান সমুদ্রের দিব্য কম্পন,
    চারণভূমির শান্তি, গবাদিপশুতে ভরা, হলরেখার শান্তি  
    কিমিতির চওড়া পড়ুয়া ভ্রুজোড়া দিয়ে বিরচিত :
    O, চরম তূর্যনিনাদ, অদ্ভুত কর্কশ আওয়াজে ভরপুর,
    জগত আর দেবদূতে রেখিত নৈঃশব্দ :
    O, সমাপ্তি, মেয়েটির চোখের বেগুনি রশ্মি !
            র‌্যাঁবো খ্রিসমাসের জন্য বাড়ি ফিরলেও ভেরলেন ফিরতেন না ;র‌্যাঁবোর সমস্যা ছিল মা সবসময় বলতেন একটা চাকরি খুঁজে জীবনে স্হির হতে । ভেরলেন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন সংসারের বাঁধন থেকে, দায়িত্ব থেকে, এবং পাপবোধে ভুগে কাঁদতেন মাঝেমধ্যে ; তাঁর কাছে র‌্যাঁবো ছিলেন ‘দীপ্তিময় পাপ’ আর র‌্যাঁবোর কাছে ভেরলেন ছিল ‘ক্ষুদে প্রিয়তমা’ । ইংরেজি শব্দের তালিকা তৈরি করেছিলেন এবং লণ্ডনে চাকরি খুঁজতে আরম্ভ করেছিলেন ভেরলেন। ফ্রান্সের গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে পল ভেরলেনের ওপর লক্ষ রাখা হচ্ছিল। তাঁর ভবিষ্যতের জীবনীকার এদমন্দ লেপেলেতিয়েকে ভেরলেন লিখেছিলেন যে, “আশা করছি কয়েক দিনের মধ্যেই একটা বড়ো সংস্হায় চাকরি পাবো, যেখানে প্রচুর রোজগার করা যাবে, ইতিমধ্যে আমি কয়েকটা আমেরিকান সংবাদপত্রের জন্য কাজ করছি যারা ভালো পয়সাকড়ি দ্যায় ।” লেপেলেতিয়ে তার কোনো প্রমাণ পাননি, এবং সবই ভেরলেনের বানানো, ফরাসি কবিদের ঈর্শ্বান্বিত করার জন্য । দুজন ভবঘুরে লণ্ডনের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন কাজের জন্য কিন্তু কারোর সাড়া তাঁরা পাননি । লেপেলেতিয়ে একটা কাগজের বিজ্ঞাপন জোগাড় করতে পেরেছিলেন, সম্ভবত র‌্যাঁবোর তৈরি খসড়া :
    এক ফরাসি ভদ্রলোক ( ২৫ ), অভিজাত সমাজে যাঁর ভালো যোগাযোগ আছে, উচ্চশিক্ষিত, ফরাসি ডিপ্লোমাধারী, ইংরেজিতে সড়গড়, এবং বিপুল সাধারণ জ্ঞানের মানুষ, ব্যক্তিগত সচিব, পর্যটনের সঙ্গী কিংবা গৃহশিক্ষকের চাকরি খুঁজছেন । সম্ভ্রান্তদের সুপারিশ আছে । ঠিকানা : ২৫ ল্যানঘাম স্ট্রিট ।
              র‌্যাঁবোর ‘ইল্যুমিনেশান্স’-এর ‘ভবঘুরে’ কবিতাটি ( ১৮ নং ইল্যুমিনেশান ) তাঁদের দুজনের সেই সময়টিকে ধরে রেখেছে :
    সমব্যথী ভাই ! ওর কাছে আমার কোনও নৃশংস নিশিপালন আছে ! ‘আমি এই ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপ্রচেষ্টাকে দখল করে নিতে বিফল হয়েছিলুম । আমি ওর অকর্মণ্যতা নিয়ে ঠাট্টা করেছিলুম । যদি আমাদের নির্বাসনে যেতে হয়, কেনা-গোলমী করতে হয়, তা হবে আমার দোষ।’ অদ্ভুত দুর্ভাগ্য আর বোকামির জন্য ও আমার প্রশংসা করেছিল, আর তার সঙ্গে জুড়েছিল অশান্তিকর কারণ ।
    এই শয়তান পণ্ডিতকে আমি বিদ্রুপ করে উত্তর দিয়েছি, আর জানালার কাছে গিয়ে তা শেষ করেছি । বিরল সঙ্গীতরেখার চালচলনের অপর পারের চারণভূমিতে আমি ভবিষ্যতের রাতের বিলাসের মায়াপুরুষ গড়েছি ।
    এই অস্পষ্ট স্বাস্হবিধিসন্মত চিত্তবিক্ষেপের পর, আমি খড়ের মাদুরের ওপরে হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে পড়তুম । এবং, বলতে গেলে প্রতি রাতে, যেই আমি ঘুমিয়ে পড়তুম, বেচারা ভাইটি উঠে পড়তো, মুখে দুর্গন্ধ, চোখে দেখতে পাচ্ছে না — যেমন ও নিজের সম্পর্কে স্বপ্ন দেখতো — আর নিজের নির্বোধ কান্নার স্বপ্নে বিভোর আমাকে ঘরের ভেতরে টানাটানি করতো !
    বাস্তবিক, সত্যি বলতে কি, আমি ওকে ওর সূর্যসন্তানের প্রাগৈতিহাসিক স্হতিতে ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা করেছিলুম — আর আমরা ঘুরে বেড়ালুম, গুহার মদে ভরণপোষণ করে, আর পথের বিসকিট খেয়ে, আমি পরিসর আর ফরমুলা খুঁজে পাবার জন্যে অধৈর্য ।
              তাঁদের দুজনের ঝগড়া গ্রেট কলেজ স্ট্রিটেই আরম্ভ হয়েছিল । তাঁদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছিল । র‌্যাঁবো মাঝে একদিন ছুরি দিয়ে ভেরলেনের উরুতে আঘাত করেছিলেন । প্রেমিকের আঘাতের আদর বলে মেনে নিয়ে কাউকে জানাননি ভেরলেন । এই বিষয়ে ভেরলেন লিখেছেন, “আমি বাড়ি ফেরার সময়ে দেখলুম জানলা দিয়ে র‌্যাঁবো আমায় দেখছে । অকারেণেও আমাকে দেখে অপমানজনক ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে লাগলো। যাহোক আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠলুম আর ঘরে ঢুকলুম । ‘তোমার কি কোনো ধারণা আছে এক হাতে একবোতল তেল আর অন্য হাতে একটা মাছ ঝুলিয়ে কেমন দেখাচ্ছিল তোমায় ?’ বলল র‌্যাঁবো । আমি তার জবাবে বললুম, আমি তোমাকে জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাকে মোটেই উপহাসাস্পদ দেখায়নি ।’  ভেরলেন মাছটা দিয়ে র‌্যাঁবোর  মুখে সপাটে মারলেন আর জানালেন যে তিনি আত্মহত্যা করে নেবেন । ভেরলেন চটে গিয়ে জাহাজ ধরে সোজা চলে গেলেন বেলজিয়াম, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগাবার উদ্দেশে । সেখানে মাতিলদে ছিলেন ।  
             র‌্যাঁবো কিছুক্ষণ পরেই ডকে পৌঁছে টের পেলেন যে ভেরলেন, তাঁর ‘বুড়ি শূকরী’ , সত্যিই চলে গেছেন । নিষ্কপর্দক র‌্যাঁবোকে সাহায্য করার কেউ ছিল না, আর যারা ছিল তারা দুজনের দৈহিক সম্পর্ক জানতে পেরে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছিল ।  র‌্যাঁবো ভেরলেনকে চিঠি দিলেন :
    তুমি কি মনে করো যে আমার বদলে অন্য লোকেদের সঙ্গে থাকলে তুমি আনন্দে থাকবে ? ভেবে দ্যাখো ! নিশ্চয়ই না ! আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে ভবিষ্যতে আমি তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব । আমি তোমাকে অত্যন্ত ভালোবাসি, আর তুমি যদি ফিরতে না চাও, কিংবা আমি তোমার কাছে যাই তা না চাও, তুমি একটা অপরাধ করছ, আর তার জন্য তুমি সমস্ত স্বাধীনতা হারিয়ে বহুকাল আফশোষ করবে, আর এতো ভয়ঙ্কর দুঃখদুর্দশায় ভুগবে যার অভিজ্ঞতা তোমার কখনও হয়নি ।
              ১৮৭৩ সালের ৮ জুলাই র‌্যাঁবোকে টেলিগ্রাম করলেন ভেরলেন ব্রুসেলসের হোটেল লিজে পৌঁছোতে । ভেরলেনের জামাকাপড় বেচে র‌্যাঁবো পৌঁছোলেন বেলজিয়ামের হোটেলে যেখানে ভেরলেন ছিলেন । দুজনের মনের মিল হল না, টানা কথা কাটাকাটি চলল । ভেরলেন একের পর এক আবসাঁথের বোতল খালি করে মাতাল হয়ে থাকতে চাইলেন । ১০ জুলাই তিনি একটা রিভলভার আর গুলি কিনলেন, আত্মহত্যা করবেন ভেবে । চারটে নাগাদ মাতাল অবস্হায় দুটো গুলি চালালেন র‌্যাঁবোকে লক্ষ করে । একটা গুলি লক্ষভ্রষ্ট হল, অন্যটা লাগল র‌্যাঁবোর কনুইতে । আঘাতকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে সঁ-জাঁ হাসপাতালে ড্রেসিং করিয়ে ব্রুসেলস ছাড়ার কথা ভাবলেন র‌্যাঁবো । সন্ধ্যা আটটা নাগাদ র‌্যাঁবোকে গারে দু মিদি রেলস্টেশনে ছেড়ে দেবার জন্য ভেরলেন আর ভেরলেনের মা গেলেন । আদালতে র‌্যাঁবোর সাক্ষ্য অনুযায়ী ভেরলেন পাগলের মতো আচরণ করছিলেন আর তাঁর পকেটে পিস্তলও ছিল । র‌্যাঁবো পুলিশের একজন টহলদারকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে বললেন তাঁকে ভেরলেনের থেকে বাঁচাতে । ভেরলেন গ্রেপ্তার হলেন, তাঁর বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ উঠল, আদালতে তাঁদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে উকিল আর ডাক্তারদের প্রশ্নের মুখে পড়লেন ভেরলেন । 
              ১৭ জুলাই র‌্যাঁবোর বুলেট বের করার পর তিনি নালিশ তুলে নিলেন । পুলিশকে দেয়া বয়ানে র‌্যাঁবো লিখেছিলেন যে, গুলি চালিয়েই ভেরলেন তাঁর অপরাধের জন্য তক্ষুনি ক্ষমা চেয়ে নিলেন । পিস্তলটা আমার হাতে দিয়ে বললেন তাঁর কপাল লক্ষ করে গুলি চালাতে। তাঁর আচরণ ছিল গভীর অনুতাপের । ভেরলেনের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ তুলে নিয়ে কেবল আঘাত করার অভিযোগ বজায় রইলো । তাঁদের পরস্পরের পায়ুকাম নিয়ে আদালতে অপমানজনক কথাবার্তা হলেও তাকে অপরাধ বলে মনে করা হয়নি এবং পুলিশ আরোপ করেনি । ৮ই আগস্ট ১৮৭৩ ভেরলেনের দুই বছরের কারাদণ্ডের আদেশ হল ।
              র‌্যাঁবো শার্লভিল ফিরে গিয়ে ‘নরকে এক ঋতু’ লেখা শেষ করলেন । তাতে ভেরলেনকে তিনি ‘উন্মাদিনী ভার্জিন’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন, আর নিজেকে ‘নারকীয় স্বামী’ হিসাবে আর তাঁদের একসঙ্গে বসবাসকে বলেছেন ‘গার্হস্হ প্রহসন’। ১৮৭৪ সালে র‌্যাঁবো ফিরেছিলেন লণ্ডনে, কবি জারমেইন নোভোর সঙ্গে, তিন মাস ছিলেন একসঙ্গে । এই সময়ে তিনি ‘ইল্যুমিনেশান্স’-এর গদ্য-কবিতাগুলো লেখা শেষ করেন । কিন্তু পায়ুকামের নায়ক-নায়িকা বা আদম-ইভের কাহিনি এখানেই ফুরোয়নি । জেল থেকে র‌্যাঁবোকে চিঠি লিখতেন আর নিজের নতুন লেখা কবিতা পাঠাতেন, যেগুলো পড়ে র‌্যাঁবো মোটেই উৎসাহিত হতেন না । র‌্যাঁবো তখন কবিতা ও সাহিত্যজগত সম্পর্কে উদাসীন এবং নতুন জীবনের সন্ধান করেছেন, বাবার মতো উধাও হয়ে যেতে চাইছেন । পরস্পরের দৈহিক ভালোবাসার বদলে যিশুখ্রিস্টকে ভালোবাসার কথা বলছেন তখন ভেরলেন । র‌্যাঁবো ঠাট্টা করে তাঁকে লিখলেন যে ‘লয়োলা’ স্টুটগার্টে এলে দেখা হবে । লয়োলা ছিলেন এক যিশুভক্ত পাদ্রি ।
            পরস্পরের সাক্ষাতের সেই মুহূর্তটা এলো এবং কমেডি ছাপিয়ে গেল ট্যাজেডিকে । ভেরলেন গোঁ ধরলেন র‌্যাঁবোকে দীক্ষিত করার জন্য, একটা শুঁড়িখানায় দুজনে একত্রিত হয়ে । ভেরলেন আর র‌্যাঁবো দুজনেই মাত্রাহীন মদ টেনে মাতাল হলেন এবং আবার কথা কাটাকাটি আরম্ভ হল । শুঁড়িখানা থেকে বেরিয়ে দুই বিখ্যাত কবির মধ্যে হাতাহাতি মারামারি আরম্ভ হল। র‌্যাঁবোর সঙ্গে পেরে ওঠা অসম্ভব ছিল ভেরলেনের পক্ষে । মার খেয়ে মাতাল ভেরলেন, রক্তাক্ত, পড়ে রইলেন পথের ধারে ।
               সাত এম-এম ছয়গুলির পিস্তলটা ক্রিস্টির নিলামে  কেউ ষাট হাজার ডলারে সম্প্রতি কিনে নিয়েছেন ; তার আগে পিস্তলটা ছয়বার নিলাম হয়েছিল । মায়ের দেয়া টাকায় ‘নরকে এক ঋতু’ ছাপিয়ে, মাকে এক কপি দিয়ে, কবিতার প্রতি র‌্যাঁবোর আকর্ষণ শেষ হয়ে গিয়েছিল ; ইল্যুমিনেশান্স’ আর ছাপাবার প্রয়োজন বোধ করেননি, যা করার কোরো বলে পাণ্ডুলিপি ভেরলেনকে দিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন আফ্রিকায়, ভিন্ন জীবনের সন্ধানে । ভেরলেন কবিতাগুলো মে-জুন ১৮৮৬-এ  ‘প্যারিস লিটেরারি রিভিউতে’ প্রথমে প্রকাশ করার জন্য দেন । তারপর গ্রন্হাকারে প্রকাশের ব্যবস্হা করেন ১৮৮৬ সালের অক্টোবরে । 
    ————————————————————-XXXXXXXXXXX————————
  • মলয় রায়চৌধুরী | 106.215.24.94 | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১১:৩০738359
  • মলয় রায়চৌধুরীর আভাঁগার্দ কবিতা 
    ভূমিকা : আভাঁগার্দ সাহিত্য কাকে  বলে 
    আভাঁগার্দ মানে 'অ্যাডভান্স গার্ড' বা 'ভ্যানগার্ড', আক্ষরিক অর্থে 'ফোর-গার্ড', ভাবকল্পটি এমন একজন ব্যক্তি বা কাজ যা শিল্প, সংস্কৃতি বা সমাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় যা পরীক্ষামূলক, নতুন বা অপ্রথাগত। কাজগুলো প্রথমদিকে নান্দনিক উদ্ভাবন এবং প্রাথমিক অগ্রহণযোগ্যতা দ্বারা চিহ্নিত করা হতো । আভাঁগার্দ শব্দটা, মূলত ফরাসি সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত একটি শব্দ ছিল । এই  সামরিক রূপকটি সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ আরম্ভ হলো, বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক, প্রথানুগত লেখালিখি থেকে পার্থক্য চিহ্ণিত করার জন্য । শব্দটি সেনাবাহিনীর সামনের জওয়ানদের নির্দেশ করে, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথমে শত্রুদের মুখোমুখি হয় এবং যারা পরে আসে তাদের জন্য পথ প্রশস্ত করে । অর্থাৎ আভাঁগার্দ বলতে বোঝায়, সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে, যাঁরা সমসাময়িক কালখণ্ড থেকে এগিয়ে । বলা বাহুল্য যে তাঁরা আক্রান্ত হবেন এবং তার জন্য তাঁরা নিজেদের সেইমতো প্রস্তুত করেন, এরকম মনে করা হয় । তবে বিবর্তনমূলক অর্থে নয়।  কারণ এটি বুর্জোয়া সমাজে সাহিত্য-শিল্পের মূল নীতি সম্পর্কে আমূল প্রশ্ন তোলে, যে বক্তব্যটি হলো এই যে, ব্যক্তি-একক  বিশেষ সাহিত্য-শিল্পের কাজের স্রষ্টা বা ব্র্যাণ্ড, পুঁজিবাদী কাঠামোয় বিক্রয়যোগ্য । আভাঁগার্দ ভাবকল্পটি সর্বদা প্রয়োগ করা হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে যাঁরা বুর্জোয়া এস্টাব্লিশমেন্টের স্থিতাবস্থাকে চুরমার করে যারা এগিয়ে যাবার কথা বলেন । কবি বা শিল্পী কী বলিতেছেন নয়, কবিতা বা শিল্পটি কী করিতেছে, এটাই হলো আভাঁগার্দের নবায়ন । স্বদেশ সেন লিখিত ‘জাদু’ কবিতাটা পড়লে টের পাওয়া যাবে আমি কী বলতে চাইছি :
    একটা কি চাঁদ উঠেছে না বৃষ্টিতে ভিজেছে অর্জুন গাছ
    সেই অর্জুন গাছে বসেছে পায়রা
    লাল পা, শাদা গা, নীল ঘুম ?
    ও জাদুবাজ তামাড়িয়া, সিল্ক, গরদ আর টায়রা
    একটা কি সূর্য উঠেছে না আগুনের ব্লুম ?
    আভাঁগার্দ কবিতা তার আগেকার অন্যান্য কবিদের কাব্যাদর্শ  প্রত্যাখ্যান করে এগোয় এবং পরিবর্তে নতুন এবং উত্তেজনাপূর্ণ বাকপথের সন্ধান করে । অর্থাৎ আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্পের মনোবিজ্ঞান এবং আদর্শে, ঐতিহাসিকভাবে বিবেচনা করা হয় যে ( হেগেলীয় এবং মার্কসবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি যাকে ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতা বলবেন), ভবিষ্যতবাদী প্রকাশের প্রতিনিধিত্ব করেL তাই বলতে গেলে, একটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক এবং ইউটোপিয়ান পর্যায়, আভাঁগার্দের বিচরণক্ষেত্র। ব্যাপারটাকে অনেকে মনে করেন, আভাঁগার্দ নিজেই বিপ্লব না হলেও তা ঘোষণা এবং বিপ্লবের জন্য একটি প্রস্তুতি। একইভাবে ছবি আঁকা আর ভাস্কর্যের নবায়ন করে আভাঁগার্দ । উদ্ভাবন ব্যাপারটা আভাঁগার্দ কাজের কেন্দ্র । ফলত, অনেকসময়ে, আভাঁগার্দ লেখা সম্পূর্ণ নতুন, দুর্বোধ্য, দুরূহ, মজার এবং প্রায়শই সমসাময়িক পাঠকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। কবি বা শিল্পী তার ফলে হতাশ হন না, ঠিক যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটে, পেছিয়ে আসার প্রশ্ন ওঠে না । মরে যাবে জেনেই  আভাঁগার্দ জওয়ানরা শত্রুনিধনে বেরোয় । কখনও কখনও কবি বা শিল্পীরা, যাঁরা আভাঁগার্দ  থিমের সাথে জড়িত, তাঁদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি পেতে কয়েক দশক লেগে যায় কিংবা শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি নাও পেতে পারেন । ক্রমশ আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প মূলধারার অংশ হয়ে যায় এবং অবিশ্বাস্যভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায়, একদা যে ডাডাবাদী কাজগুলো আভাঁগার্দ হইচই হিসাবে নিন্দিত হয়েছিল তা প্রয়োগ করছে বিজ্ঞাপনের এজেন্সিগুলো । প্রাথমিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যা আদর্শ বা স্থিতাবস্থা হিসেবে বহুকাল যাবত গ্রাহ্য, তার সীমানা অতিক্রম করে আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প । আভাঁগার্দকে  কেউ কেউ আধুনিকতার শেষ বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন যার হাত ধরে উত্তরাধুনিকতা প্রবেশ করেছে । অনেক শিল্পী  আভাঁগার্দ আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে নিজেদের কাজকে উত্তরাধুনিক হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন । ‘শ্রুতি’ আন্দোলনের কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায় আমেরিকার ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েটদের বহু আগে উত্তরাধুনিক কবিতা লিখেছিলেন ; যেমন ‘আমি সারাদিন আমি’ কবিতাটি :
    আমার মা সারাদিন মালা জপেন
    আর আমি
    আমার বোন সারাদিন উল বোনে
    আর আমি
    আমার বউ সারাদিন আলনায় জামাকাপড় সাজায়
    আর আমি
    আমার প্রতিবেশীরা সারাদিন বাড়ি তোলে
    আর আমি
    আমার বন্ধুরা সারাদিন লিফটে চড়ে
    আর আমি
    আমি সারাদিন শুধু আমি ।
     আভাঁগার্দ আমূল সামাজিক সংস্কারও সমর্থন করে।  সেইন্ট সিমোঁর মতাবলম্বী ওলিন্ডে রড্রিগেস তাঁর প্রবন্ধে ( "শিল্পী, বিজ্ঞানী এবং শিল্পপতি", ১৮২৫) বলেছিলেন যে, সাহিত্যিক এবং শিল্পীদের উচিত সমাজে আভাঁগার্দ পরিবর্তন আনা । রড্রিগেস বলেছিলেন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য "সাহিত্য ও শিল্পের শক্তি প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং দ্রুততম হতে পারে আভাঁগার্দ কাজের মাধ্যমে"।  ভাবকল্পটি উনিশ  শতকে বামপন্থী ফরাসি র‍্যাডিকালদের সাথে যুক্ত হয়েছিল,  যাঁরা রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য আন্দোলন করছিলেন। সেই শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে, শব্দটি সাহিত্য-শিল্পের সাথে যুক্ত হয়,  এই ধারণার মাধ্যমে, যে, সাহিত্য-শিল্প হলো সামাজিক পরিবর্তনের  উপকরণ।  শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপে  আভাঁগার্দ কাজকর্ম সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক বিষয়গুলোর সাথে আরও বেশি করে সংযুক্ত হওয়ার দরুন  বামপন্থী সামাজিক কারণগুলো থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছিল। বিশুদ্ধ রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে নান্দনিক বিষয়গুলোর উপর জোর দেওয়ার এই প্রবণতা  অব্যাহত, তার কারণ রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে অসাধু লোকেরা যাদের আসল উদ্দেশ্য টাকা কামানো । 
    আভাঁগার্দ আজ সাধারণত বুদ্ধিজীবী, লেখক এবং শিল্পীদের গোষ্ঠীকে বোঝায়, যার মধ্যে ভাস্কর আর  স্থপতিও রয়েছেন, যাঁরা বর্তমান সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে  শৈল্পিক পদ্ধতির নবায়নের চিন্তাভাবনা করেন এবং পরীক্ষা করেন। আভাঁগার্দ কাজগুলো, বিশেষ করে যদি তারা সামাজিক সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে চায়, প্রায়শই এমন সমাজ-কর্তাদের মুখোমুখি হয় যারা সমাধানগুলো  আত্মীকরণ করতে বড়ো বেশি সময় নষ্ট করে । সমস্যা হলো যে গতকালের প্রতিষ্ঠানবিরোধিরা মূলধারায় পরিণত হয়, সরকারে যোগ দেয় বা ক্ষমতাবান মিডিয়ার মুখপত্র হয়ে ওঠে । ফলে আবার নতুন প্রজন্মের বিরোধিদের উদ্ভবের পরিবেশ তৈরি করে। 
    প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ডাডা আন্দোলন গড়ে ওঠে সেইসব শিল্পীদের নিয়ে, যাঁরা পুঁজিবাদী সমাজের যুক্তি, কারণ বা সৌন্দর্যের ধারণা মানতেন না, বরং তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন আপাত-অর্থহীন, উদ্ভট, অযৌক্তিক এবং বুর্জোয়া-বিরোধী প্রতিবাদী বক্তব্য । আন্দোলনটির কাজ প্রসারিত হয়েছিল দৃশ্যমান, সাহিত্য ও শব্দ মাধ্যমে, যেমন   কোলাজ, শব্দসঙ্গীত, কাট-আপ লেখা, এবং ভাস্কর্যতে। ডাডাবাদীরা হানাহানি, যুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এবং গোঁড়া বামপন্থীদের সাথে তাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল। সবচেয়ে বিশিষ্ট আভাঁগার্দ কবিদের মধ্যে আমরা ভিসেন্তে হুইডোব্রো, নিকোলাস গুইলেন, সেজার ভালেজো, জর্হে লুইস বোর্হেস, অক্টাভিও পাজ, জুয়ান কার্লোস ওনেটি, মারিও বেনেদেত্তি, পাবলো নেরুদা, অলিভেরিও গিরোন্ডো, ভাসকো পোপা এবং আরও অনেককে খুঁজে পেতে পারি । 
    সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণকারী বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমগুলো আভাঁগার্দ প্রবণতাকে  সমর্থন করতে পারে এমন পাঠকদের এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় ।  অমন পাঠকদের এলাকা  সর্বদা সামাজিক অবস্থার সম্পূর্ণতা দ্বারা সীমাবদ্ধ । আভাঁগার্দ প্রবণতাগুলো সাধারণত স্বতন্ত্র ভিত্তিতে স্বীকার করা হয়, এবং সেই স্বাতন্ত্র্য হল গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যায়তনিক প্রত্যাখ্যানের মূল্যে । বিতর্কের মৌলিক বিষয় হল আভাঁগার্দ লেখক-শিল্পীদের ত্যাগ । তাঁদের কাজকে খণ্ডিত  গ্রহণযোগ্যতায় মাপা হয় যখন কিনা তাঁদের রচনাগুলো  একাধিক উন্মুক্ত গভীর পাঠ দাবি করে। এই বাণিজ্যিক প্রতিরোধ আভাঁগার্দ ভাবকল্পকে পরিসর তৈরি করে দেয় । উদ্ভাবন বিপ্লবের মাধ্যমে শিল্পে নবায়নের জন্য উদ্ভাবনার বিপ্লব জরুরি। বাস্তবতা অনেকটা একইভাবে শিল্পে নিজেকে প্রকাশ করে যেভাবে মাধ্যাকর্ষণ নিজেকে প্রকাশ করে যখন একটি ছাদ তার মালিকের মাথায় ভেঙে পড়ে। নতুন শিল্প-সাহিত্য, নতুন শব্দ, নতুন অভিব্যক্তির জন্য আগেকার ছাদ ভেঙে ফেলে নতুন ছাদ পাততে হয় শিল্পী-সাহিত্যিকদের। ভেঙে পড়ার চেষ্টায় কবি বা শিল্পী কষ্ট পান ; শব্দ এবং বাস্তবতার মধ্যে বাধা পান। আমরা ইতিমধ্যে তাঁর কলমে বা তুলিতে নতুনত্ব অনুভব করতে পারি” বলেছেন ভিক্টর শক্লোভস্কি। এই প্রসঙ্গে বাংলায় সৌমনা দাশগুপ্ত’র ‘শনির বলয় ভেঙে’ কবিতাটি উল্লেখ্য :
    বরং
    শূন্যের দিকে উড়ে যাক কসমিক হরিণের ছায়া, প্রেম ও প্রতীতি
    নিজেকে সুচের মধ্যে ভরে ক্রসস্টিচ ফোঁড়, ছুরিতে কুড়ুলে শান
    বরং
    প্ল্যাটফর্মে থইথই করুক আগুন
    প্ল্যাটফর্মে হইহই করুক শকুন
    ওপাশে সরাইখানা, মেঘের শরীরঠেসে পেরেকের কুচি, ট্যাক্সিডার্মি
    যেয়ো না যেয়ো না সখী, শুদ্ধ কল্যাণ-ঠাটে লেগে যাবে মরিচার দাগ
    ডাউন-সিনড্রোমের গলি, পিছলা রাস্তায় কত পিতলা-পিরিত নাচে গায়
    শনির বলয় ভেঙে ছিটকে ছিটকে পড়ে নিকেলের পাশা, ধুলো ও বরফ
    সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতায়, আভাঁগার্দরা তাঁদের লেখার নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন।  কবিতায় তাঁরা  ব্যাকরণ,  যেমন সঠিক বানান এবং সংযোগকারী শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করেননি; বা নিয়ম বা কাঠামো যা আগে গ্রাহ্য ছিল তাকে অস্বীকার করেছেন। এই কবিতার বৈশিষ্ট্যগুলি তাঁদের অনন্য করে তুলেছিল, যেহেতু পূর্বোক্তগুলি মেনে চলার পাশাপাশি, তাঁরা সম্পূর্ণ মুক্ত উপায়ে কবিতা চর্চার ঝুঁকিও নিয়েছিলেন; তাঁরা নতুন শব্দ উদ্ভাবন করতেন, নতুন হরফ ব্যবহার করতেন, এমনকি একই টেক্সট (ক্যালিগ্রাম নামে পরিচিত) বা তাদের সাথে ছবি দিতেন । তাঁরা ১) কবিরা ভাবনাকে উপস্থাপন করতে ছবি ব্যবহার করতেন। ২).পুরোনো কবিতার  প্রতি কবির অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এবং নতুন কিছুর সন্ধান করতেন । ৩). কাব্যিক ভাষা আমূল পরিবর্তন করতেন। ৪ ). আলোচিত বিষয়গুলি খুব বৈচিত্র্যময়, অস্বাভাবিক এবং উদ্ভাবনী হিসাবে উপস্হাপন করতেন । ৫) নতুন পাঠকের কাছে যা অর্থহীন ছিল তা পিছনে ফেলে যাওয়ার চেষ্টা করতেন ।  এই প্রসঙ্গে শম্ভু রক্ষিত-এর ‘মুক্তিবাদ’ কবিতাটি উল্লেখ্য : 
    যারা আমাকে ডিগডিগে
    আমার রুহকে যুদ্ধের হিরো
    আমার ঈশ্বরকে অনিষ্টজনক
    আমার কবিতাকে
    চাকচিক্যময় আভিজাত্য বা বিক্ষিপ্ত প্রলাপ মনে করে 
    .
    আহ ভাইরে
    তারা বাণিজ্যের অযথার্থ ক্ষমতা দিয়ে
    তাদের নাক মুখ কান দখল করে
    এই শক্তিশালী প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের
    অস্তিত্ব রক্ষা করুক

    যারা বালি ফুঁড়ে
    আমাকে বাল্যপাঠ শেখাচ্ছে
    আহ ভাইরে
    তারা মেকি সুন্দরের মিথ্যে সীমারেখা প্রত্যাখ্যান করে
    অন্তত্ব একটা ছোটখাটো দেবদূতের সন্ধান করুক
     
    অকেজো জ্যুকবক্সে স্থির ডিস্ক
    জীবনের আর ভাঙা ইঁটের
    অশুভ যুদ্ধপরা যন্ত্রনায় আন্তর্জাতিক কোরাস
    আহ ভাইরে
    কবরখানা আর টাউনশিপের সুড়ঙ্গের মধ্যে গুঞ্জন করা
    আস্তাবলের ধূর্ত পিটপিটে মায়া
    মধ্যে মধ্যে ফ্যাঁকড়া
    আহ ভাইরে.
     
    কাঁধে অগ্নিবর্ণের ক্যামেরা
    হাতে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ট্রানজিস্টর
    অন্য সম্রাটের দায় যাতে মেটে
    মাংস ভেদ করে সচল ফ্রেস্কোর মত
    এইসব রেডিয়ো-টিভি-অ্যাকটিভ যুবশক্তি
    মুক্তিবাদ এবং জাঁকজমক খুঁড়ে নৈশস্তব্ধতা
    আহ ভাইরে
     
    ইউরোপ থেকে আনা সাহিত্য-সংরূপগুলোর সংজ্ঞার স্বামীত্ব, তাদের ব্যাখ্যা করার অধিকার, দেশীয়করণের বৈধতা, সেসব বিধিবিধান তত্বায়নের মালিকানা, কথাবস্তুটির উদ্দেশ্যমূলক স্বীকৃতি, চিন্তনতন্ত্রটির অন্তর্গত সংশ্লেষে স্বতঃঅনুমিত ছিল যে, অনির্মিত লেখকপ্রতিস্বের পক্ষে তা অসম্ভব, নিষিদ্ধ, অপ্রবেশ্য, অনধিকার চর্চা । ব্যাপারটা স্বাভাবিক, কেননা যাঁরা সংজ্ঞাগুলো সরবরাহ করছেন, তাঁরাই তো জানবেন যে সেসব সংজ্ঞার মধ্যে কী মালমশলা আছে, আর তলে-তলে কীইবা তাদের ধান্দা । ফলে, কোনও কথাবস্তু যে সংরূপহীন হতে পারে, লেখক-এককটি চিন্তনতন্ত্রে অনির্মিত হতে পারে, রচনাকার তাঁর পাঠবস্তুকে স্হানাংকমুক্ত সমাজপ্রক্রিয়া মনে করতে পারেন, বা নিজেকে বাংলা সাহিত্যের কালরেখার বাইরে মনে করতে পারেন, এই ধরণের ধারণাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেয়নি ওই চিন্তনতন্ত্রটি । এই কারণেই হাংরি আন্দোলনকে বুঝতে পারেন না অনেকে, হাংরিদের কবিতা ও গদ্যকে পূর্বের কবি ও লেখকদের কাজের পাশে রেখে তুলনা করতে চান । বর্তমান কালখণ্ডে, আমরা জানি, একজন লোক লেখেন তার কারণ তিনি ‘লেখক হতে চান’ । অথচ লেখক হতে চান না এরকম লোকও তো লেখালিখি করতে পারেন । তাঁরা সাহিত্যসেবক অর্থে লেখক নন, আবার সাহিত্যচর্চাকারী বিশেষ স্হানাংক নির্ণয়-প্রয়াসী না-লেখকও নন । তাঁদের মনে লেখক হওয়া-হওয়ি বলে কোনও সাহিত্য-প্রক্রিয়া থাকে না । হাংরি আন্দোলনকারীদের, ডাডাবাদীদের মতনই, এই প্রেক্ষিতে গ্রহণ করতে হবে । এ-প্রসঙ্গে ফালগুনী রায় এর কবিতা ‘আমি এক সৌন্দর্য রাক্ষস’ উল্লেখ্য :
    প্রজাপতির চিত্রল ডানা দেখে বিরহ হতে বিবাহের দিকে
    চলে যায় মানবসম্প্রদায় – আমি এক সৌন্দর্যরাক্ষস
    ভেঙে দিয়েছি প্রজাপতির গন্ধসন্ধানী শুঁড়
    আমার নিজের কোনো বিশ্বাস নেই কাউর ওপর
    অলস বদ্মাস আমি মাঝে মাঝে বেশ্যার নাঙ হয়ে
    জীবন যাপনের কথা ভাবি যখন মদের নেশা কেটে আসে
    আর বন্ধুদের উল্লাস ইআর্কির ভেতর বসে টের পাই ব্যর্থ প্রেম
    চেয়ে দেখি পূর্ণিমা চাঁদের ভেতর জ্বলন্ত চিন্তা
    এখন আমি মর্গের ড্রয়ারে শুয়ে আছি—এক মৃতদেহ
    আমার জ্যান্ত শরীর নিয়ে চলে গ্যাছে তার
    শাঁখাভাঙ্গা বিধবার ঋতুরক্ত ন্যাকড়ার কাছে
    মর্গের ড্রয়ারে শুয়ে আছি— চিতাকাঠ শুয়ে আছে বৃক্ষের ভেতর
    প্রেম নেই প্রসূতিসদনে নেই আসন্নপ্রসবা স্ত্রী
    মর্গের ড্রয়ারে শুয়ে আছি—
    এ ভাবেই রয়ে গেছি কেটে যায় দিনরাত বজ্রপাত অনাবৃষ্টি
    কত বালিকার মসৃণ বুকে গজিয়ে উঠল মাংস ঢিপি
    কত কুমারীর গর্ভসঞ্চার গর্ভপাত -–সত্যজিতের দেশ  থেকে
    লাভ ইন টোকিও চলে গ্যাল পূর্ব আফ্রিকায়—মার্কস স্কোয়ারে
    বঙ্গ সংস্কৃতি ভারত সার্কাস – রবীন্দ্রসদনে কবিসম্মেলন আর
    বৈজয়ন্তীমালার নাচ হ’ল –-আমার ত হ’ল না কিছু
    কোনো উত্তরণ—অবনতি কোনো—
    গণিকার বাথরুম থেকে প্রেমিকার বিছানার দিকে
    আমার অনায়াস গতায়াত শেষ হয় নাই— আকাশগর্ভ
    থেকে তাই আজো ঝরে পড়ে নক্ষত্রের ছাই পৃথিবীর বুকের ওপর
    তবু মর্গের ড্রয়ারে শুয়ে আছি এক মৃতদেহ আমার জ্যান্ত শরীর নিয়ে
    চলে গ্যাছে তার শাঁখাভাঙ্গা বিধবার ঋতুরক্ত ন্যাকড়ার কাছে
    প্রজাপতির চিত্রল ডানা দেখে বিরহ হতে বিবাহের দিকে চলে যায় মানুষেরা
    আমি এক সৌন্দর্যরাক্ষস ভেঙে দিয়েছি প্রজাপতির গন্ধসন্ধানী শুঁড়
    বাঙালির সমাজে আমরা দেখি যে একদা প্রতিষ্ঠানবিরোধী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, ব্রাত্য বসু, সুবোধ সরকার, জয় গোস্বামী, প্রসূন ভৌমিক প্রমুখ যোগ দিলেন প্রতিষ্ঠানে । সুভাষ ঘোষ যোগ দিলেন সিপিএম দলে । পক্ষান্তরে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আভাঁগার্দ লেখক হিসাবে দেখা দিলেন দেবযানী বসু, শম্ভু রক্ষিত, সুবিমল বসাক, ফালগুনী রায়, সুভাষ ঘোষ, সুবিমল মিশ্র, বারীন ঘোষাল, অজিত রায়, নবারুণ ভট্টাচার্য, ধীমান চক্রবর্তী, সুব্রত সেন, রণবীর পুরকায়স্থ, জয়া গোয়ালা,  কৌশিক সরকার, অনুপম মুখোপাধ্যায়, অমিতাভ প্রহরাজ, অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ । দেবযানী বসুর কবিতা ‘কতোদিন হাসি নি’ উল্লেখ্য :
    একের পর এক নক্ষত্র পেরিয়ে যাই
    সমগ্ৰ ধানশস্যে স্নান শেষে
    মাথা রাখি কাঁধে
    হৈ হৈ করে পাতাবাহারের দল টেবিলে এল
    এদের মধ্যে কারো জন্য তোমার হাসি
    অসতর্ক মুহূর্তের লাবণিমায় বুড়ো করোটি উজ্জ্বল
    তোমার অজানা নয় বছরে একবার মাত্র
    সূর্য সাদা তিলক পরায় আমাকে
    ওখানেই বিজয়মাল্য লরেলবিজিতাঙ্গী
    ডাইনিপ্রেমে কুয়াশা মেখলা হাস্কি ভয়েস
    টব যে রঙেরই হোক ফুলটি সবুজ।
    আভাঁগার্দ কবিতা ভাষা এবং পরীক্ষামূলক কবিতার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক অন্বেষণ করে । ভাষাই বাস্তবতা। বাস্তবতা হলো ভাষা। আভাঁগার্দ কবিতা এই অন্তহীন টেনশানের মাঝে উপস্হিত । উল্লেখ্য যে পরাবাস্তববাদ এবং জার্মান অভিব্যক্তিবাদ হল আভাঁগার্দের প্রকৃষ্ট উদাহরণ যা একইসঙ্গে  নান্দনিক মূল্যবোধ এবং ব্যক্তি-এককের বিকাশকে মেশাতে পেরেছিল, কিন্তু ইউরোপীয় কোনো সাহিত্য আন্দোলনই রাশিয়ার আভাঁগার্দের সাথে যুক্ত হতে পারেনি । স্লাভয় জিজেক বলেছেন যে, ‘লেনিনবাদী রাজনীতি এবং আধুনিকতাবাদী শিল্পের মধ্যে সংঘর্ষ (জুরিখের ক্যাবারে ভলতেয়ারে দাদাবাদীদের সাথে লেনিনের সাক্ষাতের কাল্পনিক উদাহরণ) কাঠামোগতভাবে ঘটতে পারে না; আরও স্পষ্টভাবে, বিপ্লবী রাজনীতি এবং বিপ্লবী শিল্প বিভিন্ন অস্থায়ী পথ অনুসরণ করে – যদিও তারা সংযুক্ত, তারা একই ঘটনার দুটি দিক যা কখনও পরস্পরের সঙ্গে মিলতে পারে না।’
    পরাবাস্তববাদ ছিল ডাডাবাদী আন্দোলন আর অবচেতনের ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের একটি স্বাভাবিক প্রসারণ ও মিশেল। এমনকি জার্মান অভিব্যক্তিবাদকে উনিশ শতকের নব্বই দশকে হারিয়ে যেতে থাকা উত্তেজনার সঙ্গে তাকে তুলনা করা যেতে পারে । একমাত্র  এডভার্ড মুঞ্চ উভয়ের মধ্যে একটি মূল সংযোগ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। তবে নিশ্চিতভাবেই আঁদ্রে ব্রেতঁ এবং ম্যাক্স আর্নস্টের মতো উল্লেখযোগ্য পরাবাস্তববাদীরা তাদের নির্দিষ্ট কেন্দ্রের বাইরে একটি আলাদা জীবন কাটিয়েছিলেন যার দরুন পরাবাস্তববাদীদের মধ্যে অবনিবনার চূড়ান্ত হয়েছিল । এমনকি ক্যান্ডিনস্কি তাঁর নিজস্ব স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করার জন্য দ্রুত তাঁর প্রাথমিক অভিব্যক্তিবাদী অনুষঙ্গগুলোর বাইরে চলে গিয়েছিলেন। ব্যাপারটা যুদ্ধক্ষেত্রের মতনই, কে একা এগিয়ে গিয়ে শত্রুপক্ষের ঘাঁটি আক্রমণ করবে তা আভাঁগার্দ আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নবিন্দু । ত্রিস্তান জারার কবিতাকে ইউরোপীয় সাহিত্যে আর গুরুত্ব দেয়া হয় না বটে কিন্তু স্বীকার করা হয় যে তিনিই প্রথম পুঁজিবাদী শত্রুর ঘাঁটিতে আভাঁগার্দ পতাকা পুঁতেছিলেন ।
    পরাবাস্তববাদকে ‘নির্দিষ্ট’ ছকে ফেলা কঠিন। হাংরি আন্দোলনকেও নির্দিষ্ট ছকে ফেলা যায় না । হাংরি আন্দোলনকারীদের প্রতিস্ব তো একক, নিটোল, একশিলা, একমুখি নয় । পরাবাস্তববাদীরা একই আন্দোলনের সদস্য হয়ে ছবি আঁকলেও এবং কবিতা লিখলেও, তাঁদের দৃষ্টি ও উপলব্ধির মধ্যে ব্যক্তিগত পার্থক্য ছিল ।  মতবাদটি সম্পর্কে প্রত্যেকে নিজস্ব ভাবনা ভেবেছেন, যে কথা হাংরি আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোয্য । ১৯২৯ সালে সালভাদর দালি এই আন্দোলনে যোগ দেন, যদিও তাঁর সঙ্গেও ব্রেতঁর বনিবনা হতো না । সালভাদর দালি মনে করতেন, ‘সুররিয়ালিজম একটি ধ্বংসাত্মক দর্শন এবং এটি কেবল তা-ই ধ্বংস করে যা দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ করে।’ অন্যদিকে জন লেলন বলেছেন, ‘সুররিয়ালিজম আমার কাছে বিশেষ প্রভাব নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। কেননা, আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার কল্পনা উন্মাদনা নয়। বরং সুররিয়ালিজমই আমার বাস্তবতা।’
    তাঁদের রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং অন্যান্য কারণে প্রেভের, বারোঁ, দেসনস, লেইরিস, লিমবোর, মাসোঁ, কোয়েন্যু, মোরিস, বোইফার সম্পর্কচ্ছদ করেন ব্রেতঁর সঙ্গে,  এবং গেয়র্গে বাতাইয়ের নেতৃত্বে পৃথক গোষ্ঠী তৈরি করেন । তবুও তাকে আন্দোলনের মৃত্যুঘণ্টা বলে খিল্লি করা হয়নি । এই সময়েই, ১৯২৯ নাগাদ, ব্রেতঁর গোষ্ঠীতে যোগ দেন সালভাদর দালি, লুই বুনুয়েল, আলবের্তো জিয়াকোমেত্তি, রেনে শার এবং লি মিলার । ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ঝগড়া মিটমাট করে নেন ব্রেতঁ । দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ইশতাহার প্রকাশের সময়ে তাতে সই করেছিলেন আরাগঁ, আর্নস্ট, বুনুয়েল, শার, ক্রেভাল, দালি, এলুয়ার, পেরে, টাঙ্গুই, জারা, ম্যাক্সিম আলেকজান্দ্রে, জো বনসকোয়েত, কামিলে গোয়েমানস, পল নুগ, ফ্রান্সিস পোঙ্গে, মার্কো রিসটিচ, জর্জ শাদুল, আঁদ্রে তিরিয়ঁ এবং আলবেয়ার ভালেনতিন । ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকার বন্ধু ছিলেন সালভাদর দালি এবং লুই বুনুয়েল, আলোচনায় অংশ নিতেন, কিন্তু পরাবাস্তব গোষ্ঠিতে যোগ দেননি । ১৯২৯ সালে লোরকার মনে হয়েছিল যে দালি আর বুনুয়েলের ফিল্ম “একটি আন্দালুসিয় কুকুর” তাঁকে আক্রমণ করেছে ; সেই থেকে আরাগঁ ও জর্জ শাদুল ব্রেতঁ’র গোষ্ঠী ত্যাগ করেছিলেন , যদিও ব্রেতঁ বলতেন যে তিনিই ওনাদের তাড়িয়েছেন। 
    আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প  নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা নতুন শৈলীর বিকাশ ঘটায় । লেখক ও শিল্পীরা সীমাকে ঠেলে এগিয়ে না গেলে  সাহিত্য-শিল্প  অপরিবর্তিত থেকে যেতো । এটি  তাঁদের কারণে সম্ভব হয়  যাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রের অজানা এলাকায় এগিয়ে যাবার সুযোগ নিতে ইচ্ছুক, যে এলাকায় হয়তো মাইন পোঁতা থাকবে, সমালোচকদের লুকোনো কামান থাকবে, বিদ্যায়তনিক মিসাইল আচমকা হানা দেবে ।   আজ বাজার অর্থনীতির প্রকোপে ভাষা একটি ভয়ঙ্কর 'বর্জ্য' নিজের সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলছে, বিশেষত নতুন যোগাযোগ প্রযুক্তির উত্থানের দরুন। আভাঁগার্দ কবিতা ও গদ্য এই অপচয়কে শত্রু হিসাবে গ্রহণ করে । আভাঁগার্দ প্রক্রিয়া  নীরবতার মাধ্যমেও ভাষা সংরক্ষণের প্রয়াস  করে।  হাস্যকরভাবে, নিজের পুঁজিবাদী প্রযুক্তির (আত্ম-সহায়তা এবং রোমান্টিক প্রেম থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা বক্তৃতা এবং বাজারের মতাদর্শের মধ্যে) শব্দ ব্যবহারে অপচয়ের পরিমাণ শব্দগুলোকে জঙ ধরিয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে সুবিমল মিশ্রর ‘বাব্বি’ গদ্যটা উল্লেখ্য যাকে সুবিমল বলেছেন ‘অ্যান্টি-গল্প’ । ১৯৮১ সালে লেখা এটি গুরুত্বপূর্ণ আভাঁগার্দ রচনা :
    “বেড নাম্বার নাইন্টিনাইনের পেসেন্টকে কারা দেখতে এসেছেন? পেসেন্ট মারা গেছে ভাের রাতে। ঐ দেখা যায় ডানদিকে লালবাড়ি— মর্গ। মরচে-ধরা। কোলাপসিবল গেট। বডি-টা পাঠানাে হয়েছে ঐ দিকে। এক এক করে সবাই গিয়ে দেখে আসুন। চারদিকে এখন পঁচা লাশের ঠাণ্ডা নীল হাঁ। অন্ধকারে, সেই হাঁ-এর ভেতরে, মােটা থলথলে একটা মাংসপিণ্ড, ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবীতে, গাড়ি থেকে থপথপিয়ে নামে, কাছে এসে গায়ে হাত দেয়, কানে কানে বলে: ম্যাচিস আছে? ওটা কোড়-ল্যাংগােয়েজ। তারপর দুজনে অন্ধকারের দিকে মিশে যায়।
    লাঠিতে ভর করে কুঁজো মতন একটা লােক রাস্তা পেরােতে থাকে। সেই মুহূর্তের জন্য পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে পড়ে। লােকটা ঠুক ঠুক লাঠিতে ভর দিয়েই, আস্তে, রাস্তা পেরােতে থাকে, ক্রমশ রাস্তা পেরােতে থাকে। গল্প রাত-পরীদের দিকে ঘুরে যায়। রাত বাড়ার সংগে সংগে ডানা থেকে তারা তাদের সব পালক খসিয়ে ফ্যালে। কবরখানার ভেতর থেকে ফাঁসিকাঠের খট খট শব্দ হয়। অস্পষ্ট কিছু ছায়ামূর্তি সেই শব্দে আকৃষ্ট হয়ে লণ্ঠন দোলাতে দোলাতে জনবসতি ছাড়িয়ে জংলা কবরখানার দিকে চলে যায়। পর্যায়ক্রমিক এইসব অসংলগ্নতা পাঠকের মনে একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। অনুভূতির ওপর প্রভাব বিস্তার করা, তারপর তাকে ছাড়িয়ে যাওয়া— বিষিয়ে তােলা। এই হচ্ছে শক-ট্রিটমেন্ট। ক্রমশ তাদের মনোেযােগ ঝিঁঝিয়ে ওঠে, সাড়হীন যুক্তি-বিন্যাস নাড়া খায়। রক্তের সংগে জড়িয়ে যায় আপৎকালীন চরাচর। বুড়াে লােকটি এসে হাসতে হাসতে বলে: আমি ফুল চিবিয়ে খাই। তারপর হাসি থামিয়ে জানায় তার গােটা ডানহাতটাই তার নিজের নয়। বহুকাল তার নিজের কোন ডান হাত ছিল না। সে তার হাতখানা খুঁজে পেয়েছে ঘরের পাশে ডাস্টবিনে, এবং পরে সেলাই করে নিয়েছে দেহের সংগে। ডান হাতখানা কোথায় ছিল তবে আপনার? ছেলেবেলায় ওটা আমি হারিয়ে ফেলি। তখন আমি আমার বাবাকে... কোন কিছুর জন্য না, এমনিই। ঘটনাটা ঘটে যায় আর কি ... আর এই ঘটে যাওয়ার ওপর তাে কোন চারা নেই।
    বাবার এই মৃতদেহ যখন পােড়ানাে হচ্ছে, তখন, সে, হঠাৎই, উচ্ছ্বসিত, হাসিতে ভেঙে পড়েছিল। বিব্রত হয়ে সে শ্মশান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসতে বাধ্য হয় কিন্তু তখনাে তার হাসির বেগ কমেনি। বাবাই তাে সব, এইসব, সব শেখালাে। হাঁ, সে তার বাবাকে খুব ভালবাসতাে। বুড়ােটার দাঁতগুলাে খুব সুন্দর। বলে আমি ফুল চিবিয়ে খাই। বলে আর হাসে। হাসতে হাসতে মন্তব্য করে: চিবিয়ে খাই তাে কি হল— আপত্তি আছে? মাঝরাতে ফ্লাইওভার জুড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে থেঁতলে-যাওয়া এক মনীশের শরীর। রাত ১২টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটে কিন্তু ভাের রাত পর্যন্ত কেউ খবর পায়নি। পাশ দিয়ে অনেক গাড়ি গেছে কিন্তু আজকালকার দিনে কে আর ইচ্ছে করে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায়। লম্বা মতন এক যুবক, আর তার পিঠে জড়িয়ে আছে কালাে-বেলবট্‌স-আর-লাল-সােয়েটার-পরা-মেয়েটি। এতখানি চওড়া মসৃণ রাস্তা সবাই পায়ের সুখ মিটিয়ে অ্যাকসিলেটর চাপে, মােটর সাইকেলটি চুরমার হয়ে পড়েছিল নতুন ফ্লাইওভারের ওপর। পরে দেখা গেছে একদিকে বেঁকে দুমড়ে উপুড় হয়ে পড়ে-থাকা মনীশের শরীর, অন্যদিকে মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান অবস্থায় রেবেকা চ্যাটার্জী। মনীশের বৌ তখন বাড়িতে পথ চেয়ে। নীলচে কালাে লম্বা ব্যারেলে নিয়তির নিষ্ঠুরতা। ভালবাসা যায় না। অনন্তকাল সংগে থাকলেও না। বাড়ির বাথরুমে এনামেল করা স্নানের টবটা থেকে সুরু করে দরজায় পেতলের হাতল পর্যন্ত, সব, সব ভালবাসি। চারিদিকে গহন বন, নদী। পশ্চিমঘাট পাহাড়ের মধ্যিখানে বিশাল গাছের ঘন ছায়ায় সিমলিজোরা রেস্ট-হাউস। নির্জনতা সেখানে ফিতের মতাে পায়ে পড়ে জড়ায়। বাংলাের পিছনে ঝিরঝিরে ঝর্ণা। রেস্ট-হাউসের সামনে ছাঁটা-ঘাসের মাপা চৌহদ্দিতে দুটি বেতের চেয়ার। একটাতে রেবেকা বসে আছে, এলানাে গা, অদূরে মনীশের মােটরসাইকেল। ঝর্ণা দিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাের বারান্দায় শুকনাে পাতা উড়ছে ফরফর। থিরথিরে ছন্দের চেয়ে রুক্ষতার প্রাধান্য থাকলে ঘটনার নির্মমতা আরাে আরাে চারিত্রিক হয়ে ওঠে। আর স্ব-বিরােধিতাই হল কর্মপদ্ধতির একটা অংগ। চরিত্রের ভেতরে প্রবেশ করার একটা দ্বি-মাত্রিক পদ্ধতি। সেটা কখনাে কখনাে ত্রি-মাত্রিকও হতে পারে। সব-সময় সন্দেহজনক এই অনুসন্ধানটা থাকা দরকার। একটা মেয়ে লিখছে, ২৬ বছর আমার বয়স...স্লিম...স্টেট সার্ভিসের জন্য পরীক্ষা দিচ্ছি... নিজের নামের আগে মিস বা মিসেস লিখতে মর্যাদাহীনতা বােধ করি আমি... গত বছরে দিল্লিতে গিয়ে প্রকাশ্যে তােমার সংগে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ৩ দিনের মধ্যে সব টাকা ফুরিয়ে যায়। এই হােল বিরােধিতার একটা দিক। মানে আমার নিজস্ব ভাবে চিন্তা করা। এই পদ্ধতিতে চরিত্ররা এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে থাকে। লেখক খুশি হন। যে চরিত্রটি শুধু নিজের অংশটুকু পড়ে দেখছে না, সমস্ত লেখাটাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে তার কৌতুহল স্বাভাবিক ভাবেই লেখককে খুশি করে। উৎসাহ এনে দেয়। চরিত্ররা সকলে মিলে আলােচনায় বসে, তারা প্রতিটি কথার অর্থ জেনে নিতে চায়, তাদের কি কাজ, তারা এসব কেন করছে—'সবই লেখকের সংগে আলােচনা করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেয় তারা। নিজেদের মতামতও জানায়। তর্ক করে। কিন্তু লেখককে অনেক সময় নিরুপায় থাকতে হয়। সবাইকে কি সে ছাই ভাল করে জানে, ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবী পরা থলথলে চেহারার লােকটিকে রাত ৮টার পর ভিকটোরিয়ার সামনে গাড়ি থেকে নামতে একদিনই সে দেখেছিল মাত্র। আর তখনি দেশে যে পুরুষ-হিজড়ে রয়েছে, একশ্রেণির কম বয়সি ছেলেরা, এবং তাদের এইসব টিপিক্যাল কাস্টমার, তাদের অস্তিত্বের কথা টের পায়। রেবেকা জানতে চেয়েছিল পাঠকেরা তাকে কীভাবে নেবে। আমার ধারণায় পাঠকদের দৃষ্টি সব সময় তােমার কালাে বেলবটস আর লাল টকটকে ঐ শােয়েটারের ওপর থাকবে...। আসলে একটা চরিত্রের দিকে লেখকের পক্ষে ছুটে যাওয়া খুব খারাপ। ওদের করতে দেওয়া দরকার। দেশজুড়ে হঠাৎ হঠাৎ ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ অঢেল পরিমাণ বে-আইনী আগ্নেয়াস্ত্র ও বহু অস্ত্রনির্মাণ কারখানা আবিষ্কার করে ফ্যালে। উদ্ধার করে অনেক তাজা বােমা ও বােমার মশলা। রাইফেল বন্দুক পিস্তল ও পাইপগান মিলিয়ে এক দিনের তল্লাশীতেই ধরা পড়ে প্রায় ২৫ হাজার বে-আইনী আগ্নেয়াস্ত্র। তখন ছােকরাটি, তাকে সবাই পাড়ার মস্তান বলে জানে, বলতে থাকে: এই দ্যাখাে, বাড়ি থেকে নিয়ে এলুম এগুলাে—মা’র শাল, মেজদার গরদের পাঞ্জাবী, ছােড়দার বিয়ের জুতাে— চোরা বাজারে ঝেড়ে দেবাে। সে এ সব কথা বলছে ঠিকই কিন্তু খুব স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করছে না। দ্বিধা রয়েছে। সে না করেও পারে না, করেও কোনও স্বস্তি নেই। চরিত্রের অন্যতর গড়নে এটা সব সময়ই হয়। ওদের নানা সময়ে নানা রকমের আপত্তি থাকে। বিরােধিতা জিনিসটা একটা চরিত্রের কর্ম-পদ্ধতিরই একটা অংগ। বুড়ােটা, ফুল চিবিয়ে খাওয়া বুড়ােটা অবশ্য স্বীকার করেছে যাকে সে খুন করেছিল তার সংগে তার একটা বিশেষ ধরনের দৈহিক সম্পর্ক ছিল। একটা রােমান্টিক সম্পর্ক। তারপর দুজনেই দুজনকে বদলে নিলাম। রােমান্স চলে গেল। এটা একটা অন্য কিছু যা আমাদের দুজনের বন্ধনের মাঝখানে ছিল। বলে সে হাে হাে করে হাসে: আমি এমন লােক ফুল চিবিয়ে খাই। ক্রমশ পাশ থেকে মেয়েটির মুখ পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠতে থাকে। মানে, ইনিই নতুন ঐ ফ্লাইওভারের ওপর মনীশের সাথে এক মােটরসাইকেলে ছিলেন। বেশ চওড়া এক রাস্তায় রাত্তির এগারােটা ছুটে চলেছে প্রচণ্ড বেগে মনীশকে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে— বাড়িতে স্ত্রী অনুপমা অপেক্ষায়। তারপরেই ঘটনাটা ঘটল। মনীশের মনে অন্য কিছু ছিল না তাে, অন্যরকম..., অদৃশ্য থেকে মনীশ উঠে দাঁড়ায়। ছন্দ মিলিয়ে বক্ততার ঢঙে পড়ে যেতে থাকে: আমি মিথ্যাকে ভালবাসি। ভুল বােঝানােতেই আমার সুখ। যা কিছু অসত্য তাই আমার পছন্দ। যা কিছু নিষিদ্ধ তা আমাকে আনন্দ দেয়। এই এখন রেবেকাকে নিয়ে..., পড়ার মাঝখানে সে ধূমপান করতে থাকে। চেয়ারে ইতস্তত চরিত্রগুলাে বসে, অনড়। সেই ফাঁকে রেবেকার সংগে খােলাখুলি কিছু কথাবার্তা হয়।
    লেখক: তুমি কি ছেলেদের সংগে ঘুরে বেড়ানাে একটু বেশি পছন্দ করাে?
    রেবেকা: করিই তাে ...ভাল লাগে...
    লেখক: ছেলে-বন্ধুদের সংগে কখনাে কোথাও বেড়াতে গিয়েটিয়ে ... মানে রাত-টাত কাটানাে...
    রেবেকা: তা কি খুব দোষের? তবে তা অনেকটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে কখনাে কখনাে এসব ঘটে যায় আর কি...
    লেখক: গণতন্ত্র সম্বন্ধে তােমার কি ধারণা?
    রেবেকা: পলিটিকস নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।
    লেখক: চারপাশে যে-সব ঘটনা ঘটছে তার খোঁজখবর রাখাে?
    রেবেকা: খবরের কাগজে একবার তাে চোখ বুললাই, রাজনীতি একদম ভাল লাগে না। আমার পৃথিবীতে আরাে আরাে অনেক জিনিস আছে। সে সবেই আমার আগ্রহ।
    লেখক: যা তােমার ভাল লাগে না তা নিয়ে তুমি আদৌ চিন্তিত নও ?
    রেবেকা: ঠিক ধরেছেন।
    লেখক: আর একটা কথা তুমি তাে জানাে মনীশ বিবাহিত ... দুটি বড় বড় বাচ্চ আছে ...বিবাহিত জীবনে ও সুখী ...এসব জেনেও কি ...
    রেবেকা: হ্যাঁ জানি। ভেবেছি। কিন্তু তাতে কি?...
    মস্তান ছেলেটি কথাবার্তার মাঝখানেই উঠে দাঁড়ায়, প্যানটের পকেটে হাত, হাত অদৃশ্য চেম্বারে ঠেকানাে। বলে ওঠে: একটা পাত্তি ছাড়ুন না লেখক মশাই, সাট্টা খেলব। ওল্টানাে খুরিটায় সে সটান একটা লাথি মারে। সবাই দ্যাখে কিন্তু কেউ কিছু বলে না। লেবু-মেশানাে দেশি মদের মতাে সন্ধ্যাগুলাে থেকে খটাখট খটাখট আওয়াজ বেরােয়, দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন। এক-এক-জন বিশ-পঁচিশটা করে ভােট দেয়। কান-ঢাকা চুল রাখে। স্থানীয় গার্লস ইস্কুলের ছুটির মুখে বন্ধুদের সংগে মােড়ে গিয়ে দাঁড়ায়, সিটি দেয়। ক্যামেরা ধীরে ধীরে প্যান করে আসে। দেখা যায় রাস্তার মােড়ে এক বুড়াে ভিখিরি মরে পড়ে আছে। ক্রমে বেলা বাড়ে। বুড়াের শব নিয়ে পাড়ার ছেলেরা গলি দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। হরিধ্বনি শােনা যায়। দোতলা থেকে একজন বৌ কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে। লােকেরা গলা বাড়িয়ে শবযাত্রা দেখতে থাকে। কুয়াশার আলাে-আঁধারিতে ঝাপসা সেই লাল বাড়ি দেখা যায়— মর্গ। মর্গের লাগােয়া ধীরি ধীরি বয়ে যাওয়া নদী। নদীর গায়ে শান্তি-কুটির। মাটি দিয়ে নিকোনাে ছবির ফ্রেম, ভাঙা পাঁচিলের পাশে। বারান্দার কোণে একটা বুড়ি-ছাগল কালাে কুচকুচে বাচ্চাগুলােকে মাই দিচ্ছে, পায়ের তলায় একরাশ টাটকা নাদি। একঝাঁক কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে ধাড়ী একটা মুরগি বারান্দাময় ছুটোছুটি করছে। উঠোনের জবাগাছে ফুল ভর্তি। লাউয়ের মাচায় লাউ ঝুলছে। ডুরে শাড়ি পরে একটা ১১/১২ বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে অনেক দূরে, মাঠের ও প্রান্তে, রেলগাড়ির চলে যাওয়া দেখছে। চারদিক থেকে হৈ-চৈ শুরু হয়। তখন কে কি বলছে তুমুল হট্টগােলের মাঝে চাপা পড়ে। সমস্যা দেখা দেয় তখন, যখন এক টেবিলে বসিয়ে তাদের, চরিত্রগুলােকে, বােঝার চেষ্টা করি। ফুল চিবিয়ে খেতে-চাওয়া বুড়ােটা প্রথমটা কিন্তু কিন্তু করে, কিন্তু আসে, একটা চেয়ার নিয়ে বসে। রেবেকাও এসে বসে একপাশে, খানিকটা বেপরােয়া। গজ গজ করে: মনীশ বিবাহিত হলাে তাে কি হয়েছে...। মনীশও এসে যায়। সিগারেট হাতে, ধরানাে। কখনাে কখনাে অন্যমনস্ক, টানে। বেশিটা তার হাতেই পুড়ে যায়। তখন আবার নতুন করে সিগারেট ধরায়। ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবীতে থলথলে চেহারার অবাঙালি ব্যবসায়ীটিও আসে। ব্যাপারটা কি হচ্ছে সে ঠিকমতাে ধরতে পারে না। কিন্তু ছেলেটি, মস্তান সেই ছেলেটি, কিছুতেই আসতে চায় না। পাড়ার মােড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর জুয়ােখেলার জন্য এর ওর কাছ থেকে টাকা চাওয়াতেই ওর আনন্দ। বলে: এইসব লােকের সংগে কেউ লেডি কিলার, কেউ বুড়াে হাবড়া, কেউ হাফ-প্রস— এই মারােয়াড়িটা তাে এক নম্বর হােমো, বেটা আমাদের ওয়াগন-ভাঙা মাল-পত্তর জলের দামে কেনে, মানে আমাদের বেঁচে দিতে বাধ্য করে— এক টেবিলে বসা— থােঃ।। সবাইকে সংগে নিয়ে আলােচনা আদৌ ঘটানাে যায় না। মানুষগুলাের মধ্যে কোনও প্রচ্ছন্ন যােগসূত্র আছে কিনা— আলােচনার ভেতর দিয়ে যা বেরিয়ে আসতে পারে, তা বাস্তবে ঘটে না আদৌ। মুখ গােমড়া করে ছেলেটা মােড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দুরে পেটো পড়ার শব্দ হয়। ঝাঁপ বন্ধ হওয়ার শব্দ হয়। লােক দৌড়তে থাকে, নিরাপত্তার দিকে। রেবেকা উঠে দাঁড়ায়: আমাকে যেতে হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। মনীশ তুমি কি আমায় পৌঁছে দেবে?
    পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে ৭টা ৫৫-র স্থানীয় সংবাদ ভেসে আসে। গজ-কুডি ওপরে ওঠার পর সমতল পাথরের এক বিশাল চত্বর স্পষ্ট হয়। তার পরেই নীচে নামার অন্ধকার সুড়ংগ। কোণাকুণিভাবে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলে, একদম শেষ প্রান্তে, গােপন কফিনঘর। প্রাচীন এই পৃথিবীর প্রাচীনতম এই পাড়া পেচ্ছাব পুলিশ গাড়ির টহলদারি, দিশি ও বিলিতি, গাঁজা, বেলফুল, চাট ও পেঁয়াজের গন্ধে ভােম মেরে থাকে। হঠাৎ সুড়ংগ ফুরিয়ে জীবনযাত্রা শুরু হয়। শহর-নগর খেত-খামার মানুষ গিজগিজ। ঘন সবুজ পাতি-ঘাসের ডগায় ডগায় কালাে ডাঁই পিঁপড়েরা জায়গা বদলাতে বেরিয়ে পড়ে। ভাল করে চেয়ে দেখলে বােঝা যায় ওরা সব উঁচু ডাঙা-জায়গা খুঁজতে বেরিয়েছে। খুব শিগগিরই বৃষ্টি নামবে তাহলে। কেয়া ঝােপে মুরগি-চোর শেয়ালের ডাকাডাকিতে বার বার গৃহস্থ পাড়া গরম হয়ে ওঠে। রক্তের ভেতরে কেমন এক আগ্রাসী ফাটল জমতে সুরু করে। হরিণমারি-বিলের ধারে শ্মশানে মড়ারা পুড়তে থাকে। আমবাগানে ঢুকে ধােপাদের খচ্চরটা ঘাস খেয়ে যায় নিরুত্তাপ। আলসেতে চিড়। ফাটল ক্রমশ বড় হয়, তার ঠাণ্ডা নীল হাঁ। অথচ এইটেই সবচেয়ে কঠিন। এদের সবাইকে আলােচনায় বসানাে। কথাবার্তার মধ্য দিয়ে এদের সামাজিক দিকটি পরিষ্কার করে আনা। কাজটির তীব্রতা তাতেই, যা আনুষঙ্গিক, আপাত বিরােধিতা ছাপিয়ে উঠবে। অথচ সেইটেই হয় না। নীল হাঁ ক্রমশ বড় হতে থাকে। মস্তান ছেলেটি তেমনি প্যানটের পকেটে হাত, পাড়ার মােড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রেবেকা চলে যেতে থাকে, সংগে সংগে নিয়ে যায় মনীশকে। থলথলে-ভুঁড়ি অ্যামবাসাডরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বলে ফেলে: বাবুজি, এবার তাে যেতে হােবে। রেবেকা অ্যাবরসনের কথায় হাে হাে করে হেসে ওঠে ...কেন করাবাে? বিয়ে করিনি বলে ? ঝিলিক দিয়ে ওঠে তার লাল সােয়েটার। তার এই স্বীকার করতে ভয়-পাওয়াটা লেখক বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখে। তার এই স্বীকারের স্বাভাবিকতাটিও।
    মস্তান ছেলেটি একসময় বলেছে, স্বীকার গিয়েছে: আমাকে কারা তৈরি করেছে জানেন ...আমাদের হাতে পেটো তুলে দেওয়া হয়েছে, কাজের শেষে টাকা যাঃ ফুর্তি করে আয় ... স্বাভাবিক জীবন থেকে কারা আমাদের বিচ্ছিন্ন করল? ... রেল ইয়ার্ডগুলােই তাে এখন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বাস হয় না ? বুড়ােটা বলে: আমার ডান হাতখানা আসল হাত নয়। কুড়িয়ে পাওয়া। আমি ফুল চিবিয়ে খাই। স্বাভাবিক জীবন থেকে আমাকেও ... । রেবেকাও অমনি ফিসফিসিয়ে ওঠে বিশ্বাস করুন আমাকে ... বিশ্বাস করুন ... আমি সত্যকে ভয় পাই না। তখনাে মনীশের আঙুল তার হাতে ধরা। কিছুতেই এদের একসংগে করানাে যায় না, এক টেবিলে বসানাে। সবাই কিন্তু কিন্তু করতে করতে এলেও ছােকরাটি আসে না। প্যানটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গোঁজ হয়ে পাড়ার মােড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কে আসে কে যায় লক্ষ্য রাখে। নতুন মুখ দেখলে ভাল করে দেখে নেয় খোঁচড় কিনা। রেবেকাকে গটগটিয়ে যেতে দেখে মন্তব্য করে বসে: এসব হাফ-গেরস্ত মেয়েমানুষ এখানে কেন। টেবিলে একটা চেয়ার ফাঁকা থাকে, ঠাণ্ডা হয়ে-যেতে-থাকে এক কাপ চা, নির্ধারিত। ... ঐ দেখা যায় সেই লাল বাড়ি— মর্গ। মরচে-ধরা কোলাপসিবল গেট। বডি-সব পাঠানাে হয়েছে ঐদিকে। রাত বাড়ে, গল্প ক্রমশ রাত-পরীদের দিকে ঘুরে যায়। ঠাণ্ডা নীল সেই হাঁ ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকে, দেখা যায়, অ্যাকিলিশ আর কচ্ছপ, কচ্ছপ আর অ্যাকিলিশ দৌড়ে চলেছে। কচ্ছপ অ্যাকিলিশের থেকে হাজার গজ এগিয়ে, এমন অবস্থায় একদা দুজনের দৌড় শুরু হয়েছিল। অ্যাকিলিশ যে সময়ে হাজার গজ যায়, কচ্ছপ সে সময়ে যায় একশাে গজ। কতক্ষণে অ্যাকিলিশ কচ্ছপকে ধরতে পারবে? যখন অ্যাকিলিশ এই হাজার গজের ব্যবধান কমিয়ে দেবে তখন কচ্ছপ আরাে একশাে গজ এগিয়ে থাকছে। অ্যাকিলিশ আবার একশাে গজ যখন যাবে তখন কচ্ছপ দশ গজ এগিয়ে গেছে। ঐ দশ যখন অ্যাকিলিশ দৌড়ে যাবে তখনও কচ্ছপ তার থেকে এক গজ এগিয়ে। আর ঠিক এমনি করে অ্যাকিলিশ আর কচ্ছপের মধ্যে কিছু না কিছু সব সময় সর্বদা।”
    আমার আভাঁগার্দ কবিতা সত্যিকার অর্থে প্রচলিত ভাষার বাধ্যবাধকতার বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে ভাষাকে নতুন করে উদ্ভাবনের মাধ্যমে একটি নতুন প্রতিস্ব তুলে ধরতে চেয়েছে । আমার আভাঁগার্দ কবিতা, পাশ্চাত্য কবিতার ইতিহাসের বিরোধিতা হিসাবে কল্পনা করা যেতে পারে । যে সব ইউরোপীয় বইপত্র নিয়ে বাঙালি আলোচকরা নাচানাচি করেন, আমি মনে করি যে গদ্য বা কবিতা যাই হোক না কেন,  পশ্চিমের পুঁজিবাদী জীবনধারাকে বৈধতা দেওয়ার একটি উপায়। সাম্রাজ্যবাদের যুগের পর থেকে সাম্প্রতিককালে প্রায় পাঁচশো বছর ইউরোপের বাইরে বাকি বিশ্বের অভিজ্ঞতা ঠিক এটাই । বাস্তববাদ হল পুঁজিবাদের আদর্শগত অস্ত্র, যেখানে যে ভাষা বাস্তবসম্মত নয় তা পুঁজিবাদের শত্রু । সরকারি সাহিত্য সংস্কৃতি, সর্বত্র এবং সর্বদা, এই বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি করে, যে, যাদের ক্ষমতা আছে তারা শক্তিহীনদের কাজে লাগাতে  চায়। এটা  বাহ্যিক শর্তগুলোকে নেয়, বলা বাহুল্য যে তা বিপ্লবী নৈতিকতা অনুসরণ করে না । বিশ্বাস করাতে চায়  যে ব্যক্তি-এককের প্রতিস্ব স্থিতিশীল আর তা সব সময়ে তার  মানসিক নিয়ন্ত্রণে থাকে ।  সরকারী সাহিত্য ও সংস্কৃতির যারা তাঁবেদার তারা একারণেই আভাঁগার্দ শিল্প-সাহিত্যের শত্রু হিসাবে দেখা দেয় । বহুক্ষেত্রে ছবি আঁকায় বা মূর্তি গড়ায় আভাঁগার্দ স্বীকৃতি পেলেও সেই একই শৈলীকে সাহিত্যে স্বীকৃতি দিতে কুন্ঠিত হন আলোচকরা, কেননা ছবি আঁকা আর মূর্তি গড়ার ব্যকরণের সঙ্গে তাঁরা পরিচিত নন ।  আমি মূল বক্তব্যতে জোর দিচ্ছি  যে আভাঁগার্দ কবিতায় ভাষা ('বাস্তবতার' বাহ্যিক সংকেতগুলোর পরিবর্তে), যেমন ছবি আঁকায় রঙ,  হলো মৌলিক কাঁচামাল। অনুপম মুখোপাধ্যায়ের ‘অশ্বমেধ’ কবিতাটা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য :
    ফুলের অন্তর ফুঁড়ে লাফিয়ে ঢুকছে সেই আরবী ঘোড়া
    ঘোড়ার পাপড়ি খাবো
    ফুলের মাংসও
    স্তনবৃন্ত ছিল শিশ্নের শিখর
    ভগাঙ্কুর ছিল নেশা পেরিয়ে যাওয়া খাঁড়ির নোঙর
    শীৎকার চিনে নিতে তবু কেন লেগে গেল সমস্ত জীবন
    হোক হোক
    শুরুর আগেও কিছু মৈথুন হোক
    যদি সমস্ত বিশ্বের ইতিহাস এবং সমস্ত বিশ্ব ভাষা কবিতার ক্ষেত্র হয়, যদি শিল্প, স্থাপত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, ভূতত্ত্ব, জীববিজ্ঞান, রসায়ন, অর্থনীতি এবং মনোবিজ্ঞান সবই কবিতার ক্ষেত্র তৈরি করে, তবে অবশ্যই তা পুঁজিবাদের তিরস্কার। তার কারণ পুঁজিবাদ,  কেবলমাত্র একটা নির্দিষ্ট সংকীর্ণ এলাকাকে কবিতার জন্য চিহ্ণিত করে দেয় । সেই ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে কবিতা বা অন্যান্য ধরণের লেখা বা ব্যক্তিগত চিন্তা যান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করা যায়। আভাঁগার্দে কবিতা, এই অর্থেও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয় । 
    আমরা যদি বিজ্ঞাপন এবং চলচ্চিত্রের ভাষা এবং বাজারের পাল্পফিকশান আর রাজনীতির বয়ানগুলোকে কাজে লাগাই, তাহলে আমরা কি চালু  শক্তিদের হাত শক্তিশালী করব ? আভাঁগার্দ সাহিত্যিক চেষ্টা করবেন ওই জাল কেটে বেরিয়ে যেতে । বেরোবার সময়ে আভাঁগার্দ জওয়ানের মতন তিনি কাটতে-কাটতে বেরোবেন ।  অর্থাৎ, আভাঁগার্দ কবিতা দ্ব্যর্থহীনভাবে লেখার নির্দিষ্ট শৈলী, এবং প্রচলিত চিন্তাভাবনার রাস্তা ধরে চলে না। স্বীকার করে যে ভাষা একটি উস্কানি, একটা গোপন রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে কাজ করে, যদিও  প্রায়শই মনে হতে পারে যে ভাষাটা স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক নয়। আভাঁগার্দ কবিতা ব্যক্তিকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে, কারণ এটি রাজনীতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে, এমনভাবে যা মূলধারার কবিতা পারে না বা করতে চায় না। আভাঁগার্দ কবিতা তার নিজস্ব পাঠক তৈরি করে । বস্তুত আভাঁগার্দ কবিতা নতুন পাঠকদের সন্ধান করে । পাঠকের জন্য  অপরিহার্য বিষয় হল পড়ার অভ্যাস।
    যদি উত্তর-আধুনিকতাকে চলছে-চলবে বলে মনে করা হয়, তবে আমি বলব যে এই সব ম্যাক্সিমালিস্ট ভাষা-উন্মাদনার কবিতাগুলি যা আমি লিখেছি—একটি তরতাজা প্রক্রিয়া, ইন্দ্রিয়ের জন্য আকর্ষক কারণ টেক্সটগুলো কোথায় থামবে, কোথায় শেষ-বিন্দু তা জানে না বলে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। বাস্তববাদী আত্ম-শোষণের জন্য হয়, কবিতাগুলো ইতিহাস এবং রাজনীতি, বিভিন্ন বক্তৃতা (বৈজ্ঞানিক, আধ্যাত্মিক, মানবতাবাদী, টেকনোক্র্যাটিক, সাহিত্যিক, বাঙালদের বুলি) শুষে নিতে চেয়েছে যাতে নিজেকে শেষ পর্যন্ত উন্মোচিত করতে পারে, যা প্রচলিত কবিতার শীতল আবরণের বিপরীতে একটি উত্তপ্ত জিনিস। 
    আভাঁগার্দ মানেই আন্দোনকারী গোষ্ঠী, এরকম মনে করা অনুচিত । কোনো আন্দোলনের সাথে আভাঁগার্দকে  সনাক্ত করলে  সমস্যা দেখা দেয় কেননা প্রতিটি কবি বা শিল্পী আন্দোলনের অংশ হয়েও ব্যক্তি-এককের প্রতিস্বের দাবি রাখেন । শিল্পী  মার্সেল দ্যুশঁ, যিনি আভাঁগার্দ শিল্পের পুরোধা নিজেকে কখনোই কোনো গোষ্ঠীর অন্তর্গত বলে মনে করতেন না ।  তিনি ১৯২১  তাঁর তরুণ শিষ্য স্টেথিমারকে বলেছিলেন, "দূর থেকে এই ব্যাপ[আরগুলো , এই আন্দোলনগুলো এমন এক আকর্ষণ তৈরি করে যা আদপে সকলের মধ্যে নেই । বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের সবচেয়ে উগ্র আমেরিকান লেখক ছিলেন গারট্রুড স্টেইন ; তিনি কিন্তু  সাহিত্যিক আন্দোলনগুলিকে অপছন্দ করতেন, কোনও গোষ্ঠীর অন্তর্গত ছিলেন না এবং কোনও গোষ্ঠী ইশতেহার বা কার্যকলাপে অংশ নেননি। গারট্রুড স্টেইনের আড্ডায় অনেক নেতৃস্থানীয় আভাঁগার্দ কবি আর শিল্পী, যেমন অ্যাপোলিনায়ার, পিকাবিয়া, পাউন্ড প্রায়ই যেতেন । গারট্রুডের আনুগত্য অন্য আভাঁগার্দ মহিলা লেখকদের প্রতিও ছিল না । তিনি লেসবিয়ান ছিলেন কিন্তু লেসবিয়ান মহিলা কবি বা শিল্পীদের নিয়ে আভাঁগার্দ গোষ্ঠী তৈরি করেননি। এমনকী আধুনিকতাবাদী আক্রমনাত্মক বহুগামী পুরুষ চিত্রশিল্পী পিকাসোর দলেও যোগ দেননি। স্টেইন  কোনো আন্দোলনের অংশ না হয়েও আভাঁগার্দ ছিলেন । যেমন ছিলেন জেমস জয়েস।  আমরা যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপীয় আভাঁগার্দের  দিকে ফিরে তাকাই, তখন আমরা বেকেটকে কোথায় রাখব, তা নিয়ে ভাবতে হয় । বেকেট একজন অসাধারণ আভাঁগার্দ নাট্যকার যিনি কোনো  আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি ।
    বেশ কিছু লেখক আভাঁগার্দ কার্যকলাপের প্যারামিটার ম্যাপ করার চেষ্টা করেছেন। ইতালীয় প্রবন্ধকার রেনাটো পোগিওলি  ১৯৬২ সালে লেখা তাঁর  ‘দ্য থিওরি অফ দ্য আভাঁগার্দ’ বইতে একটি সাংস্কৃতিক ঘটনা হিসাবে ভ্যানগার্ডিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ  করেছেন। ভ্যানগার্ডিজমের ঐতিহাসিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক দিকগুলি জরিপ করে, পোগিওলি শিল্প, কবিতা এবং সঙ্গীতের পৃথক উদাহরণের বাইরে বেরিয়ে দেখাতে চেয়েছেন যে ভ্যানগার্ডস্টরা কিছু আদর্শ বা মূল্যবোধ শেয়ার করতে পারে, যা তাদের গ্রহণ করা অ-সঙ্গতিপূর্ণ জীবনধারার মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করে। তিনি ভ্যানগার্ড সংস্কৃতিকে বোহেমিয়ানবাদের একটি বিচিত্র বা উপশ্রেণী হিসাবে দেখেন। জার্মান সাহিত্য সমালোচক পিটার বার্গার ১৯৭৪ সালে লেখা ‘থিওরি অফ দ্য আভাঁগার্দ’ বইতে শিল্পের সামাজিক সমালোচনামূলক কাজের প্রতি এস্টাবলিশমেন্টের প্রতিক্রিয়াকে তুলে ধরেছেন এবং বলেছেন যে পুঁজিবাদী সমাজের সাথে জড়িত হবার ফলে, আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্পও প্রতিষ্ঠান হিসাবে ব্যক্তির কাজকে  রাজনীতি-নিরপেক্ষ করে দেয় ।
    পিটার বার্গারের মতে আভাঁগার্দ কাজগুলো  আধুনিক শিল্প-সাহিত্যে ক্রিয়াশীল পরস্পরবিরোধী প্রবণতার  একটি অপরিহার্য অবদান। বার্গার বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের আভাঁগার্দ আন্দোলনগুলিকে শিল্পের প্রতিষ্ঠানের উপর আক্রমণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, যা শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে জীবনকে  একত্রিত করার লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। বার্গারের মতে, আভাঁগার্দ অভিপ্রায়টি মূলত "অজৈব" শিল্পকর্মের উৎপাদনের আকারে নিজেকে প্রকাশ করে। বার্গারের দৃষ্টিতে, আভাঁগার্দের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এই সত্যে নিহিত যে তারা একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে শিল্পের আদর্শিক কাঠামোকে ভাঙচুর করতে পেরেছে । আভাঁগার্দ শিল্পকর্মের সামাজিক অবদান অনস্বীকার্য । বাজার নিয়ন্ত্রিত  সমাজে একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে শিল্পের ব্যাপক কার্যকারিতা স্বায়ত্তশাসনের নীতি দ্বারা নির্ধারিত হয় ।  আভাঁগার্দের পরবর্তী কালখণ্ডে, বার্গার অনুমান করেন, নান্দনিক তত্ত্ব শিল্পের স্বায়ত্তশাসনকে গ্রহণ করতে অক্ষম হয়ে গেছে, তবে প্রতিটি স্বতন্ত্র শিল্পকর্ম তার স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে বাজার নিয়ন্ত্রিত  সমাজে সুনির্দিষ্টভাবে যে কাজ সম্পাদন করে তা বিশ্লেষণ করা উচিত। এই প্রসঙ্গে সোনালী চক্রবর্তীর এই কবিতাটি উল্লেখ্য :
    "নৈহার ছুটো হি যায়...
    শীতলীভবন দোষে মোম মোম ব্যথাই তো জমে থাকে দাহ শেষ হলে, কেন তাকে স্মৃতি নামে ডাক? মধু মধু উত্তাল হও, দুর্গ আর বিষ না গড়ে কেউই নিজেকে নি:শেষ করে না প্রেমে, মৌমাছি অতীত শিখিয়েছে, মেনে নিলেও তো পার। আমনকর ভৈরবী ধরলে শূন্যে এহেন সাওরিয়া নেই যে বৃষ্টি নামায় না। অথচ তোমাদের দেখি স্লোগানে, ঝড়ের মেহেকেই ধ্রুবপদ রাখো। পাখীকেও তো সিনায় জিন পোষার কথা বলো কিন্তু যে কোনো আগুনের নিস্তেল কৃষ্ণ ক্যানভাস দেখতে গিয়ে গান্ধারীকেই আদর্শ করো। সাম্যের মোহে তোমাদের শৃগাল জোট দেখি, দীর্ঘশ্বাসের রুবারু বুঝে নেয়, সৃষ্টি ইস্তক ক্ষমতার রিপু শুধুমাত্র বধ প্রবণ কীভাবে হলো। আমারও কিছু বলার ছিলো উথাল পাথাল দ্বন্দ্ব পেরিয়ে, ষ্ট্রীট কর্নার থেকে আলোর পাপড়ি এসে সবই উড়িয়ে নিয়ে গেলো। সময়ও তো এক বিন্ধ্য, কবে পেরিয়ে গেছো নির্মোহ অগস্ত্যে। না বুঝে ঠোঁট ফুলে গেলে ফিসফিস করে বলে দিয়েছো, বুকের গভীরে ডার্লো, সন্ত্রাস সর্বদা অন্তরালে থাকে। শুধু আমি ক্রুশের মালিকানা শুষে নিতে নিতেও বুঝলাম না,
    কমরেড, ভালোবাসা যদি ফ্যাসিস্ট না হয়, কী লাভ অনর্থক বিপ্লবে?"
     
    জুরিখ শহরে ডাডাবাদী আন্দোলনের একটি  গতিপথ ছিল। আমরা ক্যাবারে ভলতেয়ারকে সর্বোত্তম আভাঁগার্দ মঞ্চ হিসাবে মনে করি, তার সমস্ত বুদ্ধি এবং বিস্ময় নিয়ে বিদ্রোহের চূড়ান্ত  চেতনা ফেটে বেরিয়েছিল, তবে এর বহুভুজ প্রবাসী সদস্যদের ব্যক্তিত্ব, অভিনয় এবং ইশতেহারগুলি যতই রঙিন এবং আকর্ষণীয় হোক না কেন - হুগো বল, ত্রিস্তান জারা , রিচার্ড হুয়েলসেনবেক—এই ডাডাবাদীদের  কবি হিসেবে তেমন গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়নি। যখন, যুদ্ধের শেষের দিকে, আন্দোলন ভেঙ্গে যায়, তখন অনেক ব্যক্তি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, যখন হ্যান্স আর্পের মতো অন্যরা ডাডাবাদ ছেড়ে অন্যান্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়। এদিকে, হ্যানোভারে ডাডা শব্দটি  শিল্পী, কার্ট শ্যুইটারস-এর কাজকে নির্দেশ করে, যখন কিনা  বার্লিনে ডাডা,  তার উগ্র বাম রাজনীতির কারণে একাডেমিক মঞ্চগুলোতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । হার্টফিল্ড, রাউল হাউসম্যান এবং জর্জ গ্রোজ যুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর পুঁজিবাদের উপর  ব্যঙ্গাত্মক ছবি এঁকেছেন যা জার্মান অভিব্যক্তিবাদকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই কাজগুলোর অভিপ্রায় চিল শিক্ষামূলক এবং আদর্শিক ফলে এই কাজগুলো ক্যাবারে ভলতেয়ারের হইচই এবং অ-সংবেদনশীলতাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে।
    এখন আভাঁগার্দ ধারণাটি মূলত শিল্পী, লেখক, সুরকার, ফিল্ম-পরিচালক এবং চিন্তাবিদদের বোঝায় যাদের কাজ মূলধারার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বিরোধিতা করে এবং প্রায়শই একটি সামাজিক বা রাজনৈতিক দর্শনে নির্ভর করে। অনেক লেখক, সমালোচক এবং তাত্ত্বিক আধুনিকতার গঠনমূলক বছরগুলিতে আভাঁগার্দ সংস্কৃতি সম্পর্কে দাবি করেছিলেন, যদিও আভাঁগার্দের  প্রাথমিক নির্দিষ্ট বিবৃতিটি ছিল নিউ ইয়র্কের শিল্প সমালোচক ক্লেমেন্ট গ্রিনবার্গের "আভাঁগার্দ এবং কিৎশ" প্রবন্ধে। গ্রিনবার্গ যুক্তি দিয়েছিলেন যে ভ্যানগার্ড সংস্কৃতি ঐতিহাসিকভাবে "উচ্চ" বা "মূলধারার" সংস্কৃতির বিরোধিতা করেছে, এবং এটি শিল্পায়নের দ্বারা উৎপাদিত কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষিত গণসংস্কৃতিকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। এই মাধ্যমগুলির প্রত্যেকটিই বাজার সংস্কৃতির একটি প্রত্যক্ষ পণ্য—এগুলি সবই এখন উল্লেখযোগ্য শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে —এবং যেমন, তারা প্রকৃত শিল্পের আদর্শ নয়, উৎপাদনের অন্যান্য খাতের একই মুনাফা-নির্ধারিত উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত হয়, যেমন পাল্প ফিকশান যা ট্রেনে যাবার সময়ে পড়ে পাঠক ডাস্টবিনে ফেলে দেয়৷ গ্রিনবার্গের মতে, এই ফর্মগুলি তাই কিৎশ - নকল, জাল বা যান্ত্রিক সংস্কৃতি, এক লপ্তে হাজার-হাজার কপি বাজারে ছেড়ে দিয়ে লাভ তুলে নেয়া যায়। ভ্যানগার্ড সংস্কৃতি থেকে চুরি করা আনুষ্ঠানিক ডিভাইসগুলি ব্যবহার করে এই জাতীয় জিনিসগুলি প্রায়শই তাদের চেয়ে উন্নত হওয়ার ভান করে। উদাহরণস্বরূপ,  বিজ্ঞাপন শিল্প অতিবাস্তবতাকে কাজে লাগানো আরম্ভ করে,  কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে  বিজ্ঞাপনের ফটোগ্রাফগুলি সত্যিই পরাবাস্তব কাজ।
    অনুরূপ মতামত ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরাও দিয়েছিলেন, যাঁরা সমালোচনামূলক তত্ত্বের প্রবর্তক হিসেবে বিখ্যাত ।  থিয়োডোর আদোর্নো এবং ম্যাক্স হোরখিমার তাঁদের প্রবন্ধ “দি কালচার ইনডাস্ট্রি : এনলাইটেনমেন্ট অ্যাজ মাস ডিসেপশান” ( ১৯৪৪ ) , এবং ওয়ালটার বেনিয়ামিন তাঁর অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রবন্ধ “দি ওয়র্ক অব আর্ট ইন দি এজ অব মেকানিকাল রিপ্রোডাকশান” ( ১৯৩৫ ) একই তর্ক দিয়েছিলেন । তাঁরা বলেছিলেন যে বাজার ভরে গেছে জাল সংস্কৃতিতে ।  ক্রমাগত একটি নতুন পণ্য সংস্কৃতি-শিল্প (বাণিজ্যিক প্রকাশনা সংস্থা, চলচ্চিত্র শিল্প, রেকর্ড শিল্প এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া সমন্বিত) দ্বারা তৈরি করা হচ্ছে। তাঁরা আরও উল্লেখ করেছেন যে এই পণ্য-সংস্কৃতির উত্থানের অর্থ হল এই যে উৎকর্ষ   পরিমাপ করা হয়  কতো টাকা  বাজার থেকে তোলা গেল। একটা উপন্যাস, বিচার করা হয় কতো কপি আর সংস্করণ হলো সেই পরিসংখ্যান দিয়ে। মেধার ও শৈলীর বিচার হয় না । গল্প-উপন্যাসে গদ্য, আঙ্গিক, বিষয়বস্তু বিচার করা হয় না । স্কুল-কলেজে এখনও “লেখক কী বলিতেছেন” বা “কবি কী বলিতেছেন” প্রশ্ন করে কাজ সেরে ফেলা হয় ।  সঙ্গীত বিচার হয় রেটিং চার্ট দিয়ে আর গান-বাজনা গোল্ড ডিস্কের ভোঁতা বাণিজ্যিক যুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। আজকাল বিবাহবাসরে গিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নাচেন এবং মোটা টাকা রোজগার করেন । তাঁদের নাচের ভিডিও বিক্রি হয় এবং সেই বিক্রি থেকেই উৎকর্ষ পরিমাপ করা হয় । সমাজ-সংস্কৃতির অমন অধঃপতনের কারণেই স্বায়ত্তশাসিত শৈল্পিক যোগ্যতা ও পার্থক্য, আভাঁগার্দ লেখক, কবি, শিল্পী, সঙ্গীতকার, ভাস্করদের কাছে এত প্রিয় ।  যে  ভোক্তা সংস্কৃতি এখন রাজত্ব করেছে তাকে আভাঁগার্দ শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাই কোনো গুরুত্ব দেন না। মণিদীপা সেন-এর কবিতা ‘অন্ধ রাক্ষস আর আমরা’ উল্লেখ্য :
    এখন এবং, সেই ফিরে আসা। বুকের মাঠ থেকে চালুনি করে দানা -বালি -দুঃখ বেছে ফেলি । অপরাহ্নের ছায়ায়, ঘনিয়ে নিই।
    আপাত পৃথিবীর সবটাই, মৃতের চাহনি। গোপন ঝর্ণার জলের শব্দে আমাদের তৃষ্ণা মিটে যায়। জাফরিকাটা আলোর রম্বসে পা রেখে আমরা যাই গ্রহান্তরে। ফেরার আগে ছবিতে তুলে রাখি একা কলপাড়, শীতের ট্যাঞ্জারিনের ছোট্ট বীজ।
    দূরত্ব। সে কতদূর। হাত বেগদা মাপতে মাপতে তার আঙুল ডগায় পৌঁছে যাই যতবার, আমার মানচিত্র ভেঙে যায়। সমস্ত মহাদেশীয় রেখা তার পর্ণমোচনের সাথে রেণু হয়ে ওড়ে।
    সেই রাক্ষসকে চেন? যার এক চোখে রাগ ও অন্য চোখে হতাশা। তারা একত্রে পৃথিবীর ধ্বংস আনতে পারে। ইশ্বর এই দুই চোখ পৃথিবীর দুই প্রান্তে , একটা পাহাড়ের গায়ে ও অন্যটা মরুভূমির ভিতর রেখে দিলেন। তারা কোনোদিন একসাথে হতে পারে না।
    আমাদের দূরত্ব এইসব উদাহরণে মিলে যায়। অন্ধ রাক্ষস আর আমরা অন্ধকার কামড়ে বাঁচি।
    বৈশ্বিক পুঁজিবাদী বাজার, নিওলিবারেল অর্থনীতি এবং গাই ডেবর্ড যাকে ‘দ্য সোসাইটি অফ দ্য স্পেকট্যাকল’ ("বাজার অর্থনীতির স্বৈরাচারী রাজত্ব" বর্ণনাকারী পরিস্থিতিবাদী আন্দোলনের জন্য একটি মূল পাঠ) বলে অভিহিত করেছেন তার দ্বারা আভাঁগার্দ কাজকে বাজার নিজের আওতায় আনার অবিরাম চেষ্টা করে যায় ।  সমসাময়িক সমালোচকরা আজ একটি অর্থপূর্ণ আভাঁগার্দের সম্ভাবনার প্রয়োজন অনুভব করছেন। পল ম্যানের বই ‘থিওরি-ডেথ অফ দ্য আভাঁগার্দ’ দেখিয়েছে  যে আজকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে আভাঁগার্দকে সম্পূর্ণরূপে জায়গা করে দেবার চেষ্টা হয় যাতে তা ক্রমশ বাজারের অংশ হয়ে যায় । যেমন আমরা দেখেছি সুভাষ ঘোষ, সুবিমল মিশ্র, বাসুদেব দাশগুপ্তকে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের বইবাজার ছিনিয়ে নিয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের আওতা থেকে ।
    অভি সমাদ্দারে পড়া যাক, ‘তলান্ন, এই তরঙ্গপ্রাণ, প্রথম কবিতা
    যেভাবে তাকাও তুমি
    সেভাবে এই অন্তর ফোটা দিন
    হসন্তজখমে
    বুঝেও যেন না বোঝার দিন-
    মনে হয় ভুল করি
    মনে হয় ছুটে যাই তুক ভুলের কাছে
    নদী নিরুত্তরের কাছে
    কোথায় পরম আর কোথায় পরম-প্রমাণ! 
    তার'চে তরল মশগুলে, দীনানুদীন
    তার'চে  তরঙ্গপ্রাণে
    ভরা থাক
    শালপথের উধাও হাওয়াটি
    শ্বাসের প্রতিটি আছন্নে
    সময় যেন সময়ে এসে 
    ডাকনামে ডেকে ওঠে
     
    সময় যেন দূরে ওই আগুনে পলাশ
    দূরে ওই গোধূলি গোধূলি
    গ্রিনবার্গ, আদোরনো প্রমুখের পন্য-সংস্কৃতি সম্পর্কিত যুক্তি সত্ত্বেও, মূলধারার সংস্কৃতি সাহিত্য-শিল্পের বিভিন্ন এলাকাকে আভাঁগার্দ তকমা চাপিয়ে  অপপ্রয়োগ করেছে যাতে বাজারের কোনো অংশ বাদ না যায় । প্রধানত জনপ্রিয় সঙ্গীত এবং বাণিজ্যিক সিনেমার প্রচারের জন্য আভাঁগার্দ বা নতুন শব্দটি প্রয়োগ হচ্ছে বিপণন সরঞ্জাম হিসাবে। ইউরোপ আর আমেরিকায় সফল রক মিউজিশিয়ান এবং খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের "আভাঁগাদ" হিসাবে বর্ণনা করা সাধারণ হয়ে উঠেছে, এই শব্দটি এর সঠিক অর্থ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে বাজার। এই গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগত পরিবর্তনকে চিহ্ণিত  করে, আধুনিকতার পাঁচটি অভিমুখের কথা  বলেছেন ক্যালিনেস্কুর মতো প্রধান সমসাময়িক তাত্ত্বিক: ১) আধুনিকতাবাদ, ২) আভাঁগার্দ, ৩) অবক্ষয়, ৪) কিৎশ, এবং ৫) উত্তরাধুনিকতা ।দ্য আইডিয়া অফ দ্য পোস্টমডার্ন: এ হিস্ট্রি’ বইতে, হ্যান্স বার্টেন্স পরামর্শ দিয়েছেন যে এটি একটি সামাজিক ও আর্থিক লক্ষণ যে আমাদের সংস্কৃতি একটি নতুন উত্তর-আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে, যখন চিন্তাভাবনা এবং আচরণের প্রাক্তন আধুনিকতাবাদী উপায়গুলি অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে । অর্থাৎ আভাঁগার্দ আবার নতুন চেহারায় দেখা দিয়েছে যাকে বলা হচ্ছে পোস্টমডার্ন । প্রব আল দাশগুপ্ত একে বলেছেন ‘অধুনান্তিক’।
    সাহিত্য-শিল্পের এই বাজারি পরিবর্তনকে ঝিলম ত্রিবেদী তাঁর ‘ইন্ডাস্ট্রি’ কবিতায় অসাধারণভাবে প্রকাশ করেছেন : ইন্ডাস্ট্রি / ঝিলম ত্রিবেদী
    গেরুয়া সকালের হিন্দুবাদী জামাইষষ্ঠীর সাথে
    উগ্রবাদী রাণীর সনেটও লিখে রাখা উচিৎ ছিল?-
    তোমার আর কী কী করা উচিৎ ছিল বল তো!
    প্লাক করা ভুরুর মত নদী বয়ে যাচ্ছে
    বিপদসীমা ছাড়িয়ে যাওয়া গ্রামের পাঁজর দিয়ে
    অঞ্জনা নদী মরে পড়ে আছে-
    ছলছল.... ছলাৎছল.......
    "........ কাট্ ইট্ ........!!"
    এই তো
    লুম্পেনরা বানাচ্ছে
    পিওর ক্ল্যাসিক ফিল্ম, নাটক-
    "....... এবং নায়িকা এসে
    প্যান্টি ও ব্রা আর আইটেম-সং খুলে রেখে
    লালপেড়ে নৌকো ক'রে নন্দিনী দামিনী সেজে
    আইশ্যাডো ভেসে যাচ্ছে
    তোমার 'না-হয়ে-ওঠা' রঞ্জনের যৌন করতলে........"
    মদ্যপ দলে দলে
    দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে
    কখনও বা হাত, কখনও বা ক্ষুরধার দাড়ি
    জিভ নয়
    যোনি দিয়ে গান গাইছে রেপিস্ট ও সন্ত্রাসবাদী!!
    "........ হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি
    জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি ............."---
    মহাজগৎ ধনে প্রাণে ইজ্জত লুটে নিচ্ছে তোমার-
    সন্ন্যাসীর আশাতীত চোখ নিয়ে তবুও তাকিয়ে আছ?
    "রবীন্দ্রনাথ-অটোম্যাটিক-ক্যাপিটাল"-এর অলৌকিক কর্ণধার!-
    আজি এই মহারণভূমে
    তোমার প্রফিট তুলছে ওয়ার্ল্ড ইন্ডাস্ট্রি-
    হায়!
    ভাগ্যিস জন্মেছিলে তুমি!-
    কী অবাস্তব জন্ম তোমার...........
    তবুও, মূলধারার সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে অগ্রগামীদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন ষাটের দশকের শেষের দিকে নিউ ইয়র্কের সমালোচক হ্যারল্ড রোজেনবার্গ । রেনাটো পোগিওলির অন্তর্দৃষ্টি এবং ক্লেমেন্ট গ্রিনবার্গের দাবির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে, রোজেনবার্গ পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, সারা বিশ্বে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে, প্রগতিশীল সংস্কৃতি আর বামপন্হী সাহিত্য-শিল্প তার পূর্বের প্রতিপক্ষের ভূমিকা পালন করে ক্রমশ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাত মেলাতে আরম্ভ করে। তারপর থেকে এটিকে "একদিকে আভাঁগার্দ ভূত, এবং অন্যদিকে একটি পরিবর্তিত গণ সংস্কৃতি" বলে অভিহিত করা আরম্ভ হয়েছে, । রোজেনবার্গ বলেছেন, সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে, "একটি পেশা যার একটি দিক হল এটিকে উৎখাত করার ভান।" পশ্চিমবাংলায় আমরা দেখেছি বামপন্হীরা সরকারের দখল নেবার পর আদর্শের পথ ছেড়ে টাকাকড়ির পেছনে ছোটা আরম্ভ করেন, মানুষের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাতে থাকেন, খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়েন, সৃজনশীল কাজে মূর্খেরা দাদাগিরি আরম্ভ করেন, যার দরুন বামপন্হী আঁভাঁগার্দ শিল্প-সাহিত্য লোপাট হয়ে যায় । সরকার ও প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেদের দূরত্ব গড়ে নিয়ে কবি-লেখক-সাহিত্যিকরা একা নিজেদের কাজে লিপ্ত হন ।
    প্রদীপ চক্রবর্তীর কবিতা
    কুয়াশা ভোরের ট্রাম
    পথের পাশে কারুকাজে আঁকা মুখখানা
    সে রেখে এসেছে
    গুঞ্জন সমুদ্রের কথা ভেবে নীল আমাজনে
    মুখখানা বদলে যায়
    চৈত্র সেলে পুজোর বাজারে
    শেষ বাদামের খোঁজে
    জলের বিন্দু ধরে উড়ছে যে পাখি
    ঢোঁড়াই চরিত ভালো লাগে তার
    তার চোখ প্রথম দিনের মতো শারীরিক
    বিভুঁই এবং অফুরন্ত শস্য লেগে
    শূন্যের প্রতিফোঁটা জ্বালানি
    চাঁদ বেনেদের গুপ্ত ঘাটে প্রথম রেলগাড়ি দেখে
    বেহুলা বালিকা
    নাভির সায়রে পুরোনো মাছের ঘাই কাঁপে
    সনকার •••
    আভাঁগার্দকে প্রায়শই অ্যারিয়েরগার্দের বিপরীতে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যার আসল সামরিক অর্থ একটি রিয়ারগার্ড বাহিনীকে বোঝায়, যারা সামনের সারির জওয়ানদের  রক্ষা করে। শব্দটি বিশ শতকের শিল্প সমালোচনায় "আভাঁগার্দ" এর চেয়ে কম  ব্যবহৃত হয়েছিল। শিল্প ইতিহাসবিদ নাটালি অ্যাডামসন এবং টোবি নরিস যুক্তি দিয়েছেন যে অ্যারিয়েরগার্দ একটি কিৎশ শৈলী বা প্রতিক্রিয়াশীল অভিযোজনে হ্রাসযোগ্য নয়, বরং এর পরিবর্তে এমন শিল্পীদের উল্লেখ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে যারা সচেতনতা বজায় রেখে আভাঁগার্দের উত্তরাধিকারের সাথে জড়িত। কিছু অর্থে অনাক্রমিক। সমালোচক চার্লস আলটিয়েরি যুক্তি দিয়েছেন যে আভাঁগার্দ এবং অ্যারিয়েরগার্দ পরস্পর নির্ভরশীল: "যেখানে আভাঁগার্দ আছে, সেখানে তাকে অ্যারিয়ারগার্দ অনুসরণ করবেই । পশ্চিমবঙ্গে বামপন্হী কবি-লেখকদের সরকারি লেজুড় হয়ে ওঠার পর আমরা যে প্রতিষ্ঠানবিরোধী নবায়ন পেয়েছি তা অ্যারিয়ারগার্দের । যেমন বারীণ ঘোষালের এই কবিতা, শিরোনাম, ‘দে ন লা’
    আহ্লাদ
    পই পই
    চাই চাঁদ জানে না-র পাখনা
    গলি ফলি শিশুটি অযত্নে যুবক হবেই দেখো
    দাড়ি গজালে চাইবে পাখা
    ধীর পাখোয়াজ
    একা তুম একা তুম তুম
    একা পাহাড়ে জল নামে
    পোষা শ্রু
    শ্রু নামের নদী
    নদী না নালা ড্রেন লাদেন
    Thenলা একটা পাহাড়ি মুভির পথ
    খুঁজছে কেউ
    বিংশ শতাব্দীর পর সাহিত্যের যে-কোনও অর্থপূর্ণ ধারণাকে অবশ্যই আভান্ট-গার্ড আন্দোলনের সাথে লড়াই করতে হবে যা এর দুটি সময়কাল (আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর আধুনিকতা) প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিল। আভান্ট-গার্ড শুধুমাত্র তখনই আসতে পারে যখন শিল্প একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় (যার কথা আসে, বার্গার আমাদের বলে, উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসার পর)। এই প্রতিষ্ঠানটি কোডিফাইড হওয়ার পর, নন্দনতাত্ত্বিকতা শৈল্পিক মূল্যায়নের একটি প্রভাবশালী মোড হিসাবে উঠে আসে যা কার্যকারিতাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং বার্গার "জীবন-প্র্যাক্সিস" (যা "বাস্তব জীবন"-এর মতো কিছু) বলে শিল্পের প্রতিফলনকে গ্রহণ করে। তাই এখন স্বতন্ত্র শিল্পকর্মগুলি তারা যে প্রতিষ্ঠানের (আহেম, ডেরিডিয়ান ঘরানার নির্মাণ) অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করে তা সংজ্ঞায়িত করে এবং বিশ্বকে প্রতিফলিত করা ছাড়া অন্য কোনও কাজ করে না এবং বুর্জোয়া মূল্যবোধের সমালোচনা করতে পারে তবে খুব বেশি সমালোচনামূলক হতে পারে না কারণ তখন তারা' d একটি ফাংশন আছে এবং শিল্প হতে বন্ধ হবে. অ্যাভান্ট-গার্ডে প্রবেশ করুন। বার্গারের অ্যাভান্ট-গার্ডে শিল্পের সংজ্ঞা হল এমন শিল্প যা শিল্পকে আবার জীবন-প্রাক্সিসের মধ্যে পুনঃসংহত করতে চায়, শিল্প যা মূল্য নির্ধারণ করে এমন নিরাকার প্রতিষ্ঠানের প্রতি দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়। আভান্ট-গার্ডে শুধুমাত্র একটি কার্ড যা খেলতে হবে, তা হল "শক", যা মার্সেল ডুচ্যাম্প এবং তার রেডি-মেডস এবং পিকাসো এবং ডালির জন্য ভাল কাজ করে এবং এটিই মোটামুটি। এই উদাহরণগুলি দুর্দান্ত প্রভাবে শক নিযুক্ত করেছিল এবং শিল্পের প্রতিষ্ঠানের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল এবং "শিল্প কী" সম্পর্কে প্রশ্নগুলির দিকে পরিচালিত করেছিল কিন্তু শকটি আর হতবাক না হওয়ার আগে শুধুমাত্র এতদিন ধরে সেই কার্ডটি খেলতে পারে। পরবর্তী অ্যাভান্ট-গার্ড আন্দোলন (কুৎসিতভাবে বলা হয় নিও-অ্যাভান্ট-গার্ড) এই কারণে ব্যর্থ হয়েছে, যে কারণে ওয়ারহল কখনই ডুচাম্প এট আল-এর মতো কট্টরপন্থী হবে না। অ্যাভান্ট-গার্ড আন্দোলন(গুলি) এর ফলাফল হল আপেক্ষিকতাবাদ যা সমসাময়িক শিল্পকে চিহ্নিত করে যেখানে শিল্প হিসাবে একটি কাজের মূল্য অবিলম্বে আপাত বা সহজে সম্মত হয় না। তা সত্ত্বেও, এটি আভান্ট-গার্ড যা প্রভাবশালী শৈল্পিক আন্দোলনকে অনুসরণ করার ভিত্তি তৈরি করে, তাই আধুনিকতা বোঝার অর্থ হল ঝর্ণার সাথে লড়াই করা এবং উত্তর-আধুনিকতা বোঝার অর্থ হল ব্রিলো বক্সের সাথে গণনা করা (যা পরের ঘটনাটি বেশ সুন্দরভাবে ক্লান্তি এবং প্যাস্টিচে এবং শিল্পকে বিরোধী হিসাবে তুলে ধরে। -শিল্প). এই ছোট্ট বইটিতে অনেকগুলি দুর্দান্ত ধারণা রয়েছে যা কিছু মোটামুটি শ্রমসাধ্য গদ্যে ঘনভাবে প্যাক করা হয়েছে।  যেমন নিমাই জানার ‘জিরাফ রঙের ফার্নিচার দোকান’ কবিতাটি ; এটি ট্রান্সলোকেশনাল হাইব্রিডিটির একটি রূপ যা বানিজ্যিক ট্রান্সন্যাশনাল হাইব্রিডিটি (বহুসাংস্কৃতিক রাজনীতির সহজ রূপ) গ্রহণ করতে অস্বীকার করে যা ইতিহাসের চলন-বলনের সাথে মানিয়ে নিতে :
    প্রতিটি সঙ্গমের পর নিজের ওপর সমকৌণিক বৃক্ষ হয়ে বসে পড়ি আমি , আমার গায়ের আঁশটে গন্ধ চলে যায় আমি তখন কোন এক বৈদিক যুগের বৃত্তাকার আগুন নিয়ে আরও কঠিন শীৎগর্ভ ভেদ করে কৃষ্ণ গহ্বরের লাল দগদগে লাভা নিয়ে আসি
    আমার জিভের বদ রক্ত নিজেই খাই বলে খুব মিষ্টি লাগে
    আমার অযৌন রঙের অঙ্কন প্রণালী এখনও কেউ প্রমাণ করতে পারেনি কিছু নিষিদ্ধ শিমুল গাছের কাঁটা একগুচ্ছ নারীদের শিফন শাড়ি আত্মহত্যা রং মেখে নাশপাতি বৃক্ষ হয়ে ঝুলে আছে 
    তরল পাথরের উপর একটি ফার্নিচার দোকানের মৃত জিরাফ , সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার আগেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছেন তার চৈতন্য শিখা 
    জিরাফের মধ্যপ্রাচ্যের ডগায় একটি গোলাপ ফুলের চারা লাগিয়েছি কোন ভূমা অঞ্চলের উর্বরতা দিয়ে
    চুলের ডগা দিয়ে প্রতিটি অক্ষাংশ মাপার পর দাফন শেষের পুরুষদের হাতে মাটির দাগ লেগে থাকে , সে দাগ কাঁকড়া বিছা জানে না
    আত্মহত্যার পর প্রতিটি পাজামার কিছু গ্লিসারিন মেখে নেওয়া উচিত যাতে গর্ভপাত বিষয়ক টেবিলের উপর কোন বোধিবৃক্ষের দাগ না থাকে…
     
    আভাঁগার্দ সাহিত্যিক-শিল্পীদের  কার্যকলাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো "ভঙ্গিসর্বশ্ব নন্দনতত্ত্ব" এবং "ডিসকোর্স-গদ্যকৌশল" এর বিপরীত মেরুগুলির মধ্যেকার টেনশান ।  পিটার বার্গার  যেমন তাঁর ‘থিওরি অফ দ্য আভাঁগার্দ বইতে  উল্লেখ করেছেন, যে কাজগুলোর উদ্দেশ্য হল একটি অ-জৈব এগিয়ে যাবার ধারণাকে কার্যকর করা। কাজগুলো কোলাজ, মন্টেজ, প্যাশটিশ দ্বারা চিহ্নিত হতে পারে । ফলে কাজটিকে ভিন্ন মাধ্যমগুলির সমন্বয়ে একটি "নতুন" সমগ্রের সাথে ভিন্ন ভিন্ন উপাদানকে একীভূত করার প্রক্রিয়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কবিতার অনুশীলন অভ্যাসের মতো, আভাঁগার্দ টেক্সটে নিজের থেকে বিচ্ছিন্নতার চেয়েও বেশি কিছু থাকে । আমেরিকায়  লা লিন হেজিনিয়ান, রন সিলিম্যান, ব্রুস অ্যান্ড্রুস, বব পেরেলম্যান এবং ওয়েস্ট কোস্ট আন্দোলনের অন্যরা যা সত্তর দশকে শুরু করেছিলেন । সেগুলো ছিল ষাটের দশকের স্বীকারোক্তিমূলক কবিতার পুনরুত্থিত রোমান্টিকতার সাহসী তিরস্কার । স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা প্রচুর পাওয়া যায় কৃত্তিবাস পত্রিকার সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনায় । তারাপদ রায়ের প্যারডিও আসলে স্বীকারোক্তিমূলক । অবশ্য আভাঁগার্দ সাহিত্যিক-শিল্পীরা মনে করেন সৃজনশীল মানুষেরএকটি আবিষ্কারযোগ্য প্রতিস্ব আছে, মূল বিষয়বস্তু আছে । তুষ্টি ভট্টাচার্য তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, “কৃত্তিবাসের কবিরা বীটনিক কাব্যের অনুরক্ত হয়ে পড়লেন এবং তাঁদের কবিতা হয়ে উঠল তীব্র, উদাসীন, উন্মত্ত, ক্রুদ্ধ, ভয়ংকর চতুর এবং অতৃপ্ত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বসু, তারাপদ রায় প্রমুখরা এই নতুন কবিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলেন। ১৯৬৯ সালের পর কৃত্তিবাস দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে। এরপর আবার চালু হয় মাসিক পত্রিকা হিসেবে। তখন থেকে কৃত্তিবাস আর শুধু কবিতার পত্রিকা থাকে না, গদ্যও সমান তালে ছাপা হতে থাকে। বর্তমানেও সুনীলের প্রয়াণের পরে কয়েক বছর কৃত্তিবাস পত্রিকা চলার পর একদম পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার গুজব ছড়িয়েছে। কিন্তু এতদিনে কৃত্তিবাস তার সেই দুরন্ত ছেলের তকমা হারিয়েছে। প্রথম পর্বের কৃত্তিবাস নিয়েও অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে। অতি চিৎকারের অভিযোগ ওঠে। সেই বোহেমিয়ানার ঘোর কেটে গিয়ে কৃত্তিবাস তার গৌরব হারায়।”
    আজ, আভাঁগার্দ সাহিত্যের অনেক কিছুই বিশেষভাবে চরম বা বিপ্লবী মনে হতে পারে না কেননা আভাঁগার্দ শিল্পী-সাহিত্যিক নতুন কিছু আনলেই সেগুলো বাজারের কর্তারা দখল করে নেবে । কিন্তু, যে সময়ে ডাডাবাদ-পরাবাস্তববাদ-হাংরি আন্দোলন হয়েছিল, আভাঁগার্দ কাজগুলো সাহিত্য জগতে যা করা সম্ভব, উপযুক্ত এবং যা করার যোগ্য বলে মানুষ ভেবেছিল তার সীমানা বাড়িয়ে দিতে পেরেছিল। তবে পরীক্ষামূলক শৈলী, চ্যালেঞ্জিং সিনট্যাক্স এবং প্লট স্ট্রাকচার,  লেখকরা নতুন কাঠামো নিয়ে পরীক্ষা করতে পারেন, যেমন একটি আকারে লাইন সাজানো, নির্দিষ্ট অক্ষর ব্যবহার করতে অস্বীকার করা, একই গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে দুটি ভিন্ন ভাষায় লেখা এবং আরও অনেক কিছু। অ্যাভান্ট-গার্ডে সাহিত্য কী হতে পারে তার কোনও সীমা নেই । সুবিমল বসাক ১৯৬৫ সালে তাঁর ‘ছাতামাথা’ উপন্যাসে সংলাপ ব্যবহার করেছিলেন কলকাতার বুলিতে এবং ন্যারেটিভ লিখেছিলেন ঢাকার টাঙ্গাচালক কুট্টিদের বুলিতে । তখন তা বিদ্যায়তনিক আলোচকরা গ্রহণ করতে পারেননি কিন্তু এখন স্বাধীন বাংলাদেশে ব্রাত্য রাইসুর মতো  সাহিত্যিকরা ওই বুলিতেই সাহিত্যিক কাজ করার দাবি তুলেছেন । সুবিমল বসাক কবিতাও লিখেছেন ওই বুলিতে, যেমন “অহন আমি আরশিতে” কবিতায়:
    আমি অহন আরশিতে আমার উল্টা চ্যারাহান্ দেখতাছি
    নিজেরে ঘিরা আমি এউগা চিন্তা-ভাবনা করি
    আমারে ঘিরা অন্যজনা ভিন্ন চিন্তা-ভাবনা করে
    আমার দিশায় একই রেকর্ডের আওয়াজ বারংবার চিখ্ খৈর পাড়তে থাকে
    বেশীভাগ মানুজন একই দিয়া চলাফিরি করে
    একই নীল হেজে শুইয়া কাবার করে রাত্র-দিন
    পরতেক ম্যায়ালোক জনমের পোষাক লগে লইয়া বড় হয়
    আপনা পুরুষের হুম্ কে  অরা বেবাক্তেই শরীলের চাম বদলায়
    অগো বংশধারা সচল থোয়
    নিত্যি আমি একই লেহান আকাশ দেহি
    কুনোকিচ্ছুতে হেরফের হয় না এক্কেরে
    নিজের গতর থিক্যা বেবাক কুসংস্কারের ধুলা ঝাইব়্যা ফেলছি
    তবও হায়। 
    নিজের পিরন থিক্যা বাইরইয়া আইতে পারিনা
    আমি জানি, স্বাধীনতা বেজায় মাঙ্গা —
    আর কিচ্ছু না — স্বাধীনতা মাইনষের শরীলের চাম্ —
    বংশ মজুদ রাখনের গাদ
    দেহি, যে রাস্তা আজ তৈয়ার হইতাছে
    জানি, কুনোদিন এইরাস্তা দিয়া কারো কান্ধে ব্যাইয়া মড়া যাইবো
     আদিরূপের আভাঁগার্দ  এমন একটি আন্দোলন যা সত্যিকারের সমমনা শিল্পীদের একত্রিত করেছিল, যাদের গোষ্ঠীর ম্যানিফেস্টো ছিল যে তারা সংস্কৃতির প্রভাবশালী নান্দনিক মূল্যবোধকে উচ্ছেদ করবে এবং এমন শিল্পকর্ম তৈরি করবে যা প্রকৃতপক্ষে নতুন এবং বিপ্লবী হবে । সেই কাজগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে নতুন প্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং দর্শনের সাথে। মূল উদাহরণ হলো বিশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাশিয়ান আভাঁগার্দ ছিল জীবন্ত। কবি, চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, ফটোগ্রাফার, শিল্পীর বই এবং অভিনয়ের নির্মাতা - গনচারোভা, মালেভিচ, তাটলিন, খলেবনিকভ, ক্রুশচনিখ, মায়াকভস্কি - পরবর্তীতে, রডচেঙ্কো, লিসিটস্কি, মেয়ারহোল্ড প্রমুখ মৌলিক আভাঁগার্দ নীতিগুলির সাথে একমত ছিলেন, বিশেষত তাঁদের কর্মকাণ্ডে একটি অ-প্রতিনিধিত্বমূলক শিল্প এবং কবিতার দিকে এবং ফ্যাক্টুরা (পাঠ্য বা শিল্পকর্মের উপাদান ভিত্তি), sdvig (প্রতিবেশী শব্দের দিকে অভিযোজন), এবং ostranenie (অপরিচিতিকরণ) এর সহযোগে জোর দেওয়া হয়েছিল । মালেভিচের মতো একজন শিল্পীকে একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীর সাথে চিহ্নিত করা হয়েছিল, এবং তবুও তিনি সেই গোষ্ঠী পরিচয়কে অতিক্রম করে একজন  আদি আধুনিকতাবাদী শিল্পী হিসাবে নিজের অবস্থান সৃষ্টি করেছিলেন । উল্লেখ্য যে তাঁর নিজের "আন্দোলন" পরাক্রমবাদ বা সুপপিম্যাটিজম ছিল একজন মাত্র মানুষের কর্মকাণ্ড : তিনি মালেভিচ, সর্বোপরি, একমাত্র পরাক্রমবাদী বা সুপ্রিম্যাসিস্ট । আজকের দিনে বাংলা ভাষায় কেউ যদি সুপ্রিম্যাটিজম আন্দোলনের পতাকা ওড়ান, তাঁকে গালমন্দ করা হবে ।
     একটি ভিন্ন ধরনের আভাঁগার্দ আমেরিকায় গঠিত হয়েছিল ভৌগলিক স্তরে । তা হলো  ব্ল্যাক মাউন্টেন  আন্দোলন ; যারা ব্ল্যাক মাউন্টেন কলেজে পড়াশুনা করেছিল এবং কবিতা লিখতো আর লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতো তারা ।  অনেক নামকরা শিল্পী-সাহিত্যিক ব্ল্যাক মাউন্টেনের অংশ ছিলেন, যেমন, সেফ অ্যালবার্স থেকে চার্লস ওলসন এবং রবার্ট ডানকান, বাকমিনস্টার ফুলার থেকে জন কেজ, মার্সে কানিংহাম এবং অ্যালান ক্যাপ্রো পর্যন্ত। কয়েক বছর ধরে, ব্ল্যাক মাউন্টেন রিভিউ এই কবিদের একত্রিত করেছিল, কিন্তু তাদের দলগত প্রেরণা কখনই শক্তিশালী ছিল না। 
    “স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলা ভাষার সাহিত্য আন্দোলন” প্রবন্ধে তুষ্টি ভট্টাচার্য লিখেছেন :
     “বাংলা সাহিত্যে স্হিতাবস্হা ভাঙার আওআজ তুলে, ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে, শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি আন্দোলন, যাকে অনেকে বলেন হাংরিয়ালিস্ট, ক্ষুধিত, ক্ষুৎকাতর, ক্ষুধার্ত আন্দোলন।  ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়। কবিতা সম্পর্কিত ইশতাহারটি ছিল ইংরেজিতে, কেন না পাটনায় মলয় রায়চৌধুরী বাংলা প্রেস পাননি। আন্দোলনের প্রভাবটি ব্যাপক ও গভীর ছিল ।
    হাংরি আন্দোলনকারীরা হাংরি শব্দটি আহরণ করেছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম বাক্যটি থেকে, অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে তাঁরা হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চাইলেন। তাত্তিক ভিত্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট গ্রন্হটির দর্শন থেকে । স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না; তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়। তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোনদিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়। তার সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে, তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন। হাংরি আন্দোলনকারীদের মনে হয়েছিল দেশভাগের ফলে ও পরে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। সেকারণে হাংরি আন্দোলনকে তঁরা বললেন কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন, এবং নিজেদের সাহিত্যকৃতিকে কাউন্টার ডিসকোর্স। তাঁরা বললেন, "ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের ধারণার বনেদের ওপর; কল্লোল বা কৃত্তিবাস গোষ্ঠী যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলো ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেন না সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্থনা-নির্ভ� �*, এবং তাঁদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত।" তাঁরা বললেন, "এই ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদেরকে পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, এবং স্হানিকতাকে ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে। ওই ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে-মননর্স্তাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্হানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ। ঠিক এই কারণেই, ইউরেপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে ব্যক্তিপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো । কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে পুঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন। এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠিও সীমিত হয়ে গেছে মাত্র কয়েকজন মেধাসত্তবাধিকারীর নামে। পক্ষান্তরে, ঔপনিবেশিক গণতন্ত্রের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবা হয়, তাহলে দেখা যায় যে পদাবলী সাহিত্য নামক ম্যাক্রো পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাজ, মঙ্গলকাব্য নামক পরিসরে সংকুলান ঘটেছে মনসা, চণ্ডী, শিব, কালিকা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর। লক্ষ্মণীয় যে প্রাকৌপনিবেশিক কালখণ্ডে সন্দর্ভ গুরুত্ত্বপূর্ণ ছিল, তার রচয়িতা নয় ।
    এর পর পুস্কর দাসগুপ্তের নেতৃত্বে গড়ে উঠল শ্রুতি আন্দোলন। মৃণাল বসু চৌধুরী ও পরেশ মন্ডল শ্রুতি আন্দোলনে যোগ দেন। কিন্তু ঐতিহ্যশালী ও হাংরির বাইরে অন্য কিছু একটা করে দেখাবার, যা বামপন্থী স্লোগান সর্বস্বতার বাইরে, যা কিনা সমাজ, সংস্কার, উগ্র আধুনিকতার বাইরের বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দেবে। ১৯৬৮ সালে পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আর এক দল যুবক শুরু করলেন ধ্বংসকালীন আন্দোলন। ‘সাম্প্রতিক’ পত্রটি হল এর মুখপত্র। আর ‘কবিপত্র’ তার সহযোগী। মণীন্দ্র গুপ্তর তাগাদায় পবিত্র মুখোপাধ্যায় লিখলেন ‘ইবলিশের আত্মদর্শন’। 
    এর পরবর্তী সময়ে  কবিতা হয়ে গেছে কলকাতা অভিমুখী। অর্থাৎ নাম, যশ বা কবিতা চর্চা হয়ে গেছে কলকাতা কেন্দ্রিক। এর ফলে সরকারী অ্যাকাডেমি যেমন তৈরি হয়েছে, কলকাতার বাইরের লেখক ও কবিরা রয়ে গেছেন অচ্ছুৎ। কবিতায় রাজনীতির রঙ লেগেছে। সাধারণ মানুষ যারা কবিতা ভালোবাসে, তাদের মধ্যে আবার অস্থিরতা বেড়েছে। কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে অনেকে জেলায় জেলায় নতুন পত্রিকা চালু করেছেন তাদের মুখপত্র হিসেবে। ততদিনে ইন্টারনেট এসে গেছে। যদিও নেট-এর হাত ধরে বৃহত্তর দুনিয়ায় পৌঁছনো মানুষের সংখ্যা তখন কম।
    এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘কৌরব’। একদম শুরুতে ১৯৬৮-৬৯ এ কৌরব নাট্যগোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জামশেদপুরে, কমল চক্রবর্তী, বারীন ঘোষাল, সুভাষ ভট্টাচার্য্য, অরুণ আইন ও শক্তিপদ হালদারের হাত ধরে। এ’ছাড়াও নিয়মিত কবিতা গদ্যের পাঠচক্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ’ভাবেই কৌরবে ভেড়ে স্বদেশ সেন-এর নৌকো। ২০০৪ এর কৌরব ১০০ সংখ্যা অব্দি টানা সম্পাদনার দায়িত্বে কমল চক্রবর্তী। 
    এই সময়েই (২০০২সালে) বারীন ঘোষালের হাত ধরে চিরাচরিত কবিতার ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে মেনিফেস্টোবিহীন ‘নতুন কবিতা’ আত্মপ্রকাশ করে। এই পত্রিকায় স্বপন রায় আর রঞ্জন মৈত্র ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সক্রিয় থেকেছেন অভিজিৎ মিত্র, ইন্দ্রনীল ঘোষ, অরূপরতন ঘোষ এবং এখন রয়েছেন তপোন দাশ এবং সব্যসাচী হাজরা! কিন্তু কবি সৌমিত্র সেনগুপ্ত আর অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত শুভাকাঙ্খী না থাকলে “নতুন কবিতা”কে চোদ্দ বছর ধরে চালানো যেত না! পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই চেষ্টা করা হয়েছিল কবিতা’র তত্ত্ব নয়, কবিতা’র ভাবনাই হবে “নতুন কবিতা”র বিচরণক্ষেত্র! আমরা যেহেতু কবিতা’কে বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম অতএব “স্থা”র পক্ষে থাকা জীবনানন্দীয় ধারা, বামপন্থী সামাজিক বাস্তবতার ধারা, পঞ্চাশ দশকীয় ছন্দে লিখতে থাকা পদ্যধর্মী ধারা ইত্যাদিতে জড়িয়ে থাকা বাংলা কবিতা লিখিয়েদের ৯০ শতাংশ কবি, কবিতার কাগজ, খবরের কাগজ, রাজনৈতিক দলের কাগজ ইত্যাদি সকলের কাছেই এঁরা ব্রাত্য হয়ে গেলেন, এখনো তাই আছেন! কাউকে আক্রমণ না ক’রে, কারো প্রতি বিদ্বেষ বা অসূয়া প্রকাশ না ক’রে এঁরা লেখার চেষ্টা করছিলেন বাংলা কবিতায় যা লেখা হয়নি সেরকম কবিতা, এঁদের নিজেদের ভাষায়! 
    ২০০৯সালে আন্তর্জালে এলো অনুপম মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বাক’। শুধুমাত্র ব্লগ নির্ভর বাংলার প্রথম পত্রিকা। এখানেও নতুনকে, নতুন ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ও হয়। অনুপম মুখোপাধ্যায় নিজে ‘পুনরাধুনিক কবিতা’ লেখেন। এই পুনরাধুনিক সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, পুনরাধুনিক কোনো তত্ত্ব নয়। এটা ভাবনা। যাপন আর সমাজের মধ্যে এর ঘোরাফেরা। মূল ব্যাপারটা হল একজন কবি বা শিল্পীর হাঁফিয়ে ওঠা। সে আর নিতে পারছে না অধুনান্তিক কালপর্বের অবান্তর বেঁচে থাকাকে, একজন স্রষ্টা হিসেবে নিজের অকিঞ্চিৎকরতাকে। বাংলা কবিতা থেকে একজন কবির একলা চলার ব্যাপারটাকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। প্রতাপশালী বিবিধ প্রতিষ্ঠানের মুখে বাংলা কবিতা প্রবেশ করেছে যেন সাপের মুখে ছুঁচো- প্রতাপ পারছে না কবিতাকে গ্রাস করতে, পারছে না তাকে মুছে ফেলতে। বাণিজ্যিক পত্রে কবিতা ছাপা হয়, এই কারণে নয় যে পত্রিকাটির কবিতা প্রয়োজন আছে। এই কারণেই প্রতিষ্ঠান তার সুবিধাজনক কবিতাগুলোকে প্রকাশ করে যাতে কবিতার দ্রোহ এবং কবির আগুন জনসাধারণের চোখে এসে না পড়ে। একজন পুনরাধুনিক কবি কোনো প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী হবেন না। তিনি আত্মপ্রতিষ্ঠ হবেন। 
    অনিন্দ্য রায়-এর  ‘একটা মহানিমগাছ’ পড়লে আইডিয়া হবে : 
    একটা মহানিমগাছ, একটা মনস্তত্ত্বের মতো পুকুর 
    এরকম আলোছায়াতেই কিশোরেরা 
    প্রথম ছিপের ব্যবহার শেখে 
    একটা মহানিমগাছ, একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো পাথর 
    ভুল ও সান্ত্বনাগুলি চাপা দিয়ে চলে যাওয়া যায়
     
    অনেক বছর পর যখন ফিরে আসে
    একটা মহানিমগাছ, একটা স্মৃতিফলকের মতো বক 
    একটা মহানিমগাছ, একটা ভুল-করার মতো ঢিল
                                            জলে ছুড়ে দেওয়া
    ১) পাটীগাণিতিক কবিতা ( arithmetical poetry), ২) বীজগাণিতিক কবিতা ( algebraic poetry ), ৩ )জ্যামিতিক কবিতা(geometrical poetry), ৪ )ক্যালকুলাস কবিতা (calculus poetry), ৫) পরিমিতিক কবিতা, ৬) মিশ্র গাণিতিক কবিতা(mixed mathematical poetry ), যেখানে একটি কবিতায় গণিতের একাধিক শাখার ধারণা একই সাথে ব্যবহার করা হয়।, ৭ ) আক্ষরিক কবিতা(lexical poetry), অর্থাৎ কেবল মাত্র অক্ষর দিয়ে রচিত। এখানে গণিতের কনসেপ্ট ব্যবহৃত হয় কবিতার থিম হিসেবে, মেটাফর হিসেবে। কিন্তু কবিতাটি রচিত হবে অক্ষর দিয়েই।, ৮ ) সমীকরণ কবিতা, (equational poetry) যেখানে একটি সমীকরণ দিয়ে কবিতাটি লেখা হবে।, ৯ ) দৃশ্য কবিতা (visual poetry ) যা অঙ্কের বিষয় নিয়ে রচিত হবে।,১০ )সংখ্যা কবিতা. (number poetry ) যেখানে কবিতা প্রকাশ পাবে সংখ্যা দিয়ে।,১১ )গ্রাফিক্যাল কবিতা (graphical poetry ), এখানে কবিতার মাধ্যম হবে গ্রাফ ।,১২ ) সংকর কবিতা,( hybrid mathematical poetry ) যেখানে উপরের বিভাগগুলির এক বা একাধিক কনসেপ্ট ও টেকনিক ব্যবহৃত হবে।
    তুষ্টি ভট্টাচার্যের উল্লেখ করা হাংরি, শ্রুতি, নিমসাহিত্য, শাস্ত্রবিরোধী, গাণিতিক, পুনরাধুনিক ইত্যাদি সব কয়টিই আঁভাগার্দ আন্দোলন । আন্দোলনকারীরা ঘোষিত ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক খবরদারির বিরুদ্ধে । কিন্তু তুষ্টি ভট্টাচার্য ‘স্রষ্টা কী বলিতেছেনকে’ গুরুত্ব দিয়েছেন, যখন কিনা আভাঁগার্দ আন্দোলনগুলো বলতে চেয়েছে যে ‘সৃ্ষ্টিকর্মটি কী করিতেছে’ । ঝিলম ত্রিবেদী যেমন বলেছেন, “কবিতা কোনও জবাবদিহি নয়। কবিতা প্রশ্নবাণের প্রতিউত্তর নয়। কবিতা নয় কোনও চাটুকার অসহ্য সমাজের, রাষ্ট্রের, ইতর মানুষের উল্লাস! কবিতা শারীরিক ও মানবিক ধর্ষণ শেখায় না। কবিতা হত্যাকারী নয়--- হত্যা করে মানুষ মানুষকে অবলীলায়! কবিতার চুম্বনটুকু সত্য থাক চির চিরকাল...ইহকাল পরকাল…”
    ইউরোপকে অনুসরণ করে প্রতিটি উপনিবেশে কবিতা, উপন্যাস, গল্প, পেইনটিঙ, ভাস্কর্য ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে সাইত্য-শিল্পের নতুন যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল । স্বাভাবিকভাবে ১৯২০-এর দশক থেকে নতুন শিল্প-সাহিত্যকে আভাঁগার্দ হিসেবে চিহ্ণিত করা আরম্ভ হল উপনিবেশগুলোতে । নতিন শিল্প-সাহিত্য  দেশে-দেশে একটি অপ্রচলিত পথ তৈরি করেছে যার শ্রেণীকরণ সম্ভব নয় এবং কাজগুলো ইউরোপের অনুকরণে করা তথাকথিত মূলধারার সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বছরের পর বছর ধরে, আভাঁগার্দকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে, যদিও দেশে-দেশে কাজগুলোকে আভাঁগার্দ বলা হয়নি। আভাঁগার্দ একটি নতুন শৈলী শৈলী, একটি নান্দনিক বিপ্লব,  একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়া,  এবং বর্তমান সময়ে সেই কাজগুলোকেই শিল্পের সমালোচনা হিসাবে মান্যতা দেয়া হয়েছে । যেমন জয়িতা ভট্টাচার্যের ‘স্বাধীনতা দিবস’ কবিতাটি:
    কখনো বাম কখনো ডান
    এভাবে আবার বাম দেখে
    পথ পার হয়ে যাই নিরাপদে।
    বাইক পথের অন্ধকারে
    পাতা আছে নিপুণ তার আড়াআড়ি,
    তেমন তেমন হলে
    এখন নিঃশব্দে নেমে যাবে লাশ,
    এভাবে আমরা স্বাধীনতা উদযাপন করি এই ইতরের দেশে।
    বিড়িপাতায় মুখাগ্নি করি চাঁদের আলোয়,
    ঘাতক আর সাধক,
    দুজনে সমান ছায়া ফেলে।
    এই ইতরের দেশ আমারই ,
    এই ইতর দেশের কৃষক মজুর,
    আমারই,
    ধর্ষিত মেয়ের রক্তে ভেজা পরিধানে
    জয় গোঁসাইয়ের পীড়িত কথা
    কাকজ্যোৎস্নায় জমছে উঠে বেশ।
    বেশ
    বেশ
    রাত-বিরেতে চাঁদের বুড়ি ম্লান হাসে
    অমোঘ সন্ত্রাসে।
    আলোচকরা স্বীকার করেন যে আভাঁগার্দ সাহিত্য অনুবাদ করা কঠিন । অনুবাদ, যাকে "অর্থের একটি প্রাসঙ্গিক নবায়ন" হিসাবে বোঝা যেতে পারে, সাহিত্যকর্মের সময়হীনতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে । সেই সঙ্গে আভাঁগার্দের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেই থামে না,  তার মূল সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ধরে রাখা সম্ভব কি না সে প্রশ্নও তোলে । তার ফলে সাহিত্য অনুবাদের সম্ভাবনা পরীক্ষা করার সময়, আভাঁগার্দের  প্রেক্ষাপটে অনুবাদের বিভিন্ন রূপগুলিও বিবেচনার দরকার হয় । উদাহরণস্বরূপ, ব্রাজিলের কনক্রিট আন্দোলনের কবিরা — এজরা পাউন্ডের প্রভাবে, অনুবাদের একটি ধারণা তৈরি করেছিলেন যা মূল পাঠকে পুনরুৎপাদন করতে চায় ।  ১৯৬০-এর দশকে, ফরাসি জার্নাল ‘চেঞ্জ’ (১৯৬৮-১৯৮৩) অনুবাদকে একটি রূপান্তরমূলক অনুশীলন  হিসাবে মান্যতা দিয়েছিল। সেই কালখণ্ডে, অনুবাদের কাজকে "উন্মুক্ততা", "সম্প্রসারণ", "বহুত্ব" এবং "গুণ" এর ধারণাগুলির সাথে যুক্ত করা হয় , যা সেই সময়ের সমালোচনামূলক আলোচনার অংশ ছিল । অনুবাদকে যাঁরা রূপান্তরবাদের আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা অনুবাদকে মূল টেক্সটে লুকানো ইঙ্গিত ও সম্ভাবনা খুঁজে বের করার একটি উপায় হিসাবে দেখেছিলেন । অনুবাদ হয়ে উঠেছিল আরেকরকম আভাঁগার্দ কাজ ।  কাব্যিক ভাষা এবং আঙ্গিকের সীমাকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, আভাঁগার্দ সাহিত্য মূলত অনূদিত রয়ে গেছে । তার কারণ হলো, এমনিতেই কবিতা অনুবাদ খুব কম মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং একাডেমিক পাঠ্যপুস্তকে একটি ক্ষুদ্র এলাকায় থাকে । তাত্ত্বিকরা  যুক্তি দিয়েছেন, কবিতা হল সবচেয়ে কম অনুবাদ করা সাহিত্যের ধারা  এবং কবিতা সাধারণ পাঠকের তেমন আগ্রহ জাগায় না। এরকম অবস্হায় কেই বা আভাঁগার্দ কবিতা অনুবাদ করতে চাইবেন !
    আমি আমার প্রথম কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ’ থেকে আভাঁগার্দ অভিমুখে রওনা দিয়েছিলুম । বইটা বেরিয়েছিল ১৯৬৩ সালে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে, কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশক হলেও বইটিকে স্বীকৃতি দেননি । উনি আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে যা লিখেছিলেন, তা থেকে স্পষ্ট যে আভাঁগার্দ সাহিত্য সম্পর্কে ওনার কোনো ধারণা ছিল না :
    “সাক্ষীর কাঠগড়ায় মলয়ের কবিতা আমাকে পুরো পড়তে দেওয়া হয়। পড়ে আমার গা রি-রি করে। এমন বাজে কবিতা যে আমাকে পড়তে বাধ্য করা হল, সে জন্য আমি ক্ষুব্ধ বোধ করি--- আমার সময় কম, কবিতা কম পড়ি, আমার রুচির সঙ্জগে মেলে না --- এমন কবিতা পড়ে আমি মাথাকে বিরক্ত করতে চাই না। মলয়ের তিনপাতা রচনায় একটা লাইনেও কবিতার চিহ্ণ নেই। মলয় যদি আমার ছোট ভাই হতো, আমি ওকে কবিতা লিখতে বারণ করতাম অথবা গোড়ার অ-আ-ক-খ থেকে শুরু করতে বলতাম। যাই হোক, তবু আমি বেশ স্পষ্ট গলাতেই দুবার বলেছি ওর ঐ কবিতা আমার ভালো লেগেছে। এর কারণ, আমার কোনো মহত্ব নয়--- আমার সাধারণ, স্বাভাবিক, সীমাবদ্ধ জীবন। যে-কারণে আমি আনন্দবাজারে সমালোচনায় কোনো বাজে বইকে ভালো লিখি --- সেই কারণেই মলয়ের লেখাকে ভালো বলেছি।”
    আধুনিকতাবাদের তারিখগুলি বিতর্কিত, এটি সঠিকভাবে দাবি করা যেতে পারে যে নবজাতক আধুনিকতা আভাঁগার্দ (একটি সামরিক রূপক, যার অর্থ 'অগ্রিম গার্ড') দ্বারা উদ্ভূত হয়েছিল, যা শিল্পী এবং লেখকদের একটি ছোট, স্ব-সচেতন গোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে , এজরা পাউন্ডের উপদেশ, "এটিকে নতুন করে তুলতে হবে" মেনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। স্বীকৃত প্রথা এবং নিষেধ লঙ্ঘন করে, শুধুমাত্র শিল্পের নয়, সামাজিক ডিসকোর্সও, তাঁরা নিত্য নতুন শৈল্পিক ফর্ম এবং শৈলী তৈরি করতে এবং তখনও পর্যন্ত অবহেলিত এবং কখনও কখনও নিষিদ্ধ বিষয়বস্তু প্রবর্তন করতে শুরু করেছিলেন। এই শিল্পীরা প্রায়শই নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত বিরাদরি থেকে বিচ্ছিন্ন হিসাবে উপস্থাপন করেছেন, যার বিরুদ্ধে তাঁরা তাঁদের নিজস্ব স্বায়ত্তশাসনের দাবির পতাকা তুলেছিলেন । একটি বিশিষ্ট লক্ষ্য ছিল প্রচলিত পাঠকের সংবেদনশীলতাকে ধাক্কা দেওয়া এবং প্রভাবশালী বুর্জোয়া সংস্কৃতির রীতিনীতি ও ভদ্রতাকে চ্যালেঞ্জ করা।’প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতায় আমি সেটাই করেছিলুম এবং তা কেবল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেই নয়, আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতন শিক্ষিতদেরও উত্তেজিত করেছিল। ঐতিহ্যের সাথে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে, আমি সমস্ত নিখুঁত নান্দনিক রীতিনীতি, মানদণ্ড এবং রুচির বিবেচনাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলুম এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতুকপূর্ণতা, আইকনোক্লাজম, অযৌক্তিকতার  সংস্কৃতিকে এবং রহস্যময়তাকে এনেছিলুম আমার পাঠবস্তুতে, যার সবই কিন্তু ছিল আধুনিকতাবাদী  বৈশিষ্ট্য। আভাঁগার্দ  সামরিক-রাজনৈতিক শব্দটি গ্রহণ করা ছিল আমার আত্ম-সচেতন চরমপন্থার  অভিব্যক্তি, এমন চরমপন্থা যা শিল্প ও সমাজকে ভবিষ্যতে আরও  দ্রুত গতিতে চাপ দেওয়ার জন্য নান্দনিক এবং সামাজিক ঐতিহ্যের ব্যাঘাতকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
    সংস্কৃতি এবং এর নিয়মগুলিকে বিগড়ে দিয়ে, প্যারোডি এবং লঙ্ঘন করার  ব্যবস্থা এনেছিলুম লেখায়, যেমন আমার উপন্যাস ‘নখদন্ত’তে। শক কৌশল এবং বিভিন্ন ব্যকরণ-বিরোধী আঙ্গিক  ব্যবহার করেছি যাতে পাঠকদের অপ্রচলিত মূল্যবোধে তীব্র নাড়া দেয়া যায়। আভাঁগার্দ লেখালিখি সাহিত্যের রেফারেন্সের পুরানো ফ্রেমগুলোকে পচিয়ে দিয়েছে এবং 'ভাল স্বাদ' এবং 'ভাল শিল্পের' মধ্যে অন্তর্নিহিত সঙ্গতি ভেঙে দিয়েছে। আভাঁগার্দের নান্দনিকতা  সাংস্কৃতিক অচেনাভাব দ্বারা চিহ্নিত করেছি, যেমন আমার পোস্টমডার্ন কবিতাগুলো। উল্লেখ্য ‘অবন্তিকার শতনাম’ কবিতাটা । কবিতাটা ইরটিসিজমের টুকরো, কৌতূহলী সংগ্রহ এবং অপ্রত্যাশিত সংমিশ্রণকে মূল্য দিয়েছে — কামোত্তেজক, বহিরাগত, অসংলগ্ন এবং অচেতন। উপস্থাপনা হিসাবে শিল্পের ধারণাকে বিকৃত করেছি ‘পোস্টমডার্ন আহ্লাদের কবিতা’গুলোতে।  দেশভাগ এবং তজ্জনিত বর্বরতার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা আমার বহু কবিতার আভাঁগার্দ প্রসঙ্গ প্রদান করে। কবিতামঞ্চের বক্তৃতা এবং সৃজনশীল শিল্পীর ভাষার মধ্যে একটি ফাটল তৈরি হয়েছিল যাকে অনেকেই এড়িয়ে গেছেন । একটি নতুন ভাষাকাঠামো  খোঁজার চেষ্টায় বাস্তবতার  নতুন এবং আরও খাঁটি দৃষ্টিভঙ্গি দৈনিক কথাবার্তা থেকে তুলে এনেছি । শিশুসুলভ বা স্ক্যাটোলজিকাল ভাষা, ভাষার-খেলা, স্বয়ংক্রিয় লেখা, ননসেন্স এবং একটি-সিনট্যাক্টিক্যাল কবিতা, এবং 'সংবাদপত্রের নোংরা শব্দাবলী’ এনেছি কবিতাগুলোতে ।
    ঈশ্বর, মানুষ, যুক্তি, সত্য, সৌন্দর্য, সম্মান, কর্তৃত্ব ইত্যাদি এখন হয়ে গেছে অর্থহীন ।  যুক্তি, প্রচলিত ভাষা এবং গৃহীত সামাজিক মূল্যবোধ সবই প্রত্যাখ্যান করার প্রয়াস করেছি কবিতাগুলোতে ।সমাজের মধ্যে প্রভাবশালী বিদ্যায়তনিক রক্ষণশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরোধিতায় নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছি আর  নিজেকে স্বীকৃত সামাজিক আদর্শ এবং মূল্যবোধের বিরোধী নান্দনিক সন্ত্রাসী হিসাবে উপস্হিত করেছি । পড়লে টের পাবেন  নানা আঁস্তাকুড়, নরক, স্বর্গ, মেটারনিটি ওয়ার্ড, শ্মশানের কান্না, অন্যের কবিতা, অন্যের ভাবনা থেকে যা পেয়েছি কুড়িয়ে-বাড়িয়ে এনেছি অন্ধকার জুড়ে-জুড়ে তৈরি আলোকমালা ।এনতার প্রয়োগ করেছি ইনটারটেক্সচুয়ালিটি, এমনকি পুরোহিত দর্পণ আর শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে ।
    এক
    দেখুন, আপনি রাজনীতিক, আমি আপনাকে 
    মাদার ফাকার, সান অব এ বিচ বলব ভেবেও
     বলতে পারি না, ব্লাডি আসহোল বলতে পারি, 
    বাংলা ভাষা বড্ডো নোংরা, এমন দিন ছিল যখন 
    বীর্যপাত নিয়ন্ত্রণ নামে পরিচিত, এটি হল প্রশিক্ষণ
     ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে সহবাসের সময় একজন 
    পুরুষের বীর্যপাত রোধ করার প্রাচীন অভ্যাস
    না করার ফলাফল আপনারা চোরচোট্টারা 
     উত্তেজনা-আবিষ্ট সংস্কৃতিতে, এই ধরনের ধারণা 
    বিপরীতমুখী এমনকি বিকৃত মনে হতে পারে, ক্ষতি 
     আমাদের প্রজাতি নিশ্চিত করার জন্য পুরুষরা 
    পুরষ্কার নিয়েছে নিউরোট্রান্সমিটারে স্নানের  প্রকাশ  
    এটার কারণ, কেউ কেউ বলেন, পুরুষরা কেন নেতা  
    অস্তিত্বের জোয়ারের বিরুদ্ধে যায়। সাধারণ মানুষ 
    পরিত্যাগ করতে চাইবে যা মৌলিক বেঁচে থাকার 
    সাথে এই ধরনের বিস্ফোরক আনন্দের সমতুল্য
     
    দুই
    বিষয়গত তথ্য আর বিষয়ীগত সত্য এক নয়
    টান দেওয়া এবং ধাক্কা দেওয়া নেতার যৌনাঙ্গ ও
    জিহ্বার ক্ষেত্রে ছাড়া যা পাকিস্তানের মতো জায়গায় 
    তাদের উত্তরাধিকার  চালিয়ে যাওয়া বেছে নেয়
    এটা কি রকেট সায়েন্স ? মোবাইলটা উচ্চকন্ঠে 
    কাঁদা আরম্ভ করল উড়ন্ত বালির সদালাপী হাওয়ায়, 
    ঝিরি-ঝিরি রঙ্গপ্রিয় বালির অবাক হাসিখুশি দিয়ে 
    হয়তো ক্রমে ঢাকা পড়ে যাবে আজ রাতের 
    অমনোযোগী অন্ধকারে একজন নামজাদা কুকুর 
    যে মালকিনির হাতে পড়েছে, সে যেরকম চেয়েছে, 
    যেরকম গড়েছে, তা-ই হয়েছে : প্রেমের কুকুর, 
     কাটমানি, কালোবাজার, কালোটাকা, ঘুষ, নজরানা, 
    এই নিন দেশপ্রেমের ডেফিনিশন :উৎকোচ, হাওয়ালা
     
    তিন
    ভারতবর্ষের পরিচয় ( ১ ) :সাপ সরীসৃপ শ্রেণীভুক্ত 
    শীতল রক্তের মাংসাশী প্রাণী ,তার খাদ্য হল গরু পাচার, 
     মেয়ে পাচার, গণধর্ষণ, ডাকাতি, খুন, তহবিল তছরূপ, 
    ভর্তি কেলেঙ্কারি, নারদা, সারদা,  কর্পোরেট কেলেঙ্কারি, 
    জালিয়াতি, নোটনকল, রোজভ্যালি, কয়লা পাচার, 
    দলিল কারচুপি, জিপ কেলেঙ্কারি, এলআইসি কেলেঙ্কারি,
     বেনামি সম্পত্তি, টেলিকম কেলেঙ্কারি, এইচডিডব্লিউ 
    সাবমেরিন কেলেঙ্কারি, জেএমএম ঘুষ কেলেঙ্কারি, 
    তানসি ল্যান্ড ডিল কেলেঙ্কারি, বিটুমেন কেলেঙ্কারি, 
    ইউরিয়া কেলেঙ্কারি, লটারি কেলেঙ্কারি, অনন্তনাগ পরিবহন 
    সাবসিডি কেলেঙ্কারি, তেলগি স্ট্যাম্প পেপার কেলেঙ্কারি, 
    তোলাবাজি, সিন্ডিকেট, নির্বাচনে টিকিট বিক্রি, জোচ্চুরি,
     কাজের বরাত, নদীতটের বালি বিক্রি,  পনজিস্কিম কেলেঙ্কারি, 
    চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারি, ফাটকা জোচ্চুরি,  কালোটাকা সাদা করা
     
     
    চার
    ভারতবর্ষের পরিচয় ( ২ ) সাপ সরীসৃপ শ্রেণীভুক্ত শীতল 
    রক্তের মাংসাশী প্রাণী ,তার খাদ্য হল  সাংবাদিক হত্যা,  
    সত্যম কেলেঙ্কারি, কমনওয়েল্থ গেমস কেলেঙ্কারি, মাদক পাচার, 
    জাল ওষুধ, ব্যাপম কেলেঙ্কারি, আদর্শ হাউসিঙ কেলেঙ্কারি, 
    কার্টেল, সুইসব্যাঙ্কে  টাকা, নীরব মোদি জালিয়াতি,
     ক্রিকেটে গড়াপেটা, ললিত মোদির ক্রিকেট কেলেঙ্কারি, 
    বিজয় মাল্য আর্থিক কেলেঙ্কারি, বিষমদ কাণ্ড, আসল 
    বোতলে নকল ব্ল্যাক লেবেল-শিভাস রিগাল, বেআইনি 
    লেনদেন, এবিজি শিপইয়ার্ড ব্যাঙ্ক জালিয়াতি, রাজীব 
    গান্ধী ফাউন্ডেশন-রাজীব গান্ধী চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-ইন্দিরা 
    গান্ধী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট কেলেঙ্কারি, ন্যাশানাল হেরাল্ড 
    কেলেঙ্কারি , আলি বুদেশ, আনিশ ইব্রাহিম, দাউদ ইব্রাহিম, 
    হাসান আলি খান, আবদুল কাজের কুকুর, সেবার কুকুর, 
    গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার 
    কুকুর , পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপির কুকুর, 
     
    পাঁচ
    অন্ধের কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার 
    কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, আদরের কুকুর, 
    এই কুকুর, ওই কুকুর ইত্যাদি  কিন্তু নেতাদের লেজ 
    জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল, আজও তেমনই 
    আছে  থাকবে  এখন দাঁত খেঁচাতে গিয়েও জানে, লেজটা 
    অমনই রয়েছে  বর্ষায় দিয়ারার সঙ্গেই হয়তো চলে যাবে 
    জলের তলায় শেষ কান্নার বর্ষীয়ান স্মৃতি নিয়ে, অপগণ্ড 
    নেশাভ্রমে চিকচিকে বসন্তে মাথাচাড়া দেয়া নতুন বিষের 
    পলিমাটির ওপর বোবা জেগে উঠবে কোথাও, খুরপি দিয়ে 
    কেয়ারি-করা পলতালতা বা তরমুজলতার হলুদ ফুলের 
    আড়ালে  জানালা তার চোখের পর্দার ফাঁকে উঁকি কেন যে 
    ঝুঁকির রোদে আলফা পুরুষ শীতের কুক্ষণে  ক্লীব চাঞ্চল্য এনে
    তোমার চোখের পর্দা সামলাও এই বলে– পর্দা তুলে ধরে 
     
    ছয়
    মাস্টারবেট করা চোখ আর তার থেকে পয়দা হওয়া ঘুমে 
    সামাল দিয়েছো–কীসের  অনমনীয় পর্দা না ভাঙা বিশোর্ধ 
    হাঁঙরের নোনা বীর্যপাত– হাঁ করা মুখের রক্তাক্ত জিভ 
    ঢুকে যায় এভাবে নাচনাচন্তি লাল পেখমের ময়ুর-শুক্রাণু 
    খুঁটে  খায়  ময়ুরীরা সেখানের নীল জঙ্গলে মানুষও 
    পেখম বিকশিত করে এখনো মাটি ফুঁড়ে ওঠে ফুলঝুরি  
     হাজতের অন্ধকারে, রাতের মশাগুঞ্জনের বহুভাষি 
    ঝাঁকের খেয়ালি ঘুর্ণির ভেতর দিয়ে মেঝেয় ছিটকে পড়ল,  
    হাঁটুতে ধাক্কা খেয়ে, একজন মানুষ, যে, গন্ধ থেকে যেটুকু 
    আঁচ করা গেল, কানপুরি-ঠররার নেশায় বস্তাপ্রতিম 
     হাড়গিলে   ঘরের মধ্যে আগে থাকতে কতজন যে 
    এই তটস্থ ভাব লুকাইলে সমস্যা ছিল না, তাদের 
    কৌতুহল জানা যায় ! হোয়াট দ্য ফাক !  লাবণ্য ঝরলেই 
    ফুটে উঠছে দুধকালী ! এই কাজটা হয়তো অলস দিবস
     
    সাত
    বিকেলে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আকাশে তাকিয়ে আনমনে 
    পড়ে যাওয়া চারজনের রক্ত গড়িয়ে মিশেছে মাছিদের 
    আহ্লাদী জমায়েতে, মাছিরা তাদের এঁদো-পলটন ভাইবেরাদর 
    সবাইকে ডেকে এনেছে, র‌্যালিতে-মিছিলে, যারা ভোরের 
    দিয়ারায় ডোমপাড়ার শুয়োরদের আড্ডায় টাটকা-তাজা গু 
    খেতে বেরিয়েছিল, তারাও তাজা রক্তের সু-বদবুর সংবাদ 
    পেয়ে, হাঁফ-ফুরোনো বাংলা বৈদ্যুতিন মাধ্যমের দামড়া-চোয়াল 
    ভাতচিকন সাংবাদিকের  অনুকরণে, কুয়াশাভেজা ঘষাকাচ-
    ডানা নাচাতে-নাচাতে পৌঁছে গেছে হয়তো বাসার ছাদে 
    দাঁড়িয়ে তারাছাওয়া আকাশে তাকিয়ে আনমনে পড়ে যাওয়া। 
    একারণেই অনেক জায়গায় শব্দ অস্পষ্ট। কিন্তু ভালবাসার 
    পারদে এই কাজটা অনেক অনেক উঁচুতে।  মেয়ে মাকড়শার 
    সামনে পুরুষ মাকড়শার সুইসাইডাল প্রেম, মক্ষীরাণীর সামনে 
     
    আট
    খুদে মৌমাছি শ্রমিকের প্রেম , রেপিস্ট হাঁসের প্রতি হংসিনীর 
    প্রেম, ডলফিনের হরণ বা অপহরণ মূলক প্রেম , সতী নারীর 
    পতিপ্রেম , বড়োলোকের বেশ্যাপ্রেম এবং সমান্তরাল ভাবে 
    সন্তানের মায়ের প্রতি প্রেম এমন অনেক রকমের  এটা কিছু 
    হইলো ভাই নাহয় পড়েই ফেলসিলাম, এইভাবে আমার ইজ্জতের 
    ফালুদা করে দিবেন  আচ্ছা কও কখন কল দিবা। কাজি লইয়া 
    বইসা থাকুম  আমি যদি একজন নারীকে যৌন-সত্যিকারের 
    অধিকারী করতে পারি- তাহলে আমাকে তার ধারণা, তার 
    মতামত, তার পোশাক, তার বন্ধু, এমনকি তার অন্য
     প্রেমিকদেরও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আমার সঙ্গে শত্রুতা করলেই, 
    কেবল মানুষ নয়, গাছপালা আর প্রাণীরাও মারা যায় 
    অথচ আমি কারোর সঙ্গে কখনও শত্রুতা করিনি 
    পুরুষমানুষের নাইটফল হয় শুক্রকীটগুলো মরে গেলে  
    জেটআউট করার জন্য, স্টকে নতুন শুক্রকীট আনার  
    মানুষের যখন হয় তখন প্রাইমেটদেরও হওয়া উচিত  
     
     
    নয়
    আমি চাইনি গাছটা মরে যাক শত্রু বলা বোধহয় উচিত 
    হল না, ইনটিমেট এনিমিজ বললে ভালো হয়  সব হাসাহাসি 
    করবে এখন একজন অধম আনমনে কি না কি লিখে  ছাড়লো
    অন্তর্ঘাতমূলক কাজ যেমন রেলপথ, ঝুলন্ত রজ্জু পথ, রাস্তা, খাল, 
    সেতু-কালভার্ট, বাঁধ-সেতু, বন্দর, ডকইয়ার্ড, বাতিঘর, 
    বিমান ঘাঁটি, টেলিফোন লাইন বা খুঁটি বা টেলিভিশন বা বেতার  
    কার্যক্ষমতা ব্যাহত করা বা কবিতা লেখা নাটকে অভিনয় করা 
    স্লোগান দেয়া আর একজন কবি সেটাকে কণ্ঠে তুলে ছত্রিশ ব্যঞ্জনে 
    বাজালো গরু নিয়া ভিড্যু দিসে, রিমা খান বিন্দাস গালিগালাজ 
    কর রিমা আবিষ্কার করে ফেলেছে যে ববিটাইজ করার ভয় 
    দেখালে আবালবৃদ্ধ-ক্রিমিনাল খুব আকুল হয়ে পড়ে  তাতে 
    অরগ্যাজম হয় রিমা খানের  এখন যে যুগ এ জিন্স এর সঙ্গে 
    এক-হাত লাঠি-চুড়ি পরে মডার্ন ফেমিনিন ঘুরে বেড়ায় , 
    স্ট্রিপটিজ দেখে আবার সন্তোষীমা-ও করে , সেখানে এই ডিলডো 
    প্রেমী পুলিস অফিসারটি নোংরাও বটে পরীকে জিগাইসিলাম 
     
    দশ
    কোন গরুডার দাম কতো আমার কী দোষ, দুইডা গরুমতোই 
    দেখলাম  রুবিনা সিরাজ সাইয়্যেদ, নাগপাড়ার ৩৯ বছর বয়সী
    গৃহবধূ,  ছোট শাকিল গ্যাংয়ের জন্য  সমর্থন ব্যবস্থা চালান 
    ওরফে "পাঠান" তার মেহেদি ব্যবসাকে মস্তি বেগমের লগে 
    বেআইনি কর্মকাণ্ড পরিচালনার ফ্রন্ট হিসাবে ব্যবহার করার 
    অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল এই যে বুড়া ও চিরযুবক প্রেমিক 
    আমার, আগে কথা বল  কন্ঠে মিলাও কন্ঠ  অবশেষে, পুলিশরা 
    তাকে ধরে ফেলে এবং সে  বাইকুলা কারাগারে ডিগবাজি খায়
    মৌলবাদী বিশ্বাসে যে আমরা কিছুই বিশ্বাস করি না ; এমন
     বিষ্মিত হবার দুর্ঘটনা বারবার আসে না যৌনকর্মীর জীবনে
    এ ভালোবাসাকে বুকে তুলে রাখলাম ঠিক সঙ্গম নয়, দেখছিলুম 
    যে পুরুষ পায়রা প্রতিবার সঙ্গম করছে আর ডালের এধার থেকে 
    ওধার পর্যন্ত নেচে আসছে, গর্বের সঙ্গে ঘাড় নাড়াচ্ছে  
    মাদি পায়রাটাও একটু খেলিয়ে নিচ্ছে  মৃতবৎসা বুকে তুলে
     
    এগারো 
    প্রেমিক সন্তানের শ্বাস টেকেনি সেই মাতৃগন্ধা প্রেমিকার বুকেই 
    তোমার শান, বেঘরের কসম মানুষ অমন করে না,  কারণ 
    পুরুষ মানুষের অমন পায়রাক্ষমতা নেই, একবারেই কেলিয়ে 
    পড়ে, তারপর আবার দম নিয়ে পায়রাবাজি করতে হয় 
    মানুষকে কেন এমন দুর্বল করে দেয়া হয়েছে, তা এখনকার 
    গণধর্ষণ, সোলোধর্ষণ, গ্রুপধর্ষণ, মেঠোধর্ষণ, মাচাধর্ষণ  
    খবর  থেকে আঁচ করতে পারি  মানুষকে সিংহের ক্ষমতা দিলে 
    তারা ওই কাজকেই শিল্প বলে চালাতো  শিল্প নামের ভাঁওতাটাকে 
    মানুষ বড়ো ভালোবাসে  আপনার খিচুড়ি, বিরিয়ানি খাইতে 
    যাবার সেল্ফি, ডেট মারাইতে গিয়া কি কি খাইলেন, ঘুরতে 
    গিয়া কি কি বাল ছিড়লেন  ধন্যবাদ প্রিয়  লাভিউ কিছু জিনিস 
    মেরামতের বাইরে যেমন আমি ছিলাম এক কোনে, যেখানে 
    ঝাঁঝালো চটচটে-হলদে পেচ্ছাপ জমে আছে,   যেহেতু লক-আপে 
    পেচ্ছাপ করার কোনো ব্যবস্হা নেই,  পা টেপা হচ্ছিল, তার নির্দেশে
     
    বারো
     টেনে  বাঁধের কাজে লাগানো হল, যাতে আগুনের ঝড় 
     ভেতর এসে অন্যান্যদের পোড়ায়  ডুমুর গাছে থোকা-থোকা 
    ঘুঙুর হয়ে রয়েছে, পায়ের কাছে বনপথে  ঘৃতকুমারী
     যা এখন কতো দাম দিয়ে কেনে পাবলিক বহেড়া গাছ 
    অশোকফুল  ভরাঙ্গিপাতা  ডেভিলস কটন বা উলটকম্বল 
     ইগল উড বা অগরু  আরে, এলিফ্যাণ্ট ক্রিপার বা সমুদ্রাশোক
    সুগন্ধমূল বা গ্রেটার গলাঙ্গল, উইনটার চেরি  সিলেবাসে অশ্বগন্ধা 
    তিলক্ষেতের আড়ালে জোছনা না ডুবে, কেমন দিশেহারা 
     হয়ে যেতে পারে জানলেও না মানার ক্ষমতা তোমাদের আছে
    কারাগারে না থাকলে নিজের দেশকে  সত্যিকারভাবে জানতে 
    পারে না  যেমন, হাতের রেখায় কেউ ছিলো না, যাকে জমা রেখে 
    মেঘে মেঘে আঁকবো মুখের ভাঁজ হাঁপানির ডাক্তারকে বলেছিলুম 
    আমার মাদকপ্রিয় যৌবনের ভ্রঢ়্টামি বললেন,  ধোঁয়ার কারণে 
    আমার ফুসফুস আর হার্ট অতলান্তিক বরফে পেঙ্গুইন এনেছে 
     
    তেরো
    একটা যোনি ডাকে এসেছে খুব ভাল কাজে লাগে ; গ্রহ, প্রজাতি, 
    জাতি, রাষ্ট্র, ধর্ম, দল, ইউনিয়ন, ক্লাব, সমিতি, প্রতিবেশী, কমিটি;
     কোনোটিতেই কারোর  আগ্রহ নেই আমার হাঁপানির কারণ, 
    ওনার মতে, সুগন্ধ  আমার শরীর সুগন্ধ সহ্য করতে পারে না । 
    উনি ফুল শুঁকতে, যে নারীরা পরাগ ছড়ায় তাদের জড়িয়ে ধরতে 
    সুগন্ধি সাবান আর পাউডার মাখতে, দেহে আর পোশাকে পারফিউম 
    লাগাতে, রুম ডেওডোরেন্ট ব্যবহার করতে,  বারণ করেছেন  
    এমনকি রান্নার সময়ে ফোড়নের গন্ধ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন 
    দিনমান শুয়ে থাকি কুয়াশায়, এমন তৃষ্ণার-বিতৃষ্ণার গল্প জমে
    বাদামী অক্ষিগোলক দ্যাখে কেবল তিন রঙা    জামাইবাবা চোখে 
    কালো রেব্যান চশমা, লাল বা নীল টিশার্ট  ডেনিম-জিন্স খুলে 
    টাটা সুমোতে উলঙ্গ তবিয়ত খুশ করার গুণ্ডা ভাগলপুর 
    শহর ঘোরেন, তমঞ্চাধারী দেহরক্ষীদের পাহারার দৃশ্য বুক
     বিদীর্ণ করে দিলেই মুখের উড়ে যাওয়া রঙ কি দ্রষ্টব্য হয় না ? 
    বিশ্বাস করেন যে সমস্ত রাজনেতা নীতিবিহীন চোরচোট্টা 
    কিন্তু তারা বিকল্পকে  শুঁটিয়ে লাল করে দেবে বলেছিল।
     
    চোদ্দো
    পায়ের মধ্যে তখন উদগত হচ্ছে সহস্র পদক্ষেপ অবুঝমাড়ে 
    প্রত্যক্ষদর্শীর চোখ বন্ধকরা খতিয়ানে  শহুরে মানুষের 
    রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল এই প্রথম অবুঝমাড় নিয়ে 
    অথেন্টিক লেখা  তার প্রকৃতি, বনসম্পদ ও মানুষ নিয়ে
    আশি পেরোনো মলয় কবে এমন নিবিড় করে দেখলেন? 
    আমি মাথা নোয়ালাম। যারা পড়েন নি পড়ে ফেলুন
    গ্যারান্টি ! সিনর, আজকাল শ্বাস ঘন হলেই মিস হচ্ছে বিট 
    এর নাম শ্বাসকষ্ট  আর চোখে আজন্মের ব্ল্যাংক ভার্সন 
    সরে গিয়ে স্থাপিত হয়েছে এক ছায়াসিঁড়ি  মৃত্যু; হাত নেড়ে, 
    চোখ নেড়ে কথা বলো আরো, গেয়ে ওঠো মেঘের ডাকের 
    মতো গাঢ় আহবান। যা ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামে পরিচিত, এখনও 
    প্রতিটি মুম্বাইবাসীকে কাঁপিয়ে দেয় টাইগার মেমন অপরাধ 
    সিন্ডিকেটের সহ-ষড়যন্ত্রকারীর বোরখা-বেগম রেশমা মেমন 
    শাবানা মেমন বিস্ফোরণের সময়ে আমাকে জাপ্টে রেখেছিল 
     
    পনেরো
    অভিযোগ শালবনের ভেতর দিয়ে দৌড়ে চলে যাক ভয়ার্দ্র 
    নির্নিমেষ, দেখি কীভাবে একজন দেশকে বৈঠকখানায় বসে
    ঘৃণা করে, বা দেশকে ভালোবাসে স্বচ্ছ পানির নিচে মুখোমুখি
     ছিলাম যে হাঙরের গা ঘেঁষে, তার হাতভরা ফুল ঝরে ঝরে 
    গ্রেনেড হয়ে গেল ৭৬০০০ কোটি লোন মকুব গৌতম আদনির।
    আমি খুব খারাপভাবে সোফায় তার পাশে শুয়ে, তার চারপাশে 
    অস্ত্র জড়ো করা তবু যৌনসঙ্গম নয়  যারা সিনেমার অন্ধকারে
    এমনকি সেক্সও করেন না শুধু শব্দগুচ্ছ সবচেয়ে নির্দোষ অর্থে 
    একসঙ্গে ঘুম কিন্তু আমার সাহসের অভাব ছিল যেটা পাবলিক 
    এর টাক্স এর টাকা একজন মানুষ প্রায় যেকোন কিছুতেই বেঁচে 
    থাকতে পারে, যতক্ষণ না সে শেষটা দেখতে পায়  বিষণ্ণতা 
    এতটাই ছলনাময়, এবং তা প্রতিদিনই বাড়তে থাকে, এর শেষ  
    অসম্ভব, আমাদের বাঙালির গা ভরা রক্ত। সেই লাল রঙে যখন 
    ধানক্ষেত সাজাই, সেখানে কেবল হ্যাঁ, প্রেম বিনামূল্যে মূল্যহীন
     
    ষোলো
    ওরা অন্য কোনও বায়ুমণ্ডলে বসবাস করতে পারে না
    স্বাধীনতায় নিজেকে অসংরক্ষিতভাবে, নোংরা শরিকানায় 
    সম্পূর্ণরূপে দেয় একটি দেশকে কীভাবে মহান বলা যায় 
    যদি তার মাছের স্বাদ পচা আলুর মতন হয় হে নীলরঙা 
    শয্যা দৃশ্য।স্বমেহন ছাড়া পুংবাঁদেরেরা পরস্পরকে ধর্ষণ করে, 
    যাতে পরবর্তীকালে আলফা হয়ে উঠলে যন্তরটা অকেজো 
    না হয়ে পড়ে ।  দ্যাখো, তোমরা যখন ভাবছো কেবল বিছানার 
    গল্প যৌনতার গল্পে মুখরিত স্টল, তখন সেই একাকী  তরুণী 
    এসব জেনেও মৃদু হেসে ফেলে নিজ মনে বাজারে সস্তা দরের চাল 
    আর শব্জি খুঁজে বেড়ায় জীবন এক প্যারাডক্স, অজস্র অশ্লীল 
    লোকগাথা  জীবন মানেই  যা যাপন করছো তাকে উহ্য রাখো
     যা কিছু প্রচার হবে ততটুকু বয়ে বেড়িয়েও নির্মল হেসে যাবার 
    পারঙ্গমতা জীবন মানে এক রাহুকেতু ক্যানভাস, যাতে রঙ চাই 
     
    সতেরো
     কেবল কিছু প্রাণীর জীবন  তোমার বন্ধ ঘরের অন্ধ কোনে 
    গুমরে কান্নার এক গুপ্ত ছবি  জীবন, প্রকাশ্যে তোমার অট্টহাসির 
    ডাকনাম  মাটিতে মুখ থুবড়ে ল্যাংটো দাদু , চোখের কোটরের 
     সিনথেটিক মণি বেরিয়ে ছিটকে নর্দমায়, বুড়ি  ডাকসাইটে 
    দিদিমা ওপরমুখো  দেখুন না  শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে গেল কেন 
    ডিসলয়ালটির কারণে  খাদ্য এবং বিষের মধ্যে যে কোনও 
    সমঝোতায় কেবল মৃত্যুই জয়ী হতে পারে ভাল এবং মন্দের 
    মধ্যে যে কোনও সমঝোতায়  কেবল মন্দেরই জয় হয়
    চটকলগুলো লাটে তুলে ভাগলবা বিড়াল-শ্রমিকনেতারা 
    নতুন  সিংহাসনে বসতেই লুমপেনরা লাল থেকে সবুজে 
     কেন ? শুধু লুমপেনরা নয়, কবি-লেখক-নাটুকার-চাটুকার
    অভিনেতারাও  স্লোগানের গরগরানিতে কোনো বদল নেই 
    ব্যথার শিষ্য মাইগ্রেন--  মাথায় নাবালক গুপ্তচর উঁকি মারে 
     
    আঠারো
    ঢুন্-মুন্ করে বেড়ায় কুলকাঠের  আলাপালি গতরখাকি
    দেইজিপানা হাতে কুঠ চোখের ডিমি দুটো আন্দাজি ডান দিকে
    সম্বচ্ছর ডোরাকাটা এলোকেশী চুল কুলাইতে কুলাইতে বিষয়
    বালিশে আলিস রেখো ঝাঁলর-ঝাঁপা কালো দুটি চোখের নৌকো 
    গেরাপি কোমর-কাঁকাল ধরা আগড়ে হুড়কো ল-ল চেড়েক-ডেডেং
    জোতে ভাইয়ে দিয়েছি গেঁজুরি খাজা বাতাসা গোদনেগোকুলে
    স্নায়ুজাল চমকিয়া তাওয়াদায় অতিপ্রজন হুঁকরো হুঁকরো
    উদো- হিড়িক ইহকাতি এক পয়সা কুঁকড়ো-ডাকা রাত হইটম্বা
    গুড়বাতাসা নকুলদানার কান্না থামে না কথা কওয়া লাগবে না  
    প্রেমালাপের সুবর্ণসুযোগ হারাইলা  আমার তো কিছু না। 
    তোমার লস জানবা , আমি প্রাচীনকালে আরোগ্যের 
    পিতামাতাকে খুন করে আবার জীবিত করতাম নিয়মিত  
    গরিবের রাখা মাছ-দুধে কোনো আপত্তি নেই বিড়ালদের,
     
    উনিশ
     পনজি ধোপাদের কাপড়কাচার রঙ্গে গাধার লিঙ্গ কুচকুচে 
    হোসপাইপ থেকে কাক ওড়ে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে 
    লুমপেনদের পিরামিড  হোলি শিট, এই গেঁড়েটা পলিটিশিয়ান ?
     জুতো আর জিন্স খুলে, প্যান্টিটা ফেলে দিয়ে, পেচ্ছাপ করে নিল  
    অবিরাম হাঁটার দরুণ প্যাণ্টির ঘষা লাগছিল কুঁচকিতে 
    ওহ, কতক্ষণ চেপে রেখেছিলুম, বলল হলুদ ফুলের চুমকি-
    বসানো ঘন-সবুজ ঝোপকে, যে ঝোপটা শীতভোরে বিধবা 
    ভবঘুরে পাখির গু থেকে বৃষ্টির ছাটে দু’হাত মেলে জন্মেছিল
     টপ খুলে বডিসও ফেলে দিল  সেই ক্লাস এইট থেকে অভ্যাস
     বাইরে থেকে এসে সবচে আগে এই দুটো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া 
    বাঁদিকের বুকটা তুলে দেখল, দ্বিতীয়বার উত্তেজিত হয়ে দাঁত 
    বসিয়ে দিয়েছিল অমিত, তাই ঘামের দরুন জ্বালায় গোলাপি
     শাঁষালো ঘৃতকুমারী পাতা ভেঙে কুঁচকিতে আর বুকে নরম
    জ্বালায় লাগিয়ে নিল  জরায়ুর দরিদ্র মই ধরে ওপরে উঠে যায় 
     
    কুড়ি
    ভ্রুণেরও প্রেম  বিরহ  দুঃখ যাতনা আগাম গ্লানি গোপনে 
    গ্রাহ্যতার সীমা অতিক্রম করে গেলে প্রশ্নটি দ্বিতীয় ঢোঁক 
    গেলায় উত্তর দাঁড়ালে অবলোকন করি যেহেতু মানবসমাজ
    দীর্ঘকাল সৌন্দর্য্যে কলুষিত মিথ্যা-আক্রান্ত  অস্থির  অতিরঞ্জিত 
     অন্যায্যতায় ঠাশা  নিজের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যা অনুভব 
    করা যায় না শুধু তাই বিশ্বাস করে চলে যাও  ভারতের  কোনও 
    জায়গার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ ইন্দ্রিয়কে শক্তিশালী করে তোলে।
    আত্মপ্রেমধ্যান যেন এক হ্যালুসিনেশন কেউ চাষা মজুর 
     কেউ মেছুনী  বেদেনী, কেউ বা সাধারণ ঘরণী আনবাড়ির 
    জীর্ণবা কারো কটিবাস  নিজের কপালে চুমু খাওয়া কি 
    হ্যালুসিনেশনের সাধনা তিনকাল চলে যায় গর্ভের বেডরুমে 
    ডাকাতরা জীবনের ছুরিচাকুর হ্যালুসিনেশনের  দোকানে 
    বীর্য্য সাধনার মায়াকে খোঁচাতে থাকেন সে সাধন হয়ে 
    ওঠে শৃঙ্গার লেখার মোগলাই হারেমে আফ্রিকার মেয়েরা 
    কী করে  লৌকিক অলৌকিক অস্তিত্ব প্রত্যাখানের বদলে ?
     
    একুশ
    পৃথিবীকে শৃঙ্গার করতে চাওয়া হলো, হয়তো সেই আকাশ 
    লাল সাধনা  হয়ে গিয়েছিল স্টেনলেস স্টিলের ছুঁচের ঝোপে 
    স্মৃতিহীন সন্মেহনে বুঝে ওঠে, এ হয়তো মাংসের বিনম্র শৃঙ্গার  
    তাণ্ডব নাচার পর জিরোচ্ছেন মহাকাল কবিতার অরূপ-রূপে 
    শুরুটুকু খুঁজে পান যা কথায় কথায় দুঃখ দিয়ে চলে যায় একদিন 
    তোমরা সবাই ম রে ই যাবে ! তবে ওই বোধ থেকে ডবলডিমের 
    অমলেট ছাড়া আর কিছু গ্রহণ না করলেই হলো তাকানোর আগে, 
    কোলে এসে ঘুমোও, দাঁত ফোটাও আর গুনগুন করো তুমি আমার 
    ঠিক কততম সন্তান? আপনি তো নেতা আপনাকে চুতিয়া বলব 
    না কি অন্যকিছু, ইট ইজ আপ টু ইউ, চয়েস ইজ ইয়োর্স, 
    নেতা বুঝতে পারে না যে পাবলিক গালমন্দ করতে কতটা মরিয়া, 
    একরকম ভালোবাসা অশোকস্তম্ভের শান্ত সৌম্য সিংহদের 
    নির্দ্বিধায় দাঁত খিঁচানো হিংস্র নরখাদকে রূপান্তর করার গুণ 
     
    বাইশ
    সেই আমি তোমাকে ঠিক যেভাবে সমর্থন করি কারণ তুমি 
    যেমন কুৎসিত তেমনই চমৎকার আমি চিরকাল  আমার 
    ক্ষতগুলোকে নিরাপদে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম উন্মাদনা হচ্ছে 
    এটা জানা যে আপনি যা করছেন তা সম্পূর্ণ বোকামি, কিন্তু 
    তবুও, কোনোভাবে, আপনি তাকে আমল দিতে পারবেন না 
    এ এক জীবাণুর অনুভূতি  কাঁচা চিন্তা তীব্র বিক্ষিপ্ত মুহূর্তগুলো 
    কাঁধে তুলে ঘুরে বেড়ানোর শেষে ওনারা মরে যেতেন, অবশেষে 
    মৃত্যও শীঘ্র বা পরে, লোকটাকে বলবে আত্মহত্যা করুন 
    এর মধ্যে, আমি আমার রুমে চলে  যেতে পারতাম, লুকিয়ে 
    ঘুমোতে পারতাম যেন আমি মারা গেছি   মাছ এত বেশি যে 
    লাফ মাইরা নৌকায় উইঠা আসে দুইদিন সন্ধায় বের হইলাম 
    সবই মৎস্যকুমারীর গান  ধরা দিল দুইটা মাছবউ হায় নসিব 
    এমন যে, নাওয়ের ডরায় তুইলা রাইখা ফের ভুইলা গেলাম 
    তাদের, এত ভার্জিনের ভিড়ে  আপনি  ভালবাসেন তা খুঁজুন 
     
    তেইশ
     আপনাকে হত্যা করতে অনুমতি দিন এই দেশে পুলিশ অন্ধ 
    সাজবার ফলে শিক্ষককে জুতার মালা পরাতে পারে
    শিক্ষককে মেরে মাথা ফাটিয়ে বুক ফুলিয়ে নাচবে ধিংকাচিকা 
    পথ করে দেয়া হয় কারণ তার ক্ষমতা  সে সেই কলেজের 
    মালিকের ভাগ্নে বলে কথা ! যে ছেলের বালও ঠিকমতন 
    গজায়নি, সেই বয়সেই সে সবার সামনে এইভাবে টিচারকে 
    মেরে নাচতে পারে , ভবিষ্যতে সে যে দেশের নেতা হবে 
    গারেন্টি  এটা আপনার সব ঘুমপাড়ানি নিষ্কাশন থেকে 
    আপনার পিঠে আঁকড়ে ধরতে দিন এবং আপনাকে 
    শেষ পর্যন্ত শূন্যতায় ভাসিয়ে দিন এটি আপনাকে হত্যা করুক 
    পিয়াস লাগিয়া, জলদ সেবিনু, মলয়দাস কহে,     
    পাছে কর অনুতাপে সবার একান্ত আলোচনার বিষয় ছিল,
     মেয়েটির অন্তর্বাসের মাপ কত ? পাইনের কোণ সহযোগে 
    অ্যাক্রেলিক রঙে বানিয়েছিলাম  আবোলতাবোল গয়না ?
     
    চব্বিশ
    এবং এটা আপনার অবশিষ্টাংশ গ্রাস করুক ! এটা মানে কী ? 
    গভীরতম ভয় আমার পর্যাপ্ত হয় না  অনন্তকালকে বলা 
    হয় সময়ের সম্প্রসারণ নয় বরং সময়ের অনুপস্থিতি আমার 
    গভীরতম ভয় হল আমি পরিমাপের বাইরে শক্তিশালী 
    এটা  আমার আলো, আমরা সকলেই জীবনের দুঃখ সুখ 
    আমাদের মনের মধ্যে প্রায়ই অপ্রতিরোধ্য শক্তিগুলোকে 
    উপসাগরে রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ সমুদ্রের পাঁচিল তৈরি করি
    কিছু সদস্য নাকি মহিলা মেম্বারদের নিতম্বের মাপ নেন
    আমরা যে-ভাবেই করি না কেন - প্রেম, কাজ, পরিবার, বিশ্বাস, 
    বন্ধুবান্ধব, অস্বীকার, অ্যালকোহল, মাদক বা ওষুধের মাধ্যমে, 
    আমরা এই দেয়ালগুলোর পাথরে পাথরে সারা জীবন ধরে তৈরি 
    করি আমাদের অন্ধকার নয় যা আমাদের সবচেয়ে বেশি ভয় 
    দেখায় আমি এখনকার বাঙালিদের অ্যাডমায়ার করি নাগ 
    রাজকন্যা উলুপি অর্জুনের প্রেমে পড়েন এবং তাকে অপহরণ 
    করেন  জোর করে নারীর যৌন ইচ্ছের মর্যাদার প্রসঙ্গ টেনে 
    অর্জুনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে ধর্ষণ করেছিলেন এই শুক্র-ডিম্বাণু 
    মিশেলে উলুপির ছেলের ব্রিটিশ নাম রাখা হলো ইরাভান
     
    পঁচিশ
    আমি মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য আমার চোখ বন্ধ করেছি 
    কিন্তু যখন আমি দৃষ্টি খুলি  তখন আমার বিছানা থেকে 
    কয়েক ফুট দূরে বসে থাকা মৎস্যকুমারীকে দেখে  চমকে বুঝি
    প্রেম একটি সাময়িক পাগলামি, তা  আগ্নেয়গিরির মতো ঝলসে 
    ওঠে  তারপরে নিভে কঠিন পাথর অল্প দূরে বনের পাশে স্তূপ করা 
    তুঁতকাঠি  উঠোনে মেলা সার সার চন্দ্রকীর ফুলে এখনো হলুদ 
    রেশমের আঁশ লেগে আছে হয়তো  তাই সে মুগ্ধ হয়ে দ্যাখে 
    ইস্কুলদালানের সামনে ফুলঝরা সেগুনগাছ পিঠুলিপাতার ফাঁকে 
    জড়ো হওয়া রোদ তাকে অবাক করে না চিরপরিচিত দৃশ্য  
    দাওয়ায় এসে সব অচিন হয়ে যায় কেন? আর মুহুর্মুহু তৃষ্ণায় 
    ছাতি ফাটে কেমন  যখন তা কমে যায়  আপনাকে একটা-দুটো
    সিদ্ধান্ত নিতে হবে  আপনার শিকড়গুলি  ছড়িয়ে পড়েছে
     কিনা তা খুঁজে বের করুন কেননা তা অকল্পনীয় কল্পনার 
     
    ছাব্বিশ
    একদিন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত কারণ তা ভালোবাসা
    দিক শ্বাসকষ্ট দিক, দিক উত্তেজনা দিক, হোক চিরন্তন 
    আবেগের প্রতিশ্রুতির বিস্ফোরণ , জাগুক দিনের প্রতি সেকেন্ড 
     সঙ্গম করার আকাঙ্ক্ষা , রোজ রাতে জেগে শুয়ে-বসে
    কল্পনা করা হোক যে  তার দুই স্তনে মোহক চুম্বন করছেন।
    তবে মিডিয়া'র লোক জানলেই কেমন যেন গা চিড়বিড় করে 
    কেমন যেন অসৎ অসৎ মনে হয় প্রিন্ট মিডিয়া বলে গালি 
    দিতে ইচ্ছে করে  অসৎ শাসকের পক্ষ নিয়ে একপেশে খবর 
    বিক্রি করে সমাজের অন্যতম ধনী রুটিওয়ালা তোমার শরীর
     অপেক্ষা করছে কেন সম্ভবত কয়েক ঘন্টার জন্য যদি  সঠিক হয়
    আমি একজন সাক্ষীর জন্য হৈচৈ করার কথা ভাবি কিন্তু শীঘ্রই 
    আমাকে মৎস্যবউয়ের মুখোমুখি হতে হবে কেন জানিস ? বিশ্বাস 
    শুধুমাত্র একটা বিমূর্ত  বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাপার নয়  কিন্তু অঙ্গীকার 
    আর ব্যস্ততার বিষ তুই যদি মনে করিস যে এটির সত্য 
    হওয়ার প্রায় শূন্য সম্ভাবনা রয়েছে তবে সম্ভাবনা তো রয়েছে ! 
     
    সাতাশ
    কিছুর সাথে জড়িত হওয়া অযৌক্তিক হবে উনি পুরুষের 
    ধর্ষণ কামনা করেন কিন্তু মহিলারা ওনার সমকামী  প্রেমিক
    নমঃ অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতো হপি বা 
    যঃ স্মরেত্ পুন্ডরীকাক্ষং সবাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ  নমঃ 
    সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যং বরেণ্যং বরদং শুভম্  নারায়ণং নমস্কৃত্য 
    সর্বকর্ম্মাণি কারয়েত্ যেন আমার চেয়ে তোমার কষ্ট বেশি 
    হওয়ার হিংসায় কবি হলাম, পেটুক কবি তোকে ঘুষ দিলাম 
    তোর জীবনের প্যাঁচানো নডুলস, যদিও এতে বিবাহোত্তর 
    সমবেদনার সয়াসস দরকার ছিল না তবু এক অপারগ 
    ত্যাঁড়াব্যাঁকা চামচ তোমার বেদনা আমি ধার নিয়েছিলুম 
    কোনো ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতা সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু  অনলে 
    পুড়িয়া গেল অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে  সকলি গরল ভেল  
    ওখানে বসায়েছি সমঝদারি  কিছু প্রতিষ্ঠার কুবুদ্ধি, দখলদারি 
     তোমার বোকামিতে জ্বলজ্বলে হাঙরের উছলিয়া ওঠে দাঁত 
     
    আঠাশ
     এতো কিছুর পর সেটা আমার মূলধন হয়েছে  এজন্য এমন
    বেদনায় সমসম ভাব নিতে পারে না দারুণ-দর্শিতা এখান থেকে 
    শেয়ার আমি বাজারে ছাড়তে পারি কিন্তু ছাড়বো না আরো 
    বড় উদ্দেশ্য আছে যেহেতু লভ্যাংশের চিন্তা আমার আছে তবে 
    সমসাময়িক কবিদের একই ধারার চিন্তার শেয়ারহোল্ডিং-এ এই 
    খাজানা বিকোতে আমার আপত্তি ঘোর তো যেখানে বেদনা থেকে 
    কোনো লাভ হয় নাই তোমার, তুমি তোমার বেদনার মালিকও
     হতে পারো নাই সে তোমাকে যেহেতু দেয় নাই সব শক্তিশালী 
    শব্দ-নারী হাসিল করার তাহলে এবার  আমাকে হিংসা করো 
    হে বিবাহিত মহিলা   সঙ্গমহীন  হিংসা করো অকালে কালোবরণ 
    হে নারী  হিংসা করো সর্বখোয়া গর্বখোয়াকে রানী পরমেশ্বরী       
    হিংসা করো পরকীয়া চাপে সন্তান খোয়ানো বাপ  যতো অপমানিত 
    হিজড়েনাঙ আমাকে  হিংসা-ঈর্ষা করে অমর করে তোলো
     
    উনত্রিশ
    আশ্রয় নেওয়া কুচকানো অঙ্গ পথে কুড়িয়ে পেলে বেদনায় নীল 
    এই করোনাকালে, এই অগোছালো সময়ে ইনোভেটিভ মৎস্যবউ 
    হতে পারো নাই ওল্ডমঙ্কে মেশানো গুঁড়ো দুধ এর সাথে ইঁদুরপোড়া 
     মধুরিমা। এষ সচন্দন!!! গন্ধপুষ্পে, মদ উইথ মধুরিমা  তাঁর 
    বন্ধুরা  আত্মার সঙ্গিনী, যৌনতা এবং রোম্যান্সের ব্যবহার 
    ছাড়াই সমস্ত ভালবাসা, এক অন্যরকম ঘনিষ্ঠতা যেন পাগল 
    বেশী মিসফিট বিদ্রেহী ঝামেলাকারী  বর্গাকার গর্তে গোল 
    খুঁটি  যারা সবকিছু ভিন্নভাবে দেখে  তারা নিয়ম পছন্দ 
    করে না  আর বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপারে তাদের কোন 
    শ্রদ্ধা নেই  আপনি আমাকে উদ্ধৃত করতে পারেন, আমার কথায় 
    অসম্মতি জানাতে পারেন আমাকে মহিমান্বিত করতে বা অপমান
     করতে পারেন যা আপনি করতে পারবেন না পুরোপুরি বদল 
    উপেক্ষা করুন নো প্রবলেম হিমালয়কে জাদুঘরে নিয়ে যান  
    পাগল হিসাবে দেখতে পারেন আপনার প্রতিভা চোখে পড়ে 
     
    ত্রিশ
    যে পাগল সে এক  স্বায়ত্তশাসিত নৈতিক সত্ত্বা যা
    শ্রেণীগত বাধ্যতা ভাল কিছু ঘন উপাদান যা  মজাদার
    সহজলভ্য এবং সম্ভবত  তারা দুনিয়াকে বদলে দেবে 
     তারাই মৎস্যবউদের একে অপরের প্রশংসা করে, 
    অধ্যয়ন  অপরকে হিংসা করে চরম ভক্তির পাত্রে 
     মিশ্রিত প্রেম  সবই খারাপ নয় জোব চার্নক এলেন, 
    আর বাতুলালয়ে স্লোগান আরম্ভ হল  প্রথম স্লোগান
    আগে বাতুলালয়ের মানুষ জানতো না স্লোগান বলে কিছু হয়
    আমি কখনই ভাষা, সাহিত্য, মন, হাসি এবং সমস্ত 
    উন্মাদ তীব্রতায় অদৃশ্য হয়ে যেতাম  ভাবতাম অদৃশ্য 
    পৃথিবীর  অদ্ভুত মানুষ  যখন বিষয়হীন চিন্তাভাবনা
      শান্তিতে থাকা বন্ধ করে  আপনি কথা বলেন যদি আমরা 
    একটি প্রশ্ন সঠিকভাবে বুঝতে পারি  সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া 
    যায় না আমরা জানি না কিভাবে সঠিক প্রশ্ন করতে হয়। 
     
    একত্রিশ
    প্রশ্ন জিজ্ঞাসার  বুদ্ধিমত্তা সংবেদনশীলতা উচ্চতর রোগ
    তখন আমরা অসম্পূর্ণ গতরখোর আমরা সর্বদা নিজেকে 
    সম্পূর্ণ করার জন্য কাউকে খুঁজি  যখন কয়েক বছর বা কয়েক 
    মাস সম্পর্কের পরে  দেখতে পাই যে এখনও মগজ অপূর্ণ 
     অংশীদারদের দোষ দিতে দিতে তাকেই জড়িয়ে গাছ হয়ে উঠি 
    প্রতিশ্রুতিশীল কাউকে নিয়ে যাই যদি চলতে পারে সিরিজ বহু
    বিবাহ-- যতক্ষণ না আমরা স্বীকার করি যে একটি এবং জরুরি
    আমি এখানে শুয়ে আরামে নিজের জন্য দুঃখিত হতে পারতাম, 
    ভাবছিলাম কেন এই সব আমার সাথে হয়েছে..আমি এটা করতে 
    যাচ্ছি না  আমি  নিখুঁত জীবন কামনা করতে যাচ্ছি না
    যে জিনিসগুলো  জীবনে ছিটকে চলে আসে সেগুলো পরীক্ষা 
     ত্যাগ করা এবং মাটিতে পোঁতা ময়লায় কয়েক শতক 
     ছিটকে পড়ার আগে আপনার চেয়েও লম্বা হয়ে দাঁড়ানোর 
     পছন্দ করতে বাধ্য করে দেখুন লম্বা করতে পারেন তো ভালো। 
     
    বত্রিশ
    করছি করছি তো ! এই জীবন  শেষ হওয়ার আগে আকাশ রঙ পালটে 
     কয়েকবার লাথি মারবে তবে আপনাকে গ্যারান্টি দিতে হবে
    চিরকাল মাটির তলায় থাকবেন মধ্যরাতের অন্ধকার হয়ে
    ইথারে নেশাগ্রস্ত হয়ে আমার আঙ্গুল দিয়ে ঝলমলে নক্ষত্রগুঁড়োর 
    মতো বয়ে চলেছে আমি সমুদ্রের নোনতা কান্নার স্বাদ ভালোবাসি
     কারণ তার স্বভাবগত জোয়ারগুলো আছড়ে মাথা ঠুকে ভেঙে পড়ে 
    আমি আমার ত্বকে সূর্যের মিষ্টি ঘ্রাণ আর আমার খালি পায়ের নীচে 
    ময়লার মাটির কস্তুরীর জন্য আকুল আমি সোনালী মাঠে উলঙ্গ 
    হয়ে শুয়ে থাকতে চাই যখন আমি অন্তহীন আকাশে উড়তে দেখি
    আমার স্বপ্নগুলো যেন মা প্রকৃতির ভালবাসা আধ্যাত্মিক 
    সূর্যের আলোর মতো আমাকে ধুয়ে দেয় সেই নদীর ওপরে যাওয়া 
     পৃথিবীর প্রথম দিনে ফিরে যাওয়ার মতো, যখন পৃথিবীতে 
    গাছপালার দাঙ্গা চলছিল বড় গাছগুলো খাচ্ছিল ছোটোদের
     একট দুর্দান্ত নীরবতা  দুর্ভেদ্য বন বাতাস গরমাগরম বাউল।
     
    তেত্রিশ
    ভারীপাছা মন্থর মৎস্যবউ রোদের তেজে তরল আনন্দ নিচ্ছিল 
    জলপথের দীর্ঘ প্রসারণ ছুটে চলেছে  নির্জন ছায়া ঘেরা দূরত্বের 
    অন্ধকারে মেয়েরাই বলে যতই মারুক ভালও তো বাসে -
     এই সব বোধ যে দেশে এত কিন্তু তারপর আমি ভেবেছিলাম
    পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে আমার মতো এমন কেউ থাকতে 
    হবে যে আমার মতোই উদ্ভট নিজেকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করে  তাকে 
    কল্পনায় মেরে ফেলবো যাতে সে অবশ্যই আমার কথা চিন্তা
     করে তো ভাল আমি আশা করি আপনি যদি সেখানে থাকেন 
    তবে আপনি  জানেন যে হ্যাঁ, এটা সত্য যে আমি উড্ডীন
    বায়স  আপনার মতোই অদ্ভুতজীবী ওরা ততোটাই আলোকিত 
    জঘন্য বুদ্ধিজীবী এবং পচা যে  তাদের আর সহ্য করার মন্তর 
    জানি না... আমি পোস্তা বাজারে মেঝেতে বসে টর্টিলা বিক্রি করব
    সেই 'শৈল্পিক' দুশ্চরিত্রাদের সাথে কিছু করার নেই কলকাতায়
     প্যারিসের  অনুসরণ করে ছবি আঁকিয়েরা নাচে কেন হে ? 
     
    চৌত্রিশ
    আমরা বড়ো বেশি অসুস্থ হয়ে গেছি আপনি কি জানেন কেন 
    ঘূর্ণাবর্তের সংখ্যার পরিবর্তে নাম থাকে? হত্যাকাণ্ড ব্যক্তিগত 
    রাখার জন্য এ থেকে কীভাবে বেরোনো যায় তা কেউই বলতে 
    পারছে না  মানব-শরীরের রাজনীতি, যে কোনও ঝড়ের  মতন 
     নিজেকে অসুস্থ বলে মনে করে, তখন ঝড় অ্যান্টিবডি তৈরি
     করতে শুরু করে, বা অস্বস্তির অবস্থা কাটিয়ে উঠতে নানা 
    কেরামতি ভাঁজে  প্রেম এমন কিছু ছিল যা নিয়ে আমাকে চিন্তা 
    করতে হবে না - প্রেমের পুরো রহস্য, হৃদয়বিদারক গান বাজনায় 
    পারিবারিক কিংবদন্তি  নারী যারা গেঁথে ফেলেছে পুরুষ যারা 
    পাগল হয়ে  ভুলে গেছে যে তারা সম্রাট হিসেবে কফিহাউস যেতো
    প্রয়োজনের সাথে নিজেকে লজ্জিত করেছে, তারা যাকে ভালবাসত 
    তার পরিবর্তন চায়। প্রেম ছিল এক রহস্য। প্রেম ছিল বিপর্যয়। 
    প্রেম একটি অভিশাপ যা আমাকে যৌবনে এড়িয়ে গিয়েছিল ।
     
    পঁয়ত্রিশ
    এতে কোন সন্দেহ নেই কেন আমি বহু-পছন্দের পরীক্ষায়  
    যুবতীদের চোখ মুখস্থ করতে এত ভাল  যৌনতা ছিল স্বদেশ 
    যেখানে আমি একটি অনিচ্ছুক যোদ্ধা হিসাবে জিতে গেছি - 
    যৌনতা  শরীরের উন্মাদনা তা আমাকে আতঙ্কিত আর 
    বিভ্রান্ত করে দিতো, সেক্স এমন কিছু ছিল যা আমি আত্মসাৎ 
    করে নিই মৃত্যু একটি অদ্ভুত মায়া যাকে আমি এমনভাবে 
     দেখতে শুরু করি যা আমাকে শ্বাস ছাড়াই বিশ্বকে
     ধরে রাখতে দেয়। আমার মৃত্যু যে ঘটনাগুলি ঘটিয়েছিল তা 
    নিছক একটি শরীরের হাড় যা ভবিষ্যতে কোন অপ্রত্যাশিত 
    সময়ে সম্পূর্ণ হয়ে যাবে  এই অলৌকিক দেহ দেখে আমি যা 
    পেয়েছি তার মূল্য নিলামে তুলতে হয়েছিল লোকেরা তাদের 
    পুরো জীবন এমন কাটায় যেন এর অস্তিত্ব নেই 
    তবুও  বেঁচে থাকার জন্য একটি দুর্দান্ত প্রেরণা হলো মরে যাওয়া 
     কেউ কেউ সময়ের সাথে সাথে কেটে পড়া সম্পর্কে সচেতন ।
     
    ছত্রিশ
    হয়ে ওঠে যারা আরও কঠোর, আরও কঠোরভাবে
    আরও ক্রোধের সাথে বাঁচে। কেউ কেউ এর বিরোধীতা 
    সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য এর স্থির উপস্থিতি চায় 
    যৌনতা একটি খেলা বা একটি অস্ত্র বা একটি নেশা ছিল 
    সেক্স বোকামি ছিল কিন্তু প্রেম-ভালোবাসা ছিল অন্য গ্রহ 
    সেক্স সুন্দর ছিল  যৌনতা মহৎ ছিল সেক্স ছিল মাংসল 
    সেই রাতের সেক্স ছিল তারার আলো সেক্স ছিল অক্সিজেন 
     একে অপরের জড়াজড়িতে সুন্দর, সুন্দর এবং নিখুঁত 
    ছিলাম নিশ্চয়ই সেই অজাত ভূতের মধ্যে আছে কিটসের 
    চেয়েও বড় কবি নিউটনের চেয়েও বড় বিজ্ঞানী তোমার 
    যখন ভালবাসার শক্তি  সেই শক্তি  সেই সাহস অসীম যে 
    ভালবাসা অসীম ভালবাসার জন্য এর উপস্থিতি সম্পর্কে 
    সীমাবদ্ধ কিছুই নেই তা মারা গেলে এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ 
     
    সাঁয়ত্রিশ
    নারায়ণায় নমঃ ,এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ শ্রীগুরবে নমঃ  ,
    এতে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা আজও ভালোবাসা 
    তা অঞ্জলীর ফলে ভিন্ন রূপ নেয় আপনি তাদের হাসি 
    দেখতে পারবেন না বা তাদের খাবার আনতে পারবেন না 
    বা তাদের চুল কাটতে পারবেন না বা তাদের নাচঘরে 
    ঘুরতে পারবেন না কিন্তু সেই ইন্দ্রিয়গুলো দুর্বল হয়ে পড়লে 
    জিনিসটা বেড়ে যায়  স্মৃতির স্মৃতি আপনার সঙ্গী হয়ে ওঠে
    আপনি  লালনপালন করে বলেন তুমি ধরে থাকো, স্ফীত হতে দাও
    বেশিরভাগ লোকের চোখে আমি কী—একজন অসামাজিক, 
    উদ্ভট, বা একজন অপ্রীতিকর ব্যক্তি—এমন কেউ যার সমাজে
     কোনো অবস্থান নেই আর হবেও না; সংক্ষেপে, নিম্নের সর্বনিম্ন। 
    ঠিক আছে, তাহলে - এমনকি যদি এটি একেবারে সত্য হয়, 
    তবে  আপনি আমার কোনো কাজের নন,  ব্যাংকে গচ্ছিত
     টাকা  আপনি নন।  যে গাড়িটি চালান তা আপনি নন
    আপনি আপনার কাঁধের ঝোলায় বইয়ের বিষয়বস্তু নন। 
     
    আটত্রিশ
    তোমরা সবাই গান করো, দুনিয়ার সমস্ত নাচগুলো করো
    গন্ধপুষ্পে নমঃ গণেশায় নমঃ  এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ 
    দুর্গায়ৈ নমঃ  আপনার আবেগকে পরিমাপ করা হয় 
    আপনার পদক্ষেপ নেওয়ার ইচ্ছা এবং প্রস্থান করার 
    ইচ্ছার মধ্যে পার্থক্য কী ? যখন আপনার প্রস্থান করার 
    ইচ্ছা জেদ ধরে রাখার ইচ্ছাকে ছাড়িয়ে যায়,  আপনি 
    ব্যর্থতার জন্য তৈরি একটি জীবনীশক্তি, একটি প্রচণ্ড শক্তি, 
    একটি বরফখণ্ড  ত্বরান্বিত করা হয়েছে যা আপনার মাধ্যমে 
    কর্মে রূপান্তরিত হয়  যেহেতু সর্বদা আপনার জান্তব অস্তিত্বে 
    একজনই আছেন, এই অভিব্যক্তি অনন্য মনে করুন যদি  
    এটিকে থামিয়ে দেন তবে  অন্য কোনও মাধ্যমের অস্তিত্ব 
    থাকবে না  হারিয়ে যাবে এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ শিবায় নমঃ 
    এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ লক্ষ্মীদেবৈ  অবশ্যই মনে রাখতে হবে 
     
    উনচল্লিশ
    আপনি কী বা আপনি কী হতে বেছে নিয়েছেন বা আপনি 
    যা করছেন তার তাৎপর্য জাহান্নামের সৌন্দর্য্য থেকে মূর্খেরা
     মুক্ত হতে চায়, দুনিয়ায় মানবজাতির যতো যুদ্ধ বা পরাজয় 
    বা বিজয় রয়েছে যা সামরিক ইতিহাসের ইতিহাসে গুলগল্পে
     লিপিবদ্ধ  মনে রাখবেন যে আপনি যখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার
     চেষ্টা করছেন তখন কি করবেন ব্যক্তিত্বের ধারণা আন্তঃব্যক্তিগত, 
    সম্পর্কের মধ্যে নিহিত ছিল তবু পরামর্শ দেন যে মধ্যযুগীয় স্বত্ব, 
    অন্যদের সাথে এর সংযোগ থেকে অবিচ্ছেদ্য ছিল  এই সময়ের মধ্যে
    "ব্যক্তিত্বের সারমর্ম ছিল অন্যদের দ্বারা অন্য ব্যক্তিদের  
    ভেঙ্গে পড়ার ক্ষমতা এমন  সময়ে যখন আমাদের নিজেদের
     শারীরিক শৌর্য্য স্পষ্ট - একটি মারাত্মক ভাইরাস দেখিয়েছে যে 
    আমাদের অভ্যন্তরীণ অস্তিত্ব অন্য সবার জন্য কতটা দুর্বল,  
    প্রশমনের প্রচেষ্টা আমাদের আগের চেয়ে অনেক বেশি একাকী 
    আর নষ্টমানব বোধ করেছে - অতীতের লোকেরা কীভাবে চিন্তা 
    করেছিল যে পুরো পৃথিবীকে ভাইরাস খেতে আসবে না হাঁ করে?
     
    চল্লিশ
    বিশেষ আগ্রহ হতে পারে নমঃ এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ সরস্বতৈ নমঃ ,
    এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ কৃষিকে অবশ্যই প্রকৃতি এবং মানব সম্প্রদায়ের 
    মধ্যে মধ্যস্থতা করতে হবে উভয় দিকেই বন্ধন ও বাধ্যবাধকতা
     স্পষ্টতই সঙ্গীতে প্ররোচিত করার চেয়ে মানুষের নৃত্যে 
    আরও অনেক কিছু রয়েছে এবং অন্যদের নড়াচড়ার সাথে সমন্বয় 
    আপাতদৃষ্টিতে স্নায়বিক বর্তনীর উপর আঁকতে পারে যা ভোকাল, 
    অনুকরণের পরিবর্তে সমীকরণে অন্তর্নিহিত থাকে যাইহোক, 
    পাখিদের মস্তিষ্কের একটি সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে পরামর্শ দেওয়া 
    হয়েছে যে কণ্ঠ শিক্ষা পূর্ব-বিদ্যমান স্বয়ংক্রিয় শোষণের
     মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে  যা বোঝায় যে ভোকাল এবং 
    ননভোকাল অনুকরণ একই প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল প্রাণীদের 
    অনুকরণ এবং নাচের ক্ষমতার মধ্যে একটি কার্যকারণ সম্পর্ক আছে 
    যা বাধ্যতামূলক সহায়তা বিলিয়ে দেয় তা কেন যে অনুকরণের 
    জন্য অনুকরণ  নাকি প্রাসঙ্গিক তা মিছিলের লোকেরা জানে না 
     
    একচল্লিশ
    শক্তিশালী করার চারটি পরিণয় সহজতর করে তা প্রতিষ্ঠিত 
    করা বাকি আছে  বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ, 
    মাশাআল্লাহ, সুবহানাআল্লাহ, কার্ত্তিকায় নমঃ এতে গন্ধপুষ্পে 
    নমঃসর্বদেবদবীভ্যোনম আপনি কি কখনও কাউকে এমন কিছু
     গান গাইতে শুনেছেন যা আপনি আগে কখনও গাননি  
    আপনি বুঝতে পেরেছেন যে আপনি সেই গানের  শব্দগুলো 
    শোনেননি ? আচমকা মৃত্যুশয্যায়  শুনতে পান ডাক দিচ্ছে 
    হেথা নয় হেথা নয় গো টু হেল কেন 'লাইফ ইন দ্য ফাস্ট লেন?' 
     আপনি মনে করেন, 'আমি কেন গাইছি লালি মেরে লাল কি 
    জিত দেখো তিত লাল লালি দেখন ম্যায় গ্যায়ি ম্যায় ভি হো গ্যায়ি 
    লাল ? আমায় ডুবাইলিরে আমায় ভাসাইলিরে ;অকুল দরীয়ায় 
    বুঝি কুল নাইরে শুনেছো ? খানাখাদ্যের বিপুল সম্ভারে 
    কালিজিরা জিলিপির মুচমুচে উপস্থিতি আমরা গানে টের পাই ! 
     
    বিয়াল্লিশ
    করি, খুব বেশি ধূমপান করি, খুব বেপরোয়াভাবে ব্যয় করি,  
    হাসি, খুব দ্রুত গাড়ি চালাই, খুব রাগ করি, খুব দেরি করি, খুব, 
    খুব কম পড়ি, খুব বেশি টিভি দেখি আর কক্ষনো মন্দিরে যাই না 
    আমাদের সম্পদ বহুগুণ বাড়িয়েছি, আনন্দের কথা মূল্যবোধ 
    হ্রাস করেছি আমরা খুব বেশি কথা বলি, খুব কমই ভালবাসি  
    বেশি ঘৃণা করি।আসতাগফিরুল্লাহ তুমি জীবিকা নির্বাহের জন্য 
    যা করো তাতে আমার আগ্রহ নেই আমি জানতে চাই তুমি 
    কিসের জন্য কষ্ট পাও, আর যদি তুমি তোমার দুঃস্বপ্ন 
    পূরণের চিরকাল সাহস দেখাও  এই আশায় না বাঁচো তবে
     সময় ব্যয় করে নাচো কেন হে ? যে কেউ তোমার নাচকে 
    নোংরা বলবে তার ফল ভোগ করবে, তাহলে ঐকান্তিক ভাঁড়দের 
    দ্বিতীয়বার  আঘাত করার অনুমতি দাও আর সেলাম করো
    কক্ষনো বলবে না আমি এমন মহিলাদের ঘৃণা করি পুরুষদের 
    মনোযোগেএতটাই মরিয়া যে  বিশ্বাসঘাতকতা করবেই
     
    তেতাল্লিশ
    দলবদলুরা  নিজেদের লিঙ্গের  ক্ষতি করে নপুংসক হয় 
    এমন দাবি নেতারা তাদের মস্তিষ্ক দিয়ে চিন্তা করে না
     অন্তত পুরুষরা এটি সম্পর্কে সরাসরি ফুসলে আনে
    অতীতে বেঁচে থাকার চেষ্টা তেমন কাজে দেয়নি বলে 
    এখনই সম্পূর্ণ উপলব্ধি করলেন যে মগজে কিসসু নেই ঢুঢু 
    অবিশ্বাস্যভাবে ভাগ্যবান তাহলে । কারণ মগজের আনন্দ 
     খুব দুঃখজনক ছিল  যা অতীতকে প্রতারণাতে পরিণত 
    করত মানে তোমাদের সব সুখী স্মৃতি মিথ্যা  এর অর্থ 
     সেই সমস্ত সময়  সমস্ত ভালবাসা এক জীবনের অপচয়, 
    একটি নষ্ট ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে গেছে কে না চায় নষ্টামি?
     পুরো জীবন যাদের সম্পর্কে যত্নশীল তাদের সবকিছুর 
    চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা হবে। সব মানুষ তো মানুষ নয়
    যারা  ভালোবাসে, সব মিলিয়ে স্পর্শ. একরকম সতীত্ব,
     আনুগত্য, একগামীতা, ভদ্রতার কোড  নিয়মাবলী  
    সংযম বজায় রাখার  সবচেয়ে অসুস্হ মারাত্মক শত্রু। 
     
    চুয়াল্লিশ
    ছোঁয়াছুঁয়ির মাধ্যমে আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করি  
    নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি ... দুর্ঘটনাক্রমে কাঁধ 
    নাচিয়ে হাত স্পর্শ করা ... চোরের মতো গাড্ডায় পড়ে থাকা 
    আরামের ভঙ্গিতে কাঁধে হাত রাখা মরুভূমি কোনো বিলাসিতা 
    নয় বরং মানুষের আত্মার প্রয়োজন, এবং আমাদের জীবনের
     জন্য জল এবং মাছ-ভাতের মতো অত্যাবশ্যক। একটি সভ্যতা 
    যা বন্যের সামান্য অবশিষ্টাংশ, অতিরিক্ত, আসল জিনিসগুলিকে 
    ধ্বংস করে, নিজেকে তার উত্স থেকে বিচ্ছিন্ন করছে 
    সভ্যতার নীতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে আমি তাকে 
    ভালবাসতাম. সবকিছু সত্ত্বেও. মিথ্যা, তুমি কি জানো…
    তুমি আমাকে এত খুশি কর যে মাঝে মাঝে আমি শ্বাস নিতে 
    ভুলে যাই? আমি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকব,  আমার চেতনা 
    খুব ছলনাময় হয়ে যাবে... মনে হচ্ছে, আমার মাথায় একটাই 
    চিন্তা হচ্ছে আমি কবে তোমাকে চুমু খেতে পারবো কালো মেয়ে ?
     
    পঁয়তাল্লিশ
    বিশ্বাসঘাতকতা  আঘাত সত্ত্বেও আমার নিজের গুণ্ডাদল 
    থাকা সত্ত্বেও আমি জানি না সে সেই ভালবাসা ফিরিয়ে 
    দিতে চায় কিনা,  আমি পাত্তা দিইনি। যদি সে জাহান্নামে 
    পুড়তে থাকে তবে আমি তার সাথে পুড়বো রাগকে ধরে রাখা 
    বিষ তোমার তা  ভেতর থেকে খেয়ে আনন্দে ডগমগ
     মনে করো কাউকে ঘৃণা করে  তাকে কষ্ট দিতে চাও তো
     ঘৃণা একটা হাসিমুখ খাঁড়া .আর যে ক্ষতি তোমরা আমার করলে 
     নিজেদের কাছে তোমার মৎস্যবউয়ের গা ঘিনঘিন  ঠোঁট 
    আমার সাথে মিলিত হয়েছিল, আমি জানতাম যে আমি একশ
     বছর বেঁচে থাকবো আর বিশ্বের প্রতিটি যৌনালয়ে যাবো 
    কিন্তু সেই এক মুহুর্তের সাথে কিছুই তুলনা করবে না 
    যখন আমি প্রথম আমার স্বপ্নের মেয়েটিকে চুমু খেয়েছিলাম 
    জানতাম যে  ভালবাসা স্থায়ী হয় না নতুন কেউ আসে
    যৌনকর্মীর বয়স কত তা আমাকে আগ্রহী করেছিল  
     
    ছেচল্লিশ
    আমি জানতে চাই তুই প্রেমের জন্য, তোর স্বপ্নের জন্য, 
    বেঁচে থাকার দুঃসাহসিকতার জন্য বোকার মতো দেখার 
    ঝুঁকি নিবি কিনা কোন গ্রহগুলো তোর চাঁদকে বর্গাকার 
    করছে তাতে আমার আগ্রহ নেই। আমি জানতে চাই তুই 
    তোর নিজের দুঃখের কেন্দ্রে ছুঁয়েছিলি কি না, জীবনের 
    বিশ্বাসঘাতকতায় চাপা পড়ে গেছিস নাকি  যন্ত্রণার ভয়ে 
    কুঁকড়ে  গিয়ে লুকিয়ে পড়েছিস ?  আড়াল বা বিবর্ণ বা  
    ঠিক করার জন্য সরানো ছাড়া আমি জানতে চাই তুই 
    কি আনন্দে থাকতে পারিস না ? আমার বা তোর নিজের, 
    একঘেয়েমির সহনশীলতা  সুস্থ মনে অন্ধকারের ধৈর্যের 
    প্রায় একই সম্পর্কে রয়েছে  অর্থাৎ একটি শক্তিশালী বুদ্ধির 
    ঝড় যা গোধূলির গাম্ভীর্যে আনন্দ পাবে, যা ভাঙাচোরা 
    রহস্যময় আলোর মধ্যে  জ্বলজ্বল করবে তাদের, বরং নিছক 
    উজ্জ্বলতা দৃষ্টির  মধ্যে, যখন এক তুচ্ছ ছায়া জেগে থাকে 
     
    সাতচল্লিশ
    ঝড় নিজেই ভয় পায় । একজন মহান ব্যক্তি হিসাবে শক্তি 
    বা সুখের বৃহত্তর খ্যাতি অর্জনের জন্য ভাগ্যের অনেক অন্ধকার 
    সহ্য করতে তৈরি থাকবে  একজন নিকৃষ্ট মানুষের মূল্য দিতে হবে 
     ঠিক একইভাবে এক মহান মন একঘেয়েমিকে মেনে নেবে 
     বা এমনকি আনন্দিত হবে, যা  নিকৃষ্ট বুদ্ধির উৎসার
      ক্লান্তিকর হবে, কারণ এতে আরও ধৈর্য প্রশান্তি প্রত্যাশার 
    শক্তি পরিবর্তনের মহান ভবিষ্যতের আনন্দ লুকিয়ে আছে যা
     সম্পূর্ণ মূল্য দিতে প্রস্তুত। তুমি জানো যে ব্যথা মহাবিশ্বের 
    সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। বেঁচে থাকার চেয়ে বড়, ভালোবাসার 
    চেয়েও বড়, সৌন্দর্যের চেয়েও বড় কারণ বেদনা ছাড়া কোন 
    আনন্দ হতে পারে না দুঃখ ছাড়া সুখ হতে পারে না দুঃখ ছাড়া 
    সৌন্দর্য হতে পারে না  এগুলো ছাড়া জীবন অন্তহীন আশাহীন, 
    সর্বনেশে অভিশপ্ত। প্রাপ্তবয়স্ক  হয়ে গেলি যবে থেকে 
    বেদনা ছাড়া চেতনা আসে না অত্যন্ত সংবেদনশীল লোকেরা 
    প্রায়ই দুর্বল বা ক্ষতিগ্রস্থ পণ্য হিসাবে বাংলাবাজারে বিকোয়। 
     
    আটচল্লিশ
    আমাদের মায়েরা তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন দুর্বলতার লক্ষণ  
    জীবিত  সহানুভূতির সেটাই ট্রেডমার্ক নোঙর ছেঁড়া নয়, সমাজই 
    অকার্যকর  মানসিকভাবে অক্ষম  আপনার খাঁটি অনুভূতি 
    প্রকাশ করতে কোন লজ্জা নেই  যাদের মাঝে মাঝে মাঝরাতে
    'অনেক বেশি সমস্যা  বলে বর্ণনা করা হয় তারাই 
    স্বপ্নকে আরও যত্নশীল মানবিক বিশ্বের জন্য বাঁচিয়ে রাখে 
    চোখের জলে এই পৃথিবীতে আলোকিত হতে দিলে গোহারা হবে 
    লজ্জিত হবে লোকেদের দিকে তাকানো  তাদের সম্পর্কে
    তাদের বর্তমান  তাদের অতীত  দ্রুত বিচার করা সহজ, 
    একটি একক হাসিতে লুকিয়ে থাকা ব্যথা  অশ্রুতে 
    বিস্ময় জাগবে একজন লোক বিশ্বকে দেখায়  আইসবার্গের 
    ভাসমান উঁকি বাকিটুকু দৃষ্টির আড়ালে  প্রায়ই সফেদ ফেনা 
    ফাটল এবং দাগের সাথে রেখাযুক্ত যা তাদের আত্মার ভিত্তি ।
     
    উনপঞ্চাশ
    দৈহিক জন্মের যন্ত্রণায় কাতর কে ? সন্তান না মা ?
     অথচ আধ্যাত্মিক মৎস্য-বৃদ্ধির দীর্ঘ যন্ত্রণা কে ভোগ করে?
    আমাদের পরিচিত সবচেয়ে বজ্জাত নেতারা পরাজয় চেনে না, 
    কষ্ট চেনে না, সংগ্রাম চেনে না, শিক্ষা পায়নি এবং গভীরতা 
    থেকে বেরিয়ে আসার পথে হারিয়ে যায়।   এই ব্যক্তিদের একটি 
    উপলব্ধি, একটি সংবেদনশীলতা এবং জীবনের একটি উপলব্ধি 
    রয়েছে যা তাদের সহানুভূতি, ভদ্রতা এবং গভীর ভালোবাসা 
    থেকে মুক্ত করে। কেন ?  সুন্দর মানুষ আর পয়দা হয় না কেন?
    আপনি যখন কাউকে ভালোবাসেন, তখন আপনি তাকে সব 
    সময় ভালোবাসেন না, ঠিক একইভাবে, মুহূর্তে থেকে মুহূর্ত  
    এটা এক  অসম্ভব ব্যাপার  এমনকি ভান এক মিথ্যাচার
    এখনও  ঠিক কি আমাদের অধিকাংশ দাবি জানেন ? 
    যৌনসম্পর্কের ওপর শত্রুদের  বিশ্বাস থাকে না কেন ? 
     জোয়ারের স্রোতে লাফিয়ে দেখুন বুঝবেন কেন ভাটাকে 
    প্রতিহত করেন  ভয় পান যে নদী কখনই ফিরে আসবে না। 
     
    পঞ্চাশ
    সমুদ্র তার স্থায়ীত্ব, সময়কাল, ধারাবাহিকতার ওপর জোর 
    দেয় আপা আপনি কত দিন গাঙে ডোবেন না বলেন তো?
    এই ঘোড়ার ডিমের প্রগতি বাদ দেন দেশে আসেন সিদ্ধ 
    চালের লাল ভাত টেংরা মাছ পাবদা বাইলা মাছ খান…
    সংগ্রাম অনেক হইছে কিছু হইলো ? আপনার জন্য মন 
    কেমন করে আউলা হই বাউলা হই  টাকা পান নাই ? 
    আপনার কাছে না....তবুও লাগে।এটাই ভালবাসা 
    দশদ্যাশের ভালবাসা, বালের শহরে পরকীয়া করেন ক্যান 
    আপা একমাত্র ধারাবাহিকতা সম্ভব  প্রেমের মতো জীবনে 
    বৃদ্ধিতে, তরলতায় - স্বাধীনতায়, এই অর্থে যে নর্তকরা মুক্ত 
    তারা যাবার সময় সামান্য স্পর্শ করে, কিন্তু একই প্যাটার্নের
     অংশীদার মৎস্য একমাত্র  নিরাপত্তা  মালিকানা বা 
    অধিকার, দাবি বা প্রত্যাশা নয়, আশায় নয়, এমনকি 
    একটি সম্পর্কের নিরাপত্তার নস্টালজিয়ায় যা ছিল  
    দিকে ফিরে তাকানোর মধ্যে নয়, বা এটি কী ভয় ?
     
    একান্ন
     প্রত্যাশায় হতে পারে তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে 
    নয়, তবে বর্তমান সম্পর্কের মধ্যে বসবাস করা সম্ভব নয় 
    এখন যেমন রয়েছে তেমন গ্রহণ করুন  সম্পর্কগুলো চোরাবালি
     দ্বীপের মতো হতে হবে  একজনকে অবশ্যই সেগুলিকে মেনে 
    নিতে হবে যে তারা এখানে  এখন যা আছে, তাদের মরুভূমির
    সীমায় যে  দ্বীপগুলো সমুদ্র থেকে ছিটকে বেরিয়ে ডাঙায় উঠেছে 
    এবং ক্রমাগত  জোয়ার দ্বারা পরিত্যক্ত উত্তাল চিন্তাভাবনা
    আমাদের পরিচিত সবচেয়ে সুন্দর মানুষ যারা পরাজয় চেনে 
    কষ্ট চেনে সংগ্রাম চেনে জয় জানে এবং গভীরতা
     থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পেয়েছে সেই নারীদের 
    একটি আবিষ্কার, একটি পথভ্রষ্টতা এবং জীবনের একটি 
    উপলব্ধি রয়েছে যা নারীদের সহানুভূতি, ভদ্রতা এবং গভীর 
    প্রেমময় উদ্বেগে পূর্ণ করে। সুন্দর নারী কোটিতে এক! কেন ?
    যদি নারীরা জংলিদের তালে নাচতে পারেন উড়ন্ত জাজিমে 
    পৃথিবীর সবচেয়ে করুণাময় নারী, আমি মনে করি, 
    নারীদের মনের অক্ষমতা  সমস্ত বিষয়বস্তুর সাথে শেষ ! 
     
    বাহান্ন
    স্থাপন করতে হলে আমরা অসীমের কালো সাগরের 
    মাঝে অজ্ঞতার একটি শান্ত দ্বীপে বাস করি  এর মানে 
    এই ছিল না যে আমাদের অনেক দূর যাওয়া উচিত ছিল'
    পাঠক আপনি যখন বড় হবেন তখন একটি ভয়ঙ্কর 
    নিরক্ষরতা আপনার উপরে আসবে তাকে বলে একাকীত্ব, 
    অথচ আপনি মনে করেছিলেন আপনি বোবা ও কালা 
    কিন্তু আপনি তা জানেন না। এখানে লক্ষণগুলোর তালিকা 
    রয়েছে, কোনো চিন্তা করবেন না - একাকীত্ব মূর্খের সবচেয়ে 
    সর্বজনীন সংবেদন  শুধু একটি সত্য মনে রাখবেন - একাকীত্ব 
    পাঠকেরই যদি  বেঁচে থাকেন বোবা ও কালা হয়ে জেল খাটবেন 
    আরও ভাল মানুষ হবেন  ভয়ঙ্কর হবে যখন জেলখানায় 
    মনে কিছু চাপা পড়ে নিজেকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য মগজ 
    না থাকা আপনি জানেন আমি কি বলতে চাই. আমি আমার 
    বাঁয়া তবলাকে বলি ভালবাসার চেয়ে ভয় পাওয়া অনেক বেশি 
    নিরাপদ কারণ সুযোগ বুঝে সময়মতো কেটে পড়তে পারেন। 
     
    তিপ্পান্ন
    যোগসূত্র দ্বারা কিছুই সংরক্ষিত হয় না, পুরুষদের গোবৃত্তির 
    সুবিধার জন্য প্রতিটি সুযোগে নষ্ট হয় নষ্টামিও কিন্তু ভয় 
    তোমাকে রক্ষা করে এমন শাস্তির ভয় যা কখনো ব্যর্থ হয় না
    সতর্কতা অবলম্বন না করলে তোমার হাতের আঙুল পায়ের 
    আঙুলের কল্পনা জ্ঞানের চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ  কারণ জ্ঞান 
    আমরা যা জানি  বুঝতে পারি তার মধ্যে টাইটফিট  
    যখন কল্পনা সমগ্র বিশ্বকে আলিঙ্গন করে, এবং সেখানে যা 
    কিছু জানতে এবং বোঝার জন্য থাকবে তাকে দেখে তিনি 
    যে প্রত্যাশা এবং ভয় অনুভব করেছিলেন তাও ছিল এক 
    ধরণের কামুক আনন্দ, এবং এটিকে ঘিরে ছিল, একটি 
    আলিঙ্গনের মতো, একটি সাধারণ উচ্ছ্বাস - এটি আঘাত 
    করতে পারে, এটি ভয়ঙ্করভাবে অসুবিধাজনক ছিল, এর থেকে 
    কোনও ভাল নাও হতে পারে, তবে তিনি প্রেমে থাকা কী তা 
    তিনি নিজেই খুঁজে পেয়েছিলেন এবং এটি তাকে রোমাঞ্চিত 
    করেছিল।"অবশ্যই আমি তোমাকে কষ্ট দেব। অবশ্যই তুমি 
     
    চুয়ান্ন
    সংসার করা ওইরূপ কঠিন  অনেক সাধন-ভজন করলে 
    কেউ কেউ পেরেছে আমাকে কষ্ট দেবে অবশ্যই আমরা 
    একে অপরকে আঘাত করব কিন্তু এটাই অস্তিত্বের শর্ত 
    বসন্তঋতু এলো মানেই শীতের ঝুঁকি মেনে নেওয়া
    উপস্থিতি হওয়া মানে অনুপস্থিতির ঝুঁকি থাকবে, কী বলেন ?
    যদি শত্রুকে জানেন সন্ধ্যা গায়ত্রীতে লয় হয়। গায়ত্রী আবার 
    ওঁকারে লয় হয়  একশটি যুদ্ধের ফলাফলকে ভয় পাওয়ার 
    দরকার ওরে রামলাল যাঃ মাস্টার বিয়ে করে ফেলেছে ! 
    প্রতিটি জয়ের জন্য আমি আবার কেশবের জন্য মার কাছে 
    ডাব-চিনি মেনেছিলুম আর মার কাছে কাঁদতুম, বলতুম, মা
    যা করবেন। আপনি যদি শত্রু বা নিজেকে না জানেন তবে 
    জগাখিচুড়ি আলিঙ্গন তো? তা জটিল হবে, তবে জটিলতায় 
    আনন্দ করুন কখনও কখনও যাদুটি আলিঙ্গন হয়ে যায়
    জীবনে বাস্তব কী তা খুঁজে বের করার জন্য এবং নিজের হৃদয়ে 
    এটি প্রয়োজনীয় পরিপূর্ণতা সুখের শত্রু নিখুঁতভাবে অসম্পূর্ণ 
     
    পঞ্চান্ন
     আলিঙ্গন আপনার ভুল থেকে শিখুন এবং নিজেকে ক্ষমা 
    করুন  সুখী হবেন আমরা অসিদ্ধ। আপনার ভুল থেকে শিখুন 
    পূর্বপরিচিতের ন্যায় একদৃষ্টে দেখিতেছেন ও ভাবে হাসিতেছেন
    কোনও গরু ল্যাজে হাত দিলে শুয়ে পড়ে, সে গরু কেনে না। 
    যে গরু ল্যাজে হাত দিলে তিড়িং-মিড়িং করে লাফিয়ে উঠে 
    সেই গরুকেই পছন্দ করে। নরেন্দ্র সেই গরুর জাত; খুব তেজ! 
    আমি এই অনুভূতি অনেক পেয়েছি, কিন্তু আমি জানি না 
    এর জন্য একটি শব্দ আছে কিনা। এটা নার্ভাস বা দু: খিত 
    বা এমনকি একাকী নয় এটি সবই, এবং তারপরে আরও কিছু। 
    অনুভূতি হচ্ছে আমি এখানকার নই  আমি জানি না আমি এখানে 
     যে অন্য সবাই বুঝতে পারার আগে আমি কতক্ষণ থাকতে 
    পারব আমি একজন প্রতারক  আমি আমার জীবনের প্রায় 
    সব জায়গায় এই অনুভূতি পেয়েছি  কিছু জল পান করা 
     আশা করি  কমে যাওয়া ছাড়া আপনি এটি সম্পর্কে কিছুই 
    করতে পারবেন না  অথবা আপনি চলে যেতে পারেন 
     
    ছাপ্পান্ন
    উদ্ভাবনগুলো সময় নেয় অনুমান, পৌরাণিক কাহিনী বিশুদ্ধ 
    ফ্যান্টাসি দিয়ে শুরু হয়েছিল, যা  প্রাচীন বিশ্বের  ভৌগলিক 
    বন্ধুরা ভেবেছিল উদ্ভাবনকারিণীরা খুব সুখী মানুষ 
    কারণ আমি এভাবেই অভিনয় করেছি- একজন সত্যিকারের 
    ওরাঙ-ওটাঙের মতো যদিও সেই সব ভান আমাকে ক্লান্ত 
    করেনি কেননা এডাল-ওডাল করতে বলেছিলেন ডারউইন 
    ঝাঁপ দাও তাহলে  সন্দেহ থেকে যে কিপটেকেঁচো  বন্ধুরা  
    আমার সাথে খালাসিটোলায় যেতো  তাই ভান সব খারাপ 
    ছিল না. ভান আমাকে নাচতে বাধ্য করে স্মৃতি ফেলে দিই 
    পকেটে ছিল, মহিলাদের আরও একা করে তোলে কারণ
    ওনারা একটি প্রতারণার শিকার করতে গিয়ে বিপদে পড়েন 
    সবসময় একজন নকল মানুষের মতো অনুভব করেন
    নিজেকে হত্যা করা, যাইহোক, তা ভুল ছিল না। আমরা 
    আত্মহত্যা করি না। আমরা কেবল বেঁচে থাকার দীর্ঘ, 
    কঠিন সংগ্রামের কাছে কখনও হারি কখনও জিতি কেউ দীর্ঘ 
    অসুস্থতার পরে মারা যায়, তখন লোকেরা অনুমোদন করে 
    বলে উনি খুব কঠিন লড়াই করেছিলেন যার মানে হয় না 
     
    সাতান্ন
    তারা আত্মহত্যা সম্পর্কে চিন্তা করতে ভুলে যায় এমন বোকা 
    কোনও লড়াইয়ে জড়িত ছিল না  কেবল হাল ছেড়ে দিয়েছে
    এটা কিন্তু মোটেই ভুল নয় যে ঝড় পছন্দ না বজ্রপাত নাকি 
    বৃষ্টি, পুঁজ, ভিজে জুতা যখন মেঘ তেড়ে আসে, আমি সেই 
    অস্থির প্রত্যাশায় পূর্ণ হই  বৃষ্টিতে সবকিছুই বেশি ঝাপসা 
    কেন আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না কিন্তু তা সুযোগের  
    সম্পূর্ণ অন্য রাজ্যের মতো  আমি একজন সুপারহিরোর মতো 
    অনুভব করতাম, বিপজ্জনকভাবে চটকদার আকাশের ওপর 
    আমার ড্র্যাগন ওড়াচ্ছি, অথবা হয়তো একজন অলিম্পিক 
    অ্যাথলেট রুক্ষ পরীক্ষা সহ্য করে ফিনিশিং লাইনে পৌঁছাবার 
    আগেই বলল তোমরা এগোও আমি রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে দৌড়োবো 
    সেই রোমাঞ্চিত অনুভূতিতে জেগে উঠতে পারি আমি সম্পূর্ণ 
    ব্যর্থ  আমি যা কিছু করি, আমি একেবারেই মূল্যহীন
    আমি তা জানি,  তবুও আমি  উপস্থিতি বজায় রাখি 
     
    আটান্ন
    মানব জাতির বোঝা কতোকাল বইব জানি না  নিঃশ্বাস 
    নিয়ে পৃথিবীর মূল্যবান বাতাস লুট করি আমি রঘুডাকাত 
    তাই মর্গে শুয়ে পা দোলাই আর রবিঠাকুরের গান গাই
    আমি এর জন্য নিজেকে ভালোবাসি  অস্তিত্বের ঠেলাগাড়ির
    যোগ্য নই  যদিও আমি জানি আমাকে ঘিরে রয়েছে 
    অকেজো কাপুরুষরা যারা লাফ দেওয়ার পা হারিয়েছে
    অর্জনগুলো লজ্জা, ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা, নীরবতা, অজ্ঞতা, বৈষম্য, 
    নিম্ন আত্মসম্মান বা অনৈতিকতাকে মুছে বগল বাজায়
    মাথা ঢেকে রাখে, কেননা সব রকমের অহং সৃজনশীল
     পুনরুদ্ধার, নিজেকে এবং অন্যদের ক্ষমা করা, সমবেদনা
    অনুতাপ এবং মর্যাদার সাথে অবনিবনা বজায়ই সাফল্য 
    যা অতীতকে মুছে ফেলবে প্রেমে প্রতিবার পড়ার জখমে 
    আত্ম-জ্ঞানের ওপর আশার রক্তারক্তি থাকবে  প্রেমের 
    আশায় যে আমরা নিজের মধ্যে যা জানি তা অন্যের মধ্যে 
    খুঁজে পাব  সমস্ত কাপুরুষতা, দুর্বলতা, অলসতা, অসততা । 
     
    উনষাট
    আপস করাই বোকামি কেননা নির্বাচিত ব্যক্তির চারপাশে 
    টাকাকড়ির ঘেরাটোপ তৈরি করি তবু সিদ্ধান্ত নিই যে
    ওদের মধ্যে থাকা সমস্ত দোষ আমাদের গুণ  থেকে পাওয়া
    আমরা অন্য একরকম পূর্ণতা খুঁজে পাই যা আমাদের 
    নিজেদের মধ্যেই ঘাপটি মেরে থাকে তবু আমাদের প্রজাতির  
    একটা অনিশ্চিত বিশ্বাস বজায় রাখার জন্য প্রিয় আশার সাথে 
    ভালোবাসা এমন কিছু নয় যা আমরা বিলিয়ে দিই বা পাই; 
    এমন কিছু যা আমরা লালন-পালন করি তোল্লাই দিই 
    এমন একটি সংযোগ যা শুধুমাত্র দুটি মানুষের মধ্যে গড়ে 
    উঠতে পারে যখন এটি তাদের প্রত্যেকের ফাঁকা মগজে
     থাকে - আমরা কেবল অন্যদের ততটা ভালবাসি 
    যতটা আমরা নিজেদেরকে ভালবাসি আমরা হাসবো 
    কেন? আমরা হাসবো কেন? কেন আমরা হাঃ হাঃ করি ? 
     
    ষাট
    কেন পাঠক তুমি দু: খিত এবং বিভ্রান্ত? কেন তুমি কবিতা পড়ো? 
    চিত্রকর্ম দেখলে  কেন কাঁদো ? প্রেম করলে কেন মগজে দপদপে 
    দাঙ্গা হয়? আমাদের লজ্জা করে কেন? তোর পেটের গর্তে 
    সেই জিনিসটাকে কেন যেতে দিলি ? একজন পাঠক মরতে চায়
     সে একই সাথে মাদকে মশগুল পূর্ণ জীবনে মরোমরো কেন? 
    উদাসীন ক্লান্তি  বোধ করে হাই তোলো কেন ? কেন ? কেন? 
    পাঠক কম্বলের মধ্যে কুঁকড়ে যেতে চায় কিংবা ভাঙা কাচের 
    আলমারিতে লুকিয়ে রাখতে চায় তুমি সবার কাছে দুঃখিত 
    বলতে চাও কেন ?  তুমি চাও সবাই জানুক যে তারা সবাই 
    তোমাকে কতটা হতাশ করেছে। অনিষ্ট করে পার পেতে  কোনও 
    বাধা নেই তুমি অনিয়ন্ত্রিত এবং উন্মাদ, দুষ্ট এবং দুষ্টের সাথে 
    তোমার যা মিল রয়েছে  তুমি যে সমস্ত বিপর্যয় সৃষ্টি করেছো 
    তার প্রতি তোমার উদাসীনতা এখন আমি অতিক্রম করেছি
    আমার ব্যথা ধ্রুবক এবং তীক্ষ্ণ এবং আমি কারোর জন্য
     ভাল বিশ্বের আশা করি না, আসলে আমি চাই যে আমার 
    ব্যথা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হোক বুঝুক ঠ্যালা । 
     
    একষট্টি
    দেখছি কেউ যাতে পালাতে না পারে, কিন্তু এটা স্বীকার 
    করার পরেও কোন ক্যাথারসিস নেই, লে-হালুয়া শাস্তি 
    আমাকে এড়াতে থাকে তবু আমি নিজের সম্পর্কে গভীর 
    জ্ঞান অর্জন করতে পারি না কারণ আপনাদের বাণী থেকে  
    নতুন জ্ঞান আহরণ করা যাবে না এই স্বীকারোক্তির 
     মানে হয় না লজ্জা, দোষ, অসম্মান, বিশ্বাসঘাতকতা 
    বন্ধক রাখা সেই শিকড়গুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যেখান থেকে 
    ভালবাসা জন্মেছে ভালবাসা শুধুমাত্র এই আঘাত থেকে বেঁচে 
    থাকতে পারে যদি সেগুলি স্বীকার করা হয়, নিরাময় করা
     হয় এবং বিরল হয় ! না, করো না ! লাফ দিও না !  ঠিক 
    আছে  তোমার সেরকম সাহস নেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল 
    তোমরা তবু বেঁচে আছো  জীবনে কখনও ব্যথা পাওনি তো ? 
     সবসময় এমন হয় না তোমার বেঁচে থাকার একটা কারণ 
    থাকতে হবে  তুমি সবাইকে প্রত্যাশায় চঞ্চল করে দিয়েছ ।
     
    বাষট্টি
    ঠিক যেন স্তনবৃন্ত বৃষ্টির ঝড়। তুমি ছিলে মৎস্যবউ 
    মেঘহীন আকাশে বজ্র হয়ে আমার মনে আছে আমি আমার 
    প্রাতঃরাশের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি পারতাম  যাতে বৃষ্টির 
    দরজায় টোকা দিয়ে স্তনবৃন্ত ঝরাই আর যুবকেরা কুড়োতে যাক। 
    শুধু খাবার আর ঘুমের জন্য ফিরে আসুক। ঝড়ের সঙ্গে লুকোচুরি
    খেলুক, যুবতীরা যুবকদের দোলনায় ঠেলে দেবে কিংবা গোপিনীরা
     গাছে উঠবে চুড়িদার নামাতে যুবকদের আবার বাড়ির 
    একটি ধারনা দিয়েছে. দেখবেন, যুবতীদের বয়স যখন কুড়ি, 
    তখন তাদের মায়ের বয়স দশ কি বারো সত্যিই যুবকেরা
     তাদের  জানবার আগেই গাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল । 
    যুবকদের পৃথিবী খুব অনিরাপদ বোধ করেছিল যুবতীরা ভয় 
    দেখিয়েছিল । গাছও এমন  ছিল যে পোশাকগুলো গায়েব 
     করে দিয়েছে যুবকদের সাথে যুবতীদের যোগাযোগ হয়নি। 
     
    তেষট্টি
    এমন দিন ছিল যে  মায়ের সাথে মারা যাওয়া অংশটুকু 
    ফিরে এসেছিল যখন আমি প্রেমিকার সাথে দেখা করি কেননা 
    যদি  জানতাম যে আমি তোমাকে পেয়ে গেছি তবে আমি 
    আঘাত সইতুম  একদিন, সবুজ আকাশে আমিও তোমাকে
     হারিয়েছিলাম। আঘাত ফিরে এসেছে বলে সম্পর্ক রহস্যময় 
    অন্যদের ইতিবাচক গুণাবলী সন্দেহ করো কেন? কদাচিৎ 
    নেতিবাচক হতে পারো তো ? তুমি সঙ্গিনীকে বলবে “আপনি কি 
    আমাকে সত্যিই ভালবাসেন?” তুমি কি জানো ভালোবাসা কতো 
    বিপজ্জনক ?  তুমি একথা বার বার জিজ্ঞাসা করবে যদি পারো 
    এক ঠোঙা বাদাম কিনে দেবে কিন্তু তুমি কখনও জিজ্ঞাসা 
    কোরো  না: “আপনি কি সত্যিই আমার ওপর চটা ? আপনি কি 
    নিশ্চিত আপনি রাগান্বিত?” যখন কেউ বেজায় চটে থাকে, বুঝবে 
    বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে চুমু খেতে ভুলে গেছো যদিও বিপরীত 
    হওয়া উচিত ছিল তোমার জীবনে নেতিবাচক বলে কিছু তো ছিল?
     
    চৌষট্টি
     ওরা বিষণ্ণ  কেমন করে লোকে জানতে পেরেছে বলো
    কারণ ওরা বিবাহবিচ্ছেদ নিজেরাই বেছে নিয়েছিল 
    বরের চাকরি গেছে মালকিনির বিছানায় ধরা পড়েছিল 
    কিন্তু এই অভিজ্ঞতাগুলো ওদের অনুভূতি বহন করে না 
    কেননা হতাশা, পরিবর্তে, সমতল, ফাঁপা এবং অসহনীয় 
    আর ক্লান্তিকর মালকিনি যখন হতাশাগ্রস্ত হন তখন তোমাকে 
    ইশারা করেন তবু চারপাশে থাকা মেনে চলতে পারে না 
    ভাবতে পারে যে কী কী করা উচিত ছিল । যতোরকম 
    যৌনআঙ্গিক হয় মালকিনি জানেন ওরা কি তা বোঝেনি? 
    আপনি বিশ্বাসের বাইরে ক্লান্তিকর । আপনি খিটখিটে এবং 
    প্যারানয়েড এবং হাস্যকর এবং প্রাণহীন সমালোচনামূলক
    দাবিদার মালকিনির যৌন আশ্বাস কখনও যথেষ্ট নয়। 
    আপনি ভীত কেন আপনি ভয় পাচ্ছেন আপনি 
    মোটেও আপনার মতো নন তবে শীঘ্রই চাকরি পাবেন
    কিন্তু আপনি জানেন যে আপনি জয়েন করবেন না।
     
    পঁয়ষট্টি
    একটা বাচ্চার ডায়াপার বদল  করতে সবাই পারে না
    অথচ আক্রমণের পরিকল্পনা করতে পারে। কসাইকে 
    বলতে পারে সামনের ঠ্যাং দাও তবু একটি জাহাজ চালাতে
    একটি বিল্ডিং ডিজাইন করতে, একটি সনেট লিখতে, 
    হিসাব মেলাতে, পাঁচিল তুলতে, একটি হাড় স্থাপন করতে, 
    মৃতের মাকে সান্ত্বনা দিতে হিমসিম খায় কেন তা জানে না 
    অর্ডার করুন, সহযোগিতা করুন, একা কাজ করুন, 
    সমীকরণ সমাধান করুন, একটি নতুন সমস্যা বিশ্লেষণ করুন, 
    সার তৈরি করুন, একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম করুন, 
    একটি সুস্বাদু খাবার রান্না করুন, দক্ষতার সাথে লড়াই করুন, 
    বীরত্বের সাথে মারা যান। পোকামাকড় জন্য বিশেষীকরণ হয়. 
    আমার একজন বন্ধু আছে যে একজন শিল্পী এবং মাঝে মাঝে 
    এমন এক বিদকুটে ছবি আঁকে যার সাথে ডায়াপার পরাবার 
    বিফলতার মিল সে নিজেই আবিষ্কার করে অট্টহাসি হাসে ।
     
    ছেষট্টি
    ঠাকুরের কাছে হাজরা মহাশয়, রামলাল, রাখাল প্রভৃতি থাকেন
     যদি ভুলভাবে ব্যবহার করা হয় তবে এটি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে
    আরে সাবধানে চালাইয়ো মাঝি আমার ভাঙা তরী রে
    দেখ কত সুন্দর ফাইটা ফাইটা রইছৈ যত খালা বিলা নদী
    পানির লাইগা কাইন্দা ফিরে পঙ্খী জলদি তারপর তিনি বলেন, 
    আমি একজন শিল্পী হিসাবে দেখতে পাচ্ছি যে এটা কতো সুন্দর 
    যদি আপনি একজন বিজ্ঞানী হিসাবে এটিকে আলাদা করে নেন 
    তাহলে পাখির কান্না নিস্তেজ  হয়ে যায় সে এক ধরণের বাদামে
    যাহাঁ রাম তাহাঁ নাহি কাম, যাহাঁ কাম তাঁহা নাহি রাম
    অন্য লোকেদের জন্য উপলব্ধ এবং ওনার কাছেও, আমি বিশ্বাস 
    করি যদিও  তার মতো নান্দনিকভাবে পরিমার্জিত হতে হলে
     দুষ্টুমি জরুরি কেননা মূলত দুর্ব্যবহারের একটি রূপ, এবং এর 
    অনুশীলনকারীরা সাধারণত ধরা পড়ে গেলে প্রশংসার পরিবর্তে 
    শাস্তি এবং তিরস্কারের সম্মুখীন হয় দুষ্টুমিতে পূণ্যের কিছু আছে ।
     
    সাতষট্টি
    উদাহরণ স্বরূপ, এটা ঠিক যে, যারা জড়িত তারা প্রাণের
     মূল্য সম্পর্কে অবগত ছিল না  তারা পরে দৃশ্যত 
    ক্ষতিপূরণের চেষ্টায়  চেক রেখে গেছে কাক গণ্ডি 
    মণ্ডি গাঁথা, পঞ্জরাদি নানা নাড়ী ঘুড়ি স্বগুণে নির্মাণ করা, 
    কারিগরি বাড়াবাড়ি বিষয়ে মেজেছ মাঞ্জা, কর্কশা হয়েছে
     দড়ি ৷ঘুড়ি লক্ষের দুটা-একটা কাটে, হেসে দাও মা 
    হাত-চাপড়ি ৷প্রসাদ বলে, দক্ষিণা বাতাসে ঘুড়ি যাবে উড়ি 
    ভবসংসার সমুদ্রপারে পড়বে গিয়ে তাড়াতাড়ি 
    ধ্বংস করার সময় তাদের স্বাভাবিক অনুশীলনের  
    তবুও এটি কোনও বাস্তব সমাধান নয় কেবল বিষয়
    আশয় খারাপ করার জন্য কাজ করে সুতরাং দেখা যায় 
    যে, কিছু  কাজকে প্রশংসার পরিবর্তে নিন্দা করা উচিত
    দেখা যাবে যে কেউ সম্পূর্ণ ভাল কিছু হিসাবে 
    অসংযত কথা বলতে পারে নাকি পারে না বলা অসম্ভব।
     
    আটষট্টি
    চোরচোট্টা ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্বাতন্ত্র্যসূচক গুণাবলী প্রদর্শন করে 
    আমি গোরু পাচারির স্কেচ করতে চাই পাশাপাশি কিছু প্রশংসনীয় 
    পরিণতি ধৃষ্ট দুষ্টতার প্রভাব থাকতে পারে তাও তুলে ধরছি 
    পাচারিদের কেন প্রশংসনীয় চোর হিসেবে দেখা যেতে পারে তার 
    প্রধান কারণগুলির মধ্যে যা কিছু আবির্ভূত তা কেন বজ্জাতরা 
    মহান ব্যক্তিদের প্রায়ই প্রশংসার যোগ্য হিসাবে দেখা হয়  
    সংক্ষেপে পাচারিরা ঝামেলা তৈরির লুচ্চাটাইপ কৌতুকপূর্ণ ভাঁড় 
    হালকা হৃদয়ের রূপে যারা জড়িত তাদের মজার চিত্তবিনোদন 
    তৈরি করার লক্ষ্যে মোষের চেরহারার আশ্চর্যজনক হওয়া 
    উচিত যে দুষ্টু লোকেদের একটি প্রধান গুণ হল তাদের অনুরূপ 
    খেলাধুলাপ্রিয়  হালকা মেজাজ হ্যাঃ হ্যাঃ এটি এমন  মেজাজ যা 
    অনেকেরই দেশদ্রোহী হিসাবে রয়েছে, তবে যা পরবর্তী জীবনে 
    ধর্মে হাবুডুবু খায় ধৃষ্ট ভাল্লুকরা তাই গাঁয়ে বাড়ি হাঁকিয়ে
     প্রশংসিত হয় ধৃষ্টতার অনেকগুলি সেরা কাজ আখের গোছানো 
    মেজাজের অভিব্যক্তির চেয়ে সামান্য বেশি: সেগুলি পরিণত ।
     
    উনসত্তর
    তাই .. আমি একটি ফুলের সৌন্দর্যের প্রশংসা কেনই বা করব ! 
    একই সাথে, যখন ফুল দেখি তার চেয়ে বেশি ফুল আমাকে 
    কল্পনা করতে পারে আমাদের দুইয়েরই কোষগুলো একই 
    জটিল ক্রিয়ায় ফুটে ওঠে যেগুলোর কুৎসিত সৌন্দর্য আছে
    আমি বলতে চাই যে শুধুমাত্র বহুমাত্রিক সৌন্দর্য নয়
    এক সেন্টিমিটারের গ্যাঁদাফুলে ছোট মাত্রায় অঞ্জলি দাও 
    পাওয়ার প্রক্রিয়ায় পতঙ্গকে পরাগায়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত 
    করার জন্য ফুলের রঙগুলি বিবর্তিত হয়েছে তা গিভ অ্যাণ্ড টেক 
    মানে পোকামাকড় রং দেখতে পারে পুরুতদের মুখস্হ বুলির মতন 
    এই নান্দনিক অনুভূতি কি অন্য জীবজন্তুতে বিদ্যমান? 
    কেন এটা নান্দনিক? সব ধরনের ইন্টারেস্টিং আমার প্রেমিকা। 
    সে এমন  সুন্দরী যেন অনন্য তুষারকণা দিয়ে ঢাকা আছে 
    অন্য সবকিছুর মতো একই ক্ষয়প্রাপ্ত জৈব পদার্থকে ভালোবাসি
    আমরা দুজনে একই কম্পোস্ট স্তূপের অংশ  আমরা দুজনে গান 
    গাই, বিশ্বের সমস্ত নাচ দুজনে নাচি জাদুতে লাগ ভেলকি লাগ 
    হৃদয় ছুঁয়ে হাসতে চাই দুজনে বন্ধু হতে চাই ধবধবে বিছানায় 
     
    সত্তর
    গাছে বাড়ি করতে চাই পাহাড়ের ওপরে কেননা আমি  
    চাঁদনীকে বিয়ে করতে আর তারাদের বরযাত্রী হিসেবে 
    জাদুতে হুইশশশশ ব্যাস নিজেকে লোপাট করে দিতে চাই 
    সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা সফল হয়েছে যেটা হাড় পিষে দিয়েছে, 
    চাঁদনীর ঋতুরস খেয়ে লোভনীয় বমি বমি ভাবের ভয়াবহতা  
    মৃত্যুর সময় অতিক্রম করা যায় না তারপরে এই প্রণয়-যন্ত্রণা 
    দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে  আমি নিজের কাছে এসে যেন 
    এক মহা অসুস্থতার আনন্দে ভুগছি বলে উত্তপ্ত অনুভূতিতে 
    অদ্ভুত কিছু ছিল অবর্ণনীয় তিক্ত মিষ্টি  আমি মনে করি ছোট, 
    হালকা, শরীরে তুমি সুখী যদিও  একটা মাথা ঘামানো বেপরোয়া
    বিকৃত কামুক হিসেবে বিখ্যাত করে দিয়েছে দুহুদোহাঁর মিলনরস
    ছুটে চলেছে, বাধ্যবাধকতার বন্ধনের সমাধান, আত্মার অজানা 
    নির্দোষ স্বাধীনতা আমি নিজেকে জানতাম এই নতুন জীবনের 
    প্রথম নিঃশ্বাসে, আরও কামুক হতে, দশগুণ বেশি লম্পট 
     
    একাত্তর
    মন্দের ভালো আর ভালোর মন্দ মলয়দাসকে কিনেছিলুম 
    সেই মুহুর্তে, তোমরা জীবিকা নির্বাহের জন্য যা করো 
    তাতে আমার আগ্রহ নেই  আমি জানতে চাই তোমরা মামুলি 
    কারণে কেন কষ্ট পাও  যদি তুমি তোমার মগজের চাহিদা 
    পূরণের স্বপ্ন দেখার সাহস না থাকে তো মন্দের ভালো মন্দতে 
    আমার আগ্রহ নেই। আমি জানতে চাই তোমরা প্রেমের জন্য, 
    তোমাদের স্বপ্নের জন্য, বেঁচে থাকার দুঃসাহসিকতার জন্য 
    বোকার মতো দেখার ঝুঁকি নেবে কিনা ? অন্য লোকেরা  
    গোরু চোর হবে না কয়লা চোর হবে না গণধর্ষণ করবে তা 
    নির্ধারণ করার অধিকার রাষ্ট্রের আজকাল নেই, তবে সকলকে 
    নিজেদের, তাদের উপলব্ধি আর লোভ প্রকাশ করতে যাতে 
    সৃজনশীল করোটিতে আত্মবিশ্বাস তৈরি করার পুরস্কার নেয়। 
    পাচারি ওরে স্বপ্ন দেখ যেন তুই চিরজীবী হতে পারিস ফ্যান্টাসি হল  
    লাল রঙের, নীল, আকাশী, সোনালী, সবুজ, ল্যাপিস লাজুলি 
    বাস্তবতা পাতলা কাঠ, প্লাস্টিক, কাদা, পাঁক, গুয়ের বিশ্ব। 
     
    বাহাত্তর
    এই যে, হ্যালো, গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায় 
    কালী কালী কালী বলে আমার অজপা যদি ফুরায় 
    ত্রিসন্ধ্যা যে বলে কালী, পূজা সন্ধ্যা সে কি চায় 
    সন্ধ্যা তার সন্ধানে ফেরে, কভু সন্ধি নাহি পায় 
    দয়া ব্রত দান আদি, আর কিছু না মনে লয় 
    এই যে, হ্যালো, মদনের যাগযজ্ঞ, ব্রহ্মময়ীর রাঙা পায় 
    কালীনামের এত গুণ, কেবা জানতে পারে তায় 
    এই যে, হ্যালো,দেবাদিদেব মহাদেব, যাঁর পঞ্চমুখে গুণ গায় 
    চিনি এবং লবঙ্গ, বিরল লাল মাংস আহা চুমুর মতো মিষ্টি 
    ওয়াইনগুলোর ফ্যান্টাস্টিক স্বাদ বাস্তবতা হল মটরশুটি  
     জায়গাগুলি সম্পর্কে কী বলা যায়, যেখানে কিশোর এবং 
    এমনকি ছোট বাচ্চাদের নিয়মিতভাবে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ 
    কেটে ফেলা হয় সতর্কতা হিসাবে হীরা পাচারকারীরা 
    এমন যুদ্ধরত গ্যাংদের সাথে বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে হ্যালো
     
    তিয়াত্তর
    আমার শত্রু বেড়েই চলেছে তা তোমাদের নিজেদের বিভ্রান্তি ছাড়া 
    আর কিছুই আমাদের আক্রমণ করে না  আমি বুঝি যে শহরে 
    মালগুলো ছিল নৈমিত্তিক, পাশবিক শত্রুতার যান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা 
    যার ওপর তোমরা নির্বোধভাবে তোমাদের আশাবাদী ভয় চাপিয়ে 
    দাও তবু আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, অবশেষে বুক ফুলিয়ে 
    আমি একাই একশো । বাকি সব, আমি দেখেছি, নিছক ফালতু 
    খিমচিকাটার অনুশীলনকারী আমি যাদের ঠেলে দিই অন্ধতায় 
    কী মাল একএকটা শালা চুতিয়া ভেড়াদের ঘাসখোর পাল 
    আমি পুরো মহাবিশ্ব তৈরি করি, তবু কক্ষনো মিটমিট করি না। 
    ঠিক যেমন অবাঞ্ছিত গর্ভাবস্থা, তেমনি ওদের জীবনে এমন 
    অবাঞ্ছিত মৎস্যকুমারী রয়েছে যাদের গর্ভপাত করার সময়মতন 
    চেষ্টা করা উচিত, এবং এই জাতীয় গর্ভপাত পাপ বা ক্ষতি নয়, 
    কেননা শত্রুদলের ধ্বংসাত্মক ভ্রূণের নির্মূল করা জরুরি
    নিজস্ব প্রয়োজন ছাড়া  কোনও কঠিন বাধা নেই। 
     
    চুয়াত্তর
    তিব্বতি প্রেয়ার হুইল বা জপযন্ত্রে এই মন্ত্র খোদাই করা থাকে
    এই যে, হ্যালো,হুঁং হুঁং-কারে শবারুঢ়ে নীল নীরজ লোচনে
    ত্রৈলোক্যৈকমুখে দিব্যে কালিকায়ৈ নমোহস্তুতে
    এই যে, হ্যালো, প্রত্যালীঢ়পদে ঘোরে মুণ্ডমালা প্রলম্বিতে
    খর্ব্বে লম্বোদরে ভীমে কালিকায়ৈ নমোহস্তুতে
    এই যে, হ্যালো, নবযৌবনসম্পন্নে গজকুম্ভোপদ্মস্তনি
    বাগীশ্বরী শিবে শান্তে কালিকায়ৈ নমোহস্তুতে
    এই যে, হ্যালো, ললজিহ্বে দুরারোহে নেত্রত্রয়বিভুষিতে
    ঘোরহাস্যোকরে দেবী কালিকায়ৈ নমোহস্তুতে
    কিন্তু আমরা অনুশীলনকারী হিসাবে যা পাই তা  
     দরকার তা আমাদের শেখানো না হওয়ার প্রতিবন্ধকতা 
    আমরা মহাদেশের অন্য প্রান্তে একশত মাইল দৌড়ে যাই, 
    আমরা পৌঁছানোর সময় আমাদের জন্য একই সমস্যা  
    প্রেম ছিল কুসংস্কার, একটি প্রার্থনা যা একাকীত্বের সত্যকে দূরে রাখে 
     
    পঁচাত্তর
     অনুভব করার অনুমতি দেওয়ার পরিবর্তে বন্ধ করে দিচ্ছি 
    সে সম্পর্কে আমাদের যা কিছু শিখতে হবে তা  নিজেদের দ্বিধা 
     পশ্চাদপসরণ ছাড়া, শব্দ, অপ্রত্যাশিত প্রাণী. আমরা বেঁচে থাকি 
    শব্দহীন নিঃশ্বাস ফেলি  সম্ভবত আমি সম্পূর্ণ একা নই  
    তারা সাথে সৎ হতে পারে  আমি তাদের  আপনার কথা বলব
     আপনি কি লিখেছেন, আপনি কিভাবে একাকী জীবন কাটালেন 
     কখনও বা উচ্চণ্ডপ্রতাপ সবসময় সাহসী; ব্যাসদেব যেভাবে 
    বিশ্বকে দেখেছেন, এর রঙ এবং টেক্সচার এবং শব্দ, আমি 
    অনুভব করেছি-- বাল্মীকি যেভাবে ভেবেছিলেন, আশা করেছিলেন, 
    অনুভব করেছিলেন, স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আমি অনুভব করেছি 
    আমি অনুভব করেছি যে আমি স্বপ্ন দেখছি এবং লালনের সাথে 
    ভাবছি এবং অনুভব করছি হাছনরাজা যে স্বপ্ন দেখেছেন তা  
    স্বপ্নে দেখেছি, চণ্ডিদাস যা চেয়েছিলেন তা আমি রামির গর্ভের
    লাল মশারিতে ঘুমিয়ে পেয়েছিলুম আর যত্ন করে রেখে দিয়েছি।  
     
     
    ছিয়াত্তর
     আমি বুঝতে পারি যে আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির 
    কোনো ভেদ নেই।সত্যিই কেরানিরা চটে যায় শুনে। বাদশা ?
    কোনও বন্দুক, কোনও তলোয়ার, কোনও সেনাবাহিনী একটি 
    বাক্যের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হতে পারে না। তরোয়াল কেটে ফেলতে 
    পারে এবং হত্যা করতে পারে,  শব্দগুলো খচাখচ ছুরি মারবে 
    থাকবে, আমাদের হাড়ের মধ্যে নিজেদের কবর দেবে । মৃতদেহ 
    হওয়ার জন্য যা আমরা ভবিষ্যতে বহন করব, সর্বদা খনন করে 
    শব্দ আর বাক্যের মাংস থেকে তাদের কঙ্কাল ছিঁড়ে ফেলতে ব্যর্থ 
    মানুষ মারা গেলে অদৃশ্য হয়ে যায় তাদের কণ্ঠস্বর, তাদের হাসি, 
    তাদের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা তাদের মাংস অবশেষে তাদের হাড়. 
    তাদের সমস্ত জীবন্ত স্মৃতি এক লপ্তে লোপাট। ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর  
    অথচ স্বাভাবিক । তবুও মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষেত্রে এই বিনাশের 
    ব্যতিক্রম আছে  কারণ সে যে বইগুলো লিখেছে তাতে মলয় 
    বিদ্যমান রয়েছে। আমরা তাকে মাঝে-মাঝে আবিষ্কার করি। 
    তার হাস্যরস, তার কণ্ঠস্বর, তার মেজাজ। লিখিত শব্দের 
    মাধ্যমে সে তাক লাগিয়ে আক্রমণ করে ছুরির খচাখচসহ। 
     
    সাতাত্তর
    আপনাকে সান্ত্বনা দিতে পারে যে সরকার সে আপনাকে বিভ্রান্ত 
    করবেই তারা আপনাকেই প্যাঁচপয়জার কষে পরিবর্তন করবে।
    হ্যালো, তারা মৃত. ধাপার মাঠের মাছির মতো, বরফের 
    মধ্যে জমে থাকা মৃতদেহের মতো, যা প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে 
    চলে যাওয়া উচিত, ভোটের কালির অলৌকিকতায়, সংরক্ষিত। 
    এটা এক ধরনের জাদু কেন আজকালকার স্বপ্নগুলো এত ছোট ?
    সবাই এমনভাবে বাঁচে যেন আজ তাইরে নাইরে করে মরে যাবে।
    মনে করুন যে আজকের বিশ্বের সমস্যাগুলির মধ্যে একটা হলো
    তারা কে তা নিজেরাই জানে না  প্রত্যেকে একটি পরিচয় খুঁজছে, 
    বা  ধার করার চেষ্টা করছে, শুধুমাত্র নিজেরা তা জানে না। 
    গোরু পাচারি সারদা নারদা লোকগুলো হোঁদোল কুৎকুৎ টাইপের
    বলে লোকে ভয় পায় অথচ গৃহবধূরা চটিপেটা করলে ভাবে
    হায়, এই যে, হ্যালো, মেরুদণ্ড নেই বলে কিছুই করতে পারিনি।
    হ্যাপি বাড্ডে আপু, লেট উইশ, আগেই হ্যাপি বাড্ডে বলে আসছি 
     তুমি ট্রিট  দিও, দিনে দিনে আরো সুন্দরী হও এই কামনা করি
     
    আটাত্তর
    জানালা দিয়ে দেখছি পৃথিবী ঝাপসা হতে চাইছে 
    আমি মনে করি  যে জগৎ একজন সাইকোপ্যাথ
    আমি মনে করি  আপনারা একজন অসুস্থ, দুমড়ে-মুচড়ে 
    যাওয়া দানব আমি মনে করি  যে আপনারা হৃদয়হীন 
    খুনি, এবং আমি মনে করি  যে আপনারা মরার যোগ্য,  
    আমি মনে করি আপনারা করুণা চান বা বোকা  কাপুরুষ
    আমি মনে করি যে লোকেরা আপনার সম্পর্কে যা বলেছে 
    তার মধ্যে আপনি সরীসৃপ শ্রেণীভুক্ত শীতল রক্তের মাংসাশী
     প্রাণী , খাদ্য হল পোকামাকড়, টিকটিকি ,ব্যাঙ,পাখি , 
    ছোট ও মাঝারি আকারের পুরুষ-বেশ্যা যাদের কোনো ধারণা 
    নেই যে ব্যক্তিগত সত্য ও পরিচয়ের অনুসন্ধান আসলে কী
     দেয় যে তারা সবকিছু জানে এবং যদি আপনি বারন করেন 
    তাহলে তাদের জীবন অনুকরণ করুন যাতে আপনি সঠিকভাবে 
    বসবাস করছেন কিনা হয়তো আপনার স্থান কেড়ে নিতে চায়
    তারা আসলে কোনো না কোনোভাবে আপনার মহাকাশে প্রবেশ 
    করতে চায়  অ্যালাউ করবেন কি না ডিসাইড করুন । 
     
    উনআশি
    করতে বা ধ্বংস করতে চায়...তারা বিশ্বাস করতে পারে না 
    যে আপনি কি জানেন করছেন এবং আপনি এতে খুশি এবং সন্তুষ্ট। 
    আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে সমস্যাটি সেখানেই। যদি তারা তা 
    দেখতে পায় তাহলে তাদের হুমকি বোধ করতে হবে না এবং 
    অনুভব করতে হবে যে আপনি তাদের ধ্বংস করার আগে তাদের 
    আপনাকে ধ্বংস করতে হবে। তারা কেবল তাদের পৈশাচিক 
    মাথার মাধ্যমে এটি পেতে পারে না যে আপনি যেখানে আছেন 
    সেখানে আপ ঠাণ্ডা মানুষদের ক্ষেত্রে এটাই হয় ভুল। এমন নয় যে 
    তাদের আত্মায় বরফ আছে - আমাদের সকলেরই কিছুটা আছে - 
    তবে তারা জোর দেয় যে প্রতিটি শব্দ এবং কাজ সেই বরফকে 
    আয়না করে। তারা কখনই অঙ্গভঙ্গির সৌন্দর্য বা মূল্য শেখে না। 
    মানসিক প্রয়োজনীয়তা। তাদের জন্য, এটি দয়ার আগে সততা, 
    শিল্পের আগে সত্য। প্রেম শিল্প, সত্য নয়। এটা দৃশ্যপট আঁকার মতো।” “
    কিছুই কখনো শুরু হয় না।একভাবে, এটা জেনে ভালো লাগলো যে 
    সেখানে হিন্দু দেব-দেবী আছে, কারণ কিছু ভুল হয়ে গেলে আপনার 
     
    আশি
    আসসালামুআলাইকুম । পসেইডন মিনোসের স্ত্রী পাসিফাইকে শাস্তি দিলে 
    পাসিফাই ষাঁড়কে ভালোবাসতে-বাসতে  ষাঁড়ের মাথাওয়ালা 
    বঙ্গসন্তানদের জন্ম দিয়ে দেশকে রসাতলে নিয়ে গিয়ে নাচতে থাকে 
    এইমাত্র দানব হাগড়ুস-পাদড়ুস কারাগারে গুঁতোগুঁতির দ্বারা আক্রান্ত  
    তাদের বজ্রপাতের দ্বারা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এবং অন্য সব কিছুর 
    উপরে বৃষ্টি হচ্ছে, বেশিরভাগ লোকেরা ভাবতে পারে যে এটি সত্যিই 
    দুর্ভাগ্য; আপনি যখন অর্ধ-ষাঁড় হবেন, তখন আপনি বুঝতে পারবেন 
    যে কিছু নেতার শক্তি সত্যিই আপনাকে এলোমেলো করছে
    কখনও কখনও মূর্খ হয়ে জন্মানোর পদ্ধতি  অনেক সহজে 
    বদলে যায়  বন্ধুরা চলে যায় জীবন অনেকের জন্য থেমে থাকে
    বলবেন হাসতে চেয়েছিলাম কিংবা খ্যাপাটে হয়ে মরলে অমর 
    সবাই কতো অদ্ভুত, বিশেষ করে আয়না দেখে কাঁধ নাচালো 
     ধারণাটি হল প্রত্যেক ব্যক্তিকে  নিজের জীবনকে ঘুষ মনে করা 
    উচিত যাতে তা অন্য লোকেদের সাথে ভাগ করে নেওয়া যায়।
     
    একাশি
    ভাবতে পারবেন না যে সেক্স ভালবাসা হিসাবে গণ্য হয়
    শুধু না বলতে পারবেন না আপনাকে কাজটা করতে হবে
    আমি যা করতে চাই তাই করতে যাচ্ছি আমি সত্যিই যা 
    আমি হতে যাচ্ছি আমি খুঁজে বের করতে যাচ্ছি যে সেক্স 
     চারপাশে বসে আশ্চর্য হয়ে দেখতে পারি এবং একে অপরের 
    সম্পর্কে খারাপ অনুভব করতে পারি এবং তারা যা 
    করছে বা করেনি বা তারা যা জানে না তার জন্য অনেক 
    লোককে দোষারোপ করতে পারে আমি জানি না আমি অনুমান 
    করি সবসময় দোষ দেওয়ার জন্য কেউ থাকতে পারে শুধু 
    হয়তো ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিভঙ্গিতে রাখা ভাল, কিন্তু কখনও 
    কখনও, আমি মনে করি যে একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি হল সেখানে 
    উপস্হিত থাকা সত্যিই তা অসীম অনুভব করার জন্য যথেষ্ট 
    আমি অসীমত্ব অনুভব করি সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা 
    ভাবতে পারবেন না যে সেক্স ভালবাসা হিসাবে গণ্য হয় ।
     
    বিরাশি
    সত্যং শিব সুন্দর ভাতি হৃদি মন্দিরে
    নিরখি নিরখি অনুদিন মোরা ডুবিব রূপসাগরে
    (সেদিন কবে হবে) (দীনজনের ভাগ্যে নাথ)
    জ্ঞান-অনন্তরূপে পশিবে নাম মম হৃদে,
    অবাক্‌ হইয়ে অধীর মন শরণ লইবে শ্রীপদে
    আনন্দ-অমৃতরূপে উদিবে হৃদয়-আকাশে,
    চন্দ্র উদিলে চকোর যেমন ক্রীড়য়ে মন হরষে,
    আমরাও নাথ, তেমনি করে মাতিব তব প্রকাশে
    শান্তং শিব অদ্বিতীয় রাজ-রাজ-চরণে,
    বিকাইব ওহে প্রাণসখা, সফল করিব জীবনে
    এমন অধিকার, কোথা পাব আর, স্বর্গভোগ জীবনে (সশরীরে)
    শুদ্ধমপাপবিদ্ধং রূপ, হেরিয়ে নাথ তোমার,
    আলোক দেখিলে আঁধার যেমন যায় পলাইয়ে সত্বর;
    তেমনি নাথ তোমার প্রকাশে পলাইবে পাপ-আঁধার
    ওহে ধ্রুবতারা-সম হৃদে জ্বলন্ত বিশ্বাস হে 
     
    তিরাশি
     সম্পর্ক শেষ করবে, এইভাবে পরিত্যাগকে পুনরায় 
    সক্রিয় করবে নাটকটি অনেক পুরুষের জন্য নিশ্চিত 
    করে যে তারা প্রেমে তাদের আস্থা রাখতে পারে না তারা 
    সিদ্ধান্ত নেয় যে শক্তিশালী হওয়ার  প্রভাবশালী হওয়ায় 
    তাদের বিশ্বাস রাখা বঙ্গসমাজে জরুরি এমন একটি ব্যবস্থা 
    যা মৌলিক মানবাধিকারের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, 
    ভয়টা দিনে-দিনে বাড়ে কারাবাসের, নির্যাতনের, জেরার, 
    মৃত্যুর ভয়, বন্ধু, পরিবার, সম্পত্তি, জীবিকা খোয়ানোর 
    ভয়, দারিদ্রের ভয়, বিচ্ছিন্নতার ভয়, ব্যর্থতার ভয়। ভয়ের 
    একটি সবচেয়ে ছলনাময় রূপ হল যা সাধারণ জ্ঞান বা এমনকি 
    প্রজ্ঞা হিসাবে ছদ্মবেশ ধরে, নির্বোধ, বেপরোয়া, তুচ্ছ বা 
    নিরর্থক হিসাবে নিন্দা করে, ছোট, প্রতিদিনের সাহসিক কাজ 
    যা মানুষের আত্মসম্মান আর অন্তর্নিহিত মানবিক মর্যাদা রক্ষা 
    করতে সহায়তা করে। এই নীতির লৌহ শাসনের অধীনে ভয়ে 
    আবদ্ধ জনগণের পক্ষে ভয়ের উদ্দীপক চটি ছুঁড়ে মারা 
     
    চুরাশি
    মুক্তি সহজ নয় তবু রাষ্ট্রযন্ত্রের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতার মধ্যেও 
    সাহস বারবার জেগে ওঠে, কারণ ভয় সভ্য মানুষের স্বাভাবিক 
    অবস্থা নয় প্রথম মুহূর্ত বলে কিছু হয় না কোন একক শব্দ  
    থেকে গূঢ় ইশারা আসে যার সূত্র সবসময় আগের ইশারায় 
    ফিরে পাওয়া যেতে পারে,  তার আগের ইশারাগুলো যদিও 
    যৌনসম্পর্কের সময়ে কণ্ঠস্বর হ্রাস পাওয়ার  সংযোগগুলো 
    আরও ক্ষীণ হয়ে উঠবে বলে মনে হবে, প্রতিটি বয়সের জন্য 
    শীৎকার এমনভাবে হওয়া উচিত যেন ইশারা তার নিজস্ব 
    সমস্ত পুরুষ স্বপ্ন কিন্তু ফিক্সড ডিপোজিট নয় তাদের মনের 
    ধূলিময় অবকাশের মধ্যে রাতে স্বপ্ন দেখে তারা দিনে জেগে 
    জীবনের অসারতা খুঁজে পায় দিনের স্বপ্নদ্রষ্টাদের বিপজ্জনক 
    ঘুমে তারা তাদের স্বপ্নগুলো খোলা চোখে দেখাতে পারে
    ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণু, ওঁ তদ্বিষ্ণো পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সুরয়ঃ
    দিবীব চক্ষুরাততম্‌ নমো অপবিত্রঃ পবিত্রোবা সর্ব্বাবস্থাং গতোহপি 
    বা যঃ স্মরেৎ পুন্ডরীকাক্ষং সঃবাহ্য অভ্যন্তরঃ শুচি
     
     
    পঁচাশি
    আমরা আভাঁগার্দ । কিন্তু তোমরা অধিকাংশ এক বেতনের চেক, 
    এক বিবাহবিচ্ছেদ, এক মাদকাসক্ত, এক শিশুপীড়নকারী 
    এক মানসিক অসুস্থ, এক যৌন নিপীড়ক, এক মোদোমাতাল 
    এক রাতে অরক্ষিত পায়ুভোক্তা, কিংবা মানুষ  হওয়া 
    থেকে দূরে এক সম্পর্ক—যাদের এক বিশ্বাসঘাতকতা 
     যাদের আমরা করুণা করি, যাদের সাথে কেউ 
    তাদের বাচ্চাদের খেলতে দেয় না, যাদের সাথে খারাপ ঘটনা
     ঘটে, যাদের  পাশে লোকে থাকতে চায় না অনুমান করে 
    এমনকি যদি লোকে যদি দুঃসংবাদ পায় এড়িয়ে কেটে পড়ে 
    লোকেরা ভাবে তোমাদের  জিজ্ঞাসা করার সাহস নেই কোনও
    কখনো পরোটা,আলুর দম, কখনো বা লুচি মাংস জোটে না
    যদিও ছাদে ফোটা বেলি ফুল এনে দেয় ফুলের ভালোবাসায়
     কাউকে সন্ধায় বাড়িতে ডেকে শুধু রেড ওয়াইন কে খাওয়ায় ভাই !
     
     
    ছিয়াশি
    জানতে চাই তুমি তোমার নিজের দুঃখের কেন্দ্রে ছুঁয়েছ কি না 
    জীবনের বিশ্বাসঘাতকতায় ধ্বসে গেছো নাকি আরও যন্ত্রণার ভয়ে 
    কুঁচকে গিয়ে সিঁটিয়ে গেছো ! আমি জানতে চাই তুমি কষ্ট সহ্য করে 
    কতোকাল কাটাও, নিজেকে আড়াল না করে বা কুচ্ছাতিকুচ্ছিত
     বিবর্ণ না করে, বা ঠিক কী কী করে বাঁচো ? তুমি আনন্দের 
    সাথে রফা করে চালাও ? তোমার নিজের খাঁটি দুর্গন্ধের বন্যতা 
    নিয়ে নাচতে পারো তাহলে পরমানন্দে তোমার দুহাতের ও পায়ের 
    আঙুলের ডগায় ভর দিতে পারো কেননা আমাদের সতর্কতা অবলম্বন 
    না করে, বাস্তববাদী হতে হবে দানব হওয়ার সীমাবদ্ধতা মনে
     রাখার জন্য। তুমি যদি লোকেদের উড়তে শেখাতে না পারো 
    দাঁড়কাকদের গান গাইতে শেখাও এমন গান গাইতে হবে যেন 
    বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই  জানোতো পাখির ছানা খুঁটে খেতে 
    শিখলে, আবার মার কাছে খেতে এলে, মা ঠোক্কর মারে ঠুক পালাঃ
     
     
    সাতাশি
    তব জনক পাই বশিষ্ঠ আয়সু বিয়াহ সাজ সম্বারি কৈ
    মাণ্ডবী, শ্রুতকীর্তি উরমিলা কুঅঁরি লই হংকারি কৈ
    যোগিনী মুক্তসঙ্গাশ্চ ভক্তিকামা মুমুক্ষবঃ।তামেব সমুপাসন্তে 
    দেবীং বিশ্বেশ্বরিং শিবাম্‌ ।যদ্ভক্তিলেশ – লেশাংস – লেশলেশ 
    – লবাংশকম্‌ ।লব্ধ্বা মুক্তো ভবেজ্জস্তুস্তাং ন সেবেত কো জন 
    ভুবনেশীত্যেব বক্তে দদাতি ভুবনত্রয়ম্‌ ।মাং পাহীত্যস্য
     বচসো দেয়াভাবাদৃশান্বিতা ।মনের চড়াই পাখিটির বাঁধন 
    খুলে দে ।শিকল খুলে মেঘের নীড়ে আজ উড়িয়ে দে ।
    যত বন্ধ হাজার দুয়ার ভেঙে আয়রে ছুটে আয় ।
    প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলল আলাপ, বিস্তার। মাঝে হালকা 
    বিলম্বিত গৎ, আওচার, জোড় সেরে ঝালায় উঠে 
    এলেন তিন শিল্পী। যেন স্টেজ জুড়ে শুরু হল ঝড়।
     সেতারে যখন গমক সহকারে হলকা ও সপাট তান 
    উঠে আসে, তখন তা কেমন অনুভূত হয় জানি না
     
    অষ্টআশি
    কিছুই মসৃণভাবে বেরিয়ে আসে না  আপনার মস্তিষ্কের 
    সাথে মিলিত হয় যেভাবে সাধারণ মানুষের কথা  তারা
     টুকরো  করে বেরিয়ে আসে যেন একটা গুঁড়ো বরফের লোলি 
    সরবরাহকারী  আপনার নীচের ঠোঁট জোড়া হিসাবে আপনি 
    তাদের হোঁচট সংগ্রহ করতেন তাই চুপ করে থাকা ভালো
    লকাপে স্বীকার করো তুমি জোচ্চোর নও।এমনকি কাছাকাছি
    নও তুমি মাঝে মাঝে নিজেকে তাদের একজনের মতো সাজাতে 
    পারো তাদের মতো একই মনহীন টেলিভিশন শো দেখতে পারো, 
    এমনকি কখনও কখনও একই ফাস্ট ফুডও খেতে পারো 
    মনে হচ্ছে তুমি যত বেশি মাপসই করার চেষ্টা করবে 
    তত বেশি তুমি বহিরাগতের মতো অনুভব করবে সাধারণ মানুষ
    যখন তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্তিত্ব নিয়ে তুমি পালিয়ে যাচ্ছো। 
    প্রতিবারই  পাসওয়ার্ড থাকে  "একটা সুন্দর দিন কাটুক" 
    কিংবা "আজ আবহাওয়া কি ভয়ঙ্কর” । তবু ভেতরে ঢোকার
    অনুমতি পাও না এমনই ইলেকট্রনিক দুঃখদুর্দশার ভোগান্তি ।
     
     
    উননব্বই
    নিষিদ্ধ গালাগালগুলো ছোটোবেলা থেকে বলছি অথচ নিষিদ্ধ !
    এমনকি লিফটে সেই মেয়েটিও নিষিদ্ধ গালাগাল দিচ্ছিল 
    মোবাইলে  কিন্তু  লিফটের সেই মেয়েটির ঠোঁটে থুতু আকর্ষক 
    আমাকে দেখে জোরে গালাগাল আরম্ভ করলে বললুম থ্যাঙ্কস
    কারোর সাথে কথোপকথনের সুযোগ নিয়ে আপনি কী শিখতে 
    পারেন কে জানে? প্রত্যেকেই ধাঁধার একটি টুকরো মগজে রাখে 
    নিছক কাকতালীয়ভাবে কেউ লিফ্টের জীবনে আসে না 
    মেয়েটির প্রবৃত্তিকে বিশ্বাস করি অপ্রত্যাশিত কাজ করি 
    কিন্তু খ্যাতি একটি অদ্ভুত জিনিস আমায় দেখে বলল 
    মরার পরে গৌরব অর্জন করবেন, অন্যরা বিবর্ণ হয়ে যাবে। 
    এই প্রজন্মে যা প্রশংসিত  তা অন্য প্রজন্মে ঘৃণা করবে, গারেন্টি। 
    মেয়েটি তার প্রশস্ত হাত এগিয়ে দিয়েছে কেননা আমি ওয়াকিঙ
    স্টিক নিয়ে বাজার যাই, তাছাড়া আঙুলে আরথারাইটিস
    স্মৃতির সর্বনাশ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে । কে জানে? সে হাসে। 
    হয়তো একদিন আমিও বিখ্যাত হব। আপনার চেয়ে বেশি ।
     
    নব্বই
    বিখ্যাত সব পুরুষ স্বপ্ন  কিন্তু একইরকম নয় যারা তাদের 
    মনের ধূলিময় অবকাশের মধ্যে রাতে স্বপ্ন দেখে তারা দিনে 
    জেগে তাতে অসারতা খুঁজে পায়, কিন্তু দিনের স্বপ্নদ্রষ্টারা 
    বিপজ্জনক মানুষ, কারণ তারা তাদের স্বপ্নগুলি খোলা চোখে 
    অভিনয় করতে পারে, তা সম্ভব করতে প্রত্যেক স্বপ্নদ্রষ্টা 
    জানে যে আপনি যে জায়গায় কখনও যাননি সেখানে হোমসিক 
    হওয়া  সম্ভব, সম্ভবত পরিচিত জায়গার চেয়ে বেশি
     হোমসিক হতাশাবাদী এমন একজন ব্যক্তির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ
    ভয় এবং দুঃখের সাথে লক্ষ্য করে যে তার দেয়ালে টাঙানো 
    ক্যালেন্ডার, যেখান থেকে সে প্রতি মাসে একটা পাতা ছিঁড়ে, 
    মাস চলে যাওয়ার সাথে ক্যালেণ্ডার রোগা হয়ে যায়। অন্যদিকে, 
    যে ব্যক্তি জীবনের সমস্যাগুলো সক্রিয়ভাবে আক্রমণ করে সে 
    একজন লড়াকুর মতো  তার ক্যালেন্ডার থেকে  ধারাবাহিক 
    দিনগুলো মুছে ফেলে আর আমার কাছে এসে আশীর্বাদ চায় ।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 106.215.24.94 | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১১:৪০738360
  • ঝুরোগল্প ( JHUROGALPO  ) কাকে বলে
    মলয় রায়চৌধুরী
    .
    প্রথমেই বলে নেয়া দরকার যে ‘ঝুরোগল্প’ নামের কনসেপ্ট এবং উৎপত্তি সম্পূর্ণরূপে বাঙালির । এর সঙ্গে ইউরোপ বা আমেরিকার গল্প-রচনার কোনও অবদান নেই । ঝুরোগল্প রচনার আঙ্গিক, কাঠামো ও ভাবনা ‘কালিমাটি’ পত্রিকার সম্পাদক গল্পকার-ঔপন্যাসিক কাজল সেন এবং অধুনান্তিক ভাবুক, কবি ও গল্পকার সমীর রায়চৌধুরীর।  
    গল্প এবং উপন্যাসের যে সংজ্ঞা ইউরোপ থেকে ঔপনিবেশিক আমলে আনা হয়েছিল, যাকে মানদণ্ডের মান্যতা দিয়ে বিভিন্ন পাঠবস্তু গড়া আরম্ভ হয়েছিল, উত্তর-ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে, তা থেকে এখনকার মেইনস্ট্রিম বাঙালি লেখকরা কিঞ্চিদধিক সরে গেলেও, মনে হয় তাঁদের মধ্যে একটি এখনও উদ্বেগ কাজ করে । উদ্বেগটি হল বিদ্যায়তনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অস্বীকৃতির। অবশ্য লিটল ম্যাগাজিনের গল্প ও উপন্যাস লেখকরা, যেহেতু অমন সমালোচকদের স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করেন না, আর তা আদায়ের প্রয়াস করেন না, তাঁরা ইউরোপের সংজ্ঞাকে পেছনে ফেলে নিজেদের মতন করে লেখার পৃথক-পৃথক ধারা তৈরি করে নিতে পেরেছেন এবং তাতে ‘হাংরি’, ‘শাস্ত্রবিরোধী’, ‘নিমসাহিত্য’ ইত্যাদি আন্দোলনের  গল্পকার-ঔপন্যাসিকদের অবদান হেলাফেলার নয় । যে ধরনের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর কারণে ইউরোপে গল্প আর উপন্যাস লেখা আরম্ভ হয়েছিল, এবং ক্রমশ তার মানদণ্ড ও মূল্যবোধ গড়ে উঠেছিল, অমন উৎসসূত্র আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। যাই হোক,  বিদ্যায়তনিক আলোচকদের বইগুলো থেকে জানতে পারি কোনগুলোকে তাঁরা প্রকৃত ছোটোগল্পের আর উপন্যাসের তকমা দিচ্ছেন এবং কেন । একটা ব্যাপারে কিন্তু ‘ভারতীয়তা’ ছিল ; প্রায় দেড়শোর বেশি গল্পকার বা ন্যারেটিভ-লেখক প্রথম দিকে, বঙ্কিমচন্দ্রের সময়ের পরেও, পাঠবস্তুর ওপর নিজের নাম লেখেননি । অর্থাৎ সেই সময়ে লেখকের চেয়ে পাঠবস্তু ছিল গুরুত্বপূর্ণ । ছোটগল্প  একটি বিশেষ রূপবন্ধ যা দৈর্ঘ্যে হ্রস্ব, এবং একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। ছোটগল্পের আকার কী হবে সে সম্পর্কে কোন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেই। সব ছোটগল্পই গল্প, কিন্তু সব গল্পই ছোটগল্প নয়। একটি কাহিনী বা গল্পকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কিছু নান্দনিক ও শিল্পশর্ত পূরণ করতে হয়। ছোটগল্পের সংজ্ঞার্থ কী তা নিয়ে নানা সাহিত্যিক-মুনীর নানা মত । বিদ্যায়তনিক মানদণ্ডে বলা যায়— যা আকারে ছোট, প্রকারে গল্প তাকে ছোটগল্প বলা হয় ।
    .
    ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের দরুণ যে প্যারাডাইম বদল থেকে আলোকপ্রাপ্তির কালখন্ড আরম্ভ হয়েছিল, তার প্রভাবে চাষবাসের জগত থেকে মানুষ ক্রমশ প্রবেশ করছিল যন্ত্রপাতির জগতে এবং সৃষ্টি হচ্ছিল ব্যক্তি-এককের প্রতিস্ব । ক্ষমতা চলে যাচ্ছিল জমির মালিকদের থেকে শিল্পমালিক পুঁজিপতিদের হাতে আর তৈরি হচ্ছিল বিশাল এক শহুরে শ্রমিকদল । অলস গ্রাম্য জীবন থেকে ব্যক্তি-একক স্হানান্তরিত হচ্ছিল শিল্পোদ্যোগের দ্রুতিময় একঘেয়ে জীবনযাত্রায় এবং অভাবনীয় রদবদল ঘটে যাচ্ছিল ব্যক্তি-প্রতিস্বে । এই নতুন মানুষটার ভঙ্গুর ও জটিল যাপনঘটনাই ছোটোগল্পের প্রাণকেন্দ্র হয়ে দেখা দিয়েছিল । পক্ষান্তরে, প্রথাবাহিত উপন্যাসের বিকাশ ও বিলয় ইউরোপে ঘটেছিল সাম্রাজ্যবাদের উথ্থান-পতনের সঙ্গে । উপন্যাস ইউরোপের ‘সেকাল’-এর  ফসল, যখন কিনা ছোটোগল্প ইউরোপীয় আধুনিকতার ফসল । খ্রিস্টান মিশনারিদের হাত ধরে দুটি জনারই একসঙ্গে পৌঁছেছিল নতুন বাংলা ভাষাসাহিত্যে । কর্নওয়ালিসের দৌলতে বাঙালি মধ্যবিত্ত-সমাজও গড়ে উঠেছিল, যারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ছিল সাহেবকর্তাদের ঔপনিবেশিক সহায়ক হিসাবে । তাদের খোরাকের প্রয়োজন দেখা দিতে, এবং ম্যাকলের শিক্ষাকাঠামোয় গড়েপিটে তৈরি বাঙালি  ব্যক্তি-এককদের জন্য ফিকশন প্রকাশিত হওয়া আরম্ভ হল ‘দিগদর্শন’, ‘সমাচার দর্পণ’ ‘সংবাদ প্রভাকর’, বঙ্গদর্শন, ভারতী, সাধনা, হিতবাদী, নবজীবন, সাহিত্য ইত্যাদি পত্রিকা । 
    নিজের বাড়িতে ছাপার মেশিন স্হাপন করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ।  তখনও ছোটোগল্পের সংজ্ঞা বাঙলায় নির্ধারিত হয়নি । বঙ্কিমচন্দ্রের আঠারো পাতার ‘ইন্দিরা’, পনেরো পাতার ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, ওনার দাদা পূর্ণচন্দ্রের পনেরো পাতার ‘মধুমতী’ ফিকশনগুলোকে বলা হয়েছিল উপন্যাস । আশি বছর পরে বিদ্যায়তনিক আলোচকরা বললেন যে প্রথম দুটি ছোটোগল্প বা উপন্যাস কোনোটাই নয়, কিন্তু পূর্ণচন্দ্রেরটি ছোটোগল্প । ইউরোপীয় মানদণ্ড অনুযায়ী ছোটোগল্পের তকমা পেলো ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় ১৮৯১ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার’।  রবীন্দ্রনাথের মত অনুযায়ী ছোট গল্পের সমাপ্তি হবে এমন, যেখানে মন তৃপ্তি পাবে না। বাংলা ছোটগল্প ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁর ‘সোনারতরী’ কাব্যের  ‘বর্ষাযাপন’ কবিতাটি তুলে ধরা হয় : 
    .
    ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা
    নিতান্ত সহজ সরল,
    সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
    তারি দু-চারটি অশ্রু জল।
    নাহি বর্ণনার ছটা,ঘটনার ঘনঘটা,
    নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
    অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
    শেষ হয়ে হইল না শেষ।
    জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
    অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
    অকালের জীবনগুলো, অখ্যাত কীর্তির ধুলা,
    কত ভাব, কত ভয় ভুল
    .
    ছোট গল্প শেষ হবার পর পরবর্তী ঘটনা জানার আগ্রহে পাঠকের মন ভরে থাকবে। ছোটগল্পের বিষয়বস্তুর মধ্যে সংযমবোধ থাকবে।নাটকীয়তা সংঘাত ব্যঞ্জনাধর্মীতা ছোটগল্পের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ছোটগল্পের মধ্যে ঘটনার একটি শীর্ষ মুহূর্ত বা ক্লাইম্যাক্স থাকবে, যেখানে গল্পের বিষয়বস্তু বাঁক নিয়ে অনন্য হয়ে উঠতে পারে। এই হুইপক্রাক এনডিঙ বা বদ্ধসমাপ্তি ছোটোগল্পে জরুরি । এডগার অ্যালান পো-এর মতে, যে গল্প আধ থেকে এক বা দু’ঘণ্টার মধ্যে এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়, তাকে ছোট গল্প বলে। কিন্তু এইচ জি ওয়েলস বলেছেন, ছোটগল্প সাধারণত ১০ হতে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়।  ছোটগল্পে জীবনের সামগ্রিক দিকগুলো উপন্যাসের মতো বিস্তারিতভাবে বলা হয় না বরং এর টুকরোটুকু তুলে ধরা  হয়। এজন্য ছোটগল্প যথাসম্ভব বাহুল্যবর্জিত, রসঘন ও নিবিড় হয় । সংগত কারণেই এতে পাত্রপাত্রী বা চরিত্রের সংখ্যা খুবই সীমিত হয়। 
    .
    ছোটো গল্পে প্রথম বাঁকবদল আনতে চেয়েছিলেন শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনকারীরা । ১৯৬৬ সালের মার্চে প্রকাশিত ‘এই দশক পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে’ ‘শাস্ত্রবিরোধী ছোটোগল্প’তে যে যৌথ ( সুব্রত সেনগুপ্ত, রমানাথ রায়, শেখর বসু, কল্যাণ সেন ও আশীস ঘোষ ) বক্তব্য রাখা হয়েছিল, তা এরকম : “সময় হয়েছে যা কিছু পুরোনো তাকে বর্জন করবার, সময় হয়েছে যাকিছু নতুন তার জন্য প্রস্তুত হবার । আলমারি থেকে সব বই নামিয়ে ফেল। আমাদের জন্যে এবার একে-একে তাকগুলো খালি করে দাও। তথাকথিত মহৎ উপন্যাস এবং গল্পগুলোকে ট্রাঙ্কে তাড়াতাড়ি পুরে ফেল । ওগুলো আর দরকার নেই । ওগুলো এখন আবেদনহীন এবং বিরক্তিকর । মনে রেখো আর্তোর সেই বিখ্যাত উক্তি : Masterpieces of the past, they are not good for us. ছোট গল্প আজ থেকে সমস্ত শর্তের বিরুদ্ধে । সমালোচকের সমস্ত সংজ্ঞার বেড়া ভেঙে সে বেরিয়ে এসেছে । ছোট গল্প এখন কবিতার মতই স্বাধীন এবং মুক্ত । আমরা যা লিখব, যেমন করে লিখব, তাই ছোট গল্প। শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা বাউল । আমরা শিল্পের শাস্ত্রবিধি মানি না । আমাদের কোন সামাজিক দায় নেই। বাউলের মতো আমরাও বলি, ‘মরলেই সব দায় ঘুচে যায় । তোমাদের দৃষ্টিতে আমাদের মৃত মনে করো ।’ আমরা মরমী । অন্তরাত্মার জটিল অনুভবই আমাদের গল্পের বিষয় ।” লক্ষ্যয়ীয় যে শাস্ত্রবিরোধীরা স্বীকার করেছিলেন যে তাঁদের গল্পে ‘বিষয়’ থাকবে ।
    .
    ‘এই দশক’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন ১) গল্পে আমরা আমাদের কথাই বলব । ২ ) আমরা এখন বাস্তবতায় ক্লান্ত । ৩ ) অতীতের মহৎ সৃষ্টি অতীতের কাছে মহৎ আমাদের কাছে নয় । ৪ ) গল্পে যারা এখন কাহিনী খুঁজবে তাদের গুলি করা হবে । এই আন্দোলনে পরে যোগ দিয়েছিলেন অমল চন্দ, সমীর মিত্র, অশোককুমার দাস, বলরাম বসাক, মনোমোহন বিশ্বাস, সমর মিত্র, কুমারেশ নিয়োগী, প্রিয়ব্রত বসাক, দেবশ্রী দাস, তপনলাল ধর, সুকুমার ঘোষ, সুনীল জানা, রথীন ভৌমিক, অতীন্দ্রিয় পাঠক প্রমুখ । বলরাম বসাক অবশ্য এই আন্দোলনের সঙ্গে সংস্পর্শ অস্বীকার করলেও তাঁর গল্পের ধারা পালটায়নি । পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় প্রত্যেকেই শাস্ত্রবিরোধী ছোটগল্প বলতে কী বোঝায় তা ব্যাখ্যা করেছেন । কিন্তু তাঁরা গল্পের বদ্ধ সূচনা ও বদ্ধ সমাপ্তি অমান্য করেননি । বরং হাংরি আন্দোলনের গদ্য লেখক সুভাষ ঘোষ তাঁর ছোট ন্যারেটিভগুলোতে সমাপ্তির মুক্তি ঘটাতে পেরেছিলেন । 
    .
    ঝুরোগল্প নামের আঙ্গিকটির উদ্ভাবকদের অন্যতম কাজল সেন লিখেছেন, “আমি জীবনে আশ্চর্য দুটি মানুষের স্নেহ ও সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, যাঁরা আমার সাহিত্য ভাবনাকে সম্পূর্ণ নতুন খাতে বা ধারায় বইয়ে দিয়েছিলেন। এঁরা আজ দুজনেই প্রয়াত – স্বদেশ সেন ও সমীর রায়চৌধুরী। এই দুই স্মরণীয় সাহিত্যব্যক্তিত্বের আশীর্বাদ আমার মাথায় আছে বলেই আমি আমার সাধ্যমতো নতুন কিছু করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। একদিন স্বদেশদা কথায় কথায় আমাকে বলেছিলেন, দেখো কাজল, প্রচলিত ধারায় তুমি কেমন লিখছ বা কতটা ভালো লিখছ, তা কিন্তু বিচার্য নয়, বরং তুমি নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারছ কিনা সেটাই আসল ব্যাপার। স্বদেশদা আমাকে কথাটা বলেছিলেন কবিতা লেখার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু তাঁর এই কথাটাই আমার সাহিত্য জীবনে ‘অমোঘ বাণী’র মতোই আমাকে আলোড়িত করে চলেছে। আর হয়তো ঠিক এখান থেকেই আমার ‘ঝুরো’ ভাবনাটা মাথার মধ্যে পাক খেতে লাগল। আমি সমীরদার সঙ্গে আমার যাবতীয় চিন্তা ভাবনা শেয়ার করলাম। সমীরদা আমাকে উৎসাহিত করলেন এবং এই নতুন আঙ্গিক ও ভাবনার তিনিই নামকরণ করলেন ‘ঝুরোগল্প’। এখন তো ঝুরোগল্প বাংলা সাহিত্যে একটা স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে। অনেকেই ঝুরোগল্প লিখছেন। ঝুরোগল্পের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তবে ঝুরোগল্পের প্রাসঙ্গিকতায় আমি যে ‘ঝুরোকবিতা’ লেখা শুরু করেছি, তা এখনও পর্যন্ত আর কেউ লেখেননি। সমীরাদার লেখার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।”
    .
    কাজল সেন আরও বলেছেন, “ঝুরোগল্প ও অণুগল্প এক নয়। অণুগল্প মূলত ছোটগল্পের বনসাই। এবং ছোটগল্প ও অণুগল্পে গল্পের পরিণতি থাকে বা পরিণতির ইঙ্গিত থাকে। কিন্তু ঝুরোগল্প ওপেন এন্ডেড গল্প, কখনই ক্লোজ এন্ডেড গল্প নয়। তাই ঝুরোগল্প শুরু হয় কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই এবং শেষ হয় কোনো পরিণতি ছাড়াই। এই দৃষ্টিকোণে ঝুরোগল্পকে বলা যেতে পারে অসমাপ্ত গল্প বা অসম্পূর্ণ গল্প। আর ঝুরোগল্প সীমাবদ্ধ থাকে সর্বাধিক চারশো শব্দের মধ্যে।”
    .
    ইউরোপে সীমিত শব্দের ছোটোগল্প লেখা আরম্ভ হয়েছে বেশ কিছুকাল আগে, যাদের নাম দেয়া হয়েছে ‘ফ্ল্যাশ ফিকশান’, যেমন দুশো আশি শব্দের ‘টুইটারেচার’, পঞ্চাশ শব্দের ‘ড্রিবল’ বা ‘মিনিসাগা’ কিংবা একশো শব্দের ‘ড্রাবল’ বা ‘মাইক্রোফিকশান’, সাতশো পঞ্চাশ শব্দের ‘সাডন ফিকশান’ ইত্যাদি । আদি ‘ফ্ল্যাশ ফিকশান’ ছিল এক হাজার শব্দের এবং তা একটি বৃহত্তর গল্পের প্রতি ইঙ্গিত করতো বা বোঝানোর ক্ষমতা রাখতো বলে তাকে মনে করা হতো যে তা একটি অনন্য সাহিত্যিক গুণের অধিকারী । তুর্কির মোল্লা নাসেরুদ্দিন খুব সংক্ষেপে গল্প বলতেন। জেন ধর্মীদের ‘কোয়ান’  ছিল সীমিত শব্দের কাহিনি । আমেরিকায় সীমিত শব্দের গল্প লেখা আরম্ভ করেছিলেন ওয়াল্ট হুইটম্যান, আমব্রোজ বিয়ার্স এবং কেট শোপাঁ । ১৯২০ সালে আমেরিকায় কসমোপলিটান পত্রিকা সীমিত শব্দের গল্পকে সংজ্ঞায়িত করেছিল “ছোট ছোট গল্প” হিসাবে এবং তেমন রচনাবলীর একটি সংকলন ‘আমেরিকান শর্ট শর্ট স্টোরি’ নামে ১৯৩০ সালে প্রকাশ করেছিল । সমারসেট মম এই ধরণের আঙ্গিকের প্রচলন ঘটাতে ১৯৩৬ সালে প্রকাশ করেন ‘ভেরি শর্ট স্টোরিজ’ । তার আগে আর্নস্ট হেমিংওয়ে বাজি রেখে ‘ফ্ল্যাশ ফিকশান’ লিখেছিলেন । সীমিত শব্দের ছোটোগল্প বা ফ্ল্যাশ ফিকশান লিখেছেন বোলেসলো প্রুস, আনতন চেকভ, ও হেনরি, ফ্রানৎস কাফকা, এইচ পি লাভক্র্যাফ্ট, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, হুলিও কোরটফাজার, দানীল খার্মস, আর্থার সি ক্লার্ক, রিচার্ড ব্রটিগান, রে ব্র্যাডবেরি, কুর্ট ভনেগাট জুনিয়ার, ফ্রেডরিক ব্রাউন, জন কেজ, ফিলিপ কে ডিক, রবার্ট শেকলে, ইতালো ক্যালভিনো, লিডিয়া ডেভিস, বারবারা হেনিঙ, নাগুইব মাহফুজ প্রমুখ । শব্দ সংখ্যা সীমিত হলেও তাঁরা ছোটোগল্পের বিদ্যায়তনিক সংজ্ঞাকে অস্বীকার করেননি । অনুগল্পের  শব্দসীমাকে চীনা সাহিত্যে বেঁধে দেয়া হয়েছে ‘স্মোক লং’ ফিকশন বলে। অর্থাৎ একটি সিগারেট শেষ করতে যে সময় লাগবে তার ভেতর এ গল্প শেষ হয়ে যাবে। এটিকে  পোস্টকার্ড ফিকশন, ন্যানো ফিকশন,  সুপার শর্ট ফিকশনও বলা হয়। 
    .
    ‘মিনিসাগা’ আরম্ভ করেছিলেন ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার ব্রায়ান অ্যালডিস, দীর্ঘ ঘটনা সম্বলিত কাহিনিকে পঞ্চাশ শব্দে উপস্হাপনের উদ্দেশে, যাতে সংবাদপত্র পাঠকেরা ঘটনার কথা জানতে পারে । এটা মূলত সংবাদ, ছোটগল্প নয় । বিবিসি রেডিও ফোর একসময়ে মিনিসাগা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, শিক্ষানবীশরা যাতে সংক্ষেপে সংবাদ পরিবেশন করতে শেখে ।
    .
    অশোক তাঁতী একটি নিবন্ধে জানিয়েছেন যে পশ্চিমবাংলায় অনুগল্প লেখা আরম্ভ হয়েছিল সত্তর দশকে, অমিয় চট্টোপাধ্যায় ও আশিসতরু মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পত্রাণু’ পত্রিকার মাধ্যমে ।  পরে মানব পালের সম্পাদনায় মুহূর্ত ( ১৯৭০ ), প্রদীপ ভট্টাচার্য, জগদীশ বসাক, কুমারেশ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘মিনি পত্রিকা ( ১৯৭০ ), তারাপদ দে ও বিবেকজ্যোতি মৈত্রের সম্পাদনায় ‘মাটি ( ১৯৭০ ), নির্ঝর চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘নক্ষত্র’ ( ১৯৭১ ) ইত্যাদি পত্রিকা অনুগল্পের একটা ঢেউ সৃষ্টি করেন । ‘বাংলা সাহিত্যের নানারূপ’ বইতে শুদ্ধসত্ব বসু  অনুগল্পকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস করেছিলেন এইভাবে, “অতিশয় স্বল্প পরিসরে যথার্থ ছোটোগল্পকে অণুগল্প বলা হয়।” অণুগল্প পত্রিকার সম্পাদকরা চাইতেন পঞ্চাশ থেকে চারশো শব্দের মধ্যে সীমিত হবে অনুগল্প। চিন্ময় বিশ্বাস ‘মিনিট তিনেক গল্প’ সংকলনের ভূমিকায় অমিয় চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “আমাদের জীবনে এমন অনেক চকিত ঘটনা হঠাৎই উদ্দিপিত হয়ে আমাদের চেতনায় গভীরভাবে নাড়া দেয়, যেগুলো প্রকাশের জন্য পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা দরকার হয় না । বনফুল ১৯৭৬ সালে প্রকাশ করেন তাঁর ছোটমাপের গল্পের সংকলন ‘নূতন গল্প’ । তাঁর দৃষ্টিতে ছোটোগল্প ও অনুগল্পের গঠনশৈলী আলাদা ছিল না । তিনি বিশ্বাস করতেন যে গল্পের শেষে একটা মোচড় থাকবে। অর্থাৎ ছোটগল্পের প্রধান শর্তটিকেই তিনি মান্যতা দিয়েছিলেন, পরিসর কম হলেও । 
    তার মানে ইউরোপ-আমেরিকায় যাকে ফ্ল্যাশ ফিকশান বলা হয়েছে, বাংলায় তাকেই আমরা বলছি অনুগল্প। ব্রিটেনের সাহিত্যজগতে ‘ন্যাশনাল ফ্লাশফিকশন ডে’ উদযাপিত হয়ে আসছে। নিউজিল্যান্ডেও অনুরূপভাবে জাতীয় অনুগল্প দিবস পালিত হয়। উল্লেখ্য যে, অনুগল্প সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে আমেরিকায়। সেখানে অনুগল্প এখন ছোটগল্প থেকে কিছুটা সরে এসে সাহিত্যের স্বতন্ত্র বিভাগ (genre) হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু হয়েছে।অনুগল্প লিখে ‘ম্যান অব বুকার’ পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন লেখক লিডিয়া ডেভিস । ডেভিসের গল্পের দৈর্ঘ্য এক লাইন থেকে শুরু করে দু-তিন পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তাঁর গল্পকে আদর্শ অনুগল্প বা ফ্লাশ ফিকশন বলা হয়। ছোটগল্পের পাশাপাশি অনুগল্প লিখে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন আরেক মার্কিন কথাসাহিত্যিক রবার্ট ওলেন বার্টলার। শার্ল বোদলেয়ার তাঁর ‘বিষণ্ণ প্যারিস’ বইতে যে ছোট-ছোট গদ্য-কবিতা লিখেছেন যেগুলোকে অনুগল্প হিসেবে চিহ্নিত করা চলে কিন্তু তিনিও কবিতা-বিশেষের শেষে রেখেছেন হুইপ-ক্রাক এনডিঙ বা বিদ্যুচ্চমক । তুলনামূলকভাবে র‌্যাঁবোর ‘ইল্যুমিনেশানস’-এর ন্যারেটিভগুলোতে সমাপ্তির মুক্তি পাওয়া যায় । ছোট গল্পের এই বিদ্যুচ্চমকই বদ্ধ সমাপ্তি যা ঝুরোগল্পে থাকে না । একইভাবে ঝুরোগল্পের সূচনাও মুক্ত এবং সংক্ষিপ্ত ন্যারেটিভটিতে দেখা মেলে ভঙ্গুর আত্মপরিচয়ের, বহুস্বরের, অনির্ণেয়তার । অর্থাৎ ঝুরোগল্পকে চিহ্ণিত করার জন্য মুক্ত সূচনা ও মুক্ত সমাপ্তি জরুরি ।
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 182.68.89.207 | ০৩ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৫৫738533
  • অর্ঘ্য দত্ত বক্সীর গদ্য বুঝে ওঠার চেষ্টা
    মলয় রায়চৌধুরী
              পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছেন অর্ঘ্য, দাঁড়ান গুনে বলছি কতোগুলো গদ্য আছে বইটায়, হ্যাঁ, সাতটা, তবে মাসখানেকের বেশি নানা সময়ে পড়েছি বলে জানি না, একআধটা হারিয়ে ফেললুম কি না । 
              পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে প্রথম যে ভাবনাটা মাথায় এলো, তাহলো এই যে কতো বছর বয়সে লেখকীয় ইপিফ্যানিতে আক্রান্ত হয়েছেন অর্ঘ্য দত্ত বক্সী ?
              কোনো কিছু পড়ায় আমার বদভ্যাস হল যে অবান্তর চিন্তায় হারিয়ে যাই, ফলে আবার ফিরে আসতে হয় যেখান থেকে শুরু করেছিলুম সেখানে ; এই করে অর্ঘ্যর গদ্যগুলো পড়ে উঠতে বেশ সময় লেগে গেল । সাতাত্তর বছর বয়সে ডাইগ্রেশন স্বাভাবিক, নয়কি ?
             এই বয়সে সাহিত্য আলোচনা করতে আমি বড়োই অনাগ্রহী ।
              লরেন্স স্টার্ন অবশ্য বলে গেছেন যে ‘পড়তে বসে হারিয়ে যাওয়া হলো সূর্যের আলো, জীবন, বই পড়ার আত্মা’। সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে যে গদ্যটা পড়ছিলুম, দুপুরে অন্য একটা গদ্যে আটকে যাই ; পরের দিন আবার আরেকটা অন্য গদ্য।
              পাণ্ডুলিপি পড়ে বইয়ের সামনে দিকে দুচারপাতা লিখতে বলেছেন অর্ঘ্য আর ওনার বন্ধু মৃগাঙ্কশেখর । 
              প্রস্তাবটা পেয়ে ভাবছিলুম যে আমার মতন একজন কমব্যাট্যান্টকে কেন ! আমাকে যা ক্রুদ্ধ করে, প্যাশনেট করে তোলে, অসংযত করে তোলে, বিরক্ত করে, মানুষের যা অপছন্দ করি, তা কি অর্ঘ্য দত্ত বক্সীর ক্ষেত্রেও একই ? তিনিও কি আমার মতন সমাজের হাতে বিধ্বস্তদের পক্ষে ভাবতে বসে ডিসটার্বড ? মানে খুঁজে বেড়ান যা কিছু অতর্কিত, তাইতে ? পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতন অর্থহীন শব্দবন্ধের বদলে ইনোভেটিভ শব্দটা ব্যবহার করতে চান ?
              প্রথম পাঠে মনে হলো, অর্ঘ্য সম্ভবত স্বীকার করেন যে লেখকীয় কাজ যদি সত্য হতে হয়, তাহলে তাকে মানব-মনের গভীর, অন্ধকার, অসুস্হ, হেজে-যাওয়া, বিরক্তিকর  কোনগুলোতে জোর-জবরদস্তি ঢুকে পড়তে হবে, কেবল ইনোভেশান দিয়ে সামলানো যাবে না। তারপর তো পাঠকের দায়িত্ব সেই কাজে  অজস্র রাস্তা খুঁজে পাওয়া ।
              কিন্তু আমি অনেক বইকে কেবল ফিকশান বলে মনে করি, যেমন সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের বই, এতো ভালো উপন্যাস কম লেখকই লিখেছেন । আমি রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি সবই ফিকশান বলে মনে করি, ইতিহাস বলে মনে করি না ; যেমন মঙ্গলকাব্যের কাহিনিগুলো । তাই কোন চরিত্র কেন অমন আচরণ করলো, তার দায়-দায়িত্ব পাঠকের বলে মনে করি, লেখকের নয় । 
              পুতুল নাচের ইতিকথায় শশির এরেকটাইল ডিসফাংশান ছিল কিনা তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে যাননি, তার কারণ ওটা একটা ফিকশান । যে যেমন চায় ব্যাখ্যা করবে ।
              একটি সাহিত্যকর্মকে তার নিজের গুণে দাঁড়াতে হয়, যেমন রামায়ণ মহাভারত দাঁড়িয়ে আছে , কৃতিত্বটা বাল্মীকির ও ব্যাসদেব নামের লেখকদের । বাবরি মসজিদ ভাঙার আগে আমি ভেতরে ঢুকে দেখে এসেছি, অযোধ্যায় বহুবার গেছি চাকুরিসূত্রে । আমার কখনও বিশ্বাস হয়নি যে রামায়ণ কাহিনির রামের ওটা জন্মস্হান আর জন্মশহর । কুরুক্ষেত্র আর হস্তিনাপুর গেছি । সবই গল্প । বরং কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে-থাকা মহেঞ্জোদারোর কিশোরীটি আসল, এখনও কিশোরীরা অমন ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে ।
              রামায়ণ মহাভারত সম্পর্কে অর্ঘ্যর আগ্রহ এবং মহাকাব্যগুলির চরিত্রদের নিয়ে তিনি খেলেছেন নিজের মতন করে, সেঁদিয়ে গেছেন ভেতরে ভেতরে । 
               আমি ভাবি যে রামায়ণ-এর গল্পটা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল, আশেপাশে কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ল, আর ছড়িয়ে পড়ার সময়ে মূল রামায়ণ থেকে সরে গিয়ে যে-যার নিজের মতো করে গল্পটা তৈরি করে ফেলল, চরিত্রদের ওলোট-পালোট করে ফেলল । এই একই ব্যাপার মহাভারতের ক্ষেত্রে ঘটেনি কেন ? ব্যাসদেবরা মহাভারতে যেমন যে-যার নিজেদের লেখা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন, তা কেন সম্ভব হয়নি রামায়ণের বেলায় ? শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাধাকেই বা কারা জুড়ে দিয়েছিল, মহাভারতে তো নেই ! 
              বাঙালিদের বাড়িতেও দেখি গোপাল, নাড়ুগোপাল, দোলগোবিন্দ, রাধাগোবিন্দ, রাধাকেষ্ট ইত্যাদি । তা বাঙালিরা রাধাকে কবে আর কোথা থেকে পেলো ? বঙ্গদেশে আমদানি-করা উত্তরভারতীয় ব্রাহ্মণরা এনেছিল কি নিজেদের পুঁটলিতে বেঁধে ? ব্রাহ্মণরা বঙ্গদেশে আসার আগে এখানকার দেবী-দেবতা এবং মিথগুলো কেন হারিয়ে গেল ! বৌদ্ধধর্মের দেবী-দেবতারাই বা চিরকালের জন্য কেন লোপাট হয়ে গেল !
              ন্যারেটিভে সোমরস প্রসঙ্গ এলে বেশ হতো, কেননা ওটা যে ঠিক কী জিনিস আমি আজও জেনে উঠতে পারিনি ।
              সরি, আবার ডাইগ্রেশন ঘটিয়ে ফেলছি ।
              সে যাক, পুতুল নাচের ইতিকথা নিজের গুণে দাঁড়িয়ে আছে ।
              একজন লেখক স্রেফ তার সৃজনকর্মের গাদ । রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ লেখকদের মতন তাঁদের আড়ালে চলে যাওয়া উচিত ।
              এর আগে কয়েকটা বইয়ের মুখবন্ধ বা ইনট্রো, ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের, যা-ই বলুন, লিখেছি বটে, কিন্তু ন্যারেটিভ নিয়ে এরকম নিজের সঙ্গে নিজে বার্তা-বিনিময়ের একাধিক কন্ঠস্বরের নিরীক্ষা, মেইনস্ট্রিমের বাইরে বেরিয়ে, ফাঁকা জায়গায় শ্বাস নেবার ইনোভেশানের লেখা নিয়ে লিখিনি । 
              বলা যেতে পারে, অর্ঘ্য আমাকে বিপাকে ফেলে দিয়েছেন । 
              পড়তে গিয়ে আমি কোন গদ্যের পর কোন গদ্য, তাও বিছানায় শুয়ে, আরামচেয়ারে হেলান দিয়ে সামনের টেবিলে ঠ্যাঙ তুলে,  আর ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ার সময়ে গোলমাল করে ফেলেছি । অবশ্য জানি, অর্ঘ্যর তাতে খুব-একটা কিছু আসে যায় না । ছাপাতে দেবার আগে সাজিয়ে নেবেন ।
              অর্ঘ্য তাঁর প্রোটোফিকশানগুলোকে বলেছেন প্রগল্প । মনে হয় প্রথানুগত গল্প বলার কায়দাকে তিনি কনটেম্পচুয়াস মনে করেন । স্বাভাবিক । বালজাক বলেছিলেন যে, ফিকশান লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো পরিবর্তনরত মূল্যবোধের ভয়াবহ প্রকোপ ফাঁস করে দেয়া । বালজাকের সময় থেকেই নয়, মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ নিষ্ঠুরতা আবিষ্কার করেছে, সভ্যতার প্রসারে তা কাজে লাগিয়েছে । তা সত্ত্বেও ভাবুক ও সাহিত্যিকরা আশা করেন যে মানুষ মানবতাবাদী হবে, সাম্যবাদী হবে, কল্যাণকামী হবে, যুক্তিতে বিশ্বাস করবে, ইত্যাদি । এদিকে দেখতে দেখতে রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থব্যবস্হার রক্ষিতা বা জিগোলো ।
              অর্ঘ্য ইচ্ছানুযায়ী ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন, চিন্তার স্রোত বজায় রাখার কারণে, আমিও লিখতে বসে মগজে ইংরেজি শব্দ এসে গেলে তা-ই করবো ।
              অর্ঘ্যকে পড়ার সময়ে যে বিদেশি লেখদের কথা মনে এলো, তাঁরা উলিয়াম বারোজ, ইশমায়েল রিড, টেরি সাদার্ন, কার্ট ভনেগাট, রিচার্ড ব্রটিগান, টমাস পিনচন নয়, কেননা এঁরা একরৈখিকতা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে যেতে পারেননি, এঁরা নির্ভর করেছেন প্রচলিত ন্যারেটিভের ডিভাইসের ওপর ; ফিকশান ও গদ্যের প্রথাকে ভেঙে ছাপিয়ে যাবার প্রয়াসের বদলে ফিকশানের ফিকশানালিটিকে মান্যতা দিয়েছেন ।
              অর্ঘ্যকে পড়ার সময়ে যাঁদের কথা মাথায় এলো তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য মেরি গেইটস্কিল, কেথি অ্যাকার, গ্যারি ইনডিয়ানা, কারেন ফিনলে, ডেনিস কুপার, ডেভিড ওজনারোইজ প্রমুখ । 
              হয়তো অর্ঘ্যের অবচেতনায় জাঁ জেনে, লুই ফার্দিনান্দ সেলিনে, জর্জ বাতাই, মরিস ব্লাশোঁ প্রমুখের রচনা পাঠের রেশ থেকে গেছে । এঁদের গদ্য ভিশনারি ও কাব্যিক মোডের । অর্ঘ্য নিজেই স্বীকার করেছেন ঋত্বিক ঘটক থেকে পাওয়া তাঁর প্রোটোফিকশানের উপাদান প্রাপ্তির ।
               হাংরি আন্দোলনের গদ্যকার সুভাষ ঘোষ ও সুবিমল বসাকের কথাও উল্লেখ করতে চাইবো, তুলনা নয়। তবে প্রথানুগত ন্যারেটিভ টেকনিকের কারণে বাসুদেব দাশগুপ্তের গদ্যের তুলনা করবো না । একই কারণে উল্লেখ করতে চাই না সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ফিকশান এবং শাস্ত্রবিরোধী গল্পকারদের । শাস্ত্রবিরোধী গল্পকাররা মুক্ত সূচনা দিয়ে আরম্ভ করলেও তাঁরা একরেখিকতা ও বদ্ধ সমাপ্তির বাঁধন থেকে বেরোতে পারেননি, তাঁদের চরিত্ররা কেলাসিত রয়ে গেছে ।
                উল্লেখ করতে চাইবো রবীন্দ্র গুহ, অজিত রায়, শাশ্বত সিকদার, সুব্রত সেন, অনুপম মুখোপাধ্যায়, সৌগত বালী প্রমুখের ইনোভেটিভ  গদ্য । 
                সুবিমল মিশ্রকেও উল্লেখ করতে চাইবো, তাঁর টাইপোগ্রাফিকাল ইমেজখেলা ও অক্ষরকোলাজ বাদ দিয়ে। সুবিমল মিশ্রের একজন  শিষ্য, স্বপনরঞ্জন হালদারের একটা বই আমি আলোচনা করেছিলুম, কিন্তু সেই সময়ের কমিউনিস্টদের রোগ থেকে বেরোতে পারেননি উনি, মুখ ফুটে বলতে পারেননি রক্তচোষার দিগ্বিজয়, উল্টে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁদের গুরুঘণ্টাল পিঁজরাপোল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁর অপমানজনক সমালোচনা করেছিলেন । 
                 ইনোভেটিভ গদ্যের এই এক বিপদ, কে যে কোথা থেকে ঢুকে পড়বে আর জিনিয়াসগিরির দাবি করবে স্পষ্ট করা কঠিন হয়ে পড়ে ।
                যাঁদের নাম উল্লেখ করলুম, তাঁরা সকলেই, অর্ঘ্যের মতন, জানতেন যে সাহিত্যের রিসেপশানের মণ্ডপে ঢোকার মুখে তাঁদের পড়তে হবে বাউন্সারদের পাল্লায় । কারণ এনারা ফিকশানের সংজ্ঞা ও মূল্যবোধের মালিকানা নিজেদের হাতে তুলে নিতে চেয়েছেন ।
                আগের প্রজন্মের ওই লেখকদের লেখনজগতকে সরিয়ে এগোবার রাস্তা বের করতে হয়েছে অর্ঘ্যকে । শব্দ মুচড়ে গড়া ভাষা এবং আইডিয়া ও চিন্তা দিয়ে গড়া ভাষার যে গভীর পার্থক্য আছে তা নিজের গদ্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন অর্ঘ্য ।
                এক বাসুদেব দাশগুপ্তকে ছাড়া, মেইনস্ট্রিম বাংলা সাহিত্য অন্যান্যদের নিয়ে চিন্তা করেনি, তার কারণ অবিরাম বদলাতে থাকা সংস্কৃতির, ভাষাসংস্কৃতির প্রতি, আলোচকরা খেয়াল নিয়োজিত করেননি। 
                অর্ঘ্যর হাতে পড়ে প্রতিটি অবজেক্ট মর্মার্থে ভরপুর হয়ে উঠেছে, কিন্তু অবজেক্টের মর্মার্থ প্রতিটি পাঠকের কাছে একই বার্তা পৌঁছে দেবে, তা আশা করা যায় না, কেননা অর্ঘ্যের মতামত তাতে কুঁদেকুঁদে ব্যক্তিগত গোপনতাসহ রাখা আছে, সবায়ের অভিজ্ঞতার বনেদ তো একই নয় ।
                অর্ঘ্যর গদ্যগুলোকে কোনো বিশেষ জনারে চিহ্ণিত করা যাচ্ছে না বলে আমি বলেছি প্রোটো-ফিকশান ; গদ্যগুলো পড়ে মনে হয়েছে অর্ঘ্য একজন Neo-gnostic, গোপন জ্ঞানের ভাঁড়াররক্ষক।
                শিরদাঁড়ার শীতল সিরসিরানিকে নিজের গদ্যে চারিয়ে দিতে চেয়েছেন অর্ঘ্য । সম্ভবত যখনই এই সিরসিরানি তাঁর অস্তিত্বে ঘটে তখন তিনি বাক্যগুলোয় যাতে তা থাকে এবং পাঠকের কাছে পৌঁছোয়, তার প্রয়াস করেন । পড়ার সময়ে পাঠক টের পান ঠিক কী ধরণের শীতলতার টর্চার তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে, চরিত্রগুলোকে রাস্তা থেকে, চায়ের ঠেক থেকে, গ্রন্হ থেকে, স্মৃতি থেকে, পুরাণ থেকে,  তুলে আনার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, কিংবা হয়তো কল্পনায় তৈরি করে নিতে হচ্ছে,  ন্যারেটিভের জটিলতার সূক্ষ্ম তারতম্যকে বাছাই করতে হচ্ছে, কেননা মুহূর্তবিশেষের প্রয়োজনীয়তার দিকে খেয়াল দিতে হচ্ছে অর্ঘ্যর ন্যারেটিভকে ।
                কতো কতো ফিকশান পৃথিবী জুড়ে লেখা হয়ে চলেছে । তাদের লেখক-নির্মিত চরিত্ররা কি পৃথিবীর অদৃশ্য জনসংখ্যার একটা সমান্তরাল খাড়া করছে না ? পরের প্রজন্মের লেখকরা ওই অদৃশ্য জনসমুদায়ের সঙ্গে মিশে তাদের একজন হবার প্রয়াস করেন এবং সেই অদৃশ্য জগত থেকে বেরিয়ে এসে দৃশ্যমান জগতে নিজেই গড়ে তোলেন অদৃশ্য চরিত্রদের, পাঠকদের সামনে ছেড়ে দেন তাদের ।
                গদ্যগুলো পড়ে মনে হয়েছে যে আমরা জগতসংসারকে আর আধিবিদ্যক এবং মিসটিকাল পাটাতনে ফেলে বিচার না করলেও, ব্যাপারটা হলো যে ভারতীয় মিথগুলো আমাদের জাগিয়ে তোলার অপেক্ষায় থাকে, যাতে আমরা তা খোলা চোখেই দেখতে পারি । দুর্ভাগ্য যে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক- সংস্কৃতিকে ঘেরাও করে নিয়েছে কিৎশ -- যেন একেবারে হোস্টেজ সিচুয়েশান ।
                অর্ঘ্যকে সংলাপ আবিষ্কার করতে হয়েছে, যাতে যে অভিজ্ঞতা তাঁর ঘটছে, তার সঙ্গে সংলাপগুলো খাপ খেয়ে যায় । আমরা তো সদাসর্বদা শব্দের মাধ্যমে চিন্তা করি না ; আমাদের ভেতরের গভীরতম এলাকাকে পুরোপুরি ধরতে সক্ষম হয় না কথাবার্তা । শব্দদের নিজস্ব সত্য ও সত্তা থাকে, এবং তা বেরিয়ে পড়ে তার আওয়াজের বা স্ফোটনের সূত্রে । ফলে বস্তু-বিশেষের সঙ্গে শব্দেরা হুবহু মিলে যেতে অস্বস্তি বোধ করে । বিভাবসু, কবি, এই কারণে শব্দগুলোকে ধ্বনিভিত্তিক করে নিয়ে লেখেন ।
                শব্দগুলোর নিজের নিজের ক্ষুধা থাকে এবং তারা তা-ই খেতে চায় যার অভিজ্ঞতা লেখকের হয়েছে। সমস্যা হল যে পাঠক-বিশেষের সেই একই অভিজ্ঞতা না-ও থাকতে পারে । ভিন্ন কিছু গড়ে তোলার জন্য ভাষাকে প্রয়োগ করতে অর্ঘ্য বাধ্য হন, কেননা জীবন আর ভাষা একই ব্যাপার নয় । বস্তুত পরাবাস্তব তখনই কাজ করে যখন তা বাস্তব থেকে চাগিয়ে উঠছে । 
              যা বলা হচ্ছে বা লেখা হচ্ছে, তা এক ব্যাপার, কিন্তু যা বলা হচ্ছে না, বা লেখা হচ্ছে না, তাও উপস্হিত থাকছে অর্ঘ্যর গদ্যে । যা লেখা হয়নি অথচ তা লিখিত পাঠবস্তুর সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে, তা লেখক অনুভব করতে পারেন এবং তাঁর লেখাটা এমনই হওয়া দরকার যে পাঠকও ওই ভাসতে থাকা মর্মার্থের সঙ্গে নিজেকে মিশ-খাওয়াতে পারবে ।
              অর্ঘ্যর বাক্যগুলো এলিপটিকাল, অনেকসময়ে ছোটো-ছোটো স্ফোটন জুড়ে-জুড়ে তৈরি, বাস্তব জগতকে অবিরাম স্ক্যানিং করার জন্য, যে বাস্তব জগত অর্ঘ্যর বয়সি যুবকের কাছে সতত পরিবর্তিত ও উপস্হাপিত হয় মেটাবলিজমের ও হরমোনের, প্রধানত প্রজেস্টেরনের, মাধ্যমে । 
              গদ্যের মাঝে  আচমকা উদয় হন অর্ঘ্য। মেইনস্ট্রিম আলোচনায় শৈলীটা মনে হতে পারে সাধারণ্যের শৌখিন শোভনতাকে আক্রমণের পরিবর্তে এক ধরণের অমার্জিত মর্ষকামী বিকৃতি । ওই সাহিত্যিক প্রেজুডিসকেই তো বিধ্বস্ত করতে চাইছেন অর্ঘ্য, গদ্যের নান্দনিক স্ট্র্যাটেজির বর্শাফলক দিয়ে ।
              বেশ আনন্দের সঙ্গে স্যাটায়ার প্রয়োগ করেছেন অর্ঘ্য । স্যাটায়ার ব্যাপারটা একই সঙ্গে নীতিমূলক আর রাজনৈতিক । বলা চলে লেখকের বুনো ক্রোধের তরোয়াল লুকোবার খোপ । স্যাটায়ার হলো বাঁশের তৈরি ‘হস্তশিল্পের’ চোঁচ, যা ফুটে গেলে সময়মতো বের করে না দিলে বিষিয়ে কেলেঙ্কারি ঘটাতে পারে ।
              অর্ঘ্য ওনার গদ্যে নিজের প্রতিস্বে ব্যক্তিএককের ইউনিকনেস যেমন দিয়েছেন, তেমনই ওই ইউনিকনেসকে গুলিয়ে দেবার চেষ্টাও করেছেন । পাঠককে ধৈর্য ধরে এগোতে হবে । গ্রিক দেবতা জানুসের যেমন দুটো মুখ ছিল, মুক্ত সূচনার ও মুক্ত সমাপ্তির, যে দেবতার কোনো পুরোহিত ছিল না, অর্ঘ্যর গদ্যকে তেমনই দুই দিক থেকে বুঝতে হবে ।
              অর্ঘ্যকে প্ররোচিত করে আইডিয়া ও চিন্তা, এবং তাঁর অ্যাড্রেনালিনের উৎস ওনার আইডিয়া-বিশেষ, এক-একটি আইডিয়া উদয় হয় আর তা থেকে কথন-প্রক্রিয়া ধার নিয়ে এগোতে থাকেন । আইডিয়ার ফিকশান, যদিও অর্ঘ্যর গদ্যগুলোকে ফিকশনের চৌহদ্দিতে আটকে রাখা ভুল হবে, অবহেলিত থেকে গেছে, যেমন অতীন্দ্রীয় পাঠকের গদ্যগুলোর ক্ষেত্রে ।
             অর্ঘ্যর উদ্ভাবনা আনফেটার্ড, হয়তো বাক্যগঠনে আকস্মিকতা তাঁর অজানিতেও ঘটে গেছে, প্রতিরূপ উপস্হাপনে অবসেসিভ, বারবার বলেছেন একই কথা বা ঘটনা, তাঁর কনসেপচুয়ালাইজেশান নির্বাধ ।
              সাহিত্যিক ইনোভেশান বিকল্পকে দৃষ্টিগোচর এবং কল্পনাসাধ্য করে তোলে, আর এই সমস্ত বিকল্পের মধ্যে থেকেই ভবিষ্যতের বনেদ গড়ে ওঠে, লেখালিখির সম্পূর্ণ নতুন পাটাতন, যা কালক্রমে মেইনস্ট্রিম সাহিত্যে চুয়ে পড়ে । ইনোভেশানকে বলা যায় সাহিত্যিক রদবদলের ও পুনরুদ্ধারের ইনজিন ; সাহিত্য নিজেই নিজেকে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনরাবিষ্কার করে । 
              ইনোভেশান হলো জড়তাহীন, লৌকিকতাবর্জিত, রীতিনীতি অস্বীকারকারী, কাটিং-এজ সাহিত্য, যাতে থাকে অভিঘাতের লক্ষ্য, অপমানকরার উদ্দেশ্য, আইকনোক্লাজম ও জটিলতার মারপ্যাঁচ ।
              অর্ঘ্য লক্ষ্য স্হির করেছেন নিপুণ বাক-প্রতিবেদন আবিষ্কারে, আসঙ্গময় কন্ঠস্বরে, এবং প্রয়োগ করেছেন তাঁর দৃষ্টিপ্রতিভা, পথ কেটে বের করেছেন ভয়ঙ্কর সময়ের ভেতর দিয়ে, এবং স্ট্রোব লাইটের ঝলকানির সাহায্যে এগিয়ে গেছেন, জীবন প্রকৃতপক্ষে কী তার  রহস্য অনুসন্ধানে, লিঙ্গোথ্থান হয় না এমন যৌন-প্রসঙ্গ এনেছেন, চুরো-করা বাক্যাংশের দুমড়ে ফেলা ছবি উপস্হাপনের সাহায্যে । পাঠকদের ধাঁধিয়ে দিতে পেছপা নন অর্ঘ্য ।
              নিৎশে বলেছিলেন ‘অশুদ্ধ চিন্তা”র কথা । তাঁর মতে, জীবনের বাস্তব ঘটনাবলীর সঙ্গে যখন বিমূর্ততা মিশে যায় তখন ‘অশুদ্ধ চিন্তা’ প্রশ্রয় পায়, পেয়ে বসে মানুষের ওপর, দুটোকে ছাড়িয়ে তারপর আলাদা করা যায় না । অর্ঘ্য বহু ক্ষেত্রে বিমূর্তের সঙ্গে বাস্তব জীবনের ঘটনাবলীকে উস্হাপন করেছেন । 
              অর্ঘ্য মনুস্মৃতির প্রসঙ্গ এনেছেন কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতির প্রসঙ্গে তোলেননি, যখন কিনা কাব্যিক আঙ্গিকে রচিত যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতিকে সাহিত্যিক কাজ বলা যায়, এবং যা মনুস্মৃতির পরবর্তীকালে লেখা । ব্রিটিশ শাসকরা নিজেদের পরিকল্পনা চরিতার্থ করার জন্য, প্রথম জনগণনার সময়ে  ব্রাহ্মণদের সাহায্য নিয়ে মনুস্মৃতিকে গুরুত্ব দিয়েছিল, অথচ ততোটা গুরুত্ব দেয়নি যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতিকে। প্রথম সেনসাসের চতুবর্ণকে প্রতিষ্ঠা করার ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র থেকে হিন্দু বাঙালি সমাজ আর বেরোতে পারেনি ; ব্রাহ্মণরা বাঙালি ক্ষত্রিয়দেরও শুদ্রে বর্গীকরণ করে দিয়েছিল, যে কারণে পিছড়াবর্গের কোটা নিয়ে মারাঠা, জাঠ, গুজ্জর, প্যাটেলদের মতন বর্গ বঙ্গসমাজে নেই ।
              যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতি তিনটি খণ্ডে রচিত, আচারকাণ্ড ( রীতিপ্রথা ), ব্যবহারকাণ্ড ( বিচার ব্যবস্হা ) এবং প্রায়শ্চিত্ত কাণ্ড ( অপরাধের শাস্তি ও প্রায়শ্চিত্ত ) ।
              যাজ্ঞবল্ক্যের বক্তব্য ছিল যে মানুষের রয়েছে তেজোময়তা বা কর্মশক্তির উদ্বৃত্ত, যার একটা হিল্লে প্রতিটি ব্যক্তিএকককে করতে হয় । সেই উদ্বৃত্তই হলো জীবন । উদ্বৃত্ত বাদ দিয়ে জীবন সম্ভব নয় । একটি জনসমাজের মানুষ সমবেত উদ্বৃত্ত দিয়ে যা করে, তার দ্বারা সংস্কৃতিটির তো বটেই, মনেরও, আদল-আদরা নির্ধারিত হয় । এই দিকটি অর্ঘ্য নিয়েছেন, যদিও যাজ্ঞবল্ক্যের উল্লেখ তিনি করেননি ।
              অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো, বিশেষ করে একরৈখিক একেশ্বরবাদীদের মতো, সনাতন ভারতীয় চিন্তায় দেবতারা প্রথমে আসেননি । এসেছিলেন প্রজাপতি, এবং তিনি যে কে তা মিথই রয়ে গেছে । প্রজাপতির পর এসেছিলেন ঋষিরা । তারপরে দেবতারা । অতএব লেখক যখন মিথের জগতে প্রবেশ করছেন তখন বেশ ঝুঁকি নিয়েই তা করছেন, এবং মানুষ নিজের ভেতরে মিথের মাধ্যমে পুলক সৃষ্টি করে। 
              মিথের রহস্যে , সেই বিপজ্জনক এলাকায় প্রবেশ করেন লেখক, কেননা ওই এলাকাটি অজানা । লেখক যা-ই করুন না কেন, তিনি একটি উপকথার জগতে ঢুকে পড়েন, এবং উপকথার সংজ্ঞানুযায়ী, তা মানুষের চেতনায় পুলক গড়ে তোলে । 
              মিথ কখনও একটি গল্পে ফুরোয় না । মিথ আনন্দ আনে এবং আনন্দ হলো এক বিস্ময়কর অসুখ । এই কারণেই দেবতাদের রাজা ইন্দ্রকে কেন্দ্র করে এতো অপমানজনক গল্প সংস্কৃতভাষীরা লিখে গেছেন যে মনে হয় বেচারা রাজা না হলেই পারতো ।
              সে যাক, এবার অর্ঘ্যের গদ্যের কিছু-কিছু অংশ পড়া যাক :
    নিম্নবর্গের খিস্তিমাত - চায়ের দোকানের Salanguage
              ব্লেড বা কাঁচির নাগাল পাবার আগেই যাবতীয় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আমাদের ঋতবানস্বামী গুম মেরে বসে বসে নাকি পোঁদ উল্টে মটকা মেরে ধূমকেতুর মতোন “পাশের বাড়ির বৌদিকে ন্যাপা চুদে” নামক দেশী পর্ন দেখতে থাকে অথচ স্ফূতি পায় না যাহার নিকট মেয়ে দুই প্রকার, এক যারা চুষে দেবে, আর যারা চোষে না -- এই একমাত্র criteria তার কাছে মেয়ে বিষয়ক, নারীগুণ, --- একেও এক ব্যতিক্রমী নিম্নবর্গীয় চেতনা বলি, আক্ষরিক অর্থেই উন্নতবর্গে নিম্ন শ্রেণীর চেতনা ব্যতিক্রম, বিরল প্রাণী ঋতবান -- ঋত+বান -- এই সেই “ঋত”, ঋগ্বেদের, যাহা হইতে বরুণাদি দেবতা সৃষ্টি, যাহার অনুকরণ করেন পরমদেব ইন্দ্র, যাহাই প্রকৃতিস্বরূপ, যাহার মাধ্যমে গাভী, অন্ন প্রাপ্ত হয় ও যজ্ঞ যাহার অনুগামী, অনুগামী সকল দেবতা, ঋত -- যাহার উর্দ্ধে, যাহা অপেক্ষা কেহ নাই, সকলেই ঋতবান -- সেই অর্থেই যৌনতা আমাদের এ বালকে ও সকল বালকেই প্রায়, বিশেষত বাজার ঋত অর্থে ইহাই উপাসনা করে ।
              ---লাইক ব্রিটনি বিচ, ইটস জোডি বিচ…
              ---tell one more time and i will be off…
              ---ইটস জোডি জোডি জোডি বিচবিচারি
              ---ok, it’s over, bye, see u…
              হাসতে হাসতে যে সম্পর্ক শেষ করি সে এক ব্রিটেনের অজ পাড়াগাঁর নিম্নবর্গ কিশোরী, যে কিনা সদ্য রিহ্যাব-ফেরত ও লিভটুগেদারি । প্রেমটা অফুরন্ত হাসি আর ইয়ার্কির মধ্যে দিয়ে ভাঙল, i’m suffering from too much happiness…
              আমি বিলেতি নিম্নবর্গ, গরিব মানুষ চিনলাম, যারা তাদের মাতৃভাষা ইংরেজির বানান লেখে ধ্বনিভিত্তিক, আমাদের ডিকশনারীও প্রপার স্পেলিং নয়, যারা ব্যবহারকে অসোংখো চলতি ইংরেজি, যা কেবোল মাতৃভাষাতে কথা বলার সময়ি ব্যাবহার করা যায়, খোদ ব্রিটিশের মাত্রিভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উপলব্ধি করি ধ্বনিভিত্তিক বানানেই অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎ, ইহাই প্রোতিষ্ঠান বিরোধিতার ভাষা এখন, ভবিষ্যতে ইহাই নিওম হইবে…
              এবং আমি যখন একটি লেখার শেষ স্তরগুলি edit করে যোগ করি তখন এ ভেবেই করি অ্যাখন অব্দি যাবতীয় চিন্তা ম্যাচিওরিটি অভিজ্ঞতা এতে সর্বোৎকৃষ্টরূপে একত্র ও লিপিবদ্ধ থাক । এই লেখাই যদি শেষ লেখা হয় তবে কোনো খেদ যেন না থাকে । চলছে এরকমই, চলুক, কারণ কখন যে মাথা বিগড়োয় কিচ্ছু বলা যায় না…
              সন্ধ্যেবেলা সেদিন এক হিজড়ের দল এল তারকের দোকানে ।
              তারা বলিল --- আসবি ?
              প্রবল আমোদ হইল তারকের । সে নিজ বাম হস্তের কনিষ্ঠাটি দেখাইল । মধ্যমাটি  দেখানোর বদলে । ইহাও সাংকেতিক অর্থে তোদের গুদও নেই পুরুষ মানুষের মতো বাঁড়াও নেই । আছে এক প্রতিবন্ধী বাঁড়া । না চোদা যায়, না চোদন দেওয়ার ক্ষমতা আছে ।
              তবুও তারা রাগিল না । তারকের দোকান হইতে চা কিনিয়া আমাকে ও তারককে চায়ের ভাগ দিল । আমার যথারীতি আপত্তিতে বলিল --- পি লে, পেয়ার বড়েগা ! তারক মাইতে হাত বুলাইল, তাহারা হাসিল, চলিয়া গ্যালো, তারক গান ধরিল, মহাতৃপ্তিতে, যৌনসঙ্গীত…
              সে নিম্ন, তাহা অপেক্ষা নিম্ন পাইয়া সে তো আহ্লাদিবেই । এই তো পিরামিড, সমাজের শ্রেণী পিরামিড, কেউ তোমার জ্বালায় মরে, তুমি কারো জ্বালায় মরো ।
    কিশোরের নীতা ও নামস্তোত্র
              কিশোর + নবনীতা
              Kishore + Nabanita
               কি Share + Na ব
               Ki শোর + ন Ba
              
               যে বয়সে মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়, তখনো কিশোর মেয়ে দেখে নাই । মেয়ে চেনে নাই । তখন অবধি মা, দিদা, মাসী, জেঠী, দিদি ছাড়া মহিলা কি বোঝে নাই কিশোর ।
              যে বয়সে মেয়েরা ঝাড়ি মারা কি বুঝে ফেলে, সে বয়সে কিশোর মেয়ে বানান লিখিত ‘মে’ । গৃহশিক্ষকের চপেটাঘাত, ভর্ৎসনা ও ভ্রম সংশোধন শিখিল প্রকৃত মেয়ে বানান -- মেয়ে দিবস হয়ে ওঠে সেই জিয়ানস্টাল ! তবুও তখনো মেয়ে কি বস্তু -- মেয়ে নাম কেন, কেন উহাদের মেয়ে বলে শেখে নাই ।
               ---মা, যাদের লম্বা চুল তারাই কি মেয়ে ?
               ---মেয়ে কি তুই শুধু লম্বা চুল দিয়েই চিনিস ?
              কাহাদের মেয়ে কয়, কাহারা মেয়ে, কারাই বা ছেলে -- ইহা পৃথক করিতে শিখে নাই যখন, তখন মেয়েরা শিখে গেছে ঝাড়ি মারা কাকে বলে । যখন তাহার ক্লাসমেটরা প্রাথমিক শিশুযৌনতা -- শিশু যৌনঘটনা কিছু কিছু ঘটিয়ে ফেলেছে চুপি চুপি -- অথচ দ্যাখো মেয়ে কাকে বলে কেহই শেখায় নাই -- শেখায় নাই জাতীয় গ্রন্হ কি টেক্সটবুক তাহাকে উহা শেখায় নাই বলে কিশোরের কাছে যদ্যবধি মেয়ে না আসিল -- মা, দিদা, মাসী,জেঠী ব্যতিরেকে যখন সে মেয়ে দেখিল সে তখনও বোঝে নাই কাহাকে মেয়ে কয়, কি করে মেয়ে দিয়ে, কি ভাবে করে তা জানা তো প্রশ্নাতীত ।
               কিশোর অন কিশোর
               Kishore on Kishore
               নব অন নব
               Naba on Naba
                কিshore অN Kiশোর
                Niবস  Oন নিBs
    যেই নাম সেই কৃষ্ণ ভজ নিষ্ঠা করি ।
    নামের সহিত আছে আপনি শ্রীহরি ।।
     
              কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম পড়ে আশ্চর্যান্বিত হই, ১০৮টি নাম মাহাত্মের তৎকালীন যুগানুযায়ী তা কর্ম পরিচায়ক । অর্থাৎ যে জীবনে মহৎ যে কাজগুলি করেছে ও তার চারিত্রিক গুণাবলী অনুযায়ী পরবর্তীকালে নামগুলি “আরোপিত” হয় । এগুলি বর্তমানের মতো জন্মকালীন নাম নয় । যথা মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিৎ । দুটিই পরবর্তীকালে । তার কীর্তির পরিচায়ক বিশেষণ । এ পর্যন্ত ভীষণ সাধারণ । কিন্তু কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম পড়ে চমকিত হয়ে যাই । ১০৮ জন ব্যক্তি বা ব্যক্তিগোষ্ঠী ১০৮ রকম নাম দিচ্ছে । যা নাম দিচ্ছে তা সবই কৃষ্ণের attribute, গুণ, বৈশিষ্ট্য, সুতরাং উহারা নাম বিশেষণ । এতো গেল । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, যে যে কৃষ্ণকে যা যা নাম দিচ্ছেন, তাঁর নিজের বৈশিষ্ট্যও তাইই । কৃষ্ণ যে mirror maze ; এতে যেরকম সে কৃষ্ণের মধ্যে তাই দেখছে । নিজেকেই দেখছে, নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছে। নাম--নামী--নামকারী অভেদ হয়ে যাচ্ছে । উদাহরণ দেয়া যাক ।
              যুধিষ্ঠির নিজে রাজা ও তার কাছে যাদব রাজনৈতিক শক্তির গুরুত্বই সর্বপ্রধান । তাই যুধিষ্ঠির নাম রাখে দেব যদুবর ।
              বিদুর মহামন্ত্রী হলেও কুরুক্ষেত্রের পরান্নভোজী দাসীসন্তান । তাই বিদুর রাখিল নাম কাঙ্গাল ঈশ্বর ।
              নারদ ভক্তশ্রেষ্ঠ । নারদ রাখিল নাম ভক্ত প্রাণধন ।
              অহল্যা যদিও রামায়ণের যুগের চরিত্র, তবু অহল্যার পাষাণ শাপমুক্তি celebrate হচ্ছে এই বলে যে অহল্যা রাখিল নাম পাযাণ-উদ্ধার ।
              প্রহ্লাদ রাখিল নাম নৃসিংহমুরারী।
              এই নাম সাহিত্যে  এমন অসংখ্য রেফারেন্স পাওয়া যাবে যা কৃষ্ণযুগের বহু আগের চরিত্রের উল্লেখে পূর্ণ, বৈদিক যুগের, এমনকি দেবতাদেরও জননী আদি দেবী অদিতি থেকে বহু পরবর্তীকালের, মহাভারতের বহু বহু পরবর্তীযুগের চরিত্রদের উল্লেখ বর্তমান । এ লেখা তাই ইতিহাস চর্চার এক মহৎ উপাদান, manifold, অত্যন্ত অর্বাচীন যুগের এক রচনা এক অতি উত্তম গবেষণার বিষয় হয়ে উঠতে পারে ।
              যা বলছিলাম, যার যা বৈশিষ্ট্য তাই কৃষ্ণ বৈশিষ্ট্য ।
              অত্রিমুনি হলেন বিশেষ একটি নক্ষত্র অত্রি যা সপ্তর্ষিমন্ডলের অন্তর্গত, অর্থাৎ আকাশ সম্বন্ধীয় । অত্রিমুনি নাম রাখে কোটি চন্দ্রেশ্বর । 
              রুদ্রগণও ঋগ্বেদে আকাশের দেবতা ও পসুত্ব, উগ্রতা, শত্রুবিনাশকারী, ভয় উৎপাদক, ধ্বংসকারী ইত্যাদি গুণসম্পন্ন দেবতা যার সব বৈশিষ্ট্য পরে মআদেব আরোপিত । রুদ্রগণ নাম রাখে দেব মহাকাল ।
              এ জাতীয় বর্ণনা থেকে স্পষ্ট যে ঈশ্বর আমি স্বরূপ । আমিত্বের শ্রেষ্ঠত্বই ঈশ্বরত্ব ও আমার গুণলক্ষণ, বৈশিষ্ট্য, আমার মতাদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গী, আমার যা মত ততই ঈশ্বর । কিশোরের নীতা পপেম নবনীতাই ঈশ্বরী । তার নামার্থ বদলে যায়, আসলে নীতাতেই অষ্টোত্তর শতনাম অর্পিত হতে গেলে কিশোর নিজেকে ১০৮ ভাগে, বৈশিষ্ট্যে, মতে, পরিস্হিতিতে সময়ে বাস্তবচাহিদায় বিভক্ত করে । করে নাম-নামী-নামকারী অভেদ হয় । কিশোর কৃষ্ণ হয়ে ওঠে । কারণ যার যা শ্রেষ্ঠ গুণ তা বিভূতিযোগে ঈশ্বরপ্রতিম হয়ে ওঠে ।
    কর্ণ-কৌরব সংবাদ --- অবতার সংস্করণ --- হোমো ফ্লেবার্ড --- একটি বাজে প্রগল্প
              ---কৌরব, আমি ও আমার লিঙ্গ বড্ড ইমোশানাল ফুল, বড় সেন্সেটিভ । বড় স্পর্শকাতর, অস্বাভাবিক কম রোধযুক্ত, ঘণ্টায় যেমন বাধ্যত ৬০টি একক, তেমনি বাধ্যত ওর নিত্য সেবা । না দিলে বড় সাফোকেশন হয়, বড্ড তার ছোঁয়াছুঁয়ি বাই, বড্ড তার খালি ক্ষরণ করা চাই...। এবং জলের বোতল, কল, টিপট ইত্যাদি যা যা থেকে লিঙ্গসদৃশ ক্ষরণ হয়, তা নারী ব্যবহার করছে দেখলে আমার লিঙ্গ বড্ড ইমোশানাল বড্দ সেন্সেটিভ হয়ে যায় । যথা যথা নেত্র পড়ে তথা তথা লিঙ্গ স্ফূরে, তথা তথাই কৌরব as a পুরুষোত্তম স্ফূরে স্ফূরে ওঠে…
              মাঝে মাঝে লিঙ্গ অণ্ড চেপে জঙ্ঘার ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে নারীযৌনাঙ্গ সুলভ এক ফিল আনি মুখ্যবিন্দুদেশে । সেখানে হাত বোলাই যেন যোনি নিয়েই খেলছি । পুরুষের আর কি আছে -- তার খেলার সঙ্গী তো ওই এক, সাত রাজার ধোন এক লিঙ্গ । স্বমিথুন করি । করে বীর্য উরুতে ফেলি । দেখি তার মুক্তাসম শ্বেতত্ব -- হোয়াইটনিং ফিলোজফি । পারদ, জল, বীর্যে ষড়বলের এক বল ( সারফেস টেনশন ) ধর্মতা দেখি । বীর্যকে দেখতে থাকলে -- কি ভাবে সে ঘনত্ব হারিয়ে তরল হয়ে ওঠে ক্রমশ যত ঠাণ্ডা হতে থাকে -- ধর্মের বিপরীত এই নিয়মে টেনশন কমে, রিলিজেই রিলিজড হয়ে কিছি বাস্তবোপযোগী উপদেশ দিয়ে যায়, বীর্য বেরিয়ে এসে দর্শন দিলে সিদ্ধাবস্হাই বলা হোক তাকে । আমি ভর পেট ভাত খেতে পাই বা পাই না, এই দেহামৃত ঘৃত আমি জানোয়ার শাস্ত্রানুযায়ী প্রেইজ করি । বীর্যময় বিবিধ প্রোডাক্ট ( স্পার্মস্যুপ কি স্পার্ম ডিও বা স্পার্ম ফ্লেবার্ড কন্ডোম । মার্কেটে লঞ্চ করা যায় কি না সে সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে থাকি।
    কর্ণ আপন মনে প্রশ্ন করে --- কে কৌরবকে ভালোবাসে ?
    কর্ণই উত্তর করে --- আমি কর্ণ ।
    ---কে কৌরবকে ভালোবাসে ?
    ---আমি কর্ণ ।
    ---কে কৌরবকে ভালোবাসে ?
    ---আমি কর্ণ ।
    ও রাত জাগানিয়া, তোমায় গান শোনাবো…
              সেলফ হিপনোটিক স্বমিথুন যেন ন্যায়া কুছ করনে কো মিলা । স্বমিথুন পুরুষভাবনা ধীরে ধীরে যা বোঝা যায় চলে আসবে কর্ণে, পুরুষের Porn আর ভালগার লাগবে না স্বমিথুন করে । বক্ষাকাশ, জঙ্গলশরীর, উদরসাগরে প্রাকৃতিক ধাতুবৃষ্টি কাদা কাদা করে দিলে আদিম আদিম ব্যঞ্জন হয় । তবে স্নানাগারে যাই । মৃতেঞ্জোদারোর স্নানাগার মনে হয় কাজের পর এই উঠে যাওয়ার প্রবল প্রযত্ন । ক্রমশঃ চুল ভেজে, বালী হয় ; গ্রীবায় জল আসে, সুগ্রিব হয় ; কন্ঠায় আসে, নীলকন্ঠ হয় ; হনুতে হনুমান হয় ; বক্ষ ভেজে -- সাহারায় হড়কায় স্নেহ ; উদর ভেজে, আদ্যা হয় ; নাভি সীতা হয় ; জঙ্ঘা জঙ্ঘুমুনি, পুরুষের নিতম্ব সৌন্দর্য নিয়ে একটা উপন্যাস হয়ে যাক --- শরীর বেয়ে নদী বেয়ে যায়, নাড়ির টানে এ-শরীর সদাশিব হয় । পুরুষ স্নান করে সঙ্গমোত্তর ।
              না, মিখায়েল বাখতিনের কারনিভালের প্রসঙ্গ তোলার জন্য অর্ঘ্যর পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধৃতি দিইনি ; বাখতিন থেকে আজকের সমাজে, সব দেশের সমাজেই, যা প্রাসঙ্গিক, তা হলো শরীরের ফাটলগুলোর আহ্লাদ । আজকের দিনে ফিকশানের ন্যারেটিভ আঙ্গিকগুলো আগেকার-কালের উপন্যাসের একটি চরম ও আত্মসচেতন, আত্মসচেতন কথাটায় লক্ষ্য রাখুন, রূপ, নানা রূপের মধ্যে একটি রূপ । 
              অর্ঘ্য নিজের পছন্দের রূপ বেছে নিয়েছেন প্রতিটি গদ্যে । অর্ঘ্যের গদ্যগুলো, প্রতিটি গদ্য,  নিজের আঙ্গিককেই সমালোচনা করতে করতে এগিয়েছে, ডিসকোর্সের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ককে যাচাই করতে করতে এগিয়েছে । আসলে সমস্ত আর্ট ফর্মই, ফিকশানের তো বটেই, সে তাকে প্রগল্প বলা হোক বা অন্য নাম দেয়া হোক, স্বয়ংসমালোচনায় আবিষ্ট । ওপরে যে উদ্ধৃতিগুলো দিয়েছি তা সেই অবসেশনকে পরখ করার উদ্দেশে ।
             অর্ঘ্য কী করছেন ? তিনি আর্ট ও বাস্তবের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে সরাসরি সন্দেহ করছেন, পাঠককে ফাঁসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর নিজেরই নান্দনিক আত্মপরিচয়ে । এর ফলে তাঁর গদ্যগুলো সাহিত্য ও জীবনের সীমায় আত্মসচেতনতা নিয়ে উপস্হিত থাকছে, আর তার মাধ্যমে লেখকের সঙ্গে লেখক-সহযোগী পাঠকের সূক্ষ্ম পার্থক্য গড়ে তুলছেন ।
              অর্ঘ্যের গদ্যের আঙ্গিক এবং বিষয় ( কেন্দ্রহীন বিষয় ) দুটিই একযোগে যুক্তিতর্ক-নির্ভরতা, প্রচলিত রীতি ও আধিপত্যের কাঠামোয় অন্তর্ঘাত ঘটাচ্ছে, বা বলা চলে, অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে ঘটিয়ে এগিয়েছে। বাখতিন কিন্তু ব্যক্তিকে ততো গুরুত্ব দেননি যতোটা অর্ঘ্য দিচ্ছেন তাঁর গদ্যগুলোয় । আমরা পাই ব্যথা, যন্ত্রণা, কষ্ট, ইয়ার্কি, বিভ্রান্তি, বোকামির উল্টো টাঙানো, প্রায় অভাবনীয় একখানা জগত ।
              অর্ঘ্যর অন্তর্ঘাত অনেক সময়ে তথাকথিত উচ্ছৃঙ্খলতা ও স্বেচ্ছাচারিতার আদল-আদরা পায় । এমনকি পাঠককে চমকে দেবার, বিহ্বল করে দেবার জন্য তিনি বর্তমান কালখণ্ডের যে সমস্ত যৌন আচরণ যুবক-যুবতীরা পছন্দ করেন, মূলত সন্তানোৎপাদন এড়াবার জন্য, সমকাম, বীর্য নিয়ে খেলা, যোনির বাইরে বীর্য ফেলা বা ওনানিজম, মুখমেহন ইত্যাদিকে সন্দর্ভে তুলে এনেছেন । সবকিছুই স্পার্মফ্লেভার্ড হোক । 
              সন্তানোৎপাদনের বাইরে যৌনতার কথা বাংলা সাহিত্য এতোকাল এড়িয়ে গেছে, যে কোনো কারণেই হোক । অথচ সন্তানোৎপাদনের ভীতির কারণে যৌনতার মজা নষ্ট হয়ে যায় । সন্তানোৎপাদনের ভীতিকে যদি জলাঞ্জলি দেয়া যায়, যা আমরা অর্ঘ্যর গদ্যতে পাই, তাহলে যৌনতা হয়ে ওঠে আহ্লাদের, আনন্দের, সুখের, বিজয়প্রাপ্তির, জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপার, নারী ও পুরুষ উভয়েরই ।

     

     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন