এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • মলয়ের লেখাপত্তর

    pi
    বইপত্তর | ২৪ মার্চ ২০১২ | ২৪৪৫৩২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:২৯740586
  • অঁতনা আতো’র প্রত্যাখ্যাত কবিতা সম্পর্কে মরিস ব্লাশোঁ 
    মলয় রায়চৌধুরী 
    এক
    মরিস ব্লাশোঁ (  ২২ সেপ্টেম্বর ১৯০৭ – ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৩) ছিলেন একজন ফরাসি লেখক, দার্শনিক ও সাহিত্য সমালোচক। জিল দ্যলুজ, মিশেল ফুকো, জাক দেরিদা ও জঁ-ল্যুক নঁসির মতো উত্তর-গঠনবাদী দার্শনিকদের ওপর তার কাজের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। 
    .
    ব্লাশোঁ সম্পর্কে অধ্যাপক সুমিত চক্রবর্তী লিখেছেন, “ফরাসি দার্শনিক মরিস ব্লাঁশো তাঁর ‘স্পেস অব লিটারেচার’ প্রবন্ধে সাহিত্যিক বা লেখকের পরিসর বিষয়ে একটা ভারী চমৎকার চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। তিনি লিখছেন কী ভাবে সাহিত্যিক সর্বদাই রয়েছেন এক রকম নির্বাসনে। হেঁটে বেড়াচ্ছেন একটা জনহীন মরুভূমির ভিতর। এই মরুভূমিকে ব্লাঁশো বলছেন একটা ‘প্রিভিলেজড জ়োন’ যেখানে আর কেউ ঢুকতে পারছেন না। লেখকের নিভৃত এই পরিসরে রয়েছে শুধুমাত্র স্বাধীনতা আর একাকিত্ব। এই মরুভূমি ক্রমাগত হয়ে উঠছে লেখকের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। তিনি রয়ে যাচ্ছেন এই অজান্তে তৈরি হয়ে ওঠা একাকিত্বের সাম্রাজ্যে। আর তিনি যা লিখছেন? প্রতিটি শব্দ, বাক্য, চিন্তা লেখা হয়ে যাওয়া মাত্রই তা হয়ে উঠছে অন্য কোনও সত্তার প্রকাশ, শব্দ হয়ে পড়ছে শূন্যগর্ভ। লেখক নিজের কল্পনাকে, নিজের চিন্তাকে বেঁধে উঠতে পারছেন না তাঁরই লেখা শব্দের ভিতর। ক্রমাগত তৈরি হয়ে চলেছে লেখার সঙ্গে লেখকের অনিবার্য দূরত্ব। ব্লাঁশো বলছেন, সাহিত্যকর্মের নির্যাসকে সময়ের গ্রাস থেকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় এই দূরত্ব। লেখার উপজীব্য লুকিয়ে রয়েছে তার অদৃশ্য হওয়ার ভিতরে, লেখকের অদৃশ্য হওয়ার ভিতরে। এই শূন্যতাই জন্ম দেয় ‘টাইমলেস মাস্টারপিস’-এর।তার মানে কি লেখক কোনও সামাজিক জীব নন? তিনি কি প্রতি দিনের বাইরের এক জন মানুষ? নিশ্চয়ই তা নয়। এই প্রতি দিনের ভিতর থেকেই তিনি সংগ্রহ করছেন তাঁর চিন্তার রসদ, এখানেই ক্রমাগত বুনে চলেছেন তাঁর কল্পনার একান্ত জগৎ। তার পর কখন, অজান্তেই ঢুকে যাচ্ছেন তাঁর মরুভূমির ভিতর। এই যে মরুভূমির কথা ব্লাঁশো বলছেন, তা কিন্তু লেখকের স্বেচ্ছাকৃত নয়, এই পরিসর তৈরি হয়ে যাচ্ছে তাঁর অজান্তেই। ভিতর-বাহিরের বোধ তাঁর ভিতর তৈরি হচ্ছে না, ভিড় করে আসা শব্দেরা আপনা আপনিই তৈরি করে দিচ্ছে এই বিচ্ছেদ।”
    .
    দুই
    নিজের তত্ব ব্লাশোঁ প্রয়োগ করেছেন অঁতনা আতো’র এক গুচ্ছ প্রত্যাখ্যাত কবিতার ক্ষেত্রে । ব্লাশোঁ লিখেছেন, “আতো’র বয়স যখন সাতাশ বছর তখন তিনি একটি পত্রিকায় কিছু কবিতা পাঠান। এই জার্নালের পরিচালক বিনয়ের সাথে সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেন। আতো তারপর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন কেন তাঁর পক্ষপাত রয়েছে এই ত্রুটিপূর্ণ কবিতাগুলির প্রতি : কারণ তিনি চিন্তার এমন নির্জনতায় ভুগছেন যে তিনি তাঁর কেন্দ্রীয় অনস্তিত্ব থেকে ফর্মগুলোকে পরিত্যাগ করতে পারবেন না, তা যতই অপর্যাপ্ত হোক না কেন।
    .
    এইভাবে পাওয়া কবিতাগুলোর  মূল্য কী ? আতো ও সম্পাদকের চিঠির আদান-প্রদান হয়েছিল, এবং সম্পাদক জাক রিভিয়ে হঠাৎ করে এই অপ্রকাশ্য কবিতাগুলি সম্পর্কে আতোর লেখা চিঠিগুলি প্রকাশ করার প্রস্তাব দেন (কিন্তু এবার সম্পাদক জানান যে উদাহরণ  হিসাবে চিঠির সঙ্গে কবিতার অংশ তিনি প্রকাশ করবেন )। আতো তা মেনে নেন, এই শর্তে যে কবিতায় কোনও পরিবর্তন করা চলবে না। তার ফলে জাক রিভিয়ের সাথে আদান-প্রদান করা আতোর চিঠি আর কবিতা, যা এখন বিখ্যাত , তা এক মহান তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হয়ে উঠল । ব্লাশোঁ প্রশ্ন তুলেছেন, জাক রিভিয়ে কি এই অসঙ্গতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন? তিনি যখন কবিতাগুলোকে অপর্যাপ্ত এবং প্রকাশের অযোগ্য বলে বিবেচনা করেছিলেন, সেগুলি যখন তাদের অপ্রতুলতার অভিজ্ঞতার বর্ণনার সঙ্গে প্রকাশিত হলো, তখন তা আর প্রকাশের অযোগ্য রইলো না। যেন তাদের মধ্যে কী অভাব ছিল, তাদের ত্রুটি, এই অভাবের প্রকাশ্য অভিব্যক্তি এবং এর প্রয়োজনীয়তার যুক্তির দ্বারা কবিতাগুলো প্রয়োজনীয় পূর্ণতার ভিত্তি পেয়ে গেল। 
    .
    কাজ হিসাবে কবিতাগুলোর পরিবর্তে, যা কিনা নিশ্চিতভাবে কাজের অভিজ্ঞতা, এবং যে প্রক্রিয়া কবিতাগুলো রচনার দিকে কবিকে  নিয়ে গিয়েছিল, এবং অভিজ্ঞতার কথা শুনে, যা জাক রিভিয়েকে আগ্রহী করেছিল, তা রচনাগুলোর তখনও পর্যন্ত অনামা একজন কবির, আনাড়িভাবে লেখা, অস্পষ্ট ছাপ গড়ে তুলেছিল । আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ব্যর্থতা, যা আতোর প্রতি আলোচকদের  তখনও ততটা আকৃষ্ট করতে পারেনি, যতটা পরে কবিতা আর চিঠিগুলো সম্পর্কে যাঁরা লিখবেন এবং যাঁরা পড়বেন তাঁদের মনের একটি কেন্দ্রীয় ঘটনার উপলব্ধিযোগ্য লক্ষণ হয়ে উঠবে,  যার ওপর আতোর ব্যাখ্যাগুলো একটা আশ্চর্যজনক আলো ফেলবে, আর ফেলেছেও। ফলে  আমরা , এমন একটি ঘটনার সীমানায় পৌঁছে যাই যার সাথে সাহিত্য এবং এমনকি শিল্পও যুক্ত বলে মনে হয়: যেন সেগুলো কবিতা নয়, যদি না এটির কৌশল বা "বিষয়" হিসাবে এদের  কবিতা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া ও উদ্দীপনা আমাদের কাছে  উপলব্ধ হয়, আবার অনেক সময়ে তা না জানার কারণে বাতিল করতে হয়।
     .
     আমরা এখানে রিল্কের চিঠিটির প্রসঙ্গ তুলতে পারি, যা পনেরো বছর বা তারও আগে লেখা: ‘যত এগিয়ে, এবং যতো বেশি ব্যক্তিগতভাবে , একজন যায়, তত বেশি অনন্য হয়ে ওঠে জীবন । শিল্প হিসাবে একটি কাজের এই অনন্য বাস্তবতা প্রয়োজনীয়, যা অকাট্য, চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট অভিব্যক্তি। তাতেই রয়েছে অসামান্য সাহায্য, যা কাজটাকে তৈরি করতে কবি বা শিল্পীকে বাধ্য করে।
    .
    এটা আমাদের সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যা করে যে আমাদের নিজেদের সবচেয়ে চরম অগ্নিপরীক্ষায় পুড়তে হবে, তবুও, মনে হয়,  কাজটায় নিজের মাথা পুরোপুরি গোঁজার  আগে ,  একটি শব্দের শ্বাসও সামনে আনা উচিত নয় , এমনকি তাদের সম্পর্কে বলাবলি করে  তাদের হালকা করা উচিত নয়, কেননা তা অনন্য , যা অন্য কেউ বুঝতে পারবে না বা বোঝার অধিকার নেই। এই ধরণের উড়াল যা আমাদের কাছে অনন্য, কেবলমাত্র আমাদের কাজের মধ্যে নিজেকে বোঝানোর মাধ্যমে বৈধ হয়ে উঠতে পারে, যাতে তার নিজস্ব নিয়মে আসল নকশার স্বচ্ছ শিল্পকর্মটি দৃশ্যমান হয় ও  প্রকাশ করা যায়। রিল্কে তার মানে বলতে চেয়েছেন , কাজটি যে অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কাছে আসে  তা সরাসরি প্রকাশ করা উচিত নয় : এই চরম অগ্নিপরীক্ষার মূল্য এবং সত্য কেবল তখনই পাওয়া যায়  যখন এটি সেই কাজের মধ্যে চাপা দেয়া থাকে  যেখানে এটি একই সঙ্গে দৃশ্যমান-অদৃশ্য, শিল্পের সুদূর দিবালোকের প্রতিভায়। কিন্তু প্রশ্ন হল রিলকে নিজে কি সবসময় এই গাম্ভীর্য বজায় রাখতেন? এবং তিনি কি তাকে রক্ষা করার সময় একই সঙ্গে ভেঙে ফেলার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে প্রয়াস করেননি ?  অধিকন্তু রিল্কে জেনেছিলেন যে এই ভাঁড়ার ভাঙার ক্ষমতা তাঁর বা কারও নেই। তিনি কি  কেবল এটির সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য তর্ক দিয়েছেন যে এই ধরণের উড়াল যা আমাদের কাছে অনন্য। “যা  চিন্তা করা হয়েছে তাকে ভাবা যে অসম্ভব” তা জাক রিভিয়ের বোঝাপড়া, মনোযোগ এবং সংবেদনশীলতায় ধরা পড়েছে।  কিন্তু সংলাপে, ভুল বোঝাবুঝির ভূমিকা সুস্পষ্ট থেকে যায়, যদিও তাকে চিহ্ণিত করা কঠিন। আতো, সেই সময়ে যদিও খুব ধৈর্যশীল, ক্রমাগত এই ভুল বোঝাবুঝির উপর নজর রাখছিলেন । তিনি  তাঁদের পত্রালাপ থেকে  আশ্বস্ত হন যে তাঁর মধ্যে যে সংগতির অভাব রয়েছে তা স্পষ্ট,  আর  মনের ভঙ্গুরতা মনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু আতো আশ্বস্ত হতে চান না। তিনি এমন ভয়ানক কিছুর সংস্পর্শে আছেন যে তিনি একে কমিয়ে ফেলতে পারেন না। তিনি অসাধারণত্ব অনুভব করেন, এবং তাঁর কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য, তাঁর চিন্তাধারার ভাঙনের সঙ্গে কবিতাগুলির  সম্পর্ক যা তিনি এই "প্রকৃত ক্ষতি" সত্ত্বেও লিখতে সফল হয়েছিলেন।
    .
    একদিকে, জাক রিভিয়ে অসাধারণ ঘটনাটির ব্যতিক্রমী ব্যাপারটাকে ভুল বোঝেন, আবার অন্যদিকে তিনি কবিতাগুলোর ‘সাহিত্যিক চরিত্রকে’ ভুল বোঝেন, কেননা মনের ভেতরকার যে চরম বৈশিষ্ট্য , যা থেকে কবিতাগুলো সৃষ্ট, সেই মনের অনুপস্থিতি থেকে কবিতাগুলো লেখা।
    .
    তিন
    .
    অঁতনা আতো যখন ঠাণ্ডা মাথায় রিভিয়েকে চিঠি লিখছেন, সেই চিঠি পড়ে অবাক হন জাক রিভিয়ে। আতো চিঠিতে যা বলতে চেয়েছেন তা এতোই স্পষ্ট যে টের পাওয়া যায় তিনি নিজেকে প্রকাশ করায় দক্ষ ।  কবিতাগুলো তাঁর চিন্তার কেন্দ্রহীনতার  ক্ষতির দিক উন্মোচিত করে, যে মানসিক বিপর্যয়ে তিনি ভোগেন।  এটি একটি অসহ্য যন্ত্রণা যা তিনি পরে তীব্র অভিব্যক্তির সাথে স্মরণ করেছেন, যেমন আতো বলেছেন: " আমি অনুপস্থিতির কথা বলছি, একটি ফোকরের মতো, এক ধরণের অতিশীতল, চিত্রহীন কষ্ট, অনুভূতিহীন, গর্ভপাতের অবর্ণনীয় দ্বন্দ্বের মতো।
    .
    তাহলে কেনই বা তিনি কবিতা লেখেন? কেন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতন নিজেকে সন্তুষ্ট রাখেন না, যিনি তাঁর জিভকে দিনানুদৈনিক আটপৌরে কাজে ব্যবহার করেন ? সবকিছুই ইঙ্গিত দেয় যে কবিতা, তাঁর জন্য সেই ধরনের ক্ষয়ের সাথে সংযুক্ত, অথচ যা অপরিহার্য এবং ক্ষণস্থায়ী চিন্তা করায় তাঁকে দিয়ে। আর এইভাবেই, মূলত, কেন্দ্রীয় ক্ষতির সাথে জড়িত, তাঁকে সেই ক্ষতি প্রকাশ করার বাহন হিসাবে   নিশ্চয়তা এবং তাকে প্রতিশ্রুতি দেয়। নির্দিষ্ট পরিমাণে, কবিতাগুলো লিখে, এই ক্ষতি নিজেই তাঁকে উদ্ধার করবে, তাঁর চিন্তাভাবনাকে যতদূর সম্ভব ফুরিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে।  সুতরাং তিনি অধৈর্য ও অহংকার সহকারে বলেছেন: " আমি সেই মানুষ যে চিন্তার সাথে তার ভাষার সম্পর্কের মধ্যে স্তম্ভিত অব্যবস্থা অনুভব করেছে l  প্রকৃতপক্ষে আমি আমার চিন্তায় নিজেকে হারিয়ে ফেলি যেমন  স্বপ্ন দেখার সময়ে লোকে নিজেকে হারিয়ে ফ্যালে কিংবা হঠাৎ করে নিজের চিন্তায় ফিরে আসে,  আবার নিজের চিন্তায় ডুবে যায়। আমি সেই লোক যে ক্ষতি লুকানোর জায়গাগুলো জানে।"
    .
    আতোর কাছে "সঠিকভাবে চিন্তা করা, সঠিকভাবে দেখা" বা এমন চিন্তাভাবনা যেগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত–সঠিকভাবে বাছাই করা আর প্রকাশ করা–সে সমস্ত ক্ষমতা তিনি জানেন যে তাঁর আছে, তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এবং যখন তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বলেন যে  “কিন্তু আপনি তো বেশ ভালোভাবে চিন্তা করেন, যদিও শব্দের অভাব  সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়”, তখন আতো বিরক্ত বোধ করেন। একটি চিঠিতে আতো লিখেছেন,”অনেক সময়ে  অক্ষমতা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমাকে অতি-উজ্জ্বল  হিসাবে দেখা হয় যখন কিনা আমার অপ্রতুলতা, আমার গভীর ঘাটতি,  কাল্পনিক নয় এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গঠিত নয় ।”  তিনি জানেন, ব্যথার অভিজ্ঞতা তাঁকে যে গভীর যন্ত্রণা দেয়, চিন্তা করা মানে ভাবা নয়, এবং যে চিন্তাগুলি তাঁর মগজে আসে তা তাঁকে অনুভব করায় যে তিনি "এখনও ভাবতে শুরু করেনি।"
    .
     এটা সেই কঠিন যন্ত্রণা যাতে আতো ফিরে যান । যেন তিনি ছুঁয়ে ফেলেছেন,  নিজেকে জানা সত্ত্বেও, একটা সকাতর ভুলের মাধ্যমে, যা তাঁকে ভেতরে-ভেতরে কাঁদায়,  যে বিন্দুতে চিন্তা সবসময় ভাবতে পারে না: এটা "শক্তিহীনতা”,  যা তাঁর চিন্তার অপরিহার্য অংশ, কিন্তু যা  একটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়, একটি ব্যর্থতা যা দ্রুত কেন্দ্রটি থেকে উজ্জ্বল আভা হয়ে ওঠে এবং তিনি যা ভাবেন তাকে তাঁর শারীরিক অবস্হা গ্রাস করে, সমস্ত স্তরে নিজেকে কয়েকটি বিশেষ অসম্ভাব্যতায় ছারখার করে দেয়। তাঁর কবিতাগুলো চিন্তার ওই অসম্ভাব্যতার সাথে যুক্ত যা চিন্তা করা হয়েছে –- এটা এমন এক সত্য যা প্রকাশ করা যায় না, কারণ এটি সর্বদা মুখ ফিরিয়ে নেয় আর কবিকে বাধ্য করে  সেই স্তরের তলায় নেমে অনুভব করতে   যেখানে তিনি সত্যিকার অর্থে এটির অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন।
    .
     এটa কেবল এক আধিভৌতিক অসুবিধাই নয়, এটি বেদনার বিদার, এবং কবিতা এই অবিরাম বেদনা, এটি "ছায়া" এবং "আত্মার রাত !," "কান্নার কণ্ঠ না থাকার ব্যাপার”। বিশ বা তারও বেশি বছর পরে লেখা একটি চিঠিতে, যখন অঁতনা আতো বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসালয়ে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছেন, আর যা তাঁকে একটি কঠিন এবং জ্বলন্ত সত্তায় পরিণত করেছে, তিনি সবচেয়ে সরলভাবে লিখেছেন :  "আমি সাহিত্যে বই লিখতে শুরু করেছি এই কথা বলার জন্য যে আমি কিছু লিখতে পারি না । আমার যখন কিছু লেখার কথা ছিল তখন আমাকে  চিন্তা করতে দেয়া হয়নি।” তারপর লিখেছেন, "আমি এই কথা বলার জন্য লিখেছি যে আমি কখনও লিখিনি,  আমি কখনও কিছু করিনি, কিছুই করতে পারিনি এবং যা কিছু করেছি, তা আসলে কিছুই নয়। আমার পুরো কাজ গড়ে উঠেছিল, আর গড়ে উঠতে পারে, কেবলমাত্র শূন্যতার ওপর”। সাধারণ জ্ঞানের লোকেরা অবাক হবে: কিন্তু কেন, যদি তাঁর লেখার কিছুই না থাকে তাহলে তিনি কি আসলে কিছুই লেখেননি?  এটা এই জন্য যে একজন লোক তখন কিছুই না-বলে নিজেকে সন্তুষ্ট করতে পারে যখন কিছুই নয় বলতে কিছুই নয় বোঝায়।  এখানে, যদিও মনে হচ্ছে এটি এমন এক মুছে যাবার প্রশ্ন  যা এতই বৈপ্লবিক যে, এটি যে বাহুল্যের  প্রতিনিধিত্ব করে,  যে বিপদের দিকে  দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেয় এবং  যে উত্তেজনাকে উস্কে দেয়, এটা দাবি করে, যেন এটা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, এমন এক প্রাথমিক কথাবার্তার সূচনা করে যার মাধ্যমে এমন শব্দ ব্যবহার করা হবে যে তা কিছুই বলে না।
    .
    প্রশ্ন হল কার কিছু বলার নেই? কেমন করে  একজন লোক নিজেকে কথা বলা থেকে রুদ্ধ করতে পারে আর নিজেকে প্রকাশ করতে পারে ? আতো বলছেন, “ আচ্ছা ! যতই যাই হোক না কেন, লিখতে চাওয়া এবং নিজেকে প্রকাশ করতে চাওয়াটা আমার নিজের দুর্বলতা এবং অযৌক্তিকতা। আমি এমন একজন মানুষ যে  অনেক মানসিক  কষ্ট পেয়েছি এবং এই কারণে আমার কথা বলার অধিকার আছে।"

     চার
    .
    এই শূন্যতার জন্য একটি যুদ্ধের বর্ণনা, যে তাঁর কাজ–স্বাভাবিকভাবে,  একটি এমন কাজই নয় যার সম্পর্কে আমি উচ্ছসিত হব এবং নিন্দা করব, তাকে অতিক্রম করে যাব আর সংরক্ষণ করব, কেননা তা নিজেই ইচ্ছা প্রয়োগ করে এর জন্ম দিয়েছ । আতো এমন এক আবেগ জাগিয়ে তুলবেন যাতে তিনি  দক্ষ ।  শুরুতে, এই শূন্যতা বোধের আগে, তিনি তখনও কিছুটা পূর্ণতা উপলব্ধি করার চেষ্টা করে গেছেন, যাকে তিনি  মনে করে ছিলেন নিশ্চিত, যা তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত সমৃদ্ধি, তাঁর অনুভূতির অখণ্ডতা এবং বিষয়গুলির ধারাবাহিকতার সাথে  নিখুঁত আনুগত্যের  সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিল আর যা তাঁর কবিতাকে স্ফটিকত্ব দিয়েছিল ।  তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে তাঁর এই “সুগভীর অনুষদ” আছে এবং সেইসাথে এটি প্রকাশ করতে সক্ষম আঙ্গিক এবং শব্দের সম্পদ আছে তাঁর কাছে। আতো বলছেন,  "যে মুহূর্তে আত্মা তার ঐশ্বর্য, তার আবিষ্কার, এই উদ্ঘাটনকে সংগঠিত করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে, সেই অচেতন মুহুর্তে যখন জিনিসটি নির্গত হওয়ার জন্য তৈরি, একটি শক্তিশালী এবং শয়তান ইচ্ছা আত্মাকে অ্যাসিডের মতন আক্রমণ করে, শব্দময়-চিত্রকল্পকে আক্রমণ করে , অনুভূতি-পিণ্ডের সাহিত্যের প্রশ্নকে আক্রমণ করে , এবং আমাকে, আমাকে, আমার জীবনের  দরজায় হাঁপাবার জন্য ছেড়ে দেয়।"
    .
    আতো যে  এখানে তাৎক্ষণিক বিভ্রমের শিকার তা বলা যথেষ্ট সহজ; সেটা খুবই সহজ; কিন্তু সবকিছুই সেইভাবে শুরু হয় যেভাবে তিনি এই অব্যবহিত অবস্থা থেকে দূরে রয়েছেন  যাকে তিনি বলছেন "জীবন"। কোনও বিলীন হতে থাকা নস্টালজিয়া নয় বা অদৃশ্য স্বপ্নকে পরিত্যাগ করে  নয়;  বরং তার বিপরীতে, এমন একটি সুস্পষ্ট বিদার দিয়ে, যা নিজের কেন্দ্রে একটি অবিরাম বাঁক-বিমুখতার দাবির পরিচয় দেয়, যা তাঁর আসল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের নৃশংস আশ্চর্যের মতো তাঁর অন্তরতম আত্মার অংশ হয়ে যায়। এইভাবে, একটি নিশ্চিত এবং বেদনাদায়ক উপস্হাপনের মাধ্যমে, তিনি আবেগের মেরুকে উল্টে দিতে পারেন আর তারপর অপসারণকে প্রাথমিকতা দেন , "তাত্ক্ষণিক পূর্ণতাকে" নয়,  যার দরুন এই অপসারণ প্রথমে সাধারণ অভাব বলে মনে হয়েছিল। যা প্রধান তা সত্তার পূর্ণতা নয়; প্রধান জিনিসটি হল বিদার এবং ফাটল, ক্ষয় এবং ধ্বংস, বিরতি এবং কুরে-খাওয়া একাকীত্ব : সত্তা তখন সত্তা নয় , এটি সত্তার অভাব, একটি জীবন্ত অভাব যা জীবনকে অক্ষম, পলাতক এবং অবর্ণনীয় করে তোলে, শুধুমাত্র  কান্নাকে রোধ করে থাকা।
    .
    সম্ভবত অঁতনা আতো, যখন তিনি ভেবেছিলেন যে তাঁর "অবিভাজ্য বাস্তবতার" পূর্ণতা আছে, তখন অন্য কিছু না করে তিনি ওই শূন্যতার দ্বাঁরা তার পিছনে প্রক্ষিপ্ত ছায়ার ঘনত্বে নিজেকে কাঁদানো ছাড়া আর কিছুই করেননি, কারণ একমাত্র জিনিস যা তাঁর মধ্যে ভরাট পূর্ণতার সাক্ষ্য দেয় তা হল প্রবল শক্তি যাকে অস্বীকার করা হচ্ছে । এটি, অস্বীকৃতির বাড়াবাড়ি যা সর্বদা সক্রিয় এবং শূন্যতার অসীম বিস্তার ঘটাতে সক্ষম ।  এটা এমন এক চাপ যা এতটাই ভয়ানক যে এটা তাঁকে ফাঁস করে দেয়, আর একই সাথে দাবি করে যে তিনি এটি তৈরি করতে এবং এর অভিব্যক্তি বজায় রাখতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করবেন। 
    .
     তবু, জাক রিভিয়ের সাথে চিঠিপত্র আদান-প্রদানের সময়, এবং যখন তিনি  কবিতা লিখে চলেছেন, তিনি প্রকাশ্যে নিজেকে নিজের উচ্চতায় তুলে আনার আশা বজায় রেখেছেন, যা এমনই এক সমতা, যে কবিতাগুলো সেই মুহূর্তেই নষ্ট হয়ে যায় যখন তিনি তাদের পুনরুদ্ধার করেন। তিনি তখন বলেন যে "তিনি কম হারে চিন্তা করছেন"; "আমি নিজের মানদণ্ডের নীচে রয়েছি, আমি তা জানি, আমি এ থেকে ভুগছি।"  পরে, তিনি লিখবেন: "আমার গভীর অনুষদ এবং আমার বাহ্যিক অসুবিধার মধ্যে এ এক বিরোধিতার যন্ত্রণা, যার কারণে আমি  মারা যাচ্ছি।" সেই মুহুর্তে, যদি তিনি উদ্বেগ ও অপরাধবোধে ভুগছেন , তবে এটি তাঁর চিন্তাভাবনার ক্ষমতার স্তরের নীচে চিন্তা করার জন্য, যা দিয়ে তিনি  তাঁর আদর্শ সততাকে রক্ষা করার  জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলেন , যাতে এটি প্রকাশ করার সময়, এমনকি একটি শব্দ দ্বারাও এটি প্রকাশ করলে, তাঁর সত্যিকারের মহত্ত্ব তাঁর নিজের সম্পর্কে পরম সাক্ষী হয়ে থাকবে। যন্ত্রণা এই সত্য থেকে উদ্ভূত হয় যে তিনি তাঁর চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে সক্ষম নন, এবং কবিতা তাঁর ভেতরে বাসা বেঁধে থাকে এই জন্য যে এই ঋণকে মিটিয়ে ফেলার আশা  রয়ে যায়, অথচ  তা সত্ত্বেও যা তাঁর অস্তিত্বের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে। জাক রিভিয়ের সাথে চিঠিপত্র পড়ে কখনও কখনও  মনে হয় যে কবিতাগুলির প্রতি রিভিয়ের যেটুকু আগ্রহ ছিল তা আতোর নিজের সমস্যা উথ্থাপনার দরুন কেন্দ্রীয় সমস্যাটির প্রতি রিভিয়ের আগ্রহ লেখার গুরুত্বকে স্থানচ্যুত করে।
    আতো কবিতা লিখছিলেন শূন্যতাবোধের বিরুদ্ধে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য লিখতেন। রিভিয়েরের সাথে চিঠিপত্রে, যদিও, তিনি সমস্যাটির সামনে নিজেকে উন্মোচিত করেছেন এবং বোঝা যায়  তিনি একে প্রকাশ করার চেষ্টা করে এবং এটি থেকে অভিব্যক্তি সংগ্রহ করে কবিতাগুলো লিখেছিলেন।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:৪১740587
  • অঁতনা আতো’র নিষ্ঠুরতার থিয়েটার  : অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    আমরা থিয়েটারের ধারণাকে পতিতাবৃত্তি করে ফেলতে পারি না যার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো বাস্তবতা এবং বিপদের সাথে এর যন্ত্রণাদায়ক, যাদুকর সম্পর্ক।
    .
    এভাবে বললে, থিয়েটারের ব্যাপারে  সাধারণ মানুষের আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে, তার মানে, থিয়েটার, তার বস্তুগত  দিক থেকে, যেহেতু এটির জন্য মহাকাশে অভিব্যক্তি প্রয়োজন (আসলে একমাত্র প্রকৃত অভিব্যক্তি), এটি শিল্পের যাদুকরী উপায়গুলিকে অনুমতি দেয় এবং বক্তব্যকে জৈবভাবে এবং সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করা হবে, যেমন পুনর্নবীভূত ঝাড়ফুঁক। এই সবের ফলাফল হল যে থিয়েটারকে তার ভাষা না দেওয়া পর্যন্ত তার কর্মের নির্দিষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হবে না।
    .
    এর অর্থ হল: নির্দিষ্ট এবং পবিত্র বলে বিবেচিত পাঠ্যের উপর নির্ভর করার পরিবর্তে, পাঠ্যের প্রতি থিয়েটারের অধীনতার অবসান ঘটানো এবং অঙ্গভঙ্গির মধ্যে এক ধরণের অনন্য ভাষার ধারণা পুনরুদ্ধার করা অপরিহার্য।  কথোপকথনের বুলির অভিব্যক্তিপূর্ণ সম্ভাবনার বিপরীতে স্হানিক পরিসরের গতিশীল অভিব্যক্তির সম্ভাবনা ছাড়া এই ভাষাটিকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এবং থিয়েটার এখনও কথাবার্তার বুলি থেকে যা নিতে পারে তা হল শব্দের বাইরে সম্প্রসারণের সম্ভাবনা, পরিসর বিকাশের জন্য, সংবেদনশীলতার উপর বিচ্ছিন্ন এবং স্পন্দিত ক্রিয়া করার জন্য। এটি একটি শব্দের নির্দিষ্ট উচ্চারণের সময়।

    এখানেও হস্তক্ষেপ করে (শব্দের শুনতে পাওয়া বুলি ছাড়াও) বস্তু, গতিবিধি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং অঙ্গভঙ্গির চাক্ষুষ ভাষা, তবে এই শর্তে যে তাদের অর্থ, তাদের শারীরবৃত্তীয়তা, তাদের সংমিশ্রণগুলিকে লক্ষবস্তু হওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে, এক ধরণের নতুন বর্ণমালা তৈরি করা হবে।  একবার পরিসরের এই ভাষা, শব্দ, কান্না, আলো, অনম্যাটোপোইয়ার ভাষা সম্পর্কে সচেতন হলে, থিয়েটারকে অবশ্যই অক্ষর এবং বস্তুর সাহায্যে এটিকে সত্য হায়ারোগ্লিফগুলিতে সংগঠিত করতে হবে এবং যা মানুষের সমস্ত অঙ্গের সাথে সম্পর্কিত এবং তাদের প্রতীকবাদ এবং আন্তঃসংযোগ ব্যবহার করতে হবে।
    .

     থিয়েটার সম্পর্কে প্রশ্ন হল, বক্তৃতা, অঙ্গভঙ্গি এবং অভিব্যক্তির একটি মেটা-ফিজিক্স তৈরি করা, যাতে এটিকে “মানুষের স্বার্থে” মনোবিজ্ঞানের দাসত্ব থেকে উদ্ধার করা যায় । কিন্তু এই সমস্ত কিছুরই কোন লাভ হবে না যদি না এই ধরনের প্রচেষ্টার পিছনে একধরনের বাস্তব আধিভৌতিক প্রবণতা থাকে, কিছু অবাস্তব ধারণার প্রতি আবেদন থাকে, যা  প্রকৃতির দ্বারা সীমাবদ্ধ বা এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে চিত্রিত করা যায় না। এই ধারণাগুলো যা সৃষ্টি করে, হয়ে ওঠা এবং বিশৃঙ্খলাকে স্পর্শ করে, সবই একটি মহাজাগতিক ক্রম এবং একটি এলাকার প্রাথমিক ধারণা প্রদান করে যেখান থেকে থিয়েটার এখন সম্পূর্ণরূপে আলাদা । তারা মানুষ, সমাজ, প্রকৃতি এবং বস্তুর মধ্যে এক ধরনের আবেগপূর্ণ সমীকরণ তৈরি করতে সক্ষম।
    .
    ব্যপারটা আধিভৌতিক ধারণাগুলোকে সরাসরি মঞ্চে আনার প্রশ্ন নয়, তবে আপনি যাকে প্রলোভন বলে মনে করেন, বলতে পারেন এই ধারণাগুলোর চারপাশে বাতাসের অন্তর্নিহিততা  তৈরি করার প্রশ্ন ওঠে । এবং এর নৈরাজ্যের সাথে হাস্যরস, এর প্রতীকবাদ এবং এর চিত্রগুলির সাথে কবিতা, এই ধারণাগুলির প্রলোভনকে চ্যানেল করার উপায়গুলির একটি মৌলিক ধারণা প্রদান করে।
    .
    আমাদের এখন এই ভাষার অনন্য বস্তুগত দিক সম্পর্কে কথা বলতে হবে - অর্থাৎ, এর সংবেদনশীলতার উপর কাজ করার সমস্ত উপায় এবং উপায় সম্পর্কে ভাবতে হবে।
    .
     এটা বলা অর্থহীন  যে এতে সঙ্গীত, নৃত্য, প্যান্টোমাইম বা অনুকরণ অন্তর্ভুক্ত । স্পষ্টতই  নড়াচড়া, সুর, ছন্দ ব্যবহার করা হবে, তবে শুধুমাত্র এই তর্কে যে তারা কোনো একটি বিশেষ শিল্পের সুবিধা ছাড়াই এক ধরণের কেন্দ্রীয় অভিব্যক্তিতে একমত হতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে এটি সাধারণ ক্রিয়াকলাপ, সাধারণ আবেগ ব্যবহার করবে না, তবে একটি লাফ দেবার পাটাতনের মতো সেগুলোকে একইভাবে ব্যবহার করবে যেভাবে হাস্যরসের ক্ষয়কারী প্রকৃতিকে যুক্তির অভ্যাসের সাথে সমন্বয় করা হয় ।
    .
    কিন্তু অভিব্যক্তির সম্পূর্ণ প্রাচ্য মাধ্যমের সাহায্যে, থিয়েটারের এই বস্তুনিষ্ঠ এবং বস্তুগত ভাষা অঙ্গগুলোকে মোলায়েম করতে পারে এবং দরকারে কঠিন করতে পারে। এটি সংবেদনশীলতার দ্বারা প্রবাহিত । মঞ্চেে সংলাপের পাশ্চাত্য  ব্যবহার ত্যাগ করে,  শব্দকে অন্তঃকরণে পরিণত করা হবে। এটি কন্ঠস্বরকে প্রসারিত করে। এটি কন্ঠস্বরের কম্পন এবং গুণাবলী ব্যবহার করে। এটা বুনোভাবে ছন্দকে পায়ের নিচে পিষে দেয়।  এটা দুর্মর  শব্দ প্রয়োগ যা সংলাপকে উঁচুতে তুলতে চায়, বেহুদা করতে চায়, কব্জা  করতে চায় , সংবেদনশীলতাকে আটক করতে চায়। এটি অঙ্গভঙ্গির একটি নতুন লিরিসিজমকে মুক্ত করে যা, তার বৃষ্টিপাত বা বাতাসে এর প্রশস্ততা দ্বারা, শব্দের লিরিসিজমকে অতিক্রম করে শেষ হয়। এটি শেষ পর্যন্ত ভাষার বুদ্ধিবৃত্তিক অধীনতা থেকে দূরে সরে যায়, একটি নতুন এবং গভীর বৌদ্ধিকতার অনুভূতি প্রকাশ করে যা ইঙ্গিত এবং লক্ষণগুলির তলায় নিজেকে লুকিয়ে রাখে, বিশেষ ঝাড়ফুঁকের মর্যাদায় উত্থাপিত হয়।
    .
    এই সমস্ত আকর্ষণের জন্য, এই সমস্ত কবিতার জন্য, এবং তৈরি করা গোলকধাঁধার এই সমস্ত প্রত্যক্ষ উপায়গুলি ফালতু হয়ে যাবে যদি সেগুলো আত্মাকে শারীরিকভাবে অন্য কিছুর পরিসরে রাখার জন্য ব্যবহার না করা হয়, যদি সত্যিকারের থিয়েটার আমাদের সৃষ্টির অনুভূতি দিতে না পারে।  আমরা শুধুমাত্র একটি মুখের অধিকারী, কিন্তু যা অন্যান্য স্তরে গিয়ে সম্পূর্ণ হয় ।
    .

    এই অন্যান্য স্তরগুলি সত্যিই মন দ্বারা জয় করা হয়েছে কিনা তা খুব কম গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, বুদ্ধিমত্তা দ্বারা; এটি তাদের হ্রাস করবে, এবং এতে আগ্রহ বা অর্থ নেই। যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল যে ইতিবাচক উপায়ে সংবেদনশীলতাকে গভীর এবং প্রখর উপলব্ধির একটি অবস্থায় রাখা হয় এবং এটিই যাদু এবং আচারের বস্তু যার থিয়েটার শুধুমাত্র একটি প্রতিফলন।
    .
    টেকনিক তখন থিয়েটারকে, শব্দের সঠিক অর্থে, একটি ফাংশন বানানোর প্রশ্ন; ধমনীতে রক্ত সঞ্চালন বা মস্তিষ্কে স্বপ্নের চিত্রগুলির দৃশ্যত বিশৃঙ্খল বিকাশের মতো স্থানীয় এবং সুনির্দিষ্ট কিছু, এবং এটি একটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জড়িত, মনোযোগের প্রকৃত দাসত্বের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।
    .
    থিয়েটার আর কখনও নিজেকে খুঁজে পাবে না--অর্থাৎ, দর্শককে স্বপ্নের সত্যিকারের সূচনা দিয়ে সজ্জিত করে সত্যিকারের বিভ্রমের একটি মাধ্যম গঠন করে, যেখানে অপরাধের প্রতি তার স্বাদ, তার কামোত্তেজক আবেশ, তার বর্বরতা, তার দুঃস্বপ্ন, তার জীবনের ইউটোপিয়ান অনুভূতি এবং বস্তু, এমনকি তার নরখাদক চেহারা, যে একটি স্তরে নকল এবং অলীক নয়, কিন্তু অভ্যন্তরীণ।
    .
    অন্য কথায়, থিয়েটারকে অবশ্যই তার সমস্ত উপায়ে উদ্দেশ্যমূলক এবং বর্ণনামূলক বাহ্যিক জগতের সমস্ত দিকই নয়, বরং অভ্যন্তরীণ জগতের, অর্থাৎ আধিভৌতিকভাবে বিবেচনা করা মানুষের জন্য  পুনর্ব্যক্ত করতে হবে। শুধুমাত্র এইভাবে, আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা থিয়েটারে কল্পনার অধিকার সম্পর্কে আবার কথা বলতে সক্ষম হব। হাস্যরস, বা কবিতা বা কল্পনার কোনো মানেই হয় না যদি না, একটি নৈরাজ্যবাদী ধ্বংসের মাধ্যমে একটি অসাধারন উড়াল তৈরি হয় যা পুরো দৃশ্যটিকে গঠন করে, তারা মানুষকে, বাস্তবতা সম্পর্কে তার ধারণা এবং তার কাব্যিকতাকে জৈবিকভাবে পুনরায় জড়িত করতে সফল হয়। 
    .
    থিয়েটারকে সেকেন্ড-হ্যান্ড মনস্তাত্ত্বিক বা নৈতিক ফাংশন হিসাবে বিবেচনা করা, আর বিশ্বাস করা যে স্বপ্নের নিজেরই একটি বিকল্প কাজ রয়েছে, স্বপ্নের পাশাপাশি থিয়েটারের গভীর কাব্যিক প্রভাবকে তাহলে হ্রাস করা হয় । যদি স্বপ্নের মতো থিয়েটারও রক্তাক্ত এবং অমানবিক হয়, তবে এটি কেবল তার চেয়েও বেশি কিছু নয়, আমাদের মধ্যে অবিরাম ঘটতে থাকা দ্বন্দ্বের ধারণাকে উদ্ভাসিত করা হয় এবং অবিস্মরণীয়ভাবে শিকড় দেওয়া হয়, তা এমন একটি খিঁচুনি যেখানে জীবন ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত হয়, যার মধ্যে  সৃষ্টির সবকিছু উঠে আসে । আমাদের নির্ধারিত অবস্হানের বিরুদ্ধে নিজেকে প্রয়োগ করে; এটি ঠাসবুনোন ব্যাপার । আর সময় নষ্ট না করে কল্পকাহিনীর আধিভৌতিক ধারণাগুলিকে স্থায়ী করার জন্য যার অত্যন্ত নৃশংসতা এবং শক্তি দরকার কেননা তা প্রয়োজনীয় নীতিগুলিতে তাদের উৎস এবং ধারাবাহিকতা দেখানোর জন্য যথেষ্ট। এটি এমন হওয়ায়, দর্শক দেখতে পায় যে, নীতিগুলির সান্নিধ্যে,  যা তাদের শক্তি কাব্যিকভাবে স্থানান্তর করে, থিয়েটারের এই নগ্ন ভাষাকে (নকল নয়, আসল বাস্তব ভাষা) অনুমতি দিতে হবে, এটি মানুষের স্নায়বিক চুম্বকত্বের ব্যবহার দ্বারা, শিল্প এবং সংলাপের সাধারণ সীমা লঙ্ঘন করবে, সক্রিয়ভাবে উপলব্ধি করার জন্য, যে, যা যাদুকরীভাবে বলতে গেলে, বাস্তব অর্থে, এমন এক ধরণের  সৃষ্টি যেখানে মানুষকে স্বপ্ন এবং ঘটনার মধ্যে তার স্থান পুনরায় আবিষ্কার করতে হবে।
    .
    থিম সম্পর্কে বলতে হলে,  বলা জরুরি যে, বিষয়বস্তু তুরীয় মহাজাগতিক ঘটনা দিয়ে দর্শকদের বিরক্ত করার বিষয় নয়। চিন্তাভাবনায়  কর্মের গভীর চাবিকাঠি থাকতে পারে যার সাহায্যে পুরো দর্শনটি ব্যাখ্যা করা যায়, সাধারণভাবে দর্শকরা  উদ্বেগ প্রকাশ করে নাও করতে পারে। কিন্তু তবুও তারা অবশ্যই সেখানে থাকবে; এবং সেটাই আমাদের দরকার।
    .
    নজরকাড়া বা নাটকীয় সর্বজনীন প্রদর্শন সম্পর্কে বক্তব্য হলো যে  প্রতিটি নাটকীয় প্রদর্শনীর একটি ভৌত এবং বস্তুনিষ্ঠ উপাদান থাকবে, যা সকলের কাছে উপলব্ধিযোগ্য। কান্না, হাহাকার, অপচ্ছায়া, চমক, সব ধরণের নাটকীয়তা, নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান থেকে নেওয়া পোশাকের জাদু সৌন্দর্য; দীপ্তিময় আলোকসজ্জা, কণ্ঠের উদ্দীপনাময় সৌন্দর্য, সম্প্রীতির আকর্ষণ, সঙ্গীতের বিরল স্বর, বস্তুর রঙ, নড়াচড়ার শারীরিক ছন্দ যার ওঠা আর নামা সকলের পরিচিত গতিবিধির স্পন্দনের সাথে হুবহু মিলবে। নতুন এবং আশ্চর্যজনক এর ঠাসবুনোট উপস্থিতি বস্তু, মুখোশ, মূর্তি , আলোর আকস্মিক পরিবর্তন, দর্শকের ওপর আলোর  ক্রিয়া যা তাপ ও শীতলতার অনুভূতি জাগায়, ইত্যাদি।
    .
    মঞ্চসজ্জা সম্পর্কে বলতে হলে, থিয়েটারের সাধারণ ভাষাটি প্রয়োগ করে  দৃশ্যের চারপাশে গঠন করা হবে। তা কেবল মঞ্চে কোনও পাঠ্যের প্রতিসরণের মাত্রা হিসাবে নয়, সমস্ত নাট্য সৃষ্টির জন্য প্রস্থানবিন্দু হিসাবে বিবেচিত হবে।  এই ভাষার ব্যবহার এবং পরিচালনার মধ্যেই লেখক এবং পরিচালকের মধ্যে পুরানো দ্বৈততা বিলীন হয়ে যাবে, এক ধরণের অনন্য স্রষ্টার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে যার উপর চমক এবং কাহিনির দ্বৈত দায়িত্ব অর্পণ করা হবে।
    .
    মঞ্চের ভাষা: এটি কথ্য ভাষাকে চাপা দেওয়ার প্রশ্ন নয়, বরং স্বপ্নে পাওয়া শব্দের মতন গুরুত্ব দেওয়ার প্রশ্ন।
    .
    ইতিমধ্যে এই ভাষা রেকর্ড করার নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে, এই উপায়গুলি সঙ্গীত প্রতিলিপি বা কোনো ধরনের কোডের অন্তর্গত হলে ক্ষতি নেই।
    .
     সাধারণ বস্তু বা এমনকি অভিনেতার দেহের জন্যও, লক্ষণগুলোকে মর্যাদা দিতে হবে। এটা স্পষ্ট যে কেউ হায়ারোগ্লিফিক অক্ষর থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে, তা কেবল এই লক্ষণগুলোকে টের পাবার ফ্যাশন হিসেবে তুলে ধরার জন্য নয় ।বস্তুত তা এই ইশারাগুলোকে একটি পঠনযোগ্য ফ্যাশনে উপস্হাপন করার জন্য যা তাদের ইচ্ছামত পুনরুৎপাদন করার অনুমতি দেয় । তার আসল কাজ কিন্তু মঞ্চে সুনির্দিষ্ট এবং অবিলম্বে পাঠযোগ্য ইশারা রচনা করা।
    .

    অন্যদিকে, এই কোড ল্যাঙ্গুয়েজ এবং সঙ্গীতের উপস্হাপন কণ্ঠস্বর মেলাবার মাধ্যম হিসেবে মূল্যবান হবে।
    .
     যেহেতু এই ভাষাতে স্বরভঙ্গীর  ব্যবহার জরুরি আর মৌলিক, তাই এই স্বরধ্বনিগুলি এক ধরণের সুরেলা ভারসাম্য গঠন করবে, সংলাপের  গৌণ বিকৃতিকে ইচ্ছামত পুনরুত্পাদনযোগ্য হতে হবে।
    .
     একইভাবে অজস্র মুখোশের আকারে ধরা মুখের  অভিব্যক্তির তালিকা তৈরি করা যেতে পারে, তাই তারা শেষ পর্যন্ত তাদের নির্দিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক ব্যবহার থেকে স্বাধীনভাবে মঞ্চের এই ঠাসবুনোট ভাষায় সরাসরি এবং প্রতীকীভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
    .
    এই প্রতীকী অঙ্গভঙ্গি, মুখোশ এবং মনোভাব, এই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আন্দোলন যার অগণিত অর্থ থিয়েটারের কংক্রিট ভাষা-প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ গঠন করে, উদ্দীপক অঙ্গভঙ্গি, আবেগপ্রবণ বা স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, ছন্দ এবং শব্দের বাইরে উত্তেজিত ধাক্কাধাক্কি উপস্হাপন করতে পারবে। বাড়িয়ে-চাড়িয়ে তুলে, প্রতিফলন দ্বারা অগণিত হবে। সমস্ত আবেগপ্রবণ অঙ্গভঙ্গির ভর নিয়ে গঠিত দেহচালনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি, সমস্ত ভ্রান্ত মনোভাব, মন এবং জিহ্বার সমস্ত ত্রুটি, যার দ্বারা প্রকাশ করা হয় যা বলা যেতে পারে বাকশক্তির নপুংসকতা, এবং এতে অভিব্যক্তির একটি অসামান্য সম্পদ রয়েছে, যার সুযোগ-সুবিধা পেতে ব্যর্থ হলে চলবে না।
    .
    এছাড়াও, সঙ্গীতের একটি সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে যেখানে শব্দগুলো তাদের অক্ষরের মতো প্রবেশ করে, যেখানে সুরগুলো একত্রিত হয় এবং শব্দের সুনির্দিষ্ট প্রবেশদ্বারে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।এছাড়াও, সঙ্গীতের একটা সুনির্দিষ্ট বার্তা রয়েছে যেখানে শব্দগুলি তাদের অক্ষরের মতো খুঁজে বের করে, যেখানে সুরগুলি একত্রিত হয় এবং শব্দের সুনির্দিষ্ট পথ খুঁজে বের করে।

    বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে বলতে হলে : এগুলিকে বস্তু হিসাবে এবং সেটের অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হবে। এছাড়াও, দর্শকদের সংবেদনশীলতার উপর সরাসরি এবং গভীরভাবে কাজ করার কথা ভাবা দরকার, আওয়াজের দৃষ্টিকোণ থেকে, একেবারে নতুন আওয়াজের গুণাবলী এবং কম্পনের মধ্যে গবেষণা দরকার , যা বর্তমান সময়ের বাদ্যযন্ত্রের নেই এবং যার পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন। প্রাচীন এবং বিস্মৃত যন্ত্রের বা নতুনের উদ্ভাবন করতে হবে। গবেষণার প্রয়োজন, সঙ্গীত ছাড়াও, যন্ত্র এবং যন্ত্রপাতিগুলিতে  বিশেষ সংমিশ্রণ বা ধাতুর নতুন মিশ্রণের উপর ভিত্তি করে, একটি নতুন পরিসর এবং দিকনির্দেশক অর্জন করতে পারে, যা শ্রোতার কাছে কান ফুটো করে দেবার মতন অসহ্য। 
    .
    আলো, আলোকসজ্জার ব্যাপারে বলতে হলে,  থিয়েটারে এখন ব্যবহৃত আলোর সরঞ্জামগুলো  পর্যাপ্ত নয়। মনের ওপর আলোর বিশেষ ক্রিয়া, সমস্ত ধরণের আলোকিত কম্পনের প্রভাবগুলো যাচাই করতে হবে, আলোকতরঙ্গে, আলোর চাদরে, ফুলঝুরির মতন ছড়িয়ে পড়া আলোর নতুন উপায় খুঁজতে হবে। এখন ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলোর তৈরি আলোর রঙের  শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংশোধন করতে হবে। নির্দিষ্ট বাদ্যযন্ত্রের গুণাবলী তৈরি করার জন্য, আলোকে অবশ্যই তাপ, ঠান্ডা, রাগ, ভয় ইত্যাদির সংবেদনগুলি তৈরি করার লক্ষ্যে মিহি, ঘন এবং অস্বচ্ছতার একটি উপাদান পুনরুদ্ধার করতে হবে।

    .
    পোষাক সম্পর্কে বলতে হলে, হাল আমলের পোষাক যতটা সম্ভব পরিহার করা হবে, তবে একই সাথে এমন অভিন্ন নাট্য পোষাক হবে না  যেটি প্রতিটি নাটকের জন্য একই হবে -- অতীতের প্রতি আকর্ষণ এবং কুসংস্কারপূর্ণ শ্রদ্ধা থেকে নয়,  কারণ এটি সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট মনে হয় যে নির্দিষ্ট সময়ের পোশাক, আচারের উদ্দেশ্য, যদিও তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যমান ছিল, মনে রাখতে হবে তাদের জন্ম দেওয়া ঐতিহ্যের ঘনিষ্ঠতা থেকে এক ধরনের সৌন্দর্য আর চেহারা সংরক্ষণ করে।
    .
     প্রেক্ষাগৃহ সম্পর্কে বলতে হলে বলব যে  আমরা মঞ্চ এবং প্রেক্ষাগৃহের ধারনা বাতিল করে দিয়েছি এবং কোনো প্রকার বিভাজন বা বাধা ছাড়াই একটি একক এলাকায় থিয়েটার প্রতিস্থাপন করেছি, যা অ্যাকশনের থিয়েটার হয়ে উঠবে। দর্শক এবং দর্শকের মধ্যে, অভিনেতা এবং দর্শকের মধ্যে একটি সরাসরি যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হবে, এই ঘটনা থেকে যে দর্শকদের অভিনয়ের মাঝখানে রাখা হবে, এর ফলে তারা আচ্ছন্ন এবং শারীরিকভাবে প্রভাবিত হবে। এই ঘেরাটোপের ফলাফল, অংশত, ঘরের নিজেরই ভূমিকা থাকে। এইভাবে, বর্তমান সময়ের থিয়েটারগুলির স্থাপত্যকে পরিত্যাগ করতে হবে, আমরা  হ্যাঙ্গার বা শস্যাগার ভাড়া নেব, যেগুলিকে আমরা নির্দিষ্ট গির্জা বা পবিত্র স্থানগুলির এবং তিব্বতের নির্দিষ্ট মন্দিরগুলির স্থাপত্যের মতন  পুনর্নির্মাণ করব।
    .
    এই নির্মাণের অভ্যন্তরে উচ্চতা এবং গভীরতার বিশেষ অনুপাত প্রাধান্য পাবে। হলটি কোনও রকম ভাস্কর্য ছাড়াই চার দেয়ালে ঘেরা থাকবে এবং জনসাধারণকে ঘরের মাঝখানে, নিচতলায়, ঘুরন্ত চেয়ারে বসতে হবে যাতে তারা তাদের চারপাশে ঘটতে থাকা দৃশ্য অনুসরণ করতে পারে।  প্রকৃতপক্ষে, এটা হলো প্রথানুগত মঞ্চের অনুপস্থিতি । ঘরের চারটি মূল এলাকায় অভিনেতাদের অ্যাকশনের জন্য বিশেষ অবস্থান সংরক্ষিত থাকবে। আলো শোষণ করার জন্য ডিজাইন করা হোয়াইটওয়াশ করা প্রাচীর-পটভূমির সামনে দৃশ্যগুলি চালানো হবে। উপরন্তু, গ্যালারি ওভারহেড নির্দিষ্ট আদিম পেইন্টিংগুলির মতো হলের পরিধির চারপাশে ঘুরে বেড়াবে।
    .
    এই গ্যালারিগুলো অভিনেতাদের স্বাধীনতা দেবে, যখনই অ্যাকশনের প্রয়োজন হবে, ঘরের  একটা  বিন্দু থেকে অন্য জায়গায় যাবে, এবং অ্যাকশনটিকে সমস্ত  দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাবে৷ ঘরের এক প্রান্তে উচ্চারিত একটি কান্না মুখ থেকে অন্য মুখে চলে যাবে এবং ধারাবাহিক স্বরভঙ্গীর মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়া হবে । ক্রিয়াটি উন্মোচিত হবে, তার গতিপথকে স্তর থেকে স্তরে, বিন্দু থেকে বিন্দুতে প্রসারিত করবে; প্যারোক্সিজম হঠাৎ করে ফেটে যাবে, বিভিন্ন জায়গায় আগুনের মতো জ্বলে উঠবে।  দর্শকদের ওপর নাটকীয়তার বৈশিষ্ট্য সত্যিকারের বিভ্রম বা ক্রিয়াটির প্রত্যক্ষ ও তাৎক্ষণিক প্রভাব সৃষ্টি করবে কিন্তু ফালতু সংলাপ বলা হবে না। একটি বিশাল স্থানের উপর কর্মের এই বিস্তারের জন্য একটি দৃশ্যের আলো এবং একটি পারফরম্যান্সের বৈচিত্র্যময় আলো জনসাধারণের ওপর যতটা পড়বে ততোটা  অভিনেতাদের ওপর পড়বে -- এবং একই সাথে একাধিক ক্রিয়া বা একটি অভিন্ন ক্রিয়াকলাপের কয়েকটি ধাপ গড়ে উঠতে থাকবে। যে চরিত্রগুলি, মৌমাছির মতো একে অপরের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে, পরিস্থিতির সমস্ত আক্রমণ এবং ঝড়-বৃষ্টির উপাদানগুলির বাহ্যিক আক্রমণ সহ্য করবে, আলোকসজ্জার ভৌত উপায়, বজ্র বা বাতাস উৎপাদন করবে, যার প্রতিক্রিয়া দর্শকরা ভোগ করবে।
    .
    যাইহোক, একটি কেন্দ্রীয় অবস্থান সংরক্ষিত থাকবে যা,  সঠিকভাবে বলতে গেলে, একটি মঞ্চ হিসাবে কাজ করবে যেখানে ক্রিয়াকলাপের বেশিরভাগ অংশ কেন্দ্রীভূত হবে এবং যখনই প্রয়োজন তখন একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসার অনুমতি দেবে।
    .

    থিয়েটারে ব্যবহারের জিনিসপত্র, যেমন মুখোশ আর আনুষাঙ্গিক: ম্যানিকিনস, বিশাল মুখোশ, অদ্ভুত অনুপাতের বস্তুগুলো  চিত্রগুলির মতো একই অনুমোদনের সাথে প্রদর্শিত হবে, প্রতিটি চিত্র এবং প্রতিটি অভিব্যক্তির কংক্রিট দিকটি প্রয়োগ করবে -- বৈপরীত্যসহ যে সমস্ত বস্তুর প্রয়োজন, তাদের একইরকম রাখা হবে না এবং তাদের হুবহু শারীরিক প্রতিনিধিত্ব বাতিল করা হবে বা ছদ্মবেশী করা হবে।
    .
    সেট: কোনও সেট থাকবে না। এই ফাংশনটি যথেষ্ট পরিমাণে হায়ারোগ্লিফিক অক্ষর, রিচুয়াল পোশাক-পরিচ্ছদ, দশ ফুট উঁচু ম্যানিকিন যা ঝড়ের মধ্যে কিং লিয়ারের দাড়ির প্রতিনিধিত্ব করবে, পুরুষদের মতো লম্বা বাদ্যযন্ত্র, অজানা আকৃতি এবং উদ্দেশ্যের বস্তু দ্বারা পরিচালিত হবে।
    .

    তাৎক্ষণিকতা: কিন্তু, লোকেরা বলবে, এই থিয়েটার জীবন থেকে, ঘটনা থেকে, তাৎক্ষণিক আগ্রহ থেকে বিচ্ছিন্ন।বর্তমান এবং তার ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন। হ্যাঁ! তা ঠিক । যে কোনও ব্যাপারে সেই ব্যস্ততা থাকে,  সেই গভীরতা থাকে যা কিছু পুরুষের বিশেষাধিকার, না! জোহরে, রাব্বি সিমিওনের গল্প আমরা জানি, যিনি আগুনের মতো জ্বলছেন, তিনি আগুনের মতোই তাৎক্ষণিক। 
    .
    কাজগুলি: আমরা একটি লিখিত নাটকের অভিনয় করব না, তবে আমরা থিম, ঘটনা বা পরিচিত কাজগুলিকে ঘিরে সরাসরি মঞ্চায়নের চেষ্টা করব। রুমের প্রকৃতি এবং স্বভাবই এই চিকিৎসার পরামর্শ দেয় এবং যতো বড়োই  থিম হোক, তা  অস্বীকার করা যেতে পারে।
    .
    নাটকীয়তার অবিচ্ছেদ্য  একটি ধারণা আছে যার পুনর্জন্ম ঘটাতে হবে। সমস্যা হল স্থানের নিজস্ব সংলাপ, স্হানটিকে ভরে তোলা এবং সজ্জিত করা; পাথরের দেয়ালে বিছানো খনির মতো যা হঠাৎ করে গরম জলের ঝর্না এবং পাথরের ফুলের তোড়াতে পরিণত হয়।
    .
    অভিনেতারা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যেহেতু  তাদের  কার্যকারিতার উপর নাটকীয়তা নির্ভর করে  এবং একই সঙ্গে এক ধরণের নিষ্ক্রিয় এবং নিরপেক্ষ উপাদান, যেহেতু তারা কঠোরভাবে সমস্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগকে অস্বীকার করতে বাধ্য। এটি একটি এলাকা যেখানে কোনও সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই; এবং অভিনেতাদের মধ্যে যাঁর জন্য প্রয়োজন কেবল একটি কান্নার গুণ এবং যে অভিনেতাকে অবশ্যই তার সমস্ত ব্যক্তিগত গুণাবলী সহ একটি সংলাপ বলতে হবে, সেখানে তার স্বাধীনতাটুকু রয়েছে যা একজন মানুষকে একটি যন্ত্র থেকে আলাদা করে।
    .
    ব্যাখ্যা: নাটকীয়তা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত গণনা করা হবে, একটি কোডের মতো ( ভাষাহীনতা )। এইভাবে কোনও অঙ্গভঙ্গী হারিয়ে যাবে না, সমস্ত অঙ্গভঙ্গী একটি ছন্দ মেনে চলবে; এবং প্রতিটি চরিত্র নিছক একটি বিশেষ ধরনের হওয়ার কারণে, তার অঙ্গভঙ্গি, শারীরবৃত্তীয়তা এবং পোশাক-পরিচ্ছদ আলোর রশ্মির মতো প্রদর্শিত হবে।
    .
    সিনেমা: যা তুলে ধরা হয়, তার অশোধিত দৃশ্যায়নের জন্য, কবিতার মাধ্যমে, থিয়েটার যা নয় সেই সব ইমেজের বিরোধিতা করে। যাইহোক, কর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে, কেউ একটি সিনেমাটিক চিত্রের তুলনা করতে পারে না,  তা সে যতই কাব্যিকই হোক না কেন, চলচ্চিত্র  সীমাবদ্ধ । থিয়েটার  জীবনের সমস্ত প্রয়োজনীয়তা মেনে চলে।
    .
    নিষ্ঠুরতা: প্রতিটি দৃশ্যের মূলে নিষ্ঠুরতার উপাদান না থাকলে থিয়েটার সম্ভব নয়। আমাদের বর্তমান অবক্ষয়ের অবস্থায় দেহের চামড়া ফুঁড়ে মেটাফিজিক্সকে আমাদের মনে পুনরায় প্রবেশ করতে হবে।
    .
    জনসাধারণ: প্রথমত এই থিয়েটারের অস্তিত্ব থাকতে হবে।
    .
    প্রোগ্রাম: আমরা পাঠ্য বিবেচনা না করে মঞ্চ করব:

    ১. শেক্সপিয়রের সময়ের একটি কাজের একটি অভিযোজন, একটি কাজ যা আমাদের বর্তমান অস্থির মানসিক অবস্থার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ, শেক্সপিয়রের সেই সময়ের নাটকগুলির একটি, যেমন ‘আর্ডেন অফ ফেভারশাম’। 
    .
    ২.লিয়োঁ পল ফার্গুর চরম কাব্যিক স্বাধীনতার একটি নাটক।

    .
     ৩. জোহর থেকে একটি নির্যাস: রাব্বি সিমিওনের গল্প, যাতে সর্বদা বর্তমান সহিংসতা এবং একটি সংঘাত দেখানোর শক্তি রয়েছে।
    .
    ৪.ব্লুবিয়ার্ডের গল্পটি ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী এবং কামুকতা এবং নিষ্ঠুরতার একটি নতুন ধারণার সাথে পুনর্গঠিত হয়েছে।
    .
    ৫. বাইবেল এবং ইতিহাস অনুসারে জেরুজালেমের পতন; রক্তে-লাল রঙের ধারা এটি থেকে বেরিয়ে আসে এবং আলোতেও দৃশ্যমান । পরিত্যাগ এবং আতঙ্কের অনুভূতি গড়ে তোলে। অন্যদিকে নবীদের আধিভৌতিক বিবাদ, তারা যে ভয়ানক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন তৈরি করেছিল এবং যার প্রতিক্রিয়া শারীরিকভাবে রাজা, মন্দির, জনগণ এবং ঘটনাগুলিকে প্রভাবিত করেছিল।
    .
    ৬. মার্কুইস দি সাদের একটি গল্প, যেখানে কামোত্তেজনাকে স্থানান্তরিত করা হবে, রূপক হিসাবে উপস্হাপন করা হবে এবং চিত্রিত করা হবে, নিষ্ঠুরতার একটি হিংসাত্মক বহিঃপ্রকাশ তৈরি করতে হবে এবং গড়ে উঠবে অবশিষ্টাংশের একটি বিচ্ছুরণ।
    .
    ৭. এক বা একাধিক রোমান্টিক মেলোড্রামা যেখানে অসম্ভাব্যতা কবিতার একটি সক্রিয় এবং ঠাসবুনোট উপাদান হয়ে উঠবে ।
    .
    ৮. আমাদের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার চেতনায় এবং মঞ্চের পরিপ্রেক্ষিতে একটি আনুষ্ঠানিক পাঠ্য থেকে কী টানা যায় তার উদাহরণ হিসাবে বুখনার ওজেকের কাজ।
    .
    ৯.এলিজাবেথান থিয়েটারের কাজগুলো থেকে তাদের পাঠ্য ছিনিয়ে নেয়া হবে এবং কেবলমাত্র সময়কাল, পরিস্থিতি, চরিত্র এবং কর্মের উপাদানগুলিকে ধরে রাখা হবে।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:৪৩740588
  • অঁতনা আতো’র নাটক : রক্তের ফোয়ারা : মলয় রায়চৌধুরীর অনুবাদ
    চরিত্র : একজন যুবক, একজন স্তন্যদায়ী ধাত্রী, একজন যুবতি, একজন পুরুত, একজন যোদ্ধা, একজন মুচি, একজন কনস্টেবল, একজন ফেরিঅলা, একজন বেশ্যালয়ের মাসি, একজন উচ্চ-কন্ঠস্বর, একজন বিচারপতি
    যুবক : আমি তোমায় ভালোবাসি আর সবকিছু কতো সুন্দর।.
    যুবতি: [ কাঁপা-কাঁপা কন্ঠস্বরে] তুমি আমাকে ভালোবাসো আর সবকিছু কতো সুন্দর।
    যুবক : [ মৃদুস্বরে] I আমি তোমায় ভালোবাসি আর সবকিছু কতো সুন্দর।
    যুবতি: [ আরও মৃদুস্বরে] তুমি আমাকে ভালোবাসো আর সবকিছু কতো সুন্দর।
    যুবক : [ যুবতিকে আচমকা ছেড়ে অন্য দিকে তাকিয়ে ] আমি তোমাকে ভালোবাসি [ নৈঃশব্দ ] আমার দিকে তাকাও।
    যুবতি: [ যুবতি আগের মতো যুবকের মুখোমুখি] এই যে ।
    যুবক : [ উত্তেজনায় চেঁচিয়ে ] আমি তোমাকে ভালোবাসি । আমি বিশাল, আমি স্বচ্ছ, আমি পরিপূর্ণ, আমি ভরাট।.
    যুবতি: [ যুবকের মতন উত্তেজিত কন্ঠস্বরে ] আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি ।
    যুবক: আমরা ঐকান্তিক । আহা, পৃথিবী কতো সুন্দরভাবে গড়ে উঠেছে।

    [ নৈঃশব্দ। একটা আওয়াজ হতে থাকে যেন একটা বিশাল চাকা ঘুরছে আর বাতাসকে নিয়ে যাচ্ছে। একটি ঝড় তাদের আলাদা করে। একই সময়ে, দুটি নক্ষত্রের সংঘর্ষ   দেখা যায় আর তাদের থেকে জীবন্ত মাংসল পা, হাত, মাথার খুলি, মুখোশ, প্রাসাদের থাম, গাড়িবারান্দা, মন্দির, পরিস্রাবণযন্ত্র সব সুদ্ধ আস্তে আরো আস্তে পড়তে থাকে , যেন শূন্যে ভাসতে ভাসতে পড়ছে ।  তারপর একটার পর একটা তিনটা কাঁকিড়াবিছে আর সবশেষে একটা ব্যাঙ আর একটা গুবরে-পোকা যেটা বেপরোয়া মন্থরতায়, বমি বমি ভাবের মন্থরতায়  পড়ে ]
    যুবক: [ যতো জোরে সম্ভব কেঁদে উঠে ] আকাশটা পাগল হয়ে গেছে। [ আকাশের দিকে তাকায়] চলো, এখান থেকে পালাই।
    [ যুবতিকে সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় যুবক]
    [ অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মধ্যযুগের এক যোদ্ধার প্রবেশ, তার পেছন-পেছন এক দুহাতে নিজের বিশাল দুটো মাই নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এক স্তন্যদায়ী ধাত্রী]

    যোদ্ধা : তোমার মাই দুটোকে এবার ছেড়ে দাও। কাগজপত্র দেখাও।
    স্তন্যদায়ী ধাত্রী : [ প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে ] আহ ! আহ ! আহ !
    যোদ্ধা: ধুর, তোমার কি হয়েছে?
    স্তন্যদায়ী ধাত্রী : আমাদের মেয়ে, ওই যে, লোকটার সঙ্গে।
    যোদ্ধা : চুপ, এখানে কোনো মেয়ে-ফেয়ে নেই।
    স্তন্যদায়ী ধাত্রী : আমি তোমাকে বলছি, ওরা সঙ্গম করছে।
    যোদ্ধা : ওদের সঙ্গম করাকে আমি পরোয়া করি নাকি ?
    স্তন্যদায়ী ধাত্রী: অজাচার !
    যোদ্ধা: এই মিডওয়াইফ ।
    স্তন্যদায়ী ধাত্রী : [ নিজের দুই পকেটে হাত ঢোকায়। পকেটদুটো মাইয়ের মতনই বড়ো ] বেশ্যার দালাল কোথাকার [ কাগজগুলো যোদ্ধার দিকে ছুঁড়ে দেয় ]
    যোদ্ধা : এগুলোকে এবার খাই ।

    [ স্তন্যদায়ী ধাত্রী বাইরে ভেরিয়ে যায় ] 
    [ যোদ্ধা প্রতিটি কাগজ থেকে সুইস মাখন খাবলা মেরে খেতে থাকে। তার গলায় আটকে গেলে সে কাশতে থাকে আর তার দম বন্ধ হয়ে আসে।]
    যোদ্ধা : [ মুখে ভরা মাখন নিয়ে] আহাপ। আহাপ।তোমার মাই দুটো দেখাও। তোমার মাই দুটো দেখাও।আরে কোথায় গেল ? [ যোদ্ধা বাইরে বেরিয়ে যায় আর যুবক প্রবেশ করে ]
    যুবক: আমি দেখেছি। আমি জানতাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম। এখানে, এই রাজপথে, পুরুত, মুচি, ফেরিঅলা, গির্জায় ঢোকার মুখে, বেশ্যালয়ের লালরঙা এলাকা, বিচারের ওজন পাল্লা। আমি এসব আর একেবারে সহ্য করতে পারছি না !

    [ ছায়ার মতন প্রবেশ করে পুরুত, মুচি, কনস্টেবল, বেশ্যালয়ের মাসি, বিচারক, ফেরিঅলা ]
    যুবক: আমি মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছি না। ওকে ফেরত দাও।
    সবাই একসঙ্গে : [ নানারকম কন্ঠস্বরে ] কে, কে, কে, কে ?
    যুবক: আমার স্ত্রী ।
    কনস্টেবল: [ মোটা থলথলে ] তোমার স্ত্রী ? ঠাট্টা করার জায়গা পাওনি !
    যুবক : ঠাট্টা ! হতে পারে সে তোমার !
    কনস্টেবল: [ কপালে টোকা মেরে মেরে ] হতে পারে । [ বাইরে বেরিয়ে যায় ]

    [ পুরুত যুবকের গলা দুই হাতে জড়িয়ে ধরে]
    পুরুত: [ যেন কারোর কনফেশান নিচ্ছে ] তোমার দেহের কোন অঙ্গ তোমার কাছে প্রায়ই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে?
    যুবক: ঈশ্বর। [ জবাব শুনে পুরুত কথার টানকে সুইজারল্যাণ্ডের লোকের মতন করে নেয় ]
    পুরুত: [ সুইজারল্যাণ্ডের লোকের মতন করে ] কিন্তু তা আর করা হয় না।  আমরা আর কান দিয়ে শুনতে পাই না। তোমাকে আগ্নেয়গিরি আর ভূমিকম্প সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে হবে। আমরা স্বীকারোক্তি-বাক্সের মধ্যে মানুষের যৎসামান্য অশ্লীলতা শুনে আনন্দ পাই। এটাই জীবন।

    যুবক: [ পুরুতের দ্বারা প্রভাবিত কন্ঠে ] আহা সেটাই জীবন ! তারপর সবকিছু পাঠাও নরকে।
    পুরুত: [ সুইস কন্ঠস্বর বজায় রেখে ] নিশ্চয়ই ।
    [ সেই মুহূর্তে হঠাৎ মঞ্চে রাত নেমে আসে। পৃথিবী কেঁপে ওঠে। প্রচণ্ড বজ্রপাত এবং বিদ্যুতের আঁকা-বাঁকা আলো দেখা যায় আর সমস্ত চরিত্র একে অপরের সাথে ধাক্কা খেয়ে চারপাশে দৌড়াতে থাকে আর পড়ে যায় তারপর উঠে পাগলের মতো দৌড়োতে দেখা যায়। তারপর একটা বিশাল হাত বেশ্যালয়ের মাসিকে তার চুল ধরে টানে, যা আগুনের গোলা হয়ে ফেটে যায় আর দর্শকের চোখের সামনে বিশাল আকার ধারণ করে।]
     উচ্চ কন্ঠস্বর : কুত্তি কোথাকার, নিজের শরীরের দিকে তাকা !
    [ বেশ্যালয়ের মাসির শরীর তার ব্লাউজ আর স্কার্টের নীচে একেবারে উলঙ্গ আর ভয়ঙ্কর, যা কাঁচের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে।]
    বেশ্যালয়ের মাসি : হে ভগবান, আমাকে একা থাকতে দাও ।[  কব্জিতে ভগবানের কবজিতে কামড় দেয় মাসি। পিচকিরির মতন রক্তের প্রবল স্ফুরণ মঞ্চে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, এবং বজ্রবিদ্যুতের বিশাল আলোর  ঝলকানিতে পুরুতকে ক্রুশের চিহ্ন আঁকতে দেখা যায়। যখন আবার আলো জ্বলে ওঠে তখন সমস্ত চরিত্র মারা যায় আর তাদের মৃতদেহ মাটিতে পড়ে থাকে। শুধু  যুবক আর বেশ্যালয়ের মাসি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একে অপরকে গ্রাস করে থাকে। মাসি যুবকের বাহুতে ঢলে পড়ে ]
    বেশ্যালয়ের মাসি : [ যেন অরগ্যাজমে কেঁপে উঠে শান্ত হয়েছে, যুবককের প্রতি ] বলো, তোমার কেমন লাগলো।
    [ যুবক নিজের মাথা দুই হাতে লুকিয়ে রাখে। স্তন্যদায়ী ধাত্রী যুবতিকে পুঁটলির মতন করে নিজের দুহাতে ধরে নিয়ে ফিরে আসে। যুবতি মারা গেছে। বেশ্যালয়ের মাসি যুবতিকে মাটিতে ফেলে দেয় যেখানে সে পড়ে যায় আর প্যানকেকের মতো সমতল হয়ে যায়। ধাত্রীর আর স্তন নেই। তার বুক সম্পূর্ণ সমতল]

     যোদ্ধা : [ ভয়ানক কন্ঠস্বরে ] কোথায় রাখলে ওগুলো । আমার সুইস মাখন আমায় ফেরত দাও।
    স্তন্যদায়ী ধাত্রী: [ উচ্ছসিত আনন্দে] এই নাও ।[ নিজের পোশাক তুলে ধরে। যুবক পালাবার চেষ্টা করে কিন্তু আতঙ্কে কাঠের পুতুলের মতন আড়ষ্ট হয়ে যায়]

    যুবক: [ যেন সে বাতাসে ঝুলছে আর ভেনট্রিলোকুইস্টের মতন কন্ঠস্বর] আমাকে মেরোনা মাম্মি।
    যোদ্ধা: শয়তানি মাগি কোথাকার ! [ সে ভয়ে মুখ লুকোয়। স্তন্যদায়ী ধাত্রীর পোশাকের ভেতর  থেকে একদল বিছে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে আর তার পায়ের মধ্যে ঝাঁক বেঁধে যায়। তার যোনি ফুলে ওঠে, বিভক্ত হয় এবং সূর্যের মতো স্বচ্ছ ও চকচকে হয়ে ওঠে। যুবক আর বেশ্যালয়ের মাসি মানসিক রোগীর মতন  পালিয়ে যায়]
    যুবতি: [ হতভম্ব,উঠে দাঁড়ায় ] চিরকুমারী ! আহ, তাকেই ও খুঁজছিল ।

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:৪৪740589
  • অঁতনা আতো’র কবিতা : রেড ইনডিয়ান সংস্কৃতি
    আমি মেক্সিকো এসেছি লাল পৃথিবীর সঙ্গে
    যোগাযোগ করতে              
    আর সে মিষ্টি গন্ধে দুর্গন্ধময়ী
    আর যখন সে দুর্গন্ধময়ী হয়ে ওঠে তখন তার সুগন্ধ পাই।
    নিটোল যোনির ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে 
    আদিবাসী পেচ্ছাপ                                              
    যে অঙ্গকে তুমি  নিজের আয়ত্বে নিতে চাও     
    কর্পূরগন্ধী যোনিপথ                                               
    মৃত যোনি
     তোমার কান মুচড়ে দেয় 
    তুমি পেচ্ছাপ ছড়িয়ে দাও
    যখন তুমি মিরাদোরের ওপর থেকে 
    পিত্রের দিকে তাকাও      
    ভয়ানক বাপের  সমাধিতে পুঁতে রাখা,      
    গর্ত ফাঁপা হয়ে গেছে, অম্লে চোবানো             
    গর্তে লাল আগুনে ফুটন্ত উকুনের ঝাঁক ,      
    সৌর লাল উকুন চক্র      
    শিরার তন্তুজাল সব সাদা
    সময়ে           
    সত্তর বার অপবাদ দিয়েছে
     যখন মানুষ
     নিজের সাথে সঙ্গম করে    
    সন্তানের জন্ম দিয়েছে
    যে পায়ুসঙ্গমে জন্মেছে
    তার নিজের
    পালোয়ানি পোঁদ
    তাহলে, তাদের কোন দুটো
    এবং কেনই বা, প্রথম জায়গায়, দুটো কেন ?
    বাপের অনুকরণে করুণ ভাঁড়,  
    ফাঁপার ভেতরে  নোংরা পরজীবী মঁবলাঁ পর্বত
     আগুন থেকে  টেনে তোলা মায়ের মাংস
    তোমার চারপাশে ফুরিয়ে যাওয়া সমস্ত বৃত্তাকার সূর্যের জন্য
    থপথপে পায়ের পাশে কিছুই নেই
    পুরোনো  অপরিমেয় উচ্চারণ 
    সঙ্গে জঙ্ঘায়  যেখানে
    হাড় পচে যায় ,
    যুদ্ধের মতন মাটির তলা থেকে ওপরে উঠছে
    সমস্ত হাড়ের বর্ম
    ওটার মানে কি?
    এর মানে হল যে মাবাপের ঝগড়া বন্ধ করো                                                            
    সহজাত পথচারী                       
    খ্রিস্টান হুল্লোড়ের নোংরা শ্লোক,                          
    হাসি আর কান্নার মধ্যে মাথা গলায়                          
    যারা হাসি-কান্নায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল;
    আর এর মানে তো যুদ্ধ
    মাবাপের জায়গা নেবে
    এখানে যেখানে পায়ু বাধা তৈরি করেছে
    পুষ্টিকর প্লেগের বিরুদ্ধে
    লাল পৃথিবীতে গোর দেয়া
    শবের তলায়
    যোদ্ধা
    যা দিয়ে যেতে ভয় পেত
    সাপের ছোবলে বারবার
    যে তার লেজকে সামনে থেকে কামড়ায়
    বাবামা তৈরি করার সময়
    সহজাত পথচারী,                         
    যা দিয়ে যেতে ভয় পেত
    বাবামা তৈরি করার সময়
    সামান্য ফেনিল রক্তাক্ত
    আর কাছে থেকে দেখছি,
     এক টুকরো  ফাটা ঠোঁটে
     পুরানো দাগ-দেয়া উরু,
    তারা এদিক ওদিক পড়ে যাচ্ছে, দুর্গন্ধমযয়ী;
     আর পুরোনো যোদ্ধা উঠে দাঁড়ায়
     তার বিদ্রোহী নিষ্ঠুরতা নিয়ে,
    সেই অকথ্য নিষ্ঠুরতার সাথে
    সেখানে বেঁচে থাকা ছাড়া জীবনের জন্য
    তুমি ন্যায্য নও;       
    আর পৃথিবীর স্থির গর্তে                
    ওপর থেকে আর ভেতরে থেকে দেখা যায়,
    জিভের  আলোকিত ডগাগুলো ঝরে পড়ছে
    যারা একদিন নিজেদের আত্মা ভেবেছিল      
    এমনকি ইচ্ছা না থাকলেও; 
    আর তারা আমার মরা হাত দিয়ে
    চাবুক উঁচিয়ে ধরে                                                 
    মেলে দেয়া জিভের বিরুদ্ধে
    আর কামনার লিঙ্গ, 
    যারা শুধুমাত্র মুখের তৈরি ঘুটি      
    অস্তিত্ব দখল করার ক্ষমতা যাদের নেই;
    তবুও তারা সূর্যের চেয়ে উজ্জ্বল       
    যেখানে গুহার মধ্যে ছড়ানো রশ্মি      
    বাবামা আর দেবদূত ছেলে      
    তারপর থেকে একে অপরকে খুন করছে      
    আগে সব দুর্গন্ধ ছড়িয়েছিল
    যখন সৌর গাধা নিজেকে মনে করেছিল
    সৌম্য আর ভালো।           
    আর কখনই বা                                    
    স্বর্গ রয়েছে
    তাদের বৃত্তে ?
    যখন তারা                      
    এর বাইরে,      
    একেবারে বোবা                                    
    নিজের যোনির গন্ধ শোঁকে                                                     
    যখন শূন্যের সামনে
    বাধা হিসাবে আর কিছুই দাঁড়িয়ে নেই                                       
     অকার্যকর, বাতিল,
    যেখানে দিগন্ত নেই,
    বা ভূপৃষ্ঠ নেই
    উচ্চতা নেই ,
    আর সবকিছু তোমাকে গভীরতার সংস্পর্শে ফিরিয়ে আনে
    যখন কেউ বহুক্ষণ ঋজু হয়ে আছে।
    .
    [ এই কবিতাটা অনেকে অনুবাদ করেছেন । তাদের মধ্যে থেকে আমি জ্যাক হার্শম্যানের অনুবাদ বেছে নিয়েছি]

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:৪৬740590
  • অঁতনা আতো সম্পর্কে অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর সাক্ষাৎকার
    প্রশ্ন : অঁতনা আতো সম্পর্কে বলুন।
    গিন্সবার্গ: ঠিক আছে, কবি ফিলিপ ল্যামান্তিয়ার উন্মত্ত উত্তেজনা আর স্নায়বিক  ভবিষ্যদ্বাণীর একটি নজির রয়েছে, আর তার বড় অনুপ্রেরণা, র‌্যাঁবো ছাড়াও, যিনি সকলের বড় অনুপ্রেরণা, ছিলেন অঁতনা আতো – এক ধরণের বিংশ শতাব্দীর র‌্যাঁবো, যাঁর জীবনী আপনি পড়ে দেখতে পারেন  – পাগলামি এবং শক এবং হেরোইন এবং ফ্রান্স.. তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র-অভিনেতা,  থিয়েটারের মানুষ, কিন্তু সর্বোপরি একজন অসাধারণ কবি এবং একজন অসাধারণ…
    প্রশ্ন : একটি খুব সুন্দর ফিল্ম ইউনিভার্সিটিতে দেখানো হচ্ছে…তাতে তিনি "দ্য প্যাশন অফ জোয়ান অফ আর্ক"-এ বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। 
    গিন্সবার্গ : জোয়ান অফ আর্ক, হ্যাঁ। উনি একজন চলচ্চিত্র-অভিনেতা। তাঁর জীবনী.. আপনি এটি বইয়ে দেখতে পারেন বা, যেমন কেরুয়াক বলেছেন, "যদি সঠিক শব্দগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়" - বা সঠিক তথ্যগুলি গুরুত্বপূর্ণ হলে আপনি বইটিতে তা পাবেন। আমি যা বলতে চাই তা হল.. তিনি এমন এক ধরণের কবিতার লেখক যা সমস্ত আমেরিকান কবিতাকে প্রভাবিত করেছে - এবং পরবর্তীকালে ফরাসি - অর্থাৎ কান-ফাটানো হিস্টিরিকাল শ্বাস-প্রশ্বাস-বাক্য-চিৎকার ভবিষ্যদ্বাণীমূলক শৈলী, যার  প্রতিটি লাইন এক-একটা কঠিন বিদারক শ্বাস। প্রতিটি লাইন পাগলাগারের উন্মাদের মতো এগিয়ে যায়, গভীর শ্বাস নেয়, এবং তারপর একটি অভিশাপ, বা একটি কান্না বা উপদেশ দেয়। আমি অঁতনা আতো থেকে আমার নিজস্ব অনেক স্টাইল পেয়েছি, যদিও অনেক জলে ডুবে আছি।  আপনি এইমাত্র শুনলেন যে ফিলিপ লামান্তিয়া শৈলী পেয়েছেন, যে আপনি  উত্তেজনার যে সামান্য কাঁপুনি পেয়েছেন তা অঁতনা আতো থেকে। তাই আমি এখন আতো থেকে একটু পড়ে শোনাতে চাই।না একটু নয়, আমি আতো থেকে বেশ কিছু কবিতা পড়ব...যা আমি আসলে নই.. যা পেতে হয়তো একটু সময় লাগবে। আমি  খুব ঘন ঘন পড়িনি। আমি  একটা টুকরো পড়ব, বা এর ভেতরে আর বাইরের । তিনি পাগলাগারদে ছিলেন, এবং তাঁর ধারণা ছিল যে মানুষের প্রাকৃতিক অবস্থা সমস্ত শর্ত থেকে মুক্ত, বাবা এবং মা থেকে মুক্ত, জন্ম থেকে মুক্ত, পৃথিবী থেকে মুক্ত, সময় থেকে মুক্ত, পুরুষ এবং মহিলা এবং এটি…. আচ্ছা, ওনাকে নিজেই ব্যাখ্যা করতে দিন। মজার বিষয় হল কবিতাটি বোধগম্য শব্দাবলী থেকে বেরিয়ে বিশুদ্ধ শব্দে চলে যায়। তিনি সেই কয়েকজন কবিদের মধ্যে একজন যিনি স্ব-উচ্চারিত মন্ত্রের সাথে সরাসরি ঘোষণামূলক উত্তেজিত ভাষা মিশিয়ে লিখতেন।পড়ছি তাহলে ওনার কবিতা থেকে “এবং এখন,/ আমি তোমাকে/ তোমাদের সকলকে বলি,/ তোমরা সর্বদা আমাকে হাগিয়েছ/ কেন তুমি চুদতে যাও না/ একটি কাঁটাযুক্ত গুদ/ চামউকুন/ অনন্তকালের/ আর কখনও আমার কিছু হবে না/ যারা জীবনের লোহার গুঁড়ো গিলে খায় তাদের সাথে করো। ঈশ্বর আমাকে এখানে ফিরিয়ে দিয়েছেন। (দ্য বাস্টার্ড।)/ এভাবেই তারা/বাবামাকে ঝাঁকালো/ আর এতে জে-এর ভাজা চর্বি/ক্রি/ আমার থেকে, লিঙ্গের বাইরে/ মহান শ্বাসরোধের কেন্দ্রে/যা এই ক্রস থেকে ঝাঁকুনি দেওয়া হয়েছিল... ”…”এবং এভাবেই:/ রেড ইনডিয়ান সংস্কৃতির মহান রহস্য/ বিশ্বকে শূন্যে ফিরিয়ে আনা/সর্বদা…”/ …“মন্তব্য… “তারা এসেছিল, সমস্ত জারজ,/ বড় অসঙ্গতির পরে/ওপর থেকে শব্দ করে নীচে।/ ডিমের-মুখ/ (ফিসফিস করে)/ আপনি কি জানেন না যে /ডিমের/ অবস্থা ছিল আর আতোকে বিষ দেওয়ার জন্য/ কিছু নেই/ চাবুক মারার মতো/ একটি ভাল অমলেট/পরিসরে//জেলি বুলস-আই পয়েন্টে টার্গেট করা/ যে আতো/মানুষ বানাতে চাইছে/পালিয়েছে/একটি ভয়ঙ্কর প্লেগের মতো/এবং এটাই হল/তারা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে/কিছুই, আমি বলি , একটি ভাল স্টাফড অমলেট/বিষ, সায়ানাইড এবং ক্যাপার্সের মতো,/ তার অঞ্চলে বাতাসে ছুঁড়ে দেওয়া/ আতোকে বিচ্ছিন্ন করতে/ তার হাড়ের অ্যানাথেমায়/  এক, ভিতরের মৃতদেহ থেকে ঝুলে থাকা/ এবং দুই, প্যালাউয়েট টানছে/ লার্গালালুয়েট কাউলিং/ তিন, তুবান টাইটিটার্টিং / মাথার মাথা দিয়ে আপনাকে ঘোলাচ্ছে/ চার, হোমুনকুলাস ফ্রন্টাল/ ঘুষি/ চিমটি থেকে ব্যভিচার করছে...”…. "আতো/ কে জানত যে মন নেই/ কিন্তু কেবল শরীর/ যা আবার তৈরি হয় মৃতদেহের গিয়ারের ভাঙা দাঁতের মতো..." ... "সমস্ত সত্য ভাষা/ বোধগম্য নয়/ ফাটা দাঁতের কিড়মিড়ের মতো;/ অথবা হাততালি (বেশ্যাঘর)/ ফিমার পিষে দেওয়া (নাকাল, রক্তাক্ত, নকল)/ জামাই যেমন/ হাড় থেকে চাওয়া ব্যথা থেকে...”…"উপসংহার"/ আমার জন্য, জটিল/ অঁতনা আতো,/ কেউ আমাকে স্পর্শ করতে পারে না/ যখন একজন শুধুমাত্র একজন মানুষ/ বা/ একজন দেবতা/ আমি বাবাকে বিশ্বাস করি না/ মাকে/ কোনো বাপ-মা/প্রকৃতি নেই /মন/অথবা ঈশ্বর,/শয়তান/শরীর/অথবা সত্তা/জীবন/অথবা কিছুই নেই/ভেতরে বা বাইরে কিছুই নেই/এবং সর্বোপরি মুণ্ডুতে থেকে মুখ নেই/যে নর্দমা দাঁত দিয়ে ছেঁদা করা হয়েছে/যেখানে মানুষ যে তার মাংস চুষে নেয়/আমার কাছ থেকে/দেখে আমার কাছে সব সময়/ একজন বাপ-মাখৈ ধরে রাখার অপেক্ষায়/আর একটা অস্তিত্ব পুনর্নির্মাণ করে/আমাকে মুক্ত করে/আমার মৃতদেহের উপরে/নিয়ে নেওয়া/শুন্য থেকে/নিজেকে/এবং শুঁকেছি/সময়ে/সময়ে/আমি কথা/ওপর থেকে/সময়/যেন সময়/ভাজা হয় নি/এই শুকনো ভাজা ছিল না/সব চূর্ণবিচূর্ণ/শুরু থেকে/তাদের কফিন থেকে আরও একবার বেরোচ্ছে।" …আমি মনে করি এটি রোদেজ অ্যাসাইলামে শক-ট্রিটমেন্টের একটি সিরিজের রচনা/মন্তব্য হিসাবে লেখা হতে পারে (যেমন), যেখানে অন্য একটি প্রবন্ধে [“ভ্যান গগ, দ্য ম্যান সুইসাইড বাই সোসাইটি”] তিনি দাবি করেছেন যে, কারণ সমাজের ক্ষেত্রে, তিনি "আত্মহত্যা" (বা নিহত, বা মারা গেছেন), কয়েক ঘন্টার জন্য একটি মৃত অবস্থায় বসবাস করেছিলেন এবং তারপরে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন। সুতরাং এটি মৃত্যু থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য, এবং তাই তিনি আসলে, এক অর্থে, সময়ের উপরে কথা বলছেন। আপনি যদি সেই অভিজ্ঞতাটিকে আক্ষরিক অভিজ্ঞতা হিসাবে নিতে চান (যেটি তিনি করেছিলেন) আক্ষরিক অভিজ্ঞতা হিসাবে নেওয়া হলে, এটি তাঁকে এতটাই উন্মাদনা-শক্তি দিয়েছিল যে তিনি ১৯৪০ এর দশকে সমস্ত প্যারিসকে আতঙ্কিত করেছিলেন এবং হয়ে ওঠেন একজন মহান কবি-নায়ক, রজার ব্লিন, একজন অভিনেতাকে প্রভাবিত করে এবং "চিলড্রেন অফ প্যারাডাইস" ("লেস এনফ্যান্টস ডু প্যারাডিস"), সিনেমা, এবং...
    প্রশ্ন: তা কেমন করে ? তিনি কীভাবে ‘স্বর্গের সন্তান’দের[ Les Enfants du Paradis ]প্রভাবিত করেছিলেন?
    গিন্সবার্গ: তিনি কেবল সমস্ত অভিনেতাকে প্রভাবিত করেছিলেন (এবং তার প্রধান শিল্প ছিল থিয়েটার) তাদের কোনওভাবে তাদের স্হবিরতা থেকে অন্য মস্তিষ্কে নিয়ে যাওয়ার জন্য - ঠিক একজন ব্যক্তি হিসাবে - সবাই তাঁকে রাস্তায় দেখেছিল, সবাই তার সাথে কথা বলেছিল, কেউই…
    প্রশ্ন:  তখন কি ফ্রান্স জার্মান দখলে ছিল? যে এই সব ঘটছিল?
    গিন্সবার্গ: তখন ১৯৪৪ সাল, আমার মনে হয় সম্ভবত তাইই [সম্পাদকের নোট: মার্সেল কার্নের ‘স্বর্গের সন্তান’ ১৯৪৫ সালে ফ্রান্সে এবং ১৯৪৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পায়]  আমি মনে করি  স্যামুয়েল বেকেটের ওপর অঁতনা আতোর কিছু প্রভাব ছিল আর ১৯৪০ এর দশকে, আমেরিকান কবিতায়, ব্ল্যাক মাউন্টেন গোষ্ঠীতে আর আমার নিজের লেখায়, তাৎক্ষণিকভাবে, ১৯৪৮ সালের দিকে, কার্ল সলোমনের সাথে একটি মানসিক হাসপাতালে। . কার্লের কাছে এই কবিতাটির একটি কপি ফরাসি ভাষায় ছিল [“এখানে রয়েছেন” (চি-জিট)] এবং ওনার মন্ত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন  যে “ডাকান্তাল/ডাকিস টেকেল/তা রেদাবা/তা রেদেবেল/দে স্ট্রা মুনটিলস/ও এপিটি আনিস/ও ইপিটি অত্র.." এবং এটি ছিল, একটি খুব সূক্ষ্ম ভয়ঙ্কর মন্ত্র, পাগলাগারদের ভাষার বকবক ভেদ করে। বুঝলেন ? 
    প্রশ্ন : কবিতাটার নাম কী?
    গিন্সবার্গ: এটি ফরাসি ভাষায় "চি-জিট" ("এখানে মিথ্যা"), শুরুটা এরকম - "আমি, অঁতনা আতো, আমার ছেলে, আমার বাবা, আমার মা/নিজেকে/পরিবারের গাছের শিকড়/চামড়া ছাড়ানো/ স্তরের বাবা-মা/এবং শিশু/ঠাকুমার গাধা থেকে/বাবা আর মায়ের চেয়ে অনেক বড়ো” – ঠিক আছে, বুঝলে, আমি ফিলিপ ল্যামান্তিয়ার অলঙ্কৃত শৈলীর কিছু উৎস দেখানোর চেষ্টা করছিলাম। 
    প্রশ্ন: অ্যালেন, আমি মন্ত্রের আধ্যাত্মিক অর্থ বুঝতে পারি না, কিন্তু মনে হচ্ছে দেহ এই সমস্তকিছু বের করে দিচ্ছে – এটা কোনও সুযোগ দেয় না, আপনি জানেন, আমি ফর্ম সম্পর্কে একটি কবিতা লিখছি বা বলা যায় ভাবছি
    গিন্সবার্গ : ব্যাপারটা শ্বাস-প্রশ্বাসের। ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস।
    প্রশ্ন: আচ্ছা, তাহলে কেমন করে তা অনুশীলন করতে হবে ? ঘরের দরোজা বন্ধ করে ?
    গিন্সবার্গ: উন্মাদনার জন্য ? - আমি জানি না আপনি তা অনুশীলন করতে পারেন কিনা। আপনাকে সত্যিই তা হতে হবে। ব্যাপারটা এমন কিছু নয় যা আপনি অনুশীলন করলে পাবেন । আপনি কথাটা সংশোধন করতে পারেন, মানে, আপনি অঁতনা আতো হতে চান না।
    প্রশ্ন: হা ভগবান !
    গিন্সবার্গ: ইতিমধ্যে একজন আতো তো হয়েছেন।. আপনি লামান্তিয়া থেকে বেরিয়ে আসুন। শুধু একজন নেশাখোর হতে চান আর ব্যথা পেতে চান ! না,  আমি আপনার প্রশ্নেরউত্তর দিচ্ছি না । আমাকে এই বিষয়ে একটু কাজ করতে দিন। 
    প্রশ্ন : আপনি কি জানেন কেমন করে আতো মেক্সিকোতে রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে মিশেছিলেন? 
    গিন্সবার্গ: শুরু হয়েছিল মেক্সিকোতে। সেটা প্রথম দিকের ঘটনা। ১৯৩০-এর দশকে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন.. “তারাহুমারাদের দেশে যাত্রা" নামে একটি বই আছে। তিনি পিয়োটি এবং পিয়োটির  আচার-অনুষ্ঠান এবং চিহুয়াহুয়া ইন্ডিয়ান, তারাহুমারা ইন্ডিয়ানদের গোপন মাদকের আচার আবিষ্কার করার জন্য  গিয়েছিলেন। রচনাটা ইংরেজিতে অনুবাদ ও প্রকাশিত হয়েছিল, ১৯৪২ সালে ট্রানজিশন ম্যাগাজিনে আর সেটা ছিল প্রারম্ভিক সাইকেডেলিক রচনাগুলোর একটা, যা মানুষকে এর সম্ভাবনার কথা প্রথম জানিয়েছিল।তিনি বিমূঢ় হয়ে পড়েন এবং ভেবেছিলেন যে রেড ইন্ডিয়ানরা তাঁর কাছে তাদের আচার গোপন রাখছে কারণ তারা তাঁকে তাদের সাথে পিয়োটি খোঁজার জন্যপাহাড়ে উঠতে দেবে না , আর আমার মনে হয় তার ফলে তিনি ভয়  পেয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণ ধারণা হলো যে সেটা ছিল আদিম বা আদি সংস্কৃতি, আদি মানবচেতনা যা আধুনিক চেতনাকে প্রত্যাখ্যান করে আর আতো অনুভব করেছিলেন যে তিনি আধুনিক চেতনাকে মূর্ত করছেন, যা তিনি চাননি। তিনি আদিম পর্বে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন, এবং তিনি অনুভব করেছিলেন যে তারাহুমারা আদিবাসীরা তাঁকে এক ধরণের অস্হির নরকে পাঠিয়ে দিয়েছিল, কারণ তারা তাঁকে গ্রহণ করতে চায়নি।ব্যাপারটা একেবারে সাধারণ শ্বেতাঙ্গের মাদকপ্রি মনোভাবের মতো, জঙ্গলে ঢুকে পড়া… কিন্তু তিনি তাঁর সমুদ্রযাত্রার  দুর্দান্ত গল্পটা লিখেছেন। আপনি এটা পড়েছেন, আমি মনে করি? এটা উপলব্ধ, আমার মনে হয়, সম্প্রতি আবার অনুবাদ করা হয়েছে এবং হার্পার দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে [সম্পাদকের নোট: ফারার, স্ট্রস এবং জিরো দ্বারা প্রকাশিত] গত বারো মাসে, "জার্নি টু দ্য ল্যান্ড অফ তারাহুমারাস"-এর একটা নতুন চমৎকার অনুবাদ, যাতে  প্রথম দিকের সাইকেডেলিক অ্যাডভেঞ্চার গল্প আছে।
    প্রশ্ন: আমার কাছে বইয়ের একটা পর্বের অনুবাদ আছে।
    গিন্সবার্গ : এটা সম্ভবত একটা অধ্যায়, একজন ভদ্রমহিলা  অনুবাদ করেছেন যিনি কেরুয়াকের বান্ধবী ছিলেন, অদ্ভুতভাবে, ১৯৫৭ সালে, হেলেন.. আমি ভুলে গেছি.. কিছু... যে মেয়েটি অনুবাদ করেছিল সে ছিল কেরুয়াকের বান্ধবী এবং সেও একজন সদস্য ছিল যে ১৯৬৩ সালে লেনি ব্রুসের জন্য একটি প্রতিরক্ষা কমিটি গঠন করেছিল। এটা একটা মজার আন্তঃসংযুক্ত সংস্কৃতি। আমি ওর নাম মনে করতে পারছি না। মনে করতে পারো? তোমার কোন ধারনা আছে? - হেলেন উইভার বোধহয় । ঠিক আছে, আমি যা বলার চেষ্টা করছিলাম তা হল ফিলিপ ল্যামান্তিয়ার শৈলীর সাথে সম্পর্কযুক্ত, এবং, আমি জানি না আপনি বলতে পারেন কিনা, আমার কবিতা "আমেরিকা"-তে আমার নিজস্ব কিছু শৈলী, বা বলুন, "ভ্যান গঘের কানের মৃত্যু"র সঙ্গে মিল থাকতে পারে। কাদিশের "ডেথ টু ভ্যান গঘের কান" কবিতাটি সেই শৈলীতে, অঁতনা আতো শৈলীতে  করা হয়েছে, কারণ আমি তা আতোর "ভ্যান গগ, দ্য ম্যান সুইসাইডেড বাই সোসাইটি" যা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিশ্লেষকদের পুরো ষড়যন্ত্রের ওপর প্রথম সত্যই বুদ্ধিমান উপলব্ধিমূলক আক্রমণগুলির মধ্যে একটা,  যা সবাইকে পাগল করে তুলছিল, তিনি ভেবেছিলেন, অনিয়মিত আচরণ বা অস্বাভাবিক অনুপ্রাণিত আচরণকে স্কিৎসোফ্রেনিয়া বা প্যারানয়া হিসাবে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে গণ-মগজ ধোলাই পশ্চিমা সংস্কৃতির একটা ষড়যন্ত্র। সুতরাং তা ছিল, সংস্কৃতির উপর সম্পূর্ণ আক্রমণ। এড স্যান্ডার্সের সেই বাক্যাংশ - "সংস্কৃতির উপর সম্পূর্ণ আক্রমণ" - আমার ধারণা, এমনকি অঁতনা আতো থেকেও উদ্ভূত ।আপনি কি সেই বাক্যাংশটি জানেন?, "সংস্কৃতির উপর সম্পূর্ণ আক্রমণ"? - একটি 'ষাটের দশকের যুদ্ধ-বিরোধী স্লোগান। সুতরাং অঁতনা আতো ছিলেন সেই ব্যক্তি যাঁর মস্তিষ্কের ছুরিটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির যুক্তিবাদের বেশিরভাগ অংশকে কেটে ফেলেছিল - কিন্তু, কবিতার দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি এই দুর্দান্ত শ্বাস-রেখাটি বিকশিত করেছিলেন, একটি লাইন যেখানে একটি বক্তৃতা বিন্যাস, যেখানে প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি লাইন, আক্ষরিক অর্থে, বাতাসে, জগতের মধ্যে একটি নিঃশ্বাসের নির্গমন, যেখানে প্রতিটি লাইনের উদ্দেশ্য একটি মন্ত্রের তীব্রতা, চেতনার বস্তুগত প্লেনগুলির মধ্য দিয়ে কাটা-কাটা। কথিত আছে যে তার কণ্ঠে, কণ্ঠস্বর হিসাবে, সেই গুণমান ছিল, সেই সময়ের ফরাসি রেডিও রেডিওডিফিউশন ফ্রানসেইজি দ্বারা তৈরি একটি টেপ আছে, তিনি অন্য একটি রচনা পরিবেশন করছেন, যা সম্ভবত তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ, “ঈশ্বরের  বিচারকে বাতিল করা বিষয়ক”,যাকে বলা হয় সমস্ত রকমের জমাট চেতনা থেকে মুক্তির ঘোষণা।
    প্রশ্ন: সেটা কি সংকলনে আছে ?
    গিন্সবার্গ :আমি মনে করি না সেটা সংকলনে  আছে। দেখা যাক... না, আমি মনে করি না এটা। এটি মূলত প্রকাশিত হয়েছিল, ভ্যান গঘের প্রবন্ধ, "ভ্যান গগ, দ্য ম্যান সুইসাইডেড বাই সোসাইটি", মূলত ১৯৪০-এর দশকে একটা লিটল সাহিত্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল আর তারপরে আবার মুদ্রিত হয়েছিল। 
    প্রশ্ন: আপনি বোধহয় বিষয়টা সম্পর্কে কয়েক বছর আগে নারোপা বিশ্ববিদ্যালয়ে বলেছিলেন? 
    গিন্সবার্গ: আমার মনে হয় অতোটা পর্যন্ত যাইনি।
    প্রশ্ন: আপনি বলেছিলেন মনে হয়।
    গিন্সবার্গ :হ্যাঁ, আমি এটা উল্লেখ করেছি। আমার কাছে এটা এই বাড়িতে কোথাও আছে, ফরাসি ভাষায়, আর আমার মনে হয় একটা ইংরেজি অনুবাদও আছে.. আমি জানি জ্যাক হির্শম্যানের একটি অনুবাদ রয়েছে, যিনি ১৯৬৮ সালে সিটি লাইটস বইয়ের জন্য এই অঁতনা আতো সংকলনের  বেশিরভাগ অনুবাদ করেছিলেন।  বা তাই [সম্পাদকের নোট, ডেভিড রাট্রে সহায়তা করেছিলেন ] – এটা.. আমি বলব.. উন্মাদনা–মৃগী–আমি  অপমান করতে চাই না, তবে এটি উন্মাদ এই অর্থে.. একটি অনুপ্রবেশকারী একক-বিন্দু মস্তিষ্কের  সন্ত্রাসের চিৎকার, দৃশ্যত দৃঢ় বস্তুগত বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া, যা তিনি মনে করতেন, একেবারেই অলীক এবং সিআইএ-পুঁজিবাদী ক্যাবালিস্ট ষড়যন্ত্রের উপজাত। কিন্তু, আমি যেমন বলেছি, এটা বলা হয় যে তার কণ্ঠে হাড় ভেদ করার ক্ষমতা ছিল। কার্ল সলোমন দাবি করেন যে তিনি প্যারিসে ছিলেন ১৯৪০ এর দশকের গোড়ার দিকে একজন বণিক নাবিক হিসেবে, যেদিন অঁতনা আতো একটি কবিতা পাঠের আয়োজন করেছিলেন, একটি দোকানের সামনে, একটা খুব বিখ্যাত কবিতা পাঠ, যেখানে জাঁ লুই ব্যারাল্ট এবং রজার ব্লিন  এবং অন্যরা গিয়েছিলেন, আর কার্ল সলোমান বলেছিলেন যে তিনি আতোকে এর থেকে কিছু লাইন পড়তে শুনেছিলেন, ওই “ঈশ্বরের বিচার", আর শোনার সময়ে তাঁর শরীরে একটা কাঁপুনি সৃষ্টি করেছিল, আর কার্ল আমেরিকায় ফিরে আসার সময় ,  সেই কণ্ঠস্বরের কারণে নিজেকে পাগলের ঘরে বন্ধ করে  রেখেছিলেন। লেখাটার পাঠ বাস্তবতার চেহারা কেটে বসিয়ে দেয়,আর কার্লের অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে অসুস্হ করে তুলেছিল।আতোর একটি তত্ত্ব আছে, আমার মনে হয়, ‘থিয়েটার অ্যান্ড ইটস ডাবল’, কিংবা ভ্যান গগ প্রবন্ধে , যা আমি প্রায়ই পড়ি, যাতে বলা হয়েছে  যে কিছু শব্দ আছে যা তাদের কম্পনের অদ্ভুত গুণমান দ্বারা, যখন তারা আপনার স্নায়ুতন্ত্রে প্রবেশ করে, অণুগুলিকে পুনর্বিন্যাস করে। অন্য কথায়, মানবদেহে প্রবেশকারী কিছু শব্দ-কম্পন আসলে স্নায়ুর অণুগুলোকে পুনর্বিন্যাস । তাই তিনি কবিতায় এত শক্তি দেখতে পেরেছেন।
    প্রশ্ন : মনে হয় প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো এই ব্যাপারে সব কিছুই জানতো।
    গিন্সবার্গ : হ্যাঁ ।
    প্রশ্ন : আধুনিক সমাজে সবই হারিয়ে গেছে।
    গিন্সবার্গ : আমি মনে করি অঁতনা আতো ছিলেন সেই একজন মানুষ, যিনি আধুনিক কবিদের মধ্যে, একটা ধারণা হিসাবে, বা একটা মৌলিক পদ্ধতি হিসাবে এটাকে আবার আবিষ্কার করেছিলেন।(আচ্ছা, এখন আপনি ফিলিপ  ল্যামান্তিয়ার সাথে আতোর সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় - আমরা কীভাবে এটি ব্যবহার করতে পারি? আমি মনে করি, প্রথমত, শ্বাস-প্রশ্বাসের মৌলিক চেতনা এক অর্থে অস্ত্র, বা শ্বাস একটি সত্তা, এবং প্রতিটি লাইন, শ্বাস-প্রশ্বাস লিখতে পারে, হতে পারে, একটি পৃথক বস্তুর মতো, যা পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হয়–- চেতনা এবং অঁতনা আতোর রচনায়, একটি মৌলিক উপলব্ধি রয়েছে যে প্রতিটি নিঃশ্বাসের কণ্ঠস্বর আছে অথবা মানেহীন শব্দেরও কণ্ঠস্বর  হয়।  একটি সামান্য কঠিন বস্তু যা মহাবিশ্বকে পরিবর্তন করার চূড়ান্ত ক্ষমতা রাখে - এটি একটি উন্মাদনাময়, যাদুকর, ব্যাখ্যার মতো বৌদ্ধধর্মে মন্ত্রের শান্ত ,আরো মৃদু, শিক্ষানবিস তত্ত্ব। এটা সম্ভবত মূলত বৌদ্ধ ধারণা, বা প্রাচ্যীয় ধারণাগুলির একটি বিকৃতি - এবং প্রকৃতপক্ষে, এখানে একটি খুব মজার রচনা রয়েছে, যার নাম "দালাই লামাকে চিঠি"। আমি এটি পড়তে যাচ্ছি । সুতরাং এটি ফরাসি পরাবাস্তববাদী কবিতা, আমার মনে হয়, ১৯২০ এর, একটা বার্তা পাঠাচ্ছেন। আতো এই সময়ে দুটি চিঠি লেখেন - একটি পোপকে,  পোপকে একটি কুকুর বলে , যা ১৯৫৯ সালে ইংরেজিতে বিগ টেবিল ম্যাগাজিনে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হবার পর অ্যালেন টেট আর  কবিদের একটা দল বিগ টেবল পত্রিকায় লিখতে অস্বীকার করেছিল - এটি প্রথমবারের মতো একজন পোপকে একজন গুমুখো কুকুর বলেছিলেন, আমি বলতে চাচ্ছি, পোপকে ছেড়ে দিন, সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিন, এটা আবার, বৌদ্ধ তত্ত্ব বা বৌদ্ধধর্মের এক ধরণের অদ্ভুত বিপরীত ধারণা। [অ্যালেন আর্টাউডের "দালাই লামার সম্বোধন" পড়তে এগিয়ে যান - "আমরা আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দাস, হে গ্র্যান্ড লামা, আমাদের অনুগ্রহ/আমাদেরকে এমন ভাষায় আপনার আলোকসজ্জা দিন যা আমাদের দূষিত ইউরোপীয়/মন বুঝতে পারে..."...আমরা আশেপাশের পোপ, কবি, সমালোচক, কুকুর, আমাদের/ মন চলে গেছে সেই কুকুরদের দিকে যারা/ সরাসরি ভাবে/ পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে/ যারা বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে ভুলভাবে চিন্তা করে। আপনি, হে পোপ/অভ্যন্তরীণ শিখরে। এটা অভ্যন্তরীণভাবে যে আমি তোমার মতো: আমি, ধূলিকণা, ধারণা, ঠোঁট, উচ্ছ্বাস,/স্বপ্ন, কান্না, ধারণার ত্যাগ, সমস্ত রূপের মধ্যে ঝুলে থাকা এবং/ বাতাস ছাড়া আর কিছুর আশা করছি না"] - আসলে, এটি বেশ ভাল ফরাসি কবিতা ।এতে পরাবাস্তববাদ এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান  গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়েছে। এবং এই আলোড়ন আসলে ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে আমেরিকাকে কিছুটা আক্রমণ করেছিল। এটি প্রচুর মৃত্যু এবং মাদকাসক্তির বিভ্রান্তিকর ঘটনা ঘটিয়েছে, এবং সম্ভবত সঠিকভাবে যে স্টাইল বা পদ্ধতির (চোগ্যাম) ত্রুংপা ক্রমাগত নিন্দা করে আসছেন, আসলে এটি আরও এক আবর্জনা।কিন্তু আতোয় একটি স্বজ্ঞাত বুদ্ধিমত্তা রয়েছে যা আমি পছন্দ করি, কারণ এটি প্রায় একধরনের প্রজ্ঞাকে প্রায় আনুমানিক করে, এবং এতে সূর্যতা বা  শূন্যতার ধারণা, বা শূন্যতার  একটি মজার পশ্চিমা ম্যানিচিয়ান সংস্করণ রয়েছে। কিন্তু এটি খুবই পশ্চিমা, এই অর্থে যে এটি শরীরকে বাতিল করছে। শরীরের স্বচ্ছতা বা শূন্যতা এবং এটির অপ্রাসঙ্গিকতা দেখার চেয়ে, এটি শরীরের জন্য পাগল এবং এটি বিষ্ঠার জন্য পাগল, এবং এর মূল রেফারেন্স-পয়েন্ট হল পৃথিবী এবং বিশ্ব এবং শরীরকে বিষ্ঠা হিসাবে, যা বেশ পশ্চিমা, আসলে - কিন্তু, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি এটিকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, কবি হিসাবে, তাঁর সময়ের যে কোনও কবির চেয়ে অনেক বেশি সাহসের সাথে, এবং সেই সময়ে, কারণ তাঁকে তাঁর যন্ত্রণা এবং বেদনাকে সোচ্চার করতে হয়েছিল,  তিনি এমন একটি কবিতা-পদ্ধতি বিকশিত করেছেন যা অসাধারণভাবে ব্যবহারযোগ্য, অন্যভাবে, আমাদের নিজেদের দ্বারা। কিভাবে আপনি এটা পাবেন ?  আমি মনে করি আপনাকে আপনার অস্থায়ী ধারণাগুলিকে খুব গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার জন্য নিজেকে সচেষ্ট হতে হবে, এবং সেগুলিতে সম্পূর্ণরূপে বিনিয়োগ করতে হবে - একরকম আপনার ধারণা এবং এর কণ্ঠস্বর, এই মুহূর্তে, বা প্রকৃতপক্ষে কবি হিসাবে.. - যদি আপনি  একজন কবি হন এবং আপনার কবিতাগুলি জোরে জোরে পড়া হয় – আসলে নিজেকে সেগুলির মধ্যে ফেলে দেওয়া, যেমন, একজন মহান অভিনেতার মতো, আপনার যা আছে তা দিয়ে দিন, যদিও আপনি এটি বিশ্বাস না করেন , আপনি যা বলছেন তার ধারণায় নিজেকে বিলীন করুন , এবং এটিকে উচ্চারণ করুন যেন এটি সম্পূর্ণ বাস্তব - এবং এটি দেয়.. এটি আসলে খুব বিশ্বাসযোগ্য, একটি হ্যালুসিনেটিরি স্তরে, কিছুটা। অবশ্যই, আপনি যদি অভিজ্ঞ বৌদ্ধদের একটি দলের মুখোমুখি হন, সবাই তাদের নাক দিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন, আপনি হয়ত কোনও অণু পরিবর্তন করতে পারবেন না, তবে আপনি যদি ভীরু এবং অনিশ্চিত হন তাহলে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়াটা অপরাধ বলে গণ্য হবে।
    প্রশ্ন: অথবা  অন্য কেউ যে আপনার মত একই  বিশ্বাস করে। 
    গিন্সবার্গ: হ্যাঁ।
    প্রশ্ন: তাঁর ক্ষেত্রে…
    গিন্সবার্গ: আতোর ক্ষেত্রে ?
    প্রশ্ন: এতে তাঁর উদ্বেগ  বেড়েছে বলে মনে হয়।
    গিন্সবার্গ : কীভাবে আপনি অমন অবস্হা পেতে পারেন ?  আমি মনে করি আপনাকে আপনার অস্থায়ী ধারণাগুলোকে খুব গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার জন্য নিজেকে জীবনের মধ্যে নিক্ষেপ করতে হবে, এবং সেগুলোয় সম্পূর্ণরূপে বিনিয়োগ করতে হবে - একরকম আপনার ধারণা তৈরি হবে এবং এটির কণ্ঠস্বর, এই মুহূর্তে, বা প্রকৃতপক্ষে কবি হিসাবে.. - যদি আপনি  একজন কবি হন আর আপনার কবিতাগুলো জোরে জোরে পড়া হয় – আসলে নিজেকে সেগুলোর মধ্যে ফেলে দেওয়া, যেমন, একজন মহান অভিনেতার মতো, আপনার যা আছে তা দিয়ে দিন, যদিও আপনি এটি বিশ্বাস নাও করতে পারেন , আপনি যা বলছেন তার ধারণায় নিজেকে বিলীন করুন , আর এটিকে উচ্চারণ করা যেন এটি সম্পূর্ণ বাস্তব - এবং এটি আপনাকে দেবে.. এটি আসলে খুব বিশ্বাসযোগ্য, একটি হ্যালুসিনেটিরি স্তরে, কিছুটা। অবশ্য, আপনি যদি অভিজ্ঞ বৌদ্ধদের একটি দলের মুখোমুখি হন, সবাই তাদের নাক দিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন, আপনি হয়ত কোনও অণু পরিবর্তন করতে পারবেন না, তবে আপনি যদি ভীরু এবং অনিশ্চিত মানুষ হন তবে এটি তাদের গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট অপরাধী করে তুলতে পারে...।যেমন, আতো ভেবেছিলেন, সম্ভবত, নিম্নতমের মাধ্যমে, একটি নতুন দৃষ্টি জগতে পৌঁছানোর জন্য - এবং সেগুলি অবশ্যই আর্তুর র‌্যাঁবোর দ্রষ্টা হওয়ার প্রচেষ্টায় ফিরে যায়, একটি "দীর্ঘ যুক্তিযুক্ত বিভ্রান্তির মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গুলির" - সমস্ত ইন্দ্রিয়ের একটি দীর্ঘ যুক্তিসঙ্গত বিভ্রান্তি ("dérèglement de tous les sens"), বিচ্ছিন্নতার সাথে পরীক্ষা করার মাধ্যমে, মামা-পাপা (বা বাবা-মা) দ্বারা নিঃশর্ত চেতনার সমতলে পৌঁছে। এবং, প্রকৃতপক্ষে, এটি বৌদ্ধ অনুশীলন থেকে খুব বেশি দূরে নয়, কারণ, মনোযোগ দিয়ে, সামথ্থ ধ্যানে, শ্বাস-প্রশ্বাসের  প্রতি, আপনি যা করছেন তা ঐতিহ্যের যান্ত্রিক শৃঙ্খল, বা যৌক্তিক মেলামেশা এবং মন-উচ্চারণে বাধা সৃষ্টি করছে। যে জগতে আপনি আপনার জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত, যে জগতে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত, এবং মনকে শূন্য করে ফেলছি, বা ঝলকানো ছবিগুলোর সেই শৃঙ্খলাকে আরও স্বচ্ছ করে তুলছি, যতক্ষণ না সেগুলি কম আবেশী এবং কম দৃঢ় না হয় , যতক্ষণ না তারা স্বচ্ছতার একটি অবস্থা অর্জন করে, যেখানে আপনার আর তাদের উপর কাজ করতে হবে না। কিংবা, ধরা যাক, যৌন আনন্দের একটা ছবি , এবং তারপরে তাকে আপনার মনের মধ্যে  বারবার জাগিয়ে তোলা, ত্রিশ দিন ধরে দিনে দশ ঘন্টা বসে থাকা, যতক্ষণ না আপনি টের পাচ্ছেন, আপনি এতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, আসলে যা  উইলিয়াম বারোজ, আসলে, ‘নেকেড লাঞ্চ’ এর "ব্লু মুভি" অংশ - যেটিতে তিনি তাঁর মৌলিক আবেশমূলক যৌন থিমগুলি গ্রহণ করেছেন - যা  অনৈচ্ছিক প্রচণ্ড উত্তেজনা ,যা তাঁকে সর্বদা ব্যস্ত রাখে, - এবং এটি পরিচালনা করে একটি "ব্লু মুভি" - দৃশ্যের পর দৃশ্য বিভিন্ন সংমিশ্রণে - যতক্ষণ না, শেষ পর্যন্ত, তিনি যা করতে পারেন... .. শেষ কাজটি হল অভিনেতারা তাদের গলায় দড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে এবং সামান্য শুক্রাণু ফোঁটা ফেলছে ঠোঁটে এবং একটি ক্লান্ত, ক্লান্ত, অভিব্যক্তি, সম্পূর্ণ উদাস, ঝুঁকে পড়ছে– এটা নেকেড লাঞ্চের "ব্লু মুভি" অংশ। সুতরাং এটা অঁতনা আতো আরফিলিপ ল্যামান্টিয়া আর অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর একটি নির্দিষ্ট বিন্দু। আমার যে কবিতাটা আমি আপনাকে পড়ার পরামর্শ দিচ্ছি সেটি হল "পোয়েট অ্যাজ প্রিস্ট"-এর শুরু, যা - "ডেথ টু ভ্যান গগ’স ইয়ার" - যার শিরোনাম অঁতনা আতোর বাক্যাংশ থেকে নেয়া হয়েছে - আর ভ্যান গঘ  কী ব্যাপারে পাগল ছিলেন? তিনি কেবল একটি কান বা এ জাতীয় কিছু কেটে ফেলেছিলেন। একজন বেশ্যার দ্বারা অপমানিত হওয়ার সময় তিনি কেবল একটি কান কেটে ফেলেছিলেন - একে পাগলামি বলে না! - তিনি শুধুমাত্র একটি কান কেটে ফেলে ছিলেন যখন কিনা আণবিক বোমা ফেলারর যৌথ ষড়যন্ত্রকারীদের চারপাশে দানব দৌড়াচ্ছে। তিনি যা করেছিলেন তা হলো স্রেফ নিজের একটা কান কেটে ফেলা। তাই আমার শিরোনাম ছিল, "ডেথ টু ভ্যান গঘস ইয়ার"।
    [ অ্যালেন গিন্সবার্গ আরকাইভে প্রকাশিত ]
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:৪৮740591
  • অঁতনা আতো : ‘আতো দ্য মোমো’ কাব্যগ্রন্হ থেকে
    মাটির সাথে মিশে যাওয়া গলিত শবের চাকা লাগানো জমিতে,
    গলিত শবের  শ্বাসপ্রশ্বাসের জমিতে
    এই শূন্যতার,
    শক্ত আর নরমের মধ্যে।
    .
    কালো, বেগুনি,
    অনমনীয়
    বিনোদনমূলক
    আর এটাই সবকিছু।.
    .
    যার মানে হলো একটা হাড় রয়েছে,
    কোথায়
    সৃষ্টিকর্তা
    বসলেন  কবির ওপর,
    তার বাক্যগুলোর
    গ্রাহীক্ষমতা মুছে ফেলার  জন্য
    যেন মগজটা পাদছে
    যে সে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তার গুদের ভেতর থেকে বের করে আনে,
    যে সে তার ভেতর থেকে বের করে আনবে
    যুগের তলানি থেকে,
    তার গুদের  গর্ত পর্যন্ত,
    আর  এটা গুদ সম্পর্কে কোনো কৌতুক নয়
    যে সে তার উপর এভাবেই খেলতে থাকে,
    এটা সমগ্র পৃথিবীর কৌতুক
    যার অণ্ড আছে
    তার পুরুষালি গুদের ভেতরে
    আর যদি আপনি ছবিটা বুঝতে  না পারেন,
    --আর সেই কথাই  আমি আপনাকে  বলতে শুনছি
    বৃত্তের মধ্যে, যে
    আপনি ছবিটা টের পাবেন না
    যা একেবারে তলার দিকে
    আমার গুদের গর্তে,--
    তার কারণ আপনি অতলের কথা জানেন না,
    জিনিসপত্রের নয়,
    তা আমার গুদের,
    আমার,
    যদিও যুগের তলানি থেকে
    আপনারা সবাই  সেখানে গোল-চক্কোর মেরে জিভ দিয়ে চাটছেন
    যেন একজন পরকীয়াকে গালাগাল দিচ্ছেন,
    বন্দী করে মৃত্যুদণ্ডের ষড়যন্ত্র কষছেন।
    গে রে ঘি
    রেগহেঘি
    গেঘেনা
    এ রেঘেনা
    আ গেঘা
    রিরি
    পোঁদ আর শার্টের মধ্যে,
    বীর্য আর জুয়ায় কম বাজির  মধ্যে,
    সদস্য আর হেরো লোকের মধ্যে,
    ঝিল্লি আর ব্লেডের মধ্যে,
    নরুন এবং ছাদের মধ্যে,
    শুক্রাণু এবং বিস্ফোরণের মধ্যে,
    'মাছের কাঁটা’ আর  'শিকনির’  মাঝে

    পোঁদ এবং প্রত্যেকের মধ্যে
    খিঁচুনি
    চেপে দেবার ফাঁদ
    একটা বীর্যপাত মৃত্যুর হইচই
    একটা বিন্দু নয়
    বা একটা পাথরও নয়
    আবদ্ধ এলাকায় মরে  ফেটে যাওয়া
    বা আত্মার বিচ্ছিন্ন অংশও নয়
    (আত্মা জিনিসটা পুরোনো করাত ছাড়া আর কিছুই নয়)
    বিচ্ছিন্নতার শ্বাসের
    কিন্তু ভয়াবহ কালহরণ
    ধর্ষিত, ডানা-ছাঁটা, পুরোপুরি চুষে ফেলা
    সমস্ত অস্বচ্ছল ক্যারদানি করে
    গুমাখা লোকগুলোর
    বেঁচে থাকার জন্য
    যাদের খাবার মতন আর কোনো খোরাক ছিল না
    আতোকে
    গিলে ফেলা ছাড়া
    মোমো
    আমার তুলনায়
    সেখানে, যেখানে একজন তাড়তাড়ি সঙ্গম সেরে ফেলতে পারে
    আমার চেয়ে
    দ্রুত ঠাটিয়ে ফেলতে পারে
    আমার ভেতরে
    যদি সে তার মাথা রাখার যত্ন নেয়
    সেই হাড়ের বাঁকের ওপরে
    যা মলদ্বার আর লিঙ্গের মাঝে থাকে,
    যে কোদাল হাড়ের কথা আমি বলছি
    একটা স্বর্গের 
    আঁস্তাকুড়ের মধ্যে
    পৃথিবীতে যার প্রথম প্রতারণা
    বাবা বা মা ছিল না কেউ
    কে তোমাকে এই গুহায় এনে ফেলেছে,
    কিন্তু
    আমি
    আমার উন্মাদনায় জড়িয়ে গেছি।"
    ওরা এটারই  অনুশীলন করে।
    যদি কোনো ডাক্তার না থাকত
    তাহলে কোথাও কখনো রোগী হত না,
    রোগাক্রান্ত কঙ্কালদের
    মেরে ফেলে কাটাছেঁড়া আর চামড়া ছাড়াবার জন্য,
    কেননা সমাজ আরম্ভ হয়েছে ডাক্তারদের মাধ্যমে 
    রোগীদের মাধ্যমে নয়।
    যারা বেঁচে থাকে, তারা মৃতদের জিনিসপত্র খেয়ে বাঁচে।
    আর এর জন্য জরুরি যে একইভাবে মৃত্যুও বেঁচে থাকুক;
    আর উন্মাদ আশ্রমের মতন কিছুই নেই যা শান্তভাবে পালন করবে
    মৃত্যুকে , এবং মৃত মানুষদের  ইনকিউবেটরে পুরে রাখবে।"

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:৪৯740592
  • অঁতনা আতো ও জার্জি গ্রটস্কি
    অভিনেতাদের জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা শহীদদের মতো হওয়া উচিত, জ্বলন্ত অবস্হায় খুঁটি থেকে  আমাদের দিকে ইঙ্গিত করছে।—অ্যান্টোনিন আর্টাউড
    অভিনেতা নিজেকে পুরোপুরি  উপহার হিসেবে উজাড় করে দেয়।—জার্জি  গ্রটস্কি
    অঁতনা আতো আর জার্জি গ্রটস্কি বিশুদ্ধ এবং ফলিত বিজ্ঞানের মতোই একে আরেকের থেকে আলাদা, তবে অঁতনা আতো’র নাট্যতত্ব ছাড়া জারজি গ্রটস্কির উদ্ভব  সম্ভব ছিল না বলেই মনে হয় । আতো ছিলেন একজন অসফল ফরাসি অভিনেতা যিনি ১৯৪৮ সালে উন্মাদ অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন। তিনি  স্বপ্নদর্শী কবি, অভিনেতা, তাত্বিক এবং নাট্যব্যাক্তিত্ব  ছিলেন যাঁর স্বপ্ন ছিল থিয়েটার কি হতে পারে।
    গ্রটোভস্কির বয়স যখন প্রায় 14 বছর তখন আর্টাউড মারা যান, তাই তারা স্পষ্টতই দেখা করেননি। 1964 সালে রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানির ম্যারাট/সেডের অত্যন্ত প্রশংসিত প্রযোজনা (পিটার ওয়েইস দ্বারা রচিত এবং পিটার ব্রুক দ্বারা পরিচালিত) এর পথপ্রদর্শক কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার আগে গ্রোটোস্কি আর্টাউড এবং তার থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির তত্ত্ব সম্পর্কে ভালভাবে জানতেন। গ্রোটোভস্কির কাজ নাট্যজগতে ব্যাপক স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছিল। 
    জার্জি মারিয়ান গ্রটস্কি ১৯৩৩ সালে পোল্যান্ডে  জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লুডউইক সলস্কি অ্যাকাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টস্  এবং রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অব থিয়েটার আর্টস্  থেকে নাট্যবিষয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি প্রথম নাটক পরিচালনা করেন ১৯৫৭ সালে ২৪ বছর বয়সে পোল্যান্ডের ক্রাকো শহরে। ১৯৫৯ সালে পোল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ওপোল  শহরে তিনি  ‘থিয়েটার ল্যাবরেটরি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬০ এবং ১৯৭০ – এর দশকে তিনি তাঁর ল্যাবরেটরি থিয়েটার নিয়ে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে তাঁর নাটকের প্রদর্শনী করেন। ১৯৮২ সালে তিনি পোল্যান্ড ত্যাগ করে আমেরিকায় চলে যান। আমেরিকায় থাকার সময় তিনি বুঝতে পারেন যে, নাটক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিসর  আমেরিকায় কম। তাই আমেরিকা ছেড়ে তিনি ইতালিতে চলে যান। ইতালিতে ১৯৮৫ সালে ‘গ্রটস্কি ওয়ার্কসেন্টার’  নামে একটা নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তিনি নাটক নিয়ে স্বাধীনভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। তিনি ছোট ছোট বিভিন্ন দল নিয়ে খুব গভীরভাবে কাজ করতে শুরু করেন এবং অভিনেতাদের আত্মসচেতনতা ও আত্মোপলব্ধির বিকাশে সহযোগিতা করতে থাকেন। গ্রটস্কি তাঁর এই কাজকে  ‘প্যারা থিয়েটার’ বলতেন । তিনি  লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৯ সালের ১৪ ই জানুয়ারি ইতালির পন্টেডেরাতে  মারা যান । অঁতনা আতোর মতনই মূল ধারার থিয়েটার থেকে সরে যাবার ফলে থিয়েটারের বিকাশে তিনি তাঁর নবতর অবদান রেখে গেছেন। থিয়েটার করতে গিয়ে গ্রটস্কি অনুভব করেছিলেন যে, যতই থিয়েটারে মেকআপ, লাইট, যন্ত্রানুষঙ্গ , পোশাক, সঙ্গীত প্রভৃতির ব্যবহার করা হোক না কেন থিয়েটার কখনই টেলিভিশন এবং সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না। তিনি থিয়েটার থেকে এগুলোকে বাদ দিলেন এবং পুওর থিয়েটার -এর জন্ম দিলেন। তাঁর পুওর থিয়েটার-এ অভিনেতাদের শারীরিক ও মানসিক উপস্থিতি এবং দর্শকের সঙ্গে অভিনেতার‌ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টাই শেষ কথা। তিনি বিলাসবহুল মঞ্চ ও অডিটোরিয়াম থেকে তাঁর থিয়েটারকে বের করে এনে বিভিন্ন পুরোনো বিল্ডিং, কখনও কখনও সাধারণ ঘরের মধ্যে ৫০ থেকে ১০০ জনের মত অল্প সংখ্যক দর্শক নিয়েও থিয়েটার করতে শুরু করলেন।  তাঁর পুওর থিয়েটারের ধারনা বিশ শতকের থিয়েটারে নির্দেশনার জগতে এবং মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।এক্ষেত্রে অভিনেতা ও দর্শক একই‌ স্পেস ব্যবহার করতো, অভিনেতা ও দর্শকদের মধ্যে পৃথক স্থানের ব্যবস্থা তিনি রাখেননি। থিয়েটার চলাকালীন তিনি দর্শকদের এমনভাবে বসাতেন যাতে থিয়েটার দেখতে কারও কোনও অসুবিধা না হয়। এই থিয়েটার গরিব ও ধনী দর্শকদের মাঝে কোনও বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি।
    গ্রটস্কি  পরাবাস্তববাদী ছিলেন না । প্রতীকী নাটকের ধারণার মধ্যে কিছু সাধারণ ভিত্তি পাওয়া যেতে পারে, তবে অঁতনা আতো এবং অন্যান্য পরাবাস্তববাদীদের থেকে গ্রটস্কির পদ্ধতি খুব আলাদা ছিল। গ্রটস্কি তুলনামূলকভাবে বেশ রাশভারি গম্ভীর  মানুষ ছিলেন, এবং থিয়েটার সম্পর্কে যথেষ্ট বিচক্ষণ ছিলেন। গ্রটস্কি আর্কিটাইপগুলিতে আগ্রহী ছিলেন; তিনি মনে করতেন নড়াচড়া, শব্দ এবং পরিস্থিতি মানুষের অবস্থার জন্য মৌলিক এবং মানব সংস্কৃতি জুড়ে সেগুলো ব্যাপকভাবে বোধগম্য। তিনি এগুলিকে তাঁর অভিনেতাদের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন যাতে দর্শকদের সাথে খুব প্রাথমিক স্তরে যোগাযোগ করা যায়।  এটি অঁতনা আতোর প্রতীকী নাটকের মতো । গ্রটস্কি এবং আতো উভয়ই নাট্য উৎস হিসাবে প্রতীকবাদ এবং আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু তাঁরা সেগুলো আলাদাভাবে বিকাশ ও প্রয়োগ  করেছিলেন।অঁতনা আতোর বালিনিজ নৃত্যানুষ্ঠান সম্পর্কে  আগ্রহের মতন  গ্রটস্কি আফ্রিকান এবং আফ্রো-ক্যারিবিয়ান ঐতিহ্যবাহী গান এবং আচার আন্দোলনের পাশাপাশি খ্রিস্টান নস্টিক ঐতিহ্য থেকে নাটকের উপাদান ব্যবহার করতেন।
    কাব্যিক যদিও কখনও কখনও মজি ভাষায়, তিনি "নিষ্ঠুরতার থিয়েটার" ধারণাটি তৈরি করেছিলেন। শুধুমাত্র প্রচলিত ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দগুচ্ছকে ব্যাখ্যা করা মানে আর্টাউড এর দ্বারা যা বোঝায় তা অনেকটাই মিস করা। উদাহরণস্বরূপ, তিনি লিখেছেন, "যা কিছু কাজ করে তা একটি নিষ্ঠুরতা," এবং "নিষ্ঠুরতা কঠোরতা।" আর্টাউডের দৃষ্টিভঙ্গি এমন একটি থিয়েটারকে ঘিরে রেখেছে যা প্লেগের মতো দর্শকদের মধ্য দিয়ে যেতে পারে, বুলেটের মতো সরাসরি হতে পারে, মৃত্যু, শাহাদাত এবং প্রেমে পাওয়া যন্ত্রণা এবং আনন্দকে মুক্তি দিতে পারে।তিনি অনুভব করেছিলেন যে থিয়েটার শব্দে শ্বাসরোধ করছে এবং শুধুমাত্র লক্ষণ, শব্দ এবং মিথের আদিম শক্তির মাধ্যমে পুনর্জন্ম হতে পারে। সর্বোপরি, তিনি থিয়েটারে একটি জ্বলন্ত তীব্রতা অনুভব করতে চেয়েছিলেন যা দর্শকদের আনন্দিত করবে: "আমাদের কাছে যে দর্শক আসে সে জানে যে সে একটি সত্যিকারের অপারেশন করতে রাজি হয়েছে, যেখানে কেবল তার মন নয়, তার ইন্দ্রিয় এবং তার মাংস রয়েছে। খেলায় আসতে যাচ্ছে। তাকে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে আমরা তাকে চিৎকার করতে সক্ষম।"
    কালখণ্ডের যন্ত্রণা । এইভাবে বললে, থিয়েটারের অঁতনাবাদী ধারণাটি একটি তুচ্ছ দুঃখ মনে হয় এবং এটি কেবলমাত্র ১৯২০ শতকের ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার প্রতিসরণ হিসাবে বোঝা যায়, ইউরোপের  সমস্ত অত্যাচার এবং হত্যাকাণ্ড সহ। ব্রেখত শ্রোতাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সচেতনতায় থাপ্পড় মেরে জাগাতে চেয়েছিলেন যাতে এটি যুগের কুফলগুলিকে সংশোধন করতে পারে, অঁতনা আতো তাকে যুগের যন্ত্রণার রক্তক্ষরণকে মানসিক সচেতনতায় পরিণত করতে চেয়েছিলেন; আধুনিক থিয়েটারে যারা বিশেষভাবে অঁতনা আতোর তত্বকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন জুলিয়ান বেক এবং জুডিথ মালিনার লিভিং থিয়েটার, ব্রিটিশ পরিচালক পিটার ব্রুক (মারাট/সেড) এবং তার পোলিশ ল্যাবরেটরি থিয়েটারের  পরিচালক জার্জি গ্রটস্কি।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:৫১740593
  • অঁতনা আতো এবং পরাবাস্তববাদ

    অঁতনা আতো ১৯২৪  সালের অক্টোবরে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, যে সময়ে তাঁদের জার্নাল চালু হয়েছিল আর আঁদ্রে ব্রেতঁর প্রথম ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছিল। আতো ‘লা রেভোলিউশন সাররিয়ালিস্ট জার্নালে’ নিয়মিত লিখতেন এবং বেশ কয়েকটি বিষয় সম্পাদনা করেছিলেন। তিনি পরাবাস্তব গবেষণা ব্যুরোও পরিচালনা করেছিলেন। মূল সদস্যদের অনেকের মতো, আতোকেও ব্রেতঁ পরাবাস্তব আন্দোলন থেকে ১৯২৬ সালে বহিষ্কার করেন। আতোর প্রস্থান উপলক্ষ্যে, আরাগঁ, ব্রেতঁ, এলুয়ার, বেঞ্জামিন পেরে এবং পিয়ের ইউনিক ‘গ্রাঁ জার্নাল’  নামে একটি ব্রোশিওর প্রকাশ করেছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল পরাবাস্তববাদী গোষ্ঠী থেকে আতো এবং সুপো এই দুজনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বের করে দেওয়া ।”স্বাক্ষরকারীদের" উদ্দেশ্য ছিল  সদস্যপদ সম্পর্কে জনসাধারণকে জানানো ।
    ১৯২৭ সালের জুন মাসে আতো দেরি না করে উত্তর দেন ‘টু দ্য গ্রেট নাইট বা পরাবাস্তববাদী ব্লাফ’ শিরোনামের একটি লেখায় । তিনি লেখেন “পরাবাস্তববাদীরা আমাকে তাড়া করেছে নাকি আমি নিজেই তাদের বিভৎস দলবাজিকে  লাথি মেরে বের করে দিয়েছি এই প্রশ্ন  দীর্ঘ সময়ের জন্য ওঠেইনি। পরাবাস্তববাদীরা বিপ্লবের সাথে একমত নাকি পরাবাস্তববাদী অ্যাডভেঞ্চারের বাইরে এবং উর্ধ্বে বিপ্লব দরকার তা ভাববার, যখন কেউ তা চিন্তা করে তখন অবাক হতে হয় যে পরাবাস্তব গোষ্ঠী নিজেদের সময়ের নৈতিকতার উপর যৎসামান্য প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল।  আতো কবিতা এবং জীবন সম্পর্কে ব্রেতঁর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পৃথক দৃষ্টিভঙ্গী উপস্হাপন করেছিলেন । তাঁর রচনা "টু দ্য বিগ নাইট বা পরাবাস্তববাদী ব্লাফ" এ ব্যাখ্যা করেছেন যে "তারা জীবনকে যতটা পছন্দ করে ততটা আমি ঘৃণা করি"। আতোর বেঁচে থাকার ক্রোধ কিন্তু বিস্মিত হবার ক্ষমতা দিয়ে চিহ্নিত  হয় না, বরং এর বিপরীতে দুর্ভোগ এবং দুরারোগ্য যন্ত্রণা দিয়ে চিহ্নিত  হয়। এটি তাঁর সাহিত্যের নন্দনতত্ত্বে অনুভূত : আতো তাঁর  লে পেসে-নর্ফস ( স্নায়ুর স্কেল )-এ ঘোষণা করেছেন যে "সমস্ত লেখাই ঝুলকালি।উল্লেখ্য যে, ১৯২০-এর দশকে প্যারিসের মঞ্চে অভিনীত, পরাবাস্তববাদী নাটকগুলোকে প্রায়শই এই বলে সমালোচনা করা হতো যে তারা মূলধারার বিনোদন ছাড়া অন্য কিছু নয় । তবে গুরুত্বপূর্ণভাবে, থিয়েটারে পরাবাস্তববাদ ১৯২০ এবং ১৯৩০ এর দশকে অঁতনা আতোর থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি এবং ১৯৫০ এর দশকে থিয়েটার অফ দ্য অ্যাবসার্ড আন্দোলনের পথ তৈরি করেছিল, সবই প্যারিসে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য পরাবাস্তববাদী নাটকের সংখ্যা কম।
    ব্রেতঁ বিশ্বাস করতেন যে স্বপ্নগুলো মনের তৈরি, যেখানে আতো বিশ্বাস করতেন যে সেগুলি জীবনের মতো বাস্তব এবং আমাদের অবচেতন সমাজ দ্বারা নিপীড়িত হচ্ছে। আতো বলেছেন, “এটা কতটা কঠিন, যখন সবকিছুই আমাদের ঘুমাতে উৎসাহিত করে, অথচ আমরা আমাদের সম্পর্কে সচেতন, , জেগে উঠে  স্বপ্নের মতো আমাদের দিকে তাকাতে পারি, এমন চোখ দিয়ে যা তাদের কার্যকারিতা এবং যার দৃষ্টি তাকে মনে রাখে  না।  বাস্তবের মতো স্বপ্নের ক্ষেত্রেও আতো এবং ব্রেতঁর  মতামত ভিন্ন ছিল। আতো বলেছেন যে কীভাবে সবকিছু জাগতিক এবং আপনাকে ক্লান্ত হতে এবং ঘুমাতে বাধ্য করে, এবং আপনি যখন স্বপ্ন দেখেন তখন এটি বাস্তব কিনা তা বোঝা কঠিন। পরাবাস্তববাদী আন্দোলন থেকে আলাদা, আতো তাঁর শ্রোতাদের উপর একটি ভয়ঙ্কর এবং মানসিক প্রভাব ফেলতে চেয়েছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে তাঁর কাজটি এমন হবে যে তা দর্শকদের হতবাক করবে। শ্রোতাদের এমন অনুভূতির মাঝে ছেড়ে দেওয়া উচিত যেন তাদের সত্যিকারের  অভিজ্ঞতা এবং আবেগ পরিস্কার হয়ে গেছে। তিনি বলেন, “সত্তার গুহা ত্যাগ করুন। আমার সঙ্গে আসুন। মন মনের বাইরে নিঃশ্বাস নিক। আপনার বাসস্থান পরিত্যাগ করার সময় এসেছে। সার্বজনীন চিন্তাধারার কাছে আত্মসমর্পণ করুন।" । এটি পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে ব্রেতঁর কাজের থেকে ভিন্ন ছিল, কারণ ব্রেতঁ শিল্পকে মানুষদের আতঙ্কিত করার জন্য নয় বরং একটি  দার্শনিক পদ্ধতি ।
    প্রকৃতপক্ষে, তিনি হিংস্রভাবে সাহিত্য এবং সাহিত্যিকদের সাথে সবরকম আত্মীয়তা প্রত্যাখ্যান করেন। Le Pèse-Nerfs-এ  তিনি লিখেছেন: “সমস্ত সাহিত্যিক ভদ্রতা নোংরা, এবং বিশেষ করে এই সময়ের। যাদের মনে প্রসঙ্গবিন্দু আছে, আমি বলতে চাইছি মাথার একটা বিশেষ  দিকে, তাদের মস্তিষ্কের ভাল-জায়গায় , যারা তাদের ভাষার মাস্টারমশায়,  যাদের জন্য শব্দের মানে আছে, যাদের জন্য  আত্মার উচ্চতা আছে, চিন্তার স্রোত আছে, যাদের আছে সময়ের চেতনা, এবং যারা চিন্তার এই স্রোতের নামকরণ করেছে, তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই ।  আতো এইভাবে শিল্পের যেকোন প্লেটোনিজম থেকে অপূরণীয়ভাবে দূরে সরে গেছেন: “প্লেটো লেখাকে দেহ হিসাবে সমালোচনা করেন।আতো বলেছেন দেহকে মুছে ফেলার কথা, কেননা দেহের জীবন্ত ভঙ্গি  একবারই ঘটে। 
    জাঁ-পিয়েরে লে গফের মতে, পরাবাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি মূলত দ্ব্যর্থক, আঁদ্রে ব্রেতঁ এবং অঁতনা আতো’র চিন্তাভাবনা ও কাজকর্ম দ্বারা এর দুটি মেরুতে চিহ্নিত। পরাবাস্তববাদের এই দুটি দর্শন একই সাথে বিপরীত এবং পরিপূরক। ব্রেতঁ মূলত জীবনের সৌন্দর্য এবং আশ্চর্যের সন্ধান করেছিলেন, তিনি অচেতনের "বিরক্তিকর অন্যত্ব" শিল্পের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন, "ইরোসের ইতিবাচক গতিশীলতা"-র ওপর তাঁর চিন্তাকে কেন্দ্র করে বিপ্লবের দিকে নিয়ে যান। ব্রেতঁর প্রতি আতোর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দ্বিধাবিভক্ত। ১৯৩৭ সালে, যখন তিনি সত্তার নতুন প্রকাশগুলি লেখেন, তখন তিনি ব্রেতঁকে "অ্যাঞ্জেল গ্যাব্রিয়েল" বলে ডাকতেন। তিনি ব্রেতঁকে আয়ারল্যান্ড থেকে যেভাবে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে সেভাবেই তাঁকে সম্বোধন করেছিলেন। তবে ব্রেতঁও সেই একজন যাঁর সম্পর্কে আতো তাঁর বন্ধু জ্যাক প্রেভেলকে জীবনের শেষ দিকে প্যারিসে বলবেন: “আপনি যদি আঁদ্রে ব্রেতঁর  কবিতাকে  হুক দিয়ে আলোড়িত করেন তবে আপনি কবিতাগুলো বুঝতে পারবেন।” 
     আতোকে পরাবাস্তববাদী গোষ্ঠী থেকে বের করে দিলেও লেখালিখি-আঁকা ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁর  বিশ্বাসগুলোর সঙ্গে পরাবাস্তববাদীদের  ভালভাবে মিল আছে। তারা কবিতার একটি বিশাল সংজ্ঞা ভাগ করে নিয়েছে। রবার্ট মাদারওয়েল, যিনি, ব্যাখ্যা করেছেন যে "আন্দ্রে ব্রেতঁ দৃষ্টিতে, একজন লেখক সত্যিকার অর্থে পরাবাস্তববাদী নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একজন 'কবি', লেখার জনার যাই হোক না কেন।  সংজ্ঞা অনুসারে পরাবাস্তববাদীরা ছিলেন কবি। পরাবাস্তবতা ছিল এক ধরনের লিরিকাল আচরণ, যা নৈতিক নীতি, বুর্জোয়া পরিস্থিতি এবং অবিরাম সৃষ্টির সাথে জড়িত। আতোর প্রথম সৃজনশীল আবেগ ছিল কবিতা—তিনি এই সময়ের মধ্যে তাঁর প্রথম বই, ‘ব্যাকগ্যামন ইন হেভেন’ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর সমস্ত কাজে এই প্রাথমিক কাব্যিক আবেগের ধারাবাহিকতা ছিল। আর আতো যখন কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন, তখন সারা জীবন তিনি মুক্তির অভিব্যক্তির জন্য নিরবচ্ছিন্ন অনুসন্ধানের মাধ্যমগুলো অনুসন্ধান করে গেছেন ; তিনি কবিতা থেকে থিয়েটারে চলে যান, তারপর ছবি আঁকায় এবং আবার কবিতায় ফিরে যান। এই কাব্যিক  লাইন তাঁর পাঠবস্তুর মধ্যে সংযোগ  পরাবাস্তববাদী বিশ্বাসের সাথে মিলে যায়।
     মেরি অ্যান কাউসের সাথে একই সাক্ষাৎকারে, মাদারওয়েল বলেছেন: “পরাবাস্তববাদী কবিরা খুব কমই তাদের টেক্সটের মধ্যে কোনওরকম ভাঙন তৈরি করেছিলেন। রবার্ট ডেসনোস, উদাহরণস্বরূপ, তাঁর সমস্ত কবিতাকে একটি মহান কবিতার অংশ হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন - ঠিক যেমন  প্রতীকবাদী কবি স্টিফেন ম্যালারমে সমস্ত লেখাকে একটি বইয়ের অংশ হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন।”  পরাবাস্তববাদীদের মতে, প্রতিটি সীমা লঙ্ঘন করা উচিত: ধারার, যুক্তিবাদী চিন্তার, এবং যেগুলি বাইরের জগত থেকে অভ্যন্তরীণ জগতকে আলাদা করে, সবকিছুর। আঁদ্রে ব্রেতঁ প্রথম পরাবাস্তববাদী ইশতেহারে, ঘোষণা করেছিলেনন, এই দিন এবং যুগে, যৌক্তিক পদ্ধতিগুলি শুধুমাত্র গৌণ স্বার্থের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রযোজ্য। পরম যুক্তিবাদ যা এখনও প্রচলিত  তা  শুধুমাত্র আমাদের অভিজ্ঞতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত তথ্য বিবেচনা করতে দেয়। যৌক্তিকতার তর্ক, বরং বিপরীতভাবে, আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যায়।  এটা বলা অর্থহীন যে অভিজ্ঞতা নিজেই নিজেকে ক্রমবর্ধমান সীমাবদ্ধতায় খুঁজে পায়। এটি একটি খাঁচায় আটকে পড়ে যেখান থেকে এটির বের হওয়া আরও বেশি কঠিন।  সভ্যতা ও প্রগতির ছলে আমরা মন থেকে এমন সব কিছু দূর করতে পেরেছি যাকে সঠিক বা ভুলভাবে কুসংস্কার বা অভিনব বলা যেতে পারে; যে কোনো ধরনের সত্য অনুসন্ধান করা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে যা স্বীকৃত অনুশীলনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পরাবাস্তববাদীরা যৌক্তিক চিন্তাভাবনাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছিলেন যা অবচেতন থেকে আসবে। অঁতনা আতোও যুক্তিবাদী চিন্তাধারা থেকে বৈপ্লবিক মুক্তির অনুসন্ধান করেছিলেন।  আঁদ্রে ব্রেতঁ বলেছিলেন,  "চিন্তার ধ্রুবককে বিনিময়ের গ্যারান্টি দেওয়া, যা অবশ্যই বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ জগতের মধ্যে বিদ্যমান থাকতে হবে, এমন একটি বিনিময় যার জন্য কার্যকলাপের ক্রমাগত আন্তঃপ্রবেশ প্রয়োজন।
    অঁতনা আতো অভ্যন্তরীণ/বাহ্যিক জগতের এই একই রূপক ব্যবহার করে পরাবাস্তববাদীদের সমালোচনা করেছেন যে তাঁরা এই প্রতর্ক খুঁজে পায়নি। ১৯৩৬ সালে মেক্সিকো ভ্রমণের সময় আতোর একটি বক্তৃতা "ম্যান অ্যাগেইনস্ট ডেসটিনি"-তে, আতো মার্কসবাদের ব্যর্থতার বিশদ সমালোচনার পাশাপাশি পরাবাস্তববাদকে খারিজ করে দিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট বিপ্লব, যদিও "চিন্তার সাথে সম্পর্কিত", চিন্তাকে তার সম্পূর্ণ গতিশীল আন্দোলনের অনুমতি দেয় না। আতো জোর দিয়ে বলেছেন যে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা তার গতিশীলতা থেকে অস্তিত্বকে আলাদা করে দেয়।যদিও, চিন্তাধারা, তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, তিনটি আন্দোলনের সংমিশ্রণ: ভিতরের দিকে একটি আন্দোলন, বাইরের দিকে একটি আন্দোলন এবং একটি ঘূর্ণনশীল আন্দোলন। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা - যৌক্তিক যদিও - মানে "বাস্তবতার ছোট প্রান্তের মধ্য দিয়ে একটি ল্যান্ডস্কেপ দেখা। মার্কসবাদের জন্য একটি সমান্তরাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা "পরীক্ষার বা চিন্তার দৃষ্টিকোণ থেকে   আসে, অর্থাৎ বাহ্যিক দিক থেকে তথ্যের জগতে প্রবেশ করে। অঁতনা আতো ব্যাখ্যা করেছেন যে "মানুষের বাহ্যিক কার্যাবলী নিয়ে  ব্যস্ততা মানুষকে মানুষের গভীর উপলব্ধি থেকে দূরে নিয়ে যায়। আর মনে রাখা দরকার যে মনের মধ্যে একটা পুরো পৃথিবী আছে। কমিউনিস্ট বিপ্লব চিন্তার অভ্যন্তরীণ জগতকে উপেক্ষা করে। আর্টাউডের অনুমানে, তখন পরাবাস্তববাদীরা এমন একটি তত্ত্বের সাথে জড়িত ছিলেন যা তাঁদের কেন্দ্রীয় এবং প্রাথমিক দার্শনিক নীতির বিপরীতে চলেছিল।

    অঁতনা আতো এবং পরাবাস্তববাদীরা  উভয়ই , পাশ্চাত্য চিন্তার যুক্তিবাদকে আক্রমণ করেছে। প্রথম "পরাবাস্তবতার ইশতেহারে," ব্রেতঁ এই বিদ্বেষকে খোলোসা করেছিলেন : "সন্ত টমাস অ্যাকুইনাস থেকে আনাতোল ফ্রাঁস পর্যন্ত প্রত্যক্ষবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত বাস্তববাদী মনোভাব আমার কাছে স্পষ্টতই যে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক বা নৈতিক অগ্রগতির প্রতি বিরূপ বলে মনে হয়।”যদিও অঁতনা আতো যুক্তি দিয়েছিলেন যে মার্কসবাদী চিন্তাধারার বাহ্যিক উপাদানের উপর জোর দেওয়া হলো সমস্যার একটি অংশ: “বাইরে থেকে চিন্তাকে আটক করা এবং এটি কী করতে পারে তা নিয়ে অধ্যয়ন করা হলো চিন্তার অভ্যন্তরীণ এবং গতিশীল প্রকৃতিকে ভুল বোঝা। এটি তার অভ্যন্তরীণ ভাগ্যের গতিবিধিতে চিন্তাকে উপলব্ধি করতে অস্বীকার করে,  যা কোনও পরীক্ষাই ধরতে পারে না।" আরও যুক্তি শানিয়ে ,আতো  মার্কসবাদকে কবিতার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেন: “আমি আজকে যাকে কবিতা বলি তা হলো ভাবনার এই অভ্যন্তরীণ ও গতিশীল নিয়তির উপলব্ধি।” তিনি আরও বলেন যে “কাব্যিক উপলব্ধি অভ্যন্তরীণ, কাব্যিক গুণ অভ্যন্তরীণ। কবিদের কবিতাকে সেই অভ্যন্তরীণ জাদু শক্তি দিয়ে চিহ্নিত করার জন্য আজ একটি আন্দোলন চলছে যা জীবনের জন্য একটি পথের কথা বলে এবং জীবনের উপর কাজ করা সম্ভব করে তোলে।” পরাবাস্তববাদীদের জন্য কবিতা ছিল পরাবাস্তববাদের সমার্থক, তাই তাঁর প্রবন্ধের শুরুতে, আতো পরাবাস্তববাদের সূচনাকে আলাদা করার জন্য একটি ইঙ্গিত করেছেন, যেখান থেকে অন্দোলনটি শেষ পর্যন্ত চলেছিল। আতো বলেছেন "একটি বিশুদ্ধ জীবনের জন্য সেই ক্ষুধা, যা পরাবাস্তববাদের শুরুতে ছিল তার সাথে মার্কসবাদের খণ্ডিত জীবনের  কোনও সম্পর্ক ছিল না।" 

    তাঁর কাব্যচর্চার অংশ হিসেবে থিয়েটারের প্রসঙ্গ তুলে আতো বলেছেন, ব্যাপারটা হাস্যকর কেননা "পরাবাস্তববাদ" শব্দটা গিয়ম অ্যাপোলিনায়ার একটা মঞ্চ পারফরম্যান্সের জন্য তৈরি করেছিলেন – "প্যারেড" নামের ব্যালে, যা ১৯১৭ সালে পরিবেশিত হয়েছিল। “Surrealism" ফরাসি  থেকে এসেছে, যার অর্থ "Sur" (এর বাইরে বা উপরে) + "Realism" (বাস্তববাদ), তাই "বাস্তববাদের বাইরে" বা "বাস্তবতার উপরে" হিসাবে অনুবাদ করা হয়েছে। তাঁর ১৯২৪ সালের ইশতেহারে আঁদ্রে ব্রেতঁ লিখেছিলেন, “পরাবাস্তববাদ হল দুটি আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী অবস্থা, স্বপ্ন এবং বাস্তবতাকে এক ধরণের পরম বাস্তবতায় রূপান্তর করা"। ১৯১৮ সালে অ্যাপোলিনায়ারের মৃত্যুর পর আঁদ্রে ব্রেতঁ পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের মুখপাত্র হন। ব্রেতঁ দাবি করেছিল যে পরাবাস্তববাদী শিল্পের একটা জানালা থাকা উচিত যার মাধ্যমে দর্শক মনের  অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলী দেখতে পারে। শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি, স্বপ্ন, কল্পনা এবং হ্যালুসিনেশনকে একটি নতুন গুরুত্ব দিয়েছে পরাবাস্তববাদ।
    জাঁ ককতো এবং এরিক স্যাটি দৃশ্যকল্প এবং সঙ্গীত রচনা করেছিলেন এবং সেট ও পোশাকগুলো ডিজাইন করেছিলেন পাবলো পিকাসো।আতো যখন একজন কবি ও লেখক হিসাবে  নাম  করছিলেন, তখন তিনি একই সাথে একটি অভিনয় ক্যারিয়ার গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। আতোর কাকা, লুই নালপাস, চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন এবং অঁতনা আতোকে অভিনয়ের কাজ পেতে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর কাকা আতোর সঙ্গে থিয়েটার জগতের চার্লস ডুলিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন এবং ১৯২২ সালে,  পরাবাস্তববাদীদের সাথে আতোর যোগ দেওয়ার দুই বছর আগে, তিনি অ্যান্টিগোনের একটি প্রযোজনায় টায়রেসিয়াস চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।নাটকটি অভিনয়যোগ্য  করেছিলেন, চার্লস ডুলিন আর এটি পরিচালনা করেছিলেন জাঁ ককতো এবং পাবলো পিকাসো সেটগুলি তৈরি করেছিলেন। কোকো চ্যানেল পোশাক তৈরি করেছিলেন এবং আর্থার হোনেগার সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। 
    স্টিফেন বারবার লিখেছিলেন যে "পরাবাস্তববাদীরা, যারা প্যারিসীয় উচ্চ সমাজের সাথে আতোর যোগাযোগের জন্য ককতোকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যালেটা সাফল্য লাভ করেছিল।" পরাবাস্তববাদীরা মার্কসবাদকে আরও বেশি করে গ্রহণ করার সাথে সাথে থিয়েটারের মতো শিল্পকে বুর্জোয়া বলে মনে করতেন। আঁদ্রে ব্রেতঁর প্রতিক্রিয়া থিয়েটারের প্রতি ছিল "তিক্ত" কেননা তিনি মনে করতেন যে থিয়েটার অন্তর্নিহিতভাবে বুর্জোয়া এবং মুনাফামুখী ।যদিও পরাবাস্তববাদীরা চিরকাল কমিউনিস্ট পার্টির সাথে থাকেনি, এই বিতর্কটা পরাবাস্তববাদী দল থেকে অঁতনা আতোকে বের  করার জন্য যথেষ্ট ছিল। ১৯৪৭  সালের জুলাইয়ে মায়েট গ্যালারিতে পরাবাস্তববাদী প্রদর্শনীর সময়, আঁদ্রে ব্রেতঁ তাতে অংশগ্রহণ করার জন্য আতোকে অনুরোধ করেছিলেন । ২৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৭ তারিখে ব্রেতঁকে একটি চিঠিতে সে প্রস্তাব  প্রত্যাখ্যান করেন আতো। চিঠিটিতে পরাবাস্তববাদের প্রতি আতোর অবস্থান সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকে  না।আতো লিখেছিলেন : "কিন্তু, তারপরে, আঁদ্রে ব্রেতঁ, একটি থিয়েটারে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমাকে তিরস্কার করার পরে, আপনি কি আমাকে একটি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারেন, এমন একটি আর্ট গ্যালারিতে, যেখানে ধনী যুবতীরা, অতি-লোকদেখানো,  পুঁজিবাদী (যাদের একটি কমিউনিস্ট ব্যাঙ্কে তহবিল আছে ? ) এবং যেখানে যে কোনও বিক্ষোভ, তা যাই হোক না কেন, শুধুমাত্র একটি শিল্প প্রলোভনের স্টাইলাইজড, বদ্ধ, স্থির চরিত্র থাকে ।”
    থিয়েটারে, বিশেষ করে আমেরিকান থিয়েটারে, কিন্তু ১৯৬০ এর দশকের শেষের যুব-আন্দোলনের ওপরও অঁতনা আতো’র গভীর প্রভাব ছিল যারা তাঁর বিপ্লবী চেতনার উল্লেখ করেছিলেন। পিয়ের হ্যান তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছিলেন যে মে ১৯৬৮ সালে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্র-ছাত্রীরা দখল করা আরম্ভ করেছিল, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরদের  সামনের দরজায় আতোর চিঠিটির প্রতিলিপি  সামনের দরজায় সেঁটে দেয়া হতো।  আর্টাউড বলেছিলেন: "আমি বুঝতে পেরেছি যে একটি অ্যাম্ফিথিয়েটারে লোকেদের জড়ো করার সময় চলে গেছে এমনকি তাদের সত্য বলার জন্য এবং সমাজ এবং এর জনসাধারণের সাথে বোমা, মেশিনগান এবং তার অনুসরণকারী সমস্ত কিছু ছাড়া অন্য কোন ভাষা নেই।কোনও দর্শনের গোড়ায় নিষ্ঠুরতার উপাদান ছাড়া থিয়েটার সম্ভব নয়। আমরা যে অধঃপতনের অবস্থায় আছি, ত্বকের দ্বারাই আমরা আত্মায় অধিবিদ্যায় প্রবেশ করিয়ে দেব।"

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:৫২740594
  • অঁতনা আতো : মলয় রায়চৌধুরী
    আধুনিক নাটক তত্ত্বের বিবর্তনে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত অঁতনা আতো, ফ্রান্সের মার্সেইতে ১৮৯৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন । তাঁকে স্যাকরেড হার্ট কলেজে ভর্তি করা হয় । এই প্রতিষ্ঠানে  তাঁর পরিচয় হয় আর্তুর র‌্যাঁবো, স্তেফান মালারমে আর  এডগার অ্যালান পো’র বইপত্রের সঙ্গে । সহপাঠীদের  সহযোগিতায় একটি ব্যক্তিগত সাহিত্য পত্রিকা আরম্ভ করেন। ১৯০৭ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত কলেজ শিক্ষার শেষে তিনি লক্ষণীয়ভাবে সামাজিক জীবন থেকে সরে যেতে শুরু করেন এবং নিজের  বেশিরভাগ রচনা ছিঁড়ে পুড়িয়ে দেন আর সংগ্রহের বইপত্র বিলি করে দেন । ছেলের আচরণে এরকম পরিবর্তন দেখে অঁতনা আতোর বাবা-মা তাঁকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান আর জানতে পারেন তাঁদের ছেলে মাঝেমাঝে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে । তখনকার চিকিৎসা পদ্ধতি তেমন উন্নত ছিল না । মস্তিষ্কের চিকিৎসার জন্য আফিমের নানারকম রসায়ন ব্যবহার করা হতো । 
    আঁতোর সম্পূর্ণ নাম আঁতোয়া মারি য়োসেফ পল আতো । সৃজনশীল জীবনে তিনি একজন ফরাসি লেখক, কবি, নাট্যকার, ভিজ্যুয়াল শিল্পী, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা এবং থিয়েটার পরিচালক হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। অনেকে মনে করেন যে তাঁর পরিবারে নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ের কারণে অঁতনা আতোর মস্তিষ্কের রোগ হয়ে থাকবে। তাঁর বাবা-মা ছিলেন প্রথম খুড়তুতো ভাই-বোন । তাঁর ঠাকুমা ছিলেন স্মির্নার অধিবাসী, এখনকার ইজমির, তুর্কির অন্তর্গত । তাঁর পিতামহ, ক্যাথরিন চিলি, মার্সেইতে থাকতেন, যেখানে তিনি একজন ফরাসি নাগরিক মারিয়াস আতোকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর দিদিমা, মারিয়েট চিলি, স্মির্নাতে থাকতেন, যেখানে তিনি স্থানীয় জাহাজি লুই নালপাসকে বিয়ে করেন। ফলে আতো  সারা জীবন তাঁর গ্রীক বংশধারার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন। শৈশবে ধরা পড়ে তিনি বংশানুক্রমিক সিফিলিসে আক্রান্ত ।
    প্রায় পাঁচ বছর বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসালয়ে আঁতোর চিকিৎসা হয়।১৯১৬ সালে আঁতোকে ফরাসি সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হলে তাঁর চিকিৎসায় কিছুকালের বিরতি ঘটে। "একটি অনির্দিষ্ট স্বাস্থ্যের কারণে" তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল । আতো  পরে দাবি করেছিলেন যে তিনি রাতের বেলায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হেঁটেচলে বেড়াতেন, তাই তাঁকে ছাঁটাই করা হয়েছিল । আতোর মা জানিয়েছিলেন যে অঁতনা আতো একটুতেই নার্ভাস হয়ে পড়তেন বলে সেনাবাহিনী তাঁকে বরখাস্ত করেছিল। আবার আঁতোকে ভর্তি করা হয় মানসিক চিকিৎসালয়ে । ১৯১৯ সালের মে মাসে, মানসিক চিকিৎসালয়ের পরিচালক আতোর জন্য লাউদানাম প্রেসক্রাইব করেন । 

    অঁতনা আতো সারাজীবন লাউদানামের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন । ১৯২১ সালে আঁতো  প্যারিসে ডাক্তার এদুয়ার তুলুজের মানসিক চিকিৎসালয়ে আবাসিক হিসাবে থাকা আরম্ভ করেন । তিনি কিছু দিনের জন্য সেরে উঠতেন কিন্তু আবার আক্রান্ত হতেন । লাউদানাম হল আফিমের একটি টিংচার যাতে ওজন অনুসারে প্রায় ১০% গুঁড়ো আফিম থাকে (১% মরফিনের সমতুল্য )।  আফিম পোস্তোর নির্যাস ( পাপাভার সোমনিফেরাম ) অ্যালকোহলে ( ইথানল ) দ্রবীভূত করে লাউদানাম তৈরি করা হয়। লালচে-বাদামী রঙের এবং অত্যন্ত তেতো, লাউদানামে মরফিন এবং কোডিন সহ বেশ কয়েকটি আফিম অ্যালকালয়েড রয়েছে । উনিশ শতক পর্যন্ত লাউদানাম  বিভিন্ন অবস্থার চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হত , কিন্তু এর প্রধান ব্যবহার ছিল ব্যথার ওষুধ এবং কাশি দমনকারী হিসেবে । বিশ শতকের গোড়ার দিকে, লাউদানাম প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হত এবং এটা অনেক পেটেন্ট ওষুধের একটা উপাদান ছিল । ১৯৮০ থেকে মার্কিন চাপে লাউদানাম মাদক হিসাবে  বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত । মানসিক চিকিৎসকদের সম্পর্কে আতো লিখেছিলেন, "একজন ডাক্তার এবং একই সঙ্গে একজন সৎ মানুষ হওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু একই সাথে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য উন্মাদনার ছাপ বহন না করে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়া অশ্লীলভাবে অসম্ভব।”
    ফ্র্যাংক হিলটন তাঁর বই ‘বদলেয়ার ইন চেইন’-এ লিখেছেন, মাদকাসক্ত শিল্পী হিসেবে বোদলেয়ারের ব্যক্তিত্ব, লেখা, আঁকা, পরিবার, টাকাকড়ি সামলানো, সামাজিক এবং যৌন সম্পর্কের উপর আফিম আসক্তির খারাপ পরিণতির ছবি তুলে ধরে। হিলটনের মতে, বোদলেয়ারের  গোপন অমীমাংসিত ইডিপাল কমপ্লেক্স ছিল না। লাউদানামে আসক্তির কারণে তাঁর বন্ধু-সম্পর্ক,  রাজনৈতিক আর ধর্মীয় আদর্শবাদও ব্যর্থ হয়েছিল। মাদকের অপব্যবহার তাঁর প্রেমেও প্রভাব ফেলেছিল। গ্রেট ব্রিটেনে ১৮৬৮ সালের ফার্মেসি অ্যাক্টের আগে, নাপিত, কেক-বিস্কুটের দোকান, লোহা-ব্যবসায়ী, স্টেশনারি দোকান, তামাক ব্যবসায়ী, মদ ব্যবসায়ী' সবাই আফিম বিক্রি করত। আফিম আর লাউদানাম পাওয়া সহজ ছিল । অঁতনা আতোর ক্ষেত্রে আরেকটি মাত্রা যোগ হয়েছিল ; তা হলো তাঁর মানসিক ভারসাম্যহীনতা । কিন্তু বোদলেয়ারের বিপরীত, যৌনতাকে এড়িয়ে চলতেন আতো। তিনি মানব শরীরের  প্রতি আচ্ছন্ন ছিলেন; তিনি যৌনতার ধারণাকে ঘৃণা করতেন এবং নিজের যৌন প্রতিত্ব থেকে নিজেকে আলাদা করার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন ।
    অঁতনা আতো : ম্যান অব ভিশান’  গ্রন্থে, লেখিকা  বেটিনা এল. ন্যাপ আতোর  মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে লিখেছেন: “আতো জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে অক্ষম ছিলেন; তিনি অন্যদের সাথে সম্পর্ক গড়তে পারতেন না; এমনকি তিনি তাঁর নিজের পরিচয় সম্পর্কেও নিশ্চিত ছিলেন না।” ন্যাপ মন্তব্য করেছেন যে "আতো মূলত তাঁর অসুস্থতাকে ঘিরে একটা সম্পূর্ণ আধিভৌতিক পরিমন্ডল তৈরি করেছিলেন, অর্থাৎ নিজের রোগের মাধ্যমে রহস্যবাদীর রাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তিনি নিজে এবং সবকিছুই তাঁর কাছ থেকে বাহ্যিকভাবে বিকিরিত হতো।" আতোর ‘দ্য আম্বিলিকাস অফ লিম্বোকে; উল্লেখ করে, ন্যাপ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আতো "মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে" লোকদের এমন একটা যাত্রায় নিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, 'যেখানে যেতে তারা কখনই সম্মত হবে না।' যেহেতু নাট্যকলা সম্পর্কিত তাঁর ধারণাগুলো তাঁর অসুস্থতা থেকে উৎসারিত হতো, তাই তিনি থিয়েটারকে একটা নিরাময়কারী প্রণালী হিসাবে দেখেছিলেন; এমন একটা উপায় যার মাধ্যমে ব্যক্তিকে  থিয়েটারে টেনে এনে তার  ব্যবচ্ছেদ, শল্যচিকিৎসা  এবং কেটে ফেলে তাকে খুলে ফেলা , এবং তারপরে তার নিরাময় করা।
    অনুরূপ বক্তব্য সানচে ডি গ্রামন্টের ‘হরাইজন’ পত্রিকার  প্রবন্ধে প্রকাশ করা হয়েছিল, যিনি আতো সম্পর্কে লিখেছেন, "যদি মনে করা হয় যে আতো একজন পাগল মানুষ, তবে আতো নিজের পাগলামিকে স্বাগত জানিয়েছেন । তাঁর কাছে যুক্তিবাদী জগত ছিল না; তিনি হ্যালুসিনেশনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন যা যুক্তিকে বিলুপ্ত করে এবং তার বিচ্ছিন্নতার মর্মার্থ গড়ে তোলে । আতো ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে সেই সীমার বাইরে রেখেছিলেন যেখানে বিচক্ষণতা এবং উন্মাদনার বিরোধিতা করা যেতে পারে এবং নিজেকে জাদু এবং অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি ব্যক্তিগত জগতের কাছে সমর্পণ করা যায়।”
    আমরা জানি এলিজাবেথ ব্যারেট-ব্রাউনিং, লর্ড বায়রন, উইল কলিন্স, জর্জ ক্র্যাবে, চার্লস ডিকেন্স, জন কিটস, পার্সি বিশি শেলি এবং ওয়াল্টার স্কটের মতো ইউরোপীয়  লেখকরা আর পেইনটাররা অনেকেই আফিম বা আফিম থেকে তৈরি মাদক খেতেন । অন্যান্য ওষুধগুলোও আইনত উপলব্ধ ছিল।  রানি ভিক্টোরিয়াকে  মাসিকের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির  জন্য মারিহুয়ায়ানার টিংচার দেওয়া হতো । এমনকি রানি ভিক্টোরিয়া জনপ্রিয় পণ্য ‘ভিন মারিয়ানির’ জন্য একটি প্রশংসাপত্র লিখে দিয়েছিলেন, যা ছিল  অ্যালকোহল আর কোকেনের মিশ্রণ, আর তিনি  ক্লোরোফর্মের 'আনন্দজনক পরিমাপের বাইরে' প্রভাবগুলি উপভোগ করতেন যখন তা তাঁকে প্রসবের সময় দেওয়া হতো । সেসময়ে আফিম আর লাউদানাম  শিশু আর প্রাপ্তবয়স্ক সকলের জন্যই উদ্বেগজনক  রোগে দেওয়া হতো, যেমন 'স্নায়বিক কাশি', হুপিং কাশি, অন্ত্রের প্রদাহ, দাঁতের ব্যথা, ড্রপসি আর অবিরাম হেঁচকি। লাউদানাম ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় যা  জ্বর, অনিদ্রা, এলার্জি, পিত্তশূল, মূত্রাশয়ের প্রদাহ, কলেরা মর্বাস, ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, আর পাইলসের ক্ষেত্রে সুপারিশ করা হতো। 
    পিকাসো ছিলেন প্যারিসে বসবাসকারী শিল্পীদের অন্যতম যিনি জাঁ ককতোর সঙ্গে  আফিম নিতেন । প্যারিসের আরও বহু শিল্পী লাউদানাম নিতেন । এই শিল্পীদের অনেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন এবং পিকাসোও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁকে আর তাঁর বন্ধুদের প্রায়ই তাঁর ধোঁয়ায় ভরা স্টুডিওর মেঝেতে  দেখা যেত। পিকাসো আফিমের ধোঁয়ার গন্ধ সম্পর্কে বলেছিলেন যে এটা 'পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান গন্ধ'। একবার একটা ড্রইঙ এঁকে অঁতনা আতো তার ওপর লিখেছিলেন,  "মোটেই বাস্তব নয় কিন্তু সর্বদা সত্য  এবং এভাবেই বিষণ্নতার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তিনি অনুভব করতেন যে তিনি বাস্তব নন, তিনি অন্য কেউ, অথচ তবুও  জানতেন যে তা একেবারে সত্য ।
    স্বাভাবিক যে মাথার যন্ত্রণা থেকে ছাড়ান পাবার জন্য অঁতনা আতো অহরহ লাউদানাম খেতেন । যাইহোক, আতো যে  শুধুমাত্র লাউদানাম খেতেন  তাই নয়,  তিনি অন্যদেরও  তার ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন।  যারা কোকেন এবং আফিমের মতো মাদকদ্রব্যকে নিষিদ্ধ করতে চাইছিল তাদের আতো কড়া ভাষায় আক্রমণ করতেন । ১৯২৫ সালে তিনি বলেছিলেন, "যেহেতু আমরা কখনই মানবতার হতাশার কারণগুলি সনাক্ত  এবং নির্মূল করতে সক্ষম হব না, আমাদের কোনও অধিকার নেই একজন মানুষকে নিজের দুঃখ থেকে  মুক্ত হবার উপায়কে  বাধা দেওয়ার। যদিও আতো লাউদানাম ব্যবহারের সুপারিশ করতেন,  মাদকের সাথে তাঁর  সুস্থ সম্পর্ক ছিল না। একবার মেক্সিকোতে গিয়ে যখন হেরোইনের উইথড্রল সিম্পটম দেখা দেয়, তখন তাঁকে তাঁর ঘোড়ায় ওপরে ঠেলে বসিয়ে দিয়েছিল কয়েকজন লোক মিলে,  কারণ আতো শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন । তিনি নিজেই সেই অবস্হার বর্ণনা করে লিখেছেন যে “যেন একট ফুলে ওঠা আঠার দৈত্য হয়ে গিয়েছিলাম।”
    মানসিক চিকিৎসা সম্পর্কে আতো লিখেছেন, “"আমি, নিজে, ৯ বছর একটি উন্মাদ আশ্রমে কাটিয়েছি আর কখনও  আত্মহত্যা করার কথা ভাবিনি, যদিও আমি জানি যে সকালের পরিদর্শনের সময় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আমার প্রতিটি কথোপকথন আমাকে নিজেকে ফাঁসিতে লটকাতে প্ররোচিত করেছিল কারণ আমি সচেতন ছিলাম যে আমি তার গলা চিরে মারতে  পারব না।” মানসিক চিকিৎসা সম্পর্কে বেশ বিরক্ত ছিলেন তিনি যা তাঁর এই উক্তি থেকে স্পষ্ট হয়, “এ কারণেই আমাদের কলঙ্কিত সমাজ কিছু উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তির তদন্তের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করার জন্য মনোরোগবিদ্যা আবিষ্কার করেছে কেননা ভবিষ্যদ্বাণীর অনুষদগুলি তাদের অসুবিধাজনক মনে হয়। না, ভ্যান গঘ উন্মাদ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর চিত্রকর্মগুলো ছিল গ্রীক আগুন, পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ, যার দৃষ্টিকোণ বুর্জোয়াদের বর্ণালী সামঞ্জস্যকে গুরুতরভাবে বিপর্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছে।” 
    দুই
    ষোলো বছর বয়সে তাঁর প্রথম মানসিক ভারসাম্যহীনতার পর অঁতনা আতো জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন চিকিৎসালয়ে, তবুও হার মানেননি। "নিরাময়যোগ্য প্যারানয়েড প্রলাপ" রোগে আক্রান্ত আতো হ্যালুসিনেশন, গ্লোসোলালিয়া এবং হিংসাত্মক ক্রোধে ভুগতেন।  তাঁর চিকিৎসা সম্ভবত ততটাই ক্ষতি করেছিল যতটা সুস্হ করেছিল। তিনি অত্যন্ত সন্দেহজনক ইনসুলিন থেরাপি সহ বৈদ্যুতিক শক চিকিৎসার মতো  সত্যিকারের ভয়ঙ্কর পদ্ধতি সহ্য করেছিলেন, যার দরুন কিছু সময়ের জন্য আতো কোমায় চলে যান। তা সত্ত্বেও, অঁতনা আতো একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী তাত্ত্বিক এবং নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি পান, যিনি "নিষ্ঠুর থিয়েটার" ভাবকল্প তৈরি করার জন্য বিখ্যাত। তাঁর মঞ্চনাটক আর শ্রুতিনাটক দর্শক ও শ্রোতাদের ইন্দ্রিয় এবং সংবেদনশীলতাকে আক্রমণ করার জন্য ভেবেচিন্তে তৈরি করা হয়েছিল এবং তাদের জীবনের যেগুলো মূল বাস্তবতা —- যৌনতা, নির্যাতন, হত্যা এবং ধাতুরস, ঋতুরক্ত, মলত্যাগ সম্পর্কে বোধ জাগিয়ে তোলার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। অঁতনা আতো অভিনেতা আর দর্শকদের মধ্যে সীমা ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন, আর নাটককে এমন একটা অনুষ্ঠান হিসেবে উপস্হাপন  করতে চেয়েছিলেন যা আনন্দদায়ক, অনিয়ন্ত্রিত এবং এমনকি বিপজ্জনক হবে । অঁতনা আতোর নাটকের ধারণা ইউরো-আমেরিকান মঞ্চে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে।  সুসান সন্টাগ যেমন  লিখেছিলেন, "এখন থিয়েটার নিয়ে যারা কাজ করে তারা কেউই আতোর নাট্য ধারণার প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।"
    অঁতনা আতো প্যারিসে ১৯২০ এর দশকের পরাবাস্তববাদী লেখক, শিল্পী এবং পরীক্ষামূলক নাট্যদলে যোগ দেন।  রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ফলে আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁকে পরাবাস্তববাদী গোষ্ঠী থেকে বের করে দেন । ১৯২৭  সালে আঁদ্রে ব্রেতঁ কর্তৃক বহিষ্কৃত হওয়ার কারণ ছিল কমিউনিজমে  অঁতনা আতোর অবিশ্বাস । ফ্রান্সে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে পরাবাস্তববাদীদের যোগাযোগ বৃদ্ধিকে ভালো চোখে দেখেননি অঁতনা আতো।  রস মারে লিখেছেন, "আঁতো মোটেও রাজনীতির মানুষ ছিলেন না, এমনকি তিনি মার্কসবাদিদের বর্জন করতে বলতেন।তাছাড়া, "ব্রেতঁ বেজায় থিয়েটার-বিরোধী হয়ে উঠছিলেন কারণ ব্রেতঁ থিয়েটারকে বুর্জোয়া এবং প্রতিবিপ্লব হিসাবে দেখেছিলেন।" অঁতনা আতো বলেছিলেন, আঁদ্রে ব্রেতঁর মুখের ওপর, “মার্কসবাদিদের মুখে আমি হেগে দিই।” পরাবাস্তববাদীদের নিজেদের মধ্যে মারামারি হলেও, আতোকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পায়নি । আঁদ্রে ব্রেতঁ অবশ্য পরবর্তীকালে লিখেছিলেন, “ অঁতনা আতোর  সমস্তকিছুকে অস্বীকৃতির আবেগপূর্ণ, নায়কোচিত  বার্তাকে আমি অভিবাদন জানাই কেননা সেগুলোই আমাদের জীবিত রেখে হত্যা করে।” 
    আতোর প্রথমদিকের কাজগুলোকে "কৃত্রিম" হিসাবে বর্ণনা করেছেন কেউ-কেউ, তা এই জন্য যে সেই সময়ে গতানুগতিক নাট্যধারণা ছিল প্রবল । আঁতোর কাছে তাঁর ধারণাগুলো ছিল একযোগে আশীর্বাদ এবং অভিশাপ —দুইয়ে মোড়া, যা তিনি টুকরো-টাকরা কাগজে লিখতেন এবং ১৯৩০ এর দশকের শেষের দিকে বন্ধু, শত্রু এবং কয়েকজন নেতা ধরণের ব্যক্তিত্বকে ( এমনকি  হিটলারকে ) পাঠিয়েছিলেন। এই কাজগুলোর কোনও অনুবাদ বা প্রতিলিপি করা হয়নি, আর হাতের লেখা বেশ দুর্বোধ্য হওয়ায় পাঠকদের সামনে আসেনি । অভিনেতা রজার ব্লিনকে লেখা চিঠিতে আতো বলেছিলেন,  “যারা আমাকে হেরোইন নেওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য অভিনয় করে তারা সবাই,  আর যারা ১৯৩৯ সালের রবিবারের [অবৈধ] মে মাসের জন্য অ্যান ম্যানসনের [একজন বন্ধুর] উপর আঙুল তুলেছে, আমি তাদের প্যারিসের একটা চৌরাস্তায়  জীবন্ত পোড়াবো,  আর  আমি তাদের শরীরে ছেঁদা করে দেব আর তাদের মজ্জা পুড়িয়ে দেব।
    ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে অঁতনা আতো প্রকাশ করেন তাঁর “সুস্পষ্ট ভাষা বিষয়ক ম্যানিফেস্টো”, মূলত পরাবাস্তববাদীদের, বিশেষ করে আঁদ্রে ব্রেতঁ’র বক্তব্যের সঙ্গে তাঁর মতামতের পার্থক্য স্পষ্ট করার জন্য  । আতো’র ম্যানিফেস্টোটা এরকম :
      “আমি যদি খারাপ বা ভালোতে বিশ্বাস করি না । যদি আমি ধ্বংস করার মতো প্রবল প্রবণতা অনুভব করি, যদি নীতিমালায় এমন কিছু না থাকে যা আমি যুক্তিসঙ্গতভাবে মেনে নিতে পারি, তাহলে বুঝতে হবে তার অন্তর্নিহিত কারণটি  রয়েছে আমার শরীরের মাংসে।
    “আমি ধ্বংস করি কারণ আমার দৃষ্টিতে, যুক্তি থেকে যা কিছু গড়ে ওঠে তাতে বিশ্বাস করা যায় না। আমি কেবলমাত্র সেই প্রমাণে বিশ্বাস করি যা আমার মজ্জাকে আলোড়িত করে। যা আমার যুক্তিবোধের প্রতি সম্বোধন করে তাতে  নয়। আমি স্নায়ুর রাজ্যে নানা রকম স্তর খুঁজে পেয়েছি।  বুঝতে পারি যে এখন সাক্ষ্য-প্রমাণের মূল্যায়ন করতে আমি সক্ষম। আমার জন্য বিশুদ্ধ মাংসের এলাকায় এমন  প্রমাণ রয়েছে যার সঙ্গে যুক্তি  প্রমাণ করার কোন সম্পর্ক নেই। যুক্তি এবং হৃদয়ের মধ্যে চিরন্তন দ্বন্দ্ব আমার শরীরে নিষ্পত্তি হয়, যদিও তা আমার মাংসে স্নায়ু দ্বারা সিঞ্চিত । অনুভূতিশীল অকল্পনীয়তার রাজ্যে, আমার স্নায়ুর দ্বারা গড়ে ওঠা ছবিখানা  সর্বোচ্চ বুদ্ধিবৃত্তির রূপ নেয়, যা থেকে আমি তার বুদ্ধিবৃত্তির গুণকে ছিনিয়ে নিতে অস্বীকার করি। সুতরাং  বলতে হচ্ছে যে, আমি একটি ভাবকল্পের গঠন পর্যবেক্ষণ করি, যা কিনা  বস্তুসমূহের প্রকৃত পূর্ণতা বহন করে, তা আসলে একটা ভাবকল্প যা সৃষ্টির ধ্বনি নিয়ে আমার কাছে পৌঁছোয়।
    “ কোনও ইমেজ আমাকে সন্তুষ্ট করে না যদি না তা সেইসঙ্গে  জ্ঞান হয়, যদি না ইমেজটা তার সাথে নিজস্ব সারবত্তা এবং নিজস্ব স্পষ্টতা ধরে রাখে। আমার মন, বিতর্কমূলক যুক্তির কারণে ক্লান্ত, একটা নতুন,  পরম মাধ্যাকর্ষণের চাকায় সম্পৃক্ত হতে চায়। আমার কাছে  এটা  সর্বোত্তম পুনর্গঠনের মতো ব্যাপার, যাতে শুধু  অযৌক্তিক নিয়মগুলো লাগু হয়,  আর  জয় হয় একটা নতুন মর্মার্থের আবিষ্কার । এই মর্মার্থ মাদকের ব্যাধিতে হারিয়ে গেছে আর  ঘুমের পরস্পরবিরোধী কল্পনার কাছে একটা গভীর বুদ্ধিমত্তার চেহারা উপস্থাপন করেছে। এই মর্মার্থ মনের ওপর নিজের বিজয় , আর যদিও এটা যুক্তির দ্বারা অখণ্ডনীয়, তবু তা উপস্হিত থাকে , অবশ্য সেটা কেবল মনের ভেতর । এটা হলো শৃঙ্খলা,  বুদ্ধিমত্তা । এটাই বিশৃঙ্খলার গুরুত্ব। কিন্তু তা এই বিশৃঙ্খলাকে যেমনকার তেমন ভাবে গ্রহণ করে না, এটা তাকে ব্যাখ্যা করে আর ব্যাখ্যা করে বলে তাকে হারিয়ে ফ্যালে। এটা হলো অযৌক্তিকতার যুক্তি। আর একজন লোক শুধু এই সব কথাই বলতে পারেন । আমার স্বচ্ছ অযৌক্তিকতা বিশৃঙ্খলাকে ভয় পায় না.
    “মন বলতে যা বোঝায় তার কিছুই আমি বাতিল করি না। আমি শুধু আমার মনকে তার নিজস্ব নিয়ম আর অঙ্গসুদ্ধ অন্য কোথাও নিয়ে যেতে  চাই। আমি মনের যৌন প্রক্রিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করি না, বরং এই প্রক্রিয়াটির বিপরীতে আমি সেই আবিষ্কারগুলোকে আলাদা করে দিতে চাই যা স্বচ্ছ উদ্দেশ্য  সরবরাহ করে না। আমি স্বপ্নের জ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করি, কিন্তু তা কেবল তাদের কাছ থেকে নতুন মালমশলা পাবার জন্য। আমি চাই সংখ্যাবৃদ্ধি, সূক্ষ্মতা, প্রলাপের বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টি,  দ্রুত ভবিষ্যবাণী  নয়। একটি ছুরি আছে যা আমি কখনও ভুলি না।
     “কিন্তু এই ছুরিটা  স্বপ্নের ভেতরে অর্ধেক ঢুকে আছে, যা আমি নিজের ভেতরে রাখি, যা আমি স্বচ্ছ ইন্দ্রিয়ের পরিসীমানায় আসতে দিই না। যাকিছু ইমেজের এলাকার অন্তর্গত তা যুক্তির দ্বারা অপরিবর্তনীয় এবং তাকে অবশ্যই ইমেজের মধ্যে থাকতে হবে বা বিনষ্ট হতে হবে। সে যাই হোক, ইমেজের মধ্যে একটা কার্যকারণ থাকে, এমন বহু ইমেজ আছে যেগুলো ইমেজে-ভরা বিশ্বের জীবনীশক্তির তুলনায় পরিষ্কার ।
    “মনের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে অসংখ্য প্রাণীর বহুরূপী এবং ঝকমকে ইঙ্গিত থাকে। এই ইন্দ্রিয়াতীত এবং চিন্তাশীল ধূলিকণা নিজের ভেতর থেকে নিয়মানুসারে গড়ে ওঠে , স্বচ্ছ যুক্তি  বা আটকে দেয়া চেতনার এলাকার  বাইরে ।
    “ইমেজের উচ্চতর এলাকায়,  সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় বিভ্রম, বা বস্তুগত ত্রুটির অস্তিত্ব নেই, বিশেষ করে জ্ঞানের বিভ্রমের প্রসঙ্গ তো তোলাই উচিত নয় । তবে  এটাই হলো  আসল কারণ কেন একটা নতুন জ্ঞানের মর্মার্থ জীবনের বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে অবতীর্ণ হতে পারে ।
    “জীবনের সত্য বস্তুসমূহের আবেগের মধ্যে নিহিত।  মানুষের মন নানা রকমের ভাবকল্প দিয়ে বিষিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষকে সন্তুষ্ট হতে বলবেন না, তাকে কেবল শান্ত হতে বলুন, যাতে সে বিশ্বাস করে  যে সে  তার অবস্থান খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র পাগলরাই সত্যিকার শান্ত থাকতে পারে ।”
    তিন

    প্যারিসে, আতো বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ফরাসি নাটক-পরিচালকের কাছে শিক্ষানবিশী করেন ।  এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জ্যাক কোপেউ, আঁদ্রে আঁতোয়া, গেয়র্গে এবং লুদমিলা পিতোয়েফ, শার্ল দুলাঁ, ফারমাঁ গেমিয়ার এবং লুনে পো । লুনে পো, প্রথম আতোকে  পেশাদার থিয়েটারে  প্রথম কাজ দিয়েছিলেন, পরে তিনি আতোকে "অভিনেতাদের মাঝে হারিয়ে যাওয়া একজন চিত্রশিল্পী" হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর মূল নাট্য প্রশিক্ষণ ছিল শার্ল দুলাঁর  দল, ‘থিয়েটার দে ল'আটেলিয়ারের’ অংশ হিসেবে, যেটিতে আতো ১৯২১ সালে যোগদান করেন। সেই দলে আতো  আঠারো মাস  ছিলেন।
    শার্ল দুলাঁর দলের সদস্য হিসাবে, আতো প্রতিদিন ১০ থেকে ১২  ঘন্টা প্রশিক্ষণ নিতেন। আতো দুলাঁর শিক্ষার একজন শক্তিশালী প্রবক্তা ছিলেন । আতো বলেছিলেন: "দুলাঁর প্রশিক্ষণে আমি অনুভব করি যে আমি প্রাচীনকালের যাবতীয়  গোপনীয়তা এবং উৎপাদনের সম্পূর্ণ বিস্মৃত রহস্য আবার আবিষ্কার করছি।"  তাঁরা পূর্ব এশীয় থিয়েটারে, বিশেষ করে বালি এবং জাপানের অভিনয় ঐতিহ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন । দুলাঁ  অবশ্য পশ্চিমা মঞ্চনাটকে পূর্ব এশীয় থিয়েটারের ভাষা ও শৈলী গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেননি। দুলাঁর বক্তব্য ছিল, "আমাদের পশ্চিমা থিয়েটারের উপর একটা দীর্ঘ ঐতিহ্যের থিয়েটারের নিয়ম চাপিয়ে দিতে চাওয়া, যার নিজস্ব প্রতীকী ভাষা আছে,  একটা বড় ভুল হবে।"
    নানা বিষয়ে দুলাঁর সঙ্গে আতোর মতপার্থক্য দেখা দেয়, বিশেষ করে  আলেকজান্ডার আর্নক্সের হুওন ডি বোর্দোতে সম্রাট শার্লেমেনের অভিনয় নিয়ে মতান্তর এমন স্তরে চলে যায় যে ১৯২৩ সালে আতো দুলাঁর দল ছেড়ে বেরিয়ে  যান। তারপর তিনি ১৯২৩ সালে পিতোয়েফের দলে যোগ দেন, কিন্তু পরের বছর সেই দলও ছেড়ে দেন তার কারণ এই সময়ে আতো  সিনেমা করার দিকে ঝোঁকেন। চলচ্চিত্রে একজন সমালোচক, অভিনেতা এবং লেখক হিসেবে কাজ করার  একটি সক্রিয় কর্মজীবন ছিল অঁতনা আতোর। আতো কুড়িটিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি অ্যাবেল গ্যান্সের ‘নেপোলিয়ন’ ( ১৯২৭ ) ছবিতে জাঁ-পল মারাট এবং কার্ল থিওডর ড্রেয়ারের ‘দ্য প্যাশন অফ জোয়ান অফ আর্ক’ ( ১৯২৮) ফিল্মে একজন সন্ন্যাসীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পরিচালক জার্মেইন ডুলাক-এর ,  সিশেল অ্যান্ড দ্য ক্লারজিম্যান’ ফিল্মের স্ক্রিপ্ট  ( ১৯২৮ ) লিখেছিলেন আতো । এই ফিল্মটি পরাবাস্তববাদী সালভাদর ডালি এবং লুই বুনুয়েলকে প্রভাবিত করেছিল।১৯২৯ সালে বিখ্যাত চোখের মণি কাটার দৃশ্য দিয়ে আন চিয়েন আন্দালু’  তৈরি করেছিলেন। অ্যাবেল গ্যান্সের ‘নাপোলেয়ঁ’ ( ১৯২৭ ) ছবিতে জাঁ-পল মারাতের চরিত্রে আতোর অভিনয় মারাতের ব্যক্তিত্বের শৌর্য  বোঝাতে অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিয়েছিলেন আতো । তিনি বেশ কয়েকটা চলচ্চিত্রের দৃশ্য লিখেছিলেন, তার মধ্যে দশটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। অঁতনা আতোর একটা দৃশ্যকল্প তৈরি করা হয়েছিল ‘দি সিশেল অ্যান্ড দি ক্লার্জিমান’ ফিল্মে ( ১৯২৮ ) । জার্মেইন দুলাক পরিচালিত এই ফিল্মটিকে অনেক সমালোচক  প্রথম পরাবাস্তববাদী চলচ্চিত্র বলে মনে করেন। সিনেমা সম্পর্কে আতো লিখেছেন, “সিনেমা বলতে বোঝায় মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখীতা, আলোকবিদ্যার সম্পূর্ণ উত্থান, দৃষ্টিভঙ্গি এবং যুক্তির ভাঙন। এটি ফসফরাসের চেয়ে বেশি উত্তেজনাপূর্ণ, প্রেমের চেয়েও বেশি চিত্তাকর্ষক।"

    ফিল্ম নির্মাণ ও স্ক্রিপ্ট লেখা ইত্যাদির পথ বন্ধ অনুভব করে, তিনি রজার ভিত্রাক এবং রোবের অ্যারনের সাথে আলফ্রেড জ্যারি থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা করেন।  ‘থিয়েটার আলফ্রেড জ্যারির’ জন্য লেখা "দ্য ম্যানিফেস্টো ফর অ্যান অ্যাবোরটিভ থিয়েটার" (১৯২৬-২৭) তে, অঁতনা আতো পরাবাস্তববাদীদের  সরাসরি আক্রমণ করেছিলেন, যাদের তিনি "ঠোঙা বিপ্লবী" বলে অভিহিত করেন । তিনি ঘোষণা করেন যে পরাবাস্তববাদীরা "কমিউনিজমের কাছে মাথা নত করছে", যা "একটি অলস মানুষের বিপ্লব" বই আর কিছু নয় । রজার ভিত্রাক আর রোবের্ অ্যারনের সাথে কাজ করার জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করার প্রয়াস করেছিলেন যা ফরাসি থিয়েটারে আমূল পরিবর্তন ঘটাবে। অঁতনা আতো সেই সময়কার পশ্চিমা থিয়েটার-ভাবনার বিরোধীতা আরম্ভ করেন । তিনি বলেছিলেন যে গতানুগতিক পরিকল্পিত প্লট এবং স্ক্রিপ্টেড ভাষা প্যানিং করে তাঁর সমসাময়িকরা সাধারণত একই প্রথায় দিনের পর দিন নাটক মঞ্চস্হ করে চলেছেন, কোনও নতুন ভাবনা-চিন্তা নেই । রজার ভিত্রাককেও পরাবাস্তব আন্দোলন থেকে বের করে দিয়েছিলেন আঁদ্রে ব্রেতঁ । তাঁরা ১৯২৭ সালের জুন থেকে ১৯২৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চারটি প্রযোজনা মঞ্চস্থ করেন । নাটকগুলো  স্বল্পস্থায়ী ছিল, কিন্তু আর্থার অ্যাডামভ, আন্দ্রে জিদ এবং পল ভ্যালেরি সহ ইউরোপীয় শিল্পীদের একটি বিশাল  অংশ আতোর নাটকগুলো দেখতে আসতেন ।
    ১৯৩৩ সালে আতো ‘থিয়েটার অব ক্রুয়েলটি’ নামে একটি ম্যানিফেস্টোতে নাটক সম্পর্কে তাঁর ভাবনা-চিন্তা প্রথম প্রকাশ করেন । ১৯৩৮ সালে লেখেন ‘থিয়েটার অব দি ডাবল’।অঁতনা আতোর এই গুরুত্বপূর্ণ তত্বটি ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি গালিমার প্রকাশনার ‘মেটামরফোসিস’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয় ।  যখন এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল, তখন আতো সেন্ট-অ্যানের একটি মানসিক চিকিৎসালয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্হায় ছিলেন, যাকে বলা যায়  প্রায় ক্যাটাটোনিক । প্রবন্ধসংগ্রহ জুড়ে, আতো প্রচলিত থিয়েটারের উপর তাঁর আক্রমণের রূপরেখা দিয়েছেন এবং ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন। অভিব্যক্তি ছিল দর্শকদের সাথে তাঁর সংযোগের কেন্দ্রবিন্দু। আতোর সংজ্ঞায়িত ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি’, দর্শকদের সংবেদনকে আক্রমণ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। বলেছে যে নাটকটা যেন দর্শকদের  এমনভাবে ক্রোধান্বিত করে  যা সেই সময়ের ইউরো-আমেরিকান থিয়েটার করতো না।
    নিষ্ঠুরতার থিয়েটার - এটা কি? "যা কিছু কাজ করে তা একটি নিষ্ঠুরতা" আতো  তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন। "একটা চরম কর্মকাণ্ডের ধারণার উপর ভিত্তি করে, সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে,  ঠেলে, পরিধি বাড়িয়ে থিয়েটারকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে।" আতোর বিষয়বস্তু যদি দেখা হয় - মারকুইস ডি সাদে, ব্লুবিয়ার্ড, জেরুজালেমের পতন, মেক্সিকো জয় -  এই ফরাসি কবি, অভিনেতা, মিডিয়ামের বিপ্লবী অভিব্যক্তির পিছনে এমন একজনকে পাবেন  যিনি শিল্পীকে লেখক বা পরিচালক হিসাবে না দেখে একজন সৃষ্টিকর্তা হিসাবে ভেবেছিলেন। একজন স্বপ্নদর্শী ।
    নিষ্ঠুরতার থিয়েটার ভাবকল্প সম্পর্কে আতো লিখেছেন, “নিষ্ঠুরতার থিয়েটার মানে আমার জন্য প্রথমত কঠিন এবং নিষ্ঠুর থিয়েটার। এবং, কর্মক্ষমতার স্তরে, এটি এমন নিষ্ঠুরতা নয় যে আমরা একজন আরেকজনের দেহে  আঘাত করে, আমাদের ব্যক্তিগত চামড়া-মাংস-অন্ত্র ছিঁড়ে বের করব, কিংবা সেই অ্যাসিরিয়ান সম্রাটদের মতন, মানুষের কান, নাক, বা সুন্দরভাবে কেটে নেয়া নাকের পার্সেল পাঠিয়ে একে অপরের উপর অনুশীলন করব । নিষ্ঠুরতার থিয়েটার কিন্তু অনেক বেশি ভয়ানক এবং প্রয়োজনীয় নিষ্ঠুরতা যা আমাদের বিরুদ্ধে সমাজ ব্যবহার করে । আমরা স্বাধীন নই। এবং আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়তে পারে। এবং নিষ্ঠুরতার থিয়েটার  সবাইকে সতর্ক করে শেখানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে।”
     এই তত্বগুলোর মাধ্যমে অঁতনা আতো ইউরোপীয় আভাঁ গার্দের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসাবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি পান। বিশেষ করে, তিনি ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির; ধারণার মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীর থিয়েটারে গভীর প্রভাব ফেলেছেন। এবং আদিবাসী মেক্সিকান এবং বালিনিজ নাট্যপ্রথাকে কাজে লাগিয়েছেন। ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি’ ঐতিহ্যগত পশ্চিমা থিয়েটার থেকে আলাদা  । আতোর  কাজগুলো জাঁ জেনে, গেয়র্গে গ্রোটোস্কি, পিটার ব্রুক এবং রোমিও ক্যাসেলুচি সহ বহু শিল্পীর ওপর  প্রভাব ফেলেছে ।
    পরীক্ষামূলক থিয়েটার এবং পারফরম্যান্স শিল্পের বিকাশে একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছে আতোর ভাবনা-চিন্তা ও কর্মকাণ্ড। তাঁর ধারণাগুলো. পারফরম্যান্স অনুশীলনের ভাষার,  এবং যুক্তিবাদের প্রভাবশালী ভূমিকা বর্জন করে,  পৃথিবীব্যাপী আভাঁ গার্দ আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করতে সহায়তা করেছে। তাঁর মৃত্যুর পরও  তাঁর অনেক কাজ জনসাধারণের সামনে উপস্হাপন করা সে সময়ে সম্ভব  হয়নি। যেমন  ‘স্পার্ট অফ ব্লাড’ ১৯২৫ সালে লেখা অথচ ১৯৬৪  সাল পর্যন্ত দেখানো হয়নি। পিটার ব্রুক এবং চার্লস মারোভিটজ রয়্যাল শেক্সপিয়ার কোম্পানিতে তাদের "থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি" সিজনের অংশ হিসাবে এটি মঞ্চস্থ করেছিলেন। কারেন ফিনলে, স্প্যাল্ডিং গ্রে, লিজ লেকম্পটে, রিচার্ড ফোরম্যান, চার্লস মারোভিটজ, স্যাম শেপার্ড, জোসেফ চাইকিন, চার্লস বুকাওস্কি, অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং আরও অনেকের মতো শিল্পীরা আতোকে তাঁদের অন্যতম প্রভাব হিসাবে উল্লেখ করেছেন। উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য প্রকাশের উদ্দেশ্য বলে মনে করা হয়, আঁতো’র ছোট নাটক ‘জেট অফ ব্লাড’, বা ‘স্পার্ট অফ ব্লাড’ । পাঠ্যটি যুক্তিভাঙনময় এবং মঞ্চের দিকনির্দেশগুলি পরাবাস্তব। ধ্বংসের দৃশ্য রয়েছে । একটি ভূমিকম্প আছে, একটি বিশাল হাত — এবং রক্তের একটি ফোয়ারা। নারীর যোনি থেকে বিছে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে। মঞ্চ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে  মৃতদেহ। এটি প্রথম ১৯৬৪ সাঁলে আতো’র থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি সিজনের অংশ হিসাবে প্রদর্শনের পর ১৯৬৫ সালে অ্যালবি থমাস তৈরি করেন এর একটি ফিল্ম সংস্করণ, ‘দ্য স্পার্ট অফ ব্লাড’। সমালোচক অ্যালিসন ক্রগগন এই নাটক সম্পর্কে বলেছেন যে, আতো  ' গতানুগতিক মডেলের পরিবর্তে একটি অনুঘটক এবং একটি প্ররোচনা' গড়ে তুলেছেন।
    উন্মাদনার তাৎক্ষণিক ঝাঁকুনি সত্ত্বেও, নাটকটির  মধ্যে আকর্ষণীয় কিছু আছে। আতো বলেছিলেন যে ফরাসী ভাষা বড্ডো সীমিত, সমস্ত ভাবনা লিখে প্রকাশ করা যায় না । তাঁর নাটকটা তাই বিপরীত ভাষা থেরাপির মতো, আমাদের বাস্তবতাকে ঘিরে বর্ণালী দেয়াল ভেদ করার একটি জাদুবিদ্যার উপায়। যেহেতু এটা দর্শক-শ্রোতার ইন্দ্রিয়ের ওপর আক্রমণ করে, টের পাওয়া যায়, মাদক  সবসময় প্রভাব ফেলেছে। এটি নেরভাল এবং আলফ্রেড জারির জন্য জরুরি ছিল, দুজনেই আতোর  অগ্রদূত। জারিকে নাকি খড়ের বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, কাছাকাছি ইথারের একটা সিলিন্ডার। আতোর এমন ছিলেন যে লোকটাকে বেশ্যালয়ে তাজা মৃতদেহের মতো দেখাতো -  তাঁকে সরবরাহ করা বিভিন্ন ওষুধের যেকোনো একটি দ্বারা তাঁর মৃত্যু ঘটা অসম্ভব ছিল না। 
    চার
    বেশিরভাগ সমালোচক বিশ্বাস করেন যে নাট্যতত্ত্বে আতোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হল তাঁর "নিষ্ঠুরতার থিয়েটার", একটি তীব্র নাট্য অভিজ্ঞতা যা  প্রপস, জাদু কৌশল, বিশেষ আলো, আদিম অঙ্গভঙ্গি, বক্তব্য এবং ধর্ষণ, নির্যাতন এবং হত্যার থিমগুলিকে একত্রিত করে মঞ্চস্হ করার কথা বলে  । দর্শক ও শ্রোতারা জীবনের মূল উপাদানগুলির মুখোমুখি হন। ১৯৩১ সালে,  প্যারিস ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে অঁতনা আতো বালির নৃত্য পরিবেশন করতে দেখেছিলেন। অনেকের মতে আতো যা দেখেছিলেন তার অনেকটাই তিনি ভুল বুঝেছিলেন, তবু তা নাটকের জন্য তাঁর অনেক ধারণাকে প্রভাবিত করেছিল। অ্যাড্রিয়ান কার্টিন লিখেছেন যে বালিনিজদের সঙ্গীত এবং শব্দের ব্যবহারের তাৎপর্য ইউরোপীয়দের থেকে ভিন্ন । আতো তাদের 'হিপনোটিক' ছন্দ, উচ্চনাদ  দামামার  প্রভাবের পরিসর, সঙ্গীতজ্ঞদের তৈরি বিভিন্নরকম কাঠের বাজনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । 
    সেটা ছিল  বালিনিজ থিয়েটারের একটি অংশ যা আতো ১৯৩১ সালে প্যারিস ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে দেখেছিলেন,  যা অঙ্গভঙ্গি এবং অভিনয় সম্পর্কে তাঁর ধারণাগুলো বদলাতে  শুরু করেছিল। তিনি মুখের অভিব্যক্তি এবং কথ্য শব্দের আপেক্ষিক গুরুত্বহীনতার ব্যবহারে আগ্রহী ছিলেন। অঙ্গভঙ্গি, তিনি অনুভব করেছিলেন, একজন শিল্পীর অচেতন এবং সচেতন উদ্দেশ্যগুলোকে এমনভাবে জুড়ে দিতে পারে যা শব্দেরা প্রকাশ করতে পারে না (যদিও একজন লেখক হিসেবে তিনি নিজে,  বিশ্বাস করতেন যে শব্দগুলো কী-কী করতে পারে)। যা শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয় তা অঙ্গভঙ্গি করে অভিনেতারা মঞ্চে সেগুলো দৃশ্যমান করতে পারে। তিনি বললেন যে,  'সমস্ত সত্য অনুভূতি বাস্তবে উপস্হাপন-যোগ্য নয়। প্রকাশ করা মানেই বিশ্বাসঘাতকতা। কিন্তু উপস্হাপন করা মানে তাকে ছত্রভঙ্গ করা।  সেজন্যই একটা ছবি, একটা রূপক, একটা ফিগার যা কিনা প্রকাশ করা যায় মুখোশের সাহায্যে   সেটা সংলাপ আর তার বিশ্লেষণের চেয়ে আত্মার জন্য বেশি তাৎপর্য রাখে।
    এর কিছুদিন পরেই তিনি ‘লা নুভেলে রেভিউ ফ্রানসেইজি” পত্রিকায় তাঁর 'ফার্স্ট ম্যানিফেস্টো ফর এ থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি' প্রকাশ করেন; এটি পরে তার মূল বই “দি থিয়েটার অ্যান্ড ইটস ডাবল’-এ একটি অধ্যায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল । এতে তিনি 'টোটেম এবং অঙ্গভঙ্গির একটি নতুন নাট্যভাষা তৈরি করার তাঁর অভিপ্রায় বর্ণনা করেছেন - যা কথোপকথন বর্জিত স্থানের ভাষা যা সমস্ত ইন্দ্রিয়কে আবেদন করবে'।
     অঁতনা আতোর  থিয়েটারে শ্রোতা-দর্শক যা দেখছেন-শুনছেন সেই তত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়েছিল।  তিনি বিশ্বাস করতেন যে থিয়েটারের অনেক পুরোনো নিয়মনীতি বাতিল করতে হবে । তিনি অনুভব করেছিলেন, মঞ্চে যা দর্শক-শ্রোতা দেখবে,  'স্বপ্নে তাদের গুরুত্ব থাকা উচিত' । প্রসেনিয়াম আর্চ,  তার বিরুদ্ধে কাজ করে। নাটকের অভিনয়ে তিনি শ্রোতা এবং অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে কোনো বাধা ছাড়াই একটি একক খেলার জায়গা তৈরি করতে অডিটোরিয়াম এবং মঞ্চের বিলুপ্তিতে বিশ্বাস করতেন।
    নিষ্ঠুরতার থিয়েটার একটি দর্শন এবং একটি ডিসিপ্লিন, দুইই ।  আতোর থিসিসে 'নিষ্ঠুরতা' ছিল  শ্রোতাদের চমকে দেওয়ার এবং মোকাবিলা করার উপাদান । শব্দের বাইরে গিয়ে আবেগের সাথে সংযোগ করার কথা বলেছেন তিনি,  যা কিনা স্নায়ু এবং হৃদয়কে জাগিয়ে তোলার  ক্ষমতা   রাখে । তিনি বিশ্বাস করতেন অঙ্গভঙ্গি এবং আন্দোলন,  পাঠ্যের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। শব্দ এবং আলো সংবেদনশীল ব্যাঘাতের সরঞ্জাম হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। দর্শকদের, তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, অভিনয়ের একটি অংশ হিসেবে প্রস্তুত করা উচিত। থিয়েটার হওয়া উচিত 'সংগঠিত নৈরাজ্যের' একটি কর্মকাণ্ড । আতোর থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির ধারণা হলো  অভিনয়ের  শ্রোতাদের অংশভাক করে তোলা। শ্রোতা এবং অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া হওয়া উচিত, আলো, নড়াচড়া, নাচ, কান ফাটানো শব্দ এবং আরও অনেক কিছুর মাধ্যমে শ্রোতা-দর্শকদের নাটকের চরিত্র করে তোলা প্রয়োজন মনে করতেন আতো।
    দুর্ভাগ্যবশত ‘লেস সেন্সি’ ছিল একমাত্র নাটক যা আতো তাঁর ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির’ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে মঞ্চস্হ করেছিলেন। এটি পার্সি বিসি শেলির ‘লেস সেন্সির’ ওপর ভিত্তি করে অভিনীত হয়েছিল, ১৮১৯ সালে রচিত একটি কাব্যনাট্য। কবিতাটা ছিল হাউস অফ সেন্সি দ্বারা অনুপ্রাণিত । যখন লেখা হয়েছিল তখন এটি মঞ্চযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। এতে পিতৃহত্যা এবং অজাচারের কাহিনি দর্শানো হয়েছিল। বর্তমানে, শেলির ‘লেস সেন্সি’ ইউরো-আমেরিকান নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়।নাটকটি অঁতনা আতোর  সংস্করণে প্যারিসের থিয়েটার দেস ফোলিস-ওয়াগ্রামে অভিনীত হয়েছিল।  শুধুমাত্র ১৭ বার দেখানো হয় কিন্তু দর্শকদের থেকে আশানুরূপ  প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তা সত্ত্বেও, তা ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটির’ উৎকৃষ্ট নিদর্শন হিসাবে সমালোচকদের আকৃষ্ট করেছিল । ‘লেস সেনসি’ সম্পর্কে মঞ্চ-উপস্হাপক  বলেছিলেন যে শুরুর দৃশ্যটা ছিল "তীব্র ঝড়-ঝাপটার বায়ুমণ্ডলীয় অশান্তির ইঙ্গিত , যার সাথে বাতাসে দোল খেতে থাকা পর্দা, হঠাৎ-হঠাৎ বিকট আর বাড়তে থাকা আওয়াজের  তরঙ্গ আর সেই সঙ্গে নাচানাচি করতে থাকা ভিড়ের বেলেল্লাপনা” । সমালোচক জেন গুডঅল ‘দ্য সেনসি’ সম্পর্কে লিখেছেন, "প্রতিফলনের উপর কর্মের প্রাধান্য, ঘটনাগুলির বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছিল ।একক সংলাপ, আকস্মিক, ঝাঁকুনিপূর্ণ পরিবর্তনের প্রয়োজনে কাটা-কাটা সংলাপ, প্রয়োগ করা হয়েছিল আকস্মিকতার প্রভাব তৈরি করার জন্য। সংলাপ আর নানারকম ধ্বনির চরম ওঠানামা সংবেদনশীল সচেতনতাকে ধরে রাখার চেষ্টা করে নাটকটায় ।”
    তাঁর জীবদ্দশায় অঁতনা আতোর তত্ত্বগুলো প্রাথমিকভাবে তত্ত্ব হিসেবেই রয়ে গিয়েছিল কিন্তু ক্রমশ  তাদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে থাকে । অবশ্য অনেকে  যুক্তি দেন যে আতোর ধারণাগুলো সর্বদা সুসংগত বা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তবু একথা অনস্বীকার্য  যে তাঁর তত্ত্বগুলো সমসাময়িক থিয়েটারের গতিপথ বদলে দিয়েছে ।  জাঁ জেনে এবং স্যামুয়েল বেকেট সহ ইউরোপীয় লেখকদের একটা প্রজন্মের উপর তাঁর কাজ গভীর প্রভাব ফেলেছিল। পরিচালক পিটার ব্রুক ছিলেন আতোর তত্বের  একজন প্রধান সমর্থক, যা তাঁর বই ‘দ্য এম্পটি স্পে’স-এ প্রকাশ করেছেন। পিটার ব্রুক প্রযোজিত ‘কিং লিয়ার’ এবং ‘মারাট/সেড’ সবচেয়ে স্পষ্টভাবে আতোর চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত । জিম মরিসন, ১৯৬০-এর দশকের আমেরিকান ব্যান্ড ‘দ্য ডোরস’-এর প্রধান গায়ক, অনুষ্ঠান এবং পারফরম্যান্সের উপর আতোর তত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। জন কেজ, মার্স কানিংহাম এবং দ্য লিভিং থিয়েটার সকলেই আতোর প্রতি ঋণ স্বীকার করেছেন।
    ১৯৬৪ সালে পিটার ওয়েইসের নাটকের প্রযোজনায় আতোর তত্ব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করা হয়েছিল - যার নাম ছিল  ‘দ্য পার্সকিউশন অ্যান্ড অ্যাসাসিনেশন অফ মারাট অ্যাজ পারফর্মড বাই দ্য অ্যাসাইলাম অফ দ্য অ্যাসাইলাম অফ দ্য মারকুইস ডি সেড’। ব্রুকের নির্দেশনায় - রয়্যাল শেক্সপিয়ার কোম্পানির জন্য।  প্রায়শই, আতোর নাটক প্রদর্শন করার সময়ে দর্শকদের কেন্দ্রে রেখে চারপাশে  অভিনয়ের কাঠামো তৈরি করা হতো । নাটকের ভিতর আটকে থাকা দর্শকদের গতানুগতিক থেকে একেবারেই ভিন্ন অভিজ্ঞতা হতো। আতোর ‘লেস সেন্সি’ ( ১৯৩৫ ) নাটকটি এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়ে যে তার নিজের মেয়েকে ধর্ষণ করে এবং তারপর তার মেয়ের ভাড়াটে খুনিদের হাতে খুন হয় । মেয়েটি বাপকে নির্মূল করার জন্য লোকগুলোকে নিয়োগ করেছিল। আতোর কাজের আরেকটি উদাহরণ হল ‘দ্য ফাউন্টেন অফ ব্লাড’ ( ১৯২৫ ), মানুষের, বিশেষ করে নারীদের দ্বারা বিশ্ব সৃষ্টি এবং এর ধ্বংস সম্পর্কে একটি প্রহসন। আতোর অন্যান্য নাটক, দৃশ্যকল্প এবং গদ্যের মতো, ‘লেস সেনসি’ এবং ‘দ্য ফাউন্টেন অফ ব্লাডকে’ প্রচলিত, সভ্য মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করার উদ্দেশ্যে লেখা। আতো চেয়েছিলেন মানুষের পরিমার্জিত মুখোশের পেছনে লুকিয়ে থাকা প্রাকৃতিক, বর্বর প্রবৃত্তিকে বের করে আনা। ‘ দ্য ফাউন্টেন অফ ব্লা’ড সম্পর্কে, অ্যালবার্ট বারমেল  লিখেছেন,  “সব মিলিয়ে, ‘দ্য ফাউন্টেন অফ ব্লাড’ হল একটি দুঃখজনক, বিদ্বেষপূর্ণ, আবেগপ্রবণ প্রহসন, জল্পনা-কল্পনার এক অপূর্ব স্রোত এবং নাটকের ইতিহাসে এক অনন্য অবদান। "
    যদিও আতোর নিষ্ঠুরতার থিয়েটার ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হয়নি, তাঁর ধারণাগুলো আধুনিক থিয়েটারের অনেক চিন্তকের বিষয়বস্তু হয়েছে এবং অনেক বিশ্লেষক আতোর ধারণাগুলো এখনও  অধ্যয়ন করে চলেছেন। লেখক জর্জ ই. ওয়েলওয়ার্থ,  ‘ড্রামা সার্ভেতে’, নিষ্ঠুরতার থিয়েটারকে ব্যাখ্যা করেছেন "নৈর্ব্যক্তিক, নির্বোধ-এবং সেইজন্য নির্মম-নিষ্ঠুরতার বয়ান, যার সবকিছু পিতৃতন্ত্রের  অধীন। আতোর দৃষ্টিতে জগতসংসারের প্রাকৃতিক শক্তিসহ মহাবিশ্ব প্রকৃতপক্ষে নিষ্ঠুর , এবং এই নিষ্ঠুরতা, তিনি অনুভব করেছিলেন, এটি একটি একক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য যার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন হতে হবে। আতোর থিয়েটার অবশ্যই দর্শকের অনুভূতিকে চূর্ণ এবং সম্মোহিত করবে।"  ‘সেওয়ানি রিভিউতে’ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ওয়ালেস ফাউলি  নিষ্ঠুরতার থিয়েটারের আরেকটি বর্ণনা দিয়েছেন এবং তা হলো: “এমন নাটকীয় উপস্থাপনা  যার মঞ্চায়নের সময় দর্শক বিস্মিত এবং এমনকি আতঙ্কিত হয় ।সন্ত্রাস বা উন্মত্ততার সেই অভিজ্ঞতার সময়  দর্শকরা সত্যের একটি নতুন বয়ান বোঝার প্রয়াস করেন ।”
    সুসান সোনট্যাগ  লিখেছেন যে আতোর তত্ব এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে 'পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকার সমস্ত সাম্প্রতিক থিয়েটারের কোর্সকে দুটি কালখণ্ডে ভাগ করা যেতে পারে - ‘আতোর আগে এবং আতোর পরে'।
    পাঁচ
    অঁতনা আতোর নিষ্ঠুরতার থিয়েটার তাঁর নিজের জীবন থেকে পাওয়া । তাঁর জীবনের জটিলতাগুলোর মাধ্যমে তিনি দর্শকদের তাদের নিজস্ব জটগুলো খোলার হদিশ দিতে চেষ্টা করেছেন । সারা জীবন একজন কবি, লেখক, নাট্যকার, অভিনেতা, থিয়েটার পরিচালক এবং আরও অনেক কিছু হিসাবে কাজ করেছেন আতো। তিনি আজ বিংশ শতাব্দীর থিয়েটারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে স্বীকৃত।  পরীক্ষামূলক থিয়েটারের এই ধারাটি এমনভাবে সীমানা ঠেলে-ঠেলে এলাকাকে বাড়িয়ে দিয়েছে যা অন্য ধরনের ইউরো-আমেরিকান থিয়েটার করতে পারেনি । আতো দর্শকদের অভিজ্ঞতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। 
    ১৯৩৫ সালে অঁতনা আতো মেক্সিকো যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । তাঁর মনে হয় যে “দেশটার সভ্যতায় ফিরে আসার পক্ষে এক ধরণের গভীর আন্দোলন" এখনও ঘটছে । প্যারিসের মেক্সিকান লিগেশন তাঁকে একটি ভ্রমণ অনুদান দেয় এবং তিনি ১৯৩৬ সালের জানুয়ারিতে মেক্সিকো চলে যান, কিন্তু সেখানে  তিনি এক মাস পরে পৌঁছোন। ১৯৩৬ সালে তিনি তাঁর প্রথম মেক্সিকান-প্যারিসিয়ান বন্ধু, চিত্রশিল্পী ফেদেরিকো ক্যানত্যুর সাথে দেখা করেন। সেই সময়ে ক্যানতু  পশ্চিমা সভ্যতার অবক্ষয় নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। মেক্সিকোয় গিয়ে আতো তারাহুমরান আদিনিবাসিদের বিষয়ে অধ্যয়ন ও তাদের সঙ্গে জীবনযাপন করা আরম্ভ করেন । তিনি তাদের মাদক পিয়োটির আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন । সেই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিলেন ‘ভয়েজ টু দি ল্যাণ্ড অফ দি তারাহুমারা’ যেটা ইংরেজিতে ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দি পিয়োটি ডান্স’ নামে । এই অভিজ্ঞতার বিষয়বস্তু তাঁর পরবর্তী  কবিতাগুলোর সাথে  সাদৃশ্যপূর্ণ, প্রাথমিকভাবে অতিপ্রাকৃতের সাথে সম্পর্কিত। তারাহুমারাদের দেশে প্রবেশের পর আতো হেরোইন থেকে তার ভয়ঙ্কর উইথড্রয়াল সিম্পটম রেকর্ড করেছিলেন। একটি পাহাড়ের ধারে তাঁর মাদকের শেষ সরবরাহ ত্যাগ করার পর, তাঁকে আক্ষরিক অর্থে তার ঘোড়ায় তুলে দিতে  হয়েছিল ।.
    আতোর কাজগুলোতে প্রায়শই পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মাদকের ব্যবহার, রহস্যবাদ এবং আরও নানারকম  থিম রয়েছে।  সারা জীবন  তিনি স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় ভুগেছেন এবং মানসিক হাসপাতালে জীবন কাটিয়েছেন। আতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভয় পাননি এবং যে পর্যায়ে তিনি মেক্সিকোতে তারাহুমরান লোকদের সাথে থাকতে গিয়েছিলেন আর তাদের জীবনযাত্রা থেকে জরুরি নাটকীয় ও সাহিত্যিক সম্পদ আহরণ করতে চাইছিলেন, তখনও তাঁর স্কিৎসোফ্রেনিয়া চাগিয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল।  সেখানে, দক্ষিণ আমেরিকার আদি নিবাসীদের  পিয়োটি আচার-অনুষ্ঠান উৎসবে অংশ নেয়া আর তারাহুমারা ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় এই মাদক ও সংশ্লিষ্ট উৎসব সম্পর্কে লিখেছেন।পিয়োটি হল একটা ছোট, ডাঁটিহীন ক্যাকটাস যাতে সাইকোঅ্যাকটিভ অ্যালকালয়েড, বিশেষ করে মেসকালাইন থাকে। পিয়োটি মেক্সিকো আর দক্ষিণ-পশ্চিম টেক্সাসের স্থানীয় ক্যাকটাস। খাওয়ার ফলে এর সাইকোঅ্যাকটিভ বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত, পিয়োটি অন্তত ৫০০০ বছর ধরে আদিবাসী  আমেরিকানদের দ্বারা সাংস্কৃতিক উৎসবে  এবং ঔষধি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে । 
    ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, শিল্পী এবং কবিরা চিরকালই স্বাভাবিক উপলব্ধি এবং দৈনন্দিন চেতনার বিকল্প অন্বেষণ করেছেন। অ্যালডাস হাক্সলির মতো ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের মেসকালিন ভ্রমণ থেকে শুরু করে উইলিয়াম এস বারোজের দুঃস্বপ্নের সাইকেডেলিক দর্শন পর্যন্ত, হ্যালুসিনোজেন দ্বারা প্রভাবিত লেখকরা দেবতা এবং দানব উভয়ের সাথে পরিচিত হয়েছেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে কবি, শিল্পী, লেখকদের মধ্যে হ্যালুসিনোজেনিক ওষুধের প্রতি আগ্রহের আবির্ভাব কথাসাহিত্যে একটি ক্রমবর্ধমান দূরদর্শী প্রবণতা তুলে ধরে, যা সাহিত্যিক অভিব্যক্তির পূর্ববর্তী রূপগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে । স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো প্রারম্ভিক রোমান্টিক কবিদের জন্য, নেশাগ্রস্ত কবির জীবনযাত্রায় কল্পনার রশ্মিনির্দেশক  হিসাবে লাউডানাম এবং অ্যালকোহল জরুরি মনে করা হতো। পরের প্রজন্মে কবি-শিল্পীরা আকৃষ্ট হলেন রাসায়নিক মাদকে ।
    উইলিয়াম বারোজ এবং পঞ্চাশ ও ষাট দশকের বিট লেখকরা তৃতীয় বিশ্বে তাদের জৈব শেকড় অনুসন্ধান করতে হ্যালুসিনোজেনগুলোকে ড্রয়িংরুমের বাইরে এবং রাস্তায় সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সাইকেডেলিক ল্যান্ডস্কেপ পুনর্বিন্যাস করেছিলেন। ঔপন্যাসিক উইলিয়াম বারোজ  এবং কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ মেক্সিকোতে পিয়োটি এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ইয়েজ গ্রহণ করেছিলেন।  গিন্সবার্গের কবিতা ‘হাউল’-এর কিছু অংশ পিয়োটির প্রভাবে লেখা হয়েছিল। গিন্সবার্গ এলএসডিতে থাকাকালীন একটি কবিতাও লিখেছিলেন যা তাঁকে নৃবিজ্ঞানী গ্রেগরি বেটসন দিয়েছিলেন । জাঁ জেনের মতো অন্যান্য নাট্যকাররাও থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। জেনে ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার যিনি  রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর কাজগুলি প্রায়ই ইচ্ছাকৃতভাবে উত্তেজক ছিল। তিনি অপরাধ, সমকামিতা এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে লিখেছেন।  বেশিরভাগ আলোচক মনে করেন আতোর থিয়েটার দ্বারা সবচেয়ে সফলভাবে প্রভাবিত হয়েছেন জাঁ জেনে ।
    কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ দাবি করেন আতোর কাজ, বিশেষ করে “ঈশ্বরের বিচারকে বাতিল করা বিষয়ক” শ্রূতিনাটক, তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা "হাউল"-এর উপর অসাধারণ প্রভাব ফেলেছিল।তাঁর প্রভাব দেখা যায়: কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’ ( ১৯৪৭) এর ব্যারাল্টের প্রযোজনায় । ১৯৬৮ সালের শীতকালে, উইলিয়ামস কলেজে আতোর প্রতি  উৎসর্গীকৃত ইন্টারসেশন ক্লাস হয়েছিল, যাতে কিথ ফাউলারের নির্দেশনায় সপ্তাহব্যাপী "নিষ্ঠুরতার নাট্য উৎসব" হয়। এই উৎসবে ‘দ্য জেট অফ ব্লাড’, ‘অল রাইটিং ইজ পিগ শিট’, এবং আতোর বেশ কিছু মূল রচনার প্রযোজনা অন্তর্ভুক্ত ছিল ; একটি ‘টেক্সাস টাওয়ার’ হত্যাকাণ্ডের উপর ভিত্তি করে এবং আরেকটি ‘দ্য রেসারেকশন অফ পিগ ম্যান’ নামে  এনসেম্বল ক্যাথারসিস উপস্হাপন করা হয়েছিল। কানাডায়, নাট্যকার গ্যারি বোটিং দ্য এওলিয়ান স্ট্রিংগার থেকে জেন রক ফেস্টিভ্যাল পর্যন্ত ‘আতোনীয়’ কর্মকাণ্ডের একটি সিরিজ তৈরি করেন এবং ‘প্রমিথিউস রি-বাউন্ড’ সহ  আতোনীয় থিম সহ এক ডজন নাটক মঞ্চস্হ করেন। লেখক এবং অভিনেতা টিম ডালগ্লিশ ইংরেজি ফিজিক্যাল থিয়েটার কোম্পানি বেয়ার বোনসের জন্য দ্য লাইফ অ্যান্ড থিয়েটার অফ অঁতনা আতো ( ১৯৯৯ ) নাটকটি লিখেছেন এবং প্রযোজনা করেছেন। নাটকটি আতোর নাট্যকার হয়ে ওঠার প্রথম বছর থেকে আরম্ভ হয়  যখন তিনি প্রতিষ্ঠা পেতে চাইছিলেন এবং  তাঁর শেষ বছরগুলি কতো যন্ত্রণাদায়ক, আইকনোক্লাস্টিক ও বহিরাগত হিসাবে মানসিক চিকিৎসালয়ে কাটিয়েছেন ।
    অঁতনা আতো লিখেছিলেন, “সব লেখাই শুয়োরের গু । যারা অস্পষ্টতা ত্যাগ করে এবং তাদের মাথায় যা সক্রিয় তা সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করে তারা,  শুয়োর । সমগ্র সাহিত্যিক মহল হলো শুয়োরের খোঁয়াড়। বিশেষ করে তারা, যারা তাদের আত্মার মধ্যে সুবিধার গোপন ডেরা বেঁধেছে, আমি বলতে চাইছি, তাদের মাথার কোনও না কোনও অংশে আর  কঠোরভাবে  মস্তিষ্কের নির্ধারিত  এলাকায় । তারা ভাবে তারা তাদের ভাষার অভিভাবক; যাদের জন্য শব্দের অর্থ আছে । আমি তাদের সুনির্দিষ্ট কাজের কথা ভাবছি, সেই স্বয়ংক্রিয় নাকালের কথা যা তাদের আত্মাকে বাতাএ উড়িয়ে দেয় - তারা শুয়োর।”
    দার্শনিকদের ওপরও আতোর উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখা যায় । আতো লিখেছিলেন, “আপনি যখন মাংনুষকে অঙ্গবিহীন একটি শরীরে পরিণত করবেন, তখন আপনি তাকে তার সমস্ত স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তি দেবেন এবং তাকে তার প্রকৃত স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবেন।”  জিলে দেল্যুজ এবং ফেলিক্স গুয়াত্তারি , আতোর  "অঙ্গ ছাড়া শরীর" শব্দবন্ধ  নিয়েছিলেন তাঁদের শরীরের ভার্চুয়াল মাত্রা এবং  পুঁজিবাদ এবং স্কিৎসোফ্রেনিয়ার বাস্তবতার মৌলিক স্তরের ধারণা বর্ণনা করার জন্য। দার্শনিক জ্যাক দেরিদা আতোর কাজের অবদান ‘প্রধান দার্শনিক চিকিৎসা’ বর্ণনা করেছেন তাঁর "প্যারোল সোফেলি" ধারণার মাধ্যমে। নারীবাদী দার্শনিক জুলিয়া ক্রিস্তেভা আতোর  "প্রক্রিয়ায় বিষয়" নিয়ে আলোচনা করেছেন।
    ছয়
    ১৯২৩ সালে, আতো তাঁর কয়েকটা কবিতা ‘লা নুভেল রেভিউ ফ্রান্সেইজি’ জার্নালে পাঠিয়েছিলেন। সেগুলো প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, কিন্তু আতোর কবিতা এনআরএফ-এর সম্পাদক জ্যাক রিভিয়েরকে কৌতুহলী করেছিল, আর তিনি আতোকে ডেকে পাঠান। পোস্টের মাধ্যমে দেখা করার পর তারা তাদের সম্পর্ক চালিয়ে যান। এই চিঠিগুলির সংকলন একটি গুরুত্বোপূর্ণ কাজ ছিল । আতোর প্রথম প্রধান প্রকাশনা। আতো এনআরএফ-এ তাঁর আরও রচনা প্রকাশ করতে থাকেন, যার মধ্যে রয়েছে "ফার্স্ট ম্যানিফেস্টো ফর এ থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি" ( ১৯৩২ ) এবং "থিয়েটার অ্যান্ড দ্য প্লেগ" ( ১৯৩৩ )। দ্য থিয়েটার অ্যান্ড ইটস ডাবলকে একত্রিত করার সময় তিনি এই প্রকাশনাগুলি তাতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন । আতো লিখেছেন, "কবিতা একটি বিচ্ছিন্ন এবং নৈরাজ্যিক শক্তি যা উপমা, সংসর্গ এবং চিত্রকল্পের মাধ্যমে পরিচিত সম্পর্কগুলোকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।"
    শিল্পীর মানসিক অসুস্থতার জন্য অনেক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময় আতোর সৃজনশীল ক্ষমতাগুলো আংশিকভাবে থেরাপির উপায় হিসাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এডোয়ার্ড টুলুজের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলাকালীন, আতোকে কবিতায় নিজেকে প্রকাশ করতে উৎসাহিত করা হয়, যা টুলুস পরে ‘জার্নালে ডেমেন’-এ প্রকাশ করেন। আতোর জীবন এবং তাঁর কাজ, সাইকোথেরাপির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, তাঁর মানসিক যন্ত্রণাকে প্রতিফলিত করেছে এবং মাদকদ্রব্যের উপর তাঁর নির্ভরতার কারণে তা আরও জটিল হয়েছিল। মাঝে মাঝে তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রকাশ করতেন ; অন্য সময় তিনি চার্চের নিন্দা করতেন এবং নিজেকে দেবতায় উত্তীর্ণ করেছেন। তিনি মানবদেহের প্রতিও আচ্ছন্ন ছিলেন; তিনি যৌনতার ধারণাকে ঘৃণা করতেন এবং নিজের যৌন প্রতিস্ব থেকে নিজেকে আলাদা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
    ‘অঁতনা আতো : ম্যান অফ ভিশান’ গ্রন্থে, লেখক বেটিনা এল. ন্যাপ তাত্বিক হিসাবে আতোর মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে লিখেছেন: “আতো জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে অক্ষম ছিলেন; তিনি অন্যদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারতেন না; এমনকি তিনি তাঁর নিজের পরিচয় সম্পর্কেও নিশ্চিত ছিলেন না।” ন্যাপ মন্তব্য করেছেন যে "আতো মূলত তাঁর অসুস্থতার চারপাশে একটি সম্পূর্ণ আধিভৌতিক প্রণালী গড়ে নিয়ে ছিলেন, বা, বলা যায়,, তাঁর নিজের রোগের মাধ্যমে রহস্যবাদীর রাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তিনি নিজে  এবং সবকিছুই তাঁর অস্তিত্ব থেকে বাহ্যিকভাবে বিকিরিত হতো ।" আতোর ‘দি আমবিলিকাস অফ লিমবো’-র কথা উল্লেখ করে, ন্যাপ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আতো দর্শক-শ্রোতা-পাঠকদেরও  "'ডিরেঞ্জড ম্যান' তৈরি করতে চেয়েছেন, মানুষকে এমন একটি যাত্রায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন 'যেখানে তারা যেতে কখনই সম্মত হবেন না।'" তিনি আরও ব্যাখ্যা করেছেন, "যেহেতু নাটকীয় শিল্প সম্পর্কে আতোর ধারণা ছিল যে সেগুলো তাঁর অসুস্থতাসঞ্জাত,  তিনি থিয়েটারকে  নিরাময়কারী ওষুধ হিসাবে দেখেছিলেন। এমন একটা উপায় যার মাধ্যমে মানুষ থিয়েটারে এসে ছিন্নভিন্ন, বিভক্ত এবং কেটে খুলে ফেলার জন্য রাজি,  তারপরে তার নিরাময় করা যেতে পারে।" ন্যাপ তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে আতোর জনপ্রিয়তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন: “তাঁর সময়ে, তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি নিজের  সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, নিজের মধ্যে বিভক্ত, তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে তাঁর অভ্যন্তরীণ জগত এবং বাইরের শক্তির শিকার। তাঁর কল্পনার জোয়ারের শক্তি এবং তাঁর থেরাপিউটিক অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করা হয়েছিল এবং একজন পাগলের উন্মাদনা হিসাবে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিষ্ঠান তাঁকে একপাশে সরিে দিয়েছিলছিল।বর্তমান কালখণ্ডের মানুষ  আতোর রচনা, ভাবনা, আঁকায় সাড়া দিতে পারে কারণ তারা অনেক মনস্তাত্ত্বিক মিল খুঁজে পায় এবং সখ্যতা ভাগ করে নেয়।"
    সানচে ডি গ্রামন্ট ‘হরাইজন’ পত্রিকার  প্রবন্ধে আতো সম্পর্কে লিখেছেন, "যদি আতো পাগল ছিলেন, তবে আতো নিজের পাগলামিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর কাছে যুক্তিবাদী জগত সন্দেহজনক  ছিল; তিনি হ্যালুসিনেশনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন যা যুক্তিকে বিলুপ্ত করে এবং তার বিচ্ছিন্নতার মর্মার্থ তৈরি করে। আতো ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে সেই সীমার বাইরে রেখেছিলেন যেখানে বিচক্ষণতা এবং উন্মাদনার বিরোধিতা করা যেতে পারে, এবং নিজেকে জাদু এবং অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি ব্যক্তিগত জগতের কাছে আত্মসমর্পণ করা যেতে পারে।"
    আতো তাঁর শেষ এগারো বছরের মধ্যে নয়টি মানসিক চিকিৎসালয়ে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন কিন্তু জীবনীকার সুসান সন্টাগের মতে, তাঁর জীবনের শেষ তিন বছরে তাঁর কিছু সেরা কবিতা  লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন: “এই সময়ের মধ্যে আতোর  লেখার দুর্দান্ত বিস্ফোরণ পর্যন্ত হয়। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮ এর সময়টায়. আতো কবিতাকে ‘বদ্ধ লিরিক বিবৃতি’ হিসাবে  ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন এবং কবিতায় একটি দীর্ঘশ্বাসের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছিলেন যা তাঁর কল্পনাপ্রসূত প্রয়োজনের পরিসরের জন্য পর্যাপ্ত ছিল। এমন একটি কণ্ঠস্বর যা প্রতিষ্ঠিত ফর্ম থেকে মুক্ত এবং যার সমাপ্তিও ছিল মুক্ত, এজরা পাউন্ডের কবিতার মতো।" যাইহোক, সোনটাগ, অন্যান্য জীবনীকার এবং পর্যালোচকরা একমত যে আতোর সামগ্রিক ও প্রগাঢ় প্রভাব ছিল থিয়েটারে। ১৯২০-১৯২৬ সালের অঁতনা আতোর  প্রারম্ভিক চিঠি, প্রবন্ধ, উক্তি, নাটক; এবং অন্যান্য লেখাগুলি পড়লে একটি অভ্যাস, বৈশিষ্ট্য এবং আবেশ প্রকাশ করে যা তাঁর নিজস্ব। প্রধান জীবনীকার এবং সমালোচকরা পর্যাপ্তভাবে ব্যাখ্যা করেননি, যেমন, তাঁর আফিম খাওয়া; তাঁর স্বনির্বাচিত একাকীত্ব; এবং তাঁর চরম উদ্ভাবনের সময়কাল, "অসাড়তা ছড়ানো" এবং মানসিক শূন্যতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি।  তাঁর সুপরিচিত "লেটারস টু রিভিয়ের" এর আগে, তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, তিনি কখনই "সম্পূর্ণভাবে" তাঁর মনকে দখল করতে পারেননি  ( ১৯২১ ) এবং তিনি প্রশ্ন করেছিলেন যে তার কবিতাগুলি "প্রকৃত এগারোটি মনের স্হিতি" ( ১৯২২ ) প্রকাশ করেছে কিনা।
    "লেটারস টু রিভিয়ার"-এ আতো বলেছিলেন  যে চিন্তাভাবনা এবং ভাষার সাথে তাঁর সমস্যাগুলি "মনের ভয়ঙ্কর  রোগ" থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, কিন্তু রিভিয়ার এবং পরবর্তী সমালোচকরা  তাঁর রচনা বিশ্লেষণের অন্যান্য ব্যাখ্যার পরামর্শ দিয়েছেন: শারীরিক বা রূপক অসুস্থতা, এবং বিস্তৃত তাত্ত্বিক কাঠামো যা আতোকে একটি সারিতে বসায় । ধর্মনিরপেক্ষ রহস্যবাদী, দূরদর্শী বিদ্রোহী বা "শুদ্ধ" চেতনার শিষ্যের মতো ভূমিকা ইত্যাদি ব্যাখ্যাগুলির কোনটাই বলতে পারে না কেন তিনি এত অসহায় বোধ করতেন।আতোর সমস্যা এবং একক অভিজ্ঞতার সর্বোত্তম ব্যাখ্যা সিজোফ্রেনিয়া রোগে খোঁজার চেষ্টা  হয়। 
    আগেই জানিয়েছি, অঁতনা আতো ষোলো বছর বয়সে তাঁর প্রথম বিষণ্নতাজনিত ভারসাম্যহীনতার শিকার হন; একুশ বছর বয়সে, তাঁর বংশগত সিফিলিস ধরা পড়ে। ১৯২০ থেকলে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত তাঁর বেশিরভাগ কাজ, যা প্রচলিত ইইউরোপীয় মতামতের বিপরীতে লিখেছিলেন , আবেশ তাড়িত আত্মজীবনীমূলক, “মন" এবং "মাংস"-র সার্বজনীন সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা না করে তাদের ভেতরে তাঁর  ক্রমাগত ক্রমবর্ধমান স্কিৎসোফ্রেনিক বিভাজন থেকে চাগিয়ে ওঠা একক সমস্যা এবং উদ্বেগগুলি প্রকাশ করার চেষ্টা করেছে।  আম্বিলিক্যাল লিম্বো, (নার্ভ স্কেলস, দ্য সিচুয়েশন অফ দ্য ফ্লেশ, ক্লিয়ার ল্যাঙ্গুয়েজে ম্যানিফেস্টো, হেলয়েস এবং অ্যাবেলার্ড এবং নরকে একটি ডায়েরি থেকে টুকরো টাকরা) রচনাগুলো ছাড়াও তাঁর প্রধান প্রবন্ধগুলো একটা গভীর স্কিৎসোফ্রেনিক সংকটের প্রকৃতি এবং প্রভাবগুলি বর্ণনা করেছে  যার অভিজ্ঞতা ১৯২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর হয়েছিল। এই কাজগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর তিক্ততা, সাধারণ পাঠকের কথা ভেবে যা কবি-লেখকরা এড়িয়ে চলেন। তাঁর সমসাময়িক লেখক-আলোচকদের কাছে নিজেকে সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে, যার মধ্যে স্পষ্টতই, পরাবাস্তববাদীরা ছিল, তিনি আলাদা হয়ে যেতে থাকেন সমগ্র পাঠক সমাজ থেকে। 
    অঁতনা আতোর জন্য, অন্ধকারে নিমজ্জন ছিল অন্ধকারকে কাটিয়ে ওঠা। আনাইস নিন জানিয়েছেন, একবার  প্যারিসের এক উজ্জ্বল রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে আতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে পথচারীদেরকে তাদের অভ্যন্তরীণ অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে উৎসাহিত করছিলেন । আতোর দৃষ্টিতে, শরীর এবং মন ছিল অবিচ্ছেদ্য, এবং যা একই যন্ত্র হিসাবে কাজ করে। চিকিৎসালয়ে তিনি ইলেকট্রিক শকে ক্ষুব্ধ,  মেজাজহীন, আপাতদৃষ্টিতে নানা রকমের আত্মপ্রশ্নে জর্জরিত, তবুও সর্বদা অধ্যবসায়ে একাগ্র ছিলেন। মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছেন জেনেও নিজেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেননি।অনেক সময়ে তিনি  একজন প্রতারক ঈশ্বরকে উৎখাত করতে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন । 
    সাহিত্যের সেবক  হিসেবে মার্কামারা লেখক হওয়াকে আতো ঘৃণা করতেন। এটি লেখক হতে জানতেন। ১৯৪৭  সালের আন্তর্জাতিক পরাবাস্তববাদী প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য ব্রেটনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করার পর তিনি আঁদ্রে ব্রেতঁকে বলেছিলেন "আমার জন্ম, জীবন, মৃত্যু, বাস্তবতা এবং ভাগ্য সম্পর্কে নিজস্ব ধারণা আছে, এবং আমি এমন কোনো সাধারণ ধারণায় অংশগ্রহণ করি না যার মাধ্যমে আমি নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো মানুষের সাথে থাকতে পারি।" তিনি আরও বলেছিলেন যে তিনি "পৃথিবীর সমস্ত জাদুকর এবং সূচনাকারীদের সমস্ত সম্প্রদায়ের সাথে প্রতি রাতে এবং দিনে প্রকাশ্য সংগ্রামে যুঝে চলেছেন।"

    সাত
    বহু ক্ষেত্রে আতোর কাজ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অন্তর্নিহিত, তবে এটি সংজ্ঞায়িত করা সহজ নয়। সর্বোপরি, তাঁর লেখা আর আঁকা যেন হতাশার স্মৃতিময়, ভাষার অপ্রতুলতার প্রতিবাদের একটি দীর্ঘ আর্তনাদ, মানবসমাজ, দেহ ও মনে। আতো ছিলেন এমন একজন বিপ্লবী যিনি চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করে দেয় এমন সীমাবদ্ধতা উৎখাতের জন্য লড়াই করে গেছেন। যেন  তাঁর উপলব্ধির প্রান্তে  আধ্যাত্মিক সারাংশের উপচ্ছায়া গড়ে তুলতে পেরেছেলেন এবং তাকে দখল করতে তাঁর অক্ষমতার ফলে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত কাজকে "নথিপত্র" হিসাবে বর্ণনা করেছেন—-অর্থাৎ, কবিতা, প্রবন্ধ, বিতর্ক, নাটক ইত্যাদি "শিল্প" নয়, কিন্তু সত্যের অধরা স্তরে পৌঁছানোর জন্য তাঁর ক্ষীণ প্রচেষ্টার নথি মাত্র। মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট-এর প্রদর্শনীতে থাকা তাঁর আঁকা ড্রইঙগুলোকে তিনি একইভাবে "নথিপত্র"-র তকমা দিয়েছেন৷ প্রায় সত্তরটা আইটেম রয়েছে—তাঁর জীবনের শেষ দশকের ড্রইঙ (তিনি ১৯৪৮ সালে মারা যান), পেইনটারদের কাছে তেমন সুপরিচিত নয় । তারা একক এবং শক্তিশালী কাজ। আতো তাঁর লেখালিখি আর আঁকাকে কখনও "ক্যারিয়ার" এর পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করেননি ।
    আতো ১৯৪৪ সালের দিকে আন্তরিকভাবে আঁকতে শুরু করেছিলেন। ১৯৪৫ সাল নাগাদ, তিনি হায়ারোগ্লিফিক্স নামে একটি বড় ছক তৈরি করছিলেন: মানুষের চিত্র, প্রতীকী বস্তু এবং শব্দের ক্ষেত্র, যার মধ্যে অনেকগুলি তাঁর উদ্ভাবিত ভাষায়। রঙের ইঙ্গিতসহ  পেন্সিলের এই ড্রইঙগুলোর মধ্যে কয়েকটাতে  চিত্রগত গুণ রয়েছে যা অত্যন্ত  উদ্দীপক বলে মনে করেন শিল্প আলোচকরা । প্রকৃতপক্ষে, প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন, কেউ কেউ এগুলোকে বাতিক হিসাবে ভুল করতে পারে। একাধিক স্তন, বিভিন্ন যৌনাঙ্গ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দালির পেনিস-অন-ক্র্যাচের প্রভাব আছে । ক্রাচ হল সালভাদর দালির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি এবং তাঁর অনেক কাজে এর উপস্হিতি পাওবঅ ড়অব। এটি প্রথম এবং সর্বাগ্রে বাস্তবতার প্রতীক এবং বাস্তব জগতের মাটিতে একটি নোঙ্গর, জীবনের অপ্রতুলতার জন্য আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক সমর্থন প্রদান করে। ক্রাচ ঐতিহ্যের প্রতীক, অপরিহার্য মানবিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখে ।
    ১৯৪৬ সালে, অঁতনা আতোর পেন্সিলের কাজ  আরও জোরালো হয়ে ওঠে, রঙগুলি আরও দৃঢ়, দুঃস্বপ্নের দিকগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। ‘দ্য থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি’ শিরোনামের একটি কাজে,  কাঁচের কফিনে ১৯৪৬ সালের মে মাসে, তিনি তাঁর প্রথম আত্মপ্রতিকৃতি তৈরি করেছিলেন। এতে এত বেশি আঁচড় দেয়া হয়েছে যে এটা দেখতে প্রায় ভাস্কর্যের মতো, এবং  বিন্দু দিয়ে আচ্ছাদিত যা দেখতে গুটিবসন্তের মতো —- ক্যাটালগের একটি প্রবন্ধ ফ্রয়েডকে উদ্ধৃত করেছে, জিলে ডেলিউজের কথায়, "পৃষ্ঠ এবং ত্বককে অনুধাবন করার জন্য স্কিৎসোফ্রেনিক যোগ্যতার উপর অসীম সংখ্যক ছোট গর্ত দিয়ে বিদ্ধ করা হয়েছিল। একই সময়ে তৈরি একটি নীল মাথা আরও ভয়ঙ্কর, যেন চিৎকারে ধরা পড়ে, সমস্ত রোগাক্রান্ত বিন্দু দিয়ে আবৃত, চোখ এবং  গলা। এটা, নরক  থেকে বাড়িয়ে দেয়া একটা মুখ.।
    ১৯৪৭ সালে, আতো রোডেজের মানসিক হাসপাতাল থেকে আইভরি-সুর-সেইনের একটি বাসায় চলে যান, যেখানে তিনি বেশি সক্রিয় ছিলেন আর  তিনি লোকজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তেমন অস্বস্তি বোধ করতেন না । এখানে তিনি আঁকেন, অনুপ্রবেশকারী এবং বেশ বৈচিত্র্যময় প্রতিকৃতিগুলির একটি সিরিজ। উদাহরণস্বরূপ, রোলাঁ প্রেভেলকে প্রায় ম্যাটিস ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়েছে, কোলেট থমাসকে এমন সূক্ষ্ম করা হয়েছে যা কোমলতার সমান, যখন জ্যাক প্রেভেরকে মনে হয় দুই ভাগে করাত দিয়ে কাটা  হয়েছে আর আবার সেলাই করা হয়েছে, ম্যানিয়া ওইফার একটি পেঁচায় পরিণত হয়েছে, আর্থার অ্যাডামভের  নাক আর লিঙ্গ জায়গা বদল করেছে।ছবিগুলো সম্পর্কে আতো বলেছেন, "আপনি অবশ্যই ড্রইঙগুলো দেখুন এবং ভিতরে কী আছে তা বোঝার চেষ্টা করুন।" তিনি আরও লিখেছেন যে "মানুষের মুখ একটি শূন্য শক্তি, মৃত্যুর একটি ক্ষেত্র" এবং রূপ এবং বিষয়বস্তুর প্রান্তিককরণ মুখের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের তলায় যা রয়েছে তার মধ্যে বৈসাদৃশ্যের বেশি দূরে নেই। তাঁর প্রতিকৃতিগুলি এতটাই আপসহীন যে তারা পিকাসো বা জিয়াকোমেত্তির চেহারাকে ভদ্র করে তোলে।
    আতো মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হতে পারেন, কিন্তু তাঁর শিল্প  উন্মাদনায় আক্রান্ত নয় । পোর্ট্রেট, যেখানে তিনি বিকৃতি এবং কাগজ ছিঁড়ে যাওয়া শারীরিক শক্তির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ প্রতিনিধিত্ব করার সময় বাহ্যিক বাস্তবতাকে চিত্রিত করার জন্য শান্ত পর্যবেক্ষণ এবং একাডেমিক দক্ষতা ব্যবহার করেছিলেন, উদাহরণস্বরূপ, তার দর্শনের অনেক আকর্ষণীয় বিজ্ঞান-কাল্পনিক প্রকাশগুলোর চেয়ে বেশি সমস্যাজনক। তাঁর কাজকে ব্লেক বা হোল্ডারলিনের তুলনায় "বহিরাগত শিল্প" ধরণের তকমা পরানো যায় না । আতোর শিল্প ছলনাময়। আমরা যা দেখি তার ভেতরে অনুপ্রবেশ বেশ  তীব্র আঘাত সৃষ্টি করে। ছবিগুলোর স্পষ্টতা তাদের বিভ্রম গড়ে তোলার ক্ষমতায়। আতো বলেছেন, “দেহের এইসব কাটা, এই জখম, এই ফাটল, এই আকস্মিক এবং অতল ঝরনার স্মৃতি ঠিক করা এবং স্থায়ী করা ছাড়া আমি কখনও অন্য কারণে লিখিনি।”
    আতোর জীবনের সংক্ষিপ্ত শেষ পর্ব  ১৯৪৬  সালে প্যারিসে ফিরে আসা থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ফরাসী মানসিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে নয় বছর কারাভোগ করার পর থেকে আতোর সবচেয়ে অসাধারণ কাজ হলো তাঁর কবিতা ।  ব্ল্যাক হিউমারের সাহায্যে, আতো তাঁর নিজের মর্যাদাকে তিরস্কার করেছেন। মার্সেই-তে জন্ম নেওয়া বোকাশিশু অর্থাৎ "মোমো" ( তাঁর নিজের নামকরণ )  তাঁর আত্মপরীক্ষাকে আলোকিত করে। আতোর “মোমো” চরম ধর্মহীন অশ্লীলতা এবং তার তাৎক্ষণিক শারীরিক উপলব্ধি এবং তার একাকীত্বের অনুভূতির সূক্ষ্ম উদ্ভবের মধ্যে চলে যায়। বইটির পাঁচ-অংশের ক্রমটি শেষ হয় আতোর মনস্তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠানের  নিন্দার মাধ্যমে । আতো দ্য মোমো, ভিচি ফ্রান্সের অধীনে রোদেজের একটি স্যানিটোরিয়ামে থাকার সময় তার  শেষ লেখা। এই সময়ে, তিনি ইলেক্ট্রোশকের সম্মুখীন হন, এবং নিজস্ব নরকের ডাবল মোমোর সাথে যুদ্ধ করেন।
    ‘আতো দ্য মোমো’ একটি ভয়ঙ্কর কাব্য সংকলন। এর ভাষা সমসাময়িক মান অনুযায়ী হিংসাত্মক এবং পর্নোগ্রাফিক। মোমোর  যন্ত্রণাদায়ক এবং পৌরাণিক ব্যক্তিত্ব। বিষয়বস্তুতে দ্য মোমোর প্রধান ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আতো তাঁর সুস্থতার সময়ে তৈরি করেছিলেন। এতে গ্লোসোলালিয়া ( বিশেষ করে ধর্মীয় উপাসনায় একটি অজানা ভাষায় কথা বলার আপাতদৃষ্টিতে ঘটনা ; এটা বিশেষ করে পেন্টেকস্টাল এবং ক্যারিশম্যাটিক খ্রিস্টানদের দ্বারা অনুশীলন করা হয় ।) , কাল্পনিক হারমেটিক ( দুর্বোদ্ধ ভাষা )  এবং স্ক্যাটালজিকাল ( মলত্যাগ বিষয়ক ) শব্দের খেলা রয়েছে। ‘আতো দ্য মোমো’-র প্রধান আকর্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে নিজের অঙ্গ, এবং পৌরাণিক ঐতিহ্যের মধ্যে সৃষ্টির ভূমিকা । আতোর কবিতাগুলো মাংস ও মলমূত্রকে মহিমান্বিত করে, কিন্তু যৌনতা তাঁর জন্য ছিল সর্বদাই ত্যাজ্য। অজাচার, নরমাংস খাওয়া এবং আত্মহত্যা কবিতার স্বাভাবিক প্ররোচনা, যা সভ্য পশ্চিমা মানুষের দ্বারা নিশ্চিহ্ণ করে দেয়া উপজাতীয় সংস্কৃতির কার্যকলাপ দ্বারা প্রমাণিত । সভ্যতা এতটাই ক্ষতিকর  যে ইউরোপ মেক্সিকোর মতো একসময়ের গর্বিত উপজাতীয় দেশগুলিকে অবক্ষয় এবং মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে গেছে, মাংসের পবিত্রতাকে পৃথক করে ঈশ্বরের মন্দ দিয়ে বিষাক্ত করেছিল ইউরোপ। অনিবার্য শেষ পরিণতি হবে আত্ম-ধ্বংস এবং মানসিক দাসত্ব,  যে দুটি মন্দ তাঁর নিজের জীবনে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ও কারাবাস ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। এইভাবে তিনি রাজনীতি এবং মার্কসবাদকে সর্বান্তকরণে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যার ফলে পরাবাস্তববাদীরা তাকে বহিষ্কার করেছিল। 
    আতো শিল্পের অসম্ভবতা উপস্থাপন করেন। তাঁর অস্বাভাবিক নকল, দ্য মোমোর সাথে তাঁর টানাপোড়েন সম্পর্কটাকে  দৈহিক এবং আধিভৌতিক এবং মূলত চিন্তাভাবনা, অভিজ্ঞতা এবং মানসিক অসুস্থতার চারপাশে পরস্পরবিরোধী সত্যকে তুলে ধরে। তিনি দেখান সাইকোথেরাপি এবং ফার্মাকোলজির দ্বৈতবাদের বাইরেও একটি জগত রয়েছে। কিন্তু তা দেহের অনিবার্যতার সত্য, আমাদের দেহের অনিবার্য ভাঙ্গন, তিক্ততা দূর করে না। যেহেতু স্কিৎসোফ্রেনিয়ার আধিভৌতিক দিকগুলির বিষয়ে কোনও ঐক্যমত হতে পারে না, তাই আভাঁ গার্দ ধারাবাহিকভাবে "পাগলামি"কে  গুরুত্ব দিয়েছে, যেমন ঘটেছে সালভাদর দালি, ফ্রিদা কাহলো, পিকাসোর পেইনটিঙের ক্ষেত্রে। 
    আট
    ‘আতো দ্য মোমো’ থেকে একটা অংশের অনুবাদ এখানে দিচ্ছি যাতে পাঠক অঁতনা আতোর কাব্যকৃতির সঙ্গে পরিচিত হন 
    মাটির সাথে মিশে যাওয়া গলিত শবের চাকা লাগানো জমিতে,
    গলিত শবের  শ্বাসপ্রশ্বাসের জমিতে
    এই শূন্যতার,
    শক্ত এবং নরমের মধ্যে।
    .
    কালো, বেগুনি,
    অনমনীয়
    বিনোদনমূলক
    এবং এটাই সবকিছু।.
    .
    যার মানে হলো একটা হাড় রয়েছে,
    কোথায়
    সৃষ্টিকর্তা
    বসলেন  কবির ওপর,
    তার বাক্যগুলোর
    গ্রাহীক্ষমতা মুছে ফেলার  জন্য
    যেন মগজটা পাদছে
    যে সে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তার ভোদার ভেতর থেকে বের করে আনে,
    যে সে তার ভেতর থেকে বের করে আনবে
    যুগের তলানি থেকে,
    তার ভোদার  গর্ত পর্যন্ত,
    আর  এটা ভোদা সম্পর্কে কোনো কৌতুক নয়
    যে সে তার উপর এভাবেই খেলতে থাকে,
    এটা সমগ্র পৃথিবীর কৌতুক
    যার অণ্ড আছে
    তার পুরুষালি ভোদার ভেতরে
    আর যদি আপনি ছবিটা বুঝতে  না পারেন,
    --আর সেই কথাই  আমি আপনাকে  বলতে শুনছি
    বৃত্তের মধ্যে,
    যে আপনি ছবিটা টের পাবেন না
    যা একেবারে তলার দিকে
    আমার ভোদার গর্তে,--
    তার কারণ আপনি অতলের কথা জানেন না,
    জিনিসপত্রের নয়,
    তা আমার ভোদার,
    আমার,
    যদিও যুগের তলানি থেকে
    আপনারা সবাই  সেখানে গোল-চক্কোর মেরে জিভ দিয়ে চাটছেন
    যেন একজন পরকীয়াকে গালাগাল দিচ্ছেন,
    বন্দী করে মৃত্যুদণ্ডের ষড়যন্ত্র কষছেন।
    গে রে ঘি
    রেগহেঘি
    গেঘেনা
    এ রেঘেনা
    আ গেঘা
    রিরি
    পোঁদ আর শার্টের মধ্যে,
    বীর্য আর জুয়ায় কম বাজির  মধ্যে,
    সদস্য আর হেরো লোকের মধ্যে,
    ঝিল্লি আর ব্লেডের মধ্যে,
    নরুন এবং ছাদের মধ্যে,
    শুক্রাণু এবং বিস্ফোরণের মধ্যে,
    'মাছের কাঁটা আর এবং 'শিকনির  মাঝে

    পোঁদ এবং প্রত্যেকের মধ্যে
    খিঁচুনি
    চেপে দেবার ফাঁদ
    একটা বীর্যপাত মৃত্যুর হইচই
    একটা বিন্দু নয়
    বা একটা পাথরও নয়
    আবদ্ধ এলাকায় মরে  ফেটে যাওয়া
    বা আত্মার বিচ্ছিন্ন অংশও নয়
    (আত্মা জিনিসটা পুরানো করাত ছাড়া আর কিছুই নয়)
    বিচ্ছিন্নতার শ্বাসের
    কিন্তু ভয়াবহ কালহরণ
    ধর্ষিত, ডানা-ছাটা, পুরোপুরি চুষে ফেলা
    সমস্ত অস্বচ্ছল ক্যারদানি করে
    গুমাখা লোকগুলোর
    বেঁচে থাকার জন্য
    যাদের খাবার মতন আর কোনো খোরাক ছিল না
    আতোকে
    গিলে ফেলা ছাড়া
    মোমো
    আমার তুলনায়
    সেখানে, যেখানে একজন তাড়তাড়ি সঙ্গম সেরে ফেলতে পারে
    আমার চেয়ে
    দ্রুত ঠাটিয়ে তুলতে পারে
    আমার অভ্যন্তরে
    যদি সে তার মাথা রাখার যত্ন নিয়েছে
    সেই হাড়ের বাঁকের ওপরে
    যা মলদ্বার আর লিঙ্গের মাঝে থাকে,
    যে কোদাল হাড়ের কথা আমি বলছি
    একটা স্বর্গের 
    আঁস্তাকুড়ের মধ্যে
    পৃথিবীতে যার প্রথম প্রতারণা
    বাবা বা মা ছিল না কেউ
    কে তোমাকে এই গুহায় এনে ফেলেছে,
    কিন্তু
    আমি
    আমার উন্মাদনায় জড়িয়ে গেছি।"
    ওরা এটারই  অনুশীলন করে।
    যদি কোনো ডাক্তার না থাকত
    তাহলে কোথাও কখনো রোগী হত না,
    রোগাক্রান্ত কঙ্কালদের
    মেরে ফেলে কাটাছেঁড়া আর চামড়া ছাড়াবার জন্য,
    কেননা সমাজ আরম্ভ হয়েছে ডাক্তারদের মাধ্যমে 
    রোগীদের মাধ্যমে নয়।
    যারা বেঁচে থাকে, তারা মৃতদের জিনিসপত্র খেয়ে বাঁচে।
    আর এর জন্য জরুরি যে একইভাবে মৃত্যুও বেঁচে থাকুক;
    আর উন্মাদ আশ্রমের মতন কিছুই নেই যা শান্তভাবে পালন করবে
    মৃত্যুকে , এবং মৃত মানুষদের  ইনকিউবেটরে পুরে রাখবে।
    নয়
    ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য অঁতনা আতো ধ্বংসাত্মক নন, তিনি জানতেন তিনি মরণশীল, তাই দগ্ধ করার ভাষায় লিখে গেছেন, ধূমায়িত রেডিয়াম মাছের ধোঁয়ার মতো। এই দৃষ্টান্তে রেডিয়াম, ওপর থেকে চাপানো ঝামেলা হিসাবে নয়, শক্তি হিসাবে,  যা মানুষের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা থেকে উদ্গত হয়। যদিও প্রায় ক্রমাগত শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে – তিনি যখন পাঁচ বছর বয়সে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এবং মাথাব্যথা তাঁর বাকি জীবন ধরে চলতে থাকে—-এবং মানসিক যন্ত্রণা, তিনি একচল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে কাজ করেছিলেন, যখন বেশ কয়েকটি মানসিক ঘটনা তাঁকে বিপর্যস্ত করেছিল, বিশেষ করে মানসিক হাসপাতালে বন্দী করা, যাকে   "অনিরাময় প্যারানয়েড প্রলাপ" হিসাবে বর্ণনা করা হয়,  তাতে ভুগেছিলেন এবং সেই আশ্রয় ছেড়েছিলেন কেবল অন্য আরেকটিতে প্রবেশ করার জন্য। সব মিলিয়ে, তিনি  বাহান্ন বছরের মধ্যে প্রায় পনেরোটি এক বা অন্য ধরণের চিকিৎসালয়ে বন্দীর জীবন কাটিয়েছেন ।
    মানসিক ভারসাম্যহীনতা আর চিকিৎসালয়ের বন্দীজীবন সত্ত্বেও আতো যথেষ্ট লেখালিখি করতে পেরেছিলেন। তাঁর  লেখাগুলো ফরাসি সংস্করণে ২৬টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একজন অভিনেতা হিসাবে প্রশিক্ষিত ছিলেন, এবং ফিল্ম পরিচালনা করেছিলেন, নিজের অভিনয়-মঞ্চ খুঁজে পেয়েছিলেন এবং দ্য থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি হিসাবে সংগৃহীত দূরদর্শী তাত্ত্বিক প্রবন্ধগুলির একটি সেট লিখেছিলেন, যা আজও নাট্য অনুশীলনকারীদের প্রভাবিত করে চলেছে। তিনি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন । বহুমুখী প্রতিভা বলতে যা বোঝায় তাই ছিলেন তিনি ।  তিনি পরাবাস্তববাদীদের একজন প্রাথমিক সদস্য এবং গোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় গবেষণা ব্যুরোর পরিচালক ছিলেন। দুই বছর পর আঁদ্রে ব্রেতঁ  তাঁকে গোষ্ঠী থেকে বের করে দেন–-প্রায় সকল সদস্যকে তাড়াতাড়ি বা পরে বহিষ্কার করা হয়েছিল—-কিন্তু ব্রেতঁ পরে অনুতপ্ত হয়েছিলেন, আতোকে একজন "উদ্ভাবনী মানুষ" এবং “সম্ভবত সবার মধ্যে সত্যিকারের পরাবাস্তববাদী” বলে অভিহিত করেছিলেন।
    অভিব্যক্তির অন্তর্নিহিত স্তর  আতোর জন্য প্রাথমিক ছিল আর শিল্পীর গভীর, অত্যাবশ্যক চরিত্রের যোগাযোগের জন্য প্রযুক্তিগত নির্বাহ ছিল গৌণ। তাঁর পরবর্তী কাজগুলোতে, এই দর্শনটি জটিল হয়ে উঠেছে কারণ তিনি কখনও কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে প্রথম রচনাকেই ব্যবহার করতেন, কোনো পরিশীলন করতেন না।মনে হয়  অভিব্যক্তির শক্তি পরীক্ষা করে চলেছেন আজীবন। এই পদ্ধতিটি তাঁর তথাকথিত "বানানো", টেক্সট এবং চিত্রের মিশ্রনে  সর্বোত্তম অভিব্যক্তি খুঁজে পেয়েছিল যা আতো ১৯৩৭ সালে আয়ারল্যান্ড ভ্রমণের সময় একটি স্নায়বিক বিপর্যয়ের  পরে তৈরি করতে শুরু করেছিলেন।  আতোর কাজকে পরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হলে, তাঁর ডাক্তার মানসিক অসুস্থতার প্রমাণ হিসাবে “বানানো” কাজগুলো উল্লেখ করেছিলেন। দেশলাই আর সিগারেট দিয়ে পোড়ানো এবং ক্রস, ইনফিনিটি চিহ্ন এবং অন্যান্য বিমূর্ত চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা, কাগজের এই নৃশংস টুকরোগুলোতে লুকিয়ে আছে আতোর, তীব্র আর্তনাদ।  কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে আতোর কাজগুলো - একই সাথে ভয়ঙ্কর এবং সুন্দর - তাঁর বিপর্যস্ত জীবন যাপনের খতিয়ান । যেন তাঁর প্রতিস্ব কাগজের পৃষ্ঠায় জ্বলছে । জীবনের শেষের দিকে এসে নিজেকে এবং নির্যাতিত উথালপাথালদের সমন্বয় করার চেষ্টা করে গেছেন।
    ৬ এপ্রিল, ১৯৩৩ তারিখে, রেনে অ্যালেন্ডির আমন্ত্রণে, অঁতনা আতো ‘দ্য থিয়েটার অ্যান্ড দ্য প্লেগ’ নামের অদ্ভুত শিরোনাম দিয়ে সোরবোনের দর্শকদের কাছে একটি সম্মেলনের প্রস্তাব দেন। সেখানে যে অনুষ্ঠানটি হতে চলেছে তার পূর্বাভাস কেউ  দেয়নি, ফলে তার কোনো নথিপত্র নেই। একমাত্র প্রমাণ যা আছে তা আনাস নিনের ডায়েরির লিখন । ডায়রিতে নিন লিখেছিলেন “অ্যালেন্ডি এবং আতো একটা বড় টেবিলের পিছনে বসে ছিলেন। অ্যালেন্ডি আতোর সাথে শ্রোতা-দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেন। ঘর শ্রোতায়  ছিল ঠাশাঠেশি।  সোরবোন মঞ্চে বসে আতো কী বলবেন তা ভুলে যান আর কোনো শব্দ বেরোয় না তাঁর মুখ থেকে । তিনি কোথায় বসে আছেন তা ভুলে গিয়েছিলেন,  ভুলে গিয়েছিলেন  সম্মেলনের কথা।  থিয়েটার, তাঁর পাশের ডক্টর অ্যালেন্ডি, উপস্হিত দর্শক, তরুণ ছাত্র, শিক্ষক এবং মঞ্চ পরিচালকদের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁর মুখে যন্ত্রণার খিঁচুনি দেখা দেয় এবং তাঁর চুল ঘামে ভিজে ওঠে। চোখ বিস্ফারিত, পেশী শক্ত, আঙ্গুলগুলোর নমনীয়তা বজায় রাখতে লড়াই করছেন । হঠাৎ হাউমাউ করে উঠলেন । স্বগত প্রলাপ বকতে লাগলেন। যেন তিনি প্রত্যক্ষ করছেন তাঁর  মৃত্যু ঘটছে, যেন ক্রুশবিদ্ধ হবার প্রতিনিধিত্ব করছেন। উপস্হিত দর্শকদের দমবন্ধ হতে থাকে।  তারা হাসতে হাসতে ফেটে পড়ে। সবাই হাসছিল ! শেষে লোকজন এক-এক করে বেরিয়ে গেল, চেঁচামেচি করে, প্রতিবাদ করে। চলে যাওয়ার সময় তারা দরজায়  লাথি মারতে মারতে বেরিয়ে গেল। কিন্তু আতোর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।” অঁতনা আতোকে ( ১৮৯৬ - ১৯৪৮ ) কোনো একটা নির্দিষ্ট খোপে ফেলে আলোচনা  করা কঠিন । যদিও তাঁর নাম সাধারণ পাঠকেরা বিশেষ জানে না তিনি থিয়েটার, সমালোচনা এবং শিল্পকলার উপর প্রগাঢ় প্রভাব  ফেলতে সফল  হয়েছেন, যাঁরা তাঁর নাম শোনেনি তারাও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত ।
     
    দশ 
    ১৯৩৭ সালের আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে, আতো আয়ারল্যান্ডে গিয়েছিলেন আসন্ন সর্বনাশের প্রস্তুতি বা সাক্ষী হতে। তাঁর গন্তব্য ছিল ইনিশমোর, তিনটি আরান দ্বীপপুঞ্জের একটি (সাধু ও পণ্ডিতদের দ্বীপ হিসেবে খ্যাত )। সম্ভবত আতো ভাবছিলেন যে সময়ের শেষ কালখণ্ডে আটলান্টিকের তরঙ্গের সাথে পূর্ব দিক বিধ্বস্ত হবে। তিনি নিজের সঙ্গে একটা বেতের ছড়ি নিয়ে ঘুরতেন যা তাঁর মতে ছিল যিশু খ্রিস্ট এবং সেন্ট প্যাট্রিক-এর। আয়ারল্যান্ডে থাকতে আতো ফ্রান্সের বেশ কয়েকজন শিল্পী ও লেখককে পোস্টকার্ড এবং চিঠি লিখেছিলেন, যার মধ্যে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের নেতা আঁদ্রে ব্রেতঁও ছিলেন । 
    আয়ারল্যান্ডে ঘুরে বেড়াবার সময়, আতো ইওগানাচটের বিচ্ছিন্ন গ্রামে এবং কিলরোনান, গালওয়ে, কোব আর ডাবলিনে সময়  কাটিয়েছিলেন। মনে হয় তিনি আয়ারল্যান্ডে তার পুরো সময়টা কাটিয়েছিলেন কোনো টাকাকড়ি ছাড়াই। ডাবলিন পুলিশের সাথে তাঁর বেশ কয়েকদিন ক্রুদ্ধ ঝগড়া হয়েছিলখ। তাঁকে সম্ভবত একজন ভবঘুরে হিসেবে মারধর করা হয়েছিল। তাঁকে ডাবলিনের মাউন্টজয় কারাগারে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। সদুত্তর দিতে পারেননি বলে একজন অবাঞ্ছিত বিদেশি হিসাবে আয়ারল্যান্ড থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। আসলে খুব কম ইংরাজি এবং  গ্যালিক বলতে না পারায় তিনি নিজেকে বোঝাতে পারেননি ।  প্যারিস দূতাবাস থেকে একটা পরিচয়পত্র ছিল তাঁর কাছে । আইরিশ সরকারী নথি অনুযায়ী তাঁর বেশিরভাগ সময় একটা হোটেল ঘরে কেটেছিল  যার জন্য তিনি খরচ মেটাতে পারেননি। জেসুইট সম্প্রদায়ের মিলটাউন হাউসের মাঠ থেকে তাঁকে জোর করে তাড়িয়ে  দেওয়ার চেষ্টা হয়, কিন্তু আতো চলে যেতে অস্বীকার করেন।আয়ারল্যাণ্ড থেকে নির্বাসনের আগে তিনি কিছু সময়ের জন্য কুখ্যাত মাউন্টজয় কারাগারে বন্দী ছিলেন। নির্বাসনের সময়ে তাঁর দুই হাত বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ।

    ১৯৪৩ সালে, যখন ফ্রান্স জার্মানি এবং ইতালির দখলে ছিল, তখন রোবের ডেসনোস আতোকে ভিচি অঞ্চলের অভ্যন্তরে রোদেজের মানসিক হাসপাতালে স্থানান্তর করার ব্যবস্থা করেছিলেন, যেখানে তাকে ডাঃ গ্যাস্টন ফেরডিয়ারের দায়িত্বে রাখা হয়েছিল। রোডেজে আতোকে  ইলেক্ট্রোশক শক  আর্ট থেরাপি  করা হয়েছিল। চিকিৎসক বিশ্বাস করতেন যে আতোর যাদুমন্ত্র তৈরি করা, জ্যোতিষের চার্ট তৈরি করা এবং অদ্ভুত ছবি আঁকার অভ্যাস মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। আতো অন্যদের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু করেন। আতো ইলেক্ট্রোশক চিকিৎসার নিন্দা করতেন এবং ক্রমাগতভাবে তাদের বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করতেন। তিনি ডাক্তারদের অনুরোধ করতেন যে তাঁকে “তার বান ফিরিয়ে দেয়া হোক”।আলোচক আলেকজান্দ্রা লুকস লিখেছেন যে "তাঁর নামের 'পুনরুদ্ধার'" সম্ভবত "স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাঁর ডাক্তারদের ধারণাকে শান্ত করার একটা কারসাজি"। এই সময়েই আতো আবার লিখতে এবং আঁকা শুরু করেন, দীর্ঘ সুপ্ত সময়ের পর। ১৯৪৬ সালে, ফার্ডিয়ের আতোকে তাঁর বন্ধুদের কাছে দিয়ে আসেন, যারা তাঁকে আইভরি-সুর-সেইনের সাইকিয়াট্রিক ক্লিনিকে ভর্তি করে দেন।এই ক্লিনিকে  বন্ধুরা তাঁকে আবার লিখতে উৎসাহিত করেন, যেকারণে নিজের  কাজের প্রতি আগ্রহ আবার জেগে ওঠে। তিনি প্যারিসের অরেঞ্জেরিতে  ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের একটা প্রদর্শনী দেখতে যান এবং"ভ্যান গগ, দ্য ম্যান সুইসাইডেড বাই সোসাইটি" প্রবন্ধটা লেখেন। ১৯৪৭ সালে, ফরাসি ম্যাগাজিন K এটি প্রকাশ করে।
    ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে, আতোর মলদ্বারে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এর দিন কয়েক  পরে, ৪ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে প্যারিসের দক্ষিণ-পূর্ব শহরতলির  আইভরি-সুর-সেইনের একটি মানসিক ক্লিনিকে তিনি মারা যান। তাঁকে এস্টেটের মালী প্রথম দেখতে পান। আতো নিজের বিছানার পাশে  একটা জুতা হাতে চুপচাপ বসে আছেন।  সন্দেহ করা হয়েছিল যে তিনি মাদক ক্লোরাল হাইড্রেটের বেশি ডোজ নেবার দরুন মারা গিয়েছেন। নীটশে এবং বুদ্ধের মতো, অঁতনা আতো দুঃখকে অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য হিসাবে দেখেছিলেন এবং একজন সম্পূর্ণ মানুষ হওয়ার জন্য যে মূল্য দিতে হয় তা তিনি জানতেন।  তিনি সমস্ত ইউটোপিয়াকে অনিবার্য ডিস্টোপিয়া হিসাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:৫৪740595
  • অঁতনা আতো : নরকের  ডায়েরি থেকে টুকরা-টাকরা - অনুবাদ মলয় রায়চৌধুরী

    আমার কান্নাও আমার নয়্, আমার জ্বরও আমার নয়। আমার শক্তির এই ভঙ্গুরতা, আমার চিন্তা আর আত্মার এই গোপন উপাদানগুলোর, আপনারা কি সেসবের  অধ্যবসায়কে কল্পনা করতে পারেন?
    এই "কিছু" আমার সাধারণ পরিবেশের রঙ এবং আমার বাস্তবতার বিন্দুর মাঝামাঝি রয়েছে।
      এক ধরণের প্রাথমিক বিবেকের মতো আমার পুষ্টির প্রয়োজন নেই।
    জীবনের এই গিঁটে আঁকড়ে আছে চিন্তার পথ।
    শ্বাসরোধের এক কেন্দ্রীয় গিঁট।
     আমার কাছে কেবল এক স্পষ্ট সত্যের ওপর থিতু হওয়া দরকার, যেটা একক প্রান্তে অবস্হান করছে।
    আমার "আমির"  ক্ষয়ক্ষতির সমস্যা এখন আর কেবল ব্যথার প্রশ্ন নয়। আমি  আমার জীবনের বিকৃতকরণে হস্তক্ষেপকারী নতুন কারণগুলো অনুভব করতে পারি আর আমার অন্তরঙ্গ ভঙ্গুরতায় নতুন বিবেকের মতো কিছু একটা আছে।
     আমি একটা ঘুটি ছুঁড়ে ফেলায় আর নিজেকে একটি পূর্ব-অনুভূত সত্য নিশ্চিতকরণের   অভিনয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার  সম্পূর্ণ কারণ দেখতে পাই, যেমন একটা কাজ হতে পারে গুণবাচক ।
    ঘন্টার পর ঘন্টা, আমি একটা ধারণার বা একটা শব্দের প্রভাবে থাকি। আমার আবেগ সময়ে বিকশিত হয় না, সময়কে অনুসরণ করে না। আমার আত্মার প্রতিফলনগুলো আমার আত্মার পরম আদর্শের সাথে নিখুঁতভাবে খাপ খায়।
    আমি আমার নিজের জন্য তৈরি করা অধিবিদ্যাকে আমার মধ্যে বহন করা শূন্যতার মুখোমুখি বসিয়ে রাখি।
    এই বেদনা আমাকে একটা পেরেকের মতন চালিত করে, যা গিঁথে থাকে আমার সবচেয়ে বিশুদ্ধ বাস্তবতার কেন্দ্রে, সেই সংবেদনশীলতার জায়গায় যেখানে শরীর আর আত্মার দুটো জগৎ আবার মিশে যায় - আমি শিখে ফেলেছি কীভাবে একটা বিভ্রমের প্রভাবের মাধ্যমে এটা দিয়ে নিজেকে বিভ্রান্ত করতে হয়।
    এই মুহুর্তের ভেতর, যা একটা মিথ্যা সৃষ্টির সময়টুকুতে স্থায়ী হয়, আমি নিজের জন্য একটা বিভ্রান্তি  তৈরি করে ফেলি, একটা ফাঁকি, আর আমার রক্ত যেদিকে আমাকে নিয়ে যায়, এক মিথ্যার পথে ছুটে যাই। আমি আমার বুদ্ধিমত্তার দৃষ্টি বন্ধ করে নিই আর আমার ভেতর যা  অব্যক্ত তাকে কথা বলতে দিয়ে, আমি নিজেকে এমন একটা প্রক্রিয়ার বিভ্রমে ফেলে দিই যা আমি বুঝতে পারি না। কিন্তু এই ক্ষুদ্রতম ভুল থেকে আমি  সংগ্রহ করি অজানা কোনও-কিছু বাস্তব । আমি স্বতঃস্ফূর্ত কুহকে বিশ্বাস করি। যে পথে আমার রক্ত আমাকে নিয়ে যায়, সেখানে এমন কোনো দিন আসতে পারে না যেদিন আমি সত্য আবিষ্কার করতে পারব না।
    পক্ষাঘাত আমাকে পরাস্ত করে আর একটু একটু করে আমাকে নিজের কাছে ফিরে আসতে বাধা দেয়। আমার কোনও স্পর্শপাথর নেই, কোন ভিত্তি নেই। আমি চিনতে পারি না এমন সমস্ত জায়গায় নিজেকে খুঁজি। আমার চিন্তাভাবনা আমার আবেগ আমার মধ্যে জেগে ওঠা  ছবিগুলোকে  আর ধাক্কা দিতে পারে না।
     আমি এমনকি আমার ক্ষণিকের আবেগেও নিজেকে নপুংসক  অনুভব করি । আমার বুদ্ধিমত্তা এবং আমার সংবেদনশীলতা, প্রতিটি অর্থে আমাকে  পরিত্যাগ করতে হয়েছে,  যে কারণে আমি আমার মধ্য দিয়ে দিনটাকে উজ্বল হতে দেখি । এটা বুঝতে হবে যে  আমার মধ্যে জীবিত মানুষটা, যে প্রভাবিত হয়, আর যে পক্ষাঘাত আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে, তা আমার মামুলি প্রতিস্বের কেন্দ্রে রয়েছে । তা  আমার ভাগ্যের সাথে একজন মানুষ হওয়ার অনুভূতি থেকে জেগে ওঠেনি। আমি অবশ্যই জীবনের সঙ্গে মিশে আছি।
    আমার যন্ত্রণা যেমন সূক্ষ্ম এবং মার্জিত, তেমনি তা কঠোর এবং রুক্ষ। এই শ্বাসরুদ্ধকর শ্বাসকষ্টের ফাটলে আমার কল্পনাপ্রসূত প্রচেষ্টার প্রাচুর্য চাই, তা দশগুণ  হওয়া দরকার, এমনকি আমাকে কী কষ্ট দেয় সেটা ভাবতেও তা দরকার। আর যদি আমি এই সাধনার জন্য অধ্যবসায় করি, তাহলে চিরকালের জন্য এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্হাকে কবজা করতে পারবো।
     আমি একটি চাপা মৃত্যুর দ্বারা কলঙ্কিত, যেখানে সত্যিকারের মৃত্যু আমার কাছে কোন ভয় রাখে না।
    এই ভয়ঙ্কর রূপগুলো আমার দিকে এগিয়ে আসছে - আমি মনে করি,  তারা আমাকে যে হতাশায়  নিয়ে আসে তা জীবন্ত। এটা জীবনের গিঁটে আটকে  যায়,  যার পর অনন্তকালের রাস্তাগুলো হয় অবারিত। সত্যিই, চিরকালের বিচ্ছেদ। আঙ্গিকসমূহ তাদের ছুরিগুলোকে আমার কেন্দ্রকে ফালাফালা  করে, যেখানে আমি একজন পুরুষের মতো অনুভব করি, তারা জরুরি বাঁধনগুলোকে কেটে দেয়,  যা আমাকে একটা স্পষ্ট বাস্তবতার ধারণার সাথে যুক্ত করে দেয়।
    মূলধন হতাশার রূপ (সত্যিই অত্যাবশ্যক),
    বিচ্ছেদের মোড়,
    আমার শরীরে অনুভূতির একটি মোড়,
    আমার শরীর দ্বারা পরিত্যক্ত,
    মানুষের সমস্ত সম্ভাব্য অনুভূতি দ্বারা পরিত্যক্ত।
    আমি একে কেবল সেই অবস্থার সাথে তুলনা করতে পারি যেখানে একজন মানুষ নিজেকে জ্বরের প্রলাপের সময় খুঁজে পায়,  যা তার গুরুতর অসুখের সময় ঘটে।
    আমার গভীরতম সরলতা আর আমার বাহ্যিক অসুবিধার মধ্যে অ্যান্টিমনি এমন যন্ত্রণা তৈরি করে যা আমাকে খুন করে ফ্যালে
    সময় চলে যায় আর জগতসংসারের সামাজিক খিঁচুনি পুরুষদের চিন্তাভাবনাকে ধ্বংস করতে পারে, তবে আমি সেইসব   চিন্তা থেকে মুক্ত যা এই ধরনের ঘটনায় হারিয়ে যায় । আমাকে আমার আবছা মেঘের কাছে ছেড়ে দাও, আমার অমর শক্তিহীনতা, আমার অযৌক্তিক আশার কাছে। তবে এটা জানাবেন যে আমি আমার কোনো ভুলই মাফ করি না। আমি যদি ভুল করে থাকি, তবে সেটা আমার মাংসের দোষ, কিন্তু এই আলোগুলো, যেগুলো আমার মন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছেঁকে তুলতে থাকে,  তা আমার শরীরে  রয়েছে, যেখানে বিদ্যুতের ঝলকানিতে তা আমার রক্তে মিশে যায়।
    সে আমার সাথে নার্সিসিজমের কথা বলে, আমি তাকে জানাই  যে এটাই আমার জীবন। শব্দের বাস্তব অর্থ আমার নিজের জন্য নয়, আমার মাংসের প্রতি নিবেদিত এক ধর্ম আছে। আমি স্পর্শ করেছি,  সে "আমি" নয়, সে আমার মাংস; ব্যাপারগুলো এর  সাথে মিশ খায় , যেখানে তারা একে ঝাঁকুনি দেয়, তবে তার বেশি  কিছু নয় । সরাসরি আমার ত্বককে যা ছোঁয় তা ছাড়া কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না বা আগ্রহী করে না। আর তখনই সে  আমাকে আমার অহং সম্পর্কে বলে। আমি উত্তর দিই যে ‘আমি’ এবং ‘অহং’ দুটি স্বতন্ত্র পদ, বিভ্রান্ত হবেন না, আর ঠিক এই দুটি পদ যা মাংসের ভারসাম্যকে এড়িয়ে চলে
    আমি অনুভব করতে পারি আমার চিন্তার তলদেশে ভূমিক্ষয় হচ্ছে, এবং এটি  তাদের  অধঃস্তরের প্রকৃত অর্থের সমর্থন ছাড়াই যে শব্দগুলো আমি ব্যবহার করি তা কল্পনা করতে আমাকে নির্দেশ দেয় । আর তার থেকেও ভালো: এই সাবস্ট্রেটাম হঠাৎ করেই অবিশ্বাস্যভাবে সংবেদনশীল এবং ভার্চুয়াল হয়ে ওঠে। আমার কাছে একটি অপরিকল্পিত এবং স্থির স্থানের ধারণা আছে, যখন স্বাভাবিক সময়ে সবকিছুই চলাচল, যোগাযোগ, হস্তক্ষেপ, যাত্রা ঘটতে থাকে।
    কিন্তু এই ক্ষয় যা আমার চিন্তাকে তার মূল প্রশ্নে পৌঁছে দেয়, বুদ্ধিমত্তা এবং মনের সহজাতভাবের সাথে, তার সবচেয়ে জরুরি যোগাযোগের মধ্যে, একটি অসংবেদনশীল বিমূর্তের এলাকায় কিন্তু যায় না, যেখানে শুধুমাত্র তীক্ষ্ণ ধীশক্তির টুকরোগুলো অংশগ্রহণ করে। আত্মা যতটা অক্ষত থাকে, তা বেশ কিছু বিন্দুতে ভর করে থাকে , এই ক্ষয় আমার চিন্তার স্নায়বিক যাত্রাকে দূরে সরিয়ে দেয়। আমি  আমার অঙ্গ এবং রক্তে এই অনুপস্থিতি এবং অচলতা অনুভব করতে পারি।
     প্রচণ্ড ঠান্ডা,  নৃশংস পরিহার,  দুঃস্বপ্নের অস্থি এবং পেশী,  কার্যকারিতার অনুভূতিসহ একটি ঝড়ের ফসফোরেসেন্সে একটি পতাকার মতো পতপত করতে থাকে।
    লার্ভা চিত্রগুলি এমনভাবে চলমান যেন  আঙুল দিয়ে টুসকি মারা হয়েছে আর  কোনও উপাদানের সাথে তা সম্পর্কিত নয়।
    আমি আমার হাত-পা সব নিয়ে একজন মানুষ, আমার পেট, আমার মাংসের হৃদয়, আমার পেটে গিঁট পড়ে গেছে   জীবনের বিচ্ছিন্নতার সাথে।
    তারা আমার সাথে কথা বলে, কিন্তু তা  শব্দ নয়, তা আত্মার সময়কাল।
    শব্দের এই রোঁয়া যে ওড়ে, আমাদের মনে রাখা উচিত  যে আত্মা তাতে  জড়িয়ে নেই। মনের পাশেই আছে জীবন, আছে মনের ঘূর্ণিতে আঁকা বৃত্তে মানুষ, বহু সুতোয় বাঁধা তারা ।
    না, সমস্ত শারীরিক অঙ্গচ্ছেদ, শারীরিক ক্রিয়াকলাপের এই সমস্ত হ্রাস এবং নিজের শরীরের উপর নির্ভরশীল বোধ করার জন্য এই বিব্রতবোধ, আর সেই দেহটি নিজেই মার্বেল দ্বারা ভারাক্রান্ত এবং সস্তা কাঠের উপর শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল, এর কোনটিই শারীরিক সক্ষমতা অস্বীকার করার দুঃখের সমান নয় এবং তা একজনের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যের মর্মার্থ । যে আত্মার ভাষা নেই, বা যে ভাষা আত্মাকে ব্যর্থ করে দেয়, আর এই বিরতি সমভূমির অর্থে হতাশা এবং রক্তের বিস্তীর্ণ লোমের মতো আঁকতে থাকে, এটিই বড় দুঃখ, যা পোশাকটাকে খায়, বাকলকে নয়। বা কাঠামোকে নয় । কেউ এই ভ্রান্ত দীপ্তিকে হারাতে উঠে পড়ে লেগেছে , কখনও বা কাউকে  আমরা অনুভব করি যে সে এক অতল গহ্বর যার ফলে সে  নিজের মধ্যেই বিশ্বের সমগ্র সম্ভাব্য বিস্তৃতি অর্জন করেছে, আর এমন এক অসারতার অনুভূতি সঞ্চয় করেছে যে এটা যেন মৃত্যুর গিঁট । এই অকেজোভাব,  এই অতল গহ্বরের নৈতিক রঙের মতো, আর  এই তীব্র মূর্খতার মতো, এবং এর শারীরিক রঙ মস্তিষ্কের ছিদ্র দিয়ে নির্গত রক্তের স্বাদ এনে দেয়।
    যদিও আমাকে প্রায়ই বলা হয় যে এই গলাকাটার বোধ আমার মধ্যে রয়েছে, তাই আমি জীবনে অংশগ্রহণ করি, আমি নিয়তির প্রতিনিধিত্ব করি, যে আমাকে বেছে নেয়; এবং এটা হতে পারে না যে আমি এক নির্দিষ্ট মুহুর্তে বিশ্বের সমস্ত প্রাণের  মধ্যে গণ্য হব: তার প্রকৃতির দ্বারা গণ্য হব, এই বিশ্বের, এই সমস্ত প্রাণ জীবনের নীতিকে হুমকি দেয়।
    মানুষের সমস্ত ক্রিয়াকলাপের ঊর্ধ্বে কিছু আছে: অর্থাৎ, এই একঘেয়ে ক্রুশবিদ্ধকরণের উদাহরণ, এই ক্রুশবিদ্ধকরণ যেখানে আত্মা কখনই পুরোপুরি মারা যায় না।
    যে দড়িটি দিয়ে আমি বুদ্ধিমত্তার ভেতরে ছেঁদা  করতে দিই, তা আমাকে দখল করে, আর অচেতনের মধ্য দিয়ে তা আমাকে পুষ্ট করে,  তার উজ্বল উপাদানে আরও সূক্ষ্ম সুতো আবিষ্কার করে। এইভাবে, একটি নতুন জীবনের পুনর্জন্ম ঘটে, আরও বাগ্মী, গভীর এবং মূলভূত।
     এই আত্ম-শ্বাসরোধকারী আত্মার দ্বারা কখনই কোন সূক্ষ্মতা সম্ভব নয় , কারণ যে যন্ত্রণা এটিকে হত্যা করে, যা এটিকে রেশা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে, চিন্তার তলায় চাপা পড়ে , এমন  নীচে যেখানে ভাষা প্রবেশ করতে পারে, কারণ এটি সেই একই জোড়ালাগা যা এটা নিজেই তৈরি করে। এবং এটি আধ্যাত্মিকভাবে কেন্দ্রীভূত , যা জীবনকে অবিচ্ছিন্ন উজ্জ্বলতার দিকে ডাকার সাথে সাথে ভেঙে পড়ে । এই আবেগ, এই ধরণের চক্রাকার এবং মৌলিক অপঘাতে কখনই কোন উজ্জ্বলতা নেই। এবং তবু, এটি বেঁচে থাকে,  তবে তাকে যখন মান্যতা দেয়া হয় তখন , যেখানে তা ক্ষণস্থায়ী জঙ্গমের সাথে মিশে যায় । বিভ্রান্তি সময়হীন একটি উজ্জ্বলতার বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী ভাষার সাথে মিশে যায়। এই অভিশাপ তার বসবাসের গভীরতাকে শিক্ষিত করে, কিন্তু বিশ্ব তার পাঠ শুনবে না।
    একটি আঙ্গিকের স্ফূটনের দ্বারা উদ্ভূত আবেগ, কোনও সময়কাল ছাড়াই,  বক্তৃতার মায়ার সাথে,  আমার হাস্যরসের অভিযোজন আমার কাছে মোটেই রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যবান  কার্যকলাপ নয়।
    এটা  আধ্যাত্মিক মিথ্যার পরশপাথর।

     এই ধরণের পদক্ষেপ যা আত্মা তৈরি করে, চেতনার নীচে এটি দেখছে, তা হল জীবনের আবেগের সন্ধান করা। এই আবেগটি সেই নির্দিষ্ট বিন্দুর বাইরে যেখানে আত্মা এটির সন্ধান করে, এবং একটি সমৃদ্ধ ঘনত্ব এবং একটি নতুন প্রবাহ নিয়ে আবির্ভূত হয়, এই আবেগ যা আত্মাকে বস্তুর হৃদয়গ্রাহী শব্দ ফিরিয়ে দেয়, আত্মা সম্পূর্ণরূপে এখানে প্রবাহিত হয় এবং তার প্রখর আগুনের মধ্য দিয়ে যায়। কিন্তু আগুনের চেয়েও যা আত্মাকে মুগ্ধ করে তা হল এই অতি-ঠাণ্ডা পদার্থের অলসতা, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাভাবিকতা এবং হিমবাহের প্রখরতা, উষ্ণ এবং ঠাণ্ডা।

    . এই বিষয়টির উত্থানের অর্থ কী এবং কোন আন্ডারগ্রাউন্ড গণহত্যার জন্য এর হ্যাচিং খরচ তা একজনই জানেন। এই ব্যাপারটি এমন একটি শূন্যতার মানদণ্ড যা অলক্ষিত হয়।

    যখন আমি ভাবি, আমার চিন্তাগুলি একটি নতুন স্থানের ইথারে অনুসন্ধান করে। আমি মেঘের মধ্যে আছি যেমন অন্যরা তাদের বারান্দায় রয়েছে। আমি আমার আত্মার ফাটলে গ্রহের মাধ্যাকর্ষণে অংশগ্রহণ করি।

     জীবন উন্মোচিত হবে, ঘটনাগুলি উন্মোচিত হবে, আধ্যাত্মিক দ্বন্দ্বগুলি সমাধান হবে এবং আমি অংশগ্রহণ করব না। শারীরিক এবং নৈতিকভাবে, আমার জন্য অপেক্ষা করার কিছু নেই। আমার জন্য, এটি চিরকালের বেদনা এবং ছায়া, আত্মার রাত, এবং আমার কান্নার শব্দ নেই।
    আপনার ঐশ্বর্য সেই অবোধ দেহ থেকে অনেক দূরে জীর্ণ যে কোন ঋতু, আধ্যাত্মিক বা ইন্দ্রিয়গত, পরিবর্তন করতে পারে না।
     আমি অন্যদের মত বেদনা এবং ছায়ার রাজ্য বেছে নিয়েছি যেটি দীপ্তি এবং পদার্থের সঞ্চয়নের জন্য বেছে নিয়েছি।
    আমি কোন ডোমেইনের এলাকায় পরিশ্রম করি না।
    আমি একটি অতুলনীয় সময়কালের জন্য পরিশ্রম করি।
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:৫৫740596
  • অঁতনা আতো : কবিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
    যখন আমরা কবিতার জগতে প্রবেশ করছি, তখন আমরা কেবল আত্মার অবতার হয়ে লিখছি, কিন্তু আত্মা ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, আর তা আমাদের দ্বারা নয়।  কবি, যিনি লেখেন, শব্দকে সম্বোধন করেন এবং শব্দের নিজস্ব আইন রয়েছে। এই আইনগুলিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্বাস করা কবির অচেতন অবস্থায় রয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন যে তিনি স্বাধীন কিন্তু তা তিনি নন।
    কবির মাথার পিছনে এবং কানের পিছনে কিছু আছে - তার চিন্তার জিনিসগুলো। তার ঘাড়ের কোণে কিছু একটা বেড়ে উঠছে, যার শেকড় তার কবিজন্ম উৎপত্তির আগে থেকে রয়েছে । তিনি তাঁর কাজের সন্তান, সম্ভবত, কিন্তু তাঁর কাজগুলো তাঁর দ্বারা গড়া হয়নি; কারণ তাঁর কবিতায় নিজের যা কিছু আছে, তা তিনি সেখানে রাখেননি, বরং জীবনের একজন অচেতন নির্মাতা রেখেছেন, যিনি তাঁকে তাঁর কবি হিসাবে মনোনীত করেছিলেন এবং যিনি স্পষ্টতই তাঁর প্রতি কখনই ভাল আচরণ করেননি।
    সে যাই হোক, আমি আমার অচেতন প্রযোজকের কবি হতে চাই না; অথবা সেই প্রতিস্ব যে আমাকে কবি হিসেবে বেছে নেবার নজিরহীন কল্পনা করেছিল ; আমি বরং একজন কবি-স্রষ্টা হতে চাই, যে  অহং এবং প্রতিস্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এবং আমি অহং আর প্রতিস্বের বিরুদ্ধে পুরানো বিপ্লবের কথা ভাবি । এবং আমি আমার কাছে আসা আঙ্গিকগুলোর বিরুদ্ধে পুরানো বিপ্লবের কথা ভাবি। অহংকার আর নিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমেই আমি নিজেকে শব্দের সমস্ত মন্দ অবতার থেকে মুক্তি দিতে পারি, যেগুলো  মানুষের জন্য কাপুরুষতা এবং বিভ্রমের মধ্যে সব সময় সমঝোতা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন কাপুরুষতা এবং বিভ্রমের কথা আসে তখন আমি যা জানি তা হল ঘৃণ্য ব্যভিচার।
    আমি চাই না যে  কোনো শব্দ আমার কাছে এখনও-অজানা কোনও নাক্ষত্রিক কামশক্তি থেকে আসবে ; তা আসবে ইচ্ছার গঠন সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে, যা আমার এবং শুধুমাত্র আমার। আমি জানি না মানবিক শব্দের আকারে কী কী ধর্ষণাত্মক ক্রিয়াকলাপ আছে, এও জানি না কী কী নিজেকে খেয়ে ফেলার লোভে সক্রিয়, যেখানে কবি বস্তু-বিশেষের প্রতি আত্মসমর্পিত, দেখতে পান যে সেটা তাঁকে খেয়ে ফেলছে।শব্দকে মাংস দিয়ে তৈরির অপরাধ হলো প্রথমে তাকে সেই কাজে অনুমতি দেওয়ার অপরাধ। কামশক্তি হল জানোয়ারের  চিন্তা আর এই একই প্রাণীরা একদিন মানুষে পরিণত হয়েছিল।
    মানুষের দ্বারা সৃষ্ট শব্দ হলো বস্তু-বিশেষের প্রতি জান্তব প্রতিক্রিয়ায় কবরে উল্টো লটকানো লোকের ধারণা, যে কিনা ( সময় এবং বস্তুদের শহিদ করার ) ভুলে গেছে যে শব্দটি উদ্ভাবিত হয়েছিল।উল্টো লটকানো হল সেই ব্যক্তি যে নিজেকে খায়, এবং চায় তার প্রতিস্ব তার লালন-পালন করুক, তার নিজের মধ্যে  মাকে পেতে চায় আর মাকে নিজের জন্য অধিকার করতে চায়। অজাচারের আদিম অপরাধ কবিতার শত্রু আর তাকে যারা খতম করে তারা কবিতায় নিষ্পাপ ।

    আমি আমার কবিতাকে খেয়ে ফেলতে চাই না, তবে আমি আমার কবিতাকে আমার হৃদয় দিতে চাই। আর আমার  হৃদয় আমার কবিতায় কী ? যা আমার অহং নয় তা আমার হৃদয় । নিজের কবিতার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াও কবিতার দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার ঝুঁকি। আর আমি যদি আমার কবিতার জন্য কৌমার্য বজায় রাখি, তবে তা আমার কাছে কুমারী থাকতে বাধ্য।  আমি একজন বিস্মৃত কবি,  বস্তুতে পালটে ফেলা ছাড়া আর কিছুই নই, যদিও বস্তু আমাকে বা আমার অহংকারকে কখনও গ্রাস করবে না। আমি এই পুরোনো প্রতিফলনগুলো চাই না; এগুলো প্রাচীন অজাচারের পরিণতি, যা জীবনের কৌমার্যের নিয়মনিষ্ঠা  সম্পর্কে জানোয়ারদের অজ্ঞতা থেকে এসেছে।  প্রতিস্ব এবং অহং দুটোই অস্তিত্বের বিপর্যয়কর অবস্থা, যেখানে একজন জীবিত ব্যক্তি অনুভূত আঙ্গিকের দ্বারা বন্দী হয়। নিজেকে ভালবাসা  মানে একজন মৃত ব্যক্তিকে ভালবাসা, এবং কৌমার্যের নিয়মনিষ্ঠা অসীম।
    আমাদের নিজেদের প্রতিস্বের অচেতন প্রযোজক হলো একজন প্রাচীন সঙ্গমকারী যে আদিম জাদু আচারে লিপ্ত হয়, আর যে  এই জাদু ব্যাপারটা বজ্জাতের কাছ থেকে পেয়েছে এবং নিজেকে বারবার ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, তাই সে এখন একটি শবের জন্য একটি শব্দ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। কামশক্তি হল একটি শবের জন্য এই ইচ্ছার সংজ্ঞা, আর অধঃপতিত মানুষটা একজন উল্টো লটকানো অপরাধী। আমি সেই রকমের আদিম। আমি যাবতীয় ব্যাপার-স্যাপারের অসহনীয় ভয়াবহতা নিয়ে অসন্তুষ্ট। আমি ব্যাপারগুলোয় নিজেকে পুনরুৎপাদন করতে চাই না, তবে আমি নিজের মাধ্যমে ব্যাপারগুলো ঘটাতে চাই। আমি আমার কবিতায় আমার অহংকারের কোনও ইঙ্গিত রাখতে চাই না আর আমি কবিতায় আবার নিজের সাথে দেখা করতে চাই না।
    আমার হৃদয় হল সেই চিরন্তন গোলাপ যা প্রথম ক্রুশকাঠের জাদুশক্তি থেকে এসেছে। যিনি নিজেকে ক্রুশবিদ্ধ করিয়েছিলেন তিনি কখনো নিজের কাছে ফিরে আসেননি। কখনই না। কেননা তিনিও আত্মসমর্পণ করেছিলেন জীবনের কাছে, যার দ্বারা তিনি নিজের আত্মবলিদান দিয়েছিলেন,  নিজের জীবনের সত্তায় পরিণত করতে নিজেকে বাধ্য করেছিলেন।
    আমি কেবল চিরকালের জন্য সেই কবি হতে চাই, যে নিজেকে  কাব্বালার  নিষ্পাপ ধারণার কাছে  আত্মাহুতি দিয়েছিল।
    টীকা : কাব্বালা শব্দটি ইহুদি রহস্যবাদের একটি বিশেষ বৈচিত্র্যকে বোঝায়, যা প্রথম দ্বাদশ শতকে প্রোভেন্স এবং কাতালোনিয়াতে আবির্ভূত হয়েছিল। এটি ঐশ্বরিক রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত অভ্যন্তরীণ কাঠামো এবং প্রক্রিয়াগুলির সাথে সম্পর্কিত ছিল, যার আধিভৌতিক গতিশীলতার উপর কাবালিস্টরা প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছিল।
     
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১১:০৬740597
  • অঁতনাআতো
    আত্মহত্যা কি একটি সমাধান?
    না, আত্মহত্যা এখনও একটি অনুমান। আমি আত্মহত্যা করার প্রশ্ন তোলার অধিকার দাবি করি, ঠিক যেমন আমি বাকি বাস্তবতা সম্পর্কে  প্রশ্ন তুলি । আপাতত, এবং ভবিষ্যতের কোনো দিন পর্যন্ত, আমাদের  ভয়ঙ্করভাবে সন্দেহ করতে  হবে, কেবল অস্তিত্ব সম্পর্কেই নয়, কঠোরভাবে বলতে গেলে যা  কেউ বস্তু, ক্রিয়া এবং বাস্তবতার অভ্যন্তরীণ আন্দোলন এবং গভীর সংবেদনশীলতা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারে। আমি এমন কিছুতে বিশ্বাস করি না যার সাথে আমার চিন্তা, উল্কার মতন, নাড়ির সংবেদনশীলতার দ্বারা যুক্ত নয়। সে যাই হোক, আমি সক্রিয় উল্কাদের থেকে যৎসামান্য নূন।  সমস্ত মানবজাতির অস্তিত্বের সংবেদনশীল ব্লুপ্রিন্টগুলো আমাকে বিরক্ত করে এবং আমি সমস্ত বাস্তবতাকে দৃঢ়ভাবে ঘৃণা করি।আত্মহত্যা ব্যাপারটা আগেকার কালের স্পষ্ট-চিন্তাশীল মানুষদের , কিংবদন্তী বিজয়ের চেয়ে বড়ো নয়, তবে কঠোরভাবে বলতে গেলে, আমি  আত্মঘাতী অবস্থানকে অসম্পূর্ণ বলে মনে করি। একজন স্নায়বিক দৌর্বল্যগ্রস্ত মানুষের আত্মহত্যা কোনো পরিণতিই উপস্থাপন করে না, যদি তুলনা করা হয়   একজন ব্যক্তির সঙ্গে যার আত্মার অবস্থান এমন যে বস্তুগত পরিস্থিতি এবং বিস্ময়কর মুক্তির মুহূর্তে সে তার আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছে। আমি জানি না ব্যাপারগুলো আসলে কী, বা মানুষের মনের বিশেষ অবস্থা, এই বিশ্বের কিছুই আমার জন্য সত্য নয় বা আমার মধ্যে সত্য হিসাবে চলাচল করে। জীবন আমাকে ভয়ানক কষ্ট দেয়। আমি কোন জায়মান মনের অবস্থা অর্জন করতে পারি না। আর আমি নির্ঘাত  অনেককাল আগে মারা গেছি, আমার আত্মহত্যা ইতিমধ্যেই ঘটেছে। অর্থাৎ আমার অন্তরাত্মাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আগের কোনও আত্মহত্যা সম্পর্কে আপনি কী ভাববেন, এমন একটি আত্মহত্যা যা আমাদের পুরোনো পদক্ষেপগুলো ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করবে, কিন্তু অস্তিত্বের  দিকে, মৃত্যুর দিকে নয়। সেটাই একমাত্র ব্যাপার যার আমার কাছে কোনও মানে আছে, আমি মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা অনুভব করি না।আমি না-হওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনুভব করি যে এই অক্ষমতা, অস্বীকৃতি, ত্যাগ এবং স্থূল যোগাযোগে ডুবে না পড়ি যা অঁতনা আতো’র অহংকার এবং লোকটার চেয়ে অনেক দুর্বল।  এই পঙ্গু  বিচরণকারীর অহংকার , যে সময়ে সময়ে তার ছায়া দেখাতে আসে সে বেশ আগেই নিজের থুথুর মতন ফেলে দিয়েছে, তার নড়বড়ে, খোঁড়া আত্মা, এই অপার্থিব অসম্ভব অহং যা বাস্তব জীবনে কেউই  খুঁজে পায় না। তার মতো কেউ কখনও নিজের দুর্বলতা অনুভব করেনি যা মানবজাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মৌলিক দুর্বলতা। ধ্বংস করার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য নয়।
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১১:০৮740598
  • অঁতনা আতো
    মনের একজন চিত্রকর
     একটি ভ্রূণের শৈলীতে পল ক্লি (জার্মান) কিছু আকর্ষণীয় দৃষ্টিভঙ্গি সংগঠিত করেছেন। আমি তাঁর কিছু দুঃস্বপ্নকে বেশ পছন্দ করি, তাঁর মানসিক সংশ্লেষগুলি স্থাপত্য (বা তাঁর একটি মানসিক প্রকৃতির স্থাপত্য) এবং কিছু মহাজাগতিক সংশ্লেষের মতো ধারণা করা হয় যেখানে গেয়র্গে গ্রৎসের সংশ্লেষের চেয়ে জিনিসগুলির সম্পূর্ণ গোপন বস্তুনিষ্ঠতা উপলব্ধি করা যায়। পাশাপাশি তাকালে তাঁদের অনুপ্রেরণার গভীর পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গেয়র্গে গ্রৎস তাঁর বিশ্ব নির্বাচন করেন এবং তাঁর নিজের দৃষ্টিপ্রতিভায় নিয়ে আসেন ; পল ক্লির ক্ষেত্রে বিশ্বের বস্তুগুলি নিজেরা নিজেদের সংগঠিত করে এবং তিনি কেবল সেই বস্তুগুলোর নির্দেশে রচনা করেন বলে মনে হয়। দৃষ্টিপ্রতিভার সংগঠন, আঙ্গিক, ধারণাগুলোকে ঠিক করা এবং স্থির করা, ছবিগুলোকে তুলে আনা আর তাদের কাটছাঁট করা, সেগুলো থেকে গড়ে-ওঠা ফলাফলসহ, তাদের সচিত্র গঠন, একটি নির্দিষ্ট চিত্রকল্পের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুসন্ধান করা এবং মানসিক দৃষ্টিপ্রতিভার স্পষ্টীকরণ। তাই সেটা  আমার কাছে শিল্প মনে হয়েছিল। এই সংগঠিত দৃষ্টিভঙ্গির সামনে গ্রৎসের শুষ্কতা এবং সূক্ষ্মতা ফেটে পড়ে, তাদের ভিশানারি দিকটি রয়ে যায়,  তাদের প্রকৃতি যেন মনের ব্যাপার।

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১১:০৯740599
  • অঁতনা  আতো
     
    জাঁ ককতো এবং আলফ্রেদ পয়জা 
    আমাদের সংবেদনশীলতাকে শালীনতার খাতিরে  কিছু মান্যতাপ্রাপ্ত আদল-আদরার দ্বারা, এমনকি বস্তুগতভাবেও  অনেক ঝাঁকুনি দেওয়া হয়েছে  । অনুভূতির প্রকৃতি এবং শ্রেণির চেয়ে এটিকে যা প্রভাবিত করে তা হল এর অভ্যন্তরীণ ঘনত্ব, এর শক্তি, এর স্ফুলিঙ্গ। আমরা অন্য আর কিছুতেই বিশ্বাস করি না। মহত্বের জন্য মহত্ত্ব আমাদের কাছে মহত্ত্ব নয় বরং জিনিসের ভেতরের চাপ, তাদের প্রশ্নহীনতাই মহত্ব। আমি মনে করি ককতো এই অর্থে অ্যান্টিগোন করেছিলেন । তিনি মূল উৎসগুলোতে ফিরে গিয়েছিলেন, মনস্তাত্ত্বিক উৎসগুলোতে, যা কিনা মানুষের , সাহিত্যের উৎসগুলোতে নয় — এবং পৌরাণিক উৎসগুলোতেও যা বাস্তব নাটকীয়তা গড়ে তোলে। তিনি আমাদের পুরানো নাটকের সারাংশের সমতুল্য একটি সমসাময়িক নাটক দিতে চেয়েছিলেন, যাতে আমরা এটিকে নতুন করে বিশ্বাস করতে পারি। আলফ্রেদ পয়জা এবং তার ইলেক্ট্রা সম্পর্কে বলি যে, তাঁর কবিতার সমতলতা, তিনি যে প্রযোজনা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন, তার ঝাঁকুনি এবং ধাতব অস্পষ্টতা, ট্র্যাজেডি সম্পর্কে তাঁর দুঃখজনক ধারণাকে প্রমাণ করে।

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১১:১১740600
  • অঁতনা আতো
     
    অঁতনা আতো’র : "দ্য পিয়োটি ডান্স"-এর অংশ
    ১৯৩৬ সালে মেক্সিকো ভ্রমণের সময়, অঁতনা আতো স্থানীয় উপজাতি গোষ্ঠীতে জীবনযাপন করার সময়ে পিয়োটি মাদকের আচার আবিষ্কার করতে সিয়েরা তারাহুমারার একটি তামার খনি অঞ্চলে একা ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।
    সেখানে একটি গুহায় থাকার সময়ে, তিনি তাঁর বই "দ্য পিয়োটি ডান্স"-এ তাঁর অভিজ্ঞতা এবং হ্যালুসিনেশন সম্পর্কে লিখে রেখেছিলেন - তিনি লিখেছিলেন, “মুক্তি এবং আলোকিতকরণের একটি কাব্যিক কাজ  করতে পারলেন যা অঁতনা আতোকে জীবন, পৃথিবী এবং অতিপ্রাকৃতের সাথে পুনরায় সংযুক্ত করেছে।”
    এটাই ছিল তাঁর জীবনে আনন্দের শেষ সময়। ফ্রান্সে ফিরে যাবার পর, ১৯৩৭ সালে, তিনি তাঁর বাকি জীবন মানসিক চিকিৎসালয়ে কাটান। তিনি ১৯৪৮ সালে ইভরি-চ্যূস-সেন-এ মারা যান। তাঁর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন:  
    আমি মেক্সিকোর পাহাড়ে পিয়োটির নেশা করেছিলাম, এবং আমার কাছে এটির একটি ডোজ ছিল যা আমাকে তারাহুমারা গোষ্ঠীর সাথে থাকার সময়ে দুই বা তিন দিন স্থায়ী হয়েছিল এবং সেই সময়ে সেই তিনটি দিন আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন বলে মনে হয়েছিল।
    আমি নিজেকে যন্ত্রণা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম, আমার জীবনের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলাম, এবং আমি আমার দেহকে চারপাশে বয়ে নিয়ে যাওয়া করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
    আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি জীবন আবিষ্কার করছি, আর এটাই আমার কাজ এবং আমার বেঁচে থাকার কারণ, এবং যখন আমার কল্পনা ব্যর্থ হতো আমি কষ্ট পেতাম, এবং পেয়োটি আমাকে কল্পনাশক্তি দিয়েছিল ।
    একজন মানুষ এগিয়ে এসে আমাকে এক ঘুষি মেরে  পিয়োটিকে আমার ভেতর থেকে বের করে দিল।
    আমি নিজেকে সত্যিকারের টুকরো টুকরো করে দিলাম, এবং একজন মানুষের মৃতদেহ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো এবং অন্য কোথাও ছিঁড়ে পড়ে গেছে।
    রাই দা কানকা দা কুম
    আ কুম দা না কুম ভোনোহ
    এটা মেনে নিয়ে যে এই পৃথিবী আরেকটির বিপরীত নয় এবং এখনও তার অর্ধেক , এই পৃথিবীও একটি বাস্তব যন্ত্র যাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমার হাতে রয়েছে, এটি প্রকৃতপক্ষে একটি  কারখানা যার মূল হল জন্মগত হাস্যরস।
    সানা তাফতান তানা
    তানাফ তামাফৎস বাই

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১১:১৩740601
  • অঁতনা  আতো
    খারাপ স্বপ্নদর্শী 
     আমার  বেশিরভাগ স্বপ্নই তরল। আমি একধরনের বমিভাবপূর্ণ জলে ডুবে আছি যেখানে রক্ত-লাল ছবি ওলোট-পালোট খায়। আমি কখনই কয়েকটা প্রতীতির ওপরে উঠি না, তা আমার স্বপ্নে হোক বা বাস্তব জীবনে।  আমি আমার জীবনের ধারাবাহিকতায় কখনই স্থির নই। আমার স্বপ্ন কোনও পলায়ন, কোনও আশ্রয় বা পথ প্রদর্শনের প্রস্তাব করে না। তা সত্যই বিচ্ছিন্ন অঙ্গের হাল। এছাড়া, আমি আমার চিন্তাভাবনার ভেতরে যা ঘটতে থাকে তাকে আকর্ষক করে তুলতে খুব বেশি আগ্রহী নই । আমি কেবল একটি জিনিস চাই:  আমার চিন্তায় আটকে থাকার সুসময়। আর আমার স্বপ্নে শারীরিক চেহারা হিসাবে, আমি আপনাকে যা বলেছিলাম, স্রেফ তরল অবস্হায়।
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১১:১৫740602
  • অঁতনা  আতো
    ১৯২৮ সালের সংলাপ ; প্রশ্ন? তার উত্তর ।
    একটি সাধারণ বিষয়, সমতুল্য খুঁজে বের করা। এটি কথোপকথনের সমস্তরকম আশা বোঝায়। দুই বক্তার চিন্তাধারা ভিন্ন পথে চলে। কিন্তু এসব চিন্তার মধ্যে যে কোনো ক্ষণস্থায়ী সম্পর্ক, পরস্পরবিরোধী হলেও, সেগুলোকে কাকতালীয় বলে বাতিল করে। সব মিলিয়ে, খুব সান্ত্বনাদায়ক, যেহেতু আপনি জিজ্ঞাসা করা বা উত্তর দেওয়ার চেয়ে ভাল কিছু উপভোগ করেন না। "সুন্দর মৃতদেহ" খেলাটা বহু প্রশ্ন এবং উত্তর তৈরি করেছে যেমনটা তার উদ্দেশ্য ছিল এবং তাদের মধ্যে সংযোগ, বেশ সাবধানে অপ্রত্যাশিত, স্পষ্টভাবে নিশ্চিত করা হয়েছিল। আমাদের কোন আপত্তি নেই, যারা এই চিন্তা নিয়ে চিন্তিত, তারা শুধুমাত্র এখানে খেলার ফলাফলের নিয়মে কম-বেশি উপলব্ধিযোগ্য উন্নতি দেখতে পাচ্ছেন।
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১১:১৭740603
  • অঁতনা আতো নিয়েছেন আঁদ্রে ব্রেতঁ’র সাক্ষাৎকার 

    আতো:  পরাবাস্তববাদ কি এখনও আমাদের জীবনের সংগঠন এবং অব্যবস্থাপনায় একই গুরুত্ব রাখে?

    ব্রেতঁ : এটা পুরোপুরি  কাদা, প্রায় সম্পূর্ণ ফুল দিয়ে তৈরি।

    আতো: তুমি আর কতবার প্রেমে পড়বে বলে মনে করো? 

    ব্রেতঁ:  সেন্ট্রি বাক্সে একজন সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে। সে একা। সে তার মানিব্যাগ থেকে বের করা একটি ফোটোর দিকে তাকিয়ে আছে।

    আতো : তোমার জীবন গুছিয়ে তোলার জন্য মৃত্যু কি তোমার কাছে  গুরুত্বপূর্ণ? 

    ব্রেতঁ :  শুতে যাবার সময় হয়েছে।

    আতো : অমর প্রেম কী? 

    ব্রেতঁ : দারিদ্র্য কোন পাপ নয়।

    আতো : রাত্রি না ধাক্কাধাক্কি? 

    ব্রেতঁ : শুধু একটা ছায়া।

    আতো : প্রেম সম্পর্কে তোমাকে কী সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করে ? 

    ব্রেতঁ :  তুমি, আমার প্রিয় বন্ধু, আর আমি।

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১১:২০740604

  • অঁতনা আতো সম্পর্কে রস মারির ( Antonin Artaud: The Scum of the Soul -এর লেখিকা ) সংক্ষাৎকার নিয়েছেন ফিল সি – অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    [ রস মারি বিশ ও একুশ শতকের ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতি, সমালোচনামূলক তত্ত্ব, বৈচিত্র্য তত্ত্ব এবং নারীবাদ সম্পর্কে গবেষণা করেছেন । তিনি আভাঁ-গার্দ, পরীক্ষামূলক সাহিত্য ও পেইনটিঙ এবং তথ্যচিত্র এবং ভিডিও নিয়েও কাজ করেছেন। তাঁর বই Antonin Artaud: The Scum of the Soul অন্বেষণ করার প্রয়াস করেছে কীভাবে আতো’র কাজ বিভিন্ন মিডিয়ায় মানুষের দেহের সাথে সম্পর্কিত —থিয়েটার, ফিল্ম, অঙ্কন, নোটবুক এবং ম্যানিফেস্টো ইত্যাদিতে।]

    ফিল সি : তাঁর কাজের কোন অংশে আপনি বিশেষভাবে আগ্রহী ?
    মারি: ওনার সমালোচনামূলক তত্ত্বের উপর  প্রভাব সম্পর্কে আমি আগ্রহী ; ডেলিউজ, ফুকো এবং বার্থেসের মতো লোকেরা ওনার সম্পর্কে লিখেছেন। ওনাদের জটিল তত্ত্বের বেশিরভাগই ছিল অঁতনা আতোর ভাবনার উপর ভিত্তি করে লেখা । খুব বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অনেক বেশি বোধগম্য। তাঁর প্রকৃত কাজের পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কেও আমি আগ্রহী।  তিনি সেই মানুষ যিনি বিংশ শতাব্দীর প্রতিনিধি কারা তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করেছেন।ব্যাপারটা একটা বিশাল দাবি,  কিন্তু  মনে হয় যে ভাষা ,  কেউ যখন ভাষা লিখতে বা পারফর্ম করে  তখন তা তার জন্য এমন একটি সমস্যা খাড়া করে যা তিনি সত্যিই বুঝতে পেরেছিলেন। যেমন ধরা যাক, শব্দ ব্যবহার করার বদলে আমরা কীভাবে শব্দ ছাড়া কিছু প্রকাশ করতে পারি ? কারণ তিনি যা লিখেছিলেন তার বেশিরভাগই ছিল পাঠ্য। এটা একটা প্যারাডক্স  যা সত্যিই আকর্ষণীয়।
    ফিল সি: এমন কোনো টেক্সট আলাদা করে   আপনার  চোখে পড়েছে যা প্যারাডক্সটাকে হাইলাইট করে?
    মারি: হ্যাঁ, দুটি ব্যাপার। তাঁর প্রথম দিকে লেখালিখি এবং তাঁর একেবারে শেষ দিকের লেখালিখি । শুরুর দিকে তিনি কীভাবে নিজেকে কোন শব্দগুলো দিয়ে প্রকাশ করবেন তা নিয়ে পর্যাপ্ত  সমস্যায় ছিলেন।  তিনটি প্রাথমিক কাজ উল্লেখ করা যায় : ‘দ্য নার্ভ স্কেলস’, ‘দ্য অম্বলিকাস অফ লিম্বো’ এবং জ্যাক রিভিয়েরের সাথে তাঁর চিঠিপত্র, যিনি ‘নুভেল রেভিউ ফ্রাঁসেজি’র সম্পাদক ছিলেন। "আমি আমার চিন্তা প্রকাশ করতে পারি না" ছিল তাঁর প্রাথমিক লেখার সারাংশ । তারপরে তাঁর শেষ লেখাগুলো, যেগুলো তিনি তৈরি করেছিলেন, আমি জানি না আপনি সেগুলোকে সত্যিই টেক্সট বলতে পারেন কিনা, সেগুলো আরও বেশি বস্তুগত । তিনি তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলিতে ৪০৬টি নোটবুক তৈরি করেছিলেন। তবে তিনি তাতে নানারকম অঙ্কন এবং বানানও তৈরি করেছিলেন। আমি  সত্যিই আগ্রহী ছিলাম যে এটি কী কাগজে শুধু  বিন্দু আঁকা হয়েছে। এটি কেবল একটা ছোট বিন্দু  তবে এটা ওনার এক ধরণের বন্য অঙ্গভঙ্গি। তিনি এই সমস্ত জাদুকরী কাজ করবেন, তাঁর হাত ছুঁড়বেন আর তারপরে কাগজের পাতায় যথেচ্ছা লিখবেন । তিনি এমন ছবিও তৈরি করেছিলেন যেগুলোতে ছেঁদা রয়েছে কারণ তিনি সেগুলিকে সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতেন। আমার আগ্রহ যে, উনি কীভাবে নিজের মনঃস্হিতি  রেকর্ড করার চেষ্টা করেছিলেন ।  অসুবিধা হল যে তিনি এমন কিছু তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা কেবল একবারই ঘটতে পারে, একটি পারফরম্যান্স, একটি যাদুকরী অঙ্গভঙ্গির উপর ভিত্তি করে, আর তাকে কোথাও রেকর্ড করতে হবে। যে সময়-বিন্দুতে এটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল তখন এটি জড় এবং মৃত । সেই প্যারাডক্সে যদি  ফিরে যাই: পৃষ্ঠায় চিহ্নটি ছিল একমাত্র উপায় যার দ্বারা নিজেকে প্রকাশ  করা যেতে পারে।
    ফিল সি : কোনো কিছু শুধুমাত্র একবার করা যেতে পারে বা করা উচিত এই ধারণাটা বিস্ময়কর । এটা কি অঁতনা আতোর নিষ্ঠুরতার থিয়েটারের অন্তর্গত ?
    মারি: হ্যাঁ, ‘দ্য থিয়েটার অ্যান্ড ইটস ডাবল’-এ, যেখানে তিনি লিখেছেন: "পৃথিবীতে থিয়েটারই একমাত্র জায়গা যেখানে একটি অঙ্গভঙ্গি, একবার করা হলে, একইভাবে দুবার করা যায় না।"  তিনি এই ধারণার উপর জোর দিতেন যে এটি তাৎক্ষণিক, এটি এমন কিছু  যা কখনও পুনরাবৃত্তি করা যায় না।
    ফিল সি: পরাবাস্তববাদীদের সাথে অঁতনা আতো একটা সংক্ষিপ্ত সময় কাটিয়েছিলেন। তিনি কি তাদের সাথে একটি থিয়েটার শুরু করেছিলেন?
    মারি: হ্যাঁ, ১৯২৬ সালে রজার ভিত্রাক এবং রবার্ট অ্যারনের সাথে থিয়েটার আলফ্রেড জ্যারি। থিয়েটার ছিল এমন একটা ব্যাপার যার কারণে  পরাবাস্তববাদীদের সাথে তাঁর মতবিরোধ হয় । তিনি ১৯২৪ সালে পরাবাস্তববাদীদের সাথে যোগ দেন। আঁদ্রে ব্রেতঁ ছিলেন পরাবাস্তববাদের মূল পরিকল্পনাকারী ; তিনি বেশ রাশভারি ব্যক্তিত্ব ছিলেন; আর ইচ্ছানুযায়ী সদস্যদের আন্দোলন থেকে বের করে দিতেন। ব্রেতঁ কমিউনিজম এবং মার্কসবাদে অনেক বেশি আগ্রহী হতে শুরু করেন। আতো মোটেও রাজনীতিতে আকৃষ্ট ছিলেন না, এমনকি লিখেছিলেন: ‘আমি মার্কসবাদের মাথায় হাগি’। তিনি লিখেছেন যে তিনি যেকোন ধরনের মতাদর্শের বিরুদ্ধে , যার অর্থ তিনি মূলত মতবাদে নির্ভরতার বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে রাজনৈতিক আন্দোলন বা ধারণার সাথে  পরাবাস্তববাদ আন্দোলনকে মেশানো উচিত নয় । সেই সময়েই, ব্রেতঁ খুব থিয়েটার-বিরোধী হয়ে উঠছিলেন কারণ তিনি থিয়েটারকে বুর্জোয়া এবং বিপ্লববিরোধী হিসাবে দেখতেন। আতো তাঁর থিয়েটার প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে তহবিল যোপগাড়ের চেষ্টা করছিলেন এবং ব্রেতঁ এটা পছন্দ করেননি, কারণ ব্রেতঁ ভেবেছিলেন যে এটা খুব বুর্জোয়া ব্যাপার। ব্রেতঁ ফ্রয়েডের প্রতি সত্যিই আগ্রহী ছিলেন কিন্তু অঁতনা আতো ছিলেন একেবারেই মনোবিশ্লেষণ বিরোধী, ফ্রয়েডীয় যেকোনো ধারণার বিরোধী। এটা বেশ মজার যে জনসমক্ষে তাঁরা  একে অপরের বিরুদ্ধে  লিখেছিলেন অথচ তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব বজায় ছিল। অঁতনা আতোকে রোডেজের চিকিৎসালয়ে স্থানান্তরিত করার ক্ষেত্রে ব্রেতঁর বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আবার ব্রেতঁ  তাঁকে মানসিক হাসপাতাল থেকে বের হতে সাহায্য করেছিলেন এবং তার জীবনের শেষ সময়ে তাঁর জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, আমি মনে করি আসলে যা ঘটছিল তা হল ব্রেতঁর ভয় ছিল যে আতো  অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন। পরাবাস্তববাদীরাও নির্দিষ্ট পরিমাণে এই ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতো কিন্তু কেউ যদি সত্যিই পাগল এবং বিপজ্জনক হয় তবে তারা কেউ তা সামলাতে পারত না। 
    ফিল সি:  তারা কি আতোকে বিপজ্জনক বলে মনে করতো?
    মারি: হ্যাঁ। ব্রেতঁর একটা সাক্ষাৎকার আছে যেখানে তিনি আতো সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন।  তিনি আতোর ভাষায় “ঝকমকে ভাব” সম্পর্কে কথা বলেছেন, তবে তিনি বলেছেন যে আতোর হাতে এটি একটি অস্ত্রের মতো জ্বলজ্বল করতো। আতোর দৃষ্টিভঙ্গি, বলেছেন ব্রেতঁ যে তা আরাগঁর বিপরীত, যিনি একজন পরাবাস্তববাদী কবি ছিলেন, যিনি "স্বপ্নের তরঙ্গ" সম্পর্কে লিখেছেন, যখন কিনা আতো অনেক বেশি হিংসাত্মক ব্যাপারের কথা বলেছেন।
    ফিল সি: আপনি কি মনে করেন আতোর ধারণা হিংস্র ছিল  ? আমি জানি নিষ্ঠুরতা শব্দটি মূল,  কিন্তু আতোর কাছে এর একটি সহজ অর্থ পাওয়া যায়নি। নিষ্ঠুরতা বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন,  বলবেন?
    মারি: এটা উপলব্ধি করা কঠিন। আপনি যে প্রথম জিনিসটি বলতে পারেন তা হ'ল এটি অহেতুক সহিংসতা সম্পর্কে নয় যেমন আপনি এটি সম্পর্কে সাধারণভাবে ভাবতে পারেন। তিনি "নিষ্ঠুরতার অধিবিদ্যা" অভিব্যক্তিটি ব্যবহার করেছিলেন। এটা সত্যিই বিঘ্ন ঘটাবার ব্যাপার। এর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে জরুরি নয় যে তা দেহের ওপর অত্যাচার বিষয়ক। আপনি ভাষায় ব্যবহৃত নিষ্ঠুরতার পরিপ্রেক্ষিতে এটি সম্পর্কে চিন্তা করতে পারেন: ধারণা, ভাবনা, উপস্থাপনা। নিষ্ঠুরতার দ্বারা উনি  জীবনকে বোঝাতে চেয়েছেন : জীবন ব্যাপারটাই। তাঁর থিয়েটারের লেখায় ‘জীবন’ মানে একেবারেই দৈনন্দিন জীবন নয় যেমনটি আমরা বসবাস করি। জীবন হল  বাস্তবতা আর পিছনের অন্ধকার শক্তির মধ্যেকার চৌকাঠ। জীবনের আসল সারমর্ম হল সেই শক্তি যা সেই দোরগোড়ায় রয়েছে। 
    ফিল সি: উনি কি দেহের মাধ্যমে এবং শারীরিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেই দোরগোড়াকে খুঁজতে চেয়েছেন ?
    মারি: হ্যাঁ । থ্রেশহোল্ড সম্পর্কে চিন্তা করার অন্য উপায় হল জাদুতে তাঁর আগ্রহ সম্পর্কে চিন্তা করা। আবার এই ধরণের জাদু যা বস্তুর পিছনে একটি শারীরিক শক্তি, যা বস্তুজগতে ঘটতে পারে। তিনি অভিনয়ের কথা বলেন বটে কিন্তু তা চরিত্র অভিনয়ের ক্ষেত্রে নয়। ফরাসি ভাষায় দুটি শব্দ আছে: 'জউয়ার' যা অভিনয়, যা আপনি সাধারণত 'অভিনয় একটি ভূমিকা' বলতে ব্যবহার করবেন; তারপরে আরেকটি আছে, যা হল 'আগির' - এর অর্থ এক ধরণের শারীরিক কাজ, এটির মৌলিক অর্থে একটি কাজ। তিনি সর্বদা ‘জউয়ার’ শব্দের পরিবর্তে ‘আগির’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি এমন কিছু হিসাবে নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে কথা বলেছেন যা কাজ করে (আগির) এই অর্থে নয় যে এটি একটি ভূমিকা (জউয়ার) সম্পাদন করে তবে এটি আসলে শারীরিকভাবে কাজ করে। এটি সেইভাবে কাজ করে যেমনভাবে জাদু কারোর ওপর কাজ করে, তা কিছু বদলে দেবে, আবার কিছু নতুনত্ব ঘটাবে।
    ফিল সি : 'অ্যাক্ট' বা 'অ্যাকশন' অভিধাগুলো এমন কথা বলে যে মনে হয় তা অনেক অনুশীলনকারীদের বার্তা দেয় দুটির পার্থক্য করার এবং তা  গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে তাদের কাছে আসে। অঁতনা আতো’র বেশ  প্রভাবদায়ী অভিজ্ঞতা হয়েছিল : মেক্সিকোতে তারাহুমারা উপজাতিদের কাছে যাওয়া এবং ভ্রমণকারী বালিনিজ নৃত্যশিল্পীদের কাজ দেখার পর । সেই অভিজ্ঞতাগুলি কখন ঘটেছিল এবং সেই অভিজ্ঞতাগুলি  তাঁকে  অনুপ্রাণিত করেছিল বলে মনে হয়?
    মারি:  এটা গুরুত্বপূর্ণ। বলা যেতে পারে যে তাঁর প্রস্তাবগুলিকে বাস্তবে প্রয়োগ করা অসম্ভব ছিল, তবে তাঁর ধারণাগুলো এমন সমস্ত ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল যা তিনি বাস্তবে দেখেছিলেন: বালিনিজ নৃত্য আর তারাহুমারা। এই বিষয়েই তিনি লেখার চেষ্টা করেছিলেন। এক অর্থে তা সত্যিই বাস্তবে ছিল, কিন্তু তিনি যা দেখছিলেন তা ছিল তাঁর দৃষ্টিপ্রতিভায় বা ভিশানে।
    ফিল সি: তিনি কখন বালিনিজ নৃত্যশিল্পীদের দেখেছিলেন ?  কারণ তিনি বালিনিজ সংস্কৃতির বিশেষ প্রতিনিধি না হওয়ার জন্য সমালোচনা করা হয়েছে।
    মারি: হ্যাঁ। তিনি যে প্রেক্ষাপটে সেগুলো দেখেছিলেন তা স্পষ্টতই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ১৯৩০-এর দশকে প্যারিসে যে ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন তার অংশ হিসাবে বালিনিজ নৃত্য পরিবেশন দেখেছিলেন। একটি যুক্তি দেয়া হয়  যে উনিশ এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে ফরাসি এবং ইউরোপীয় সাহিত্যের বেশিরভাগই ‘ওরিয়েন্ট’ সম্পর্কিত রোমান্টিক ছিল । তারা 'অপর’' (এডওয়ার্ড সাঈদ, প্রাচ্যবাদ দেখুন) এর দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে শ্বেত ইউরোপীয় প্রতিস্ব অন্বেষণ করেছিলেন। এটি আতোর ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক: তিনি যে সমস্ত পাঠবস্তুর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন, তিনি তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে পরখ করেছিলেন।
    ফিল সি :  তিনি কিন্তু এই বিষয়ে বেশ খোলামেলা এবং সৎ ছিলেন। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত বা প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা করেননি। ব্যাপারটা আরও গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য তাঁর ধারণাগুলি উপস্হাপন করতে নিজের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করেছিলেন।
    মারি : হ্যাঁ তারাহুমারাদের সাথে আসলে কী ঘটেছিল তা কেউই জানে না কারণ এটি সঠিকভাবে নথিভুক্ত করা হয়নি, তবে তিনি মেক্সিকোতে গিয়েছিলেন, আমরা এতটাই জানি। তাঁর লেখাটি তারাহুমারদের সম্পর্কে: তিনি এই উপজাতির দলে যাওয়ার এবং পিয়োটি নেশার আচার ইত্যাদি এই সমস্ত অন্যান্য অদ্ভুত কাজকর্মগুলো করার কথা বলেছেন। বেশ কয়েকজন লিখেছেন যে তিনি আসলে মোটেও যাননি বরং  এটা তাঁর কল্পনাপ্রসূত কারণ তিনি সেই সময়ে কিছুটা মানসিক অসুস্হ হয়ে যাচ্ছিলেন। আমি মনে করি কয়েকজন নৃবিজ্ঞানী  উপজাতির সাথে অঁতনা আতোর যোগাযোগের প্রমাণ পেয়েছেন। তিনি তারাহুমারদের সাথে এই আচারগুলি সম্পাদন করতে সময় কাটিয়েছিলেন এবং তারা তাঁর থিয়েটার দেখতে এসেছিলেন।
    ফিল সি: পিয়োটি আচারের অভিজ্ঞতায় কি নির্দিষ্ট কিছু আছে যা তার ধারণাগুলিকে প্রভাবিত করেছিল ?
    মারি: পিয়োটি হলো এলএসডির মতো একটি হ্যালুসিনোজেনিক ওষুধ তবে এটি একটি প্রাকৃতিক ভেষজ। উপজাতিদের আচারটি একটি নাচের মাধ্যমে করা হয় । তিনি ল্যান্ডস্কেপ এবং গ্রামাঞ্চলের সাথে তারাহুমারাসের সম্পর্ক এবং পাথরের শিলাগুলো কীভাবে কথা বলছিল তা লিখে গেছেন।
    ফিল সি: আপনি অনলাইন ভিডিওতে এই ধরনের নাচ দেখতে পাবেন। অভিজ্ঞতা ছাড়াই সম্পূর্ণরূপে অনুভব না করেই আর্টাউড যা দেখেছিলেন তা দেখার একটি ভাল উপায় সেটা! ব্যাপারটা পুনরাবৃত্তিমূলক,  ছন্দময়। দেহের এবং কণ্ঠস্বরের ছন্দ।
    মারি: আপনি কি ubuweb.com এ আতো’র রেকর্ডিং শুনেছেন? http://www.ubu.com/sound/artaud.html
    ফিল সি : আতো’র মানসিক স্বাস্থ্য কীভাবে তাঁর কাজে প্রভাব ফেলেছে ?
    মারি: আমি মনে করি আতো সম্পর্কে লোকেরা প্রথম যে জিনিসটি জানে তা হল তিনি ইনভার্টেড কমায় 'পাগল' ছিলেন। আতো’র জীবনকে তাঁর কাজ থেকে আলাদা করা বেশ কঠিন যেমনটা আপনি প্রায়শই অন্যান্য লেখকদের সাথে করবেন বলে আশা করা হয়। আতো’র সাথে এটি সম্পূর্ণ অসম্ভব কারণ তিনি কেবল তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা এবং নিজের জীবন সম্পর্কে লিখেছেন। উন্মাদ হওয়া নিয়ে অনেক লিখেছেন।
    ফিল সি : তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য তাঁকে কোনও বিশেষ অভিজ্ঞতার দিকে পরিচালিত করেছিল?
    মারি: আপনি যখন অঁতনা আতোকে কাজ করছেন তখন এটি বেশ দুঃখজনক কারণ ভাবনার এমন একটা চল রয়েছে যেখানে  উন্মাদনাকে মহিমান্বিত করা হয়। মানুষ তাকে  নির্যাতিত কবি হিসেবে দেখে। কিন্তু আপনি যখন প্রকৃতপক্ষে পাঠবস্তুগুলো পড়েন আর  দেখেন তখন বুঝতে পারেন যে ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর: যে ধরণের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি গেছেন। তাঁর অনেক কাজ নষ্ট হয়ে গেছে।
    ফিল সি: আপনি কি বোঝাতে চাইছেন যে তিনি যে ধরনের জীবন বা বিশেষভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার মধ্য দিয়ে গেছেন?
    মারি: এটা সত্যিই দুইই।  আমি জানি তাঁকে  ৫২টা ইলেক্ট্রো-শক দেয়া হয়েছিল । কয়েকটা বছর তাঁর নষ্ট হয়ে গিয়েছিল । আমি জানি না আপনি এই ব্যাপারে জানেন কি না তাঁর সঙ্গে যা-যা ? তিনি ১৯৩৭ সালে আয়ারল্যান্ডে গিয়েছিলেন, তখন তিনি বিভ্রান্তিতে ভুগছিলেন বলে তাঁকে ফ্রান্সে ফেরত পাঠানো হয়েছিল আর ফ্রান্সে  তাঁকে বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসালয় আর প্রতিষ্ঠানে রাখা হয়েছিল।
    ফিল সি: হ্যাঁ, তাঁকে  নৌকায় বেঁধে রাখা হয়েছিল কি ? তাঁর চিঠিতে কি সেই সময়ের তথ্য আছে?
    মারি: তিনি ফ্রান্সে আসার পর থেকে সব ধরনের চিঠি এবং মেডিকেল রিপোর্ট রয়েছে, ডাক্তাররা তাঁর অবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি আয়ারল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে লোকেদের উন্মাদ অবস্হায় চিঠি লিখছিলেন, সেগুলো বেশ উদ্বেগজনক স্হিতির প্রকাশ, যার মধ্যে আছে আগুনে পোড়ানো ছেঁদা । তিনি আয়ারল্যাণ্ডে গ্রেপ্তার হন আর নির্বাসিত হন এবং ফ্রান্সে ফেরার নৌকায় সংযত করা হয়। আমার মনে হয় বিদেশী দূতাবাসে কিছু রেকর্ড আছে। তারপরে তিনি কখন ফ্রান্সে এসেছিলেন তাঁর মেডিকেল রিপোর্টে তা আছে । তাঁর মা, বেশ কয়েক মাস ধরে তাঁকে খুঁজছিলেন এবং তারপরে তিনি তাঁকে একটি মানসিক হাসপাতালে খুঁজে পান। ফ্রান্সের অধিকৃত রোদেজে, ফ্রান্সের বাইরে  পাঠানোর আগে তাঁকে প্যারিসের আশেপাশের বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর বেশ কয়েকজন প্যারিসীয় বন্ধু, কয়েকজন পরাবাস্তববাদী, একত্রিত হন আর তাঁকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করার ব্যবস্থা করেন -  ফ্রান্সের বাইরে অধিকৃত জায়গায়। তাঁরা ভেবেছিলেন  বন্দী শিবিরে তাঁর জীবন শেষ হবে। সেই আমলে  কোনো কাজ করতে পারেননি আতো । আয়ারল্যান্ড থেকে ফিরে রোদেজে  যে প্রথম কাজটি তিনি করেন তাতে উন্মাদ অবস্হায়  পাঠানো কাগজে একটা ব্যাপার রয়েছে, যা, মজার বিষয়, লুইস ক্যারলের অনুবাদ। সেটি মজার কারণ তিনি  ইংরেজি বলতে পারেননি তাই তিনি এমন অনুবাদ করেছেন যা আসলে লুইস ক্যারলের ফরাসি অনুবাদের পুনর্লিখন।সেটি অ্যালিসের অ্যাডভেঞ্চারস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের মাত্র একটি অধ্যায়। সেখানেই তাঁর গ্লসোলালিয়া (তৈরি ভাষা) প্রথম উপস্থিত হয়।
    ফিল সি: তা কি  ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়?
     মারি : আমি যতোদূর জানি, তা কেবল ফরাসি ভাষায়। অ্যালিসের অ্যাডভেঞ্চারস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের অধ্যায়ে যখন হাম্পটি ডাম্পটি আর অ্যালিসের মধ্যে কথোপকথন হয়: অ্যালিস তাঁকে ভাষার অর্থ সম্পর্কে প্রশ্ন করছেন এবং তিনি শব্দগুলি তৈরি করছেন। এটা সেই মুহুর্ত যখন সে গ্লোসোলিয়ায় যেতে শুরু করে। আতো’র রচনার শেষ হয় সেই অধ্যায়ে যেখানে হাম্পটি ডাম্পটি দেয়াল থেকে পড়ে যায় আর এক হাজার টুকরো হয়ে যায়। লুইস ক্যারলে তাকে আবার একত্রিত করা হয় কিন্তু অঁতনা আতোর রচনায় সে ধ্বংস হয়ে যায়।
    ফিল সি: আয়ারল্যান্ড সফর ছিল তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। আপনি কি মনে করেন রোদেজে পৌঁছোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল? অন্যরাও কি ছিল সেখানে ?
    মারি: হ্যাঁ রোদেজে যখন এসেছিলেন তখন তিনি প্রথম লিখতে শুরু করেছিলেন লুইস ক্যারলের  সংস্করণগুলোহ। তিনি এগুলো আরো বড়ো করে লিখতে শুরু করেন, তিনি তাদের ‘ডেসিন্স ইক্রিটস’ নামে অভিহিত করেছেন, যা লেখা-আঁকা একই সঙ্গে : এতে আছে পাঠবস্তু সহ অঙ্কন। কিন্তু তাঁর প্রারম্ভিক জীবনে ফিরে যাওয়া যাক। তাঁর ছোট বোন মারা গিয়েছিলেন যখন তিনি শিশু  এবং এটি তার শেষ পাঠবস্তুতে আবার ফিরে আসে। তিনি অদ্ভুত পরিস্থিতিতে মারা যাওয়া এই ছোট বোনের আত্মাকে জাগিয়ে তোলেন।  তিনি বলেছেন যে নার্স তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিল কিন্তু তা লেখার সময়ে আতো বেশ বিভ্রমে আক্রান্ত ছিলেন তাই ব্যাপারটা জানা যায় না... ইলেক্ট্রো-শক চিকিৎসা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ তিনি লিখেছেন ইলেক্ট্রো-শকের অধীনে নিজের মারা যাওয়ার কথা ; তিনি অতীত কালের মধ্যে নিজের সম্পর্কে লিখেছেন: "অঁতনা আতো  মারা গেছেন - তিনি অমুক তারিখে ইলেক্ট্রো-শক চিকিৎসায় মারা গেছেন।" এরপর তিনি নিজের জন্য নতুন নতুন নাম উদ্ভাবন করেন। স্পষ্টতই রোদেজ ছেড়ে যাওয়া তার জন্য সত্যিই একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। তিনি তাঁর জীবনের অর্ধেক সময় মানসিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কাটিয়েছেন এবং তারপরে তিনি আইভরিতে, যাকে আপনি একটি আধখ্যাঁচড়া বাসা বলতে পারেন, সেখানে থাকতেন। এটাও তখন একটি চিকিৎসালয় ছিল কিন্তু তিনি নিজের খুশি মত আসা-যাওয়া করতে পারতেন।
    ফিল সি: তিনি যখন তাঁর শেষ লেখাগুলো লিখছিলেন এটা কি তখনকার কথা ?
    মারি: হ্যাঁ । তারপর আতো তাঁর বন্ধুদের প্রচুর পোর্ট্রেট আঁকা শুরু করেন। লোকে ভেবে ছিল যে তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য এই প্রতিকৃতিগুলো বিক্রি করতে চলেছেন কিন্তু তিনি এই ছবিগুলো এত ভয়ানক বানিয়েছিলেন যে খুব কম লোকই সেগুলো কিনেছিলেন। লোকেরা, এই সমাজের সম্ভ্রান্ত  মহিলারা, তাদের প্রতিকৃতি দেখে এমনভাবে বর্ণনা করেছিল  যেন তারা নিজেদের শব দেখছে।
    ফিল সি: আতো’র কাজ যদি তাঁর জীবন এবং অভিজ্ঞতার সাথে এতো বেশি সংযুক্ত থাকে তবে কেউ কীভাবে অঁতনাবাদী কিছু তৈরি করতে পারে?
    মারি:  অবশ্যই শরীরে তার শিকড় থাকা দরকার যাতে তাঁরা  তাদের শরীরের নিজস্ব অভিজ্ঞতা,  প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করতে পারেন আর তা নিয়ে ভাবতে পারেন। কেবল কথায় নয়। তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস সম্পর্কে যা লিখেছেন তা সম্ভবত আতোকে অনুশীলন করার জন্য একটি ভাল সূচনাবিন্দু । ‘দি থিয়েটার অ্যাণ্ড দি প্লেগ’-এ তিনি প্লেগ সম্পর্কে আগ্রহী কারণ যে দুটি অঙ্গে প্লেগ প্রভাব ফ্যালে তা হল এমন অঙ্গ যা আপনি সচেতনভাবে পরিচালনা করতে পারেন: মস্তিষ্ক এবং ফুসফুস। তিনি বলেন যে আপনি আপনার চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং আপনি আপনার শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এই দুটির সাথে খেলা, বিশেষ করে শ্বাসের ব্যাপারে, আপনাকে হাইপার-ভেন্টিলেট করতে হবে না, তবে এমন ব্যাপারগুলো ব্যবহার করার কথা উনি ভেবেছেন যেগুলোকে আপনি শারীরিক ক্রিয়া বলে মনে করবেন যা একরকম স্বয়ংক্রিয় এবং কোনওভাবে সেগুলিতে বাধা সৃষ্টি করে । আর তার প্রভাব ভাষার ওপরে কেমনতর তা ভেবেছেন।
    ফিল সি: ভাষায় বিঘ্ন ঘটানো ?
    মারি: গ্লোসোলালিয়া ব্যবহার করে, চিৎকার করে  আওয়াজকে নতুনত্ব দেওয়া। একটি বাক্য  শুরু করে তাকে ভেঙে ফেলার প্রক্রিয়া ।
    ফিল সি: ছোট বাচ্চাদের মধ্যে ভাষা কীভাবে উদ্ভূত  এবং বিকশিত হয় তা বোঝা আকর্ষণীয় হতে পারে। একটি পাঠ্যের উপর কাজ করার সময় শিক্ষার্থীরা সেই প্রক্রিয়াটিকে উল্টে দিতে পারে। মানুষের শরীরে সহজতম শব্দ কেমনভাবে প্রভাব ফেলে তা এই প্রক্রিয়ায় খুঁজে বের করা যায় ।
    মারি :হ্যাঁ এবং তারা একটা টেক্সট  নিয়ে তারা কী করতে পারে।শরীরের প্রতি সহিংসতার বদলে  তারা টেক্সটকে ছারখার  করতে পারে।  যে সহিংসতা তারা তাদের দেহে ব্যবহার করতে পারতো তা পাঠ্যের প্রতি করতে পারে। কেউ কীভাবে 'অঁতনাবাদী' কিছু করতে পারে তা বলা কঠিন।ণ গ্রটোস্কি লিখেছেন: আতো’র প্যারাডক্স হল তার প্রস্তাবগুলি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব।
    ফিল সি:  আমি মনে করি যে  অনুশীলনকারীদের কাজকর্ম পুনরাভিনয় করা কঠিন কারণ তারা একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে নিহিত: গ্রোটোভস্কির কাজটি নাৎসিবাদের পোলিশ অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়া থেকে এসেছে, বিশেষত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে । ব্রেখট নাৎসিবাদের উত্থান এবং নাৎসিবাদের অধীনে জার্মানিতে জীবনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই অনুশীলনকারীরা কাজকর্ম করেছিলেন এবং তাদের প্রযোজনার বিস্তারিত নথিপত্র রয়েছে: ফটোগ্রাফ এবং ফিল্ম।
    মারি: হ্যাঁ, তিনি আসলে খুব বেশি কাজকর্ম করেননি, যার ফলে  আতো এত কঠিন । তাঁর থিয়েটার বাস্তবে বিদ্যমান ছিল না। Les Cenci নিয়ে কাজ করেছিলেন কিন্তু তা  ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।  তাঁর সমস্ত থিয়েটার প্রজেক্ট ব্যর্থ হয়েছে। শুধু থিয়েটার নয়, একজন অভিনেতা হিসেবে তাঁর ফিল্ম কেরিয়ার ছিল যখন তিনি চলচ্চিত্র করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাও ছিল বিপর্যয়। তিনি আসলে কখনোই একটা সম্পূর্ণ বই লেখেননি: তাঁর সমস্ত লেখালিখিই হয় ম্যানিফেস্টো নয়তো বিষয়ের নোট। তিনি আসলে এমন কিছু তৈরি করে যাননি যাকে সম্পূর্ণ বলা যায়। ব্যাপারটা তাঁর সম্পর্কে বিশ্লেষণ  কঠিন করে তোলে। তবে একই সময়ে, তাঁর বহু ধারণা বোধগম্য।
    ফিল সি: তিনি কি নিজেকে ব্যর্থ করতে চেয়েছিলেন ? একটি অদ্ভুত উপায়ে ব্যর্থ হয়ে নিজের তত্ত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন নাকি ? তিনি কি মনে করেছিলেন যে প্রতিনিধিত্ব ব্যাপারটা অসম্ভব তাই এটি ব্যর্থ হবে? এক ধরনের পেশাদার আত্মহানির মতন ?
    মারি: হ্যাঁ। দুটো জিনিস আতো সম্পর্কে চোখে পড়ে,  বিশেষ করে যখন আপনি  সম্পাদকদের লেখা তাঁর সমস্ত চিঠি পড়েন: একদিকে তিনি অর্থ উপার্জন এবং জীবনযাপনের জন্য একেবারে মরিয়া ছিলেন, তাই জীবিকা নির্বাহের জন্য লেখাপত্র প্রকাশ করা অপরিহার্য ছিল কিন্তু একই সাথে তিনি তাঁর রচনাগুলোকে সম্পূর্ণ করার প্রতিরোধী ছিলেন’। হ্যাঁ আমি মনে করি আপনি যা বলছেন তা ঠিক। মূলত প্রতিনিধিত্ব নিজেই ব্যর্থ  হয়ে যায়  তা প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ার জন্য তাঁর সমস্ত কাজে ব্যর্থ হওয়ার  প্রয়োজন ছিল। তাই ওনার সম্পর্কে আরেকটি প্যারাডক্স আছে: সফল হওয়ার জন্য ব্যর্থ হওয়া প্রয়োজন ছিল; দেখানোর জন্য যে ভাষা এবং প্রতিনিধিত্ব সহজাতভাবে ত্রুটিপূর্ণ।
    ফিল সি : আপনি আতো’র প্লেগ রূপক উল্লেখ করেছেন। আপনি কি সেই রূপকটি ব্যাখ্যা করতে পারেন এবং কীভাবে এটি থিয়েটারের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করেছিল?
    মারি: কীভাবে থিয়েটার প্লেগের মতো হওয়া উচিত তা নিয়ে তিনি লিখেছেন। প্লেগে তিনি যে বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন তা হল সংক্রমণ। এটি এই সংক্রামক, অনিয়ন্ত্রিত শক্তি অভিনেতার দেহকে আক্রমণ করে তাদের সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতাকে অকেজো করে দেয়া দরকার : ফলে তাদের  বিশুদ্ধ, আবেগময় শক্তিতে পরিণত করে দেবে । এটি আতো’র একটি কেন্দ্রীয় রূপক। এটা কতটা রূপক বা তিনি আসলে এর মর্মার্থ কী তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আমি বলতে চাইছি, এটি একটি রূপক কিন্তু তিনি এটিকে এতদূর টেনে নিয়ে গেছেন যে মনে হচ্ছে তিনি আসলে একটি সত্যকার প্লেগের কথা বলছেন।
    ফিল সি: তিনি কি প্রস্তাব করেছিলেন যে অভিনয়ের দ্বারা  দর্শকদের সংক্রামিত করা উচিত?
    মারি: এর থেকে পরিত্রাণ নেই এটাই বোঝাতে চেয়েছেন। আপনি যদি ঘরে বসে থাকেন তাহলেও আপনার প্লেগ হবে।  আপনি এই শক্তি, এই ধ্বংসাত্মক শক্তি দ্বারা সংক্রামিত হতে চলেছেন। আপনি কে তা এই সংক্রমণ বিবেচনা করে না, আপনি যে কেউ হতে পারেন এবং আপনি এখনও এটি দ্বারা সংক্রামিত হতে পারেন। প্লেগ কোন সামাজিক স্তরবিন্যাস বা জাতীয়তা বা ভাষার বাধা মানে না।
    ফিল সি: তিনি প্লেগ সম্পর্কে কতোটা গবেষণা করেছিলেন ? নাকি তিনি প্লেগের সাধারণ ধারণাটি নিয়েছিলেন এবং তারপরে এটা নিয়ে এগিয়ে গেছেন ?
    মারি: আমি প্লেগ সম্পর্কে তাঁর গবেষণার বিষয়ে নিশ্চিত নই। তিনি ‘দ্য বুক অফ দ্য ডেড’ পড়েছেন এবং তিনি প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতি এবং জাদু, ইহুদি রহস্যবাদ এবং কাব্বালা এবং আরও অনেক বিষয়ে গবেষণা করেছেন, এর বাইরে আমি মনে করি না যে তিনি আর কোনও বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন। তিনি নির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়েছেন : মার্সেইতে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল বটে কিন্তু আমি মনে করি তা তাঁর ধারণাকে বনেদ দেবার জন্য একটি অজুহাত ছিল।
    ফিল সি: আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল দর্শকদের সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি। আমি জানি যে তাঁর কাজ সত্যিই একটি শ্রোতাগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পায়নি কিন্তু কীভাবে তিনি দর্শকদের কল্পনা করেছিলেন ?
    মারি: আমি মনে করি আমার প্রিয় উদ্ধৃতিগুলির মধ্যে একটি, এটি যদিও সঠিক উদ্ধৃতি নয়,  তবে এটি ব্যাপারটাকে সামান্য ব্যাখ্যা করে। তিনি বলেছেন যে, 'শ্রোতা সদস্যদের সাপের মতো আচরণ করা উচিত এবং তাদের প্রতিটি কম্পন অনুভব করা উচিত।' থিয়েটারের কম্পনের মাধ্যমে দর্শকদের সাথে যোগাযোগ গড়ে ওঠা দরকার যেমনভাবে সাপেদের ক্ষেত্রে হয় ।  দর্শকরা একটি নিষ্ক্রিয় বাহন। কিন্তু একই সময়ে শ্রোতারা নিষ্ক্রিয় হতে পারে না কারণ তারা প্রক্রিয়াটির সক্রিয় অংশ হয়ে ওঠে।
    ফিল সি: শ্রোতাদের শরীর কি শারীরিকভাবে অভিনয়কারীর শারীরিক অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত?
    মারি: হ্যাঁ।  সমবেত শ্রোতা সদস্যের শরীরের  সীমানা  এবং তাঁরা মঞ্চে যা দেখেন তার মাঝে উথালপাথাল ঘটা দরকার। তবে এটি কেবল একমুখী বলে মনে হয়, তাই ব্যাপারটা কেবল অভিনয়শিল্পী থেকে শ্রোতা পর্যন্ত পৌঁছোয় । শ্রোতারা যদিও প্রদর্শনীর সঙ্গে  যুক্ত কিন্তু তা মোটামুটি তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। দর্শক হিসাবে আপনাকে সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা পরিত্যাগ করতে হবে এবং কেবল মঞ্চাভিনয়ের আক্রমণের শিকার হতে হবে।
    ফিল সি: আমি পড়েছি যে  তিনি ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি’ ম্যানিফেস্টোতে দর্শকদের ঘিরে রাখার বিষয়ে  বলেছেন। আতো’র পর  কি অন্য লোকেদের মঞ্চাভিনয়ে সেই ব্যাঘাত ও আক্রমণ উপলব্ধি করা হয়েছে? সম্ভবত লিভিং থিয়েটার এবং তাদের 'ঘটনাবলী’তে করা হয়েছিল। তাদের ‘প্যারাডাইস নাউ’ সেই সীমানাকে ব্যাহত করেছে বলে মনে হয়েছিল।
    মারি: হ্যাঁ । পারফরম্যান্স আর্টের মধ্যে অনেক কিছু আছে। আমি জানি না তারা আসলে কতটা 'অঁতনাবাদী' কিন্তু এমন অনেক লোক আছে যারা আতোকে একটি প্রভাব হিসাবে কথা বলে। স্টিফেন বারবার ‘দ্য লিভিং থিয়েটার[ এবং ‘জ্যাপানিজ বুতোহ’তে আতোর  প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, সেইসাথে মারিনা আব্রামোভিচের মতো লোকেরা: যারা তাঁদের দেহকে বাহনন হিসাবে ব্যবহার করেছেন।
    ফিল সি: তাঁর থিয়েটারের নান্দনিকতা কি ছিল? তা কি তারাহুমারা এবং বালিনিজ নৃত্যের অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত ছিল?
    মারি: যখন আমি ওনার নান্দনিকতা সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন যে জিনিসটি মনে আসে তা হল আলো এবং শব্দ। এটি সমস্ত আচ্ছন্নতাকারী, সংবেদনশীল অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
    ফিল সি:  "ইন্দ্রিয়কে সন্তুষ্ট" করার ব্যাপার আছে তাতে। তিনি  আলো এবং শব্দ নিয়ে কী-কী লিখে গেছেন ?
    মারি: তিনি লিখেছেন সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা। মূলত তা চোখে পড়া উচিত। শব্দের সাথে আমি জানি তিনি  ওন্ডেস মার্টেনট সিনথেসাইজার  যন্ত্র ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন যা একটি থেরেমিনের মতো ( থেরেমিন একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র যা স্পর্শ না করেই বাজানো যায়।) । এটি একটি অদ্ভুত অনিয়ত শব্দ তোলে। তিনি সত্যিই প্রযুক্তি সম্পর্কে আগ্রহান্বিত ছিলেন আর অন্য উপায় অবলম্বন করার ব্যাপারে তিনি বেশ উদ্ভাবনী ছিলেন। তিনি সিনেমায় আওয়াজ ব্যবহারের  বিরোধী ছিলেন কিন্তু এই সংবেদনশীল অভিজ্ঞতাকে উন্নত করার জন্য তিনি থিয়েটারে সমস্ত নতুন প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা ব্যবহার করেছিলেন।
    ফিল সি : তাঁর কাজে এই সংবেদনশীল অভিজ্ঞতা ব্যবহারের কোন উদাহরণ আছে?
    মারি: Les Cenci তে । কিন্তু এর নেতিবাচক রিভিউ হয়েছিল আর লেখা হয়েছিল যে এটি সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় আর এতে সূক্ষ্ম কিছুই নেই। শ্রোতাদের  ইন্দ্রিয়ের ওপর বড়ো বেশি আক্রমণ হয়ে গিয়েছিল।
    ফিল সি: আমি মনে করি এটা একটা সাধারণ অসুবিধা যা শিক্ষকরা তাঁদের ছাত্রদের  ‘অতনাবাদী’ হওয়ার ছত্রছায়ায় তৈরি করার প্রয়াস করেন - এতে প্রায়শই সূক্ষ্মতার অভাব থাকতে পারে।
    মারি: আমি মনে করি না যে আতো’র প্রস্তাবগুলো বাস্তবে  প্রয়োগ করা সম্ভব । একটি ধারনা চালু আছে যে এই প্লেগ রূপকটি সত্যিই কেবল  রূপক নয় তাই এটি এমন কিছু যা এত হিংস্র এবং ধ্বংসাত্মক। হ্যাঁ  তারাহুমারা এবং বালিনিজ নৃত্য আছে, এবং হ্যাঁ, বেশিরভাগ লোকই বলবেন যে তাঁর নিষ্ঠুরতা সহিংসতা বিষয়ক নয়, তবে আতো’র থিয়েটার তত্ত্বগতভাবে এমন কিছু যা হিংসাত্মক এবং ধ্বংসাত্মক। তিনি সর্বদা এই সব অপক্যালিপ্টিক দৃশ্যকল্প সম্পর্কে লিখতেন। এটাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় যার পরামর্শ আতো দিয়েছিলেন।
    ফিল সি : শব্দ এবং ভাষা তাঁর প্রথম দিকের লেখায় কি রূপ নিয়েছিল এবং কীভাবে তিনি  লিখিত এবং কথ্য ভাষাকে সাময়িক করে তোলেন?
    মারি: সেগুলি ফরাসি ভাষায় লেখা । তিনি তাঁর গ্লোসোলালিয়ার জন্য বেশ সুপরিচিত শব্দ ব্যবহার করতেন, যেগুলি  তৈরিকরা শব্দ, কিন্তু তিনি আসলে তার থিয়েটার লেখার আগে পর্যন্ত গ্লোসোলালিয়া ব্যবহার শুরু করেননি। ১৯৪০-এর দশকের প্রথম দিকে বা ১৯৩০-এর দশকের শেষের দিকে যখন তিনি মানসিক হাসপাতালে ছিলেন তখন তিনি সবসময় ফরাসি ভাষা ব্যবহার করতেন এবং তখন তিনি নিজের ভাষা আবিষ্কার করতে শুরু করেছিলেন। একটি শব্দ যা সত্যিই আতোকে আগ্রহী করে তা হল 'কাকা' যা ফরাসি ভাষায় 'গু' এর জন্য বাচ্চারা বলে । ‘কা’ শব্দাংশটি তাঁর গ্লোসোলিয়ায় বহুবার উঠে আসে। এটি ‘খা’-এর প্রাচীন মিশরীয় চিত্রের সাথেও সম্পর্কিত যা কখনও কখনও 'কা' উচ্চারিত  হয় তবে এটি ‘খা'-এর জন্য প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ যা 'দ্বৈত'বা ডাবল। তাই যখন তিনি এই 'কাকা' বা 'কা' শব্দ ব্যবহার করতে থাকেন তখন তিনি এই শারীরিক প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেন, যেটির বিষয়ে তিনি কথা বলতে পছন্দ করেন এবং তাঁর পরবর্তী গ্রন্থে বারবার উঠে আসে, তবে তিনি এই প্রাচীন মিশরীয় ধারণার কথাও উল্লেখ করেছেন। 'দ্য ডাবল', যা তাঁর থিয়েটারের লেখাগুলিকে চিহ্ণিত করেছিল - থিয়েটার অ্যান্ড দ্য ডাবল - "যদি থিয়েটার জীবনকে দ্বিগুণ করে, জীবনসত্য থিয়েটারকে দ্বিগুণ করবে।" সবকিছুতে তাঁর  এই দ্বিগুণ আছে। 'কা' ধ্বনিটি তাঁর ভাষা ব্যবহারের একটি সত্যিই আকর্ষণীয় উদাহরণ যা অর্থবহ এবং প্রতীকী উভয়ই। অ্যালান ওয়েইস এ সম্পর্কে লিখেছেন যে, তিনি এটিকে বেশ হাস্যকর মাত্রায় নিয়ে গেছেন, কিন্তু তিনি বলেছেন যে আপনি যখন 'কা' শব্দটি, কে অক্ষর, কে-এর শব্দটি বলেন, তখন আপনি আপনার ডায়াফ্রামের উপর চাপ দিচ্ছেন যা আপনার পাচনতন্ত্রকে সহজতর করে।
    ফিল সি:  কিভাবে সবকিছু ফাঁসে আটকিয়ে সংযুক্ত করা হয় তা ব্যাখ্যা করে ব্যাপারটা।
    মারি: হ্যাঁ ।
    ফিল সি: আতো’র লেখা কি অনুবাদযোগ্য নয় কারণ তিনি স্বেচ্ছাচারিভাবে এবং উদ্ভাবনী উপায়ে ফরাসি ব্যবহার করেছেন?
    মারি: আমি সত্যিই এটির উত্তর এড়াতে চাই, কারণ আমি মনে করি যে ভাষা নিয়ে অনেক লোক কাজ করেন,  তাঁরা বলেন, "ওহ ! ভাল, তবে অবশ্য অনুবাদ করা অসম্ভব।" যদি আপনি একথা বলেন, তার মানে আপনি বলছেন যে এটি এমন কারো কাছে সম্পূর্ণরূপে অগম্য যে এই ভাষাটি একটি নির্দিষ্ট স্তরে বোঝে না । আমি মনে করি যে আতো’র ধারণাগুলি অনুবাদযোগ্য কিন্তু একই সাথে তিনি প্রচুর সমজাতীয় শব্দ ব্যবহার করেছেন।
    ফিল সি: বারবার ব্যবহৃত সমজাতীয় শব্দ কোনগুলো ?
    মারি: তার কাছে ছুরি, ছেঁদা, ধাক্কাধাক্কি, নখর, পোড়ানো এই প্রত্যাবর্তনমূলক ছবিগুলো রয়েছে যা তার নোটবুকে আঁকা চিত্র হিসাবে তৈরি, তবে শব্দ হিসাবেও ব্যবহৃত, যেগুলি উচ্চস্বরে আওড়ালে ছন্দের মতন শোনায় যেমন ত্রাও, কু, ক্লাও ইত্যাদি।
    ফিল সি: তাঁর কর্মকাণ্ড, টেক্সট এবং আওয়াজ এক হয়ে যায়।
    মারি: হ্যাঁ। এই  ধরনের ব্যাপার তাঁর নোটবুক আছে।  তিনি প্রায়ই কথা বলার সময়  হাতুড়ির মতন হাত পিটতেন ।  তাঁর আঁকা কিছু ছবি রয়েছে যেখানে তিনি কলম দিয়ে সেই ড্রইঙ খুঁচিয়েছেন। এগুলি সত্যিই আকর্ষণীয় কারণ তাঁর অনেক কাজ ছিল অঙ্গভঙ্গি করার পরে একটি কলম দিয়ে পৃষ্ঠাটিতে ছুরিকাঘাত করা কিন্তু তিনি তাঁর নিজের দেহেও ছুরিকাঘাত করছিলেন; টেক্সট তাঁর শরীরের একটি ধারাবাহিেঁর মতন হয়ে ওঠে।
    ফিল সি: তিনি কি রক্ত দিয়ে এঁকেছেন এবং পৃষ্ঠাটি রক্ত দিয়ে চিহ্নিত করেছিলেন?
    মারি: না তিনি আসলে রক্ত দিয়ে আঁকেননি। আপনি জানেন যে তিনি তীব্র উন্মাদনার মুহূর্তে তেমন কাজ করেছেন এবং তিনি তাঁর শরীরের একটি বিন্দু চিহ্ণিত করার কথা বলবেন এবং তারপরে তিনি নিজের কলম দিয়ে নিজেকে খোঁচাবেন - আসলে রক্ত আঁকবেন না, তবে তিনি একটি কলম দিয়ে নিজেকে খোঁচাবেন এবং তারপরে পৃষ্ঠাটিতে ছুরিকাঘাত করবেন। তিনি একজিমা এবং একজিমা রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়েও লিখেছেন এবং তাঁর তৈরি কিছু লেখা, বিশেষ করে উন্মাদনার মুহূর্তে, তিনি পৃষ্ঠায় স্ক্র্যাপ করতেন যাতে পৃষ্ঠাটি এক ধরণের একজিমার ত্বকের মতো দেখায়; যাতে লেখার পৃষ্ঠটি তাঁর ত্বকের একটি এক্সটেনশনের মতো হয়ে উঠতো।
    ফিল সি:  কাগজপত্রের অন্য কোনও  উৎস আছে যা লোকে আতো’র দ্বারা অনুপ্রাণিত কাজ হিসাবে দেখতে পারে?
    মারি: আমার মনে হয় থিয়েটার সম্পর্কে তাঁর ধারণাগুলো এখন সিনেমায় অনেক বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ফিল্মগুলো বিভিন্ন উপায়ে মানবদেহের কাছে আবেদন করতে চায়।
    ফিল সি: তাঁর থিয়েটারের ধারণা সিনেমায় ব্যবহৃত হচ্ছে তার কোনো উদাহরণ আছে?
    মারি: গ্যাসপার নো এবং ক্লেয়ার ডেনিসদের কাজে আছে। Cinema and Sensation নামে মার্টিন বেউগনেটের লেখা একটি বই আছে। তিনি আতো  সম্পর্কেও লিখেছেন। ‘নতুন ফরাসি চরমপন্থা’ তকমা দেওয়া হয়েছে এমন অনেক চলচ্চিত্র রয়েছে ; আমি মনে করি এটি এমন একটি শব্দ যা একজন ইংরেজ সাংবাদিক দ্বারা উদ্ভাবিত । ফ্রান্সে যে ফিল্মগুলি হয়েছে তা দেহের ওপর প্রভাব সম্পর্কিত । ফিল্ম তত্ত্বে,  ফিল্ম দেখার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা (প্রপঞ্চবিদ্যা) বর্ণনা করা নিয়ে ফিল্ম হয়েছে। এই ক্ষেত্রে নতুন করে আগ্রহ দেখা যায় যেখানে আপনার ব্যক্তিগত চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে বা কিছু উপায়ে ব্যাহত করছে।
    ফিল সি: আমি মাইকেল হানেকের চলচ্চিত্র পছন্দ করি। আমি জানি না কোনও সংযোগ আছে কিনা, তাঁর চলচ্চিত্রগুলি বিচ্ছিন্নতা ( verfremdung ) ব্যবহার করে বলে মনে হয়, তবে তা এক ধরণের ব্যাঘাত। আমি মনে করি  কীভাবে বিষয়বস্তু বিচ্ছিন্নভাবে অনুভূত  হয় তা ব্রেখত দেখিয়েছিলেন  যেখানে কিনা আতো এবং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে হানেকে অভিজ্ঞতার ব্যাঘাতের উপর জোর দিয়েছেন। দেখার সেই মুহুর্তে আপনার ইন্দ্রিয়গুলি ব্যাহত হয়, জীবন ব্যাহত হয়, এটি অনিবার্য। হিংসা এবং মৃতদেহের চিত্রগুলি বিশেষত হানেকের চলচ্চিত্রগুলিতে পুনরাবৃত্তি হয় বলে মনে করি।
    মারি: এছাড়াও হানেকে যেভাবে সময়কে অন্বেষণ করেন : দর্শকের দেখার সাময়িকতা। শ্রোতারা যে শারীরিক প্রভাব অনুভব করে তা আসলে অপেক্ষা করার এবং আরও অপেক্ষার  কাজ করে এবং আপনি সত্যিই সময়ের সেই অনুভূতিটি অনুভব করতে পারেন।
    ফিল সি: এর একটি উদাহরণ Cache (লুকানো) যেখানে বাবা রান্নাঘরে আত্মহত্যা করেন, এটি  মূলধারার ফিল্মে, 'হলিউড' সম্পাদনার তুলনায় হঠাৎ করেই ঘটে। এটা তাৎক্ষণিক ভাবে ঘটে যায় এবং আপনি শবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। আপনি অনেকক্ষণ যাবত সেই শবের সঙ্গে সময় কাটান ।
    মারি: আর Funny Games,  আপনি আসলে কোনো খুনোখুনি দেখতে পাচ্ছেন না কিন্তু আপনার অবস্হা  আরও খারাপ কারণ আপনি শুধু অপেক্ষা করছেন। এছাড়াও Seventh Continent যেখানে পুরো পরিবার আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং শেষে তারা সবাই এক এক করে মারা যায় আর তার জন্য সময়ের পর সময়, সময়ের পর সময় লাগে এবং টিভিতে একটি পপ ভিডিও দেখানো হয়।
    ফিল সি: সময় একেবারে আসল ব্যাপার।  আমি মনে করি ছাত্রদের জন্য আতো’র সময় দ্বারা প্রভাবিত  ব্যবহারিক অনুসন্ধানে ফোকাস করার জন্য জরুরি: সময় ।
    মারি: এবং এছাড়াও এই ধরনের সিনেমায় অঙ্গভঙ্গির উপরও ফোকাস করা হয় । থিয়েটার এখন সিনেমাকে যেভাবে প্রভাবিত করছে তা ইঙ্গিত ব্যবহার প্রয়োগের মাধ্যমে।  লোকেরা সিনেমায় একটি ইঙ্গিতকে দার্শনিক ধারণা হিসাবে দেখছে, যা থিয়েটার থেকে সিনেমায় গেছে।
    ফিল সি : আপনি কি শরীরকে নাড়াচাড়া করার  অঙ্গভঙ্গি কাকে বলতে চান: হাতগুলো?
    মারি : হ্যাঁ একটি খুব, খুব সহজ উপায়ে। বিশেষ করে এই ধরনের চলচ্চিত্র যেগুলোকে আমি ‘অঁতনাবাদী’ হিসেবে দেখি। তাঁরা শারীরিক অঙ্গভঙ্গির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যা সাধারণত সিনেমায় উপেক্ষা করা হয় । অপ্রত্যাশিত নড়াচড়ার ফলে, যেগুলোর আখ্যানের সাথে সত্যিই কোনও সম্পর্ক নেই, এমন মুহূর্ত যেখানে দেহকে আখ্যানে অবস্থানের পরিবর্তে তার নড়াচড়ার মাধ্যমে স্বস্তি দেওয়া হয়।
    ফিল সি: আতো কখন সিনেমা সম্পর্কে তাঁর ধারণা তৈরি করেছিলেন?
    মারি: বলতে গেলে, আতো বেশিরভাগ লোকের বিপরীত পথে হেঁটেছিলেন: তিনি সিনেমা দিয়ে শুরু করেছিলেন এবং তারপরে থিয়েটারে ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁর বেশিরভাগ কাজে, দেখা গেছে, তিনি একটা নির্দিষ্ট মাধ্যম দিয়ে শুরু করছেন তারপরে তিনি এতে বিরক্ত হয়ে পরিত্যাগ করবেন। তিনি সিনেমা দিয়ে শুরু করেছিলেন এবং তারপরে তিনি এটা নিয়ে সত্যিই হতাশ হয়েছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে থিয়েটার সম্ভবত সিনেমার চেয়ে অনেক বেশি বিপ্লবী। তিনি অনুভব করেছিলেন যে তিনি সিনেমার চেয়ে থিয়েটারে আরও বেশি কিছু করতে পারেন। আইজেনস্টাইন, উদাহরণস্বরূপ, থিয়েটার থেকে সিনেমায় গিয়েছিলেন।
    ফিল সি: কাজের ক্ষেত্রে সমসাময়িক অন্য কারোর উদাহরণ আছে যিনি প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং শরীরের উপর ফোকাস করেছেন ? জরুরি নয় যে তা আতো’র সঙ্গে স্পষ্টভাবে যুক্ত। কিন্তু কারোর এমন কোনও কাজ আছে যা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কারণ এটা তো উপস্থাপনা এবং ভাষার ভাঙচুরকে অন্বেষণ করে?
    মারি: আমি শ্যানতাল আকেরম্যানের চলচ্চিত্রগুলোকে সত্যিই আকর্ষণীয় বলে মনে করি। তিনি চিত্রগ্রহণে অঙ্গভঙ্গি  ব্যবহার করেছেন : যেভাবে কোনও কিছু চিত্রায়িত করা হয়; এবং  পর্দায় শরীর প্রদর্শিত হয়। একজন পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাতাও আছেন যিনি তারাহুমারাদের নিয়ে চলচ্চিত্রের একটি সম্পূর্ণ সিরিজ তৈরি করেছেন।সেটার সঙ্গে যে আঁতোর চিন্তাভাবনার  যোগাযোগ রয়েছে তা স্পষ্ট ।
    ফিল সি: আপনি কি নৃত্যকলায় আতো’র অনেক প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন ? আমরা সময়, শরীর এবং আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে যে আলোচনা করলুম, সেগুলো পিনা বাউশ এবং হোফেশ শেচটারের কাজের কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে হয়।
    মারি: হ্যাঁ । আর মার্স কানিংহামের মতো লোকেদের কাজে। আলাদা একটি কারণে ইভন রেইনার: তিনি ভাষা নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তাঁর  এমন অনেক ব্যাপার আছে যার সঙ্গে আতোর মিল নেই । ‘থিয়েটার অ্যান্ড ইটস  ডাবল’  ব্ল্যাক মাউন্টেন কলেজে  বিশাল প্রভাব ফেলেছিল,  যেখানে জন কেজ, ন্যান্সি স্পেরো এবং মার্স কানিংহাম ছিলেন। লুসি ব্র্যাডনক ব্ল্যাক মাউন্টেন কলেজে  ১৯৫০-এর দশকে আতো’র ভুল অনুবাদ প্রসঙ্গে  কাজ করেছিলেন এবং কীভাবে সেটা আমেরিকায় ১৯৬০-এর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছিল যা পরে অন্যত্র রপ্তানি  হয়েছিল - এই বিষয়ে তিনি ‘হোয়াইট নয়েজ অ্যাট ব্ল্যাক মাউন্টেন’ নামে একটা নিবন্ধ লিখেছিলেন ।
    ফিল সি: অঁতনা আতো সম্পর্কে আপনার আর কোন কোন ব্যাপারে আগ্রহ আছে?
    মারি: আতো সম্পর্কে আমি যে জিনিসটি সত্যিই পছন্দ করি তা হল তিনি থিয়েটারবিরোধী।
    ফিল সি: আপনি কি ঐতিহ্যগতভাবে মূলধারার থিয়েটারের কথা বলছেন ?
    মারি: হ্যাঁ। আমি স্কুলে ইংরেজি পড়েছি আর আমি থিয়েটারে যেতে অপছন্দ করতাম, আমি একে সত্যিই বিরক্তিকর বলে মনে করি এবং এটিই আতো লিখেছেন।
    ফিল সি: ‘বোরিং'-এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখানোর সেই ধারণাটি বেশ মূলধারায় পরিণত হয়েছে এবং এটি স্কুলগুলিতে অধ্যয়ন করা ধারণাগুলোর বনেদ । প্রভাবশালী থিয়েটার অনুশীলনকারীরা সকলেই থিয়েটারে কিছু বিরক্তিকর খুঁজে পান যা তাঁরা অনুভব করেছেন এবং তাঁদের ধারণাগুলো প্রতিক্রিয়া হিসাবে বিকাশ লাভ করে।  স্কুলগুলোতে অঁতনা আতো বেশ জনপ্রিয় অনুশীলনকারী, যে ব্যাপারটা,  আমি কল্পনা করি, তাঁকে তার কবরের ভেতরে পালটি খাওয়াবে ! আমি মনে করি যে জনপ্রিয়তা অভ্যন্তরীণভাবে বয়ঃসন্ধির অবস্থার সাথে জড়িত:  যেমন ভাবে জগতকে আপনার সামনে উপস্থাপন করা হয়, আপনার মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করে,  আপনি অনুভব করেন যে আপনি জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যবর্তী একটি জগতে ঝুলছেন, কেননা শরীরের একটি অতি-সচেতন ব্যাপার। আতো জীবনভর এই ধরণের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে ছিলেন।
    মারি: হ্যাঁ, এটি এমন  অনুপ্রেরণামূলক অভিজ্ঞতা যা বেশিরভাগ মানুষ বড় হয়ে গেলে হারিয়ে ফ্যালে।
    ফিল সি: আমি জানি যে এটা একটা অসম্ভব প্রশ্ন কিন্তু আপনি কি আতোর কাজকে সংক্ষেপে বর্ণনা করতে পারেন?
    মারি: তাঁর প্রধান উদ্বেগ ছিল শরীর এবং শরীরের প্রকাশ নিয়ে। ভাষা থেকে একেবারে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করার পুরো বিষয়টা হল সরাসরি শারীরিক অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার চেষ্টা; বাইরে থেকে যে দেহ দেখা যায় তা নয়, বেঁচে থাকার মধ্যে দেহে যেভাবে বাস করা হয়। সর্বাধিক গুরুত্বের ব্যাপার হল মানবদেহ কিন্তু তা একই সঙ্গে অভিব্যক্তি এবং প্রতিনিধিত্বের অবয়ব । আপনি অভিজ্ঞতাকে হ্রাস না করে কেমন করে তার প্রতিনিধিত্ব করবেন?

    ( ESSENTIAL DRAMA সাইটে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার )
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১২:২১740605
  • শ্রীমতি কোলেট টমাসকে লেখা অঁতনা আতো’র  চিঠি
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
      অঁরি তমাস, তরুণ ঔপন্যাসিক, যিনি আতো’র সাথে ‘থিয়েটার এবং তার ডাবল’ নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধের বিষয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন, ১৯৪৬ সালের ১০ই মার্চ  রোদেজে আতো’র সাথে দেখা করতে যান।তাঁর যুবতী স্ত্রী কোলেত তমাসকে  সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, যিনি ছিলেন একজন  উচ্চাকাঙ্ক্ষী  অভিনেত্রী। কোলেত যখন আঁতোর সাথে দেখা করেছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর এবং সেই সময়ে তাঁদের বিয়ে ভেঙে যাবার অবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল।  আতো’র মনে হয়েছিল যুবতিটি  নতুন সম্ভাবনা এবং স্বাধীনতার জীবনকে প্রতিনিধিত্ব করছেন । শীঘ্রই তিনি তার "হৃদয়ের কন্যা" হয়ে ওঠেন এবং কিছু সময়ের জন্য অঁতনা আতোর কল্পনার জগতে একটি কেন্দ্রীয় অবস্থান দখল করেন। এই সময়ে তাঁরা প্রায়ই একে অপরকে চিঠি লিখতেন এবং কোলেতকে লেখা আতোর এই চিঠিগুলি নিয়ে তাঁর একটি বই, ‘দ্য টেস্টামেন্ট অফ দ্য ডেড ডটার’, ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
    কিন্তু আতোর প্রতি কোলেতের শ্রদ্ধা ভক্তি তাঁকে এবং তাঁর লেখার সাথে একটি অতিরিক্ত পরিচয়ের দিকে পরিচালিত করে, যা ছিল তীব্র এবং পুরুষটিকে দখলের প্রয়াস । আতোকে আর্থিক সাহায্যের জন্য, তিনি প্যারিসে ১৯৪৬ সালের জুন মাসে আতোর ‘ফ্র্যাগমেন্টেশন’ থেকে কিছু অংশ শ্রোতাদের  পড়ে শুনিয়ে ছিলেন । তাঁর উদ্বেগ এবং আতঙ্ক সত্ত্বেও তিনি অতি উত্সাহে , লোডশেডিঙের মাঝে, শ্রোতাদের করতালির মাঝে আতোর রচনা পাঠ  করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের শরৎকাল পর্যন্ত আতো  কোলেতের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন, কিন্তু আতো তাঁর কাছ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। আতো  অভিযোগ করতে শুরু করেছিলেন যে কোলেত দাবি করছেন যে আতোর রচনা নাকি কোলেত লিখেছেন আর কোলেত তাঁর রচনাগুলো  তাঁর কাছ থেকে চুরি করেছেন।
    তিনি তাকে সন্তান ধারণের জন্য প্রলুব্ধ করতে চেয়েছিলেন বলেও অঁতনা আতো অভিযোগ করেন। সেই বছরের নভেম্বরে আতোর রচনা পাঠে  অংশ নিতে অস্বীকার করেছিলেন কোলেত। এতে ক্ষুব্ধ হন আতো,  যিনি বলেছিলেন যে এটি যুবতিটির  একটি "অযৌক্তিক আবদার"। কিন্তু আতোর কাছের লোকেদের  কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে বাস্তব বা কাল্পনিক চাপে যুবতিটির মানসিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে।কোলেট থমাসের মানসিক অবস্থা পরবর্তী বছরগুলিতে এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে তিনি আতোর কথা মনে করতে পারেননি। কোলেত তাঁর বাকি জীবন প্রাইভেট মানসিক চিলিৎসালয়ে কাটিয়েছেন। এই চিঠিগুলো  প্রথম সামান্থা মারেনজির গুরুত্বপূর্ণ বই, ‘অঁতনা আতো এত কোলেট থমাস’ বইতে প্রকাশিত হয়েছিল। 
    [ প্রথম চিঠি ] প্যারিস, জুন ১৪, ১৯৪৬
    আমার অত্যন্ত প্রিয় কোলেত,
     আমি আপনার জন্য রেইন ব্লাঞ্চে [১] দুই বা তিন ঘন্টা অপেক্ষা করেছি। আমি আপনার হোটেলে ফোন করেছিলুম কিন্তু তারা আমাকে বলল যে আপনি ওই হোটেলটি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এবং আজ রাতে আপনার লাগেজ নিতে আসছেন।
    আপনি কি প্যারিস ছেড়ে যেতে চান?
    এই খবর আমাকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করেছে এবং আমি ভাবছিলুম যে আপনি তো হতাশার  প্রজাতি নন যে হারিয়ে যাওয়া বিভ্রমের মতো আপনাকে হঠাৎ প্যারিস ছেড়ে যেতে হবে।
    তবু, আমি, যতদূর ব্যাপারটা আমার সাথে সম্পর্কিত, আমি আপনার কাচ থেকে কিছুই নিইনি এবং আপনাকে অযথা প্রতারিত করিনি।
    আপনি যদি আজ বিকেলে আমাকে দেখতে আসতেন তবে নতুন প্রলয় বা সডোমের আরেক পতনের জন্য অপেক্ষা না করে আপনার হৃদয় পুরোপুরি আশ্বস্ত হয়ে উঠত এবং আমার কাজের জন্য আপনাকে আমার প্রয়োজন ছিল।
    আমাকে কি নিজেকে চিরকাল একা ভাবতে হবে?
    আমাকে লিখে জানান আর  প্যারিসে একটা সাক্ষাতের দিনক্ষণ ঠিক করুন।
    আমি নিশ্চিত যে আপনি মনে করেন আমি আপনার প্রতি নিজেকে পুরোপুরি নিবেদন করিনি।
    আমি কিছু গোপন না করে আমার জীবন সম্পর্কে আপনাকে জানাতে  চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি আসেননি।
    আমি আপনার কাছ থেকে একটা চিঠির শব্দ অপেক্ষা করছি.
    আমি আপনাকে আলিঙ্গন করি। 
    অঁতনা আতো
    [ দ্বিতীয় চিঠি ]প্যারিস, রবিবার, জুন ২৪, ১৯৪৬ [২]
    কোলেত,
     আমি ৫০ বছর ধরে অপরিসীম কষ্ট সহ্য করেছি, যার মধ্যে নয় বছরের বন্দিত্ব কারোর চেতনায় আঘাত সহ্য করতে সক্ষম হবে।
     আমি আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি ।এমন কিছু আছে যা আপনাকে পীড়িত করে, এটি আমাকে অবাক করে না, এটিই জীবন, বাকিদের জন্য, আমি স্থায়ীত্ব শব্দের অর্থ কী তা বুঝতে পারি না, এমনকি দর্শনে আমার কোনও স্নাতক ডিগ্রি নেই।
    আপনার  শেষ কথার জবাবে আমার আর কিছু বলার নেই, আর কিছু বলার নেই     
    অঁতনা আতো
    [ তৃতীয় চিঠি ] প্যারিস, জুন 26, 1946
    কোলেট,
     
    কার্ডিয়াজলের চিকিৎসার সাথে বন সউভার [৪]-এ বন্দী থাকার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আমি ভুলতে পারি না। [৫]
    আমি সারাহ বার্নহার্ড থিয়েটারের ঘটনাটি ভুলতে পারি না [6] যেখানে ছিল শুভাকাঙ্খী কোলেত তমাস  অন্য কেউ নয় যে কিনা তাকে  বাস্তবায়নের জন্য ব্যবস্হা নিয়েছিল।
     আমিও ভুলতে পারি না, এবং বিশেষ করে একজন বিস্ময়কর চেতনাময়ী যে আমার সাথে কাজ করতে এসেছিল এবং ইভরি-সুর-সিয়েন [৭ ]-এ আমার  এস্পালিয়ন এবং রোদেজে সদ্য লেখা রচনাগুলো তার সমস্ত হৃদয় দিয়ে সকলের কাছে পড়ে শুনিয়েছিল ।
    আমি জানি, কোলেত, একটি দীর্ঘ এবং ভয়ানক ইতিহাস এবং বায়ুবিজ্ঞান সংক্রান্ত [8] ব্যাপারে যা  আপনি আমাকে অ্যানি সম্পর্কে পাঠিয়েছেন তা আমাকে এমন  দেখায় যেন আপনি নানাভাবে এটা নিয়ে সচেতন ছিলেন, কিন্তু আপনি যাতে আপনার সঠিক অবস্থান দেখতে পান এবং আমারও অবস্হান স্পষ্ট হয় তাতে বিরাট উথালপাথাল ঘটে যাবে।  ইতিমধ্যে আমি চাইবো যে আপনার আত্মা যেন অন্যায়ভাবে যন্ত্রণায় আক্রান্ত না হয়, তবে আমি আপনার কাছ থেকে অনেক অন্যায় এবং বিশেষত অযাচিত কথা শুনেছি। যেহেতু আমি সচেতন ছিলুম যে  আপনাকে শুধুমাত্র বাঁচতে সাহায্য করতে চেয়েছিলুম এবং খারাপভাবে পুরস্কৃত হওয়ার ছাপ নিয়ে সচেতন নই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে আপনি এখন এটি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, তবুও আপনি সারাহ বার্নহার্ডে আমার রচনা ‘দি চিলড্রেন অফ দি মিসে-এন-সিন প্রিন্সিপল’ [৯] পড়েছেন আমি চাই আপনি বাকিটা রেডিওতে ধারাবাহিক পড়ুন, এবং আমি চাই না আপনি এই শেষ সুযোগটি হারাতে চাইবেন। আমি ডাক্তারদের বিরুদ্ধে  অনুসরণ করার মতন একটা নতুন লেখা লিখেছি [১০] 
    এই বিষয়ে একটি মিটিং এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাকে একটা লেখা পাঠাতে [ ১১ ] পাঠাতে হবে।
     আপনার
    অঁতনা আতো
    পুনশ্চ. আমি বিশেষভাবে বিশ্বাস করি না যে আপনি অ্যানির জায়গা নিয়েছেন [৩ ], তবে আমি মনে করি এমন কেউ যিনি সত্তার স্থায়ীত্বে বিশ্বাস করেন, যদিও আপনি পরোয়া করেন না, আপনার জায়গা নিয়েছেন, তবে ব্যাপারটা অ্যাপোকালিপসের জিঘাংসা দ্বারা সমাধান  হবে। যদিও আমি ভেবেছিলাম যে আমরা শেষবার দেখা করার সময় মঁপারনাস স্টেশনের সামনে পরস্পরের প্রতি আগ্রহী ছিলুম কিন্তু তাতে আপনার কাছে কী আসে যায়। 
    টীকা : [১] প্যারিসের হোটেল হোয়াইট কুইন । [ ২ ] প্রকৃতপক্ষে রবিবার ছিল ২৩ জুন । [ ৩ ] অ্যানি বেসনার্ড - আতোর বন্ধুনি এবং তাঁর "হৃদয়ের কন্যা ড়ৈ এখনো অজাত।" আতো এবং অ্যানি বেসনার্ডের মধ্যে ১৯৩৩ সালের প্রথম বৈঠকটি একটি রূপকথার মতন। রাতের বেলা আতো অ্যানিকে দেখলেন মঁপারনাসের বুলেভার্দে, মেয়েটি একটি বেঞ্চে বসে কাঁদছে। তার বয়স ষোল বছর, বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে এবং ক্ষুধার্ত। তাঁর নিজের দারিদ্র  সত্ত্বেও, আতো মেয়েটিকে খাওয়াতে এবং তাকে সান্ত্বনা দিতে পেরেছিলেন এবং তারা বন্ধু হয়ে ওঠেন। স্টিফেন বারবার লিখেছেন, "পিতৃত্বের বিশুদ্ধতা এবং অনাচারী ঈর্ষার মধ্যে সীমানা অ্যানি বেসনার্ডের প্রতি আতোর মনোভাবের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। আতো নিজের পরিবারের প্রতি সর্বদা প্রতিরোধী, অ্যানির সাথে সমান্তরাল সম্পর্কের মাধ্যমে এই অনুপস্থিতি পূরণ করেছিলেন।[ ৪ ] কায়েনে একটি চিকিৎসালয় । [ ৫ ]  কোলেতকে তার ছাত্রাবস্থায় একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল যেখানে তাকে দুই হাত বাঁধা অবস্হায় রাখা হয়েছিল এবং কার্ডিয়াজল দেওয়া হয়েছিল, যা একটি খিঁচুনি-দমনকারী ওষুধ সাধারণত ইলেক্ট্রোশকের আগে  দেওয়া হয়। আতো ৩ এপ্রিল, ১৯৪৬-এ তাঁর  একটি চিঠিতে লেখেন: “আশ্রয়, চিকিত্সা এবং কার্ডিয়াজলের গল্প, যখন আমি এটি ভাবি, তখন আমার দম বন্ধ হয়ে যায়, কারণ এটি বয়ঃসন্ধিকাল থেকে আমার অভিজ্ঞতার সমস্ত গল্পের সাথে অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে আছে। [ ৬ ]  কোলেত তমাস ৭ জুন, ১৯৪৬-এ সারাহ বার্নহার্ড থিয়েটারে আয়োজিত গালা বেনিফিট-এ আতোর ‘ফ্র্যাগমেন্টেস’ থেকে পড়েন। [ ৭ ] ১৯৪৬ সালে আতোকে তাঁর বন্ধুদের কাছে রেকৈ দেওয়া হয়েছিল, যাঁরা তাকে আইভরি-সুর-সেইনের সাইকিয়াট্রিক ক্লিনিকে ভর্তি করে দেন।[ ৮ ] আতো প্রেসারাইজড এয়ার টিউবের মাধ্যমে চিঠি পাঠানোর ব্যবস্হাকে নির্দেশ করছেন, যাকে বলা হয় নিউমেটিক মেল বা পোস্ট। আতো ১৯৪৬-১৯৪৮ সালের শেষের দিকে খুব কমই সাধারণ পোস্টে মেইল পাঠাতেন। সাধারণত এগুলি নিবন্ধিত চিঠি ছিল যা প্রাপককে সই করে নিতে হয়। [ ৯ ]   এই শিরোনামের আরেকটি সামান্য পরিবর্তন করা রচনা ছিল। দুটিই ছিল একই পাঠ্যের মূল শিরোনাম যা ‘ফ্র্যাগমেন্টস’ নামেও বইয়ে ছিল। শিরোনাম "ফ্র্যাগমেন্টেশনস" দিয়ে শেষ হয়েছিল।[ ১০ ] ক্লাব ডি'এসাই-এ রোগী এবং ডাক্তারদের রেকর্ড করার পর (৮ জুন, ১৯৪৬ ), আতো রেডিও রিডিং, এলিয়েনেশন এবং ব্ল্যাক ম্যাজিকের জন্য আরেকটি রচনা প্রস্তুত করেন; তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে কোলেত পাঠে অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু তিনি ১৬ জুলাই একাই রচনাটি পড়েন এবং তারপর এটি ‘আতো দ্য মোমোতে’ ঢোকান।[ ১১ ] আতোর "নিউ" শব্দের ব্যবহার  "নিউমেটিক" শব্দটিকে স্মরণ করায়। "Pneu" বায়ুসংক্রান্ত মেইলের জন্য সংক্ষিপ্ত এবং ঘন ঘন ব্যবহৃত নাম ছিল। তিনি তাঁর শেষ মাসগুলিতে লেখা চিঠিতে প্রায়শই এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আতোর জন্য, শব্দটির একটি বিশেষ তাৎপর্য ছিল, যা শ্বাসের শক্তির কথা বলে। প্রাচীন গ্রীক ভাষায়, "নিউমা" শব্দটি ছিল, যা শ্বাস নেওয়া বা প্রস্ফুটিত হওয়াকে বোঝায়। 

     

                                                                                                                  
                                                
                                                                            

                                                                                                                  
                                                                                             
                                                                                        
                                                                                 

     

     
     
     
    .
     
     
     
     
    .
     
     
     
     
     
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:11f4:b84:1e3:7da5 | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১২:২৪740606
  • অঁতনা আতো’র “সুস্পষ্ট ভাষা বিষয়ক ম্যানিফেস্টো”
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে অঁতনা আতো প্রকাশ করেন তাঁর “সুস্পষ্ট ভাষা বিষয়ক ম্যানিফেস্টো”, মূলত পরাবাস্তববাদীদের, বিশেষ করে আঁদ্রে ব্রেতঁ’র বক্তব্যের সঙ্গে তাঁর মতামতের পার্থক্য স্পষ্ট করার জন্য  । আতো’র ম্যানিফেস্টোটা এরকম :
      “আমি যদি খারাপ বা ভালোতে বিশ্বাস করি না । যদি আমি ধ্বংস করার মতো প্রবল প্রবণতা অনুভব করি, যদি নীতিমালায় এমন কিছু না থাকে যা আমি যুক্তিসঙ্গতভাবে মেনে নিতে পারি, তাহলে বুঝতে হবে তার অন্তর্নিহিত কারণটি  রয়েছে আমার শরীরের মাংসে।
    “আমি ধ্বংস করি কারণ আমার দৃষ্টিতে, যুক্তি থেকে যা কিছু গড়ে ওঠে তাতে বিশ্বাস করা যায় না। আমি কেবলমাত্র সেই প্রমাণে বিশ্বাস করি যা আমার মজ্জাকে আলোড়িত করে। যা আমার যুক্তিবোধের প্রতি সম্বোধন করে তাতে  নয়। আমি স্নায়ুর রাজ্যে নানা রকম স্তর খুঁজে পেয়েছি।  বুঝতে পারি যে এখন সাক্ষ্য-প্রমাণের মূল্যায়ন করতে আমি সক্ষম। আমার জন্য বিশুদ্ধ মাংসের এলাকায় এমন  প্রমাণ রয়েছে যার সঙ্গে যুক্তি  প্রমাণ করার কোন সম্পর্ক নেই। যুক্তি এবং হৃদয়ের মধ্যে চিরন্তন দ্বন্দ্ব আমার শরীরে নিষ্পত্তি হয়, যদিও তা আমার মাংসে স্নায়ু দ্বারা সিঞ্চিত । অনুভূতিশীল অকল্পনীয়তার রাজ্যে, আমার স্নায়ুর দ্বারা গড়ে ওঠা ছবিখানা  সর্বোচ্চ বুদ্ধিবৃত্তির রূপ নেয়, যা থেকে আমি তার বুদ্ধিবৃত্তির গুণকে ছিনিয়ে নিতে অস্বীকার করি। সুতরাং  বলতে হচ্ছে যে, আমি একটি ভাবকল্পের গঠন পর্যবেক্ষণ করি, যা কিনা  বস্তুসমূহের প্রকৃত পূর্ণতা বহন করে, তা আসলে একটা ভাবকল্প যা সৃষ্টির ধ্বনি নিয়ে আমার কাছে পৌঁছোয়।
    “ কোনও ইমেজ আমাকে সন্তুষ্ট করে না যদি না তা সেইসঙ্গে  জ্ঞান হয়, যদি না ইমেজটা তার সাথে নিজস্ব সারবত্তা এবং নিজস্ব স্পষ্টতা ধরে রাখে। আমার মন, বিতর্কমূলক যুক্তির কারণে ক্লান্ত, একটা নতুন,  পরম মাধ্যাকর্ষণের চাকায় সম্পৃক্ত হতে চায়। আমার কাছে  এটা  সর্বোত্তম পুনর্গঠনের মতো ব্যাপার, যাতে শুধু  অযৌক্তিক নিয়মগুলো লাগু হয়,  আর  জয় হয় একটা নতুন মর্মার্থের আবিষ্কার । এই মর্মার্থ মাদকের ব্যাধিতে হারিয়ে গেছে আর  ঘুমের পরস্পরবিরোধী কল্পনার কাছে একটা গভীর বুদ্ধিমত্তার চেহারা উপস্থাপন করেছে। এই মর্মার্থ মনের ওপর নিজের বিজয় , আর যদিও এটা যুক্তির দ্বারা অখণ্ডনীয়, তবু তা উপস্হিত থাকে , অবশ্য সেটা কেবল মনের ভেতর । এটা হলো শৃঙ্খলা,  বুদ্ধিমত্তা । এটাই বিশৃঙ্খলার গুরুত্ব। কিন্তু তা এই বিশৃঙ্খলাকে যেমনকার তেমন ভাবে গ্রহণ করে না, এটা তাকে ব্যাখ্যা করে আর ব্যাখ্যা করে বলে তাকে হারিয়ে ফ্যালে। এটা হলো অযৌক্তিকতার যুক্তি। আর একজন লোক শুধু এই সব কথাই বলতে পারেন । আমার স্বচ্ছ অযৌক্তিকতা বিশৃঙ্খলাকে ভয় পায় না.
    “মন বলতে যা বোঝায় তার কিছুই আমি বাতিল করি না। আমি শুধু আমার মনকে তার নিজস্ব নিয়ম আর অঙ্গসুদ্ধ অন্য কোথাও নিয়ে যেতে  চাই। আমি মনের যৌন প্রক্রিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করি না, বরং এই প্রক্রিয়াটির বিপরীতে আমি সেই আবিষ্কারগুলোকে আলাদা করে দিতে চাই যা স্বচ্ছ উদ্দেশ্য  সরবরাহ করে না। আমি স্বপ্নের জ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করি, কিন্তু তা কেবল তাদের কাছ থেকে নতুন মালমশলা পাবার জন্য। আমি চাই সংখ্যাবৃদ্ধি, সূক্ষ্মতা, প্রলাপের বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টি,  দ্রুত ভবিষ্যবাণী  নয়। একটি ছুরি আছে যা আমি কখনও ভুলি না।
     “কিন্তু এই ছুরিটা  স্বপ্নের ভেতরে অর্ধেক ঢুকে আছে, যা আমি নিজের ভেতরে রাখি, যা আমি স্বচ্ছ ইন্দ্রিয়ের পরিসীমানায় আসতে দিই না। যাকিছু ইমেজের এলাকার অন্তর্গত তা যুক্তির দ্বারা অপরিবর্তনীয় এবং তাকে অবশ্যই ইমেজের মধ্যে থাকতে হবে বা বিনষ্ট হতে হবে। সে যাই হোক, ইমেজের মধ্যে একটা কার্যকারণ থাকে, এমন বহু ইমেজ আছে যেগুলো ইমেজে-ভরা বিশ্বের জীবনীশক্তির তুলনায় পরিষ্কার ।
    “মনের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে অসংখ্য প্রাণীর বহুরূপী এবং ঝকমকে ইঙ্গিত থাকে। এই ইন্দ্রিয়াতীত এবং চিন্তাশীল ধূলিকণা নিজের ভেতর থেকে নিয়মানুসারে গড়ে ওঠে , স্বচ্ছ যুক্তি  বা আটকে দেয়া চেতনার এলাকার  বাইরে ।
    “ইমেজের উচ্চতর এলাকায়,  সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় বিভ্রম, বা বস্তুগত ত্রুটির অস্তিত্ব নেই, বিশেষ করে জ্ঞানের বিভ্রমের প্রসঙ্গ তো তোলাই উচিত নয় । তবে  এটাই হলো  আসল কারণ কেন একটা নতুন জ্ঞানের মর্মার্থ জীবনের বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে অবতীর্ণ হতে পারে ।
    “জীবনের সত্য বস্তুসমূহের আবেগের মধ্যে নিহিত।  মানুষের মন নানা রকমের ভাবকল্প দিয়ে বিষিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষকে সন্তুষ্ট হতে বলবেন না, তাকে কেবল শান্ত হতে বলুন, যাতে সে বিশ্বাস করে  যে সে  তার অবস্থান খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র পাগলরাই সত্যিকার শান্ত থাকতে পারে ।”
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:743c:8667:dec5:697b | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১৭:৫৮740607
  • পল সেলান : মৃত্যুর যৌথসঙ্গীত 
    ভোরের কালো দুধ আমরা সবাই সন্ধ্যায় তা খাই
    আমরা সবাই তা দুপুরে খাই সকালে আমরা তা রাতের বেলায় খাই
    আমরা সবাই খাই আর তা খেতেই থাকি
    আমরা হালকা হাওয়ায়  কবর খুঁড়ি তার ভেতরে একজন কয়েদমুক্ত শুয়ে আছে
    একটা লোক বাড়ির ভেতরে থাকে সে কালসাপেদের সঙ্গে খেলা করে সে লেখে
    সে লেখে যখন সন্ধ্যা নামে জার্মানিতে তোমার সোনালিচুল মার্গারিতে
    সে তা লেখে আর দরোজার বাইরে বেরোয় ঝিলমিলে নক্ষত্রেরা সে শিস দিয়ে তার নেকড়েদের ডাকে
    সে শিস দিয়ে তার ইহুদিদের বাইরে ডাক পাড়ে তাদের দিয়ে একটা কবর খোঁড়ায়
    সে আমাদের ওপর নাচবার হুকুম জারি করে.
    ভোরের কালো দুধ আমরা সবাই রাতের বেলায় তোমায় খাই
    আমরা সবাই সকালে তোমায় খাই দুপুরে তোমায় খাই সূর্যাস্তের সময়ে
    আমরা সবাই খাই আর তোমায় খাই
    একটা লোক বাড়ির ভেতরে থাকে সে কালসাপেদের সঙ্গে খেলা করে সে লেখে
    সে লেখে যখন সন্ধ্যা নামে জার্মানিতে তোমার সোনালি চুল মার্গারেতে
    তোমার ধূসর চুল শুলামিথ আমরা হালকা হাওয়ায়  কবর খুঁড়ি যার ভেতর অনেকখানি জায়গা আছে.
    সে হুমকি দেয় তোরা মাটি খোঁড়  বাকিরা গান শোনা আর খেলা দেখা
    কোমরবেল্টের লোহা ধরে সে ঘোরায় তার চোখদুটো নীল
    তোরা কোদাল দিয়ে আরও গভীর খোঁড় বাদবাকিরা খেলা দেখা আর নাচ
    ভোরের কালো দুধ আমরা সবাই রাতের বেলায় তোমায় খাই
    আমরা সবাই দুপুরে তোমায় খাই সকালে সূর্যাস্তের সময়ে খাই
    আমরা সবাই খাই আর তোমায় খাই
    একটা লোক বাড়ির ভেতরে থাকে তোমার সোনালি চুল মার্গারেতে
    তোমার ধূসর চুল শুলামিথ সেই লোকটা কালসাপেদের সঙ্গে খেলা করে.
    লোকটা আরো মিষ্টি গলায় ডাক দেয় তোরা খেলতে থাক মৃত্যু মৃত্যু জার্মানিই মালিক
    সে আরো ভয়ঙ্কর ডাক পাড়ে এবার তোরা যন্ত্রের তার বাজা ধোঁয়ার মতন উড়ে হাওয়ায় মিশবি
    তারপর মেঘের ভেতরে কবর খুঁজে পাবি সেখানে একজন শুয়ে আছে কয়েদমুক্ত.
    ভোরের কালো দুধ আমরা সবাই রাতের বেলায় তোমায় খাই
    আমরা দুপুরে তোমায় খাই মৃত্যু হলো জার্মানির একজন মালিক
    আমরা সূর্যাস্তে তোমায় খাই আর সকালে খাই আর আমরা সবাই খেতে থাকি
    মৃত্যু জার্মানি থেকে এসেছেন এক প্রভূ তার চোখদুটো নীল
    সে তোমাদের সীসার গুলিতে ঝাঁঝরা করে তার লক্ষ্য অব্যর্থ
    একটা লোক বাড়ির ভেতরে থাকে তোমার সোনালি চুল মার্গারেতে
    সে তার নেকড়েদের আমাদের দিকে লেলিয়ে দিয়ে হাওয়ায় আমাদের কবর উপহার দেয়
    সে কালসাপেদের নিয়ে খেলা করে আর মৃত্যুর দিবাস্বপ্ন দেখে মৃত্যু হলো জার্মানির একজন প্রভূ
    তোমার সোনালি চুল মার্গারিতে
    তোমার ধূসর চুল শুলামিথ
    ( জার্মান ভাষা থেকে মাইকেল হামবার্গার কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে এই কবিতাটা বাংলায় অনুবাদ করেছি। নেটে এই কবিতাটি নিয়ে তর্কাতর্কি থেকে মনে হল যে মাইকেল হামবার্গারের অনুবাদকে অনেকেই মনে করেন মূল জার্মান কবিতাটির সঠিক অনুবাদ )
    যশোধরা : হীরা বাণসোডে
    ( যশোধরা কবিতাটি মারাঠি দলিত মহিলা কবি হীরা বাণসোডে-র কাব্যগ্রন্হ ‘বিষাক্ত রুটি’ থেকে নেয়া )
    ও যশোধরা !
    ব্যাথায় কাতর স্বপ্নের মতন তুমি
    সারা জীবন দুঃখি
    তোমার মুখের দিকে চেয়ে দেখার সাহস নেই আমার
    বুদ্ধের প্রভায় আমরা আলোকিত হয়েছি
    কিন্তু তুমি শুষে নিয়েছিলে অন্ধকার
    এক তুকরো জীবন জ্বলেপুড়ে ছাই
    ও যশোধরা !
    মায়াবি আকাশ তোমার কাছে আশ্রয় চায়
    তোমার উজ্বল অথচ ফলহীন জীবনের দিকে চোখ মেলে
    সহমর্মী নক্ষত্রেরা কেঁদেছিল তোমার জন্য ।
    আমরা মুষড়ে পড়ি
    তোমার অতুলনীয় সৌন্দর্য
    তোমার প্রেমিকের থেকে বিচ্ছিন্ন
    গোধুলীর মতন আবছা ।
    তোমার নিঃশব্দ হাহাকার শুনে
    স্বগীয় আনন্দের প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যা মনে হয় ।
    একটা কথা তুমি আমাকে বলো যশোধরা, কী ভাবে তুমি
    তোমার দুই ছোট্ট হাতে দুর্দম ঝড়কে সামাল দিয়েছিলে ?
    তোমার জীবনের কথাই তো জগতসংসারকে কাঁপায়
    আর ফেনাময় সমুদ্রের ঢেউগুলোকে
    তীরে নিয়ে গিয়ে আছাড় মারে ।
    তোমার হয়তো মনে আছে
    যে-সময়ে তোমার জীবন হারিয়ে যেতে চলেছে
    সিদ্ধার্থের শেষ বিদায়ের চুমু
    তোমার তুলতুলে ঠোঁটে ।
    তুমি কি জানতে পারোনি, হে মানবী,
    হৃদয় ছারকার করে দেয়া আসন্ন আগুনের কথা
    আর ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা
    ওই চুমুর ভয়াবহ ক্ষমতা ?
    বজ্রপাত ঘটে গেল আর তুমি তা জানতেও পারলে না
    উনি এগিয়ে চলেছেন একটি বিশাল শৌর্যযাত্রার পথে
    যেখানে তুমি শূয়ে আছো তা থেকে বহুদূরে….
    উনি চলে গেলেন, উনি জয় করলেন, উনি প্রভায় ভাস্বর ।
    তোমি লোকমুখে ওনার জয়গাথা শুনতে পেতে
    তোমার নাঋইত্ব নিশ্চয় কেঁদেছিল ?
    তুমি, যে নিজের স্বামী ও ছেলেকে হারিয়েছো
    নিজেকে কি শেকড়সুদ্ধ উপড়ে-তোলা মনে করোনি
    কচি কলাগাছের মতন ?
    ইতিহাস কিন্তু
    তোমার আত্মবলিদানের কথা বলে না ।
    সিদ্ধার্থ যদি
    সমাধির ধাঁধার ভেতর দিয়ে যেতেন
    তাহলে তোমার সম্পর্কে মহাকাব্য লেখা হতো !
    পুরাণ আর তালপাতার রচনায় তুমি বিখ্যাত হয়ে উঠতে
    সীতা ও সাবিত্রীর মতন
    ও যশোধরা !
    অমন ন্যায়বিচার আমায় লজ্জা দ্যায়
    কোনো বৌদ্ধবিহারে তোমার কণামাত্র অস্তিত্ব নেই ।
    তোমার কি কোনোই অবদান ছিল না ?
    কিন্তু, শোনো— তুমি কষ্ট পেয়ো না ।
    আমি দেখেছি তোমার সুন্দর মুখশ্রী ।
    সিদ্ধার্থের দুই নিমীলিত চোখে মাঝখানে আছো তুমি ।
    যশো, কেবল তুমি আছো ।
    ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি-র কবিতা ‘ট্রাউজার-পরা এক মেঘ 
    প্রস্তাবনা
    তুমি ভাবলে,
    স্যাঁতসেতে এক মগজের কল্পনায়,
    এক তেলচিটে খাটে হাত-পা-ছড়ানো পেট-মোটা চাকরের মতন,–
    আমার হৃদয়ের রক্তাক্ত ছেঁড়া টুকরো নিয়ে, আমি আবার  ঠাট্টা করব ।
    যতক্ষণ না আমি উপেক্ষিত নই, আমি হবো নিষ্ঠুর আর পীড়াদায়ক ।
    আমার চিত্তে আর দাদুসুলভ স্নেহশীলতা নেই,
    আমার আত্মায় আর ধূসর চুল নেই !
    আমার কন্ঠস্বর দিয়ে জগতকে ঝাঁকিয়ে আর কাষ্ঠহাসি হেসে,
    আমি তোমাদের পাশ দিয়ে চলে যাই, — সৌম্যকান্তি,
    বাইশ বছর বয়সী ।
    সুশীল ভদ্রমহোদয়গণ !
    তোমরা বেহালায় তোমাদের ভালোবাসা বাজাও ।
    অমার্জিতরা তা ঢোলোকে তারস্বরে বাজায় ।
    কিন্তু তোমরা কি নিজেদের অন্তরজগতকে বাইরে আনতে পারো, আমার মতন
    আর কেবল দুটো ঠোঁট হয়ে যেতে পারো পুরোপুরি ?
    এসো আর শেখো–
    তোমরা, দেবদূত-বাহিনীর ফুলবাবু আমলার দল !
    মিহি কাপড়ের বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এসো
    আর তোমরা, যারা তোমাদের ঠোঁট পেতে দিতে পারো
    সেই রাঁধুনীর মতন যে নিজের রান্নার বইয়ের পাতা ওলটায় ।
    যদি তোমরা চাও–
    আমি কাঁচা মাংসের ওপরে চারুশিল্পের শত্রুর মতন লালসিত হবো
    কিংবা সূর্যোদয় যে উদ্রেক ঘটায় তার রঙে পালটে দেবো,
    যদি তোমরা চাও—
    আমি হতে পারি অনিন্দনীয় সুশীল,
    মানুষ নয় — কিন্তু ট্রাউজার-পরা এক মেঘ।
    আমি সুন্দর অঙ্কুরোদ্গমে বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করি !
    তা সত্ত্বেও আমি তোমাদের প্রশংসা করব, —
    পুরুষের দল, হাসপাতালের বিছানার চাদরের মতন কোঁচকানো,
    আর নারীরা, অতিব্যবহৃত প্রবাদের মতন নির্যাতিত । 
    প্রথম পর্ব
    তোমরা কি ভাবছ আমি ম্যালেরিয়ায় ভুল বকছি ?
    তা ঘটেছিল ।
    ওডেসায়, তা ঘটেছিল ।
    “আমি চারটের সময় আসব,” কথা দিয়েছিল মারিয়া ।
    আটটা…
    নয়টা…
    দশটা…
    তারপর তাড়াতাড়ি,
    সন্ধ্যা,
    বিরাগ দেখানো,
    আর ডিসেম্বরসুলভ,
    জানালাগুলো ছেড়ে
    আর ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ।
    আমার পেছন থেকে, আমি শুনতে পাই হ্রেষা আর হাসি
    ঝাড়বাতিগুলোর ।
    তোমরা আমায় চিনতে পারতে না যদি আগে থেকে পরিচিত হতে :
    পেশীতন্তুর স্তুপ
    গোঙানি,
    স্নায়বিক অস্হিরতা ।
    এরকম একজন বোকাটে কি চাইতে পারে ?
    কিন্তু একজন বোকাটে অনেক কিছু চায় ।
    কেননা নিজের জন্য তা অর্থহীন
    তা তোমরা তামায় গড়া হও
    কিংবা হৃদয় হোক শীতল ধাতুর ।
    রাতের বেলায়, তোমাদের দাবিকে জড়িয়ে নিতে চাইবে
    মেয়েলি কোনোকিছু দিয়ে,
    কোমল ।
    আর এইভাবে,
    বিশাল,
    আমি কাঠামোর ভেতরে প্রতিষ্ঠিত হই.
    আর আমার কপাল দিয়ে, গলিয়ে ফেলি জানালার কাচ ।
    এই ভালোবাসা কি অসাধারণ হবে নাকি গতানুগতিক ?
    তা কি বজায় থাকবে নাকি উপেক্ষিত হবে ?
    বিরাট কেউ এরকম দেহে আঁটবে না :
    একটু ভালোবাসা জরুরি, — একটা শিশু, হয়তো,
    যখন মোটরগাড়ি হর্ন বাজায় আর আওয়াজ করে তখন এ ভয় পায়,
    কিন্তু ঘোড়ায়-টানা ট্র্যামের ঘণ্টি পছন্দ করে ।
    আমি মুখোমুখি হলুম
    তরঙ্গায়িত বৃষ্টির সঙ্গে,
    তবু আরেকবার,
    আচ্ছা অপেক্ষা করো
    শহুরে ফেনার বজ্রপাতের গর্জনে ভিজে গেলুম ।
    ছুরি নিয়ে পাগলের মতন বাইরে বেরিয়ে,
    রাত ওকে ধরে ফেললো
    আর ছুরি মেরে দিলো,
    কেউ দেখেনি ।
    ঠিক মধ্যরাতে
    গিলোটিন থেকে খসা মুণ্ডুর মতন পড়ে গেলো।
    জানালার কাচে রুপোর বৃষ্টিফোঁটা
    জমিয়ে তুলছিল মুখবিকৃতি
    আর চেঁচাচ্ছিল ।
    যেন নত্রে দামের পশুমুখো নর্দমাগুলো
    চেল্লানো আরম্ভ করে দিলো ।
    ধিক্কার তোমাদের !
    যা ঘটেছে তাতে কি তোমরা এখনও সন্তুষ্ট নও ?
    কান্না এবার চারিধার থেকে আমার গলা কাটবে।
    আমি শুনতে পেলুম:
    আস্তে,
    বিছানার বাইরে রোগীর মতন,
    একটা স্নায়ু লাফালো
    নীচে ।
    প্রথমে,
    পুরুষটা সরে যায়নি, প্রায় ।
    তারপর, সন্দিগ্ধ
    আর সুস্পষ্ট,
    ও লাফাতে আরম্ভ করলো।
    আর এখন, ও আর আরও দুই জন,
    এদিক-ওদিক লাফাতে লাগলো, তিড়িঙ নাচ ।
    একতলায়, পলেস্তারা তাড়াতাড়ি খসে পড়ছিল ।
    স্নায়ুরা,
    বড়োগুলো
    ছোটোগুলো,–
    নানান ! —
    পাগলের মতন টগবগাতে আরম্ভ করলো
    যতক্ষণ না, শেষে,
    ওদের পা ওদের টানতে অক্ষম হলো ।
    ঘর থেকে রাত টপটপ করে বেরিয়ে এলো আর ডুবে গেলো।
    চটচটে মাটিতে আটকে গিয়ে, চোখ তা থেকে পিছলে বের করতে পারলো না।
    হঠাৎ দরোজাগুলো দুমদাম করতে লাগলো
    যেন হোটেলের দাঁতগুলো কিড়মিড় করতে শুরু করেছে ।
    তুমি প্রবেশ করলে,
    আচমকা যেন “এই নাও !”
    সোয়েড চামড়ার মোচড়ানো দস্তানা পরে, তুমি অপেক্ষা করলে,
    আর বললে,
    “তুমি জানো,–
    আমার শিগগির বিয়ে হবে।”
    তাহলে যাও বিয়ে করো ।
    ঠিকই আছে,
    আমি সামলে নিতে পারবো ।
    দেখতেই পাচ্ছো — আমি শান্ত, নিঃসন্দেহে !
    কোনো শবের
    নাড়ির স্পন্দনের মতন ।
    মনে আছে ?
    তুমি বলতে :
    “জ্যাক লণ্ডন,
    টাকাকড়ি,
    ভালোবাসা আর আকুলতা,”–
    আমি কেবল একটা ব্যাপারই দেখেছি :
    তুমি ছিলে মোনালিসা,
    যাকে চুরি করা জরুরি ছিল !
    আর কেউ তোমায় চুরি করে নিলো ।
    ভালোবাসায় আবার, আমি জুয়া খেলা আরম্ভ করব,
    আমার ভ্রুর তোরণ আগুনে উদ্ভাসিত ।
    আর কেনই বা নয় ?
    অনেক সময়ে গৃহহীন ভবঘুরেরা
    পোড়া বাড়িতেও আশ্রয় খোঁজে !
    তুমি আমাকে ঠাট্টা করছো ?
    “উন্মাদনার কেবল গুটিকয় চুনী আছে তোমার
    ভিখারির কয়েক পয়সার তুলনায়, একে ভুল প্রমাণ করা যাবে না !”
    কিন্তু মনে রেখো
    এইভাবেই পম্পেইয়ের শেষ হয়েছিল
    যখন কেউ ভিসুভিয়াসের সঙ্গে ইয়ার্কি করেছিল !
    ওহে !
    ভদ্রমহোদয়গণ !
    তোমরা অশুচি
    নিয়ে চিন্তা করো,
    অপরাধ
    আর যুদ্ধ ।
    কিন্তু তোমরা কি দেখেছো
    ভয়ঙ্কর সন্ত্রস্ত
    আমার মুখ
    যখন
    তা
    নিখুঁত শান্তিময়তায় থাকে ?
    আর আমি অনুভব করি
    “আমি”
    আমাকে ধরে রাখার জন্য খুবই ক্ষুদ্র ।
    আমার অন্তরে কেউ কন্ঠরুদ্ধ হচ্ছে ।
    হ্যালো !
    কে কথা বলছে ?
    মা ?
    মা !
    তোমার ছেলের হয়েছে এক অত্যাশ্চর্য অসুখ !
    মা !
    ওর হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে !
    তার বোন, লিডিয়া আর ওলগাকে বোলো
    যে আর কোথাও কোনো লুকোবার জায়গা নেই ।
    প্রতিটি শব্দ,
    মজার হোক বা অভদ্র,
    যা ও নিজের জ্বলন্ত মুখ থেকে ওগরায়,
    উলঙ্গ বেশ্যার মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে
    জ্বলন্ত বেশ্যালয় থেকে ।
    লোকেরা গন্ধ শোঁকে–
    কোনো কিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ।
    ওরা দমকলকে ডাকে ।
    ঝলমলে হেলমেট পরে
    তারা অবহেলাভরে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে ।
    ওহে, দমকলের লোকদের বলো :
    বুটজুতো পরে ঢোকার অনুমতি নেই !
    গনগনে হৃদয় নিয়ে একজনকে বিচক্ষণ হতে হবে ।
    আমিই তা করব !
    আমি আমার জলভরা চোখ ঢেলে দেবো চৌবাচ্চায় ।
    আমাকে কেবল আমার পাঁজরকে ঠেলতে দাও আর আমি আরম্ভ করে দেবো।
    আমি লাফিয়ে পড়বো ! তোমরা আমাকে বাধা দিতে পারবে না !
    তারা বিদ্ধস্ত ।
    তোমরা হৃদয় থেকে লাফিয়ে পড়তে পারবে না !
    ঠোঁটের ফাটল থেকে,
    এক অঙ্গার-আস্তৃত চুমু উৎসারিত হয়,
    জ্বলন্ত মুখাবয়ব থেকে পালিয়ে যায় ।
    মা !
    আমি গান গাইতে পারি না ।
    হৃদয়ের প্রার্থনাঘরে, আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল গায়কদের গায়ে !
    শব্দাবলী আর সংখ্যাসমূহের প্রতিমাদের
    খুলির ভেতর থেকে,
    জ্বলন্ত বাড়ি থেকে শিশুদের মতন, পালাতে থাকে ।
    এইভাবে ভয়,
    আকাশে পৌঁছে, ডাক দেয়
    আর তুলে ধরে
    লুসিতানিয়ার আগুনে-বাহু আর উদ্বেগ ।
    শত-চোখ আগুন শান্তির দিকে তাকালো
    ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে, যেখানে লোকেরা ঘামছিল ।
    এক শেষতম চিৎকারে,
    তুমি কি গোঙাবে, অন্তত,
    শতাব্দীগুলোকে প্রতিবেদন দেবার জন্য যে আমি অগ্নিদগ্ধ ? 
    দ্বিতীয় পর্ব
    আমার মহিমাকীর্তন করো !
    প্রসিদ্ধরা কেউ আমার সমকক্ষ নয় !
    যাকিছু এপর্যন্ত করা হয়েছে তার ওপরে
    আমি ছাপ মেরে দিই “নস্যাৎ।”
    আপাতত, আমার পড়ার ইচ্ছে নেই।
    উপন্যাস ?
    তাতে কি !
    বইপত্র এইভাবে তৈরি হয়,
    আমি ভাবতুম :–
    একজন কবির আগমন হয়,
    আর নিজের ঠোঁট অনায়াসে খোলে।
    অনুপ্রাণিত, মূর্খটা বেমালুম গাইতে আরম্ভ করে–
    ওহ ক্ষান্তি দাও !
    দেখা গেলো :
    উৎসাহে গাইবার আগে,
    নিজেদের কড়া-পড়া পায়ে ওরা কিছুক্ষণ তাল ঠোকে,
    যখন কিনা কল্পনার ঘিলুহীন মাছেরা
    হৃদয়ের পাঁকে কাদা ছেটায় আর মাখামাখি করে ।
    আর যখন, ছন্দে হিসহিসোচ্ছে, ওরা গরম জলে সেদ্ধ করে
    যাবতীয় ভালোবাসা আর পাপিয়া-পাখিদের ক্বাথের মতন ঝোলে,
    জিভহীন পথ কেবল কিলবিল করে আর কুণ্ডলী পাকায়—
    তাতে আর্তনাদ করার বা এমনকি বলার মতো কিছুই থাকে না ।
    আমরা নিজের গর্ববশে, সারাদিন সৎমেজাজে কাজ করি
    আর ব্যাবেলের শহর-মিনারগুলোর আবার পুনরানয়ন হয় ।
    কিন্তু ঈশ্বর
    গুঁড়িয়ে
    এই শহরগুলোকে ফাঁকা মাঠে পালটে ফ্যালেন,
    শব্দকে মন্হন করে ।
    নৈঃশব্দে, রাস্তাকে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় দুর্দশায়।
    গ্রাসনলিকার পথে এক চিৎকার ঋজু দাঁড়িয়ে পড়ে।
    যখন মোটাসোটা ট্যাক্সি আর মোটরগাড়ি অন্তরায়ে স্হির,
    গলার ভেতরে আটকে থাকে ।
    যেন ক্ষয়রোগের কারণে,
    নিষ্পিষ্ট বুক শ্বাস নেবার জন্য খাবি খাচ্ছিল ।
    শহর, বিষাদে আক্রান্ত, তাড়াতাড়ি রাস্তা বন্ধ করে দিলো ।
    আর তখন–
    তা সত্ত্বেও !–
    রাস্তাটা চৌমাথার মোড়ে নিজের ধকল উগরে দিলো কেশে
    আর গলা থেকে বারান্দাকে ঠেলে বের করে দিলো, শেষ পর্যন্ত,
    মনে হলো যেন,
    শ্রেষ্ঠশ্রেনির দেবদূতের গায়কদলের ধুয়ায় যোগ দিয়ে,
    সাম্প্রতিককালে লুন্ঠিত, ঈশ্বর তার তাপ আমাদের দেখাবে !
    কিন্তু রাস্তাটা উবু হয়ে বসে কর্কশকন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো :
    “খেতে যেতে দাও !”
    শিল্পপতি ক্রুপ আর তার আণ্ডাবাচ্চারা ঘিরে ধরে
    শহরে চোখরাঙানো ভ্রু আঁকার জন্য,
    যখন কিনা সঙ্কীর্ণ প্রবেশপথে
    শব্দাবলীর লাশ এদিক-ওদিক ছড়ানো পড়ে থাকে,–
    দুটো বেঁচে থাকে আর মাথাচাড়া দ্যায়,–
    “শুয়োর”
    আর অন্যটা,–
    আমার মনে হয় “খাবার সুপ” ।
    আর কবির দল, ফোঁপানি আর নালিশে ভিজে সপসপে,
    রাস্তা থেকে দৌড় লাগায়, বিরক্ত আর খিটখিটে :
    “ওই দুটো শব্দ দিয়ে এখন আর ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়
    এক সুন্দরী রমণী
    কিংবা ভালোবাসা
    কিংবা শিশির-ঢাকা ফুল।”
    আর কবিদের পর,
    অন্যান্য হাজার লোকের হুড়োহুড়ি আরম্ভ হলো :
    ছাত্রছাত্রীর দল,
    বেশ্যার দল,
    বিক্রেতার দল ।
    ভদ্রমহোদয়গণ,
    থামুন !
    আপনারা তো অভাবগ্রস্ত নন ;
    তাহলে ভদ্রমহোদয়গণ কেন আপনারা ওগুলো চাইছেন !
    প্রতিটি পদক্ষেপে দালান অতিক্রম করে,
    আমরা স্বাস্হ্যবান আর অত্যুৎসাহী !
    ওদের কথা শুনবেন না, বরং ওদের পিটুনি দিন !
    ওদের,
    যারা মাঙনার বাড়তি হিসাবে সেঁটে রয়েছে
    প্রতিটি রাজন্য-বিছানায় !
    আমাদের কি নম্রভাবে ওদের জিগ্যেস করতে হবে :
    “সাহায্য করো, দয়া করে !”
    স্তবগানের জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করতে হবে
    আর বাগ্মীতার জন্য ?
    আমরা জ্বলন্ত স্তবগানের সৃষ্টিকারী
    কলমিল আর রসায়ানাগারের গুনগুনানির পাশাপাশি ।
    আমি কেন ফাউস্তের কথা ভাবতে যাবো ?
    আতশবাজির লুন্ঠনে পরীদের প্রদর্শন করে
    ও মেফিসটোফিলিসের সঙ্গে নক্ষত্রপূঞ্জের নকশাকাটা পাটাতনে পিছলে চলেছে !
    আমি জানি —
    আমার বুটজুতোয় একটা পেরেক
    গ্যেটের কল্পনার চেয়ে বেশি ভয়াবহ !
    আমি
    সবচেয়ে সোনালী-হাঁমুখের
    প্রতিটি শব্দের সঙ্গে আমি দিচ্ছি
    দেহের এক নামদিবস,
    আর আত্মাকে এক পূনর্জন্ম,
    আমি তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি :
    জীবজগতের কণাও
    আমি এই পৃথিবীতে যা কিছু করব তার চেয়ে অনেক বেশি !
    শোনো !
    বর্তমান যুগের জরাথুষ্ট্র,
    ঘামে ভিজে,
    তোমাদের চারিপাশে দৌড়োচ্ছে আর এখানে ধর্মপ্রচার করছে ।
    আমরা,
    বিছানার কোঁচকানো চাদরের মতন মুখ নিয়ে,
    ঝাড়লন্ঠনের মতন ঝোলা ঠোঁটে,
    আমরা,
    কুষ্ঠরোগীর জন্য নির্দিষ্ট শহরে বন্দী,
    যেখানে, জঞ্জাল আর সোনা থেকে, কুষ্ঠরোগীদের ঘা দেখা দিয়েছিল,
    আমরা ভেনিসের নীলাভ সমুদ্রের চেয়ে পবিত্র,
    রোদ্দুরের মলম-রশ্মিতে ধোয়া ।
    আমি সেই তথ্যে থুতু ফেলি
    যে হোমার আর ওভিদ সৃষ্টি করেননি
    গুটিবসন্তে ঢাকা ঝুল,
    আমাদের মতন সব মানুষদের,
    কিন্তু সেই সঙ্গে, আমি জানি যে
    সূর্য ফ্যাকাশে হয়ে যাবে
    যদি তা আমাদের আত্মার সোনালি খেতের দিকে তাকায়।
    প্রার্থনার তুলনায় পেশী আমাদের কাছে নির্বিকল্প !
    আমরা আর ভরতুকির জন্য প্রার্থনা করব না !
    আমরা–
    আমরা প্রত্যেকে–
    নিজেদের মুঠোয় ধরে রাখি
    জগতকে চালনা করার লাগাম !
    এ-থেকেই সভাস্হলগুলোয় গোলগোথার সূত্রপাত
    পেট্রোগ্রাড, মসকো, কিয়েভ, ওডেসায়,
    আর তোমাদের একজনও সেখানে ছিলে না যারা
    এইভাবে হাঁক পাড়ছিল না :
    “ওকে ক্রুসবিদ্ধ করো !
    ওকে উচিত শিক্ষা দাও !”
    কিন্তু আমার কাছে,–
    জনগণ,
    এমনকি তোমরা যারা জঘন্য ব্যবহার করেছ,–
    আমার কাছে, তোমরা প্রিয় আর আমি গভীরভাবে তোমাদের কদর করি।
    দেখোনি কি
    যে হাত তাকে পেটাচ্ছে সেই হাতকেই কুকুরটা চাটছে ?
    আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে
    আজকালকার দলবল ।
    তারা তৈরি করেছে
    আমাকে নিয়ে
    একটা নোংরা পরিহাস ।
    কিন্তু আমি সময়ের পাহাড়কে ডিঙিয়ে দেখতে পাই,
    ওনাকে, যাঁকে কেউ দেখতে পায় না ।
    যেখানে মানুষের দৃষ্টিশক্তি পৌঁছোয় না,
    বিপ্লবের কাঁটার মুকুট পরে,
    ক্ষুধার্ত মানুষদের নেতৃত্ব দিয়ে,
    ১৯১৬ সাল ফিরে আসছে ।
    তোমাদের মধ্যে, ওনার অগ্রদূত,
    যেখানেই দুঃখকষ্ট থাকবে, আমি থাকবো কাছাকাছি ।
    আমি সেখানে নিজেকে ক্রুশবিদ্ধ করেছি,
    প্রতিটি অশ্রুফোঁটার ওপরে ।
    ক্ষমা করার মতন এখন আর কিছু নেই !
    যে আত্মারা সমবেদনার অঙ্কুরের জন্ম দেয়, আমি পুড়িয়ে দিয়েছি তার ক্ষেত ।
    তা অনেক কঠিন
    হাজার হাজার ব্যাষ্টিল আক্রমণের তুলনায় ।
    আর যখন
    তাঁর আবির্ভাব ঘোষিত হয়,
    আনন্দে আর গর্বে,
    তোমরা এগিয়ে যাবে উদ্ধারককে অভ্যর্থনা জানাতে–
    আমি টেনে নিয়ে যাবে
    বাইরে আমার আত্মাকে,
    আর পায়ে পিষবো
    যতক্ষণ না তা ছড়িয়ে পড়ছে !
    আর তোমাদের হাতে তুলে দেবো, রক্তে লাল, পতাকা হিসাবে ।
     
    তৃতীয় পর্ব
    আহ, কেমন করে আর কোথা থেকে
    ব্যাপারটা এই পরিণতিতে পৌঁছেছে যে
    উন্মাদনার নোংরা মুঠোগুলো
    আলোকময় আনন্দের বিরুদ্ধে বাতাসে তুলে ধরা হয়েছিল ?
    মেয়েটি এলো,–
    পাগলাগারদের চিন্তায়
    আর আমার মাথা ঢেকে দিলো বিষণ্ণতায় ।
    আর যেমন ড্রেডনট যুদ্ধজাহাজের ধ্বংসের বেলায়
    কন্ঠরুদ্ধ অঙ্গবিক্ষেপে
    সেনারা আধখোলা দরোজার ভেতরে লাফিয়ে পড়েছিল, জাহাজডুবির আগে,
    ভবিষ্যবাদী কবি বারলিয়ুক হামাগুড়ি দিয়ে এগোল, পেরিয়ে গেল
    তাঁর চোখের চিৎকাররত ফাঁক দিয়ে ।
    তাঁর চোখের পাতাকে প্রায় রক্তাক্ত করে,
    উনি দেখা দিলেন হাঁটু গেড়ে,
    উঠে দাঁড়ালেন আর হাঁটতে লাগলেন
    আর উত্তেজিত মেজাজে,
    কোমলভাবে, অমন মোটা একজনের কাছে অপ্রত্যাশিত,
    উনি কেবল বললেন :
    “ভালো !”
    ব্যাপারটা ভালোই যখন পর্যবেক্ষণে এক হলুদ সোয়েটার
    আত্মাকে লুকিয়ে রাখে !
    ব্যাপারটা ভালোই যখন
    ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে, আতঙ্কের মুখোমুখি,
    তুমি চেঁচিয়ে বলো :
    “কোকো খাও — ভ্যান হুটেন কোম্পানির !”
    এই মুহূর্ত,
    বাংলার আলোর মতন,
    বিস্ফোরণে ঝলসে,
    আমি কিছুর সঙ্গেই অদলবদল করব না,
    কোনো টাকাকড়ির জন্যও নয় ।
    চুরুটের ধোঁয়ায় মেঘাচ্ছন্ন,
    আর মদের গেলাসের মতন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত,
    যে কেউ কবি সেভেরিয়ানিন-এর মতো মাতাল-মুখো হতে পারে ।
    কোন সাহসে তুমি নিজেকে কবি বলো
    আর ধূসর, তিতির-পাখির মতন, নিজের আত্মাকে কিচিরমিচিরে ডুবিয়ে দাও !
    তখন
    পেতলের বাঘনখ দিয়ে
    ঠিক এই মুহূর্তে
    জগতের খুলিকে তোমায় চিরে ফেলতে হবে !
    তুমি,
    মাথায় শুধু একটিমাত্র ভাবনা নিয়ে,
    “আমি কি শৈলী অনুযায়ী নাচছি ?”
    দ্যাখো আমি কতো আনন্দিত
    তার বদলে,
    আমি,–
    সদাসর্বদা একজন ভেড়ুয়া আর জোচ্চোর ।
    তোমাদের সবার কাছ থেকে,
    যারা মামুলি মজার জন্য ভালোবাসায় ভিজেছো,
    যারা ছিটিয়েছো
    শতকগুলোতে অশ্রুজল, যখন তোমরা কাঁদছিলে,
    আমি বেরিয়ে চলে যাবো
    আর সূর্যের একচোখ চশমাকে বসাবো
    আমার বড়ো করে খোলা, একদৃষ্ট চোখে ।
    আমি রঙিন পোশাক পরব, সবচেয়ে অস্বাভাবিক
    আর পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াবো
    জনগণকে খুশি দিতে আর তাতিয়ে তুলতে,
    আর আমার সামনে
    এক ধাতব দড়িতে গলাবাঁধা,
    ছোটো কুকুরবাচ্চার মতন দৌড়োবে নেপোলিয়ান ।
    একজন নারীর মতন, শিহরিত, পৃথিবী শুয়ে পড়বে,
    আত্মসমর্পণ করতে চেয়ে, মেয়েটি ধীরে-ধীরে অবনত হবে ।
    জীবন্ত হয়ে উঠবে সবকিছু
    আর চারিদিক থেকে,
    ওদের ঠোঁট তোতলা কথা বলবে :
    “য়াম-য়াম-য়াম-য়াম !”
    হঠাৎ,
    মেঘের দল
    আর বাতাসে অন্যান্য ব্যাপার
    আশ্চর্য কোনো উত্তেজনায় আলোড়িত,
    যেন শাদা-পোশাকে শ্রমিকদল, ওপরে ওইখানে,
    হরতাল ঘোষণা করেছে, সবাই তিক্ত আর আবেগে আক্রান্ত ।
    বর্বর বজ্র মেঘের ফাটল থেকে উঁকি দিলো, ক্রুদ্ধ ।
    নাকের বিশাল ফুটো থেকে ঘোড়ার ডাক দিয়ে, গর্জন করলো
    আর এক মুহূর্তের জন্যে, আকাশের মুখ তেবড়ে বেঁকে গেলো,
    লৌহ বিসমার্কের ভেঙচির মতন ।
    আর কেউ একজন,
    মেঘের গোলকধাঁধায় জড়িয়ে,
    কফিপানের রেস্তরাঁর দিকে, হাত বাড়িয়ে দিলো এখন :
    দুটিই, কোমলতর,
    আর নারীমুখ নিয়ে
    আর একই সঙ্গে, কামান দাগার মতন ।
    তুমি কি ভাবছো
    ওটা চিলেকোঠার ওপরে সূর্য
    কফিপানের রেস্তরারাঁকে আলতো আদর করতে চাইছে ?
    না, আবার এগিয়ে আসছে সংস্কারকামীদের কচুকাটা করতে
    উনি জেনেরাল গালিফেৎ !
    ভবঘুরের দল, পকেট থেকে হাত বের করে নাও–
    বোমা তুলে নাও, ছুরি কিংবা একটা পাথর
    আর কেউ যদি লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে ছুঁড়তে না পারে
    তাহলে সে চলে আসুক কেবল নিজের কপাল দিয়ে লড়তে !
    এগিয়ে যাও, ক্ষুধার্ত,
    গোলামের দল,
    আর নির্যাতিতরা,
    এই মাছি ভনভনে জঞ্জালে, পোচো না !
    এগিয়ে যাও !
    আমরা সোমবারগুলো আর মঙ্গলবারগুলোকে
    ছুটির দিনে পালটে দেবো, তাদের রাঙিয়ে দেবো রক্তে !
    পৃথিবীকে মনে করিয়া দাও তাকে আমি হীন প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলুম !
    রূঢ় হও !
    পৃথিবী
    রক্ষিতার মুখের মতন ফুলে উঠেছে,
    যাকে রথসচাইল্ড বেশি-বেশি ভালোবেসেছিল !
    গুলির আগুনের বরাবর পতাকাগুলো উড়ুক
    যেমন ওরা ছুটির দিনে করে, জাঁকজমকসহ !
    ওহে, রাস্তার লন্ঠনেরা, পণ্যজীবীদের আরও ওপরে তোলো,
    ওদের মড়াগুলোকে হাওয়ায় ঝুলতে দাও ।
    আমি অভিশাপ দিলুম,
    ছুরি মারলুম
    আর মুখে ঘুষি মারলুম,
    কারোর পেছনে হামাগুড়ি দিলুম,
    তাদের পাঁজর কামড়ে ধরে ।
    আকাশে, লা মারসেইলিজ-এর মতন লাল,
    সূর্যাস্ত তার কম্পিত ঠোঁটে মরণশ্বাস তুলছিল ।
    এটা মানসিক বিকার !
    যুদ্ধ থেকে কোনো কিছুই বাঁচবে না ।
    রাত এসে পড়বে,
    কামড়ে ধরবে তোমাকে
    আর বাসিই গিলে ফেলবে তোমাকে ।
    দ্যাখো–
    আকাশ আরেকবার জুডাস-এর ভূমিকায়,
    একমুঠো নক্ষত্র নিয়ে কাদের বিশ্বাসঘাতকতায় চোবানো হয়েছিল?
    এই রাত
    তাতার যুদ্ধবাজ মামাই-এর মতন, আহ্লাদে পানোৎসব করে,
    উত্তাপে দগ্ধ করে দিলো শহরকে ।
    আমাদের চোখ এই রাতকে ভেদ করতে পারবে না,
    দুই পক্ষের চর আজেফ-এর মতন কালো !
    শুঁড়ির আসরে চুপচাপ এক কোণে হেলান দিয়ে, আমি বসে থাকি,
    আমার আত্মায় আর মেঝেতে মদ চলকে পড়ে,
    আর আমি দেখি :
    কোনের দিকে, গোল চোখের প্রভা
    আর তাদের সঙ্গে, ম্যাডোনা চেবাচ্ছে হৃদয়ের কেন্দ্র  ।
    এরকম মাতাল ভিড়ে অমন আনন্দবিচ্ছুরণ প্রদান করা কেন ?
    ওদের কিই বা দেবার আছে ?
    তোমরা দেখতে পাচ্ছ — আরেকবার,
    ওরা কেন বারাব্বাসকে পছন্দ করে
    গোলগোথার মানুষটির তুলনায় ?
    হয়তো, ভেবেচিন্তে,
    মানবিক ভানে, কেবল একবার নয়
    আমি কি তরতাজা মুখ পরে থাকবো ।
    আমি, হয়তো,
    তোমার ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে সৌম্যকান্তি
    সম্পূর্ণ মানবজাতিতে ।
    ওদের দিয়ে দাও,
    যারা আহ্লাদে ডগমগ,
    এক দ্রুত মৃত্যু,
    যাতে ওদের ছেলেপুলেরা ভালোভাবে গড়ে ওঠে ;
    ছেলেরা — পিতা হিসাবে
    মেয়েরা — গর্ভবতী নারী হিসাবে ।
    সেই জ্ঞানী মানুষদের মতন, নব্যপ্রসূতদের
    অন্তর্দৃষ্টি আর ভাবনাচিন্তায় ধূসর হয়ে উঠতে দাও
    আর ওরা আসবে
    শিশুদের নামকরণের অনুষ্ঠানে
    যে কবিতাগুলো আমি লিখেছি, তাদের।
    আমি যন্ত্রপাতি আর ব্রিটেনের শিল্পের গুণগান করি ।
    কোনো মামুলি, সার্বজনিক ধর্মোপদেশে,
    হয়তো লেখা হয়ে থাকতে পারে
    যে আমিই ত্রয়োদশতম দূত ।
    আর যখন আমার কন্ঠস্বর তারস্বরে ঘোষণা করবে,
    প্রতি সন্ধ্যায়,
    ঘণ্টার পর ঘণ্টা,
    আমার আহ্বানের অপেক্ষায়
    যিশুখ্রিস্ট, নিজে, হয়তো ঘ্রাণ নেবেন
    আমার আত্মার ফরগেট-মি-নট গুল্মের ।
     
    চতুর্থ পর্ব
    মারিয়া ! মারিয়া !
    ভেতরে আসতে দাও, মারিয়া !
    আমাকে রাস্তায় ফেলে যেও না !
    তুমি অমন করতে পারো ?
    আমার গাল চুপসে গেছে,
    অথচ তুমি নিষ্ঠুরভাবে অপেক্ষা করাও ।
    তাড়াতাড়ি, সবায়ের দ্বারা পরীক্ষিত,
    বাসি আর বিবর্ণ,
    আমি চলে আসবো
    আর বিনা দাঁতে তোতলাবো
    যে আজকে আমি
    “সাতিশয় অকপট।”
    মারিয়া,
    চেয়ে দ্যাখো–
    আমার কাঁধ দুটো আবার ঝুলে পড়ছে ।
    রাস্তায়, লোকেরা
    তাদের চার-তলা পেটের চর্বিতে আঙুল বোলায়।
    ওরা চোখ দেখায়,
    চল্লিশ বছরের অবসাদে ক্ষয়িত, আর অস্হির—
    ওরা চাপা হাসি হাসে কেননা
    আমার দাঁতে,
    আবারও,
    আমি গত রাতের আদরগুলোর শক্ত-হয়ে-যাওয়া ধৃষ্টতা কামড়ে ধরে রেখেছি ।
    বৃষ্টি ফুটপাথের ওপরে কেঁদে ফেললো,–
    ও তো জমা-জলে কারারুদ্ধ জোচ্চোর ।
    রাস্তার লাশ, পাথরবাঁধানো পাথরের পিটুনি খেয়ে, নিজের কান্নায় ভিজে গেলো।
    কিন্তু ধূসর চোখের পাতাগুলো–
    হ্যাঁ !–
    ঝুলন্ত বরফের চোখের পাতা হয়ে উঠলো জমাট
    তাদের চোখ থেকে ঝরা অশ্রুজলে–
    হ্যাঁ !–
    ড্রেনপাইপগুলোর বিষাদভারাতুর চোখ থেকে ।
    প্রতিটি পথচারীকে চাটছিল বৃষ্টির শুঁড় :
    পথের গাড়িগুলোয় ঝিকমিক করছিল খেলোয়াড়ের দল ।
    ফেটে পড়ছিল জনগণ
    গাদাগাদি ভরা,
    আর তাদের চর্বি উথলে উঠছিল ।
    ঘোলাটে এক নদীর মতন, মাটিতে স্রোত গড়ে উঠেছিল,
    তাতে মিশেছিল
    বাসি মাংসের রস ।
    মারিয়া !
    কেমন করে আমি কোমল শব্দকে স্ফীত কানে আঁটাবো ?
    একটা পাখি
    ভিক্ষার জন্য গান গায়
    ক্ষুধার্ত কন্ঠস্বরে
    বরং ভালো,
    কিন্তু আমি একজন মানুষ,
    মারিয়া,
    আমি তো প্রেসনিয়ার নোংরা তালুতে অসুস্হ রাতের কাশি ।
    মারিয়া, তুমি কি আমাকে চাও ?
    মারিয়া, আমাকে গ্রহণ করো, দয়া করো ।
    কাঁপা আঙুলে আমি গির্জার ঘণ্টার লোহার গলা টিপে ধরবো !
    মারিয়া !
    রাস্তার চারণভূমিগুলো বুনো আর দর্শনীয় হয়ে গেছে !
    ওরা আমার গলা টিপে ধরেছে আর আমি প্রায় অজ্ঞান হতে চলেছি।
    খোলো !
    আমি আহত !
    দ্যাখো — আমার চোখ খুবলে নেয়া হয়েছে
    মেয়েদের টুপির আলপিন দিয়ে !
    তুমি দরোজা খুলে দিলে ।
    আমার খুকি !
    ওহ, ভয় পেও না !
    এই মহিলাদের দেখছো,
    আমার গলায় পাহাড়ের মতন ঝুলে রয়েছে,–
    জীবনভর, নিজের সঙ্গে টেনে নিয়ে যাই
    কয়েক কোটি, প্রচুর, বিশাল, বিশুদ্ধ ভালোবাসাদের
    আর কোটি কোটি নোংরা, বিদকুটে ভাড়াপ্রেমিকাদের ।
    ভয় পেও না
    যদি সততার
    প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হয়,
    হাজার সুন্দরী মুখ দেখে, আমি নিজেকে তাদের দিকে ছুঁড়ে দেবো–
    “ওরা, যারা মায়াকভস্কিকে ভালোবাসে !”
    দয়া করে বোঝো যে ওটাও হল
    রানিদের বংশ, যারা একজন উন্মাদ মানুষের হৃদয়ে সওয়ার হয়েছে ।
    মারিয়া, কাছে এসো !
    নগ্ন আর লজ্জাহীন হও,
    কিংবা আতঙ্কে শিহরিত,
    তোমার ঠোঁটের বিস্ময়কে সমর্পণ করো, কতো নরম :
    আমার হৃদয় আর আমি কখনও মে মাসের আগে পর্যন্ত থাকিনি,
    কিন্তু অতীতে,
    শত শত এপ্রিল মাস জড়ো হয়েছে ।
    মারিয়া !
    একজন কবি সারা দিন কল্পিত সুন্দরীর বন্দনায় গান গায়,
    কিন্তু আমি–
    আমি রক্তমাংসে গড়া,
    আমি একজন মানুষ —
    আমি তোমার দেহ চাই,
    খ্রিস্টধর্মীরা যেমন প্রার্থনা করে :
    “এই দিনটা আমাকে দাও
    আমাদের প্রতিদিনের রুটি।”
    মারিয়া, আমাকে দাও !
    মারিয়া !
    আমি ভয় পাই তোমার নাম ভুলে যাবো
    চাপে পড়ে কবি যেমন শব্দ ভুলে যায়
    একটি শব্দ
    সে অস্হির রাতে কল্পনা করেছিল,
    ঈশ্বরের সমান যার প্রভাব ।
    তোমার দেহকে
    আমি ভালোবেসে যাবো আর তত্বাবধান করবো
    যেমন একজন সৈনিক
    যুদ্ধে যার পা কাটা গেছে,
    একা
    আর-কেউ তাকে চায় না,
    অন্য পা-কে সে সস্নেহে যত্ন করে ।
    মারিয়া,–
    তুমি কি আমাকে নেবে না ?
    নেবে না তুমি !
    হাঃ !
    তাহলে অন্ধকারময় আর বেদনাদায়ক,
    আরেকবার,
    আমি বয়ে নিয়ে যাবো
    আমার অশ্রু-কলঙ্কিত হৃদয়
    এগোবো,
    কুকুরের মতন,
    খোঁড়াতে খোঁড়াতে,
    থাবা বইতে থাকে সে
    যার ওপর দিয়ে দ্রুতগতি রেলগাড়ি চলে গেছে।
    হৃদয় থেকে রক্ত ঝরিয়ে আমি যে রাস্তায় ঘুরে বেড়াই তাকে উৎসাহ দেবো,
    আমার জ্যাকেটে ফুলের গুচ্ছ ঝুলে থাকে,  ধূসরিত করে,
    সূর্য পৃথিবীর চারিধারে হাজার বার নাচবে,
    স্যালোম-এর মতন
    ব্যাপটিস্টের মুণ্ডু ঘিরে যে নেচে ছিল ।
    আর যখন আমার বছরগুলো, একেবারে শেষে,
    তাদের নাচ শেষ করবে আর বলিরেখা আঁকবে
    কোটি কোটি রক্ত-কলঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে
    আমার পিতার রাজত্বের পথ
    আমি চড়ে বেরিয়ে আসবো
    নোংরা ( রাতের বেলায় গলিতে ঘুমিয়ে ),
    আর কানেতে ফিসফিস করে বলব
    যখন আমি দাঁড়িয়ে
    ওনার দিকে :
    শ্রীমান ঈশ্বর, শোনো !
    এটা কি ক্লান্তিকর নয়
    তোমার মহানুভব চোখদুটো মেঘেতে ডুবিয়ে দাও
    প্রতিদিন, প্রতি সন্ধ্যায় ?
    তার বদলে, এসো,
    বৃত্তাকারে পাক খাবার উৎসব আরম্ভ করা যাক
    শুভ আর অশুভের জ্ঞানবৃক্ষ ঘিরে !
    সর্বশক্তিমান, তুমি চিরকাল আমাদের পাশে থাকবে !
    মদ থেকে, মজাগুলো আরম্ভ হবে
    আর প্রেরিত দূত পিটার, যিনি সব সময়ে ভ্রুকুটি করেন,
    দ্রুত-লয়ের নাচ নাচবেন— কি-কা-পু ।
    আমরা সব কয়জন ইভকে ইডেন স্বর্গোদ্যানে ফিরিয়ে আনবো :
    আমাকে আদেশ করো
    আর আমি যাবো —
    বীথিকাগুলো থেকে, প্রয়োজনের সুন্দরী মেয়েদের বেছে নেবো
    আর তাদের তোমার কাছে আনবো !
    আনবো তো আমি ?
    না ?
    তুমি তোমার কোঁকড়াচুল মাথা কেন অভব্যভাবে নাড়াচ্ছো ?
    কেন তুমি তোমার ভ্রুতে গিঁট ফেলছো যেন তুমি রুক্ষ ?
    তুমি কি মনে করো
    যে এই
    যার ডানা আছে, সে কাছেই,
    ভালোবাসার মানে জানে ?
    আমিও একজন দেবদূত ; আগেও ছিলুম–
    শর্করায় তৈরি মেশশাবকের চোখ নিয়ে, আমি তোমার মুখগুলোর দিকে তাকালুম,
    কিন্তু আমি ঘোটকিদের আর উপহার দিতে চাই না, —
    সেভরে-পাড়ার সমস্ত অত্যাচারকে ফুলদানির রূপ দেয়া হয়েছে ।
    সর্বশক্তিমান, তুমি দুটো হাত তৈরি করে দিয়েছো,
    আর তা সযত্নে,
    একটা মাথা গড়ে দিয়েছো, আর তালিকায় অনেককিছু রয়েছে–
    কিন্তু কেন তুমি তা করলে
    কেননা ব্যথা করে
    যখন কেউ চুমু খায়, চুমু, চুমু ?!
    আমি ভেবেছিলুম তুমিই মহান ঈশ্বর, সর্বশক্তিমান
    কিন্তু তুমি একজন ক্ষুদে মূর্তি, — স্যুট-পরা একজন নির্বোধ,
    ঝুঁকে, আমি ইতিমধ্যে আয়ত্বে পেয়েছি
    সেই ছুরি যা আমি লুকিয়ে রেখেছি
    আমার বুটজুতোর ফাঁকে ।
    তোমরা, ডানাসুদ্ধ জোচ্চোরের দল
    ভয়ে জড়োসড়ো হও !
    নিজেদের কাঁপতে-থাকা পালকগুলো ঝাঁকাও, রাসকেলের দল !
    তুমি, গা থেকে ধুপের গন্ধ বেরোচ্ছে, তোমাকে চিরে ফালাফালা করব,
    এখান থেকে আলাস্কা পর্যন্ত ধাওয়া করে।
    আমাকে যেতে দাও !
    তুমি আমাকে থামাতে পারবে না !
    আমি ঠিক হই বা ভুল
    তাতে কোনো তফাত হয় না,
    আমি শান্ত হবো না ।
    দ্যাখো,–
    সারা রাত নক্ষত্রদের মাথা কাটা হয়েছে
    আর আকাশ আবার কোতলে রক্তবর্ণ ।
    ওহে তুমি,
    স্বর্গ !
    মাথা থেকে টুপি খোলো,
    যখনই আমাকে কাছে দেখতে পাবে !
    স্তব্ধতা ।
    ব্রহ্মাণ্ড ঘুমোচ্ছে ।
    কালো, নক্ষত্রে- কানের তলায়
    থাবা রেখে ।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:743c:8667:dec5:697b | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১৮:০০740608
  • নাইজেরিয়ার সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবের পরাবাস্তব কবিতা ( ১৯৩০ – ২০১৩ ) 
    শকুনেরা
    ধূসরতায়
    আর এক পশলা বৃষ্টিতে এক হতাশ
    সকাল অগ্রদূতদের দ্বারা অনালোড়িত
    সূর্যোদয়ে এক শকুন
    অনেক উঁচু গাছের ভাঙা
    হাড়ের ডালে বসে
    কাছে ঘেঁষে বসল
    ওর সঙ্গীর মসৃণ
    চোট-খাওয়া মাথায়, একটা নুড়ি
    এক ডালে শেকড়-পোঁতা
    কুৎসিত পালকের জঞ্জালে
    আদর করে ঝুঁকলো
    শকুনির দিকে । কালকে ওরা পেয়েছিল
    জলভরা গর্তে একটা ফোলা লাশের
    দুটো চোখ আর নাড়িভুঁড়িতে
    যা ছিল তা খেয়েছিল । পেট
    ভরে খেয়ে ওরা বেছে নিলো
    ওদের বিশ্রামের দাঁড়
    বাকি ফাঁপা মাংসের দিকে
    শীতল চাউনির সহজ
    দূরবিন চোখের আওতায়…
     
    অদ্ভুত
    সত্যিই প্রেম কেমন অন্য
    উপায়ে এতো সুনির্দিষ্ট
    একটা কোনা তুলে নেবে
    শব রাখার ওই বাসায়
    সাজিয়ে-গুছিয়ের গুটিয়ে বসবে সেখানে, হয়তো
    ঘুমিয়েও পড়বে — শকুনির মুখ
    দেয়ালের দিকে মুখ করে !
     
    …এইভাবেই বেলসেন ক্যাম্পের
    কমাণ্ডান্ট দিনের শেষে বাড়ি
    গেলেন সঙ্গে পোড়া মানুষের
    ধোঁয়া বিদ্রোহ করে নাকের
    চুলে ঝুলে আছে যা থামবে
    রাস্তার ধারে মিষ্টির দোকানে
    একটা চকোলেট তুলে নেবে
    তার কচি খোকার জন্য
    বাড়িতে অপেক্ষা করছে
    বাবা কখন ফিরবে…
     
    বদান্য দূরদর্শিতার
    গুণগান করো যদি চাও
    যে এমনকি মানুষখেকো
    রাক্ষসকেও একটা ছোটো
    জোনাকি উপহার দ্যায়
    কোষে মোড়া কোমলতা
    নিষ্ঠুর হৃদয়ের তুষার গুহায়
    নয়তো সেই বীজানুর জন্যেই
    হাহুতাশ করো স্বজাতীয় প্রেমে
    যাতে চিরকালের জন্য
    প্রতিষ্ঠিত করে হয়েছে
    অমঙ্গল ।
     
    জবাব
    শেষ পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেললুম
    সন্ত্রাসের ঝালর-বসানো মোহ
    যা আমার প্রাচীন চাউনিকে বেঁধে রাখে
    ওই ভিড়ের মুখগুলোর সঙ্গে
    যা লুটতরাজের আর দখল করে আমার
    অবশিষ্ট জীবন এক অলৌকিকতায়
    শাদা-কলার হাতের নির্দেশের মাঝে
    আর নাড়িয়ে দিলুম এক সস্তা
    ঘড়ির মতন আমার কানের কাছে
    আর আমার পাশে মেঝেয় ছুঁড়ে
    ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালুম । আমি
    তাদের কাঁধ আর মাথাকে
    ওপর-নিচ করালুম এক নতুন
    সিঁড়ি দিয়ে আর ঝুঁকলুম
    ওদের ঘেমো সারিতে
    আর উঠে গেলুম মাঝের হাওয়া পর্যন্ত
    আমার হাত কঠোরতার জন্য এতো নতুন
    পাকড়াও করতে পারলুম এক
    ঝঞ্ঝাটে দিনের বন্ধুরতা
    আর তেষ্টা মেটালুম উৎসের
    যা তাদের পাগুলোকে উথালপাথাল
    খাওয়াচ্ছিল । আমি এক নাটকীয়
    অবনমন আরম্ভ করলুম সেইদিন
    পেছন দিক ফিরে গুঁড়িমারা ছায়ায়
    ভাঙা মৌতাতের টুকরোয় । আমি
    খুলে ফেললুম অনেকদিনের বন্ধ জানালা
    আর দরোজা আর দেখলুম আমার চালাঘর
    ইন্দ্রধনুর ঝাঁটায় নতুন সাফসুথরো করা
    সূর্যের আলো আবার আমার বাড়ি হয়ে গেল
    যার নিয়তিনির্দিষ্ট মেঝেতে অপেক্ষা করছিল
    আমার গর্বিত চঞ্চল জীবন ।
     
    উড়াল
    ( নিই ওসুনদারের জন্য ) 
    দ্রাঘিমায় কিছু-একটা ক্ষমতার লালসাকে প্রশ্রয় দ্যায়
    নিছক বাড়ির ছাদটুকু আমিরের জন্য যথেষ্ট
    বৈভবশালী পাগড়ির দামি পাক থেকে বিলিয়ে দেন
    ধুলোয় হামাগুড়ি দেয়া কৃষকদের
    বিরল দুর্বোধ্য মাথা নাড়া যা প্যাঁচানো থাকে
    রাজকুমারীয় বিষণ্ণতায় ।
    আমিও জেনেছি
    ওই ঝলসানো আদিম ক্ষুধাবোধ,
    জীবন প্রকাশ করার দ্রুতি
    এক দীর্ঘ পিছুহটা প্রবৃত্তি ।
    যদিও দড়িবাঁধা আর হাতকড়া পরানো
    সেই দিন আমি চূড়া থেকে হুকুম দিলুম ।
    তিন তলা জগতের এক সেতু খাপ খেয়ে যায়
    আমার উন্মাদ গর্বিত মূর্তির সঙ্গে যা আমি হয়েছি।
    ভাসমান মেঘের এক ম্যাজিক লেপ
    নিজের শাদা কোমলতাকে ওড়ালো আর ঘষল
    আমার পায়ের তলায় পেশাদার পরীর আঙুলের মতন
    আর ব্যাণ্ডেজের কাপড়ের ছাঁকনি দিয়েঢ
    এক মহানগরের বিস্ময় প্রকাশ করল
    সে ম্যাজিক পরীর দেশের আয়তনের ।
    চাউনিকে বিভিন্নভাবে মাপজোক করে
    আমি মেঘগুলোকে ভাসিয়ে দিলুম
    এক স্হির চারণভূমির ওপরে, মিনারের ওপরে
    আর মাস্তুল আর ধোঁয়া-পালক চিমনিতে ;
    কিংবা পৃথিবীটাকেই উল্টে দিলুম, ছেড়ে দিলুম
    তা থেকেই, এক ভবঘুরে ফেরারিকে
    অবিচল আকাশের তলায় । তারপর এলো
    জগতের ওপরে এক আচমকা ঔজ্বল্য,
    তা ছিল বিরল শীতের হাসি, আর আমার
    মেঘ-জাজিমের ওপরে একটা কালো ক্রশ আঁকা
    যা ইন্দ্রধনুর অক্ষিগোলকে আটক । যাতে এলো
    খ্রিষ্টজন্মের অসাধারণত্ব — তাছাড়া কেই বা আসতো
    ধূসর অখেলোয়াড়সুলভ তর্ক, অবিশ্বস্ত
    বিদ্যাবাগিশের উৎসর্গ-করা টেকো অবাধ্য ঘোষণা ?
    কিন্তু কি তুলনাহীন সৌন্দর্য ! কি গতি !
    রাতের এক রথ নিয়েছে আতঙ্কের উড়াল
    সেই দিনের আচার-বিচার সম্পর্কে আমাদের
    রাজকীয় ঘোষণা থেকে ! আর আমাদের কল্পনার
    মিছিল ঘোড়ায় চেপে এগিয়েছে। আমরা এক প্রাচীন
    লোভকে দমিয়েছি যা যুগ যুগ পড়ে থেকে কুঁকড়েছিল
    যতক্ষণ না মহিমাময় শোভাযাত্রা দেখে ক্লান্ত চোখ
    ফিরে এলো বিশ্রাম নেবার জন্যে ওই ক্ষুদ্র
    কিংবদন্তিতে যা জীবনের পোশাককে টেনে নিয়ে গেল
    সব জায়গা ছেড়ে আমার আসনের তলায় ।
     
    এখন আমি ভাবি আমি জানি কেন দেবতারা
    উচ্চতার ক্ষেত্রে পক্ষপাত করেন — পাহাড়ের
    শীর্ষকে আর গম্বুজকে, গর্বিত ইরোকো গাছগুলোকে
    আর কাঁটার পাহারা-দেয়া বোমবাক্সকে,
    কেন মামুলি গৃহদেবতারা
    কঠিন কাঠের দাঁড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বসবেন
    ঝুরঝুরে কড়িকাঠ  থেকে বিপজ্জনকভাবে ঝোলানো
    চালাবাড়ির চালে যা আরামে বসে আছে
    পৃথিবীর নিরাপদ মাটিতে ।
     
    প্রতিশ্রুতি-ভীতি
    হুররে ! তাদের জন্য যারা কিচ্ছু করে না
    কিছুই দেখে না অনুভব করে না যাদের
    হৃদয়ে বসানো আছে দূরদর্শিতা
    পাতলা ঝিল্লির মতন গর্ভের উন্মুখ
    দরোজায় যাতে বীর্যক্রোধের কলঙ্ক
    না ঢুকতে পারে । আমি শুনেছি পেঁচারাও
    জ্ঞানের গোলক পরে থাকে তাদের
    চোখের চারিধারে প্রতিরোধ হিসেবে
    প্রতিটি অসুরক্ষিত চোখ দ্রুত আড়াল পেতে চায়
    আলোর ছোঁড়া কাঁকর থেকে । অনেকদিন আগে
    মধ্য প্রাচ্যে পনটিয়াস পাইলেট
    সবার সামনে তাঁর শাদা হাতের অবদান
    ধুয়েছিলেন যা বিখ্যাত হয়েছিল । ( তাঁর আগের
    আর পরের রোমের কর্তাদের মধ্যে তাঁকে ছাড়া আর
    কাকে নিয়ে আলোচনা হয়েছিল প্রতিটি
    রবিবার পাঠানো প্রচারকদের ধর্মবিশ্বাস ? ) আর
    প্রচারকদের কথা বলতে হলে সেই অন্য লোকটা
    জুডাস অমন মূর্খ ছিল না মোটেই ; যদিও
    বড়ো বেশি বদনাম হয়েছিল পরের প্রজন্মের
    লোকেদের দ্বারা তবু তথ্য তো থেকেই যায় যে
    তারই একা ওই  নানা-পোশাক জমঘটে
    যথেষ্ট বোধবুদ্ধি ছিল এই কথা বলার
    একটা মারাত্মক আন্দোলন যখন ও দেখল
    আর তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল, একটা সুন্দর
    ছোটো পুঁটলি ওর কোটের পকেট ফুলিয়ে রেখেছে
    লেনদেনের ব্যাপারে — ব্যাটা বেশ বিচক্ষণ ।
     
    প্রেমচক্র
    ভোরবেলায় আস্তে আস্তে
    সূর্য নিজের কুয়াচ্ছন্ন দীর্ঘ
    বাহুর আলিঙ্গন ফিরিয়ে নেয় ।
    খোশমেজাজ প্রেমিক-প্রেমিকারা
    প্রেমের ঘষাঘষি-কারবারের
    কোনোরকম স্বাদ বা ক্বাথ
    ফেলে যায় না ; পৃথিবী
    শিশিরে সুগন্ধিত
    সুবাসে জেগে ওঠে
    নরম-চোখ আলোর
    ফিসফিসানিতে…
    পরে যুবক তার
    গুণাবলীর সমতা খুইয়ে ফেলবে
    স্বর্গের বিশাল জমি চাষ করার
    সময়ে আর তার ফল ফলাবে
    যুবতীটির তপ্ত ক্রোধের
    ফুলকির ওপরে । বহুকাল যাবত
    অভ্যস্ত অমনধারা আবদারে
    যুবতীটি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে
    সন্ধ্যার জন্য যখন আরেক রাতের
    চিন্তাভাবনা যুবকটির প্রফুল্লতা
    পুনরুদ্ধার করবে
    আর যুবতীটির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা
    যুবকটির ওপরে ।
     
    প্রজাপতি
    গতি হল উৎপীড়ন
    ক্ষমতা হল উৎপীড়ন
    ওজন হল উৎপীড়ন
    প্রজাপতি সুরক্ষা খোঁজে মৃদুতায়
    ভারহীনতায়, ঢেউখেলানো উড়ালে
    কিন্তু এক চৌমাথায় যেখানে নানারঙা আলো
    গাছেদের থেকে হঠকারী নতুন রাজপথে পড়ে
    আমাদের অভিসারী এলাকার সংযোগ ঘটে
    আমি দুজনের জন্য যথেষ্ট খাবার সঙ্গে করে আনি
    আর অমায়িক প্রজাপতি নিজেকে উৎসর্গ করে
    উজ্বল হলুদ আত্মবলিদানে
    আমার কঠিন সিলিকন ঢালের ওপরে ।
     
    উদ্বাস্তু মা আর ছেলে
    কোনো ম্যাডোনা আর
    শিশু ছুঁতে পারবে না
    মায়ের কোমলতার ওই ছবিটিকে
    একজন ছেলের খাতিরে ওনাকে দ্রুত ভুলে যেতে হবে।
    বাতাস দুর্গন্ধে কটু হয়ে উঠেছিল
    না-ছোঁচানো শিশুদের আমাশার
    যাদের ক্ষয়ে যাওয়া পাঁজর আর শুকনো
    পাছা ফুলে ফাঁপা তলপেট নিয়ে
    দাঁড়াতে চেষ্টা করছিল । অনেকেরই
    মা বহুকাল যাবত পালন করা বন্ধ
    করে দিয়েছে কিন্তু এর নয় । মা
    দাঁতের পাটির মাঝখানে ভুতুড়ে
    হাসি ধরে রেখেছিল আর দুই চোখে
    এক ভুতুড়ে মায়ের গর্ব যা আঁচড়ে দিচ্ছিল
    করোটিতে টিকে থাকা মরচেরঙা চুল
    আর তখনই —
     
    দুই চোখে গান নিয়ে — যত্নে আরম্ভ করল
    সিঁথেকাটা…আরেক জীবনে এই কাজ
    হতো প্রতিদিনের ঘটনা যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ
    নয়, ওর সকালের খাবার আর স্কুলে যাবার
    আগে ; এখন মা
     
    একটা ছোটো কবরে
    ফুল রাখার মতন কাজটা করছিলেন ।
    মার্গারেট র‌্যানডাল-এর কবিতা ( ১৯৩৬ ) 
    পরবর্তী সূর্যের সন্ধানে       
    তেওতিহুয়াকানে আমি অসহায় দেখি তুমি পিছলে চলে যাচ্ছ,
    চুষে ফেলা, নিয়ে নেয়া
    এই সময় থেকে অন্য সময়ে ।
    তুমি আমার পাশে হাঁটো,
    ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনিরা ভুলে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে
    সূর্য আর চাঁদের পিরামিডের মাঝে
    মৃতের চওড়া রাস্তা বরাবর,
    কিন্তু আমি জানি যে তোমার খোলোস কেবল আমার সঙ্গে থাকে
    খড়ির মতন ফ্যাকাশে আর বোবা । 
    পরে তুমি বর্ণনার চেষ্টা করো কোথা থেকে পালিয়ে এসেছ
    কতো কষ্ট করে : ঝুরঝুরে আর শীতল
    দুই সহস্র বছর যা গেছে আর আছে তার মাঝে ।
    কেমন করে তুমি সাক্ষীর কাছ থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিলে
    তোমার হলোগ্রাম চোখদুটো,
    একের পর এক বুকের ভেতরে ঢুকে-যাওয়া
    আগ্নেয়শিলার ছুরি, রক্তে জবজবে হৃদয়গুলো
    অন্ধকার থেকে আকাশে তোলা
    পরবর্তী সূর্যের সন্ধানে । 
    দেবতাদের জন্মস্হান, তার মহাগৌরবের মুহূর্তে
    পিরামিডের স্পন্দিত শহর
    আর প্রজাপতি প্রাসাদসারি,
    ২০০০০০ ওটোমি, জাপোটেক, মিক্সটেক,
    মায়া, নাহুয়া আর টোটোনাকদের বাড়ি,
    কারিগরদের, কুমোরদের,
    কোয়েৎজালকোটলের উপাসকরা :
    পালকদেহ সাপ যা ওদের দিয়েছিল
    সাধারণ জীবনের ঝর্ণা । 
    কোনও বীভৎস ব্যাপার এখানে ঘটেছিল,
    এটুকুই কেবল তুমি বলতে পারো
    যখন তুমি শেষ পর্যন্ত আমার কাছে ফিরে এলে,
    কোনও ঘটনা যা বলা যায় না,
    আর তুমি তা বললে না
    যতদিন না আমাদের কবিবন্ধু মেয়েটি
    তার নিজের মৃত্যুর মুখে-পড়া অভিজ্ঞতার কথা বলল
    পিরামিডের সর্বোচ্চ শিখরে আটক
    নামতে অসমর্থ । 
    চাকোতেও তুমি সেই সন্ত্রাস অনুভব করো,
    বিশেষ করে পুয়েবলো বোনিতোতে : বিশাল বাড়ি
    মাটির তলায় ৬০০টা ঘর রেড ইনডিয়ানদের
    গোলাকার অসম্পূর্ণ দেয়াল, ছোটো দরোজা আর উঁচু জানালা
    ফ্রেমের মতন উড়ন্ত মেঘদলের সৌন্দর্য ধরে রাখতো
    ৮০০ বছর আগে যা ঘটেছিল তাকে আড়াল করে রাখা
    সেসময়ে যখন এটাই ছিল কেন্দ্র,
    পথের মোড় গাণিতিক বাতাসে সর্পিল চলে গেছে ।
     
    আর কেঅন দ্য চেলিতে, নাভাহো ৎসেগিদের সঙ্গে
    স্পেনিয়দের ঘোটালা — “গুহার ভেতরে”
    ১৮০৫ সালে যেখানে দুটো স্রোতোধারা মেশে
    সাক্ষী হিসাবে রয়ে গেছে এক বিধ্বস্ত গুহা ।
    আক্রমণকারীরা নারী, শিশু, বৃদ্ধদের গণহত্যা করল,
    আর দুই শতক পরে
    তাদের ভয় তোমার দেহে বাস করে,
    তুমি নিজের ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে নাও,
    সেদিন মরুভূমির বাতাসকে চিরে ফেলেছিল আর্তচিৎকার। 
    এক হাজার বছরে যদি আমরা এখনও অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি
    পরবর্তী সূর্যের জন্য
    আমি অবাক হবো যদি কোনো পর্যটক আউশউইৎস,
    রামাল্লা, বাগদাদ, কাবুল, সোয়েটো,
    মোরাজান, অ্যাকটেল কিংবা পোর্ট-অউ-প্রিন্স প্রমুখ জায়গায়
    সেখানে যা ঘটেছে সে সম্পর্কে জানতে পারেন
    তাহলে হয়তো অনুভব করবেন তাঁকে একটা দিকে
    টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
    তাদের আর আমাদের সময়ের মাঝে, ভয় হয় তাঁরা
    এখনও একে আরেকের সঙ্গে যা করি তা থেকে পালাতে পারবেন না ।
     মাইনের ভেতরের ক্যানারি পাখি
    ড্রেসডেন আর টোকিও, হিরোশিমা, বাগদাদ,
    কাবুল, পাইনট্রি রেজ কিংবা সাউথ ব্রংকস,
    ক্যানারিদের মনে করা হয়  কোল্যাটারাল ড্যামেজ
    সেই লোকগুলোর কাছে যারা গুলি চালাবার, বোমা ফেলার হুকুম দেয় ।
     
    ও এক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসে যা ওরা বলেছিল আমাদের স্বাধীন রাখবে।
    এখন বাসা হয়ে গেছে টুকরো সাজাবার ধাঁধা যেখানে অনেক টুকরো নেই।
    কেউ আর পুরোনো অবস্হায় ফিরিয়ে আনতে পারবে না, কেউই নয়
    নৈঃশব্দ্য এখন চলমান স্বপ্ন ।
     
    দুই ঘণ্টা পর আর প্রতিটি গোপনতার একটি মিথ্যা বরাদ্দ,
    মেয়েটি ভেবেছিল ভেটেরান অ্যাসিসট্যান্স সাহায্য করবে
    কিন্তু মহিলা সেনাদের জন্য তেমন সাহায্যের ব্যবস্হা নেই
    আর যেখানেই আরোগ্যের প্রতারণা ঘাপটি মেরে আছে সেখানে ধর্ষণ লুকিয়ে।
     
    দেহরক্ষার সাম্প্রতিকতম বর্ম বেশি বিকলাঙ্গের উৎস।
    যদি কোথাও কিছু অবশিষ্ট থাকে
    তা কৃতজ্ঞ রাষ্ট্রকে ফেরত পাঠিয়ে দাও
    পতাকায় মোড়া বাক্সের গরিমায় ।
     
    যারা বাড়ি ফেরে না তাদের জন্য : দীর্ঘ নিরবতা,
    মেয়েটি কখনও পরিচিত হয়নি এমন প্রিয় মুখগুলো,
    কন্ঠস্বরগুলো মেয়েটিকে বলে
    ও হলো মাইনের ভেতরের ক্যানারি পাখি
     
    ডেভিড আর গলিয়াথ     
    পাহাড়ের ওপর থেকে সময় গড়িয়ে যায়,
    অ্যালাব্যাস্টারের পাতলা চাদর
    মরুভূমির পালিশের মতন পোক্ত ।
    ভয় জেগে ওঠে
    বুকের হাড় আর হৃদয়ের মাঝে
    তার ধাক্কা খাবার অধিকার জানায়
    যৎসামান্য রেশসহ
    ভিয়েৎনামের জাতীয় সঙ্গীতের ।
    সময় আর সঙ্গীতের পংক্তি
    আমার সংস্কৃতি থেকে এতো বিচ্ছিন্ন
    মনে হয় পর্যটক পাখিদের
    মিল নেই এমন এক জুটি
    আর আমি স্মৃতির টুকরো ওছলাই
    লাইনাস কম্বলের ওপরে
    —লূতাতন্তু-আলো এখনও জড়িয়ে
    প্রতিটি অমীমাংসিত পুরস্কারে ।
     
    ভিয়েৎনাম : ডেভিড আর গলিয়াথ
    আমার প্রজন্মের ।
    প্রতিটি ন্যায়নিষ্ঠ সংঘর্ষ
    লোভ ও দোষের দেবতাদের বিরুদ্ধে,
    প্রতিটি নারী ব্যবহৃত ও অপব্যবহৃত
    কেবল তারা নারী বলে,
    প্রতিটি ক্ষুধার্ত শিশু
    বাড়ি সম্পর্কে আতঙ্কিত ।
     ধূর্ততা ছদ্মবেশ পরে থাকে শুশ্রুষার,
    মানচিত্রে ঘুরে বেড়ায় পথগুলো
    যতক্ষণ না তারা টলতে-টলতে কিনারায় গিয়ে পড়ে যায়
    খেলার বিশাল টেবিল থেকে ।
    বরফের অদৃশ্য ফালি
    ত্বকের তলায় গর্ত করে
    যা কেবল আদর খেতে চায়
    প্রতিটি ক্লান্ত গহ্বরে ।
     মানাগুয়া থেকে লেখা চিঠি
    একমাত্র যা তুমি চাও তা হল আমাদের হত্যা, যারা টিকে গেছে
    তোমাদের অজস্র পোশাক-মহড়ায়
    এখনও ব্যাপারটা তেমন গুরুতর নয়, আমাদের অনেকেই তোমাদের
    আশা ব্যক্তিগত স্তরে পূরণ করে না :  তাগড়া বা নীল-চোখ বা সম্ভাবনাময়
    কেউই করে না তোমাদের বর্তমান আই কিউ অনুযায়ী
    কিংবা ররশাখ যা তোমাদের জীবনের বোধ সম্পর্কে সংজ্ঞা তৈরি করেন ।
    তোমাদের সঙ্গে মতের মিল না হলে ক্ষমা করো
    তোমাদের আণবিক বোমার সংজ্ঞা প্রয়োগ করে
    যুগ্মবৈপরীত্যের রাসায়নিক সমাধান
    কিংবা সালভাদোরের  সমাধান যথেষ্ট ব্যথা-নির্মূলক হিসাবে।
    আমরা অত্যন্ত অনুন্নত আমাদের ব্যথা নিজেদের প্রাগতৈহাসিক
    উপায়ে সামলাবার জন্য ।
    আমাদের সমাজ নিয়ে তোমাদের প্রশ্নের যদি সম্পূর্ণ উত্তর দিতে না পারি
    তাহলেও আমাদের ক্ষমা কোরো, যদি একে মার্কিস্ট-লেনিনিস্ট
    কিংবা সামাজিক-গণতান্ত্রিক, বহুমাত্রিকতাকে মান্যতা দেওয়া
    কিংবা যথেষ্ট খোলা বাজার ।
    যদি আমরা আমাদের নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার প্রক্রিয়া অনুসন্ধানের
    অপক্বতায় জোর দিই
    আমাদের স্বদেশকে তীব্রভাবে ভালোবাসি
    ৫০০০০ বোন আর ভাইরা আমাদের কন্ঠে শিকড় বিছিয়ে রাখে ।
    আমাকে ক্ষমা করবেন, দয়া করে, আমরা সব সময়ে ভুলে যাই
    আমাদের সত্যকে রক্ষা করার জন্য তোমাদের অনুমতি নেবার প্রয়োজন ছিল
    আর যেমন ভালো বুঝি তেমন করে আমাদের হাসি বিতরণ করা দরকার ছিল।
    নিজেদের মাথা ঘামাবেন না এটুকু বোঝার জন্য যে
    আমাদের সৈন্যদের লড়াই করতে শেখার সঙ্গে কবিতাপাঠও শিখতে হয়
    আত্মসন্মানবোধ আর কেমন করে রক্তের বদলে কালি দিয়ে তাদের নাম লিখবে,
    যখন আমাদের দাদুদিদারা এই জমি খুঁচিয়ে তাঁদের জীবন কাটাতেন
    তোমরা তোমাদের সৈন্য পাঠালে । পরে তোমরা আমাদের দিলে
    “আমাদেই একজন” : কিনলে আর দাম মেটালে
    তোমাদের মার্কিন জীবনযাত্রা দিয়ে ।
    তার ছিল এক ভাই আর এক ছেলে, এক নাতি
    আর অজস্র পকেট ।
    আমরা একাধিকবার বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েছি
    কিন্তু তোমরা বিপুল সংখ্যায় আমাদের ভাইদের শিক্ষা দিলে
    তাদের কিনে ফেললে আর ছাঁচে গড়লে
    ( আমাদের ছাঁচে রাখার জন্য )
    আর যে ছাঁচে তারা আমাদের রাখল তা বেশির ভাগই পাইন-বাক্সে
    আর অনুভূমিক । এখানে যুবক হওয়া
    অপরাধ ছিল, আর তোমরা রোজ মনে করিয়ে দিতে
    সেই অপরাধের কথা
    কতোজনের দ্বারা, আর কতো দিন অন্তর করা হয় ।
    কিন্তু আমরা ভেলে যেতুম, আমরা লড়তুম আর তোমাদের চিরন্তন বন্ধুর
    প্রতিরক্ষামূলক পাহারার নিচে থেকে বেরিয়ে আসতুম।
    আমরা লড়তুম আর জিততুম, আমরা কবর দিতুম
    আমাদের বোনেদের আর ভাইদের ( কেউ কেউ ছিল ফর্সা
    বা তোমাদের ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞার সঙ্গে খাপ খেতো )
    আর আমাদের দীর্ঘ ব্যথা আরম্ভ হতো, নিঃশব্দ আনন্দ, অসম্ভবকে
    আমাদের ইতিহাসের চোখ আর হাত দিয়ে সম্ভব করে তোলা ।
    আমরা জানি আমরা তোমাদের ১৯৮২-এর মাপকাঠির সঙ্গে
    খাপ খাই না যা তোমরা নির্ভরশীল দেশগুলোর জন্যে তৈরি করেছ ।
    তোমরা চাও কেবল আমাদের খুন করতে । আমরা কেবল চাই বেঁচে থাকতে ।
    ব্লাইজি সঁদরা : ট্রান্স-সাইবেরিয়ান এক্সপ্রেস
    তখন আমি বেশ তরুণ ছিলুম
    আমি সবে ষোলো বছরের হবো হয়তো কিন্তু ছেলেবেলার স্মৃতি মুছে গিয়েছিল
    যেখানে জন্মেছিলুম সেখান থেকে ৪৮,০০০ মাইল দূরে
    আমি ছিলুম মসকোতে, তিনঘণ্টির হাজার মিনার
    আর সাতটা রেলস্টেশান
    আর ওই হাজার আর তিন মিনার আর সাতটা রেলস্টেশান
    আমার জন্যে যথেষ্ট ছিল না
    কারণ আমি ছিলুম গরমমেজাজ আর পাগল তরুণ
    আমার হৃদয় ইফিসিয়াসের মন্দির কিংবা
    মসকোর রেড স্কোয়ারের মতন ছিল তপ্ত
    সূর্যাস্তের সময়ে
    আর আমার দুই চোখ ওই পুরোনো রাস্তা-ধরে চলার সময়ে জ্বলজ্বল করতো
    আর আমি আগেই এমন খারাপ কবি ছিলুম
    যে আমি জানতুম না তা কেমন করে নিজের সঙ্গে বয়ে নিয়ে যাই 
    ক্রেমলিন ছিল যেন বিরাট তার্তার কেক
    সোনার আইসিঙে সাজানো
    তার ওপরে বড়ো মাপের ভাজা কাগজিবাদামের গির্জা
    আর ঘণ্টাগুলো মধু-সোনালী…
    একজন বুড়ো সন্ন্যাসী আমাকে নোভোগোর্দের কিংবদন্তি পড়ে শোনাচ্ছিল
    আমি ছিলুম পিপাসার্ত
    আর আমি কীলকাকার বর্ণমালা পড়ার চেষ্টা করছিলুম
    তারপর তক্ষুনি রেড স্কোয়ারে উড়তে লাগলো ঈশ্বরের তৃতীয় রূপ
    উড়ে গেল আমার হাতও, যেন অ্যালবাট্রস পাখির উড়ালের শব্দ
    আর, হ্যাঁ, শেষ দিনের ওইটুকুই আমার মনে আছে
    শেষ যাত্রার
    এবং সমুদ্রের । 
    তবু, আমি সত্যিই ছিলুম একজন বাজে কবি ।
    আমি জানতুম না কেমন করে তা সহ্য করতে হবে ।
    আমি ছিলুম ক্ষুধার্ত
    আর সেইসব দিনগুলো আর সেইসব নারীরা সেইসব কফির দোকানে
    আর সেইসব কাচের গেলাস
    আমি গলায় ঢেলে নিতে চাইছিলুম আর ভেঙে ফেলতে চাইছিলুম
    আর সেইসব জানালা আর সেইসব পথগুলো
    আর সেইসব বাড়িগুলো আর সেইসব জীবন
    আর সেইসব ঘোড়ারগাড়ির চাকা ভাঙা ফুটপাথ থেকে ধুলো ওড়াচ্ছে
    আমি তাদের আগুনের হলকায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছিলুম
    আর আমি তাদের হাড়গোড় গুঁড়িয়ে দিতে চাইছিলুম
    আর টেনে বের করে আনতে চাইছিলুম ওই জিভগুলো
    আমাকে ওদের অদ্ভুত পোশাকের ভেতরের যে ল্যাংটো পেল্লাই শরীর
    পাগল করে তুলছিল তাদের গলিয়ে ফেলতে চাইছিলুম…
    আর দেখতে পাচ্ছিলুম রুশ বিপ্লবের লাল যিশুখ্রিস্ট আসতে চলেছেন
    আর সূর্য একটা নোংরা ঘা
    লাল গরম কয়লার মতন ফাটছে 
    তখন আমি বেশ তরুণ ছিলুম
    আমি সবে ষোলো বছরের হবো হয়তো কিন্তু ভুলে গিয়েছিলুম কোথায় জন্মেছি
    আমি ছিলুম মসকোতে আগুনের শিখাকে খেয়ে নিতে চাইছিলুম
    আর আমার চোখে ঝলমল করার মতন যথেষ্ট মিনার আর রেলস্টেশান ছিল না
    সাইবেরিয়ায় কামানের আওয়াজ — যুদ্ধ চলছিল
    ক্ষুধা শীত প্লেগ কলেরা
    আর আমুরের কাদাটে জল লক্ষ লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল
    প্রতিটি রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে দেখছিলুম শেষ ট্রেনের ছেড়ে যাওয়া
    ব্যাস ওইটুকুই : ওরা আর টিকিট বিক্রি করছিল না
    আর সেনারা বরং চাইছিল থেকে যেতে…..
    একজন বুড়ো সন্ন্যাসী আমাকে শোনাচ্ছিল নোভোগোর্দের কিংবদন্তি 
    আমি, একজন খারাপ কবি যে কোথাও যেতে চায়নি, আমি কোথাও যেতে পারতুম না
    আর  ব্যবসাদার লোকটার নিশ্চয়ই যথেষ্ট টাকাকড়ি ছিল
    বিদেশে গিয়ে ধনরত্ন কামাবার ধান্দায় চলেছে ।
    ওদের ট্রেন প্রতি শুক্রবার সকালে ছাড়ে ।
    শুনে মনে হতো যে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে ।
    একজন লোক কৃষ্ণ অরণ্য থেকে নিজের সঙ্গে একশো বাক্স অ্যালার্ম ঘড়ি
    আর কোকিল ঘড়ি নিয়ে যাচ্ছিল
    আরেকজন টুপির বাক্স, স্টোভের পাইপ, আর নানাধরণের
    শেফিল্ড কোম্পানির কর্ক খোলার প্যাঁচ
    আরেকজন, ম্যালমো থেকে কফিনে ভরে নিয়ে যাচ্ছিল টিনের খাবার
    আর তেলে চোবানো সার্ডিনমাছ
    আর বহু মহিলা জড়ো হয়েছিলেন
    ভাড়া করার জন্য উলঙ্গ উরুর তরুণী
    যারা কফিনও সরবরাহ করতে পারে
    সবার কাছে অনুমতিপত্র ছিল
    মনে হচ্ছিল যেন অনেক মানুষ ওই দিকে মারা যাচ্ছে
    তরুণীরা যাত্রা করছিল তাদের জন্য বরাদ্দ কম দামের টিকিটে
    আর তাদের সকলেরই ছিল ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ।
     
    এবার, এক শুক্রবার সকালে আমার যাবার পালা এলো
    তখন ডিসেম্বর মাস
    আর আমিও যাত্রা করলুম, হারবিনযাত্রী এক ধনরত্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে
    এক্সপ্রেস ট্রেনটায় আমাদের ছিল দুটো কামরায় ভরা রওরঝিম থেকে আনা
    ৩৪ বাক্স ধনরত্ন
    জার্মানির বাজে মাল “মেড ইন জার্মানি”
    লোকটা আমাকে কয়েকটা নতুন পোশাক কিনে দিয়েছিল
    আর ট্রেনে চাপার সময়ে আমি একটা বোতাম হারিয়ে ফেলেছিলুম
    —আমার মনে আছে, আমার মনে আছে, আমি অনেক সময়ে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি–
    আমি ধনরত্নের ওপরে শুয়ে রইলুম আর ওনার দেয়া
    নিকেলকরা মাউথঅর্গান নিয়ে দারুন বোধ করছিলুম
    আমি বেশ খুশ ছিলুম আর অসতর্ক
     
    যেন চোর-পুলিশের ব্যাপার
    আমরা গোলকুন্ডার ঐশ্বর্য চুরি করে নিয়ে যাচ্ছি
    আর আমরা ট্রান্স-সাইবেরিয়ানে চেপে নিয়ে যাচ্ছি
    যাতে পৃথিবীর উল্টো দিকে লুকিয়ে রাখতে পারি
    জুল ভার্নের সার্কাসযাত্রী দলকে উরালের যে চোরেরা আক্রমণ করেছিল
    তাদের থামাতে পাহারা দিচ্ছিলুম
    খুনখুজ থেকে, চিনের বাক্স
    আর মহান লামার ক্রুদ্ধ বেঁটে মোঙ্গোলদের থেকে
    আলিবাবা চল্লিশ চোর থেকে
    আর পাহাড়ের ভয়ঙ্কর বুড়ো লোকটার অনুচরদের থেকে
    আর সবচেয়ে খারাপ, সবচেয়ে আধুনিক
    বিড়ালের মতন চোরদের থেকে
    আর আন্তর্জাতিক এক্সপ্রেসের বিশেষজ্ঞদের থেকে
    আর তবু, আর তবু
    আমি ছিলুম বাচ্চা ছেলের মতন দুঃখি
    ট্রেনের ছন্দ
    যাকে আমেরিকান মনোবিদরা বলেন “ রেলপথের স্নায়ু”
    বরফজমা রেললাইনের ওপরে দরোজা কন্ঠস্বর অ্যাক্সেলের ঘষটানি
    আমার ভবিষ্যতের সোনালী সূত্র
    আমার পিস্তল পিয়ানো পাশের কামরায় তাস খেলুড়েদের গালমন্দ
    জিন নামের তরুণীর দুর্দান্ত উপস্হিতি
    নীল চশমা-পরা লোকটার করিডরে পায়চারি আর আড়চোখে আমার দিকে তাকানো
    মহিলাদের পোশাকের আওয়াজ
    আর হুইসেলের
    আর চাকাগুলোর বিরতিহীন শব্দ আকাশের গায়ে দেগে দেয়া বুনো রাস্তায়
    জানালার কাচ তুষারে ঢাকা
    প্রকৃতিবিহীন !
    আর ওইদিকে সাইবেরিয়ার সমতলভূমিতে নেমে আসা আকাশ
    দীর্ঘ অনিচ্ছুক ছায়ারা উঠে যাচ্ছে আর নামছে
    আমি ঘুমিয়ে পড়েছি
    তার্তার পশমের চাদর ঢেকে
    ঠিক আমার জীবনের মতন
    আমার জীবনে  স্কচ শালের চেয়ে বেশি উষ্ণতা দিচ্ছে না
    আর সমস্ত ইউরোপ বাতাস-চেরা এক্সপ্রেস ট্রেনের তীব্র গতি দিয়ে দেখা
    আমার জীবনের চেয়ে অর্থবহ নয়
    আমার দুঃখের জীবন
    এই শাল
    সোনায় ভরা সিন্দুকের ওপরে ছত্রাখান
    আমি  গড়াই
    স্বপ্নে
    এবং ধোঁয়ায়
    আর বিশ্বজগতে একমাত্র আলো
    একটি ফালতু চিন্তা… 
    আমার হৃদয়তল থেকে কান্না উঠে আসে
    যদি ভাবি, হে প্রেম, আমার দয়িতার সম্পর্কে ;
    মেয়েটি বেশ নষ্ট, যাকে খুঁজে পেয়েছিলুম, ফ্যাকাশে
    এবং বিশুদ্ধ, এক বেশ্যালয়ের পেছন দিকে । 
    মেয়েটি ফর্সাত্বকের শিশু বেশ হাসে,
    দুঃখি, হাসে না, কখনও কাঁদে না ;
    কিন্তু কবির কুসুম, শ্বেতপদ্ম, কাঁপতে থাকে
    যখন তোমাকে ওর চোখের গভীরতায় তা দেখতে দেয় । 
    মেয়েটি বেশ মিষ্টি, তুমি শুনতে পাও এমনকিছু বলে না.
    দীর্ঘক্ষণের শিহরণ তুলে যখন তুমি কাছে টেনে নাও,
    কিন্তু যখন আমি ওর কাছে আসি, এখান থেকে, সেখান থেকে,
    এক পা এগিয়ে আসে আর চোখ বন্ধ করে — আরেক পা এগিয়ে আসে । 
    তার কারণ ও আমার প্রেম আর অন্য নারীরা
    সোনার চাদরে মোড়া বিশালদেহ আগুন
    আমার দুঃখি বন্ধু এতো একা
    ও সম্পূর্ণ নগ্ন, শরীর নেই — ও বড়োই দুঃখি । 
    মেয়েটি এক নিষ্পাপ ফুল, রোগা আর অপলকা,
    কবির কুসুম, করুণা-জাগানো শ্বেতপদ্ম,
    এতো শীতল, এতো একা, আর এখন এতো শুকিয়ে গেছে
    ওর হৃদয়ের কথা ভাবলে আমার কান্না পায় ।
    আর এই রাত আরও শত সহস্র রাতের মতন যখন রাতের ভেতর দিয়ে
    একটা ট্রেন গলে বেরিয়ে যেতে থাকে
    –ধুমকেতুর পতন হয় —
    আর একজন পুরুষ ও একজন নারী, যতোই কমবয়সী হোক, প্রেম করার আনন্দ নেয়। 
    আকাশ যেন ভাঙা সার্কাসের ছেঁড়া তাঁবু
    ফ্ল্যাণ্ডার্সের মেছোদের ছোটো গ্রামে
    সূর্য যেন ধোঁয়াটে লন্ঠন
    আর ওপরে দোলনায় এক নারী দ্বিতীয়ার চাঁদ
    ক্ল্যারিনেট ভেরী তীক্ষ্ণ বাঁশি তালদেয়া ঢোলোক
    আর এখানে রয়েছে আমার দোলনা
    আমার দোলনা
    ওটা সবসময় পিয়ানোর কাছে থাকতো যখন আমার মা, মাদাম বোভারির মতন
    বিটোফেনের সোনাটা বাজাতেন
    আমি শৈশব কাটিয়েছি ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগানে
    স্কুল-পালিয়ে, ট্রেনগুলোকে অনুসরণ করে
    যখন ওরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে যেতো
    এখন আমি ট্রেনগুলোকে বাধ্য করেছি আমায় অনুসরণ করতে
    বাসেল-টিমবুকটু
    আতেউইল আর লঙচ্যাম্পসের মাঠের মতন ঘোড়াদের ছুটিয়েছি
    প্যারিস-নিউইয়র্ক
    এখন ট্রেনগুলো আমার পাশাপাশি ছোটে
    মাদ্রিদ-স্টকহোম
    সব হারিয়েছি ঘোড়দৌড়ের যৌথ আনন্দের খেলায়
    বেঁচেছে কেবল প্যাটাগোনিয়া, প্যাটাগোনিয়া, যার সঙ্গে আমার গভীর দুঃখের মিল
    প্যাটাগোনিয়া আর দক্ষিণ সমুদ্রে যাত্রা
    আমি রাস্তায়
    আমি চিরকাল রাস্তায় কাটিয়েছি
    আমি ফ্রান্সের ছোট্ট জিনের সঙ্গে পথে-পথে
    ট্রেন ডিগবাজি খেয়ে চার পায়ে দাঁড়ায়
    ট্রেন নিজের চাকায় ভর দিয়ে থামে
    ট্রেন চিরকাল নিজের চাকায় ভর দিয়ে থামে
     
    “ব্লাইজি, বলো, আমরা কি মমার্ত থেকে অনেক দূরে ?”
     
    অনেক দূরে, জিন, তুমি সাত দিন যাবত গড়িয়ে চলেছ
    তুমি মমার্ত থেকে অনেক দূরে, সেই পাহাড়তলি থেকে
    যেখানে তুমি বড়ো হয়েছ, সাকরে-কোয়ের যেখান ছিলে নিরালায়
    প্যারিস তার বিশাল ঝলকানিসুদ্ধ মুছে গেছে
    উড়ন্ত স্ফূলিঙ্গ ছাড়া সবকিছু মিইয়ে গেছে
    বৃষ্টি পড়ছে
    জলজঞ্জাল ফুলে ওঠে
    সাইবেরিয়া বাঁক নেয়
    তুষারের পরতের পর পরত জমতে থাকে
    আর নীল আলোয় উন্মাদনার পাগলাঘণ্টি বাজে শেষ আকাঙ্খার মতন
    ভারি দিগন্তের হৃদয়ে ট্রেনটা স্পন্দিত হতে থাকে
    আর তোমার এককীত্ব তোমায় কচুকাটা করে…
     
    “বলো, ব্লাইজি, আমরা কি সত্যিই মমার্ত থেকে অনেক দূরে ?”
     
    অশান্তি
    অশান্তির কথা ভুলে যাও
    পথের ভাঙাচোরা আর হেলেপড়া রেলস্টেশনগুলোকে
    যে টেলিগ্রাফ তার থেকে তারা ঝুলছে
    তাদের গলা টিপে ধরার জন্য হাত বাড়ানো গোমড়া স্তম্ভ
    পৃথিবীটা উন্মাদ মর্ষকামীর হাত দিয়ে বাজানো
    অ্যাকর্ডিয়ানের মতন বেড়ে দীর্ঘ হয় আবার কুঁচকে ছোট হয়ে যায়
    আকাশের চিড়ফাটল দিয়ে বুনো ইঞ্জিনগুলো উড়তে থাকে
    আর গর্তগুলোয়
    পাগলকরা চাকা কন্ঠস্বরের হাঁ-মুখ
    আর দুরবস্হার কুকুরেরা আমাদের চাকায় ঘেউঘেউ করে
    রাক্ষসদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে
    লোহায় নখ ঘষে
    সবকিছু আওয়াজ তোলে
    চাকার ঘ্যাঙঘ্যাঙে শব্দ থেকে
    সামান্য অন্যথা
    ঝাঁপায়
    নড়েচড়ে
    আমরা এক বোবা মানুষের খুলির ভেতরের ঝড়….
     “বলো, ব্লাইজি, আমরা কি সত্যিই মমার্ত থেকে অনেক দূরে ?” 
    হ্যাঁ, আমরা তাইই, আমাকে বিরক্ত কোরো না, তুমি জানো, আমরা অনেক দূরে
    ইঞ্জিনের ভেতরে অতিউত্তপ্ত পাগলামি গোমরায়
    প্লেগ আর কলেরা আমাদের চারিধারে জ্বলন্ত স্ফূলিঙ্গের মতন ওড়ে
    আমরা যুদ্ধের সুরঙ্গে সরাসরি ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেছি
    ক্ষুধা, সেই বেশ্যাটা, আকাশে ছড়ানো মেঘ আঁকড়ে ধরে
    আর যুদ্ধের মাঠ ভরে যায় পচা লাশের দুর্গন্ধে
    তা যা চায় তাই করুক, তুমি তোমার কাজ করে যাও…. 
    “বলো, ব্লাইজি, আমরা কি সত্যিই মমার্ত থেকে অনেক দূরে ?”
     
    হ্যাঁ, আমরা দূরে, আমরা দূরে
    দুষ্কর্মের ভারবাহীরা ফুলেফেঁপে মরুভূমিতে নেতিয়ে পড়েছে
    এই খোসপাঁচড়ায় সেনার গরুর গলার ঘণ্টাধ্বনি শোনো
    টোমস্ক চেলিয়াবিনস্ক কানস্ক ওব টায়শেট ভের্কনে-উদিনস্ক কুরগান সামারা
    পেনজা-টুলুন
    মাঞ্চুরিয়ায় মৃত্যু
    সেখানেই আমরা নামবো আমাদের শেষ গন্তব্য
    এই যাত্রাটা ভয়াবহ
    কালকে সকালে
    ইভান উলিচের চুল পেকে গেল
    আর কোলিয়া নিকোলাই ইভানোভিচ দুই সপ্তাহ যাবত নিজের নখ খাচ্ছে…
    মৃত্যু আর দুর্ভিক্ষ যা করে তাই করো, তোমার কাজ করে যাও
    একশো ফরাসি টাকা লেগেছে — ট্রান্স-সাইবেরিয়ানে তা একশো রুবল
    বসার জায়গাকে তপ্ত করো আর টেবিলের তলায় লজ্জা ঢাকো
    শয়তানের কবজায় রয়েছে লেখবার চাবিকাঠি
    ওর গাঁটসুদ্ধ আঙুল নারীদের আপ্লুত করে
    সহজপ্রবৃত্তি
    ঠিক আছে মহিলাগণ
    তোমরা নিজেদের কাজ চালিয়ে যাও
    যতক্ষণ না আমরা হারবিনে পৌঁছোচ্ছি…..
     “বলো, ব্লাইজি, আমরা কি মমার্ত থেকে সত্যিই অনেক দূরে?” 
    না, ওহে…আমাকে বিরক্ত কোরোনা….একা থাকতে দাও
    তোমার পোঁদ ঢাউস হয়ে গেছে
    তোমার পেট টকেছে আর রয়েছে তোমার প্রশংসা
    একমাত্র জিনিস যা প্যারিস তোমাকে দিয়েছে
    আর রয়েছে এক কচি আত্মা…কারণ তুমি অসুখি
    তোমার জন্য আমার কষ্ট হয় এসো আমার হৃদয়ে
    চাকাগুলো ককেন দেশের উইণ্ডমিলের মতন
    আর উইণ্ডমিলগুলো সেই ভিখারির যে নিজের লাঠি মাথার ওপরে ঘোরাচ্ছে
    আমরা শূন্যের নুলো
    আমরা আমাদের চার আঘাতের ওপর ভর দিয়ে চলাফেরা করি
    আমাদের ডানা ছেঁটে ফেলা হয়েছে
    আমাদের সাতটি পাপের ডানা
    আর ট্রেনগুলো হলো শয়তানের খেলনা
    মুর্গির খাঁচা
    এই আধুনিক জগতসংসার
    গতি কোনো কাজে লাগে না
    এই আধুনিক জগতসংসার
    ব্যবধানগুলো অনেক দূরে-দূরে
    আর যাত্রার শেষে একজন নারীর সঙ্গে একজন পুরুষের বসবাস ভয়াবহ… 
    “ব্লাইজি, বলো, আমরা কি মমার্ত থেকে সত্যিই অনেক দূরে ?” 
    তোমার জন্য কষ্ট হয় এখানে এসো একটা গল্প শোনাবো
    আমার বিছানায় এসো
    আমার কাঁধে তোমার মাথা রাখো
    আমি তোমাকে একটা গল্প শোনাবো… 
    আরে এসো দিকিনি ! 
    ফিজিতে সব সময়েই বসন্তকাল
    তুমি সঙ্গম করে বেড়াও
    উঁচু ঘাসে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মাতন লাগে আর তপ্ত সিফিলিস
    কলাগাছের বাগানে বইতে থাকে
    এসো প্রশান্তসাগরের দ্বীপগুলোয়
    ফিনিক্স, মারকোয়েসাস
    বোরনিও আর জাভা
    আর বিড়ালের মতন দেখতে সেলেবেস 
    আমরা জাপানে যেতে পারব না
    মেকসিকোতে চলো !
    উঁচু সমতলভূমি টিউলিপ গাছে ছেয়ে থাকে
    সূর্য থেকে ঝুলে থাকা আলুলায়িত চুলের মতন আঙুরলতা
    যেন চিত্রকরের ব্রাশ আর প্যালেট
    বিস্ময়করভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে ঘণ্টাধ্বনির মতন–
     
    রুশো ছিলেন সেখানে
    ওনাকে চিরকালের জন্য ঝিলমিলিয়ে রেখেছিল
    দেশটা পাখির জন্য বিখ্যাত
    স্বর্গের পাখি বেহালার পাখি
    টউকান মকিংবার্ড
    আর কালো ফুলের মধ্যে টুনটুনি পাখিরা বাসা বাঁধে
    এসো !
    আমরা অ্যাজটেক মন্দিরের রাজকীয় ধ্বংসাবশেষে প্রেম করব
    তুমি হবে আমার দেবীপ্রতিমা
    খুকিরঙা জলের ছাটে কিছুটা কুৎসিত আর সত্যিকারের অপার্থিব
    ওহ এসো ! 
    তুমি চাইলে আমরা বিমানে চেপে হাজার হ্রদের দেশের ওপরে উড়ব
    সেখানে রাতগুলো দৌরাত্মপূর্ণভাবে দীর্ঘ
    ইঞ্জিনের আওয়াজে আমাদের প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষরা ভয় পাবেন
    আমি নামবো
    আর ম্যামথের জীবাশ্ম দিয়ে গড়ে তুলব বিমান রাখার হলঘর
    আদিম আগুন আবার জাগিয়ে তুলবে আমাদের ক্ষীণ প্রণয়
    রুশদেশের চায়ের কেটলি
    আর আমরা সাধারণ মানুষের মতন মেরু অঞ্চলে সংসার পাতবো
    ওহ এসো !
    জিন জিনেট আমার খুকি আমার মাটির-পাত্র আমার পাদ
    আমার আমি মা পুপু পেরু
    পিপি কোকিল
    ডিঙডিঙ আমার ডঙ
    মিষ্টি শুঁটি মিষ্টি মাছি মিষ্টি ভ্রমর
    চিকাডি বেডি-বাই
    ছোট্ট পায়রা আমার প্রেমিকা
    ছোট কুকি-নুকি
    ঘুমোচ্ছে । 
    মেয়েটা ঘুমোচ্ছে
    আর সারা দিন পেটে কিছু পড়েনি
    স্টেশনে দেখা সেই সব মুখগুলো
    যাবতীয় ঘড়িগুলো
    প্যারিসের সময় বার্লিনের সময় সেইন্ট পিটার্সবার্গের সময় সেইসব স্টেশনের সময়
    আর উফাতে কামানদাজের রক্তাক্ত মুখ
    আর গ্রোন্ডোর অবাস্তব আলোজ্বলা ঘড়ির কাঁটা
    আর ট্রেন চলেই চলেছে শেষহীন
    রোজ সকালে তুমি তোমার ঘড়ি মিলিয়ে নাও
    ট্রেন এগোয় আর সূর্যের সময় ফুরোয় কোনো কাজে লাগে না ! ঘণ্টাধ্বনি শুনি
    নোট্রেদামের বিরাট ঘণ্টা
    সন্ত বার্থোলোমিউ দিবসে লুভরের তীক্ষ্ণ ঘণ্টাধ্বনি
    নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির বৈদ্যুতিক ঘণ্টাধ্বনি
    ভেনিসের ইতালীয় ঘণ্টাঘরের বাজনা
    আর বাজতে থাকে মসকোর ঘণ্টা, লাল সিংহদ্বারের ঘড়ি
    যা আমার জন্য সময় জানাতো যখন আমি একটা অফিসে কা্জ করতুম
    আর আমার স্মৃতিগুলো
    ট্রেন বিদ্যুৎচমকের মতন গোলঘরে প্রবেশ করে
    চলতে থাকে ট্রেন
    গ্রামোফোনে বেজে ওঠে ছোট্ট ভবঘুরে কুচকাওয়াজ
    আর জগতসংসার, প্রাগের ইহুদিপাড়ার ঘড়ির কাঁটার মতন
    পাগল হয়ে পেছন দিকে যেতে থাকে
     
    বাতাসের সতর্কতা উড়িয়ে
    ঝড় উঠেছে
    আর ট্রেনগুলো প্যাঁচালো রেললাইনে ঝড় তোলে
    নারকীয় খেলনা
    এমন ট্রেন আছে যাদের কখনও পরস্পরকে দেখা হয় না
    অন্যগুলো হারিয়ে যায়
    স্টেশানমাসটাররা দাবা খেলে
    ব্যাকগ্যামন
    শুট পুল
    ক্যারামের টুসকি
    প্যারাবোলা
    রেললাইনের প্রণালী হলো নতুন ধরণের জ্যামিতি
    সাইরাকিউজ
    আরকিমিডেস
    আর যে সৈন্যরা তাঁকে কোতল করেছিল
    আর ছিপনৌকা
    আর রণতরী
    আর বিস্ময়কর যন্ত্র যা উনি আবিষ্কার করেছিলেন
    আর যাবতীয় কোতল
    প্রাচীন ইতিহাস
    আধুনিক ইতিহাস
    জলঘুর্ণি
    জাহাজডুবি
    এমনকি টাইটানিকও যার বিষয়ে কাগজে পড়েছিলুম
    এতো চিত্রকল্পের জমায়েত আমি আমার কবিতায় আনতে পারছি না
    কেননা আমি এখনও সত্যিকারের খারাপ কবি
    কারণ ব্রহ্মাণ্ড আমার ওপর দিয়ে দ্রুত চলে যায়
    আর ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা পড়ার ব্যাপারে বীমার জন্য গা করিনি
    কেননা আমি জানিনা কেমন করে তা সারাটা পথে বয়ে নিয়ে যেতে হবে
    আমি বেশ ভয়ে আছি
    আমি ভিতু
    জানি না কেমন করে সারাটা পথ বয়ে নিয়ে যেতে হবে
    আমার বন্ধু শাগাল-এর মতন আমি যুক্তিবর্জিত ছবির সিরিজ আঁকতে পারি
    কিন্তু আমি প্রসঙ্গবিন্দু লিখে রাখিনি
    “আমার অজ্ঞতা ক্ষমা করুন
    ছন্দের প্রাচীন খেলা ভুলে গেছি বলে ক্ষমা করে দিন”
    গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার যেমন বলেছেন
    যুদ্ধ সম্পর্কে যদি কিছু জানতে চাও তাহলে ক্রোপোটকিনের ‘স্মৃতিকথা’ পড়ো
    কিংবা নৃশংস ছবিসহ জাপানি সংবাদপত্র
    কিন্তু বইয়ের তালিকা তৈরি করে কীই বা হবে
    হাল ছেড়ে দিই
    লাফিয়ে ফিরে আসি আমার নাচতে থাকা স্মৃতিতে…
     
    ইরকুটস্কে যাত্রা হঠাৎ মন্হর হয়ে যায়
    সত্যি বলতে টেনে নিয়ে যেতে থাকে
    বাইকাল হ্রদের বাঁকে আমাদেরটাই ছিল প্রথম ট্রেন
    গাড়িটা লন্ঠনের আলোয় আর পতাকায় সাজানো ছিল
    আর দুঃখি গান “ঈশ্বর জারকে রক্ষা করুন” শুনে আমরা স্টেশন ছাড়লুম
    আমি যদি চিত্রকর হতুম এই যাত্রার শেষে প্রচুর হলুদ আর লাল রঙের ঝাপটা মারতুম
    কারণ আমার মনে হয় আমরা সবাই যৎসামান্য উন্মাদ
    আর সেই ছেয়েথাকা সন্মোহন আমার সহযাত্রীদের ক্লান্ত মুখ রক্তাভ করে তুলছিল
    আমরা যখন মোঙ্গোলিয়ার কাছাকাছি
    তা দাবানলের মতন গর্জন করছিল ।
    ট্রেন মন্হর হয়ে গিয়েছিল
    আর চাকার অবিরাম ঘষটানিতে আমি শুনতে পেলুম
    এক শাশ্বত প্রার্থনার
    উন্মাদ ফোঁপানি আর চিৎকার 
    আমি দেখলুম
    আমি দেখলুম শেষ পূর্বপ্রান্ত থেকে যে শব্দহীন কালো ট্রেনগুলো ফিরে আসছে
    তারা যেন মায়াপুরুষ
    আর আমার চোখদুটো, গাড়ির পেছনের আলোর মতন,
    তখনও ট্রেনগুলোর পিছু ধাওয়া করেছে
    টালগাতে ১০০০০০ আহত লোক মারা যাচ্ছে অথচ কোনো সাহায্য আসছে না
    আমি ক্র্যাসনোইয়ার্সকের হাসপাতালে গেলুম
    আর খিলোকে আমাদের সঙ্গে সৈন্যদের এক সারির সঙ্গে দেখা হলো
    যারা পাগল হয়ে গেছে
    আলাদা করে রাখাদের দেহে দেখলুম জখমের হাঁ-মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে
    আর কেটে ফেলা অঙ্গগুলো চারিদিকে নাচছে কিংবা কাঁচা বাতাসে উড়ছে
    তাদের মুখমণ্ডলে আর হৃদয়ে ছিল আগুন
    জানালায় টোকা দিয়ে বাজনা বাজাচ্ছিল মূর্খ আঙুলগুলো
    আর ভয়ের চাপে এমনই চাউনি যা থেকে ফেটে বেরোবে নালি-ঘা
    স্টেশনগুলোয় ওরা মোটরগাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল
    আর আমি দেখলুম
    ষাটটা ইঞ্জিন তপ্ত দিগন্তের তাড়া খেয়ে দৌড়োচ্ছে
    আর বেপরোয়া কাকেরা
    উধাও হয়ে যাচ্ছে
    পোর্ট আর্থারের দিকে 
    শিটাতে পেলুম কয়েক দিনের বিশ্রাম
    পাঁচ দিনের বিরাম ততোক্ষণ ওরা রেললাইন পরিষ্কার করছিল
    আমরা মিস্টার ইয়াঙ্কেলেভিচের বাড়িতে আশ্রয় নিলুম যিনি
    ওনার একমাত্র মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাইলেন
    তারপর যাবার সময় এলো ।
    এখন আমিই পিয়ানো বাজালুম আর আমার দাঁতে ব্যথা করছিল
    আর যখনই চাই আমি আবার দেখতে পাই সেই নিঃশব্দ ঘর আর ভাঁড়ার আর
    ওনার মেয়ের দুই চোখ যে আমার সঙ্গে প্রতিরাতে শুচ্ছিল
    মুসোর্গস্কি
    আর হ্যুগো উল্ফের জার্মান গীতিকবিতা
    আর গোবি মরুভূমির বালিয়াড়ি
    আর খাইলারে শাদা উটদের একটা যাত্রীদল
    আমি দিব্যি করে বলতে পারি ৩০০ মাইলের বেশি মোদোমাতাল ছিলুম
    কিন্তু আমি পিয়ানো বাজাচ্ছিলুম — এসবই দেখেছি
    যাত্রায় বেরোলে তোমার উচিত চোখ বন্ধ করে নেয়া
    আর ঘুমিয়ে পড়া
    আমি ঘুমোবার জন্যে পাগল হয়ে যাচ্ছিলুম
    চোখ বন্ধ করে গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারি আমি কোন দেশে
    আর কোন ধরণের ট্রেন যাচ্ছে তা শুনে বলে দিতে পারি
    ইউরোপের ট্রেনগুলো ৪/৪ যখন কিনা এশিয়ার ট্রেন ৫/৪ কিংবা ৭/৪
    অন্যগুলো ঘুমপাড়ানি গানের সুর তুলে যায়
    আর কয়েকটা এমন যাদের চাকার একঘেয়েমি আমাকে
    মাতেরলিঙ্কের কঠিন গদ্য মনে পড়ায়
    চাকাগুলোর খণ্ডিত উচ্চারণের মানে আমি বুঝতে পারছিলুম
    আর সৌন্দর্যের সন্ত্রাসের উপাদানকে একত্রিত করতে পারছিলুম
    যার আমি মালিক
    আর যা আমাকে চালিয়ে নিয়ে যায়
     
    সিৎসিহার আর হারবিন
    অতোটাই আমি যেতে পারি
    শেষ স্টেশন
    ওরা রেড ক্রসের দপতরে আগুন ধরিয়ে দেবার পর
    হারবিনে আমি ট্রেন থেকে নামলুম
     
    ও প্যারিস
    পরম উষ্ণ আরামগেহ তোমার পথগুলোর মোড়ের ফুলকি
    আর তার ওপরে হেলে থাকা বাড়িগুলো পরস্পরকে তাপ দেয়
    ঠাকুমা-দিদিমার মতো
    আর এখানে রয়েছে লাল সবুজ সমস্ত রঙের পোস্টার আমার অতীতের মতন
    এক কথায় হলুদ
    ফ্রান্সের উপন্যাসের গর্বিত রঙ হলো হলুদ
    বড়ো শহরগুলোয় যখন বাস যায় আমি তাতে হাত ঘষি
    সঁ-জারমেঁ-মমার্ত রুটে যা আমাকে নিয়ে যায় ছোটো পাহাড়তলিতে
    নিচের মোটরগুলো যেন সোনালি ষাঁড়
    সন্ধ্যায় গরুগুলো সাকরে-কয়েরে চরে বেড়ায়
    ও প্যারিস
    প্রধান স্টেশন যেখানে অস্হিরতার মোড়ে আকাঙ্খাগুলো নামে
    এখন কেবল রঙের দোকানে দরোজায় ছোট্ট আলো জ্বলছে
    ইনটারন্যাশানাল পুলম্যান আর গ্রেট ইউরোপিয়ান এক্সপ্রেস কোম্পানি
    তাদের পুস্তিকা আমাকে পাঠিয়েছে
    এটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গির্জা
    আমার বন্ধুরা আছে যারা আমাকে রেলিঙের মতন ঘিরে থাকে
    ওরা ভয় পায় যে আমি চলে গেলে আর ফিরবো না
     
    প্যারিস
    যে নারীদের সঙ্গে  পরিচিত হয়েছি তারা দিগন্তে আমার চারিধারে দেখা দেয়
    বৃষ্টিতে দুঃখি লাইটহাউসের মতন দেখতে তাদের হাত বাড়িয়ে দেয়
     
    বেলা, অ্যাগনেস, ক্যাথারিন, আর ইতালিতে আমার ছেলের মা
    আর সেই মেয়ে যে আমেরিকায় আমার প্রেমের মা
    অনেক সময়ে হুইসিলের কান্না আমাকে ছিঁড়ে ফ্যালে
    মাঞ্চুরিয়াতে একটি গর্ভ স্পন্দিত হচ্ছে, যেন জন্ম দিতে চলেছে
    আমার ইচ্ছেকে
    আমার ইচ্ছে যে আমার কখনও যাত্রা করা উচিত হয়নি
    আজকের রাতে এক গভীর প্রেম আমাকে পাগল করে তুলছে
    আর আমি ফ্রান্সের ছোট্ট জিনের কথা ভুলতে পারছি না ।
    এক দুঃখের রাতে তার সন্মানে এই কবিতাটা লিখছি
    জিন
    কচি গণিকা
    আমি বড়ো দুঃখি বড়ো দুঃখি
    ফুরিয়ে যাওয়া যৌবনকে মনে আনার জন্য যাচ্ছি লাপাঁ অ্যাগাইল
    কয়েক গেলাস মদ খাবো
    আর বাসায় ফিরবো একা
    প্যারিস
    তুলনাহীন মিনার আর মহান ক্রুশকাঠ আর চাকার শহর
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c21:b62b:743c:8667:dec5:697b | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১৮:২৭740609
  • হাংরি আন্দোলন : মলয় রায়চৌধুরী
    ১৯৫৯-৬০ সালে আমি দুটি লেখা নিয়ে কাজ করছিলুম। একটি হল ইতিহাসের দর্শন যা পরে বিংশ শতাব্দী পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যটি মার্কসবাদের উত্তরাধিকার যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই দুটো লেখা নিয়ে কাজ করার সময়ে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা আমার মাথায় আসে । হাংরি আন্দোলনের ‘হাংরি’ শব্দটি আমি পেয়েছিলুম ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম বাক্যটি থেকে। ওই সময়ে, ১৯৬১ সালে, আমার মনে হয়েছিল যে স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তর ঔপনিবেশিক কালখন্ডে। ‘হাংরি’ মানে খাওয়া নয় ; সাওয়ার হাংরি টাইম মানে ‘পচনরত কালখণ্ড’।
    উপরোক্ত রচনাদুটির খসড়া লেখার সময়ে আমার নজরে পড়েছিল ওসওয়াল্ড স্পেংলারের লেখা দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েষ্ট বইটি, যার মূল বক্তব্য থেকে আমি গড়ে তুলেছিলুম আন্দোলনের দার্শনিক প্রেক্ষিত। ১৯৬০ সালে আমি একুশ বছরের ছিলুম। স্পেংলার বলেছিলেন যে একটি সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফুরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময়ে আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন। আমার মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। এখানে বলা ভালো যে আমি কলাকাতার আদি নিবাসী পরিবার সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশজ, এবং সেজন্যে বহু ব্যাপার আমার নজরে যেভাবে খোলসা হয় তা অন্যান্য লেখকদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
    ওই চিন্তা ভাবনার দরুণ আমার মনে হয়েছিল যে কিঞ্চিদধিক হলেও, এমনকি যদি ডিরোজিওর পর্যায়েও না হয়, তবু হস্তক্ষেপ দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন। আমি আমার বন্ধু দেবী রায়কে, দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে আমার আইডিয়া ব্যাখ্যা করি, এবং প্রস্তাব দিই হাংরি নামে আমরা একটা আন্দোলন আরম্ভ করব। ১৯৫৯ থেকে টানা দুবছরের বেশি সে সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় দাদার চাইবাসার বাড়িতে থাকতেন। দাদার চাইবাসার বাড়ি, যা ছিল নিমডি নামে এক সাঁওতাল-হো অধ্যুষিত গ্রামের পাহাড় টিলার ওপর, সে-সময়ে হয়ে উঠেছিল তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডা। ১৯৬১ সালে যখন হাংরি আন্দোলনের প্রথম বুলেটিন প্রকাশিত হয়, এবং ১৯৬২ সালে বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত, আমরা এই চারজনই ছিলুম আন্দোলনের নিউক্লিয়াস।
    ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের বনেদের ওপর অর্থাৎ আন্দোলনগুলো ছিল টাইম-স্পেসিফিক বা সময় কেন্দ্রিক। কল্লোল গোষ্ঠী এবং কৃত্তিবাস গোষ্ঠী তাঁদের ডিসকোর্সে যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলোও ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক নন্দন-বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেননা সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্থনা নির্ভর এবং তাদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত। সময়ানুক্রমী ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদের পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, এবং স্থানিকতাকে ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে।
    ১৯৬১ সালের প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি আন্দোলন চেষ্টা করল সময়তাড়িত চিন্তাতন্দ্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্র গড়ে তুলতে। সময়ানুক্রমী ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে মননসন্ত্রাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ। ঠিক এই জন্যেই, ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে যাচাই করলে দেখা যাবে যে ব্যক্তিপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোন। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখব যে পুঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে সমসাময়িক শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন। এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীও সীমিত হয়ে গেছে দুতিনজন মেধাস্বত্বাধিকারীর নামে। পক্ষান্তরে, আমরা যদি ঔপনিবেশিক নন্দনতন্ত্রের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবি, তাহলে দেখব যে পদাবলী সাহিত্য নামক স্পেস বা পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাজ; মঙ্গলকাব্য নামক-ম্যাক্রো-পরিসরে পাবো মনসা বা চন্ডী বা শিব বা কালিকা বা শীতলা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর। লক্ষণীয় যে প্রাকঔপনিবেশিক কালখন্ডে এই সমস্ত মাইক্রো-পরিসরগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তার রচয়িতারা নন। তার কারণ সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বের ফসল। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিটি উপনিবেশে গিয়ে এই ফসলটির চাষ করেছে।
    ইতিহাসের দর্শন নিয়ে কাজ করার সময়ে আমার মনে হয়েছিল যে স্পেস বা স্থানিকতার অবদান হল পৃথিবী জুড়ে হাজার রকমের ভাষার মানুষ, হাজার রকমের উচ্চারণ ও বাকশৈলী, যখন কিনা ভাষা তৈরির ব্যাপারে মানুষ জৈবিকভাবে প্রোগ্রামড। একদিকে এই বিস্ময়কর বহুত্ব; অন্যদিকে, সময়কে একটি মাত্র রেখা-বরাবর এগিয়ে যাবার ভাবকল্পনাটি, যিনি ভাবছেন সেই ব্যক্তির নির্বাচিত ইচ্ছানুযায়ী, বহু ঘটনাকে, যা অন্যত্র ঘটে গেছে বা ঘটছে, তাকে বেমালুম বাদ দেবার অনুমিত নকশা গড়ে ফ্যালে। বাদ দেবার এই ব্যাপারটা, আমি সেসময়ে যতটুকু বুঝেছিলুম, স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাঙালির ডিসকোসটি উচ্চবর্গের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায়, যার ফলে নিম্নবর্গের যে প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্স বাঙালি সংস্কৃতিতে ছেয়ে ছিল, তা ঔপনিবেশিক আমলে লোপাট হয়ে যাওয়ায়। আমার মনে হয়েছিল যে ম্যাকলে সাহেবের চাপানো শিক্ষাপদ্ধতির কারণে বাঙালির নিজস্ব স্পেস বা পরিসরকে অবজ্ঞা করে ওই সময়ের অধিকাংশ কবি লেখক মানসিকভাবে নিজেদের শামিল করে নিয়েছিলেন ইউরোপীয় সময়রেখাটিতে। একারণেই, তখনকার প্রাতিষ্ঠানিক সন্দর্ভের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রতিসন্দর্ভের সংঘাত আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল প্রথম বুলেটিন থেকেই এবং তার মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রতিটি বুলেটিন প্রকাশিত হবার সাথে-সাথে, যা আমি বহু পরে জানতে পারি, ‘কাউন্সিল ফর কালচারাল ফ্রিডাম’-এর সচিব এ.বি.শাহ, ‘পি.ই.এন ইনডিয়ার অধ্যক্ষ নিসিম এজেকিয়েল, এবং ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা পুপুল জয়াকরের কাছ থেকে।
    আমনধারা সংঘাত বঙ্গজীবনে ইতোপূর্বে ঘটেছিল। ইংরেজরা সময়কেন্দ্রিক মননবৃত্তি আনার পর প্রাগাধুনিক পরিসরমূলক বা স্থানিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাঙালি ভাবুকের জীবনে ও তার পাঠবস্তুতে প্রচন্ড ঝাঁকুনি আর ছটফটানি, রচনার আদল-আদরায় পরিবর্তনসহ, দেখা দিয়েছিল, যেমন ইয়ং বেঙ্গল সদস্যদের ক্ষেত্রে (হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিরী, রাধানাথ শিকদার, প্যারীচাঁদ মিত্র, শিবচন্দ্র দেব ও দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়) এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও আরও অনেকের ক্ষেত্রে। একইভাবে, হাংরি আন্দোলন যখন সময় কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক চিন্তাতন্ত্র থেকে ছিড়ে আলাদা হয়, উত্তর ঔপনিবেশিক আমলে আবার স্থানিকতার চিন্তাতন্ত্রে ফিরে যাবার চেষ্টা করেছিল, তখন আন্দোলনকারীদের জীবনে, কার্যকলাপে ও পাঠবস্তুর আদল-আদরায় অনুরূপ ঝাঁকুনি, ছটফটানি ও সমসাময়িক নন্দন কাঠামো থেকে নিস্কৃতির প্রয়াস দেখা গিয়েছিল। তা নাহলে আর হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতি, ধর্ম, উদ্দেশ্য, স্বাধীনতা, দর্শনভাবনা, ছবি আঁকা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে ইস্তাহার প্রকাশ করবেন কেন।
    হাংরি আন্দোলনের সময়কাল বেশ দীর্ঘ। ১৯৬১ থেকে আটের দশকের মাঝামাঝি  পর্যন্ত। এই আন্দোলন একটিমাত্র পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একটি শহরের ঘটনা নয়, তাই চেষ্টা করব সমগ্র যুগকে একটি পরিসরে তুলে আনার। হাংরি আন্দোলন নিয়ে অনেক বই আছে, কিন্তু এর আগে সেই বিস্তৃত কালখণ্ডের যুবক-যুবতীদের কর্মকাণ্ডকে ‘হাংরি যুগ’ হিসাবে চিহ্ণিত করে কোনো বই লেখা হয়নি । যে বইগুলো লেখা হয়েছে সেগুলো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ।  হাংরি আন্দোলন সক্রিয় ছিল বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর  পত্রিকার মাধ্যমে, যেমন প্রতিদ্বন্দী, চিহ্ণ, ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার্ত খবর, জিরাফ, ফুঃ, ঋত্বিক, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, ধৃতরাষ্ট্র, ক্ষুধার্ত সময়, ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ, রোবোট, কুরুক্ষেত্র, পাগলা ঘোড়া, দ্রোহ, বিকল্প, দন্দশূক, সময়সূত্র, যুদ্ধযাত্রা, মন্বন্তর, এখন এই রকম, অনার্য, পাখি সব করে রব ইত্যাদি,  এবং  আশির দশকের শেষ পর্যন্ত কলকাতাসহ উত্তরবঙ্গ আর ত্রিপুরার তরুণ কবি-লেখকরা সেই যুগকে করে তোলেন মহামিলন-ক্ষেত্র ।
    সদস্যরা ছিলেন : শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র,  সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, অবনী ধর, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, অজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই,  করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অলোক গোস্বামী, মলয় মজুমদার, রাজা সরকার, কিশোর সাহা, প্রবীর শীল, রতন নন্দী, কুশল বাগচী, সুমন্ত ভট্টাচার্য, পল্লবকান্তি রাজগুরু, চন্দন দে, বিকাশ সরকার, নির্মল হালদার, সূর্য মুখোপাধ্যায়, দেবজ্যোতি রায়, অরুণেশ ঘোষ, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ রাউত, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরণি বসু, প্রিতম মুখোপাধ্যায়, সুনীতা ঘোষ,  রবীন দত্ত, সেলিম মুস্তফা, রবিউল, অরুণ বণিক, রসরাজ নাথ, রত্নময় দে, সাত্বিক নন্দী, নিত্য মালাকার, সুভাষ কুণ্ডু, স্বপন চক্রবর্তী, সুবীর মুখোপাধ্যায়, দীপকজ্যোতি বড়ুয়া, নির্মল হালদার, সৈকত রক্ষিত, রবীন্দ্র মল্লিক, বিজন রায়, স্বপন মুখোপাধ্যায়  প্রমুখ । .
    এই  সময়ে শতাধিক ছাপান আর সাইক্লোস্টাইল করা বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছিল, অধিকাংশই হ্যান্ডবিলের মতন ফালিকাগজে, কয়েকটা দেয়াল-পোস্টারে, তিনটি একফর্মার মাপে, এবং একটি (যাতে উৎপলকুমার বসুর ‘পোপের সমাধি’ শিরোনামের বিখ্যাত কবিতাটি ছিল) কুষ্ঠিঠিকুজির মতন দীর্ঘ কাগজে। এই যে হ্যান্ডবিলের আকারে সাহিত্যকৃতি প্রকাশ, এরও পেছনে ছিল সময়কেন্দ্রিক ভাবধারাকে চ্যালেঞ্জের প্রকল্প। ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের পাঠবস্তুতে তো বটেই, মাইকেল মধুসুদন দত্তর প্রজন্ম থেকে বাংলা সন্দর্ভে প্রবেশ করেছিল শিল্প-সাহিত্যের নশ্বরতা নিয়ে হাহাকার। পরে, কবিতা পত্রিকা সমগ্র, কৃত্তিবাস পত্রিকা সমগ্র, শতভিষা পত্রিকা সমগ্র ইত্যাদি দুই শক্ত মলাটে প্রকাশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপের এই নন্দনতাত্ত্বিক হাহাকারটিকে। পক্ষান্তরে, ফালিকাগজে প্রকাশিত রচনাগুলো দিলদরাজ বিলি করে দেয়া হতো, যে প্রক্রিয়াটি হাংরি আন্দোলনকে দিয়েছিল প্রাকঔপনিবেশিক সনাতন ভারতীয় নশ্বরতাবোধের গর্ব। সেই সব ফালিকাগজ, যারা আন্দোলনটি আরম্ভ করেছিলেন, তাঁরা কেউই সংরক্ষণ করার বোধ দ্বারা তাড়িত ছিলেন না, এবং কারোর কাছেই সবকটি পাওয়া যাবে না। ইউরোপীয় সাহিত্যে নশ্বরতাবোধের হাহাকারের কারণ হল ব্যক্তিমানুষের ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা প্রদান। যে ট্র্যাজেডি-ভাবনা গ্রেকো-রোমান ব্যক্তি এককের পতনযন্ত্রণাকে মহৎ করে তুলেছিল পরবর্তীকালের ইউরোপে তা বাইবেলোক্ত প্রথম মানুষের ‘অরিজিনাল সিন’ তত্ত্বের আশ্রয়ে নশ্বরতাবোধ সম্পর্কিত হাহাকারকে এমন গুরুত্ব দিয়েছিল যে এলেজি এবং এপিটাফ লেখাটি সাহিত্যিক জীবনে যেন অত্যাবশক ছিল।
    আমরা পরিকল্পনা করেছিলুম যে সম্পাদনা ও বিতরণের কাজ দেবী রায় করবেন, নেতৃত্ব দেবেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সংগঠিত করার দিকটা দেখবেন দাদা সমীর রায়চৌধুরী, আর ছাপা এবং ছাপানোর খরচের ভার আমি নেব। প্রথমেই অসুবিধা দেখা দিল। পাটনায় বাংলা ছাপাবার প্রেস পাওয়া গেল না। ফলে ১৯৬১ সালের নভেম্বরে যে বুলেটিন প্রকাশিত হল, তা ইংরেজিতে। এই কবিতার ইশতাহারে আগের প্রজন্মের চারজন কবির নাম থাকায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় ক্ষুন্ন হয়েছিলেন বলে ডিসেম্বরে শেষ প্যারা পরিবর্তন করে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে অংশগ্রহণকারীদের নামসহ এই ইশতাহারটি আরেকবার বেরোয়। ১৯৬২ সালের শেষাশেষি সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। দাদার বন্ধু উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় যোগ দেন। আমার বন্ধু সুবিমল বসাক, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় যোগদেন। সুবিমল বসাকের বন্ধু প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরূপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত সুভাষ ঘোষ, সতীন্দ্র ভৌমিক, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, শৈলেশ্বর ঘোষ, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পান্ডা, মনোহার দাশ যোগ দেন। তখনকার দিনে বামপন্থী ভাবধারার বুদ্ধিজীবীদের ওপর পুলিশ নজর রাখত। দেবী রায় লক্ষ্য করেন নি যে পুলিশের দুজন ইনফর্মার হাংরি আন্দোলনকারীদের যাবতীয় বই পত্র, বুলেটিন ইত্যাদি সংগ্রহ করে লালবাজারের প্রেস সেকশানে জমা দিচ্ছে এবং সেখানে ঢাউস সব ফাইল খুলে ফেলা হয়েছে।
    এতজনের লেখালিখি থেকে সেই সময়কার প্রধান সাহিত্যিক সন্দর্ভের তুলনায় হাংরি আন্দোলন যে প্রদিসন্দর্ভ গড়ে তুলতে চাইছিল, সে রদবদল ছিল দার্শনিক এলাকার, বৈসাদৃশ্যটা ডিসকোর্সের, পালাবদলটা ডিসকার্সিভ প্র্যাকটিসের, বৈভিন্ন্যটা কখন-ভাঁড়ারের, পার্থক্যটা উপলব্ধির স্তরায়নের, তফাতটা প্রস্বরের, তারতম্যটা কৃতি-উৎসের। তখনকার প্রধান মার্কেট-ফ্রেন্ডলি ডিসকোর্সটি ব্যবহৃত হতো কবিলেখকের ব্যক্তিগত তহবিল সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। হাংরি আন্দোলনকারীরা সমৃদ্ধ করতে চাইলেন ভাষার তহবিল, বাচনের তহবিল, বাকবিকল্পের তহবিল, অন্ত্যজ শব্দের তহবিল, শব্দার্থের তহবিল, নিম্নবর্গীয় বুলির তহবিল, সীমালঙ্ঘনের তহবিল, অধ:স্তরীয় রাগবৈশিষ্ট্যের তহবিল, স্পৃষ্টধ্বনির তহবিল, ভাষিক ইরর্যাশনালিটির তহবিল, শব্দোদ্ভটতার তহবিল, প্রভাষার তহবিল, ভাষিক ভারসাম্যহীনতার তহবিল, রূপধ্বনির প্রকরণের তহবিল, বিপর্যাস সংবর্তনের তহবিল, স্বরন্যাসের তহবিল, পংক্তির গতিচাঞ্চল্যের তহবিল, সন্নিধির তহবিল, পরোক্ষ উক্তির তহবিল, স্বরণ্যাসের তহবিল, পাঠবস্তুর অন্তঃস্ফোটিক্রিয়ার তহবিল, তড়িত বাঞ্জনার তহবিল, অপস্বর-উপস্বরের তহবিল, সাংস্কৃতিক সন্নিহিতির তহবিল, বাক্যের অধোগঠনের তহবিল, খন্ডবাক্যের তহবিল, বাক্যনোঙরের তহবিল, শীংকৃত ধ্বনির তহবিল, সংহিতাবদলের তহবিল, যুক্তিছেদের তহবিল, আপতিক ছবির তহবিল, সামঞ্জস্যভঙ্গের তহবিল, কাইনেটিক রূপকল্পের তহবিল ইত্যাদি।
    ইতোপূর্বে ইযংবেঙ্গলের সাংস্কৃতিক উথাল-পাথাল ঘটে থাকলেও, বাংলা শিল্প সাহিত্যে আগাম ঘোষণা করে, ইশতাহার প্রকাশ করে, কোন আন্দোলন হয়নি। সাহিত্য এবং ছবি আঁকাকে একই ভাবনা-ফ্রেমে আনার প্রয়াস, পারিবারিক স্তরে হয়ে থাকলেও, সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর মাধ্যমে হয়নি। ফলত দর্পণ, জনতা, জলসা ইত্যাদি পত্রিকায় আমাদের সম্পর্কে বানানো খবর পরিবেশিত হওয়া আরম্ভ হল। হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক ইশতাহার নিয়ে প্রধান সম্পাদকীয় বেরোল যুগান্তর দৈনিকে। আমার আর দেবী রায়ের কার্টুন প্রকাশিত হল দি স্টেটসম্যান পত্রিকায়। হেডলাইন হল ব্রিৎস পত্রিকায়। সুবিমল বসারের প্রভাবে হিন্দি ভাষায় রাজকমল চৌধুরী আর নেপালি ভাষায় পারিজাত হাংরি আন্দোলনের প্রসার ঘটালেন। আসামে ছড়িয়ে পড়ল পাঁক ঘেটে পাতালে পত্রিকাগোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে। ছড়িয়ে পড়ল বগুড়ার বিপ্রতীক এবং ঢাকার স্বাক্ষর ও কণ্ঠস্বর পত্রিকাগুলোর সদস্যদের মাঝে, এবং মহারাষ্ট্রের অসো পত্রিকার সদস্যদের ভেতর। ঢাকার হাংরি আন্দোলনকারীরা (বুলবুল খান মাহবুব, অশোক সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, শহিদুর রহমান, প্রশান্ত ঘোষাল, মুস্তফা আনোয়ার প্রমুখ) জানতেন না যে আমি কেন প্রথম হাংরি বুলেটিনগুলো ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলুম। ফলে তাঁরাও আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন ইংরেজিতে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে।
    যার-যেমন-ইচ্ছে লেখালেখির স্বাধীনতার দরুন হাংরি আন্দোলনকারীদের পাঠবস্তুতে যে অবাধ ডিক্যাননাইজেশান, আঙ্গিকমুক্তি, যুক্তিভঙ্গ, ডিন্যারেটিভাইজেশান, অনির্ণেয়তা, মুক্ত সমাপ্তি ইত্যাদির সূত্রপাত ঘটে, সেগুলোর যথার্থ সার্থকতা ও প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকেন তখনকার বিদ্যায়তনিক আলোচকরা, যাঁরা বিবিধতাকে মনে করেছিলেন বিশৃঙ্খলা, সমরূপ হবার অস্বীকৃতিকে মনে করেছিলেন অন্তর্ঘাত, সন্দেহপ্রবণতাকে মনে করেছিলেন অক্ষমতা, ঔপনিবেশিক চিন্তনতন্ত্রের বিরোধীতাকে মনে করেছিলেন অসামাজিক, ক্ষমতাপ্রতাপের প্রতিরোধকে মনে করেছিলেন সত্যের খেলাপ। তাঁদের ভাবনায় মতবিরোধিতা মানেই যেন অসত্য, প্রতিবাদের যন্ত্রানুষঙ্গ যেন সাহিত্যসম্পর্কহীন। মতবিরোধিতা যেহেতু ক্ষমতার বিরোধিতা, তাই তাঁরা তার যে কোন আদল ও আদরাকে হেয় বলে মনে করেছিলেন, কেননা প্রতিবিম্বিত ভাবকল্পে মতবিরোধীতা অনিশ্চয়তার প্রসার ঘটায়, বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত করে বলে অনুমান করে নেয়া হয়, তা যদি সাহিত্যকৃতি হয় তাহলে সাহিত্যিক মননবিশ্বে, যদি রাজনৈতিক কর্মকান্ড হয় তাহলে রাষ্ট্রের অবয়বে। এখানে বলা দরকার যে, পশ্চিমবাংলায় তখনও রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেনি। তখনকার প্রতিবিম্বিত বিদ্যায়তনিক ভাবাদর্শে, অতএব, যারা মতবিরোধের দ্বারা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছিল, অর্থাৎ হাংরি আন্দোলনকারীরা, তারা অন্যরকম, তারা অপর, তারা প্রান্তিক, তারা অনৈতিক, তারা অজ্ঞান, তারা সত্যের মালিকানার অযোগ্য। বলাবাহুল্য যে, ক্ষমতা ও সত্যের অমনতর পার্থক্যহীন পরিসরে যাদের হাতে ক্ষমতা তাদের কব্জায় সত্যের প্রভূত্ব। অজ্ঞানের চিন্তাভাবনাকে মেরামত করার দায়, ওই তর্কে, সুতরাং, সত্য মালিকের।
    প্রাগুক্ত মেরামতির কাজে নেমে বিদ্যায়তনিক আলোচকরা হাংরি আন্দোলনের তুলনা করতে চাইছিলেন পাঁচের দশকে ঘটে যাওয়া দুটি পাশ্চাত্য আন্দোলনের সঙ্গে। ব্রিটেনের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ও আমেরিকার বিট জেনারেশনের সঙ্গে। তিনটি বিভিন্ন দেশের ঘটনাকে তাঁরা এমনভাবে উল্লেখ ও উপস্থাপন করতেন, যেন এই তিনটি একই প্রকার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, এবং তিনটি দেশের আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামো, কৌমসমাজের ক্ষমতা-নকশা, তথা ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মিতির উপাদানগুলো অভিন্ন। আমার মনে হয় বিদ্যায়তনিক ভাবনার প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে সীমিত ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞতা, অর্থাৎ কেবলমাত্র বাংলা ভাষাসাহিত্য বিষয়ক পঠন-পাঠন। যার দরুণ সমাজ ও ব্যক্তিমানুষের জীবনকে তাঁরা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন সাহিত্যের উপকরণ প্রয়োগ করে। যে-সমস্ত উপাদানের সাহায্যে কৌমসমাজটি তার ব্যক্তি এককদের প্রতিস্ব নির্মাণ করে, সেগুলো ভেবে দেখার ও বিশ্লেষণের প্রয়াস তাঁরা করতেন না। প্রতিস্ব-বিশেষের পাঠবস্তু কেন অমন চেহারায় গোচরে আসছে, টেক্সট-বিশেষের প্রদায়ক গুণনীয়ক কী-কী, পুঁজিপ্রতাপের কৌমকৃৎকৌশল যে প্রতিস্ব-পীড়ন ঘটাচ্ছে তার পাপে পাঠবস্ত-গঠনে মনস্তাত্ত্বিক ও ভাষানকশা কীভাবে ও কেন পাল্টাচ্ছে, আর তাদের আখ্যান ঝোঁকের ফলশ্রুতিই বা কেন অমনধারা, এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার বদলে, তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত ভালোলাগা (ফিল গুড) নামক সাবজেকটিভ খপ্পরে পড়ে পাঠক-সাধারণকে সেই ফাঁদে টানতে চাইতেন। যে কোনও পাঠবস্ত একটি স্থানিক কৌমসমাজের নিজস্ব ফসল। কৌমনিরপেক্ষ পাঠবস্ত অসম্ভব।
    কেবল উপরোক্ত দুটি পাশ্চাত্য সাহিত্যিক ঘটনা নয়, ষাটের দশকের বাংলা সাহিত্যে অন্যান্য যে আন্দোলনগুলো ঘটেছিল, যেমন নিমসাহিত্য, শ্রুতি, শাস্ত্রবিরোধী এবং ধ্বংসকালীন, তাদের সঙ্গেও হাংরি আন্দোলনের জ্ঞান-পরিমন্ডল, দর্শন-পরিসর, প্রতিপ্রশ্ন-প্রক্রিয়া, অভিজ্ঞতা-বিন্যাস, চিন্তার-আকরণ, প্রতীতি, বিশ্লেষণী আকল্প, প্রতিবেদনের সীমান্ত, প্রকল্পনার মনোবীজ, বয়ন-পরাবয়ন, ভাষা-পরাভাষা, জগৎ-পরাজগৎ, বাচনিক নির্মিতি, সত্তাজিজ্ঞাসা, উপস্থাপনার ব্যঞ্জনা, অপরত্ববোধ, চিহ্নাদির অন্তর্বয়ন, মানবিক সম্পর্ক বিন্যাসের অনুষঙ্গ, অভিধাবলীর তাৎপর্য, উপলব্ধির উপকরণ, স্বভাবাতিযায়ীতা, প্রতিস্পর্ধা, কৌমসমাজের অর্গল, গোষ্ঠীক্রিয়ার অর্থবহতা, প্রতাপবিরোধী অবস্থানের মাত্রা, প্রতিদিনের বাস্তব, প্রান্তিকায়নের স্বাতন্ত্র্য, বিকল্প অবলম্বন সন্ধান, চিহ্নায়নের অন্তর্ঘাত, লেখন-গ্রন্থনা, দেশজ অধিবাস্তব, অভিজ্ঞতার সূত্রায়ন-প্রকরণ, প্রেক্ষাবিন্দুর সমন্বয়, সমষ্টী পীড়াপুঞ্জ ইত্যাদি ব্যাপারে গভীর ও অসেতুসম্ভব পার্থক্য ছিল। ষাটের দশকের ওই চারটি আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি প্রতিসন্দর্ভের যে-মিল ছিল তা হল এই যে পাঁচটি আন্দোলনই লেখকপ্রতিম্ব থেকে রোশনাইকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পাঠবস্তর ওপর। অর্থাৎ লেখকের কেরামতি বিচার্য নয়, যা বিচার্য তা হল পাঠবস্তুর খুঁটিনাটি। লেখকের বদলে পাঠবস্তু যে গুরুত্বপূর্ণ, এই সনাতন ভারতীয়তা, মহাভারত ও রামায়ণ পাঠবস্তু দুটির দ্বারা প্রমাণিত।
    অনুশাসন মুক্তির ফলে, লিটল ম্যাগাজিনের নামকরণের ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল হাংরি আন্দোলন, যে, তারপর থেকে পত্রিকার নাম রাখার ঐতিহ্য একবারে বদলে গেল। কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস, শতভিষা, উত্তরসূরী, অগ্রণী ইত্যাদি থেকে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে হাংরি আন্দালনকারীরা তাঁদের পত্রিকার নাম রাখলেন জেব্রা, উন্মার্গ, ওয়েস্টপেপার, ফুঃ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদি। অবশ্য সাহিত্য শিল্পকে উন্মার্গ আখ্যাটি জীবনানন্দ দাশ বহু পূর্বে দিয়ে গিয়েছিলেন, যদিও হাংরি আন্দালনের সময় পর্যন্ত তিনি তেমন প্রতিষ্ঠা পান নি। জেব্রা নামকরণটি ছিল পাঠকের জন্যে নিশ্চিন্তে রাস্তা পার হয়ে হাংরি পাঠবস্তুর দিকে এগোবার ইশারা। হাংরি আন্দোলন সংঘটিত হবার আগে ওই পত্রিকাগুলোর নামকরণেই কেবল এলিটিজম ছিল তা নয়, সেসব পত্রিকাগুলোর একটি সম্পাদকীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। বুর্জোয়া মূল্যবোধ প্রয়োগ করে একে-তাকে বাদ দেয়া বা ছাঁটাই করা, যে কারণে নিম্নবর্ণের লেখকের পাঠবস্ত সেগুলোর পৃষ্ঠায় অনুপস্থিত, বিশেষ করে কবিতা। আসলে কোন-কোন রচনাকে ‘টাইমলেস’ বলা হবে সে জ্ঞানটুকু ওই মূল্যবোধের ধারক-বাহকরা মনে করতেন তাঁদের কুক্ষিগত, কেননা সময় তো তাঁদের চোখে একরৈখিক, যার একেবারে আগায় আছেন কেবল তাঁরা নিজে।
    ‘টাইমলেস’ কাজের উদ্বেগ থেকে পয়দা হয়েছিল ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ ভাবকল্পটি, যা উপনিবেশগুলোয় চারিয়ে দিয়ে মোক্ষম চাল দিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ। এই ভাবকল্পটির দ্বারা কালো, বাদামি, হলদে চামড়ার মানুষদের বহুকাল পর্যন্ত এমন সম্মোহিত করে রেখেছিল সাম্রাজ্যবাদী নন্দনভাবনা যাতে সাহিত্য-শিল্প হয়ে যায় উদ্দেশ্যহীন ও সমাজমুক্ত, যাতে পাঠবস্তু হয়ে যায় বার্তাবর্জিত, যাতে সন্দর্ভের শাসক-বিরোধী অন্তর্ঘাতী ক্ষমতা লুপ্ত হয়, এবং তা হয়ে যায় জনসংযোগহীন। হাংরি বুলেটিন যেহেতু প্রকাশিত হতো হ্যান্ডবিলের মতন ফালিকাগজে, তা পরের দিনই সময় থেকে হারিয়ে যেত। নব্বইটির বেশি বুলেটিন চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে। লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির পক্ষেও ও বুলেটিনগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি।
    যে কোন আন্দোলনের জন্ম হয় কোন না কোন আধিপত্য প্রণালীর বিরুদ্ধে। তা সে রাজনৈতিক আধিপত্য হোক বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক, নান্দনিক, ধার্মিক, সাহিত্যিক, শৈল্পিক ইত্যাদি আধিপত্য হোক না কেন। আন্দোলন-বিশেষের উদ্দেশ্য, অভিমুখ, উচ্চাকাঙ্খা, গন্তব্য হল সেই প্রণালীবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে পরিসরটিকে মুক্ত করা। হাংরি আন্দোলন কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প ছিল না। যে কোন কবি বা লেখক, ওই আন্দোলনের সময়ে যিনি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করেছেন, তাঁর খুল্লমখুল্লা স্বাধীনতা ছিল হাংরি বুলেটিন বের করার। বুলেটিনগুলোর প্রকাশকদের নাম-ঠিকানা দেখলেই স্পষ্ট হবে (অন্তত যে-কটির খোঁজ মিলেছে তাদের ক্ষেত্রেও) যে, তা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্নজন কর্তৃক ১৯৬৩-র শেষ দিকে এবং ১৯৬৪-র প্রথমদিকে প্রকাশিত। ছাপার খরচ অবশ্য আমি বা দাদা যোগাতাম, কেননা, অধিকাংশ আন্দোলনকারীর আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপল কুমার বসুও নিজের খরচে প্রকাশ করেছিলেন বুলেটিন। অর্থাৎ হাংরি বুলেটিন কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না। এই বোধের মধ্যে ছিল পূর্বতন সন্দর্ভগুলোর মনোবীজে লুকিয়ে থাকা সত্ত্বাধিকার বোধকে ভেঙে ফেলার প্রতর্ক যা সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা এদেশে এনেছিল। ইউরোপীয়রা আসার আগে বঙ্গদেশে পার্সোনাল পজেশান ছিল, কিন্তু প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না।
    হাংরি আন্দোলনের কোন হেড কোয়ার্টার, হাইকমান্ড, গভর্নিং কাউনসিল বা সম্পাদকের দপ্তর ধরণের ক্ষমতাকেন্দ্র ছিল না, যেমন ছিল কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস ইত্যাদি পত্রিকার ক্ষেত্রে, যার সম্পাদক বাড়ি বদল করলে পত্রিকা দপ্তরটি নতুন বাড়িতে উঠে যেত। হাংরি আন্দোলন কুক্ষিগত ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারণাকে অতিক্রম করে প্রতিসন্দর্ভকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রান্তবর্তী এলাকায়, যে কারণে কেবল বহির্বঙ্গের বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক ছাড়াও তা হিন্দি, উর্দু, নেপলি, অসমীয়া, মারাঠি ইত্যাদি ভাষায় ছাপ ফেলতে পেরেছিল। এখনও মাঝে মধ্যে কিশোর-তরুণরা এখান-সেখান থেকে নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে গর্বিত হন, যখন কিনা আন্দোলনটি চল্লিশ বছর আগে, ১৯৬৫ সালে ফুরিয়ে গিয়েছে।
    বিয়াল্লিশ বছর আগে সুবিমল বসাক, হিন্দি কবি রাজকমল চৌধুরীর সঙ্গে, একটি সাইক্লোস্টাইল করা ত্রিভাষিক (বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি) হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন, তদানীন্তন সাহিত্যিক সন্দর্ভের প্রেক্ষিতে হাংরি প্রতিসন্দর্ভ যে কাজ উপস্থাপন করতে চাইছে তা স্পষ্ট করার জন্যে। তাতে দেয়া তালিকাটি থেকে আন্দোলনের অভিমুখের কিছুটা হদিশ মিলবে:
    ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে সুবিমল বসাকের আঁকা বেশ কিছু লাইন ড্রইং, যেগুলো ঘন-ঘন হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হচ্ছিল, তার দরুণ তাঁকে পরপর দুবার কফিহাউসের সামনে ঘিরে ধরলেন অগ্রজ বিদ্বজ্জন এবং প্রহারে উদ্যত হলেন, এই অজুহাতে যে সেগুলো অশ্লীল। একই অজুহাতে কফিহাউসের দেয়ালে সাঁটা অনিল করঞ্জাইয়ের আঁকা পোস্টার আমরা যতবার লাগালুম ততবার ছিঁড়ে ফেলে দেয়া হল। বোঝা যাচ্ছিল যে, কলোনিয়াল ইসথেটিক রেজিমের চাপ তখনও অপ্রতিরোধ্য। হাংরি আন্দোলনের ১৫ নম্বর বুলেটিন এবং ৬৫ নং বুলেটিন, যথাক্রমে রাজনৈতিক ও ধর্ম সম্পর্কিত ইশতাহারের, যাকে বলে স্লো বলিং এফেক্ট, আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, এবং আমাদের অজ্ঞাতসারে ক্রুদ্ধ করে তুলছিল মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের এসট্যাবলিশমেন্টকে। আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে ইশতাহার দুটিকে অলমোস্ট প্রফেটিক বলা যায়। এরপর, যখন রাক্ষস জোকার মিকিমাউস জন্তজানোয়ার ইত্যাদির কাগুজে মুখোশে ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন’ বার্তাটি ছাপিয়ে হাংরি আন্দোলনের পক্ষ থেকে মুখ্য ও অন্যান্য মন্ত্রীদের মুখ্য ও অন্যান্য সচিবদের জেলা শাসকদের, সংবাদপত্র মালিক ও সম্পাদকদের, বাণিজ্যিক লেখকদের পাঠান হল, তখন সমাজের এলিট অধিপতিরা আসরে নামলেন। এ ব্যাপারে কলকাঠি নাড়লেন একটি পত্রিকা গোষ্ঠীর মালিক, তাঁর বাংলা দৈনিকের বার্তা সম্পাদক এবং মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের খোরপোষে প্রতিপালিত একটি ইংরেজি ত্রৈমাসিকের কর্তাব্যক্তিরা।
    ১৯৬৪ এর সেপ্টেম্বরে রাষ্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার হলুম আমি, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ এবং দাদা সমীর রায়চৌধুরী। এই অভিযোগে উৎপল কুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইসু হয়ে থাকলেও, তাঁদের প্রেপ্তার করা হয়নি। এরকম একটি অভিযোগ এই জন্যে চাপান হয়েছিল যাতে বাড়ি থেকে থানায় এবং থানা থেকে আদালতে হাতে হাতকড়া পরিয়ে আর কোমরে দড়ি বেঁধে চোরডাকাতদের সঙ্গে সবায়ের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। অন্তর্ঘাতের অভিযোগটি সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ থেকে মে ১৯৬৫ পর্যন্ত বজায় ছিল, এবং ওই নয় মাস যাবৎ রাষ্ট্রযন্ত্রটি তার বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনকারীরূপে চিহ্নিত প্রত্যেকের সম্পর্কে খুটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছিল, এবং তাদের তখন পর্যন্ত যাবতীয় লেখালেখি সংগ্রহ করে ঢাউস-ঢাউস ফাইল তৈরি করেছিল, যেগুলো লালবাজারে পুলিশ কমিশনারের কনফারেন্স রুমের টেবিলে দেখেছিলুম, যখন কলকাতা পুলিশ, স্বরাষ্ট্র দফতর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ ও ভারতীয় সেনার উচ্চপদস্থ আধিকারিক এবং পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারালকে নিয়ে গঠিত একটি বোর্ড আমাকে আর দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে কয়েক ঘন্টা জেরা করেছিল।
    অভিযোগটি কোন সাংস্কৃতিক অধিপতির মস্তিস্কপ্রসূত ছিল জানি না। তবে অ্যাডভোকেট জেনারেল মতামত দিলেন যে এরকম আজেবাজে তথ্যের ওপর তৈরি এমন সিরিয়াস অভিযোগ দেখলে আদালত চটে যাবে। তখনকার দিনে টাডা-পোটা ধরণের আইন ছিল না। ফলত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নিয়ে ১৯৬৫ সালের মে মাসে বাদবাকি সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হল, এই অভিযোগে যে সাম্প্রতিকতম হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত আমার ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি অশ্লীল। আমার বিরুদ্ধে মামলাটা দায়ের করা সম্ভব হল শৈলেশ্বর ঘোষ এবং সুভাষ ঘোষ আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন বলে। অর্থাৎ হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে গেল। ওনারা দুজনে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুচলেকা দিলেন, যার প্রতিলিপি চার্জশিটের সঙ্গে আদালত আমায় দিয়েছিল ।
    প্রসিকিউশনের পক্ষে এই দুজন রাজসাক্ষীকে তেমন নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি । তাই আমার বিরুদ্ধে সমীর বসু আর পবিত্র বল্লভ নামে দুজন ভুয়ো সাক্ষীকে উইটনেস বক্সে তোলা হয়, যাদের আমি কোন জন্মে দেখিনি, অথচ যারা এমনভাবে সাক্ষ্য দিয়েছিল যেন আমার সঙ্গে কতই না আলাপ-পরিচয়। এই দুজন ভুয়ো সাক্ষীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমাকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা। আমার কৌশুলিদের জেরায় এরা দুজন ভুয়ো প্রমাণ হবার সম্ভাবনা দেখা দিলে প্রসিকিউশন আমার বিরুদ্ধে উইটনেস বক্সে তোলে, বলাবাহুল্য গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে। ফলে আমিও আমার পক্ষ থেকে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করাই জ্যোতির্ময় দত্ত, তরুণ সান্যাল আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। বহু সাহিত্যিককে অনুরোধ করেছিলুম, কিন্তু এনারা ছাড়া আর কেউ রাজি হননি। শক্তি এবং সুনীল, দুই বন্ধু, একটি মকদ্দমায় পরস্পরের বিরুদ্ধে, চল্লিশ বছর পর ব্যাপারটা অবিশ্বস্য মনে হয়। সবায়ের সাক্ষ্য ছিল বেশ মজাদার, যাকে বলে কোর্টরুম-ড্রামা।
    তেরটা আদালতঘরের মধ্যে আমার মকদ্দমাটা ছিল নয় নম্বর এজলাসে। বিচারকের মাথার ওপর হলদে টুনি বালবটা ছাড়া আলোর বালাই ছিল না জানালাহীন ঘরটায়। অবিরাম ক্যাচোর-ক্যাচোর শব্দে অবসর নেবার অনুরোধ জানাত দুই ব্লেডের বিশাল ছাদপাখা। পেশকার গাংগুলি বাবুর অ্যান্টিক টেবিলের লাগোয়া বিচারকের টানা টেবিল, বেশ উঁচু, ঘরের এক থেকে আরেক প্রান্ত, বিচারকের পেছনে দেয়ালে টাঙানো মহাত্মা গান্ধীর ফোকলা-হাসি রঙিন ছবি। ইংরেজরা যাবার পর চুনকাম হয়নি ঘরটা। হয়ত ঘরের ঝুলগুলোও তখনকার। বিচারকের টেবিলের বাইরে, ওনার ডান দিকে, দেয়াল ঘেঁষে, জাল-ঘেরা লোহার শিকের খাঁচা, জামিন-না-পাওয়া বিচারাধীনদের জন্যে, যারা ওই খাঁচার পেছনের দরোজা দিয়ে ঢুকত। খাঁচাটা অত্যন্ত নোংরা। আমি যেহেতু ছিলুম জামিনপ্রাপ্ত, দাঁড়াতুম খাঁচার বাইরে। ঠ্যাঙ ব্যথা করলে, খাঁচায় পিঠ ঠেকিয়ে।
    পেশকার মশায়ের টেবিলের কাছাকাছি থাকত গোটাকতক আস্ত-হাতল আর ভাঙা-হাতল চেয়ার, কৌঁসুলিদের জন্যে। ঘরের বাকিটুকুতে ছিল নানা মাপের, আকারের, রঙের নড়বড়ে বেঞ্চ আর চেয়ার, পাবলিকের জন্যে, ছারপোকা আর খুদে আরশোলায় গিজগিজে। টিপেমারা ছারপোকার রক্তে, পানের পিকে, ঘরের দেয়ালময় ক্যালিগ্রাফি। বসার জায়গা ফাঁকা থাকত না। কার মামলা কখন উঠবে ঠিক নেই। ওই সর্বভারতীয় ঘর্মাক্ত গ্যাঞ্জামে, ছারপোকার দৌরাত্মে, বসে থাকতে পারতুম না বলে সারা বাড়ি এদিক-ওদিক ফ্যা-ফ্যা করতুম, এ-এজলাস সে-এজলাস চক্কর মারতুম, কৌতুহলোদ্দীপক সওয়াল-জবাব হলে দাঁড়িয়ে পড়তুম। আমার কেস ওঠার আগে সিনিয়ার উকিলের মুহুরিবাবু আমায় খুঁজে পেতে ডেকে নিয়ে যেতেন। মুহুরিবাবু মেদিনীপুরের লোক, পরতেন হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, ক্যাম্বিশের জুতো, ছাইরঙা শার্ট। সে শার্টের ঝুল পেছন দিকে হাঁটু পর্যন্ত আর সামনে দিকে কুঁচকি পর্যন্ত। হাতে লম্বালম্বি ভাঁজ করা ফিকে সবুজ রঙ্গের দশ-বারটা ব্রিফ, যেগুলো নিয়ে একতলা থেকে তিনতলার ঘরে-ঘরে লাগাতার চরকি নাচন দিতেন।
    আমার সিনিয়র উকিল ছিলেন ক্রিমিনাল লয়ার চন্ডীচরণ মৈত্র। সাহিত্য সম্পর্কে ওনার কোন রকম ধারণা ছিল না বলে লেবার কোর্টের উকিল সতেন বন্দ্যোপাধ্যায়কেও রাখতে হয়েছিল। চাকরি থেকে সাসপেন্ডেড ছিলুম কেস চলার সময়ে, তার ওপর কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাই ছিল না। খরচ সামলানো অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল।
    আদালত চত্বরটা সবসময় ভিড়ে গিজগিজ করত। ফেকলু উকিলরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে “সাক্ষী চাই? সাক্ষী চাই? এফিডেফিট হবে।” বলে-বলে চেচাত মক্কেল যোগাড়ের ধান্দায়। সারা বাড়ি জুড়ে যেখানে টুলপেতে টাইপরাইটারে ফটর ফটর ট্যারাবেকা টাইপ করায় সদাব্যস্ত টাইপিস্ট, পাশে চোপসানো মুখ লিটিগ্যান্ট। একতলায় সর্বত্র কাগজ, তেলেভাজা, অমলেট, চা-জলখাবার, ভাতরুটির ঠেক। কোর্ট পেপার কেনার দীর্ঘ কিউ। চাপরাসি- আরদালির কাজে যে সব বিহারিদের আদালতে চাকরি দিয়েছিল ইংরেজরা, তারা চত্বরের খোঁদলগুলো জবরদখল করে সংসার পেতে ফেলেচে। জেল থেকে খতরনাক আসামিরা পুলিশের বন্ধ গাড়িতে এলে, পানাপুকুরে ঢিল পড়ার মতন একটু সময়ের জন্যে সরে যেত ভিড়টা। তারপর যে কে সেই। সন্দর্ভ ও প্রতিসন্দর্ভের সামাজিক সংঘাতক্ষেত্র হিসেবে আদালতের মতন সংস্থা সম্ভবত আর নেই। 
    সাক্ষ্যাদি শেষ হবার পর দুপক্ষের দীর্ঘ বহস হল একদিন, প্রচুর তর্কাতর্কি হল। আমি খাঁচার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে। রায় দেবার দিন পড়ল ১৯৬৫ সালের আঠাশে ডিসেম্বর। ইতিমধ্যে আমেরিকার ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে সংবাদ হয়ে গেছি। যুগান্তর দৈনিকে ‘আর মিছিলের শহর নয়’ এবং ‘যে ক্ষুধা জঠরের নয়’ শিরোনামে প্রধান সম্পাদকীয় লিখলেন কৃষ্ণ ধর। যুগান্তর দৈনিকে সুফী এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় চন্ডী লাহিড়ী কার্টুন আঁকলেন আমায় নিয়ে। সমর সেন সম্পাদিত ‘নাউ’ পত্রিকায় পরপর দুবার লেখা হল আমার সমর্থনে। দি স্টেটসম্যান পত্রিকায় হাংরি আন্দোলনের সমর্থনে সমাজ-বিশ্লেষণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। ধর্মযুগ, দিনমান, সম্মার্গ, সাপ্তাহিক হিন্দুস্থান, জনসত্তা পত্রিকায় উপর্যুপরি ফোটো ইত্যাদিসহ লিখলেন ধর্মবীর ভারতী, এস. এইচ. বাৎসায়ন অজ্ঞেয়, ফনীশ্বর নাথ রেণু, কমলেশ্বর, শ্রীকান্ত ভর্মা, মুদ্রারাক্ষস, ধুমিল, রমেশ বকশি প্রমুখ। কালিকটের মালায়ালি পত্রিকা যুগপ্রভাত হাংরি আন্দোলনকে সমর্থন করে দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করল। বুয়েনস আয়ার্স-এর প্যানারোমা পত্রিকার সাংবাদিক আমার মকদ্দমা কভার করল। পাটনার দৈনিক দি সার্চলাইট প্রকাশ করল বিশেষ ক্রোড়পত্র। বিশেষ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা প্রকাশ করল জার্মানির ক্ল্যাকটোভিডসেডস্টিন পত্রিকা, এবং কুলচুর পত্রিকা ছাপলো সবকটি ইংরেজি ম্যানিফেস্টো। আমেরিকায় হাংরি আন্দোলনকারীদের ফোটো, ছবি-আঁকা, রচনার অনুবাদ ইত্যাদি নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করল সল্টেড ফেদার্স, ট্রেস, ইনট্রেপিড, সিটি লাইটস জার্নাল, সান ফ্রানসিসকো আর্থকোয়েক, র্যামপার্টস, ইমেজো হোয়্যার ইত্যাদি লিটল ম্যাগজিন। সম্পাদকীয় প্রকাশিত হল নিউ ইয়র্কের এভারগ্রিন রিভিউ, আর্জেনটিনার এল কর্নো এমপ্লমাদো এবং মেকসিকোর এল রেহিলেতে পত্রিকায়। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায় টিটকিরি মারা ছাড়া আর কিছু করেন নি বাঙ্গালি সাহিত্যিকরা।
    ভুয়ো সাক্ষী, রাজ সাক্ষী আর সরকারি সাক্ষীদের বক্তব্যকে যথার্থ মনে করে আমার পক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্য নাকচ করে দিলেন ফৌজদারি আদালতের বিচারক। দুশো টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের কারাদান্ড ধার্য করলে তিনি। আমি হাইকোর্টে রিভিশন পিটিশন করার জন্যে আইনজীবির খোঁজে বেরিয়ে দেখলুম যে খ্যাতিমান কৌঁসুলিদের এক দিনের বহসের ফি প্রায় লক্ষ টাকা, অনেকে প্রতি ঘন্টা হিসেবে চার্জ করেন, তাঁরা ডজনখানেক সহায়ক উকিল দুপাশে দাঁড় করিয়ে বহস করেন। জ্যোতির্ময় দত্ত পরিচয় করিয়ে দিলেন সদ্য লন্ডন-ফেরত ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে। তাঁর সৌজন্যে আমি তখনকার বিখ্যাত আইনজীবি মৃগেন সেনকে পেলুম। নিজের সহায়কদের নিয়ে তিনি কয়েক দিন বসে তর্কের স্ট্রাটেজি কষলেন। ১৯৬৭ সালের ছাব্বিশে জুলাই আমার রিভিশন পিটিশানের শুনানি হল। নিম্ন আদালতের রায় নাকচ করে দিলেন বিচারক টি. পি. মুখার্জি। ফিস ইন্সটলমেন্টে দেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন করুণাশঙ্কর রায়।
    হাংরি আন্দোলন চল্লিশ বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন শুরু হয়েছে তাকে নিয়ে ব্যবসা। সমীর চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি (আমার দাদার নামের মিলটা কাজে লাগান হয়েছে) ‘হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন’ নামে একটা বই বের করেছেন। তাতে অন্তর্ভূক্ত অধিকাংশ লেখককে আমি চিনি না। শক্তি, সন্দীপন, উৎপল, বিনয়, সমীর, দেবী, সুবিমল, এবং আমার রচনা তাতে নেই। অনিল, করুণা, সুবিমলের আঁকা ছবি নেই। একটিও ম্যানিফেস্টো নেই। বাজার নামক ব্যাপারটি একটি ভয়ংকর সাংস্কৃতিক সন্দর্ভ।
    তিন
    বাংলা সাহিত্যে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে অভিজিৎ পাল একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, এবাদুল হক সম্পাদিত ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকায়, তা থেকে উল্লেখ্য অংশ তুলে দিচ্ছি এখানে :
    বাংলা সাহিত্যে ষাটের দশকের হাংরি জেনারেশনের ন্যায় আর কোনও আন্দোলন তার পূর্বে হয় নাই । হাজার বছরের বাংলা ভাষায় এই একটিমাত্র আন্দোলন যা কেবল সাহিত্যের নয় সম্পূর্ণ সমাজের ভিত্তিতে আঘাত ঘটাতে পেরেছিল, পরিবর্তন আনতে পেরেছিল। পরবর্তীকালে তরুণ সাহিত্যিক ও সম্পাদকদের সাহস যোগাতে পেরেছে । 
    ১ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা সাহিত্যকে পণ্য হিসাবে চিহ্ণিত করতে অস্বীকার করেছিলেন । কেবল তাই নয় ; তাঁরা এক পৃষ্ঠার লিফলেট প্রকাশ করতেন ও বিনামূল্যে আগ্রহীদের মাঝে বিতরণ করতেন । তাঁরাই প্রথম ফোলডার-কবিতা, পোস্ট-কার্ড কবিতা, ও পোস্টারে কবিতা ও কবিতার পংক্তির সূত্রপাত করেন । পোস্টার এঁকে দিতেন অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । ফোলডারে স্কেচ আঁকতেন সুবিমল বসাক  । ত্রিদিব মিত্র তাঁর ‘উন্মার্গ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিজে আঁকতেন। পরবর্তীকালে দুই বাংলাতে তাঁদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।
    ২ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । তাঁদের আগমনের পূর্বে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করার কথা সাহিত্যকরা চিন্তা করেন নাই । সুভাষ ঘোষ বলেছেন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ সরকার বিরোধিতা নয়, সংবাদপত্র বিরোধিতা নয় ; হাংরি জেনারেশনের বিরোধ প্রচলিত সাহিত্যের মৌরসি পাট্টাকে উৎখাত করে নবতম মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার । নবতম শৈলী, প্রতিদিনের বুলি, পথচারীর ভাষা, ছোটোলোকের কথার ধরণ, ডিকশন, উদ্দেশ্য, শব্দ ব্যবহার, চিন্তা ইত্যাদি । পশ্চিমবঙ্গে বামপন্হী সরকার সত্বেও বামপন্হী কবিরা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে নিষ্কৃতি পান নাই । শ্রমিকের কথ্য-ভাষা, বুলি, গালাগাল, ঝগড়ার অব্যয় তাঁরা নিজেদের রচনায় প্রয়োগ করেন নাই । তা প্রথম করেন হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগন ; উল্লেখ্য হলেন অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখ । সুবিমল বসাকের পূর্বে ‘বাঙাল ভাষায়’ কেউ কবিতা ও উপন্যাস লেখেন নাই। হাংরি জেনারেশনের পরবর্তী দশকগুলিতে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবিদের রচনায় এই প্রভাব স্পষ্ট ।
    ৩ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের তৃতীয় অবদান কবিতা ও গল্প-উপন্যাসে ভাষাকে ল্যাবিরিনথাইন করে প্রয়োগ করা । এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ও গল্প-উপন্যাস । মলয় রায়চৌধুরী সর্বপ্রথম পশ্চিমবাংলার সমাজে ডিসটোপিয়ার প্রসঙ্গ উথ্থাপন করেন । বামপন্হীগণ যখন ইউটোপিয়ার স্বপ্ন প্রচার করছিলেন সেই সময়ে মলয় রায়চৌধুরী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ডিসটোপিয়ার দরবারি কাঠামো ।উল্লেখ্য তাঁর নভেলা ‘ঘোগ’, ‘জঙ্গলরোমিও’, গল্প ‘জিন্নতুলবিলদের রূপকথা’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ ইত্যাদি । তিনি বর্ধমানের সাঁইবাড়ির ঘটনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে লেখেন ‘আরেকবারে ক্ষুধিত পাষাণ’ । বাঙাল ভাষায় লিখিত সুবিমল বসাকের কবিতাগুলিও উল্লেখ্য । পরবর্তী দশকের লিটল ম্যাগাজিনের কবি ও লেখকদের রচনায় এই প্রভাব সুস্পষ্ট ।
    ৪ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের চতুর্থ অবদান হলো পত্রিকার নামকরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে পত্রিকাগুলির নামকরণ হতো ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’, ‘শতভিষা’, ‘পূর্বাশা’ ইত্যাদি যা ছিল মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ পত্রিকার নামকরণ করলেন ‘জেব্রা’, ‘জিরাফ’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘উন্মার্গ’, ‘প্রতিদ্বন্দী’ ইত্যাদি । পরবর্তীকালে তার বিপুল প্রভাব পড়েছে । পত্রিকার নামকরণে সম্পূর্ণ ভিন্নপথ আবিষ্কৃত হয়েছে ।
    ৫ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনে সর্বপ্রথম সাবঅলটার্ন অথবা নিম্নবর্গের লেখকদের গুরুত্ব প্রদান করতে দেখা গিয়েছিল । ‘কবিতা’, ‘ধ্রুপদি’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’ ইত্যাদি পত্রিকায় নিম্নবর্গের কবিদের রচনা পাওয়া যায় না । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের বুলেটিনগুলির সম্পাদক ছিলেন চাষি পরিবারের সন্তান হারাধন ধাড়া । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ তৎকালীন কবিরা তাঁর এমন সমালোচনা করেছিলেন যে তিনি এফিডেভিট করে ‘দেবী রায়’ নাম নিতে বাধ্য হন । এছাড়া আন্দোলনে ছিলেন নিম্নবর্গের চাষী পরিবারের শম্ভু রক্ষিত, তাঁতি পরিবারের সুবিমল বসাক,  জাহাজের খালাসি অবনী ধর, মালাকার পরিবারের নিত্য মালাকার ইত্যাদি । পরবর্তীকালে প্রচুর সাবঅলটার্ন কবি-লেখকগণকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে দেখা গেল। 
    ৬ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো রচনায় যুক্তিবিপন্নতা, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোনোর প্রবণতা, আবেগের সমউপস্হিতি, কবিতার শুরু হওয়া ও শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না দেয়া, ক্রমান্বয়হীনতা, যুক্তির দ্বৈরাজ্য, কেন্দ্রাভিগতা বহুরৈখিকতা ইত্যাদি । তাঁদের আন্দোলনের পূর্বে টেক্সটে দেখা গেছে যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতন যুক্তি ধাপে-ধাপে এগোতো, কবিতায় থাকতো আদি-মধ্য-অন্ত, রচনা হতো একরৈখিক, কেন্দ্রাভিগ, স্বয়ংসম্পূর্ণতা । 
    ৭) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে লেখক-কবিগণ আশাবাদে আচ্ছন্ন ছিলেন মূলত কমিউনিস্ট প্রভাবে । ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখতেন । বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁরা বিচ্ছিন্ন ছিলেন । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ প্রথমবার হেটেরোটোপিয়ার কথা বললেন । হাংরি জেনারেশনের কবি অরুণেশ ঘোষ তাঁর কবিতাগুলোতে বামপন্হীদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। হাংরি জেনরেশনের পরের দশকের কবি ও লেখকগণের নিকট বামপন্হীদের দুইমুখো কর্মকাণ্ড ধরা পড়ে গিয়েছে, বিশেষ করে মরিচঝাঁপি কাণ্ডের পর ।
    ৮ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে কবি-লেখকগণ মানেকে সুনিশ্চিত করতে চাইতেন, পরিমেয়তা ও মিতকথনের কথা বলতেন, কবির নির্ধারিত মানে থাকত এবং স্কুল কলেজের ছাত্ররা তার বাইরে যেতে পারতেন না । হাংরি জেনারেশনের লেখকগণ অফুরন্ত অর্থময়তা নিয়ে এলেন, মানের ধারণার প্রসার ঘটালেন, পাঠকের ওপর দায়িত্ব দিলেন রচনার অর্থময়তা নির্ধারণ করার, প্রচলিত ধারণা অস্বীকার করলেন । শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার সঙ্গে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে ।
    ৯ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে ‘আমি’ থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক আমি থাকতো, লেখক-কবি ‘আমি’র নির্মাণ করতেন, তার পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ড থাকতো, সীমার স্পষ্টিকরণ করতেন রচনাকার, আত্মপ্রসঙ্গ ছিল মূল প্রসঙ্গ, ‘আমি’র পেডিগ্রি পরিমাপ করতেন আলোচক। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ নিয়ে এলেন একক আমির অনুপস্হিতি, আমির বন্ধুত্ব, মানদণ্ড ভেঙে ফেললেন তাঁরা, সীমা আবছা করে দিলেন, সংকরায়ন ঘটালেন, লিমিন্যালিটি নিয়ে এলেন ।
    ১০ ) হাংরি  জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে শিরোনাম দিয়ে বিষয়কেন্দ্র চিহ্ণিত করা হতো । বিষয় থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক মালিকানা ছিল, লেখক বা কবি ছিলেন টাইটেল হোলডার। হাংরি জেনারেশনের লেখক-কবিগণ শিরোনামকে বললেন রুবরিক ; শিরোনাম জরুরি নয়, রচনার বিষয়কেন্দ্র থাকে না, মালিকানা বিসর্জন দিলেন, ঘাসের মতো রাইজোম্যাটিক তাঁদের রচনা, বৃক্ষের মতন এককেন্দ্রী নয় । তাঁরা বললেন যে পাঠকই টাইটেল হোলডার।
    ১১ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচিত হতো ঔপনিবেশিক মূল্যবোধ অনুযায়ী একরৈখিক রীতিতে । তাঁদের ছিল লিনিয়রিটি, দিশাগ্রস্ত লেখা, একক গলার জোর, কবিরা ধ্বনির মিল দিতেন, সময়কে মনে করতেন প্রগতি । এক রৈখিকতা এসেছিল ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্হের কাহিনির অনুকরণে ; তাঁরা সময়কে মনে করতেন তা একটিমাত্র দিকে এগিয়ে চলেছে । আমাদের দেশে বহুকাল যাবত সেকারণে ইতিহাস রচিত হয়েছে কেবল দিল্লির সিংহাসন বদলের । সারা ভারত জুড়ে যে বিভিন্ন রাজ্য ছিল তাদের ইতিহাস অবহেলিত ছিল । বহুরৈখিকতারে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘মহাভারত’ । হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকগণ একরৈখিকতা বর্জন করে বহুরৈখিক রচনার সূত্রপাত ঘটালেন । যেমন সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ উপন্যাস, মলয় রায়চৌধুরীর দীর্ঘ কবিতা ‘জখম’, সুভাষ ঘোষের গদ্যগ্রন্হ ‘আমার চাবি, ইত্যাদি । তাঁরা গ্রহণ করলেন প্লুরালিজম, বহুস্বরের আশ্রয়, দিকবিদিক গতিময়তা, হাংরি জেনারেশনের দেখাদেখি আটের দশক থেকে কবি ও লেখকরা বহুরৈখিক রচনা লিখতে আরম্ভ করলেন ।
    ১২ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে মনে করা হতো কবি একজন বিশেষজ্ঞ । হাংরি জেনারেশনের কবিরা বললেন কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য । পরবর্তী প্রজন্মে বিশেষজ্ঞ কবিদের সময় সমাপ্ত করে দিয়েছেন নতুন কবির দল এবং নবনব লিটল ম্যাগাজিন ।
    ১৩ ) ঔপনিবেশিক প্রভাবে বহু কবি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতেন । ইউরোপীয় লেখকরা যেমন নিজেদের ‘নেটিভদের’ তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করতেন । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ কবিতা, শ্রেষ্ঠত্ব, বিশেষ একজনকে তুলে ধরা, নায়ক-কবি, সরকারি কবির শ্রেষ্ঠত্ব, হিরো-কবি, এক সময়ে একজন বড়ো কবি, ব্র্যাণ্ড বিশিষ্ট কবি  আইকন কবি ইত্যাদির প্রচলন ছিল । হাংরি জেনারেশন সেই ধারণাকে ভেঙে ফেলতে পেরেছে তাদের উত্তরঔপনিবেশিক মূল্যবোধ প্রয়োগ করে । তারা বিবেচন প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা সরিয়ে দিতে পেরেছে, কবির পরিবর্তে একাধিক লেখককের সংকলনকে গুরুত্ব দিতে পেরেছে, ব্যক্তি কবির পরিবর্তে পাঠকৃতিকে বিচার্য করে তুলতে পেরেছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার কথা বলেছে । সার্বিক চিন্তা-চেতনা ও কৌমের কথা বলেছে । তাঁদের পরবর্তী কবি-লেখকরা হাংরি জেনারেশনের এই মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন ।
    ১৪ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শব্দার্থকে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচলন ছিল । রচনা ছিল কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন । হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকরা বলেছেন কথা চালিয়ে যাবার কথা। বলেছেন যে কথার শেষ নেই । নিয়েছেন শব্দার্থের ঝুঁকি । রচনাকে মুক্তি দিয়েছেন আত্মমনস্কতা থেকে । হাংরি জেনারেশনের এই কৌম মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন পরবর্তীকালের কবি-লেখকরা । এই প্রভাব সামাজিক স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
    ১৫ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত ছিল ‘বাদ’ দেবার প্রবণতা ; সম্পাদক বা বিশেষ গোষ্ঠী নির্ণয় নিতেন কাকে কাকে বাদ দেয়া হবে । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সাংস্কৃতিক হাতিয়ার ছিল “এলিমিনেশন”। বাদ দেবার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে তাঁরা নিজেদের আয়ত্বে রাখতেন । হাংরি জেনারেশনের সম্পাদকরা ও সংকলকরা জোট বাঁধার কথা বললেন । যোগসূত্র খোঁজাল কথা বললেন । শব্দজোট, বাক্যজোট, অর্থজোটের কথা বললেন । এমনকি উগ্র মতামতকেও পরিসর দিলেন । তাঁদের এই চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য পরবর্তীকালের সম্পাদক ও সংকলকদের অবদানে স্পষ্ট । যেমন অলোক বিশ্বাস আটের দশকের সংকলনে ও আলোচনায় সবাইকে একত্রিত করেছেন । বাণিজ্যিক পত্রিকা ছাড়া সমস্ত লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রে এই গুণ উজ্বল ।
    ১৬ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত একটিমাত্র মতাদর্শকে, ইজমকে, তন্ত্রকে, গুরুত্ব দেয়া হতো । কবি-লেখক গোষ্ঠীর ছিল ‘হাইকমাণ্ড’, ‘হেডকোয়ার্টার’, ‘পলিটব্যুরো’ ধরণের মৌরসি পাট্টা । হাংরি জেনারেশন একটি আন্দোলন হওয়া সত্বেও খুলে দিল বহু মতাদর্শের পরিসর, টুকরো করে ফেলতে পারলো যাবতীয় ‘ইজম’, বলল প্রতিনিয়ত রদবদলের কথা, ক্রমাগত পরিবর্তনের কথা । ভঙ্গুরতার কথা । তলা থেকে ওপরে উঠে আসার কথা । হাংরি জেনারেশনের পরে সম্পূর্ণ লিটল ম্যাগাজিন জগতে দেখা গেছে এই বৈশিষ্ট্য এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রভাব ।
    ১৭ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত দেখা গেছে ‘নিটোল কবিতা’ বা স্বয়ংসম্পূর্ণ এলিটিস্ট কবিতা রচনার ধারা । তাঁরা বলতেন রচনাকারের শক্তিমত্তার পরিচয়ের কথা । গুরুগম্ভীর কবিতার কথা । নির্দিষ্ট ঔপনিবেশিক মডেলের কথা । যেমন সনেট, ওড, ব্যালাড ইত্যাদি । হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ নিয়ে এলেন এলো-মেলো কবিতা, বহুরঙা, বহুস্বর, অপরিমেয় নাগালের বাইরের কবিতা । তাঁদের পরের প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মাঝে এর প্রভাব দেখা গেল । এখন কেউই আর ঔপনিবেশিক বাঁধনকে মান্যতা দেন না । উদাহরণ দিতে হলে বলতে হয় অলোক বিশ্বাস, দেবযানী বসু, ধীমান চক্রবর্তী, অনুপম মুখোপাধ্যায়, প্রণব পাল, কমল চক্রবর্তী প্রমুখের রচনা ।
    ১৮ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল স্হিতাবস্হার কদর এবং পরিবর্তন ছিল শ্লথ । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ পরিবর্তনের তল্লাশি আরম্ভ করলেন, প্রযুক্তির হস্তক্ষেপকে স্বীকৃতি দিলেন । পরবর্তী দশকগুলিতে এই ভাঙচুরের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যেমন কমল চক্রবর্তী, সুবিমল মিশ্র, শাশ্বত সিকদার ও নবারুণ ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে ; তাঁরা ভাষা, চরিত্র, ডিকশন, সমাজকাঠামোকে হাংরি জেনারেশনের প্রভাবে গুরুত্ব দিতে পারলেন ।
    ১৯ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে নাক-উঁচু সংস্কৃতির রমরমা ছিল, প্রান্তিককে অশোভন মনে করা হতো, শ্লীল ও অশ্লীলের ভেদাভেদ করা হতো, ব্যবধান গড়ে ভেদের শনাক্তকরণ করা হতো । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা সংস্কৃতিকে সবার জন্য অবারিত করে দিলেন । বিলোপ ঘটালেন সাংস্কৃতিক বিভাজনের । অভেদের সন্ধান করলেন । একলেকটিকতার গুরুত্বের কথা বললেন । বাস্তব-অতিবাস্তব-অধিবাস্তবের বিলোপ ঘটালেন । উল্লেখ্য যে বুদ্ধদেব বসু মলয় রায়চৌধুরীকে তাঁর দ্বারে দেখামাত্র দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন । পরবর্তীকালের লিটল ম্যাগাজিনে আমরা তাঁদের এই অবদানের প্রগাঢ় প্রভাব লক্ষ্য করি ।
    ২০ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল ইউরোপ থেকে আনা বাইনারি বৈপরীত্য যা ব্রিটিশ খ্রিস্টানরা হা্রণ করেছিল তাদের ধর্মের ঈশ্বর-শয়তান বাইনারি বৈপরীত্য থেকে । ফলত, দেখা গেছে ‘বড় সমালোচক’ ফরমান জারি করছেন কাকে কবিতা বলা হবে এবং কাকে কবিতা বলা হবে না ; কাকে ‘ভালো’ রচনা বলে হবে এবং কাকে ভালো রচনা বলা হবে না ; কোন কবিতা বা গল্প-উপন্যাস  উতরে গেছে এবং কোনগুলো যায়নি ইত্যাদি । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা এই বাইনারি বৈপরীত্য ভেঙে ফেললেন । তাঁরা যেমন ইচ্ছা হয়ে ওঠা রচনার কথা বললেন ও লিখলেন, যেমন সুভাষ ঘোষের গদ্যগ্রন্হগুলি । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন বহুপ্রকার প্রবণতার ওপর, রচনাকারের বেপরোয়া হবার কথা বললেন, যেমন মলয় রায়চৌধুরী, পদীপ চৌধুরী ও শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা । যেমন মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা ও ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাস । যেমন সুবিমল বসাকের বাঙাল ভাষার কবিতা যা এখন বাংলাদেশের ব্রাত্য রাইসুও অনুকরণ করছেন । হাংরি জেনারেশনের পরের দশকগুলিতে  তাঁদের এই অবদানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, এবং তা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে ।
    ২১ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল আধিপত্যের প্রতিষ্ঠার সাহিত্যকর্ম । উপন্যাসগুলিতে একটিমাত্র নায়ক থাকত । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ আধিপত্যের বিরোধিতা আরম্ভ করলেন তাঁদের রচনাগুলিতে । বামপন্হী সরকার থাকলেও তাঁরা ভীত হলেন না । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সেকারণে ছিল খণ্ডবাদ বা রিডাকশানিজমের গুরুত্ব । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন কমপ্লেকসিটিকে, জটিলতাকে, অনবচ্ছিন্নতার দিকে যাওয়াকে । যা আমরা পাই বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, মলয় রায়চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ প্রমুখের গল্প-উপন্যাসে । পরবর্তী দশকগুলিতে দুই বাংলাতে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।
    ২২ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল গ্র্যাণ্ড ন্যারেটিভকে । হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন মাইক্রো ন্যারেটিভকে, যেমন সুবিমল বসাকের ‘দুরুক্ষী গলি’ নামক উপন্যাসের স্বর্ণকার পরিবার, অথবা অবনী ধরের খালাসি জীবন অথবা তৎপরবতী কঠিন জীবনযাপনের ঘটনানির্ভর কাহিনি । পরবর্তী দশকগুলিতে দেখা যায় মাইক্রোন্যারেটিভের গুরুত্ব, যেমন গ্রুপ থিয়েটারগুলির নাটকগুলিতে ।
    ২৩ ) হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ নিয়ে এলেন যুক্তির ভাঙন বা লজিকাল ক্র্যাক, বিশেষত দেবী রায়ের প্রতিটি কবিতায় তার উপস্হিতি পরিলক্ষিত হয় । পরের দশকের লেখক ও কবিদের রচনায় লজিকাল ক্র্যাক অর্থাৎ যুক্তির ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে । যেমন সাম্প্রতিক কালে অগ্নি রায়,  রত্নদীপা দে ঘোষ, বিদিশা সরকার, অপূর্ব সাহা, সীমা ঘোষ দে, সোনালী চক্রবর্তী, আসমা অধরা, সেলিম মণ্ডল, জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়, পাপিয়া জেরিন,  প্রমুখ ।
    ২৪ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে রচনায়, বিশেষত কবিতায়, শিরোনামের গুরুত্ব ছিল ; শিরোনামের দ্বারা কবিতার বিষয়কেন্দ্রকে চিহ্ণিত করার প্রথা ছিল । সাধারণত বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত এবং সেই বিষয়ানুযায়ী কবি কবিতা লিখতেন । শিরোনামের সঙ্গে রচনাটির ভাবগত বা দার্শনিক সম্পর্ক থাকতো । ফলত তাঁরা মৌলিকতার হামবড়াই করতেন, প্রতিভার কথা বলতেন, মাস্টারপিসের কথা বলতেন ।হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ শিরোনামকে সেই গুরুত্ব থেকে সরিয়ে দিলেন । শিরোনাম আর টাইটেল হোলডার রইলো না । শিরোনাম হয়ে গেল ‘রুবরিক’ । তাঁরা বহু কবিতা শিরোনাম র্বজন করে সিরিজ লিখেছেন । পরবর্তী দশকের কবিরা হাংরি জেনারেশনের এই কাব্যদৃষ্টির সঙ্গে একমত হয়ে কবিতার শিরোনামকে গুরুত্বহীন করে দিলেন ; সম্পূর্ণ কাব্যগণ্হ প্রকাশ করলেন যার একটিতেও শিরোনাম নেই ।
    চার
    দেবেশ রায় প্রথম বলেছিলেন যে হাংরি আন্দোলন থেকে নকশাল আন্দোলনের দিকে সময় একটা বীক্ষার মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছিল, কিংবা এই ধরণের কোনো কথা, তারপর অনেকেই নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের ভাবনার একটা যোগসূত্র খুঁজতে চেয়েছেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে রফিক উল ইসলাম জিগ্যেস করেছিলেন যে দুটো আন্দোলনের নিজেদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা । সুনীল বলেছিলেন যে নকশাল আন্দোলনে অনেক মহৎ আত্মত্যাগ হয়েছিল, অনেক তরুণ মারা গিয়েছিল । 
    আমার মতে দুটোর মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল তা সময়-পরিসরের রেশের । হাংরি আন্দোলনের চিত্রকর অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় নকশাল আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন আর পুলিশ ওনাদের রাতের মিটিঙের কথা জানতে পেরে স্টুডিও ভাঙচুর করে যাবতীয় পেইনটিঙ নষ্ট করে দিয়েছিল । অনিল, করুণা আর ওদের ছবি আঁকার দলের যুবকরা আগেই খবর পেয়ে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল, অনিল দিল্লিতে আর তারপর এক মার্কিন যুবতীর সঙ্গে আমেরিকায় ; করুণা চুলদাড়ি কামিয়ে, চেহারা পালটিয়ে সপরিবারে পাটনায়, সেখানে দাদা করুণাকে একটা রঙিন মাছের দোকান খুলে দিয়েছিলেন । আমার কাকার মেয়ে পুটি উত্তরপাড়ার বাড়ির বড়োঘরের কড়িকাঠ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছিল, তার কারণ যে নকশাল যুবকটিকে পুটি ভালোবাসতো তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে লোপাট করে দিয়েছিল । 
    ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আমার এক মাসের সাজা হয়ে গিয়েছিল ২৮ ডিসেম্বর ১৯৬৫ আর কলকাতা হাইকোর্টে উকিলের খোঁজে আমি নানা লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করছিলুম । জ্যোতির্ময় দত্ত পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সদ্য লণ্ডন ফেরা ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে, ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে কপি নিয়ে যাবতীয় কাগজপত্র দিয়ে আসতে হচ্ছিল, তাঁর বাড়িতে,  লোহাপট্টিতে, যাতে কলকাতা হাইকোর্টে রেজিস্ট্রারের দপতরে জমা দেয়া যায় । এদিকে কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, নানা জায়গায় রাত কাটাই, পকেট ফাঁকা হয়ে যায় আদালতের কাজে আর দুবেলা খেতে । অনেককাল স্নান না করলে যে নিজের গা থেকে নিজেরই মাংসের গন্ধ বেরোয় তা তখন জেনেছিলুম । বন্ধুবান্ধবরা, সুবিমল বসাক ছাড়া, সবাই হাওয়া ।
    তার মাঝেই ২২-২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ খাদ্য আন্দোলনে সারা বাংলা বন্ধ ডাকা হয়েছিল, মনে আছে । তখনকার কলেজ স্ট্রিট এখনকার মতন ছিল না, একেবারে ফাঁকা থাকতো, দিনের বেলাকার মিছিল সত্বেও, সন্ধ্যে হলেই অন্ধকার । বস্তুত, পুরো কলকাতাই একেবারে আলাদা ছিল । রণবীর সমাদ্দারের একটা লেখায় পড়েছিলুম যে নকশাল আন্দোলনের প্রকৃত সময়টা হলো ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ ; আর কোলকাতা হাইকোর্ট আমার মামলা এক দিনেই সেরে ফেলেছিল, ২৬ জুলাই ১৯৬৭ তারিখে, আমার দণ্ডাদেশ নাকচ করে । তাই হয়তো কেউ-কেউ মনে করেন যে হাংরিরা ১৯৬৭-পরবর্তী কালখণ্ডকে নকশালদের হ্যাণ্ডওভার করে দিয়েছিল । সময়-পরিসরকে হ্যাণ্ডওভার করার প্রক্রিয়া চলে আসছে সেই ব্রিটিশ-বিরোধিতার সময় থেকে। প্রফুল্ল চক্রবর্তী ওনার ‘মার্জিনাল মেন’ বইতে লিখেছিলেন যে দেশভাগের পর বহু তরুণ লুম্পেন প্রলেতারিয়েত হয়ে ওঠে এবং তাদের থেকেই পশ্চিমবঙ্গে মাস্তানদের জন্ম । বস্তুত মাস্তানরও সময়-পরিসরকে ক্রমশ হ্যাণ্ডওভার করে চলেছে এখনকার জিঙ্গোবাদী রাজনীতিকদের করকমলে ।
    ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে স্বদেশি আন্দোলনের যে রেশ আরম্ভ হয়েছিল, সেই রেশ নানা বাঁক নিয়ে যখন দেশভাগের ঘুর্ণিতে পড়ল তখন তার চরিত্র পালটে গেল, তার আগে সেই রেশে তেমন অ্যাড্রেনালিন ছিল না বলা চলে । এই রেশটাই হাংরি আন্দোলনের উৎসভূমি । এই রেশকে প্রথমে কৃষক নেতারা এবং পরে তরুণ সমাজ নিয়ে যান নকশাল আন্দোলনে এবং এই রেশকেই কেন্দ্র করে বামপন্হীরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসেন। এই রেশই নন্দীগ্রামে পৌঁছোবার পর বামপন্হীরা দিশেহারা হয়ে পড়েন আর তৃণমূল ক্ষমতা দখল করে । রেশটা থাকে জনগণের মাঝে । আমার মনে হয়, সব সময়েই থাকে,চিরকাল থাকে । 
    হাংরি আন্দোলনের পরে-পরেই নকশাল আন্দোলন ঘটেছিল অথচ যাঁরা হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও পুলিশের কাছে নালিশ করেছিলেন তাঁরা কেন আসন্ন উথালপাথাল টের পাননি ? হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্যজগতের মূল্যবোধ-মালিক ও প্রকাশক-বাজারের জোতদারদের উৎখাত করতে চেয়েছিল, জন্তুজানোয়ারের মুখোশ পাঠিয়ে বিদ্যায়তনিক জোতদারদের টপলেস অর্থাৎ গলা কেটে ফেলতে চেয়েছিল, সাহিত্যিক ক্ষমতাকে দখল করে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনের মাঝে, জুতোর বাক্স রিভিউ করতে দিয়ে এবং শাদা ফুলস্কেপ কাগজকে ছোটোগল্প নামে বাজারি কাগজে জমা দিয়ে সাহিত্যিক জোতদারদের দলিদস্তাবেজ বেদখল করতে চেয়েছিল । এগুলো কোনোরকমের ইয়ার্কি বা প্র্যাঙ্ক ছিল না।
    যাঁরা নালিশ ঠুকেছিলেন তাঁদের মধ্যে বিদ্যায়তনিক প্রতিনিধিরাও ছিলেন যাঁদের হাংরি আন্দোলনকারীদের পাঠানো কার্ডে FUCK THE BASTARDS OF GANGSHALIK SCHOOL OF POETRY ঘোষণা পড়ে অপমানবোধ হয়েছিল, জানোয়ার ও দানবের মুখোশ পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল । অথচ তার কয়েক বছর পরেই নকশাল তরুণরা শিক্ষকদের গলা কাটা আরম্ভ করলেন, জোতদারদের বাড়ি লুঠ করে দলিল-দস্তাবেজ পুড়িয়ে দিলেন, জমি দখল করে বিলিয়ে দিলেন ভাগচাষিদের । নকশাল আন্দোলনকারীরা জোতদারদের বেদখল করার সময়ে, বাড়িতে-খামারে আগুন ধরিয়ে দেবার সময়ে FUCK THE BASTARDS -এর পরিবর্তে বাংলা ও চোস্ত হিন্দি গালাগাল দিয়েছিল, জোতদার আর ভূস্বামীদের মুখোশ চামড়াসুদ্দু ছিঁড়ে উপড়ে নিয়েছিল । 
    নকশাল তরুণরা এসে দেখিয়ে দিল যে হাংরি আন্দোলনকারীদের এই কাজগুলো ঠাট্টা-ইয়ার্কি করার ব্যাপার ছিল না, তা ছিল চোখে আঙুল ঢুকিয়ে বাস্তবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রক্রিয়া । জোতদারদের বিরুদ্ধে যে ইতর বুলি কথাবার্তায় প্রয়োগ করে ক্ষান্ত থেকেছিলেন নকশালরা, তা নিজেদের লেখায় নিয়ে এসেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীরা যাকে মধ্যবিত্ত পরিবারের বিদ্যায়তনিক ও গ্লসি পত্রিকার চাকুরে আলোচনাকারীরা বলে এসেছেন অশ্লীল ও অশোভন । আলোচকরা ভুলে গিয়েছিলেন যে ছোটোলোকদের ভাষা অমনই হয়। নকশাল আন্দোলনের কবিতা  কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালির ভাষার আওতার বাইরে বেরোতে পারেনি বলেই মনে হয় । 
    যেমন কৃষ্ণ ধর-এর ‘একদিন সত্তর দশকে’ কবিতাটি :-
    শিকারকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে
    অন্ধকারে মিলিয়ে যায় জল্লাদের গাড়ি
    শহরের দেয়ালে দেয়ালে পরদিন দেখা যায় তারই কথা
    সে নিদারুণ তৃষ্ণায় একবার জল চেয়েছিল
    যে যন্ত্রণায় নীল হয়ে একবার ডেকেছিল মাকে
    তবু স্বপ্নকে অক্ষত রেখেই সে
    বধ্যভূমিতে গিয়েছিল
    একদিন সত্তর দশকে।”
    স্বপন চক্রবর্তী লিখেছিলেন :-
    ‘আমরা সাহায্য চাইনি’
    আমরা সাহায্য চাইনি
    কারণ আমরা বদল চেয়েছি।
    চেয়েছি ক্ষিদের মানসিক যন্ত্রণার বিরুদ্ধে
    একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।
    .কোনদিনই আমরা কমিউনিস্ট হতে চাইনি।
    এখন সময়
    মানুষের জন্যে আমাদের মানুষের মত হতে শেখাচ্ছে।
    মানুষের জন্যে আমাদের মানুষের মত হতে শেখাচ্ছে।
    আমরা চাইনি ইজ্জত খুইয়ে ঘাড় হেঁট করে পেট ভরাতে।
    আমরা বদল চেয়েছি
    চেয়েছি ক্ষিদের যন্ত্রণার বিরুদ্ধে
    একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।”
    নির্মল ঘোষ তার ‘নকশালবাদী আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘অনস্বীকার্য, নকশালপন্থী কাব্যচর্চায় আঙ্গিকের চেয়ে বিষয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আর এর ফলে বক্তব্যে বহুক্ষেত্রেই আবেগের প্রাধান্য দেখা গেল, যা শেষপর্যন্ত পাঠক মানসকে প্রায়শ প্রভাবিত বা প্রাণিত করতে সমর্থ হয়নি।’ পক্ষান্তরে, কবিতার শৈল্পিক মানের এ বিতর্কে অর্জুন গোস্বামী নকশালবাদী কবিতার পক্ষেই রায় দিয়েছেন, ‘এটা সত্তরের দশক। এই দশক প্রত্যক্ষ করেছে শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিতশ্রেণীর লড়াই। এই দশকেই প্রমাণিত হয়েছে যে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রকে উপরে উপরে যতই শক্তিশালী বলে মনে হোক না কেন আসলে তারা হলো কাগুজে বাঘ। স্বভাবতই এই দশকের মানুষের সচেতনতা অনেক বেশি। আমরা এমন কোন কবিতা পড়তে চাই না যাতে আছে হতাশা, আছে যন্ত্রণার গোঙানি। আমরা এমন কবিতা পড়তে চাই যাতে ধরা পড়বে শোষণের আসল স্বরূপ, যে কবিতা পড়ে অনুপ্রেরণা পাবেন লক্ষ লক্ষ খেটে খাওয়া মানুষ এবং যে কবিতা প্রকৃতই হবে শোষিতশ্রেণীর সংগ্রামী হাতিয়ার। আমাদের মধ্যে অনেকে বলেন কবিতা হলো এমন একটা জিনিস যা ঠিক স্লোগান নয়। আমাদের বক্তব্য হলো কবিতার বিষয় ও কবিতার আঙ্গিক এই দুটোর মধ্যে আগে বিষয়, পরে আঙ্গিক। বক্তব্যকে সাধারণের উপযোগী করে বলার জন্য কবিতা যদি কারুর কাছে স্লোগান বলে মনে হয় তবে সেই স্লোগানই হলো সত্তরের দশকের শ্রেষ্ঠ কবিতা।’
    হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমিও বলেছিলুম,  “কবিতা কেবল মঞ্চে বিড়-বিড় করে পড়ার ব্যাপার নয় ; উন্মাদের মতন চিৎকার করে না পড়লে প্রতিষ্ঠান কষ্ট-যন্ত্রণার গোঙানি শুনতে পায় না ।” বাসব রায়কে দেয়া ‘যুগশঙ্খ’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন যে মলয়ের কবিতায় অত্যধিক অব্যয় থাকে, চিৎকার থাকে । এই প্রেক্ষিতে নকশালদের সঙ্গে হাংরিদের তুলনা করা চলে, যেমন ত্রিদিব মিত্রের বিখ্যাত কবিতা ‘হত্যাকাণ্ড’ । হাওড়া স্টেশানের প্ল্যাটফর্মে বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে ‘হত্যাকাণ্ড’ কবিতাটা পড়ে ভিড় জমিয়ে ফেলেছিল ত্রিদিব মিত্র ।
    হাংরি আন্দোলনের গ্রন্হ রিভিউ করতে গিয়ে শৈলেন সরকার বলেছেন, “হাংরি-র পুরনো বা নতুন সব কবি বা লেখকই কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করেছেন অবদমিতের ভাষা। এঁদের লেখায় অনায়াসেই চলে আসে প্রকৃত শ্রমিক-কৃষকের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দাবলি। ভালবাসা-ঘৃণা বা ক্রোধ বা ইতরামি প্রকাশে হাংরিদের কোনও ভণ্ডামি নেই, রূপক বা প্রতীক নয়, এঁদের লেখায় যৌনতা বা ইতরামির প্রকাশে থাকে অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ— একেবারে জনজীবনের তথাকথিত শিল্পহীন কথা। অনেকেই প্রায় সমসময়ের নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে তুলনা করে এদের অরাজনৈতিক তকমা দেন, কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নিয়ে হাংরি জেনারেশন যে প্রশ্ন তুলেছিল তা ছিল নকশালদের তোলা প্রশ্নের চেয়েও অনেক বেশি মৌলিক। এমনকী তুমুল প্রচার পাওয়া এবং নিজস্ব অস্তিত্ব তৈরি করা সত্ত্বেও দলিত সাহিত্য আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত হাংরি আন্দোলনের থেকে পিছিয়েই রাখতে হয়।” শৈলেন সরকার যে বইটি আলোচনা করেছেন তাতে কোনো কারণে সম্পাদকমশায় হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো অন্তর্ভুক্ত করেননি । করলে স্পষ্ট হতো যে হাংরি আন্দোলন অরাজনৈতিক ছিল না ।
    প্রবুদ্ধ ঘোষ হাংরি আন্দোলন ও নবারুণ ভট্টাচার্য সম্পর্কে আলোচনা করার সময়ে বলেছেন, “বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার শব্দ তখনই শোনা যায়, যখন তা শোনার জন্যে কেউ থাকে। সাহিত্যের কাজ কী? ক্যাথারসিস করা? মানে, মোক্ষণ? বরং হাংরিদের লেখা প্রতিমুহূর্তে ক্যাথারসিসের উল্টোদিকে হাঁটে। মোক্ষণ করা, শান্তি দেওয়া তাঁদের কাজ নয়, বরং আপাতশান্তির বোধটাকে আঘাত করাই মূল উদ্দেশ্য!” একটু আগে আমি যেকথা বলেছি, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান-সাহিত্যের জোতদারদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে চেয়েছিল হাংরি আন্দোলনকারীরা, তাদের কাজের দ্বারা, লেখার দ্বারা, ড্রইং দ্বারা, সেকথাই বলেছেন প্রবুদ্ধবাবু । তবে প্রবুদ্ধবাবু একটা কথা ভুল বলেছেন, যে হাংরি আন্দোলনকারীরা কেবল আত্মবীক্ষণ ও আত্মআবিষ্কারে আলো ফেলতে চেয়েছেন। হাংরি আন্দোলনকরীরা যদি তাই করতেন তাহলে যে কাজগুলোকে মধ্যবিত্ত আলোচকরা ‘অসাহিত্যিক’ ব্যাপার বলে তকমা দেগে দেন তা তাঁরা করতেন না, বিভিন্ন বিষয়ে ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করতেন না । নকশালরা যে মূর্তির গলা কেটে প্রতীকিস্তরে বিশেষ মূল্যবোধকে আক্রমণ করেছিল, শিক্ষকদের খুন করেছিল, তার সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ-খুনের আক্রমণাত্মক কাজগুলো তুলনীয় ।
    সুবিমল বসাকের একটা কবিতা এখানে তুলে দিচ্ছি, যা হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল :-
    ‘হাবিজাবি’
    আমারে মাইরা ফেলনের এউগা ষড়যন্ত্র হইসে
    চারো কোনা দিয়া ফুসফুস আওয়াজ কানে আহে
    ছাওয়াগুলান সইরা যায় হুমকে থিক্যা
    অরা আমারে এক্কেরে শ্যায করতে সায়
    আমি নিজের ডাকাইতে্যা হাতেরে লইয়া সচেত্তন আসি
    কেউ আইয়া চ্যারায় দিশায় চ্যাবা কথা কয় না
    আমি সুপসাপ থাকি
    ভালাসির গুছাইয়া আমি কথা কইতে পারি না
    ২ কইতে গিয়া সাত হইয়া পড়ে
    ১৫ সাইলে ৯ আইয়া হাজির হয়
    ছ্যাব ফেলনের লাইগ্যা বিচড়াইতাসি অহন
    আহ, আমার দাঁত মাজনের বুরুশ পাইতাসি না
    বিশ্বাস করেন, কেউ একজনা আমার মুহের সকরা খাবার খাইসে ।
    (হাংরি বুলেটিন নং ১৮ থেকে)
    প্রবুদ্ধবাবু বলেছেন “হাংরিদের ‘ক্ষুধা’ বিষয়ে তাঁদের নিজস্ব মতামত ছিল ; এই ক্ষুধা আসলে নিজেকে দগ্ধ করে সত্য আবিষ্কারের ক্ষুধা। সত্য, যা ক্রমাগতঃ এমনকি নিজেকেও ছিঁড়েখুঁড়ে উন্মোচিত করে চলে। তাকাই ফাল্গুনী রায়ের কবিতায়, “আমার বুকের ভিতর লোভ অথচ হৃদয় খুঁজতে গিয়ে বুকের ভিতরে/ রক্তমাংসের গন্ধ পাচ্ছি কেবল”। আজ স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; প্রকাশ্যে চুম্বন করে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাধানিষেধ ও সমাজের প্রচলিত ‘ট্যাবু’গুলিকে। এই বিদ্রোহ কিন্তু ’৬০ এর দশক থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকেরা। সমস্তরকম গোঁড়ামি এবং ‘ঢাকঢাকগুড়গুড়’ বিষয়ের ভিতে টান মেরেছেন। সাহিত্য বহু আগেই ভবিষ্যতের কোনো এক আন্দোলনের কথা স্বীকার করে যাচ্ছে- তার নিজের মত করে, নিজের প্রকাশে। না, নিশ্চিতভাবেই সাহিত্যের কাজ ভবিষ্যৎদর্শন নয়; কিন্তু হ্যাঁ, সাহিত্যের অন্যতম কাজ ভবিষ্যতের সামাজিক আন্দোলনের, সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রগুলোর হদিশ দিয়ে যাওয়া। ফাল্গুনী রায় যখন কবিতায় বলেন, ‘শুধুই রাধিকা নয়, গণিকাও ঋতুমতী হয়’, তখন কি আজকের কথাই মনে হয় না? যেখানে, ঋতুমতী হওয়া কোনো ‘লজ্জা’র বিষয় নয়, ‘অশুদ্ধি’র বিষয় নয়, বরং তা স্বাভাবিক জৈবনিক প্রক্রিয়া। আর, প্রতিমুহূর্তের এই আত্মজৈবনিক বিষয়গুলিই উঠে আসে হাংরি জেনারেশনের লেখায়। বা, সগর্ব্ব মানুষ-প্রমাণ ‘আমি মানুষ একজন প্রেম-পেচ্ছাপ দুটোই করতে পারি’’। এগুলো তো দৈনন্দিন। এগুলো তো স্বাভাবিক। তাহলে? আসলে, ‘শুদ্ধতা’-র একটা অর্থহীন ধোঁয়াশাবোধ তো তৈরি করেই দেয় সমাজ, একটা বর্ডারলাইন। সাহিত্যের নায়ক রক্তমাংসের মতো হবে কিন্তু তার ক্ষুধা-রেচন ইত্যাদি থাকবে না বা পুরাণচরিত্রদের শারীরবৃত্তীয় কার্য নেই! এই ‘মেকি’ ধারণাসমূহ লালন করে আসা আতুপুতু প্রতিষ্ঠানগুলো যখন হাড়-মজ্জা-বোধ জীবন্ত হতে দেখে তখন ‘অশ্লীল সংস্কৃতি’ ছাপ্পা মারে। সমাজের জড়তা, মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির মুখোশগুলো খুলে দেয় টান মেরে। আর, তাই ‘নিষিদ্ধ’, অশ্লীল মনে হয় এদের লেখাগুলি। হাংরি-দের যেখানে মূল বক্তব্যই ছিল প্রতিটি লেখায় ও সাহিত্যযাপনে আত্মউন্মোচন, সেখানে এই বিষয়গুলি স্বাভাবিক বীক্ষাতেই উঠে এসেছে। এবং, ‘সাহিত্য বিক্রির জন্যে আরোপিত যৌনতা’ বনাম ‘শিল্প ও জীবনের সাথে সম্পৃক্ত যৌনতা’ এই বিতর্কের ডিস্‌কোর্স তৈরি করেছে।” 
    প্রবুদ্ধবাবু আরও বলেছেন, “পণ্যসময়ে বেঁচে থেকে, কিচ্ছু না-পেয়ে বেঁচে থেকে, হতাশার অবিমৃষ্য বোধ তৈরি হয়। ’৬০-’৭০ র দশকের ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবক্ষয়, মধ্যবিত্তের আশাহীনতার অভিঘাত নৈরাশ্যের জন্ম দেয়; এমনকি সাহিত্যেও। আর, সেই নৈরাশ্যকে এড়িয়ে গিয়ে কবিতা বা গদ্য লেখা যায় না। অরুণেশ ঘোষ তাঁর ‘কিচ্ছু নেই’ সময়কে লিখছেন- ‘১ পাগল এই শহরের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে তার লেঙ্গট/ ১ সিফিলিস রুগী পতাকা হাতে মিছিলের আগে/ ১ রোবট নিজেকে মনে করে আগামীকালের শাসক/ ১ মূর্খ ঘুমিয়ে থাকে শহর-শুদ্ধ জেগে ওঠার সময়… শীতের ভোর রাত্রে- মধ্যবিত্তের স্বপ্নহীনতার ভেতর/ আমাকে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে বেশ্যাপাড়ার মেয়েরা’। এই স্বপ্নহীনতাকে বাড়িয়ে তোলে পুঁজিবাদের দমবন্ধ চেপে বসা। ভারতের তথা বাংলার অর্থনীতি-মডেলকে সাজানোর দোহাই দিয়ে বিদেশি শস্যবীজ এবং সবুজ বিপ্লবের সাথেই আমদানি হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আর, নগরায়ণের মুখ খুলতে থাকে। ’৯০ র দশকের পরে যে বীভৎস হাঁ-তে ঢুকে যেতে থাকবে ভারতবর্ষের একের পর এক গ্রাম-মফস্বল।”
    ১৯৬৮ সালে বিনয় ঘোষ ‘কলকাতার তরুণের মন’ নামক প্রবন্ধে লিখছেন- “গোলামরা সব উঁচুদরের ঊর্ধ্বলোকের গোলাম, আগেকার কালের মতো তাঁদের হাত-পায়ের ডাণ্ডাবেড়ি দেখা যায় না। তাঁদের ‘স্টেটাস’ আছে, ‘কমফর্ট’ আছে, ‘লিবার্টি’ আছে। তাঁরা নানাশ্রেণীর ব্যুরোক্র্যাট টেকনোক্র্যাট ম্যানেজার ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার সেলস-প্রমোটার বা ‘অ্যাড-মেন’- যাঁরা যন্ত্রের মতো সমাজটাকে চালাচ্ছেন। ব্যক্তিগত ভোগ-স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাধীনতার একটা লোভনীয় মরীচিকা সৃষ্টি করছেন তাঁরা সাধারণ মানুষের সামনে এবং দিনের পর দিন বিজ্ঞাপনের শতকৌশলে নেশার পিল খাইয়ে সেই ভোগস্বাধীনতার স্বপ্নে তাদের মশগুল করে রাখছেন।”। ’৬০-’৭০ র অবক্ষয়ী অথচ পণ্যপ্রিয় ভোগসমাজের কথা সেইসময়ের মতন করেই লেখেন হাংরি আন্দোলনের গল্পকাররা। আর, ভবিষ্যতের পণ্যসমাজের একটা আভাসও থাকে। “আপাতত প্রতীয়মান ধূম্রজালে জড়ানো ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর একজন দৈত্যভৃত্য বলে,  ‘আপনার গোলাম, আকা কি হুকুম যা বলবেন যা চাইবেন জীবনে তাই হাজির… একটি সিগারেট। …একটি সিগারেট। পাঁচ বছরে একটি টিভি সেট। দশ বছরে একটি গাড়ি আর বিশ বছরে সিগারেট খেতে খেতে একবার সারা দুনিয়ায় চক্কর দেব। বাতাস স্তব্ধ। অবাক হঠাৎ মেঘের আকাশ-কাঁপানো অট্টহাসি।”[ঘটনাদ্বয় ও তাদের সাজসজ্জাঃ রবিউল] 
    বোর্দ্রিয়ারের মতে, উত্তর-আধুনিক সমাজে শ্রেণিবিভাগ আর শুধুমাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকছে না, বরং তা এখন নির্ভর করছে ভোগের ওপর। কে কোন পণ্য ভোগ করছে, তার ‘ব্র্যাণ্ড’ এবং দামের ওপর নির্ভর করছে তার শ্রেণিঅবস্থান। অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন, পণ্যকৌশলে ভুলিয়ে দিতে চাওয়া দেশকাল-ইতিহাস আর, এমনকি প্রকৃত যৌনতা, সামাজিকতা, সবকিছুরই মৃত্যু ঘটছে- তখনই অধিবাস্তব টেনে নিয়ে চলেছে ‘ভার্চ্যুয়াল’ জগতে, এই সত্য তো হাংরি আন্দোলনকারীদের লেখাতে উদ্ঘাটিত হয়েছে! বস্তুতঃ, তাঁদের লেখায় তাঁরা এটাকেই আক্রমণ শানাতে চেয়েছেন। আজকের মানুষের পরিসর-মাফিক রূপবদলের কথা আমি লিখেছি আমার ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’ নামের অধিবাস্তব গল্পে আর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ফাঁসিয়েছি ‘গহ্বরতীর্থের কুশীলব’ নামের অধিবাস্তব কাহিনিতে — যা কিনা সময়-পরিসরের সঙ্গে অ্যাড্রেনালিনের রেশ এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রক্রিয়া ।
    হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা-মকদ্দমা করে তাদের বিক্ষিপ্ত করে দেবার পর, প্রতিষ্ঠানের লেখকরা লেখালিখি করে দেখাতে চাইলেন, নকশাল আন্দোলন মধ্যবিত্ত রোম্যাণ্টিকতা ও কাঁচা প্রেমের মতো, বামপন্থা মানেই তা ভ্রষ্ট সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখায় এবং আসলে নিরাজনীতিই মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলে! হাংরিদের পর থেকে তাদের বিরুদ্ধতাকারী পঞ্চাশের ও পরবর্তী সাহিত্যিকরা এহেন ভাবনাগুলোকে সচেতন ভাবেই প্রতিষ্ঠানের  মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন । প্রবুদ্ধ ঘোষ বলেছেন “আশির দশকের বাংলা সাহিত্য থেকেই আর, ’৯০ পরবর্তী প্রাতিষ্ঠানিক ও ‘এলিট’ পত্রিকার সাহিত্যগুলি কিছু অবয়ববাদী বা স্ট্রাক্‌চারালিস্ট ধাঁচা (স্টিরিওটাইপ) এনে ফেলল। যেমন, নকশাল ছেলেটি লেখাপড়ায় মারাত্মক ব্রিলিয়াণ্ট ছিল, ‘ভুল’ রাজনীতির পাল্লায় পড়ে গ্রামে গেল রাজনীতি শিখতে ও ডি-ক্লাস্‌ড হতে, তার প্রেমিকা উচ্চবিত্ত ঘরের এবং যৌনসম্পর্কের বিশদ অনর্থক বর্ণনা, পুলিশের গুলিতে বা অত্যাচারে পঙ্গু হল, আদতে লড়াইটা এবং মতাদর্শটা ব্যর্থ হল এবং অ্যাপলিটিক্সের ওপরে সমাজসেবার ওপরে ভরসা রাখল ব্যর্থ নায়ক! এই অবয়ববাদী ধাঁচায় ফেলে প্রতিষ্ঠানগুলি বিক্রি বাড়াতে লাগল তাদের সাহিত্যের। আর, তার সাথেই ক্রমে ‘সক্রিয় রাজনীতি’ ও বামপন্থা থেকে বিমুখ করে দিতে লাগল বিশ্বায়ন পরবর্তী প্রজন্মকে। 
    প্রবুদ্ধবাবু বলেছেন, “হাংরি-দের গল্পের এবং গদ্যের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হচ্ছে, মুক্তসমাপ্তি। অর্থাৎ, কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন না লেখক; হয়তো স্থির সিদ্ধান্ত হয় না কোনও। অন্ততঃ, যে সময়ে তাঁরা লিখছেন, সেই সময়ে অচঞ্চল বিশ্বাস কিছু নেই, কোনও স্থিতি নেই, সিদ্ধান্তে আসার ভিত্তি নেই। বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘বমন রহস্য’ গল্পে আশাহীন এবং আলোহীন ভোগবাদী সমাজের প্রতি ঘৃণা ঠিকরে বেরোয়। গল্পের শেষ লাইন- “বমি করে যাই রক্তাক্ত পথের উপরে। সমস্ত চর্বিত মাংসের টুকরো, সমস্ত জীবন ভোর খেয়ে যাওয়া মাংসের টুকরো আমি বমি উগরে বার করতে থাকি। বমির তোড়ে আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।”। 
    আসলে মুক্তসূচনা এবং মুক্তসমাপ্তির জনক হলেন জীবনানন্দ দাশ । ‘মাল্যবান’ যেভাবে শেষ না হয়েও শেষ হয়েছে, তা থেকে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় । এই শৈলী প্রয়োগে পাঠকের যথেচ্ছ স্বাধীনতা থাকে, জীবনের সাথে মিলিয়ে পরিণতি ভাবার; সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেওয়ার দায় কবির বা লেখকের নয়। প্রবুদ্ধবাবুকে অবশ্য একথা বলার যে, নকশাল আন্দোলন বা ফিদেল কাস্ত্রোর আন্দোলনও ছিল মুক্তসমাপ্তির, আন্দোলনের পরে কি ঘটবে তা আগাম পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল না । নকশাল আন্দোলনকারীরা জানতেন নিশ্চয়ই যে পশ্চিমবঙ্গ বলতে ভারতবর্ষ বোঝায় না । চারু মজুমদার কি জানতেন না যে চীন আদপে তিব্বত দখল করার পর মাও-এর সাম্রাজ্যবদী দিকটাকে ফাঁস করে দিয়েছে ? এখন চীন যা করছে তার ভিত তো মাও-এর গড়ে দেয়া। 
    প্রবুদ্ধ ঘোষ বলেছেন, “নবারুণ কবিতার সংজ্ঞাও একপ্রকার নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। ঠিক যেভাবে হাংরি-রা তাদের কবিতার ধারণা স্বতন্ত্র করে দিয়েছেন । নবারুণের কবিতা চিরাচরিত চাঁদ-ফুল-তারার রোম্যাণ্টিকতা অস্বীকার করে। কবিতা যে ‘লেখার’ নয়, বরং কবিতা ‘হয়ে ওঠার’ বিষয়, তা স্পষ্টতর হয় অস্থির সময়ে- “কবিতা এখনই লেখার সময়/ ইস্তাহারে দেওয়ালে স্টেনসিলে/ নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে/ এখনই কবিতা লেখা যায়…”। কবিতার আসন্ন সম্ভাবনাও লিখে রাখেন শেষ পংক্তিগুলিতে। “কবিতার জ্বলন্ত মশাল/ কবিতার মলোটভ ককটেল/ কবিতার টলউইন অগ্নিশিখা/ এই আগুনের আকাঙ্খাতে আছড়ে পড়ুক”। হাংরি আন্দোলনকারীরাই প্রথম বলেছিল যে কবিতা চাঁদ-ফুল-তারা ইত্যাদির ব্যাপার নয় । আমি আমার কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধে এ-কথা ষাটের দশকেই বলেছিলুম ।
    প্রবুদ্ধবাবু বলেছেন, “এখানেই কবিতাকে নতুনভাবে সাজিয়ে নেওয়ার ভাবনার সাথে মিল পাওয়া যায় হাংরি-দের। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা থেকে প্রথম হাংরি বুলেটিন বেরোয় ইংরাজিতে। ‘Weekly manifesto of hungry generation’, যার সম্পাদক দেবী রায়, মুখ্যনেতা শক্তি চ্যাটার্জ্জী এবং ক্রিয়েটর মলয় রায়চৌধুরি। তার প্রথম অনুচ্ছেদ- “Poetry is no more a civilizing maneuver, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual Hunger.” কবিতা কোনো নিরপেক্ষতার মাপকাঠি নয়, কবিতা শুধুমাত্র ছন্দ-শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখার নান্দনিকতা নয়। বরং, অসহ্য জীবনকে তার মধ্যে প্রতিটি ছত্রে রেখে দেওয়া, অনন্ত বিস্ফারের সম্ভাবনায়। আর, এখানেই মনে পড়ে মারাঠি কবি নামদেও ধাসালের লেখা। দলিত জীবনের আখ্যান এবং প্রতিটি পংক্তিতে উল্লেখযোগ্য ঘৃণা; এই ঘৃণাই আসলে জীবন, এখান থেকে ভালবাসার জন্ম।” 
    এখানে উল্লেখ্য যে নবারুণ ভট্টাচার্যের বাবা-মা দুজনেই ছিলেন শিক্ষিত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের, কলকাতার সংস্কৃতি জগতের মানুষ । অপরপক্ষে হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় এসেছিলেন চাষি পরিবার থেকে; এমনকি কলকাতার সাহিত্যিকদের টিটকিরি প্রতিহত করার জন্য তিনি পতৃদত্ত নাম হারাধন ধাড়া বর্জন করতে বাধ্য হন।  সুবিমল বসাক এসেছিলেন তাঁতি পরিবার থেকে যাঁর বাবা স্যাকরার কাজ করতে বাধ্য হন এবং মোরারজি দেশাইয়ের গোল্ড কনট্রোলের দরুন দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেন । অবনী ধর ছিলেন জাহাজের খালাসি, বাড়ি ফিরে কলকাতার রাস্তায় হকারি করতেন, ঠেলায় করে কয়লা বেচতেন, ফুটপাতে ছিট কাপড় বেচতেন । এই ধরণের জীবনে জড়িয়ে হাংরি-দের লেখায় পরিপার্শ্বের প্রেক্ষিতে আত্ম-কে আবিষ্কার জরুরি হয়ে ওঠে , জীবনের কেন্দ্রের মূল উৎস গুলোয় ফেরা, সন্ধান করা অসুখের উৎসের। কবিতা থেকে কবিতাযাপন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ক্রাইসিস-গুলোকে চিনে নিতে নিতে প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠা। কবিতা মানে বাস্তব থেকে দূরে সরার, অথবা কিছু মিথ্যে স্তোকবাক্য দিয়ে বাস্তবকে আড়াল করার চেষ্টা আর নেই; চাঁদ ফুল তারা নদী আর অতটাও সুন্দর নেই যে তারাই হয়ে উঠতে পারে ‘Aesthetics’-র মাপকাঠি। এস্থেটিক্‌স-ও নিয়ন্ত্রিত হয় পুঁজির দ্বারা, পুঁজির স্বার্থেই! সেই এস্থেটিক্‌স কে প্রবল বিক্ষোভে উপহাস করেন ফাল্গুনী রায়ও- “রাজহাঁস ও ফুলবিষয়ক কবিতাগুলি আমি মাংস রাঁধার জন্যেই দিয়েছিলাম উনোনে…”। বরং দৈনন্দিন যুদ্ধদীর্ণ ‘অসুস্থ’ জীবন থেকেই উঠে আসে ‘Aesthetics’-র সারবত্তা। আর, কবির নিশ্চয়ই দায়বদ্ধতা থাকে সমাজের প্রতি; হাংরি-দের সেই নিজেকে, ভাষাকে, কবিতাকে, নাটককে,  ছিঁড়েখুঁড়ে সত্যের কাছাকাছি পৌছানোর উপলব্ধিকে ঔপনিষদীয় বলা ভুল হবে না ।
    রাষ্ট্রের ভণ্ডামিগুলো, ‘আদার্‌’ অর্থাৎ’অপর’ ছাপ্পা মেরে দেওয়াগুলো, ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া’র গড্ডালিকা স্রোতগুলোর পালটা স্রোত সাহিত্যে-জীবনযাপনে আসে। আর, যতোটা ‘সংস্কৃতি’ ঠিক করে দেওয়া কর্তারা থাকবে, ততটাই থাকবে সেই ‘সংস্কৃতিকে’ প্রত্যাখ্যান। হয়তো সমান্তরাল, তবু থাকবে। প্রবলভাবেই। সমাজশাসকেরা বরাবরই নিজেদের মত করে হেজিমনি চাপিয়ে দেয়, শাসনের ডিস্‌কোর্সের অভিমুখে দাঁড় করাতে চায় সব্বাইকে। আর, যখনই তার বিরুদ্ধে স্বর ওঠে, তা সে সাহিত্যেই হোক বা রাজনিতিতে , তাকে দমিয়ে দেওয়া হয়। ব্রাত্য করে রাখা হয় ‘সংস্কৃতি’-র শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে। জাতীয় সাহিত্যের মাপকাঠিতে ‘অশ্লীল’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে প্রতিপন্ন হয় এই সাহিত্যগুলো ও রাজনীতিগুলো । হাংরি আন্দোলনকারীদের যেভাবে জেলে পোরার চক্রান্ত হয়েছিল, একইভাবে প্রতিষ্ঠানের আরও বৃহত্তর চক্রান্তে একের পর এক হত্যা করে নিশ্চিহ্ণ করা হয়েছিল নকশালদের, সমাজকে ‘শুদ্ধ’ করে তোলার জন্য। 
    অরবিন্দ প্রধান সম্পাদিত ‘অপর : তত্ব ও তথ্য’ বইতে সমীর রায়চৌধুরী লিখেছেন, “নিজেদের রয়ালিস্ট, প্রকৃত খ্রিস্টিয়, প্রগতিবাদী ইত্যাদি নির্দিষ্টাত্মক বিশেষণের খপ্পরের ছাঁচে ফেলে দেওয়ার তোড়জোড়ে সাম্রাজ্যবাদী চেতনার জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছেন ঔপনিবেশিক শ্রেষ্ঠত্ববোধসম্পন্ন লেখকরা, ফলে তাঁদের টেক্সটে আশ্রিত হয়েছে চরম অপরত্ব-বোধ । দক্ষিণ আফ্রিকার ঔপন্যাসিক জে. এম. কোয়েতসে তাঁর ‘ওয়েটিং ফর দ্য বারবারিয়ানস’ গ্রন্হে দেখিয়েছেন কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য অপরায়নের প্রক্রিয়া কার্যকরী করে । এই প্রক্রিয়া তার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব, এগিয়ে থাকা, সভ্যতাকে শ্রেয় এবং অপরের অসত্বিত্বকে হেয় করতে সাহয্য করে । কেবল টেক্সটে নয়, জীবনের সব এলাকাতে এভাবে স্ব-আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সহজ হয়ে ওঠে ।” বলা বাহুল্য যে হাংরি আন্দোলন আর নকশাল আন্দোলনকে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন ‘অপর’ তকমা দিয়ে সমাজ থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল, যেমন আফ্রিকার আদিনিবাসদের মুছে ফেলতে চেয়েছিল ইউরোপের শাসক-সমাজ ।
    নারায়ণ সান্যালের বিবরণীতে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার এক অজানা কথা উঠে আসে। “কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর-মশায়ের মর্মরমূর্তির যেদিন মুণ্ডচ্ছেদ হয় তার মাসখানেকের মধ্যে সিপিএম (এম. এল) দলের এক নেতৃত্বস্থানীয় ছাত্রনেতার সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ হয়েছিল! ঘটনাচক্রে সে আমার নিকট আত্মীয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। কট্টর নকশাল। আমার পেচকপ্রতিম বিরস মুখখানা দেখে সে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, ‘বিশ্বাস কর ছোটকাকু! মূর্তিটা যে ভেঙ্গেছে তাকে আমি চিনি। গত বছর হায়ার সেকেন্ডারিতে সে বাংলায় লেটার পেয়েছে। ওর সেই বাংলা প্রশ্নপত্রে প্রবন্ধ এসেছিল তোমার প্রিয় দেশবরেণ্য নেতা। ও লিখেছিল বিদ্যাসাগরের উপর।”
    অধিকাংশ আলোচক বলেন হাংরি আন্দোলন এবং নকশাল আন্দোলন দুটিই ব্যর্থ্য এবং তাদের ব্যর্থতার কারণও এক : প্রথমত, প্রশাসনিক আক্রমণ ; দ্বিতীয়ত, আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ ; তৃতীয়ত, আন্দোনের সদস্যদের মধ্যে বিভাজন ; চতুর্থত, তাঁদের কার্যকলাপ । আমি শুধু বলতে চাই যে দুটি আন্দোলনই বাংলার বৌদ্ধিক সমাজে ছাপ ফেলেছে এবং তা ‘ব্যর্থ্য’ তকমা দিয়ে চাপা দেয়া যায় না ।
    পাঁচ
    হাংরি আন্দোলনকারীদের মত পরাবাস্তব আন্দোলনকারীদের মাঝেও ভাঙন ঘটত, সে কথাও জানিয়েছেন অভিজিৎ পাল ।
    ১৯১৭ সালে গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার “সুররিয়ালিজম” অভিধাটি তৈরি করেছিলেন, যার অর্থ ছিল বাস্তবের অতীত। শব্দটি প্রায় লুফে নেন আঁদ্রে ব্রেতঁ, নতুন একটি আন্দোলন আরম্ভ করার পরিকল্পনা নিয়ে, যে আন্দোলনটি হবে পূর্ববর্তী ডাডাবাদী আন্দোলন থেকে ভিন্ন । ত্রিস্তঁ জারা উদ্ভাবিত ডাডা আন্দোলন থেকে সরে আসার কারণ হল ব্রেতঁ সহ্য করতে পারতেন না ত্রিস্তঁ জারাকে, কেননা কবি-শিল্পী মহলে প্রতিশীল্পের জনক হিসাবে ত্রিস্তঁ জারা খ্যাতি পাচ্ছিলেন। আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিজম তত্বটির একমাত্র ব্যাখ্যাকারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে আরম্ভ করেন। ১৯১৯ সালে ত্রিস্তঁ জারাকে কিন্তু ব্রেতঁ চিঠি লিখে প্যারিসে আসতে বলেছিলেন । একইভাবে ‘হাংরি’ শব্দটি মলয় রায়চৌধুরী পেয়েছিলেন কবি জিওফ্রে চসার থেকে । এই ‘হাংরি’ শব্দটি নেয়ার জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তেমন কিছুই করা হয়নি আঁদ্রে ব্রেতঁ ও ত্রিস্তঁ জারা সম্পর্কে । মলয় রায়চৌধুরী হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ঘোষণা করেন ১৯৬৫ সালের পয়লা নভেম্বর একটি লিফলেট প্রকাশের মাধ্যমে ।
    পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে, প্রথম থেকেই, আঁদ্রে ব্রেতঁ’র সঙ্গে অনেক পরাবাস্তববাদীর সদ্ভাব ছিল না, কিন্তু পরাবাস্তববাদ বিশ্লেষণের সময়ে আলোচকরা তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন না । আমরা যদি বাঙালি আলোচকদের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব যে তাঁরা হাংরি জেনারেশন বা ক্ষুধার্ত আন্দোলন বিশ্লেষণ করার সময়ে হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে অত্যধিক চিন্তিত, হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্য অবদান নিয়ে নয় । ব্যাপারটা বিস্ময়কর নয় । তার কারণ অধিকাংশ আলোচক হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের বইপত্র সহজে সংগ্রহ করতে পারেন না এবং দ্বিতীয়ত সাংবাদিক-আলোচকদের কুৎসাবিলাসী প্রবণতা । 
    আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁর বন্ধু পল এলুয়ার, বেনিয়ামিন পেরে, মান রে, জাক বারোঁ, রেনে ক্রেভালl, রোবের দেসনস, গিয়র্গে লিমবোর, রোজের ভিত্রাক, জোসেফ দেলতিল, লুই আরাগঁ ও ফিলিপে সুপোকে নিয়ে ১৯১৯ পরাবাস্তববাদ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন । কিছুকাল পরে, রাজনৈতিক ভাবাদর্শের কারণে তাঁর সঙ্গে লুই আরাগঁর ঝগড়া বেধে গিয়েছিল । মার্সেল দ্যুশঁ,  ত্রিস্তঁ জারা এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ, উভয়ের সঙ্গেই ছিলেন, এবং দুটি দলই তাঁকে গুরুত্ব দিতেন, দ্যুশঁ’র অবাস্তব ও অচিন্ত্যনীয় ভাবনার দরুন।
    পরাবাস্তব আন্দোলনের আগে জুরিখে ডাডাবাদী আন্দোলন আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ পরাবাস্তববাদের অনুপ্রেরণা পান ডাডা আন্দোলনের পুরোধা ত্রিস্তঁ জারার কাছ থেকে, কিন্তু ব্রেতঁ চিরকাল তা অস্বীকার করে্ছেন । ডাডা ছিল শিল্পবিরোধী আভাঁ গার্দ আন্দোলন ; অবশ্য প্রতিশিল্পও তো শিল্প । ডাডাবাদের রমরমার কারণে ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ব্রেতঁর সম্পর্ক দূষিত হয়ে যায় ; একজন অন্যজনের নেতৃত্ব স্বীকার করতে চাইতেন না । ডাডা (/ˈdɑːdɑː/) বা ডাডাবাদ (দাদাবাদ নামেও পরিচিত) ছিল ২০ শতকের ইউরোপীয় ভিন্নচিন্তকদের একটি সাহিত্য-শিল্প আন্দোলন, যার প্রাথমিক কেন্দ্র ছিল সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ক্যাবারে ভলতেয়ার ( ১৯১৬ নাগাদ ) এবং নিউ ইয়র্কে (প্রায় ১৯১৫ নাগাদ)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ডাডা আন্দোলন গড়ে ওঠে সেইসব শিল্পীদের নিয়ে, যাঁরা পুঁজিবাদী সমাজের যুক্তি, কারণ বা সৌন্দর্যের ধারণা মানতেন না, বরং তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন আপাত-অর্থহীন, উদ্ভট, অযৌক্তিক এবং বুর্জোয়া-বিরোধী প্রতিবাদী বক্তব্য । আন্দোলনটির শিল্পচর্চা প্রসারিত হয়েছিল দৃশ্যমান, সাহিত্য ও শব্দ মাধ্যমে, যেমন- কোলাজ, শব্দসঙ্গীত, কাট-আপ লেখা, এবং ভাস্কর্য। ডাডাবাদী শিল্পীরা হানাহানি, যুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এবং গোঁড়া বামপন্থীদের সাথে তাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল।
    যুদ্ধ-পূর্ববর্তী প্রগতিবাদীদের মধ্যেই ডাডার শিকড় লুকিয়ে ছিল। শিল্পের সংজ্ঞায় পড়েনা এমন সব সৃষ্টিকর্মকে চিহ্নিত করার জন্য ১৯১৩ সালে “প্রতি-শিল্প” শব্দটি চালু করেছিলেন মার্সেল দ্যুশঁ । কিউবিজম এবং কোলাজ ও বিমূর্ত শিল্পের অগ্রগতিই হয়তো ডাডা আন্দোলনকে বাস্তবতার গন্ডী থেকে বিচ্যুত হতে উদ্বুদ্ধ করে। আর শব্দ ও অর্থের প্রথানুগত সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান করতে ডাডাকে প্রভাবিত করে ইতালীয় ভবিষ্যতবাদী এবং জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টগণ । আলফ্রেড জ্যারির উবু রোই (১৮৯৬) এবং এরিক স্যাটির প্যারেড (১৯১৬-১৭) প্রভৃতি লেখাগুলোকে ডাডাবাদী রচনার আদিরূপ বলা যেতে পারে।  ডাডা আন্দোলনের মূলনীতিগুলো প্রথম সংকলিত হয় ১৯১৬ সালে হুগো বলের ডাডা ম্যানিফেস্টোতে। এই ম্যানিফেস্টোর প্রভাবে পরবর্তিকালে ব্রেতঁ সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো লিখতে অনুপপ্রাণিত হন — এই কথা শুনতে ব্রেতঁ’র ভালো লাগত না এবং সেকারণে তিনি বহু সঙ্গীকে এক-এক করে আন্দোলন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন । তাছাড়া ব্রেতঁ মনে করতেন ডাডাবাদীরা নৈরাজ্যবাদী বা অ্যানার্কিস্ট, যখন কিনা তিনি একজন কমিউনিস্ট ।
    ডাডা আন্দোলনে ছিল জনসমাবেশ, মিছিল ও সাহিত্য সাময়িকীর প্রকাশনা; বিভিন্ন মাধ্যমে শিল্প, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি নিয়ে তুমুল আলোচনা হতো। আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্বরা ছিলেন হুগো বল, মার্সেল দ্যুশঁ, এমি হেনিংস, হানস আর্প, রাউল হাউসম্যান, হানা হৌক, জোহান বাডার, ত্রিস্তঁ জারা, ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, রিচার্ড হিউলসেনব্যাক, জর্জ গ্রোস, জন হার্টফিল্ড, ম্যান রে, বিয়াট্রিস উড, কার্ট শ্যুইটার্স, হানস রিখটার এবং ম্যাক্স আর্নেস্ট। অন্যান্য  আন্দোলন, শহরতলীর গান এসবের পাশাপাশি পরাবাস্তববাদ, নব্য বাস্তবতা, পপ শিল্প এবং ফ্লক্সেস প্রভৃতি গোষ্ঠীগুলোও ডাডা আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এই আন্দোলনের অনেকে সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ।
    পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে যাঁরা ব্রেতঁর সঙ্গে একে-একে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম হলেন ফিলিপে সুপো, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, রেনে ক্রেভাল, মিশেল লেইরিস, বেনিয়ামিন পেরে, অন্তনাঁ আতো,জাক রিগো, রবের দেসনস, ম্যাক্স আর্নস্ত প্রমুখ । এঁদের অনেকে ডাডাবাদী আন্দোলন ত্যাগ করে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২৩ সালে যোগ দেন চিত্রকর আঁদ্রে মাসোঁ ও ইভস তাঙ্গুই । ১৯২১ সালে ভিয়েনায় গিয়ে ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করেন ব্রেতঁ । ফ্রয়েডের ধারণাকে তিনি সাহিত্য ও ছবি আঁকায় নিয়ে আসতে চান । ফ্রয়েডের প্রভাবে ব্রেতঁ বললেন, সুররিয়ালিজমের মূলকথা হল অবচেতনমনের ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট ও আশ্চর্যকর সব রূপকল্প দ্বারা প্রকাশ করা। ডাডাবাদীরা যেখানে চেয়েছিলেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী করতে যার মাধ্যমে সে ভেদ করতে পারবে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল, পৌঁছাতে পারবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে; সেখানে পরাবাস্তববাদ আরো একধাপ এগিয়ে বলল, প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে। পরাবাস্তববাদী শিল্পীর লক্ষ্য হল তার কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে ব্যক্তি-অস্তিত্বের গভীর থেকে তুলে আনা। 
    সুররিয়ালিজমের প্রথম ইশতেহার প্রকাশ করেন ইয়ান গল। এ ইশতেহারটি ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পরেই ১৫ অক্টোবর আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিজমের দ্বিতীয় ইশতেহারটি প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৩০ সালে এ ধারার তৃতীয় ইশতেহারটিও প্রকাশ করেন। ইয়ান গল ও আঁদ্রে ব্রেতঁ—দুজনে দু দল সুররিয়ালিস্ট শিল্পীর নেতৃত্ব দিতেন। ইয়ান গলের নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, ত্রিস্তঁ জারা, মার্সেল আর্লেন্ড, জোসেফ ডেলটিল, পিয়েরে অ্যালবার্ট বিরোট প্রমুখ। আন্দ্রে ব্রেতঁর নেতৃত্বে ছিলেন লুই আরাগঁ, পল এলুয়ায়, রোবের ডেসনোস, জ্যাক বারোঁ, জর্জ ম্যালকিন প্রমুখ। এ দুটি দলেই ডাডাইজম আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। অবশ্য ইয়ান গল ও আন্দ্রে ব্রেতঁ এই আন্দোলন নিয়ে প্রকাশ্য-রেশারেশিতে জড়িয়ে পড়েন। তখন থেকেই পরাবাস্তববাদীরা ছোটো-ছোটো গোষ্ঠীতে বিভাজিত হতে থাকেন, যদিও তাঁদের শিল্প ও সাহিত্যধারা ছিল একই । পরে আন্দোলনে যোগ দেন জোয়ান মিরো, রেমণ্ড কোয়েনু, ম্যাক্স মোরিজ, পিয়ের নাভিল, জাক আঁদ্রে বোইফার, গেয়র্গে মালকাইন প্রমুখ । জিয়োর্জিও দে চিরোকো এবং পাবলো পিকাসো অনেক সময়ে গোষ্ঠির কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন, তবে আন্দোলনের ঘোষিত সদস্য ছিলেন না।
    সুররিয়ালিজম বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ডাডাইজম থেকে নিলেও এই মতবাদটি, যে,  ‘শিল্পের উৎস ও উপকরণ’ বিবেচনায় একটি অন্যটির চেয়ে স্বতন্ত্র্য। সুররিয়ালিজম আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন ফরাসি কবি আঁদ্রে ব্রেতঁ। তিনি শিল্প রচনায় ‘অচেতন মনের ওপর গুরুত্ব’ দেওয়ার জন্যে শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি মনে করতেন, ‘অচেতন মন হতে পারে কল্পনার অশেষ উৎস।’ তিনি অচেতন মনের ধারণাটি নিঃসন্দেহে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। ডাডাবাদী শিল্পীরা শিল্পের উৎস ও উপকরণ আহরণে ‘অচেতন’ মনের ধারণা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা এসে অচেতন মনের উৎস থেকে শিল্প রচনার প্রতি গুরুত্ব দেন এবং সফলতাও লাভ করেন।
    আঁদ্রে ব্রেতঁ মনে করতেন, ‘যা বিস্ময়কর, তা সবসময়ই সুন্দর’। অচেতন মনের গহীনেই বিস্ময়কর সুন্দরের বসবাস। তার সন্ধান করাই সাহিত্যিক-শিল্পীর যথার্থ কাজ। অচেতন মনের কারণেই সুররিয়ালিজমের কবি-শিল্পীরা গভীর আত্মঅনুসন্ধানে নামেন। মনের গহীন থেকে স্বপ্নময় দৃশ্যগুলো হাতড়ে বের করতে এবং মনের অন্তর্গত সত্য উন্মোচনে তাঁরা আগ্রহী ছিলেন। যার কারণে চেতন ও অচেতনের মধ্যে শিল্পীরা বন্ধন স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা অচেতন মনের সেই সব উপলব্ধিকে দৃশ্যে রূপ দিলেন যা পূর্বে কেউ কখনো করেনি। অচেতনের ভূমিতে দাঁড়িয়ে বাস্তব উপস্থাপনের কারণে খুব দ্রুতই এ মতবাদটি বিশ্ব শিল্পকলায় ‘অভিনবত্ব’ যোগ করতে সমর্থ হয়। এমনকী, পুঁজিবাদ-বিরোধী এই আন্দোলন থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন বহু বিখ্যাত বিজ্ঞাপন কোম্পানি ।
    সুররিয়ালিজমকে ‘নির্দিষ্ট’ ছকে ফেলা কঠিন। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা একই ছাতার নিচে বসবাস করে ছবি আঁকলেও এবং কবিতা লিখলেও, তাঁদের দৃষ্টি ও উপলব্ধির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ফলে এ মতবাদটি সম্পর্কে প্রত্যেকে ব্যাক্তিগত ভাবনা ভেবেছেন। ১৯২৯ সালে সালভাদর দালি এই আন্দোলনে যোগ দেন, যদিও তাঁর সঙ্গেও ব্রেতঁর বনিবনা হতো না । সালভাদর দালি মনে করতেন, ‘সুররিয়ালিজম একটি ধ্বংসাত্মক দর্শন এবং এটি কেবল তা-ই ধ্বংস করে যা দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখে।’ অন্যদিকে জন লেলন বলেছেন, ‘সুররিয়ালিজম আমার কাছে বিশেষ প্রভাব নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। কেননা, আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার কল্পনা উন্মাদনা নয়। বরং সুররিয়ালিজমই আমার বাস্তবতা।’ ব্রেতোঁ বলতেন, ‘ভাবনার যথাযথ পদ্ধতি অনুধাবনের জন্যে সুররিয়ালিজম আবশ্যক।’ এ ধারায় স্বপ্ন ও বাস্তবতার মিশ্রণ হয় বলে সুররিয়ালিজমকে স্বপ্নবাস্তবতাও বলা হয়ে থাকে।
    সুররিয়ালিজমের ঢেউ খুব অল্প সময়েই শিল্পের সবগুলো শাখায় আছড়ে পড়ে। কবিতা, গান থেকে শুরু করে নাটক, সিনেমা পর্যন্ত সুররিয়ালিস্টদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সুররিয়ালিজম ধারায় অন্তত ছয়টি সিনেমা নির্মিত হয়। এ ধারার প্রধান শিল্পীরা হলেন জ্যাঁ আর্প, ম্যাক্স আর্নেস্ট, আঁদ্রে মেসন, সালভাদর দালি, রেনে ম্যাগরেট, পিয়েরো রয়, জোয়ান মিরো, পল ডেলভাক্স, ফ্রিদা কাহলো প্রমুখ। এ ধারার চিত্রকর্মের মধ্যে ১৯৩১ সালে আঁকা সালভাদর দালির ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ সবচেয়ে আলোচিত ছবি। এটি কেবল এ ধারার মধ্যেই আলোচিত চিত্রকর্মই নয়, এটি দালিরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভার নিদর্শন। ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’-তে দালি ‘সময়ের’ বিচিত্র অবস্থাকে ফ্রেমবন্দি করতে চেষ্টা করেছেন। ‘মেটামরফসিস অব নার্সিসাস’, ‘নভিলিটি অব টাইম’, ‘প্রোফাইল অব টাইম’ প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
    সুররিয়ালিজম ধারার প্রধানতম চিত্রকর্মের মধ্যে রেনে ম্যাগরেটের ‘দ্য সন অব ম্যান’, ‘দিস ইজ নট এ পাইপ’, জর্জিও দি চিরিকো-এর ‘দ্য রেড টাওয়ার’, ম্যাক্স আর্নেস্টের ‘দি এলিফ্যান্ট সিলিবেস’, ইভ তঁগির ‘রিপ্লাই টু রেড’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে সুররিয়ালিজম আন্দোলন থেমে যায়। শিল্পবোদ্ধারা মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলনটির অনানুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘটে। কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্প আন্দোলনের মতো সুররিয়ালিজমের চর্চা বর্তমানেও হচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনেও সুররিয়ালিজমের প্রভাব লক্ষ করা যায়।  ১৯২৪ সালে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো । মার্কসবাদের সঙ্গে আর্তুর র‌্যাঁবোর আত্মপরিবর্তনের ভাবনাকে একত্রিত করার উদ্দেশে ব্রেতঁ ১৯২৭ সালে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন । কিন্তু সাম্যবাদীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বেশিদিন টেকেনি । সেখান থেকেও তিনি ১৯৩৩ সালে বিতাড়িত হন । পরাবাস্তববাদীদের “উন্মাদ প্রেম” তত্বটি ব্রেতঁর এবং “উন্মাদ প্রেম” করার জন্য বেশ কিছু তরুণী সুররিয়ালিস্টদের প্রতি আকৃষ্ট হন । যৌনতার স্বেচ্ছাচারিতার ঢেউ ওঠে সাহিত্যিক ও শিল্পী মহলে ; পরাবাস্তববাদীদের নামের সঙ্গে একজন বা বেশি নারীর সম্পর্ক ঘটে এবং সেই নারীরা তাঁদের পুরুষ প্রেমিকদের নামেই খ্যাতি পেয়েছেন । 
    তাঁর রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং অন্যান্য কারণে প্রেভের, বারোঁ, দেসনস, লেইরিস, লিমবোর, মাসোঁ, কোয়েন্যু, মোরিস, বোইফার সম্পর্কচ্ছদ করেন ব্রেতঁর সঙ্গে এবং গেয়র্গে বাতাইয়ের নেতৃত্বে পৃথক গোষ্ঠী তৈরি করেন । এই সময়েই, ১৯২৯ নাগাদ, ব্রেতঁর গোষ্ঠীতে যোগ দেন সালভাদর দালি, লুই বুনুয়েল, আলবের্তো জিয়াকোমেত্তি, রেনে শার এবং লি মিলার । ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ঝগড়া মিটমাট করে নেন ব্রেতঁ । দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ইশতাহার প্রকাশের সময়ে তাতে সই করেছিলেন আরাগঁ, আর্নস্ট, বুনুয়েল, শার, ক্রেভাল, দালি, এলুয়ার, পেরে, টাঙ্গুই, জারা, ম্যাক্সিম আলেকজান্দ্রে, জো বনসকোয়েত, কামিলে গোয়েমানস, পল নুগ, ফ্রান্সিস পোঙ্গে, মার্কো রিসটিচ, জর্জ শাদুল, আঁদ্রে তিরিয়ঁ এবং আলবেয়ার ভালেনতিন । ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা বন্ধু ছিলেন সালভাদর দালি এবং লুই বুনুয়েলের, আলোচনায় অংশ নিতেন, কিন্তু সুররিয়ালিস্ট গোষ্ঠিতে যোগ দেননি । ১৯২৯ সালে তাঁর মনে হয়েছিল যে দালি আর বুনুয়েলের ফিল্ম “একটি আন্দালুসিয় কুকুর” তাঁকে আক্রমণ করার জন্যে তৈরি হয়েছিল ; সেই থেকে তিনি সুররিয়ালিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন । আরাগঁ ও জর্জ শাদুল ব্রেতঁ’র গোষ্ঠী ত্যাগ করেছিলেন রাজনৈতিক মতভেদের কারণে, যদিও ব্রেতঁ বলতেন যে তিনিই ওনাদের তাড়িয়েছেন ।
    ১৯৩০ সালে কয়েকজন পরাবাস্তববাদী আঁদ্রে ব্রেতঁ’র একচেটিয়া নেতৃত্বে বিরক্ত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একটি প্যামফ্লেট ছাপিয়েছিলেন । পরাবাস্তববাদ আন্দোলন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । ১৯৩৫ সালে ব্রেতঁ এবং সোভিয়েত লেখক ও সাংবাদিক ইলিয়া এরেনবার্গের মাঝে ঝগড়া এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছোয় যে প্যারিসের রাস্তায় তাঁদের দুজনের হাতাহাতি আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । এরেনবার্গ একটি পুস্তিকা ছাপিয়ে বলেছিলেন যে পরাবাস্তববাদীরা পায়ুকামী । এর ফলে পরাবাস্তববাদীদের ইনটারন্যাশানাল কংগ্রেস ফর দি ডেফেন্স অফ কালচার সংস্হা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল । সালভাদর দালি বলেছিলেন যে পরাবাস্তববাদীদের মধ্যে প্রকৃত সাম্যবাদী হলেন একমাত্র রেনে ক্রেভাল । চটে গিয়ে ক্রেভালকে পরাবাস্তববাদী আন্দোলন থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ । অঁতনা অতো, ভিত্রাক এবং সুপোকে পরাবাস্তববাদী দল থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ, মূলত সাম্যবাদের প্রতি ব্রেতঁর আত্মসমর্পণের কারণে এই তিনজন বিরক্ত বোধ করেন ।
    ১৯৩৮ সালে ব্রেতঁ মেকসিকো যাবার সুযোগ পান এবং লিও ট্রটস্কির সঙ্গে দেখা করেন । তাঁর সঙ্গে ছিলেন দিয়েগো রিভেরা ও ফ্রিদা কালহো । ট্রটস্কি এবং ব্রেতঁ একটা যুক্ত ইশতাহার প্রকাশ করেছিলেন, “শিল্পের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা” শিরোনামে । লুই আরাগঁর সঙ্গেও ব্রেতঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না । ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত ডাডাবাদীদের সঙ্গে আন্দোলন করার পর ১৯২৪ সালে আরাগঁ যোগ দেন পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে । অন্যান্য ফরাসী পরাবাস্তববাদীদের সঙ্গে তিনিও ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দ্যান এবং পার্টির পত্রিকায় কলাম ও রাজনৈতিক কবিতা লিখতেন । আরাগঁর সঙ্গে ব্রেতঁর বিবাদের কারণ হল ব্রেতঁ চেয়েছিলেন ট্রটস্কির সঙ্গী ভিকতর সার্জকে সন্মানিত করতে । পরবর্তীকালে, ১৯৫৬ নাগাদ, সোভিয়েত রাষ্ট্র সম্পর্কে নিরাশ হন আরাগঁ, বিশেষ করে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশ কংগ্রেসের পর যখন নিকিতা ক্রুশ্চভ আক্রমণ করেন জোসেফ স্তালিনের ব্যক্তিত্ববাদকে । তা সত্ত্বেও স্তালিনপন্হী আরাগঁ ও ট্রটস্কিপন্হী ব্রেতঁর কখনও মিটমাট হয়নি । কাট-আপ কবিতার জনক ব্রায়ন জিসিনকেও গোষ্ঠী থেকে বিতাড়ন করেন ব্রেতঁ ; ব্রায়ান জিসিনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছিলেন বিট ঔপন্যাসিক উইলিয়াম বারোজ । বিট আন্দোলনের প্রায় সকলেই সুররিয়ালিজম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । বিটদের যৌন স্বাধীনতার ভাবনা-চিন্তায় সুররিয়ালিস্টদের অবদান আছে ।
    পরাবাস্তববাদই সম্ভবত প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন, যেখানে নারীকে দূরতম কোনো নক্ষত্রের আলোর মতো, প্রেরণা ও পরিত্রাণের মতো, কল্পনার দেবী প্রতিমার মতো পবিত্র এক অবস্থান দেওয়া হয়েছিল। নারী তাদের চোখে একই সঙ্গে পবিত্র কুমারী, দেবদূত আবার একই সঙ্গে মোহিনী জাদুকরী, ইন্দ্রিয় উদ্দীপক ও নিয়তির মতো অপ্রতিরোধ্য। ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টোয় আদ্রেঁ ব্রেতঁ নারীকে এরকম একটি অপার্থিব অসীম স্বপ্নিল চোখে দেখা ও দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। পুরুষ শিল্পীদের প্রেরণা, উদ্দীপনা ও কল্পনার সুদীর্ঘ সাম্পান হয়ে এগিয়ে আসবেন নারীরা। হয়ে উঠবেন পুরুষদের আরাধ্য ‘মিউজ’ আর একই সঙ্গে femme fatale। সুদৃশ্য উঁচু পূজার বেদি উদ্ভাসিত করে যেখানে বসে থাকবেন নারীরা। তাঁদের স্বর্গীয় প্রাসাদে আরো সৃষ্টিশীল হয়ে উঠবে পুরুষ।
    ব্রেতঁ ছিলেন সেই সময়ের কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ। তাঁর সম্মোহক ব্যক্তিত্বে আচ্ছন্ন হননি তাঁর সান্নিধ্যে এসেও – এরকম কোনো দৃষ্টান্ত কোথাও নেই। উজ্জ্বল, সাবলীল, মেধাবী, স্বতঃস্ফূর্ত এবং নায়কসুলভ ব্রেতঁ একই সঙ্গে ছিলেন উদ্ধত, আক্রমণাত্মক ও অহমিকাপূর্ণ। নিজের তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে মাঝেমধ্যেই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতেন। কিন্তু যদি তাঁর একবার মনে হতো যে কেউ তাঁর প্রভুত্বকে অগ্রাহ্য করছে, সর্বশক্তি দিয়ে তাকে আঘাত করতেন। নেতৃত্ব দেওয়ার সব গুণ প্রকৃতিগতভাবেই ছিল তাঁর মধ্যে। মহিলাদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল তরুণ প্রেমিকের মতো সম্ভ্রমপূর্ণ। তাঁর আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, অভিজাত ভাষা – এসবের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই মেজাজ হারিয়ে সম্পূর্ণ লাগামহীন হয়ে পড়া আর দুর্বোধ্য জটিল মানসিকতার জন্য পারতপক্ষে অনেকেই ঘাঁটাতে চাইতেন না তাঁকে।
    নারী পরাবাস্তববাদীদের সংখ্যা কম ছিল না । কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখ্য ফ্রিদা কাহলো, আসে বার্গ, লিজে দেহামে, আইরিন হামোয়ের, জয়েস মানসোর, ওলগা ওরোজকো, আলেহান্দ্রা পিৎসারনিক, ভ্যালেনটিন পেনরোজ, জিসেল প্রাসিনস, ব্লাঙ্কা ভারেলা, ইউনিকা জুর্ন প্রমুখ । নারী চিত্রকররা সংখ্যায় ছিলেন বেশি । তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য গেরট্রুড আবেরকমবি, মারিয়ন আদনামস, আইলিন ফরেসটার আগার, রাশেল বায়েস, ফ্যানি ব্রেনান, এমি ব্রিজওয়াটার, লেনোরা ক্যারিংটন, ইথেল কলকুহুন, লেনোর ফিনি, জেন গ্রাভেরোল, ভ্যালেনটিন য়োগো, ফ্রিদা খাহলো, রিটা কার্ন-লারসেন, গ্রেটা নুটসন ( ত্রিস্তঁ জারার স্ত্রী ), জাকেলিন লামবা ( আঁদ্রে ব্রেতঁ’র স্ত্রী), মারুহা মালো, মার্গারেট মডলিন, গ্রেস পেইলথর্প, অ্যালিস রাহোন, এডিথ রিমিঙটন, পেনিলোপি রোজমন্ট, কে সেজ ( ইভস তাঙ্গুইর স্ত্রী ), ইভা স্বাঙ্কমাজেরোভা, ডরোথি ট্যানিঙ ( ম্যাক্স আর্নস্টের স্ত্রী ), রেমেদিওস ভারো ( বেনিয়ামিন পেরের স্ত্রী ) প্রমুখ । ভাস্করদের মধ্যে উল্লেখ্য এলিজা ব্রেতঁ ( আঁদ্রে ব্রেতঁ’র তৃতীয় স্ত্রী ), মেরে ওপেনহাইম ( মান রে’র মডেল ছিলেন ) এবং মিমি পারেন্ট । ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ক্লদ কাহুন, নুশ এলুয়ার, হেনরিয়েতা গ্রিনদাত, আইডা কার, দোরা মার ( পাবলো পিকাসোর সঙ্গে নয় বছর লিভ টুগেদার করেছিলেন ), এমিলা মেদকোভা, লি মিলার, কাতি হোরনা প্রমুখ । পুরুষ পরাবাস্তববাদীদের বহু ফোটো এই নারী ফোটোগ্রাফারদের কারণেই ইতিহাসে স্হান পেয়েছে ।
    নারীদের নিয়ে পরাবাস্তববাদীদের এই স্বপ্নিল কাব্যময় উচ্ছ্বাস জোরালো একটা ধাক্কা খেল যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পশ্চিম ইউরোপে দ্রম্নত বদলাতে থাকা পরিস্থিতির ভস্ম ও শোণিত স্নাত শোণিত আত্মশক্তিসম্পন্ন নারীরা তাঁদের ভারী বাস্তবতা নিয়ে এসে দাঁড়ালেন সামনে। স্বপ্নে দেখা নারীর আয়না-শরীর ভেঙে পড়ল ঝুরঝুর করে আর বেরিয়ে এলো মেরুদ-সম্পন্ন রক্তমাংসের মানবী। সুররিয়ালিজম চেয়েছিল পুরুষের নিয়ন্ত্রণে নারীদের মুক্তি। কিন্তু যে গভীর অতলশায়ী মুক্তি দরজা খুলে দিলো নারীদের জন্য, সুররিয়ালিজম তার জন্য তৈরি ছিল না। মৃত অ্যালবাট্রসের মতো এই বিমূর্ত আদর্শায়িত ধারণা নারী শিল্পীদের গলায় ঝুলে থেকেছে, যাকে ঝেড়ে ফেলে নিজস্ব শিল্পসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করা দুঃসাধ্য ছিল। সময় লেগেছে সাফল্য পেতে। কিন্তু দিনের শেষে হেসেছিলেন তাঁরাই। এমন নয় যে, পরাবাস্তবতার প্রধান মশালবাহক ব্রেতঁ চাইছিলেন যে পুরুষরাই হবেন এই আন্দোলনের ঋত্বিক আর দ্যুতিময় নারী শিল্পী এবং সাহিত্যিকদের কাজ হবে মুগ্ধ সাদা পালক ঘাসের ওপরে ফেলে যাওয়া এবং আকর্ষণীয় ‘গুজব’ হিসেবে সুখী থাকা। ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশের পরবর্তী প্রদর্শনীগুলোতে নারী শিল্পীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু পুরুষ উদ্ভাবিত পরাবাস্তবতা থেকে তাঁদের ভাষা, স্বর ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র। নিজেদের ভারী অসিত্মত্ব, শরীরী উপস্থিতি জোরালোভাবে জায়গা পেল তাঁদের ছবিতে।
    কিন্তু নারী শিল্পীদের কাছে আত্মপ্রতিকৃতি হয়ে উঠল একটি সশস্ত্র ভাষার মতো। নিজস্ব গোপন একটি সন্ত্রাসের মতো। এই আন্দোলনের মধ্যে নারীরা এমন এক পৃথিবীর ঝলক দেখলেন, যেখানে আরোপিত বিধিনিষেধ না মেনে সৃজনশীল থাকা যায়, দমচাপা প্রতিবাদের ইচ্ছেগুলোর উৎস থেকে পাথরের বাঁধ সরিয়ে দেওয়া যায়। নগ্ন ও উদ্দাম করা যায় কল্পনাকে। নোঙর নামানো জাহাজের মতো অনড় ও ঠাসবুনট একটি উপস্থিতি হয়ে ছবিতে নিজের মুখ তাঁদের কাছে হয়ে উঠল অন্যতম প্রধান আইকন। যে ছবি আত্মপ্রতিকৃতি নয়, সেখানেও বারবার আসতে থাকল শিল্পীর শরীরী প্রতিমা। ফ্রিদা কাহ্লোর (১৯০৭-৫৪) ক্যানভাস তাঁর যন্ত্রণাবিদ্ধ শান্ত মুখশ্রী ধরে রাখল। মুখের বিশেষ কিছু চিহ্ন যা তাঁকে চেনায় – যেমন পাখির ডানার মতো ভুরু, আমন্ড আকারের চোখ ছবিতেও আনলেন তিনি। রিমেদিওস ভারোর (১৯০৮-৬৩) ছবিতে পানপাতার মতো মুখ, তীক্ষন নাক, দীর্ঘ মাথাভর্তি চুলের নারীর মধ্যে নির্ভুল চেনা গেল শিল্পীকে। আবার লিওনর ফিনির (১৯১৮-৯৬) আঁকা নারীরা তাদের বেড়ালের মতো কালো চোখ আর ইন্দ্রিয়াসক্ত মুখ নিয়ে হয়ে উঠল ফিনিরই চেনা মুখচ্ছবি। ১৯৩৯ সালের ‘The Alcove : An interior with three women’ ছবিতে ভারী  পর্দা টাঙানো ঘরে দুজন অর্ধশায়িত মহিলা পরস্পরকে ছুঁয়ে আছেন। আর একজন মহিলা দাঁড়িয়ে। তিনজনেই যেন কোনো কিছুর প্রতীক্ষা করছেন চাপা উদ্বিগ্ন মুখে। যে তিনজন নারীর ছবি, তাঁরা যে লিওনর ফিনি, লিওনারা ক্যারিংটন এবং ইলিন অগার – এটা ছবিটিকে একঝলক দেখেই চেনা যায়। এমনকি যখন অন্য কোনো নারীর প্রতিকৃতি আঁকছেন তাঁরা, সেখানেও তাঁদের বিদ্রোহের অস্বীকারের জোরালো পাঞ্জার ছাপ এই শিল্পীরা সেইসব নারীর মুখে ঘন লাল নিম্নরেখা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন
    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হতে ১৯৩৯ সালে অধিকাংশ পরাবাস্তববাদী বিদেশে পালিয়ে যান এবং তাঁদের মধ্যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও বক্তব্য নিয়ে খেয়োখেয়ি বেধে যায় । অলোচকরা মনে করেন যে গোষ্ঠী হিসাবে পরাবাস্তববাদ ১৯৪৭ সালে ভেঙে যায়, প্যারিসে “লে সুররিয়ালিজমে” প্রদর্শনীর পর । যুদ্ধের শেষে, প্যারিসে ব্রেতঁ ও মার্সেল দ্যুশঁ’র ফিরে আসার পর প্রদর্শনীর কর্তারা সম্বর্ধনা দিতে চাইছিলেন কিন্তু পুরোনো পরাবাস্তববাদীরা জানতে পারলেন যে একদল যুবক পরাবাস্তববাদীর আবির্ভাব হয়েছে, যাঁরা বেশ ভিন্ন পথ ধরে এগোতে চাইছেন । যুবকদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ফ্রাঁসিস বেকঁ, আলান দাভি, এদুয়ার্দো পোলোৎসি, রিচার্ড হ্যামিলটন প্রমুখ ।
    সুররিয়ালিজমের উদ্ভব সত্ত্বেও ডাডার প্রভাব কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি, তা প্রতিটি দশকে কবর থেকে লাফিয়ে ওঠে, যেমন আর্পের বিমূর্ততা, শুইটারের নির্মাণ, পিকাবিয়ার টারগেট ও স্ট্রাইপ এবং দ্যুশঁ’র রেডিমেড বস্তু বিশ শতকের শিল্পীদের কাজে ও আন্দোলনে ছড়িয়ে পড়ছিল । স্টুয়ার্ট ডেভিসের বিমূর্ততা থেকে অ্যান্ডি ওয়ারহলের পপ আর্ট, জাসপার জনসের টারগেট ও ফ্ল্যাগ থেকে রবার্ট রাউশেনবার্গের কোলাঝে — সমসাময়িক সাহিত্য ও শিল্পের যেদিকেই তাকানো হোক পাওয়া যাবে ডাডার প্রভাব, সুররিয়ালিজমের উপস্হিতি । ১৯৬৬ সালে মৃত্যুর আগে, ব্রেতঁ লিখেছিলেন, “ডাডা আন্দোলনের পর আমরা মৌলিক কিছু করিনি । ডাডা ও সুররিয়ালিজম আন্দোলনকারীদের ওপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং কয়েকজন আত্মহত্যা করেন, যেমন জাক রিগো, রেনে ক্রেভেল, আরশাইল গোর্কি, অসকার দোমিংগেজ প্রমুখ । অত্যধিক মাদক সেবনে মৃত্যু হয় গিলবার্ত লেকঁতে ও অঁতনা আতোর ।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:236b:a5a0:fd4e:4616:b1db | ১৮ আগস্ট ২০২৩ ১০:১১740612
  • মানুষের অকুস্হল : মলয় রায়চৌধুরী
    এক
    স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে, প্রাথমিক লিঙ্গ নির্ধারণ কঠোরভাবে ক্রোমোসোমাল এবং সাধারণত পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয় না । কিছু প্রজাতি যেমন বিভিন্ন উদ্ভিদ আর মাছের কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গ থাকে না এবং পরিবর্তে জীবনচক্র চলতে থাকে আর জীবনের কোনও পর্যায়ে তারা জিনগত সূত্রের ভিত্তিতে লিঙ্গ পরিবর্তন করে। এটা মৌসম এবং তাপমাত্রার মতো পরিবেশগত কারণগুলির কারণে হতে পারে। কুমির, কিছু কচ্ছপ এবং টুয়তারা সহ সরীসৃপের কিছু প্রজাতির লিঙ্গ তাপমাত্রা দিয়ে নির্ধারিত হয়। এছাড়াও কিছু প্রজাতি রয়েছে যাদের পার্থেনোজেনেসিসের কারণে কেবল একটি লিঙ্গ থাকে আর নিষেক ছাড়াই স্ত্রী প্রজনন করার কাজ করে।
    মানুষের সমাজে, শিশু জন্মালেই সবচেয়ে প্রথমে তার মা আর  আত্মীয়রা জানতে চান শিশুটির অকুস্হলের নিদর্শন পুরুষের না নারীর । এক্স এক্স প্যাটার্ন ডিম্বাণুর সমন্বয়ে মেয়ে শিশু আর এক্স ওয়াই প্যাটার্ন থেকে জন্মায় ছেলে শিশু। ভ্রূণের পূর্ণতার স্তরগুলোতে ক্রোমোজোম প্যাটার্নের প্রভাবে ছেলে শিশুর মধ্যে অণ্ডকোষ আর কন্যা শিশুর মধ্য ডিম্বকোষ গড়ে ওঠে। অণ্ডকোষ থেকে নিঃসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন আর ডিম্বকোষ থেকে নিঃসৃত হয় এস্ট্রোজেন। 
    ভারতে সব পরিবারই ‘ছেলে’ সন্তান চায় । কন্যাভ্রূণ হত্যা রোধ ও সামগ্রিকভাবে কন্যা সন্তানের সুরক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর স্বপ্নের প্রকল্পের সূচনার জন্য তাই প্রথমেই বেছে নিয়েছিলেন হরিয়ানাকে। আর সে রাজ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর যোগগুরু রামদেবই এবার পুত্রসন্তান লাভের জন্য মহিলাদের মধ্যে 'ওষুধ' বিক্রি করা শুরু করলেন।রামদেবের দিব্য ফার্মেসি এখন জোর কদমে  তাদের আয়ুর্বেদিক ওষুধ ''পুত্রজীবক বীজ'' বিক্রিতে ব্যস্ত। এই ওষুধের সঙ্গেই আর একটি ওষুধ বিক্রি করছে দিব্য ফার্মেসি। নাম 'শিবলিঙ্গ বীজ' যার মধ্যে রয়েছে 'পুত্রজিবা রক্সাবুর্ঘি'। আয়ুর্বেদ মতে এই ওষুধটি নাকি বন্ধ্যাত্ব রোধক এবং কামোদ্দীপক।

    ভ্রূণের গঠনকালে নিষিক্তকরণ ও বিভাজনের ফলে বেশকিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হয়, যেমন এক্স এক্স ওয়াই বা এক্স ওয়াই ওয়াই। এর ফলে বিভিন্ন গঠনের অবমানব বা হিজড়ে শিশুর জন্ম হয়।মূলত এটি একটি শারীরিক গঠনজনিত সমস্যা যা অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মতনই কিন্তু প্রতিবন্ধকতার স্থানটি ভিন্ন হওয়াতেই তারা সুস্পষ্টভাবে পুরুষ বা নারী নয়।  ভ্রুনের বিকাশকালে নিষিক্তকরণ ও বিভাজনের ফলে বেশকিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হয় যেমন XXY অথবা XYY। এর ফলে বিভিন্ন গঠনের হিজড়ে শিশুর জন্ম হয়। হিজড়ে এক ধরনের ইন্টারসেক্স ডিজঅর্ডার (আইএসডি) বা ডিজঅর্ডারস অব সেক্সুয়াল ডেভেলপমেন্ট (ডিএসডি) জাতীয় জন্মগত ত্রুটি। কয়েকটি ইন্টারসেক্স ডিজঅর্ডার হলো : কঞ্জেনিটাল এড্রিনাল হাইপার প্লাসিয়া, অভোটেস্টিকুলার ডিজঅর্ডার অব সেক্স ডেভেলপমেন্ট, টেস্টোস্টারন বায়োসিন্থেসিস ডিফেক্ট, এস্ট্রোজেন ইন্সেসিটিভিটি সিনড্রোম, গোনাডাল ডিসজেনেসিস ইত্যাদি।  
    মূলত ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গ হলো—-- মানুষ যে জৈবিক লিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন এরসঙ্গে নিজেকে সনাক্ত করতে পারেন না। শারীরিকভাবে পুরুষ অথবা নারী হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেও এদের মানসিক লিঙ্গবোধ তাদের জৈবিক লিঙ্গের বিপরীত বা এদের লৈঙ্গিক অনুভূতি সুস্পষ্টভাবে নারীসুলভ বা পুরুষসুলভ নয়। কিছু ট্রান্সজেন্ডার এক লিঙ্গ থেকে অন্য লিঙ্গে রূপান্তরিত হতে চিকিৎসার সহায়তা নেয়। এদের ট্রান্সসেক্সচুয়াল বা রূপান্তরকামী বলা হয়। এটা ট্রান্সজেন্ডারদের লৈঙ্গিক পরিচয়ের একটি স্থায়ী সমাধানের অভিব্যক্তি বলা যেতে পারে। তবে হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার এক নয়। বিভিন্ন দেশে রূপান্তরিত নারী (ট্রান্সওম্যান) ও রূপান্তরিত পুরুষদের (ট্রান্সমেন) তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছে রূপান্তরিত লিঙ্গের জনগোষ্ঠীরা।
    কিছু ট্রান্সজেন্ডার মানুষ, যদিও সবাই নয়, এমন চিকিৎসা  বেছে নেয় যা তাদের লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে তাদের দেহকে পালটে ফ্যালে। চিকিত্সায় হরমোন থেরাপি, সার্জারি এবং অন্যান্য শল্যচিকিৎসা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। ট্রান্সজেন্ডার শব্দটা একজন মানুষর রোমান্টিক আর যৌন পছন্দকে বর্ণনা করে না। কারণ লিঙ্গ পরিচয় যৌন অভিযোজনের মতো নয়।  শব্দটি পুরুষ, মহিলা বা উভয় লিঙ্গের সাথে রোমান্টিক বা যৌন সম্পর্কের জন্য একজন ব্যক্তির সহজাত পছন্দ বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। বিষমকামী ("সোজা") লোকেরা বিপরীত লিঙ্গের সদস্যদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সমকামী মানুষ (গে এবং লেসবিয়ান) একই লিঙ্গের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। উভকামী মানুষ নারী ও পুরুষ উভয়ের প্রতিই আকৃষ্ট হয়। রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিবর্গ বিপরীতকামী, সমকামী, উভকামী বা নিষ্কামী ইত্যাদি হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন ।

    অবমানব বা হিজড়েদের শারীরিক গঠন মূলত তিন ধরণের। ১. নারীদের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও নারী জননাঙ্গ থাকে না, ২.পুরুষের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও পুরুষ জননাঙ্গ থাকে না, ৩. উভয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ট্রান্সজেন্ডার,  হার্মাফ্রোডাইট, খোজা, শিখণ্ডী, বৃহন্নলা, উভয় লিঙ্গ ইত্যাদি নাম দেয়া হয় অবমানবদের । অবমানব শব্দটা মানবী ( সোমনাথ ) বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৈরি । ঋতুপর্ণ ঘোষ  তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর পত্রিকার নাম ‘অবমানব’ কেন? ঋতুপর্ণ বলেছিলেন, ‘আপনি কি মনে করেন মানুষগুলো অবমানব?’ তখন মানবী  বললেন? ‘ দেখুন, আমি যদি ওঁদের ‘মহামানব’ বলি, ওঁরা কি সেই মর্যাদা পাবেন? কখনও পাবেন না। সামাজিক ক্ষেত্রে যে ভাবে ওঁদের দেখা হয়, সেই অর্থেই অবমানব।” হিজড়া শিশুকে পরিণত বয়সে যাওয়ার আগে যদি যথযথ মেডিকেল ট্রিটমেন্ট করা হয় তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু যখন বোঝা যায় সে সাধারণ আর দশজনের থেকে আলাদা তখন আসলে অনেক দেরি হয়ে যায়। একইভাবে কোন পুরুষ বা নারীও হিজড়া হতে পারেন । ভারতের বিভিন্ন স্থানে, রূপান্তরিত লিঙ্গের হিজড়ারা আরাভানি, আরুভানি এবং জাগাপ্পা নামেও পরিচিত। হিজড়া বলতে বোঝায় ১. আন্তঃলিঙ্গ - জন্মগতভাবে দৈহিক বা জিনগত পুরুষ ও নারীর মধ্যবর্তী কোন অবস্থানের ব্যক্তিবর্গ।২.তৃতীয় লিঙ্গ - নারী ও পুরুষ ব্যতিরেকে সকল লিঙ্গের পৃথক একক শ্রেণিবিভাগ।৩.রূপান্তরিত লিঙ্গ - সেসকল ব্যক্তিবর্গ যাদের যৌন পরিচয় বা যৌন অভিব্যক্তি তাদের জন্মগত যৌনতা হতে আলাদা। ৪.খোজা - শুক্রাশয় অপসারণকৃত নপুংসক পুরুষ। ৫.পুরুষ থেকে নারী রুপান্তরিত বা রূপান্তরকামী নারী।
     
    ট্রান্সজেন্ডার একটি স্ব-প্রযোজ্য, বিস্তৃত শব্দ যা সেই সমস্ত লোকদের বোঝায় যাদের লিঙ্গ পরিচয় ঐতিহ্যগতভাবে জন্মের সময় তাদের আপাত জৈবিক লিঙ্গের সাথে যুক্ত থেকে আলাদা। লিঙ্গ পরিচয় বলতে একজন ব্যক্তির পুরুষ বা মহিলা বা এই বিভাগের মধ্যে বা বাইরের কিছু হওয়ার অভ্যন্তরীণ অনুভূতি বোঝায়। ট্রান্সজেন্ডার শব্দটিও লিঙ্গ অভিব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে। লিঙ্গ অভিব্যক্তি সেই আচরণকে বোঝায় যার মাধ্যমে লোকেরা তাদের লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করে। কিছু আচরণের মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট সর্বনাম ব্যবহার করা, নির্দিষ্ট ধরণের পোশাক পরা এবং একটি নির্দিষ্ট চুলের স্টাইল থাকা। যদিও লিঙ্গ পরিচয় এমন কিছু নয় যা অন্যরা দেখতে পারে, লিঙ্গ অভিব্যক্তি সর্বজনীনভাবে দৃশ্যমান। অনেকে বলেন,ট্রান্সজেন্ডারের কোনো সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। আসলে, বিভিন্ন গবেষক বিভিন্ন উপায়ে শব্দটি ব্যবহার করেন।
    যেহেতু ট্রান্সজেন্ডার একটি বিস্তৃত ছাতা শব্দ, এটি বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে এমন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত যারা বিশ্বাস করে যে তাদের জন্মের সময় তাদের নির্ধারিত লিঙ্গের বিপরীত লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। ট্রান্সসেক্সুয়াল ব্যক্তিরা অস্ত্রোপচার বা হরমোন থেরাপির মাধ্যমে শারীরিকভাবে তাদের শরীর পরিবর্তন করতে চাইতে পারেন। অন্যান্য লোকেরা বিপরীত লিঙ্গের সাথে লিঙ্গ-শনাক্ত করে তবে তাদের দেহ পরিবর্তন করতে চায় না। ট্রান্সজেন্ডার ছাতার অধীনে অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে অ্যান্ড্রোজাইনস। এন্ড্রোজাইন হল এমন মানুষ যাদের মধ্যে জৈবিক বা মনস্তাত্ত্বিকভাবে উভয় লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর বিস্তৃত অর্থে, ট্রান্সজেন্ডার আরও সাম্প্রতিক শব্দ লিঙ্গের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত. এই শব্দটি এমন লোকেদের দ্বারা স্ব-প্রয়োগ করা হয় যারা ট্রান্সজেন্ডার বা যাদের কোনো লিঙ্গ নেই, তৃতীয় (পুরুষ বা মহিলা নয়) লিঙ্গ, বা ওঠানামা করা লিঙ্গ।
    এটি একটি বিস্তৃত কিন্তু ভুল ধারণা যে সমস্ত ট্রান্সজেন্ডার মানুষ সমকামী পুরুষ বা লেসবিয়ান (অর্থাৎ, জন্মের সময় তাদের নির্ধারিত লিঙ্গের সদস্যদের প্রতি আকৃষ্ট হয়)। লিঙ্গ পরিচয় এবং যৌন অভিমুখিতা ভিন্ন। কিছু ট্রান্সজেন্ডার মানুষ সমকামী বা লেসবিয়ান। অন্যরা বিষমকামী বা উভকামী। এখনও অন্যরা কোন নির্দিষ্ট যৌন অভিমুখীতার সাথে সনাক্ত করে না।
    ট্রান্সজেন্ডার হল একটি সাধারণ শব্দ যা এমন মানুষদের কথা বলে যাদের লিঙ্গ পরিচয়, জন্মের সময় তাদের নির্ধারিত লিঙ্গের সাথে মেলে না। বিপরীতে, ‘সিসজেন্ডার’ শব্দটি এমন লোকদের বর্ণনা করে যাদের লিঙ্গ পরিচয় তাদের জন্মের সময় নির্ধারিত লিঙ্গের সাথে মিলে যায়। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা লিঙ্গবিহীন হতে পারে, যার অর্থ তারা এমন প্রথা এবং অভ্যাস গ্রহণ করে যা সাধারণত তাদের জন্মের সময়ের লিঙ্গের সাথে যুক্ত নয়। অর্থাৎ, তারা তাদের কথাবার্তা, অভিনয়, পোশাক, চুলের স্টাইল এবং অন্যান্য আচরণের মাধ্যমে তাদের লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করতে পারে। একটা নতুন নাম বেছে নেয় যা একজনের লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে আরও ভালভাবে খাপ খায়।
    বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ে সেক্স চেঞ্জ করে পুরুষ হতে চাইছেন শুনে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “সুচেতনা  আমাদের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কন্যা। তিনি পুত্রে রূপান্তরিত হচ্ছেন এটা আমার কাছে এক অদ্ভূত অনুভূতি!ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না কি ।বুদ্ধবাবুর মুখ্যমন্ত্রীত্বকালীন সময়ে আমার সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন সার্জারি হয় এবং শাস্তিস্বরূপ আমার পিএইচডি অগ্রাহ্য হয়! আমি রিডার পোস্ট থেকে বঞ্চিত হই। আমার প্রাপ্য দুটি ইনক্রিমেন্ট থেকে চিরতরে বঞ্চিত হই! যেটা অকারণ এক বিশাল আর্থিক ক্ষতি! দুহাজার ছয় সালে আমি পিএইচডি অ্যাওয়ার্ডেড হয়েছিলাম! ২০০৩-০৪ সালে আমি লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারী হই! বুদ্ধবাবুর সরকার তা মেনে নেন নি! কর্মস্থলে পুরুষ করে রাখা হয়েছিল! ভোটের ডিউটিতে পুরুষদের সঙ্গে ডিউটি দেওয়া হয়েছিল। অপমান অসম্মানের চূড়ান্ত! আত্মহত্যার পথে ঠেলা হয়েছিল! বাবা মা ভয় পেতেন শহর থেকে বহু দূরে গ্রামের কলেজের চাকরিতে খুন না হয়ে যাই!” স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতে কাটতেই তিনি, সায়ন্তনী ঘোষ মেঘ (Sayantani Ghosh Megh) রাজ্যের প্রথম রূপান্তরকামী (Transgender) মহিলা আইনজীবী। একই সঙ্গে সমাজের বাকি তৃতীয় লিঙ্গদের সম্মান এনে দিতে গড়ে তুলেছেন রুদ্রপলাশ (Rudra Polash) নৃত্য একাডেমি। 
    অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গপরিবর্তন বা সেক্স চেঞ্জ খুব জটিল প্লাস্টিক সার্জারী অপারেশন। এই অপারেশনে যারা নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন হ্যারি বেঞ্জামিন, স্টিনাক, আব্রাহাম, জন মানি প্রমুখ। রূপান্তরকামী এবং উভলিঙ্গ মানবদের চাহিদাকে মূল্য দিয়ে ডাক্তাররা সার্জারির মাধ্যমে সেক্সচেঞ্জ অপারেশন করে থাকেন। যেসকল রূপান্তরকামী একে অসুখ মনে করেন না, তাদের ঔষধ প্রয়োগ করে উক্ত মানসিকতাকে বদলে ফেলা সম্ভব হয় না। এদের অনেকেই সেক্সচেঞ্জ অপারেশনের মধ্য দিয়ে মানসিক পরিতৃপ্তি পেয়ে থাকেন। পুরুষ রূপান্তরকামী অর্থাৎ যারা পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হতে চায়, তাদের জন্য এক ধরনের অপারেশন, আর নারী রূপান্তরকামীদের জন্য ভিন্ন অপারেশন রয়েছে। মুলতঃ শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে চামড়া অ টিস্যু নিয়ে গ্রাফটিং এর মাধ্যমে যোনিপ্রদেশ গঠন করা হয়, হরমোন থেরাপির সাহায্যে স্তন গ্রন্থির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানো হয়, সিলিকন টেস্টিকেলের সাহায্যে অন্ডকোষ তৈরি করা হয়; ইত্যাদি মানসিক ব্যাধি ।

    জৈবিক লিঙ্গ (সেক্স) শারীরিক বৈশিষ্ট্য বহন করে। আর মানসিক লিঙ্গ (জেন্ডার) একটি নির্দিষ্ট সমাজে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত বিশিষ্টতা নির্দেশ করে। একজন নারী ও পুরুষের কার কী রকম পোশাক-পরিচ্ছদ হবে; কে কী রকম আচার-আচরণ করবে; আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা কার কী রকম হবে; সমাজের নানা ধরনের কাজে একজন নারী বা একজন পুরুষের ভূমিকা কী হবে এই বিষয়গুলো নির্ধারণ করে জেন্ডার বা লিঙ্গ । অর্থাৎ, সেক্স বা জৈবিক লিঙ্গ বিষয়টি পুরোপুরি শরীরের উপর নির্ভরশীল কিন্তু জেন্ডার বা মানসিক লিঙ্গ নির্ভররশীল সমাজের উপর। যেহেতু নারী বা পুরুষের দায়িত্ব, কাজ ও আচরণ মোটামুটি সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত হয়, তাই সমাজ পরিবর্তন বা সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে জেন্ডারের ধারণা বদলে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ- আমরা যখন কাউকে ‘নারী’ বা ‘পুরুষ’ হিসেবে চিহ্নিত করি, তখন সেখানে জৈব-লিঙ্গ নির্দেশ করাটাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাড়ায়। কিন্তু ‘মেয়েলি’ বা ‘পুরুষালি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে জেন্ডার প্রপঞ্চকে যুক্ত করা হয় যেখানে নারী বা পুরুষের লিঙ্গীয় বৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে স্বভাব-আচরণগত ইত্যাদি বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। আর এ কারণে সেক্সকে জৈবলিঙ্গ এবং জেন্ডারকে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক লিঙ্গ বলে অনেকে অভিহিত করেন। বস্তুত জৈব বৈশিষ্ট্যর বলয় অতিক্রম করে সাংস্কৃতিক বলয়ে অন্তর্ভুক্ত হবার বাসনার কারণেই মানব সমাজে রূপান্তরকামিতার অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা হয় ।

    দুই
    ভারতবর্ষে মানুষের দেহের অকুস্হল নিয়ে বহুকাল আগে থেকে ভাবনাচিন্তা করা হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীর কথা বহুকাল আগে উপস্হাপন করা হয়েছে সংস্কৃত মহাকাব্য ‘মহাভারত’-এ । মহাভারতের  প্রাচীনতম অংশটি মোটামুটি ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ গুপ্তযুগে রচিত হয়, মানে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। মহাভারতের   একটি যক্ষের নাম স্হূলকর্ণ । আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের নাম শিখণ্ডী । এদের দুজনেই ঘটনাক্রমে নারী অথবা পুরুষে রূপান্তরিত। শিখণ্ডীর পূর্বজন্মের নাম চিল ‘অম্বা’। তিনি ছিলেন কাশীরাজের বড়ো মেয়ে । 
    সত্যবতীর গর্ভে ও শান্তনুর ঔরসে জন্মগ্রহণ করে চিত্রাঙ্গদ আর বিচিত্রবীর্য। অবিবাহিত যুবক চিত্রাঙ্গদ গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদের হাতে নিহত হয়। কারণ তাদের দুজনার নাম এক হওয়ায় গন্ধর্বরাজ তাকে যুদ্ধে আহ্বান করেন। এরপর বিচিত্রবীর্য রাজা হলে ভীষ্ম তার বৈমাত্রেয় ভাইয়ের জন্য কাশীরাজের তিন মেয়ে অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে কিডন্যাপ করে আনেন। কিন্তু কাশীরাজের বড়ো মেয়ে অম্বা আগেই রাজা শাল্বকে মনে মনে স্বামী হিসেবে  বরণ করে নিয়েছিল । কিন্তু ভীষ্ম তাকে তুলে আনায় শাল্বরাজ আর মেয়েটিকে বিয়ে  করতে রাজি হননি। অম্বা এরপর ফিরে এসে ভীষ্মকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় । কিন্তু পূর্ব প্রতিজ্ঞার কারণে ভীষ্ম অম্বার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন । কারণ ভীষ্ম আজীবন ব্রহ্মচর্য গ্রহণের পাশাপাশি অমরত্ব লাভ করেছিলেন। কিন্তু অম্বা তার দাবি বজায় রাখতে উপস্থিত হয় ভীষ্মের গুরু পরশুরামের দরবারে। প্রতিজ্ঞার কারণে গুরুর আদেশেও অসম্মত হয় ভীষ্ম। ফলে পরশুরাম আর ভীষ্মের যুদ্ধ শুরু হয় কিন্তু কেউই জয়লাভ করে না। তখন পরশুরাম অম্বাকেই ভীষ্মের কাছে যেতে বলেন। কিন্তু অম্বার বদলা নেবার ইচ্ছে এত বেশি ছিল যে, যেকোনোভাবে ভীষ্মের প্রাণনাশ করার কথা ভাবেন। কারণ ভীষ্মের কারণেই তাঁর প্রেমিক  শাল্বকে হারাতে হয়েছিল। আবার ভীষ্মও তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
    হিন্দুধর্মে ও ভারতীয় পুরাণে একাধিক দেবদেবীকে বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন রূপে পুরুষ ও নারী উভয় সত্ত্বা ধারণ করতে দেখা যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার একজন দেবতা ও একজন দেবী একই সময়ে একই মূর্তিতে একাধারে পুরুষ ও নারী রূপে প্রকাশিত হন। এই রকম একটি মূর্তি হল অর্ধনারীশ্বর। ইনি শিব ও তাঁর পত্নী পার্বতীর সম্মিলিত রূপ। অর্ধনারীশ্বর নামটির অর্থ "প্রভু, যাঁর অর্ধাংশ নারী"। শিবের এই মূর্তিটি "দ্বৈতসত্ত্বার উর্ধ্বে স্থিত সামগ্রিকতা"র প্রতীক। এই মূর্তি নশ্বর জীব ও অমর দেবদেবীদের এবং পুরুষ ও নারীসত্ত্বার যোগসূত্র। অ্যালাই ড্যানিলোর মতে, "উভলিঙ্গ, সমকামী ও রূপান্তরকামীতার একটি প্রতীকী মূল্য রয়েছে এবং এঁদের সম্মানীয় সত্ত্বা অর্ধনারীশ্বর মূর্তি মনে করা হয়।" আরেকটি অনুরূপ মূর্তি হল লক্ষ্মী-নারায়ণ। এই মূর্তিটি সৌন্দর্য ও সম্পদের দেবী লক্ষ্মী ও তাঁর স্বামী বিষ্ণুর যুগল উভলিঙ্গ মূর্তি।
    ভাগবত পুরাণ গ্রন্থে পাওয়া যায়, বিষ্ণু অসুরদের অমৃত থেকে বঞ্চিত করার জন্য ছলনাকারী মোহিনী অবতার গ্রহণ করেছিলেন। শিব মোহিনীকে দেখে আকৃষ্ট হন এবং তাঁর বীর্যপাত হয়। সেই বীর্য পাথরের উপর পড়ে সোনায় পরিণত হয়। ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ গ্রন্থে দেখা যায়, শিবের পত্নী পার্বতী তাঁর স্বামীকে মোহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখে "লজ্জায় মাথা নত করেন"। কোনও কোনও উপাখ্যানে দেখা যায়, শিব পুনরায় বিষ্ণুকে মোহিনী মূর্তি ধারণ করতে বলেন, যাতে তিনি প্রকৃত রূপান্তরটি স্বচক্ষে দেখতে পারেন।যে সকল উপাখ্যানে শিব মোহিনীর সত্য প্রকৃতিটি জানতেন, সেই উপাখ্যানগুলিকে "যৌন আকর্ষণে লিঙ্গের অনিশ্চয়তার পরিচায়ক" হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।
    শুধুমাত্র সমকাম উদ্দীপনার দিকে গুরুত্ব আরোপ করলে, লেখকের রচনার গভীর অধিবিদ্যামূলক গুরুত্বটি হারিয়ে যায়: মোহিনীর নারীসত্ত্বা হল সত্যের জাগতিক দিক এবং শিবকে আকর্ষিত করার যে চেষ্টা মোহিনী করেছিলেন, তা শুধুমাত্র শিবকে জাগতিক বিষয়ে আগ্রহী করে তোলার জন্যই তিনি করেন। পট্টনায়ক অপর একটি উপাখ্যানের উদাহরণ দেখিয়ে বলেছেন যে, কেবলমাত্র বিষ্ণুরই শিবকে "মোহিত" করার ক্ষমতা ছিল: এক অসুর নারীমূর্তি ধারণ করে শিবকে হত্যা করতে যায়। সে তার নারীমূর্তির যোনিতে তীক্ষ্ণ দাঁত স্থাপন করেছিল। শিব তার ছলনা ধরে ফেলেন এবং নিজের "পুরুষত্বে" একটি "বজ্র" স্থাপন করে "রতিক্রিয়া"র সময় সেই অসুরকে হত্যা করেন।
    হিন্দু পুরাণে প্রায়শই দেখা যায় দেবদেবীরা লিঙ্গ পরিবর্তন করছেন বা বিভিন্ন সময়ে বিপরীত লিঙ্গের রূপ ধারণ করছে অথবা একজন দেবতা ও একজন দেবী মিলিত হয়ে একই শরীরে উভলিঙ্গ রূপ ধারণ করছেন। যৌনমিলনের সুবিধার্থেও দেবতাদের বিপরীত লিঙ্গের অবতার রূপে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়।দেবতা ভিন্ন অন্যান্য চরিত্রদেরও দেবতার বরে বা অভিশাপে অথবা পুনর্জন্মের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় লিঙ্গ পরিবর্তন করতে দেখা যায়।
    হিন্দু দেবতা আয়াপ্পার জন্ম সংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনিটির মধ্যেও অ-বিষমকামী যৌনপ্রবৃত্তির আভাস পাওয়া যায। শিবের ঔরসে মোহিনীরূপী বিষ্ণুর গর্ভে আয়াপ্পার জন্ম হয়। বিষ্ণু লজ্জায় তাঁকে পরিত্যাগ করেন। পট্টনায়ক লিখেছেন, শিবের ঔরসে মোহিনীর গর্ভে আয়াপ্পার জন্ম হয়নি। মোহিনীকে আলিঙ্গন করার সময় শিবের বীর্যপাত হয় এবং সেই বীর্য থেকেই আয়াপ্পার জন্ম হয়েছিল। এই কাহিনির অন্য একটি পাঠান্তর অনুসারে, পন্তলমের পাণ্ড্য রাজা রাজশেখর একটি শিশুকে দত্তক গ্রহণ করেছিলেন। এই কাহিনি অনুসারে, আয়াপ্পা হলেন অযোনিজাত (অর্থাৎযোনি থেকে যাঁর জন্ম হয়নি) এবং হরিহরপুত্র (অর্থাৎ,বিষ্ণু ও শিবের পুত্র)। বড়ো হয়ে আয়াপ্পা একজন মহান যোদ্ধা হয়েছিলেন।
    মহাভারত মহাকাব্যের তামিল সংস্করণ অনুসারে, বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণ মোহিনী মূর্তি ধারণ করে অরবানকে বিবাহ করেছিলেন। ইরাবান আত্মবলিদানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে প্রেমের স্পর্শ দান করার জন্য কৃষ্ণ তাঁকে বিবাহ করেন। অরবানের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ মোহিনী মূর্তিতেই তাঁর জন্য বিলাপ করতে থাকেন। বার্ষিক তালি অনুষ্ঠানে অরবানের বিবাহ ও মৃত্যুর ঘটনাকে স্মরণ করা হয়। এই অনুষ্টানে হিজরারা (ভারতীয় তৃতীয় লিঙ্গ গোষ্ঠীর মানুষ) কৃষ্ণ-মোহিনীর ভূমিকা গ্রহণ করে এবং একটি গণবিবাহ অনুষ্ঠানে অরবানকে "বিবাহ" করে। এরপর ১৮ দিন ধরে উৎসব চলে। উৎসব শেষ হয় অরবানের আনুষ্ঠানিক সমাধিদানের মধ্য দিয়ে। এই সময় হিজরারা তামিল প্রথানুসারে নৃত্য করতে করতে বুক চাপড়ায়, হাতের চুড়ি ভেঙে ফেলে এবং বৈধব্যের শ্বেত বস্ত্র পরিধান করে।

    আরেকটি উপাখ্যান হল ইলার কাহিনি। এই কাহিনিটি একাধিক হিন্দু ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়। ইলা ছিলেন এক রাজা। তিনি শিব ও পার্বতীর অভিশাপে এক মাস পুরুষ রূপে এবং পরবর্তী এক মাস নারী রূপে দেহধারণ করতেন। লিঙ্গ পরিবর্তনের পর ইলা তাঁর পূর্বতন লিঙ্গের কথা বিস্মৃত হতেন। এই রকম একটি পর্যায়ে ইলা গ্রহদেবতা বুধকে বিবাহ করেন। বুধ ইলার পরিবর্তনশীলতার কথা জানতেন। কিন্তু তিনি ‘পুরুষরূপী’ ইলাকে তা জানালেন না। ইলাও তাঁর নারী রূপের কথা বিস্মৃত হলেন। ইলা যখন স্ত্রী রূপে থাকতেন, তখনই বুধ ও ইলা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্রে বাস করতেন। রামায়ণ অনুসারে, ইলা বুধের এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। যদিও মহাভারত অনুসারে, ইলাকেই সেই পুত্রের মাতা ও পিতা বলা হয়েছে। পুত্রের জন্মের পর ইলার অভিশাপের মেয়াদ শেষ হয়। তখন ইলা পাকাপাকিভাবে পুরুষে পরিণত হন। এরপর ইলা তাঁর স্ত্রীর কাছে ফিরে যান এবং তাঁর একাধিক সন্তানের জন্ম হয়।
    তিন 
    একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি সাধারণত এমন একটি দেহ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন যার দ্ব্যর্থহীন যৌন বৈশিষ্ট্য রয়েছে (পুরুষ বা মহিলা) কিন্তু তারা ব্যক্তির লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে মেলে না। বিপরীতে, একজন ইন্টারসেক্স ব্যক্তি এমন একটি দেহ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন যা স্পষ্টভাবে পুরুষ বা মহিলা নয়। উদাহরণস্বরূপ, পুরুষ ক্রোমোজোম সহ একটি শিশুর যৌনাঙ্গ এবং অন্যান্য যৌন বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে যা নারী বলে মনে হয়। মহিলা ক্রোমোজোম নিয়ে জন্মানো শিশুদের ক্ষেত্রে বিপরীতটি সত্য হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, একজন ইন্টারসেক্স ব্যক্তির প্রজনন শারীরস্থান পুরুষ এবং মহিলা বৈশিষ্ট্যগুলিকে একত্রিত করতে পারে।  একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিও ইন্টারসেক্স হতে পারে এবং এর বিপরীতে, যদিও এটি সাধারণত হয় না। একজন ইন্টারসেক্স ব্যক্তি এমনভাবে জীবনযাপন করতে পারে যা তাকে জন্মের সময় নির্ধারিত লিঙ্গের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, জন্মের সময় একটি আন্তঃলিঙ্গের শিশুকে মেয়েলি লিঙ্গের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে একটি মেয়ে হিসাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং সারা জীবনের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে মেয়েলি পদ্ধতিতে আচরণ, পোশাক এবং বর চালিয়ে যেতে পারে। যাইহোক, কিছু যারা এক লিঙ্গ হিসাবে বেড়ে উঠেছেন তারা পরবর্তীতে বিপরীত লিঙ্গের লিঙ্গ পরিচয়কে আলিঙ্গন করে, তাদের চেহারা, আচরণ এবং দেহে পরিবর্তন আনে যা অনেক ট্রান্সজেন্ডার মানুষের দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। কিছু ট্রান্সজেন্ডার লোকেদের জন্য, জন্মের সময় তাদের নির্ধারিত লিঙ্গ এবং তাদের লিঙ্গ পরিচয়ের মধ্যে অমিলের কারণে লিঙ্গ ডিসফোরিয়া নামের  মানসিক সমস্যা হতে পারে। কিশোর-কিশোরীরা লিঙ্গ ডিসফোরিয়া বিকাশ করতে পারে, যদিও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা অনেক সময়ে শেষ হয়ে যায়। লিঙ্গ ডিসফোরিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা যে যৌন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল তা থেকে মুক্তি পেতে এবং অন্য লিঙ্গে পরিণত হওয়ার তীব্র এবং অবিরাম আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে। পরিবার আর সমাজ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবার বোধ সামাজিক ডিসফোরিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। 
    আন্তঃলিঙ্গ বা ক্লীবলিঙ্গ (ইংরেজি: Intersex, ইন্টারসেক্স), মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর ক্রোমোজোম, কর্মক্ষম জননাঙ্গ, যৌন হরমোন অথবা গোপনাঙ্গসহ বিভিন্ন যৌন বৈশিষ্ট্যের সে সকল পার্থক্যকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যেগুলো জাতিসংঘের "অফিস অব দি হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস" এর বর্ণনা অনুযায়ী নারী বা পুরুষ দেহের যৌন দ্বিরূপতার ধারণার সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। এই পার্থক্যগুলো হতে পারে যৌনাঙ্গের অস্পষ্টতা, এবং এক্সওয়াই-পুরুষ এবং এক্সএক্স-নারী ব্যতিরেকে অন্যান্য ক্রোমোজোমীয় জিনোটাইপ (জেনেটিক বৈশিষ্ট্য) এবং যৌন ফিনোটাইপ (বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য) এর সমন্বয়।আন্তঃলিঙ্গকে পূর্বে উভলিঙ্গ বলা হত কিন্তু বর্তমানে উভলিঙ্গ শব্দটির ব্যবহার সীমিত হয়ে আসছে কারণ শব্দটিকে বিভ্রান্তিকর এবং অসম্মানজনক বলে বিবেচনা করা হয়। ২০০৬ সালে ''ডিজঅর্ডার অব সেক্স ডেভলাপমেন্ট'' (যৌন ক্রমবিকাশের বৈকল্য) হিসেবে আন্তঃলিঙ্গীয় বৈশিষ্ট্যের মেডিক্যাল সঙ্গায়ন প্রবর্তিত হয় যা প্রবর্তনের পর থেকেই যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে।

    চার
    ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন ভারতের এলজিবিটি সম্প্রদায়ের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। জীবনের শেষ বছরগুলিতে তিনি রূপান্তরকামী জীবনযাত্রা নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন। তিনি নিজের সমকামী সত্ত্বাটিকে খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে নেন, যা ভারতের চলচ্চিত্র জগতের খুব কম মানুষ করেছেন । ঋতুপর্ণ ঘোষ দশ বছর ধরে ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিস মেটিলাস টাইপ টু ) রোগে এবং পাঁচ বছর ধরে প্যানক্রিটিটিস রোগে ভুগছিলেন।এছাড়াও তার অনিদ্রা রোগ ছিল এবং সেই জন্য তিনি ঘুমের ওষুধ খেতেন। ডাক্তারদের রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যাবডোমিনোপ্ল্যাস্টি ও ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর প্রয়োজনীয় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করাতে গিয়ে তার শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। আরেকটি প্রেমের গল্প ছবিতে এক সমকামী চিত্রপরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য তাকে এগুলি করাতে হয়েছিল ।
    হিন্দু পুরাণে এলজিবিটি বিষয়বস্তু বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কয়েকজন দেবদেবী ও যোদ্ধার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে বা আচরণে স্ত্রী সমকামীতা, পুরুষ সমকামীতা, উভকামীতা বা রূপান্তরকামীতা অর্থাৎ (এককথায় এলজিবিটি) বৈশিষ্ট্য বা আচরণ পরিদৃষ্ট হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁদের চরিত্রে লিঙ্গ পার্থক্যঅ-বিষমকামী যৌনপ্রবৃত্তিরও আভাস মেলে। ঐতিহ্যগত হিন্দু সাহিত্যে সরাসরি সমকামিতার কথা উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু বেদ, রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরাণিক সাহিত্যে এবং স্থানীয় লোকসাহিত্যে লিঙ্গ পরিবর্তন, সমকামোদ্দীপক (হোমোইরোটিক) ঘটনা এবং আন্তঃলিঙ্গতৃতীয় লিঙ্গ চরিত্রের উপস্থিতি প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু পুরাণে এমন অসংখ্য ঘটনা দেখা যায়, যেখানে যৌনমিলন একটি অযৌন পবিত্র উদ্দেশ্যে সাধিত হয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এগুলি সমকামী যৌনমিলন। কখনও কখনও দেবতাদের এই জাতীয় মিলনকে নিন্দা করতে দেখা যায়। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে এগুলি তাঁদেরই বরে ঘটেছে।
    আধুনিক গবেষক ও সমকামী-অধিকার আন্দোলনকারীরা মূলধারার প্রাচীন সাহিত্যে উল্লিখিত লিঙ্গ বিভিন্নতা ও অ-বিষমকামী যৌনপ্রবৃত্তি সংক্রান্ত উপাখ্যানগুলি ছাড়াও অপেক্ষাকৃত অল্পপরিচিত গ্রন্থগুলিতে প্রাপ্ত এলজিবিটি বিষয়বস্তুর উপর আলোকপাত করেছেন। এমনকি সাধারণ দৃষ্টিতে যে সকল উপাখ্যানের মধ্যে কোনও প্রকার সমকামিতার আভাস নেই, তাঁরা সেগুলিরও অ-বিষমকামী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অবশ্য এই ধরনের ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে প্রাচীন উপাখ্যানগুলির অর্থ সংক্রান্ত মতবিরোধও দেখা দিয়েছে।
    একাধিক দেবদেবীকে তৃতীয়-লিঙ্গ বা সমকামীদের রক্ষাকর্তা মনে করা হয়। এই সব দেবদেবীদের পৌরাণিক কাহিনি বা তাঁদের পূজার রীতিনীতিগুলি এই ধারণার উৎস। কনার ও স্পার্কস মনে করেন যে, অগ্নি, প্রেম ও যৌনতার দেবী অরণিকে তাঁর অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে স্ত্রী সমকামিতার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে: উক্ত অনুষ্ঠানে দুটি কাঠের টুকরোকে নারী মূর্তি মনে করা হয়। এগুলির নামকরণ করা হয় অধরারণি ও উতরারণি। তারপর এই দুটি টুকরোকে পরস্পরের সঙ্গে ঘষা হয়। এটি একটি আধ্যাত্মিক স্ত্রী সমকামী মিলনের পরিচায়ক।
    বহুচারা মাতা হলেন হিজরাদের দেবী। তাঁর জনপ্রিয় মূর্তিটিতে দেখা যায়, তিনি একটি মোরগের পিঠে বসে আছেন এবং হাতে ধরে আছেন একটি তরবারি, ত্রিশূল ও একটি বই। বহুচারা সংক্রান্ত কাহিনিগুলিতে পুরুষাঙ্গ কর্তন এবং শারীরিক যৌন বৈশিষ্ট্যের অন্যান্য পরিবর্তনের বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। এই জন্য তাঁকে পুরুষের প্রতি অভিশাপদাত্রী দেবী মনে করা হয়। কথিত আছে, বহুচারা ছিলেন এক নশ্বর নারী। তিনি শহিদ হন। একটি গল্পে দেখা যায়, একদল দস্যু বহুচারাকে ধর্ষণ করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু তিনি তরবারি বার করে নিজের স্তনদুটি কেটে ফেলেন এবং মারা যান। অন্য একটি গল্পে দেখা যায়, বহুচারার স্বামী যখন একটি উপবনে সমকামী রতিক্রিয়ায় রত ছিলেন, সেই সময় বহুচারা তাঁকে ধরে ফেলেন। ফলে তাঁর পুরুষাঙ্গ খসে যায় এবং তিনি নারীর বেশ ধারণ করতে বাধ্য হন।
    বহুচারার উপাখ্যানগুলিতে তাঁর দৈবসত্ত্বা পাওয়ার পর লিঙ্গ পার্থক্যের বিষয়টি লক্ষিত হয়। একটি কিংবদন্তি অনুসারে, এক রাজা বহুচারার কাছে পুত্রসন্তান কামনা করেছিলেন। বহুচারা তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। কিন্তু বড়ো হয়ে রাজকুমার সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হন। এক রাত্রে বহুচারা স্বপ্নে সেই রাজকুমারকে দেখা দেন এবং আদেশ করেন যাতে তিনি নিজের পুরুষাঙ্গ কর্তন করেন, নারীর বেশ ধারণ করেন এবং তাঁর দাসত্ব করেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, বহুচারা এরপরও পুরুষত্বহীন পুরুষদের চিহ্নিত করে সেই কাজ করতে বলেন। যারা তা করতে অস্বীকার করে, তিনি তাদের শাস্তি দেন। তারা পরবর্তী সাত জন্ম পুরুষত্বহীন হয়ে থাকে। এই গল্পটিই বহুচারা কাল্টের উৎস। বহুচারার ভক্তদের নিজের পুরুষাঙ্গ কর্তন করে আজীবন ব্রহ্মচারী থাকতে হয় ।
    কৃষ্ণের পুত্র শাম্বও খোজা পুরুষ, রূপান্তরকামী ও সমকামোদ্দীপনার পৃষ্ঠপোষক। শাম্ব নারীর বস্ত্র পরিধান করে মানুষকে উপহাস করতেন এবং বিপথে চালনা করতেন। নারীর বেশ ধারণ করে তিনি সহজেই নারীদের সঙ্গে মিশতে পারতেন এবং তাঁদের সম্ভোগ করতেন। মৌষলপুরাণ গ্রন্থে দেখা যায়, শাম্ব একবার নারীর বেশ ধারণ করে কয়েকজন ঋষিকে নিজের গর্ভধারণ নিয়ে প্রশ্ন করেন। ঋষিরা তাঁকে অভিশাপ দেন যে, পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি লৌহ মুষল প্রসব করবেন।

    দেবতাদের মধ্যে সমকামী বা উভকামী ক্রিয়াকলাপ ঘটতে দেখা যায়। যদিও এই ধরনের আদানপ্রদান যৌনসুখ উপভোগের জন্য ঘটে না। এগুলি শুধুমাত্র অনুষ্ঠান-সংক্রান্ত বা অন্যান্য উদ্দেশ্যে ঘটে। আগুন, সম্পদ ও সৃষ্টিশক্তির দেবতা অগ্নির সঙ্গে সমকামিতার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি অন্যান্য দেবতাদের বীর্য গ্রহণ করেন। অগ্নি দেবী স্বাহাকে বিবাহ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তাঁকে ও চন্দ্রদেবতা সোমকে সমকামী যুগল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সম্পর্কে অগ্নি গ্রহিতার ভূমিকা পালন করেন। তিনি নিজের মুখে সোমের বীর্য গ্রহণ করেন। এটি পৃথিবী থেকে স্বর্গে যজ্ঞের আহুতি নিয়ে যাওয়ায় অগ্নির ভূমিকাটির অনুরূপ। রক্ষণশীল হিন্দুধর্মে এটিকে "মিথুন" বা আনুষ্ঠানিক যৌন ক্রিয়া বলা হয় এবং বলা হয় যে অগ্নি ও তাঁর মুখ নারীর ভূমিকা পালন করেন।
    পুরুষ-সৌন্দর্য ও যুদ্ধের দেবতা কার্তিকের জন্ম-সংক্রান্ত পুরাণকথাতেও অগ্নিকে বীর্যগ্রহিতা রূপে দেখা যায়। কার্তিকের জন্মকাহিনির একাধিক পাঠান্তর পাওয়া যায়। এগুলির অনেকগুলিতেই দেখা যায় যে, শুধুমাত্র পুরুষের দ্বারাই কার্তিকের জন্ম হয়েছে। তবে এগুলিতে বিষমকামী যৌনতা বা ইচ্ছাও একটি ভূমিকা গ্রহণ করেছে। যদিও পার্বতীকেই কার্তিকের মা বলা হয়ে থাকে। কারণ, শিবের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনিই শিবের বীর্যপাতের কারণ হয়েছিলেন। কোনও কোনও কাহিনিতে গঙ্গাকে কার্তিকের মা বলা হয়। তিনি অগ্নির থেকে বীর্য গ্রহণ করে অজাত শিশুটিকে বহন করেছিলেন। এই ক্ষেত্রে জনকের ভূমিকায় কোথাও শিবকে, কোথাও অগ্নিকে অথবা কোথাও শিব ও অগ্নি দুই জনকেই রাখা হয়েছে।শিবপুরাণ ও রামায়ণ গ্রন্থে রয়েছে, দেবতারা শিব ও পার্বতীর ‘মহাসুরতে’র (প্রগাঢ় রতিক্রিয়া) ফল কী হতে পারে, তা চিন্তা করে ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁরা সেই রতিক্রিয়ায় বাধা দিলেন। শিব তখন তাঁদের সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন, “এখন যে বীর্য আমি পাত করব, তা যে গ্রহণ করতে পারবে সে সামনে আসুক।” দেবতাদের অনুরোধে অগ্নি শিবের বীর্য নিজের হস্তে গ্রহণ করলেন এবং তা পান করলেন। এই কাহিনিগুলিতে দেখা যায়, শিব ও পার্বতী অগ্নির কাজকে অনুমোদন করছেন না। তাঁরা এই কাজকে ‘অশুভ’ ও ‘ভুল’ বলে উল্লেখ করছেন। খ্রিস্টীয় ১১শ শতাব্দীতে রচিত কথাসরিৎসাগর গ্রন্থে যদিও দেখা যায়, শিব বলপূর্বক অগ্নিকে নিজের বীর্য গ্রহণে বাধ্য করছেন। সেই বীর্য অগ্নির উদরে প্রচণ্ড জ্বলন সৃষ্টি করল। তখন তিনি শিবের উপদেশে তা একদল ঋষিপত্নীর উপর উগরে দিলেন। ঋষিপত্নীগণ আবার সেই বীর্য গঙ্গা নদীতে ফেলে দিলেন। গঙ্গার তীরে পড়ে কার্তিকেয়ের জন্ম হল। মহাভারত গ্রন্থেও কার্তিককে অগ্নির পুত্র বলা হয়েছে। এই গ্রন্থ অনুসারে, অগ্নি একজন কৃত্তিকার হাতে নিজের বীর্য দান করেছিলেন। উক্ত কৃত্তিকা সেই বীর্য একটি হ্রদে নিক্ষেপ করেন। তা থেকেই কার্তিকের জন্ম হয়। কোনও কোনও পুরাণকথায় দেখা যায়, অগ্নি তাঁর বীর্য এমন এক পর্বতের উপর পাত করেছিলেন, যেটি শিবের দিব্য বীর্যে নির্মিত হয়েছিল। এইভাবে কার্তিক শিব ও অগ্নির সন্তান। বনপর্ব অংশের মার্কণ্ডেয় কৃত একটি ব্যাখ্যায় তা-ই বলা হয়েছে।

    পাঁচ
     সামগ্রিকভাবে "এলজিবিটি" বলতে বোঝায় "লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়ালট্রান্সজেন্ডার" অর্থাৎ, নারী ও পুরুষ সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামী। ১৯৮০-এর দশকের মধ্য থেকে শেষ ভাগের মধ্যে "গে কমিউনিটি"-র পরিবর্তে "এলজিবি" আদ্যক্ষরটির ব্যবহার চালু হয়। এরপর ১৯৯০-এর দশকে "এলজিবিটি" আদ্যক্ষরটি গৃহীত হয়। উল্লেখ্য, "গে কমিউনিটি" শব্দটি সম্প্রদায়ের অনেকেরই যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করছিল না বলে মনে করা হচ্ছিল।

    "যৌনতা ও লিঙ্গ পরিচয়-ভিত্তিক সংস্কৃতিগুলির" বৈচিত্র্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করার জন্য "এলজিবিটি" শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সাধারণভাবে অ-বিষমকামী সমকামী, উভকামী বা রূপান্তরকামী কোনো ব্যক্তিকে বোঝাতেও এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের অন্তর্ভুক্তির স্বীকৃতি হিসেবে আদ্যক্ষরটির একটি জনপ্রিয় পাঠান্তরে ইংরেজি "কিউ" (Q) অক্ষরটি যুক্ত করা হয় যৌন অভিমুখিতার স্থলে কুইয়্যার (কিম্ভুত) বা কোয়েশ্চনিং (প্রশ্নবিদ্ধ) বোঝাতে (অর্থাৎ, "এলজিবিটিকিউ" বা "জিএলজিবিটিকিউ", ১৯৯৬ সাল থেকে নথিভুক্ত। 

    সংজ্ঞাবাচক নাম হিসেবে এই আদ্যক্ষরটি মূলধারায় পরিণত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য কয়েকটি ইংরেজি-ভাষী দেশের অধিকাংশ "যৌনতা ও লিঙ্গ পরিচয়-ভিত্তিক" কমিউনিটি সেন্টার ও গণমাধ্যম দ্বারা গৃহীতও হয়। তবে এই আদ্যক্ষরটি সমাজের সংশ্লিষ্ট অংশের অনেকেরই সমর্থন লাভে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে কোনো কোনো ইন্টারসেক্স ব্যক্তি নিজেদের এলজিবিটি গোষ্ঠীভুক্ত করতে চেয়ে আদ্যক্ষরটিকে "এলজিবিটিআই" পর্যন্ত প্রসারিত করার পক্ষে মত দেন আবার এক গোষ্ঠীর কেউ কেউ মনে করেন যে তাদের সঙ্গে অপর গোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই এই জাতীয় আদ্যক্ষর ব্যবহার অপমানজনক। কারোর কারোর মতে রূপান্তরকামীরা "এলজিবি" গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে ন। এই জাতীয় ধারণাগুলি "লেসবিয়ান ও গে বিচ্ছিন্নতাবাদ" তত্ত্বের প্রমাণ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। উক্ত তত্ত্ব অনুযায়ী, নারী ও পুরুষ সমকামীদের পৃথক সমাজ গঠন করা প্রয়োজন ও সাধারণভাবে তাদের যেসব গোষ্ঠীমণ্ডলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তা থেকেও বিচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন। কেউ কেউ আবার এই শব্দটিকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না। তারা এটিকে রাজনৈতিকভাবে অতিরিক্ত রকম সঠিক শব্দ মনে করেন। তাদের মতে, এটি বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একই ধূসর এলাকার আবদ্ধ করার এবং প্রধান গোষ্ঠীর ইস্যু ও প্রধান বিষয়গুলিকে সম গুরুত্ব প্রদানের একটি প্রয়াস মনে করেন।
    ১৯৬০ সালের পূর্বে বিসমকামীহীনতার পক্ষে কোন সাধারণ শব্দের প্রচলন ছিল না। কাছাকছি শব্ যেটি ব্যবহৃত হত তা হল, তৃতীয় লিঙ্গ, যা ১৮৬০ সালেও ব্যবহৃত হয়েছে কোন কোন জায়গায়। তবে তা আমেরিকার সমাজে তখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সমকামী শব্দটি সর্বপ্রথম ভালো অর্থে মোটেই ব্যবহার করা হয় নি। হোমোফাইল শব্দ কর্তৃক এটি স্থানান্তরিত হয় ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দিকে।  এবং ১৯৭০ সালে গে শব্দ ব্যবহার প্রচলন হয়। পরবর্তীতে, সমকামি সমাজে গে শব্দটি গ্রহণযোগ্যতা পায়।  লারস উলেরস্টাম সেক্সুয়াল মাইনরিটি শব্দজোড়া ১৯৬০ সালের দিকে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। যা মূলতঃ জাতীয়তার দিক দিয়ে সংখ্যালঘু শব্দের সাথে মিল রেখে প্রয়োগ করে করা হয়। 

    এলজিবিটি বা জিএলবিটি আদ্যাক্ষর সকলের কাছে সমান গ্রহণযোগ্যতা পায় না। অনেকেই রূপান্তরলিঙ্গের ও রূপান্তরকামীদের লেসবিয়ান, গে ও বাইসেক্সুয়ালদের (এলজিবি) সাথে একই তালিকায় ফেলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তাদের পক্ষে যুক্তি হল, রূপান্তরলিঙ্গ ও রূপান্তরকামিতা যৌন পরিচয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যৌন অভিমুখিতার সাথে নয। এলজিবি ইস্যুগুলো যৌন অভিমুখিতাকে কেন্দ্র করে, যৌন পরিচয় নিয়ে নয়। মূলত এলজিবি সম্প্রদায়ের বেশ কিছু অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই পার্থক্য তুলে ধরা হয়। এলজিবি সম্প্রদায় সমলিঙ্গের বিবাহের আইনি অধিকার এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছে, যা রূপান্তলিঙ্গের মানুষের ক্ষেত্রে অনেকক্ষেত্রেই প্রয়োগ করার মত নয়। 

    ছয়
    রূপান্তরকামিতা (ইংরেজি: transsexualism ট্রান্সেক্সুয়্যালিজম) বলতে বিশেষ একটি প্রবণতা বোঝায় যখন সেক্স বা ‘জৈব লিঙ্গ’ ব্যক্তির জেন্ডার বা ‘সাংস্কৃতিক লিঙ্গ’-এর সাথে প্রভেদ তৈরি করে। রূপান্তরকামী বা ট্রান্সসেক্সুয়াল লোকেরা এমন একটি যৌন পরিচয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করে যা ঐতিহ্যগতভাবে তাদের নির্ধারিত যৌনতার সাথে স্থিতিশীল নয়, এবং নিজেদেরকে স্থায়ীভাবে সেই লিঙ্গে পরিবর্তন করতে চান। ট্রান্সেক্সুয়াল বা রূপান্তরকামী মানুষেরা ছেলে হয়ে (বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে) জন্মানো সত্ত্বেও মনমানসিকতায় নিজেকে নারী ভাবেন (কিংবা কখনো আবার উল্টোটি- নারী হিসেবে জন্মানোর পরও মানসিক জগতে থাকেন পুরুষসুলভ)। এদের কেউ কেউ বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করেন, এই ব্যাপারটিকে বলা হয় (ট্রান্সভেস্টিজম / ক্রসড্রেস), আবার কেউ সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির মাধ্যমে রূপান্তরিত মানবে (Transexual) পরিণত হন। এরা সকলেই রূপান্তরিত লিঙ্গ নামক বৃহৎ রূপান্তরপ্রবণ সম্প্রদায়ের (Transgender) অংশ হিসেবে বিবেচিত ।
    রূপান্তরকামী : রূপান্তরকামিতা (Transsexualism) বলতে বিশেষ একটি প্রবণতা বোঝায় যখন জৈব লিঙ্গ ব্যক্তির জেন্ডারের সঙ্গে প্রভেদ তৈরি করে। রূপান্তরকামী ব্যক্তিরা এমন একটি যৌন পরিচয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেন, যা ঐতিহ্যগতভাবে তাঁদের নির্ধারিত যৌনতার সঙ্গে স্থিতিশীল নয় এবং  নিজেদেরকে স্থায়ীভাবে সেই লিঙ্গে পরিবর্তন করতে চান। রূপান্তরকামী মানুষেরা পুরুষ হয়ে (বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে) জন্মানো সত্ত্বেও মন-মানসিকতায় নিজেকে নারী ভাবেন এবং নারী হিসাবে জন্মানোর পরও মানসিক জগতে থাকেন পুরুষসুলভ। এঁদের কেউ কেউ বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করেন, এই ব্যাপারটিকে বলা হয় ট্রান্সভেস্টিজম বা ক্রসড্রেস। আবার কেউ সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির মাধ্যমে রূপান্তরিত মানবে (Transexual) পরিণত হন। যেমন সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে যাওয়া। এঁরা সকলেই রূপান্তরিত লিঙ্গ নামক বৃহৎ রূপান্তরপ্রবণ সম্প্রদায়ের (Transgender) অংশ হিসেবে বিবেচিত।
    মানবসভ্যতার বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় লিখিত ইতিহাসের সমগ্র সময়কাল জুড়ে রূপান্তরকামিতার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে আমেরিকার পুরুষ রূপান্তরকামী জর্জ জরগেন্সেনের ক্রিস্টিন জরগেন্সেনের রূপান্তরিত হওয়ার কাহিনি মিডিয়ায় একসময় আলোড়ন তুলেছিলো। এ ছাড়া জোয়ান অব আর্ক, জীববিজ্ঞানী জোয়ান (জনাথন) রাফগার্ডেন, বাস্কেটবল খেলোয়াড় ডেনিস রডম্যান, চক্ষুচিকিৎসক এবং পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় ডঃ রেনি রিচার্ডস, সঙ্গিতজ্ঞ বিলিটিপটন সহ অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির মধ্যে রূপান্তর প্রবণতার উল্লেখযোগ্য ইতিহাসে পাওয়া যায়। ১৯৬০ সালে মনোচিকিৎসক ওয়ালিন্দার রূপান্তরকামীদের উপরে একটি সমীক্ষা চালান। তাঁর এই সমীক্ষা থেকে জানা যায়, প্রতি ৩৭,০০০ জনের মধ্যে একজন পুরুষ রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতি ১০৩,০০০ জনের মধ্যে একজন স্ত্রী রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে। ইংল্যান্ডে এই সমীক্ষাটি চালিয়ে দেখা গেছে যে, সেখানে প্রতি ৩৪,০০০ জনের মধ্যে একজন পুরুষ রূপান্তরকামী ভূমিষ্ট হচ্ছে, আর অন্যদিকে প্রতি ১০৮,০০০ জনের মধ্যে একজন জন্ম নিচ্ছে একজন স্ত্রী রূপান্তরকামী। অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ২৪,০০০ পুরুষের মধ্যে একজন এবং ১৫০,০০০ নারীর মধ্যে একজন রূপান্তরকামীর জন্ম হয়।
    সাত
    হিজড়া , দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবহৃত একটি পরিভাষা - বিশেষ করে, ভারতের রূপান্তরকামী বা রূপান্তরিত লিঙ্গের নারীদের বুঝিয়ে থাকে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে, রূপান্তরিত লিঙ্গের হিজড়ারা আরাভানি, আরুভানি এবং জাগাপ্পা নামেও পরিচিত। বাংলা ভাষায়, হিজড়া বলতে আন্তঃলিঙ্গ ব্যক্তিবর্গকেও বোঝানো হয়, অর্থাৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়। সমাজকর্মী ও রূপান্তরিত লিঙ্গের সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদেরকে সাধারণত খাওয়াজা সিরা  নামে চিহ্নিত করে এবং এসকল ব্যক্তিবর্গকে রূপান্তরকামী ব্যক্তি, রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তি (খুসরা), ক্রস-ড্রেসার বা আন্তঃলিঙ্গীয় পোশাকধারী (জেনানা) বা খোঁজা (নরবান) বলে ডেকে থাকে। "হিজড়া" শব্দটি একটি উর্দু শব্দ, যা সেমেটিক আরবি ধাতুমূল হিজর থেকে "গোত্র হতে পরিত্যাক্ত" অর্থে এসেছে। এবং পরবর্তীতে তা হিন্দি ভাষায় বিদেশী শব্দ হিসেবে প্রবেশ করেছে। শব্দটির ভারতীয় ব্যবহারকে প্রথাগতভাবে ইংরেজিতে "ইউনাক" (Eunuch, অর্থঃ খোজা) বা "হারমাফ্রোডাইট" (hermaphrodite, অর্থঃ উভলিঙ্গ) হিসেবে অনুবাদ করা হয়, যেখানে "পুং জননাঙ্গের অনুপস্থিতি হল উক্ত সংজ্ঞার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্ত। দক্ষিণ এশিয়ায়, বহু হিজড়া সুসংজ্ঞায়িত ও সংবদ্ধ সর্ব-হিজড়া সম্প্রদায়ে বসবাস করে, যা একজন গুরুর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই সম্প্রদায়গুলো অসহায় দরিদ্র, পরিত্যাক্ত অথবা পরিবার থেকে পালিয়ে আসা বালকদের দত্তক নেয়ার মাধ্যমে প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে এদের মধ্যে অনেকেই জীবিকার তাগিদে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করে । সাধারণ মানুষের মত ওদের গলার স্বর নয়। মহিলাদের মত করে কথা বলে ওরা। গলার স্বর অনেকটা নারী পুরুষের মিশ্র ভঙ্গিতে। দুহাতে তালি, কোমড় দোলোনোসহ অদ্ভুত চালচলন পথিককে দৃষ্টি কাড়ে। যাই হোক, সাধারণত অধিকাংশ হিজড়াই স্বাভাবিক পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণকারী, এদের মধ্যে আন্তঃলিঙ্গ বৈচিত্র্য নিয়ে জন্মানো সদস্য খুবই অল্পসংখ্যক। কিছু হিজড়া সম্প্রদায়ে নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার পূর্বে তাদেরকে "নির্বাণ" নামক এক আচার পালন করতে হয়, যেখানে শিশ্ন, শুক্রথলি এবং শুক্রাশয়দ্বয় অপসারণ করা হয়।
    পাকিস্তান ও বাংলাদেশে, হিজড়াগণ সরকার কর্তৃক আইনগতভাবে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত, যারা সম্পূর্ণরূপে পুরুষ বা নারী কোনটাই নয়। ভারতেও, রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিবর্গকে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে সমাজ কর্তৃক পরিত্যাজ্য হওয়া সত্ত্বেও তাদের অধিকারকে আইনগতভাবে সুরক্ষিত করা হয়েছে। নেপাল, পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশ আইনগতভাবে পাসপোর্ট এবং অন্যান্য দাপ্তরিক কাগজপত্রে লিঙ্গ অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে একটি তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

    নবজাতকের কান্নার শব্দে যেন ওরা সারা দেয় তেমনি বিয়ে , জন্মদিন উপলক্ষে দলবদ্ধভাবে ওদের সরব পদচারণা। “ওগো পেয়ারে পোলা নাচাইবি ”। ময়মনসিংহ জেলা, উপজেলা শহর এমনকি গ্রামাঞ্চলের উচ্চ বিত্ত মধ্যবিত্ত পরিবারে নবাগত বাচ্চার কান্না কানে আসলেই ফটকে কড়া নাড়ে ওরা। এরপর ঢোল বাজিয়ে তালি দিয়ে টাকার আবদার। ওদের আবদারে নবজাতকের অভিভাবক মহল কেউবা সাড়া দেয় হাসি মুখে। কেউবা আবার খালি হাতে ফেরৎ দেয়। বেশীরভাগ মানুষই নজজাতককে তুলে দেয় তাদের কোলে। দুহাতের বিচিত্র ভঙ্গির তালি আর ঢোলের তালে তালে কোরাস গায় ওরা। ওদের নেই নির্দিষ্ট কোন পেশা। ওদের জীবন জীবিকা বড়ই করুণ। 
    হিজড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবহৃত একটি পরিভাষা— বিশেষ করে ভারতের ট্রান্সসেক্সয়াল বা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকে।চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌনপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্ম-পরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, মূলত তাঁরাই হিজড়া। হিজড়া শব্দের অপর অর্থ হচ্ছে ‘ট্রান্সজেন্ডার’, ট্রান্সজেন্ডার বলতে এমন এক লৈঙ্গিক অবস্থাকে বোঝায় যা দৈহিক বা জেনেটিক কারণে মেয়ে বা ছেলে কোনো শ্রেণিতে পড়ে না। প্রকৃতিতে কিছু মানুষ নারী এবং পুরুষের যৌথ বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বাংলা ভাষায় এই ধরনের মানুষগুলো হিজড়া নামে পরিচিত। সমার্থক শব্দে শিখণ্ডী, বৃহন্নলা, তৃতীয় লিঙ্গ, উভলিঙ্গ, নপুংসক, ট্রান্সজেন্ডার (ইংরেজি), ইনুখ (হিব্রু), মুখান্নাতুন (আরবি), মাসি, বৌদি, চাচা, তাউ, ওস্তাদ, মাংলিমুখী, কুলিমাদর, ভিলাইমাদর, মামা, পিসি, অজনিকা ষণ্ড, অজনক, সুবিদ, কঞ্চুকী, মহল্লক, ছিন্নমুষ্ক, আক্তা, পুংস্তহীন ইত্যাদি। হরিদ্বারে হিজড়াদের সকলে তাওজি বা পণ্ডিতজি বলে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে হিজড়াদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
    হিজড়া, সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী– এঁরা না-নারী না-পুরুষদের দলে অন্তর্ভুক্ত হলে এঁদের সূক্ষ্ম মূলগত পার্থক্য আছে। সবাইকে পাইকারি দরে এক পংক্তিতে ফেলা যাবে না। প্রথমে আসি হিজড়া প্রসঙ্গে।
    হিজড়া : লিঙ্গ ও অণ্ডকোশ কর্তন করে যাঁরা বাচ্চা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তাঁরা হিজড়া বলে পরিচিত। বা যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও অপরিণত বা ত্রুটিপূর্ণ যৌনাঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাঁদেরও হিজড়া বলা হয়। এঁরা সমকামী হতে পারে আবার নাও হতে পারে। এঁরা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

    ধর্মবেত্তারা হিজড়াদের নিয়ে বিপুল শ্রম খরচ করে ভয়ানক ভ্রম সৃষ্টি করে রেখেছেন। ঘৃণা আর অবজ্ঞা ছড়িয়ে রেখেছেন। তা সত্ত্বেও হিজড়ারা কেউ নাস্তিক নয়। তথাকথিত ‘ঈশ্বরের এই বিধান ও ধর্মীয় অনুশাসনকে মাথায় পেতে নিয়ে নিজেদেরকে ‘অভিশপ্ত’ বলেই গোটা জীবন কাটিয়ে দেন। 

    আট

    সমকামিতা (হোমোসেক্সুয়ালিটি) বা সমপ্রেম বলতে সমলিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি "রোমান্টিক আকর্ষণ, যৌন আকর্ষণ অথবা যৌন আচরণ"কে বোঝায়। যৌন অভিমুখিতা হিসেবে সমকামিতা বলতে বোঝায় মূলত সমলিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি "আবেগীয়, রোমান্টিক ও/বা যৌন আকর্ষণের একটি স্থায়ী কাঠামোবিন্যাস"। এই ধরনের সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত বা সামাজিক পরিচিতি, এই ধরনের আচরণ এবং সমজাতীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত কোনো সম্প্রদায়কেও এই শব্দটি দ্বারা নির্দেশ করা হয়।"
    উভকামিতাবিপরীতকামিতার সাথে সমকামিতা বিপরীতকামী-সমকামী অনবচ্ছেদের অন্তর্গত যৌন অভিমুখিতার তিনটি প্রধান ভাগের অন্যতম বলে স্বীকৃত।বিজ্ঞানীরা সমকামিতার প্রকৃত কারণ জানেন না, কিন্তু তারা তাত্ত্বিকভাবে ধারণা করেন যে, জিনগত, হরমোনগত এবং পরিবেশগত কারণসমূহের এক জটিল আন্তঃক্রিয়ার ফলে এটি ঘটে থাকে তারা জীববিদ্যা-নির্ভর তত্ত্বগুলোকে বেশি সমর্থন করে থাকেন,এর অন্তর্গত হল জিন, মাতৃগর্ভের পরিবেশ, এই দুই প্রভাবের মেলবন্ধন অথবা এই সব কিছুর সাথে সামাজিক প্রভাবের মেলবন্ধন। যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণে যে সন্তানপালন বা শৈশবের অভিজ্ঞতার কোনো ভূমিকা আছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ সমকামী যৌন আচরণকে অপ্রাকৃতিক মনে করলেও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সমকামিতা মানব যৌনতার একটি সাধারণ ও প্রাকৃতিক প্রকরণ, এবং অন্য কোনো প্রভাবকের অস্তিত্ব ছাড়া এটি কোনো নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। যৌন অভিমুখিতা পরিবর্তনের বিভিন্ন কর্মসূচীর কার্যকারিতা সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ নেই।
    মহিলা সমকামীদের বোঝাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দটি হল লেসবিয়ান এবং পুরুষ সমকামীদের ক্ষেত্রে গে, যদিও গে কথাটি প্রায়শ সমকামী মহিলা ও পুরুষ উভয়কে বোঝাতেও সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়। নানা কারণে স্বঘোষিত সমকামীর সংখ্যা এবং মোট জনসংখ্যার মধ্যে সমলৈঙ্গিক সম্পর্কে আবদ্ধ মানুষের অনুপাত নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। এই কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হল সমকামভীতিবিপরীতকামবাদের সমর্থনজনিত বৈষম্যের কারণে অনেক সমকামী প্রকাশ্যে তাদের যৌনতা স্বীকার না করা। অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও সমকামী আচরণের নিদর্শন নথিভুক্ত হয়েছে।
    অনেক সমকামী মানুষ স্থায়ী পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ আছেন, যদিও আদমশুমারির ফর্ম, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদির আনুকূল্যে তাদের আত্মপ্রকাশের পথ নিরাপদ হয়েছে একেবারে সাম্প্রতিক কালে। মূল মনস্তাত্ত্বিক গঠনের দিক দিয়ে এই সম্পর্কগুলো বিপরীতকামী সম্পর্কের সমান।নথিভুক্ত ইতিহাস জুড়ে সমকামী সম্পর্ক এবং কার্যকলাপের প্রশস্তি ও নিন্দা - উভয়েরই নিদর্শন মেলে; কেবল প্রকাশের ভঙ্গিমা ও সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতিজনিত তারতম্য দেখা যায়।] ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়েছে, যার অন্তর্গত বিবাহ, দত্তক গ্রহণসন্তানপালন, কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকার, সামরিক পরিষেবা, স্বাস্থ্য পরিষেবায় সমানাধিকার, এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সমকামীদের নিরাপত্তার স্বার্থে অ্যান্টি-বুলিং আইন

    বাংলা সমকামিতা শব্দটির গঠন সংস্কৃত-সঞ্জাত। সংস্কৃত শব্দ ‘সম’-এর অন্যতম অর্থ সমান অথবা অনুরূপ এবং ‘কাম’ শব্দের অন্যতম অর্থ যৌন চাহিদা, রতিক্রিয়া তথা যৌন তৃপ্তি। অতঃপর এই দুই শব্দের সংযোগে উৎপন্ন সমকামিতা শব্দ দ্বারা অনুরূপ বা সমান বা একই লিঙ্গের মানুষের (বা প্রাণীর ক্ষেত্রে অন্য প্রাণীর) প্রতি যৌন আকর্ষণকে বোঝায়। সমকামিতার ইংরেজি প্রতিশব্দ হোমোসেক্সুয়ালিটি তৈরি হয়েছে গ্রিক ‘হোমো’ এবং ল্যাটিন ‘সেক্সাস’ শব্দের সমন্বয়ে। গ্রিক ভাষায় ‘হোমো’ বলতে বোঝায় সমধর্মী বা একই ধরনের। আর ‘সেক্সাস’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে যৌনতা।
    বর্তমানে হোমোসেক্সুয়াল শব্দটি বিদ্বৎসমাজে এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হলেও ‘গে’ এবং ‘লেসবিয়ান’ শব্দদুটি অধিক জনপ্রিয়। গে শব্দটির দ্বারা পুরুষ সমকামীদের বোঝানো হয় এবং নারী সমকামীদেরকে বোঝানো হয় লেসবিয়ান শব্দটির দ্বারা। পশ্চিমে ‘গে’ শব্দটি সমকামী অর্থে প্রথম ব্যবহৃত হতে দেখা যায় সম্ভবত ১৯২০ সালে। তবে সে সময় এটির ব্যবহার একেবারেই সমকামীদের নিজস্ব গোত্রভুক্ত ছিলো। মুদ্রিত প্রকাশনায় শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ১৯৪৭ সালে। লিসা বেন নামে এক হলিউড সেক্রেটারী ‘Vice Versa: America’s Gayest Magazine’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশের সময় সমকামিতার প্রতিশব্দ হিসেবে ‘গে’ শব্দটি ব্যবহার করেন। আর ‘লেসবিয়ান’ শব্দটি এসেছে গ্রিস দেশের ‘লেসবো’ নামক দ্বীপমালা থেকে। কথিত আছে, খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে স্যাফো নামে সেখানকার এক কবি/শিক্ষিকা মেয়েদের সমকামী যৌন জীবন নিয়ে কাব্য রচনা করে ‘কবিতা উৎসব’ পালন করতেন।এইভাবে প্রথম দিকে লেসবিয়ান বলতে ‘লেসবো দ্বীপের অধিবাসী’ বোঝালেও, পরবর্তীতে নারীর সমকামিতার সাথে এটি যুক্ত হয়ে যায়।

    দেশ ও কালভেদে সমকামিতার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন স্তর পরিলক্ষিত হয়েছে। সমকামী সম্পর্ককে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক বলে মনে করা, এর প্রতি সামাজিক উদাসীনতা, সাধারণ সহনশীলতা বা তীব্র অসহনশীলতা, একে একপ্রকার লঘু পাপ হিসেবে গণ্য করা থেকে শুরু করে আইন প্রণয়ন ও বিচারব্যবস্থার সাহায্যে এর অবদমন এবং মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজ সমকামিতাকে গ্রহণ বা বর্জন করেছে। প্রাক্‌-শিল্পায়ন সংস্কৃতিসমূহের ঐতিহাসিক ও জাতিতত্ত্বগত নমুনার একটি সুপরিকল্পিত সংকলনে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী "সমীক্ষাধীন ৪২ টি সংস্কৃতির ৪১ শতাংশে সমকামিতার প্রবল বিরোধিতার নমুনা পাওয়া গেছে; ২১% এর পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, আর ১২% জানিয়েছে তারা এমন কোনো ধারণার সঙ্গে পরিচিত নয়। সমীক্ষাধীন ৭০ টি জাতির মধ্যে ৫৯% জানয়েছে সমকামিতা তাদের মধ্যে অনুপস্থিত বা বিরল, এবং অবশিষ্ট ৪১% এর মতে তা উপস্থিত বা 'বিরল নয়'।
    আব্রাহামীয় ধর্মসমূহের দ্বারা প্রভাবিত সংস্কৃতিসমূহে আইনগির্জা কর্তৃক সডোমিকে ঐশ্বরিক বিধানের পরিপন্থী তথা 'প্রকৃতির বিরুদ্ধাচার' বলে অভিহিত করা হয়েছে।এবং ইসলাম ধর্মে সমকামিতা কে হারাম ঘোষণা করা হয়ে। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী লূতের জাতিকে সমকামিতা অপরাধে ধংস্য করা হয়[২৯][৩০] পুরুষদের মধ্যে পায়ুসঙ্গমের নিন্দা অবশ্য খ্রিস্টধর্মের চেয়েও প্রাচীন; প্লেটোর কাজকর্মেও "অপ্রাকৃতিক"-এর ধারণার প্রমাণ পাওয়া যায়।
    বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, যেমন সক্রেটিস, লর্ড বায়রন, দ্বিতীয় এডওয়ার্ড, হাদ্রিয়ান-এর ক্ষেত্রে সমকামী বা উভকামীর মত পরিভাষাগুলো মাঝেমধ্যে প্রয়োগ করা হয়। মিশেল ফুকোর ন্যায় কিছু দার্শনিকের মতে এই অভ্যাস ভুল, কারণ প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সমাজে যৌনতার উক্ত ধারণাগুলির অস্তিত্ব ছিল না, তাই আধুনিক যুগে নির্ণীত শব্দ দিয়ে তৎকালীন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গেলে কালবিভ্রাটজনিত দোষের আশঙ্কা তৈরি হয়। অবশ্য অন্যান্য দার্শনিক এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন।
    সমাজবিজ্ঞানে সমকামিতার প্রতি "আবশ্যকতাবাদী" ও "গঠনবাদী" দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে মতভেদ আছে। প্রথম পক্ষের মতে "স্ট্রেট" (বিপরীতকামী), "গে" প্রভৃতি শব্দগুলি দেশ, কাল তথা সংস্কৃতি-নিরপেক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়; দ্বিতীয় পক্ষের সমর্থকেরা মনে করেন এই শব্দগুলি কেবল নির্দিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতেই প্রযোজ্য। "আবশ্যকতাবাদীরা" বলেন, যৌন অভিমুখিতা হল স্বতঃস্ফূর্ত জৈবিক ক্রিয়াবিশেষ, কিন্তু "গঠনবাদীরা" বলেন তা অর্জিত বৈশিষ্ট্য।বিজ্ঞানের দার্শনিক মাইকেল রুজ বলেছেন যে ফুকো প্রভাবিত সামাজিক গঠনবাদী মতবাদটি ইতিহাসের বিশেষ কিছু নিদর্শনের উপর জোর দেওয়ার ফলে এতে সমকামীদের বাস্তব অবস্থার সাথে তাদের সম্পর্কে অবশিষ্ট জনসমাজের ভ্রান্তিকে গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

    .

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:236b:a5a0:fd4e:4616:b1db | ১৮ আগস্ট ২০২৩ ১০:১৬740613
  • মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস : গলগণ্ডপুরম 
    প্রথম পর্ব
    মনে পড়ছে, বাস কন্ডাক্টর বলেছিল, স্যার, আপনার পাশে যে লোকটা বসেছিল, সে তো নেমে চলে গেল, কিন্তু তার মাথাটা আপনার কাঁধে রয়ে গেছে ।
    এই বাসে যারা চেপেছে তারা সবাই ল্যাংটো ; তা নাহলে চাপতে দেয়া হয় না । যাত্রীরা কে কোথায় যাচ্ছে বা ফিরছে বা আসছে তা চালক জানে না । চালকও ল্যাংটো ।
    যে লোকটা নেমে গেল সে জানে প্রতারণার বিষয়বস্তু সর্বদাই একটি আকর্ষণীয় বিষয়, আর যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের স্বভাবে যা আছে তা বহাল থাকে আর সমাজ যখন নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় তখন এক বা অন্য আকারে প্রতারকদের বিকাশ লাভের সম্ভাবনা থাকে। এই গলগণ্ডপুরমে প্রতারণার বিখ্যাত নায়ক নায়িকাদের ইতিহাসগুলোকে একত্রিত করা হবে যাতে দেখা যায় যে এই শিল্পটি অনেক রাজ্যপুরমে চর্চা করা হয়েছে। এদিকে গলগণ্ডপুরম নামের রাষ্ট্রপুরমে রূপগুলো-- ছদ্মবেশী, ভানকারী, প্রতারক, আর সব ধরণের জোচ্চোর; যারা সম্পদ, পদ, বা অর্জনের জন্য খ্যাতির মুখোশ পরেছে আর যারা নিছক শিল্পের উন্নতির জন্য এটি করেছেন।যেমন একজন লোক কেবল নানা রকমের কাক আঁকে তো আরেকজন আঁকে বউদের নেতিয়ে পড়া মাই ।
    গলগণ্ডপুরমের নাগরিকদের সাথে নৈতিকভাবে আচরণ করার কোন চেষ্টা একে আরেকের সঙ্গে করে  না : তবুও রাষ্ট্রপুরমের প্রতারকদের উপর এই যে নথি লেখা হচ্ছে তার জন্ম একটি গবেষণা থেকে, তা এই যে, একদল চোর-চোট্টা যায়, আরেকদল আসে । মসনদে পোঁদ ঠেকলেই হাল আমলের রাষ্ট্রপুরমে কর্ণধাররা জোচ্চর হয়ে যায় । 
    কন্ডাক্টারের কথায় গদাধরের হুঁশ ফিরে এলো আর ওর ঘাড়ে বসে থাকা মুণ্ডুটাকে বলল, এই বাঞ্চোৎ, মাথা নামা। কিন্তু কথাগুলো ওর মুখ দিয়ে না বেরিয়ে কাঁধে বসে থাকা মাথাটার মুখ দিয়ে বেরোলো ।
    গদাধর মুণ্ডুটাকে কষে একটা ঘুষি মারল আর ওর নিজের নাক ফেটে রক্ত বেরোতে লাগলো । 
    কন্ডাক্টার বলল, এই ঘটনা আখছার হচ্ছে । এই কাঁধে মুণ্ডু ফেলে পালিয়ে যাওয়া আর সেই মুণ্ডু আসল মুণ্ডুর জায়গা নেয়া । আসল লোকটা নিজেরই ডুপলিকেট হয়ে যায় । 
    বাস চালক বাস থামিয়ে পেছন ফিরে বলল, সেই কারণেই রাষ্ট্রপুরম নিয়ম করে দিয়েছে যে সমস্ত নাগরিককে ল্যাংটো থাকতে হবে । ল্যাংটো থাকলে নাকি প্রতারণা আর দূর্নীতি থাকবে না ।
    গদাধরের ঘাড়ের মুণ্ডুটা বলল, ল্যাংটো থাকা আসলে কি? এটা হল কোন কাপড় না থাকার অবস্থা । যে নেমে গেল তার জীবনের যৌন প্রসঙ্গে নাও থাকতে পারে। হয়তো সে নাগা সন্যাসী যার লিঙ্গ অকেজো করে দেয়া হয়েছে যাতে মেয়েমানুষ দেখে কোনো দমকা চাগাড় না দেয় । মানব সভ্যতা এগোনোর ফলে ল্যাংটো থাকার ব্যাপারে আমাদের  দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে থেকেছে কারণ মানুষ একটি লম্পট শ্রেণির প্রাণী । নৃতাত্ত্বিকরা আগেই ফতোয়া দিয়েছেন  যে মানুষ মূলত নগ্ন অবস্থায়, পোশাক ছাড়াই, তাদের প্রাকৃতিক অবস্থা হিসাবে আরামে থাকতো । অ্যাডাম আর ইভ নামে যাদের গপপো শোনানো হয় তারা ল্যাংটো থাকতো ; বইতে তার প্রমাণ আছে । সে বই কিন্তু আমি লিখিনি । কেউ জানে না কার লেখা। 
    বাসচালক গাড়ি থামিয়ে রেখেছিল । বলল, গলগণ্ডপুরমের পৌরাণিক যুগ ছিল ল্যাংটো ঋষি, মুনি, সাধু, সন্তে ঠাশা । এই যেমন জৈনদের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর, সমস্ত জাগতিক জিনিসপত্র ত্যাগ করার ব্রত হিসাবে ভিক্ষুদের জন্য সম্পূর্ণ নগ্নতার উপর জোর দিয়েছিলেন। সাকা, ভারতের এক হিন্দু সম্প্রদায়, খাজুরাহো শহরের দেয়ালে থাকা হাজার হাজার সুস্পষ্ট ভাস্কর্যের মাধ্যমে তাদের নগ্নতার ঐতিহ্যকে আধুনিক ভারতে স্হায়ি করে রেখেছে। প্রায় ১০০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি, খাজুরাহোর  মন্দিরগুলো আধুনিক দর্শনার্থীদের কাছে তার মূল্যবোধকে এমন প্রত্যক্ষতার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয় যে কল্পনার জন্য কিছুই বাকি রাখে না। ওই মন্দিরগুলোর সামনে দিকের আর চারপাশে হাজার হাজার মানুষ আর প্রাণীর মূর্তি আনন্দের সাথে নাচছে । রাজা আর সাধারণ মানুষদের আনন্দময় যৌন মিলনে চিত্রিত করা হয়েছে, পুঁতি, চুড়ি আরে সাজসজ্জা ছাড়া একেবারে ল্যাংটো । মানুষকে ল্যাংটো করে দিলে তার শ্রেণিচেতনা লোপ পায় ।
    কন্ডাক্টার বলল, হাই তুলে, যারা মনে করেন ভারতীয় নারীরা পোশাকে পশ্চিমাদের নকল করছেন তারা ইতিহাস সম্পর্কে কীই বা জানে ? সব তো ঘুষ দিয়ে মাস্টার হয়েছে ।  প্রাচীন আর মধ্যযুগে ভারতে যারা বেড়াতে আসতো তারা এই ব্যাপারটা  দেখে বোমকে যেতো  যে পুরুষ আর নারী,  উভয়েই তাদের দেহের নীচের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ছাড়া খুব কমই ঢেকে রাখতেন। ধড়ের চারপাশে আলগাভাবে পরা একটা উত্তরিয় ছাড়া পুরুষ আর মহিলা উভয়েই প্রায় খালি স্তনে যেতেন। এছাড়াও, মহিলারা কখনও কখনও তাদের স্তনের চারপাশে শক্তভাবে অন্য কাপড় বেঁধে রাখতেন বটে কিন্তু তাঁরা নিজেদের বডিকে বোরখা দিয়ে ঢাকতেন না।
    ড্রাইভার বলল, তখনকার দিনে মেয়েমানুষ দেখলেও বাঁড়া ছিল পুরুষের আজ্ঞাবহ । ওই তো অ্যাডাম নামের লোকটা কতোদিন ইভের সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালো কিন্তু ওর বাঁড়া দাঁড়ায়নি, যদ্দিন ও ল্যাংটো ছিল । 
    দ্বিতীয় পর্ব
    —আমার নাম মিনহাজ আল-সিরাজ জুজজানি, গদাধরের কাঁধের মুণ্ডুটা ওর দিকে তাকিয়ে বলল : তারপর যোগ করল, শুনে থাকবেন আমার নাম । আমিই তো আপনাদের দেশে এসে যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তাদের ইতিহাস লিখেছি, নয়তো আপনারা জানতে পারতেন না । আপনাদের দেশে তো ইতিহাস লেখার চল ছিল না । ইতিহাসের ঘটনাগুলোকে মহাকাব্য বানিয়ে মহাকবিরা মহা গোলমাল বাধিয়ে গেছেন ।
    —আমি ঠিক বুঝেছি। তুই-তোকারি করে ফেলেছি বলে মাফ করবেন । একজন লোক আমার কাঁধে মুণ্ডু রেখে সটকে পড়বে, সেটা আমি সহ্য করতে পারিনি । 
    — জানেন তো ?  ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কি মুসলমান আক্রমণকারী বখতিয়ার খিলজি নালন্দা মহাবিহার লুঠ আর  ধ্বংস করে। এই ঘটনা ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। শত শত বছর ধরে অবদান রেখে আসা একটা সভ্য, উন্নত জাতি তৈরী ও জ্ঞান উৎপাদনকারী নিরীহ এই প্রতিষ্ঠানটা ১১৯৩ খ্রষ্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী আক্রমন করে ধ্বংস করে ফেলে। তার আক্রমনের বর্বরতা এত ভয়াবহ আকারে ছিল এ সম্পর্কে আমি আমার “তাবাকাতে নাসিরি” বইতে লিখেছি যে “হাজার হাজার হিন্দু, বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আগুনে পুড়িয়ে আর গলা কেটে হত্যা করে সেখানে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করে খিলজী” এরপর আগুন লাগিয়ে দেয় লাইব্রেরীর বিলডিঙে। লাইব্রেরীতে  এত বেশী বই ছিল যে কয়েক মাস সময় লেগেছিল সেই মহা মূল্যবান বই গুলো পুড়ে ছাই ভষ্ম হতে।  খিলজী শুধু নালন্দাকে পুড়িয়ে ছাই করে নি, একই সাথে পুড়িয়ে ছাই করেছে একটি জাতির সভ্যতা, ইতিহাস, প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের অমূল্য বই যা থেকে আপনারা জানতে পারতেন সে যুগের ভারতবর্ষের শিক্ষার অবকাঠামো, তৎকালীন সামাজিক-সাংষ্কৃতিক অবস্থা ও প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে। জাতি হিসাবেও আপনাদের পিছিয়ে দিয়েছে কয়েক হাজার বছর। 
    —একদিক থেকে উনি ভালো কাজ করেছিলেন, বলুন । ওনার জন্যই বাংলা ভাগ হতে পারলো, এতো লোক উদ্বাস্তু হয়ে ঘরছাড়া হলো । এই যে ওই পারে গোরু পাচার চলছে, বেচারা নেতারা একটু টাকাকড়ি করে জেলে যাচ্ছে, উনি যদি না আসতেন তো কিছুই হতো না । বেওয়ারিশ গোরু আর বলদগুলোর তবু হিল্লে হচ্ছে ।
    —কিন্তু ওনার কারণেই পাকিস্তানিরা কতো কাণ্ড করতে পারলো একাত্তর সালে, ভেবে দেখেছেন ।
    —তা ঠিক । কত্তো বাঙালি এই পারে পালিয়ে এসেছিল । সেসব দেখে বিদেশি কবিরা কবিতা লিখেছিল।
    —আর মরিচঝাঁপি ? তার জন্য সবাই জ্যোতি বসুকে দায়ি করে । আসল কালপ্রিট তো বখতিয়ার খিলজি । ভেবে দেখুন আপনি । খিলজি না এলে দেশভাগ হতো না । নন-খিলজি বাঙালিরা আপনাদের দিকে পালিয়ে আসতো না । পালিয়ে এসে মরিচঝাঁপিতে বসত গড়ত না ।
    –কিন্তু নন-খিলজিদের জ্যোতি বসুই তো বলেছিলেন, ওদের মেরে তাড়াও ।
    –জ্যোতিবাবুর দোষ নেই । খিলজি আর নন-খিলজির ভাগাভাগির জন্য দায়ি বখতিয়ার খিলজি । তাই তো আল মাহমুদ নামে একজন কবি বখতিয়ার খিলজির গুণ গেয়ে মহাকাব্য লিখেছেন ।
    নিউটাউনের চোট্টাভরম আবাসনের এগারো তলার ফ্ল্যাটে নিজের পনেরো বাই পঁচিশ বেডরুমে আঠারো ডিগ্রিতে এসি চালিয়ে একুশ ইঞ্চি পুরু বিছানায় শুয়ে, পালবালিশ জড়িয়ে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে, স্বপ্নের মধ্যে বাসের ঘটনাগুলো দেখছিল গদাধর, দুজন প্রেমিকার লাৎ খাওয়া গদাধর, যাদের একজন ওর সমবয়সী অন্যজন বয়সে পাঁচ বছর বড়ো ছিল, স্বপ্নের মধ্যে দেখা দিল আরেকটা ঘটনা, বাসটা অন্ধকারে উধাও, সেই ঘটনা ঘটেছিল বিখ্যাত সঙ্গমতীর্থ সোনাগাছির লাল-নীল-সবুজ টুনি বালব ঝলমলে সন্ধ্যায় আগ্রা রাজস্থানী গার্লস আর উত্তর ভারতীয় দিল্লিটাইপ যুবতীদের জমঘট বাজার নীলকমল, প্রেমকমল, গঙ্গাযমুনা, রাত্রিপ্রেমিক, স্বপ্নেরঘর ঢুঁ মেরে, এক ব্যাটা লাল টিশার্ট আর চোঙা ফেডেদ জিন্সপরা পিম্পের সঙ্গে দেখেছিল ঘুরে-ঘুরে ;  সে নিয়ে গিয়েছিল সস্তার  বাঙালি সুন্দরীদের বাড়িউলি নন্দ রানীর আড্ডাতেয় । পিম্পটা জ্ঞান দিয়েছিল, যেন পাহাড়ের ওপর থেকে কোনো ধর্মপুরুষের বাণী, ডলবি ডিজিটালে, যে এই এলাকাটা চালায় পিম্প, পুলিশ, পলিটিশিয়ান আর পয়সা ; এই চারটে পি সেবা করে আরেকটা পি যাকে লোকে বলে পেনিস। গদাধর বলল, আরে মিস্টার, আসল পি তো বাদ দিলে, প্রস্টিটিউট । 
    –চুপ, চুপ, স্যার, ওই শব্দটা মুখ থেকে বের করবেন না । 
    গদাধর বেছে নিয়েছিল সবচেয়ে সুন্দরী আর দামি নন্দিনী কৌর নামের এক দিল্লিওয়ালিকে, যে, কাজ শুরু হবার আগেই, বেঁজি যেমন কেউটের ছোবল এড়াবার জন্যে স্প্রিঙের মতন লাফিয়ে পেছনে সরে গিয়ে ফিরে আক্রমণ করে , বলে উঠেছিল, আবে, তু সালে মুসলমান হ্যায়, বাংলাদেশি ভগোড়া ? 
    —না গো চুলবুলেশ্বরী, আমার জন্মের পর পেচ্ছাপ বেরোচ্ছিল না, খোসার মুখটা বন্ধ ছিল, পেট ফুলে যাচ্ছিল, তাই পেডিয়াট্রিক সার্জেন ফোরস্কিন বাদ দিয়ে  রিমুভ করা জায়গায় পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে তা গজ দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন । আমার বাপকে তার জন্য দশ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছিল, যা তুমি নিচ্ছ আজকে রাতটা তোমার সঙ্গে শোবার জন্য ।  তুমি যেমন দিল্লি থেকে এসে এই শহরে ব্যবসা ফেঁদেছ আমার গ্র্যাণ্ডফাদার বিদ্যাধর সেন কৃষ্ণনগর থেকে এই শহরে এসে ব্যবসা ফেঁদেছিল, কাপড়ের, সেই ব্যবসাই চালায় আমার বাপ আর আমার দাদা ।
    —-আমি মুসলমান কাস্টমার নিই না, আমার এজেন্টকে বলা আছে । 
    —-মুসলমানরা ওটা শুরু করেনি চুলবুলিদেবী, ওটা অনেক আগের, ইহুদিদের জেনেসিস বইতে লেখা আছে,  ইয়াহওয়েহ আব্রাহামকে বললেন, এবার থেকে তুমি  আমার চুক্তি পালন করবে, তুমি আর তোমার পরে তোমার বংশধরেরা আর  বংশ পরম্পরায় মানতে হবে এই চুক্তি। তোমাদের প্রত্যেক পুরুষকে সুন্নত করা হবে। তোমাদের নুনুর ডগার  মাংসে সুন্নত করানো হবে, আর এটা আমার আর তোমাদের মধ্যে  মাংসল চুক্তি ৷ তোমাদের মধ্যে যার বয়স আট দিন হবে তার সুন্নত করা হবে৷ তোমাদের বংশ পরম্পরায় প্রত্যেক পুরুষ, তা তোমাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করুক বা কেনা গোলাম হোক৷ তোমার কোঁচড়ে আমার চুক্তি হবে চিরস্থায়ী চুক্তি। যে কোন খৎনা না করা পুরুষকে  তার লোকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে; কেননা  সে আমার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। 
    –জানি, সব মানুষ কোনো না কোনো বই থেকে জন্মেছে । ওই তুমি যে বললে, ইহুদিরা একটা বই থেকে জন্মেছে। 
    —আরও অনেক দেশের লোকেরা করে । আসলে যে দেশে বালির ঝড় হয় সেখানকার পুরুষদের চামড়ার ভেতরে বালুকণা ঢুকে কষ্ট দিতো, ঘা হয়ে যেতো, তাই খোসা ছাড়াবার প্রথা । যারা ইহুদিদের বইটাকে মেনে নিজেদের বই থেকে জন্মায়, তারাও মেনে নিয়েছে । জলের অভাব বলে ধোয়াধুয়ি ওদের শুচিব্যামো। হিসি করার পর ধোয়, ঈশ্বরের বাড়িতে যাবার আগে ধোয়, মরবার পর কবরে যাবার আগে ধোয় ।
    — কিন্তু ভক্ত কবীর দাস বারণ করে গেছেন আর তা গুরুগ্রন্হে লেখা আছে । 
    —তাই বুঝি ? জানতুম না । তবে এটা জানি, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিজয়ের পরে,  খতনাকে গ্রীকরা অপছন্দ করতো । ওরা মনে করতো খতনার ফলে পুরুষ অসম্পূর্ণ হয়ে যায় । এর ফলে গ্রিকদের  মধ্যে এর প্রবণতা হ্রাস পায় আর গ্রিক জিমনাশিয়ামে সবাইকে ল্যাংটো হয়ে ব্যায়াম করতে হতো বলে কেউ আর নুনুর খোসা ছাড়াবার প্রথা অনুসরণ করতে চাইতো না । গ্রিক জিমনাশিয়ামে  ল্যাংটো থাকাই ছিল আদর্শ। ভ্যাটিকান সিটির বাইরে অ্যাপোলোর একটা ল্যাংটো মূর্তি আছে, খোসাসুদ্ধ, কিন্তু বড্ডো ছোটো । গ্রিক আর রোমানরা বড়ো মাপের নুনু শুধু অসুর-দানবদের মূর্তিতে দিতো । দেবতাদের বেলায় ছোট্টো, খোকাদের মতন ।
    —তুমি তো তাহলে অসুর বা দানব । আচ্ছা, তুমি যে কাজের জন্যে এসেছো তা শুরু করছ না কেন। তখন থেকে আমার শরীরে নানা জায়গায় গুপ্তধন খুঁজে বেড়াচ্ছ আর গল্প শুনিয়ে নিজের শরীর-মনকে উত্তেজনার বাইরে রেখেছ ?
    —আমার এই খোসা ছাড়ানো ব্যাপারটার কারণে ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ আমাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাঠিয়েছিল । আমি ন্যাশানাল ক্যাডেট কোরে ছিলুম আর রাইফেল, পিস্তল চালাতে ভালো লাগতো। একেবারে অব্যার্থ হয়ে গিয়েছিল আমার টিপ । সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে গিয়েছিলুম, ছাতির মাপ সেসময়ে কম ছিল বলে নেয়নি । ওদের কাছে আমার রেকর্ড ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের কচুকাটা করার জন্যে তৈরি হচ্ছে জানতে পেরে আমাদের দেশেও রেডি হবার তোড়জোড় আরম্ভ হয়ে যায় । 
    গদাধর আবার পুরোনো স্বপ্নের দ্বিতীয় পর্বে ফিরে গেল, অন্ধকার বাসযাত্রায় । গদাধর পেছন ফিরে দেখলো বেশ কয়েকজন তরুণীর দেহটা মেয়ে মানুষের আর তার কাঁধে একজন পুরুষ মাথা রেখে পালিয়েছে । এই ডুপলিকেটটা আমার কাঁধে মাথা না রাখলে আমি পেছনে গিয়ে কোনো যুবতীর কাঁধে মাথা রাখতুম ।
    ড্রাইভার বাস চালানো আরম্ভ করে দিয়েছিল । বলল, সব মানুষ কোনও না কোনও বই থেকে জন্মেছে । আপনি ঘাবড়াবেন না, আপনার কাঁধ থেকে মাথাটা সটকে পড়লেই কোনো যুবতীর কাঁধে মাথা রাখবেন, বাসে রাখুন বা রাস্তায় হাঁটার সময়ে রাখুন । আমরা সবাই কোনো না কোনো বই থেকে জন্মেছি । অ্যাডাম আর ইভ জন্মেছিল জেনেসিস বা আদিপুস্তক থেকে। 
    বইয়ের ঈশ্বর বললেন, ঘ্যাচাঙ ফুঃ, এখন এসো, আমরা মানুষ সৃষ্টি করি। আমার আদলে আমরা মানুষ সৃষ্টি করব। মানুষ হবে ঠিক আমার মতন। তারা সমুদ্রের সমস্ত মাছের ওপরে আর আকাশের সমস্ত পাখির ওপরে কর্তৃত্ত্ব করবে। তারা পৃথিবীর সমস্ত বড় জানোয়ার আর বুকে হাঁটা সমস্ত ছোট প্রাণীর ওপরে কর্তৃত্ত্ব করবে।” ঈশ্বর মাটি থেকে ধুলো তুলে নিয়ে একজন মানুষ তৈরি করলেন এবং সেই মানুষের নাকে ফুঁ দিয়ে প্রাণবাযু প্রবেশ করালেন আর মানুষটা জীবন্ত হয়ে উঠল। ঈশ্বর সেই মানুষটাকে  গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করলেন। মানুষটা যখন ঘুমোচ্ছিল তখন  ঈশ্বর তার পাঁজরের একটা হাড় বের করে নিলেন।  ঈশ্বর মানুষটার পাঁজরের সেই হাড় দিয়ে তৈরি করলেন একজন নারী । নারীকে ঈশ্বর মানুষটার সামনে নিয়ে এলেন।  মানুষটা বলল,“যাক অ্যাদ্দিনে আমার মতন একজনকে পেলুম । আমার পাঁজরা থেকে তার হাড়, আর আমার শরীর থেকে তার দেহ তৈরী হয়েছে।  নর থেকে তার সৃষ্টি হয়েছে বলে তাকে ‘নারী’ বলে  পরিচয় দেয়া হবে।” সেসময়ে নরনারী ল্যাংটো থাকতো, কিন্তু সেজন্যে তাদের কোন লজ্জাবোধ ছিল না।পরের বইটার নাম নিউ টেস্টামেন্ট । সেই বই থেকে আরেকদল মানুষ জন্মেছে । ঈশ্বর তাঁর পবিত্র, নির্দোষ এবং প্রেমময় লোক হবার জন্য আমাদের খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে বেছে নিলেন।ঈশ্বর  যাকে ভালবাসেন সেই খ্রীষ্টের মাধ্যমেই  ঈশ্বর নতুন বই থেকে খ্রিস্টান সৃষ্টি করলেন । 
    বাসচালক স্টিয়ারিঙ ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, আমরা কিন্তু বাঙালি, আমরা একটা বই থেকে জন্মাইনি, অনেকগুলো বই থেকে জন্মেছি, তা লোকে নিজেকে বাঙালি বলে মানুক বা না মানুক ।
    পেছনের কোনো সিটে পুরুষের কাঁধে মাথা রেখে যে নারীদেহ পালিয়েছে, সেই নারীমুখ বলল, আমি এই বিষয়ে পিএইচডি করেছি ।  বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে হরিবংশে যে কাহিনি আছে, সেই কাহিনি থেকে আমরা জানতে পারি যে পুরু  বংশে বলি নামে এক রাজা ছিলেন। সেই রাজার পাঁচ ছেলে ছিল, তাদের নাম  অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুহ্ম ও পুশু। মহাভারতের আদিপর্বেও অসুর-রাজ বলির এই পাঁচ ছেলের উল্লেখ আছে। বলিরাজার এই পাঁচ ছেলে যে পাঁচটা রাজ্য শাসন করতে, তাদের নাম থেকেই এই পাঁচটি রাজ্যের নামকরণ হয়েছিল। বলিরাজার এই পাঁচটি ছেলে বালেয় ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত, এবং তাঁরাই চারি বর্ণের সৃস্টি করেছেন। মৎস্য আর বায়ু পুরাণেও বলা হয়েছে যে, বলিরাজার ছেলেরাই জগতে চারি বর্ণের সৃষ্টি করেছেন। ‘মুঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ নামের একটা বইতে বলা হয়েছে যে, বাঙলাদেশের  লোকেরা ‘অসুর’ জাতিভুক্ত। এটা মহাভারতের এক উক্তি থেকেও সমর্থিত । সেখানে বলা হয়েছে যে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড ও সুহ্মদেশের লোকেরা দীর্ঘতমা ঋষির ঔরসে, মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভে অসুর-রাজ বলির ক্ষেত্রজ সন্তান। 
    বাস কন্ডক্টর জিগ্যেস করল, আমরা অসুর ?  তাই বলি । এতো এতো টাকা নিয়ে মুকখুগুলোকে টিচার করেছে, তা অসুররা ছাড়া কেই বা করবে । কত্তো টাকা ! বাপরে বাপ । তার ওপর আবার স্যাঙাৎসুন্দুরীর দল । চোখ জুড়িয়ে যায় ।
    পেছনের কোনো সিট থেকে যুবকের কাঁধে মাথা রেখে পালানো যুবতীর কন্ঠে কেউ বলল, এখন কথা হচ্ছে এই অসুর জাতির লোকেরা কারা, এবং তারা কোথা থেকেই বা বাঙলাদেশে এসেছিল। বৈদিক ও বেদোত্তর সংস্কৃত সাহিত্যে ‘অসুর’ শব্দটির খুব ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় দেবগণের বিরোধী হিসাবে। ঋগ্বেদে শব্দটির বহু উল্লেখ আছে। ঋগ্বেদের বিভিন্ন মণ্ডলের যে সকল সূক্ত ও ঋকে ‘অসুর’ শব্দটির উল্লেখ আছে সেগুলো যথাক্রমে ১।২৪।১৪, ১৫৪।৩, ২।১।৬, ৩।৩।৪, ৪।২।৫, ৫।১২।১, ৬।২২।২, ৭।২।৩, ৭। ৬।২, ৭।৬।২, ৭।১৩।১, ৭।১৩।১, ৭।৩০।৩, ৭।৩৬ ২, ৭।৫৬।২৪, ৭।৬৫।২৪, ৬০।৬৫।২, ৭।৯৯।৫, ৮।৯।২৩, ৯।৭৩।১ ও ১০/১০/২। সিন্ধুর অসুর-রাজ ও অন্যান্য অসুর-রাজগণের উল্লেখও ঋগ্বেদে আছে। আমরা অনুমান করেছি যে, অসুররা বিস্তৃত-শিরস্ক জাতি ছিল। প্রথম অধ্যায়ে আমরা প্রাচীন নরকঙ্কাল সম্বন্ধে যে আলোচনা করেছি তা থেকেও, জানতে পারি যে, হরপ্পা যুগে গুজরাট ও সিন্ধুপ্রদেশে বিস্তৃত- শিরস্ক জাতি বিদ্যমান ছিল। ভারতের মেগালিথ নির্মাণকারীরাও বিস্তৃত- শিরস্ক জাতি ছিল। মেগালিথে অনুরূপ প্রোথিত শিরাখণ্ড বাঙলার মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলায় পাওয়া গিয়েছে।
    গদাধরের কাঁধে মাথা রাখা মিনহাজ বলল, অনেকে মনে করেন যে ‘অসুর’ বলতে আর্যপূর্ব-যুগের ভারতের এক দেশজ জাতি বুঝাত। যদি অসুররা বৈদিক আর্যগণের আগমনের পূর্বেই ভারতে এসে থাকে, তা হলে তারা যে দেশজ এই মতবাদ গ্রহণ করতে কোনো আপত্তি নেই। বৈদিক সাহিত্যে আমরা ‘দাস’, ‘দস্যু’, ‘নিষাদ’ প্রভৃতি আরও অনেক দেশজ জাতির নাম পাই। সুতরাং বৈদিক আর্যগণের ভারতে আগমনের পূর্বে এদেশে যে একাধিক জাতি বাস করত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এদের অনেককেই অনার্য-ভাষাভাষী বলা হয়েছে। 
    গদাধর চটে গিয়ে মুণ্ডুটাকে ঘুষি মারতেই সেটা গদাধরের নাকে লেগে নাকমুখ থেকে রক্ত বেরোতে লাগল । রক্তাক্ত মুখেই গদাধর বলল, শালা, আর্য-অনার্য থিয়োরি চাপিয়ে গেছে ইংরেজগুলো, তাই নিয়ে লোকে এখনও কপচে চলেছে । আর্য এবং অনার্য তত্ত্ব হলো ১৮ শতকের মিথ্যা ইউরোপীয় প্রচার তত্ত্ব যা ১৮ শতকে ব্রিটিশ-রা তৈরি করেছিল ভারতীয় মানুষদের ছোট দেখানোর জন্য এবং তাদের ইউরোপীয়ান মানুষদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য। আর্য এবং অনার্য তত্ত্ব সম্পুর্ন একটা মিথ্যা এবং ভুল ধারণা, আর্য এবং অনার্য তত্ত্ব কথা থেকে এসেছে? ব্রিটিশ-রা প্রথম যখন ভারতবর্ষে আসল তখন তারা ভারতবর্ষের মধ্যে থাকা অসীম গৌরব এবং বৈভব দেখে তাদের মনে হিংসা জাগে, তখন তারা ভারতবর্ষের সকল জিনিসের কৃতিত্ব তাদের নিজের নামে করার জন্য একটা ফন্দি আঁটে, এবং এই ফন্দিটার নামই হচ্ছে, "আর্য অনার্য তত্ত্ব" আর্য অনার্য তত্ত্বের মুল ভিত্তি হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ বছর আগে নাকি একদল ইউরোপীয়ান মানুষ ইউরোপ থেকে এসে ভারতবর্ষে আক্রমণ করে , এবং তারা স্থানীয় ভারতীয় মানুষদের নাকি পিছনে তাড়িয়ে দেয়, তারা নাকি ঘোড়া এবং রথে চড়ে ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিল, এবং তারা নাকি সঙ্গে করে বেদ নিয়ে এসেছিল এগুলো সিব মিথ্যা এবং ভুল তথ্য ব্রিটিশদের দ্যারা ভারতীয় মানুষদের ছোট দেখানোর জন্য ১৮০০ শতকে তৈরি করা হয়েছিল।এবং বিড়ম্বনা হলো, ১৮০০ শতকের পুরনো ব্রিটিশদের তৈরি মিথ্যা তথ্য গুলো আজও ভারতবর্ষের বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে বাচ্চাদের পড়ানো হয়,
    প্রচলিত ধারণায়, 'ইন্দো-ইউরোপীয়' ভাষাভাষীদেরই আর্য বলা হয়ে থাকে। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, দীর্ঘকায়, গৌডরবর্ণ এবং দেখতে সুদর্শন আর্যরা ছিল ভারতের বহিরাগত এক জাতি — যাদের আদি বাসস্থান ছিল মধ্য-এশিয়া অথবা রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল অর্থ কিংবা ইউরোপের অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী অথবা চেকোশ্লোভাকিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। ঋকবেদের রচনাকালের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকরা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দকেই ভারতে আর্যদের সম্ভাব্য আগমনকাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রথম দিকে আর্যরা আক্রমণকারী হিসেবে ভারতে প্রবেশ করেনি; শান্তিপূর্ণভাবেই নিজেদের গৃহপালিত পশু, জীবনযাত্রার উপকরণ ও দেবদেবী সঙ্গে নিয়ে তারা ভারতে আসে, কিন্তু পাঞ্জাবে বসতি স্থাপন করার পর থেকে ক্রমেই আর্যরা আক্রমণকারীর রূপ ধারণ করতে থাকে। ঋকবেদের যুগের প্রথম পর্যায়ে, ১৫০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, আফগানিস্তানের সীমান্ত থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভারত-ভূখণ্ডে আর্যরা বসতি স্থাপন করলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে আর্যরা ভারতের আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে গঙ্গা ও যমুনা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে। পরবর্তী বৈদিক যুগ অর্থাৎ 'ব্রাক্ষ্মণ' রচনার যুগে সরস্বতী নদী থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের কোশল (অযোধ্যা), কাশী, বিদেহ মানে উত্তর বিহার, মগধ মানে দক্ষিণ বিহার, অঙ্গ মানে পূর্ব বিহার অঞ্চলে আর্য-সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল। দক্ষিণ ভারত ও বাংলায় আর্য-সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল অনেক দেরিতে।
    —বুঝলেন তো আপনারা ! বলল বাসচালক, অন্ধকারে গাড়ি থামিয়ে । তারপর যোগ করল, আমরা যে বইটা থেকে জন্মেছি তার নাম ঋগ্বেদ । ঋগ্বেদে বিশ্বজগত সৃষ্টি সম্পর্কে বহু তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে। ঋগ্বেদের পুরুষসূক্ত অনুযায়ী, সৃষ্টির প্রকাশ হয়েছিল হিরণ্যগর্ভ নামক এক মহাজাগতিক অণ্ড তথা ডিম থেকে যার মাঝে সমস্ত কিছু সুপ্ত অবস্থায় ছিল। এ সূক্তে বর্ণনা করা হয়েছে, পুরুষের বিরাট নামক বিশ্বরূপ হল সৃষ্টির উৎস। বিরাটের মধ্যে সর্বব্যাপী জ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে এবং বিরাট থেকে বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। শেষের দিকের মন্ত্রগুলোতে বলা হয়েছে, পুরুষ নিজেকে আহুতি দিয়ে পক্ষী, বন্য ও গবাদি পশু, চার বেদ, মন্ত্রের ছন্দ সৃষ্টি করেন। তার মুখ, বাহু, জঙ্ঘা ও পা থেকে চার বর্ণের জন্ম হয়। পুরুষের মন থেকে চন্দ্র ও চোখ থেকে সূর্যের জন্ম হয়। তার মুখ ও নিঃশ্বাস থেকে ইন্দ্রঅগ্নির জন্ম হয়। তার নাভি থেকে আকাশ, মাথা থেকে স্বর্গ, পা থেকে পৃথিবী ও কান থেকে অন্তরীক্ষের জন্ম হয়।এই সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষ, জাগতিক ও মহাজাগতিক সকল সত্ত্বার মধ্যে একত্ব স্থাপিত হয়। কারণ, সবই সেই একক সত্ত্বা পুরুষের অংশসম্ভূত। পুরুষসূক্তে আরো বলা হয়েছে, পুরুষের কৃত যজ্ঞের মাধ্যমে এবং যজ্ঞ থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। এই আদি যজ্ঞ থেকেই যাবতীয় সৃষ্টি রূপ ধারণ করেছে। সপ্তদশ মন্ত্রে বলা হয়েছে যে, এই আদি যজ্ঞ থেকেই যজ্ঞের ধারণার উৎপত্তি হয়েছে। শেষ মন্ত্রগুলোতে সকল সৃষ্টির আদিশক্তি রূপে যজ্ঞের গৌরব ঘোষিত হয়েছে। নাসদীয় সূক্তও বিশ্বতত্ত্ব ও ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তির ধারণার সঙ্গে জড়িত। বিশ্বসৃষ্টির বিষয়ে সূক্তটি ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দার্শনিক মহলে প্রসিদ্ধ। ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তে সৃষ্টিতত্ত্ব সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিভিন্ন পুরাণেও বিশ্বজগৎ ও মানব সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনার পাশাপাশি অসংখ্য মহাবিশ্বের ধারণা উল্লেখ করা হয়েছে।এছাড়াও শতপথ ব্রাহ্মণে, মনুসংহিতায়, ঐতয়ের উপনিষদে, সাংখ্য-দর্শনেও বিশ্বজগৎ ও মানব সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে।
    কন্ডাক্টার বলল, আরেকদল মানুষ যে বইটা থেকে জন্মেছে তার নাম আবেস্তা বা জেন্দ আবেস্তা হল জরাথুস্ট্রবাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এটি আবেস্তা ভাষায় রচিত। আবেস্তাকে ফারসি ও ইংরেজি সহ অন্যান্য ভাষায়ও অনুবাদ করা হয়েছে। এর প্রাচীনতম অংশ হল গাঁথাসমূহ, যেগুলো স্বয়ং জরাথ্রুস্ট্র দ্বারা রচিত ধর্মীয় স্তবজ্ঞান। জরাথুস্ট্রবাদে আরও দুটি ধর্মীয় গ্রন্থ রয়েছে যার নাম দেওয়া হয়েছে দেনকার্দ এবং আরদাভিরাফ নমক। আবেস্তা বা জেন্দ আবেস্তা নামটি দ্বারা ধর্মীয় ভাষা এবং ধর্মীয় গ্রন্থ উভয়কেই বোঝায়। জারথুস্ট্র ধর্মের বিশাল সাহিত্য (পারস্য/ইরানে আরব মুসলিমদের বিজয়ের আগে মূল ধর্ম) যে ভাষার আশ্রয় নিয়ে তৈরি হয়েছিল, তাকে 'আবেস্তা' বা 'আভস্তাই ভাষা' বলা হয়। উক্ত সাহিত্যে নবী জরাথুস্ট্র বা তাঁর সমসাময়িক অনুসারীদের ভাষার নাম কি ছিল বা কথ্য ভাষা কি ছিল তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তবে ঐতিহ্য অনুসারে প্রমাণিত হয় যে সেই ভাষা ও সাহিত্যের নামটিও ছিল "অবিস্তক"। অনুমান করা হয় যে "বিদ" ,জানা, এই শব্দের মূলধাতু, যার অর্থ 'জ্ঞান' বা 'প্রজ্ঞা'।
    দিল্লিওয়ালি চুলবুলেশ্বরী সুযোগ বুঝে গদাধরের স্বপ্নে ঢুকে পড়েছিল, উলঙ্গ, তাই কেউ টের পায়নি । গদাধরের কাঁধ থেকে পুরুষের ফেলে যাওয়া মাথাটা দুহাত দিয়ে উপড়ে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দেবার পর গধাধরের পাশে বসে বলল, তুই সত্যিই অসুর, অনার্য, আর আমি আর্য, দ্যাখ আমার কাঁচা সোনার মতন গায়ের রঙ আর তোর কালচে গায়ের রঙ ।  তুই যা বলিসনি, তা হলো, যারা পড়াশুনা করেছে তারা জন্মেছে চার্লস ডারউইনের বই থেকে । ডারউইন ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত তাঁর অন দ্যা অরিজিন অব স্পিসিজ গ্রন্থে তাঁর প্রমাণ ও সিদ্ধান্ত আরও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছিলেন। ১৮৬১ সালে প্রকাশিত বইটির তৃতীয় সংস্করণে ডারউইন স্বীকার করেছিলেন যে উইলিয়াম চার্লস ওয়েলস ১৮১৩ সালে এবং প্যাট্রিক ম্যাথিউ ১৮৩১ সালে একইরকম মত প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা কেউই সেগুলোকে বিস্তৃত করেননি কিংবা কোন খ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় উপস্থাপন করেননি।[৩২]
    গদাধর বাসের বাঁদিকের সারিতে প্রথম সিটে বসেছিল, কাঁধে অন্য লোকের মাথা থাকায় দেখতে পেলো না মেয়েটিকে, যদিও তার কন্ঠস্বর শুনে গদাধর আঁচ করতে পারছিল মেয়েটির কাঁধের বদলে বুকে মাথা রেখে বডি ফেলে পালিয়েছে দুজন লোক । 
    মেয়েটি বলছিল,  কর্মক্ষেত্রে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বলি । বাংলায় সবচেয়ে ঢপবাজ পত্রিকায় এক কমবয়সী মেয়ের যোগ দেওয়া, সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার একরাশ স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করা, সিনিয়রদের অন্ধের মতো বিশ্বাস করা হয়ে দাঁড়াল ভয়ঙ্কর। একজন আদ্দামড়া সিনিয়ার পুরুষ সহকর্মীর অভব্য আচরণ, যৌন হেনস্থা, যা থেকে বাঁচতে আমাকে বাধ্য হয় অভিযোগ জানাতে হয়েছিল। আমি সদ্য বিবাহিতা, সবে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করেছি । ঢপবাজ পত্রিকার জেলা ডেস্কে কাজ করার সেই সময় আমার সঙ্গে এই নোংরামি করেছিল লোকটা । ঢপবাজ পত্রিকার জেলা ডেস্কেই আমাকে যৌন হেনস্হা করা শুরু হয় । জেলা ডেস্কের তখনকার চিফ মিস্টার গাধাবাহন বর্মণ নানা অছিলায় আমার কাঁধে, গায়ে হাত দিতো, আমার স্যানিটারি প্যাড, পোশাক, অন্তর্বাস, যৌন জীবন নিয়ে আলোচনা করতে চাইতো । শেষ পর্যন্ত এই অভিযোগ গিয়ে পৌঁছোয় বাঁজারাম শিকদারের চেম্বারে, যা প্রতিপন্ন হয় চূড়ান্ত এক সামন্ততান্ত্রিক, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আঁতুড়ঘরে।
    ড্রাইভার : আরে ! হাইহিল জুতো পায়ে পোঁদে একটা লাৎ কষাতে পারতে তো ?
    মেয়েটি বলা বজায় রাখলো । একদিন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে, আমি জেলা ডেস্কের প্রধানের বিরুদ্ধে এই লাগাতার যৌন হেনস্থা আর নোংরা আচরণ নিয়ে অভিযোগ জানাই পত্রিকার বার্তা সম্পাদক চামচাচরণকে । উনি পরামর্শ দেন, গাধাবাহন বর্মণের বিরুদ্ধে অফিসের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেলে অভিযোগ জানাতে। যদিও তিনি ভালোই জানতেন, এই সেলের মাথায় রয়েছেন সংস্থার এইচ আর ডিপার্টমেন্টের প্রধান চিকনি চামেলি, যাঁর সঙ্গে অভিযুক্ত গাধাবাহন বর্মণের মাখামাখি সম্পর্ক। অভিযোগ জানানোর পরই আমি বুঝতে পারি যে এই ঢপবাজ পত্রিকার দাবার ছকে আমাকে বোড়ের মতন খেলাচ্ছে পুরুষের দল । সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেলের কিছু লোক দেখানো মিটিং হয়, কিন্তু পরিস্থিতি বদলায় না। বরং আমার কাছে অফিসের পরিস্থিতি আরও অসহনীয় হয়ে ওঠে।
    এরপর একদিন হঠাৎই মালিক বাঁজারাম শিকদারের  ঘর থেকে ডাক আসে । সাংবাদিকের। সেটিই ওই ঢপবাজবাবুর সঙ্গে আমারর প্রথম আর অবশ্যই শেষ সাক্ষাত। 
    ঢপবাজবাবুঃ  আমি শুনেছি, তোমার কাছে এই অভিযোগের কোনও প্রমাণ নেই।
    আমি : স্যর, যৌন হেনস্থার কী প্রমাণ থাকতে পারে?
    ঢপবাজবাবুঃ (সামান্য হেসে), তবে তুমি কীভাবে এই অভিযোগের বিচার বা সমাধান পাবে আশা করতে পারো?
    আমি : (বিস্ময় এবং কান্না চেপে), তবে এই সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেল কেন রয়েছে স্যর?
    ঢপবাজবাবুঃ কারণ, এটা এখনকার দিনে কর্পোরেট বাধ্যবাধকতা। ঠিক যেভাবে আমাদের দেশে ইউজলেস বিচার ব্যবস্থা আছে, সেরকম। আমাদের আইন আছে, আইনজীবী আছে, বিচারক আছে, কিন্তু কতজন মানুষ বিচার পায়? কর্পোরেট সংস্থায় সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেলও অনেকটা তাই। আজকের কর্পোরেট দুনিয়ার এটাই নিয়ম, তাই এই সেল করা হয়েছে, মাই ডিয়ার। যদি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে মারপিট হয়, বাবা তোমাকে চড় মারে, তুমি কি থানায় যাও অভিযোগ জানাতে? নিজেদের মধ্যে ঝামেলা তো মিটিয়ে নাও। তবে এখানে অভিযোগ জানাতে গেলে কেন? এটা কি তোমার পরিবার নয়? অভিযোগ তুলে নাও। এবং তাড়াতাড়ি। লিখে দাও, ভুল বোঝাবুঝি একটা হয়ে গিয়েছিল এবং তুমি তা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাও না। চাইলে আমি তোমাকে অন্য ডিপার্টমেন্টে বদলি করতে পারি।
    আমি আর কথা বাড়াইনি । সিটে ফিরে পদত্যাগপত্র টাইপ করে ঢপবাজবাবুর মুখে ছুঁড়ে মেরে চলে এসেছি ।
    বাসের সব যাত্রীরা একসঙ্গে চিৎকার করে বলতে থাকে, বাস ঘোরাও, বাস ঘোরাও, চলো ওই ব্যাটা ঢপবাজকে ধরে আমরা সবাই মিলে প্যাঁদাবো ।
    বাসচালক বলল, ঘোরানো যাবে না, কেননা ওই ঢপবাজ হলো একটা গল্প বলার সংস্হা । গল্প যখন আখ্যানের কারাগার থেকে মুক্তি পায়, আমরা টের পাই গল্পের জটিলতা আসলে বিস্ময়কর। ন্যারেটিভিস্টরা গল্পকে রৈখিক-প্লট সহ একটি কালানুক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেন, শুরু, মধ্য এবং শেষের সাথে একটি সমন্বিত কথকতা। যদি আমরা আখ্যানের কারাগার থেকে গল্পকে মুক্ত করি, তবে, বিশেষত পুঁজিবাদী বিশ্বের সংস্থাগুলিতে, জটিল গল্প বলার বিক্রয়যোগ্য পদ্ধতি খুঁজে পাই,  যাকে বলা যায় "গল্প বলার সংস্থা" ।   গল্প বলার সংস্থাগুলো গল্পগুলোকে  পাবলিকের মাথায় লেলিয়ে দিয়েছে । গল্প সাপ্লাই কোম্পানির অবদান হল গল্পের একটা তত্ত্ব যা কৌশল, নেতৃত্ব আর সংস্থাগুলোর ভার কমিয়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য আখ্যানের জটিলতা এড়িয়ে   কাজ করে। এখনকার অধিকাংশ ঔপন্যাসিক, যাঁরা বাজার ধরতে চান, তাঁরা নানা কোম্পানিরা যে কাজ করছে সেই কাজই তাঁদের পাল্প ফিকশানে করেন।”
    তৃতীয় পর্ব
    বাসের উড়ন্ত যাত্রাপথ ছিল সস্তা নেশা, হুইস্কি-হেডস, হোঁচট খাওয়া,  মাস্তানদের পাড়া; বেশ্যাদের  লাইন, গরিব সৎ শ্রমিকদের হাইতোলার পরিসর আর অপরাধের  প্রজনন ক্ষেত্র। উদাস চোখের বেশ্যারা রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে অশ্লীলতা অদলবদল করছে  নোংরাদের সাথে। ছিনতাইকারী আর চোর অন্ধকারের খোঁজে বেরিয়েছে । ডাকাতি করার জন্য অপেক্ষা করছে ছোকরার দল। একে অপরকে ছাড়া এরা কেউ টেকে না। 
    গদাধরের মনে পড়ল, গত বছর শরতের এক নিস্তেজ, অন্ধকার আর ঘড়ঘড়ে শব্দহীন দিনে, যখন মেঘ আকাশে নিপীড়নমূলকভাবে ঝুলছিল, তখন আমি দূরপাল্লার এক লজঝড় সরকারি বাসে । দেশের একক নিরানন্দ মাঠ-ময়দানের মধ্য দিয়ে বেঘোরে ছুটছিল বাসটা, কখনও নীল রঙের পোঁচ ; সন্ধ্যার ছায়া ঘনিয়ে আসার সাথে বুঝতে পারলুম পাশের লোকটা আমার কাঁধে মাথা রেখে নাক ডাকছে ।  বিষণ্ণ ধানখেতের দৃশ্য মাখতে চাইছিল না বাসটা। আমি জানি না নাক ডাকা লোকটা যখন পাশে এসে বসেছিল তখন কেমন দেখতে  ছিল -- কিন্তু, পোশাকের বিটকেল গন্ধের আভাস দিয়ে, অসহনীয় গ্লানির অনুভূতি আমার চারিদিক ঘিরে ধরেছিল।
    —স্যার, আপনার কাঁধে মাথা রেখে যে লোকটা ঘুমোচ্ছিল, সে এই স্টপেজে নেমে গেল, কিন্তু ওর মাথাটা আপনার কাঁধেই রয়েছে । দূরপাল্লার বাসের কন্ডাক্টার গদাধরের ঘুমন্ত কাঁধে নাড়া দিয়ে বলল।
    ড্রাইভার বলল, তাহলে ঠিক আছে, আমি বাসটাকে ফ্লাইট মোডে নিচ্ছি, অটো পাইলট সেট করে । আপনারা এবার নক্ষত্রর গুঁড়ো হাত বাড়িয়ে তুলতে পারবেন, মুখে মেখে নিলে অন্ধকারে একে আরেকজনকে দেখতে পাবেন।
    —--মৌলবাদ আর  শিল্প পরস্পরবিরোধী। মৌলবাদী শিল্প বলে কিছু হয় না। তার মানে এই নয় যে মৌলবাদী সৃজনশীল নয়। বরং তার সৃজনশীলতা হলো ডিগবাজির । মৌলবাদী ঘৃণার আর ধ্বংসের সৃষ্টি করে। কাঁধের মাথাটা বলল গদাধরকে ।
    একজনের কাঁধে আরেকজন মাথা রাখছে আর দুজনের একজন বাস থেকে নেমে চলে যাচ্ছে, মাথাটা অন্যের কাঁধে পড়ে থাকছে, এরকম ঘটনা ঘটেই চলেছে, শুধু এইরুটে নয়, গলগণ্ডপুরমের সব রুটে , দুজনের একজন নাকি শহীদ হয়ে যাচ্ছে । বলল ড্রাইভার।
    কন্ডাক্টারকে একজন দুই-মাথা কাঁধে হেলান দিয়ে বলল, এখন  শুনুন। আসলে ফ্যারাওরা যখন মিশর থেকে যে লোকজনদের তাড়িয়ে দিয়েছিল, তারাই প্রথম একটা বই পেয়েছিল যেটা মানুষের লেখা নয় । মানুষের লেখা বই থেকে মানুষ কেমন করে জন্মাবে, বলুন ড্রাইভার সাহেব । আমাদের ঋগ্বেদ ছাড়া গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, মেঘনাধবধ কাব্য, সুবিমলমিশ্রর বইসমগ্র আছে, একটা বইই নয় । যাদের একটাই বই আছে আর তা মানুষের লেখা নয়, তাদের বই থেকে সবকিছু জন্মেছে । আমরা আর আফরিকার কিছু বুনো মানুষ বই থেকে জন্মাইনি। 
    —আপনি কি বাঙালি ? এই পারের বাঙালিরা বলে যে ওরা বই থেকে জন্মায়নি অথচ ওই পারের বাঙালিরা বই থেকে জন্মেছে ! এটা কি অক্সিমোরোন ? তাও আবার বাংলা বই থেকে নয় । আরবি বই থেকে।
    —আরবি বই থেকে জন্মাতেই পারে । আমি সত্যিই যা চাই তা হল ছোটো-ছোটো হরফ, দুর্বোধ্য শব্দে ঠাসা কঠিন বাক্য, অনেক অক্ষরের শব্দ আর লম্বাই-চওড়াই মার্কা ধারণা, বেশ মোটা হাজার পাতার বই, এমন লেখখের  লেখা বই যে কিনা হাওয়া দিয়ে গড়া । 
    —আজকাল শতকরা আশিভাগ যুবতীরা বিয়ের বিরুদ্ধে। কেন জানেন ? কারণ যুবতীরা বুঝতে পেরে গেছেন যে সামান্য সসেজ পাওয়ার জন্য একটা পুরো শুয়োর  কেনার কোনো মানে হয় না! পেছনের সারিতে বসে ছিলেন এক বুড়ির কাঁধে মাথা রেখে দেহহীন যুবতী, তিনি বললেন কথাগুলো।
    বুড়ি বলল, এই ছুঁড়ি, তোর তো বডি নেই, সসেজ নিয়ে করবিটা কী ?
    যুবতী বলল, যে কোন প্রাণী চোদাতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র মানুষই যৌন আবেগ অনুভব করতে পারে, যা সঙ্গমের জৈবিক তাগিদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আর যৌন আবেগ সহস্রাব্দ ধরে মানব জীবনের একটা অত্যাবশ্যক মানসিক শক্তি হিসাবে মনে করা হয় । সাধারণ পুরানো সহবাস শুধুমাত্র সেইসব পয়েন্টে ইরোটিকভাবে ঠাটিয়ে ওঠে আর আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে যেখানে প্রতিবন্ধকতা, দ্বন্দ্ব, নিষেধাজ্ঞা এবং পরিণতি এটিকে একটি দ্বি-ধারী চরিত্র ধার দেয় - অর্থপূর্ণ যৌনতা  পরাজিত  আত্মসমর্পণ, একটা অতিক্রম আর লঙ্ঘন, বিজয়ী আর ভয়ঙ্কর এবং আনন্দিত এবং দুঃখজনক।  শুধুমাত্র মানুষই ইচ্ছা হলে করে নয়তো করে না। সীমালঙ্ঘন করতে পারে, পরাস্ত করতে পারে, ভালোবাসতে পারে: বেছে নিতে পারে।
    —যাঁরা হাত বাড়িয়ে নক্ষত্রের গুঁড়ো গায়ে মাখলেন, তাঁরা কিন্তু, এই যাত্রার আইনভঙ্গ করলেন, কেননা, বাসের যাত্রীদের সবাই ল্যাংটো বা নগ্ন থাকবেন এই শর্তে তোলা হয়েছিল । বলল কন্ডাক্টার ।
    —কেন ? জানতে চাইল গদাধর ।
    ড্রাইভার বলল, ঈশ্বর প্রথম যুবক আর প্রথম যুবতীকে  বললেন, ফলবান হও আর সংখ্যাবৃদ্ধি কর, তাই আমি তোমাদের গায়ে পোশাক দিইনি। একে অপরের সাথে যৌনমিলন করো বা  গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে একে অপরের সাথে যৌনমিলন করো, বা কামসূত্র থেকে কিছু আকর্ষণীয় জিমন্যাস্টিক নিয়ে এসো ।
    —দেখুন, আপনারা যাকে ঈশ্বর ভাবছেন, তা হলো রাষ্ট্র । অনেকগুলো রাষ্ট্র হবার পর ঈশ্বরদের সংখ্যা বেড়ে গেছে ।
    চতুর্থ পর্ব
    If you’ve ever peered into the eyes of a cat or a goat, you’ll have noticed that pupils can come in quite a few shapes and sizes. And those are just two among a great many animals – including geckos, toads, stingrays and cuttlefish – that demonstrate the diversity of pupil shapes in nature. With stylish and clever animation, this video from TED-Ed takes a brief dive into animal vision, detailing the wide range of pupil types in the eyes of the animal kingdom, as well as the fascinating ways they can shape perception and indicate a creature’s place in their ecosystem.

    গায়ে নক্ষত্রের রুপোলি গুঁড়ো মাখার পর যাত্রীরা টের পেলো তাদের অকুস্হলে যৌন অঙ্গ নেই । তাদের বিদেশী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, তাদের ব্যঙ্গগত এবং ভাষাগত পরিবর্তনের কারণে, তারা প্রভাবশালী মূল্য ব্যবস্থার জন্য হুমকি হিসাবে দেখা দেয়, প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল দুই পক্ষেই ।
    এখন কী করবে ওরা সবাই ?
    বাস কন্ডাক্টার বলল, তখন ১৯৭৯ সাল । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে সরকারি টাকায় একটা টুকিটাকির দোকান খুলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলুম। টিভিতে দেখলুম চৌঠা এপ্রিল পাকিস্তানের লোভি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে রাওয়ালপিন্ডির জেলখানায়, আজেবাজে দোষ লোকটার ঘাড়ে চাপিয়ে। কোনো মানে হয় না । লোকটার আসল দোষ ছিল ওদেরই পাবলিক পাকিস্তানি সেনাদের থুথু করছিল ভুট্টোর দোষে আর পাঞ্জাবি সেনারা  ওদের দেশের বাঙালিদের লোপাট করে দিচ্ছিল । মজার ব্যাপার হলো যে পাকিস্তানের সেনা প্রশাসন ওর প্রাণদণ্ডাদেশ দিয়েছে। শালা নব্বই হাজার পাকিস্তানি সেনা নিজেরা ধরা দিয়েছিল, নানা কুকীর্তি করার পর। ভুট্টো কড়া ঘুমের ওষুধে ন্যালব্যাল করছিল বলে ওকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাতে হয় ।ওর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের পর ওর বউ নুসরাত আর মেয়ে বেনজির  প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিল ওদের রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হকের কাছে। তা জিয়াউল হক শুনবে কেন ? ওই তো ভুট্টোকে রাত দুটোয় ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল আর জেলের পেছনের দরোজা দিয়ে লাশ নিয়ে গিয়ে কবর দেবার ব্যবস্হা করেছিল।
    ড্রাইভার বলল, আমরা তো আল বদর, আল শামস আর রাজাকরদের ধরেধরে প্যাণ্ট খুলে পোঁদে এতো লাথি মেরেছিলুম যে নিজেদেরই পা ব্যথা করছিল । পাকিস্তানি সেনাদের অমন অপমান করার হুকুম ছিল না কেননা ওরা প্রিজনার অফ ওয়ার । তবু, যেকটা এদিক সেদিকে একা ধরা পড়েছিল সেগুলোকে শহর গাঁয়ের পাবলিকই শায়েস্তা করেছে । 
    গদাধর বলল, সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবার ইচ্ছে আমার ছোটোবেলা থেকেই ছিল। তাই কলেজে পড়ার সময়ে ন্যাশানাল ক্যাডেট কোরের ইনফ্যান্ট্রিতে যোগ দিয়ে থ্রি নট থ্রি, বাইশ বোরের রাইফেল, স্টেনগান আর পিস্তল চালাতে শিখেছিলুম । তা সত্বেও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারলুম না তার কারণ শারীরিক সক্ষমতা যাচাই করার এই পরীক্ষাগুলোয় অন্যদের থেকে ভালো ফল করতে পারলুম না, বা বলা যায় ফেল করলুম: ছয় কিলোমিটার দৌড়, বিমের ওপর পুশ-আপ, নয় ফুট গর্তের মধ্যে দিয়ে যাওয়া আর জিগজ্যাগ ব্যালেন্স। আসলে প্রতি বছর তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ লক্ষ ছাত্রছাত্রী সেনায় যোগ দেওয়ার আবেদন করে। তার কারণ এই কেরিয়ারে রয়েছে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা, দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ, আকর্ষণীয় বেতন, অ্যাডভেঞ্চার, আত্মত্যাগের হাতছানি। 
    আপনি পাকিস্তানিদের প্যাঁদাতে যাননি ? গদাধরের কাঁধের মুণ্ডুটা জিগ্যেস করল ।
    —-দিয়েছিলুম তো, বলল গদাধর, তারপর যোগ করল, সেনায় যোগ দেবার আশা যখন ছেড়ে দিয়েছি, ১৯৭১ সালের এপ্রিলে একজন লোক এসে জানতে চাইল আমি সেনার হয়ে কাজ করতে চাই কিনা, আর একটা কাগজ দিয়ে বলল, রাজি থাকলে এই ঠিকানায় কালকে সকাল ছয়টায় হাজিরা দিতে । পরের দিন পৌঁছে দেখলুম, আমার বয়সী অনেকে এসেছে । আমাদের শপথ করিয়ে বলা হলো যে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ লাগবে আর তার জন্য সেনার দরকার বেসরকারি যোদ্ধা আর গুপ্তচর । আমরা কুড়িজন, সবাই বাঙালি, একদিন বাসে চেপে হাজির হলুম একটা ক্যাম্পে। বাসটা সেনার ছিল না আর ক্যাম্প দেখেও টের পাবার উপায় নেই যে ওখানে ভবিষ্যতের কোনো লড়াইয়ের জন্য ট্রেনিঙ দেয়া হচ্ছে ।
    একজন বুড়ির কন্ঠস্বর শোনা গেল বাসের পেছন দিকের সিট থেকে। বলল, পৃথিবীতে মানুষের জীবন যাপনের দিক নির্দেশনা এবং সাম্য-মৈত্রীর বাণী নিয়ে যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মের আগমন ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারতবর্ষ হচ্ছে ধর্মের আদিভূমি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধর্মের নামে মানুষ রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে আবার এই ধর্মই মানুষকে করেছে সুসংহত, মানবতাবাদী। এছাড়া মানবধর্ম রয়েছে যেটা নাস্তিকরা পালন করে। তারা কোন ধর্মকেই বিশ্বাস করে না,তাদের মতে বিজ্ঞান ও আধুনিক পৃথিবী,তাদের জন্ম হয়েছে বির্বতনের মাধ্যমে এটাই তাদের বিশ্বাস। আর এখন এই উড়ন্ত বাসে আমরা সবাই লিঙ্গহীন হবার পর ধর্মের বা মানুষের উৎপত্তির ইতিহাস জানার দরকার নেই ।
    —এই তো ! কিছুক্ষণে একটা গ্রহে গিয়ে উড়ন্ত বাসটা নামাবো আর আপনারা অন্য রকমের যৌন অঙ্গ ফিরে পাবেন । তখন নতুন বসতি গড়তে পারবেন আর সৃষ্টি করবেন ঈশ্বর-দেবী-দেবতা-ঈশ্বরপুত্র বা যা চাইবেন তাই । কথাগুলো কে বলল টের পাওয়া গেল না ।
    বাসটা নতুন একটা গ্রহে নামার পর সবাই দেখল গেটের কাছে একজন লোক রবিঠাকুরের আলখাল্লা পরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে । লোকটা বলল, আমি একা এই গ্রহে থাকি । আপনাদের জন্য একটা বুলেটিন লিখে রেখেছি । এর নাম হাংরি বুলেটিন । এই গ্রহে সংসার পাতুন আর এই বুলেটিনের কমাণ্ডমেন্টসকে প্রতিষ্ঠা করুন।
    গদাধর বুলেটিন হাতে নিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে পড়ে শোনালো 
    ১. বস্তুসমুহের গুণরাজি মনেরই আরোপিত, মনেই তাদের অবস্থিতি, মন দিয়েই তারা নির্মিত। আমরা যেমন ভাবি, ঠিক তেমনি রুপান্তরিত হই। তাই দূষিত মনে কেউ কিছু বললে বা করলে দুঃখ তার অনুগমন করে, যেমন গাড়ির চাকা বাহক বলদের অনুসরণ করে।
    ২. বস্তুসমূহের গুণরাজি মনেরই আরোপিত, মনেই তাদের অবস্থিতি, মন দিয়েই তারা নির্মিত। প্রসন্ন মনে যিনি কতাহ বলেন বা কাজ করেন সুখ তাকে নিরবচ্ছিন্ন ছায়ার মত অনুসরণ করে।
    ৩-৪. আমার প্রতি আক্রোশ করল, আমায় মেরে ফেলল, আমাকে অন্যায়ভাবে হারাল, আমারটা ছিনিয়ে নিল; সবসময় যাদের এই চিন্তা, তাদের মন থেকে বৈর-ভাব কখনো দূর হয় না। আমার সঙ্গে শ্ত্রুতা করল, আমায় মারল, আমারটা হারাল, আমারটা নিল; এই সব চিন্তা যারা মনে স্থান দেন না, তাদের বৈরভাব দূর হয়ে যায়।
    ৫. শত্রুতা দিয়ে কখনো শত্রুতার মীমাংসা হয় না। শত্রুহীনতা দিয়েই এর প্রশমন সম্ভব; এই হল সনাতন ধর্ম।
    ৬. মূর্খরা জানে না যে তারা চিরকাল এই সংসারে থাকবে না। যারা জানেন তাদের সব কলহের শান্ত হয়।
    ৭-৮. যে কেবল বাইরের সৌন্দর্য খুজে বেড়ায়, যার ইন্দ্রিয় সংযত নয়, অতিভোজনকারী, অলস আর হীনবীর্য, সে বাতাহত দুর্বল গাছের মত মারের কাছে পরাজিত হয়। দেহের মলিনতার কথা জেনে যে বাইরের শোভা খোজে না, যে ইন্দ্রিয় জনযত রাখে, পরিমিত আহার করে, সেই শ্রদ্ধাবান ও বীর্যবান ব্যক্তিকে রসবিত করতে পারে না-বাতাস যেমন শিলময় পর্বতকে নাড়াতে পারে না, ঠিক তেমনি।
    ৯-১০. যৌন আসক্তিতে যে আসক্ত, সে কাষায বস্ত্র পরিধান করা, তথা ভিক্ষু হয়ার যোগ্য নন। যিনি কাম, রাগ ইত্যাদি দোষ মুক্ত, শোলসমূহে সুপ্রতিষ্ঠিত, সংযমী, সত্যনিষ্ঠ তিনিই কাষায় বস্ত্র তথা নাগরিক হয়ার যোগ্য।
    ১১-১২. যা অসার বা অসত্য তাকে যারা সার বা সত্য মনে করে, আর সারকে অসার মনে করে, মিথ্যা সংকল্পের সেই আশ্রয়দাতারা কখনো সত্যকে লাভ করতে পারে না। অন্যদিকে যারা ঐ অসত্যকে অসত্য বলেন আর শীল প্রভৃতি সার বস্তুকে সার বলে জানেন তারাই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে মুক্তিপথ লাভ করেন।
    ১৩-১৪. যে ঘর ভালভাবে আচ্ছাদিত নয়, তার মধ্যে যেমন বৃষতি ঢুকে পড়ে, তেমনি যে চিত্ত ধ্যানপরায়ণ নয় তাতেও রাগ (আসক্তি) প্রবেশ করে। ভালভাবে আচ্ছাদিত ঘরে যেমন বৃষ্টি ঢুকতে পারে না, ভাবনামুক্ত চিত্তে চেমনি আসক্তি প্রবেশ করতে পারে না।
    ১৫. যে পাপ করে, সে ইহলোকে ও পরলোক, দুই জায়গাতেই অনুশোচনা করে। নিজের দুষ্কর্ম দেখে সে শোক করে আর কষ্ট পায়।
    ১৬. যিনি কৃতপুণ্য, তিনি ইহলোক ও পরলোক, উভয় স্থানেই আনন্দ লাভ করেন। তিনি নিজের সুকৃতি দেখে পরম আনন্দ পান।
    ১৭. পাপী ইহলোক ও পরলোক, উভয় স্থানেই অনুতাপ ভোগ করে। আমি পাপ করেছি – এই চিন্তা তাঁকে যেমন দগ্ধ করতে থাকে, তেমনি পাপেরর ফলে দুর্গতি লাভ করে সে আরো দুঃখ পায়।
    ১৮. যিনি পুণ্য কাজ করেছেন, তিনি ইহলোক ও পরলোক, দুই জায়গাতেই আনন্দিত হন। আমি সৎ কাজ করেছি – এই চিন্তায় যেমন তাঁর আনন্দ হয়, তামনি সুগতি লাভ করে তিনি আরো আনন্দ পান।
    ১৯-২০. যে বহু বই-গ্রন্থ-শাস্ত্র পড়ে কিন্ত সেই জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করে না, সে ঠিক সেই রাখালের মত, যে অন্যের কয়টা গরু মরল তা নিয়েই পড়ে থাকে, বৈরাগ্য/শ্রামণ্য তাঁর জন্য নয়। শাস্ত্র অল্পমাত্র উচ্চারণ করলেও যিনি জীবণে তা ধারণ করে রাগ, দ্বেষ ও মোহ থেকে মুক্ত হন, সম্যক জ্ঞানের অধিকারী, বিমুক্তচিত্ত এবং ইহলোক ও পরলোকে উপাদান-রহিত তথা কামশূন্য হন, তিনিই শ্রামণ্যের ফল ভোগ করেন।

    ২১. যে যার আরাধ্য দেবী-দেবতা-ঈশ্বর-শয়তান-দৈত্য-দানব সৃষ্টি করে বই লিখুন । আসল কথা হলো বই। কে লিখেছে তার কোনো গুরুত্ব নেই ।
    ( একশো পর্ব পর্যন্ত চলবে )

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:236b:b979:e774:8760:5c66 | ১৮ আগস্ট ২০২৩ ১৮:০৮740614
  • দস্তয়েভস্কির ধর্মদ্বন্দ্ব : মলয় রায়চৌধুরী
    ফিয়োদর দস্তয়েভস্কির বাবা, মিখাইল আঁদ্রিভিচ দস্তয়েভস্কি ১৮৩৯ সালে মারা যান, যখন ফিয়োদর সেন্ট পিটার্সবুর্গে মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তেন । ফিয়োদরের বাবার মৃত্য সম্পর্কে তিনটি পরস্পরবিরোধী কারণের কথা শোনা যায় এবং সত্যটি আজও অজানা । প্রথমটি হল যে তাঁকে তাঁর জমিদারির চাষিরা খুন করেছিল, দ্বিতীয়টি হল যে স্ত্রী মারিয়া নেচায়েভার মৃত্যুর পর মিখাইল অত্যধিক মদ খেতেন যার দরুন তাঁর সিরোসিস হয়ে গিয়েছিল, তৃতীয় হল যে মিখাইল হার্ট অ্যাটাকে মারা যান । মিখাইলের মৃত্যু যদিও রহস্যে ঢাকা, তাঁর ছেলে আঁদ্রের রচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে স্ত্রী মারিয়ার মৃত্যুর পর মিখাইলের স্বাস্হ দ্রুত খারাপ হয়ে গিয়েছিল আর সমস্ত রকমের প্রতিরোধ-শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন । তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের যাজক এবং তাঁদের আদিনিবাস ছিল লিথুয়ানিয়ার পিন্সকে, যা এখন বেলারুসের অন্তর্গত । লিথুয়ানিয়ায় তাঁর নামের উচ্চারণ ছিল মিখাইল । ফলত, শৈশব থেকে ফিয়োদরের মনে খ্রিস্টধর্মের ব্যাখা নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ পরিবারিক। বাঙালি হিন্দু লেখকদের কী এই ধরণের প্রশ্ন মনে জাগে না ?
    মিখাইল ছিলেন মসকোয় গরিব রোগীদের মারিনস্কায়া হাসপাতালের ডাক্তার । ১৮২৮ সালে, যখন তাঁর দুই ছেলে, মিখায়েল আর ফিয়োদরের বয়স যথাক্রমে আট আর সাত বছর,  তিনি কলেজিয়েট অ্যাসেসরের পদে উন্নীত হন, যা তাঁকে আইনত অভিজাত শ্রেণির সদস্য হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং তিনি মসকো থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে  দারোভোয়েতে একটি ছোটো জমিদারি কেনেন ; সেখানে তাঁরা গ্রীষ্মাবকাশে গিয়ে থাকতেন । এই চাষজমির একটা পয়োনালিতে পাওয়া গিয়েছিল মিখাইলের মৃতদেহ ।  মৃতদেহ এই ভাবে পাওয়া,  ফিয়োদরের চরিত্রে ‘পাপবোধ’ বা ‘সিন’ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন ক্ষত তৈরি করে দিয়েছিল, যেমনটা ক্যাথলিকরা খ্রিস্টের মৃত্যুর জন্য অনুশোচনা করেন ।
    ফোবিদরের বাবার আরও ছয়টি সন্তান হয়েছিল : ভারভারা ( ১৮২২-১৮৯২ ), আঁদ্রেই ( ১৮২৫-১৮৯৭ ), লিউবভ ( ১৮২৯ সালে জন্মের পরই মারা যায় ), ভেরা ( ১৮২৯-১৮৯৬ ), নিকোলাই ( ১৮৩১-১৮৮৩ ) এবং আলেকসান্দ্রা ( ১৮৩৫ - ১৮৮৯ ) । মিখাইল ছিলেন সুশিক্ষিত  ও স্নেহময় মানুষ, কিন্তু তাঁর আচমকা চটে যাবার স্বভাব তাঁকে এমন করে তুলতো যে তখন তাঁকে অত্যন্ত কড়া মেজাজের ও অবিশ্বাসযোগ্য মনে হতো ।  যখন তাঁর মনের ভাব খারাপ থাকতো তখন মিখাইল জগতসংসারকে  তিক্তভাবে দেখতেন, উত্ত্যক্ত হয়ে যেতেন, সদাচার ভুলে যেতেন এবং আত্ম-সচেতনতা  থাকতো না । বাবার চরিত্রের তিক্ততা ও অন্তর্মুখীনতা বর্তেছিল ফিয়োদরের ওপর । 
    মিখাইল  ছিলেন অত্যধিক ধার্মিক এবং তিনি ও স্ত্রী মারিয়া বাচ্চাদের গোঁড়া রুশ খ্রিস্টধর্মের ঐতিহ্য অনুসারী করে তুলতে চাইতেন, যার বৈশিষ্ট্য হল ভয়, কঠোরতা ও আনুগত্য । কাথলিক শব্দটি গ্রীক শব্দ কাথোলিকোস থেকে এসেছে, যার অর্থ সর্বজনীন কিন্তু রাশিয়ার অর্থোডক্স চার্চ তাকে সর্বজনীন বলে মনে করে না। একই ধর্মের এরকম দুটি ভিন্ন ব্যাখ্যা, ফিয়োদরকে শৈশবেই অবাক করেছিল ।বাচ্চাদের তিন-চার বছর বয়স থেকে ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট পড়ে ও ব্যাখ্যা করে শোনাতেন তাঁদের মা-বাবা। পাশাপাশি, বাচ্চাদের আয়া  আলেনা ফ্রোলভ্‌না রাতে শোবার সময় তাদের খ্রিস্টধর্মীদের  বীরগাথা, রূপকথা ও কিংবদন্তির গল্প পড়ে শোনাতেন । 
    ১৮৩৭ সালে মারিয়া যক্ষ্মা রোগে মারা যান আর ফিয়োদরের ছোটো ভাই আঁদ্রেই এই সময়ের পর বাবার মধ্যে প্রভূত পরিবর্তন লক্ষ করেন । আঁদ্রেই লিখেছেন যে তাঁর মা মারা যাবার পর বাবার মধ্যে অদ্ভুত বদল ঘটতে থাকে, নিজের সঙ্গে এমন জোরে-জোরে কথা বলতেন যেন স্ত্রী মারিয়ার সঙ্গে কথা বলছেন। আঁদ্রেই একটি চিঠির কথা উল্লেখ করেছেন যাতে তাঁর বাবা ফিয়োদরকে লিখছেন যে মারিয়ার মৃত্যুর ফলে গড়ে ওঠা নিজের অসীম দুঃখ আর যাতনা তাঁর সহ্যের অতীত হয়ে গেছে । ফিয়োদরের মনে হয়েছিল যে এই দুঃখ ও যাতনা তো আসলে খ্রিস্টের ! আঁদ্রেই-এর মতে, চরম একাকীত্ব তাঁর বাবাকে মদ্যপ আর প্রায়-উন্মাদ করে তুলেছিল । বাবার মৃত্যু সম্পর্কে তিনটি সম্ভাব্য কারণের মধ্যে চাষিদের হাতে খুন হওয়াকেই সত্য বলে মনে করেন আঁদ্রেই ; মিখাইলের বদমেজাজের কারণে একবার তিনি চিৎকার করে একজন চাষিকে অপমান করেছিলেন ; সেই চাষি অন্য চাষিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে খুন করেছিল তাঁর বাবাকে । ঘটনাস্হলে পুলিশ এসেছিল কিন্তু চাষিরা সবাই মিলে মোটা ঘুষ দেবার দরুন হত্যাকাণ্ড ধামা চাপা পড়ে যায় ; সরকারি নথিতে লেখা হয় যে মিখাইল হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন । 
    মিখাইলের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংবাদ আশি বছর অজানা ছিল । মিখাইলের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আজও জানা যায়নি, তবে মৃত্যু ঘিরে যে রহস্য এবং বাবাকে হারানোর বিষাদ, ফিয়োদরের লেখালিখি ও বিশ্ববীক্ষার ওপর প্রভূত ছাপ ফেলেছিল । ফ্রয়েড বলেছেন যে দস্তয়েভস্কির মৃগীরোগ যেভাবে আচমকা দেখা দিয়েছিল তা তাঁর বাবার মৃত্যুর ঘটনাকে কিনারা করতে  ও সহ্য করতে গিয়ে মস্তিষ্কে ব্যাখ্যাহীন ছাপের দরুন,  সারাজীবন যাতনাটি ফিয়োদরের সঙ্গী ছিল। মৃগীরোগ তাঁর রচনার থিম, বিশেষ করে ‘দি ইডিয়ট’ উপন্যাসে । পিতৃহত্যা ও পিতৃস্হানীয়ের হত্যা এবং বাবা ও ছেলেদের পরস্পর সম্পর্ক দস্তয়েভস্কির থিমগুলোর অন্যতম, বিশেষ করে ‘দি ব্রাদার্স কারামাজোভ’ উপন্যাসে, যে রচনায় বাবার মৃত্যু সম্পর্কিত অপরাধবোধ তাঁর ছেলেদের মধ্যে সঙ্ঘাতের কারণ হয়ে ওঠে । উল্লেখ্য যে যিশুর পিতা হলেন ঈশ্বর ।
    জার-শাসিত রাশিয়ায় ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি  এমন একটি জীবন যাপন করেছিলেন যা তাঁর উপন্যাসগুলোয় ভয়াবহভাবে  প্রতিফলিত হয়েছে : জটিল, উত্তেজনায় টান-টান এবং মানসিক অস্থিরতা ও প্রশ্নজালে জর্জরিত। মানুষের স্বভাবচরিত্র তাঁর উপন্যাসে বল্গাছাড়া পরিসর পেয়েছে, তারা যেন সেই লোকগুলোর মতন যারা নির্দিধায় যিশুর হাতে আর পায়ে গজাল ঠুকে ক্রুশকাঠে ঝুলিয়েছিল । দস্তয়েভস্কি দেখেছেন যে এই এরাই আবার পরস্পরের নির্মমতা, হিংস্রতা, ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রগাঢ় প্রেমে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়ার আনন্দ আহ্লাদিত ও যন্ত্রণায় কাতর হয় ।  তাছাড়া মহৎ ব্যক্তির জীবনেও থাকতে পারে গোপন নোংরামির ঘা যেমন থাকে বহু যাজকের । 
    বাবা মিখাইলের হাসপাতাল ছিল মস্কোর প্রায় বাইরে গরিবদের এলাকায় । হাসপাতালের ঘাসহীন মাঠে একা-একা ঘুরে বেড়াবার সময় নানা অসুখে-ভোগা রোগিদের যাতায়াত নিয়মিত দেখতেন ফিয়োদর, সেই ধরণের রোগী যারা যিশুর ছোঁয়ায় সেরে উঠতো । সেই সব লোকেরা বেশির ভাগ ছিল দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত  নিচুতলার মানুষ। সেই নিম্নবিত্ত এলাকায় বন্ধুহীন নিরানন্দ  কঠোর ও নিঃসঙ্গ  শৈশবের একাকীত্ববোধ, শৈশবের ফ্ল্যাটের দমবন্ধকরা পরিবেশ ফিয়োদরের মধ্যে গড়ে তুলছিল ভিন্ন একটি অ-বালক চারিত্র্য । তিনি যেন কাঁধে ক্রুশকাঠ বইবার একাকীত্ববোধে নির্বাসিত ।
    নিউ ও ওল্ড টেস্টামেন্ট শোনার সময় থেকে ফিয়োদরের মনে আব্রাহামিক বাইনারি বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়েছিল । ঈশ্বর সম্পর্কে দ্বন্দ্ব থেকে  কখনও মুক্তি পাননি তিনি এবং তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যানার মতে, এই বিষয়ে দস্তয়েভস্কি একটি পুরো গ্রন্হাগারের বই পড়ে ফেলেছিলেন । “দ্য ইডিয়ট’ উপন্যাস লেখার আগে, দস্তয়ভস্কি  একটি চিঠিতে বন্ধু এ. এন.মাইকভকে  লিখেছিলেন, “যে ব্যাপারে  আমি আমার সারা জীবন সচেতনভাবে বা অজ্ঞানভাবে যাতনা ভোগ করেছি---তা হলো ঈশ্বরের অস্তিত্ব।" । অর্থাৎ যিশুর বাবার অস্তিত্ব। 
    দস্তয়েভস্কির অধিকাংশ বই  খ্রিস্টান মতবাদের কাঠামোর মধ্যে লেখা হয়েছে, এবং ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের ও অবিশ্বাসীদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যগুলোকে আলোকিত করেছে :  চূড়ান্ত ভাল এবং খারাপের দ্বন্দ্ব ।  দস্তয়েভস্কি বিশ্লেষণ করেছেন, যীশু খ্রিষ্টের "সত্য" উপলব্ধির ধাপে অন্তর্নিহিত মানসিক যন্ত্রণা এবং সেই সূত্রে জেগে ওঠা প্রশ্নাবলী । তাঁর সমালোচক বারদাইয়েভ-এর মতে , “দস্তয়েভস্কিকে  পৌত্তলিকদের মতো ঐশ্বরিক সমস্যার সমাধান করতে হয়নি, বরং তাঁকে ভাবতে হয়েছে মানবজাতির সমস্যা, ব্যক্তিমানুষের যন্ত্রণা,  আধ্যাত্মিক মানুষ হিসাবে একজন খ্রিস্টানের সমস্যা।" দস্তয়েভস্কি বলেছেন যে, বিবেকের স্বাধীনতার চেয়ে মানুষের জন্য আর কিছু প্রলুব্ধকর নয়। কিন্তু যাতনা ভোগার তার চেয়ে  বড় কারণ আর নেই । যিশু এই যাতনা ভোগ করেছিলেন।   ঈশ্বর ও শয়তানের দ্বন্দ্বে একজন হিন্দু বা অনীশ্বরবাদী পাঠকের  জড়িয়ে পড়া এবং তার যাতনা বুঝতে পারা কঠিন কেননা হিন্দু তো জানে না শয়তান বলতে কাকে বোঝায়, তাই সে সহজেই নিজের দুষ্টু ছেলেকে ‘শয়তান কোথাকার’ বলে বকুনি দিতে পারে ।
    দস্তয়েভস্কির ভাবুক সত্তার বিকাশ মোটামুটি দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায় । তাঁর কারাবাসের আগের ছোটো লেখাগুলো, যাতে লক্ষ করা যায় রুশ ও বিদেশি সাহিত্যিকদের প্রভাব , যদিও কিছু বৈশিষ্ট্য এবং শৈলীগত উদ্ভাবন যা পরে তাঁকে চিহ্ণিত করবে, তার আভাস সেগুলোয় স্পষ্ট ।   গোগলের দ্বারা সেন্ট পিটার্সবার্গের কেরানিদের অপমানজনক চরিত্রচিত্রণ  এবং তাদের ক্ষতিকারক পরিবেশের বর্ণনা যুবক দস্তয়েভস্কির ভালো লেগেছিল । দস্তয়েভস্কি নিজেও এই সমস্ত প্রান্তিক, হিংসুটে, ঝগড়ুটে লোকেদের সঙ্গে শৈশব থেকে পরিচিত ছিলেন; এরা যেন জুডাসের বংশধর। দস্তয়েভস্কির সেই সময়ের গল্পগুলোতে এই উপাদানগুলো এতো বেশি যে তিনি নিজেকে গোগলের শিষ্য হিসেবে চিহ্নিত করতেন। ই.টি.এ. হফমান- এর  গল্পের বৈশিষ্ট্যগুলো, বিশেষ করে  গথিক এবং রোমান্টিক মেলোড্রামা,  পছন্দ ছিল দস্তয়েভস্কির । তা সত্বেও, দস্তয়েভস্কিকে অমন প্রভাব থেকে যা আলাদা করে তা হল গরিব বর্গের লোকেদের যাতনার আর কষ্টের  কার্নিভালিস্ট অতিরঞ্জন ।
    রুশরা যে ধর্ম সম্পর্কে গোঁড়া তা সোভিয়েত দেশ ভেঙে যাবার পর অর্থোডক্স চার্চের স্বমহিমায় ফেরা থেকে টের পাওয়া যায়, যখন কিনা ইউরোপের অন্যান্য দেশে ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাস ক্রমশ ফিকে হয়ে এসেছে । প্রকৃতপক্ষে, দস্তয়েভস্কি একটি গোঁড়া ধর্মীয় পরিবারে বেড়ে ওঠেন । উনি নিজেই বলেছেন, "আমি একজন ধার্মিক রাশিয়ান পরিবার থেকে এসেছি। আমরা আমাদের পরিবারে আমাদের শৈশবকাল থেকেই গসপেলের কথা জানি। আমার কাছে, তা একটি গৌরবময় ব্যাপার। " তিনি অবশ্যই বাইবেলের বিষয়বস্তুর সাথে ভালভাবে পরিচিত ছিলেন, কারণ তাঁর নিষ্ঠাবান মা তাঁর সন্তানদের পড়তে এবং লিখতে শেখানোর জন্য শুধুমাত্র ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্ট ব্যবহার করতেন। 
    দস্তয়েভস্কি তাঁর প্রিয় আয়ার কথাও বলতেন, যিনি  তাঁকে রাতে শুতে যাবার আগে এই  প্রার্থনা করতে বলতেন, , "আমি আমার সমস্ত আশা তোমার ওপরই রাখি, মাদার মেরি, আমাকে তোমার সুরক্ষা দিও ।" শৈশবে এই ধরনের  শক্তিশালী মহিলারা  সম্ভবত দস্তয়েভস্কির পরবর্তী লেখাকে প্রভাবিত করেছিল, যার কারণে তিনি নারী চরিত্রগুলোকে এমন ভূমিকা দিয়েছেন যা সত্য এবং সম্পূর্ণ ধার্মিক, যার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসের সোনিয়া চরিত্রে। যদিও দস্তয়েভস্কির লালন -পালনের একটি বড় অংশ খ্রিস্টান পরিবারে ঘটেছিল,  তিনি মানুষের কঠোর স্বভাবচরিত্রের পরিচয়ও শৈশবেই পেয়েছিলেন। তাঁর বাবাকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন বটে, কিন্তু তিনি মাতাল ছিলেন এবং পরে তাঁর অমানবিক আচরণের কারণে চাষিদের হাতে খুন হন, এটা তিনি জীবনে কখনও ভুলতে পারেননি । 
    দস্তয়েভস্কি  পরিচিত সাহিত্য সমালোচক বেলিনস্কির দ্বারা প্রভাবিত "রাশিয়ান ইউটোপিয়ান সোশ্যালিস্টস"  দলে যোগ দেন। এই দলের মতাদর্শ সম্ভবত দস্তয়েভস্কির বিশ্বাসকে নাড়া দিয়েছিল, কারণ  বেলিনস্কি মনে করতেন যে "সমাজতান্ত্রিক হিসাবে, তাঁদের প্রথমে খ্রিস্টধর্মকে ধ্বংস করতে হবে, কেননা বিপ্লব অবশ্যই নাস্তিকতা দিয়ে শুরু হওয়া উচিত।" পরে, যদিও, দস্তয়েভস্কি আন্দোলনের এই শাখা থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছিলেন, তবু  অর্থোডক্স চার্চের বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক অভিব্যক্তিতে পূর্ণ একটি ব্যক্তিগত চিঠির প্রচারের জন্য তাঁকে  গ্রেপ্তার করে কারাগারে চালান করা হয়েছিল। স্পষ্টতই, দস্তয়েভস্কি মাদার মেরিকে এবং যিশুকে ভুলে গিয়েছিলেন। 
    কারাগারে থাকাকালীন (যেখানে একমাত্র বই বাইবেল অনুমোদিত ছিল) মনে হয় দস্তয়েভস্কি একজন ঈশ্বর-বিশ্বাসী হিসেবে আবার নিজেকে আবিষ্কার করতে আরম্ভ করেন । শ্রীমতী ফনভিজিনকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন: "আমি বিশ্বাস করি যে এর চেয়ে প্রিয়, গভীর, আরও সহানুভূতিশীল, যুক্তিসঙ্গত কিছু নেই। ত্রাণকর্তার চেয়ে বড়ো  এবং নিখুঁত পুরুষ আর কেউ নেই;  যদি কেউ আমাকে প্রমাণ দেখাতে পারে যে খ্রিষ্ট সত্যের বাইরে, এবং যদি তারা খ্রিস্টকে বাদ দেয় তবে আমার উচিত হবে খ্রিস্টের সাথে থাকা।” 
    ঈশ্বর ও যিশুকে বিশ্বাসের প্রকৃত পুনর্জন্ম দেখা গেল  ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’,’ ডেভিলস’,’ দ্য ইডিয়ট’ এবং ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এর মতো উপন্যাসগুলোয়, যে রচনাগুলোতে অর্ধোডক্স চার্চের বক্তব্য স্পষ্ট এবং অবিচল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয় হল এই আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম  সাইবেরিয়ায় কারাবাসের সময় ঘটেছিল, যেখানে দস্তয়েভস্কি পুরুষদের মধ্যে খারাপ হবার ক্ষমতা সম্পর্কে তথ্যের একটি বড় সংগ্রহ গড়ে তুলেছিলেন। দস্তয়ভস্কি এমন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে একটি বিশ্বাস গড়ে তুলতে পেরেছিলেন যা একইসঙ্গে ঈশ্বর ও শয়তানের পরস্পরবিরোধের বনেদ ।
    তার মানে দস্তয়ভস্কির কাছে ঈশ্বর-বিশ্বাসের  সমস্যা সত্যের স্বীকৃতি সমস্যা নয়, বরং তা সংশয়কে  দূর করে। সন্দেহে যন্ত্রনাক্ত দস্তয়েভস্কির আত্মপ্রশ্নের প্রাথমিক উৎস ছিল পৃথিবীতে এতো  যন্ত্রণা রয়েছে কেন, এবং কেমন করেই বা প্রেমময় ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে তা খাপ খায়। দস্তয়েভস্কি এই দ্বন্দ্বটি আইভান কারামাজভের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন, "এমন নয় যে ঈশ্বরকে আমি মানি না, বোঝার চেষ্টা করো,  আমি এই জগতকে গ্রহণ করি না, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন, ঈশ্বরের এই জগতকে, এবং এর সাথে একমত হতে পারি না।" ‘ব্রাদার্স কারামাজভ’, যে উপন্যাসে দস্তয়েভস্কি ঈশ্বরের প্রশ্ন নিয়ে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন, এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল যা "বিশ্বাস বনাম নাস্তিকতার” দ্বন্দ্বকে পরিণাম দিতে পারে ।  
    প্রাথমিকভাবে তাঁর ভাই অ্যালোয়িশার "সক্রিয় স্নেহ", দস্তয়েভস্কির মতে, বিশ্বাস । কিন্তু  জোসিমাকে তিনি উপস্হাপন করেছেন একটি ‘আদিরূপ’ হিসাবে , যার মাধ্যমে দস্তয়ভস্কি দেখাতে চেয়েছেন যে তিনি "মানুষকে স্বীকার করতে বাধ্য করতে পারেন, যে, প্রকৃত খ্রিস্টধর্ম  বিমূর্ত বিশ্বাস নয়, বরং জীবনে গ্রহণযোগ্য উজ্জ্বল বাস্তবতা । এই খ্রিস্টধর্ম আছে নাগালের মধ্যে, এবং অর্থোডক্স চার্চের খ্রিস্টধর্মই রাশিয়ান ভূখণ্ডের সমস্ত মন্দ থেকে একমাত্র পরিত্রাণ । এই খ্রিস্টধর্ম রোমান ক্যাথলিকদের নয়, যারা স্পেনে মানুষদের খুঁটিতে বেঁধে পোড়াতো।  অ্যালিয়োশা এবং জোসিমা চরিত্র দুটি দস্তয়েভস্কির আগের উপন্যাসে বিশ্বাস বিষয়ক প্রচেষ্টার তুলনায় সফল এবং এই দুজন ধার্মিক চরিত্র হলো আদর্শ সৎকর্মের উদাহরণ । পক্ষান্তরে ধরা যাক, ‘দ্য ইডিয়ট’ উপন্যাসের প্রিন্স মিশকিন, যে একজন মামুলি মূর্খ আর শেষ পর্যন্ত মূর্খ থেকে গেছে, কেননা  খ্রিস্টান হিসাবে তার বিশ্বাসে গড়ে ওঠেনি, সে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে গেছে। 
    ‘ব্রাদার্স কারমাজোভ’ উপন্যাসে ফিয়োদর কারমাজোভের ছেলেদের প্রত্যেককে দস্তয়েভস্কি নিজের চৈতন্যের একটি অংশ দিয়ে চিত্রিত করেছেন, যাতে তাঁর নিজের ভেতরের ঝগড়া তাদের মুখ দিয়ে করাতে পারেন এবং বিশ্বাসের যাতনার বিশ্লেষণ করতে পারেন । অ্যালোয়িশা, তাঁরই এক ছেলের নাম যে এই উপন্যাস লেখার সময়ে মারা যায় । চরিত্রটি দস্তয়েভস্কির আধ্যাত্মিক দিকের প্রতিফলন,  যে দস্তয়েভস্কির আধ্যাত্মিক আদর্শকে সমর্থন করে । দিমিত্রি তাঁর চরিত্রের আবেগময় দিক, যার কন্ঠে সব সময় দস্তয়েভস্কির প্রিয় কবিতা শোনা যায়, আর যার আর্থিক দুরবস্হা লেখকের সঙ্গে মিলে যায়, যিনি লিখেছিলেন “রুবলগুলো কাঁকড়ার মতন এদিক-ওদিক পালায়” । স্মেরদিয়াকভ চরিত্রটি  দস্তয়েভস্কির মতনই জীবনের অসহ্য যন্ত্রণা ও তিক্ততা ভোগ করেছে ; দস্তয়েভস্কি এই চরিত্রের মাধ্যমে রাশিয়ায় যুবকদের বিপ্লবী নৈতিকতা বিশ্লেষণ করেছেন । আইভান হলো সব ভাইদের মধ্যে একজন বুদ্ধিজীবী, যার মাধ্যমে দস্তয়েভস্কি নিজের দার্শনিক ও ধর্ম-সম্পর্কিত বক্তব্যগুলো ঝালাই করার সুযোগ পেয়েছেন । যদিও আইভানের চরিত্র দস্তয়েভস্কির সঙ্গে মেলে না, কিন্তু পরস্পরবিরোধী ভাবনাগুলোকে তিনি কাটাছেঁড়া করতে পেরেছেন, বিশেষ করে আইভানের দীর্ঘ ‘দি গ্র্যাণ্ড ইনকুইজিটর’ বক্তব্যের  মাধ্যমে, যাকে দস্তয়েভস্কি বলেছেন কবিতা ।
    অ্যালিয়োশার চরিত্রে প্রদর্শিত বিশ্বাসের মাধ্যমে মূলত আইভান কর্তৃক ঈশ্বরের বৌদ্ধিক নিন্দা  প্রতিহত করেছেন দস্তয়েভস্কি । তবুও, নাস্তিকতার সমর্থনে আইভানের দৃষ্টিভঙ্গি নিহিত রয়েছে  মানবজাতির প্রতি তার ভালোবাসায় -- দস্তয়েভস্কির যৌবনের রাজনীতি যা তাঁকে কারাগারে বন্দী করেছিল এবং ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়েছিল। আইভান তর্ক দিচ্ছে স্রষ্টার বিরুদ্ধে,  কেননা সে মানুষের যন্ত্রণাভোগে বিপর্যস্ত । দুজন কারামাজভ ভাইয়ের মতামতের দ্বন্দ্ব মানুষের আত্মার মধ্যে পাওয়া যায়, সেখানে চলছে সতত সংগ্রাম । অদ্ভুত ব্যাপার  হল যে সৌন্দর্য যেমন রহস্যময় তেমনি ভয়ঙ্কর। ঈশ্বর এবং শয়তান সেখানে অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রটি হলো ব্যক্তি-এককের মস্তিষ্ক । দুটি তর্কবিন্দুতে আইভান  অ্যালিয়োশার বিরোধিতার প্রয়াস করে, তা হলো, নির্দোষদের কষ্টভোগ এবং অদম্য সাহসের ধারণা, মূলত  ইচ্ছার স্বাধীনতা বা খ্রিষ্টধর্মে যাকে বলা হয়েছে ‘মানুষের ফ্রি উইল’। বলাবাহুল্য এই দুই তর্কবিন্দু দস্তয়েভস্কির সারাজীবনের ক্ষত হয়ে কাজ করেছে মস্তিষ্কে ।
    শিশুদের যন্ত্রণাভোগ আইভানের দৃষ্টিতে সবচেয়ে অযৌক্তিক এবং অন্যায়, এবং আলিয়োশার কাছেও তা ক্ষতিকর। আইভান স্বগতোক্তির মাধ্যমে  শিশুদের নির্যাতনের ভয়াবহ উদাহরণ উপস্হাপন করে এবং তার দ্বারা বুঝে উঠতে চায় অ্যালিয়োশা কেমন করে অমন নির্যাতনের সঙ্গে তার ঈশ্বরপ্রেম মেলাতে পারে।  অ্যালিয়োশার অপরিসীম দয়ার প্রতি আবেদন করার তর্কে আইভান এইভাবে যুক্তি দেয়: “কল্পনা করো যে তুমি  মানুষকে সুখী করার, তাদের শান্তি ও বিশ্রাম দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে মানব-নিয়তির একটি পরিকল্পনা  তৈরি করলে, অথচ সেই পরিকল্পনায় অপরিহার্যভাবে দেখা গেল একটি ক্ষুদ্র জীবনকে  অত্যাচারে জর্জরিত করা অনিবার্য হয়ে উঠেছে, তুমি কি সেক্ষেত্রে অমন পরিকল্পনার স্হপতি হতে রাজি হবে ?” আইভানের মতে ‘ফ্রি উইল’  আলোচনায় পাঠক ঈশ্বর সম্পর্কে আরেকটি সমস্যার সন্মুখীন হয় যা বিদ্যায়তনিক নাস্তিকতার অন্যতম প্রধান নীতির উপর আঘাত করে।  মানুষের পতনের কারণ হিসেবে আইভান মনে করে যে ঈশ্বর দোষী, এবং তাঁর প্রতি অবিশ্বাসের  যুক্তিও খাড়া করে : “মানুষের অস্তিত্বের রহস্য কেবল বেঁচে থাকা নয় ; বরং কোনও উদ্দেশ্যে বেঁচে থাকা । খ্রিস্টের উক্তি স্মরণীয়, “নট বাই ব্রেড অ্যালোন।”এ-ও দস্তয়েভস্কির নিজস্ব অন্তরদ্বন্দ্ব ।
    অ্যালিয়োশা আইভানের বক্তব্যের বিরুদ্ধে যিশুখ্রিষ্টের উদাহরণ দেয়, যিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন।  দূরদর্শিতা হিসেবে এই ধারণাটিকে  অ্যালিয়োশা ব্যাখ্যা করে যে 'প্রত্যেকেরই সবার প্রতি দায় আছে  ।' যে-কোনো অপরাধবোধ, এবং ফলস্বরূপ যে-কোনো  যাতনাভোগ, প্রত্যেক ঈশ্বর-বিশ্বাসীর কাছে একই হওয়া উচিত, কারণ আমরা সবাই অ্যাডাম ও ইভের আদি পাপের জন্য দোষী। আর যদি আমরা সেই দায়িত্বকে প্রগাঢ়ভাবে অনুভব করি তাহলে যন্ত্রণাভোগকে ভবিষ্যতে দূর করতে পারি । অ্যালিয়োশার বক্তব্যের  প্রতিক্রিয়ায় দস্তয়েভস্কি যা লিখেছেন তা তাঁর সবচেয়ে গভীর দার্শনিক মতামত  হিসাবে সূত্রায়িত করেছেন বিভিন্ন ভাবুক । এটি কাহিনির ভেতরে কাহিনি টেকনিকে লেখা এবং  আইভানের কবিতা ‘দ্য গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর’ নামে বিখ্যাত স্বগতোক্তি । 
    “দ্য গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর" নামের গদ্যটি, যাকে দস্তয়েভস্কি বলেছেন কবিতা, তা  উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম সুপরিচিত অনুচ্ছেদ, কারণ মানুষের প্রকৃতি ও স্বাধীনতা সম্পর্কে ধারণা এবং মৌলিক অস্পষ্টতা নিয়ে তাতে তর্কবিতর্ক করা হয়েছে। দীর্ঘ স্বগতোক্তিতে, ‘দি গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর’ এই ধারণাগুলো সমর্থন করেন: “কেবল শয়তানের নীতিগুলিই মানবজাতির সার্বজনীন একীকরণের দিকে পরিচালিত করতে পারে: মানুষকে রুটি দিন, তার বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করুন এবং বিশ্বকে শাসন করুন; যীশু নিজেকে নির্বাচিতদের একটি ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন , যখন কিনা ক্যাথলিক চার্চ নিজেদের কাজের উন্নতি করে, এবং সমস্ত মানুষকে তার আওতায় আনে। গির্জাগুলো ঈশ্বরের নামে বিশ্ব শাসন করে, কিন্তু তা আসলে শয়তানের নীতি অনুসরণ করে ;  মানুষকে উচ্চ মর্যাদা-সম্পন্ন মনে করা ছিল যিশুখ্রিস্টের ভুল ।” ‘দি ইনকুইজিটর’ স্বগতোক্তিটি নিজেদের রচনায় আলোচনা করেছেন বা উদ্ধৃতি দিয়েছেন নোয়াম চমস্কি, আলডস হাক্সলি, ডেভিড বেন্টলি হার্ট, ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস, ক্রিশ্চিয়ান ফিলোস্ট্র্যাট, ইরভিন ডি ইয়ালম, পিটার ব্রুক, হেলেনা ব্লাভিটস্কি, লুই আলথুসার, ওরহান পামুক প্রমুখ ।
    শুরুতে ছিল অল্প স্বাধীনতা , যা কিছু  ভালো তাকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, অথচ তা  পাপের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে না ; শেষ পর্যায়ের স্বাধীনতা ছিল বড়ো মাপের, ঈশ্বরকে পাবার স্বাধীনতা, ঈশ্বরের বুকে ঠাঁই পাবার স্বাধীনতা । মানুষের মর্যাদা এবং তার বিশ্বাসের মর্যাদার জন্য দুটি স্বাধীনতারই স্বীকৃতি প্রয়োজন : সত্যকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা এবং সত্যের স্বাধীনতা ; কিন্তু বাঁধনহীন  কল্যাণ, যা একমাত্র সত্য, তা অশুভের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে। এই সেই ট্র্যাজেডি যা  দস্তয়েভস্কি যাচাই  এবং অধ্যয়ন করেছেন । আর এতে রয়েছে খ্রিস্টধর্মের রহস্য । ফলে  এটি আইভানের যুক্তিকে নস্যাৎ  করে, কেননা অশুভের জন্য যদি  স্বাধীনতার প্রয়োজন হয়, তাহলে মানুষের কারণেই দুষ্টতা এবং যন্ত্রণা ঘটে, আর তাই ঈশ্বরকে দোষ দেওয়া যায় না। তবে স্বাধীনতারও প্রয়োজন আছে, যাতে আমরা ঈশ্বরের ভালবাসাকে গ্রহণ করে তাঁকে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারি। এমন একটি জগতের অস্তিত্ব সম্ভব নয় , যা একই সঙ্গে মুক্ত এবং ভাল, কারণ মানুষের খুঁত তা হতে দেবে না। পৃথিবী বজ্জাতিতে ঠাশা আর কৃপণ, কারণ তা মুক্তির বনেদে দাঁড়িয়ে । তবু, সেই মুক্তি বা উত্তরণ মানুষের এবং তার জগতের সমগ্র মর্যাদা দিয়ে গঠিত। যাই হোক, পাঠবস্তুর ছকের ভেতরে দস্তয়েভস্কি বিতর্কটা তোলেননি । তিনি অ্যালিয়োশার কাজকারবারের  মাধ্যমে  স্বাধীন-ইচ্ছার কূটাভাসের জবাব দিয়েছেন । তত্ত্ব থেকে অনুশীলনে গেছেন।  দস্তয়েভস্কি  দেখিয়েছেন প্রেমের আকাঙ্খা, যা কিচ্ছু করে না এবং কেবল আত্মসমর্পণ করে, তার সঙ্গে সক্রিয় প্রেম যা বাঁচিয়ে তোলে,  তার পার্থক্য আছে । 
    যদিও দস্তয়েভস্কি খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে নিজের সন্দেহগুলো যাচাই করতে-করতে এগিয়েছেন, তাঁর দ্বন্দ্বকে কিন্তু  বিশ্লেষণ করেছেন চরিত্রগুলোর মাধ্যমে । শেষ পর্যন্ত  এটা স্পষ্ট হয় যে তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঈশ্বরের উপস্থিতির  প্রত্যয়ের মধ্যে নিহিত। তাঁর উপন্যাসের সমাপ্তির সময়  চরিত্রগুলোকে এমনভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন যে বোঝা যায়,  ‘‘ভালো’’ বা পছন্দসই চরিত্রগুলোকে তিনি ঈশ্বরের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, যখন কিনা  "মন্দ" ব্যক্তিরা সর্বশক্তিমানের বিরোধিতা করে। ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ উপন্যাসের শেষান্তে আমরা দেখি  অ্যালিয়োশা, মিতিয়া এবং কোলিয়া সকলেই বিশ্বাসী হিসাবে উপস্হাপিত, আর তাদের সকলের প্রতিই পাঠক সমবেদনা বোধ করেন । কিন্তু ধূর্ত এবং ক্ষতিকর স্মারদিয়াকভ আত্মহত্যা করে, যা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে  সবচেয়ে ধর্মদ্রোহী বিদ্রোহ। ‘ডেভিল’ উপন্যাসে  কিরিলভ এবং নিকোলাই আত্মহত্যা করে, আর তারা রচনাটির  সবচেয়ে নিন্দনীয় চরিত্র। দস্তয়েভস্কি  সাধারণত তাঁর নায়কদের ঈশ্বরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হিসাবে উপস্হাপন করেন, কিন্তু খলনায়কদের উপস্হাপন করেন নাস্তিক হিসেবে । পাঠক কী নির্ণয় নেবেন তা তাঁদের হাতেই ছেড়ে দেন ।
    এছাড়াও তাঁর উপন্যাসগুলোতে খ্রিস্টান পাঠকদের জন্য পাতা আছে কিছু ছোটখাট ফাঁদ, যা দস্তয়েভস্কির মনোভাব ও বিশ্বাসকে মেলে ধরে । যেমন সুপারম্যান তত্ত্ব, অন্যায় খ্রিস্টানদের নমুনা, অর্থোডক্স চার্চের বাড়াবাড়ি, পাপের জয় এবং  "আলোর" প্রতি চরম ও প্রকৃত আত্মসমর্পণ। ১৮৭৮ সালে এন. এল. ওজিমভকে  একটি চিঠিতে দস্তয়েভস্কি লিখেছিলেন: "এখন ধরে নিন ঈশ্বর বলে কিছু নেই কিংবা আত্মার অমরত্ব নেই। এখন আমাকে বলুন, যদি আমি নিছক পৃথিবীতেই মারা যাই, তাহলে আমি কেন (যতোদিন না আইন আমাকে ধরে ফেলছে,  নিজের চাতুর্য আর তৎপরতায় ) সৎভাবে জীবন যাপন করব এবং ভাল কাজ করব?  অন্য একজনের গলা কাটবো না, ছিনতাই করব না, আর চুরি করব না?” 
    এই সুপারম্যান তত্ত্ব, প্রাথমিকভাবে ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এ রাসকোলনিকভে প্রতিষ্ঠিত, ঈশ্বরের অস্তিত্বে প্রকাশ করা সন্দেহের ফল, যার জন্য রয়েছে প্রচুর গর্ববোধ । তত্ত্বটি  রাসকোলনিকভকে বিনা প্ররোচনায় দুই নারী এবং  একটি সম্ভাব্য অনাগত শিশুকে হত্যা করার অনুমতি দেয়। উচ্চতর সত্তা হিসাবে, সে তাদের জীবন নিতে পারে, যাদের জগতে দরকার নেই, যারা না থাকলেও চলে । একই যুক্তি ব্যবহার করে কিরিলভ ঈশ্বরের কাছে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, আর নিজের জীবন শেষ করে ফেলার প্রস্তুতিতে বলে যে , "যদি ঈশ্বর থাকেন, তাহলে সবকিছুই তাঁর ইচ্ছা, এবং আমি তাঁর ইচ্ছা ছাড়া নিজে থেকে কিছুই করতে পারি না। যদি ঈশ্বর না থাকেন , তাহলে সবকিছু আমার ইচ্ছা, এবং আমি আমার ইচ্ছা প্রকাশ করতে বাধ্য। " এই আশ্চর্যজনক অহংকার কিরিলভের যিশুখ্রিস্টে অবিশ্বাস  থেকে উদ্ভূত, তার বদলে কিরিলভের রয়েছে নিজের প্রতি অটুট বিশ্বাস  :
    “আপনি যদি নিজেকে গুলি করেন, তাহলে আপনি ঈশ্বর হয়ে যাবেন, তাই না? 
    "হ্যাঁ, আমি ঈশ্বর হয়ে যাবো।" 
    এই তত্ত্বটি অবশ্য দস্তয়েভস্কি তাঁর প্লটের  বিকাশে নিজেই খণ্ডন করেছেন। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর রাসকলনিকভ নিজের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না । যদিও তার বিকৃত তর্ক তার জঘন্য কাজের জন্য একটা যুক্তি খাড়া করতে চেয়েছে , কিন্তু তার কোন কাজ ভুল  আর কোন কাজ ঠিক, সেগুলোর মানদণ্ডের অনুভূতি মুছে ফেলতে রাসকলনিকভ অক্ষম। প্রথম-প্রথম সে গতানুগতিকভাবে জীবন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, নিজের চতুর কৌশল উপভোগ করে এবং এই  উপসংহারে পৌঁছোয়  যে, সে একজন সুপারম্যান। তা সত্বেও, নম্রস্বভাবের সোনিয়া যখন রাসকোলনিকভের বোধবুদ্ধিকে কাটাছেঁড়া করে, আর তাকে তার আত্মার নিম্নতম স্তরে নিয়ে যায়, তখন সে স্বীকার করে যে সে দোষী, সে অপরাধ করেছে এবং খারাপ কাজ করেছে এবং তার ক্ষমা দরকার। দস্তয়েভস্কি সুপারম্যান তত্ত্বটি খারিজ করে দেন সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলোয় মানসিক যন্ত্রণা সৃষ্টি করে,  যতক্ষণ না তারা খ্রিস্টধর্মের সত্য এবং আলোকে স্বীকৃতি দেয় ততোক্ষণ তারা যাতনায় ভোগে। 
    দস্তয়েভস্কির রচনায় প্রস্তাবিত আরেকটি ধারণা, যা ঈশ্বরে বিশ্বাসকে দুর্বল করে দিতে পারে তা হলো অসাধু খ্রিস্টানদের উদাহরণ। পাঠবস্তুতে এমন ব্যাপার পুরে দিয়েছেন তিনি, যেগুলো বিশ্বাসের ভিত্তিকে নড়িয়ে দিতে পারে । যেমন, অ্যাদেলায়াদা ইভানোভনা, "স্বামী ফিয়োদর পাভলোভিচের হাতে তিন বছরের শিশু মিত্যাকে ছেড়ে বাড়ি থেকে পালালো  গরিব একজন চার্চ-ছাত্রের সঙ্গে ।" তক্ষুনি প্রশ্ন ওঠে, এ কেমনতর, যে, খ্রিস্টধর্মের ছাত্র পালিয়ে যায় অন্যের স্ত্রীর সাথে, যে কিনা এক শিশুর মা ! লক্ষনীয় যে স্বামীর নাম ফিয়োদর । এই অসঙ্গতিকে   দস্তয়েভস্কি ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ উপন্যাসে আরও স্পষ্ট করেছেন  রাকিতিন চরিত্রটির বিকাশের মাধ্যমে । রাকিতিন, একজন সন্ন্যাসী হয়েও উপন্যাসের  নাস্তিক চরিত্রদের তুলনায় ঈশ্বরের বিরুদ্ধে আরো তীব্রভাবে কাজ করে । অ্যালিয়োশার সবচেয়ে দুঃখের সময়ে, যখন তার বড়ো ভাই সদ্য  মারা গেছে, রাকিতিন অ্যালিয়োশাকে  খাবার-দাবার, মদ আর গ্রুশেঙ্কাকে এগিয়ে দিয়ে লোভ দেখায় । তাছাড়া, রাকিতিন ক্রমাগত ঝামেলা আর পরচর্চায় জড়িয়ে পড়ে, শেকসপিয়ারের ইয়াগোর ছোটো নমুনা যেন । বজ্জাত আর নকল  খ্রিস্টানরা সম্ভবত দস্তয়েভস্কির মানসিক যাতনা । দস্তয়েভস্কি যেন নোংরা চরিত্রগুলোকে সৃষ্টিই করেন যাতে উপন্যাসে তাদের আলোচনা করে মুখ বন্ধ করে দেয়া যায় । 
    দস্তয়েভস্কির কাছে এই ধরনের সমস্যা তথাকথিত ধার্মিক লোকেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং খবরদারি সংস্হা হিসেবে চার্চের  (বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক চার্চ)  বাড়াবাড়ি পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে । দস্তয়েভস্কি ক্রমাগত সমালোচনা করেছেন  যাজকদের আরামদায়ক জীবনধারা আর উৎসবের মতন ব্যাপারের প্রতি তাদের তড়িঘড়ি অনুমোদনকে ।  ফিয়োদর পাভলোভিচ,  ফাদার সুপিরিয়রের খাবারের সময়ে ঢুকে পড়ে বিরাট তর্ক আরম্ভ করে , সংস্থার সমগ্র সংগঠনকে নিন্দা করে । বলে,  হে যাজকমশায়,  আপনি সমাজে নিজের সততা প্রমাণের চেষ্টা করেন,  সমাজে ভাল কাজ করার প্রদর্শন করেন, অন্যান্য লোকের খরচে একটা মঠে খাসা থাকেন, জানি, এর জন্য কোনো পুরষ্কারের আশা করেন না--অথচ আপনি সেই খাটুনিকে একটু কঠিন মনে করেন। ওই বোতলগুলো দেখুন যেগুলো চার্চের পাদ্রিরা এনে দিয়েছেন আর কারা কাকে এই সব দিয়েছে ? রাশিয়ার গরিব চাষিরা খেতমজুররা। একবার যদি দস্তয়েভস্কি কোনও চরিত্রের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম-কথিত সত্যের জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করেন, তাহলে পরবর্তী সমস্যা দেখা দেয় ঈশ্বরকে নিয়ে --- সেই সত্যকে দৃঢ় করা এবং তাকে  বজায় রাখার সমস্যা । 
    পরিশেষে, দস্তয়ভস্কি দ্বারা প্রস্তাবিত ঈশ্বর সম্পর্কিত  সমস্যা হল পাপ করার ক্রমাগত তাগিদ আর অমন কাজে জড়িয়ে পড়ার লোভ ।  মিত্যা স্বীকার করে, "যদিও আমি শয়তানকে অনুসরণ করছি, আমি তোমার পুত্র, হে প্রভু।"  এখানে, এই দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখার মধ্যে রয়েছে ভুল পথে এগোনো, যে, ঈশ্বরই হলেন পিতা, যাঁর প্রতি আমাদের অনুগত হওয়া উচিত, যদিও আমরা বারবার ভুল করতে পারি। 
    যদিও দস্তয়েভস্কির লেখায় স্পষ্টভাবে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং সেই বিশ্বাসকে বজায় রাখার মানসিক লড়াইয়ের সাথে মোকাবিলা করে, তার চূড়ান্ত উপসংহার প্রশ্নাতীত -- তা হলো এই যে, যদিও মানুষ হিসাবে আমরা ঈশ্বরবিশ্বাসকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারি, এমনকী অনুমিত অসঙ্গতিগুলি আমাদের আলোড়িত করতে পারে , বিশ্বাসী হিসাবে তাঁর কৃপায় আমাদের তুচ্ছ অজ্ঞতা সত্বেও আমরা তা করি  । ‘দ্য ব্রাদার্জ কারমাজভ শেষ হয়  যিশুর পুনরুত্থান সম্পর্কে তার সহপাঠীদের আশায় । খ্রিষ্টের পুনরুত্থানে বিশ্বাসের একটি উপযুক্ত পৃষ্ঠভূমি এখানে উপস্হাপন করেন দস্তয়ভস্কি।  অনেকসময়ে দেখা গেছে,  বিতর্কের যে উদ্ভাসগুলো দস্তয়েভস্কি আলোচনা করছেন, তিনি যেন নিজেই ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন। দস্তয়ভস্কির পাঠক এবং তাঁর বিতর্কের সাক্ষী হিসাবে খ্রিস্টানরা ‘দি ইনকুইজিটরের’ মতো যুক্তি খাড়া করতে পারছেন, এবং যুক্তি দিয়ে বিশ্বাসের কাছাকাছি হতে পারছেন । যাইহোক, দস্তোয়েভস্কির অভিপ্রায়কে বুঝে ওঠার জন্য, পাঠককে মনে রাখতে হবে তিনি যিশুর মহিমান্বয়ন করেছেন অবিরাম । 

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c96:236b:b979:e774:8760:5c66 | ১৮ আগস্ট ২০২৩ ১৮:১১740615
  • হাংরি ও পরাবাস্তববাদের অবনিবনার অহেতুক চর্চা
    মলয় রায়চৌধুরী

    এক
    হাংরি আন্দোলনকারীদের অবনিবনা নিয়ে যতো খিল্লি হয় তা কিন্তু পরাবাস্তববাদীদের মাঝে অবনিবনা নিয়ে হয় না । অথচ পরাবাস্তববাদীদের পরস্পরের ঝগড়া কতোজনের সঙ্গে যে প্রত্যেকের হয়েছিল তার কোনও হিসেব নেই । ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে চে গ্বেভারার অবনিবনা চেপে গিয়ে পালা করে ওই দুজনের টি শার্ট পরে ঘুরে বেড়ান বাঙালি ছোকরা লেখক-কবি। অথচ হাংরি আন্দোলনের আলোচনা শুরু করলেই সবাই  তাঁদের পারস্পরিক অবনিবনা চর্চা করেন ; লেখালিখি বিশ্লেষণের কথা চিন্তা করেন না বা করতে চান না, বিশেষ করে বাঙালি আলোচকরা । নন্দিনী ধর হাংরি আন্দোলন আলোচনা করতে বসে দুম করে লিখে দিলেন যে আমার সংকলিত বই থেকে শৈলেশ্বর ঘোষকে বাদ দিয়েছি ; অথচ আমি হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনার কোনো সংকলন প্রকাশ করিনি । নন্দিনী ধর লিখেছেন যে হাংরি আন্দোলনকারীরা নিজেদের ছোটোলোক ঘোষণা করে বিবিক্ততাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন ; উনি জানতেন না যে আমি পাটনায় ইমলিতলা নামে এক অন্ত্যজ অধ্যুষিত বস্তিতে থাকতুম, অবনী ধর ছিলেন জাহাজের খালাসি আর পরে ঠেলাগাড়িতে করে কয়লা বেচতেন, শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ এসেছিলেন উদ্বাস্তু পরিবার থেকে, দেবী রায় চায়ের ঠেকে চা বিলি করতেন । এ-থেকে টের পাওয়া যায় যে আলোচকরা কোনও বই পড়ার আগেই ভেবে নেন যে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনা আলোচনার সময়ে কী লিখবেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের বিশ্ববীক্ষার তর্ক-বিতর্ক ও লেখালিখি বাদে দিয়ে আলোচকরা ব্যক্তিগত সম্পর্ককে গুরুত্ব দেন ।
    অন্য বাঙালি লেখকদের ক্ষেত্রে কিন্তু তাঁরা এমন অডিটরসূলভ বিশ্লেষণ করতে বসেন না । বিদেশি সাহিত্যিকদের মাঝে নিজেদের বিশ্ববীক্ষার সমর্থনে পারস্পরিক বিবাদ-বিতর্কের কথা যেমন শোনা যায় তেমনটা বাঙালি লেখকদের ক্ষেত্রে বড়ো একটা দেখা যায় না । আমরা পড়েছি গোর ভিডাল আর নরম্যান মেইলারের বিবাদ এমনকি হাতাহাতি, সালমান রুশডি - জন আপডাইক বিবাদ, হেনরি জেমস - এইচ জি ওয়েল্স বিবাদ, জোসেফ কনরাড - ডি এইচ লরেন্স বিবাদ, জন কিটস - লর্ড বায়রন বিবাদ, চার্লস ডিকেন্স - হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যাণ্ডারসন বিবাদ ইত্যাদি । আলোচকরা কিন্তু তাঁদের রচনাবলী বিশ্লেষণের সময়ে সৃজনশীল কাজকেই গুরুত্ব দেন, বিবাদকে নয় ।        
      
    বাঙালি সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, মনে করেন মানুষ ও প্রাণীরা এসেছে অন্য গ্রহ থেকে, অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য । ওই একই দপতরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর পাশের কেবিনেই বসতেন ,যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না, ডারউইনের তত্বে বিশ্বাস করতেন, বামপন্হী ছিলেন । অথচ পরপস্পরের লেখা আলোচনার সময়ে এই বিষয়গুলো ওনাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেত, যেন সাহিত্য আলোচনায় লেখকের বিশ্ববীক্ষার কোনো প্রভাব থাকে না । অধিকাংশ বাঙালি সাহিত্যিক এই ধরণের ভাই-ভাই ক্লাবের সদস্য । এদিকে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনা আলোচনা করতে বসে তাদের ব্যক্তিগত অবনিবনায় জোর দেন ।         
    এই তো সেদিন ক্লিন্টন বি সিলির জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্হ ‘এ পোয়েট অ্যাপার্ট, পড়ার সময়ে হাংরি আন্দোলনকারীরা খালাসিটোলায় জীবনানন্দের যে জন্মদিন পালন করেছিল, তার বর্ণনা পড়ছিলুম । উনি ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ তারিখে প্রকাশিত সংবাদ তুলে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মে জীবনানন্দের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন । একই খবর প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায় । সেদিন সন্ধ্যায় জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন পালনের জন্য  টেবিলে উঠে পড়লেন হাংরি আন্দোলনের গল্পকার অবনী ধর আর নাচের সঙ্গে গাইতে লাগলেন একটা গান, যা তিনি জাহাজে খালসির কাজ করার সময়ে গাইতেন, বিদেশি খালাসিদের সঙ্গে । উপস্হিত সবাই, এমনকি হাংরি আন্দোলনের কয়েকজন ভেবেছিলেন গানটা আবোল-তাবোল, কেননা ইংরেজিতে তো এমনতর শব্দ তাঁদের জানা ছিল না । যে সাংবাদিকরা খবর কভার করতে এসেছিলেন তাঁরাও গানটাকে ভেবেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের বজ্জাতি, প্রচার পাবার ধান্দা ।  ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ শিরোনামে ঠাট্টা করে দুই পাতা চুটকি লেখা হয়েছিল, অবনী ধরের কার্টুনের সঙ্গে ।  ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ তকমাটি যিনি ব্যবহার করেছিলেন তিনি জানতেন না যে এই শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন গারট্রুড স্টিন এবং বিশ শতকের বিশের দশকে প্যারিসে আশ্রয় নেয়া আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, টি. এস. এলিয়ট, জন ডস প্যাসস, ই ই কামিংস, আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ, হার্ট ক্রেন প্রমুখকে বলা হয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’-এর সদস্য । অবনী ধর-এর নামের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন । যাঁরা তাঁর নাম শোনেননি এবং ওনার একমাত্র বই ‘ওয়ান শট’ পড়েননি, তাঁদের জানাই যে ছোটোগল্পের সংজ্ঞাকে মান্যতা দিলে বলতে হয় যে অবনী ধর ছিলেন হাংরি আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ ছোটো গল্পকার । 
    গানটা এরকম, মোৎসার্টের একটা বিশেষ সুরে গাওয়া হয়:
    জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,
    জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।
    জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,
    জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।
    হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা উউউউউহ,
    হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা, উহ
    শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি ।
    উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ । 
    ১৯২০ সালে,, প্রথম বিশ্ব স্কাউট জাম্বোরির জন্য, রবার্ট ব্যাডেন-পাওয়েল, প্রথম বারন ব্যাডেন-পাওয়েল (স্কাউটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা) সিদ্ধান্ত নেন যে একটা মজার গান পেলে ভালো হয়, যা সব দেশের স্কাউটরা গাইতে পারবে ; কারোরই কঠিন মনে হবে না । উনি মোৎসার্টের  এক নম্বর সিম্ফনির ইবি মেজরে বাঁধা সুরটি ধার করেছিলেন । গানটা স্কাউটদের মধ্যে তো বটেই সাধারণ স্কুল ছাত্রদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়েছিল । এই স্কাউটদের কেউ-কেউ জাহাজে চাকরি নিয়ে খালাসি এবং অন্যান্য কর্মীদের মধ্যে এটাকে ছড়িয়ে দিতে সফল হন । অবনী ধর বেশ কিছুকাল জাহাজে খালাসির কাজ করেছিলেন এবং তাঁরও ভালো লেগে যায় সমবেতভাবে গাওয়া গানটি । শতভিষা, কৃত্তিবাস, কবিতা, ধ্রুপদি  পত্রিকার কর্নধারদের প্রিয় সঙ্গীত-জগত  থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া এই গান সেসময়ে নিতে পারেননি সাংবাদিক আর বিদ্যায়তনিক আলোচকরা, তার ওপর যেহেতু হাংরি আন্দোলনের ব্যাপার, তাই তাঁরা এটাকে অশিক্ষিত নেশাখোর-মাতালদের কারবার ভেবে হেঁ-হেঁ করে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ।

    দুই
    উত্তরবঙ্গে হাংরি জেনারেশনের প্রসার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, হাংরি পত্রিকা ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ এর সম্পাদক অলোক গোস্বামী এই কথাগুলো লিখেছিলেন, তা থেকে অবনিবনার যৎসামান্য আইডিয়া হবে, আর এই অবনিবনার সঙ্গে পরাবাস্তববাদীদের নিজেদের অবনিবনারে যথেষ্ট মিল আছে :-
    “নব্বুই দশকে সদ্য প্রকাশিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বগলে নিয়ে এক ঠা ঠা দুপুরে আমি হাজির হয়েছিলাম শৈলেশ্বরের বাড়ির গেটে। একা। ইচ্ছে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে মুখোমুখি বসে যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবো। যেহেতু স্মরণে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি তাই আস্থা ছিল শৈলেশ্বরের প্রজ্ঞা,ব্যক্তিত্ব,যুক্তিবোধ তথা ভদ্রতাবোধের ওপর। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শৈলেশ্বর আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন এবং যৌথ আলোচনাই পারবে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নতুন উদ্যমে একসাথে পথ চলা শুরু করতে। কিন্তু দুভার্গ্য বশতঃ তেমন কিছু ঘটলো না। বেল বাজাতেই গেটের ওপারে শৈলেশ্বর। আমাকে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন।
    --কী চাই!
    মিনমিন করে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলবো।
    --কে আপনি?
    এক এবং দুই নম্বর প্রশ্নের ভুল অবস্থান দেখে হাসি পাওয়া সত্বেও চেপে গিয়ে নাম বললাম।
    --কি কথা?
    --গেটটা না খুললে কথা বলি কিভাবে!
    --কোনো কথার প্রয়োজন নেই। চলে যান।
    --এভাবে কথা বলছেন কেন?
    --যা বলছি ঠিক বলছি। যান। নাহলে কিন্তু প্রতিবেশীদের ডাকতে বাধ্য হবো।
    এরপর স্বাভাবিক কারণেই খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম কারণ আমার চেহারাটা যেরকম তাতে শৈলেশ্বর যদি একবার ডাকাত, ডাকাত বলে চেঁচিয়ে ওঠেন তাহলে হয়ত জান নিয়ে ফেরার সুযোগ পাবো না। তবে 'ছেলেধরা' বলে চেল্লালে ভয় পেতাম না। সমকামিতার দোষ না থাকায় নির্ঘাত রুখে দাঁড়াতাম।
    ভয় পাচ্ছি অথচ চলেও যেতে পারছি না। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে আরও খানিকটা জানা বোঝা জরুরি।
    --ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। তবে পত্রিকার নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে সেটা রাখুন।
    এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন শৈলেশ্বর।
    --কোন পত্রিকা?
    --কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।
    --নেব না। যান।
    এরপর আর দাঁড়াইনি। দাঁড়ানোর প্রয়োজনও ছিল না। ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি ব্যক্তি শৈলেশ্বর ঘোষকে চিনতে ভুল হয়নি আমাদের। আর এই সমঝদারি এতটাই তৃপ্তি দিয়েছিল যে অপমানবোধ স্পর্শ করারই সুযোগ পায়নি।”
    পরাবাস্তববাদীদের  মতনই, শৈলেশ্বর ঘোষের হয়তো মনে হয়েছিল যে কলকাতায় তিনি হাংরি আন্দোলনের যে কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাইছেন তাতে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করা হচ্ছে । তাঁর আচরণ ছিল হুবহু আঁদ্রে ব্রেতঁর মতন । পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে আঁদ্রে ব্রেতঁর সঙ্গে অনেকের সম্পর্ক ভালো ছিল না, দল বহুবার ভাগাভাগি হয়েছিল, অথচ সেসব নিয়ে বাঙালি আলোচকরা তেমন উৎসাহিত নন, যতোটা হাংরি আন্দোলনের দল-ভাগাভাগি নিয়ে। ইংরেজিতে মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী হাংরি আন্দোলন নিয়ে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে একটি বই লিখেছেন, পেঙ্গুইন র‌্যাণ্ডাম হাউস থেকে প্রকাশিত । সেই বইটি বাংলা পত্রপত্রিকায় আলোচিত হল না । 
    তিন
    আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৬ জুন ২০১৩ তারিখে গৌতম চক্রবর্তী হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছিলেন ; তাতেও রয়েছে টিটকিরি, যা তিনি পরাবাস্তববাদীদের সম্পর্কে কখনও বলেছেন কিনা জানি না । উনি লিখেছিলেন :
    “মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র ও বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে। কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়।... এখন কবিতা রচিত হয় অর্গ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে।
    ১৯৬২ সালে এই ভাষাতেই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস থেকে খালাসিটোলা, বারদুয়ারি অবধি সর্বত্র গোপন বিপ্লবী আন্দোলনের ব্লু প্রিন্টের মতো ছড়িয়ে পড়ে একটি ম্যানিফেস্টো। ২৬৯ নেতাজি সুভাষ রোড, হাওড়া থেকে প্রকাশিত এই ম্যানিফেস্টোর ওপরে লেখা ‘হাংরি জেনারেশন’। নীচের লাইনে তিনটি নাম। ‘স্রষ্টা: মলয় রায়চৌধুরী। নেতৃত্ব: শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদনা: দেবী রায়।’
    তখনও কলেজ স্ট্রিটের বাতাসে আসেনি বারুদের গন্ধ, দেওয়ালে লেখা হয়নি ‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’। কিন্তু পঞ্চাশ পেরিয়ে-যাওয়া এই ম্যানিফেস্টোর গুরুত্ব অন্যত্র। এর আগে ‘ভারতী’, ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ অনেক কবিতার কাগজ ছিল, সেগুলি ঘিরে কবিরা সংঘবদ্ধও হতেন। কিন্তু এই ভাবে সাইক্লোস্টাইল-করা ম্যানিফেস্টো আগে কখনও ছড়ায়নি বাংলা কবিতা।
    ওটি হাংরি আন্দোলনের দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টো। প্রথম ম্যানিফেস্টোটি বেরিয়েছিল তার কয়েক মাস আগে, ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে। ইংরেজিতে লেখা সেই ম্যানিফেস্টো জানায়, কবিতা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় না, বিভ্রমের বাগানে পুনরায় বৃক্ষরোপণ করে না। ‘Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of bamboozled gardens.’ বিশ্বায়নের ঢের আগে ইংরেজি ভাষাতেই প্রথম ম্যানিফেস্টো লিখেছিলেন হাংরি কবিরা। কারণ, পটনার বাসিন্দা মলয় রায়চৌধুরী ম্যানিফেস্টোটি লিখেছিলেন। পটনায় বাংলা ছাপাখানা ছিল না, ফলে ইংরেজি।
    দুটি ম্যানিফেস্টোতেই শেষ হল না ইতিহাস। হাংরি আসলে সেই আন্দোলন, যার কোনও কেন্দ্র নেই। ফলে শহরে, মফস্সলে যে কোনও কবিই বের করতে পারেন তাঁর বুলেটিন। ১৯৬৮ সালে শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁর ‘মুক্ত কবিতার ইসতাহার’-এ ছাপিয়ে দিলেন ‘সমস্ত ভন্ডামির চেহারা মেলে ধরা’, ‘শিল্প নামক তথাকথিত ভূষিমালে বিশ্বাস না করা’, ‘প্রতিষ্ঠানকে ঘৃণা করা’, ‘সভ্যতার নোনা পলেস্তারা মুখ থেকে তুলে ফেলা’ ইত্যাদি ২৮টি প্রতিজ্ঞা। পরে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া বাধবে। মলয় ব্যাংকের চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাবেন। শৈলেশ্বর, সুবো আচার্য এবং প্রদীপ চৌধুরীরা বলবেন, ‘মলয় বুর্জোয়া সুখ ও সিকিয়োরিটির লোভে আন্দোলন ছেড়ে চলে গিয়েছে।’কী রকম লিখতেন হাংরিরা? বছর দুয়েক আগে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিতে গৌতম ঘোষের চরিত্রটি লেখা হয়েছিল হাংরি কবিদের আদলে।
    ‘জেগে ওঠে পুরুষাঙ্গ নেশার জন্য হাড় মাস রক্ত ঘিলু শুরু করে কান্নাকাটি
    মনের বৃন্দাবনে পাড়াতুতো দিদি বোন বউদিদের সঙ্গে শুরু হয় পরকীয়া প্রেম’,
    লিখেছিলেন অকালপ্রয়াত ফালগুনী রায়। র‌্যাঁবো, উইলিয়াম বারোজ এবং হেনরি মিলারের উদাহরণ বারে বারেই টেনেছেন হাংরিরা। ঘটনা, এঁরা যত না ভাল কবিতা লিখেছেন, তার চেয়েও বেশি ঝগড়া করেছেন। এবং তার চেয়েও বেশি বার গাঁজা, এলএসডি, মেস্কালিন আর অ্যাম্ফিটোমাইন ট্রিপে গিয়েছেন।
    অতএব, সাররিয়ালিজ্ম বা অন্য শিল্প আন্দোলনের মতো বাঙালি কবিদের ম্যানিফেস্টোটি কোনও দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। কিন্তু ‘হাংরি’রা আজও মিথ। এক সময় ‘মুখোশ খুলে ফেলুন’ বলে তৎকালীন মন্ত্রী, আমলা, সম্পাদকদের বাড়িতে ডাকযোগে তাঁরা মুখোশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবার এক সময় ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি লেখার জন্য অশ্লীলতার মামলা হল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে। উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাকের বিরুদ্ধে জারি হল গ্রেফতারি পরোয়ানা।
    রাষ্ট্র ও আদালত কী ভাবে কবিতাকে দেখে, সেই প্রতর্কে ঢুকতে হলে ১৯৬৫ সালে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলাটি সম্পর্কে জানা জরুরি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কাঠগড়ায় উঠেছেন মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে। পাবলিক প্রসিকিউটরের জিজ্ঞাসা, ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে?
    শক্তি: ভাল লাগেনি।
    প্রসিকিউটর: অবসিন কি? ভাল লাগেনি বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
    শক্তি: ভাল লাগেনি মানে জাস্ট ভাল লাগেনি। কোনও কবিতা পড়তে ভাল লাগে, আবার কোনওটা ভাল লাগে না।
    শক্তি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন মলয়ের বিরুদ্ধে। কয়েক মাস পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয়ের সমর্থনে...
    প্রসিকিউটর: কবিতাটা কি অশ্লীল মনে হচ্ছে?
    সুনীল: কই, না তো। আমার তো বেশ ভাল লাগছে। বেশ ভাল লিখেছে।
    প্রসিকিউটর: আপনার শরীরে বা মনে খারাপ কিছু ঘটছে?
    সুনীল: না, তা কেন হবে? কবিতা পড়লে সে সব কিছু হয় না।
    একই মামলায় শক্তি ও সুনীল পরস্পরের বিরুদ্ধে। তার চেয়েও বড় কথা, ’৬৫ সালে এই সাক্ষ্য দেওয়ার আগের বছরই সুনীল আইওয়া থেকে মলয়কে বেশ কড়া একটি চিঠি দিয়েছিলেন, ‘লেখার বদলে আন্দোলন ও হাঙ্গামা করার দিকেই তোমার ঝোঁক বেশি। রাত্রে তোমার ঘুম হয় তো? মনে হয়, খুব একটা শর্টকাট খ্যাতি পাবার লোভ তোমার।’ ব্যক্তিগত চিঠিতে অনুজপ্রতিম মলয়কে ধমকাচ্ছেন, কিন্তু আদালতে তাঁর পাশে গিয়েই দাঁড়াচ্ছেন। সম্ভবত, বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে অনুজ কবিদের কাছে সুনীলের ‘সুনীলদা’ হয়ে ওঠা হাংরি মামলা থেকেই। প্রবাদপ্রতিম কৃত্তিবাসী বন্ধুত্বের নীচে যে কত চোরাবালি ছিল, তা বোঝা যায় উৎপলকুমার বসুকে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটি চিঠি থেকে, ‘প্রিয় উৎপল, একদিন আসুন।...আপনি তো আর শক্তির মতো ধান্দায় ঘোরেন না।’
    তা হলে কি হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে প্রভাবহীন, শুধুই কেচ্ছাদার জমজমাট এক পাদটীকা? দুটি কথা। হাংরিদের প্রভাবেই কবিতা-সংক্রান্ত লিট্ল ম্যাগগুলির ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ গোছের নাম বদলে যায়। আসে ‘ক্ষুধার্ত’, ‘জেব্রা’, ‘ফুঃ’-এর মতো কাগজ। সেখানে কবিতায় বাঁকাচোরা ইটালিক্স, মোটাদাগের বোল্ড ইত্যাদি হরেক রকমের টাইপোগ্রাফি ব্যবহৃত হত। পরবর্তী কালে সুবিমল মিশ্রের মতো অনেকেই নিজেকে হাংরি বলবেন না, বলবেন ‘শুধুই ছোট কাগজের লেখক’। কিন্তু তাঁদের গল্প, উপন্যাসেও আসবে সেই টাইপোগ্রাফিক বিভিন্নতা। তৈরি হবে শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন। হাংরিরা না এলে কি নব্বইয়ের দশকেও হানা দিতেন পুরন্দর ভাট?
    আসলে, ম্যানিফেস্টোর মধ্যেই ছিল মৃত্যুঘণ্টা। ’৬২ সালে হাংরিদের প্রথম বাংলা ম্যানিফেস্টোর শেষ লাইন, ‘কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা ও ঈশ্বরীর মতো অনুষ্মেষিণী।’ হাংরিরা নিজেদের যত না সাহিত্যবিপ্লবী মনে করেছেন, তার চেয়েও বেশি যৌনবিপ্লবী।”
    চার
    গৌতম চক্রবর্তী বহু বিদেশি নাম বাদ দিয়ে দিয়েছেন ; সম্ভবত তিনিও লেখার আগেই হাংরি আন্দোলনকারীদের ব্যঙ্গ করবেন বলে ঠিক করে ফেলেছিলেন । হাংরি আন্দোলনকারীরা জানতো যে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স তিনি মর্গে যেতে ভালোবাসতেন; সেখানে দিনের একটা সময় কাটাতেন।  মর্গে যাওয়া ছাড়াও চার্লস ডিকেন্সের ছিল আফিমে আসক্তি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতন।  আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছিল মদের প্রতি আসক্তি, কমলকুমার মজুমদারের মতন। মদের ভালোবাসা থেকে তিনি লিখেছেন- যখন আপনি মাতাল, তখন আপনি অনেক বেশি ভদ্র । এটা আপনার মুখ বন্ধ রাখতে সাহায্য করবে। আমেরিকান রোমান্টিক মুভমেন্টের প্রধান ব্যক্তি, অ্যাডগার অ্যালান পো ছিলেন মাদকাসক্ত। হেমিংওয়ের মতো তিনিও দুঃখ-কাতরতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য মদ পান শুরু করেন।  ব্রিটিশ কবি, রোমান্টিক মুভমেন্টের অন্যতম প্রবক্তা, কুবলা খান ও দ্য রাইম অব দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার এর কবি স্যমুয়েল টেইলর কোলরিজে  আফিমে আসক্ত ছিলেন। সেই সময় তিনি আফিমখোর হিসেবে ব্রিটেনে পরিচিত ছিলেন এবং এটা নিয়ে তিনি গর্বও বোধ করতেন। তিনি বলেছেন, কুবলা খান লিখতে গিয়ে আফিমের ঘোর তাঁকে সাহায্য করেছিল। ট্রেজার আইল্যান্ড, দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডা. জ্যাকেল অ্যান্ড মি. হাইড-এর স্রষ্টা  স্কটিশ সাহিত্যিক রবার্ট লুইস স্টিভেনসন ছিলেন কোকেনে আসক্ত। তার স্ত্রীর ভাষ্যমতে, তিনি কোকেন নিয়ে করে মাত্র ছয় দিনে  ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় ৬০ হাজার শব্দ লিখেছিলেন। এর মধ্যে দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডা. জ্যাকেল অ্যান্ড মি. হাইডও লিখেছেন।
    .

    তিন
    ১৯১৭ সালে গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার “সুররিয়ালিজম” অভিধাটি তৈরি করেছিলেন, যার অর্থ ছিল বাস্তবের অতীত। শব্দটি প্রায় লুফে নেন আঁদ্রে ব্রেতঁ, নতুন একটি আন্দোলন আরম্ভ করার পরিকল্পনা নিয়ে, যে আন্দোলনটি হবে পূর্ববর্তী ডাডাবাদী আন্দোলন থেকে ভিন্ন । ত্রিস্তঁ জারা উদ্ভাবিত ডাডা আন্দোলন থেকে সরে আসার কারণ হল ব্রেতঁ সহ্য করতে পারতেন না ত্রিস্তঁ জারাকে, কেননা কবি-শিল্পী মহলে প্রতিশীল্পের জনক হিসাবে ত্রিস্তঁ জারা খ্যাতি পাচ্ছিলেন। আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিজম তত্বটির একমাত্র ব্যাখ্যাকারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে আরম্ভ করেন। ১৯১৯ সালে ত্রিস্তঁ জারাকে কিন্তু ব্রেতঁ চিঠি লিখে প্যারিসে আসতে বলেছিলেন । একইভাবে ‘হাংরি’ শব্দটি মলয় রায়চৌধুরী পেয়েছিলেন কবি জিওফ্রে চসার থেকে । এই ‘হাংরি’ শব্দটি নেয়ার জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তেমন কিছুই করা হয়নি আঁদ্রে ব্রেতঁ ও ত্রিস্তঁ জারা সম্পর্কে । মলয় রায়চৌধুরী হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ঘোষণা করেন ১৯৬৫ সালের পয়লা নভেম্বর একটি লিফলেট প্রকাশের মাধ্যমে ।
    পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে, প্রথম থেকেই, আঁদ্রে ব্রেতঁ’র সঙ্গে অনেক পরাবাস্তববাদীর সদ্ভাব ছিল না, কিন্তু পরাবাস্তববাদ বিশ্লেষণের সময়ে আলোচকরা তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন না । আমরা যদি বাঙালি আলোচকদের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব যে তাঁরা হাংরি জেনারেশন বা ক্ষুধার্ত আন্দোলন বিশ্লেষণ করার সময়ে হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে অত্যধিক চিন্তিত, হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্য অবদান নিয়ে নয় । ব্যাপারটা বিস্ময়কর নয় । তার কারণ অধিকাংশ আলোচক হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের বইপত্র সহজে সংগ্রহ করতে পারেন না এবং দ্বিতীয়ত সাংবাদিক-আলোচকদের কুৎসাবিলাসী প্রবণতা । 
    আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁর বন্ধু পল এলুয়ার, বেনিয়ামিন পেরে, মান রে, জাক বারোঁ, রেনে ক্রেভালl, রোবের দেসনস, গিয়র্গে লিমবোর, রোজের ভিত্রাক, জোসেফ দেলতিল, লুই আরাগঁ ও ফিলিপে সুপোকে নিয়ে ১৯১৯ পরাবাস্তববাদ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন । কিছু
    দুই
    যাঁরা কবি ও লেখকদের পারস্পরিক অবনিবনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তাঁরা লেখক-প্রতিস্ব নির্মাণের ব্যাপারটা ভেবে দ্যাখেননি, বিশেষ করে সমাজটির আর্থসামাজিক পৃষ্ঠপটে ও পূর্বের সাহিত্যিক পঠন-পাঠনের প্রভাবে নির্মিত প্রতিস্ব ।
    প্রথম ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র ও প্রথম ছোটোগল্পকার পূর্নচন্দ্র থেকে হাল আমলের মফসসলের কথাসাহিত্যিক, প্রান্তিক ও শহুরে গল্পকার কিংবা মেট্রপলিটান ঔপন্যাসিক, তাঁদের লেখক প্রতিস্ব অবিনির্মাণ করলে প্রথম যে উপাদানটি পাওয়া যাবে, তা তাঁদের মাতৃভাষায় এবং অন্যান্য যে ভাষায় তাঁদের দখল আছে, সে ভাষায় পূর্ব প্রজন্মগুলোর সাহত্যিকদের লেখা গল্প-উপন্যাসের পঠন-পাঠনের জমা করা স্মৃতি । ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মাণে ভাষার অবদান অনস্বীকার্য, কিন্তু লেখক-প্রতিস্ব নির্মাণে ভাষাসাহিত্যের জ্ঞান তথা সাহিত্যের বিশেষ ঝোঁকের প্রতি লেখকের টান, তাঁর লেখনকর্মের আদল আদরা দিশা তাৎপর্য অন্তর্নিহিত-সম্পদ দাপট চৈতন্য অস্তিত্ব আত্ম-উন্মোচন এমনকী তাঁর সাহিত্য চক্রান্তক কলমটির গঠনকারী মূল উপাদান । তাঁদের লেখন-অভিজ্ঞতার মালিকানার বখরা কিন্তু তাঁদের পড়া পূর্বসূরী গল্পকার-ঔপন্যাসিক-দার্শনিকদের প্রাপ্য।
    আমি যে প্রতিস্ব-নির্মাণের কথা বলছি তা বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ বাঁকবদলের সময়কার । উল্লেখ্য যে ভারতবর্ষে পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ, বেতাল পঞ্চবিংশতি, কথাসরিৎসাগর, বৃহৎকথা, কথামঞ্জরী, দশকুমার চরিত, বাদবদত্তা ইত্যাদি গদ্যে রচিত কথাবস্তুর অতিপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে । ইংরেজরা আসার পর, এবং ফলে, বাংলা গদ্যসাহিত্য ও গদ্যে নানা ধরণের সংরূপের উদ্ভব জলবিভাজকের কাজ করেছিল ; আমি সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি । এক নতুন নন্দনক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল সাহিত্যের এলাকায়, যে এলাকায় লেখক নামের নির্মিত-প্রতিস্বের মানুষটির লেখনকর্মকে কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসেবে নৈতিকতা আর বৈধতা আরোপের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল । ফলে লেখনকর্ম বা পাঠবস্তুতে সতত কেন্দ্র দখল করে থাকলেন লেখ-সৃষ্টিকারী ব্যক্তিমালিকটি ।
    ইংরেজরা আসার পরই, আর বাংলা কথাসাহিত্যের শুরুতেই যে লেখকরা নির্মিত-প্রতিস্ব নিয়ে লেখন-পরিসরে নেমেছিলেন, তা কিন্তু নয়। লেখন পরিসরে ব্যক্তিনামের লালন, ব্যক্তি-আধিপত্যের ছাপ, ব্যক্তিপ্রসূত রচনাগত মৌলিকতা, ব্যক্তিসৃজনশীলতা ইত্যাদি প্রতর্কগুলো হিন্দু বাঙালির জীবনে প্রবেশ করতে পেরেছিল  সেই সময়কার কলকাতায় ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্তির মননবিশ্বটি পাকাপাকি ভাবে থিতু হয়ে বসার পর । ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ থেকে শিক্ষার বাহন হিসেবে ইংরেজি, তারপর ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষিত বাঙালির সমাজে ওই মননবিশ্ব প্রবেশ করতে পেরেছিল। বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে, লেখক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের মননবিশ্বটি ওই আদরায় নির্মিত হবার পর এবং ফলে, আর একই কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই পূর্ণচন্দ্র দ্বারা রচিত হলো, ১৮৭৩ সালে, প্রথম বাংলা ছোটোগল্প ‘মধুমতী’ । তার আগে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এবং ১৮৩১ সালে প্রকাশিত ‘নববাবুবিলাস’ আর ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পাঠবস্তুগুলোতে ওই মননবিশ্বের ছাপ ছিল না ।
    পূর্ণচন্দ্র তাঁর গল্পটিতে নামস্বাক্ষর করেননি । ‘নববাবুবিলাস’ আর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ছদ্মনামে লেখা । নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘বাংলা ছোটোগল্প — সংক্ষিপ্ত সমালোচনা’ বইতে জানিয়েছেন যে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সময়কালে ( ১২৮০ থেকে ১৩০৬ বঙ্গাব্দ ) বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় একশ ছাব্বিশটি ছোটোগল্প প্রকাশিত হয়েছিল যেগুলোয় লেখকরা নামস্বাক্ষর করেননি, এমনকী ছদ্মনামও নয় । রচনার সঙ্গে লেখকের নাম দেওয়ার প্রথাটি প্রবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্মধর্মের প্রভাবশালী প্রতিনিধি । সেসময়ে ব্রা্‌হ্মধর্ম হয়ে উঠেছিল ওই মননবিশ্বের ধারক ও বাহক । নামস্বাক্ষর না-করার প্রক্রিয়াটি থেকে স্পষ্ট যে কথাবস্তুর রচয়িতারা জানতেন না যে লেখকসত্তা বলে কোনো ব্যাপার হয়, এবং লেখকের নামটি সত্তাটিকে বহন করে । কোনও কথাবস্তু যে মেধাস্বত্ত, সে ধারণাটির প্রতিষ্ঠা হতে সময় লেগেছিল । তার কারণ অস্তিত্বের কেন্দ্রে ব্যক্তিমানুষকে স্হাপনের কর্মকাণ্ডটির প্রভাব, যাকে উনিশ শতকের রেনেসঁস বলা হয়, সেই চিন্তাচেতনাকে ছড়িয়ে দেবার জন্য অজস্র নির্মিত-প্রতিস্বের প্রয়োজন ছিল । ইউরোপীয় চিন্তনতন্ত্রটির বাইরে যে নন্দনক্ষেত্রটি রয়ে গেল, জলবিভাজিকার অন্য দিকে, তাকে বটতলা নামে এইজন্য দোষারোপ করা হল যে সেই এলাকায় ব্যক্তিএককগুলো অনির্মিত। জেমস লঙ বললেন বটতলার বইগুলো অশ্লীল ও অশোভন, যার দরুন বাংলার সংস্কৃতি থেকে লোপাট হয়ে গেল বইগুলো ।
    ইউরোপ থেকে আনা সাহিত্য-সংরূপগুলোর সংজ্ঞার স্বামীত্ব, তাদের ব্যাখ্যা করার অধিকার, দেশীয়করণের বৈধতা, সেসব বিধিবিধান তত্বায়নের মালিকানা, কথাবস্তুটির উদ্দেশ্যমূলক স্বীকৃতি, চিন্তনতন্ত্রটির অন্তর্গত সংশ্লেষে স্বতঃঅনুমিত ছিল যে, অনির্মিত লেখকপ্রতিস্বের পক্ষে তা অসম্ভব, নিষিদ্ধ, অপ্রবেশ্য, অনধিকার চর্চা । ব্যাপারটা স্বাভাবিক, কেননা যাঁরা সংজ্ঞাগুলো সরবরাহ করছেন, তাঁরাই তো জানবেন যে সেসব সংজ্ঞার মধ্যে কী মালমশলা আছে, আর তলে-তলে কীইবা তাদের ধান্দা । ফলে, কোনও কথাবস্তু যে সংরূপহীন হতে পারে, লেখক-এককটি চিন্তনতন্ত্রে অনির্মিত হতে পারে, রচনাকার তাঁর পাঠবস্তুকে স্হানাংকমুক্ত সমাজপ্রক্রিয়া মনে করতে পারেন, বা নিজেকে বাংলা সাহিত্যের কালরেখার বাইরে মনে করতে পারেন, এই ধরণের ধারণাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেয়নি ওই চিন্তনতন্ত্রটি । বর্তমান কালখণ্ডে, আমরা জানি, একজন লোক লেখেন তার কারণ তিনি ‘লেখক হতে চান’ । অথচ লেখক হতে চান না এরকম লোকও তো লেখালিখি করতে পারেন । তাঁরা সাহিত্যসেবক অর্থে লেখক নন, আবার সাহিত্যচর্চাকারী বিশেষ স্হানাংক নির্ণয়-প্রয়াসী না-লেখকও নন । তাঁদের মনে লেখক হওয়া-হওয়ি বলে কোনও সাহিত্য-প্রক্রিয়া থাকে না ।
    বহুকাল যাবৎ বিভিন্ন আলোচককে মন্তব্য করতে দেখা গেছে যে, উপন্যাস আর্ট ফর্মটির বঙ্গীয়করণ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, ছোটোগল্প আর্টফর্মটিকে সম্পূর্ণ দেশজ করে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সনেট-তের্জারিমা-ভিলানেলকে এতদ্দেশীয় করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী ইত্যাদি ।  এই যে একটি ভিন্ন ভাষসাহিত্যের সংরূপকে আরেকটি ভাষাসাহিত্যে এনে সংস্হাপন, এর জন্য দ্বিভাষী দক্ষতা এবং সংরূপটি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানই যথেষ্ট নয় । যিনি এই কাজটিতে লিপ্ত, তাঁর গ্রাহীক্ষমতা, বহনক্ষমতা ও প্রতিস্হাপন ক্ষমতা থাকা দরকার। অমন ক্ষমতা গড়ে ওঠে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে । আর এই জ্ঞান আহরণ তখনই সম্ভব যখন আ্হরণকারীর লেখক-প্রতিস্বের নির্মাণ ঘটে জ্ঞানটির পরিমণ্ডলে ।
    অনির্মিত লেখক-একককে ব্র্যাণ্ডার ম্যাথিউজ প্রণীত ছোটোগল্পের সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা যাক । ‘দি ফিলজফি অফ দি শর্ট স্টোরি’ বইতে ম্যাথিউজ বলেছেন, “যাহা কেবলমাত্র গল্প এবং পরিসরে ক্ষুদ্র, তাহাই ছোটোগল্প নহে । ভাবের ঐক্য ছোটোগল্পের পক্ষে অপরিহার্য এবং এইখানেই উপন্যাসের সহিত ইআর পপধান প্রভেদ । ছোটোগল্পে ভাবের ঐকভ আছে, উপন্যাসে নাই ।  ক্ল্যাসিকাল ফরাসি নাটকের তিনটি ঐক্যই ফরাসি নাটকে আছে ; ইহা একটি ক্ষেত্রে, একটি দিনে, বিশেষ একটি ঘটনা দেখায় । ছোটোগল্পে একটিমাত্র চরিত্র, ঘটনা বা ভাব থাকে, অথবা একটিমাত্র পরিস্হিতির পটভূমিকায় কতকগুলো ভাবের সমাবেশ ঘটে।” এখন, অনির্মিত লেখক-প্রতিস্বের কাছে ‘ভাবের ঐক্য’, ‘ভাবের সমাবেশ’ ‘ক্লসিকাল ফরাসি নাটক’ ইত্যাদি ভাবকল্পগুলো দুর্ভেদ্য থেকে যাবে, এবং ব্যাখ্যার পরও বিমূর্ততা কাটবে না ।
       ‘অ্যান ইনট্রোডাকশান টু দি স্টাডি অফ লিটারেচার’ বইতে দেয়া ডাবলু. এইচ. হাডসন-এর তৈরি অনুশাসনের প্রেক্ষিতেও ব্যাপারটা বিচার করা যেতে পারে । হাডসন বলেছেন, “ছোটোগল্পে শিল্পকলার মূল্য নির্ধারণের জন্য ‘একক উদ্দেশ্য ও ভাবের ঐক্য’ বজায় আছে কিনা তা দেখা উচিত।” এখানেও প্রশ্ন উঠবে ‘শিল্পকলা’, তার ‘মূল্য নির্ধারণ’ এবং ‘একক উদ্দেশ্য’ ভাবকল্পগুলো নিয়ে । বস্তুত যে চিন্তনতন্ত্রের কথা একটু আগে বলেছি, তার সরবরাহ করা সংজ্ঞায় খাপ খায়নি বলে পূর্ণচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের লেখা ‘মধুমতী’ রচনাটিকে সার্থক ছোটোগল্পের তকমা দেয়া হয়নি । সার্থক ছোটোগল্পের তকমা দেয়া হল ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘দেনাপাওনা’ রচনাটিকে । ছোটোগল্পের সংজ্ঞাকে গভীরভাবে বুঝতে না পারলে ‘সার্থক’ ছোটোগল্প লেখা সম্ভব ছিল না । সার্থকতা নামের মানদন্ডটি ওই চিন্তনতন্ত্রের ফসল । বর্তমান কালখণ্ডে ওই চিন্তনতন্ত্র বাতিল হয়ে গেছে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ ।
    ওপরের কথাগুলো এইজন্য বলতে হল যে অবনী ধর, যাঁর চোদ্দটি গদ্য নিয়ে ‘ওয়ান সট’ বইটি  প্রকাশিত হয়েছিল, তিনি ছোটোগল্প-লেখক বা গল্পকার হওয়া-হওয়ি অবস্হান থেকে সেগুলো লেখেননি, এবং তাঁর লেখক-প্রতিস্বটি ছিল অনির্মিত । ১৯৬৯ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত, এই কালখণ্ডে তিনি এও চোদ্দটি গদ্যই লিখেছিলেন। ১৯৭৫ সালের পর তিনি লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিলেন । হাংরি আন্দোলনের সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার একবারই দেখা হয়েছিল, অশোকনগরে, কিন্তু তখনও তিনি লেখালিখি আরম্ভ করেননি, যদিও তিনি নিজের জীবনের এই ঘটনাগুলো শোনাতে ভালোবাসতেন । তাঁর কথনভঙ্গিমা ও জীবননাট্যের ঘটনা থেকে স্পষ্ট ছিল যে কথাবস্তুর পরিসরটি সেই সময়ের সাহিত্যিক ডিসকোর্স এবং কাউন্টার-ডিসকোর্স থেকে একেবারে আলাদা, এমনকী হাংরি আন্দোলনের গল্পকার-ঔপন্যাসিক থেকেও আলাদা । ১৯৯৪ সালে কলকাতায় ফিরে জানতে পারি যে অবনী ধরের রচনাগুলো নিয়ে বই বের করার উৎসাহ কোনও হাংরি আন্দোলনকারী দেখাননি । আমি শর্মী পাণ্ডেকে অনুরোধ করি যে অবনী ধরের গদ্যগুলো নিয়ে একটা সংগ্রহ ওদের শিলালিপী প্রকাশনী থেকে বের করতে । শর্মী আর ওর স্বামী শুভঙ্কর দাশ তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যায় আর আমাকে একটা ভূমিকা লিখে দিতে বলে । এই সময়ে অবনী ধরের সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ ঘটে আর ওনার জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ফেলি । অবনী ধর জন্মেছিলেন ১৯৩৪ সালে, তখনকার পূর্ববঙ্গের মাদারিপুর জেলার কালাকিনি থানার পাঙাশিয়া গ্রামে. তাঁর মামার বাড়িতে । মারা যান ২০০৭ সালে, অশোকনগরে । তাঁর বাবা বঙ্কিমচন্দ্র ধর ( ১৯০৫ ) ওই জেলার মাইচপাড়া গ্রামের নিবাসী ছিলেন, সাত ভাইয়ের সবচেয়ে ছোট ; বঙ্কিমচন্দ্র ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন, কিন্তু কখনও কোনও চাকরি বা ব্যবসা করেননি ; স্বাদেশী আন্দোলনে যোগ দেবার কারণে কয়েকমাসের জেল হয়েছিল তাঁর । বঙ্কিমচন্দ্র তখনকার দিনের ম্যাট্রিক পাশ ছিলেন, অর্থাৎ যে চিন্তনতন্ত্রের কথা একটু আগে বলেছি, তার মননবিশ্বে অবনী ধরের প্রতিস্বনির্মাণের সুযোগটি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল, বিশেষ করে অবনী ধর যখন তাঁর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ।
    অবনী ধরের বয়স যখন এক বছর, তখন তাঁর বাবা বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে, তাঁর মা লাবণ্য ধর ( ১৯১৫ – ১৯৭৭ ) , আর ঠাকুমাকে নিজেদের ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে দিয়ে, অন্য এক তরুণীর সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, এবং বাকি জীবন বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর সঙ্গিনী বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীরূপে ভিক্ষা করে চালিয়েছিলেন । যদিও বঙ্কিমচন্দ্র মারা যান ১৯৬২ সালে, তাঁর মৃত্যুর খবর অবনীরা পান ১৯৭২ সালে । ততোদিন তাঁর মা শাঁখা-সিঁদুর পরতেন । অবনী ধরের লেখক-প্রতিস্ব প্রাগুক্ত চিন্তনতন্ত্রের  পরিসরে যদি গড়ে উঠত, তাহলে তিনি এই ট্র্যাজেডির মুহূর্তটি নিয়ে একটি কথাবস্তু তৈরি করতে পারতেন, কেননা ইউরোপীয় সাহিত্যে গ্রিসের সময় থেকে ব্যক্তি-এককের ট্র্যাজেডিটি লেখকত্ব প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপাদান ছিল, যা খ্রিস্টের নৃশংস হত্যা ও আত্মবলিদানের প্রতীকি অতিকথার প্রচার-প্রসারের কারণে সাহিত্যের নন্দনক্ষেত্রটিকে দখল করে নিতে পেরেছিল । তাছাড়া বাইবেলোক্ত “আরিজিনাল সিন” বা প্রথম পাপের পতনযন্ত্রণাকে সর্বজনীন নৈতিক-দার্শনিক বনেদে পালটে ফেলার জন্যেও জরুরি ছিল ইউরোপীয় সাহিত্যের পাতায় পাতায় ব্যক্তি-ট্র্যাজেডির উপস্হিতি ।
    অবনী ধরের জীবনে বহুবার বহুরকম ট্র্যাজেডি সংঘটন দেখা গেছে, কিন্তু সেসব অভিজ্ঞতার সরাসরি মালিকানা সত্তেও তিনি সংঘটন-মুহূর্ত বা ক্লাইম্যক্স বা হুইপক্র্যাক এনডিং প্রয়োগ করে কথাবস্তুকে ঔপনিবেশিক সাহিত্য-অনুশাসন ও হেলেনিক মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্ত করেননি । প্রকৃত প্রস্তাবে কথাবস্তুগুলো গড়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক সাহিত্য-মূল্যবোধের আওতার বাইরে । প্রসঙ্গত, যে সময়ে অবনী ধর তাঁর প্রথম পর্বের গদ্যগুলো লিখেছিলেন, সেসময়ে মান্যতাপ্রাপ্ত বাংলা ছোটো গল্পকাররা ইউরোপীয় সাহিত্যের অনুশাসন মোতাবেক, বিষণ্ণতা, পারক্য, প্রেমের বিকার, মৃত্যুপ্রবণতা, নিঃসঙ্গতার বেদনা,শহুরে যৌনতা ইত্যাদির চর্চা করছিলেন ।
    বাবা বঙ্কিমচন্দ্র তাঁদের একা ফেলে নিরুদ্দেশ হবার কারণে বছর পাঁচেক অন্নকষ্টে ভোগার পর তখনকার বিহারে ( এখন ঝাড়খণ্ড ) মধুপুরনিবাসী অবনীর ‘বুড়োমা’ অর্থাৎ তাঁর ঠাকুর্দার ভাইয়ের স্ত্রী, অবনী ও তাঁর মাকে দেখাসোনার জন্য, ও নিজের বার্ধক্যে দেখভালের জন্য, সেখানে নিয়ে গেলেন । যদিও অবনীর জ্যাঠামশাবরা, প্রথম দুজন ডাক্তার, ততীয়জন উকিল, চতুর্থজন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ যথাক্রমে দেওঘর ও মধুপুরে আশ্রম বসিয়ে তার মোহন্ত ছিলেন, অবনীর পড়াশুনার এবং স্কুলে ভর্তি হবার সুরাহা হলো না । বুড়োমার আশ্রয়ে অবনী ও তাঁর মায়ের অন্ন সমস্যার সমাধান হলেও, শিক্ষাপ্রাপ্তির সুযোগ ঘটল না । স্কুলে ভর্তির জন্য অবনীকে কলকাতার চেতলায় মামারবাড়ি যেতে হলো । প্রবাদবাক্যের মামার বাড়ির আবদারের বদলে অহরহ দুর্ব্যাবহার জোটায়, ১৯৫০ সালের পয়লা অক্টোবর, কাউকে না জানিয়ে, স্কুল থেকে পালিয়ে, অবনী চলে গেলেন মার্চেন্ট নেভিতে, খালাসির কাজ নিয়ে । তখন তাঁর ষোলো বছর বয়স ।
    এই সময়ের অভিজ্ঞতাগুলো অবনী সংগ্রহ করেন জাহাজে খালাসির কাজ করার সময়ে, বিভিন্ন দেশের বন্দর-শহরে, ইউরোপ তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাঙন কাটিয়ে উঠতে পারেনি । বস্তুত তাঁর খালাসিপর্বের কথাবস্তুগুলো, কথনভঙ্গীর অন্তর্গত আহ্লাদময়তার কারণে, সুখশ্রাব্য ও কৌতূহলোদ্দীপক ছিল, যে গল্পগুলো বাসুদেব দাশগুপ্তকে তিনি শোনাতেন । অনেকে মনে করেন বাসুদেব দাশগুপ্তের গল্পগুলোর উৎস হলো অবনী ধরের অভিজ্ঞতা । লেখালিখি না করেও অবনী ধর তাঁর জীবনযাপনের কারণে নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করতেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে খালাসিটোলায় ঢুঁ মারতেন । বাসুদেব দাশগুপ্ত ও শৈলেশ্বর ঘোষের প্ররোচনায় সোনাগাছির যৌনকর্মী বেবি, মীরা এবং দীপ্তির সঙ্গে নৈকট্য গড়ে ফেলেছিলেন ।
    হাংরি আন্দোলনের সময়ে, উৎসাহদানকারী সম্পাদক ও স্তাবকদলের অভাবে, এবং অবনী ধরের সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্খার অনুপস্হিতিতে, তাঁর বলা কাহিনিগুলো লিখিত পাঠবস্তুর আকার নিতে পারেনি । জরুরি অবস্হার শেষে সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে লিটল ম্যাগাজিন বিস্ফোরণ ঘটলেও, সম্পাদকরা অবনীর গদ্য সম্পর্কে আগ্রহী হননি, মূলত তাঁর কথনভঙ্গীর ও রচনাকাঠামো বিদ্যায়তনিক সংরূপ বহির্ভূত ছিল বলে । একজন খালাসির গদ্যসন্দর্ভে যে যাযাবরতার নিবাস, যার উপকরণগুলো যাত্রাপথের খুদে অনির্ণেয়তায় তাৎপর্যময়, যার বিন্যাসে ভাসমান পরিভ্রমণের অনুন্মোচিত বাচন, স্নায়ুভাষায় রচিত সেরকম স্বতঃজাত কৃৎপ্রকরণ, স্বীকৃতি পায়নি লিটল ম্যাগাজিন স্তরেও । যেহেতু অবনীর পাঠবস্তু আত্মমগ্নতাকে অতিক্রম করে যায়, এবং তাঁর বাকব্যঞ্জনা বদ্ধসমাপ্তির কাঠামোটাকেই উপহাস করে, প্রধাগত আলোচকদের দৃষ্টিও তিনি আকর্ষণ করতে পারেননি ।
    অবনীর ও তাঁর আত্মীয় পরিজনের পরিবারে নিরুদ্দিষ্ট, সাধু, সন্ন্যাসী, মোহন্ত, ভিখারি-বৈষ্ণব, বাউল ইত্যাদির পূর্বেতিহাস থাকার কারণে অবনীর ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর মা চিন্তিত ছিলেন । বয়ঃসন্ধি অতিক্রান্ত সন্ধিক্ষণে তাঁর ছেলে হয়তো কোনও বন্দরশহর থেকে বিদেশিনী বিয়ে করে বা না-করে সঙ্গে এনে একদিন হাজির হবেন, এমন দুশ্চিন্তাও লাবণ্য ধরের ছিল । ছেলের চরিত্রে অভিজ্ঞতাজনিত পার্থক্যও তিনি লক্ষ্য করে থাকবেন । তিনি অবনীকে বললেন জাহাজের চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসতে । খালাসির চাকরি ছেড়ে ১৯৫৫ সালে ফিরে এলেন অবনী ।  বুড়োমা মারা যেতে তাঁর মা মধুপুরে একা হয়ে পড়েছিলেন । অবনী দেশে ফিরে চেতলার একটা বস্তিঘরে, মামার বাড়ির কাছে, বাসা ভাড়া নিয়ে মাকে মধুপুর থেকে নিয়ে এলেন । ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৩, এই আট বছর টাকা রোজগারের জন্য নানা রকম জীবিকার অভিজ্ঞতা হলো অবনীর — ক্রেন-ড্রেজার-ডাম্পার অপারেটার, লরি-ট্যাকসি-প্রায়ভেট মোটরগাড়ি চালক, রেলওয়ে ক্যাটারিঙের বেয়ারা, কোককয়লা ফেরি, ঠোঙা ও প্যাকেট তৈরি, পোস্টার-ফেস্টুন লেখা ইত্যাদি, অসংগঠিত শ্রমিকের জন্য যে-ধরণের কাজ পাওয়া যায় সবই করলেন । ১৯৬২ সালে অবনীর মা পাত্রী নির্বাচন করে সাধনার সঙ্গে তাঁর বি্য়ে দেন ।
    অবনী তাঁর সংসার ইতিমধ্যে চেতলা থেকে নতুন গড়ে-ওঠা উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কলোনি অশোকনগরে তুলে নিয়ে যান । তখন সেখানে স্হানীয় স্বায়ত্বশাসনের পরিকাঠামো বিশেষ ছিল না । তিনি নবতর অভিজ্ঞতার সামনে পড়লেন অশোকনগরে । তিনি এও দেখলেন যে, যাঁদের মাঝে তিনি বসবাস করতে এলেন, তাঁরা পপতিদিনকার মূর্ত নাগরিক অসুবিধা ও জাগতিক দুঃখকষ্টে ও অভাব প্রতিকারের বদলে সোভিয়েত রাষ্ট্র, চিন, ভিয়েৎনাম, কিউবা, আমেরিকা, দিল্লী ইত্যাদি সুদূরবর্তী বিমূর্ত অদরকারি তর্কাতর্কিতে সময় ও ক্ষমতা অপচয় অপচয় করে আনন্দ পান । অর্থাৎ সুপ্রাইণ্ডিভিজুয়াল বা অধিব্যক্তিক ম্যাক্রোলেভেল ভাবুকদের পশ্চিমবাংলার মাটিপৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কহীন তৎপরতার প্রেক্ষিতে, তাঁর মাইক্রোলেভেল খালাসিত্ব তাঁকে কল্যাণকামীতার স্বাভাবিক সনাতন মূল্যবোধে হায়ারার্কিবর্জিত করে রেখেছিল, এবং সেই ভূমিজ প্রবৃত্তিকে অবনী ধর কাজে লাগালেন ।
    তিনি এবং আরও কয়েকজন মিলে, বিশেষ করে শিক্ষক সমর ঘোষ, অশোকনগরে ডাকঘর বসানো, পৌরসভা গঠন, অসামাজিক কাজকারবার বন্ধ ইত্যাদির উদ্যোগ নিলেন । উদ্যোগটিকে কন্ঠস্বর দেবার জন্য, এবং তাঁদের অভাব-অভিযোগ যাতে কর্তাব্যক্তিদের কানে পৌঁছোয়, ১৯৬৪ সালে পপকাশ করা আরম্ভ করলেন ‘অশোকনগর বার্তা’ নামে একটি পাক্ষিক সংবাদপত্র, যেটি ছিল ওই অঞ্চলের প্রথম পঞ্জিকৃত সংবাদপত্র । পত্রিকাটির আয়ু ছিল তিন বছর, সম্ভবত যথেষ্ট । পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, নিজের অভিজ্ঞতাকে কথাবস্তুতে রূপান্তরিত করে ছাপাবার কথা তাঁর মনে আসেনি কখনও ; পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত অন্যেরাও তাঁর মুখে ঘটনা শুনেও তাঁকে লিখতে বলেননি । সম্ভবত সমাজচিন্তনকে আত্মসাৎ করে ব্যক্তি-ক্রিয়াকরণের চিন্তা-পরিসর লালিত হবার মতো পৃথকত্ববোধ জাগার সুযোগ বা মনস্হিতি তাঁর হয়নি । ১৯৬৩ সাল থেকে চাকুরিহীন অবনীর কাছে আপনা থেকেই পরিত্যক্ত হয়েছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দর্শন ।
    অবনী ধরের কথাবস্তুগুলোকে দুটি পর্বে চি্‌হ্ণিত করা যায় । প্রথম পর্বটি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্বটি ২০০০ সালের পর । মাঝে লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন । প্রথম পর্বে তিনি ছিলেন অর্থস্রোতহীন এবং কোনও সাহিত্যিক স্বকীয়তা আনার প্রয়াস করেননি । তা আপনা থেকে হয়ে গিয়েছিল তাঁর অনির্মিত লেখক-প্রতিস্বের কারণে । অবনী ধরের ডিসকোর্স, কখনও খালাসির, কখনও বা অসংগঠিত শ্রমিক বা কর্মহীনের, ভূপ্রকৃতির উথ্থানভূমিলব্ধ, স্হানিক, অবিমিশ্র, মুক্ত, যৌগিক, বর্ণিল, অনুভূমিক, প্রতিসংস্হাপিত, কৌমনিষ্ঠ এবং অতিজ্ঞাপনমূলক । প্রথম লেখাটি, ‘আমার দুঃখী মা’ রচনার পর তিনি তা লাবণ্য ধরকেই পড়ে শুনিয়েছিলেন । স্তম্ভিত মা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর. বলেছিলেন, ‘সত্য কথাই ল্যাখছস।’
    দ্বিতীয় পর্বের শুরু ২০০০ সালে । এই পর্বে অবনীর গদ্য-কাঠামোয় কয়েকটি কারণে সাইত্যিকতা এসে গেছে । তাঁর স্ত্রী, আরও কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে একজোট হয়ে মামলা করে ১৯৯০ সালে চাকরি পাবার পর অবনীর আর্থিক অনিশ্চয়তা কাটে । তাঁর মেয়ে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ও বি এড এবং ছেলে বি এ পাশ করেন । অর্থাৎ প্রথম পর্বের জ্ঞান পরিমণ্ডলটি, তাঁর মেয়ে ও ছেলের প্রভাবে ক্রমশ অপসারিত হয়ে বাড়ির মধ্যে একটি ভিন্ন, যা অবনীর কাছে তুলনামূলকভাবে উচ্চতর ঠেকে থাকবে, জ্ঞানপরিমণ্ডলের প্রবেশ ঘটিয়েছে । তৃতীয়ত, তাঁর প্রথম পর্বের রচনাগুলো, অন্তত কিছু সাহিত্যপাঠকের, হাতে গোনা হলেও, দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে, যাঁদের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় তিনি উৎসাহিত হয়ে থাকবেন গদ্যগুলোকে একটি সাহিত্যিক আদল-আদরা দেবার । দ্বিতীয় পর্বের কথাবস্তুগুলোর গদ্যবিন্যাসে ধরা পড়ে যে প্রথাবাহিত গদ্যসাহিত্যের সঙ্গে, যেগুলো তাঁর ছেলে-মেয়ে নিজেরা পড়ার জন্য বাড়িতে এনে থাকবেন, তাঁর যোগাযোগ ঘটেছে । অবনী নিজে চেষ্টা করলেও, এই বয়সে পৌঁছে, তাঁর পক্ষে মুকুরবিম্ব গড়া সম্ভবপর হয়নি, এবং তাঁর অপরত্ববোধ ও সাহিত্যিক অপরত্ব মুছে যায়নি । প্রথম ও দ্বিতীয়, দুটি পর্বেই, তাঁর জীবনজিজ্ঞাসা তাড়িত হয়েছে অপরত্ববোধের অবস্হাননজনিত  বিপর্যয় দ্বারা। আর কোনো বাঙালি সাহিত্যিকের কথাবস্তুতে, অপরত্ববোধের মাত্রাগুলোকে, অবনীর মতো করে ইতোপূর্বে উপস্হাপন করতে দেখা যায়নি । তাঁর মস্তিষ্কে আতিথ্য নেয়া কথাকারটি নিজেরই স্মৃতির ঐতিহাসিক হিসেবে অবনীর সামনে উদয় হয়েছে কখনও-সখনও, যিনি অতীতকে বাঁচিয়ে তুলতে চেষ্টা করছেন না বা অতীতে বেঁচে থাকার কথা বলছেন না ; আসলে কথাকার ওই দূরবর্তী এবং নিকট অতীতের লোপাট হয়ে যাওয়া ও তাকে বাগে আনার বাচনক্রীড়ায় অংশগ্রহণকারীরূপে ‘অপর প্রতিসন্দর্ভের’ সতর্কতাগুলো জাহির করছেন ।
    দুই
    উত্তরবঙ্গে হাংরি জেনারেশনের প্রসার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, হাংরি পত্রিকা ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ এর সম্পাদক অলোক গোস্বামী এই কথাগুলো লিখেছিলেন, তা থেকে অবনিবনার যৎসামান্য আইডিয়া হবে, কিন্তু এই অবনিবনার সঙ্গে পরাবাস্তববাদীদের নিজেদের অবনিবনারে যথেষ্ট মিল আছে :-
    “নব্বুই দশকে সদ্য প্রকাশিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বগলে নিয়ে এক ঠা ঠা দুপুরে আমি হাজির হয়েছিলাম শৈলেশ্বরের বাড়ির গেটে। একা। ইচ্ছে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে মুখোমুখি বসে যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবো। যেহেতু স্মরণে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি তাই আস্থা ছিল শৈলেশ্বরের প্রজ্ঞা,ব্যক্তিত্ব,যুক্তিবোধ তথা ভদ্রতাবোধের ওপর। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শৈলেশ্বর আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন এবং যৌথ আলোচনাই পারবে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নতুন উদ্যমে একসাথে পথ চলা শুরু করতে। কিন্তু দুভার্গ্য বশতঃ তেমন কিছু ঘটলো না। বেল বাজাতেই গেটের ওপারে শৈলেশ্বর। আমাকে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন।
    --কী চাই!
    মিনমিন করে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলবো।
    --কে আপনি?
    এক এবং দুই নম্বর প্রশ্নের ভুল অবস্থান দেখে হাসি পাওয়া সত্বেও চেপে গিয়ে নাম বললাম।
    --কি কথা?
    --গেটটা না খুললে কথা বলি কিভাবে!
    --কোনো কথার প্রয়োজন নেই। চলে যান।
    --এভাবে কথা বলছেন কেন?
    --যা বলছি ঠিক বলছি। যান। নাহলে কিন্তু প্রতিবেশীদের ডাকতে বাধ্য হবো।
    এরপর স্বাভাবিক কারণেই খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম কারণ আমার চেহারাটা যেরকম তাতে শৈলেশ্বর যদি একবার ডাকাত, ডাকাত বলে চেঁচিয়ে ওঠেন তাহলে হয়ত জান নিয়ে ফেরার সুযোগ পাবো না। তবে 'ছেলেধরা' বলে চেল্লালে ভয় পেতাম না। সমকামিতার দোষ না থাকায় নির্ঘাত রুখে দাঁড়াতাম।
    ভয় পাচ্ছি অথচ চলেও যেতে পারছি না। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে আরও খানিকটা জানা বোঝা জরুরি।
    --ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। তবে পত্রিকার নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে সেটা রাখুন।
    এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন শৈলেশ্বর।
    --কোন পত্রিকা?
    --কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।
    --নেব না। যান।
    এরপর আর দাঁড়াইনি। দাঁড়ানোর প্রয়োজনও ছিল না। ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি ব্যক্তি শৈলেশ্বর ঘোষকে চিনতে ভুল হয়নি আমাদের। আর এই সমঝদারি এতটাই তৃপ্তি দিয়েছিল যে অপমানবোধ স্পর্শ করারই সুযোগ পায়নি।”
    শৈলেশ্বর ঘোষের হয়তো মনে হয়েছিল যে কলকাতায় তিনি হাংরি আন্দোলনের যে কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাইছেন তাতে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করা হচ্ছে । তাঁর আচরণ ছিল হুবহু আঁদ্রে ব্রেতঁর মতন । পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে আঁদ্রে ব্রেতঁর সঙ্গে অনেকের সম্পর্ক ভালো ছিল না, দল বহুবার ভাগাভাগি হয়েছিল, অথচ সেসব নিয়ে বাঙালি আলোচকরা তেমন উৎসাহিত নন, যতোটা হাংরি আন্দোলনের দল-ভাগাভাগি নিয়ে । ইংরেজিতে মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী হাংরি আন্দোলন নিয়ে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে একটি বই লিখেছেন, পেঙ্গুইন র‌্যাণ্ডাম হাউস থেকে প্রকাশিত । সেই বইটি বাংলা পত্রপত্রিকায় আলোচিত হল না । 
    আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৬ জুন ২০১৩ তারিখে গৌতম চক্রবর্তী হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছিলেন ; তাতেও রয়েছে টিটকিরি যা তিনি পরাবাস্তববাদীদের সম্পর্কে কখনও বলেছেন কিনা জানি না । উনি লিখেছিলেন :
    “মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র ও বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে। কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়।... এখন কবিতা রচিত হয় অর্গ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে।
    ১৯৬২ সালে এই ভাষাতেই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস থেকে খালাসিটোলা, বারদুয়ারি অবধি সর্বত্র গোপন বিপ্লবী আন্দোলনের ব্লু প্রিন্টের মতো ছড়িয়ে পড়ে একটি ম্যানিফেস্টো। ২৬৯ নেতাজি সুভাষ রোড, হাওড়া থেকে প্রকাশিত এই ম্যানিফেস্টোর ওপরে লেখা হাংরি জেনারেশন। নীচের লাইনে তিনটি নাম। স্রষ্টা: মলয় রায়চৌধুরী। নেতৃত্ব: শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদনা: দেবী রায়।
    তখনও কলেজ স্ট্রিটের বাতাসে আসেনি বারুদের গন্ধ, দেওয়ালে লেখা হয়নি ‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’। কিন্তু পঞ্চাশ পেরিয়ে-যাওয়া এই ম্যানিফেস্টোর গুরুত্ব অন্যত্র। এর আগে ‘ভারতী’, ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ অনেক কবিতার কাগজ ছিল, সেগুলি ঘিরে কবিরা সংঘবদ্ধও হতেন। কিন্তু এই ভাবে সাইক্লোস্টাইল-করা ম্যানিফেস্টো আগে কখনও ছড়ায়নি বাংলা কবিতা।
    ওটি হাংরি আন্দোলনের দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টো। প্রথম ম্যানিফেস্টোটি বেরিয়েছিল তার কয়েক মাস আগে, ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে। ইংরেজিতে লেখা সেই ম্যানিফেস্টো জানায়, কবিতা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় না, বিভ্রমের বাগানে পুনরায় বৃক্ষরোপণ করে না। ‘Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of bamboozled gardens.’ বিশ্বায়নের ঢের আগে ইংরেজি ভাষাতেই প্রথম ম্যানিফেস্টো লিখেছিলেন হাংরি কবিরা। কারণ, পটনার বাসিন্দা মলয় রায়চৌধুরী ম্যানিফেস্টোটি লিখেছিলেন। পটনায় বাংলা ছাপাখানা ছিল না, ফলে ইংরেজি।
    দুটি ম্যানিফেস্টোতেই শেষ হল না ইতিহাস। হাংরি আসলে সেই আন্দোলন, যার কোনও কেন্দ্র নেই। ফলে শহরে, মফস্সলে যে কোনও কবিই বের করতে পারেন তাঁর বুলেটিন। ১৯৬৮ সালে শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁর ‘মুক্ত কবিতার ইসতাহার’-এ ছাপিয়ে দিলেন ‘সমস্ত ভন্ডামির চেহারা মেলে ধরা’, ‘শিল্প নামক তথাকথিত ভূষিমালে বিশ্বাস না করা’, ‘প্রতিষ্ঠানকে ঘৃণা করা’, ‘সভ্যতার নোনা পলেস্তারা মুখ থেকে তুলে ফেলা’ ইত্যাদি ২৮টি প্রতিজ্ঞা। পরে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া বাধবে। মলয় ব্যাংকের চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাবেন। শৈলেশ্বর, সুবো আচার্য এবং প্রদীপ চৌধুরীরা বলবেন, ‘মলয় বুর্জোয়া সুখ ও সিকিয়োরিটির লোভে আন্দোলন ছেড়ে চলে গিয়েছে।’কী রকম লিখতেন হাংরিরা? বছর দুয়েক আগে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিতে গৌতম ঘোষের চরিত্রটি লেখা হয়েছিল হাংরি কবিদের আদলে।
    ‘জেগে ওঠে পুরুষাঙ্গ নেশার জন্য হাড় মাস রক্ত ঘিলু শুরু করে কান্নাকাটি
    মনের বৃন্দাবনে পাড়াতুতো দিদি বোন বউদিদের সঙ্গে শুরু হয় পরকীয়া প্রেম’,
    লিখেছিলেন অকালপ্রয়াত ফালগুনী রায়। র‌্যাঁবো, উইলিয়াম বারোজ এবং হেনরি মিলারের উদাহরণ বারে বারেই টেনেছেন হাংরিরা। ঘটনা, এঁরা যত না ভাল কবিতা লিখেছেন, তার চেয়েও বেশি ঝগড়া করেছেন। এবং তার চেয়েও বেশি বার গাঁজা, এলএসডি, মেস্কালিন আর অ্যাম্ফিটোমাইন ট্রিপে গিয়েছেন।
    অতএব, সাররিয়ালিজ্ম বা অন্য শিল্প আন্দোলনের মতো বাঙালি কবিদের ম্যানিফেস্টোটি কোনও দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। কিন্তু ‘হাংরি’রা আজও মিথ। এক সময় ‘মুখোশ খুলে ফেলুন’ বলে তৎকালীন মন্ত্রী, আমলা, সম্পাদকদের বাড়িতে ডাকযোগে তাঁরা মুখোশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবার এক সময় ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি লেখার জন্য অশ্লীলতার মামলা হল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে। উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাকের বিরুদ্ধে জারি হল গ্রেফতারি পরোয়ানা।
    রাষ্ট্র ও আদালত কী ভাবে কবিতাকে দেখে, সেই প্রতর্কে ঢুকতে হলে ১৯৬৫ সালে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলাটি সম্পর্কে জানা জরুরি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কাঠগড়ায় উঠেছেন মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে। পাবলিক প্রসিকিউটরের জিজ্ঞাসা, ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে?
    শক্তি: ভাল লাগেনি।
    প্রসিকিউটর: অবসিন কি? ভাল লাগেনি বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
    শক্তি: ভাল লাগেনি মানে জাস্ট ভাল লাগেনি। কোনও কবিতা পড়তে ভাল লাগে, আবার কোনওটা ভাল লাগে না।
    শক্তি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন মলয়ের বিরুদ্ধে। কয়েক মাস পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয়ের সমর্থনে...
    প্রসিকিউটর: কবিতাটা কি অশ্লীল মনে হচ্ছে?
    সুনীল: কই, না তো। আমার তো বেশ ভাল লাগছে। বেশ ভাল লিখেছে।
    প্রসিকিউটর: আপনার শরীরে বা মনে খারাপ কিছু ঘটছে?
    সুনীল: না, তা কেন হবে? কবিতা পড়লে সে সব কিছু হয় না।
    একই মামলায় শক্তি ও সুনীল পরস্পরের বিরুদ্ধে। তার চেয়েও বড় কথা, ’৬৫ সালে এই সাক্ষ্য দেওয়ার আগের বছরই সুনীল আইওয়া থেকে মলয়কে বেশ কড়া একটি চিঠি দিয়েছিলেন, ‘লেখার বদলে আন্দোলন ও হাঙ্গামা করার দিকেই তোমার ঝোঁক বেশি। রাত্রে তোমার ঘুম হয় তো? মনে হয়, খুব একটা শর্টকাট খ্যাতি পাবার লোভ তোমার।’ ব্যক্তিগত চিঠিতে অনুজপ্রতিম মলয়কে ধমকাচ্ছেন, কিন্তু আদালতে তাঁর পাশে গিয়েই দাঁড়াচ্ছেন। সম্ভবত, বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে অনুজ কবিদের কাছে সুনীলের ‘সুনীলদা’ হয়ে ওঠা হাংরি মামলা থেকেই। প্রবাদপ্রতিম কৃত্তিবাসী বন্ধুত্বের নীচে যে কত চোরাবালি ছিল, তা বোঝা যায় উৎপলকুমার বসুকে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটি চিঠি থেকে, ‘প্রিয় উৎপল, একদিন আসুন।...আপনি তো আর শক্তির মতো ধান্দায় ঘোরেন না।’
    তা হলে কি হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে প্রভাবহীন, শুধুই কেচ্ছাদার জমজমাট এক পাদটীকা? দুটি কথা। হাংরিদের প্রভাবেই কবিতা-সংক্রান্ত লিট্ল ম্যাগগুলির ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ গোছের নাম বদলে যায়। আসে ‘ক্ষুধার্ত’, ‘জেব্রা’, ‘ফুঃ’-এর মতো কাগজ। সেখানে কবিতায় বাঁকাচোরা ইটালিক্স, মোটাদাগের বোল্ড ইত্যাদি হরেক রকমের টাইপোগ্রাফি ব্যবহৃত হত। পরবর্তী কালে সুবিমল মিশ্রের মতো অনেকেই নিজেকে হাংরি বলবেন না, বলবেন ‘শুধুই ছোট কাগজের লেখক’। কিন্তু তাঁদের গল্প, উপন্যাসেও আসবে সেই টাইপোগ্রাফিক বিভিন্নতা। তৈরি হবে শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন। হাংরিরা না এলে কি নব্বইয়ের দশকেও হানা দিতেন পুরন্দর ভাট?
    আসলে, ম্যানিফেস্টোর মধ্যেই ছিল মৃত্যুঘণ্টা। ’৬২ সালে হাংরিদের প্রথম বাংলা ম্যানিফেস্টোর শেষ লাইন, ‘কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা ও ঈশ্বরীর মতো অনুষ্মেষিণী।’ হাংরিরা নিজেদের যত না সাহিত্যবিপ্লবী মনে করেছেন, তার চেয়েও বেশি যৌনবিপ্লবী।”
    তিন
    ১৯১৭ সালে গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার “সুররিয়ালিজম” অভিধাটি তৈরি করেছিলেন, যার অর্থ ছিল বাস্তবের অতীত। শব্দটি প্রায় লুফে নেন আঁদ্রে ব্রেতঁ, নতুন একটি আন্দোলন আরম্ভ করার পরিকল্পনা নিয়ে, যে আন্দোলনটি হবে পূর্ববর্তী ডাডাবাদী আন্দোলন থেকে ভিন্ন । ত্রিস্তঁ জারা উদ্ভাবিত ডাডা আন্দোলন থেকে সরে আসার কারণ হল ব্রেতঁ সহ্য করতে পারতেন না ত্রিস্তঁ জারাকে, কেননা কবি-শিল্পী মহলে প্রতিশীল্পের জনক হিসাবে ত্রিস্তঁ জারা খ্যাতি পাচ্ছিলেন। আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিজম তত্বটির একমাত্র ব্যাখ্যাকারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে আরম্ভ করেন। ১৯১৯ সালে ত্রিস্তঁ জারাকে কিন্তু ব্রেতঁ চিঠি লিখে প্যারিসে আসতে বলেছিলেন । একইভাবে ‘হাংরি’ শব্দটি মলয় রায়চৌধুরী পেয়েছিলেন কবি জিওফ্রে চসার থেকে । এই ‘হাংরি’ শব্দটি নেয়ার জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তেমন কিছুই করা হয়নি আঁদ্রে ব্রেতঁ ও ত্রিস্তঁ জারা সম্পর্কে । মলয় রায়চৌধুরী হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ঘোষণা করেন ১৯৬৫ সালের পয়লা নভেম্বর একটি লিফলেট প্রকাশের মাধ্যমে ।
    পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে, প্রথম থেকেই, আঁদ্রে ব্রেতঁ’র সঙ্গে অনেক পরাবাস্তববাদীর সদ্ভাব ছিল না, কিন্তু পরাবাস্তববাদ বিশ্লেষণের সময়ে আলোচকরা তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন না । আমরা যদি বাঙালি আলোচকদের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব যে তাঁরা হাংরি জেনারেশন বা ক্ষুধার্ত আন্দোলন বিশ্লেষণ করার সময়ে হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে অত্যধিক চিন্তিত, হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্য অবদান নিয়ে নয় । ব্যাপারটা বিস্ময়কর নয় । তার কারণ অধিকাংশ আলোচক হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের বইপত্র সহজে সংগ্রহ করতে পারেন না এবং দ্বিতীয়ত সাংবাদিক-আলোচকদের কুৎসাবিলাসী প্রবণতা । 
    আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁর বন্ধু পল এলুয়ার, বেনিয়ামিন পেরে, মান রে, জাক বারোঁ, রেনে ক্রেভালl, রোবের দেসনস, গিয়র্গে লিমবোর, রোজের ভিত্রাক, জোসেফ দেলতিল, লুই আরাগঁ ও ফিলিপে সুপোকে নিয়ে ১৯১৯ পরাবাস্তববাদ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন । কিছুকাল পরে, রাজনৈতিক ভাবাদর্শের কারণে তাঁর সঙ্গে লুই আরাগঁর ঝগড়া বেধে গিয়েছিল । মার্সেল দ্যুশঁ,  ত্রিস্তঁ জারা এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ, উভয়ের সঙ্গেই ছিলেন, এবং দুটি দলই তাঁকে গুরুত্ব দিতেন, দ্যুশঁ’র অবাস্তব ও অচিন্ত্যনীয় ভাবনার দরুন।
    পরাবাস্তব আন্দোলনের আগে জুরিখে ডাডাবাদী আন্দোলন আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ পরাবাস্তববাদের অনুপ্রেরণা পান ডাডা আন্দোলনের পুরোধা ত্রিস্তঁ জারার কাছ থেকে, কিন্তু ব্রেতঁ চিরকাল তা অস্বীকার করে্ছেন । ডাডা ছিল শিল্পবিরোধী আভাঁ গার্দ আন্দোলন ; অবশ্য প্রতিশিল্পও তো শিল্প । ডাডাবাদের রমরমার কারণে ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ব্রেতঁর সম্পর্ক দূষিত হয়ে যায় ; একজন অন্যজনের নেতৃত্ব স্বীকার করতে চাইতেন না । ডাডা (/ˈdɑːdɑː/) বা ডাডাবাদ (দাদাবাদ নামেও পরিচিত) ছিল ২০ শতকের ইউরোপীয় ভিন্নচিন্তকদের একটি সাহিত্য-শিল্প আন্দোলন, যার প্রাথমিক কেন্দ্র ছিল সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ক্যাবারে ভলতেয়ার ( ১৯১৬ নাগাদ ) এবং নিউ ইয়র্কে (প্রায় ১৯১৫ নাগাদ)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ডাডা আন্দোলন গড়ে ওঠে সেইসব শিল্পীদের নিয়ে, যাঁরা পুঁজিবাদী সমাজের যুক্তি, কারণ বা সৌন্দর্যের ধারণা মানতেন না, বরং তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন আপাত-অর্থহীন, উদ্ভট, অযৌক্তিক এবং বুর্জোয়া-বিরোধী প্রতিবাদী বক্তব্য । আন্দোলনটির শিল্পচর্চা প্রসারিত হয়েছিল দৃশ্যমান, সাহিত্য ও শব্দ মাধ্যমে, যেমন- কোলাজ, শব্দসঙ্গীত, কাট-আপ লেখা, এবং ভাস্কর্য। ডাডাবাদী শিল্পীরা হানাহানি, যুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এবং গোঁড়া বামপন্থীদের সাথে তাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল।
    যুদ্ধ-পূর্ববর্তী প্রগতিবাদীদের মধ্যেই ডাডার শিকড় লুকিয়ে ছিল। শিল্পের সংজ্ঞায় পড়েনা এমন সব সৃষ্টিকর্মকে চিহ্নিত করার জন্য ১৯১৩ সালে "প্রতি-শিল্প" শব্দটি চালু করেছিলেন মার্সেল দ্যুশঁ । কিউবিজম এবং কোলাজ ও বিমূর্ত শিল্পের অগ্রগতিই হয়তো ডাডা আন্দোলনকে বাস্তবতার গন্ডী থেকে বিচ্যুত হতে উদ্বুদ্ধ করে। আর শব্দ ও অর্থের প্রথানুগত সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান করতে ডাডাকে প্রভাবিত করে ইতালীয় ভবিষ্যতবাদী এবং জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টগণ । আলফ্রেড জ্যারির উবু রোই (১৮৯৬) এবং এরিক স্যাটির প্যারেড (১৯১৬-১৭) প্রভৃতি লেখাগুলোকে ডাডাবাদী রচনার আদিরূপ বলা যেতে পারে।  ডাডা আন্দোলনের মূলনীতিগুলো প্রথম সংকলিত হয় ১৯১৬ সালে হুগো বলের ডাডা ম্যানিফেস্টোতে। এই ম্যানিফেস্টোর প্রভাবে পরবর্তিকালে ব্রেতঁ সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো লিখতে অনুপপ্রাণিত হন -- এই কথা শুনতে ব্রেতঁ’র ভালো লাগত না এবং সেকারণে তিনি বহু সঙ্গীকে এক-এক করে আন্দোলন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন । তাছাড়া ব্রেতঁ মনে করতেন ডাডাবাদীরা নৈরাজ্যবাদী বা অ্যানার্কিস্ট, যখন কিনা তিনি একজন কমিউনিস্ট ।
    ডাডা আন্দোলনে ছিল জনসমাবেশ, মিছিল ও সাহিত্য সাময়িকীর প্রকাশনা; বিভিন্ন মাধ্যমে শিল্প, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি নিয়ে তুমুল আলোচনা হতো। আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্বরা ছিলেন হুগো বল, মার্সেল দ্যুশঁ, এমি হেনিংস, হানস আর্প, রাউল হাউসম্যান, হানা হৌক, জোহান বাডার, ত্রিস্তঁ জারা, ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, রিচার্ড হিউলসেনব্যাক, জর্জ গ্রোস, জন হার্টফিল্ড, ম্যান রে, বিয়াট্রিস উড, কার্ট শ্যুইটার্স, হানস রিখটার এবং ম্যাক্স আর্নেস্ট। অন্যান্য  আন্দোলন, শহরতলীর গান এসবের পাশাপাশি পরাবাস্তববাদ, নব্য বাস্তবতা, পপ শিল্প এবং ফ্লক্সেস প্রভৃতি গোষ্ঠীগুলোও ডাডা আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এই আন্দোলনের অনেকে সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ।
    পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে যাঁরা ব্রেতঁর সঙ্গে একে-একে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম হলেন ফিলিপে সুপো, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, রেনে ক্রেভাল, মিশেল লেইরিস, বেনিয়ামিন পেরে, অন্তনাঁ আতো,জাক রিগো, রবের দেসনস, ম্যাক্স আর্নস্ত প্রমুখ । এঁদের অনেকে ডাডাবাদী আন্দোলন ত্যাগ করে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২৩ সালে যোগ দেন চিত্রকর আঁদ্রে মাসোঁ ও ইভস তাঙ্গুই । ১৯২১ সালে ভিয়েনায় গিয়ে ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করেন ব্রেতঁ । ফ্রয়েডের ধারণাকে তিনি সাহিত্য ও ছবি আঁকায় নিয়ে আসতে চান । ফ্রয়েডের প্রভাবে ব্রেতঁ বললেন, সুররিয়ালিজমের মূলকথা হল অবচেতনমনের ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট ও আশ্চর্যকর সব রূপকল্প দ্বারা প্রকাশ করা। ডাডাবাদীরা যেখানে চেয়েছিলেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী করতে যার মাধ্যমে সে ভেদ করতে পারবে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল, পৌঁছাতে পারবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে; সেখানে পরাবাস্তববাদ আরো একধাপ এগিয়ে বলল, প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে। পরাবাস্তববাদী শিল্পীর লক্ষ্য হল তার কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে ব্যক্তি-অস্তিত্বের গভীর থেকে তুলে আনা। 
    সুররিয়ালিজমের প্রথম ইশতেহার প্রকাশ করেন ইয়ান গল। এ ইশতেহারটি ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পরেই ১৫ অক্টোবর আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিজমের দ্বিতীয় ইশতেহারটি প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৩০ সালে এ ধারার তৃতীয় ইশতেহারটিও প্রকাশ করেন। ইয়ান গল ও আঁদ্রে ব্রেতঁ—দুজনে দু দল সুররিয়ালিস্ট শিল্পীর নেতৃত্ব দিতেন। ইয়ান গলের নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, ত্রিস্তঁ জারা, মার্সেল আর্লেন্ড, জোসেফ ডেলটিল, পিয়েরে অ্যালবার্ট বিরোট প্রমুখ। আন্দ্রে ব্রেতঁর নেতৃত্বে ছিলেন লুই আরাগঁ, পল এলুয়ায়, রোবের ডেসনোস, জ্যাক বারোঁ, জর্জ ম্যালকিন প্রমুখ। এ দুটি দলেই ডাডাইজম আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। অবশ্য ইয়ান গল ও আন্দ্রে ব্রেতঁ এই আন্দোলন নিয়ে প্রকাশ্য-রেশারেশিতে জড়িয়ে পড়েন। তখন থেকেই পরাবাস্তববাদীরা ছোটো-ছোটো গোষ্ঠীতে বিভাজিত হতে থাকেন, যদিও তাঁদের শিল্প ও সাহিত্যধারা ছিল একই । পরে আন্দোলনে যোগ দেন জোয়ান মিরো, রেমণ্ড কোয়েনু, ম্যাক্স মোরিজ, পিয়ের নাভিল, জাক আঁদ্রে বোইফার, গেয়র্গে মালকাইন প্রমুখ । জিয়োর্জিও দে চিরোকো এবং পাবলো পিকাসো অনেক সময়ে গোষ্ঠির কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন, তবে আন্দোলনের ঘোষিত সদস্য ছিলেন না।
    সুররিয়ালিজম বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ডাডাইজম থেকে নিলেও এই মতবাদটি, যে,  ‘শিল্পের উৎস ও উপকরণ’ বিবেচনায় একটি অন্যটির চেয়ে স্বতন্ত্র্য। সুররিয়ালিজম আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন ফরাসি কবি আঁদ্রে ব্রেতঁ। তিনি শিল্প রচনায় ‘অচেতন মনের ওপর গুরুত্ব’ দেওয়ার জন্যে শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি মনে করতেন, ‘অচেতন মন হতে পারে কল্পনার অশেষ উৎস।’ তিনি অচেতন মনের ধারণাটি নিঃসন্দেহে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। ডাডাবাদী শিল্পীরা শিল্পের উৎস ও উপকরণ আহরণে ‘অচেতন’ মনের ধারণা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা এসে অচেতন মনের উৎস থেকে শিল্প রচনার প্রতি গুরুত্ব দেন এবং সফলতাও লাভ করেন।
    আঁদ্রে ব্রেতঁ মনে করতেন, ‘যা বিস্ময়কর, তা সবসময়ই সুন্দর’। অচেতন মনের গহীনেই বিস্ময়কর সুন্দরের বসবাস। তার সন্ধান করাই সাহিত্যিক-শিল্পীর যথার্থ কাজ। অচেতন মনের কারণেই সুররিয়ালিজমের কবি-শিল্পীরা গভীর আত্মঅনুসন্ধানে নামেন। মনের গহীন থেকে স্বপ্নময় দৃশ্যগুলো হাতড়ে বের করতে এবং মনের অন্তর্গত সত্য উন্মোচনে তাঁরা আগ্রহী ছিলেন। যার কারণে চেতন ও অচেতনের মধ্যে শিল্পীরা বন্ধন স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা অচেতন মনের সেই সব উপলব্ধিকে দৃশ্যে রূপ দিলেন যা পূর্বে কেউ কখনো করেনি। অচেতনের ভূমিতে দাঁড়িয়ে বাস্তব উপস্থাপনের কারণে খুব দ্রুতই এ মতবাদটি বিশ্ব শিল্পকলায় ‘অভিনবত্ব’ যোগ করতে সমর্থ হয়। এমনকী, পুঁজিবাদ-বিরোধী এই আন্দোলন থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন বহু বিখ্যাত বিজ্ঞাপন কোম্পানি ।
    সুররিয়ালিজমকে ‘নির্দিষ্ট’ ছকে ফেলা কঠিন। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা একই ছাতার নিচে বসবাস করে ছবি আঁকলেও এবং কবিতা লিখলেও, তাঁদের দৃষ্টি ও উপলব্ধির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ফলে এ মতবাদটি সম্পর্কে প্রত্যেকে ব্যাক্তিগত ভাবনা ভেবেছেন। ১৯২৯ সালে সালভাদর দালি এই আন্দোলনে যোগ দেন, যদিও তাঁর সঙ্গেও ব্রেতঁর বনিবনা হতো না । সালভাদর দালি মনে করতেন, ‘সুররিয়ালিজম একটি ধ্বংসাত্মক দর্শন এবং এটি কেবল তা-ই ধ্বংস করে যা দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখে।’ অন্যদিকে জন লেলন বলেছেন, ‘সুররিয়ালিজম আমার কাছে বিশেষ প্রভাব নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। কেননা, আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার কল্পনা উন্মাদনা নয়। বরং সুররিয়ালিজমই আমার বাস্তবতা।’ ব্রেতোঁ বলতেন, ‘ভাবনার যথাযথ পদ্ধতি অনুধাবনের জন্যে সুররিয়ালিজম আবশ্যক।’ এ ধারায় স্বপ্ন ও বাস্তবতার মিশ্রণ হয় বলে সুররিয়ালিজমকে স্বপ্নবাস্তবতাও বলা হয়ে থাকে।
    সুররিয়ালিজমের ঢেউ খুব অল্প সময়েই শিল্পের সবগুলো শাখায় আছড়ে পড়ে। কবিতা, গান থেকে শুরু করে নাটক, সিনেমা পর্যন্ত সুররিয়ালিস্টদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সুররিয়ালিজম ধারায় অন্তত ছয়টি সিনেমা নির্মিত হয়। এ ধারার প্রধান শিল্পীরা হলেন জ্যাঁ আর্প, ম্যাক্স আর্নেস্ট, আঁদ্রে মেসন, সালভাদর দালি, রেনে ম্যাগরেট, পিয়েরো রয়, জোয়ান মিরো, পল ডেলভাক্স, ফ্রিদা কাহলো প্রমুখ। এ ধারার চিত্রকর্মের মধ্যে ১৯৩১ সালে আঁকা সালভাদর দালির ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ সবচেয়ে আলোচিত ছবি। এটি কেবল এ ধারার মধ্যেই আলোচিত চিত্রকর্মই নয়, এটি দালিরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভার নিদর্শন। ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’-তে দালি ‘সময়ের’ বিচিত্র অবস্থাকে ফ্রেমবন্দি করতে চেষ্টা করেছেন। ‘মেটামরফসিস অব নার্সিসাস’, ‘নভিলিটি অব টাইম’, ‘প্রোফাইল অব টাইম’ প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
    সুররিয়ালিজম ধারার প্রধানতম চিত্রকর্মের মধ্যে রেনে ম্যাগরেটের ‘দ্য সন অব ম্যান’, ‘দিস ইজ নট এ পাইপ’, জর্জিও দি চিরিকো-এর ‘দ্য রেড টাওয়ার’, ম্যাক্স আর্নেস্টের ‘দি এলিফ্যান্ট সিলিবেস’, ইভ তঁগির ‘রিপ্লাই টু রেড’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে সুররিয়ালিজম আন্দোলন থেমে যায়। শিল্পবোদ্ধারা মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলনটির অনানুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘটে। কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্প আন্দোলনের মতো সুররিয়ালিজমের চর্চা বর্তমানেও হচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনেও সুররিয়ালিজমের প্রভাব লক্ষ করা যায়।  ১৯২৪ সালে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো । মার্কসবাদের সঙ্গে আর্তুর র‌্যাঁবোর আত্মপরিবর্তনের ভাবনাকে একত্রিত করার উদ্দেশে ব্রেতঁ ১৯২৭ সালে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন । কিন্তু সাম্যবাদীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বেশিদিন টেকেনি । সেখান থেকেও তিনি ১৯৩৩ সালে বিতাড়িত হন । পরাবাস্তববাদীদের “উন্মাদ প্রেম” তত্বটি ব্রেতঁর এবং “উন্মাদ প্রেম” করার জন্য বেশ কিছু তরুণী সুররিয়ালিস্টদের প্রতি আকৃষ্ট হন । যৌনতার স্বেচ্ছাচারিতার ঢেউ ওঠে সাহিত্যিক ও শিল্পী মহলে ; পরাবাস্তববাদীদের নামের সঙ্গে একজন বা বেশি নারীর সম্পর্ক ঘটে এবং সেই নারীরা তাঁদের পুরুষ প্রেমিকদের নামেই খ্যাতি পেয়েছেন । 
    তাঁর রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং অন্যান্য কারণে প্রেভের, বারোঁ, দেসনস, লেইরিস, লিমবোর, মাসোঁ, কোয়েন্যু, মোরিস, বোইফার সম্পর্কচ্ছদ করেন ব্রেতঁর সঙ্গে এবং গেয়র্গে বাতাইয়ের নেতৃত্বে পৃথক গোষ্ঠী তৈরি করেন । এই সময়েই, ১৯২৯ নাগাদ, ব্রেতঁর গোষ্ঠীতে যোগ দেন সালভাদর দালি, লুই বুনুয়েল, আলবের্তো জিয়াকোমেত্তি, রেনে শার এবং লি মিলার । ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ঝগড়া মিটমাট করে নেন ব্রেতঁ । দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ইশতাহার প্রকাশের সময়ে তাতে সই করেছিলেন আরাগঁ, আর্নস্ট, বুনুয়েল, শার, ক্রেভাল, দালি, এলুয়ার, পেরে, টাঙ্গুই, জারা, ম্যাক্সিম আলেকজান্দ্রে, জো বনসকোয়েত, কামিলে গোয়েমানস, পল নুগ, ফ্রান্সিস পোঙ্গে, মার্কো রিসটিচ, জর্জ শাদুল, আঁদ্রে তিরিয়ঁ এবং আলবেয়ার ভালেনতিন । ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা বন্ধু ছিলেন সালভাদর দালি এবং লুই বুনুয়েলের, আলোচনায় অংশ নিতেন, কিন্তু সুররিয়ালিস্ট গোষ্ঠিতে যোগ দেননি । ১৯২৯ সালে তাঁর মনে হয়েছিল যে দালি আর বুনুয়েলের ফিল্ম “একটি আন্দালুসিয় কুকুর” তাঁকে আক্রমণ করার জন্যে তৈরি হয়েছিল ; সেই থেকে তিনি সুররিয়ালিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন । আরাগঁ ও জর্জ শাদুল ব্রেতঁ’র গোষ্ঠী ত্যাগ করেছিলেন রাজনৈতিক মতভেদের কারণে, যদিও ব্রেতঁ বলতেন যে তিনিই ওনাদের তাড়িয়েছেন ।
    ১৯৩০ সালে কয়েকজন পরাবাস্তববাদী আঁদ্রে ব্রেতঁ’র একচেটিয়া নেতৃত্বে বিরক্ত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একটি প্যামফ্লেট ছাপিয়েছিলেন । পরাবাস্তববাদ আন্দোলন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । ১৯৩৫ সালে ব্রেতঁ এবং সোভিয়েত লেখক ও সাংবাদিক ইলিয়া এরেনবার্গের মাঝে ঝগড়া এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছোয় যে প্যারিসের রাস্তায় তাঁদের দুজনের হাতাহাতি আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । এরেনবার্গ একটি পুস্তিকা ছাপিয়ে বলেছিলেন যে পরাবাস্তববাদীরা পায়ুকামী । এর ফলে পরাবাস্তববাদীদের ইনটারন্যাশানাল কংগ্রেস ফর দি ডেফেন্স অফ কালচার সংস্হা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল । সালভাদর দালি বলেছিলেন যে পরাবাস্তববাদীদের মধ্যে প্রকৃত সাম্যবাদী হলেন একমাত্র রেনে ক্রেভাল । চটে গিয়ে ক্রেভালকে পরাবাস্তববাদী আন্দোলন থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ । অঁতনা অতো, ভিত্রাক এবং সুপোকে পরাবাস্তববাদী দল থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ, মূলত সাম্যবাদের প্রতি ব্রেতঁর আত্মসমর্পণের কারণে এই তিনজন বিরক্ত বোধ করেন ।
    ১৯৩৮ সালে ব্রেতঁ মেকসিকো যাবার সুযোগ পান এবং লিও ট্রটস্কির সঙ্গে দেখা করেন । তাঁর সঙ্গে ছিলেন দিয়েগো রিভেরা ও ফ্রিদা কালহো । ট্রটস্কি এবং ব্রেতঁ একটা যুক্ত ইশতাহার প্রকাশ করেছিলেন, “শিল্পের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা” শিরোনামে । লুই আরাগঁর সঙ্গেও ব্রেতঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না । ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত ডাডাবাদীদের সঙ্গে আন্দোলন করার পর ১৯২৪ সালে আরাগঁ যোগ দেন পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে । অন্যান্য ফরাসী পরাবাস্তববাদীদের সঙ্গে তিনিও ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দ্যান এবং পার্টির পত্রিকায় কলাম ও রাজনৈতিক কবিতা লিখতেন । আরাগঁর সঙ্গে ব্রেতঁর বিবাদের কারণ হল ব্রেতঁ চেয়েছিলেন ট্রটস্কির সঙ্গী ভিকতর সার্জকে সন্মানিত করতে । পরবর্তীকালে, ১৯৫৬ নাগাদ, সোভিয়েত রাষ্ট্র সম্পর্কে নিরাশ হন আরাগঁ, বিশেষ করে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশ কংগ্রেসের পর যখন নিকিতা ক্রুশ্চভ আক্রমণ করেন জোসেফ স্তালিনের ব্যক্তিত্ববাদকে । তা সত্ত্বেও স্তালিনপন্হী আরাগঁ ও ট্রটস্কিপন্হী ব্রেতঁর কখনও মিটমাট হয়নি । কাট-আপ কবিতার জনক ব্রায়ন জিসিনকেও গোষ্ঠী থেকে বিতাড়ন করেন ব্রেতঁ ; ব্রায়ান জিসিনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছিলেন বিট ঔপন্যাসিক উইলিয়াম বারোজ । বিট আন্দোলনের প্রায় সকলেই সুররিয়ালিজম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । বিটদের যৌন স্বাধীনতার ভাবনা-চিন্তায় সুররিয়ালিস্টদের অবদান আছে ।
    পরাবাস্তববাদই সম্ভবত প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন, যেখানে নারীকে দূরতম কোনো নক্ষত্রের আলোর মতো, প্রেরণা ও পরিত্রাণের মতো, কল্পনার দেবী প্রতিমার মতো পবিত্র এক অবস্থান দেওয়া হয়েছিল। নারী তাদের চোখে একই সঙ্গে পবিত্র কুমারী, দেবদূত আবার একই সঙ্গে মোহিনী জাদুকরী, ইন্দ্রিয় উদ্দীপক ও নিয়তির মতো অপ্রতিরোধ্য। ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টোয় আদ্রেঁ ব্রেতঁ নারীকে এরকম একটি অপার্থিব অসীম স্বপ্নিল চোখে দেখা ও দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। পুরুষ শিল্পীদের প্রেরণা, উদ্দীপনা ও কল্পনার সুদীর্ঘ সাম্পান হয়ে এগিয়ে আসবেন নারীরা। হয়ে উঠবেন পুরুষদের আরাধ্য ‘মিউজ’ আর একই সঙ্গে femme fatale। সুদৃশ্য উঁচু পূজার বেদি উদ্ভাসিত করে যেখানে বসে থাকবেন নারীরা। তাঁদের স্বর্গীয় প্রাসাদে আরো সৃষ্টিশীল হয়ে উঠবে পুরুষ।
    ব্রেতঁ ছিলেন সেই সময়ের কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ। তাঁর সম্মোহক ব্যক্তিত্বে আচ্ছন্ন হননি তাঁর সান্নিধ্যে এসেও – এরকম কোনো দৃষ্টান্ত কোথাও নেই। উজ্জ্বল, সাবলীল, মেধাবী, স্বতঃস্ফূর্ত এবং নায়কসুলভ ব্রেতঁ একই সঙ্গে ছিলেন উদ্ধত, আক্রমণাত্মক ও অহমিকাপূর্ণ। নিজের তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে মাঝেমধ্যেই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতেন। কিন্তু যদি তাঁর একবার মনে হতো যে কেউ তাঁর প্রভুত্বকে অগ্রাহ্য করছে, সর্বশক্তি দিয়ে তাকে আঘাত করতেন। নেতৃত্ব দেওয়ার সব গুণ প্রকৃতিগতভাবেই ছিল তাঁর মধ্যে। মহিলাদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল তরুণ প্রেমিকের মতো সম্ভ্রমপূর্ণ। তাঁর আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, অভিজাত ভাষা – এসবের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই মেজাজ হারিয়ে সম্পূর্ণ লাগামহীন হয়ে পড়া আর দুর্বোধ্য জটিল মানসিকতার জন্য পারতপক্ষে অনেকেই ঘাঁটাতে চাইতেন না তাঁকে।
    নারী পরাবাস্তববাদীদের সংখ্যা কম ছিল না । কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখ্য ফ্রিদা কাহলো, আসে বার্গ, লিজে দেহামে, আইরিন হামোয়ের, জয়েস মানসোর, ওলগা ওরোজকো, আলেহান্দ্রা পিৎসারনিক, ভ্যালেনটিন পেনরোজ, জিসেল প্রাসিনস, ব্লাঙ্কা ভারেলা, ইউনিকা জুর্ন প্রমুখ । নারী চিত্রকররা সংখ্যায় ছিলেন বেশি । তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য গেরট্রুড আবেরকমবি, মারিয়ন আদনামস, আইলিন ফরেসটার আগার, রাশেল বায়েস, ফ্যানি ব্রেনান, এমি ব্রিজওয়াটার, লেনোরা ক্যারিংটন, ইথেল কলকুহুন, লেনোর ফিনি, জেন গ্রাভেরোল, ভ্যালেনটিন য়োগো, ফ্রিদা খাহলো, রিটা কার্ন-লারসেন, গ্রেটা নুটসন ( ত্রিস্তঁ জারার স্ত্রী ), জাকেলিন লামবা ( আঁদ্রে ব্রেতঁ’র স্ত্রী), মারুহা মালো, মার্গারেট মডলিন, গ্রেস পেইলথর্প, অ্যালিস রাহোন, এডিথ রিমিঙটন, পেনিলোপি রোজমন্ট, কে সেজ ( ইভস তাঙ্গুইর স্ত্রী ), ইভা স্বাঙ্কমাজেরোভা, ডরোথি ট্যানিঙ ( ম্যাক্স আর্নস্টের স্ত্রী ), রেমেদিওস ভারো ( বেনিয়ামিন পেরের স্ত্রী ) প্রমুখ । ভাস্করদের মধ্যে উল্লেখ্য এলিজা ব্রেতঁ ( আঁদ্রে ব্রেতঁ’র তৃতীয় স্ত্রী ), মেরে ওপেনহাইম ( মান রে’র মডেল ছিলেন ) এবং মিমি পারেন্ট । ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ক্লদ কাহুন, নুশ এলুয়ার, হেনরিয়েতা গ্রিনদাত, আইডা কার, দোরা মার ( পাবলো পিকাসোর সঙ্গে নয় বছর লিভ টুগেদার করেছিলেন ), এমিলা মেদকোভা, লি মিলার, কাতি হোরনা প্রমুখ । পুরুষ পরাবাস্তববাদীদের বহু ফোটো এই নারী ফোটোগ্রাফারদের কারণেই ইতিহাসে স্হান পেয়েছে ।
    নারীদের নিয়ে পরাবাস্তববাদীদের এই স্বপ্নিল কাব্যময় উচ্ছ্বাস জোরালো একটা ধাক্কা খেল যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পশ্চিম ইউরোপে দ্রম্নত বদলাতে থাকা পরিস্থিতির ভস্ম ও শোণিত স্নাত শোণিত আত্মশক্তিসম্পন্ন নারীরা তাঁদের ভারী বাস্তবতা নিয়ে এসে দাঁড়ালেন সামনে। স্বপ্নে দেখা নারীর আয়না-শরীর ভেঙে পড়ল ঝুরঝুর করে আর বেরিয়ে এলো মেরুদ-সম্পন্ন রক্তমাংসের মানবী। সুররিয়ালিজম চেয়েছিল পুরুষের নিয়ন্ত্রণে নারীদের মুক্তি। কিন্তু যে গভীর অতলশায়ী মুক্তি দরজা খুলে দিলো নারীদের জন্য, সুররিয়ালিজম তার জন্য তৈরি ছিল না। মৃত অ্যালবাট্রসের মতো এই বিমূর্ত আদর্শায়িত ধারণা নারী শিল্পীদের গলায় ঝুলে থেকেছে, যাকে ঝেড়ে ফেলে নিজস্ব শিল্পসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করা দুঃসাধ্য ছিল। সময় লেগেছে সাফল্য পেতে। কিন্তু দিনের শেষে হেসেছিলেন তাঁরাই। এমন নয় যে, পরাবাস্তবতার প্রধান মশালবাহক ব্রেতঁ চাইছিলেন যে পুরুষরাই হবেন এই আন্দোলনের ঋত্বিক আর দ্যুতিময় নারী শিল্পী এবং সাহিত্যিকদের কাজ হবে মুগ্ধ সাদা পালক ঘাসের ওপরে ফেলে যাওয়া এবং আকর্ষণীয় ‘গুজব’ হিসেবে সুখী থাকা। ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশের পরবর্তী প্রদর্শনীগুলোতে নারী শিল্পীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু পুরুষ উদ্ভাবিত পরাবাস্তবতা থেকে তাঁদের ভাষা, স্বর ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র। নিজেদের ভারী অসিত্মত্ব, শরীরী উপস্থিতি জোরালোভাবে জায়গা পেল তাঁদের ছবিতে।
    কিন্তু নারী শিল্পীদের কাছে আত্মপ্রতিকৃতি হয়ে উঠল একটি সশস্ত্র ভাষার মতো। নিজস্ব গোপন একটি সন্ত্রাসের মতো। এই আন্দোলনের মধ্যে নারীরা এমন এক পৃথিবীর ঝলক দেখলেন, যেখানে আরোপিত বিধিনিষেধ না মেনে সৃজনশীল থাকা যায়, দমচাপা প্রতিবাদের ইচ্ছেগুলোর উৎস থেকে পাথরের বাঁধ সরিয়ে দেওয়া যায়। নগ্ন ও উদ্দাম করা যায় কল্পনাকে। নোঙর নামানো জাহাজের মতো অনড় ও ঠাসবুনট একটি উপস্থিতি হয়ে ছবিতে নিজের মুখ তাঁদের কাছে হয়ে উঠল অন্যতম প্রধান আইকন। যে ছবি আত্মপ্রতিকৃতি নয়, সেখানেও বারবার আসতে থাকল শিল্পীর শরীরী প্রতিমা। ফ্রিদা কাহ্লোর (১৯০৭-৫৪) ক্যানভাস তাঁর যন্ত্রণাবিদ্ধ শান্ত মুখশ্রী ধরে রাখল। মুখের বিশেষ কিছু চিহ্ন যা তাঁকে চেনায় – যেমন পাখির ডানার মতো ভুরু, আমন্ড আকারের চোখ ছবিতেও আনলেন তিনি। রিমেদিওস ভারোর (১৯০৮-৬৩) ছবিতে পানপাতার মতো মুখ, তীক্ষন নাক, দীর্ঘ মাথাভর্তি চুলের নারীর মধ্যে নির্ভুল চেনা গেল শিল্পীকে। আবার লিওনর ফিনির (১৯১৮-৯৬) আঁকা নারীরা তাদের বেড়ালের মতো কালো চোখ আর ইন্দ্রিয়াসক্ত মুখ নিয়ে হয়ে উঠল ফিনিরই চেনা মুখচ্ছবি। ১৯৩৯ সালের ‘The Alcove : An interior with three women’ ছবিতে ভারী  পর্দা টাঙানো ঘরে দুজন অর্ধশায়িত মহিলা পরস্পরকে ছুঁয়ে আছেন। আর একজন মহিলা দাঁড়িয়ে। তিনজনেই যেন কোনো কিছুর প্রতীক্ষা করছেন চাপা উদ্বিগ্ন মুখে। যে তিনজন নারীর ছবি, তাঁরা যে লিওনর ফিনি, লিওনারা ক্যারিংটন এবং ইলিন অগার – এটা ছবিটিকে একঝলক দেখেই চেনা যায়। এমনকি যখন অন্য কোনো নারীর প্রতিকৃতি আঁকছেন তাঁরা, সেখানেও তাঁদের বিদ্রোহের অস্বীকারের জোরালো পাঞ্জার ছাপ এই শিল্পীরা সেইসব নারীর মুখে ঘন লাল নিম্নরেখা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন
    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হতে ১৯৩৯ সালে অধিকাংশ পরাবাস্তববাদী বিদেশে পালিয়ে যান এবং তাঁদের মধ্যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও বক্তব্য নিয়ে খেয়োখেয়ি বেধে যায় । অলোচকরা মনে করেন যে গোষ্ঠী হিসাবে পরাবাস্তববাদ ১৯৪৭ সালে ভেঙে যায়, প্যারিসে “লে সুররিয়ালিজমে” প্রদর্শনীর পর । যুদ্ধের শেষে, প্যারিসে ব্রেতঁ ও মার্সেল দ্যুশঁ’র ফিরে আসার পর প্রদর্শনীর কর্তারা সম্বর্ধনা দিতে চাইছিলেন কিন্তু পুরোনো পরাবাস্তববাদীরা জানতে পারলেন যে একদল যুবক পরাবাস্তববাদীর আবির্ভাব হয়েছে, যাঁরা বেশ ভিন্ন পথ ধরে এগোতে চাইছেন । যুবকদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ফ্রাঁসিস বেকঁ, আলান দাভি, এদুয়ার্দো পোলোৎসি, রিচার্ড হ্যামিলটন প্রমুখ ।
    সুররিয়ালিজমের উদ্ভব সত্ত্বেও ডাডার প্রভাব কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি, তা প্রতিটি দশকে কবর থেকে লাফিয়ে ওঠে, যেমন আর্পের বিমূর্ততা, শুইটারের নির্মাণ, পিকাবিয়ার টারগেট ও স্ট্রাইপ এবং দ্যুশঁ’র রেডিমেড বস্তু বিশ শতকের শিল্পীদের কাজে ও আন্দোলনে ছড়িয়ে পড়ছিল । স্টুয়ার্ট ডেভিসের বিমূর্ততা থেকে অ্যান্ডি ওয়ারহলের পপ আর্ট, জাসপার জনসের টারগেট ও ফ্ল্যাগ থেকে রবার্ট রাউশেনবার্গের কোলাঝে -- সমসাময়িক সাহিত্য ও শিল্পের যেদিকেই তাকানো হোক পাওয়া যাবে ডাডার প্রভাব, সুররিয়ালিজমের উপস্হিতি । ১৯৬৬ সালে মৃত্যুর আগে, ব্রেতঁ লিখেছিলেন, “ডাডা আন্দোলনের পর আমরা মৌলিক কিছু করিনি । ডাডা ও সুররিয়ালিজম আন্দোলনকারীদের ওপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং কয়েকজন আত্মহত্যা করেন, যেমন জাক রিগো, রেনে ক্রেভেল, আরশাইল গোর্কি, অসকার দোমিংগেজ প্রমুখ । অত্যধিক মাদক সেবনে মৃত্যু হয় গিলবার্ত লেকঁতে ও অঁতনা আতোর ।
  • Rupa ray | 2409:4060:2d36:856b::2e48:6f04 | ২১ আগস্ট ২০২৩ ০৭:২৭740636
  • রুপা রায় 
  • মলয় রায়চৌধুরী | 2401:4900:1c20:1d48:596d:3d2:148e:4373 | ২১ আগস্ট ২০২৩ ১১:০৬740639
  • জিরো নম্বর মানুষ

    ইংরেজগুলো আসার আগে চট আর পাট তো একই জিনিস ছিল না । শনের সুতোর মোটা কাপড় ছিল চট, এখন যা দিয়ে গানিব্যাগ তৈরি হয় মিলগুলোয় । বিদ্যাপতি লিখেচিলেন, ‘চটের চান্দয়া খসায় চটের মসারি।’ চট কথাটার মধ্যেই কেমন একটা ছ্যাঁচড়ামি লুকিয়ে । চটকলের সাইনবোর্ড-সর্বস্ব ট্রেড ইউনিয়ানগুলো কথাটায় নিজেদের পাঁয়তাড়া ঢুকিয়ে আরও নোংরা করে দিয়েছে, একেবারে ভ্রষ্ট, পতিত, উদ্ধারের অযোগ্য । সাইনবোর্ড হল ক্ষমতার উৎস । তাতে থাকে মসনদের ছাপ্পা, তাই । বোর্ড ঝুলিয়ে, চেয়ার-টেবিল পেতে ফ্যালো, মসনদি রঙের ঝাণ্ডা ওড়াও, ব্যাস, যত ইচ্ছে অন্যদের বুকনি ঝাড়ো, মাইকচোঙে বকমবকম বকে যাও ।
    পাটের জন্নত থেকে চটের জাহান্নমে পৌঁছে দেবার জন্যে কাকে যে দায়ি করবেন, জানেননি খালেদালি মণ্ডল । বিলেতের মেম-সায়েবগুলোকে ? যাঁরা লাটবাহাদুরের পেছন-পেছন স্কটল্যাণ্ডের ড্যাণ্ডি থেকে এসেছিলেন চটের ব্যবসা করতে ? জর্জ অকল্যাণ্ড নামে লোকটাকে, যেনি ১৮৫৫ সালে হুগলি জেলার রিষড়েতে প্রথম চটকলটা পত্তন করেছিলেন ? খালেদালির দাদুর আব্বা ঢুকেছিলেন মিলটায় কুলি হয়ে । হেল্পার হয়েছিলেন । দাদু তো হয়েছিলেন সরদার । সরদার ওঁদের পদবি নয়, তবু দাদুর নাম হয়ে গিয়েছিল হেদায়েত সরদার ।
    হেদায়েত সরদারের বাপ পাটতাঁতি ছিলেন । পাটের তাঁত । বিশ্বাসই করতে চান না খালেদালির ছেলে-মেয়েরা যে, পাটের তাঁত ছিল এককালে । সে তাঁতে চটকাপড় বোনা হত না । বোনা হতো পাটের শাড়ি । যিনি পরতেন তিনিই তো ছিলেন রাজার পাটরানি । বিলেতি সায়েবরা আসার আগে আমাদের তো আর চেয়ার ছিল না ; ছিল গদি, চটের গদি, রাজার জন্য পাটের রেশমের ওপর সিংহের চামড়া, সিংহাসন । শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল পালায় আছে তো, ‘পাটে কংস নরবর’। সে কবেকার লেখা গান । আরেকটা পালাগান আছে দুর্গাপঞ্চরাত্রির, ‘রামচন্দ্র পাটে রাজা হইলা।’ কিংবা শূন্যপুরাণ পালায়, সুনার পাটেত বেসাতির বৈসয়ে হাট।’
    এখন আর গাও না ক্যানে ?
    গলায় চটের ফেঁসো ঢুকে জাম হয়ে গেচে । ও সব গান আর গলা দে বেরুবেনি । খালেদালির বউ আফরোজা জানান, তবলিগ পার্টি বলে গেচে, হিঁদুর গান গাইবিনি । বাপ আর মেয়ের কথাবার্তার মাঝে মাথা গলান তিনি, ছেলেমেয়ের নিকাশাদি আছে, সমাজে থাকতি হয় । আরে, ওদের কথা ছাড়ো, তবলিগ করছেন আবার সিপিএম করছেন । না, এখন তো তৃণমূল । এখানেও সেই সাইনবোর্ড । চটকলের সাইনবোর্ড-নেতাদের দায়ে তো মিলগুলো ডুবল । ডুববেনি ? প্রথম পোয়াতির বুক আর পাটের পোয়াতির মুখ ।
    বলেচো ভালো । পাটের পোয়াতি, মানে যার ছেলেপুলে অনেক । আমাদের মিলে তো আঠারোটা ইউনিয়ান । আরও বিয়োবে শুনচি, ব্যালটের বিল পাস হবার আগে । সংস্হান নেই সংস্হা আছে ।
    তোমাদের তো সিটু, ইনটাক, আইটাক, এলএস, এইচ এম এস, বি এম এস, এন এফ আই টি উ, এম এল ও সি আরও কী কী যেন ?
    মিল গেচে বি আই এফ আর-এ, কিন্তু সাইনবোর্ড ব্যবসা চলচে পুরোদমে ।
    ওঁরাই আবার চুক্তি তদারকির মনিটারিং কমিটিতে । আমেদালিটা মাধ্যমিক পাস করলে ছেড়ে দেব এই জিরো নম্বর ওয়ার্কার কুলিগিরি ।
    চটকলের রেকর্ডে যে শ্রমিকের অস্তিত্ব নেই, তাঁরা জিরো নম্বর ওয়ার্কার । যতবার ধর্মঘত, লকআউট, সাসপেনশান অব ওয়র্ক হয়ে কারখানা বন্ধ হয়েছে, ততবার মিল খুলেছে মালিক বদল হবার পর । আর প্রতিবার স্হায়ী মজুর ছাঁটাই হয়েছেন । বেড়েছেন জিরো নম্বর ওয়ার্কার । জিরো ন্ম্বর ওয়ার্কারকে পুরো মজুরি দিতে হয় না । তাঁর জন্য পি এফ, গ্র্যাচুইটি, ই এস আই, ঝক্কি-ঝামেলা পোয়াতে হয় না । একটা পোস্টের জন্য দুটো করে শূন্য নম্বর কর্মী । কাংগাল চামার নামে মজুরটা পুলিশি হামলার পরে নিখোঁজ হয়ে গেলে, মিল যখন আবার খুলেছিল, তখন বদলি মজুরের কাজ থেকে ছাঁটাই হবে, ওই কাংগাল চামারের জায়গা ভরাট করতে ঢুকেছিলেন খালেদালি আর বৈকুন্ঠ নস্কর ।
    এক জনের জায়গায় দুজনের কাজ । ‘দুই জনারে কাম পাইয়া দিসি কমরেড’ , বলেছিলেন এক ট্রেড ইউনিয়ানের নেতা । কী বারফট্টাই ভাটিয়া বাবুলোগদের । অন্য শ্রমিকরা তবু স্হায়ী, বদলি, স্পেশাল বদলি, ক্যাজুয়াল, কনট্র্যাক্ট হন । খালেদালি-বৈকুন্ঠরা কিছুই হন না । ওঁরা আছেন, কিন্তু নেই । খালেদালিও স্হায়ী ছিলেন । তারপর বদলি, স্পেশাল বদলি, ক্যাজুয়াল হয়ে জিরো নম্বরে নেবেছেন ।
    ১৯৭০ সালে কুড়ি দিনের ধর্মঘট হয়েছিল, সাত থেকে ছাব্বিশ ডিসেম্বর । ১৯৭৪ সালে ১৫ই জানুয়ারি থেকে ১৫ই ফেব্রূয়ারি, ৩১ দিন । ১৯৭৯ন সালে টানা পঞ্চাশ দিন, পাঁচ জানুয়ারি থেকে তেইশ ফেব্রূয়ারি । ১৯৮৪ সালে ষোলো জানুয়ারি থেকে সাত এপ্রিল, চুরাশি দিন । ১৯৯২ সালে জানুয়ারি মাসে । ১৯৯৫ সালে নভেম্বরে । প্রায় একই সময়ে দু-হাজার সালে । বাজারে কাঁচা পাট আসে জুন-জুলাইতে । প্রতি মাসে দাম বাড়ে । ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দ্বিগুণ হয়ে যায় । ওই সময়ে ধর্মঘট হলে মালিকের সুবিধে । যাঁরা কাঁচা পাট খরচ করে ফেলেছেন, তাঁদের আর কিনতে হবেনি । দাম আক্রা । যাঁদের বেনামি গুদামে মাল আছে তাঁরা বিদেশে বেচে ডলার কামাবেন । কাঁচা পাটের গুদামগুলো মিল কমপাউণ্ডে নয়, তাই টের পাবার উপায় নেই । মালিকরা মিল চালান এক নামে, কাঁচা পাট কিনে গুদামে ঢোকান আরেক নামে । একই লোক, অথচ গুদাম থেকে মিলকে বেশিদামে কাঁচা পাট বিক্রি করেন যাতে মিলটা লোকসানে চলছে দেখান যায় ।
    বৈকুন্ঠ নস্কর বলেছিলেন, খালেদ, তুই এত জানিস, সব ফাঁস করে দিস না কেন ?
    ফাঁস ? কার কাছে ফাঁস ? সরকার জানেন, বিধায়ক জানেন, শ্রমমন্ত্রী জানেন, লোকাল ইউনিয়ান নেতা, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ান নেতা, পার্টিগুলো, কাগজের লোকেরা জানেন । সব্বাই সবকিছু জানেন ।
    ভগবান শুধু জানতে পারেন না ।
    না, আল্লা জানবেননি, তা কখুনো হয় !
    জানেন বলে খালেদালি আজ জিরো নম্বর। চটকলে আট ঘণ্টার কাজ শ্রমিকরা করেন দুটো শিফটে । চটের উড়ন্ত ফেঁসো আর ধুলোয় টানা আট ঘণ্টা কাজ করা অসম্ভব । প্রথম খেপে পাঁচ ঘণ্টা, তারপর কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে দ্বিতিয় খেপে তিন ঘণ্টা । কাংগাল চামার, থাকতেন কুলি ব্যারাকে, মিলের লাগোয়া, দুটো খেপ নিজেই করতেন । এখন পাঁচ ঘণ্টার খেপটা করেন খালেদালি আর তিন ঘণ্টার খেপটা বৈকুন্ঠ । ভাউচারে টিপছাপ দিয়ে মজুরির টুকরো-টাকরা পান । একজন টুকরো, অন্যজন টাকরা ।
    হেদায়েত সরদার, খালেদালির দাদু, কুলি ব্যারাকে ঘর পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু খালেদের বাপ সেটা ভাড়া দিয়ে দ্যান এক প্রাইমারি স্কুল শিক্ষককে । শিক্ষকের বড় ছেলে ছাত্র ইউনিয়ানের নেতা, তাই ভাড়া পাওয়া যায় না । তাছাড়া, তিনটে জিনিস খুবই দিষ্প্রাপ্য, হাওয়া, জল আর আলো । আর নোংরা কুলি ব্যারাক, তাই থাকা যায় না অমন বাসায় । খালেদের বাপ নেয়ামতালি সাত কাঠা জমি কিনে দু-মাইল দূরে কোতলবেড়িয়ায় থাকতেন দুই বউ আর সাত ছেলে-মেয়ে নিয়ে । খালেদের ভাগে দেড় কাঠার ওপর কুঁড়েঘর । বিজলিবাতি হুকিং করে পাওয়া । কেরোসিন এত আক্রা যে হুকিং ছাড়া উপায় নেই ।
    পাঁচ ঘণ্টার মজুরিতে চারজনের ছিয়ানব্বই ঘণ্টার পেট । বাকি সময়টা গান গেয়ে রোজগারের চেষ্টা । বলতে গেলে ভিকখে । কেউ যদি দ্যান তো দিলেন । বৈকুন্ঠ অন্তত ছুতোরের কাজটা ছাড়েনি । কাজের ফাঁকে, যদি পান ছুতোর মিস্ত্রির করার মতন কিছু, তিন ঘণ্টার খেপটা মেরে চলে যান । তাঁতির কাজটা খালেদালির শেখা থাকলে বাড়িতে সবাই মিলে গামছা-মোটাকাপড় তো বোনা যেত । যাঁরা স্হায়ী শ্রমিক তাঁদেরই, ১৮২৯ টাকা ন্যূনতম মজুরিতে, কাটৌতি বাদ দিলে, তো কথাই নেই, চলে না । একই কাজের জন্য, একই মজুরি পান না সবাই । শ্রমিক মানে তো শ্রমের দাস । অসুখ-বিসুখে পড়লে পাঁচ ঘণ্টার কাজটাই চলে যাবে । আঠারোজন ইউনিয়ান কত্তা তক্কে-তক্কে থাকেন সবসময় । কাউকে কাজ পাইয়ে দিলেই ভাগা দিতে হয় কত্তাদের ।
    তিমি মাছ মারা বেশি করে আরম্ভ হল বলে পাট তাঁতিদের মরণ হয়েছিল দেড়শ বছর আগে । তিমির তেল দিয়ে চটের কাপড় ব্লিচ করা আবিষ্কার হতেই তো সুতির কাপড় বোনার কলে একটু অদল-বদল করে সায়েবরা তড়িঘড়ি চটকল বসাতে লাগলেন । ১৮৭০ সালে ওব্দি পাঁচটা চটকল বসে গিয়েছিল এ-তল্লাটে । একশ একটা চটকল ছিল দেশভাগের সময় ।
    দেশভাগ ! কোনো মানে হয় ! কার কেমন নুনু সেই অনুযায়ী দেশভাগ । যাঁদের নুনুর খোসা ছাড়ানো, তাঁদের জন্য একটা দেশ । যাঁদের আস্ত তাঁদের জন্য আরেকটা দেশ । বাপ নেয়ামতের কাছে সেসব গল্পগাছা শুনেছেন খালেদ । উনি নিজে তো জন্মেছেন দেশভাগের দশ বছর পর । নেয়ামত ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে চাননি । পাগল নাকি । জানি না, চিনি না, দেখিনি, সেখানকার জনমনিষির কথা বুঝিনে, কেন ছুটব সেখানে ? নুনুর খোসা ছাড়ানো বলে ? সে তো সারা দুনিয়া জুড়ে দেশে-দেশে অমন । সবাই উদিকে ছুটচে নাকি ? মারামারি কাটাকাটি অমন হয়ই । নিজেরাই সামাল দাও । বর্গিরা যখন আসত ত্যাখন তো নিজেরাই সামলিচি । তবে ?
    সদামাল দিতে নেয়ামতের অসুবিধা ছিল না । গর্দা সাফাই কুলি ছিলেন নেয়ামতের দুই বউ । চটকলের গর্দায় যক্ষ্মা হয়ে মরেছিলেন বড়টি । ছোটটির চাকরি গেল ১৯৭৪ সালের ধর্মঘটের পর । সারা পশ্চিমবাংলায় চল্লিশ হাজার জেনানা শ্রমিককে খেপে-খেপে ১৯৭০ সালের ধর্মঘটের পর ছাঁটাই করে দিয়েছেন চটকল মালিকরা । বাঙালিরা যত আধুনিক হয়েছেন ততই কমেছেন নারী শ্রমিক । এখন উনষাটটা রুগ্ন মিলে হাতে গোনা কজন । ফুলটাইম চটকল শ্রমিক মা-বাপের ছেলে কিনা জিরো নম্বর কর্মী ।
    চাকরি গিয়ে বেঁচে গিসলেন আম্মি । যেখানটায় সাফাই করার কাজ বরাদ্দ ছিল, সেখানেই ১৯৯৩ সালের ফেবরারিতে কারখানার ভেতর পায়খানার চেম্বার ফেটে মারা গিসলেন তিনজন কুলি । ইংরেজরা যাবার পর আর পোষ্কার হয়নি । মালিকের লোক বলেছিলেন, মিল তো চলে লোকসানে, পোষ্কার করবার ট্যাকা কোথায় । ইউনিয়ানের লোক বলেছিল, ‘আমরা কী করুম কন কমরেড, সটকলের হাল ভালো না, দ্যাখতাসেন তো থুঁকতাসে।’
    ধুঁকতাসেন তো সবাই । কুলি লাইনে বর্ষাকালে যে পাঁক জমে, তাতে ফি-বছর আন্ত্রিকে মরে বাচ্চারা । দিনের বেলায় ডাঁশ ওড়ে । গতবছর ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় মরেছেন তিনজন উড়িয়া মজুর । জিরো নম্বর নয়, স্হায়ী ছিলেন তাঁরা । যাঁরা টিকে আছেন তাঁরাও ধুঁকতাসেন । রোজই ভয়ে-ভয়ে কাজে যান । গিয়ে হয়ত দেখবেন, গেটে কারখানা বন্ধের নোটিশ ঝোলানো । ইউনিয়ান নেতারা অফিস বন্ধ করে হাওয়া । খালেদালি অনেকবার দেখেছেন অমন কাণ্ড । মিল বন্ধ হলে যাদব, কুর্মি আর বিহারি মুসলমানরা লালু যাদবের রাজ্যে আলু চাষের কাজে চলে যান কিংবা কোনো ধান্দাবাজির ফিকিরে । খালেদালি আর কোথায় যাবেন । ব্যাণ্ডেল বর্ধমান শ্রীরামপুর হাওড়া কলকাতায় গান গেয়ে ভিককে করতে বেরোন । শহরের তুলনায় শহরতলীতে রোজগার বেশি । কুলিগিরি ছেড়ে ভিকিরি হবার লোভ পেয়ে বসে অনেক সময়ে ।
    মিল বন্ধ হয়, আবার খোলে । আবার খুলবে, এই উদ্বেগে, আর হয়ত খুলবে না, এই আতঙ্কের মাঝে, দোল খান ওঁরা । সিধো কানহো ডহরে মজুরের কাঁচাপাকা চুল আর শিড়িঙ্গে মুখ আবিরে লাল-সবুজ হয় । নানা কিসিমের নেতা ভাষণ দেন সংগ্রামী সাফল্যের । তারপর আবার যে-কে সেই । বছর ঘুরতেই চুক্তি আঁস্তাকুড়ে । সব কর্মীকে জিরো নম্বর না করলে মিলের হাল ফিরবেনি । যে মিলে যত জিরো নম্বর সে চটকল তত ভালো চলে । তাঁরা ডিভিডেণ্ড বিলি করেন, মিল বন্ধ করতে চান না । ওই তো চাঁপদানি, ডেল্টা, একতা, বিড়লা, ল্যাডলো, কত ভালো চলছে, বিদেশে মাল যাচ্ছে, বাজারে শেয়ার ছেড়েচে ।
    বৈকুন্ঠ নস্কর বলেছিলেন, আর কোনো কাজে জিরো নম্বর কর্মী নেই কেন বলো দিকিন ।
    সত্যি তো, জিরো নম্বর প্রথানমন্ত্রী হন না কেন ? জিরো নম্বর সাংসদ ? বিধায়ক জিরো নম্বর ? জেলাধিপতি ? পঞ্চায়েত প্রধান ? মিলমালিক ?
    আরে মিলমালিক তো জিরোর চেয়ে অধম, বলেছিলেন বৈকুন্ঠ ।
    তা একখানা জবর বলেচ বটে । মিলটা তো বসিয়েছিল টমাস ডাফ । তারপর কিনলে হেনরি ব্রাউন । তারপর ব্রেইলি । সেই থেকে ভাড়ায় খাটছে মিলটা । মালিক বলে কিছু নেই ।
    কখনো মেহতা, কখনো দুগার, বাজোরিয়া, সারদা, পাসারি । আসল বাচ্চা যে কার, কেউ জানে না । রাঁঢ়ের বাচ্চা ।
    ফলে আবার ক্লোজার । খালেদালি মণ্ডল বেরিয়ে পড়েছিলেন ভিককের পর্যটনে । অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন টালা পার্কের কাছে, কলকাতায় । পেটে দানা পড়েনি কদিন । পাবলিক চ্যাংদোলা করে আর জি কর হাসপাতালে সোপর্দ করেছিলেন । কুড়ি দিন পর মারা যেতে তদন্তের জন্য গিয়েছিলেন পুলিশ মর্গে । ময়না তদন্তের কাটাছেঁড়ার পর কালো পলিথিন প্লাসটিকে মোড়া অন্ধকারে আবদ্ধ ছিলেন । খালেদের ছেলে আর কোতলবেড়িয়ার গ্রামবাসীরা সেই প্লাসটিক পুঁটলি নিয়ে ফিরেছিলেন গাঁয়ে । একটাই বডি ছিল, তাও ওনারা দ্যাখেননি প্লাসটিক খুলে । খুলতে সাহসও হয়নে । কেমনধারা কাটাছেঁড়া কে জানে । প্লাসটিকের গায়ে লেবেলে খালেদালি মণ্ডল নাম লেখা ছিল ।
    কোতলবেড়িয়া পৌঁছে, শবকে পবিত্রকরণের জন্য বের করতে গিয়ে সবাই থ । কান্নাকাটি স্তব্ধ । এ তো খালেদালি মণ্ডল নয় । এর পায়ে তো দিবাকর যুগির লেবেল সাঁটা । ম্যাটাডর ভ্যানে শব চাপিয়ে আবার ফেরত পুলিশ মর্গে, কলকাতায় ।
    নিয়ে যাবার সময় দ্যাখেন নাই কেন ?
    স্যার, একটাই বডি ছেল । পলিথিনের ঢাকনায় আব্বার নামের লেবেল ছেল ।
    ময়না তদন্তের পর থানা থেকে ডিসপোজাল অর্ডার বা দেহ নিয়ে যাবার আদেশের কাগজ দেখে তবেই মর্গ থেকে মৃতদেহ নিয়ে যেতে দ্যান ওয়ার্ডমাস্টার । ডিসপোজাল অর্ডার দেয়ার পরে তা নিয়ে ওয়ার্ডমাস্টার কিংবা ডোমেরা কী করছেন তা দেখার কাজ আমাদের নয়, বললেন পুলিশ ইন্সপেক্টর কালীশঙ্কর জানা । যান, ডাক্তারবাবুকে জিগেস করুন গিয়ে ।
    ডাক্তার পার্থসারথি গুপ্ত, যিনি ময়নাতদন্ত করেছেন, জানালেন, আপনারা শোকে মূহ্যমান বলে হদিশ করতে পাংরছেন না । দেহটা আপনার বাবা খালেদালি মণ্ডলেরই । দিবাকর যুগির হলে তো সে দেহ ফেরত চলে আসত আগেই ।
    স্যার এটা মুসলমান পুরুষের দেহ নয় ।
    ডেড বডির আবার ধর্ম হয় নাকি ? আমাকে জ্ঞান দেবেন না । মৃতদেহ শনাক্ত করার পরেই তো মর্গের রেজিস্টারে সই করে নিয়ে গেছেন ।
    কিন্তু এই দেহ তো আমাদের পক্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় ডাক্তারবাবু । মুসলিম সম্প্রদায়ে মৃতকে বাড়িতে নিয়ে যাবার পর স্হানীয় মানুষ তাঁর মুখ দ্যাখেন । দেহকে চান করানো হয় । তারপর জানাজা বেরোয় ।
    আমি আর কি করতে পারি !
    কোতলবেড়িয়ার লোকজন পুলিশের বড়কর্তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন । আহা, উনি তো আর ফিরবেন না, বিষয়টা মিটিয়ে ফেলুন না ।
    মিটমাট ? কী বলছেন স্যার !
    আচ্ছা আমরা দেখছি । দিবাকর যুগির ভেরিফিকেশানের জন্য ওয়ারলেস করা হয়েছে । কাল আসবেন । বডি মর্গে ফেরত দিয়েছেন ?
    হ্যাঁ স্যার ।
    অসুস্হ লোককে বাড়ি থেকে বেরোতে দেন কেন ? ওনার পকেটে এলিজাবেথ জুট মিলের কাগজ না থাকলে তো লাশ বেওয়ারিশ হয়ে যেত । তার ওপর আবার আমাদের কাছে জুট মিলের যে লিস্ট আছে তাতে তো দেখছি এলিজাবেথ মিলের কোনো উল্লেখ নেই । ডিসি সদর কথাগুলো বলার সময়ে সৎ ভাবেই বিরক্তি জানালেন ।
    খালেদালির ছেলে আর ওনার কাকারা একযোগে আঁৎকে ওঠেন, কী বলছেন কী সায়েব, ওই চটকলেই তো কাংগাল চামারের নিখোঁজ হবার কেস হয়েছিল । সিবিআই এনকোয়ারি হয়েছিল । আদালতে মামলা চলছে আজ ক’বছর ।
    টেবিলের ওপর থেকে পুস্তিকাটা তুলে পাতা ওলটান আমিনুল । উনিই একমাত্র ইংরিজি জানেন, শার্ট ফুলপ্যান্ট পরেন । বাকি সবাই লুঙ্গি-গেঞ্জি বা কুর্তা । আমিনুল, খালেদালির ছেলে ঘিরে, রুদ্ধশ্বাস ।
    তালিকাটায়, পশ্চিমবঙ্গে চালু চটকলগুলোর লিস্টটায়, বারবার চোখ বোলান খালেদালির ছেলে, ওপর থেকে নিচে আর নিচে থেকে ওপরে । সত্যি এলিজাবেথ চটকলের নাম নেই । কাংগাল চামারের লাশের সঙ্গে মিলটাকেও হাপিশ করে দিয়েছে ।
    সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে এক চশমাচোখ টেকো কালো হোঁৎকা বসেছিলেন চুপচাপ । পুস্তিকাটা মৃতের ছেলের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মন্তব্য করলেন, ‘ইংরেজগুনো বিদেয় হতেই চটকলগুনো বন্ধ করে দেয়া উচিত ছিল । যত্তোসব ক্রিমিনালের ডেন । কী উবগার হয়েছে শুনি বাঙালিদের ? মজুরগুনো তো সব উড়ে-খোট্টা-তেলেঙ্গি, আর মালিকগুনো মেড়ো কিংবা গুজু ।’
    সিঁড়ি দিয়ে নাবতে-নাবতে মৃতের সৎভাই বললে, শালা বোধহয় নবোজাগড়নঅলা ।
    মৃতের আত্মীয় জ্ঞাতি-প্রতিবেশিদের মগজ থেকে সে মুহূর্তে মৃতের উবে যাবার বদলে এলিজাবেথ জুটমিলের উবে যাওয়াটাই দুশ্চিন্তা হয়ে ঘিরে ধরেছে ।
    মৃতের চাচা : মিলটাই কি না জিরো নম্বর করে দিয়েচে ।
    মৃতের বড়ভাই : প্রথমে কাংগাল চামারের কোর্ট কেসকে জিরো নম্বর করেছেল ।
    মৃতের ছোটোভাই : আলামোহন দাসের পর চটকলে তো বাঙালিরাই জিরো নম্বর ।
    মৃতের সৎভাই : এবার পাট হতে চলল জিরো নম্বর ।
    মৃতের ছেলে : লিজ কাকে বলে ?
    মৃতের সহকর্মী : মাসে মাসে ভাড়া না দিয়ে একলপ্তে কিছুকালের জন্যে ।
    মৃতের ছেলে : আর টেকওভার ?
    মৃতের আরেক সহকর্মী : কাঁচা পাটের দাম অনেক বকেয়া পড়লে মহাজনের হাতবদল ।
    মৃতের ছেলে : মালিকানা তো দেখলুম সিনেমা প্রযোজক আরন বিল্ডিং প্রোমোটারের ।
    মৃতের চাচা : সব কাঁচা পাটের দালাল, শেয়ার মার্কেটে চটকলের টাকা খাটায় ।
    মৃতের ছেলে : এরাই কি ক্রিকেট বুকি ? ইস্টবেঙ্গল – মোহনবাগান গড়াপেটায় খরচ যোগায় ?
    মৃতের বড়ভাই : সল্টলেক আলিপুরের বাড়িগুনোও তো টেকওভার করেচে ।
    মৃতের চাচা : কী টেকওভার করতে বাকি রেকেচে ?
    মৃতের বড়ভাই : আমাদের কথাবার্তাও তো টেকওভার করে নিচ্চে ওরা ।
    মৃতের সহকর্মী : ট্রেড ইউনিয়ানগুলোকে নিয়েচে ।
    মৃতের ছেলে : পার্টিগুলোকে নিয়েচে ।
    মৃতের সহকর্মী : পুরো দেশটাকেই জিরো নম্বর করে দিল ।
    দিবাকর যুগি ছিলেন খেতমজুর । বৈদ্যনাথ পাল যে জমিটা পার্টিকে বলে-কয়ে বর্গা পেয়েছিলেন, তার নাবাল অংশটা ফি-বছর পাঁচ মাসের জন্যে পেতেন । বৈদ্যনাথবাবুর অন্য অংশে সারা বছর মাঙনায় কাজ করার মজুরি হিসেবে । মে মাসেও জল জমে থাকত বলে, শুকনো পাটকাঠি চুবিয়ে রাখার আর ফেঁসো বের করার সুবিধে । ফেবরারি থেকে মে কিংবা জুন । ধারকর্জ পালবাবুই দিতেন । উনি আরও অনেক চাষির পাট কিনে ব্যাপারিকে বেচেন । ব্যাপারি বেচেন আড়তদারকে । আড়তদারের মাল তোলেন পাটের দালালের লোক । তাঁরা চটকলের পাটমজুতদারকে বেচেন । মিল কেনে মজুতদারের কাছ থেকে । এত উঁচু সিঁড়ি থেকে পাটের দাম নাবতে-নাবতে দিবাকরের জন্যে বাঁচত না লাভ করার মতন কিছু । তারপর চটকলে ধর্মঘট ক্লোজার লকআউট সাসপেনশান অব ওয়র্ক তো আর দিবাকরকে আগাম জানিয়ে হয় না । তখন কাঁচা পাট যে দামে পারা যায় বেচে দিতে হয় দিবাকরকে । অথচ তখনই আড়তদারের কেনার ধুম । ঘন ঘন ট্রাক বোঝাই হয় । ধর্মকাঁটায় ওজন হয়ে চলে যায়।
    বদ্যিনাথবাবু জেনে নিতে পারেন ব্যাপারির কাছে, তোষা-তেইশি নাকি সাদা পাটের বীজ বুনলে লাভ । তোষা-তেইশির টিভি-তিন বীজ আর সাদার ডাবলু-তিন বীজের পাট বেশি দামে বিকোয় । আষাড় থেকে আশ্বিন ওব্দি হপ্তায়-হপ্তায় দাম বাড়ে । ব্যাপারি পরশুরাম সাহার গুদাম আছে তুফান গঞ্জে আর মাথাভাঙায় । আড়তদার চাপ না দিলে মাল ধরে রাখেন । বড় একটা পারেন না ধরে রাখতে । ফরোড ব্লক ছেড়ে সিপিয়েম করতে গিয়ে হ্যাঙ্গামে ফেঁসেছেন কমরেড বদ্যিনাথ । যে তল্লাটে যারা বেশি তাদের সঙ্গেই থাগগি যা না বাপু । তবে টিভি-তিন আর ডাবলু-তিনের একর প্রতি ফলনটা কম, বড্ড খেয়াল রাখতে হয় । তার চেয়ে টিভি-পাঁচ কিংবা ডাবলু-ছয়ের ফলন বেশি, আর প্যাঁকাটি পচতে ঝক্কি-ঝামেলা কম । কোমরজল ডোবাগুলোয় থাকতে-থাকতে পচা প্যাঁকাটি থেকে বাড়িসুদ্দু সবাই হপ্তা দুয়েকে পাট বের করে নাও । ভাদ্দর মাসের রোদে শুকুতে পারলে ডাবলু-তিন কি চারের পাট তো ঐ্যাকেবারে সোনার জল-চড়ানো রুপো, চোখ জুড়িয়ে যায় দেখে।
    পাটের ভালোমন্দ ছাঁটাই করে বেল বানিয়ে ব্যাপারিই পাঠায় আড়তদারকে । সে ব্যাটা মারোয়াড়ি ব্যাবসাদার, প্রতিটি বেল ওজন করে দেখে নেয় পাক্কা আশি কিলো আছে কি না । বছর বিশেক আগে তো এক হেক্টরে পাঁচ-ছ বেল তৈরি মাল বেরোত । এখন সার আর কীটনাশক দিয়ে দশ-এগারো বেল মাল ওঠে । অথচ চাষির অবস্হা বছর-বছর খারাপ হয়ে চলেছে ।
    জুট কর্পোরেশান এ-বছর থেকে পাট কেনা বন্ধ করে দিলে । বদ্যিনাথবাবু এর আগে বার দুয়েক জুট কর্পোরেশানকে মাল বেচার চেষ্টাচরিত্তির করেছিলেন । ব্যাপারি আরআর আড়তদার এমন ধাতানি দিয়েছেন যে বাপের জমমে ওমুখো হবেন না । দিবাকর তো বর্গাদারের খেতমজুর, ওসব উঁচু মনিষ্যিদের কাজে নাক গলাবেন কেন । কলকাতার পার্টির র‌্যালিতে যাবার জন্যে বাড়ির সবাইকে মাথাপিছু একশ টাকা দেন বদ্যিনাথবাবু, তা কি চাড্ডিখানি কথা ! তাছাড়া জুট কর্পোরেশান তো নিজেই অসুখে ভুগছে ।
    –বুঝলে দিবাকর, কেন্দ্রীয় সরকার কাঁচা পাটের সহায়ক মূল্য কুইন্টাল প্রতি ন’শো টাকা বেঁধেছে এ-বছর ।
    –আজ্ঞা হ্যাঁ ।
    –পশ্চিমবঙ্গের দুশো আটটা জুট কর্পোরেশান আপিসের বেশিই তো আগে থাকতে বন্ধ । ওদের পাট দিয়েই এন জে এম সির পাঁচটা মিল চলত ধিকিয়ে-ধিকিয়ে ।
    –আজ্ঞা হ্যাঁ ।
    –ওই পাঁচটা চতখলও তার মানে বছর কয়েকে বন্ধ হয়ে যাবে । আকাশে শকুন উড়তে লেগেছে । কাঁচা পাটের ফাটকাবাজার জমবে । বাবুরা তিরিশ বছরেই ঝাঁঝরা করে দিলে জেসিকে ।
    –আজ্ঞা হ্যাঁ । কই শকুন দেখতাছি না ।
    –মাস দুয়েক পাটটা ধরে রাখতে হবে আমাদের । পঁচানব্বুই সনে টিভি-পাঁচের দাম দেড় হাজার টাকা কুইন্টাল উঠেছিল । মনে আছে ? মাসে দুই-এক বেলা মুড়ি খেয়ে থেকো ।
    –আজ্ঞা হ্যাঁ ।
    –তাছাড়া কলকাতায় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে র‌্যালি আছে একটা, আসছে সোমবার । যাবার সময় টাকা আর ঝাণ্ডা নিয়ে যেও ।
    –আজ্ঞা হ্যাঁ । কুন ঝাণ্ডা এবার ?
    –এখনও খবর আসেনি । সে তোমায় ভাবতে হবে না । ন’টন করা পাট নিয়ে আড়তদারের লরি যাচ্ছে ফাটকার জন্যে । ওতে চেপেই দশজন করে লোক চলে যাও । গুদোমগুলো দেখে রেখো ।
    কলকাতায় র‌্যালি-সমাবেশে গেলে অনেক খবর পান দিবাকর । গতবার বজবজ জুট মিলের দিনমজুর মদনবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছেল, এখন চাগরি গিয়ে আইসক্রিম বেচেন, হানিফভাই রিকশা চালান, গৌরবাবু রাস্তায় গামছা বেচেন । ওই মিলের বারোজন মজুর আত্মহত্যা করেছেন । ওখানকার কয়াল সড়ক আর চড়িয়াল বাজারে গিয়েছিলেন দিবাকর । আত্মহত্যা করা কেন ! কোনো উপায়ই কি নেই ?
    –উপায় আর কই দাদা ? ছমাস র‌্যাশান তুলতে পারিনি বলে কার্ড বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে । আগে জানলে কার্ডটা কিছু দিনের জন্যে বেচে দিতুম বা বন্ধক দিতুম কাউকে ।
    –ধার দিয়ে-দিয়ে তো আমার কাপড়ের দোকান উটে গেল । কেউ শোধ দিতে পারেনি ।
    লাউডস্পিকারে কে একজন, অত দূরে ডেঁওপিঁপড়ের মতন দেখাচ্ছিল, বললেন, বেশ মনে ধরেছিল দিবাকরের, ‘শ্রমিক সাথিগণ ! এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে ১৮৮৪ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণির দুরবস্হা হ্রাস পায়নি।’
    –১৮৪৮ কেন গা ?
    –বুড়ো, তোমার দাদুন জন্মেছিল সে বছর, হ্যাঃ হ্যাঃ ।
    শুনে, দিবাকরের প্রথমবার খেয়াল হল, সত্যইই বুড়ো হয়ে গেছেন, ষাট-পঁয়ষট্টি হবে । এসব সমাবেশে হাজিরা দেয়াটা স্বাস্হ্যে কুলোয় না ।
    সঠিকই ভেবেছিলেন দিবাকর । সভা ভাঙলে ভিড়ের চাপে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন ছেলে আর ছেলের বোউ থেকে । অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন গরমে । হাসপাতালে জনগণ চ্যাংদোলা করে বাসে চাপিয়ে নিয়ে গেলে ডাক্তার বললে, রেনাল ফেলিয়র হয়ে মারা গেছেন । বদ্যিনাথবাবুর দৌড়ঝাঁপে দিবাকর যুগির মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেল পুলিশ মর্গে ।
    ভাগ্যিস বদ্যিনাথবাবু ছিলেন । নইলে লাশ খালাসের পাঁচশো টাকা মর্গের ডোমকে দেবার মতন রেস্ত দিবাকরের সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের কারোরই ছিল না । মৃতদেহ ছিলেন কালো পলিথিনে মোড়া । ডোম বললেন, এইটে আবনাদের, ওইটে একটা নেড়ের, খালেদালি মণ্ডলের ।
    –ভালো যে তুমি বলে দিলে । শেষে মুসুলমানের মড়া ছুঁয়ে জাতধম্ম যেত ।
    –হুজুর আমরা হলুম ডোম । আমাদের কাজই সেবা করা । লোকে মরে গেলেও আমরা তার সেবা করি ।
    আড়তদারের যে-লরি মজুতদারের গুদামে কাঁচা পাট নাবিয়ে ফিরে যাচ্ছিল, তাতেই তোলা হল দিবাকরকে । কলকাতায় মকড়া পোড়াতে অনেক খরচ আর হাজার হ্যাঙ্গাম । পলিথিনটা বর্ষাকালে কাজে দেবে ।
    মৃতদেহ নিয়ে মাথাভাঙায় পৌঁছোবার পরেই বরং আরম্ভ হল হ্যাঙ্গাম । লোকাল থানায় আগেই কলকাতা থেকে ওয়ারলেস এসে গিয়েছিল যে, ওই সব আসলে খালেদালি মণ্ডল নামে এক চটকল মজুরের । পৌঁছোনো মাত্র যেন কলকাতায় ফেরত পাঠানো হয় । ডেড বডি বদলা-বদলি হয়ে গেছে । পুলিশমন্ত্রী ও স্বাস্হ্যমন্ত্রী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ।
    ওসি ভক্তিভূষণ কুণ্ডু ওয়ারলেসের কপি হাতে পাবার আগেই দুপুরে টিভিতে খাসখবর প্রোগ্রামে স্বস্হ্যমন্ত্রীকে বলতে শুনেছেন, ‘হাসপাতালে কোনো রোগী যতক্ষণ বেঁচে থাকেন, ততক্ষণই দায়িত্বটা বর্তায় স্বস্হ্য দফতরের উপরে । রোগীর মৃত্যুর পরে মৃতদেহ পুলিশ মর্গে চলে গেলে পুরো দায়িত্ব গিয়ে পড়ে পুলিশের উপরে ।’ আবার লালবাজারে গোয়েন্দা প্রধানকে ওসি বলতে শুনেছেন, ‘হাসপাতালের মর্গ থেকে মৃতদেহ উধাওয়ের যে-ঘটনা ঘটেছে, তার দায়িত্ব কোনোমতেই পুলিশের নয় । হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই পুরো বিষয়টি দেখেন ।’
    অবস্হা বেগতিক বুঝে ওয়ারলেস বার্তা পাওয়া মাত্র দিবাকর যুগির চালাঘরে পৌঁছেছিলেন ওসি ভক্তিভূষণ কুণ্ডু । সঙ্গে এ এস আই নারায়ন সান্যাল । জিপ থেকে নেবে তাঁরা দেখলেন শবকে পলিথিন মোড়ক থেকে খুলে কাঁচা বাঁশের খাটে শোয়ানো হয়েছে ।
    –এই যে বদ্যিনাথবাবু রয়েছেন দেখছি । কলকাতা থেকে অর্ডার এসেছে এই ডেড বডি ইমিডিয়েটলি ফেরত পাঠাবার । বডিটা খালেদালি মণ্ডলের ।
    –কী বলছেন কী ! কুড়ি বছর আমার খেতের কাজ দেখছে দিবাকর আর আমি চিনব না ? ওর বাড়ির লোকেদেরই জিগ্যেস করুন ।
    –হ্যাঁ, ইনি আমার বাবা দিবাকর যুগি ।
    –প্রমাণ কী ?
    –প্রমাণ আবার কিসের ? বাবাকে আমি চিনব না ? বললেই হল খালেদালি মণ্ডল !
    –কী বিপত্তি বলো দিকিন ! কলকাতা থেকে জেলা সদরে হুকুম এসেছে যে ডেডবডিটা সিজ করে ফেরত পাঠাতে হবে । জেলা শাসকের আদেশে একটা ম্যাটাডর ভ্যান সিজ করা হয়েছে, বরফের ফ্যাকট্রিকে ছ’স্ল্যাব আইস দেবার আদেশ হয়ে গেছে, অথচ আপনারা বলছেন ইনি হলেন দিবাকর যুগি । কাকে ঠিক বলে মানব ? আমার ওপরঅলাদের না আপনাদের ?
    আচ্ছা, আপনারা একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, আমরা একটু চেক করেনিই, বললেন ওসি ।
    বদ্যিনাথ পাল, এই তল্লাটের ডাকসাইটে রাজনৈতিক ফোড়ন, কলকাতার হুকুমের চেয়ে স্হানীয় হুকুমের আধিপত্য যে বেশি, তা দেখাবার চেষ্টায় বললেন, মরা লোকের আবার চেক করাকরির কী আছে ? বডি তো কাটাছেড়াঁ করায় আগেই দোরমা হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি দাহসংস্কসর করে ফেলা দরকার । তা আপনি যখন জোরাজুরি করতে চাইছেন, তখন দেখে নিন কী-কী চেক করার আছে, আমরা বাইরে গিয়ে অপিক্ষে কচ্চি । ভোটাত আইডেনটিটি কার্ডটা করিয়ে দিলুম, সেটাও হারিয়ে ফেলেচে দিবাকর ।
    –তা হলেও হয় । বডির বদলে বডির কাগজ সিজ করলেই চলে যাবে ।
    –অ্যাই দ্যাখো না, আইডেনটিটি কার্ডটা খুঁজে ।
    আত্মীয়স্বজনের কান্নাকাটি, ওসি ভক্তিভূষণ কুণ্ডু আর তাঁর বাপের বয়সী এ এস আই নারায়ণ সান্যালকে দেখে থেমে গিয়েছিল আগেই । ওনাদের গাঁয়ে ঢুকতে দেখে দিবাকরের আঙনায় ইতিমধ্যে প্রায় তাবৎ ভোটার আর হবু ভোটার জড়ো হয়েগিয়েছিলেন নতুন আহ্লাদের খোঁজে । গাঁয়ে রাজনীতিহীন আহ্লাদ এখন খাওয়া-পরার চেয়েও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ।
    ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে যেতেই, বার-ভেতরের আড়কপাট বন্ধ করে ওসি গলা নাবিয়ে ্ধে এস আইকে বললেন, শশ শশ চেক করে নিন, চেক করে নিন ।
    –কী ভেরিফাই করব, আমি তখন থেকে সেটাই ভাবছি স্যার । গাঁয়ের এত লোকজন, বাড়ির লোকেরা, সবাই মেনে নিয়েছে যে এই লোকটাই খেতমজুর দিবাকর যুগি । দেখুন না, পায়ে সাঁটা স্টিকিং প্লাস্টারেও লেখা রয়েচে দিবাকর যুগি । সরকারি কাজে বাংলা আরম্ভ হয়েচে বলে এই দেখুন না, দেখুন, বাংলায় লেখা দিবাকর যুগি । বাংলায় লেখা আমাদের জেলার প্রথম ডেড বডি । বডি বদলা-বদলি কি আর আজকে হবেছে স্যার, সেসব দেড়শো বছর আগেই হয়ে গেছে । জাতে পাটতাঁতি দিবাকর হয়ে গেছে চাষা, আর জাতে চাচা খালেদালি মণ্ডল হয়ে গেল চটকলের তাঁতি।
    আরে টাইম ওয়েস্ট করবেন না, তাড়াতাড়ি চেক করে নিন ।
    –কী স্যার ? চেক তো হয়েই গেল । আমরা যা দেখলুম, আর একটা পাঁচনামা দিয়ে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেব ।
    –শশ, তা বলছি না । শিওর হয়ে নিন । ওইটে চেক করুন, ওইটে ।
    –ওইটে ?
    –হ্যাঁ হ্যাঁ, নুনুটা চেক করুন, রিপোর্ট লিখতে হবে তো ?
    –নুনু ? কী বলছেন স্যার ?
    –কেন ? বামুন বলে তাঁতির নুনুতে হাত দিতে অসুবিধে ?
    –না স্যার, যদি সত্যই অন্য হয় ? মুসুলমান বেরোয় ? তবে ? নিজেই তো নিশ্চিত নন, আর আমায় বলছেন !
    দিবাকরকে ঢাকা দেয়া ওঁরই মেটে ধুতিটা ওপর থেকে সরান দুই সরকারি প্রতিনিধি । কোমরে লুঙ্গির মতন পরানো ছেঁড়া ধুতিটা তোলেন এবং একযোগে আশ্বস্ত হন দুজনেই । নাঃ, এ সত্যই দিবাকর যুগি, এর খোসা ছাড়ানো নয় । বদলা-বদলি হয়নি ।
    খালেদালি মণ্ডলের দেহ গেল কোথায় স্যার ? এই দিবাকর যুগি লোকটার দেহ আর আইডেনটিটি দুই আছে । কলকাতার মর্গে যে-লোকটার দেহ আছে তার কিন্তু আইডেনটিটি নেই । আর খালেদালি মণ্ডলের দেহও নেই, আইডেনটিটিও নেই । জিরো ? অ্যাঁ !
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন