এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • মলয়ের লেখাপত্তর

    pi
    বইপত্তর | ২৪ মার্চ ২০১২ | ২৪৪২৭১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • basab roy | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:২৩541351
  • বাসব রায় : মলয় সম্পর্কে দু’একটা কথা
    ১. মলয় রায়চৌধুরী আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেন মাত্র দুটো কারণে। ফিফটিজ-এ লেখালিখি শুরু করলেও তাঁর ভাষায় একেবারে রাবীন্দ্রিক ছাপ নেই। তখন যাঁরা লিখছিলেন বাংলা ভাষায়, মলয় ঠিক তার উলটোদিক থেকে লিখেছেন এবং লিখতে লিখতে নিজস্ব একটি ভাষা তৈরি করেছেন। চলমান গদ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, তাকে অস্বীকার করে লেখা সত্যিই কঠিন বিষয় ছিল, এমনকি আজও তা সমান সত্য। এখানে অজিত রায়ের ভাষার কথা বলতে হয় যে তিনি সমকালকে অতিক্রম করেছেন, অন্তত ভাষার দিক থেকে।

    এবং মলয়ের নিজেকে উপুড় করে দেওয়ার ক্ষমতাকে আমি সেলাম করি। মলয় নিজেকেই যেন ছুরি দিয়ে কোপাতে থাকেন, আর তখন যে রক্তপাত হয় সেটাই তাঁর লেখালিখি। ছোটলোকের ছেলেবেলা, ডুবজলে, মেধার বাতানুকূল, নামগন্ধ যাই পড়ি না কেন, মলয় সেখানে নিজের মাংসের টুকরোই সাজিয়ে রেখেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার যে মলয় রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী লেখক হতে আসেননি, তিনি এসেছিলেন বাঁক বদলের জন্য, যেন সেটাই তাঁর কাজ। মলয়ের সেরা লেখা কোনটা? আমি জানি না, সম্ভবত মলয়ও জানেন না। কেননা তিনি সেরা লেখা লিখতে চাননি কখনো, চেয়েছিলেন চলমান সাহিত্যের ওপর হাতুড়ির ঘা মেরে নিজের ভাষাটাকে প্রতিষ্ঠা করতে। এবং কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি সফল।

    আজ অজিত রায়, এর আগে নবারুণ, যে ভাষায় লিখছেন সেটা মলয় রায়চৌধুরীরই লিগ্যাসি।

    ২. শুধুই লিটল ম্যাগাজিনের লেখক বলে কিছু হয় না। যে কোনো লেখকই লেখেন পাঠকরা পড়বেন বলে। লিটল ম্যাগাজিনে সিরিয়াস লেখালিখি করা যায়, অধিকাংশ বাণিজ্যিক পত্রিকা যা ছাপায় না। কিন্তু শুধুই লিটল ম্যাগাজিনে লিখবেন বলে কোনো লেখক পণ করেন না। লেখকের লেখাটাই কাজ, কোথায় ছাপা হচ্ছে সেটা দ্বিতীয় বিষয়। লিটল ম্যাগাজিন শুরু হয়েছিল বা এখনও হয় প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে কোনো লিটল ম্যাগাজিন নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়। এটা চমস্কির তত্ত্ব, যে একটা মত প্রবল হতে থাকলে তার বিরুদ্ধ মত উঠে আসে। এবার দ্বিতীয় মত শক্তিশালী হলে আসে তৃতীয় মত। খেলাটা চলতেই থাকে। এবং এভাবে লিটল ম্যাগাজিনে লিখেও কখন যে লেখক প্রতিষ্ঠান বা আপনার কথায় লিটল ম্যাগাজিনেই লিখে ফেলেন, এটা বোঝা যায় না।

    মলয় রায়চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, আমার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই, আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী নই। আমার লেখাটা যদি ঠিকঠাক প্রতিষ্ঠান ছাপায় তাহলে আমার লেখা দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু ওরা তা ছাপবে না, তাই বলা যায় আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী নই, প্রতিষ্ঠান আমার বিরোধী।

    ৩. আমরা যাঁদের লেখালিখি-জীবন দেখে কবিতার জগতে এসেছিলাম, কবিতা লিখেই সমাজের ঝুঁটি নাড়িয়ে দিয়েছিলেন যিনি, আমার সম্পর্কিত দাদা, ওহঃ হো, মেজোকাকার কবিতা পড়ুন। আরেকটি তথ্য আমার জন্মের দুবছর আগে কবিতা লিখে জেলে গিয়েছিলেন ওই অসভ্য, বুনো, প্রথাবিরোধী বা নতুন প্রথার জন্মদাতা....
    ‘মলয়দাস বাউলের দেহতত্ব’

    ডোমনি, তুইই দয়াল, যখন বিদেশে যাস কেন রে আনিস কিনে সেক্সটয় ?
    ভাইব্রেটর, ডিলডো, বেন-ওয়া-বল, গুহ্যের মুক্তমালা ?
    ডোমনি, তুইই দয়াল,জানি কেন বিডিএসএম কবিতার বই এনেছিস,
    জি-বিন্দু হিটাচির ম্যাজিকের ছড়ি ? নিপল টিপে কাঁপাবার ক্লিপ ?
    ডোমনি, তুইই দয়াল, হাত-পায়ে দড়ি চোখে ঠুলি আমাকে চেয়ারে
    উলঙ্গ বেঁধে রেখে দিয়েছিস, নিজের ফাঁস খুলে তলাতল রক্তের স্বাদটুকু দিলি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, শুদ্ধ প্রেমে মজল যারা কাম-রতিকে রাখলে কোথায়
    চাবুক মারিস তুই, চুলের মুঠি ধরে ক্ষিরোদধারাকে চুষে বের করে নিস
    ডোমনি, তুইই দয়াল, চাতক স্বভাব নাহলে অমৃতের দুধ তুই দিবিনাকো
    আমার খিদে নেই, মুখের ভেতরে কৃষ্ণের বিশ্বরূপ খেয়ে মজে গেছি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, যতো ইচ্ছে আনন্দ কর, দেহ নিয়ে খেল
    আমি একটুও নড়ব না, আহ উহ করব না, যতো চাই ধাতুবীজ নিস
    ( দহগ্রাস পত্রিকায় প্রকাশিত )

    ৪. সমীর রায়চৌধুরী মারা গেলেন। কে তিনি? না সুনীল-শক্তি-সন্দীপন-দীপকের বন্ধু, হাংরি খ্যাত মলয় রায়চেৌধুরীর দাদা। এমন নয় যে সমীর রায়চেৌধুরী অন্যদের পরিচয়েই পরিচিত। তাঁর নিজেরও কিছু উচ্চমানের লেখা আছে। হাওয়া ৪৯ নামে দুরন্ত একটা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনাও করেছেন বেশ কিছুদিন। আনন্দবাজারীয় সাহিত্যের পাঠকরা অবশ্য সমীরকে শুধু সুনীল-শক্তির চাইবাসার বন্ধু বলেই জানেন।
    এর বাইরে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বিভিন্ন আত্মজৈবনিক লেখালিখিতে সমীরকে আবিষ্কার করা যায়। অ্যালেন গিনসবার্গের কাশী যাত্রায় সমীর সম্ভবত সঙ্গী ছিলেন কিছুদিন। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে ওঠাবসা ছিল সমীরের, পরে চাইবাসায় চলে যান। জনশ্রুতি তাঁর বোনের সঙ্গেই প্রথম প্রেম শক্তির। তবে সমীর রায়চৌধুরীকে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন হাংরির নকল গ্রুপ। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত খুব মোটা একটা বই আছে বাজারে। যার সম্পাদনা করেছেন সমীর চেৌধুরী। মজার ব্যাপার ওই বইটিতে হাংরির শেষকথা মলয় রায়চেৌধুরীর কোনো লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অথচ তাঁর দাদাই কি না সম্পাদক! সত্যটা হচ্ছে এই সম্পাদক সমীর চৌধুরী আজ মারা যাননি, অনেক আগেই হারিয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্য থেকে। কেননা ওই বইয়ের সম্পাদক মলয়ের দাদা নন। এটাই মজা।

    ইদানীং সমীর কিছুই লিখছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন গত ষাট বছরের বাংলা লেখালিখির এক আশ্চর্য দলিল। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের সব খবর রাখতেন। তাঁর চেয়ে অনেক বেশি ধারালো হয়েও মলয় রায়চৌধুরী এই জায়গায় কিছুটা পিছিয়ে আছেন (যদি তুলনা করতেই হয়), মলয় বেশ কয়েক বছর লেখালিখির বাইরে ছিলেন। সমীর রায়চেৌধুরীর মৃত্যু মানে ইতিহাসের ইতিহাসে চলে যাওয়া।
    তাঁকে শ্রদ্ধা…

    ৫. দায়িত্ব না নিয়ে একটু হাস্যচ্ছলে বলি, হাংরি লেখকদের মধ্যে কেউ আধুনিকতাবাদীদের মতো 'ডক্টরেট' ছিলেন না, ----- সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, মনোবিজ্ঞান কোন কিছুতেই একজনও 'উলেমা' ছিলেন না ... ঠিকই, কিন্তু এঁরা সকলেই প্রচুর পড়াশোনা করতেন, মলয়-সমীর সবচেয়ে বেশি পড়েছেন। শৈলেশ্বর কাছাকাছি থাকবেন। অরুণেশ একটু পেছনে।

    ৬.ইদানীং, না, ইদানীং নয়, যখন হাংরি আন্দোলন প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে, মানে সবাই যখন বলতে শুরু করেছেন হাংরিরা নতুন কিছু শুরু করেছিল, ভালোই করেছিল। লক্ষ করেছি, তখনই এই শৈলেশ্বর জাতীয়রা খোপ থেকে বেরিয়ে গলাবাজি করছেন যে আমিও ছিলাম... আমিই স্রষ্টা। এরকম আরো কেউ কেউ আছেন। শৈলেশ্বর অন্য এক সমীর চৌধুরীকে দিয়ে ঢাউস বই সম্পাদনা করিয়েছেন হাংরি আন্দোলন, প্রজন্ম নিয়ে। সেখানে মলয় রায়চৌধুরীর কোনো কবিতা নেই, লেখা নেই। হতে পারে ! মলয়কে ছাড়া হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে একটা বাক্য লেখা সম্ভব? কিন্তু সেটাই হয়েছে। শৈলেশ্বর কয়েকটা ভালো কবিতা লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু চরিত্রে গোলমাল আছে... কিংবা এটাই হয়তো অনেকের পছন্দের চরিত্র ।

    ৭. “আপনারা গত ৪৭ বছরে কোন বালডা ছিড়ছেন ; রাজনীতি মেধায় লাথি মারছে…; রাজা আছে, নীতি নাই
    নেতা চোদার টাইম নাই ; লাঠির ভয় দেখাবে না। লাঠি একদম ভরে দিব।”
    আমার কথা নয়, বাংলাদেশে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের পোস্টারের ভাষা। এবং আমার কথাটা হল যে এটাই ভাষা। এটাই সভ্য ভাষা। সমাজ বদলে যাচ্ছে, পৃথিবী বদলে যাচ্ছে, সংস্কার বদলে যাচ্ছে, মানসিকতা বদলে যাচ্ছে আর তাই এটাই মান্য ভাষা।

    বাংলাভাষায় হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট প্রথম এরকম ভাষা ব্যবহার করেছিল, তার অপ্রত্যাশিত সমালোচনা হয়েছে, যদিও এখন অনেকেই ওই আন্দোলনের ক্ষীর খেতে চাইছেন। তো সেটা অন্য কথা, যা বলার তা হল এই যে যাঁরা বৈষ্ণব সাহিত্যের পর, বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-বিভূতি-শরতের পর, আর পড়েননি, খুব বেশি হলে সুনীল-শঙ্খ, তাঁদের বলার, আপনারা একটু মলয়-অজিত-নবারুণ-সন্দীপন পড়ুন।
    এখন আর প্রেম করছি বা ভালোবাসি নয়, বলুন প্রেম পাচ্ছে। সংস্কার বদলে যাচ্ছে, চরিত্র-চরিত্রহীনতার সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে... আপনারা আর ভাষার শুদ্ধতা আশা করবেন না... সংস্কারের শুদ্ধতা আশা করবেন না... জীবনকে দেখুন.. শুধু বেঁচে না থেকে জীবনকে যাপন করুন... আনন্দে থাকুন... আত্মাকে কষ্ট দেবেন না... যা মন থেকে করতে ইচ্ছে যাচ্ছে সেটাই করুন... সবাইকে কষ্ট দিন, শুধু নিজেকে কষ্ট দেবেন না... গালি দিন...প্রেম করুন... মূল কথা আনন্দে থাকুন... নির্মল থাকুন...।

    ৮.”একাই লড়েছিলুম; কেউ বলেনি হোক কলরব । একাই নেমেছিলুম ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সিঁড়ি বেয়ে। সেদিন একাই কলকাতার পথে ঘুরেছিলুম সকাল পর্যন্ত ।” বলেছেন মলয় রায়চৌধুরী । লড়াইটা শুরু একাই করতে হয়, পরে সহযাত্রী হয় অনেকে, যেমন এখন হয়েছি, আমরা

    ৯. ‘যুগশঙ্খ’ পত্রিকার জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে বলেছিলেন, "হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করার জন্য মলয় ইচ্ছে করেই আমার আমেরিকা-বাসের সময়টা বেছে নিয়েছিল"।

    ১০. সাইয়েদ জামিলের কবিতা কারো ভালো লেগেছে, কারো ভালো লাগেনি, যা স্বাভাবিক। সেই প্রসঙ্গে একটা বা দুটো কথা যা আমার বলতে ইচ্ছে করছে, তা হল, আজ, এই ২০১৮ সালে, সাহিত্যে শুদ্ধতা আর আশা না-করাই ভালো। এখন আর কেউ বলছে না ‘কুৎসা রটাচ্ছে’, বরং ‘কুৎসা করছে’ চলছে। শব্দের ব্যবহার বদলে যাচ্ছে, ভাষা বদলে যাচ্ছে ; বদলে যাচ্ছে সংকেত, প্রতীক, চিত্রকল্প। ফেসবুক করছ, গুগল করুন... এসব বেশ চলছে। বিদেশে এটা অনেক আগেই প্রতীয়মান। দু-একটি উল্লেখ মনে হয় সংগত।
    America when will we end the human war?
    Go fuck yourself with your atom bomb.
    I don’t feel good don’t bother me.
    এই কবিতা ১৯৫৭ সালে লিখেছেন অ্যালেন গিনসবার্গ।
    ষাটের দশকে ‘আমায় দিয়ে করিয়ে নিল তিন বিধবা’ লিখেছেন অরুণেশ ঘোষ। এই সেদিন ‘ভুলে যাবেন না, অনেক কিছুর উপরই পেচ্ছাপ করে যেতে হবে আমাদের’ লিখলেন বন্ধু-কবি প্রবুদ্ধসুন্দর কর। আর যে কবিতা দিয়ে এই পোস্ট শেষ করব সেটা হল আরেকটা কবিতা, অংশ নয়, গোটা...
    ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব
    আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে
    আমি কী কোরবো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না
    সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা
    শুভা আমাকে তোমার তরমুজ আঙরাখার ভেতর চলে যেতে দাও
    চুরমার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়
    সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
    আর আমি পারছি না, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে
    আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
    প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
    শাশ্বত অসুস্থতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ
    মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?
    তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমো খেতুম
    কিন্তু কিছুই ভলো লাগছে না আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না
    একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয়
    ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন
    কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে
    এসব কী হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ
    সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা
    ছিন্নভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব
    শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাব আমার ক্ষুধায়
    দিতেই হবে শুভাকে
    ওঃ মলয়
    কোলকাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ
    কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কী কোরবো বুঝতে পারছি না
    আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
    আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
    আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি
    প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি
    অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি
    শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসি চামড়ার ব্যবহার
    অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্থতা
    যোনিকেশরে কাচের টুকরোর মতন ঘামের সুস্থতা
    আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম
    আমি বুঝতে পারছি না কী জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি
    আমার পূর্বপুরুষ লম্পট সাবর্ণচৌধুরীদের কথা আমি ভাবছি
    আমাকে নতুন ও ভিন্নতর কিছু কোরতে হবে
    শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
    জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে
    আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
    মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
    তোমার তীব্র রূপালি য়ূটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
    শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
    তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল
    আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
    আমার বাবা-মা আন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?
    সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওরফে আমি হতে পারতুম ?
    আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?
    শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন ?
    ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
    শুভা, ওঃ শুভা
    তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়
    পুনরায় সবুজ তোশকের ওপর চলে এসো শুভা
    যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়
    ১৯৫৬ সালের সেই হেস্তনেস্তকারী চিঠি মনে পড়ছে
    তখন ভাল্লুকের ছাল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল তোমার ক্লিটোরিসের আশপাশ
    পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি তখন তোমার স্তনে নামছে
    হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
    আ আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ
    মরে যাব কিনা বুঝতে পারছি না
    তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহায়তায়
    সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব
    শিল্পের জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোব
    কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই
    শুভা
    আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ কোরতে দাও
    দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও
    বেসামাল হৃদয়বত্তার স্বর্ণসবুজে
    কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে ?
    কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি ?
    কেন আমি রজোস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায় ?
    অথচ আমার নীচে চিত আধবোজা অবস্থায়
    আরামগ্রহণকারিণী শুভাকে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছে আমার
    এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়
    আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই
    এখন আমার হিংস্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে
    মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে
    আমি মরে যাব
    ওঃ এসমস্ত কী ঘটছে আমার মধ্যে
    আমি আমার হাত হাতের চেটো খুঁজে পাচ্ছি না
    পায়জামায় শুকিয়ে-যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে
    ৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
    ঝাঁকে-ঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
    এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
    হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপরচুলায়
    ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মারমুখি আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
    কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার অপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি।
    এই কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে, কার কবিতা এবং কবিতার নাম কী বলার জন্য কোনো পুরস্কার নেই।

    ১১. এখনকার কলেজ পড়ুয়াদের তো আর মলয়ের মেধা নেই ।

    ১২. বহু আগে আর্থার মিলার বলেছিলেন, ‘ভাষাকে যে আক্রমণ সরে সেই ভাষাকে বাঁচায়।’ এখানে আমি অজিত রায়ের নামটি উল্লেখ করতে চাই, যিনি ভাষাকে আক্রমণ করে বাংলাভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই আক্রমণের বিষয়টি অবশ্য সবাই সাদরে আমন্ত্রণ জানাবেন না। কেননা তাঁর লেখায় উল্লেখ না করলেও একটা শ্রেণির প্রতি তাচ্ছিল্য, শ্লেষ ধরা পড়ে। এবং এখান থেকেই তিনি হয়ে যান ব্রাত্য, যেভাবে একদিন মলয় রায়চৌধুরীকে কলকাতা রেখেছিল একটু দূরে। আজ তিনিই কি না বাংলাভাষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জীবিত ব্যক্তিত্ব।

    .
  • nabanita | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:২৯541352
  • মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    মলয় রায়চৌধুরী ( ১৯৩৯ ) একজন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রবন্ধলেখক ও অনুবাদক । পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশকে যে চারজন হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন ( অন্যেরা হলেন দেবী রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সমীর রায়চৌধুরী ), তিনি তাঁদের অন্যতম । কবিতা লেখার জন্য ১৯৬৪ সালে তাঁকে অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল । এ মকদ্দমা তিনি হাইকোর্টে জিতে যান । তাঁর ‘জখম’ কবিতাটি বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে । ১৯৬৮ সালে তিনি মধ্যপ্রদেশের রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় সলিলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন । বর্তমানে তিনি মুম্বাইতে কাণ্ডিভালি শহরতলিতে একটি বহুতলে একরুমের ফ্ল্যাটে সস্ত্রীক থাকেন । তাঁর মেয়ে, জামাই নাতনিরা বিদেশে থাকেন এবং ছেলে ও ছেলের স্ত্রী থাকেন কলকাতায় ।

    প্রশ্ন : নিজের লেখালিখির আপনি কি ভাবে মূল্যায়ন করেন ?
    উত্তর: কোনো মূল্যায়ন করি না । যেমন খিদে পায়, ঘুম পায়, পেচ্ছাপ পায়, তেমন লেখা পায় বলে লিখি । খিদের যেমন মূল্যায়ন করি না, তেমনই লেখালিখির । মূল্যায়ন করতে হলে অন্যের ধরে থাকা আয়না দরকার । আমি তো নিজের জন্য অন্যের আয়নার প্রয়োজন বোধ করি না ।
    প্রশ্ন : আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই ।
    উত্তর : আমার প্রথম লেখা দুটি কবিতা, প্রকাশিত হয়নি, কেননা সেদুটি ছিল প্রেমানুভূতি ; একটি বাংলায়, স্কুলের উঁচু ক্লাসের সহপাঠিনী নমিতা চক্রবর্তীকে, যিনি আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে সুমিতাদি ; আরেকটি ইংরেজিতে, চুম্বনের দাম হিসাবে, স্নাতকস্তরে নেপালি সহপাঠিনী ভূবনমোহিনী রাণাকে, ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসের রাণো । প্রথম প্রকাশিত লেখা ইংরেজিতে ১৯৬১ সালের নভেম্বরে হাংরি ম্যানিফেস্টো, বাংলায় এপ্রিল ১৯৬২তে হাংরি ম্যানিফেস্টো। যে উথালপাথাল ঘটিয়ে ছিল তা কল্পনাতীত । সম্ভবত হ্যাণ্ডবিলের মতন বিলি করা কাগজে তখনও পর্যন্ত সাহিত্য করার কথা ভাবা হয়নি, আর হ্যাণ্ডবিলের মতন ছিল বলে দ্রুত পৌঁছে যেতে পেরেছিল সর্বত্র । প্রথম বই ছিল ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ যে বইটি প্রকাশিত হবার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উল্টোডাঙার বস্তিবাড়ির সামনে পেটরল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছিলুম । বইটা বের করার ভার দিয়েছিলুম শক্তিদাকে; উনি ম্যাসাকার করে দিয়েছিলেন, কাউকে দিয়ে প্রূফ দেখাননি, নিজে দেখেননি, অত্যন্ত বাজে কাগজে ছাপিয়েছিলেন এবং পুরো পাণ্ডুলিপি কমপোজ করাননি । আমার উপন্যাস ‘রাহুকেতু’তে আমি ঘটনাটা দিয়েছি । তার পরের বই, যাকে প্রকৃত অর্থে বলা যায় পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়া বই, তা হল ‘কৃত্তিবাস’ থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ’, প্রকাশক ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । বইটি এবং আমাকে নিয়ে কলকাতায় হইচই হচ্ছে জেনে তিনি আমেরিকা থেকে ১৩ জুন ১৯৬৪ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, “আপনি মলয়কে এত পছন্দ করছেন -- কিন্তু ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে বিশ্বাস করেন না ।” আবার কলকাতা ফিরে যখন দেখলেন যে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু আমার বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেছেন, তখন উনি তুরুপের তাসটি খেলে আমার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেলেন ! জীবনের এমনতর ঘটনাকে কী বলবেন ?
    প্রশ্ন : বাংলাসাহিত্যের কোন শাখা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন ?
    উত্তর: কবিতা তো অবশ্যই, এবং প্রবন্ধ । কবিতা লেখার জগতটা কারোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকছে না, কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক কলকাঠি নাড়া সত্ত্বেও । আর এখন ইনটারনেট হয়ে এলাকাটা সম্পূর্ণ স্বাধীন ; শব্দ, বাক্য, ছন্দ, বিন্যাস নিয়ে যথেচ্ছ বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন তরুণ কবিরা, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় যে কবিতা লেখা হচ্ছে, যেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ পড়ার সুযোগ পাচ্ছি, তার পাশে বাংলা কবিতাকে রাখলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়। গল্প-উপন্যাস এখনও বিষয়নির্ভর হয়ে রয়েছে, আলোচকরা গপপো নিয়ে চিন্তিত, যেকারণে আমরা জয়েস, প্রুস্ত, কাফকা, ফকনার, মার্কাজের মতন গদ্যশিল্পী পাইনি; গল্প-উপন্যাসের বাংলা গদ্য এখনও ইউরোপীয় ভাষাগুলোর স্তরে তাই পৌঁছোয়নি ।
    প্রশ্ন : বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে ?
    উত্তর : প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলুম না । জীবনের প্রতিফলন সাহিত্যে ? নাকি সাহিত্যের প্রতিফলন জীবনে ? পশ্চিমবঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এমনই হাল যে ভালো ফলাফল করলেই ছাত্ররা রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে পালান, তারপর বিদেশে পালান ।
    প্রশ্ন : আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি ?
    উত্তর : সারা জীবন কেবল একজন তো আর প্রিয় লেখক হতে পারেন না ; বয়সের সঙ্গে, পাঠ-অভিজ্ঞতার সঙ্গে যাঁদের লেখার প্রতি আকর্ষিত হয়ে্ছি, তাঁরা পালটে যেতে থেকেছেন । তবে কিছুকাল আগে যে বই দুটো আমি বহুবার পড়েছি তা হল ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচুড’ এবং পামুকের ‘রেড’ । আমি কিন্তু বই সংগ্রহ করি না ; বইয়ের লাইব্রেরি নেই আমার । বই আর পত্রিকা পড়া হয়ে গেলে বিলিয়ে দিই । আমার কোনো স্টাডিরুম, লেখার টেবিল, পড়ার ঘর জাতীয় ব্যাপার নেই । আর আজকাল তো কাগজ-কলমও ব্যবহার করি না । যাঁরা বাড়িতে সাক্ষাৎকার নিতে আসেন, তাঁদের পিলে চমকে যায় ।
    প্রশ্ন : আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটা এবং কেন ?
    উত্তর : ‘নখদন্ত’ নামে একটি সাতকাহন । রামায়ণ থেকে সাতকাহনের আইডিয়া আর মহাভারত থেকে গল্পের ভেতরে গল্পের ভেতরে গল্প টেকনিক প্রয়োগ করেছি, সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত রোজনামচার টুকরো-টাকরা, আর পশ্চিমবাংলায় পাট চাষ-চট শিল্পের বিলুপ্তির রাজনৈতিক পৃষ্ঠপট । এটা প্রিয় এইজন্য যে এই বইটা লিখে আমি হ্যাপি ফিল করেছিলুম ।
    প্রশ্ন : আপনার লেখালিখির পেছনে মূল প্রেরণা কি ?
    উত্তর : এটা অ্যাডিকশান । অ্যাডিকশানের বোধ হয় প্রেরণা হয় না ।
    প্রশ্ন : শর্তসাপেক্ষে লেখালিখি ছেড়ে দিতে বললে কি ছাড়তে পারবেন ?
    উত্তর : জানি না ভারতের সাহিত্য একাডেমিকে লেখা আমার চিঠিটা বাংলাদেশে পৌঁছেচে কিনা । চিঠিটা আমি এখানে তুলে দিচ্ছি ; মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া আছে চিঠিটিতে ।
    April 30, 2004
    Prof K. Satchidanandan
    Secretary
    Sahitya Akademi
    Rabindra Bhaban
    35 Ferozeshah Road
    New Delhi

    Dear Sir
    Refusal to accept Sahitya Akademi Award

    Thanks for your telegram dated 30.4.2004 conveying that my translation work of Dharmaveer Bharati’s “Suryer Saptam Asva” has been awarded the Sahitya Akademi Translation prize.
    I am constrained to refuse this award. As a matter of principle I do not accept literary and cultural prizes, awards, lotteries, grants, donations, windfalls etc. They deprave sanity.
    My decision to refuse the award is in no way to affront late Dharmaveer Bharati, who was a great admirer of my work, and had supported me during my literary ordeals in 1960s when most of the Bengali intelligentia had conspired against the Hungryalist movement. Your magazine the “indian Literature” itself had never bothered to write about this movement.
    Sincerely
    Malay Roychoudhury
    আর কী শর্ত থাকতে পারে ? জেনিফার লোপেজের সঙ্গে মহাকাশযানে করে অন্তরীক্ষে এক পাক খেয়ে আসা বা ক্যাটরিনা কাইফের সঙ্গে জাহাজের রেলিঙে দাঁড়িয়ে পেংগুইনদের সাঁতার দেখা ?
    প্রশ্ন : একজন লেখকের ভেতরের ‘মানুষসত্তাকে’ আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করেন ?
    উত্তর : কোনো লোক লেখক হয়েছে বলেই তো আর তার ভেতরের মানুষসত্তাটা পালটে যেতে পারে না । সে লেখক না হলেও তার মানুষসত্তাটা যা ছিল তাই থাকবে । আসেপাশে লেখকদের যা সব কাণ্ড-কারখানা দেখি, তা থেকে স্পষ্ট যে তারা লেখক না হলেও ওই সমস্ত কাজ-কারবারই করত । আমি লেখক না হলেও মানুষটা আমি যা রয়েছি তা-ই থাকতুম । আমার সত্তা জিনিশটায় যদি বাইরের কোনো উপাদানের অবদান থেকে থাকে তাহলে তা শৈশবের বিহারি অন্ত্যজ আর দুস্হ মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ার একলেকটিক পরিবেশ ; যেকোনো বাড়িতে যেকোনো সময়ে প্রবেশ করতে পারতুম, এমনকি পাড়ার মসজিদেও, যা বর্তমান ভারতীয় সমাজে অকল্পনীয় ।
    প্রশ্ন : মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন ?
    উত্তর : সত্যি বলতে কি, মৃত্যু সম্পর্কে আমি বেশ কনফিউজড ।
    প্রশ্ন : লেখালিখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয় ?
    উত্তর : আমি খেতে ভালোবাসি । বয়সের কারণে নানা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে গিয়েও যতটা পারা যায় খাওয়ার ব্যাপারটায় রদবদল করতে থাকি । আমি রাঁধতেও পারি । আমি আর দাদা রান্নাঘরে মাকে টুকিটাকি সাহায্য করার সময়ে অনেককিছু রাঁধতে শিখে গেছি । মাঝে ভেবেছিলুম যা রান্নার রেসিপি নিয়ে একটা বই বের করব, তা আর হল না । আমি বিরক্ত হই আমার একাকীত্ব বিঘ্নিত হলে, এমনকি আশেপাশের আওয়াজও আমার একাকীত্বকে নষ্ট করে বলে বিরক্ত হই । আমি বেসিকালি একজন লোনার, একা থাকতে ভালোবাসি ।
    প্রশ্ন : সাহিত্যের বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শত্রুকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন ?
    উত্তর : বন্ধু বলতে যা বোঝায় তা আর আমার নেই । স্কুল-কলেজে ছিল আমার তিনজন বন্ধু, সুবর্ণ-বারীন-তরুণ । তারপর থেকে আমি বন্ধুহীন । আমার একাকীত্বপ্রিয়তার জন্যই বোধহয় আমি বন্ধুহীন । এই এখন হঠাৎ যদি আমার স্ত্রীর কিছু হয়, এমন কেউই নেই যাকে ডাক দিতে পারব । অমন পরিস্হিতিতে ডাক দিতে হবে অ্যাম্বুলেন্সকে । শত্রুও নেই । কেনই বা কেউ শত্রুতা করবে ? লেখালিখির জগতে অনেকে অনেক কিছু লেখে আমার বিরুদ্ধে ; তার জন্য তাদের শত্রু তকমা দেয়া উচিত হবে না ।
  • Subhasree | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:২০541353
  • মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাসে জাদুবাস্তবতা
    শুভশ্রী দাস, অধ্যাপক, কবি সুকান্ত মহাবিদ্যালয়
    বিশ্বসাহিত্যের মনমর্জি বদলায় সময়ের হাওয়া । আমরা কি লিখব, কি বলতে চাই তা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের সময়, সমাজ । মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে সময় খেলা করে । রাজনীতি, অর্থনীতি মানুষের চিন্তাশক্তিকে প্রভাবিত করে । ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ কথাটি একটি মিথের মতো । আছে, কিন্তু বাস্তব উপস্‌ইতি খুব স্পষ্ট নয় । ‘সভ্য’ বিশ্বে বলার অধিকার দেব, কিন্তু কি বলবে তা পপত্যক্ক্ষে বা পরোক্ষে আমিই নির্দিষ্ট করে দেব -- উপনিবেশবাদের এই প্রচলিত কাঠামোর বাইরে খুব বেশি এগোনো যায়নি আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও । তবু কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ টিকে থাকতে চায় প্রতিবাদ নিয়ে, সত্যকে আঁকড়ে । পারিপার্শ্বিকের প্রবল চাপেও অনড় হয়ে থাকা এই একরোখা মানুষের হাতেই তৈরি হয় এক-একটি কশাঘাতের মতো শিল্প-সাইত্য, যা আছড়ে পড়ে শাসকের মুখে । শোষিত জনগোষ্ঠী থেকেই জন্ম নিয়েছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, যাঁর কলমে রূঢ় বাস্তব হল জাদু, আর যে জাদু চপেটাঘাত করল বাস্তবকে । এমনই সব জাতি থেকে মাথা তুললেন সলমন রাশদি, আলেহো কার্পেন্তিয়ের, ওরহান পামুক, নবারুণ ভট্টাচার্যরা । যাঁরা শিখিয়ে দিলেন ঠাট্টা করতে, যাঁরা এতদিনের কুড়িয়ে পাওয়া লাঞ্ছনা, অপমান দিয়ে তৈরি করলেন শানিত অস্ত্র । জাদুবাস্তবতার ইতিহাস একটি সম্পূর্ণ জাতির ইতিহাস। পাশাপাশি পৃথিবীতে যেখানে যতো জাদুবাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে বা হবে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইতিহাস একটি বিশিষ্ট ভূমিকা নেবে ।
    লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপট থেকে জন্ম নিয়েছিল জাদুবাস্তবতা, বাংলা কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবের প্রবেশ কবে, কখন, কিভাবে ঘটল তা ঠিক নির্দিষ্ট করে বলা যায় না, যেমন বলা যায় না লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রেও। স্পেনীয় ও পরে লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে অকথ্য অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে বহুকাল ধরেই প্রতিবাদের পন্হা খুঁজছে মানুষ । মার্কেস তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সময়ে বলেন, জাদুবাস্তবতা হল ‘exaggerated proportion of reality’. তিনি জাদুবাস্তবতার ব্যাখ্যায় নোবেলপ্রাপ্তির দিন বলেছিলেন :
    “লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয় অঞ্চলের মানুষদের জীবনে এই জাদুবাস্তবতা কোনো আরোপিত ব্যাপার নয় । এটা তাদের সঙ্গেই বাঁচে সব সময় । প্রতি মুহূর্তে নির্ধারিত করে দেয় অসংখ্য মৃত্যুকেও।” ( গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ও একশো বছরের নিঃসঙ্গতা, সুচেতন মিত্র, মহাযান সাহিত্যপত্র, ৯ম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১০, পৃষ্ঠা ৩৪ ) ।
    জাদুবাস্তবতা আসলে একটি ধারণা, যার আত্মা ঘোর বাস্তব এবং শরীর কল্পনা ও উপকথা দিয়ে গড়া । দীর্ঘদিনের কিছু অবদমিত লাঞ্ছনা, অত্যাচারের ক্ষত ব্যুমেরাং করে শাসকের দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি জাদুবাস্তব রচনাধারার মধ্যে রয়েছে ।
    প্রায় দুশো বছরের ইংরেজ শাসনের পর ভারতবর্ষের অলিগলিতে যে কলোনিগুলি ঔপনিবেশিকতার অভিশাপ বহন করে চলেছে, জিবন সেখানে থমকে দাঁড়ায় । দুশো বছরের শাসনের প্রভাব প্রায় হাজার বছর ধরে অবদমন করবে ভারতীয় চিন্তা চেতনাকে । যুদ্ধপরবর্তী সময় থেকেই ভারতীয় যুবসমাজের উপর পরিচয়হীনতার যে অভিশাপ নেমে আসে, তাতে জেরবার হয়ে শিক্ষিত যুবকের দল শুরু করেন নানা সাহিত্য আন্দোলন । এ বিষয়ে পাশ্চাত্যের তরুণ সম্প্রদায়ের কয়েকটি আন্দোলন তাঁদের পথ দেখায় । বিহার ও বাঙলার শিক্ষিত যুবকদের সৃষ্ট এমনই একটি সাহিত্যনির্ভর ও ইস্তাহার নির্ভর বহুবিতর্কিত আন্দোলন ‘হাংরি জেনারেশন এর বহু লেখায় জাদুবাস্তবের বিমূর্তরূপ ধরা পড়ে ।
    ‘অতলান্তিক’ সাহিত্যপত্র থেকে হাংরির সূত্রপাতের ইতিহাস কিছুটা উদ্ধৃত করব : “১৯৬১ সনে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র বাইশ বছরের বাঙালি যুবক মলয় রায়চৌধুরী কবি চসারের ‘ভয়ানক কবিতা টুকরো In the sowre hungry tyme’ পড়ে hungry শব্দের দ্যোতনা ও অভিঘাতে অনুরূপ উত্তেজিত হন ।”( নন্দলাল শর্মা, হাংরি জেনারেশন সংখ্যা, ষষ্ঠ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ১৮ ) ।
    ঢেকে রাখা ‘সভ্য’ সমাজের ছ্যুঁৎমার্গ ও নিম্ন অর্থনৈতিক সঙ্গতির মানুষকে তাদের না-করা অপরাধের শাস্তি দিতে আগ্রহী হিন্দু সমাজের প্রচলিত পন্হার প্রতিস্পর্ধায় মাথা তোলে হাংরি আন্দোলন । যাঁরা দিতে পারেননি নিরাপদ ভবিষ্যত, দেহ মনের সুস্হ গঠনের সাহায্য করতে পারেননি, তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্খা সুখ স্বপ্ন যৌনতা কোনো কিছুর ভারই যে সমাজ বা যে পরিবার নেয় না, সেই সমাজের দেওয়া রুক্ষ ও ক্রুর নিয়মের ভণ্ডামিকে দুহাত দিয়ে ছিঁড়তে চেয়েছেন এই তুণরা । মলয় রায়চৌধুরী ও সমীর রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে গড়া এই আন্দোলনে অরুণেশ ঘোষ, দেবী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, অবনী ধর, সুবো আচার্য, পপদীপ চৌধুরী, ত্রিদিব মিত্র, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ প্রমুখ প্রতিভাবান কবি-লেকক যুক্ত থেকেছেন নানা সময়ে ।
    এই সন্দর্ভের মূল আলোচ্য মলয় রায়চৌধুরীর ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’, ‘নামগন্ধ’ একত্রে ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’, ‘এই অধম ওই অধম’ ও ‘নখদন্ত উপন্যাস ।
    ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাসটি গুরুচণ্ডালী প্রকাশনার চটি সিরিজের মাত্র ৯৬ পাতার উপন্যাস । এই স্বল্প পরিসরেই উপন্যাসটি যেন সংস্কারের সাজানো সাজানো পাঁচিলে একটি ইঁট সরিয়ে নেওয়া । মিশ্র সংস্কৃতি ও সংকর সংস্কৃতির ফাঁকে পড়ে বাঙালি সমাজে প্রচ্ছন্নভাবে প্রবাহিত হয়েছে পঙ্কিলতা, এসেছে স্বৈরাচারিতা । উপন্যাসের শুরুতে যে দুজনের উল্লেখ পাই, তারা আধুনিকতার শীর্ষে বসবাসকারী দুজন বাঙালি যুবক-যুবত, বাংলা পড়তে-লিখতে রীতিমত অনভ্যস্ত । ব্যানার্জি বংশের মেয়ে ইন্দিরার তেইশ বছর বয়সে একটি গুজরাতি বিয়েও সংলগ্ন ডিভোর্স দুইই সারা হয়ে গেছে । সুবীর দত্তও শিক্ষিত, ভালো চাকুরে যুবক খ একটি ফিরে পাওয়া ডায়েরির সূত্রে উভয়ের আলাপ, কিন্তু সেই ডায়রি আবিষ্কার করবে তাদেরই পূর্বপুরুষের শরীরী উদ্দামতার পাশবিক কাইনি । পুরুষত্বহীন স্বামীর হাতে মার খাওয়া কেকা একের পর এক পুরুষদের ব্যবহার করে পৌঁছে যায় এমন এক উপলব্ধিতে যেখানে শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকা যায় । অন্য দিকে শিশির বা অতুলরা মজেছে শ্বেতাঙ্গিনীদের শরীরী নেশায় । নেপালের, বেনারসের পথে ঘাটে পাওয়া সেই সব মুক্ত বিহঙ্গ-বিহঙ্গীর দল জীবনের নামে জয়ধ্বজা উড়িয়েছিল । মলয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘রাহুকেতু’-তে লিখেছেন
    “ষাটের দশকের কথা তো । সে সময়ে ফান ফুড ফ্রিডাম ফ্রিক আউট আর ফাকিং-এর উদ্দেশ্যে দলে দলে তরুণ তরুণী আমেরিকা ইউরোপ এমনকি জাপান থেকেও নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেন ; লণ্ডন বা আমস্টারডাম হয়ে বাসে, ট্রেনে হিচহাইক করে তুরস্ক ইরান আফগানিস্তান পাকিস্তান ভারত হয়ে শেষ গন্তব্য নেপাল । “ ( পৃষ্ঠা ৬২ )
    শিশিরের কাছেও শরীর ও শারীরীক উথ্থান-পতন ভিন্ন কোনো মানসিক অনুভূতির প্রয়োজন নেই । অতুলও নারী থেকে নারীতে যাতায়াত করে ও শেষে ডিপ্রেশনের শিকার হয় । এই বিস্তীর্ণ পটভূমি ও এতগুলি চরিত্র আসলে একটি সময়ের সাক্ষী । রাবীন্দ্রিক বাণী তাই ‘এঁটোকাঁটা’য় পর্যবসিত হয় । বলিউডি ছবির অনুকরণে কেকার সম্ভোগকলা, শিশিরের লেখা দিনলিপির জড়তাময় ভাষা আরেকবার বিদ্রুপের ব্যুমেরাং ছুঁড়ে দেয় শ্লীল বাংলা সংস্কৃতির দিকে । আসলে সুস্হ জীবন প্রসবে অক্ষম এই মেকি শ্লীল সমাজের বিদ্রূপভারই মলয়ের জাদুবাস্তবতার মূল উপাদান ।

    ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ ও ‘এই অধম ওই অধম’
    মার্কেস জাদুবাস্তব আলোচনায় বলেছেন, লাঞ্ছনার ইতিহারে পরিবারের ভূমিকা থাকে । জাদুবাস্তবের একটি উপাদান মাকফেস ও মলয়ের জীবনে সমান্তরাল ঘটেছে । তা হল, উভয়েই নিজের বয়স্কা আত্মীয়ার কাছে অলৌকিক গল্প বলার পাঠ পেয়েছেন । মার্কেস একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন,
    “তিনি ( মার্কেসের ঠাকুমা ) সেইসব জিনিস বলতেন যেগুলোকে অতিপ্রাকৃত আর আজগুবি শোনাত, কিন্তু তিনি বলতেন সেগুলো একেবারে স্বাভাবিকভাবে ।” ( ‘দীর্ঘ সাক্ষাৎকার : গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস’, পিটার এইচ স্টোন, বয়ান, ত্রৈমাসিক পত্রিকা, মার্কেস স্মরণ সংখ্যা, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, জুন ২০১৪ )
    মলয় যেমন বলেছেন, বড়ো জ্যাঠাইমার অসামান্য গল্পরচনার প্রতিভা:-
    “আমরা দালানে ওনাকে গিরে বসতুম, আর লন্ঠনের আলো কমিয়ে উনি নিয়ে যেতেন গল্পের দেশে ।...জেঠিমার গল্পের জগত ছিল অলৌকিক…” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা, পৃষ্ঠা ৪৫ )
    সস্তার জীবন যাপনের জন্য বিহারী ছোটোলোকদের পাড়ায় বসবাসকারী বালকের ন্যারেশন ভোজপুরি মগহি পরিচারকদের সান্নিধ্যে শেখা তুলসীদাসি দোহা, হতদরিদ্র প্রতিবেশীদের পোকামাকড়ের মতন জীবনযাপন, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের নগ্নচিত্র দেখায় । সংকরায়িত পরিবেশে আত্মপরিচতি খোঁজা বয দুরূহ কাজ । তার ওপর যুক্ত হয় লৌকিক বিশ্বাস, তুক-তাক, আচার-বিচার ও যৌনতার নতুন সব অনুভূতি । মামাবাড়ির ভদ্র পরিবেশ আরো স্পষ্ট দেখায় পাটনার নিম্নমানের জীবনযাপনের গ্লানি । বালক মলয় শিখে যান :-
    “মামার বাড়ির কেউ কখনও পাটনায় যান না । আমরা তো ছোটোলোক।” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা, পৃষ্ঠা ৫৯ )
    অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের পাশাপাশি বালক জেনেছিল মেজদা, অর্থাৎ বড়জ্যাঠার পালিত পুত্র আসলে তার ‘কেনা ভাই’ । ‘দেবতুল্য’ জ্যাঠামশাই এক পাঞ্জাবি বউয়ের কাছে দেড়শো টাকায় কেনা বাচ্চাটি আসলে জেঠামশাইয়ের অবৈধ সন্তান । যাকে ফিরে পুষ্যি নিয়ে ক্রমাগত স্লো পয়জনিং করেছেন জ্যাঠা-জ্যেঠিমা । পড়তে পড়তে মনে হয় ইমলিতলার কোনো বাস্তবিক ভৌগলিক অবস্হান না থাকলেও চলত । নাম-কা-ওয়াস্তে স্বাধীনতা পাওয়ার পর পুরো ভারতবর্ষই বোধহয় কমবেশি ইমলিতলা ছিল । শিক্ষাহীন, স্বাস্হ্যহীন, স্মৃতিহীন স্বাধীনতা উত্তরকালের ভারতবর্ষের চেহারা ছত্রে-ছত্রে বহন করে এই যুগ্ম উপন্যাস । উপন্যাসে অনেক জাদুর পাশাপাশি কিছু অসামান্য বাস্তব আছে । ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ গ্রামগুলির চেহারা এতদূর কদর্য ও অর্থনৈতিক অবস্হা এমন পঙ্গু হওয়ার জন্য ছিল দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা :-
    “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে, পুঁজি বানাবার কলকাঠি কব্জা করার ধান্দায় সাবেকি গ্রামের সমাজকে দুমড়ে মুচড়ে তার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছিল ইংরেজরা । ব্যাটারা মহা ঘোড়েল । যাবার সময় চাদ্দিকময় হেগে রেখে গেছে ।” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা/এই অধম ওই অধম, পৃষ্ঠা ১১২ )
    এই বিষ্ঠা আসলে সেই স্মৃতিহীন মানব সমাজের দেহে মনে মাখামাখি হয়ে বিষাক্ত করে তোলে, দুর্গন্ধময় পঙ্কিল করে তোলে তাকে । ‘এই অধম ওই অধম’-এ পূর্ব কাহিনির নিরবচ্ছিন্নতা বজায় থাকে, শুধু যুক্ত হয় লেখকের স্মৃতিতে রয়ে যাওয়া সেই সব তুলসীদাসী পঙক্তিগুলি, যেগুলির সাথে জড়িয়ে রয়েছে লেখকের শৈশবস্মৃতি । ইমেল আদান-প্রদানে মলয় জানিয়েছিলেন :-
    “হিন্দি কোটেশানগুলো তুলসীদাস-এর রামচরিতমানস, কবির এবং রহিম-এর দোহা থেকে নেয়া । বাড়ির চাকরদের তো আমাদের বকুনি দেবার অধিকার ছিল না, তাই ওরা কোটেশানের মাধ্যমে উপদেশ দিত ; তারা নিরক্ষর হলেও, শৈশব থেকে শুনে-শুনে ওগুলো তাদের স্মৃতি থেকে উৎসারিত । বইটায় আমার ন্যারেটিভের সমান্তরাল এগিয়েছে ওদের ন্যারেটিভ।”
    ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, মেজদা বুড়ো অর্থাৎ পাড়ার বুঢ়ুয়া কেবলই রক্তমাংসের অস্তিত্ব নিয়ে নেই, তার অবয়ব আসলে রূপকায়িত করে পোস্টমডার্ন কলোনিয়ালিজমের সেই অপরিণত সময়কে, যাকে দাঁড়াতে হয়েছিল শত্রুপক্ষীয় স্বজন, লক্ষহীন ভবিষ্যৎ, প্রবৃত্তির নিষিদ্ধ লোভনীয় হাতছানির প্রতিস্পর্ধায় । ভোজপুরি যে মাকে তার পিতা সন্মান দেননি, সেই ক্ষোভ নিয়ে সে পিতার গোষ্ঠীবিরোধিতা করে ।
    “ভোজপুরি মগহিতে গালাগাল ছিল মেজদার নান্দনিক ঔদ্ধত্য । ভাষার আদরায় রদবদল করে জীবনে পরিবর্তনের সংকেত পাঠাতে চাইত।” ( এই অধম ওই অধম, পৃষ্ঠা ৯৭ )
    আসলে পাটনার ছোটোলোকপাড়ার অবস্হান বঙ্গসংস্কৃতির খণ্ডহরস্বরূপ । যার ঝুরঝুরে চুনসুরকি খসা অস্তিত্ব মানতে পারা সহজ নয় ।
    “জমিদারি বেনেদিয়ানার ধুলোবালি ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াতে চাইছিলুম আমরা ছোটোরা সবাই,....মেজদা ঝেড়ে ফেলতে চাইছিল অতীতত্বের ক্ষীণ রেশটুকু, যা ঘাপটি মেরেছিল আমাদের পারিবারিক ভাষার আদরায়।” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা/এই অধম ওই অধম, পৃষ্ঠা ৯৫ )
    সাস্কৃতিক ধ্বসন ঠেকানোর উপায় নেই বলে গড়ে ওঠে প্রতিস্পর্ধা । হাতিয়ার করে জাদুবাস্তবকে । সাতজন বন্ধু মিলে একটা আইসক্রিম চেটে খাওয়া, নোংরা নর্দমা থেকে হাত দিয়ে বল তুলে নেওয়া, মৌর্যদের চৌর্যবৃত্তি এক বাস্তব, আর জেঠিমার গল্প, পুঁটির গল্প, ছোটোকাকিমার শাক্তবচন, সীতাদেবীর কুঁয়োয় ঝাঁপ, জাদুটোনা, ‘কালিদাসের কলম দিয়ে লেখা মেয়েমানুষ’, বিহারি পুলিশ অফিসারের মতন কেঁদো কুকুর...একের পর এক ছবি, যা দিয়ে গড়া হয় জাদু । এই সরস উপাখ্যান শেষ হয় একটি চাবুকের দ্বারা:-
    “জেঠিমা ছোড়দিকে বলছেন, ‘করুণার ঘর থেকে বুড়োর সমস্ত জিনিসপত্তর নিয়ায়...কবচ-কুণ্ডল সব, চিতার সঙ্গে ওগুলোও ছাই করে ফেলতে হবে । কোনো রেশ যেন না থাকে।” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা/এই অধম ওই অধম, পৃষ্ঠা ১৪৪ )
    আমাদের পূর্বপুরুষরা আসলে এভাবেই মুছে দেবেন প্রমাণ । প্রতিবাদের, পপতিস্পর্ধার । আর তার বদলে আমরাও ছুঁড়ব ঠাট্টার ব্যুমেরাং । মলয় আসলে প্রতিনিইত্ব করলেন ক্রীড়ানক প্রজন্মের যাদের সুশীল সমাজ সর্বদা বিদ্রূপই করেছে । মলয়ের একটি অসামান্য কবিতা এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা আবশ্যক:-
    “আমার মাকে যেন বলবেন না”
    আমি কবিতা লিখি
    কি লজ্জার, না ?
    আমার বাবা কখনও স্কুলে পড়েননি
    কি লজ্জার, না ?
    আমার মা কখনও স্কুলে পড়েননি
    কি লজ্জার, না ?
    আমার ঠাকুর্দা বাংলা লিখতে পারতেন না
    কি লজ্জার, না ?
    আমার ঠাকুমা শুদ্ধ বাংলা বলতে পারতেন না
    কি লজ্জার, না ?
    ………...।”
    এই লজ্জা তাঁর একলার নয় । আসলে সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের কারণ ভারতের উত্তরঔপনিবেশিক দশা । শাণিত প্রতিবাদের ধার উপন্যাসের নামকরণ থেকে শুরু করে শেষ বাক্যটি অবধি নানা রঙের জাদুয়ি বিস্তার দেখালো ।

    নখদন্ত
    ‘নখদন্ত’ মলয়ের আরেকটি অসামান্য পোস্টমডার্ন উপাখ্যান । এই নতুন ধরণের উপন্যাসে লেখকের প্রাত্যহিক দিনলিপি ও তাঁর নিজের লেখা কয়েকটি গল্পের প্লট ও ন্যারেটিভ পাশাপাশি চলে । মেইলে কথাবার্তায় মলয় জানিয়েছিলেন :-
    “নখদন্ত ন্যারেটিভটাকে আমি শুরু থেকে একটা অন্তর্ঘাতমূলক টেক্সট হিসাবে লিখতে চেয়েছিলুম।”
    রামায়ণের সপ্তকাণ্ডের আদলে সাপ্তাহিক দিনলিপিতে আধুনিক এক সংস্কৃতিময়, সৃজনশীল মানুষের বৈচিত্র্যময় অবসর জীবনের চিত্র পাওয়া যায় । পশ্চিমবঙ্গের দ্রুত পচনশীল সমাজের ভাগাড়ে রোজ পচতে থাকা মানবাত্মার তীক্ষ্ণ চিৎকার যেন তাঁর কলমে বরাবরই স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে এসেছে । ‘নখদন্তে’ পাই সেই সৃষ্টির পৃষ্ঠভূমি । নিজের কয়েকটি গল্পের উল্লেখ রেখেছেন মলয় এই দিনলিপির ফাঁকে । প্রথম ‘শেষ হাসি’ গল্পে কাংগাল চামারের ওপর অসহ্য অমানুষিক অত্যাচারের পরেও মুখের হাসিতে জাদুর ছোঁয়া বজায় রাখেন তিনি । চামড়া ভেদ করে বেরুনো ভাঙা পাঁজরের হাড়ের গোলাপি সাদা রঙ যেন সজোরে চপেটাঘাত করে কোমলতার সাথে গোলাপি অস্তিত্বকে । কন্সটেবল হত্যার জন্য বস্তিতে ‘হিন্দি ফিলিম’ হয় ।
    ‘চামার’ হয়ে ‘রাজপুত’কে হত্যার অপরাধে কাংগাল চামারকে ছিঁড়েখুঁড়ে হত্যা করে পুলিশ । ক্ষমতা ও অর্থ দখলের বাজারে সাইনবোর্ড আর টেবিল চেয়ার পেতে ট্রেড ইউনিয়নের ধামাধারীরা চটকলগুলিকে ভুতের আড্ডা বানিয়ে চলেছে । আর কাংগাল চামাররা আমারান্তা উরসুলার ( মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ ) মতো মৃত্যুকালেও মুখে সন্তুষ্ট হাসি ঝুলিয়ে রাখেন । উপেক্ষার, তামাশার হাসি । ‘শহিদ’ ও ‘জিরো নম্বর মানুষ’ একই পটভূমির ভিন্ন আঙ্গিকের কাইনি । দুটোতেই মলয় চটকল শ্রমিকের বেঁচে থাকার অলৌকিক লড়াই ও সহ্যশক্তির সাথে প্রশাসন তথা ক্ষমতালোভীদের অপার্থিব নিষ্ঠুরতার গল্প জাদুর মোড়কে পরিবেশন করলেন । ‘জিরো নম্বর মানুষ’ আবার মনে করায় আইডেনটিটি ক্রাইসিস । আত্মপরিচয়হীন মানুষ কেবলই ‘লাশ’ হয় । সে লাশের মৃত্যুর কারণ পাওয়া যাক আর না যাক, তার ধর্ম পাওয়া যায় । হিন্দু মুসলিম লাশেরা জায়গা বদলায় । চেনার উপায় শুধুই ‘নুনু’ । প্রতিবাদীতা সবই কাড়ে । সবশেষে কাড়ে পরিচয় । ‘খোসা ছাড়ানো নুনু ওয়ালা খালেদালি মণ্ডল লোপাট হয়ে যায় :-
    “খালেদালি মণ্দলের দেহও নেই, আইডেনটিটিও নেই । জিরো ? অ্যাঁ !” ( ‘নখদন্ত’ পৃষ্ঠা ৫৭ )
    মনে করায় মার্কেসের সেই ভয়াবহ স্মৃতি, যুদ্ধে গুলি খাওয়া এক ট্রেন শব স্রেফ লোপাট হয়ে গেল ।
    সমান্তরালে ‘ভাগ্যলিখনে হরফ দরকার নেই’ গল্পে শিক্ষিত বেকার যুবসম্প্রদায়ের কীটপতঙ্গের মতো অপমানের জীবন একটি বাস্তব । কিন্তু গান গেয়ে প্রতিবাদের ঐক্যবদ্ধ হাঁক পাড়ায় জাদু আছে । চাকরির ‘কুল্লে কুড়িটা’ পোস্টের জন্য অপেক্ষমাণ আগারোশো ক্যাণ্ডিডেট চূড়ান্ত ভণ্ডামি ও বশৃঙ্খলার ধিক্কারে যে সমবেত হুমহুনা বোল ধরে, তার সাথে লণ্ডন বা জার্মানির গণহত্যার জন্য সারিবদ্ধ বন্দীর গানে মিল আছে । অসউইৎজ এর চেম্বারে ঢোকার আগেও কি এভাবেই গলা মেলাতে চাইতেন না শিকলবাঁধা বন্দিরা ?
    ‘অট্টহাস্য বিনির্মাণ’ গল্পটির আগা গোড়াই বিদ্রূপের তীক্ষ্ণতায় জর্জর । পতাকা বহুবার টেস্ট করেই রাখা হয় উত্তোলনের আগে, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর টানে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকার ভূমিতে পতন আসলে একটি অসামান্য বিদ্রূপাত্মক রূপক । প্রশাসন ও রাজনীতি, ভারতবর্ষকে যেখানে স্হাপন করল, তা আসলে নেতার পদযুগল । জাদু ও বাস্তবের খেলার অসামান্য শব্দশৈলী রীতিমত ঈর্ষনীয় :-
    “গরম-শেষের বুড়ো ঘাসেরা যৌনতাবর্ধক বৃষ্টিফোঁটার অপেক্ষায় । শালিকশিশুকে কেঁচো কিংবা পিঁপড়ে খুঁটতে শেখাচ্ছেন ওর মাম্মি-ড্যাডি ।...ওপারে গোটাকতক রুডিয়ার্ড কিপলিঙ টাইপের নেড়ি কুকুর।” ( ‘নখদন্ত’, হাওয়া৪৯, পৃষ্ঠা ৮০ )
    বস্তুত পোস্টমডার্ন ভারতবর্ষের প্রতিটি স্তরে যে পাঁক প্রবিষ্ট হয়েছে, তার থেকে নিস্তার পাওয়া অসম্ভব, তাই:-
    “বাঙালির জিম্মায় হাসাহাসি করা ছাড়া আর কিছু টিকে নেই।” ( ‘নখদন্ত’, হাওয়া৪৯, পৃষ্ঠা ৮১ )
    ‘নখদন্ত’র নোটগুলি সম্পর্কে মলয় তাঁর মেইলে জানিয়েছিলেন :-
    “নোটগুলো ইংরেজিতে এই জন্য যে ইংরেজরাই চটকলগুলো স্হাপন করেছিল এবং ঔপনিবেশিক শাসকের ভাষার মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলুম তারা কেমনতর ধ্বংস করে দিয়ে গেছে --- সমাজে, সংস্কৃতিতে, ভাষায়, নৈতিকতায় ইত্যাদি । সাবভার্শনের কৌশল হিসাবেই নোটগুলো যেখানে সেখানে ঢোকানো --- যাতে নোটগুলোও রৈখিকতার সীমালঙ্ঘন করে যেতে পারে ।”
    তাঁর নোটগুলির অবস্হান ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে তাঁর এই বক্তব্য এতই সম্পূর্ণ ও স্পষ্ট যে আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না ।
    মানসিক চেতনার এই রূপকায়ন হল দীর্ঘ এক আত্মপ্রবঞ্চনার ফলাফল । মলব লিখেছেন :-
    “রাজনীতির সেল্ফকনট্যামিনেশন তো পশ্চিমবাংলায় দেখেই চলেছি । নিজেদের আদর্শের দ্বারা নিজেরাই কলুষিত হয়ে চলেছে রাজনীতি-করিয়েরা।”
    জবরদখল হতে হতে বাঙালি তার অস্তিত্ব হারিয়েছে, শুধু জমি নয়, সংস্কৃতিও বিক্রি করেছি আমরা । প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে পার্টি নির্বিশেষে সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা অগুনতি । আবিলতায় ঢেকেছে আসমুদ্রহিমাচল । মলয়ের এই সাহিত্যধারা সেই স্মৃতিহীন অস্তিত্বহীনতার ক্ষুদ্র এক প্রতিবিম্ব ।

    নামগন্ধ
    শেষ যে উপন্যাসটি আমার আলোচ্য, তা হল ‘নামগন্ধ’ । ঔপনিবেশিকতা ও উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গ যে কতদূর পচনের সীমালঙ্ঘন করেছিল, তার একটা অসামান্য দলিল এই উপন্যাস । যৌনতার এক ভিন্ন পরীক্ষামূলক সম্পর্কের পাশাপাশি উপন্যাসের প্লটিঙ-এ রয়েছে দৃঢ়তা ও রহস্য । ভবেশকারা আসলে সেই ‘মার্জিনাল মেন’, আঞ্চলিক দেবতা । যাঁদের ভোগ প্রস্তুত না করে কোনো গঠনমূলক কাজ করা সম্ভব নয় । দেশভাগের পর বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরা পুনর্বাসন পান বা না পান, উদ্বাস্তু নেতাদের আখের গোছানো ছিল দৃষ্টিকটু রকমের । মলয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল এই পংক্তি :-
    “পথে পোড়ানো ট্রামের ছাই মেখে বাঙালির যে সৎসমাজ, ভবেশকা আজ তার অগুন্তি সন্তানদের একজন।”
    খুশিদি, যিশু, ভবেশকার এই ত্রিভূজের মাঝে জাল বিস্তার করেছে প্রাকৃতিক মায়াজালে ঘেরা নীরবতা, যৌনতার রহস্যময়তা ও বারব্রত-ঝাড়ফুঁকের কাহিনি । ব্যুমেরাং করে ছুঁড়ে দেওয়া গোপন প্রেম, দেহপুজা । যেখানে যত দারিদ্র, অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা, সেখানে জ্যোতিষের কদর, ওঝার আদর তত বেশি । অর্থপিশাচ দাঙ্গাবাজ ভবেশকা তাই ঝাড়ফুঁকের ওঝা হয় :-
    “অসীম তালোধি, ওর মেয়ের ভুতের ব্যারাম আচে । দাদা ওষুধ পথ্যি করে । রোগবালাই ঝাড়ার জন্যে রাসপা ত্রিফলা হিং রসুন শুঁঠ নিশিন্দে কুচিলা বেড়ালা হত্তুকি চিতেমূল সব বাটছিলুম একসঙ্গে ।”
    ভুত ঝাড়ার মন্ত্রের সাথে মিলে মিশে যায় প্রণয় নিবেদনের মন্ত্র । খুশিদিকে এক অদ্ভুত স্হবিরতার মধ্যে আটকে রাখতে পেরে ভবেশকা পায় অধিগ্রহণের আনন্দ । কিন্তু শাপভ্রষ্টা নারীর মতো খুশিদি চায় পূজা, বন্দনা, আরাধনা, তৃপ্ত হতে চায় পুরুষের মুগ্ধতা গায়ে মেখে । ভবেশকা খুশিদিকে ভোগ করেছে কিনা বা না করলেও তা কেন করেনি তার উল্লেখ লেখক করেননি । পোস্টমডার্ন তৃতীয় বিশ্বের গ্রামের চেহারা ডায়াস্পোরিক সমাজের ভণ্ডামির প্রতিস্পর্ধী হয় । শাসন ও হুমকির ভয়ে জড়সড় গ্রামীণ সমাজের প্রতিস্পর্ধায় মাথা তোলে যিশু ও খুশিদির শরীর পূজাময় প্রেম । গার্সিয়া ‘মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর’-এ সেই শেষ প্রজন্ম আরোলোয়ানো ও আমারান্তা উরসুলার মিলনের মতো অলৌকিক এই প্রেম । স্বার্থপরের জিইয়ে রাখা অভাবে ও শোষণে জর্জর বঙ্গভূমির ছিবড়ে হয়েছে কল্পপ্রেমের জ্বালানি ।
    “ওঃ মলয়
    কলকাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ
    কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কি করব বুঝতে পারছি না
    আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
    আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
    আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি।”
    ( ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’, ‘অতলান্তিক’ হাংরি জেনারেশন সংখ্যা, ৬ঠ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, এপ্রিল-জুন, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৪০ )
    মলয়ের সেই বিখ্যাত কবিতার এই পংক্তিগুলি চিৎকার করে সাক্ষ্য দেয় সেই অস্তিত্বহীন শিকড়হীন সময় ও সমাজের ক্ষুধাতাড়িত যুবসমাজের, যাদের অনুভব অনুভূতির কোনো দায় দায়িত্ব পূর্বপুরুষ বা অভিভাবকরা নেন নি । তাঁদের সেই ক্ষুধার তৃপ্তিতে তাঁরা সাহিত্যের কানাগলি অবধি সন্ধান করেছেন, কিন্তু বাংলা বাজারের শ্লীল সাহিত্যের সাথে, খাপ খাওয়াতে না পেরে সৃষ্টি করেছেন চাবুকের মতো এই সাহিত্যধারার, যা বহন করেছে জাদুবাস্তবের আগাম বীজ । বাংলা সাইত্যের লেখক-পাঠক কেউই খুব সহজে মান্যতা দিতে পারেননি হাংরিদের। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিস্ময়াদীর্ণ হয়ে বলেছিলেন এই সাহিত্য কি পিতা মাতার সামনে পাঠ করতে পারবেন এই লেখকরা ? পিতা মাতা গুরুজন অভিভাবকের নীতি আদর্শের রক্ষণশীলতার আড়ালে নিজেরা ফুরিয়ে যেতে চাননি এই তরুণরা । ডাডাইজমের প্রবর্তক ত্রিস্তান জঁরা যেমন বলেছিলেন, আমার আগে মানুষ আদৌ ছিল কিনা আমি জানতে চাই না, তেমনি মলয়, সমীর, বাসুদব, অরুনেশরা জানতে চাননি অতীতকে, যে অতীত তাঁদের সন্মুখীন করেছে এক ক্লেদাক্ত, নোংরা সমাজের সামনে । দিয়েছে কেবলই শৃঙ্খল ও পরিচয়হীনতা । প্রতিস্পর্ধায় কন্ঠ তুলতে তাঁরা স্বঘোষিত প্রতিলেখক ।
    হাংরিরা যে হেনস্তা হবেনই, তা পূর্বনির্ধারিত ছিল । কিন্তু সময় বলে দিচ্ছে প্রতিস্পর্ধার আগুন ছড়াবেই । জাদুবাস্তবের প্রয়োজন আজ সমগ্র পৃথিবী অনুভব করছে । আমার তৃতীয় বিশ্বের পূর্বসূরীদের এই বিচক্ষণতাকে সন্মান জানানোই এই সন্দর্ভের মূল উদ্দেশ্য ।
    ( পলাশ খাটুয়া সম্পাদিত ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম ও বাংলা সাহিত্য’, ২০১৬, বই থেকে নেয়া হয়েছে )
  • Bahata Angshumali | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:২৩541354
  • বহতা অংশুমালী
    মলয় রায়চৌধুরীর ডিটেকটিভ উপন্যাস : অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস
    উপন্যাস এর নামটা আমাকে বুঝতেই দেয় নি ভিতরের খনিজের উপস্থিতি । প্রচ্ছদে যুবতীর ছবি দেখে মনে হয় কোনো রগরগে রবিবাসরীয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছি। বুঝি নি এই অতি সংক্ষিপ্ত উপন্যাসের প্রতিটি লাইন এক বিরল জীবনদর্শনের মুখোমুখি করে দেবে আমাকে । এক অন্যধরণের সত্যানুসন্ধান , সাধারণ খুনের মামলার প্রেক্ষাপটে যা এক যুবক যুবতীর উৎকেন্দ্রিক আরণ্যক ভালোবাসা থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে। তেলেগুতে এনক্রিপ্টেড, বাংলায় লেখা , সিডিতে সংরক্ষিত ডায়রিলেখনে বন্দী হয়ে থাকে সেই জীবনকাহিনী । আর কংকাল প্রেমিক এর জীবন ও মৃত্যু রহস্য উন্মোচিত হয় নোংরা পরীর হাতে।
    নোংরা পরী , ববিটাইজিং ভীতির কার্যকারিতা আর সারল্যের সংজ্ঞা
    নোংরা পরী বেরিয়ে এসেছে Edith Wharton এর বর্ণিত The Age of Innocence এর পর্দা কেটে । ইন্সপেক্টর রিমা খান অপরাধীর চোখের গতির ভিত্তিতে ক্রিমিনাল ঠ্যাঙায় । যে ক্রিমিনালরা জেরা করার সময়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের দু-ডিগ্রি , যারা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের থার্ড ডিগ্রি । বুকের দিকে তাকিয়ে থাকারা নাকি তুলনামূলক ভাবে স্বাভাবিক, রিমা খানের ভাষায় তারা প্রকৃতির মাদার-সান-ইন্সটিংক্ট মেনে চলে। তাদের ঠেঙিয়ে কথা আদায় করে না , সাবইন্সপেক্টারের ওপর ছেড়ে দেয় ।
    রিমা খানকে উপন্যাসের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নাম দিয়েছে "নোংরা পরি" । নোংরা- কারণ সে সিমেন-দি-বভার সেকেণ্ড-সেক্স হতে রাজী নয়। সে আদ্যোপান্ত পুলিশ , প্রফেশনাল সমস্ত অর্থে , এমনকি ছুটকো ঘুষ নেবার ক্ষেত্রেও । সে দুর্দান্ত , দুঁদে । তার ভয়ে তার অঞ্চলের ক্রিমিনালরা লোক্যালিটি বদলে ফেলে ।
    বেটি ফ্রিড্যান যে ফেমিনিন-মিস্টিক কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তা এখনো আজকের সমাজেও পৃথিবী জুড়ে বর্তমান । এই নারীত্বের রহস্য শতকের পর শতক কখনো চীনে মেয়েদের পা জুতোয় ঢুকিয়ে ছোটো করতে বাধ্য করে , আফ্রিকার উপজাতির মেয়েদের মরাল গ্রীবাকে দীর্ঘায়িত করতে ধাতব বালায় বালায় বরবাদ করে দেয় ঘাড়ের মাথাকে ধরে রাখার কার্যকারীতাটুকু। এই নারীত্বের সন্ধানে ইউরোপের শিক্ষিতা মহিলা প্রেমপত্রে বানান ভুল করে, পদার্থবিদ্যার ডিগ্রি না নিয়ে পড়তে চায় সুললিত আর্টস।
    রিমা খানের মধ্যে সেই সারল্যটুকু নেই , সভ্যতা যে সারল্য শেখায় মেয়েদের, কাঁচের-পাথরবাটির মতো । যে শিক্ষিত সারল্যে মেয়েরা দুই বাচ্চার মা হয়ে গিয়েও সেক্সটকের অধিকার পায় না, বলে "ইস ছি ছি ছি", আজকের জমানাতেও । রিমা খান বিন্দাস গালিগালাজ করে। রিমা আবিষ্কার করে ফেলেছে যে ববিটাইজ করার ভয় দেখালে আবালবৃদ্ধ-ক্রিমিনাল খুব আকুল হয়ে পড়ে । তাতে অরগ্যাজম হয় রিমা খানের । এখন যে যুগ এ জিন্স এর সঙ্গে এক-হাত লাঠি-চুড়ি পরে মডার্ন ফেমিনিন ঘুরে বেড়ায় , স্ট্রিপটিজ দেখে আবার সন্তোষীমা-ও করে , সেখানে এই ডিলডো প্রেমী পুলিস অফিসারটি নোংরাও বটে পরীও বটে। তাকে কোথাও প্লেস করা যায় না, কোনো গ্রাফ এ ফেলা যায় না ! তার উলঙ্গ সত্ত্বায় কোনো কালো-দস্তানা-মোজা পরা লজ্জার ভেজাল ভঙ্গিমাও নেই । তাই সে মানুষী নয়। মানুষের ভোগ্যাও নয় হয়তো । বাঘিনী বাঘের জন্যে ভার্জিনিটি-টুকু বাঁচিয়ে রেখে ছিল । তা চারদিকে তো শুধুই ছাগল গবাদি পশু তার । তাই কুমারীত্ব ঘোচেনি কোনোদিন । এক ব্যতিক্রম কংকাল প্রেমিক ।
    যে কংকাল সে শুধু প্রেমিক
    প্রেম কয়প্রকারের হয়ে থাকে ? বহু প্রকারের হয়ে থাকে প্রেম। মেয়ে মাকড়শার সামনে পুরুষ মাকড়শার সুইসাইডাল প্রেম, মক্ষীরাণীর সামনে খুদে মৌমাছি শ্রমিকের প্রেম , রেপিস্ট হাঁসের প্রতি হংসিনীর প্রেম, ডলফিনের হরণ বা অপহরণ মূলক প্রেম , সতী নারীর পতিপ্রেম , বড়োলোকের বেশ্যাপ্রেম এবং সমান্তরাল ভাবে সন্তানের মায়ের প্রতি প্রেম এমন অনেক রকমের ।
    আমাদের কংকাল , যিনি কিনা ইন্সপেক্টর রিমা খানের আবার চাকরি ফিরে পাবার পাসপোর্ট, তিনি ছিলেন গণিতবিদ । এখানে মলয় রায়চৌধুরী বোধ হয় গণিতের অবতারণা করেছেন কুয়াসাহীন শুদ্ধচিন্তার প্রতীক হিসেবে। নিরঞ্জন, ওরফে কঙ্কাল , বুঝে গিয়েছিলেন তিনি বহুগামী । তাই কোন মহিলাকে এবং নিজেকে সমস্যা না দিতে চেয়ে , বিয়ে টিয়ে না করে , শুদ্ধ গণিত ও শুদ্ধ যৌনতার চর্চা করেছেন প্রেমে পড়ার আগে অব্দি। মলয় রায়চৌধুরী দেখিয়েছেন তাঁর দুরকম প্রেম ।
    নিম্নগামী প্রেমটি (মস্তিষ্ক থেকে শীষ্ণ হয়ে এসে হৃদয়ে যা ইকুইলিব্রিয়াম পেলো , মাসিকের আবর্তনে মাপলো সময় )
    একজন জীবন খুঁজতে পালিয়েছিল , অন্যজন গিয়েছিল শুধু পলায়নপরাকে দেখে । মায়া পাল পুরোদস্তুর আধুনিক যুবতী , যিনি কুড়ুমুড়ে ইংরেজী বলতে বলতে অনায়াসে উচ্চপদের চাকরি পেতে পারেন , তিনি সুপুরুষ গণিতবিদের হাত ধরে বললেন "চলুন পালাই" । আর কামুক বিশ্বামিত্র ও তাঁর সঙ্গিনী চললেন অরূপের সন্ধানে, অন্ধ্রপ্রদেশের ব্যারাইটস খনি অঞ্চলে । তাঁদের অতিপ্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃতিক প্রেম সেই অরণ্যে যাপিত হয়। অতিপ্রাকৃতিক কারণ মলয় রায়চৌধুরী এখানে খুঁজতে চেয়েছেন প্রকৃতির সঙ্গে মিথোজীবী ভাবে যাপিত জীবনের দিকটি । বাছুরকে দুধ থেকে বঞ্চিত না করে, মুরগীর ছাল ছাড়িয়ে না নিয়ে, ভেড়ার লোম কেটে না নিয়ে বাঁচার পদ্ধতি । মায়ার এনভায়রনমেণ্টালিজম, জীবপ্রেম ।
    মলয় রায়চৌধুরী এখানে মনে করিয়ে দেন আমাদের ভুলে যাওয়া নারী পুরুষের প্রেমের রূপটিও । এখানে এক মানুষীর গায়ের গন্ধটি প্রেমিক চেনেন । প্রেমিক প্রেমিকাকে আলিঙ্গন করতে থাকেন মনের তাপে, আর রোজ আলিঙ্গন করতে করতে বুঝতে পারেন তাপের তারতম্য , ডিম্বাণুর আবির্ভাব। তাঁরা প্রেমটুকু চেয়েছিলেন , বীজটুকু নয়। তাই নিরোধ প্রক্রিয়া , অদ্ভুত আত্মনিয়ন্ত্রণ । মায়া নিরঞ্জনকে সেই প্রেম শেখান যাতে শরীর বড় হয়েও ওঠে না অযথা , ছোটও হয় না। যতটুকু আসে সহজে আসে। এই প্রথম নিরঞ্জন কোনো নারীর আলিঙ্গনে উত্তেজিত না হয়ে শান্ত হন।
    এখানে খুব সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে দুজন মানুষের একে অন্যকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকার আনন্দ। এখানে নিরঞ্জন ঘড়ির অভাবে মায়ার মাসিক বা ঋতূস্রাব এর দিন গুলিকে গাছের গুঁড়িতে খোদাই করে রাখেন । আর হিসেব রাখেন দিন মাস বছরের । "Metaformic theorists also discuss how cultures, like the Romans and Gaelic used the same words for menstruation and the keeping of time, while the Mayan calendar was directly influenced by women's menstrual cycles."(উইকিপিডিয়া থেকে উদ্ধৃত) উইকিপিডিয়া আর গুগল আমাদের বলে দেবে , মহাজাগতিক ক্যালেণ্ডারটি অনেক ক্ষেত্রেই কিভাবে প্রাচীন কালে নারীর শরীরের ঋতূচক্রের দিকে তাকিয়ে বানানো হয়েছিল । কখনো উনত্রিশ কখনো ত্রিশ দিনের বিরতিতে।
    এই প্রেমে এক মানুষী বলেন আমি সবটুকু দেব, আর পুরুষটি বলেন আমি সবটুকু নেব । আর ঋতূস্রাবের পরে প্রেমিক ধুইয়ে দেন পরম আদরে প্রেমিকার রসস্থল , আরণ্যক দিনে ।
    ঊর্ধ্বগামী ভালোবাসা (সখীর জন্যে বীজ শুয়ে আছে বরফে)
    শরীরের ভালোবাসাকে আমরা মাঝে মাঝেই একটু নিম্নমানের বলি, পর্দা তুলে দিই । "রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়" । যেন কামগন্ধ খারাপ বস্তু । যেন আমাদের সব্বার উৎস্য লজ্জার । এই ক্রিশ্চান ওরিজিন্যাল-সিন এর পাপবোধ যা আমাদের উপরে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে , যে পাপবোধ থেকে আজ বহু মেয়ের অঙ্গ কেটে দেওয়া হয় যাতে তারা "শয়তানি আনন্দ" উপভোগ না করে শুধু সন্তান প্রসবের যন্ত্র হিসেবে নিজেদের বহন করতে পারে, সেখানে মিলি একদমকা খোলা হাওয়া । মিলি কিশোর আনাড়ি নিরঞ্জন কে "ভালোবাসতে" শেখায় । তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিজেদের শরীর নিয়ে খেলে , জানতে পারে যান্ত্রিক ভঙ্গীতেই বিভিন্ন আনন্দের উৎস্যমুখ । সে তো সেতার বাজাবার আগে টুংটাং টুকু না করলেই নয়।
    মিলি ভালোবেসেছিল কংকালকে। নিরঞ্জন ভালোবাসেননি সেই অর্থে। তিনি তখন-ও পুরুষ নন। বৃন্দাবনবিলাসী কিশোর , যে পালিয়ে যাবে , পালিয়ে গেছে। কিন্তু মিলি বিয়ে করেন নি । আর নিরঞ্জনের সন্তান পাওয়ার জন্যে জোরাজুরিও করেছেন বহু বছর পরে দেখা হলে ।
    নিরঞ্জন ভালোবেসেছেন মায়াকে । কিন্তু মিলির জন্যে মৃত্যুর আগে রেখে গেছিলেন শুক্র, ডাক্তারের কাছে ।
    মিলি সন্তান চেয়েছিল, মায়া চায়নি । এখানে শিষ্ণ থেকে উঠে গেছে ভালোবাসা হার্ট এ । কি মন্ত্রে কে জানে।
    এক্ষেত্রে মলয় রায়চৌধুরীর একটি ইণ্টারভিউ মনে পড়ে গেল Alexander Jorgensen কে দেওয়া। " Alex: If you could walk a mile in whatever circumstance, where would you choose to do it ?
    Malay : I would go to the bank of river Ganges, at the place where I had kissed my Nepali classmate Bhuvanmohini Rana. My first and memorable kiss. I do not know where she is now. Must have become old or might have died ; she was two years older than me. I would sit at the same spot at the same time of autumn evening to revisit her tenderness." । আমার যেন মনে হয় ভুবনমোহিনী কোথাও মিলি , তার সমস্ত কোমলতা নিয়ে, যেখানে নিরঞ্জনের কৈশোর আটকে আছে।
    মায়ার সত্যি নিরঞ্জনের সত্যি , মায়ার জীবনদর্শন
    কাহিনীটি তো ডিটেকটিভকে নিয়ে। সত্যানুসন্ধান ! Akira Kurosawa র Rashomon যেমন দেখিয়ে দেয়, বিষয়গত তথ্য আর বিষয়ীগত সত্য এক নয় , প্রেমিক নিরঞ্জন ও প্রেমিকা মায়ার সত্যিও আলাদা।
    মায়া আধুনিক , কিন্তু পুনরাধুনিক। তিনি জানতে চেয়েছেন জীবনের যাপনগত সত্যটা । মানুষ ঠিক কোন আঙ্গিকে সভ্য , জীবহত্যার ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃতির সঙ্গে মিথোজীবীতার মাধ্যমে বাঁচা যায় কিনা, তাই দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই দুধের শিশুকে ছেড়ে, স্বামীর ও সমাজের দেওয়া অসহিষ্ণুতা ও অপমান থেকে পালিয়ে যেতে , তিনি "খপ করে" নিরঞ্জনএর হাত ধরে বলেছিলেন "চলুন পালাই " ।
    “No, it is impossible; it is impossible to convey the life-sensation of any given epoch of one’s existence--that which makes its truth, its meaning--its subtle and penetrating essence. It is impossible. We live, as we dream--alone.” -- Joseph Conrad এই জাতীয় উক্তি কে মেনে নিতে পারেননি ইংরাজির ছাত্রী মায়া পাল। নিরঞ্জন লিখেছেন , "সে আমাকে টমাস হবস, জোসেফ কনরাড, অ্যান্টনি বারজেস, উইলিয়াম গোলডিং আরো কারা কারা যেন, প্রতিটি নাম মনেও নেই এতদিন পর , এনাদের লেখালিখির কথা শোনাতো । তার জীবনের অতীতসূত্র কেবল এই সাহিত্যদর্শনকে ঘৃণা । তার অতীত সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানি না, সে বলতে চায়নি । বলত ওনারা জীবনের ভুল ব্যাখ্যা করে গেছেন । ওনারা নাকি বলে গেছেন একজন মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত, সে একাকী, কেউ নেই তার, যত বৈভব থাক না কেন সে প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র , পঙ্কিল, কদর্য, অশ্লীল, জঘন্য, স্হূল, পাশবিক, অশিষ্ট ও বর্বর । সে বলত, জীবনের এই আশাহীন দৃষ্টিকোণ অসত্য । "
    কিন্তু নিরঞ্জন এর সত্য আলাদা। তিনি মূলতঃ প্রেমিক । তিনি নিজেকে দেখেন এইভাবে -"মায়ার পাশে বসে একই ভাবনা ঘুরছিল আমার মগজে, যা বহুকাল থেকে বাসা বেঁধে আছে । তা এই যে, আমি একজন কুকুর । যে মালকিনির হাতে পড়েছি, সে যেরকম চেয়েছে, যেরকম গড়েছে, তা-ই হয়েছি : প্রেমের কুকুর, কাজের কুকুর, সেবার কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর , পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপির কুকুর, অনধের কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল, আজও তেমনই আছে । থাকবে । এখন টাইপ করতে বসেও জানি, লেজটা অমনই রয়েছে ।" এই আকাশমুখী লেজ এই গণিতবিদের জীবনচেতনা ।
    নিরঞ্জনের জীবনচেতনার অন্য একটি দিক দেখা যায় , তাঁর চেতনায় "পবিত্র" শব্দটির অভিঘাতে । নিরঞ্জন লিখছেন - "আমার দিকে না তাকিয়েই মায়া বলেছিল, আমরা সারা জীবন নিজেদের সম্পর্ক আপনি-আজ্ঞের পবিত্র গভীরতায় রাখব । তুমি-তুমি ওগো-হ্যাঁগোর ছেঁদো নোংরা রুটিনে বাঁধা পড়ব না। বলেছিলুম, পবিত্র ? এই ধরণের অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করবেন না প্লিজ । "
    নিরঞ্জন এক জমির মতন পড়ে থাকেন সমস্ত জীবন । নানান মেয়ে , মহিলা তাঁর উপর দিয়ে বয়ে যান , তাঁকে উর্বর করেন , তাঁকে ভেঙ্গে দেন । তাঁর ল্যাণ্ডস্কেপ পালটে দেন। এভাবেই মানবজমিনের চাষ করে গেছেন নিরঞ্জন । শেষ দিন অবধি। তিনি কোনো মহিলা কে "ডিমিন" করেন নি কখনো । দেহ ব্যবসায়িনীর "গিগলিং" টুকুকেও নয়। "পৃথিবী নামের ছোট্টো দ্বীপটায়, নারী ছাড়া আমি একা, নিঃসঙ্গ, অন্তরীণ । জীবনে নারী নেই ভাবলেই মনে হয় মরে যাবো, মরে যাচ্ছি, মরে গেছি ; ফাঁকা, ফোঁপরা, খালি । জানতেই পারতুম না আহ্লাদ কি, আঘাত কি, বেদনা কি, হাহাকার কি । " - নিরঞ্জন এমনই ভাবেন, বলেন , বাঁচেন। এই নারীসঙ্গ ইচ্ছা সামগ্রিক শারীরীক কাম নয় একেবারে। তিনি শেষ বয়সেও ‘শেষনীর’ সঙ্গ চান উত্থানরহিত অবস্থায় । যেমন "অ্যালিস ইন দ্য ওয়াণ্ডার ল্যাণ্ড" এর লেখক লুই ক্যারল এর স্নেহের ডাকে খোকারা সুবিধে করে উঠতে পারতো না। তিনি খুকিদের বলতেন গল্প শুনতে আসতে। আর বলতেন ভাইদের ঘরে রেখে এসো । যে তার যে সুরে বাজে, সে তার সেই সুরেই বাজে । অন্যথা পচে যায় , যেমন আমরা পচে যাই অহরহ ।
    সত্যানুসন্ধান কি? ভিলেন কারা কারা ? কাঠগড়ার এপারে ওপারে ।
    ফেলুদা, ব্যোমকেশ , কাকাবাবু সন্তু এই সব্বার থেকে আলাদা নোংরা পরী , ডিটেকটিভ রিমা খান । ১) তিনি পুলিশ , সখের গোয়েন্দা নন ২) তিনি মহিলা, প্রথম , একমাত্র মহিলা সত্যানুসন্ধানী বাংলা উপন্যাসের । তিনি ক্ষমতাশালী, ইনফর্ম্যার কনস্টেবল ইত্যাদি প্রয়োগে সমর্থ । যদিও তিনি সাসপেণ্ডেড । ববিটাইজ-করার ভয় দেখাবার প্রক্রিয়ায় নোংরা ।
    রাষ্ট্রই ভিলেন নম্বর ওয়ান
    এই উপন্যাসে, প্রথম বাংলা উপন্যাসে আমরা দেখতে পেলাম অপরাধ জগতের ব্যক্তিনির্ভরতার ঊর্ধ্বে সিস্টেমটাকে । আমরা দেখতে পেলাম রাষ্ট্র কোথায় অপরাধী । কিভাবে তুরুপ উপজাতির মানুষদের উৎখাত করে ফেলে খনি-মাফিয়া খনির লোভে । কিভাবে ক্যাপিটালিজম এর , ব্যবসায়িক উদারনীতির , শিকার হয় অরণ্যের মানুষ । যাদের রাষ্ট্র কিচ্ছু দেয় না, যাদের "সমাজ" ব্যবস্থা , নীতি ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র স্বীকারই করে না , যাদের ভোটাধিকার নেই, পৌরসুবিধা নেই , তাদের কিভাবে অনায়াসে একটি মাত্র পুলিশ চৌকির অন্তর্গত করে ফেলে রাষ্ট্র। মায়া ও নিরঞ্জন যখন তুরুপ গোষ্ঠীর বাচ্চাদের শিক্ষিত করতে থাকেন , কিভাবে সেই মানবিক প্রচেষ্টাকে পুলিশ অবলীলায় বলে "উপজাতিদের পড়াশুনা শিখিয়ে তোমরা যে এই অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট করছিলে সে সংবাদ আছে আমাদের কাছে ।" এই ভারসাম্য ফেরত আসে , যখন সমস্ত আদিবাসী অরণ্য ছাড়া হয়ে খনি শ্রমিকে পরিণত হয়। কনজিউমার সোসাইটির প্রয়োজন তো সত্যই , কিন্তু আরণ্যক উপজাতির সত্যটুকুর কোনো দাম থাকে না রাষ্ট্রের চোখে । সবুজ নষ্ট হয়ে যায় । মাটিতে বড় বড় হাঁ করা গর্ত তৈরি হয়। কারণ খুঁড়েছে মাফিয়া, কোন বিবেকবান রাষ্ট্র নয় ।
    মায়ার "আচ্ছা চলি"র পিছনে রাষ্ট্র নামক ভিলেনের কি অবদান তা বোঝার জন্যে পড়ে দেখুন উপন্যাসটা
    ভিলেন নম্বর দুই
    বলব না। তাহলে আর কী পড়ে দেখবেন । কিন্তু রিমা বুঝতে পেরেছিলেন ভিলেন কে। কংকাল প্রেমিকের ঘাতক কে । আর সেই ভিলেন কে বানিয়েছিল মধ্যবিত্ত সমাজের হাশহাশ নীতি, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা । যারা ভালবাসা দেখতে পায় না। ভালবাসার অভাব দেখতে পায় না । পবিত্র বিবাহগ্রন্থির নীচে চেপে রাখতে চায় সব রকম অতৃপ্তির চিৎকার । আর গ্রন্থিমুক্ত হতে চাইলে আঘাত করে সেই মানুষটিকে সুপরিকল্পিত ভাবে।
    ভিলেনের স্মৃতিসৌধ
    মায়ার "আচ্ছা চলির" পরে , মায়ালিঙ্গার পুলিশের হাতে অত্যাচারিত হবার পরে , তুরুপ প্রজাতির জঙ্গুলে মানুষই পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনে নিরঞ্জনকে। মায়া ছিলেন তাদের জন্য শিক্ষিকা , মাতৃরূপিণী , জীবন্ত দেবী , আম্মা। আর মায়াগারু সেই দেবীর জীবনের অঙ্গ । তুরুপ গোষ্ঠীর এই মানুষদের সমাজচেতনা আলাদা। তারা মায়া-নিরঞ্জনকে গ্রহণ করেছিল খুব সহজ ভাবে , বর্তমানে নির্ভর করে, তাদের অতীত না খুঁড়ে। তাঁদের চলে যাওয়ার পরে তারা কুঁড়ে ঘরটাকে মন্দিরের সম্মান দেয় । কোন বিগ্রহহীন মন্দির। কিন্তু মায়ার আকস্মিক প্রস্থানের জন্য দায়ী ক্ষমতা গোষ্ঠী , কুঁড়েটাকে ধর্মের দোকান বানিয়ে ফেলে অচিরেই । বহু পরে রিমা খান অকুস্থলে গিয়ে দেখতে পান, এক অদ্ভুত মূর্তি সহকারে মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে । সেখানে মায়া পাল-এর ভাবমূর্তি বেচে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে খনি-মাফিয়ার দল বেশ দু পয়সা আয়ও করে নিচ্ছে ।
    এভাবেই আমাদের দেশে সতী প্রথা থেকে শুরু করে অনার-কিলিং অব্দি বিভিন্ন ভাবে একটি মেয়ের সত্ত্বা ও অস্তিত্ব গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর তাকে "ধার্মিক" প্রমাণ ক'রে , দেবী প্রমাণ ক'রে, তার ব্যক্তিসত্তা ছিনিয়ে নিয়ে সমাজ তাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় নিজের মধ্যে ।
    যৌনতার অর্ধেক আকাশ ,যান্ত্রিক ও মানবিক অরগ্যাজম , অশ্লীল মলয় রায়চৌধুরী
    মায়া
    মলয় রায়চৌধুরী সেই অর্থে অশ্লীল যে অর্থে ডি এইচ লরেন্স বা গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজ অশ্লীল ছিলেন । যখন 'লেডি চ্যাটার্লিস লাভার্স-এ কনির মনে হয় নারীকে তার নারীত্ব থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে আজকের পুরুষ আর সমাজ , বহু বায়বীয় কথার মধ্যে দিয়ে তার শরীরী রহস্য আর দেহোত্তীর্ণতা দুটোকেই নষ্ট করছে, তখন কংকাল প্রেমিক পরম যত্নে ধুইয়ে দেন প্রেমিকার অঙ্গ প্রেমিকার অনুজ্ঞায় , ঋতূস্রাবের পর । এই স্পর্শ আমাদের পরিচিত যৌনতার থেকে অনেক ঊর্ধ্বে । এখানে ভালোবাসা যে-কোনো ইজমকে অতিক্রম করেছে। লজ্জা ঘৃণা ভয় ত্যাগ করেছেন কৃষ্ণ এখানে , শুধু রাধা বা গোপিনীর দল নয় । এই ভালোবাসায় নিরঞ্জন নিষিক্ত হতে থাকেন মায়ার সঙ্গে , সভ্যতা-ছেঁকে পাওয়া সভ্যতায় ।
    মিলি
    মেয়েদের যৌনতাকে সমাজ সাধারণতঃ অশ্লীল মনে করে। এই উপন্যাস-এ লেখক সেই ঢেকে যাওয়া অর্ধেক আকাশকে টেনে নিয়ে এসেছেন অনেকখানি । নিরঞ্জনের কৈশোরে মিলি , তাদের খেলাধূলোয় কেবল কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা দেখায় না। সে আগে নিজে তৃপ্ত হয়ে নেয় নিরঞ্জনের মাধ্যমে । তারপর নিরঞ্জনকে নিয়ে যায় শিখরে । এই দেয়া নেয়ার সহজ হিসেবটুকু এই টেণ্ডারনেসের সঙ্গে আমি সচরাচর পাই নি কোন বাংলা উপন্যাসে । এই প্রসঙ্গের অবতারণা যখনই হয়েছে, কিছু বিকৃতির সঙ্গে করা হয়েছে । আবার লরেন্সের থেকে ভাবটি উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করে- স্পর্শ ছাড়া কিই বা টিকে থাকে , শেষ পর্যন্ত দেহে মনে অস্তিত্বের শিকড়ে ? যদি স্পর্শ তেমন স্পর্শ হয় ।
    রিমা খান
    RACHEL P. MAINES এর "The Technology of Orgasm "Hysteria," the Vibrator, and Women's Sexual Satisfaction" রচনা যেটি Johns Hopkins University Press থেকে প্রকাশিত হয়েছিল, তার প্রথম পরিচ্ছেদের নাম হলো " THE JOB NOBODY WANTED " যে-কাজটি-কেউ-চায়নি । শতকের পর শতক মেয়েরা তাদের যৌন চেতনাকে ঢেকে রেখেছে , সেবামূলক ও প্রদান-ভিত্তিক মিলনের আড়ালে। তাই তার চেপে রাখা "হিস্টিরিয়া" টুকুকে কখনোই অনুরণনে পরিণত হতে দেয় নি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ । সেটা শুধু চিকিৎসা-সাপেক্ষ গোঙ্গানি হয়ে থেকে গেছে। তাই রিমা খান যখন ডিলডো ব্যবহার করে খুশী হয়, তৃপ্ত হয় , ফুরফুরে হয় , আমি তখন আবার উদ্ধৃত করি " When the vibrator reemerged during the 1960s, it was no longer a medical instrument; it had been democratized to consumers to such an extent that by the seventies it was openly marketed as a sex aid. Its efficacy in producing orgasm in women became an explicit selling point in the consumer market. The women's movement completed what had begun with the introduction of the electromechanical vibrator into the home: it put into the hands of women themselves the job nobody else wanted. " RACHEL P. MAINES এর রচনা থেকে ।
    আমি এই "অশ্লীল" , নারীবাদী , মানবতাবাদী লেখককে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
    উপন্যাসের ফর্ম , Anachronism , সাহিত্যের ডিটেকটিভদের টাইম ট্রাভেল , রাজনৈতিক গণহত্যা ও ডিটেকটিভ বিলাসিতা
    টাইম ট্রাভেল ও ডিটেকটিভ দের চোখে সামাজিক অবক্ষয়
    এই উপন্যাসে বেশ কটি মজার পয়েণ্ট রয়েছে । Anachronism বা সময়ের হেরফের ব্যবহার করে দিল্লিতে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ কনফারেন্সে মলয় রায়চৌধুরী আবির্ভূত করেছেন দেশ বিদেশের বহু সত্যান্বেষীকে , সাহিত্যের পাতা থেকে উঠিয়ে তাদের জীবন্ত করে তুলে, তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাতে চেয়েছেন আজকের সমাজে ডিটেকটিভদের অপ্রাসঙ্গিকতাটুকু ।
    দিল্লিতে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ কনফারেন্সে "প্রায়ভেট ডিটেকটিভ এসেছিলেন চেন কাও , ডেভিড স্মল, নিও উল্ফ, ভি আই ওয়ারশসস্কি, শন স্পেনসার, স্যাম স্পেড, শার্লক হোমস, কিনসে মিলোনে, এরকিউল পয়েরো, লিউ আর্চার, পল আর্টিজান, লিন্ডসে গর্ডন, জো ক্যানোলি, রেক্স কার্ভার, এলভিস কোল, হ্যারি ড্রেসডেন, ড্যান ফরচুন, ডার্ক জেন্টলি, এলেনি কুইন, এমারসন কড, কেট ব্যানিংগান, ক্লিফ হার্ডি, মাইক হ্যামার, টমাস ম্যাগনাম, ভেরেনিকা মার্স, ফিলিপ মারলো, জিম রকফোর্ড, জন শাফ্ট আর ম্যাথিউ শাডার ।" দেবেন্দ্রবিজয় , অরিন্দম , বাংলাদেশের কিশোর পাশা, মাসুদ রাণা আর মুসা আমন; আমাদের হুকাকাশি, কল্কেকাশি, নিশীথ রায়, ইন্দ্রনাথ রুদ্র, জয়ন্ত-মাণিক-সিন্দরবাবু জুটি , গুপি-পানু-ছোটোমামা জুটি, গোন্ডালু, কিকিরা, পাণ্ডব গোয়েন্দা, ট্যাঁপা-মদনা জুটি, গোগোল এরাও সবাই দেখা দিয়েছেন কনফারেন্সে ।
    এঁরা সব্বাই একবাক্যে বলেছেন, যেখানে দেশের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পচছে , রাজনৈতিক ফুসলানিতে তৈরী দাঙ্গায় মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ , সেখানে খুচরো দু একটা খুনের কিনারা করতে গোয়েন্দা পোষা , বিলাসিতা মাত্র, সরকারের ধুলো দেয়া জনতার চোখে । এইভাবে সাহিত্যের গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সাহিত্যের সমালোচনা অভিনব ও বেনজির ।
    সংক্ষিপ্ত উপন্যাস এর সুবিশাল গণ্ডী
    এই উপন্যাসটি অত্যন্ত চটি , টানটান । এটি সম্ভব হয়েছে একটি বিশেষ ফর্মের কারণে । সেটা হলো , ফ্ল্যাশব্যাক বা ডায়রি-লিখনের মাধ্যমে উপন্যাস এর বেশীরভাগ অংশ বর্ণিত হয়েছে। কঙ্কাল প্রেমিকের অতীত , রিমাখানের বর্তমান, এই দুই এর মধ্যে ঘুরেছে সমস্ত ঘটনা । অতি স্বল্প পরিসরে ভালোবাসা, সামাজিক সমস্যা , রাজনৈতিক কূটকচালি আর একটা লোমহর্ষক গোয়েন্দাকাহিনী এক সাথে বর্ণিত হয়েছে । লেখকের "অরূপ তোমার এঁটোকাটা " উপন্যাসেও ডায়রি লিখনের মাধ্যমে খুব স্বল্প পরিসরে অনেকটা ক্ষেত্র দেখানো গিয়েছিল । এই পদ্ধতিটি বেশ অভিনব বাংলা সাহিত্যে , যদিও কিছু কিছু এমন নজির আছে (যেমন "স্ত্রীর পত্র" শুধু পত্র লিখনের মাধ্যমে জীবনের সত্যিটুকু তুলে ধরতে পেরেছিল )।
    পুলিশের গোয়েন্দাগিরির পদ্ধতিটাও খুব ভালো ভাবে ধরা পড়েছে এখানে, যে পদ্ধতি শখের বা প্রাইভেট গোয়েন্দার পদ্ধতির চেয়ে অনেক আলাদা। ইনফরম্যার-এর ব্যবহার, ছিঁচকে অপরাধীকে ভয় দেখিয়ে ছোটখাটো কাজ করিয়ে নেওয়া , ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্ট এর মতামত নিয়ে আইনতঃ প্রমাণ সাজানো , দরকার পড়লে অনিচ্ছুক লোকের বাড়ির ফোনের তার কেটে টেলিফোন কোম্পানির লোক সেজে ঢুকে পড়ার ফিকির ইত্যাদি অনেক রকম উপায় সম্পর্কে আমরা অবহিত হই ।
    আবার কোন একটি কেস হঠাত করে পুলিশের কাছে দরকারি হয়ে পড়ে কেন, জমির বা রিয়াল এস্টেটের মাফিয়া কেন চায় যে একটা কোন সম্পত্তি দুর্নাম মুক্ত হোক, তা সে সত্যি বার করেই হোক বা বিশ্বাসযোগ্য সত্যি ক'রে , এই নানান জটিলতা ধরা থাকে এই উপন্যাসে ।
    মলয় রায়চৌধুরী নিজেই এই উপন্যাসের একটি চরিত্র হয়ে শেষ দৃশ্যে উদয় হন ; কাহিনির সত্যতাকে পাঠকচেতনায় সংশয়ে রাখার প্রয়াসে । আর উপন্যাসের শেষে , অন্ততঃ একজন অপরাধীর উত্তরণ দেখা যায় মানুষ হিসেবে।
    শেষকথা
    সবটুকু মিলিয়ে বলা যায় যে এরকম প্রেমের উপন্যাস , যা কিনা অনেকগুলি বহুমুখী সত্যের ভিত্তিতে তৈরি করা বহুভূজের মধ্যে আমাদের এক অন্যরকম জীবনচেতনার মুখোমুখি করে দেয়, খুব বেশী লেখা হয় নি বাংলা ভাষায় । বিষয় বৈচিত্র ও সাহসী মনোজ্ঞ বর্ণনায় এই উপন্যাসটি বড্ড আলাদা, উৎকেন্দ্রিক , ঠিক এর লেখকের মতোই । পড়ে দেখতে পারেন সময় করে । মনের জটগুলো খুলে যাবে (অন্ততঃ আমার তো গেছে ) , আলো আসবে মনে।
  • মলয় | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:২৬541355
  • পৌঁছে-যাওয়া মানুষ - ডাকাতের আশীর্বাদধন্য আমি
    --------------------------------------------------------
    মলয় রায়চৌধুরী
    বিশ্ববিদ্যালয় হইতে পথে নামিবার পরই, প্রথম যে চাকুরিটিতে যোগ দিয়াছিলাম তাহা, দশটা-পাঁচটা চক্র না হইলেও, অত্যন্ত বিরক্তিকর ছিল বলিয়া অন্যপ্রকার একটি চাকুরির সুযোগ পাইতেই তাহাতে যোগ দিলাম কেননা আমি একই গৃহে একই পাড়ায় একই শহরে থাকিতে অভ্যস্ত নই ; ভালো লাগে না , অন্যত্র পলাইতে ইচ্ছা করে । একই মানুষদের দ্বারা পরিবৃত থাকিবার ফলে জীবন ও জীবনবীক্ষা মামুলি ও ক্ষুদ্র হইয়া পড়ে । নতুন কিছু ঘটিবার সম্ভাবনা সীমিত বোধ হয় । যদিও আমি রেকলুজ প্রকৃতির, একা থাকিতে পছন্দ করি, কম কথা বলি, কিন্তু আমার চতুর্দিকের মানুষদিগের কথাবার্তা ও জীবনযাত্রায় আগ্রহের কারণে, ওই যে বলিলাম, একই গৃহ-পাড়া-শহরের বৃত্তে পাক খাইয়া সেই একই মানুষদিগের মুখ দেখিয়া ও কথাবার্তা শুনিয়া কিয়ৎকালের ভিতরই ক্লান্ত বোধ করি । হ্যাঁ, ঠিকই, অন্যের জীবনের ঘটনাহীনতা আমার জীবনকেও ঘটনাহীন করিয়া তুলিতে পারে , তোলেও।
    প্রতিটি ঘরের নিজস্ব উদাসীনতার যন্ত্রণাক্লিষ্ট সুবাস হয়, প্রতিটি গৃহের নিজস্ব নয়নসুখ আলো-বিচ্ছুরণ , প্রতিটি পাড়ার নিজস্ব গুঞ্জনমালা বাতাসকে ভারাক্রান্ত করিয়া ভাসে, প্রতিটি শহরের নিজস্ব কথাপ্রণালীর কাহিনিময় শব্দতরঙ্গ চতুর্দিক মথিত করে । সেকারণে চিরকাল নূতন সুবাস, আলো, গূঞ্জন ও শব্দতরঙ্গের অনুসন্ধানে ক্ষণিক-তীর্থের উদ্দেশ্য-সন্ধানী যাযাবরের ন্যায় চরিয়া বেড়াইবার প্রয়াস করিয়াছি ।
    প্রথম চাকুরিটি পাইতে অসুবিধা হয় নাই কেননা আমার পক্ককেশ ইনটারভিউ গ্রহণকারীগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল পর্যাবেক্ষণান্তে অর্থশাস্ত্রের কয়েকটি তাত্ত্বিক প্রশ্নের উত্তরে সন্তুষ্ট বোধ করিয়া , যদিও সে-সকল তত্ত্ব বর্তমানে মানবচরিত্রের ব্যাখ্যাহীনতার কারণে খারিজ হ‌ইয়া গিয়াছে, তৎক্ষণাত চাকুরিটিতে যোগ দিতে বলেন । চাকুরিটি খারাপ ও ভালো লাগার কারণটিও একই । প্রতিনিয়ত ট্যুরের চাকুরি হইলেও, এবং ট্যুরজনিত রোজগার মনোরম হইলেও , চাকুরিটি ছিল অন্যের দোষ ও কারচুপি অন্বেষণ সংক্রান্ত । যেথায় যাইতাম, শহরতলি হউক বা শহর, তথাকার কর্মচারীগণ তটস্হ হইয়া থাকিত। কেহই সন্নিকটে আসিতে চাহিত না । তাহাদের ও আমার বরাত এতই খারাপ যে হাতে কলম তুলিয়া লইতেই কারচুপি খুঁজিয়া পাইতাম । ফিরিয়া প্রতিবেদন জমা দিবার কয়েক মাস পরে শুনিতাম অমুকের চাকুরিটি আমি খাইয়া লইয়াছি অথবা তমুকের পদোন্নতি বিঘ্নিত করিয়াছি। প্রতিনিয়ত নূতন-নূতন স্হানে যাইতে ভালো লাগিত, নূতন জনপদ ও শহরের জনগণকে শুনিবার , জানিবার , বুঝিবার সুযোগ হইত, নবনব খাদ্যবস্তুর স্বাদ পাইতাম । কিন্তু কাহারও চাকুরি খাইয়া লইতে বা পদোন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করিতে একেবারেই ভালো লাগিত না ।
    অন্য চাকুরি খুঁজিতে ছিলাম । দরখাস্ত জমা দিবার পর যথারীতি ইনটারভিউয়ের ডাক পড়িল । এই চাকুরিটি ছিল কৃষি উন্নয়ন সংক্রান্ত । চাষবাস সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতা তৎপূর্বে , ছাদের টবে মৌসুমি ফুলে সীমিত ছিল । সুতরাং কৃষি বিষয়ক গ্রন্হাদি সংগ্রহ করিয়া রাত জাগিয়া পড়াশুনা করিলাম । তথ্যাদি মুখস্হ করিলাম । আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া পরামর্শ লইলাম । ইনটারভিউতে আমাকে কৃষি বিষয়ক একটিও প্রশ্ন করা হইল না , কেবল সাধারণ জ্ঞান যাচাই করিবার নিমিত্ত কয়েকটি প্রশ্ন করা হইল যেগুলির সঠিক উত্তর দিতে অসুবিধা হইল না । ইনটারভিউ দিবার পর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিয়ে যখন পিছন ফিরিয়াছি, ইনটারভিউ পরিষদের চেয়ারম্যান কহিলেন, একটু দাঁড়ান । পুনরায় তাঁহার মুখোমুখি হইতে, তিনি বলিলেন, ওই ফুলদানিটি দেখিতেছেন, উহাতে কয়েকটি শষ্যের শুকনো শিষ রহিয়াছে, আপনি উহার মধ্য হইতে ধানের শিষটি লইয়া আসুন ।
    নির্দেশ শুনিয়াই বিপদে পড়িলাম । একত্রে এতপ্রকার ফসলের শিষ বা ছড়া দেখি নাই । বস্তুত বাল্যকাল হইতে শহরের ঘিঞ্জি নিম্নবিত্ত পাড়ায় জীবন যাপন করিবার কারণে, এবং প্রথম চাকুরিটি কেবল নথিপত্র যাচাই করিবার ছিল বলিয়া চাষবাস সম্পর্কে জ্ঞানান্বেষণের সুযোগ হয় নাই । খেতে গিয়া কোন ফসলের শিষ দেখিতে কীরকম তাহা জানিবার সুযোগ হয় নাই । চালের সহিত যে ধানগুলি মিশিয়া থাকে সেই ধান নিকট হইতে দেখিবার সুযোগও হইত না, কেননা ভাত রাঁধিবার পূর্বে মা-জেঠিমা চাল হইতে তাহা বাছিয়া ফেলিয়া দিতেন । সেসময়ে টিভি ইত্যাদি গণমাধ্যম থাকিলে কোনোও না কোনো চ্যানেলে ধানের ছড়ার সহিত পরিচয় হইত নিশ্চয়, যেরূপ বর্তমানের শিশু-কিশোরদিগের হয় ।
    ফুলদানিটির নিকটে গিয়ে দুইটি অল্প-পরিচিত শিষ পর্যবেক্ষণ আঁচ করিলাম যে সেগুলি যব ও গমের । সরস্বতী পুজার পূর্বে আমাদের গৃহের ছাদে টবে গম পুঁতিয়া দিদিগণ পুজার জন্য শিষ সংগ্রহ করিতেন । অন্য শিষগুলি বোতল পরিষ্কারের ব্রাশের ন্যায় দেখিতে এবং সেগুলিতে ধানের দানা নজরে পড়িল না । কয়েকটি ছড়া দেখিয়া ঘাসের শিষের ন্যায় প্রতিভাত হইল । অগত্যা যে শিষটি অবশিষ্ট তদ্দর্শনে অনুমান করিলাম যে উহা নিশ্চয়ই ধানের হইবে । সেইটি তুলিয়া আনিয়া চেয়ারম্যানের সন্মুখে রাখিলাম । এক মাসের ভিতর নূতন চাকুরির নিয়োগপত্র পাইলাম, লখনউতে যোগ দিবার নির্দেশসহ ।
    লখনউতে যোগ দিবার প্রথম দিনই আমাকে বলা হইল যে আমার জন্য বুন্দেলখণ্ড এলাকাটির কৃষি-উন্নয়ন পর্যালোচনার ও প্রতিবেদন তৈয়ারির কর্ম বরাদ্দ হইয়াছে এবং কল্যই আমি যেন ইটাওয়া-ললিতপুর-জালাউন ইত্যাদি অঞ্চল পরিদর্শনে যাত্রা করি । অধস্তন আধিকারিকগণের কথা শুনিয়া অনুমান করিলাম যে কার্যালয়ের রাজনীতির খেলায় নূতন অধিকারীদের এই প্রকার প্রত্যন্ত অঞ্চল, কৃষিজ্ঞানের পরীক্ষা লইবার জন্য ,নির্ধারিত হয় । অঞ্চলগুলিতে রাত্রিবাসের জন্য হোটেল , যানবাহন ও খাওয়া-দাওয়ার অভাব সহজেই কাবু করিয়ে তোলে ।
    সৌভাগ্য যে ইটাওয়ার জেলা কৃষি আধিকারিক শার্দুল মীনাকে আমাদের অফিসের কেহ আগেভাগে, আমি যোগ দিবার পূর্বেই, যেহেতু বুন্দলেখণ্ড আমার জন্য চিহ্ণিত হইয়াছিল, আমার সম্পর্কে বিস্তারিত সংবাদ সরবরাহ করিয়া দিয়াছিল । কথাপ্রসঙ্গে জানিলাম, তিনি আমার স্নাতকস্তরের সহপাঠী অভিমন্যু মীনার অগ্রজ । তাঁহার সরকারি বদান্যতায় অতিথিভবনে রাত্রিবাসের ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্হা হইয়া গেল । ক্ষেত্রসমীক্ষায় সহায়তা করিবার নিমিত্ত তিনি তাঁহার বিভাগের একজন বয়স্ক অফিসার, শ্রীসুগ্রীব নিমচকে আমার সঙ্গে দিলেন । ভালোই হইল । সরকারি জিপ ব্যবহারের সুযোগ পাইলাম ।
    তিন দিনের ক্ষেত্রসমীক্ষায় আমার কর্ডুরয় প্যান্ট , ডোরাকাটা শার্ট , চোখের পাতা, মাথার ও ভুরুর চুল গেরুয়া ধুলায় , এবং কাগজপত্র সংখ্যা ও তথ্যে ভরিয়ে উঠিল । গেঞ্জি ও আন্ডারওয়্যার কেবল পরিবর্তন করিতাম , কেননা মাত্র চার দিনের ভ্রমণ বলিয়া দুইটি সেট শার্ট-প্যান্ট লইয়াছিলাম ।
    অঞ্চলটি বর্ণনাতীত । পথের দুইধারে গভীর ও সঙ্কীর্ণ গিরিখাতের শুষ্ক ও বিমূর্ত ভুলভুলাইয়ার প্রায় জনহীন বিস্তার ধূলা উড়াইয়া সতত অধঃক্ষিপ্ত জলরাশির প্রত্যাশায় ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যকে করিয়া তুলিয়াছে কৌতূহলোদ্দীপক ও দূরভিসন্ধিপূর্ণ । দ্বিপ্রহরের পূর্বেই দিগন্ত আবরিত হয় গেরুয়া কুয়াশায় । পুষ্পিকা ও প্রাণীকুল এতদঞ্চলে ছলনাময় । চতুর্দিকে থম মারিয়া আছে মায়াময় অস্হিরতা । একটিই নদী বহিয়া গেছে যাহা উটের পিঠে বসিয়া পারাপার করিয়া থাকে স্হানীয় গ্রামবাসীগণ ।
    চতুর্থ দিন কিয়দ্দূর রওনা হইবার পর শ্রীনিমচ একটি মন্দিরের নিকট জিপগাড়ি পার্ক করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলে বুঝিতে পারিলাম যে উহা একটি কালীমন্দির । অবাক লাগিল । সাধারণত কয়েকঘর বাঙালি যে অঞ্চলে বসবাস করেন সেখানেই কালীমন্দির গোচরে পড়ে । শ্রীনিমচকে প্রশ্ন করিতে উনি বলিলেন যে মন্দিরটি শপ্তদশ শতকে প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন আতেরের মহারাজা বদন সিংহ। তিনি শক্তির উপাসক ছিলেন । এতদঞ্চলের শক্তি-উপাসকগণ সুকর্ম সমাপনান্তে মন্দিরে ছাগ-বলি দিয়া থাকেন ।
    পুরোহিত শ্রীনিমচকে কহিল, বাবাসাহেব নিকটের একটি গ্রামে আসিয়াছেন । প্রত্যুত্তরে নিমচ কহিল, বহুদিন পর বাবাসাহেব নদীর এই পারে আসিলেন । দেখা করিয়া লইব । সেই পরবের সময় আশীর্বাদ লইয়াছিলাম, আর তো দেখা হয় নাই ।
    --বাবাসাহেব ? সাধুসন্ত হ্যাঁয় কেয়া ? জিজ্ঞাসা করিলাম ।
    --জি হাঁ । পঁহুচে হুয়ে আদমি হ্যাঁয় । শ্রীনিমচ প্রত্যুত্তর করিল । অভিব্যক্তিটি অদ্ভুত লাগিল । পৌঁছে-যাওয়া মানুষ ! মহাকাশে, চাঁদে, সমুদ্রগর্ভে সর্বত্র মানুষ পৌঁছাইয়া গিয়াছে । সাধুসন্তরাও সাধনালব্ধ ক্ষমতার বলে পৌঁছাইয়া যান হয়তো তাঁদের অভীষ্ট লক্ষ্যে ।
    কাঁচা রাস্তায় জিপগাড়ি ছুটিল আমার পোশাক ও ত্বকে গেরুয়া মিহিন ধুলার আস্তরণ সংগ্রহ করিতে-করিতে । কিছুটা যাইবার পর লালকাঁকরের পথের মাঝখানেই কয়েকজন গ্রামবাসী বসিয়াছিল বলিয়া চালক গাড়ি থামাইল; তাহারা চালককে বলিল যে এই রাস্তাটি খারাপ হইয়া গিয়াছে , আপনারা পাশ্ববর্তী গ্রামের ভিতরের পথ দিয়া চলিয়া যান। বাতাসকে আরও ধুলিধূসরিত করিয়া সাত-আট কিলোমিটার যাইবার পর দেখিলাম একটি বিশাল বটবৃক্ষের তলায় প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন গ্রামবাসী একজন তামাটে পেটমোটা মোড়লের সন্মুখে বসিয়া, সম্ভবত তাঁহার বাণী শুনিতেছে। তদ্দর্শনে চালক সেই দিকে জিপগাড়িটি লইয়া গিয়া থামাইল । শ্রীনিমচ নামিল, আমিও তাঁহার সহিত নামিলাম । মোড়ল লোকটির বাবরিচুল উস্কোখুস্কো, উর্ধাঙ্গে পোশাক নাই, নিম্নাঙ্গে একটি চাককাটা লুঙ্গি। তিনি বসিয়া আছেন মাটির উঁচু বেদির উপরে ।
    শ্রীনিমচ মোড়লের নিকট গিয়া হাতজোড় করিতে তিনি কোঁচড় হইতে একমুষ্টি মুড়ি দিলেন এবং নিমচ তাহা তৎক্ষণাত ভক্ষণ করিয়া লইল । মোড়ল আমাকে দেখিয়া শ্রীনিমচকে জিজ্ঞাসা করিল, সরকার বাহাদুর ?
    --জি হাঁ । শ্রীনিমচের বিনয়ী প্রত্যুত্তর ।
    মোড়ল আমাকে ডাকিয়া বলিল, সরকার বাহাদুর, তুম ভি লো । যত্রতত্র ভক্ষণ সম্পর্কে আমার পেট খারাপের ভীতি আছে । আমি পকেট হইতে রুমাল লইয়া তাঁহার প্রদত্ত মুড়ি বাঁধিয়া লইলাম, পরে ফেলিয়া দিব । আমার আচরণে মোড়ল প্রীত হইলেন, বলিলেন, আও । আমি আরও নিকটে গেলে তিনি আমার মাথার উপর হাত রাখিয়া বলিলেন, জিতে রহো।
    আমরা জিপগাড়িতে গিয়া বসিলাম । কিয়দ্দূর যাইবার পর শ্রীনিমচ বলিল, আপনি বুন্দেলখণ্ডের চম্বলঘাটিতে যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারেন, কেহ আপনার কোনো ক্ষতি করিবে না, বাবার আশীর্বাদ পাইলেন । প্রশ্ন করিলাম, ইনি কি এতদঞ্চলের কোনো ধর্মগুরু ? পোশাক দেখিয়া তো মনে হইল বয়স্ক চাষি । শ্রীনিমচ কহিল, স্যার উনি ডাকাত সর্দার বাবা মুস্তাকিম, সরকার ওনার মাথার দাম রাখিয়াছে এক লক্ষ টাকা । যাহারা ঘাসের উপর বসিয়াছিল তাহারা ওনার দলের ডাকাত ।
  • মলয় | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৩১541356
  • আমার মেজদা চোর ছিলেন
    ---------------------------------
    মলয় রায়চৌধুরী
    আমার মেজদা অরুণ রায়চৌধুরী, ডাক নাম বুড়ো, ছোটোবেলায় মনে হয়েছিল হঠাৎ, পরে বুঝতে পারি, হঠাৎ নয়, তার কারণ ছিল, চুরি-ডাকাতি-গুণ্ডামির জগতে, বলা চলে বুক ঠুকে, বয়ঃসন্ধিকালেই, ঢুকে পড়েছিলেন । পাটনার কাহার কুর্মি দুসাধ পাশি আর অতিদরিদ্র শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ায়, চারিদিকে গোলটালির বস্তিবাড়ির মাঝে, আমাদেরটাই ছিল দু-তলা ইঁটের দাঁত বেরোনো পাকা বাড়ি । ইমলিতলায় বড়ো জ্যাঠা বাড়িটা তৈরি করেছিলেন কেননা অমন এলাকায় ভদ্রলোকেরা ঢোকে না বলে জমিজমা সস্তা ছিল । আমরা জানতুম যে পাড়ার লোকেদের পেশা হল প্রধানত চুরি করা, আর পুলিস তাদের খোঁজে আসলে গোলটালির ওপর দিয়ে দৌড় লাগিয়ে পেছনের আম বাগানে পালানো । পাড়ায় পুলিশ ঢুকলে কুকুরগুলো ঘেউ-ঘেউয়ের মাধ্যমে বার্তা পৌঁছে দিত আর ধরা পড়ে যাবে আঁচ করে অনেকে পালাতো । চুরি সফল হলে ভোজ হতো পাড়ায়, পাঁঠার নাড়িভূঁড়ির রান্না আর পাঁঠির থন পিষে কাবাব, খাওয়া হতো তাড়ি সহযোগে । তাড়িও চুরি করে আনা । কোন গাছ থেকে তাড়ি চুরি করে আনা হবে, তাল গাছের গায়ে দাগ দিয়ে তাড়ি চোরের দলকে তা জানিয়ে দেয়া হতো। আমার, মেজদার আর দাদার তাড়ি খাবার হাতেখড়ি ছোটোবেলাতেই, পাড়ার চোরেদের পাল্লায় পড়ে । পাড়ায় দাদার এক বন্ধু ছিল বদ্রি পাটিকমার নামে ; সে চুরি করাকে ঘৃণ্য বলে মনে করত, কেননা সে ছিল পকেটমার, আর পকেট মারতে হলে ‘তরকিব’ দরকার ।
    হিন্দি গালাগাল, যাকে বাঙালিরা বলেন অশ্লীল, তাও আমরা ছোটোবেলায় ইমলিতলা পাড়াতেই শিখি । অশ্লীল গালাগাল দিয়ে ফেললে তিনবার ‘ওং বিষ্ণু’ বললে দোষ কেটে যায় । আমার শৈশবের বন্ধু কপিলের দাদু শিশুদের গালাগাল শেখার ক্লাস নিতেন । আমাদের বাড়ির সামনের কলে যারা জল ভরতে আসত তাদের গালাগাল দিতে উৎসাহিত করতেন কপিলের দাদু, যিনি রাতে আমাদের বাড়ির লাল সিমেন্টের রোয়াকে শুতেন; ওনার মাথায় দেবার বালিশ এত তেলচিটে হয়ে গিয়েছিল যে মনে হতো চামড়ার তৈরি । অবাধ যৌনতার শিক্ষাও এই পাড়াতেই পেয়েছিলুম ছোটোবেলায়, বিশেষ করে দোলের দিন যেদিন পাড়ার মহিলারা দল বেঁধে বেরোতেন আর কিশোরদের ওপর জোরাজুরি করতেন, এমনকি নিজের স্বামীর সামনেই চুমু খেতেন আর যেখানে-সেখানে হাত ঢুকিয়ে হাসাহাসি করতেন । বাড়ি থেকে কড়া নির্দেশ ছিল যে দোলের দিন মহিলাদের দল চলে না যাওয়া পর্যন্ত বেরোনো যাবে না । কিন্তু বেপরোয়া বিহারি বউদের ডাক এড়ানো যেত না ।
    আমাদের বাড়ির কুড়িজন সদস্যের আর্থিক দায় বর্তেছিল প্রধানত আমার বাবার ওপর ; তাই বাবা ভোর বেলা বেরিয়ে যেতেন আর ফিরতেন রাত করে । বড়ো জ্যাঠা প্রথমে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী হিসেবে পাটনা মিউজিয়ামে যোগ দেন; পরে পদোন্নতি পেয়ে কিপার অফ পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার হন । তিনিও সকালে বেরিয়ে রাতে আড্ডা দিয়ে ফিরতেন । মেজজ্যাঠা আর কাকাদের মনে করা হতো অপ্রকৃতিস্হ ; তাঁদের বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হতো না । ইলেকট্রিসিটি ছিল না : আমরা ভাইবোনরা সবাই একটা লন্ঠন ঘিরে পড়াশোনা করতুম । রাতের খাওয়া হয়ে গেলে বড়জেঠিমা লন্ঠনের আলো কমিয়ে দিয়ে আমাদের গল্প শোনাতেন । জেঠিমা-মা-কাকিমা কেউই স্কুলে যাননি কখনও, জানি না বড় জেঠিমা ইশপের আর আরব্য রজনীর গল্পগুলো কোথা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন । বাবার ছয় ভাইয়ের মধ্যে নতুনকাকা ছাড়া আর কেউ স্কুলে যাননি ; চাকরি পেয়েই নতুনকাকা ইমলিতলার বাড়ি ছাড়েন ।
    মেজদা, যিনি চোর-ডাকাত-গুণ্ডা হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন বড়জেঠার ছেলে । বাবা প্রধান রোজগেরে হলেও বাড়িতে কারোর প্রতি কোনো পক্ষপাত করা হতো না । ছোটোদের জন্য যা কেনা হতো তা মেজদার জন্যও কেনা হতো । পাড়ার প্রভাবে মেজদা চুরি-ডাকাতি-গুণ্ডামির জগতে প্রবেশ করেননি, রাজনৈতিক কর্তাদের চাপেও নয় । নিজের অন্তরজগতের ডাকে তিনি ওই পথে যান । ছোটোবেলায় আমরা সবাই বিভিন্ন স্কুলে পড়তুম । মেজদা প্রথমে পড়তেন টি কে ঘোষ অ্যাকাডেমিতে, যে স্কুলটা সেসময়ে বেশ নাম করা ছিল। হঠাৎই মেজদা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, বইপত্র বেচে দিলেন, ফলে স্কুল থেকে নাম কাটা গেল । দাদার উপনয়ন বেশ কম বয়সে হয়ে গিয়েছিল । মেজদা চাইছিলেন যে দাদার পর ওনার উপনয়ন হোক, তেরো বছর বয়সেও যখন মেজদার উপনয়ন হল না, মেজদা খেপে গিয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন । বড়জেঠা আর জেঠিমা অনেক বুঝিয়ে , যে, যখন আমার উপনয়ন হবে তখন মেজদারও একই সঙ্গে হবে, মেজদাকে আরেকটা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন, পাটলিপুত্র স্কুলে, সেসময়ে বলা হত যে স্কুলটা বজ্জাত ছেলেদের জন্য । মেজদা কিছুদিন ক্লাস করার পর বইটই বেচে দিয়ে এই স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিলেন । আমরা সবাই লন্ঠন ঘিরে পড়তে বসলেও মেজদা বসতেন না, বাড়িতেও থাকতেন না । স্কুল ছাড়ার পর মেজদা বাড়ির বাইরেও লুঙ্গি পরে বেরোনো আরম্ভ করলেন, অনেক সময়ে কেবল গেঞ্জি পরে । মেজদা আমাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলাও বন্ধ করে দিলেন । সবায়ের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলা আরম্ভ করলেন । কেন যে মেজদার চরিত্রে আচমকা এরকম বদল ঘটছে, তার ব্যাখ্যা কেবল বয়স্কদের কাছেই ছিল । হয়ত দাদার কাছেও ছিল, কিন্তু ম্যাট্রিক পাশ করার পর দাদাকে আদিবাড়ি উত্তরপাড়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল ।
    বাড়িতে দেখা গেল যে মাঝে মাঝে পেতলের বাসনপত্র লোপাট হয়ে যাচ্ছে । কাজের লোক শিউনারায়ণ বা শিউনন্নি আমাদের বাড়িতেই থাকত, তাই তার হাত নেই বলেই মনে করলেন বয়স্করা । একদিন পাড়ার শিয়া মুসলমান মসজিদের ইমাম সাহেব এসে বললেন যে মেজদা মসজিদে ঢুকেছিলেন, তারপর থেকে ওনার পেতলের বদনাটা লোপাট । ইমাম সাহেবের সামনেই মেজদাকে বড়জেঠা জেরা করলেন ; মেজদার যুক্তি শুনে আর মুখ দেখে ইমাম সাহেবের মনে হল কাজটা মেজদার নয় । এর কিছুদিন পর, বড়জেঠা সকালে সবাইকে ধমকানি দেয়া আরম্ভ করলেন, কেননা কালকে উনি মাইনে পেয়ে সুটকেসে এনে রেখেছিলেন, সকালে বাজার যাবার জন্য সুটকেস খুলে দ্যাখেন কিচ্ছু নেই, টাকা হাপিস । তার সঙ্গে মেজদাও বাড়ি থেকে হাপিস । মেজদা যে চুরি করা আরম্ভ করেছেন তা স্পষ্ট হল ।
    মাস খানেক পর মেজদাকে বাড়িতে এনে রেখে গেল একজন লালপাগড়ি কন্সটেবল, এ কথা জানিয়ে যে মেজদা সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করছিল । তবুও মেজদার মধ্যে পরিবর্তন দেখা গেল না । দিনকতক পরে ডুণ্ডাসিং ঠাকুরবাড়ির আখড়ার জনৈক কুখ্যাত গুণ্ডা জানিয়ে গেল যে মেজদাকে যেন সামলানো হয়, কেননা মেজদা যেভাবে কুকাজ আরম্ভ করেছে যেকোনো দিন খুন হয়ে যেতে পারে । ওদের আস্তানায় মেজদার খোঁজে পুলিশ কয়েকবার এসে খোঁজ করে গেছে । বয়স্করা কিছু বললেন না মেজদাকে । বড়জেঠিমা ওনার পাড়াতুতো বান্ধবী জনৈক কামারের বউ রামপতিয়ার পরামর্শে মেজদাকে বশীকরণের সুতো বাঁধা, মাথায় ফুল রাখা ইত্যাদির মন্ত্রপূতঃ ঘুগনি খাওয়ানো আরম্ভ করলেন । ছোলার ঘুগনি খেতে ভালো লাগত মেজদার । মন্ত্রপূতঃ ঘুগনিতে রামপতিয়া মিশিয়ে আনত শুকনো ধুতরোর গুঁড়ো । মেজদার ক্রমশ রোগা আর খিটখিটে হয়ে উঠল । একদিন রাতে সদর দরজার খিল মাটিতে পড়ার আওয়াজে বাড়ির সবায়ের ঘুম ভেঙে যেতে দেখা গেল যে মেজদা নিজের ঘরে একজন বেশ্যাকে এনেছিলেন । বউটি তো দ্রুত বেরিয়ে চলে গেল, কিন্তু মেজদাকে বড়জেঠা কানমুলে মার দেয়া আরম্ভ করলেন, চিৎকার করতে লাগলেন, “বাড়িতে বেবুশ্যে মাগি আনা…” । বেশ্যাকে যে বেবুশ্যে বলে তা জানলুম । মাঝরাতে বউটির পেছন-পেছন বেরিয়ে গেলেন ষোলো বছরের মেজদা ।
    প্রতিবেশিরা, যাদের অনেকেই চুরি-পকেটমারি করত, তাদের মুখেই শোনা যেতে লাগল যে মেজদা চুরি-ডাকাতি-গুণ্ডামি আরম্ভ করেছে। বয়স্করা আমাদের আদেশ দিলেন যে মেজদার দেয়া কোনো জিনিস যেন আমরা না নিই, কেননা ওগুলো চুরি করে আনা । বয়স্করা কেউই বুঝতে পারছিলেন না মেজদাকে কি ভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনবেন । জেঠা-বাবা-কাকারা আর মেজদা সম্পর্কে আগ্রহ দেখাতেন না : বড়জেঠিমা কেবল কাঁদতেন, সারাদিন কাঁদতেন, আর ঘুগনিতে শুকনো ধুতরোর গুঁড়ো মিশিয়ে বশীকরণের মাধ্যমে মেজদাকে স্বাভাবিক করতে চাইতেন ।
    একদিন স্কুলে যাবার সময়ে বৈঠকখানা ঘরে তুমূল চেঁচামেচি শুনে বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে দেখলুম যে মেজদা ভোজপুরি-মগহি-হিন্দিতে তুই-তোকারি করে বড়জেঠিমাকে নানা কথা বলে চলেছেন । বড়জেঠিমা ফুঁপিয়ে চলেছেন নিঃশব্দে । মেজদা বলে চলেছেন যে বড়জেঠিমা ওনার মা নয় তা কেন এতদিন জানানো হয়নি ; মেজদাকে যে দেড়শো টাকায় একজন বেশ্যার কাছ থেকে কেনা হয়েছিল তা কেন জানানো হয়নি ; কে মেজদার আসল মা, কে মেজদার আসল বাবা, তারা কোথায় থাকে, জাতের ঠিকঠিকানা নেই বলেই উপনয়ন দেয়া সম্ভব নয় তা কেন আগে জানানো হয়নি, প্রচণ্ড চিৎকার করতে-করতে শানবাঁধানো লাল সিমেন্টের মেঝেতে, কুয়োবোজানো গোল দাগটার মধ্যে মাথা ঘুরে পড়ে গেল মেজদা ।
    চেঁচামেচি শুনে পাড়াপ্রতিবেশিরা বৈঠকখানায় এসে জড়ো হয়েছিল । তাদের একজন ঝুঁকে মেজদার বুকে কিছুক্ষণ কান রেখে ঘোষণা করল যে মেজদা মারা গেছে । শবযাত্রীরা তৈরি হবার পর বড়জেঠা ঘোষণা করলেন যে একজন চোরের মুখাগ্নি তিনি করবেন না । বড়জেঠার বড়মেয়ের স্বামীকে সে-কাজ করার জন্য ডেকে পাঠানো হল । চলে গেলেন মেজদা, পাড়ার লোকেদের ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ ধ্বনির সঙ্গে, তাদের কাঁধে চেপে । মেজদাও চেয়েছিলেন নিশ্চয়ই যে হরিবোল নয়, রাম নাম সৎ হ্যায় ধ্বনিই উঠুক তাঁর শবযাত্রায়। আমাকে বলা হল যে অত কম বয়সে শ্মশানে যাওয়া অনুচিত । বাড়ির কেউই গেলেন না, বড়জামাইবাবু ছাড়া ।
    পরে, পুরুতমশায়, যিনি জেঠা-বাবা-কাকাদের বন্ধু, তিনি আর বড়জেঠা সন্ধ্যাবেলায় চুপচাপ বসেছিলেন, সেই ঘরেই যেখানে মেজদা মারা গিয়েছিলেন । শুনলুম পুরুতমশায় বলছেন, ‘উপনয়নটা দিয়ে দিলেই পারতে, তখনই বলেছিলাম তোমাকে, দিয়ে দাও, ব্রাহ্মণ পুরুষের পুত্রসন্তান ব্রাহ্মণই হয়, তার মা শুদ্রাণী না মুসলমান না নেপালি তা তুমিই জানো, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না । চুরি-ডাকাতি করলেই বা, সে তো ব্রাহ্মণের ছেলে ।’
  • মলয় | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৩৭541357
  • আবু সয়ীদ আইয়ুব, অ্যালেন গিন্সবার্গ ও হাংরি আন্দোলন
    ---------------------------------------------------------------------------------
    মলয় রায়চৌধুরী
    ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার কিছুকাল পর থেকেই কলকাতার তখনকার এলিটরা লালবাজারে প্রতিনিয়ত ফোন করে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নিতে অনুরোধ করছিলেন । ফলে লালবাজারের প্রেস সেকশানকে অ্যাক্টিভেট করা হয়েছিল এবং দুজন ইনফরমারকে কলেজ স্ট্রিট কফিহাউস এবং আন্দোলনকারীরা যেসব ঠেকগুলোয় যেতেন আর কবিতা পাঠ করতেন সেখানে-সেখানে নজর রাখতে বলা হয় । এঁরা দুজনে, পবিত্র বল্লভ এবং সমীর বসু, মামলার সময়ে যাঁরা আমার বিরুদ্ধে ভুয়ো সাক্ষী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন, আন্দোলনের বুলেটিন ও বইপত্র যোগাড় করে লালবাজারের প্রেস সেকশানে জমা দিতেন । আমাকে আর দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে যখন পুলিশ কমিশনারের ঘরে একটা বিশেষ ইনভেসটিগেটিং বোর্ড জেরা করেছিল, তখন দুটো ঢাউস ফাইল দেখেছিলুম গোলটেবিলের ওপর, তাতে আমাদের যাবতীয় লেখালিখি সংগ্রহ করে ফাইল করা ছিল ।
    আমাদের বিরুদ্ধে যে এলিট ভদ্রলোকরা নালিশ ঠুকেছেন তা পুলিশ কমিশনার নিজেই আমাদের বলেছিলেন । পরে, কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর সচিব শ্রী এ. বি.শাহ যখন পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন, তিনি জানতে পারেন যে আমাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নেবার জন্য সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব আর সন্তোষকুমার ঘোষ । কলকাতায় র‌্যাডিকাল হিউমানিস্ট-এর দপতরে শ্রী শাহ-এর সঙ্গে মকোদ্দমা নিয়ে আমার আলোচনা হয়েছিল । সন্তোষকুমার ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলুম, তিনি রাজি হননি। বুদ্ধদেব বসুও আমার সঙ্গে দেখা করতে চাননি, আমার নাম শুনেই মুখের ওপর দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন । সমর সেন তখন ইংরেজি ‘নাউ’ পত্রিকার সম্পাদক, ওনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে উনি বলেছিলেন, ‘কারা আপনাদের বিরুদ্ধে পুলিশে মৌখিক অভিযোগ দায়ের করেছেন তা আমি জানি, কিন্তু তাঁদের নাম আপনাদের বলব না ।” একই কথা বলেছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ । আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর বাড়িতে গিয়ে আমি আর দাদা দেখা করেছিলুম ।
    মজার ব্যাপার হল যে আইয়ুব সাহেব নিজেই ছিলেন ‘ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম’-এর চতুর্মাসিক ম্যাগাজিন ‘কোয়েস্ট’-এর সম্পাদক ; ( পত্রিকাটি আমেরিকার সি, আই. এ.-র সাহায্য পায় এমন সংবাদ প্রচারিত হলে, বন্ধ হয়ে যায় ), অথচ অ্যালেন গিন্সবার্গকে একটি চিঠিতে উনি জানিয়েছিলেন যে উনি প্রতিষ্ঠিত লেখক নন এবং ওনার কোনো পদমর্যাদা নেই । পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক ছিলেন অম্লান দত্ত, যাঁর সঙ্গে আমরা দেখা করিনি কেননা জানতে পারি যে পুলিশের হস্তক্ষেপে ওনার কোনো ভূমিকা নেই। আইয়ুব সাহেব, যাকে বলা হয় ‘সফ্ট স্পোকেন’, তেমন মানুষ ছিলেন, কিন্তু আমাকে আর দাদাকে দেখে দৃশ্যত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন, ক্রোধ সামলাবার জন্য কাঁপছিলেন বলা যায় । দুজন যুবক দেখা করতে চাইছে শুনে উনি আশা করেননি যে ওনার সামনে দুই মুর্তিমান হাংরি আন্দোলনকারী গিয়ে দাঁড়াবে । প্রতিষ্ঠিত ঔপনিবেশিক নান্দনিক সাহিত্যতন্ত্রের সঙ্গে উত্তরঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানবিরোধীর সংঘাত ! আমি আর দাদা পাটনার ইমলিতলার স্লাম থেকে উঠে আসা যুবক, আর উনি কলকাতার ওপরতলার সম্ভ্রান্ত বুদ্ধিজীবি । ওনার সঙ্গে আমাদের যে কোনো বিষয়েই মিল নেই তা কথা বলে বোঝা যাচ্ছিল । কিন্তু কেন উনি নালিশ ঠুকেছেন, তা স্পষ্ট করতে চাইলেন না । উনি সম্ভবত আমাদের পড়াশোনার গভীরতা আশা করেননি ; কানাঘুষোয় শুনে ভেবেছিলেন কলকাতার বাইরের খোট্টা ছোটোলোকের দল। তখনকার দিনে এরকম ধারণাই ছিল এলিট মহলে, যে, স্লাম বা বস্তি বা উদ্বাস্তু কলোনিতে যারা থাকে তাদের জ্ঞানগম্যি বিশেষ নেই।
    আমাদের বিরুদ্ধে আইয়ুব সাহেবের নালিশের বিষয়বস্তু আমরা জানতে পারি অ্যালেন গিন্সবার্গকে লেখা ওনার চিঠি থেকে । চিঠিতে, আমেরিকার একজন কবি, অ্যালেন গিন্সবার্গ, আমাদের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, আর বাংলা ভাষার এক প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, যিনি ঘোষিতভাবে কবি-লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে, তিনি আমাদের জেলে পাঠাবার ব্যবস্হা করছেন ! আইয়ুব সাহেবের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি যে উনি আমাদের বুলেটিন আর পত্রিকা কিছুই পড়েননি ; শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া উনি আর কারোর নাম শোনেননি, উৎপলকুমার বসুর নামও নয় । আমি আর দাদা যে ওনার সঙ্গে দেখা করেছি, তাও উনি লিখেছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গকে । প্রত্যুত্তরে গিন্সবার্গ তাঁর চিঠিতে আইয়ুব সাহেবকে লিখেছিলেন, “বেচারা মলয় -- যদি ও একজন নিম্নমানের লেখকও হয় -- তা হলেও ওর জায়গায় আমি থাকলে আপনার সন্মুখীন হতে আমি ঘৃণা বোধ করতাম ।”
    ‘মুখোশ খুলে ফেলুন’ লেখা কাগজের মুখোশ, দানব রাক্ষস জন্তু-জানোয়ার পাখি ইত্যাদির মুখোশ আমরা ওনাকে পাঠাইনি কিন্তু উনি জানতেন যে অমন মুখোশ পাঠানো হয়েছে মন্ত্রী আমলা সাংবাদিকদের। কিন্তু তাও ওনার ক্রোধের কারণ ছিল না । ওনার ক্রোধের কারণ ছিল একটা বিয়ের কার্ড, যা মূলত সাহিত্যিকদের এবং সাংবাদিকদের পাঠানো হয়েছিল ; যে কার্ডে ছাপানো ছিল Fuck The Bastards Of The Gangshalik School of Poetry. উনি বোধহয় নিজেকে তথাকথিত ‘গাঙশালিক’ স্কুলের দিকের মানুষ হিসাবে মনে করে থাকবেন । দ্বিতীয়ত, ওনার সম্ভ্রান্ত শ্রেণিতে ‘ফাক’ এবং ‘বাস্টার্ড’ শব্দ দুটি ছোটোলোকদের অভিধান থেকে নেয়া মনে হয়ে থাকবে । আমি আর দাদা যখন আইয়ুব সাহেবের সঙ্গে দেখা করি তখন উনি বিয়ের কার্ডটি আর তাতে ছাপানো শ্লোগান প্রসঙ্গ একেবারেই তোলেননি অথচ অ্যালেন গিন্সবার্গকে লেখা চিঠিতে উনি লিখেছিলেন যে এই বাক্যটি ‘প্রশ্নাতীতভাবে আপত্তিকর’ । তিনি এও লিখেছিলেন যে হাংরি আন্দোলনকারীরা বিটনিকদের প্রতিচ্ছায়া । বস্তুত স্লাম-বস্তি-উদ্বাস্তু কলোনির ছোটোলোক স্তর থেকে উঠে আসা বাঙালি যুবকদের সম্পর্কে আইয়ুব সাহেবের কোনো ধারণা ছিল না বলে মনে হয় ।
    আবু সয়ীদ আইয়ুবকে লেখা চিঠিগুলোয় অ্যালেন গিন্সবার্গ হাংরি আন্দোলনকারীদের, বিশেষ করে আমার, ম্যানিফেস্টোগুলোর, প্রশ্ংসা করছিলেন, তাও বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ করে থাকবে ওনাকে । আইয়ুবকে লেখা গিন্সবার্গের চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি :

    ৬ অক্টোবর ১৯৬৪ : মলয় মানুষ হিসাবে আমার পছন্দের এবং ওঁর ইংরেজিদুরস্ত ম্যানিফেস্টোর প্রাণোচ্ছলতা আমার সত্যিই ভালো লাগে --- আমার মতে যে-কোনও ভারতীয়-ইংরেজি গদ্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত ।

    ৬ অক্টোবর ১৯৬৪ : Fuck The Bastards of Gangshalik School of Poetry-র মতো একটি বাক্য নিয়ে অশ্লীলতা সম্পর্কে আপনার যা বিশ্লেষণ, তার সঙ্গে আমি একেবারেই সহমত নই । এটা যে কোন ‘স্কুল’ তা আমি জানিও না । কিন্তু প্যারিস কিংবা কলকাতার কাফেতে, ত্রিস্তঁ জারার পুরোনো ম্যানিফেস্টোতে এটাই চলতি সাহিত্যভাষা -- মুখের ভাষা এবং প্রকাশিত লেখাতেও । সাহিত্যে এই কায়দা, এই আবেগ, বুদ্ধিদীপ্ত হালকা বদমাইশি বিশ শতকের ‘গ্রন্হাগার পুড়িয়ে দাও’ চিৎকারের মতোই ।

    ৬ অক্টোবর ১৯৬৪ : অনুবাদ পড়ে আমি যেটুকু বুঝেছি, মলয় এবং অন্যান্য কবিদের, যাঁদের গ্রেপতার কিংবা জেরা করা হয়েছে, কবিতা এবং ম্যানিফেস্টো যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক ।

    ৬ অক্টোবর ১৯৬৪ : আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এঁদের কাজে আধুনিক জীবনের নানা চিহ্ণ সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে । এঁরা জিনিয়াস বা অসাধারণ, এমন দাবি না করেও বলা যায়, সমাজব্যবস্হার প্রতি তাঁদের যে মনস্তত্ত্বগত অনাস্হা, সেটি তাঁরা ফুটিয়ে তুলেছেন স্পষ্ট ও মৌলিক ভাষায় । অন্যদিকে, এঁদের সমসাময়িক এবং অগ্রজরা এখনও ধ্রুপদি ভক্তিভাব বা সামাজিক ‘উন্নত’ ভাবনা, মার্কসবাদ, মানবতাবাদ ইত্যাদি সম্পর্কেই অধিক আগ্রহী । আমার মনে হয় না এই লেখকদের বিটনিক আখ্যা দেওয়া উচিত, বিট-অনুকারকও নয়, কারণ শব্দটাই অত্যন্ত কাগুজে বাঁধাধরা বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনকি আমেরিকার মাপদণ্ড অনুযায়ী ‘বিটনিকদের’ সঙ্গে এরা খাপ খায় না ।

    ১১ নভেম্বর ১৯৬৪ : এ একদম অসুস্হকর এক পরিস্হিতি । এরকমভাবেই সব চলতে থাকবে, এই ভেবে চিন্তিত হয়ে আমি আসলে আপনাকে তড়িঘড়ি, অতি দ্রুত চিঠি লিখেছিলাম । কারণ পুলিশ শাসনতন্ত্রের অভিজ্ঞতা আমার ভারতে থাকতেই হয়েছে । এখন কিন্তু পরিস্হিতি যথেষ্ট সংকটপূর্ণ । প্রবীণ, দায়িত্ববান কোনোও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হস্তক্ষেপ না করলে এর থেকে নিষ্পত্তি সম্ভব নয় । বোধহয় ‘ক্যালকাটা কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম’ এর প্রতি চিঠি আপনাকে উদ্দেশ করে লেখা আমার উচিত হচ্ছে না । যদি তাই হয়, তাহলে কলকাতার কংগ্রেসের দপতরে এ-বিষয়ে ভারপ্রাপ্তের হাতে দয়া করে চিঠিটি পৌঁছে দেবেন । আপনাকে রুষ্ট করে থাকলে মার্জনা করবেন । তবে, চিঠিতে অন্তত আপনাকে সোজাসুজি কথাগুলো বলছি । এই মুহূর্তে আপনার আমার মতানৈক্যের থেকেও পুলিশ পরিস্হিতিই প্রকৃত চিন্তার বিষয়।

    বলা বাহুল্য যে কলকাতার কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর কেষ্টবিষ্টুরা কেউ আমাদের সমর্থনে এগিয়ে আসেননি । এই সময়েই, ১৯৬৪ সালের নভেম্বরে TIME ম্যাগাজিনে আমাদের ফোটোসহ হাংরি আন্দোলনের সংবাদ বেরোয়, আর তা প্রতিষ্ঠানের কেষ্টবিষ্টুদের আরও ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল ।
  • মলয় | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৩৯541358
  • আমার বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী
    --------------------------------------------
    মলয় রায়চৌধুরী
    মহারাজা রঞ্জিত সিংহের গালগল্পে প্রভাবিত হয়ে ঠাকুমা, যাঁর নাম ছিল অপূর্বময়ী, বাবার অমন নাম রেখেছিলেন । আমার বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী জন্মেছিলেন বর্তমান পাকিস্তানের লাহোর শহরে, ১৯১২ সালে । পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিংহ সম্প৩ই নভেম্বর ১৭৮০ । বাবাও জন্মেছিলেন ১৩ই নভেম্বর । ছয় ভাই আর এক বোনের মধ্যে বাবা ছিলেন তৃতীয় বা সেজ ভাই । অন্যান্য ভাইদের পোশাকি আর ডাক নাম দুটিই থাকলেও, বাবার ওই একটি নামই ছিল, রঞ্জিত । ঠাকুর্দার আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় । ১৭০৯ সালে উত্তরপাড়া শহরটির পত্তন করেছিলেন দাদুর পূর্বপুরুষ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী ।
    ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী, পোরট্রেট আঁকতে পারতেন, এবং সেই সূত্রে তিনি বিভিন্ন রাজপরিবারের ডাকে সপরিবারে ভারতের এক রাজ দরবার থেকে আরেক রাজ দরবারে চলে যেতেন । লাহোরে গিয়ে তিনি ড্যাগেরোটাইপ ক্যামেরায় ফোটো তুলতে শেখেন, যাতে ফোটো তুলে তা থেকে ছবি আঁকতে সুবিধা হয় এবং রাজ পরিবারের মহিলাদের এক নাগাড়ে বসে থাকতে না হয় । সেসময়ে মেয়ো স্কুল অফ আর্টসের অধ্যক্ষ এবং লাহোর মিউজিয়ামের কিউরেটার ছিলেন রাডিয়ার্ড কিপলিঙের বাবা জন লকউড কিপলিঙ, যাঁর সঙ্গে পরিচয়ের ও তাঁর অধীনে কাজ করার সূত্রে তাঁর কাছ থেকেই তিনি ফোটো তোলা শেখেন । ফোটো তোলা হতো সরাসরি ব্রোমাইড পেপারে । পরে, কাচের প্লেটে নেগেটিভ ফিল্ম তোলা হতো, সেই নেগেটিভকে রসায়নে চুবিয়ে রেখে ফোটো গড়ে উঠত; তারপর সেই প্লেটের ওপর ফোটোর কাগজ রেখে, প্রয়োজনীয় আলো দেখিয়ে ফোটো প্রিন্ট করা হতো, আর সেই প্রিন্টকে রসায়নে চুবিয়ে, শুকিয়ে, স্হায়ীত্ব দেয়া হতো ।
    ড্যাগেরোটাইপ ক্যামেরা ছিল বেশ ভারি ; বাইরে গিয়ে ফোটো তুলতে হলে তাকে বয়ে নিয়ে যাবার লোক দরকার হতো । বাইরে তোলা হচ্ছে বলে একসঙ্গে অনেকগুলো তুলে যেটা ভালো হল সেটা থেকে ফোটো তৈরি করা হতো । ফোটো তোলা হতো ক্যামেরা স্ট্যাণ্ডের ওপরে ক্যামেরা রেখে । ফোটো তোলার সময়ে হাত দিয়ে লেন্সের ঢাকনা খুলে, ‘স্মাইল প্লিজ’ বলে দু’এক সেকেণ্ডে আবার লেন্স পরিয়ে দেয়া হতো । স্টুডিওতে ফোটো তুলতে হলে প্রথম দিকে কুঁজোর মাপের হাজার-দুহাজার ওয়াটের বাল্বের আলোয় ফোটো তুলতে হতো, পরে অবশ্য বাল্বের মাপ ছোটো হয় । এখন প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়েছে যে ড্যাগেরোটাইপের ঝঞ্ঝাটকে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক । বাবা এই প্রযুক্তি দেখে যেতে পারলেন না । শৈশবে তাঁকে দেখতুম শহরের বাইরে ফোটো তুলতে যাচ্ছেন কাজের লোক রামখেলাওন সিংহের কাঁধে ক্যামেরার বাক্স চাপিয়ে, নিজে ক্যামেরা তিন-ঠেঙে স্ট্যান্ড আর মাথায় চাপা দেবার কালো মোটা কাপড় । বাবা মারা যাবার পর যখন পাটনার বাড়ি ছেড়ে চলে আসলুম, দেখেছিলুম তিনতলার একটা ঘরে থাক-থাক কাচের প্লেট, কড়িকাঠ থেকে র‌্যাকে সাজানো । ইতিহাসবোধ না থাকলে যা হয়, আমি বা দাদা আমরা কেউই সেগুলো সংরক্ষণের প্রয়াস করিনি ।
    দাদুর ছেলেরাও ফোটো তোলা আর ছবি আঁকায় সড়গড় হলে দাদু ১৮৮৬ সালে ফোটোগ্রাফির ভ্রাম্যমান ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন, এবং সংস্হাটির তিনি নাম দেন ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’ । হুগলি জেলায় গঙ্গা নদীর ধারে উত্তরপাড়ার পাশে এখন যেখানে বালি ব্রিজের সংলগ্ন ফ্লাইওভার, তখন একটা রাস্তা ছিল, সেখানে একটা দপতর খুলে নকাকাকে চালাতে বলেছিলেন । কিন্তু নকাকা তা সামলাতে পারেননি, হঠাৎ বৈরাগ্যে আক্রান্ত হবার কারণে ।
    দাদুর অমন ঘোরাঘুরির কারণে বড়জেঠা, মেজজেঠা, বাবা, পিসিমা আর নকাকার স্কুলে পড়া হয়ে ওঠেনি । দাদু হঠাৎ মারা যাবার পর তাঁর ছেলেরা পাটনায় থিতু হতে বাধ্য হন এবং তখন নতুনকাকা আর ছোটোকাকাকে স্কুলে ভর্তি করা হয় । নতুনকাকা নিয়মিত স্কুল করলেও ছোটোকাকার আগ্রহ না থাকায় তিনি পড়াশোনা ত্যাগ করেন । জেঠাকাকাদের যেটুকু পড়াশোনা হয়েছিল তা রাজদরবারগুলোর শিক্ষকদের অবদান । দাদু সংস্কৃত আর ফারসি লিখতে-পড়তে পারতেন । বাবা ইংরেজি ভাষা আয়ত্ব করে ফেলেছিলেন ।
    দাদু বিভিন্ন সময়ে আফগানিস্তানের কাবুল-কান্দাহার এবং পাকিস্তানের বাহাওলপুর, চিত্রাল, হুনজা, ফুলরা, মাকরান ও লাহোরে ছিলেন। আফগানিস্তানে ব্রিটিশদের যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর লাহোরে চলে যান । বড়জেঠার মুখে শুনেছি যে বাহাওলপুরের সেই সময়ের ডাকটিকিটে আমিরের পোরট্রেট ছিল দাদুর আঁকা । ওই অঞ্চলের ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদির মাংস আর শুঁটকিমাংস খাওয়ার সঙ্গে বাবার ভাইরা নিজেদের মানিয়ে নিলেও বাবা পারেননি, এবং তিনি সারা জীবন শাকাহারী হয়ে যান । বাবার মুখে শুনেছি যে বাজারে ঝোলানো গোরু, মোষ, ইয়াক আর কাটা উটের মাংস দেখার পর উনি আর মাংস খেতে পারতেন না, তাই নিরামিশাষী হয়ে যান । দুম্বা একরকমের ভেড়া যার ল্যজের জায়গায় বাড়তি মাংস গজায়, আর বাড়তি লেজের মাংস, বড়জেঠার বক্তব্য অনুযায়ী, ছিল খুবই সুস্বাদু ।
    ফোটোগ্রাফির সূত্রেই দাদুর সঙ্গে উত্তর চব্বিশ পরগণার পাণিহাটি-নিবাসী আমার দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় হয়েছিল । কিশোরীমোহন ছিলেন ম্যালেরিয়া রোগের উৎস আবিষ্কারক রোনাল্ড রসের সহগবেষক । রোনাল্ড রস স্বদেশে ফিরে যাবার পর কিশোরীমোহন ম্যালেরিয়া রোগের কারন ও তা প্রতিরোধ করার জন্য গ্রামে-গঞ্জে ম্যাজিক লন্ঠনে স্লাইড দেখিয়ে প্রচার করতেন । এই স্লাইডগুলো তৈরি করে দিয়েছিলেন দাদু । কিশোরীমোহন তাঁর বড় মেয়ে অমিতার সঙ্গে বাবার বিয়ে দেন । বিয়ের সময়ে মায়ের বয়স ছিল ১৪ বছর আর বাবার ১৮ বছর । কিশোরীমোহন সম্পর্কে উইকিপেডিয়া আর নেটে অন্যত্র তথ্য আছে । বাবা নিজে শাকাহারী হলেও মাকে বাধ্য করেননি তাঁর আহারের রুচি অনুসরণ করতে ; আমি আর দাদা দুজনেই আমিষাশী । দাদু প্রতি বছর দুর্গা পুজোর সময়ে উত্তরপাড়া ফিরে যেতেন ; ছেলেদের বিয়ে দেয়ার কাজটাও সেরে নিতেন সেই সময়টুকুর মধ্যে ।
    দ্বারভাঙ্গা মহারাজের পরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার জন্য ডাক পড়লে দাদু সপরিবারে পাটনায় যান, আর সেখানেই হৃদরোগে মারা যান । পুরো পরিবার নির্ভরশীল ছিল দাদুর ওপর ; তিনি মারা যেতে ঠাকুমা বিপদে পড়েন । তাঁরা একটি মাটির দেয়ালের ওপর টালির চালার বাসা ভাড়া করে বিভিন্ন উপায়ে টাকা রোজগারের চেষ্টা করেন, কিন্তু কিছুতেই সফল না হতে পারায় বাবা দাদুর প্রতিষ্ঠিত সংস্হা ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’ এর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ছবি আঁকা আর ফোটো তোলার একটি স্হায়ী দোকান চালাবাড়ির কাছেই, বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে, খোলেন । ঠাকুমার জাঠতুতো ভাই কলকাতা মিউজিয়ামের সহকিউরেটার লেখক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুপারিশে বড়জেঠা পাটনা মিউজিয়ামে চতুর্থ বর্গের একটি চাকরি পান । পরে অবশ্য তিনি নিজের যোগ্যতার দরুন পদোন্নতি পেয়ে পাটনা মিউজিয়ামের ‘কিপার অব পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার’ হয়েছিলেন। বড়জেঠা মাটির মূর্তি তৈরি করায় আর অয়েল-পেইন্টিং আঁকায় দক্ষ ছিলেন । ছোটোবেলায় ছুটির দিনে আমি মিউজিয়ামের এক থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে বেড়াতুম, চৌকাঠ ডিঙোতেই প্রাগৈতিহাসিক থেকে মহেঞ্জোদরোয়, সেখান থেকে অশোকের রাজত্বে !
    দাদু মারা যেতে, ঠাকুমা উত্তরপাড়ার বসতবাড়িতে, যা অবহেলায় খণ্ডহরের চেহারা নিয়ে ফেলেছিল, থাকতে চলে গেলে, পরিবারের আর্থিক ভার পুরোপুরি এসে পড়েছিল বাবার কাঁধে । ঠাকুমা ছেলেদের আর তাদের বোউদের বলে দিয়ে যান যে আমার মা সংসারটাকে সামলাবেন । যেকোনো কারণেই হোক মেজজেঠা, নকাকা আর কাকাবাবুর স্বভাব আর আচরণ এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে আমরা শৈশবে শুনতুম যে এঁরা কিছুটা অপ্রকৃতিস্হ । দোকানের কাজে তাঁদের তেমন আগ্রহ ছিল না ; তাঁরা প্রকৃতই শিল্পীচরিত্রের বিপন্ন বিস্ময়ে আক্রান্ত অস্বাভাবিকতা পেয়েছিলেন । মেজজেঠা ঘুম থেকে উঠতেন দুপুরবেলা, তারপর জলখাবার খেতেন কোনো দোকান থেকে লুচি আলুর তরকারি কিনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কখনও চুল আঁচড়াতেন না, বাড়ি ফিরে দাঁত মেজে স্নান করে বিকেলের দিকে দোকানে পৌঁছোতেন, এবং একটি ফোটোর সামনে বসে তাকে মাসখানেকে আঁকা অপূর্ব ছবিতে দাঁড় করাতেন । নকাকা অনেক ভোরে উঠতেন, সবাইকে, শিশুদেরও ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন, স্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ কথা বলতেন না, জুতো পরার অভ্যাস ছিল না, কোরা ধুতি পরতেন, নিজের ধুতি-শার্ট নিজেই কাচতেন, কোনো এক ফাঁকে দোকানে গিয়ে বাড়িতে করার জন্য বাবার কাছ থেকে ‘কাজ’ চেয়ে আনতেন । ছোটোকাকা মাঝরাতে নিজের ঘরে ছোটোকাকিমার নানা আঙ্গিকের পোশাকহীন ফোটো তুলতেন আর দোকানে গিয়ে বাবাকে সাহায্য করার নাম করে ডার্করুমে ঢুকে সেই ‘অপ্সরা’ ফোটোগুলো প্রিন্ট করে নিতেন । উনি যখন উত্তরপাড়ায় পাকাপাকি চলে গেলেন তখন তাড়াহুড়োয় অ্যালবামগুলো নিয়ে যেতে ভুলে যান । ছোটোকাকা ৯০ বছর বয়সে মারা যান, নিঃসন্তান ; উত্তরপাড়ার বাড়ির অংশ ছোটো শালার প্রথম পক্ষের মেয়েকে দিয়ে গেছেন ।
    বিহারের ভূমিকম্পে চালাবাড়ি ধ্বসে পড়ার পর বড়জেঠা ঠাকুমার আর বড়জেঠিমার গয়নাগাটি বেচে ইমলিতলা নামে একটি নিম্নবর্গ ও গরিব শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত পাড়ায় বাড়ি কেনেন । তখন নিম্নবর্গের লোকেদের বলা হতো অস্পৃশ্য, আর সেকারণেই দুসাধ-মুসহর-কাহার-ডোম-চামার পরিবার অধ্যুষিত ঘিঞ্জি নিচুচালা-বস্তির সস্তা এলাকায় বাড়ি কেনা সহজ হয়। তেঁতুলগাছটা দাদার জন্মের সময়ে ছিল, আমি দেখিনি, কেননা তেঁতুলগাছটা কেটে সেই জায়গায় জলের কল আর গ্যাসবাতির থাম বসিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার । পাটনার অন্যান্য বাঙালিরা ইমলিতলাকে বলতেন ছোটোলোকদের পাড়া । সেকারণে আমাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর ওই ছোটোলোক ছাপ্পা পড়ে গিয়েছিল । পাটনার শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান বাঙালিরা ওই সরু গলির ভেতরে ঢুকে দিনের বেলাতেও আমাদের বাড়ি আসতেন না । বড়জেঠা যেতেন তাদের বাড়ি, সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য । আমি যখন স্কুলে ঢুকলুম তখন স্কুলের বন্ধুরাও ইমলিতলা শুনে আমাদের বাড়ি আসতে চাইত না ; অনেকে নাম শুনেই ভয় পেত, অঞ্চলের কুখ্যাত নিবাসীদের কাজকর্মের দরুন । মেজদা, যাকে শিশু অবস্হায় এক বেশ্যার কাছ থেকে বড়জেঠা কিনেছিলেন, পাড়ার চাপ এড়াতে না পেরে পুলিশের নথিতে গুণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, মাদকের দরুন কম বয়সে মারা গিয়েছিল ।
    বাবা ভোরবেলা বেরিয়ে যেতেন আর ফিরতেন বেশ রাত করে । ফোটো তোলা, জিনিসপত্র বিক্রি আর ডার্করুমের কাজ তাঁকে একা করতে হত বলে ভোরবেলা জলখাবার খেয়ে সোজা গিয়ে ডার্করুমে ঢুকতেন, তারপর রাতে দোকান বন্ধ করার পর আবার ঢুকতেন ডার্করুমে । বিহারে সেসময় তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, তাই কাজ পেতে অসুবিধা হতো না । মা আর বাবা দুজনের চরিত্রেই যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তা হল সবায়ের সঙ্গে মানিয়ে চলা । বাবা বাড়ির প্রধান রোজগেরে হলেও নিজের ভাইদের আর তাদের ছেলে-মেয়েদের, মানে আমাদের জাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোনদের, সমান চোখে দেখতেন। বড়জেঠা ইমলিতলা বাড়ির ট্যাক্স আর সবজি কিনতেন, বাবা বাদবাকি সমস্ত খরচ করতেন, ঠাকুমাকে টাকা পাঠাতেন, উত্তরপাড়ার বাড়ির ট্যাক্স দিতেন । চালগমের দোকানদারকে মাসে একবার, মায়ের তৈরি ফিরিস্তির কাগজ, দোকানে যাবার পথে বাবা দিয়ে যেতেন আর সে ইমলিতলার বাড়িতে পাঠিয়ে দিত । পরিবারের সদস্যদের পোশাকের জন্য বাবা দর্জিকে বলে রেখেছিলেন, তার দোকানে গিয়ে মাপ দিয়ে দিতে হতো, সে তৈরি করে বাড়ি পাঠিয়ে দিত । একইভাবে ছিল জুতোর দোকানের সঙ্গে বন্দোবস্ত । চুল কাটার জন্য মাসে একবার নাপিত আসত, পরে বাবার কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে নিত ।
    ইমলিতলার বাড়িতে বাবা-মা-দাদা-আমি যে ঘরটায় থাকতুম সেটাই ছিল বাড়ির সবচেয়ে ছোটো ঘর । লন্ঠনের আলোয় পড়াশুনা করতে হতো । চেয়ার-টেবিল ছিল না, দোকানের মালপত্র যে প্যাকিংবাক্সতে আসত তার ওপর চাদর পেতে বই রাখার ব্যবস্হা ছিল । পাড়ার কুসঙ্গ-কুখ্যাতির প্রভাব দাদার ওপর পড়তে পারে অনুমান করে ম্যাট্রিক পাশের পর ১৯৪৯ সালে দাদাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল পাণিহাটিতে থেকে কলকাতায় পড়াশোনা করার জন্য । কলকাতায় দাদা সিটি কলেজে ভর্তি হন । কলেজে বন্ধু হিসেবে পান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, আনন্দ বাগচী প্রমুখ তরুণ কবিদের । দাদা বিহার সরকারের মৎস্য বিভাগে চাকরি পেলে তাঁর পোস্টিঙের জায়গায় বন্ধুরা একা বা দলবল নিয়ে পৌঁছোতেন । ছোটোবেলায় আমি একবার তাড়ি খেয়েছিলুম, মানে পাড়ার এক সর্বজনীন দাদু খাইয়ে দিয়েছিল । মুখে তাড়ির গন্ধ পেয়ে মা আমায় আমাদের ঘরে শেকল তুলে বন্ধ করে দিয়েছিলেন ; বাবা রাতে বাড়ি ফিরলে শেকল খোলা হয় । মায়ের সব সময় আশঙ্কা ছিল যে আমরা দুই ভাইও মেজদার মতন অসামাজিক চরিত্রের মানুষ হয়ে যেতে পারি । পাড়ায় মেলামেশায় কোনো নিষেধাজ্ঞা কিন্তু ছিল না । ছোটোবেলায় চোর-পুলিশ খেলতে গিয়ে অনেকের শোবার ঘরে ঢুকে খাটের তলায় লুকোবার স্মৃতি আছে ।
    ইমলিতলার বাড়িতে জলের কল ছিল না ; বড়জেঠা তো অফিস চলে যেতেন, জল ভরে এনে দেবার লোক না এলে দুপুরে বাবা যখন দোকান থেকে আসতেন, অনেক সময়ে নিজের স্নান করার জল নিজেই কল থেকে ভরে আনতেন। শীতকালেও ঠাণ্ডা জলে স্নান করতেন । দাদা আর আমি ইমলিতলায় রাস্তার কল থেকে জল ভরে এনেছি, রাস্তার কলে স্নান করেছি । বাবার নির্দেশ ছিল যে বাড়ির সব কাজ আমাদেরও করতে হবে, প্রয়োজনে কয়লা ভাঙা আর উনোন পরিষ্কার, জঞ্জাল ফেলে আসাও । বাবা রাস্তার কলে স্নান করতে লজ্জা পেতেন । ২০০৫ - ২০০৮ নাগাদ আমি কলকাতার রাস্তা থেকেও খাবার জল ভরে আনতুম পেপসির বোতলে করে, কেননা তিন তলায় কোনো ভারি জলের টিন নিয়ে বা মিনারাল ওয়াটারের বড়ো বোতল নিয়ে রিকশাঅলা উঠতে চাইত না । মাঝে-মাঝে দাদার বাড়ি গিয়ে দুটো থলেতে পেপসির বোতলে জল ভরে আমি আর আমার স্ত্রী সলিলা রিকশা করে নিয়ে আসতুম নাকতলার বাড়িতে। এই সমস্ত অসুবিধার জন্যেই নাকতলার ফ্ল্যাটটা বেচে মুম্বাইতে একরুমের ফ্ল্যাটে চলে আসতে হয়েছে ।
    বাবা চিরকাল শাদা পাঞ্জাবি, ধুতি আর পায়ে পামশু পরতেন । তাঁর ভাইয়েরা শাদা ছাড়া অন্যান্য রঙের শার্ট বা পাঞ্জাবি পরলেও বাবার পোশাকের অন্যথা হতো না, শীতকাল ছাড়া, যখন উনি নস্যি রঙের শাল গায়ে দিতেন, বা ওই রঙের উলের পাঞ্জাবি পরতেন । দোকানে যাবার তাড়ায় বাবার দ্রুত হাঁটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল । ইমলিতলায় থাকতে দুবার ওনার পা দোকানে যাবার পথে ভেঙে গিয়েছিল ; বাবার পা ভাঙা মানে আর্থিক দিক থেকে বেশ বিপজ্জনক অবস্হা ; দাদাকে গিয়ে দোকানে বসতে হত । উত্তরপাড়া থেকে চাকুরিহীন কোনো জ্ঞাতির ছেলেকে নিয়ে এলেও তাদের অবাঙালি পরিবেশে মানিয়ে নিতে এতই অসুবিধা হত যে কয়েক দিনেই তারা ফেরত চলে যেত । পরে দরিয়াপুরে গিয়ে বাবার যখন আরেকবার পা ভেঙেছিল তখন আমি দোকানদারি করেছি । গরিব হলে যা হয়, গতি কেবল সরকারি হাসপাতাল, সেখানে কিউ, কেননা প্রায়ভেটে কোনো নার্সিং হোম ছিল না সেসময়ে ; এখন তো প্রতিটি রাস্তায় একজন করে হাড়ের ডাক্তার । বড়জেঠির এক বান্ধবীর স্বামী ছিল ছুতোর ; ওনার পা ভেঙে যেতে, জেঠিমার বান্ধবীর কথামতো বাবার পায়ে বসাবার জন্য ছুতোরকে দিয়ে কাঠের খাপ তৈরি করিয়ে পায়ে বেঁধে রাখার ব্যবস্হা হয়েছিল । প্রথমবার বানিয়ে দেয়া খাপটা দ্বিতীয়বার কাজে লেগে গিয়েছিল ।
    বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে যে দোকান ছিল সেই বাড়ির মালিক উঠে যাবার নোটিস দিলে বাবা পড়েন মহাবিপদে । বিকল্পের সন্ধানে বেরিয়ে তিনি তখনকার বারি রোডে দরিয়াপুরে একটা চালাবাড়ি কেনেন ; সেটা ছিল একজন কামারের হাপর-বসানো ঘর, পেছনে আর পাশে সামান্য জমিতে ঝোপ । এই এলাকাটাও সেসময়ে গরিবদের পাড়া ছিল, ধারণার অতীত দুস্হ সুন্নি মুসলমানদের পাড়া । বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে যে দোকান ছিল তার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা চলে বেশ কয়েকবছর ; সেই সুযোগে দরিয়াপুরে দোকানঘর তৈরি করে ফেলা হয় । তৈরি হয়ে গেলে পুরোনো দোকানের পাট গুটিয়ে বাবা চলে আসেন দরিয়াপুরে । ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’-এর খ্যাতির কারণে পুরোনো খদ্দেররা দরিয়াপুরে আসত । এখন এই সংস্হা চালায় দাদার বড় ছেলে হৃদয়েশ ।
    দরিয়াপুরে যখন দোকান তৈরি হচ্ছিল তখন আমি ওই বাড়িতে একা থাকতুম, কেননা ইমলিতলার প্রাত্যহিক মাতালদের চেঁচামেচি আর ঝগড়াঝাঁটির দরুন পড়তে বসে বেশ অসুবিধা হত । তাছাড়া দরিয়াপুরে ইলেকট্রিসিটি ছিল, কলের জল ছিল। ছোটোদের হাতখরচের জন্য বাবা টাকা দিতেন না ; বলতেন যার যা চাই জানিয়ে দাও, কিনে এনে দেব । স্কুলের বাৎসরিক ফলাফলের রিপোর্টে বাবা কখনও কাউকে ‘গুড’ দিতেন না । নব্বুইয়ের কোঠায় মার্কস পেলেও দিতেন না ; বলতেন আরও বেশি পেতে হবে । দরিয়াপুরের বাড়িতে একা থাকলে আমার চরিত্রদূষণ ঘটতে পারে অনুমান করে বছরখানেক পরে মা আর বাবা রাতে শুতে আসতেন । মা টিফিন ক্যারিয়ারে করে রাতের খাবার আনতেন । দিনের বেলা ইমলিতলায় গিয়ে খেতে হতো । দরিয়াপুরের বাড়িতে একা থাকার সময়ে বন্ধুদের নিয়ে কিঞ্চিদধিক চরিত্রদূষণ যে ঘটত না তা বলা যাবে না ।
    বাবা আর মা দুজনেই মন্দিরে গিয়ে পুজো দেয়া বা তীর্থকর্ম করা ইত্যাদিতে আগ্রহী ছিলেন না ; আমার মনে হয় কাজের চাপে উনি সংস্কারমুক্ত করে ফেলেছিলেন নিজেকে । । আমি কখনও তাঁদের তীর্থক্ষেত্রে বেড়াতে যেতে দেখিনি । জেঠা-কাকারাও কেউ আগ্রহী ছিলেন না ; পাটনার বাইরে যেতে হলে তাঁরা যেতেন কেবল দেশের বাড়ি, অর্থাৎ উত্তরপাড়ায় । তবে বাবা নিয়মিত পৈতে বদলাতেন, একাদশীর দিন লুচি খেতেন । কালীঘাটের কালী আমাদের পারিবারিক দেবতা, যেহেতু তা আমাদের কোনো পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত, সেকারণে বাড়িতে পারিবারিক দেবতা আর তার সেবাযত্ন করার প্রয়োজন হতো না । পৈতে পরতেন বড়জেঠা আর ছোটোকাকা, যদিও খাওয়ার কোনো নিষেধ মানতেন না, মেজজেঠা কখনও পৈতে পরতেন আবার কখনও কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে দিতেন । দাদার আর আমার ছোটোবেলায় পৈতে হয়েছিল বটে কিন্তু আমরা স্বরূপে এসে জলাঞ্জলি দিয়েছিলুম । পৈতেহীন হবার কারণে বাবা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন বলে মনে হয় না ; এই প্রসঙ্গে কখনও কোনো কথা তোলেননি ।
    মা, বাবা এবং শিক্ষক, যে তিনজন মানুষ ব্যক্তিজীবনের অভিমুখ গড়ে দেয়, আমার জীবনে মা আর বাবার ভূমিকাই প্রধান । প্রকৃত অর্থে আমি কোনো শিক্ষক সেই সময়ে পাইনি যখন তা জরুরি ছিল । প্রাইমারি স্তরে ক্যাথলিক কনভেন্টে পেয়েছিলুম সিসটার আইরিনকে আর যাযক ফাদার হিলম্যানকে । শৈশবের বইতে বর্ণিত সমস্ত জিনিস যাতে নিজের চোখে দেখে যাচাই করতে পারি তার দিকে খেয়াল রাখতেন সিসটার আইরিন আর স্বদেশ আয়ারল্যাণ্ডে গেলে অনেককিছু সংগ্রহ করে আনতেন, স্কুল সংল্গন ফার্মে নিয়ে গিয়ে ফল, ফুল, গাছ, জন্তুতের চাক্ষুষ করাতেন । ফাদার হিলম্যানের সৌজন্যে আমি কনভেন্টে ভর্তি হয়েছিলুম ; উনি ফোটো তুলতে ভালোবাসতেন আর বাবার সঙ্গে ওনার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল, আমাকে দোকানে দেখতে পেয়ে সাড়ে তিন বছর বয়সে নিয়ে গিয়ে ট্রানজিশান ক্লাসে ভর্তি করে দেন; সপ্তাহে একদিন চার্চে বাইবেল ক্লাসে নিয়ে গিয়ে ওল্ড আর নিউ টেস্টামেন্টের কাহিনি শোনাতেন । পরে যখন ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন সেমিনারিতে ক্লাস সিক্সে গিয়ে ভর্তি হলুম, কোনো শিক্ষকের সঙ্গে নৈকট্য গড়ে উঠল না ; এই স্কুলে যিনি আমাকে বাংলা সাহিত্যে আগ্রহী করলেন, তিনি গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তী , আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসের সুমিতাদি।
    মা আর বাবার কাছ থেকে যা পেয়েছি তা হল সততা, নিজের বিশ্বাসের সমর্থনে একক লড়াই করার চারিত্র্য । বাবা দোকানদার হয়েও সৎ ছিলেন, যা আজকের দিনে অকল্পনীয় । কেবল সৎ নয়, তাঁর ছিল সৎসাহস । হাংরি আন্দোলনের সময়ে আদালতের মামলায় বন্ধুরা যখন আমার বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে রাজসাক্ষী হয়ে গেল, আর লড়াইটা আমার একক হয়ে দাঁড়াল, তখন আমি আমার চরিত্রগঠনে মা আর বাবার অবদানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলুম । বাবা কলকাতায় লালবাজারে গিয়ে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন যে অমন মকদ্দমা কেন করা হয়েছে আর তখনই জানা যায় যে কলকাতার কয়েকজন সমাজকর্তা-বুদ্ধিজীবীর নালিশ কাজ করেছে এর পেছনে, যাদের বলা হয় এসট্যাবলিশমেন্টের ধারক-বাহক । মকদ্দমা চলার সময়ে বাবা কয়েকবার পাটনা থেকে দুএক দিনের জন্য দোকান বন্ধ করে কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে আসতেন । যারা আমার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিল আর চামড়া বাঁচাবার জন্য রাজসাক্ষী বা সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেল তাদের পরিবারের কাউকে কোনো দিন আসতে দেখিনি কোর্টে ; অর্থাৎ তাঁরা তাঁদের ছেলের সাহিত্যকর্মকে সমর্থন করতে পারেননি।
    বাবা আমাদের বাড়ির ক্ষমতাকেন্দ্র হলেও ছোটোদের কাউকে শাসন করতেন না । তাঁর কাছে অভিযোগ জানালে তিনি বলতেন, “অ, ও শুধরে নেবে ।” তারপর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে বলতেন, “কী, শুধরে নিবি তো ? বড় হয়েছিস, শুধরে নিতে শেখ।” বড়জেঠা শাসন করতেন, নিজে থেকে নয়, জেঠিমা-কাকিমারা অভিযোগ করলে, কিন্তু অভিযোগ করলে তিনি বিরক্ত হতেন । বড়জেঠার দুই মেয়ের বিয়ে আমার শৈশবেই হয়ে গিয়েছিল । মেজজেঠা আর কাকাদের মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্হা করেন বাবা, তাঁদের শৈল্পিক উদাসীনতায় ওদের বয়স বেড়ে যাচ্ছিল ; তাছাড়া বিয়ের খরচের ব্যাপারটাও ছিল । মেজজেঠার এক মেয়ে মীনাক্ষী একজন বিহারি ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলে মেজজেঠা অমত জানান ; মেজজেঠার অমত হওয়ায় বাবা তাঁকে বোঝালেও তিনি রাজি হননি । বাবা তাঁর বিরুদ্ধতা করে মেজজেঠাকে অপমানিত করতে চাননি । শেষে আমাকে টাকাকড়ি দিয়ে বলেন যে ওরা কোথায় গিয়ে বিয়ে করতে চাইছে সেখানে গিয়ে সম্প্রদান করে আয় । আমার ছোটোশালী এক যুবককে বিয়ে করতে চাইলে নাগপুরে অভিভাবকরা রাজি হলেন না, তখন তার বিয়েও দরিয়াপুরের বাড়ি থেকে হল ।
    দাদা যখন চাইবাসায় পোস্টেড ছিলেন সেখানে সুধীর চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে বেলার সঙ্গে পরিচয় হয়, আর দাদা পাটনায় গিয়ে বাবাকে বিয়ের কথা জানাতে তিনি তক্ষুনি রাজি হয়ে যান । আমি অফিসের কাজে নাগপুরে গিয়ে কয়েকদিনের পরিচয়ের পরই রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় আর সহকর্মী সলিলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ের প্রস্তাব দিতে ওর অভিভাবকরা সেদিনেই সায় দেন । বাবাও টেলিগ্রামে অনুমোদন জানিয়ে দেন । কয়েকদিনের পরিচয়ের পরই এই বিয়েকে মা আর বাবা বলতেন, “তোদেরটা বৈপ্লবিক বিয়ে, পরিবারদের মাথা গলাতে হল না, হপ্তার পর হপ্তা রোদ-বৃষ্টি ঠেঙিয়ে প্রেম করতে হল না, ব্যাস, একজন আরেকজনকে বললি বিয়ে করব, করে ফেললি ।”
    আমি লেখালিখির চেষ্টা করছি, মায়ের কাছে সেকথা জানতে পেরে ১৯৫৮ সালে বাবা আগফা-গেভার্ট কোম্পানির একটা দামি ডায়েরি দিয়েছিলেন, আর তাতেই আমি কবিতা মকসো করা শুরু করেছিলুম । বাড়িতে ইংরেজি ভাষার পছন্দের বইয়ের সংগ্রহ গড়তে চাই জানতে পেরে বাবা বলতেন বইয়ের তালিকা তৈরি করে দিতে । বইয়ের দোকানে গিয়ে বই পছন্দ করে নিতুম আর পেয়ে যেতুম । বাংলা বই, বিশেষ করে কবিতার বই দাদা কলকাতা থেকে নিয়ে আসতেন । পরে বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকেও প্রচুর বই আর পত্রিকা পেতুম । হাংরি আন্দোলনের সময়ে কলকাতার পুলিশ আমায় গ্রেপ্তার করতে এসে আমার বইগুলো নিয়ে সারা ঘরে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলেছিল । বাবার দোকানের কাচের আলমারি ভেঙে দিয়েছিল । মায়ের বিয়ের তোরঙ্গ ভেঙে লণ্ডভণ্ড করার সময়ে ওনার বিয়ের পুরোনো বেনারসি ভাঁজ থেকে ছিঁড়ে গিয়েছিল । কিন্তু আমাকে যখন কোমরে দড়ি বেঁধে, হাতে হাতকড়া পরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাটিয়ে নিয়ে গেল পুলিশ তখন বাবাকে বেশ বিচলিত দেখেছিলুম, যা উনি সচরাচর হতেন না । ছোটোবেলায় আমি বাড়ি থেকে বেশ কয়েকবার পালিয়েছি ; ফিরে এসে মনে হয়নি যে বাবা বিচলিত ; উনি আমাকে এই প্রসঙ্গে কোনো কথা জিজ্ঞাসাও করতেন না । পরে, আমার মেয়ের কাছে গল্প করেছিলেন যে আমি ওনাদের না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালাতুম ।
    অ্যালেন গিন্সবার্গ আমাদের দরিয়াপুরের বাড়িতে এসে ছিলেন কয়েক দিন । তিনি নানা শহরে ঘুরে বেশ কিছু ফিল্মে ফোটোম তুলেছিলেন আর সেগুলো বাবাকে দেন ডেভেলাপ করার জন্য । বাবা ডেভেলাপ করে দ্যাখেন গিন্সবার্গ কেবল নুলো, ভিখারি, দুস্হ, পথের পাশে অসুস্হ লোক, কুষ্ঠরোগি-- এদের ফোটো তুলেছে । তখন গিন্সবার্গের সঙ্গে ওনার একচোট ঝগড়া হয়েছিল । বাবা গিন্সবার্গকে বলেছিলেন, “তোমরা যতই বড় কবি-লেখক হওনা কেন, আমাদের দেশটাকে এইভাবেই দেখাতে চাইবে ; কেন ? ফোটো তোলার আর কোনো বিষয় কি নেই !” গিন্সবার্গ সম্পর্কে যে গবেষকরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তাঁদের সবাইকে এই ঘটনার কথা জানালেও, কেউই নিজেদের লেখায় এই বিতর্কটা অন্তর্ভুক্ত করেননি । পরে , পাটনার বাড়িতে বা কলকাতায়, বিদেশিরা এলে আমি তাঁদের বলতুম যে ফোটো তুলে থাকলে দেশে ফিরে ডেভেলাপ আর প্রিন্ট করিও ।
    আমি প্রথম চাকরিটা পাই পাটনাতেই । তারপর ১৯৭৯ নাগাদ গ্রামোন্নয়নের চাকরি পেয়ে স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে চলে যাই লখনউ । দাদা সপরিবারে পাটনা ফেরার পর মা আর বাবা আমার কাছে লখনউ চলে আসেন । লখনউতে ১৯৮২ সালের ১৮ই নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মা মারা যান । মা মারা যেতে বাবা বেশ একা বোধ করতেন, কেননা আমি আর সলিলা দুজনেই অফিসে চলে যেতুম আর ছেলে-মেয়ে চলে যেতে স্কুলে । দাদা তাই বাবাকে পাটনায় নিয়ে যান । লখনউ থেকে আমি ১৯৮৭ সালে বদলি হয়ে মুম্বাই চলে যাই । বাবাকে তখন মুম্বাই নিয়ে গেলে ভালো হতো ; মুম্বাইতে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা পাটনার চেয়ে উন্নত । ১৯৯১ সালের ৮ই অক্টোবর বাবা পাটনায় মারা যান ।
  • মলয় | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৪১541359
  • আমার মা অমিতা রায়চৌধুরী
    ---------------------------------------------
    মলয় রায়চৌধুরী
    আমার মায়ের জন্ম ১৯১৬ সালে, পানিহাটিতে । মায়ের ডাক নাম ভুল্টি । মায়ের বাবা, কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, পানিহাটির রামচাঁদ ঘাট রোডে ‘নিলামবাটী’ নামে এক একান্নবর্তি পরিবারের সদস্য ছিলেন । কিশোরীমোহন ছিলেন, কলকাতা ও সেকেন্দ্রাবাদে, ম্যালেরিয়া রোগের কারণ নির্ণয়কারী ও ১৯০২ সালে সেকালে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ডাক্তার রোনাল্ড রস-এর সহকারী । তাঁর অবদানের জন্য ১৯০৩ সালে দিল্লি দরবারের সময়ে কিশোরীমোহনকে সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছিল । ২০১৩ সালে প্রকাশিত তাঁদের ‘দি ফ্লাইং পাবলিক হেল্হ টুল : জেনেটিকালি মডিফায়েড মসকিটোজ অ্যান্ড ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল’ ( সায়েন্স অ্যাজ কালচার, ল্যাংকাস্টার, ইউ কে ) গবেষণাপত্রে উলি বিজেল এবং ক্রিস্টোফ বোয়েট অধ্যাপকদ্বয় জানিয়েছেন যে উপনিবেশের নেটিভ হবার কারণে কিশোরীমোহনের নাম রোনাল্ড রসের সঙ্গে সুপারিশ করা হয়নি । সমাজ সেবার কাজে স্ত্রীর গয়না এবং পৈতৃক সম্পত্তি বেচে, আর সঞ্চয়ের পুঁজি খরচ করে তিনি দেউলিয়া হয়ে যান, আর মায়ের বিয়ের কয়েক বছর পরই মারা যান ।
    দেউলিয়া অথচ খ্যাতিপ্রাপ্ত অমন একটি বাংলা-ইংরেজি পড়া আধুনিক পরিবার থেকে মা আমাদের সংস্কৃত-ফারসি পড়া গঙ্গার অপর পাড়ের উত্তরপাড়া নিবাসী পরিবারে এসেছিলেন । উত্তরপাড়ার জমিদারবাড়ি তখন খণ্ডহরে রূপান্তরিত হওয়া আরম্ভ হয়েছে । আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ ছিলেন কিশোরীমোহনের বন্ধু । ম্যালেরিয়া রোগ সম্পর্কে প্রচারের জন্য পেইন্টার-ফোটোগ্রাফার ঠাকুর্দা কিশোরীমোহনকে ম্যাজিক লন্ঠনের জন্য স্লাইড তৈরি করে দিতেন । বিয়ের সময় মায়ের বয়স ছিল ১৪ বছর আর বাবার ১৮ বছর । বাবা, রঞ্জিত, জন্মেছিলেন লাহোরে । ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফার ঠাকুর্দা বহুকাল আফগানিস্তানের কাবুল-কান্দাহার আর বর্তমান পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে ছিলেন । অর্থাৎ মা এসে পড়েছিলেন এমন একটি পরিবারে যার সদস্যদের সাংস্কৃতিক চরিত্রগঠন ভিন্নভাবে গড়ে উঠেছিল ।
    ছয় ভাই আর এক বোনের সেজভাই ছিলেন আমার বাবা । বড়জেঠিমা নন্দরানি নয় বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন । মেজজেঠিমা এসেছিলেন তেরো বছর বয়সে । কাকিমারা এসেছিলেন তাঁদের বয়স যখন সতেরো । দাদু তাঁর ছেলে আর তাদের স্ত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন রাজপরিবারের অতিথি হয়ে তার সদস্যদের ফোটো তুলে পেইনটিঙ তৈরি করে দিতেন । পাটনায় দ্বারভাঙ্গা মহারাজের পরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার সময়ে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান । দাদু মারা যাবার পর বড়জেঠা পাটনা মিউজিয়ামে চতুর্থ শ্রেনির কাজ পান ; কিন্তু ওইটুকু মাইনেতে এতজনের পরিবারের খরচ সামলানো কঠিন হয়ে গিয়েছিল । বছর দশেক পরে অবশ্য উনি পদোন্নতি পেয়ে কিপার অফ পেইন্টিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচাসর হন । ভাই আর তাদের পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে বাবা ফোটোগ্রাফির স্হায়ী দোকান খোলেন পাটনায় । এই সময় থেকে আমাদের পরিবারে মায়ের গুরুত্ব বেড়ে যায় । দারিদ্র্য সামলাতে না পেরে ঠাকুমা মায়ের হাতে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে চলে যান উত্তরপাড়ার খণ্ডহরে একা থাকতে । ভূমিকম্পের পর ইমলিতলার অন্ত্যজ পাড়ায় বিহারি কাঠামোর একটি বাড়ি কিনে পুরো পরিবার সেখানে চলে আসেন । দলিত বিহারি এবং অতিদরিদ্র শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ার মাগধি আর ভোজপুরি ইথসকে সহজেই মা আ্ত্তীকরণ করে নিতে পেরেছিলেন ।
    সংসারের ক্ষমতা মায়ের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবার পর মায়ের চরিত্রে লুকোনো কিশোরীমোহন বেরিয়ে আসে । প্রায়ই দেখতুম ইমলিতলার প্রতিবেশিরা এসে মায়ের কাছে নিজেদের আর্থিক দৈন্য আর পারিবারিক দুর্দশার গল্প করছে, আর মা তাদের সাহায্য করছেন, পয়সাকড়ি দিয়ে তো বটেই, চাল-ডাল, পুরোনো বাসনপত্র আর ব্যবহৃত জামাকাপড়, পুরোনো হয়ে আসা জুতো ইত্যাদি দিয়ে দিয়ে । মায়ের বোনেদের বিয়ে আরও গরিব পরিবারে হয়েছিল বলে পুজোয় পাওয়া শাড়ি-চটি ইত্যাদি নিজে না পরে বোনেদের বা নিলামবাটীর দুস্হ জ্ঞাতিদের পাঠিয়ে দিতেন বা যখন নিজে যেতেন তখন নিয়ে যেতেন । যদিও মা পরিবারের ডি ফ্যাক্টো কর্ত্রী ছিলেন, কিন্তু ইমলিতলার বাড়িতে মা-বাবা-দাদা-আমি থাকতুম সবচেয়ে ছোটো ঘরটায় । লন্ঠনের আলোয় পড়াশোনা, রাস্তার কল থেকে জল ভরে আনা । দাদার এক ভায়রাভাই অত্যন্ত গরিব ছিলেন, চাকরি পাননি, তাঁদের পরিবারকেও মা নিয়মিত র‌্যাশান দিয়ে আসতেন, আমার মেয়ের ফ্রক আর জুতোও অনেক সময়ে লুকিয়ে দিয়ে এসেছেন যা আমরা এতোদিন পর জানতে পারছি সেই ভায়রাভাইয়ের মেয়ের কাছ থেকে ।
    সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকার চারিত্রবৈশিষ্ট্যের দরুণ বড়জেঠা সংসারের সমস্ত ব্যাপারে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করতেন । আমার মনে আছে, ১৯৫১ সালে যে বছর প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল, কোন দলকে ভোট দেয়া হবে তা নিয়ে আলোচনার শেষে মায়ের নির্ণয় সবাই মেনে নিয়ে ছিলেন, অর্থাৎ যার যে দলকে ইচ্ছে ভোট দেবে । কলকাতায় নাকতলায় থাকতে অবাক লাগত দেখে যে বাড়ির কর্তা যে দলের সমর্থক, পরিবারের সকলেই সেই দলকে ভোট দ্যায়, অথচ তারাই আবার ডাইন্যাস্টিক পলিটিক্সের তর্ক তোলে !
    স্কুলে ভর্তি হয়ে টের পাই যে মা শুদ্ধ হিন্দি জানেন না, ইমলিতলার ‘ছোটোলোকি’ বুলি দখল করে ফেলেছেন, আর তার বহু শব্দ যে শুদ্ধ হিন্দিতে অশোভন, এমনকি অশ্লীল, তা উনি অনেক পরে জানতে পারেন, যখন আমরা ইমলিতলা ছেড়ে দরিয়াপুরে সুন্নি মুসলমান পাড়ায় চলে যাই । পানিহাটিতে মেয়েদের স্কুল তখনও ছিল না বলে মা নিরক্ষর হয়েই এসেছিলেন ; নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন দাদা স্কুলে ভর্তি হবার পর । নভেল আর বাংলা সংবাদপত্র পড়া অভ্যাস করেন । একটা হিসাবের খাতা লেখা আরম্ভ করেন ।
    ইমলিতলার বাড়িতে হিন্দুত্ব সামলাবার কাজ ছিল পুজারী বাড়ি থেকে আসা বড়-জেঠিমার । সেকারণে মা এবং কাকিমারা প্রতিদিনের ধর্মাচরণ থেকে নিজেদের আর আমাদের মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন । জনৈক পাদরির আর্থিক সৌজন্যে প্রাইমারি স্তরে আমি ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিলুম ; মা ঘটিতে গরম জল ভরে আমার শার্ট-প্যান্ট আয়রন করে রাখতেন। আমার বাংলা বনেদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল বলে মায়ের নির্দেশে আমাকে ব্রাহ্ম স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করা হয়েছিল ।
    দরিয়াপুরের বাড়িতে আমি একা থাকতুম বলে, এবং এর-তার কাছে শুনে, আমার চরিত্রদূষণ আটকাতে বাবা আর মা প্রতি রাতে ইমলিতলার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া সেরে, দরিয়াপুরে থাকা আরম্ভ করেন । দাদা ১৯৪৯ সালে কলকাতার সিটি কলেজে পড়তে চলে গিয়েছিলেন, দরিয়াপুরের বাড়িতে দাদা ফেরেন চাকরির শেষ বছরে, তখন আমি মা-বাবাকে নিয়ে লখনউ চলে গেছি । ইমলিতলার বাড়ি থেকে মা প্রতিদিন রাতে টিফিন ক্যরিয়ারে করে আমার আর বাবার খাবার নিয়ে দরিয়াপুরে আসতেন, প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে।
    দরিয়াপুরে পাকাপাকি চলে আসার পরও ইমলিতলার সদস্যদের দায়িত্ব মা ছাড়েননি ; সপ্তাহে এক দিন গিয়ে টাকাকড়ি আর চাল-ডাল-আনাজের ব্যাপারটা সামাল দিয়ে আসতেন । গোলা রোডের এক বানিয়ার দোকানে তালিকা দিলে সে যাবতীয় জিনিস ইমলিতলা আর দরিয়াপুরে পাঠিয়ে দিত । পুজোর সময়ে পোশাকের ভেদাভেদ মেটাতে সবায়ের জন্য ছিল একই কাপড়ের শার্ট আর ফ্রক, এমনকি জেঠা-কাকারাও সেই কাপড়ের শার্ট পরতেন ।
    স্কুলের পর্ব শেষ করে যেটুকু সময় ছিল আর ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ে আমি আমার বন্ধু তরুণ শুরের মামার ট্রাকে করে নানা জায়গায় চলে যেতুম, বাড়িতে বলে যেতুম না, বললে বাবা-মা যেতে দেবেন না অনুমান করে । বলা যায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতুম । ফিরে আসার পর মা কিছুই বলতেন না । পরে আমার মেয়েকে উনি বলেছিলেন যে ওনাদের না জানিয়ে আমি বাড়ি থেকে পালাতুম ।
    দাদা চাকরি পাবার পর দাদার চাকুরিস্হলে গিয়ে মা মাঝেমধ্যে সপ্তাহখানেকের ছুটি কাটিয়ে আসতেন । দরিয়াপুরের বাড়িতে কাজের মাসি রান্না করে দিত । নিম্নবর্ণের হাতে রাঁধা ভাত বাবা খেতেন না বলে ভাতটা আমিই বসিয়ে দিতুম । রান্নায় মাকে সাহায্য করতে হতো বলে ডাল-তরকারিও রাঁধতে শিখে গিয়েছিলুম । এখনও মাঝে-মাঝে স্ত্রীকে রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করি । মা বলতেন, ডাল আমি ভালো রাঁধতে পারি ।
    হাংরি আন্দোলনের সময়ে দাদার আর আমার বন্ধুরা কোর্টে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে গেছেন শুনে মা, যিনি ছিলেন অত্যন্ত চাপা প্রকৃতির, নিজের ক্রোধ সামলাতে পারেননি । আমি তাদের চিঠি ইত্যাদি ছিঁড়ে ফেলছি দেখে বলেছিলেন, ‘সব নিয়ে গিয়ে গুয়ের ডাবায় ফ্যাল ; সব কটাই আহাম্মক, অকৃতজ্ঞ ।’ আমার আর দাদার লেখালিখি সম্পর্কে উনিই ছিলেন প্রধান উৎসাহদাত্রী । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নামে যে কবিতাটা নিয়ে মকদ্দমা হয়েছিল সেটা মা-বাবা-ঠাকুমা সকলেই পড়েছিলেন ।
    নাগপুরে অফিসের কাজে গিয়ে রাজ্যস্তরের হকি প্লেয়ার ও সহকর্মী সলিলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই বিয়ে করতে চাই জানিয়ে পাটনায় খবর পাঠালে মা চিঠি লিখে পাঠান যে ‘সিঁদুর পরিয়ে নিয়ে আসলেই হবে ।’ তার কারণ আমার বন্ধুনিদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকতেন উনি । আমার সম্পর্কে নানা গালগল্প শুনে বেশ উদ্বেগে থাকতেন । এমনকি আমার পেছনে কয়েকজন ঘটককে লাগিয়ে দিয়েছিলেন যারা প্রায়ই আমার অফিসে একজন তরুণীকে নিয়ে হাজির হতো । বাড়িতে এসে মায়ের কাছে এই বিষয়ে অভিযোগ করলে উনি বলতেন, এছাড়া আমার অন্য উপায় নেই, কোনো একজনকে তো পছন্দ কর ।
    লখনউ বদলি হয়ে আমরা চলে গেলে মা একা হয়ে গিয়েছিলেন, রান্নার মাসি রাখা হয়েছিল ওনার দায়িত্ব কমাবার জন্য । আসলে উনি আমার মেয়ে আর ছেলের সঙ্গে সময় কাটানোয় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তাদের অভাব বোধ করতেন । একাকীত্ব কাটাবার জন্য পাটনার বিভিন্ন বাঙালি পরিবারের মহিলাদের সঙ্গে গল্প করতে চলে যেতেন প্রতি সন্ধ্যায় । দাদা পাটনায় চলে আসার পর মা আর বাবাকে আমি লখনউ নিয়ে চলে আসি । লখনউতে মায়ের হৃদরোগ আর আরথ্রাইটিস ধরা পড়ে ।
    হৃদরোগের লক্ষণগুলোর সঙ্গে তখন আমরা ততটা পরিচিত ছিলুম না, মাও তাঁর কষ্টের কথা বলতেন না। লখনউতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮ই নভেম্বর ১৯৮২ মারা যান । মা মারা যেতে আমি লখনউয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলুম ।
  • TSC | 012312.60.8912.247 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১৭:১৫541361
  • Interview with Malay Roychoudhury

    By The Sunflower Collective
    Malay Roychoudhury is an Indian Bengali poet and novelist who founded the Hungryalist Movement in the 1960s. He was awarded a Sahitya Akademy award for translating Dharamvir Bharati’s Suraj Ka Satvan Ghoda in 2003 but he refused to accept it. He spoke to The Sunflower Collective at length about his work, Hungryalist Movement, Allen Ginsberg, other writers associated with the Movement, politics and rifts with other poets, publishers, and the establishment during the Movement.
    The Sunflower Collective: Young poets are calling themselves Hungryalists in West Bengal again, as you said in a recent interview. Jeet Thayil is making a BBC documentary on Ginsberg’s time in India for which he met you. Deborah Baker wrote a book about the same not so long ago. Internationally, several films about the Beats hit the screens in quick succession in recent years. Do you see it as a revival of the two movements that were linked willy-nilly?
    Malay Roychoudhury: I don’t think so. Saileswar Ghose, Subhas Ghose, Basudeb Dasgupta had been editing Hungryalist magazines, Kshudharta and Kshudharta Khabor, before they died a few years back. Pradip Choudhuri is still publishing Phoo and Swakal. Rasaraj Nath and Selim Mustafa are still publishing Anarya Sahitya. Ratnamoy Dey is still publishing Hungryalist Folder. Aloke Goswami had published Concentration Camp before he concentrated on writing novels and short stories. Arunesh Ghose continued publishing Giraffe before he died a couple of years back. Since these magazines are in Bengali and they are not active on social media, you don’t hear about them. Pradip Choudhuri has done a lot of translation of Hungryalist work in French.
    Prior to Jo Wheeler and Jeet Thayil, another producer, Dominic Byrne, had come and made a radio programme exclusively on our movement. Marina Reza had come from Weslyan University for research on our movement. Daniella Limonella had come from Italy for the same purpose. University of Exeter has published an interview of mine in their Exeposé online newspaper. Mrigankasekhar Ganguly has made a film based on my poem, ‘Stark Electric Jesus.’ A debate is going on for a decade, for and against this poem on a Bangladeshi news portal.
    Deborah Baker neither met any Hungryalist nor consulted any written material available at Kolkata’s Little Magazine Library Research Centre. Most of the information is wrong and concocted, though she claims to read and write Bengali. This Research Centre has an exclusive section on Hungryalist periodicals, bulletins, manifesto, and books.
    Students at IIT, Kharagpur, Jadavpur University, Rabindra Bharati University, Visva Bharati University, Calcutta University, and Assam University have been doing PhD and M Phil, etc. on our work for more than a decade as a matter of academic routine.
    Academic interest in the Beats, especially Allen Ginsberg, continues. He had himself established a Trust to look after the interest of all the Beats and his own work with the million dollars he got from Stanford University by selling his collections. Bill Morgan, one of the Trustees, had visited me when I used to reside at Kolkata.
    We, the Hungryalists, have not even been able to bring out an anthology of our work in English and Hindi, as there is no commercial interest in our work from the publishers. And none of us are well to do. Hindi being the prime Indian language, the Sahitya Academy should have evinced interest in bringing out an anthology.
    TSC: Ginsberg was concerned that the Beats did not receive the amount of academic attention in America they deserved. Do you feel the same about the Hungryalists, as far as the Indian academia is concerned? In the case of the painter Karanajai, it appears even the critics abandoned him after a while leading to a very embittered existence. What are your thoughts on this?
    MRC: Yes, he was worried during his lifetime that the American Establishment is not ready to award them with governmental and academic recognition. However, presently a lot of academic work is being done on the Beats due to the next generation of poets, who took an interest in them. Even if the Beats were anti-Establishment, they were typical products of the American capitalist world. Ginsberg created his trust with a huge fund to carry on his legacy. Kerouac’s manuscript roll was sold for 2.40 million dollars, enough to carry on his legacy by his Trustees for eternity. Ferlinghetti opened City Lights Bookstore on West Front in order to regularly publish the Beats. In Greenwich Village, they had Barney Rosset’s Grove Press, James Laughlin’s New Directions and the Village Voice newspaper for support. They regularly interacted with the digital companies and brought out their recitations and films, etc. They appointed secretaries to enable them to get paid invitations for poetry readings from various European and American cities.
    As I told you just now, there has been continuous academic work on Hungryalist poets and writers. Sahitya Academy has awarded prizes to Utpalkumar Basu, Sandipan Chattopadhyay, Binoy Majumdar, Saileswar Ghosh, and Subimal Basak. Since I do not accept literary and cultural prizes, I had refused their award. The point is we do not get publishers like Ferlinghetti or James Laughlin in Kolkata to bring out our works and arrange for distribution. And we do not get translators who would translate and publish our works in Indian periodicals. There is still a strong lobby against us at Kolkata, though it has weakened after Sunil Gangopadhyay’s demise; nevertheless Sunil’s trained disciples are still active.
    After receiving the Lalit Kala Academy prize at a young age in 1972, Anil Karanjai started sympathizing with the Naxalite Movement; his studio at Benaras was ransacked by police. To avoid the repression, he married an American lady and went to Wahington DC to live there. He was soon disillusioned with the Western world and came back a few years later after divorcing the lady. He got involved in social activities and avoided the dirty machinations that painters had started resorting to at that time. Karuna Nidhan also fled from Benaras and went to Patna, where my elder brother Samir opened a coloured fishes shop for him. When Anil returned to Delhi, Karuna joined him. Anil married Juliet Reynolds and settled at Dehradun to avoid the Delhi painters’ circus. Anti-Establishment writers and artists in that circuit are rare these days.
    TSC: What are your views on Shakti Chattopadhyay leaving the movement?
    MRC: Shakti Chattopadhyay testified against me because Shakti had fallen in love with Samir’s sister-in-law, Sheela, at Chaibasa. He felt that he could not marry Sheela because of Samir, who did not want her to get married to an unemployed drunkard. That Sheela was living at our Patna residence at that time for post graduate study at Patna University added fuel to Shakti’s fire.
    This, along with instructions from a newspaper group which was against us, and which offered Shakti a sub-editor’s job, forced him to leave the movement. Now, after Sunil Gangopadhyay’s death, when Sunil’s letters to his friends are being published, it is found that Sunil was goading his friends to leave Hungryalist Movement, as Sunil thought that my sole motive in launching the Hungryalist Movement was to destroy his ‘Krittibas’ group. Almost all of these letters spew venom against me. In these letters, Sunil wrote that to be an anti-establishment writer, you have to join the Establishment and work from within.
    TSC: Is there something akin to an anxiety of influence which informs the relationship between the two movements? In his Indian Journals, Ginsberg continues to profess adherence to the Blake vision. He mentions the harmonium but there is no indication he first learnt about it through the Hungryalists. At what point do you think he discarded the Blake vision and allowed the Indian influences to play out? Could you give some specific examples? I understand that his use of breath as a measuring unit for verse might be one?
    MRC: I don’t think we were bothered about influencing each others’ movements. In an interview to LIFE magazine, Ginsberg had said that the Blake vision departed from him when he was traveling in a train while returning from India and started weeping.
    When he had visited Bodhgaya, he had chanced upon a piece of stone wherein small replicas of Buddha were inscribed. He had told me that seated on two stones he was shitting, as at that time the Japanese had not developed Bodhgaya and it was almost a village. He said it was a divine direction from Buddha; thus he became interested in Buddhism and departed from mysticism. Due to archaeological restrictions, he could not carry the stone to USA. He had cleaned that stone with his tooth brush at our Patna residence.
    Bill Morgan, one of Ginsberg’s trustees, who visited me, had said that there were more than fifty copies from which edited pages were included in his Indian Journals. Ginsberg was spied upon by the Indian agents and a few of his copies were picked out of his shoulder sling-bag by some of these agents to find out what he was recording. Ginsberg himself told me about it. The harmonium story might have been in one of the fifty copies.
    Sunil Gangopadhyay, who was in the USA at the time of editing Indian Journals, tried his best to shut out the Hungryalist Movement from this book. Bill Morgan had told me that Ginsberg regularly mailed packets to his step-mother in New Jersey so that she could arrange the papers in the almirahs of their basement. Ginsberg had country-wise almirahs. He collected most of our manifestos and they are available in Stanford University.
    TSC: In his Indian Journals, Ginsberg does not allude to your movement, although he knew about it and took a deep interest. Do you think it was deliberate? Do you think he appropriated your techniques and attitudes regarding poetry and art in general?
    MRC: I think I have answered your question just now.
    TSC: Ginsberg met poets in Bombay also, including Kolatkar and others. How can then it be said that he was principally influenced by the Hungryalists?
    MRC: He met poets of other Indian languages for a day or two ; but he stayed in Kolkata for about two years, attended Bengali poetry readings, went to country liquor den Khalasitola, visited by Bengali poets, Sonagachhi visited by Bengali poets, and smoking joints, visited by Bengali poets.
    TSC: You have criticised Ginsberg for clicking pictures of beggars while he was here. Is that part of a larger disenchantment with your old friend? Do you think at the end of the day, he was as superficial as other white tourists?
    MRC: Yes, when Ferlinghetti sent me a copy of Indian Journals I felt quite ashamed. I did not show the book to my dad, who had admonished Ginsberg for taking photographs of beggars, lepers, lame men, naked sadhus, etc. I have visited other countries and never thought of making a mockery of poverty of certain people. In his Indian Journal, there is a photograph of Ginsberg himself in the guise of a beggar seated beside a beggar.
    Ginsberg had several photo exhibitions in USA, which highlighted Indian beggars, lepers, destitutes, almost naked sadhus, cows on the streets, stray dogs, goats, etc. Cards to these exhibitions were sold to patrons. When he revisited India during the Bangladesh War (1971), he shot photos of refugees fleeing the war zone.
    He did have the typical white tourist in him.
    Probably my childhood in Imlitala slum taught me to respect the poorest man.
    TSC: Could you tell us about the politics of the Hungryalists? Were there direct links back then between the Naxals and the Hungryalists?
    MRC: Hungryalist Movement had started in 1961; the Naxalite Movement started in the Seventies. I have already told you about the plight of Anil Karanjai and Karuna Nidhan. My first book was on Marxism. Saileswar Ghose, Subhas Ghose, Aloke Goswami had joined the CPI (M) for literary gains. I was disillusioned with Marxism after I started reading about the activities of the Soviet establishment as well as the activities of the lumpens of CPI (M). Strangely CPI (M) resorted to the same murderous activities of the earlier Bengal governments. Now the new Bengal government has co-opted the same lumpens and are resorting to same murderous activities.
    TSC: The Beats were criticised for their lack of gender awareness. How do the Hungryalists fare in your opinion on that count? Were there female hungry gen writers and artists? Also, did the movement display consciousness of caste issues?
    MRC: Young bold women writers were rare at that time. We had one lady member, Alo Mitra, who later married Tridib Mitra. They together used to edit two Hungryalist magazines, one in Bengali, named, UNMARGA, another in English named, WASTE PAPER.
    We were the first to bring lower and backward class writers and poets in literature. Prior to us, there was not a single poet to be seen on the pages of poetry magazines. Debi Roy, Subimal Basak, Abani Dhar, Rasaraj Nath belong to lower or backward class.
    TSC: Tell us a little about your poetic process? What influences and inspires you? Is the process of writing poems that deal with stark reality harder than facing the wrath of audience and editors?
    MRC: I was initiated into poetry in a strange way. Being a Brahmin family, at our Imlitala house we were not allowed to eat chicken eggs. I was sent to fetch duck eggs from our Shia Muslim neighbour quite frequently. I was ten. The elder girl of their house whom I called Kulsum Apa was fifteen-years-old. She used to recite Ghalib and Faiz Ahmed Faiz to me, whom I did not understand; but she explained those poems to me. She indirectly, through those poems, told me that she loves me. One day when I asked for the meat being cooked in their house because of the scent, she induced me into a sexual relation. The meat was wonderful and she licked clean my lips with her tongue. After a few days, due to painful scratches on my penis, I got scared and stopped going to Kulsum Apa’s house. However, the impact of the poems remained. I had told about this sexual relation to my grandmother, who told me to never talk about it to anyone in my life. I still miss Kulsum Apa. When I last visited Imlitala, I enquired of the family and was told that they had sold their house and left Imlitala.
    My next influence was again a girl of higher class named Namita Chakroborty at the Ram Mohun Roy Seminary, who doubled up as Librarian for the Bengali section. I had a great crush on her. She initiated me into Marxism and introduced me to works of Brahmo writers and poets, including Rabindranath Tagore and Jibanananda Das. One day I had kept a chit on her table in which I had written ‘I love you’. She had preserved the chit and showed it to one of my aunts after several years, when my name started appearing in magazines and papers. Both Kulsum Apa and Namitadi had dimples.
    At Imlitala house, we had two servants, Shivnanni and Ram Khelawan, who were paid in kind, that is food, dresses, and shelter. Since they were servants, they could not reprimand us children directly. Shivnanni knew Ramcharitmanas by heart. Ramkhelawan knew dohas of Kabir, Rahim, and Dadu. Both of them reprimanded through quotations and explained the lines as well. Shivnanni used to play a game called, Ramshalaka, that is a metal stick. You have to close your eyes, open a page and put the Ramshalaka on a line. Shivnanni explained how our day will pass based on the line.
    Imlitala was considered a bad influence by Dad as we were exposed to free sex, toddy, cannabis, country liquor, etc. He constructed a house in Dariapur and we shifted there. My elder brother Samir was packed off to Kolkata for post-school studies. It helped me. He joined groups of poets and brought lots of poetry collections and periodicals for me. Ginsberg had come to our Dariapur residence. Prior to that Ginsberg and Orlovsky had visited Samir at Chaibasa, Singhbhum and experienced Mahua drink.
    I am not bothered about editors in my life. Only when I am requested, do I send my poems and novels to them. Most of the editors are younger to me and they respect me. Yes, dealing with reality is harder. Earlier I used to maintain a bank of images, words, lines, sentences when I wrote with pen on paper, Now, because of arthritis of fingers, especially the thumb, the process has become difficult with the computer. Since I take a lot of medicines, including sleeping pills, I tend to forget these days.
    TSC: What is your opinion of the current writing scene in Bangla and English in India? Are there any writers you like in particular?
    MRC: I do not have much idea about what is happening in Indian Writing in English. As far as Bengali writing is concerned, lot of exciting things are happening in the little magazine world. Every year a Little Magazine Fair is held apart from the Kolkata Book Fair. Book Fairs are also held at the district headquarters. This gives us a glimpse into a wide range of creative writing.
    The poets whom I have noticed recently writing in a new way are Raka Dasgupta, Sridarshini Chakraborty, Mitul Dutta, Barin Ghoshal, Dhiman Chakraborty, Anupam Mukhopadhyay and Bahata Anshumali, to name a few.
    TSC: Are you concerned about the general rise of right-wing and other intolerant forces in India and elsewhere?
    MRC: Yes, I am very much disturbed by the latest events taking place all over India. It appears that a worthless government run by cheaters was better than one influenced by fundamentalist criminals baying for blood of the meek and helpless. I wonder how this country had once given us Khajuraho, Puri temple, Meenakshi temple, Konarak, Ajanta, Ellora; how kings enjoyed meat and wine after the Ashwamedh Yajna.
    TSC: Is Neera in Sunil’s poems and the one whose name appears in your poem, “Please Don’t tell my grandmother”, the same person? Was she real? Was she a writer/publisher who could be associated with the Generation? Is Mala in Debi Roy’s Malar Jonne real? Was she, too, a poet associated with the Generation?
    MRC: Yes, she is the same Neera. Sunil Gangopadhyay never asked for a poem from me for his magazine, Krittibas. After his death, his wife Swati Gangopadhyay became the editor of Krittibas, which Sunil used to edit. Krittibas asked me to contribute a poem. I had sent this poem but they were scared to publish it in Krittibas. They did not publish it and told me to replace it. Obviously I had to decline. But the fact became known to the little magazine circle of poets and writers in Kolkata.
    No, Debi Roy’s wife Mala was not a poet; she was a housewife. She died recently.
    The interview was first published in The Sunflower Collective on 10/11/15
    Bio:
    Malay Roy Choudhury is a Bengali poet and novelist, who founded the Hungryalist Movement that took the poetry scene in Bengal by storm in the 1960s. The Hungry Generation was a literary/art movement that Malay Roy Choudhury, along with Shakti
  • Tarun Mukhopadhyay | 012312.60.8912.247 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১৭:১৮541362
  • মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা : অধ্যাপক তরুণ মুখোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ
    ---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    বিশ শতকের ষাট বা ছয় দশক বাংলা কবিতার ইতিহাসে যে কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে, তার মধ্যে 'হাংরি আন্দোলন' অন্যতম, এ বিষয়ে দ্বিমত নেই । আর সেই হাংরি আন্দোলনের অন্যতম নেতা মলয় রায়চৌধুরী, যিনি আজও সৃজনক্ষম । কারো আনুকূল্য বা হাততালির প্রশংসা করেন না । ভুল কি ঠিক, সে বিচার করবে ইতিহাস বা মহাকাল । পরোয়াহীন এই লেখককে তাঁর নিজস্ব ভাষামুদ্রা ও ভঙ্গির জন্য অভিবাদন জানাতেই হয় । তথাকথিত বিপ্লবী কবি না হয়েও, কবিতার অস্ত্র প্রয়োগে তিনি সংগ্রামী কবি হতে পেরেছেন ।

    ১৯৬১ সালের নভেম্বরে হাংরি আন্দোলনের যে বুলেটিন প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে চোদ্দোদফা দাবি পেশ করা হয়। যার মধ্যে উল্লেখ্য :-
    1. The merciless exposure of the self in its entirety.
    2. To present in all nakedness all aspects of the self and thinking before it.
    3. To challange every value with a view to accepting or rejecting the same.
    4. To use the same words in poetry as are used in ordinary conversation.
    5. To reject traditional forms of poetry and allow poetry to take its original forms.

    আমরা জানি প্রথা ভাঙার এই স্পর্ধা তখন সরকার মানতে পারেনি । কাব্যে অশ্লীলতার জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয় ।

    বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের পর নতুন সুর শুনিয়েছিলেন তিরিশের কবিরা । চল্লিশের কবিদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রতিবাদী ভঙ্গি আরেকমাত্রা যোগ করেছিল । আত্মকথন ও আত্মরতিকে সম্বল করে অন্য রকম স্বাদ নিয়ে এলেন পঞ্চাশের কবিরা । আর ষাটের কবিরা, বিশেষভাবে 'হাংরি আন্দোলন' আমূল নাড়া দিল বাংলা কবিতার সনাতন ঐতিহ্যকে, নিয়মানুবর্তিতাকে । কবিতার ভাষায়, ছন্দে, অলংকারে, স্তবকে, তুমুল ভাঙচুর পাঠকের অভ্যস্ত চোখ ও কানকে বিব্রত করে তুলল । বিশেষত মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় যৌনতার সঙ্গে এলো ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও অসহায় মানুষের নিষ্ফল যন্ত্রণা ।

    কিভাবে মলয় রায়চৌধুরী তাঁর কবিতায় আত্মপ্রক্ষেপণ ঘটিয়েও নিরপেক্ষ হয়ে যান, সামাজিক ঘটনার দ্রষ্টা হন, নির্মম সমালোচনায় শাণিত ইস্পাত হয়ে ওঠেন, তাঁর কবিতাগুলি পড়লে টের পাওয়া যায় । তাঁর "কবিতা সংকলন"-এর নানা মেজাজের আটটি কবিতা আলোচনা করে তাঁর কবি কৃতি ও কবিস্বরূপ বুঝতে ও বোঝাতে চেষ্টা করা যাক । আলোচিত কবিতাগুলি হলো -- কামড়, ফুলিয়ার হাতটান, উৎখাত, তুলকালাম আত্মহত্যা, কপর্দকহীনতা, লোহার রড, রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা, প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ।

    'কামড়' নামাঙ্কিত কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী যে ভঙ্গিতে ভারতবর্ষকে প্রশ্ন করেছেন, বিদ্রুপ করেছেন, পড়তে পড়তে মনে হয় সত্তরের কবি সুবোধ সরকার মলয়ের কাছে অধমর্ণ । ধান্ধাবাজ সুবিধাবাদী এই দেশের চরিত্র, মানুষের প্রকৃতি, নিপুণ ভঙ্গিতে তিনি তুলে ধরতে পেরেছেন--

    আর কোল্কাতা এখন নিম রেনেসঁসের ভেতর দিয়ে কোথায় যাচ্ছে জানি না
    ভারতবর্ষ দু'চারটে লেখা ছাপিয়ে দিন না উল্টোরথ, দেশ, নবকল্লোলে
    আমিও মনীষী হয়ে যাই, কিংবা শান্তিনিকেতনে নিয়ে চলুন
    সাহিত্যের সেবা করব, ধুতি-পাঞ্জাবি দেবেন একসেট
    আজ বিকেলে চলুন খালাসিটোলায় বঙ্গসংস্কৃতি করি ।

    শেষ পর্যন্ত মলয়ের সুতীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ, "নিজের হৃৎপিণ্ড খেয়ে নিজের সঙ্গে রফা করে নিলে কেমন হয়"? এই ব্যঙ্গাত্মক মনোভাবেই তিনি দেখেন, "পায়রার বুকে টাইম বোমা বেঁধে শান্তির জন্য ওড়ানো হচ্ছে" ( ফুলিয়ার হাতটান ) । পিকাসোর আঁকা শান্তিদূতও আজ নিরাপদ নয়, প্রতারক -- অন্তত নেতাদের হাতে । এই মর্মান্তিক সত্য মলয়ই পারেন উচ্চারণ করতে ।

    তাঁর অন্যান্য কবিতার মধ্যে পাই আত্মবীক্ষ্ণণ ও আত্মসমালোচনা । যেমন 'কপর্দকহীনতা' কবিতায় লিখেছেন--

    আদালতের পেঙ্গুইনদের সঙ্গে খেলা করে এলুম
    আমার এই কাঁতড়া চেহারা দেখে বুঝে নাও
    প্রজ্ঞাহীন হতে চেয়েও কিছু হল না ।
    * * *
    কাঠমগজ কাঠমগজ
    নিজেকে বিশ্বাস করা গেল না ।

    ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মিশেল এখানে আছে । আদালত ও পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ কবি ঠাট্টা করে বলেন,

    এদের পুলিশ আমার চুলে সরেজমিন তল্লাশি চালিয়েছে
    এক জোড়া পাকাচুল ধরে নিয়ে গেছে ( লোহার রড )

    পৃথিবীর আকার, আয়তনের অভ্যস্ত ধারণায় ( 'পৃথিবী গোলাকার কমলালেবুর মতন' ) পদাঘাত করে মলয় লেখেন -- "অণ্ডকোষের কাছে বাড়া-কমা শিখছে পৃথিবী" । কিরকম জীবন তিনি কাটাচ্ছেন, কোন সমাজে ও পরিবেশে বাস করছেন, তারও ছবি অকপটে আঁকেন কবিতায় ---

    চশমার কাচে চুয়ে পড়ে কুয়াশায় হাওয়া-ধোনা শিশিরের ধাতুরস
    পিরানহা মাছের ঝাঁকে-ঝাঁকে সাঁতার কটি মনে হয় ( উৎখাত )

    যাঁরা মনে করেন আত্মরতিই এই কবির আশ্রয়, ভুল করেন । চারপাশের জীবন ও জগতকে তিনি গভীরভাবে দেখেছেন । জেনেছেন । 'বেঁচে থাকা বা প্রেম' এবং মৃত্যু তাই সমার্থক হয় তাঁর কাছে আর বুঝে যান 'হৃদয় নামে কিছু নেই' । দ্রষ্টা কবির বোধিলাভ এইরকম ---

    ছাপার অক্ষরের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেল এবার
    সভ্য ও সংস্কৃতিবান হয়ে মানুষের লাভ হয়নি
    মূর্খ বেড়েছে ( তুলকালাম আত্মহত্যা )

    সংবাদনশীল ও সামাজিক একজন কবির পক্ষে এই অভিজ্ঞতা মর্মান্তিক । কবিতার শেষাংশে মলয়ের হাহাকার সহৃদয় পাঠককে স্পর্শ করে, কষ্ট দেয়--

    এককালে সুন্দর ও শিব ছিল সত্য
    যুক্তি ছিল সত্য
    ঈশ্বর ছিল সত্য
    অ্যাজটেকরা মৃত্যুকে সত্য বলে মনে করেছিল
    এখন আত্মহত্যা ছাড়া সত্য নেই
    যুক্তিহীন দেহে দায়িত্বরহিত চুমো
    বাঁচতে দাও কিংবা মরে যেতে ( তুলকালাম আত্মহত্যা )

    এ যেন আলবেয়ার কামুর 'মিথ অফ সিসিফাস' -- অ্যাবসার্ড জগতে অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত হওয়ার আর্তনাদ । এই সুরই যেন একটু অন্য ভাবে পাই 'রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা' কবিতায় । তথাকথিত রবীন্দ্রবন্দনা ও বিরোধিতায় না গিয়ে ষাটের কবি আত্মকথনে মগ্ন হন । চারপাশের যে ভাঙন, হত্যা, সন্ত্রাস, হৃদয়হীনতা -- দেখতে দেখতে কবি অস্হির হয়ে ওঠেন ।

    হরিণের মাংস কাটা হয়েছিল কোদাল দিয়ে
    আমার ছেলেমেয়েরা খরগোশের চোখ উপড়ে
    খেলা করেছিল বেতলার দুর্গে

    নতুন প্রজন্ম কিভাবে হিংসা ও হিংস্রতায় দীক্ষা নিয়েছে, এ যেন তারই দলিল । যেখানে রবীন্দ্রনাথের সত্য-সুন্দর-মঙ্গল ব্যর্থ । বেঁচে থেকে পৃথিবীকে মধুময় বলা আর সম্ভব নয় । অসম্ভব চলে যাবার আগে পৃথিবীকে প্রণতি জানিয়ে তারই মাটির তিলক কপালে এঁকে নেওয়া । বরং কবি বলতে পারেন --

    অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে আমার লাশ বাঁচিয়ে তুলতে চাইছি
    আমাকে ক্ষমা করুন ।

    মলয় রায়চৌধুরীর খয়াত-অখ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা যে কবিতার জন্য তার নাম 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' । যে কবিতার পরতে পরতে মিশে আছে যৌনতার আমিষ গন্ধ । ১৯৬৩ লেখা এই কবিতা যখন ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়, তখন দেশকালের পরিস্হিতি কেমন ছিল, তা এক নজরে দেখে নিতে পারি ।

    ক) চীনে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ।
    খ) দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যাণ্ডেলার কারাদণ্ড ।
    গ) চিন-ভারত যুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজন ।
    ঘ) হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ।
    ঙ) প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর মৃত্যু ।

    এই পটভূমিতে অতি-ব্যক্তিগত কবিতা লিখলেন মলয় । তাঁদের ইস্তাহারে যা বলেছিলেন -- Merciless exposure of the self বা Nakedness of all aspects of the self --- এখানে তা পাওয়া গেল, কবিতার ভাষায়, গঠনেও প্রথাভাঙা হলো । মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করলেন, অস্বীকৃত হলো Traditional form শুধু গদ্যকবিতা রূপে নয়, শব্দ ব্যবহারে তিনি নিজস্বতা মুদ্রিত করলেন । লিখলেন --- কোর্বো, তর্মুজ, পার্ছিনা, কোল্কাতা, ওর্ফে, চুর্মার, জাফ্রান ইত্যাদি শব্দ । অকথ্য শব্দ ব্যবহারেও তিনি অলজ্জিত --- 'ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম' । কবিতার মধ্যে যৌন রসাত্মক শব্দ, বাক্য ও ভাবনা অজস্র ছড়িয়ে আছে । কয়েকটি বিচ্ছিন্ন পংক্তি উদ্ধৃত করছি ---

    ১. আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
    ২. শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
    ৩. তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও
    ৪. আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ করতে দাও
    ৫. পায়জামায় শুকিয়ে যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে

    শুভা নাম্নী নারীর কাছে এই ধরণের কাতরোক্তি কবি করলেও, আসলে যেন যৌনগাথা রচনা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না । যুগজ্বরে আক্রান্ত কবি যেন নিরাপত্তাহিনতায় ও আশ্রয় প্রার্থনায় আকূল হয়েছেন । যেমন, ষাটের আরেক কবি, ভাস্কর চক্রবর্তী নিরাশ্রয় মানসিকতায় বলেছিলেন, "শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা, আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব" । মলয় এই পলায়নী মনোভাবের বদলে অনুভব করেছেন, "নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই"। হতাশায় কবি বলেছেন, "কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই" । আমাদের সৌভাগ্য, মলয় রায়চৌধুরী কবিতার জন্য আজও বেঁচে আছেন ; যুদ্ধ করে চলেছেন । তাঁর সংগ্রামের হাতিয়ার কবিতাই ।
  • Sanchari Bhattacharya | 012312.60.8912.247 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১৭:৫৭541363
  • Sanchari Bhattacharya ( Jadavpur University ) : No Hungry Generations Tread Thee Down
    "No Hungry Generations Tread Thee Down": Exploring the Poetics of Alterity
    --------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

    Abstract act: This essay discusses the Hungryalist Movement of the 1960swhich attempted to change the path of the early 20th century Bengali literature because it failed to represent the existential angst and pessimism of the youth of post-Partition Bengal. There is no doubt, of course, that the movement ushered in a violent surge of change that hit
    right at the outdated mode of conceiving literature and art according to a city-centric, western educated, bourgeois sense of taste. But despite their constant revolution for almost five years, the extent of success of the Hungryalist movement still remains questionable. It is argued
    here that although it set out to attack and disintegrate contemporary Bengali literature on the premise that it was unbearably imitative of the West, the movement itself seems to have been heavily inspired by certain revolutionary ideas conceptualized largely by the Occident.

    Keywords: Hungryalist movement, Hungryalism, Bengal,
    postcolonial, anti-canonical, socio-literary revolution.

    The Hungryalist Movement hit the complacent surface
    of mid 20th century mainstream Bengali literature in 1961 and the storm that would rage through the next four years in Bengal would alter the course of history of Bengali literature forever.
    Chronologically speaking, the Hungryalist movement
    continued from 1961 to 1965. The movement was Malay
    Roychoudhury’s brainchild whereas his elder brother Samir
    Roychoudhury, renowned poet Shakti Chattopadhyay and Debi Ray alias Haradhan Dhara led it on. Soon the movement gathered many other members from different sections of the society, e.g.,Utpal Kumar Basu, Binoy Majumdar, Sandipan Chattopadhyay, Basudeb Dasgupta, Falguni Roy, Subhas Ghosh, Saileshwar Ghosh, Tridib Mitra, Alo Mitra, Arunesh Ghosh, Ramananda Chattopadhyay, Anil Karanjai, Karunanidhan Mukhopadhyay, Subo Acharya etc. The goal of the Hunrgyalists was to offer a complete artistic alterity so as to devastate the readers’ normative taste that had been shaped by colonial canons. Their deviant
    poetry in terms of both form and content also influenced Hindi, Marathi, Assamese, Telegu and Urdu literatures. But the Establishment accused the movement of promoting perversion and obscenity in society and issued arrest warrants against Samir Roychoudhury, Malay Roychoudhury, Debi Ray, Subhash Ghosh, Saileshwar Ghosh, Pradip Choudhury, Utpal Kumar Basu, Ramananda Chattopadhyay, Basudeb Dasgupta, Subo Acharya and Subimal Basak. Although all of them were finally released, the movement slowly died down. There have been occasional claims about the revival of the movement by many writers of the post 70s period as also by practioners of other later streams of literature that resembled the Hungyalist genre in a
    few ways. In fact, Malay Roychoudhuri, who was the founder
    and life spirit of the movement, mentions that he is often
    requested by youngsters to help them re-launch the Hungryalist movement afresh. But he steadily rejects any such proposal. “I tell them to understand their own space and time”, he says, “and thereafter, devise their own platform to express themselves” (Roychoudhury, “A Sour Time of Putrefaction” Web. np).
    So, what was this alterity that the Hungryalists tried to
    forge through their movement? Alterity can briefly be defined
    as the state of being different, as a state of otherness as opposed to the self. The concept can be traced back to Descartes and his formulation of the relationship between the self and the other (Newman).But rather than engaging in the philosophical notion of alterity, I have here used the term to refer to the cultural difference that the movement symbolized from the mimetic tendencies of post-colonial socio-literary scenario of Bengal.
    In my paper, I have provided an elaborate idea about how
    the Hungryalists launched the movement as an attack on the
    status quo of the literary scenario during the 1960s, only to
    propose that despite being a revolutionary period in the history of Bengali literature that shocked the typical 19th century poetic sensibility of the Calcutta-based intelligentsia, the success of the Hungryalist movement seems questionable as the organized counter discourse developed by the Hungryalists are often found to rely on those very points of references that they set out to destroy and discard. I have divided my paper into four sections in order to discuss separately certain important aspects of the Movement. In the first section I have given a general overview of the movement by locating it in its social, cultural and political context. In the second part, I have talked about the fundamental
    characteristics of Hungryalist literature, its principles and beliefs, and how the movement promised an alternate form of poetics that shook the roots of the orthodox and sanitized tradition of postcolonial Bengali literature. I have taken examples of certain poems and prose pieces written by the Hungryalists to elaborate their theories through instances of their works and demonstrate their stark difference from the elitist, bourgeois literature. In the last section, I have attempted to examine the extent of success
    that the movement could achieve in freeing Bengali literature
    from the shackles of western notions of politics and aesthetics.

    1
    Bengali art and literature has always been deeply influenced
    by the different aesthetic movements of the West. Despite the presence of certain minor trends in parallel literature, the modern Bengali artistic and literary arena had been fed on Western colonial thought. Even little magazines like Kallol (1932) and Krittibas (1953) that appeared with promises of rebellion and change had failed to break completely away from the Bengali literary canons which were modeled largely on Western philosophical notions. They clearly depended on the colonial aesthetic reality for their creations. The Hungryalists started a movement against this boot-licking tendency of postcolonial Bengali art and literature by denying the basic premises of Western aesthetic theories in their works. According to Malay Roychoudhury, the name ‘hungry’ was taken from Chaucer’s phrase “In Sowre Hungry Tyme” (Ray 64). The philosophical basis for the movement was founded on Oswald Spengler’s idea of history not as a linear progression but rather, as a flourishing of self-contained individual cultures (1991). The Hungryalist movement was thus, the offspring of its sour and hungry time.
    The two Five Year Plans of 1951 and 1956 proved to be
    unsatisfactory for the progress of the newly independent nation. The dream of a free, ideal state which had kept the nation going in the pre-Independence era remained unfulfilled. Partition led to an unprecedented cultural bankruptcy in Bengal giving rise to stagnancy in creative endeavors. It is at this juncture that the Hungryalist movement first broke out in the form of an alterity
    in poetics and thought and posed a serious threat to the discursive practices of the mainstream elite culture of Bengal through the assertion of a counter discourse. The movement was first launched in November 1961 from the Patna residence of Malay and Samir Roychoudhury. The first bulletin however, was published in English since Bengali typefaces were hard to find in the Hindi speaking township of Patna and the only printer with the required typefaces refused to publish it. This first bulletin
    Goes:

    Poetry is no more a civilizing maneuver, a replanting
    of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent
    and somnambulistic jazzing of the hymning five, a
    sowing of the tempestual Hunger. […]Naturally, we
    have discarded the blanket-blank school of modern
    poetry, the darling of the press, where poetry does
    not resurrect itself in an orgasmic flow, but words
    come out bubbling in an artificial muddle. […]
    Saturated with self-consciousness, poems have begun
    to appear from the tomb of logic or the bier of unsexed
    Rhetoric.

    Debi Ray, who was in charge of strategically distributing
    the pamphlets, had arranged to disperse the bulletin at intellectual joints, offices of periodicals and college campuses within one single day. Such a movement being unprecedented in the history of Bengal, it had taken Calcutta by storm. It had struck each layer of the Establishment as it had aspired to and disturbed profoundly, the age old canons with its practice of systematic counter-canonization. The bulletin was reprinted with slight revisions in 1962 and then again in November 1963 under the heading “The Hungryalist Manifesto on Poetry”. By then, the movement had gathered quite a few members whose names were printed on the flipside of the reprinted pamphlet. Meanwhile many other bulletins and manifestoes were constantly being
    issued and distributed freely by the Hungryalists which caused the number of members to cross forty, by January 1964. Samir had introduced his friends Sandipan Chattopadhyay, Utpalkumar Basu and Binoy Majumdar; Malay had brought in his friends Subimal Basak, Sambhu Rakshit, Tapan Das, Anil Karanjai and Karunanidhan Mukhopadhyay; Subimal Basak had brought in his friends Tridib Mitra, AloMitra and Falguni Ray; Shakti had brought in Arupratan Basu, Pradip Choudhuri and Basudeb Dasgupta; Debi Ray had brought in Subo Acharya, Subhas Ghosh, Satindra Bhowmik, Haranath Ghose, Nihar Guha, Saileswar Ghosh, Amritatanay Gupta, Ramananda Chattopadhyay, Sunil Mitra, Shankar Sen, Bhanu Chattopadhyay, Ashok Chattopadhyay, Jogesh Panda and Manohar Das. The painters Anil and Karuna, brought in painters like Subir Chatterjee, Bibhuti Chakrabarty, Arun Datta and
    Bibhas Das into the fold of the movement. Before long, the
    Hungry Generation had become a socio-cultural force to deal
    with. Many contemporary critics were of the idea that
    Hungryalism was deeply influenced by Dadaism.
    The theoretical basis for the movement was borrowed
    from Oswald Spengler’s The Decline of the West, a two volume work that had influenced Malay greatly in his youth. According to Spengler, the history of a culture does not move in a linear progression but develops into a number of cultural preferences,each with its own typical spiritual tendency, or idea of space within which they operate (Spengler 4). This whole theory was revolutionary since it broke away completely from the traditional Hegelian concept of history being a process governed by reason. Spengler uses the metaphor of biology. He says that this is an organic process and so it’s impossible to predict towards which direction it would grow (Mitra Web). The cultures go through a
    process of growing, reaching a climax and then withering away. A culture is self-creative during ascendency, but once its creativity is exhausted, it starts absorbing random elements from without.Its demand for these external elements becomes insatiable during descent. It is this unquenchable thirst for ingredients outside self that was termed Hunger by Malay when he first launched the
    movement. The Hungryalists felt that after Partition, Bengal
    had reached that moment of rot and it was impossible to go back to the idealized position of the 19th century. That is why they devised the Hungryalist movement as a counter-culture
    movement and deliberately created their literature in a counter discourse. All the artistic and literary movements of the West had been arranged according to the functioning of a linear history. Groups like Parichay (1931), Kallol (1932), Krittibas (1953) and Notun Reeti (1958) which were founded with the promise of making a difference with their new literary experimentations also started replicating the colonial aesthetic reality and linear progression of narrative history in their works. Their writings were heavily dependent on logical progression of thoughts and the idea of self as one, whole and unified. Parichay and Kallol were formulated on the basis of Calcutta-centric, middle class values that identified themselves with occidental canons and discourses. Krittibas and Notun Reeti developed a method of counter-identification by remaining within the discursive control of the above ideas only with the incorporation of certain elements from the Soviet discourse in case of some writers. The Hungryalists aspired to go beyond this structure of conflicts and completely negated that discourse through de-identification.
    They also opposed aesthetic realism. In a poem, Shambhu Rakshit Writes:

    These coconut-leaf combs, even they threaten me as
    soon as I turn my back.
    Nothing, just a minute, nothing do I know about
    parliaments or rumors or.
    The shrieks of wild dogs surround me— and of course
    I should be informed, of course I
    Should be allowed to sink, allowed to go where I don’t
    want to, allowed to pace up and down.
    (My own translation of Ami Swechhachari by
    Shambhu Rakshit, Lines 1–4) (Hungry Bulletin O
    Patrika Theke (1961 - 1965)

    Instead of following a normative, logical sequence which
    is used to express realism, this movement sought to introduce chaos and disintegration in the very structure of a poem rendering it conventionally meaningless. To sum it up in the words of Professor Howard McCord, the Hungryalists composed “Poetry of Chaos and Death” (in Mitra Web).
    The Hungryalists generally brought out their bulletins in
    one page pamphlets. The ones that were published by Malay
    from Patna were in English due to the lack of Bengali typeface there. The address given on the pamphlets was generally of Haradhon Dhara, who was the editor, and whose slum residence in Howrah was used by the Hungryalists for correspondence. This decision was perhaps intentional since Dhara belonged to a subaltern caste and so his image aided in flouting the conservative sensibility that denied the subaltern any position in the space of its aestheticism. The Hungryalists published their precise, solidified commentary on various issues ranging from poetry, short story, drama to religion, politics, obscenity and even life and distributed them all across Calcutta— in the College Street Coffee House, many magazine and newspaper offices, in colleges,
    especially in the Bengali departments and libraries etc. Because a large body of writing was printed on handbills and leaflets, the Hungryalists were unable to preserve and archive much of their work which leads to some difficulty in carrying on extensive and detailed research on the movement. But it no doubt fulfilled their immediate objective— that of being noticed by both common people and those in power. It is not difficult to guess that their innovative use of different media generated far greater attention towards the movement than it would have done had the media been conventional and expected.
    In between 1963 to 1965, the Hungryalists had also started
    publishing a few magazines, e.g., Protidwondwi edited by Subimal Basak, Unmargo edited by Tridib Mitra, Jebra edited by Malay Roychoudhury, Chinho edited by Debi Ray, Phoo edited by Pradip Choudhury, Eshona edited by Satindra Bhowmick and the only English language magazine of the movement, The Waste Paper, edited by Alo Mitra.

    Except for Debi Ray, Tridib and Alo Mitra, who were
    stationed at Howrah, across Calcutta, most of the participants came from outside the city. They belonged to the fringe. Subimal, like Malay, came from Patna; Samir was Chaibasa-based; the Ghosh brothers, Subhas and Saileswar, were from Balurghat; Shakti was from Jaynagar-Majilpur; all the painters were from Benaras; Pradip Choudhuri, originally from Tripura, was based at Shantiniketan; Subo Acharya was based at Bishnupur and Ramananda Chattopadhyay at Bankura. The Hungryalist movement thus developed spatial qualities instead of timecentric features of earlier post-Tagore literary generations.
    Professor Howard McCord clearly states that although the
    serious, introspective Indian poetry before the Hungryalist
    movement had a certain merit, they seemed to lack any sense of space. “These are sincere and harmless poems, and aside from a little local colour, could have been written in Leeds or Philadelphia. The denatured cosmopolitanism that infects the poetry of the West prevails in India as well, and few of the poems carry any sense of place, or the sound of a man speaking, or the rasping smell of cow-dung fires”, he writes (in Mitra Web). On the other hand, in the guise of being spatially neutral, a large body of post-Tagore poetry remained too regional, focusing only on a privileged social group and their discourse. It was predominantly Kolkata-centric, epitomizing certain urban middle class values and considering them to be universally ‘perfect’, a proposition that directly reflects Matthew Arnold’s ideas about poetry in The Study of Poetry (Arnold 184). But defying this inheritance of Victorian conservatism, Hungryalism emerged as a post-colonial counter-discourse. In the first bulletin itself the movement gave a battle cry against modern poetry, as
    well as against the tyranny of logic. Till then the concept of
    syntactical and logical progression of the text was considered the ultimate poetics in literary canons. Following the narrative
    conventions of post-Enlightenment English literature that went on till the turn of the 19th century, the poets and writers of early 20th century Bengal were chiefly following a chronological and syntactical order in their writings. The reason for such linear progression of narratives was to produce proper meaning for the urban elite readers whose literary and cultural sensibility were deeply influenced by the three hundred years of colonial rule in India. That is why, when the Hungryalists moved out of this convention of representation, their works were considered vulgar
    and obscene by the erudite middle class population who had
    already hierarchized literature according to their notions of
    literary taste.

    But at the peak of the movement, Binoy Majumdar
    developed schizoid problems. Shakti was harried by literary
    guardians to leave the group and issue anti-Hungryalist
    proclamations. Sandipan Chattopadhyay was enticed by a mass circulation magazine with a promise to bring out his novel provided he quit the movement. Sunil Gangopadhyay, in his editorial in Krittibas, castigated the movement:
    We don’t know whether the Hungry Generation
    movement is good or bad. We have nothing to
    comment about its future. However, none of the
    leaflets circulated by them had shown any remarkable
    literary merit— ordinary writings aspiring to be
    different. Funnily enough, some are even juvenile.
    Other than that, the non-literary associations that
    the movement seems to have developed are indeed
    disgusting. We really couldn’t imagine that a few
    youths would attempt to create literature in Pidgin
    English even after 1960. But if the movement can
    give rise to a different kind of literature, we’ll definitely
    welcome it. (“Hungry Bulletin O Patrika Theke”
    [1961 – 1965]. Translation mine)

    As a result several fence-sitters were trapped in an
    intellectual bind. These writers in the end committed themselves to prolific commercial writing. By the middle of 1964 only Utpal, Samir, Malay, Debi, Subimal, Subhas, Saileshwar, Pradip, Karuna,Anil, Tridib, Alo, Falguni, Subo and Ramananda remained in the movement. The departure of fence-sitters proved to be a positive feature. The process accelerated the disintegration of aesthetic realism, leading to gradual dissolution of distinction between the elite and subaltern cultures. Hungryalist texts developed subversive and multiple semiotic and semantic characteristics. The mono-centric, unified truth as demanded by the then presiding academicians were persistently attacked by
    the participants. In their writings, prose writers such as Samir,
    Falguni, Subhas and Subimal, as well as in Malay (in his dramas), developed a kind of textual reality that was not oblivious to the problematics of heteroglossia (Vice 18).They accommodated not only different languages but also different dialects within the same language irrespective of how localized that dialect was. They were aware of the hierarchical relationship between different
    languages and even different forms of the same language. They used this awareness of heteroglossia to highlight their own minority status which defied contemporary literary poetics in favor of transgressive styles. Subimal Basak’s novel Chhata Matha is a good example of this transgression. It is written in its entirety in the language of East Bengali tongawalas which makes it a difficult read. However, being in a distinct East Bengali dialect, the novel could be understood easily by the illiterate common East Bengalis when read out loud.

    Hungryalists like Malay Roychoudhury, Subimal Basak
    and Debi Ray became well known through their radically anti-
    Establishment policies. They used different, innovative media
    to spread their manifestos and bulletins. “It had been a revolution from the very beginning. I had constantly sponsored the production of bulletins, masks, posters, poems in wedding cards, literary meets in red light areas, tribal women in Chowrangi, etc.”(My own translation) (Ray 64), said Malay Roychoudhury in an interview taken by Arunesh Ghosh during the 1980s. They would deliver paper masks of animals, monsters and gods to ministers, critics, publishers and other powerful people with the slogan ‘please remove your mask’. They would critique poets on wedding cards and make obscene sketches on papers and posters and distribute them for free. They would send shoeboxes for
    book review or blank paper in the name of short stories to wellknown commercial newspaper offices. They violently attacked the administration and media. They would often go to Benaras or Kathmandu and engage in sexual anarchy and drug abuse along with hippies. They would exhibit Hungryalist paintings and at the end of the exhibition, set fire to all of them. It was their firm belief that it was only through such brutality that the colonial hangover which the decadent Bengali culture had absorbed, could be shaken out of the Bengali socio-literary arena. Naturally, these meetings, exhibitions and promotion of such literature among
    the masses led to a socio-literary unrest which alarmed the
    government. Finally, the administration intervened. On 2nd
    September 1964, an arrest warrant was issued against eleven Hungryalists namely Samir Roychoudhury, Malay
    Roychoudhury, Debi Ray, Subhash Ghosh, Saileshwar Ghosh, Pradip Choudhury, Utpal Kumar Basu, Ramananda
    Chattopadhyay, Basudeb Dasgupta, Subo Acharya and Subimal Basak under IPC sections 120b and 292. Articles were seized from Samir and Malay’s ancestral home in Patna on 4th September. Consequently, a charge sheet against Malay was submitted at the Bankshal court by Calcutta Police on 3rd May 1965.

    The charge sheet goes:
    In August 1964 a printed booklet entitled Hungry
    Generation published by Samir Roychoudhury was
    found in circulation at Kolkata. The poetry captioned
    Prachanda Boidyutik Chhutar(Stark Electric Jesus)
    by Malay Roychoudhury was found obscene and the
    Director of Public Prosecution, West Bengal being
    consulted, observed that the book was actionable
    under Section 292 of Indian Penal Code, and
    suggested prosecution of Malay Roychoudhury, who
    is on criminal bail till today the 3rd May 1965, may
    be prosecuted against under Section 292 IPC. (Hungry
    Generation)

    Many of the fellow Hungryalists were coerced and
    persuaded by the police to bear witness against Malay. Shakti Chattapadhyay, one of the founding members of the movement himself spoke against the movement. Saileshwar Ghose and Shubhas Ghose also bore witness against Malay. But Malay appealed to the higher court and eventually was acquitted of all charges by July 1967. However, this court case against the Hungryalists had a tremendous impact on their individual lives. Utpal Kumar Basu was fired from his job of a professor; Pradip Choudhury was rusticated from Bishwabharati. Samir Roychoudhury was suspended from his government office; Debi Ray and Subimal Basak were transferred outside Calcutta. Subo Achrya and Ramananda Chattapadhyay became fugitives. Article 120b being that of conspiracy, the Calcutta detective department had issued dossiers for each and every Hungryalist member.
    During the arrests, the police mercilessly rummaged through each of their houses and the books, manuscripts, files, diaries and even letters that they had confiscated during that period were never given back to them.

    2
    Who would you acknowledge as the first poet? Some
    think that it was that Cro-Magnon who plucked a
    flower for his Eve twenty five thousand years ago. But
    for me, the first poet was that Zinjanthropus who
    lifted a stone millions of years ago and made it into a
    weapon. (My own translation) (Ray 41)
    This very comment of Malay makes it evident how the
    Hungryalist movement revolutionized the ways in which poetry was to be composed in postcolonial Bengal. The Hungryalists evolved a new ethos of diction breaking down the stagnancy and depravity of the sophisticated, artificial poetry that was constantly highlighted by the intelligentsia of the 40s, 50s and 60s in Calcutta. In one of his Hungry bulletins, Malay Roychoudhury clearly announces that poetry has to erupt in an orgasmic flow; hence it is essential to unlearn the education imposed by the institutionalized units of administration, religion, politics and society. Vision, which is fundamental to creativity, can come only to the raw, uneducated soul. Logic and rationality must be done away with, completely. It should be freed from the fetters of artistic hierarchies, from the manacles of neatly assigned
    watertight meters. While discussing the condition of
    contemporary Bengali literature Malay says:
    "those idealized and universalized noble passions,
    knowledge and expertise in art, all those academic
    hotchpotch, the artificialities dressed as
    subjectivism— if these are not gotten rid of, no poetry
    is possible…”(Roychoudhury, Ishtahar Sankalan 47.
    Translation mine).
    He bitterly condemns western aesthetic movements like
    “art of art’s sake”, art for technique’s sake, art for form’s sake, art for symbol’s sake etc. and the imitators of such movements in the Bengali bourgeois scholastic circle. Vision can be attained only through the mediation of the ‘native idiom’ and it is this native idiom that serves as the language of real poetry, the language of resistance. In the Hungryalist Manifesto, the objectives of the Movement have been clearly stated:
    1. To never emulate the reality of Aristotle, but to
    take the un-enameled whoring reality by shock under
    the genital of Art.
    2. To let speechlessness burst into communication
    without breaking the silence.
    3. To let free a creative ruckus, in order to unknot the
    knotted world and start afresh from chaos.
    4. To exploit every matrix of senses except that of a
    writer.
    5. To disclose the belief that world and existence are
    justified only as an aesthetic phenomenon.
    142 Margins: A Journal of Literature and Culture
    6. To accept all doubts and despairs rather than to be
    content to live with the sense made by others.
    7. To lash out against the values of the bi-legged careermaking animals.
    8. To abjure all meretricious blandishments for the
    sake of absolute sincerity.
    9. To stop writing and painting beyond the point of
    Self-realization.

    The Hungryalists, as mentioned before, had completely
    broken away from any kind of form, meter, style, mannerism,
    punctuation, line, pattern, symbol, genre, metaphor and logical arrangement of words. They believed that the only justification for writing is bursting out in passion. They were deeply inspired by Antonin Artaud’s views. “People who leave the obscure and try to define whatever it is that goes on in their heads, are pigs....
    Those for whom certain words have meaning, and certain
    manners of being; those who are so fussy; those for whom
    emotions are classifiable, and who quibble over some degree or other of their hilarious classifications; those who still believe in ‘terms’, those who brandish whatever ideologies belong to the hierarchy of the times, who talk of contemporary currents of thought; those who still believe in some orientation of the spirit, those who follow paths, who drop names, who fill books with screaming headlines ...are the worst kind of pigs” (Artaud 38).
    This principle of uncontrollable energy, welling out of the self
    without any pre-determined shape, form or purpose can be amply found in Hungryalist poetry:

    Oh I’ll die I’ll die I’ll die
    My skin is in blazing furore
    I do not know what I’ll do where I’ll go oh I am sick
    […]
    Oh Malay
    Calcutta seems to be a procession of wet and slippery
    organs today
    Margins: A Journal of Literature and Culture 143
    But I do not know what I’ll do now with my own self
    My power of recollection is withering away
    Let me ascend alone toward death
    I haven’t had to learn copulation and dying
    […]
    Aaaaaaaaaaaaaaaaaaaah
    I do not know whether I am going to die
    Squandering was roaring within heart’s exhaustive
    impatience
    I’ll disrupt and destroy
    I’ll split all into pieces for the sake of Art
    There isn’t any other way out for poetry except
    suicide… (Roychoudhury “Stark Electric Jesus”, Lines
    1-62)

    This poem ‘Prochondo Boidyutik Chhutar’, translated as
    ‘Stark Electric Jesus’ composed by Malay, was a ground-breaking one of its time. It elaborated unmistakably that the Hungryalists aimed not at changing or appropriating form, but at completely destructing any formal elements that have been thrust upon indigenous literature indiscriminately following the practice of occidental literary canons. In the original Bengali texts, the alteration of the spellings of certain words according to their pronunciations was a blasphemously revolutionary poetic innovation that sought to redefine the rules of quintessential Bengali grammar. The primary job of a poet is to declare war against art. The reader should first be alienated and made hostile, and then, through that same aggressive rhetoric and attitude, be provoked and scandalized. Poetry, in actuality is the embodiment
    of violent and destructive creativity. According to Dr. Indrajit
    Bhattacharjee, (Professor of English, Osmania University) the movement had reached a crescendo when it was on the brink of withdrawing itself completely from the western canon and discourse (Hungry Generation Blog). The stark difference of this revolutionary movement from the contemporary mainstream aesthetics was neatly categorized by Subimal Basak and Rajkamal Choudhary in their trilingual (Bengali-Hindi English) bulletin in 1963.

    Prevailing Canons
    1. Establishment 2. Tyranny 3. Insiders 4. Elite high-brow culture
    5. Satisfied 6. C ohesive 7. Showy 8. Sex as known 9. Socialite
    10. Lovers 11. Ecstasy 12. Unmoved 13. Hatred as camouflage
    14. Art films 15. Art 16. Sugam Sangeet (Tagore songs) 17.
    Dream 18. Tutored language 19. Redeemed 20. Framed 21.
    Conformist 22. Indifferent 23. Mainstream 24. Curiosity 25.
    Endocrine 26. Conclusions inevitable 27. Ceremony 28. Throne
    29. Entertainer 30. Self-projecting 31. How am I 32.
    Symmetrical 33. Accountants of prosody 34. Revising poems
    35. Fantasy’s game.

    Hungryalist Canons
    1. Anti-Establishment 2. Protester 3. Outsiders 4. Commoners’
    culture 5. Unsatisfied 6. Brittle 7. Raw-bone 8. Sex as unknown
    9. Sociable 10. Mourners 11. Agony 12. Turbulent 13. Real hatred
    14. All films 15. Life 16. Any song 17. Nightmare 18. Gut
    language 19. Unredeemed 20. Contestatory 21. Dissident 22.
    Struck ethically 23. Watershed 24. Anxiousness 25. Adrenalin
    26. No end to unfolding 27. Celebration 28. Abdication 29.
    Thought provoking 30. Self-effacing 31. How are you 32.
    Tattered and decanonized 33. Extravagance 34. Continuation
    revision of life 35. Imagination’s flight (Hungry Generation).

    Apart from their avant-garde theories on poetry, the
    Hungryalists also issued manifestos discussing politics and
    religion which alarmed the administration of Bengal and made them realize that Hungryalism had already become a cult in itself. In their ‘political manifesto’, the Hungryalists promoted that it is important to depoliticize the soul of every individual, in order to make him realize that existence is pre-political. They declared that all intellectual fakeries called political hypothesis are basically the sources of lethal and seductive lies exploding out of monstrous irresponsibility. In their religious manifesto, they propagated that god is garbage and that religion is nothing but murder, rape, suicide, drug-abuse, poison, perversion, addiction, insomnia and constant transformation.
    The Hungryalist Movement redefined the meaning of
    obscenity in contemporary Bengali literature. For the first time, it introduced the idea that there is nothing called obscenity. The Hungryalists felt that obscenity is an artificial construct; it is created, invented, made-up by a group of uneducated class conscious conspirators. These opportunistic conspirators have divided the vocabulary along class divisions. To the elite, the language of the subaltern is coarse, crude, obscene and his own language, an art. The Hungryalists deliberately attacked this double standard by subverting the very diction in which Bengali poetry was written during the 40s, 50s and 60s. The poem
    ‘Habijabi’, by Subimal Basak would have been a brilliant example to cite here, a poem which brings to life the colloquial Bengali of Dhaka, posing a direct challenge to the so called puritan guardians of mainstream Bengali literature. But unfortunately, the essence of the poem lies in its accent and delivery of words, so it loses its most important meaning in translation.
    The movement further launched the idea that sexuality is
    not obscene. In fact, sex is the only phenomenon which is beyond the pettiness of culture, tradition, religion, race, wealth, rituals, conventions and law. Sexuality is probably the only medium through which the unconscious can be realized and examined.

    Within my clasp, your absolute, exploding fetus
    Bursts again. I’m my own root, I’m food for the soil,
    earth
    Salty water, I’m grass and I smoke myself, look, my
    green body, my maroon limbs
    Maroon eyes, maroon abdomen and pale genital
    146 Margins: A Journal of Literature and Culture
    Hurling abuses of love among the yellow waves of
    blood
    The scent of fresh gunpowder numbs my body and
    perhaps life… (Siddhartha by Pradip Choudhury in
    “Hungry Bulletin O Patrika Theke” [1961 – 1965]
    Translation mine)

    The Hungryalists vehemently protested against the
    hypocrisy of the established literary culture which censored
    sexual content and language when used as an expression of
    unprocessed creativity and yet, itself indulged in sexuality for
    achieving certain commercial, capitalistic ends. It was them, who first exposed how the establishment promotes a society where sexuality can be used as a commodity but not as a weapon.

    3
    It is unnecessary to mention the huge legacy of alterity
    that the Hungryalist Movement has left to the history of
    postcolonial Bengali literature. The movement had shaken away the yoke of dominance imposed upon Bengali literature by the stalwarts of established literary canons; stalwarts, who replicated Western philosophical thought in their writings and criticism even many years after India had attained independence. It brought in a breath of fresh air through the brutally different ideas that were born out of it. Hungryalist literature, even in its initial stage,seemed to have been self conscious of its minority status and deliberately sought to locate itself as the ‘other’ which would question the very power structures associated with the ideas of majority and minority. Before 1961, most Bengali magazines
    had Sanskritized names which were probably supposed to mark their superiority over cheap Bengali literature, e.g., Kobita, Purbasha, Arani, Krittibas, Uttorsuri, Dhrupodi, Kranti, etc. After the movement such classical names were replaced by radical ones like Kaurab, Abar Esechhi Phire, Manusher Bachchha, Dhoper Kagoj, etc. Subaltern literature, a field so long intentionally left out of the scope of magazines like Kobita, Krittibas, Dhrupodi and others, found its voice for the first time in Hungryalist literature. The subaltern discourse was given as much importance as the dominant discourse or perhaps more. This further hastened the use of mixed diction in modern Bengali poetry. Poets started employing sexual metaphors and slangs of every kind to create striking and hard-hitting images in their works. The openness in rhythm, punctuation and order gave a new freedom to Bengali literature post 1965. Poems of Falguni Ray, Malay Roychoudhury, Saileshwar Ghose and Tridib Mitra
    are points of reference in poetry and the pieces by Subimal Basak and Malay Roychoudhury in prose. Expressions such as ‘uh’,‘ahh’, ‘aaaaaaaaaaah’, ‘oh’, ‘phooh’ etc. that were so long forbidden to be a part of the sophisticated postcolonial Bengali rhetoric,now began to be accommodated. Absence of a logical sequenceboth in terms of sentence structure and meaning was first usedby the Hungryalists, a process that became vital to the literatureof the 70s. As is evident from the lines of Roychoudhury’s “Stark Electric Jesus”, the Hungryalists also introduced the playful use of unstable imagery which collapsed into one another even before
    being fully formed. The Naxalite movement that ravaged Bengal towards the 1960s seems to be somewhat influenced by the subversion, the destructiveness and the urge to restart after complete collapse that the Hungryalist movement embodied.The revolutionary ideologies developed by the
    Hungryalists were however, not limited only to Bengal. It created a stir all over the world. Not only the English version of Time magazine, but the Spanish version too, wrote about the movement. Many international magazines and periodicals like City Lights Journal, Kulchur, Klactoveedsedsteen, Salted Feathers etc. printed, reprinted and brought out special issues on the Movement.

    In his letter to Malay Roychoudhury, American writer
    Howard McCord requests Malay to send him a copy of “Stark
    Electric Jesus” which he wished to publish in Contemporary
    Indian Poetry (Ghosh Dastidar np). The poem was first written in Bengali and translated by Malay himself. The poem was published in City Lights Journal with an introduction on the movement written by Prof McCord, and the same matter was republished in the Hungryalist commemorative issue of Salted Feathers edited by Dick Bakken. Salted Feathers featured most of the participants of the movement.

    As for the other Indian languages, in Hindi, Sharad Deora
    wrote a novel titled College Street Ka Naya Maseeha based on the life and works of Hungryalists; Phanishwarnath Renu wrote Ram Pathak Ki Diary Se; Dharmaveer Bharati and S.H.
    Vatsayana Ajneya wrote quite frequently about them in the
    periodicals they edited, i.e., Dharmayug and Dinaman; Ashok
    Shahane, Dilip Chitre and Arun Kolatkar hailed them in Marathi; Umashankar Joshi introduced them in Gujarat; Ameeq Hanfee translated and introduced them to Urdu readers. The Bengali intelligentsia had not bargained for this national and international exposure and publicity. Reputed academicians of the time, such as, Sukumar Sen, Asitkumar Bandyopadhyay, Haraprasad Mitra, Bhabatosh Datta, Ujjwalkumar Majumdar, Kshetra Gupta, Saroj Bandyopadhyay, Sashubhushan Dasgupta, Sukumar Bhattacharya, Debiprasad Bhattacharya, Bhudeb
    Choudhury, Tarapada Mukhopadhyay, Chinmohan Sehanobis
    and others preferred to ignore the turbulence created by the
    movement. Some academicians even persuaded academicians of other Indian languages to ignore the Hungryalist impact (Hungry Generation). Nevertheless, intellectuals from other countries, such as Gary Snyder, Octavio Paz and Ernesto Cardenal sought out the Hungryalists when they visited India.

    4
    One question must be asked in order to properly evaluate
    the Hungryalist Movement through a post colonial lens. Could the Hungryalists succeed completely in evolving a counter discourse against the colonial aesthetics practiced by the established literary culture? Perhaps not entirely. The name of the movement itself was a lift from the great medieval poet of England, Geoffrey Chaucer. The theoretical foundation on which the whole body of the movement stands is borrowed from Oswald Spengler, himself a German historian and philosopher who wrote his theories on the decline of the ‘west’. It is his theory that Malay and Shakti had imposed upon the postcolonial Indian reality. The justification of such an assumption of similarity is
    indeed questionable. In his letter to Malay on 22nd May 1965,
    Howard McCord writes:

    I have enjoyed very much reading your letter and
    coming in contact with your thoughts. Artaud, Genet,
    Burroughs: yes. They are the dialecticians of chaos
    presiding at the dissolution of the west. They
    describe, with joy and exactitude, the destruction in
    which they are themselves involved. Burroughs, to
    me, is a man performing an autopsy on himself. They
    are all quite mad, and therefore speak the truth. We
    can only trust the mad anymore. The West began to
    die around 1750, and it has been the function of poets
    to recite, in series, the long funeral oration. William
    Blake began it. Goethe, Baudelaire, Lautremont,
    Rimbaud, Huysmans (unknowingly), Pound, Eliot,
    Crane, and all the other familiar names have
    continued the chant. We are their heirs, and perhaps
    the culmination, for our anguish and despair, the
    aesthetic suicide of which we are capable, may mark
    the end. Perhaps it will go on. (in Ghosh Dastidar)
    Although we don’t have access to Malay’s letter to McCord,
    it is evident from this letter that Malay had indeed discussed the influence of these significant theoreticians with McCord. Both Antoine Artuad and Jean Genet are controversial thinkers of 20th century France, a typically colonial power and William S. Burroughs, a primary figure of the Beatnik movement that has always been notoriously aligned with the Hungryalist movement. Moreover, Hungryalists have repeatedly expressed their admiration for the 19th century Bengal renaissance literary personages like Michael Madhusudan Dutt and Bankim Chandra Chattapadhyay. The 19th century enlightenment was perceived by them to be a state of idealized history which has been lost forever. This indeed seems murky waters since 19th century was
    the age of western education and Cartesian philosophy of
    thought— two issues that the principles of Hungryalism clearly appears to negate, unlearn and cruelly annihilate. What are we to make of such contradictions?
    Poets like Pabitra Mukhopadhyay, Basudeb Dasgupta etc.
    have seen overt Beatnik influence in Malay’s poems of the
    Amimangshito and Jakham range poetry. I have already quoted McCord’s letter to Malay to demonstrate how indeed Malay seems to have discussed Burroughs in his correspondence with him. Some have even pointed towards the obvious similarity between Hungryalism and the Hippie culture of the west. When confronted with this charge, Malay had refuted it by saying that such a comment can only be the result of poor research. In an interview to Sayed Samidul Alam during the 1980s, he specifies the distinction between the Hungryalists and the hippies. He says that hippies were essentially a sect of upper-class dropouts; they represented a counter culture. But the Hungryalists, while also representing a counter culture, had always been lower class
    people, subaltern to the elites, complete ‘outsiders’ to mainstream society. Their bohemianism, unlike the hippies, was not by choice, but by compulsion. Any charge of the Hungryalists imitating the hippies must be taken as the ploy of the bourgeois Bengali society to dishonor the movement. On one hand, Malay says, “I think of my ancestor, the lascivious Sabarna Choudhury, I must do something new, something different” (‘Prochondo Boidyutik Chhutar’) – which is a total castigation of his ancestor. But on the other hand, there is a sense of unease associated with his own
    roots that he seems unable to justify to himself, an anxiety with respect to his present identity as the founding member of a subaltern movement.

    A close reading of the Hungryalist poems often reveals
    that after all, poetry does not actually well out of the self in an
    orgasmic fervor. It is a careful construct, a cautiously developed pattern of words placed one against the other in order to shock the readers. Most of the Hungryalist poems, in fact, clearly bear marks of being a manufactured product designed to create a certain affect. Every single image seems a meticulous choice to be juxtaposed against another image. The Hungryalist objective of making every word speak for itself gives special attention to the vividness and audibility of words, and the poets, while they erect
    the body of poetry with these words are quite conscious of thiswhole process of rigorous creation. Malay himself confesses, “An idea keeps revolving inside my head for a few days. I put it down on paper in a trance. And only after polishing it thoroughly does it become poetry” (Ray 13).

    So Malay, (who, in the Hungryalist manifestos ridicules
    poet and academician Buddhadeb Basu for his statement “any art is a construct and in that sense, artificial” (Roychoudhury, Ishtahar Sankalan) unwittingly confesses that he himself undergoes this same procedure of initial inspired passion and consequent thorough polishing and revision while composing, quite contrary to his propagated theory of making poetry the expression of bare, unmediated instincts.
    The claim that Hungryalism is different from the Western
    hippie culture since the former propagates a system of alternate ethos and the latter, a conscious conflict with the Establishment, hardly seems convincing. In many Hungryalist manifestos and bulletins, the members of the movement repeatedly use words like “counter-canonization”, “counter-discourse”, etc. In each of their writings, it becomes apparent that the whole cult of Hungryalism has been formulated as a reaction or counter-action to the prevailing, established aesthetics. It is undoubtedly a confrontation, an act of calculated flouting of ‘norm’. But in this act of ‘writing back’ the Hungryalists often seem to use those very points of reference (e.g., counter-discourse can be formulated only in reference to that of the ‘discourse’)that they had planned to undo at the very outset.

    Conclusion
    According to Pradip Choudhuri, a leading philosopher
    and poet of the time whose work has been extensively translated in French, the counter-discourse of the Hungryalist Generation of Bengal was the first voice of post-colonial freedom of pen and brush (Datta Web). The majority of Bengalis having almost an instinctive inclination for Marxist ideology during the post independence era, Oswald Spengler’s prophecy of doom and disaster was the first salvo of controversy which made the Hungryalists unacceptable to leftist media and professors for almost two decades. It was because of the individual genius of such authors as novelist Subimal Basak and poet Malay Roychoudhury that the barriers were broken. Subsequent researchers such as Dr. Uttam Das of Calcutta University, Prof.Nandalal Sharma of Chittagong University and Prof Howard McCord of Washington State University, however, have
    explained that the social commitment in the Hungryalist writers over the years alleviated the fear of political leftists (Mitra Web). It is the trace of nationalist feeling that has kept them in goodstead and cut through shallow political controversies.
    Nevertheless, very often their nationalism itself has led to
    controversy as the Hungryalists have been criticizing politicians of all kinds. In spite of trial and harassment, the Hungry Generation has continued to produce and publish poetry and prose. Sharp, caustic, dark, hallucinatory, nihilistic, offensive, obscene, angry, piercing— these characterize the terrifying and cleansing visions that the Hungryalists insist Indian literature must suffer. With a few exceptions, modern Indian literature is age old and tedious: pallid, otiose, and dull. It is timid and moralizing, and when it is not courteously realistic, it is idealistic and pointlessly and eternally philosophical (Mitra Web). But in the Hungry Generation, excluded from the academies and the
    literary aristocracy, the sense of urgency and anguish can be seen, for they, more than any other group have realized that there is possibly no hope for most indigenous literatures of India; that what lies ahead is disorder and disintegration. And it is through their movement that they had announced a declaration of freedom, of independence from any culture that is normative by compulsion and unaccommodating and snobbish by choice. There are indeed certain portions still unanswerable with regard to the combination of their theories and practice. Hopefully the Hungryalist poets, especially Roychoudhury himself, being still alive, would be able to shed some light on the murky issues discussed within the course of this paper and without, in the near Future.

    Works Cited
    Amader Bangla Kobita. n.d. Blog. 22 January 2013. <http://
    aamaaderbanglakabita.blogspot.in>.
    Amimangsito. Kolkata: Zebra Publications, 1965.
    Arnold, Matthew. “The Study of Poetry.” English Literature and
    Irish Politics (Complete Prose Works of Matthew Arnold). Ed. R.
    H. Super. Vol. 9. Ann Arbor: University of Michigan Press,
    1973. 161-188.
    Artaud, Antonin. Artaud Anthology. Ed. Jack Hirschman. Trans.
    Jack Hirschman. Paris: City Lights Books, 1965.
    Cocteau, Jean. Crucifixion (Translation). Kolkata: Kobita
    Prakshik, 1996.
    Das, Uttam. Hungry Shruti O Onyanyo Probondho. Kolkata:
    Mahadiganta Prokashoni, 1995.
    154 Margins: A Journal of Literature and Culture
    Datta, Ketaki. “Life & Letters.” 15 January 2012. The Statesman.
    Newspaper. 5 January 2013. <http://202.144.14.20/
    index.php?option=com_content&view=article&show=article&id=
    396937&catid=44&year=2012&month=1&day=15&Itemid=66>
    Dutta, Jyotirmoy. “Bangriji Sahitye Khudhito Bongsho.” Desh
    Sahitya Sankhya 1969.
    Ezekiel, Nissim. Hungry Generation. Mumbai: Indian P.E.N.,
    Marine Lines, 1987.
    Ferlinghetti, Lawrence, ed. City Lights Journal. SF, USA: City
    Lights, 1963.
    Ghosh Dastidar, Gargi. Letters to Malay Roychoudhury. 6 June
    2008. Blog. 21 August 2013. <http://
    letterstomalay.blogspot.in>.
    Ginsberg, Allen. Howl & Other Poems (Translation). Kolkata:
    Kobita Prakshik, 1996.
    —. Kaddish (Translation). Kolkata: Kabitirtha, 1995.
    Haque, Ebadul, ed. Hungry Andoloner Ishtahar. Murshidabad:
    Abar Esechhi Phire Prokashoni, 2008.
    History of Hungryalism. n.d. Wiki. 22 December 2012. <http://
    .
    “Hungry Bulletin O Patrika Theke (1961 - 1965).” 27 January
    2009. Hungry Andoloner Kobider Kobita. Blog. 2 February
    2013. <http://hungrykobita.blogspot.in/2009/01/blogpost.
    html>.
    Hungry Generation. 20 September 2010. Blog. 19 November 2012.
    <http://hungryalist.wordpress.com/2010/09/20/hungrygeneration/>.
    Hungryalist Manifestoes (Collection of Manifestos). Kolkata:
    Mahadiganta Prokashoni, 1986.
    Hungryialist Photos. n.d. Blog. 23 January 2013. <http://
    hungryderphoto.wordpress.com>.
    Marxbaader Uttoradhikar. Kolkata: Shakti Prokashon, 1962.
    Mitra, Tridib. “Hungry Generation.” 30 June 2008. Hungry
    Generation. Blog. 3 January 2013. <http://
    hungryalistgeneration.blogspot.in/2008/06/hungrygeneration.
    html>.
    Margins: A Journal of Literature and Culture 155
    Nandi, Bishwajit, ed. Milon Hungry Andolon Sankhya. Meghalaya:Milon Prokashoni, 2007.
    Newman, Lex. “Descartes’ Epistemology.” 10 July 2010. The
    Stanford Encyclopedia of Philosophy. Web. 21 June 2014.
    Poems of Hungryialist. n.d. Blog. 23 January 2013. <http://
    poetmalay.blogspot.com>.
    Postmodern Bangla Poetry 2003 : An Overview. Bansdroni, Kolkata:Haowa49 Publishers, 2003.
    Postmodernism. Bansdroni, Kolkata: Haowa49 Publishers, 1995.
    Ray, Ajit, ed. Hungry Sakkhatkarmala. Kolkata: Mahadiganta
    Prokashoni, 1999.
    Roychoudhury, Malay. A Sour Time of Putrefaction Nayanima Basu.
    10 December 2011. Web Archive. 12 January 2013. <http://

    of-putrefaction-111121000058_1.html>.
    —. Ishtahar Sankalan. Kolkata: Mahadiganta Prokashoni, 1985.
    —. Stark Electric Jesus. n.d. 21 August 2013. <http://redroom.com/
    member/malay-roychoudhury/writing/stark-electric-jesustranslation-
    of-bengali-poem-prachanda-boidyut>.
    Selected Poems. Kolkata: Writers’ Workshop, 1989.
    Sen, Prabir. Allen Ginsberg (Biographical Criticism). Kolkata:
    Kabitirtha, 2000.
    Shoytaner Mukh. Kolkata: Krittibash Prokashoni, 1963.
    Spengler, Oswald. The Decline of the West. Ed. Charles Francis
    Atkinson Helmut Werner. Trans. Charles Francis Atkinson.
    New York: Oxford University Press, 1991. Google Book Search.
    Web.
    Tristan Tzara’s Poems. Jamshedpur: Kalimati, 1996.
    Uttor Ouponibeshik Postmodernism. Medinipur: Bakpratima, 2001.
    Vice, Sue. Introducing Bakhtin. Manchester: Manchester UniversityPress, 1997.
    Weissner, Carl. Klactoveedsedsteen Hungryalist Issue. Germany,1966.
    Zakham. Kolkata: Zebra Publications, 1966.
    ( Published in "Margins: A Journal of Literature and Culture" )
  • Debi Roy | 012312.60.8912.247 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১৮:০৩541364
  • The Hungryalist under-caste: A Conversation with Debi Roy
    Debayudh চ্যাটার্জী
    ----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    Debi Roy was born in 1938 as Haradhon Dhara
    to an impoverished under-caste household residing
    in a slum in Howrah. He had to discard his real name
    to survive in a literary establishment dominated and
    hegemonized by the upper-class elite. Roy was one of
    the four founder members of the Hungryalist movement.
    He was hailed to be the editor of the first manifesto
    of the movement that came out from Patna in 1961.
    His slum address was used for official correspondence
    during the movement. Pitching an under-caste in the forefront
    was conscious effort to lodge an attack on the Brahminical arena
    of Bengali poetry. Roy passed his school final in 1958 and IA in 1960
    before enrolling himself in a course on library science at
    the University of Calcutta.
    His first anthology Kolkata o Ami (Kolkata and I) came out in 1965.
    He was arrested later on the ground of obscenity
    along with other members of the Hungry generation.
    While he was suspended from his government job,
    the lower court soon acquitted him.
    After 1965, as the movement fizzed out and splintered
    into different groups, Roy continued writing as an individual
    in his own merit. Till date, he has authored more than
    ten titles in poetry, translated extensively from Hindi into Bengali,
    and wrote three books of non-fictional prose.
    ----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    Debayudh: Let me begin by asking why
    you changed your name to Debi Roy.
    Debi Roy: There wasn’t any other way apart
    from adopting that name. No way whatsoever.
    There was so much of Brahminism around me,
    so much of humiliation… When they cannot topple
    over you in any other way, they seek resort in caste.
    This is just a way of suppressing you. Some of my
    own friends can be accused for that crime. Some very
    close friends who used to frequent my slum once upon a time.
    They came at an hour when my mother couldn’t eat…
    But they were ones to humiliate me first. They still do it…
    even now… though their powers have ceased to exist.
    Debayudh: What I know about the movement is that
    after four years of its inception, it got fragmented.
    Some of the members denied their allegiance in the court,
    some pioneers changed their stance, a lot of other nasty
    things happened. You were one of those who actually
    faced the music. You were arrested, heckled,
    suspended from your job… Today, after more than
    fifty years, on retrospect, would you relate that as
    subtle form of caste oppression?
    Debi Roy: I despise caste. I have no words
    to condemn what happened to me. It’s just that
    I have to remain silent. My wife passed away last June, on 24th…
    I am not in the right state now. I am a self-made man.
    I was born in a slum and now I live in an apartment
    with an air-conditioner in each room.
    I never imagined I could climb such heights.
    Debayudh: Did you ever write directly on caste?
    Debi Roy: Nirendranath Chakrabarty
    once told me that I can skillfully enmesh my life in
    my poetry. He once asked me why I don’t write an
    autobiography. I mocked back, should I write a Jibansmriti?
    Tagore wasn’t any less humiliated for being a Brahmno…
    a fallen Brahmin… But why would I write? Who would be interested to read about me?
    Debayudh: I can share an anecdote with you.
    In 1926, Tagore attended a Namasudra conference
    in Dhaka. He was severely chastised by his folks
    at Viswabharati. He never went back to Dhaka again,
    that was his final visit. AK Biswas has written
    about it in detail.
    Debi Roy: Imagine. Such is the consequence
    of the caste system. But Bangladesh has been very
    hospitable to me. I have been there four times as of now.
    However, Tagore is zillion times greater than me. I owe my life to him.
    Debayudh: Although Tagore was preoccupied
    with discrimination throughout his life, he kept
    altering his views on the caste system. You can track
    that change from Gora to Home and the World to a
    couple of short stories to Chandalika. He preferred Gandhi
    over Ambedkar at the time of the Poona Pact.
    I find it deeply problematic.
    Debi Roy: Tagore championed the supremacy
    of the human spirit over anything else.
    He was in and out a humanist. There’s one thing that
    I can tell you. If you leave everything aside,
    the profound knowledge and love that
    the Geetabitan speaks of transcends any barrier
    imposed on humankind. Apart from the
    Ramkrishna Kathamrita, one book that keeps me alive
    and immensely influences me is the Geetabitan.
    Sri Ramkrishnadev didn’t have a single degree,
    but the kind of wisdom that runs through his words is
    amazing. Even Tagore didn’t have a university degree.
    But look at how these two men went on to shape
    the consciousness of the entire civilization.
    Debayudh: Yes, Sri Ramkrishnadev and, later on,
    Vivekananda, did play an important role in reforming
    Hinduism from within. They were strictly against caste
    discrimination albeit they never thought of annihilating it
    by its roots. I see a photograph of Vivekananda
    hanging on your walls. What’s his impact on your life?
    Debi Roy: My wife and I have been baptized by t
    he Ramkrishna Mission. We were going through a
    restless period, a lot of agony and pain. I subscribed to
    Udbodhon, their mouthpiece, and started reading the Kathamrita.
    I realized it was already too late, no point
    in delaying further, we decided to embrace the Mission.
    Debayudh: This leads me to my next question.
    If you think it’s too personal and uncomfortable,
    do refrain from answering. The Hungry Generation began
    by repudiating the existence of God.
    I remember that you wrote in one of your poems,
    “It’s more important for me to look for
    bread than run after an unnecessary God…”
    Debi Roy: That was solely Malay’s idea.
    Most of it was gimmick. Not mine. Whatever came from my
    side was youthful folly.
    Debayudh: Describe the initial years how you met
    Roychoudhury brothers, Shakti Chattopadhya,
    Subimal Basak in those early days of the movement.
    What it was like to be part of it?
    Debi Roy: The “Hungry Generation”
    was mostly conceived by Malay.
    He was the one who wrote to me.
    Later on we met face to face in Subarno Upadhyay’s
    rented apartment. Subsequently I was introduced
    to the other members of the movement. In 1962,
    in the month of April, Malay brought out
    the first Hungryalist bulletin and mailed it to me.
    It was published in English. Creator: Malay Roychoudhury,
    Leader: Shakti Chattopadhyay, Editor: Debi Ray.
    It’s natural to protest against convention, social evils,
    and injustice when you’re young, quite natural to be a non-conformist.
    Someone who accepts everything is a person who cannot question.
    That’s certainly not the trait of youth.
    Debayudh: Could you help us understand t
    he Hungry aesthetic better?
    Debi Roy: Immersed in youthful folly,
    the Hungry Generation dared to challenge
    the norms and ethics with whatever cultural capital it had.
    The movement opened up a lot of windows in our minds. T
    here was no hesitation, but pride.
    I used to read a lot, at times, a lot of random stuff at that age.
    John Keats made me thinking, “Thou was not born for death,
    immortal Bird! No hungry generation tread thee down…”
    Malay told me how he was influenced by
    the English poet Chaucer’s phrase, “In sowre hungry tyme”.
    Spenglar’s theory of cultural degradation
    provided the philosophical axis of the Hungry generation.
    Uttam Das researched on the theoretical
    and philosophical implications of the movement.
    Debayudh: Can the hungry aesthetic
    of breaking the state of art exist without the classical dictum?
    Debi Roy: Poetry or literature in general,
    is not a boxing ring that you need to knock
    somebody out to gain fame. I write by myself, for myself.
    Alone. Surrounded by stalwarts on all sides,
    I live a low-profile life. I do not have any sense of inferiority
    because of that. I ask myself, am I educated?
    I have never been educated in the institutional sense.
    I did not have the opportunity to. I prefer not to overload
    my writings with postmodernism and other theoretical
    back-scratching. My liaison with poetry is like my long conjugal life.
    I am still enamoured in her spell.
    I will be until I die. Is there an end to knowing one’s self?
    There is a need to bridge the gap between life and death.
    That is why you need poetry. It’s another name of
    delving deep into life. I have to leave this world someday
    even if I don’t want to. Death is inevitable, life ephemeral.
    But that does tamper with its charm? I find these ideas of
    ‘classic’ and ‘eternal’ quite problematic though.
    My real work is with poetry.
    Debayudh: Do you think the Beats and
    the Hungry generation had anything
    in common and if they have inspired each other?
    Tell us about your interactions with
    the Beat poets and publishers.
    Debi Roy: When the first bulletin came out,
    I went to the editorial office of Janasebak
    to hand a copy over to Sunil Gangopadhyay.
    He quickly went through it once and remarked,
    “So you’re bringing out all this?”
    Later on we got to know that he believed that
    our movement was completely influenced by Allen Ginsberg
    and the Beats. The Beats and the Hungryalists were similar
    only on the grounds of being anti-establishment.
    But one stemmed from the soil of a wealthy nation
    while another thrived in the dust of poverty.
    Debayudh: The leftists often view the movement
    as a middle class reaction that celebrates
    urban alienation and male sexual frustration.
    They accuse that the movement was politically wrong.
    They say you bring in a new order of morality
    while trying to tackle the classical Bengali bhodrotta
    with obscenity and rage of alienation.
    What is your opinion on that?
    Debi Roy: I’m not into politics.
    That’s not my cup of tea. Why don’t political leaders
    across party lines teach us to love people irrespective of differences?
    Aren’t the ones in opposition human beings too?
    Some of them travel enveloped in security,
    in bulletproof cars, instigate the common mass from a distance,
    and go back to their ivory towers.
    There are exceptions that must be respected.
    But why are there so many commandos around the leader
    of an impoverished backward country?
    Why can’t the peasants avail the irrigation and manure
    they deserve? Why do the workers out of work stare
    depressingly at the gates of factories that have been shut down?
    Why do trade unions end up being centres of other profitable trades?
    Why are the youth still unemployed?
    Why are they forced to choose such despicable ways of life?
    But, in the middle of all this, I know of a communist leader
    who refused to take more than a piece of fish on his platter.
    There was another who did his own laundry.
    You cannot imagine such a brand of politics in our times.
    Debayudh: Tell me more about your
    engagement with the Hungry Generation.
    Debi Roy: There are a lot of memories.
    Some of them are too sad to recount.
    I remember spending a month in Varanasi
    on a friend’s travel pass. Probably we hardly had any inhibition those days.
    I adjusted quite well in the household of a widow and her son.
    That’s where I met Anil Karanjai and Karunanidhan Mukhopadhyay.
    Once, after I wrote a piece on Subhash Ghosh,
    an Englishman, probably British rang me and asked whether
    I speak English. I replied that I obviously do,
    but I cannot speak in your accent. This is not my mother tongue.
    I am a poet from Bengal, I write in Bengali.
    I am quite satisfied with myself.
    Debayudh: Yes, English for most of us is
    an acquired language. We had to learn it from scratch.
    It’s obvious that our English will be different
    from her native speakers.
    Debi Roy: We are rather compelled to learn it to make a living.
    Not that I put much of my heart in it. Like Hindi,
    I had to master it to find a job.
    It had nothing to do with my love for that language.
    Debayudh: I can understand.
    I didn’t know a word of Hindi when I first came to Delhi.
    I had to acquire it.
    Debi Roy: Exactly. My bosses thought
    that they would put me into trouble by asking me
    to learn Hindi. But it became a boon in disguise.
    The lady who taught us Hindi came to know that
    I was a poet who tries to translate once a while.
    She advised me to take Pragya, the highest qualifying
    examination in that language, to find a better job.
    The College Street kept calling me, but why would I go?
    Debayudh: That echoes a famous poem
    by Shakti Chattopadhyay, your once upon a time comrade.
    Debi Roy: I have written about it in length.
    Despite Malay keeps bitching about him,
    I believe that he was a great poet:
    a poet in the truest sense of the term.
    There can be no qualms about it.
    I have not come across many who had so much
    dedication for poetry. The rest of the poets
    I know taught at different places, worked in myriad offices,
    but Shakti, he gambled his life for the sake of poetry.
    Debayudh: I read that he moved out for personal reasons.
    Once of his affairs didn’t work out and that placed him a
    gainst the Roychoudhury-s. Shakti Chattopadhyay, as I believe,
    was eccentric and mercurial to the core.
    May be that’s something that defines his poetry.
    Debi Roy: Very true.
    Debayudh: Could you please run us
    through a timeline of major events that led to Shakti’s
    parting ways with the movement,
    and the various fractures within the group
    until the arrest of the poets when the movement ended?
    Debi Roy: One of the reasons is what you said. Shakti
    fell for one of Malay’s relatives. Apart from that t
    here were personal clashes between Malay and Shakti.
    Shakti was also offered a job. But, at the end of the day,
    I believe he is great poet with a timeless appeal.
    Debayudh: Describe the last days of your time
    with Hungry generation. How was it to live with
    the threat of arrest and other threats
    that you all faced during the last phase.
    Debi Roy: I was suspended for a year from my job—
    I was working at the head post office in Burdwan then—
    for being involved in the Hungryalist movement.
    Some custodians of Bengali literature weren’t happy with us.
    I was arrested and put behind bars.
    I was acquitted at last after a lot of storm.
    My friend Samir Ray arranged for my bail.
    Our friendship is still intact. During the trials, Gourkishore Ghosh,
    Jyotirmoy Dutta, and Sunil Gangopadhyay among others
    stood by us. By then, the famous Times magazine
    brought us into limelight. Almost all the major magazines
    and newspapers across the nation started publishing gossips
    and news about us. Dharamveer Bharti, Khushwant Singh,
    Pupul Jayakar, all of them came out in our support,
    collected funds for us, and moved strings to secure our freedom.
    Pranab Kumar Sen, who was the police commissioner of Kolkata back then,
    also admitted later on that arresting the Hungryalists was wrong.
    Debayudh: Let me get back to the sixties again.
    The time in which you took up writing
    was just a few years after Babasaheb Ambedkar’s death.
    Jogendranath Mondal was back in India and was
    trying to consolidate his political career. He failed though…
    Debi Roy: Hasn’t Debesh Roy written a novel on him?
    Debayudh: Yes, Barishal-er Jogen Mandal [Jogen Mandal of Barishal].
    It got published from Dey’s. Anyway, it was that time,
    in the sixties, when you were forced to adopt a different name.
    I completely empathize with that.
    But weren’t you even drawn to their anti-caste ideologies?
    Didn’t they inspire you to fight back? What’s your take on Ambedkar?
    Debi Roy: I immensely respect them.
    The kind of struggle they put up against this system gave voice
    to thousands who were silenced for centuries.
    But I got to know of them much later in my life.
    At that time, in the sixties, I was hardly familiar with their names.
    I was far from being exposed to their life and works.
    Debayudh: I can understand.
    The middle class intelligentsia of Bengal
    after partition has always been very hostile to identity politics.
    As I just told you, Jogen Mandal fought a lost battle
    of reinforcing caste politics in the public sphere of West Bengal.
    With Congress on the one hand, and the Communist Party
    or the Hindu Mahasabha on the other, all the mainstream
    political forces tried to bring the scheduled castes into their fold.
    This was carefully done by appropriating,
    if not shrouding Ambedkar from the common masses.
    Debi Roy: Very true. That’s the reason.
    May be that’s why we never thought so intricately
    about caste assertion in our times.
    There’s another reason. In an impoverished land like ours,
    livelihood becomes an important matter to take care of. As you know,
    I come from a very humble origin. In the sixties, at the brim of my youth,
    I was desperately trying to make ends meet.
    I began my career by working as an errand boy who delivered water and tea.
    I wanted to get out of the muck at the any cost.
    I didn’t have much time to delve into other things.
    Whatever leisure I had, I devoted it to literature.
    Debayudh: Yes, it calls for a bit of privilege
    to actually engage in activism. Those coming
    from well-to-do families can think about losing
    their job and writing, distributing pamphlets for free,
    buying and sending masks to the pillars of the society.
    Obviously, none of it is free of cost.
    Debi Roy: Hahaha… and I had to face the brunt…
    Debayudh: …Even the regular doze of booze,
    weed, hash and travelling to different places
    need some amount of financial affluence…
    Debi Roy: All of these were gimmicks.
    Going to crematoriums and getting drunk… pure hoax!
    All of us have done that, the next generations will also do,
    there’s nothing wrong in that. But all these are gimmicks.
    These have no connection whatsoever with literature.
    Debayudh: Ginsberg once in an article that
    marijuana brings about an aesthetic experience
    that a writer requires…
    Debi Roy: I don’t believe in that.
    Literature has no connection with the use and abuse of substances.
    You can write without excess.
    I don’t think Tagore needed any drug to write.
    But Sarat Chandra was completely different.
    Michael Madhusudan had a life of excess.
    It varies from person to person. It’s a matter of individual choice.
    Besides, it doesn’t mean that all of us have to have a similar lifestyle
    for belonging to the same movement. You can go to Khalasitola
    and have a blast together, but writing itself is a solitary exercise.
    Debayudh: As I went through a lot of anthologies
    on the Hungry Generation, I noticed that you have been obnoxiously ignored.
    Not many of your poems have been included,
    there’s hardly any write-up on you.
    Although you were the editor of the first manifesto
    and your address was used for official correspondence,
    you have been strangely sidelined in the discussions later on.
    Debi Roy: All of it is because of jealousy.
    I achieved what most of them couldn’t. The Sahitya Academy,
    the ICCR took interest in my works, translated me,
    included my poems in their definitive anthologies.
    It is no wonder a group of ghettoized poets would be envious of me.
    They thought that I was being sold out to the establishment.
    I reminded Malay that he was promoted to the post of an officer from a clerk.
    It is the same process.
    But, leave it, there’s no point in resurrecting
    old wounds. Let the sleeping dogs lie as they are.
    There is no perfect job in the entire world,
    there’s no fun in humiliating others as well.
    Debayudh: Yes, opportunism and back-biting
    have perennially plagued the Bengali literary establishment.
    I have seen poets shamelessly advertizing themselves
    and buttering the ones who matter to go places.
    Debi Roy: Oh yes, I have a victim of it.
    A friend from Germany once asked me why I have made
    so many enemies. He held a powerful position.
    He was once asked why he never recommended me.
    He remarked that supporting me would lead to riots.
    Debayudh: Such miserable spinelessness.
    Debi Roy: Poets behave like bureaucrats these days.
    They’re running after publishing their pictures on
    mainstream dailies, inaugurating stupid programs…
    There’s no point in talking about them.
    There was one major poet who changed his jersey and made it big.
    He was after my life once though couldn’t do much.
    I pity these people. But his wife was a genuine poet.
    Debayudh: Let’s go back in time.
    You were telling me about your humble origins,
    the immense hard work you had to put in
    to materialize your aspirations.
    In the middle of all this, how did poetry happen?
    Debi Roy: There was a library near our place.
    I went there to while away my time or forget the pangs of hunger.
    I started reading, I read as much as I could.
    I still remember the librarian. He used to smirk and enquire
    whether I had no other work. There was another library
    near the Howrah Girls’ College. I spent hours there reading authors
    like Bankim Chandra. Not that I understood all of what I read but
    I realized that literature is my poison. I also loved music.
    But once literature takes over someone,
    his life and afterlife are perpetually destroyed. (laughs)
    Debayudh: Did you face any sort of caste
    discrimination from the other members of the movement
    or other writers when you started publishing?
    Debi Roy: There are things that I don’t want to recollect.
    So much of shit has been spewed. Shaileswar Ghosh
    used to think a lot about history. I was perpetually humiliated by him.
    Sub-altern-heaven-afterlife-soul-moksha-the four varnas- these are his truths.
    Some of those Hungryalists are doing the Vedas and worshipping now to make a living.
    Just as Jabali once told Ram, do not be blinded by deceitful Brahmins;
    only the dumb can pin his faith in spirits, afterlife,
    rituals, reconciliation, etc, even in post-modernism!
    Will these theories enable the lower castes and marginalized
    with two square meals a day? Will the roads be repaired after the elections?
    Proper drinking water? Will the peasants get irrigation, manure?
    Education for all? Light? Will the youth from ‘our homes’ get a job?
    Equal opportunities? Will the wheels of historical oppression
    come to an end? An end to discrimination? Prejudiced mentalities?
    Will all problems be solved if a percentage finds employed in software firms?
    Will the closed factories start producing again?
    People like me who have fought their way to privilege,
    do we carry out our duties? Such hullabaloo about caste!
    That Dalit, that OBC, that Yadav, all that discourse with names.
    Young progressive people laugh at it.
    One of them once asked me, is your ‘friend’—
    he was referring to Malay—from that time, a big fan of Manu?
    How could you tolerate him since the sixties?
    Debayudh: Do you have any regrets?
    Debi Roy: Once a friend told me that I made a major mistake in my life.
    He argued that had I passed my masters,
    I would have got a far better job and a lot more time
    to read and write. But people do make mistakes.
    One’s life is defined by his mistakes. There’s no point regretting them.
    Another mistake that I made was not to secure a medical insurance.
    I still haven’t been reimbursed for the heart surgery I had to undergo.
    This is the condition of a central government officer in an independent nation.
    Debayudh: Thank you Debida! That’s all for now.
    It was beautiful getting to know you.
    ------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    Debayudh Chatterjee (b 1991) is pursuing his MPhil at the Department of English, University of Delhi.
    While his dissertation looks at Dalit writing as a ground of contention between caste and class ideologies,
    he takes active interest in the avant-garde, counterculture,
    and 20th century Bengali literature. Apart from being employed
    as a Project Fellow at the department he is affiliated to,
    Chatterjee is a published poet in Bengali, having three titles to his credit.
  • মলয় রায়চৌধুরী | 012312.60.1234.23 | ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ১১:০০541365
  • উপন্যাস : ঔরস
    মলয় রায়চৌধুরী
    জওয়ান : স্যার, দুজন সিভিলিয়ান হিট হয়ে খাদে পড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে ; কানে ইয়ারপ্লাগ লাগিয়ে গান শুনছিল মনে হয়, ট্র্যানসেন্ড বা মোবাইল থেকে, তাই আমাদের আর শত্রুদের ফায়ারিঙের আওয়াজ শুনতে পায়নি ।
    অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাণ্ডান্ট : মোবাইল ? এখানে মোবাইলের কোনো টাওয়ার একশ কিলোমিটারের মধ্যে নেই । যাকগে, যেতে দাও, অমন আনুষঙ্গিক দুর্ঘটনার জন্য আমরা দায়ি নই । বাস্টার্ডগুলো এই অঞ্চলে এসেছিলই বা কেন ! ডিসগাস্টিং ।
    জওয়ান : ওদের বডি কি রিকভার করা হবে ? উওমেন না মেন বুঝতে পারছি না ।
    অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাণ্ডান্ট : তোমার কি মাথা খারাপ ? থাকুক যেখানে পড়ে আছে । আমাদের অপারেশান ক্লোজ হলে স্হানীয় প্রসাশন বা বনবিভাগ গতি করবে ।
    জওয়ান : গ্রাম তো কাছে পিঠে নেই স্যার; দুজনেই জীবিত বলে সন্দেহ হচ্ছে ।
    অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাংণ্ডান্ট : বাজে ব্যাপারে মাথা ঘামিও না । ওটা সিভিল প্রশাসনের মাথাব্যথা ।

    দুই
    আগুনের ঢেউ-তোলা আর ফিনকি-ওড়ানো কয়েকটা জ্বলন্ত খোড়ো চালাঘরের সোনালি আলোয় , চারিদিকে ছিৎরে ছড়ানো লাশের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল ক্রুদ্ধ অপু, পোশাকি নাম অশ্বমেধ ঘোষ, যার বাবা সুশান্ত ঘোষকে অনেককাল আগে কিডন্যাপ করে, দশ লাখ টাকা ফিরৌতি বা র‌্যানসাম না পেয়ে, নিজের চোদ্দ বছরের কচি শ্যামলিমা নিরক্ষর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন তারিণী মণ্ডল, মহানন্দে, ধুমধাম করে, যেভাবে অপরাধ-জগতের ছাতিঠোক অখণ্ডপ্রতাপ বাহুবলি বীরেরা ভাগলপুর আর মাধেপুরা জেলার গঙ্গার চরের দিয়ারায় করে থাকে, করে আসছে বহুকাল যাবত, আর তারিণী মণ্ডল তো অপরাধিদের জগতে ছিল মহাজ্যোতিষ্ক, যার কদমছাঁট হাফটেকো মাথা ঘিরে ভনভন করত দুপুর গঙ্গার ঢেউ-গনগনে চনমনে রোদ, তেল-চুকচুকে সোঁটার পেতলমাথায় ধরা থাকত অমাবস্যার নদী-ছলছলে অন্ধকার । সে সোঁটার অভিজ্ঞতা তারিণী মণ্ডলের চেয়ে পুরোনো, ব্যাপক আর গভীর, কেননা ওটা উনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রে, লাঠিয়াল বাবার কাছ থেকে, যে তার বাবার, সে তার বাবার । তারিণী মণ্ডলের দুঃখ যে ওনার ছেলে নেই, জামাই যদিও ঘরজামাই, তিনি ওসব সোঁটাসুটির প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্রে বিশ্বাস করেন না, আধুনিক পিস্তলও শুধু লুঙ্গির গেঁজেতে গুঁজে রাখেন, কখনও একটু-আধটু চালিয়ে দেখার চেষ্টা করেন না । নাতি অপু বরং ওর বাবার চেয়ে আধুনিক, আজকালকার তেজিয়ান ছোকরা ।
    অপু জানতে পেয়েছিল, বেশ একটু দেরিতেই, আত্মীয়-স্বজন জ্ঞাতিগুষ্টি দলচররা চেষ্টা করেছিল নানা-নানির অপঘাতে মৃত্যুর দুঃসংবাদটা ওর কানে যাতে দেরিতে পৌঁছোয়, যে, দাদু তারিণী মণ্ডল আর দিদিমা মন্হরা দেবী খুন হয়ে গেছে সকালবেলায়, একেবারে ছলনি । রোজকার মতন তেলমাখা লাঠি আর দুজন কালচে-কেঁদো খইনিঠোকা বন্দুকধারী দেহরক্ষীর গাঁট্টাগোট্টা পাহারায়, পটলের লোডিং তদারকি করতে বেরিয়েছিল, ট্রাকে পটলের পঞ্চাশটা বস্তা চালান হবার কথা ছিল ভোরবেলায় ।
    যে ট্রাক আসার কথা ছিল সেই নম্বরের ট্রাকই এসেছিল, বনেটে বজরংবলির গেরুয়া টুনিপতাকা উড়িয়ে, কিন্তু তা থেকে মুখে লাল গামছা বাঁধা চারজন লাফিয়ে নেমে তারিণী মণ্ডলকে লক্ষ করে একনল্লা দুনল্লা একে-সানতালিস চালিয়ে চকাচৌঁধ ধুঁয়াধার অন্ধাধুন ব্রাশফায়ারে ছলনি করে, ট্রাক ফেলে রেখে, ট্রাকের পেছনে যে ছাইরঙা ইনোভা আসছিল, তাতে চেপে দক্ষিণের ভোররাতের গু-শোভিত আর মাটির সোঁদা দেয়ালে ঘুঁটেতে পাঁচ আঙুলের ছাপ-মারা গোবর-সুসজ্জিত কাঁচা রাস্তা ধরে আধাশীতেল অলস কুয়াশার সঙ্গে ধুলো মিশিয়ে উধাও।
    মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল দাদু , বাঁ-চোখের কোটর থেকে নকল সিনথেটিক মণি বেরিয়ে ছিটকে নর্দমায়, আর ডাকসাইটে দিদিমা ওপরমুখো চিৎ ; দেহরক্ষীরা পিছু ধাওয়া করে কাঁধ থেকে একে সানতালিস নামাতে-নামাতেই বেতাহাশা গুলি খেয়ে হাত-পা ছড়িয়ে তারা দুজনেও মোরাম-পথের ওপর ঠ্যাং ছড়িয়ে লালজবজবে-চিৎ, আকাশের দিকে হাঁমুখ, চোখ-খোলা । দিদিমা, মানে নানি, নানিকে নিয়ে বেরোত না নানা সচরাচর । নানির হাঁটুর ব্যাথা সারাবার জন্যে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, যাতে পায়চারি করে জাম হয়ে থাকা হাঁটুর চাকতি আলগা হয় ।

    তিন
    চারজনের রক্ত গড়িয়ে মিশেছে মাছিদের আহ্লাদী জমায়েতে, মাছিরা তাদের এঁদো-পলটন ভাইবেরাদর সবাইকে ডেকে এনেছে, র‌্যালিতে-মিছিলে, যারা ভোরের দিয়ারায় ডোমপাড়ার শুয়োরদের আড্ডায় টাটকা-তাজা গু খেতে বেরিয়েছিল, তারাও তাজা রক্তের সু-বদবুর সংবাদ পেয়ে, হাঁফ-ফুরোনো বাংলা বৈদ্যুতিন মাধ্যমের দামড়া-চোয়াল ভাতচিকন সাংবাদিকের অনুকরণে, কুয়াশাভেজা ঘষাকাচ-ডানা নাচাতে-নাচাতে পৌঁছে গেছে ।
    --হ্যাঁ দীপঙ্করদা-মাছি, ঘটনাস্হলে কী দেখতে পাচ্ছেন ?
    --সুমিতা-মাছিনী, এখানে চারজনকে কে বা কারা খুন করে বডি ফেলে তিনচার দিকে দৌড়ে চলে গেছে বলে জানাচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শী মাছিরা ; ইশে, নিমন্ত্রণ করা হয়েছে বিভিন্ন পাড়ার বিশেষজ্ঞ মাছি-মাছিনীদের । একজন মহিলা কেন খুন হলেন তা ভেবে দেখতে হবে, অ্যাবং খুন হলেও কেন তিনি লজ্জা নিবারণ করতে পারলেন না, তার জন্য সরকারকে জবাবদিহি করতে হতে পারে ।
    --দীপঙ্করদা-মাছি, আপনি কী স্বয়ং স্বাদ নিয়েছেন, রক্তের অ্যাবং গুয়ের ? না নিয়ে থাকলে ঘটনাস্হলে যাঁরা একত্রিত হয়েছেন, তাঁদের দিকে একটু ক্যামেরা প্যান করতে বলুন, আমরা মাছি-দর্শকদের দেখাতে চাই, যাতে মানুষের কাঁচা গু খেয়ে-খেয়ে বিরক্ত দর্শকরাও রক্তের স্বাদ নিতে পারেন ; চার-চার জনের রক্তের স্বাদ কীরকম তা আমাদের গুয়েমাছি চ্যানেলেই প্রথম দেখানো হচ্ছে । অ্যাবং নারীরক্তের স্বাদ সম্পর্কে একটু পরেই স্টুডিওর রাসায়নিক মাছি ও ফরেনসিক মাছিনী তাঁদের মূল্যবান মতামত গু-ঞ্জরিত করবেন ।
    --সুমিতা-মাছিনী, স্টুডিওতে যে গুসেবক অ্যাবং রক্তসেবক মাছিরা বিতর্কে অংশ নিতে এসেছেন, তাঁদের জন্য আরেকবার আমরা ক্যামেরা প্যান করে তারিণী মণ্ডল নামে মানব প্রজাতির জনৈক প্রতিকল্পের ছিৎরে-যাওয়া মগজ দেখাতে চাই ; ইশে, ঘিলুসেবন করার জন্য স্হানীয় নির্বাচনক্ষেত্রের নীলমাছি পৌঁছে গেছেন, তাঁর ভোজন সমাপ্ত হলে স্টুডিওর সঙ্গে যোগাযোগ করব । ইশে, তারিণী মণ্ডলের স্ত্রীর শব দেখাতে পারছি না, কেননা স্তনদ্বয়ে গুলি খেয়ে পড়ার পর তাঁর শাড়ি ওপরে উঠে গিয়ে অকুস্হলের পাকাচুল বেরিয়ে পড়েছে । ইশে, রাজ্য প্রশাসন দেশের প্রগতি দাবি করে অথচ আজ পর্জন্ত অকুস্হলের পাকাচুলের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি ।
    --দীপঙ্করদা-মাছি, দ্রুত সংবাদের জন্য ধন্যবাদ । এতক্ষণ আপনারা ভাগলপুরের দিয়ারা-সম্রাট তারিণী মণ্ডল হত্যার দৃশ্য দেখছিলেন । সময়াভাবে আমরা পৃষ্ঠভূমি সঙ্গীত তৈরি করতে পারিনি । পরবর্তী কোনো হত্যাকাণ্ডে যাতে ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোর দেয়া যায় তার ব্যবস্হা করা হয়েছে । সঙ্গে থাকুন ; রক্তের অ্যাবং গুয়ের স্বাদ উপভোগ করুন ।
    --সুমিতা-মাছিনী : দর্শকগণ, কেউ একজন আমাদের সংবাদ পরিবেশনকে ঠাট্টা করে তার ঔরস উপন্যাসে যা নয় তাই লিখেছে । ল্যাখককে বিশ্বাস করবেন না, কেননা আপনারা ওনাকে দেখতে পাচ্ছেন না, আমাকে স্বচক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা দেখছেন । মনে রাখবেন, যা দেখছেন তা-ই সত্য ।

    চার
    সাড়ে ছ’ফিটের ছিয়াত্তুরে তাগড়া-কালো তারিণী মণ্ডলের টেকো খুলির হাড় গুলিতে ছিৎরে গিয়েছিল, মুখের আদরা চৌচির, টেরিকটের ফিকে-গেরুয়া পাঞ্জাবি রক্তে জবজবে, বুক পকেট থেকে উঁকি মারছে হাজার টাকার গোটাকয় করকরে নোট । ধুতি থেকে বেরিয়ে-থাকা পায়ের গোছের পাকাচুল ঘিরে লতানো ফুলে-ওঠা শিরা । ভারিভরকম মন্হরা দেবী হাঁটবার সময় শাড়ি দুহাতে সামান্য তুলে পা ফেলছিল বলে আচমকা গুলির চোট খেয়ে সম্পূর্ণই তুলে ফেলেছে । মাছিরা তার পাকাচুলশোভিত হাট করে খোলা হাটে বসে কী যে পান করছে তা মাছিগুলোই জানে ।
    অপু ক্লাস বাংক করে বাড়ি এসেছিল দিনকতকের জন্যে । দিল্লির জওয়াহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে, মানে জে এন ইউতে একই সঙ্গে, দিল্লির হবু দেশসেবকদের খাদিয়াল ঢঙে, সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর আর বামপন্হী ছাত্র ইউনিয়ান করছিল । বামপন্হী ছাত্র ইউনিয়ান করার সুবিধা এই যে পরে ইচ্ছেমতন এবং হাওয়া বুঝে ভিনপন্হী বিজয়ী দলে সেঁদিয়ে যাওয়া যায়, ভিনপন্হী হলে বামপন্হীতে ঢোকা একটু কঠিন কেননা ভিনপন্হীদের ছ্যাঁদা বড়ো, বামপন্হীদের ছ্যাঁদা ছোটো । এই করেই দিল্লি-গুড়গাঁওয়ার ছাত্ররা জীবনে এগিয়ে যেতে পারে, জানে ও, দেখেছে আগের ব্যাচের ফেলটু ছাত্ররাও দিল্লির রাজনীতিতে কেমন করেকম্মে টরটরিয়ে টঙে চড়ে গেছে, কোনো চাকরি-বাকরি না করেই ফাঁপিয়ে তুলছে দুদিকের পকেট, ডেনিম-প্যাণ্টের হোক বা খাদিয়াল পাঞ্জাবির, নিজের বা জ্ঞাতিগুষ্টির । ইউনিয়ানের নির্বাচনে টাকা দরকার বলে দাদুর কাছে এসেছিল অপু, ফোমচামড়ার ব্যাগ নিয়ে, কাঁচা টাকা নিয়ে যাবে, যা তারিণী মণ্ডলের তিজোরিতে সব সময়েই থাকে, কেননা দিয়ারার জীবন বেশ ঝুটঝামেলার, দরিন্দগির, লেনদেনের, কখন কী হয় কত টাকা ঝপ করে কার দরকার তার নিশ্চিতি নেই ।
    হাত-পা বাঁধা, গুটকাদেঁতো মুখে লিউকোপ্লাস্ট, বছর তিরিশের ঢাউসভুঁড়ি হুলোচোখ ট্রাক ড্রাইভারটা মার খেয়ে আধজখম হয়ে খড় কাটার যন্ত্রে সবুজ নাইলন দড়ি বাঁধা অবস্হায়, অজ্ঞান হয়ে নেতিয়ে ছিল, প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পাশিদের পাড়ায় তোতারাম পাসওয়ানের মহাত্মা গান্ধি রাষ্ট্রিয় কর্মইয়োজনার টাকা মেরে তৈরি খামারে। ট্রাকচালক বৈসাখি যাদবের কাছ থেকেই তারিণীর সাঙ্গপাঙ্গরা আঁচ করতে পেরেছিল খুনের পেছনে কাদের হাত থাকতে পারে । আররে, বৈসাখি হ্যায় কংসায়তি যাদব, অসলি কৃষ্ণায়ত যাদব নহিঁ হ্যায়,মুহ খোলেগা ক্যায়সে নহিঁ ; ডরপোক কংসায়তি ফাট্টু কঁহিকা ।
    তারিণী মণ্ডলরা, তার নিজের দাবি অনুযায়ী, যখন সে সুশান্ত ঘোষকে অপহরণ করে বন্ধক রেখেছিল, তখন পোড়াটে-কালো বুকে ঘুষি ঠুকে বলেছিল, তার পূর্বপুরুষরা লালেলাল খাঁটি-রক্তের বাঙালি ছিল, তিন-চারশ বছর আগে, আংরেজদের জমানায় । যে পূর্বপুরুষ প্রথম খুন করে মহাঅপরাধীর খেতাব পেয়েছিল, সে শত্রুর জিগর বা হৃদয়ের রক্তে ভেজা পৈতে পরার চল আরম্ভ করলে, হলেই বা নিচু জাত, উত্তরপুরুষরাও প্রথাটা বজায় রেখেছিল, যদিও শত্রুর হৃদয়ের রক্তের বদলে অমাবস্যায় জবাই করা পাঁঠার দিল-কা-খুনে ভেজা পৈতে পরার চল করে গেছে কোনো পূর্বপুরুষ । তারিণী মন্ডলের পৈতেও অমাবস্যার দিন পাঁঠা কেটে জিগরের রক্তে ভিজিয়ে পরানো হয়েছিল । নাতি অপুকেও অমন পৈতে পরাবার চেষ্টা করেছিল তারিণী মন্ডল, জামাইয়ের প্রতিবাদের জন্য সফল হয়নি । জামাই বলেছে, মনে রাখবেন, ও সুশান্ত ঘোষের ছেলে, ঘোষরা যতই খুনোখুনি করুক না কেন, কায়স্হই থাকবে।
    বেবি নামের চোদ্দ বছরের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর মেয়েকে বিয়ে করে, ভাগলপুরের দিয়ারায় থেকে গিয়েছিলেন ছাপোষা বাঙালি বাড়ির কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক চাকুরে যুবক সুশান্ত ঘোষ, প্রথমে রোগাটে বাংগালি জামাই, তারপর দোহারা সুশান্তবাবু নামে, তারপর পেটমোটা গদাইলস্কর জামাইবাবা নামে অপরাধীদের রাজপুত্র হয়ে উঠেছেন গোপালপুরের ফলকিয়া, পরবত্তা, ডিমহা, কেলওয়ারি, তিনহেংগা আর কহলগাঁও-এর অনাদিপুর, আভাপুর আর অঠগম্মা দিয়ারায় ।
    সুশান্ত ঘোষ প্রথম দিকে ফিতেবাঁধা কুকুরবাচ্চার মতন গোমড়া মুখে বোবা সেজে থাকলেও, গ্রাম্য অশিক্ষিত বাংলা জানে না এমন, গংগোতা জাতের চোদ্দ বছরের কচি নিরক্ষর শ্যামলিমা তুলতুলে মাংসের মেয়ের সঙ্গে বাসা বেঁধে ফেলেছিলেন, ঠান্ডা মেঠো দেয়ালের সোঁদা-ছমছমে প্রায়ান্ধকারে, খালি গায়ে, মাদ্রাজি হাফ-লুঙ্গিতে, শাশুড়ির দেয়া কালো কাপড়ের চৌকো তাবিজ গলায় , ছত্রিশ ডিগ্রির বালি-ওড়ানো থমথমে গ্রীষ্মে, এগারো ডিগ্রির কম্বলচাপা হিহি ঠাণ্ডায়, বর্ষার মেঘপাগল ঝোড়ো ঝড়ের টালিভাঙা দাপটে । যখন কিডন্যাপ হয়েছিলেন, তখন দিয়ারার এই এলাকায় বিজলি ছিল না, যাতায়াতের রাস্তা ছিল না, পানীয় জল ছিল না । তারপর ওনার রাজত্ব ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে, স্কুল-কলেজের লিখাপড়হিকে কাজে লাগিয়ে বিজলি সড়ক পানি এনেছেন।
    দিয়ারার লোকেরা মনে করে উনি, সুশান্ত ঘোষ, আড়ালে কলকাঠি নাড়েন । সামনে সবসময় ভঁয়সাবদন কউয়াডোল তারিণী মণ্ডল । যদিও কখনও-কখনও, হয়ত নদীর ওপর বিদ্যুতের কিলবিলে কেউটে রুপোলি খোলোস ছেড়ে ঝাঁপিয়ে-পড়া সন্ধ্যায়, মগজের ব্যাস্টিলে নিজেকে পায়ে চেন-বাঁধা কয়েদির ঢঙে, ভেবে ফ্যালেন, তিনি আসলে একজন মহা-অপরাধীর জামাই, গংগোতা-ডন নামক এক ভয় উদ্রেককারী দুষিত চরিত্রের মানুষ, যে ওই মহাডনত্বে আটকা পড়ে ছটফট করতে পারে, নিজের কারাগার থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারে না । চারিদিকে এত সাঙ্গপাঙ্গের জি-হুজুরি, কচি নিরক্ষর স্নেহদেহ স্ত্রীর নিঃশর্ত আগুনযোনি-ভালোবাসা, শশুরশাশুড়ির অফুরন্ত আদরযত্ন সত্ত্বেও, তিনি নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের বিষে ক্ষয়ে চলেছেন । আসলে তিনি, সুশান্ত ঘোষ, মনে করেন যে এই ক্ষয়-রোগের আনন্দে সুফিসন্তের মতন অজানা ঐশ্বর্যে আলোকিত হয়ে চলেছেন প্রতিদিন।
    যে-সময়ে সুশান্ত ঘোষকে অপহরণ করা হয়েছিল, ভাগলপুরের ষোলোটা ব্লকের ছয়টায় দিয়ারা ছিল , যাদের গঙ্গা দয়া করে ছাড় দেয়ায়, চিকচিকে পলিমাটির চাদরে ঢাকা প্রায়-পাকা চেহারা নিয়েছে সেগুলো । গঙ্গার সুমতি বা দুর্মতি যা-ই হোক, আরও তেরোটা ব্লকে জেগে উঠেছে চর, যাকে লোকে বলে দিয়ারা । এই চরগুলো অনেক সময়ে বেগড়বাঁই করতে-করতে মেটেল জলের তলায় বর্ষায় ডুবকি মেরে লুকিয়ে পড়ে, আবার ফিরে আসে ঝিলিকদার হাসি ফুটিয়ে সারমাটি মাখা মাথা উঁচু করে । নারায়ণপুর, বিহপুর, খারিক, ফুলাউথ, নৌগাছিয়া, ইসমাইলপুর আর গোপালপুরে লোকবসতি জমে উঠেছে জামাইবাবার রাজত্বে ।
    হেমন্তে, ঝিরিঝিরি হাওয়ার আদুরে সুড়সুড়িতে, বালির ছোটোছোটো নাভি ঘিরে আলতো ঘুর্ণিরা দিয়ারাময় খেলে বেড়ায় । সেই হাওয়াই আবার গ্রীষ্মকালে বালির ঘোমটা মাথায় দল বেঁধে দেহাতি বউদের ঢঙে দৌড়োয় চরের ওপর দিয়ে । বসন্তকালের বালি ডেকে আনে পোয়াতি পাখিদের, তাদের খোকা-খুকুকে বাছাই পোকা, ফড়িং, প্রজাপতি খাওয়াবে বলে ।
    জামাইবাবা চোখে কালো রেব্যান চশমা, লাল বা নীল টিশার্ট আর ডেনিম-জিন্স পরে টাটা সুমোতে বা বোলেরোয় তবিয়ত খুশ করার জন্য ভাগলপুর শহর ঘোরেন, তমঞ্চাধারী দেহরক্ষীদের পাহারায় । বাবা-জ্যাঠার বাড়ি যেতে কি ইচ্ছে করে না ওনার ? করে । ছেলে হবার আগে আর পরে সবসুদ্দু পাটনার গর্দানিবাগের বাড়িতে গেছেন সাকুল্যে চারবার, বোলেরোয়, বন্দুকধারী দেহরক্ষী নিয়ে । কিন্তু দিয়ারার হারামখোর মৌজমস্তি আর শোধ-প্রতিশোধের আঘাত-প্রত্যাঘাত আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ তো নেই সেই ছাপোষা বাঙালি জীবনে, বেবি নামের মেঠোগন্ধা সুঠামবুক নধরউরু গাঁইয়া নিরক্ষর চোরাটান বউ নেই, যার আয়ত গোবেচারি চাউনি সেই চোদ্দ বছর বয়সেই আটক থেকে গেছে। বাবা মারা যাবার খবর পেয়ে গিয়েছিলেন বটে, তবে ওনাকে কাঁধ দিতে দেয়া হয়নি, ক্রিমিনাল পরিবারে ছোটো জাতে বিয়ে করে ওনার কাঁধ নিচে নেমে গেছে বলে । ওনার ছেলেকেও কাঁধ দিতে দেয়া হয়নি, তার কাঁধ জারজ বলে আরও তলায় । শোকার্ত বিষণ্ণতার মর্মপীড়া ফর্দাফাঁই করে, ওনার মা ঘোষণা করেছিলেন যে সুশান্তর কুকর্ম সহ্য করতে না পেরেই বাবা মারা গেলেন।
    বাবা মারা যাবার আগে যখন সুশান্ত ঘোষ পাটনার বাড়িতে গিয়েছিলেন, বাড়ির ছোটোবড়ো প্রতিটি সদস্যের জন্য হালআমলের স্মার্টফোন কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন, সিম কার্ড তোমরা যে-যার নিজেদের নামে কিনে নিও, আর যদি চাও তাহলে মাঝে-মাঝে ফোন কোরো । মেজজ্যাঠার নাতনি ইতু ছাড়া, প্রথমে ইতস্তত করলেও সকলেই নিয়ে নিয়েছিলেন, জেঠি-কাকি, ভাই-বউদি, ভাইপো-ভাইজি, এমনকি মা-বাবাও । বাবা মুখ গোমড়া করে বলেছিলেন, ঠিক আছে, টেবিলের ওপর রেখে দে । মা বলেছিলেন, এ তোর খুনোখুনির টাকায় কেনা নয়তো, দেখিস বাবা, তোর পাপের ভাগি করিসনি যেন আমাদের।
    জবাবে সুশান্ত বলেছিলেন, আমি সেখানে কোনো কাজই করি না মা , ঠ্যাং ছড়িয়ে আরাম করি, সারাদিন খবরের কাগজ পড়ি, বাংলাও, টিভি দেখি, ইনটারনেট ঘাঁটি, খাইদাই আর ঘুমোই, যেমন ঘরজামাইরা করে । একটু থেমে, যোগ করেছিলেন, পিঁজরেপোলের ষাঁড়ের মতন ।
    খোশগল্পপ্রিয় বড়জ্যাঠাইমা, প্রায়-ফোকলা হাসিমুখে, তখনই মোবাইলের কাগজ-বাক্স খুলে ফোনটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বলেছিলেন, আমি তোর সঙ্গে প্রায়ই কথা কইব, তুই আমাকে তোর নম্বরটা দিয়ে যা। কথা কইবার টাকা ফুরিয়ে গেলে তোর ওখান থেকে ভরিয়ে দিস । কেউ তো অ্যাদ্দিন কিনে দেয়নি, তুই দিলি ।
    অমিত কোথায়, দেখছি না ? জানতে চেয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ । অমিত ওনার প্রথম যৌবনের বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলে, যাকে শৈশবে ওনাদের গর্দানিবাগের বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন অতনু চক্রবর্তী ও তাঁর সঙ্গিনী মানসী বর্মণ ; তাঁরা জানিয়েছিলেন যে, নওয়াদায়, যেখানে তাঁদের বাস, সেখানে অমিতকে পড়াশোনা করানো সম্ভব নয়, তাঁদের রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে খাপ খাবেনা একটি শিশুর আধুনিক লালন-পালন, বুঝিয়েছিলেন অতনু-মানসী জুটি ।
    --অমিত উচ্চমাধ্যমিক দেবার পর বাড়ি থেকে চলে গেছে, কাউকে কিছু বলে যায়নি । কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল, হাসপাতাল, থানা-পুলিশ করা হয়েছিল, ওর কোনো পাত্তা নেই , বলেছিলেন ইতুর রাঙাকাকা, সুশান্তর ছোটো ভাই, যিনি অমিতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ; ওনার ছেলেপুলে হয়নি বলে বাড়ির সবাই অমিতকে পরিবারের সদস্য করে নিয়েছিল । সুশান্ত যখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিলেন, অকালমৃত ভাই অপাংশুর মেয়ে ইতুর সঙ্গে দেখা করার জন্য, সিঁড়ির বাঁকে অপেক্ষারত রাঙাবউ সুশান্তকে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, অমিত আর ইতুর মাঝে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তিন তলার ছাদে অন্ধকারে গাঁজাপাতা খেয়ে দুজন জড়াজড়ি করছিল, তখন সেজোকর্তা ধরে ফেলেছিলেন । জানাজানি হতে অমিতকে এমন অকথা-কুকথা বলা হয়েছিল যে যেদিন ওর উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল বেরোলো সেদিন রাতেই কাউকে না বলে কোথাও চলে গেছে । তোমার কিডন্যাপ হয়ে চলে যাবার পর এটা এই বাড়ির আরেক মর্মান্তিক অঘটন । বিজ্ঞাপন-ফিজ্ঞাপন, হাসপাতাল-পুলিশের গল্প সব বানানো, বিশ্বাস কোরোনি ।
    মানসী বর্মণ-অতনু চক্রবর্তীর ইচ্ছানুযায়ী, অমিতের পদবি স্কুলে বর্মণ হিসাবে নথি করানো হয়েছিল বলে বাবার সম্পর্কে অবজ্ঞামেশানো চাপা ক্রোধ পুষতো অমিত ।
    সুশান্তর মেজজেঠার নাতনি, অপাংশুর মেয়ে ইতান, অর্থাৎ ইতুর সঙ্গে ওর তিন তলার ছাদের ঘরে দেখা করতে গেলে বলেছিল, কী করব মোবাইল ফোন নিয়ে, আমার কে আছে জগত-সংসারে যার সঙ্গে কথা বলব, সামনা-সামনিই কথা হয় না কারোর সঙ্গে, তো ফোনে কার সঙ্গে কথা কইব, আর দরকার পড়লে বাড়িতে তো ল্যাণ্ডলাইন আছেই ; তুমি কখনও আমাকে ফোন করেছ, যে মোবাইল ফোন দিতে এসেছ বড়ো ।
    অমিত নিরুদ্দেশ হবার পর, ইতু মনে করে, ওর বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে ; ভ্রু কুঁচকে থাকার দরুন কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে, কোমর হয়ে গেছে ভেতো , বয়সের তুলনায় উঁচু বুক। অপাংশুর একমাত্র সন্তান । অপাংশু আর ওর বউ যখন ডাক্তার দেখিয়ে হাতেটানা রিকশা করে কংকরবাগ থেকে ফিরছিল, তখন একটা ট্রাক ওদের রিকশাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে, দুজনকেই চাপা দিয়ে, চলে যায় । ইনশিওরেন্সের টাকা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । সেই থেকে, মনে করে ইতু, একান্নবর্তী পরিবারে ওর জায়গা ক্রমশ নেমে-নেমে ডিলুক্স চাকরানির স্তরে চলে গেছে । বাবা-মা মারা যেতে, এম বি বি এস এক বছর পড়ে ছেড়ে দিতে হয়েছে, কে-ই বা খরচ যোগাবে? বেশ কিছুকাল দুঃখিত ক্রোধে আচ্ছন্ন থাকার পর নিজের প্রগলভা সদালাপী দুঃসাহসী নির্ভীক আন্তরিকতায় ফিরেছে । এম বি বি এস এর বিকল্প হিসাবে, বাবার রেখে যাওয়া সঞ্চয়ে, পড়েছে অলটারনেটিভ মেডিসিন । মানুষের জন্য কিছু করতে হবে, সমাজের জন্য কিছু করতে হবে, দেশের জন্য কিছু করতে হবে, অন্তত অলটারনেটিভ মেডিসিনের মাধ্যমেই করা যাক, ভেবেছিল ইতু ।
    সুশান্ত বেফাঁস বলে ফেলেছিলেন, বিয়ে করলি না কেন ?
    গোখরো সাপের ছোবলের আগে সতর্কবার্তার মতন ইতু বলে উঠল, বিয়ে ? চাইলেই বিয়ে করা যায় নাকি? বাড়ির কেউ কি কখনও চেষ্টা করেছে আমার বিয়ের ? তোমার ভাইরা তোমার ভাইপো-ভাইঝিদের বিয়ে দিয়েছে, তারা যে যার বিয়ে করে সংসার পেতে ফেলেছে, আর প্রায় সকলেই মা-বাপের দায়-দায়িত্ব এড়াবার জন্য এবাড়ি ছেড়ে, নানা অজুহাত দেখিয়ে, পালিয়েছে । তোমার জেঠা-কাকারা নিজের-নিজের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, ব্যাস, সবায়ের সব দায়িত্ব শেষ । সহানুভূতির জন্য টিকে আছে শুধু তিনজন বুড়ি, বটঠাকুমা, মেজঠাকুমা আর তোমার মা, মানে আমাদের অন্নমা, যাঁদের আর তেমন গুরুত্ব দেয় না এই একান্নবর্তী নৌটাংকি পরিবার । এরা এমন যে এদের সুবিধা হবে ভেবে রেলপার বস্তি থেকে একজন বাংলাদেশি বউকে এনেছিলুম রান্নাঘরের পুরো কাজ করার জন্য, থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে, তা তোমার কায়েত পরিবার বামুনগিরি ফলিয়ে বলল যে বাড়ির কাজে মুসলমান চলবে না ।
    --কেন, অলটারনেটিভ মেডিসিন পড়লি, তার একটা দাম তো আছে, কত লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করছিস ।
    --হুঃ, অলটারনেটিভ মেডিসিন । এম বি বি এস কোর্স পুরো করার মতন টাকা খরচ করতে চায়নি তোমার খুড়তুতো-জাঠতুতো ভাইরা, জ্যাঠা-বাবা-কাকারা, তোমার নিজের ভাই রাঙাকাকার কথা তো যত কম বলা যায় ততই ভালো , তাই ওই সস্তার ডাক্তারি পড়তে হল, তাও ডিপ্লোমা, একটা অখদ্দে প্রাইভেট কলেজে । তুমি তো এ-বাড়ির ত্যাজ্যপুত্র, নয়তো তোমার দিকে হাত বাড়াতে পারতুম । কিন্তু তুমি কখনও জানতে চাওনি যে মা-বাপ মরার পর ইতুটা কেমন আছে, কী করছে । আমার বাবা তো আর জেঠাদের মতন মাইনে পেত না, যেটুকু সঞ্চয় রেখে গেছে, তা থেকেই চেম্বার খুলেছি, সাইনবোর্ড টাঙিয়ে, বিহারি ডাক্তারদের মতন বড়ো-বড়ো করে ডাক্তার ইতু ঘোষ লিখে। মাসে একটা কি দুটো রোগি আসত, তাও তাদের পয়সাকড়ি খরচ করার যোগ্যতা নেই বলে আসত ; যারা আসত তারাও অবাক হতো যে আমি কেন রাংতায় মোড়া ট্যাবলেট দিচ্ছি না । খগোলের গরিব বস্তিতে গিয়ে ফোলডিং টেবিল পেতে রোগিদের সেবা করার চেষ্টা করেছি ; তারাও ভাবে ওষুধের বড়ি নেই, ইনজেকশান নেই, এ আবার কেমন ডাক্তার, জড়িবুটি দ্যায়, গা-হাত-পা টেপে, জলে মাথা ডোবাতে বলে । শুধু ভাড়াই গুণে যাচ্ছি । এবার বন্ধ করে দেবো । ভেবেছিলুম যে গরিবদুঃখিদের জন্য অন্তত এইটুকু তো করি, জীবনের একটা উদ্দেশ্য তো হোক । কিছুই হল না । আই অ্যাম জাস্ট এ ফেলিয়র ।
    --কেন, অলটারনেটিভ মেডিসিনের প্রচার তো ভারতের ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্টও করে ।
    --সেই ডাক্তারদের চেম্বারে গিয়েছ কখনও, তাদের তো চেম্বার নয়, বিরাট দপতর থাকে, বাগানবাড়ি থাকে, কয়েকজন লোক খাটে, ওষুধের বিরাট ভাঁড়ার । ব্যবস্হাও ভালো । অলটারনেটিভ মেডিসিন জিনিসটা কী তা জানো ?
    --না । কী ?
    --হাইড্রোথেরাপি, অ্যাকুপাংচার, অ্যারোমাথেরাপি, আয়ুর্বেদ যাকে আমরা বলি হার্বালিজম, হিপনোথেরাপি, রেইকি, ম্যাগনেট থেরাপি, চিরোপ্র্যাকটিক এটসেটরা । একবার কেরলে গিয়ে দেখে এসো , তোমার যা ঝিল্লিদার চর্বি জমছে, ট্রিটমেন্ট করিয়ে এসো । অনেকে হোমিওপ্যাথিও করে , যদি কোর্সটা আলাদা করে পড়া থাকে । আমার সঙ্গে যারা অলটারনেটিভ মেডিসিন পাশ করেছিল তারা প্রায় সবাই ক্লিনিকে বসে অ্যালোপ্যাথিক মেডিসিনকে গুঁড়িয়ে পুরিয়া তৈরি করে রোগিদের রোগ সারাচ্ছে । আমি এখনও, আনফরচুনেটলি, বিবেক নামের ইডিয়সিটা ঝেড়ে ফেলতে পারিনি বলে গরিব মানুষদের ঠকাতে পারছি না। ট্রাই করে যাচ্ছি ।
    --বিয়ে করলি না কেন । অলটারনেটিভ মেডিসিন বাদ দে । এমনি হাউসওয়াইফ ম্যারেজ তো করতে পারতিস ।
    --কে বিয়ে করত আমায় । তোমার মতন গায়ের রং পাইনি । তোমার মায়ের মতন নাক, দিদিদির মতন চোখ, কিছুই তো পাইনি । শুধু একরাশ চুল পেয়েছি আমার মায়ের মতন । চুল দেখে কে-ই বা বিয়ে করে আজকাল ? লাখ দশেক টাকা ছড়ালে হয়তো দুচারটে কাক-চিলকে ফাঁসানো যেত । তা কে করবে ? তোমাকে যখন কিডন্যাপ করেছিল তখন তোমার শশুরবাড়ির লোকেরা দশ লাখ টাকা চেয়েছিল । দিতে পারেনি তোমার বাবা-জেঠারা । সবাই মিলে হয়ত যোগাড় করতে পারত টাকাটা, কিন্তু এ-বাড়ি হল মানসিক দারিদ্র্যে সমৃদ্ধ।
    --তুই কি কাউকে বিয়ে করতে চাইছিলি ?
    --বিয়ে করতে চাইলেই তো আর তাকে বিয়ে করা যায় না । পাত্র যদি বাপের পদবির বদলে তার মায়ের পদবি নিয়ে জন্মায়, যদি সেই পাত্রের মা তার বাবার নয়, অন্য কারোর বউ হয়, যদি সেই পাত্রকে তার মা-বাপ অনাগ্রহী এক দম্পতির কোলে ফেলে দিয়ে কেটে পড়ে, তাহলে সেই পাত্রকে কোন চোখে দেখা হয় জানো ? কুলের কলঙ্ক । আমি সেরকম এক পাত্রকে পছন্দ করেছিলুম, কিন্তু বাড়ির গুরুজনদের মতে, যদিও তারা পষ্টাপষ্টি সেকথা বলেনি, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছে যে অমন পাত্র এই বাড়ির সম্মানের উপযুক্ত নয় । তোমাকেই এরা আজ পর্যন্ত স্বীকার করতে পারল না তো যার বাবা-মায়ের সম্পর্ক সন্দেহজনক তাকে স্বীকার করবে কী ভাবে ? তোমারই তো নিকট বন্ধু ছিল অতনু চক্রবর্তী আর তোমার এককালের সহকর্মী ছিল মানসী বর্মণ । মানসী বর্মণ নাকি অতনু চক্রবর্তীর চেয়ে দশ বছর বড়ো, আর তাঁরা লিভ টুগেদার করতেন, মানসী বর্মণ আর অতনু চক্রবর্তী নাকি মানসীর স্বামীর সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতেন । তাতে তাদের ছেলে কী দোষ করল ? আর যদি তোমরা এতই রক্ষণশীল ছিলে তো শিশুটাকে এবাড়িতে রেখে মানুষ করবারই বা কী দরকার ছিল ? ওনারা কোথায় থাকেন তাও এবাড়ির কেউ জানে না, জানবার চেষ্টা করেনি । তোমার তো বন্ধু ছিল ওরা, এই অতনু-মানসী জুটিকে কেমন দেখতে বলোতো ? কেমনতর রাক্ষস-রাক্ষসী যে নিজেদের বাচ্চাকে অন্যের কোলে চাপিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে?
    --কেন, রাঙা আর রাঙাবউ তো অমিতকে নিজের ছেলের মতনই মানুষ করেছে বলে জানি ।
    --কিছুই জানো না । তোমার মায়ের পেটের ভাই, সে তোমার বিপরীত । অমিতকে দত্তক তো আর নেয়নি; এমনিই কোলে নিয়েছিল । আর তারপরেও বাচ্চা হবার জন্য আইভিএফ করাতে কলকাতা দৌড়োতো । কতবার যে সে আইভিএফ ফেল করল আর প্রতিবার লাখ খানেক করে গচ্চা গেল, তার কোনো হিসেব আছে ? ওই টাকায় ওরা অমিতকে ভালো স্কুলে পড়াতে পারত । ওই যে বলে না, দাঁত নেই, চলেছে বিষকামড় দিতে, রাঙাকাকার অবস্হা তেমনই । আইভিএফ করালে সে বাচ্চাটা রাঙাকাকার হতো না, অন্য কারোর হতো, তাতেও আপত্তি নেই, অবশ্য দেখতে-শুনতে ভালো হতো, ফর্সা ঢ্যাঙা ডোনারের বীজ নিলে ।
    --আর গাঁজাটাজা খাস না তো ? কন্ঠস্বর নামিয়ে জানতে চেয়েছিলেন সুশান্ত, প্রশ্রয়দানকারী জেঠামশায়ের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টায় ।
    দীর্ঘ চুলের ঝাপট বুক থেকে পিঠে উড়িয়ে, উঁচু গলায় ইতুর জবাব, ওঃ, তোমাকে জানানো হয়ে গেছে, তোমারও দেখছি এজেন্ট রয়েছে এ-বাড়িতে । তারপর যোগ করেছিল, কলেজে পড়ার সময়ে মারিহুয়ানা ফোঁকেনি, এমন ছাত্রছাত্রী তোমাদের জুরাসিক যুগে ছিল, তোমার ছেলেও হয়ত খায় বা খেয়েছে, জিগ্যেস করে দেখো । কলেজ তো বহুদিন ছেড়েচি, মৌজমস্তি করার টাকাকড়ি কোথায়, যে ওসবে ইনডালজ করব ? বিরক্তি ধরে গেছে জীবনে, কিচ্ছু ভাল্লাগে না । আমার আইডেনটিটি কী ? গ্যাসভরা ফানুস !
    --কবে চলে গেছে অমিত ? সুশান্ত সরাসরি প্রশ্ন তুললেন, যে ভাবে উকিলরা সাক্ষীদের প্রশ্ন করে ।
    --চার বছরের বেশি । কে জানে বেঁচে আছে কি না । অপমানে হয়ত আত্মহত্যা করে থাকবে । প্রায় ফুঁপিয়ে ফেলেছিল ইতু, সামলে নিল ।
    সুশান্ত বললেন, মোবাইলটা নে, মন খারাপ হলে আমার সঙ্গে কথা বলিস । তোকে দেখতে যথেষ্ট ভালো ; কলেজে তোর ছেলে-বন্ধুরাই এককালে লাইন মারত বলে শুনেছি । তুই-ই কাউকে প্রশ্রয় দিসনি, এখন বুঝতে পারলুম যে তার কারণ অমিত বর্মণ ।
    সুশান্তকে স্তম্ভিত করে ইতু বলল, তুমি আমাকে কিডন্যাপ করিয়ে দাও না, তোমার ওখানকার কারোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিও, সুখে ঘর করব, কথা দিচ্ছি, সিরিয়াসলি বলছি, তুমি আমাকে কিডন্যাপ করিয়ে নাও, কবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে বল, সেই মতো অপেক্ষা করব । জীবনটা তো জীবনের মতন হয়ে উঠুক । একটা উদ্দেশ্য তো হোক বেঁচে থাকার । তুমি জানো , তথাকথিত এই একান্নবর্তী পরিবারে আমি সবচেয়ে বেশি বোল্ড, যা ভালো বুঝি তা-ই করি, সব্বাই কাওয়ার্ড, ইনক্লুডিং অমিত । মেজমাসির মেয়ে ফুলকিও বোল্ডনেস দেখালো । জানো তো ফুলকি বাচ্চা হবার পর ওর বরকে ডিভোর্স দিয়ে আবার সেই বরের কাছেই ফিরে গেছে, বাচ্চাও হয়েছে । আসলে পারপাস, জীবনের একটা পারপাস চাই, অভিমুখ চাই ।
    --আমার দিয়ারার গাঁয়ের যে কোনো যুবক তোকে বিয়ে করতে চাইবে, সম্রাজ্ঞী বানিয়ে রাখবে, কিন্তু বিয়ে করতে পারে এমন কেউ তোর বয়সী তো নেই । ওখানে ছেলেদের ছোটোবেলাতেই বিয়ে হয়ে যায় ।
    --তাতে কি । কম বয়সী বরও তো হয় অনেকের, কিংবা আমি কারোর দ্বিতীয় বউ হয়ে থাকব, সুখে-শান্তিতে তো থাকব, কারোর সংসারের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে, বেঁচে থাকার পারপাস তো হবে । আমার মাথার ভেতরে একজন ল্যাংটো ইতুকে তো শান্তি দিতে পারব । আমার কি সাধ-আহ্লাদ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই ? প্রেমিককে চুমু খাওয়াও এরা সহ্য করতে পারে না, কেননা তাদের মতে সে প্রেমিক সম্ভবত বেজন্মা ।
    --কী বলছিস জানিস ? আমার ছেলেকেও একই সঙ্গে গালাগাল দিচ্ছিস ।
    --হ্যাঁ, এরা তো তা-ই মনে করে । তোমার ছেলের তো এ-বাড়িতে প্রবেশ নিষিদ্ধ । জানি না তুমি কেন আত্মসম্মান খোয়াবার জন্য যেচে এসেছ ।
    --সকলের জন্য মাঝে-মাঝে মনকেমন করে রে ।
    --এ-বাড়িতে আমি তো একজন শ্রদ্ধেয় চাকরানি, গ্লোরিফায়েড মেইড । সুশান্তকে উত্তরহীন বসে থাকতে দেখে ইতু বলল, দেখলে তো, সমাধান কারোর কাছে নেই, সবাই কেবল উপদেশ ঝাড়ে । তোমার বউকেই এরা আসতে দিতে চায় না এমন কনজারভেটিভের এঁটো-খাওয়া বংশ । কোন জগতে তুমি বাস করো গো ? এখনও মনকেমন টাইপ আবেগে ভোগো !
    মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে ইতু বলেছিল, সিমকার্ড কেনার টাকা দিয়ে যাও, আর মাঝে-মাঝে তোমার ওখান থেকেই রিচার্জ করিয়ে দিও । জানি এতে অনেক খেলা-টেলা থাকে, তাই করেই টাইমপাস করব, আমাদের বাড়ির কাজের বউয়েরও মোবাইল আছে যখন , আমি তো বললুম তোমাকে, আমি হলুম গ্লোরিফায়েড খাওয়াপরার মেয়ে, চব্বিশ ঘণ্টার।
    সুশান্তর প্রায়-ফোকলা বড়জ্যাঠাইমা অবশ্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন, নিয়ে আয় না তোর বউকে, কি হয়েছে, আমরা তো সবাই তোর বউয়ের ভাষায় কথা বলতে পারি । মোবাইলে বড়জেঠিই সুশান্তর সঙ্গে প্রথম কথা বলা আরম্ভ করেছিলেন, তখন উনি জামশেদপুরে ছেলের কাছে, হাসপাতাল থেকে ফোন করতেন । বড়জ্যাঠাইমার বড়ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে বদলি নিয়ে বউ-ছেলে-মেয়েসহ চলে গেছে জামশেদপুর । বড়জ্যাঠাইমা গিয়েছিলেন কিন্তু ছেলের বাড়িতে ওঠেননি, ওনাকে ছেলের বউ ফ্ল্যাটের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি । যে তিন মাস জামশেদপুরে ছিলেন সে তিন মাস ছেলে ওনাকে এক হাসপাতালের শীতাতপ আরামে ভর্তি করে দিয়েছিল ; প্রতিদিন সকাল বিকাল গিয়ে দেখা করত ; দুয়েকবার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল মার সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে তোলার জন্য । হাসপাতালের স্বাস্হ্যকর খাবার খেয়ে সুশান্তর জেঠির চেহারার খোলতাই হয়ে গিয়েছিল । ছেলের বউ চেয়েছিল যে তার বুড়ি বিধবা মা, একা, চোখে ভালো দেখতে পান না, থাকুন পাটনায় ছেলের বাড়িতে ; তাতে সুশান্তর বাবা-কাকা-জেঠারা রাজি হননি । এসব ঝুটঝামেলা এড়াতে বড়জ্যাঠাইমার ছেলে বদলি নিয়ে পালিয়েছে জামশেদপুর । ছোটোছেলে আমেরিকায় পড়তে গিয়ে আর ফেরেনি ; ওখানের চিনা মেয়েকে বিয়ে করে থেকে গেছে, দুই মেয়ের চিনাভাষায় নাম রেখেছে ।
    সুশান্তর বাবা কখনও ফোন করেননি ওঁকে । ইতু ফোন করে জানিয়েছিল যে সুশান্তর মায়ের মোবাইলটার প্যাকিঙই খোলা হয়নি । যেখানে সুশান্ত রেখে গিয়েছিল ড্রইংরুমের সেই সাইড টেবিলেই ধুলোর ওপর পড়ে আছে । কাজের বউ সৌদামিনীও ঝাড়পোঁছ করার সময়ে তাতে হাত দেয় না ।
    তারপর সুশান্ত ঘোষের বাবা মারা গেলেন । হয়ত উনিও ফোনটা ব্যবহার করেননি ।

    পাঁচ
    পুড়তে-থাকা কুঁড়েঘরগুলোর মাঝে দাঁড়িয়ে, এ কে সানতালিস রাইফেলটা হাতে নিয়ে, সিলভারব্যাক গোরিলার ঢঙে বুক চাপড়ে, রগ বয়ে যৌবন-প্রাপ্তির মস্তির রস ঝরানো যুবক হাতির মতন, অপুর, অশ্বমেধ ঘোষ-এর, কন্ঠস্বর থেকে যে চিৎকার বেরিয়ে এলো তাকে বৃংহনের সঙ্গেই তুলনা করা যায় । তার কারণ অপু ক্রোধেও গালাগাল দিতে পারে না, দিতে না-পারার অতিরিক্ত আক্ষেপে ক্রোধ মাথায় উঠে যায় ; সে-উক্তিগুলো ওর সাঙ্গপাঙ্গরাই করছিল ।

    ছয়
    বাবা-মার জন্য স্মৃতির জারকে আচ্ছন্ন সুশান্তর মনকেমন করে মাঝেসাঝে, তখন গ্যাঁজানো তরমুজের চোলাই-করা সোমরস নিয়ে বসেন, সঙ্গে শুয়োরের মাংসের বড়া , আদা-রসুন-পেঁয়াজবাটা আর বেসন মাখা, হামান দিস্তায় থেঁতো করা মাংসের বড়া, সাদা তেলে যা রাঁধতে ওনার বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউয়ের ভারিভরকম মায়ের জুড়ি নেই । ওনার ছেলে অপু , যদিও বাংলা বলতে পারে, কিন্তু মাকে শুনিয়ে হিন্দিতেই বলে, হাঁ পিজিয়ে পিজিয়ে অওর গম গলত কিজিয়ে ; আরে অগর আপকা দিল নহিঁ লগতা থা তো ভাগ কেঁও নহিঁ গয়ে থে ? য়ঁহাসে নিকলকে ভাগলপুর স্টেশন, অওর ওঁয়াহাসে সিধে পটনা, স্টেশন ভি ঘর কে নজদিক । পর আপ নহিঁ ভাগে । লগতা হ্যায় আপকো অপনে বিবি সে জ্যাদা প্যার অপনে সসুর সে হ্যায় । বিবি কহিঁ ভি মিল জাতি, মগর তারিণী মণ্ডলকে তরহ মকখনভরা পহাড় নহিঁ মিলতা, য়হি হ্যায় না আপকা গম ?
    তারিণী মণ্ডলের হাঁটু-ডিংডং স্ত্রী, ফোকলা গুটকাদেঁতো হাসি হেসে নিজের মহিষ-কালো বরকে খুসুরফুসুর কন্ঠে বলেন, দোগলা হ্যায় না আপকা পোতা, ইসিলিয়ে বহুত দিমাগ রখতা হ্যায় । সাধারণ জারজ নয়, বাঙালি-বিহারি, উঁচুজাত-নিচুজাত, পড়াশোনাঅলা- মুখ্খু, শহুরে-গাঁইয়া, গরিব-মালদার, কানুনি-গয়েরকানুনি, কলমচি-খেতিহর, কত রকমের মিশেল ।
    --আরে মাথা তো খাটিয়েছিলুম আমি ছোঁড়াটাকে বন্ধক বানিয়ে, ঘরজামাইও পেলুম, আবার নসলও ভালো হয়ে গেল । এখন কয়েক পুরুষ চকচকে ফর্সা বাচ্চা পাবি ; অপুর মেয়েদের বিয়ে দিতে বেশি অসুবিধা হবে না। জামাইবাবার মেয়ে না হওয়াই ভালো, কী বল ? বলল তারিণী মণ্ডল, ডান চোখে হাসি মেলে । যখন সুশান্ত ঘোষকে কিডন্যাপ করেছিল, তখন অবশ্য দুটো চোখই ছিল,বাঁ চোখটা নষ্ট হয়নি রামধারী ধানুকের হামলায় ।
    --সে কথা ঠিক । আমি তি ভেবেছিলুম ছোঁড়াটা পালিয়ে যাবে ।
    --আমার মেয়ের সঙ্গে রাত কাটিয়ে পালিয়ে গেলেই হল ? ধরে এনে কেটে টুকরো করে দিয়ারার বালিতে পুঁতে দিতুম ।
    --ছোঁড়াটা ভালোবেসে ফেলেছে ওর গালফোলা বউকে । শোবার সময় রোজ রাতে খুশবুর টিন থেকে গ্যাস মারে তোমার মেয়ের গায়ে, দ্যাখো না কেমন গন্ধ ভুরভুর করে বেবির গা থেকে, মনে হয় চবুতরা জুড়ে ফুলের গাছ ? ভৌঁরাভৌঁরি জোড়ি ।
    --তাজ্জব ব্যাপার, না ? বকের সঙ্গে কোকিলের বিয়ে !
    --তাজ্জবের কি আছে । এরকম কচি কুচুরমুচুর মেয়ের সঙ্গে কি ওর বিয়ে হতো ওদের নিজেদের সমাজে ? কোনো দরকচা হেলাফেলা টিড্ডিছাপ বউ পেতো ।
    --কি যা তা বকছিস নিজের মেয়ের সম্পর্কে ।
    --সত্যি কথাটাই বলছি । নিজের বিয়ের কথা মনে করে দ্যাখো । তুমিও কচি কুচুরমুচুরই পেয়েছিলে । ওই কুচুরমুচুর জিনিসটাই হল মেয়েদের দুসরা দিল, যা মরদদের থাকে না । দ্বিতীয় হৃদয়ে রক্ত থাকে না, থাকে রসালো মাদকের ফাঁদ, যে ফাঁদে একবার পড়লে রোজ-রোজ পড়ার নেশায় মরদরা ভোগে, যতদিন সে মরদ থাকে ততদিন তো ভোগেই ।
    --তা ঠিক, ছিলিস ছাপ্পানছুরি-ছইলছবিলি । এটা কোনো টিভি সিরিয়ালের সংলাপ বললি নাকি ? ছোঁড়াটা নাকি প্রথম রাতেই রক্তারক্তি করে ফেলেছিল ?
    --হ্যাঁ । বেচারা । গলার শেকল খুলে-দেয়া শহুরে রামছাগল । কত দিনের বদবুদার তবিয়ত ।
    --ওদের বিয়ে দিতে এত দেরি করে কেন জানি না । কম বয়সের টাটকাতাজা রস সব বেকার বয়ে চলে যায় ।
    --দেরি করে বলেই তো পেলে ছোঁড়াটাকে ।
    তা নয় ; কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক সুশান্ত ঘোষ হয়ে গেছেন দিয়ারাচরিত্রের উন্মূল মানুষ । যখন নোট গোণার চাকরি করতেন, তখন বিহারি জোতদার পরিবারের যুবকদের মতন, রাজপুত ভূমিহার কুরমি যারা, কিংবা ব্রাহ্মণ কায়স্হ বিহারি আমলার শহুরে ছেলেদের ধাঁচে, অফিসে প্রতি ঋতুতে হালফ্যাশান আনতেন। ব্র্যাণ্ডেড জ্যাকেট জিন্স টিশার্ট উইন্ডচিটার । দপতরের গৃহবধু কর্মীদের চোখে সুশান্ত ঘোষ ছিলেন অবিনশ্বর জাদুখোকোন, লিচুকুসুম, মাগ-ভাতারের অচলায়তনের ফাটল দিয়ে দেখা মুক্ত দুনিয়ার লালটুশ । গেঁজিয়ে যেতে পারতেন, চোখে চোখ রেখে, ননস্টপ, যেন বাজে বকার মধ্যেই পালটে যাচ্ছেন পৌরাণিক কিন্নরে, সবায়ের অজান্তে । গায়কের ইশারায় যেভাবে ধ্বনিপরম্পরা টের পায় তবলাবাদকের আঙুলের ছান্দসিক অস্হিরতা, তেমনই, নৈশভোজে বেরোনো শীতঘুম-ভাঙা টিকটিকি যুবকের মতন, মহিলা সহকর্মীদের অবান্তর কথাবার্তা, ভোজপুরি বা হিন্দি বা বাংলায় বা ইংরেজিতে, বলার জন্যই বলা, শ্বাসছোঁয়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে গিলতেন সুশান্ত ঘোষ ।
    এখন আর ওনার, সুশান্ত ঘোষের সম্পর্কে, আগাম বলা যায় না কিছু । চাকরি করতেন পচা টাকার নোট জ্বালিয়ে নষ্ট করার । এখন কাঁচা টাকার করকরে আরামে ঠ্যাং তুলে খালি গায়ে, ভুঁড়ির তলায় চেককাটা লুঙ্গি পরে, লুঙ্গির গেঁজেতে সেমিঅটোমেটিক পিস্তল, যা জীবনে কখনও চালাননি, শাশুড়ির পরানো কালো কাপড়ের ছোট্ট তাবিজ গলায় , নিজেকে অন্যমানুষে পালটে ফেলার আনন্দে তরমুজ-সোমরসের হেঁচকি তোলেন। যা একখানা চেহারা করেছেন, ওনার স্তাবকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময়ে ওনাকে বলে গেণ্ডা-মরদ অর্থাৎ আলফা গণ্ডার ।
    প্রতি রাতে শোবার আগে বিবসনা বউয়ের আগাপাশতলা বডি ডেওডোরেন্ট স্প্রে করেন সুশান্ত ঘোষ বা গেণ্ডা-মরদ, মানে আলফা গণ্ডার । এমন নয় যে বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউয়ের গায়ে দুর্গন্ধ ; প্রথম রাতেই সুশান্ত ঘোষ একটা স্যান্ডালউড সাবান কিনে বলে দিয়েছিলেন যে রোজ এই সাবান মেখে স্নান করতে হবে, সপ্তাহে একদিন শাম্পু করতে হবে । বউই আসক্ত হয়ে গেছে ডেওডোরেণ্টের, শ্যাম্পুর, লিপগ্লসের, লিপস্টিকের, ফেয়ার অ্যাণ্ড লাভলির, কমপ্যাক্ট পাউডারের, ওলে টোটাল এফেক্টের, নখপালিশের, পিচ-মিল্ক ময়েশ্চারাইজার আর নানা আঙ্গিকের শিশি-বোতল-কৌটোর-ডিবের সুগন্ধের নেশায় ।
    শহুরে দশলাখিয়া বরকে বশ করার জন্য, টিভিসুন্দরীরা যা মাখে, তা মেখে কৃষ্ণাঙ্গী-অপ্সরা হবার প্রয়াস করে বেবি, সুশান্ত ঘোষের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর শ্যামলিমা চির-তুলতুলে বউ, আর সুশান্তর শাশুড়ি বশ করার মন্ত্রপূত তাবিজ পরিয়ে জামাইকে বেঁধে রেখেছেন বেবির আপাত-বেবিত্বে ।
    কোনো রাতে মাতাল অবস্হায় সুশান্ত ঘুমিয়ে পড়লে, মাঝরাতে বউ ওনাকে ঠেলে জাগিয়ে দিয়ে বলে, উঠিয়ে না, নিন্দ নহিঁ আ রহল , জরা গ্যাস মার দিজিয়ে না । হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে রাখা একাধিক ডেওডোরেন্টের স্প্রে থেকে যেটা হাতে পান বউয়ের পোশাকহীন গায়ে সুগন্ধী বর্ষা ছিটিয়ে এক খেপ দ্রূত-প্রেম সেরে ফেলে দুজনে দুপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন । অনেক সময়ে বেবি নামের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বউ আগেই হুশিয়ারি দিয়ে রাখে, জল্দিবাজি মত কিজিয়ে, ধিরজ সে কিজিয়ে, বুডঢি নহিঁ না হো গয়ে হ্যাঁয় হম ।
    ডেস্কটপের মনিটারে , বেবি নামের মেঠোগন্ধা শ্যামলিমা বউকে, পর্নো ফিল্ম দেখিয়ে আরো বিপদ ডেকে এনেছেন নিজের । বেবি বলে, ফিলিম মেঁ জইসন কর রহা হ্যায় ওইসন কিজিয়ে না, উঠাইয়ে, লেটাইয়ে, গিরাইয়ে, গিরিয়ে, পটক দিজিয়ে, সাঁস ফুলাইয়ে, মুহ সে প্যার কিজিয়ে, হমকো ভি মৌকা দিজিয়ে । কেতনা দের তক ভোগ করতা হ্যায়, অওর আপ হ্যাঁয় কি কবুতরকে তরহ ঝপট লিয়ে বস সো গয়ে । শুন রহেঁ হ্যাঁয় নাআআআআআ । তারপর বলে, দেখেছেন তো ওরা কেউ পৈতে পরে না ; আপনি যদি পৈতে পরতেন তাহলে সুতোর লচ্ছা সামলাতেই আমাদের সময় চলে যেত , ভালো করেছেন পৈতে পরা বন্ধ করে ।
    ঘুমনেশার ঘোরে সুশান্ত বলেন, আরে ওরা সব সাহেব-মেম কিংবা হাবশি, কুমিরের মাংস, বনমানুষের মাংস, ঘোড়ার মাংস, হাতির মাংস খায়, গাধার মাংস খায় ।
    --হাঁ, সে-কথা ঠিক, হাতিদের মতন ; হাতিরা কেমন নিজেদের গোমোরের জিনিসকে লটকিয়ে হাঁটে, মাটিতে ছুঁয়ে যায়। আপনি অপুকে বিলেতে পড়াশুনা করতে পাঠাতে চাইছেন ; সেখানে গিয়ে ও যদি মেম বিয়ে করে তাহলে তো সঙ্গত দিতে-দিতে হালকান হয়ে যাবে ! বিয়ে দিয়ে পাঠাতে পারতেন ; ওর বউ থাকত দিয়ারায় আমাদের সঙ্গে ।
    --ওখানে বিয়ে করার দরকার হয় না ; না করেই একসঙ্গে থাকা যায় । সঙ্গত মনের মতন না হলে আরেকজনের কাছে চলে যাওয়া যায়, বুঝলি ?
    --তাহলে তো ভালোই, মন ভরে গেলে বাড়ি ফিরে আসবে ; তখন ওর বিয়ে দেবেন ।
    অপুর মা, সুশান্তর মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বউ, পর-পর কয়েকদিন মাঝ রাতে ঘুম ভাঙাবার পর বলে ফ্যালে, চাহিয়ে তো এক বংগালন বিবি শাদি করকে লাইয়ে না পটনা য়া কলকত্তা সে, সাহব-মেম খেলিয়েগা দোনো মিলকর, জইসন নঙ্গা-ফিলিম মেঁ দিখাতা হ্যায়, কেতনা মছলি পকড়া যাতা হ্যায় অপনে হি নদী মেঁ, বড়কা-বড়কা রোহু । ঘরকা বনা মিঠাই খাতে হম লোগ সব । আপ চখতে বংগালন বিবি কি মিঠি চুচি । হমরে বিছওনে মেঁ হি, লগাকে মচ্ছরদানি, পিলাসটিকবালা গুলাবি মচ্ছরদানি । নহিঁ তো কলকত্তা যাইয়ে না, বংগালন রণ্ডিলোগন কা বাজার নহিঁ হ্যায় ওয়াহাঁ কাআআআআআআ ? কমর হিলাকে আইয়ে, অইসন দুখি-দুখি মত রহিয়ে, অওর দারু মে মত ডুবে রহিয়ে রাত ভর ; দারু পিকে আপ একদম সঠিয়া যাতে হ্যাঁয় । দিন মেঁ পিজিয়ে দারু, কৌনো মনা কিয়া হ্যায় কাআআআআ ? রতিয়া কে বখত বদনওয়া ফিরি রখিয়ে জি ।
    বারবার শুনে বিরক্ত সুশান্ত একদিন বলেছিলেন, ঠিক আছে, নিয়ে আসবো একজন লেখাপড়া-শেখা বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে । নাছোড়বান্দা বেবি, যাকে বলা যায় তৎক্ষণাত, প্রত্যুত্তর দিয়েছিল, নিয়ে এসে দেখুন না, আপনার আর আপনার বাঙালি বউয়ের মাথা, সেই দিনই হাসুয়া দিয়ে ধড় থেকে নামিয়ে দেবো ; জানেন তো আমি তারিণী মণ্ডলের মেয়ে ।
    --হ্যাঁ, জানি, তুই প্রথমে তারিণী মন্ডলের মেয়ে, তারপর আমার বউ । ধড়টা তো তোকে দিয়েই দিয়েছি, আর আলাদা করে নিয়ে কী করবি ? আর মুণ্ডুও অনেকসময়ে তোর উরুর ঝক্কি সামলায় ।
    --খারাপ লাগল শুনে ? তাহলে মাফ করে দিন । আমি বেবি ঘোষ, আপনিও জানেন, আমিও জানি, ভোটার লিস্টে দেখে নেবেন, আমি তো লিখাপড়হি জানি না, কিন্তু বেবি ঘোষই লেখা আছে আমার ফোটুর পাশে, ভোট দিতে গিয়ে জানতে পেরেছি । আমি বেবি মণ্ডল নই । আমার ছেলেও মণ্ডল নয় । আর বলব না, মাফ করেছেন কি না ? আঁয় ?
    --করে দিলুম । এখন যা । দরকার হলে ডেকে নেবো ।
    --দাঁড়ান চান করে আসি, তারপর । ভিজে-ভিজে শরীরে আপনি যখন ফোঁটায় ফোঁটায় গুটিপোকা ফ্যালেন তবিয়ত এতো মগন হয়, গুটিপোকাগুলো সব ভেতরে গিয়ে নানা রঙের প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায় ।
    --এই জন্যই তো থেকে গেলুম ; যখন বলি তখনই তুই তৈরি, ঘুম থেকে উঠে হোক, দুপুর হোক, সন্ধ্যা হোক, মাঝ রাত হোক ।
    --রান্না চাপিয়ে গ্যাস নিভিয়েও তো কতবার এসেছি আপনার গুটিপোকাদের ফোঁটা নিয়ে প্রজাপতি ওড়াবো বলে। ভাগ্যিস আপনাকে পেয়েছি, কোনো গংগোতা বর হলে তো যৌবন নষ্ট হয়ে যেত বছর-বছর বাচ্চা পয়দা করে ।
    দিয়ারা, দ্বীপের মতন চর, জেগে ওঠে, জলপ্রবাহকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে বছরের পর বছর, জামাইবাবার মতন, বেগুসরায় মুঙ্গের থেকে গঙ্গা নদীর কিনার বরাবর, ভাগলপুর কাটিহার অব্দি ; এক জায়গায় ডুবে আরেক জায়গায় কুমিরের মতন জেগে ওঠে, খেলা করে অজস্র মানুষের সুখ-শান্তি নিয়ে, তাদের দুর্ধর্ষ ক্রুর মমতাহীন আতঙ্কিত উদ্বিগ্ন করে রাখে আজীবন, ভালা বরছি গাঁড়াসা ভোজালি পাইপগান কাট্টা তামাঞ্চা একনল্লা দুনল্লা একে-সানতালিস একে-ছপ্পন দিয়ে ।
    আচমকা যদি কখনও ওনার, সুশান্ত ঘোষের, মগজে ঘুমিয়ে থাকা লোকটা ধড়মড় করে উঠে বসে জানতে চায় যে, ওহে খোকা, তুমি কি ছিলে আর কি হয়ে গেলে, তখন ছিপি খুলে গুড়ে চোলাইকরা তরমুজের সোমরসের বোতল নিয়ে বসেন, আর নিজেকে বলেন, ইতু জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে চলেছে, আমার উদ্দেশ্য আমাকে খুঁজতে হয়নি। উদ্দেশ্যই আমাকে খুঁজে নিয়েছে । আমারও কী আত্মপরিচয় আছে ? কী ? আমি তারিণী মণ্ডলের জামাই, বেবির স্বামী, গংগোতা ক্ল্যানের ডনের অভিনেতা ! আমি কে ? আমি, যার নাম সুশান্ত ঘোষ ? আই অ্যাম নাথিং ।
    ল্যাপটপে বা স্মার্টফোনে লোডকরা ওনার প্রিয় গান শোনেন, বারবার, বারবার, দিল ঢুণ্ডতা হ্যায় ফির ওয়হি ফুরসতকে রাতদিন, ব্যায়ঠে রহে তসব্বুর-এ-জানা কিয়ে হুয়ে, দিল ঢুণ্ডতা হ্যায় ফির ওয়হি ফুরসতকে রাতদিন...। শুনতে পান, বেবি বলছে, এরকম দুখি-দুখি গান শুনছেন কেন, অন্য গানটা শুনুন না, দো দিওয়ানে শহর মেঁ, রাত মেঁ য়া দোপহর মেঁ...। ঠিক আছে, শোন, জিন্দগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি হায়, কভি ইয়ে রুলায়ে, কভি ইয়ে হাসায়ে...।
    বেবি : কী-ই বা করবেন, আমাদের দুজনের অদৃষ্ট, আর সেই শুশুকটার ইশারা, আপনি রামচন্দ্রজীর মতন দরজায় এসে যেদিন দাঁড়ালেন, তার আগের দিন গঙ্গায় শুশুক দেখে সবাই বলেছিল যে আমার জন্য গঙ্গা মাইয়া একজন রাজপুত্রকে পাঠাচ্ছেন । হ্যায় নাআআআআআ ।
    দুপুরের প্যাচপেচে গরমে একা বসে-বসে স্বস্তি না পেলে ল্যাপটপে বা ডেস্কটপে ট্রিপল এক্স । তাতেও স্বস্তি না পেলে বেবি বলে হাঁক পাড়েন, আর বেবি ঘরে ঢুকলে, বলেন, দরোজা বন্ধ করে দে, এই নে, দেখে একটু শরীর টাটকা-তাজা করে নে, তারপর তুই শুশুক ধরিস, আমি চুচুক ধরব, তাড়াহুড়ো করব না । বেবি উত্তর দ্যায়, তাড়াহুড়ো করলে আপনার গুটিপোকাগুলো থেকে তরমুজের গন্ধ বেরোতে থাকে, ভাল্লাগে না, গ্যাসের টিন বরবাদ ।
    জমিন, জল, জবরদস্তি-- এই তিনটের মালিকানা, একদা লালটুশ এখন ভুঁড়োকার্তিক সুশান্ত ঘোষকে করে তুলেছে বহু ফেরারির আশ্রয়দাতা । নর্থ বিহার লিবারেশান আর্মির নেতা শংকরদয়াল সিং, ফাইজান পার্টির অওধেশ মণ্ডল আর হোয়াইট অ্যান্ট পার্টির বিকরা পাসওয়ানদের পোঁদে বেয়নেট ঠেকিয়ে পুলিশ যখন তাড়িয়ে বেড়াবার খেলা খেলছিল, তখন সুশান্ত ওদের লুকিয়ে রেখেছিলেন দুষ্প্রবেশ্য নামহীন এক দিয়ারায়, গঙ্গামাটির প্রলেপ-দেয়া, ডিজেল ইনভার্টারে চালানো রুমকুলারে ঠাণ্ডাখড় আরামঘরে । ভাড়া সেভেনস্টার হোটেলের । রুম সার্ভিস চাইলে ওনার শশুর ডান্সবারের নাচিয়েদের আনান নৌকোয় চাপিয়ে, সার্ভিস হয়ে গেলে ডান্সগার্লদের ফেরত পাঠান ভোর রাতের নৌকোয় চাপিয়ে ।
    সুশান্ত ঘোষের পারিবারিক কিংবদন্ধি অনুযায়ী, ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ছিল ঠগি ; গুড়ে চোলাই করা তরমুজের মদ টেনে সুশান্ত ঘোষ ভেবে ফ্যালেন যে হয়ত তাই তিনিও শশুরের দেয়া সুপারঠগির সিংহাসন দখল করলেন ।
    পুলিশ যায় না অপরিচিত কোনো দিয়ারায় ; গুজব যে ভাগলপুর শহর থেকে চান করার মার্বেল-বাথটব এনে দিয়ারার বালিতে বসিয়ে রেখে গেছেন তারিণী মণ্ডলের বাবা । তাইতে নাইট্রিক অ্যাসিড ভরে একজন পুলিশের মুখবির বা ইনফরমারকে চুবিয়ে গলিয়ে ফ্যালা হয়েছিল ।

    সাত
    শেষবার যখন ইতু ওর ক্লিনিক থেকে নিজের সঙ্গে, একদা পালিয়ে-যাওয়া অমিতকে বাড়ি নিয়ে এলো, বিরোধের হল্কা প্রায় নিভে গিয়েছিল, কেননা ইতিমধ্যে একান্নবর্তী পরিবারের অধিকাংশ সদস্য একে আরেকের সঙ্গে কথাহীন বার্তা-বিনিময় করে নিয়েছিলেন, যে, ইতুটাকে ঘাড় থেকে যদি নামানো যায় তাহলে স্হান-কাল-পাত্রের যেমন সুবিধা পাওয়া যাবে, তেমনই, আর্থিক দায়টাও বাড়ির বাইরে চালান করে দেয়া যাবে। এর আগে যখন অমিত এসেছে, সেদিন বিকেলেই চলে গেছে বা থেকে গেছে একদিন, বহিরাগতের মতন, অতিথির মতন নয়, বাড়ির সদস্যের মতন তো নয়ই ।
    শেষবার যখন অমিত এসেছিল, কোথায় শোবে তা নিয়ে আলোচনা চলছিল, ইতু প্রস্তাব দিল, তিনতলার ছাদে ওর ঘরেই রাতটা কাটাক অমিত, সঙ্গে টয়লেট-বাথরুম আছে, কোনো অসুবিধা হবে না ; দোতলার বারান্দায় যে খাট পাতা আছে তাতে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়বে ইতু, একটা রাতেরই তো ব্যাপার । আগে ঘরটা ছিল সুশান্তর বাবার, তিনি মারা যেতে জাঠতুতো ভাই সমরেন্দ্রর দখলে গিয়েছিল ; ওর বউ যমজ বাচ্চাদের ইতুদের বাড়ির জিম্মায় চাপিয়ে ঝাড়া হাত-পা ডিভোর্স দিয়ে নাচতে-গাইতে চলে গেছে, যার দরুণ নিজের বলার মতন একটা ঘর পেয়েছে ইতু ।
    অমিত যখন এই বাড়ির সদস্য ছিল, তখন ও একতলায় ওর রাঙাবাবা-রাঙামা, মানে ইতুর রাঙাকাকা-রাঙাকাকিমার ঘরে ওনাদের সঙ্গে থাকত । উধাও হবার পর প্রথমবার ফিরে, অমিত ওর রাঙাবাবা-রাঙামায়ের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ দেখায়নি ; ওনারাও কুন্ঠিত, হয়তো অমিত চলে যাওয়ায় ওনারা যেচে-নেয়া দায়ভার থেকে ছাড়ান পেয়েছেন ।
    শুকগে তিনতলার ঘরে, মরুকগে যাক, মেয়েটা মা-বাপকে খেয়েছে, এবার ছেলেটাকে খাক, বয়স্কদের মুখ দেখে, তাদের ঘিলুর ভেতরের মেঘে সেরকমই রুপোলি পাড় দেখতে পেয়েছিল ইতু ।
    সকলকে শুনিয়ে ইতু বলল, তুই চল, বিছানা পেতে দিচ্ছি, জিনিসপত্র নেই দেখছি, শুধু এই কাঁধব্যাগ ?
    --হ্যাঁ, এতেই আমার পেন আর খাতা আছে, সংবাদ যা পাই টুকে নিই, পরে অফিসে গিয়ে তথ্যগুলো খাতা থেকে লিখে নিই আর যা দেখেছি বা শুনেছি তা স্মৃতি থেকে লিখে নিই । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
    --একটা ল্যাপটপ রাখলেই পারতিস, রিপোর্টাররা তো আজকাল ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন এই সব নিয়ে কাজ করেন । ইতুর অভিনয়, সংলাপ ।
    --আমি এখনও টেকস্যাভি হতে পারিনি । হাতে কলম নিয়ে লিখতে ভালো লাগে আমার । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
    --তুই স্নানটান করে রেডি হয়ে নে, খাবার সময় হলে ডেকে নেব । ইতুর অভিনয়, সংলাপ ।
    --আমার না খেলেও চলবে, রিপোর্টারের চাকরিতে সময়ে খাওয়া হয়ে ওঠে না, জানিসই তো, অভ্যাস হয়ে গেছে । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
    --ও লজ্জা পাচ্ছিস । এমব্যারাসড ফিল করার কী আছে, আমি তোর ডিনার ঘরেই পৌঁছে দিচ্ছি । ডিনার মানে রুটি আর আলু-পটলের তরকারি হয়েছে আজকে । ছয়টা রুটি চলবে তো ? ইতুর অভিনয়, সংলাপ ।
    --না না, দুটো রুটি হলেই হবে । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
    রাঙাকাকা আর সুশান্তজেঠুর মা, যাকে ওনার ছেলেরা, ভাসুরপো-দেওরপোরা, তাদের বাচ্চারা, অন্নমা বলে ডাকে, অমিতকে বললেন, তুমি আসো বেশ ভালো লাগে বাবা , তুমি সুশান্তর সবচেয়ে কাছের বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলে, এ-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েই বা কেন গিয়েছিলে , সব বাড়িতেই অমন মেলামেশা হয়, তাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় নাকি , কী আর বলব, আমার কোনো গুরুত্ব আর নেই, সুশান্তর বাবা মারা যাবার পর কিছুই আর ভালো লাগে না । কিন্তু প্রতিবার অমন আপত্তি করো, আর যাই-যাই করো বলে মন খারাপ হয়ে যায়। এমনিতেই আমার মন বিষিয়ে থাকে, জানোই তো ।
    ইতু জানে, সুশান্তজেঠুর অভাব, জেঠুর বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলের মাধ্যমে কিছুটা মেটাবার চেষ্টা করেন অন্নমা । অতনুজেঠুকে ইতু দেখেছে ছোটোবেলায়, সুশান্তজেঠুর মোটরসাইকেলে বসে এ-বাড়িতে আসতে, কিন্তু ভুলে গেছে ওনার মুখ । সুশান্তজেঠু কিডন্যাপ হয়ে চলে গেলেন, তারপর অতনুজেঠু চাকরি-বাকরি ছেড়ে চলে গেলেন কোথাও । তখন সবাই বলত উনি সাধু হয়ে গেছেন, কুম্ভ মেলায় ওনাকে জটাজুট দেখা গেছে । শেষে উনি যখন অমিতকে এবাড়িতে রাখতে এলেন, ইতু তখন স্কুলে, জানা গিয়েছিল যে উনি নওয়াদা জেলার কোনো গ্রামে মানসী বর্মণের সঙ্গে সংসার পেতেছেন, সেই বাড়িতে আবার মানসী বর্মণের স্বামীও থাকেন । আরও পরে, যে অফিসে উনি কাজ করতেন, সেখানের কর্মীদের সূত্রে, কানাঘুষা শোনা গিয়েছিল যে ওনারা নকসল্লি-মালে আন্দোলন করতেন, পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন ; ওনাদের বিপ্লবী জীবনে শিশু অমিত খাপ খাবে না ভেবেই হয়ত রেখে গিয়েছিলেন ইতুদের বাড়িতে । বাবা-মাকে খুঁজে পাবার আগে পর্যন্ত অমিত ছিল বাবাহীন-মাহীন ।
    তিন তলার ঘরে পৌঁছে ইতু বলল, তোর মেসেঞ্জার আমাকে যে চিরকুট দিয়েছিল তাতে তো লেখা ছিল তুই কালকে সকালে আসবি ? মেসেঞ্জারদের দেখে বাড়ির লোকেদেরও খটকা লাগে ; বলেন ওরা কে রে, তোর পেশেন্ট, অথচ তুই তো বলতিস যে তোর রোগি জোটে না । বানচোদ, তোর জন্য কতো আর মিথ্যার সিনেমা করব ? আমি বিপদে পড়লে ক্ষতি নেই, বাড়িসুদ্দু লোকেরা যেন বিপদে না পড়ে ।
    --আমার বিহারশরিফে একটা কাজ ছিল । প্রতিবারের মতন আমি পাটনায় চলে এলুম । কতদিন তোর সঙ্গে দেখা হয়নি, মুখোমুখি কথা হয়নি । তোকে টাচ অ্যান্ড ফিল করতে ইচ্ছে করে ।
    ডিনারের বদলে একটু পরে ফোটো অ্যালবাম নিয়ে এলো ইতু । খাটের ওপর বসে, অ্যালবাম খুলে দ্যাখালো, এই দেখ, আমাদের দোল খেলার দিন তুই, তোর ক্লাসের বন্ধুরা সবাই এসেছিল, এই যে তোর ছবি, কতকাল হয়ে গেল, অবহেলায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ।
    গোটা দশেক ফোটো ছিল ওদের, সেগুলো প্লাসটিকের খাপ থেকে বের করে অমিত যখন বলল, আমি কি এগুলো রেখে নেব, তখন ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ইতু বলল, রেখে আবার কী করবি ? ডেসট্রয় করে ফেলতে চাইছিস তো ?
    --হ্যাঁ, এ-বাড়িতে আমার কোনো চিহ্ণ রাখতে চাই না ।
    --পরে কথা হবে, ফোটোগুলো ছিঁড়তে-ছিঁড়তে বলল ইতু । তারপর হাতের মুঠোয় দলাটা ধরে যোগ করল, জ্বালিয়ে ফেলতে হবে তো ? ডিনার আনছি, ঘুমিয়ে পড়িসনি যেন । ফোটোগুলো থাকলেও বিশেষ কিছু ক্ষতি হতো না । এই বাড়িতে এসে কে-ই বা তোর ফোটো খুঁজবে । যাদের খোঁজবার তারা যদি সন্দেহ করে থাকে তাহলে তোর স্কুল-কলেজের রেকর্ড থেকেই যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়ে ডোসিয়ার বানিয়ে ফেলে থাকবে ।
    --ফোটোগুলো কেনই বা রেখেছিলিস, আননেসেসারিলি ।
    --ফোটোগুলো ছমাস যাবত প্রায়ই দেখতুম আর আশা করতুম যে তোর চিরকুট আসবে বা তুই নিজে আসবি। তার বদলে এসেছে তোর মেসেঞ্জার, একজন চিঠি দিয়ে যায়, তো আরেকজন নিয়ে যায় । ভাগ্যিস ক্লিনিকটা বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিতে হল ।
    রাতভোজন এনে, সামনে বসে অমিতকে খাইয়ে, বাথরুম থেকে অমিত হাত ধুয়ে এলে, ইতু বলল, সকলের খাওয়া হয়ে গেছে, তোর আর কিছু চাই ?
    --না, এত করছিস আমার জন্য, না চাইতেই । কাল সকাল-সকাল বেরিয়ে যাবো ।
    --বার-বার অমন যাই-যাই কোরিসনি তো, ইউ ইডিয়ট । কতদিন পর তো এলি । বলেছিলিস সঙ্গে নিয়ে যাবি অথচ প্রতিবার এড়িয়ে যাস, ইউ লায়ার । আমার তো কেমন সন্দেহ হওয়া আরম্ভ হয়েছে । তোর হয়তো কিছুই চাই না, আমার চাই, আমি এবার তোর সঙ্গে যেতে চাই, পালাতে চাই এখান থেকে ।
    --কিন্তু..
    --থাম দিকিনি । ফোটো জ্বালিয়ে এলুম , আর এখন আবার গল্প ফাঁদবার তালে আছিস । তোর কাঁধব্যাগও দেখে নিয়েছি, শুধু একটা লুঙ্গি আর গামছা । জানতুম না যে সিক্রেট কাল্টের মানুষরাও মিথ্যাবাদী হয় । আমি এবার তোর সঙ্গে যাচ্ছিই । ফাইনাল ।
    অমিত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর আত্মগ্লানির মতন করে বলল, সিক্রেট কাল্ট বলে অপমান করিস না প্লিজ, চে গ্বেভারার নাম শুনেছিস ?
    --শুনেছি । বিপ্লবীদের রোমান্টিক মৃত্যু নিয়ে বেশ একটা মুখরোচক রহস্য তৈরি করে ফেলিস তোরা । গুয়েমুতে মরে পড়ে-থাকা স্তালিনকে নিয়ে, কই, তোদের মুখে কিছু শুনতে পাই না । পল পটের বিষয়েও শুনি না। কিম জং উন, কিম জং ইন, কিম জং হিং এটসেটরা, তাদের কথাও তো শুনি না । যাকগে যাক, কী হবে আমার ওসব জেনে ? তোর কাজের অংশীদার করার প্রয়োজন মনে করিসনি আমাকে । আমি যেন তোর ডাকবাক্স । একজন চিঠি দিয়ে যায়, আর আরেকজন এসে নিয়ে যায় । এতই যখন বিশ্বাস করেছিস আমাকে, তো সঙ্গে নিসনি কেন ? এ-বাড়ি ছেড়ে যখন উধাও হয়ে গেলি তখনই তো সঙ্গে নিতে পারতিস ? তোর নিজের বাবা-মাকে খুঁজে পেলি, তবু নিয়ে গেলি না ।
    --চেয়ার রয়েছে তো, বোস না আয়েস করে, গল্প করা যাক ।
    ইতু বিছানার ওপর নিজেকে, তেমনই মনে হল অমিতের, পাথর-চাঁইয়ের মতন ফেলে, বলে উঠল, তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে, চেয়ারে বসলে হবে না । অমিত অনুমান করতে পারেনি ইতু কী করতে চলেছে। ইউ কাওয়ার্ড আহাম্মক, অমিতকে সজোরে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল প্রগলভা ইতু ; আঁকড়ে ধরে, ইতু নিজের ঠোঁট অমিতের ঠোঁটে চেপে ধরে রেখেই বলল, তুই হয় আমাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবি, নয়তো আমি আজকে রাতেই আত্মহত্যা করে তোর আরেকবার উধাও হয়ে যাওয়া ভণ্ডুল করে দেব ।
    --তুই কী করতে চাইছিস বল তো ? দু’জনে এভাবে ধরা পড়ে গিয়েছিলুম বলে, আমাকে তোদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল । এবার দেখে ফেললে ওনারা নির্ঘাত গলাধাক্কা দেবার আগে বেদম পিটুনি দেবেন । বলল উদ্বিগ্নবাক অমিত ।
    --ছাঁচি পেঁয়াজি মারিসনি । ভয়কে কাবু করতে শেখ, স্টুপিড । মার খেলে পালটা মার দিতে শেখ । নিজে তো মা-বাবার আদর-ভালোবাসা খাচ্ছিস । আমার কি ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে না ? জড়িয়ে ধর আমায়, হোল্ড মি ইন ইওর আর্মস, শক্ত করে ধর । প্রেম কর আমার সঙ্গে । জানি আমি প্রায় চটা-ওঠা, তামাটে, নাক-নকশা ভালো নয় । হলেই বা তুই কোনো সিক্রেট কাল্টের জানগুরু, আমিও তো মানুষ, না কি, অ্যাঁ । সাধারণ মানুষের জন্য, দেশের জন্য, কিছু করার কাজে কি আমার কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ? ইতুর নিঃশ্বাসে তাপ । অমিতকে জাপটে বিছানায় শুয়ে ইতু বলল, তোর মনে আছে নিশ্চই তোর মা তোকে ভালোবাসা সম্পর্কে কী বলেছিলেন ? তবে ?
    --অমিত বলল, মায়ের কথায় তো সঠিক উত্তর পাইনি । যতই যাই হোক, কেন মা-বাবা আমাকে, নিজের বাচ্চাকে, ফেলে চলে গিয়েছিলেন, আর কখনও পেছন ফিরে তাকাননি, তার সঠিক উত্তর আজও পাইনি ।
    --অত-শত জানি না, আই অ্যাম নট গ্রেট লাইক দেম ; নিজের আর্জের কথা জানি । অবদমনের মানসিক অশান্তির কথা জানি ।
    --এই বারই এত চাপ দিচ্ছিস কেন, ছমাস আগে তো এরকম বিহেভ করিসনি । আমার জন্যেই তুই সবায়ের দ্বারা অপমানিত হয়েছিলি। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর কার ছবি সামনে রেখে মিষ্টিবিষ্টি করতিস?
    --আহাআআ, আহাআআ, মেয়েদের কোড ওয়র্ডটাও জানিস দেখছি । বেগুন ব্যবহার করতুম, বুঝলি । নারকেল তেলে ইউরিনারি ট্র্যাক্টে ইনফেকশান হয় না । আর কিছু ? বিব্রত করার চেষ্টা করিসনি । তুই কার ছবি মনে করে মিষ্টিবিষ্টি করতিস ? কোনো ফিল্মস্টারের বোধহয় ?
    --না, একটা বিশেষ অঙ্গ কল্পনা করে নিতুম, যা নেটে দেখেছি । একটু দেখতে দে না ।
    --দ্যাখ, দেখে নে, ইউ বিট্রেয়ার, চোখের জলের আলোয় দেখে নে, ইউ মেনিমুখো কাওয়ার্ড ।
    --মুখ দেবো ? আমার তো সিংহের কালো কেশর গজিয়েছে, দ্যাখ হাত দিয়ে ।
    --তোর চোখের জলে ভিজিয়ে ওখানে মুখ দিবি, হাঁটু গেড়ে বসে । গেট অন ইওর নিজ । কাঁদ, ফোঁপা, তোর ফোঁপানি শুনতে চাই আমি, কাঁদ, কাঁদ, কাঁদ, ইউ আনগ্রেটফুল ডেজার্টার । অমিতের চুল দু’মুঠোয় ধরে বলল ইতু ।
    ঘর্মাক্ত প্রেমের শেষে, প্রস্তুতির জন্য এনে-রাখা ওষুধের বড়ি গলায় ফেলে, বেডসাইড টেবলের গেলাস থেকে জল খেলো ইতু । বলল, ভিতুরা হল লাশের মতন, স্রোতের সঙ্গে ভাসে ; স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতরাতে শেখ, তোর অস্তিত্বে প্রাণ আছে কিনা তা প্রমাণ করতে হলে তোকে স্রোতের বিরুদ্ধে ননস্টপ হাত-পা চালিয়ে যেতে হবে।
    --প্রথমবার প্রেম করতে গেলে যে ছড়ে যায়, জানতুম না, আমার ধারণা ছিল মেয়েদেরই ছেঁড়াছিঁড়ি হয়, বলল অমিত ; তারপর যোগ করল, এসেছিলুম এক রাত কাটিয়ে চলে যাবো, এই ভেবে ; তুই কি করলি জানিস? তুই আমাকে আইডেনটিটি দিলি, প্রেমিকের আইডেনটিটি, এ-ছাড়া আমার বলার মতো আত্মপরিচয় নেই । বাবা-মা বিসর্জন দিয়ে চলে গেল, তোদের বাড়ির লোকেরা যৌথ সম্পত্তিতে ভাগ বসাবো ভেবে দত্তক নিল না, পরিবারের অংশ বলে মনে করল না, প্রতি বছর আগের ছাত্রদের বই চেয়ে-চেয়ে পড়ে কোনো রকমে পাশ করতুম, স্কুলও ফালতু তকমা দিয়ে লাস্ট বেঞ্চে বসাতো । বাবা-মাকে যতটা বুঝেছি, ওনাদের কাছে আমি আরও হাজারখানেক কর্মীর একজন, গুরুত্বহীন । ওনারা যেসব তত্ত্বকথা আওড়ান, তা যে আমার জীবনে প্রযোজ্য, সেকথা ভুলে যান । বলতে-বলতে ছলছল-চোখ হয়ে গিয়েছিল অমিতের।
    --তখন কাঁদতে বলেছিলুম, জাস্ট এ মোমেন্টারি রিভেঞ্জ, দ্যাট ওয়াজ এনাফ, আর ধ্যাড়াসনি, প্লিজ । কেন করলুম জানিস, বলল ইতু, তুই এবার আমাকে নিয়ে যেতে বাধ্য হবি । তুই তো কাল্ট মেম্বার, কমিটেড, ডেডিকেটেড, আদর্শবাদী, অ্যান্ড হোয়াটএভার, ফেলে পালাতে তোর দায়বদ্ধ বিবেক বাধা দেবে । আই থিংক সো । আমাকে ধোকা দিয়ে পালাতেও পারবি না, আমি দোতলাতেই জেগে থাকব সারারাত, পাহারা দেব । বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই, তারপর দেখা যাবে ছাড়াছাড়ি এটসেটরা, আই ডোন্ট কেয়ার, আমি একাই এনাফ । আর, গুছিয়ে বলি, তোর প্রাপ্য তোকে দিয়ে দিলুম, পরে দেয়া হয়ে উঠবে কিনা, দেবার সময়-সুযোগ হবে কিনা, তা তো জানি না ।
    --অমন অদ্ভূত সব খুঁতখুতে শব্দ কোথায় পেলি ? না, তোকে ফেলে এবার পালাব না, পালাবার হলে আর আসতুমই না, তোদের বাড়ির গোমড়ামুখগুলো দেখতে ; পাহারা দেবার দরকার নেই, তুই জানিস তোর টান ছিন্ন করতে পারিনি । তুই এবার আমার সঙ্গে যাবি । তোর কর্মকাণ্ড নির্ধারিত হয়ে গেছে । অকল্পনীয় কষ্টের জীবনে তোকে মানিয়ে নিতে হবে, শারীরিক কষ্টের । হয়ত পানীয় জল নেই, বিজলি বাতি নেই, শোবার ঘরবাড়ি নেই, প্রতিদিন খাবার জোটার সম্ভাবনা কম । পদে-পদে মৃত্যু ওৎ পেতে থাকতে পারে । সময়ে-অসময়ে ডাক্তারি করতে হতে পারে ।
    --বাড়ির কুচুটে নোংরা স্বার্থপর জঙ্গলে বসবাসের পর আমি আফ্রিকার সিংহ আর হায়েনাদের জঙ্গলে গিয়েও থাকতে পারব ।
    --জঙ্গলে নয়, ওরা সাভানার ঘাসভূমিতে থাকে ।
    --হোয়াটএভার, ডোন্ট ট্রাই টু টিচ মি । তোর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করতুম ।
    --কেউ কোথাও আমাকে চিনে ফেললে, তুই বলবি তুই আমার সঙ্গী নোস, কোনো একটা জায়গায় যাবার নাম করে বলে দিস বাবা বা কাকার বাড়ি যাচ্ছিস ।
    --সে দেখা যাবে, কপি-পেস্ট সংলাপবাজি করিসনি । যখন অমন বিপদ আসবে তখন তার মোকাবিলা করব । তাছাড়া এটা পাটনা শহর। গয়া, নওয়াদা, সাসারাম, জেহানাবাদ, পালামউ নয় । এই শহরের জাতপ্রথার রাজনীতিকদের খেলা যতটা বুঝি, এখানে তোদের কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয় না ; অবশ্য খুনোখুনি হলে আলাদা কথা ।
    --না, ওই লাইনে ভাবিসনি ।
    --কোথায় যাব আমরা ? প্রশ্নটা এই জন্য করছি যে আমার যাবার সঙ্গে ইলোপ শব্দটা জুড়ে আছে ।
    --তুই যেখানে যাবি সেখানে যারা থাকে তারা মুরিয়া মারিয়া মাড় গোঁড় । দশ-পনেরো বছর আগে পর্যন্ত ওদের যুবতীরা পোশাক দিয়ে বুক ঢাকত না, খালি গায়ে গয়না পরে থাকত । কোনো-কোনো গ্রামে পৌঢ়ারা এখনও খালি গায়ে থাকে, যখন খুব গরম পড়ে । অবশ্য ওদের খুচরো জনবসতিগুলোকে গ্রাম বলা যায় না, এক জায়গায় চাষবাস করে আবার জনবসতি অন্য জায়গায় তুলে নিয়ে যেত, সেখানে গিয়ে এক ঋতু চাষবাস করে আবার অন্য কোথাও বসতি তুলে নিয়ে যেত । ব্রিটিশ গবেষকরা লিখে গেছেন ওদের মাড় শব্দটা নাকি এসেছে বনের আগুন, মানে, পলাশ ফুলের নাম থেকে । আমার তা মনে হয় না, কেননা গাছটাকে তো ওরা পুজো করে না । তার তুলনায় মহুয়াগাছকে শ্রদ্ধা করে ।
    --জঙ্গলমহলে ? ঝাড়খণ্ডের খবরও তো পড়ি কাগজে ।
    --ওয়েস্ট বেঙ্গলে আর ঝাড়খণ্ডে কী গোঁড় বা মাড়িয়া উপজাতির মানুষ থাকে ? আমি যাদের কথা বলছি তারা পশ্চিমবাংলার মানুষ নয় । সিলেবাসের বাইরে একটু-আধটু সাধারণ জ্ঞানের বই-টই পড়তে পারতিস । তুই যাবি দণ্ডকারণ্যের দুর্ভেদ্য, প্রায় দুর্ভেদ্য, জঙ্গলে । অবুঝমাড় ।
    --হ্যাঁ, অবুঝই ছিলাম এতকাল । অবুঝ জীবনে পড়ে-পড়ে মার খেয়েছি । তুই যাবি মানে ? তুই যাচ্ছিস না ? কিন্তু তুই ওরকম ব্লাডি মোরোনদের মতন বসে-বসে পা দোলাসনি ।
    --এই তো বললি যে সাধারণ দুস্হ গরিব মানুষের সেবা করতে চাস । আমার থাকা-না-থাকার সঙ্গে তোর জীবনের উদ্দেশ্যকে কেন জড়াচ্ছিস ? আমার মা-বাবা তো আমাকে এখনও পুরোপুরি জড়ায়নি তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে, আলাদা দায়িত্ব দিয়েছেন ! আমি চিরকাল পরিত্যক্ত সন্তান থেকে যাবো, ফর দেয়ার কজ ।
    --আমিও ইনডিপেন্ডেন্টলি কাজ করতে চাই, তোর লেজুড় হবো বলিনি । আমি কারোর লেজুড় হতে চাই না । কিন্তু তুই না থাকলে কী করে জানবো যে কোথায় যেতে হবে, কাদের সেবা করতে হবে ? হোয়াট অ্যাবাউট টাকাকড়ি ?
    --গন্তব্য তো তোর, ঠিকই পৌঁছে যাবি । জানি তুই যথেষ্ট বোল্ড, আউটস্পোকন, সেল্ফ-মেড, এমনকি দুঃসাহসী । নিজেকে প্রয়োগ করে দ্যাখ-ই না । ভারতের এলোমেলো-হেলাফেলা মানুষদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হোক । টাকাকড়ির জন্য সুশান্তজেঠুর দরবারে ঢুঁ মারব ।
    --ওকে, তবে তা-ই হোক । এবার থেকে আমিই আমার গন্তব্য । কারেক্ট, আমার উদ্দেশ্য আমি নিজে । জানি, গন্তব্যের লক্ষ্যে চলতে থাকা জরুরি, চলাটাই সফলতা, লক্ষ্যবস্তুটা নয় । আজ থেকে আমার কাছে যুক্তি আর যুক্তিহীনতার পার্থক্য রইল না । আর তো ভার্জিন থাকার বিড়ম্বনা রইল না যে আগের মতন ওয়ান-ডে প্রেমিকদের দুর্ভাবনায় সিঁটিয়ে থাকবো ।
    ঘুমোতে যাবার আগে ইতু ড্রয়ার থেকে কাপড় কাটার কাঁচি এনে বলল, আমার আকর্ষণের কেন্দ্র বা ভ্যানিটি, যা-ই বল, তা হল আমার চুল, তুই তো জানিস, এই নে , ঘাড়ের কাছ থেকে ঘ্যাঁচাৎ করে কেটে দে দিকিনি ।
    --ভ্যানিটি ? আকর্ষণের কেন্দ্র ? তা তোর সুরাহিদার গর্দন, ভারি পাছা আর নিটোল বুক ।
    --শাট আপ, চাপলুসি করিসনি । হ্যাঁ, আমার বুক সম্পর্কে আমার গর্ব আছে । কিন্তু ওগুলো তো আর কেটে বাদ দিতে পারি না । চুল কেটে দিতে বলছি, কাট, এই নে ।
    --এরকম দীর্ঘ চুল, পুরো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আ্ছে, তাকে বাদ দিয়ে দিতে চাইছিস ?
    --হ্যাঁ, জাস্ট ডু ইট, কেটে ফ্যাল, এত বড়ো চুল বয়ে বেড়ানো যায় না । আমিও আর আয়নার মুখ দেখতে চাই না । যাদের মাঝে বড়ো হয়েছি, তাদেরই যদি বাদ দিতে পারি, তাহলে চুলটুকু কেন বাদ দিতে পারব না ?
    চুল কাটতে গিয়ে অমিতের নজরে পড়ল মাথার শিয়রে স্যাঁতসেতে দেয়ালে সেলোটেপ দিয়ে একটা ইংরেজি পোস্টার লাগানো, ফ্যাকাশে, পুরোনো, ছেঁড়া । রঙিন হরফে লাইনের তলায় লাইন উদ্ধৃতি । চুল কাটার শেষে লাইনগুলো জোরে পড়ে ফেলছিল, ইতু বলল, মনে-মনে পড়, ওটা ডাকবাংলো রোডের ফুটপাথ থেকে কিনে এনেছিলুম । বেশ ভালো, না ? অমিত অনুবাদ করে পড়ল :
    “কখনও নিজেকে গুরুত্বহীন মনে করবেন না
    কখনও উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপন করবেন না
    কখনও সদর্থক দায়িত্ব এড়িয়ে যাবেন না
    কখনও শরীরে আরামের শিকড় গজাতে দেবেন না
    কখনও নিজেকে অক্ষম মনে করবেন না
    কখনও অসন্তোষে আপ্লুত হয়ে নিজের সঙ্গে মনে-মনে কথা কইবেন না
    কখনও আত্মাভিমান বর্জন করবেন না
    আনন্দের মুহূর্ত ছোট্ট হলেইবা তাকে সযত্নে উপভোগ করুন”
    চুলের কাটা গোছাটা ইতুর হাতে দিয়ে অমিত ইতুর মুখের দিকে অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ে তাকাতে, ইতু বলল, হ্যাঁ, জানি, আমার মুখময় ওই কথাগুলো লেখা আছে, বহুকাল, পাঁচ বছরের বেশি, লেখা আছে, মগজে গেঁথে গেছে ইন ফ্যাক্ট । এতক্ষণে বোধহয় তুই আমার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলি । ভাগ্যিস চুলটা কাটতে বলেছিলুম, নয়তো ওদিকে তোর চোখ যেত না ।
    রাত দুটোয় তিনতলার ঘর থেকে নেমে দোতলার বারান্দায় ইতুর বিছানায় অমিত মশারি তুলে ঢুকতে গেলে, ইতু বলল, তুই যে আসবি জানতুম, তোর ভয়কে যে কাবু করতে পারলি, দ্যাখ, আমার কাছে নেমে আসাই তার প্রমাণ, আরো বড়ো প্রমাণ যে তুই জামাকাপড় খুলেই নেমে এসেছিস । তোর কাওয়ার্ডাইস থেকে তোকে বের করে আনার জন্য আমাকে কী করতে হল, ভেবে দেখেছিস ? তুই আসবি জানতুম বলে আমিও শাড়ি-টাড়ি খুলে শুয়েছিলুম । দাঁড়া, এই খাটে আওয়াজ হয়, নিচের তলায় শোনা যায় । তিনতলার ছাদে চল, খোলা আকাশের তলায় শাড়ি পেতে সুহাগ-রাত করব । দ্বিতীয়বার আকুতিময় শ্বাসের ঘনঘটা আর স্পন্দনের লেনদেন শেষ হলে ইতু ওর দোতলার বিছানায় ফিরে যেতে যেতে বলল, স্কাউন্ড্রেল, কি তোড়ু লাভমেকিং করলি, বুকে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিস, হারামি কোথাকার ; তূরীয়-মুহূর্তে সিংহরা সিংহীর মাথায় দাঁত বসায়, বুকে নয় ।
    ভোরবেলা বাড়ির লোকেরা জাগবার আগেই সদরের ছিটকিনি আলতো খুলে বেরিয়ে পড়েছিল দুজনে । কাঁধের ঝোলায় স্টেথোস্কোপ, মশার কামড়ের প্রতিষেধক মলম, কয়েকটা জরুরি ওষুধ, এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন, গামছা , পেনসিল টর্চ, এক সেট ডেনিম ট্রাউজার আর কটন-টপ পুরে নিয়েছিল ইতু ; পায়ে জগিং করার কেডস । রাতের নোংরা হয়ে যাওয়া শাড়ি-শায়া আর চুলের গোছা দোতলার বিছানার ওপর ফেলে রেখে গেল, যাতে বাড়ির সদস্যরা আঁচ করতে পারেন যে ওরা দুজনে ষড় করে বাড়ি থেকে পালিয়েছে ।
    জানার পর আর ওনারা ইতুর খোঁজ করবেন না, জানে ইতু ।
    ইতুর পালানোর চাটনি-রসালো সংবাদ বাড়ির সদস্যরা শুনলেন কাজের বউয়ের মুখে । সকালে দরোজা খোলা পেয়ে সে অনুমান করেছিল যে বড়কর্তা প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে থাকবেন । তিনতলার ছাদে ইতুর ঘর থেকেই ঝ্যাঁটানো আর পোঁছা আরম্ভ করে । দেখলো ইতুদি বিছানা তোলেনি, দোতলাতেও আসার সময়ে দেখে এসেছে খাটের ওপর বিছানা গোটানো নেই, তার বদলে পড়ে আছে ইতুদির শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ । আর অনেকখানি চুল, দেখলেই বোঝা যায় ইতুদিদির চুল, বাড়িতে আর কারোর চুলই অমন কোঁকড়া আর লম্বা নয় । শাড়ি তুলে তাতে অতিপরিচিত আঠা দেখে, নাকের কাছে এনে মোহক গন্ধে আতঙ্কিত হয়ে উঠল বিহারি কাজের ব্‌উ রুকমিনি ।
    কাজের বউয়ের হাঁক, ইতুদিদি বিছৌনা তোলোনি কেন আজকে, ঘরে বসে খেয়েছ, বাসনও ফেলে রেখেছ, কলতলায় নিয়ে গিয়ে রাখেনি, ইতুদিদি, ইতুদিদি..
    বাড়ির মেজবুড়োর কন্ঠস্বর শোনা গেল, ইতু ওপরেই আছে দ্যাখ, দোতলায় এখনও মশারি ফেলে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ডেকে তোল । ইতুর ঘরে একজন অতিথি আছে, টয়লেটে গিয়ে থাকবে, অমিত, আমাদের বাড়িতে থাকত আগে, তুই বোধহয় দেখিসনি, সৌদামিনী কাজ করত তখন ।
    রুকমিনি টয়লেটে-বাথরুমে ঢুঁ মেরে দেখল ফাঁকা, কেউই নেই । চেঁচিয়ে বলল, কেউ নেই, অতিথিও নেই, দোতলার বিছানায় ইতুদিদিও নেই । শাড়ি-শায়া-বেলাউজ পড়ে আছে, সঙ্গে ওনার কাটা চুল ।
    রুকমিনির হাঁকডাকে, যে হাঁকডাকে শাড়ি-শায়ায় আঠামাখা গন্ধের প্রচ্ছন্ন আহ্লাদ ছিল, শুনে, বাড়ির অধিকাংশ সদস্য, বৃদ্ধরা ছাড়া, দৌড়ে প্রথমে দোতলার বিছানায় দোমড়ানো শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ-চুলের গোছা আর তারপর তিনতলায় পৌঁছোলে, রুকমিনি পান-খাওয়া দাঁতে হাসি মাখিয়ে যখন বলল যে বাড়ির সদর দরজা খোলা ছিল, তখন সকলে ঠাহর করতে পারল যে ইতু অতিথির সঙ্গে উধাও হয়েছে ।
    --বিয়ে দিলে না তোমরা সময় মতন, পালাবে না তো কি করবে ? বললেন সেজকর্তার গোলগাল ভারিভরকম স্ত্রী, সাতসকালে ওজনদার শরীর নিয়ে বাতের ব্যথা সত্ত্বেও তিনতলায় হাঁটু ভেঙে উঠতে হয়েছে বলে যিনি ক্লান্ত, হাঁপাচ্ছিলেন ।
    --অমিতের সঙ্গে ওদের সম্বন্ধটা করে ফেললেই হতো, তোমরাই অযথা ছেলেটার মা-বাবার সম্পর্কের প্রসঙ্গ তুলে মেয়েটার জীবন গোলমাল করে দিলে । সুযোগ পেয়ে বলে নিলেন রাঙাকাকি । ওরা ভাইবোন নাকি ? তোমরা ভাইবোন-ভাইবোন আওড়াতে লাগলে । এখন হল তো সেই-ই ।
    --যাক ভালোই হল একদিক থেকে, দায়িত্বটা বড় খচখচ করত এদান্তি । বললেন মেজকর্তা ।
    মেজকর্তার দুই যমজ নাতি, পাঁচে পড়েছে সবে, যাদের মা, মানে মেজকর্তার বড় ছেলের স্ত্রী, ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে, নাতিরা একযোগে চেঁচিয়ে উঠল, ঘরটা আমরা নেবো, আমাদের নিজেদের ঘর নেই, পড়াশোনার ডিসটার্বেন্স হয়, একতলার বারান্দায় বড্ড চেঁচামেচি করে সবাই ।
    --পড়াশুনোর নামে নিজেদের ঘর মানে তো দেয়ালে সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে জেনিফার লোপেজ. লেডি গাগা আর কাটরিনা কাইফের ব্লোআপ, সৌরভের হাফ-টেকো পোস্টারটা বদলে ফেলিস, এখন ওর মাথায় আবার চুল গজিয়েছে । বললে দুই খোকাটে নাতির বাবা, পরোক্ষে তাদের দাবির সমর্থনে । দুই নাতির দিকে তাকিয়ে মুখে পানপরাগি-হাসি খেলালো রুকমিনি ।
    ইতুর পলায়নে তৃপ্ত অভিভাবকরা সিঁড়ির ধাপে চোখ রেখে, এক-পা দু-পা করে নেমে চলে গেলেন যে যার ঘরে । নাতি দুজন তিনতলার ছাদের ঘরে ঢুকে ইতুর আর ইতুর আগে ওদের বাবার চাকরানি-প্রেমী যৌনতার স্মৃতিকে নিশ্চিহ্ণ করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ।
    --চুলটা আমি নিচ্ছি , খোঁপার ভেতরে ঢুকিয়ে বানখোঁপা বাঁধলে বেশ ভালো দেখাবে । নেবো তো ? জিগ্যেস করল রুকমিনি, নেমে যেতে থাকা সিঁড়ির উদ্দেশ্যে ।
    --নিয়ে নে, বিছানার ওপর যা শাড়ি-টাড়ি আছে সেগুলোও যাবার সময় নিয়ে যাস ।
    --আর যেগুলো ইতুদিদির আলমারিতে আছে ?
    --নিয়ে যাস সময় করে, কিন্তু গিটারটা নিসনি যেন, ওটা নবনীতার, ফাইনাল ঝগড়া করবে বলে রেখে গেছে । জবাব দিল নামতে-থাকা সিঁড়ি ।
    রুকমিনিকে রাখা হয়েছে তার আগের কাজের বউ সৌদামিনির সঙ্গে দুই নাতির বাবা সমরেন্দ্রর আঠালো সম্পর্ক ধরা পড়ে যাবার পর । সৌদামিনির সঙ্গে দুপুরে বিছানায়, ওদেরই বিছানায়, দুই নাতি তখন শিশু, সমরেন্দ্র রঙ্গিলা-রতির ম্যাটিনি শো করছিল । শিশুদের দেখাশোনার জন্যই রাখা হয়েছিল সৌদামিনীকে, যার বর আরেকটা বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে গেছে হরিয়ানার খেত-খলিহানে কাজ করতে । সমরেন্দ্রর বউ নবনীতা অনুমান করেছিল যে কিছু একটা গোলমাল চলছে, কেননা যখনই সৌদামিনীকে বকুনি দেয় নবনীতা, তখনই সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে সমরেন্দ্র ঝগড়া করত নবনীতার সঙ্গে । একবার তো নবনীতার গালে চড় কষিয়ে দিয়েছিল সমরেন্দ্র, শিশু দুটোর কান্না সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে শুনে অফিসের পোশাকেই সোজা তিন তলার ছাদের ঘরে পৌঁছে দ্যাখে বাচ্চা দুটো গুয়েমুতে মাখামাখি । যে ডায়াপার নবনীতা পরিয়ে গিয়েছিল, দুটো বাচ্চাই সেগুলো পরে আছে, আলগা ডায়াপারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে গুয়ের স্রোত ।
    নবনীতা সৌদামিনিকে বকুনি দিতে, বুকে কাপড় চেপে ও সমরেন্দ্রর দিকে চোখ কুঁচকে তাকালে, সমরেন্দ্র সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে বলেছিল, কত কাজ করবে ও, সারা বাড়ির ফাই ফরমাস, তারপর দু-দুটো বাচ্চা সামলানো ।
    --ও, কাজের বউ তার মালিকের মুখ নিজের বুকে গুঁজে খাটছিল, তাই না ? দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল নবনীতা।
    --ও তুমি বুঝবে না, যাদের হৃদয় বড়ো হয় তাদের বুকের মাপও বড়ো হয় । সমরেন্দ্রর উত্তর ।
    --হৃদয় বড়ো না ছোটো তা বিয়ের আগে তো আন্দাজ করে থাকবে ?
    --তখন তো দেখে মনে হয়েছিল হৃদয় যথেষ্ট বড়ো । তা যে নকল কী করে জানব ?
    --নকল হৃদয়ের সুধারস পান করার সময় তো উচ্ছ্বসিত হতে ।
    হাঁ করে তাকিয়ে থাকা সৌদামিনীকে বুঝিয়েছিল সমরেন্দ্র, হৃদয় মতলব দিল, যিস অওরতকা দিল জিতনা বড়া, উস অওরতকা ছাতি ভি উতনাহি বড়া হোতা হ্যায় ।
    সমরেন্দ্র যখন ডিউটি আওয়ার্স পালটে রাতের শিফট নিল, সন্দেহে জারিত নবনীতা সেদিনই নির্ণয় নিয়েছিল যে ব্যাপারটাকে এবার ট্যাকল করতেই হবে । একদিন অফিস যাবার নাম করে অফিসে না গিয়ে বন্ধুদের বাড়িতে সময় কাটিয়ে দুপুর বারোটা নাগাদ পা টিপে-টিপে ওপরে উঠে দরোজা আলতো ফাঁক করে দ্যাখে সৌদামিনি আর সমরেন্দ্র দুজনে উলঙ্গ হয়ে ঘুমোচ্ছে বিছানায় । তিনতলার ছাদে কেউ আসে না ভেবে ওরা দুজনে বেপরোয়া হয়ে গিয়ে থাকবে, তাই দরোজা বন্ধ করার প্রয়োজন মনে করেনি ।
    বড়জেঠি আর রাঙাকাকিকে চুপচাপ ডেকে এনে, দরোজা ঠেলে, সৌদামিনী পর্বের শেষ দৃশ্যের অভিনয় নবনীতা দেখিয়ে দিয়েছিল ওনাদের । তাৎক্ষণিক ঝগড়া, বড়ো-হৃদয়ের প্রাপ্তি সম্পর্কিত বুকের আদল, ইত্যাদি প্রগাঢ় মন্তব্য । তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে নবনীতা সোজা বাপের বাড়ি, কয়েকদিন পর ডিভোর্সের নোটিস, ব্যাস। সমরেন্দ্র চালান হল দুই শিশুর সঙ্গে একতলায়, কেননা শিশুদের দেখাশোনা যাঁরা করবেন তাঁদের একতলা-তিনতলা করার ক্ষমতা ছিল না ।
    ইতু পেয়ে গেল ঘরটা । রুকমিনি পেয়ে গেল চাকরি ।
    সমরেন্দ্র আর বিয়ে করেনি । এখনও নাইট ডিউটি করে । দুপুরে বেরিয়ে যায় খেয়েদেয়ে, যেখানে যায় সেখান থেকেই নাইট ডিউটি করতে চলে যায় । বাড়ির সবাই জানে কোথায় যায় । রুকমিনি পেছন-পেছন গিয়ে দেখে এসেছে, সৌদামিনীর বস্তির ঘরে ঢুকছে সমরেন্দ্র । সৌদামিনীর তিন মাসের বাচ্চাটা যে সমরেন্দ্রর তাতে কোনো সন্দেহ নেই, অত চেকনাই-মার্কা বাচ্চা কী করেই বা হবে ! সৌদামিনী সাঁওলা ওর পালিয়ে-যাওয়া বর কালো । বাচ্চা চেকনাই-মার্কা বলে সৌদামিনীর কত গর্ব, রুকমিনিকে বলেছিল, এরকম খোকা-বাচ্চা তোর কোনো কালেই হবে না ; পারিস তো করে দ্যাখা । অটোতে বসিয়ে সৌদামিনীকে কুর্জি হোলো ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল সমরেন্দ্র, বাচ্চা হবার সময়ে, ফর্মে বাপের জায়গায় নিজের নামই লিখেছে, রুকমিনিকে জানিয়েছে সৌদামিনী, নিজের স্কুটারের পেছনে বসিয়ে পোলিও ড্রপস খাওয়াতে, ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায় ওর বাংগালি আদমি, সাচ্চা দিলওয়ালা ।
    সমরবাবু বাচ্চাটার খাওয়াপরার খরচ দ্যায় আর বলেছে বড়ো হলে ওকে ভালো আংরেজি স্কুলে পড়াবে ।
    --কী করে শুরু হল তোদের প্যার-মোহোব্বত ? জানতে চেয়েছিল রুকমিনি ।
    --বাচ্চা দুটো একদিন ভিষণ কাঁদছিল, একেবারেই চুপ করছিল না, কী করব ভেবে পাচ্ছিলুম না, তো সমরবাবু বলল, তোর দুই বুকে বাচ্চা দুটোর মুখ গুঁজে দে না, তোর বুক তো নবনীতা মেমসাবের চেয়ে বড়-বড় । আমি বললুম আমার বুকে তো দুধ নেই, ওরা কি হাওয়া খেয়ে চুপ করবে ? জবাবে সমরবাবু বললে, বাচ্চারা যেভাবে চুষিকাঠি চুষে ঘুমিয়ে পড়ে, তুই ওদের মুখে তোর বুক গুঁজে দ্যাখ চুপ করে যাবে, ঘুমিয়েও পড়বে । সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ল বাচ্চা দুটো । সমরবাবু আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল । আমি বললুম, আমি রোজ-রোজ একাজ করতে পারব না । সমরবাবু জিগ্যেস করল, কেন, তোর অসুবিধা কিসের । আমি বললুম, বাচ্চারা আমার বুক চুষলে গা থিরথিরিয়ে যায়, মনে হয় কাউকে জড়িয়ে ধরি । তা সমরবাবু তক্ষুনি আমায় জড়িয়ে ধরলে পেছন থেকে আর বললে, যখনই তোর শরীর থিরথিরোবে, আমাকে বলবি, আমি শান্ত করে দেব । তারপর তো সমরবাবু দিনের বেলার অফিসের ডিউটিকে রাতের ডিউটি করে নিলে, আমরা দুজনে মিলে বাচ্চা দুটোকে ঘুম পাড়িয়ে, নবনীতা দিদির বিছানায় শুয়ে পড়তুম । কত রকম ভাবে প্যার-মোহোব্বত করতে পারে সমরবাবু ; কাঁইচিমার মোহোব্বত করতে শিখিয়েছে । চুল ওঠাবার কিরিম, বগলের পাউডার, বুকের কিরিম, গায়ে গন্ধমাখার গ্যাসের টিন, শ্যাম্পু, লিসটিপ, প্যার-মোহোব্বত করতে গেলে এসব জিনিস কত দরকার তা সমরবাবুর চেয়ে ভালো কেউ জানে না । নবনীতা দিদি জানবার পর আমাকে যখন বকুনি দিচ্ছিল, সমরবাবু নবনীতাকে গালে কষে দিয়েছে এক থাপ্পড়, এইসান, ধাঁয় । ওনাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, আমি সমরবাবুকে পেয়ে গেলুম, এখন আমি ডবল মাইনে পাই, কাজও করতে হয় না ।
    ডিভোর্স দেয়া সমরেন্দ্রর বউ নবনীতা এখন নিজের মারুতি গাড়ি চেপে অফিস যায়, নিজে চালায় । বলেছে, যাদের বাড়ির পদবি নিয়ে বাচ্চা দুটো জন্মেছে, তারাই মানুষ করুক । সৌদামিনীকে স্কুটারে পেছনে বসিয়ে, রাজপথে নবনীতার গাড়ি দেখতে পেলে, তার পাশাপাশি চালায় সমরেন্দ্র । নবনীতার দিকে বাচ্চাটাকে তুলে দেখিয়েছে সৌদামিনী, বত্রিশপাটি হাসি ফুটিয়ে । সেই ঘটনার পর, আইনত নিষিদ্ধ হলেও, গাড়ির কাচে কালচে সানফিল্ম লাগিয়েছে নবনীতা ।

    আট
    ইতুকে দেখে অবাক হননি সুশান্ত ঘোষ, কেননা ইতু বাসে বসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে গর্দানিবাগের বাড়িতে অমিত বর্মণ এসেছে আর ও আজকেই অমিতের সঙ্গে পালাচ্ছে, সুশান্তজেঠুর বাড়িতে যাবে, বাসস্ট্যাণ্ডে সুশান্তজেঠু যেন ওদের নিতে আসেন । তার আগে সুশান্তর বড়জেঠি, মানে ইতুর বটঠাকুমা, ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, দ্যাখ ইতু আর তোর ছেলেবেলাকার বন্ধু অতনুর ছেলে অমিত তোর বাড়ি পৌঁছোল বলে, এখানে হইচই ফেলে চলে গেছে, যা করেছে একশবার ভালো করেছে, ওদের মুখেই শুনিস ।
    বাসস্ট্যাণ্ডে বোলেরো নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সুশান্ত ঘোষ। দিয়ারায় পৌঁছে, পটলের পাহাড়, তরমুজ-শসা-ফুটির ডাঁই দেখে ইতু বলল, এ তো বেশ ভালো জায়গা গো, ভিলেজ-ভিলেজ টাইপ, যেমন টিভিতে দেখি । দিনকতক থেকে গেলে হয়না এখানে ?
    --না না, প্রায় আঁৎকে বলে উঠল অমিত, যত তাড়াতাড়ি কেটে পড়া যায় ততই সবায়ের মঙ্গল ।
    --ঠিক আছে, যাসখন, কালকে সকালে তোদের জন্যে নৌকো করে দেব । আজকে রেস্ট নিয়ে নে । আমরা কি খাই কোথায় শুই এসব দেখে যা । আমাদের জীবন কম রঙিন নয় । আমার বউ, শশুর, শাশুড়ির সঙ্গে আগে পরিচয় করিয়ে দিই তোদের ।
    --হ্যাঁ, আমি তো আজ পর্যন্ত তোমার শশুরমশায়কে দেখিনি, শুনেছি যে উনি গর্দানিবাগের বাড়িতে এসে তোমাকে ফেরত দেবার জন্য দশ লাখ টাকা চেয়েছিলেন ।
    --উনি যখন জেঠা-বাবা-কাকার কাছে র‌্যানসাম চাইতে গিয়েছিলেন, তার আগেই বেবির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। উনি জানতেন যে বাবা-জেঠারা ফোতো-বড়োলোক, আর দশ লাখ টাকা দেবার মতো ক্ষমতা বাবা আর জেঠাদের নেই ।
    অমিত বলল, তোমার লাইফটা আনবিলিভেবল । অ্যাডভেঞ্চারস ।
    --এখানে এসে টের পাচ্ছি গো, কী ধরনের বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছ নিজের জীবনে । ইতু বলেছিল ।
    সুশান্ত, এই যে আমার বউ বেবি, বলতে, একজন ঢ্যাঙা কালচে কৃশতনু যুবতী, দেখলেই বোঝা যায় সাজগোজ করে পারফিউম মেখে এলো, অমিত আর ইতুর পায়ে দুহাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল । সুশান্তর বউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে আরম্ভ করল ইতু, কেঁপে-কেঁপে কাঁদতে লাগল । ইতু বলল, হিন্দিতে, তুমি আমাদের পায়ে হাত দিচ্ছ কেন ? বয়সে তুমি আমাদের বড়ো, তুমি তো আমার জেঠিমা হও ।
    বেবি : এই প্রথম শশুরবাড়ির লোক আমাদের বাড়ি এলো । শশুর শাশুড়িকে তো দেখিনি ; তাদের প্রণাম তোমাদের পায়ে রাখলুম ।
    সুশান্তর শশুর তারিণী মণ্ডল আর শাশুড়ি মন্হরা দেবী ইতুদের আসার খবর পেয়ে হাজির হলে, ছফিটের ঋজু পালোয়ানি কালো তারিণী মণ্ডলকে দেখে ইতু বলে ফেলল, তোমার শশুর তো একেবারে কোমোডো ড্র্যাগন গো, সেরকমই জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছেন । বলে ফেলে, বলল, সরি , ওনাকে দেখে বেফাঁস বেরিয়ে গেল মুখ থেকে।
    --বেফাঁস বেরোয়নি, উত্তর দিল সুশান্ত, তারপর যোগ করল, ইতু তোর অবচেতনে ওনার সম্পর্কে যে ভীতি জমে আছে তা থেকেই বেরিয়ে এলো কোমোডো ড্র্যাগনটা । ঘাবড়াসনি, উনি কোনো ড্র্যাগনের কথাই জানেন না, নিজেকে ছাড়া ।
    তারিণী মণ্ডলের শাশুড়ি বলল, এতদিন পরে আত্মীয়দের সঙ্গে জামাইবাবার খাঁটি বাংলায় কথা বলার সুযোগ হল । বলে নাও, বলে নাও, তারপর আমাদের পালা । অমিত-ইতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার নাতিও বাংলা, আংরেজি, হিন্দি, ভোজপুরি, মৈথিলি বলতে পারে ।
    তারিণী মণ্ডল গমগমে কন্ঠস্বরে গর্ব ঝরিয়ে বলল, আমার নাতি বাংলা বলতে, লিখতে আর পড়তে পারে। ইংলিশে কথা বলতে পারে, একদম আংরেজ পলটন জইসন ।
    বেবির প্রশ্নাতুর ভ্রু দেখে অমিতের মনে হল, এনারা বোধহয় প্রণাম বা নমস্কার আশা করছেন ওদের তরফ থেকে ; বেবি এসেই ঝপ করে দুজনের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছে । ইতু নির্ঘাত প্রণাম করতে চাইছে না, হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করতেও ওর বাধো-বাধো ঠেকবে, একে বিহারি তায় আবার শিডুলড কাস্ট, হয়ত জীবনে কোনো বিহারির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেনি । হাতজোড় করে নমস্কার করাটাও বিসদৃশ । অমিত আচমকা সবাইকে অবাক করে দিয়ে মুঠো পাকিয়ে নির্বাক রেড স্যালুট দিল সুশান্তর শশুর-শাশুড়িকে । দেখাদেখি ইতুও তাই করল ।
    তারিণী মণ্ডল বলল, চাবস চাবস, এই তো চাই, নেতাজির মতন স্যালুট দেবে, বলে, সুভাষচন্দ্র বসুর নাম উচ্চারিত হলেই যা করে থাকে, উরুতে চাপড় মেরে বিব্রত করল নিজের জামাই আর তার অতিথিদের । মন্হরা দেবী বেবিকে হুকুম দিল, এই বেবি, আজকে ওদের জন্য একটা কচি শুয়োর কাটতে বল, গরম-গরম শুয়োরের মাংস আর পুদিনার চাটনি দিয়ে ভুট্টার রুটি খেয়ে যাক ।
    শুয়োরের মাংস খেতে হবে শুনে অমিতের কব্জি আঁকড়ে ফেলেছিল ইতু । অমিত ফিসফিস করে বলল, যেখানে যাচ্ছ সেখানে হয়ত মহুয়ার রুটি আর ভাল্লুকের মাংস খেতে হতে পারে । পরে, নৌকোয় করে যাবার সময়ে, ছইয়ের ভেতরে বসে, নদীর ছলাৎছলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অমিত গল্প করেছিল মুরিয়া, মাড়িয়া, গোঁড় উপজাতিদের জীবন নিয়ে । অবুঝমাড়ের পাহাড়ি মানুষদের বিভিন্ন গোষ্ঠীদেবতা আছে । নাগবংশ, যারা কেউটে সাপের পুজো করে বলে কোনো সাপ খায় না, মরা সাপ দেখতে পেলে সেদিন শোক পালন করে গোষ্ঠীর সবাই । তেমনই আছে কাছিমবংশ, বকরাবংশ, বাঘবংশ, আর বোধমিকবংশ, মানে মাছের বংশ ।
    --হ্যাঁ, তাহলে আজকে থেকে অভ্যাস করে নিই । বমি পায় পাক, বমি করতে-করতে তো পোয়াতিরাও অভ্যস্ত হয়ে যায় ; প্রসবের অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগে বারবার বাচ্চার জন্ম দেয় । ইতু বলল ফিসফিসিয়ে । শুয়োরের মাংস তবু খেলো না ইতু, বলল, এখন পারছি না, ক্রমশ অভ্যাস করব । সুশান্তর ঘরে খেতে বসে বেবির দেয়া সিম আর ফুলকপির আচার দিয়ে মকাইয়ের রুটি খেলো । বিভিন্ন ব্র্যাণ্ডের বডি পারফিউম দেখে ইতু বলল, তুমিও তো তোমার এই জীবনে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারোনি দেখছি ।
    বেবি : ওই সব গ্যাসগুলো নাআআআ ? ফিকফিকে দাঁতে বলল বেবি, ডেওডেরেন্টের দিকে তাকিয়ে ইতুকে কথা বলতে দেখে, ওই গ্যাস আমার গায়ে না মারলে আমার ঘুম আসে না ।
    ইতু : কার ঘুম আসে না ? তোমার না আমার জেঠুর ?
    বেবি : আমাদের দুজনেরই । তুমি নিয়ে যাও না কয়েকটা গ্যাস, বেশ ভালো লাগবে । দুজনে ঘুমোতে পারবে ।
    --আর ওই কসমেটিকসগুলো ? বউকে তো হাল ফ্যাশানের সাজগোজের জিনিস কিনে দাও দেখছি, বলল ইতু ।
    --আমি কিনে দিই না, বেবি টিভিতে দ্যাখে আর কিনতে লোক পাঠায় । বলল সুশান্ত, শুয়োর মাংসের বড়ার ঢেঁকুর তুলে ।
    --সুশান্তজেঠু তোমার কাছে যদি থাকে তো তুমি ইতুকে মশা থেকে বাঁচার ক্রিম দিতে পারো, গিয়েই হয়তো অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না । অমিতের প্রস্তাব ।
    --আমি নিয়ে নিয়েছি সঙ্গে, কোথায় থাকবো শোবো কিছুই তো জানি না, প্রথম-প্রথম লাগবে । ওষুধ-বিষুধও নিয়েছি ।
    --অ্যালোপ্যাথিক ? প্রশ্ন করল অমিত ।
    --হ্যাঁ, হারবাল মেডিসিন তোদের চারপাশ থেকে যোগাড় করে নেব ।
    --তোর দলের ডাক্তারের অভাব পুরণ করে দিল ইতু। বলল সুশান্ত ।
    --তোমার ছেলের নাম কি গো, গর্দানিবাগে তোমরা যখন এসেছিলে, আমি ছিলুম না ? জানতে চাইল অমিত ।
    --অপু, সুশান্ত বলার আগেই জবাব দিল ইতু ।
    --ওর নাম আপ্রাধি ঘোষ, বলল বেবি, অপু আর নাম এই শব্দ দুটো থেকে প্রশ্নটা অনুমান করে ।
    সুশান্ত বলল, সামান্য হেসে, বেবি টের পাবে না এমন করে, ওর দাদুর মতে মহাকবি বাল্মিকী ছিলেন ওনার মতনই অপরাধী, তিনি যদি পূজিত হন, তাহলে কারোর নাম অপরাধী হলে সে পূজিত হবে না কেন । এরা সবাই জানে যে আমার ছেলের নাম আপ্রাধি : আমি স্কুলে ওকে অশ্বমেধ নামে ভর্তি করেছি, স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট, বি এ পাশের ডিগ্রিতে আমার দেয়া নামটাই আছে । ছেলেকে বলা আছে যে এ-কথা এনাদের কাছে ফাঁস করার প্রয়োজন নেই, ওনারা যে নামে ডাকতে চান ডাকুন, পরিচয় করাতে চান, করুন ।
    --তুমি কিন্তু একেবারে বদলে গেছ, তাই না, উচ্চমাধ্যমিক দেবার পর বাড়ি ছেড়ে ? অমিতকে বলল সুশান্ত । ইতুর কাছে শুনলুম এন জি ওতে ঢুকে দেশোদ্ধারের কাজ নিয়েছ।
    --দেশোদ্ধার ? এই দেশের ব্যবস্হাকে আমূল উপড়ে না ফেললে, কারোর উদ্ধার হবে না । বাবার আওড়ানো বুলিকে, প্রয়োগ করল অমিত, তারপর বলল, তুমিও তো অন্যমানুষ হয়ে গেছ , দেখে মনে হচ্ছে, নিজের মতন করে শোষণের বিরুদ্ধে লড়ছ ।
    --না আমি সেই লোকটাই আছি, কেবল অভ্যাসগুলো পালটেছে । টাকাকড়ি করার লোভ ছিল, তা করেছি, আয়েস করার লোভ ছিল তা করছি । মানুষের ওপর আধিপত্যের নেশাই আলাদা, ও তুমি বুঝবে না, কারোর বিরুদ্ধেই লড়ছি না ; আর শোষণের বিরুদ্ধে ? কই ? বরং শোষকের সিংহাসনে বসে পড়েছি হে । শোষিতরা শোষকের আনন্দের মজা বুঝতে পারে না । ধার্মিক গুরুদের দেখেছ তো ? অনেকটা সেরকম । নিজেকে নিঃশব্দে বললেন, আমি আমার বিরুদ্ধে লড়ছি ।
    --ঈশ্বরে বিশ্বাস এটসেটরা হিন্দুগিরি করছ নাকি, চারিপাশে তাকিয়ে টের পাচ্ছি । রসুন, পেঁয়াজ, আদাবাটা, বেসন মাখানো, হামান দিস্তেতে থেঁতো করা শুয়োরের মাংসের বড়ে খেতে-খেতে বলল অমিত ।
    --ইসওয়র নাআআআআ ? ছট পুজা করতে হ্যাঁয় ইনকে খাতির, বলে, সুশান্তর দিকে ইঙ্গিত করল বেবি ; আপ ভি কিজিয়েগা ইতু দিদি, আপকে আদমি কা লমবিইইইই জিন্দগি কে লিয়ে ।
    --ঈশ্বর ? ইউ মিন গড ? ইয়েস, গড ইজ ওমনিকমপিটেন্ট ওমনিপ্রেজেন্ট । আই অ্যাম গোইং টু গেট হিম ইরেজড ওয়ান ডে, ওনার অবসান পৃথিবীতে অবধারিত । বক্তব্য রাখতে গিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন সুশান্ত ।
    --বদলাওনি দেখছি, বলল ইতু, আগে গর্দানিবাগের বাড়িতে যেমন বলতে, তেমন ধরনের কথাই বলছ, ভগবানের ওপর বেশ চটে আছ, তাই না ? এখন আর কি, এখন তো তুমিই-ই ভক্তের ভগবান, দেখতেই পাচ্ছি এসে অব্দি ।
    --হ্যাঁ, শুধু ঈশ্বর বদলে-বদলে যেতে থাকে । তারপর জিগ্যেস করলেন, আমার আর অতনুর বন্ধুবান্ধব, যেমন অরিন্দম মুখার্জি , মৌলিনাথ, মাহমুদ জোহের, এরিক পেজ, মলয় রায়চৌধুরী, ওদের খবর জানিস নাকি ইতু ? দেখা-সাক্ষাৎ হয় ? সবাই বুড়ো হয়ে গিয়ে থাকবে বোধহয় ; আমিই কেবল যুবক থেকে গেলুম, বেবি আর বেবির বাবা-মায়ের খাঁচার খাবার-পানীয় সেঁটে ।
    --তোমাদের অফিসের শ্যামলী কর্মকারকে মনে আছে ? যার পিঠে শিরদাঁড়ার দুপাশে জড়ুল, যেন প্রজাপতির ডানা, দেখাবার জন্য পিঠখোলা ব্লাউজ পরেন ? ওনার মেয়ে তো আমার বন্ধু । সব খবরই পাই । অরিন্দম ওনার সাঁওতাল গার্লফ্রেণ্ডের সঙ্গে কার অ্যাকসিডেন্টে পুড়ে মরে গেছেন, কলকাতায় । মৌলিনাথ কিডনি ফেল করে মরে গেছেন, কলকাতায় । মাহমুদ জোহের দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন, করে, সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পা ভেঙে হুইলচেয়ারে জীবন কাটাচ্ছিলেন ; একদিন এক যুবক এসে মাহমুদ জোহেরের চোখের সামনেই ছোরা মেরে-মেরে ওনার দ্বিত্বীয় বউটাকে মেরে ফেললে, পাটনায় ; যুবক ছিল দ্বিতীয় বউয়ের প্রেমিক ।
    --সে কি !
    --হ্যাঁ গো । এরিক পেজ পাগল হয়ে গেছেন, বাড়িতে ওনাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে, মোকামায় ; শুনেছি যে যখন বেশি চেঁচামেচি-গোলমাল করেন তখন ওনার হাতে একটা ব্রিটিশ আমলের রুপোর টাকা গুঁজে দিলে চুপ করে যান, আর টাকাটাকে শুধিয়ে-শুধিয়ে, হ্যালো মাউন্টব্যাটেন সাহেব, আপনি চলে গেলেন কেন, এখন আমাদের কী হবে, ইনডিয়াকে ফ্রিডাম দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু বেইমানি করে চলে গেলেন, কেউ-কেউ ফ্রি হল, সবাই কেন হল না, ডেডউইনা মাইয়া, ডেডউইনা মাইয়া, ডেডউইনা মাইয়া, এই ধরনের কথা বলে নিজের মনে বকবক করেন ।
    --পাগল হয়ে গেল ? অতনুদের গ্যাঙের তো ও লিডার ছিল রে ! অমিতের দিকে ফিরে বললেন, সরি অমিত, তোমার বাবার অন্যধরণের বন্ধুবান্ধবও ছিল, নারী-নারকটিক গ্যাঙ বলত সবাই ।
    --মলয় রায়চৌধুরী, নোট পোড়াবার চাকরি ছেড়ে, পাটনার বাড়ি ছেড়ে, গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরি নিয়ে কলকাতা চলে গেছেন; পাটনায় এসে হোটেলে উঠেছিলেন, এসেছিলেন আমাদের বাড়ি, বউকে নিয়ে । পাটনার বাড়িটা আর বসবাসের মতন নেই জানিয়েছিলেন, ওনার পাটনার বাড়ির লাইব্রেরি থেকে হাজার খানেক বই রঞ্জিত ভট্টাচার্য নামে ওনাদের এক আত্মীয় চুরি করে নিয়ে চলে গেছে । কলকাতায় আবার নাকি অনেক বই জড়ো করেছিলেন, মুম্বাই যাবার সময় সেসব বই যাকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, সেই লোকটাকে রাজনৈতিক মাস্তানরা এমন পিটুনি দিয়েছিল যে মরো-মরো লোকটা প্রায় ছয় মাস ভেলোরে ট্রিটমেন্টের পর সুস্হ হয়েছে, কিন্তু হিন্দু বাঙালিদের ওপর চটে গিয়ে খ্রিস্টান হয়ে গেছে, চার্চ-টার্চ যায়।
    -- ওঃ, তুই তো অনেক খবর রাখিস রে । সমরেন্দ্রর কী খবর ?
    --সমরজেঠুর গোলমালের কথা তুমি কী করে জানলে ? জিগ্যেস করল ইতু ।
    --বড়জেঠিমাকে মোবাইল কিনে দিয়ে এই সুযোগটা পেয়েছি, উনি বহুক্ষণ আমার সঙ্গে গ্যাঁজাতে ভালোবাসেন । ওনার কাছ থেকে বাড়ির সব খবর পেয়ে যাই । বাংলায় কথা বলার সুযোগ পাই । আমি ওনার বেশ কিছু গল্প মোবাইলে রেকর্ড করে ল্যাপটপে ধরে রেখেছি । শুনি মাঝে-মাঝে ।
    --সমরজেঠুর লেটেস্ট সমস্যার কথা বলেছে জেঠি ?
    --কী সমস্যা ?
    --সৌদামিনীর বাচ্চাটাতো বেশ ফুটফুটে ক্যালেণ্ডার-খোকা হয়েছে । নবনীতাজেঠির দুই যমজ ছেলের চেয়ে ভালো দেখতে । তো সেই বাচ্চাটাকে মহাবীর নেমিচাঁদ নামে একজন বিলডার-কনট্রাক্টার লিফ্ট করিয়ে নিয়েছিল । বিলডারটার দুটো মেয়ে আছে, নয় বছর আর চোদ্দো বছরের ; তবু ব্যাটা ছেলে-ছেলে করে অবসেসড ছিল । সৌদামিনী একদিন অটো করে বাচ্চাটাকে খগোলে ওর বাপের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল মা-বাবাকে দেখাবার জন্য, তখন মোটর সাইকেলে দুজন লোক বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিয়ে দে চম্পট । সৌদামিনী, জানো বোধহয়, কেমন চালাকচতুর মেয়ে, মোটর সাইকেলের নম্বরটা মনে রেখেছিল । সমরজেঠুকে সঙ্গে নিয়ে কোতোয়ালিতে কমপ্লেন করার বারো ঘন্টার মধ্যে বাচ্চাটাকে ফেরত পায় ওরা । সবসুদ্দু সাতজন লোক ধরা পড়েছে । নেমিচাঁদ নাকি ওর বউকে সঙ্গে নিয়ে দানাপুরের এক মন্দিরে পুজো দিয়ে বেরোবার সময় সিঁড়িতে বাচ্চাটাকে পেয়ে ওর বউকে বুঝিয়ে ছিল যে বাচ্চাটা ঈশ্বরের দান । যে গুণ্ডাগুলোকে দিয়ে লিফ্ট করার কাজে লাগিয়েছিল, তারা, পরিকল্পনা অনুযায়ী বাচ্চাটাকে মন্দিরের সিঁড়িতে রেখে দূরে দাঁড়িয়ে বাকি পেমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখনই পুলিশ ওদের পাকড়াও করেছে । নেমিচাঁদ সৌদামিনিকে প্রোপোজাল দিয়েছে যে মামলাটা তুলে নিলে দুলাখ টাকা দেবে । সৌদামিনী সমরজেঠুকে সঙ্গে নিয়ে নেমিচাঁদের বাড়ি গিয়েছিল, এক লাখ টাকা নিয়ে নিয়েছে বিল্ডারটার কাছ থেকে, কিন্তু মামলা এখনও ফেরত নেয়নি সৌদামিনী, সমরজেঠু চাপ দিচ্ছে অ্যামাউন্ট বাড়াবার জন্য । পাটনার হিন্দি কাগজে তো সৌদামিনী আর সমরজেঠুর কোলে ওর বাচ্চা নিয়ে ফোটো বেরিয়েছিল, দেখোনি ?
    অমিত অবাক তাকিয়েছিল ইতুর দিকে । গল্প শেষ হলে বলল, যেখানে যাচ্ছ সেখানে কোনো গল্প পাবে না, কেবল শোষণ, অস্বাস্হ্য, মৃত্যু আর গুলিবারুদের রক্ত হিম করা গল্প পাবে । দারিদ্র্য, ক্ষুধা, শোষণ আর বঞ্চনার প্রতিদিনকার সত্যকার ঘটনা স্বচক্ষে দেখবে ; তোমার এই গোপ্পুড়ে মস্তিষ্ক এখানে দিয়ারার গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে যাও । বাবার বক্তৃতার কয়েকটা কথা, যে কথাগুলোকে, শুনে-শুনে, অমিত মনে করে কিতাবি-বাকোয়াস, ব্যবহার করার সুযোগ ছাড়ল না ।
    উচ্ছ্বাসকে সামলে ইতু বলল, সরি, সুশান্তজেঠুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেই ছোটোবেলায় ফিরে গিয়েছিলুম, যখন ডাইনিং টেবিলে বসে বড়োরা সবাই মিলে শহরের নানা কেচ্ছা আলোচনা করত, আর আমরা ছোটোরা শুনতুম, তুইও তো হাঁ করে শুনতিস, ভুলে গেলি কেন ।
    --দু-দুটো মেয়ে রয়েছে লোকটার, আবার ছেলের কী দরকার ? মেরে ফেলা মেয়ের কথা মনে পড়ল সুশান্তর, ওকে তো সেই মেয়ের মুখও দেখতে দেয়া হয়নি ।
    --সৌদামিনীর বডি দেখলে মাথা বিগড়োবেই । বটঠাকুমা বলেছিল যে একে রেখো না, এর ভাবগতিক ভালো নয়, কাজের বউয়ের অমন খাঁজ-দেখানো লোকাট ব্লাউজ কেন ? কিন্তু সকলে মিলে সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে বলেছিল যে তিন তলা বাড়ি ঝ্যাঁটানো, পোঁছা আর এতগুলো লোকের বাসন মাজার জন্য উপযুক্ত স্বাস্হ্য থাকা জরুরি ।
    সুশান্ত : আমার কাছে অমরেন্দ্রর গল্পটাও রেকর্ড করা আছে । বড়জেঠি বলেছিল একদিন, শুনবি ?
    ইতু : শোনাও, বড় জেঠি ভেতরের খবর আরো বেশি জানেন । অমরকাকু চলে গেছে ব্যাঙ্গালোর । কী করবে বল ? বউ পালিয়ে গেলে পুরুষদের যে কী অবস্হা, যেন জাঁতিকলে পড়া জ্যান্ত ইঁদুর । অমিতের দিকে ফিরে ইতু বলল, তুই তো জানিস, অমরেন্দ্রকাকু আমাদের নতুনদাদুর ছেলে, ব্রিলিয়ান্ট ছিল, খড়গপুরে পড়েছে, নতুনদাদু ওকে পড়াবার জন্য মেমারির তিন কাঠা জমি বিক্রি করে টাকা তুলেছিলেন ।
    অমিতের উদাসীন মুখের পানে তাকিয়ে ইতু টের পেল যে প্রসঙ্গটা তোলা উচিত হয়নি । অমিতের মা মানসী বর্মণ, পালিয়ে না গেলেও, স্বামীর উপস্হিতিতেই আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে অমিতের জন্ম দিয়েছেন । হয়ত অমিতের বাবা-মা সেই কারণেই অমিতকে মানুষ করার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন রাঙাকাকু-কাকিমার ওপর ; ওনারা অমিতকে আইনত দত্তক নিয়ে নিলে অমিত নিশ্চই গর্দানিবাগের বাড়ি থেকে অমনভাবে উধাও হয়ে যেত না ।
    সুশান্ত : শোন । স্পিকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দিই ।
    ইতু : তোমার তরমুজ মদ দাও তো একটু, খেয়ে দেখি, হুইস্কি, রাম, ব্র্যাণ্ডি, জিন, ভোদকা খেয়েছি, চিড়াইয়াটাঁড়ের দেশিদারুও খেয়েছি, এই ধরণের রঙিন কান্ট্রি লিকার খাইনি । বার্থ ডে সেলিব্রেট করতে বার-রেস্তরাঁয় গেলে, বাবা বিয়ার এলাউ করত, বড় জোর, দু’পেগ প্রিমিয়াম হুইস্কি ।
    সুশান্ত । এই নে, চুমুক দিতে-দিতে শোন ।
    ...এদিকে কী হয়েছে জানিস তো...অ্যাঁ...অমরের বউটা একজনের সঙ্গে পালিয়েছে...অমর রে...অমরেন্দ্র...প্রেম করে বিয়ে করেছিল...আই আই টিতে পড়ার সময়ে...বামুন বাড়ির মেয়ে...তুই তো দেখিসনি….বাবা...কী দেমাগ...মাটিতে পা পড়ে না...পালিয়েছে এক ব্যাটা তামিলিয়ানের সঙ্গে...কোথায় জানিস...আমেরিকা...অমর কেন জানতে পারেনি...তুই-ই বল...পাসপোর্ট ওর বউয়ের আগে থাকতেই ছিল...কবে ভিসা হল...কবে টিকিট হল...কাকপক্ষীও টের পায়নি...আচ্ছা তুই আমাকে বল...অমর কেন জানতে পারেনি না যে ওর বউ কার সঙ্গে মিশছে...কোথায় যাচ্ছে...রাত করে কেন ফিরছে...অমরের মতন পুরুষদের উচিত শাস্তি...ওরা বউকে মনে করে যেন ফলের গাছ...যখন ইচ্ছে এই ডাল থেকে আম খাচ্ছি..ওই ডাল থেকে লিচু খাচ্ছি...সেই ডাল থেকে আপেল খাচ্ছি...তা খাচ্ছিস তো খা না...কে বারণ করেছে...কিন্তু বউ তো আর গাছ নয়...যে এক জায়গায় শেকড় বসিয়ে সারা জীবন তোমার পোঁতা মাটিতে থেকে যাবে...আর তুমি আজ হিল্লিতে কাল দিল্লিতে যত্তো নচ্ছার বন্ধুদের সঙ্গে বেলেল্লাপনা করে বেড়াবে...বউয়েরও তা সাদ আহ্লাদ আছে...শরীর আছে...রসের চাহিদা আছে...তাকেও তো সময় দিতে হবে...বউকে অবহেলার ন্যায্য পুরস্কার পেয়েছে ব্যাটা...তুই তোর বউকে সময় দিস তো...তোর বউ অবশ্য পালাবে না...বউ তো গাছের মতন নয় যে নট নড়ন-চড়ন এক জায়গায় থেকে যাবে...এখন বোঝো...গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ঘুমোও...আর গাছের গুণকেত্তন করো খঞ্জনি বাজিয়ে...পরে আবার গল্প করব, অ্যাঁ...পার্কে বসে তোকে ফোন করছি রে...বাড়িতে কে আড়ি পেতে শুনবে...তার চেয়ে পার্কে আসি সকালে...ডায়াবেটিস কমাতে হলে নাকি দুবেলা হাঁটতে হবে...এই এক বেলাই হাঁটি...বিকেলে টিভিতে একটা প্রোগ্রাম হয়...মেজকত্তা কচুর লতি এনেছিল ভুল করে...লতির ঘণ্ট তোর প্রিয় ছিল বলে কাজের বউকে বললুম ফেলে দিয়ে আসতে… ও কী আর ফেলে দেবে...নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে নিজেদের মতন করে রাঁধবে….রাঁধলে তোর মা কান্না সামলাতে পারবে না….বিকেলে টিভির জন্য সময় পাইনা...ভালো থাকিস...তোর বউ ছেলেকে আশীর্বাদ দিস...সকালে পুজো-আচ্চা আছে...জানিস তো...
    ইশারায় বেবিকে ডেকে ইতুদের গিফ্ট দিতে বলল সুশান্ত, ইতু বলল, আরে তুমি বিয়ে করলে, নতুনবউকে গিফ্ট তো আমরাই দেবো, তোমার বউ কেন দেবে ? তুমি বরং আমাদের কিছু মোটা টাকা দিও । তোমার বউকে দেবার মতন আমার সঙ্গে অবশ্য কিছুই নেই । তোমার বউয়ের গালে বরং একটা চুমু দিই ।
    বেবি হাজার টাকার দুটো প্যাকেট এনেছিল । সুশান্ত বলল, ওরা যেখানে গিয়ে সংসার পাতবে সেখানে বোধহয় লোকে একশ টাকার নোটও দেখতে পায় না । শুনে, বেবি প্রকৃতই হতবাক, বলল, বাংগালের লোকেরা কি বিহারিদের চেয়েও কাংগাল ?
    সুশান্ত বলল, একশ আর দশ-পাঁচ টাকার প্যাকেট নিয়ে আয়, হাজার টাকা প্যাকেট খুলে নিয়ে আয় । এনে ইতুর ঝোলাতে রেখে দে ।
    --জি । আচ্ছা ।
    ইতু : এরকম করকরে টাটকা হাজার টাকার নোটের প্যাকেট ? এ তো আমিও দেখিনি গো !
    সুশান্ত : পলিটিশিয়ান আর ঠিকেদারদের দেয়া ডোনেশান । শশুরমশাই মাসোহারা পান ।
    ইতু : এরকম রাজত্ব পেয়েছ, সঙ্গে দীঘলচাউনি রাজকন্যা পেয়েছ । ও, তাই তো ভাবি, কীসের টানে আটকে রইলে । তোমার বউতো একেবারে হরিণী, অমন বড়-বড় চোখ, এই বয়সে ফিগারও মেইনটেইন করেছে, গায়ের রঙের কী করার আছে ! ওনার ব্যবহার অনেক মিষ্টি । ট্রফি বলে একটা কথা আছে, জানো তো, তোমার বউ হল সেই ট্রফি ।
    বেবি : হরণ ? না ওনাকে বাবা হরণ করে আনেননি, উনি নিজেই এখানে বাবার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন । তখন ওনাকে দেখতে অনেক ভালো ছিল, এখন মদ আর শুয়োরের মাংস খেয়ে-খেয়ে ভমচৌলা কুম্ভকরণ হয়ে গেছেন । ওনাকে দেখেই আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল । আমি কেন দিয়ারার অন্য কাউকে বিয়ে করতুম, বলুন, যখন এত ভালো পাত্র আমাদের দরোজায় শ্রীরামচন্দ্রের মতন এসেছে !
    সুশান্ত : আমাকে হরণ করার কথা বলছে না । বলছে যে তুই হরিণের মতন সুন্দরী ।
    বেবি হাঁটু মুড়ে ইতুর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলল, এতদিনে শশুরবাড়ির আশীর্বাদ পেলুম । ইতু ওর মাথা ধরে কপালে একটা চুমো দিল, বলল, তুমি তো বাক্যবাগীশ হরিণী গো, আমি ভাবতুম আমিই বুঝি গায়েপড়া বেহায়া ; সুশান্তজেঠু, আমার হয়ে তোমার বউকে একটা মুখরোচক চুমু দিও । নিজের দুই হাত থেকে চারগাছা চুড়ি আর কান থেকে টপ খুলে বেবিকে দিয়ে ইতু বলল, যেখানে যাচ্ছি সেখানে এগুলোর প্রয়োজন হবে না, তুমি রেখে নাও । বেবি সুশান্তর দিকে চাইতে, সুশান্ত বলল, লে লে, কুছ তো তুঝে তেরে সসুরাল সে মিলা ।
    --এই ছিঃ, গুরুজন না, ইতুর চুমু প্রসঙ্গে বলল অমিত ।
    --কোনো-কোনো গুরুজন ঝাঁসু হন, ইয়ার্কিকে প্রশ্রয় দিতে ভালোবাসেন । সুশান্তজেঠু তাদের এক ও অদ্বিতীয় । করে নিচ্ছি ইয়ার্কি । আর তো বোধহয় দেখা হবে না । তাছাড়া এই মদটা বেশ কড়া । তোমার ছেলে অপুকে দেখছি না, তোমার শশুরবাড়ির ট্র্যাডিশান ফলো করে ওর বিয়ে দাওনি এখনও ?
    বেবি বলল, আপ্পু নাআআআআ ? ওকে বিলেতে পাঠাতে চান উনি, আরও পড়াশুনা করার জন্য ; বিলেতে গেলে কি আর ফিরবে ? থেকে যাবে সেখানেই, টিভিতে দেখি, কত সুন্দর ওদেশের মেমরা, বুড়িরাও জোয়ান ।
    অপুর সঙ্গে ওদের দেখা হল না । অপু তো দিল্লিতে ।
    সুশান্ত ওদের নৌকোয় চাপিয়ে দিলে, গর্দানিবাগের বাড়িতে দেয়া মোবাইলটা গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছিল ইতু । সুশান্ত ওকে একটা চোরাই মোবাইল আর চারটে বেনামি সিমকার্ড দিয়েছেন ।
    অমিতরা চলে যাবার পর সুশান্তকে মনমরা দেখে মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বেবি জানতে চাইল, পুরোনো দিনের জন্য আপনার মন খারাপ লাগছে ?
    অমিত আর ইতু চলে যাবার পর সুশান্ত ঘোষের মনে হচ্ছিল যে উনি প্রকৃতপক্ষে একা, নিঃসঙ্গে । ওনার বউ রয়েছে, চারিপাশে হুকুমবরদার রয়েছে, শশুর-শাশুড়ি রয়েছে, তবু উনি একা বোধ করেন নিজেকে । কেন এমন হয় ? কিছুরই তো অভাব নেই । ঠাণ্ডা একটা চাঞ্চল্য, বিক্ষোভ, অজানা অসন্তোষ লুকিয়ে রয়েছে , সেন্স অব বিলংগিং নেই ওনার, সদা সন্ত্রস্ত থাকেন, ভয়ে নয়, সন্ত্রস্ত থাকার অবস্হানকে ভালোবেসে ফেলেছেন বলে । মনে করেন যে ওনার বাইরের সঙ্গে ভেতরের মিল নেই । হোক না অস্বাস্হ্যকর, তবু একা থাকতে ওনার ভালোলাগে । উনি তো সেই চাকরি করার সময় থেকে মিশে আসছেন সবায়ের সঙ্গে, ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে, কিন্তু দিয়ারায় স্হায়ী হবার পর থেকে আসেপাশের সবাই ওনাকে হতাশ করে চলেছে । উনি যেমন জগতসংসারের পরোয়া করেন না, তেমনই পৃথিবী ওনার পরোয়া করে না, জানেন উনি । এই যে অমিত বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতে চাইছে, রাষ্ট্রকাঠামো বদলে ফেলে ইউটোপিয়া আনার স্বপ্ন দেখছে, তাতে জগতসংসারের বয়েই গেছে । কাটার সময় শুয়োরগুলো যেমন আতঙ্কিত চিৎকার দেয়, তেমনই নিঃশব্দ চিৎকার ওঠে ওনার অস্তিত্ব জুড়ে । তিনি যেন তাঁর নিজের মগজের ফাঁকা পোড়োবাড়ির একমাত্র ভাড়াটে । কিসের সঙ্গে যে সংঘর্ষ করে চলেছেন তা উনি নিজেই জানেন না । কে জানে কোন আড়ালে ওৎ পেতে আছে বিষণ্ণ আতঙ্ক, ঘষা কাচের ভঙ্গুর আদলে ভেসে বেড়াচ্ছে শরীরময়, পেটের ভেতরের কুনকি-হাঁস, যাকে তরমুজের মদ প্রতিদিন গিলিয়েও বশে আনা যাচ্ছে না । বেবির সমর্পিত ভালোবাসার অতিউন্নত খোঁয়াড় সত্ত্বেও নিজেকে কেন অসম্পূর্ণ মনে হয়, পার্থিব সব কিছু পাবার পরও, চাহিদা মেটার পরও, নিজেকে অতৃপ্ত মনে হয়, আর এগুলো তো স্হায়ী হয়ে গেছে। এ থেকে যে মুক্তি নেই, তা আরও বিষময় যন্ত্রণাদায়ক এক সমস্যা ।

    নয়
    দিয়ারার আসেপাশের জলে মাছ ধরতে হলে, নৌকো বাইতে হলে, সুশান্তকে, মানে জামাইবাবার নামে তাঁর শশুরকে, রংদারি ট্যাক্স দিতে হয় । এই মহার্ঘ বালিয়াড়িতে সরকার বলতে বোঝায় তারিণী মণ্ডলের জামাই, যাকে গ্রামের লোক আর প্রশাসনের লোকেরা যে-যার আতঙ্কের মাধ্যমে চেনে-জানে । অঞ্চলের অন্য গুণ্ডারা, যেমন দীনা যাদব, দমদমি যাদব, রাসবিহারি মণ্ডল, দারা মিয়াঁ, সৎইয়া মণ্ডল প্রতিমাসে জামাইখোরাকি দিয়ে যায় ওনার শশুর বা শাশুড়িকে । ওনার দলের সবায়ের কাছে কাট্টা,তমঞ্চা, একনল্লা, দুনল্লা আছে, কয়েকজনের কাছে একে-সানতালিস আর একে-ছপ্পন ।
    যে দিয়ারাগুলোর পলি প্রায় পাকা জমির চেহারা নিয়েছে, সেখানে সরকারি স্কুল আছে বটে কিন্তু বর্ষায় তারা ডুববে না ভাসবে তা কেউ আগাম বলতে পারে না বলে সারা বছর ক্লাস হয় না । ছেলে অপুকে তাই ভাগলপুর শহরে রেখে সেইন্ট জোসেফ কনভেন্টে ভর্তি করে দিয়েছিলেন জামাইবাবা । তারিণী মণ্ডলও চেয়েছিলেন নাতি আজকালকার খ্যাতনামা অপরাধীদের মতন স্যুটটাই পরে দেশে-বিদেশে নাম করুক । স্কুলে যে চারটে গ্রুপ ছিল লাল, হলুদ, সবুজ আর নীল, তাতে লাল গ্রুপে ছিল অপু, বাদশাহি লাল । ওর, অপুর, নামটা তারিণী মণ্ডলের দেয়া, আদর করে, আপ্রাধি ঘোষ, তারিণীর মতে জগতসংসারে অপরাধীর চেয়ে বড়ো আর কেউ হতে পারে না, তা মহারাজ বাল্মিকীর জীবন থেকে জানা যায় । এককালের ডাকাত সর্দার, পরে রামায়ণের লেখক, তাঁর নাম যদি উইয়ের ঢিবি হতে পারে তাহলে তারিণী মণ্ডলের একমাত্র নাতির নাম কেন রামায়ণ রচয়িতার অনুকরণে হবে না । তাই আপ্রাধি ; সুশান্ত নিজের মতো করে তাকে বাঙালিয়ানা দিয়ে অপু করলেও, কেউই ওকে অপু বলে ডাকে না, এমনকি সুশান্তর বিড়িসেবিকা মেঠোগন্ধা নিরক্ষর ডাগরচোখ শ্যামলিমা বউও নয় । বেবি ডাকে আপ্পু বলে ।
    ওর ডাকনাম হয়ে গেছে আপ্পু । আড়ালে, আপ্পু দোগলা । স্কুলেতে সহপাঠীরা ‘আবে আপ্পু’ ডাকটাকে ‘এবি আপ্পু’তে, মানে ‘এ বাস্টার্ড আপ্পুতে’, পালটে তাতাতে চেষ্টা করলে, অপুর সরাসরি উত্তর, হ্যাঁ, তো কি হয়েছে ?
    অশ্বমেধ হোষ নামে ডাকে না কেউ, টিচাররাও বলেন আপ্পু ।
    বুক চিতিয়ে অপু জানায়, আমি বাঙালি, বুঝলি বাঙালি ।
    --বাংগালি ? সে তো আরও কমজোর, দল বেঁধে চেঁচায় । দুজন এক সঙ্গে না হলে লড়তে ভয় পায় । আর কায়স্হ মানে তো মুনশিগিরি, যমরাজের কেরানি চিত্রগুপ্ত জাতে কায়স্হ । দেখিস না কায়স্হগুলো চিত্রগুপ্ত পুজো করে ।
    --বাড়ি গিয়ে পুরাণ-শাস্ত্র পড়গে যা । চিত্রগুপ্ত হল বিহারি কেরানি, আর যমরাজ হল বাঙালি ।
    --আচ্ছা ?
    --হ্যাঁ । নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের নাম শুনিসনি তোরা । ইংরেজদের এমন বাঁশ দিয়েছিল যে সে বাঁশ কাংরেসিরা ধামাচাপা দিয়ে পুঁতে রেখেছে । একদিন ওই বাঁশের চারা বেরোবে চারপাশ থেকে, তখন দেখিস কী হয়।
    সুভাষচন্দ্র বসুর নামটা তারিণী মণ্ডল মুখস্হ করে রেখেছেন । নাতিকে যখনই উৎসাহিত করার দরকার হয়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের গল্প আরম্ভ করেন, সবই গাঁজাখুরি, কেননা উনি কেবল নামটুকুই জানেন আর ফোটো দেখেছেন । বলেন, আরে ওনার ফোটুর দিকে দ্যাখ, লম্বা-চওড়া গাবরু জওয়ান, প্যান্ট-শার্ট পরে স্যালুট নিচ্ছে । আর আজকালকার নেতাদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, ভয়ে সবায়ের ল্যাজ পোঁদে এমন ঢুকে থাকে যে দশটা বন্দুকধারি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ; আমি তো শুধু দুটো পহলওয়ানকে রেখেছি, আমার ওপর রামধারি ধানুক একবার হামলা চালিয়েছিল বলে, রামধারীর জন্যই আমার বাঁচোখটা নষ্ট হয়ে গেল ।
    --জানি দাদু, রামধারিকে তুমি লোক পাঠিয়ে কলকাতায় মারিয়েছিলে ; দুই রাজ্যের ঝগড়ায় সে ব্যাটার লাশ পনেরোদিন কলকাতার মর্গে পড়ে পচে পোকা ধরে গিয়েছিল ।
    --আরে, এই দিয়ারার জমিজমা সবই গংগোতা আর মাল্লাহদের ছিল ।
    --জানি, বাবা সেকথা বলেছিল তোমায় । এচ এচ রিজালে নামে একজন সায়েব ১৮৯১ সালে লোকগণনা করে লিখে গেছে সেসব । কিন্তু উঁচু জাতের আফসাররা টাকা খেয়ে ভূমিহার, রাজপুত, যাদব, কোয়েরি, কুর্মিদের হাতে দিয়ারার জমি তুলে দিত । গংগোতারা ফেরত নেবার চেষ্টা করতে গেলে তাদের চোখে ছুঁচ ফুটিয়ে অ্যাসিড ঢেলে দেয়া হয়েছিল, ক্রিমিনাল দেগে দেয়া হয়েছিল ।
    --ক্রিমিনাল খারাপ হতে যাবে কেন ? রামায়ণ লিখেছিলেন মহারাজ বাল্মিকী, উনি কি ক্রিমিনাল ছিলেন? উনি ছিলেন মহাআপ্রাধি । তুই বড়ো হয়ে মহাআপ্রাধি হয়ে দেখা দিকিনি ।
    গঙ্গার তো মতিগতির ঠিকঠিকানা নেই ; এই বর্ষায় এক দিয়ারা ডোবায় তো আরেক বর্ষায় আরেক । যে খেতি করে তার জমি ডুবলে যে নতুন জমি ভেসে উঠল সেটা তার পাওনা, কিন্তু ইংরেজরা যাবার পর উঁচু জাতের লোকেরা নতুন ভেসে-ওঠা দিয়ারা নিজেদের নামে লিখিয়ে নিত । কী আর করা যাবে, বল । তাই আমরা হাথিয়ার তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি । বন্দুক যার, জল-জমিন তার । কৈলাশ মণ্ডল নামে একজন গংগোতা নকসল্লি কামকাজ করে চেষ্টা করেছিল সব ঘোটালা বন্ধ করতে, সেই ১৯৬৭ সালে ; কিন্তু সেও তো কোথায় গায়েব হয়ে গেল ।
    --গায়েব হয়নি, আমাদের ইউনিভারসিটির একজন টিচার বলেছে যে তাকে গায়েব করে দেয়া হয়েছিল । তখন নকসল্লি ধরে-ধরে গায়েব করার সরকারি কারিয়াকরম চলছিল ।
    --আরে সব বেকার । লুকিয়ে-লুকিয়ে যদি কিছু করতেই হয় তো সুভাষচন্দ্র বোসের মতন করো । আংরেজরা অব্দি পালিয়ে গেল ভয়ে । কথা কটা বলে উরুতে কুস্তিগিরের চাপড় দাদুর ।
    --দাদু, আমাদের মতন ছিল না সুভাষচন্দ্র বোস । ওর জন্যে জান দেবার অনেক সঙ্গীসাথী ছিল । আমরা তো নিজেরাই লড়ে মরি ।
    বাবা সুশান্ত ঘোষ মনে করেন ওনার কোনো প্রত্যক্ষ অবদান নেই অপুর চরিত্র গঠনে । পরোক্ষ অবদান আছে । অপু নিজেও তাই মনে করে । বাবা বাংলা বলতে আর ভাগলপুর শহর থেকে বই এনে বাংলা পড়তে শিখিয়েছেন, সাধারণ জ্ঞানের বই কিনে দিতেন ছোটোবেলা থেকে । বাংলা শেখানোর সময়েই চটে যেতেন বাবা, কান মুলে দিতেন, চড় মারতেন । বাংলা শেখার দরুণ আলটপকা কথা বলে বিব্রত হতে হয়েছে অনেক সময়ে । জে এন ইউয়ের বন্ধুরা তো আর জানে না যে ওর মা দিয়ারার গংগোতা বিহারিন । পদবি দেখে অনুমান করে নেয় যে এ. ঘোষ মানে শহুরে বাঙালি ।
    সনাতন সরকার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল অপুর। গায়ের রং বেশ ময়লা, কোঁকড়া উস্কো-খুস্কো চুল, রোগা, সাড়ে পাঁচ ফিটের, কালো ফ্রেমের চশমা-চোখ সনাতন দিল্লিতেও ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বজায় রেখেছে, পায়ে কোলহাপুরি, বাংলা কথায় ওড়িয়া টান । বিড়ি ফোঁকে । প্রথম পরিচয়ের পর প্রায়ই সনাতনের সঙ্গে আড্ডা মারে অপু ।
    --হাই সনাতন, আপনিও কি সোকলড প্রবাসী ? প্রথমবার পরিচয় করার জন্য শুরু করেছিল অপু ।
    --পশ্চিমবাংলার বর্ণহিন্দু হাফগাণ্ডুরা আমাদের অমনভাবে গালাগাল দেয়, ইসকি মাকা সালে…... ; তুইও কেন সেকথা পাড়ছিস । তুই তো ভাগলপুরি খোটুয়া বলে জানি । কথায় বিড়ির ধোঁয়া মিশিয়ে বলল সনাতন সরকার ।
    --না, পুজোপাণ্ডালে, দিল্লি হাটে বা কোনো ফাংশানে দিল্লির বাঙালিদের সঙ্গে আলাপ হলে, যখন ওনারা জানতে পারেন যে আমি ভাগলপুরের তখন অমন প্রশ্ন তোলেন । আপনি তো উড়িষ্যা থেকে ?
    --না, টু বি স্পেসিফিক, আমি দণ্ডকারণ্য থেকে । শুনেছিস কি দণ্ডকারণ্য ?
    --বাবার কাছে গল্প শুনেছিলুম, রামায়ণ না মহাভারতের গল্প ঠিক জানি না, নর্মদা আর গোদাবরী নদীর তীরে দণ্ডক রাজার রাজ্য ছিল । কোনো ঋষির অভিশাপে জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল ।
    --আবে সালে হাফউইট, আমি সেই আদ্যিকালের গাঁজাখুরি এরিয়ান গল্পের কথা বলছি না ।
    --দেন হোয়াট ?
    --দণ্ডকারন্য জায়গাটা হল ভারতের কয়েকটা রাজ্যের আদিবাসী অধ্যুষিত নয়টা জেলা , মাটির তলায় প্রচুর মিনারালস আছে ; গড়চিরোলি, ভাণ্ডারা, বালাঘাট, রাজনন্দগাঁও, কাউকের, বস্তার, নারায়ণপুর, দাঁতেওয়াড়া আর মালকানগিরি । আমি মালকানগিরি প্রডাক্ট, সুভাষপল্লিতে থাকতাম, এখনও আছে সুভাষপল্লী, জঙ্গল পরিষ্কার করে আমরাই বসত গড়েছিলাম, আর এখন চুতিয়াগুলো আমাদেরই ঘরছাড়া করে দিতে চাইছে, ইসকি মাকা... । কিন্তু এখন চলে গেছি ছত্তিসগড়ের নারাণপুরে ।
    --মালকানগিরি ? অমন অড, গড ফরসেকন জায়গায় ?
    --দেশভাগের পর কী হয়েছিল জানিস না, চামগাদড় কঁহিকা ?
    --হ্যাঁ, জানি-জানি, বাস্তুহারাদের দণ্ডকারণ্যে সেটল করানো হয়েছিল ।
    --কোন ভোঁসড়িকে-জনা তোকে বুঝিয়েছে, ইসকি মাকা... ? কিছুই জানিস না তুই । আমাদের, নমঃশূদ্র বাঙালিদের, আনসেটল করা হয়েছিল, ডেসট্রয় করা হয়েছিল, ইসকি মাকা…. । বাঙালির প্রত্নতাত্ত্বিক রুইনস যদি দেখতে চাস তো ঘুরে আয় একবার, ইসকি মাকা...। স্বাধীনতার লাৎ খেয়ে আমরা সেই সব মানুষ হয়ে গড়ে উঠেছি যাদের অতীত লোপাট, বর্তমান গায়েব আর ভবিষ্যৎ নেই । আইডেনটিটিলেস । আমাদের ইতিহাস প্রতিদিন রিপিট হয়, কেননা আমরা ইতিহাসহীন, বিমূর্ত । বিমূর্ত বুঝিস ? অ্যাবসট্র্যাক্ট !
    …চুপ করে যায় অপু । টের পায় যে সারেনি এমন আঘাতের রক্তপূঁজের খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছে ।
    --আমরা ১৯৪৭-এ, ১৯৬৪-৬৫-তে, ১৯৭১-এ, ১৯৭৫-এ মার খেয়েছি, যখনই ওপার বাঙালির কসাইদের প্রবৃত্তি সালভাদর দালির পেইনটিঙের মতন হয় , তখনই ওরা আমাদের পোঁদে জ্বলন্ত জিরাফ ঢোকায়। অপর জানিস তো, দি আদার, পড়ছিস বোধহয়, তোদের কোর্সে আছে তো, দি আদার, ইসকি মাকা... । সম্প্রতি নাস্তিক আর আস্তিকদের খুনিখুনি হল ঢাকায়-চট্টগ্রামে, তাতেও ঘরছাড়া করা হল আমাদের, আমাদের ইয়ানেকি নিম্নবর্ণের লোকেদের । ওদেশের রাজনীতির বনেদ হয়ে গেছে খেদাও, খেদাও, খেদাও, মেইনলি রিমেইনিং নিম্নবর্ণদের খেদাও।
    ...চুপ করেই থাকে অপু ।
    --মরিচঝাঁপি শুনেছিস, মরিচঝাঁপি ?
    --হ্যাঁ, জানি ঘটনাটা, বাবা বলেছিলেন, দণ্ডকারণ্য থেকে কয়েক হাজার পরিবার গিয়েছিল সুন্দরবনের ওই দ্বীপে বসতি গড়তে ।
    --ওই দ্বীপেই, ১৯৭৯ এর ৩১ জানুয়ারি আমার বাবা-মাকে খুন করেছিল ইসকি... । মরিচঝাঁপি দ্বীপটাকে চারিদিক থেকে তিরিশটা পুলিশ-লঞ্চ ঘিরে রেখেছিল যাতে খাবার আর পানীয় জল না পোঁছোয় ; তারপর যুদ্ধক্ষেত্রের ঢঙে ব্রাশফায়ার করেছিল, ইসকি... । দণ্ডকারণ্যের অনেকের বাড়িতে ৩১ জানুয়ারির দিনটা তাদের কোনো-না-কোনো আত্মীয়ের মৃত্যু দিন হিসাবে পালিত হয় । আমাদের বাড়িতে পালিত হয় আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুদিন হিসাবে । যারা বেঁচে ফিরতে পেরেছিল তাদের কেউ-কেউ কলকাতার বারাসাতের কাছে মরিচঝাঁপি কলোনি গড়ে থেকে গেল, কেউ-কেউ থেকে গেল ক্যানিঙের হিঙ্গলগঞ্জে কলোনি গড়ে, কেউ রেললাইনের ধারে, কেউ খালপাড়ে । আমাকে মরিচঝাঁপি থেকে দণ্ডকারণ্যে নিয়ে এসেছিলেন আমার পিসেমশায়, নিজের পিসেমশায় নন, তবু আপন । নয় বছর বয়সে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম, ইসকি... । তোরা হয়তো ভাবিস তোদের চেয়ে আমার বয়স এত বেশি, ইউনিয়ানবাজি করার জন্য গাণ্ডুগর্দি চালিয়ে ইউনিভার্সিটিতে টাইম পাস করছি, হয়তো মনে করিস পি এইচ ডি করতে এত বছর লাগছে কেন, ইসকি... ।
    ...আবার চুপ করে যায় অপু ।
    --আমাকে আবার দণ্ডকারণ্যে এনে লালন-পালন বলতে যা বোঝায় তা করেছেন, স্কুল-কলেজে পড়িয়েছেন, এখনও পড়ার খরচ যোগাচ্ছেন, আমার পিসতুতো বোন যাকে ১৯৭১ সালে রেপ করেছিল পাকিস্তানি রাজাকারগুলো, ইসকি...। সেও আমার নিজের পিসতুতো বোন নয়, কিন্তু আপন । ও দণ্ডকারণ্য থেকে মরিচঝাঁপি যায়নি । ওর বর, আমার অভিভাবক জামাইবাবু গণেশচন্দ্র সরকার যেতে চাননি ; উনি তখনই বলেছিলেন ওই টেঁটিয়া গিরগিটিমার্কা বর্ণহিন্দু বাঙালিগুলোকে বিশ্বাস করা যায় না, ইসকি...। আন্দামানে যাবার জেটিতে গিয়ে ওদের ছাতুবাবুরা কালাপানি-দ্বীপান্তরের আতঙ্ক ছড়িয়ে ভাষণবাজি করে হাজার-হাজার মানুষের আন্দামানে যাওয়া ভণ্ডুল করে দিয়েছিল । নেহেরু আমাদের ঠুঁসে দিল আদিবাসীদের জংলি এলাকাগুলোয়, আর বর্ণহিন্দু বাঙালিরা পেলো চিত্তরঞ্জন পার্ক, তুই তো এসব সাপসিঁড়ির পলিটিক্স জানিস না। বাড়ি থেকে কাঁচা টাকা আনিস, আর নাইটক্লাব-ডিসকোবাজি করে বেড়াস ।
    ...অপু চুপ করে রইল । বুঝতে পারছিল যে সনাতন সরকার সম্ভবত মন খুলে ঝাল ঝাড়ার অবসর তৈরি করে ফেলতে পেরেছে ওর প্রশ্নগুলোর চোট খেয়ে । অপু আরও ভয়ঙ্কর হিন্দি গালাগাল জানে, ব্যবহার করে না কখনও, ছোটোবেলা থেকে বাবার চড়-খাওয়া নির্দেশ ।
    --ওই নেতাগুলোর বেশ কয়েকজন বেঙ্গলের ডিভিজান করে পাকিস্তান সৃষ্টি সমর্থন করেছিল । যেই পাকিস্তান হল অমনি বর্ণহিন্দু লোকগুলো আগেভাগে পালিয়ে এলো ; এসে, এ আজাদি ঝুটা হ্যায় জিগির তুলে ট্রাম-বাস পোড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর আমরা ? আমরা তো নমঃশূদ্র, নিম্নবর্ণ, আনটাচেবল, ইসকি...। বর্ণহিন্দু পরিবারগুলো পশ্চিমবাংলায় বাড়িঘর তৈরি করে থেকে গেল, পার্টিগুলোকে দখল করে নিল । নিম্নবর্ণের জন্যে দণ্ডকারণ্য, হিমালয়ের তরাই, আন্দামান, ইসকি...। বর্ণহিন্দু ভাড়ুয়াগুলোই আমাদের আন্দামানে যেতে দেয়নি । এখন আন্দামানে গিয়ে দ্যাখ, সাউথ ইনডিয়ান আর পাঞ্জাবিরা গুছিয়ে নিয়েছে । বাংলা তো পড়তে পারিস । তোর ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিতে মনোরঞ্জন ব্যাপারির লেখা চণ্ডালের চোখে চণ্ডাল বইটা আছে, পড়িস । জঁ জেনে সম্পর্কে জাঁ পল সার্ত্রে বিস্তারিত আলোচনা করে সেইন্ট জেনে নামে একটা বই-ই লিখে ফেলেছেন । কোনো বাঙালি কি মনোরঞ্জন ব্যাপারিকে নিয়ে বই লিখেছে ? শালা বর্ণহিন্দু চুতিয়া ইনটেলেকচুয়ালদের দল, ইসকি...।
    ক্যান্টিনের অন্য টেবল থেকে একজন সহপাঠির মন্তব্য শোনা গেল, আবে সানি, হিন্দি মেঁ গালি কিঁউ ? তু বংলা গালি নহিঁ জানতা হ্যায় ক্যা ? সুনা, সুনা, দো-চার, ইয়াদ করকে রখুঁ ।
    সনাতন জবাব দিল, যাদের দিচ্ছি তাদের জন্য এই গালাগালগুলোই উপযুক্ত মনে হল । বাংলা গালাগাল কয়েকটা জানি, কিন্তু সেগুলোয় তেমন তেজ নেই । মালকানগিরিতে বাংলা বলার চল শেষ হয়ে গেছে, ইসকি...। উড়িষ্যা সরকার বাংলা শেখানো তুলে দিয়ে ওড়িয়া শেখাচ্ছে । মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর আর গড়চিরোলি জঙ্গলের উদ্বাস্তু গ্রামে বাঙালিরা আছে, তাদের বাচ্চাদের স্কুলে মারাঠি শিখতে বাধ্য করা হয়েছে, সাতচল্লিশটা স্কুলে, বুঝলি, আমরাই এসট্যাবলিশ করেছিলাম ওগুলো। চন্দ্রপুর আর গড়চিরোলিতে বাংলা বলার মতন বাঙালি আর পাবি না, দশ-পনেরো বছর পর, ইসকি...। কোথাও কোথাও ইলেকট্রিসিট পৌঁছেচে বটে, কিন্তু চাষের জল, সেচের ব্যবস্হা নেই, সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র নেই । গালাগাল দেবো না তো কী দেবো, ভ্যালেন্টাইনের খামে পুরে আমাশার মিক্সড ফ্রুট জ্যাম ?
    অপু বলল, আরে আপনি ওদের ছাড়ুন, শালারা সারাদিন লন্দিফন্দি করে আর চকরলস কাটে ; ছোলে-ভাটুরে খাতে, অওর লিডারকে দুম চাটতে ।
    --এখন দণ্ডকারণ্যে পোলাভরম ড্যাম তৈরি হবে নয় হাজার কোটি টাকা খরচ করে, চুতিয়া শালা ইসকি...। উপজাতি আর উদ্বাস্তু অধ্যুষিত দুশো ছিয়াত্তরটা গ্রামের দু লাখ মানুষ ভেসে যাবে, উৎখাত করা হবে তাদের, দাঁতেওয়াডায় সাবরি নদীর ধারে চাষের সব জমি ভেসে যাবে, ইসকি...। কারোর দুশ্চিন্তা নেই, তার কারণ যারা ভেসে যাবে তারা হয় শিডুল্ড ট্রাইব বা বাঙালি শিডুল্ড কাস্ট । এই যে সেনসাস হল, তাতে আমরা যে শিডুলড কাস্ট তা চাপা দিয়ে দেখানো হল আমরা বাঙালি, ইসকি...। কেন ? যাতে আমরা শিডুলড কাস্টের সুবিধাগুলো না পাই । ভোঁসড়িকে, পোলাভরমের জল যাবে ভিশাখাপটনমের কারখানাগুলোয়, স্টিল প্ল্যান্টে, হাইড্রোপাওয়ারে,শহরে । ক্যান ইউ ইম্যাজিন ? লক্ষ-লক্ষ মানুষ পানীয় জল পাবে না, ইসকি...। আর কলকাতায় গিয়ে দ্যাখ ; বর্ণহিন্দু লৌণ্ডাগুলো আমরা বাঙালি আমরা বাঙালি করে ধুতি খুলে লুঙ্গি ড্যান্স নেচে চলেছে। দেশভাগের দরুণ আমরা শুধু তাদের সাংস্কৃতিক গর্বের বাল ওপড়াবার জন্য নিশ্চিহ্ণ হয়ে চলেছি, ইসকি...। দণ্ডকারণ্যের দলিতরাও তাদের দলে আমাদের নিতে চায় না । আমরা ইতিহাসের গার্বেজ ডাম্প, ইসকি...।
    সনাতন সরকার নিজের রোষকে সামাল দিয়েছে আঁচ করে অপু বলল, বাংলাদেশ কিন্তু দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নিচ্ছে, এতকাল পরে হলেও নিচ্ছে । সেখানের জনসাধারণের মধ্যে থেকেই সরকারকে নাড়া দেয়া হচ্ছে, মৌলবাদী প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করা হচ্ছে ।
    --কী রকম শুনি ?
    --শাহবাগে এককাট্টা হয়ে মেয়েরা পর্যন্ত প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে, বোরখা পরে নয়, ওপনলি । আমাদের এখানে চুরাশির শিখ নিধন, নেলি গণহত্যা, গোধরার পর আহমেদাবাদের দাঙ্গা, কয়েকমাস আগে মুজফফরনগরে আর শ্যামলিতে যে দাঙ্গা হল, কই এখানে তো শাহবাগের মতন রাস্তার মোড়ে নামতে দেখা গেল না ছেলে-মেয়েদের ।
    --ওদের দেশে বিয়াল্লিশ বছর লেগেছে কাদের মোল্লাকে কাঠগড়ায় তুলতে, যে লোকটা শুধু মীরপুরেই সাড়ে তিনশ মানুষকে খুন করিয়েছিল । আসল শয়তান বাচ্চু রাজাকরটা আগেই পাকিস্তানে পালিয়েছিল, ইসকি...। তুই আমার তর্কটাকে অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছিস । আমাদের এখানে যতই দাঙ্গা হোক না কেন, আমরা কাউকে পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে তাড়া করে নিয়ে যাই না । আমাদের কোনো রাজাকরের ইকুইভ্যালেন্ট নেই । রাজাকর কাদের বলে জানিস ?
    --ধার্মিক স্বেচ্ছাসেবকদের । যতদূর জানি হায়দ্রাবাদের নিজামের টাকায় তৈরি মিলিশিয়া ।
    --আবে ঘড়িয়ালকে চামড়া, তর্ক চলছে পূর্ব পাকিস্তান আর নিম্নবর্ণের বাঙালি নিয়ে , তুই তার মধ্যে নিয়ে এলি হায়দ্রাবাদ। রাজাকার হল খুনি মিলিশিয়া, যাদের অর্ডিনান্সের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছিল টিক্কা খান, ইসকি... । পূর্ব পাকিস্তানে, আই মিন বাংলাদেশে, তুই ঘরে-ঘরে রাজাকার পাবি। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, হিমালয়ের তরাই, আন্দামান এমনকি দণ্ডকারণ্যেও বাঙালিদের মধ্যে তুই অমন জাতকসাই পাবি না । আমাদের এখানে সরকার কোনো দিনই ধর্মান্ধ মিলিশিয়া তৈরি করবে না, আমরা দেবো না তৈরি করতে, গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে , ব্লাডি সিভিল ওয়র । হুমায়ুন আজাদের নাম শুনেছিস ?
    --হ্যাঁ, আমার বাবা হুমায়ুন আহমেদের অনেক বড়ো ফ্যান । যে গংগোতা বাংলাদেশ-ইনডিয়া সীমার ব্যবসা দেখভাল করে আর থার্মোকোল আইসবক্সে বাবার জন্যে ইলিশ আনে, শুঁটকি-মাছ আনে, সে বাবাকে বইপত্র এনে দ্যায় । ইলিশ-টিলিশ বাবা নিজেই রাঁধেন ।
    সনাতন সরকার, স্তম্ভিত, অপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আবে, তেলচাট্টা ঘাসলেট, আমি একজন ভাবুকের কথা বলছি, পাল্প ফিকশান রাইটারের কথা বলছি না। হুমায়ুন আজাদকে পাক সার জমিন সাদ বাদ নামে একটা বই লেখার জন্য রাজাকাররা খচাখচ-খচাখচ ছুরি-ছোরা-চপার মারার কিছুদিন পর উনি মারা যান। যাকগে, তোর মতন অ্যায়রা-গ্যায়রা নাৎথু-খায়রাকে এসব বলে কোনো লাভ নেই ; কী জানতে চাইছিলিস যেন ?
    --এমন লেকচার দিলেন যে যা বলতে চাইছিলুম, তা-ই ভুলে গেলুম । গালাগালের তোড়ে ভেসে গেলুম ।

    দশ
    মংরুরাম নুনেতি ( কানাগাঁও-এর প্রাক্তন সরপঞ্চ ): আরে, আরে, খাদেতে দুজন লোক পড়ে আছে । সাপের কামড়ে নাকি অন্য কোনো জন্তু জানোয়ার মেরে ফেলে রেখে গেছে, পরে এসে খাবে ?
    গাসসুরাম ( গ্রামবাসী ) : গ্রামের তাতিম গোঁড় বলছিল যে এই জঙ্গলে সেদিন সন্ধ্যাবেলা গুলিগোলা চলেছিল । গুলি লেগে মরেছে বোধহয় ।
    মংরুরাম : রক্ত লেগে নেই কেন তাহলে ? গুলি লাগলে রক্ত থাকত জামাকাপড়ে ।
    গাসসুরাম : চলুন চলুন, শেষে আধামিলিট্রি জওয়ানরা দেখতে পেলে আমাদেই জেলে পুরবে । মাওওয়াদিরা দেখতে পেলে ধরেবেঁধে নিয়ে গিয়ে গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে শেয়ালের মাংস ঢুকিয়ে দেবে ।
    মংরুরাম : যে-ই ধরুক, নিখালিস উড়িয়ে দেবে ।
    গাসসুরাম : বাপ রে । তাকাবেন না ও দিকে ।
    মংরুরাম : তাড়াতাড়ি চল, তুই তো ভাঙা পা নিয়ে হাঁটতেই পারিস না ।

    এগারো
    দণ্ডকারণ্যে যাবো আপনার বাড়ি, যদি নিয়ে যান কখনও । আর হ্যাঁ, আমি কয়েকদিনের জন্য বাড়ি যাবো, আপনি আমার অ্যাবসেন্সটা ম্যানেজ করে দেবেন । আপনি তো পি এইচ ডি করছেন , অসুবিধা হবার কথা নয় । অপু বলল সনাতন সরকারকে ।
    --চলিস আমার সঙ্গে, একা তুই রাস্তা গোলমাল করে ফেলবি । নারায়ণপুর জেলাসদর হলেও, এখনও ডেভেলাপ করেনি ।
    --আমার বাবার পদবি ঘোষ হলেও, আমার মা বিহারি গংগোতা পরিবারের মেয়ে, ভাগলপুর শহরে নয়, আমাদের বাড়ি গঙ্গার চরে, দিয়ারায় । দিয়ারা শুনেছেন তো ? মলম লাগাবার মতো করে কথাগুলো বলল অপু, ক্যান্টিনে বসে মসালা দোসা খেতে-খেতে, সনাতনকে ।
    --গংগোতা ? কাস্ট ? তোর পাঞ্জাবি গার্লফ্রেণ্ড সে-কথা জানে, যে মেয়েটা সব সময় তোর সঙ্গে চিপকে থাকে ?
    --হ্যাঁ, বিহারের লোয়েস্ট নিম্নবর্ণ । হ্যাঃ, নিকিতা মাখিজা পাঞ্জাবি নয় , ও সিন্ধি । ওকে আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জানিয়েছি, বিশ্বাস করে না, ভাবে কাটিয়ে দেবার জন্য গুল মারছি । বলেছি প্রায়ভেট ডিটেকটিভ দিয়ে ইনভেসটিগেট করাতে, সে-প্রস্তাবকেও মনে করে ওকে ছেড়ে দেবার আরেক চাল । দিল্লির নাইটলাইফ এনজয় করা-মেয়ে, প্রায়ই ডিসকোয় গিয়ে টাল্লি হয়ে যায়, আর বাড়ি পৌঁছে দিতে হয় আমাকে । ওর বাবা-মা কেন যে অমন ছুট দিয়ে রেখেছেন, জানি না । ওকে আমাদের দিয়ারায় নিয়ে গেলে ওর হার্টফেল করবে।
    --নিম্নবর্ণের আবার হাই-লো আছে নাকি রে, বওড়া ? এনিওয়ে, তোর বাবার প্রেম তো স্যালুট করার মতন অসমসাহসী ঘটনা রে । তোর বাপ পারলেন, তোর গার্লফ্রেণ্ডও পারবে, সিন্ধিরা বেশ সহজে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারে, ওরাও উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিল, কিন্তু সরকার ওদের ধরে-ধরে আদিবাসীদের মাঝখানে পোঁতেনি, যেমন আমাদের পুঁতেছে । তবে টাকাকড়িকে ওরা মানুষের চেয়ে বেশি ভালোবাসে ; চেক করে দেখেনিস তোর কাঁচা টাকা ওড়ানো দেখে তোকে ফাঁসিয়েছে কি না । সেক্স-টেক্স করলে কনডোম পরে করিস, মনে রাখিস এটা ইনডিয়ার রাজধানি, এখানে মানুষের মুখের লালায় যত সায়েনাইড, তার চেয়ে বেশি সায়েনাইড তাদের চুতে আর লাঁড়ে।
    --প্রেম নয়, আমার মায়ের বাবা আমার বাবাকে কিডন্যাপ করে আমার মায়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন । মায়ের বয়স তখন চোদ্দ বছর আর বাবার একুশ । মা লেখাপড়া শেখেননি, স্কুলের কোনো বিল্ডিংও দেখেননি আজ পর্যন্ত ; বাবা কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক । সেই থেকে বাবা শশুরবাড়িতে আমার নানা, মানে দাদুর সঙ্গে থাকেন, দিয়ারায় চাষবাসের উন্নতির কাজ দেখেন । বাবা আমার মাকে নিজের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাননি, একাই গিয়েছিলেন বিয়ের পরে। গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে মাকে ওই বাড়িতে অ্যাকসেপ্ট করা হবে না । তারপরে আমাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন, আমাকেও অ্যাকসেপ্ট করা হয়নি ।
    --স্ট্রেঞ্জ । আমি ভাবছিলাম আমার জীবনের ঘটনাটাই ইউনিক । তুই তো নিজেই একটা ইউনিক সোশিওলজিকাল প্রডাক্ট । তো তুই বাংলা শিখলি কী করে ?
    --বাবার কাছে । আমি বলতে, পড়তে, লিখতে পারি ।
    --বাবা বাঙালি হলে না শেখার কারণ নেই, যদিও আমরা মাতৃভাষার, মানে মায়ের ভাষার কথা বলি, আদপে কিন্তু বাবার ভাষাটাই শিখি সবাই । তুই তো গ্রেট ।
    --আপনার জামাইবাবুর বাড়ির ঠিকানাটা দেবেন আমায় । নিকিতাকে প্রথমেই দিয়ারায় আমাদের বাড়ি নিয়ে গেলে ওর মাথা খারাপ হয়ে যাবে । আমার তো বাঙালি আত্মীয়স্বজন নেই, আপনার বাড়িতে নিয়ে যাবো ওকে । যদি আপনার ফ্যামিলিকে দেখে অ্যাডজাস্ট করতে পারে, তাহলে নিয়ে যাব দিয়ারার গংগোতা পাড়ায় ।
    --লিখে নে না । আমি বরং জামাইবাবুকে একটা চিঠি লিখে তোকে দিয়ে রাখছি, যখনই তোর গার্লফ্রেণ্ডকে নিয়ে যাবি চিঠিটা সঙ্গে নিয়ে যাস । তোর নাম জানিয়ে ফোন করে দেব । আমরা মালকানগিরি থেকে চলে গেছি ছত্তিশগড়ে, আমার ভাগ্নের হিউমিলিয়েশান এড়াবার জন্য। দিদি-জামাইবাবু নারায়ণপুরে বাড়ি করেছেন, এখন তো নারায়ণপুর জেলা শহর, আগে যাতায়াতে বেশ অসুবিধা হতো । সরি ফর দ্য অ্যাবিউজেস । সামলাতে পারি না, বুঝলি । এত ছোটো ছিলাম যে মা-বাবার মুখও মনে নেই । ওনাদের মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। পুলিশের লোকেরা লোপাট করার জন্য শব তুলে-তুলে জলে ফেলে দিয়েছিল ।
    --ভাগ্নের হিউমিলিয়েশান ? অসুবিধা না থাকলে বলতে পারেন ।
    --১৯৭১-এ ঢাকায় আমার দিদিকে চারজন রাজাকার রেপ করেছিল, জামাইবাবু অ্যাবর্ট করাতে দেননি। ইন ফ্যাক্ট, জামাইবাবু দিদিকে মালকানগিরিতে বিয়ে করেছিলেন, দিদি যখন প্রেগন্যান্ট, বিষ খেয়ে সুইসাইড করতে গিয়েছিলেন দিদি। তখন মালাকানগিরিতে ডাক্তার-ফাক্তার ছিল না, জঙ্গল এলাকা, নব্বুই বছরের একজন বুড়ি ওকে জড়িবুটি খাইয়ে বিষ বের করে দিলে, জামাইবাবু দিদিকে ইমোশানাল সাপোর্ট দ্যান, বাচ্চা হবার কয়েকমাস আগে বিয়ে করেন ।
    --আমি তাই ভাবতুম যে আপনি দলিতদের এক্সট্রিম লেফটিস্ট ইউনিয়ানে কেন ঢুকেছেন । আপনার পারসোনাল ব্যাকগ্রাউণ্ড তো জানা ছিল না ।
    --এক্সট্রিম লেফটিস্ট ? স্ট্রেঞ্জ ওয়র্ড । দিল্লির সংসদবাজ লেফটিস্টদের দেখছিস তো ? অনেকে জে এন ইউতে এসে কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছে মাঝে-সাঝে, হোয়াট ফর ?
    --দণ্ডকারণ্য তো এখন শুনি আলট্রা লেফটিস্টদের ঘাঁটি ।
    --এই লেফটিস্ট ওয়র্ডটা কাইন্ডলি বারবার উচ্চারণ করিসনি । পোঁদ জ্বালা করে । আই হেট দেম ।
    --অলটারনেটিভ ওয়র্ড কী ?
    --প্রতিশব্দ নেই । মাওওয়াদকে প্রতিশব্দ বলা যায় না । মাওওয়াদ ইজ এ সেল্ফকনফিউজড ডগমা ।
    --কেন ? আমি যদিও মাওওয়াদ সম্পর্কে বিশেষ জানি না, কাগজে পড়ি, ব্যাস ওইটুকু । সিলেবাসে্ও নেই।
    --ওদের লক্ষ্য হল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক জবরদস্ত গণআন্দোলন, ইংরেজি মাইটিকে বাংলায় জবরদস্ত বলা ছাড়া অন্য ওয়র্ড আছে কিনা জানি না ।
    --আমার বাংলা নলেজ আপনার চেয়ে খারাপ, হাফ বেকড । ইন ফ্যাক্ট সাম্রাজ্যবাদ ব্যাপারটাই যে কী তা ঠিকমতন বুঝি না । সবকটা রাজনীতিককেই তো মনে হয় সাম্রাজ্যবাদী, যে যার নিজের এমপায়ার খাড়া করে চলেছে ।
    --কী করে তুই স্নাতক হলি রে ? টুকলি ? না তোর হয়ে অন্য কেউ পরীক্ষায় বসেছিল ? মওকাপরস্ত তেঁদুয়া কহিঁকা । হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাকে বিধ্বস্ত করতে চায় মাওওয়াদিরা, গড়ে তুলতে চায় পাওয়ারফুল আর্বান মুভমেন্ট, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির সাহায্যে, কেননা কেতাবি মার্কসবাদ মেনে সশস্ত্র কৃষকদের সংঘর্ষ এদেশের কৃষিকাঠামোয় দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয় । ভারতীয় বহুত্বওয়াদি বাস্তবতার ক্ষেত্রে ওগুলো কোনোটাই লাগু হয় না ; তাছাড়া পৃথিবীতে কী ঘটছে সেদিকেও তো তাকাতে হবে । পৃথিবী তো রামচন্দ্রের বনবাসের দণ্ডকারণ্যে আটকে নেই, রামচন্দ্রের নির্বাসনের পথটাই নাকি রেড করিডর ।
    --রিয়্যালি ? এই ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা জিনিসটাও বুঝলুম না ।
    --যা যতটা বুঝেছিস, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাক । জে এন ইউতে কয়েকজন নেপালি ছাত্র আছে, ওই তুই যাদের বলছিস একস্ট্রিম বা আলট্রা লেফটিস্ট । তাদের একজন, চিনিস বোধহয়, জনক বহুছা, ওর মতে রেড করিডর হল যে পথে গৌতম বুদ্ধ নেপাল থেকে বেরিয়ে তাঁর বাণী বিলিয়েছিলেন ভারতবর্ষের গ্রাম-গঞ্জ-বনপথে।
    --বলুন না, থামলেন কেন ? ইনটারেসটিং ।
    --দণ্ডকারণ্যে ওরা বৌদ্ধবিহার বানায় না, যা বানায় তার নাম দলম । দলমরা বানায় জনতম সরকার। দলম, জনতম এটসেটরা শব্দ থেকে বুঝতে পারছিস যে ডিসকোর্সটা তেলুগু ডমিনেটেড । ডিসকোর্স বুঝিস তো, না তাতেও গাড্ডুস ? এর আগে মানুষের ইতিহাসে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতরা সন্ত্রাসের সাহায্য নেয়নি । ওদের মতে শোষিতদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় এখন সন্ত্রাস ।
    অপু নিজেকে নিঃশব্দে বলতে শুনল, সনাতন বোধহয় মায়াবতীর দলের ভাবুক, আর এগোনো উচিত হবে না । বলল, আপনার পিসতুতো দিদির কথা বলছিলেন, যিনি আপনার অভিভাবক, তাঁর গল্প বলুন না , আপনার ভাগ্নের হিউমিলিয়েশানের, যদি অসুবিধা না থাকে।
    --বললাম বোধহয় একটু আগে, দিদি বাচ্চাটাকে অ্যাবর্ট করায়নি, জামাইবাবু করাতে দেননি । ভাগ্নেটা জানতে পেরে দু-দুবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল । ভাগ্নের বয়স অবভিয়াসলি আমার চেয়ে বেশি, সেভেন্টিটুতে জন্মেছিল, আর আমি জন্মেছি ওর পাঁচ বছর পর, ভাগ্নেদা বলে ডাকি । ওকে ওর বাবার নাম জিগ্যেস করলে ও আনকনট্রোলেবলি উন্মত্ত হয়ে যায়, বলে, আমার বাবা একজন নয় চারজন, বাবাদের নাম জানি না । দিদি-জামাইবাবুর চোখাচোখি বড় একটা হতে চায় না কার্তিক, বাড়ির বাইরে সময় কাটায় । আমার ভাগ্নের নাম কার্তিক সরকার । ওকে একটা মোটরসাইকেল কিনে দেয়া হয়েছিল, নারায়ণপুর থেকে রায়পুর, কিংবা অন্যা নন-মোটোরেবল জায়গায় যাত্রীদের নিয়ে যায় ; সব জায়গায় তো বাস যায় না, মোটোরেবল রোডও বিশেষ নেই নারায়ণপুর জেলার ফরেস্ট এরিয়ায় । আগে তো রেসট্রিকশান ছিল ফরেস্ট এরিয়ায় যাবার, মুরিয়া, মাড়িয়া আর গোঁড় উপজাতির লোকেরা থাকে ওখানে, ষাট বছরে কোনো ডেভেলপমেন্ট হয়নি, সার্ভে হয়নি, সেনসাস হয়নি ।
    --সরকারি অফিসাররা যেতে চায় না, না ? সব রাজ্যে একই ব্যাপার ।
    --যেটুকু কাজ তা রামকৃষ্ণ মিশন করে, এমন কি রেশনের দোকান আর স্কুলও মিশনই চালায় । বিজলি নেই, পানীয় জল নেই, মাসে এক-আধ লিটার কেরোসিন, ব্যাস ।
    --ফরেস্ট এরিয়ায় গেছেন ?
    --না তেমন করে যাইনি, রেসট্রিকশান ছিল এতদিন । নদীর জল নিয়ে, জঙ্গলের গাছ নিয়ে নানা কেলেঙ্কারি হয়েছে । তারপর গোপনীয় সৈনিক, স্পেশাল পুলিশ অফিসার, অগজিলিয়ারি ফোর্স আর সালওয়া জুড়ুমের নামে উপজাতিদের নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করানো হল । ভারতের সংবিধান ওই অঞ্চলে অস্তিত্বহীন । সালওয়া জুড়ুম আর আধামিলিট্রির সাহায্যে জঙ্গলে শান্তি ফেরানোর চেষ্টা হল জাস্ট নাইটমেয়ার । কতকাল যে চলবে লড়াইটা, কেউই জানে না । ইনডিয়ার আকরিক খনিজের মানচিত্র আর ট্রাইবাল ডেনসিটির মানচিত্র একই, বুঝলি ? যারা আকরিক খনিজ চায় তারা আদিবাসিদের উৎখাত করতে উঠেপড়ে লেগেছে ; তাদের চাই-ই চাই । প্রতিরোধ করার জন্য যা-যা করা দরকার তা আদিবাসীরা করে চলেছে , এসপার নয়তো ওসপার । ইয়াতো করনা হ্যায়, নহিঁতো মরনা হ্যায় ।
    অপু চুপ করে রইল, যে বিষয়ে কিছুই জানে না সে ব্যাপারে বেফাঁস কিছু যাতে না বলে ফ্যালে । প্রসঙ্গের খোঁচা ভোঁতা করার জন্য বলল, কী-কী গাছ হয় জঙ্গলে ?
    --সব তো আর জানি না, তবে প্রচুর পলাশ, মহুয়া, আমড়া গাছ দেখেছি । আর আছে চিকরাসি, জিলন, শিমুল, উলি, বডুলা, কড়ুয়া পাঙার, পিছলা, জারুল, জংলি বাদাম, ছাতিম এইসব ।
    শুনে, বুঝতে পারল অপু, ওর বাংলা জ্ঞান দিয়ে গাছের নাম চিনতে পারছে না । দিয়ারায় বসবাস করে গাছের নাম জানতে চাওয়া বোকামি হয়ে গেছে । কেবল মাথা দুলিয়ে সায় দিল, বোঝার ভান করে ।
    --মালিক মকবুজা শুনেছিস ?
    --না, কার লেখা ?
    --তুই তো পুরো চুতিয়াছাপ মূর্খ থেকে গেছিস রে, পিওর অ্যাণ্ড সিম্পল গাণ্ডু । মালিক মকবুজা হল একটা স্ক্যাণ্ডালের নাম ।
    --না শুনিনি । বিহারে রোজ এতো স্ক্যাণ্ডাল হয় যে অন্য রাজ্যের স্ক্যাণ্ডাল পড়ার দরকার হয় না ।
    --ট্রাইবালদের ওনারশিপের নাম মালিক মকবুজা । দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে প্রচুর সেগুনকাঠের গাছ ছিল আর সেসবের মালিক ছিল স্হানীয় আদিবাসীরা । টিমবার মাফিয়ারা প্রশাসন আর রাজনীতিকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আদিবাসীদের ঠকিয়ে সেগুনের গাছগুলো কেটে পাচার করে দিত, ইসকি... । সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে লোকায়ুক্ত একটা কমিটি গড়ে রিপোর্ট চেয়েছিল । রিপোর্টে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল যে নিচেতলা থেকে ওপরতলা পর্যন্ত প্রশাসন সেগুনগাছ কাটায় আর ট্রাইবালদের ঠকানোয় ইনভলভড । সেসময়ের বস্তারের কমিশনার নারায়ণ সিং আর সালওয়া জুড়ুমের জন্মদাতা মহেন্দর করমার বিরুদ্ধে ছিল প্রধান অভিযোগ । কিন্তু অ্যাজ ইউজুয়াল সে রিপোর্ট ধামা চাপা পড়ে গেল, কারোর কিছু হল না, মাঝখান থেকে আদিবাসীগুলো জমিও হারালো আর জমির ওপরের সেগুনকাঠের গাছগুলোও, ইসকি...। রিপোর্টে দেখানো হয়েছিল যে আদিবাসীদের শহরে নিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখিয়ে বা ধমক দিয়ে বা চকচকে বোতলের মদ খাইয়ে চুক্তিতে টিপছাপ করিয়ে নেয়া হয়েছিল । যখন হইচই হয়েছিল তখন সেগুনগাছের গুঁড়িগুলোর চালান বন্ধ ছিল, তারপর সংবাদ মাধ্যম ভুলে গেল, পাবলিকও ভুলে গেল । সংবাদ মাধ্যম যে কাদের, তুই তো জানিস, ইসকি...।
    --কিছুদিন আগে মারা গেছে, সেই লোকটাই মহেন্দর করমা, না ?
    --হ্যাঁ, মাওওয়াদিদের অনেকদিনের পেয়ারা সনম ছিল । সালওয়া জুড়ুমের ভয়ে প্রচুর আদিবাসী ছত্তিশগড় থেকে পালিয়েছে অন্ধ্র আর মহারাষ্ট্রে ; ওদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হতো, ফসল কেটে নেয়া হতো । সরকারি অফিসাররা বলে যে মাওওয়াদিদের ভয়ে ওরা ছত্তিশগড় থেকে পালিয়েছে । দাঁতেওয়াড়ায় হাই টেনশান লাইন উড়িয়ে দশদিন অন্ধকার করে দিয়েছিল মাওওয়াদিরা । সত্যি-মিথ্যে একাকার হয়ে গেছে আমাদের দণ্ডকারণ্যে । নিম্নবর্ণের বাঙালি উদ্বাস্তুদের অভিশাপ থেকে রাঘব বোয়ালের বংশই মুক্তি পেলো না, এরা তো সব চিতি-কাঁকড়া, ইসকি...।
    --এ তো দেখছি কিছুটা আমাদের দিয়ারার মতন ব্যাপার । উঁচু জাত আর উঁচু চাকরির মতলবখোরি !
    --আদিবাসীদের জমিজমার কোনো রেকর্ডও সরকারি দপতরে পাওয়া যায় না, ইসকি...। একবার ছানবিন করে জানা গিয়েছিল যে দুজন মুখিয়ার পাঁচশ একর করে জমির মালিকানার পাট্টা আছে, আর কারোর নামে কোনো প্রমাণ নেই। জমি নেই তো কিষাণ ক্রেডিট কার্ড হবে না । অনেকে ভোটার কার্ড কাকে বলে জানে না, বি পি এল কাকে বলে জানে না ।
    --ওফ, বড় বেশি কমপ্লিকেটেড আপনার এনভিরন । যাকগে, রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যেতে কোন কোন শহর পড়ে বলুন ? আপনার দিদিকে দেখতে ইচ্ছে করছে । সেলাম জানাতে ইচ্ছে করছে ।
    --কথাটা সেলাম নয়, প্রণাম ।
    --হ্যাঁ, হ্যাঁ, কারেক্ট, সরি ।
    --ভিলাই, দুর্গ, দাল্লি রাজহরা, ভানুপ্রতাপপুর, তারপর নারায়ণপুর । তবে রায়পুর থেকে মোটোরেবল রোডও আছে । কোন রাস্তায় যাবি তার ওপর নির্ভর করে দূরত্ব, ২২৫ থেকে ২৭৫ কিলোমিটার খানেক হবে । শর্টকাট রাস্তা হল রাওঘাট হয়ে । এখন অবশ্য বয়লাডিলার খনির জন্যে এলাকাটায় চহলপহল দেখা দিয়েছে । আগে মাওওয়াদিরা কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছিল, এখনও ওড়ায় মাঝে-মধ্যে, রাস্তার মাঝখানে লাশ পড়ে থাকে, পুলিশ ভয়ে সরায় না, সরাতে গেলেই বোমা ফাটার সম্ভাবনা ; মরেওছে অনেক সিপাহি জওয়ান । আসাম থেকে, হরিয়ানা থেকে, তামিলনাডু থেকে, চাকরি করতে এসে বেচারাদের কি বিপত্তি ।
    অপুর জ্ঞান সীমিত, টের পেল অপু, দিয়ারাও তো প্রায় আদিনিবাসীদের অঞ্চল ।

    বারো
    পৃথিবীর উঠাপটক-জোড়তোড় সম্পর্কে বেশি খোঁজখবর রাখেন অপুর বাবা, অখবার পড়েন, আংরেজি টিভি দ্যাখেন, স্কুলে আর কালেজে যা শেখানো হতো সেসব বাবা জানেন, পড়া বুঝিয়ে দিতেন । মারোয়াড়ি কলেজে পড়ার সময়ে অনেক সাহায্য করেছেন বাবা । সকলে শহরে কোচিং পড়তে অঢেল টাকা খরচ করে, ওকে, অপুকে, করতে হয়নি । দাদু কিছুই জানেন না, খেতের রোপনি, কাটাই, মাল বিক্রি, লেন-দেন, পহলওয়ান সাপলাই আর রংদারি ট্যাক্স ছাড়া। অপুকে কোনো কথা বোঝাতে হলে মায়ের মাধ্যমে বোঝান বাবা। মা যদি তা না বোঝেন তখনই বাবা নিজে বিষয়টা নিয়ে অপুর সঙ্গে কথা বলেন ।
    --আরে উ অব বচ্চা-বুতরু হ্যায় কাআআআআআ ? করনে দিজিয়ে জো মন মেঁ আবে । কৌনো মৌগি কে সাথ নহিঁ না ফঁসা হ্যায়, না আপকে তরহ দিন-দহারে দারু কা নিসা করতা হ্যায় । কহিয়েএএএএএ ।
    --সসুরজি উসকো এতনা রুপয়া দে-দেকে খরাব কর রহে হ্যাঁয় ।
    --আরে রুপয়া হ্যায় কিস লিয়ে ? আপ কোই সোনে কা মুরত হ্যাঁয় কি আপকা বেটা হীরা-জওহারাত কা মুরত হোগা ? মগর ডরপোক নহিঁ হ্যায় আপকে তরহ । পহলওয়ান লেকে নহিঁ ঘুমতা হ্যায় মেরা বেটা । কা কহ রহেঁ হ্যাঁয় হম, সুন রহেঁ হ্যাঁয় নাআআআআআ ? আপনার আর আমার বাবার চাপে পড়ে আমার ছেলের ঘাড়ে দুটো মাথা গজিয়েছে, বিষ্ণু ভগওয়ানের আর ভস্মলোচনের , ও নিজেই বুঝতে পারে না যে কোন মাথাটার নির্দেশ কখন শুনবে। মাথা দুটোর লড়াই একদিন ওকে ডোবাবে । দুটো মাথার একটাও আমার কথা শোনে না । যখনই ফোন করি ফোন কেটে দিয়ে বলে ব্যস্ত আছি, এখন বিরক্ত কোরো না । ছেলেটা দিল্লি গিয়ে একদম সরফিরা হয়ে গেছে ।
    --মেরে তরহ গোরাচিট্টা হ্যায় উ । বাল ভি মেরে তরহ ঘুংরালি । অন্য কাউকে বিয়ে করতিস তো কয়লার খাদান থেকে বেরোনো কুলির চেহারা নিয়ে জন্মাতো ।
    --কয়লা খাদানের মজা লুটবেন বলেই তো থেকে গেলেন । এমন কচি কয়লাখনি তো আর পেতেন না, যাতে ঢুকতে দু’ঘণ্টা ধরে গলদঘর্ম হয়েছিলেন । লেকিন লম্বাই-চওড়াই ওকর নানাকে তরহ হ্যায় নাআআআআআ?
    --মজা ? কেঁচোর মাটিখাওয়া আবার মজা নাকি !
    --তবে না তো কী ? প্রথম রাত আমি দাঁতে দাঁত দিয়ে, মুঠো শক্ত করে, চুপচাপ সহ্য করেছিলুম, আপনি কতক্ষণ চেষ্টা করে সফল হয়েছিলেন, ভুলে যাচ্ছেন কেন । আমি জানতুম যে আপনি সফল মানেই দিয়ারায় ঘরজামাই হয়ে থাকা আপনার পাক্কা । মনে-মনে ঠিক করে নিয়েছিলুম যে, গঙ্গায় শুশুক ভেসে উঠেছে মানে আপনাকে আমার চাই-ই চাই, চিরে রক্তারক্তি হলেও, একফোঁটা চোখের জল ফেলব না। আপনার সফলতা আমার সফলতার সঙ্গে মিশে গেল, ছোটোবেলা থেকে স্নান করে-করে গঙ্গার যতগুলো ঢেউ আমার গায়ে জমা হয়েছিল, সেগুলো সেদিন ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল ।
    --হ্যাঁ, তোর ঢেউ তবু ফুরোয়নি । গঙ্গায় স্নান করিস আর নতুন-নতুন ঢেউ গায়ে করে তুলে আনিস ।
    --আপনি তো দেওয়ি-দেওতায় বিসওয়াস করেন না, গঙ্গায় স্নান করে দেখুন না একদিন, সব পাপ ধুয়ে যাবে।
    --কোনো পাপই করিনি আমি যে পাপ ধোবার জন্য তোর গঙ্গায় স্নান করতে হবে । পাপ অন্যেরা করে, আমি তার পূণ্য ভোগ করি ।
    জামাইবাবা সুশান্ত ঘোষের মেয়েও হয়েছিল, অপুর জন্মের এগার বছর পর । ওনাকে বোঝানো হয়েছিল, দিয়ারায় মেয়ে-বাচ্চা অশুভ বলে তাকে একদিনের বেশি বাঁচতে দেয়নি তারিণী মণ্ডলের বউ, মানে জামাইবাবার শাশুড়ি । দিয়ারার খেত এত উর্বরা কেন , যুক্তি দিয়েছেন শাশুড়িমাইয়া ; তার কারণ দিয়ারায়-দিয়ারায় পোঁতা আছে সীতামাইয়ার কন্যা-সন্তানরা, তারা মাটির তলায় নাল ফেলে-ফেলে জমিকে উর্বরা করে দ্যায় । জানতে পেরে, যদিও সুশান্ত ঘোষের গেঁয়ো বউয়ের ততটা মনখারাপ হয়নি, জামাইবাবার হয়েছিল । তারপর উনি নিজেকে স্তোক দিয়েছিলেন, যে, শহুরে মগজ নিয়ে দিয়ারার নৈতিকতা যাচাই করা অনুচিত ; যেমন ভুঁইসমাজ তেমন তার আচার-বিচার, তেমন তার সত্য, তার নৈতিক নিয়মাবলী ; কে বাঁচবে কে মরবে তার নির্ণয় নেবার অধিকার তো যে নিচ্ছে তার ।
    ওনার শশুর, তারিণী মণ্ডল, কাউকে উড়িয়ে দেবার হুকুম দিলে, যাকে ওড়ানো হচ্ছে তাতে তার কোনো নির্ণয় নেবার নৈতিক অধিকার থাকে না, কেননা সে এমন কাজই করেছে যে তাকে চলে যেতে হবে । তিনি কিডন্যাপ হলেন, তাতে তো তাঁর নিজের কিছু করার ছিল না । নির্ণয় নিয়েছিলেন হবু-শশুর ।
    মেয়ের মুখটুকু দেখা হল না বলে আপশোষ থেকে গেছে অপুর বাবার । যখনই মনে পড়ে, শরীর খারাপ হয়ে যায় । তরমুজের গুলাবি মদ নিয়ে বসেন ।
    আসল কারণটা অবশ্য সুশান্ত ঘোষের মেঠোগন্ধা বউই ফাঁস করে দিয়েছিল, সারা গায়ে ডেওডেরেন্ট উড়িয়ে, যখন একদিন রাতে মরা মেয়ের শোকে তরমুজের চোলাই করা মদ খেয়ে একা-একা কাঁদছিলেন । বউ বলেছিল, কেঁদে আর কী হবে ? ছেলে জারজ হলেও তার বিয়ের সমস্যা হয় না । কিন্তু জারজ মেয়েকে কে বিয়ে করত ? আপনি তো এমন মানুষ যে মনের মতন পাত্র কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে দিতে পারতেন না ; আজকালকার ছেলে, কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে দিলেও সে পালিয়ে যেত কিনা বলা যায় না । তারপর আবার কাজিয়া-খুনোখুনি, বিশ-পচিশ লাশ ইধর তো বিশ-পচিশ লাশ উধর ।
    ভাগলপুরের দিয়ারা অঞ্চলে সুশান্ত ঘোষ নিজে একাই এসেছিলেন, বাড়ির কাউকে না জানিয়ে, তারিণী মণ্ডলের খুংখার ক্রিমিনাল দলের সাহায্য নিয়ে মুঙ্গেরের পিপারিয়ায় বেদখল হয়ে-যাওয়া জমিজমার পুনর্দখল নেবার মতলব নিয়ে । সুশান্ত ঘোষ অফিসের বিহারি সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন যে ভাগলপুরের নাথনগর, আর বিহপুর থানার কসমাবাদ, দুধলা, বৈকুন্ঠপুর, তেতিস, অমরি, নকরটিয়া, অজমেরিপুর, ভগবতীপুর, দিলদারপুর, রত্তিপুর, ওদেদিয়া, কাহেওয়ারা, গিরিপুর, চোওহদ্দি, রাঘোপুর, গঙ্গাপুর, রসতপুর আর শাহপুরের গ্রামগুলোতে রাজত্ব করে একদল খুনি, তারিণী মণ্ডল, মলহারিয়া মণ্ডল, লালে মণ্ডল, ডুব্বা মণ্ডল আর সন্তান মণ্ডলের পহলওয়ানরা -- আধুনিক সমাজের বাইরে মারকাট অঞ্চল ।
    ইংরেজদের সময় থেকে কোনো তারতম্য হয়নি এই দিয়ারার মানুষদের জীবনধারায়, সংঘর্ষে, দারিদ্র্যে, শোষণে । যার যত পেশিশক্তি তার তত জমিন আর জলপ্রবাহ, গঙ্গার ধারের জমিন, গঙ্গার মাঝে জেগে ওঠা জমিন, আর গঙ্গার জলপ্রবাহ । ১৯৫৯ থেকে ভাগলপুরে গঙ্গানদীর তীরে একশো আটত্রিশটা গ্রামে ভূমিসংস্কারের চেষ্টা বারবার ভেঙে গেছে । কাগজে-কলমে যে-ই মালিক হোক না কেন, খুংখার খুনি গিরোহদের সমর্থনে দখলে রাখতে হয় ছুঁচের ডগার সমান জমি আর তর্জনী-বুড়ো আঙুলে ছেটানোর সমান জল । সুশান্ত ঘোষ ব্রিফকেস ভরে লাখ দেড়েক টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের সাহায্যে নিজেদের পিপারিয়ার জমিদারির জমিজমা ফেরত পাবার ষড় কষতে ।
    জমিজমার দখল নিতে গিয়ে নিজেই জবরদখল হয়ে গিয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ । সেই কাঁচা যৌবনে, তখনই, তাঁর চেহারার খোলতাই ছিল অবাঙালি, প্রায় মারোয়াড়ি । পাঁচ ফুটের ফর্সা গালফোলা ঘাড়ে-গর্দান কোঁকড়াচুল চনমনে । অথচ বাঙালি বলে, মুঙ্গেরের পিপারিয়া গ্রামে, যেখানে ওঁদের জমিজমা, সেখানে যাওয়া, ফসল তোলা, এতোয়ারি হাটের খাজনা আদায় সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । ওনার বাবার ঠাকুর্দা, মানে ঠাকুর্দার বাবা, হাইকোর্টে, তখন কলকাতায় মামলা লড়তে হতো, ভূমিহার রাজনাথ সিংকে ফৌজদারি মামলায় জিতিয়ে দেয়ায়, মুঙ্গেরের রোমহর্ষক দিয়ারায়, দুশো একর জমি আর সাত একর আনাজ বাগান, আর এতোয়ারি হাট ওনার ঠাকুর্দার নামে করে দিয়েছিল ।
    সুশান্ত ঘোষ আগে যাননি কখনও পিপারিয়া । ছোটোবেলায় চাল মুসুর অড়র ভুট্টা সর্ষে পটল কচু আম রাঙা-আলু গাওয়া-ঘি আর হাটের টাকা আসত । তারপর ওখানে কৈলু যাদব, কজ্জল ধানুকদের দলের অপহরণকারী অপরাধীরা এমন জ্বালাতন আরম্ভ করলে যে সুশান্তদের বাড়ির কেউই ওমুখো হবার সাহস যোগাতে পারেননি । কাদের হাতে যে সেই বিশাল সবুজ খেতখামার তা কেবল কানাঘুষোয় শুনতে পাওয়া যেত। বাংগালি-তাংগালি বলে সুশান্ত ঘোষের জ্যাঠা-কাকা-বাবা সেখানে পাত্তা পেতেন না ।
    সত্তরে পৌঁছে বাঁচোখ কানা তারিণী মণ্ডল পাকাপাকিভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন জামাইবাবার হাতে ।
    তারিণী মণ্ডলের সিংহাসনে বসার দিনকতক পর, একদিন রাতে মুঙ্গেরের পিপারিয়ায় তাঁর দলের বাছাই পালোয়ানদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ, বাপ-ঠাকুর্দার জমিজমা দখলের জন্য নয়, সেই জমিজমা যারা দখল করে ওনাদের বেদখল করে দিয়েছে, তাদের সাফায়া করে প্রতিশোধ নেবার জন্য । সাফায়া করার পর তাদেরই তিনটে লাশ আর বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র বোমাবারুদ ফেলে এসেছিল মাধেপুরার আরেকটা দলের অঞ্চলে, যাতে তাদের পারস্পরিক খুনোখুনিটা চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের চেহারা নিতে পারে । নিয়েও ছিল । সেই থেকে মুঙ্গেরের আর মাধেপুরার অপরাধীরা লড়ে মরে জামাইবাবাকে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছিল । মারকাট এড়াবার জন্যে শলা করতে বসে ওরা জানতে পারে যে ওদের মধ্যে লড়াইটা বাধিয়েছিল তারিণী মণ্ডলের জামাই ।
    ভোঁসড়িকে ক্যা বাংগালি দিমাগ, হমনিলোগকে চালিস আদমি মর গেলই আপস মেঁ লড়ঝগড়কে । প্রকৃত ব্যাপার জেনে ফেলার পর, পিপারিয়া গিরোহ লোক পাঠিয়েছিল তারিণী মণ্ডল আর তার বাংগালি জামাইকে খুন করার জন্য । সাতসকালে ট্রাক চালিয়ে এসে, সামনেই তারিণী মণ্ডল আর মন্হরা দেবীকে পেয়ে যাওয়ায় শশুর আর তার বউকে সাফায়া করার লোভ সামলাতে পারেনি তারা।
    বালিয়াড়িতে দুই চিতার ওপর সাজানো দাদু-দিদিমার শব দেখে পর্যন্ত অপু নিজেকে বুঝিয়েছিল যে বদলা নিতে হলে আজকেই নিতে হবে । শোক-ফোকে ডুবে থাকলে চলবে না । দাদু তো শিখিয়ে গেছেন যে পৃথিবীতে ভয় নামে কোনো ব্যাপার নেই । মনের ভেতরে পোষা অজানা আতঙ্ক ছাড়া বাইরের কোনো কিছুকে ভয় করতে নেই । বুলেটই হল চিরসত্য ।
    একবার নিজের মাথার ওপর খেত থেকে সদ্য তোলা পটল রেখে, তখন ওর বারো বছর বয়স, দাদুকে বলেছিল, চালান গুলি, দেখি কে ভয় পায়, আপনি না আমি । উত্তরে তারিণী মণ্ডল বলেছিল, আমার বাঁচোখ নেই, ডান চোখ এখন খারাপ হয়ে গেছে, জোয়ান বয়স হলে চালাতুম গুলি, দেখিয়ে দিতুম তোকে, চশমা পরে তো আর এক-নল্লা চালানো যায় না । অপু বলেছিল, ডরপোক কহিঁকা ।
    --আমি আর ডরপোক ? আমার নাম শুনলে সরকারি অফিসাররাও হেগে ফ্যালে, জানিস তো, আমি হলুম মূর্তিমান ত্রাস । আচ্ছা, আমি রাখছি পটলটা মাথার ওপর, তুই চালা ।
    --আমার তো আর এখন অত টিপ হয়নি । পাঁচদশ বছর যাক তখন দেখবেন, দেয়ালের পিঁপড়েকেও একশ মিটার দূর থেকে গুলি চালিয়ে মেরে দেখাবো । পিস্তল-বন্দুক চালাতে শেখাচ্ছেন তো আপনিই ; দেবো গুরুদকছিণা, চিন্তা করবেন না।
    --তোর বাপকে আর মাকে বলিসনি যেন যে তুই পিস্তল-বন্দুক চালাতে শিখছিস । শসার শাঁষ দিয়ে হাত পুঁছে নে, নয়তো তোর মা হাত শুঁকলে বারুদের গন্ধ পেয়ে যাবে ।
    --জানি ।

    তেরো
    রাত নামতেই চারটে মেছো নৌকো আর একটা গাদাবোটে নম্বরপ্লেট-খোলা মোটরসাইকেল চাপিয়ে, বাবা সুশান্ত ঘোষকে না জানিয়ে, গংগোতা গ্যাঙের দলবল নিয়ে চুপচাপ মাধেপুরায় পৌঁছে গিয়েছিল অপু । সঙ্গে দশটা জেরিক্যানে পেট্রল । পটলের পাহাড়, তরমুজের ঢিবি, ভুট্টাগাছের কাটা আঁটির ডাঁই আর শুয়োর-ছাগলের খোঁয়াড়ে পেট্রল ঢেলে বোমা মেরে আগুন যখন দাউ-দাউ, অপু একে-সানতালিস চালিয়েছে ঝোপড়িগুলোকে লক্ষ্য করে ।
    মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে ঠেলে দিয়েছে উল্টো দিকে, আর নিজেরা চুপচাপ ফিরেছে নৌকোয় চেপে ।
    --আপ্পু, চল অব, ছোড় দে, সব মর গয়া হোগা । সঙ্গীদের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে, থেমেছিল অপু । অন্ধকারে কোনো কিছু নড়তে দেখলেই গুলি চালিয়েছিল, বেরহম । সবুজ পটলের পাহাড় পেট্রলের আগুনে ঠিশ-ঠাশ লাফিয়েছে দিকবিদিক, পাকা পটলগুলো হলদে ছ্যাদলামাখা কালো দাঁত থেকে আগুনের ফিনকি বের করে অট্টহাসিতে গলা ফাটিয়েছে। কালচে তরমুজরা শ্মশানে চিতায় শোয়া খুলির মতন ফেটে লাল রঙের ঘিলু উড়িয়েছে অন্ধকারের মহোল্লাসে । ভুট্টার খোসার ভেতরে গচ্ছিত পাকা দানাগুলো হাতবোমায় ভরা ছররার ঢঙে ফরফরিয়েছে ।
    পরের দিনই স্হানীয় সংবাদপত্রের শিরোনামে তারিণী মণ্ডল ও তার স্ত্রীর হত্যা আর মাধেপুরায় নারীশিশু মিলিয়ে তেত্রিশজনের জ্বলেপুড়ে বা গুলি খেয়ে মরার খবর । তার পরের দিন সর্বভারতীয় মুদ্রিত আর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে, আতংকওয়াদি নেতা আপ্রাধি ঘোষের নেতৃত্বে অতর্কিত হামলায় শতাধিক নিহত । পুলিশের ডিজিকে ওপরতলা থেকে গোপন হুকুম দেয়া হয়েছে যে আতংকওয়াদিদের নেতাকে যদি ধরা যায়, তাহলে, যদি সে ধরা দিতে না চায়, তাহলে, দেখামাত্র তাকে, আপ জানতে হ্যাঁয় কেয়া করনা হ্যায় । একটা মুদ্রিত মাধ্যমে নামকরা সাংবাদিক উত্তরসম্পাদকীয়তে লিখেছে, বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে যে লোকটা প্রতিবেশী দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিল, আর ওর প্রকৃত নাম আপ্রাধী ঘোষ নয় ।
    অপু নিজেকে তারিণী মণ্ডলের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে, শুনে, খেপে গেলেন সুশান্ত ঘোষ । ভ্যাপসা অন্ধকারে বসে, মেঠোগন্ধা স্ত্রী বেবিকে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে, যেভাবে উনি কখনও আজ পর্যন্ত কথা বলেননি, বললেন, আমি নিজে কোনোদিন বন্দুক-পিস্তল চালাইনি, আমার লুঙ্গিতে এই অটোমেটিক পিসতলটা শুধু গোঁজাই থাকে, চালিয়ে মাঝে-সাঝে টেস্ট করার হলে রামশরণ করে, আমি ট্রিগারও ছুঁয়ে দেখিনি । আমি অপুকে কোনো অস্ত্র-শস্ত্রে হাত দিতে দিইনি, তোর মাথায় ছোটোবেলায় হাত রেখে ও শপথ করেছিল যে জীবনে কোনোদিন ও বোমাবারুদ গুলিগোলা বন্দুক রাইফেলে হাত দেবে না । এটা কী করে হল ? কে শেখাল ওকে ? নিশ্চই ওর দাদু কোনো ফাঁকা দিয়ারায় নিয়ে গিয়ে নিশানার অভ্যাস করিয়েছে ; তুই আমায় জানতে দিসনি, তুইও চেয়েছিস যে তোর ছেলে আমার মতো নয়, তোর বাবার মতন খুনি কিডন্যাপার অপরাধী হোক । এখন কী করবি ? তোর ছেলেকে খুন করার জন্য নিশ্চই বেরিয়ে পড়েছে শত্রুরা ।
    সতত কলহাস্যময় বেবি এখন নিঃশব্দে, দুঃখ-মেশানো ক্রোধে, চোখের জল ফেলছিল ; সম্ভবত বাবা-মার অপঘাতে মৃত্যুর কারণে। চোখ মুছে, দাঁতে দাঁত রেখে, বিরক্তির স্বাচ্ছন্দ্যে, বলল, আমিও জানতাম না যে ও বন্দুক চালানো শিখেছে ; দিয়ারায় বাচ্চারা ছোটোবেলা থেকেই কাট্টা তামাঞ্চা একনল্লা দুনল্লা চালাতে শেখে । ও-ও হয়তো সেভাবেই শিখেছে ।
    নৃশংস ঘটনার অতর্কিত বিহ্বলতায় বিচলিত ও বিমূঢ় সুশান্ত বসেছিলেন দাওয়ায় বাঁশের বেঞ্চে, ফলসা আর খিরনিগাছের তলায় । অপুকে কি ভাবে বাঁচানো যায় চিন্তা করছিলেন ।
    বেবির পরবর্তী কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সুশান্ত ঘোষ ।
    ঠোঁটের কোনে উত্তজনার দুঃসাহসী ফেনায় হতচেতন বেবি, ভয়ার্ত শ্রদ্ধায়, বলল, আপনি তো খুশিই হলেন আমার বাবা ওভাবে খুন হওয়ায়, রাস্তার মাঝখানে জানোয়ারের মতন, মুখ দেখে আর চেনার উপায় ছিল না যে ওই লোকটাই তারিণী মণ্ডল । আপনি মনে-মনে ষড়যন্ত্র করে আপনার জমিদারি বেদখলের বদলা নিতে লোক পাঠিয়েছিলেন । অন্য সবাইকে বোকা বানাতে পারেন, আমাকে নয়, আমি আপনার সঙ্গে প্রতিদিন-প্রতিরাত থাকি, জানি আপনকে, কখন কোন গান শুনছেন তা থেকে আপনার মনের অবস্হা বুঝে যাই, কেন বেশি মদ খাচ্ছেন তার আসল কারণ টের পেয়ে যাই । কী দরকার ছিল ? বেশ ভালোই তো ছিলেন, দিয়ারার একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে । আসলে আপনি জানতেন যে পিপারিয়াকে আক্রমণ করলে ওরা তারিণী মণ্ডলকে নির্ঘাত খুন করবে । আর আমার বাবা আপনাকে কিডন্যাপ করে আমার সঙ্গে যে জোর করে, চারিদিকে পাহারাদার বসিয়ে, বিয়ে দিয়েছিলেন, তার প্রতিশোধ নেয়া হবে । নয়কি ? নিশ্চই আপনি মনে-মনে ষড়যন্ত্র করেছেন বিয়ের পর থেকেই, কী করে আপনার কিডন্যাপিঙের আর মুখ্যু কালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ের বদলা নেবেন।
    বেবির কথাগুলো ওনাকে, সুশান্ত ঘোষকে, অবাক করল । তিনি যাকে মেঠোগন্ধা বোকা মেয়ে ভাবছিলেন, সে তো তা নয় । সে ওনার গোপন ইচ্ছের কথা জানে ! কখনও কি ঘুমের ঘোরে বা অত্যধিক মদ খেয়ে বলে ফেলেছেন মনের কথা ? কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক যুবককে রাজধানীর ব্যাপক জীবন থেকে উপড়ে তুলে এনে ফালতু একটা জায়গায় পুঁতে বনসাই করে দেবার কাজের বিরুদ্ধে পুষে রাখা রোষের আগ্নেয়গিরির মুখকে খুলে ড্র্যাগনের আগুন-নিঃশ্বাস ছড়িয়ে সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেবার পরিকল্পনা ?
    বেবির মর্মপীড়া প্রতিবন্ধকহীন, বলতে থাকল, খুন-করার ঋণ খুনের মাধ্যমেই প্রতিশোধ হয়, জানি, ছোটোবেলা থেকে ; বদলা যে নেয় তার মাথার দাম বদলা নেবার সময়েই নির্ধারিত হয়ে যায় । আপনি তো আলাদা মানুষ ছিলেন, সাক্ষাৎ দেওতা, কী করলেন আপনি ? বিষ খেতে-খেতে ভাবলেন যে আপনি বিষ খেলে যার কাছ থেকে বিষ কিনেছিলেন সেই দোকানদার মারা যাবে, আপনার কিছুই হবে না ।
    সুশান্ত , উদাসীন ক্ষোভে, বাকরুদ্ধ, শুনছিলেন, বেবির উদ্গীরণ, কে জানে কোথায় চাপা দেয়া ছিল, যাকে উনি মেঠোগন্ধা বোকা কথাকিপটে মেয়ে ভেবেছিলেন, তার অন্তরঙ্গ মিশুকে সংযমের আড়ালে ছিল আরেক বেবি।
    বেবি বলল, আপনি আপনার ছেলেকে বসিয়ে বাংলা বলতে পড়তে লিখতে শেখালেন, আমাকে তো শেখালেন না, আমি তো হিন্দিতেও আনপঢ়, আপনি চাইলে আমাকে চোদ্দ বছর বয়স থেকে আপনার বাঙালি বউ করে তুলতে পারতেন । আমাকে আপনি আপনার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাননি । মিষ্টি কথা বলে-বলে আমায় ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন, তা কি আমি বুঝতুম না ? আজ আপনার কাছে অনুতপ্ত হওয়া ছাড়া কিছু করার নেই।
    সুশান্ত বেবির কথাগুলোর উত্তর দিলেন না, কেবল বললেন, কোথায় অপু, ওর এখানে থাকা চলবে না, এখানে ও হয়তো আজকেই খুন হয়ে যাবে । ওকে একটা মিডিয়া আতংকওয়াদি, আরেকটা মিডিয়া মাওওয়াদি বানিয়ে দিয়েছে ।
    অপু এলে সুশান্ত ঘোষ বললেন, গেট রেডি টু গেট লস্ট । গো ফ্রম দিস প্লেস । যেখানে কেউ তোকে খুঁজে পাবে না এমন জায়গায় চলে যা ।
    অপু কিছু বলতে চাইছিল । ওর নিরক্ষর মা, ইংরেজির একটিও শব্দ না জানা সত্ত্বেও, সুশান্তর মনোভাব আঁচ করে, অবিচলিত কন্ঠে বলল, তোর বাবা যা বলছেন, তা-ই কর । তোর এখানে থাকা চলবে না । তোর দাদুর মতন তুইও রাস্তায় গাড়ি চাপা শুয়োরের মতন মরে পড়ে থাক তা দেখার আগে আমি গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে নেবো।
    ডেস্কটপের মনিটারে গুগল ম্যাপ খুলে, বাবা সুশান্ত ঘোষ অপুকে বোঝালেন , তুই পালা, এই দ্যাখ, ইতুদিদি আর অমিত বর্মণ নামের লোকটা যে জঙ্গলে গেছে তার ম্যাপ, জায়গাটার নাম অবুঝমাড়, কেউ যায় না আদিবাসীদের ওই অঞ্চলে, গুগল সার্চ করে দেখেছি, ইমপ্রেগনেবল ফরেস্ট । প্রথমে দণ্ডকারণ্যের নারায়ণপুরে যাবি, সেখান থেকে হদিশ নিয়ে অবুঝমাড় ।
    সুশান্ত ঘোষ অনুমান করেছিলেন যে পুলিশ এসে ওনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে উত্তম-মাধ্যম দিয়ে কথা আদায়ের চেষ্টা করবে । ছেলেকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্হা করে দিয়ে বেবিকে সঙ্গে নিয়ে নিজেও পালালেন দিয়ারার চরে, যেখানে পলিমাটির প্রলেপ-দেয়া চ্যাঁচারির বেড়ায় ঘেরা ঢেউতোলা অ্যাসবেসটসের চালাঘরে দাগি অপরাধীরা, পুলিশ-প্রশাসনকে এড়াবার জন্য, এসে লুকোয় । তারা এসে লুকোলে শহর থেকে নাচানিয়াওয়ালি আনিয়ে তাদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্হা করত তারিণী মণ্ডল ।
    সুশান্ত ঘোষ ভেবে দেখলেন যে, যতদিনে পুলিশ ওনাকে ধরবে ততদিনে অপু পৌঁছে যেতে পারবে নাগালের বাইরে । অবুঝমাড়ে পালিয়ে গেছে শুনলে পুলিশের আর কিছু করার থাকবে না ।
    দিয়ারায় বানানো গঙ্গামাটি-লেপা বাঁশের কাঠামোর ওপর বেছানো অ্যাসবেসটসে পাতা খড়ের ছাদের তলায় ফেরারি অপরাধীদের কুকর্মশালায় আশ্রয় নিলেন সুশান্ত ঘোষ । ডিজেল জেনারেটারে চালানো কুলারের ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে ছিলেন চেয়ারে । ওনার চালাঘর ঘিরে, আর নৌকোয় বসে, কুড়ি-পঁচিশজন বন্দুকধারী পাহারাদার, তারা পুলিশের আর শত্রু গ্যাঙদের আক্রমণ প্রতিহত করবে যতক্ষণ পারবে । বেবি আর ওনার মাঝে কথা বলার বিষয় হতে পারত ওনাদের ছেলে অপুর সুরক্ষিত থাকা, নির্ধারিত জায়গায় পোঁছানো । কিন্তু বিবাহ নামের কর্মকাণ্ডের দ্বারা দুজনের যোগাযোগের যে মাধ্যমটি ছিল, যা কিডন্যাপিঙের সূত্রে জোর করে তৈরি সম্পর্কে গড়ে উঠেছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে তারিণী মণ্ডলের মৃত্যুতে। বেবির নিঃশর্ত ভালোবাসা তাঁর সমস্যার সমাধান করতে পারেনি । দেখনপ্রেম হোক বা মাংসঘর্ষণ ভালোবাসা, সেসবের প্রলেপ লাগিয়ে কোনো ঘা শুকোয় না । শশুরের মৃত্যুতে তিনি যেমন গোপন আহ্লাদে মাতোয়ারা, তেমনই ছেলে অপুর অবধারিত গ্রেপ্তার, বিচার ও কারাদণ্ডের, এমনকি মৃত্যুদণ্ডের, দুশ্চিন্তার চাপা আতঙ্কে বিপর্যস্ত । পারস্পরিক সম্পর্কের সমস্যার সমাধান এই ভাবেই করতে হল, বোঝাচ্ছেন নিজেকে, এ ছাড়া উপায় ছিল না । কিন্তু সে সমস্যার সমাধান হতে দিল না তাঁরই ছেলে। ছোঁ-মারা কিডন্যাপিঙের সময় যেমন আলাদা ছিলেন, এতকাল একসঙ্গে ঘর করে সেই আলাদাই রয়ে গেছেন, মাংসাশী জানোয়ারের হাইবারনেশানে, রেকলুজ, কাস্টঅ্যাওয়ে ।

    চোদ্দ
    মুঙ্গেরের দিয়ারার ঝোপড়িগুলোয় সাতসকালে তাজা রক্তের গন্ধে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বেলেমাছি চ্যানেল, ঘোড়ামাছি চ্যানেল, হোবারমাছি চ্যানেল, সিসিডামাছি চ্যানেল পলিমাটির দরদালানে পৌঁছে গিয়েছিল । ওঃ এত লোক গুলি খেয়ে, আগুনে পুড়ে মরেছে, আর কি থাকা যায়, প্রতিটি মাছি চ্যানেল ভনভনিয়ে ওবি ভ্যান চালিয়ে তড়িঘড়ি দুর্ঘটনার জায়গায় ।
    ঘোড়ামাছি : আপনারা দেখতে পাচ্ছেন এই মুহূর্তে, জনগণমাছিদের ডুমোচোখের সামনে তিরিশ-চল্লিশটি হত্যা হয়েছে অ্যাবং সেই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ড। কিন্তু রাতের অন্ধকারে কারা এই লজ্জাজনক বীরত্ব দেখিয়েছে, তা কেউ বলতে রাজি নন, কেননা স্হানটি অসামাজিক চরিত্রের মাছিদের নিয়ন্ত্রণে । এই যে, ফলেরমাছি, আপনি তো প্রত্যক্ষদর্শী, আপনি কী দেখলেন ?
    ফলেরমাছি : আমি কিছুই দেখিনি, তখন তরমুজের খোসার ভেতরে রাতের ঘুম দিচ্ছিলাম ; আমি গুলির শব্দে বিরক্ত হয়ে পচা তরমুজের ভেতর থেকে উড়তে বাধ্য হয়েছি, তাই আমার গায়ে লাল রং লেগে আছে । আমি এর ঘোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি । আমরা ফলের মাছিরা নির্ণয় নিয়েছে যে আমরা এইপ্রকার আওয়াজ অ্যাবং আগুন, যা শান্তি নষ্ট করে, তার বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলনে যাবো । তবে গুজবমিশ্রিত অনুমান যে একজন যুবক বদলা নেবার হাতিহাঁক পেড়েছিলেন।
    বেলেমাছি : নীল মাছির দল পৌঁছে গেছেন অকুস্হলে । আপনারা দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই, মানব প্রজাতির একাধিক মহিলার বক্ষস্হল নির্মল আকাশের তলায় উন্মুক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে অ্যাবং তাঁদের যাবতীয় অভিমান নিঃশব্দ বিলাপ হয়ে দৃশ্যমান । দীপঙ্করদামাছি, ক্যামেরাটা একটু প্যান করে দেখান ঘরের মাছিরা ঘরের কাজকর্ম ফেলে কোন আঙ্গিকে এই সামগ্রিক রসপানে অংশ নিতে র‌্যালির পর র‌্যালিতে আসছেন ।
    নীলমাছি : বন্ধুগণ, আপনারা জানেন যে গত কয়েক দশক যাবত ডানার রঙ পালটে পালটে কায়েমিস্বার্থান্বেষী দলবদলু অ্যাবং রংবদলু গুয়েমাছিরা ভুল সংবাদ পরিবেশন করে চলেছেন । রক্তপাত ঘটলেও তাঁরা বলছেন যে রেতঃপাত হয়েছিল...আচ্ছা আমরা এখান থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছি, কেননা মানবপ্রজাতির বহু নমুনা পৌঁছে গেছেন এবং তাঁরা মাছিসমাজ সম্পর্কে অভদ্র কথাবার্তা বলছেন । ব্যাক টু স্টুডিও ।
    হোবারমাছি : সঙ্গে থাকুন ।
    মোদোমাছি : সঙ্গে তো থাকতে চাই গো, কিন্তু কী করে তোমাদের কাঁচের বাক্সটার ভেতরে ঢুকবো তার উপায় তো বাতলাও না ।
    সরকারিমাছি : মানব সম্প্রদায়ের এক প্রতিকল্প তার ঔরস উপন্যাসে, আপনাদের সম্পর্কে যাচ্ছেতাই কথাবার্তা লিখেছে । আপনারা তাকে গিয়ে বিরক্ত করুন, সে-ই আপনাদের সবার সামনে ল্যাংটো করে ছেড়েচে।

    পনেরো

    দিল্লির ওপন টিকিট কাটাই ছিল অপুর । ফোমচামড়ার ব্যাগে তারিণী মণ্ডলের তিজোরি থেকে করকরে নোটের বাণ্ডিল আর কয়েকটা জামাপ্যান্ট নিয়ে, পাটনা গিয়ে সোজা দিল্লি, দিল্লি বিমানবন্দর থেকে রায়পুরে একরাত হোটেলে । পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে আতংকওয়াদি বা মাওওয়াদি আপ্রাধি ঘোষকে । সিকিউরিটি চেকে অশ্বমেধ ঘোষের অসুবিধা হল না । ভাগলপুর স্টেশানের টেলিফোন বুথ থেকে নিকিতাকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে ওর ম্যালেরিয়া হয়েছে, ফিরতে মাসখানেক লেগে যাবে । নিকিতা জানতে চাইছিল কী করে ভাগলপুরে অপুর বাড়ি যাবে । অপু বোঝালো, অনেকের ম্যালেরিয়া হয়েছে, শেষে নিকিতা আসলে ওর-ও হতে পারে । নিকিতা বলল, হরওয়খৎ ধোখা দেনে কে চক্কর মেঁ রহতে হো, মুঝে গিনতি মত পঢ়াও, ম্যায় জরুর পহুঁচ জাউঙ্গি, তুমহারে মাতা-পিতা সে মিলনা হ্যায় ।
    অপু মোবাইলের সিম কার্ড বের করে ট্রেনলাইনে ফেলে দিল ।
    রায়পুরে, বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে, বাসস্ট্যাণ্ডের সামনে, ফালতু হোটেল, ওর কাছে পরিচয়পত্র চাইল না, চাইলে ইউনিভার্সিটির পরিচয়পত্র দেখাবে বলে তৈরি ছিল , রেজিস্টারে লেখালিখিও করতে বলল না । রেজিস্টার চাইতে বেঁটে-মোটা-টেকো হোটেল মালিক বললে, আরে এখন ছাড়ুন ওসব ; এখন নদীর নিলাম হবে বলে লোক আসছে আর যাচ্ছে, আসছে আর যাচ্ছে । আপনার ভাগ্য ভালো যে ঘরটা আজ সকালেই খালি হয়েছে।
    --নদীর নিলাম ? অনেক মাছ হয় নাকি ? না নৌকো যাতায়াত করে ?
    --জলের জন্য নিলাম ।
    --জলের জন্য ?
    --শোনেননি আপনি ? রায়গড়ে কুরকেত নদী, দাঁতেওয়াডাতে সাবরি নদী, রায়পুর জেলায় খারুন নদী, কোরবাতে হাদেও নদী, ঝাঙ্গির-চম্পায় মাঁড নদী নিলাম হয়ে গেছে । সাবরি বা কোলাভ নদীর ধারে চিন্তালনাডের জঙ্গলে মাওওয়াদীরা ছিয়াত্তর জওয়ানকে মটিয়ামেট করে দিয়েছিল, কাগজে পড়েননি ? সাবরি নদীই তো উড়িষা আর ছত্তিসগড়কে আলাদা করেছে । উড়িষ্যার কোরাপুট থেকে চালু হয়েছে ।
    --নদী যে নিলাম হয়, এই প্রথম শুনলুম । কোথায় গিয়ে মিশেছে নদীটা ?
    --সাবরি নদী নারায়ণপুর-দাঁতেওয়াডায় প্রথমে পশ্চিম থেকে পুবে, তারপর উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে ভদ্রাচলমের কাছে গোদাবরীতে গিয়ে মিশেছে ।
    --নৌকো চলে ?
    --হ্যাঁ, কিন্তু বন্যার সময়ে নদীর চেহারা পালটে যায় । কখনও-কখনও আঠাশ ফিট পর্যন্ত জল ওঠে । আসেপাশে সব ডুবে যায় । যাতায়াত, এখন যেটুকু দেখছেন, তাও বন্ধ হয়ে যায় ।
    ...অপু আরেকটু হলে অবুঝমাড় শব্দটা উচ্চরণ করে ফেলত । গিলে ফেলল মগজ থেকে জিভে এসে নামা কথাটা।
    --নদীর পাড়ে জংলিরাই থাকে । দণ্ডকারণ্যে কে যে আসলি জংলি আর কে যে মাওওয়াদী জংলি তা আপনি বুঝতে পারবেন না । পুরো দণ্ডকারণ্য জঙ্গলে হয় মাওওয়াদী নয়তো সিপাহিদের জামাত । আর ছিটপুট রিফিউজি, সোয়াধিনতার টাইমে ওরা বাংগালি ছিল।
    --নদী কিনে করবে কি লোকে ?
    --ফ্যাকটিরি বসছে । আপনি কিনতে পারবেন না, অনেক টাকা খাওয়াতে হয় এসব ব্যাপারে । করোড় করোড় । করোড়-করোড় ক্যাশ । নিলাম একটাকায়, পিছুয়াড়িতে করোড়-করোড়, পেটি ভর-ভরকে, খুল্লমখুল্লা।
    --সব জল কি ফ্যাকট্রিই নিয়ে নেবে ? এতগুলো নদীর ?
    --ওই তো কুরকেতি নদীর ধারে গারিয়া জাতের জংলিরা তরমুজ, শশা তারপর রবির মরশুমে রবি চাষ করত, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত, কিন্তু রাবো গ্রামের কাছে ড্যাম তৈরি হল, ব্যাস, জাঁপলি, কিকরিচোলি, দেহজান গ্রামের খেতি বন্ধ হয়ে গেল । এক হাজার মেগাওয়াটের পাওয়ার প্ল্যান্ট বসেছে তামনারে, সব জল খেয়ে নিচ্ছে ফ্যাকটিরি । জংলিদের খাবার জল নিয়ে চলছে হল্লাগুল্লা ।
    --জংলি ?
    --গারিয়া, গোঁড়, মাড়িয়া, মুরিয়া লোকেরা থাকে, গায়ে এক চিলতে জামা-কাপড় নেই, শর্মনাক, শর্মনাক, পুরুষগুলো দিনেরবেলাতেও সালফি মদ খেয়ে টপ্পাগুল বেহুঁশ ।
    --আচ্ছা নারায়ণপুর যাবার সহজ উপায় বলুন তো ।
    --বাসে করে চলে যান । তবে বাসগুলো সবকটা সিটে প্যাসেঞ্জার না পেলে যেতে চায় না । নৌকরওয়ালা বাসেও যেতে পারেন, ওটা রেগুলার, সরকারি নৌকরি করে যারা, নারায়ণপুর জেলা হেডকোয়ার্টার হবার পর পোস্টিং হয়েছে, বউ-বাচ্চা রায়পুরে, তাদের বাসে যেতে পারেন ।
    --মোটর সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায় না ?
    --ভাড়া তো পাওয়া যায় না, তবে আপনার মতন একজন বাংগালি আদমি আছে, নারায়ণপুরে বাড়ি, সে নিয়ে যেতে পারে। ও অনেক ফোটোগ্রাফার আর সাংবাদিককে নিয়ে গেছে, ওই দিকের অলিগলি চেনে ।
    --লোকটাকে খবর দিন না ; আজকেই বেরিয়ে পড়ব তাহলে ।
    --আগে ও মালকানগিরির যে গ্রামে থাকত তার নাম একানওয়ে ।
    --একানওয়ে ? নাইনটিওয়ান ? এরকম নাম কেন ?
    --বাংগালি রিফিউজিরা এসেছিল, সানতালিস, একাওয়ান, পঁয়ষট আর একহত্তর সালে, পরেও এসেছে ছিটপুট । জঙ্গল কেটে বানানো তাদের ঝোপড়পট্টিগুলোর তো নাম ছিল না । এক দুই তিন চার করে হবে বোধহয়, একানওয়ে বানওয়া এমনি করে একশো দুশো, কে জানে, সে অনেকদিন আগের কথা। যুগ কেটে গেছে কিন্তু বাংগালি লোকগুলো রিফিউজির মতনই গরিব থেকে গেছে । মাওওয়াদীরাও ওদের কাছ থেকে…
    --রংদারি ট্যাক্স নেয় ?
    --রংদারি ট্যাক্স । ভালো বলেছেন ।
    --নাম কি ছেলেটার ?
    --কাতিক, কার্তিক ছিল বোধহয়, লেখাপড়া শেখেনি তো, কার্তিককে কাতিক করে ফেলেছে । দেয়োই-দেওতাদেরও সম্মান করে না আনপড় বাংগালিগুলো ।
    --ওর বাবার নাম কি গণেশচন্দ্র সরকার ?
    --জি হাঁ । আংরেজি পড়ান । লেকিন কাতিক অপনে বাপ কো আব্বা পুকারতা হ্যায়, অওর মা কো অম্মি। অজব বাংগালি ।
    --একটু ফোন করে দেখুন না । গণেশচন্দ্র সরকারের বাড়িতেই যাবো ।
    --এসে যাবে, এসে যাবে, কজনই বা প্যাসেঞ্জার হয়, মোটর সাইকেল সওয়ারি করতে অনেক প্যাসেঞ্জারের সাহস হয় না ।
    --আচ্ছা । তাহলে অপেক্ষা করি ।
    --আপনি কী করেন ?
    --আমি ফিউজিটিভ ?
    --ফিউজিটিভ মতলব ?
    --ভগোড়া ।
    --হেঁঃ হেঁঃ, আচ্ছা-খাসা মজাক কর লেতে হ্যাঁয় আপ ।
    ঘণ্টাখানেক পরে মোটর সাইকেলে গেরুয়া মাটির ধুলো উড়িয়ে কাটাঢ়েঁড়া জিন্সের প্যান্ট আর হাতকাটা লাল গেঞ্জিতে, পাঁচ ফিটের, বছর চল্লিশের একজন দোহারা লোক হোটেলের সামনে পৌঁছে হর্ন দিতে, হোটেল মালিক বলল, নিন, এসে গেছে কাতিক । লোকটাকে দেখে, বাবা একটা শব্দ শেখাতে কয়েকটা চড় মেরেছিলেন, সেই শব্দটা অপুর মগজে ভেসে উঠল, অকুতোভয় ।
    কয়েকটা ধাপ নেমে অপু বলল, হিন্দিতে, আমি নারায়ণপুরের ইংলিশ টিচার গণেশচন্দ্র সরকারের বাড়ি যেতে চাই । উকোখুস্কো চুল লোকটা জিগ্যেস করল, গণেশচন্দ্র সরকার ? তার সঙ্গে কী কাজ ? আজ পর্যন্ত কাউকে দেখিনি তাঁর খোঁজে আসতে । অপু জবাবে বলল, সনাতন সরকার একটা চিঠি দিয়েছেন তাঁকে দেবার জন্য । ছেলেটার চোখ কটা, লক্ষ করল অপু ।
    --সনাতনভাই ? তাঁর সঙ্গে কী করে পরিচয় হল, জানতে চাইল কার্তিক ।
    অপু বলল, ওনার সঙ্গে পড়ি ।
    --আপনি এখন কী করেন ? ভ্রু কোঁচকায় কার্তিক, নিশ্চিন্ত যে ওর মোটর সাইকেলের একজন সওয়ারি পাওয়া গেল । মোটর সাইকলের ধুলো পুঁছতে-পুঁছতে বলল, হাজার টাকা নিই ।
    --ঠিক আছে, নো প্রবলেম, বলে অপু যোগ করল, কিছুই করি না । আমি ফিউজিটিভ ।
    --ফিউজিটিভ ইয়ানে কি ?
    --ভগোড়া । আমি আইনের চোখে ধুলো দিয়ে পালাচ্ছি । ওনার সাহায্য নিয়ে অবুঝমাড় জঙ্গলে গিয়ে লুকোবো । জঙ্গলটা নাকি দুর্ভেদ্য, পুলিশও যায় না সেখানে ।
    কোমরে হাত দিয়ে গেরুয়া ধুলোর পাশাপাশি অট্টহাসি ওড়ালো কার্তিক । বলল, আরে ইয়ার, মাওওয়াদি, বনবিভাগ, রেভেন্যু ডিপাট আর আধামিলিট্রি মিলে জবরদস্ত কাহানি ছড়িয়েছে, হাউয়া খাড়া করে দিয়েছে । ভারতীয় জওয়ানরা কার্ল গুস্তাভ রাইফেল, আনডারব্যারেল গ্রেনেড হাতে ভেতরে ঢুকে বুড়বক বেনে গেছে । গিয়ে দ্যাখে হাড্ডিসার ঝোপড়পট্টি, গাছের পাতা আর সরু বাঁশে তৈরি ভুখমরিতে বেচয়েন অনজান আদমিদের গ্রাম, আর তংগ দড়িদঙ্কা আদিবাসী । অবুঝমাড়ে এখন যার ইচ্ছে সে ঢুকে যেতে পারে । শুধু মাওওয়াদিদের আর আধামিলিট্রির তিকড়মবাজিতে পড়ে চকনাচুর হয়ে যাবার মওকা থাকে, এই যা, বাদবাকি সব মনোহর কাহানিয়াঁ । চলুন, বসুন, ফিউজিটিভ মহাশয়জি ।
    প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা জামা-ট্রাউজারে, ফোমচামড়ার ব্যাগে, চুলে, ভুরুতে ধুলোর চাদরে ঢাকা পড়ার পর অপু পৌঁছোল রায়গড় থেকে নারায়ণপুর ।
    কার্তিকের বাবাকে সনাতন সরকারের চিঠিটা দিয়ে, গংগোতা প্রথা অনুযায়ী গণেশচন্দ্র সরকার আর তাঁর স্ত্রীর হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করে অপু ওনাদের জানালো যে চিঠিতে ওর যে বান্ধবীর উল্লেখ রয়েছে, তাকে সঙ্গে আনতে পারেনি ।
    গণেশচন্দ্র সরকার সনাতনের চিঠি পড়ে অপুকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, দ্যাখো, কতদূর থেকে তুমি এলে, সনাতনের বন্ধু বলে, জায়গাটা দেখার ইচ্ছা হয়েছে তোমার ; কেউ আমাদের কোনো খোঁজখবর নেয় না, কে-ই বা নেবে, কেউ তো নেই। সনাতন নিশ্চয়ই ওর গালাগালের স্টক তোমার মাথায় উপুড় করে দিয়েছে? ভীষণ রগচটা । যত বেশি পড়াশোনা করছে তত ওর হিন্দি গালাগালের স্টক বাড়ছে । তুমি খাও-দাও, যতদিন ইচ্ছা থাকো, আমাদের ভালো লাগবে, তার আগে স্নান করে নাও, লাল চালের ভাত খাও, মাছ-টাছ পাবে না ।
    অপু ওনাকে বলল, আপনি বসুন, প্রথমে শুনুন, আমার জীবনে কী ঘটেছে, আমি কেন এসেছি, কেন আমার বান্ধবীকে সঙ্গে আনিনি, আর এখন আমি কেন অবুঝমাড় জঙ্গলে যেতে চাইছি । শুনে, গণেশচন্দ্র সরকার, কোলে হাত রেখে, কিছুক্ষণ বসে রইলেন, পাশে দাঁড়িয়ে ওনার স্ত্রী । অপুর মনে হল, রোগা, ময়লা, টাকমাথা গণেশচন্দ্র সরকারের বয়স ওনার স্ত্রীর চেয়ে বেশ কম । ওনার স্ত্রী বললেন, তোমাকে কে বুঝিয়েছে যে অবুঝমাড় দুর্ভেদ্য? আমার ছেলে ওই জঙ্গলে তিন বছর ছিল ; মাওওয়াদিরা ওর গোঁড়-মাড়িয়া বউকে গুলি করে মারার পর ও পালিয়ে এসেছে । বাড়িতে প্রায় থাকেই না কার্তিক । রাতে ফেরে, খায়, ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ভোর না হতেই বেরিয়ে পড়ে ; যদি রায়পুরে থেকে যায় তাহলে সে-রাতে ফেরেই না ।
    অপু স্তম্ভিত ।
    কার্তিক সরকার অপুকে পৌঁছে দিয়ে নতুন যাত্রীর খোঁজে মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ।
    কার্তিকের বাবা-মা ওর জীবনের ঘটনা, থেমে-থেমে, কন্ঠস্বরে শ্লেষ্মা মিশিয়ে, অপুকে বলতে আরম্ভ করলেন। কার্তিক এক মাড়িয়া-গোঁড় মেয়ের প্রেমে পড়েছিল ; মেয়েটি মাঝে-মাঝে কোকোমেত্তায় ডিম, মুর্গি, শুয়োর বাচ্চা, বিয়ার বাহুতি পোকা, মহুয়ার ফুল, সালফি মদ বিক্রি করতে আসত । কার্তিক ওর ডিম কিনত, মুর্গি কিনত, সালফি খেতো আর যত দাম তার চেয়ে বেশি টাকা দিত । একদিন মেয়েটা কার্তিককে জানালো মাওওয়াদিরা ফতোয়া জারি করেছে যে জঙ্গলের বাইরে আর যাওয়া চলবে না । যারা যাবে তাদের পুলিশের চর বলে সন্দেহ করা হবে ; ফিরে আসলে জন আদালতে তাদের বিচার হবে । মেয়েটার নাম ছিল কুমিয়া খোসা।
    ---ছিল মানে ?
    --কইছি, কইছি, কার্তিক কুমিয়াকে মোটর সাইকেলে বসিয়ে, আমাদের কাছে এনে জানালো যে ও চলে যাচ্ছে মেয়েটার সঙ্গে ঘর করতে, কুমিয়ার হিকোনার গ্রামে । আমরা কার্তিককে কোনো কাজে বাধা দিই না, ওর জন্মের কথা আরেকদিন শুনো । মনে হয়েছিল, যাচ্ছে যাক, কোথাও তো সংসার পাতবে, নারায়ণপুরে একা-একা অস্হির হয়ে, মাথা খারাপ করে, দুঃখে-দুঃখে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে, ঘুরে বেড়াবার চেয়ে ঢের ভালো ।
    হিকোনারে যাবার পর ওদের বিয়ে দেয়া হয়েছিল গোঁড়-মাড়িয়া রীতি অনুযায়ী , দুজনকে রঙিন কাপড়ে আগাপাশতলা মুড়ে ওদের ওপর দুধ ঢেলে বিয়ে হল ; আমরা দুধ, গায়ে জড়াবার শাড়ি, গোটা পাঁঠার মাংস কিনে নিয়ে গিয়াছিলাম । গোঁড়-মাড়িয়া সমাজে বিয়ে না করলেও চলে, অনেক ছেলে-মেয়ে বিয়ে করে না, তাদের কয়েকটা বাচ্চা হয়ে যাবার পরও বিয়ে করতে পারে না, দুধের টাকা, নতুন কাপড়ের টাকা, মাংস খাওয়াবার টাকা, সালফি খাওয়াবার টাকা, কোথা থেকে পাবে, বলো । পঁচিশ তিরিশটা চালাঘর নিয়ে এক-একটা গ্রাম, যদিও সেগুলো পাশাপাশি নয়, ছড়ানো-ছেটানো । তুমি ভেবো না যে অবুঝমাড় অ্যামাজনের মতন ঘন জঙ্গল, মোটেই নয়, সুন্দরবনের মতনও নয়, খোলামেলা ধরণের জঙ্গল, দূর থেকে গাছের ফাঁকে দেখতে পাবে, কে আসছে, ভাল্লুক, শেয়াল, বনবিড়াল আসছে কি না।
    আমরা ওর সংসার শুরু করার কয়েক মাসের খরচ দিয়ে ফিরে এসেছিলাম । ওরা তেল-মশলা দিয়ে আমাদের মতো রান্না করে না, বেশির ভাগ মাংস পুড়িয়ে খায় । একদিক থেকে ভাল, খরচের বোঝা কম । ভালই ছিল দুজনে, ওদের চালাঘরে, মুর্গি, খরগোশ আর শুয়োর পুষেছিল । কুমিয়া তীর-ধনুক দিয়ে খরগোশ, বেঁজি, কাঠবেরালি, সাপ, পাখি শিকার করে আনলে দুজনে মিলে খেতো । পেণ্ডা খেতি, মানে শিফটিং কালটিভেশান বা জুম চাষের সময়ে পাহাড়ের ঝোপঝাড় পোড়ানোয়, ফসল পোঁতা আর কাটায়, অংশ নিত । শিকারের ফাঁদ পাতায়, জংলি পাখি শিকারে, মহুয়ার ফুল কুড়োনোয়, অংশ নিত ।
    সকলের দেখাদেখি কার্তিকও পাঁচ টাকা দিয়ে মাওওয়াদি জনতম সরকারের নাগরিক হয়ে গেল । জন আদালতের সদস্য করা হল ওকে । কার্তিক ভেবেছিল সদস্য হয়ে গেলে জঙ্গলের কোনো অংশের পাট্টা পাবার সুবিধা হবে । পাট্টার জন্য জনতম সরকারের অধ্যক্ষকে বলতে গিয়ে বিপদে পড়ল । পাট্টা দেয় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট । জনতম সরকারের নেতারা ভাবল যে কার্তিক যেহেতু গোঁড়-মাড়িয়া নয়, তাই গোঁড়-মাড়িয়া মেয়ের সঙ্গে বসবাস করে, বাচ্চা পয়দা করে, বন বিভাগ-রাজস্ব বিভাগে যোগাযোগের নামে ফিরে যাবার তাল করছে, ফিরে গিয়ে হয়ত পুলিশের সঙ্গে যোগসাজস করে জনতম সরকারকে বিপদে ফেলে দেবে ।
    তার আগে সেরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে, কোনো-কোনো গ্রামবাসী জনতম সরকারের হুকুম পছন্দ হয়নি বলে পালিয়েছে জঙ্গলের বাইরে, নারায়ণপুরে, বা আরও দূরে অন্ধ্র কিংবা মহারাষ্ট্রতে । পুলিশ তাদের সাহায্য নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার চেষ্টা করেছে, ঢুকেছে, খুনোখুনি হয়েছে, গুলিগোলা চলেছে । এই তো সেদিন সতেরো বছরের একটা মেয়ে ধরা পড়ল, সে আইইডি বানাতো ; সে জানিয়েছে যে তার চেয়ে কম বয়সী মেয়েরা আইইডি বানায় ।
    গোঁড়-মাড়িয়ারা নির্লোভ, সরল প্রকৃতির, বুঝলে, খায়, নেশা করে, জংলি জানোয়ার বা পাখি শিকার করে, পেণ্ডা খেতি করে সবাই মিলে, ফসল তোলে, এই ভাবেই জীবন চলে যায় । সহযোগীতার ক্ষেত্রে ইজরায়েলের কোঅপারেটিভের চেয়ে ভালো । ওরা পড়ে গেছে মাওওয়াদি আর সরকারের জাঁতাকলে । আদিবাসীরা প্রথমে ভেবেছিল যে মাওওয়াদিরা ওদের সরকারি অত্যাচার-অবিচার থেকে বাঁচাবে। তার বদলে সেই একই শাসনপ্রথা নতুন ভুত হয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে ।
    ওখানে সরকারি স্কুল আছে, আঙনওয়াডিও আছে, সোলার পাওয়ার আছে, পাহাড়ে ওঠার আগে পর্যন্ত হ্যাণ্ড পাম্প আছে । স্কুলে মিড-ডে মিল রান্না করার কাজ পেয়েছিল ওর বউ । রান্না করার দরকার হতো না । শুনে তুমি অবাক হবে যে স্কুলের প্রার্থনা হয় গায়ত্রী মন্ত্র গেয়ে, কারণ স্কুলটা সরকারি, আমি দেখে এসেছি । স্কুল থেকে বরাদ্দ র‌্যাশন মাওওয়াদিরা নিয়ে চলে যেত, তাদের বন্দুকধারি ক্যাডারদের জন্য, তাতে কারোরই আপত্তি ছিল না । ওরা জানতে পারেনি যে ওদের ওপর জনতম সরকারের জন মিলিশিয়া নজর রেখেছে ; কার্তিক তো রিফিউজির ছেলে । মালকানগিরিতেও লক্ষ করতুম যে মাওওয়াদিরা বাঙালি রিফিউজিদের পছন্দ করে না । জন মিলিশিয়ারা বন্দুকধারী গণমুক্তি গেরিলা বাহিনীর ক্যাডারদের থেকে আলাদা । জন আদালতে কাউকে মেরে ফেলার হুকুম হলে জন মিলিশিয়ার লোক তা পালন করে । জন মিলিশিয়ার ছোকরাদের কাছে ট্রানজিসটার আর ল্যাপটপ দেখেছি । ল্যাপটপে ওরা সিনেমাও দ্যাখে, হলিউডের হিন্দিতে ডাব করা সব ফিল্ম, হিরোগিরির ফিল্ম, যদিও বেশির ভাগ গোঁড়-মাড়িয়া হিন্দি ভালো জানে না । কুমিয়া, কার্তিকের বউও, তেমন হিন্দি জানত না । কার্তিক অবশ্য ছোটোবেলা থেকে ওদের সঙ্গে মিশেছে বলে গোঁড়-মাড়িয়ায় কথা বলতে পারে, আমরা দুজনেও তত ভালো পারি না ।
    বাচ্চা হবার পর কুমিয়াকে নিয়ে তিন-চার মাসে একবার আসত আমাদের কাছে । গোঁড়-মাড়িয়া মেয়েদের গয়নার খুব শখ । কুমিয়ারও গয়না পরার শখ ছিল । সোনার চেয়ে রুপোর জল-দেয়া ব্রোঞ্জের গয়না ওদের বেশি পছন্দ । আমরা ভাবলাম ব্রোঞ্জের কেন দেবো, ছেলের বউকে দিচ্ছি যখন তখন রুপোর গয়নাই দিই। ওদের ওপর যে জন মিলিশিয়ার জাসুসরা নজর রাখত তা ওরা টের পায়নি । গয়না পরে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল কুমিয়াকে । কার্তিক ভাবল যে বার-বার কষ্ট করে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে প্রায় আট-দশ কিলোমিটার হেঁটে আসা আর আবার আট-দশ কিলোমিটার হেঁটে ফেরত যাওয়ার চেয়ে মোটর সাইকেলটাই গ্রামে নিয়ে গিয়ে রাখবে, ছাগল-চরানো রাস্তাতেও কার্তিক মোটর সাইকেল চালাতে পারে । ওর বউ আগে চলে গেল বাচ্চা নিয়ে যাতে জনতম সরকারের কোপে না পড়ে । কার্তিকের যেতে দু’দিন দেরি হয়ে গিয়েছিল, মোটর সাইকেলের সারভিসিং করাতে গিয়ে ।
    গ্রামে পৌঁছে কার্তিক জানতে পারল যে জন আদালতের বিচারে কুমিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে । গুলি করে মারা হয়েছিল কুমিয়াকে । কার্তিক যাবার আগেই ওরা কুমিয়াকে কবরও দিয়ে দিয়েছিল । বাচ্চা ছেলেটা কার কাছে আছে জানতে চাইলে কেউ কার্তিকের সঙ্গে কথা বলেনি । ওকে বলা হয়েছিল তক্ষুনি নারায়ণপুরে ফিরে যেতে নয়তো ওরও কুমিয়ার দশা হবে । কুমিয়ার কবরের কাছে গাছের ডালে নিজের শার্ট খুলে বেঁধে খালি গায়ে চলে এসেছিল ।
    সেই যে ও জঙ্গল থেকে মোটর সাইকেলে চেপে পালিয়ে এসেছে, আর ও-মুখো হয়নি । আমাদের মনে হয় পালিয়ে এসে বেঁচে গেছে । এই কিছুদিন আগে অপারেশান হাক্কা করেছিল সরকার, টোকে নামের পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলেছিল। হেলিকপ্টারের ডানার বাতাসে অনেকের চালাঘরের ছাদ উড়ে গেছে । আসলে অবুঝমাড় নিয়ে সবাই এতকাল এমন গল্প ফেঁদেছিল যে প্রচার হয়ে গিয়েছিল জায়গাটা দুর্ভেদ্য । সরকার তো ড্রোন উড়িয়ে ফোটো তুলেছিল আর ভেবেছিল যে কালো-কালো দেখতে জায়গাগুলো বুঝি ট্রেঞ্চ আর মাওওয়াদিদের ক্যাম্প । কোবরা-ফোবরা, সিআরপিএফ, পুলিশের লোকজন অপারেশান হাক্কা চালিয়ে ভেতরে ঢুকে বুঝতে পেরেছে যে সবই ফক্কিকারি, মাওওয়াদি, টিম্বার মাফিয়া আর সরকারি কর্মচারীদের স্বার্থান্বেষী প্রচার ।
    --কিন্তু আমি তো এরকমই শুনে এখানে এসেছি । এটাই সেফেস্ট জায়গা মনে হয়েছিল ।
    গণেশচন্দ্র সরকার বললেন, আশির দশকের শুরুতে বিদেশি টিভি চ্যানেল অবুঝমাড়ে ঢুকে ওদের ঘোটুল নিয়ে একটা তথ্যচিত্র তৈরি করে প্রচার করেছিল । এখন গোঁড়-মাড়িয়া মেয়েরা সকলেই পোশাক পরে, শাড়ি-ব্লাউজ-শায়া, ভেতরের জামা । এখনও ঘোটুল আছে, সেখানে পোশাক পরে ঢোকে ছেলে-মেয়েরা ; সেক্সের ব্যাপারে ওদের সমাজ ইউরোপ আমেরিকার চেয়েও প্রগ্রেসিভ আর পারমিসিভ । যখন তথ্যচিত্র তোলা হয়েছিল তখন ওদের ঘোটুলে ওরা পোশাক পরে যেত না । ভারত সরকার ভাবল যে এটা ভারতবিরোধী প্রচারের ষড়যন্ত্র, ভারতের ইমেজ বিদেশে নষ্ট হচ্ছে । ব্যাস, হাঁটু-কাঁপা প্রতিক্রিয়ায় অবুঝমাড়কে প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করে দেয়া হল । এতকাল নো একট্রি জোনই ছিল, এই কিছুদিন হল নিষেধ তুলে নেয়া হয়েছে । নিষেধের ফায়দা লুটত মাওওয়াদি, টিমবার মাফিয়া, বন বিভাগ, তেন্দু পাতার ব্যাপারি, রেভেনিউ ডিপার্টমেন্ট । নিষেধের দরুণ একদিকে তো নানা গল্প ছড়িয়েছে, অন্যদিকে দেশের অন্য আদিবাসীরা যে সুযোগ-সুবিধা পায় তা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত থেকেছে অবুঝমাড়ের আদিবাসীরা ।
    আমার প্রতিবারই এলেকশান ডিউটি পড়ে । গত বিধানসভা নির্বাচনে কোকোমেত্তায় ভোট দেবার জন্য কুরসুনার, জিলাপুর, সোনাপুর, কুদলা, কাছাপাল, ঝারাবাহি, মাঙ্গুর, বোলাবেড়া, মাস্তুর, সাহাকাগোড়া থেকে গোঁড়-মাড়িয়া আর মুরিয়ারা হেঁটে ভোট দিতে এসেছিল, বাচ্চা কোলে মেয়েরা, বুড়ো-বুড়িরাও । ভোটের জন্য ঢেড়া পেটানো হয়েছিল গ্রামে-গ্রামে, যাকে ওরা বলে মুনাড়ি । অনেকে আগের দিন রাতের বেলাই পৌঁছে গিয়েছিল বলে তাঁবু খাটিয়ে শোবার ব্যবস্হা করতে হয়েছিল ।
    এবারের সংসদ নির্বাচনেও গোঁড় মাড়িয়া মুরিয়ারা দলে-দলে ভোট দিতে এসেছিল । তা ভোট শেষে ফেরার সময়ে পোলিং পার্টির আটজন আর আধামিলিট্রির পাঁচজনকে কেতুলনার গ্রামের কাছে ল্যাণ্ডমাইন পেতে উড়িয়ে দিল আশি-নব্বই জনের মাওওয়াদি জামাত । ঈশ্বরের কৃপায় আমার এলেকশান ডিউটি এখানেই পড়েছিল । তুমি বলো, ওভাবে কি বিপ্লব হবে ? গোঁড়-মাড়িয়াদের জীবনের উন্নতি হবে ? আমি তো কিছুই বুঝি না বাবা ।
    --বিপ্লব ? বিপ্লবের আমি তেমন কিছু বুঝি না । যুক্তাক্ষর শব্দগুলো সব বেকার ।
    হ্যাঁ, একটা কাজ ওরা করছে, তা হল সেগুনগাছ, শিশুগাছ, শালগাছগুলো টিম্বার মাফিয়াদের করাত থেকে বেঁচেছে ; তখন যদি ওরা থাকত তাহলে মালিক মকবুজার মতন জঘন্য ঘটনা ঘটত না । আরেকটা হল, সব আদিবাসী এলাকার মতন অবুঝমাড়েও তো মাটির তলায় খনিজে ভরা । যতদিন ওরা পাহারা দিতে পারবে ততদিন কর্নাটকের আকরিক লোহার মতন লুকিয়ে-লুকিয়ে জাহাজ ভরে-ভরে মাও-এর দেশ চিনে চোরাচালান করা হবে না । দেখা যাক কারা শেষ পর্যন্ত জেতে ।
    কার্তিকের সঙ্গে কথা বললেই টের পাবে যে জঙ্গলের ভেতরে কে যে আদিবাসী, কে মাওওয়াদি জন মিলিশিয়া, কে জন আদালতের সদস্য, কে মাওওয়াদি তাত্ত্বিক, কে কেন্দুপাতার ফড়ে, আর কে বনদপতর বা রাজস্ব বিভাগের কর্মী তা তুমি পার্থক্য করতে পারবে না । শুধু পিএলজিএ, মানে গণমুক্তি গেরিলা বাহিনীর ক্যাডারদের, চিনতে পারবে, ওরা জওয়ানদের মতন জলপাইরঙের পোশাক পরে । আমার-তোমার মতন সাধারণ মানুষের সামনে ওরা বেরোয় না বড়ো একটা । আদিবাসীরা দুপক্ষের শাসনের-হুমকির আতঙ্কে জীবন কাটাচ্ছে ।
    তুমি ফিউজিটিভ হয়ে এখানেই থাকো । বিহারে সবই কালক্রমে ধামাচাপা পড়ে যায়, তিন হাজার কোটি টাকার চারাঘোটালাই চাপা পড়ে গেল । এবারের এলেকশানে রাবড়ি দেবী এফিডেভিট দিয়ে জানিয়েছেন যে ওনার সম্পত্তি হল পঁয়ষট্টি কোটি টাকা, ওনার মেয়ে মিশার চার কোটি টাকা । তবেই বোঝো । সম্প্রতি প্রাক্তন কয়লা সচিব পি সি পারিখের স্মৃতিকথা সময় পেলে পোড়ো । উনি লিখেছেন যে কয়লা মন্ত্রী শিবু সোরেন আর ওনার উপমন্ত্রী দাসারি নারায়ণ রাও কোল ইনডিয়া লিমিটেডের পদে পোস্টিঙের জন্য শশী কুমার-এর কাছ থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা একলপ্তে আর প্রতিমাসে দশ লাখ টাকা করে চেয়েছিল । এই তো দেশ, যার স্বাধীনতার জন্য আজও আমরা লাৎ খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছি । আমাদের কোনো আইডেনটিটি নেই । সনাতন যে গালাগাল দেয়, তা ইমপোটেন্ট রেজ । ও গালমন্দ করে শরীর সুস্হ রাখে । ইমপোটেন্ট রেজে ভুগে-ভুগে আমার কন্সটিপেশানের ব্যারাম হয়ে গেছে ; রাতে ল্যাক্সেটিভ খাই আর সকালে চোখ বুজে বসে থাকি, যারা আমাদের দুরবস্হার জন্য দায়ি তাদের মাথার ওপর ।
    --আমার রেজ ইমপোটেন্ট নয় বলে আমি ফিউজিটিভ, গংগোতা মায়ের গরম রক্ত আর বাঙালি বাবার ঠাণ্ডা রক্তের গুণ । বলল অপু ।
    --কার্তিক তোমায় ওর মোটর সাইকেলে বসিয়ে একদিন অবুঝমাড় ঘুরিয়ে আনবে । কুমিয়া মারা যাবার বাৎসরিকে গাছে নতুন কাপড় বাঁধতে যাবার জন্য গোঁ ধরেছিল, আমরা যেতে দিইনি। তুমি সঙ্গে থাকলে সুবিধা হবে, চারিদিকে নজর রাখতে পারবে।

    ষোলো
    বনবিভাগের বিট মার্শাল : দুজন পোচারের বডি পড়ে আছে স্যার ।
    বনবিভাগের রেঞ্জ অ্যাসিস্ট্যান্ট : দেখে তো পোচার মনে হচ্ছে না । টিম্বার মাফিয়ার এজেন্ট শালারা, নিশ্চই ।
    বনবিভাগের বিট মার্শাল : টিম্বার মাফিয়ার এজেন্টদের আমি চিনি স্যার । এরা বাইরের লোক । কী করে ওখানে গিয়ে পড়ল ? বেঁচে আছে না মরে গেছে !
    বনবিভাগের রেঞ্জ অ্যাসিস্ট্যান্ট : কেন মিছিমিছি নিজের বিপদ ডেকে আনছ । যা রেগুলার রিপোর্টিং তাই রেকর্ড করে দিও ।
    বনবিভাগের বিট মার্শাল : ব্যাস স্যার, কুরুসনার ছেড়ে অনেকটা চলে এসেছি, আর ভেতরে যাওয়া সুবিধার নয়।
    বনবিভাগের রেঞ্জ অ্যাসিস্ট্যান্ট : চলো ।

    সতেরো
    রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যাবার বাসে ইতুকে তুলে দিয়ে অমিত বলে দিয়েছিল, বাস থেকে নেমে সোজা গিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকবি; সুশান্তজেঠুর দেয়া তোর মোবাইল থেকে একটা ছেলেকে ফোন করে দিয়েছি । তুই মিশনের গেটের কাছে পৌঁছে এই নম্বরে একটা মিস কল দিবি । নারায়ণপুরে নেটওয়র্ক তত ভালো কাজ করে না । ছেলেটা রেসপণ্ড করে ওর নাম বলবে বীরবল মাড়িয়া । হিরো হণ্ডার কালো রঙের স্পেলনডার মোটর সাইকেলে আসবে । ও তোকে নমস্তে ইতু দিদি বললে কোনো বাক্যব্যায় না করে পিলিয়নে বসে পড়িস । ও তোকে যেখানে পোঁছে দেবে, সেখানে তোর সঙ্গে আমার পরিচিতদের দেখা হবে, হয়তো তোর পরিচিতও থাকতে পারে কেউ । চিন্তা করিসনি না, মনে রাখিস, যেখানে ঢুকতে যাচ্ছিস সেটাকে প্রশাসনের লোকেরা বলে জংলি পাকিস্তান।
    বাসডিপোয় ইতুর কান্না পায়নি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল । কেঁদে ফেলেছিল অমিত, রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছিল যাত্রীদের চোখ এড়িয়ে । বলেছিল, আর দেখা হবে না, জানি, তোকে শেষবার দেখে নিচ্ছি । উত্তরে ইতু বলেছিল, আমি আমার অতীতকে কলকাতা বিমানবন্দরে প্লেনে ওঠার সময় থেকে কাট-অফ করে দিয়েছি, তুইও তাই করে ফ্যাল । সবাইকে ভুলে গিয়ে যা করবার কর, বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেও তাদের ভুলে যা । গেট রিড অফ অলল মেমরিজ ।
    ডেনিমের ট্রাউজার আর ঢিলেঢালা টপ পরেছিল ইতু, পায়ে জগিং করার কেডস, কাঁধে ওর ঝোলা । রায়পুরে দু’বোতল মিনারেল ওয়াটার আর বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে নিয়েছে ।
    যে-বাসটায় চেপেছিল সেটার নাম, ইতুর অবাক লাগল শুনে, নৌকরওয়ালা বাস । কন্ডাক্টার টিকিট দিল না কাউকে । স্কুলের অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার হাতে প্রত্যেক যাত্রির কাছে গিয়ে তাদের নামের সামনে ছককাটা ঘরে সই নিয়ে নিল । মাসের শেষে টাকা নেবে । প্যাসেঞ্জারদের পোস্টিং হয়েছে নতুন জেলা-সদর নারায়ণপুরে ; তাদের পরিবারকে নিয়ে যায়নি, নারায়ণপুরে ভালো স্কুল-কলেজ, সিনেমা হল, মল, মাল্টিপ্লেক্স কিছুই গড়ে ওঠেনি এখনও । ইতুকে কন্ডাক্টার বলল, দিতে হবে না ।
    বাস থেকে নেমে হাতেটানা রিকশয় চেপে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে বীরবল মাড়িয়াকে মিসড কল দিয়ে অর্জুন গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ইতু ।
    নমস্তে ইতু দিদি, শুনে, কালো মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে, ইতুর নাকে ছেলেটির যৌবনগ্রন্হির ঝাপটের উগ্র গন্ধ নাকে এসে লাগতে প্রায় বমি পেয়ে গেল ; উফ, ফেরোমোন । মুখে থলেটা চাপা দিয়ে সামলাল । কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারল যে এক হাতে ছেলেটির পেট ধরে থাকতে হবে, আরেক হাতে মোটর সাইকেলের হ্যাণ্ডল, নয়তো সড়কের যা অবস্হা, নির্ঘাত ছিটকে পড়বে কোনো পাথরে চাকা পড়লেই । ঘামে ভেজা পেটে হাত রেখে ধরতে, ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, ঠিক করে বসুন, রাস্তা ভালো নয়, এই তো সবে দুটো ব্লক নিয়ে নারায়ণপুর জেলা তৈরি হয়েছে । ইতুর মনে পড়ল অমিত এভাবেই ওর স্কুটারে পেট ধরে বসেছিল, আর নাভিতে সুড়সুড়ি দিয়েছিল ।
    যুবকটির পেট, বর্ষায় ভেড়ার লোমের মতন, বেশ ভিজে, উনিশ-কুড়ি বছর বয়স হবে, গায়ের রং মুখের গড়ন দেখে আদিবাসী বলেই মনে হল । ইতু জিগ্যেস করল, দান্তেশ্বরীর মন্দির পড়বে কি রাস্তায় ।
    --না দিদি, দান্তেশ্বরী হল বস্তারের দেবী । নারায়ণপুরে অবুঝমাড়িয়াদের দেবী হল কাকসার । বৈগারা রাসনাভাকে পুজো করে, আর গোঁড়রা পুজো করে মেঘনাদকে । উত্তর শুনে যুবকটিকে কোনো পালটা প্রশ্ন করল না ইতু । নিজেকেই প্রশ্ন করল, মেঘনাদ, এ কোন মেঘনাদ, রামায়ণের মেঘনাদ, যে মেঘনাদকে নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকাব্য লিখেছিলেন ?
    যুবকটি বলল, আমার নাম বীরবল মাড়িয়া নয়, আমার ট্রাইবের নাম ওটা । অবুঝমাড়ে দুজাতের গোঁড় থাকে, মাড়িয়া গোঁড় আর মুরিয়া গোঁড় । শহরের লোকেরা মনে করে অবুঝমাড় মানে যে জায়গাকে এখনও জানা হয়ে ওঠেনি । ঠিকই, অবুঝমাড়কে কেউ জানে না । কিন্তু তা অবুঝমাড়ের মানে নয় । মাড় একরকমের শেকড় ।
    --ও, বলল ইতু, ভাবল রোদ বাঁচাতে মাথায় গামছা চাপা দেবে কিনা । নাঃ, এখন থেকে তো রোদ বৃষ্টি ঝড় যা-ই হোক, কোনো কিছুর দ্বারা পরাস্ত হলে চলবে না । সহ্য করবে । সহ্য করবেই । সহ্য করতে হবে । ছেলেটিকে বলল, তুমি সামনে দিকে তাকিয়ে চালাও, যা রাস্তার অবস্হা ।
    এভাবে কখনও বাইরে-দূরে বেরোয়নি ও, ইতু । সঙ্গে টুথব্রাশ, চিরুনি, তোয়ালে, সাবান অবশ্যই নিত, বাবা-মার সঙ্গে বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবার সময় । বটঠাকুমা বড়দাদু ইউরোপে বেড়াতে যাবার সময়, সেখানে টয়লেট পেপার ব্যবহার করতে হবে শুনে, সঙ্গে একটা প্লাসটিকের মগ নিয়েছিলেন । ও কী করবে, কোথায়ই বা করবে ?
    --জানেন, এখানে কেউ আসে না , বেশ দূরে-দূরে প্রায় দুশো তিরিশটা গ্রাম আছে, চার হাজার একর জঙ্গলে ছড়িয়ে, তিরিশ হাজারের বেশি মানুষ, বেশির ভাগই বীরবল মাড়িয়া আর গোঁড়, যাদের খোঁজখবর সরকার নেয় না, জানেই না সরকারি আফসররা । কেন বলুন তো ? হোল ইনডিয়ায় শুধু এইটুকু এলাকার কোনো সার্ভে আজ পর্যন্ত হয়নি, সেনসাস হয়নি । রিপোর্টাররাও বস্তার যেতে চায়, নারায়ণপুরে আসতে চায় না, তাই আমার রোজগার তেমন হয় না । নারায়ণপুর, বিজাপুর আর বস্তার, এই তিন জেলার জঙ্গল এলাকা হল অবুঝমাড় । আপনাকে এ-সব বলছি কেন বলুন তো ? যিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন তিনি বলেছেন যে আপনাকে জায়গাটার ছবি বুঝিয়ে দিতে ।
    --ও, আচ্ছা । মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল বলে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল ইতু । তারপর নিজের মোবাইলটা বীরবল মাড়িয়ার হিপ পকেটে ঢুকিয়ে বলল, যিনি তোমাকে পাঠিয়েছেন, তিনি বলেছিলেন মোবাইলটা তোমাকে দিয়ে দিতে ।
    --হ্যাঁ, আচ্ছা, ঠিক আছে । অবুঝমাড়কে ঘিরে রেখেছে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বল আর মাওওয়াদিরা । গ্রামের লোকেদের সঙ্গে মাওওয়াদিরা মেশার চেষ্টা করে । সিপাহি জওয়ানরা এড়িয়ে চলে । আপনাদের শহরের ভিখমাংগা বস্তির চেয়েও বদতর এখানকার জীবন । বিজলি নেই, খাবার জল নেই, স্কুল নেই, ডাক্তার-বইদ নেই, কারোর কিছু হলে চিকিৎসার কোনো উপায় নেই, তা সে আধামিলিট্রি জওয়ান হোক বা মাওওয়াদি জওয়ান, গ্রামের লোকেদের কথা তো ছেড়েই দিন, ওরা জানেই না কাকে ডাক্তার বলে, হাসপাতাল বলে । আফ্রিকাতেও এরকম গয়াগুজরা এলাকা পাবেন না । তবে, শ্বাস নিয়ে, বলল বীরবল মাড়িয়া, শহর মানেই তো চাপা দুর্গন্ধের ম্যানহোল ; যতো বড়ো শহর, তত বেশি ম্যানহোল । এখানের আকাশে যেমন রাতের তারা, আপনাদের শহরে তেমন মাটিতে পাতা ম্যানহোল ।
    ইতু নিজেকে প্রশ্ন করল, এখানে কেন আসতে চাইলুম ? বাড়িতে কী ভালো ছিলুম না ? কত বাঙালি বাড়িতেই তো অবিবাহিতা মেয়েরা থাকে যারা সকলের অবহেলায় অবরে-সবরে মুখঝামটা খেয়ে তাদের মাঝে বসবাস করে ক্রমশ ন্যাড়ামাথা বুড়ি হয়ে যায়, স্বজনদের বাচ্চা হলে তাদের সঙ্গে খেলে, সময় কাটায়, বাড়িতে কোনো উৎসব হলে সে-ই খাটাখাটুনি করে, আর অতিথি অভ্যাগতদের সাবাশি পায়, অসুস্হ হয়ে সিঁড়ির তলায় চটে বা সতরঞ্চিতে শুয়ে মরে ভুত হয়ে যায় । নাঃ, একেবারে ভালো ছিলুম না, তার কারণ কোনো কাজই নিজের জন্য করছিলুম না, শুধু বেগার খাটছিলুম । এবার নিজের জন্য কিছু করব । যা হবার হোকগে, সিআরপিএফ-এর গুলি খেয়ে, না খেতে পেয়ে, মাওওয়াদিদের বিশ্বাস অর্জন করতে না পেরে, গ্রামবাসীদের সন্তুষ্ট করতে না পেরে, মরে যেতে হলে মরে যাবো, নিজের জন্য তো মরব । ছেলেটিকে বলল, তুমি চুপ করে গেলে কেন, বেশ ভালোই তো লাগছে শুনতে ।
    --কুরসুনার গ্রাম এসে গেল তো, তাই । যে অনজান দুনিয়ায় আপনি ঢুকতে চলেছেন, এই গ্রাম হল তার প্রবেশপথ । ভারত সরকার বলুন, ছত্তিশগড় সরকার বলুন, এখান পর্যন্তই তারা ছিল, অপারেশান হাক্কার পরে কিছুটা বদলালেও, মানুষের মনের ভেতরটা বদলাতে অনেক সময় লাগে । ওই যে স্কুল বিল্ডিং দেখছেন, ওখানে আগে আধামিলিট্রি জওয়ানরা থাকত, তাই স্কুলটা চলে গেছে, ওই যে, ওখানে যে চালাঘর দেখতে পাচ্ছেন, ওখানে । আসলে স্কুলটাকে টেনে নিয়ে গেছে মাড়িয়াদের আৎমা, পূর্ণিমার দিন যদি আসেন, তাহলে নিজের চোখে দেখতে পাবেন যে স্কুলটা একটু-একটু করে দক্ষিণে সরে যাচ্ছে । নতুন স্কুল বিল্ডিংটা পুরো তৈরি হয়নি, অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে । মাওওয়াদিরা নাকি ঠিকেদারকে এমন হুমকি দিয়েছিল যে সে প্রাণ বাঁচিয়ে ভাগলবা । তা নয়, আসলে মাড়িয়াদের আৎমা ঠিকেদারকে বলেছিল যে চলে যাও, নয়ত গুলি খেয়ে মরবে । তবে মাওওয়াদিরা ঠিকেদারের ট্র্যাক্টরটাও কেড়ে নিয়েছিল । ট্র্যাক্টর নিয়ে মাওওয়াদিরা কী করবে জানি না ; এরপর তো ট্র্যাক্টর চালাবার মতন রাস্তা পাহাড় শুরু হবার আগে পর্যন্ত, তারপর ছাগল-গরু চরাবার সরু হাঁটা-পথ ।
    কিছুক্ষণ থেমে, শ্বাস নিয়ে, ছেলেটি বলা বজায় রাখল । অবুঝমাড় এমন ভুতাহা জায়গা যে মাওওয়াদিদের শরীরকেও অদৃশ্য ডাইনরা আক্রমণ করে, যতই বন্দুক-কামান থাক, কিছুদিনের মধ্যে খারাপ হয়ে যায়, ওদের কামচলাউ ডাক্তার আছে, আনপঢ়, সে কি আর ডাইনদের সঙ্গে পারে, বলুন । কুরুসনার আধামিলিট্রি ভুতাহা ক্যাম্প দেখলেন, ওখানে একবার হামলা চালিয়েছিল মাওওয়াদিরা ; যারা চালিয়েছিল তারা আন্ধ্রার, এখানকার জঙ্গলে তাদের দুজনের শরীর এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তারা আন্ধ্রার আদিলাবাদে গিয়ে সারেনডার করেছিল, তাও লোকটার বয়স মোটে পঁয়ত্রিশ, নাম ছিল রায়সিদম জাওয়েন্দ্রা রাও উর্ফ লালচন্দ, মেয়েটার বয়স আরো কম, তিরিশ বছর, নাম ছিল কোনগাতি করুণা উর্ফ লতা । মাওওয়াদিরা নিজের বড়ো-বড়ো নাম বদলে নিয়ে ছোটো করে ফ্যালে, অন্য নাম নিয়ে নেয়, নিজের মা-বাপের আদর করে দেয়া নামকে কেন ওদের বন্দুকবাজির সঙ্গে জড়াবে, বলুন ? অবুঝমাড়ের আদিবাসীরা হালউই ভাষায় কথা বলে ; ওরা ছত্তিশগড়িয়া, হিন্দি, তেলেগু কোনো ভাষায় কথা বলতে পারে না, বললে বুঝতেও পারে না ।
    --তুমি তো ভালই হিন্দি বলছ ।
    --আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে পড়েছিলুম ।
    --ছেড়ে দিলে কেন ?
    --আধামিলিট্রিরা আমার মাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, বলেছিল আমার মা নাকি মাওওয়াদিদের চর । মাওওয়াদিরাও ভেবেছিল আমার মা নিশ্চই সরকারের চর, নয়তো কেন্দ্রীয় রিজর্ভ পুলিশ বলের ক্যাম্পে কেন গেছে । একবার দু-পার্টির গুলিগোলা চলার সময় মায়ের গায়ে গুলি লাগে । সরকার বলেছিল মাওওয়াদিদের গুলিতে মরেছে । মাওওয়াদিরা বলেছিল, আধামিলিট্রির গুলিতে মরেছে। মা মরে যেতে আমি এক লাখ টাকা মুয়াবজা পেয়েছিলুম, সেই টাকা থেকেই তো এই সেকেণ্ড হ্যাণ্ড মোটর সাইকেলটা কিনেছি । আপনাদের মতন প্যাসেঞ্জারদের নানা জায়গায় নিয়ে যাই, নিয়ে আসি, তা থেকেই সংসার চলে যায় । আপনাকে ভাড়া দিতে হবে না , আপনার ভাড়ার টাকা আমি কালকেই পেয়ে গেছি ।
    --তোমার বাড়িতে কে আছে ?
    --বাবা আছে, দিনভর মদ খেয়ে পড়ে থাকে, সালফি মদ, এতো নেশা হয় যে লোকে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় ; ওরকম মদখোরকে কে-ই বা বিয়ে করবে, বলুন, লোকটা যদি সারাদিন আকাশে উড়তে থাকে তাহলে কোনো মেয়েই আসবে না, বৃষ্টি না পড়লে কী করেই বা আকাশ থেকে নামাবে, বলুন । বৃষ্টি শুরু হলে পেণ্ডা খেতি করবে, না নিজের আদমিকে আকাশ থেকে নামাতে ছুটবে । বাবা আমাকেই বলছিল বিয়ে করে নিতে । দুটো ছোটো-ছোটো বোন আছে, তাদের দেখাশোনা করব, বিয়ে দেব, তবে তো আমি বিয়ে করব, কি না ?
    --বিয়ে করলে আমায় ডেকো ।
    --হ্যাঁ, ডাকব, সে তো এখন অনেক দেরি, দেখুন আপনি কতদিন অবুঝমাড়ে টিকতে পারেন । টিকতে হলে সালফি খেতে হবে ; নোংরা জলের চেয়ে সালফি খাওয়া ভালো, সকাল হবার আগেই খেয়ে নেবেন, সকালের সালফি খেলে আকাশ তাকে নেয় না । সকালের পর সালফি মেঘ হয়ে যায় ।
    --সালফি ?
    --হ্যাঁ, সালফি হল তাড়ির মতন দেখতে একরকম মদ । তালগাছ বা খেজুরগাছের মতন দেখতে হয় গাছগুলো , যেমন করে চেঁচে নিয়ে তালের বা খেজুরের রস বেরোয়, তেমন করে বের করে গ্রামের লোকেরা । তালের রস পচলে তাড়ি হয়, তেমনই সালফির রস চব্বিশ ঘণ্টার পর সাদা রঙের মেঘ হয়ে যায় । তবে মাওওয়াদিরা হুকুম জারি করে মাড় বাজারে গুটকা, গুড়াকু, বিড়ি, সিগারেট, সালফি বিক্রি বন্ধের কাগজ সেঁটেছে। ওরা যদি কাউকে খেতে দ্যাখে তাহলে তাকে একশো টাকা জরিমানা করে । জরিমানার টাকাটা মাওওয়াদিদের ওষুধ কেনার কাজে লাগায় । বাতের আর গা-হাতপা ব্যথার রোগ খুব হয় অবুঝমাড়ে । আমরা তাই বিয়ার বাহুতি পোকা থেকে তেল বের করে বাড়িতে রাখি । যাদের নতুন বিয়ে হয়েছে তারা ওগুলো শুকিয়ে খায় । নারায়ণপুর বাজারে কিনতে পাবেন ।
    --কী পোকা ? কী করকম দেখতে ?
    --বিয়ার বাহেতি, লাল টকটকে । সরকারি আফসাররা বলে রেড ভেলভেট মাইট ।
    --ওঃ, ট্রমবিডাইডা পোকা । হ্যাঁ, ওর তেলকে হিন্দিতে তিজ বলে, বাতে বা প্যারালিসিসে ব্যবহার করে আয়ুর্বেদিক ডাক্তাররা ।
    গাঁয়ের লোকেরা পোকাগুলো শুকিয়ে ইনডিয়ান ভায়াগ্রা হিসেবে খায়, তা জানে ইতু, পড়েছে অলটারনেটিভ মেডিসিনের কোর্সে । পুরুষ পাখিরাও বসন্তঋতুতে খায় পোকাগুলো, প্রজননের জন্য ।
    --এর পর আমাদের হাঁটতে হবে ।
    --এত ভারি মোটর সাইকেল ঠেলে হাঁটবে কী করে ?
    --না, কাছে আধামিলিট্রি চেকপোস্ট আছে ; তারা আপনাকে আমার সঙ্গে দেখে ফেললে যেতে দেবে না । আপনি চুপচাপ এগিয়ে চলে যান, আমি মোটর সাইকেল একটু পরে স্টার্ট দিয়ে আসব ।
    পাকা রাস্তা শেষ হয়ে গেরুমাটির পথ আরম্ভ হল, গরুর গাড়ি বা ট্র্যাক্টর চলার মতন চওড়া কাঁচা রাস্তা। শুকিয়ে যাওয়া সরু নদী পেরোবার পর বীরবল মাড়িয়া মোটর সাইকেল চালিয়ে এলে ইতু বসে পড়ল পিলিয়নে । বীরবলের পেট আরও ঘেমেছে, কিন্তু উপায় নেই । দু’পাশে শালগাছের সারি, যাক, ছায়া পাওয়া গেল এতক্ষণে, জংলি জঙ্গলের জংলা ঝাউ । কই, ল্যাণ্ডমাইন, বোমাফাঁদ, মাওওয়াদি, আদিবাসী, কিছুরই তো দেখা নেই । গাছগাছালির রংছড়ানো সৌন্দর্য্যে বেশ খাপছাড়া, লেবুসবুজ পাতাগুলো বনের আশ মেটাতে পারছে না । কোনো গ্রামে পৌঁছোল ওরা, পাটনা শহরে গঙ্গায় যাবার ঘাটের দুধারের ভিকিরিদের ঝোপড়ির মতন কুঁড়েঘর, একটা থেকে আরেকটা বেশ দূরে-দূরে।
    --ওগুলো কী ? ঢিবিগুলো । রঙিন কাপড়ে উড়ছে ? একটায় শার্টও ঝোলানো রয়েছে । ইতু জিগ্যেস করল বীরবল মাড়িয়াকে, কয়েকটা ঢিবির দিকে আঙুল দেখিয়ে ।
    আঙুল দেখাবেন না, আঙুল দেখাবেন না, আৎমার অপমান হবে । ওগুলো মাড়িয়াদের কবর । কোনো আত্মীয় আৎমার শান্তির জন্য কাপড়ের টুকরো বেঁধে গেছে, কাপড়গুলো অমাবসের রাকছসদের থেকে আৎমাদের রক্ষা করে । বলল বীরবল মাড়িয়া ।
    লোহার তোরণের মত দেখতে একটা জায়গায় থামল বীরবল । তোরণের ওপরের টিনে সবুজ রঙের ওপর সাদা রঙে হিন্দিতে লেখা রয়েছে, ভারতীয় সেনা ওয়াপস যাও, বস্তরওয়াসী বাহরি নহিঁ হ্যাঁয় । জঙ মত লড়ো । টিনের সাইনবোর্ডের পেছনে লেখা, বস্তরকে য়ুবায়োঁ, সরকার কে নাজায়জ জঙ কে খিলাফ জনয়ুধ মেঁ শামিল হো জাও ।
    মোটর সাইকেল থামিয়ে বাক্সে রাখা একটা কাঁধে ঝোলাবার ব্যাগ বের করে ইতুর দিকে এগিয়ে দিল বীরবল, ইতু বলল, আমার কাছে তো রয়েছে কাঁধে ঝোলাবার থলে ।
    বীরবল মাড়িয়া বলল, আপনার ঝোলাটা এই কাঁধব্যাগে ঢুকিয়ে নিন, এটায় ডাক্তারের ক্রস চিহ্ণ আঁকা আছে । আপনাকে যিনি পাঠিয়েছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে ডাক্তারের লাল ক্রস চিহ্ণ আঁকা ঝোলাটা দিই আপনাকে । নিজের ঝোলাটা বীরবলের দেয়া ঝোলায় পুরে নিল ইতু । থ্যাংকস জানিয়ে জিগ্যেস করল, ওই চালাঘরটার ছায়ায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসা যায় কি ?
    --ওটা র‌্যাশানের দোকান ছিল । যে লোকটা চালাত সে ছিল বস্তারের গোঁড় , মাওওয়াদিদের আৎমার ভয়ে দোকান তুলে দিয়ে, নারায়ণপুরে চলে গেছে, মরে গেলে মাওওয়াদিরা তাদের আৎমাকে এই জঙ্গলে ছেড়ে যায় । আগে র‌্যাশানের কাজ রামকৃষ্ণ মিশন করত । সরকার ওদের হাত থেকে নিয়ে দোকানদারদের হাতে দেবার পর চালাতে না পেরে আবার রামকৃষ্ণ মিশনকে দিয়েছে ; মিশনের পাঁচটা সেন্টার আছে অবুঝমাড়ে । আসলে দোকানদাররা গড়বড়ি করে টাকা বানাতো র‌্যাশান থেকে, ভাবতো যে গোঁড়-মাড়িয়ারা তো জংলি, ওদের নিয়মমত র‌্যাশান না দিলে টের পাবে না, গোঁড়-মাড়িয়ারা তো আর জানে না যে কত র‌্যাশান ওরা পায় । কিন্তু মাওওয়াদিরা দোকানদারদের গড়বড়ি ধরে ফেলেছিল । হুমকি খেয়ে কেউই আর দোকান চালাবার সাহস করেনি । র‌্যাশান মানে পঁয়ত্রিশ কিলো চাল আর কেরোসিন তেল ।
    ছায়ায় আধঘণ্টা জিরিয়ে কয়েক ঢোঁক জল খাবার পর, মোটর সাইকেলটা চালাঘরের কাছে রেখে বীরবল বলল চলুন, আরেকটু এগিয়ে দিই ।
    মিনিট পনেরো হাঁটার পর, দুটো নিচুছাদ চালাঘরের গ্রামের মতন একটা জায়গায় পোঁছোলো ইতু আর বীরবল মাড়িয়া । উলঙ্গ বাচ্চারা খেলা করছে, ছেলে-মেয়ে দুই-ই, রুক্ষ চুল, দেখেই বোঝা যায় বহুদিন, বা হয়ত কখনও, স্নান করেনি । শহরে এই বয়সের মেয়েরা কুঁচকি আর বুকঢাকা পোশাক পরে । কয়েকজন শিড়িঙ্গে শিথিল-দাবনা পুরুষ বসে আছে, তারাও প্রায় উলঙ্গ, কৌপিনগোছের ন্যাকড়ায় লিঙ্গ ঢাকা ; বৃন্দাবনের বিধবাদের অনেকে এরকমই শিড়িঙ্গে, বাবা-মায়ের সঙ্গে যখন গিয়েছিল, তখন দেখেছিল ইতু । লোকগুলোর কোনো আগ্রহ হল না ওদের উপস্হিতিতে, সম্পূর্ণ উদাসীন , যেন সত্যিই আকাশে ভেসে রয়েছে । ওদের মধ্যে একজন যুবকও ছিল, তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বীরবল গোঁড় মাড়িয়া ভাষায় কথা বলল । ইতুর দিকে ফিরে বলল, এর পরের গ্রামে যেতে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে । ওরাও এ গ্রামের নয়, কুরুসনারে গিয়ে সালফি খেয়ে এখানে মৌতাত নিচ্ছে । এই অবস্হায় ওরা ভেতরে গেলে মাওওয়াদিরা ধরে ফেললে ফাইন করবে ।
    বড় ধাপ থেকে ছোটো হতে থাকা সিঁড়ির মতন ওঠা লাল আর সাদা কয়েকটা স্তুপের দিকে ইশারা করে বীরবল মাড়িয়া বলল, ওগুলো শহিদ-বেদি ; যারা আধামিলিট্রির গুলিতে মারা গেছে তাদের ইয়াদগারে বানানো, বেশিরভাগ বেদি আসলে সমাধি, দেখছেন না বেদির ওপরে টিনের কাস্তে-হাতুড়ি । ইতু নিজেকে বলল, এখানে তার মানে ইঁট, বালি, সিমেন্ট এনে ঘর তোলা যায় ; জায়গাটাকে দুর্ভেদ্য করে না রাখলে হয়ত গ্রামের লোকেরা পাকা আস্তানা তৈরি করতে পারত, যেমন অন্য প্রদেশের আদিবাসীদের বাড়িগুলো ।
    মায়ের বাবা-মা, মানে দাদু-দিদা, বেঁচে থাকতে, ছোটোবেলায়, একবার বাবার সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিল ইতু ; সেখানে পাড়ার রাস্তায় ওইরকমই, কিন্তু ছোটো মাপের, কয়েকটা ক্ষয়ে-যাওয়া ইঁটদেঁতো বেদি দেখতে পেয়ে জানতে চাইলে, দাদু বলেছিলেন, ওগুলো শহিদ বেদি, যারা বসিয়েছে তারা নিজেদের, আর যে মারা গেছে তাকে, বোকা বানাবার স্মৃতিকে জিইয়ে রেখেছে । আজকে দাদুর বলা কথাটার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারল ও, ইতু ।
    মানুষ যদি এরকমই থাকতে চায়, তাহলে তাতে পৃথিবীর ক্ষতি ছিল কোনো, নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছিল ইতু । এই লোকগুলো এখনও বিস্মিত হবার ক্ষমতা রাখে, এখনও এরা কলাকৌশলের ইঁদুরকলে আটকে পড়েনি, এখনও এরা ভড়ংশূন্য, সরল, স্বাভাবিক ; প্রযুক্তির প্রগতিতে এসে যায় না কিছু । সভ্যতা যতো বুড়ো হয়েছে তত বিমূর্ত আর অবাস্তব হয়ে গেছে শহুরে মানুষ, শিকড় থেকে ওপড়ানো, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, যেমন আমি নিজে । মেট্রপলিসের মানুষ আর জৈবিক হৃদয়ের প্রাণী রইল না, তার আবেগের স্বাভাবিকতা আর আন্তরিকতা উবে গেছে । বোধহয় এটা মানুষের নৃবৈজ্ঞানিক ভবিতব্য । সভ্যতা যত সভ্যতর হয়ে চলেছে ততই আমরা হয়ে চলেছি জটিল, খারাপ, অনৈতিক, ভয়াবহ । এই লোকগুলোর আনন্দের পরিভাষা তো এরাই তৈরি করবে, নাকি আমি বাইরে থেকে এসে তাকে বোঝাবো কিসে তাদের আনন্দ । সভ্যতা হয়তো মানুষের যৌবনকে ক্ষইয়ে দিচ্ছে । মানুষ আসলে ভঙ্গুর, ঠুনকো, নশ্বর, তার শরীর অসুস্হ হবেই, ঋতুদের প্রকোপ সামলে চলতে হবে তাকে, সভ্য থাকার কাঁচামাল ফুরিয়ে যাচ্ছে, না-খেয়ে বা আধপেটা-খেয়ে থাকতে হচ্ছে, তার ওপর আবার সন্ত্রাসের আতঙ্ক । কে জানে, আমার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই । দেখি কী হয় । অন্যদের সুখে-আনন্দে-সুস্হতায় যদি জীবন উৎসর্গ করতে পারি, তাহলেই যথেষ্ট ।
    ইতুর দোভাষীর কাজ চালিয়ে বীরবল বলল, যুবকটির নাম হরিয়া, ও বলছে যে ওর কোনো কিছুরই দরকার নেই, সবই আছে, রামকৃষ্ণ মিশনের লোকেরা আসলে, পঁয়ত্রিশ কিলো চাল নিয়ে আসে । এক টাকা কিলো চাল কিনতে অসুবিধা হয়না, শুয়োরবাচ্চা , মুরগি, মুরগির ডিম, মহুয়ার ফুল বিক্রি করে যথেষ্ট টাকা হয়ে যায় মাসে । রামকৃষ্ণ মিশনের লোকেরা আসার আগে খবর পাঠিয়ে দেয় ।
    গ্রামটার পর পথ ক্রমে ওপর দিকে ওঠা আরম্ভ হল । অঝোর বৃষ্টিতে খসে-পড়া পাথরকে সিঁড়ির মতন সাজিয়ে নেয়া হয়েছে । দুপাশে নানা রকমের চেনা-অচেনা গাছ, ছায়ায় হাঁটতে ভালো লাগছিল ইতুর । তখনই বীরবল বলল, দিদি, আমাকে এখান থেকে ফিরে যেতে হবে, বিকেল হয়ে গেছে । আপনি আগে যে গ্রাম পাবেন সেখানে অপেক্ষা করুন কিংবা এই সরু পাহাড়ি বনপথ ধরে এগিয়ে যান, আরেকটা বড় গ্রাম আসবে , আমার সেরকমটাই মনে আছে, কয়েক বছর আগে গিয়েছিলুম তো । অন্ধকার হয়ে গেলে কোনো গাছে হাত দেবেন না ; সন্ধ্যার পরে গাছ আর গাছের ডালপালাগুলো সাপ হয়ে যায়, নানা রকমের সাপ, সবুজ, কালো, হলদে, মোটা, রোগা, চিত্তিদার ; আপনাকে সাবধানে হাঁটতে হবে । টর্চ এনে থাকলে জ্বালাবেন না, সাপেরা আলোয় বিরক্ত হয় ।
    --সে কি, তুমি যাবে না ? ইতু বুঝতে পারল যে ও এই ছেলেটির ওপর নির্ভর করছিল এতক্ষণ, ওর কল্পকাহিনী খাচ্ছিল । এবার ওকে আত্মনির্ভর হয়ে নির্ণয় নিয়ে এগোতে হবে । কারোর ঘাড়ে চাপার জন্য তো ও বাড়ি ছেড়ে বেরোয়নি । কিছুক্ষণেই সূর্য অস্ত যাবে । একা-একা কী করব এখানে । চিনি না, জানি না কাউকে।
    --না, আমি ফিরে যাই, এখানে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করবে না । মাড়িয়া গোঁড়রা জানেই না কাকে ক্ষতি করা বলে । জঙ্গলের ভেতরে শহরের মানুষ পাবেন না । যদি পান তো নিজেকে দূরে-দূরে রাখবেন ।
    ইতু হাত তুলে ফির মিলুংগি জানিয়ে এগোলো বনের পথ ধরে । বীরবল চলে গেলে, জুতো আর জিন্স খুলে, প্যান্টিটা ফেলে দিয়ে, পেচ্ছাপ করে নিল । অবিরাম হাঁটার দরুণ প্যাণ্টির ঘষা লাগছিল কুঁচকিতে । ওহ, কতক্ষণ চেপে রেখেছিলুম, বলল হলুদ ফুলের চুমকি-বসানো ঘন-সবুজ ঝোপকে, যে ঝোপটা হয়তো কোনো ভবঘুরে পাখির গু থেকে বৃষ্টির ছাটে দু’হাত মেলে জন্মেছিল । টপ খুলে বডিসও ফেলে দিল । সেই ক্লাস এইট থেকে অভ্যাস, বাইরে থেকে এসে সবচে আগে এই দুটো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া ।
    বাঁদিকের বুকটা তুলে দেখল, দ্বিতীয়বার উত্তেজিত হয়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল অমিত, তাই ঘামের দরুন জ্বালা করছিল । একটা ঘৃতকুমারী পাতা ভেঙে, কুঁচকিতে আর বুকে, গোলাপি-জ্বালায় লাগিয়ে নিল ।
    বনের ভেতরে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দাঁড়িয়ে অবর্ণনীয় ভালোলাগা পেয়ে বসল ইতুকে । দুহাত ওপরে তুলে চেঁচিয়ে উঠল, আমি ইতুউউউউ..., আমি ইতান..., পৃথিবীর মাটিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন... । দুদিকে দুহাত মেলে দিয়ে, আবার চেঁচালো, আমি ইতু..., আমি আদিমানবী..., আমি ইতু...আমি ইতু...আমি ইতুউউউউ...।
    শুকনো পাতার ওপর থেকে পোশাক তুলতে গিয়ে ইতু দেখল, একটা কাঠবিড়ালি নতজানু হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । ইতু, নগ্ন, শুকনো পাতার ওপর বসে কাঠবিড়ালিটাকে বলল, সেতু বাঁধতে এসে থাকলে ভুল করছিস, সব সেতু ভেঙে চলে এসেছি । কাঠবিড়ালিটা পালিয়ে গেলে, জুতো আর পোশাক পরে নিল, কাঁধে ঝোলা, এগোলো বনপথে । হালকা হয়ে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল না আর । এটা জঙ্গল, না বনানীর ধ্বংসাবশেষ, কেমন যেন ছড়ানো-ছেতরানো !
    সোফানরম শুকনো-পচা পাতার ওপর হাঁটতে-হাঁটতে ইতুর মনে হল এই জায়গাটা তো ওর চেনা । ওই তো ডুমুর গাছে থোকা-থোকা পাকা ডুমুর হয়ে রয়েছে, পায়ের কাছে বনপথের পাশে-পাশে ঘৃতকুমারীর জঙ্গল, ঘৃতকুমারী, যা এখন কতো দাম দিয়ে কেনে পাবলিক, বহেড়া গাছ, অশোকফুল গোছা-গোছা, ভরাঙ্গিপাতা, ডেভিলস কটন বা উলটকম্বলের গাছ, ইগল উড বা অগরু গাছ, আরে, এলিফ্যাণ্ট ক্রিপার বা সমুদ্রাশোক, সুগন্ধমূল বা গ্রেটার গলাঙ্গল, উইনটার চেরি যাকে সিলেবাসে অশ্বগন্ধা বলা হতো, কত পরিচিত গাছ-গাছড়া, পাটনায় পেতুম শুকনো, কবে কোথা থেকে অশোক রাজপথের ইউনানি দোকানে আসত কে জানে । এখানে দিব্বি রয়েছে অবহেলার ঐশ্বর্যে ঝিলমিলিয়ে, শিশি-বোতল-বয়ামের বাইরে মাথা তুলে, হাতপা ছড়িয়ে।
    ঘণ্টাখানেক চলার পর, সন্ধ্যা নেমে আসায়, অজানা এক গাছের গুঁড়ির কাছে, ছায়ায় , জুতো খুলে, বসে পড়েছিল ইতু, বুকের ভেতরে বাজানো ভীতির দামামা দূর থেকে কানের ভেতরে উঠে আসছিল। ওপর থেকে ঝরঝর করে কয়েকটা শুকনো ফুল ঝরে পড়তে চমকে উঠেছিল, তারপর টের পেল যে এটা মহুয়ার গাছ ; তাইতো অমন গন্ধ বেরুচ্ছিল। মহুয়া ফুলের গন্ধে যদি ভাল্লুক আসে, তাহলে ? কোথায় যেতে হবে সুস্পষ্ট বলে দেয়নি অমিত । বলেছিল হাঁটতে থেকো যতটা পারো । পরিচিত কাউকে ঠিকই পেয়ে যাবে । তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। গাছে ঠেসান দিয়ে ঢুলতে লাগল । সারাদিনের রোদের আমেজে বুঁদ গাছের পাতাগুলো অবসাদে ঝিমিয়ে ।
    ঘুম ভাঙতে, দেখল, অন্ধকার, আজকে বোধহয় চাঁদ ওঠার রাত নয় । জুতো পরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অন্ধকারে গাছে ডান হাত ঠেকতেই মনে হল সাপের গায়ে হাত দিয়ে ফেলেছে, নরম, মাংসল । দ্রুত হাত সরিয়ে নিল । কী করবে ? গাছগুলো রাতে সাপের আকার নিয়ে নিচ্ছে ! কেউ এলে তাকে দেখতেও তো পাবো না জঙ্গলের অন্ধকারে । হয়তো বিভ্রম, মনে করে, বাঁহাত বাড়িয়ে গাছ অনুমান করে হাত বাড়াতে, সাপের গায়ে ঠেকল, ঠাণ্ডা । সাপের ভয়ে ইতুর বুকের ভেতরের ইঁদুরগুলো দাপাদাপি আরম্ভ করে দিয়েছিল । বুঝতে পারল যে যা ওর অস্তিত্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তা আতঙ্ক, সাপের আকার পাওয়া গাছগাছালির আতঙ্ক ।
    হঠাৎ ওর মুখের ওপর সরু নিয়ন আলো পড়তে চোখ ধাঁধিয়ে গেল । কোনো ময়ালের চোখ ?
    আওয়াজ আর কন্ঠস্বর শুনে সন্দিগ্ধ ভয়ে সিঁটিয়ে উঠল ইতু । ভাল্লুক ? আরও তিনটে টর্চ জ্বলতে, আঁচ করল ওর চারপাশে জলপাই রঙের উর্দিতে চারজন যুবক আর একজন যুবতী । প্রত্যেকের কাঁধে বন্দুক বা রাইফেল, কে জানে কী, জওয়ানদের কাঁধে ঝুলতে দেখেছে অমন অস্ত্র । আধামিলিট্রি জওয়ান নয়তো ? একজন যুবতী রয়েছে যখন তার মানে এরা সি আর পি এফ জওয়ান নয় বলেই মনে হচ্ছে । যুবতী তো খোঁপাও বেঁধেছে, চুলে তেল দেয় নিশ্চয়ই, চকচক করছে। এখানে জঙ্গলে মাথায় দেবার তেলও পাওয়া যায় নাকি ! চুলটা কেটে ফেললুম, না কাটলেও বোধহয় চলত ।
    একজন যুবক এগিয়ে এলো, যাকে দেখে চিনতে পারল ইতু, আরে, এই ছেলেটা তো ওর ক্লিনিকে একবার খাম দিতে আর ওর বাড়িতে একবার খাম নিতে এসেছিল । যাক এরা তাহলে অমিতের পরিচিত । অমিতও এরকম কাঁধে বন্দুক ঝোলায় নাকি ? আমাকেও বন্দুক ঝোলাতে হবে নাকি ? তা তো চাইনি ।
    --ডক্টর ঘোষ, ওয়েলকাম, বলল ছেলেটি ।
    ইতুর মুখ দিয়ে বেরোল, থ্যাংকস , ম্যায় বহুত ডরি হুই থি, কোই দিখাই নহিঁ দে রহা থা, কাফি অন্ধেরা ভি হো চলা হ্যায় ।
    --জানতি হুঁ, আপ সো গয়ে থে দেখকর হম লোগোঁনে নিন্দ সে নহিঁ জাগায়া আপকো । আপ জব অপনা নাম লেকর চিল্লায়েঁ, তভি সে হমলোগ আপকে সাথ হ্যাঁয় । আপ হম লোগোঁ কে সাথ আইয়ে, বলল ওদের সঙ্গের যুবতী । সে-ই বোধহয় এদের নেতা । পিঠের ব্যাগ থেকে দুশো এম এল জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, লাইফ ইজ টাফ ফর অল ইন দিস প্লেস, অ্যান্ড ভেরি ডেঞ্জারাস টু, ইউ হ্যাভ টু গ্র্যাজুয়ালি অ্যাডজাস্ট ।
    জল খেয়ে তৃপ্ত বোধ করল ইতু । ওর উলঙ্গ চিৎকার এরা দেখেছে তাহলে । দেখুকগে, কীই বা এসে যায়। এতক্ষণ পর মানুষ দেখতে পেয়ে অসুরক্ষিত থাকার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত লাগল নিজেকে ।
    মেয়েটি বলল, আপনি হাঁটার সময়ে মাঝখানে থাকবেন, আমি আপনার দেহরক্ষী, আমার নাম সোনারি । ওদের সঙ্গে হাঁটা আরম্ভ করল, ওর সামনে তিন জন, পেছনে দুজন । গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশে তারা দেখতে পেয়ে দেহরক্ষীদের চেয়ে তাদের টিমটিমে আলোদের বেশি আপন মনে হল ইতুর । সেই সকাল থেকে বেরিয়েছে, রোদের জন্য দ্বিতীয়বার আর পেচ্ছাপ পায়নি, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আর কতক্ষণ হাটঁতে হবে কে জানে, কয়েকটা বিস্কিট আগেই খেয়ে নিলে ভালো হতো । এরা কেউ কথাবার্তাও বলছে না । নিজে থেকে কোন প্রসঙ্গেই বা কথা বলবে, নানা ভাবনা মগজে ঘুরছিল ইতুর। দেহের আলো জ্বালিয়ে পুরুষ জোনাকিরা উড়ে বেড়াচ্ছে মাদি-জোনাকিদের আকৃষ্ট করার জন্য । বনের পাতারা গন্ধ বিলোচ্ছে । নয়নাভিরাম নির্বাক অন্ধকার । বনপথের সহযাত্রীদের পাহারায় হয়ত আরও দেড় ঘন্টা হেঁটেছিল ইতু ।
    তখনই, অন্ধকারকে হুশিয়ারি দিয়ে কয়েকবার হুইসিল বেজে থেমে গেল ।
    আচমকা গুলিচলার শব্দ আরম্ভ হতে, ইতুর ওপর ঝাঁপিয়ে একজন সঙ্গী যুবক ওকে জঙ্গলের শুকনো পাতার ওপরে উপুড় করে শুইয়ে দিল, ইতুকে বাঁচাবার জন্য দুদিক থেকে ওর দেহকে নিজেদের শরীর দিয়ে ঢেকে নিল বাকি দুজন যুবক । মেয়েটি শুকনো পাতার ওপর উপুড় হয়ে কোনো অচেনা শত্রুর দিকে তাক করে বন্দুক উঁচিয়ে শুয়ে পড়ল ইতুর মাথার কাছে।
    অবিশ্বাস্য । এরা আমার কেউ নয়, তবু আমাকে বাঁচাবার জন্য নিজেদের শরীরকে আমার দেহের বর্মে পালটে ফেলল ! মানুষ না রোবোট এরা !
    ইতু অনুমান করল দুদিক থেকে গুলি চলছে, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, গুলির আগুন-ফিনকিও দেখতে পাচ্ছে না । ওর মুখ মাটির দিকে, জিভেতে ভয়ার্ত আহ্লাদের স্বাদ । নিজেকে নিঃশব্দে বলল, বোধহয় নতুন জীবন আরম্ভ হল, কিংবা জীবন হয়তো কিছুক্ষণেই শেষ হয়ে যাবে । আর আশ্চর্য, এক্ষুনি হয়তো মরে যাবো, এই ভেবেও ভেতরে-ভেতরে আনন্দ খেলছে।
    শুকনো পাতার ছোঁয়াচে গন্ধে, বাড়ি থেকে পালাবার পর প্রথম যখন অমিত ওর ক্লিনিকে এসেছিল সেই দিনকার ঘটনাগুলো মনে পড়তে লাগল ইতুর, হুবহু ।

    আঠারো
    মালগুজার কর্মচারী : ওই দ্যাখো । সালফি খাবার জন্যে জঙ্গলে ঢুকেছিল, ভ্যায়েনচো, সামলাতে পারেনি, মাতাল হয়ে পড়ে রয়েছে ।
    কেন্দুপাতার ফড়ে : সালফি খেয়ে মাতাল হলে তো যেখানে খেয়েছে, তার কাছাকাছি পড়ে থাকত । এখানে আসপাশে কোনো গ্রাম নেই, সালপিখোরদের গেঁয়ো জামাতও নেই ।
    মালগুজার কর্মচারী : ভ্যায়েনচো, কেন্দুপাতার চোরাকারবারি নয়তো ?
    কেন্দুপাতার ফড়ে : কেন্দুপাতার ব্যাবসার সবাইকে চিনি, চোরাকারবারিদেরও । ওখানে, রাস্তার ধারে খাদে পড়ে থাকবে কেন ?
    মালগুজার কর্মচারী : মরুকগে বেওড়াগুলো, ভ্যায়েনচো । আমাদের কী করার আছে ।
    কেন্দুপাতার ফড়ে : হ্যাঁ, উঠিয়ে নিয়ে যাবার হলে বনদপতরের লোক বা সিআরপিএফ নিয়ে যাবে । নয়তো খাবে জন্তু-জানোয়াররা । চলুন, চলুন । কদম চলাকে চলিয়ে ।

    উনিশ
    অমিত বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রথম বার যখন ইতুর সঙ্গে দেখা করতে ওর ক্লিনিকে এসেছিল, সে ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে ইতুর । অবুঝমাড়ের জঙ্গলে, মাটিতে শুকনো জঞ্জালের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে, গুলির অধারাবাহিক শব্দ শেষ হবার পরও, বহুক্ষণ ওভাবে শুয়ে থেকে, সব কিছু মনে পড়ে যাচ্ছিল ইতুর, হুবহু ; পাতাগুলো বোধহয় বয়ে এনেছে অমিতের যৌবনগ্রন্হির নিঃসরনের বুনো গন্ধ ।
    অমিতের সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না । হয়তো কেন, নিশ্চিত হবে না ।
    বছর আড়াই আগে,আনিসাবাদে, নিজের ক্লিনিকে রোগি আসার অপেক্ষায় হতাশ বসেছিল ইতু, ইতু ঘোষ ; দেখল, ফুটপাতে, ওর ক্লিনিকের সামনেই চেককাটা শার্ট আর ধূসর ট্রাউজার পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে, ওপরে মুখ তুলে । দাড়ি-গোঁফ আর বাবরি চুলে মুখ প্রায় ঢাকা, ইতু বয়স আন্দাজ করল বাইশ-তেইশ হবে, রোগকে যেচে ডেকে আনার সবচেয়ে উদ্দীপক বয়স । উঠে দাঁড়িয়ে, সাদা গাউন পরেই ছিল, টেবিলে রাখা স্টেথোস্কোপটা গলায় ঝুলিয়ে, এগিয়ে গিয়ে ডাকল লোকটাকে, হিন্দিতে, আসুন না, আসুন, আপনাকে দেখেই তো বুঝতে পারছি আপনি বেশ ক্লান্ত, হয়ত কোনো রোগের কারণে ।
    সাইনবোর্ডের দিকে আঙুল তুলে লোকটা বলল, ডাক্টর ইতু ঘোষ কা ক্লিনিক, য়ঁহা সভি রোগোঁকা ইলাজ কিয়া জাতা হ্যায়, তারপর ইতুর দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলল, তুই ইতু ঘোষ, গর্দানিবাগের ঘোষবাড়ির মেয়ে, তাই না ?
    যুবকের মুখের দিকে না তাকিয়ে, পেছন ফিরে তাকে বলল, হ্যাঁ, আমি ঘোষবাড়ির মেয়ে ইতু, অনেকে ইতি বা ইতান বলেও ডাকে । আপনি ভেতরে আসুন না, শুনবো আপনার শারীরিক সমস্যার কথা, কোনো চিন্তা করবেন না, হেভি অ্যালোপ্যাথিক ডোজের ব্যয়সাপেক্ষ চিকিৎসা আমি করি না, আসুন, ভেতরে আসুন ।
    লোকটা ভেতরে ঢুকে, ইতুর টেবিলের উল্টো দিকে, রোগির চেয়ারে বসলে, নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসে, স্টেথোটা টেবিলে রেখে, টেবিলে ছড়ানো জিনিসগুলো, খোলা-সংবাদপত্র, সাজাতে-সাজাতে ইতু বলল, কি হয়েছে শুনবো, তার আগে আপনার ব্লাড প্রেশার আর পাল্স চেক করে নিই । রোগি তার সমস্যা বর্ণনা করার আগেই, ইতু বলল, দিন আপনার বাঁ হাতখানা এখানে রাখুন তো, বলে ব্লাড প্রেশার মাপার জন্য ফ্ল্যাপটা হাতে জড়িয়ে বলল, আপনি ওনাদের চেনেন ?
    --আমি তোকেও চিনি, বলল লোকটা, তুইও আমাকে চিনিস, মুখের পানে আগে তাকিয়ে দ্যাখ, ইডিয়ট । আমার গলার আওয়াজও এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি নাকি ?
    যুবকের কথা শুনে তার মুখের দিকে চেয়ে সঞ্চিত বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ইতু, আরে অমিত, চিনতেই পারিনি, দাড়ি গোঁফ রেখে এমন ভোল পাল্টে ফেলেছিস রাসকেল, গলার আওয়াজও বড়দের মতন হয়ে গেছে, সন্ন্যাসী হয়ে গেছিস নাকি ? ফুঁপিয়ে ফেলেছিল, সামলে নিয়ে বলল, সেই যে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলি, আমাকে বলে যাবার প্রয়োজন বোধ করলি না।
    --হ্যাঁ, সাধুই হয়ে গেছি প্রায় ?
    --বাড়িতে গিয়ে আমার ক্লিনিকের ঠিকানা পেলি ? টিশ্যু পেপারে চোখ পুঁছে বলল ইতু ।
    -- গিয়েছিলুম একটু আগে, ভেতরে ঢুকিনি , তাই আমাকে দেখে রোগীর মতন মনে হয়ে থাকবে, হাঁটছি তো অনেকক্ষণ যাবত । বাড়িটা বাইরে থেকে দেখে চলে এলুম । তোদের প্রতিবেশী গোবর্ধন মিশ্রর কাছে খোঁজ করে তোর ক্লিনিকের ঠিকানা পেলুম । মন কেমন করছিল রে সবায়ের জন্য, কিন্তু ওই বাড়িতে আমি তো আনওয়ান্টেড কলঙ্ক । কিছুক্ষণ থেমে, মাথা নামিয়ে অমিত বলল, ওই বাড়িতে আমি একজন বেজন্মা ।
    --স্টপ ইট, ভাট প্যাঁদাসনি । কেউই তোকে বেজন্মা বলেননি ।
    --তা না হলে তোর সঙ্গে আমার সম্পর্কের স্বীকৃতি দিতে বাধা ছিল কোথায় ? আমার বাবার চেয়ে আমার মা দশ বছরের বড়, আর আমার মা আমার বাবার স্ত্রী নন, অন্য আরেকজনের স্ত্রী, এই তো ? এই কারণেই তো ওনাদের আপত্তি ?
    ইতু চিৎকার করে উঠল, না, না, না, না । ক্লিনিকে বসে অমনভাবে চেঁচিয়ে ফেলে, হুঁশ হল, যে, ফুটপাথ দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তারা ওর দিকে অবাক ঔৎসুক্যে তাকাচ্ছে, সম্ভবত ভাবছে যে এ কেমন ডাক্তারনি, রোগিকে বকুনি দিয়ে ভয় পাওয়াচ্ছে । উঠে গিয়ে শাটার নামিয়ে, অমিতের মুখের কাছে মুখ এনে ইতু বলল, ওনাদের বক্তব্য ছিল আমরা দুজনে ছোটোবেলা থেকে ভাইবোনের মতো বড়ো হয়েছি, আমরা বিয়ে করলে ভাইবোনের বিয়ে বলে মনে করবে পাড়াপড়শিরা, বলেছিলেন সকলে । আফটার অল রাঙাকাকু-রাঙাকাকিমা তোর দায়িত্ব নিয়েছিল, ছেলের মতন মানুষ করছিল, তাই । শুনে রাখ, তুই যদি আমার মায়ের পেটের ভাইও হতিস, ইনসেসচুয়াস হলেও, তোর সঙ্গেই রিলেশানশিপ করতুম, কিংবা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে তোর সঙ্গে লিভ ইন করতুম ।
    --তুইও জানিস, আমিও জানি ইতু, তোদের বাড়িতে কী ধরণের ট্রিটমেন্ট হতো আমার । তারপর যখন ওনারা জানতে পারলেন যে তুই আমাকে ভালোবাসিস তখন ওনারা ঘেন্না আর রাগ সামলাতে পারেননি ।
    অমিতের জামার কলার ধরে ঝাঁকিয়ে ইতু বলল, বানচোদ, তাই তুই আমাকে ফেলে পালিয়ে গেলি; ইনফর্মটুকু করতে পারলি না ? বেশ ককিয়ে কেঁদে ফেলল ইতু, ফিরে গিয়ে বসল নিজের চেয়ারে, টিশ্যু দিয়ে চোখ পুঁছল , মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, কাওয়ার্ড রেনিগেড ।
    অমিত : আমি আমার বাবা আর মায়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলুম রে, বিশ্বাস কর, ওনাদের কাছ থেকে জবাবদিহি পাওয়া জরুরি ছিল । কেন ওনারা জাস্ট একজন বন্ধুর বাড়ি আমাকে ডাম্প করে চলে গেলেন, তাও সেই বন্ধু নিজেই কিডন্যাপ হয়ে গিয়েছিল বলে যে বাড়ি তার বউ-বাচ্চাকে স্বীকৃতি দেয়নি ।
    চেয়ার ছেড়ে অমিতের কাছে পৌঁছে, এবার ওর দীর্ঘ চুল দু’হাতে ধরে ইতু বলল, তাই বলে তুই আমাকে ডিচ করবি ? আমি কি দোষ করেছিলুম ? আমিই বা কোন রাজকন্যার মতন আছি ওই বাড়িতে ?
    অমিত : ডাক্তার হয়েছিস তো ! কনভেন্ট এজুকেশান ঝাড়ার অভ্যাস ছাড়তে পারিসনি দেখছি ।
    ইতু : এটা ডাক্তারি ? ভালো করে পড়েছিস বাইরে সাইনবোর্ডে কী লেখা আছে, ইউ ফুল ? বাবা-মা অ্যাকসিডেন্টে মারা যাবার দরুণ এক বছর এম বি বি এস পড়ে ছেড়ে দিতে হয়েছিল । আমি যেটা করেছি সেটা অলটারনেটিভ মেডিসিন । রোগি আসে না, যাও দুচারটে আসে তারা দ্বিতীয়বার আসে না, কেননা আমি রাংতায় মোড়া অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ দিই না ।
    অমিত : মিশ্রাজির কাছে শুনেছি, তোর মা-বাবার অ্যাকসিডেন্টের কথা । হ্যাঁ, সাইনবোর্ড দেখেছি, তুই অলটারনেটিভ মেডিসিনের ডাক্তার । বাবা-মায়ের খোঁজে গিয়েছিলুম, অথচ সে বিষয়ে জানতে চাইছিস না ? কেবল নিজের চিন্তা করছিস ?
    ইতু, মুঠো থেকে অমিতের চুল আলগা করে বলল, তুই ছাড়া আমার আপন বলতে কে আছে বলতো ওই ফাকিং একান্নবর্তী পরিবারে ? আই অ্যাম সরি, এতদিনে তোকে পেয়ে ক্যারিড অ্যাওয়ে হয়ে গিয়েছিলুম । তোর বাবা-মা কোথায় আছেন ? খুঁজে পেয়েছিস ওনাদের ? কী করে পেলি ?
    অমিত : আমাকে কথাই বলতে দিচ্ছিস না । বোস, গিয়ে নিজের চেয়ারে বোস । তোকে আমার দরকার।
    অমিত : বাবা আর মা দুজনকেই খুঁজে পেয়েছি । মায়ের হাজবেন্ডকেও খুঁজে পেয়েছি ।
    অমিত : আমার মা এই বয়সেও সুন্দরী, পাকাচুল-সুন্দরী । শি ইজ সো সিরিন অ্যাণ্ড ডিগনিফায়েড, কী বলব তোকে, কিন্তু ডিসট্যান্ট, হ্যাঁ, এক্সট্রিমলি ডিসট্যান্ট । জানিস, আমি কলকাতায় নার্সিং হোমে জন্মেছিলুম । নার্সিং হোমের আর কলকাতা কর্পোরেশানের বার্থ সার্টিফিকেট আছে রাঙাবাবার কাছে, অথচ, কখনও সে কথা বলেনি আমাকে । বার্থ সার্টিফিকেটে আমার নাম অমিত বর্মণই লেখানো হয়েছিল ।
    ইতু : এই ডাফার, পা দোলাসনি, পা ব্যথা করছে তো চেয়ারে পা তুলে বোস ।
    অমিত : ওকে, ওকে, পা তুলেই বসছি । যেদিন সকালে তোদের বাড়ি ছাড়লুম, সোজা বাবার অফিসের কর্মীদের কাছে গিয়েছিলুম, বাবার কনটেমপোরারি একজন বললেন, যে উনি কোনো নকসল্লি ফ্যাকশানের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিলেন । অফিসের এক ক্লাস ফোর স্টাফের কাছে রসিক পাসওয়ান নামে এক পিওনের নাম-ঠিকানা পেয়ে তার কোচাগাঁও গ্রামের দলিত টোলার বাড়িতে গিয়েছিলুম ; সে ওই ফ্যাকশানে ছিল । গিয়ে শুনলুম যে রসিক পাসওয়ান পুলিশের গুলিতে মারা গেছে । শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল । আশঙ্কা করেছিলুম যে তাহলে বাবাও হয়ত মারা গিয়ে থাকবেন আর মাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া হয়ে থাকবে ।
    অমিত : ওয়ারিস আলি গঞ্জে স্টেশানে বসে ভাবছিলুম যে এর পর কী করব, কোথায় সুত্র পাবো, যাবোই বা কোথায় ? গর্দানিবাগের বাড়িতে বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যাবার সময় নাকি বলে গিয়েছিলেন যে ওনার আর আমার মায়ের খোঁজখবর যেন কখনও করা না হয় । বাড়িতে কেউ কখনও আলোচনা করেনি ; করল প্রথম যখন ওনারা তোর-আমার সম্পর্কের কথা জানতে পারল । আমার বাবার নাম অতনু চক্রবর্তী আর মায়ের নাম মানসী বর্মণ, ওনারাই সেদিন উত্তেজনার মুখে বলেছিলেন, মনে আছে তোর ? আমি তোর রাঙাকাকুকে কতবার জিগ্যেস করতুম যে আমার পদবী বর্মণ কেন, উনি এড়িয়ে যেতেন, বলতেন কী করবি জেনে ।
    অমিত : স্টেশানে প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল পরের ট্রেনের জন্য । ভাবছিলুম শালা যে ট্রেনই আসুক, যেখানেই যাক, চেপে যাব । হঠাৎ কাঁধে কেউ একজন হাত রাখতে, পেছন ফিরে দেখি, বুড়োটে কদমছাঁট বিহারি , মাথায় লাল গামছা বাঁধা, বলল যে তুমি রসিক পাসোয়ানকে খুঁজছ কেন ? আমি বললুম, উনি আমার বাবাকে আর মাকে চেনেন, তাই, আমি ওনার কাছে জানবার জন্য এসেছিলুম যে আমার বাবা-মাকে কোথায় পাবো, তাঁরা বেঁচে আছেন কি না । উনি বললেন, তোমার মুখ অনেকটা তোমার বাবার মতনই । আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি কে, আমার বাবা-মাকে চেনেন ?
    অমিত : উনি বললেন ওনার নাম রসিক পাসওয়ান । ওনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, সেই একই দলিত টোলায়, সেই বাড়িতেই, যেখানে আমাকে বলা হয়েছিল যে রসিক পাসওয়ান মারা গেছে । রসিক পাসওয়ান নামে সত্যি একজন মারা গিয়েছিল পুলিশের সঙ্গে নকসল্লিদের লড়াইতে, কিন্তু সে অন্য রসিক পাসওয়ান ।
    ইতু : যাই হোক, বাবা মাকে কোথায় পেলি, কী করেই বা পেলি ? ওনাদের বাড়িতেই ছিলি এতকাল ? আমাকে নিয়ে চল, আমি তোর সঙ্গে ওনাদের বাড়িতেই থাকব ।
    ইতু : আমার আর এখানে একদম ভাল্লাগছে না । এখানে থাকতে হলে আমি মরেই যাবো ।
    অমিত : আবার তুই নিজের প্রসঙ্গে ফিরে এলি । বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা হল, সে কথা তো জানতেই চাইছিস না । রসিক পাসওয়ান বলল যে আমার বাড়িতে দুচারদিন থাকো, আমি খোঁজখবর নিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবো ওনাদের কাছে । দশ দিন থেকে গেলুম ।
    ইতু : একজন অচেনা বিহারির বাড়ি দশ দিন থেকে গেলি ? তোকে কিছু করেনি তো ?
    অমিত : আমাকে আবার কী করবে ? আমার কাছে পয়সাকড়িও ছিল না তেমন যে লুটপাট করে কেড়ে নেবে । বটঠাকুমা মাঝে-সাঝে যে হাতখরচ দিতেন সেটুকু জমানো টাকাই ছিল । রসিক পাসওয়ানের সঙ্গে দেখা না হলে ভিক্কে করতে হত ।
    ইতু : তা নয় । যখন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলি তখন খিচ্চা-কওলা-চিকনা-লালটু, ইনোসেন্ট-ইনোসেন্ট টাইপ, ছিলি । ওইসব এরিয়ায় ছেলেদের সঙ্গে জোর করে সেক্স করে শুনেছি । এই ক’বছরে অবশ্য রোদে পুড়ে কিছুটা চেবানো-চোয়াড়ে আর ছিবড়ে-মাসকুলার হয়ে গেছিস, যে জন্য দেখামাত্র চিনতে পারিনি ।
    অমিত : আমি সিরিয়াস আলোচনা করছি আর তুই তার মাঝে গল্পগাছা নিয়ে আসছিস । লোকটা আর ওর বউ অনেক ভালো । তোদের বাড়িতেও আমার অমন আদর-যত্ন হয়নি । দশদিন পরে, সকালে আমরা বাসে করে গেলুম গয়া । গয়া থেকে ট্রেনে করে লাতেহার, ওটা ঝাড়খণ্ডে পড়ে । দিনের বেলাটা তেতিয়া বিরহোর নামে একজন আদিবাসীর মাটির বাড়িতে কাটিয়ে বিকালে হাঁটা দিলুম তিনজনে । সারারাত উবড়-খাবড় রাস্তা ঠেঙিয়েছি, ভেবে দ্যাখ ।
    অমিত : পৌঁছোলুম কাতিয়া নামে একটা জঙ্গলে, রিয়্যাল ঘন-জঙ্গল, গাছের পর গাছ আর ঝোপঝাড়। তাতিয়া ফিরে গেল ; আমাদের আরেকজন কম বয়সী আদিবাসীর জিম্মায় দিয়ে, তার নাম ঝুনাই । সেখান থেকে অনেকটা ওপর দিকে উঠে, অনেকটা, অনেকটা, জঙ্গলের আরও ভেতরে গিয়ে ঝুনাই ফিরে গেল । আরেকজন, তার নামও তেতিয়া, আমাদের নিয়ে গেল আরও ভেতরে খোলামতন একটা জায়গায়, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে ব্যাডমিন্টন কোর্টের মতন অমন একটা খোলা জায়গা রয়েছে, ন্যাচারাল জায়গা । কয়েকটা পলিথিনের তাঁবু দেখতে পেলুম, দু’জন লোক কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে পাহারা দিচ্ছিল । কীরকম তাঁবু জানিস, তোর ক্লিনিকের একটু আগে ফুটপাথে চায়ের দোকান আর ভাতের দোকানে যেমন পলিথিনের তেরপল আছে, তেমন । একটা তাঁবুতে ঢুকে তেতিয়া আস্তে ডাক দিতে, একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন, তিনি বললেন, আবার ম্যালেরিয়া হল নাকি রে, সেরে তো গিয়েছিলি । তেতিয়ার পেছনে আমাদের দেখতে পেয়ে রসিককে বললেন, আচ্ছা, রসিক একজন নতুন ছাত্র এনেছে বলে মনে হচ্ছে । মাস্টারসাহেবকে খুঁজছ তো ? উনি ওইদিকের ছাউনিটায় মিটিং করছেন । শুনেছ তো কয়েকদিন আগে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বল-এর লোকেরা জওয়ানদের শব তোলার কাজে কয়েকজন গ্রামবাসীকে লাগিয়েছিল, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বোমা ফেটে মারা গেছে আর কয়েকজনের অঙ্গহানি হয়েছে ।
    ইতু : জঙ্গলে স্কুল-মাস্টার কী করেন রে ?
    অমিত : ধৈয্য ধর না, সবই তো বলছি । ওই মহিলা আমার মা আর মাস্টারসাহেব আমার বাবা ।
    ইতু : মাই গড ! আমি যাবো ওখানে, তুই আমাকে আজই নিয়ে চল । আমি ওনাদের বলব যে আমি তোকে চাই বলে তুই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিস, তোর কোনো দোষ নেই ।
    অমিত : মা আমাকে দেখে চিনতেই পারলেন না যে আমি ওনার ছেলে ; শালা মাতৃত্ব নিয়ে লেকচারবাজি সবই ফালতু । আমার তক্ষুনি এত খারাপ লেগেছিল যে হয়ত কেঁদেই ফেলতুম । উনি হিন্দিতে বললেন, তোমাকে বেশ ডিপ্রেসড দেখাচ্ছে । অনেকটা হেঁটে এসেছ তো, ক্লান্ত হয়ে গেছ, ওই শেডটায় যাও, মাস্টারসাহেব আছেন, যাও দেখা করে নাও, ক্লান্তি জুড়িয়ে নাও । রসিক পাসওয়ান ওনাকে বললই না যে আমি ওনার ছেলে । পাশের তেরপলে ঢুকেছি, রসিক পাসওয়ান ওনাকে লাল সেলাম মাস্টারসাহেব বলতেই, উনিও একইভাবে প্রত্যুত্তর দিলেন, আর আমাকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন, গভীরভাবে আমার মুখের পানে তাকিয়ে দেখে তক্ষুনি জড়িয়ে ধরলেন , বাংলাতেই বললেন, এখানে কেন এলে, যেখানে ছিলে ভালোই তো ছিলে । তুমি আমার ছেলে, ওনারা নিশ্চয় তোমাকে বলে থাকবেন, যে কারণে তুমি কমরেড রসিককে সন্ধান করে এখানে ছুটে এসেছ, দাঁড়াও তোমার মাকে ডাকছি, উনি প্রায়ই তোমার প্রসঙ্গ তোলেন আর বলেন যে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছিলুম আমরা । আমি বললুম যে আমার নাম অমিত । ওনাকে ঘিরে যে আদিবাসীরা ছিল, জিগ্যেস করল, আপকা বেটা ? বাবা মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু হারিয়ে-যাওয়া ছেলেকে দেখে একজন বাবার যেমন রিঅ্যাকশান এক্সপেক্ট করেছিলুম, তেমন প্রতিক্রিয়া হল না দেখে, মনটা খারাপ হয়ে গেল, ডিফিটেড ফিল করলুম রে ।
    অমিত : উনি বলতে লাগলেন, আমি কিন্তু মনে করি কিছুই ভুল করিনি । দেখছ তো অঞ্চলটা ? এখানে একজন শিশুকে লালন করা অসম্ভব । উনি তারপর মানসী মানসী বলে কয়েকবার ডাক দিতে আমার মা এলে, বাবা বললেন, একে চিনতে পারছ ? তোমার ছেলে । মা আমার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, আমিও মায়ের দিকে । উনি কোনো কথা না বলে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে, ব্যাস, জীবনে প্রথমবার নিজের গ্রোনআপ ছেলেকে দেখে, জড়িয়ে, কাঁদাবার কথা । উল্টে, আমারই কান্না পেয়ে গেল । মায়েরা জড়িয়ে ধরলে মগজের মধ্যে যে তুফান আরম্ভ হয় তা জানতে পারিনি কখনও । মা বললেন, তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছ, জবাবদিহি চাইতে, না? আমার কাছে দেবার মতো ব্যাখ্যা নেই । আমি জবাবে বলেছিলুম, আপনি আমাকে এভাবে অনেকক্ষণ জড়িয়ে থাকুন, তাহলে আমার কান্না পাবে না । ওনার হৃৎস্পন্দন যে দ্রুত হয়ে চলেছে, তা টের পেয়ে মনে হচ্ছিল যে যাক, জবাবদিহি পাওয়া গেল । দূরত্ব কিন্তু থেকেই গেছে রে ।
    অমিত : বাবা বললেন, মানসী, ডাক্তারসাহেবের কাছে নিয়ে যাও ওকে, দেখাও তোমার ছেলে কত বড় হয়ে গেছে । আমার দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন, অমিত, তুমি এখানেই থাকবে, আমাদের সঙ্গে কাজ করবে, আর ফিরে যাবার দরকার নেই ।
    অমিত : মা আমাকে অন্য একটা পলিথিনের তেরপলে নিয়ে গেলেন । সেখানে রোগা, পাকাচুল, চশমাপরা, ফর্সা একজন বসে টেবিলে কিছু লিখছিলেন, তাঁর সামনে দুজন আদিবাসী বসেছিল । মা তাঁকে বললেন, একে চিনতে পারছ ? এ আমার ছেলে । উনি এমনভাবে আমার ছেলে কথাটা বললেন যে বুঝতে পারলুম তার ভেতরে গোপন গর্ব লুকিয়ে আছে, আর কিছুটা ওই পাকাচুল লোকটার প্রতি অবজ্ঞা । লোকটা উঠে আমার মুখের কাছে মুখ এনে চশমা কপালে তুলে বলল, তুই কমরেড অতনুর ছেলে ? কী নাম রেখেছে তোর, অমিতই আছে তো ? ডাক্তারসাহেবের কথা শুনে আমার বেশ ভালো লাগল রে । বাবা-মা তুমি-তুমি করে কথা বলছিলেন, ইন ফ্যাক্ট আজও ওনারা আমার সঙ্গে তুমি-তুমি করে কথা বলেন, আর আমি ওনাদের আপনি-আপনি করে কথা বলি, কিছুতেই তুমি বেরোয় না মুখ থেকে । বুঝতে পারি যে ওনারা একটা অদৃশ্য পর্দা টাঙিয়ে আলাদা করে রেখেছেন আমাকে ।
    ইতু : আমি হলে দেখা হতেই বলতুম, মা, বাবা, তোমরা আমাকে অন্যের কোলে ফেলে দিয়ে আর কখনও ফিরে তাকাওনি কেন । তারপর কী হল ? ঘ্যাঙাচ্ছিস কেন, শিট, তাড়াতাড়ি বল ? তুই ওনাদের সঙ্গেই ছিলি এতকাল ? কী করতিস ? আমায় কবে নিয়ে যাবি ?
    অমিত : হ্যাঁ, থেকে গেলুম । ডাক্তারসাহেব কী করেন জানিস ? যে সব আদিবাসী ছেলেরা স্কুলে ক্লাস এইট-নাইন পর্যন্ত পড়েছে, তাদের ডাক্তারির প্রথমপাঠ পড়ান, অ্যান্টিবায়টিক দেয়া, কখন অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ওষুধ দিতে হবে, ইনজেকশান দেয়া, ওষুধের নাম, জখম হলে কী ভাবে পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে হবে, এইসব । গরিবদের জন্য, বিশেষ করে আদিবাসীদের জন্য কিলোমিটার-কিলোমিটার তো ডাক্তার পাওয়া যায় না। তাই হাতে-নাতে প্রাথমিক ডাক্তারি শিখে তারা গ্রামে-গ্রামে ডাক্তারি করে, বেয়ারফুট ডাক্তার ।
    ইতু : আর তোর বাবা-মা, ওনারা ওই জঙ্গলে কী করেন ?
    অমিত : বাবা ক্লাস নেন, আদিবাসী ছেলে-মেয়ে-জোয়ান সবায়ের । হিন্দি, ইংরেজি আর অঙ্ক শেখান । এছাড়া উনি রাজনীতি সম্পর্কে সহজ বিশ্লেষণ করে বোঝান কেন গরিবরা ষাট বছর পরও গরিব থেকে গেল ; তা থেকে মুক্তি পেতে গেলে কী করতে হবে, এইসব তত্ত্বকথা । ওনারা কিন্তু একই জায়গায় থাকেন না ; প্রায় রোজই পলিথিনের তাঁবু আর জিনিসপত্তর গুটিয়ে অন্য কোথাও তাঁবু খাটান । বন্দুকধারীরা পাহারা দ্যায়, কুচকাওয়াজ করে, বন্দুক চালাতে শেখে । অনেক লোক আছে, প্রথম দিন কোনো আইডিয়া হয়নি । একটু-একটু করে জানতে পারলুম ।
    ইতু : আর মা ?
    অমিত : মা যে ঠিক কী করেন জানি না । আমি তো বাবার তাঁবুতে শুই । মাঝে-মাঝে অলিভ রঙের পোশাকে বন্দুকধারী লোকজন আসে, তারা মায়ের সঙ্গে খুসুরফুসুর কথা বলে, তারপর চলে যায় । সাধারন পোশাকের বন্দুকধারীও দেখেছি আসতে । তখন ওনার ছাউনিতে ঢোকা নিষেধ । বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলুম যে লোকগুলো কারা, কেন আসে, উনি বলেছিলেন, সময় হলে জানতে পারবে, যদি বোধবুদ্ধি গড়ে ওঠে তাহলে তোমাকে ওই কাজগুলোই করতে হতে পারে যা তোমার মা এখন করছেন । আপাতত তুমি দেখতে থাকো আমি কী ভাবে পড়াই, কোন বই পড়ি ; তুমি সেই বইগুলো পড়ো । মাঝে-মাঝে আমিও অঙ্কের ক্লাস নিই, বাবা উপস্হিত থাকেন, আমাকে গাইড করেন । ব্যাস ওইটুকুই, উনি বাবার মতন বিহেভ করেন না । তত্ত্বফত্ত্ব যতটা বুঝেছি, সব ফালতু ।
    ইতু : হাঃ, তুই ক্লাস নিস, পড়াশুনায় লো সেকেন্ড ক্লাস ! যাকগে, পড়াচ্ছিস, পড়া । তুই তো বললি এই বয়সেও তোর মা অপরূপ সুন্দরী ?
    অমিত : হ্যাঁ, সত্যিই সুন্দরী ; চুল পাকলেই বা । আমি ওনাকে একদিন সাহস করে জিগ্যেস করেছিলুম যে, আপনি তো ডাক্তারসাহেবকে ডিভোর্স দিয়ে বাবাকে বিয়ে করলেই পারতেন, তাহলে আমাকে জন্মের গঞ্জনা শুনতে হতো না । উনি কী বললেন জানিস ?
    ইতু : কী ?
    অমিত : বললেন, আমি অতনুর এত কাছে চলে গিয়েছিলুম, এত ভালোবেসে ফেলেছিলুম যে বিয়ের প্রয়োজন ছিল না; অতনুও বাড়ি-চাকরি সবকিছু ছেড়ে আমার খোঁজে বেরিয়ে চলে এসেছিল আমার আস্তানায়, তখন আমি আর ডাক্তারসাহেব নওয়াদায় থাকতুম । বললেন, তুমি আমাদের প্রেম থেকে জন্মেছ, গতানুগতিক দৈহিক সম্পর্ক থেকে নয় । তোমার ছোটোবেলায় যদি আমাদের সঙ্গে তোমাকে রেখে মানুষ করতুম তাহলে আমরাও গতানুগতিক সম্পর্কের রুটিনে জড়িয়ে পড়তুম । দেশের জন্য, মানুষের জন্য, যে স্বপ্ন দেখি, তা দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠত ।
    ইতু : হোয়াট ডাজ শি মিন ? উনি একটা পোয়েটিক অ্যালিবাই খাড়া করে তোকে বুঝিয়ে দিলেন, আর তুই বুঝে গেলি ? রাবিশ । আমি তো তোর ফ্লেশকে আমার ফ্লেশ দিয়ে কারনিভোরের মতন ভালোবাসি । তুই যখন চলে গেলি তখন এমন হয়ে গিয়েছিল যে তোকে রাস্তায় পেলে সত্যি খুন করে ফেলতুম । একদম ভেঙে পড়েছিলুম ।
    অমিত : এখন সামলে নিয়েছিস তো ? আমার বাবাকে তোর কথা বলেছিলুম । উনি বলেছেন, তুই যেহেতু আমার বিশ্বাসের পাত্রী, আমাদের হয়ে কাজ করতে পারবি ।
    ইতু : কাজ ? না, না, আমি তোর সঙ্গে যেতে চাই, কাজ-ফাজ করার হয় ওখানে গিয়ে করব, তোর মাকে হেল্প করব, ডাক্তারি করব, আমি তো বেয়ারফুট ডাক্তারের চেয়ে বেশি কমপিট্যান্ট । আমি যে-কোনো অবস্হার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারি, তুই তা জানিস । আই জাস্ট ওয়ান্ট টু গেট আউট অফ দিস মিনিংলেস লাইফ।
    অমিত : মানুষের-সেবা, সমাজের-সেবা, গরিবদের সেবা, ওয়েলবিইং অফ ম্যানকাইন্ড, এইসব বক্তৃতা ঝাড়তিস, আর এখন শুধু আমার সঙ্গে যাবার বায়না করছিস । তুই যাবি, তবে এখনই নয় । এখন তুই বাবা-মার জন্য কিছু-কিছু কাজ করবি । সহজ, কিন্তু বিপজ্জনক কাজ । তোর ক্লিনিকে মাঝে-সাঝে একজন লোক সবুজ বা নীল টিশার্ট পরে খাম দিয়ে যাবে, তুই সেটা নিজের কাছে রাখবি, পরে ধূসর বা ছাইরঙের টিশার্ট পরা একজন লোক এসে ওটা কালেক্ট করে নেবে । এটা অত্যম্ত গোপন কাজ ; এ-বিষয়ে তুই কখনও কারোর সঙ্গে আলোচনা করবি না । ভেবে নে, চিন্তা করে বল । আবার বলছি, এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক । যদি ওৎ-পাতা পুলিশ তোকে ওই খামসুদ্দু ধরে তো কী যে হবে তা জানিস তো, মেয়েদের ধরে লকাপে যা-যা হয় ।
    ইতু : তোর জন্য সবকিছু করতে পারি । ধরেবেঁধে রেপও যদি ওরা করতে চায়, তো করবে । কিন্তু, দাঁড়া, স্তোক দিয়ে তুই কেটে পড়ছিস না তো ?
    অমিত : না । বি সিরিয়াস । এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । ইয়ার্কি হাসিঠাট্টার নয় ।
    ইতু : তাহলে বাড়ি চল । চান-টান করে খেয়ে-দেয়ে তারপর যাস । আমি স্কুটার কিনেছি, চল না একবার পুরো গান্ধি ময়দানের চক্কর মেরে গোলঘরের পেছন দিয়ে ঘুরে আসি ; তুই জড়িয়ে বসে থাকবি, আর আমি হ্যাপি ফিলিং নেবো । চল, চল ।
    অমিত : কী যে বলিস, এমনিতেই আমি ক্লান্ত । ওই বাড়িতে আমি আর ঢুকতে চাই না রে।
    ইতু : সুশান্তজেঠু অত অপমান সহ্য করে, হেনস্হা সহ্য করে, অবহেলা সহ্য করে আসেন । তোকে তো শুধু বলা হয়েছিল যে আমি তোর বোন, তুই যাদের ছেলে তারা নিজেদের মধ্যে বিয়ে করেনি । তোর তো একটা স্পেস আছে বাড়িটায় । এত তাড়াতাড়ি হেরে যাবি কেন ? বি পজেসিভ অ্যাণ্ড অ্যাগ্রেসিভ লাইক মি । বটঠাকুমা আর অন্নমা তো তোকে ভালোবাসেন । ওনারা দুজনে কাঁদছিলেন, যেদিন তুই বাড়ি ছেড়ে চুপচাপ কেটে পড়লি । চল, চল ।
    অমিত : ঠিক আছে, চল তাহলে, দেখি ওনাদের প্রতিক্রয়া, আমি তো জন্মেছি লাৎখোর হয়ে, অপমান-ফপমান সব মাথার ভেতর থেকে হাপিশ করে দিয়েছি ।
    ইতুর স্কুটারে বসে অমিত ওদের বাড়িতে পৌঁছলে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া তেমন হল না । বটঠাকুমা আর অন্নমা বুকে জড়িয়ে আদর করলেন অমিতকে । বললেন, যে যাই বলুক, যতদিন আমরা দুই বুড়ি বেঁচে আছি ততদিন তুই এই বাড়ির ছেলে । যা চান-টান করে আয়, ব্রেকফাস্ট করা হয়নি তো ?
    ইতু টয়লেটে টাওয়েল সাবান রেখে এসেছিল । সুশান্তজেঠুর মা টয়লেটে সুশান্তজেঠুর সযত্নে রাখা অতিপুরোনো পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি রেখে এলেন । স্নান করে আসার পর ডাইনিং টেবিলে অমিতকে ঘিরে বাড়িতে উপস্হিত সবাই ওর উধাও হয়ে যাবার গল্প শুনতে চাইছিলেন, হয়তো ওনাদের অভিনয় । রাঙামা লুচি ভেজে নিয়ে এলেন, সঙ্গে আগের দিন ইতুর রাঁধা আলু দিয়ে ডিমের ডালনা, আর আচার । অমিত ভাবল, একবার জিগ্যেস করে, ওর পোশাক-আশাক জামাকাপড়গুলো কী হল, যে সুশান্তজেঠুর কম বয়সের পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরতে হচ্ছে । আর কী-ই বা হবে, যাকগে, আমি তো আউটসাইডার, নিজেকে বলল ।
    --সত্যিই আমি ভবঘুরে সাংবাদিক হয়ে গেছি , ঘুরে বেড়াই, আজ এখানে, কাল সেখানে, কোনো নির্দিষ্ট জায়গা আর নেই । আমি কিন্তু আজকেই চলে যাব । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
    --আজ আর যেতে হবে না, কত দিন পরে হারিয়ে যাওয়া ছেলে বাড়ি ফিরল, বললেন বটঠাকুমা । এটা কি তোর বাড়ি নয় নাকি, বল, আমরা কি তোর পর ? আমাদের কোনো অসুবিধা নেই । সুশান্তর বাবা মারা যাবার পর ওনার ঘরটা তো পড়েই আছে, আমি আর ওই ঘরে শুতে পারি না, ইতু শোয়, বললেন সুশান্তজেঠুর মা।
    --হ্যাঁ, আমি এই বাড়ির মিউজিকাল চেয়ার । একজনের বিয়ে হয়, তার জন্য ঘর ছাড়তে হয়, আবার আরেকজনের বিয়ে বা বাচ্চা হয়, বা কারোর পরীক্ষা, ব্যাস, নির্দেশ আসে, ইতু এবার বারান্দায় শো, দালানে শো, রান্নাঘরে শো, ডাইনিং টেবিলের পাশে শো, সিঁড়ির তলায় শো । রাঁধুনি না এলে, এটা রাঁধ, সেটা রাঁধ। জমিয়ে রাখা ক্ষোভ চারিয়ে দেবার সুযোগ হাতছাড়া করল না ইতু ।
    --ওঃ, এই অবস্হায় আমি কেন আবার জমির লড়াইতে শরিক হই । অমিতের কথায় পরিবেশ ফিরল স্বাভাবিকতায় । বলল, বহুকাল বাড়িতে তৈরি লুচি আর ডিমের ডালনা খাইনি । দুপুরে আর লাঞ্চ করার দরকার হবে না । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
    --বাড়ির রান্না খাসনি বলছিস, দুপুরে মাছের ঝোল আর ভাতও তো খেতে হবে তাহলে । বলল ইতু, তারপর অমিতকে বলল, চল মাছের বাজারে যাওয়া যাক, তোর পছন্দের মাছ কেনা যাবে । লুঙ্গি পরেই চল, লজ্জা পাসনি, নেতারা পর্যন্ত লুঙ্গি পরে গান্ধি ময়দানে ভাষণ দিচ্ছে, মিছিলে হাঁটছে , অমিতের হাত ধরে চেয়ার থেকে টেনে তুলে বলল ইতু । বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ইতু বলল, বানচোদ, তুই এসেই যাই-যাই করছিস কেন বলতো ?
    সিঁড়ির পাশের স্লোপ দিয়ে স্কুটার নামাতে-নামাতে বাড়ির উল্টো দিকের গেটের দিকে মুখ তুলে ইতু বলল, মিশ্রাজির ছেলেটা অন্ধকার থাকতে সকাল পাঁচটা থেকে মারুতি গাড়ি রিভার্স করতে শেখে আর ঘুম ভাঙিয়ে দ্যায়, রিভার্স হর্নে ভোর থেকে একঘেয়ে সারে জাহাঁসে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা বাজায় ।
    একদিকে পা ঝুলিয়ে বসার কারণে ইতুর পেটে অমিতের জাপট কিছুটা নিকটতর হল । ইতু বলল, এই, নাভিতে সুড়সুড়ি দিসনি, ব্যালান্স গোলমাল হয়ে যাবে । অলরেডি তুই আমার জীবনের ব্যালান্স গোলমাল করে দিয়েছিস ।
    -- মাছের বাজার এসে গেছে, নাম আর বল কোন মাছ খেতে চাস । তখন প্রস্তাব দিয়েছিলুম যে শহরটা এক পাক ঘুরে নিই, রাজি হলি না, ফর হোয়াটএভার রিজনস ।
    --বলব আবার কি, ইলিশ পাওয়া গেলে ইলিশ কেন, খেয়ে নিই, কে জানে আবার কখনও খাওয়া হবে কিনা, ইলিশ কেমন দেখতে তা-ই তো ভুলে গেছি।
    ইলিশ কিনে, কাটিয়ে, স্কুটারে পা ঝুলিয়ে বসে, অমিত বলল ইতুকে, রাতটা থেকেই যাবো, বুঝলি । তোকে কিছু-কিছু দায়িত্ব দিয়ে যাবো ।
    --তোর নিজের দায়িত্বটাই দে না, এত ভিতু কেন তুই ? অমিতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল ইতু। গান গাইতে শিখিনি, নয়তো মন খুলে একখানা পেলব-পেলব ঢিললা-হিললা টাইপ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতুম । কোন গান জানিস ?
    --না, কী করে জানবো ? স্কুলের বন্ধুরা তো সব ছিল হিন্দি গান আর হিন্দি সিনেমার কীট । রাঙামা হিন্দি টিভি সিরিয়ালের পোকা । নবনীতাবৌদি গিটারে হিন্দি ফিলমের সুর বাজাতো ।
    --হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে…
    --শুনতে পাবে পাবলিক । মাছের বাজার মানেই বাঙালির জমায়েত ; অনেকে তোকে-আমাকে ভালোই চেনে ; হয়ত আমাদের রিলেশানশিপের খবরও ছড়িয়ে গিয়ে থাকতে পারে ।
    --বুলশিট, তুই এখনও আমাকে নেগলেক্ট করার ডিজাইন বজায় রেখেছিস কেন বল তো ? তোর দায়িত্ব চাইছি বলে ভয় পেয়ে গেলি নাকি, কাওয়ার্ড ?
    --ক্লাস টেন থেকেই তো কত ছেলে তোকে লাইন মারত, নিজেই ঢিল দিসনি, নয়তো দায়িত্ব পেয়ে যেতিস এতদিনে। স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করানোর লাইনে ভোর রাত থেকে দাঁড়িয়ে থাকতিস ।
    --স্টপ ইওর জিবারিশ । যত্তোসব ফালতু ছোকরার দল । তোর তো ক্লাস টেনেই গোঁফের রেখা আবছা বেরিয়ে এসেছিল, তবু তুই লাইন মারার সাহসটুকু দেখাতে পারিসনি । আমি না এগোলে তুই বোধহয় চেপেই রাখতিস নিজেকে ।
    --তখন বেশ ক্যাবলা ছিলুম রে, তোকে দেখলেই তোর বুকের দিকে চোখ চলে যেত, আড়ষ্ট ফিল করতুম, কথা বলতে পারতুম না, ভাবতুম কোন বিষয়ে কথা বলব । তাছাড়া, মগজে ঢুকে গিয়েছিল যে আমি তোদের বাড়ির চাকরের স্তরের । মালিকের মেয়েকে প্রণয়-প্রস্তাব কোন চাকরেই বা দ্যায় ? ওসব নাটক-নভেলে হয় ।
    --শাট আপ, ইউ সাকার..., গালাগাল এসে যাচ্ছে মুখে ।
    --কেমন বোকা-বোকা কথা বলছি না আমরা ?
    --হ্যাঁ, বর-বউ হতে পারত কিন্তু হল না, এরকম একজোড়া বোকা-বোকির গল্প ।
    রাতে, খাওয়া-দাওয়ার পর, ইতুকে বলল অমিত, ও একটা মিটিঙে , বিহারশরিফে, এসেছিল, বাবার সঙ্গে।
    --হোলি শিট, তোর বাবাও এসেছিলেন ?
    --হ্যাঁ । উনি তো মেশেন না কারোর সঙ্গে ।
    --দায়িত্বটা কী তা বললি না তো ? বিছানায় বসে জিগ্যেস করল ইতি ।
    --এতো ঘেঁষে বসিস না, আবার গোলমাল হবে শেষকালে ? ভাববেন, ছাড় দেয়া হয়েছে, ব্যাস, মাখামাখি করছে রাতদুপুরে ।
    --কারোর অমন মাথাব্যথা নেই; ওসব নিয়ে চিন্তা করিসনি । বরং তোর ঘাড়ে চেপে যদি কেটে পড়ি তো ওনারা বেঁচে যান । হয়তো ওনারা আমাকে এই স্পেসটা সেকারণেই ছেড়ে দিলেন । এখন দেখার যে তুই কীভাবে রেসপণ্ড করিস ।
    --এই তো সবে এতদিন পর দেখা হল, তুই বেশ ফ্রিলি গল্প করতে পারছিস , মনের কথা খুলে বলতে পারছিস । আগেই বলেছি, আমি যে কাজটা দেবো সেটা বেশ সিম্পল কিন্তু বিপজ্জনক । ভেবে উত্তর দিস । কাল সকালে আমার যাওয়া পর্যন্ত তোর হাতে সময় থাকবে ।
    --কী কাজ, শুনি, ঘোড়ার ডিম বিপজ্জনক । কাউকে বোমা মারতে বা গুলি মারতে বলবি নাকি ? কিংবা সোনার বিস্কুট এখান-ওখান । তা আমি পারব না, আগেই বলে রাখলুম ।
    --বলেছি তো, মনে করে রাখ । তোর ক্লিনিকে বা বাড়িতে সবুজ বা নীল শার্ট বা টিশার্ট পরা একজন একটা চিঠি দিয়ে যাবে, হয়ত স্মার্ট নয়, বিহারি বা বাঙালি না-ও হতে পারে সে, ইংরেজিতে একটা-দুটো কথা বলে চিঠিটা দিয়ে চলে যাবে । তুই তা নিজের কাছে রেখে দিবি । পরে, দু-এক সপ্তাহের ভেতর বা মাসখানেক পরেও হতে পারে, ওই খামটা আরেকজন নিতে আসবে, তার গায়ে ছাইরঙা বা ধূসর শার্ট বা টিশার্ট থাকবে ।
    --ওঃ, ডাকবাক্সের কাজ, পারব না কেন ? স্মাগলিং-টাগলিং নয়তো ? যেরকম দাড়ি-গোঁফ বাবরিচুল চেহারা করেছিস, দেখে তো স্মাগলার বলেই মনে করবে লোকে । লুঙ্গি পরে তোকে মানিয়েও গেছে ।
    --না, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের কাজ ।
    --তুই আসবি না ? তুইও তো আসবি, দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে, হলুদ টিশার্ট আর জিন্স পরে, স্মার্টলি । ফর মি ?
    --সিরিয়াস ইশ্যু ।
    --ওকে, টেকন । কিন্তু আমি কেবল তোর ওই প্রক্সিদের নিয়ে ডিল কোরবো নাকি ? তুই যদি না আসিস তাহলে কেন বেগার খাটতে যাবো উটকো লোকেদের জন্য ?
    --তা-ই কর কিছুদিন । কিন্তু আবার বলছি, অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ । ওই খামসুদ্দু তুই ধরা পড়লে যে ধরণের ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বি তা মোটেই সুখকর নয় ।
    ইতু নিঃশব্দে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলল, অমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে । তারপর অমিতের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, দায়িত্ব নিলুম, কিন্তু এক শর্তে, ন’মাসে-ছ’মাসে তোকেও আসতে হবে । ইউ মাস্ট, আদারওয়াইজ দি ডিল ইজ ক্যানসেল্ড ।
    অমিত আবার এসেছিল, প্রায় এক বছর পরে, ক্লিনিকে, বিনা দাড়ি-গোঁফে, হলুদ টিশার্ট আর জিনস পরে, চোখে রোদ চশমা । তার মাঝে নীল-টিশার্ট ধূসর-টিশার্ট যুবকেরা ক্লিনিকে খাম দিয়ে গেছে আর নিয়ে গেছে, বেশ কয়েকবার । ইতুর কি খাম খুলে দেখতে ইচ্ছে হয়নি কী আছে ভেতরে ? হয়েছে । কিন্তু সেলোটেপে মোড়া চিঠি খোলেনি । নিজেকে বুঝিয়েছে যে অমিতকে জানতে হলে ওর মুখোমুখি বসেই জানতে হবে, গোপন কাজকর্ম, তা যাই হোক, স্মাগলিং বা লুকিয়ে বেড়ানো বিপ্লব, না সিক্রেটিভ কোনো ধার্মিক কাল্ট, কথা বলে জেনে নিতে হবে ।
    অমিতের চেহারা বেশ রোদঝামা হয়ে গেছে, স্মার্ট পোশাক সত্বেও, আঁচ করল, ইতির মগজের ডাক্তার । অমিত ক্লিনিকে ঢুকে চেয়ারে বসে স্মিত হাসি ফোটাবার চেষ্টা করলে, ইতি বলল, প্রায় শিশুর আদুরেপনা মিশিয়ে, তোর একটা খাম পড়ে আছে, কেউ নিতে আসেনি তো ?
    --খাম, কই দেখা, বিস্ময়ে বলল অমিত ।
    --এই যে, দ্যাখ, পড়ে আছে সেই কবে থেকে ।
    -- কই দে তো, দেখি ।
    টেবিলের ওপর চারভাঁজ করা প্রেসকিপশানের কাগজে, দেখল অমিত, লেখা রয়েছে, ‘যদি বিপদ শেয়ার করি, তাহলে বেডশিট শেয়ার করব না কেন’ ? ইতি বলল, তারিখ দেখেছিস, ছয় মাস আগের । কত এক্সপেক্ট করেছি তোকে । ইন ফ্যাক্ট আমার এই ক্লিনিক চলে না, রোগি আসে মাসে হয়ত দুজন, কখনও আসেই না, তবু খুলে রেখেছি, স্রেফ তুই একদিন হঠাৎ আসবি বলে । আজ থেকে ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেল । চল , বাড়ি চল, বাড়িতেও সবাই বলে যে কেন মাছি মারছিস বসে-বসে, ভাড়া গুনছিস, বাবার দেয়া জমানো টাকা নষ্ট করছিস। তারপর, প্রায় কান্নামাখা কন্ঠস্বরে বলল, কী করে ওনাদের বলতুম যে আমি তোর অপেক্ষায় বোকার মতন হাঁ করে বসে থাকি ।
    অমিত থ । অনুমান করতে পারেনি যে রহস্যময় খামগুলোর মাধ্যমে নৈকট্যকে বিপজ্জনক করে ফেলেছে। কাগজের লেখাটার দিকে তাকিয়ে, চুপ করে রইল । বলল, যে ভালোবাসার কথা বলছিস, তা আমি যে জীবন কাটাই, তাতে কতটা প্রযোজ্য, তা যারা এই জীবন যাপন করে কেবল তারাই বুঝতে পারবে । আমি তো ভবঘুরে, বলেইছিলুম তোকে । তোকে তো বলেছি কী ধরণের লাইফ লিড করছি । বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেও তাঁদের সঙ্গে নেই, তাঁরা আমার কেউ নন । এখন মনে হয় আত্মপরিচয়ের সন্ধানে তাঁদের খোঁজে বেরোনোটাই ছিল ব্লাণ্ডার ।
    ইতি ক্লিনিকের চাবি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল, বলল, চল, চল, যেতে যেতে কথা বলা যাবে । ক্লিনিক আমি বন্ধ করে দিচ্ছি আজ থেকে, তোর এই মোবাইল ডাকবাক্সে বার্তা ফেলতে হলে মেসেঞ্জারদের আমার বাড়ি আসতে হবে । ইতুর কব্জি শক্ত করে ধরে অমিত বলল, তোর নির্দেশমতো যে পোশাক পরে এলুম সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করলি না ।
    --তুই তাহলে শুনতে পাসনি ; চোখ দিয়ে করা মন্তব্য শোনার মতন ইন্দ্রিয় হারিয়ে ফেলেছিস । বোতাম খুলে তোর বুকের চুলও দেখাচ্ছিস, তোর বুকে যে চুল গজিয়েছে কী করে জানব । তা জানার জন্যও তো করাঘাতের অধিকার দরকার, নয়কি, বিপদ শেয়ার করার অধিকার থেকে সামান্য পৃথক অধিকার ?
    --তোদের বাড়িতে চড়ুইপাখির বাসা আছে, মনে আছে, দালানের কড়িকাঠের ফাঁকে ? কখনও লক্ষ করেছিস কি যে মাদি চড়ুইপাখিকে ইমপ্রেস করার জন্য পুরুষ চড়ুইপাখিরা তাদের কালো বুক দেখাবার প্রতিযোগীতা করে ?
    ক্লিনিকের শাটার নামিয়ে, তালা দিয়ে, ফুটপাতে নেমে, অমিতের দিকে তাকিয়ে ইতু বলেছিল, ঠিক কী বলতে চাইছিস বুঝতে পারলুম না । তুই কি বলতে চাইছিস যে তোর হৃদয় উনিশ শতকের গৌরবগাথায় বর্ণিত মসীলিপ্ত ভিলেনের মতন হয়ে গেছে ? নাকি বলতে চাইছিস যে তুই মাদি চড়ুইপাখিটাকে জয় করতে এসেছিস ? ভুলে যাচ্ছিস কেন যে মাদি চড়ুইপাখিটাই তোকে জয় করার জন্য যুদ্ধ করেছিল । ওহ, ইনটলারেবল, জাস্ট ইনটলারেবল ।
    --না সত্যিই অনুমান করতে পারিনি । না, অনুভব করতে পারিনি বললে যুৎসই হয় ।
    --বাঃ, আমার কথামতন পোশাক পরে এক বছর পর উদয় হলি, আর অনুভব করতে পারিসনি, ইউ সেল্ফসার্ভিং জোকার ? নিজেকে ভুল বুঝিয়েই কি তুই তোর রহস্যময় জীবনকে মিনিংফুল করে তুলতে চাইছিস?
    তারপর যোগ করল, স্কুটারটা বেচে দিয়েছি । ভাড়া গোনার জন্য টাকার দরকার ছিল । বলল ইতু, ফুটপাতে পড়ে-থাকা শালপাতার দিকে তাকিয়ে ।
    একটা রিকশাকে হাত দেখিয়ে থামতে বলল অমিত । ইতু বলল, রিকশা ডাকছিস কেন, হাঁট না পাশাপাশি । চল গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি, কতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাইনি । গিয়ে বসি কিছুক্ষণ । কিছু কথা স্পষ্ট করে নে্য়া দরকার, বাড়িতে গেলে দোতলার বারান্দায় বসে গল্প করতে হবে । প্রিভেসি নেই ।
    --বিশ্ববিদ্যালয় ? গঙ্গার ধারের কথা ভাবছিস ? কিন্তু গঙ্গা তো দূরে সরে গেছে, সরকার ভাবছে গঙ্গার ধার দিয়ে মেরিন ড্রাইভের মতন পথ বানাবে । তুই তোর শহরে থেকেও জানিস না, দ্যাখ, আমি বাইরে-বাইরে থাকি, থাকি বলা ভুল হল, অ্যাকচুয়ালি থাকিই না কোথাও, তবু জানি শহরের কথা ।
    --ও, তুই তাহলে শহরে আসিস, আর দেখা না করে কেটে পড়িস ? আর ইউ চিটিং অন মি ?
    --না, শহরে আজকেই এলুম, সেদিনকার পর, এবারেও বাবার সঙ্গে নালান্দাতেই এসেছিলুম, এর-তার মুখে শহরের পরিবর্তনের কথা শুনতে পাই । তোর সঙ্গে দেখা করব বলেই এলুম পাটনায় । এত কাছে এসে ফিরে যেতে পারলুম না । মনের ভেতরের ব্ল্যাংক স্পেসটায় তুই ক্রমশ জায়গা করে নিয়েছিস, বাবা-মায়ের সঙ্গে তো এখনও আপনি থেকে তুমিতে যেতে পারিনি ; ওনারাও তুমি থেকে তুইতে আসতে চাননি । শুধু তুই-ই একমাত্র যে আমার কাছে একই সঙ্গে তুমি আর তুই । কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অমিত বলল, চল ওই অমলতাস গাছটার তলায় বসি, রাস্তার দিকে পেছন ফিরে বসা যাবে ।
    --কেন ? আমার সঙ্গে বসে আছিস তা কেউ দেখে ফেলতে পারে ?
    --তুই আমার সঙ্গে বসে আছিস তা কেউ দেখে ফেলতে পারে, তোর সঙ্গে আমি নয় ।
    অমলতাসের হলুদ ফুলের পাপড়ি ছড়ানো চারিদিকে । সিটের ওপর পাখিতে হেগে রেখেছে । তার ওপরই বসল দুজনে । অমিত জিগ্যেস করল, কী বলবি বল ?
    অতনুর হাত নিজের কোলে নিয়ে ইতু বলল, আমি সেল্ফ ডেসট্রয় করার জন্য ডেসপারেট হয়ে গেছি । জীবন সম্পর্কে তিতিবিরক্ত । জানি না কী করব । এনজিও জয়েন করার কথা ভাবি । কোনো পারপাস নেই জীবনে । এর চেয়ে কমার্স পড়লে টাকাকড়ির গুণ ভাগ যোগ বিয়োগ নিয়ে থাকতে পারতুম । বাবা-মা মারা যাবার পর আমি রাডারলেস হয়ে গেছি, কোনো নোঙর নেই । ওনাদের ইনশিওরেন্সের টাকাটা এখনও পেলুম না।
    অমিতের হাত নিজের ঠোঁটের ওপর চেপে ধরেছিল ইতু, ছাড়িয়ে অমিত বলল, চল, তোর ক্লিনিক আরেকবার খুলতে হবে । পাটনা শহরের পথে, অমলতাস গাছের তলায়, এভাবে কাছ-ঘেঁষটে বসে থাকার চেয়ে তোর ক্লিনিকের নিভৃতি ভালো ।
    --হ্যাঁ, আমাদের বাড়ির দোতলার বারান্দার চেয়ে তো অবশ্যই ভালো। আসলে আমার কথাগুলো কী ভাবে তোকে বলব, কোথায় গিয়ে বলব, তোকে দেখামাত্র যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তাতে শাটার নামিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলুম । চল, ক্লিনিকেই যাই ।
    রিকশা থেকে নেমে, ক্লিনিকের তালা খুলে শাটার ওঠাতে সাহায্য করল অতনু, বলল, বেশ ভারি তো, রোজই এভাবে খুলিস আর বন্ধ করিস, বলে, শাটারটা নামিয়ে দিল অমিত । নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসে ইতু বলল, এবার বল, যা জানতে চাইছি তা বল, কেউ নেই এখানে, কেউ তোর পেছু নেয়নি, রাস্তা একেবারে ফাঁকা ছিল ।
    --আমি রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতি করি । তোকে তাতে ব্যবহার করি ।
    --তাতে কী হয়েছে ! রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতি তো আজকাল সবাই করছে, কে করছে না শুনি ? রাষ্ট্রবিরোধী-ফিরোধি বলে কিছু হয় না । দুশ্চিন্তার কী আছে ? সরকার যারা চালায় তাদের কুকর্ম দেখে, আর ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের স্ক্যাম প্রতিদিন কাগজে পড়ে, সব পাবলিকই মনে-মনে রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে পড়েছে । ধর্ষক, খুনি, ডাকাত সকলেই তো দিল্লির তখত-এ-তাউসে পৌঁছোচ্ছে । এই তো সেদিন মহাত্মা গান্ধির নাতি গোপালকৃষ্ণ গান্ধি দিল্লিতে ওনার বক্তৃতায় বলেছেন যে রিলায়েন্স কোম্পানি এত বেশি ক্ষমতা রাখে যে ভারতে তারা একটা সমান্তরাল রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়িয়েছে । তবে ? তুই ভাবছিস বোধহয় আমি কোনো খবরই রাখি না । সারাদিন ক্লিনিকে বসে কী করি ? পাশের কাপড়ের দোকানটা থেকে হিন্দি আর ইংরেজি কাগজ তিনটে এনে সারাদিন পড়ি ।
    --বাবা-মা যে রাজনীতি করেন, তা-ই করি ।
    --জানি, অতটা বোঝার মতো জ্ঞান আছে আমার । প্রশ্ন হল, আমি কি এখানে একা পড়ে থাকব, তোর ডাকবাক্স হয়ে ?
    --আমি তো কোনো নির্ণয় নিতে পারি না, আই অ্যাম জাস্ট এ ওয়ার্কার, ওনারা যে নির্ণয় নিয়েছেন, সেই অনুযায়ী তুই ভালোই কাজ করছিস । তাছাড়া, কোনো বিষয়ে কথা বলার কোনো ক্ষমতাই নেই আমার । নেতারা কয়েকজন মিলে নির্ণয় নেন, তাঁরা যে কারা তাও আমি জানি না । তবে, শুনেছি, তাঁদের দুজন তোকে যাচাই করে গেছেন । তুই আমার জন্য নয়, তাঁদের জন্য ডাকবাক্সের কাজ করছিলিস। রোগি সেজে তোর অলটারনেটিভ মেডিসিনের ক্লিনিকও তাঁরা দেখে গেছেন ; তোর মতন ডাক্তারই ওনাদের প্রয়োজন, কেননা তুই আসেপাশে যা পাওয়া যায় তাই প্রয়োগ করে উপশম ঘটাবার চিকিৎসাবিদ্যা আয়ত্ত করেছিস, এম বি বি এসও এক বছর পড়েছিলি ।
    --তাহলে কবে তুই আমাকে তোদের সঙ্গে নিবি, আই ওয়ান্ট এ ক্লিয়ার আনসার, নো মোর ডিলিড্যালিং ? ক্লিনিকটা আমাকে বন্ধ করতেই হবে, কেননা বাড়ি থেকে কোনো সাহায্য পাই না, ভাড়া দিই বাবা যে টাকা আমার ভাগ্যে বরাদ্দ করে গেছেন তা থেকে, ফিক্সড ডিপোজিট ফুরিয়ে গেছে, তাই স্কুটারটা বিক্রি করতে হল । ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, আই ওয়ান্ট টু গেট আউট অফ দিস রাট, আমার বডি একটু-একটু করে শবের আদল পাচ্ছে ।
    রিভলভিং চেয়ারের কাছে গিয়ে মুখ নামিয়ে ইতুর চোখে চোখ রেখে, অমিত বলল, আমি কি তোকে চুমু খাবো ?
    ইতু কেঁদে ফেলেছিল, বলল, চড়ুইপাখি তো কালো বুক দেখিয়ে জিতে গেছে । অমিতের অনুমতির অপেক্ষা না করে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে অতনুর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল ইতু, কয়েক সেকেন্ড পর তুলে নিয়ে, রিভলভিং চেয়ারে বসে, ফুঁপিয়ে কাঁদা আরম্ভ করল । বলল, কেঁদে নিই, অনেক দিনের কান্না জমে আছে । কান্না থামার পর সামলে নিয়ে বলল, চল বাড়ি যাই, অন্নমা, মানে সুশান্তজেঠুর মা, তোকে দেখে খুশি হবেন । সুশান্তজেঠু ওনার ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন, তারপর থেকে অত্যন্ত ভেঙে পড়েছেন ।
    --তাহলে না যাওয়াই ভালো । সুশান্তজেঠুর অভাব আমাকে দিয়ে মিটবে না। বরং ঘায়ে খোঁচা লেগে আঘাত বেড়ে যাবে । তোদের বাড়ির সবাই শুরুতেই মানিয়ে নিলে অবস্হা এতটা নিরাশাজনক হতো না । সুশান্তজেঠু আর ওনার বউ-ছেলেকে অ্যাকসেপ্ট না করার তো কারণ ছিল না । তোর বাড়ির লোকেরা তো আর ক্রিমিনাল গ্যাঙটাকে নেমন্তন্ন করে আনছিল না ।
    --না, সুশান্তজেঠু নাকি ওদের ক্রিমিনাল দলের ডন হয়ে গিয়েছেন, ওনার শশুর নিজের নেতৃত্ব সুশান্তজেঠুর হাতে দিয়ে দিয়েছে।
    --হ্যাঃ, ওসব তো তোরা এর-তার মুখে শুনেছিস । তোদের বাড়ি থেকে কেউ কি গিয়েছিল একবার ? গিয়ে দেখতে কে বারণ করেছিল ? ওরা তো তোদের বাড়ির কাউকে খুন বা কিডন্যাপ করত না । যা করার তা তো করেই ফেলেছিল ওরা, সুশান্তজেঠুর সঙ্গে ওদের গ্যাঙ লিডারের মেয়ের বিয়ে দিয়ে । সম্বন্ধটা শুধরে নিলে সকলেরই মঙ্গল হতো ।
    --কত রেসপনসিবলি কথা বলছিস রে, ইউ হ্যাভ রিয়্যালি গ্রোন আপ উইথ ইওর চেস্ট হেয়ার । চল না সুশান্তজেঠুর আস্তানায় ট্রিপ মারি ।
    --যাবো । সময় হলে যাবো । এবার আমি যাই ।
    --এক্ষুনি ?
    --হ্যাঁ, আবার তো আসব ।
    --ক্লিনিক কিন্তু বন্ধ করে দিচ্ছি । তোর মেসেঞ্জাররা কি আমাদের বাড়ি চিনে নিতে পারবে ? আমাকে চিনতে পারবে ? কয়েকবার তো নতুন মেসেঞ্জার দেখেছি ।
    --তারা সব কিছুই পারে ।
    --তাহলে পুরোটা কেঁদে নিতে দে, বলে, সান্নিধ্যের সঙ্কোচ কাটিয়ে, অমিতকে জড়িয়ে ধরেছিল ইতু । কান্না শেষ হলে চোখ পুঁছে বলেছিল, চড়ুইপাখিরা বসন্তঋতুতে একশকুড়িবার প্রেম করে, তা জানিস ?
    --না, জানা ছিল না ; তবে, সিংহের কেশর কখন বাদামি থেকে কালো হয়ে ওঠে তা জানি ।
    --হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস । পরের বার যখন আসবি তখন কাঁধের ওপর অদৃশ্য কালো কেশর নিয়ে আসিস, মনে থাকে যেন । জাস্ট টু রিমাইণ্ড ইউ, সিংহিগন্ধের ঋতুতে সিংহরা দিনভর পনেরো মিনিট অন্তর প্রেম করে ।

    শেষ
    মোবাইলে বড়জেঠিকে রিং দিয়ে সুশান্ত ঘোষ শুনতে পেলেন ওনার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর, সুশান্ত...সুশান্ত...কাল থেকে তোকে রিং দিচ্ছি...কতবার চেষ্টা করছি...সুইচ অফ আসছিল….তুই কোথায়...অপু কোথায়...কাগজে খবর পড়ে অব্দি ঘুমোতে পারিনি...খেতে বসে রুচি হল না...শুনছিস তো…সাড়া দিচ্ছিস না কেন...সুশান্ত… অপুকে পাঠিয়ে দে...আমি ওকে আমার ঘরে লুকিয়ে রাখব...সুশান্ত শুনতে পাচ্ছিস...কথা বলছিস না কেন...আমার কথা শোন...তুই চলে আয়...বউকেও নিয়ে আয়...আবার সব আগের মতন ঠিক হয়ে যাবে...তিনজনেই চলে আয়...পুলিশ তোদের এখানে খুঁজবে না...পুলিশ জানে তুই ত্যাজ্যপুত্র...শুনতে পাচ্ছিস ? উদ্বেগ উৎকন্ঠা ক্রমে ফোঁপানি এবং ফোঁপানি ক্রমে কান্নায় রূপান্তরিত হলে, সুশান্ত ঘোষ বললেন, এই নাও, শোনো ।
    লুঙ্গিতে গোঁজা সেমিঅটোমেটিক পিস্তলটা বের করে একটা গুলি ওপর দিকে চালিয়ে পরখ করলেন কাজ করছে কিনা । গুড, করছে ।
    শোকার্ত আতঙ্কিত বেবি, দড়ির খাটে, রাতের পর রাত ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি-মাখা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে, পাশ ফিরে শুয়ে, চাপা ফোঁপানি ছড়িয়ে দিচ্ছিল শরীর জুড়ে, খাটের শিয়র থেকে দীর্ঘ এলোচুল নামিয়ে, কী হল, কী হল, বলতে-বলতে খাট থেকে নেমে, ওনার, সুশান্ত ঘোষের দিকে ছুটে এলে, বেবিকে লক্ষ করে পর-পর দুটো গুলি চালালেন, বুকে আর মাথায় ।
    তারিণী মণ্ডলের মতনই, বেবির খুলি ফেটে দুধে-আলতা মগজ ছিৎরে পড়ল । মুখ থুবড়ে পড়ে গেল বেবি, প্রতিদিন শাম্পু-করা সুগন্ধিত চুল উড়িয়ে ।
    দেহরক্ষীরা, যারা সুশান্ত ঘোষের পাহারায় চ্যাঁচারির বেড়ার বাইরে আর নৌকোয় বন্দুক হাতে বসেছিল, তারাও কী হল, কী হল, কারা ফায়ার করছে, বলতে-বলতে চালাঘরের দিকে দৌড়োল ।
    সেমিঅটোম্যাটিক পিস্তলের নল নিজের ডান কানের ওপর করোটিতে চেপে , তাকিয়ে দেখলেন বালির ওপড় পড়ে-থাকা তাঁর এত বছরের সঙ্গিনী, তারিণী মণ্ডলের মেয়ে বেবির মৃতদেহের দিকে, তারপর ট্রিগার টিপলেন সুশান্ত ঘোষ ।
    বালিতে ছিটকে পড়ে-যাওয়া মোবাইলে বড়জেঠির কান্না-মেশানো কন্ঠস্বর আতঙ্কিত আর্তনাদে বলে চলেছে, গুলির আওয়াজ কেন...কী হচ্ছে ওখানে...সাড়া দিচ্ছিস না কেন...সুশান্ত..শুনতে পাচ্ছিস...গুলিগোলা চলছে কেন...কথা বলছিস না কেন...ঠিক আছিস তো...তোর ছেলে কোথায়...সুশান্ত...সুশান্ত...বলছি তো অপুকে পাঠিয়ে দে...তোর বউকে নিয়ে চলে আয়...সুশান্ত...সুশান্ত…
    মোবাইলটা উচ্চকন্ঠে কাঁদা আরম্ভ করল উড়ন্ত বালির সদালাপী হাওয়ায়, ঝিরি-ঝিরি রঙ্গপ্রিয় বালির অবাক হাসিখুশি দিয়ে হয়তো ক্রমে ঢাকা পড়ে যাবে আজ রাতের অমনোযোগী অন্ধকারে । বর্ষায় দিয়ারার সঙ্গেই হয়তো চলে যাবে জলের তলায় শেষ কান্নার বর্ষীয়ান স্মৃতি নিয়ে, তারপর একদিন চিকচিকে বসন্তে মাথাচাড়া দেয়া নতুন চরের পলিমাটির ওপর বোবা জেগে উঠবে কোথাও, খুরপি দিয়ে কেয়ারি-করা পলতালতা বা তরমুজলতার হলুদ ফুলের আড়ালে ।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 012312.60.5634.239 | ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:১৪541366
  • চশমরঙ্গ
    বাইলাইন : অ্যাকাডেমি অফ দি পারফরমিং ফ্লেশ
    মলয় রায়চৌধুরী
    নগেন দত্ত নিজের মগজের ভেতরের গোলাপি অন্ধকারকে বলছিলেন, আমি তো একজন সাধারণ ল্যাওড়াকান্তি মানুষ মাত্র, তবে কেন সবাই আমাকে প্রতিভাধর বলে, চেনা কিশোররা প্রতিভাধারী নগেন বলে পঞ্চাশ একশো দেড়শো বছর আগে ক্ষ্যাপাতো, এখনও ক্ষ্যাপায়, এখন, যখন তাঁর বয়স চব্বিশ পেরিয়ে সবে পঁচিশ ; প্রায় তিরিশ বছর আটকে ছিলেন চব্বিশতম বয়সে, তাঁর দাদামশায়ের ফারসি ভাষায় লেখা উইলে সেরকমই নির্দেশ ছিল, কত বছর বয়সে কোন বয়সে কতোকালের জন্যে আটকে থাকতে হবে, নগেন দত্ত তা মেনে চলেছেন !
    ওনার, দাদামশায়ের, যিনি ছিলেন ছয় ফিট লম্বা, চওড়া কপাল, কাঁধ পর্যন্ত চুল, জোড়াভুরু, সিক্সপ্যাক অ্যাব, যদিও সময়ের প্রথা অস্বীকার করে একটিই বিয়ে করেছিলেন, উইলে ‘কী করিতে পারিবে’ আর কী করিতে পারিবে না’, তার দুটি তালিকা আছে, ‘কী করিতে পারিবে না’ তালিকার কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন নগেন দত্ত যে তিনি তা সত্যিই পারেননি, যেমন একবার এক কুকুরীকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন যখন তাঁর সজীব বয়স উত্তাল নয় বছরে আটকে ছিল ।
    যারা ওনাকে, মানে নগেন দত্তকে, প্রতিভাধারী বলে ক্ষ্যাপায়, তাদের উনি ইচ্ছে করলেই উন্মাদ করে দিতে পারেন, স্রেফ লম্পটের শিস দিয়ে, করেন না, কেননা জিনিয়াসগিরি হল দানবিক আর দৈব প্রাপ্তির মিশেল, সকলের জীবনে জোটে না ।
    নগেন দত্ত, ছটফটে তারুণ্যের অনিশ্চয়তায় যখন প্রেসিডেন্সি কালেজে পড়তেন, হেনরি মেইনে ছিলেন ভাইস চ্যান্সেলার, সহপাঠী নবীনচন্দ্র সেন, যিনি তাঁর সঙ্গেই ১৮৬৫ সালে এফ এ পাশ করেছিলেন, তাঁকে বলতেন, ‘তোমার মাথায় কীট প্রবেশ করিয়াছে, সত্বর বৈদ্যের নিকট যাও।’
    নগেন দত্ত উত্তরে বলেছিলেন, ‘মাথায় কীট আছে বলেই আমি নগেন দত্ত, নয়তো বাংলার নাগরিক আমায় নুনুযুবক বলে চিনতো ।’
    তখনও নুড়িপূজক আর কাটানেড়েরা মারামারি কাটাকাটি করে আলাদা হয়নি, একই জালে ধরা দুই সের ওজনের ইলিশ খেতো, একই খেতের ধানের পান্তা-ভাত খেতো, একই বানভাসিতে ডুবে পচে ভেসে উঠতো হাত ধরাধরি করে সুন্দরবনের মোহনায়, তারপর হারিয়ে যেতো, একই দুর্ভিক্ষে কেঁদেকেটে ‘একটু ফ্যান দাও গো মা’ বলে গেরস্তের দোরে কঙ্কালসার পরিবার নিয়ে হাজিরা দিতো, একই মড়কে রাস্তায় মরে পড়ে থাকতো, যার ওপর একই নীল মাছি ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গাইতে গাইতে মরে যেতো ।
    নিজের জীবনীতে নগেন দত্ত সম্পর্কে লিখেছিলেন নবীনচন্দ্র সেন, যদিও পাণ্ডুলিপির সেই পৃষ্ঠা হারিয়ে গিয়েছিল হাতে সাজানো সীসার অক্ষরের ছাপাখানা থেকে, নবীনচন্দ্র সেনের সন্দেহ ছিল যে এই কুকীর্তি স্বয়ং নগেন দত্তের, উনি অমরত্ব নিজে চান না, অন্যদের বিলিয়ে থাকেন।
    নবীনচন্দ্র সেন লিখেছিলেন যে, “নগেন দত্ত নামের তরুণটি লুডউইগ বিঠোফেনের সি শার্প মাইনরে বাজানো চোদ্দো নম্বর পিয়ানো সোনাটা শুনিলে উন্মাদের ন্যায় আচরণ করিতেন, তখন তাঁহাকে সামলাইবার জন্য তিরিশ হাজারিনীর দেশে লইয়া যাইতে হইত।”
    তিরিশ হাজারিনীর দেশে কেবল বুদ্ধিমান আর সাহসী পুরুষরাই যাতায়াত করে ।
    তিনি, নগেন দত্ত, কখনও কদমছাঁট, কখনও ব্যাকব্রাশ তেলচুকচুক, কখনও বাবরিছাঁট, কখনও পিগটেল নুটি, আকাশে বসন্তকালের কালবৈশাখির হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কালো মেঘ আর আওয়াজহীন মেয়াদি বিদ্দ্যুচমক সত্ত্বেও, কোনো বাড়িতে চেনবাঁধা নেড়ি-কুকুরের অনুনয়ী ডাক শুনতে-শুনতে, বৃষ্টির আগের রাশ-টানা শীৎশিতে হাওয়া মুখে মেখে, মনে করার চেষ্টা করছিলেন, দেড়-দুশো বছর আগের আকুলি-বিকুলি ঘটনা, বা তারও আগের হতে পারে, ঝোড়ো ঝড় এড়িয়ে আলোকপ্রাপ্তির জন্যে নৌকো থেকে নেমে তিরিশ হাজারিনীর দেশে যখন এসেছিলেন উনি, মাত্র কয়েকটা পাকা দোতলা বাড়ি ছিল, জমিদারি আয়েসের হাঁসজারু স্হাপত্যের বাড়ি, এলাকাটা তখন এরকম বহুযোনিক ছিল না, পাড়া নামের বিদকুটে ব্যারিকেড অঞ্চল হয়নি বলে, আজ কালো টয়োটা এটিওস সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে পার্ক করে, হঠাৎ লোডশেডিঙের নানাবিধ অন্ধকার হাতড়িয়ে, মুঠোয়ধরা মোবাইলে দেড়-দুশো বছর আগে রেকর্ড করা, জিপিএস পথনির্দেশ দেখতে-দেখতে, আর ইয়ার ফোনে তা শুনতে-শুনতে, এগোচ্ছিলেন, রেকর্ড করা কন্ঠস্বর ওনার নিজের, অথচ যাকে কালেজের শিক্ষকরা মনে করেন তা এক ডেপুটি ম্যাজিসট্রেটের ।
    তখনকার, যখন লোকে তাঁকে, তিনি সাধারণ মানুষ নন বলে, প্রতিভাধর কিংবা অতিমানুষ আখ্যা দিতো, সেইসব অচেনা-আধাচেনা মানুষের কথাগুলো শুনে, নগেন দত্ত নিজের মগজের ভেতরের গোলাপি অন্ধকারে, প্রতিক্রিয়ায় বলে ওঠতেন, “যতো সব অ্যাঁড়গ্যাঁজানে পেঁচো মালের গুষ্টি।”
    তিরিশ হাজারিনীর দেশের পথে, তিল ধারণের জায়গা নেই এমন জমাট অন্ধকারে, ওনার কথাগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো ওনার কাছে, তা শুনে টের পেলেন, কেউ উনোনে চাপানো কড়াইতে সর্ষের গরম তেলে হিঙের ফোড়ন দিলো, হয়তো ধোকার ডালনা বানাবে, যেমন ওনার স্ত্রী সূর্যমুখী, আশি বছর আগে কচিসবুজ তুঁতে-বিষ খেয়ে আত্মহত্যার আগে রাঁধতো ।
    হেডফোনে যা উনি শুনছিলেন :
    “আকাশে মেঘাড়ম্বরকারণ রাত্রি প্রদোষকালেই ঘনান্ধতমোময়ী হইল । গ্রাম, গৃহ, প্রান্তর, পথ, নদী, কিছুই লক্ষ্য হয় না । কেবল বনবিটপী সকল, সহস্র সহস্র খদ্যোতমালাপরিমণ্ডিত হইয়া হীরকখচিত কৃত্রিম বৃক্ষের ন্যায় শোভা পাইতেছিল । কেবলমাত্র গর্জনবিরত শ্বেতকৃষ্ণাভ মেঘমালার মধ্যে হ্রস্বদীপ্তি সৌদামিনি মধ্যে মধ্যে চমকিতেছিল --- স্ত্রীলোকের ক্রোধ একেবারে হ্রাসপ্রাপ্তি হয় না । কেবলমাত্র নববারিসমাগমপ্রফুল্ল ভেকেরা উৎসব করিতেছিল । ঝিল্লিরব মনোযোগপূর্বক লক্ষ্য করিলে শুনা যায়, রাবণের চিতার ন্যায় অশ্রান্ত রব করিতেছে, কিন্তু বিশেষ মনোযোগ না করিলে লক্ষ্য হয় না । শব্দের মধ্যে বৃক্ষাগ্র হইতে বৃক্ষপত্রের উপর বর্ষাবিশিষ্ট বারিবিন্দুর পতনশব্দ, বৃক্ষতলস্হ, বর্ষাজলে পত্রচূত জলবিন্দু পতনশব্দ, পথিস্হ অনিঃসৃত জলে শৃগালের পদসঞ্চরণশব্দ, কদাচিৎ বৃক্ষারূঢ় পক্ষীর আর্দ্র পক্ষের জল মোচনার্থ পক্ষবিধূনন শব্দ । মধ্যে মধ্যে শমিতপ্রায় বায়ুর ক্ষণিক গর্জন, তৎসঙ্গে বৃক্ষপত্রচূত বারিবিন্দু সকলের এককালীন পতনশব্দ । ক্রমে নগেন্দ্র দূরে একটা আলো দেখিতে পাইলেন । জলপ্লাবিত ভূমি অতিক্রম করিয়া, বৃক্ষচ্যূত বারি কতৃক সিক্ত হইয়া, বৃক্ষতলস্হ শৃগালের ভীতি বিধান করিয়া, নগেন্দ্র সেই আলোকাভিমুখে চলিলেন । বহু কষ্টে আলোক সন্নিধি উপস্হিত হইলেন । দেখিলেন এক ইষ্টকনির্মিত প্রাচীন বাসগৃহ হইতে আলো নির্গত হইতেছে । গৃহের দ্বার মুক্ত ।”
    ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছি, তিরিশ হাজারিনীর দেশে, নিজের মগজের ভেতরে নিজেকে ফিসফিস করে বললেন নগেন দত্ত, যেন পারিবারিক মানদণ্ডের অলিখিত অথচ সর্বমান্য সীমালঙ্ঘন করতে চলেছেন এমন সাবধানি সন্তর্পণে, খরগোশের গর্তের মুখে শেয়ালের অপেক্ষারত ঔৎসুক্যের মতন, যদিও দাদামশায়ের বাঁধা সীমা উনি পেরোন না, পেরোবার উপায় নেই, তা এক মহাজাগতিক সীমা । কোনো মামণিকে যে পিং করবেন তাও প্রেমের শেমে বাঁধা ।
    বেশ দূরে, ঝিমন্ত-হলুদ আলো জ্বলছিল দেখে, নিশ্চিন্ত হলেন নগেন দত্ত, লন্ঠনের আলো, হ্যাজাকের নয়, ওই তো একটা বাড়ির সদরের কপাট হাঁ করে খোলা, নাগরদের গিলে ফেলার অপেক্ষায়, যারা এই পাড়ায় আরেকটু রাত হলেই আসা আরম্ভ করবে । কিন্তু জঙ্গলের বদলে রয়েছে ইঁটের দাঁত-বেরোনো ফুটপাথ-ঘেঁষা দিনকয়েকের পচা জঞ্জাল, শেয়ালের বদলে খ্যাংরাটে হাড়গিলে ভেড়ুয়াদের ঘ্যানঘ্যানানি, রয়েছে বুড়িয়ে হেলে পড়া বৃষ্টি-বাদলার মার খাওয়া নোংরা কুঁজো বাড়ি, কার্নিশের ফাঁকে বেবি অশথ্থগাছ, অন্ধকারে যেটুকু দেখা যায়, বাড়িগুলোর সামনে কচি-পাকা নানা রকমের চংকুমণি ঢলঢলে-যৌবন যুবতী আর উঠতি-যুবতীরা দাঁড়িয়ে আছে, পোশাকও অদ্ভুত, যেন হাফশেমিজের তলা কেটে কোমরে বেঁধেছে, যেন শেমিজের ওপরটা কেটে ওপরে পরেছে যাতে তাদের বুকের খাঁজের মনমাতানো আলো আর কোমরের হাতমাতানো বেড় দেখতে পাওয়া যায় ,ওপরের সঙ্গে তলাকার পোশাকের মিল নেই কোনো, অন্তত তাই মনে হল অন্ধকারে ।
    যাতায়াত-মুখর ল্যাদখোর রাস্তায় আরেকটু খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পারলেন নগেন দত্ত, যাকে উনি কাটা-শেমিজ বলে ভাবছিলেন, তা ওদের ত্বকে আঁকা, কয়েকটা পেইনটিঙ উনি ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যাণ্ড, আমেরিকায় দেখেছেন, যখন পতৃদেবের হাত ধরে গিয়েছিলেন ওই দেশগুলোয়, ভ্যানগঘের ‘স্টারি নাইটস’, সান্দ্রা বত্তিচেলির ‘বার্থ অফ ভেনাস’, গুস্তাভ ক্লিমটের ‘দি কিস’, গেওর্গে সেরার ‘এ সানডে আফটারনুন’, দিয়েগো ভেলাকোয়েজের ‘লা মেনিনাস’, জ্যাকসন পোলকের ‘নম্বর ফাইভ’, দিয়েগো রেভেরার ‘দি ফ্লাওয়ার ক্যারিয়ার’, আরও অনেকের । ছবিগুলোর নিউড দেখে নগেন দত্ত বাবাকে বলেছিলেন, ইশ কি ভীষণ বাজে সুন্দর মেয়েরা। উত্তরে বাবা বলেছিলেন, ছবি দেখে ক্রাশ খাসনি, এখন অনেক বছর বাঁচবি, অপেক্ষায় শিমুল পলাশ রঙ ধরে।
    অন্ধকারে ভেসে বেড়াচ্ছে মেয়েগুলোর কাঁচা মাংসের ডাক, কতোরকমের পাখির ডাকের গন্ধ, গত দুশো বছর যাবত শুনে এসেছেন নগেন দত্ত, বাদাতিতির, লালগলা-বাতাই, রাজসরালি, ধলাকপাল রাজহাঁস, চকাচকি, মেটেহাঁস, মেটেধনেশ, নাটাবটের, কুটিকুড়ালি, নীলকন্ঠ, সুইচোরা, পাপিয়া, কোকিল, মালকোয়া, কুবোপাখি, চন্দনা, ঘরবাতাসি, রাতচরা. তিলাঘুঘু, হরিয়াল, ডাহর, সারস, ডাহুক, নেউপিপি, সোনাজিরিয়া, গাঙচিল, মধুবাজ, চড়ুই, ঈগল, শাহিন, পানকৌড়ি, কানিবক, কাস্তেচরা, মদনটাক, শুমচা, বেনেবউ, ফিঙে, ফটিকজল, দোয়েল --- তাদের ডানা-ঝাপটানো ডাকের মিহিমিহি সুবাস রয়ে গেছে নগেন দত্তের শরীরে ।
    উনি, নগেন দত্ত, কয়েকশো বছর যাবত খুঁজে ফিরছেন কুন্দনন্দিনী নামে কুমারীফাটল এক তরুণীকে । জীবনের উদ্দেশ্য থাকা প্রয়োজন মনে করে নয়, খুঁজে চলেছেন মেয়েটিকে ভালোবাসবেন বলে, তাকে আজও ভালোবাসতে পারেননি নগেন দত্ত ; আসলে ভালোবাসাই ওনার জীবনের উদ্দেশ্য, বেঁচে থাকার মানে । বেঁচে থাকার জন্যে ওনাকে কিছুই করতে হয় না, কিন্তু জানেন যে ভালোবাসার জন্যে অনেককিছু করতে হবে । জীবন ওনার তারিখহীন হয়ে গেছে ।
    মগজের ভেতরে যে গানটা তাঁকে বিনবিনে উনকির মতন ছেঁকে ধরেছিল, অন্ধকারকে চটচটে একাকীত্ব থেকে বের করে আনার জন্য, তা মুখ দিয়ে জগন্ময় মিত্রের কন্ঠস্বরে বেরিয়ে আসছে শুনে অবাক হলেন না নগেন দত্ত, বেরোতে দিলেন গানখানা, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকসুদ্দু, কেননা ওনার মুখের ভেতরে হেন বাঙালি-অবাঙালি পুরুষ নেই যার কন্ঠস্বর সময়ে-অসময়ে বেরিয়ে আসেনি গত পঞ্চাশ একশো দেড়শো বছর যাবত, উনি যদি আজ ধুতি-পাঞ্জাবির বদলে জিনস-টিশার্ট পরে থাকতেন, তাহলে হয়তো গলার ভেতরে নাচতে আরম্ভ করতেন এলভিস প্রিসলে তাঁর ‘জেল হাউস রক’ গানখানা গাইতে-গাইতে, কিংবা হয়তো মাইকেল জ্যাকসনের ‘আই জাস্ট কান্ট স্টপ লাভিং ইউ’ গাইতে গাইতে, এখন ধুতি-পাঞ্জাবি-কোলহাপুরি পরে আছেন বলে জগন্ময় মিত্রের গানখানা আচমকাই বেরিয়ে এলো, নয়তো বড়ে গুলাম আলির ‘কা করুঁ সজনা আয়ে না বালম’ ও বেরোতে পারত, কার গান যে কখন বেরোবে তার ওপর ওনার, নগেন দত্তর বড়ো একটা নিয়ন্ত্রণ নেই, তা উনি মুখ বন্ধকরে রেখেও দেখেছেন, গান এসে গেলে তা বেরোবেই বেরোবে, আর ভালোবাসার গান হলে তা থামানো অসম্ভব :
    ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে
    তোমারে করেছি রানি ।
    তোমারই দুয়ারে কুড়াতে এসেছি
    ফেলে দেওয়া মালাখানি
    নয়নের জলে যেকথা জানাই
    সে ব্যথা আমার কেহ বোঝে নাই
    মেঘের মরমে যে মিনতি কাঁদে
    চাঁদ বুঝিবে না জানি ;
    ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে
    তোমারে করেছে রানি
    মাধবীলতা গো আজ তুমি
    আছ ফুলের স্বপনসুখে
    একদিন যবে ফুল ঝরে যাবে
    লুটাবে ধূলির বুকে ।
    খেয়ালি প্রেমের খেলা বোঝা দায়
    কখনো হাসায় কখনো কাঁদায়
    মুক হয়ে যায় কারও মুখরতা
    কারও মুখে জাগে বাণী
    ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে
    তোমারে করেছে রানি….
    ভালোবাসা, নগেন দত্ত চেয়েছেন, বিপথে যাবার মতন হোক, পথে যা পাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে চুরমার করে, নারকেল গাছের মাথা থেকে পাতা মুড়িয়ে, ডাবের কাঁদি ছিঁড়ে ফেলে, চিলের বাসার ডিম ফাটিয়ে, বটগাছকে ঝুরি-শেকড়সুদ্দু উপড়ে ফেলে, মেছোবকের ঘুমন্ত ঝাঁক উড়িয়ে, নদীর জলে বান এনে, মাছের ঝাঁকেদের মধ্যে ঘুর্ণির মতন ঢুকে যাক, চালাবাড়িসুদ্দু গ্রামের পর গ্রাম এক জায়গা থেকে নিয়ে গিয়ে আরেক জায়গায় বসিয়ে দিক, শহরের বাড়িগুলো হেলে পড়ুক ভালোবাসার ভূমিকম্পে, ঝড়ে উড়তে থাকুক মিছিল ফেরত মানুষের দল, সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাক তাঁর প্রাপ্য ভালোবাসার পাত্রীর জন্যে ।
    আশা ছাড়ে না অনুভূতির দালাল পেশাদার কোটনারা, খ্যাংরাটে পিম্পদের ঢ্যামনাকাত্তিক চেল্লাচিল্লির ঘ্যানঘ্যানানি ছেঁকে ধরেছিল ওনাকে, ঠিক যেমন ওদের হাড়ের সঙ্গে কোনোরকমে চিপকে আছে চামড়াটে মাংস, মুখের ভেতরে সেকারণেই থেমে গিয়েছিল গানখানা, ব্যাটারা দেখেছে নগেন দত্ত নেমেছেন টয়োটা গাড়ি থেকে, ওরা জানে খদ্দেরটা মালদার হাবলা, রসের নাগর, খাজা পাবলিক নয়, টাকার টাইমকল, সহজে ইল্লি খায় না, দশ কুড়ি চল্লিশ একশো দেড়শো বছরে অবিরাম কয়েকদিনের জন্যে আসে আর তারপর কোথায় হারিয়ে যায়, কোনো মেয়ে এনাকে ভালো কাস্টমার সার্ভিস দিলে তার একশো-দুশো বছরের জন্যে জীবনের বীমা করিয়ে দ্যান।
    কাচরাদের ক্যাচাল ভ্যানতারা এড়িয়ে, অন্ধকারে বাঁহাতে মোবাইল দেখে এগোচ্ছেন , ডানহাতে অ্যাটাচিকেস, যাতে হয়তো অনেক টাকা আছে, তবু লুটপাটের চেষ্টা করে না দালালরা, তুকতাক করে এমন ক্ষতি করে দিতে পারেন যে হঠাৎ চিৎপটাঙ হয়ে মরে পড়বে গলিতে, মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত, এর আগে দুজন নাঙের সঙ্গে ঘটেছে অমন ঘটনা, একজনকে তো আকাশের চিল বানিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই থেকে দালালটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, থানায় নালিশ করতে গেলে ওসি বলেছিল, “এই, এই মালগুলোকে লকআপে বন্ধ করে দুচার ঘা দিয়ে হুঁশ ফিরিয়ে আন তো।” যখন তাদের হুঁশ ফিরেছিল তখন ওরা দেখল যে কেষ্টপুরের খালের পাঁকে পোঁদ উল্টে উলঙ্গ পড়ে আছে, চারিদিকে অশ্লীল আধুনিক বাংলা ভাষার শহুরে ডিগডিগে কিচাইন ।
    আকাশের মেঘ আর কালবৈশাখিও যে নগেন দত্তই নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সে ব্যাপারে কয়েকজন পুরোনো ভেড়ুয়া নিশ্চিন্ত, নয়তো এখন তো কালবৈশাখির মরসুম নয় ।
    লেগেই আছে পিটপিটে-চোখ ফ্যাঁচফ্যাঁচে সর্দি দাঁতক্যালানে দালালরা, যেমনটা ওরা প্রতিবার নগেন দত্তকে দেখলেই বিস্কুটখেকো নেড়ি-কুকুরের মতন পেছনে দৌড়োয়, মেজাজ চটকে যাবার যোগাড়, স্যার যেমন চান তেমন পাইয়ে দেবো, এই বাড়িতে আসুন, ফর্সা ধবধবে পাঞ্জাবি পাবেন, গুলশন কৌর, ফুরসত মাজিঠিয়া, সিমরন সিং, গালফোলা ঢাউসবুক নেপালি চান পাবেন, ছিনমুন থাপা, চম্পক গুরুং, কুচর কইরালা, ঘড়ঘড়ে সর্দিবন্ধ গলার স্বরে, না স্যার, আমাদের বাড়িতে আসুন, মারোয়াড়ি বউয়ের সঙ্গে শুয়েছেন কখনও, জগৎশেঠের বাঁদির মেয়ের মেয়ের মেয়ের মেয়ে, ছয়েলছবিলি ঝুনঝুনওয়ালি, রাজস্হান থেকে টাটকা আমদানি, ব্রিটিশ সায়েবদের আমলের মারোয়াড়ি বউ, শিফনশাড়ি, কানে ঝমঝমে দুল, এয়ার কান্ডিশান ঘর, ঠোঁটে ল্যাকমে, গায়ে ডিওডোরেন্ট, ঘরে রুম ফ্রেশেনার, নাকি সুরে, লোকটার গালে ছুরি খাওয়ার দাগ, স্যার ওদের ছাড়ুন, আমি টিভিস্টার পাইয়ে দেবো, বাংলা চান বাংলা, হিন্দি চান হিন্দি, এক্সট্রা লার্জ বুকের সাইজ হুজুর, এক্সট্রা লার্জ পাছা, একবার এসে দেখুন না হয় তারপর যা ভালো বোঝেন করবেন, সারা রাত চান, ঘণ্টাখানেক চান, এমনকি দশ-পনেরো মিনিটের জন্যেও পাবেন হুজুর, বড়ো ছ্যাঁদা চান পাবেন, ছোটো ছ্যাঁদা চান পাবেন, যেন কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভেঙেছে, হাই তোলা বন্ধ রেখে ।
    নাহ, এ পাগল কাউকে পাত্তা দেবে না, বলল একজন কমবয়সী দালাল, ফিসফিস, হাঁ-মুখে চোলাই সাঁটা হাওয়া, চোঙা প্যান্ট । এই দালাল পঁচাত্তর বছর আগে, যখন ওর বয়স কুড়ি ছিল, নাইট-ভিউ গ্যালারির দরোজায় গেট-মিটিং করে পিম্পদের হরতাল ডেকেছিল, তবে তাতে অন্য পিম্পরা যোগ না দেয়ায় পাড়ার নেতা হতে পারেনি, বাইরের এক পালোয়ান এসে পাড়ার নেতা হয়ে গিয়েছিল, মনে পড়ল নগেন দত্তর। পালোয়ানের নাতি এখন মোহোল্লা কমিটির মুখ্য-কোটনা ।
    নগেন দত্ত কাউকে পাত্তা দিচ্ছেন না দেখে একজন খ্যাংরাকাঠি লুঙ্গিপরা গুটকামুখ দালাল টিটকিরি মারল, ওর বড়ো ছ্যাঁদার পাল্লায় পড়বেন না হুজুর, ঝাণ্ডা নিয়ে বড়ো ছ্যাঁদায় ঢুকবেন আর পুরো পার্টি দলবল নিয়ে মিছিলের স্লোগান দিতে-দিতে বেরিয়ে আসবে আবনার পিছন-পিছন ।
    নগেন দত্ত জানেন যে লোকটা সঠিক কথা বলেছে, ওনার ক্ষমতা আছে তা করার, একবার রাস্তা পেরোতে আধ ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল বলে, ময়দানমুখো র‌্যালিকে সেই মিছিলের একজন মহিলার গর্ভে লোপাট করে দিয়েছিলেন, গর্ভের ভেতরে স্লোগানের দপদপানি শুনে সিজার করতে হয়েছিল মেডিকাল বোর্ডকে । এক ইঞ্চি মাপের মানুষেরা গর্ভ থেকে ‘ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়’ স্লোগান দিতে-দিতে বেরিয়েছিল।
    আমি শুতে আসিনি, জীবনে হাজার-হাজার বার শুয়েছি, দিনে দুতিনবার দুতিন জনের সঙ্গে শুয়েছি, বাৎসায়নের সবগুলো শোয়া শুয়ে নিয়েছি, এখন ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতে এসেছি, এবার শুধু ভালোবাসার পাত্রীর ভালোবাসা চাইছি, বললেন নগেন দত্ত ।
    খেটে-খাওয়া মা আর খুঁটে খাওয়া বাপের ঝুপ্পুসলীলায় পয়দা-হওয়া দালালগুলো নাছোড়, মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত মুখে পুরে কথা বলার ঢঙে, পাবেন স্যার, ভালোবাসা পাবেন, যেমন করে ভালোবাসতে চান পাবেন, দাঁড়িয়ে, বসে, পা ছড়িয়ে, উপুড় হয়ে, কুকুরের পোজে, সিংহের পোজে, গণ্ডারের পোজে, হাতির পোজে, বাসুন না যেমন ভাবে চান, একবার এসে তো দেখুন, দেখবেন ভালোবাসবার জন্য মুখিয়ে আছে, আপনার মন ভরে যাবে, রোজ আসতে ইচ্ছে করবে, বেশি রেট নয় স্যার, চলুন না, একবার নিজের চোখে দেখে তো নিন, যাদের দেখছেন এরা ভালো কোয়ালিটির আইটেম নয় স্যার, সস্তা, রোগ বাধিয়ে দেবে, ওপরে চলুন, নামি-দামি পাইয়ে দেব আপনাকে ।
    মোবাইলকে লাউডস্পিকার মোডে লাগিয়ে নরেন দত্ত পিম্পগুলোকে বললেন, শোন শোন, তোরা শোন, আমি এই মেয়েকে খুজছি, তাকেই ভালোবাসতে চেয়েছি, ভালোবাসতে এসেছি, তা দুশো বছর আগের কথা তো হবেই, বেশি তো কম নয় ।
    দালালগুলো নগেন দত্তকে ঘিরে মোবাইলে রেকর্ড করা কথা শুনতে লাগল, এতো কাছ থেকে যে নগেন দত্ত নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে বললেন, ব্যাটারা ষাট-সত্তর বছর স্নানটান করে নি, গায়ে কি দুর্গন্ধ, এখন থেকেই ধেনো টেনে রেখেছে, বা হয়তো দশ বছর আগে যে ধেনো টেনেছে তার খোঁয়ারির বদবুতে মুখ ম-ম করছে ।
    একজন দালাল বলল, স্যার এর আগে কি এই মেয়েটাকেই খুঁজেছিলেন ?
    নগেন দত্ত বললেন দুশো বছর যাবত খুঁজে চলেছি, তোরা মন দিয়ে শোন :
    “সকলেই বিস্মিত হইয়া দেখিল যে যুবতীর শরীরে আর রূপ ধরে না । সেই বহুসুন্দরীশোভিত রমণীমণ্ডলেও, কুন্দনন্দিনী ব্যতীত তাহা হইতে সমধিক রূপবতী কেহই নহে । তাহার স্ফুরিত বিম্বাধর, সুগঠিত নাসা, বিস্ফারিত ফুল্লিন্দীবরতুল্য চক্ষু, চিত্ররেখাবৎ ভ্রুযুগ, নিটোল ললাট, বাহুযুগের মৃণালবৎ গঠন, এবং চম্পকদামবৎ বর্ণ, রমণীকুলদুর্লভ ।”
    মোবাইল অফ করে নগেন দত্ত বললেন, বুঝেছ, এই মেয়েকেই খুঁজছি ।
    একজন দালাল, গলায় মাফলার জড়ানো, এই গরমেও, বলল, স্যার এটা কি সরকারি হিন্দি, দূরদর্শনে খবর পড়ে, সেরকম মনে হল, শুনি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারি না । এর আগে তো আপনি কুঁদি নামে একটা মেয়েকে খুঁজতে আসতেন ।
    আরে, না রে ল্যাওড়ার ক্যাওড়া, মালায়ুলি মালায়ুলি, নীলকমল গ্যালারিতে আছে, দেখিছিস তো, এমনি করেই কতাটতা বলে, রেমড়িঁআম্মা, চলুন স্যার, নিয়ে যাচ্ছি মালায়ুলির কাছে, তবে ওর গায়ের যা রঙ, আবনার পাঞ্জাবি-ধুতি শাদা থাগলে হয়, ঘড়ঘড়ে গলার দালাল ।
    মালায়ুলি নয়, মালায়ুলি নয়, হায়দ্রাবাদি, কাইকু কাইকু করে কতা বলে, মোচোরমান চলবে তো হুজুর, ওর চেয়ে ভালো মোচোরমান মেয়ে পাইয়ে দেবো, আরবদেশের চেয়ে ফর্সা, চলুন আমার সঙ্গে, বুকে মুখ গুঁজে পিথ্থিবির সব দুখ্খু ভুলে যাবেন , অবশ্যি মেয়েদের হিন্দু-মোচোরমান বলে কিছু নেই স্যার, ওসব আস্ত-খোসা আর ছাড়ানো-খোসা পুরুষদের ব্যাপার স্যার, চলুন না, একবারটি দেখে নিন, নাকিসুর দালাল ।
    কারেন্ট চলে আসতে, ভেড়ুয়াগুলোকে দেখলেন নগেন দত্ত, নাঃ, কর্নওয়ালিসের দেয়া জমিদারি উঠে যাবার আগে এদের কেউই তাঁর মোসাহেব ছিল না, এরা তো সংসদীয় গণতন্ত্রের বাইপ্রডাক্ট, একেবারে ভিকিরি, দুবেলা নালির চোলাই আর পচাই-তাড়ি খেয়ে পড়ে থাকে । এরা কুন্দনন্দিনী উচ্চারণ করতে পারবে না ভেবে কুন্দনন্দিনীর ডাকনামটার কথা বলেছিলেন ।
    আরেকজন ভেড়ুয়া, গমগমে গলায় বলল, হুজুর, শুনে তো কিছুই বুঝতে পারিনি, তবে কুন্দনন্দিনী শুনতে পেলুম । আমার মাসিপিসির গ্যালারিতে যতোগুলো মেয়ে আছে সকলের নামই কুন্দনন্দিনী । ওই যে গন্ধরানির বাড়ি দেখছেন, সেখানে। আপনি আগের বার গিসলেন বোধয় স্যার ।
    মাসিপিসির গ্যালারি ? মুখময় পানিবসন্তের আলপনাদেয়া কোটনাটার দিকে মুখ ঘুরিয়ে, জানতে চাইলেন নগেন দত্ত, মাসি আর পিসি একই সঙ্গে ! যতোদূর জানি, আগে তো মাসি বলেই ডাকা হতো বাড়িউলিকে । তার বাড়িতে একজন নয়, দুজন নয়, সবাই কুন্দনন্দিনী ! কেমন করে জানা যাবে আসল কুন্দনন্দিনী কে ! ভালোবাসার পাত্রীকে কেমন করে খুঁজে পাবো ?
    না স্যার, উনি আগে কালেজে পড়াতেন, প্রফেসার চক্কোত্তি, কালেজের ছেলে-মেয়েরা ওনাকে পিসি বলে ডাকতো, কালেজে পড়িয়ে আর বেনামে বই লিখে তেমন রোজগারপাতি হতো না বলে এই লাইনে এয়েচেন, ওনার মালিক অনেক ট্যাকা ঢেলেচেন, আগের মাসি ছোটোবেলায় ওনার বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতো, তাপ্পরে কেউ ফুসলিয়ে ঝিকে বেচে দিলে দিল্লির মেড়ো পার্টিকে, সে আর ছাড়ে কেন, হেভি দাম দিয়ে কুমারী মেয়ের পরদা ছিঁড়তে পেলো । প্রফেসার চক্কোত্তি অ্যাগবার এসেছিলেন গন্ধরানির কাছে, বছর তিরিশ-চল্লিশ আগে, নকশাল করবার সময়ে গন্ধরানির খাটের তলায় পনেরোদিন লুক্কে ছিলেন, দুজনের এমন সখি-সখি ভাবভালোবাসা হল যে প্রফেসর চক্কোত্তি গন্ধরানির ব্যবসা অনেক ট্যাকা দিয়ে কিনে নিলেন, লোকে বলে ট্যাকাটা ওনার গুরু-মহারাজের। অ্যাগবারে নতুন ঢঙে সাজিয়েচেন স্যার । গন্ধরানিকে রেখে এয়েচেন বুড়োবুড়ি আবাসে ।
    ---ওঃ, ছোটো থেকে প্রোমোশান পেয়ে-পেয়ে এই বাড়িটা দখল করে নিলেন ?
    ---জি হুজুর, আগের মাসির নামই গন্ধরানি । পাড়ার মেয়েরা বাড়িটাকে মাসিপিসির গ্যালারি বলে জানে । ঘড়ঘড়ে কন্ঠস্বরের দালাল ।
    ---চলো, নিয়ে চলো, আসল কুন্দনন্দিনীকে যদি পাই, দেড়শো বছরের কান্না চোখের তলার থলিতে জমে আছে ।
    ---পাবেন, পাবেন, সুদু এপার বাংলা-ওপার বাংলার মেয়ে পাবেন মাসিপিসির গ্যালারিতে, সকলের নামই কুন্দনন্দিনী ।
    ---চলো, নিয়ে চলো, কতকাল হয়ে গেল বাংলা ভাষার সঙ্গে শুইনি, বাংলা ভাষার অরগ্যাজমের আনন্দ উপভোগ করিনি, ঠোঁটে বাংলা ভাষার থুতু পাইনি, বুকে বাংলা মাংসের জাপট পাইনি, বোধহয় পঞ্চাশ আশি একশো বছর হয়ে গেল । সেই কবে তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদারের সঙ্গে লিভ-টুগেদার করার দিনকালে যেটুকু আয়েশ করেছিলুম ।
    নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে ফিসফিস করে বললেন, যে মেয়েগুলোকে দোরগোড়ায় দেখছি, এরা বাঙালিনী নয় বলেই তো মনে হচ্ছে, ত্বকে শ্যামল কোমলতা নেই, চোখ ডাগর নয়, পাছা অব্দি কোঁকড়ানো চুল নয়, কেবল ফর্সা দিয়ে নগেন দত্তের মন ভরে না, অবাঙালিনী হলে আবোলতাবোল কথা বলার আনন্দের তো উপায় নেই, কেবল দুদণ্ড জড়িয়ে শোয়া আর ইল্লি করে উঠে পড়ার জন্যে তো আসেননি, ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতে এসেছেন, যে ভালোবাসা কুন্দনন্দিনী দেবে বলে কথা দিয়েছিল বহুকাল আগে । অ্যাটাচিকেসটা সেই জন্যেই তো এনেছেন সঙ্গে ।
    রাস্তার মুখে নীলের ওপর সাদা অক্ষরে লেখা কোবরেজ হরিদাস পাল সরণী ।
    মনে পড়ল নগেন দত্তর, জঙ্গলের মধ্যে শিশু গাছের তলায় বসে-থাকা নাকে-নস্যি হরিদাস পাল কোবরেজের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল ।
    ---তুমি কি ?
    ---আমি জীব ।
    ---তুমি কোন জীব ?
    ---আমি তটস্হ জীব ।
    ---থাকেন কোথায় ?
    ---ভাণ্ডে ।
    ---ভাণ্ড কিরূপে হৈল ?
    ---তত্ববস্তু হইতে ।
    ---তত্ববস্তু কি ?
    ---পঞ্চ আত্মা, একাদশেন্দ্র, ছয় রিপু, ইচ্ছা, এই সকল য়েক যোগে ভাণ্ড হইল । আমি সেহেতু চিরযুবক।
    নগেন দত্তর উত্তর শুনে হরিদাস পাল কোবরেজ বলেছিলেন, সঠিক উত্তর দিয়েছ, আলোকপ্রাপ্তির জন্যে জঙ্গলে প্রবেশ করতে পারো ।
    আলোকপ্রাপ্তি শব্দের সঙ্গে কুন্দনন্দিনীর কোথাও মিল আছে, মনে হল নগেন দত্তর।
    আজকে রাস্তাটায় ঢুকে সবই গুলিয়ে যাচ্ছিল নগেন দত্তর । ময়নামতির বাড়ির নাম হয়েছে নীলকমল গ্যালারি, সুখরানির বাড়ির নাম হয়েছে প্রেমকমল গ্যালারি, হরিমতির বাড়ির নাম হয়েছে প্রেমবন্ধন গ্যালারি, হেমনন্দিনীর বাড়ির নাম হয়েছে গঙ্গাজমুনা গ্যালারি, নলিনীবালার বাড়ির নাম হয়েছে নাইট লাভার্স গ্যালারি, যশোমতির বাড়ির নাম পালটে কি হয়েছে দেখতে হবে , পিসির বাড়ির ঝিয়ের কথা বলছে, তাহলে কি যশোমতির কথা বলছে ! তবে বাড়ির দরজায় একটা নম্বর দেয়া, লোডশেডিঙের সময়ে অন্ধকার ফুটো-করা আলো দেখা যাচ্ছিল এই বাড়ির দরোজায় ।
    আরেকটু ভেতরে ঢুকতে পারতেন নগেন দত্ত, চিনতে পারলেন, দুর্গাবরণ মিত্র সরণী, হ্যাঁ, এই জমিদারবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বলে মনে পড়ছে, ওনার কাছারিবাড়িতে রামপ্রসাদ সেন নামে একটি ছেলে ভালো শ্যামাসঙ্গীত গাইত। মগজের ভেতরে রামপ্রসাদ সেনের কন্ঠস্বর গেয়ে উঠতে চেয়েছিল, শ্লেষ্মা দিয়ে চাপা দিলেন এখনকার মতন, পরে ওনাকে গলায় গাইতে দেওয়া যাবে, আপাতত কালীবন্দনার প্রয়োজন ঘটেনি ।
    তারপর হামাম বক্স সরণী, নাঃ, এনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি । এই এলাকায় যারা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তারা তেমন আকর্ষক নয় । তাদের গায়ে কালিঘাটের পট আঁকা ।
    এদের কাউকে বেছে নিয়ে কুন্দনন্দিনীর রূপ দিতে পারি, নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে বললেন নগেন দত্ত, কিন্তু তার ভেতরটা, যাকে আগেকার লোকেরা বলত অন্তরজগত, তা তো পালটে কুন্দনন্দিনীর করে দিতে পারব না । আমার চাই আসল কুন্দনন্দিনী, যাকে দুশো বছর যাবত খুঁজছি ।
    মনে পড়ল ওনার, কাজী জহির রায়হান নামে এক মুসলমান যুবকের সঙ্গে বছর পঁয়তাল্লিশ আগে পরিচয় হয়েছিল বটে, বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে যারা মুক্তি যুদ্ধ এড়িয়ে তিরিশ হাজারিনীর দেশে আলোকপ্রাপ্তির জন্যে আসত, লুকিয়ে-লুকিয়ে তাদের মুভি ফিল্ম তুলেছিল, সেই থেকে কাজী জহির রায়হানকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি । দেশটা তখন পাকিস্তান ছিল, এখন বাংলাদেশ হয়েছে ; বাংলাদেশ হলেও অনেকের অন্তরজগতে পাকিস্তান রয়ে গেছে ।
    নগেন দত্তের একবার মনে হয়েছিল কাজী জহির রায়হানকে জীবন্ত করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেবেন, তা আর করেননি, শেষে ওপার বাংলার লোকেরাও তাঁকে প্রতিভাবান মনে করবে, এই আতঙ্কে ।
    পিসিমাসির গ্যালারির বাড়ির দরোজা খোলা দেখে, দালালটাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে, ওপরে দোতলায় ওঠার সময়ে নগেন দত্ত বাইরে হাত নাড়িয়ে শিলাবৃষ্টি আরম্ভ করে দিলেন, তিরিশ হাজারিনীর শহরে শিলাবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হবার সমস্যা নেই, পিম্পগুলো অন্তত আড়ালে আশ্রয় নেবে ।
    সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে, হাজার-হাজার পুরুষেরা উঠে-উঠে সিঁড়ির গোলাপি দেয়ালকে ছুঁয়ে মসৃণ করে দিয়েছে, স্লেট-রঙের সিঁড়িগুলো ক্ষইয়ে দিয়েছে, দেখলেন দেয়ালজুড়ে বাংলায় লেখা রয়েছে ‘বিইং অ্যাণ্ড নাথিংনেস’, বিইং-এর ওপর পুরুষের বিশাল লিঙ্গ আঁকা আর নাথিংনেসের ওপরে ফাটল-স্ফীত ভগ ।
    সিঁড়িতে কোথাও লুকোনো স্পিকার থেকে জি-মাইনরে য়োহানেস ব্রাহমসের পাঁচ নম্বর হাংগেরিয়ান নাচ বাজছিল মৃদুস্বরে, আগত নাগরদের মেজাজকে আহ্লাদে চুবিয়ে দেবার খাতিরে ।
    নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে নগেন দত্ত বললেন, ঠিক বাড়িতেই এসে পড়েছি, বছর আশি আগে যখন এসেছিলেন তখন সিঁড়ির দেয়ালে এই লেখা আর লিঙ্গ-যোনির হাতে আঁকা রঙিন ছবি ছিল, বাজনাও এইটেই ছিল।
    বিইং মানে যা ‘আছে’, নাথিংনেস মানে যা ‘নেই’। আঁকা লিঙ্গ দাঁড়িয়ে থেকে প্রমাণ করছে যে সে ‘আছে’, শিশ্নকে গোলাপি রঙ করে গেছেন কোনো আন্তর্জাতিক বহুজাতিক প্রেমিক ছবি-আঁকিয়ে, হয়তো এদেশেরই, হয়তো ফরাসি দেশের, হয়তো ইতালির রেনেসঁসের সময়কার, যাঁদের তুলির মাপ একহাত সাতইঞ্চি ছিল, বিখ্যাত ছবি-আঁকিয়েরা, যশোমতির বাড়িতে প্রেম করতে এলে ছবিগুলোকে চাঁঙ্গা করে দিয়ে যান । টুকরো দু-পাট লাবিয়ার মাঝে গোলাপি ভগাঙ্কুর প্রমাণ করছে যে সেখানে বিইং জিনিসটা ‘নেই’ ।
    দালালটা ঠিকই বলেছিল, ‘নেই’ এর হিন্দু-মুসলমান হয় না ।
    সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে নগেন দত্ত অনুভব করতে পারছিলেন যে তিনি উলুপি-সুবাসের হ্রদের হাফঠাণ্ডা তলদেশ থেকে ওপরের দিকে উঠছেন, আলোকপ্রাপ্তির আধুনিকতায় ধুয়ে যাচ্ছে তাঁর পোশাক, যেমন দুশো বছর আগে হয়েছিল, তখন বাবার সঙ্গে এসেছিলেন, বাবা নিয়ে এসেছিলেন ছেলেকে যৌনকর্মে সুদক্ষ করে তোলার জন্য ।
    নগেন দত্তের বাবা ভাব-ভালোবাসায় বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন যৌনখেলার দক্ষতায়, যেমন তাঁর পূর্বপুরুষরা তিন-চারশো বছর আগে দশবারোজন বউ রাখতেন আর আনন্দ করতেন ।
    বাবা একটি যুবতীকে চিৎ করিয়ে শুইয়ে, ছেলেকে বলেছিলেন, তুমি যতোই প্রেমের রসবিজ্ঞান পড়ো, লিঙ্গের স্মৃতির কাছে সবই তুচ্ছ, যে লিঙ্গের নিজস্ব স্মৃতি নেই, বুঝতে হবে তাতে মনুষ্যত্বের অভাব রয়েছে, এইভাবে দশ বছরের ছেলেকে শিক্ষা দিয়েছিলেন :
    বাবা : এই দুটো হল ঠোঁট, তোর যেমন আছে তেমন মেয়েদেরও থাকে, দেখেইছিস, তা এই দুটো ঠোঁটে তুই নিজের দুটো ঠোঁট রেখে ডাবের জল খাবি ।
    ছেলে : ডাব তো আমাদের শেতলপুরের জমিদারিতে কাঁদি কাঁদি হয় বাবা, একজন মেয়ের ঠোঁটে কেন খাবো, ডাবের জল তো পাবো না, কী পাবো তাহলে ?
    বাবা : যখন খাবি তখন বুঝতে পারবি, লালার সঙ্গে লালা মিশলে জ্বালা বাড়ার জ্বালা কমে ।
    ছেলে : আচ্ছা, তুমি বলছ যখন তখন খেতেই হবে ।
    বাবা : এই দ্যাখ, এদুটো হল মাই, কিন্তু শক্তপোক্ত হলে তাকে বলে স্তন, ছোটো বেলায় যেমন করে চাকরানিদের দুধ খেয়েছিস, এখনও তেমন করেই খাবি ।
    ছেলে : এখন আর কেন দুধ খাবো বাবা, বাড়িতে গোরুর খাঁটি দুধ তো খাইই ।
    বাবা : দুধ খাবার মতন করে খাবি, কিন্তু দুধ বেরোবে না, আনন্দ খাবি, দুধ থাকলে একরকমের আনন্দ হয়, আবার দুধ না থাকলে আরেকরকমের আনন্দ ।
    ছেলে : দুধের বদলে কী বেরোবে তাহলে ?
    বাবা : কিছুই বেরোবে না, তুই যখন খাবি তখন বুঝতে পারবি ।
    ছেলে : বাবা, এনাকে এরকম উলঙ্গ দেখে আমার কুঁচকির জায়গায় টিং-টিং করে শিরশিরানি আরম্ভ হয়ে গেছে ।
    বাবা : গেছে তো ? এই যে কুঁচকির মাঝে যা দেখছিস, সেখানে শিরশিরানির সঙ্গে শিরশিরানি মেশালে তোর আনন্দধারা প্রবাহিত হবে, তোর মন ভালো হয়ে যাবে, অন্ধকার থেকে আলোয় পৌঁছোবি, আলোকপ্রাপ্তি ঘটবে ।
    যে মেয়েটি শুয়েছিল সে আচমকা উঠে বসে বলেছিল, ওভাবে বোঝালে হবে না কত্তা, শেষে বন্দরের বদলে খেয়াঘাটে জাহাজ ভেড়াবে তোমার ছেলে, তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, ও আমি হাতে-নাতে শিখিয়ে দেবো, যেমন করে তোমায় শিখিয়েছিলুম, তোমার শশুরের উইল অনুযায়ী । এখন তুমি বাইরে গিয়ে অপিক্ষে করো, আমরা মহড়া দিয়ে নিই । ওকে জানতে হবে তো দুটো শরীরকে কেমন করে স্হিতাবস্হা থেকে স্ফীতির অবস্হায় নিয়ে যায় প্রেম, ওতো এখনও জানে না যে প্রেম হল স্হিতাবস্হার বিরুদ্ধে প্রথম উল্লাস ।
    ছেলে বলেছিল, জানি গো জানি, প্রেমিকার সবকিছু জেনে ফেললেই প্রেম গুবলেট ।
    শিক্ষিকা মেয়েটি বলেছিল, নগেন দত্তর চুলে বিলি কেটে, অ্যাই তো কতার মতোন কতা ।
    ছেলে সেইমতো জীবন কাটাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎই কুন্দনন্দিনীকে দেখে তার প্রতি ভালোবাসায় আক্রান্ত হলেন নগেন দত্ত।
    ছেলেকে ভালোবাসায় আক্রান্ত হতে দেখে হঠাৎ মারা গিয়েছিলেন নগেন দত্তের বাবা ।
    শেষ শয্যায় শুয়ে উনি, নগেন দত্তের বাবা, বলেছিলেন, আমার আর কোনো আপশোষ নেই, পরশুই দেখে এলুম মোহনবাগান ফুটবলাররা খালি পায়ে আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে কেমন গুহারান হারালো ।
    ১৯১১ সালের সে-কথা মনে আছে নগেন দত্তর । তবে পরাজয়ের সঙ্গে গুয়ের সম্পর্কের রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি আজও ।
    আজকে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময়ে টের পেলেন, ‘আছের’ সঙ্গে ‘নেইয়ের’ মিলনে আলোকপ্রাপ্তি ঘটে এই গ্যালারিতে, নগেন দত্ত নিজের মোবাইলে বিইং অ্যাণ্ড নাথিংনেসর ফোটো তুলে নিলেন, দেড়-দুশো বছর পরে আবার যখন আসবেন তখন মিলিয়ে দেখার জন্য, বিইং কতোটা উন্নতশির হলো আর নাথিংনেস কতোটা ডাকসাইটে গোলাপি ।
    দেশ-বিদেশের কতো কতো ‘আছে’ এখানে আসে ‘নেইদের’ সঙ্গে মিলন করতে, নিজেকে আলোয় আলো করে তুলতে । ‘নেইরা’ কতো কতো ‘আছেকে’ আলোয় ভরে দ্যায় ।
    সিঁড়ি দিয়ে উঠে, দোতলার বারান্দায় ঢোকার মুখে চারিধারে লাল টুনিআলো ঝোলানো একটা সাইনবোর্ড টাঙানো, তাতে সাদার ওপরে গেরুয়া রঙে লেখা “দি অ্যাকাডেমি অফ পারফরমিং ফ্লেশ” । সাইনবোর্ডেরও ছবি তুলে নিলেন মোবাইলে, তুলে, মনে পড়ে গেল সেই গানটা, কে যেন গেয়েছিল, মগজের ভেতরে তার গুনগুন শুনতে পাচ্ছিলেন নগেন দত্ত :
    পা গা মা রে সা নি
    পা নি সা রে মা গা রে
    রে মা পা নি ধা মা পা না সা রে নি সা
    পা ধা মা পা নি ধা মা গা গা সা নি সা
    ঘষা-কাচের আড়াল-তোলা মাসিপিসি গ্যালারির কিউবিকলের পাশ দিয়ে দোতলার বারান্দায় পৌঁছোলেন নগেন দত্ত, মাসিপিসির সঙ্গে কথা পরে বলবেন ।
    যে কোনে একশো বছর আগে এই বাড়ির মাসি জলচৌকিতে বসে দোক্তাদেয়া পানের খিলি সাজাতো, আর মেয়ে বাছাই নিয়ে দরাদরি করত, সেখানটা ফাঁকা, সেই জলচৌকির ওপরে মাসির দোক্তামুখ হাসির ফোটো, তাতে যে রজনীগন্ধার মালা পরানো, তা দশ বছর আগে শুকিয়ে গেছে, মাসি তবুও দোক্তামুখে হাসি বজায় রেখেছে ।
    নগেন দত্ত দেখলেন, বারান্দায় দুটো খাটে দুঃখকাতর দুটো কাটা-মুণ্ডু রাখা , তাদের মলম ধরণের কিছু মাখানো হয়েছে, দুই খাটের পাশে মুণ্ডুদের শিয়রে দুজন যুবক মেঝেয় বসে, যেন কাটা মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের ধড়হীনতার দুঃখ কমাবার চেষ্টা করছে ।
    মুণ্ডুদের মুখে গোঁজা সিগারেটের ফিকে নীল ধোঁয়া জিজ্ঞাসার চিহ্ণ হয়ে উঠে যাচ্ছে প্রেমালাপে ব্যস্ত কড়িকাঠের টিকটিকিদের মাঝে, মুণ্ডুদের খাটের পাশে চায়ের কাপে ফোঁকা সিগারেট গোঁজা, কিন্তু সিগারেটের ধোঁয়া বেরোচ্ছে যুবকদের মুখ থেকে, মুণ্ডুদের মুখ থেকে নয়, ধোঁয়ার গন্ধে নগেন দত্ত টের পেলেন ওরা চরস ফুঁকছে ।
    বোঝা গেল না জিজ্ঞাসায় আক্রান্ত কারা, মুণ্ডুদুটো নাকি পাশে বসে থাকা যুবকেরা ।
    টিকটিকি আর টিকটিকিনী বিরক্ত হল তাদের প্রেমে ব্যাঘাত ঘটায়, ক্লাইম্যাক্সে প্রায় পৌঁছে গিয়েছিল, বাধ সাধলো চরসের ধোঁয়া ; বিরক্তি জানাতে বাধ্য হল
    টিকটিকি : এই বাঞ্চোত মানুষগুলো আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না, আমাদের সবকিছু দখল করে নিয়েছে, কোথাও যাবার যো নেই, ওদের বাড়ির বউগুলো তো আমাদের দেখলেই অজ্ঞান হবার যোগাড়, যাও বা একটু দূরত্ব রেখে প্রেম করছি, তাও করতে দেবে না । এদিকে নিজেরা বাজার খুলে বসে আছে ।
    টিকটিকিনী : ওদের কথা আর বোলো না, ঘরের ভেতরে দেখেছি তো, মরদগুলো চুর হয়ে থাকে, পায়ের ফাঁকে গেল না বালিশের ফাঁকে গেল, সেসব টের পায় না, ব্যাস, নিজের শকড়ি বয়ে গেলেই হলো । মাগিগুলোও চুষে পকেট ফাঁকা করে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে । সেদিন তো একজনকে সিঁড়ি দিয়ে লাথিয়ে বের করে দিলে, যন্তর দিয়ে “আই লাভ ইউ” বলতে পারেনি বলে ।
    টিকটিকি : ওদের সংস্কৃতি হল গোলাপায়রার সংস্কৃতি, চোপরদিন বকরবকম বকরবকম ছাড়া অন্য কাজ নেই ।
    টিকটিকিনী : ওদের সমাজে যারা দুর্বল তাদের ওরা বলে ভালোমানুষ, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ ।
    টিকটিকি : ওয়ান টু থ্রি বলব, আর দুজনে মিলে ওদের মাথায় হাগবো, কি বলিস ? নে, ওয়ান টু থ্রি।
    টিকটিকি আর টিকটিকিনীর ন্যাড় ঝরে পড়ে যুবতী কন্ঠস্বরের যুবকদের কোঁকড়া চুলে, আর পাকতে লাগলো ওদের মাথার চুল ।
    নগেন দত্তের সন্দেহ হল যে এই দুই ধড়হীন মুণ্ডুর দেহ ডিকনসট্রাক্ট করে ফেলা হয়েছে, অবিনির্মাণ, পি সি সরকার, মানে প্রতুলচন্দ্র সরকার যেমন অবিনির্মাণ করতেন মঞ্চে রাখা তরুণীর দেহ, পি সি সরকারের বাবা ভগবানচন্দ্র সরকার ওনাদের টাঙ্গাইলের বাড়িতে ১৯০৯ সালে নগেন দত্তকে দেখিয়েছিলেন অবিনির্মাণের ক্যারদানিখানা, নগেন দত্ত তখন কৈশোরে আটকে আছেন , সবে গোঁফে রদবদল ঘটছে, কতোকাল আটকে ছিলেন কৈশোরে তা আর মনে নেই ওনার ।
    নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে নগেন দত্ত বললেন, দেখি, সময় পেলে এদের দেহ দুটো রিকনসট্রাক্ট করে জেনে নেবো প্রকৃত আদল-আদরা , এদের মুণ্ডুদের বোধহয় ডেফারাল চলছে।
    যুবকেরা মুণ্ডুদের ঠোঁট থেকে সিগারেট বের করে নিলে, দুটো মুণ্ডুই একসঙ্গে বলে উঠল, “নগেন এসেছ?”
    নগেন দত্তর মনে হল, মুণ্ডু দুটো নয়, যে যুবকেরা খাটের শিয়রে বসে আছে, কথাটা তারাই একসঙ্গে বলে উঠল ; নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে প্রশ্ন জেগে উঠল নগেন দত্তের, যুবকদের কন্ঠস্বর এরকম মেয়েলি আর সুরেলা কেন ? এরা সত্যিই যুবক নাকি তিনি কোনো মায়ায় আক্রান্ত হয়েছেন, পায়ুকামের মায়ায় । মুণ্ডু দুটো তাঁকে চিনল কেমন করে ! কখনও শুয়েছেন হয়তো এদের সঙ্গে, পঞ্চাশ, আশি, একশো বছর আগে, মুখ তো আর মনে থাকে না, বড়ো জোর বুকের উঁকি-দেয়া আঁচিল মনে থাকে, উরুর ট্যারা-চাউনি তিল মনে থাকে, ভগাঙ্কুরের জটার-পেন উথাল-পাথাল মনে থাকে, অকুস্হলের পাকানো চুলের গান মনে থাকে, মনমাতানো গন্ধ আর হাতমাতানো কোমর মনে থাকে ।
    মুণ্ডু দুজনের উদ্দেশে নগেন দত্ত বললেন, আপনাদের তো চিনতে পারছি না, আগেও কতোবার এসেছি, সকালে, দুপুরে, মাঝরাতে, কিন্তু কখনও দেখিনি তো, বললেন নগেন দত্ত, তারপর যোগ করলেন, দেহের বাকি অংশ নেই কেন ?
    চিনতে পারছ না কেন নগেন ? আমি তোমার তিথি আহমেদ, বেগমপুরের জর্দাভরা কতো পান খাইয়েছো, তুমি প্রথমবার যখন ঢাকায় রাতের-বউ বাছতে এলে তখন আমাকে বেছে নিয়েছিলে, আর জলপাইগুড়ি থেকে ছন্দরানি মজুমদারকে, তোমাদের গোবিন্দপুরের জমিদারিতে, ছাতিমগাঁয়ের বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলেছিলে, ভুলে গেলে এতো তাড়াতাড়ি ? বিলিতি মদ খাবার পর, তুমি আমায় আদর করে কখনও মেরি, কখনও এমিলি বলে ডাকতে । মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে চশমা, কাটা-মুণ্ডু, জোর করে হেসে বললে।
    নগেন দত্ত বললেন, মনে পড়েছে গো, বাবর আহমেদ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তিথি নামটা বড়ো ভালো লাগেছিল, অনেকের নামের ভেতরেই মাংসল ইশারা গোঁজা থাকে ।
    অন্য মুণ্ডু বলে উঠল, আর আমাকে মনে নেই তোমার ?
    ছন্দরানি মজুমদার ? তিনি কোথায়, দেখলে মনে করতে পারব হয়তো, উত্তরবঙ্গে যেতুম তো মাঝেমাঝে, দেশভাগের যেমন দুঃখের দিক ছিল, তেমনই আনন্দের দিকও ছিল, বললেন নগেন দত্ত ।
    তাঁর সন্দেহ হল যে মুণ্ডুটা নিজে কথাগুলো বলেনি, ছন্দরানির খাটের পাশে যে যুবক মুণ্ডুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কথাগুলো সেই বলল, অথচ কথা বলার মতন করে ছন্দরানির ঠোঁট তো নড়ছিল ।
    অ, মা, সেকি অলুক্ষুণে কতা গো, বলে উঠলে অন্য মুণ্ডু, আমিই তো ছন্দরানি মজুমদার, উত্তরবঙ্গে বেড়াতে গিয়ে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল তোমার, তুমি আমাকে আদর করে কখনও বলতে পুলি, কখনও বলতে মিশলি, এরই মধ্যে ভুলে গেলে, আমাদের দুজনকেই তো তুমি ছাতিমগাঁয়ের বাগানবাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছিলে ঢাকা আর জলপাইগুড়ি থেকে, গোড়েগ্রাম থেকে যুঁইবেলির মালা এনে দিতো মোচোরমান মালি, তোমার জুড়িগাড়ি করে, বাদামি রঙের একজোড়া ঘোড়া, সহিস দিদিয়ের সন্ধেবেলা গঙ্গার ধারে বেড়াতে নিয়ে যেতো ।
    যে নিজেকে ছন্দরানি বললে, নগেন দত্ত দেখলেন, তার মাথায় চুল নেই, টাক পড়ে গেছে, চোখে চশমা, ঠোঁট নড়ছিল বটে, কিন্তু কথাগুলো যে যুবকদের কন্ঠ থেকে বেরোচ্ছিল তা নিশ্চিত । বুড়িদের কন্ঠস্বর হলে তো কাঁপা-কাঁপা হতো । টাক পড়া মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে যুবতী-কন্ঠস্বরের যুবক ।
    তা তোমাদের দুঃখটা কিসের, জানতে চাইলেন নগেন দত্ত, যুবক দুজন হাত বুলিয়ে চলেছে, যন্ত্রণার কি উপশম হচ্ছে ?
    আমাদের দুঃখ চাউনির গো, চাউনির, বলে ওঠে দুই কাটা-মুণ্ড, কিংবা বোধহয় যুবতী কন্ঠস্বরের দুই যুবক ।
    মুখ আর পোশাক দেখে এদের যুবক ভাবছি, সত্যিই কি এরা যুবক, কন্ঠস্বর তো যুবতীর । এটা কি আমার চাউনির যন্ত্রণা, পোশাক আর মুখ দেখে মনে হচ্ছে ‘আছে’, কন্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে ‘নেই’, এই যুবক-যুবতী পার্থক্য করতে না পারা ? নিজেকে প্রশ্ন করলেন নগেন দত্ত ।
    মগজের গোলাপি অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে বললেন, আমার পায়ুকামেও আগ্রহ ছিল, এখনও আছে যৎসামান্য, হয়তো তাই এই আধাযুবক-আধাযুবতীদের দিকে টান অনুভব করছি । কিন্তু সে কামেচ্ছা পুরো করতো তিথি আহমেদ-ছন্দরানি মজুমদাররা আর নানা বয়সের নানা রানিরা । পুরুষদের সঙ্গে তো পায়ুকামের খেলা খেলিনি । নারীর দেহে ধরে থাকার মতন যে দুটি নোঙর থাকে তা পুরুষের দেহে নেই, নারীদেহের নোঙরগুলো আঁকড়ে অনেক ঝড়ঝাপটা পার হওয়া যায় ।
    তোমাদের আবার কিসের চাউনির যন্ত্রণা, যদি বলতে দেহ না থাকার যন্ত্রণা, বা গলাটা কাটা থাকার যন্ত্রণা, তাহলে না হয় বুঝতুম, চাউনি মেলে তো দিব্বি দেখছ, দেখেও এসেছ এতোকাল কতো কতো নানা মাপের নানা রঙের নানা দামের ‘আছে’, যার রসাস্বাদন করেছ তোমাদের ‘নেই’ দিয়ে ।
    আ খেলে যা, আমাদের দুজনের যন্ত্রণা কি একই হতে হবে, বললে তিথি আহমেদের মাথা, যতো চাউনি সারা জীবন আমাকে দেখেছে, আমার ‘নেইয়ের’ দিকে তাকিয়ে থেকেছে, আমার বুকের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, আমার বোঁটার দিকে তাকিয়ে থেকেছে, সব চাউনি জমা করা আছে আমার মনখারাপের ওজনপাল্লায় । যারা যারা দেখে গেছে তারা আমার ফাঁকফোকোর, বুক, বোঁটা, পাছা নিজেদের চাউনির সঙ্গে তুলে নিয়ে গেছে, যেন ওগুলো ওনাদের দখলের মালপত্তর।
    আমার চাউনি কিন্তু দেখেছে, বললে ছন্দরানি মজুমদারের মাথা, নজর রেখেছে,’আছেঅলাদের’ ওপর, ভেতর পর্যন্ত দেখেছে, সেপাইলস্করদের দেখেছে ।
    নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নেমে নগেন দত্ত নিজেকে বললেন, একথাও তো ঠিক, একজনের স্বাধীনতা মানে তো আরেকজনের স্বাধীনতা নয়, স্বাধীনতার নানা রকমফের আছে, কে কার থেকে, কী থেকে স্বাধীন হতে চায়, সেটা তো তার নিজের ব্যাপার ।
    যে ঘরগুলো দেখা যাচ্ছিল সেদিকে তাকিয়ে নগেন দত্ত বললেন, তোমাদের মেয়েদের ঘরে মেঝেয় শেতলপাটি পাতা নেই কেন ? ধুতি খুলব কোথায়, পরবই বা কোথায় দাঁড়িয়ে ? নরুণপেড়ে ধুতির কাছা-কোঁচা যে নোংরা হয়ে যাবে । পঞ্চাশ বছর আগেও পাতা থাকতো, তার আগেও পাতা থাকতো ।
    তিথি আহমেদের মুণ্ডু বললে, শেতলপাটির যুগ চলে গেছে গো, লোকে খেতে ধানগম পুঁতবে না শেতলপাটির গাছ পুঁতবে, শান্তিপুরী ধুতির যুগও চলে গেছে, এখন মাসিপিসির গ্যালারিতে হবু শশুররা হবু জামাইকে ট্রেনিং দেওয়াতে নিয়ে এলে লাল টকটকে ধুতি পরিয়ে আনে, বরযাত্রীদলের নাপিত এখানেই ধুতি খুলে দেখে নেয় যন্তর ঠিকঠাক আছে কিনা, তবু তুমি আমাদের রসের নাগর, বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে ধুতি খুলতে পারো, পরতেও পারো, তা ধুতি খোলার দরকারটাই বা কি, পরে থেকেও প্রণয় করা যায়, যেমন আমাদের করতে, একবার আমাকে একবার ওকে, একবার আমাকে একবার ওকে, একবার আমাকে একবার ওকে, এই করে তো সকাল হয়ে যেতো গো, তুমি কি আর আমাদের ঘুমুতে দিতে ।
    ছন্দরানির মাথা বললে, ধুতি খোলার দরকারটাই বা কেন, তুমি তো কখনও জাঙিয়া পরো না, ধুতি পরেই সব কাজ করতে । আজকাল, মঙ্গলা হাটের দিন ছাড়া, বুড়ো ক্লায়েন্টরাও ধুতি পরে আসে না, সবাই ফুলপ্যান্ট-শার্ট পরে আসে, তারা মেঝেয় ঝপ করে প্যান্ট ফেলে, কাজ সেরে চলে যায়, কারই বা কোমরে অতো সময় আছে, তোমার কালের মতন, তুমি ভুলে যাচ্ছ বোধহয় এটা হল যুগসন্ধিক্ষণ, ছোকরা বয়সীরা, যারা সকালে আসে, প্যান্ট খোলারও সময় পায় না, জিপ নাবিয়ে কাজ সেরে আপিসমুখো হয়, তাতে নাকি আপিসের চাপ কমে । আমি তাদের বলি ভালো গো ভালো, এখানে এসে চাপ বাড়াও, সেখানে গিয়ে চাপ কমাও ।
    অবাক হলেন না নগেন দত্ত, তবে কয়েকটা দরোজায় উনি দেখলেন মেয়েরা পেতলের ঝিকমিকে জিপ-বসানো হাফপ্যান্ট পরে, বুকে সাঁতার কাটার ফুলতোলা বুকবাঁধুনি, কাকে ছেড়ে কাকে বাছি মনে হচ্ছিল নগেন দত্তর । আজকালকার ফ্যাশান বেশ আকর্ষণীয়, মাসে প্রতিদিনই আসতে হবে, একদিনে একজনের সঙ্গে খেলা করা যাবে । তবে খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পারলেন, ওগুলো পোশাক নয়, আন্তর্জাতিক পেইনটারদের আঁকা ত্বক, যিনি যখন যার কাছে এসেছেন, চামড়ায় এঁকে দিয়ে গেছেন ।
    তার আগে কুন্দনন্দিনীকে ভালোবাসতে চাই, পেতেই হবে কুন্দনন্দিনীকে, ওহ কুন্দনন্দিনী । প্রেম করা, প্রণয় করা মানে ভালোবাসা নয় ।
    তিথি আহমেদ বললে, বুঝলে নগেন, তুমি ভালো বলে মহৎ, মহৎ বলে ক্ষমতাশালী, ক্ষমতাশালী বলে সুন্দর, সুন্দর বলে সুখি, সুখি বলে ঈশ্বরভক্ত ।
    ধন্যবাদ জানিয়ে নগেন দত্ত বললেন, আমি ঈশ্বরভক্ত ছিলুম, এখন আর নই রে, কেননা আমার বাবার সময়েই ঈশ্বর মারা গিয়েছিল, বাবা ঈশ্বরের শ্রাদ্ধশান্তি করিয়েছিলেন, হাজার লোক খেয়েছিল, এখন আমি আপনভক্ত । তবে আমার পোষা অ্যালসেশিয়ানটা আমাকে ওর একমাত্র ভগবান বলে মনে করে । বুঝলে কিনা, আমি কুকুরের ঈশ্বর ।
    ছন্দরানি মজুমদার বললে, উচিত কথা বলেছ নগেন, লাঞ্ছিত-নিপীড়িতরাই কেবল ভালো বলে গরিবরা ভালো, গরিবরা ভালো বলে নিম্নবর্গেরা ভালো, নিম্নবর্গেরা ভালো বলে সর্বহারারা ভালো, সর্বহারারা ভালো বলে তারা কষ্টজর্জর, কষ্টজর্জররা ভালো বলে তারা বঞ্চিত, বঞ্চিতরা ভালো বলে তারা অসুস্হ, অসুস্হরা ভালো বলে তারা কুশ্রী, কুশ্রীরা ভালো বলে তারা ধার্মিক ।
    ধন্যবাদ জানিয়ে নগেন দত্ত বললেন, ওই গরিব হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো, উদ্বাস্তু হওয়া ভালো, ইংরেজি না শেখা ভালো, কমপিউটার না শেখা ভালো, হড়তাল ডাকা ভালো, বনধ ডাকা ভালো, এগুলোয় আমি আর নিজেকে সোপর্দ করি না, একশো-দেড়শো বছর ধরে যথেষ্ট করেছি, মুখ টকে গেছে সেসব করে-করে ।
    কিছুক্ষণ থেমে, কোমরে দুহাত রেখে নগেন দত্ত বললেন, ১৯২২ সালে আমি স্ট্যালিনকে বলেছিলুম, হুঁশিয়ার, এই পেছলতত্ত্ব পিছলেই যাবে ল্যাঠামাছের মতন, স্ট্যালিন বিশ্বাস করলে না, ট্রটস্কির পেছনে লেগে গেল, এখন দ্যাখো, কোথাকার ভোমরা কোথায় গিয়ে মধু খাচ্ছে, মাটি ফুঁড়ে বেরোচ্ছে নানা মাপের মাফিয়া আর তাদের গোলাপিউরু লালকুঁচকি বিছানাবউ ।
    তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদার দুজনে একই সঙ্গে চিৎকার করে উঠলো, তাহলে তুমি কি চাও ?
    নগেন দত্ত বললেন, কুন্দনন্দিনীকে চাই, আসল কুন্দনন্দিনীকে চাই, তাকে ভালোবাসতে চাই।
    তিথি আহমেদ বললে, তাহলে তোমাকে সেই গানখানা শোনাই যেটা তোমার বাগানবাড়িতে নেচে-নেচে গাইতুম, প্রেমের গান, তাহলে তোমার বিশ্বাস হবে যে আমিই তোমার তিথি ।
    কোন গান ? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন নগেন দত্ত ।
    সেই যে পোস্টমডার্ন প্রেমের গানখানা, বলে, গাইতে আরম্ভ করল তিথি আহমেদের মাথা, গাইতে-গাইতে খাটের ওপরে ড্রোনের মতন ভাসতে লাগল মুণ্ডুখানা, তালে তালে হাততালি দিতে লাগল যুবতী কন্ঠস্বরের যুবকেরা, রাস্তার মোড়ে ভিকখে চাইবার সময়ে হিজড়েরা যেভাবে হাততালি দ্যায় :
    চাঁদনিরাতের পেতনিপিসি সজনেতলায় খোঁজ না রে
    থ্যাঁৎলামাথা হ্যাংলা সেথা হাড়কচকচ ভোজ মারে ।
    চালতাগাছে আলতাপরা নাক ঝোলানো শাঁকচুনি
    মাকড়ি নেড়ে বলে আমায় তো কেউ ডাকছনি ।
    মুণ্ডু ঝোলা উলটোবুড়ি ঝুলছে দেখ চুল খুলে,
    বলছে দুলে, মিনসেগুলোর মাংস খাব তুলতুলে ।
    নগেন দত্ত বললেন, হ্যাঁ, যতোদিন না মিনসেগুলোর মাংস খুবলে খাওয়া হচ্ছে, ততোদিন এমনি করেই চলবে, তারপর যোগ করলেন, আমার সারেঙ্গিঅলা ওস্তাদ তো তোমাদের পোস্ট-মার্কসিস্ট প্রেমের গান শিখিয়েছিল একখানা, মনে পড়ছে, মগজে বাজছে গানটা, ভুলে গেলে নাকি গো ?
    ছন্দরানি মজুমদারের মাথা বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব মনে আছে, তোমার মোসাহেবরা পাশ বালিশ জড়িয়ে মাঙনার আফিমের নেশা করে কতো মাথা দোলাতো, তুমি লণ্ডনে তোমার বাবার হরমোন চিকিৎসা করাতে নিয়ে যেতে বছরে একবার , তখনও মোসায়েবরা পাশবালিশ জড়িয়ে আফিম টেনে এই গানখানা শুনতে চাইতো । গাইছি শোনো, গাইতে গাইতে ছন্দরানির মাথা ড্রোনের মতন ভাসতে লাগল খাটের ওপর :
    মিশিমাখা শিখিপাখা আকাশের কানে কানে
    শিশিবোতল ছিপিঢাকা সরু সরু গানে গানে
    আলোভোলা বাঁকা আলো আধোআধো কতো দূরে
    সরু মোটা শাদা কালো ছলছল ছায়া সুরে
    গানের সুরে সুরে হাততালি দিচ্ছিল বটে যুবতী কন্ঠস্বরের যুবকেরা, কিন্তু সে হাততালি বুড়োদের মতন শ্লথ, কেননা তাদের পুরো চুলে পাক ধরে গেছে মাথায় টিকটিকি হাগার দরুন ।
    আরেকবার শুরু করতে যাচ্ছিল ছন্দরানি, নগেন দত্ত বললেন, থাক থাক, পরে আবার শুনবোখন, এখন তোমাদের মনে করার চেষ্টা করি, গান মনে এলেই তো আর গায়িকাকে মনে পড়ে না, তোমাদের দেহগুলো থাকলে নাহয় খুঁত দেখে-দেখে আর তিল গুনে-গুনে মনে করতে পারতুম ।
    এক পলক চোখ বুজে তিথি আহমেদ আর নন্দরানি মজুমদারের দেহ রিকনসট্রাক্ট করে ফেললেন নগেন দত্ত, পুণর্নিমাণ ।
    নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে বললেন, ১৯৬৭ সালে যখন প্যারিসে থাকতুম লাতিন কোয়ার্টারের একটা লজে, সবাই তাকে বলত বিট লজ, সেখানে উইলিয়াম বারোজ, গ্রেগরি কোর্সো, অ্যালেন গিন্সবার্গ, ব্রায়ন জিসিন নামে মার্কিন ছোকরারা ল্যাংটোপোঁদে হ্যাশিস ফুঁকে নাচতো, সেই লজ থেকে বাদামি কোটের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় বেরিয়েছি, তখন বসন্তকালের সকাল, রাস্তার দুপাশে চেরিব্লসম আর পলোনিয়া গাছের সারি, পার্কে-পার্কে আর ঝুলবারান্দার টবে ফুটে আছে হলুদ ড্যাফোডিল, পিওনিস, আইরিস, লিলি, গুর্দোঁ ফুল, বাচ্চারা নাসতুরতিয়াম ফুল ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছে, তখন জাক দেরিদা নামে একজন ফরাসির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তার কাছ থেকেই শিখেছিলুম, অবিনির্মাণ আর পুনর্ণিমানের ওয়র্ডপ্লে ।
    তারপর যখন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গেলুম, আমেরিকায়, তখন, ১৯৮১ সালের হেমন্তে, তামারঙের পাতায় ঢাকা কপার বিচ গাছ, হর্সচেস্টনাট গাছ থেকে সব পাতা ঝরে গেছে, নীল রঙের বিশাল মাপের লিঙ্গর মতন ফল ঝোলানো ডেড ম্যানস ফিংগার্স গাছ, লাল পাতায় ঢাকা জাপানি মেপল, জাপানি সেডারের ঝোপ চারিধারে, উপিং চেরি, রেড ওক, পড়াবার বদলে বাগানে ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগতো, সেই সময়ে পল ডি মান, জিওফ্রে হার্টম্যান, জে হিলস মিলার ওরা তো টেবিলের ওপর এক তরুণীর দেহের কাটা টুকরোগুলো রেখে, দিখিয়েছিল, কেমন করে জোড়া লাগাতে হয় আর আবার কেটে টুকরো করতে হয় ।
    নগেন দত্তের আপশোষ হল, কেন যে পি সি সরকার ওনার ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করে মানুষকাটার সময়ে কাটাকুটির তত্ব বানাননি ! তাহলে এখন তত্বের রয়ালটি পেতো ওনার বংশধররা, যেমন জাক দেরিদার রয়ালটি পাচ্ছে তার বংশধররা ।
    পুনর্নিমান প্রক্রিয়ার নিয়মগুলো প্রয়োগ করে দেখলেন নগেন দত্ত, তিথি আহমেদ ফর্সা, চোখ দুটো সামান্য কটা, নাক একটু টেপা, ঠোঁট চিনা মেয়েদের মতন গোল, কোমর পাতলা, বুক দুটো মাঝারি, পাছার ঢেউ আদরযোগ্য, অরগ্যাজমের অভিনয় করত না, জড়িয়ে ধরে নখ আর দাঁত বসাতো কাঁধে, পা দিয়ে কোমর জড়িয়ে নিতো ।
    মনে পড়তে লাগল, মদ খেয়ে যখন তিথি আহমেদ চুর হয়ে যেতো, ওর উলঙ্গ শরীর হয়ে উঠতো মায়াবী, পাঁজাকোলা করে পাক খেলে শরীর ভরে যেতো আগুনের হলকায়, সহজে নিভতো না সে আগুন, তরল আগুন, মদে মাতাল দেহের সঙ্গে প্রেম করাটা ধর্ষণ হয়ে যাবে ভেবে অপেক্ষা করতেন নগেন দত্ত, কখন তিথি আহমেদ খোঁয়ারির ভেতর থেকে তাঁকে ডাক দেবে ।
    তিথি আহমেদের মায়ের মায়ের মায়ের মায়ের মায়ের মায়ের মায়ের মায়ের মায়ের দিদিমির দিদিমা ছিলেন সুলতান ইলিয়াস শাহের পেয়ারের বাঁদির মেয়ে, তাই তিথির থুতুতে চাটগাঁইয়া স্বাদ বেশ ভালো লাগতো নগেন দত্তর, বুলিবুকনির যৌন আহ্লাদ উপভোগ করতেন, কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের ঢেউয়ের মতন দোল খেতো ওর উরু জোড়া । আহা সে কি ঘেমো মাংসল ঘুমের রাত গেছে ।
    একই প্রক্রিয়ায় দেখলেন, ছন্দরানি মজুমদার কালচে, চোখ দুটো বেশ বড়ো, কপাল ছোট্ট, কোঁকড়ানো চুল পাছা পর্যন্ত, বুক দুটো ঢাউস, পাছাও ঢাউস, কোমর পাতলা, অরগ্যাজম অনেক বার হতো, একের পর এক, শরীর কাঁপিয়ে-কাঁপিয়ে, একের পর আরেক, নিজেই ওপরে থাকতে চাইতো । ছন্দরানি মাতাল হয়ে কেবল হাসতো, হাসতেই থাকতো, যেন ওর ভাঁড়ারের শব্দরা ফুরিয়ে গিয়ে কেবল হাসিগুলোর দেহঢেউ টিকে আছে, হাসতে হাসতেই উঠে পড়তো নগেন দত্তের ওপর, কালচে কোমরে খেলতো ভুঁড়িনাচন, কখনও মায়াবি খোঁয়ারিতে হারিয়ে যেতো না ।
    চিকনচাম রোগাটে গুটকাখোর দালাল, নগেন দত্তর পাশে দাঁড়িয়ে হাবামুখে অপেক্ষা করছিল, বললে, স্যার চলুন না, এই গ্যালারির ম্যানেজার প্রফেসার চক্কোত্তির সঙ্গে কথা বলে রেট-সময় ঠিক করে নেবেন, এই সব বাজে কথা বলে ফালতু সময় নষ্ট করছেন, দেখছেন তো কেমন ভাসা-ভাসা প্রকৃতির, এতক্ষণে মনের মতন মেয়ে বেছে নিতে পারতেন, মাসকাবারি বাবু হতে চাইলে উনি ডিসকাউন্ট দ্যান, আপনি জোয়ান হয়েও দেড়-দুশো বছর আগে আসতেন বলছিলেন, তা উনি সিনিয়র সিটিজেনদের জন্যে ভরতুকির ব্যবস্হা রেখেছেন, সুগন্ধী কনডোম, ডিওডেরেন্ট, তোয়ালে, ফুলের মালা, বিছানায় ফুলশয্যার ফুল, অ্যাটাচড টয়লেট যাতে আপনার সামনেই আপনার প্রেমিকা ধোয়াধুয়ি না করে, ধোয়াধুয়ির জন্যে টয়লেটে জেট-ওয়াটার স্প্রে-পাইপ আছে, প্রথম দিন এক্সট্রা বেনেফিটস ফ্রি।
    দালালটাকে বুকপকেট থেকে একহাজার টাকার একটা নোট দিয়ে নগেন দত্ত বললেন, যা, এখান থেকে যা, এদের কাছ থেকে তোর দালালি চাইতে আসিসনি, জানিস তো আমাকে, কি থেকে কি হয়ে যাবি, নিজেই জানতে পারবি না।
    হ্যাঁ হুজুর হ্যাঁ হুজুর বলতে-বলতে সিঁড়ি বেয়ে প্রায় গড়িয়ে চলে গেল চিকনচাম পিম্প । উঠে এলো হাঁপাতে-হাঁপাতে, প্রমিথিউসের অদৃশ্য পাথর ঠেলে, বলল, স্যার, আকাশ থেকে কয়লার টুকরোর মতন বড়ো-বড়ো শিল পড়েছে, কুচকুচে কালো, হাঁটু জলে ভরে গেছে রাস্তা, এই দেখুন আমার পা দুখানা।
    নগেন দত্ত পায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, যা, আহিরিটোলা ঘাটে গিয়ে পা ধুয়ে নে, কালো জল নামতে সময় লাগবে, ওগুলো সব দিল্লি আর চেন্নাইয়ের উকিল ছিল, জমাট বেঁধে অন্য লোকেদের জান কয়লা করতে গিয়ে নিজেরাই কয়লা হয়ে গেছে।
    নগেন দত্ত ঢুকলেন পিসির ঘরে, ভেতরে আসতে পারি, ঢুকে দেখলেন, মহিলা নয়, একজন পুরুষমানুষ, ডানদিক ঘেঁষে সিঁথিকাটা, চুলে পাক ধরেছে, চোখে চশমা, মুখে পানের খিলি, চেনা মনে হল, আগের বার এসে দেখে থাকবেন, বা অন্য কোথাও, বিপ্লবে ব্যসনে দুর্ভিক্ষে, ঢুকে পড়লেন ঘরে, হ্যালো, প্রফেসার, হাউ আর ইউ ।
    মনে পড়ল, যে কালেজে নগেন দত্ত একসময়ে বিজ্ঞান পড়াতেন সেই কালেজেই দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন পি চক্রবর্তী ।
    ঘরে আরেকজন লোক বসেছিল, তার পাশে বসলেন নগেন দত্ত, ভালো পারফিউম মেখেছে লোকটা, চাককাটা ফুলশার্ট, চওড়া টাই, কালো ট্রাউজারে বেশ স্মার্ট ।
    তোমাদের কথা পুরো করে নাও, আমার তো তাড়াহুড়ো নেই, জানোই তো, বললেন নগেন দত্ত ।
    প্রফেসর পি চক্রবর্তী পরিচয় করিয়ে দিলে, ইনি নগেন দত্ত, ইনডাসট্রিয়ালিস্ট, জমিজমাও প্রচুর, বয়সের গাছপাথর নেই কথাটা এনাকে দেখেই বলে গেছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ওনার বঙ্গীয় শব্দকোষ বইখানায়, অবশ্য কলিম খান ওনার শব্দকোষে নগেন দত্তের উল্লেখ করেননি ।
    আগন্তুকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে প্রফেসর পি চক্রবর্তী, আর ইনি তারকনাথ ব্যানার্জি, লোকে ঠাট্টা করে বলে টিবি, রপ্তানির ব্যবসা করেন ।
    প্রফেসর পি চক্রবর্তী টেবিলের তলা থেকে একটা পাত্র তুলে তাতে পানের পিক ফেললেন, ওয়াক থুঃ ।
    পানের পিকদানিটা নতুন ধরণের দেখে নগেন দত্ত বললেন, অমন পিকদানি তো দেখিনি ।
    উত্তরে প্রফেসর পি চক্রবর্তী বললে, একে বলে ‘ওয়াখটিন’, নতুন বেরিয়েছে বছর ষাটেক হল, রাশিয়ায় একজন লোক ছিল মিখায়েল বাখতিন নামে, তার স্মৃতিতে বেরিয়েছে, এই ‘ওয়াখটিনে’ পানের পিক ফ্যালো, শিকনি ফ্যালো, থুতু ফ্যালো, ধাতুরস ফ্যালো, সব নিমেষে উবে যায় । আমার বা অন্যদের গ্যালারিতে যেমন নানা ভাষার খদ্দের এসে মিশে যায়, তেমনিই এই ‘ওয়াখটিন’, বাংলার ভেতরেই তুমি পাবে হিন্দি মারোয়াড়ি গুজরাতি পাঞ্জাবি অহমিয়া ওড়িয়া তামিল তেলুগু মালায়ালম কন্নড় মারাঠি আর যতো বিদেশি খদ্দের হয় সব ।
    আগন্তুক নগেন দত্তের দিকে মুখ করে বলল, এই প্রডাক্টটা আমরাই ম্যানুফ্যাকচার করি ।
    নগেন দত্ত চুপচাপ বসে পিসি আর টিবির কথা শুনতে লাগলেন ।
    পিসি : তিন পিসের দাম ক্যাশে দিতে হলে জিএমকে জিগ্যেস করতে হবে ।
    টিবি : জিগ্যেস করে তাড়াতাড়ি জানিও ।
    পিসি : অরিজিনাল না সেকেন্ডহ্যাণ্ড ?
    টিবি : অরিজিনাল ছিল, এক লাখে বিক্রি হয়েছিল এক-একটা আইটেম ।
    পিসি : রিপেয়ার করাতে হবে তার মানে ।
    টিবি : রিপেয়ার করিয়ে নিও, তোমার প্রবলেম কোথায়, তোমার কাছে তো ভালো রিপেয়ারিং ইউনিট আছে । দরকার হলে আরও ইমপ্রুভ করিয়ে নিতে পারো ।
    পিসি : জিএমের পারমিশান নিতে হবে ।
    টিবি : ইমপ্রুভ করিয়ে নিলে ওগুলো প্রত্যেকটা দুলাখে বিকোবে, ক্রেতা আমি যোগাড় করে দেবো । ওদের কাস্টমার সার্ভিস অনেক ভালো, কোনো বেগড়বাঁই নেই, নো কমপ্লেইন্টস ।
    পিসি : ওকে, জিএমের সঙ্গে ডিসকাস করে তোমায় কল ব্যাক করব ।
    টিবি : ওকে, বাই ।
    টিবি চলে গেল উঠে ।
    ঘরে এসি চলছে, পুরোনো উইনডো এসি, হালকা ঘরঘর আওয়াজ, টেবিলে ফুলদানিতে বিদেশি ফুলের তোড়া, মালদার কোনো পার্টি দিয়ে গিয়ে থাকবে দুপুরে আয়েস করতে এসে । কাচের গেলাসে সোনার দাঁতের পাটি ভিজছে, কার কে জানে, হয়তো কোনো খাজা খদ্দের ইল্লি করার সময়ে খুলে রেখেছিল । চারিদিকের দেয়ালে সুন্দরী-করে-তোলা মামুলি মেয়েদের পোস্টার । পেছনের দেয়ালে কোনো গুরু-মহারাজের গেরুয়া ছবি, হাত ওপরে তুলে বাতাসকে আশীর্বাদ করছে, খালি গায়ে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, ভুঁড়ি ঝুলে পড়েছে গেরুয়া লুঙ্গির তলায়, ফ্রেমে সাদাচন্দনে র‌্যাঁদামারা কাঠের মালা, যা বোধহয় গত চল্লিশ বছরে বদলানো হয়নি ; ঘরে চন্দনের গন্ধ বেরোচ্ছে, ধুপকাঠি থেকে। গুরু-মহারাজের ফোটোতে তাঁর বাণী সোনালী অক্ষরে লেখা রয়েছে, “সত্যের জয় কখনও হয় না, কখনও হয়নি, কখনও হবে না।”
    স্মার্টফোন আর অ্যাটাচি টেবিলের ওপর রাখলেন নগেন দত্ত ।
    প্রফেসার চক্রবর্তী অবাক উঠে দাঁড়িয়ে সবাক, বললেন, আরে, নগেন দত্ত না ? কতোকাল পরে দেখছি, পঞ্চাশ একশো না দুশো, অ্যাঁ, কত বছর হল । বোসো, বোসো, কি খাবে বলো, কনিয়াক না শেরি ? চুল্লু চাও তো তাও আছে, ওটাই বেশি চলে তিরিশ হাজারিনীর দেশে, জানোই তো মাফিয়া জন্মায় না এই ভূঁয়ে, সবই তাপ্পিমারা মাস্তান ।
    ---নো, থ্যাংকস, এখন পানভোজন করতে চাই না, অন্য কাজে এসেছি, হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ পঞ্চাশ বছর সাত মাস কুড়ি দিন আগে ; তুমি যখন কালেজে পড়াতে ।
    ---চন্দনকাঠের মালা দেখছিলে তো ? উনি আমার গুরু মহারাজ । খাঁটি একেবারে, বীরপ্পন ছিল গুরু-মহারাজের শিষ্য, নিজের হাতে গাছে র‌্যাঁদা মেরে মালা তৈরি করে পরিয়ে দিয়েছিল ওনাকে ।
    ‘ওয়াখটিন’-এ আরেকবার পিক ফেলে প্রফেসর চক্কোত্তি বলল, এই তিরিশ হাজারিনীর দেশে মনুস্মৃতি চলে না, বুঝলে, আর যেখানেই চলুক, ক্লায়েন্টরা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে তাদের জাত-ধর্ম-পরিবার সবকিছু পেছনে ফেলে আসে । শিষ্যদের পনজিস্কিমের টাকায় গুরু-মহারাজ নিজের টিভি, সংবাদপত্র, ল্যাংবোট অনেককিছু করে ফেলেছেন । অধ্যাপক চক্কোত্তি যোগ করলে, তোমার চেহারার বেশ খোলতাই হয়েছে কিন্তু, সেই পঁচিশ বছরই চলছে বোধহয় ?
    ---হ্যাঁ, দাদামশায়ের উইলের আইনি বাঁধন তো উপেক্ষা করতে পারি না ।
    ---আমি তো, জানোই, সাতাশি বছর কার্ড হোল্ডার ছিলুম, কিন্তু হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট করলে না, বড়ো-ছোটো এমনকি চুনোপুঁটিদেরও কতো তেল দিলুম, কোনও ফল হল না, তাই রেগেমেগে এই লাইনে চলে এলুম, গুরু-মহারাজের কাছে দীক্ষা নিয়ে শান্তিতে ব্যবসা চালাচ্ছি । আগেরবার এসে কুন্দনন্দিনী নামে একটি মেয়ের খোঁজ করেছিলে, মনে আছে, রেকর্ড করা আছে আমার মোবাইলে, মালদার ক্লায়েন্ট পেলে তাদের শোনাই তোমার বর্ণনা, টিভিতে আমাদের সেক্সুয়াল পাওয়ার বাড়াবার প্রডাক্ট বিক্রির জন্যে কাজে লাগাই ।
    ---মানে ? ওই জাপানি কোরিয়ান ক্যামবোডিয়ান তেল ? বুলেট-বড়ি ? স্টে অন ? হোল নাইট ?
    ---কারেক্ট, কারেক্ট । তোমার উদাত্ত গলা বেশ কাজে দ্যায় ।
    ---তাই বুঝি ? কই শোনাও তো । কারখানা-টারখানা খুলে ব্যবসাও করছ তাহলে । এটা সাইড বিজনেস? আগ্রহ না থাকলেও কথার পিঠে কথা চাপিয়ে বললেন নগেন দত্ত ।
    অধ্যাপক চক্রবর্তী তাঁর টেবিলের ডেস্কটপে একটা সিডি ঢুকিয়ে বললেন, শোনো, তোমারই কন্ঠস্বর। ব্যাকগ্রাউন্ডে গিটারের মৃদু আবহ গড়ে নগেন দত্তের কথাগুলো শুনতে লাগলেন নগেন দত্ত ।
    “বৃহৎ নীল দুইটি চক্ষু --- চক্ষু দুইটি শরতের মত সর্বদাই স্বচ্ছ জলে ভাসিতেছে -- সেই দুইটি চক্ষু আমার মুখের উপর স্হাপিত করিয়া চাহিয়া থাকে ; কিছু বলে না --- আমি সে চক্ষু দেখিতে দেখিতে অন্যমনস্ক হই, আর বুঝাইতে পারি না । তুমি আমার মতিস্হৈর্যের এই পরিচয় শুনিয়া হাসিবে, বিশেষ তুমি বাতিকের গুণে গাছ কয় চুল পাকাইয়া ব্যঙ্গ করিবার পরওয়ানা হাসিল করিয়াছ ; কিন্তু যদি তোমাকে সেই দুইটি চক্ষুর সন্মুখে দাঁড় করাইতে পারি, তবে তোমারও মতিস্হৈর্যের পরিচয় পাই । চক্ষু দুইটি যে কিরূপ তাহা আমি এ-পর্যন্ত স্হির করিতে পারিলাম না । তাহা দুইবার একরকম দেখিলাম না ; আমার বোধহয়, যেন এ পৃথিবীর সে চোখ নয় ; অন্তরীক্ষে যেন কি দেখিয়া তাহাতে নিযুক্ত আছে । কুন্দ যে নির্দোষ সুন্দরী, তাহা নহে । অনেকের সঙ্গে তুলনায় তাহার মুখাবয়ব অপেক্ষাকৃত অপ্রশংসনীয় বোধ হয়, অথচ আমার বোধহয়, এমন সুন্দরী কখনও দেখিনাই । বোধহয় যেন কুন্দনন্দিনীতে পৃথিবী ছাড়া কিছু আছে, রক্তমাংসের যেন গঠন নয়, যেন চন্দ্রকর কি পুষ্পসৌরভকে শরীরী করিয়া তাহাকে গড়িয়াছে । তাহার সঙ্গে তুলনা করিবার সামগ্রী হঠাৎ মনে হয় না । অতুল্য পদার্থটি, তাহার সর্বাঙ্গীন শান্তভাবব্যক্তি --- যদি স্বচ্ছ সরোবরে শরচ্চন্দ্রের কিরণসম্পাতে যে ভাবব্যক্তি, তাহা বিশেষ করিয়ে দেখ তবে ইহার সাদৃশ্য কতন অন্তর্ভূত করিতে পারিবে । তুলনায় অন্য সামগ্রী পাইলাম না।”
    সিডিটা ড্রয়ারে রেখে প্রফেসার চক্রবর্তী বললেন, তোমার এই অসাধারণ বর্ণনার দরুণ একজন কুন্দনন্দিনীকে কেউ এংগেজ করে নিলে সেদিন আরেকজনকে কুন্দনন্দিনী নামে চালাই, সেও এংগেজ হয়ে গেলে অন্য কাউকে কুন্দনন্দিনী নামে চালিয়ে দিই । বাইরে নিয়ে যাবার অর্ডার এলে কচি কুন্দনন্দিনীকে পাঠাই না, ডুলিকেট, ট্রিপলিকেট যে ফ্রি থাকে তাকে কুন্দনন্দিনী নাম দিয়ে পাঠিয়ে দিই, সবাইকে ট্রেনিং দেয়া আছে । বুঝতেই পারছ, এটা সাইড বিজনেস নয়, প্রধান ব্যবসা, পলিটিশিয়ানদের সঙ্গে ওঠাবসার দরুন অনেক সময়ে পাশের গ্যালারি থেকে পারফরমিং ফ্লেশ ধার নিই । সত্যি কথা বলতে কি, আসল কুন্দনন্দিনী যে কে তা আমি নিজেই জানি না, তাই গোলমাল এড়াতে সবায়ের নামই কুন্দনন্দিনী করে দিয়েছি ।
    ---পারফরমিং ফ্লেশ ? প্রশ্ন তুলে নগেন দত্ত নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে বললেন, কন্ঠস্বরটা আমার নয়, একজন ডেপুটি ম্যাজিসট্রেটের, যাঁর বন্দে মাতরম গান এখন অনেকে খাকি ঢোলা-হাফপ্যান্ট পরে গায়, অনেকে তাকে নিজেদের স্লোগান বানিয়ে ফেলেছে, অনেকে আবার ডেপুটি ম্যাজিসট্রেটকে পছন্দ করে না, তারা বলে স্লোগানটা তাদের ধর্মবিরোধী ।
    অধ্যাপক চক্রবর্তী বললেন, তাছাড়া আর কী ? ক্লায়েন্ট তো এমন ফ্লেশ চায় যে মনের মতন পারফর্ম করবে । নয়কি ? আঠার সঙ্গে আঠা জুড়ে শরীরে ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলবে, তুমিও তো তাই চাও । কুন্দনন্দিনী তোমাকে মনের মতন পারফরম্যান্স দিয়েছিল বলেই তো তাকে দু-আড়াইশো বছরেও ভুলতে পারোনি ।
    ----না না, ভুল ধারণা, আমি ভালোবাসতে চেয়েছি, ভালোবাসা পেতে চেয়েছি, কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে শোয়া হয়নি কখনও, তাকে খুঁজে ফিরছি একশো-দেড়শো বছর হয়ে গেল , সারা দেশের লোকালয় ঘুরে-ঘুরে খুঁজে চলেছি ।
    ----আরে সেই কথাই তো বলছি, পারফরমিং ফ্লেশ হল একটা আর্ট, আর যে ওই আর্টকে অ্যাপলাই করতে শিখে গেছে, সে ভালোবাসা এগজিবিট করতে শিখে গেছে বুঝতে হবে, আর্টের বাংলা হল শিল্প । ভালোবাসা হল সবচেয়ে উন্নত প্রদর্শনী, একে আরেকের কাছে, দেখছি তো কতো মাল আসে আর যায়, আজ একশো বছর হতে চলল, আমি কি আর ভালোবাসাবাসি করিনি ভাবছ, অনেকের সঙ্গে করেছি, সে ছিল ভালোবাসার দিনকাল, তখন আমাকে রোগে ধরেনি, এখন সকলে কুইকি পছন্দ করে, মরনিং আফটার ট্যাবলেট বেরিয়ে আমাদের মার্কেট ডাউন করে দিয়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলো, তার ওপর ভার্জিনিটি রিপেয়ারিঙেরও ক্লিনিক বড়ো-বড়ো শহরে, আমার কাছে কোনো খদ্দের ভার্জিন মাল চাইতে এলে স্টকের কম বয়সী মেয়ের ভার্জিনিটি রিপেয়ার করিয়ে পাঠাই পার্টিকে ।
    চক্কোত্তি বলা বজায় রাখলে, সিগারেট ধরিয়ে এক ফুঁক মেরে, আমার স্টকে কোনো মেয়ে এলে তাকে শেখাতে হয় যে ক্লায়েন্টের ক্লাইম্যাক্স যখন হবে, তার সঙ্গে অরগ্যাজমের অভিনয় করতে হবে, যাতে সে নিজেকে সফল মনে করে, যদি সে অবাঙালি হয় তাহলে তাকে ‘জানেমন, বলম পরদেসি, আপকা প্যার মুঝে পাগল কর দিয়া, ফির জরুর আইয়েগা, ম্যায় ইন্তজার করুঙ্গি’ আর যদি বাঙালি হয় তাহলে একই ভাবে সিংক্রোনাইজ করে তাকে বলতে হবে, ‘আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি, এতো সুন্দর করে আপনি ভালোবাসা দেন প্রতিদান না দিয়ে পারি না, আপনার মতন এভাবে কেউ ভালোবাসেনি আমায়, আবার নিশ্চই আসবেন, আমি অপেক্ষা করব’, এটসেটরা, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে টেনশন কমাবার জন্যে যে খোকা কাস্টমার আসে, তাদের বলতে হয়, আবার এসো, লক্ষিটি, সব শিখিয়ে দেবো, কতোরকমের আনন্দ হয় জানতে পারবে, আমি অপেক্ষা করব, অ্যাঁ, তারপর থুতনিতে হাত বুলিয়ে খোকা-ক্লায়েন্টকে পার্টিং কিস দিতে হয়, অভিনয় শেখাবার জন্যে চিৎপুর যাত্রাদল থেকে অভিনেত্রী ভাড়া করে আনি ।
    নগেন দত্ত জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা, বারান্দায় দুটি ধড়হীন মাথা দেখলুম, বললে তারা তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদার, আমার লিভ টুগেদার বউ ছিল, মনে করতে পারলুম না, তাদের দেহে তো সালভাদর দালি আর পাবলো পিকাসোর পেইনটিঙ শাড়ির মতন করে আঁকা ছিল । যুবতী-কন্ঠস্বরের যুবকরাই বা কেন পাশে বসে মাথায় হাত বোলাচ্ছে, তাও বুঝতে পারলুম না ।
    প্রফেসার চক্কোত্তি ওরফে পিসি চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলের ওপর রেখে, মদখোর চিকনগালে বাঁহাত দিয়ে আদর করতে-করতে, সুইংগিং চেয়ারে একচিলতে হেলে বললে, তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদার হলেন গাইড, কালেজে হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট ছিলেন, অবসর নিয়েছেন, তোমার দাদামশায়ের উইল অনুযায়ী, যে বয়সে ওনাদের শেষবার দেখেছিলে সেই বয়সেই আটকে আছেন, ছাত্রদের গাইড করার জন্যে মাথাটাকে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন করে তোলেন ওনারা, সেই ক্ষমতাও তো তোমার দাদামশায়ের উইল অনুযায়ী তোমারই দেয়া, আর যুবতী-কন্ঠস্বরের যুবক দুজন ওনাদের আন্ডারে ডক্টরেট করছে, কেননা আজকাল ডক্টরেট না করলে লেকচারারের চাকরি পাকা হয় না, মাইনেও স্কেল অনুযায়ী হয় না, ডক্টরেট করার জ্ঞানের জন্যে আফগানি খাঁটি চরস আনিয়ে দিয়েছি।
    তা না হয় বুঝলুম, বললেন নগেন দত্ত, তা ওদের ধড় নেই কেন ।
    যে গাইডদের ধড় থাকে তারা বেশ বিপজ্জনক ; তাদের সঙ্গে না শুলে, তাদের সঙ্গে দার্জিলিং, দীঘা কিংবা পুরিতে বেড়াতে না গেলে গাইডরা পিএইচডির কাগজটা সহজে ছাড়ে না । আমাকে তো ওদের জন্যে একটা পুরো লাইব্রেরি খুলতে হয়েছে, ওই তো দ্যাখো, তবে কোনো বইই আমার গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে কেনা নয় । ওনাদের নাম তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদার হলেও, ধড় নেই বলে ছাত্রীরা নিশ্চিত হতে পেরেছে যে লেসবিয়ান কাজকম্মো করতে পারবেন না, আজকাল সকলেই যে-যার দেহকে যুগপোযোগী করে ফেলেছে, জানো তো ।
    ঘষাকাচের পার্টিশানের লাগোয়া গোদরেজ আলমারিতে রাখা বইগুলো কাছ থেকে দেখতে গেলেন নগেন দত্ত, যদি কাজে লাগে এমন কোনো বই , যদিও ওনার বাবা নিজেদের কারখানা আর ব্যবসা অন্ধ্রপ্রদেশে তুলে নিয়ে গেছেন, ইনকেলাব জিন্দাবাদ চলবে না চলবে না, এড়াবার জন্যে, বইগুলো দাতব্য করে দিয়েছিলেন গ্রামের চণ্ডীমন্দিরে ।
    নগেন দত্ত বললেন, দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম শুনেছ তো ? তা দ্বারকাবাবুর ব্যাংক ইনশিওরেন্স জাহাজ কোম্পানি চটকল কয়লা চা বাগানের ম্যানেজিং এজেন্সি আর চিনে আফিম পাঠাবার কারবারে আমার বাবার আর ঠাকুর্দার শেয়ারের কাগজ ছিল, হঠাৎ করে উনি মারা গেলেন আর সেই থেকে বাঙালির ব্যবসা লাটে উঠে গেল । ১৮৪৬ সালের আগস্টে আমি তো বাবার সঙ্গে লণ্ডনে ছিলুম যখন দ্বারকাবাবুর দেহ থেকে হৃৎপিণ্ড কেটে নিয়ে ওনাকে কেনসাল গ্রিন গোরস্তানে কবর দেয়া হয়েছিল ।
    ভুরু কুঁচকে নগেন দত্ত বললেন, ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠিয়ে দেবার দায় ওনার ছেলে দেবেন্দ্রনাথ আর নাতিদের । দেবেনবাবু বেমমো-বেমমো করে এমন ধর্ম নিয়ে পড়ল যে ব্যবসা ছারখার, তারপর যাও বা পুঁজি ছিল, দ্বারকাবাবুর নাতিরা পড়াশুনা আর লেখালিখিতে খরচ করে নামখ্যাতি করার পেছনে দৌড়ুলো । এখন সব ফক্কা-টরেটক্কা, কোন বেমমো যে কোথায় আছে তার খোঁজখবর রাখেনা কেউ, মাদুর গুটিয়ে শান্তিনিকেতনে, সেখানেও হরেদরে পেঁকোজল, অধ্যাপকরা পড়াবার বদলে অন্য কাজে লেগে থাকে। পুরস্কারের সোনার বিসকুটটাও কেউ নিয়ে গিয়ে গয়না করে ফেলেছে।
    কয়েকটা বই দেখে, সেদিকে আঙুল দেখিয়ে, নগেন দত্ত বললেন, এই বইগুলো তোমার এখানে কারোর কাজে লাগে নাকি ?
    ---আমার আলমারিতে যে বইপত্র দেখছ সবই ক্লায়েন্টদের ডোনেট করা কিংবা ভুলে ফেলে যাওয়া, তবুও কাজে লাগে ডক্টরেট করিয়ে ছাত্রীদের । একবার এক মার্কিন ছাত্রী গবেষণার উদ্দেশ্যে একমাসের জন্যে যৌনকর্মীর কাজ করে গেল, ক্লায়েন্টদের সাক্ষাৎকার নিতো কথা বলার ছলে, মেম পাবার জন্যে আগে থেকে ক্লায়েন্টরা বায়না দিয়ে যেতো, অনেক প্রফিট করেছি ওই এক মাস, সে প্রচুর বই ফেলে গেছে, ওই যে বিটকেল নামের বইগুলো, অন গ্র্যামেটোলজি অফ সেক্স, ফরম্যালিজম অ্যান্ড দি নিউড, এগজিসটেনশিয়াল পোজিশানস, ডিকন্সট্রাকশান অফ দি ফ্যালাস, দি রিটার্ন অফ দি রিয়াল স্লিট, হারমেনিউটিক্স অ্যাজ হরমোনাল চেঞ্জ, বডি অফ দি আদার, দি ট্রুথ অ্যাবাউট দি ট্রুথ অফ ইমমরট্যাল ট্রাইঅ্যাঙ্গল, কার কাজে যে লাগে ঈশ্বরই জানেন, প্রচ্ছদ দেখে পড়ুয়া কাস্টমাররা প্রশংসা করে অথচ পড়ে না ।
    ---আর এগুলো, এগুলোও কেউ ডোনেট করেছে নাকি ?
    ---না না, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো আর দাস ক্যাপিটালের কথা বলছ তো ? ওগুলো এক ছোকরা কমরেডের, বইগুলোর গন্ধ শুঁকলেই বুঝতে পারবে সোভিয়েত দেশে ছাপানো, গোরুর খুর গলিয়ে তৈরি আঠায় পুট সাঁটা হয়েছে, বৃষ্টি পড়লেই বইগুলো সোভিয়েত দেশের দুঃখে দুর্গন্ধ ছাড়ে ।
    তা জানি, তা জানি, রাশিয়ার গোরু আর রাশিয়ার মেয়েমানুষ, ওদের থন তো বিশ্বখ্যাত, তা সে যতোই দুর্গন্ধ থাকুক, একবার মুখ গুঁজে পড়ে থাকলে রাশিয়ার পুরো শীতকাল কাবার হয়ে যায় । বললেন নগেন দত্ত, বিশেষজ্ঞর গাম্ভীর্যে।।
    সেই ছোকরা কমরেড রাতটা কাটিয়ে সকালে উঠে টিভিতে জানতে পারলো যে পরিবর্তনের সরকার গদিতে বসতে চলেছে, কমরেডদের রাজত্ব শেষ, পরিবর্তনঅলারা কমরেডদের ধরে-ধরে আড়ং ধোলাই দিচ্ছে । রাতের কমরেড এমন ধরাধরি করতে লাগল যে নাপিত ডাকিয়ে তার দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে, চুল কদমছাঁট করিয়ে এখান থেকে বেরিয়েছিল, কাঁধের ঝোলাটা আমার টেবিলের ওপর ফেলে বলেছিল, এগুলোর যা গতি করার করবেন ।
    ড্রয়ার থেকে নোংরা বাদামি একটা কাঁধব্যাগ বের করে চক্কোত্তি বললে, এই ঝোলা থেকেই ওই বইগুলো পেয়েছিলুম, আর একটা ডায়েরি, সেটা আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি, ব্যাটা এখানে কার সঙ্গে কবে শুয়েছে, তার দিনক্ষণ-রেট সবই লিখে রেখেছিল, মেয়েরা কত রকমের, তাদের গুণদোষ কি-কি। বই পড়াপড়ি আর লেখালিখিই কাল হয়েছে বাঙালির ।
    তাতে কুন্দনন্দিনীর নাম ছিল ? জানতে চাইলেন নগেন দত্ত ।
    অতো আর দেখিনি, থাকলেও থাকতে পারে, সকলের নামই তো কুন্দনন্দিনী করে দিয়েছি, বললেন প্রফেসর চক্কোত্তি । তারপর যোগ করলেন, যেন কোনো ব্যাপারই নয় এমন স্বাভাবিক কন্ঠস্বরে, ছোকরাকে সেদিন রাতেই পিটিয়ে মেরেছিল, ছবি বেরিয়েছিল কাগজে, কে বা কারা মেরেছিল তা আজও ধরতে পারেনি পুলিশ, তবে বিশ্বস্ত সূত্রের খবর ছাপা হয়েছিল যে তার সাগরেদরা যারা রাতারাতি কমরেড থেকে পরিবর্তনের দিকে চলে গিয়েছিল তারাই ওকে সাবড়ে দিলে । টিভিতে দেখোছো তো ব্যাঙরা ওজনপাল্লার একদিক থেকে আরেক দিকে লাফাচ্ছে, কানমুলে নাক খৎ দিচ্ছে ।
    তোমার আলমারিতে তো কুড়িটি প্রেমের চটচটে উপন্যাস, পনেরোটি ভালোবাসার রগরগে উপন্যাস, তিনশো প্রেমের ভিজে কবিতা, শ্রেষ্ঠ প্রেমের চকাচক কবিতা, শ্রেষ্ঠ ভুতের ননস্টপ প্রেমের কবিতা, শ্রেষ্ঠখোকাদের প্রেমের কবিতা, কাফকার প্রেমের উপন্যাস, ডসটয়েভস্কির ভালোবাসা, মুরাকামির জাপানি যৌনতা আর প্রেম, আরও অনেকের শ্রেষ্ঠপ্রেমের কবিতার বই দেখছি । ওগুলোও কি ফেলে গেছে ক্লায়েন্টরা ?
    না, কেউ কেউ কুন্দনন্দিনীদের উপহার দিয়ে গেছে । শোবার আগে নিজেদের কবিতা শুনতে চেয়েছে কুন্দনন্দিনীদের গলায় । প্রধান অতিথি হয়ে দেখেছি তো, কবিতাপাঠের আসরে তো কেউ বড়ো একটা কবিতা শোনে না, পেছনের সারিতে বসে ঝিমোয়, চা-সিঙাড়া খেয়ে কেটে পড়ে নিজের কবিতা পড়ার পর, তাই একরাতের ভালোবাসার পাত্রীর গলায় নিজের কবিতা শুনে দাঁড়ানো যন্তরকে শোনায় ।
    টেবিলের ওপর রাখা গুরু-মহারাজের ফোটো ঝোলা দিয়ে মুছে অধ্যাপক চক্রবর্তী বললে,
    আমার প্রজেক্ট অত্যন্ত সরল ; পুরুষরা ইডিয়ট, আমার কুন্দনন্দিনীদের কাজ হল তাদের বোকা বানিয়ে যতো পারা যায় নিংড়ে নেয়া। তাই তো চব্বিশ ঘণ্টা একটা টেলিফোন সেক্সের লাইন খোলা রাখি ।
    টেলিফোন সেক্স ? তাতে মন ভরে ? জানতে চাইলেন নগেন দত্ত ।
    পুরুষদের ইডিয়ট বলেছে কেন, ইডিয়ট জানোয়ার, মেয়েদের সিডাকটিভ গলার আওয়াজ স্বমেহন করতে সাহায্য করে ; যে মেয়েদের অবসর নেবার বয়স হয়েছে, তাদের আমি টেলিফোন সেক্সের টেবিলে বসিয়ে দিই পালা করে, তাদের অভিজ্ঞতা কাজে দ্যায়, একটা মালটিলাইন বোর্ড আছে তার জন্য, আগেই অনলাইন পেমেন্ট করতে হয়, ইনটারনেটে স্কাইপে যৌনআলাপের ব্যবস্হাও করেছি, তাতে অবসরপ্রাপ্তদের বসিয়ে দিই ফিল্ম স্টারের মুখোশ পরিয়ে । ব্যাকগ্রাউণ্ডে বাংলা বা হিন্দি ফিলমের গান বাজে, হওলে-হওলে, ছিনছিনাছিনছিন, ইয়ামবা ইয়ামবা ।
    যাকগে যাক, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো আর ডায়েরিটা বের করে দাও তো একটু, কেমন যেন চেনা-চেনা লাগছে, বললেন নগেন দত্ত, গলায় উদ্বেগ ।
    প্রফেসর চক্কোত্তি, নিজের মনে বললেন, কোন জিনিয়াসের পাল্লায় পড়েছি, মাঝে মাঝেই আসে আর কেলো করে যায়, ঘাঁটাতে চাই না বেশি, কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা কোথা থেকে পায় কে জানে, এমনও নয় যে টাকাগুলো চিনে ছাপিয়ে পাকিস্তানি কিংবা বাংলাদেশিরা এপারে এনেছে, সবই খাঁটি টাকা, যাচাই করিয়ে দেখেছি, তবুও প্রতিভাধর বলে কথা, এঁটুলির বাড়ন্ত, জিনিয়াসের সঙ্গদান করার সময়ে সকলকেই সাময়িকভাবে পাগল হয়ে উঠতে হয়, তাই কিই বা করি, পাগলামিই করি, অবশ্য পাগলামি করার মধ্যে আনন্দ আছে ।
    বইয়ের গোদরেজ আলমারি থেকে ডায়েরি, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো আর দাস ক্যাপিটাল বের করে, প্রফেসর চক্কোত্তি টেবিলের ওপর রাখতেই, নগেন দত্ত প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন, আরে এগুলো তো আমারই, আমিই ফেলে গিয়েছিলুম কখনও ।
    এই দ্যাখো, বললেন নগেন দত্ত, ১৭৫২ সালে ভারত মুকুজ্জে নিজের হাতে ‘রসমঞ্জরী’ বই থেকে এই লাইনগুলো লিখে দিয়েছিলেন । ভারত মুকুজ্জেকে জানো তো, ওই যে, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, মহারাজা কেষ্টচন্দ্রর দরবারি কবি ছিলেন, তোমার এই গ্যালারিতে কতোবার এসেছেন-গেছেন, ওনার অভিজ্ঞতার থই পাওয়া যাবে না, আমি তো ওনার নির্দেশিকা মিলিয়ে কুন্দনন্দিনীকে মনে-মনে আবার থেকে গড়ে নিয়েছি । তুমিও এই নির্দেশিকা দেখে বাছবাছাই করতে পারো, এতো কুন্দনন্দিনী তোমার আণ্ডারে ।
    ---না, আমি মানিক বাঁড়ুজ্জের শশীরোগে ভুগি, বললেন প্রফেসার চক্কোত্তি । বলার পর তাঁর সন্দেহ হল যে এই রোগের জন্যে নগেন দত্তই দায়ি, গেলবার নগেন দত্ত ফিরে যাবার পর থেকে এই রোগে ধরেছে তাঁকে, নগেন দত্তের আসল কুন্দনন্দিনীকে খুঁজে দিতে পারেননি সেবার । এবার লোকটা কী করবে কে জানে, হয়তো তাঁকে বলবে “তুমি মোটা চামড়ার মানুষ”, আর উনি নিমেষে গণ্ডার হয়ে যাবেন ।
    নগেন দত্ত শশীরোগের বিষয়ে জানেন না বলে অপ্রস্তুত গলায় বললেন, অমন রোগের কথা শুনিনি তো ।
    মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বইটা পড়েছ তো, তাতে শশী নামে যে চরিত্র আছে, তার এরেকটাইল ডিসফাংশান রোগ ছিল, আমিও আজকাল ওই রোগেই ভুগি ।
    নিজের মগজের ভেতরে নিজেকে নগেন দত্ত বললেন, তার মানে ‘আছে’ থেকেও ‘নেই’ । বিইং নিজেই নাথিংনেস, চিন্তা করে হাসতে লাগলেন, কীক্কাণ্ড, বিইং আর নাথিংনেসে কোনো তফাতই থাকে না বহু ক্ষেত্রে । সিঁড়ির দেয়ালের পেইনটিঙের মানে ছবি দেখে যা মনে হয়েছিল তা নয় । দুটো অঙ্গের প্রতিটিই নাথিংনেস হতে পারে ।
    নগেন দত্ত বললেন, তোমার কথায় মনে পড়ে গেল, ১৯২১ সালে একবার শরৎ চাটুজ্জের সঙ্গে চিনেপাড়ায় দেখা হয়েছিল, উনি আফিম কিনতে গিয়েছিলেন আর আমি আফিম সাপলাই দিতে গিয়েছিলুম এক চীনে হোলসেলারকে, মালদায় আমাদের যে জমিদারি, সেখানে প্রচুর পোস্তখেত আছে, তা শরৎ চাটুজ্জেকে আমি জিগ্যেস করেছিলুম যে চন্দ্রমুখীর সঙ্গে দেবদাসের রিলেশানশিপটা কমপ্লিকেটেড করে দিলেন কেন ? উনি বলেছিলেন, দেবদাস এতো মদ খেতো যে ওকে এরেকটাইল ডিসফাংশান রোগে ধরেছিল, তা বুঝতে পারার পর দেবদাস মদ খাওয়া আরও বাড়িয়ে দিলে, ধেনো টানতে লাগল, তা আমি আর কি করি, দেবদাসের মুখে মাতালের সংলাপ দেয়া ছাড়া , সংলাপের জন্যে বইটা হিট হয়ে গেল, একটা বইয়ের সংলাপের টাকা থেকে সারা বছরের আফিমের খরচ উঠে যায় ।
    ---এখনও পোস্তচাষ হয় ? এখন তো মার্কিন চাপে আফিম বেআইনি হয়ে গেছে শুনি, জানতে চাইলেন অধ্যাপক চক্রবর্তী ।
    ---বেআইনি বলে কিছু আছে নাকি, এই তো কয়েকমাস আগে আমার কালিয়াচকের চাষিরা বিপদে পড়েছিল বলে নিজেরাই নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে ফয়সালা করে ফেললে ; আইনভাঙার কোনো প্রমাণ কারোর কাছে নেই।
    প্রফেসর চক্কোত্তি বললেন, সে যাহোক, নির্দেশিকাটা দেখান দিকি, ক্লায়েন্টদের হয়তো কাজে দিতে পারে, কেন কেউ একজন বিশেষ মেয়েকে পছন্দ করে, আর তার চেয়ে সুন্দর-মুখ সরেস-বডির মেয়েকে করে না, তার হদিশ পাইনি আজ পর্যন্ত, এ যেন বিয়ের জন্যে মেয়ে বাছাই করার মতন, কোন মেয়েকে যে কোন বরের পছন্দ হয়ে যায়, কেন হয়, তার ব্যাখ্যা নেই কোনো।
    নগেন দত্ত পড়া আরম্ভ করলেন, এই বলে যে, নারীরা চার রকমের হয়, পদ্মিনী, চিত্রিনী, শঙ্খিনী আর হস্তিনী, তোমার এই গ্যালারিতেই তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লিখে গেছেন ভারত মুকুজ্জে । তাঁর, নগেন দত্তর, গলা থেকে বেরোতে লাগল আঠারো শতকের বাঙালি বামুনের স্বর:

    পদ্মিনী
    নয়ন কমল কুঞ্চিত কুন্তল ঘন কুচস্হল
    মৃদু হাসিনী।
    ক্ষুদ্ররন্ধ্র নাসা মৃদুমন্দ ভাষা নৃত্যগীতে আশা
    সত্যবাদিনী ।।
    দেবদ্বিজে ভক্তি পতিঅনুরক্তি অল্পরতিশক্তি
    নিদ্রাভোগিনী
    মদন আলয় লোম নাহি হয় পদ্মগন্ধ কয়
    সেই পদ্মিনী ।।

    চিত্রিনী
    প্রমাণ শরীর সর্ব কর্মে স্হির নাভি সুগভীর
    মৃদু হাসিনী ।
    সুকঠিন স্তন চিকুর চিকন শয়ন ভোজন
    মধ্যচারিনী ।।
    তিন রেখে যুত কন্ঠবিভূষিত হাস্য অবিরত
    মন্দ গামিনী ।
    মদন আলয় অল্প লোম হয় ক্ষারগন্ধ কয়
    সেই চিত্রিনী।।

    শঙ্খিনী
    দীঘল শ্রবণ দীঘল নয়ন দীঘল চরণ
    দীঘল পাণি।
    মদন আলয় অল্পলোম হয় মীনগন্ধ কয়
    শঙ্খিনী জানি ।।

    হস্তিনী
    স্হূল কলেবর স্হূল পয়োধর স্হূল পদকর
    ঘোর নাদিনী ।
    আহার বিস্তর নিদ্রা ঘোরতর রমণে প্রখর
    পরগামিনী ।।
    ধর্মে নাহি ডর দম্ভ নিরন্তর কর্মেতে তৎপর
    মিথ্যাবাদিনী ।
    মদন আলয় বহুলোম হয় মদগন্ধ কয়
    সেই হস্তিনী ।।

    ---ক্লায়েন্টরা কতো রকমের হয় লিখেছিলেন নাকি ? জানতে পারলে ক্লায়েন্ট অনুযায়ী কুন্দনন্দিনীদের কোন দরোজায় কে দাঁড়াবে, ডিসাইড করতে পারবো তাহলে ।
    নগেন দত্ত বললেন, পুরুষরা জানোয়ার, তা ভারত মুকুজ্জে ১৭৫৫ সালে আমাকে বলেছিলেন, আর লালন সাঁইও বলেছিলেন আমাকে ১৮৭০ সালে, সে আজ অনেককাল হয়ে গেল, পুরুষদের বিশেষ হেরফের হয়নি, জানোয়ারই রয়ে গেছে, আমি নিজেকে দিয়েই জানতে পারি, কখন কোন পশু হয়ে গেলুম, মেয়েদের বরং অনেক রদবদল ঘটে গেছে, আর চার রকমে আটকে নেই ।
    কোন জানোয়ার ? কুকুর নিশ্চয়ই, পুরুষগুলোকে দেখি হয় কুকুরের মতন ল্যাজ নাড়ায় কিংবা কামড়াতে দৌড়োয়, জ্ঞানীর গাম্ভীর্যে বললেন অধ্যাপক চক্রবর্তী ।
    নগেন দত্ত বললেন, এখানে গুণাগুণের কথা আলোচনা করছি আমরা, প্রভূভক্তির নয় । ভারত মুকুজ্জে আর লালন সাঁইয়ের মতে পুরুষ চার রকম জানোয়ারের মতন হয়, খরগোশ, হরিণ, ঘোড়া আর ষাঁড় । তবে ১৯৪০ সালে যখন আফ্রিকায় গিয়েছিলুম, সিংহের চামড়ার ব্যবসার ব্যাপারে, তখন মাসাই নদীতে যে কুমিরগুলোকে দেখেছিলুম, আমার মনে হয় সবকটা পুরুষ ওই কুমিরদের মতন, বুঝলে, কুমিররা কামড়ে খেতে পারে না তো, একটা জেব্রা কি মোষ যদি নদীর জলে ধরতে পারে, সব কয়টা কুমির মিলে তাকে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খায়, ছেঁড়ার জন্যে কামড় দিয়ে জলের মধ্যে পাক খেয়ে মাংস-নাড়িভুঁড়ি টেনে বের করে আনে ।
    ---যা বলেছো, বেশিরভাগ বাঞ্চোতই ষাঁড় কিংবা ঘোড়া, জান কালি করে দ্যায় মেয়েগুলোর । কালেজের ছেলেরা দল বেঁধে আসে হরিণ-খরগোশের মতন ল্যাংচার টুকটুকুনি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি চলে যায়, কিংবা কোনো কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে আমোদ করে । রেসের দিন থাকলে ষাঁড়-ঘোড়াগুলো বাড়িটাকে একেবারে চোরছ্যাঁচড়ের আড়ত বানিয়ে তোলে, আর ব্যাটারা যদি দলবেঁধে কোনো মেয়ের ঘরে ঢোকে তাহলে কুমিরেরও বেহদ্দ হয়ে ওঠে।
    এতোটা টানা বলার পর টেবিলের ওপরে রাখা কাচের গেলাসের জল খেয়ে, জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে চক্কোত্তিমশায় বললে, তা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর সঙ্গে ভারত মুকুজ্জের রসমঞ্জরীর কোটেশান ঠিক মেলাতে পারলুম না, ও-দুটো তুমি পিটুনি খেয়ে মারা যাবার আগে অষ্টপ্রহর সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে, কেন ?
    বলশেভিক বিপ্লবের পর যখন স্ট্যালিনের সঙ্গে মসকোয় দেখা করেছিলুম, দিনের বেলা দশটাতেই অন্ধকার, ভাগ্যিস ঘড়ি ছিল, ওভারকোটের ওপর মাথায় কুরাকুল ভেড়ার চামড়ায় তৈরি অ্যাসট্রাখান টুপি পরে, টুপির ওপরে হ্যাট তুষার থামাবার জন্যে, ওভারকোটের তলায় প্যাডেড কোট, হাতে কুমির চামড়ার দস্তানা, তার তলায় কাপড়ের দস্তানা, কাপড়ের মোজার ওপর থার্মাল মোজা, থার্মাল জাঙিয়া, জুতোর ওপরে পরার পেরেক বসানো গোরেটেক্স বুটজুতো, তখন তুষারে ঢাকা পড়ে গেছে রেড স্কোয়ার, চোখের পাতায় তুষার জমে যাচ্ছে আর ঝাড়ছি, মুলো দিয়ে ভোদকা খেয়ে বেরিয়েছিলুম, মুখের গন্ধ দূর করার জন্যে কালো চকোলেট চুষতে-চুষতে, ভোদকা কেনার কি লাইন ।
    ঠিক সময়ে ওনার কাছে না পৌঁছোলে দেখা করেন না শুনেছিলুম, তা উনি বলেছিলেন যে প্রত্যেকটা গরিব দেশে একজন করে স্ট্যালিন থাকা দরকার, যে শ্রমিকের শত্রুদের ধরে-ধরে নিকেশ করবে, একনায়কের গদিতে বসে রাজত্ব করবে, লাল সৈন্যদের প্রধান হবে, অধস্তন কাউকে ইচ্ছে হলে পেপারওয়েট ছুঁড়ে নাচাবে, বেয়াড়াদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে পাঠিয়ে দেবে বরফের দেশে জেল খাটতে ।
    আমি ভেবেছিলুম যে আমিই হবো সেই একেশ্বর, তাই মাঝে-মাঝে কমিউনিস্ট ইশতাহার পড়তুম আর স্বপ্ন দেখতুম । দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর করে বললেন নগেন দত্ত । স্ট্যালিন বললে, জনগণের ভেতরটা বদলে দিতে না পারলে একনায়ক হওয়া যায় না, লাগাতার নাগরিকের ভেতরটা বদলাবার মেশিন তার শরীরে চালু রাখতে হবে, সকলের দ্বারা তা সম্ভব নয় ।
    একটা ব্যাপারে স্ট্যালিন আমার ওপর চটে গিয়েছিলেন, জুলিয়াস সিজারকে খুন করার ষড়যন্ত্রে আমিও ছিলুম, শুনে থাকবে, মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস আর কয়েকজন মিলে আমরা নির্ণয় নিয়েছিলুম যে পম্পেই থিয়েটারের কাছে ১৫ ই মার্চ জুলিয়াস সিজারকে ছোরা মেরে-মেরে খুন করব, কেননা ওর বড্ডো বাড় বেড়ে গিয়েছিল, আমাদের কথায় কান দেয়া দরকার মনে করতো না, তখনও যিশুখ্রিস্ট জন্মায়নি, সে চুয়াল্লিশ সালে, আমিও দিয়েছিলুম কয়েক ঘা, খচাখচ, সেদিন ছিল দোলপূর্ণিমা, দুধে ভাঙ মিলিয়ে টেনেছিলুম, কাৎ হয়ে পড়ে গেল সিজার ।
    স্ট্যালিন বললে, ইতিহাসকে ওইভাবে পাল্টানো উচিত হয়নি, আসলে স্ট্যালিনের নিজেরও তো ভয় ছিল, তাই কাউকে সন্দেহ হলেই কোতল করে দিতো । সাধারণ মানুষরা ভুল বুঝলে বেশ মজা পেতো স্ট্যালিন। উত্তরে আমি ডেনিস দিদেরোর কথা বলেছিলুম । দিদেরো বলেছিলেন যে যতোদিন না শেষ পুরোহিতের নাড়ি দিয়ে শেষ রাজার গলায় পেঁচিয়ে মারা হচ্ছে, ততোদিন মানুষ স্বাধীন হবে না । শুনে স্তালিনের সেই যে শরীর খারাপ হলো, পরের দিন ওকে ওর খাটের পাশে অজ্ঞান অবস্হায় পাওয়া গিয়েছিল ।
    ফেরার আগে আমি স্ট্যালিনকে জিগ্যেস করেছিলুম যে হিটলার কেমন করে একনায়ক হয়ে গেল, সে কি জার্মানদের ভেতরটা বদলে দিতে পেরেছিল ?
    স্ট্যালিন বললে, ও ব্যাটা টেম্পো বজায় রাখতে পারেনি, ব্যাটার একটা বিচি ছিল না, আর দাঁড়ানো অবস্হায় নুনু ছিল এক ইঞ্চির, যাকে কমিউনিস্ট ডিকশনারিতে বলে ন্যানোনুনু, তাই যুদ্ধু হেরে গেল, দেশটাকে টুকরো করে ফেললে, ধরা পড়ার ভয়ে বিষ খেয়ে নিলে, ছ্যা ছ্যা ছ্যা । আমেরিকানরা ওর ন্যানোনুনু খুঁজে পেয়েছিল, সেটা ব্যবহার করে ওরা হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কার করলে ।
    তারপর ? কান দুটো গাধা-কান করে জানতে চাইলে অধ্যাপক চক্রবর্তী । অধ্যাপকের কাছে মাঝে মাঝে ক্লায়েন্টরা এই হিটলারি সমস্যা নিয়ে আসে, তার জন্য ট্রেনিং দিয়ে রাখতে হয়েছে দুটি মেয়েকে ।
    তারপর কুন্দনন্দিনীর দেখা পেলুম আর বিপ্লব সমাজে ঘটার বদলে আমার মগজে ঘটে গেল, সব ওলোটপালোট হয়ে গেল । তদ্দিনে স্ট্যালিন আর ওর বসানো লোকগুলো গণেশ উল্টে খাল্লাস । আমাদের এখানে স্ট্যালিনের রুবল খেয়ে অনেক বাঙালি কর্নওয়ালিসের জমিদারি আরম্ভ করে দিলে, কেজিবির দপতরে তাদের নাম-সাকিন দেখেছি, আমার কাছে তার তালিকা আছে।
    তা চলে এলে কেন ? অনেকে তো রাশিয়ান ভাষায় বাংলা লিখে প্রচুর পয়সা কড়ি করে ফিরেছে। সেসময়ে ডবকা-উরুর রুশ মেয়েদের অবশ্য সঙ্গে আনতে পারেনি, এখন তো রুশ মেয়েরা নিজেরাই পাকাপাকি বর বা সাময়িক বর খুঁজতে এদেশে আসছে, ডবকা উরু দেখাতে আর কোনো লজ্জা নেই তাদের ।
    আমি কুন্দনন্দিনীর জন্যে বেঁচে আছি । কতোকাল হয়ে গেল খুঁজে পাচ্ছি না কুন্দনন্দিনীকে । খরগোশ, হরিণ, ঘোড়া, কুমির, ষাঁড়ের মতন জানোয়ারি করেও খুঁজে পেলুম না, আরও জানোয়ার হয়ে চলেছি, জানোয়ারেরা আরও বেশি-বেশি জানোয়ার হয়ে চলেছে । আমি যেকোনো মেয়েকে কুন্দনন্দিনী বানিয়ে ফেলতে পারি, কিন্তু তার ভেতরটা বানাতে পারব না, যাকে ভালোবাসবো তার ভেতরটাই তো আসল ।
    অধ্যাপক চক্কোত্তি, হতাশা মেশানো গলায় বললে, তুমি স্ট্যালিন হলে আমার ব্যবসা লাটে উঠিয়ে আমাকেই কোতল করে দিতে ; ভাগ্যিস স্ট্যালিনের যুগ গিয়ে আবার তুঘলকের যুগ ফিরে এসেছে, সোনার টুকরো ছেলেদের রাতারাতি গাধার চামড়ার টুকরোয় গড়া ছেলে বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, তারা নিজেরাই গাধা কিংবা খচ্চরের চামড়ায় গড়ে ফেলছে নিজেদের, এ একেবারে স্বর্ণযুগ, স্বর্ণযুগ, বুঝলে নগেন, বলছি কেন যে পারফরমিং ফ্লেশ হল উন্নততম শিল্প, আদি শিল্প বলে গেছেন রসশাস্ত্রীরা । এই শিল্প ছাড়া তো অন্য কোনো শিল্পের কথা শুনিনা ।
    তা বটে, বললেন নগেন দত্ত ।
    অধ্যাপক চক্রবর্তী, অধ্যাপকের ক্লাস নেবার ঢঙে বললে, দ্যাখো, একদিক থেকে সোভিয়েত দেশ ভেঙে গিয়ে ভালো হয়নি, আমার মার্কেটে নতুন নতুন কমপিটিটর এসে পড়েছে, ফর্সা চামড়া, ঢ্যাঙা ঠ্যাং, লাল-টুকটুকে ঠোঁট, উঁচু বুক, গোলাপি বোঁটার মেয়েরা, এসটোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, আজারবাইজান, আরমেনিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, মলডোভা থেকে ।
    টেবিলের ওপর থেকে ঝোলাটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে অধ্যাপক চক্কোত্তি বললে, এখন আপকানট্রির ক্লায়েন্টদের হাতে ঠিকেদারির আর দিল্লিঘুষের দেদার কাঁচা টাকা, তারা এই মেম মেয়েদেরই পছন্দ করছে আজকাল, সেই জন্যেই তো আমি এপার বাংলা আর ওপার বাংলা ছাড়া আমার গ্যালারিতে অন্য আইটেম রাখি না, কেননা আপকান্ট্রির পুরুষরা বাঙালি মেয়েদের পেলে সব কিছু ভুলে যায় । ওসব ফর্সা মেমদের সঙ্গে সেলফি তোলাতে হলেও হাজার টাকা লাগে, বিয়েতে নাচাতে হলে আরো বেশি, শুতে লাগে এক থেকে দেড় লাখ ; আমার মেয়েদের সঙ্গে সেলফি তোলাতে হলে প্রথমে ক্লায়েন্ট হতে হয়, তারপর যতো ইচ্ছে সেলফি তোলো, ব্ল্যাকমেইলিঙের পাল্লায় পড়লে তার দায় ক্লায়েন্টের ।
    নগেন দত্ত বললেন, দ্যাখো, কুন্দনন্দিনীকে যদি পদ্মিনী হিসেবে পাই তাহলে বেশ হয়, কিন্তু ভারত মুকুজ্জে বলেছে যে তাদের অকুস্হলে লোম থাকে না, সেখানে লোম না থাকাটা যেন কেমন বিসদৃশ, নয়কি !
    চিন্তা নেই তোমার, বললে প্রফেসার চক্কোত্তি, যাত্রাদলের অভিনেত্রীরা ট্রেনিং দিচ্ছে কেন, এই অভাব পুরণের জন্যেই তো ! যাদের বগলে আর কুঁচকিতে যথেষ্ট লোম নেই, গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী আমরা স্পিরিটগাম দিয়ে সাময়িকভাবে নকল চুল বসিয়ে দেবার ব্যবস্হা করেছি, আদারওয়াইজ লোম কারোরই রাখা হয়নি, পদ্মিনী, শঙ্খিনী, চিত্রিনী আর হস্তিনী, যারই বলো, লেজার ট্রিটমেন্ট করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ।
    ---আচ্ছা, সেকারণেই সিঁড়ির দেয়ালে ‘বিইং অ্যান্ড নাথিংনেস’ দুটোই দেখলুম লোমহীন ।
    অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল অধ্যাপক চক্রবর্তী, নগেন দত্তকে জিগ্যেস করলে, কতো টাকা নিয়ে ঘোরো তোমার অ্যাটাচি কেসে, এমন পাড়ায় যাতায়াত করো, কখন ছিনতাই হয়ে খুন হয়ে যাবে, সাবধানে চলাফেরা করা উচিত, তার ওপর একটু আগেই শিলাবৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে ।
    শিলাবৃষ্টি এই এক্ষুনি বন্ধ হয়ে গেছে, বলার পর, নগেন দত্ত অ্যাটাচির মুখ অধ্যাপক চক্রবর্তীর দিকে ঘুরিয়ে বোতাম টিপতেই খুলে গেল, আর দেখা গেল তাতে রাখা রয়েছে একটা ফেডেড জিনস, লাল রঙের টিশার্ট, জগিং করার জুতো-মোজা, খাপে গোঁজা কাগজপত্র ।
    টাকা মেটাবে কেমন করে ? জানতে চাইলে উদ্বিগ্ন অধ্যাপক, আমার গ্যালারিতে চার্জ সবচেয়ে বেশি জানো তো , তোমার ট্যাঁক তো ফাঁকা দেখছি ।
    নগেন দত্ত অ্যাটাচি কেস বন্ধ করে আরেকবার খুলে দেখালেন যে একহাজার টাকার চল্লিশটা প্যাকেট রাখা । দেখে, পঁচাত্তর বছর আগের ভীতি ফিরে এলো অধ্যাপক চক্রবর্তীর মগজে, বললে, দাঁড়াও অনেকক্ষণ হিসি চেপে আছি ।
    ঘরের লাগোয়া ওয়াশরুমে পেচ্ছাপ করতে দৌড়ুলো চক্কোত্তি প্রফেসর, আধ ঘন্টা লাগল ওনার ব্লাডার খালি হবার ধারার আওয়াজ বন্ধ হতে ।
    অথচ নিজের ঘরে ফিরলো না অধ্যাপক মশায়।
    ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে ওয়াশরুমে ঢুকে নগেন দত্ত দেখলেন দেয়ালে একটা গোপন দরোজা, উঁকি দিয়ে দেখলেন টিমটিমে আলোয় একাধিক সিঁড়ি নানা দিকে নেমে গেছে, তার মানে অ্যাটাচিকেসের ভোলবদলে ভয় পেয়ে পালিয়েছে প্রফেসর চক্কোত্তি, অথচ ভয়ের তো কিছু নেই । হয়তো ওর এরেকটাইল ডিসফাংশানকেও ভাবছে আমার কারসাজি । কারসাজি করতে হলে ওর ‘বিইং’কেই ‘নাথিংনেস’ করে দিতুম । যাকগে, পুলিশের রেইড হলে মেয়েদের এই পথেই লোপাট করে দ্যায় চক্কোত্তি, বেচারা, জীবনের ফুটোগুলো নিয়ে বাঁচতে শেখেনি, পালাতে শিখেছে, বাঙালিদের নাম ডোবালো ।
    এই পাড়ায় গ্যালারিগুলো পালাবার পথ রেখেছে, রাস্তাগুলো পালাবার পথ রাখেনি, সবকটা রাস্তা কোথাও গিয়ে কানা হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে, এছাড়া অধঃপতনের আহ্লাদে গদগদ হবার অন্য উপায় নেই, ফোসলানোর বিভ্রমে আটকে পড়ে বার বার সবাই এসে খুঁজতে চায় পাড়াটা থেকে বেরোবার বিকল্প পথ ।
    আরেকটু অপেক্ষা করেই দেখি, ভাবলেন নগেন দত্ত, মাথার কোঁকড়া কালো চুলে হাত বুলিয়ে । পেছন ফিরে দেখলেন, দুটি যুবতী ঢুকলো ঘরে, বলে উঠলেন, আরে তিথি আর ছন্দরানি, তোমরা তো বিগতবুড়ি হয়ে গিয়েছিল, আবার দেহ ফিরে পেলে কী করে ? আমি তো তোমাদের পুনর্নিমাণ করে দেখলুম একটু আগে, আগাপাশতলা। এখনও পোশাক না পরেই আছো ? চক্কোত্তিবাবুর কোনো ক্লায়েন্ট এসে পড়লে বিপদে পড়বে, যাও আগে পোশাক পরে এসো ।
    তিথিই প্রথম কথা বলল, নগেন দত্তকে জড়িয়ে গালে ঠোঁট চিপে, মমুয়াআআআআআঃ, ডক্টরেট করিয়ে ছাত্ররা গেছে, তাই তুমি চলে যাবার আগে পুরোনো রাতগুলো আরেকবার গুলজার করার জন্যে এলুম, তক্কে-তক্কে ছিলুম, নজর রেখেছিলুম দরোজার দিকে, চলো আমরা দুজনে তোমার দুদিকে শুয়ে জম্পেশ খেলা করি ।
    নগেন দত্ত তিথি আহমেদের মুখটা ঘুরিয়ে নিজের দিকে এনে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললেন, তোরাও যে অধ্যাপক হয়ে গেছিস তা জানতুম না, অধ্যাপনার সঙ্গে মর্ষকামী সেক্স যায় কিনা তেমন জানি না গো । তখন তো তোরা আকাট ছিলিস, খেলতে ভালো লাগতো, মুকখুর সঙ্গে খেলার স্বাদ আর বিএ-এমএ পাশের সঙ্গে খেলার স্বাদে কি তফাত নেই, কী বলিস তোরা ? ।
    ছন্দরানি বললে, অধ্যাপনা করি বলে কি আমাদের যৌনতা নেই, আমাদের দেহও কি অধ্যাপকদের মতন গোমড়া থাকবে নাকি ! আমাদেরও লাবিয়া আছে, উৎসুক ভগাঙ্কুর আছে, তুমি আমাদের সমান স্ট্যাটাসের, আমরা তো সীমা ভেঙে ছাত্র ফুসলিয়ে তাদের সঙ্গে শুতে পারি না, টাকা না নিয়ে শুলে স্ট্যাটাসে বাধে, এতো পড়াশুনা করে ফেলেছি, হাজার দশেক বই পড়ে ফেলেছি, সতেরোটা গবেষণার বই লিখে ফেলেছি ইংরেজি আর বাংলায়, তুমি, আমাদের দেহের ঈশ্বর, আজ দেখা দিলে আশি-নব্বুই বছর পর, ঝিনচাকুনি খেলা তো খেলতেই হবে ।
    নগেন দত্ত বললেন, ওহ, আমার জ্ঞানচক্ষু যাকে বলে উন্মীলন করে দিলি তোরা দুজনে, আমি তো কখনও স্ট্যাটাসের কথা ভেবে কারোর সঙ্গে শুইনি, দেশে হোক বা বিদেশে, কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে হোক বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, ব্রিটেনের পুঁজিবাদে হোক বা ভিয়েতনামের সাম্যবাদে, নিউ ইয়র্কের আনডারগ্রুাউন্ড হুকারের সঙ্গে হোক বা জার্মানির ওভারগ্রাউন্ড ব্রথেলে, আমি তো ভাবতুম যা পাই তাই খাই হল প্রকৃত প্রেমিকের লক্ষণ । বুঝতেই পারছিস যে আমি একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী ।
    তিথি আহমেদ বললে, চলো না গো, জানই তো আমার গায়ে সুলতান ইলিয়াস শাহের রক্ত বইছে, সেরকম স্ট্যাটাসের নাগর পাইনি বহুকাল, সবই এলেবেলে রাস্তাছাপ, প্লেবিয়ান কোমরের মিনসে-মরদ, চুমু খাবার টেকনিক জানে না, শোবার শৈলী জানে না, জড়াবার আঙ্গিক জানে না, তাদের কেবল মুঠোয় কনটেন্ট হলেই হয়ে গেল, আমাদের যেন সাধ-আহ্লাদ নেই, উপচে ওঠার ইচ্ছে নেই । সংসার করিনি কেন বলো তো, সংসার মানেই তো পুনরাবৃত্তি, একই পুরুষ, একই দুর্গন্ধ, একই বিছানায় দিন নেই রাত নেই, বাচ্চার পর বাচ্চা বিইয়ে চলো বছর-বছর, ওহ ভাবা যায় না।
    তোরা এখন অধ্যাপনা করিস, ছাত্র ঠ্যাঙাস, সকালে টিউশানি রাতে ইশক সমুন্দর ডাল দে অন্দর, তোদের কি বিনা পোশাকে পাগলু ডান্স করা শোভা পায়? আমার কথা বাদ দিচ্ছি, আমি হলুম জমিদার বাড়ির ছেলে, কর্নওয়ালিসের দেয়া অধিকার শরীরে রয়ে গেছে, আইনে থাকুক বা না থাকুক, তাই ভাবছিলুম...।
    নগেন দত্ত ভেবেছিলেন অধ্যাপক চক্কোত্তির পেছন-পেছন ওয়াশরুমের কোনও একটা গোপন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে দেখবেন রহস্যটা কি, আবার দুজন যুবতী টোপ ফেলেছে, লোভ ছাড়তে পারছেন না, জানোয়ারগুলো ভেতর থেকে ডাক দিচ্ছে । সেই সঙ্গে মনের ভেতরে কুন্দনন্দিনীর চাহিদা আকুপাঁকু ।
    বিনা পোশাকে কই, ঠিক করে চেয়ে দেখবে তো ! তুমিই তো সালভাদর দালিকে ১৯২৯ সালে বলেছিলে আমার শরীরে ‘দি গ্রেট ম্যাসটারবেটর’ পেইনটিংখানা এঁকে দিতে, দ্যাখো কেমন ঝলমল করছে সারা শরীর জুড়ে, বলল তিথি আহমেদ, নগেন দত্তের দিকে পেছন ফিরে, সামনে দিক দেখাবার পর ।
    নগেন দত্ত বললেন, তাই তো চিন্তায় ছিলুম যে তোরা বুড়ি হলি কেমন করে, দাদামশায়ের উইলে লেখা আছে যে আমি যার সঙ্গেই শুই না কেন, তার বয়স উনিশ থেকে কুড়ির ভেতরে আটকে থাকবে ।
    আমি উনিশেই আছি গো, তিথি আহমেদ নিজের দুই বুকে হাত রেখে বললে, এ রঙ একেবারে পাকা, তোমার গায়ে বা ধুতি-পাঞ্জাবিতে লাগবে না । সালভাদর দালি তো বলেই ছিলেন তোমাকে যে ‘দি গ্রেট ম্যাসটারবেটর’ হল কালজয়ী পেইনটিং, আমার দেহ জয় করে ফেলেছে কালপ্রবাহকে । তোমার দাদামশায়ের উইল অনুযায়ী আমার পিরিয়ডও মাসে-মাসে হয় না যে পেইনটিং খারাপ হয়ে যাবে ; সেই যে সালভাদর দালি আমার দেহে এঁকে দিলেন, তারপর তো একশো বছর হতে চলল, মাসিক হয়নি, স্যানিটারি প্যাড বেঁধে পেইনটিংটার মাঝখানে প্যাচ বসাতে হয়নি । কালেজে পড়াতে গেলে এর ওপর জিনস আর টপ পরে নিই, যদিও উপাচার্য মশায় বলেছেন যে পেইনটিঙ দেখতে না পেলেও ছাত্ররা পেইনটিঙের নাম শুনে বিপথগামী হয়ে যেতে পারে । আমি উপাচার্য মশায়কে বললুম যে আমার পড়াবার বিষয় হল ‘লিঙ্গ উইথ স্টিকস’, যাকে কালেজ পড়ুয়ারা বলে লিঙ্গুইস্টিকস, তাতে তো তারা বিপথগামী হচ্ছে না, বিশ্বখ্যাত পেইনটিঙ দেখে হবার প্রশ্ন ওঠে না।
    তা ঠিক,বললেন নগেন দত্ত, সালভাদর দালি বলে কথা, কজনের ভাগ্যে জোটে অমন দৈহিক অমরত্ব ! তাছাড়া কালেজের ছাত্রদের পড়াবার সময়ে তুই দেহের ভাষাকে আড়াল করে রাখতে পারছিস, মাংসের ত্রিকোনমিতিকে আড়াল করে রাখতে পারছিস, যখন কোনো ছাত্রের সঙ্গে শুচ্ছিস তখন সে তোর দেহের গোপন চিহ্ণ আবিষ্কার করে আহ্লাদে রসাক্ত হবার সুযোগ পাচ্ছে ।
    ছন্দরানি বললে, আমার বুকদুটোকে কাঁচা আমের রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল পাবলো পিকাসো নামে তোমার এক বন্ধু, দুটোরই তলায় হাত আঁকা, যেন তুমি তুলে ধরে আছো, যেদিন আঁকছিল সেইদিনকে তো তুমি অমন করেই হাত রেখেছিলে, আর এই তলায় মাঝখান থেকে কাটা পিচফল এঁকে দিয়েছিল, তার বদলে ওনার সঙ্গে শুতে হয়েছিল, তুমি বলেছিলে, শুয়েনে-শুয়েনে, কজনেরই বা ভাগ্য হয় পাবলো পিকাসোর সঙ্গে শোবার, তা উনি ভেবেছিলেন উনিই বুঝি ধামসা-ধামসি করতে এক্সপার্ট, আমি এমন ধামসে দিয়েছিলুম যে ওনার রাশিয়ান বউকে চেয়ার ঠেলে ওনাকে এয়ারপোর্টে প্লেন ওব্দি নিয়ে যেতে হয়েছিল। শোবার আগে উনি ওনার গুয়ের্নিকা নামের পেইনটিঙ আমার গায়ে শাড়ির মতন এঁকে দিয়েছিলেন, সুবিধে এই যে স্নান করলেও যায় না আর শাড়ি পরারও দরকার হয় না ।
    তা ভালো করেছিস, কাঁচা সবুজ আম দেখে কালেজের ছেলেদের নোলা নিশ্চই সকসক করে, কার্নিভালের লালা ঝরায় । তুই কী পড়াচ্ছিস তোর কালেজে, জানতে চাইলেন নগেন দত্ত, তুইও কি উনিশে আটকে আছিস ।
    না গো, বললে ছন্দরানি, আমি কুড়িতে রয়েছি সেই ইংরেজদের সময় থেকে, তখন স্যানিটারি ন্যাপকিন আসেনি, দ্রৌপদীর মতন কানি বাঁধতে হতো । কিন্তু ইংরেজদের সময় থেকে পিরিয়ড তিরিশ বছরে একবার হয় বলে নিশ্চিন্তে আছি । আমি অনেক সহজ বিষয় পড়াই, লুডহ্বিগ হিটগেনস্টাইন নামে একজন সায়েবের লেখালিখি, যা উনি জটিল করে লিখে গেছেন ।
    মানে ?
    এই ধরো উনি বলেছেন, এক এক করে বলব, নাকি গড়গড় করে বলে যাবো ? গড়গড় করে বললে আমি বুঝতে পারব না কি বলছি আর তুমি কী শুনছ ?
    তাহলে এক এক করেই বল ।
    লুডহ্বিগ হ্বিটগেনস্টাইন বলেছেন :
    ১) সেই সমস্ত ব্যাপারই হল জগৎ যা যেমন ঘটে চলেছে ।
    ২) সেই সমস্ত ব্যাপার একসঙ্গে হল জগৎ, বস্তুর নয় ।
    ৩) জগৎ নির্ধারিত হয় ঘটনা দিয়ে আর ওই ঘটনাগুলোর ঘটনা হবার মধ্যে দিয়ে ।
    ৪) তার কারণ ঘটনার সামগ্র্য ঠিক করে দ্যায় যা যেমন ঘটছে আর যা যেমন ঘটছে না ।
    ৫) যে সমস্ত ঘটনা যৌক্তিক পরিব্যাপ্তির ভেতরে রয়েছে তা-ই হল জগৎ ।
    ৬) ঘটনাসমূহের দ্বারা জগৎ বিভাজিত ।
    ৭) অন্য সবকিছু একইরকম থেকে গেলেও, প্রতিটি ব্যাপার যেমন ঘটছে তেমন হতে পারে কিংবা তেমন নাও হতে পারে ।
    ৮) একটা ঘটনা, তা যেমন ঘটছে, তা হল অস্তিত্বশীল বস্তুস্হিতি ।
    ৯) বস্তুস্হিতি হল বস্তুর সমন্বয় ।
    ১০) কোনও না কোনও সম্ভাব্য বস্তুস্হিতির অঙ্গ হওয়া বস্তুগুলোর পক্ষে অপরিহার্য ।
    দশটা তর্কবিন্দু এক-এক করে বলার পর নগেন দত্ত আগ্রহ হারিয়ে বার বার ওর কাঁচা আমের দিকে তাকাচ্ছেন দেখে ছন্দরানি জিগ্যেস করল, আরও অনেক আছে, অনেক-অনেক, সেগুলোও বলব ?
    নগেন দত্ত বললেন, থাক আর বলতে হবে না, তা এতো তর্কবিন্দু থাকা সত্ত্বেও, এই জগতে তাহলে কুন্দনন্দিনীকে খুঁজে পাচ্ছি না কেন ?
    তিথি আর ছন্দরানি দুজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, এখনও সেই কুন্দনন্দিনীর খোঁজ চলছে ? কী এমন আছে কুন্দনন্দিনীর যা আমাদের নেই ?
    তোদের বাইরেটা আছে, তা কুন্দনন্দিনীর মতনই, কিন্তু আমি চাই কুন্দনন্দিনীর ভেতরের কুন্দনন্দিনীকে । যে কোনো মেয়ের বাইরেটা আমি কুন্দনন্দিনীর মতন গড়ে নিতে পারি, হুবহু পারি, কিন্তু কোনো মানুষের ভেতরটা তো পারি না, তাই আসল মানুষটাকে দরকার, তাকে ভালোবাসতে চাই, ভালোবাসা তো ভেতরের ব্যাপার, জানিসই তো ।
    একটুক্ষণ থেমে নগেন দত্ত বললেন, এই একই কথা স্ট্যালিনের সঙ্গে হয়েছিল, উনি বলেছিলেন মানুষের ভেতরটা না বদলাতে পারলে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না । স্ট্যালিন চলে গেল আর সবায়ের ভেতরে উনি একটা করে যে স্ট্যালিন গড়ে দিয়েছিলেন, তারাও চলে গেল ওনার সঙ্গে, যতো দেশের নেতার ভেতরে স্ট্যালিন একটা করে স্ট্যালিন ঢুকিয়ে ছিলেন, তারাও তাদের ভেতরের স্ট্যালিনকে বের করে ফেলে দিয়ে পুরোনো মালগুলো বের করে আনলে, তাদের দেশগুলোতেও একই ব্যাপার ঘটল, বুঝতে পারছিস তো কী বলছি ।
    নগেন দত্তের বাঁ পাশের চেয়ারে বসে, ডান পায়ের ওপর বাঁ পা রেখে, তিথি আহমেদ জানতে চাইল, তাহলে লিবিয়ার গদ্দাফি আর ইরাকের সাদ্দাম গেল কেন ? ছন্দরানি বসল নগেন দত্তের ডানদিকে, পা ফাঁক করে দোলাতে লাগল , নগেন দত্তের গায়ে গা ঠেকছিল, বুঝতে পারছিলেন নন্দরানির দেহে তাপ রয়েছে, তিথি আহমেদের দেহ সেই তুলনায় ঠাণ্ডা।
    নগেন দত্ত বললেন, আরে ওরা কিছুই বদলাতে পারেনি, শুধু ভয় পাওয়াকে বদলে দিয়েছিল, তাই তো নিজেরাও ভয় পেয়ে শেষকালে গিয়ে লুকোলো নর্দমায় আর গর্তের ভেতরে । মানুষের ভেতরটা বদলাবে তবে তো দেশটাকে বদলাবে । ওরা যাবার পর ভেতরের ভয় অনেকেরই চলে গেছে, তারা এখন অন্যদের ভয় পাইয়ে খুন লোপাট গণধর্ষণ বোমা-মারা সোনাদানা লুট, মূর্তিভাঙা, কালোবাজারি, পেটরল বিক্রি, ক্রীতদাসী বিক্রি এই সব কাজ করে চলেছে, ওদের ভেতরটা যা ছিল, কয়লার রঙের বরফখণ্ড, তা-ই রয়ে গেছে ।
    মূর্তিগুলোকে কেন ভাঙে আজও বুঝতে পারলুম না, এ এক হেঁয়ালি ! বললে ছন্দরানি ।
    হেঁয়ালির কি আছে ? নিজেদের মেয়েমানুষের যদি অমন বড়ো-বড়ো বুক না থাকে, নিজেদের পুরুষদের যদি অমন বড়ো-বড়ো ব্রবডিংনাগের মেশিন না থাকে, তাহলে ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে ভাঙাভাঙি করা ছাড়া তো আত্মগ্লানি থেকে মুক্ত হবার পথ নেই ।
    গলার স্বরে আফশোষ ফুটিয়ে তিথি আহমেদ, গায়ে শাড়ির মতন জড়ানো সালভাদর দালির হলুদ রঙের পেইনটিং, বাঁহাত দিয়ে টেবিলের ওপরে রাখা পেপার ওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, দেয়ালে ওই গুরু-মহারাজের ছবি দেখছো, ওই বাঞ্চোতের সঙ্গে আমাকে মাসে একবার শুতে যেতে হয়, পাঁচতারা হোটেলে, উনি সেখানে স্যুট-টাই পরে কর্পোরেট মালিকের সাজে আসেন । ভালো পয়সা আর পাঁচতারার শীতাতপ আরাম সত্ত্বেও লোকটার গায়ে রামছাগলের বোটকা বিটকেল গন্ধে বমি পেয়ে যায়, বাঞ্চোটার লিঙ্গও এক ইঞ্চের, চক্কোত্তি বলে যে অমন হিটলারেরও ছিল, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জাগিয়ে তুলতে হয়, ক্লাইমেক্সের সময়ে রামছাগলের মতন জিভ বের করে উলু দ্যায় ।
    পেপার ওয়েটের ভেতরে গোলাপি রঙে ‘ভালোবাসা’ লেখাটার দিকে তাকিয়ে তিথি আহমেদ বলল, ভালোবাসা কাকে বলে তা জানা হল না জীবনে, রোমান্টিক প্রেম কাকে বলে তা অনুভব করা হল না, শুধু শোয়া আর শোয়া ।
    নগেন দত্ত তিথি আহমেদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি তো সারাজীবন খুঁজে চলেছি ভালোবাসার পাত্রীকে, আমিও তো জানি না, আমারও তো শোয়া আর শোয়া । তিথির হনু সামান্য উঁচু, গালে গোলাপি আভা, ঠোঁট চিনাদের মতন ছোট্ট আর গোল হলেও, ছড়ানো শ্যাম্পু করা চুল কাঁধ পর্যন্ত, নাকও ছোটো আর একটু ওঠানো, মুখশ্রীতে ক্ষমতা আছে নিজের ভাব প্রকাশের আর লুকোনোর, জোরে হাসে, হাসাতেও পারে নানা কথা বলে ।
    সুর্মা আতর কাজল তেল মাখা, গোলছাঁদের মুখে টসটসে হাসি ফুটিয়ে ছন্দরানি মজুমদার পা নাড়াতে-নাড়াতে বললে, আমি এই বেশ ভালো আছি, তোমাকেই ভালোবেসেছিলুম, তা এখনও বজায় রেখেছি, তা সে যতজনের সঙ্গেই শুই না কেন । তারপর নগেন দত্তের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি বললে, তখন থেকে তুমি আমার আমের দিকে তাকাচ্ছ, খেতে ইচ্ছে হয় খাও না, তোমারই তো ফল, তোমার গাছে ফলিয়ে গেছে তোমার বন্ধু পাবলো পিকাসো ।
    নগেন দত্ত জিগ্যেস করলেন, একবার বাঁদিক আর আরেকবার ডানদিকে মাথা ঘুরিয়ে, চক্কোত্তি গেল কোথায়, ওয়াশরুমের ভেতরের গোপন দরোজা দিয়ে সেই যে গেছে, ফেরার নাম নেই ।
    তিথি আহমেদ, চোখ বুজে, চোখের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে পুরোপুরি চুবিয়ে বলল, ও, তাই বুঝি, তাহলে কোনও কারণে তোমাকে ভয় পেয়ে পালিয়েছে, এখন কিছুদিন আর ফিরবে না ।
    সে কি রে, অবাক হলেন নগেন দত্ত, তাহলে এই যে রাত হতে চলল, রাতচরা খদ্দেররা আসা তো আরম্ভ হয়ে গেছে, দরদস্তুর, সময়, ঘরনির্দেশ, মাগবাছাই সেসব কে সামলাবে ।
    ছন্দরানি মজুমদার , যার দেহে আঁকা পিকাসোর গুয়ের্নিকা শাড়ি, আর যার চাউনির মধ্যে কৌতূহল ঝলকাচ্ছিল, বললে, কেন, যে দুজন আমাদের আন্ডারে পিএইচডি করছে, তারাই তো সামলায় পিসি বাড়ি না থাকলে, ওদের শেখানো-পড়ানো হচ্ছে কেন, এই জন্যেই তো ! পিসির তো ছেলেপুলে নেই, তার ওপর কি একটা ব্যামো আছে যে ছেলেপুলে হবে না, তাই ওরা দুজনই ওনার বংশ ধরে আছে ।
    ছন্দরানির সবুজ ফজলি আমের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে নগেন দত্ত বললেন, তোর আম দেখতে-দেখতে মনে পড়ে গেল সাত বছর আগে পালতোলা নৌকোয় তোর সঙ্গে পূর্ণিমার রাতে শোয়ার কথা, আমার ছোঁয়াকাতর অঙ্গ তোকে ভেদ করে ভেতরে গিয়ে থামতেই চাইছিল না, এগিয়েই যাচ্ছিল, যেন কিছু অনুসন্ধান করছে, তখন আমি বুঝতে পারলুম যে তোর ভেতরে গিয়ে আমার প্রাণপুরুষ স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছে, অদ্ভুত স্বপ্ন, আজও মনে আছে, মাংসের তৈরি মেশিনের শহর, বাড়িঘরও মাংসের, রাস্তাঘাটও মাংসের, গাছ আর ফুলফলও মাংসের, কতো রঙের মাংস, শুধু মানুষ আর অন্য প্রাণীরা পেতলের তামার রুপোর লোহার আর নানা ধাতুর মিশেলের । আমার অঙ্গ ঘুরে বেড়াতে লাগল ওই মাংসের শহরে, দেখল ধাতুর তৈরি সব মানুষ আর প্রাণীরাই আনন্দ করছে, নাচছে গাইছে মদ খাচ্ছে ভাতরুটি খাচ্ছে, ছাগল-গোরু-শুয়োরের মাংস ধাতুর বলে তাদের ব্লাস্ট ফার্নেসে গলিয়ে গেলাসে আর কাপে ভরে খাচ্ছে । তুই বলতে লাগলি, হে আড়ম্বর আরও ভেতরে এসো, আরও ভেতরে এসো, আরও ভেতরে এসো, কিন্তু তুই আমাকে বলছিলি না, তোর ভেতরে গিয়ে যে স্বপ্ন দেখছিল, তাকে বলছিলি, আমি যদিও ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, কিন্তু তোর কথা শুনতে পাচ্ছিলুম, বুঝতে পারছিলুম যে স্বপ্নটা আমি দেখছি না, দেখছে আমার প্রিয় অঙ্গখানা তোর প্রিয় অঙ্গের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে ।
    হ্যাঁ, এই এক তোমার অস্ত্রখানার চরিত্রেরই দেখেছি তোমার সঙ্গে মিল আছে, স্বপ্ন দেখতে জানে, বেশির ভাগ মিনসে নিজেরাই মেশিন, জানেই না যে তারা যেমন স্বপ্ন দেখে, তেমনই তাদের অঙ্গখানার স্বপ্নের সঙ্গে আমার অঙ্গের স্বপ্নের মিল হওয়া উচিত । তোমাকে বলেছিলুম তো, সেদিন নৌকোয় আমার অঙ্গখানাও একই সঙ্গে স্বপ্ন দেখছিল, ভেসে চলেছি একজন মানুষের ভেতরের নৌকোয় চেপে, লাল রঙের সমুদ্রে সে কি ঢেউ, লাল জলের ঘুর্ণি উঠে এলো আর আমার অঙ্গ সেই লাল ঘুর্ণির সঙ্গে ঘুরতে লাগল, ভাসিয়ে নিয়ে চলল লাল বানভাসিতে আশেপাশের সবকিছু, তারপর আছড়ে লাল জলের সমুদ্রে পড়ে গেল লাল জলের জলস্তম্ভ । আমি ভার্জিন ছিলুম তো, আর সেটাই ছিল আমার প্রথম রাত, তার আগে থেকেই, তোমাকে দেখে পর্যন্ত ভালোবাসতে শুরু করেছিলুম, মনে আছে তোমার, আমি তোমার বুক চাটছিলুম, হাত চাটছিলুম, কোমর চাটছিলুম, মনে হচ্ছিল তোমার পুরোটা চেটে নিজের পাকস্হলিতে ঢুকিয়ে নিই । আমার শরীরের ভেতরে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমার ছেড়ে দেয়া ভয়ংকর সামুদ্রিক জীবরা, হাঙর, তিমি, শুশুক, ড্র্যাগনমাছ, ভ্যামপায়ার স্কুইড, লাল-জেলিফিশ, ব্লবমাছ, কফিনমাছ, আইসোপড, স্টারগেজার, চিমেরা, অক্টোপাস, অ্যাঙ্গলারমাছ, হ্যাচেটমাছ, ব্যারেলচোখো, ভাইপারমাছ, গবলিনমাছ, ওঃ, কতো রক্ত বেরিয়েছিল, যা দেখে তোমার মতন নৈমিত্তিক অভিজ্ঞ মানুষও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলে ।
    আসলে তোর ভেতরে ঢুকে আমার স্বপ্নের নদী খুঁজে বেড়াচ্ছিল কুন্দনন্দিনীকে, ডাকছিল তাকে কেঁদে-কেঁদে, তারপর না পেয়ে মুষড়ে পড়েছিল ।
    ছন্দরানি বললে, আমি তোমাকে চেয়েছিলুম, তোমাকে পেয়েছিলুম, আজও তোমাকেই চাই, অন্যের সঙ্গে শুলেও চোখ বুজে মনে করি যে তোমার সঙ্গেই শুয়ে আছি, আমার সঙ্গে যা করা হচ্ছে, তা তুমিই করছ । তোমাকে জিইয়ে রেখেছি আমার ভেতরে, প্রতিদিন ক্লায়েন্টরা আমাকে এইভাবে তোমাকে পাইয়ে দ্যায় ।
    তিথি আহমেদ বললে, সমস্যা কি জানিস, তিরিশ হাজারিনীর দেশে যারা আসে সকলেই দুঃখি, ভাবে শুলে বুঝি দুঃখু চলে যাবে, অথচ শোবার ব্যাপার তো আনন্দের, আহ্লাদের, মাংসের সঙ্গে মাংসের সংঘাত আর সংঘর্ষের, জন্নতপ্রাপ্তির । এই এক তোমাকে ছাড়া নগেন, কাউকে দেখলুম না যে আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারে ।
    ছন্দরানি সায় দিয়ে বললে, হ্যাঁ গো সত্যি কথাই বলেছে তিথি, বুড়োগুলো তো বটেই ছেলে-ছোকরারাও কুন্দনলাল সায়গলের কান্নাকাটি শুনতে চায় । শুনে-শুনে মুখস্হ হয়ে গেছে, অনেক সময়ে এমন রাত গেছে যে শোবার বদলে রাত জেগে সায়গল গেয়ে গেছি একের পর এক । মেড়োপার্টিগুলো ফাটকায় লস খেয়ে আসে আর কান্নার গান শুনতে চায়, এই করে-করে চটকলগুলোর বারোটা বাজিয়ে দিলে ।
    তাই বুঝি ? দাঁড়া, কুন্দনলাল সায়গলকে ডাকছি, উনি ভালো বোঝেন কোন গানটা আসল-দুঃখের আর কোন গানটা দুঃখের অভিনয়ের ।
    ডাকো তাহলে । বললে ছন্দরানি, ও নগেন দত্তের ক্ষমতায় অবিশ্বাস করে না । করার কথা নয় । যার মাংস ওর দেহে গিয়ে স্বপ্ন দেখে পথ হারিয়ে যায়, তার ক্ষমতার তুলনা হয় না ।
    কই সায়গল, এসো, তোমার দুজন প্রেমিকা তোমার দুঃখের গান শোনার জন্যে উৎসুক ।
    দরোজা খুলে ঘরে ঢুকলেন কে এল সায়গল, এক হাতে শিভাস রিগাল বোতল, আরেক হাতে একটা বড়ো কাঁচের গ্লাস । একটু ঝুঁকে পড়েছেন গানের ভারে ।
    চক্কোত্তির চেয়ারে বসে জিগ্যেস করলেন, কোন গানটা তোমাদের শোনাবো ?
    তিথি আর ছন্দরানি দুজনে একসঙ্গে বলে উঠল, সায়গলসাব, আমাদের একটা দুঃখের গান শোনান । আমাদের ক্লায়েন্টরা দুঃখের গান শোনার জন্যে হাপিত্যেশ করে থাকে ।
    সায়গল বললেন, আমার নিজের তো কোনো দুঃখ নেই, সবাই দুঃখ কমাবার জন্যে মদ খায়, আমি দুঃখ পাবার জন্যে মদ খাই, দাঁড়াও বোতলটা খালি করে নিই, তোমরা দুজনেও খাবে নাকি, এটা আসল শিভাস রিগাল, প্রযোজকের দেয়া ভেজাল মাল নয় ?
    ওরা দুজনে বললে, না,না, আপনি খান, যদিও ভেজালে আমাদের আপত্তি নেই, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, এখন আসল আর ভেজালে কোনো তফাত নেই স্যার ।
    সায়গল পুরো বোতল ফাঁকা করে গান ধরলেন । নগেন দত্ত চোখ বুজে গানটার পুরোনো সঙ্গীতযন্ত্র প্রয়োজনমতো জুড়ে দিলেন ।
    অব ম্যায় কা করুঁ কিত জাউঁ
    ছুট গয়া সব সাথ সহারা
    অপনে ভি কর গয়া কিনারা
    এক বাজি মেঁ সবকুছ হারা
    আশা হারি, হিম্মত হারি
    অব ক্যা দান লগাউঁ
    মাঈ কা করুঁ কিত জাউঁ
    জো পৌধা সিঁচা মুরঝায়া
    টুট গয়া জো মহল বনায়া
    বুঝ গয়া জো ভি দিয়া জলায়া
    মন অন্ধিয়ারা জগ অন্ধিয়ারা
    জ্যোত কহাঁ সে লাউঁ মাঈ
    কা করুঁ কিত জাউঁ…
    গান শেষ হলে, বোতল আর গ্লাস হাতে নিয়ে উবে গেলেন কুন্দনলাল সায়গল ।
    তিথি বললে, দেখলে তো, কেবল আমার নয় ছন্দরও ওই একই প্রবলেম । ওফ দুঃখ বিষাদ অবসাদ গ্লানি ক্ষোভ উদ্বেগ উৎকন্ঠা বিবমিষা যন্ত্রণা করে-করে মরে গেল খদ্দেরগুলো, এখানে এসেছিস আনন্দ কর, আনন্দ দে, তা নয়্, কান্নাকাটি, এক্কেবারে সহ্য করতে পারি না । মদে চুর হলে তো একেবারে ল্যাজেগোবরে, বাড়িতে তো কাঁদতে পারে না, এখানে এসে কাঁদে।
    তার কারণ আছে, বললেন নগেন দত্ত, আমি তোর সঙ্গে প্রথম রাতে শুয়েই বুঝে গিয়েছিলুম, অবশ্য আমাকে বুঝতে হয়েছিল হাত দিয়ে, মগজ দিয়ে নয় । তুই ইলিয়াস শাহী পরিবারের, তোকে কম বয়সে খতনা করা হয়েছিল, তোর দেহের স্বপ্ন দেখার কুঁড়িটাকে কেটে ফেলে দেয়া হয়েছিল তো ফুল আর কোথ্থেকে ফুটবে, আমি জেনে গিয়েছিলুম যে ফুল ফোটাতে হলে অনেকক্ষণ সার দিতে হবে, মাটি খুঁড়তে হবে, জল দিতে হবে, তারপরই তোর দেহে স্বপ্ন আসবে যা তোর মগজ নষ্ট করতে পারবে না ।
    ছন্দরানি বললে, আমার ঘরে ইশকুলের একটা ছেলে আসে, এগারো ক্লাসে পড়ে, টিউশানির টাকা খরচ করতে আসে তিরিশ হাজারিনীর দেশে । তুমি তো জানোই যে কারোর বুকেপিঠে ঘামাচি আর গালে ব্রণ আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না । ছেলেটা আলোয় পোশাক ছাড়তে লজ্জা পাচ্ছিল বলে আমি আলো নিভিয়ে ওর শার্ট-প্যান্ট খুলতে সাহায্য করলুম, তারপর দেখি কি, সারা পিঠ আর বুক জুড়ে ঘামাচি ।
    পা নাড়ানো থামিয়ে ছন্দরানি বললে, আমার কাছে ঘামাচির ট্যালকম পাউডার রাখি, তা ভালো করে মাখিয়ে দিলুম ছেলেটার পিঠে-বুকে, গালের ব্রণতে বোরোলিন লাগিয়ে দিলুম । ছেলেটা বিছানায় টাকাটা রেখে কেঁদে ফেললে, সে এক কেলেঙ্কারি, কিছুতেই শুতে রাজি হল না, শার্ট-প্যাণ্ট পরে টুক করে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সিঁড়ি দিয়ে পোঁ-পাঁ । তারপর যখনই আসে, পাউডার মাখিয়ে দিতে বলে, টাকা দিয়ে বলে, এটা পাউডার আর পাউডার-মাখানোর দাম মনে করে রেখে নিন। কতোবার বলেছি যে এসো বিছানায় এসো, অন্তত শিখে যাও কী করে কি করতে হয়, তা নয়, পাউডার মেখে চোখের জল ফেলে চলে যায় । একদিন বললে, ওর একজন প্রেমিকা আছে, সেও জানে যে ওর গা-ময় ঘামাচি হয়, কিন্তু কখনও বলেনি যে চলো তোমায় পাউডার মাখিয়ে দিই, কিংবা পাউডার কিনে দিয়ে বলেনি যে এটা গায়ে মেখো । ছেলেটা এলে আমার ভালো লাগে, বলে দিয়েছি যে ইচ্ছে হলেই এসো, কিন্তু পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে কষে এক থাপ্পড় দেবো ।
    যাক, তিরিশ হাজারিনীর দেশে একজন তো তোকে শ্রদ্ধায় উন্নীত করেছে, বললেন নগেন দত্ত, তোর নিজের ছেলে লণ্ডনে পড়াশুনা করলেও, এখানে পাতানো ছেলের ভালোবাসা পাচ্ছিস আবার ছেলে তোর প্রেমিকও, কজনের ভাগ্যেই বা ছেলে-প্রেমিক জোটে, ।
    তিথির মুখের প্রকাশভঙ্গী দেখে নগেন দত্তের মনে হল, তিথি যেন ভাবছে ছন্দরানির সঙ্গে জীবন পালটা-পালটি করে নিতে পারলে ভালো হতো । তিথির চরিত্রে একটা ব্যঙ্গ করার দিক আছে, যাকে ভুল করে মনে হতে পারে দাম্ভিকতা ।
    দাদামশায়ের উইল অনুযায়ী ওদের দুজনেরই আইডিওলজিকাল মেনোপজ শুরু হয়ে গেছে, উনিশ-কুড়িতে আটকে থেকে কোনো সমস্যা নেই ।
    হ্যাঁ গো, ছেলেটা আমায় ম্যাম বলে ডাকে, কতোবার বলেছি যে আমার নাম ধরে ডাক, তা ডাকবে না, বলে যে ওর প্রেমিকা আর ও দুজনে মিলে অন্ধ্রপ্রদেশের জঙ্গলে পালাবে মাওবাদী বিপ্লব করতে; কী যে বিপ্লবে পেয়েছে আজকালকার ছেলেমেয়েদের । এতো রকমের মাল আসে, কী বলব, তারা নানা সম্পর্কের আগল ভাঙতে চায়, যা তিরিশ হাজারিনীর দেশের বাইরে অনুমোদন পায় না । একজন আমাকে বৌদি বলে ডাকে তো একজন কাকিমা, একজন মাসিমা বলে ডাকে তো আরেকজন পিসিমা । মুখে বিড়বিড় করতে থাকে তারা, নানা কথা বলে-বলে, বৌদি তোকে ভালোবাসি, মাসি তোকে ছাড়া বাঁচব না, কাকি তুইই আমার সব, পিসি তুমি আমার হৃদয় কেড়ে নিয়েছো । আমিও সায় দিয়ে যাই, যাতে যার আনন্দ । এদের অনেকে প্রথম দিন এলে বুঝতে পারি যে খেয়াঘাট কোথায় আর বন্দর কোথায় তা জানে না ।
    নগেন দত্ত বললেন, আমার পতৃদেবও আমাকে শেখাবার জন্যে যার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার কাছেই আমি বন্দর আর খেয়াঘাটের পার্থক্য শিখেছিলুম ।
    ছন্দরানি বললে, একবার কালেজের ছয়টা ছেলে এসেছিল, দেখেই টের পেয়েছিলুম পয়সাঅলা বাড়ির, বললে যে, কাগজে গণধর্ষণ পড়ে-পড়ে ওদেরও গণধর্ষণ করার ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু রাস্তাঘাটের পার্টিগুণ্ডাদের মতন তো গণধর্ষণ করতে পারবে না, তাই এই বাড়িতে এয়েচে । মাসিপিসি বললে, তার জন্যে তো তোমাদের নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে হবে, যাকে গণধর্ষণ করবে তার সঙ্গে টানাহেঁচড়া করতে হবে, সেসব করতে গিয়ে ঘরের জিনিসপত্রের ভাঙচুর হলে খেসারত কে দেবে । ওদের দলের ফর্সা ছেলেটা একতাড়া পাঁচশো টাকার নোট মাসিপিসিকে দিয়ে বললে, এই নিন আগাম ক্ষতিপূরণ, দু-ক্রেট বিয়ার আর চিকেন ললিপপ আনিয়ে দিন, আর যাকে আমরা গণধর্ষণ করব তাকে তার আলাদা চার্জ দিয়ে দেবো, কেননা যা ব্যক্তিগত তা যে সর্বজনীন তা আমরা আজ প্রমাণ করে ছাড়ব ।
    নগেন দত্ত কৌতূহলে বললেন, তারপর ?
    মাসিপিসি ওদের পাঠিয়ে দিলে মীরার ঘরে, মীরাকে তো চেনো, ওর গায়ে এডওয়ার্ড মুঞ্চ ১৮৯৩ সালে ‘দি স্ক্রিম’ পেইনটিঙ এঁকে দিয়ে গিয়েছিল শাড়ির মতন করে, ওর ঘরটা বেশ বড়ো, খাটের চারিপাশে যথেষ্ট জায়গা আছে, আয়নাও সাবেকি, ঠুনকো নয়, ঠাকুরদেবতার তাকও বেশ ওপরে । ছোঁড়াগুলো কেমন করে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না, মীরার দেয়া চোলাই মদ খেয়ে বোকার মতন হাসাহাসি করছিল । কাস্টামাররা প্রথম এসে সন্দেহমাখা চাউনি তুলে তাকায় । মীরাকে দেখেছো তো, রঙ ধবধবে, চুলও বড়ো, ছোট্টো কপাল, পাতলা ঠোঁট, শুধু চোখ দুটো ছোটো বলে মার খেয়ে গেছে, নয়তো ওর রেট দশ মিনিটের দশ হাজারে শুরু হতো । যাকগে, তা ছেলেগুলো সাহস যোগাতে পারছে না দেখে মীরা একজনের গালে বসিয়ে দিলে কষে একখানা চড় ।
    বাইরে উড়ন্ত বাদলাপোকাদের দিকে তাকিয়ে কথা বজায় রাখল ছন্দরানি, চড় খেতেই তার মুখ থেকে বাংলা ভাষা লোপাট, খিস্তি আরম্ভ করে দিলে, খানকি, ব্লাডি বিচ, রাঁঢ়, মাগি, ফাকিং স্লাট, স্ট্রিট হুকার, এইসব, তবুও কেউ এগোচ্ছে না দেখে আরেকজনকে দিলে একখানা চড়, আমরা বারান্দা থেকে রগড় দেখছিলুম, ওদের মধ্যে যেটা ঢ্যাঙা ছিল সেই প্রথমে এগিয়ে গেল মীরার দিকে, তাকে টেনে আলাদা করলে ফর্সা ছেলেটা, লেগে গেল নিজেদের মধ্যে সত্যিকার মারামারি, বিয়ারের বোতলগুলো খুলে-খুলে এ ওকে ও তার মাথায় ঢেলে নিজেদের ভিজিয়ে ফেললে, মীরাও সেই সুযোগে বাকি দুটোকে কষিয়ে দিলে চড়, একটা ছোকরা লাফিয়ে মীরার ওপর পড়তেই মীরা তাকে নিয়ে সোজা বিছানায়, নিজের গোড়ালি দিয়ে ছেলেটের পোঁদে দুতিনবার চাপ দিতেই তার হাওয়া কলকলিয়ে বেরিয়ে গেল, সিংহির মতন আঁচড়ে কামড়ে গরগর আওয়াজ তুলে ওর শখ মেটালো । পরের তিনটেকেও মীরা আঁচড়ে কামড়ে পোঁদে গোড়ালির চাপ দিয়ে ওই ভাবেই হাওয়া বের করে দিলে, বিয়ারে ভিজে পোশাক শোকাবার জন্যে ল্যাংটো পোঁদে ল্যাংচা বের করে বসে-বসে ললিপপ খেলে ছোঁড়াগুলো । ওদের ছিল প্রথমবারের শোয়াশুয়ি, মীরার দেয়া বোরোলিন লাগিয়ে পা ফাঁক করে অনেকক্ষণ ধরে ল্যাংচার জ্বালা সারিয়েছিল ।
    হাসিমুখে ছন্দরানি স্মৃতির আমোদ নিয়ে বললে, ওরা গণধর্ষণের পালা সাঙ্গ করে বিদেয় হল । মীরা ওদের বলেছিল, যখন ওরা ওর ঘর থেকে টলতে-টলতে বেরোচ্ছে, এখন মদে চুর হয়ে আছো, যাও গিয়ে নর্দমায় একরাত কাটিয়ে বাড়ি ফিরো, নর্দমায় রাত না কাটালে জীবনের উত্তম অভিজ্ঞতা হবে না ।
    হাসি বজায় রেখে ছন্দরানি আরও বলল, তিরিশ হাজারিনীর দেশে মীরার কিন্তু খ্যাতি আছে একসঙ্গে দশবারোজনকে হ্যাণ্ডল করার । মীরা বলেছিল, ওদের মধ্যে একজনকে ও চিনতে পেরেছিল, সে মীরার ভাইপো, যে ভাইটা পার্টি করতো আর মীরাকে ফুসলিয়ে বেচে দিয়েছিল দিল্লির এক ব্যাবসাদারকে, তার বড়ো ছেলে ।
    তাছাড়া কি জানো, বলল ছন্দরানি কিছুক্ষণ থেমে, যেন চেঁচিয়ে চিন্তা করছে, মীরার ঘরের আয়নায় নিজেকে দেখতে গেলে নিজেকে দেখা যায় না, তার বদলে হনুমান, শিম্পাঞ্জি, বেবুন, গেরিলা, বাঁদর, ওরাং ওটাং দেখতে পাওয়া যায়, আগের জন্মে লোকটা যা ছিল, তাই কেউ বেগড়বাঁই করলেই আয়নার পর্দাটা সরিয়ে দ্যায় মীরা, ও তো জুলজির অধ্যাপনা করে, জন্তু-জানোয়ারের অন্তরজগতের খবর রাখে ।
    তিথি বলল, এমন-এমন সব জোটে না, কী বলব । যাকগে, সেই থেকে বসে আছ, রাত তো বেশ হল, তোমার খিদে পেয়েছে নিশ্চই ? বলো তো কিছু রান্না করি তোমার জন্যে, পোর্টাবেলো মাশরুমের সঙ্গে অলিভ অয়েলে বাছুরের মাংস দারুণ রাঁধতে পারি, বা যদি চাও তাহলে রসুন রেড ওয়াইন ভিনিগারে চুবিয়ে হরিণের মাংসের স্টির-ফ্রাই, পরোটায় মুড়ে, কিংবা অর্ডার করে আনাই ; তিরিশ হাজারিনীর দেশে খাবার হোটেল প্রচুর।
    নগেন দত্ত বললেন, তার চেয়ে চল বাইরে গিয়ে খাওয়া যাক, সালামি আর বিয়ার, তারপর না হয় একটা ফিল্ম দেখা যাবে, কতো যুগ হয়ে গেল দেখিনি । ওয়াশরুমের যে রাস্তায় চক্কোত্তি পালিয়েছে, ওই রাস্তার কোনো একটা সিঁড়ি দিয়েই যাই, ওকে খুঁজে পেতে পারি, খুঁজে না পেলেও ক্ষতি নেই, নিচের তলায় কি হয় আর চক্কোত্তির গোপন ব্যাপারখানা জানারও ইচ্ছে রয়েছে ।
    কোন রাস্তা ? গোপন পথ আছে নাকি কোনো, কই জানি না তো ! এতোকাল রয়েছি এই বাড়িতে ! বললে তিথি আহমেদ ।
    নগেন দত্ত বললেন, তিথির দিকে চেয়ে, সে কি রে, ওই ওয়াশরুমের ভেতরে একটা দরোজা আছে, সেই দরোজা দিয়ে অনেকগুলো সিঁড়ি নিচে কোথাও কিংবা অনেক দিকে চলে গেছে, তা তোরা জানিস না ? আজব ব্যাপার ।
    ছন্দরানি বললে, মুখময় শঙ্কার পাতলা চাদর, না, এই ঘরে কতোবার এসেছি গেছি, কখনও তো চক্কোত্তিমশায়কে দেখিনি টয়লেটে গেলো আর লোপাট হয়ে গেল ।
    লোপাট হয়ে গেল বলেই তো অপেক্ষা করে এক ঘণ্টা পরেও যখন এলো না, তখন ভেতরে ঢুকে সিঁড়িগুলো দেখতে পেলুম, বললেন নগেন দত্ত ।
    দুজনেই বললে, চলো, আমরা ওনার কালোধান্দার অনেককিছু জানি, আবার অনেককিছু জানিও না । এই পোশাকেই যাই, হাজার তিরিশিনীর দেশে পোশাক-আশাকের তেমন বাঁধাধরা নিয়মনীতি নেই, ওপর ঢাকা-তলা ঢাকা মনে হলেই হল, তা সে ঢাকা বাস্তব হোক বা কাল্পনিক ।
    তিথি বললে, আমি তো সালভাদর দালির আঁকা দেহশাড়ি পরেই আছি, ছন্দও পাবলো পিকাসোর আঁকা দেহশাড়ি পরে আছে । তুমি তোমার পোশাক পালটে নাও ।
    ব্রিফকেস খুলে পোশাক পালটে নিলেন নগেন দত্ত । লাল টিশার্ট, ব্লু-জিনস আর জগিঙ-জুতো । ইল্যাসটিক ব্যাণ্ডে বাঁধা পিগটেল চুল । ব্রিফকেস টেবিলের ওপরেই রেখে দিলেন, চক্কোত্তি ফিরলে যা করার করবে ।
    টয়লেটের গোপন দরোজা খুলে ওরা দেখলো অনেকগুলো সিঁড়ি রয়েছে আর তাদের মুখে বোর্ড টাঙানো ; ইতিহাসের পুর্নলিখন, ধর্মের কারখানা, রাজনৈতিক বৈধতা, গ্রন্হাদির রূপবদল, চিৎকারনিলয়, স্লোগানছন্দ, খোচরত্বের প্রশিক্ষণ, নাটুকেপনা প্রশিক্ষণ, গুপ্তচর প্রশিক্ষণ, দলবদল প্রশিক্ষণ, ভোটার ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি প্রশিক্ষণ, ইত্যাদি ইত্যাদি, এক পলকে যেটুকু পড়া গেল । সবকটা বোর্ডের তলায় ছৌ-নাচের মুখোশ ঝুলছে, এক-একটায় এক-একরকম, দেবীর, দেবতার, অসুরের, দানবের, পশুর । কারণ আছে নিশ্চই ।
    যে বোর্ডে লেখাছিল ‘রাজনৈতিক বৈধতা’’ সেই সিঁড়িটা সামনে ছিল বলে সেটা দিয়েই নামল ওরা ।
    নেমে দেখতে পেল, হাসপাতালের বিশাল অপারেশান থিয়েটার, কড়িকাঠ থেকে তার বেঁধে ঝোলানো, সাদার ওপর গেরুয়ায় লেখা বোর্ড টাঙানো, তার তলায় অপারেশান চলছে পার্টিশান করা ঘরে, তীব্র আলোর তলায় সার্জেনরা গেরুয়া মেডিকাল স্ক্রাব পরে, মুখে গেরুয়া কাপড়ের স্ক্রাব বেঁধে একাগ্র হয়ে শল্যচিকিৎসায় ব্যস্ত ।
    বোর্ডে যা লেখা রয়েছে তার সঙ্গে শল্যচিকিৎসকদের কাজের মিল খুঁজে না পেয়ে, তিথি আহমেদ বলল, একেই বলে লিঙ্গ উইথ স্টিকস বা লিঙ্গুইস্টিকস, যা পড়ছ বা যা দেখছ তার সঙ্গে যা ভাবছ তার মিল নেই ।
    ওরা তিনজন যে নামল তাতে শল্যচিকিৎসক আর সাহায্যকারী নার্সদের দৃকপাত নেই । পরিবেশ বেশ শীতল, প্রায়ান্ধকার, গভীর । চিকিৎসালয়ের ভীতিকর গন্ধের নৈঃশব্দ । ছন্দরানির মনে হল আতঙ্কের অন্ধকারের গিঁট গড়ে উঠছে গলার কাছে ।
    নগেন দত্ত দেখলেন, বোর্ডগুলোয় লেখা রয়েছে কী ধরনের অপারেশান চলছে : রাইনোপ্লাস্টি ( নাককে সুন্দর করা তোলার কাজ চলছে ), ব্লেফারোপ্লাস্টি ( চোখের পাতায় সৌন্দর্যদান করার কাজ চলছে), ফেশিয়াল স্কার রিভিজন ( মুখের দাগ মোছার চিকিৎসা চলছে ), ফোরহেড লিফ্টস ( কপালকে আকর্ষক করার চিকিৎসা চলছে ), হেয়ার রিপ্লেসমেন্ট ( টাকে চুল বসাবার চিকিৎসা চলছে ), মেনট্রোপ্লাস্টি ( থুতনিকে সৌন্দর্যময় করার কাজ চলছে ), অটোপ্লাস্টি ( কানকে সৌন্দর্যময় করার কাজ চলছে ), ব্রেস্ট রিকন্সট্রাকশান আফটার ম্যাসেকটনি ( ক্যানসারে স্তন কাটা গেলে নতুন স্তন বসাবার কাজ চলছে ), ফ্যালোপ্লাস্টি ( লিঙ্গকে ছোটো বা বড়ো করার কাজ চলছে ), ম্যাস্টোপ্লাস্টি ( স্তনকে বড়ো বা ছোটো করার কাজ চলছে ), বাটক লিফ্ট ( পশ্চাদ্দেশ উঁচু করা তোলার কাজ চলছে ), লাবিয়াপ্লাস্টি ( যোনিকে বড়ো বা ছোটো করার কাজ চলছে ), ব্রাউপ্লাস্টি ( ভ্রূযুগল সৌন্দর্যময় করার কাজ চলছে ), ভার্জিনিটি রিপেয়ার ( সতীচ্ছদ রিপু করার কাজ চলছে ), পাম রিপ্লেসমেন্ট ( হাত কচলাবার হাত জোড়া চলছে ) ।
    ছাদের দিকে তাকিয়ে ওরা টের পেলো যে পাহারা দেবার জন্যে কর্তৃপক্ষ বাদামি মেঘের মতন রসায়নে উড়িয়ে রেখেছেন নানা রকমের ভুতপ্রেত, পেত্নি, শাঁকচুন্নি, মেছোভুত, গেছোভুত, ব্রহ্মদত্যি, কানাভুলো, পিশাচ, মিলিটারি ভুত, অতৃপ্তভুত, তারা নিজেদের মধ্যে সংস্কৃত আর লাতিন ভাষায় কথা বলছে ।
    একটা গেছোভুত ছন্দরানির সবুজ আমে মুখ রেখে চুষে উড়ে গিয়ে ফিরে এসে কুঁচকিতে থাবড়া মেরে চলে গেল । ছন্দরানি তার গালে কষে চড় মারলেও বুঝতে পারল যে ভুতটা কোনো পারদর্শী বাষ্পীয় রসায়নে তৈরি, ছোঁয়া যায় না । অথচ ভুতটার গায়ে বিজবিজে এঁটুলি । সংস্কৃত ভাষায় ভুতটা বলল, বস্তুরা যে অবস্তু তা নিজের হাতে দেখলি তো রে মাগি ।
    তিথি আহমেদকে জড়িয়ে ধরল একটা মেছোভুত, কী বিটকেল গন্ধ, বলে চেঁচিয়ে ভুতটাকে দুহাতে ছাড়াতে চেষ্টা করলেও পারল না তিথি, ভুতটা কোনো বস্তু দিয়ে গড়া নয় । ভুতটা রাস্তাছাপ ছোকরার মতন সিটি বাজিয়ে ছাদের কাছে উড়ে গিয়ে হাসতে হাসতে বলল, লাতিন ভাষায়, বস্তুদেরও বস্তুহীনতা হয় গো খুকি ।
    বিরাট দুটো মাই ফুলিয়ে একটা শাঁকচুন্নি বাদামি মেঘ থেকে সরাসরি নেমে এসে নগেন দত্তকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে চুমো খেয়ে বুকের গোলাপি বেলুন আরও ফুলিয়ে ফাটালো, তার ভেতর থেকে দুধ বেরিয়ে ছিটকে জ্বালা করতে লাগল ওদের তিনজনের । নগেন দত্ত শাঁকচুন্নির গলা দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে, ভুতটার মাথা আর ধড় আলাদে হয়ে উড়ে গেল খিঁকখিঁক হিঁঃহিঁঃ হাসতে হাসতে ।
    এবার সবকটা ভুতপ্রেত, শাঁকচুন্নি, মেছোভুত, গেছোভুত, ব্রহ্মদত্যি, কানাভুলো, অতৃপ্তভুত বাদামি মেঘকে নিয়ে নিচে নেমে এসে তিথি আর ছন্দরানিকে ঘিরে পাক খেতে লাগল, নাচতে লাগল বাদামি মেঘের কুণ্ডলী, ক্রমশ নীল রঙের দেবতা-টাইপ হয়ে, বাবরি চুলে ময়ূর-পালক, ওদের ঘিরে গাইতে লাগল, নাচতে লাগলো হিপ-হপ ।
    সরে গিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে নগেন দত্ত মনে করতে পারলেন যে গানটা যিনি লিখেছেন, জয়দেব, তাঁর সঙ্গে বহুকাল আগে, বারো শতক নাগাদ, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে একবার দেখা হয়েছিল, মন্দিরের নাচিয়েরা এই গানটা গাইতে গাইতে নেচেছিল :
    স্মরসমরোচিতবিরচিতবেশা
    গলিতকুসুমদরবিলুলিতকেশা

    হরিপরিরম্ভণবলিতবিকারা
    কুচকলসোপরি তরলিতহারা

    বিচলদলকললিতাননচন্দ্রা
    তদধরপানরভসকৃতন্দ্রা

    চঞ্চলকুণ্ডলললিতকপোলা
    মুখরিতরসজঘনগতিলোলা

    দমিতবিলোকিতলজ্জিতহসিতা
    বহুবিধকূজিত রতিরসসিতা

    বিপূলপূলকপৃথুবেপথুভঙ্গা
    শ্বসিতনিমিলতবিকসদনঙ্গা

    শ্রমজলকণভরসুভগশরীরা
    পরিপতিতোরসি রতিরণধীরা

    গান শেষে, নীল দেবতা-টাইপ মিলিয়ে যেতে, ব্রহ্মদত্যি সংস্কৃততে বলল, দরোজা তো খুলবে না, দরোজা তো খুলবে না, আগে বলো, অলবার্সের হেঁয়ালি কাকে বলে ?
    নগেন দত্ত উত্তর জানতেন, তিনি এককালে কালেজে বিজ্ঞান পড়াতেন । সংস্কৃততে বললেন, মহাবিশ্ব যদি সুষমভাবে তারাপূর্ণ হতো, তাহলে যেদিকেই তাকাই না কেন, আমাদের দৃষ্টি কোনো না কোনো তারার পিঠে গিয়ে পৌঁছোনোর কথা, আর সেক্ষেত্রে, রাতের আকাশ অন্ধকার হবার কথা নয় । রাতের আকাশ অন্ধকার থাকে কেননা আমাদের দৃষ্টি একই সঙ্গে সব তারার পিঠে গিয়ে পৌঁছোয় না । বহু তারার আলো এখনও পৃথিবীতে এসে পৌঁছোয় নি ।
    মিচকে প্রেমিকের মতন মিলিয়ে যাওয়া নীল মানুষ বাদামি মেঘ হয়ে গেল আর ভুতগুলো হাততালি দিয়ে ছাদের কাছে মিশে গেল ।
    বাইরে বেরোবার কাঁচের দরোজার কাছে গেলে তা আপনা থেকে খুলে গেল । দরোজার ওপরে গুরু-মহারাজের ফ্রেমেবাঁধানো বিশাল ছবি, ওপরের ঘরের ছবির মতনই চন্দনকাঠ চাঁছাইয়ের মালা পরানো । একই বাণী সোনালি রঙে লেখা, “সত্যের জয় কখনও হয় না, কখনও হয়নি, কখনও হবে না” ।
    দরোজার কাছে যে মিলিটারি ভুত দাঁড়িয়েছিল, সারা মুখে আর গায়ে পোশাকের বদলে সাদা রঙ করা, কেবল লিঙ্গের রঙ কুচকুচে কালো, লাল শিশ্ন জ্বলছে টর্চের মতন, সে ওদের দেখে স্যালুট ঠুকলো । নগেন দত্ত একটা এক হাজার টাকার নোট দিতে, গদগদ লোকটা মাথা নিচু করে আবার সেলাম ঠুকলো। বলল, স্যার, আমাদের ভুতপ্রেত বলে মনে করবেন না, আমরা সবাই ভুতগ্রস্ত দেবদূত, আপনারা কখনও দেবদূত দেখেননি বলে হয়তো আমাদের বিশুদ্ধ ভুত বলে মনে করছেন ।
    নগেন দত্ত লাতিন ভাষায় জিগ্যেস করলেন, ছৌ-নাচের মুখোশগুলো কিসের জন্যে ?
    মিলিটারি ভুত সংস্কৃততে বলল, জানি না স্যার, আগে যে মেছোভুত বাউন্সার ছিল সে জানতে চাওয়ায় তার চাকরি চলে গেছে । তবে কানাঘুষা শুনেছি যে এই অপারেশান থিয়েটারে ভবিষ্যতের মানুষ গড়ার কাজ চলছে, তাদের মুখ হবে মুখোশের মতন আর কাজ করবে যন্ত্রের মতন, তাদের একটা করে নম্বর থাকবে আর মানুষের বদলে তাদের বলা হবে নাগরিক, তারা গ্রামে থাকুক বা জঙ্গলে সবাই হবে নাগরিক, তারা টাকার জন্যে সবকিছু করবে ।
    মিলিটারি ভুত চলে গেলে, তিথি বলল, তিরিশ হাজারিনীর দেশটা তার মানে মরণের গুরু-মহারাজ বাঞ্চোতের, ইচ্ছে করে লিঙ্গকে ন্যানোনুনু করিয়ে নিয়েছে, যাতে যে ওর সঙ্গে শোবে সে গলদঘর্ম হয়ে যাবে ব্যাটাকে জাগিয়ে তুলতে, ক্যাওড়াটার পলিটিকালি কারেক্ট লিঙ্গ, বোকাচোদার গায়ে পুলিশের জেরা করবার ঘরের টেবিলের মতন তেলচিটে দুগ্গন্ধ।
    আরে ! চমকে উঠলেন নগেন দত্ত, বললেন, এই হম্বিতম্বি গুরু-মহারাজই অধ্যাপক চক্কোত্তির কোম্পানির জিএম, এরই পারমিশান নেবার জন্যে চক্কোত্তি গেছে ওনার আশ্রমে । এতক্ষণে বুঝতে পারলুম তারক ব্যানার্জির সঙ্গে কোন ব্যাপারে কথা হচ্ছিল । তিনটে মেয়েকে নিয়ে আসবে, তাদের একলাখ করে বিক্রি করেছিল অলরেডি, এবার তাদের ভার্জিনিটি রিপেয়ার করে আর শল্যচিকিৎসায় সুন্দরী করে প্রত্যেককে দুলাখ টাকা করে বিক্রি করবে ।
    ওনার আশ্রম তো ছত্তিশগড় না ঝাড়খণ্ডে কোথাও আছে ঘন জঙ্গলের ভেতরে, বললে তিথি আহমেদ, খিস্তিখোরটা আমাকে পটিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, যাইনি, জঙ্গলের লাইফ আমায় স্যুট করবে না, মশারি টাঙিয়ে আমি কাস্টমার সার্ভিস ভালো দিতে পারি না , তারওপর লোকটা ন্যানোনুনুর কাহ্ণ । জীবনের বেশিরভাগ তো কাটালুম তিরিশ হাজারিনীর দেশে, এখানের অনিশ্চয়তার অনির্ণেয়তার নেশা ধরে গেছে গো । প্রতিদিন মানুষের সঙ্গে সাময়িক সম্পর্ক পাতাই, আমার সম্পর্ক প্রতিদিন বদলাতে থাকে, তা নয় এক ব্যাটা থলথলে গুরু-মহারাজের আশ্রমে গিয়ে পাকা সম্পর্ক তৈরি করে ভৈরবী হয়ে খঞ্জনি বাজিয়ে নাচো আর রাতে তার ওজন সামলাও । ভাবলেও ঝাঁট জ্বলে যায় ।
    গম্ভীর মুখে ছন্দরানি মন্তব্য করলে, হ্যাঁ, মানবসম্পর্ক কখনও স্হায়ী হওয়া উচিত নয় ; স্হায়ী হলে তারা বালকের সুবোধত্ব হারিয়ে ফ্যালে, খিল্লি কেস হয়ে যায় ।
    বাইরে বেরিয়ে ওরা দেখলো বিরাট আঁস্তাকুড়, শল্যচিকিৎসার পর বাড়তিমাংস ফেলে দেয়া হয়েছে জঞ্জালের স্তূপে, নাকের চিলতে, ঠোঁটের টুকরো, মাইয়ের শাঁস, পেটের বাড়তি চর্বি, পাছার বাড়তি মাংস আর চামড়া, নুনুর ডগা, যোনির কুচি, ফেলে দেয়া হাত-পা-মুণ্ডু আর নানা রকমের মাংসের ছাঁট যা চেনার উপায় নেই, আর একটা ড্রামে রক্ত, যতো রক্ত বেরিয়েছে তা ওই ড্রামে এনে ফেলে থাকবে ।
    তিথি আহমেদ, যে সাধারণত কোনোকিছুই সিরিয়াসলি নেয় না, ওর মনে হল, কোনো দৃশ্য দেখলে তার একটা মানে গড়ে নেয়া যায় মনের ভেতরে, কিন্তু যা দেখছে তা যেন চিরকুট না লিখে মারা যাওয়া আত্মহত্যাকারীর মতন রহস্যময় ।
    আঁস্তাকুড় জুড়ে মানুষের গাদাগাদি, পুরুষ, নারী, কিশোর, বাচ্চা সবাই কাড়াকাড়ি করছে মাংস নিয়ে তক্ষুনি খাবার জন্য, যা হাতে পাচ্ছে গপাগপ খেয়ে ফেলছে, গলায় আটকে গেলে ড্রামের কাছে গিয়ে আঁজলা ভরে রক্ত খেয়ে আবার ফিরে এসে মানুষের ছাঁট মাংস খাচ্ছে, জঞ্জাল খাচ্ছে, টিনের কৌটো, কাঁচের বয়াম, প্লাসটিকের বোতল, পচা কাপড়, আধুনিকতার ফেলে দেয়া সমস্তকিছু খেয়ে ফেলছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন আধুনিকতাকেই সাবাড় করে দিতে চাইছে, এদের ধাপার মাঠে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলে কয়েক দিনে সব খেয়ে পরিষ্কার করে ফাঁকা মাঠ বানিয়ে দিতো । ওদের হাতগুলো আর হাঁ-মুখ বেশ বড়ো ।
    ছন্দরানি বললে, এই মানুষগুলো কারা, ওপরে তিরিশ হাজারিনির দেশের রাস্তায় তো কখনও দেখিনি এরকম রোগা, হাড়গিলে, না-খেতে পাওয়া মানুষদের কাড়াকাড়ি, আমরা বোধহয় আনডারগ্রাউণ্ডে অন্য কোনো সিসটেমে চলে এলুম ।
    নগেন দত্তও এরকম মানুষজন দেখেননি আগে, শিড়িঙ্গে, হাড়ের ওপর চামড়া, গায়ে মাংস প্রায় নেই, বাচ্চাগুলোর পেট তবুও ফোলা, এরা বোধহয় অনেককাল স্নান করেনি, চুল রুক্ষ, পোশাক বলতে পুরুষরা কানি বেঁধে আছে, নারীদের ময়লা শাড়িতে যতোটুকু শুকনো বুক ঢাকা যায়, বাচ্চাদের পোশাক বলতে কিছুই নেই ।
    গায়ে সাদা রঙ করা মিলিটারি ভুতটা, যাকে সিকিউরিটির লোকের চেয়ে বাউন্সার বলেই মনে হচ্ছিল, এসে লাঠিপেটা করে তাড়ালো লোকগুলোকে, বলল, যতোই তাড়াই, তিষ্ঠোতে দ্যায় না, দশ মিনিট পরেই আবার দল বেঁধে চলে আসে, এতো খাচ্ছে, দিনের পর দিন খাচ্ছে, তবু ওদের পেট ভরে না । আমি একজন ভুতগ্রস্ত দেবদূত, আমাকেও ভয় পায় না । অন্য ভুতদের লেলিয়েও দেখেছেন কর্তৃপক্ষ, কাউকেই ভয় পায় না ওরা ।
    খেলেই বা, ক্ষতি কি ? গলার স্বরে ঔদ্ধত্য মিশিয়ে বলল তিথি আহমেদ।
    মিলিটারি ভুত বলল, ওরা খায় কিন্তু হাগে না । এরা তিরিশ হাজারিনীর দেশের বৈধ নাগরিক নয়, তাই নিচের স্তরে নামিয়ে দেয়া হয়েছে, পরার পোশাক নেই যাদের, তাদের বৈধ কাগজপত্রই বা কোথ্থেকে হবে, তিরিশ হাজারিনীর দেশের ব্যবস্হাকে পালটাবার কোনো উপায় নেই, এই লোকেরা পালটে দেবে ভেবেছেন, তাহলেই হয়েছে । কন্ঠস্বরে সহানুভূতি থাকলেও, ষণ্ডামার্কা ভুত চাকরির দাবি-দাওয়ার কাছে অনুগত, কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বলল কথাগুলো, সম্ভবত আগন্তুকদের কৌতূহল মেটাবার জন্য বলে-বলে অভ্যস্ত ।
    ওরা তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, এটা বোধহয় গণতন্ত্রের আনডারগ্রাউন্ড ব্যবস্হা ।
    একটু এগিয়ে, নগেন দত্তর দুইপাশে ছন্দরানি আর তিথি ওনার পকেটে ওদের একটা হাত ঢুকিয়ে, কাঁধে মাথা রেখে, হাঁটতে লাগল । নগেন দত্ত জানেন চারিপাশের পরিবেশকে কেমন করে নিয়ন্ত্রণ আর মেরামত করে নিতে হয় । বাঁহাত ডানদিকের পকেটে ঢুকিয়ে তিথি আহমেদ নগেন দত্তর প্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করতে করতে বললে, এটা আমার । ডানহাত বাঁদিকের পকেটে ঢুকিয়ে প্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করতে করতে ছন্দরানি বললে, এটা আমার ।
    তিথি আর ছন্দরানি দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল তোমার আদি রসের দুটো যন্ত্র নাকি, শোবার সময়ে তো একটাই দেখেছি ।
    নগেন দত্ত বললেন, তোরা পকেটে হাত ঢোকাতেই জেনে গিয়েছিলুম কী করতে চলেছিস, তাই দুজনের মধ্যে রেশারেশি যাতে না হয় তাই দুটো প্রত্যঙ্গ করে নিলুম । দাদামশায় ওনার উইলে লিখে গেছেন যে আমার ওপর যদি একইসঙ্গে একই সময়ে কয়েকজন দাবি জানায় তাহলে নিজেকে সমানভাবে তাদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে দেবো ।
    তিথি আহমেদ নগেন দত্তর গালে তুলতুলে ঠোঁট ঠেকিয়ে চুমু খেল, মমুয়াআআআআআঃ ।
    নগেন দত্ত বললেন, দাদামশায়ের উইল অনুযায়ী তোদের তো অনেক সম্পত্তি আর টাকাকড়ি দেয়া হয়েছে, তবু এই তিরিশ হাজারিনীর দেশে পড়ে আছিস কেন ?
    ছন্দরানি নগেন দত্তের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, আরে, তোমরাই শুধু জীবনের সাধআহ্লাদ উপভোগ করবে, আমাদের বুঝি ইচ্ছে হয় না, অনেকের সঙ্গে শুই, নানা আঙ্গিকে শুই, নানা বয়সের সঙ্গে শুই, নানা ভাষার সঙ্গে শুই, নানা মাপের সঙ্গে শুই, নানা চামড়ার সঙ্গে শুই, নানা গন্ধের সঙ্গে শুই ? তোমার দাদামশায়ের উইল অনুযায়ী এখন কম বয়সে যতদিন আটকে আছি ততোদিন জীবনের মজাগুলো নিয়ে নিতে চাই ।
    তিথি বললে, হ্যাঁ, শনৈশনৈ । কাদের সঙ্গ পাইনি বলো দিকিন ? ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনের সময়ে একজন ছোকরা এসে আমার লেপের তলায় ঘুমোচ্ছিল, ব্রিটিশের পুলিশ তাকে ঘুম থেকে তুলে লাঠি পিটিয়ে নিয়ে চলে গেল ।
    ১৯১৫ সালে গদর ষড়যন্ত্রের সময়ে একজন আমার লেপের তলায় এসে লুকিয়েছিল, ব্রিটিশের পুলিশ তাকে দড়ি বেঁধে নিয়ে চলে গেল ।
    ১৯২০ সালে অনুশীলন সমিতির একজন এসে আমার সঙ্গে লেপের তলায় লুকিয়েছিল, ব্রিটিশের পুলিশ তাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেল ।
    ১৯২০ সালে কুইট ইনডিয়ার সময়ে একজন লালটুশ যুবক আমার লেপের তলায় লুকিয়েছিল, ব্রিটিশের পুলিশ তাকে ধরেবেঁধে নিয়ে চলে গেল।
    ১৯২৮ সালে কমিউনিস্টদের যখন মিরাট ষড়যন্ত্রর দোষ দিলে, তখন আমার চাদরের তলা থেকে একজন দাঁড়িঅলা ছোকরাকে ব্রিটিশের পুলিস ধরেবেঁধে নিয়ে গেল ।
    ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় এক গুণ্ডা এসে আমার খাটের তলায় লুকিয়েছিল, ব্রিটিশের পুলিশ তাকে প্যাঁদাতে-প্যাঁদাতে নিয়ে গেল ; ওই বছরেই কিসান সভার একজন আমার লেপের তলায় জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল, ব্রিটিশ পুলিশ দরোজা ধাক্কিয়ে লোকটাকে নিয়ে চলে গেল ।
    ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্টরা যখন ‘ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়’ জিগির তুলে ট্রামবাস পোড়ালে তখন স্বদেশি পুলিশ আমার ঘর থেকে মাসকাবারি বাবুকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে চলে গেল ।
    ১৯৫৪ সালে এক উদ্বাস্তু নেতা আমার ঘরে লেপের তলায় দুপুরে জিরোচ্ছিল, তখন স্বদেশী পুলিশ ধরেবেঁধে নিয়ে চলে গেল ।
    ১৯৬২ সালে একজন চিনা যুবক আমার লেপের তলায় জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল, তখন স্বদেশী পুলিশ তাকে চড় মারতে-মারতে নিয়ে চলে গেল ।
    ১৯৬৪ সালে মলয় রায়চৌধুরী নামে এক চশমাপরা রোগাটে কবি আমার ওপর চেপে সবে আরম্ভ করেছে, স্বদেশী পুলিশ টেনে আমার ওপর থেকে নামিয়ে হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি পরিয়ে নিয়ে চলে গেল, পুলিশের সঙ্গে দুজন খোচর ছিল যারা ওই কবিটার চলাফেরার ওপর নজর রাখতো ।
    ১৯৭০ সালে বর্ধমানের সাঁইবাড়ির গোলমালের সময়ে একজন লোক এসে আমাকে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল, তাকে প্যাঁদাতে-প্যাঁদাতে নিয়ে গেল পুলিশের মতন পোশাক পরা একদল লোক ।
    ১৯৭১ সালে একজন নকশাল যখন আমার খাটের তলায় এসে লুকিয়েছিল, স্বদেশী পুলিশ মার দিতে-দিতে হিঁচড়ে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে চলে গেল ।
    ১৯৭৬ সালে ইন্দিরার এমারজেন্সির সময়ে একজন লেখক আমার কম্বলের তলায় ঘুমোচ্ছিল, স্বদেশী পুলিশ তাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেল ।
    ১৯৭৯ সালে যখন মরিচঝাঁপি থেকে পালিয়ে এসে একজন বুড়ো শান্তিতে আমাকে জড়িয়ে শুয়েছিল, পুলিশ তাকে টানতে-টানতে নিয়ে চলে গেল ।
    ১৯৮২ সালে গেরুয়া লুঙ্গি পরা গোঁফদাড়িঅলা একজন মাঝবয়সী আমার ঘরে শুয়েছিল, সাদা পোশাকের পুলিশ বললে যে সে আনন্দমার্গী, আইন ভেঙেছে, তাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেল ।
    ২০০০ সালে নানুরের এক মুসলমান বুড়ো আমার লেপের তলায় লুকিয়েছিল, তাকে সাদা পোশাকের লোকেরা হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল ।
    ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামের এক চাষি আমার লেপের তলায় আমাকে জড়িয়ে শুয়েছিল, তাকে স্বদেশি পুলিশ মারতে-মারতে ধরে নিয়ে গেল ।
    ২০১১ সালে মুখে গামছা বেঁধে একজন ঘুমোচ্ছিল আমার কম্বলের তলায়, যাতে আমি লোকটার মুখ ছাড়া সবকিছু দেখতে পাই, তাকে তো মুখে গামছা ঢাকা অবস্হাতেই তুলে নিয়ে গিয়েছিল স্বদেশী পুলিশ ।
    তাহলে দেখতে পাচ্ছে, দেশটাকে কতো ভালো করে জানতে পেরেছি তিরিশ হাজারিনীর দেশের নাগরিক হয়ে ? জীবন বড্ডো ব্যানাল, বুঝলে গো, তা থেকে বেরোবার উপায় তো খুঁজে পেয়েছি ।
    নগেন দত্ত তিথির গালে চুমো দিয়ে বললেন, সাবধানে থাকিস, এখন উত্তরাধুনিক যুগ চলছে তিরিশ হাজারিনীর দেশে, লোকে খুন হয়ে গেলে টিভি আর কাগজের গল্প হয়ে যায়, তারপর তার কথা সবাই ভুলে যায়, নতুন গল্প চলে আসে । এটা তাড়াতাড়ি ভুলে যাবার দিনকাল ।
    তিথির মুখেচোখে তখওন আত্মগর্বের ছোঁয়া । নিজের চেয়ে চারিপাশের জগতসংসারকে নিয়ে বেশি চিন্তিত যেন । একনাগাড়ে কথা বলার পর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তিথি আহমেদ বলল, ব্যথায় আনন্দ আছে, যন্ত্রণাতেও আহ্লাদ আছে, আহ উহ করাতেও মজা আছে , পোঁদে চিমটি কাটে তাও অনেক সময়ে ভালো লাগে, আমরা তো লজ্জাবোধের সিংহাসনে বসে রাজত্ব করি ।
    তিথির কথাকে এগিয়ে নিয়ে গেল ছন্দরানি, বলল, তিরিশ হাজারিনীর দেশে আমরা সবায়ের শিরদাঁড়া তরতাজা করে দিই, রিফ্রেশ করে পৃথিবীর সঙ্গে লড়তে পাঠাই, ওদের চিন্তার ভেতরে লড়বার গানের সুর ঢুকিয়ে দিই । যাদের শিরদাঁড়া থাকে না তাদের কুণ্ডলিণী দিয়ে শিরদাঁড়া ঢুকিয়ে পথে ছেড়ে দিই, বলি যে, যাও, পেঁদিয়ে এসো, লাথিয়ে এসো, বাঞ্চোত দুনিয়াটাকে ।
    নগেন দত্ত ছন্দরানির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর বয়স না হয় আটকে আছে, তোর ছেলের বয়স তো আটকে নেই, সে তো তোর চেয়ে বয়সে বড়ো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে ।
    তিথি আহমেদের দিকে তাকিয়ে নগেন দত্ত বললেন, তোর মেয়েরও বয়স তোর চেয়ে বেশি হয়ে গেছে, মনে রাখিস ।
    দুজনেই বলে উঠল, ওরা তোমার বাচ্চা তুমি বুঝবে, তুমি ওদের ইনজিনিয়ার-ডাক্তার বানাতে চেয়েছো, ওদের কাছে আমরা দুজনে তো কবেই মরে গেছি ।
    নগেন দত্ত বললেন, কদিন বাদেই আমি লণ্ডনে যাচ্ছি, গিয়ে ওদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে দেব, নয়তো ওদের বয়স আমার চেয়ে বেশি হয়ে গেলে মুশকিল হবে ।
    ও মা, সেকি ! ভাইয়ের সঙ্গে বোনের বিয়ে ? তোমার কি মাথা খারাপ ? বললে ছন্দরানি । যেন উদ্বেগের স্বপ্ন ভেঙে আচমকা জেগেছে ।
    নগেন দত্ত বললেন, দাদামশায়ের উইলে সেরকমই লেখা আছে, আমি তো রাজনীতিক নই যে আইনি নির্দেশকে অমান্য করব । দাদামশায় লিখে গেছেন যে আমার দুই শয্যাসঙ্গিনীর সন্তানদের পরস্পরের বিয়ে না হলে তারা সম্পত্তির ভাগ পাবে না ।
    দাদামশায় রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখতেন, রোমের যেমন ভাইবোনের সম্পর্ক থেকে বিরাট সাম্রাজ্যের পত্তন হয়েছিল, উনিও চেয়েছেন যে আমার ছেলেমেয়ের মিলনে তেমনই এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হোক । দাদামশায় ওনার উইলে লিখেছেন যে তিরিশ হাজারিনীর দেশের অবস্হা ভালো নয়, সেখানের বিষাক্ত পরিবেশ থেকে যেন আমার সন্তানদের দূরে রাখা হয়, যেন নতুন একটা দেশের পত্তন করা হয়, যেখানে বরফের রঙ কখনও কয়লার মতন হবে না, টিউকলের জল খেয়ে আর্সেনিক আর আন্ত্রিক হবে না, নুন খেয়ে নিমকহারামি হবে না, বিশ্বাসঘাতকতা থাকবে না, মানুষের হাগবার মাঠে জাতিপ্রথা প্রয়োগ করে হবে না, বিরোধীদের মাটিতে পুঁতে দিলেও তারা যেন সেখানে আজীবন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে, মাঠের পাকা ফসল কেটে নিলে যে কাটল তার যেন পেচ্ছাপ-পায়খানা বন্ধ হয়ে যায়, মিছিলে হাঁটলে নেতারা যেন নাগরিকের পায়ে রুমা অয়েল মালিশ করে দ্যায়, আরও অনেক নির্দেশিকা আছে, দুশোর বেশি, অতো কি আর মনে থাকে ।
    তিথি আর ছন্দরানি চুপ করে, নগেন দত্তের কথা, এতক্ষণ যাবত শোনার বদলে, নিজেদের হাতে-ধরা নরম মাংসকে শক্ত করে তোলার চেষ্টা করছিল ।
    নগেন দত্ত বললেন, তোরা যা করার চেষ্টা করছিস তা হবে না, কেননা, দাদামশায়ের উইলে এ-কথাও লেখা আছে যে যুগপৎ দুজনে আমাকে উত্তেজিত করতে পারবে না, আমার উত্তেজনাবোধ সেসময়ে নিস্পৃহ দিবানিদ্রায় থাকবে ।
    ওঃ, বলে দুজনেই আত্মনিয়ন্ত্রণ করে নিলে, কী আর করা যায়, বিকল্পের কোনো বিকল্প নেই ।
    নগেন দত্ত বললেন, তাছাড়া ওরা তো জানে না যে ওরা ভাইবোন । ছন্দরানি, তোর ছেলের নাম রেখেছি অর্ণব মজুমদার আর তিথি, তোর মেয়ের নাম রেখেছি লিপি আহমেদ । ওদের নাম তোদের বলেছিলুম অনেককাল আগে, জানি না ভুলে গেলি কেমন করে ।
    প্রসঙ্গ পালটাতে হল নগেন দত্তকে, বললেন, এটা তো তিরিশ হাজারিনীর দেশ নয় রে, মাটির তলায় অন্য কোনো দেশে এসে পড়েছি আমরা । পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করে জিপিএস নির্দেশের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করলেন, কোন দেশে বা রাষ্ট্রে এসে পড়েছেন । জিপিএস নির্দেশে বললে, “কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্হা জানিয়েছে আপনাদের সমীক্ষা একান্তভাবে গোপনীয়, আপনার সঙ্গিনীরা জীবিত অবস্হায় তাঁদের দেহশাড়ি কোনো বিদেশিকে বিক্রি করতে পারবেন না ।”
    দূরে অধ্যাপক চক্কোত্তিকে যেতে দেখে, শার্ট-প্যান্টের বদলে খালি গা্য়ে লুঙ্গি পরেছিল, নগেন দত্ত চেঁচিয়ে ডাকলেন, চক্কোত্তি, ও চক্কোত্তি, কোথায় গিয়েছিলে, তোমার অপেক্ষায় বসে-বসে বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েছি তোমার খোঁজে ।
    ওরা দেখল, নগেন দত্তের চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে, কুড়ি-পঁচিশজন অধ্যাপক চক্রবর্তী, সকলে একই রকম চাককাটা লুঙ্গি পরে, আকাশ থাকে নেমে আসছে হাত দুটোকে ডানার মতন নাড়াতে, নাড়াতে ।
    একজন চক্কোত্তি মাটিতে নেমে, লুঙ্গিকে হাঁটু পর্যন্ত তুলে, বলল, বলুন কী বলবেন, আমরা আজ ব্যস্ত আছি, নির্বাচন করাতে যাচ্ছি ।
    তিথি আহমেদ বলল, আপনি একজন থেকে এতোগুলো হয়ে গেলেন কেমন করে মাসিপিসি ? কে আসল কে নকল কিছুই তো বুঝতে পারছি না ।
    চাককাটা লুঙ্গি-পরা চক্কোত্তি বলল, আমরা সকলেই আসল, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে তিরিশ হাজারিনীর শাখা-প্রশাখা আছে তা আমরাই চালাই, তবে আজকে নির্বাচন বলে আমরা একত্রিত হয়েছি, আমাদের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বীহীন, থাকে বটে নাম-কা-ওয়াস্তে প্রতিদ্বন্দ্বী, আমরাই তাদের দাঁড় করাই, নয়তো লোকে কী ভাববে । আমাদের বাবা জি এম আর মা জি এম অজস্র চক্কোত্তি গড়ে তুলেছেন নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্যে, সেই কাজেই যাচ্ছি, পরে দেখা হবে ওভারগ্রাউণ্ডে । বলে উড়ে চলে যাবার চেষ্টা করছিল নেমে-আসা চক্কোত্তি, হাত দুটোকে ডানার মতন নাড়িয়ে, কোমর থেকে ঝুলছে চাককাটা লুঙ্গি ।
    তিথি আহমেদ বললে, এখানে কোনো শৌচালয় দেখছি না, হাগা পেয়ে গেছে, মুততেও হবে, একটু ডিরেকশানটা বলে দিন না ।
    উড়তে-উড়তে প্রফেসর চক্কোত্তি বললে, এখানে হাগবার মোতবার পাদবার আজাদি নেই ।
    নগেন দত্ত বললেন, আমি আর ছন্দ তোকে আড়াল করছি, তুই পুরো-কোটা হেগে-মুতে-পেদে নে ।
    তিথি আহমেদ শিমুল-পলাশে ঘেরা গাছতলায় বসে হেগে-মুতে-পেদে নিলে ।
    নগেন দত্ত বললেন, পাদবার আজাদি নেই, এ আবার কেমন বখাটে-ক্ষয়াটে জগত ! মনে আছে, ১২৩৬ সালে যখন দিল্লি গিয়েছিলুম, রাজিয়া সুলতান বলেছিল ওসব তুর্কিদের মাথায় আমি হাগি আর ওদের মুখে পাদি। মনে আছে, ১৩০৩ সালে যখন চিত্তোরে ছিলুম, আলাউদ্দিন খিলজি সেখানের রাজাকে মেরে রাজার সুন্দরী বউ পদ্মিনীকে পাবার চেষ্টা করেছিল ; রানি আত্মহত্যা করার আগে সোনার থালায় হেগে আর মুতে পাঠিয়েছিল খিলজিকে, আমার স্বচক্ষে দেখা, আর এটা কিরকম আন্ডারগ্রাউণ্ড এলাকা যে হাগবার-মোতবার-পাদবার স্বাধীনতা নেই ।
    কে বললে নেই, না থাকলে জোর করে আজাদি নিতে হয়, বলে বেশ জোরে পাদল ছন্দরানি মজুমদার, তারপর বললে, তা নির্বাচন অথচ তো মারামারি কাটাকাটি হচ্ছে না তো !
    গাছ থেকে ঝরা শিমুলের পাপড়ি দিয়ে পোঁদ পুছতে-পুঁছতে তিথি আহমেদ বলল, খুনোখুনির পালা শেষ হয়ে গেছে বোধহয়, আঁস্তাকুড়ে যারা জঞ্জাল খাচ্ছিল, তারা মরা মানুষের হাত-পা-মুণ্ডুও তো খাচ্ছিল চুষে-চুষে, হয়তো নির্বাচনের ছাঁটমাংসও তাতে ছিল, এখানে সকলেই লেড়িয়েছে বলে মনে হয় ।
    নাঃ, এটা বোধহয় কোনো জনগণতান্ত্রিক দেশ, তিরিশ হাজারিনীর দেশ নয়, তিরিশ হাজারিনীতে নির্বাচন হলে সবাইকে নিজের পরিচয়পত্র নিয়ে গিয়ে বোতাম টিপতে হয়, একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজনের কোনো মিল থাকে না । এদেশে দেখছি সকলেই চক্কোত্তির মতন দেখতে, কারোর সঙ্গে কারোর তফাত নেই, বললে ছন্দরানি মুজমদার । তিরিশ হাজারিনীতে তো নির্বাচনের রেট আর আমাদের রেটে বিশেষ তফাত নেই, এখানে সবাই দেখতে সমান, রেট ফিক্স হয় কেমন করে !
    নগেন দত্ত বললেন, অনেক এলাকায় সত্য নিজেই সত্যের শত্রু ।
    তিথি আহমেদ বললে, ঠিকই বলেছিস ছন্দ, ওপরে ছিল সন্ধ্যাবেলা । এতো তাড়াতাড়ি দুপুর হয়ে গেল কেমন করে ! যাকগে যাক, চলো কিছু খেয়ে নেওয়া যাক, সেই সকাল থেকে দুজন সমকামীকে পড়াতে-পড়াতে কিছুই খাওয়া হয়নি ; হেগে পেট একেবারে খালি ।
    একটা চীনা রেস্তরাঁ দেখে ঢুকলো তিনজনে, বসল ফাঁকা টেবিলে । দেয়ালে ঝুলছে গ্যাঙ অফ ফোরের চিয়াং চিংএর সাদা-কালো ছবি, চশমা-পরা, ওপর দিকে তাকিয়ে ।
    ওরা দেখল ওয়েটাররা সকলেই চক্কোত্তির মতন হুবহু লুঙ্গি পরে, যারা খাচ্ছে, তারাও হবহু চক্কোত্তি । চীনা রেস্তরাঁ নাম দিয়েছে কেন তাহলে !
    মেনুতে নতুন ধরণের পিৎজা দেখে অর্ডার দিল, লেখা রয়েছে সাংস্কৃতিক বিপ্লব বিফল হবার কারণে এবং দেং জিয়াও পিং-এর বিড়ালতত্বের প্রভাবে কাঁচা মাল সব চিন থেকে আসে বলে বেশ সস্তা । পিৎজায় টপিং দেয়া আছে ফ্রাইড জোঁক, পিকলড কেঁচো, উচ্চিংড়ের চিজলিং, হাফ-বয়েলড কোলা ব্যাঙের জিভ, কাঁচা সবুজ ফড়িং আর ঘন চিজের আস্তরণ, সঙ্গে সৌদি আরব থেকে আনা উটের দুধের চা ফ্রি ।
    তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদার যখন পিৎজা খাচ্ছিল, চিজের সুতোর আঠালো টান পিৎজা থেকে ওদের মুখ পর্যন্ত বেশ অশ্লীল আনন্দ দিচ্ছিল নগেন দত্তকে, এক দৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে বললেন, খেতে-খেতেও তোরা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিস ।
    নগেন দত্ত পিৎজা খেতে-খেতে, মেনুকার্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন, এদের এখানে দেখছি মানুষের ঘাম থেকে চোলাই করা মদ পাওয়া যায় । তিন জনের জন্যে তিন পেগ অর্ডার দিয়ে বললেন, তোদের স্ট্যালিনের গল্প বলার সময়ে একরকম মদের কথা বলতে তো ভুলেই গেছি, স্ট্যালিন খাইয়েছিলেন । আমি মুলো আর ভোদকা খেয়ে গেছি, গন্ধ পেয়ে উনি বললেন, আরে পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মদ তৈরি হয় চোখের জল চোলাই করে, সাইবেরিয়া থাকে ড্রামে ভরে-ভরে আসে, খাইয়েছিলেন নতুন বোতল খুলে, তিন পেগ খেয়েছিলুম, চোখের জল তো নোনতা হয়, কিন্তু উনি নতুন প্রযুক্তির গুণে তাকে রেড ওয়াইনের চেয়ে মিষ্টি করে তুলেছিলেন ।
    তিথি আহমেদ বললে, আহা গো, টেকনোলজিটা যদি জেনে আসতে তাহলে আমাদের কাজে দিতো, কতো ফ্যাঁচফ্যাঁচে সর্দি কান্না যে কাঁদে পুরুষরা আমার কাঁধে মাথা রেখে, যদি চোখের কাছে কাচের বয়াম ধরি তাহলে রোজ সকালে একজন কাস্টামারের কাছ থেকে একলিটার করে বিশুদ্ধ কান্নার জল পেয়ে যাবে, সারা রাতে দশজন কাস্টামার হলে দশ লিটার ।
    ছন্দরানি মজুমদার ঘামের মদে চুমুক দিতে-দিতে বললে, এর স্বাদ তেমন ভালো নয়, কেমন যেন নরমাংসে মেশানো পেট্রলের গন্ধ বেরোচ্ছে, মনে হয় গদ্দাফির লিবিয়া কিংবা সাদ্দামের ইরাক থেকে আমেরিকানরা চুরি করে এনে বাজারে ছেড়েছে, এখন তো খোলাবাজারের আলোবেলা ।
    ওয়েটারকে ডেকে তিথি আহমেদ জিগ্যেস করল, জোঁকগুলো তো শুকনো, রক্তে টুসটুসে নয় কেন ?
    ওয়েটার একটা কাঁচের প্লেটে ঝাড়ন ঘষতে-ঘষতে বলল, ম্যাডাম, জোঁকগুলো তো চিন থেকে ইমপোর্ট করা, কাস্টমসের লোকেদের ঘুষ না দিলে ছাড়ে না, ততো দিনে ওদের গা থেকে রক্ত শুকিয়ে যায় ।
    ছন্দরানি ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করল, ইনডিয়ান জোঁক দিলেই তো পারেন, টপিং তাহলে ফ্রেশ থাকবে।
    ওয়েটার প্লেট পোঁছা বজায় রেখে বললে, ইনডিয়ান জোঁকে চীনা জোঁকের মতন স্বাদ হয় না ; চীনা জোঁকের বিশেষ চাষ হয়, পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে সেখানকার নাগরিকদের হাত-পা বেঁধে তাদের গায়ে জোঁক ছাড়া হয়, টুপ-টুপ করে জোঁকগুলো পড়ে গেলে রেড আর্মির লোকেরা কালেক্ট করে এক্সপোর্ট করার পারমিশান দ্যায় ।
    আপশোষ বেরোলো তিথি আহমেদের মুখ থেকে, খোলাবাজার হয়েও এই অবস্হা !
    ছন্দরানি একটা জোঁক চুষতে-চুষতে বলল, খোলাবাজারের বাঁশ আমেরিকানদের পোঁদেই ঢুকছে এখন, চাকরি নেই, কারখানা বন্ধ, সস্তার জিনিস চিন থেকে যাচ্ছে, সস্তার শিক্ষিতরা ইনডিয়া থেকে যাচ্ছে, আইটির সস্তার জিনিসও যাচ্ছে ।
    খেয়ে, টিপস দিয়ে, বেরোতে যাবে, চীনা রেস্তঁরায় একজন চক্কোত্তি আরেকজনকে পেটে ছোরা মেরে দিলে, তাকে বেয়ারাগুলো, তাদের দেখতেও চক্কোত্তি, জড়িয়ে ধরতে, ছাড়িয়ে নিয়ে এলোপাতাড়ি ছোরা চালানো আরম্ভ করলে, দুজনের পেটে লাগতে তারা মাটিতে পড়ে কাতরাতে লাগলো, একজন চক্কোত্তি বেয়ারা ওদের বলল, পালান পালান, এ বিরোধীতার কাজ করে বলে পাগল হয়ে গেছে, নিজের ইশকুল, নার্সিং হোম, ভুটভুটির ব্যাবসা, চালের কল, আলুর কোল্ড স্টোরেজ, গাঁয়ে তিনতলা পাকাবাড়ি, অনেক-কিছু করে ফেলেছে, পালান পালান ।
    তিথি জানতে চাইল, কিসের বিরোধীতা করেছিল ?
    বেয়ারা বলল, বিরোধিতার আবার কারণ হয় নাকি ! কারণ থাকলে তো বিরোধিতাই হতো না ।
    নন্দরানি নিজের মনে বললে, এখানেও ওই একই ব্যাপার, খুন হয়ে গল্প হয়ে যাও, তারপর নতুন খুন এসে পুরোনো খুনের গল্পকে সরিয়ে দেবে । চলো, এখানে অযথা সময় নষ্ট করার মানে হয় না।
    ওরা বেরিয়ে হন হন হাঁটা দিলো ।
    বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মিছিল যাচ্ছিল বলে রাস্তা পেরোতে দেরি হল, বাচ্চাদের হাতে প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা “ভয় পাবার মতো কিছু লিখবেন না”, ‘ভয় পাবার মতো কিছু বলবেন না”, “ভয় পাবার মতো কিছু ভাববেন না”, “ভয় পাবার মতো কিছু শুনবেন না”, “ভয় পাবার মতো কিছু দেখবেন না”, সেই সঙ্গে স্লোগান দিচ্ছে, “তুঘলকের জয় হবেই, জয় তুঘলকের জয়, তুঘলক জিতবেন, তিনি জিতবেন, তিনি জিতবেন, তিনি তুঘলক, তিনি তুঘলক, তিনি তুঘলক, তিনি জিতবেন, তুঘলকবিরোধীরা নিপাত যাক, নিপাত যাক, জয় দৌলতাবাদের জয়, মানুষ যদি নাও পৌঁছোয় তার ঠ্যাং দৌলতাবাদে পৌঁছোবে, জয় তুঘলকের জয় ।”
    তিথি আহমেদ নাক চাপা দিয়ে বলল, এ কি রে বাবা, বাচ্চাদের গা থেকে রামছাগলের বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে, এই গন্ধই তো গুরু-মহারাজের গা থেকে বেরোয় ।
    ছন্দরানি বিজ্ঞের মুখ করে বলল, ওই গুরু-মহারাজটাই তার মানে তুঘলক, কতো বেজন্মা বাচ্চা পয়দা করেছে, তাদের গায়ের দুর্গন্ধ দিয়ে তাদের পরিচয় জানিয়ে দিচ্ছে ।
    সম্ভব, খুবই সম্ভব তিথি, তুঘলকের গা থেকে অমন গন্ধ বেরোতো বলে লিখে গেছে ইবন বতুতা, বললেন নগেন দত্ত । তুঘলক নানা তত্ব বের করেছিলেন, একজনের চেয়ে বেশি মানুষকে যদি নির্বিচারে কোতল করতে হয় তাহলে তার জন্যে তত্ব দরকার, আর উনি তো মানুষ খুন করার রেকর্ড করে গেছেন, শত্রু হোক বা বন্ধু হোক, কাউকে বাদ দেননি ।
    নতুন মোহম্মদ বিন তুঘলক এলো নাকি ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে নেমে, স্বগতোক্তি করলেন নগেন দত্ত, যে হারে পুতুলনাচের পুতুলরা সংখ্যায় বাড়ছে ।
    রাজপথে একটা সিনেমা হল দেখতে পেয়ে তিথি আহমেদ চেঁচিয়ে উঠল, ওই তো, ওই যে একটা সিনেমা হল. চলো-চলো, প্রমথেশ বড়ুয়া কিংবা ফিয়ারলেস নাদিয়ার ফিল্ম হলে জমে যাবে ।
    ছন্দরানি মজুমদার, বলে উঠল, তোর ওই একঘেয়ে পছন্দ, আমি দেখতে চাই দেব-শুভশ্রী জুটির ফিল্ম । দেবের পরাণ জ্বলিয়া যায় রে, চ্যালেঞ্জ, খোকাবাবু, খোকা চারশোবিশ, চাঁদের পাহাড়, দুই পৃথিবী, রোমিও, সবকটা দেখেছি । তুইও তো দেখতে গিয়েছিলি ।
    তিথি আহমেদ : দেবটা তৃণমূল বলে ভাল্লাগে না ।
    ছন্দরানি মজুমদার : ভালো না লাগবার কী আছে ? ওর বাড়ির সবাই সিপিএমকে ভোট দ্যায় । নগেন দত্ত : চুপ কর দিকিনি তোরা । কুন্দনন্দিনীকে খুঁজতে বেরিয়েছি আর তোরা এখন প্রমথেশ বড়ুয়া-ফিয়ারলেস নাদিয়া-দেব নিয়ে পড়লি । আমার মনের ভেতরের গোলাপি অন্ধকারে যদি তোদের দুজনকে বসিয়ে দিতে পারতুম তাহলে বুঝতে পারতিস আমার মনের চিনচিনে হাহাকারগুলো ।
    সিনেমা হলের সামনে পৌঁছে ওরা দেখলো, দেয়ালে বিশাল পোস্টার লাগানো, একজন সুন্দরীর মুখ আঁকা, পোস্টারে লেখা সুপ্রসিদ্ধ পরিচালক সৃজিৎ মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘কুন্দনন্দিনী”, মহাসমারোহে পঞ্চাশতম বৎসর চলিতেছে, কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্ল্যাটিনাম তালপাতা প্রাপ্ত, বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে প্ল্যাটিনামের ভাল্লুক প্রাপ্ত, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্ল্যাটিনামের সিংহ প্রাপ্ত, স্পেনের চলচ্চিত্র উৎসবে প্ল্যাটিনামের শামুক প্রাপ্ত এবং লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে প্ল্যাটিনাম চিতাবাঘ প্রাপ্ত ।
    তিথি আহমেদ বললে, এই পরিচালক তো বেশ নামকরা গো, তিরিশ হাজারিনীর দেশের বইমেলায় আগুন ধরিয়েছিল, সেই লোকটা না ?
    ছন্দরানি মজুমদার বললে, উনি একলা আগুন ধরাননি, ওনার সঙ্গে গৌতম ঘোষ নামে আরেকজন ছিলেন, যাঁকে মুজফফরপুরের লোকেরা নিবারণ বলে ডাকতো ছোটোবেলায় ।
    নগেন দত্ত বললেন, কী আবোল-তাবোল বকছিস তোরা, ওটা ছিল সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়ের মগজভাঁড়ের গুলগল্প, হাংরি আন্দোলনকে বদনাম করার জন্যে । কল্পনা ব্যাপারটা হল ক্ষয়রোগ, ক্ষইয়ে দিতে থাকে, ভেতরে-ভেতরে, মানুষকে, সমাজকে, সংস্কৃতিকে, দেশকে ।
    তিথি আহমেদ বললে, হ্যাঁ, ওই আন্দোলনের অনেকে প্রফেসর বেবি নস্কর , প্রফেসর দীপ্তি কুণ্ডু আর প্রফেসর মীরা দাশের ঘরে প্রায়ই দূর-দূর থেকে আসত, অশোকনগর, চন্দননগর, উত্তরপাড়া, বরানগর, বেলঘরিয়া, বেনারস, হাওড়া, বিষ্ণুপুর, ত্রিপুরা, বি টি রোড, আরও নানা শহর থেকে, প্রফেসর বেবিকে ওদের খুব পছন্দ ছিল, বেবির দেহশাড়ি এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন তোমার বন্ধু পল গগাঁ, ওনার দি সিয়েস্তা পেইনটিঙের হুবহু, তাই ওরা বেশ পছন্দ করতো প্রফেসর বেবিকে, গায়ে মাখবার সেন্ট পাউডার ময়েশ্চারাইজার সুগন্ধী কনডোম এনে দিত, ফুলের তোড়া এনে দিত, গান শোনাতো, সবাই মিলে টাকা তুলে টাকাও দিতো, বেবি তো সাজগোজ করে না, তাই ওদের পছন্দের ছিল । বেবি অন্য গ্যালারিতে চলে যাবার পর ওদের একজনের কি দুঃখ কি দুঃখ, মোটা কাঁচের চশমাপরা স্কুল-টিচার বেবিকে মার্কসবাদ বোঝাতো, স্ট্যালিন, মাওসে তুং, কিউবা, ভিয়েতনাম, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বোমবার্ড দি হেডকোয়ার্টার বোঝাতো, নিজের বই উপহার দিত, যৌনকর্মীরা কেন যৌনকর্মী তা বোঝাতো, হাসতো এমন যেন গার্গল করছে, বেবিকে লেখা প্রেমপত্রও আছে বেবির আয়নার ড্রয়ারে ।
    টিচারটাকে প্রফেসর বেবি বলত, পৃথিবীকে বদলানো যায় না গো, কিছুই বদলানো যায় না, তুমি এইসব আলফাল চিন্তা করে, মদে চুর হয়ে, জীবন নষ্ট করছ কেন ? বেবি বাংলার প্রফেসর শুনে ওদের সে কি আনন্দ ।
    আমি বলতুম, জীবনের আনন্দ নাও, বেঁচে থাকার আনন্দ নাও, জীবনের উদ্দেশ্য থাকলে বেঁচে থাকার মজা নষ্ট হয়ে যায়, বলল ছন্দরানি মজুমদার ।
    তিথি বলল, বেশিরভাগ মরদরা জানে না যে অন্ধকারই সেক্সকে আলো যোগায়, অথচ তারা তুলতুলে ফাটলে আলো খুঁজে বেড়ায় ।
    ওরা তিনজন দেখল সিনেমা হলের কোলাপসিবল গেট বন্ধ, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই মিলিটারি ভুতটা, সারা গায়ে সাদা রঙ আর লিঙ্গ কয়লার মতন কুচকুচে, শিশ্নে আলো জ্বলছে, নগেন দত্তকে দেখে চিনতে পারল, হেসে বলল, স্যার “হাউস ফুল”, এই শো তো শেষ হয়ে এলো, পরের শোও সম্পূর্ণ বুকড ।
    নগেন দত্তর তর সইছিল না, পকেট থেকে তিনটে হাজার টাকার নোট বের করে মিলিটারি ভুতের হাতে দিয়ে বললেন, ঢুকতে দাও, নইলে ঢুকেই যাবো আর তুমি টের পাবে না, দেখতেই হবে, ওই তো পোস্টারে যার মুখ আঁকা সে-ই তো কুন্দনন্দিনী, তাকেই খুঁজছি আজ পঞ্চাশ একশো দুশো বছর যাবত ।
    মিলিটারি ভুত গেটের তালা খুলে দিয়ে বলল, যান, তাড়াতাড়ি যান, শেষ হয়ে এলো, লাস্ট সিনে পাবলিক এতো জোরে-জোরে কাঁদে যে সংলাপ শুনতে পাবেন না । লাইটম্যানকেও ওর পাওনা মিটিয়ে দেবেন, তাহলে এইলের সিঁড়িতে বসে দেখতে পারবেন, অলরেডি এইলের সিঁড়িতেও পাবলিক বসে আছে ।
    মিলিটারি ভুতকে আরেকটা একহাজার টাকার নোট দিয়ে নগেন দত্ত বললেন, তাড়াতাড়ি করো, তুমিই নিয়ে চলো, ফিল্ম শেষ হয়ে গেলে কুন্দনন্দিনীকে পাবো কী করে । মিলিটারি ভুত, যার কালো কুচকুচে লিঙ্গের টর্চ জ্বলছিল, তার পেছন -পেছন, টর্চের আলোয়, দৌড়োলো তিনজনে, আরেক হুবহু মিলিটারি ভুত টর্চ জ্বেলে, টাকা নিয়ে, ওদের বসতে দিলে, পর্দার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন নগেন দত্ত, কুন্দনন্দিনী আমি এসে গেছি ।
    দ্বিতীয় মিলিটারি ভুত টর্চ নিভিয়ে, বকুনি দিয়ে বলল, এই চুপ করুন, কুন্দনন্দিনীর সংলাপ শুরু হচ্ছে, তারপর ডাকবেন ।
    নগেন দত্ত দেখলেন কুন্দনন্দিনী ওনারই বসতবাড়ির পালঙ্কের রেলিঙে মাথা রেখে মাটিতে বসে কাঁদছিল। অবাক হলেন,পর্দায় তো উনি নিজে, কই ফিল্মে তো কখনও অভিনয় করেননি । ফিল্মের নগেন দত্ত আর কুন্দনন্দিনীর সংলাপ শুনতে লাগলেন, হতবাক, থ, কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলেন না ।
    ফিল্মের নগেন দত্ত : এ কি কুন্দ ! তুমি কি দোষে ত্যাগ করিয়া যাইতেছ ?
    কুন্দনন্দিনী : তুমি কি দোষে আমাকে ত্যাগ করিয়াছ ? কাল যদি তুমি আসিয়া এমনি করিয়া একবার কুন্দ বলিয়া ডাকিতে --- কাল যদি একবার আমার নিকটে এমনি করিয়া বসিতে -- তবে আমি মরিতাম না । আমি অল্পদিন মাত্র তোমাকে পাইয়াছি -- তোমাকে দেখিয়া আমার আজিও তৃপ্তি হয় নাই ।
    এইলে-বসা নগেন দত্ত : আরে, আমি আবার কখন ছেড়ে গেলুম ! কতোকাল ধরে তোকে খুঁজে চলেছি, একশো বছর, দুশো বছর হয়ে গেল, আর তুই এখন মরার কথা বলছিস !
    কুন্দনন্দিনী : আমি অল্পদিন মাত্র তোমাকে পাইয়াছি -- তোমাকে দেখিয়া আমার আজিও তৃপ্তি হয় নাই । আমি মরিতাম না । ছি ! তুমি অমন করিয়া নীরব হইয়া থাকিও না । আমি তোমার হাসিমুখ দেখিতে দেখিতে যদি না মরিলাম -- তবে আমার মরণেও সুখ নাই ।
    ফিল্মের নগেন দত্ত : কেন তুমি এমন কাজ করিলে ? তুমি একবার কেন আমায় ডাকিলে না ?
    এইলে-বসা নগেন দত্ত : আমি আবার কী করলুম, আমি তো কবে থেকে তোকে ডেকে চলেছি, তোর খোঁজই পাইনি এতোকাল ।
    তিথি আহমেদ : তোমার কুন্দনন্দিনী বিষ খেয়েছে মনে হচ্ছে, দেখছ না ঠোঁট কেমন করছে, মরবার কথা বলছে, কিছু একটা করো নগেন, শিগগির কুন্দনন্দিনীকে হাসপাতালে নিয়ে চলো ।
    ছন্দরানি মজুমদার : ওই ফিল্মের নগেনটা এক নম্বরের কাপুরুষ, কোথায় অ্যামবুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, তা নয়, সংলাপবাজি করছে, আর তুমিও নগেন, এখানে এইলে হাত গুটিয়ে বসে আছ, যাও যাও, পাঁজাকোলা করে তুলে আনো, আমি ততক্ষণ একটা অ্যামবুলেন্স ডেকে আনছি ।
    তিথি আহমেদ : তাড়াতাড়ি যা ছন্দ, ট্যাক্সি পেলে ট্যাক্সিই ধরে নিস, বলিস ডবল ভাড়া দেবো, যা ছুট্টে যা।
    কুন্দনন্দিনী : তাহা ভাবিও না । যাহা বলিলাম তাহা কেবল মনের আবেগে বলিয়াছি । তোমার আসিবার আগেই আমি মনে স্হির করিয়াছিলাম, দিদি যদি কখনও ফিরিয়া আসেন তবে তাঁহার কাছে তোমাকে রাখিয়া আমি মরিব -- আর তাঁহার সুখের পথে কাঁটা হইয়া থাকিব না ।
    তিথি আহমেদ : এই দিদিটা আবার কে ?
    এইলে-বসা নগেন দত্ত : মন্তর পড়ে বিয়ে-করা আমার প্রথম বউ, সূর্যমুখী ।
    তিথি আহমেদ : নিজেই কেলো করে রেখেছো । কুন্দনন্দিনীকে এতই যদি ভালোবাসতে তাহলে ওকে জোর করে ধরে রাখতে হতো । এখন ভোগো, নিজের খোঁড়া কুয়োয় নিজেই পড়েছ ; কে বলেছিল কুয়ো খুঁড়তে ? তোমার কি জলের অভাব ছিল !
    এইলে-বসা নগেন দত্ত : আমি তো বুঝতেই পারছি না ফিল্মের নগেন দত্তটা কিছু ব্যবস্হা নিচ্ছে না কেন!
    কুন্দনন্দিনী : আমি মরিব বলিয়াই স্হির করিয়াছিলাম --- তবে তোমাকে দেখিলে আমার মরিতে ইচ্ছা করে না । আমার কথা কহিবার তৃষ্ণা নিবারণ হইল না --- আমি তোমাকে দেবতা বলিয়া জানিতাম -- সাহস করিয়া কখনও মুখ ফুটিয়া কথা কহি নাই । আমার সাধ মিটিল না -- আমার শরীর অবসন্ন হইয়া আসিতেছে -- আমার মুখ শুকাইতেছে --- জিভ টানিতেছে --- আমার আর বিলম্ব নাই ।
    ছন্দরানি মজুমদার : এখনও বোকার মতন বসে আছো তোমরা, যাও যাও, কুন্দনন্দিনীকে কোলে তুলে নিয়ে এসে, ফিল্মের নগেন দত্তকে বাদ দাও, ওর দ্বারা কিসসু হবে না, তাড়াতাড়ি করো, অ্যামবুলেন্স এসে গেছে, আমার এক ক্লায়েন্ট ডাক্তারকে ফোন করে দিয়েছি, উনি পেট থেকে বিষ বের করে তিরিশ হাজারিনীর দেশের অনেক মেয়েকে বাঁচিয়েছেন ।
    ফিল্মের নগেন দত্তের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল কুন্দনন্দিনী । ওরা তিনজনে এইল দিয়ে দৌড়োতে-দৌড়োতে ফিল্মের ভেতরে ঢুকে ফিল্মের নগেন দত্তর কোল থেকে কুন্দনন্দিনীকে পাঁজা-কোলা করে তুলে সিনেমা হলের বাইরে দৌড়োলো ।
    কুন্দনন্দিনী গলা জড়িয়ে ধরল নগেন দত্তর ।
    নগেন দত্ত বললেন, কুন্দ, তোকে আমি বাঁচাবোই, কতোকাল ধরে তোকে খুঁজছি, তোকে ভালোবাসতে চাইছি ।
    কুন্দনন্দিনী বলল, আমার ঠোঁটে এখন বিষ, তুমি বাঁচিয়ে তোলার পর চুমু খাবো গো, কতোকাল অপেক্ষায় আছি ।
    সাইরেন বাজিয়ে রাস্তা থেকে গাড়িদের একপাশে সরিয়ে, অ্যামবুলেন্স পৌঁছোলো এস এস কে এম হাসপাতালে ।
    ড্রাইভারের পাশ থেকে দ্রুত নেমে অ্যামবুলেন্সের পেছনের দরোজা খুলে নগেন দত্ত দেখলেন তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদার বসে আছে ।
    নগেন দত্ত জানতে চাইলেন, কুন্দনন্দিনী কোথায়, ওকে তো স্ট্রেচারে শুইয়ে রেখে তারপর সামনে গিয়ে বসলুম ।
    তিথি আহমেদ : ও মা, কুন্দনন্দিনী তো বললে, ও বিষ খায়নি, বিষ খাবার বিভ্রম তৈরি করছিল, সিগন্যালে অ্যামবুলেন্স থামতে, ও বললে তোমার পাশে গিয়ে বসতে যাচ্ছে ।
    ছন্দরানি মজুমদার : আমিও তো এতক্ষণ ভাবছিলুম তোমার পাশেই বসে আছে ।
    নগেন দত্ত : কই, আসেনি তো ! আবার কয়েকশো বছরের জন্যে হারিয়ে গেল ও, আবার আমাকে খুঁজে বেড়াতে হবে, জীবনে ভালোবাসবার সুযোগ বোধহয় কখনও আসবে না, শুধু ভালোবাসার খোঁজই করতে থাকবো ।
    তিথি আহমেদ নগেন দত্তকে জড়িয়ে ধরে বলল, এখন তুমি কিরকম অনুভব করছ বলো, কী ভাবছা তা বলতে হবে না ।
    নগেন দত্তর অস্ফূট কাতরোক্তি শোনা গেলো, ভালোবাসাকে অতিক্রম করে এবার থেকে নিজেকে খুঁজবো, নিজেকে তো আজ পর্যন্ত জানতে পারিনি ।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 012312.60.8934.15 | ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৪৪541367
  • যখন রাজকমল চৌধুরীর সঙ্গে চীনা পাড়ায় ঢুঁ মারতম
    মলয় রায়চৌধুরী

    ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত, সন্তোষ রায় সম্পাদিত ‘জলজ’ পত্রিকার নভেম্বর ২০১২ সংখ্যায় হিন্দি কবি রাজকমল চৌধুরীর বিখ্যাত ( আলোচকদের মতে কুখ্যাত ) ‘মুক্তিপ্রসঙ্গ’ কবিতার বিশ্বজিত সেনকৃত বাংলা অনুবাদ পড়ার পর রাজকমল সম্পর্কে অনেক কথা মনে পড়ছিল । ‘মুক্তিপ্রসঙ্গ’ একটি দীর্ঘ কবিতা । হাংরি আন্দোলনের সময়ে রাজকমল কলকাতায় ছিল আর ওর সান্নিধ্যে কলকাতার অন্ধকার জগতটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল, কেননা সেসময়ে ওই জগতটির নিচুতলার বেশির ভাগ কুশীলব ছিল বিহারি, অনেকে রাজকমলের জেলার । তখনকার কলকাতায় চিনে পাড়ায় চিনেদের জন্যে যে বিশেষ চিনা রমণীদের রেড লাইট এলাকা আছে তা রাজকমলের দরুন জানতে পেরেছিলুম ।
    রাজকমলের গ্রাম মাহিশিতে একটা মন্দিরের কথা বলত ও, যেখানে মোষ বলি হত আর গ্রামের সবাই সেই মোষের রান্নার ভোগ খেত । আমাকেও নিয়ে গিয়েছিল মোষের মাংস খেতে । আমি অবশ্য তার আগেই নেপালে কচিলা খেয়েছিলুম, গমের মদ সহযোগে । রাজকমলের মতে, ওই মন্দিরের তারা মূর্তির মাথায় ফুল রাখলে ফুলটা যদি না পড়ে তাহলে মনোকামনা পূর্ণ হয় । রাজকমল, আমার সামনেই কয়েকবার চেষ্টা করেছিল, প্রতিবারই ফুল পড়ে গিয়েছিল । ফুল রাখছিল ওর দ্বিতীয় স্ত্রীর ভাইঝিকে প্রণয় নিবেদন করে সফল হবার আশায় ।
    রাজকমলের বাবার স্ত্রীর মৃত্যুর পর আবার বিয়ে করেছিলেন । রাজকমলের বিমাতা ছিলেন রাজকমলের চেয়ে ছোট । বাড়িতে অবস্হা ঘোরালো হয়ে উঠছে অনুমান করে রাজকমলের বাবা রাজকমলকে সৌরঠ সভার গণবিবাহের মাঠে নিয়ে গিয়ে শশীকান্তা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন , আর রাজকমলকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন আমাদের কলেজের হোস্টেলে । বিয়ের চার বছর পর রাজকমল সাবিত্রী শর্মা নামে একটি মেয়েকে বিয়ে করে, প্রথম বউ যদিও তখন বাড়িতে । সাবিত্রীর সঙ্গে বিয়ে এক বছরের বেশি টেকেনি, তার ভাইঝির প্রতি রাজকমলের টানের কারণে ।
    দ্বিতীয় স্ত্রী সঙ্গে বিচ্ছেদের পর কলকাতায় চলে এসেছিল রাজকমল । তখন আমি হাংরি মকদ্দমার দরুন কলকাতায় ফ্যা-ফ্যা করছি । আমার ফ্যা-ফ্যা বৃত্তির সঙ্গে যোগ দিল রাজকমল । ও ছিল ফালগুনী রায়ের মতন । গাঁজা আর চরসের নেশা ওকে ধরে ফেলল । ফলে শরীর বেশ খারাপ হওয়া আরম্ভ হতে ফিরে গেল পাটনায় ।
    আমি হাইকোর্টে মকদ্দমা জিতে পাটনায় গিয়ে দেখি রাজকমল হাসপাতালে ভর্তি । ওর জন্যে পাটনা হাসপাতালের রাজেন্দ্র ওয়ার্ডে একটা আলাদা ঘর বরাদ্দ হয়েছিল । প্রতি সন্ধ্যায় তরুণ সাহিত্যিকদের আড্ডা হতো । টের পাওয়া যাচ্ছিল ওর শরীরের অবনতি হয়ে চলেছে । ও বলত সার্জেন বলেছে অপারেশান টেবিলে পেট চেরার পর পুরো হাসপাতাল গাঁজার ধোঁয়ায় ভরে যাবে ।
    একদিন সবাই চলে যাবার পর রাজকমল আমায় বলল, পরের দিন সকালে আমি যেন ওকে এক প্যাকেট কনডোম দিয়ে যাই । বলল, একটি নার্স রাজি হয়েছে । একটু পরে একজন মালায়ালি নার্স এসে ওর মাথায় যখন হাত বোলানো আরম্ভ করল, রাজকমল বলল, এই যে এই মেয়েটিই রাজি হয়েছে । মেয়েটি আমার দিকে চেয়ে হাসল , জানাল যে, আপনি কাল সকালে দিয়ে যাবেন এক প্যাকেট কনডোম ।
    পরের দিন সকালে গিয়ে দেখি ঘর ফাঁকা । খোঁজ নিয়ে জানতে পারলুম যে রাতেই মারা গেছে রাজকমল । ওর মরদেহ বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ওর প্রথম স্ত্রীর কাছে ।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 012312.60.8934.15 | ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৪৬541368
  • যখন বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে হাঙরের ঢেউয়ে সাঁতার কাটতুম
    মলয় রায়চৌধুরী
    হাংরি আন্দোলনের দ্বিতীয় বছরে, ১৯৬২ সালের প্রথম দিকে, পরিচয় হয়েছিল বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে, আর তখন থেকেই আমাদের হাঙরের ঢেউয়ে সাঁতার কাটা ।
    বাসুদেব দাশগুপ্ত তখন ‘রন্ধনশালা নামের ফিকশনটা লিখছে ।
    ওহ সে কতো সমুদ্র, কতো নদ-নদী, কতো ঝিলপুকুর ।
    কতো হাঙর চলে গেছে আমাদের পাশ দিয়ে, দেঁতো হাসি হেসে, কিংবা ল্যাজের আছাড় মেরে জলকে ঘোলাটে ফেনায় ফাঁপিয়ে, হাঁ-মুখ খুলে গোঁতা মেরেছে কুচো মাছের ঝাঁকে ।
    ক্রান্তীয় নাতিশীতোষ্ণ উষ্ণ পত্রিকায় আর খোলা সাগরের সেই স্পিনার হাঙরেরা, গায়ে চাককাটা বুশশার্ট, ছুঁচোলো মুখ, কালচে নিউজপ্রিন্ট নাড়িয়ে ভাসতে ভাসতে গেছে আড়চোখে ।
    ক্যারিবীয় প্রবাল হাঙর, আঙুলে গোমেদ আর প্রবালের আঙটি কিন্তু মার্কসবাদী, রঙবদলু অক্টোপাস খেতে ভালোবাসে, অতলান্তিকে সাঁতরেছে আমাদের পাশ কাটিয়ে, শিকারি চোখের পিটপিটে চাউনি মেলে ।
    কাঁধে ঝোলা পিগমি হাঙর, বড়ো হাঙরদের চেলা, দেখেই ফিসফিসিয়ে পালিয়েছে কফিহাউসের ভিন্ন ভিড়েল টেবিলে । তিমি হাঙর, বেঘো হাঙর, লিটল সিল মাছ দেখলেই, পেংগুইন দেখলেই ছুটেছে পেছনে, তুলে আছাড় মারার ধান্ধায়, তারপর আমাদের দেখে কেটে পড়েছে অন্য ঢেউফেনায় ।
    কতো যে দাঁত বদলাতে দেখেছি সেসব হাঙরদের, সারা জীবনে তিরিশ হাজার দাঁত ওঠে আর পড়ে যায় ওনাদের, মানে জীবনভর ওনারা একবার শিশু , আর একবার বুড়ো , এই ভাবেই চালিয়ে দেন ওনাদের দেঁতো বিদ্যায়তনিক আর সাংবাদিক অভিজ্ঞতার ওঠানামা ।
    আমরা তবুও সাঁতরেছি নীল জলে; কাউকে ভয় দেখাইনি, তবুও হাঙরেরা আমাদের ভয় পেয়েছে । সেপাই বরকন্দাজ খোচর লেলিয়েছে । টেকো খোচর, পিঠে কুঁজ খোচর ।
    কতো দিন পেছন ফিরে দেখেছি, ফলো করছে । ভেবেছি, আমাদের ফলো করার কি দরকার ! কোনো তরুণী ফলো করলে না হয় কথা ছিল । কিন্তু টেকো কুঁজো কিংবা রোগা কেলো ভেড়া ! তারা যে পুলিশের ইনফরমার, জেনেছি, কয়েক বছর পর ।
    কখনও পাশ দিয়ে কিলবিলিয়ে গেছে কালচে-পেছল অ্যানাকোণ্ডা ।
    আর রুপোলি আঁশের মাছেরা ? বোয়াল, চিতল, মাগুরেরা ? তারা তিড়িক নাচন নেচেছে । তারপর প্রতিষ্ঠানের বঁড়শিতে গেঁথা কেঁচো কামড়ে ধরতে গিয়ে এইপাশ ওইপাশ । পড়েছে গিয়ে মেছো বাজারের দরাদরিতে । গলা কাটা, রক্ত বেরোচ্ছে, পটকা ফেটে বেরিয়ে গেছে বক্তিমেবায়ুর তেলপোঁটা ।
    ঠোঁটে লিপ্সটিক মাখা পারশে, তোপসে, বাটা ।
    আর বিদ্যায়তনিক শুঁটকি । রোদে থুথ্থুরে লাঠি হাতে গলির ভেতর দিয়ে যেতে দেখেছি শুঁটকি মাছবুড়োদের।
    ব্ল্যাক সি, ইয়েলো সি, হোয়াইট সি, রেড সি ।
    কালো প্রেস, হলুদ প্রেস, শাদা প্রেস, লাল প্রেস -- হাঙরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ।


    শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কোচিং ক্লাসের টিচার বাসুদেব দাশগুপ্ত, শক্তিদার চেলা, কোচিং ক্লাসে সব বিষয়ই পড়ায় ।
    উনি বললেন, একে নিয়ে নাও, পাণ্ডুলিপি দেখিয়েছে, গদ্যের হাত খুব ভালো । ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘কঙ্কাবতী’ পড়েছো তো ? ও এর আগে যে লেখাটা লিখেছে, ‘চোরাবালি’ নামের গদ্য, সেটা অবশ্য এক্সপেরিমেন্টাল নয় ।
    ‘রন্ধনশালা’ নামে একটা গল্প লিখছি । একটা উপন্যাসও প্রায় শেষ করে এনেছি, নাম দিয়েছি, ‘উৎপাত’ । শক্তিদাকে বলল বাসুদেব । আচরণে যৎসামান্য বিব্রতভাব ।
    কঙ্কাবতী আমার স্নাতকস্তরের বাংলা কোর্সে ছিল ; তাছাড়া ত্রৈলোক্যনাথ আমার ঠাকুমার জাঠতুতো ভাই, ওনার সুপারিশে বড়োজ্যাঠা পাটনা মিউজিয়ামে কিপার অফ পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার হয়েছিলেন । পরে, বাসুদেবের ‘রন্ধনশালা’ সিরিজের ফিকশান পড়ে বুঝেছি যে ত্রৈলোক্যনাথের সঙ্গে বাসুদেবের বেশ পার্থক্য আছে । ত্রৈলোক্যনাথ ইরর‌্যাশানাল হলেও ধাপেধাপে যুক্তিগেঁথে ফিকশানকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন । বাসুদেব এগিয়েছে ন্যারেটিভের সময়ের অনুক্রম ভেঙে-ভেঙে, এক ঘটনা থেকে হঠাৎ আরেক ঘটনায় লাফিয়েছে । বাসুদেবের ন্যারেটিভ স্ট্রেটেজির সঙ্গে ত্রৈলোক্যনাথের ন্যারেটিভ স্ট্র্যাটেজির মিল নেই ।
    বাসুদেব, তুমি হারাধন ধাড়াকে গদ্যটা দিয়ে দিও, উনিই কলকাতায় ছাপাবার ব্যবস্হা করেন । বললুম আমি, যুবকটিকে ।
    নববর্ষের অনাবিল আনন্দ
    মিস ক্যালকাটার উপস্হিতিতে ২০ জন শ্রেষ্ঠ শিল্পীর নৃত্য, অর্কেষ্ট্রা, বাংলা ও হিন্দী চিত্রের গান, গজল ও
    ফিরপোর পুরো ক্যাবারে ।
    আরও একটা ব্যাপার, বললেন মিসেস কফ । এখেনে নিউ ইয়র্কের মতো বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় না।
    ওখানে জানালা খুললে বিজ্ঞাপনের আলো, টেলিভিশানে বিজ্ঞাপনের ছবি, রেডিওয় বিজ্ঞাপনের চিৎকার, কোথায়
    যাই বুঝতে পারি না । এখানে বিজ্ঞাপন এখনও তেড়ে এসে মাথায় উঠে বসেনি । ইচ্ছে করলে নিরিবিলি শান্তিতে
    গার্হস্হ জীবন যাপন করতে পারে একজন বিজ্ঞাপনের দৌরাত্ম্যের বাইরে ।
    শাড়ি পরা মিসেস কফের কোলে দৌড়ে এসে বসল তার ফুটফুটে ছেলে আর মিসেস কফের ছোট্ট চিৎকার, এই
    যাঃ ।
    কী হল ?
    শাড়ি খুলে গেল !
    ঘুটঘুটে অন্ধকার । আমরা কোথায় চলেছি ?
    স্টিকস নদী পার হওয়ার সময় নিশ্চিন্ত করে কেউ বলতে পারে না কোথায় যাচ্ছি….
    -- ঐ যে ডেসমণ্ড । ওই তোমার শত্রু ।
    --কোথায় ?
    -- এটা ছেড়ে দাও । শান্ত হও ডেসমণ্ড । পৃথিবীতে তোমার কে শত্রু আছে ?
    -- আমি জানি না স্যার । কিন্তু তলোয়ারটা ছোঁবার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে অজেয় মনে হল, আর সবাইকে শত্রু বলে
    মনে হতে লাগল ।
    --এটা অশুভ….। এখান থেকে পালাতে হবে ।

    দিয়ে দেব । তুমিই ছাপাবার খরচ দাও ? চাকরি করো ? আমার এখনও চাকরি জুটল না । টিউশানি করে চালাচ্ছি ।
    আমার মুখ থেকে আর্কটিক সাগরের গন্ধ বেরোচ্ছিল বোধহয় ।
    বললুম, ওয়েলকাম টু দি হাংরিয়ালিস্ট প্যানথেয়ন ।
    আমার দিকে ইশারা করে শক্তিদা বললেন, আরে ও তো কোটিকোটি টাকার নোট পোড়াবার চাকরি করে ।
    নোট পোড়াবার চাকরি ? অবাক বাসুদেব । অমন চাকরি হয় নাকি ?
    হ্যাঁ, বস্তা-বস্তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পচা গলা তেলচিটে নোংরা নোট, যেগুলো আর চলবেনা, সেগুলো জ্বালানো হয়, ইনসিনেটারে । নাকে রুমাল বেঁধে, কেননা তা থেকে মড়াপোড়ার গন্ধ বেরোয় ।
    বাসুদেব মোটা কাচের চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ কুঁচকে জানতে চাইল, তোমার ইয়ার অফ বার্থ কতো ?
    ব্যাঙ্কনোট পোড়ানোর সঙ্গে জন্মসালের কি করার আছে বুঝতে পারলুম না. বললুম, ১৯৩৯ সাল ।
    হেঃ হেঃ, বলল বাসুদেব, আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়ো, আমি জন্মেছি ১৯৩৮ সালে । তা তুমি হারাধন ধাড়া লোকটাকে পেলে কোথায় ? দেখতে কেমন ভদ্রলোককে ?
    বললুম, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দৌরাত্ম্যে এতদিন তো ব্রাহ্মণ, কায়স্হ, বদ্যিরাই সাহিত্যে রাজত্ব করল, ইউরোপ থেকে আনা মানদণ্ডে লেখালিখি করে । তাই ধাড়া পদবি দেখে একটা লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের বাড়িতে মিট করতে বলে ওনাকে পেয়েছি । তবে উনি পদবি পালটে ফেলার কথা ভাবছেন ; ওনার মতে, অমন পদবী দেখে কেউই লেখা ছাপতে চায় না ।
    সেকথা ঠিক । তা কোথায় থাকেন উনি ?
    হাওড়ার একটা বস্তিতে ।
    আচ্ছা, আন্দোলনের অফিস তাহলে বস্তিতে ?
    অফিস-টফিস বলে কিছু নেই । কলকাতায় একজন কাউকে তো দরকার যে কোঅর্ডিনেট করবে । আমাদের আন্দোলন কারোর বাপের সম্পত্তি নয়, কোনো হেডকোয়ার্টার, হাইকমাণ্ড, পলিট ব্যুরো, সম্পাদকের দপতার জাতীয় ব্যাপার নেই ; তুমিও নিজের লেখা নিজেই ছাপাতে পারো, হাংরি জেনারেশনের ডাক তুলে ।
    ছাপাবার পয়সা কোথায় ! বাংলায় বিএ স্নাতক হয়ে চাকরিই জুটলো না এখনও ।
    বাংলা পড়ে চাকরি জোটা কঠিন । গ্র্যাজুয়েশানের পর পোস্টগ্র্যাজুয়েশান করছ না ?
    খরচ দেবে কে ? স্নাতক হয়েছি এই তো যথেষ্ট । স্কুলটিচারি যদি পাই তাহলে বি এডটা দেবো ।
    শক্তিদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো আমার চেয়ে বেশি ডুবজলে চলে গেছো দেখছি ; সকালবেলাতেই টেনে এসেছ ?
    পিসেমশায়ের বাড়ি উঠেছি ; সেন্টুদাকে তো জানেনই, বললে, চল, রাধাবল্লভী, আলুর দম আর তাড়ি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করা যাক । বিহারিদের ঠেক আছে সোনাগাছির লাগোয়া, সকালবেলায় তাড়ি বিক্রি করে ।
    সোনাগাছিও যাও নাকি ? জানতে চাইল বাসুদেব ।
    এখনও যাইনি ।
    যদি যাও তাহলে জানিও । নোট পোড়াবার চাকরি করছ, কিছু নোট না হয় ওই পাড়ায় পোড়ালে।
    ঠিক আছে ; সেন্টুদাকে সঙ্গে নিতে হবে, নয়তো উল্টোপাল্টা বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোব আর টাকা খসিয়ে নেবে ।
    মলয়, ওকে এত তাড়াতাড়ি তোমাদের খোট্টা লাইনে নিয়ে যেও না, আগে লেখালিখিটা পাকুক , শক্তিদার উপদেশ ।
    জিগ্যেস করি বাসুদেবকে, ওর মুখে অসহায়তার পাতলা প্রলেপ দেখে, তুমি কি প্রেম করে ব্যর্থ হয়েছ ?
    বাসুদেব, কোনো উত্তর না দিয়ে কেবল, হেঃ হেঃ ।
    এরপর লক্ষ করেছি, প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যেতে হলে বাসুদেবের মুখ থেকে কেবল হেঃ হেঃ ।
    সেন্টুদাকে চেনেন শক্তিদা, সমুদ্র দুজনেই এক চুমুকে ফুরিয়ে ফেলতে পারেন । পিসেমশায়ের বড়ো ছেলে । সেন্টুদা আর পিসেমশায় দুজনেই বাংলা সমুদ্র ভালোবাসেন, বিদেশি সমুদ্রে আগ্রহ নেই । ওঁদের দুজনেরই দাঁত কালো হয়ে এসেছে । সন্ধ্যাবেলায় একই সময়ে দুজনকে দেখা যায় খালাসিটোলায় ।
    শক্তিদার সঙ্গে সাঁতার কাটা মানে পুরো পুকুর উনি শুষে নেবেন, নদী হলে নদী, সাগর হলে পুরো সাগরই চোঁ-চোঁ করে । ওনাকে সাগরে ভাসাতে হলে বেস্ট ছিল ওনার উল্টোডাঙার বস্তির ঘরে এক বোতল সমুদ্র নিয়ে পৌঁছোনো, নীল সমুদ্র নয়, আবসাঁথ তো আর আমাদের পুকুরে-নদীতে-সাগরে মেলে না । জলের রঙের সমুদ্র কিংবা চায়ের লিকারের রঙের । ওনার কোনো বাছবিচার নেই ।
    চাইবাসায় দেখেছি ওনার কাজকম্মো । প্রেমিকাকে ফেলে পালিয়ে এসেছিলেন কেন, তা তখন, ১৯৬১-৬২ সালে জানতুম না, পরে জানলুম, ব্যর্থ প্রেমের বদলাটা আমার ওপর নিয়েছিলেন, আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে ।
    বাসুদেবের মোটা কাচের চশমা, বাদামি ফ্রেম, ফিকে নীল জলকাচা বুশশার্ট, ধূসর রঙের প্যাণ্ট, চটি । হেঃ হেঃ হাসি । করমর্দন করে বুঝলুম হাত ঘামে, নরম । হেঃ হেঃ হাসির আড়ালে কেমন যেন যন্ত্রণার রেশ ।
    বললে, তুমি তো পাটনায় থাকো, কলকাতায় হ্যাঙ্গাম বাধিয়েছ কী করে ?
    বললুম, হারাধন ধাড়া আছেন কলকাতায় । কফিহাউসে, প্রেসিডেন্সিতে, সংবাদপত্র অফিসে প্রথম তিনটে বুলেটিন বিলি করেছে, ফলে হইচই ।
    বললে, হারাধন ধাড়া, ওই যিনি হাওড়ায় থাকেন ? পরিচয় হয়নি এখনও ।
    শক্তিদা বললেন, আমি পরিচয় করিয়ে দেব’খন । আজকেই সন্ধ্যাবেলা কফি হাউসে লেখা কালেক্ট করতে আসবে অরূপরতন বসুর থেকে । সন্দীপন হারাধনের বাড়ি গিয়ে লেখা দিয়ে এসেছে ।
    পাটনার ঠিকানা দিয়ে বললুম, তোমার কয়েকটা ফোটো পাঠিয়ে দিও, সকলের ফোটো কালেক্ট করছি, কোলাঝ বানাবো, পোস্টার হবে আর সেটা ছোটো করে বুলেটিনেও যাবে ।
    বাসুদেব দাশগুপ্ত আর সুভাষ ঘোষের ফোটো দিয়ে দুটো পৃথক কোলাঝ করেছিলুম । সকলের ফোটো মিলিয়ে একটা কোলাঝ করেছিলুম, যেটা নিরানব্বুই নম্বর বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল । তা অবশ্য বেশ পরে । সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে, ‘এষণা’ পত্রিকায় প্রকাশিত শৈলেশ্বর ঘোষের ‘তিন বিধবা’ কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে আমি ১৯৬৩-এর ডিসেম্বরে পাটনায় একটি প্রেসে বুলেটিনে ছাপাই ; তাছাড়া ওর আর মাত্র একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল হাংরি বুলেটিনে । সুভাষেরও একটামাত্র লেখাই বুলেটিনে বেরিয়েছিল, সেই যে সংখ্যাটা নিয়ে মোকদ্দমা হয়েছিল । বাসুদেবের লেখা ১৯৬২ থেকে বুলেটিনে ছাপা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ।
    বাসুদেবকে বললুম, ঠিকানা তো দেয়াই রইল, পাটনায় চলে এসো, হিপিরা কাঠমাণ্ডু যাবার পথে আমাদের বাড়িটাকে হলটিং স্টেশান করে, একদিন থেকে, পরের দিন পাড়ি মারে । ফেরার সময়ে একদিন থেকে, বেনারস পাড়ি মারে। বেনারসে অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় আছে ।
    বাসুদেব আসেনি কখনও ; দাদাও বলেছিল, চাইবাসায় যেতে, যায়নি ।
    পরে, দাদা বাঁশদ্রোণীতে পাকাপাকি থাকা আরম্ভ করলে বাসুদেব প্রায়ই দুপুরবেলায় বেহেড মাতাল হয়ে দাদার বাড়িতে এসে চিৎপটাঙ হয়ে খাটে শুয়ে পড়ত । একা । নেশা কেটে গেলে চলে যেত ।
    শেষদিকে কি বন্ধুহীন হয়ে গিয়েছিল ? অবনী ধরের মতে হ্যাঁ, একা থাকতে ভালো লাগত এদান্তি ।


    পথে বেরিয়ে বাসুদেব বলল, ওরা রিফিউজি ফ্যামিলি, ছয় ভাই এক বোন, তারপর চুপ করে গেল ।
    ছয় ভাই, এক বোন, আজকালকার দিনে, শুনে, পরিবারটাকে স্ট্রেঞ্জ মনে হয়েছিল । বৈভবশালী ছিল তাহলে, জমিজমা, প্রতিপত্তি ওপার বাংলায় ।
    আমি আবার জানতে চাইলুম, প্রেম করে লাৎ খেয়েছ নাকি ?
    আরেকদিন বলব, অত্যন্ত জটিল সম্পর্কে ফেঁসে গেছি । হঠাৎ মুখ নিচু করে বলল, শালা আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে ।
    আত্মহত্যা ? আর ইউ ম্যাড ? আমিও তো প্রথম প্রেমে প্রেমিকার লাৎ খেয়েছি, কিন্তু কখনও হেরে গেছি বলে ভাবিনি, হেরে যাবার বোধ আমার মধ্যে নেই ।
    তুমি তো বিহারি খোট্টা, শক্তিদার কাছে তোমার আর তোমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর অনেক গল্প শুনেছি, চাইবাসার, পাটনার, মহুয়া, হাড়িয়া, সোমরস, ঠররা, তাড়ি, গাঁজা, চরস, ভাঙ, আরও কতো কি ! যাকগে পরে শুনবো একদিন । এখন বড্ডো খিদে পেয়েছে । চলো না, কোনো পাইস হোটেলে, ভাত খেয়ে নেয়া যাক । খরচটা তুমিই দেবে ।
    এখনকার, মানে ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ের ছেলে-মেয়েরা, গাঁজা, চরস, ভাঙ বলতে লজ্জা পায় । গাঁজাকে বলে পাতা বা মারিহুয়ানা । চরসকে বলে হ্যাশ । অথচ ফোঁকেনি এমন ছাত্র-ছাত্রী মিলবে না । তখনকার দিনে এগুলো সরকারি দোকানে বিক্রি হতো, পুরিয়ায় সত্যমেব সিংহের ছাপ মারা ।
    শ্যামবাজারের মোড়ের পাইস হোটেলে, যেখানে দাদা কলেজে পড়ার সময়ে খেতুম, মুড়ি ঘন্ট, ডাল, ভাত আর লেবু । আমি বেশি খেতে পারলুম না, তাড়ি আর রাধাবল্লভী তখনও হজম হয়নি ।
    কফি হাউসে যাবে নাকি ?
    বললুম, নাঃ, পিসেমশায়ের বাড়িতেই যাই, ভাত আর তাড়ির মিশেলে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে । তুমি কোথায় যাবে ?
    দাদার বাড়ি । বালিগঞ্জে ।
    পরের বার কলকাতায় এসে বাসুদেবের মুখেই শুনেছিলুম, ওর দাদার বাড়িতে থাকার সময়েই এক নিকটাত্মীয়ার প্রেমে পড়েছিল বাসুদেব । সেই প্রেমিকা ওর মাসির মেয়ে নয়, যেমনটা বিভিন্ন পত্রিকার গালগল্পে লেখা হয়ে থাকে। সেই মেয়েটি ছিল বাসুদেব দাশগুপ্তের Neice. আমি Niece লিখছি, পরিচয় গোপন রাখার জন্য ।
    চুমু পর্যন্ত খায়নি তখনও পর্যন্ত । সব সময় ধরা পড়ে যাবার ভয় । দুজনে একসঙ্গে ইডেন গার্ডেনস, গঙ্গার পাড়, চিড়িয়াখানা ইত্যাদি জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর গল্পও সম্পাদকদের বানানো, সম্ভবত বাসুদেবের গেলানো গুলগল্প । আমি ওর প্রেমের ঘটনাটা জানি, কেননা আমার সামনে কেঁদেছিল বাসুদেব । ওর প্রায় প্রতিটি কাহিনীতে দেখা যায় ওর প্রেমিকাকে, একটি বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়ে, ‘রতনপুর’ কাহিনির চুমকি আর রুমকি, ‘বমনরহস্য’-এর হৈমন্তী উল্লেখ্য ।
    পরিকল্পনা করেছিল ছাতা আড়াল করে দুজনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়ে একদিন ঘনিষ্ঠ হবে । প্রেমিকার ভীতির জন্য তা সম্ভব হয়নি ।
    শেয়ালদার কাছে একটা হোটেলঘর ভাড়া নিয়েছিল একদিনের জন্য । কিন্তু প্রস্তাবেই কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল ওর প্রেমিকার, তেড়ে জ্বর এসে গিয়েছিল । তাই ফাঁকা হোটেলঘর ফাঁকাই থেকে গিয়েছিল অন্ধকারে।
    ব্যর্থ প্রেমিক বাসুদেব আমার চেয়েও বেশি মদ খাওয়া আরম্ভ করে দিয়েছিল । আমি কলকাতায় গেলে প্রতি সন্ধ্যার ঠেক হয়ে গেল খালাসিটোলা । নয়তো সুভাষ ঘোষের সঙ্গে ; তখনও পর্যন্ত সুভাষের সঙ্গে সাহিত্যিক রেশারেশি আরম্ভ হয়নি ওর । আরম্ভ হল সুভাষের ‘আমার চাবি’ গদ্যটা বেরোবার পর ; যদিও তার কোনো কারণ ছিল না, কেননা দুজনের গদ্যের জনার ছিল সম্পূর্ণ আলাদা ।
    মদের প্রভাব বাসুদেবের গালে আর দেহে পড়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । ছিপছিপে ভাবটা হারিয়ে ফেলছিল।
    সুভাষের চরিত্রে সমবয়সী গদ্যলেখকদের হিংসে করার গোপন একটা দিক ছিল ।
    আমার ‘ডুবজলে যেটুইকু প্রশ্বাস’ পড়ে সৈয়দ মুজতফা সিরাজ একটা চিঠি দিলে, দাদা সেটা ‘হাওয়া৪৯’ পত্রিকায় ছাপিয়েছিল ।
    সুভাষের চন্দননগরের বাড়িতে ১৯৯৬ নাগাদ দেখা করতে গেলে, প্রথমেই আক্রমণ করে বসল সিরাজকে । ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপন্যাসকে টিটকিরি মারা আরম্ভ করলে টের পেলুম কেন সিরাজ সম্পর্কে অকথা-কুকথা বলছে ।
    বাসুদেব আর সুভাষের তাত্বিক ঝগড়াটা ওদের কাহিনি-বিশ্লেষণে নিয়ে যায়নি ওরা, বা পশ্চিমবঙ্গের সমাজব্যবস্হার ক্রম-অবনমন নিয়ে এগোয়নি তর্কটা, যেমনটা আমরা দেখি ওক্তাভিও পাজ আর কার্লোস ফুয়েন্তেসের পারস্পরিক বিতর্কে ; চার্লস ডিকেন্স আর হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যানডারসনের পারস্পরিক সমালোচনায়, গোর ভিডাল আর নরম্যান মেইলারের, সলমান রুশডি আর জন আপডাইকের, হেনরি জেমস আর এইচ জি ওয়েলসের, জোসেফ কনরাড আর ডি এইচ লরেন্সের, রবের্তো বোলানো আর গ্যাব্রিয়েল মার্কেজের মাঝে । কিংবা পিকাসোর আঁকার স্টাইল নিয়ে মাতিসের ।
    বামপন্থার দুটি ভিন্ন পাটাতনে দাঁড়িয়ে দুজনের কাছে কাঙ্খিত ছিল যে বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘খেলাধূলা’ উপন্যাস নিয়ে সুভাষ ঘোষ তার বক্তব্য রাখবে আর সুভাষ ঘোষের ‘সাবিত্রীবালা’ কিংবা ‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট’ নিয়ে রাখবে বাসুদেব দাশগুপ্ত--- পরস্পরের রাজনৈতিক চিন্তার বৈভিন্ন্যের প্রেক্ষিতে ।
    আজিজুল হক সম্পর্কে যখন বক্তব্য রাখতে পারে বাসুদেব তখন হাংরি আন্দোলনের দুই গল্প-উপন্যাস লেখক সুভাষ ঘোষ আর সুবিমল বসাক সম্পর্কে লেখা প্রয়োজন মনে করল না কেন ? এমনকি যখন ‘ক্ষুধার্ত’ সম্পাদনা করল, তখনও সুবিমল বসাককে বাদ দিল । আমি এই ব্যাপারটাকে হালকা করে দেখতে চাই না, এই বাদ দেবার প্রক্রিয়াটি ইউরোপ থেকে আমদানি করা আধুনিকতাবাদী বিদ্বেষমূলক চারিত্র্য । এটা তিরিশের দশকের লেখক-কবিরা আরম্ভ করেছিলেন ।
    আমার তো মনে হয় বাসুদেবের চরিত্রে গোপন ঈর্ষা কাজ করত, দরবারি প্রতিষ্ঠানের নেকনজর পাওয়া সত্ত্বেও, যা সিপিএম কার্ড হোল্ডার সুভাষ ঘোষ পায়নি, আর প্রতিটি রাজনৈতিকপন্হার সমালোচক সুবিমল বসাক একেবারেই পায়নি । সুবিমল বসাককে শেষে আলোচনার কেন্দ্রে আনার প্রয়াস করলেন নিম্নবর্গ ও দলিত বাঙালি লেখকগোষ্ঠী-সংস্হা ।
    বাঙালি লেখকরা এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে একটা ভাই-ভাই ক্লাবের মতন সাহিত্যের আলোচনা করেন । শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, মনে করেন মানুষেরা এসেছে ভিন্ন গ্রহ থেকে, অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য, অথচ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কখনও শীর্ষেন্দুর সাহিত্যে এইগুলির প্রভাব নিয়ে ওনার সাহিত্য আলোচনার সময়ে লেখেননি, যখন কিনা সুনীল ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা ভাবনাচিন্তার মানুষ । একই বক্তব্য খাটে শীর্ষেন্দুর ক্ষেত্রেও । এইটেই প্রাতিষ্ঠানিকতার বিষ ।
    বাসুদেবের গোরু আর শুয়োরের মাংস খাবার সঙ্কোচ ছিল না । সুভাষ কখনও গোরুর আর শুয়োরের মাংস খেতে চাইত না, বলত আমার ধার্মিক ইনহিবিশান কাজ করে, বমি করে ফেলব । সিপিএম-এর কার্ডহোল্ডারের এই ধার্মিক ইনহিবিশান বেশ কনট্রাডিকটরি মনে হয়েছিল । ব্যক্তি-এককের কনট্রাডিকশান অবশ্য থাকবেই ।


    অশোকনগরে উদ্বাস্তুদের জন্য নির্দিষ্ট ফ্ল্যাট পেয়ে প্রেমিকার শহর থেকে দূরে থাকার সুযোগ তৈরি হল বাসুদেবের, এবং মেয়েটিকে ক্রমশ ভুলে যাবার । আমি কেবল দুবার গেছি বাসুদেবের অশোকনগরের বাড়িতে। দ্বিতীয়বার আমায় দেখে বিব্রত বোধ করেছিল বাসুদেব, কেননা তখন হাংরি আন্দোলন মোকদ্দমা পুরোদমে চলছে আমার বিরুদ্ধে । পুলিশের কাছে জমা দেয়া মুচলেকাগুলো হাতে পেয়ে গেছি ।
    অশোকনগরের মার্কসবাদে ওই এলাকার জীবন যাপনের প্রভাব ছিল, আর বাসুদেব তাকে আত্তীকরণ করে নিয়েছিল । বস্তুত প্রমোদ দাশগুপ্তের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি শহর ও গ্রামকে পার্টি নেটওয়র্কের অন্তর্গত করার প্রয়াস হয়েছিল ; ছোটো শহরগুলোর যুবকদের পক্ষে ওই ফাঁদের বাইরে স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ করা তখনকার দিনে অত্যন্ত কঠিন ছিল । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনে জেতার প্রধান কারণ ছিল প্রমোদ দাশগুপ্তের দমবন্ধকরা নেটওয়ার্কিঙের প্রভাব, যে নেটওয়র্কিঙের কারণে মুসলমানরা নিজেদের অবহেলিত মনে করেছিল ।
    বর্তমানে তৃণমূল দলটি ওই নেটওয়র্কটিকেই রেডিমেড পেয়ে গেছে এবং তা আমরা ছোটো শহরগুলোয় চাক্ষুষ করছি । বাসুদেবের পক্ষে অশোকনগরের জাল আর সুভাষের পক্ষে চন্দননগরের জাল এড়ানো কঠিন ছিল । যে কবি-লেখকরা কলকাতায় থাকেন তাঁরা এই জালটিকে এড়িয়ে নিজস্ব ভাবনাচিন্তা আর রাজনৈতিক লেখালিখি ও সমাজ-বিশ্লেষণ করতে পারেন । মফসসলে ব্যাপারটা তখন বিপজ্জনক ছিল; এখন হয়তো আরও বিপজ্জনক । জানতে ইচ্ছে করে সুভাষ যদি অশোকনগরে থাকত আর বাসুদেব যদি চন্দননগরে, তাহলে ওদের মননজগতটা কেমনধারা হতো ।
    সুভাষের চন্দননগরের মার্কসবাদ ছিল পার্টি প্রভাবান্বিত, প্রাতিষ্ঠানিক দরবারি রাজনীতির বামপন্হা ।
    পরে বামপন্হী সরকার তখতে বসলে দুজনের মধ্যে বিদেশী তাত্ত্বিকদের মার্কসবাদের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ নিয়ে তুমূল মনোমালিন্য শুরু হয়েছিল । বাসুদেব একদল শিষ্য যোগাড় করে ফেলেছিল আর সুভাষ ঘোষ আরেকদল । অথচ তা বাসুদেব সম্পাদিত বা সুভাষ ঘোষ সম্পাদিত ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকায় প্রতিফলিত হয়নি, কখনও হয়নি ।
    কমিউনিস্ট পার্টি দুভাগ হয়ে গেলে সুভাষ ঘোষ সিপিএম-এর কার্ড হোল্ডার হয়ে গেল । জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হলে, সুভাষ ঘোষ নিজের বাড়িতে জ্যোতিবাবুর ফোটো টাঙিয়ে রাখত, সিপিএম-এর ঝাণ্ডা উড়তো দোরগোড়ায় । সিপিএমের মিছিলে যোগ দিয়ে স্লোগান দিত ।
    বাসুদেব আকর্ষিত হল উগ্র বামপন্হার দিকে, অ্যাকটিভিস্ট হিসাবে নয়, ভাবুক হিসাবে । ওর অশোকনগরের বাড়িতে জ্যোতি বসুর ফোটো ঝুলতে দেখিনি । বালক-বালিকাদের মাঝে ইনটারন্যাশানাল গাইত । সুভাষ ঘোষ গান গাইতে বিব্রত বোধ করত ।
    হাংরি আন্দোলনে করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, যে আমাদের পোস্টার ড্রইং ইত্যাদি এঁকে দিত, সে বেশ গলা ছেড়ে গান গাইত, বিশেষ করে হিন্দি । করুণানিধান মুখোপাধ্যায় একবার ফালগুনী রায়ের পোরট্রেট এঁকে খালাসিটোলায় পেছনের দিকে টাঙিয়েছিল, যেখানে তখনকার দিনে শ্রমিক আন্দোলনের পোস্টার মারা হতো । পেইনটিঙটা দুতিন দিন পরেই হাপিশ হয়ে গিয়েছিল ।
    বাসুদেব হিন্দি ফিল্ম দেখতে ভালোবাসত আর হিন্দি সিনেমার গানও গাইত গলা ছেড়ে । নায়িকাদের স্তন দেহ ইত্যাদি নিয়ে খোশমেজাজ আলোচনা করত, বিশেষত নার্গিস আর মধুবালার । প্রদীপ চৌধুরী, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র এদের কখনও গান গাইতে শুনিনি । অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য হবার পর সুবো আচার্য হয়তো আশ্রমিকদের নির্দিষ্ট গান গায় ; আমি অবশ্য শুনিনি কখনও ।
    আমার মনে হয়, বাসুদেব আর সুভাষের মার্কসবাদ নিয়ে কচকচিটা ছিল আড়াল । ওই আড়ালের পেছনে দুজনে দুজনের গদ্য নিয়ে ঈর্ষার লড়াই লড়ত । নয়তো, মাও জে ডং, চীন, সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ে ১৯৭৮ সালের ‘দন্দশূক’ পত্রিকায় বিতর্কের আর তো কোনো কারণ দেখি না ; সে সময়ের পশ্চিম বাংলার সামাজিক-অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রেক্ষিতে ওই সমস্ত তত্ব ছিল জ্ঞান ফলাবার অহেতুক বালখিল্য । পশ্চিমবাংলা ক্রমশ যে গাড্ডায় গিয়ে পড়ল, তার আভাস নেই ওদের তর্কবিতর্কে ।
    তখন পশ্চিমবাংলা থেকে কল-কারাখানা পালাতে আরম্ভ করেছে অন্যান্য রাজ্যে, অথচ তার কারণ বিশ্লেষিত হল না বা প্রতিফলিত হল না ওদের লেখায় । তারপর যখন স্কুলে মিডডে মিল খাওয়াবার ব্যবস্হা হল, তখন আড়ালে যে উঁচু জাত-নিচু জাতের বিভাজন দিব্বি বজায় রয়েছে, তাও নজরে পড়ল না ওদের !
    একদিকে দুজনে মানবতাবাদী তক্কাতক্কি চালাচ্ছে, আরেক দিকে ‘ক্ষুধার্ত খবর’ আর ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকা থেকে বাদ দিয়ে দিচ্ছে ত্রিদিব মিত্র, দেবী রায়, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই আর সুবিমল বসাককে । চরিত্রের দৈন্য ছাড়া কী বলব একে ?
    আমাকে বাদ দেবার ব্যাপারটা ব্যাখ্যাযোগ্য, কেননা আমার জন্যই বাকি দশ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরোয় ; ওদের নতুন চাকরি নিয়ে টানাটানির ভয় ছিল । অবিরাম বাদ দিতে থাকার দরুন ত্রিদিব মিত্রও লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিল । ত্রিদিব ‘উন্মার্গ’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করত ; তাতে লেখা দিতে অস্বীকার করল বাসুদেব, সুভাষ, শৈলেশ্বর । বেশ আহত আর অপমানিত বোধ করেছিল ত্রিদিব । পত্রিকাটা তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল ওদের অসহযোগীতায় । বাসুদেবকে আমি যতটা বুঝেছিলুম, মানে সেই সময়, এই রকম আচরণ কাঙ্খিত ছিল না। পরে তো ওরা দেজ থেকে প্রকাশিত সংকলনে শঙ্খ ঘোষকেও হাংরি বলে চালিয়ে দিলে !
    সারা ভারত সম্পর্কে ধারণা না থাকার ফলে কুয়োর ব্যাঙ হয়ে কেবল পশ্চিম বাংলার একটি বিশেষ শহরের, চন্দননগর আর অশোকনগর, ভাবনাচিন্তা-নির্ভর বিতর্ক, যাতে পরস্পরের গদ্য বিশ্লেষণ হচ্ছে না, সময়-কাগজ-টাকা নষ্ট ছাড়া আর কিই বা বলা যায় তাকে ।
    ১৯৭০ সালে বাসুদেবের বিয়ের সময় সুভাষ ঘোষ আর ফালগুনী রায় বিয়ের মণ্ডপে এতো বেশি মাতলামি করছিল যে বাসুদেব ওদের দুজনকে তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল । কোনো কথা শুনছিল না সুভাষ । ফালগুনীও সুভাষের পাল্লায় পড়ে অপমানিত হয়েছিল । এই তথ্য অবনী ধরের কাছে পাওয়া ।
    ফালগুনীকে অপদস্হ করে অনুতপ্ত বাসুদেব ফালগুনীর কবিতাগুলো নিয়ে ১৯৭৩ সালে প্রকাশ করেছিল এক ফর্মার ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিসন’ ।
    অবনী ধরের কাছে শুনেছিলুম, শৈলেশ্বর ঘোষের স্ত্রীর পরিবারের যুবতী ইন্দিরা কুণ্ডুকে বিয়ে করেছিল বাসুদেব দাশগুপ্ত । ইন্দিরা কুণ্ডুর সঙ্গে বাসুদেবের বন্ধুত্ব শৈলেশ্বর ঘোষের সূত্রেই হয়েছিল ।
    সুভাষ ঘোষ আর ফালগুনী রায় গোলমাল করতে পারে অনুমান করে ওদের সম্ভবত নিমন্ত্রণ করা হয়নি ; তাই ওরা বিয়ের মণ্ডপে উদয় হয়ে মাতলামির মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছিল ।
    আমি, দাদা, সুবিমল বসাক, দেবী রায়, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই, আর ত্রিদিব মিত্রও বাসুদেব দাশগুপ্তের বিয়ের নিমন্ত্রণ পাইনি । প্রদীপ চৌধুরী আর সুবো আচার্য নিমন্ত্রণ পেয়েছিল কিনা জানি না । অবশ্য সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষও ওদের বিয়েতে জানায়নি ; শৈলেশ্বর বিয়ের পর দাদাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল ।
    বাসুদেবের প্রথম প্রেমের জটিলতা সম্পর্কে জানতুম বলে, আর মোকদ্দমার দরুন সম্পর্ক বিগড়ে গিয়েছিল বলে হয়তো বলেনি আমাকে ।


    বাসুদেবের প্রথম প্রেমোত্তর বিষণ্ণতা কেটেছিল ডেভিড গারসিয়া নামে একজন বিদেশির হোটেলঘরের স্নানঘরে উলঙ্গ হুল্লোড়ের পর । ডেভিড এসেছিল গ্রিস থেকে । আগেই ও আমাকে লিখে জানিয়েছিল যে কলকাতায় আসছে আর কোন হোটেলে উঠবে ।
    আমি সবাইকে জানিয়ে দিলুম । তারপর একদিন সবাই মিলে ডেভিডের হোটেলঘরে পৌঁছে চরস ফোঁকার পর যৌথ স্নানের ইচ্ছে হল । ঝটপট পোশাক খুলে ফেলল বাসুদেব, সুবিমল, সুভাষ, শৈলেশ্বর । আমিও। স্নানঘরটা বেশ বড়ো ছিল ।
    পরস্পরকে হোটেলের দামি সাবান মাখিয়ে স্নানের হুল্লোড়ের মাঝে বাসুদেব বলেছিল, যাক, আমার লিঙ্গ সুভাষের চেয়ে ছোটো নয় ।
    সুভাষের দেয়া উত্তরটা মনে আছে, ‘আমি এখনও ভার্জিন, বুঝলে, এখনও ফুল খোলেনি ; একবার খুলে যাক, তারপর সবাইকে দেখাবো’ ।
    ডেভিড বললে, ও একজন বাঙালি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে চায় । অথচ কেবল এক সপ্তাহ থাকবে, তারপর যাবে দাদা সমীর রায়চৌধুরীর বাড়ি দুমকায় ।
    এতো তাড়াতাড়ি তো আর প্রেমিকা পাওয়া যাবে না । আমরা প্রস্তাব দিলুম, সোনাগাছি যাওয়া যাক ।
    অবিনাশ কবিরাজ লেনে পৌঁছোতেই, সন্ধ্যা তখন সবে নামছে, পিম্পরা পেছনে লেগে গেল । একজন সাহেবের সঙ্গে এতোগুলো ভারতীয় দেখে পিম্পগুলোও মন্তব্য আরম্ভ করল আমাদের উদ্দেশ্য করে, সায়েবকে ফতুর করার জন্য আমরা ওকে এপাড়ায় ধরে এনেছি ।
    পিপ্মগুলোর টিটকিরি এড়াতে সামনে বাঁদিকে যে তিনতলা বাড়িটা ছিল, তার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলুম আমরা। দোতলায় উঠে দশ স্কোয়ার ফুট মতো বারান্দার তিন দিকে একাধিক দরোজায় দাঁড়িয়ে নানা বয়সের সুন্দরীরা।
    মাসি সামনে পানের ডাবর রেখে সুপুরি কাটছিল, পান সাজছিল ।
    মাসিকে বলা হল যে ইনি বিদেশ থেকে এসেছেন, বাঙালি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে, কম বয়সী হলে ভালো হয়, যাকে প্রেমিকা-প্রেমিকা মনে হবে । মাসি একটা দরোজার দিকে আঙুল তুলে দেখাতে বছর কুড়ির এক তন্বীকে দেখে পছন্দ হল ডেভিডের । গোলাপি অরগ্যাণ্ডির শাড়ি, কেবল বডিস পরে, খাঁজ দেখা যাচ্ছে, যদিও মেয়েটির খাঁজ তখনও ভালো করে গড়ে ওঠেনি । কম বয়সের বলে অন্যান্য যৌনকর্মীদের মতন কুৎসিত ভাবে সাজতে হয়নি মেয়েটিকে ।
    মেয়েটি আমাদের এতজনকে দেখে বলল, সবাইই নাকি, একসঙ্গে একের পর এক পারব না ; পনেরো মিনিট করে হাঁপ ছাড়ার সময় দিতে হবে ।
    সুভাষ বোঝালো যে, সবাই নয়, কেবল এই সায়েব, কোনো সায়েবের সঙ্গে ইয়ে করেছ কখনও ?
    ডেভিডের দাড়িতে হাত বুলিয়ে মেয়েটি বললে, না গো করিনি, তবে সায়েব বলে দাম কম হবে না, বলে দিচ্ছি ।
    বাসুদেব বলল, শুধু সায়েব হলেও আমাদের একটু নষ্টামি করতে দিতে হবে ।
    ফষ্টিনষ্টির নামে সবাই যদি এখানে সেখানে হাত দাও আর চুমু খাও, তাহলে দাম ডবল পড়বে কিন্তু ।
    আমি বললুম, ঠিক আছে, চলবে ।
    মাসিকে ডেকে মেয়েটি জানিয়ে দিল যে সবাই প্রথমে একটু ফস্টিনষ্টি করবে, তারপর সায়েবের সঙ্গে কাজ হবে । মাসি বললে ঠিক আছে, ডবল খরচ লাগবে, সায়েবরা তো বিদেশি টাকাও দেয় ।
    আমি বললুম, চলবে । জানি বাদবাকি সকলেই মহাকিপটে কিংবা চাকরি নেই ।
    সেইদিনের জন্য মেয়েটির নাম রাখা হয়েছিল বেবি । ওদের নাম প্রতিদিন বদলায় । মনে আছে । বেবি বলল, মদ আনাও, খেয়ে নিই আগে, মেজাজকে বাগে আনি ।
    ‘আমিও খেয়ে নিই’ বলে বাসুদেব বেবিকে জড়িয়ে ওর ঠোঁটে চকাচক-চকাচক কয়েকটা চুমু খেল । বাসুদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল যে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে প্রেমে পড়ার গ্লানি আর কুন্ঠাকে কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছে ।
    বাংলা মদ এলে, সকলে তাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল ; বেবিকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল কেউ-কেউ । ডেভিড বলল, বাংলা মদ অনেকটা ক্যারিবিয়ান হোমমেড রাম-এর মতন স্বাদ ।
    ডেভিডকে ঘরে রেখে আমরা বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালুম আর এঘর-সেঘর থেকে ডাক শুনতে লাগলুম । চারিদিকে তাকিয়ে বিভিন্ন বাড়ির নারীদের দেখা গেল কে কেমন বিদকুটে সেজে আছে ।
    ডেভিড প্রায় আধঘণ্টা পরে বাটারফ্লাই স্ট্রোক সাঁতার কেটে বেরিয়ে এলো । বলল, সাচ এ স্মল কান্ট, অ্যাণ্ড দ্য বুবস আর সো স্মল ইউ ক্যাননট হোল্ড ইন ইওর পাম ; আই লাভড হার, টকড টু হার ইন ইংলিশ অ্যান্ড শি ওয়াজ ভেরি মাচ অ্যাটেনটিভ ।
    বুকে আঁচল চাপা দিয়ে বেবি দরোজায় এসে বললে, আরেকজন এসো, ডবল দাম দেবে যখন । দুই ঘোষভাইয়ের মধ্যে একজন ঢুকে গেল তড়িঘড়ি । দশ মিনিটেই বেরিয়ে এলো, হয়তো ব্রেস্টস্ট্রোক সাঁতার দিতে গিয়ে ডুবে যাবার আশঙ্কায় ।
    অবিনাশ কবিরাজ লেন থেকে বেরিয়ে আমরা সাঁতার দিলুম হিন্দি ‘জ্ঞানোদয়’ পত্রিকার সম্পাদক-লেখক শরদ দেওড়ার আড্ডায় । কাছাকাছি স্টুডিওয় গিয়ে আমাদের সবায়ের একটা গ্রুপ ফোটো তোলানো হল শরদের ইচ্ছায় ।
    ডেভিডকে নিয়ে আমি রওনা দিলুম দুমকা, দাদার আস্তানায়, মহুয়া, হাড়িয়ার জগতে ।


    শক্তিদা ১৯৬৪ সালের প্রথম দিকে দলবল নিয়ে সুবিমল বসাককে মারধর করার জন্য কফি হাউসের সামনে ঘিরে ধরেছিলেন । সুবিমলের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের যারা ছিল পালালো সবাই । বাসুদেব দাশগুপ্তও পালালো। সুবিমলের খোট্টা চিৎকারে শক্তিদার দলবলও ছত্রভঙ্গ ।
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমেরিকা থেকে ফিরেছিলেন । আমেরিকা থেকে শক্তি, সন্দীপন, উৎপল প্রমুখকে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন হাংরি আন্দোলন ছেড়ে দেবার । তার প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল তাঁর ইয়ারদোস্তদের মাঝে । ওনার চিঠি প্রকাশিত হওয়া আরম্ভ হয়েছে, তা থেকে জানা গেছে যে উনি আশঙ্কা করেছিলেন ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীকে ভেঙে দেবার জন্যই হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করা হয়েছে ।
    একদিন সন্ধ্যায়, আমিই খরচ করব জানিয়ে, বাসুদেব দাশগুপ্তকে ওর মুখের কোলাঝটা দেখাবার জন্য নিয়ে গিয়েছিলুম খালাসিটোলায় ।
    ওর দুটো মুখের ওপর বসানো জাপানে আণবিক বোমার দরুণ জন্মানো এক বিকৃত শিশুর দেহ, যার মুখ বলতে প্রায় কিছুই নেই ।
    কোলাঝের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে হঠাৎ কাঁদতে আরম্ভ করে দিল বাসুদেব ।
    বলল, তুমি আমার অবস্হার যথার্থ ব্যাখ্যা করেছ । এই যে আমার কপালের ওপর এক বিকৃত শিশুর লিঙ্গ এসে পড়েছে, এটাই আমার বর্তমান অস্তিত্ব, হয়তো এটাই আমার বেঁচে থাকার ব্যাখ্যা ।
    কি বলব বুঝতে পারলুম না । কেন কান্না, তাও জিগ্যেস করতে পারলুম না । ভাঙা প্রেম হয়তো খোঁচা হয়ে লুকিয়ে আছে । ভাবলুম, কাঁদছে, কেঁদে নিক, জমে থাকা কান্না বেরিয়ে যাক । সে সময়ে খালাসিটোলায় অনেককেই কাঁদতে দেখা যেত, তাই ওই পরিবেশে বাসুদেবের আচরণে কোনো ব্যাখ্যাহীনতা ছিল না ।
    বাসুদেবের সঙ্গে যেটুকু মিশেছি, ওকে মনে হয়েছে ভিতু প্রকৃতির । একাধিক বন্ধুবান্ধব সঙ্গে থাকলে ওকে সাহসী মনে হতো । একা থাকলে ভালনারেবল ফিল করতো ।
    হাংরি আন্দোলনের মুখোশ পাঠানোর ব্যাপারটা ওর পছন্দ হয়নি । সব সময় বলত, কিছু যদি হয়, যদি সরকার স্টেপ নেয়, ইত্যাদি । সুবিমল বসাকের আঁকা ড্রইংগুলো সম্পর্কেও বাসুদেবের ইনহিবিশান ছিল, বলত ওগুলো নোংরা হয়ে যাচ্ছে না কি । বিভিন্ন ট্যাবলয়েডের সংবাদে বা আমাদের কার্টুন কোনো কাগজে বেরোলে বলত, কাজগুলো বোধহয় উচিত হচ্ছে না । আসলে বাসুদেবের ভীতির কারণ যে পবিত্র বল্লভ নামে এক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক, যে পুলিশের কফিহাউস-ইনফমফার ছিল, তা আমরা তখন জানতে পারিনি ।
    সুভাষকে নিয়ে করা কোলাঝটা সুভাষের পছন্দ হল না । আমরা দুজনে অলিমপিয়ায় । সুভাষ বলল, বাসুদেবের প্রতি তোমার পারশিয়ালিটি রয়েছে, ওই কোলাঝটা আমার হবার কথা, আমি কপালে বিকৃত শিশুর লিঙ্গ নিয়ে জন্মেছি ।
    সুভাষের সমস্যা ছিল যে বাসুদেবের ১৯৬২ সালে ‘রন্ধনশালা’, ১৯৬৪ সালে ‘রতনপুর’ প্রকাশিত হয়ে গেছে আর কফিহাউসে আলোচ্য হয়ে উঠেছে ; তখনও পর্যন্ত সুভাষের ‘আমার চাবি’ গদ্যটা বেরোয়নি ।
    সুভাষের আরেকটা অভিযোগ ছিল । যখন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কার্যক্রম চালাচ্ছে হাংরি আন্দোলনকারীরা তখন বাসুদেব দাশগুপ্ত চুপচাপ নিজের একটি কাহিনি ‘দেশ’ পত্রিকায় জমা দিয়ে এসেছিল । পরবর্তীকালে যখন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘এখন আমার কোনো অসুখ নেই’ উপন্যাস ওই একই বিগহাউস পত্রিকায় প্রকাশিত হল, তখন প্রথম অভিযোগের আঙুল তুলেছিল বাসুদেব দাশগুপ্ত ।


    ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে আমাদের এগারোজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরোল, সমীর রায়চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত আর আমি, ১২০ ( বি ) আর ২৯২ ধারায়, দাদার জন্য একটা আলাদা ধারা, ২৯৪ যোগ হয়েছিল । কিন্তু সবাইকে গ্রেপ্তার করা হল না ।
    আমি, দাদা, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ গ্রেপ্তার হয়েছি শুনে, অনেকেই কলকাতা ছেড়ে যে যার গ্রামে চলে গিয়েছিল । রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তো ভয়ে সাহিত্যই ছেড়ে দিলে । সুবো আচার্যকে প্রদীপ চৌধুরী সঙ্গে চলে গিয়েছিল ত্রিপুরায় ওর বাড়িতে । সেখান থেকে প্রদীপকে গ্রেপ্তার করে এনেছিল কলকাতা পুলিশ, সুবো তখন আরও ভেতরে কোনো গ্রামে চলে গিয়েছিল ।
    কলকাতা ছেড়ে যারা চলে গিয়েছিল তারা ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ২রা নভেম্বর ১৯৬৪-এর ফোটোতে নেই । ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের রিপোর্টার লুই কার কলকাতায় এসে জ্যোতির্ময় দত্তর কাছে আমাদের খোঁজ করে । আমি আর দাদা সবাইকে সংবাদ পাঠাই যাতে সাক্ষাৎকারের জন্য গ্র্যান্ড হোটেলে উপস্হিত হয় ।
    মামলাটা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল আমার বিরুদ্ধে, ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি লেখার দায়ে । বাদবাকি সকলের ওপর থেকে আরোপ তুলে নিয়েছিল পুলিশ ।
    শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ হাংরি আন্দোলনের বিরোধীতা করে, মুচলেকা লিখে, আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হতে রাজি হওয়ায় ওদের বিরুদ্ধে চার্জ তুলে নেয়া হয়েছিল । আমার একমাসের কারাদণ্ডের আদেশ ওদের সাক্ষ্যের কারণেই হয়েছিল ।
    বাসুদেব দাশগুপ্তকে জেরার জন্য পুলিশ লালবাজারে ডেকে পাঠায়নি, তাই বাসুদেবকে কোনো এজাহার দিতে হয়নি । বাসুদেবকে তলব না করার প্রধান কারণ অবশ্য ছিল পবিত্র বল্লভ নামে লালবাজার পুলিশের প্রেস সেকশানের একজন খোচর, যে ‘উপদ্রুত’ নামে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করত, আর তারই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’ ।
    পবিত্র বল্লভ যে একজন খোচর, কফিহাউসে লেখকদের ওপর নজর রাখে, লালবাজারের প্রেস সেকশানে লিটল ম্যাগাজিন জমা দেয়, তা জানতে পেরেছিলুম লালবাজারে ঘোরাঘুরি করে ; আমার মামলায় পবিত্র বল্লভ ছিল পুলিশের পক্ষে ভুয়ো সাক্ষী ।
    বাসুদেব কখনও পবিত্র বল্লভ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করেনি । পবিত্র বল্লভ সম্পর্কে জানাজানির পরে বাসুদেব আমার আর দাদার কাছ থেকে সেসময়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল ।
    ১৯৬৫ সালের ৩ মে আমাকে চার্জশিট দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হতেই, সবাই কেটে পড়েছিল, মায় বাসুদেব দাশগুপ্ত । সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র আর পরে ফালগুনী রায় ছাড়া কেউই আদালতের ত্রিসীমানায় আসত না । আমার মোকদ্দমা চলেছিল পঁয়ত্রিশ মাস । বাসুদেব দাশগুপ্ত আর সুভাষ ঘোষের মাও জে ডং, সাংস্কৃতিক বিপ্লব আর চিন-কিউবার মানবতাবাদী বিতর্ক তখন হাওয়া । কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, কিন্তু বাসুদেব কখনও বলেনি যে মামলার ডেট না থাকলে ওর অশোকনগরের বাসায় গিয়ে থাকি । থাকতে বাধ্য হতুম সুবিমলের জ্যাঠার স্যাকরার দোকানঘরে, আর টয়লেট ব্যবহার করতুম শেয়ালদার টয়লেটে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা দূরপাল্লার ট্রেনে ।
    তখন থেকে হাঙরের ঢেউয়ে একাই সাঁতার কাটা রপ্ত করে ফেললুম ।


    ফিকশান লেখকরা দুটি উপায়ে সাধারণত তাঁদের কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যান । প্রথম উপায়ে তাঁরা চরিত্রগুলোকে সুস্পষ্ট ভাবে ছকে নেন, তাদের দেখতে কেমন, আচরণ কিরকম হবে, তাদের জীবনের ঘটনাবলী, এবং সর্বোপরি কাহিনির প্লট আগেই নিশ্চিত করে প্রারূপ তৈরি করে রাখেন । আরেকটি উপায় হল একটি আইদিয়াবিন্দু থেকে লেখকের কল্পনাশক্তি তাঁর কলমকে যেমন-যেমন এগিয়ে নিয়ে যায়, লেখক সেই প্রবাহের সঙ্গে চলেন । বাসুদেব দাশগুপ্তের রন্ধনশালা সিরিজের ফিকশানগুলো দ্বিতীয় প্রক্রিয়ায় লেখা ।
    সৌষ্ঠবের অবশ্যম্ভাবী প্রত্যয় নিয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত তার ফিকশানে গড়ে তুলেছে এক বিশেষ জগত যেখানে ক্রিয়া করে চলেছে অবিশ্বাস্য বাস্তব । ফিকশান বলছি, কেননা ছোটোগল্পের যে সংজ্ঞা ইউরোপ থেকে আমরা পেয়েছি, তার আওতায় পড়ে না বাসুদেবের রন্ধনশালা সিরিজের গদ্য । জাগতিক চরিত্রের চৌহদ্দিতে বাসুদেব প্রদর্শন করেছে তার প্রভাববিস্তারী দক্ষতা, যে জগতে জীবন অতিবাহিত হয় কল্পনার সীমাহীনতার দ্বারা, যেখানে মৃতরা মরে না, যেখানে ইনোসেন্স সবসময় নিষ্পাপ, যেখানে যাপনপ্রক্রিয়ার জটিলতাগুলো আদপে জটিল নয় ।
    ইউরোপের সংজ্ঞাকে অস্বীকার করায় কাজ করেছে উত্তরঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ববোধ, যে দ্বন্দ্ববোধের মাধ্যমে বাসুদেব বিদেশী আর স্বদেশী অথবা সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক দুই কাহিনিবিন্যাসের সংঘর্ষজনিত বাস্তবকে আয়ত্ত করতে চেয়েছে । যদিও ‘রন্ধনশালা’ সিরিজের ফিকশনগুলোয় ‘আমি’ বলে চলেছে ঘটনাগুলো, কিন্তু তা মেটাফিকশান হিসাবে নয় । হিন্দু পুরাণের অপ্রত্যাশিত ও অসম্ভাব্য ঘটনাবলীর সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। বাসুদেব প্রয়োগ করেছে উত্তরঔপনিবেশিক ফিকশন স্ট্র্যাটেজি, যার দ্বারা ইউরোপের ন্যাচারালিজম ও রিয়্যালিজমকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে ।
    প্রতীকি বলা উচিত নয় হয়তো, কিন্তু যে ঘটনাগুলো তিনি ঘটিয়ে চলেন, তাতে গুরুত্ব পায় প্রেমের প্রয়োজনীয়তা । তার ফিকশানের পৃথিবীকে সে নিজেই আবিষ্কার করেছে । অথচ ন্যারেটিভের শেকলগুলো বারবার ভেঙে ফেলেছে । কল্পনাশক্তিকে বাসুদেব ব্যবহার করেছে বাস্তবকে সমৃদ্ধ করার জন্য, তাকে এড়িয়ে যাবার জন্য নয় । বাসুদেবের অবাস্তবতার গভীর শিকড় রয়েছে বাস্তবে, কেননা তা বাস্তব থেকেই উদ্ভূত, আর রোশনি ফ্যালে অপ্রত্যাশিত ঘটনার সৌন্দর্যে ।
    মার্কেজের অথবা রুশডির ম্যাজিক রিয়ালিজমের সঙ্গে রন্ধনশালা সিরিজের ফিকশানগুলোর কল্পনাকে তুলনা করা যাবে না বলেই মনে হয় । মার্কেজ ও রুশডি স্বদেশের ইতিহাসের ঘটনাবলীর ওপরে গড়ে তুলেছেন তাঁদের ফিকশানগুলো, চরিত্রগুলো সেই ইতিহাস থেকে বাছাই করে তোলা । বাসুদেব রন্ধনশালা সিরিজের ফিকশানে ভারতের বা কলকাতার বা বাঙালির ইতিহাসকে আশ্রয় করেনি । কিন্তু মার্কেজের বা চার্লস ডিকেন্সের মজাদার অতিশয়োক্তিকে প্রয়োগ করেছে বাসুদেব । হয়তো মাশাদো দি আসিস, হোর্হে লুই বোর্হেস, হুয়ান রালফোর কল্পনাপ্রয়োগের সঙ্গে তুলনা করা যায় বাসুদেবের ফিকশানের দ্রুত জায়মান ঘটনাগুলোকে ।
    শহরের মাঝেই গ্রাম গড়ে তুলেছে বাসুদেব, কফিহাউসের মধ্যেই বিশাল গ্রাম, তবু তা আর্বান ফিকশান নয়। কল্পনার উড়ালের জন্য তার শেকড় অভিজ্ঞতায় সঞ্চয় করা বাস্তবে পোঁতা । শহর আর গ্রামের দ্বন্দ্ব । ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ফিকশানও আর্বান নয়, আবার তা গ্রামীণও নয় । বাসুদেবের বাস্তবতাকে বিশেষ চারিত্র দেয় আধাশহুরে সংবেদন, অলৌকিক রয়েছে সর্বত্র এবং তা রয়েছে প্রাত্যহিকতায় ।
    বামপন্হী হিসাবে বাসুদেব স্বপ্ন দেখতো, নিভৃত কুহকে আশ্রিত সেই সব স্বপ্ন, স্বপ্নের গভীরের সত্য, যা গড়ে তুলেছে একযোগে একাধিক সময় পরিসর, অতীত-বর্তমান একে আরেকের ভেতরে প্রবেশ করে যায়, ঘটতে থাকে আনন্দের ডিলিরিয়াস মুহূর্তপূঞ্জ ।
    পরবর্তীকালে, রাজনৈতিক বোধোদয়ে ক্রমে স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল ।
    বাসুদেব ‘রন্ধনশালা’ সিরিজের জন্য একটি পৃথক জনার তৈরি করে ফেলতে পেরেছিল, যা ম্যাজিক রিয়ালিজম নয়, এবং সুররিয়ালিজমও নয় । প্যারাগ্রাফের ভেতরেই সংলাপ চলতে থাকে; একজনের সংলাপের সঙ্গে আরেকজনের সংলাপের যোগসূত্র থাকে না । প্যারাগ্রাফের মানদণ্ড অস্বীকার করে, প্যারাগ্রাফ যেখানে বদলানো দরকার সেখানে পরের প্যারায় না গিয়ে অবিরম চলতে থাকে । এক প্যারা থেকে ফিকশন পরের প্যারায় কেন গেলো, তার গোপন ইশারা আছে বটে কিন্তু তা ম্যাজিক রিয়্যালিজম ও পরাবাস্তববাদ কিংবা ঠাকুমার ঝুলির মতন ফেবুলিস্ট ফিকশানের শেকলগুলোকে মান্যতা দেয় না । শেকল জুড়ে দিতে থাকে ‘আমি’ নামের এক ব্যক্তিএকক, যার বর্ণনা কোথাও নেই ; কেবল জানা যায় যে সে চশমা পরে ।


    ‘রন্ধনশালা’ সিরিজের ফিকশানে বহু চরিত্র উদয় হয় আর মিলিয়ে যায় ; ডিটেইল বাস্তব বন্দোবস্তের ভেতরে ঢুকে পড়ে এমন অবাস্তবপ্রতিম ঘটনাবলী যা সহজে বিশ্বাসযোগ্য নয় । বাস্তব ও দৈনন্দিনের পরিবেশে স্বাভাবিকত্ব পেয়ে যায় প্রকৃতির নিয়ম বহিভূত অতিপ্রাকৃত ছমছমে উপাদানসমূহ ।
    আমি বাসুদেবের ফিকশনকে পরাবাস্তব বলছিনা কেননা বাসুদেবের গদ্যের ফোকাস রয়েছে বস্তু বা মেটেরিয়াল অবজেক্টের ওপর এবং পৃথিবীতে যে সমস্ত জিনিসপত্র ও মানুষজন রয়েছে তার ওপর, যখন কিনা পরাবাস্তবে কাঙ্খিত হল বৌদ্ধিকতা, স্বতঃলিখন, ও অবচেতনের বাস্তব ।
    ত্রিস্তান জারা চেয়েছিলেন, প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে এমন একটি বিশ্ববীক্ষার অধিকারী করতে যার ভিত্তিতে সে ডিঙোতে পারবে ভণ্ডামি ও নীতিসীমার প্রাকার-পরিখা, এবং পৌঁছোতে পারবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে । আঁদ্রে ব্রেতঁ বলেছিলেন, প্রকৃত সত্য বিরাজ করে ব্যক্তিএককের অবচেতনে ; পরাবাস্তববাদীর উদ্দেশ্য হল তার স্বতঃলিখনের মাধ্যমে সেই সত্যকে গভীর থেকে আবিষ্কার করা । বাসুদেবের গদ্যকে আমি স্বতঃলেখন বলব না । উল্লেখ্য যে বাসুদেব, তখন উনি মার্কসবাদী, বলেছিলেন. “আমার ক্ষুধা ছিল মানুষের সার্বিক মুক্তির ক্ষুধা ।” এই একই বক্তব্য রেখেছেন সুবো আচার্য, অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য হবার পরে, তাঁর গুরুদেবের ধর্মবোধের ভিত্তিতে ।
    বাসুদেবের ফিকশনগুলো বিজ্ঞানের কল্পকাহিনি বা ফ্যানটাসি-গল্প নয় ; অর্থাৎ বাসুদেব এসকেপিস্ট ফিকশান লেখেননি ; সিরিয়াস ফিকশান লিখেছেন । বিজ্ঞানের কল্পকাহিনি বা ফ্যানটাসি-গল্পও সিরিয়াস ফিকশান হতে পারে । সিরিয়াস ফিকশানের কাজ হল পাঠককে ন্যারেটিভের বিশ্ববীক্ষায় বিজড়িত করে নেয়া এবং সত্যের অনুসন্ধানে সাহায্য করা । বাসুদেব সিরিয়াস ফিকশানের একটি নিজস্ব জনার গড়ে তুলেছেন, যে ন্যারেটিভে সময় লিনিয়র নয়, কার্যকারণ-সম্বন্ধ তাঁরই আবিষ্কৃত, এবং দৈনন্দিন ও অপ্রকৃতে তফাত নেই । পরে বাসুদেব যখন মার্কসবাদী তত্বের আওতায় নিজেকে আটক করলেন তখন আর ‘রন্ধনশালা’ সিরিজের মতন ফিকশন তিনি লিখতে পারলেন না, তার কারণ তখন তাঁর বিশ্ববীক্ষা পালটে গিয়ে হয়ে গেছে বস্তুগত, অভিজ্ঞতাজাত এবং দৃষ্টবাদী ।
    শেষ পর্যন্ত লেখালিখি তাঁকে ছেড়ে চলে গেল ।
    [ রচনাকাল : জুন ২০১৫ ]
  • মলয় রায়চৌধুরী | 012312.60.8934.15 | ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৪৮541369
  • মহানগরে পথচর বদল্যার
    মলয় রায়চৌধুরী
    কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা-একা শহরের পথ থেকে পথে
    অনেক হেঁটেছি আমি ; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম বাস সব ঠিক চলে
    তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে

    সারারাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো করে জ্বলে ।
    কেউ ভুল করেনাকো --- ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব
    চুপ হয়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে ।

    একা একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব ;
    তখন অনেক রাত --- তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা
    নির্জনে ঘিরেছে এসে ; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব

    আর দেখেছি কি : একরাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা ?
    চোখ নিচে নেমে যায় --- চুরুট নীরবে জ্বলে --- বাতাসে অনেক ধুলো খড় ;
    চোখ বুজে একপাশে সরে যাই --- গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতা

    উড়ে গেছে ; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর
    কেন যেন ; আজো আমি জানিনাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর ।
    ( “পথ হাঁটা”--- জীবনানন্দ দাশ )

    আমি একজন রেকলুজ, একা থাকতে ভালোবাসি, একা-একা শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি । ভারতের এবং পৃথিবীর অন্যান্য যে শহরেই কিছুকাল থেকেছি, কুড়ি বছর হোক বা কুড়ি দিন, রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি, একা-একা টহল দিয়ে চারিদিকে চোখ বোলাতে-বোলাতে ,কান পেতে, গন্ধ নিতে-নিতে, হেঁটেছি, স্রেফ হেঁটেছি, কোথাও বা ফাঁকা ফুটপাত বেয়ে শোকেস দেখতে-দেখতে আর কোথাও বা ভিড়ে গাদাগাদি মানুষ-মানুষীর মাংসময়তার ভেতরে-ভেতরে । শহরবাসীর ভাষায় দখল থাকলে যে অভিজ্ঞতা হয়, তার থেকে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে অজানা ভাষাভাষিদের চলমান জমায়েতে । অফিসের কাজে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে সমীক্ষা করতে গিয়ে টের পেতুম যে রাজনৈতিক ভয়ে অনেকে সঠিক উত্তর দিচ্ছেন না ; তখন আমার হিন্দি-উর্দু প্রয়োগ করে , যেহেতু দাড়ি-গোঁফ ছিল, আর সহকারীরা আমার পরিচয় এম আর চৌধরী বলে দিত, অবাঙালি রূপে ভেতরের কথা টেনে বের করা সহজ হয়ে যেত । আমার ‘অপ্রকাশিত ছোটগল্প’ বইতে ব্যাপারটা নিয়ে ‘মিহিকার জন্মদিন’ শিরোনামে একটা গল্প লিখেছিলুম । ইনকগনিটো থাকার অভিজ্ঞতা । যেমন অভিজ্ঞতাই হোক না কেন, তা বেশ আহ্লাদময় ।
    উনিশ শতকের প্যারিস মহানগরের পথে-পথে টহলক্রিয়াকে চিহ্ণিত করে শার্ল বদল্যার একটি ভাবকল্প তৈরি করে দিয়ে গেছেন । ক্রিয়াটিকে তিনি বলেছেন ‘ফ্ল্যানেরি’ এবং ওই পথচর দর্শককে বলেছেন ‘ফ্লনিয়র’।
    উনিশ শতকের ইউরোপে শহরগুলো দ্রুত অভূতপূর্ব বিশাল আকারে এমন ভাবে বেড়ে উঠছিল যে শহরবাসীর অভিজ্ঞতায় সুদূরপ্রসারী প্রভাবের নকশা গড়ে দিচ্ছিল তারা । বদল্যারের ফ্লনিয়র জন্মেছিল এই নকশাটি থেকে , আধুনিকতাবাদের প্রথম চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যের অন্যতম । গ্রামাঞ্চল থেকে এসে বিশাল মহানগরের ভুলভুলাইয়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল ব্যক্তিমানুষ । গ্রামাঞ্চলে সে ছিল কৌমের অংশ , সবুজ ভূখণ্ডের অংশ । মহানগরের জটিল ও সর্পিল পথসমষ্টির বিভ্রান্তিকর রাস্তা, পথ, গলি, তস্যগলির ভুলভুলাইয়ায় তার কৌমপ্রতিস্ব ক্রমশ আবছা হয়ে জন্মাচ্ছিল ব্যক্তিএককের আধুনিক প্রতিস্ব । ভুলভুলাইয়াগুলোতে গড়ে উঠছিল গোপন ও নিষিদ্ধ পরিসর, যা একযোগে ভয়ের এবং আনন্দলাভের এলাকা ; সেই পরিসরে বক্তিমানুষ , অবশ্যই পুরুষ-ব্যক্তি, এলাকাটির অংশ হয়েও আক্রান্ত হচ্ছিল পারস্পরিক দূরত্বে, অসম্বদ্ধতায়, অপসৃতির বোধে । আধুনিকতা দেশে-দেশে গড়ে তুলছিল মহানগর, এবং সেই মহানগরগুলোয়, আধুনিকতার অবদানরূপে দেখা দিচ্ছিল আলোকময়তার পরিসর ও অন্ধকারাচ্ছন্নতার পরিসর ; বৈভবশালীর এলাকা ও ভিখারি জুয়াড়ি নেশাখোর যৌনকর্মী অপরাধী ও শ্রমিকদের এলাকা । যুগ্মবৈপরীত্যের বিভাজন ।
    গ্রিক পুরাণে আছে যে ক্রিট দ্বীপে ছিল এক সর্পিল জটিল বিভ্রান্তিকর ভুলভুলাইয়া, আর সেই ভুলভুলাইয়ায় থাকত মাইন্যটর নামের বৃষাসুর, যার দেহ মানুষের মতন কিন্তু মাথাটা ষাঁড়ের । জার্মান ভাবুক ওয়াল্টার বেনিয়ামিন ভুলভুলাইয়ার এই গ্রিক রূপকটির তুলনা করেছেন নতুন গড়ে ওঠা উনিশ শতকের ইউরোপীয় মহানগরের সঙ্গে । পথ, গলি , তস্যগলি, ইত্যাদির গোলকধাঁধায় তৈরি ভয়ের ও আনন্দের চিত্তাকর্ষক পরিসরকে তুলনা করেছেন মাইন্যটর দানবটির সঙ্গে । মহানগরের ভেতরে একটি এলাকা মানব দেহের আরেকটি ষাঁড়ের মাথার । বেনিয়ামিন ও বদল্যারসহ ইউরোপীয় ইমপ্রেশানিস্ট চিত্রকরদের অনেকেই ভয়ের ও বাসনার যে মনোহর মেট্রপলিটান এলাকাটিতে আকর্ষিত হতেন তা যৌনকর্মী, লুম্পেন, ভবঘুরে, ছন্নছাড়া, মাতাল, নেশাড়ু, জুয়াড়ি, অপরাধী অধ্যুষিত ।
    ১৮৬৩ সালে, যে-সময়ে প্যারিস শহরকে পুঁজিবাদের চিত্তাকর্ষক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলছেন তৃতীয় নেপোলিয়ান ও ব্যারন হাউসমান, সে-সময়ে, চারিদিকের ঝিকমিকে ঝিলমিলে দোকান-পশার ও তা উপভোগের জন্য উপচে-পড়া জনসমুদায়কে বিশ্লেষণ করে, নিজেকেও সেই আয়নায় প্রতিফলিত দেখে, ‘লে ফিগারো’ পত্রিকায় শার্ল বদল্যার একটি প্রবন্ধ লেখেন, যার শিরোনাম ছিল ‘আধুনিক জীবনের চিত্রকর’ । রচনাটিতে তিনি ‘ফ্লনিয়র’ (Flaneur ) শব্দটি প্রয়োগ করেন । বদল্যারের আলোচকরা বলেছেন ফ্লনিয়র শব্দটির প্রতিশব্দ অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় নেই । অনেকে অবশ্য ইংরেজি Stroller ও Saunterer শব্দগুলো ব্যবহার করেছন । যে লোকটি পথে-পথে গন্তব্যহীন অলস পায়ে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে বেড়িয়ে বেড়ায়, তাকে তিনি বলেছেন ফ্লনিয়র । লোকটাকে ভবঘুরে (Vagabond, Badaud, Gawker ) বলা যাবে না । সে কোনো-কিছুর ক্রেতা নয়, কেননা সে শপিং করতে বেরোয়নি । বদল্যার নিজেই রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, একা-একা, অনেক সময়ে ভোর
    রাত পর্যন্ত , অপাড়া-বেপাড়া সর্বত্র। পৃথিবীর সব ভাষাতেই শব্দটি যেভাবে ব্যবহৃত ও উচ্চারিত হচ্ছে, আমি সেভাবেই তাকে বাংলায় ব্যবহার করছি । আরও অনেকে, যেমন জীবনানন্দ দাশ, ফালগুনী রায়, অসকার ওয়াইল্ড, জ্যাক কেরুয়াক পথে-পথে হেঁটে বেড়াতেন। তবে, নিষিদ্ধ পরিসরগুলো জীবনানন্দের ক্ষেত্রে কিয়দংশে নিষিদ্ধ ছিল বলেই অনুমান করি ।
    ফ্ল্যানেরি, তাকিয়ে-তাকিয়ে বেড়িয়ে বেড়াবার ক্রিয়াটি, মডার্নিটির আলোচনায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে । ফ্লনিয়র লোকটি একা ঘুরে বেড়ায় ; বন্ধুবান্ধদের সঙ্গে পথচারণা করে না, নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে গুলতানি করে না, বন্ধু বা বন্ধুনির পাশাপাশি হাঁটছেনা, কাউকে দেখে মন্তব্য করে না। বস্তুত ফ্লনিয়র লোকটি নিজে একজন অজ্ঞাত সত্তা । আধুনিকতাবাদের গর্ভ থেকে পয়দা হওয়া পুরুষালি প্যাশনের মহানাগরিক নমুনা । নগ্নিকার ছবি আঁকেন চিত্রকর, কিন্তু নগ্নিকার দিকে তাকিয়ে-থাকা একজন সাধারণ পুরুষ যে আ্হ্লাদ লাভ করে তা স্কোপোফিলিয়া নামের চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য । আমি আমার ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাসে এই বৈশিষ্ট্যযুক্ত একটি চরিত্রকে উপস্হাপন করেছি, তার পুরুষালি চাউনির মাধ্যমে দখল করে নেবার প্রক্রিয়াটি কী ভাবে কাজ করে তা বিশ্লেষণের জন্যে । ফ্ল্যানেরি ও স্কোপোফিলিয়া দুটি ভিন্ন প্যাশন । স্কোপোফিলিয়া নারীর ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে বটে , ( তরুনীরা যেমন নগ্ন উর্ধ্বাঙ্গের হৃতিক রোশন বা সালমান খান দেখতে ভালোবাসেন ) তবে নারীর পক্ষে ফ্লনিয়র হওয়া কঠিন বলে স্বীকার করে নেয়া যায় । মহানগরের গোপন পরিসরগুলো নারীর কাছে প্রায় অগম্য । ভিড়ের গাদাগাদির ভেতরে সেঁদিয়ে মাংসের মহাসমুদ্রের অংশ হয়ে হাঁটা সম্ভব নয় নারীর পক্ষে । উনিশ শতকের লেখিকাদের কেউ-কেউ অবশ্য তাঁদের পাঠবস্তুতে ফ্লনিয়র-নারী চরিত্র উপস্হাপন করে গেছেন, যেমন চার্লট ব্রন্টে, ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড, জিন রাইস, ভার্জিনিয়া উলফ প্রমুখ । বিপজ্জনক এলাকায় প্রবেশ ও সেই পরিসরের জীবনযাত্রার দিকে তাকিয়ে গড়ে ওঠে তাঁদের উপস্হাপিত নারী-চরিত্রগুলো । নিজেদের ও শহরের মাঝের দূরত্বকে তারা কল্পনা প্রয়োগ করে মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয় ।
    আধুনিক কবি ও চিত্রকরকে চিহ্ণিত করার জন্য বদল্যারের তৈরি ফ্লনিয়র ভাবকল্পটি, এখন ব্যবহার করা হচ্ছে ‘পোস্টমডার্ন গেজ’ বা উত্তরাধুনিক চাউনি বিনির্মাণ করার কাজে । পুরুষের চাউনির চাপে সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে ; বহু মহিলা নিজেদের ওই চাউনির উপযুক্ত করে তোলার জন্য আকর্ষক পোশাক পরেন, সাজগোজ করেন । পুরুষের চাউনির কথা মাথায় রেখে পণ্যবস্তু বিজ্ঞাপিত হয়, এবং সেখানেও নারীকে উপস্হাপন করা হয় টোপ হিসেবে । মিশেল ফুকো বলেছেন যে এমন নয় যে চাউনি ব্যাপারটা কারোর থাকে বা সে প্রয়োগ করে ; এটি একটি সম্পর্কক্ষেত্র যেখানে কেউ প্রবেশ করে । দর্শক যখন কোনো বস্তুর দিকে তাকায় তখন সে ওই বস্তুটিই কেবল দেখছে না । দর্শক আসলে দেখছে সেই বস্তুটি ও নিজের সম্পর্কের দিকে । কোনো-কোনো বস্তু কেবল তাকাবার খাতিরেই তৈরি হয় , যেমন চিত্রকরদের পেইনটিঙ । এখন সাইবার জগতে একা-একা বা কয়েকজন মিলে ভারচুয়াল জগতের দিকে তাকিয়ে কোনো বস্তু বা জীবের সঙ্গে পোস্টমডার্ন সম্পর্ক গড়ে তোলে । ইনটারনেট পরনোগ্রাফিক চলচ্চিত্র বা নগ্ন নারী-পুরুষ দেখে যে দর্শক সে একজন স্কোপোফিলিক চরিত্রবৈশিষ্ট্য মানুষ । সে ফ্লনিয়র নয় ।
    ফ্লনিয়রকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বদল্যার বলেছিলেন, ভিড় হল এই মানুষটির অপরিহার্য অংশ বা নিদান, পাখির যেমন আকাশ এবং মাছের যেমন জল । তার প্যাশান ও তার বৃত্তি হল জনসমুদায় নামক বিশাল মাংসল সমুদ্রের মাংসাংশ হয়ে ওঠা। একজন নিখুঁত ফ্লনিয়রের, একজন আবেগোচ্ছাসিত দর্শকের, মহানন্দ ঘটে জনসমুদায়ের হৃদয়ে নিবাসস্হান গড়ে নেবার দরুন, জনস্রোতের ঢেউগুলোর গতির ওঠা-নামার লয়ের সাথে-সাথে মিশ খাবার কারণে । সে ওই অনন্তময় ও আশ্রয়প্রার্থী গায়ে-গা ভিড়ের ভেতরে নিজের জন্য এমনই এক বোধে আহ্লাদিত হয় যেন সে বাড়ি থেকে বহুদূরে চলে গেছে অথচ চারিদিকেই তার বাড়ি, সমাজ-সংসার থেকে লুকিয়ে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করছে, ওই পৃথিবীটিরই অংশ হিসেবে । ওই দর্শক-কবি হল রূপকথার সেই রাজপুত্র যে সাধারণ মানুষের পোশাকে নিজেকে লুকিয়ে জনগণের কাজ-কারবার দেখার আনন্দে মজে আছে । সে হল জীবনের এমনই এক প্রেমিক যে সমগ্র জগত-সংসারকে নিজের পরিবারের অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছে ; কিংবা সুন্দরীদের প্রতি আকর্ষিত সেই যুবকের মতো যে ওই না-পাওয়া সুন্দরীদের নিয়ে নিজের পরিবার গড়ে তুলেছে ; কিংবা পেইনটিঙের সেই আঁকিয়ের মতন, যার নিবাস স্বপ্ন দিয়ে বোনা এক ম্যাজিক নগরীতে ,যা সে ক্যানভাসে মেলে ধরে । অর্থাৎ সার্বজনীন জীবনের প্রেমিক মানুষটি ভিড়ের ভেতরে এমনভাবে সেঁদিয়ে যায় যেন তা বৈদ্যুতিক তেজোময়তার অপরিমেয় আধার । অথবা আমরা তাকে জনসমুদায়ের মাপের সমান একটা আয়নার সঙ্গে তুলনা করতে পারি , কিংবা তুলনা করতে পারি এমনই এক ক্যালাইডোস্কোপের সঙ্গে যা নিজের চেতনার সাহায্যে প্রতিটি বিচলনে সাড়া দেয়, আর জীবনের বহুত্বময়তাকে তার উপাদানগুলোর ঝিলমিলে মাধুর্যসহ পুনরুৎপাদন করে চলে ।
    তাঁর ‘প্যারিস সপ্লিন’ গ্রন্হে ফ্ল্যানেরি ক্রিয়াটিকে বদল্যার গ্রহণ করেছেন পাঠবস্তু গঠনের কৌশল রূপে, বিশেষ করে ‘ভিড়’ শিরোনামের গদ্যকবিতায় । একজন ফ্লনিয়র ঠিক কী-কী করে,তাকে উপলব্ধি করার বনেদ হয়ে উঠেছে পাঠবস্তুটি । ফ্লনিয়র চরিত্র-বিশিষ্ট কবির ব্যক্তিসত্তাটি একজন পুরুষের, যে কিনা চেয়ে-দেখা প্রাণী বা বস্তুটির দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে তাতে নান্দনিক মর্মার্থ সঞ্চার করে দিতে পারে , এবং নিজেকে ঘিরে গড়ে ফেলতে পারে, ভিড়ের সাহায্যে, আস্তিত্বিক নিরাপত্তার বলয়। তাঁর ফ্লনিয়র একজন পুরুষ কবি, যে তার ব্যক্তিগত একাকীত্ব থেকে আত্মবিতাড়িত অবস্হায় নিজের জীবনের অর্থ খুঁজে চলেছে, জনসমুদায়ের সমুদ্রে, পণ্যবাজারের মনোহারি শোভায়, নিষিদ্ধ পরিসরের গোপন খাঁজখোদরে । তার দিনের বেলাকার মেট্রপলিটান পরিবেশ হল ভিড় এবং দোকানপাট । সে ভিড়ের মানুষ ; ভিড়ের মধ্যেকার একজন মানুষ নয় । জনসমুদায়ের সাহায্যে যে শৃঙ্খলা সে নির্মাণ করছে, সে অবিস্হিত তার কেন্দ্রস্হলে , যদিও ভিড়ের অন্যান্য মানুষের কাছে সে, অর্থাৎ ফ্লনিয়র-কবি, মেট্রপলিসের নিরন্তর প্রবহমান জনসমুদায়েরই অংশ । তার আস্তিতিক বোধ তাকে ফ্লনিয়র করে তুলছে, পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে অন্যান্যদের থেকে ।
    ‘ভিড়’ গদ্যকবিতায় বদল্যার বলেছেন, জনতার ভেতরে নিজেকে চুবিয়ে জনতা দিয়ে স্নান করার ক্ষমতা সকলের থাকে না ; জনতা ও একাকীত্ব, এ-দুটি হল অভিন্নরূপ যমজ অভিধা । তাদের পরস্পরকে পালটাপালটি করার ক্ষমতা রাখে ফ্লনিয়র কবি । যে মানুষ তার একাকীত্বকে জনতাপূর্ণ করতে অক্ষম, সে গাদাগাদি ভিড়েও একা থাকতে অক্ষম । আসলে ফ্লনিয়র তো সেই রাজপুত্র যে পোশাক পালটে প্রজাদের কেন্দ্রস্হলে গোপনে প্রবেশ করেছে ; এই রাজসিক নামহীনতা, বদল্যারের মতে, ফ্লনিয়র-কবির কাছে স্পষ্ট করে মেলে ধরছে মহানাগরিক পরিসরের মর্মার্থ । সতত অপসৃয়মান ওই প্রবাহের অন্তস্হলে যে অনন্তকাল তাকে টের পান কেবল একজন ফ্লনিয়র-কবি ।
    জীবদ্দশায় বদল্যার স্বীকৃতি পাননি, তাঁর কবিতা প্রকাশ করার আগ্রহ দেখাতেন না পত্রিকা-সম্পাদকরা, তাঁর বন্ধুবান্ধব বিশেষ ছিল না, বন্ধুনিরা তাঁকে এড়িয়ে যেতেন, চাকরি-বাকরি ছিল না, অন্যের দানের ওপর নির্ভর করতে হত তাঁকে, উদ্যমের পরিবর্তে যন্ত্রণা ভুগতে ছিলেন আগ্রহী, সংসার বলতে যা বোঝায় তা তাঁর ছিল না , থাকতেন একটি ভাড়ার বাসায়, ছিলেন মহানগরের পথচর, তাঁর কবিতায় চলে আসে জঞ্জালকুড়ুনিয়া আর ভিখারি। একাকীত্বের সেই জীবনযাত্রায় বদল্যার একা-একা পথে-পথে হাঁটতেন,নিরাময়ের উপায় হিসেবে । প্রায় মিলে যায় জীবনানন্দ দাশ ও ফালগুনী রায়ের জীবনের সঙ্গে । জীবনানন্দের থেকে পার্থক্য এই যে বদল্যার ও ফালগুনী রায় দুজনেই ছিলেন হ্যাশিশের ভক্ত ।
    ওয়াল্টার বেনিয়ামিন সর্বপ্রথম বদল্যারের ফ্লনিয়র ভাবকল্পটি পুঁজিবাদের উন্মেষের প্রেক্ষিতে একটি সর্বৈব ‘মহানাগরিক অভিজ্ঞতা’ হিসেবে বিশ্লেষণ করার পুর্বে আরও অনেকে চর্চা করেছিলেন বিষয়টি । স্যঁৎ ব্যোভ বলেছিলেন যে ভাবকল্পটিকে ‘কোনও কিছু না করার’ সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ভুল হবে । বালজাক বলেছিলেন, ফ্লনিয়র লোকটির কাজ হল ‘চোখের মাধ্যমে ভুরিভোজ’। অ্যানাইস বাজিন বলেছিলেন যে ‘প্যারিসের সার্বভৌম কর্তা হল ফ্লনিয়র’। ভিকটর ফুরনেল বলেছিলেন, ‘ফ্লনিয়র লোকটির কাজের সঙ্গে আলস্যের কোনো সম্পর্ক নেই ; তার কাজটি হল বিশেষ এক ধরনের আর্ট বা শিল্প কেননা সে মহানগরের ঐশ্বর্যময় ভূদৃশ্যের বৈভিন্ন্যেকে বোঝার ক্ষমতা রাখে।’ যাঁরা তাঁদের জীবন মহানগরের বাইরে গ্রামঞ্চলে বা উপনগরে কাটিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে ভিড়ে গাদাগাদি রাজপথে হাঁটার এই মেট্রপলিটান অভিজ্ঞতার বিষয়টি ঠাহর করতে অসুবিধা হবে।
    ওয়াল্টার বেনিয়ামিনের বদল্যার বিশ্লেষণ বদল্যারকে উপস্হাপন করেছে আধুনিকতা ও আধুনিকতাবাদ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ও উপলব্ধির সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিপ্রেক্ষিতে । বেনিয়ামিন মানতে চাননি যে বদল্যার ছিলেন রোমান্টিক স্বপ্নময় জগতের লিরিক কবি । তিনি বলেছেন যে বদল্যার এমনই একজন আধুনিক কবি যিনি ১৮৫০ এর দশকের পর উদ্ভূত মহানাগরিক পণ্য পুঁজিবাদের হাঙরদাঁতের মাঝে ফেঁসে গিয়ে জীবন-মৃত্যুর লড়াই লড়ছেন ; তাঁর কবিতা ও গদ্য থেকে যে বদল্যার আমাদের সামনে আসেন তিনি একজন ফ্লনিয়র, যিনি বাণিজ্যে ভাসমান প্যারিস মহানগরের রাস্তায়-রাস্তায় পদচারণা করতে-করতে তুলে নিচ্ছেন একের পর এক চলমান ছবি; তিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্হার জঞ্জাল-কুড়ুনিয়া , যিনি কবিতায় পালটে ফেলার জন্য জড়ো করে চলেছেন শহুরে সংঘর্ষে উৎপন্ন সামাজিক জঞ্জালের নুড়িপাথর ; বদল্যার একজন আধুনিক নায়ক যিনি আধুনিক মহানাগরিক জীবনের পরস্পরবিরোধিতা ও অসম্ভাব্যতার জাঁতাকলে আত্মসমর্পণ করে সেই দুর্ভোগকে দিয়েছেন কাব্যিক অনুভববেদ্যতা । তিনিই প্রথম আধুনিক কবি-শিল্পী যিনি নিজের সৃজনকর্মকে একটি ব্র্যাণ্ড দিতে চেয়েছেন যাতে তা সাহিত্যিক পণ্যতোরণ শোভিত পথের দুধারের রঙিন শোকেসের উপযুক্ত হয়ে ওঠে ।
    বদল্যার বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন যে মহানাগরিক আধুনিকতার মসনদে তাঁর সাহিত্যকর্মকে কী ভাবে অধিষ্ঠিত করলে তা কালক্রমে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে । একজন ফ্লনিয়র হিসাবে তিনি বাজারে ঘুরলেন, বাজারে যে মালগুলো নামছে সেগুলো দেখলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি অপেক্ষা করলেন সেই ক্রেতাদের জন্যে যারা আধুনিকতার হাতে মার খেয়ে তাঁর কবিতা ও গদ্য তুলে নিতে আসবে । সে-অর্থে বদল্যার ছিলেন একজন সামাজিক কবি , বলেছেন বেনিয়ামিন।
    ১৮৫০ এবং ১৮৬০-র দশকে লেখা তাঁর কবিতা ও গদ্যে বদল্যার বর্ণনা করেছেন মহানগরের পথে-পথে হেঁটে বেড়ানোর উত্তেজক অ্যাডভেঞ্চারগুলো, যা যে-কোনও নাটকের চেয়ে বেশি নাটুকে, যে-কোনও গ্রন্হে আলোচিত আইডিয়ার চেয়ে গভীর ও চিন্তা-উদ্রেককারী । ফ্লনিয়রের সঙ্গে অন্যান্য পথচারীর পার্থক্য হল যে অন্যেরা, তারা অলস পায়ে হাঁটলেও, কোনো একটা কাজে বেরিয়েছে, তাদের হাঁটার উদ্দেশ্য আছে, তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে, যে পথে তারা হাঁটবে তা পূর্ব-নির্ধারিত, যে পথে ফিরবে হয়তো তাও পূর্ব-নির্ধারিত । ফ্লনিয়র কোথাও যাবার জন্য হাঁটছে না, তার কোনো গন্তব্য নেই, উদ্দেশ্য নেই, কেনাকাটা করার নেই । পুঁজিবাদী সমাজের দুটি প্রধান অনুজ্ঞাকে সে অবহেলা ও অস্বীকার করছে : প্রথমত তার তাড়া নেই, এবং দ্বিতীয়ত তার কিছু কেনার নেই, এমনকী সে দরদস্তুরেরও প্রয়োজন বোধ করে না । বদল্যারের ফ্লনিয়র ভাবকল্পটিকে আদর্শে রুপান্তরিত করে কোনো-কোনো অনুজ কবি কাছিমের গলায় বাহারি ফিতে বেঁধে প্যারিসের বাজারে হাঁটতে বেরোতেন , যখন কিনা ব্যস্ত লোকেরা কুকুরের বেল্ট ধরে কুকুরের পেছন-পেছন দৌড়োতেন ।
    ভিড়ের দরুন ফ্লনিয়র বিরক্ত হয় না ; জনসমুদায়কে চলার পথে বাধা মনে করে না সে । জনসমুদায়ের মাঝে সে নিজেকে চুপচাপ খুলে ধরতে পারে যাতে সে আশপাশের সবকিছু সেই খোলা হাঁ-মুখে ফেলে-ফেলে কবিতার জন্য সঞ্চয় করতে পারে । ছবি আঁকার জন্য সঞ্চয় করতে পারে । জনসমুদায়ই তার ন্যারেটিভের উৎস । বদল্যারের সমসাময়িক সাহিত্যিকরা আগ্রহান্বিত ছিলেন ধ্রুপদি শিল্পবস্তুর সৌন্দর্যে । বদল্যার আগ্রহান্বিত হলেন পথে-পথে পাওয়া জীবনযাত্রার আধুনিকতায় । মহানগর যেমন নিজের প্রতি আকর্ষন করে অজস্র মানুষকে, কিন্তু এমনই তার আত্মবিরোধিতা যে একজন ব্যক্তিএককের সঙ্গে আরেকজনের অমিল ঘটাতে ওস্তাদ । ‘অমিল’ হল আধুনিকতাবাদের মহানাগরিক বীজ । অসম্ভব হলেও ফ্লনিয়র ফিরে পেতে চায় মিলগুলোকে, ফিরে পেতে চায় গোষ্ঠীসমাজের সংবেদনকে, যাকে বদল্যার
    বলেছিলেন, “বাড়ির বাইরে গিয়েও নিজের চারিধারে বাড়ি গড়ে নেওয়া” । স্বাধীন ও নামহীন ফ্লনিয়র, এর দরুন, ঘটনার সঙ্গে আত্মতা গড়ে নিয়ে আহত, বিষণ্ণ, দুঃখিত, ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে, এমনকী দর্শকরূপে একতরফা প্রেমেও পড়তে পারে । যে বস্তু বা যাদের বদল্যার দেখছেন-শুনছেন তা তাঁর কাছে টেক্সটরূপে দেখা দিচ্ছে । নিজের চতুর্দিক থেকে সূক্ষ্ম অনুসন্ধান-সূত্র এবং ইশারা সংগ্রহ করেছেন বদল্যার, যা সাধারণ পথচারীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে । ভিড়ের অংশ হয়ে, যে ভিড় ছেয়ে ফেলেছে রাস্তার দুধার, ফ্লনিয়র তার টেক্সটে দৈহিকভাবে উপস্হিত । শীতল ও কৌতুহলী চাউনি মেলে, ক্ষণকালীন ও একান্ত দূরত্ব বজায় রেখে, পরিবর্তনরত প্রদর্শনীর মিছিলকে অবিরাম অধ্যয়ন করতে থাকে ফ্লনিয়র । তার অস্তিত্বে রয়েছে সক্রিয় বুদ্ধিপ্রক্রিয়া । এই নবতর সাহিত্যিক পরিকল্পনার জনক হিসাবে, সে, চাউনি ফেলে ফেলে নির্মিত সংস্কৃতির সন্দর্ভ-নির্মাতা ; ফলে সে একযোগে হয়ে ওঠে প্রট্যাগনিস্ট ও দর্শক । ভিড়ের কোনো ব্যক্তির সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক নেই, অথচ যা বা যাকে সে দেখছে তার সঙ্গে সে গড়ে তোলে,সাময়িক হলেও, তার সত্তায় লীন হবার মতন গভীর ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ।
    ওয়াল্টার বেনিয়ামিন বলেছেন, ফ্লনিয়র নিজেকে খেলানোর জন্যে ছেড়ে দেয়, অন্যের সত্তায় লীন হবার মাদক প্রক্রিয়ায় । সে একযোগে উপভোগ করে স্বকীয় আত্মতা এবং ‘আরেকজন’ হয়ে ওঠার মজা, যেন সে দেহের খোঁজে চরে বেড়ানো একটি আত্মা । সে যথেচ্ছ অন্যের দেহে প্রবেশ করে যায় । তার বুদ্ধিবৃত্তির খাবারের খোঁজে সে যেন ভিড়ের দেহে একটি পরভুক প্রাণী। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে নিজেরই তৈরি করা আশ্চর্যনগরীতে, কখনও এই বিপণি-জানালায়, কখনও সেই বিজ্ঞাপনের দিকে, কখনও ওই ভবঘুরের দিকে , কখনও সেই নারীটির দিকে, তাকিয়ে-তাকিয়ে ,তাদের শরীরে পরজীবি হয়ে জীবনরস সংগ্রহের আনন্দ উপভোগ করে । সে নিজেই নিজের চিন্তার আদল নিয়ে চারিদিকের বস্তুজগতে চষে বেড়ায়, হাঁটতে থাকে সাধনা-তাড়িতের একাগ্রতায়, পর্যবেক্ষণের সতর্কতায় । প্রকৃতপক্ষে তার রয়েছে পর্যবেক্ষণের বৌদ্ধিক কর্মতাড়না । অথচ তার আছে সত্তাস্বাতন্ত্র্য । ফ্লনিয়র নিজেই নিজের চেতনাশক্তি । বদল্যার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন মহানগরের আধুনিক দর্শকের, মহানগরগুলোয় সে অপরিহার্য চরিত্র, একজন অ্যামেচার ডিটেকটিভ বা শহরের তদন্তকারী ।
    বদল্যারের ফ্ল্যানেরি ক্রিয়া ও ফ্লনিয়র কবিসত্তা ভাবকল্পটির বিশ্লেষণ, তাঁর আলোচকদের মতে, অসম্পূর্ণ থেকে যায় তাঁর ‘ক্লেদজ কুসুম’ গ্রন্হের ‘ট্যাবলো প্যারিসিয়েন’ এর অন্তর্গত ‘পাশ দিয়ে যাওয়া পথচারিণী’ কবিতাটির উল্লেখ ব্যতিরেকে ( A une passante ) । ফ্লনিয়রের প্যাশনকে উপস্হাপনের একটি নিখুঁত দৃষ্টান্ত এই কবিতাটি । ফ্লনিয়রের ভূমিকায় অবতীর্ণ বদল্যার যাঁকে উদ্দেশ করে কবিতাটি লিখছেন, তাঁর পোশাক দেখে তিনি অনুমান করছেন যে যুবতীটি বিধবা ; যুবতীটি এক মুহূর্তের জন্য তাঁর চোখের সামনে আসেন আর অপসৃয়মান ভিড়ে মিশে যান । ওই মুহূর্তটি গড়ে তোলে অনন্তকাল । প্যারিসের মতন বিশাল শহরে একজনকে দেখার সুযোগ বারবার ঘটার সম্ভাবনা কম । যুবতীটির চকিত চাউনির সঙ্গে কবির চাউনির আদানপ্রদানে লুকিয়ে থাকে ক্ষণস্হায়ীত্বের অনন্তকালীন উপাদান । সেই উপাদান দর্শককে মৃত্যুর হুঁশিয়ারি দেয় এবং জীবন সম্পর্কে মুগ্ধতার ইশারাও দিয়ে যায় । যুবতীটিকে দেখে কবির অস্তিত্বে প্রেমের আভাস সৃষ্টি হয়, সে প্রেম ‘প্রথম দর্শনে প্রেম’ নয়, সে প্রেম ‘শেষ দর্শনে প্রেম’ ।
    কবিতাটিতে ওই বিধবা যুবতীটি পথচারী ব্যক্তি-এককদের দ্বারা নির্মিত জনসমুদায়ের কথা ঝলকের জন্য কবিকে জানিয়ে উধাও হয়ে যায়। যুবতীটি পূর্বাভাসদায়ক সম্ভাবনা ও কার্যকরিতার প্রতিমূর্তি হয়ে দেখা দেয় কবির জীবনে --- আশ্চর্য নয় যে সেগুলো ভবিষ্যমুখী বৈশিষ্ট্য ; অর্থাৎ কবির জন্যে ওই অচেনা মহিলা তাঁর সৃজনকর্মের সাধিত্র । অন্য যে কোনও প্রেরণাসুত্রের প্রতি তাঁর যে আকর্ষণ সেই একই প্রেরণাসূত্র কবি পেয়ে যান যুবতীটির ক্ষণিক ঝলকে । লক্ষ্য করলে দেখা যাবে , এই সনেটটি ফ্লনিয়রের বহুবিধ বিচার্য বিষয়কে মেলে ধরছে । প্রথমত, শহরের পশ্চাতপটে কান ঝালাপালা-করা আওয়াজ, যা ভিড়ের ভেতরে অকস্মাত চয়নিত বিষয়বস্তুর সঙ্গে কবির সম্পর্ককে ক্ষণিক ও আচমকা করেই শেষ হয় না ; দ্বিতীয়ত, ফ্লনিয়রের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া যুবতীটির সঙ্গে প্রা্য় ভ্যামপায়ারের আদলে জীবনরস ছেঁচে তোলার সম্পর্ক গড়ে ফেলেন কবি ; যুবতীটির চোখ তাঁর কাছে পানপাত্র । ফ্লনিয়র উন্মাদের মতন কাঁপে, রোমাঞ্চিত হয় । তৃতীয়ত, তাঁদের দুজনের সম্পর্ক, যা হয়তো গড়ে উঠতে পারতো, সেই সম্ভাবনা যাচাই করার সুযোগ ঘটে না । পারস্পরিক চাউনি-বদল দুজন মানুষের অস্তিত্বে নৈকট্যের অনুভূমিক মুহূর্ত তৈরি করে দেয় ; চাউনি হয়ে ওঠে , ফ্লনিয়রের কাছে, এমনই এক কাল্পনিক সাধিত্র, যার সাহায্যে কবি ওই মেয়েটির শোক দুঃখ কষ্ট ও অন্যান্য ঝড়ঝাপটের অভিজ্ঞতা নিজে অনুভব করতে পারেন , একদা বাংলায় যাকে বলা হতো “হৃদয় দিয়ে হৃদয় অনুভব” করার শক্তি । চতুর্থত, সতত অপসৃয়মান নৈর্বক্তিক রাস্তা ফ্লনিয়রকে দিচ্ছে ব্যক্তিক হাল-হকিকত অনুমানের দক্ষতা । কবিতাটি অনেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন । আমি এখানে ১৯৫২ সালে রয় ক্যাম্পবেল কৃত অনুবাদটি তুলে দিচ্ছি :

    The deafening street roared on. Full, slim, and grand
    In mourning and majestic grief, passed down
    A woman, lifting with a stately hand
    And swaying the black borders of her gown ;

    Noble and swift, her leg with statue’s matching,
    I drank, convulsed, out of her pensive eye
    A livid sky where hurricanes were hatching,
    Sweetness that charms, and joy that makes one die.

    A lightning flash --- then darkness ! Fleeting chance
    Whose look was my rebirth --- a single glance !
    Through endless time shall I not meet with you ?

    Far off ! too late ! or never ! --- I not knowing
    Who you may be, nor you where I am going ---
    You, whom I might have loved, who know it too.
    ( রচনাকাল: ফেব্রুয়ারি-মার্চ, ২০১৩ )
  • Steven Belletto | 012312.60.90023.32 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১২:২৬541370
  • The Beat Generation Meets the Hungry Generation: U.S.—Calcutta Networks and the 1960s “Revolt of the Personal”
    Steven Belletto
    Department of English, Lafayette College, Easton, PA 18042, USA

    Abstract: This essay explores the relationship between the U.S.-based Beat literary movement and the Hungry Generation literary movement centered in and around Calcutta, India, in the early 1960s. It discusses a trip Allen Ginsberg and Peter Orlovsky took to India in 1962, where they met writers associated with the Hungry Generation. It further explains how Lawrence Ferlinghetti, owner of City Lights Books in San Francisco, was inspired to start a new literary magazine, City Lights Journal, by Ginsberg’s letters from India, which included work by Hungry Generation writers. The essay shows how City Lights Journal packaged the Hungry Generation writers as the Indian wing of the Beat movement, and focuses in particular on the work of Malay Roy Choudhury, the founder of the Hungry Generation who had been prosecuted for obscenity for his poem “Stark Electric Jesus”. The essay emphasizes in particular the close relationship between aesthetics and politics in Hungry Generation writing, and suggests that Ginsberg’s own mid-1960s turn to political activism via the imagination is reminiscent of strategies employed by Hungry Generation writers.

    Keywords:
    Beat Generation; Hungry Generation; Hungryalists; Allen Ginsberg; Malay Roy Choudhury; Beats in India; transnational Beats; international Beat movement; Beat politics; City Lights Journal; “Stark Electric Jesus”; “Wichita Vortex Sutra”

    In March 1962, Allen Ginsberg and Peter Orlovsky arrived in India, where they would live for the next fourteen months. Students of Beat literature have long noted that during this time they met up with fellow poets Gary Snyder and Joanne Kyger, and that together they immersed themselves in the local religious and literary cultures. Partly because all four writers kept journals of the period that have since been published, readers have tended to characterize their own interactions as among the more significant of the trip.1 While there is a wealth of material to be mined in this regard—not the least of which is their meeting with the Dalai Lama, during which Ginsberg brought up the consciousness-expanding potential of LSD—other important connections were forged that tell differing stories about the international reach of the Beat movement. Indeed, as Ginsberg and Orlovsky traveled on without Snyder and Kyger, they met a host of writers, artists, and holy men in Banaras, Calcutta and beyond; as Orlovsky wrote to their old friend Lucien Carr: “Main thing we do in Calcutta is meat [sic] Bengale poets by the dozen”.2

    One such Bengali poet who caught Ginsberg’s interest was Malay Roy Choudhury, also a playwright and essayist who had distinguished himself by founding a literary movement he called the Hungry Generation or the Hungryalists, a group of young writers and artists centered in and around Calcutta who were united in their pugnaciously antiestablishment attitudes and in their drive to reinvigorate what they took to be the tired, academic modes of traditional Bengali arts and letters. Late in 1962, in one of his long, detailed letters to Lawrence Ferlinghetti, owner of City Lights Books and publisher of Howl and Other Poems (1956), Ginsberg turned particularly rhapsodic about his latest exploits, and folded in a copy of “The Hungryalist Manifesto on Poetry,” a broadside by Choudhury filled with audacious pronouncements about poetry and culture. Ferlinghetti was impressed enough by Ginsberg’s letter and the suggestive energies of the Hungryalist Manifesto that he was inspired to start a new little magazine intended to showcase the contemporary international avant-garde, including the Hungryalists. As he replied to Ginsberg: “I have just been prodded by your India descriptions to start another Journal and publish your description in it, along with anything else you send, and also publish that beautiful Weekly Manifesto of Hungry Generation of India which you enclosed in letter.”3 This exchange was the germ of what would become City Lights Journal (first run: 1963–1966), the magazine that introduced Choudhury and the Hungry Generation to Western readers, but did so by suggesting their contributions to international letters were broadly comparable to what the Beats had achieved in the States.4

    The Hungry Generation’s association with the Beats was a boon insofar as Ginsberg was already an internationally recognized writer, and ever the astute marketer, he was able to package the Hungryalists as something like the Indian wing of a global Beat phenomenon. In those early days, Choudhury also tended to play up his connection to Ginsberg and the Beats, at least when describing the Hungry Generation to non-Indian readers. In 1963, for example, Choudhury wrote a dispatch from India for El Corno Emplumado, Margaret Randall and Sergio Mondragon’s bilingual arts journal published out of Mexico City, and described the situation like this: “We have started a literary rebellion here calling ourselves HUNGRYALISTS, mainly fighting for a change, along with some crazy conceptions. Allen Ginsberg, who came to India and stayed with us for about a year or more (he was in my house for a few days and wrote some beautiful poems in this very room where I am now sitting and writing this letter to you), introduced us to his fellow Beats by reprinting and publishing our Manifestoes and poems etc. in U.S. journals.”5 Choudhury has in mind Ferlinghetti’s City Lights Journal (No. 1 [1963]; No. 2 [1964]; No. 3 [1966]), which, thanks to Ginsberg’s efforts, was the first to print English translations of Hungry Generation manifestos and poetry, a move that at once announced them to the West and cemented Beatdom’s international bona fides. Taking the link between Ginsberg and Choudhury as a starting point, this essay explores the Beat–Hungryalist connections via City Lights Journal, which introduced the Hungry Generation to Anglophone audiences by framing it as an extension of the Beat movement. This framing suggested the internationalist cast of contemporary Beat writing while simultaneously conferring hip or underground legitimacy on the Hungryalists through their supposed association with the Beats. Given this scope, I will not wade very deeply into the intricacies of Bengali poetry or the factional rivalries on the local Calcutta literary scene—which would of course be required to more fully understand the poetic and aesthetic interventions of the Hungryalists—but will instead investigate the version of the Hungry Generation presented in English in City Lights Journal and other venues such as the “Hungry!” issue of Salted Feathers (1967), edited by Dick Bakken (Bakken 1967), and the “Poetry of India” issue of Intrepid (1968), guest edited by Carl Weissner (Weissner 1968a).

    There is a paucity of critical work on the Hungryalists available in English, but that which does exist tends to cast their importance in terms of rebellion and iconoclasm.6 In his introduction to the 1968 issue of Intrepid he guest edited, for example, German writer and Beat associate Carl Weissner announced that the Hungryalists “have established themselves as the largest & most remarkable avantgarde element in the country.”7 More recently, Aditya Misra has called the Hungry Generation “the first avant-garde uprising against modern Bengali poetry which believed in giving the decaying Indian civilization a mortal blow,” and Bhaswati Bhattacharya underscores that the movement’s “goal” was “to examine the extent to which it could subvert the existing literary and social norms.”8 Reflecting on her interviews with Samir Roy Choudhury, Malay Roy Choudhury’s elder brother and original Hungryalist, Maitreyee B. Chowdhury argues that the movement

    gave a new vocabulary to Bengali literature, taught new reading habits and made the stench of the road, among other such ‘un-poetic’ things, poetic … the movement became an expression for those frustrated with the culture and ethics of those times … the Hungryalists perhaps spoke for an entire city affected by post-Partition poverty politics. New conversations and a new language became the need of the day—a language that would cast aside elitist aspirations and speak of angst, instead.9

    This critical language of subversion and newness, of anti-civilization stances and “post-Partition poverty politics,” suggests the degree to which the Hungry Generation was a literary, social, and political movement rolled into one, and as such was characterized by uncertain distinctions between aesthetic interventions and political statements. As Weissner put it in 1968, “the HG poets, most of them anyway, are as much political agitators as they are poetic discoverers.”10

    In later years, in fact, Malay Roy Choudhury pinpointed the genesis of the movement not to the writing or publication of a poem, but to the manifesto about poetry Ferlinghetti would eventually print in City Lights Journal: “The Hungry Generation literary movement was launched by me in November 1961 with the publication of a manifesto on poetry in English.”11 According to Choudhury, then, the Hungryalists were “launched” into public visibility via their manifestos, which were printed on broadsides and distributed throughout Calcutta and Patna. Indeed, although Choudhury is widely credited as the founder of the Hungryalists, it was a pointedly social and communal enterprise, and he accordingly insisted that it is recognizable as a “generation” or movement because it sprang not from him alone, but from a coterie of four poets: the Choudhury brothers, Debi Rai, and Shakti Chattopadhyay. There were many other writers and artists who came to be associated with the Hungry Generation, and while I do touch on some in the course of this essay, I’ll concentrate primarily on Choudhury and others who were most visible in the States.

    In connection with their poetry and manifestos, the Hungryalists became notorious in Calcutta in the early 1960s for their public acts of protest. As one later observer explains, for example, “the poets started a campaign to personally deliver paper masks of jokers, monsters, gods, cartoon characters and animals to Bengali politicians, bureaucrats, newspaper editors and other powerful people. The slogan was, ‘Please remove your mask.’”12 Such antics became increasingly irritating to municipal authorities, and tensions came to a head on 2 September 1964, when eleven writers who had appeared in a Bengali-language book titled Hungry Generation were arrested and charged with “criminal conspiracy to bring out the aforesaid obscene publication,” which, the complaint read, would “corrupt the minds of the common reader.”13 Malay Roy Choudhury, Samir Roy Choudhury, and Debi Rai were among the eleven arrested; Shakti Chattopadhyay, the fourth original Hungryalist, had also published in Hungry Generation, but had managed to avoid arrest by agreeing to testify against Malay Roy Choudhury at his obscenity trial. Chattopadhyay claimed that despite his appearance in Hungry Generation, “I had no relationship with so called Hungry Generation and this book was not published by me.” He went on to allege that Choudhury’s writing in particular represented “mental pervertion [sic] and [the] language is vulgar,” and then “strongly condemned” Choudhury’s contribution to Hungry Generation, a febrile, sexually-explicit poem called “Prachanda Baidyutik Chhutar” or “Stark Electric Jesus.”14 Eventually, the charges against the ten other writers were dropped, but Choudhury, as reputed founder of the Hungryalists, was forced to stand trial for obscenity.

    The ensuing trial is broadly analogous to an earlier moment in Beat history, when in 1957 Ferlinghetti and bookseller Shig Murao were charged with obscenity for distributing Howl and Other Poems.15 Although “Howl” was finally determined to have literary merit, “Stark Electric Jesus” was found obscene and Choudhury was fined roughly two months’ salary, fired from his civil service job, and the poem was banned and extant copies ordered destroyed.16 The immediate, material aftermath of the decision was thus dire for Choudhury, but as the “Howl” trial did for Ginsberg, the public battle over “Stark Electric Jesus” propelled him into a new realm of renown because he came to epitomize the right to free expression in the face of government censorship. In rendering his verdict, A.K. Mitra, Presidency Magistrate of the 9th Court of Calcutta, concluded that “Stark Electric Jesus” was “per se obscene” as “it starts with restless impatience of sensuous man for a woman obsessed with uncontrollable urge for sexual intercourse followed by a description of vagina, uterus, clitoris, seminal fluid, and other parts of the female body and organ, boasting of the man’s innate impulse and conscious skill as how to enjoy a woman, blaspheming God and profaning parents accusing them of homosexuality and masturbation, debasing all that is noble and beautiful in human love and relationship.”17 Choudhury’s trial became a minor cause célèbre in avant-garde circles in India, the States, and beyond, and thus stands as perhaps the landmark moment in the history of the Hungry Generation, even as Chattopadhyay’s testimony against Choudhury symbolized the dissolution of the original coterie.18

    After Choudhury’s arrest, he and the Hungryalists became the latest example of writers and publishers around the world who had been subject to legal action by backward-looking authorities, and Choudhury received letters of support from a wide spectrum of fellow writers, from Daisy Aldan (editor of the poetry magazines Folder and New Folder) and poet Carol Bergé in New York to Margaret Randall and Octavio Paz in Mexico City; Paz had in fact met some of the Hungryalists while visiting Calcutta and been suitably impressed.19 However, while Choudhury’s obscenity trial served as a rallying-point for sympathetic writers, even prior to this event the Hungry Generation was being characterized as part of an international avant-garde, thanks in no small part to Ginsberg and Ferlinghetti’s efforts.

    In the first issue of City Lights Journal, Ferlinghetti’s headnote described it as “a new international annual,” and he announced in the second that its content “circles the world.”20 However much the journal favored eclecticism under the banner of the avant-garde, it was also not above framing these international writers in terms of Ferlinghetti’s favored literary provocateurs, the Beats. The inaugural issue, for example, began not with Indian writing, but with Ginsberg’s and Snyder’s writing about traveling through India. The cover even featured a photograph of Ginsberg somewhere in the “Central Himalayas,” wrapped in a blanket and staring frankly at the camera, his hair whipped up in the wind. Readers were presented, in other words, with the celebrated Beat poet in his newly adopted environment, the implication being that while he may have been broadening his worldview through travel, his mere presence also served to confer legitimacy on the region and its writers.
    As he had promised to Ginsberg, Ferlinghetti printed “fragments of letters from … Allen Ginsberg In India” in the first issue of his new journal. The excerpts he selected emphasize the correspondences among what Ginsberg was witnessing in India and his sense of the American underground: “the common saddhu scene here is, feels like, just about the same as beat scene in US—amazing to see the underlying universality of people’s scenes.”21 Elsewhere Ginsberg describes a moment when “drunken saddhus came up—just like mill valley [California] scene” (p. 8), and claims that “all the hip rituals in US involving pot have been developed and institutionalized here” (p. 8). Thus as he draws attention to what he takes to be the more exotic aspects of his Indian experience, Ginsberg also insists on the “universality” of subterraneans the world over. He even calls saddhus “nothing but a bunch of gentle homeless on-the-road teaheads” (p. 8), drawing a direct line from Hindu holy men to the most famous novel of the Beat movement. (Following Ginsberg’s letters is Gary Snyder’s “A Journey to Rishikesh & Hardwara,” a more conventional piece of travel writing that describes yoga and meditation in various ashrams Snyder visited with Ginsberg, Orlovsky, and Kyger.22)
    It is only after these depictions of India through the eyes of sympathetic Westerners does Ferlinghetti present an example of Indian writing, the manifesto that had inspired him to create a new magazine in the first place. Previously published in Calcutta as a broadside signed by some 25 poets and “written and translated from Bengali” by Malay Roy Choudhury, the version in City Lights Journal accentuates the idea of a literary “Generation” by presenting a kind of poetic board of directors:

    Editor: Debi Rai     Leader: Shakti Chattopadhyay
        Creator: Malay Roy Choudhury
          Howrah, India23

    Framed as it is by the impressions of India from Ginsberg and Snyder, including Ginsberg’s mention of hanging out with Shakti Chattopadhyay “of enclosed manifest” (p. 7), readers of City Lights Journal could be forgiven for interpreting this manifesto as an Indian counterpart to well-known Beat manifestos such as Jack Kerouac’s “Belief & Technique in Modern Prose” or “Essentials of Spontaneous Prose,” both of which originally circulated in the little magazines Black Mountain Review and Evergreen Review, respectively. The Hungry Generation manifesto announces that traditional Bengali poetry is “cryptic, short-hand, … flattered by own sensitivity like a public school prodigy,” and that, by contrast, the Hungryalists have “discarded the blankety-blank school of modern poetry, the darling of the press, where poetry does not resurrect itself in an orgasmic flow, but words come bubbling in an artificial muddle” (p. 24). According to such a view, something called “the Hungry Generation” is best clarified in terms of opposition: there is a “blankety-blank school of modern poetry,” underwritten by the media—and, presumably, the academy—that is stuck merely regurgitating tradition. In the context of City Lights Journal, the details of this tradition are less important than the claim that it is outmoded and “artificial”: what matters is that the Hungryalists stand opposed to whatever is the dominant strand in Bengali letters. Indeed, in other versions of the manifesto, Choudhury insists that Hungry Generation writing seeks to “convey the brutal sound of breaking values and startling tremors of the rebellious soul of the artist himself, with words stripped of their usual meanings and used contrapuntally. It must invent a new language, which would incorporate everything at once, speak to all senses in one.”24 The shattering of values, the embracing of rebellion, the restless search for “new language”; these are the features of the Hungry Generation that would likewise be recognizable to readers of Beat literature, thus providing a familiar template for seeing Calcutta as the latest outpost in a worldwide literary movement.

    Like a teaser trailer for coming attractions, the manifesto announces a new generation of Indian poets but is not accompanied by the work itself, and readers of City Lights Journal would have to wait until the next issue (1964) to encounter actual poetry by these writers, in a special section called “A Few Bengali Poets.” As in the first issue, these poets are framed by and filtered through Ginsberg’s perspective insofar as he contributed a prefatory statement explaining why the Journal’s readers should care about these Bengali poets. First, he establishes a familiar binary between staid traditional poetry and the freshness and immediacy of the selected poets. Reminiscent of the ways Donald Allen’s influential anthology The New American Poetry (1960) had positioned the Beats and other writers of the “new poetry” as sharing “a total rejection of all those qualities typical of academic verse,” Ginsberg sets the Hungryalists against their national and local traditions.25 As T.S. Eliot came to embody for many Beats the “closed form” of American academic poetry, Ginsberg figures Rabindranath Tagore, Calcutta’s Nobel Prize-winning poet and literary giant, as the elder icon to be smashed: “As a modern literary kelson he seems to be a big bore; that is to say early XX century academic preoccupations in the poetic field are so dominated by Tagore festivals, speeches, recitations, criticisms that his work has become institutional and apparently of little use … to the young.”26 Against this “academic” Tagore monolith, Ginsberg identifies another strand of Bengali poetry associated with “‘the modern spirit’—bitterness, self-doubt, sex, street diction, personal confession, frankness, Calcutta beggars etc.” (p. 117). Substitute “American hobos” for “Calcutta beggars” and this list would be a fair approximation of much Beat poetry, at least in popular conception, and in Ginsberg’s telling, the first thing one need know about the Hungry Generation is that its writers attack tradition, that they are iconoclasts invested in remaking language just as he and his circle had done in the States. In fact, Ginsberg insists that the Bengali “poems are interesting in that they do reveal a temper that is international, i.e., the revolt of the personal. Warsaw Moscow San Francisco Calcutta, the discovery of feeling” (p. 118). Inasmuch as Ginsberg is gesturing toward the idea of an international avant-garde by facilitating the publication of Bengali poets in City Lights Journal, his particular framing also has a curiously leveling effect, such that the Hungryalists are elevated mainly via their association with the Beats, rendered significant as Indian brothers-in-arms in the “revolt of the personal.”

    Ginsberg’s notion of the “personal” does not merely signal intimate, confessional energies, but also underscores the importance of community, and the other thing he wants American readers to know is that the Bengali poets are “excellent drinking companions” (p. 117). Such a statement is not as flip as it may seem at first blush because what Ginsberg is really doing is implying that the Hungryalists can be viewed as part of an ever-expanding network of poets who comprise a global literary underground. In this regard, Jimmy Fazzino’s recent work on the “worlding” of Beat literature can help us understand Ginsberg’s thinking here. Fazzino borrows the concept of “networks” to describe the “expression[s] of felt solidarity and mutual understanding” that the American Beats shared with others outside national bounds, and in fact uses Ginsberg’s attraction to the Hungry Generation as his book’s opening anecdote.27 Although Fazzino does not pursue the relationship among the Beats and the Hungryalists beyond noting that both “would be censored … for their literary licentiousness and antinomian views,” he does claim that the relationship suggests that India was not for Ginsberg “timeless or unchanging or utterly exotic … but vital and dynamic” (p. 1). Fazzino’s work has been a useful corrective to the perception that Ginsberg and other Beats were facilely orientalist in their thinking, and demonstrates how the Beats could and did see international writers as progenitors of a literary avant-garde and fomenters of social and political dissent in the context of their own local and national cultures.

    For Ginsberg, emphasizing the social spaces he shared with the Hungryalists served both to advertise his own fluency with the local literary scene and to render this scene legible in terms of a diffuse, international Beat sensibility. He notes, for instance, that the Hungry Generation is a “big gang of friend poets [who meet] in an upstairs coffee-house across the tramcar-bookstall street from Calcutta University” (p. 118). These “friend poets” include the likes of Sunil Ganguly and Shakti Chattopadhyay; Malay Roy Choudhury, Ginsberg explains, “isn’t there with his friends, he lives in Patna way up the Ganges” and “sits upstairs in his room and writes manifestos for the ‘Hungry Generation’” (p. 119). As he did with his own circle of friends, Ginsberg construes a whole Generation from the social bonds of a small group, taking care to write himself and Orlovsky into this group, as when he describes a drinking session with the Hungryalists, during which they apparently begged Orlovsky to read and reread his irreverant poem “Morris.”28 Ginsberg in fact insists on his own role in bringing Hungry Generation poetry to Anglophone audiences: “The poems were translated into funny english by the poets themselves & I spent a day with a pencil reversing inversions of syntax & adding in railroad stations” (p. 118). Ginsberg, lodestar of the Beats, presents a Hungry Generation mediated by his own guiding hand: not only is he a drinking companion, but their editor, agent, and publisher, and so figures himself as the embodied link between otherwise far-flung literary movements.

    The poems that Ginsberg rendered into less “funny english” do seem to bear traces of the Beat sensibility; the particular work collected in City Lights Journal 2 is Sunil Gangopadhyay’s “Age Twenty Eight” and “Interruption”; Sarat Kumar Mukherjee’s “Toward Darkness” and “The Lion in a Zoo”; Sankar Chattopadhaya’s “Civilization Through Angry Eyes” and “Hateful Intimacy”; and Malay Roy Choudhury’s “Drunk Poem” and “Short-Story Manifesto” (in his preface, Ginsberg explains that Shakti Chattopadhyay, “perhaps the finest poet” of the Hungryalists, was nevertheless “not represented here because his poems are such elegant Bengali they’re too hard to translate”).29 From its title alone, Gangopadhyay’s “Age Twenty Eight” may remind Beat aficionados of Gregory Corso’s “I am 25”, a poem that announces his “love a madness” for the famously youthful poets Shelley, Chatterton, and Rimbaud, declaring: “I HATE OLD POETMEN!”30 Like Corso, Gangopadhyay asserts his love of language, but is by age 28 haunted by “dead friends” and surrounded by “married women,” suggesting that his coevals have passed into adulthood while he clings to the youthful idealism of the written word, piercing “a hornet’s nest with my pen.”31 Insofar as “Age Twenty Eight” rails against those friends who have chosen convention, retreating to their “new-bought bed sheet” and hiding “their faces in / domestic dryness” (p. 121), the poem amounts to a critique of bourgeois domesticity that would seem familiar to those white, middle-class Americans worried about the creeping conformity of the long 1950s. In fact, in an essay about the Hungry Generation by Debi Rai and others, the authors leveled similar observations that could have been torn from the pages of classic studies of American conformist culture like William Whyte’s The Organization Man (1956) or C. Wright Mills’ The Power Elite (1956): “Cultural patterns are crowded by a system of mass production and mass communication in which we all become like one another, speaking the same slang, wearing the same clothes, reading the same magazines. But instead of creating a sense of community, this only creates a crowd of faceless and anonymous men” (p. 169). Thus the “hidden … faces” of Gangopadhyay’s domesticated men resonate with the “faceless and anonymous men” against which the Hungry Generation statement positioned itself, underscoring that the oppositional structure described above was instrumental to both the poetry and prose manifestoes of the movement—or at least to the work chosen for inclusion in City Lights Journal.32
    The work by Gangopadhyay and others notwithstanding, it is clear that City Lights Journal was positioning Choudhury as the preeminent Hungry Generation writer even prior to the obscenity trial that would later solidify his countercultural legitimacy. Choudhury’s “Drunk Poem” may be read as a Hungryalist expression of what Steven Watson sees as a defining feature of Beat literature: “The artist’s consciousness is expanded through nonrational means: derangement of the senses, via drugs, dreams, hallucinatory states, and visions.”33 A note appended to “Drunk Poem” informs readers that it was “scribbled” after “taking a peg of ‘mamushi,’ … an interesting wine made with the help of snake venom” (p. 128), and the poem begins by hailing the reader then immediately deploying unusual word combinations that betoken a confused sensorium, perhaps akin to what happens in a state of drunkenness: “Ahoy!/Gymtwist spangles of shockboom music.”34 Choudhury approximates sense derangement with the kinetic energy of “gymtwist” paired with a visual noun (“spangles”) that is then connected to the auditory (“shockboom music”). These opening lines introduce readers to the poem’s basic method, to juxtapose that which is generally seen as dissimilar; as Choudhury asserted in another manifesto, “The Aims of the Hungry Generation Poets,” he wanted to “break the traditional association of words and to coin unconventional and heretofore unaccepted combinations of words.”35

    While “Drunk Poem” begins with the individuated body, it quickly links the body and its senses to larger political concerns:

    Supersonic bombers of totalitarian peace
          hiss inside the adult stew
          and the adults
    Sell their hipholes
          to social sadders
          for rhymeless chunks of Rupee $ £
    (p. 126)

    The oxymoronic phrase “bombers of totalitarian peace” figures the West as a neoimperial power residing inside “adults,” rather than vice versa. In other words, rather than depicting adulthood as mere resignation to bourgeois normality, as in “Age Twenty Eight,” Choudhury sees existence in the “adult stew” as being infected by Cold War imperatives that cannot be escaped, signaled in this case by “supersonic bombers” and elsewhere in the poem by “the deathskirts of U235” (p. 127), the uranium isotope used in the atomic bomb dropped on Hiroshima. And as attested by the rapid-fire catalogue of “Rupee $ £,” the autonomy of nation states is compromised by the reach of capitalism, so the differentiation of national currencies becomes irrelevant in a world in which even hipness is for sale. In a purposively disorienting poem, such lines suggest that the true object of attack is figurations of “civilization,” which Choudhury had declared treacherous in the opening sentence of “The Hungryalist Manifesto on Poetry”: “Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual hunger” (p. 24). “Drunk Poem” does not merely exemplify the speaker’s deranged senses, then, but does so to derange civilization itself by attacking markers of cultural, religious, and political authority, from “naked Shiva” to “bureaucracy” to the “Pax Romana upon the windmill” (pp. 126–27). If the poem represents an anti-civilizing maneuver, then these and other examples are stripped of their context and authority such that the only course of action is to drunkenly and violently tear down anything smelling of establishment and tradition; the poem concludes:

    Pardon the sinner
          but
    MURDER
           the criminal.
    (p. 128)

    “Drunk Poem” is a good representation of the outré, antiestablishment, anti-civilization pose that the Hungryalists cultivated, a pose that was codified in the States when they were presented with perhaps the greatest gift a countercultural movement could be given: withering coverage in the reliably conservative, middle-of-the-road Time magazine. In November 1964, two months after the obscenity charges were brought, Time claimed the Hungryalists as an upstart movement overly imitative of the Beats: “Born in 1962, with an inspirational assist from visiting U.S. Beatnik Allen Ginsberg, Calcutta’s Hungry Generation is a growing band of young Bengalis with tigers in their tanks. Somewhat unoriginally they insist that only in immediate physical pleasure do they find any meaning in life, and they blame modern society for their emptiness.”36 Unsurprisingly, Time collapses Ginsberg’s instrumentality in introducing the Hungryalists to Western readers with his inspiring their very existence, but the mere act of reporting on the “growing band” as a movement heightened their visibility in the States. The association with the Beats via Ginsberg was one that stuck, not merely because of Time, but also because of statements by Ginsberg, Choudhury, and the Indian press. In 1965, American scholar and poet Howard McCord, then at Washington State University, became interested in the Hungryalists and traveled to India to meet with Choudhury and others. That same year, he published an English edition of “Stark Electric Jesus” with the aim of raising money for Choudhury’s legal expenses, and his Afterword argues that however supportive Ginsberg was to the Hungryalists, it would be inaccurate to say he inspired them: “The Indian press believes to this day that the group’s origins can be traced to the 1962 Indian visit of Allen Ginsberg, Peter Orlovsky, and Gary and Jeanne [sic] Snyder. But however stimulating the visit of these American poets … I believe the movement is autochthonous and stems from the profound dislocation of Indian life.”37 The very fact that McCord felt obliged to claim the Hungryalists as autochthonous suggests how they had already become entangled with the Beats by 1965.

    The third issue of City Lights Journal (1966) again enacted such entanglements as its section on Indian poetry contained a single poem, “Stark Electric Jesus,” flanked by an expanded version of McCord’s Afterword titled “Note on the Hungry Generation,” and another seven-page statement by Debi Rai and others simply called “Hungry Generation.” By City Lights Journal 3, then, the “Few Bengali Poets” of issue two had been congealed into a “Generation,” so despite the protestations to the contrary, it was clear that these writers were being advertised in ways broadly comparable to the Beat Generation. Nevertheless, in his prefatory note, McCord again insists that the Hungryalists did not materialize as a group because of Ginsberg’s influence, but he does accede that “[t]here was little notice of the group in the West until 1963, when City Lights Journal No. 1 carried news of them.”38 He goes on to characterize the Hungry Generation’s importance in terms of their on-going refusals to be bullied by the authorities: “In spite of prosecution and harassment, Malay Roy [Choudhury] has published two more long poems, ‘Jakham,’ (The Wound), and ‘Aamar Amimangshita Shubha,’ and other members of the Hungry Generation have continued to irritate the authorities with their work” (p. 160). Thus, while insisting on the Hungry Generation’s distinction from the Beats, McCord relies on the Beats’ most visible feature, their rebuke of authority, to argue for their importance.

    McCord’s insistence that the Hungryalists are best seen in light of their antiestablishment posture is echoed in the other essay accompanying Choudhury’s poem. Like McCord, Rai and his co-authors contrast their efforts to what they call “The Establishment” while taking care to distinguish themselves from the Beats. The latter can be somewhat tricky as the authors rely on explicitly hip language to make their case, as when they open by declaring “Modern Bengali writing” is “a lump of academic bullshit” or when they claim a younger generation is “digging” Choudhury.39 Fans of “Howl” might hear shades of the memorable phrase “boatload of sensitive bullshit” or even of Moloch, Ginsberg’s catch-all embodiment of normative culture, in the Hungryalists’ attack on the “manicured robot hand of the Establishment” (p. 164).40 Even so, the authors go out of their way to distance themselves from the Beats:

    Hunger describes a state of existence from which all unessentials have been stripped, leaving it receptive to everything around it. Hunger is a state of waiting with pain. To be hungry is to be at the bottom of your personality, looking up to be existential in the Kierkegaard, rather than the Jean-Paul Sartre sense. The Hungries can’t afford the luxury of being Beats, ours isn’t an affluent society. The single similarity that a Beat has with a Hungry is in their revolt of the personal. … The nonconformity of the Hungries is irrevocable.
    (p. 166)

    While this sounds a lot like Ginsberg’s later characterization of Beatness as “at the bottom of the world, looking up … rejected by society,” the Hungryalists force City Lights Journal readers to stretch their notions of dominant culture versus counterculture beyond the confines of the United States. This move reminds American readers that the Beats were far more privileged than their Hungryalist counterparts, a fact indexed by the Beats’ very mobility.41 Thus although the Hungryalists rely on some of the same terms Ginsberg and others used to describe the Beats, even borrowing his phrase “revolt of the personal” from his preface to the Hungryalist work presented in City Lights Journal 1, Rai and his co-authors figure themselves as more downtrodden or “beat” than the Beats themselves, for “hunger” can never be a mere pose, but is rather an urgent, all-consuming fact that is therefore “irrevocable”.

    These prose descriptions are valuable complements to the lone poem included in the issue, Choudhury’s “Stark Electric Jesus.” The poem was of course notorious by the time it was printed in City Lights Journal, but despite the opinion of the 9th Court of Calcutta, it does not read as particularly obscene, especially by contemporary standards. The poem is a dynamic paean to lust that, like “Drunk Poem”, figures the body as something enigmatic that must be investigated. The poem opens with the speaker’s skin in a “blazing furore” of desire as he declares “I can’t resist anymore, million glass-panes are breaking in my cortex.”42 This is the “revolt of the personal” identified by Ginsberg and Rai, et al. Choudhury is giving himself permission to articulate feelings he himself does not understand as a route to actuating his embodied existence. The first stanza concludes: “I do not know what these happenings are but they are occurring within me,” and the poem takes readers through a catalogue of the speaker’s sexual desires that might be achieved were he able to “destroy and shatter” his previous notions about himself and his body (p. 161). Taken as a statement of Choudhury’s poetics, “Stark Electric Jesus” insists that just as the lover must attend even to those bodily impulses he cannot understand, the poet must find a way to let his body speak through language: “I’ll split all into pieces for the sake of art / There isn’t any way out for Poetry except suicide” (p. 163). With this final turn of the poem, Choudhury analogizes the true lover’s experience of bodily defamiliarization with the true poet’s need to manifest bodily experience in writing, the very premise of using the word “hunger” to name his generation. Indeed, in the poem’s final lines, the speaker says that “Millions of needles are now running from my blood into Poetry,” into “the hypnotic kingdom of words” (p. 163), such that his body and his poetry are collapsed into one organic being. It is this sense of poetry as something embodied that “Stark Electric Jesus” really argues for, and what has made it a powerful testament to the poetics of the Hungry Generation. Indeed, although the Hungry Generation may have lasted only a few years, “Stark Electric Jesus” has remained one of Choudhury’s better-known poems (for instance, it inspired a short film in 2014), even as he has gone on to have a very prolific career writing poetry, drama, and non-fiction in English and Bengali.43

    With respect to the connections among the Hungryalists and the Beats, I think that Choudhury’s yoking of the body and poetic utterance offers a suggestive way to understand the shifts in Ginsberg’s own poetics after he returned from India. As is well-known, Ginsberg became a prominent political activist in the 1960s while simultaneously developing a pointedly embodied poetics; as Tony Triligio has put it, “Ginsberg’s return to the body is not simply a renewal of sensory experience; instead, it claims the body as both product and producer of political experience.”44 While I will sidestep questions of who precisely influenced whom, I do see Ginsberg’s use of his own body to blur distinctions among poetry and political activism as roughly analogous to what Choudhury and the Hungry Generation were doing in India. Ginsberg himself signals some of these associations even as he does not explicitly name them. For example, in an interview that appeared in City Lights Journal 2 immediately following Choudhury’s “Drunk Poem” and “Short-Story Manifesto,” Ginsberg discussed his turn to political activism by linking it to his experiences in India. Ernie Barry interviewed Ginsberg right after a demonstration against repressive government leadership in Vietnam, and when Barry asked: “What other political demonstrations have you been involved in?” Ginsberg replied: “None. This is the first time I’ve taken a political stand.”45 When Barry pressed him on this “new policy,” Ginsberg directed him to his protest sign, a poem which read, in part:

    ‘Oh how wounded, how wounded!’ says the guru
    Thine own heart says the swami
    […]
    War is black magic
    Belly flowers to North and South Vietnam
      include everybody
    End the human war
    Name hypnosis and fear is the
    Enemy-Satan go home!
    I accept America and Red China
      To the human race
    Madame Nhu and Mao Tse-Tung
    Are in the same boat of meat
    (p. 132)

    This poem is notable for a few reasons, not the least of which is that it marks Ginsberg’s foray into taking a “political stand.” It also abandons the distinction between poetry and protest via the moral authority of the gurus and swamis he met in India. The quoted phrase, “‘Oh how wounded, how wounded!’,” was in fact important enough to Ginsberg that he would repeat it in later work, including the dedication to Indian Journals, which names its source, a “conversation on bamboo platform in Ganges with Dehorava Baba who spake ‘Oh how wounded, how wounded!’ after I fought with Peter Orlovsky,” and in what is perhaps his greatest antiwar poem, “Wichita Vortex Sutra,” in which he again refers to “Dehorhava Baba who moans Oh how wounded, How wounded.”46 With this poem on a protest sign, then, Ginsberg identifies the origins of his interest in politics as a conversation with celebrated yogi Devraha Baba, and the protest-poem is itself the germ of “Wichita Vortex Sutra”, a long poem in which Ginsberg calls on his own body to declare the end of the Vietnam War.
    “Wichita Vortex Sutra,” written in 1966 at the height of Ginsberg’s fame as a poet-protester, is built around the notion that the Vietnam War is “Black Magic Language,” an idea imported from his very first poem-protest sign, which announced “War is black magic,” lines written just five months after he left India. “Wichita Vortex Sutra” develops this idea:

    The war is language,
        language abused
         for Advertisement,
        language used
    like magic for power on the planet:
    Black Magic language,
      formulas for reality
    (p. 119)

    This is a poem that banishes all distinctions between poetry and political protest, that understands the war as underwritten by the “Black Magic language” of politicians, military leaders, and the media, all of whom retreat into euphemism and vagueness in order to defend and justify actions Ginsberg considers indefensible. In a moment that might seem to echo the Hungryalists mailing paper masks to politicians and others, “Wichita Vortex Sutra” asks “Have we seen but paper faces, Life Magazine?” (p. 118), the implication in both cases being that those practitioners of “Black Magic Language” are hiding their real selves behind masks (in his interview with Barry, Ginsberg had observed that “everyone wants to feel, and wants to feel loved and to love, so there’s inevitable Hope beneath every grim mask [p. 137]). In “Wichita Vortex Sutra,” Ginsberg’s answer to the masked mendacity of language abusers is to collapse poetic utterance and political act so completely that his own embodied voice is given the incredible power to declare the war’s end.
    As he readies himself for this imaginative act, Ginsberg again calls on those same swamis and gurus from the earlier protest-poem:

    I call all Powers of imagination
      to my side in this auto to make Prophecy,
                     all Lords
          of human kingdoms to come
    Shambu Bharti Baba naked covered with ash
          Khaki Baba fat-bellied mad with the dogs
    Dehorhava Baba who moans Oh how wounded, How wounded
    (p. 127)

    This catalogue continues on for some time, and grows to encompass not only these compassionate souls he encountered in India but also figures like Christ, Allah, and Jaweh, so that he will claim to counter “Black Magic language” by tapping into positive energies of the world’s religions, a universalist gesture that Choudhury, for one, has linked to their time together in India. Choudhury has remarked, for instance, that “I can’t claim that I contributed to [Ginsberg’s] thinking, though, perhaps in changing the notion that there can not be only one God; there has to be innumerable gods for innumerable human spreads out in order to be eclectic, tolerant and resilient.”47 In his 1963 protest poem, as well as in “Wichita Vortex Sutra,” figures like Dehorhava Baba and Shambu Bharti Baba (whose photograph, incidentally, appears in Indian Journals) were routes toward the eclectic tolerance Choudhury describes. It is only after Ginsberg names these figures that he can muster the “right magic” to counter the black magicians’ “formulas for reality”:

    I lift my voice aloud,
      make Mantra of American language now,
            I here declare the end of the War!
    […]
    Let the States tremble,
      let the Nation weep,
        let Congress legislate its own delight
          let the President execute his own desire—
    this Act done by my own voice,
    […]
    The War is gone,
      Language emerging on the motel news stand,
            the right magic
        Formula, the language that was known
    in the back mind before, now in the black print
            of daily consciousness
    (pp. 127–29)48

    These lines have been subject to a fair amount of critical commentary, but I would point out that they are premised on a collapse of the realms of poetry and political action that are reminiscent of the ways the Hungryalists saw poetry and manifesto as two sides of the same coin.49 Ginsberg insists that the embodied nature of his language—“my voice … this Act done by my own voice”—can in and of itself effectuate actual political change. This is a “revolt of the personal” that reverses the mandates of “civilization” and its proxies to invest superhuman power in a single individual, Allen Ginsberg the embodied speaker whose utterance is political intervention. Just as the Hungryalists marshaled defiant theatricality as they circulated manifestos and demotic poetry that were political as much as aesthetic statements, Ginsberg’s theatrical declaration of the war’s end is politically effective insofar as it rebukes the very terms of the “Black Magic language” that had led to the Vietnam War in the first place. This moment in “Wichita Vortex Sutra” is in fact one among many examples of Ginsberg’s sixties-era poems and protests that fused aesthetics and politics, the embodied poet and the embodied protester. He articulated such a fusion in a piece published in the Berkeley Barb in 1965, in which he couched political protest as “spectacle,” using the same language of declaration found in “Wichita Vortex Sutra”: “Open declarations, ‘We aren’t coming out to fight and we simply will not fight.’ We have come to use imagination. A spectacle can be made, an unmistakable statement OUTSIDE the war psychology which is leading nowhere. Such statement would be heard around the world with relief.”50 Here Ginsberg is recommending strategies for actual political protests, which, he argues, must exploit “imagination” to be effective; otherwise put, he urges tactics that would seem nonsensical to the “war psychology,” but that would paradoxically be effective precisely for the ways they expose broader cultural and political ideologies that have become so widespread as to seem reality itself. Ginsberg’s political intervention is to reset the terms of reality via the imagination.

    While we can finally only remain suggestive as to questions of influence, I do think it is fair to say that the Beats and the Hungryalists were mutually generative literary and cultural movements. This is perhaps most evident in the material history of how the Hungryalists were circulated and packaged to Anglophone readers as a “generation” not unlike the Beats. But there is also a deeper argument to be made about how these movements came to perceive the relationship between poetry and politics. I do not think it is incidental that in the Berkeley Barb piece quoted above, Ginsberg insists that the use of imaginative spectacle in political protest “would be heard around the world with relief,” for this underscores his post-India interest in cultivating political solidarities beyond national borders. When thinking about the Beat movement, then, readers and critics must be attentive to the particularities regarding how U.S.-based writers read and interacted with the work of global writers, and vice versa, which helps us understand the profusion of texts produced in the context of an international avant-garde. And as attested by the various connections among the Beats and the Hungryalists traced throughout this essay, there is need for further work that acknowledges these continuities while still attending to the particularities of the writers understood as associated with these movements.

    Allen, Donald. 1960. Preface. In The New American Poetry. Edited by Donald Allen. New York: Grove. [Google Scholar]
    Baker, Deborah. 2008. A Blue Hand: The Beats in India. New York: Penguin. [Google Scholar]
    Bakken, Dick, ed. 1967. Hungry! Special issue, Salted Feathers 4.1–2. March. [Google Scholar]
    Barry, Ernie. 1964. A Conversation with Allen Ginsberg. City Lights Journal 2. [Google Scholar]
    Basu, Nayanima. 2011. A Sour Time of Putrefaction. Business Standard. December 10. Available online: https://www.business-standard.com/article/beyond-business/-a-sour-time-of-putrefaction-111121000058_1.html (accessed on 27 December 2018).
    Bhattacharya, Bhaswati. 2017. Much Ado over Coffee: Indian Coffee House Then and Now. New Delhi: Social Science Press. [Google Scholar]
    Brahmachari, Goirick, and Abhimanyu Kumar, eds. 2016. The Beat and the Hungry Generation: When Losing Became Hip. Café Dissensus 26, Special issue. Available online: https://cafedissensus.com/2016/06/16/contents-the-beat-and-the-hungry-generation-when-losing-became-hip-issue-26/(accessed on 27 December 2018). [Google Scholar]
    Chattopadhaya, Sankar. 1964. Civilization through Angry Eyes. City Lights Journal 2. [Google Scholar]
    Choudhury, Malay Roy. 1961. The Hungryalist Manifesto on Poetry. Calcutta: H. Dhara. [Google Scholar]
    Choudhury, Malay Roy. 1963. Weekly Manifesto of the Hungry Generation. City Lights Journal 1. [Google Scholar]
    Choudhury, Malay Roy. 1964a. Drunk Poem. City Lights Journal 2. [Google Scholar]
    Choudhury, Malay Roy. 1964b. Letter to El Corno Emplumado (9 August 1963). El Corno Emplumado 9. [Google Scholar]
    Choudhury, Malay Roy. 1966. Stark Electric Jesus. City Lights Journal 3. [Google Scholar]
    Choudhury, Malay Roy. 1968a. On Subhash Ghose’s AAMAAR CHAABI. In Poetry of India. Special issue, Intrepid 10. [Google Scholar]
    Choudhury, Malay Roy. 1968b. From ‘Subimal Basak—Victim & Spirit. In Poetry of India. Special issue, Intrepid 10. [Google Scholar]
    Choudhury, Samir Roy. 1968c. Tagore. In Poetry of India. Special issue, Intrepid 10. [Google Scholar]
    Choudhury, Malay Roy. 1968d. The Aims of the Hungry Generation Poets. In Poetry of India. Special issue, Intrepid 10. [Google Scholar]
    Choudhury, Malay Roy. 1968e. Drunk Poem. In Poetry of India. Special issue, Intrepid 10. [Google Scholar]
    Choudhury, Malay Roy. 2009. Impact of Hungry Generation (Hungryalist) Literary Movement on Allen Ginsberg. Available online: (accessed on 15 October 2018).
    Choudhury, Malay Roy. 2015. The Sunflower Collective Interview with Malay Roy Choudhury. November 10. Available online: (accessed on 27 December 2018).
    Chowdhury, Maitreyee B. 2016. Talking Poetry, Ginsberg and the Hungryalists: Samir Roychoudhury, a Retrospective. In The Beat and the Hungry Generation: When Losing Became Hip. Special issue, Café Dissensus 26. June 16, Available online: https://cafedissensus.com/2016/06/16/talking-poetry-ginsberg-and-the-hungryalists-samir-roychoudhury-a-retrospective/ (accessed on 27 December 2018).
    Corso, Gregory. 1992. Gasoline. San Francisco: City Lights. First published 1958. [Google Scholar]
    Datta, Robin. 1968. An Indictment. In Poetry of India. Special issue, Intrepid 10. [Google Scholar]
    Fazzino, Jimmy. 2016. World Beats: Beat Generation Writing and the Worlding of U.S. Literature. Hanover: Dartmouth College Press. [Google Scholar]
    Ferlinghetti, Lawrence. 1963. City Lights Journal. City Lights Journal 1. [Google Scholar]
    Ferlinghetti, Lawrence. 1964. City Lights Journal: Number Two. City Lights Journal 2. [Google Scholar]
    Ferlinghetti, Lawrence, and Allen Ginsberg. 2015. I Greet You at the Beginning of a Great Career: The Selected Correspondence of Lawrence Ferlinghetti and Allen Ginsberg, 1955–1997. Edited by Bill Morgan. San Francisco: City Lights. [Google Scholar]
    Gangopadhyay, Sunil. 1964. Age Twenty Eight. City Lights Journal 2. [Google Scholar]
    Ghosh, Saileswar. 1995. Hungry Generation Andoloan [The Hungry Generation Movement]. Kolkata: Pratibhas. [Google Scholar]
    Ginsberg, Allen. 1956. Howl and Other Poems. San Francisco: City Lights. [Google Scholar]
    Ginsberg, Allen. 1963. In India. City Lights Journal 1. [Google Scholar]
    Ginsberg, Allen. 1964. A Few Bengali Poets. City Lights Journal 2. [Google Scholar]
    Ginsberg, Allen. 1968. Planet News, 1961–1967. San Francisco: City Lights. [Google Scholar]
    Ginsberg, Allen. 1996. Indian Journals. New York: Grove. [Google Scholar]
    Ginsberg, Allen. 1999. Foreword. In The Beat Book: Writings from the Beat Generation. Edited by Anne Waldman. Boston: Shambala. [Google Scholar]
    Ginsberg, Allen. 2000. Demonstration or Spectacle as Example, As Communication; or How to Make a March/Spectacle. In Deliberate Prose: Selected Essays, 1952–1995. Edited by Bill Morgan. New York: Perennial. [Google Scholar]
    Houen, Alex. 2009. ‘Back! Back! Back! Central Mind-Machine Pentagon…’: Allen Ginsberg and the Vietnam War. Cultural Politics 4: 351–74. [Google Scholar] [CrossRef]
    Hungerford, Amy. 2010. Postmodern Belief: American Literature and Religion since 1960. Princeton: Princeton University Press. [Google Scholar]
    Kyger, Joanne. 2000. Strange Big Moon: The Japan and Indian Journals: 1960–1964. Berkeley: North Atlantic Books. [Google Scholar]
    Lee, A. Robert, ed. 2018. Routledge Handbook of International Beat Literature. New York: Routledge. [Google Scholar]
    Malay Roy Choudhury’s Prosecution. 1967, In Hungry! Special Issue, Salted Feathers 4.1–2. March.
    McCord, Howard. 1965. Afterword. In Malay Roy Choudhury, Stark Electric Jesus. Pullman: Tribal Press. [Google Scholar]
    McCord, Howard. 1966. Note on the Hungry Generation. City Lights Journal 3. [Google Scholar]
    Melehy, Hassan. 2016. Kerouac: Language, Poetics, Territory. New York: Bloomsbury. [Google Scholar]
    Misra, Aditya. 2016. ‘I can but why should I Go?’: The Romance of Opposition in Shakti Chattopadhaya’s Poetry. South Asian Review 37: 178–90. [Google Scholar] [CrossRef]
    Mitra, Tridib, ed. 1968. Letters/Letters. Howrah: Zebra Books. [Google Scholar]
    Morgan, Bill, and Nancy J. Peters, eds. 2006. Howl on Trial: The Battle for Free Expression. San Francisco: City Lights. [Google Scholar]
    Orlovsky, Peter. 1978. Clean Asshole Poems & Smiling Vegetable Songs. San Francisco: City Lights. [Google Scholar]
    Orlovsky, Peter. 2014. Peter Orlovsky, a Life in Words: Intimate Chronicles of a Beat Writer. Edited by Bill Morgan. Boulder: Paradigm Publishers. [Google Scholar]
    Rai, Debi, and et al. 1966. Hungry Generation. City Lights Journal 3. [Google Scholar]
    Snyder, Gary. 2007. Passage Through India: An Expanded and Illustrated Edition. Berkeley: Shoemaker & Hoard. [Google Scholar]
    The Complaint against the ‘Hungry Generation’. 1967, In Hungry! Special issue, Salted Feathers 4.1–2. March.
    The Hungry Generation. 1964, Time, November 20.
    The Verdict Against Malay Roy Choudhury. 1967, In Hungry! Special issue, Salted Feathers 4.1–2. March.
    Triligio, Tony. 2007. Allen Ginsberg’s Buddhist Poetics. Carbondale: Southern Illinois University Press. [Google Scholar]
    Watson, Steven. 1995. The Birth of the Beat Generation. New York: Pantheon. [Google Scholar]
    Weissner, Carl, ed. 1968a. Poetry of India. Special issue, Intrepid 10. [Google Scholar]
    Weissner, Carl. 1968b. Introduction. In Poetry of India. Edited by Carl Weissner. Special issue, Intrepid 10. [Google Scholar]

    See Allen Ginsberg (1996), Indian Journals (New York: Grove); Joanne Kyger (2000), Strange Big Moon: The Japan and Indian Journals: 1960–1964 (Berkeley: North Atlantic Books); Peter Orlovsky (2014), Peter Orlovsky, a Life in Words: Intimate Chronicles of a Beat Writer, ed. Bill Morgan (Boulder: Paradigm Publishers), pp. 175–213; and Gary Snyder (2007), Passage Through India: An Expanded and Illustrated Edition (Berkeley: Shoemaker & Hoard).
    Quoted in Deborah Baker (2008), A Blue Hand: The Beats in India (New York: Penguin), p. 148.
    Lawrence Ferlinghetti to Allen Ginsberg (2015, p. 166). (15 November 1962), in I Greet You at the Beginning of a Great Career: The Selected Correspondence of Lawrence Ferlinghetti and Allen Ginsberg, 1955–1997, ed. Bill Morgan (San Francisco: City Lights Books).
    City Lights Journal 4 was not published until 1978.
    Malay Roy Choudhury (1964b) to El Corno Emplumado (9 August 1963), El Corno Emplumado 9 (January 1964), p. 153. In later years, Choudhury would reverse these terms by arguing that the Hungryalists had a profound though largely unacknowledged impact on Ginsberg and his work; see Malay Roy Choudhury (2009), “Impact of Hungry Generation (Hungryalist) Literary Movement on Allen Ginsberg,” .
    To my knowledge, no comprehensive, English-language study of the Hungry Generation exists. In fact, there is a surprising lack of work on the Beats and India in general; even the recent, otherwise thorough Routledge Handbook of International Beat Literature, ed. A. Robert Lee (2018), which has chapters on Beat-associated literature from Australia to China, lacks a chapter on India. Deborah Baker’s (2008) A Blue Hand: The Beats in India (New York: Penguin) is the clear exception insofar as it is a lively account of the American Beats in India, but some critics have questioned the book’s accuracy with regard to its brief discussions of the Hungryalists (see pp. 154–59, 177–78, 194–99, 216–20); Maitreyee B. Chowdhury (2016), for example, calls it “a somewhat fictionalized account of Allen’s stay and influences from India” (“Talking Poetry”). See also Café Dissensus 26 (special issue on “The Beat and the Hungry Generation: When Losing Became Hip”), ed. Brahmachari and Kumar (2016), https://cafedissensus.com/2016/06/16/contents-the-beat-and-the-hungry-generation-when-losing-became-hip-issue-26/. In addition to this special issue (only some of which actually deals with Beat–Hungryalist connections), fans of the Hungry Generation do actively post brief essays, interviews, and other material about the movement online, and while I refer to some of these sites in this essay, note that they can be laced with misinformation and are often colored by the idiosyncratic memories or biases of the compilers. Although it is somewhat difficult to locate, the best English language collection of Hungry Generation material—including poetry, manifestos, letters, and legal documents pertaining to the 1964 arrests and subsequent trials—remains the “Hungry!” issue of Salted Feathers 4.1–2 (March 1967). Readers of Bengali may also consult Saileswar Ghosh (1995), Hungry Generation Andoloan [The Hungry Generation Movement] (Kolkata: Pratibhas).
    Carl Weissner (1968b), “introduction,” Intrepid 10 (“Poetry of India” issue) (Weissner 1968b), n.p.
    Aditya Misra (2016), “‘I can but why should I Go?’: The Romance of Opposition in Shakti Chattopadhaya’s Poetry,” South Asian Review 37.2, p. 181; and Bhaswati Bhattacharya (2017), Much Ado Over Coffee: Indian Coffee House Then and Now (New Delhi: Social Science Press), p. 196.
    Maitreyee B. Chowdhury (2016), “Talking Poetry, Ginsberg and the Hungryalists: Samir Roychoudhury, a Retrospective,” Café Dissensus 26 (special issue on “The Beat and the Hungry Generation: When Losing Became Hip” (16 June 2016). https://cafedissensus.com/2016/06/16/talking-poetry-ginsberg-and-the-hungryalists-samir-roychoudhury-a-retrospective/.
    Weissner (1968b), “introduction,” n.p.
    Malay Roy Choudhury (2009), “Impact of the Hungry Generation (Hungryalist) Literary Movement on Allen Ginsberg,” .
    Nayanima Basu (2011), “A Sour Time of Putrefaction,” Business Standard (December 10), https://www.business-standard.com/article/beyond-business/-a-sour-time-of-putrefaction-111121000058_1.html
    The Complaint against the ‘Hungry Generation’ (1967), reprinted in Salted Feathers 4.1–2 (“Hungry!” issue) (March 1967), n.p.
    Malay Roy Choudhury’s Prosecution (1967), reprinted in Salted Feathers 4.1–2 (“Hungry!” issue) (March 1967), n.p.
    See Howl on Trial: The Battle for Free Expression, ed. Morgan and Peters (2006).
    Howard McCord (1966), “Note on the Hungry Generation,” City Lights Journal 3 (1966), p. 159.
    The Verdict Against Malay Roy Choudhury (1967), reprinted in Salted Feathers 4.1–2 (“Hungry!” issue) (March 1967), n.p.
    Malay Roy Choudhury (2015), “The Sunflower Collective Interview with Malay Roy Choudhury” (10 November), malayinterview.wordpress.com/category/hungry-generation.
    The letters to Choudhury from Aldan, Bergé, Randall, and Paz—along with others, a total of 21—are collected in Letters/Letters, ed. Tridib Mitra (1968). Mitra, another Hungryalist writer, explains that the selection is “idiosyncratic,” that he pulled from “thousands of letters dumped in a trunk” and collected “letters from those persons only whom I’ve heard of and am damn fascinated for” (n.p). Mitra and his wife Alo Mitra edited two little magazines associated with the Hungry Generation, Waste Paper (English) and Unmarga (Bengali).
    Lawrence Ferlinghetti (1963), “City Lights Journal,” City Lights Journal 1 (1963), p. 4; and Ferlinghetti (1964), “City Lights Journal: Number Two,” City Lights Journal 2 (1964), p. 5.
    Allen Ginsberg (1963), “In India,” City Lights Journal 1 (1963), p. 9. The excerpts come from a series of letters Ginsberg had written to Ferlinghetti on 2 November 1962, 15 November 1962, and 10 January 1963.
    A revised version of this piece appears in Snyder (2007), Passage Through India, pp. 87–95.
    “Weekly Manifesto of the Hungry Generation,” City Lights Journal 1 (Choudhury 1963), 24. Note that there are differing methods of transliterating Bengali names into English, and as such writers’ names are spelled variously across venues. I have changed the spelling of names in order to maintain consistency in the context of this essay (for instance, Shakti Chattopadhyay appeared in City Lights Journal as Shakti Chatterjee, and Malay Roy Choudhury as Malay Roy Choudhuri).
    Malay Roy Choudhury (1961), “The Hungryalist Manifesto on Poetry” (Calcutta: H. Dhara, no date), n.p. See also Choudhury (1968a), “The Aims of the Hungry Generation Poets,” Intrepid 10 (“Poetry of India” issue) (Choudhury 1968b), which counts among these aims “abolishing the accepted modes of prose and poetry” (n.p.).
    Donald Allen (1960), “Preface,” in The New American Poetry, ed. Allen (New York: Grove, 1960), p. xi.
    Allen Ginsberg (1964), “A Few Bengali Poets,” City Lights Journal 2 (1964), p. 117. See also Samir Roy Choudhury (1968c), “Tagore,” and Malay Roy Choudhury (1968d), “from Subimal Basak—Victim & Spirit,” both of which discuss Tagore and link him to what Maitreyee B. Chowdhury calls Calcutta’s “post-Partition poverty politics” (both pieces appear in Intrepid 10 [“Poetry of India” issue] [Choudhury 1968e], n.p.).
    Jimmy Fazzino (2016), World Beats: Beat Generation Writing and the Worlding of U.S. Literature (Hanover, NH: Dartmouth College Press), pp. 1, 33. For more on the rich connections among another key Beat writer and transnational poetics, see Hassan Melehy (2016), Kerouac: Language, Poetics, Territory (New York: Bloomsbury).
    See “Morris” in Peter Orlovsky (1978), Clean Asshole Poems & Smiling Vegetable Songs (San Francisco: City Lights), pp. 61–67.
    Ginsberg (1964), “A Few Bengali Poets,” p. 118. Note that from Malay Roy Choudhury’s perspective, Sunil Gangopadhyay ought not to be associated with the Hungryalists, but rather with the circle around the journal Krittibas, those whom Choudhury calls a “pro Establishment commercial renegade coterie whose machinations had led to the arrest and trial of the Hungryalists.” At the time he was gathering material for inclusion in City Lights Journal 1, such sectarian differences were opaque to Ginsberg, and Choudhury later recalled that “One thing which annoyed me at the time was that Ginsberg was unable to differentiate between the members of avant garde Hungryalist movement and the … commercially inclined pro-Establishment Krittibas group” (Malay Roy Choudhury (2009), “Impact of the Hungry Generation (Hungryalist) Literary Movement on Allen Ginsberg,” .
    Gregory Corso (1992), Gasoline (San Francisco: City Lights; Corso [1958] 1992), p. 42.
    Sunil Gangopadhyay (1964), “Age Twenty Eight,” City Lights Journal 2 (1964), p. 120.
    See also Sankar Chattopadhaya’s “Civilization Through Angry Eyes,” which couches an anti-civilization stance in the concept of hunger: “In all the ravaged scenes, civilization gives birth to art, love / and hunger in a continuous process” (Chattopadhaya 1964, p. 124).
    Steven Watson (1995), The Birth of the Beat Generation (New York: Pantheon), p. 40.
    Malay Roy Choudhury (1964a), “Drunk Poem,” City Lights Journal 2 (1964), pp. 128, 126. Given that in August of 1962 Ginsberg had remarked to Ferlinghetti that he could not title his new manuscript “Tasty Scribbles” because he “used the word scribbles too oft in the book already,” it seems likely that he wrote the note appended to “Drunk Poem” (Ginsberg to Ferlinghetti [27 August 1962], I Greet, p. 157). Note that a very different “Drunk Poem” by Choudhury (1968c) appears in Intrepid 10 (“Poetry of India” special issue) (Choudhury 1968c), n.p.
    Malay Roy Choudhury (1968e), “The Aims of the Hungry Generation Poets,” reprinted in Intrepid 10 (“Poetry of India” issue) (Choudhury 1968e), n.p.
    The Hungry Generation (1964), Time 84.21 (20 November 1964), p. 46.
    Howard McCord (1965), “Afterword,” in Malay Roy Choudhury, Stark Electric Jesus (Pullman, WA: Tribal Press,), n.p. For more on McCord, see http://www.possibilityx.com/hm/bio.htm.
    McCord (1966), “Note on the Hungry Generation,” p. 159.
    Debi Rai, et al. “Hungry Generation,” City Lights Journal 3 (Rai et al. 1966), p. 164.
    Allen Ginsberg (1956), Howl and Other Poems (San Francisco: City Lights), p. 22.
    Allen Ginsberg (1999), “Foreword,” The Beat Book: Writings from the Beat Generation, ed. Anne Waldman (Boston: Shambala, 1999), pp. xiv-xv.
    Malay Roy Choudhury (1966), “Stark Electric Jesus,” City Lights Journal 3 (1966), p. 161.
    See Stark Electric Jesus, dir. Hyash Tanmoy and Mrigankasekhar Ganguly (2014).
    Tony Triligio (2007), Allen Ginsberg’s Buddhist Poetics (Carbondale: Southern Illinois University Press), p. 67.
    Ernie Barry (1964), “A Conversation with Allen Ginsberg,” City Lights Journal 2 (1964), p.131.
    Ginsberg (1996), Indian Journals, n.p.; and Ginsberg (1968), Planet News, 1961–1967 (San Francisco: City Lights), p. 127.
    Choudhury (2015), “Sunflower Collective Interview.”
    Note some later work by Hungryalists employs similar language of declaration. For example, Malay Roy Choudhury (1968d) writes: “I declare AC [“Aamaar Chaabi” by Subhash Ghose] the first Bengali experiment to peel off the rusty anti-communicative bourgeois layers of Bengali language” (Choudhury, “On Subhash Ghose’s AAMAAR CHAABI,” Intrepid 10 (“Poetry of India” issue) (Choudhury 1968a), n.p.). Robin Datta’s (1968) poem “An Indictment” excoriates “America seeking peace with Starfighters & Napalms through/masskilling in the Mekong Delta” and includes the line “I Declare The End of God” (Intrepid 10, n.p.).
    See, for example, Triligio; Amy Hungerford (2010), Postmodern Belief: American Literature and Religion since 1960 (Princeton, NJ: Princeton University Press); and Alex Houen (2009), “‘Back! Back! Back! Central Mind-Machine Pentagon…’: Allen Ginsberg and the Vietnam War,” Cultural Politics 4.3, pp. 351–73.
    Allen Ginsberg (2000), “Demonstration or Spectacle as Example, As Communication; or How to Make a March/Spectacle,” in Deliberate Prose: Selected Essays, 1952–1995, edited by Bill Morgan (New York: Perennial), p. 10.
  • From "The Hungryalists" by Mai | 236712.158.891212.205 | ২৬ জুন ২০১৯ ১৩:০৪541373
  • BOOK EXCERPT
    A new book chronicles the radically iconoclastic movement in Bengali poetry in the 1960s
    Maitreyee Bhattacharjee Chowdhury’s ‘The Hungryalists’ portrays a group of literary revolutionaries in Bengal.
    A new book chronicles the radically iconoclastic movement in Bengali poetry in the 1960s
    Samir Roy Choudhury (left) and Malay Roy Choudhury | via Facebook
    Jan 08, 2019 · 08:30 am
    Maitreyee Bhattacharjee Chowdhury

    In October 1962, young poet Malay Roy Choudhury boarded the newly launched Janata Express at Patna. The train would stop in Delhi before it reached Calcutta – a rather tedious journey that would go on for over two days. Malay hoped Calcutta would be pleasant this time of the year. His elder brother, Samir, had written to him just before he had left for Calcutta.

    You’ll reach just in time to see the city being decorated for Durga Puja. Ma arrives in the most beautiful colours and people make the most creative podiums for her to be worshipped in. The kash phool would have spread its abundance. You’ll find them everywhere if you care to look, spread out sleepily in the emptiness outside the city. The sound of dhak will be everywhere and if you’re lucky, you’ll find some of the dhakis at the Howrah station when you arrive.
    Advertisement

    Malay wondered if Calcutta had changed Samir. Patna was dry and without a trace of chill. The narrow seats and the stale air that greeted him in the third-class compartment were terrifying. He was carrying two small bags, his underwear peeking out of one, some papers and a few packets of crisps from the other. It was still early evening, with reluctant bogies standing around idly, basking in a gentle sun. It was Malay’s first trip to Calcutta after the establishment of the Hungry Generation.
    Before the year would end, Malay would meet American poet Allen Ginsberg in Calcutta.

    It was February 1961 when Ginsberg landed in Bombay (now Mumbai). The Cold War was still on, a nuclear face-off had just been averted in Cuba and Delhi was at loggerheads with Peking – a border dispute had pushed the two countries to the brink of war. And just like everywhere else, poets, writers and thinkers in India were had been affected too.

    Ginsberg visited many places in the country, including Benaras (now Varanasi), Patna, the Himalayan foothills and Calcutta (now Kolkata). During his trip, he spent most of his time mingling with like-minded poets, musicians and artists, and even wrote about them in great detail in Indian Journals. In Calcutta, between keeping company with Ashok Fakir in “Ganja Park” – an area near the main road stretching from Chowringhee to Rashbehari Avenue – and hallucinating at Kali’s feet while lying in her temples, Ginsberg would walk around the city or watch bodies being burned in the ghats.

    To the ever-sceptical Bengali, he might have seemed like another disillusioned westerner doing the rounds of holy Indian cities, in search of drugs, sex and a vague notion of exotic spirituality. But Ginsberg was all that and more. As it turned out, not many Indians at that time were aware of Ginsberg’s reputation or the influence he wielded back home.
    Advertisement

    Ginsberg, of course, had read Howl, his legendary poem, at Six Gallery in San Francisco by then, and had begun shaping the American approach and reaction to poetry. What effect his presence would have on the poets in Calcutta, or they on him, time would tell vividly. But for now, he was one of them – a poet and a wanderer, who carried with him a turbulent and disturbed past, with the belief that here, of all places, he would be accepted no matter how dirty or disillusioned he was.
    The train now moved slowly, egged on as if by a reluctant inertia. Malay remembered what Samir had written to him from Calcutta while he was in Patna.

    He had been angry with their father for sending him away to Calcutta after school. The Roy Choudhurys had decided to shift from Imlitala, a neighbourhood in Patna, which their father considered exerted a bad influence on the boys. Pretty early on in life, the place had exposed them to free sex, toddy, ganja, and much more. Their father had built a new house in Dariapur and the family had shifted there. Subsequently, when Samir was sent to Calcutta, it was a double blow for him and one that didn’t go down very well. Calcutta was a place he knew almost nothing about. His instructions to Malay had been clear – he was going to live vicariously through his brother in Patna. On certain days, Samir would almost be pleading with Malay in his letters.

    Dear Malay,

    Near the charali next to our house is a woman who sells bidis for two annas. Buy a packet from her, hide it in your trunk and bring it for me when you’re in Calcutta. Remember, nobody should know about this.

    Dada

    And another about a month later read:

    Dear Malay,

    Apparently, there are many things to do here, but I don’t know where to start. I have made a few friends; we meet at the Coffee House regularly. Deepak [Majumdar], Ananda [Bagchi] and Sunil [Ganguly] are close to me. Sometimes we discuss kobita [poetry], at other times, it is the state of affairs. Everyone is angry here; there are strange people I meet on the road. They are not like the poor of Imlitala; they have a lost look about them. They don’t look or feel poor when you talk to them – all you can understand is death on the inside. I think they have lost a dream. It makes me feel horrible; I miss the easy poverty of Imlitala...You must go to Bade Miyan’s paan shop at the end of our lane and tell him about the paan that I used to have, he will know. You could have one yourself, but I fear it might not be good for you. You must bring one for me though. It will cost you one anna.

    Dada

    Malay could not understand from Samir’s letters whether he was happy in Calcutta or not.

    But he sensed some anger. He seemed like a revolutionary without an understanding of what his revolt was about. Malay wished Samir knew how much he wanted to see Calcutta – the city he had spoken so much about in his letters. He greatly desired to visit the city where poetry was read aloud on the streets; where a Shankha Ghosh, even at the height of his literary career, could be approached by college students; where Shakti Chatterjee would recite poetry on the stairs of the Coffee House. Samir’s shift to Calcutta indirectly helped Malay in many ways.
    Advertisement

    It was Ashadh of 1952 when Malay next received a letter from Samir. It had been raining for two days and the blue inland envelope got a bit wet as Malay fetched it from the letterbox. Unlike his previous letters, Samir sounded excited in this one – it was the first time he had forgotten to mention Imlitala.

    Dear Malay,

    Last evening, Sunil, Shakti and Deepak came home. My room is small, and the bed has too many books on it for me to move them. We sat on the terrace adjoining my chilekotha [an attic-like room]. While it didn’t matter to either Sunil or Deepak, I was glad I had the small mat Ma had insisted I bring from Patna. Tha’mma doesn’t stir out of her room after dusk, so it was OK for Sunil to bring his smoke. Thanks to the gondhoraj lebu plant that is full of flowers and small bulbs of lemons, the smell of smoke was confined to the terrace. We talked for a long time; thankfully, none of them were in a hurry. Tha’mma might ask a lot of questions tomorrow though. Sunil is full of ideas; he says he wants to start a magazine. He is still not sure how to go about it though, but he says he is bored of reading the same kind of writing. I told him what you and I have talked about so many times. He seemed a bit surprised at first, and then asked me about you. Deepak was quiet all evening, but he sang a song later. Kaka came up to meet us. Later, he and Deepak talked about Hindi film heroines. Their discussion made Shakti and me laugh a lot. There was not much to eat, but Sunil had bought some pakoras on the way; we ate them and, later, licked the plate clean. Sunil went through my books and wanted the Swinburne collection. I can give it to him only later, which is what I told him. I hope he didn’t take offence though.

    More later,

    Dada

    Maitreyee Bhattacharjee Chowdhury
    Maitreyee Bhattacharjee Chowdhury
    Many of the new writers were Samir’s classmates in City College. There were other established ones, who frequented the Coffee House, whom Samir had befriended and would discuss literature with.

    Shakti and Sunil came up quite often; they were close friends, who had been to his family home in Uttorpara a few times. Sunil was a prolific and acclaimed novelist, but poetry was his first love. In fact, Samir, who’d recognised his talent early on, went on to fund and publish Sunil’s first book of poems, Eka Ebong Koyekjon.

    Samir would have intense discussions with Deepak, Sunil and Shakti on many an evening on the kind of literature they had all grown up with and began to believe in. Subsequently, he got deeply involved with Sunil in establishing Krittibash – a journal that launched many a Bengali poet that time. Deepak, Ananda and Shakti were also compatriots in this venture. Krittibash found “its voice’” in 1953. Samir always kept his brother in the loop about everything, and Malay would occasionally receive large paper packets containing literary periodicals and books of poetry.

    Now as the train moved towards Calcutta, Malay felt as if his life was coming full circle. It had been a strange decision to visit the city at a time when post-Partition vomit and excreta was splattered on Calcutta streets. Marked by communal violence, anger and unemployment, the streets smelled of hunger and disillusionment. Riots were still going on. The wound of a land divided lingered, refugees from East Pakistan (now Bangladesh) continued to arrive in droves. And since they did not know where to go, they occupied the pavements, laced the streets with their questions, frustrations and a deep need to be recognised as more than an inconvenient presence on tree-lined avenues.
    Advertisement

    The feeling of being uprooted was everywhere. Political leaders decided that the second phase of the five-year planning needed to see the growth of heavy industries. The land required for such industries necessitated the evacuation of farmers. Devoid of their ancestral land and in the absence of a proper rehabilitation plan, those evicted wandered aimlessly around the cities—refugees by another name.

    Calcutta had assumed different dimensions in Malay’s mind. The smell of the Hooghly wafted across Victoria Memorial and settled like an unwanted cow on its lawns. Unsung symphonies spilled out of St Paul’s Cathedral on lonely nights; white gulls swooped in on grey afternoons and looked startling against the backdrop of the rain-swept edifice. In a few years, Naxalbari would become a reality, but not yet. Like an infant Kali with bohemian fantasies, Calcutta and its literature sprouted a new tongue – that of the Hungry Generation. Malay, like Samir and many others, found himself at the helm of this madness, and poetry seemed to lick his body and soul in strange colours. As a reassurance of such a huge leap of faith, Shakti had written to Samir:

    Bondhu Samir,

    We had begun by speaking of an undying love for literature, when we suddenly found ourselves in a dream. A dream that is bigger than us, and one that will exist in its capacity of right and wrong and beyond that of our small worlds.

    Bhalobasha juriye

    Shakti

    Excerpted with permission from The Hungryalists: The Poets Who Sparked A Revolution, Maitreyee Bhattacharjee Chowdhury, Penguin Books.
  • The Hungryalists published by | 236712.158.891212.249 | ২৬ জুন ২০১৯ ১৩:০৮541374
  • A new book chronicles the Hungryalist poets, who revitalised Bengali literature during the turbulent 1960s

    Maitreyee Bhattacharjee Chowdhury’s The Hungryalists: The Poets Who Sparked A Revolution offers a compelling portrait of poets such as Malay Roy Choudhury, Shakti Chattopadhyay, Samir Roychoudhury, Haradhan Dhara and Binoy Majumdar, who initiated the “Hungry Movement” to revitalise Bengali literature during the 1960s.

    It was a turbulent period marked by the influx of refugees from East Bengal, the Indo-China War, the Vietnam war, and the Naxalite uprising. The Hungry Generation of poets responded to the on-going national and international turmoil, though as a group they were never quite a cohesive entity. Chattopadhyay, for instance, left the group in the mid-sixties.

    Around the same time, Roy Choudhury and Dhara, along with several other Hungryalists, were held for writing “obscene” poetry. Chattopadhyay accepted a Sahitya Akademi Award in 1983. Roy Choudhury was conferred the same honour in 2003 but he refused to accept it.

    Given their anti-establishment sensibilities, the Hungryalists had befriended the iconic post-war American poets, the Beats, including Allen Ginsberg and Peter Orlovsky, who were touring India at the time. The most striking feature of The Hungryalists is that though it records this significant chapter of literary history, it does so by tracing the rich internal lives of the poets — their motivations, dreams, and disappointments.

    Excerpts from an interview with the author:

    What drew you to the Hungry Generation?

    About four years ago I read Deborah Baker’s book A Blue Hand: The Beats in India, where I found a fleeting mention of the Hungryalists. Like me, many in Bengal had heard of the Hungry Andolan and read them in Bangla but no substantial work had been done on them in English. This was when I began my research on them.

    Early into the writing, I felt that narrating their dreams and disappointments was necessary because poetry wasn’t only a way of life; for them, it was life.

    Since you are a poet, was it challenging for you to focus on the poets’ biographies rather than on their poetry?

    As a poet and non-fiction writer, this was in fact the perfect combination. Being a poet probably made me understand their choices in life and revolt better. The Hungryalists’ fight was against elitism, casteism and authoritarianism. The sixties were a time during which any kind of sensuality in poetry or other writing was looked down upon. Buddhadeb Bose’s book Raat Bhor Brishti which released around this time was banned, copies were burnt and he was put on trial standing in a wired cage. While such a response might have been shocking in the’60s, these subjects resonate with writers such as myself too.

    Why made you draw parallels between the Beats and the Hungryalists?

    There have been too many comparisons between the Beats and the Hungryalists, as a result of which the Hungryalists are somewhat defensive about acknowledging the influence of the Beats. The fact remains, however, that the two groups shared a tremendous love for a new kind of poetry which joined them at the hip, in a manner of speaking. Also, the Hungryalists did mingle with the Beats, read their work, and accepted their help when necessary. While the parallels make for a great narrative and situate the Hungryalists’ revolt in an international context, there is also no doubt that the Hungryalists were poor Bengali writers with no great financial support, which is why their rebellion against elitism, classism, casteism and negation of sensuality in literature was crushed so easily.

    The Hungryalists identified as outsiders, and you consider their condition as analogous to those of the refugees from East Bengal and Dalits. Could you elaborate on the analogies?

    The Hungryalists came about because some of them, such as Haradhan Dhara, were Dalit writers ignored by the literati, others like Binoy Majumdar were refugees and still others like Malay were probasi Bengali writers — they were already social misfits. Coming together as a group was the only way they would get any attention of the so-called ‘cultured society’.

    The Hungryalists understood the consequences of shunning mainstream dictums and had, in many ways, begun feeling the heat of being socially shunned. They formally named themselves, inspired by Geoffrey Chaucer’s line, “In the sowre hungry tyme”. But they were, perhaps, unprepared for facing legal consequences. But they were, perhaps, unprepared for facing legal consequences.

    While researching how the Hungryalists were tried for writing “obscene” poetry, did you feel an event like that would pan out any differently today?

    While writing about sexuality might be more acceptable today than it was in the ’60s, people are still wary of reading or reacting to anything outside their comfort zone. As far as tolerating another’s thought process is concerned, I feel people are still not as accepting. Where poetry and poets are concerned, I feel that people had more love for poets and poetry before. There was a certain sense of awe associated with poets because they presented the world from an altogether different perspective. The fact that Malay had been arrested created a huge stir internationally, but when poet Binoy Majumdar died in poverty and mental trauma in 2006, how many people were aware of it?

    The need for deep poetic introspection seems mostly lost, the realm of subtlety no longer exists, and though poetry is still popular, the magic of finding value in something that doesn’t have much monetary consequence is redundant.

    Torsa Ghosal is the author of Open Couplets, and professor of English at California State University, Sacramento
    Published on March 15, 2019
  • Md. Imtiaz | 236712.158.891212.93 | ২৭ জুন ২০১৯ ১০:৩৭541375
  • Hungryalist Movement: When People Took Their Fight Against The Government Through Poetry
    Md Imtiaz

    June 29th, 2016 / 4:08 PM

    Post independence, Bengal was caught between a tumultuous time after the bleak era of the partition. The gradual inflow of the displaced people was taking a major toll on the social fabric of Bengal, with a rise in poverty, hunger and death. The milieu was rearing a young brigade among the middle-class Bengalis who went all out against the government not with their weapons, but with their blunt blow of pen and paper mingling into poetry. Thus gave rise to avant-garde Hungryalist movement in Bengali.

    The Hungryalist or the hungry generation movement was a literary movement in Bengali that was launched in 1961, by a group of young Bengali poets. It was spearheaded by the famous Hungryalist quartet — Malay Roychoudhury, Samir Roychoudhury, Shakti Chattopadhyay and Debi Roy. They had coined Hungryalism from the word ‘Hungry’ used by Geoffrey Chaucer in his poetic line “in the sowre hungry tyme”. The central theme of the movement was Oswald Spengler’s idea of History, that an ailing culture feeds on cultural elements brought from outside. These writers felt that Bengali culture had reached its zenith and was now living on alien food.

    Contribution to Bengal’s literature

    The movement shook the roots of the Bengali literary and cultural establishment in India. The poets significantly brought about a change in the language and vocabulary used in Indian literature.The Hungryalists wanted to disturb the reader’s mind that was filled with preconceived colonial ideas. That’s why it became one of most controversial movement during its time and faced huge criticism from the upper class of the society and government. The movement was joined by other young poets like Utpal Kumar Basu, Binoy Majumdar, Sandipan Chattopadhyay, Basudeb Dasgupta, Falguni Roy, Tridib Mitra and many more. Their poetry spoke the displaced people and also contained huge resentment towards the government as well as profanity.

    On September 2, 1964, arrest warrants were issued against 11 of the Hungry poets. The charges included obscenity in literature and subversive conspiracy against the state. The court case went on for years, which drew attention worldwide. Poets like Octavio Paz, Ernesto Cardenal and Beat poets like Allen Ginsberg visited Malay Roychoudhury. The Hungryalist movement also influenced Hindi, Marathi, Assamese, Telugu & Urdu literature. The government’s decision to crack a whip on the poets slowly saw them leaving the movement out of fear. Later the ultra-leftist student movement by the Naxalites also brought about the end of the Hungry generation. It is still remembered as one of the greatest literary movements in the world.
  • Sara Hussain | 236712.158.891212.235 | ২৭ জুন ২০১৯ ১০:৪০541376
  • The Rebel Poets Of 1960’s Bengal

    By Sara Hussain | Posted Sep 14 2017

    There is a certain kind of magnetic attraction that literary figures of the past hold over young struggling writers of today. We often look to their work, their lives and lifestyles for inspiration, adopting their methods and styles into our own experimentations with finding our own writer’s voice. We look to the past movements and revolutions that have created the literary landscape of today. Nothing seems to pull a writer in more than the Beat generation in 1950’s America. Young, scruffy anti-establishment writers living life on their own terms and rejecting dominant societal rules has a kind of attraction that makes you fantasize about travelling across cities with Jack Kerouac and Allen Ginsberg, with the sun shining on your face – there’s definitely someone playing the harmonica – living the ideal hippie writer’s life you’ve imagined through romanticised notion of the Beats.

    But once you wake up to the reality of adulthood and working, these images slowly start to change. Depending on the kind of writer you want to be you still strive to change the world with your words, create worlds of wonder, magic and whimsy, or even trigger entire revolutions. While we may all not end up being these ideal selves we’re created in our minds, there was a literary movement in India itself, our own Beat generation, in a way, that changed the way Bengali literature was received, read and written in the 1960’s.

    The Hungryalist Movement was founded by what is referred to as the Hungryalist quartet by Dr Uttam Das in his dissertation ‘Hungry Shruti and Shastravirodhi Andolan’ – Malay Roychoudhury and his elder brother Samir Roychoudhury, Shakti Chattopadhyay and Debi Roy, alias of Haradhon Dhara. These mavericks of the avant-garde shook an unsuspecting Calcutta’s (as it was named at the time) literary and cultural world and became a real force to reckon with. Members grew in number as more and more poets and writers came into the folds of this new generation of writers, resulting in one of the most historically and culturally significant trials of the Indian literary world.

    The Hungryalist movement picked its name from Geoffrey Chaucer’s phrase “the sowre hungry tyme”. “When a civilisation falls, people tend to eat every thing that comes their way,” said Malay Roychoudhury in an interview with Nayanima Basu. “Today when I look at West Bengal, the Hungryalist premonition appears prophetic.”

    The 1960s was host to a generation of disaffected youth in post-partition Bengal. They voiced their anger and sense of displacement by creating literature that challenged the pre-existing colonial perspectives and traditional readings of Bangla writings to make reader’s question how Indian literature is perceived and received. As Prof. S Mudgal explains, “The central theme of the movement was Oswald Spengler’s idea of History, that an ailing culture feeds on cultural elements brought from outside. These writers felt that Bengali culture had reached its zenith and was now living on alien food.”

    The Hungry generation was more than just a group of angry young men. At the time, Bengali literature was, for lack of a better word, limited and inaccessible for most people. The Hungryalists wanted more – they wanted a new language, a new literary space that was open, accessible and representative of all Bengalis, not just limited to an elite few. “Their entire position was extremely iconoclastic. To break whatever was held sacrosanct till then, including the way n which they wrote poetry and the way in which they lived their lives,” said Ipshita Chanda, professor of Comparative Literature at Jadavpur University, to the BBC. Their frustration was shared with not just other poets, she explains, but with an entire generation of over-educated people who felt they had no future.

    The Hungryalist quartet grew in number and was soon joined over the years with writings by renowned Bengali voices such as Subimal Basak, Sunil Gangopadhyay, Saileswar Ghose, Basudeb Dasgupta, Tridib Mitra, Subhas Ghose, Falguni Ray and Arunesh Ghose, to name a few. These were young writers who came from humble backgrounds and meagre means, and the political and social climate of the time only made their voices louder.

    This was a difficult time in the region’s history. Thousands were displaced and forced to migrate following partition, with no money and no place to go – no place they belonged to. There was rampant poverty, food shortages and homelessness, but this immediate reality would never find its way into the writings and literature of the time – into the living rooms of the elite who lived sheltered lives in the comfort of their homes. The Hungryalists were very aware of this reality, and carried these people’s stories, their histories through words into the limelight in their pamphlets/bulletins.

    The movement broke all conventions of writing – they were different in form, in content and rhythm from the traditional, ‘elitist’ works that dominated the literary sphere. These used language that was polite, cultured and ‘civilised’ and the Hungryalist’s disruption came into this space with a sense of pure anarchy. While they viewed Tagore’s language as ‘vegetarian’, their’s focused on being streetwise and colloquial, for the people, raw and relatable – the “language of life” that was viewed by the rest as vulgar and obscene.

    As Malay Roychoudhury explained, they identified themselves as a part of the post-colonial period that disconnected itself from colonial canons. They published their work through single-sheet pamphlets that they would then distribute in coffee houses, colleges, and offices. While their anti-establishment antics may have carved for them a special place in the heart of Allen Ginsberg, who the Roychoudhurys met during his trip to India in the 60s, it definitely wasn’t for everyone, especially dominant Bengali society. Criticising society meant a harsh critique of politics and those in power. As Nayanima Basu writes, “The administration’s ire towards the Hungryalists reached its peak when the poets started a campaign to personally deliver paper masks of jokers, monsters, gods, cartoon characters and animals to Bengali politicians, bureaucrats, newspaper editors and other powerful people. The slogan was, ‘Please remove your mask’.”

    Arrest warrants for eleven of the movement’s poets were issued, and Malay Roychoudhury, viewed as the face and leader of this bunch of troublemakers, was arrested on September 2, 1964. His poem ‘Prachanda Boidyutik Chhutar’ (translated as ‘Stark Electric Jesus’) didn’t sit well with the good Bengali people of civilised society, and he was charged with conspiracy against the state and literary obscenity. The trial went on for 35 months, he explains, during which he spent a month in jail. While many of the Hungry poets slowly began to break away from the movement during this time – many lost their jobs, faced regular police raids and some ventured into different fields altogether – Malay Roychoudhury received tremendous support from other friends and family, even from writers and poets abroad who read of the news in a Time magazine editorial, such as Octavio Paz, Ernesto Cardenal, and Allen Ginsberg, who even wrote a letter in his support.

    The charges were subsequently dropped by the High Court of Calcutta, but in the mean time the Hungry generation seemed to have dwindled to a handful of people. “Some of them carried the news to Europe and I started getting translated for the little magazines there,” said Malay Roychoudhury. “My poems were read at New York’s St Mark’s Church to raise funds to help me. It would have been impossible to fight the case up to the High Court without this help. I was poor, all my friends who were part of the movement deserted me, I lost my job with the Reserve Bank of India during the case, my grandmother died hearing the news of my imprisonment, and thus, I stopped writing.” But the spirit of the movement still lives on in the hearts and works of the Roychoudhurys and many other writers of the time, even if they separated themselves from the group.

    The Hungryalists left an indelible impact on not just Bengali literature, but that of India. The Hungry generation are remembered as literary heroes, however romanticised our notions may be. These were writers that were hungry for a new voice and found themselves in a storm of politics and bold, brave words that stood as a declaration for a change, one that they themselves put into motion.

    Read Nayanima Basu’s interview with Malay Roychoudhury here and listen to BBC’s podcast about the Hungry Generation here.

    By Sara Hussain
  • Jayeeta Bhattacharya | 236712.158.34900.2 | ২৯ জুন ২০১৯ ১৯:৩৬541377
  • Jayeeta Bhattacharya in conversation with Malay Roychoudhury

    [ Jayeeta Bhattacharya, post graduate in English, and teacher,
    is a poet who writes both in Bengali and English. She is the first
    female author who has written a Bildungsroman novel in Bengali. ]
    Jayeeta : Poetry or prose -- in case of prose critical
    essays or stories and novels -- which do you prefer writing ?
    Malay : I do not have any preference as such.
    Depends on what is happening in my brain at
    a particular time. Critical essays I mostly write on
    the request of Editors. These days I dislike writing essays ;
    actually, since essay writers are only a few,
    Editors request for essays ; in many cases
    Editors even select a specific subject and request
    me to write on it. Is it possible, tell me ?
    Now a days I do not like to read much or
    think about the society. I write fictions,
    once something strikes me I start writing,
    there is no dearth of material in my experience,
    I may pick up scores of characters from my own life.
    When an Editor requests, I send him.
    Poetry is really an addiction ; once the grug grips you,
    there is no way out other than writing.
    I write them on the body of emails ;
    when someone requests for a poem or poems,
    I mail him. If it is not to what I had intended to achieve
    I delete it completely. In fact whoever requests,
    I send him, without any preferences.
    Some editors identify a subject and request me
    to write on it. That creates a problem for me,
    as you know I do not write subject-centric poems ;
    I write as I please, whether it is liked or not.
    I do not have anything like a writing diary or pages,
    after 2005, because of arthritis I suffered induced by
    wrong medicines after angioplasty.
    Then I started suffering from asthma, hernia, prostate,
    varicose veins. Because of arthritis
    I was going out of writing habit,
    you would not be able to feel that suffering.
    Texts kept on creating vertigo of thoughts and
    I was not able to write anything.
    Then my daughter encouraged me to learn
    computer, I learned typing in Bengali,
    the middle finger of right hand is less affected,
    I use it for typing. My son has gifted this computer,
    he cleans it whenever he visits on holidays.
    For about three-four years I was not able to
    write because of problems with my fingers.

    Jayeeta : While reading your novels one
    finds that the narrative techniques and forms
    are different from one another.
    From Dubjaley Jetuku Proshwas to Jalanjali,
    Naamgandho, Ouras, Prakar Porikha,
    have almost the same characters you
    have proceeded with, it may be called a single novel,
    but you have kept on changing the form and technique.
    Why ? Then in Arup Tomar Entokanta novel you
    have introduced a new technique,
    you have displayed three types of Bengali diction.
    In Nakhadanta novel you have put together
    several short stories along with your daily diary.
    Tell us something about these. Are they conscious effort ?

    Malay : Yes. No editor would have published such a
    large novel comprising of five, obviously I
    wrote them at different periods, each separate
    from the other. Dubjaley is written based on my co-workers,
    I had learned that some of them are Marxist-Leninist.
    Writing five different novels was a sort of boon for me,
    I have tried to bring in novelty in all of them.
    When an idea comes to me I think about its
    form for quite some time, about its presentation,
    then I start writing. Quite often a form develops
    at the time of writing itself, such as in Nakhadanta or
    Arup Tomar Entokanta. While writing Nakhadanta
    I had gathered substantial information during field
    studies in West Bengal about the jute cultivators
    and jute mills. Similarly, for writing Naamgandho
    I collected field information of potato cultivators and
    cold storages in West Bengal. A large number of
    characters in these two novels are from real life events.
    I have written outside of my experience as well such as
    Jungleromeo, based on beastiality of a bunch of criminals.
    I have written the fiction Naromangshokhroder Halnagad
    in one single sentence, this is also imaginative,
    based on political divisions in West Bengal.
    Hritpinder Samudrajatra is based on the voyage of
    Rabindranath Tagore’s grandfather’s heart ripped off
    from his body in a cemetery in England to Calcutta
    in a ship of those days ; I have criticised Rabindranath
    and his father in the fiction. Had Rabindranath’s
    grandfather lived for another ten years the industrial
    scene in West Bengal would have been developed.
    Idiot Bengalis of those days attacked his character of
    vices which you would find thousand times more in
    today’s Indian industrialists, among whom there are
    thieves, black marketeers, smugglers and even those
    criminals who have fled the country. I wrote the detective
    novel as a challenge, but I have dragged Indian society
    there as well. I am not able to write a fiction without
    involving Indian politics and society. Even the
    lengthy story Jinnatulbilader Roopkatha which
    have animal and bird characters, is based on
    political events a personalities of West Bengal.
    Rahuketu is based on court case and activities
    of members of the Hungryalist movement.
    Anstakurer Electra is about sexual relations
    between father and daughter. I have written
    Nekropurush deriving on necrophilia. Chashomrango
    is about elasticity of time.

    Jayeeta : Do you think Salman Rushdie
    is the ideal Postmodern novelist in the perspective
    of Postcolonial or Commonwealth literature ?

    Malay : Rushdie is a magic realist novelist,
    influenced by Marquez. However chaotic it might be,
    the reader understands the novelist, just like
    in the case of Satanic Verses. American critics
    do not give much importance to magic realism
    because the technique was not invented
    in their country ; as a result magic realist writers
    are also labelled as postmodern by them.
    Though there are certain subtle usage of
    postmodern features in Rushdie’s fiction it
    would be incorrect to call it postmodern.
    If you call fictions of Gabriel Garcia Marquez
    as postmodern, spanish critics may shoo bulls
    of bullfight at you.

    Jayeeta : In your fictions we do not find
    conventional trope of love. There are no stereotype
    protagonists. Have you adopted these in
    order to individualize your fiction as yours ?
    In Dubjaley Jetuku Proshwas novel,
    Manasi Burman, Shefali, Julie-Judy ;
    in Naamgandho novel Khushirani Mondal ;
    in Arup Tomar Entokanta Keka sister-in-law,
    Itu in Ouras, they are different from
    one another and none of them are
    stereotype character. You have even
    created a shock at the end of the fiction
    by revealing that Khusirani Mondal was
    kidnapped from East Bengal during partition
    and she is actually grand daughter of
    one Minhazuddin Khan. You have played with
    self-identity in case of Khushirani Mondal ;
    without knowing her own origin she recites
    songs in praise of goddess Lakshmi, follows
    Hindu fasts, believes in superstitions like Chalpara .
    I would like to know the intricacies of Malay’s fiction in detail.

    Malay : That is because my love life has
    not been conventional. Secondly, the concept
    of central character was brought to the colonies
    by Europe, as a symbol of metropilitan throne.
    Women elder to me have first entered my life.
    That might be the reason for the ladies being
    elder to young men in relationship in my novels.
    In female characters obscurely there is presence
    of Kulsum Apa and Namita Chakroborty.
    The life I led during the Hungryalist movement
    has left its impact on female characters.
    Through Khushirani Mondal I have tried to
    indicate that how problematic is the idea of identity.
    Look at today’s Indian society, because of
    identity politics the society is getting fragmented,
    skirmishes are taking place daily,
    Dalits are being beaten up,
    Muslims are being driven out of their home and hearth.
    By banning beef livelihood of hundreds of families
    have been destroyed, Posrk is banned in Islam,
    but in Dubai malls you’d get shop corners in which pork is sold.
    From identity politics we have reached jingoism.
    Let me tell you about my marriage ;
    I had married Shalila within three days of proposing to her,
    both of us liked each each other at first sight.
    I have written these incidents in my memoir.
    Shalila’s parents died when she was a kid ;
    I am unfortunate that I did not get the affection
    of a Bengali mother-in-law.

    Jayeeta : In Dubjaley Jetuku Prashwas novel
    Manasi Burman’s excess breast milk was kept
    on a table after she pumped it out. Atanu Chakraborty
    who had come to visit her suddenly picked it
    up and drank it. Why did he do it ?

    Malay : Atanu’s mother had died recently ;
    he had sexual relation for several months
    with two Mizo step sisters Julie and Judy
    at the Mizo capital where he had gone
    for official work and was quite depressed.
    When he found a mother’s milk on the
    table of Manasi Burman he felt the absence
    of his mother and instinctively gulped the milk.
    In later novels Ouras and Prakar Parikha
    I have explored the strange sexual relations
    between Atanu Chakraborty and Manasi Burman,
    they had by then joined the Marxist-Leninist bandwagon.

    Jayeeta : How far globalization impacted Bengali literature.
    Do you think that globalization is withering away ?

    Malay : I can’t tell you about the current state of affairs.
    These days I do not get much time to read.
    We are both quite old and have to share
    family activities, going to market, cleaning home,
    peeling and cutting vegetables,
    helping my wife in cooking etc --
    I do not get much time. I have not read any novel
    after introduction of globalization.
    Because of Brexit and Donald Trump’s
    withdrawal from international politicking globalization
    has weakened ; only China is interested in selling
    their products ; our markets have already been
    captured by China. However, colonial Bengali
    literature was possible because of Europe.
    Bankimchandra started writing novels in European
    form. Michael Madhusudan Dutt wrote Amitrakshar
    in European form. Poets of thirties started writing
    in European form, so much so that academicians
    have been pointing out Yeats’ influence on
    Jibanananda Das, Eliot’s presence in
    Bishnu Dey’s poems. Before the British arrived,
    our literary style was completely different.
    Symbol, metaphor, image etc were Europe’s contribution.
    I do not have much knowledge about modern songs,
    but critics talk about Tagore having been
    influenced by Europe, in fact some tunes
    are said to be same as certain European songs.
    Singing changed after arrival of Kabir Suman.

    Jayeeta : There is opacity in understanding of
    Remodern, Postmodern or Alt-modern
    even among the poets of Zero decade.
    What are the reasons ? How far Bengali literature
    on the same level as that of international literature ?
    Malay : Even if there is opacity in understanding
    you would find influences. And it would be
    incorrect to presume that everybody’s mind
    is full with smoke. Some are well educated.
    Some do not have any interest, they want to
    write as they please. Without any understanding
    of Remoden, Postmodern, Structuralism,
    Poststructuralism, Feminism one may write as
    he pleases. Kabita Singha did not know about
    Feminist theories but she has written Feminist poems.
    The type of rhymed poems being written in
    Bengali commercial magazines are no more
    being written in Europe, their images are
    fragmentary and have speed. If one reads
    the poems in Paris Review or Poetry magazine
    one would find that they are being written in
    easy dictions, abandoning complexities,
    whereas many young poets have resorted to
    complex Bengali poetry writing. The point is
    that poets do not like to be branded by labels.
    Everybody wants that his name should be known,
    not within any arena of a label.
    I myself feel disgusted because of Hungryalist label.
    Most of the readers do not know beyond Stark Electric Jesus.

    Jayeeta : Now let us discuss some of your personal issues.
    You have written about your growing up period in
    Chhotoloker Chhotobela and Chhotoloker Jubobela.
    You have written about the Hungryalist period in
    Hungry Kimbadanti and Rahuketu.
    However, the later Malay Roychoudhury
    remains unpublished for sometime.
    Tell me about this period. Did you not write
    or they are unpublished ? Tell us about this transitional period.

    Malay : I have already written,
    I have covered the entire period. In the latest issue
    of Akhor little magazine I have written about the
    entire period titled Chhotoloker Jibon. It is to be
    published by Prativas with the title Chhotoloker Sarabela.
    I have sent you a copy of Chhotoloker Jobon,
    you may like to go through. Amitava Praharaj
    has written that readers were purchasing this copy
    of Akhor as people buy bottles of Rum before
    Gandhi’s birthday, since intoxicants are not
    sold on Gandhi’s birthday.

    Jayeeta : What is the difference between
    Malay as a person and Malay as a writer ?
    How do you see yourself ?

    Malay : I do not think there is any difference.
    However, I have tried to destroy the image of my
    identity as a person ‘Malay’ ; I am not satisfied just
    by destroying the language as such. Like any other
    person I go to the market, bargain during purchases,
    resorted to flirting during my youth with a fisher-girl,
    drink single malt in the evening. During the Hungryalist
    movement I used to smoke marihuana, hashish, opium,
    took LSD capsules and drank country liquor. The attire
    I am in during the day is the attire I am in when
    guests visit, even if they are women. I do not change
    they way I talk if someone visits, though I had seen
    some poets and authors talk in a peculiar limpid
    way in Kolkata. Most of them are Buddhadeva Basu’s
    students. I talk in Hooghly district lingo mixed
    with Imlitala diction. As a person and as a writer
    I belong to Imlitala, which makes it easier to break my image.

    Jayeeta : Tell me about your contemporary writers
    who have not been properly evaluated by Kolkata-centric
    literary groups.
    Malay : No evaluation is made at all and you are
    talking of proper evaluation. So much cultural-political
    groupism takes place that works of talented writers
    and poets are not evaluated, specially fiction writers
    remain neglected. Tug of war is played with literary prizes.
    For the same cultural-political reasons CPM
    people were driven out of Bangla Academy,
    though they also were well educated and wise men.
    A new bunch has come who are lavishing their dear
    writers with awards. The Establishment does not
    give importance to those who have avoided both sides.
    For example Kedar Bhaduri, Sajal Bandyopadhyay.

    Jayeeta : Has there been any change in your
    consciousness after reaching life’s twilight ?
    I am talking about philosophy of life.

    Malay : Now I like solitude, I do not want to keep
    on talking, my wife also does not like too much talking.
    We do not go to celebrations.
    Avoid lunch or dinner invitations, for health reasons.
    Here in Mumbai, if I talk about relatives,
    my wife’s cousin and her husband lives in Andheri,
    who is six years older than me. Sometimes I ponder
    over the problem of gathering people to take me to
    the crematorium when I die. I wanted to get cremated
    where my mother was cremated. Or the best thing would
    be to donate the body. That depends on the condition
    of the body after my death. My wife is agreeable to
    this proposition. If she dies first, I also do not have
    any reservation. Problem is that because of arthritis
    I am not able to sign, my wife has to do it
    every time when I visit a bank.

    Jayeeta : Now a days your life and literary
    works are subject to research and dissertation.
    Readers in Kolkata want to know more about it.

    Malay : It has started from about ten years back.
    First Ph D was written by Bishnuchandra De and
    M Phil was written by Swati Banerjee in 2007.
    Marina Reza had come from USA for a research
    project on the Hungryalist movement. Daniela Limonella
    is working on the subject at Gutenburg University.
    Rupsa Das, Probodh Chandra Dey have
    written M Phil papers. Nayanima Basu, Nickie Sobeiry,
    Jo Wheeler from BBC, Farzana Warsi, Juliet Reynolds,
    Sreemanti Sengupta have written about our
    literary movement. Maitreyee B Chowdhury has written
    a book titled The Hungryalists which have been published
    by Penguin Random House. I know about them because
    they had contacted me. Some researchers do not contact
    me and approach Sandip Dutta’a Little Magazine Library
    for information, such as Rima Bhattacharya, Utpalkumar
    Mandal,Madhubanti Chanda, Sanchayita Bhattacharya,
    Mohammad Imtiaz, Nandini Dhar, Titas De Sarkar,
    S. Mudgal, Ankan Kazi, Kapil Abraham and others.
    Udayshankar Verma wrote his Ph D dissertation at
    North Bengal University, he did not contact me,
    neither did he cover the entire literary movement.
    He could have gathered more information and
    documents had he contacted Dr Uttam Das.
    Deborah Baker did not meet any of us nor
    did she visit Sandip Dutta’s Library and wrote
    abracadabra in The Blue Hand based on what
    Tarapada Roy told her. Rahul Dasgupta and
    Baidyanath Misra have edited a collection of
    research papers and interviews titled
    Literature of The Hungryalists : Icons and Impact ;
    this book have photographs of all the Hungryalists.
    Samiran Modak has collecte the issues of Zebra
    edited by me in 1960s and published it recently ;
    he is trying to anthologize all Hungryalist periodicals.

    Jayeeta : You have worked in various genres of literature.
    Do you have any other subject in mind to write about ?

    Malay : I am thinking of writing a fiction on a Baul
    couple who in their youth were involved in Naxal
    movement and the other in anti-Naxal or Kangshal gang.
    The fall in love after renouncing their earlier role when
    they become Bauls. But I am unable to construct the
    characters around them to carry the fiction forward.
    The idea came after reading Faqirnama by Surojit Sen.
    Since I do not have personal experience about these
    mendicants I could not proceed further. Here also
    the woman is elder and has more experience for
    having changed partners several times. They call
    themselves Mom and Dad. Sarosij Basu has
    requested to write an essay on the present social
    conditions of the country, nationalism, patriotism,
    riots, beef eating, suppression of undercastes etc
    for his periodical Bakalam,. I have started writing
    under the title of Vasudaiva Jingovadam.
    Problem is, I am unable to sit at the computer for long.

    Jayeeta : You seem to be like Homer’s Spartan heroes.
    You do not care about being attacked, people
    talking against you, writing against you.
    Where from do you get the life-force ? Who is your inspiration ?

    Malay : Your question seems to be based on
    your experience of having watched
    Hollywood-Bollywood films. Is it ? Rambo,
    Thor, Gladiator etc heros. I was handcuffed
    and a rope tied around my waist during my
    arrest for having written Stark Electric Jesus.
    I was made to walk in that condition with seven criminals.
    After the Khudharto group testified against
    me in the Court, nothing bothers me,
    lot of people of the Establishment write against me,
    abuses me, specially the disciples of Khudharto group.
    When I started writing, Kulsum Apa, Namita Chakraborty,
    our Imlitala helping had Shivnandan Kahar and Dad’s
    helper at his photo-shop introduced me to poets.
    The latter two had by-hearted Saint poets
    and would quote from them for scolding us.
    My wife and son do not have any interest in my writing.
    My daughter has but she does not have much time,
    recently she suffered from a cerebral stroke as well.
    I do not know whether there is really anything called
    inspiration. I think I am my own inspiration, when
    I walk the streets inspirations keep on getting
    accumulated in my brain.

    Jayeeta : Tell your devoted readers about your
    present daily life.

    Malay : Do you think I have devoted readers ?
    I do not think so. I get up first in the morning,
    wife gets up late, as she does not get good sleep
    during night, takes homoeopathic medicines during
    the night. After brushing I do some free hand exercise,
    taught to me by the physiotherapist. Drink a glass
    of lukewarm water to keep bowels clean.
    Prepare breakfast, oats. Then while reclining
    on the easy chair I go through The Times of India.
    I do not get Bengali newspaper in our locality.
    It is an area of Gujarati brokers who purchase
    one Financial Times which is consulted for the
    share market news by dozens of persons.
    I have never invested in shares and do not
    find any interest in talking to them.
    If I request the hawker he will deliver four days’
    Bengali newspaper in a bunch.
    Then I go through the little magazines received by post.
    After physiotherapy I prepare tea, green tea.
    By that time my wife gets up and serves oats and fruits.
    I complete my breakfast. Her breakfast is
    completed around Eleven. Then I go to the market.
    Fish is delivered by the shop whenever we ring them
    for a particular type of fish. I do not eat meat anymore
    though my wife loves it but unless you go to the butcher
    you will not get good portion ; my daughter in law,
    whenever she comes from Saudi Arabia on holidays,
    she brings cooked meat. About eleven I sit at the desktop
    and start thinking ; browse through Facebook and Emails.
    Take bath at about one, have lunch with my wife,
    then have a nap. From six I repeat at the desktop.
    I write during this time. Now a days I am translating
    foreign poets. After having dinner, take a sleeping
    pill and go to bed. This the time to brood and lots
    of ideas come swarming.

    Jayeeta : These days poets are being categorised
    in to decades ; they are being categorised on the basis
    of the districts they live in as well as subjects
    they specialize in. What is your opinion ?

    Malay : It is a time induced phenomenon.
    Time will sieve out those who are not attuned to
    a particular time. The number of poets have
    increased in the districts. When such anthologies
    are published we would be able to have an
    idea of the effects of local diction and ecology
    of the space in their poems. I do not know to
    which district I belong. Ancestors had come from
    Jessore to Calcutta and settled at Barisha-Behala
    of Calcutta. One of the descendant settled at Uttarpara
    in Hooghly district in 1703, I am from his bloodline.
    Now the Villa he built has been demolished and
    I have sold off my portion. Then I stayed in a flat at
    Calcutta’s Naktala. Thereafter came to Mumbai after
    donating all my books and furnitures etc. The house I
    once left, I have never gone back to live there again.
    I have not spent my life in the same room, same house,
    same locality, same city.

    Jayeeta : Literary periodicals have now
    discovered micro-poems. What is your idea about it.
    Should an Editor specify the number of words or lines ?
    The poet finds himself at sea in such cases.

    Malay : This also has happened because of increase
    in number of poets. To accommodate a large number
    of poets in a particular issue of the periodical
    such publications have come into vogue.
    But Ezra Pound had written imagist poems
    after being influenced by Chinese and
    Japanese poems. He had written a poem
    titled “In a Station of the Metro” which is the best
    short poem ever written. Here it is:

    The apparition of these faces in the crowd ;
    Petals on a wet, black bough.
    Jayeeta : Tell us about your international
    connection, your introduction to World literature.
    Have you been fascinated by any foreign
    poet or writer? With whom your friendship
    has been quite close ? Are they present day
    foreign readers aware about your work ?
    Malay : During the Hungryalist movement
    I had known Howard McCord, Dick Bakken,
    Allen Ginsberg, Laswrence Ferlinghetti,
    Margaret Randall, Daisy Aldan, Carol Berge,
    Daiana Di Prima, Carl Weissner, Allan De Loach
    and others. During my arrest Police had seized
    all letters which I did not get back with many books,
    manuscripts and other things. These days people
    from print and electronic media visit me for interviews.
    BBC representatives had come for their
    Radio Channel 3 and 4 programmes.
    Daniela Limonella had visited a few times,
    she is writing a dissertation on our movement ;
    my wife also loves her. I do not know whether
    you have read Maitreyee B Chowdhury’s book
    “The Hungryalists” published by Penguin.
    Baidyanath Misra and Rahul Dasgupta has
    edited an anthology of dissertations by
    academicians along with interviews of some of us.
    Recently painter Shilpa Gupta visited and presented
    me with sets of colours, brushes etc to enable me
    to paint.I have started experimenting with colours.
    In Mumbai students often visit for collecting
    information. Recently a Turkish periodical has
    written about me and translated my poem
    Stark Electric Jesus. Turkish writer Dolunay Aker
    has interviewed me which will be published in
    Turkey shortly.

    Jayeeta : When did you start writing poems ?
    Why ? Because your elder brother Samir used to write ?

    Malay : In 1958 my Dad had presented me
    with a beautiful diary in which I started writing.
    At that time I wrote both in Bengali and English.
    Samir started writing after me. When Sunil Gangopadhyay
    visited our Patna residence he evinced interest
    and Samir gave him some of my poems which
    Sunil published in his magazine “Krittibas”.
    Later Sunil became very angry because of
    the Hungryalist movement. In an interview to
    “Jugashankha” Sunil had told Basab Ray that
    “Malay deliberately took the opportunity as
    I was in America at that time.”

    Jayeeta : Without going into the details of Hungryalist
    movement I would like to ask whether the poetic diction
    of that time had any influence of Nicanor Parra or
    Beat Generation poets ?

    Malay : To be frank, till then I had not read them.
    In fact I was not aware about their names.
    Foreign poets meant romantic British poets.
    In my poems you will find influences of Magahi
    and Bhojpuri diction because of my childhood
    spent at Imlitala slum of Patna. I read Beat literature
    after Lawrence Ferlighetti and Howard McCord
    sent me some books. Moreover all Beat prose
    and poems have not been written in same style.
    We in the Hungryalist movement did not follow
    the same diction and style. Some of my friends
    after joining CPI ( M ) party started writing in a different vein.

    Jayeeta : The poems you had written during
    the first phase were different from your present
    day style and diction. During the first phase there
    were elements of disruption. Their syntax and diction
    structures were astounding. In the subsequent phase
    your family life, experience have weighed
    upon your work; poetry has become like deep
    sea and up-wailing.
    Though there is no similarity,
    even then one may find out that you are the author.
    Tell us something about it.

    Malay : During that phase my poems had
    testosterone, adrenalin. We used to fund our own
    broadsides and periodical and felt free to write as we
    pleased. We were in a world of drugs and Hippie Colony.
    Now after having read so much and experience
    of touring almost entire India, the changes have come
    automatically. In between I did not write for fifteen
    years and concentrated on reading.

    Jayeeta : Do you think Postmodern poetry
    is being written in Bengali ?

    Malay : Yes, definitely. What is known as postmodern
    features are seen in the poems of almost all
    contemporary poets. Some young writers compose
    wonderful and stunning lines and images ;
    I rather feel jealous. You may read Barin Ghoshal.
    Alok Biswas, Pronab Pal, Dhiman Bhattacharya.
    But there are differences between postmodern
    philosophy and postmodern literature.

    Jayeeta : Who are the contemporary poets
    you love to read, in Bengali as well as in foreign languages ?

    Malay : In Bengali, Binoy Majumdar, Manibhushan
    Bhattacharya, Falguni Roy, Kedar Bhaduri,
    Jahar Senmajumdar, Yashodhara Raichaudhury,
    Mitul Dutta, Anupam Mukhopadhyay Helal Hafiz,
    Rudra Muhammad Shahidulla, Pradip Chowdhuri’s
    “Charmarog” -- I am not able to remember all the
    names immediately. In foreign poets I would name
    Paul Celan, Sylvia Plath, Maya Angelu, John Ashbery,
    Amiri Baraka, Yeves Bonneyfoy, Jaques Dupan.
    I am not naming more ; you may start searching
    for influences. Recently I have started translating
    most of the European Surrealist poets, Arab,
    Turkish and Russian poets and I am sure there
    may be influences creeping in to my own poems.
    Though I do not write much.

    Jayeeta : Lot of research is going on about
    Hungryalist movement and your work in English.
    Do you feel proud about it ? Do you think you
    have achieved what you had started for ?

    Malay : Nothing happens to me. Those who
    used to denigrate and attack me, I suppose they
    feel distressed. A few days ago Kamal Chakraborty
    had expressed his anguish. Actually I was offended when
    Kamal agreed to publish a poetry collection of mine.
    However the book was a disaster in publishing
    with newsprint papers and ordinary cover
    compared to his own book. But I no longer keep my books
    and do not bother about them.
    Publisher Adhir Biswas agreed to publish
    all my books but backed out because of unknown reasons;
    he also told other publishers not to publish my books.
    Calcutta Literature scene has become quite dirty.

    Jayeeta : Syllables or rhymes, what should be followed ?

    Malay : I do not count syllables.
    I write based on breath spans.

    Jayeeta : You tell us to keep updated with
    foreign poetry but in poetry is it not necessary
    to maintain Bengali sentiment and own Bengali diction ?
    If one follows foreign poetry, can it be called
    copying or following ? Jibanananda Das and
    many other poets had to face such complaints?

    Malay : If one reads poems in other languages
    one may have an idea as to in which way world poetry
    is moving. There is no need to copy.

    Jayeeta : In fictions, writers during Hungryalist
    movement had not used local Bengali diction or
    dialogoues of the marginal society. What could be the reason ?

    Malay : At that time most of the writers were
    Calcutta-centred. When muffassil writers started
    writing marginal people and their voice entered literature.
    In 1965 Subimal Basak Had written “Chhatamatha”
    in Dhaka’s kutty peoples language. Rabindra Guha
    and Arunesh Ghosh had also brought the lingo of
    the local and marginal.

    Jayeeta : In literature sexuality has entered as
    Art but entirely in explicit and uncompromising way.
    Readers are stunned. You people had brought
    Activities of the bed and sex in creativity.
    I would talk about you. Sexuality has been
    highlighted in various ways, in poetry, sometimes
    through characters in fiction or in memoirs,
    specially in your life-based fiction “Arup Tomar Entokanta”.
    Please talk about it.

    Malay : Sexuality existed in Sanskrit and Bengali
    literature from antiquity. During British rule, after
    the Evangelical Christians poked their nose in
    the syllabus of schools and colleges a new
    middle class appeared and they started hesitating
    with sexuality in literature. Thereafter the Brahmo Samaj
    people arrived, specially Rabindranath Tagore.
    When literature got out of the clutches of middle class,
    sexuality in literature got its rightful place.

    Jayeeta : You had proposed to your would be wife
    Shalila the day after you two were introduced
    and she agreed instantly ; since Shalila’s guardians
    were hesitating to agree immediately, you had purchased
    rail tickets to Patna to elope. But when the guardians
    agreed you got married within a few days and returned
    to Patna with your wife. Did you think her behaviour
    to be strange for agreeing immediately.
    Did your parents react annoyingly to your decision ?

    Malay : No. Shalila was a field hockey player,
    had reacted like a sports-girl. Moreover she did not
    have her parents. She wanted to get out of the
    oppressing establishment of maternal uncles.
    The uncles hesitated as Shalila’s income from
    her job was useful for them. If we had eloped then
    there would have been problems with her job which
    she did not want to quit. For getting a transfer to Patna
    she required legal documents. You are a teacher,
    you know how important it is for women to be financially
    independent. My parents were very happy when
    I reached Patna with Shalila. They thought I might become
    a lout if I do not get married.
    But no rituals were performed at Patna.

    Jayeeta : After marriage you left your
    Patna job and joined Agricultural Refinance
    and Development Corporation at Lucknow,
    from there you went to Mumbai to join NABARD ;
    thereafter you came back to NABARD, Calcutta.
    Returning after so many years did you feel that the
    Hungryalist days are no more there at Calcutta ?

    Malay : Only after going to Lucknow I came to
    know Indian village life. Prior to that I had no idea
    about cultivation, jute and cotton mills,
    carpentry, handicraft, tribal life etc.
    I did not know there were so many types of cattle,
    pigs, goats, camels and their breeding methods.
    I toured almost entire country. When I came to Calcutta,
    I took along Shalila with me so that she enters the
    houses of villagers to find out their way of life.
    I have utilised those information in my fictions
    as well as essays. What you said is correct.
    When I returned West Bengal the society
    had changed completely. Some critics have
    written that I was in a government job.
    That is not correct. The Finance Commission
    increases pays and pensions of government workers
    but my pension remains that same
    as I am not a government worker.

    Jayeeta : Do you watch Bengali serials ? Films ?

    Malay : Shalila watches some serials,
    but she does not stick to any one story.
    If she feels a girl is not being treated properly
    she shifts to another serial midway.
    During dinner time I also watch with her.
    Here in Mumbai there is no scope to talk
    and listen to people talking in Bengali.
    The Bengali serial is helpful in keeping in
    touch with the way people talk in present day
    Bengali. I watch short films also on my desktop
    but the problem is my sound system does not
    work properly ; the desktop is very old, it belonged
    to my son when he was in college. Moreover
    I am not able to sit continuously in front of the computer
    for a long time.
    I have not been to any cinema hall for about thirty years.
  • Maitreyee B. Chowdhury | 236712.158.8989.217 | ০২ জুলাই ২০১৯ ১০:২১541378
  • The Hungry Poets
    By Maitreyee B Chowdhury
    In a city roiled by poverty, immigration, violence and the energy of youthful anger, a new generation of writers staked their claim, says Maitreyee B Chowdhury

    In October 1962, young poet Malay Roy Choudhury boarded the newly launched Janata Express at Patna. The train would stop in Delhi before it reached Calcutta—a rather tedious journey that would go on for over two days. Malay hoped Calcutta would be pleasant this time of the year. His elder brother, Samir, had written to him just before he had left for Calcutta. You’ll reach just in time to see the city being decorated for Durga Puja. Ma arrives in the most beautiful colours and people make the most creative podiums for her to be worshipped in. The kashphool would have spread its abundance. You’ll find them everywhere if you care to look, spread out sleepily in the emptiness outside the city. The sound of dhak will be everywhere and if you’re lucky, you’ll find some of the dhakis at the Howrah station when you arrive. Malay wondered if Calcutta had changed Samir. Patna was dry and without a trace of chill. The narrow seats and the stale air that greeted him in the third-class compartment were terrifying. He was carrying two small bags, his underwear peeking out of one, some papers and a few packets of crisps from the other. It was still early evening, with reluctant bogies idly basking in a gentle sun. It was Malay’s first trip to Calcutta after the establishment of the Hungry Generation.

    Before the year would end, Malay would meet American poet Allen Ginsberg in Calcutta. It was February 1961 when Ginsberg landed in Bombay. A nuclear face-off had just been averted in Cuba and Delhi was at loggerheads with Peking—a border dispute had pushed the two countries to the brink of war. And just like everywhere else, poets, writers and thinkers in India too were affected by these events.

    Ginsberg visited many places in the country, including Benares, Patna, the Himalayan foothills and Calcutta. During his trip, he spent most of his time mingling with like-minded poets, musicians and artists, and later wrote about them in great detail in his Indian Journals. In Calcutta, between keeping company with Ashok Fakir in ‘Ganja Park’—an area near the main road stretching from Chowringhee to Rashbehari Avenue—and hallucinating at Kali’s feet while lying in her temples, Ginsberg would walk around the city or watch bodies being burned in the ghats. To the ever-sceptical Bengali, he might have seemed like just another disillusioned westerner doing the rounds of holy Indian cities, in search of drugs, sex and ‘exotic’ spirituality. Not many Indians at the time were aware of Ginsberg’s reputation or the influence he wielded back home. Ginsberg, of course, had read ‘Howl’, his legendary poem, at Six Gallery in San Francisco by then, and had begun shaping the American approach and reaction to poetry. What effect his presence would have on the poets in Calcutta, or they on him, time would tell vividly. But for now, he was one of them—a poet and a wanderer, who carried with him a turbulent and disturbed past, with the belief that here, of all places, he would be accepted no matter how dirty or disillusioned he was.

    The train moved slowly, as if struggling with a natural inclination for inertia. Malay remembered what Samir had written to him from Calcutta while he was in Patna. He had been angry with their father for sending him away to Calcutta after school. The Roy Choudhurys had decided to move from Imlitala, their Patna neighbourhood, which their father considered a bad influence on the boys. Pretty early on in life, the place had exposed them to free sex, toddy, ganja, and much more. Their father had built a new house in Dariapur and the family had shifted there. Subsequently, when Samir was sent to Calcutta, it was a double blow for him, to be removed at once from Imlitala and his family. Calcutta was a city he knew almost nothing about. His instructions to Malay had been clear—he was going to live vicariously through his brother in Patna. On certain days, Samir would almost be pleading with Malay in his letters.

    Dear Malay,
    Near the chariali next to our house is a woman who sells bidis for two annas. Buy a packet from her, hide it in your trunk and bring it for me when you’re in Calcutta. Remember, nobody should know about this.
    Dada

    And another about a month later read:
    Dear Malay,
    Apparently, there are many things to do here, but I don’t know where to start. I have made a few friends; we meet at the Coffee House regularly. Deepak [Majumdar], Ananda [Bagchi] and Sunil [Ganguly] are close to me. Sometimes we discuss kobita [poetry], at other times, it is the state of affairs. Everyone is angry here; there are strange people I meet on the road. Theyare not like the poor of Imlitala; they have a lost look about them. They don’t look or feel poor when you talk to them—all you can understand is death on the inside. I think they have lost a dream. It makes me feel horrible; I miss the easy poverty of Imlitala . . . You must go to Bade Miyan’s paan shop at the end of our lane and tell him about the paan that I used to have, hewill know. You could have one yourself, but I fear it might not be good for you. You must bring one for me though. It will cost you one anna.
    Dada

    Malay could not understand from Samir’s letters whether he was happy in Calcutta or not. But he sensed some anger. He seemed like a revolutionary without an understanding of what his revolt was about. Malay wished Samir knew how much he wanted to see Calcutta—this city where poems were read aloud on the streets; where a Shankha Ghosh, even at the height of his literary career, could be approached by college students; where Shakti Chatterjee would recite poetry on the stairs of the Coffee House. Samir’s shift to Calcutta indirectly helped Malay in many ways. It was Ashadh of 1952 when Malay next received a letter from Samir. It had been raining for two days and the blue inland envelope was wet when Malay fetched it from the letterbox. Unlike his previous letters, Samir sounded excited in this one—it was the first time he had forgotten to mention Imlitala.

    Dear Malay,
    Last evening, Sunil, Shakti and Deepak came home. My room is small, and the bed has too many books on it for me to move them. We sat on the terrace adjoining my chilekothar [an attic-like room]. While it didn’t matter to either Sunil or Deepak, I was glad I had the small mat Ma had insisted I bring from Patna. Tha’mma doesn’t stir out of her room after dusk, so it was OK for Sunil to bring his smoke. Thanks to the gondhoraj lebu plant that is full of flowers and small bulbs of lemons, the smell of smoke was confined to the terrace. We talked for a long time; thankfully, none of them were in a hurry. Tha’mma might ask a lot of questions tomorrow though. Sunil is full of ideas; he says he wants to start a magazine. He is still not sure how to go about it though, but he says he is bored of reading the same kind of writing. I told him what you and I have talked about so many times. He seemed a bit surprised at first, and then asked me about you. Deepak was quiet all evening, but he sang a song later. Kaka came up to meet us. Later, he and Deepak talked about Hindi film heroines. Their discussion made Shakti and me laugh a lot. There was not much to eat, but Sunil had bought some pakoras on the way; we ate them and, later, licked the plate clean. Sunil went through my books and wanted the [Victorian poet, Algernon Charles] Swinburne collection. I can give it to him only later, which is what I told him. I hope he didn’t take offence though.
    More later,
    Dada

    Many new writers were Samir’s classmates in City College. There were other established ones, Coffee House regulars, whom Samir had befriended and would discuss literature with. Shakti and Sunil came up quite often; they were close friends, who had been to his family home in Uttorpara a few times. Sunil was a prolific and acclaimed novelist, but poetry was his first love. Indeed, Samir, who’d recognized his talent early on, went on to fund and publish Sunil’s first book of poems, Eka Ebong Koyekjon. Samir would have intense discussions with Deepak, Sunil and Shakti on many an evening on the kind of literature they had all grown up with and began to believe in. Subsequently, he got deeply involved with Sunil in establishing Krittibhash—a journal that launched many a Bengali poet at that time. Deepak, Ananda and Shakti were also compatriots in this venture. Krittibhash found its voice in 1953. Samir always kept his brother in the loop, and Malay would occasionally receive large paper packets containing literary periodicals and books of poetry. Now as the train moved towards Calcutta, Malay felt as if his life was coming full circle. It had been a strange decision to visit the city at a time when post-Partition vomit and excreta were splattered on Calcutta streets. Marked by communal violence, anger and unemployment, the streets smelled of hunger and disillusionment. Riots were still raging. The wound of a land divided lingered, refugees from East Pakistan (now Bangladesh) continued to arrive in droves. And since they did not know where to go, they occupied the pavements, laced the streets with their questions, frustrations and a deep need to be recognised as more than an inconvenient presence on tree-lined avenues. The feeling of being uprooted was everywhere. Political leaders decided that the second phase of five-year planning needed to see the growth of heavy industries. The land required for such industries necessitated the evacuation of farmers. Forced off their ancestral land and in the absence of a proper rehabilitation plan, those evicted wandered aimlessly around the cities—refugees by another name.

    Calcutta had assumed different dimensions in Malay’s mind. The smell of the Hooghly wafted across Victoria Memorial and settled like an unwanted cow on its lawns. Unsung symphonies spilled out of St Paul’s Cathedral on lonely nights; white gulls swooped in on grey afternoons and looked startling against the backdrop of the rain-swept edifice. In a few years, Naxalbari would become a reality, but not yet. Like an infant Kali with bohemian fantasies, Calcutta and its literature sprouted a new tongue—that of the Hungry Generation. Malay, like Samir and many others, found himself at the helm of this madness, and poetry seemed to lick his body and soul in strange colours. As a reassurance of such a huge leap of faith, Shakti had written to Samir:

    Bondhu Samir,
    We had begun by speaking of an undying love for literature, when we suddenly found ourselves in a dream. A dream that is bigger than us, and one that will exist in its capacity of right and wrong and beyond that of our small worlds.
    Bhalobashajuriye
    Shakti

    Patna, October 1961. Shakti and Haradhan Dhara met Samir and Malay at the brothers’ newly built house. Evening crept stealthily on to their shoulders and sat still there. The Roy Choudhurys were still in a transitional frame of mind. The brothers had not forgotten Imlitala—its terrific chaos, the shadows of their childhood and their small house. The new house in Dariapur on Abdul Bari Road looked spick and span, and stupid. “Not a house for me, not for me!” Malay would shout at the walls. But their father would have none of it—in his vision for his family, Imlitala was a matter of the past. Nearby, in Rajendra Nagar, lived Hindi writers Phanishwar Nath Renu and Ramdhari Singh Dinkar. They belonged to the Nayi Kahani and Uttar Chhaya Wadi movements respectively—groups that believed in largely individualistic, urbanistic and self-conscious aesthetics. While Renu was critically acclaimed as among the most powerful and brilliant writers of his time, Dinkar had a huge impact on readers of Hindi poetry. He went on to become a renowned poet of national standing. His poetry, a precursor to the A-Kavita movement, would later emerge in the sixties as a contemporary influence, inspired in some ways by Ginsberg and the Beat journey. Samir’s regular interactions with them would leave a deep impact on his thinking and mould his poetry in the future. Sometime later, Dinkar, who belonged to the community of Bhumihars, would abandon his caste to make an important statement on caste politics.

    It was nine in the evening; dinner was over. None of them had ventured out all day. Malay insisted that Shakti visit Imlitala with him: “I miss Naseem Apa—her fragrant hair, the curve of her back, the way she ran after I kissed her hazaar times in the shadow of the imam. Shakti, come with me to see her, won’t you?” Shakti was overwhelmed by the romanticism of a ghetto being named after a tree. He had been eager to see the imli tree after which Imlitala was named. “Will there be an enactment of Radha–Krishna’s sharad purnima rasa dance?” he asked. “Did the imli tree have a golden wall after the legend of Krishna turning a golden hue while searching for his beloved Radha, who had disappeared in between their dance?” Malay was amused. He had not witnessed any religion in Imlitala. Everyone born there was sworn to poverty, their only allegiance was to the mad dance of filth around them. He told Shakti, “Would you like to read your poetry during the Imlitala fest? Small-time thieves, prostitutes and roadside urchins make up the audience. Women in pink blouses and green petticoats sit down with their men to have country liquor, one hip bent on another, and with dirty hands touch each other. Some love will flow, some lust too. You’ll need a different lens to be able to see this poetry.” Samir sounded a warning that the police might be there too. “Wherever poetry is, the dogs follow,” Malay quipped. A round of laughter followed.
    Excerpted from The Hungryalists, forthcoming from Penguin India. Published in the Jan-Mar 2019 issue.

    About the author
    Maitreyee B Chowdhury is a poet and writer based in Bengaluru.
    She is poetry editor of The Bangalore Review. Maitreyee is author of Where Even the Present Is Ancient: Benaras and Uttam Kumar and Suchitra
    Sen: Bengali Cinema’s First Couple (nominated for the Crossword Awards, non-fiction).
  • রঞ্জন | 237812.69.4556.38 | ০৩ জুলাই ২০১৯ ১৪:০৩541379
  • ্দু'দিন ধরে কোনরকমে নাওয়া-খাওয়া সেরে একটানা পড়ে শেষ করলাম --"ঔরস" উপন্যাস।
    অসাধারণ লেগেছে। হয়ত মলয়বাউকে নিয়ে কিছু পূর্ব ধারণার কারণে এমন গদ্যরচনা আসা করিনি। এটি উপন্যাসের ভঙ্গিমায় একটি সোশিও অ্যান্থ্রপলজিক্যাল বয়ানকথা।
    আমি বীজাপুর, নারায়নপুর, কোন্ডাগাঁও, বস্তার, দন্তেওয়াড়া সুকমা গেছি। অবুঝমাড়ে ঢুকি নি । বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট পড়েছি যাতে শহুরে মানুষের রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল।
    এই প্রথম 'অবুঝমাড়' নিয়ে একটি অথেন্টিক লেখা পড়লাম, তার প্রকৃতি, বনসম্পদ ও মানুষ নিয়ে । আশি পেরোনো মলয়বাবু কবে এসব এমন নিবিড় করে দেখলেন? আমি মাথা নোয়ালাম।
    যারা পড়েন নি পড়ে ফেলুন; ঠকবেন না -- গ্যারান্টি!
    শেষে পাইম্যামকে অকুন্ঠ ধন্যবাদ একজায়গায় মলয়বাবুর এত লেখা আপলোড করার জন্যে ।
  • Margaret Randall | 124512.101.89900.159 | ২২ জুলাই ২০১৯ ১০:৪৭541380
  • Excellent analysis of the Sandinista Revolution in Nicaragua by one who was there and remains true to his ideals.

    Forty Years Since the Sandinista Revolution: Could it Have Been Different?
    July 19, 2019

    On the 40th anniversary of the overthrow of the Somoza dictatorship, Envío magazine invited Luis Carrion Cruz, one of the nine comandantes on the original FSLN National directorate, deputy minister of the interior and minister of the economy during the 1980s, and in the leadership of the Sandinista Renovation Movement (MRS) since 2005, to share his assessment of the current situation. Carrion writes of the revolution, his participation in it, and his take on how we all got to this moment in which Daniel Ortega has Nicaragua trapped in a dictatorial crisis with no clear or easy way out given his determination to remain in power at all cost.
    By Luis Carrión Cruz (Envio magazine)

    HAVANA TIMES – I’ll do my best to evaluate the revolution, though I’m hesitant to do so for several reasons. First because I was there as a protagonist, so I share responsibilities for the good and bad parts of that period, some of which are still topical today even though they date back 40 years. Secondly, I speak from my memories, and memory is always fallible and selective. And finally, the revolution was such an enormous, complex and multidimensional phenomenon, it’s very hard to summarize what it represented in a few pages.
    The revolution was a giant popular movement
    A revolution is never just a political power takeover by a party through elections or a coup. In Nicaragua’s case it was a huge political and social movement, a giant movement of people who overthrew the Somoza dictatorship and later continued pushing for deep changes in our country’s social reality. Masses of people from all social classes and different political positions participated in different moments and in different ways. The Sandinista National Liberation Front (FSLN) was the catalyst and main protagonist of that historic struggle, its ethical and political guide.
    But the revolution wasn’t just a social and political phenomenon. It mobilized the spirit of those of us who participated in it. And I’m not referring only to the leaders, but to many, many more. Because of the revolution, many of us set aside all of our personal life projects to replace them with the revolution’s overriding collective project. That vital experience also explains why thousands of people were willing to face enormous difficulties and sacrifices, even risk their lives for the revolution, demonstrating extraordinary heroism that will remain in a history that cannot be erased or debased. Without that, we can’t explain how in 1990 almost 40% of the voters still voted for the FSLN after a decade of terrible difficulties, shortages, pain and many deaths.
    The FSLN acquired power nobody had ever had before
    The revolution unleashed energies and passions, which mixed with all types of emotions aimed at building “the promised land.” Those emotions and actions ranged from the most basic ones, such as seeking vengeance for perceived or real harm by Somoza’s representatives or followers, to the most noble ones by those of us who wanted to transform the social and political reality in favor of the great majorities.
    The fall of the Somoza dictatorship eliminated the plug that was blocking most people’s political participation and opened the doors to a multifaceted, and at first disorganized, popular action. The end of Somocismo allowed for the awakening of all the diverse and many times contradictory dreams and demands of different sectors, frequently manifested in a chaotic form.
    For reasons unique to our case, the revolution entirely swept out the capitalist Somoza State. Not a brick was left of it, permitting a new State to be built practically from scratch. By arising in that vacuum as the political force that capitalized on the returns of Somoza’s overthrow after a long history of struggle, the FSLN acquired more power than anybody had ever had before in the history of Nicaragua. With that unanticipated total power, we took on the construction of a new State, placing the Sandinista seal on all public institutions, and on numerous genuinely mass organizations that covered virtually every social sector.
    Soon the worse suspicions were mutually confirmed
    The revolution didn’t happen in an isolated Nicaragua. It happened in an international context marked by the Cold War between the East and the West, between the US and the Soviet Union. Ronald Reagan’s government (1981-1989), which took office just as we were beginning to implement our vision of a true national revolution, saw it as a Soviet Union advance on the American continent that threatened to destabilize the whole region.
    During Reagan’s electoral campaign, his team produced a famous programmatic text called the Santa Fe Document that openly established the objective of overthrowing the Sandinista government. Once in power, Reagan launched an ongoing large-scale and multidimensional aggression with political, diplomatic, economic and military actions against the Sandinista government. The Reagan administration supported the remnants of the Somoza family’s National Guard, developed actions of sabotage executed directly by the CIA and last, but hardly least, financed and militarily advised and equipped the “Contra,” as the counterrevolutionary forces that began with those former National Guardsmen soon came to be called. These actions involved not only the United States, but also other countries in the region.
    For historical reasons, we had a deep mistrust of US governments because of their military interventions all over the world, and their history of overthrowing governments and supporting sanguinary regimes. Nicaragua, too, had been through more than one US military intervention, and Washington had supported the Somoza family right up to its final moment. We were convinced that the US would always try to destroy the revolution, as it was in its imperialist nature.
    Very soon we felt the need to develop a three-pronged defense strategy. One was to support the guerrilla movements of Central America, not only for solidarity reasons, but also defensive ones. Another was to establish an alliance with the Soviet Union, because we needed some sort of umbrella that would protect us from the “monster.” And the third was to create a strong Army.
    Both the US actions and ours mutually confirmed each other’s worse suspicions and set the stage for the bloodiest war between Nicaraguans we’ve ever had, and the country has had several in its history.
    We felt we were fighting for our survival
    The US aggression tapped into a growing disaffection among Nicaraguan peasants, brought about by factors of our own making.
    Peasants from all over the central part of the country rose up against the revolution and against the Sandinista government. Many joined the Contra ranks, which made way for a sort of organized civil war, financed and managed by the US, but made up largely of disaffected peasants who were supported by much of the civilian rural population.
    I say “a sort of civil war” because the Contra side didn’t have a coherent, developed political project opposing the revolutionary project. This contrast had an impact at the moment of the first peace negotiations, held in the border town of Sapoá, so they didn’t demand important institutional changes, contrary to what the FMLN did when the war ended in El Salvador.
    The revolution lived a good part of its 10-year life under siege, fighting for survival, under constant threat of a direct US military intervention. Let’s remember that just in the 1980s the US intervened militarily twice in our neighborhood: in the Caribbean island of Grenada in 1983 and in Panama in 1989. We thus weren’t exaggerating or being paranoid by believing we, too, could experience a military intervention. We felt harassed, besieged and threatened, convinced we were fighting for our very survival.
    At the end of the 1980s the world situation changed radically. The socialist camp collapsed, and the United States emerged triumphant from the Cold War. The financial and military support we were getting from the USSR ended abruptly.
    There was also a shift in the United States. With a Democratic majority in both houses of the US Congress and Bush Sr. replacing Reagan in the White House following the 1988 elections, the war policy against the Sandinista government wound down and support for the Contra was suspended.
    By then, the accumulated erosion of Nicaragua’s human and economic conditions was brutal. While there was less recruitment for military service, it was increasingly difficult and conflictive. Both sides were completely exhausted and negotiations became the only way out.
    Following the regional negotiations known as the Esquipulas peace process – named after the city in Guatemala in which they were first held – talks began with the Contra, culminating in the Sapoá accords. These negotiations opened the door for the 1990 elections, the electoral defeat of the FSLN and the end of the revolution.
    The FSLN’s 72-hour Assembly Ruptures the national consensus
    Now, after that fast forward through the war that so dominated the revolutionary decade, let’s start back at the beginning and look at the ups and downs of the revolutionary process itself. The revolution came into power with a program hammered out by the broad-based five-person National Reconstruction Junta, which itself had been negotiated as a provisional government with other opposition sectors and even the US government before the fall of Somoza.
    With respect to democracy, that program said: “The necessary legislation will be enacted for the organization of a regime of effective democracy with justice and social progress that will fully guarantee the rights of all Nicaraguans to political participation and universal suffrage, as well as the organization and functioning of political parties, without ideological discrimination, with the exception of parties and organizations whose intention is to return to Somocismo.”
    The equivalent paragraph about this issue in the historic 1969 FSLN program, said: “The Sandinista Front is a political-military organization whose strategic objective is the seizure of political power through the destruction of the military and bureaucratic apparatus of the dictatorship and the establishment of a revolutionary government based on a worker-peasant alliance and the participation of all anti-imperialist and anti-oligarchic patriotic forces of the country.”
    The huge differences in the tone and content of the proposals in the two documents are clearly noticeable. One places emphasis on institutional democracy and the other on building a State with a different class content. What happened? As the triumph of the revolution swept out the capitalist Somocista State and its entire military apparatus and left a huge amount of power in the FSLN’s hands, the Sandinista version ended up prevailing.
    In September 1979, the FSLN called its most outstanding members to a meeting later dubbed the 72-hour Assembly. Its purpose was to draft the FSLN’s “big plan” for the revolution. Why another program if there already was one? Our answer was that, “the circumstances have changed.” By then, the balance of power among the different sectors and groups that had participated in the overthrow of Somoza had shifted significantly. With the collapse of the National Guard, the FSLN had conquered all the military power; the two large traditional political parties were in disarray or fragmented, and the FSLN had the bulk of the new mass organizations on its side. In short, the FSLN had conquered virtually all the power, hence the circumstances that had led to the Junta’s program and the alliances with non-revolutionary sectors were no longer in force, rendering that program unnecessary.
    In the program that resulted from the 72-hour Assembly, one particular point stands out enough to appreciate the course the revolution would take from then on. It defined objective number one as: “to isolate the bourgeois traitors” and to “organize the revolution’s driving forces,” i.e. the workers and the peasants, and “place all forces under the direction of the FSLN.”
    This was the guide with which we started acting and followed from then on. The first result of this decision was the rupture of the previously negotiated national consensus. The Junta’s program reflected that pre-triumph consensus, but with the major post-triumph change in the power balance we had an unanticipated opportunity to implement our historic program and we went for it. Our attitude was: “We’re in charge here and can do whatever we want, and we don’t have to make concessions to anyone else…”
    Even though other parties existed, a single-party logic was imposed
    This decision implied the effective ending of the National Reconstruction Junta. Although Alfonso Robelo and Violeta Chamorro had been in it from the beginning, the decisions made by the FSLN were the ones the Junta implemented and executed. That’s why they both resigned a few months after the Assembly. We replaced them with some other non-Sandinista personalities, but it was a mere formality because the FSLN maintained the hegemony.
    In fact, a single-party logic was imposed, even though other parties subsisted, weak and controlled. Under that logic, we began to build not a national State, but a Sandinista State. All institutions were under Sandinista control. The Army was Sandinista, the Police was Sandinista, and all ministries and other state institutions came under the aegis, influence and control of the FSLN. It was assumed that all would adopt, follow and act according to its objectives and policies.
    With the party’s political power consolidated, another objective stated in the 72-hour Assembly’s program implied neutralizing any political force that could question the FSLN’s hegemony. In March 1980, right around the time he resigned from the Junta, Alfonso Robelo, leader of the Nicaraguan Democratic Movement party he founded in 1978, tried to reorganize his party and called a demonstration in the town of Nandaime. Faced with a possible massive mobilization, we decreed that “Nandaime isn’t happening” and stopped the demonstration through all means possible.
    That act marked our route: we would stop any political action by anyone who could question the revolution in any effective form. By that same logic, we later imposed media censorship and repressed any attempt at opposition. All political space for those who opposed us was quickly closed. The FSLN was the “enlightened vanguard” that had to lead everything in Nicaragua, as if it was a right born of the revolution. That mentality prevailed from the beginning.
    Political democracy wasn’t a revolutionary objective
    This logic led to the harassment of business sectors, who we called “bourgeois traitors.” We mainly applied it to the financial oligarchy, but the concept was spread to all of those who opposed the revolution or just did things we didn’t like. We also used confiscations as a political weapon. They were so political that they were announced in public plazas during large demonstrations where everybody would applaud them.
    Classist and confrontational language—the proletariat against the bourgeois—was also widely developed, above all during the first years of the revolution. All bourgeois were traitors, with little distinction made between those who were and those who weren’t. In fact, in some places, especially in rural areas, where it was difficult to find any real “bourgeoisie”, petty bourgeois farmers and people with some small business were harassed with that same classist language, accusations and threats. All this shows that institutionalized democracy was not an explicit objective of the revolution, even though we talked about “political pluralism.”
    How did we come to terms with this? First by not declaring ourselves the only party, and second by allowing other political parties to subsist, even though they had no possibility of real advocacy in the country’s political life.
    The kind of organization needed to fight against a dictatorship must be clandestine, very disciplined and very centralized, with all information compartmentalized and very little debate because the conditions won’t allow for it. All this generates non-democratic behavior and values when transferred to a country’s political system.
    Unlike the Cuban model, which had so much influence on the revolution, we never declared ourselves Socialists. Nor did we declare ourselves the only party, although the actions of the other political parties were seriously limited.
    And while the media was censored, there were critical media outlets. In reality, we were influenced by the Cubans, but weren’t an exact copy of their model.
    We based ourselves on the concept that the revolution was… well, irreversible, that it would be there forever. Because what had been won had cost so much blood and sacrifice, we weren’t about to raffle it off in some election. We thought that if we had risked our lives conquering power, leaving a large amount of blood along the way, we weren’t going to let a few votes change that.
    No reflection about the contradictions of the 1984 elections
    The revolution was eternal and we weren’t going to raffle off that power… yet, we allowed elections in 1984. It was a tactical decision in the hopes of giving the Sandinista government a legitimacy acceptable to the Western world and weakening Reagan’s aggressive strategy of openly fighting to overthrow it.
    The 1984 elections were semi-democratic. I say that because, even though the votes were counted well, the whole campaign and the whole state apparatus were at the service of the FSLN, which controlled all the institutions, assuring its triumph.
    The political effect we sought with these elections was important but limited, mainly because the US-backed Democratic Coordinator, at that time the main opposition, didn’t participate. It started out doing so, launching a candidate and all, but a little before election day, it pulled out, claiming it was impossible to campaign under so much hounding and harassment. Pressure from the Reagan administration weighed heavily in its decision, because its participation would had taken justification away from the White House’s determination to bring down the revolution.
    The most important thing I want to say about those elections is that they represented a fundamental contradiction with the prevailing logic up until then: that the revolution was eternal and that its legitimacy was based on the struggle and sacrifice, and elections represent raffling off power… By holding elections, we were admitting, without acknowledging it, that the revolution could lose, and were taking the risk of demonstrating that the revolution wasn’t eternal. With those elections, the revolution’s legitimacy was no longer anchored to the struggle, the sacrifice, the martyrs…Henceforward it would be anchored to the popular will, to winning the majority of the people’s votes.
    The 1984 elections clearly contradicted the logic we had been following. From my perspective, we didn’t assimilate, didn’t assume, didn’t even understand the huge consequences those elections had. We clung to the tactical perspective that the elections were only a formality and the belief that we could always be sure of victory in any election. For that reason, we didn’t prepare ourselves for what was to come six years later: the 1990 electoral defeat.
    People who had never been anything became empowered
    In spite of it all, the revolution stimulated true social democracy.
    When the revolution blew the lid off the dictatorship, there was an explosion of demands and massive popular participation. A bunch of sectors that had remained crushed during the Somocista regime and, unable to express themselves in any way, started presenting demands: some for land, the Miskitos for sovereignty, others simply for the right to be taken into account…
    Mobilizations of all shapes and colors took place, with people demonstrating in the streets, the fields, everywhere…Some organizations that had existed previously, such as the Farm Workers Association (ATC) and industrial unions grew rapidly. Other new ones emerged within this context: the National Farmers and Ranchers Union (UNAG), the Sandinista Defense Committees (CDS) and others. Some were born out of their own dynamics and others launched by the FSLN itself, which according to its vision had to create a network of mass social organizations that were coordinated and subordinated in some way to it.
    Just one statistic illustrates what this organizational explosion was like: in 1978, there were 138 unions with 20,000 members in Nicaragua; by 1982, unions had increased tenfold and had 90,000 members.
    Organizations gained important quotas of power. I remember unions, including the ones in state companies, having a lot of recognition and influence even in administration decisions. Frequently they would question the company administrator or the manager. Popular organizations had real power. For example, the CDS’s were asked to provide endorsements for anyone from their neighborhood who sought employment with the government and were put in charge of managing the ration cards for the distribution of the five basic products.
    There was a huge leap in organization, and organization changes people. People who had never been anything during the dictatorship, who were totally ignored or marginalized, suddenly felt a sense of dignity, of having rights and of the strength to do things and demand things. They became empowered.
    The organizations became conveyor belts
    The leap by these popular organizations was huge, but that achievement gradually weakened, basically because the FSLN, which viewed these organizations as their “conveyor belts,” eventually placed them totally under its direction, converting them into Sandinista organizations, rather than somewhat autonomous organizations whose members were affiliated with them. There were always tensions between the organizations’ role of representing sectorial interests and of being vehicles for government policies. In the end, the FSLN’s hegemony prevailed.
    Non-Sandinista and anti-Sandinista opposition started being left by the wayside in these organizations or had little influence inside them. Those who expressed their disagreement were soon dubbed Contras, enemies of the revolution, and were disempowered… The old unions from the Somoza era as well as some more recently organized by other leftist parties were completely marginal; they had no meaning.
    The Association of Women in Response to the National Problematic (AMPRONAC), born in 1977 to fight the dictatorship, particularly its human rights abuses against young people who demonstrated against it, was one of the first organizations to be put under Sandinista control as FSLN officials and administrators quickly replaced founders and leaders, effectively bringing the original organization to an end. They even changed its name to the ‘Luisa Amanda Espinoza’ Association of Nicaraguan Women (AMNLAE), the female wing of the FSLN which quickly turned it into another conveyor belt. With AMPRONAC’s dissolution, the country lost the knowledge of a very rich experience accumulated by its first large organized, autonomous, democratic, multi-party, multi-class mass women’s movement, made up of both grassroots women and those from all other social classes.
    We knew absolutely nothing about the Caribbean coast
    We didn’t know a thing about Nicaragua’s Caribbean Coast, absolutely nothing, other than that it had been colonized by the British, while the Pacific side had been colonized by the Spanish. We had no clue how important that different history was in practice. The National Reconstruction Junta’s program only said: “The population of the Atlantic Coast region will be integrated into the country’s development.” That was all. Absolute ignorance. Not even the existence of the five different native indigenous and Afro-Caribbean peoples in the region was acknowledged in the program.
    But the revolution triggered expectations among the different groups, particularly the Miskitus, the most numerous and dominant indigenous population. By the time of the revolution, the Coast already had a new generation of young, educated leaders. With the revolution, new organizations blossomed, just as they did in the Pacific, but with their own cultural, political and social stamps. For example, there was Misurasata, which means Miskitus, Sumus and Ramas allied with Sandinistas. Later, due to conflicts that arose, it broke with the Sandinistas and split into two armed organizations, one of which removed the “SA” from its name and called itself Misura.
    The avalanche of demands and complaints coming to us from the Coast was truly huge. But since we didn’t understand anything, this promptly caused mutual mistrust, confusion and, from our side, suspicion and accusations of separatism.
    The revolution would send party leaders and government officials from the Pacific to the region and put them at the head of all the government areas, but those people didn’t know anything about the Caribbean either. They wanted to mechanically transfer all that was being done in the Pacific—the same organizations, the same approaches, the same discourse—to a region with an utterly different history and five different cultural identities. I don’t remember a single official or political leader having at least tried to learn to speak Miskitu. Maybe there was someone, but I don’t know a single one of the main ones who even made an attempt.
    There was a huge culture clash with the Coast
    The cultural clash provoked dissatisfaction, irritation and resentment among the Coast populations. They felt the revolution as an invasion of “Spaniards,” because for them, all of us from the Pacific are Spaniards. And on our side, a high degree of racism developed among the “Spaniards” who were sent over; we saw the people from the Coast as “lying and cheating Indians,” not understanding that they had to lie and pretend in order to defend and protect themselves.
    On the positive side, the revolution did a literacy program in the Coast’s three main languages. Some say we imposed literacy in Spanish, but that’s not true. The literacy program began on the Coast after the national campaign, but only because we had to make different textbooks in those three languages: Miskitu, Sumu and English. Unfortunately, the content of the literacy materials was similar to that of the rest of the country: highly politicized… and Sandinista and didn’t even take their cultures into account.
    In this context, and with such a serious lack of communication, the protest on the Coast spread, and became a generalized resistance to everything that came from the revolution. As the conflict escalated, we responded with repression. With that the war started and the US got involved in the Coast, with President Reagan taking up the Miskitu cause for his own purposes. That war was different from the Contra war in the rest of the country, because the demands from the Coast people, especially the Miskitus, were very different: they specifically had to do with their identity as a people.
    We proclaimed Nicaragua a multi-ethnic nation
    At a certain point, we finally grasped there was a different reality on the Coast and gave the war on the Coast a different treatment. In 1984, the government began negotiating with Brooklyn Rivera, a Misurasata leader, and then with Yatama, an organization that had reunified the different armed indigenous groups, seeking a ceasefire and talks regarding their political demands.
    In that context, the revolutionary government recognized and published a Decalogue of the specific rights of the indigenous peoples. It was an enormous advance over what had existed up until then in Nicaraguan history, which was a benign misunderstanding of the indigenous peoples in the rest of the country, and frequently brutal exploitation by extractive companies, especially foreign ones.
    The recognition of a culture native to the Caribbean Coast was the result of a lot of work, dialogue and meetings. We always maintained communication with some Miskito leaders. Finally, in 1987, all this resulted in a regional autonomy law and recognition in the Constitution that same year that “the people of Nicaragua are of a multi-ethnic nature.” Until then, we had seen ourselves as only mestizos.
    The autonomy scheme was not perfect, and the way it was conceived and built is possibly outdated. Today, the reality of the Coast is a lot more complex, because now the majority population on the Coast is relatively recently arrived mestizos from the Pacific. We are seeing that the current government isn’t defending the indigenous communities from the aggressive advance, sometimes armed, of settlers from the Pacific on lands now legally demarcated as belonging to those communities.
    I believe Caribbean Coast autonomy and recognition of the native peoples were very important contributions by the revolution that led to a change in how we see ourselves as a country. But they weren’t a feat only of the revolutionary government. They were also fruit of the effort and sacrifice of the Miskitus and other Coast people who fought and resisted and placed what we were ignoring on the table.
    Confiscations infringed upon the peasants’ values
    The US government’s many-faceted aggressions against the revolution in Nicaragua wouldn’t have reached the proportions they did if the massive peasant uprising against the revolution hadn’t happened in the central part of the country, from north to south, despite the revolution defining the peasantry as one of its “driving forces” within the “worker-peasant alliance.”
    Why did that force rise up against the revolution, particularly if there had been an agrarian reform? One important reason was the confiscations. These first affected the Somocistas, then those “close to Somocismo”, even when it wasn’t clear who was or wasn’t close. Afterwards, confiscations continued for various other political reasons: for example, to punish people who collaborated with the Contra or were opposition activists. Those actions were perceived as arbitrary or abusive in a society where private property and work are important values.
    In addition, many of those confiscated had relatives and friends who were offended by what we were doing. I remember a case in Boaco in 1979, after a farm had been confiscated with the argument that the owner had been a Somocista: “And why did you confiscate his land?”, one woman who knew him demanded. “He had supported Somoza, yes, but he earned that farm you took away from him with his hard work; he didn’t steal it from anybody and nobody gave it to him.” It is a generalized concept in the rural areas that someone who honestly earns his land, independent of his political affiliation, has the right to his land and it’s unfair to take it away, no matter how unequal land distribution might be. Our confiscations attacked the traditional values of agrarian society in the central part of the country.
    Another problem is that confiscations were conducted by government functionaries and political leaders who came from the cities and were imbued with an ideological vision of the countryside, without knowing a thing about the identity of a peasant society. The impact of that created more contradictions and lack of communication, and an incapacity to relate to peasants, who speak a language quite different from those who went to the countryside representing the revolution.
    Roadblocks for rural products: Another negative policy
    With the war, shortages increased and the food prices rose higher in the cities. The government wanted to protect its social base, especially the urban one. An official food price policy was established, for products produced by peasants. Roadblocks were placed on the highways and when farmers headed into the city to sell their produce, they were stopped, the produce was taken from them and they were paid the official price for it. That produce was then sold in the city at an even lower price. This policy harmed the peasants’ way of being, living and understanding things in a very fundamental way, and they rejected these impositions.
    It was a very negative policy. The cities were protected with lower food prices, which was positive, but at the cost of huge sacrifices from the peasants. Production fell because the peasants saw they weren’t getting paid enough for their efforts, and when production fell, shortages worsened.
    This caused a dramatic deterioration in the peasants’ standard of living, only made worse by the fact that while the prices of their products were kept low, prices for industrial products went up. An example of the impoverishment this policy caused in the rural areas is that in 1978, a peasant could buy a pair of pants with 49 pounds of corn and a shirt with 22 pounds, whereas by 1985, a pair of pants would cost him 230 pounds of corn and a shirt 140.
    Still other factors that influenced the peasants’ rebellion were the pressure to form cooperatives, the confrontations with the Catholic Church hierarchy, the destruction of the traditional commercial networks and the continuous harassment in the rural area.
    Repression also caused the war
    While the above are some of the reasons for the peasants’ rejection of the revolution, they aren’t all of them. A few weeks ago, I was at an event in Brown University in the US to evaluate the revolution after 40 years. A Contra leader who was there explained why he had joined that side, and he didn’t mention any of the reasons I’ve just mentioned. He said he did so out of fear. Fear of repression, fear of being imprisoned and fear that they’d take away his properties.
    In the context of war, repression and abuses tend to multiply. If we add to this the imperative of having to defend ourselves against the aggression and permanent threat from the US government, which put the revolutionary government in a situation of fighting to the death for survival, oversight regarding respect for human rights weakened. Abuses increased, and only a few of them were investigated and punished.
    With the peasant rebellion joining forces with the US aggression, the result was a large-scale war that polarized the country and led hundreds of thousands of young and not so young people to join the Sandinista Army or the ranks of the Contra. The consequences of that war are beyond comparison in our country’s history. I don’t believe any of the many wars between Liberals and Conservatives that fill our history have caused even a tenth of what that war did: deaths, orphans, disabled, deranged, large-scale material destruction, hate, resentments and divisions, even within families… The after effects were huge, the divisions were deep, and many wounds that were never healed have reopened with this current reality.
    The changes came too late
    A Manichean interpretation of the war of the eighties is off base. It wasn’t black and white. Thousands of people on both the contra side and the Sandinista side went to battle convinced it was the only fair and decent choice they could make. Both sides have examples of disinterested heroism, whose memory we honor. Many youths willingly accepted the military draft and many others offered to serve even before reaching draft age. On both sides, they fought for a better Nicaragua, convinced of the justice of their cause.
    Starting in 1985, we attempted to correct the revolution’s course. Based on an evaluation of the situation, the government decided to implement a series of policy changes aimed mostly at the countryside. Orders were issued to suspend the land confiscations; the prices of agricultural products were freed up; and an effort was made to develop more political and respectful behavior by the armed forces and the FSLN authorities. We stressed that this war couldn’t be viewed merely as a military confrontation but was also a vital political struggle to win the peasantry’s support.
    It was very hard to fully implement all those changes to the degree needed; and it was already too late. The peasantry’s distrust of the revolution was firmly lodged in their consciousness. In my opinion, there was no longer any way of overcoming that.
    The mixed economy concept had no definition
    During the revolution we talked about a mixed economy, but we had no coherent concept of it. We basically understood it as the coexistence of different types of property ownership, which actually exists everywhere in the world, as every country has public, cooperative and private property to a greater or lesser degree.
    The phrase “mixed economy” didn’t define anything. There was no model to explain how the sectors would interrelate, though we did say state property formed the heart of the national economy. That was the only thing we were clear about: ownership of the resources would be concentrated in the state area. Foreign trade was nationalized, as was the banking sector and all extractive industries. We also put the commercialization of basic grains in state hands. There was no room in any of these areas for private enterprise.
    In the productive and commercial areas, large state agrarian, agro-industrial, industrial and commercial businesses were created. The spaces for private enterprise were greatly reduced, obliging it to compete for the scarce resources available at a disadvantage with the public companies. Private investment ground to a near halt, and although large amounts of resources were pumped into public investment, it couldn’t replace the loss of private investment.
    The economic model failed due to its own contradictions
    The costs of the war kept growing and growing until they became enormous, yet we continued the major social programs and huge economic projects, even though we didn’t have the money to cover them. At that point, we began to simply print money, without production or any other source of revenue to back it. That only generated hyperinflation, which at its peak, in 1987, reached 56,000%.
    A change in the economic policy finally came in 1988. A huge effort was made to reduce state spending, prices were freed up for the majority of products, and export businesses were allowed to keep the hard currency they brought in so they could reinvest. The controlled distribution of basic products was suspended.
    The changes were an attempt to give the market a greater role in resource allocation. All this effort had some positive effects, but state spending continued to be too high and available resources too scant, so inflation quickly shot up again.
    The mixed economy model failed due to its own contradictions and to the imposition of the war, which weighed on everything we did. Our corrections in this area were too little, too late, because we no longer had the resources to underpin them.
    The revolution made important transformations in education
    In Somoza’s time education covered only a tiny percentage of school-aged youths. At the triumph of the revolution, more than 40% of the Nicaraguan population couldn’t read or write. The revolution changed that radically.
    Massively promoting educational coverage, facilitating access to all who wanted to study, became a central government objective. Just to provide one comparative figure: in 1978 there were 2,696 teachers in the entire country, and ten years later there were 19,289. Such accelerated growth had consequences that affected the quality of education. So many new teachers meant too little training, and although new schools were built, construction couldn’t keep up with the increased number of students.
    The literacy crusade, which was an effort by the whole of society, especially the youth, deserves a special mention. More than 100,000 young people participated in that campaign. Many from the cities on the Pacific side of the country learned about the rural areas by teaching entire families to read while living with them for five months.
    It was a heroic feat and I believe that. In addition to the obvious fact that so many people learned to read and write, it had a huge impact and effect on the consciousness of the young people who went out as teachers. For the first time, both they and the adults who participated learned first-hand about the poverty in which the peasants were living and in many cases established emotional ties with them that still exist after all this time. Increasing literacy to well over 80% had impacts on the country’s educational development and on the development of awareness and solidarity among the campaign’s volunteers.
    On a visit to a coffee farm in Matagalpa in 1985, I met a girl who was giving classes to a group of kids. She told me she had learned to read in the literacy crusade and that had enabled her to become a teacher, which was her vocation, what she wanted to do in life. And there she was, teaching a group of kids from three different levels, in a multi-grade school. I don’t know if she was doing well, average or badly, but the crusade changed her life, giving her the possibility of achieving a dream and of making a contribution to society, That’s the kind of thing the literacy crusade left that statistics don’t reflect.
    In my opinion, the downside in all that educational effort by the revolution was the politicization of teaching, because education was also an instrument for disseminating Sandinista concepts that included very important values but also promoted the FSLN as the guiding force of society. And that was its deadly sin.
    There were huge advances in health
    The revolution gave our country a national public health system for the first time, something that had never existed during the Somoza years. Hospitals were previously the responsibility of local Social Assistance Boards and were seen almost as a government charity by the people who went there. This radically changed with the revolution, which invested heavily in resources and capacity-building.
    Health care was seen exclusively as a government responsibility. Particular weight was given to preventive health care and the population was mobilized to implement different activities. Thousands participated in the health campaigns at different times of the year, vaccinating and offering health information.
    As in education, there were important results. The number of health professionals quadrupled compared to before the revolution and the vaccination campaigns reduced transmittable diseases. Poliomyelitis, which had been endemic in Nicaragua, has been eradicated since 1982 and there have been no national diphtheria or measles epidemics since 1983, although after 1990 there was a major outbreak in the Caribbean Coast region. And during the revolutionary years infant mortality was reduced by half.
    The conquests in health and education remained after 1990 and all the governments continued promoting what we initiated in the revolutionary years. Some have done better than others, but health and education were definitively established as rights for all Nicaraguans.
    Access to land was democratized
    Despite all the contradictions and limitations of the agrarian reform, there was extensive land redistribution, both to individuals and collectives.
    What remains today of that democratization of property ownership? All I have at hand are the data of the 2011 Agricultural Census, which shows that while owners of less than 7 hectares had 2% of cultivable land before the revolution, they had 6% in 2011. The owners of properties of between 7 and 35 hectares possessed 11.2% before the revolution and 20% in 2011; and medium owners of between 35 and 140 hectares had 30% of the land before the revolution and 36% in 2011. And finally, owners of more than 350 hectares made up 41% of the land ownership before the revolution and only 22% in 2011.
    The FSLN is today a mafia band
    One of the questions people are asking today is what has become of the FSLN since 1990.
    The FSLN’s destruction was a gradual process. One of the pivotal moments was the crisis caused by the electoral defeat that year, which resulted in a two-line struggle about where to go from there. Some of us wanted to transition into a truly democratic party that would play by the rules of the electoral game and renounce violence as a political weapon. The other group, Daniel Ortega in the lead, proposed maintaining the same model, the same schemes and the same discourse. In the 1994 party congress, which I would argue was the most open and democratic we’d ever had, Daniel’s side won.
    Its victory demonstrated that our position was a minority within the FSLN. We lost the debate both for that reason and because Daniel Ortega understood the psychology of the Sandinista rank and file better than those of us who wanted a change. For the party’s base, the change we were talking about represented more of the fear and insecurity they were already feeling. The electoral defeat had been such a traumatic change for the immense majority of Sandinistas that they were looking for reaffirmation that it was nothing more than a historic accident, the FSLN was still right and the tremendous sacrifices hadn’t been in vain.
    Daniel picked up on that very well and acted on it. He responded to their psychological need, not to the FSLN’s needs if it wanted to evolve in the new context. That was the point at which he began to take over the party. It is no longer even a political party today, because it has no orientation and no arenas of debate. All that’s left is a mafia band at the service of a family that maintains alliances with other powerful individuals and groups in order to hold onto its own political power.
    Daniel Ortega was considered the personal representation of the revolution
    During the revolutionary years, the National Directorate functioned as a collegial body and a space of debate among the nine of us. It was also an expression of a balance of forces in which there were internal alliances, as happens in all bodies of power.
    That shared leadership began weakening in 1985 because Daniel Ortega’s election as President the previous year meant his legitimacy no longer derived from the National Directorate, as it had done since 1979 when we chose him to head the Government Junta of National Reconstruction. From November 1984 on it grew out of having been elected by the people, which was a different source of political backing.
    No one imposed Ortega as a candidate in either 1984 or 1990. We all agreed he was the best choice to avoid changes that could create internal conflicts or even splits. He was the most messianic figure of us all and was considered the personal representation of the revolution. This idea, which was also growing inside him, became even more acute after 1990. He saw his conceptions and decisions, whatever they might be, as the only truly revolutionary ones. That aggrandizing of his own views meant he gave increasingly less importance to consensus by the other National Directorate members.
    I resigned from both the Directorate and my FSLN militancy in 1995 due to differences I considered irresolvable. Some others of the original nine also resigned and others just kind of slipped quietly away until the only ones remaining were Tomás Borge and Bayardo Arce, both originally from the Prolonged Popular War tendency. Most of the figures of a certain relevance who are still with him are from that same tendency. Daniel Ortega, of course, was from the Tercerista, aka Insurrectionist tendency, from which no important figures any longer accompany him.
    The vices of our political culture are still present
    Daniel Ortega isn’t Nicaragua’s first dictator. We came out of one that lasted for nearly 50 years: the Somoza family dynasty. And before him there was Zelaya, and still others. The roots of this authoritarian matrix go deep in our political culture. The FSLN’s authoritarian tendencies don’t emanate only from ideological factors, but also from our country’s history. And if we don’t recognize and learn more about that history, we’re doomed to repeat it.
    Following the April (2018) rebellion, there’s a risk if we don’t recognize that the underlying problem we’re dealing with today isn’t Sandinismo versus anti-Sandinismo. Many of the political prisoners and those who were killed come from Sandinista families and some of those who are part of what’s known as the blue and white opposition are reproducing the behavior and values that brought us to Daniel Ortega. The confrontation today is between dictatorship and democracy, but if we don’t accept that we’re all carriers of anti-values and authoritarian attitudes and aren’t very tolerant of different ideas and criticism, authoritarianism will only be repeated. Some young people believe that being under 30 makes them exempt from the evils of our political culture. They’re wrong.
    We need to keep lines of self-criticism and dialogue open
    We can only surmount this by maintaining an ongoing debate. We have to keep information and reflection flowing. Regrettably, these times since April 2018 have been ones of action and viscera, of a lot of activism and very visceral reactions in which the “bad guy” is always the “other one” and “mine” is “the only truth.” This impedes any authentic political reflection, self-criticism and dialogue, which in turn leads us to exclusion and to repeating the cycle.
    All these ideas I’ve presented about the revolution, its objectives, accomplishments and failures are pretty sketchy, but I trust they will contribute to a much needed and long-postponed debate about its light and shadows and its consequences for the country. I also hope my words have helped people understand that there are no easy answers or black and white interpretations; that simplistic explanations only encourage extremism and stop us learning from our own errors to avoid making them again.
    Reflecting on the revolutionary period is indispensable
    One of the major problems in our history is that after a big crisis we not only wipe the slate clean and start fresh, but we also shut it out, cover it up and try to forget what happened before that caused or contributed to it.
    After the FSLN’s electoral defeat, two narratives emerged about the revolution and the counterrevolution, in short about the war of the eighties, and there was never any dialogue between them. What we’re seeing today is that same lack of dialogue, and if we still don’t engage in one, don’t put the truth on the table, the risk of repetition will remain. It’s not about revenge or getting even, because that only intensifies hatreds rather than ensuring non-repetition.
    Truth and justice are indispensable to reconstructing what was lost in April. If all those involved in the crimes against the blue and white movement get off scot-free, what’s to stop others from repeating similar actions, confident they won’t be sanctioned either? The fact there have been so many amnesties in Nicaragua’s history —52 before this year’s amnesty law—, is the best proof that such laws don’t resolve the need for reconciliation and justice between Nicaraguans.
    I believe a truth commission, in fact several, are essential. I’m also convinced that a reflection about the revolutionary period, about the conduct and behaviors of those of us who headed it, is necessary for the reason I mentioned before, that some blue and white sectors are repeating our same conduct.
    They think it’s enough to reject Ortega and disqualify anything and anybody to do with Sandinismo. They don’t understand that for cultural and historical reasons we all bear the vice of sectarianism. In my party, the MRS, we’ve engaged in a profound and ongoing reflection about many of the characteristics of the political culture that brought us the Somozas, the FSLN and now Daniel Ortega.
    I can’t deny I was part of that…
    Luis Carrion Cruz. Photo: agenciasnn.com
    In the end, reflecting about and summing up the revolution is also a personal appraisal. Because I can’t deny I was there, even if I left in 1995 and have been active against this new dictatorship since 2005.
    Am I still the idealistic committed youth ready to give my life for the revolution that I was before 1979? Or am I the person I became in the eighties… and if so, what moment of the eighties? Am I who I was in the nineties or in 2005 or am I strictly in and of the present? I’m all of those people, with all my contradictions, cause for pride and also responsibility for the things I did or failed to do.
    For me the revolution was a dream. I joined the struggle for it with no certainty what I would see. Many died along the way and I was almost surprised that I lived to see the culmination of our struggle. The triumph was an intoxicating experience after years of clandestinity, suffering tremendous restrictions, difficulties and dangers. It was like a drunken binge, which only increased when we saw thousands upon thousands upon thousands of people mobilized by the same dream.
    And having accomplished that dream, even though there were problems, I didn’t feel they negated the essence of what the revolution was, because all societies have bad things: there’s corruption in all of them. So they inevitably also existed in the government and in the governing party, but they didn’t justify breaking with the revolution or certainly not switching to the other band, the Contras.
    Could have it have been otherwise?
    We thought the revolution could be improved. We also understood, for reasons of ideological or political vision, that any revolution generates a counterrevolution, that a revolution has to stand firm to avoid being swept away by counterrevolutionary forces…That was the ideological and political model we had in our heads.
    It was in that context that we saw the closing of political spaces, press censorship and repression as weapons in a fight to the death in which we were at a disadvantage… I’m not justifying myself by saying that. Today I think that not everything had to be done the way it was, that important things could have been done differently. But that’s how we thought at the time.
    In my personal case, a certain frustration was building even before the 1990 elections. I could see that what we had achieved in 10 years fell well short of our dream and ideal. And I wondered if it could have been any other way; if what we were going through wasn’t just a particular circumstance but rather a law of history, the price to be paid for a revolution like ours in a totally adverse world context, with the triumph of the United States in what was suddenly a unipolar world.
    In 1990 I felt a different possibility had opened up
    With the 1990 defeat, I perceived that behavioral changes couldn’t be brought about by force, that social transformations made by force are also reversible because they haven’t taken root in people’s consciousness. And I told myself that it’s different in a democratic context; that first you have to change people’s consciousness to then achieve political results. It had been the reverse with the revolution because political changes came first and then we aspired to mold people’s consciousness to those changes we were making from power.
    With the FSLN’s electoral defeat in 1990, I felt personally that a different possibility was opening up; that if the revolution had been unable to achieve what we had once dreamed of on its own particular path, another path was before us that we had to take to try to obtain the same goals another way.
    At that point certain values reemerged from my personal formation, my family and my activism for a time in the popular church. These values had been put on a back burner, inundated by the tsunami of the revolution and the idea that the revolution was so great that it justified anything.
    That threw me into conflict, first with myself and then within the FSLN and in 1995 it finally led me to break with the organization I had been a part of for nearly 25 years. Today I feel at ease, even though back then I was in power and today I’m on the sidelines.
  • Antonin Artaud | 124512.101.89900.123 | ২৬ জুলাই ২০১৯ ১০:২০541381
  • আঁতোনা আতো-র কবিতা ( Antonin Artaud ) [ ১৮৯৬ - ১৯৪৮ ]
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    নিরংশু কবি
    নিরংশু কবি, একটি তরুণীর বুক
    তোমাকে হানা দিয়ে বেড়ায়,
    তিক্ত কবি, জীবন ফেনিয়ে ওঠে
    আর জীবন পুড়তে থাকে,
    আর আকাশ নিজেকে বৃষ্টিতে শুষে নেয়,
    জীবনের হৃদয়ে নখের আঁচড় কাটে তোমার কলম ।

    অরণ্য, বনানী, তোমার চোখ দিয়ে প্রাণবন্ত
    অজস্র ছেঁড়া পালকের ওপরে ;
    ঝড় দিয়ে বাঁধা চুলে কবি চাপেন ঘোড়ায়, কুকুরের ওপরে ।

    চোখ থেকে ধোঁয়া বেরোয়, জিভ নড়তে থাকে
    আমাদের সংবেদনে স্বর্গ উথালপাথাল ঘটায়
    মায়ের নীল দুধের মতন ;
    নারীরা, ভিনগারের কর্কশ হৃদয়,
    তোমাদের মুখগহ্বর থেকে আমি ঝুলে থাকি ।

    আমার টাকাকড়ি নেই
    আমার টাকাকড়ি নেই কিন্তু
    আমি
    আঁতোনা আতো
    আর আমি ধনী হতে পারি
    ব্যাপকভাবে আর এক্ষুনি ধনী হতে পারি
    যদি আমি তার জন্য প্রয়াস করতুম ।
    সমস্যা হলো আমি চিরকাল টাকাকড়িকে,
    ধনদৌলতকে, বৈভবকে ঘৃণা করেছি ।

    কালো বাগান
    এই কালো পাপড়িগুলোর ভারতে আকাশের ঘুর্ণাবর্তকে ঘোরাও।
    ছায়ারা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলেছে যা আমাদের সহ্য করে ।
    তোমার নক্ষত্রদের মাঝে চাষের জমিতে পথ খুলে দাও ।
    আমাদের আলোকিত করো, নিয়ে চলো তোমার নিমন্ত্রণকর্তার কাছে,
    চাঁদির সৈন্যবাহিনী, নশ্বর গতিপথে
    আমরা রাতের কেন্দ্রের দিকে যেতে চেষ্টা করি ।

    আমি কে
    আমি কে ?
    আমি কোথা থেকে এসেছি ?
    আমি আঁতোনা আতো
    আর আমি একথা বলছি
    কেননা আমি জানি তা কেমন করে বলতে হয়
    তাৎক্ষণিকভাবে
    তুমি আমার বর্তমান শরীরকে দেখবে
    ফেটে গিয়ে বহু টুকরো হয়ে গেছে
    আর তাকে আবার গড়ে ফেলবে
    দশ হাজার কুখ্যাত পরিপ্রেক্ষিতে
    এক নতুন শরীর
    তখন তুমি আমাকে
    কখনও ভুলতে পারবে না ।

    স্নায়ু ছন্দ
    একজন অভিনেতাকে দেখা হয় যেন স্ফটিকের ভেতর দিয়ে ।
    মঞ্চের ওপরে অনুপ্রেরণা ।
    সাহিত্যকে বেশি প্রবেশ করতে দেয়া উচিত নয় ।
    আমি আত্মার ঘড়ি ধরে কাজ করা ছাড়া আর কোনো চেষ্টা করিনি,
    আমি কেবল নিষ্ফল সমন্বয়ের যন্ত্রণাকে লিপ্যন্তর করেছি ।
    আমি একজন সম্পূর্ণ রসাতল ।
    যারা ভেবেছিল আমি সমগ্র যন্ত্রণার যোগ্য, এক সুন্দর যন্ত্রণা,
    এক ঘন আর মাংসল পীড়া, এমন এক পীড়া যা বিভিন্ন বস্তুর মিশ্রণ,
    বুদবুদ-ভরা একটি নিষ্পেশিত ক্ষমতা
    ঝুলিয়ে রাখা বিন্দু নয় --- আর তবু অস্হির, উপড়ে-তোলা স্পন্দনের সাহায্যে
    যা আমার ক্ষমতা আর রসাতলের দ্বন্দ্ব থেকে আসে
    শেষতমের উৎসার দেয় ( ক্ষমতার তেজের দ্বন্দ্বের মাপ বেশি ),
    আর কোনও কিছু বাকি থাকে না বিশাল রসাতলগুলো ছাড়া,
    স্হবিরতা, শীতলতা--
    সংক্ষেপে, যারা আমাকে অত্যধিক জীবনের অধিকারী মনে করেছিল
    আত্মপতনের আগে আমার সম্পর্কে ভেবেছিল,
    যারা মনে করেছিল আমি যন্ত্রণাদায়ক আওয়াজের হাতে নির্যাতিত,
    আমি এক হিংস্র অন্ধকারে লড়াই করেছি
    তারা সবাই মানুষের ছায়ায় হারিয়ে গেছে ।
    ঘুমের ঘোরে, আমার পুরো পায়ে স্নায়ুগুলো প্রসারিত হয়েছে ।
    ঘুম এসেছে বিশ্বাসের বদল থেকে, চাপ কমেছে,
    অসম্ভাব্যতা আমার পায়ের আঙুলে জুতো-পরা পা ফেলেছে ।
    মনে রাখা দরকার যে সমগ্র বুদ্ধিমত্তা কেবল এক বিশাল অনিশ্চিত ঘটনা,
    আর যে কেউ তা খুইয়ে ফেলতে পারে, পাগল বা মৃতের মতন নয়,
    বরং জীবিত মানুষের মতন, যে বেঁচে আছে
    আর যে অনুভব করে জীবনের আকর্ষণ আর তার অনুপ্রেরণা
    তার ওপর কাজ করে চলেছে ।
    বুদ্ধিমত্তার সুড়সুড়ি আর এই প্রতিযোগী পক্ষের আকস্মিক প্রতিবর্তন ।
    বুদ্ধিমত্তার মাঝপথে শব্দেরা ।
    চিন্তার প্রতিবর্তন প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা একজনের চিন্তাকে হঠাৎ নোংরামিতে পালটে দ্যায় ।
    এই সংলাপটি চিন্তার অন্তর্গত ।
    ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়া, সবকিছু ভেঙে ফেলা ।
    আর হঠাৎ আগ্নেয়গিরিতে এই পাতলা জলের স্রোত, মনের সরু, আস্তে-আস্তে পতন ।
    আরেকবার নিজেকে ভয়ঙ্কর অভিঘাতের মুখোমুখি আবিষ্কার করা, অবাস্তবের দ্বারা নিরসিত, নিজের একটা কোনে, বাস্তব জগতের কয়েকটা টুকরো-টাকরা ।
    আমিই একমাত্র মানুষ যে এর পরিমাপ করতে পারি ।
  • পোস্টমডার্ন কবিতা | 236712.158.895612.192 | ২৯ জুলাই ২০১৯ ১৭:০৯541382
  • অবন্তিকার কমপ্লেকসিটি
    ------------------------------
    শ, যে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, অবন্তিকার প্রেমিক নং ১, ইংলিশ

    মিডিয়াম স্কুলে পড়বার সময়ে ওর সঙ্গে ইংরেজিতে

    প্রেম করতো ।

    শ-এর বাবা জ ( দুই ) ফরাসিদেশ থেকে হটেনটট ভেনাসের যোনি

    কিনে এনেছিলেন ( কথিত আছে )।

    জ ( এক ) যিনি অবন্তিকার মেশোমশায়, তা জানতে পারেন, শ-এর

    বাড়ি যেতে বারণ করে দ্যান।

    অলোকনন্দা গোস্বামী দোলের দিন রঙ খেলতে চায়নি বলে শিফন

    শাড়ি পরেছিল।

    অবন্তিকার খুব ঈর্ষা হল, শিফন শাড়ি দিয়ে অলোকনন্দার মাইয়ের

    খাঁজ দেখা যাচ্ছিল ।

    জ ( দুই ) নামকরা পেইনটার, উনি কেবল যুবতীদের খাঁজ আঁকেন,

    কলকাতার কালবৈশাখিতে অনেকের খাঁজে জল চুয়েছিল

    অবন্তিকার মনে হতো প্রেম কেবল মাতৃভাষায় সম্ভব, একদিন

    অ্যানাইস নিনকে লেখা হেনরি মিলারের চিঠি পড়ে বুঝতে

    পারলো যে শ বই থেকে টুকলিফাই করেছিল ।

    ক্লাসটিচার সিসটার ব ( এক ) আয়ারল্যাণ্ডে ফিরে গেলেন, তাঁর

    বদলি টিচার কেরালার, সিসটার আইয়াক্কম ।

    জ ( দুই ) কেরালার টিচারকে বাইবেল উপহার দিলেন, যাতে কালচে

    খাঁজ আঁকতে পারেন ।

    অবন্তিকা ২নং প্রেমিক খ ( তিন ) এর দিকে ঝুঁকলো, কেননা

    সে স্কুলে বাংলায় প্রথম হতো আর অবন্তিকার মেসোর

    ওপন হার্ট সার্জারির খরচ দিয়েছে।

    প্রতিদান হিসেবে অবন্তিকা খ ( তিন ) কে ব্লাউজে হাত ঢুকিয়ে

    টিপতে অনুমতি দিয়েছিল ( আহা কী আনন্দ )।

    মিস্টার শৈলেন বোস মারা গেছেন । মিস্টার অজিত গাঙ্গুলিও।

    অবন্তিকা ওনাদের নাম শোনেনি ।

    দ ( দুই ) এর দপতরে শ চাকরি করতে গেল ; খ ( তিন )

    ইটালির একজন ছাত্রীর সঙ্গে চলে গেল বিদেশে ।

    প্রেম সম্পর্কে অনির্বাণের কোনো ধারণা গড়ে ওঠার আগেই র-নামের

    স্কুল থেকে সে দ-নামের কলেজে ভর্তি হবার পর অবন্তিকা

    যাকে সবাই অবু বলে ডাকতো, পরিচয়ের প্রথম দিনেই বললে

    আমি ডেটিং-ফেটিং করি না।

    অনির্বাণ, যে জ ( দুই ) এর জারজ ছেলে, উত্তরে বলেছিল, আমিও

    ফাকিং-সাকিং করি না । বেচারা ন্যাড়া বোষ্টম হয়ে গেল।

    “মেয়েদের মাসিক প্রকাশ করা উচিত নয়”, সাইনবোর্ডে লেখা, তলায়

    পেইনটিঙ, জিনস-পরা যুবতীর মাসিক হবার রক্ত লেগে।

    পত্রিকার নাম ‘আরেত্তেরি ইস কি মা কা আঁখ’ ।

    পড়ার পর অবন্তিকা নিজের পাছায় হাত দিয়ে চেক করে নিল। নেই।

    যুবতী সাইনবোর্ড থেকে নেমে জিগ্যেস করল, পাতা ফুঁকবে?

    মইনুদ্দিন খানের কাঁধে হাত রেখে জ ( এক ) নির্বাচনে কজন মারা

    গেছে তা আলোচনা করতে-করতে গেল।

    কালবৈশাখির মেঘ একটু একটু করে জমা হচ্ছে, ছাতা আনেননি

    কেরালার টিচার, ওনার খাঁজ অতিপবিত্র, দেখানো যাবে না

    বৃষ্টির জল তা মানতে বাধ্য নয় ।

    শ একদিন জানতে পারলো তার বাবা জ ( দুই ) যাকে হটেনটট

    ভেনাসের যোনি বলে সকলকে ঈর্ষায় পুড়িয়েছেন তা আসলে

    ফরম্যালিনে চোবানো বড়ো বাদুড়

    খবরের কাগজে সংবাদটা পড়ে ম, যার সঙ্গে স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ে

    অবন্তিকার পরিচয় হবে, নিজেকে বলেছিল কি লজ্জা কি লজ্জা

    মরা বাদুড় দেখেও লিঙ্গোথ্থান হয় ।

    অনির্বাণ বোষ্টম হয়ে এক সুন্দরী বোষ্টমীকে ফাঁসিয়েছে, কী কুক্ষণে যে

    লটারির টিকিট কিনেছিল দশ লক্ষ টাকা পেয়ে চুল গজালো।

    অবন্তিকা একদিন ম-কে কাফে কফি ডে-তে বললে যে ওর একটা মাই

    কেউ এখনও টেপেনি ।

    ম বলেছিল, চিন্তা করিসনি, আমি টিপে দেবো । ম এমনই চরিত্রহীন যে

    তার আগেই শ-এর খুড়তুতো বোনের মাই টেপার অফারের

    সদ্ব্যাবহার করে ফেলল।

    খবরের কাগজের উত্তর সম্পাদকীয়তে হটেনটট ভেনাসের আসল যোনি

    আর জ ( দুই )-এর বাদুড় যোনির তুলনা প্রকাশিত হলো।

    পেইনটিঙের সমালোচকরা আবিষ্কার করলেন জ ( দুই ) এর খাঁজের

    তেলরঙগুলো আসলে বাদুড়দের ছবি ।

    ম একদিন অবন্তিকাকে প্রস্তাব দিল যে পূর্ণিমার রাতে সেন্ট্রাল পার্কের

    ঘাসে ফুলশয্যা করা যাক ।

    ম-এর মা ট ( দশ ) পার্কে সঙ্গমরত দুজন মানুষকে ভাবলেন ভুত আর

    ভুতনির অষ্টাঙ্গদশা, দেখেই দুহাত তুলে দৌড়োলেন ।

    ম-এর বড়ো ভাই প ( এক ) মাকে দৌড়ে আসতে দেখে সাপ মারার

    লাঠি নিয়ে পার্কে ছোটোভাইকে দেখে চটে গেলেন।

    ম-এর মা ট ( দশ ) বড়ো ভাই প ( এক ) কে স্তোক দিলেন যে তোকে

    তিনচারটে মেয়ের সঙ্গে একই দিনে বিয়ে দেবো।

    ট ( দশ ) এর ছোটোবোন ট ( নয় ) যে জ ( এক )-এর ডিভোর্সি বউ

    তা কেবল অবন্তিকা আর ম জানতো।

    ট ( নয় ) ম-কে বললেন, ঘাসে লীলেখেলা করিস কেন রে, হাঁটু ছড়ে

    যাবে, আমার বাড়ির ব্যবহার-না-করা বিছানা তো ছিলই।

    ট ( নয় ) এর ব্যবহার-না-করা বিছানায় লিলেখেলা করার সময়ে ম-কে

    অবন্তিকা বললে, তুমি আমার প্রেমিক নং ১৮ ।

    ম অবাক হলো যে এর আগে সতেরোজন প্রেমিক কি বিছানার চাদরে

    রক্ত মাখাতে পারেনি !

    অবন্তিকা ম-কে জানালো যে জ ( এক ) যিনি ওর মেসোমশায় তিনি

    এই শহরের ভার্জিনিটি রিপেয়ার বিশেষজ্ঞ ।

    শ, যে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, জ ( এক )-এর ভার্জিনিটি রিপেয়ারের

    হিসেব রাখে, তার কাছ থেকে ম জানতে পারলো যে এই শহরের

    প্রতিটি ভার্জিনের ভার্জিনিটি রিপেয়ার করা ।

    জ (এক ) আর জ ( দুই ) দুজনেই তাঁদের স্হাবর-অস্হাবর সম্পত্তি ম

    আর অবন্তিকাকে লিখে দিয়ে গেছেন ।

    ম আর অবন্তিকা ছেলে মেয়ে বউ জামাই নাতি নাতনি নিয়ে এখন সুখে

    থাকার চেষ্টা করে অথচ পারে না ।
  • Nicanor Parra | 236712.158.455612.60 | ১৯ আগস্ট ২০১৯ ১৩:০৭541384
  • "ম্যানিফেস্টো"

    মহোদয়া ও মহাশয়গণ

    এটা আমাদের শেষ কথা ।

    –আমাদের প্রথম ও শেষকথা —

    কবিরা অলিমপাস থেকে নেমে এসেছেন ।

    আমাদের বুড়োবুড়িদের জন্য

    কবিতা ছিল বিলাসের জিনিস

    কিন্তু আমাদের জন্য

    এটা একটা বনিয়াদি প্রয়োজন :

    আমরা কবিতা ছাড়া বাঁচতে পারি না ।

    আমাদের বুড়োবুড়ির থেকে আলাদা

    –আর আমি বেশ শ্রদ্ধা সহকারেই বলছি —

    আমরা মনে করি

    একজন কবি রাসায়নিক নন

    একজন কবি অন্য যেকোনো মানুষের মতন

    একজন রাজমিস্ত্রি যে দেয়াল গাঁথে :

    যে দরোজা আর জানালা তৈরি করে

    আমরা কথা বলি

    প্রতিদিনের ভাষায়

    আমরা গুপ্ত চিহ্ণে বিশ্বাস করি না

    তাছাড়া, আরেকটা ব্যাপার :

    একজন কবি বেঁচে থাকেন

    যাতে গাছটা তেএঁটেভাবে না বড়ো হয় ।

    এ হলো আমাদের বার্তা ।

    আমরা সৃষ্টিকর্তা কবিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জন করি

    সস্তা কবি

    গ্রন্হাগারের ইঁদুর কবি ।

    এই সব বাবুদের

    –আর আমি তা শ্রদ্ধা সহকারেই বলছি —

    অভিযুক্ত ও বিচার করা দরকার

    হাওয়ায় দুর্গ খাড়া করার জন্য

    জায়গা আর সময় নষ্ট করার জন্য

    যাহোক-তাহোক শব্দ জড়ো করার জন্য

    প্যারিসের সাম্প্রতিক ফ্যাশান অনুযায়ী ।

    আমাদের জন্য নয় :

    ভাবনাচিন্তা মুখের ভেতরে জন্মায় না

    তা হৃদয়ের হৃদয়ে জন্মায়

    আমরা অগ্রাহ্য করি

    রোদচশমা কবিতা

    তরোয়াল আর ফতুয়া কবিতা

    বড়ো ডানা কবিতার ছায়াকে

    পরিবর্তে, আমরা পছন্দ করি

    খোলা চোখের জন্য কবিতা

    ঢাকা না-দেয়া বুকের কবিতা

    নগ্ন মাথার কবিতা

    আমরা মায়াপরী আর শুশুক-দেবতায় বিশ্বাস করি না ।

    কবিতাকে এরকম হতে হবে :

    ঝর্ণায় ঘেরা এক যুবতী

    কিংবা কোনো কিছুই হবে না ।

    সুতরাং এখন, রাজনীতির এলাকায়

    ওনারা, আমাদের দাদুদিদারা,

    আমদের ভালো দাদুদিদারা !

    প্রতিসরিত আর ছড়িয়ে-পড়া

    যখন তাঁরা কাচের স্ফটিকের ভেতর দিয়ে গেলেন

    তাঁদের কয়েকজন সাম্যবাদী হয়ে গেলেন ।

    আমি জানি না তাঁরা সত্যই তা ছিলেন কিনা।

    ভেবে নেয়া যাক তাঁরা সাম্যবাদী ছিলেন

    আমি একটা ব্যাপার জানি :

    তাঁরা ঘাসভূমির কবি ছিলেন না,

    তাঁরা ছিলেন শ্রদ্ধেয় বুর্জোয়া কবি ।

    তাঁরা কেমন ছিলেন তা বলা জরুরি :

    সময়ে সময়ে

    তাঁরা জানতেন কেমন করে জনগণের হৃদয়ে প্রবেশ করতে হয় ।

    প্রতিবার তাঁরা যদি পারতেন

    তাঁরা শব্দ আর কাজের মাধ্যমে নিজেদের ঘোষণা করতেন

    পথনির্দেশিত কবিতার বিরুদ্ধে

    বর্তমানকালের কবিতার বিরুদ্ধে

    শ্রমিকশ্রেনির কবিতার বিরুদ্ধে ।

    মেনে নেয়া যাক তাঁরা সাম্যবাদী ছিলেন ।

    কিন্তু কবিতা হয়ে উঠেছিল দুর্বিপাক

    সেকেণ্ডহ্যাণ্ড পরাবাস্তববাদ

    থার্ডহ্যাণ্ড ডেকাডেন্টিজম,

    সমুদ্রের ফেরত-পাঠানো পুরোনো কাঠের পাটাতন ।

    বিশেষণ কবিতা

    নাকিসুর আর কুলকুচির কবিতা

    স্বেচ্ছাচারী কবিতা

    বই থেকে জড়ো করা কবিতা

    বিপ্লব শব্দের ওপর

    নির্ভর করা কবিতা

    পরিস্হিতি অনুযায়ী তা হওয়া উচিত ছিল

    বিপ্লবের ধারণায় নির্ভর

    কবিতার বজ্জাত গোষ্ঠীচক্র

    আধডজন নির্বাচিতদের

    “আত্মপ্রকাশের চরম স্বাধীনতা”

    এখন আমরা নিজেদের জেরাই করে জানতে চাই

    এসব তাঁরা কিসের জন্য লিখেছিলেন,

    পাতিবুর্জোয়াদের ভয় দেখাবার জন্য ?

    ফালতু সময় নষ্ট !

    পাতিবুর্জোয়ারা প্রতিক্রিয়া জানায় না

    যদি না তা তাদের পেটের ব্যাপার হয় ।

    তারা কবিতার ফলে আঁৎকে উঠবে !

    এটাই অবস্হা দাঁড়িয়েছে :

    তারা যখন সমর্থন করেছিল

    এক গোধূলীর কবিতা

    এক রাতের কবিতা

    আমরা সমর্থন করেছিলুম

    এক ভোরের কবিতা ।

    এটাই আমাদের বার্তা, কবিতা ঔজ্বল্য

    সকলের কাছে পৌঁছোনো দরকার, সমানভাবে

    কবিতা সকলের জন্য যথেষ্ট ।

    আর কিছু নয়, সহকর্মীবৃন্দ

    আমরা অগ্রাহ্য করি

    — আর আমি তা শ্রদ্ধা সহকারে বলছি —

    ছোটো-দেবতা কবিতা

    পবিত্র গরু কবিতা

    ক্ষ্যাপা ষাঁড় কবিতা

    আমরা বিরোধিতা করি

    মেঘের কবিতা

    শক্তমাটি কবিতা

    –ঠাণ্ডা মাথা, উষ্ণ হৃদয় —

    আমরা নিশ্চিতভাবে শক্তমাটির

    কফি কবিতার বিরুদ্ধে — প্রকৃতির কবিতা

    বৈঠকখানা কবিতার বিরুদ্ধে — রাস্তার মোড়ের কবিতা

    সামাজিক প্রতিবাদের কবিতা ।

    কবিরা অলিম্পাস থেকে নেমে এসেছেন ।

    সেইরকমই কিছু

    পাররা হাসেন যেন তাঁকে নরকে নির্বাসিত করা হয়েছে

    কিন্তু কবেই বা কবিরা হাসেননি ?

    তিনি অন্তত ঘোষণা করছেন যে তিনি হাসছেন

    তারা যেতে দেয় বছরগুলোকে যেতে দেয়

    বছরগুলো

    অন্তত মনে হব তারা যাচ্ছে

    প্রকল্পের আমি ভান করি না

    সবকিছু চলে যায় যেন চলে যাচ্ছে

    এখন উনি কাঁদতে আরম্ভ করেন

    ভুলে যান যে উনি একজন অ্যান্টিপোয়েট

    0

    মাথা ঘামানো থামান

    আজকাল কেউই কবিতা পড়ে না

    তা ভালো না খারাপ তাতে কিছুই আসে-যায় না

    0

    চারটে খুঁত যার কারণে আমার ওফেলিয়া আমাকে ক্ষমা করবে না :

    বুড়ো

    নীচুস্তরের জীবন

    সাম্যবাদী

    আর জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার

    <<আমার পরিবার হয়তো আপনাকে ক্ষমা করতে পারেন

    প্রথম তিনটির কারণে

    কিন্তু শেষটির জন্য একেবারেই নয়>>

    0

    আমার শব আর আমি

    ভালোভাবে নিজেদের বুঝতে পারি

    আমার শব আমাকে জিগ্যেস করে : তুমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো ?

    আমি জোরগলায় বলি না

    আমার শব জিগ্যেস করে । তুমি সরকারকে বিশ্বাস করো ?

    আমি কাস্তে আর হাতুড়ি দেখিয়ে জবাব দিই

    আমার শব জিগ্যেস করে । তুমি পুলিশকে বিশ্বাস করো ?

    আমি ওর মুখে ঘুষি মেরে জবাব দিই

    তারপর ও কফিন থেকে উঠে বেরিয়ে আসে

    আর আমরা বাহুতে বাহু গলিয়ে বেদিতে যাই

    0

    দর্শনের আসল সমস্যা হল

    যে থালাগুলো কে ধোবে

    কিচুই অন্যজগতের নয়

    ঈশ্বর

    সত্য

    সময়ের চলে যাওয়া

    চরম

    কিন্তু প্রথম, থালাগুলো কে ধোবে

    যে কেউই করতে চাক না কেন, যাও করো

    পরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে, কুমির

    আর আমরা আবার পরস্পরের শত্রু হয়ে গেছি

    0

    হোমওয়র্কের কাজ

    একটি সনেট লিখো

    যা এই লাইনের ছন্দে লিখতে হবে :

    আমি তোমার আগে মরে যেতে চাই

    আর শেষ হবে এই লাইন দিয়ে

    আমি চাইবো তুমি প্রথমে মারা যাও :

    0

    তুমি জানো কী ঘটেছে

    যখন আমি হাঁটু মুড়ে বসেছিলুম

    ক্রসের সামনে

    ওনার আঘাতের দিকে তাকিয়ে ?

    উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন আর চোখ মারলেন !

    আমি ভাবার আগেই যে উনি কখনও হাসেননি

    কিন্তু এখন হ্যাঁ আমি মনে করি সত্যি

    0

    একটা জরাজীর্ণ বুড়ো লোক

    ওর প্রিয় মায়ের কফিনে

    লাল কারনেশন ফুল ছোঁড়ে

    আপনারা কি শুনছেন মহোদয়া এবং মহাশয়গণ :

    এক বুড়ো বেহেড মাতাল

    তার মায়ের সমাধিতে বোমা ফেলছে

    ফিতেবাঁধা আর লাল কারনেশানসহ

    0

    ধর্মের খাতিরে আমি খেলাধুলো ছেড়েছিলুম

    ( প্রতি রবিবার গির্জায় যেতুম )

    আমি ধর্মকে বর্জন করলুম শিল্পের খাতিরে

    গণিতবিজ্ঞানের শিল্পের খাতিরে

    যখন শেষে ঔজ্বল্য আক্রমণ করলো

    আর এখন আমি একজন যে কেবল ছলেই চলেছে

    যার সমগ্রতে আর অংশতে কোনো বিশ্বাস নেই

    কোনো রাষ্টপতির মূর্তি পার পায় না

    ওই অব্যর্থ পায়রাগুলো থেকে

    ক্লারা সানদোভাল আমাদের বলতেন :

    ওই পায়রাগুলো জানে ওরা ঠিক কোন কাজ করছে

    হুঁশিয়ারি

    আগুন লাগলে

    লিফ্ট ব্যবহার করবেন না

    সিঁড়ি দিয়ে যাবেন

    যদি না অন্য কোনো নির্দেশ থাকে

    সিগারেট ফুঁকবেন না

    কাগজ ছড়াবেন না

    হাগবেন না

    রেডিও বাজাবেন না

    যদি না অন্য কোনো নির্দেশ থাকে

    পায়খানায় জল ঢালবেন

    প্রতিবার ব্যবহার করার পর

    কেবল যখন স্টেশানে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকে তখন নয়

    ভাবনাচিন্তা করবেন

    পরবর্তী যাত্রির জন্য

    খ্রিস্টধর্মী সেনারা এগোও

    দুনিয়ার শ্রমিক এক হও

    আমাদের কিছুই হারাবার নেই

    পিতার প্রতি আমাদের জীবনগৌরব ছাড়া

    এবং পুত্রের প্রতি ও ঈশ্বরের তৃতীয়রূপ ছাড়া

    যদি না অন্যরকম নির্দেশ দেয়া হয়ে থাকে

    আচ্ছা যা বলছিলুম

    আমরা এই সত্যগুলোকে স্বসমর্থিত বলে মনে করি

    যে সমস্ত মানুষের সৃষ্টি হয়েছে

    তাদের ওপরে বর্তেছে

    তাদের সৃষ্টিকর্তার দ্বারা

    কিছু অপসারণের অসাধ্য অধিকার

    তাদের মধ্যে হলো : জীবন

    মুক্তি ও আনন্দের প্রয়াস করা

    এবং শেষটি যদিও তা ক্ষুদ্রতম নয়

    যে ২ + ২ যোগ করলে ৪ হয়

    যদি না অন্যরকম নির্দেশ দেয়া হয়ে থাকে

    ফাঁদ

    সেই সময়ে যখন আমি পরিস্হিতিগুলো থেকে নিজেকে

    সরিয়ে রাখতুম যা অত্যন্ত রহস্যময়

    ঠিক যেমন পেটরোগা লোকেরা বেশি খানাপিনা এড়িয়ে যায়

    আমি বাড়িতে থাকা পছন্দ করতুম বিশেষকিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে

    মাকড়সাদের বংশবৃদ্ধি সংক্রান্ত

    বাগানের কোন কোনায় আমি নিজেকে আড়াল করে রাখবো

    আর রাত না হওয়া পর্যন্ত জনগণের সামনে বেরোবো না ;

    কিংবা, পুরোহাতা শার্ট পরে, অবজ্ঞায়,

    চাঁদের দিকে রাগি চাউনি ছুঁড়ে দেবো,

    ওই সমস্ত খিটখিটে কল্পনা থেকে মুক্ত হবার জন্য

    যা মানুষের আত্মায় এঁটুলির মতন আঁকড়ে থাকে ।

    যখন একলা ছিলুম তখন আমি একেবারে আত্মঅধিকারে থাকতুম,

    নিজের কাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এগোতুম আর পেছোতুম

    কিংবা নিচুতলার মদের ঘরে পাটাতনের ওপরে হাতপা ছড়িয়ে শুতুম

    আর স্বপ্ন দেখতুম, উপায় খোঁজার কথা ভাবতুম,

    ছোটোখাটো জরুরি সমস্যা সমাধান করতুম।

    ঠিক সেই সময়েই আমি স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার

    আমার বিখ্যাত প্রক্রিয়কে কাজে লাগানো আরম্ভ করলুম

    যা হলো নিজের প্রতি হিংস্রতা আর চিন্তা করা যে অন্য লোকে কি চাইবে,

    দৃশ্য গড়তে চাইবে

    যা আমি আগেই অন্যজগতের ক্ষমতা থেকে আদায় করে রেখেছি ।

    এই উপায়ে আমি অসামান্য তথ্য যোগাড় করতে পেরেছি

    আমাদের অস্তিত্বকে যে উদ্বেগ কাঁপিয়ে দেয় সেসব সম্পর্কে :

    বিদেশ ভ্রমণ, যৌন বিকৃতি, ধার্মিক জটিলতা ।

    কিন্তু সব সতর্কতাই ছিল অপর্যাপ্ত,

    কেননা, কারণ ব্যাখ্যা করা কঠিন বলে,

    আমি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঢালু পাটাতনে পিছলে যেতে লাগলুম ।

    আমার আত্মা ফুটো বেলুনের মতন দ্রাঘিমা হারিয়ে ফেললো,

    আত্মসংরক্ষণের প্রবৃত্তি কাজ করা বন্ধ করে দিলো

    আর, আমার জরুরি পক্ষপাত থেকে বঞ্চিত,

    আমি অপরিহার্যভাবে টেলিফোনের ফাঁদে পড়লুম

    যা তার চারিপাশের সবকিছুকে শুষে নেয়, ভ্যাকুয়ামের মতন,

    আর কাঁপতে-থাকা হাতে অভিশপ্ত নম্বরে ডায়াল করলুম

    যা আমি এখনও ঘুমের মধ্যে আপনা থেকে বারবার করি ।

    পরের মুহূর্তগুলো ভরে উঠলো অনিশ্চয়তা আর দুর্দশায়,

    যখন কিনা আমি, নরকের ওই টেবিলের সামনে কঙ্কালের মতন দাঁড়িয়ে

    হলদে সুতি-কাপড়ে ঢাকা,

    পৃথিবীর অন্য পার থেকে উত্তরের জন্য অপেক্যা করতে লাগলুম,

    আমার অ্স্তিত্বের বাকি অর্ধাংশ, আকটা গর্তে কারারুদ্ধ ছিল ।

    টেলিফোনের ওই স্পন্দিত আওয়াজ

    আমার ওপরে ডেন্টিস্টের ছ্যাঁদা করার মতন কাজ করতে লাগলো,

    আকাশ থেকে ছোঁড়া ছুঁচের মতন তারা আমার আত্মায় ঢুকে গেলো

    যতক্ষণ না, মুহূর্ত নিজেই এসে আবির্ভুত হলো,

    আমি রোগির মতন ঘামতে আর তোতলাতে লাগলুম

    আমার জিভ বাছুরছানার মাংসের মতন

    যে যুবতী শুনছিল আর আমার মাঝে ঝুলে রইলো,

    সেই কালো পর্দার মতন যা আমাদের থেকে মৃতদের আলাদা করে।

    আমি অমন অতি-অন্তরঙ্গ বার্তালাপ করতে চাইনি

    যার উৎস আমিই ছিলুম, যাই হোক না কেন, আমার বোকামিতে,

    আমার কন্ঠস্বর আবেগে ঘন, আর বিদ্যুৎপ্রবাহ সঞ্চারিত ।

    আমার ডাকনামে আহ্বান শুনে

    তা কি জোর করে জাগানো পরিচয়ের সুর

    আমাকে অস্পষ্ট অস্বস্তিতে ফেললো,

    স্হানিক গোলমালের মানসিক পীড়াসহ যা আমি থামাবার প্যাঁচ কষছিলুম

    প্রশ্ন আর উত্তরের দ্রুতি-প্রণালীসহ

    যা যুবতীটির মধ্যে নকল-যৌনতায় ফেনায়িত হয়ে উঠলো

    যা শেষ পর্যন্ত আমাকেও প্রভাবিত করল

    সর্বনাশের অনুভূতি টের পেলুম ।

    তারপরে নিজেকে হাসালুম আর তার দরুন মানসিকভাবে সটান শুয়ে পড়লুম

    এই মজাদার ক্ষুদে আলাপগুলো কয়েক ঘণ্টা চললো

    যতক্ষণ না যুবতীটি যিনি পেনশন প্রকল্প সামলান পর্দার পেছনে দেখা দিলেন

    আমাদের বোকা-বোকা কাব্যি আচমকা বন্ধ করলেন ।

    স্বর্গের দরোজায় একজন দরখাস্তকারীর ওইসব প্রবল মোচড়

    আর ওই পরিণতি যা আমার তেজকে দমিয়ে ফেললো

    তখনও সম্পূর্ণ থামেনি যখন টেলিফোন রেখে দিলুম

    কেননা আমরা নির্ণয় নিলুম

    পরের দিন সোডা ফাউন্টেনে দেখা করব

    কিংবা এক গির্জার দরোজায় যার নাম আমি ভুলে যেতে চাই ।

    কাল্পনিক মানুষ

    কাল্পনিক মানুষটা

    এক কাল্পনিক প্রাসাদে থাকে

    কাল্পনিক গাছে ঘেরা

    কাল্পনিক নদীর তীরে

    কাল্পনিক দেয়ালগুলোতে

    কাল্পনিক পুরোনো তৈলচিত্র ঝোলে

    সারাবার অসাধ্য কাল্পনিক ফাটল

    যা কাল্পনিক ঘটনাবলীর কথা বলে

    যা কাল্পনিক জগতে ঘটেছে

    কাল্পনিক সময়ে আর জায়গায়

    প্রতি দুপুরে এক কাল্পনিক দুপুর

    ও কাল্পনিক সিঁড়ি চড়ে

    আর কাল্পনিক বারান্দায় হেলান দেয়

    কাল্পনিক দৃশ্য দেখার জন্য

    যেখানে রয়েছে এক কাল্পনিক পাহাড়তলি

    কাল্পনিক পাহাড়া ঘেরা

    কাল্পনিক ছায়ায়

    সোজা চলে গেছে কাল্পনিক পথ

    কাল্পনিক গান গাইছে

    কাল্পনিক সূর্যের মৃত্যুর জন্য

    আর কাল্পনিক চাঁদনি চাঁদের রাতে

    ও কাল্পনিক যুবতীটির স্বপ্ন দেখে

    যা ওকে দিয়েছিল কাল্পনিক ভালোবাসা

    আরেকবার পুরোনো ব্যথা অনুভব করে

    সেই কাল্পনিক আনন্দ

    আর কাল্পনিক মানুষের হৃদয়

    আরেকবার স্পন্দিত

    আমি যা-কিছু বলেছি সব ফিরিয়ে নিচ্ছি

    যাবার আগে

    আমার একটা শেষ ইচ্ছা প্রাপ্য মনে করা হয়

    দয়ালু পাঠক

    এই বইটা পুড়িয়ে ফেলুন

    আমি যা বলতে চেয়েছিলুম তা এটা মোটেই নয়

    যদিও এটা রক্ত দিয়ে লেখা

    আমি যা বলতে চেয়েছিলুম তা এটা নয়

    আমার চেয়ে দুঃখি আর কেউ হতে পারে না

    আমি আমার ছায়ার কাছে পরাজিত হয়েছিলুম :

    আমার শব্দেরা আমার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিলো ।

    ক্ষমা করে দিন, পাঠক, প্রিয় পাঠক

    যদি আমি আপনাকে ছেড়ে যেতে না পারি

    উষ্ণ আলিঙ্গন দিয়ে, আপনাকে ছেড়ে যাচ্ছে

    জোর করে আর দুঃখি হাসি হেসে ।

    হতে পারে যে আমি কেবল এইটুকুই

    কিন্তু আমার শেষ কথাটা শুনুন :

    আমি যা বলেছি তা সমস্ত ফিরিয়ে নিচ্ছি :

    জগতের সমস্ত তিক্ততা নিয়ে

    আমি যা বলেছি তার সব কিছু ফিরিয়ে নিচ্ছি ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন