এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • আমার সকল ভালোবাসায় ...

    siki
    অন্যান্য | ২৮ জুন ২০১৩ | ১৫৩১৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • siki | 132.177.215.106 | ১১ জুলাই ২০১৩ ১৬:৫১612459
  • না না। এগোবে। একটু ভাবার সময় নিচ্ছি আর কি। কাল চেষ্টা করব।
  • dd | 69.92.171.197 | ১১ জুলাই ২০১৩ ১৬:৫৬612460
  • হাতে একটু পাখী রেখো।
    ঐ যে শুরু করলে সাদা কালো পায়রা পাখীদের নিয়ে তারপর আর তাদের বা অন্য কোনো পাখীর খোঁজই পাওয়া গেলো না। এতে পারম্পর্য্য ব্যাহত হচ্ছে।

    তুমি নায়ক নায়িকা যেমনই করাও পশ্চাতপটে কিছু পাখী ছেড়ে দিও। চিল ,প্যাঁচা নয় - ক্লিশে। কাক - পলিটিকালি বায়াসড। কাকাতুয়া গোছের কিছু মোটাল্যাজের পাখী ই জমবে।
  • | 24.96.185.244 | ১১ জুলাই ২০১৩ ১৬:৫৯612461
  • :-)))
  • শ্রাবণী | 134.124.244.107 | ১১ জুলাই ২০১৩ ১৭:০৩612462
  • হ্যাঁ, ভালো করে ভেবে লেখো, গল্পই তো, আত্মজীবনী তো আর নয়!:)
    খরা কাটলে আশাকরি এই রাফের ফেজ পেরিয়ে ফেয়ার লেখাও আসবে তবে এখানে লিখলে আমাকে একটু খবর দিও........নাহলে পড়া হয়না (এটা সিরিয়াস)। এদ্দিন পরে পড়ে উঠলাম।
  • siki | 132.177.215.106 | ১১ জুলাই ২০১৩ ১৭:০৮612463
  • শ্রাবণী সঠিক ধরেছে। খরা কাটাচ্ছি। কোনও ভাবনাচিন্তার কাহিনী লিখছি না।

    লিখব। :)
  • nina | 78.34.162.175 | ১২ জুলাই ২০১৩ ০৯:৪৩612464
  • ডিডি ঃ-)))))))))))))))
    কেকের ওপর আইসিং এক্কেরে--তাতে এট্টুস গোলমরিচ ও--ঃ-))
  • de | 69.185.236.52 | ১২ জুলাই ২০১৩ ১৩:৪৬612465
  • গপ্পোটা বেশ সিকি৯ হচ্চে ঃ)) -- ডিডিদা অনবদ্য!!!
  • জিগীষা | 127.194.98.223 | ১২ জুলাই ২০১৩ ২০:২৪612466
  • কই কই কই কই
  • kabya | 59.249.113.182 | ১২ জুলাই ২০১৩ ২১:২৯612467
  • আমার কিন্তু গপ্পো টা হেব্বি লাগছে।

    শেষ এ কি হয় তাই ভাবছি।
  • siki | 132.177.215.106 | ১২ জুলাই ২০১৩ ২২:১৭612469
  • সোংবারের আগে টাইম হবে নি। আপিস ফ্রন্টে ঝামেলি এসচে।
  • sosen | 218.107.178.181 | ১৩ জুলাই ২০১৩ ০০:১৬612470
  • কোঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈ !
  • kumu | 52.110.2.45 | ১৩ জুলাই ২০১৩ ২০:০২612471
  • আমারো গল্পটা বেশ লাগচে।ডিডিদার জন্য মাঝপতে থেমে রয়েচে।
  • kiki | 69.93.254.37 | ১৩ জুলাই ২০১৩ ২০:০৭612472
  • হ্যাঁ, একি! নাহোক রন আদ্দন্ত্য এক ভালো ছেলে হয়ে কেমন মত হয়ে গেলো গল্পটা(না পানু, না পরকীয়া), তাবলে থেমে যাবে?:D
  • dd | 132.167.42.29 | ১৩ জুলাই ২০১৩ ২২:৪২612473
  • আমি, আমি কিনা সাতে পাঁচে,সাড়ে ছয়ে ..... কোথ্থাও নেই। লজ্জায় ম্রিয়মান হয়ে ন্যাজেগোবোরে একসা হয়ে একটি মুহ্যমান ব্যাং মাত্রো। দোষের মধ্যে লাউ আর বাঁদাকোপি খাই না,ল্যাৎপ্যাতে লাগে আর,আর, আর .... ইয়েস, সত্যের পথ থেকে বিচ্যুতো হই না। খচ্চা হোলেও।

    বেসিক্যালি সরোল আর ঠ্যাংঠাংএ।

    আর দেখুন, দেখুন, কুমু কি না আমরেই দুষলো। হা।
  • siki | 132.177.158.245 | ১৩ জুলাই ২০১৩ ২২:৪৮612474
  • আর্ধুর! ডিডিদার জন্য কেন হবে? আমি একটু অকুপায়েড আছি অন্য ঝামেলায়। সোমবার নাগাদ বসতে পারব আশা করি।
  • কৃশানু | 213.147.88.10 | ১৪ জুলাই ২০১৩ ০০:১৭612475
  • ওহ! ডিডিদা!!
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ জুলাই ২০১৩ ১১:৩৬612476
  • মুশকিলটা হচ্ছে পরকীয়া জিনিসটা জাতে সায়েন্স, তালে বাংলা অনার্স। সায়েন্স এই কারণে, হাতেকলমে প্র্যাকটিকাল রাখতেই হবে, 'হাত থাকতে মুখে কেন' (নো হিনী) টাইপ ব্যাপার।

    আবার লেখার সময় একটু খেলিয়ে খেলিয়ে ভাষা দিয়ে না লিখলে নইলে পাঠক বলবে 'চটি' লিখছেন স্যার? তাইলে নীলনির্জন ছেড়ে গুরু এলাম কি কত্তে? ঐখানে বাংলা অনার্স ঢুকে পড়ল।

    সিকি কি করছে দেখি।

    প্রথম পর্বে ঊর্মিলার লোনলিনেসের গল্পটা দিয়ে খাতা খুলল। শুরু হিসেবে ভালো। আগেই একটা জাস্টিফিকেশান, একটা প্রেক্ষাপট রেডি থাকল। দ্বিতীয় পর্বে যার জন্য এই মন উচাটন, সেই রণ এলো, আলাপ জমল, এই পর্বের লাস্ট লাইনে টুক করে গল্পটা একটু এগিয়ে দিল সিকি, রণের কাছে ঊর্মিলার স-ব কনফেস করেছে লিখে। অর্থাৎ এই লাইন অবধি ঊর্মিলা নিজে, রণ এবং পাঠক সবাই সেম পেজে এসে গেল।

    পরের পর্বে গল্পটা ঘুরে গেল কিন্তু গতির দিক থেকে না, বরং দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে। অনেকটা মাই নেজ ইজ রেড এর স্টাইলে, যেখানে সব ইন্টারেস্টেড পার্টি নিজেদের দিক থেকে একটাই গল্প বলছে। রণের বায়োডেটা জানলুম, ব্যাকগ্রাউন্ডটা ক্লিয়ার হল...
    সবই তো বুঝলুম, জ্ঞানের হেনতেন/
    সিকি তোমার গল্পের ফ্লো, থমকে গেল কেন?

    পর্ব দুইয়ের প্রথম পার্টে অনেক সংলাপ আছে, প্রচুর ফ্ল্যাশব্যাক আছে, ক্যারেকটারদের বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সিকির চেষ্টায় একটুও খামতি নেই, কিন্তু লোকে বসে আছে পোলাউ-মাংসের অপেক্ষায়, সিকি এক্সট্রা একটা ভেজ ডিশ একরাউন্ড ঘুরিয়ে দিল।

    সেকেন্ড পার্টে একটা সম্ভাবনা ভেবেছিলুম রাজীব বা দীপালির বয়ান আসবে, মাই নেম ইজ রেডের স্টাইলে, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, সিকি রণের কনফ্লিক্টের ওপরে জোর দিচ্ছে।

    জোর দিচ্ছে এরম বললুম কেন? পুরো লেখাটাই এর-ওর বয়ানে। প্রথমে রণ দোলাচলের কথাগুলো ভাবল। নো প্রবলেম। শেষের দিকে এসে দেখি, তিব্বতে টিনটিনে কুট্টুসের সেই দুটো ইনার সেল্ফ ছিল না, অ্যাঞ্জেল সেল্ফ বলছে ওটা তো হুইস্কি। ওটা খেলে মানুষের মত নচ্ছার হয়ে যেতে হয়। আর ডেভিল সেল্ফ বলছে, ঐ দ্যাখ বোতল থেকে মদ গড়াচ্ছে, যা খা। রণেরও সেই অবস্থা। কিন্তু এটাই তো প্রথমে বলা হয়েছে। সেই এক কথা ঘুরে ঘুরে। তবে লাস্ট লাইনটা বোল্ড যেটার দরকার ছিলো।

    পর্ব তিনে এসে শুরু হল ঊর্মিলার কনফ্লিক্ট। এই পর্বে অবশ্য সিকি অনেক বেশি সংযত, অনেক শর্টে সেরেছে, এমনকি এই পর্বে একটাই পার্ট। কিন্তু সাইকোলজিকাল দিকগুলো নিয়েই গল্পটা পাক খাচ্ছে, বল সেই মাঝমাঠেই আটকে আছে, শুধু এর পা থেকে ওর পায়ে।

    চার নম্বরে গল্প এগিয়েছে। যদিও আবারও সেই পর্ব দুইয়ের চর্বিতচর্বণ ফিরে ফিরে এসেছে, কিন্তু তাহলেও এগোচ্ছে, প্লাস কিঞ্চিৎ প্রাইভেট আই গিরিও আছে, কিন্তু গল্পটা সামহাও ফোকাস থেকে সরে যাচ্ছে। টেকেন ফর গ্র্যান্টেড বলেই কি রণের মধ্যে একটা অনীহা, একটা মরালিটি গজিয়ে উঠল। আদৌ কিছু হবার আগে। পরকীয়ার গল্পে পরকীয়া কোথায়? আমার সেই বন্ধু বলেছিল, দাদা, লংকা বাদ দিয়ে একটা ঝালমুড়ি দিন, সেই রকম হয়ে গেল।

    হয়ত এটাই বাস্তব, এরকমই ঘটেছিল, ফলে সিকিও সেই রকম লিখে চলেছে। সিকির লেখার হাত ভালো, বিশ্বাসযোগ্য, তাই টানে পড়ে ফেলা যায়। কিন্তু গল্পের উপাদান আরেকটু দরকার, আর গল্পটাও এগোক। কিছুমিছু ঘটুক, সে ভালো হোক আর মন্দই হোক।

    বাংলা অনার্স উৎরেছে এবারে হ্যান্ডস-অন কিছু হবার আশায়....
  • Sibu | 183.60.205.153 | ১৪ জুলাই ২০১৩ ১২:৫৫612477
  • সিকির কাছে একটা অনুযোগ আমার থাকলই। বাংলা পরকীয়ার গল্পে প্রোটাগোনিস্টদের পার্টনারদের হয় হৃদয়হীন নিষ্ঠুর নয় কাজপাগলা আনমাইন্ডফুল টু দি রিলেশনশিপ অথবা হাস্যকর রকমের ভাঁড় সাজানোর একটা প্রচলিত প্রথা আছে। সিকিও ঊর্মির ক্ষেত্রে সেই ছকটা ভাঙলো না। এইসব ছকের মধ্যে একটা মর‌্যালিটি জাজমেন্ট থেকেই যায় - তোমার পার্টনার যদি অন্যমনস্ক হয় তো তা তোমার দোষ।

    অথচ বাস্তব হল দুটি পারফেক্টলি চমৎকার, এমনকি বাঞ্ছনীয় মানুষ, দে গ্রো অ্যাপার্ট। সেটা আটকাতে হলে মানুষের বনসাই বানাতে হয়। গাছের দুটি ডাল দুদিকে বাড়তে বাড়তে অন্য গাছের ডালদের কাছাকাছি চলে আসতেই পারে। তার জন্য কি অন্য ডালের কিছু শর্টকামিং থাকতেই হবে?

    এছাড়াও তো আরো অনেক ব্যাপার থাকেই। মোটের ওপর, নারী-পুরুষের প্রেম, নির্মলেন্দু গুনের ভাষায় - "বড়ো লজ্জাহীন কঠোর নির্মম এই খেলা"। বা দি লাস্ট মিসট্রেসে এসিয়া আর্জেন্টোর মুখে - এসব ব্যাপারে যে আগে কেঁদে ফেলল সেই হেরে গেল। একবার, এক বিবাহিতা বান্ধবী তার প্রসপেকটিভ প্রেমিককে বলেছিল - তোমাকে ঘেন্না করি, প্রেমিক কেন, বন্ধু হিসেবেও মানতে পারি না। কিন্তু তোমার এই মনোযোগে আমি এত খুশী হয়েছি যে আমার বরের সাথে আমার সম্পর্কে আবার প্রাণ ফিরে এসেছে। শুধু সেই জন্যই আমি তোমার সাথে কথা বলি। ঘটনাচক্রে এটা দুজনের মুখেই শোনা, নইলে বিশ্বাস হত না।

    এইসব অগুন্তি জটিল টানাপোড়েন বাদ দিয়ে পরকীয়ার গল্প হয় টিন-এজার সুলভ শরীর খোঁজার গল্প হয়, নয় তো কোন ব্র্যাট মহিলা/পুরুষের প্রশ্রয়ের সন্ধানে দাঁড়ায়।
  • kabya | 59.249.52.69 | ১৬ জুলাই ২০১৩ ২০:৪৪612478
  • সিকি বাবু জে বল্লেন সোমবার এ লিখবেন, কিন্তু কৈ কৈ লেখা কৈ?
  • কৃশানু | 213.147.88.10 | ১৬ জুলাই ২০১৩ ২২:২৭612481
  • শালা সব রিমাইন্ডার সেট করে বসে আছে!!!
  • জিগীষা | 127.194.97.117 | ১৬ জুলাই ২০১৩ ২৩:১৫612482
  • কই কই কই
  • siki | 132.177.162.2 | ১৭ জুলাই ২০১৩ ১৯:৫১612483


  • - চল্‌।

    - কোথায়?

    - জাহান্নামে। তোর আপত্তি আছে?

    - সে তুই হাত ধরে নিয়ে গেলে খুব একটা আপত্তি নেই, কিন্তু জাহান্নামটা ঠিক কোথায় সেটা তো বল!

    - কেন, ঠিকানা না জানলে কি তোর আমার সাথে জাহান্নামে যেতে আপত্তি আছে? ভয় পাস নি রণ, তোকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাচ্ছি না। আমি ছেলেধরা নই রে। কোথাও একটা যাবো, যেখানে কেউ আমাদের চেনে না। কিছুক্ষণের জন্য। ... হাত ধরব?

    ঊর্মিলা সত্যি সত্যি আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে। এটা ঠিক আমার পাড়া নয় যদিও, তবু পাড়া থেকে খুব একটা দূরেও নয়। চেনা লোকের অভাব নেই এদিকে। ঝটিতি একবার চোখ বুলিয়ে নিই এদিক ওদিক। ঊর্মিলা খিলখিলিয়ে হেসে ফেলে, - লজ্জা করছে? পাবলিক

    প্লেসে হাত ধরে ফেলেছি বলে? অ্যাই রণ, বল না, হাত ছেড়ে দেব?

    রাস্তার আলোয় ঝিকমিকিয়ে ওঠে ঊর্মিলার গজদাঁত। ঊর্মির একটা গজদাঁতও ছিল? কোনওদিন খেয়াল করি নি তো! ... ছেড়ে দেব বলল বটে, তবে ছাড়ে নি এখনও আমার হাত। আমার কবজি আলতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে ঊর্মির আঙুলগুলো। হালকা উষ্ণতা একটা, যেন

    পায়রার গায়ের ওমের মত। আমার কেমন যেন মাথায় দুলুনি জাগে। সারাদিনের ফাঁকা অলসতা ঝেড়ে উল্টোডাঙার মোড় এখন ব্যস্ত রূপ নিয়েছে। আমরা হাঁটছি ফুটপাথ ধরে, দুদিক থেকে অজস্র লোকের ভিড় অনবরত আমাদের দুপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ ফিরেও

    তাকাচ্ছে না আমাদের দিকে। তবু আমার কেন মনে হচ্ছে, সব্বাই, ঠিক আমাদেরই লক্ষ্য করছে? ওই যে, ওই যে ওষুধের দোকান থেকে বেরোলেন ওই বৃদ্ধ, উনিও কি আমার দিকেই দেখছেন না? ওটা কি কানুজেঠু? আমাকে চিনতে পেরেছেন?

    কাছে আসতে ভুল ভাঙে, না, কোনও জেঠু-টেঠু নয়, নিতান্তই অপরিচিত একজন। ভুল ভাঙে, কিন্তু ঘোর ভাঙে না। মনে হয় আমি যেন হাঁটছি, কিন্তু আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঊর্মি, আমার কিশোরবেলার গোপন প্রেমিকা, এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ অপরিচিত, একজন নারী।

    নারী, যে আমাকে চায়। অপরিচিত। ঊর্মি আমার হাত ধরে রয়েছে। হাতের স্পর্শ অপরিচিত। ঊর্মির গা থেকে যে পারফিউমের সুবাস বেরোচ্ছে, সে গন্ধ আমার চেনা নয়। প্রতিটা মেয়ের শরীরেই বোধ হয় আলাদা গন্ধ থাকে। এ গন্ধ আমার অপরিচিত। আর এই অপরিচিতি

    আমাকে জড়িয়ে ফেলছে। আমি ঘোরে পড়ে যাচ্ছি। ঊর্মি আমার খুব কাছে কাছে হাঁটছে। হাতে হাত ঠেকে যাচ্ছে। আমি হাত ছাড়িয়ে নিই ওর হাত থেকে, ফিরে স্পর্শ করি ওর হাত। আমার আঙুল ধীরে ধীরে চালিয়ে দিই ওর আঙুলের ফাঁকফোকরে। ঊর্মির আঙুল কি একটু

    কেঁপে ওঠে? ঊর্মির ঠোঁটের হাসিতে কি অন্য কোনও রঙ লাগে? অপরিচিত কোনও রং?সেই অপরিচিতি কি আমাকে আরও বেশি মোহাচ্ছন্ন করে ফেলে?

    জানি না। শুধু মনে হয়, এই যে আমরা দুজন হাঁটছি, চতুর্দিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কল্লোলিনী শহর, নিজের খেয়ালে, কিছুই যেন সত্যি নয়, কিছুই যেন স্থায়ী নয়। সব যেন কিছুক্ষণের কল্পনা। শুধু বাস্তব আমরা। আমাদের পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকা হাত। বাস্তব এই মুহূর্ত। এই পল,

    অনুপল। আমি যেন এর আগে কোথাও ছিলাম না, আমি যেন এর পরে কোথাও থাকব না, শুধু এই মুহূর্তটুকুই আমার আয়ু, শুধু এই বিকেলটুকুই আমার অস্তিত্ব। আমার ঘর নেই, সংসার নেই, স্ত্রী-সন্তান নেই, কেরিয়ার নেই, পাপপুণ্যের ভালোমন্দের বিচারবোধ নেই, শুধু

    এক অনন্ত দুলুনির মধ্যে দিয়ে আমার হাতের মধ্যে দিয়ে কী এক অদ্ভূত তরঙ্গ ছুঁড়ে দিচ্ছে আমার ভেতরে এই নারী, আর মাথার স্নায়ুর মধ্যে দিয়ে রক্তের কণিকারা ছোটাছুটি করছে অসীম দ্রুততায়, ঘা মারছে মগজের অনেক দিন আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া এক কুঠুরিতে, বেরিয়ে

    আসছে, প্রায় ভুলে যাওয়া কবিতার লাইন, অন্যরকম মানে নিয়ে।

    কাছে থাকো। ভয় করছে। মনে হচ্ছে
    এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়। ছুঁয়ে থাকো।
    শ্মশানে যেমন থাকে দেহ ছুঁয়ে একান্ত
    স্বজন। এই হাত, এই নাও, হাত।
    এই হাত ছুঁয়ে থাকো, যতক্ষণ
    কাছাকাছি আছো, অষ্পৃষ্ট রেখো না।
    ভয় করে। মনে হয় এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়।
    যেমন অসত্য ছিল দীর্ঘ গতকাল।
    যেমন অসত্য হবে অনন্ত আগামী।

    অথচ এমনটা তো হবার কথা ছিল না। এই ধরণের ঘোরে পড়ার বয়েস তো আমি পেরিয়ে এসেছি বহুকাল! মেয়ে-হাতের স্পর্শ আজ তো আমার অজানা নয়! আমি তো তৈরি হয়েই এসেছিলাম! তবু কেন ঊর্মি আমাকে ছোঁয়ামাত্র আমার যুক্তিবোধ আমার র‍্যাশনালিটি সমস্ত

    এইভাবে লোপ পেল? আমাকে কীভাবে এই রকম বশীভূত করে ফেলল ঊর্মি? আমাকে? রণজয় সেনকে? সব জেনে, সব বুঝেও যে এসেছিল ঊর্মিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে তার নর্মাল জীবন ফিরিয়ে দিতে, সে নিজে ঊর্মির কাছে ঘোল খেয়ে যাচ্ছে আজ? কোথায় গেল, রণজয়

    সেন, তোমার পার্সোনালিটি? তোমার সহজাত বিচারবোধ?

    বুধবারে কলকাতায় নেমেই জানতে পারি শুক্রবার বাংলা বনধ ডেকেছে বিরোধী দল। সময় নষ্ট না করে ভাস্করকে ফোন করেছিলাম। ভাস্কর ছিল না অফিসে, সন্ধ্যেবেলায় ওর বাড়িতে ডেকেছিল। না, বিশেষ কিছু জানতে পারি নি ওর কাছ থেকে। অথবা জেনেও আমাকে

    বিশেষ কিছু জানায় নি কিনা, তাই বা কে জানে! বর্ধমানে রাজীব-ঊর্মির বাড়ির ঠিকানা চেয়েছিলাম, সেটা অবশ্য দিয়েছে আমাকে। তবে রাজীবের সাথে দেখা করতে পারে নি ভাস্কর; অন্তত আমাকে যা বলল। খানিক এদিক সেদিক আলোচনা করে যা বুঝলাম, এ সবের মধ্যে

    নিজেকে জড়াতে চাইছে না ভাস্কর। আমিও অতএব, এ নিয়ে আর বিশেষ কিছু কথা বাড়ালাম না। খানিক এ-কথা সে-কথার মধ্যে দিয়ে ভাস্কর মূলত আমাকে যা বলল তার নির্যাস এই, কেন খামোকা নিজেকে এইসবের মধ্যে জড়াচ্ছি? নিজের জীবন নিয়ে থাকাটাই তো

    বেটার।

    সে কি আর আমিও জানি না? আমি তো জড়াতে আসি নি নিজেকে। আমি এসেছি নিজেকে মুক্ত করতে। ঊর্মির সাথে দেখা করে বলতে, যে, যা হয়েছে হয়েছে। কোনওভাবে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি যদি হয়ে থাকে, সেটা নিজেদেরই মিটিয়ে নিতে, আর যদি এ

    ব্যাপারে আমার মধ্যস্থতা ওদের কোনওভাবে সাহায্য করতে পারে, সেটুকু সাহায্যের হাত আমি বাড়িয়ে দিতে পারি বন্ধু হিসেবে, এর বেশি কিছু নয়। ঊর্মিকে প্রেমিকা হিসেবে ভাবা আমার সম্ভব নয়।

    কাল গেছিলাম ক্যামাক স্ট্রিটে। উদ্দেশ্যহীনভাবে খানিক ঘোরাঘুরি করেছি রাজীবের অফিসের সামনে, রাজীবকে দেখতে পাই নি। অবশ্য রাজীব কলকাতার অফিসে থাকবে কিনা, সেটা আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না, আর শুধুমাত্র একটা ছবি দেখে রাজীবকে ভিড়ের

    মধ্যে চিনতে পেরে যাব, এতটা ধুরন্ধর গোয়েন্দাও আমি নই। নেহাতই কৌতূহলে ঘুরে এসেছিলাম। আজ সকাল থেকেই বাংলা বনধ ছিল। সমস্ত গাড়িঘোড়া বন্ধ, দোকানপাট সব ঝাঁপ ফেলা, কলকাতায় একটা টিপিকাল বনধ যেমন হয়, তেমন করেই ঘরে বসে দিনটা কাটল।

    ঊর্মিলার ফোন এল না সারাদিনেও। ভেবে নিয়েছিলাম, কাল সকাল সকাল বর্ধমানের দিকে রওনা দেব। বাদামতলা কত বড় জায়গা আমার কোনও ধারণা নেই, তবে এই লেকটাউনের থেকে বড় নিশ্চয়ই হবে না।

    উল্টোডাঙার মোড়ে ঊর্মির সাথে দেখা হয়ে যাওয়া আজ বোধ হয় দিনের সেরা চমক ছিল। সারাদিনের বনধের প্রভাব স্তিমিত হতে হতে বিকেল পাঁচটার মধ্যে দোকানপাট খুলতে শুরু করেছিল, অটো-বাসও চলতে শুরু করেছিল দু একটা। ছুটকোছাটকা দু একটা ব্যাপার ছাড়া

    এমনি শান্তিপূর্ণই ছিল, অন্তত এদিকটায় কিছু হয় নি। সারাদিন বাড়িতে বসে বসে বোর লাগছিল, তাই হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলাম উল্টোডাঙার দিকে। রাস্তায় আস্তে আস্তে ভিড় জমছিল। হঠাৎই পেছন থেকে আমার নাম ধরে কে যেন ডাকল, আর ঘাড় ঘুরিয়েই দেখি, না,

    ভুল দেখার কোনও চান্সই নেই, ঊর্মি দাঁড়িয়ে আছে আমার ঠিক পেছনটায়। মুখে মিটিমিটি হাসি।

    এ রকম কি গল্পে উপন্যাসে হয়ে থাকে? ও জানল কী করে আমি এই সময় এই জায়গাটাতে থাকব? আমি নিজেই তো জানতাম না! হঠাৎ দেখা? মুখ দেখে যেন মনে হচ্ছে ও জানত আমি ঠিক এই সময়ে এই জায়গাটা দিয়েই হেঁটে যাব, যেন ধরে ফেলেছে আমাকে।

    প্রায় কুড়ি বছর বাদে দেখা। ঊর্মি পরে আছে একটা অফ হোয়াইট রঙের স্লিভলেস কুর্তি, আর একটা জিনস। যতটা মোটা লেগেছিল ওকে ছবিতে, ততটা তো মোটা নয়! শরীর জুড়ে স্বাভাবিক মেদ। যতটা মেদ আকর্ষণ জাগায়। জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার?

    কই, মনে তো হচ্ছে না! শেষ দেখার সেই কিশোরী মুখ আর নেই, সেখানে আছে পরিপূর্ণ এক নারীর মুখ। ঠোঁটের ওপর স্বেদবিন্দু, গলার দুদিক থেকে একটা হাল্কা সোনার চেন গড়িয়ে এসে হারিয়ে গেছে কুর্তির অন্তরালে। ঊর্মি। অজান্তেই আমার চোখ চলে যায় ওর সিঁথির

    দিকে, না, সিঁদুরের চিহ্ন তো নেই।

    - কী দেখছিস? চিনতে পারিস নি নাকি?

    - না, মানে, তু-তুই এখানে, কবে এলি? কী ব্যাপার? জানলি কী করে?

    - আমি তো ম্যাজিক জানি রে। তোকে ব্যাঙ্গালোর থেকে নিয়ে এনে ফেললাম এখানে, আর সামান্য বাজারদোকানের ভিড়ে তোকে খুঁজে বের করতে পারব না? আমিই তো তোকে নিয়ে এলাম এইখানে, এই চৌরাস্তার মোড়ে।

    - হেঁয়ালি ছাড়। তুই কবে এসেছিস?

    - কাল সন্ধ্যেয়।

    - একা এসেছিস?

    - না, ওই তো আমার বর রয়েছে ওই দোকানটায়। সিডি কিনছে। যাবি, আলাপ করবি? নাকি আমাকে নিয়ে পালাবি এখান থেকে?

    আমি থতমত খেয়ে যাই। রাজীব, এখানে? আপনাআপনিই আমার নজর চলে যায় সামনে সিডির দোকানের ভেতরে। খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে ঊর্মিলা, আলতো করে আমার পিঠে চাপড় মেরে দেয়, ভয় পেয়ে গেলি, রণ? রাজীব তোকে আমার সাথে দেখতে পেলে

    কিন্তু খুব রেগে যাবে, এখনও সময় আছে রণ। চল্‌, পালাই এখান থেকে।

    বলতে বলতে হাসতে থাকেঊর্মি। আমি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলি, রেগে যাবে কেন রে? বিয়ে করা বউদের কি ছেলেবন্ধু থাকতে নেই নাকি? চল, আলাপ করে আসি। ... আমি পা বাড়াই। পেছন থেকে হাসতে হাসতে হাত টেনে ধরে ঊর্মি, পাগল কোথাকার। এদিকে

    তাকা। কেউ নেই দোকানে। রাজীব এখানে নেই রে।

    আস্তে আস্তে হাসি থামিয়ে অল্প গম্ভীর হয় ঊর্মিলা। আমি অপলক তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। ঊর্মিলাও তাকিয়ে থাকে আমার চোখে চোখ রেখে। আমার বিহ্বলতা বোধ হয় ওকে খুশি করে। ঠোঁটে আবার অল্প হাসি ফোটে।

    - কী দেখছিস?

    - তোকে।

    - পছন্দ হয়?

    - মানে, ইয়ে ...

    - একা এসেছি না দোকা এসেছি, সেটা তো প্রথম প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল না রে, রণ। আমি তোর জায়গায় থাকলে কিন্তু ঠিক তোর হাত ধরে দৌড় লাগাতাম। একা আসি নি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাল এসেছি। তারা বাড়িতে আছে, তাদের দিদার কাছে। রাজীব ওখানেই আছে।

    বনধের জন্য একদিন বাড়তি ছুটি হয়ে গেল, তাই ভাবলাম চলে আসি। ... তা বলে ভাবিস না যেন, না এলে তোকে ফোন করতাম। তোর ফোন নম্বর আমি সেদিনই হারিয়ে ফেলেছি। আমার বয়ে গেছে তোকে ফোন করতে।

    - আমি কিন্তু একাই এসেছি।

    - এই তো সাহস বেড়েছে খোকাবাবুর। আমি কি তোকে জিজ্ঞেস করেছি তুই কারুর সাথে এসেছিস কিনা? আমি জানি তুই একা এসেছিস। তা, এখানেই দাঁড়িয়ে ভিড়ের ধাক্কা খেতে থাকবি, নাকি কোথাও একটা বসবি? এতদিন বাদে দেখা হল পুরনো বান্ধবী কাম সিক্রেট

    লাভারের সাথে, কিছু খাওয়াবি টাওয়াবি না?

    - হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চই, নিশ্চই, কোথায় যাবি বল, কী খাবি?

    - যা খেতে চাইব, খাওয়াতে পারবি? এখানে, এক্ষুনি?

    - ঊর্মি, আস্তে, সবাই শুনতে পাবে।

    - পাক না। তুই যতক্ষণ এই রকম ভেবলুর মত মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকবি, আমি ততক্ষণ তোর পেছনে লেগে থাকব। আপাতত তো একটা আইসক্রিম খাওয়া, পরে ভেবে দেখছি, কোথায় কী খাওয়া যায়।

    অনেক কথা বলব ভেবে রেখেছিলাম, ঊর্মির সঙ্গে দেখা হলে। কিন্তু কী যে হল, এখন আর কিছুই মনে পড়ছে না। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে বসলাম একটু দূরে একটা আইসক্রিম পার্লারে। কিছু যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার নিজেকে স্মার্ট, কইয়ে বইয়ে হিসেবে ভাবা একটা

    অভ্যেস হয়ে গেছিল, সেটা যে কতটা অন্তঃসারশূন্য ধারণা, এখন বুঝতে পারছি। পার্লারের এক কোণে আমার ঠিক মুখোমুখি বসে ঊর্মিলা এখন আইসক্রিম খাচ্ছে। হাতের আঙুলে ঝিলিক দিচ্ছে একটা সোনার আংটি। কাঁচের চুড়িরা বাজছে রিনিঠিনি শব্দে। ঊর্মিলা কোনও

    বিবাহচিহ্ন ব্যবহার করে না। হাতে শাঁখা পলাও নেই। ঊর্মিলার ঠোঁট অল্প ভিজে। নিজের বউকে ছাড়া এত কাছ থেকে আর কখনও কোনও মেয়ের ঠোঁট এত ক্লোজলি বসে ওয়াচ করি নি। এখন করছি। মুখের ভেতর আইসক্রিম নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ঊর্মি। অল্প ভিজে ঠোঁট,

    নড়ছে। আমার দেখতে খুব ভালো লাগছে। স্লিভলেস কুর্তির বাইরে ঊর্মির হাত বড় বেশি ঝলসাচ্ছে যেন। এই হাতে একদিন স্পর্শ হত আমার হাত, আমার প্রেমে পাগল হত কিশোরী ঊর্মিলা, আজ কি তারই প্রতিশোধ নেবার দিন? নইলে আমার কেন বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছে

    ওর হাতের দিকে, কেন বারবার ছুঁতে ইচ্ছে করছে ওর ঠোঁট? আমি কেন কিছুতেই কোনও কাজের কথা আর মনে করতে পারছি না, মনে করতে পারছি না কোনও কথা, আর কারুর কথা? ঊর্মি কি জেনেবুঝেই জাল বিছিয়ে রেখেছে আমার জন্যে?খুব উগ্র কিছু তো সাজে নি

    ঊর্মিলা, ওকে আমার এত বেশি ইনভাইটিং লাগছে কেন আজ? আমি কি হ্যালুসিনেটেড হয়ে যাচ্ছি? খুব বেশি মাত্রায় ওকে নিয়ে ভেবে ফেলেছি?

    জানি না। ঊর্মিলাই কথা চালাচ্ছিল, আমি শুধু উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম।

    - কিছু বলবি না?

    - কী বলব বল তো? তোর গল্প বরং বল।

    - আমার গল্প তো শুনেছিসই।

    - তোর বরের গল্প?

    - আমরা কি এখানে আইসক্রিম খেতে খেতে সাংসারিক আলোচনা চালাতে এসেছি? এর পর কি জিজ্ঞেস করবি, আজ কী বাজার করলাম তার গল্প বল? ... বর বরের মত থাকে। আমি আমার মত।

    - ছেলেমেয়েরা?

    - আচ্ছা রণ, আমি কি একবারও তোকে জিজ্ঞেস করেছি দীপালি কেমন আছে, তোর ছেলের কী খবর? তুই এত সেফ খেলছিস কেন? কিছুক্ষণের জন্য মনে কর না, আমি শুধু আমিই? পেছনে সংসার নেই, সামনে ভবিষ্যত জানা নেই, আর কখনও কোনওদিন দেখা হবে

    কিনা জানা নেই, শুধু এই সন্ধ্যেটুকুতে আমরা আছি, তুই আছিস, আমি আছি। এটুকু কি যথেষ্ট নয়?

    - না, আসলে তুই ঠিক কীভাবে ওইখানে ভিড়ের মধ্যে আমাকে খুঁজে পেলি, আমি এখনও বুঝতে পারি নি। একবার বললি, বর আছে, একবার বললি, বর নেই ...

    আবার হাসিতে লুটিয়ে পড়ে ঊর্মিলা, - ওরেবাবা, তুই তো আমার বরের ভয়ে এখনও কাঁটা হয়ে আছিস দেখছি। শোন্‌ বাবু, তোকে পেয়েছি স্রেফ তোর পেছনে ধাওয়া করে।

    - ধাওয়া করে?

    - হুঁ। ফলো করছিলাম তোকে, তুই বাড়ি থেকে বেরনো মাত্র। কেন, তোরা স্কুলে পড়ার সময়ে ফলো করতিস না মেয়েদের?

    - আরে সে তো স্কুলে পড়ার সময়ে। তুই আজ এখন কী বলে আমাকে ফলো করে, ওখানে ডাকলি না কেন?

    - তুমি যে ভিতুর ডিম, সোনা। উল্টোডাঙার মোড়েই আমাকে দেখে কীরকম তোৎলাচ্ছিলিস, পাড়ার মধ্যে ডেকে হাত ধরলে বোধ হয় অজ্ঞানই হয়ে যেতিস। তাই পেছু পেছু এলাম। ... আমি এমনিই গেছিলাম তোদের পাড়ায়, জানতাম না যে তুই তখনই বেরোবি। তুই

    বেরোলি, আর আমার কাজটা সহজ হয়ে গেল। নইলে হয় তো তোদের বাড়িতে ঘন্টি বাজাতাম।

    - আমি মোটেই তোতলাই নি, অবাক হয়ে গেছিলাম শুধু।

    - কতক্ষণ ধরে অবাক থাকবি রে? অনেকক্ষণ ধরেই তো দেখছি সার্চলাইটের মত চোখ দিয়ে সমানে মেপে যাচ্ছিস আমাকে।

    - বাজে বকিস না। অনেকদিন বাদে দেখলাম, এইভাবে হঠাৎ দেখলাম, তাই অবাক হয়ে তোকে দেখছিলাম।

    - তাই অবাক হয়ে আমাকে দেখছিলিস। হিহিহি, ঠিক আছে, তাই না হয় হল। তো, দেখা হল, অবাক হবার পালাপর্ব মিটল, এইবার?

    - এইবার? কী এইবার ...?

    - কী করবি? মানে, অতদূর থেকে এলি আমার সাথে দেখা করবি বলে, কিছু তো প্ল্যান করেই এসেছিলি, নাকি? কী প্ল্যান?

    - না, মানে ইয়ে, কোনও প্ল্যান করে তো আসি নি! দেখা হলে এমনিই গল্প করে ...

    - নাড়ুগোপাল! বেশ তো, তোর না হয় কোনও প্ল্যান ছিল না। আমার তো প্ল্যান ছিল। তা হলে করি সেইটা?

    - ক্‌ কী প্ল্যান?

    - সেই যে, লিখেছিলাম? কামড়ে ছিঁড়ে নেব তোর ঠোঁট?

    হঠাৎ কী মনে হল, ভাবলাম, দেখিই না কথা এগিয়ে, কতটা সাহসী হতে পারে ঊর্মি। মুখে আলতো হাসি রেখে প্রশ্ন ভাসিয়ে দিলাম, - এখানেই?

    আমার চোখে চোখ রাখল ঊর্মি। সে চোখের ভাষা আলাদা। ওর চোখের তারায় আমি আমার ছায়া দেখতে পেলাম।

    - এখানে নয়। তবে, যদি তোকে সত্যিই একটা চুমু খেতে চাই, তুই খেতে দিবি?

    - যদি দিই?

    - যদি তোর ঠোঁট ছিঁড়ে নিতে যাই?

    - খুব লাগবে।

    - তবু ... ?

    - প্রথমটা যদি পছন্দ হয়, তা হলে দ্বিতীয়টা অ্যালাউ করব।

    - যদি তোকে, প্রায় ফিসফিসানিতে পরিণত হয়ে যায় ঊর্মির গলা, - যদি তোকে আরও বেশি করে পেতে চাই, রণ, তুই কি দিবি? একটিবারের জন্য?

    - কী বলছিস? তুই কি সিরিয়াস, ঊর্মি?

    - তোর মনে কোনও অপরাধবোধ কাজ করবে না? তুই আমাকে রিফিউজ করবি না?

    - ঊর্মি, আমি ...

    - আমার কথাটা জানিয়ে রাখি, রণ। তোকে সেদিন যেমন ভালোবাসতাম, আজও তেমনই বাসি। আমি খুব সাধারণ মেয়ে, কখনও তোকে বলার সাহস পাই নি, তোকে হারাবার ভয় হত। আজ আর ভয় হয় না, কারণ আমার হারাবার আর কিছু নেই। জীবনে হয় তো অনেক

    কিছু হয়েছে, দু-দুটো সন্তান আমার, কিন্তু তারা থাকার পরেও আমি বড় একা। এর বেশি কিছু জানতে চাস না রণ, আমি তোকে এখন এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না। মাঝে মাঝে খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয়, জানিস। মরতে পারি না ছেলেমেয়েদুটোর মুখ চেয়ে। হয় তো

    ওদের জন্যই বেঁচে থাকব। তবু, একেবারে শেষ হয়ে যাবার আগে অন্তত একবার আমার নিজের মত করে, নিজের শর্তে বাঁচতে চাই।

    - ঊর্মি, তুই যেটাকে তোর একাকীত্ব বলে ভাবছিস, সেটা তো অন্য তরফের ক্ষেত্রেও সত্যি হতে পারে।

    - কতটা সত্যি, কতটা মিথ্যে তুই জানিস না রণ। থাক না এখন এসব কথা। আমরা তো অন্য তরফের কথা বলব বলে দেখা করি নি আজ।

    - আমাদের তো আজ দেখা করার কথাই ছিল না, ঊর্মি! তোকে নম্বর দিয়েছিলাম, তুই হারিয়ে ফেলেছিস। আমি যদি আজ আমার বাড়িতে না থাকতাম, তুই তো আমার দেখাও পেতিস না!

    ঊর্মি সোজা হয়ে বসল। চোখ থেকে চোখ সরাল না। - ঠিক বলেছিস। তবু দেখা যখন হয়েই গেল, ধরে নিতে ক্ষতি কী, যে, আমাদের দেখা আজ হবারই ছিল? ... তুই বোস। আমি আসছি দু মিনিট।

    ঊর্মি উঠে গেল ওয়াশরুমের দিকে। আমি দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইলাম একলা টেবিলে। ঊর্মিলা কী চাইছে? ... তার চেয়েও বড় কথা, আমি কী চাইছি?

    কাঁধে আলতো নাড়া খেয়ে মুখ তুললাম। ঊর্মি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। -চল্‌।

    - কোথায়?

    - জাহান্নামে। তোর আপত্তি আছে?

    * * *

    - পালাবি, এক রাতের জন্য?

    - কোথায়?

    - উফ, তুই এত সাবধানী কেন রে, রণ? কখন, কোথায়, প্ল্যান প্রোগ্রাম না করে পালাতেও পারিস না? আমাকে ভরসা করিস?

    - যাব্বাবা, ভরসা করার কথা আসছে কোত্থেকে?

    - শোন রণ, ভয় পাস না। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজছে এখন। তোর যদি মনে হয়, আমার হাত ধরে তুই জীবনের খুব বড় ভুল করছিস, কারুর কাছে তুই ছোট হয়ে যাচ্ছিস, আমি তোকে আটকাবো না। তুই এই মুহূর্তে চলে যেতে পারিস আমার কাছ থেকে। কেউ জানবে না তুই

    আমার জন্য এসেছিলি। আর যদি মনে হয় একটা মেয়ে, যে তোকে ভালোবেসে গেছে কিন্তু কোনওদিন জানায় নি, তাকে একটা দিনের জন্য ভালোবাসা দিলে তোর জীবনের অন্য ভালোবাসাগুলোর সম্মানহানি হবে না, তুই কারুর কাছে ছোট হয়ে যাবি না, চল আমার

    সঙ্গে। পালাই। এক্ষুনি। একটা দিনের জন্য তুই আমার হ'। কথা দিচ্ছি, কেউ জানবে না। কাল বিকেলে এইখানে ফিরে আসবি তুই। আমি কোনওদিন, কোনও কারণে তোর কাছ থেকে কোনও কৈফিয়ত চাইব না।

    তা হলে আমি যা ভাবছিলাম, তাইই। কিন্তু ঊর্মিলা কোথায় পালাতে চায় আমাকে নিয়ে? মুখ দিয়ে শুধু বেরলো, কিন্তু ঊর্মি, এইভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে, এইভাবে কি ডিসিশন নেওয়া যায়?

    ঊর্মির ঠোঁট বেঁকে গেল বিদ্রূপের হাসিতে, তার মানে তোর আপত্তি নেই।

    - আমি সে কথা কখন বললাম?

    - তার মানে কি তোর আপত্তি আছে?

    - তুই কি আমাকে নিয়ে খেলতে চাইছিস?

    ঊর্মিলা ফিরে দাঁড়াল আমার মুখোমুখি, একবার চোখে চোখ রাখল, তারপরে ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিল, - দ্যাখ রণ, যদি মনে করিস আমি তোকে ইউজ করছি নিজের স্বার্থে, নিজের প্লেজারের জন্য, আমি বলব না তুই খুব ভুল ভাবছিস। তবে, শুধু ইউজ করছি বললে হয়

    তো মানেটা অনেক ছোট হয়ে দাঁড়ায়। আমি একটা দিনের জন্য সত্যি সত্যি বাঁচতে চাইছি। সেটুকুর জন্য আমি সারাজীবন তোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে পারি। তুই যা খুশি মনে করতে পারিস আমাকে। খারাপ মেয়ে, ঘরভাঙানি, যে কোনও রকম বিশেষণ দিতে পারিস তুই

    আমাকে। আমার মনে কোনও আঘাত লাগবে না। আমি শুধু তোর ওপরে কোনও জোর করতে পারব না। তোর ঘর ভাঙতে চাই না আমি। স্বেচ্ছায় যদি আসতে পারিস, চল। না চাইলে চলে যা, এখান থেকেই।

    আমার কী হল? চলে যেতে কেন পারছি না? পা আটকে গেছে ফুটপাথের সঙ্গে? জিভ আটকে গেছে টাগরায়? এত স্পষ্টভাবে এইসব কথা শুনব, এমন এক্সপেক্টেশন নিয়ে তো আসি নি, বরং এসেছিলাম ঊর্মিলাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নিজের কাছে নিজে মহান প্রতিপন্ন হতে। এত

    সহজে ঊর্মি আমার কোর্টে বল ঠেলে দেবে, আর আমি কী করব, বুঝতে না পেরে অসহায় হয়ে থাকব?

    নাঃ। এত সহজে আমি হাল ছাড়তে রাজি নই। খেলতে যখন নেমেছি, খেলার শেষ দেখেই ছাড়ব। এত সহজে আমি হেরে যাব না। ঊর্মি আমাকে নিয়ে খেলবে অথবা ছুঁড়ে ফেলে দেবে, আর আমি তার কথায় সায় দিতে থাকব? এ হতে পারে না।

    চুলোয় যাক আমার প্ল্যানিং, চুলোয় যাক আমার মূল্যবোধ।

    এক পা এগিয়ে গেলাম সর্বনাশের দিকে। সর্বনাশের চোখে চোখ রেখে বললাম, চল, কোথায় যাবি।
  • siki | 132.177.162.2 | ১৭ জুলাই ২০১৩ ১৯:৫৩612484
  • উফফ। সরি। ফর্ম্যাটিং ঘেঁটে একেবারে চোদ্দটা বেজে গেছে। দাঁড়ান, এইটা পড়বেন না। আমি আরেকবার ভালো করে পেস্ট করে দিচ্ছি।
  • siki | 132.177.162.2 | ১৭ জুলাই ২০১৩ ১৯:৫৪612485


  • - চল্‌।

    - কোথায়?

    - জাহান্নামে। তোর আপত্তি আছে?

    - সে তুই হাত ধরে নিয়ে গেলে খুব একটা আপত্তি নেই, কিন্তু জাহান্নামটা ঠিক কোথায় সেটা তো বল!

    - কেন, ঠিকানা না জানলে কি তোর আমার সাথে জাহান্নামে যেতে আপত্তি আছে? ভয় পাস নি রণ, তোকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাচ্ছি না। আমি ছেলেধরা নই রে। কোথাও একটা যাবো, যেখানে কেউ আমাদের চেনে না। কিছুক্ষণের জন্য। ... হাত ধরব?

    ঊর্মিলা সত্যি সত্যি আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে। এটা ঠিক আমার পাড়া নয় যদিও, তবু পাড়া থেকে খুব একটা দূরেও নয়। চেনা লোকের অভাব নেই এদিকে। ঝটিতি একবার চোখ বুলিয়ে নিই এদিক ওদিক। ঊর্মিলা খিলখিলিয়ে হেসে ফেলে, - লজ্জা করছে? পাবলিক প্লেসে হাত ধরে ফেলেছি বলে? অ্যাই রণ, বল না, হাত ছেড়ে দেব?

    রাস্তার আলোয় ঝিকমিকিয়ে ওঠে ঊর্মিলার গজদাঁত। ঊর্মির একটা গজদাঁতও ছিল? কোনওদিন খেয়াল করি নি তো! ... ছেড়ে দেব বলল বটে, তবে ছাড়ে নি এখনও আমার হাত। আমার কবজি আলতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে ঊর্মির আঙুলগুলো। হালকা উষ্ণতা একটা, যেন পায়রার গায়ের ওমের মত। আমার কেমন যেন মাথায় দুলুনি জাগে। সারাদিনের ফাঁকা অলসতা ঝেড়ে উল্টোডাঙার মোড় এখন ব্যস্ত রূপ নিয়েছে। আমরা হাঁটছি ফুটপাথ ধরে, দুদিক থেকে অজস্র লোকের ভিড় অনবরত আমাদের দুপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না আমাদের দিকে। তবু আমার কেন মনে হচ্ছে, সব্বাই, ঠিক আমাদেরই লক্ষ্য করছে? ওই যে, ওই যে ওষুধের দোকান থেকে বেরোলেন ওই বৃদ্ধ, উনিও কি আমার দিকেই দেখছেন না? ওটা কি কানুজেঠু? আমাকে চিনতে পেরেছেন?

    কাছে আসতে ভুল ভাঙে, না, কোনও জেঠু-টেঠু নয়, নিতান্তই অপরিচিত একজন। ভুল ভাঙে, কিন্তু ঘোর ভাঙে না। মনে হয় আমি যেন হাঁটছি, কিন্তু আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঊর্মি, আমার কিশোরবেলার গোপন প্রেমিকা, এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ অপরিচিত, একজন নারী। নারী, যে আমাকে চায়। অপরিচিত। ঊর্মি আমার হাত ধরে রয়েছে। হাতের স্পর্শ অপরিচিত। ঊর্মির গা থেকে যে পারফিউমের সুবাস বেরোচ্ছে, সে গন্ধ আমার চেনা নয়। প্রতিটা মেয়ের শরীরেই বোধ হয় আলাদা গন্ধ থাকে। এ গন্ধ আমার অপরিচিত। আর এই অপরিচিতি আমাকে জড়িয়ে ফেলছে। আমি ঘোরে পড়ে যাচ্ছি। ঊর্মি আমার খুব কাছে কাছে হাঁটছে। হাতে হাত ঠেকে যাচ্ছে। আমি হাত ছাড়িয়ে নিই ওর হাত থেকে, ফিরে স্পর্শ করি ওর হাত। আমার আঙুল ধীরে ধীরে চালিয়ে দিই ওর আঙুলের ফাঁকফোকরে। ঊর্মির আঙুল কি একটু কেঁপে ওঠে? ঊর্মির ঠোঁটের হাসিতে কি অন্য কোনও রঙ লাগে? অপরিচিত কোনও রং? সেই অপরিচিতি কি আমাকে আরও বেশি মোহাচ্ছন্ন করে ফেলে?

    জানি না। শুধু মনে হয়, এই যে আমরা দুজন হাঁটছি, চতুর্দিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কল্লোলিনী শহর, নিজের খেয়ালে, কিছুই যেন সত্যি নয়, কিছুই যেন স্থায়ী নয়। সব যেন কিছুক্ষণের কল্পনা। শুধু বাস্তব আমরা। আমাদের পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকা হাত। বাস্তব এই মুহূর্ত। এই পল, অনুপল। আমি যেন এর আগে কোথাও ছিলাম না, আমি যেন এর পরে কোথাও থাকব না, শুধু এই মুহূর্তটুকুই আমার আয়ু, শুধু এই বিকেলটুকুই আমার অস্তিত্ব। আমার ঘর নেই, সংসার নেই, স্ত্রী-সন্তান নেই, কেরিয়ার নেই, পাপপুণ্যের ভালোমন্দের বিচারবোধ নেই, শুধু এক অনন্ত দুলুনির মধ্যে দিয়ে আমার হাতের মধ্যে দিয়ে কী এক অদ্ভূত তরঙ্গ ছুঁড়ে দিচ্ছে আমার ভেতরে এই নারী, আর মাথার স্নায়ুর মধ্যে দিয়ে রক্তের কণিকারা ছোটাছুটি করছে অসীম দ্রুততায়, ঘা মারছে মগজের অনেক দিন আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া এক কুঠুরিতে, বেরিয়ে আসছে, প্রায় ভুলে যাওয়া কবিতার লাইন, অন্যরকম মানে নিয়ে।

    কাছে থাকো। ভয় করছে। মনে হচ্ছে
    এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়। ছুঁয়ে থাকো।
    শ্মশানে যেমন থাকে দেহ ছুঁয়ে একান্ত
    স্বজন। এই হাত, এই নাও, হাত।
    এই হাত ছুঁয়ে থাকো, যতক্ষণ
    কাছাকাছি আছো, অষ্পৃষ্ট রেখো না।
    ভয় করে। মনে হয় এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়।
    যেমন অসত্য ছিল দীর্ঘ গতকাল।
    যেমন অসত্য হবে অনন্ত আগামী।

    অথচ এমনটা তো হবার কথা ছিল না। এই ধরণের ঘোরে পড়ার বয়েস তো আমি পেরিয়ে এসেছি বহুকাল! মেয়ে-হাতের স্পর্শ আজ তো আমার অজানা নয়! আমি তো তৈরি হয়েই এসেছিলাম! তবু কেন ঊর্মি আমাকে ছোঁয়ামাত্র আমার যুক্তিবোধ আমার র‍্যাশনালিটি সমস্ত এইভাবে লোপ পেল? আমাকে কীভাবে এই রকম বশীভূত করে ফেলল ঊর্মি? আমাকে? রণজয় সেনকে? সব জেনে, সব বুঝেও যে এসেছিল ঊর্মিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে তার নর্মাল জীবন ফিরিয়ে দিতে, সে নিজে ঊর্মির কাছে ঘোল খেয়ে যাচ্ছে আজ? কোথায় গেল, রণজয় সেন, তোমার পার্সোনালিটি? তোমার সহজাত বিচারবোধ?

    বুধবারে কলকাতায় নেমেই জানতে পারি শুক্রবার বাংলা বনধ ডেকেছে বিরোধী দল। সময় নষ্ট না করে ভাস্করকে ফোন করেছিলাম। ভাস্কর ছিল না অফিসে, সন্ধ্যেবেলায় ওর বাড়িতে ডেকেছিল। না, বিশেষ কিছু জানতে পারি নি ওর কাছ থেকে। অথবা জেনেও আমাকে বিশেষ কিছু জানায় নি কিনা, তাই বা কে জানে! বর্ধমানে রাজীব-ঊর্মির বাড়ির ঠিকানা চেয়েছিলাম, সেটা অবশ্য দিয়েছে আমাকে। তবে রাজীবের সাথে দেখা করতে পারে নি ভাস্কর; অন্তত আমাকে যা বলল। খানিক এদিক সেদিক আলোচনা করে যা বুঝলাম, এ সবের মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাইছে না ভাস্কর। আমিও অতএব, এ নিয়ে আর বিশেষ কিছু কথা বাড়ালাম না। খানিক এ-কথা সে-কথার মধ্যে দিয়ে ভাস্কর মূলত আমাকে যা বলল তার নির্যাস এই, কেন খামোকা নিজেকে এইসবের মধ্যে জড়াচ্ছি? নিজের জীবন নিয়ে থাকাটাই তো বেটার।

    সে কি আর আমিও জানি না? আমি তো জড়াতে আসি নি নিজেকে। আমি এসেছি নিজেকে মুক্ত করতে। ঊর্মির সাথে দেখা করে বলতে, যে, যা হয়েছে হয়েছে। কোনওভাবে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি যদি হয়ে থাকে, সেটা নিজেদেরই মিটিয়ে নিতে, আর যদি এ ব্যাপারে আমার মধ্যস্থতা ওদের কোনওভাবে সাহায্য করতে পারে, সেটুকু সাহায্যের হাত আমি বাড়িয়ে দিতে পারি বন্ধু হিসেবে, এর বেশি কিছু নয়। ঊর্মিকে প্রেমিকা হিসেবে ভাবা আমার সম্ভব নয়।

    কাল গেছিলাম ক্যামাক স্ট্রিটে। উদ্দেশ্যহীনভাবে খানিক ঘোরাঘুরি করেছি রাজীবের অফিসের সামনে, রাজীবকে দেখতে পাই নি। অবশ্য রাজীব কলকাতার অফিসে থাকবে কিনা, সেটা আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না, আর শুধুমাত্র একটা ছবি দেখে রাজীবকে ভিড়ের মধ্যে চিনতে পেরে যাব, এতটা ধুরন্ধর গোয়েন্দাও আমি নই। নেহাতই কৌতূহলে ঘুরে এসেছিলাম। আজ সকাল থেকেই বাংলা বনধ ছিল। সমস্ত গাড়িঘোড়া বন্ধ, দোকানপাট সব ঝাঁপ ফেলা, কলকাতায় একটা টিপিকাল বনধ যেমন হয়, তেমন করেই ঘরে বসে দিনটা কাটল। ঊর্মিলার ফোন এল না সারাদিনেও। ভেবে নিয়েছিলাম, কাল সকাল সকাল বর্ধমানের দিকে রওনা দেব। বাদামতলা কত বড় জায়গা আমার কোনও ধারণা নেই, তবে এই লেকটাউনের থেকে বড় নিশ্চয়ই হবে না।

    উল্টোডাঙার মোড়ে ঊর্মির সাথে দেখা হয়ে যাওয়া আজ বোধ হয় দিনের সেরা চমক ছিল। সারাদিনের বনধের প্রভাব স্তিমিত হতে হতে বিকেল পাঁচটার মধ্যে দোকানপাট খুলতে শুরু করেছিল, অটো-বাসও চলতে শুরু করেছিল দু একটা। ছুটকোছাটকা দু একটা ব্যাপার ছাড়া এমনি শান্তিপূর্ণই ছিল, অন্তত এদিকটায় কিছু হয় নি। সারাদিন বাড়িতে বসে বসে বোর লাগছিল, তাই হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলাম উল্টোডাঙার দিকে। রাস্তায় আস্তে আস্তে ভিড় জমছিল। হঠাৎই পেছন থেকে আমার নাম ধরে কে যেন ডাকল, আর ঘাড় ঘুরিয়েই দেখি, না, ভুল দেখার কোনও চান্সই নেই, ঊর্মি দাঁড়িয়ে আছে আমার ঠিক পেছনটায়। মুখে মিটিমিটি হাসি।

    এ রকম কি গল্পে উপন্যাসে হয়ে থাকে? ও জানল কী করে আমি এই সময় এই জায়গাটাতে থাকব? আমি নিজেই তো জানতাম না! হঠাৎ দেখা? মুখ দেখে যেন মনে হচ্ছে ও জানত আমি ঠিক এই সময়ে এই জায়গাটা দিয়েই হেঁটে যাব, যেন ধরে ফেলেছে আমাকে।

    প্রায় কুড়ি বছর বাদে দেখা। ঊর্মি পরে আছে একটা অফ হোয়াইট রঙের স্লিভলেস কুর্তি, আর একটা জিনস। যতটা মোটা লেগেছিল ওকে ছবিতে, ততটা তো মোটা নয়! শরীর জুড়ে স্বাভাবিক মেদ। যতটা মেদ আকর্ষণ জাগায়। জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার? কই, মনে তো হচ্ছে না! শেষ দেখার সেই কিশোরী মুখ আর নেই, সেখানে আছে পরিপূর্ণ এক নারীর মুখ। ঠোঁটের ওপর স্বেদবিন্দু, গলার দুদিক থেকে একটা হাল্কা সোনার চেন গড়িয়ে এসে হারিয়ে গেছে কুর্তির অন্তরালে। ঊর্মি। অজান্তেই আমার চোখ চলে যায় ওর সিঁথির দিকে, না, সিঁদুরের চিহ্ন তো নেই।

    - কী দেখছিস? চিনতে পারিস নি নাকি?

    - না, মানে, তু-তুই এখানে, কবে এলি? কী ব্যাপার? জানলি কী করে?

    - আমি তো ম্যাজিক জানি রে। তোকে ব্যাঙ্গালোর থেকে নিয়ে এনে ফেললাম এখানে, আর সামান্য বাজারদোকানের ভিড়ে তোকে খুঁজে বের করতে পারব না? আমিই তো তোকে নিয়ে এলাম এইখানে, এই চৌরাস্তার মোড়ে।

    - হেঁয়ালি ছাড়। তুই কবে এসেছিস?

    - কাল সন্ধ্যেয়।

    - একা এসেছিস?

    - না, ওই তো আমার বর রয়েছে ওই দোকানটায়। সিডি কিনছে। যাবি, আলাপ করবি? নাকি আমাকে নিয়ে পালাবি এখান থেকে?

    আমি থতমত খেয়ে যাই। রাজীব, এখানে? আপনাআপনিই আমার নজর চলে যায় সামনে সিডির দোকানের ভেতরে। খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে ঊর্মিলা, আলতো করে আমার পিঠে চাপড় মেরে দেয়, ভয় পেয়ে গেলি, রণ? রাজীব তোকে আমার সাথে দেখতে পেলে কিন্তু খুব রেগে যাবে, এখনও সময় আছে রণ। চল্‌, পালাই এখান থেকে।

    বলতে বলতে হাসতে থাকেঊর্মি। আমি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলি, রেগে যাবে কেন রে? বিয়ে করা বউদের কি ছেলেবন্ধু থাকতে নেই নাকি? চল, আলাপ করে আসি। ... আমি পা বাড়াই। পেছন থেকে হাসতে হাসতে হাত টেনে ধরে ঊর্মি, পাগল কোথাকার। এদিকে তাকা। কেউ নেই দোকানে। রাজীব এখানে নেই রে।

    আস্তে আস্তে হাসি থামিয়ে অল্প গম্ভীর হয় ঊর্মিলা। আমি অপলক তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। ঊর্মিলাও তাকিয়ে থাকে আমার চোখে চোখ রেখে। আমার বিহ্বলতা বোধ হয় ওকে খুশি করে। ঠোঁটে আবার অল্প হাসি ফোটে।

    - কী দেখছিস?

    - তোকে।

    - পছন্দ হয়?

    - মানে, ইয়ে ...

    - একা এসেছি না দোকা এসেছি, সেটা তো প্রথম প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল না রে, রণ। আমি তোর জায়গায় থাকলে কিন্তু ঠিক তোর হাত ধরে দৌড় লাগাতাম। একা আসি নি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাল এসেছি। তারা বাড়িতে আছে, তাদের দিদার কাছে। রাজীব ওখানেই আছে। বনধের জন্য একদিন বাড়তি ছুটি হয়ে গেল, তাই ভাবলাম চলে আসি। ... তা বলে ভাবিস না যেন, না এলে তোকে ফোন করতাম। তোর ফোন নম্বর আমি সেদিনই হারিয়ে ফেলেছি। আমার বয়ে গেছে তোকে ফোন করতে।

    - আমি কিন্তু একাই এসেছি।

    - এই তো সাহস বেড়েছে খোকাবাবুর। আমি কি তোকে জিজ্ঞেস করেছি তুই কারুর সাথে এসেছিস কিনা? আমি জানি তুই একা এসেছিস। তা, এখানেই দাঁড়িয়ে ভিড়ের ধাক্কা খেতে থাকবি, নাকি কোথাও একটা বসবি? এতদিন বাদে দেখা হল পুরনো বান্ধবী কাম সিক্রেট লাভারের সাথে, কিছু খাওয়াবি টাওয়াবি না?

    - হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চই, নিশ্চই, কোথায় যাবি বল, কী খাবি?

    - যা খেতে চাইব, খাওয়াতে পারবি? এখানে, এক্ষুনি?

    - ঊর্মি, আস্তে, সবাই শুনতে পাবে।

    - পাক না। তুই যতক্ষণ এই রকম ভেবলুর মত মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকবি, আমি ততক্ষণ তোর পেছনে লেগে থাকব। আপাতত তো একটা আইসক্রিম খাওয়া, পরে ভেবে দেখছি, কোথায় কী খাওয়া যায়।

    অনেক কথা বলব ভেবে রেখেছিলাম, ঊর্মির সঙ্গে দেখা হলে। কিন্তু কী যে হল, এখন আর কিছুই মনে পড়ছে না। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে বসলাম একটু দূরে একটা আইসক্রিম পার্লারে। কিছু যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার নিজেকে স্মার্ট, কইয়ে বইয়ে হিসেবে ভাবা একটা অভ্যেস হয়ে গেছিল, সেটা যে কতটা অন্তঃসারশূন্য ধারণা, এখন বুঝতে পারছি। পার্লারের এক কোণে আমার ঠিক মুখোমুখি বসে ঊর্মিলা এখন আইসক্রিম খাচ্ছে। হাতের আঙুলে ঝিলিক দিচ্ছে একটা সোনার আংটি। কাঁচের চুড়িরা বাজছে রিনিঠিনি শব্দে। ঊর্মিলা কোনও বিবাহচিহ্ন ব্যবহার করে না। হাতে শাঁখা পলাও নেই। ঊর্মিলার ঠোঁট অল্প ভিজে। নিজের বউকে ছাড়া এত কাছ থেকে আর কখনও কোনও মেয়ের ঠোঁট এত ক্লোজলি বসে ওয়াচ করি নি। এখন করছি। মুখের ভেতর আইসক্রিম নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ঊর্মি। অল্প ভিজে ঠোঁট, নড়ছে। আমার দেখতে খুব ভালো লাগছে। স্লিভলেস কুর্তির বাইরে ঊর্মির হাত বড় বেশি ঝলসাচ্ছে যেন। এই হাতে একদিন স্পর্শ হত আমার হাত, আমার প্রেমে পাগল হত কিশোরী ঊর্মিলা, আজ কি তারই প্রতিশোধ নেবার দিন? নইলে আমার কেন বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছে ওর হাতের দিকে, কেন বারবার ছুঁতে ইচ্ছে করছে ওর ঠোঁট? আমি কেন কিছুতেই কোনও কাজের কথা আর মনে করতে পারছি না, মনে করতে পারছি না কোনও কথা, আর কারুর কথা? ঊর্মি কি জেনেবুঝেই জাল বিছিয়ে রেখেছে আমার জন্যে?খুব উগ্র কিছু তো সাজে নি ঊর্মিলা, ওকে আমার এত বেশি ইনভাইটিং লাগছে কেন আজ? আমি কি হ্যালুসিনেটেড হয়ে যাচ্ছি? খুব বেশি মাত্রায় ওকে নিয়ে ভেবে ফেলেছি?

    জানি না। ঊর্মিলাই কথা চালাচ্ছিল, আমি শুধু উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম।

    - কিছু বলবি না?

    - কী বলব বল তো? তোর গল্প বরং বল।

    - আমার গল্প তো শুনেছিসই।

    - তোর বরের গল্প?

    - আমরা কি এখানে আইসক্রিম খেতে খেতে সাংসারিক আলোচনা চালাতে এসেছি? এর পর কি জিজ্ঞেস করবি, আজ কী বাজার করলাম তার গল্প বল? ... বর বরের মত থাকে। আমি আমার মত।

    - ছেলেমেয়েরা?

    - আচ্ছা রণ, আমি কি একবারও তোকে জিজ্ঞেস করেছি দীপালি কেমন আছে, তোর ছেলের কী খবর? তুই এত সেফ খেলছিস কেন? কিছুক্ষণের জন্য মনে কর না, আমি শুধু আমিই? পেছনে সংসার নেই, সামনে ভবিষ্যত জানা নেই, আর কখনও কোনওদিন দেখা হবে কিনা জানা নেই, শুধু এই সন্ধ্যেটুকুতে আমরা আছি, তুই আছিস, আমি আছি। এটুকু কি যথেষ্ট নয়?

    - না, আসলে তুই ঠিক কীভাবে ওইখানে ভিড়ের মধ্যে আমাকে খুঁজে পেলি, আমি এখনও বুঝতে পারি নি। একবার বললি, বর আছে, একবার বললি, বর নেই ...

    আবার হাসিতে লুটিয়ে পড়ে ঊর্মিলা, - ওরেবাবা, তুই তো আমার বরের ভয়ে এখনও কাঁটা হয়ে আছিস দেখছি। শোন্‌ বাবু, তোকে পেয়েছি স্রেফ তোর পেছনে ধাওয়া করে।

    - ধাওয়া করে?

    - হুঁ। ফলো করছিলাম তোকে, তুই বাড়ি থেকে বেরনো মাত্র। কেন, তোরা স্কুলে পড়ার সময়ে ফলো করতিস না মেয়েদের?

    - আরে সে তো স্কুলে পড়ার সময়ে। তুই আজ এখন কী বলে আমাকে ফলো করে, ওখানে ডাকলি না কেন?

    - তুমি যে ভিতুর ডিম, সোনা। উল্টোডাঙার মোড়েই আমাকে দেখে কীরকম তোৎলাচ্ছিলিস, পাড়ার মধ্যে ডেকে হাত ধরলে বোধ হয় অজ্ঞানই হয়ে যেতিস। তাই পেছু পেছু এলাম। ... আমি এমনিই গেছিলাম তোদের পাড়ায়, জানতাম না যে তুই তখনই বেরোবি। তুই বেরোলি, আর আমার কাজটা সহজ হয়ে গেল। নইলে হয় তো তোদের বাড়িতে ঘন্টি বাজাতাম।

    - আমি মোটেই তোতলাই নি, অবাক হয়ে গেছিলাম শুধু।

    - কতক্ষণ ধরে অবাক থাকবি রে? অনেকক্ষণ ধরেই তো দেখছি সার্চলাইটের মত চোখ দিয়ে সমানে মেপে যাচ্ছিস আমাকে।

    - বাজে বকিস না। অনেকদিন বাদে দেখলাম, এইভাবে হঠাৎ দেখলাম, তাই অবাক হয়ে তোকে দেখছিলাম।

    - তাই অবাক হয়ে আমাকে দেখছিলিস। হিহিহি, ঠিক আছে, তাই না হয় হল। তো, দেখা হল, অবাক হবার পালাপর্ব মিটল, এইবার?

    - এইবার? কী এইবার ...?

    - কী করবি? মানে, অতদূর থেকে এলি আমার সাথে দেখা করবি বলে, কিছু তো প্ল্যান করেই এসেছিলি, নাকি? কী প্ল্যান?

    - না, মানে ইয়ে, কোনও প্ল্যান করে তো আসি নি! দেখা হলে এমনিই গল্প করে ...

    - নাড়ুগোপাল! বেশ তো, তোর না হয় কোনও প্ল্যান ছিল না। আমার তো প্ল্যান ছিল। তা হলে করি সেইটা?

    - ক্‌ কী প্ল্যান?

    - সেই যে, লিখেছিলাম? কামড়ে ছিঁড়ে নেব তোর ঠোঁট?

    হঠাৎ কী মনে হল, ভাবলাম, দেখিই না কথা এগিয়ে, কতটা সাহসী হতে পারে ঊর্মি। মুখে আলতো হাসি রেখে প্রশ্ন ভাসিয়ে দিলাম, - এখানেই?

    আমার চোখে চোখ রাখল ঊর্মি। সে চোখের ভাষা আলাদা। ওর চোখের তারায় আমি আমার ছায়া দেখতে পেলাম।

    - এখানে নয়। তবে, যদি তোকে সত্যিই একটা চুমু খেতে চাই, তুই খেতে দিবি?

    - যদি দিই?

    - যদি তোর ঠোঁট ছিঁড়ে নিতে যাই?

    - খুব লাগবে।

    - তবু ... ?

    - প্রথমটা যদি পছন্দ হয়, তা হলে দ্বিতীয়টা অ্যালাউ করব।

    - যদি তোকে, প্রায় ফিসফিসানিতে পরিণত হয়ে যায় ঊর্মির গলা, - যদি তোকে আরও বেশি করে পেতে চাই, রণ, তুই কি দিবি? একটিবারের জন্য?

    - কী বলছিস? তুই কি সিরিয়াস, ঊর্মি?

    - তোর মনে কোনও অপরাধবোধ কাজ করবে না? তুই আমাকে রিফিউজ করবি না?

    - ঊর্মি, আমি ...

    - আমার কথাটা জানিয়ে রাখি, রণ। তোকে সেদিন যেমন ভালোবাসতাম, আজও তেমনই বাসি। আমি খুব সাধারণ মেয়ে, কখনও তোকে বলার সাহস পাই নি, তোকে হারাবার ভয় হত। আজ আর ভয় হয় না, কারণ আমার হারাবার আর কিছু নেই। জীবনে হয় তো অনেক কিছু হয়েছে, দু-দুটো সন্তান আমার, কিন্তু তারা থাকার পরেও আমি বড় একা। এর বেশি কিছু জানতে চাস না রণ, আমি তোকে এখন এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না। মাঝে মাঝে খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয়, জানিস। মরতে পারি না ছেলেমেয়েদুটোর মুখ চেয়ে। হয় তো ওদের জন্যই বেঁচে থাকব। তবু, একেবারে শেষ হয়ে যাবার আগে অন্তত একবার আমার নিজের মত করে, নিজের শর্তে বাঁচতে চাই।

    - ঊর্মি, তুই যেটাকে তোর একাকীত্ব বলে ভাবছিস, সেটা তো অন্য তরফের ক্ষেত্রেও সত্যি হতে পারে।

    - কতটা সত্যি, কতটা মিথ্যে তুই জানিস না রণ। থাক না এখন এসব কথা। আমরা তো অন্য তরফের কথা বলব বলে দেখা করি নি আজ।

    - আমাদের তো আজ দেখা করার কথাই ছিল না, ঊর্মি! তোকে নম্বর দিয়েছিলাম, তুই হারিয়ে ফেলেছিস। আমি যদি আজ আমার বাড়িতে না থাকতাম, তুই তো আমার দেখাও পেতিস না!

    ঊর্মি সোজা হয়ে বসল। চোখ থেকে চোখ সরাল না। - ঠিক বলেছিস। তবু দেখা যখন হয়েই গেল, ধরে নিতে ক্ষতি কী, যে, আমাদের দেখা আজ হবারই ছিল? ... তুই বোস। আমি আসছি দু মিনিট।

    ঊর্মি উঠে গেল ওয়াশরুমের দিকে। আমি দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইলাম একলা টেবিলে। ঊর্মিলা কী চাইছে? ... তার চেয়েও বড় কথা, আমি কী চাইছি?

    কাঁধে আলতো নাড়া খেয়ে মুখ তুললাম। ঊর্মি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। -চল্‌।

    - কোথায়?

    - জাহান্নামে। তোর আপত্তি আছে?

    * * *

    - পালাবি, এক রাতের জন্য?

    - কোথায়?

    - উফ, তুই এত সাবধানী কেন রে, রণ? কখন, কোথায়, প্ল্যান প্রোগ্রাম না করে পালাতেও পারিস না? আমাকে ভরসা করিস?

    - যাব্বাবা, ভরসা করার কথা আসছে কোত্থেকে?

    - শোন রণ, ভয় পাস না। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজছে এখন। তোর যদি মনে হয়, আমার হাত ধরে তুই জীবনের খুব বড় ভুল করছিস, কারুর কাছে তুই ছোট হয়ে যাচ্ছিস, আমি তোকে আটকাবো না। তুই এই মুহূর্তে চলে যেতে পারিস আমার কাছ থেকে। কেউ জানবে না তুই আমার জন্য এসেছিলি। আর যদি মনে হয় একটা মেয়ে, যে তোকে ভালোবেসে গেছে কিন্তু কোনওদিন জানায় নি, তাকে একটা দিনের জন্য ভালোবাসা দিলে তোর জীবনের অন্য ভালোবাসাগুলোর সম্মানহানি হবে না, তুই কারুর কাছে ছোট হয়ে যাবি না, চল আমার সঙ্গে। পালাই। এক্ষুনি। একটা দিনের জন্য তুই আমার হ'। কথা দিচ্ছি, কেউ জানবে না। কাল বিকেলে এইখানে ফিরে আসবি তুই। আমি কোনওদিন, কোনও কারণে তোর কাছ থেকে কোনও কৈফিয়ত চাইব না।

    তা হলে আমি যা ভাবছিলাম, তাইই। কিন্তু ঊর্মিলা কোথায় পালাতে চায় আমাকে নিয়ে? মুখ দিয়ে শুধু বেরলো, কিন্তু ঊর্মি, এইভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে, এইভাবে কি ডিসিশন নেওয়া যায়?

    ঊর্মির ঠোঁট বেঁকে গেল বিদ্রূপের হাসিতে, তার মানে তোর আপত্তি নেই।

    - আমি সে কথা কখন বললাম?

    - তার মানে কি তোর আপত্তি আছে?

    - তুই কি আমাকে নিয়ে খেলতে চাইছিস?

    ঊর্মিলা ফিরে দাঁড়াল আমার মুখোমুখি, একবার চোখে চোখ রাখল, তারপরে ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিল, - দ্যাখ রণ, যদি মনে করিস আমি তোকে ইউজ করছি নিজের স্বার্থে, নিজের প্লেজারের জন্য, আমি বলব না তুই খুব ভুল ভাবছিস। তবে, শুধু ইউজ করছি বললে হয় তো মানেটা অনেক ছোট হয়ে দাঁড়ায়। আমি একটা দিনের জন্য সত্যি সত্যি বাঁচতে চাইছি। সেটুকুর জন্য আমি সারাজীবন তোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে পারি। তুই যা খুশি মনে করতে পারিস আমাকে। খারাপ মেয়ে, ঘরভাঙানি, যে কোনও রকম বিশেষণ দিতে পারিস তুই আমাকে। আমার মনে কোনও আঘাত লাগবে না। আমি শুধু তোর ওপরে কোনও জোর করতে পারব না। তোর ঘর ভাঙতে চাই না আমি। স্বেচ্ছায় যদি আসতে পারিস, চল। না চাইলে চলে যা, এখান থেকেই।

    আমার কী হল? চলে যেতে কেন পারছি না? পা আটকে গেছে ফুটপাথের সঙ্গে? জিভ আটকে গেছে টাগরায়? এত স্পষ্টভাবে এইসব কথা শুনব, এমন এক্সপেক্টেশন নিয়ে তো আসি নি, বরং এসেছিলাম ঊর্মিলাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নিজের কাছে নিজে মহান প্রতিপন্ন হতে। এত সহজে ঊর্মি আমার কোর্টে বল ঠেলে দেবে, আর আমি কী করব, বুঝতে না পেরে অসহায় হয়ে থাকব?

    নাঃ। এত সহজে আমি হাল ছাড়তে রাজি নই। খেলতে যখন নেমেছি, খেলার শেষ দেখেই ছাড়ব। এত সহজে আমি হেরে যাব না। ঊর্মি আমাকে নিয়ে খেলবে অথবা ছুঁড়ে ফেলে দেবে, আর আমি তার কথায় সায় দিতে থাকব? এ হতে পারে না।

    চুলোয় যাক আমার প্ল্যানিং, চুলোয় যাক আমার মূল্যবোধ।

    এক পা এগিয়ে গেলাম সর্বনাশের দিকে। সর্বনাশের চোখে চোখ রেখে বললাম, চল, কোথায় যাবি।
  • cm | 181.51.244.131 | ১৭ জুলাই ২০১৩ ২০:২২612486
  • লেখাটো খাসা হইয়েছে বটে, তবে এ বড়দের গপ্পো আর পরবুনি।
  • byaang | 132.166.145.24 | ১৭ জুলাই ২০১৩ ২২:১৩612487
  • অ্যাট লিস্ট যেন হায়াত বা সোনার বাংলায় যায়। উল্টোডাঙা থেকে বেশি দূর না। পরকীয়ার এমন ক্লাইম্যাক্সের সময় বকখালি/দীঘা/ডায়মন্ডহারবারের ছ্যাঁচড়ামি সইবে না।
  • a x | 138.249.1.202 | ১৭ জুলাই ২০১৩ ২২:১৫612488
  • ডায়মনে খুব রেইড হয় কিন্তু। সাবধান।
  • siki | 132.177.160.20 | ১৭ জুলাই ২০১৩ ২২:১৯612489
  • :)
  • byaang | 132.166.145.24 | ১৭ জুলাই ২০১৩ ২২:২০612490
  • উল্টোডাঙা থেকে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার সময় কোনো ট্যাক্চি ডায়মন জেতে রাজি হবে না। আর যদি বা যেতে রাজি হয়, যা খচ্চা হবে, তার থেকে হায়াত সস্তা পড়বে। ওখানে রেইডও হয় না। উল্টোডাঙার মোড়ে অনেকগুলো ওষুধের দোকান আছে। খেয়াল রাখিস।
  • byaang | 132.166.145.24 | ১৭ জুলাই ২০১৩ ২২:২১612492
  • ট্যাকিচ না, ট্যাকিচ না। ট্যাকচি, ট্যাকচি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন