আবাসনের গেট দিয়ে গাড়ি করে বেরোনর সময় সুবীর দেখতে পেলেন লোকটাকে। গেটের ঠিক বাইরে। জিন্স আর রঙচটা জামা পরা, মুখে দাড়ি, চোখে একটা হিংস্র ভাব। কালকেও ছিল। কে লোকটা? কী চায়? সুবীর ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। গাড়ির কাচ নামিয়ে হাত দিয়ে সিকিউরিটির ছেলেটাকে ডাকলেন। বাইরের গরম হাওয়া ঢুকে পড়ল খানিকটা। ছেলেটি কাছে আসতে সুবীর একটু চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “এই লোকটাকে দেখছি রোজ ঘুরঘুর করছে। কে লোকটা জানো? এখানে কী করছে?” সিকিউরিটির ছেলেটি একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোন লোকটা স্যার?” সুবীর গেটের দিকে তাকিয়ে দেখেন সেখানে কেউ নেই। বোধহয় সুবীরকে সিকিউরিটি ডাকতে দেখে সরে পড়েছে। ব্যাপারটা আরো সন্দেহজনক। ... ...
মধুর ঠোঁট থেকে সিগারেটটা পড়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে লোকটাকে আচমকা ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করল সে। পারলো না, আরও দু জন লোক কাছেই ছিল, একজন মধুকে ল্যাং মারল, সে উলটে পড়ে যেতেই চার জন মিলে তাকে ধরে পিছমোড়া করে হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দিল। তারপর কোমরে দড়ি পরিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল পাশের গলির দিকে, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুলিশের গাড়ি। মধুকে তাতে তুলে বেরিয়ে গেল গাড়িটা। আশেপাশে জড়ো হওয়া লোকেরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। ... ...
তাছাড়া সেদিন কি শুধু সুকল্প তাকে মুক্তি দিয়েছিল? ঊর্মি সুকল্পকে দেয়নি মুক্তি? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের হাত ধরে ঘটে যাওয়া এই নিঃশব্দ বিপ্লবকে কোনোদিন স্বীকার করে নি করবেও না। কিন্তু তাতে ঊর্মীদের কৃতিত্ব কমে না। ... ...
গৌর আর ওর মা, পুজোর মাঠ ছেড়ে, ফুচকার ঠেলা ঠেলে নিয়ে যায় মোড়ের মাথায়। নিতাই চাপাকল টিপে জ্যারিকেনে জল ভরে। গঙ্গার বড় ছেলে সুরজিৎ, চপে পুর ভরে বাবার কড়াইয়ে দেয়। ছোট ছেলে দেবজিৎ, পাশে বসে গালে হাত দিয়ে ভাবে - এবার মার্চে টেন্-টা পাস করতে পারলেই পিঙ্কিকে নিয়ে পালিয়ে যাবে টাটায়, জুটিয়ে নেবে একটা চাকরি। ... ...
আজ সক্কাল সক্কাল উঠতে হয়েছে। টেলিফোন অফিস থেকে লোক আসবে। ভোরটা তরতাজা। কারণ উঠেই নিয়মমত হাফ গ্লাস সবুজ রসের সামনাসামনি হতে হল না আজ। না, রসতত্ত্বের নবীন কোন রস নয়, নির্ভেজাল করলার থকথকে নির্যাস, যা খেলে অন্তরাত্মাও খিঁচড়ে যায় সারাদিনের জন্য। সেটাই পান করি রোজ প্রাতঃকালে। ফলত, ক্লাসে যাই তেতো মুখে, লেকচার দিই তেতো স্বরে, নম্বর বসাই তিতকুটে। প্রেমের কথা যদি বলার হত, তবে বোধহয় তাও বলতাম তিক্ত সুরে। তবে রক্ষে এই যে, আমার এই আধবুড়ো বয়সে অত ঝুঁকি নিতে কেউ সাহস পায় না। ... ...
ছোটবেলায় মোটা বেতের ঝুড়ি মাথায় ফেরিওয়ালারা হেঁকে যেত “হরেএএএক মাল পাঁসসিকে”, এখন যায় তাদেরই আধুনিক সংস্করনরা, রেকর্ড করা গলায় বলে “আমাদের প্রচার গাড়িতে পাবেন নানা ধরনের জিনিস”। ‘প্রচার গাড়ি’ শব্দগুচ্ছ অনেকটা ‘সৌন্দর্য সাবান’-এর মত, কী যে তার মানে কেউ জানে না। যাই হোক, সেই পায়ে চালানো গাড়িতে যা যা থাকে তার প্রায় সবই ভেসে যেতে দেখলাম বারান্দা থেকে - ছোট গামলা, বাটি, খেলার বল, বোতল, ক্যারি ব্যাগ, দড়ি ইত্যাদি। গাড়িতে যা থাকে না তাও দেখলাম - ধবধবে সাদা টগর ফুল, সবুজ রঙের বাঁশ, গাছের পাতা, এমনকি এক পাটি জুতোও। ... ...
১৬৭৯ সালের ১৮ অক্টোবর শিবাজির নৌবাহিনীর হাতে বম্বের ইংরেজরা সত্যিই শোচনীয়ভাবে হেরে যায়। শম্ভাজির নৌবলাধ্যক্ষ কনহজি শঙ্খপালের বাবা বিঘ্নেশ কাল্পনিক চরিত্র। কিন্তু দৌলত খান,জর্জ কোল, থ্রপ, ব্র্যাডবেরি আর ওয়েলশ্ এর নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। মারাঠা গ্রামীণ শাসনের রূপ, আর নারী স্বাধীনতা ঐতিহাসিক সত্যি। এছাড়া বাকিটার পুরোটাই কাল্পনিক গল্প। ... ...
আমাদের পরিবারের সাথে এখন খুব ঘুলেমিলে গেছে সোনামণি। ইচকি পিচকিও খুব খুশি তাদের নতুন মামি পেয়ে। এদিকে আমিও ওর হাতে দুজনকে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত। মা এখন হরিপদবাবুদের পুরনো কুলারে আমাদের থাকার জায়গা করে দিয়েছেন, আর মেয়েটাও অল্প কদিনে ঐ খুপচিটাকে কেমন ঘর বানিয়ে ফেলেছে। ... ...
দুটো রোমান মিথকে একসঙ্গে করে, দু'বছর আগে লিখেছিলাম গল্পটা। এই গল্পে ব্যবহৃত ঘরবাড়ি, খাবার, জীবনযাত্রা, কবিতা সবই ইতিহাস থেকে নেওয়া। বানাইনি। এমনকি, পাস্তুমিয়ার চুটকিটাও দু'হাজার বছর আগেকার! যাঁর কবিতা অনুবাদ করেছি, সেই অসামান্য ক্ষমতাশালিনী, সাফো সমপ্রেমী ছিলেন। ... ...
সারাদিন জঙ্গ লড়ার পর খুনখারাপিতে আকাশ ছিঁড়ে ফালা ফালা করে আফতাব আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পশ্চিমে ঢলে পড়বে। এই রঙ্গীন আকাশটা ঢেকে যাবে হিজাবে। সুর্মা পরা চোখের মতো আসমানে তখন ঝিকমিক করবে সিতারার চুমকি। তখন এই ঘাসের উপর বসে কারোর চোখে কী চিকচিক করবে আতর? ... ...
ইতিহাস আশ্রিত এই গল্পটায়, যেটুকু কল্পনা মিশেছে, তাতে মানুষের নিজের পরিচিতি খোঁজাকে বুঝতে চেয়েছিলাম। খুব উঁচুদরের সাহিত্যকর্ম নয়। একটা প্রচেষ্টা মাত্র। ... ...
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বিতান দেখে চারপাশটা বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসছে। নিচে, মাটিতে জল জমছে আস্তে আস্তে। কাল রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, টানা। এরকম মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি মুম্বইতে হয়েছে কয়েকবার, খবরে পড়েছে বিতান। এবার কী কলকাতার পালা? সে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ তলার ওপর। তার বাড়িও কি ভেসে যেতে পারে? বিতান ভয় পায় না। পাঁচতলা ভাসিয়ে নেওয়া বৃষ্টি কোথাও হয়েছে বলে জানা নেই বিতানের, তবু হলে ভাল হয়। কিছু একটা অন্তত হবে জীবনে। ... ...
দ্রৌপদীর চিত্তহরণ করাটা কি মুখের কথা? অতবড় শালপ্রাংশু মহাভুজ বৃষস্কন্ধ পরম রূপবান মানুষটা? একহাতে বৃক্ষ উপড়ে ফেলতে পারেন এরকম চণ্ড মানুষটাও দ্রৌপদীর কাছ থেকে এক কণা ভালবাসা পাবার জন্য কেমন শিশু হয়ে যেতেন। ... ...
গরম লাগছিল প্রচন্ড। কিভাবে এই জ্বালা থেকে মুক্তি পাই, সাজেশন চাওয়ায় বিল্লি তৎক্ষণাৎ বললো, তিব্বত গেলেই পারো। আমরা হাঁ হাঁ করে উঠলাম, "বলে কী! তিব্বত? যাওয়ার জোগাড় করতে করতেই তো ঘেমে নেয়ে মরে যাব!" বিল্লি একটুও না দমে বললো, "সে মরতে পারো, কিন্তু একবার চেষ্টা চরিত্তির করে যদি পৌঁছে যাও তিব্বতে, দেখবে এ জীবনের মতো গরম উধাও হয়ে গেছে! তাপ্পর যতই যাও বীরভূম বা আফ্রিকা, গরম আর লাগবে না। এমনকি বরাত থাকলে পরের জন্মে গ্রিনল্যান্ডেও জন্ম হতে পারে।" ... ...
কফিহাউসের সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই মনটা ভাল হয়ে গেল ধীমানের। কফিহাউস বলতে যাদবপুর কফিহাউস। কলকাতায় কফিহাউস মোট তিনটে, অন্তত ধীমান তাই জানে। কিন্তু অন্য দুটো কফিহাউস ধীমানের তেমন পছন্দ নয়। কলেজ স্ট্রীটের কফিহাউসটা একটা প্রাগৈতিহাসিক, অন্ধকার গুহার মত মনে হয় আর সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ-এরটায় ঢুকলেই মনে হয় কোন অফিসের ক্যান্টিন। যাদবপুর কফিহাউস সে তুলনায় অনেক বেশী খোলামেলা, এখানে অনেক বেশী আলো হাওয়া। ... ...
সুজিত ডাক্তার চোঁয়া ঢেঁকুরের রুগী দেখতে এসে আধঘন্টার মধ্যে লিভার ক্যান্সার প্রেডিক্ট করে "খুবই ভয়ের ব্যাপার" বলে শেষ করেছেন। সেই থেকে ভিড় জমে গেছে সান্যালের আঙিনায়; গুমরে-ডুকরে বিলাপ উঠছে -- ডাক্তারবুড়োর সহজ কালমেঘের অঙ্কে যে সমস্যা মিটতে পারতো, এখন মনে হচ্ছে অঙ্কলজিস্ট ছাড়া গতি নেই। মুড়িমাসিও নাকিসুরে কেঁদে বললো, তার মুড়ির ধুলো চোখে ঢুকে করকর করছিল, সুজিত ডাক্তার দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক ঝলক দেখে নাকি বলেছে, রেটিনা ফেটে গেছে। ... ...
ফুলবানু বাস-টারমিনাল এলাকাতে থাকতেই পছন্দ করে। বাস-টারমিনালে ঢুকতে দশ টাকা দিতে হয় বটে, তবে এখানে আয় ভালো। কল্যাণপুর থেকে শত শত বাস ছেড়ে যায়। কিন্তু ওখানকার মানুষগুলো দান-খয়রাতে তেমন পটু না। হাতটা বড়িয়ে দিলেই রেগে যায়। গাবতলী বাস-টারমিনালই তার পছন্দ। এখানকার মানুষগুলোর বেশভূষা দেখলেই বোঝা যায় এরা কল্যাণপুরের মানুষগুলোর চেয়ে অর্থবিত্তে কমা। তবুও এরাই বাসে ওঠার আগে না হলেও দু’ টাকা দেয়। জ্ঞান হওয়া অবধি সে এখানেই। ... ...
লরার সাথে আমার আলাপ হয়েছিল নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে এক শীতকালীন সেমেস্টারে; আমরা দুজনেই কনভেক্স অপ্টিমাইজেশনের একটা কোর্স নিয়েছিলাম আর কোর্স প্রজেক্টে আমি ছিলাম ওর পার্টনার। লরা এসেছিল এল.এ. থেকে। নিউইয়র্কের শীত আমি পছন্দ করিনা, সে প্রায়ই বলত। ... ...