বিজু স্কুলে এসে জানতে পারলো হেডস্যার আসতে পারেনি। তার নাকি জ্বর। কাল কোন এক স্যার চাল বিলির ব্যবস্থা করবে। কিন্তু আজ তারা খাবে কী? রান্না হবে কি দিয়ে? এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিজু যখন বাড়ি ফিরলো বাবাকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। বাবা দাড়ি কামিয়ে, চান করে, আলমারী থেকে জামা কাপড় বের করে, পরে, রেডি হয়ে বসে আছে। বিজুকে দেখতেই বাবা বললো তাড়াতাড়ি চান করে নে বিজু। একটু পরেই আমরা বেরিয়ে যাবো। গনেশ কাকু গাড়ি নিয়ে আসবে। বিজু তো অবাক। কোথায় যাবো আমরা বাবা? বাবা বলে সেও জানে না। কোন একটা জায়গা। শ্যুটিং দেখবো। বিজুর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ফিল্মের শ্যুটিং বাবা? বাবা ঘাড় নাড়ে, হ্যাঁরে ফিল্মের শ্যুটিং। বলেছে নাকি শ্যুটিং দেখাবে। খেতে দেবে। চল চল দেরি করিস না। ... ...
বহুবছর পরে 'দ্য প্যাশন অ্যাকোর্ডিং টু জি.এইচ.' পড়তে গিয়ে এই ঘটনাটা অংশুমানের মনে পড়বে: অংশুমানের মা চিরকালই ভীষণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লোক; ফলে বর্ষাকালে তার খুব সমস্যা হতো। অর্ধেকদিনই খাবার সময় পোকামাকড় এসে পড়লে না খেয়ে উঠে যেত। একদিন রাতে, অংশুমানের মা তখন কলেজে পড়ে, দিদু থালায় ভাত বেড়েছেন দুজনের, হ্যারিকেনের আলোয় খেতে খেতে হঠাৎ একটা আরশোলা দিদুর পাতে এসে পড়ল। দিদু তখন ভাবলেন আরশোলাটাকে পাতের পাশে ফেললে মেয়ের চোখে পড়বে এবং সঙ্গে সঙ্গে থালা ফেলে উঠে যাবে, সারারাত খালিপেটে থাকবে মেয়েটা; ফলে তিনি কোনো শব্দ না করে ভাতসুদ্ধু আরশোলাটাকে মুখে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন। ... ...
প্রথমবার জেলে যাওয়ার পরই সুধারাণী বুঝে গেছিলেন তার বিবাহিত জীবনের পরিণতি কী হতে চলেছে। তার মেধাবী স্বামী শুধু পড়াশোনা করার জন্যই কলকাতায় যান নি। পড়াশোনার পাশে পাশে দেশকে স্বাধীন করার সংকল্পও নিয়ে রেখেছেন। গোপন বিপ্লবী জীবন কাটানোর মাঝেমাঝে হয়ত গ্রামে এসে কোনো এক রাতের জন্য স্ত্রীর সাথে দেখা করতেন, আবার সকাল হলে চলে যেতেন। পুলিশ খবর পেলে বাড়িতে হানা দিত। এভাবেই চলত দিনের পর দিন। কখনো বা স্বমীর অনুরোধে কোনো বিপ্লবীকে লুকিয়ে রাখতেন বাড়িতে। তার পরিচর্যা করতেন। একদিনের জন্যও হয়ত বিবাহিত জীবনের সুখ লাভ করেন নি। তবু কোনোদিনও কোনো অভিযোগ করেন নি। দেশের কাজ মনে করেই হয়ত হাসিমুখে সমস্ত কিছু সহ্য করে গেছেন। যখন কালাপানির সাজা হল তখন থেকে দেশের কাজের পাশাপাশি সংসারের হাল নিয়েও দুশ্চিন্তা শুরু হল৷ বৃদ্ধ শ্বশুর তখন পুরোপুরি ছেলের বৌ এর ওপর নির্ভরশীল। বিয়ের সময় সুধারাণী পড়তেন ক্লাস এইটে। পড়াশোনায় বেশ ভালোই ছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর তখনকার প্রথা অনুযায়ী পড়াশোনা ছাড়তে হয়৷ এরপর স্বামী ঘরছাড়া থাকার সময়ে বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা শেষ করেন। সংসারে টানাটানি দেখা দিল চাকরির চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু একেই তো চাকরির পক্ষে বয়স বেশি হয়ে গেছিল, তারওপর যখন সবাই শুনতেন ফণীভূষণের স্ত্রী, তখন আরোই ভয়তে চাকরিতে বহাল করতেন না। হয়ত কয়েকমাসের জন্য কোথাও পড়ানোর কাজে ঢুকেছেন, ফণীভূষণের স্ত্রী পরিচয় বাইরে আসার সাথে সাথেই চাকরিটা খোয়াতে হত। এভাবেই কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সংসার। ... ...
১৯৭৫। বাঁকুড়ার ছোট্ট মফস্সল শহর বিষ্ণুপুর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন দুই তরুণ। দুনিয়া ঘুরে দেখার আগে সাঙ্গ করছেন ভারতভ্রমণ। সাইকেলে। কিছু পরে হাল ছাড়লেন একজন। ঘুরতে থাকে দ্বিতীয়জনের সাইকেলের চাকা। ১৭ বছর। ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। ১৫৪ টি দেশ। আজও এ কীর্তিতে তিনি অদ্বিতীয়। এই প্রথম দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সে পরমাশ্চর্য সফরের অনুপুঙ্খ কাহিনি শোনাচ্ছেন জয় মণ্ডল। এ পর্বে জুতোর শুকতলা খইয়ে, কপর্দকশূন্য অবস্থায় মুম্বই-দিল্লিতে বহু আচেনা মানুষকে বহু কষ্টে রাজি করিয়ে আফ্রিকা যাওয়ার দুটি ফ্রি টিকিট জোগাড়ের কাহিনি। আলাপে নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হবে আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রস্তুতি প্রায় শেষ। বেরোনোর আগে সুলতানের শুভেচ্ছা নিতে তাঁর প্রাসাদে। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। তরজমায় স্বাতী রায় ... ...
চলছে খিচুড়ি মহারহস্য অ্যাডভেঞ্চার। আগের কিস্তিতে দেখেছিলাম খাঁটি ভারতীয় খিচুড়িতে কীভাবে আফগানিস্তান পার করে এসে মিশেছিল ইরানি ‘শোলে’। এ কিস্তিতে আমরা সেই জাহাঙ্গিরি খিচড়ি আর বাজরা খিচড়ির রহস্যভেদের তাগিদে নেতি নেতি করতে করতে হাজির হব ইরান ফিরতি দিল্লি হয়ে সোজা বর্ধমান! নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
তামাশা-এ-গুলশন, তমন্না-এ-চিদন/বাহার-আফরিনা গুনাহগার হ্যায়ঁ হম! বাগান অবলোকন, বাসনায় চয়ন/বাসন্তী দেবী, পাপী যে এ মন! হায় মির্জা গালিব, বাগান থেকে ফুল ছেঁড়ার অনুশোচনায় এমন কবিতা, ফুল চয়নের এই বহর দেখলে না-জানি কী লিখতেন জনাব! এক ছাদের তলায় ২২০০ বিঘার বাজার—শুধু ফুল আর ফুল। বছরে বিকিয়ে যায় ১ লক্ষ ১০ হাজার কোটি পিস্ ফুল! হল্যান্ডের আল্সমীর। সুকান্ত ঘোষ ... ...
গোপন কথাটি রবে না গোপনে এমন তো নয় যে আমেরিকা সারা বিশ্বের শান্তিরক্ষার ইজারা নিয়েছিল কোনোদিন। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে যখন দুনিয়া উত্তাল তখনও আমেরিকা একবারও মুখ ফুটে কোনো প্রতিবাদের ধার কাছ দিয়েও যায়নি কেন? সামান্য হিপোক্রেসিও কি আশা করা যেত না? লেখক বাস তিনটি কারণ বলেছেন। প্রথম দুটি গৌণ। প্রথমত, নিকসন আর ইয়াহিয়া, দুজনের কেউই যখন নিজের নিজের দেশের প্রেসিডেন্ট নন, তখন থেকেই দুজনের মধ্যে একটা সখ্যতা ছিল। নিকসনের অন্তরঙ্গ কথোপকথনের যে টেপ পাওয়া যায় তাতে দুজনের সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ হয়েছে একাধিক বার। দ্বিতীয়ত, নিকসন, ইন্দিরা গান্ধিকে রীতিমতন অপছন্দ করতেন। রাশিয়ার সাথে মাখামাখি, ইন্দিরা সোস্যালিস্ট ঝোঁক—শুধু এগুলিই নয়। মানুষ হিসেবেই ইন্দিরাকে নিকসন পছন্দ করতেন না। এর আগে একবার দুজনের মিটিং হয়েছিল দিল্লিতে মিনিট কুড়ির জন্য। ইন্দিরা নাকি যথেষ্ট উৎসাহ তো দেখানইনি, তায় তাঁর এক সহকর্মীকে হিন্দিতে প্রশ্ন করেন, “এ আরও কতক্ষণ টাইম নেবে?” নিকসনের আর-এক পরামর্শদাতার মতে নিকসন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কোনো মহিলাকে হজম করতে পারতেন না। তো সে কথা বলতে কী, নিকসন গোটা ভারতীয় জাতিকেই অপছন্দ করতেন, বলেছিলেন ভারতীয়রা ‘Slippery and treachorous’। পাকিস্তান ও তার অধিবাসীদের ক্ষেত্রে কিন্তু প্রশংসাই বরাদ্দ ছিল। ... ...
দারিয়াবান্দা, কুতকুত (এইটা সম্ভবত আন্তর্জাতিক খেলা, অনেক বিদেশি সিনেমায় দেখছি তারাও কুতকুত খেলে! নিয়ম কানুনে হয়ত পার্থক্য আছে কিন্তু খেলে।) ফুলটোকা বা গোলাপ টগর, রুমাল চোর, কানামাছি, মোরগ লড়াই, ইচিং বিচিং, ওপেন টু বাইস্কোপ , আজকে আর কেউ খেলে না। এর মধ্যে দারিয়াবান্দা খুব জনপ্রিয় একটা খেলা। ব্যাডমিন্টন কোর্টের মত করে কোর্ট কাটা হত। একদল দাগে দাঁড়িয়ে থাকত অন্য দল ঘর গুলাতে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে হবে। দাগে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা দাগে পা রেখে ঘরের ভিতরে যারা আছে তাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করবে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার সময়ও যদি ছোঁয়া যায় তাহলেও চলবে। এক ঘর থেকে অন্য ঘর এভাবে পুরোটা যেতে হবে আবার আসতে হবে। সবাই মরে গেলে অন্য দলের সুযোগ। এই খেলার একটা আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। দারিয়াবান্দা খেলা একটু নরম প্রকৃতির, মেয়েরাও অংশ নিতে পারত। এটার একটা পুরুষালি ধরণ ছিল। এতে হাত পা যেমন খুশি তেমন ছুঁড়ে বিপক্ষকে ঘায়েল করা যেত। কেউ হয়ত লাফ দিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করল, অন্য জন হয়ত সোজা লাথি মেরে ফেলে দিল! বেশ ভয়ংকর একটা ব্যাপার ছিল। এর নাম ছিল চিক। আমরা দারিয়াবান্দা খেললে কেউ কেউ মেয়েদের খেলা খেলছি বলে খেপানোর চেষ্টা করত। কিন্তু চিক খেলছি দেখলে! হুম, এবার হচ্ছে খেলা! কতদিন যে চিক খেলে হাত পায়ে ব্যথা পেয়েছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। সেই ব্যথাও এখন সুখের মনে হয়। কী অদ্ভুত সময় পার করে এসেছি। এখন ভাবলে পরাবাস্তব কিছু বলে মনে হয়। ... ...
খাদ্যাভাস থেকে কথ্য ভাষা-- দুইয়ের ক্ষেত্রেই বাঙালির ভিতরে পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গ -- এই দুই ভৌগোলিক অবস্থান জনিত কিছু ফারাক আছে।সেই ফারাকগুলিকে খুব বড় মৌলিক ফারাক হয়তো বলা যায় না।কিন্তু সেই ফারাককে ঘিরেই বাঙালির সামাজিক আবর্ত আজ ও অনেকটাই আন্দোলিত হয়।তবে ঘটি বা বাঙাল, কেউ ই আজ তাঁদের যাপনচিত্রে , নিজেদের ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্যগুলি প্রায় মৌলিক ভাবে মেনে চলছেন, এমনটা দাবি করেন না।আর এই মেনে না চলার ভিতর দিয়েই কিন্তু সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের একটা সুন্দর ধারা বিকাশ লাভ করেছে। ... ...
সকালগুলো মনোরম এ সময়। বাতাসের গায়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়তে শুরু করে। উৎসবের ফুল শিশিরভেজা ঘাসে ছড়িয়ে দেয় গাছ, একটা মনকেমনের সুগন্ধ শরীরময় আনচান করে। এসময় সূর্য ওঠার আগে বিছানা ছাড়তেও আলস্যি নেই। গ্রামের বাড়িতে থাকলে পুকুরঘাটের ভাঙা পাথরের ধাপে বসে জলে ভাসা কুয়াশা দেখতাম। সেই কুয়াশা কেমন মৃদু বাতাসে ধোঁয়া কেটে কেটে উড়ে গিয়ে স্থির হত ওপারে শুরু হওয়া হৈমন্তী ধান-জমির এক মাথায়। রাতের জল লেগে আছে ধানের শিষের আনত শিরে, যেন ঘুমভার জড়িয়ে আছে সারা খেতে । কবে পড়া ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’-র লাইনগুলি মনে পড়ে, ‘কোলে ধান, কাঁখে ধান নিয়ে একেকটি গাছ নিঃসাড়ে ঘুমায়। কুয়াশা চুঁইয়ে শিশিরের একেকটি বিন্দু শীষের ওপর স্বপ্নের তরল ফোঁটার মতো পড়লে ধানগাছের ঘুম আরও গাঢ় হয়।’ সদ্য কচি ধানে দুধ আসার সময় ধানের ভারী ঘুম হয়। তার আগে দীর্ঘ শ্রমের ইতিবৃত্ত। মাটি তৈরি হবে বলে কৃষক তার ভাঙা গাল নিয়ে নীচে নয় আকাশের দিকে তাকায়। শুরুতে কয়েক পশলা বৃষ্টি পেলে মাটির কঠোর বুক ভেজে, নরম হয়। লাঙল দিতে সহজ তখন। এক ফসল তুলে নিয়ে আর-এক বোনার আগে জমিতে থেকে যায় কেটে নেওয়া ফসলের অবশেষ। খড়ের নড়ার গোড়ায় জল পেলে সে মাটি চষতে কষ্ট নেই। তবু এক-এক শীতের সন্ধ্যায় জমির পর জমিতে ধু ধু আগুন জ্বলে, নড়ায় ধরানো আগুন। চাষির অন্ধবিশ্বাসে নড়ার ছাই জমিতে মিশে উর্বর হয়! সন্ধে-নামা বাতাসে তার ধোঁয়া কুয়াশার মতোই স্থির হয়ে থাকে বহুক্ষণ। ... ...
চলার গতি বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়ে কোমরের দুলুনি। ওই দুলুনি জল বাঁচানোর জন্য। জল, খাবার জল। এই সোঁদরবনের গাঁ গেরামে বড়ো মহার্ঘ এই জল। কেউ একফোঁটা খরচ করে না অকারণে। করতে নেই। কেননা জল এখানে মাথা কুটলেও মিলবে না কোথাও। কেমন মজা বোঝো! মজাটি নিয়ে শরিফা আর ওর মিতেনি জীবন ঢালির বউ নেকি এক সময় খুব হাসাহাসি করত। জলের দেশের মেয়ে ওরা। জলের অভাব ব্যাপারটা মাথায় ঢোকে না কিছুতেই। মুখে বলেও, ধুস তাই আবার হয় নিকি! ভাত নি, কাপড় নি সে তো বুঝি, তা বলে পানি নি! শরিফার স্বামী ময়জুদ্দি হেসে বলে, হয় হয়। এটাই তো মজা র্যা। সোঁদরবনে পানি আছে, তবে লোনা, খাবার পানি খুব কম। হ্যাঁ, দেখেছে শরিফা, উলার চকে আট-আটটা টিউকল বসল। পানি উঠল বালি গোলা। খাওয়া দূরে থাক, মুখে দিলে ওয়াক থুঃ। পুকুরের পানি! সে তো তিন-চার মাস। খেলে পেটে ঘা হয়। বলে আর্সেনিক। তবে পানি কোথায়! হুই ডাঁসা নদী পার হও। ভবানীপুরে ডিপ টিউকল করেছে পঞ্চায়েত। সেখান থে পানি নে এসো। কিন্তু যাবে কীভাবে? বড়ো বাধা যে নদী। ছোটো-বড়ো নাও যা আছে, সব মাছ মারতে যায় বাদায়, চালানি যায় হাসনাবাদে। দু-একখানা নাও যা আছে, সেখানে ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। কলসি-বালতি পিছু এক টাকা, নগদা-নগদি। টাকা দাও আর পানি নাও। কার আছে পয়সা! উলার চকের মানুষের চাষবাসের উপর জীবন। ছ-মাস কাজ, বাকি সময় জোন খাটো, নাও চালাও নয়তো বিশপুরের হাটে মাল বও। না হলে উঞ্ছবৃত্তি করে চালাও। তাই পানি নিয়ে চলে টানাপোড়েন। কখনও মারপিট, মেয়ে হলে ইজ্জতের উপর হামলা। অনন্ত ঢালির বউ আয়না এক কাণ্ড ঘটিয়েছে। সে শরীরের রং ঢং দেখিয়ে মাঝিদের বশ করে পানি আনত। কিন্তু রসিক মাঝি সেয়ানা খুব, সুযোগ বুঝে একদিন হামলে পড়ল ওর উপর। আর আয়নাও তেমনি৷ ইজ্জত বাঁচাতে দিল হালের বাড়ি কষিয়ে। এক ঘায়ে কাত রসিক। আয়না এখন জেলে। ওর রুগ্ন ছেলেটা মা মা বলে উলার চকের আকাশ বাতাস ভারী করে চলেছে। ... ...
সন্ধ্যে হয়ে গেছে, কিন্তু পটলকে খুঁজে কোথাও পাচ্ছি না। এই ঘর, ওই ঘর, দোতলা, বাইরে—সব জায়গায় খুঁজলাম। “পটল! পটল!” কোনো সাড়া নেই। মনটা একটু খারাপ লাগতে শুরু করল। রাত বেড়েছে। কিন্তু পটলের কোনো খোঁজ নেই। সামনে একটা গাড়ি আসছে। নিশ্চয়ই আমার মাতাল বাপ। দরজা খুলে ঢুকল মাতাল বাপ, সঙ্গে আবার আর-একজন। জানি না আবার একে মা বলতে হবে কি না। লোকেরা মা-বাবার জন্য ছটফট করে আর আমি? আমার মা-বাবার অভাব নেই। নিজেকে কেমন যেন বিশ্বসন্তান বলে মনে হয়। জানলা দিয়ে দেখি টিয়া কী করছে। দেখি একটা সাদা কাপড়ে জড়িয়ে আছে। ওর ঘরে একটা গোল চাঁদের মতো লাইট আছে। টিমটিম করে জ্বলে রাতের বেলায়, কেমন যেন মুক্ত আকাশের খোঁজ দেয়। কোন্ এক সপ্নের দেশে নিয়ে যায়, যেখানে আমার টিয়া হয়তো তার সবুজ ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। ... ...
দুনিয়া জুড়ে এ তাবৎ ফলিত গণতন্ত্র নানা গলদে ভরা—বিসদৃশকেও নিজের এবং নিজেকেও বিসদৃশের সমান ভাবার অক্ষমতা, ভোটের অঙ্কের পাটিগণিতের দাপটে সংখ্যালঘুর স্বর না শোনা, সেই পাটিগণিতকে কর্মক্ষম করার জন্য প্রয়োজনীয় পূর্ব স্থাপিত গণতান্ত্রিক সমাজের অভাব ইত্যাদি। এ থেকে মুক্তির পথ কী? শিক্ষা। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের একটি বই। পড়লেন সাংবাদিক রজত রায় ... ...
নেজওয়ান দরবিশ। জন্ম ১৯৭৮। জেরুসালেনবাসী। এ সময়ের আরবি কবিতার নক্ষত্র। এ পর্যন্ত কাব্যসংকলন আটটি। পনেরোটি ভাষায় অনূদিত। মেহমুদ দরবেশ ও পূর্বজ মহান আরবি কবিদের থেকে তাঁর স্বর একেবারে ভিন্ন। আমরা বাধ্য হই সেই স্বর ‘হৃদয়ে পেরেক দিয়ে গেঁথে’ নিতে। লিখছেন পাকিস্তানের কবি অফজ়াল আহমেদ সৈয়দ। ... ...
এ জগতে কবিরা সৃষ্টিশীল অন্তত সাত শতক ধরে। বঙ্গের ঠিক পাশের অঞ্চলে। এও কম আশ্চর্যের বিষয় নয়, বিদ্যাপতি ব্যতীত এ ভাষার দ্বিতীয় কোনো কবির নাম অধিকাংশ কবিতাপ্রেমী বাঙালির কাছে আজও অজানা। তরজমা বিরল। বাংলা অনুবাদে মৈথিলি কবিতার তেমনই একটি সংকলন। পড়লেন তৃষ্ণা বসাক ... ...
১৯৭১-এ ভয়ের বাতাবরণ কেটেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে। বরুণ সেনগুপ্ত লিখলেন সাতক্ষীরে অভিযানের কথা। আমরা সাতক্ষীরের লোক। বাড়ির সকলে হুমড়ি খেয়ে বরুণ সেনগুপ্তর প্রতিবেদন পড়লাম। বাঙালি লড়াই করছে স্বাধীনতার জন্য। ছেড়ে আসা মাটি, দেশ, গ্রাম, ভিটে কেমন ছিল তা আমার অজানা ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর দুই দেশে বৈরিতা আরও বেড়েছিল। পূর্ববঙ্গের খবর আসা ক্রমশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খবরের কাগজ এবং রেডিও খবর দিতে লাগল। পাকিস্তান ভেঙে যাচ্ছে। উদ্বাস্তু স্রোত আসছে সীমান্ত পার হয়ে। আমি তখন কী করব কী করব ভেবেই দিন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হতে চাই। একটা দেশ স্বাধীন হবে। সেই দেশটি আমার পিতৃকুল, মাতৃকুলের দেশ। ... ...
ভারতে যখন সুলতানী যুগ, তখনও পৃথিবীর বৃহত্তম গম্বুজ ছিল ১২৮ অব্দে নির্মিত রোমের প্যান্থেওন। দ্বিতীয় বৃহত্তম গম্বুজ ছিল ইস্তানবুলের আয়াসোফিয়া (তখন গীর্জা)। আয়াসোফিয়ার গম্বুজ ইঁটের। প্যান্থেওন ইঁটের গম্বুজ ছিল না, কংক্রীটের, তবে একই পদার্থবিদ্যার নিয়মে তৈরী। প্যান্থেওনের সমতুল্য মাপের গম্বুজ ভারতে তৈরী হয় অনেক পরে- সপ্তদশ শতকে- সেটিও একটি সমাধি, যার কথা আমরা পরে বলব। প্যান্থেওনের আরএকটা বিস্ময়কর ব্যাপার হল, এটিই এই বিশ্বে একমাত্র বাড়ী যা টানা ১৯০০ বছর ধরে সক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে- আগে রোমান মন্দির ছিল, পরবর্তীকালে গীর্জা। ... ...
সতীনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আমি কলেজে ফিলসফি পড়তুম। প্রথম যখন হেগেল-মার্কস পড়েছি, আমরাও মনে মনে মার্কসকে শ্রদ্ধা করেছি; তোর এখন যে বয়েস, এ বয়েসে হয়তো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা বেঁচে গিয়েছিলুম, মার্কসিস্ট হওয়ার কথা ভাবিওনি। কেন জানিস? নৈতিক সংঘাত। আমাদের আজন্ম শিক্ষা নাস্তিক মার্কসের মেটিরিয়ালিজ্ম্ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো আমাদের। তোদের তো আমি সেভাবে মানুষ করতে পারিনি। এই তো, এখনই সন্ধ্যা-আহ্ণিক বন্ধ করে দিয়েছিস, বাইরে কার হাতে কী খেয়ে বেড়াস আমি ভয়ে জিজ্ঞাসাই করি না। আমি এখনো বেঁচে আছি, তা সত্ত্বেও পৈতেটা পর্যন্ত ফেলে দিয়েছিস তুই, যদুগোপাল ন্যায়রত্নের পৌত্র ! ... ...