এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Biplob Rahman | ২৮ মার্চ ২০১৪ ০৯:৫৪582754
  • সালেক খোকন
    যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৯ “স্বাধীনতা দিবস হওয়া উচিত ছিল ৭ মার্চ’’
    মার্চ ৭, ২০১৪

    ১৪ আগস্ট। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। তখন এই দিনটি ঘটা করেই পালন করা হত। কীর্তনখোলা নদীতে চলত নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। নানা রঙ-ঢঙে নৌকা সাজিয়ে ভিড় জমাত দূর-দুরান্তের মানুষ। সবার মধ্যে টানটান উত্তেজনা। নৌকাবাইচ দেখতে আমরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম। বন্ধু দেলোয়ার মুন্সি, আবদুল মান্নান, ইউসুফ আলী চৌধুরী, জালাল, শামসুল হকসহ দলবেঁধে হৈ-হুল্লোড় করে তা দেখতে যেতাম।

    সে সময় মহররমও ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হত। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমরা চাল-ডাল আর টাকা তুলতাম। তা দিয়ে মহররমের দিন রান্না হত খিচুড়ি। হাডুডু ও ফুটবল ছিল পছন্দের খেলা। সবচেয়ে আনন্দ পেতাম কীর্তনখোলা নদীতে ঝাঁকি জাল দিয়ে মাছ ধরতে। ইস! আজও মন চায় ছুটে যাই কীর্তনখোলার বুকে।

    যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এস এম মোফাজ্জল হোসেন এভাবেই তাঁর একাত্তরের গল্প বলতে শুরু করলেন। কীর্তনখোলার তীরে বেড়ে ওঠা এই যোদ্ধা খানিক দম নিয়ে আবার বলতে থাকেন–

    ছোটবেলা থেকেই আমি ডানপিটে। সময় কাটত বন্ধুদের আড্ডায়। দুষ্টুমি ছিল আকাশচুম্বী। মাঝে মধ্যেই বাড়িতে বিচার আসত। বাবা একবার খুব রাগ করলেন। বললেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। কথাটি প্রায়ই বলতেন তিনি। কিন্তু তিনি কখনও ভাবেননি ঘর ছাড়ব। সেবার আমিও বেঁকে বসি। কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসি ঢাকায়। মেজ খালা ওয়াজিবুন নেসা তখন থাকতেন ঢাকার মগবাজের ৩৯৪ নম্বর বাড়িতে।
    যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন

    যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন

    সময়টা ১৯৬৯। ঢাকা তখন উত্তপ্ত। মিছিল মিটিংয়ে আমরা সক্রিয়। মাঝে মধ্যে কারফিউ দেওয়া হত। গা ঢাকা দিতাম তখন। রাজনৈতিক মিটিংগুলো তখন হত আউটার স্টেডিয়ামে। সত্তরের নির্বাচনে আমরা মাঠে নামি। কাজ করি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে।

    সময় গড়িয়ে আসে ১৯৭১। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। ওইদিন দুপুরে মগবাজার থেকে নাজমুল, ফেরদৌসসহ আমরা যাই ভাষণ শুনতে। রেসকোর্স ময়দানে তখন লোকে লোকারণ্য। এত বড় জনসভা আমি কখনও দেখিনি। দেশ তখন উত্তপ্ত। সবার মুখে একই প্রশ্ন। কী বলবেন বঙ্গবন্ধু? ‘ভায়েরা আমার’ বলে ভাষণ শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। বললেন– ‘‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে…।’’

    কণ্ঠ আকাশে তুলে আমরা তখন স্লোগান তুললাম। বঙ্গবন্ধু আরও বললেন– ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…।’’

    আজও ওই ভাষণ শুনলে শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। রক্ত এখনও টলমল করে। মুক্তিযুদ্ধের সব নির্দেশনাই দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ওই ভাষণের পরই মনের ভেতর আমরা স্বাধীনতার বীজ বুনি।

    মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা ঘটনা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এস এম মোফাজ্জল হোসেনের মুখে। তার বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার চর করানজি গ্রামে। বাবা হাতেম আলী সিকদার কৃষিকাজ করতেন, আর মা সৈয়দা তাজিমন নেছা ছিলেন সাধারণ গৃহিণী। তিন ভাই ও এক বোনের সংসারে তিনি ছিলেন মেজ। তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গ্রামের বাড়িতেই। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি দিনার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন চর আইসা গ্রামের এয়ার খান ইনিসটিটিউডে। সেখানে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর চলে যান ঢাকাতে। ভর্তি হন সিদ্ধেশরী হাই স্কুলে। একাত্তরে তিনি এ স্কুলেরই এসএসসি পরিক্ষার্থী ছিলেন।

    মোফাজ্জল হোসেন যুদ্ধ করেন ৯ নং সেক্টরে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া একটি গুলি তার ডান পায়ের হাঁটুতে বিদ্ধ হয়। ফলে হাঁটুর হাড় ছয় ইঞ্চি ভেঙে উড়ে যায়। পরে সেখানে আর্টিফিশিয়াল বন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে ডান পা তিনি ভাঁজ করতে পারেন না।

    পঁচিশ মার্চ মধ্যরাত। গোলাগুলির শব্দে সবাই ভয়ে তটস্থ। যে যার মতো ঢাকা ছাড়ছে। খুব ভোরে মোফাজ্জলরা মগবাজার থেকে রওনা হন গ্রামের উদ্দেশে। পায়ে হেঁটে প্রথমে লৌহজং এবং পরে লঞ্চে করে চলে যান বরিশাল শহরে।

    ট্রেনিংয়ের কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘‘বরিশাল তখনও মুক্ত। ওখানকার নেতা ছিলেন নূর ইসলাম মঞ্জু। সত্তরের নির্বাচনে তিনি এমপি হয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন সার্জেন্ট ফজলুল হক, সরদার জালাল আহমেদ প্রমুখ। তাদের উদ্যোগেই ট্রেনিংয়ের আয়োজন হয়। এপ্রিলের এগার তারিখ। বরিশাল ভিলেজ পার্কে আমি ট্রেনিং নিই। আমাদের দলে ছিল চল্লিশ জন। ট্রেনিং করান সুবেদার মেজর মান্নান সাহেব। পরে ওনার অধীনেই আমরা যুদ্ধ করি। লিলিং, লাইন, স্টেনডিং, আর্মস ক্রেরিং, ফায়ার করা, ক্রলিং প্রভৃতি শেখানো হয় আমাদের। ১৮ এপ্রিল ১৯৭১। বরিশাল শহর দখলে নেয় পাকিস্তানি আর্মি। আমরা তখন গ্রামের দিকে চলে যাই। মান্নানের নেতৃত্বে ক্যাম্প গাড়ি গজনী দিঘীর পাড়ে। তখন ক্যাম্পের টো-আইসি ছিলেন হাবিলদার মোকসেদ আলী খান।’’

    কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছেন ?

    মোফাজ্জলের উত্তর, ‘‘আমার ছিলাম গেরিলা। আঘাত করেই সরে পড়তাম। মাঝে মধ্যে হ্যারেসমেন্ট ফায়ার করতে হত। আমরা একটি গুলি করলে ওরা করত দশটি। ওদের গুলি নষ্ট করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ৯ নং সেক্টরের অধীনে আমরা যুদ্ধ করি বাকেরগঞ্জ, নলছোটি, টঙ্গিবাড়িয়াসহ বরিশালের বিভিন্ন জায়গায়।’’

    তিনি বলেন, ‘‘সে সময় এম আক্তার মুকুলের চরমপত্র শোনার জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকতাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হত দেশাত্ববোধক ও নজরুলের বিদ্রোহের গান। এগুলো আমাদের প্রেরণা জোগাত।’’

    কোন অপারেশনে গুলিবিদ্ধ হলেন?
    ডান পা ভাঁজ করতে পারেন না যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন

    ডান পা ভাঁজ করতে পারেন না যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন

    এমন প্রশ্নে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন খানিকক্ষণ চুপ করে থাকেন। অতঃপর লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বলতে থাকেন, “২৯ নভেম্বর ১৯৭১। ভোরবেলা। কীর্তনখোলা নদীর ঘাটে আসে রাজাকারদের কয়েকটি নৌকা। ওত পেতে আমরা তাদের ওপর আক্রমণ করি। ফলে মারা পড়ে কয়েকজন রাজাকার। বাকিরা পালিয়ে যায়। তারা উল্টো অ্যাটাক করতে পারে। এই চিন্তা থেকেই আমরা চর আইসায় নদীর পাড়ে অ্যামবুস করে বসে থাকি। আমাদের দুশ জনের দলে কমান্ডার ছিলেন মান্নান সাহেব।

    ৩০ নভেম্বর। রাত তিনটা। কমান্ডারের নির্দেশে আমরা অ্যামবুস তুলে ফেলি। সেকশন কমান্ডার আবদুর রব, আলমগীর ও আমি ছুটি পাই রেস্টের জন্য। নদীর পাড়ের একটি বাড়ির দিকে আমরা রওনা হই। আমাদের পেছন দিকে ছিল চর কাউয়া ঘাট। ওদিক দিয়ে ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি আর্মিরা। আমরা তার কিছুই টের পাই না। বাড়ির ভেতর ঢুকতেই হঠাৎ তারা পেছন থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ করে। চারপাশ ঘিরে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। একটি গুলি এসে লাগে আমার ডান পায়ে। আমি উঠানের এককোণে ছিটকে পড়ি। আলমগীর ও রব কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়।

    পাকিস্তানিদের গুলির আঘাতে আমার ডান পায়ের হাঁটুর ওপরের হাড় ভেঙে মাংসসহ উল্টে যায়। রক্ত পড়ছিল গলগলিয়ে। গোটা উঠান রক্তে লাল। ধীরে ধীরে আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। ঝাপসা হয়ে আসে চোখ দুটো। কিন্তু তবুও জ্ঞান হারাই না। রক্তাক্ত দেহ দেখে পাকিস্তানি সেনারা ভেবেছে মরে গেছি। তারা চলে যেতেই আমার কাছে ছুটে আসেন সহযোদ্ধারা। তখনও রক্ত পড়ছিল। তা বন্ধ করতে রব একটি শক্ত দড়ি দিয়ে পা বেঁধে দেন। বাঁধার দাগটি এখনও মিলিয়ে যায়নি। আজও দেখলে সবকিছু জীবন্ত হয়ে ওঠে।

    কোথায় কোথায় চিকিৎসা চলল?

    তিনি বলেন, ‘‘একটি টিনে করে আমাকে নেওয়া হয় ওই গ্রামেরই হাসন মিঞার বাড়িতে। সেখানেই চলে প্রাথমিক চিকিৎসা। ৮ ডিসেম্বর মুক্ত হয় বরিশাল। ১০ তারিখ আমাকে নেওয়া হয় বরিশাল সদর হাসপাতালে। সম্মান জানাতে সে সময় সহযোদ্ধারা আমার দুইদিকে দাঁড়িয়ে উপরে ফাঁকা গুলি করতে থাকে। বুকটা ভরে গিয়েছিল সেদিন। এমন সম্মান আমি কখনও পাইনি। আজও মনে হলে আনন্দে চোখ ভিজে যায়। বরিশাল থেকে আমাকে পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতাল (পুরাতন পিজি)-তে। সেখান থেকে সরকারি উদ্যোগে নেওয়া হয় ডেনমার্কে। অপারেশন করে ৬ ইঞ্চি আর্টিফিসিয়াল বন লাগিয়ে দেওয়া হয় আমার ডান পায়ে।’’

    শারীরিক কষ্টের কথা বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল বলেন, ‘‘চলতে হয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বিয়াল্লিশ বছর ধরে ডান পা ভাঁজ করতে পারি না। পা পৌনে এক ইঞ্চি ছোট হয়ে গেছে। প্রস্রাব-পায়খানা করতে হয় অন্যের সাহায্যে। সামাজিক কোনো জায়গায় যেতে পারি না।’’

    মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের সহযোগিতার কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘‘মুসলিম লীগ, জামায়াত, নিজামী ইসলাম ছাড়া সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। তারা আমাদের খাবার ও খবর দিয়ে সাহায্য করত। বরিশাল জেলার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুর রহমান বিশ্বাস। ওই সময় যারা মাদ্রাসায় লেখাপড়া করত তারা অধিকাংশই ছিল পাকিস্তানি আদর্শে উজ্জীবিত। এই ধারা এখনও অটুট আছে।’’

    স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভাগ হওয়াকে কালো অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করেন এই মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘‘স্বাধীনতার পর সেক্টর কমান্ডার ও সাব-সেক্টর কমান্ডাররা মন্ত্রী ও এমপি হওয়ার জন্য যোগ দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে। তাদের হাত ধরেই রাজনীতিতে আসেন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা। এতে মুক্তিযোদ্ধারা হারান তাদের সর্বজনীনতা। স্বাধীনতাবিরোধীতাকারীরা আজও সুসংগঠিত। অথচ আমাদের এক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে অন্য মুক্তিযোদ্ধার সুসম্পর্ক নেই।’’

    মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে মোফাজ্জল বলেন, ‘‘স্বাধীনতার পর পরই এ তালিকা চূড়ান্ত করা যেত। তখন সব সেক্টর কামান্ডারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ছিল।’’

    বিয়াল্লিশ বছর পরও তালিকা কেন বাড়ে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক কারণ তো রয়েছেই। এছাড়া কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাদের লোভই এর জন্য দায়ী। এ তালিকা এখনই বন্ধ হওয়া দরকার।’’

    যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জলের পরিবার চলে সরকারি ভাতার ওপর। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের বিষয়ে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘পাওয়ার জন্য কিছু করিনি। তবে বেঁচে থাকার জন্য এখন কিছু প্রয়োজন।’’

    মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না বলে জানান মোফাজ্জল। তবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটি কিছুটা মনোবল বাড়িয়ে দেয় তাদের। তিনি বলেন, ‘‘সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসাররাও আমাদের সঙ্গে আছেন– এ বিষয়টিই আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।’’

    তিনি মনে করেন, ২৬ মার্চ নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হওয়া উচিত ছিল ৭ মার্চ। কেননা সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণই অধিকাংশ বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য।

    বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘‘ক্ষমা করাটা ঠিক ছিল না। ছোট ছোট তথ্য যারা দিয়েছে তার ভিত্তিতেই বড় বড় অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। তাই অপরাধের শ্রেণিভাগ না করে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা দরকার ছিল।’’

    তিনি আরও বলেন, ‘‘মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের অনেককেই রাজাকাররা ধরিয়ে দিয়েছিল। যে ওই তথ্যটি দিয়েছে সে কি অন্যায় করেনি? আজ যদি দেশ স্বাধীন না হত তারা কি মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচিয়ে রাখত?’’

    পচাঁত্তরের পর বাতিল হয় দালাল আইনটি। ফলে রাজনীতিতে আসে রাজাকাররা। সে পথ ধরেই স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী হন রাজাকার। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপতি রাজাকার, এ লজ্জা জনতার। এর চেয়ে লজ্জার ও ঘৃণার কিছু থাকে না।’’
    যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হওয়া উচিত ৭ মার্চ

    যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হওয়া উচিত ৭ মার্চ

    খারাপ-লাগা অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যখন দেখি ইসলামের নামে বোমাবাজি করে মানুষ মারা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলে পাকা আসন গেড়েছে স্বাধীনতাবিরোধীরা– তখন সত্যি কষ্ট লাগে।’’

    মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এ জাতি মুক্তিযোদ্ধাদের মন থেকে স্মরণ করবে তখন, যখন এদেশে কোনো মুক্তিযোদ্ধা থাকবে না। ভবিষৎ প্রজন্ম তখন ঠিকই উপলব্ধি করতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের ইতিহাসকে। তাই বিশেষভাবে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস সংরক্ষণ করা।’’

    স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। ‘‘পা গেছে কিন্তু স্বাধীনতা তো পেয়েছি, এতেই আমি তৃপ্ত। সবাই যখন সম্মিলিতভাবে কাজ করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়– তখন ভালো লাগে। ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চে ভুলে যাই নিজের কষ্টের কথা’’– এভাবেই বললেন মোফাজ্জল।

    পরবর্তী প্রজম্মের উদ্দেশ্যে বিশ্বাস ও আশা নিয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘‘এ দেশ একদিন অনেক উন্নত হবে। তোমরা দেশপ্রেম নিয়ে কাজ কর। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে শেষ কর নিজের দায়িত্বটুকু। তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শুধু একটি জিনিসই চাই আমরা– চাই রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ।’’

    সংক্ষিপ্ত তথ্য

    নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন।

    ট্রেনিং: ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে বরিশাল ভিলেজ পার্কে তাকে ট্রেনিং করান সুবেদার মেজর মান্নান।

    যুদ্ধ করেছেন: ৯ নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন বাকেরগঞ্জ, নলছোটি, টঙ্গিবাড়িয়াসহ বরিশালের বিভিন্ন জায়গায়।

    যুদ্ধাহত: ৩০ নভেম্বর ১৯৭১। রাত তিনটা। পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া একটি গুলি তার ডান পায়ের হাঁটুর ওপরে বিদ্ধ হয়। ফলে ছয় ইঞ্চি হাড় ভেঙে উড়ে যায়। পরে সেখানে আর্টিফিশিয়াল বন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে ডান পা তিনি ভাঁজ করতে পারেন না। চলতে হয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পা পৌনে এক ইঞ্চি ছোট হয়ে গেছে।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/15756
  • Biplob Rahman | ২৮ মার্চ ২০১৪ ০৯:৫৮582755
  • শারমিন আহমদ
    সত্যের সংগ্রাম
    ডিসেম্বর ২৯, ২০১৩

    ঢাকা কলেজের আরবীর অধ্যাপক সৈয়দ সেরাজুল হকের প্রিয় ছাত্র ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আরবী ভাষাসহ সব বিষয়ে সেরা ছাত্র হওয়ার জন্যই নয়, তিনি এই মিতভাষী ছাত্রটিকে অশেষ স্নেহ করতেন তার চারিত্রিক গুণাবলীর জন্যও। ন্যায়পরায়ণতা ও সততা ছিল এই ছাত্রটির মধ্যে লক্ষ্য করার মতো বৈশিষ্ট্য।

    একদিন এই ছাত্রটিই হবেন তার জামাতা। তাঁর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান সৈয়দা জোহরা খাতুন লিলির সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন। আরও পরে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী রুপে মুক্তিযুদ্ধের হাল ধরবেন এবং তার সেই তিল তিল করে লালিত চারিত্রিক গুণাবলী প্রজ্ঞা, সততা ও ন্যায়ের শিখার আলোকে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করে জাতিকে পৌঁছে দেবেন বিজয়ের কূলে। শত ষড়যন্ত্র নির্মূল করে তিনি ছিনিয়ে আনবেন আপসহীন স্বাধীনতা।

    ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের দিনটিতে তিনি ভাষণে বলেছিলেন–

    “আমাদের মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শের পতাকা সমুন্নত রেখে আমরা আবার প্রমাণিত করেছি আমরা তিতুমীর-সূর্য সেনের বংশধর। স্বাধীনতার জন্য আমরা যেমন জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশি শত্রুসৈন্যদের চিরতরে হটিয়ে দিতেও আমরা সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত প্রবলপরাক্রম হোক না কেন, পরাজয় বরণ করতে বাধ্য”।

    স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন দুর্জয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদকে ভয় করতেন ভুট্টো, ইয়াহিয়া ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা প্রণয়নকারী রাও ফরমান আলী। তারা তাজউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচারণা করেছিলেন তার একটি ছিল যে তিনি ভারতীয় হিন্দু, আসল নাম তেজারাম। গৃহবন্দি, আমার নানা, বর্ষীয়ান সেরাজুল হককে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জিজ্ঞেস করেছিল যে তিনি আরবী ও ইসলামশাস্ত্রের পণ্ডিত হয়েও কী করে তাঁর কন্যাকে একজন হিন্দুর সঙ্গে বিয়ে দিলেন। সেরাজুল হক সাহেব মিথ্যা খণ্ডন করলেও পাকিস্তানি সেনারা ছিল ব্রেইনওয়াশড। খুব সুপরিকল্পিতভাবে তাদের মস্তিস্কে ধর্ম ও জাতিবিদ্বেষের বীজ বপন করা হয়েছিল। যখন সত্যের সম্মুখ হতে শত্রু ভয় পায় তখনি সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। জামাতা সমন্ধে গর্বিত সেরাজুল হক বলতেন যে, “তাজউদ্দীনের সর্বোত্তম গুণ হল যে সে সত্য বলতে ভয় পায় না।”

    তিনি এ প্রসঙ্গে নবী করিম (স:) বর্ণিত এই হাদিসটি বলতেন–

    “সর্বোত্তম জিহাদ হল অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্যি কথা বলা।”

    এই হাদিসটি বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও একই ধরনের বর্ণনা আবু দাউদ ও তিরমিজি শরীফেও উল্লিখিত হয়েছে। জিহাদের আক্ষরিক অর্থ হল সংগ্রাম যা আত্মিক এবং চারিত্রিক উন্নয়নের সংগ্রাম হতে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপ্ত। বিপন্ন, অসহায়, নিপীড়িত ও নির্যাতিতকে রক্ষা ও তাদের পক্ষ হয়ে অত্যাচারী-অহংকারী-উদ্ধত ও উৎপীড়ক শাসকের সামনে সত্যি কথা বলার মতো শক্তি ও সাহস খুব কম মানুষেরই থাকে। যারা সাহস করে সত্যি কথা বলেন এবং ন্যায়ের পক্ষে লড়েন তারা অর্জন করেন মনুষ্যত্বের উচ্চ সোপান এবং তাদের স্থান ইতিহাসে লেখা থাকে স্বর্ণাক্ষরে। আমি লেখার এই অংশে তুলে ধরব সেই বিদেশিদের কথা যারা বাংলাদেশের প্রসঙ্গে তাদের সরকারের অন্যায় নীতি এবং পাকিস্তানের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।

    বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে, গণতন্ত্রর সমর্থক এই দাবিদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেছিল চরম অগণতান্ত্রিক, স্বেচ্ছাচারী ও গণহত্যাকারী পাকিস্তান সামরিকতন্ত্র ও তাদের অত্যাচারের দোসর ইসলাম ধর্মের কলঙ্ক মৌলবাদী দলগুলিকে। নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন কমিউনিজম উৎখাতের নাম করে সন্ধি করেছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী স্বৈরাচারী রাজা-বাদশা, একনায়ক ও সামরিক জান্তাদের সঙ্গে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের প্ররোচনায় ও সমর্থনে লাতিন-আমেরিকা এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু রাষ্ট্রে সংঘটিত হয় নারকীয় গণহত্যা যে জন্য হেনরি কিসিঞ্জারের বিচার দাবি করে প্রখ্যাত সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেন্স রচনা করেন সাড়াজাগানো ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ বইটি।

    প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী, নির্দয় প্রকৃতির, ধূর্ত এই কূটনীতিক-কৌশলবিদের সামনে তার সমালোচনা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস খুব কম মানুষই দেখাতে পেরেছিল। বিশেষত সেই মানুষটি যদি তারই অধীনস্থ হন। ১৯৭১ সালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের নাম সত্যভাষী, সত্যপ্রিয় ও সত্যসন্ধানী মানুষের হৃদয়ে এবং ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করে তার শাণিত বিবেক হতে উচারিত সত্য ভাষণের জন্য। বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রের শক্তিশালী প্রশাসকের অন্যায়কে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর চাকুরী এবং কূটনৈতিক ক্যারিয়ারের পরোয়া না করে তিনি ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেট হতে, বিশজন কূটনীতিকের স্বাক্ষরসহ তাঁর ঊর্ধ্বতন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান হেনরি কিসিঞ্জারকে ৬ এপ্রিল, ১৯৭১ একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন।

    ওয়াশিংটন ডিসির, স্টেট ডিপার্টমেন্টে ওই তারবার্তাটি পৌঁছুবার পর আরও নয়জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাতে স্বাক্ষর প্রদান করেন। ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে খ্যাত আর্চার ব্লাডের বার্তাটিকে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ইতিহাসের সবচাইতে শক্ত ভাষায় লেখা চিঠি হিসেবে অভিহিত করেন সাংবাদিক হিচেন্স। গণতন্ত্রকে দাবিয়ে পাকিস্তান সরকারের বাংলাদেশের নিরীহ জনসাধারণকে নির্বিচার হত্যার প্রেক্ষিতে তাঁর নিজ দেশ, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নির্লিপ্ত ভূমিকাকে তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি লিখেন–

    our government has failed to denounce the suppression of democracy. Our government has failed to denounce atrocities.Our government has failed to take forceful measures to protect its citizens while at the same time bending over backwards to placate the West Pak dominated government and to lessen any deservedly negative international public relations impact against them.our government has evidenced what many will consider moral bankruptcy,ironically at a time when the USSR sent President Yahya Khan a message defending democracy,condemning the arrest of a leader of a democratically-elected majority party,incidentally pro-West,and calling for an end to repressive measures and bloodshed….But we have chosen not to intervene,even morally,on the grounds that the Awami conflict,is purely an internal matter of a sovereign state. Private Americans have expressed disgust.We,as professional civil servants,express our dissent with current policy and fervently hope that our true and lasting interests here can be defined and our policies redirected.

    প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং সেক্রেটারি অব স্টেট কিসিঞ্জারের অমানবিক নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় আর্চার ব্লাডকে হারাতে হয় তার কনসাল জেনারেলের পদ। তাকে দ্রুত ওয়াশিংটনে ফিরিয়ে এনে সাধারণ ডেস্ক জবে নিয়োগ দেওয়া হয়। গনহত্যাকারী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিসিঞ্জার চিঠি লিখেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে তার ‘কোমল ও কৌশলপূর্ণ’ আচরণের জন্য।

    ঢাকায় আর্চার ব্লাডের স্থলাভিষিক্ত হন হারবার্ট স্পিভাক। অবসরগ্রহণের কাছাকাছি সময়ে পদোন্নতিপ্রাপ্ত এই নতুন কনসাল জেনারেল মুখ খুলবেন না এই ধারণা করেই কিসিঞ্জার তাকে এই পোস্টে নিয়োগ করেন। কিন্তু তার পক্ষেও নিশ্চুপ হয়ে থাকা সম্ভব হয়নি যখন তিনি চাক্ষুষ প্রমাণ পান যে রাতের অন্ধকারে (ডিসেম্বর ৮-৯, ১৯৭১) ঢাকার তৎকালীন তেজগাঁও বিমান বন্দরে ভিআইপিদের ব্যবহারের জন্য মোতায়েন ক্ষুদ্র দুই ইঞ্জিনযুক্ত বিমানকে (Piaggio P-136-L) পাকিস্তান সরকার ব্যবহার করেছে তেজগাঁও বিমান বন্দর হতে মাইলখানেক দূরে অবস্থিত এতিমখানা ও বেসামরিক এলাকায় বোমাবর্ষণের জন্য। ওই বর্বরোচিত বোমা হামলায় কয়েকশত নিরীহ এতিম বালক ঘুমন্ত অবস্থায় প্রাণ হারায়।

    এই অমানবিক কাজটি পাকিস্তান সরকার করে ভারতীয় এয়ারফোর্সের ওপর দোষ চাপানোর জন্য। উল্লেখ্য, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জামায়াত-এ-ইসলাম দল রটিয়েছিল যে তার অঙ্গ সংগঠন আলবদর বাহিনী নয়, ভারতীয় বাহিনীই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। পাকিস্তান সরকারও একই রকম চেষ্টা চালিয়েছিল।

    এতিমখানায় পাকিস্তান সরকারের নারকীয় বোমাবর্ষণের ঘটনাটি খোদ পাকিস্তানের গণহত্যার সমর্থক রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার দালিলিক প্রমাণাদিসহ অফিসিয়াল চিঠি হতেই প্রথম জানা যায়। মার্কিন সেক্রেটারি উইলিয়াম রজারস ও পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ দোসর জোসেফ ফারল্যান্ডের কাছে প্রেরিত তারবার্তায় অকাট্য প্রমাণাদিসহ স্পিভাক ঘটনাটি বিশদাকারে জানান। তার চিঠির শিরোনাম ছিল– villainy by Night যা পুলিতজার বিজয়ী সাংবাদিক জ্যাক অ্যান্ডারসন তার বই The Anderson Papers এ উল্লেখ করেন।

    স্পিভাকের বিশদ চিঠির অংশবিশেষ উল্লিখিত হল–

    United Nations Assistant Secretary General [Paul Marc Henry] and I are convinced on the basis of evidence we both regard as conclusive that bombings of non military areas in Dacca last night (and inferentially bombing of orphanage on night of December 8-9) were carried out by a Pak government plane based at Dacca airport and that the purpose of the attacks was to discredit the Indian airforce…. I strongly urge that the Ambassador Farland and Ambassador Bush( possibly in consultation with Secretary General)make immediate demarche to President Yahya and Pak UN Rep Shahi to confront them with evidence and warn them that any future attempt of this kind will bring about full publicity.

    স্পিভাক, আর্চার ব্লাডের মতো তার সহকর্মীদের নিয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ না জানালেও, পাকিস্তানের বর্বরতা যাকে তার সরকার সমর্থন দিচ্ছে সে বিষয়ে নিশ্চুপ থাকতে পারেননি। তিনি, রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ও জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ বুশ সিনিয়রকে (পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি) জোরালো আবেদন জানান যাতে তারা প্রমাণাদি সহকারে পাকিস্তান সরকারের বর্বরোচিত বোমা হামলার ঘটনাটি নিয়ে ইয়াহিয়া খান ও জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহীর মুখোমুখি হন।

    বলাবাহুল্য পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমর্থন সে সময় বিন্দুমাত্রও কমেনি। তা সত্ত্বেও সর্ব ক্ষেত্র হতেই যুক্তরাষ্ট্রর বিবেকবান মানুষেরা সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের সমর্থনে। (বিশ্বজুড়েই সেই যুগটাকে হয়তো বলা যেতে পারে আদর্শবাদের যুগ। বৈষয়িক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে মানবিক দায়িত্বকে প্রাধান্য দেওয়া এবং আন্তরিকভাবেই নিপীড়িতর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের প্রতিবাদ করার মানসিকতা এই আগ্রাসী ভোগবাদের যুগে তেমন করে পরিলক্ষিত হয় না।)

    জগদ্বিখ্যাত সেতারবাদক বন্ধু রবিশঙ্করের অনুরোধের প্রতি সম্মান জানিয়ে বিশ্বনন্দিত শিল্পী জর্জ হ্যারিসন আয়োজন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ (১ আগস্ট, ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন, নিউ ইয়র্ক) নামের চ্যারিটি কনসার্ট যার মাধ্যমে নিমিষেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে বিশ্ববাসীর পরিচয় ঘটে। এই কনসার্ট থেকে উপার্জিত আড়াই লাখ ডলার দান করা হয় জাতিসংঘের শিশু তহবিলে– ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে মরণাপন্ন ও রোগাক্রান্ত বাংলাদেশি শিশুদের কল্যাণে। নামিদমি সেলেব্রিটির সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত এই বিশাল কনসার্টটি ছিল পরবর্তীকালের ইথিওপিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি চ্যারিটি কনসার্টের পথিকৃৎ।

    কংগ্রেসম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালাঘের কংগ্রেসে প্রদত্ত তাঁর গভীর অনুভূতিসম্পন্ন বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টে বলেন–

    “সন্ত্রাস সবসময় জনগণকে দাবিয়ে রাখতে পারে না। সন্ত্রাস কখনওই মানুষের বিশ্বস্ততা ও সহানুভূতি জয় করতে পারে না।— সন্ত্রাস যতখানি পাশবিক হবে প্রতিরোধও ততখানি দৃঢ় হবে। পূর্ব পাকিস্তানে আজ সে ধরনেরই যুদ্ধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সামনে একটা নতুন ভিয়েতনাম ঘটতে যাচ্ছে। পাকিস্তান তার বর্তমান আকারে টিকে থাকতে পারবে না। তার কারণ আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। একটি বেপরোয়া সরকারের বর্বর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদেরকে সংযুক্ত করে আমরা মানুষ হিসেবে আমাদের মানবতাবাদী, মুক্ত এবং মুক্তিপ্রিয় ভাবমূর্তিকে কলংকিত করছি।” (৩ আগস্ট, ১৯৭১; অনুবাদক- লেখক)

    সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি নিজ সরকারকে তীব্র ধিক্কার দেন পাকিস্তানের নৃশংসতা ও গণহত্যায় সহায়তা করার জন্য। তিনি বলেন–

    It’s a story of indiscriminate killing, the execution of dissident political leaders and students and thousands of civilians suffering and dying every hour of the day….The situation in East Pakistan should be particularly distressing to Americans, for it is our military hardware–our guns and tanks and aircraft–which is contributing much to the suffering”. (১ এপ্রিল, ১৯৭১)

    পাকিস্তানের হামলা হতে বাঁচার জন্য ভারতে আশ্রয় নেয় দশ লক্ষ বাংলাদেশের শরণার্থী। ভারত সরকার তাদের রক্ষার জন্য সীমান্ত খুলে দেয়। ভারতের সাধারণ জনগণ এই বিপন্নদের পাশে এসে দাঁড়ায়। সেই সময় মার্কিন সিনেটের শরণার্থী বিষয়ক সাব কমিটির সভাপতি সিনেটর কেনেডি ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলি দেখে আসার পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক সম্মেলনে তাদের নিদারুণ অবস্থার বর্ণনা এবং তার সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন–

    I am grateful to the members of the National Press Club and to share my experiences during a week long visit to the refugee camps of India–to a scene which only can be described as the most appalling tide of human misery in modern times….Unfortunately the face of America today in South Asia is not much different from its image over the past years in Southeast Asia. It is the image of an America that supports military repression andfuels military violence.

    (জাতীয় প্রেস ক্লাব, ২৬ আগস্ট, ১৯৭১; ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ কংগ্রেসনাল রেকর্ডভুক্ত হয় )

    সত্যের জন্য যারা সংগ্রাম করেন তারা দেশ-জাতি-ধর্ম-বর্ণ দেখেন না। ওই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানও দেখেন না। সত্য বলেন তারা বিবেকের তাগিদে। মানুষ পরিচয়টির সার্থক প্রতিনিধি তারা হন জাগ্রত বিবেকের অনির্বাণ দ্যুতিতে।

    তথ্যসূত্র:

    ১. Christopher Hichens. The Trial of Henry Kissinger. New York: Verso, 2001, p. 45-47

    ২. Jack Anderson with George Clifford.The Anderson Papers. New York: Ballantine Books, 1974, p 296-299

    ৩. http://tajuddinahmad.com/friends-of-bangladesh

    ৪. http://tajuddinahmad.com/us-congressional-records
    ________
    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/14182
  • Biplob Rahman | ২৮ মার্চ ২০১৪ ০৯:৫৯582756
  • শারমিন আহমদ
    জেলহত্যাকাণ্ড: আবদুস সামাদ আজাদের সাক্ষাৎকার (পর্ব-১)
    ডিসেম্বর ২১, ২০১৩

    জেলহত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে ভূমিকা:

    ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম. মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানের নির্মম হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যখন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৭২-৭৩) আবদুস সামাদ আজাদের সাক্ষাৎকারটি পত্রিকায় পাঠাচ্ছি, তখন সারা বাংলাদেশে বইছে চরম অস্থিরতার ঝড়।

    তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার নিরীহ মানুষের রক্তে প্লাবিত হচ্ছে মাঠ-ঘাট-রাজপথ, হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বলছে, ধ্বংস হচ্ছে জাতীয় সম্পদ, ধসে পড়ছে আশা ও স্বপ্ন। শিশু, কিশোর ও তরুণ যারা এই জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের মধ্যকার সব সম্ভাবনা শ্বাসরুদ্ধ হচ্ছে এই নৈরাজ্যপূর্ণ ও কলুষিত রাজনৈতিক আবহাওয়ায়। হরতালে কিশোর মনিরের ভস্মীভূত দেহখানি আমাদের মৌন বিবেকের ওপর আর্তনাদ করে প্রশ্ন করেছে কেন আমরা জাতিগতভাবে মেনে নিচ্ছি এমন অন্যায়-অপরাধ?

    হরতালকারীদের হিংস্রতার আরেক বলি, মাথার খুলি বিদীর্ণ হয়ে নিহত (২৭ নভেম্বর) মনোয়ারা বেগমের কন্যা শোকাহত নাসিমা ধিক্কার দিয়ে বলছে, “একজন রাজনীতিবিদের নাম দাও, যে এই হরতালের সহিংসতায় মৃত্যুবরণ করেছে?” আসলেই তাই, রাজনীতিবিদ যারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে তারা কিন্তু নিরাপদেই রয়েছে। তাদের নিয়োজিত কর্মীবাহিনী দেশকে জিম্মি করে ঘটিয়ে যাচ্ছে এইসব নারকীয় কার্যকলাপ।

    সবই হচ্ছে জনগণের স্বার্থরক্ষার নামে। জনগণের স্বার্থরক্ষার নাম করে যখন জনগণকেই জিম্মি করে তাদেরকে হত্যা ও তাদের জান-মাল ভস্মীভূত করা হয় তখন সেই রাজনৈতিক দল/দলসমূহ হারায় জনগণের প্রতিনিধি হবার বৈধতা ও যোগ্যতা। কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্যেই ঘটছে ব্যতিক্রম। যুগ থেকে যুগে। সে যেই দলই হোক না কেন, পেশীবলে, অর্থবলে, প্রতারণা ও মিথ্যাচার বলে কোনো প্রকার রাজনীতিবিদের সিলটি যদি একবার গায়ে এঁটে যায় তখন তাকে সেই পদ থেকে হটানো হয় মুশকিল।

    জনগণের অর্থ ও সম্পদ ডাকাতি করে,আত্মসাৎ করে (যাকে বলা হয় দুর্নীতি), রাহাজানি, খুন, গুম খুন ও সকল প্রকার অমানবিক কাজ ও অসভ্য আচরণ করেও এই পেশাদার রাজনীতিবিদ ও তাদের অনুসারীরা ভালোমতোই বেঁচে থাকে। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, কিন্তু যেখানে পুরো রাষ্ট্রপরিচালনা পদ্ধতিটিই কলুষিত সেখানে মুষ্টিমেয়র সততা ও ন্যায়নীতি কতটুকুই-বা পরিবর্তন আনতে পারে অথবা তাদেরকে কতদূরই-বা সত্যিকারের কাজ করতে দেওয়া হয়!

    আজ বাংলাদেশে যে চরম নৈরাজ্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার মূল কারণ হল এই আষ্টেপৃষ্ঠে দুর্নীতিগ্রস্ত মানসিকতাসম্পন্ন রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও রাষ্ট্রপরিচালনা পদ্ধতি। তারা জনগণের সেবক হবার বদলে পরিণত হয়েছে ভক্ষকে। স্বাধীনতার মহান আদর্শকে অপমানিত করে ব্যক্তি,পরিবার-স্বজন ও দলীয় স্বার্থে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া ও লালন করা দুর্নীতি, অনাচার ও আইনের শাসনের গতিপথ রুদ্ধ করার প্রবণতা– এই কারণগুলির শিকড় বেয়েই আজ উঠে এসেছে গণহত্যাকারী রাজাকার-আলবদর ও তাদের নির্লজ্জ সমর্থকরা।

    আওয়ামী লীগ উন্নয়ন ক্ষেত্রে (বিশেষত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি) বিএনপির চাইতে অনেক ভালো করেও জনগণের আস্থা এবং জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে উল্লেখিত কারণগুলির জন্য। আর উল্লিখিত কারণগুলিসহ বিএনপির দুঃশাসনের চরম নমুনা সৃষ্টির প্রতিবাদে এক-এগারোই শুধু ঘটেনি এবং গত নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয়নি, তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিজেদেরকে নিক্ষিপ্ত করার আয়োজন করেছে একাত্তরের পরাজিত, পাকিস্তান-সৌদিপালিত সাম্প্রদায়িক ও গণহত্যাকারী দলের বাহন হয়ে।

    তাদের এই অশুভ অ্যালায়েন্স লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যই আজ হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি এবং জামায়াত-এ-ইসলামসহ পবিত্র ধর্মের নাম বিক্রি করে চরম অধর্মপূর্ণ কর্মকাণ্ডের হোতা দলগুলির মধ্যকার আদর্শগত পার্থক্য আজ বিলীন হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের ভাগ্য হয়ে উঠছে জটিল থেকে জটিলতর। আর এমনি একটি অনিশ্চিত সময়ের প্রেক্ষাপটে আমি জেলহত্যার সাক্ষাৎকারের অবতারণা করছি।

    ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলি এমন এক সময়ের ইতিহাস যাকে দল-মতের উর্ধ্বে উঠে বস্তুনিষ্ঠভাবে গবেষণা-বিশ্লেষণ না করা ও তার থেকে শিক্ষা না নেবার বিষয়টিও ছিল অন্যতম এক কারণ, যে জন্যে আমরা আজও পরিগণিত হতে পারিনি সভ্য এক রাষ্ট্ররূপে। যে কারণে আজও বাংলাদেশ লাভ করেনি মানসিক স্বস্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এই বিষয়গুলি নিয়ে আমাদের দেশে মৌলিক গবেষণা হয়নি বললেই চলে।

    আজকে জেল হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত সাক্ষাৎকারটি উল্লেখ করার আগে এক ঝলক চোখ বুলানো যাক সেই সময়টিতে। আজকের প্রজন্ম যারা সেই সময়টি সমন্ধে জানে না বা তাদেরকে আমরা সঠিকভাবে জানাতে ব্যর্থ হয়েছি, বিশেষত তাদের জন্যই সেই ইতিহাসের অতিসংক্ষিপ্ত এই বর্ণনা।

    দেশ যখন স্বাধীন হল তখন যদি সদ্যস্বাধীন দেশটির প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অনুযায়ী, আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখা হত এবং নিজ দলের ভেতর লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী প্রথম বাংলাদেশ সরকারবিরোধী মূল ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হত, তাহলে ভেতরের ও বাইরের কোনো চক্রই তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করতে পারত না। আজকের দুঃখজনক এই প্রসঙ্গেরও অবতারণা হত না।

    ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবারসহ নির্মমভাবে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন, তাঁর মন্ত্রিসভা ও বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী জুনিয়র আর্মি অফিসাররা ক্ষমতা দখল করে। অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখলকারী মোশতাক অর্ডিন্যান্স জারি করে যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না।

    মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী যিনি বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত একদলীয় বাকশালের প্রতিবাদ করে তাতে যোগদান করেননি, তিনি নির্দ্বিধায় বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদে যিনি ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুসহ নারী-শিশুর হত্যাকারীদের অন্যতম মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার পদে নিয়োজিত হন। চিফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তার স্থলভূক্ত হন।

    তিনিও হত্যাকারীদের বিরদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেন না; বরং হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না এই অর্ডিন্যান্সকে পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হবার পর সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনীর (৬ এপ্রিল, ১৯৭৯) মাধ্যমে বৈধতা দেন (বলাবাহুল্য, কোনো অন্যায় কখনওই আইনত বৈধ হতে পারে না, তা একদিন বাতিল হতে বাধ্য)।

    ১৫ আগস্টে হত্যাকাণ্ডের দুইমাস বিশ দিন পর ৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (লেখার শুরুতেউল্লেখিত) মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুর চার সহকর্মী নিহত হন। ওই একই রাতে অবৈধ মোশতাক সরকার ও বঙ্গভবন দখলকারী হত্যাকারী সেনা অফিসারদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং জিয়াকে গৃহবন্দী করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এক রক্তপাতহীন অভ্যুথানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন।

    তার মাত্র চার দিন পরে, ৭ নভেম্বর সিপাহী বিদ্রোহে (এই দিনটিকে সিপাহী-জনতার অভ্যূত্থান বলা হলেও, আসলে এই বিদ্রোহটি ছিল বামপন্থী জাসদ সংগঠিত এবং জনতার অংশগ্রহণ এতে ছিল না) নেতৃত্বদানকারী কর্নেল তাহের জিয়াকে মুক্ত করেন। ওই একই দিন খালেদ মোশাররফ ও তাঁর দুই সহকর্মী কর্নেল নাজমুল হুদা ও কর্নেল এ টি এম হায়দার নিহত হন।

    তাদের বিরুদ্ধে অভ্যূথানকারীরা এই অপবাদ ছড়ায় যে খালেদ ও তার অনুগামীরা ভারতের দালাল। যারা খালেদ মোশাররফ সমন্ধে কিছুটা ধারণা রাখেন তারা জানেন যে এই অকুতোভয় স্বাধীনচেতা বীর মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে ওই কথাটি ছিল অপপ্রচার মাত্র।

    পরবর্তীতে জিয়াকে মুক্তকারী, কর্নেল তাহেরকেই এক প্রহসনমূলক গুপ্ত বিচারের মাধ্যমে জিয়া ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে একাত্তরের পরাজিত ঘাতক-দালালদের পুনর্বাসিত করেন। জিয়াউর রহমান পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর মেজর জেনারেল মঞ্জুর নির্দেশিত আরেক ব্যর্থ সেনা অভ্যূথানে নিহত হন। জিয়ার বিএনপি সরকারকে এক রক্তপাতহীন ক্যু-এর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসেন ১৯৮২ সালে।

    এই এতগুলো বছরেও জাতির জনক ও স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার নেতা, যারা গোটা জাতিরই নেতা, তাদের হত্যার কোনো বিচার হয় না। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও চৌদ্দ বছর; আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ একুশ বছর পর পুনরায় ক্ষমতায় আসার সময় পর্যন্ত।

    ১৯৮৭ সালে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসে জেল হত্যাকাণ্ডের ওপর তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করি তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করি যে এই সম্পর্কে হত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ বার বছর পরেও তথ্য, উপাত্ত এবং প্রমাণসহ গবেষণামূলক কোনো লেখনী প্রকাশিত হয়নি। জেল হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী ব্যক্তিবর্গ এবং এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার, ইতিহাসের উপাদান হিসেবে যার গুরুত্ব অনেক, তা সংগ্রহ করে জাতিকে জানাবারও কোনো প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি।

    জাতির বিবেককে যারা নাড়া দেবেন বলে আশা করা যায় সেই বুদ্ধিজীবী সমাজ এই বিষয়টি সমন্ধে জানতে এবং জানাতে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেননি। আমাদের এমনিতর ইতিহাস সংরক্ষণ চেতনার অভাবের কারণেই তো ঘটে যায় আরও নির্মমতা এবং জাতি ঘুরপাক খায় বিভ্রান্তিতে। বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা কলামে, প্রখ্যাত কলামিস্ট আবু জাফর শামসুদ্দীন, জাতীয় ইতিহাসের মর্মান্তিক ঘটনাবলী সম্পর্কে আমাদের এই সম্মিলিত উদাসীনতা ও অবহেলাকে চিহ্নিত করে জাতির কাছে কিছু প্রশ্ন রেখেছিলেন। জেলহত্যা দিবসে তিনি লিখেছিলেন–

    “কী দোষ করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর তিন সহকর্মী এ প্রশ্নের জবাব এ পর্যন্ত কোনো সরকার দেয়নি। আমরা দেশবাসীও সোচ্চার হয়ে এ প্রশ্ন করিনি এবং তার জবাব চাইনি। এই যে প্রশ্ন করিনি এবং তার জবাব চাইনি এটাও আমাদের লজ্জার বিষয়– গণতন্ত্রের সমর্থকরূপে প্রশংসিত নাগরিকদের কর্তব্যকর্মে চরম ঔদাসীন্য ও অবহেলার প্রমাণ।” (সংবাদ , ৫ নভেম্বর, ১৯৮৪)

    ঢাকায় পৌঁছে আমি যাদের কাছ থেকে তথ্য সংগহ করি ও সাক্ষাৎকার নিই তারা হলেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৭২-৭৩) আবদুস সামাদ আজাদ, জেলহত্যা তদন্ত কমিশনের সদস্য, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি কে এম সোবহান (৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়) স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এ এস মহসীন বুলবুল, ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক (ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নির্দেশে তিনি জেল হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ডিআইজি প্রিজনস আবদুল আউয়ালের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার নেন) ও প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমিন।

    উল্লিখিত প্রথম ও তৃতীয় সাক্ষাৎকারদাতা ১৯৭৫ সালে চার নেতার সঙ্গে জেলে বন্দি ছিলেন। এছাড়াও তাজউদ্দীন আহমদের শৈশব ও ছাত্রজীবন সম্পর্কে ওনার শিক্ষক ও ভাই-বোনদের সাক্ষাৎকার নিই। পঁচাত্তরে জেলে কর্মরত কর্তৃপক্ষর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। আরও যাদের সঙ্গে দেখা হয় তারা সে সময় আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

    বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকারী লে. কর্নেল ফারুক ও রশীদ তখন দেশে ফিরে ফ্রিডম পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা প্রকাশ্যেই শেখ মুজিবের মরণোত্তর বিচার করবে বলে হুমকি দিচ্ছে। লে. কর্নেল ফারুক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯৮৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছে। মোশতাক দুর্নীতির দায়ে জেল খেটে বেরিয়ে তার আগা মসীহ লেনের বাড়িতে বহাল তবিয়তেই আছে (তাকে হত্যাকাণ্ডের জন্য বিচারের মুখোমুখি কখনওই দাঁড়াতে হয়নি, তার আগেই সে মৃত্যুবরণ করে)।

    সুতরাং এই পরিস্থিতিতে, অনেকেই যে কোনো তথ্য বা সাক্ষাৎকার দিতে অপারগতা প্রকাশ করবে সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। তারপরেও সেদিনের সাক্ষাৎকার হতে জেলহত্যা সম্পর্কে যে চিত্রটা মনে অস্পষ্ট ছিল তা অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জেল থেকে চিরতরে ও রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যাওয়া তাজউদ্দীন আহমদের মহামূল্যবান ও ঐতিহাসিক ডায়েরিটি কে নিয়েছিল সে সমন্ধেও জানতে পারি।

    ১৯৮৭ তে সংগ্রহকৃত তথ্যাবলীর ভিত্তিতে রচনা করি “৩ নভেম্বরের জেলহত্যা ও বিবেকের আত্মাহুতি” প্রবন্ধ যা ১৯৮৮ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত প্রথম নিয়মিত সাপ্তাহিক ‘প্রবাসী’ পত্রিকা এবং পরে বাংলাদেশের অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিন বছর পরে, ১৯৯১ সালে আমার ছোটবোন সিমিন হোসেন রিমি বহু কষ্টে অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি প্রিজনসের ঠিকানা যোগাড় করে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে সমর্থ হয়। ডিআইজিসহ অবসরপ্রাপ্ত আইজি প্রিজনস নুরুজ্জামান, জেলর আমিনুর রহমান ও সুবেদার ওহায়েদ মৃধার সাক্ষাৎকার সে ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় এবং তার লেখা “আমার ছোটবেলা, ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ” বইয়ে প্রকাশ করে।

    বলাবাহুল্য যে, নিজ পিতা ও তাঁর তিন সহকর্মীর নির্মম ও অন্যায় হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজটি মনের দিক থেকেও সহজসাধ্য ছিল না। তারপরেও করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি অন্যন্য সংগঠক এক অসাধারণ চরিত্রের বাবার প্রতি অসীম ভালোবাসা থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের তাঁর তিন সহযোদ্ধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা হতে। রক্তস্নাত নির্মম অতীতের উত্তরসূরী, দিশাহীন এই বর্তমানের অন্ধকারাচ্ছন পথটিতে, নতুন প্রজন্ম একদিন আশা ও শান্তির আলো ছড়াবে সেই পরম প্রত্যাশা হতে।

    আবদুস সামাদ আজাদের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার (প্রথম অংশ)

    এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় উনার কলাবাগানের বাসায়, ১৯৮৭ সালের ৫ জুলাই। সে সময় আমার সঙ্গে ছিলেন আমার মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন।

    শারমিন আহমদ: ১৯৭৫ সালের কোন সময় আপনি জেলে যান?

    আবদুস সামাদ আজাদ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর আমাকে ইন্টার্ন করে রাখল। তার বোধহয় ৭ দিন পর, যতদূর মনে হয় শবেবরাতের রাত ছিল, নামাজ পড়েছি সারারাত, রোজাও রেখেছি। সকালবেলা সূর্য তখনও উদয় হয়নি, হঠাৎ পিয়ন এসে বলল, ‘একজন অফিসার এসেছে’। সঙ্গে দেখি আরও অফিসার এসেছে। তারাও ঘুম থেকে উঠে এসেছে। তারাও ঘটনা উপলব্ধি করতে পারছে না।

    তারা বলল, ‘স্যার আপনাকে আমাদের নিয়ে যেতে হবে’। আমার সন্দেহ হল। এর আগেও ঘটনা হয়েছে দুই একটা। আমি বললাম, ‘আমি কাপড়-চোপড় চেঞ্জ করে আসি’। তারা বলল যে, ‘আরও নেতাদের নেওয়া হবে তো, সেইভাবেই আসেন’। আমি তখন একটা ব্যাগে কাপড়-চোপড় ভরে এলাম। আমাদের বাড়ির কাছেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারা একটি কন্ট্রোল রুম করেছে। সেখানেই তারা নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান সাহেব—ও আরও কিছু লোক অন্য রুমে আছেন। আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। মোট ২৬ জন লোক। ১০ মিনিট পর দেখি তাজউদ্দীন সাহেব এলেন।’

    শারমিন আহমেদ: দিনটি ২২ আগস্ট ছিল?

    আ সা আ: হ্যাঁ, ২২ আগস্ট। তো তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমরা দুজন আলাপ করলাম। কেন এনেছে, কী ব্যাপার– উনি তো কেবিনেটেও ছিলেন না। (দল ও সরকার পরিচালনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মতবিরোধের কারণে তাজউদ্দীন আহমদ ২৬ অক্টোবর, ১৯৭৪ অর্থমন্ত্রীর পদ হতে ইস্তফা দেন) একটু পরেই (মেজর শরিফুল হক ডালিম) ডালিম এল। কামরুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে কথা বলে গেল। তখন কামরুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করলাম– ‘এ কে?’ বললেন, ‘এ-ই ডালিম’।

    তখনও জানি না কী করবে না করবে, মেরে ফেলার জন্য এনেছে না কী করবে। একটু পরে (মেজর আবদুর রশীদ) রশীদ এল। সে ইলেকট্রিক কানেকশন আছে কিনা লোক লাগিয়ে পরীক্ষা করল। এরপর সৈয়দ হোসেন সাহেব এলেন। উনি আগেই অ্যারেস্টেড ছিলেন।

    শা আ: সৈয়দ হোসেন কে?

    সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন: বঙ্গবন্ধুর—-

    আ সা আ: বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি। তো ওনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রশীদ বলছিল, “আপনাকে আমরা এনেছি, আপনি তো কারাগারেই আছেন–”(টেপের এই অংশটি অস্পষ্ট)। পরে আমরা জানতে পারলাম, রশীদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল আমাদের মেরে ফেলবে। এমন ভাবসাব। কারণ ইলেকট্রিক ওয়্যারিং-টয়্যারিং করছে। একটু পর দেখি ফটোগ্রাফার এল।

    একজন ফটোগ্রাফার আমার সঙ্গে অ্যাটাচড ছিল (বঙ্গবন্ধু প্রশাসনে মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে) সে বলল, ‘স্যার, আমাদেরকে ঘুম থেকে উঠিয়ে এনেছে’। তারপর দেখি টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানও আছে। তারপর রশীদও চলে গেল। আমরা ভাবছি কীসের জন্য আনল না আনল-–এর মধ্যেই আরেকজন এসে বলল, ‘আপনারা চলেন’। বললাম, ‘কোথায়?’ সে বলল, ‘ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে?’

    শা আ: কে এসে বলল?

    আ সা আ: কোনো এক অফিসার। মিলিটারি অফিসার। বলল, ‘সেন্ট্রাল জেলে চলেন।’ তারপর আমাদেরকে কারে নিল। এই পাঁচ জনকে কারে নিল।

    শা আ: আব্বুর সঙ্গে কি আপনি ছিলেন?

    আ সা আ: হ্যাঁ, আমি, তাজউদ্দীন সাহেব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান সাহেব।

    সৈ জো তা: আহহা! (দুঃখ প্রকাশ)

    আ সা আ: আমরা তো সেন্ট্রাল জেলে ঢুকলাম ওইদিনই এগারোটা সাড়ে এগারোটায়। দিনের বেলা।

    শা আ: বেলা এগারোটা সাড়ে এগারোটা?

    আ সা আ: মনে হয় ওই রকমই সময়।

    শা আ: আব্বুকে ধরে নিয়েছিল ২২ আগস্ট বেলা–

    সৈ জো তা: ৮ টায়।

    আ সা আ: মনে হয় তখন রোদ উঠে গিয়েছিল। সেন্ট্রাল জেলে গিয়ে ঢুকলাম। কী সিচুয়েশন! সমস্ত জেলখানায় কয়েদীদের তালা বন্ধ করে রেখেছে। আমরা সলেম্ন অবস্থায়– কী হবে না হবে। আমি, তাজউদ্দীন সাহেব তো আগে থেকে জেলখাটা লোক। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কয়েদিরা হৈচৈ করছে জানালা দিয়ে। জাসদ আছে, নকশাল আছে, তারা নাম ধরে ধরে ডাকছে। এরপরে আমাদের অ্যাপ্রুভার সেলে রাখল।

    শা আ: কী সেল?

    আ সা আ: অ্যাপ্রুভার। ওই যে রাজসাক্ষী হয়। খুব খারাপ সেল। ২০ নম্বর ওয়ার্ড। আমি প্রটেস্ট করলাম। এখানে থাকব না। আমরা তো জেল খেটেছি। সব ওয়ার্ড জানা আছে। জেলর বলল, “স্যার, জায়গা তো নাই। আপনাদের তো আলাদা রাখতে হচ্ছে।” জেনারেলি এইসব হৈচৈ-এর মধ্যে সৈয়দ সাহেবেরা বাহির হতে চান না। আমরা তো জেল খেটেছি।

    শা আ: সৈয়দ নজরুল কি এর আগে জেল খাটেননি?

    আ সা আ: সৈয়দ সাহেব তো জেল খাটেননি। এই অবস্থায় আমাদেরকে নিল পরে।(অন্য জায়গায়) আইজির অফিস ছিল একটা এরিয়ায়। সেটা তখন অফিস নাই। সেই বিল্ডিংটাকে (অফিস) খালি করে করে আমাদেরকে নিয়ে গেল বিকালবেলায়। সেটার নাম নিউ জেল। সেই জেলে রাস্তাও ছিল না, বাগানও ছিল না। তাজউদ্দীন সাহেব নিজেই বাগান করেছেন।

    শা আ: যে সময় (ওখানে) ছিলেন তখুনি আব্বু বাগান করেছিলেন?

    আ সা আ: হ্যাঁ। দুই মাস পর্যন্ত, বড় বাগান। কয়েদীদের নিয়ে নিজেই মাটি খুঁড়তেন। সুন্দর বাগান করেছিলেন। এরিয়াটাকে খুব সুন্দর করা আরকি। নিট এন্ড ক্লিন করা। ওটা বাজে জায়গা ছিল। ড্রেনগুলি পচা ছিল। সেগুলিকে সুন্দর করেন। এইভাবে জেলখানার জীবন চলছে। নানা রকমের রিউমার ডেইলি যায়। প্রথমদিকে ইন্টারভিউ দিচ্ছিল না। পরে ইন্টারভিউ দেওয়া শুরু হল। আমাদের সকলেরই।

    শা আ: কে ইন্টারভিউ দেওয়া শুরু করল?

    আ সা আ: আমাদের ফ্যামিলির সঙ্গে ইন্টারভিউ। আমাদের সঙ্গে ফ্যামিলি মেম্বাররা দেখা করা আরম্ভ করল।

    সৈ জো তা: আমাদেরকে প্রথমদিকে দেখা করতে দেয়নি (অন্যদের সাক্ষাতের অনুমতি আগে মিললেও একমাস পরে তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারকে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া হয়)।

    আ সা আ: হ্যাঁ, প্রথমদিকে দেয়নি। পরে ইন্টারভিউ দেয়। তারপরে ফ্যামিলি মেম্বারদের সঙ্গে যতটুকু সময় কাটাই, ফ্যামিলির সমস্যা ছাড়াও, বাইরের খবর-টবর কী অবস্থা এই সব জানি। ওরা তখনও আছে বঙ্গভবনে– মোশতাক, রশীদ, ফারুক (তদানীন্তন মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান)। এরা আছে এই খবর-টবর পাই। তার কিছুদিন পরে, প্রায় দুই মাস (তখন) হয়ে গিয়েছে, কোনো পরিবর্তন কি হবে? আমরা কি ছাড়া পাব? (এই চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়)
    (অস্পষ্ট) —–ইনভেসটিগেশন শুরু করেছে স্পেশালি আমাদের এই কজনের। এখানে (ইনভেস্টিগেশনে) মিলিটারি অফিসারসহ চার-পাঁচজন বসেছে। তারা আমাদেরকে প্রশ্ন করে।

    শা আ: তারা কী ধরনের প্রশ্ন করে?

    আ সা আ: এই সমস্ত পার্সোনাল (বিষয়)– কার কোথায় কী আছে, না আছে। আমাদের বাড়ি-ঘর-প্রপার্টি ইত্যাদি সমন্ধে স্টেটমেন্ট দিতে হয়। ইনভেস্টিগেশন আর কি। পুলিশের লোক দুইজন আছে। বাকি মিলিটারি। জেলগেটেই।

    সৈ জো তা: রাজনৈতিক অবস্থার ওপর তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে কী বলতেন?

    আ সা আ: এটা পরে আলাপ করব। পলিটিক্যাল আলাপটি পরে করব। তোমার সঙ্গে (শারমিন আহমদকে লক্ষ্য করে) আলাপ করব আরেক সিটিংয়ে।

    শা আ: আমি পুরো ঘটনাটি টেপ করে রাখতে চাচ্ছি। সে সময় কী পরিস্থিতি ছিল? হয়তো একদিন আমি বেঁচে থাকি কি আপনি বেঁচে থাকেন, কিন্তু ইতিহাস বেঁচে থাকবে।

    আ সা আ: তারপরে আমাদেরকে প্রথমে ডিভিশন দেয়নি। প্রথম রাতে আমরা সাধারণ ঘরে—

    শা আ: প্রথম কতদিন ডিভিশন দেয়নি?

    আ সা আ: প্রথম দিন ও রাতটা ডিভিশন দেয়নি। পরদিন, বোধহয় একদিন পরেই আমাদেরকে ডিভিশন দিয়ে দিল। ক্লাস ওয়ান। প্রথম রুমটা ছিল ছোট। সবাই এই রুমে প্রথমে উঠেছিল। এরপরেই ওই বিল্ডিঙে আরেকটা রুম। তারপরে বড় রুমটা। ওই রুমটায় আমি চলে গেলাম। আমার সঙ্গে মনসুর আলী সাহেব ছিলেন (নিউ জেল বিল্ডিং)।

    শা আ: আপনি কত নং রুমে ছিলেন?

    আ সা আ: তিন নাম্বার রুমে।

    শা আ: তিন নাম্বার রাজবন্দিদের?

    আ সা আ: এই বিল্ডিঙটা আইজির অফিস ছিল। জেলের ভিতরেই। পরে নিউ জেল নাম দেয়। এটা, ফাঁসি দেয় যে এরিয়ায়, সেটা পার হয়ে– আরেকটা ওয়াল আছে, তারপরে এটা। সেটাতেই আমাদের জন্য জেল বানায়।

    শা আ: আইজির অফিসের তিন নাম্বার রুমে ছিলেন?

    আ সা আ: না। একটা বিল্ডিং আছে আইজি অফিসের। সেই বিল্ডিঙের তিনটা রুম। প্রথম রুম হল— আমরা নিজেরাই (নাম্বার) বলতাম আর কি। প্রথম রুমটায় গিয়ে বসলাম। সবাই ওই রুমে গিয়ে বসলাম। সন্ধ্যার দিকে দেখলাম ওই রুমে তো থাকা যাবে না। মাঝের রুমে গেলেন কামরুজ্জামান ও আরও কিছু লোক। লাস্ট রুমটায় আমি গেলাম। মনসুর আলী বললেন, ‘আমি সেখানে থাকব’।

    শা আ: আব্বু কোন রুমে থাকতেন?

    আ সা আ: এই প্রথম রুমটায়। এই রুমটা ইতিহাস!

    (বড় মর্মান্তিক ইতিহাস। এই এক নম্বর রুমটিতে অন্যান্যদের সঙ্গে থাকতেন তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বঙ্গভবন থেকে মোশতাক-রশীদের নির্দেশপ্রাপ্ত হত্যাকারীদের আদেশে দুই নম্বর অর্থাৎ মধ্যের রুম থেকে কামরুজ্জামান সাহেব এবং তিন নাম্বার বা শেষ রুম থেকে মনসুর আলী সাহেবকে প্রথম রুমে নিয়ে যায় জেল কর্তৃপক্ষ। বাকি নেতৃবৃন্দদের ওই রুম থেকে সরিয়ে রাতের গভীরে মুক্তিযুদ্ধের চার নেতাকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।)

    শা আ: আব্বুর সঙ্গে কেউ ছিলেন?

    আ সা আ: হ্যাঁ, কিছু গেলেন এখানে (প্রথম রুমে) আর সবাই রইলেন তিন নম্বর রুমে। বিল্ডিঙটা এভাবে লম্বা। এই রুমটা পয়লা পাওয়া যায়। এরপর দুই নম্বর সেখানে কামরুজ্জামান ও সঙ্গে আরও কিছু লোক– সঙ্গে যারা ছিল– মায়া (শ্রমিক লীগের নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী) ও আরও কয়জন। আর লাস্ট রুমে– এটা বড় রুম– তিন নম্বর– আমরা বলি আর কি। জেলের নম্বর কী আছে আমরা জানি না। তারপর সেই রুমে প্রথমে আমি আর মনসুর আলী পরে আরও বহু লোক (গেলেন)।

    শা আ: আর সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব কোথায় থাকতেন?

    আ সা আ: ওই এক নম্বর রুমে। সৈয়দ সাহেব, তাজউদ্দীন সাহেব, শেখ আবদুল আজীজ, মাখন (ছাত্রনেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন), কোরবান আলী, শেষ পর্যন্ত যারা ছিল আর কি। মোট ৮ জন ছিল।

    শা আ: দ্বিতীয় রুমে কামরুজ্জামান —

    আ সা আ: কামরুজ্জামান ও আদার্স, প্রায় ১২ জন। তৃতীয়টায় যারা আসত (জেলে) তারা ওখানে যেত। কারণ বড় রুম তো। যেমন জোহা সাহেব–

    সৈ জো তা: জোহা সাহেব তো অনেক পরে গেলেন।

    আ সা আ: হ্যাঁ, পরে গেলেন। তিন নম্বর রুমে জায়গা বেশি ছিল। তারপর ১ তারিখে আমাদের ইন্টারভিউ হচ্ছে– বিভিন্ন খবরাখবর পাই—

    শা আ: ১ তারিখ কোন মাসের?

    আ সা আ: নভেম্বর মাসের। পয়লা নভেম্বর। জেলার–

    শা আ: জেলরের নাম কী?

    আ সা আ: মনে হয় মোখলেসুর রহমান। গোপালগঞ্জ বাড়ি। (সঠিক নাম আমিনুর রহমান যা পরে জানতে পারি) এখনও আছে।

    শা আ: এখন উনি কোথায় আছেন?

    আ সা আ: —-(অস্পষ্ট) সুপারিটেনডেনট ছিল। এখন কোথায় আছে জানি না।

    শা আ: আর ডিআইজি প্রিজনের নাম জানেন?

    আ সা আ: আউয়াল সাহেব (আবদুল আউয়াল), আর আইজি (প্রিজনস) ছিলেন নুরুজ্জামান।

    শা আ: তারপর কী হল? পয়লা নভেম্বর?

    আ সা আ: পয়লা নভেম্বর তাজউদ্দীন সাহেবের ইন্টারভিউ ছিল (বেগম জোহরা তাজউদ্দীনের সঙ্গে)। উনি ডায়েরি লিখতেন। তো বিকালবেলায় আমি ও ইনি একটু বেড়াতাম। সকালেও বেড়াতাম, বিকালেও ওই এরিয়ার ভেতরে। বেড়াবার সময় যা কথাবার্তা হত। মাঝে মাঝে মিলাদ পড়াতাম, খতম পড়তাম। এই সব সময় বসতাম। পার্সোনাল আলাপ-টালাপ হত বেড়াবার সময়। তো ওই দিন বিকালবেলা (১ নভেম্বর) তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে প্রথম বললেন যে, ‘‘জেলটা আমার যেন মনে হচ্ছে যে রেডক্রসে নিলে ভালো হয়। রেডক্রসের হাতে না নিলে জেলটা মনে হচ্ছে ডেঞ্জারাস—-”

    শা আ: মাই গড! আব্বু এটা বললেন যে জেলটা–

    আ সা আ: এটা পুরা একটা ইমপ্রেশন। ওনার ইমপ্রেশনটা বললেন। তারপর আমাকে বললেন, “আপনি দেখেন একটা কিছু করা যায় কিনা। আমিও চেষ্টায় আছি। আপনিও চেষ্টা করেন।”

    সৈ জো তা: ইশশ! কী আতঙ্ক ঢুকে গিয়েছিল! বুঝে গিয়েছিলেন–

    শা আ: ওহ! তখুনি আব্বু বুঝতে পেরেছিলেন—

    সৈ জো তা: উনি বুঝে গিয়েছিলেন যে জেলে সিকিউরিটি নেই–

    আ সা আ: তখন তো উল্টা আমাদেরকে খবর দেওয়া হয়েছে যে চার পাঁচ দিনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে। তাজউদ্দীন সাহেব তো সেদিন কথায় কথায় ওনার ইমপ্রেশন বললেন যে, “আপনিও চেষ্টা করেন আমিও চেষ্টা করি যে কোনোভাবে রেডক্রসে খবর পৌঁছানো যায় কিনা।”

    তারপর সন্ধ্যার পর মনসুর আলী সাহেব আমার পাশের সিটে ছিলেন (৩ নম্বর রুমে পাশাপাশি বিছানায়)। উনিও একটু আনমনা। আমাকে বললেন, “সামাদ সাহেব, কী যে এরা খবর-টবর বলে। এমনি কথায় কথায় শোনা যায় যে মনে হয় ছেড়ে দেবে– কোনো কেইস তো (দোষী সাব্যস্ত করে কেইস) দাঁড় করাতে পারছে না”। কিছুটা প্রাইভেটলি ওই জেলের ভেতর থেকে খবর যায়।

    শা আ: মনসুর আলী সাহেবের সঙ্গে কথা হয় সেদিন সন্ধ্যায়?

    আ সা আ: হ্যাঁ। সে তো আমরা এক রুমে থাকি। মনসুর আলী সাহেব ও আমি পাশাপাশি। মনসুর আলী সাহেব বললেন “সামাদ সাহেব আমাদের জেলখানাটা– মিলিটারির লোকরা আসে যায়—”।

    একদিন রাতে আমাদের সবাইকে (জেল কর্তৃপক্ষ) এসে জানিয়ে গেল যে কিছু মিলিটারির লোকরা যাবে তো– এখানে গান বাজনা— বাচ্চারা তো গান-টান গায়– ছেলেরা (তরুণ রাজবন্দিরা সময় কাটানোর জন্য কখনও একত্রে গান গাইতেন), একটু হৈচৈ কম হলে ভালো হয়– এইসব বলছিল। দুইদিন আগে দেখেছিলাম যে রাতে কিছু মিলিটারির লোক ওইসব (নিউ জেল) এরিয়া দেখেছিল।

    শা আ: ওইসব এরিয়া টহল দেয়?

    আ সা আ: না, না– দেখতে গিয়েছিল। তখন তো কোনো গভরমেন্ট নাই। জেল কর্তৃপক্ষ জানে না তারা কী করছে। তারা এসে জানাল, “আজ রাতে মিলিটারির লোক এসে এরিয়াটা প্রদর্শন করবে।” আমরা তো তখন মিলিটারির রাজত্বে। খুব কড়া রাজত্ব। মোশতাকের গভরমেন্ট (নামে মাত্র সিভিলিয়ান গভরমেন্ট)– তারপর আনফরচুনেটলি মোশতাক ছিল আওয়ামী লীগের। মোশতাকের কেবিনেটও আওয়ামী লীগেরই। তার মানে আগে যারা মেম্বার (ছিল) তারাই মেম্বার ছিল কেবিনেটে।

    তারপর মনসুর আলী সাহেব আমাকে বললেন রেডক্রসে খবর দিতে। আমি বললাম– “হ্যাঁ, তাজউদ্দীন সাহেবও আমাকে বলেছেন। দেখি আমি পারি কিনা।”

    [চলবে]

    কোস্তারিকা, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/13989
  • Biplob Rahman | ২৮ মার্চ ২০১৪ ১০:০১582757
  • শারমিন আহমদ
    জেলহত্যাকাণ্ড: আবদুস সামাদ আজাদের সাক্ষাৎকার (পর্ব-২)
    জানুয়ারী ৩০, ২০১৪

    দ্বিতীয় অংশ

    এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় উনার কলাবাগানের বাসায়, ১৯৮৭ সালের ৫ জুলাই। সে সময় আমার সঙ্গে ছিলেন আমার মা প্রয়াত সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন। প্রথম অংশটি প্রকাশ হয়েছে ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩, মতামত-বিশ্লেষণের এই পাতায়। এটি দ্বিতীয় অংশ।

    [প্রথম অংশটির লিংক দেখুন--

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/13989]

    আ সা আ: ময়েজউদ্দীন (আহমেদ, এমপি) সাহেব ছিলেন রেডক্রসের সঙ্গে কানেকটেড। আমি রাতেই– আমার যে চ্যানেল ছিল– (গার্ডের মাধ্যমে খবর) পাঠাবার মতো যে চ্যানেল করেছিলাম– সে আসবে কিনা– (কিন্তু) ও এসেছে। আসার পর, রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে আমার ঘুম ভাঙল। রাত দুইটা কি আড়াইটায় ঘুম ভাঙল। (রাত) একটায় ঘুমালেও দুইটা কি আড়াইটায় ঘুম ভাঙত। আমার জানালার সামনে– আমাদের জেলখানার জানালার কাছাকাছি তারা আসত।

    শারমিন আহমেদ: কারা?

    আবদুস সামাদ আজাদ: ওই ডিউটি যারা করত। আমাদের জেলখানার সামনে একটা বারান্দা ছিল–

    শা আ: সে জন্য তারা (ঘরের দরজার সামনে) আসতে পারত না–

    আ সা আ: সে জন্য একটা ডাবল লকআপ হয়ে যেত। আমাদের রুমটা লকআপ হত। বারান্দাটাও লকআপ হত (বারান্দার গেইট)। সুতরাং বারান্দার ওই দিক থেকে কথা বলত। কোনো জিনিস পাস করতে অসুবিধা হয়। কোনো একটা চিঠি দিতে হলে ঢিল দিত। কিন্তু বারান্দা থেকে যদি সেটা পড়ে যায়– আমি তো সেটা রিসিভ করতে পারছি না।

    শা আ: কারা দিত আপনাকে চিঠিপত্র?

    আ সা আ: (অস্পষ্ট) সরকারের লোক– জেলখানার নিয়মেই আমরা (চ্যানেল) করে ফেলি। যারা জেল-টেল খাটি, আমরা খবর-টবর দেবার (অস্পষ্ট) (চ্যানেল তৈরি করেন)।

    শা আ: কিন্তু আপনারা (খবর) দিতে পারতেন না বারান্দাটার জন্য?

    আ সা আ: রাতে এই অসুবিধা হত।

    শা আ: জেলখানার বারান্দার মধ্যে লকআপ ছিল?
    জেলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার জাতীয় চার নেতা

    জেলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার জাতীয় চার নেতা

    আ সা আ: হ্যাঁ, লকআপ ছিল। ডাবল ব্যারিয়ার। দূর থেকে দিতে হত ঢিল দিয়ে। যদি আমি রিসিভ করতে না পারি তাহলে সকালে (অন্য গার্ডরা) এসেই যদি পেয়ে যায় তাহলে ধরা খেয়ে যাব। সে জন্য সাবধান থাকতে হত। তো বারান্দার ওখানে নামাজ পড়ছি, তখন সে লোকটা (নাইটগার্ড) এল, যে লোকটা আমার চিঠি নেয়।

    তো সে আসছে। আমি বললাম যে আমার একটা চিঠি (আছে)। সেই লোকটা মসজিদে নামাজে যেত। ইমাম সাহেবের কাছে (চিঠি) দিয়ে আসত। ইমাম সাহেব আবার বাসায় পৌঁছে দিত। এটা (চ্যানেল) এসটাবলিশ করতে সময় লাগে। আমি গিয়েই করেছি। সেজন্যই তাজউদ্দীন সাহেব জানতেন যে আমি পারব।

    তো আমি একটা চিঠি (জানালাপথে) ময়েজউদ্দীনের কাছে পাঠালাম। আমি লিখে পাঠালাম যে, “জেলের পরিস্থিতিটা ভালো লাগছে না। অতিসত্ত্বর চিঠি পাওয়া মাত্র তুমি জেলখানাটাকে রেডক্রসের আওতায় আনা যায় কিনা সেটার একটা চেষ্টা কর।”

    তখন তো কোনো আইন নাই, কানুন নাই, whole আর্মি এটার মধ্যে নাই। তারা ক্যান্টনমেন্টে। আর এই লোকগুলি বঙ্গভবন দখল করে বসে আছে– ট্যাংক কয়েকটা নিয়ে। আর ক্যান্টনমেন্টে যারা আছে তারা তো আরেক কমান্ডে। তাদের কমান্ড তো এদের উপর নাই। এদের কমান্ড আবার ওদের উপর নাই (দলছুট জুনিয়র আর্মি ও মোশতাক-চক্র বঙ্গভবনে)।

    এই ছিল একটা অবস্থা। এই অবস্থায় তারা যে কোনো জিনিস, পাগলামি করে করে ফেলতে পারে। মেরে ফেলতে পারে। এই যে একটা চিন্তা– পরিস্থিতি, যে নেক্সট কোনো গভরমেন্ট হবার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে (স্বীকৃত) যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের পিলার– তাদেরকে এই কারণে এলিমিনেট করে দিতে পারে। এই যে একটা মনোভাব– এটা খুব ইনফরমেশনভিত্তিক না– এটা একটা গেসওয়ার্ক।

    তো আমি ১ তারিখ রাতে ওকে পেলাম। আমার চ্যানেল এসে গিয়েছে ডিউটিতে, তাকে (চিঠি) দিয়ে দিলাম। সে বলল, “স্যার, কাল আমি নামাজে যাব।”

    তাকে তো বলতে হয় না। এর আগেও নিয়ে গিয়েছে। উত্তরও এসেছে।

    শা আ: সেটা কি ২ তারিখ রাতে না ১ তারিখ রাতে?

    আ সা আ: ১ তারিখ রাতে। তারপর ২ তারিখ গেল। ২ তারিখ নভেম্বরের। অ্যাকজাক্ট অবস্থাটা তোমাকে বলি। আমাদের যে বিল্ডিংটা, এরপরে কিচেন, তারপরে আরেকটা এরিয়া আছে যেখানে বেশিরভাগ আমাদের লোক (রাজবন্দী) থাকত। সেই জায়গায় আরেকটা দিক আছে– (অস্পষ্ট) তার ডান দিকে ডেপুটি সুপারিনটেন্ডের বাড়ি ছিল। এই আমাদের এলাকায়।

    তো বাড়িটা এরিয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো। তো জানালাগুলি বন্ধ রাখত। যাতে ওখান থেকে কেউ কথা না বলতে পারে। পাকা রাস্তা আছে। পাকা রাস্তা আমরা করেছিলাম (অস্পষ্ট) হাতে। ওখানে ছায়া আছে। ওখানে টেবিল-চেয়ার নিয়ে বিকালবেলা তাজউদ্দীন সাহেব খুব নিরিবিলিতে কী লিখছেন। ওই ডায়েরি লিখছেন। খুব একবারে— (নিবিষ্ট মনে) একটা কথার জবাব একবারে দিচ্ছেন। পাল্টা যে আরও কিছু কথা কওয়া– বলছেন না।

    শা আ: কোথায় লিখছেন? ওই ছায়াতে বসে?

    আ সা আ: ছায়া আছে গাছের। ছায়া পড়ে না বিকেলে– ওখানে একটা টেবিল-চেয়ার পেতে– ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল তো–

    সৈ জো তা: উনি সব লিখে গিয়েছিলেন।

    আ সা আ: ডায়েরিটা পরে পেলাম না।

    শা আ: অনেকে বলে এটা কোরবান আলীর কাছে (পরবর্তী সাক্ষাৎকারদাতা মহসীন বুলবুল কনফার্ম করেন যে তাজউদ্দীন আহমদের ঐতিহাসিক ডায়েরিটি কোরবান আলী নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন)।

    আ সা আ: ওই ডায়েরিটা ওই রুমে যারা ছিল— কোরবান আলী– এদেরকে আমরা বললাম যে ডায়েরিটা দাও। ড. আসহাবুল হক উনিও ছিলেন।

    শা আ: কে– না, প্রথম বললেন যে কোরবান আলী নিয়ে গিয়েছেন—
    স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদ

    স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদ

    আ সা আ: আসহাবুল হক, মাখন— (পরের বাক্য অস্পষ্ট)– তারপর আমি বললাম যে, ‘‘তাজউদ্দীন সাহেব, উঠতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। লকআপ হয়ে যাবে।’’

    মাগরেবের আজান পড়লেই লকআপ হয়ে যায়। বারান্দার দরজা ও তিনরুমের সামনের লোহার শিকওয়ালা চারটি দরজা তালা-চাবি দিয়ে লকআপ করা হত।

    শা আ: গেট লকআপ হয়ে যায়?

    আ সা আ: আমাদের ঘরের বাইরের দিকে লকআপ করে রাখে। জেলের ভেতর আমরা যে থাকি-– ভেতরদিকে লকআপ হয় না। বাইরের দিকে তালা মেরে আমাদের ভেতরে রেখে দেবে। আবার সকালে খুলবে। না খুললে আমরা বাহির হতে পারব না।

    তো সাধারণ কয়েদীদের এক নিয়ম। আমাদের আরেক নিয়ম। আমাদেরকে ভোরবেলায় খুলে দিত। কারণ আমাদের বেড়াতে হবে, নামাজ পড়তে হবে। পলিটিক্যালি আদায় করে নিতে হয় আর কি।

    তো আমাদের একটা কমিটি হয়েছিল। জেলখানায় আমাদের থাকা-টাকা, কী করে উন্নতি হবে সংক্রান্ত বিষয়ে একটা কমিটি। আর আমরা পাঁচজন মিলে আরেকটা কমিটি। আমি, নজরুল সাহেব, তাজউদ্দীন সাহেব, মনসুর আলী সাহেব, কামরুজ্জামান সাহেব আমরা পাঁচজন মিলে একটা একজিকিউটিভ কমিটি ফর্ম করি, যাতে আরও closely আলাপ করতে পারি। সকলে আমার রুমে যেয়ে বসতেন।

    তো তাজউদ্দীন সাহেব তো খুব আইন মানা লোক ছিলেন। তো যারা বাইরে গিয়ে আলাপ করতেন, বলতেন একজন আলাপ করবে, সামাদ সাহেব আলাপ করবে। চৌদ্দ জনের আরেকটা কমিটি হয় আসাদুজ্জামান, রশীদ সরদার, এসপি মাহবুব (সহ)—

    শা আ: কোন আসাদুজ্জামান?

    আ সা আ: সেক্রেটারি ছিলেন গভরমেন্টে। এখনও আছেন চাকরিতে। জেল থেকে বের হয়ে চাকরিতে গিয়েছেন আর কি। এনারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ছিলেন– এনাদেরকেও আমাদের লোক মনে করে জেলে দিয়েছে আর কি। যাই হোক, আমরা বসতাম, আলোচনা করতাম।

    ওইদিন (২ নভেম্বর বিকালে) আমি ডাকলাম। বললাম, “শুনেন, লকআপ তো হয়ে যাবে– আমরা একটু বেড়াই।’’

    আমরা তারপর হাঁটলাম। বললাম, ‘‘ইন্টারভিউতে ভাবি এসেছিলেন না?’’

    তোমার আম্মার কথা। বললেন, ‘‘আমার ইন্টারভিউটা আসতে দেরি হবে, কারণ কদিন আগে ইন্টারভিউ হয়েছে।’’

    শা আ: দোসরা নভেম্বর আপনার সঙ্গে আব্বুর ইন্টারভিউ ছিল, তাই না আম্মা?

    সৈ জো তা: ফার্স্ট নভেম্বর।

    আ সা আ: সেদিন হয়েছিল– এই আমার মনে পড়েছে (তাজউদ্দীন আহমদ ১ নভেম্বর ওনার স্ত্রীর সঙ্গে ইন্টারভিউয়ের কথা বলেছিলেন যা বেগম তাজউদ্দীনের কথায় আবদুস সামাদ আজাদের মনে পড়ে)। ওই ইন্টারভিউ নিয়ে আলাপ করছিলাম– ২ তারিখ হল। ইনফরমেশন এক্সচেঞ্জ হচ্ছে আর কি।

    উনি একটা চিঠি দিয়েছিলেন ভাবির মাধ্যমে মানিক চৌধুরীর (এমপি) কাছে। বললাম যে কাজ-টাজ বাইরে করার প্রশ্ন উঠছে। পার্লামেন্টে মেম্বারদের ডাকবে। ওরা প্রেসার দিচ্ছে ডাকবার জন্য।

    শা আ: কারা?

    আ সা আ: বাইরে পার্লামেন্টে। মানিক চৌধুরী ছিল, ময়েজউদ্দীন ছিল (মোশতাকের বিপক্ষে)। আর কিছু লোক ছিল– ইউসুফ আলী, সোহরাব হোসেন (পক্ষে), ওরা উল্টা মেম্বারদের বোঝাচ্ছে– যা হবার হয়ে গিয়েছে– এভাবে বাইরের খবরগুলি পেতাম। পার্লামেন্টের সদস্যদের মধ্যে, মোশতাক যে ডাকবে শিওর হতে পারছেন না। পার্লামেন্ট নিয়মিত হবে কিনা– সদস্যরা যারা আছে এই নিয়ে একটা লবি হচ্ছে।

    সেই লবির খবরটা আমরা পেয়েছি। মানিক চৌধুরী আমাদের পক্ষে (মোশতাকের পার্লামেন্ট বর্জনের পক্ষে আওয়ামী লীগের এক অংশের তৎপরতা)। আর ইউসুফ আলী, সোহরাব হোসেন ওনারা তো মন্ত্রীই আছেন (প্রথমে বঙ্গবন্ধুর সরকারে, তারপর মোশতাকের সরকারে)।

    ওনারা মেম্বারদেরকে অন্যভাবে বোঝাচ্ছেন যাতে মোশতাককে মেনে নিয়ে একটা পার্টি বিলড-আপ করা যায়। সেই লাইনে (কথাবার্তা চলছে)— এইসব খবর আমরা পেয়েছি। এসব আলাপ-টালাপ করে রাতে লকআপে চলে গিয়েছি। যার যার রুমে চলে গিয়েছি। গার্ড আসছে চাবি নিয়ে। একটা রুমে তালা মারে, তারপর আরেকটা রুমে। লাস্টে আমাদের রুমে তালা মারে।

    আমাদের রুমে প্রায় পঁচিশ জন ছিল। আমাদের রুম বড় তো। জোহা সাহেব (সামসুজজোহা এমপি), আতিউর রহমান, তারপর আমু (আমির হোসেন আমু) ছিল, সৈয়দ হোসেন– ওই সময়টায় প্রায় পঁচিশ-তিরিশ জন ছিল। রাতে একসঙ্গে নামাজ পড়তাম। একসঙ্গে খেতাম। যার সঙ্গে যার খাতির আছে তার সিটে যেয়ে গল্প-সল্প করতাম।
    স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ

    স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ

    রাতে ওই যে আমার অভ্যাস ছিল ঠিক সবাই ঘুমিয়ে গেলে লাইট অফ করে দিতাম। টেবিলে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে যাতে কারও অসুবিধা না হয়, আমি ইয়াসিন সূরা পড়তাম। ইয়াসিন সূরা পড়ে আমি ঘুমাতাম।

    আমার পাশে মনসুর আলী সাহেব ছিলেন। তার পরের সিটটায় ছিলেন সৈয়দ হোসেন সাহেব। তারপর অন্যান্যরা। আমি কোরআন শরীফ পড়ছি। উনি আমার পাশের সিটটা থেকে উঠে, উনি কাছে এসে উপুড় হয়ে আস্তে আস্তে বললেন, “সামাদ সাহেব, পাঠিয়েছেন?”

    (সামাদ সাহেব মনসুর আলীর উদ্বিগ্ন গলার অনুকরণে বললেন)

    শা আ: কোনটা?

    আ সা আ: জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘রেডক্রসে (খবর) পাঠাতে পেরেছিলেন?’’

    আমি ওনাকে সাহস দিলাম। উনি বললেন, “আমার জানি কেমন মনে হচ্ছে।’’

    এই স্বাভাবিক আলাপ কিন্তু উনি একটু অয়ারিড। আমি বললাম, “আল্লাহ, আল্লাহ করেন। আমাদের তো আর করার কিছু নাই।’’

    এরপরে আমি ঘুমিয়েছি। তারপর ওই যে বললাম তাহাজ্জুদের ওয়াক্তে ঠিক রাত আড়াইটার সময় আমার ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে উঠে আমি তাহাজ্জুদ পড়ছি। লাইট-টাইট না জ্বালিয়ে। শুধু বাইরের লাইটে। রাতের ডিউটি হল রাত ১১ টা, তারপর ১ টা। দুই ঘণ্টা পরপর চেঞ্জ হয়। একদল যায় আরেক দল আসে। তারপর আবার ৩ টায় চেঞ্জ হয়। এ সময় আমি আড়াইটার নামাজ পড়ে বসে আছি।

    শা আ: আবার ৩ টায় চেঞ্জ হয়।

    আ সা আ: রাতের ডিউটি হল ২ ঘণ্টা পরপর। দিনের ডিউটি হল ৬ ঘণ্টা পরপর।

    সৈ জো তা: আপনি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে বসলেন–

    আ সা আ: ওই ডিউটিতে আসবে সিপাই, যার যার ওয়ার্ডে ডিউটি আছে না– এই ডিউটি সেই ডিউটি। ৩ টার সময় একটা চেঞ্জ হয়। অন্য লোক না আসা পর্যন্ত এরা যাবে না। তারপর নতুনরা আসবার পর যারা যাবার তারা গিয়েছে এবং যারা আসবার তারা এসেছে।

    সৈ জো তা: পাগলা ঘণ্টি বাজল না?

    আ সা আ: আরও পরে। আমরা তো তখনও জানি না কী হবে। আমি নরমালি জিজ্ঞেস করছি (ডিউটিরত গার্ডকে), ‘‘কী, কেমন আছেন’’– ওই যে লোকটা আমার চিঠিপত্র (আদান-প্রদান করত)–

    শা আ: সে তখন ডিউটিতে এসেছে?

    আ সা আ: হ্যাঁ, ওই সপ্তাহ হয়তো ডিউটি করবে। সে আমাকে বলল, “কেমন আছেন?”

    আমি বললাম, “ইমাম সাহেব কেমন আছেন?”

    সে ইমামতি করত। সে বলল, “ভালো আছি।”

    এর মধ্যেই শুনি হুইসেল বাজছে। বললাম, “কী হল, হুইসেল বাজে কেন?”

    তখন সে বলল, “আমরা যখন আসি তখন আইজি এসেছিল।”

    জেনারেলি আইজির অত রাতে আসার কথা না!

    শা আ: ডিআইজি প্রিজনস, না আইজি?

    আ সা আ: আইজি (প্রিজনস), ওরা বলল যে, “স্যার, জেলখানার অন্যান্য অফিসারদেরও দেখলাম।”

    তারা তো ডিউটিতে আসে-যায়, তারা তো অত বোঝে নাই। ভাবলাম কয়েদী-টয়েদী পালালে যে রকম ঘটনা হয় তেমন হবে আর কি।

    সৈ জো তা: আপনারা ওটাই আন্দাজ করছিলেন?

    আ সা আ: আমরা তো আর বুঝলাম না। তারপর সমস্ত জেলখানায় হুইসেল, পাগলা ঘণ্টা বাজছে। এই হল কয়েক মিনিটের প্রস্তুতি। এর মধ্যেই দেখি বারান্দার যে জায়গাটা সেকেন্ড গেট, মানে ফার্স্ট লকআপ বলে যাকে, দেখি ১ নম্বর রুমের কোরবান আলী, শেখ আবদুল আজিজ, মাখন, ড. আসহাবুল হক (৩ নম্বর রুমে ঢুকছেন)–

    শা আ: বারান্দার ফার্স্ট লকআপটা খুলে?

    আ সা আ: রুমে ঢুকতে তো একটা বারান্দা থাকে। তারা তো ওয়ারিড অবস্থা। বললেন, কী ব্যাপার বুঝতে পারছি না। আমাদেরকে তো এখানে নিয়ে এসেছে।

    শা আ: ফার্স্ট লকআপ খুলে তাদেরকে আপনার ঘরে নিয়ে আসে?

    আ সা আ: আমাদের যে রুমটা সেটা তো একটা বিল্ডিঙের মতো। ওদিকে কী হচ্ছে আমরা তো আর কিছু জানি না। আমরা তো রুমের ভিতরে। বারান্দা আছে– রেলিং আছে।

    শা আ: রুমগুলি হচ্ছে ১, ২, ৩। এ রকম আঁকা (নিজে রুমগুলির একটি ছবি এঁকে আবদুস সামাদ আজাদকে অনুরোধ করলাম উনিও যেন একটি ছবি আঁকেন যাতে ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্থানটি সমন্ধে আরও ধারণা পাওয়া যায়)। আপনি আমাকে একটু এঁকে দেখান তো, তাহলে আমি বুঝব।

    আ সা আ: চশমাটা কোথায়?

    (তিনি বিস্তারিত ছবি আঁকলেন)– এই হল ৩ টা রুম। এই হল বারান্দা। জেলখানা থেকে আসে এই দিক দিয়ে। এই যে কিচেন। এই দিকে আরেকটা ওয়ার্ড আছে টিনশেডের। এটা কিন্তু লোহার শিকের খোলা দরজা। সব জেলখানা কিন্তু খোলা।

    শা আ: খোলা দরজা, আচ্ছা। লোহার শিকের। তার মানে লকআপের মধ্যে দিয়ে কথা বলা যায়। খোলা শিক?

    আ সা আ: শিকগুলি তো ওপেন। কাঠ নাই। জেলখানার সবটাই ওপেন– শিকের দরজা। সমস্ত জেলখানার বিল্ডিঙের নিয়ম হল ঢুকিয়েই লকআপ করে দেবে।

    শা আ: এটা লকআপ করে, তারপর আবার এটা লকআপ করবে।

    (সামাদ সাহেবের হাতে আঁকা নিউ জেল বিল্ডিঙের ১, ২ ও ৩ নম্বর রুমের ছবি নির্দেশ করে)

    আ সা আ: আবার এখানে একটা ডাবল লকআপ।

    (ছবি নির্দেশ করে)

    এখানে বারান্দাও যেহেতু লকআপ ওখান দিয়ে ভেতরে কেউ ঢুকতে পারে না। সুতরাং এই সময় এই রুমের (১ নম্বর রুমের ছবি, এই রুম হতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া বাকি সবাইকে হত্যাকারীদের নির্দেশে জেল কর্তৃপক্ষ ৩ নং রুমে পাঠায়) এই কটি লোক বারান্দায়।

    আমরা বললাম, “কী হয়েছে?”

    (ওনারা) বললেন, “কী জানি আমাদেরকে নিয়ে এসেছে এখানে। অফিসার এসেছে কীসের জন্য।”

    শা আ: আপনারা কি ঘরের মধ্যে থেকে জিজ্ঞেস করলেন?

    আ সা আ: না, ওনারা এসেছেন আমাদের রুমে।

    শা আ: আপনাদের রুমে নিয়ে এসেছে এনাদেরকে।

    আ সা আ: হঠাৎ দেখি আমাদের রুমে। চিন্তা করছি ব্যাপারটা কী। পাগলা ঘণ্টি বাজছে। তখন তো জেল অথরিটি কেউ নাই। সিপাই-টিপাইকেও পাচ্ছি না। তখন দেখি মাখন, শেখ আজিজ, ড. আসহাবুল হক, (কোরবান আলী) ওই চারজন যাদের নাম বললাম– ওই রুমেরই কয়েকজন যাদের নাম বললাম, রুমে তখনও ঢুকে নাই, তারা বারান্দায়।

    আমরা জানলা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”

    তারা বলল, “কী জানি, আমাদেরকে (এখানে) নিয়ে আসছে কেন, আবার ওই তিনজনকে– কামরুজ্জামানকে (২ নম্বর রুম হতে বের করেছে) নিয়েছে। সৈয়দ সাহেব আর তাজউদ্দীন সাহেবকে (১ নম্বর রুমে) রেখে দিয়েছে। তাদেরকে বাদ দিয়ে আমাদেরকে এই রুমে নিয়ে এসেছে।”

    তখন আমাদের লকআপ খুলে এনাদেরকে আমাদের রুমে ঢোকাল। আর কামরুজ্জামানকে ওই রুমে (১ নম্বর) নিয়েছে কিনা আমরা তো আর জানি না। মনসুর আলীকে আমাদের রুম থেকে তাগাদা দিয়ে (জেল কর্তৃপক্ষ) নিয়ে গেল। সামান্য সময় তো।

    শা আ: আর্মি অফিসার কারা ছিল?

    আ সা: এটা তো আমরা জানি না। জেল অফিসার দুজন ছিল (জেলর আমিনুর রহমান ও সুবেদার নায়েব আলী ওরফে নেয়ামত আলী যা পরে জানতে পারি), আমরা তো যে রুমে আছি সে রুমেই। আমরা মাত্র জিজ্ঞেস করছি ‘‘কী বিষয়, কী হয়েছে’’-– এই কথা বলতে না বলতেই হঠাৎ শুনি ব্রাশফায়ারের শব্দ– সাংঘাতিকভাবে। আমরা সবাই ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম সেকেন্ডের মধ্যে। পাশের রুমে ফায়ারিং (১ নম্বর রুমে), ভাবলাম, আমাদের রুমে ফায়ারিং হল না কেন?

    আমরা তখন সব ফ্লোরে, ক্রলিং করে করে চেয়ারের আড়ালে, খাটের আড়ালে আশ্রয় নিলাম। দরজাগুলো তো ওপেন– সমস্ত লোহার বড় বড় শিক দিয়ে– ওপেন জানালা– সকলেই মাটিতে পড়ে ক্রলিং (খোলা জানালা ও দরজার শিক দিয়ে গুলি ঢুকতে পারে এই আশংকায়)। তখুনি একটা রিয়ালাইজেশন হল যে ফায়ারিং এখানে নয়, সামহোয়্যার এলস হয়েছে। চারদিক সাইলেন্ট। একটু পর ফজরের আজান পড়ল। চার-পাঁচটা জায়গায় আজান পড়েছে।

    আজানের আগেই একজন লোক, পরে জানলাম একজন সিপাই, সেই একা সুন্দর করে সূরা রহমান জোরে জোরে পড়ছে। সে ডিউটিতে ছিল। আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। একটা বুঝলাম তাদের (চার নেতার ওপর) ওপর ফায়ারিং হয়েছে।

    প্রথমে ওদেরকে ঢোকাল। মনসুর আলী ঘুমিয়ে ছিলেন। উনি ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুলেন। ওনাকে তাগাদা দিয়ে (নায়েব আলী) বলল, ‘তাড়াতাড়ি আসেন’। তখনও আমরা জানি না মাঝের রুম থেকে কামরুজ্জামানকে নিয়ে গিয়েছে। সকালে টের পেয়েছি। এর পরে জেলের কোনো সিপাই কিন্তু ডিউটিতে নাই। কাউকে যে জিজ্ঞেস করব–

    সৈ জো তা: ফায়ারিং-এর পর কোনো শব্দ শুনলেন না? ওনাদের কোনো আওয়াজ, শব্দ?

    আ সা আ: টু-শব্দ আসেনি। এখানে তো ওয়াল। চিৎকার করে মায়া ওদেরকে জিজ্ঞেস করেছে, “তোমাদের রুমের খবর কী? ওই দিকের (১ নম্বর) রুমের খবর কী?’’

    আর সামনের সেলে (১৫ নম্বর) সব দেখেছে মাহবুব– এসপি মাহবুব (মাহবুবউদ্দীন আহমেদ)। উনি (১ নম্বর রুমের) উল্টাদিকের সেলে ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে দেখেছেন। উনি পরে বলেছেন আর কি।

    সৈ জো তা: সে দেখেছে সব! এসপি মাহবুব!

    শা আ: তাহলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে।

    আ সা আ: ২ নম্বর (সঠিক ১ নম্বর) রুম সাইলেন্ট। আজান পড়েছে। আমরা তো বুঝে ফেললাম যে একটা ঘটনা ঘটেছে। মনসুর আলী সাহেবকে নিয়ে গেল। কামরুজ্জামানকে ‘এই কামরুজ্জামান’ বলে নিয়ে গেল।

    সৈ জো তা: আহ হা!

    আ সা আ: ওরা তো দুই নম্বর রুমে। ওরা তো (পাশের ১ নম্বর) অবস্থা বুঝে ফেলেছে। ওরা বলল, “লিডারদেরকে শেষ করে ফেলেছে।”

    শা আ: কে বলল এ কথাটা?

    আ সা আ: আমাদের মধ্যেই এ কথাটা চলছে। আমরা তো লকআপে।

    শা আ: এসপি মাহবুবকে আপনারা দেখেছেন?

    আ সা আ: আমরা দেখব কী করে? ওই রুমটার সামনেই হল সেলটা। ওখান থেকে সে কিছু দেখেছে। সে পরে বলেছে আর কি। পরে আমাদের রুমে তো সবাইকে আনল– ওইদিকের সেল থেকে। যারা আমাদের রুমে এসেছিল তারা আর যায়নি। ওই রুম তো তালা মেরে দেয়।

    শা আ: ১ নম্বর রুম?

    আ সা আ: পরে জেনেছি। বহু পরে। যখন আমাদের সঙ্গে (জেল কর্তৃপক্ষের) দেখাশোনা হল। সকালে (৩ নভেম্বর দিবাগত রাত সকালে) তো কেউ আসে না। সমস্ত জেলখানা তালা বন্ধ। সকাল হয়ে গেল। আমি কোরআন তেলাওয়াত করছি। কোনো খবর নাই। একটা সিপাইও নাই।

    সৈ জো তা: রেডক্রসেরও তো কোনো কিছুই হল না।

    আ সা আ: রেডক্রস বাদই– জেল অথরিটির কোনো লোকও নাই। আমাদের ওখানে একটা সিপাইও নাই, ডিউটি সিপাইও আসে না। আমরা লকআপে তালা মারা।
    তৎকালীন তিন বাহিনীর প্রধান ও চিফ-অব-ডিফেন্স স্টাফ জিয়াউর রহমান

    তৎকালীন তিন বাহিনীর প্রধান ও চিফ-অব-ডিফেন্স স্টাফ জিয়াউর রহমান

    তার কিছু পরে এরোপ্লেনের আওয়াজ শুনলাম। আকাশে উড়ছে। ওই যে প্লেনটা উড়ছিল–

    সৈ জো তা: হ্যাঁ, শুনেছি।

    শা আ: কীসের প্লেন উড়ল?

    সৈ জো তা: জেট প্লেন।

    আ সা আ: আমরা আওয়াজ শুনলাম ভোরবেলায়।

    সৈ জো তা: প্লেনের আওয়াজ ঢাকা শহরে সবাই শুনেছে।

    আ সা আ: আমরা তো ভেতর থেকে কিছু বুঝলাম না। শাঁ শাঁ আওয়াজ শুনছি। আমরা তো তালা মারা, কোনো খবর জানি না। কোনো সিপাই নাই। দশটার দিকে কিছু নাশতা নিয়ে– তালাটা খুলে– চুপটি করে বারান্দার গেটটা খুলে– আমাদের রুম খুলল না– নিচ দিয়ে (রুমের দরজার নিচ দিয়ে) কিছু নাশতা দিল। নাশতা মানে রুটি-টুটি আর কি। কেউ তো খায়-টায় না। খাওয়ার তো কথা না। আমরা তো বুঝেই ফেলেছি ঘটনা কী। তারপরে ৩ তারিখ গেল। আমাদের লকআপ আর খোলা হল না।

    আ সা আ: ভাবি আপনি আমাকে একটু সাহায্য করবেন। ৩ তারিখ সারাদিন গেল (তিনি এই অংশটি বেগম তাজউদ্দীনকে আগে একবার বলেছিলেন)–

    সৈ জো তা: রাতও পার হল–

    আ সা আ: আমার মনে হয় ৩ তারিখ রাতও পার হল। এর মধ্যে দিনের বেলা দুই কর্নেল প্লেন ড্রেসে–

    শা আ: তিন তারিখ রাতে?

    আ সা আ: দিনের বেলা।

    শা আ: তিন তারিখ দিনের বেলা?

    আ সা আ: তিন তারিখ না চার তারিখ মনে হচ্ছে না। তবে তিন তারিখ মনে রেখ। দুটা কর্নেল– ডিএফআই-এর (আর্মির গোয়েন্দা সংস্থা) একজনের, কাদের না কী যেন নাম– যেহেতু তারা ইন্টারোগেশনে ছিল– মোজাম্মেল আছে আমাদের– ওই টঙ্গীর– লেবার লিডার ছিল, পরে বিএনপি-জাতীয় দলে গিয়েছিল– তো ওই মোজাম্মেলকে বহুদিন ধরে রেখেছিল ডিএফআইতে। আর হাবিবুল্লাহ ও ২ নম্বর রুমের মায়াকেও ওরা (ধরেছিল)–

    শা আ: মায়া কে?

    আ সা আ: মায়া আমাদের আওয়ামী লীগের–

    সৈ জো তা: মুক্তিযোদ্ধা ছিল–

    শা আ: মোজাম্মেল, মায়া আর কে?

    আ সা আ: মায়া কিন্তু অন্য রুমে। মোজাম্মেল আমাদের রুমে।

    শা আ: আচ্ছা, মোজাম্মেলকে ধরে নিয়েছিল ডিএফআই–

    আ সা আ: এটা আগের কথা। ওই ডিএফআই-এর লোক তো আমরা চিনি না। ওরা চিনল। যেহেতু আগে ওদেরকে নিয়ে গিয়েছিল। দুজন অফিসার এল। ওরা ওই লাশ দেখেছে। লাশ কী অবস্থায় আছে আমরা তো আর জানি না। আমাদেরকে দেখতেও দিল না। কেউ এলও না। কোনো একটা জেলের অফিসারও এল না। ২ নম্বর রুম থেকে মায়া কী কথা বলছে শুনতে পাচ্ছি।

    দিনের বেলা তো, ১ টা-২ টার সময়। কর্নেল কাদের না কী যেন নাম। তখন তারা ৩ নম্বর রুমে এসে মোজাম্মেলকে ডাকল। ইন্টারোগেশনে তাদের সঙ্গে পরিচয় আগেই। তারা কানে কানে কী কথা বলল।

    তখন সৈয়দ হোসেন সাহেব বললেন, “কী, আপনারা কারা?”

    তারা বলল, “আপনারা চিনবেন।’’

    কালো চশমাপরা জন বলল, “bad days are coming for you, মনে করবেন না সুবিধা পাবেন।’’

    আমাদেরকে ওয়ার্নিং দিয়ে গেল। এই বলে ওরা চলে গেল। চলে যাবার পর ৩ তারিখ রাত গেল মনে হয়। ৪ তারিখ রাতে– লাশটা কবে দেওয়া হয়েছিল (পরিবারের কাছে)?

    সৈ জো তা: ৪ তারিখ রাতে।

    আ সা আ: তাহলে ৩ তারিখ রাতে– ৩ তারিখ দিবাগত রাতে– ঠিক সকালবেলা–- ওই রকম ভোরবেলা–তাহাজ্জুদের নামাজ– তখন আমার জ্বর ছিল ভাবি– ১০৪ ডিগ্রি। তখন তো জ্বর-টর পাচ্ছি না। ঠিক তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত হয়েছে, হঠাৎ আমাকে জোহা সাহেব বললেন, “জেলর এসেছে, কথা বলবে।”

    আমার একটু চোখ লেগেছিল। উঠলাম। উঠে জেলরকে বললাম, “কেন এসেছেন?’’

    লকআপটা খুলতে চায় আর কি। তারা সাহস পাচ্ছে না যে বারান্দার লকআপটা খুলে তারা কথা বলবে। কথা তো এমনিই বলা যায়। সবই তো ওপেন, শুধু বড় বড় শিক। জেলার বলল, “স্যার, আমি আপনাদের সঙ্গে একটু কথা বলব।”

    আমি বললাম, “যার যেটা আছে হাতে নাও। আজকে আর খালি হাতে যেতে দেব না।”

    জেলর বলে, “স্যার খবর আছে।” বললাম, “কীসের খবর? সারাদিন কোথায় ছিলেন?”

    জেলর বলল, “স্যার, মিসক্রিইয়েনটদের হাতে এখন ক্ষমতা নাই। ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে।’’

    একটু পরেই জানলাম যে তাহেরউদ্দীন ঠাকুর ও (শাহ) মোয়াজ্জেমকে (উভয়ে মোশতাকের গ্রুপের) অ্যারেস্ট করেছে। তখন বলল, “লাশ আমরা আজকে ধোয়াব।”

    আমি বললাম, “লাশ আমাদের দেখতে দেন।”

    তখন (জেলর) ঘটনাটা বলল। মিলিটারির লোক– অফিসার নয়– চার জন এসেছিল।

    শা আ: চারজন মিলিটারি?

    আ সা আ: চার জন মিলিটারি। তারা জেলগেটে এসেছিল। ডিআইজি আউয়াল সাহেব বললেন, “আমরা তো এভাবে ঢুকতে দিতে পারি না।”

    তখন তারা বলল, “আমরা প্রেসিডেন্টের (মোশতাকের) অর্ডার নিয়ে এসেছি।”

    তারপর আইজি সাহেবকে আনিয়েছি। আইজি সাহেব প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলল। প্রেসিডেন্ট বলল, “তাদের একটা ডিউটি আছে। তাদেরকে ডিউটি করতে বাধা দিও না।”

    যখন জিজ্ঞেস করলাম, অস্ত্র নিয়ে তারা কী করে ঢুকল, তখন (জেলর) বলল, “হ্যাঁ, আউয়াল সাহেব তাদেরকে বাধা দিয়েছিল, তখন ডিআইজিকে লিটারেলি চড় মারে।”

    শা আ: কে চড় মেরেছিল?

    আ সা আ: যারা এসেছিল। পরে আমরা শুনেছি। ও (জেলর) বলল, “তারা বলেছিল ওনাদেরকে (মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে ১ নম্বর রুমে) আনতে। আমরা এনেছি– তারপর তারা ঢুকতেই ব্রাশফায়ারে মেরে ফেলে চলে যায়। তারপর আর খবর নাই সারাদিন। আমরাও বুঝতে পারছি না কী করব না করব। সারাদিন গভরমেন্ট পাই না, কিছু পাই না। এদিকে আইজিও কাউকে পায় না। তো আজকে অর্ডার এসেছে যে দিনের বেলা লাশ ধোয়াব।”

    আমি বললাম, “আমাদের বেডশিট আছে– ভালো ভালো কাপড় আছে (দাফনের জন্য)।”

    জেলর বলল, “না, আমরাই ব্যবস্থা করব।”

    আমি তখন খুব রাগ করেছি। সকালবেলা তারা লাশ বাইরে নিল। আমরা তো লকআপে। সবাই লকআপে। অন্যানরা কিছু দেখতে পেরেছে, আমরা তাও পারছি না। ওই সাইডে (১ নম্বর রুমের কাছে) যারা আছে– সেলে মাহবুব থাকায় সে কিছু দেখতে পেরেছে। টিনশেডে যারা আছে তারাও কিছু দেখতে পেরেছে।

    তো ৪ তারিখ রাতে শুনলাম যে লাশ ওখানেই পোস্ট মর্টেম করেছে। এসপি মাহবুব ওদিকে এসে, বাইরে থেকে আমার নাম ধরে ডাকল, বলল, “সমস্ত মিসক্রিয়েনটরা পালিয়ে গিয়েছে।”

    শা আ: কারা মিসক্রিয়েনট?

    আ সা আ: ওই যে রশীদ, ডালিম, ফারুক– বলল, “ওরাই এটা করেছে”।

    সৈ জো তা: আর মুসলেহউদ্দীন– (পরে জানা যায় যে এই ঘাতক সুবেদার জেল গেটে মোসলেম নামে স্বাক্ষর করে। প্রকৃত নাম কেউ জানে না। বর্তমানে যদিও সে ১৯৭৫ এর জেল হত্যাকাণ্ডের জন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কিন্ত তার কোনো হদিস গত আটত্রিশ বছরে পাওয়া যায়নি)।

    শা আ: খুনী ঘাতক সুবেদার মুসলেহউদ্দীন এসেছিল? আরেকজন কে?

    আ সা আ: তারা পালিয়েছে।

    শা আ: এরা কিন্তু খুনী (ঘাতকরা), আর ওরা হচ্ছে আসল কালপ্রিট (হত্যার চক্রান্তকারীরা)–

    আ সা আ: মোসলেহউদ্দীন তো একজন জাত খুনী। পরে শুনলাম তার বাড়ি নাকি টঙ্গীর ওইদিকে।

    শা আ: মারা গিয়েছে এ খবর আমি পেপারে পড়েছি (সে সময় বাংলাদেশের কোনো কোনো পেপারে প্রকাশিত হয়েছিল যে জেল হত্যাকারী এই সুবেদার মৃত্যুবরণ করেছে– খবরটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে আদালত মৃত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে)।
    খালেদ মোশাররফ

    খালেদ মোশাররফ

    আ সা আ: সেদিন বলল (এসপি মাহবুব) যে মিসক্রিয়েনটরা পালিয়ে গিয়েছে– খালেদ মোশাররফ পাওয়ারে এসেছে (ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, ৫ নভেম্বর মেজর জেনারেলের র‌্যাংক পরেন), তারপর খন্দকার ইলিয়াস, এনারা খবর পাঠালেন যে চার তারিখে প্রসেশন।

    (আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার দাবি করে এই প্রসেশনে খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই রাশেদ মোশাররফ যোগ দেন। চার তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশবাসী জানত না যে জেলখানায় মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে)

    যাই হোক, ওই শুনলাম যে খালেদ মোশাররফ পাওয়ারে। খালেদ মোশাররফকে জিজ্ঞেস করল (জেল কর্তৃপক্ষ), কোথায় লাশ দেওয়া হবে। আমাদেরকে অফিসেও যেতে দেয় না, কারও সঙ্গে কথাও বলতে দেয় না– যারা আসে (জেলে কর্মরত) তাদের সঙ্গে কথা বলে (অস্পষ্ট–) আত্মীয়রা জেলগেট থেকে লাশ নিয়ে গিয়েছে। চার তারিখ (রাতে) আমাদের কথায় কথায় জানাল।

    পাঁচ তারিখ আমি ইন্টারভিউ পেলাম। তখন লাশ বাইরে গিয়েছে। খালেদ মোশাররফ পাওয়ারে এসেছে। এরা পাওয়ারে নাই। একটা চেঞ্জ এসেছে। এ রকম একটা অবস্থায় ইন্টারভিউ নিয়েছি।

    তখন দেখি জেলর ভিতরের দিকে আসছে। তার মন-টন ভালোর দিকে। বলে, “স্যার, সব কিছু চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে।”

    বললাম, “চেঞ্জ আর কী হবে?”

    তখন বললেন যে, জিয়াউর রহমানকে লকআপ (গৃহবন্দী) করা হয়েছে আর মোশতাক (পাওয়ারে) নাই– এসব বলল।

    তখন ইন্টারভিউতে গেছি। আমার ফ্যামিলি ইন্টারভিউ। বেগম সাহেব বললেন এই এই হয়েছে। তাঁর যা এক্সপেরিয়েন্স, বাইরে থেকে যা যা শুনেছে।

    তারপর আমি বললাম, “আমার কাছে মনে হচ্ছে conspiracy is conspiracy, এখনও কন্সপিরেসি চলছে। যদিও বলা হচ্ছে সব ঠিক আছে, সবাই রিলিজ হয়ে যাবে, আবার ৪ তারিখে প্রসেশনও হয়েছে। বাইরের সব দেখে মনে হয় সবই আমাদের পক্ষে।”

    ইন্টারভিউতে আমি বলে দিলাম, “এখনও কন্সপিরেসির শেষ হয় নাই। ক্ষমতা যদি আমাদের পার্টির কাছে হস্তান্তর করত তাহলে বুঝতাম যে এরা (অস্পষ্ট) ডিসিপ্লিনড– ওই আর্মির কাছেই পাওয়ার।”

    তারপর বললাম, “ছেলেমেয়েদের বাসায় রেখ না। প্রস্তুত থাকা ভালো। কোন সময় কী হয়—।”

    এসব বলে (ইন্টারভিউয়ের পর) ভাত খেতে যখন বসেছি, দেখলাম জেলর দুইজন লোক নিয়ে ঢুকছে– পিআইডি– সরকারেরই একটা ডিপার্টমেন্ট আছে– এরা ফটো তুলতে এসেছে ওই রুমের (১ নম্বর)– ক্যামেরাম্যান। জেলর বলল, “বাইরের অবস্থা এই– ক্রিমিনালরা পালিয়েছে– খালেদ মোশাররফ পাওয়ারে– মনে হয় cloud is over ….”

    আমি যখন (রুমের) বাইরে আসব তখন জেলরের কাছে শুনলাম একটা (জেলহত্যা তদন্ত) কমিশনও হয়েছে জাস্টিস সোবহান, জাস্টিস (মোহম্মদ হোসেন) হোসেনসহ। মনে হয় পরিস্থিতির একটা চেঞ্জ হয়েছে।

    [চলবে]

    কোস্তারিকা, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/14756
  • Biplob Rahman | ২৮ মার্চ ২০১৪ ১০:০২582758
  • শারমিন আহমদ
    জেলহত্যাকাণ্ড: আবদুস সামাদ আজাদের সাক্ষাৎকার (তৃতীয় পর্ব)
    মার্চ ২৫, ২০১৪

    আবদুস সামাদ আজাদের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার

    তৃতীয় অংশ

    এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় উনার কলাবাগানের বাসায়, ১৯৮৭ সালের ৫ জুলাই। সে সময় আমার সঙ্গে ছিলেন আমার মা প্রয়াত সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব দুটি প্রকাশিত হয়েছে মতামত-বিশ্লেষণের এই পাতায়। এটি তৃতীয় পর্ব।

    [প্রথম অংশটির লিংক দেখুন--

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/13989]

    [দ্বিতীয় অংশটির লিংক দেখুন--

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/14756]

    আবদুস সামাদ আজাদ: বাইরের গেট থেকে যখন ভেতরে ঢুকছি তখন দেখি জেলরের মন-টন খুব খারাপ। বলে, “স্যার, শুনছি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগ বাড়িয়ে (আর্মি) আসছে– বগুড়া থেকে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে আরেকটা দল আসছে– কেমন যেন মনে হচ্ছে।’’

    সরকারি খবর তাদের কাছে বেশি আসে। জেলখানায় সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম খবর পাওয়া যায়। এই গেল ৫ তারিখ আরেকটা থমথমে ভাবের খবর পেলাম। ৫ তারিখ দিবাগত রাতে আবার ও রকম সময় ফায়ারিং, ফায়ারিং, খালি গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যায়। আকাশ লাল হয়ে গিয়েছে, এসব খবর পাওয়া যায়।

    শারমিন আহমেদ: আসলে ৬ তারিখ দিবাগত রাত। ৭ নভেম্বর।

    আ সা আ: ৬ তারিখ দিবাগত রাত। ৭ নভেম্বর। ৪ তারিখে প্রসেশন। ৫ তারিখে জানাজা (চার নেতার)। ৫ তারিখ সকালে শুনলাম শাহ মোয়াজ্জম ও তাহেরউদ্দীন ঠাকুরকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। চার তারিখ সন্ধ্যায় তারা (কেবিনেট মেম্বাররা) জানতে পেরেছে। চার তারিখ সন্ধ্যায় কেবিনেট মিটিং-এ এই ঘটনাগুলি ঘটে। কিন্তু আগে মিলিটারির মধ্যে ইন্টারনালি কিছু হয়ে গিয়েছে। খালেদ মোশাররফ শাফায়াতকে (কর্নেল শাফায়াত জামিল) নিয়ে গিয়েছে। তারপর তারা কেবিনেট ডাকিয়েছে। খলিল সাহেবও ছিলেন তখন– ৪ তারিখ সন্ধ্যায়– এটা পরে শুনেছি। আমার মনে কিন্তু সবসময় ‘কন্সপিরেসি ইজ কন্সপিরেসি’ (ভাবনা চলছে)।
    খালেদ মোশাররফ

    খালেদ মোশাররফ

    ৬ তারিখে আওয়াজ শুনি– ওই গুলির আওয়াজ শোনা যায়– ঠাস ঠাস ঠাস। আওয়াজ বন্ধ হয় না। সকাল হল। আমরা চিন্তায় যে কী আরও একটা হল। সকাল হল। রোদ উঠল। আস্তে আস্তে জেলখানার চারদিকে আওয়াজ হচ্ছে। শ্লোগান, প্রসেশন। তো সিপাইরা বলল, “এটা সিপাই-জনতার উল্লাস।’’

    সিপাইরা তো আর খবর পায় নাই যে এদের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। তখনও তারা ঘটনা জানে না। রবদের জেলখানা (জাসদ নেতা আসম আবদুর রব ও মেজর জলিল ৮ নভেম্বর রাজশাহী জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন) থেকে ছুটিয়ে আনল ৭ তারিখ সকালে। জাসদের ওয়ার্কাররা আর সিপাইরা একসঙ্গে নেমেছে। নেমে ট্রাক দিয়ে ঘুরে ঘুরে ফায়ারিং করছে। জেলখানার চারদিকে আওয়াজ শোনা যায়। পরে রাতে শুনলাম কামানের আওয়াজ।

    সকালে উঠে মনে হয়েছে জেলখানা ঘেরাও হয়ে গিয়েছে। আমরা নিজেদের জীবন নিয়ে চিন্তা করছি যে আমাদের বোধহয় শেষ করে দেবে, এইসব। এই হল ৭ নভেম্বর সকাল। খালি আওয়াজই শুনি। শুনতে শুনতে শেষ পর্যন্ত ১১ টার দিকে খবর পেলাম যে এরা জেলখানার চারদিকে যে ফুর্তি করে যায়। এরা আমাদের অ্যাগেইনস্টে– শুনলাম খালেদ মোশাররফকে মেরে ফেলেছে। খালেদ মোশাররফের ভায়রা বোধহয় (অস্পষ্ট) এয়ারফোর্সে ছিল। পাইলট ছিল। ওদেরকে ফাঁসি দিল (পরবর্তীতে)।

    শা আ: আপনি কতদিন জেলে ছিলেন?

    আ সা আ: চার বছর। ’৭৯ পর্যন্ত। তারপর আমাকে আবার নিয়ে গেল রাজশাহী জেলে। হেলিকপ্টারে।

    সৈ জো তা: ওনার ওপর টর্চার করেছিল। ইলেকট্রিক শক দিয়েছিল।

    আ সা আ: সুলতান মাহমুদ যে চিফ অব (এয়ার) স্টাফ ছিল সেই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। আমাকে তো রাজশাহী জেলে নিয়ে গেল। সেলে রাখল বহুদিন। সেখানেও তারা অস্ত্র নিয়ে ঢুকেছিল। ভাবলাম হয়তো মেরে ফেলবে।

    সৈ জো তা: সেলে, যেখানে খুনী আসামিরা থাকে?

    শা আ: তখন জিয়ার আমল—
    জিয়াউর রহমান

    জিয়াউর রহমান

    আ সা আ: সব করল তো জিয়াউর রহমান। ওখান থেকে ’৭৭ বা ’৭৮ এর শেষে ঢাকায় আনল। তারপর দুইমাস পর পিজিতে। প্রফেসর নুরুল ইসলাম সাহেব ও ব্রিগেডিয়ার মালেক, তারা রেকমেনড করলেন ভর্তিতে।

    ভাবি, আপনি কনভিনর (আওয়ামী লীগের) হলেন কোন ইয়ারে?

    সৈ জো তা: ’৭৭ এ। তখন খুব আন্দোলন। আপনাকে তখন পিজিতে আনল।

    আ সা আ: তাহলে ’৭৭ এর বোধহয় নভেম্বরের শেষের দিকে আমাকে পিজিতে নিয়ে এল। পুরা ’৭৮ থাকলাম পিজিতে। ট্রিটমেন্ট হল। বোর্ড বসল। ব্রিগেডিয়ার সিরাজ জিন্নাত, ব্রিগেডিয়ার মালেক চিকিৎসা করলেন। নুরুল ইসলাম ছিলেন চেয়ারম্যান। প্রফেসর ইউসুফ আলীও ছিলেন। ওই সময় ভাবি যেতেন, অন্যান্যরা যেতেন, দেখা হত। তখন ভাবি পার্টিতে– লিডারশিপে।

    সৈ জো তা: তখন তো পার্টিতে একটা আন্দোলন ছিল, গতি ছিল–

    আ সা আ: তখন তো ওয়ার্কাররা চাঙ্গা হয়ে ছিল।

    শা আ: আমি যখন আম্মার সঙ্গে যশোরে তখন ওয়ার্কারদের মধ্যে সে কী আলোড়ন! তারা ফুল-ফ্লেজেড কাজ করছে।

    আ সা আ: জিয়াউর রহমানের সময় বহু আর্মি অফিসার–

    শা আ: মেরেছে, তো বলে যে পাঁচ-ছয় হাজার লোককে তারা খুন করেছে–

    আ সা আ: খুন করেছে। জেলের ভেতর নিয়ে তারা ফাঁসি দিয়েছে। বগুড়ার আর্মির লোকদের রাজশাহীতে আনল। ওরা ক্যু করেছিল। তাদেরকে হাতে-পায়ে চেন দিয়ে আনল। ক্যু উনি নিজেই করালেন। ১৭-১৮ টা ক্যু করালেন ইন কোল্ড ব্লাড।

    শা আ: আচ্ছা কাকু, আপনার সঙ্গে জেলে আব্বুর কী কী ধরনের কথাবার্তা হত?

    আ সা আ: আমাদের দুজনের মধ্যে এত আন্তরিকতা ছিল কল্পনা করতে পারবে না। কোনো কথা আমাদের দুইজনের মধ্যে গোপন ছিল না। ভবিষ্যৎ, বর্তমান, অতীত। অতীতের ভুল-টুল সমন্ধে আলোচনা হত। আমরা যেভাবে স্বাধীনতা আনলাম, সেভাবে যদি থাকতে পারতাম, তাহলে স্বাধীনতা অন্যরকম হয়ে যেত। এর মধ্যে অনেক কথাই হয়েছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাতেও কনট্রাডিকশনগুলি মোটামুটি সেটেল করে এনেছিলাম।

    মনসুর আলী সাহেব তো বাকশালের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। ভবিষ্যতে তাজউদ্দীন সাহেব পার্টি বিলড আপ করবেন (মনসুর আলী সাহেবের সঙ্গে) এই আলাপ হত। মনসুর আলী সাহেব তো আমার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, “আপনি তাজউদ্দীনকে বোঝান সে ছাড়া পার্টি হবে না।’’

    তাজউদ্দীন সাহেব তো খুব straight মানুষ ছিলেন। ওই যে যারা অয়েলিং করত তারা তো-–

    সৈ জো তা: উনি এগুলো পছন্দ করতেন না…

    আ সা আ: তাজউদ্দীন সাহেব যে সব কথা বলতেন সেগুলি তো ফ্যাক্টলেস ছিল না। লিবারেশনের সময় আমরা কী আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতাম। এই সময় ছিল তাজউদ্দীন সাহেব সৈয়দ সাহেবকে বুঝিয়ে দিতেন। আমি কমন ম্যান ছিলাম। তারপর ইন্ডিয়ান গভরমেন্টের সঙ্গে এগ্রিমেন্টটা করলাম দুজনের সিগনেচারসহ। তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে এটা করালাম। লাস্ট যেটা হল– আমি তাজউদ্দীন সাহেব আর সৈয়দ সাহেব– শেষ যেটা হল…

    শা আ: কোন বিষয়ের সিগনেচার এটা?

    আ সা আ: ইন্ডিয়ানরা যে এখানে আসবে, জয়েন্ট।

    [বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে মর্যাদাশীল চুক্তি যাকে বলা যেতে পারে, যাতে বলা হয়েছে যে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃত দেওয়ার পরই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। বাংলাদেশ সরকার যখনই মিত্রবাহিনীকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বলবে, তখুনি তারা বিদায় নেবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।]

    শা আ: মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী?

    আ সা আ: হ্যাঁ, অ্যালাইড যেটা হল। আমরা জয়েন্ট অ্যালাইড ফোর্স করলাম। দেখলাম, না, আসলে পারা যাবে না। এই শাহ মোয়াজ্জম ওনারা যা করেছেন। বলে যে, “আমরা কি দালাইলামা হবার জন্য এসেছি?’’

    তাজউদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে কত কিছু ষড়যন্ত্র– সেই সময়ই এগুলো হয়েছে।

    সৈ জো তা: (দীর্ঘশ্বাস) কী সব!

    আ সা আ: সেভেনটি ওয়ানের স্বাধীনতার সময় আমরা যখন আগরতলায় গেলাম, তাজউদ্দীন সাহেবের ওখান থেকে মেসেজ আমি পেয়ে গেলাম। আমি তো সাধারণ একটা ড্রেসে গিয়েছি, কেউ বোঝেনি। এপ্রিলের ৯ তারিখ বোধহয় আগরতলায়। দুপুরবেলা তাহেরউদ্দিন ঠাকুর আর চাষী আলম (মাহবুব আলম চাষী, এই দুই ব্যক্তি মোশতাকের আস্থাভাজন), ওরা তো খুব অ্যাকটিভ ছিল, আমাকে বলে, “সামাদ ভাই, আপনি একটু এগিয়ে আসেন।’’

    অন্যান্য এমপিরাও আছে। মিজানুর রহমান চৌধুরীরা ক্যালকাটায়। মনে করেছে ওখানে কেবিনেট হবে। আমরা সিলেট, কুমিল্লার, ওই সাইডে যারা ছিল সব রয়ে গেল। কিন্তু মেইন লিডাররা, তারা চলে গেছে ক্যালকাটায় তাড়াতাড়ি। তারা মনে করেছে ওখানে কেবিনেট হয়ে যাবে।

    তো আমি গিয়েই বললাম, “একটা গভরমেন্ট ফর্ম করতে হবে, না হলে হবে না।’’

    তখন এটা শুনেই তাহেরউদ্দিন ঠাকুর বলে যে, “একটা অফিস আমরা খুলেছি। সিঁড়ির নিচে একটা অফিস।’’

    রাত আড়াইটার সময় চাষী আলম এসে বলে, “স্যার, একটু ঘুরে আসি। উনি এসে গেছেন।’’

    “কে এসে গেছেন?’’

    যেয়ে দেখি মোশতাক সাহেব টুপি-আচকান পরে শুয়ে আছে উপরতলায়।

    শা আ: কোথায় শুয়ে আছে?

    আ সা আ: আগরতলার একটা বাড়িতে– যে বাড়িতে আমরা থাকি আর কী। এর আগেই কিন্তু একটা অফিস করেছে আমাদেরসহ। বলে, ‘‘অফিস করে আপনাকে নিয়ে অগ্রসর হব। কাজের জন্য সেন্টারালাইজ করব।’’

    সন্ধ্যার দিকে আমি, জেনারেল ওসমানী (তখন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, ১০ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর জেনারেল পদে উন্নীত) ও মোশতাক রেস্টহাউসে গেলাম। লক্ষ্য করলাম মোশতাকের হাবভাব। যেন নিজেই গভরমেন্ট ডিক্লেয়ার করবে।

    সৈ জো তা: ওদিকে কিন্তু ফার্স্ট এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা হয়। ১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লিতে পৌঁছেন এবং ৩ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ওনার ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার হয়। সেদিন তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা বলে বলেছিলেন যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একান্ত বাংলাদেশেরই। এই যুদ্ধ করবে বাংলাদেশের মুক্তিকামী যোদ্ধা-জনতা। এই যুদ্ধর আন্তর্জাতিকীকরণ তারা চান না। তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিঃশর্তভাবে সহযোগিতা লাভের জন্য অপর এক স্বাধীন রাষ্ট্রের কাছে এসেছেন।

    আ সা আ: ওটা আরেক চ্যাপ্টার। আমার চ্যাপ্টার আমি বলছি। ওখানে যেয়ে বসলাম। অন্যান্য এমপিরা এল। তাজউদ্দীন সাহেব সৈয়দ সাহেবকে আনলেন তুরা থেকে।

    [১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্ধান পান। তিনি তাকে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা এবং তাঁকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি করে কেবিনেট গঠনের কথা জানান। তারপর তাঁকে নিয়ে বিএসএফের ডাকোটা প্লেনে আগরতলায় ফেরেন।]

    মনসুর আলী সাহেবকেও আনল একটা মিলিটারি প্লেনে।

    শা আ: তুরা?
    তাজউদ্দীন সাহেব ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আনলেন তুরা থেকে

    তাজউদ্দীন সাহেব ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আনলেন তুরা থেকে

    সৈ জো তা: হ্যাঁ, তুরা–

    আ সা আ: তুরা পাহাড়। ময়মনসিংহর বর্ডারে–

    সৈ জো তা: ওখান থেকে আনল নজরুল ইসলামকে–

    আ সা আ: ওখান থেকে নিয়ে এল আগরতলায়। আমরা মোটামুটি চাইছিলাম তেলিয়াপাড়া সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া– সিলেটের বর্ডারে তেলিয়াপাড়ায় একটা বাগান আছে, সেখানে আমরা হেডকোয়ার্টার করব। ওখানে যারা ছিলাম আর কী। পাকিস্তান আর্মি ঢুকতে পারে নাই। চারদিকে বাগান-টাগান আছে। তেলিয়াপাড়া লাস্ট স্টেশন সিলেটের। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বর্ডারে। কুমিল্লার বর্ডারে। তেলিয়াপাড়া লিবারেটেড তো। জেনারেল রব সাহেব বললেন, “তেলিয়াপাড়াটা ভালো।’’

    তখন তাজউদ্দীন সাহেব ওনারা এসেছেন। তখন তাজউদ্দীন সাহেব রিপোর্ট করলেন যে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। মোশতাক তখন বুঝল যে ঘটনা তো হয়ে গিয়েছে। উনি চট করে উঠে সালাম দিয়ে বললেন, “আসি।’’

    শা আ: ১০ তারিখ এ কথা তাজউদ্দীন সাহেব জানালেন?

    আ সা আ: ৯ তারিখ রাতে। ১০ তারিখ পরে আসবে।

    সৈ জো তা: ১০ তারিখে তো রেডিওতে অ্যানাউন্স হল।

    [বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা, সরকারের নীতিমালা, মুক্তিযুদ্ধর মাধ্যমে দেশ স্বাধীন, পাকিস্তান সরকারের গণহত্যা সম্পর্কে বহির্বিশ্বকে অবহিত করা এবং বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে বিশ্ববাসীর সমর্থন লাভ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দান করেন।]

    আ সা আ: ৯ তারিখ সন্ধ্যায় খবর পেয়ে আমি মোশতাককে বললাম, “মোশতাক সাহেব, আপনি উঠেন।’’

    আমি তো ঠিক সময়ে শক্ত হই।

    শা আ: উনি কী বললেন?

    আ সা আ: উনি উঠে গেলেন। আমাদের আলাপের মধ্যে তাজউদ্দীন সাহেব রিপোর্ট করলেন যে এই হয়েছে। উনি রিপোর্ট করলেন মিসেস গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার কথা। বললেন, ‘‘এখন কী করার দরকার?’’

    আমি বললাম, “বঙ্গবন্ধু যখন অনুপস্থিত, তাকে প্রেসিডেন্ট করা ছাড়া উপায় নাই। কারণ উনি তো উপস্থিত হয়ে পার্টিসিপেট করতে পারবেন না। আর ডেপুটি লিডার উনি (সৈয়দ নজরুল ইসলাম), ওনাকে অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট আর তাজউদ্দীন সাহেব– বাকি সেক্রেটারি।’’

    এটা একটা কথা আলাপ করছি, এর মধ্যে উনি উঠে গেলেন ‘স্লামালাইকুম’ বলে। আমি বললাম, “মোশতাক সাহেব, বসেন। সমস্ত দেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে– কী করব না করব– একটা জায়গায় তো আসতে হবে।’’

    বগুড়াও ফল করে যাচ্ছে। কুষ্টিয়ার মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা তখনও ফ্রি ছিল। কর্নেল ওসমান ডিক্লেয়ার করল আমাদের চুয়াডাঙ্গায় হেডকোয়ার্টার করার কথা।

    সৈ জো তা: চুয়াডাঙ্গার ওসমান– মেজর ওসমান (মেজর ওসমান কুষ্টিয়ায় পাকিস্তান সেনাদের বিরুদ্ধে অসম সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন)।

    আ সা আ: হ্যাঁ, হ্যাঁ। ডাক্তার আসহাবুল হক তারাও সেখানে একটা ডিক্লেয়ারশন দিয়ে দিল যে ওখানে হেডকোয়ার্টার হবে।
    খন্দকার মোশতাক আহমেদ

    খন্দকার মোশতাক আহমেদ

    [বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী চুয়াডাঙ্গায় হবে, এই ঘোষণাটি উচ্ছাসের বসে ফাঁশ করে দেওয়ার ফলে পাকিস্তান সেনারা চুয়াডাঙ্গায় বোমাবর্ষণ করে। এর ফলে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের কথা গোপন রাখা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী ওই স্থানের নামকরণ করেন ‘মুজিবনগর’।]

    ঠিক হল আমরা বসব আবার। ভোর হয়ে গিয়েছে তো– সকাল হয়ে গিয়েছে। একটা বাংলো গেস্ট হাউস ছিল– সেখানে আমাকে নিয়ে গেল। সেখানে তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আলাপ করলাম। ঠিক হল সৈয়দ সাহেব, মনসুর আলী সাহেব আর আমি– আমরা তিনজন মিলে ডিসাইড করব কী করা যায়, আমাদের মধ্যে মিনিস্টার কে হবে, কী করা না-করা যায়…

    সৈ জো তা: আর কামরুজ্জামান সাহেব?

    [উনি তখন কোলকাতায়।]

    আ সা আ: তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, “আপনারা বসেন, বসে ডিসাইড করেন।’’

    শা আ: ডিসাইড করবেন কি?

    আ সা আ: সরকার গঠন করা। কারণ একটা সিদ্ধান্তে যেতে হবে তো।

    সৈ জো তা: মানে লবি কনটিনিউ?

    আ সা আ: মানে, একটা লাইনে আনতে হবে তো। ভোরবেলায় মান্নান (আবদুল মান্নান এমপি) সাহেবকে বললাম “মান্নান সাহেব, একটা গভরমেন্ট না করলে হবে না।’’

    তখন সৈয়দ সাহেব, মনসুর আলী আর আমি বসলাম। এইভাবে সারাদিন গেল। এই ৩ টা ৪ টার সময় সৈয়দ সাহেব বললেন, “কীভাবে গভরমেন্ট হবে?’’

    আমি বললাম, “একটা তো হাইকমান্ড আছে আমাদের। বঙ্গবন্ধু– যারা অফিস বেয়ারার ছিলেন তাদেরকে নিয়ে ডিল করেছেন। তাজউদ্দীন সাহেব সেক্রেটারি– সবসময় ওনার সঙ্গে ছিলেন। আপনি আছেন। মনসুর আলী সাহেব এখনও ভাইস প্রেসিডেনট, মোশতাক ভাইস প্রেসিডেন্ট, কামরুজ্জামান সাহেব অল পাকিস্তানের (আওয়ামী লীগ) সেক্রেটারি। এর বাইরে গেলে কিন্তু সবাই মিনিস্টার হতে চাইবে। এত মিনিস্টারের তো দরকার নাই। এনাদের তো কোনো ডিউটি নাই, ফাংশন নাই।’’

    সৈ জো তা: এটা তো ওয়ার টাইম।

    আ সা আ: হ্যাঁ, এটা ওয়ার টাইম। সৈয়দ সাহেবকে আমি বললাম, “আপনার একটা কন্সটিটিউশনাল ভূমিকা আছে, সেটা হল পার্টিগতভাবে আপনি অ্যাকটিং ভাইস প্রেসিডেন্ট। দলীয়ভাবে আপনি ডেপুটি লিডার, ইলেকটেড। ইলেকটেড মেম্বাররা আপনাকে ডেপুটি লিডার করে রেখেছে। সুতরাং আমরা দুইমাস পরে সংসদের মেম্বারদের ডাকব এবং এই গভরমেন্টকে আমরা কনফিডেন্স দেব।’’

    এই বলে আমরা বাইরে গেলাম। তাজউদ্দীন সাহেব তো ওপরে রয়েছেন। তারপর আমরা তিন-চারজন আবার বসলাম। কিন্তু মোশতাক আসে না। তখন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এসে আমাকে একটা কথা বলল, “সামাদ ভাই, একটা কাজ করেন, আমরা বিদেশে আছি– এখন তো সারভাইব করার ব্যাপার– ওকে (মোশতাককে) একটা পজিশন দিয়ে দেন– ফরেন মিনিস্টারের।’’

    শা আ: আহহা!

    আ সা আ: তাজউদ্দীন সাহেব, আমি, সৈয়দ সাহেব, কামরুজ্জামান আসেননি– উনি ক্যালকাটায় ছিলেন। আমরা চারজন (মনসুর আলীসহ) মান্নান সাহেবকে ডাকলাম। ডেকে বললাম, “ঠিক আছে দিয়ে দেন।’’

    তাকে বাদ দিলে আবার মনে করবে আমরা যেন–

    সৈ জো তা: তাকে আয়ত্তের মধ্যে আনা।

    আ সা আ: রাতে, সন্ধ্যার পর সমস্ত এমপিদের– যারা ছিল ওখানে– ডেকে কেবিনেট ঘোষণা করা হল। ওখানে ইন্ডিয়ান চ্যানেল যারা ছিল তারা বলল, “ক্যাপিটাল ওদিকে হবে, ক্যালকাটার সাইডে– ওয়ার্ল্ডটা ওদিকে– এই আগরতলার দিকে পড়লে যোগাযোগের অসুবিধা।’’

    [প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাজধানী মুজিবনগর, যার নামকরণ তাজউদ্দীন আহমদ করেছিলেন, তা ছিল মেহেরপুরে, বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে। তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন যে যুদ্ধাবস্থায় সরকার যেখানে যাবে তার নাম হবে ‘মুজিবনগর’।]

    পরদিন গভরমেন্ট ঘোষণা করা হল। গেলাম ক্যালকাটা। জায়গা পাওয়া যায় না। বিএসএফের– কী নাম ছিল? গোলোক রায়?

    শা আ: গোলোক মজুমদার (বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের আইজি)–

    আ সা আ: গোলোক মজুমদারের হেড অফিসে আমরা থাকতাম। সেখানেই আমরা গভরমেন্ট ফর্ম করলাম। গভরমেন্ট তো আর বাইরে যেতে পারে না– ইন্ডিয়ার ভেতরে কাজ। তখন আমরা স্ট্যান্ড নিলাম যে আমরা সেন্ট্রাল গভরমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করব। ওই মিসেস গান্ধীর সঙ্গে দেখা হল আবার। তারা বাইরের জগতে (বাংলাদেশের পক্ষে) প্রোপাগাণ্ডা করবে। থিয়েটার (৮ নম্বর) রোডে হেড অফিস করা হল। থাকবার জায়গা যেটা, আমি সেটা আরও পরে পেয়েছি।

    ভাবি, আপনি তখনও আসেননি।

    সৈ জো তা: আমি গেলাম মে মাসের একদম লাস্টে।

    [২৫ মে, ১৯৭১, মৃত্যু তালিকাভুক্ত বেগম তাজউদ্দীন, চার নাবালক ছেলেমেয়ে নিয়ে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চক্ষু এড়িয়ে সীমান্ত পার হন।]

    আ সা আ: ওই মে মাসেই এটা হল। অফিস হল ওই থিয়েটার রোডে। তাজউদ্দীন সাহেব ওই থিয়েটার রোড ছাড়েননি।

    [তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না। রণাঙ্গনে যোদ্ধারা যদি পরিবার ছেড়ে থাকতে পারেন, তাহলে তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের প্রধানমন্ত্রী হয়ে কেন পারবেন না? ৮ নম্বর থিয়েটার রোড ছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাসস্থান। অফিস কক্ষের পাশেই একটি রুমে তিনি থাকতেন। নিজের কাপড় নিজেই ধুতেন এবং আহার-নিদ্রা প্রায় ত্যাগ করে তিনি স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।]

    সৈ জো তা: ২৭ মে যেয়ে উঠলাম (আগরতলা হতে কোলকাতায়)–

    আ সা আ: (আমাকে উদ্দেশ্য করে) তোমরা যে বাড়িতে উঠলে– সে বাড়িতে তাজউদ্দীন সাহেব দিনের বেলা খালি দেখা করে আসত–

    শা আ: দিনের বেলায়ও যেত কিনা– দুবার বোধহয় গিয়েছিল।

    [একমাত্র পুত্র দেড় বছরের শিশু সোহেল মারাত্মক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাজউদ্দীন আহমদকে সে খবর জানালে তিনি দেখতে যেতে অপারগতা জানিয়ে বলেন যে তার পুত্রকে তিনি অন্য সবার পুত্র থেকে আলাদা করে দেখেন না। যুদ্ধাবস্থায় তার কাছে সব শিশুই সমান। পরে গোলোক মজুমদার এবং বিএসএফের নিরাপত্তা অফিসার শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়ের পীড়াপীড়িতে তিনি অসুস্থ পুত্রের শিয়রে অল্প কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে দোয়া করে চলে আসেন। দ্বিতীয়বার ৬ ডিসেম্বর, ভারতের বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দিন, তার পরিবারের উল্টা দিকের ফ্ল্যাটে, সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে মিটিং সেরে যাবার পথে তিনি কয়েক মিনিটের জন্য পরিবারের সঙ্গে দেখা করে অফিসে চলে যান।]

    আ সা আ: উনি কিন্তু অফিস ছাড়লেন না। বললেন, “লিবারেশন না হলে যাব না।’’

    সৈয়দ সাহেব– ওনারা গেলেন ওখানে।

    [মন্ত্রিপরিষদের পরিবারদের জন্য ভারত সরকার, পার্ক সার্কাসে ড. সুন্দরী মোহন এভিনিউতে বসবাসের ব্যবস্থা করে। ওখানেই বাকি মন্ত্রীরা পরিবারসহ থাকতেন।]

    ওখানে বসেও– ওই বাড়িতে বসেও কন্সপিরেসি হয়েছে। তারপর শিলিগুড়ি গেলাম– সমস্ত এমপিদের ডাকা হল।
    তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন যে যুদ্ধাবস্থায় সরকার যেখানে যাবে তার নাম হবে ‘মুজিবনগর’

    তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন যে যুদ্ধাবস্থায় সরকার যেখানে যাবে তার নাম হবে ‘মুজিবনগর’

    [জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত শিলিগুড়ির এই সম্মেলনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানায়। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অনুসারী ছাত্র নেতাদের প্রচণ্ড বিরোধিতা এবং মোশতাকের ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও এই সম্মেলন সফল হয়। মোশতাক ও মনি বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করে।]

    সৈ জো তা: কন্সপিরেসি কারা করল?

    আ সা আ: মোশতাকরা। সে তো পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার নিজ হাতে রেখেছে। মোশতাক নো কনফিডেন্সের চক্রান্ত করেছিল। তারপর বিভিন্ন জেলার সঙ্গে আলাপ করে সৈয়দ সাহেবকে বললাম। সৈয়দ সাহেবের তো কী পজিশন। সৈয়দ সাহেব করলেন কী, ওখানে (শিলিগুড়ি) যাবার পরে বক্তব্যটা খুব কড়াভাবে দিলেন যে, “আমরা এখন সংগ্রামে যাচ্ছি……”

    সৈ জো তা: তখন এই গভরমেন্টের অ্যাগেইনস্টে একটা ইয়াং বাহিনীকে মোশতাক তার দলে রেখেছিল।

    আ সা আ: সেটা তো পরে– তারপরে সেখানে পারল না– দেখল সব গোলমাল হয়ে গিয়েছে। সৈয়দ সাহেবের বক্তব্য–

    সৈ জো তা: সৈয়দ সাহেব তখন খুব strong ছিলেন–

    আ সা আ: খুব strong, তাঁর সঙ্গে বহু আলাপ হয়েছে। সৈয়দ সাহেবকে বোঝালে উনি কিন্তু খুব strong থাকতেন।

    শা আ: সৈয়দ সাহেব কোথায় বক্তৃতা দিলেন?

    আ সা আ: শিলিগুড়িতে। পার্লামেন্টারি পার্টির মিটিং ডাকলেন। একটা নিয়ম আছে। একটা কন্সটিটিউশনাল পজিশন দিতে হবে তো। ইলেক্টেড গভরমেন্টের যারা মেম্বার আছে তারা একটা কনসলিডেটেড প্রস্তাব পাশ করল যে এই সরকার প্রভিশনাল সরকার। এর আগে ১৭ এপ্রিল আমরা মুজিবনগরে গভরমেন্ট ঘোষণা করলাম।

    সৈ জো তা: শপথ নিলাম মুজিবনগরে।

    [গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান।]

    আ সা আ: ইউসুফ আলী তো আগে জানতেনই না। তাঁকে আগে পাঠিয়ে দিয়েছি। পড়বার (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র) সময় তাঁর হাতে দিয়েছি। কেউ একজন ঘোষক, কেউ একজন পাঠক। এগুলো তো কয়েকজন মিলে– দুই-তিন জন মানুষ মিলে আমরা করেছি। স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস তো আছেই, একের পর এক।

    শা আ: আমরা যাতে একতাবদ্ধ থাকি, এখন এই সরকারে যোগদান করি, এটার পক্ষে সৈয়দ সাহেব বক্তব্য রাখলেন–

    আ সা আ: সৈয়দ সাহেব বক্তব্য রাখলেন যে “আমরা struggle এ আছ– আমরা (সম্মিলিতভাবে) যা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই হবে– (এমপিদের উদ্দেশ্যে) আপনারা যার যার এরিয়ায় যান, জোনাল কমিটি করেন।’’ যা যা প্রোগ্রাম ছিল তার পক্ষে কড়া বক্তব্য দেন। তারপর মনসুর আলী সাহেবকে বলেন, “আপনি প্রিজাইড করেন।’’ মনসুর আলী সাহেব প্রিজাইড করলেন। মনসুর আলী সাহেবও শক্ত ছিলেন। মোশতাকের কন্সপিরেসি ওইভাবে ভেঙে যায়– নো কনফিডেন্স আনার তার ক্ষমতাই নাই– ওই লাইনেই এল না–

    সৈ জো তা: পারল না। চেষ্টা করেছিল– পারল না।

    শা আ: এ রকম হীন তো মোশতাক ছাড়া কেউ ছিল না?

    আ সা আ: নাহ! হি ইজ দ্য ‘হীন’।

    সৈ জো তা: সব খেলোয়াড়ের একটা মাস্টার লিডার থাকে না! তোমার আব্বুর দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, মুজিব হত্যার পর সামাদ সাহেব যদি ছাড়া থাকতেন, তাহলে উনি কারেক্ট ডিসিশন নিতে পারতেন। পার্টিটাকে ঠিক রাখতে পারতেন।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/16167
  • Biplob Rahman | ২৮ মার্চ ২০১৪ ১০:০৫582759
  • সলিমুল্লাহ খান
    মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
    মার্চ ২৬, ২০১৪

    ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলিতে কি বুঝায় তাহা লইয়া সম্প্রতি একটি সূক্ষ্ম বিতর্কের সূচনা হইয়াছে। কিন্তু কয়েকটি মোটা কথা লইয়া আশা করি কেহ বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হইবেন না। ইহাদের মধ্যে প্রধান কথা খোদ ‘স্বাধীনতা’ অথবা যে কোন জাতির বা জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক আইনানুগ অধিকার।

    ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাত শেষে অর্থাৎ ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশ কার্যত স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইহার দুই সপ্তাহ পরে গঠিত হয় অস্থায়ী সরকার। ইহাতেই প্রমাণ বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য অন্তত সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল না। মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত এই সরকার ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করেন। স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রকে প্রামাণ্য দলিল বলিয়া গণ্য করিলে কয়েকটি বিষয়ে বিতর্কের সমাপ্তি হয়। ১০ই এপ্রিলের ঘোষণাপত্র জারি হইয়াছিল ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে। এই প্রতিনিধিগণ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হইয়াছিলেন।



    ১০ই এপ্রিলের ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ কি কারণে স্বাধীনতা ঘোষণা করে তাহার একটি ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়। সেই ব্যাখ্যা অনুসারে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্বতস্ফূর্তভাবে কিম্বা আগ বাড়াইয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নাই। স্বাধীনতা ঘোষণা করিতে তাহাদিগকে বাধ্য করা হইয়াছিল। কারণ ‘পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সহিত আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে।’

    খোদ ১০ই এপ্রিলের ঘোষণাপত্রেই উল্লেখ করা হইয়াছিল ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান’। দুঃখের মধ্যে, স্বাধীনতার ঘোষণা লইয়া কেহ কেহ পরকালে একপ্রস্ত বিতর্কের সূচনা করিয়াছিলেন। ১০ই এপ্রিলের ঘোষণাপত্রের প্রামাণ্যতা কি কেহ আজ পর্যন্ত অস্বীকার করিয়াছেন? না করিলে জিজ্ঞাসা করিতে হয় এই ঘোষণাপত্রের কোন বক্তব্যটিকে তাহারা অস্বীকার করিতেছেন?

    প্রশ্ন উঠিবে ২৬শে মার্চ তারিখে কেন স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করা হইয়াছিল। ১০ই এপ্রিলের ঘোষণাপত্রে তাহার একটা উত্তরও পাওয়া যাইতেছে। ঘোষণাপত্র অনুসারে এই উত্তরটি পাঁচ দফায় পাওয়া যায়।

    এক নম্বরে, [পাকিস্তানের] একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

    দুই নম্বর কথা, এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জনকে নির্বাচিত করেন।

    তিন নম্বর কথা, সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে [পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি] জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে মিলিত হইবার জন্য আহবান করেন।

    চার নম্বরে, [পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ] এই আহুত পরিষদ-সভা স্বেচ্ছাচারী ও বে-আইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন।

    আর পরিশেষে, পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের সহিত আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

    এই পর্যন্ত যাহা বলা হইল– অর্থাৎ পাকিস্তান কর্তৃক অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতক যুদ্ধ চাপাইয়া দেওয়া– তাহাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রকৃত আর পর্যাপ্ত কারণ। ইহার সহিত যুক্ত হইয়াছিল আরো একটি বাড়তি কারণ। পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ শুদ্ধ যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াই বসিয়া থাকে নাই। ২৫শে মার্চ মধ্যরাত্রি হইতে তাহারা ‘বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের উপর নজিরবিহীন নির্যাতন ও গণহত্যার অসংখ্য অপরাধ সংঘটন’ করে।

    পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ অন্যায় যুদ্ধ চাপাইয়া দিয়াছিল আর গণহত্যার মতন অপরাধ ও অন্যান্য দমনমূলক কার্যকলাপ করিয়াছিল বলিয়াই বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছিল আর বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করিয়াছিলেন। এই ঘোষণাপত্রের মধ্যস্থতায় তাঁহারা একটি ন্যায়যুদ্ধের আইনানুগ ভিত্তি রচনা করিয়াছিলেন। পিছনে ফিরিয়া তাকাইলে তাই বলিতে হইবে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের চাপাইয়া দেওয়া অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও দমনপীড়নের জওয়াবে বাংলাদেশের জনগণ বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর আপনার কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে। এই যুদ্ধে জনগণের মূলধন ছিল তাহাদের ‘বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী উদ্দীপনা’।



    এই পর্যন্ত যাহা বলা হইল– অর্থাৎ অন্যায় যুদ্ধের মুখে ন্যায়যুদ্ধ– তাহা সত্যের অর্ধেক মাত্র। প্রশ্ন উঠিবে ন্যায়যুদ্ধের মধ্যস্থতায় যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাইবে তাহার লক্ষ্য কি হইবে। ১০ই এপ্রিলের ঘোষণাপত্রে তাহারও একটি জওয়াব পাওয়া যায়। এই ঘোষণাপত্র ঘোষণা করিয়াছিল সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সামান্য কারণ, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত’ করা।

    বাংলাদেশের ভূখণ্ডে কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের জনগণ সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হইয়াছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের শর্তহীন আত্মসমর্পণের ঘটনায় সেই কর্তৃত্বই নিরঙ্কুশ হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিজয় লাভ করে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হইতে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর জনগণ যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হইয়াছিল– যাহার প্রকাশ ১০ই এপ্রিলের ঘোষণাপত্রে পাওয়া যায়– তাহাই তো ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’।

    জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার অর্থাৎ স্বাধীনতা পাওয়ার ৪২/৪৩ বৎসরে আমাদেরও খতিয়ান খুলিয়া দেখিতে হইবে আমরা কি পাইলাম। স্বাধীনতা লাভের চারি বৎসরও পার হইতে না হইতে দেশে কেন সামরিক শাসন নামিয়া আসিয়াছিল? এই জিজ্ঞাসা আমাদের করিতেই হইবে। সেই চারি বৎসরে যাহারা ছিলেন জাতির মনোনীত গণপরিষদ বা নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্য তাহারা কেন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ‘বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী উদ্দীপনা’র মধ্যস্থতায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে পারিলেন না? ইহাও জিজ্ঞাসার বিষয়।

    ইহার পর হরেদরে পনের বৎসর কাটিয়াছে এক ধরনের না আর ধরনের সামরিক শাসনে। ১৯৯০ সনের পর হইতে– মধ্যখানের দুই বছরের কথা ছাড়িয়া বলিতেছি– আবার নিয়মতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হইয়াছে। কিন্তু মানুষের দুঃখ-কষ্টের কি নিবারণ হইয়াছে? ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক সুবিচার’ কি প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে? যদি না পাইয়া থাকে, তবে তাহার জন্য দায়ী কে? চুপ করিয়া থাকা নহে, এই সকল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

    পাকিস্তান ‘স্বাধীন’ হইয়াছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট তারিখে। ইহার দশ বৎসরের মাথায়– ১৯৫৮ সালের ২৭শে অক্টোবর নাগাদ– সেই দেশে পহেলা সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়। ১৯৬৪ সালের শেষদিকে এই ঘটনার কথা স্মরণ করিয়া অধ্যাপক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখিয়াছিলেন, ‘স্বাধীনতার ফলে আমরা কি পেলাম? আমরা যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মিত্র শক্তির নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি যে, তাঁদের আর্থিক ও অন্য সাহায্যে আমরা কিছুটা অগ্রসর হয়েছি। আমরা যে পূর্ণ সাফল্য লাভ করতে পারিনি, তার একটি বড় কারণ ১৯৫৮ সালের ২৭শে অক্টোবরের সামরিক শাসন প্রবর্ত্তনের পূর্বে যাঁরা শাসনকার্যে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁরা ছিলেন ইংরেজের গোলাম। স্বাধীনতার পরেও তাঁরা সেই গোলামীর মনোবৃত্তি ষোল আনা ছাড়তে পারেননি।’ ইহার সহিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আরো একটি বাক্য যোগ করেন: ‘তারপর যাঁরা ছিলেন জাতির মনোনীত রাষ্ট্রীয় কিংবা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, তাঁদের সম্মানিত কয়েকজনকে বাদ দিয়ে বলতে হয় অধিকাংশের মূলমন্ত্র ছিল Nepotism এবং Pocketism, বাংলায় বলতে গেলে “আত্মীয় প্রতিপালন এবং পকেট পরিপূরণ”।’

    এইসব দুর্নীতির কারণেই পাকিস্তানে সামরিক শাসনের প্রয়োজন হয় বলিয়া শহীদুল্লাহ সাহেব অনুমান করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনিও জানিতেন মাত্র শাসনকর্তার পরিবর্তনে দেশের ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। পাকিস্তানের সামরিক শাসন সে দেশের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করে নাই। শহীদুল্লাহ সাহেবের মতে, ইহার প্রধান কারণ জনসাধারণের অজ্ঞতা। তাঁহার কথামৃত সামান্য আরেকটু উদ্ধার করিলে মন্দ হইবে না: ‘অন্ধের পক্ষে দিন-রাত দুইই সমান। মূর্খের পক্ষে আযাদী ও গোলামী দুই সমান। যেখানে প্রকৃত প্রস্তাবে শতকরা ৪/৫ জন শিক্ষিত সেখানে আমরা কি আশা করতে পারি? মূর্খ ও নাবালক দুইই সমান। নাবালককে ফাঁকি দিয়ে তার আত্মীয়-স্বজনেরা নিজেদের জেব ভর্তি করে। এদেশে তাই ঘটেছে।’

    বাংলাদেশ স্বাধীন হইয়াছে আজ ৪৩ বছর হইল। বাংলাদেশেরও অনেক গতি হইয়াছে। কিন্তু সমাজের ভিত্তি যে জনগণ– বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী যে জনগণ– তাহাদের ভাগ্যের কি পরিবর্তন হইয়াছে? আমাদের দেশে এই ৪৩ বছরেও– অন্য কথা না হয় বলিলাম না, বলেন দেখি– প্রকৃত প্রস্তাবে শতকরা কতজন শিক্ষিত হইয়াছেন?



    আমরা নিত্য বলিয়া থাকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লক্ষ মানুষ শহিদ হইয়াছেন। কিন্তু আমরা তাঁহাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকাও এই ৪৩ বছরের মধ্যে তৈয়ার করিতে পারি নাই। তাহা হইলে কি করিয়া আমরা ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ নিশ্চিত করিব? ইংরেজি ২০০০ সনের ১২ ডিসেম্বর তারিখে প্রকাশিত এক নিবন্ধে মহান লেখক আহমদ ছফা এই প্রশ্নটি তুলিয়াছিলেন। আমি আজও প্রশ্নটির কোন সদুত্তর পাই নাই। তাই প্রশ্নটির একটু সবিস্তার বয়ান করিতে হইতেছে।
    আহমদ ছফার জন্ম চট্টগ্রাম (দক্ষিণ) জেলার অন্তপাতী পটিয়া উপজেলায়। তাঁহার গ্রামের নাম গাছবাড়িয়া। এখন তাহা সম্প্রতি গঠিত চন্দনাইশ উপজেলায় পড়িয়াছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ ছাড়িয়া আগরতলা হইয়া কলিকাতায় আশ্রয় লইয়াছিলেন। যুদ্ধশেষে তিনি প্রথমে ঢাকায় আসেন, পরে নিজ গ্রামে গেলেন। ইহার পরের কথা তাঁহার লেখায় পাওয়া যাইতেছে: ‘১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে যতবারই আমি গ্রামে গেছি, গ্রামের মানুষদের একটি বিষয়ে রাজি করাতে বারবার চেষ্টা করেছি। গ্রামের মেম্বার, চেয়ারম্যান এবং মাতব্বর-স্থানীয় মানুষদের একটা বিষয়ে রাজি করাতে বারবার চেষ্টা করেছি। আমি তাঁদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম– আমাদের গ্রামের প্রায় একশ মানুষ পাকিস্তানী সৈন্য এবং রাজাকার আলবদরদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। আমাদের গ্রামের মাঝ দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রাস্তাটি চলে গেছে। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, গ্রামের প্রবেশমুখে মুক্তিযুদ্ধে নিহত এই শতখানেক মানুষের নাম একটি বিলবোর্ডে লিখে স্থায়ীভাবে রাস্তার পাশে পুঁতে রাখার জন্য।’

    আহমদ ছফা আরো জানাইতেছেন: ‘আরো একটা বাক্য লেখার প্রস্তাব আমি করেছিলাম। সেটা ছিল এরকম– হে পথিক, তুমি যে গ্রামের ওপর দিয়ে যাচ্ছ সে গ্রামের একজন সন্তান দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে। আমি আমার এই প্রস্তাবটি ১৯৭২ সাল থেকে করে আসছি। প্রথম প্রথম মানুষ আমার কথা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করত। তিনচার বছর অতীত হওয়ার পরও যখন প্রস্তাবটা নতুন করে মনে করিয়ে দিতাম লোকে ভাবত আমি তাদের অযথা বিব্রত করতে চাইছি। আমার ধারণা, বর্তমান সময়ে যদি আমি প্রস্তাবটা করি লোকে মনে করবে আমার মাথাটা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেছে।’

    তাহা হইলে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলিতে কি বুঝাইতেছে? শুদ্ধ আহমদ ছফার নিজ গ্রামে কেন, সারাদেশেই তো একই অবস্থা। তিনি লিখিতেছেন: ‘উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গ এবং মধ্যবঙ্গের প্রায় আট-দশটি জেলায় আমাকে কার্যোপদেশে এন্তার ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। আমি যেখানেই গিয়েছি লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করেছি, এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন ঘটনা ঘটেছিল কিনা। অনেক গ্রামের লোক আমাকে জানিয়েছে, ‘আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবিরা একেবারেই আসেনি’। অনেক গ্রামের লোক জানিয়েছে পাঞ্জাবিরা এসেছিল, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে এবং অনেক খুনখারাবি করেছে। আমি জিজ্ঞেস করতাম যে সব মানুষ মারা গেছে তাদের নাম-পরিচয় আপনারা জানেন কিনা। গ্রামের লোক উৎসাহ সহকারে জবাব দিতেন– জানব না কেন! অমুকের ছেলে, অমুকের নাতি, অমুকের ভাই ইত্যাদি ইত্যাদি।’

    তবুও কেন মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের একটা পূর্ণ তালিকা কেহ প্রণয়ন করিলেন না! আহমদ ছফা আক্ষেপ করিতেছেন, ‘আমি তখন বলতাম, মুক্তিযুদ্ধে নিহত এই মানুষদের নাম আপনারা রাস্তার পাশে লিখে রাখেন না কেন! কোন লোক যখন আপনাদের গ্রামের ওপর দিয়ে যাবে এবং নামগুলো পড়বে [তখন সেই] পথিকের মনে আপনাদের গ্রাম সম্পর্কে একটা শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেবে। গ্রামের লোকেরা আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকত। যেন আমি কি বলছি সেটার মর্মগ্রহণ করতে একেবারে অক্ষম।’

    এই জায়গায় আসিয়া আমাদের মহান লেখক দেখাইতেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কি সুদূর অবস্থা হইয়াছে! আহমদ ছফা লিখিয়াছিলেন, ‘বাংলাদেশের যে সমস্ত অঞ্চলে আমি গিয়েছি কোথায়ও দেখিনি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নাম যত্ন এবং সম্মানের সঙ্গে লিখে রাখা হয়েছে। এ ধরনের একটি কাজ করার জন্য আহামরি কোন উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল না। দেশের প্রতি এটুকু ভালবাসা এবং মুক্তিযুদ্ধের কারণে নিহত মানুষদের প্রতি এটুকু শ্রদ্ধাবোধই যথেষ্ট ছিল।’ ইহার প্রতিকার আজও কি সম্ভব নহে? সম্ভব না হইলে বলিতে হইবে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলিতে কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নাই।

    ১০ মার্চ ২০১৪

    দোহাই

    ১. অধ্যাপক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ‘স্বাধীনতা’, দৈনিক পয়গাম, বিপ্লব সংখ্যা, ২৬ অক্টোবর ১৯৬৪, ৯ কার্তিক ১৩৭১।

    ২. আহমদ ছফা, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথায় জন্মায়?’ খবরের কাগজ, ১৯ বর্ষ, ৫০ সংখ্যা, ১২ ডিসেম্বর ২০০০, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪০৭।

    ৩. ‘১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’, সপ্তম তফসিল [১৫০ (২) অনুচ্ছেদ], গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, পুনর্মুদ্রণ, অক্টোবর ২০১১।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/16290
  • Biplob Rahman | ২৮ মার্চ ২০১৪ ১০:১৮582760
  • অমি রহমান পিয়াল
    রহস্যময় মাহমুদ হোসেন ও কালুরঘাট
    মার্চ ২৭, ২০১৪

    কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের (ইটস জাস্ট আ ট্রান্সমিটার) উদ্যোক্তা এবং জিয়াকে এতে সম্পৃক্ত করার পেছনে আছেন একজন অবাঙালি! অবিশ্বাস্য, তাই না? রহস্যময় এই চরিত্রের নাম মাহমুদ হোসেন। তিনি নায়ক না খলনায়ক তা মূল্যায়িত হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন; তবে তাতে রহস্যটা মেটেনি। বাস্তবতা হচ্ছে, ২৬ মার্চ রাত দশটায় ‘হ্যালো ম্যানকাইন্ড’ বলে ভরাট কণ্ঠের উচ্চারণে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারটি আবারও সচল করেছিলেন মাহমুদ হোসেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তার তৎপরতায় বোঝা গেছে, তিনি আসলে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন বাঙালিদের। তবে ঠিক কীভাবে সেটি রহস্যই রয়ে গেছে।

    শুরু হোক মাহমুদ হোসেনের রহস্যময়তার। আরম্ভ করছি কালুরঘাটে সে সময় উপস্থিত এবং জিয়ার অন্যতম সহচর মীর শওকত আলীর স্মৃতিচারণ দিয়ে—

    ‘‘…কক্সবাজার যাওয়ার পথে কালুরঘাট ব্রিজ পেরুলেই রাস্তাটা একটা ঢালের তীক্ষ্ম বাঁক নিয়েছে। তারপর এগিয়ে গেছে সোজা পটিয়া, দুলাহাজরা এবং কক্সবাজার হয়ে মূল ভুখণ্ডের সর্বদক্ষিণের প্রান্ত টেকনাফের দিকে। ঢালের শেষ মাথায়, যেখানে রাস্তাটা আবার সোজা হয়েছে, একটা পেট্রোল পাম্প আছে। পাম্পটা ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, অন্ধকারে ডুবে ছিল জায়গাটা। একপাশে কিছু গাছের গুঁড়ি স্তূপাকারে রাখা, কিছু খালি বাসও ছিলও এখানে। পলায়নপর ড্রাইভাররা ফেলে রেখে গিয়েছিল। পাম্প স্টেশনের আশেপাশে গোটাকতক গাড়ি আর পিকআপও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা ছিল। ক্রমশ রাত ঘনিয়ে এল।

    রাত তখন আটটা। একটা গুঁড়ির উপর বসে কথা বলছিলাম আমি আর অলি। একটা বাসের ভেতর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন জিয়া। হঠাৎ একটা লোককে এগিয়ে আসতে দেখলাম আমরা। মোটামুটি দীর্ঘকায়, চমৎকার চেহারা, মাথায় লম্বা চুল, বয়স মধ্য ত্রিশের মতো হবে। আগন্তুক আমাদের কাছে এসে জানালেন, জিয়ার খোঁজ করছেন তিনি। মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম আমি আর অলি। কারণ ওই অবস্থায় ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছিল।

    যাহোক, আমরা তার পরিচয় জানতে চাইলাম; জিয়াকে তিনি চেনেন কীভাবে। কিন্তু পরিচয় বা উদ্দেশ্য জানাতে রাজি হলেন না ভদ্রলোক। জিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য জোর করলেন। আমি চমৎকার আমেরিকান উচ্চারণ ভঙ্গীতে আলাপরত আগন্তুককে নিয়ে ব্যস্ত। ঠিক তখন ক্যাপ্টেন অলি গিয়ে জিয়াকে নবাগতের উপস্থিতির কথা জানালেন। একটু বাদেই অলি ফিরে এসে বললেন, ভদ্রলোককে বাসের ভেতর নিয়ে যেতে বলেছেন জিয়া।

    আগন্তুককে নিয়ে আমরা বাসে অপেক্ষারত জিয়ার কাছে এলাম। জিয়া আমাদের দুজনকে বেরিয়ে যেতে ইশারা করলেন। আগন্তুককে আগেই তল্লাশি করা হয়েছিল, জিয়ার একখানা ফটোগ্রাফ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি তার কাছে। আগন্তুকের সঙ্গে জিয়াকে একা রেখে বেরিয়ে এলাম আমরা।…’’

    (মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় প্রথম প্রতিরোধ: লে.জে মীর শওকত আলী; গোলাম মোস্তফা সম্পাদিত ‘অনন্য জিয়াউর রহমান’, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আগস্ট ২০০৪)

    ২৭ মার্চের সে রাতের ঘণ্টাখানেক একান্ত আলাপচারিতার পর আগন্তুক যখন বেরিয়ে গেলেন, জিয়া তার পরিচয় দিলেন সঙ্গীদের। লোকটা আমাদের বন্ধু, আমাদের একটা উপকার করতে চায়। কী উপকার, কী তার ধরন সে আলোচনায় একটু পরেই আসছি। কিন্তু মীর শওকতের লেখায় বা আর কোথাও সেই ফটোগ্রাফের রহস্য মেলে না। কীভাবে একজন বিদেশির বুকপকেটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসারের ছবি এল তা জানা হয় না আমাদের। তার আগেই অবশ্য বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তার স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাটা পড়ে ফেলেছেন।

    তবে জিয়াই প্রথম নন। চট্টগ্রাম শহরে প্রতিরোধ লড়াইটা ঢাকার ঘণ্টাকয়েক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এর নেতৃত্বে ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ক্যাপ্টেন রফিক। ২৫ মার্চ রাতে জিয়া যখন পরিস্থিতি আরও ভালো করে বোঝার জন্য ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের নিয়ে পটিয়ার দিকে সরে গেছেন (চট্টগ্রাম থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ), রফিক তাঁর সীমিত লোকবল ও সামর্থ্য নিয়েই জোর লড়াই লড়ছেন। সেদিন রাত দুটোয় রেলওয়ে হিলে রফিকের ট্যাকটিকাল হেডকোয়ার্টারে আমরা একই আগন্তুকের দেখা পাই।

    আগন্তুকের নাম বা পরিচয় রফিক দেননি। মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা তাঁর ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইতে আমরা জানতে পারি, একটি বিদেশি রাষ্ট্রের তরফে তাঁকে সামরিক সাহায্যের প্রস্তাব দেন ব্যক্তিটি। শর্ত তার সঙ্গে কক্সবাজার যেতে হবে। ‘আমি যেতে পারব না, আমি ছাড়া এখানে আর কোনো অফিসার নেই’– রফিকের প্রত্যাখ্যানের পর অপরিচিত লোকটি তাঁকে বিকল্প প্রস্তাব দেন রেডিওতে ভাষণ দেওয়ার। আগের গ্রাউন্ডে এবারও প্রত্যাখ্যান করলেন রফিক। বরং একটি টেপরেকর্ডার এনে তাঁর ভাষণ রেকর্ড করে নেওয়ার পাল্টা প্রস্তাব দিলেন।

    রফিক লিখেছেন:

    ‘‘…. এরপরেও অপরিচিত আগন্তুক তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য আমার উপর এত চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন যে আমি খুবই সন্দিহান হয়ে পড়লাম। পুরা বিষয়টা পাকিস্তানিদের ফাঁদ হওয়া বিচিত্র নয়– আমি ভাবলাম। আমাকে রাজি করাতে না পেরে তিনি রেকর্ডিং যন্ত্রপাতি নিয়ে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু ভদ্রলোক আর কখনও ফিরে আসেননি। পরে আমি জানতে পেরেছিলাম যে তিনি বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অন্য একটি দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাদেরকে কক্সবাজারের দিকে যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করেছিলেন। হয়তো কক্সবাজারের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের স্থান থেকে বাঙালি সৈন্যদেরকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত জনগণ অবশ্য তাকে সন্দেহজনক কার্যকলাপের কারণে মেরে ফেলে। তবে তার এসব কার্যকলাপের পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী ছিল সেটা হয়তো আর কখনও-ই জানা যাবে না।’’

    এ পর্যন্ত সবাই ‘আগন্তুক’ হিসেবেই তার পরিচয় দিয়েছেন; সেটা আরও রহস্যময় করে তুলেছেন বেলাল মোহাম্মদ নিজে তার পরিচয় গোপন করে। অবশ্য ‘মাহমুদ হোসেন’ নামে আমাদের আলোচিত রহস্যপুরুষটির জাতীয়তা ও পরিচিতি সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী তথ্য রয়েছে। মীর শওকত তার চোস্ত আমেরিকান ইংরেজিতে মুগ্ধ; রফিকের মনেই হয়নি তিনি বাঙালি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সফল রূপকার বেলাল মোহাম্মদ নিশ্চিত করেছেন, তিনি বাঙালি। কিন্তু বেগম মুশতারী শফি তাকে উল্লেখ করেছেন ‘ভারতীয়’ বলে। বাংলাদেশে কবে থেকে আছেন এবং কী উদ্দেশ্যে এটা নিয়েও দুজনের মন্তব্য দু’ধরনের।

    এখানে না বললেই নয়, সে সময় এনায়েতবাজারে ডাক্তার শফির বাসা কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের লোকদের একটি আড্ডা গড়ে উঠেছিল এবং বেলাল মোহাম্মদ ছিলেন সেখানকার নিয়মিত অতিথি। এটাও বলতে হবে যে, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বেলাল মোহাম্মদ যে ক’টি সাক্ষাতকার দিয়েছেন তাতে তিনি মিথ্যে না বললেও সত্য গোপন করে গেছেন। কৌশলে আড়াল করেছেন ‘মাহমুদ এপিসোড’। কখনও তাঁর লেখায় এসেছে ‘গাড়ি চালাচ্ছিলেন আমার এক বন্ধু’।

    এমনকি বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমে দেওয়া সর্বশেষ সাক্ষাতকারটিতেও একবারই মাহমুদের উল্লেখ ছিল তাঁর মুখে। সেখানে তাকে ‘আগ্রাবাদ হোটেলের প্রোমোটার জাতীয়’ কিছু বলা হয়েছে। ভিডিওতে তার নাম বলা হলেও যিনি সেটি শুনে শুনে লিখেছেন, তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ঠেকেনি মাহমুদ হোসেনকে, তাই বাদ দিয়েছেন!

    আর বেলাল মোহাম্মদের ব্যাপারটা হল, উনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়ে একটি বই লিখেছেন। এরপর ‘স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক’ নিয়ে বিডিনিউজের আগে ডয়চেভেলেও তাঁর একটি সাক্ষাতকার রয়েছে। সব ক্ষেত্রেই তিনি বইয়ের বক্তব্যটি ধরে রেখেছেন– কালুরঘাট ট্রান্সমিশন সেন্টারটি চালু করা, সেটার প্রতিরক্ষার জন্য রফিককে না পেয়ে পটিয়া থেকে জিয়াকে নিয়ে আসা। তারপর কৌতুকছলে বলা– ‘এখানে তো সবাই মাইনর, আপনিই একমাত্র মেজর, আপনি আপনার নামে একটি ঘোষণা পড়ুন না’। কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই জিয়া তাঁর অনুরোধে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন।

    সুস্পষ্টভাবেই এসবের কৃতিত্ব বেলাল নিজের বলেই দাবি করছেন। এমনকি আঙুলে গুনে জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী নবম ঘোষক, সম্মানী হিসেবে ১৫ টাকার ভাতা পেতেন তখনকার ঘোষকরা– এ জাতীয় রসিকতাও আছে তাঁর বয়ানে।

    চারদিনের ওই শব্দ-লড়াইয়ে (প্রোপোগাণ্ডমূলক প্রচারণা অর্থে) বেলাল মোহাম্মদদের কৃতিত্ব কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু একটু ঘাঁটাঘাটি করলেই ছায়া এবং কায়াকে আলাদা করে ফেলা যাচ্ছে। রফিকের মুখেই আমরা শুনেছি, ২৫ মার্চ রাত দুটোয় তাঁর কাছে এসেছিলেন মাহমুদ, রেডিওতে ঘোষণা পাঠের আবদার নিয়ে। বেলালরা কালুরঘাটের ওই ট্রান্সমিশন সেন্টারটি মূল বেতারের বিকল্প হিসেবে চালু করার পেছনে মূল মন্ত্রণাটিও ক্ষুরধার মাহমুদ হোসেনের মাথা থেকে বেরিয়েছে ধরলে, অনেক হিসেবই দুয়ে দুয়ে চারের মতো মিলে যায়। মিলিয়ে দেন বেলাল নিজেই।

    ২৬ মার্চ সন্ধ্যার পর তাঁরা ওই বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র চালু করে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করেন। রাতে যখন আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ হান্নান সেখানে গেলেন, তিনি বললেন এই ট্রান্সমিটার দিয়ে তিনি সেদিন দুপুরেই একদফা ঘোষণা পাঠ করে গেছেন (বিডিনিউজে বেলাল মোহাম্মদের সাক্ষাতকার ২য় পর্ব)। বইয়ে মূল বেতারের কথা বলে এড়িয়ে গেলেও, সাক্ষাতকারে আর সেটা অস্বীকার করেননি।

    কথা হচ্ছে, হান্নান কীভাবে এই ট্রান্সমিশন সেন্টারটি ব্যবহার করলেন, কে তাকে দিয়ে ঘোষণা পাঠ করাতে সাহায্য করেছেন? বেলাল মোহাম্মদ এড়িয়ে গেছেন; আমার ধারণা উত্তরটা তাঁর জানা। মুশতারী শফিই আমাদের জানিয়ে দেন যে, ২৭ মার্চ সকালে তাঁর বাসা থেকেই গাড়ি করে বেলালকে নিয়ে পটিয়া রওনা দেন মাহমুদ। অথচ বেলাল মোহাম্মদ স্মৃতিচারণে এই যাত্রাকে ‘এক বন্ধুর গাড়িতে’ বলে চালিয়ে দিয়ে নিজেকে বসিয়ে রেখেছেন ‘ড্রাইভারের পাশের আসনে’।

    আসা যাক বেলাল কীভাবে মাহমুদকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। মাহমুদ হোসেন নিজেকে মূখ্য চরিত্রে রেখে ‘অরিজিন অব হিপ্পিজম’ নামে একটা ছবি তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিলেন যার প্রেক্ষাপট ভারতবর্ষ। পাশাপাশি তুলে ধরেছেন তার বিপ্লবী চরিত্র। লন্ডনে আইউব খানের এক সভায় নাকি বোমা হামলা চালিয়েছিলেন ভাইয়ের সঙ্গে মিলে। আর মুশতারী শফির বইয়ে ঠিক উল্টো চিত্র পাই আমরা। এখানেই আমরা জানতে পারি সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের ভাতিজি ভাস্করপ্রভার স্বামী মাহমুদ হোসেন।

    ২৭ মার্চের রোজনামচায় মুশতারী লিখেছেন:

    ‘‘… এ সময় মাহমুদ হোসেন নামে একজন লোক এল আমার বাসায় বেলাল ভাইকে কোথায় যেন নিয়ে যেতে। মাহমুদ হোসেন ভারতীয় লোক। থাকে কখনও লন্ডন, কখনও আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায়। তার স্ত্রী নাকি ভারতের জনতা পার্টির নেতা মোরারজী দেশাইর ভাইঝি। নাম ভাস্করপ্রভা। তিনি প্রায় মাসকয়েক হল বাংলাদেশে এসেছেন। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের পল্লীগীতি ও বাউল সঙ্গীতের উপর ধারাবর্ণনা সহকারে লং প্লের রেকর্ড বের করবেন। বেলাল ভাইয়ের সাথে তার চুক্তি সংগৃহীত গানের ধারাবর্ণনা লিখে দেবার। উঠেছেন আগ্রাবাদ হোটেলে। চট্টগ্রাম রেডিওর সঙ্গীত প্রযোজক রামদুলাল দেবের সাথেও তার সখ্যতা গড়ে উঠেছে। উনি শিল্পীদের সংগ্রহ করে গানের রিহার্সেল করেন, রিহার্সাল হয় আগ্রাবাদ হোটেলেই। বেলাল ভাইও সেখানে যেতেন।

    প্রায় ৬ ফিটেরও ওপর লম্বা কালো লোক, মাথাভর্তি কোকড়া ঝাঁকড়া চুল। দেখলে ভয় লাগে। আজ এসেছেন একটা কালো মরিস মাইনর গাড়ি নিয়ে। গাড়িতে দুজন ইপিআর জোয়ান, গাড়ির দুপাশে বন্দুকের নল বের করে। তার সাথে আরও এসেছেন আগ্রাবাদ হোটেলের সহকারী ম্যানেজার ফারুক চৌধুরী। কেন এসেছেন মাহমুদ হোসেন? কোথায় নিয়ে যেতে চান বেলাল ভাইকে? ডাক্তার শফিকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বেলাল ভাই বললেন, ‘মাহমুদ হোসেন এসেছেন আমাকে নিয়ে যেতে চান, সীমান্তের ওপারে অস্ত্র-সাহায্যের জন্য’।

    আমিও কথাটা শুনলাম। শফি আঁতকে উঠে অনেকটা ধমকের সুরেই বলল, ‘খবরদার বেলাল, এ কাজে তুমি কিছুতেই যাবে না ওর সাথে’।

    বেলাল ভাই বলল, ‘ঠিকাছে, সীমান্তের ওপারে যাব না, তবে পটিয়া পর্যন্ত যাই। শুনেছি বাঙালি সৈন্যরা এখন নাকি ক্যান্টনমেন্ট এবং শহর ছেড়ে পটিয়ার দিকে গেছে। সেখান থেকে কিছু আর্মড গার্ড নিয়ে আসি। কারণ কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনটি এখন নিরাপদ নয়’।

    ও আর এই কাজে বাধা দিল না। বেলাল ভাই চলে গেল মাহমুদ হোসেনের সাথে।”

    (‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’, পৃষ্ঠা- ১০৪)

    বেগম মুশতারী শফির ভাষ্যটাই সমর্থন করেছেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্ণেল নুরুন্নবী বীরবিক্রম। মাহমুদ হোসেন সম্পর্কে যাবতীয় খোঁজখবরের সূত্রপাতও তিনিই। তাঁর লেখা ‘জীবনের যুদ্ধ: যুদ্ধের জীবন’ (কলম্বিয়া প্রকাশনী) নামে একটি বই আছে। সেখানেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রামগড় জেডফোর্স হেডকোয়ার্টারে জিয়ার সঙ্গে মদ্যপানের (রাম) ফাঁকে ফাঁকে নানা আলাপচারিতার উল্লেখেই আমি প্রথম পাই মাহমুদ হোসানকে। মিসিং লিংকগুলো জোড়া দেওয়ার প্রয়াসও তখন থেকেই।

    মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক অনুষ্ঠান শেষে নুরুন্নবীকে আমি ধরেছিলাম কথাগুলোর ব্যাখ্যা চেয়ে। আমার সঙ্গী ছিলেন সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা (সামরিক বাহিনীতে গণহত্যাখ্যাত) আনোয়ার কবীর। নুরুন্নবী আমাকে রেকর্ড করতে দেননি, তবে জানিয়েছেন শিগগিরই তার একটি বই বেরোবে যাতে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ থাকবে। তিনি যা বলেছিলেন তাই স্মৃতি থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি:

    ‘‘ওই লোকের পুরো নাম মাহমুদ হাসান (নুরুন্নবী তাকে ‘মাহমুদ হাসান’ বলে উল্লেখ করেছেন; আর তাঁর লেখায় বলেছেন শুধু ‘মাহমুদ’; আমরা অন্য সব জায়গা থেকে জেনেছি তার নাম ‘মাহমুদ হোসেন’)। সত্তরের নির্বাচনের পর থেকেই সে চট্টগ্রাম হোটেল আগ্রাবাদে স্থায়ী আবাস নেয়। লন্ডনে পড়াশোনার সুবাদে মোররাজী দেশাইর ভাতিঝির সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে। বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের উপর গবেষণা ও তথ্যচিত্র নির্মাণের কথা বলে সে স্থানীয় মহলে বেশ খাতির জমিয়ে তোলে। তার গুণমুগ্ধদের মধ্যে ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রখ্যাত বেলাল মোহাম্মদসহ অনেকেই। বেগম মুশতারী শফির স্মৃতিকথায়ও উল্লেখ আছে মাহমুদের। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে অগ্রগণ্যদের একজন ছিলেন মাহমুদ। জিয়া বেশ কয়েকবারই বিভিন্ন উপলক্ষে এই গল্প করেছেন তার অধীনস্তদের কাছে।”

    নুরুন্নবীর ভাষ্য অনুযায়ী– মাহমুদ জিয়াকে জানান যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সিআইএর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নাকি এ রকম একটি হাস্যকর যুক্তিতে জিয়াকে কনভিন্স করেন যে, জিয়া যদি একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন তবে তার সাহায্যের জন্য একদিনের মধ্যে ফিলিপাইন থেকে সপ্তম নৌবহরকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি। ২৭ মার্চ জিয়ার প্রথম ঘোষণাটার এটা অন্যতম রহস্য। যদিও উপস্থিতদের চাপে এরপর তিনি ঘোষণা পাল্টান।

    মাহমুদ জিয়ার ছাড়পত্র, আগ্রাবাদ হোটেলের পিআরও এবং ক্যাশিয়ার ফারুক ও গনি এবং ইস্ট বেঙ্গলের দুজন সিপাই নিয়ে কক্সবাজার রওয়ানা দেন জনৈক উকিলের সঙ্গে দেখা করতে। এর মধ্যে মীর শওকত ও খালেকুজ্জামানও রওয়ানা হন। পথে দুলহাজারায় একটি ব্যারিকেডে না থেমে এগিয়ে যায় মাহমুদের মরিস মাইনর। পরের ব্যারিকেডে উত্তেজিত জনতা চড়াও হয় তাদের ওপর। মাহমুদ বাংলা বলতে পারতেন না, তাকে বিহারী ভেবে হত্যা করে উন্মত্ত স্থানীয়রা।

    মাত্র একজন সিপাই প্রাণ নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে আসে। কিন্তু জিয়ার দেখা পাননি; কারণ ২৮ মার্চ জিয়া অলি আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই কক্সবাজারে যান। বাংলা ভালো বলতে পারেন না বলে তারও একই সমস্যা হয়, কিন্তু চট্টগ্রামের স্থানীয় লোক অলি সে যাত্রা তাকে পার করিয়ে নেন। কক্সবাজারে পৌছে সপ্তম নৌবহরের কোনো দিশা পাননি জিয়া। খোঁজ মেলেনি শওকতেরও, যিনি রিপোর্ট করেন ৭ এপ্রিল।

    খানিকটা ফাঁক রয়েছে নুরুন্নবীর বক্তব্যে। প্রথমত, জিয়া ২৭ মার্চ যে ভাষণটি দেন তাতে নিজেকে তিনি সরকারপ্রধান দাবি করেননি। করেছেন ২৮ মার্চের ভাষণে (যা লে. শমসের মুবিন চৌধুরী বেশ কয়েকবার পাঠ করেন), তৃতীয় দফা ভাষণে (মাহমুদের মৃত্যুর পর আবার পাল্টে দেন ভাষা)। আবার মীর শওকতের ভাষ্য অনুযায়ী, রাত ৮টার দিকেই জিয়ার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত মাহমুদের। তার অর্থ, পটিয়ায় তিনি এ বিষয়টি নিয়ে মুখোমুখি হননি জিয়ার। আর জিয়ার প্রথম ভাষণটি প্রচার হয় ৭টা ২০ মিনিটে (বেলাল মোহাম্মদের সাক্ষাতকার)। সে ক্ষেত্রে পরদিন জিয়ার ভাষণ এবং মাহমুদের কক্সবাজার যাত্রার যোগসূত্র ওই দ্বিতীয় ভাষণ।

    জিয়া মাহমুদকে কেন বিশ্বাস করলেন এটা একটা রহস্যই বটে। কারণ সপ্তম নৌবহর ফুল থ্রটলে চললেও পাঁচ দিনের আগে বঙ্গোপসাগরে ঢোকার কোনো সুযোগ ছিল না। পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের অপশনও রেখেছিলেন মাহমুদ। সে ক্ষেত্রে হেলিকপ্টার যোগাড়ের একটা ব্যাপার ছিল। মাহমুদ নিশ্চয়ই সে জন্য কক্সবাজার যাচ্ছিলেন না।

    ফেরা যাক মাহমুদের সিআইএ পরিচয় দান নিয়ে (যা জিয়া নিজের মুখে বলেছেন নুরুন্নবীকে)। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মোররাজী দেশাই সিআইএ-র চর হিসেবে কাজ করেছেন বলে প্রমাণ মিলেছে। তার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বাবার হয়ে পাচার করা তথ্যের পেমেন্ট আনার। কাকতালীয়ভাবে জিয়ার শাসনামলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে দ্বিতীয় দফা আসীন হয়েছিলেন মোরারজী। তখন মার্কিন ছাতার তলে উপমহাদেশেও বেশ একটা ‘শান্তি শান্তি’ ভাব চলে এসেছিল।

    তবে বেলাল মোহাম্মদ বন্ধু মাহমুদের সম্মান রেখেছেন তার মৃত্যুর ব্যাপারটি বিস্তারিত জানিয়ে। অলি আহমেদের মুখেই তিনি খবরটা পেয়েছেন। বেলাল মোহাম্মদের ভাষ্যে:

    ‘‘সেই ২৭ মার্চ রাতেই তারা ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে এগিয়েছিল তাদের গাড়ি। পথে পুলিশ ফাঁড়িগুলোর সামনে সামনে প্রহরা। একটা লম্বা বাঁশ রাস্তার এপাশ ওপাশ পাতা। সেখানে গাড়ি থামাতে হয়, পরিচয় বলতে হয়। তারপর ছাড়া পাওয়া যায়। বাঁশের একপ্রান্ত উপরে ঠেলে দিয়ে গাড়ি গলিয়ে নেবার পথ করে দেওয়া হয়। ফাঁড়িতে ফাঁড়িতে এমনি যাত্রাবিরতিতে সময় নষ্ট হয়।

    মাহমুদ হোসেনের জন্য হয়তো এ ছিল অসহ্য। তিনি তাই জোরে গাড়ি হাঁকিয়ে দিয়েছিলেন। এপাশে ওপাশে পাতা বাঁশ ভেঙে এগিয়ে গিয়েছিল গাড়ি। পরের ফাঁড়িতে টেলিফোনে খবর চলে গিয়েছিল। মাহমুদ হোসেনের পুষ্ট শরীর ও দীর্ঘ চুল চকিতে দেখা গিয়েছিল। সন্দেহ হয়েছিল তিনি অবাঙালি বলে। পরের ফাঁড়ি হারবাংয়ে আটক করা হয়েছিল তাদেরকে। তারপর জিজ্ঞাসাবাদ। গাড়ির মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল অনেক টাকাকড়ি। বিদেশি মুদ্রাও। মেজর জিয়াউর রহমানের দেওয়া পরিচয়পত্র হয়েছিল উপেক্ষিত।

    ওখানে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরাও উপনীত হয়েছিলেন। মাহমুদ হোসেনকে দালাল ঘোষণা করা হয়েছিল। গুলি করা হয়েছিল তিনজনকে। মাহমুদ হোসেন, ফারুক চৌধুরী ও ওসমান গনি। সিভিল পোশাকধারী রাইফেলধারী দুজনকে এবং ড্রাইভারকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

    তিনটি লাশ দু’দিন শঙ্খ নদীতে ভাসমান ছিল। স্থানটির নাম ‘বুড়ো মৌলবীর ট্যাক’। দুদিন পর বুড়ো মৌলবী সাহেব দাফনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের প্রথমদিকে মাহমুদ হোসেনে পরিবারের সদস্যরা চট্টগ্রামে এসেছিলেন; তাদের নিয়ে আমি গিয়েছিলাম হারবাং এলাকায়। বুড়ো মৌলভী সাহেব তখন গত হয়েছিলেন। তার ছেলে কবরের স্থানটি দেখিয়েছিলেন। শঙ্খ নদীতে ভাঙনের ফলে স্থানটি তখন জলমগ্ন।’’

    শামসুল হুদা চৌধুরীর ‘একাত্তরের রণাঙ্গন’-এ সংযোজন হিসেবে মাহমুদ হোসেনের নাম স্বাধীন বাংলা বেতারের চ্যাপ্টারে আছে (৭৫ নং পৃষ্ঠা)। সেখানে তাকে সদ্য লন্ডন থেকে প্রত্যাগত তরুণ ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এ সূত্রমতে, ২৬ মার্চ রাত ১০ টার পর স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এনার উদ্যোগে একটি অতিরিক্ত অধিবেশন প্রচারিত হয়। সহযোগী ছিলেন ফারুক চৌধুরী, রঙ্গলাল দেব চৌধুরী ও আরও কিছু কলাকুশলী। ২৭ মার্চ রাতেই মাহমুদ ও ফারুক নিহত হন অজ্ঞাতনামা আততায়ীদের গুলিতে।

    এত কিছুর পরও রহস্যই থেকে যান মাহমুদ এবং তার অভিপ্রায়। স্রেফ অস্থিরতার কারণে ‘ক্যাজুয়ালটি অব ওয়ার’ হয়ে যান দুজন নির্দোষ মানুষকে সঙ্গী করে।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/16312
  • Biplob Rahman | ২৮ মার্চ ২০১৪ ১০:২০582761
  • ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর
    মার্চ ২৮, ২০১৪

    আমি যখন এটা লিখছি তখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছরে পা দিয়েছে। একজন মানুষ যখন চুয়াল্লিশ বছরে পা দেয় সে তখন পূর্ণবয়স্ক হয়ে যায়। দেশের জন্যে সেটা সত্যি নয়, চুয়াল্লিশ বছর একটা দেশের জন্যে এমন কিছু বয়স নয়। আমাদের দেশের জন্যে তো নয়ই। এই চুয়াল্লিশ বছরের ভেতর পনেরো বছর দেশটা ছিল মিলিটারি শাসকদের কব্জায়– দেশের মন-মানসিকতা তখন একবারে উল্টোদিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই আমাদের দেশ আসলে শূন্য থেকে শুরু করেনি– নেগেটিভ থেকে শুরু করেছে।

    এই চুয়াল্লিশ বছরেও দেশের কয়েকটা খুব বড় অপ্রাপ্তি রয়েছে। আমার ধারণা, সেগুলো গুছিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত আমরা ঠিকভাবে অগ্রসর হতে পারব না। তার একটা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অবস্থান– আমরা যারা স্বচক্ষে এই দেশটিকে জন্ম নিতে দেখেছি তারা জানি বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু প্রায় সমার্থক দুটি শব্দ। বঙ্গবন্ধুর যদি জন্ম না হত তাহলে আমরা সম্ভবত বাংলাদেশ পেতাম না।

    ১৯৭৫ সালে সেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে এই দেশে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হল যেখানে বঙ্গবন্ধুর সঠিক অবস্থান দূরে থাকুক, এই মানুষটির অস্তিত্বই রীতিমতো মুছে দেওয়া হল। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর নাম প্রথমবার রেডিও-টেলিভিশনে উচ্চারিত হতে শুরু করল। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রচারণা এত ব্যাপক আর পূর্ণাঙ্গ ছিল যে এখনও অনেকেই মনে করে, যে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করে সে বুঝি আওয়ামী লীগের সমর্থক!

    বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্মান দেখানোর বিষয়টি সবচেয়ে উৎকটভাবে দেখিয়েছেন খালেদা জিয়া; বঙ্গবন্ধুকে যেদিন সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে সেই দিনটিকে নিজের জন্মদিনের উৎসব করার দিন হিসেবে বেছে নিয়ে! আমাদের পারিবারিক একজনের জন্মদিন ঘটনাক্রমে নিজেদের অন্য একজনের মৃত্যুদিন হয়ে যাওয়ার কারণে জন্মদিনটি আর সেদিন পালিত হয় না– অথচ বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মানুষের সপরিবারে নিহত হওয়ার দিনটিতে বিছানার মতো বড় কেক কেটে জন্মদিনের উৎসব পালন করা যে কত বড় রুচিহীন কাজ সেটি একটি রাজনৈতিক দল জানে না সেটি বিশ্বাস করা কঠিন।

    এই বিষয়টা থেকে একটা বিষয়ই শুধু নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বিএনপি (এবং তাদের সহযোগী দলগুলো) এখন বঙ্গবন্ধুকে তাঁর যথাযথ সম্মান দিতে রাজি নয়। সত্যি কথা বলতে কী, তাঁকে অসম্মান করাটা তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে।

    অথচ সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, বিএনপি দলটির জন্ম হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর অনেক পরে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে বিএনপি কিংবা তাদের প্রতিষ্ঠাতা কোনো মানুষের সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধিতা হওয়ার কোনো সুযোগ পর্যন্ত ছিল না। তাহলে এই মানুষটিকে তাঁর যথাযথ সম্মান দেখাতে এই দলটির এত অনীহা কেন?

    আমি রাজনীতির বিশ্লেষক নই, রাজনীতির অনেক মারপ্যাঁচ আমি বুঝি না। কিন্তু অন্তত এতটুকু জানি যে ‘কমন সেন্স’ দিয়ে যদি রাজনীতির কোনো একটা বিষয় বোঝা না যায় তাহলে সেখানে অনেক বড় সমস্যা আছে। তাই কোনো রাজনৈতিক দল যদি বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চায়, অথচ সেটা করার জন্যে এই দেশের স্থপতিকেই অস্বীকার করে তাহলে সেটা হচ্ছে ভুল রাজনীতি। ভুল রাজনীতি করলে একটা দল কত দ্রুত ক্ষমতাহীন হয়ে যেতে পারে সেটা বোঝার জন্যে কি আইনস্টাইন হতে হয়? হয় না।

    কাজেই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বিএনপিকে যদি এই দেশের রাজনীতিতে টিকে থাকতে হয় তাহলে তাদের সবার আগে বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা স্বীকার করে নিতে হবে!

    আমরা সব সময়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সম্প্রীতির অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যদি দেশ, দেশের পতাকা, দেশের জাতীয় পতাকার মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ দেশের স্থপতিকে নিয়ে বিভ্রান্তির মাঝে থাকে তাহলে তারা কোন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবে?

    ২.

    এবারের স্বাধীনতা দিবসে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া নিয়ে শুরুতেই একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল, আমরা সবাই সেটা জানি। জটিলতাটি এসেছিল ইসলামী ব্যাংকের অনুদান নিয়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল যে কুলাঙ্গারেরা, তাদের সমর্থনপুষ্ট এই ব্যাংক কী করেছে সেটি তো কারও অজানা নেই! এই মুহূর্তে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ চলছে, সেই বিচারকাজ থামানোর জন্যে দেশে-বিদেশে যে লবিস্ট লাগানো হয়েছে, তাদেরকেও টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করছে এই ব্যাংক– আমাদের কাছে সে রকম গুরুতর অভিযোগ আছে।

    জামায়াতে ইসলামী নামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে দলটি আছে, তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে টাকা-পয়সা আর ব্যবসা-বাণিজ্য। এই ব্যাংকটি দিয়েই সেই টাকা-পয়সা, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেই ব্যাংকটি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্যে টাকা দেবে আর সেই টাকায় আমরা ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইব– এটি যে কত উৎকট একটি রসিকতা সেটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার জানে না সেটা বিশ্বাস করা কঠিন!

    কিন্তু সেটাই ঘটে গিয়েছিল, এই দেশের তরুণেরা প্রথমে এর বিরোধিতা করে সোচ্চার হয়েছিল; তারপর অন্যেরা। এই দেশের মানুষের প্রচণ্ড চাপে সরকার শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছে যে, ইসলামী ব্যাংকের টাকাটা তারা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্যে ব্যবহার করবে না।

    এইটুকু হচ্ছে ভূমিকা। আমি এর পরের কথাটা বলার জন্যে এই ভূমিকাটুকু করেছি। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ইসলামী ব্যাংকের টাকা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্যে ব্যবহার করা না হলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্যে ব্যবহার করা হবে! সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, এই দেশের তরুণ ছেলেমেয়েরা ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ফেলেছে, ইসলামী ব্যাংক যেন সেই দুর্ব্যবহারে মনে কষ্ট না পায় সে জন্যে যেভাবে হোক সরকারের তাদেরকে যখোপযুক্ত সম্মান দেখাতে হবে! তাই তাদের টাকাটা বাংলাদেশের আয়োজিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যবহার করা হবে!

    বেশ কিছুদিন আগে যখন হলমার্ক চার হাজার কোটি টাকা চুরি করেছিল, তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা এমন কিছু বেশি টাকা নয় (শুনে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম, টাকা চুরি করার টার্গেট হিসেবে কত টাকা রাখা যেতে পারে সেখানে এটা একটা নূতন মাত্রা যোগ করেছিল)! যদি চুরি করার জন্যেই হাজার কোটি টাকা খুব বেশি টাকা না হয়, তাহলে ইসলামী ব্যাংকের মাত্র কয়েক কোটি টাকা যেন আমাদের দেশের জাতীয় একটা অনুষ্ঠানে নিতেই হবে? দেশের মানুষের রক্তমাখা টাকা তাদের ফিরিয়ে দিলে কী হত? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে জানতে হবে, ইসলামী ব্যাংকের প্রতি তাদের এই ভালোবাসা আর সহমর্মিতা এই দেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে হতাশ করেছে– আমাকেও হতাশ করেছে।

    শুরুতে বলেছিলাম, দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে হলে মূল কিছু বিষয়ে সবার একমত হতে হবে। বঙ্গবন্ধু যে এই দেশের স্থপতি সেটি হচ্ছে এ রকম একটি বিষয়। এই দেশটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ করে পাওয়া একটি দেশ; তাই মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন নিয়ে এই দেশটি শুরু করা হয়েছিল সেই স্বপ্নকে ভিত্তি করে তার উপর পুরো দেশটি দাঁড় করানো হবে– এই সত্যটিও সে রকম একটি বিষয়।

    আমরা আজকাল খুব ঘন ঘন গণতন্ত্র শব্দটি শুনতে পাই। যখনই কেউ এই শব্দটি উচ্চারণ করেন তখনই কিন্তু তাকে বলতে হবে এই গণতন্ত্রটি দাঁড়ানো থাকবে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তির উপরে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি সরিয়ে একটা গণতন্ত্র তৈরি করব, সেই গণতন্ত্র এই দেশটিকে একটা সাম্প্রদায়িক দেশ তৈরি করে ফেলবে, সকল ধর্মের সকল বর্ণের সকল মানুষ সেই দেশে সমান অধিকার নিয়ে থাকতে পারবে না– সেটা তো হতে পারে না।

    কাজেই ধর্ম ব্যবহার করে রাজনীতি করা গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করা হলেও কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের সঙ্গে খাপ খায় না। গত নির্বাচনের ঠিক আগে আগে নির্বাচন প্রতিহত করা আর যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রতিহত করার আন্দোলন যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল, তখন সন্ত্রাস কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেটা দেশের মানুষের নিজের চোখে দেখার একটা সুযোগ হয়েছিল।

    সেই সন্ত্রাসের নায়ক ছিল জামায়াতে ইসলামী আর তার ছাত্র সংগঠন। একাত্তরে এই দেশটি যুদ্ধাপরাধ করেছিল। চার দশক পরেও সেই যুদ্ধাপরাধের জন্যে তাদের মনে অপরাধবোধ নেই, গ্লানি নেই, একাত্তরের সমান হিংস্রতা নিয়েই তারা এই দেশে তাণ্ডব করতে রাজি আছে।

    আমি অবশ্য এই লেখায় জামায়াতে ইসলামীর সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলতে আসিনি। আমি কিছুদিন আগে দেখা খবরের কাগজের একটা রিপোর্টের কথা বলতে এসেছি যেখানে লেখা হয়েছে উত্তরবঙ্গের কোনো একটি শহরে জামায়াতে ইসলামীর বড় একটা দল অনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে এসেছে। বিষয়টা কি এতই সহজ?

    যে সারাজীবন জামায়াতে ইসলামী করে এসেছে, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের জবাই করেছে, হিন্দুদের বাড়ি লুট করে তাদেরকে দেশছাড়া করেছে, এই কয়েক মাস আগেও পেট্রোল বোমা দিয়ে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে, হিন্দুদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে– রাতাবাতি তারা জামায়াতে ইসলামী থেকে আওয়ামী লীগ হয়ে গেল! তাদের সমস্ত মন-মানসিকতা, চিন্তা করার ধরন, আদর্শ, স্বপ্ন একটা ম্যাজিকের মতো পাল্টে গেল?

    তারা এখন বঙ্গবন্ধুর অনুসারী, মুক্তিযুদ্ধের পতাকাবাহক? এটি কী করে সম্ভব? আমাকে কেউ বুঝিয়ে দেবে? না কি প্রকৃত ব্যাপারটা আরও ভয়ংকর– জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের গ্রহণ করার জন্যে আওয়ামী লীগকেই খানিকটা পাল্টে যেতে হবে? তাদের এখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বেশি বলা যাবে না, বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করতে হবে, হিন্দুধর্মের মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে হবে, পেট্রোল বোমা বানানো শিখতে হবে?

    কেউ কি আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন? যে আদর্শকে আমরা এত গুরুত্ব দিয়ে নিই, রাজনীতিতে সেটা আসলে একটা রঙ-তামাশা?

    এই লেখাটি যখন লিখছি তখন খবর পেলাম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান লন্ডনে ঘোষণা দিয়েছেন, তার বাবা জিয়াউর রহমান যেহেতু ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দিয়েছিলেন তাই তিনিই হচ্ছেন দেশের ‘প্রথম’ প্রেসিডেন্ট! ভাগ্যিস বেচারা জিয়াউর রহমান বেচেঁ নাই। যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই তার গুণধর ছেলের কথাবার্তা শুনে লজ্জায় গলায় দড়ি দিতেন।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/16341
  • Biplob Rahman | ২৮ মার্চ ২০১৪ ১০:২৫582762
  • আড়াই লাখ কণ্ঠে ‘সোনার বাংলা’ বিশ্বময়
    লিটন হায়দার, সুমন মাহবুব, আশিক হোসেন ও সুলাইমান নিলয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
    Published: 2014-03-26 11:34:01.0 BdST Updated: 2014-03-27 02:54:47.0 BdST

    মাথার ওপরে স্বাধীনতা দিবসের সূর্য, জাতীয় প্যারেড ময়দানে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, তাদের মাঝে উপস্থিত খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সবার কণ্ঠে এক সুর- আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।

    বুধবার বেলা ১১টা ২০ মিনিটে এভাবেই লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানোর দাবি তুলল বাংলাদেশ।

    ২০১৩ সালের ৬ মে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে গিনেজ বুকে স্থান করে নিয়েছিল সাহারা ইন্ডিয়া পরিবার (ভারত)। ওই আয়োজনে ১ লাখ ২১ হাজার ৬৫৩ জন অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের আয়োজনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল তার দ্বিগুণেরও বেশি।

    কেবল মাঠেই নয়, প্যারেড গ্রাউন্ডের বাইরে এবং রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে যেখানে ছিলেন, সবাই দাঁড়িয়ে শামিল হয়েছেন এই আয়োজনে, কণ্ঠ মিলিয়েছেন ‘সোনার বাংলা’য়।

    অনুষ্ঠান শেষে ফেরার সময় উত্তরার ব্যবসায়ী ষাটোর্ধ্ব হাজী মতিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আজ জাতীয় সংগীত গাইলাম। নিজেকে আজ স্কুলের ছাত্র মনে হচ্ছে। ভালো লাগছে এত বড় আয়োজনে অংশ নিতে পেরে।”

    ধানমণ্ডির শফিউদ্দিন গাজী জানালেন তিনি এসেছেন তিন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে।

    “একত্রে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার সংগীতে অংশ নিয়েছি। ভালোয় ভালোয় এখন বিশ্ব রেকর্ড হলেই হয়।”

    গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা পুরো অনুষ্ঠানটি পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের পাঠানো প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে- বাংলাদেশের এই আয়োজন রেকর্ড বইয়ে উঠবে কি-না।

    সকাল সাড়ে ৬টায় প্যারেড মাঠের ফটক খুলে দেয়ার আগেই নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে পায়ে হেঁটে এসে বাইরে জড়ো হতে থাকেন নানা বয়সী নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী।

    মুক্তিযোদ্ধা; বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী; সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য; বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ভিডিপি; রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, পোশাক, পরিবহন ও বিভিন্ন খাতের কর্মীসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ প্যারেড মাঠে উপস্থিত হতে থাকেন জাতীয় সংগীতে কণ্ঠ মেলাতে।

    সকাল সাড়ে ১০টায় গাড়ি থেকে নেমে পতাকা হাতে মাঠের ৯ সেক্টরের উত্তর দিকে নির্ধারিত মঞ্চে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

    লাল-সবুজ পাড়ের সাদা জামদানি শাড়ি পরিহিত সরকার প্রধান মঞ্চে উঠেই পতাকা হাতে সবার উদ্দেশে হাত নাড়েন। সমবেত সবাই পাল্টা পতাকা নেড়ে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছার জবাব দেন।

    ওই মঞ্চে থেকেই জাতীয় সংগীতে কণ্ঠ মেলান তিনি।

    স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও দেশের প্রথম সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভুঁইয়া, নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল এম ফরিদ হাবিব ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল এম ইনামুল বারী এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল এই মঞ্চে ছিলেন।

    প্রধানমন্ত্রী যখন মঞ্চে আসেন, - তখন মাঠে হাজির ২ লাখ ৩১ হাজার নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী। আর ১০টা ৫৫ মিনিটে প্রথম মহড়ায় অংশ নেয় ২ লাখ ৫১ হাজার মানুষ।

    দ্বিতীয় মহড়ার পর চূড়ান্ত সময়ে, অর্থাৎ জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮১ জনে।

    এর আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আয়োজনে শামিল সবাইকে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে শাণিত করার আহ্বান জানান।

    তিনি বলেন, “বাঙালি সবসময় ইতিহাস সৃষ্টি করে।বাঙালি আবার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে।আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, যে সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের ভালোবাসা জানাই দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি, যে জাতীয় সঙ্গীত আমাকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বেলিত করে, আমাদের চেতনার অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করে, সেই জাতীয় সঙ্গীত লাখো কণ্ঠে আমরা গাইব, যা বিশ্বে ইতিহাস হয়ে থাকবে।”

    এই আয়োজনে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, ভিডিপি, গার্মেন্টকর্মী, নারী-শিশু, সংস্কৃতিকর্মীসহ সব শ্রেণি পেশার মানুষকে স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবসের শুভেচ্ছা জানান তিনি।

    সকালে মাঠের প্রতিটি ফটক দিয়ে আগ্রহীদের প্রবেশ করতে দেয়া হয় গুণে গুণে। প্রত্যেকটি প্রবেশপথে ছিল সংক্রিয় গণনার ব্যবস্থা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চের প্রবেশপথ এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রবেশপথেও গণনার ব্যবস্থাসম্বলিত গেইট বসানো হয়।

    অনেকেই মাঠে আসেন গায়ে পতাকা জড়িয়ে, মাথায় পতাকার রঙের ব্যান্ডানা পরে। শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে প্যারেড মাঠের ওই অংশটি ভাগ করা হয় ১৫টি সেক্টরে।

    অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককে একটি করে ক্যাপ ও ব্যাগ দেয়া হয়, যাতে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত ও নিয়মাবলী লেখা সংবলিত একটি কার্ড, পানি, জুস, স্যালাইনসহ তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ওষুধ ছিল। প্রতিটি সেক্টরে একটি করে বড় স্ক্রিনে কিছুক্ষণ পরপরই জানিয়ে দেয়া হচ্ছিল মাঠের পরিস্থিতি আর উপস্থিতি।

    ৯ নম্বর সেক্টরের উত্তর দিকে প্রধানমন্ত্রীর, ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য করা হয় বিশেষ মঞ্চ। সরকারের মন্ত্রী, সাংসদসহ অন্যরা ছিলেন তার দক্ষিণ দিকে সামিয়ানার নিচে।

    প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চের উল্টো দিকে মাঠের অপর প্রান্তে অনুষ্ঠানের মূলমঞ্চের পশ্চাদপট সাজানো হয় মাঝখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে। ডান দিকে ছিল চার জাতীয় নেতা ও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছবি। আর বাম দিকে সাত বীর শ্রেষ্ঠ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি।

    মূল পর্বের আগে সকাল ৮টা থেকে শিল্পকলা একাডেমির পরিবেশনায় দেশবরেণ্য এবং খ্যাতনামা শিল্পীদের অংশগ্রহণে মাঠে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চূড়ান্ত জাতীয় সংগীত পরিবেশনের আগে পৌনে ১১টায় হয় দুই দফা অনুশীলন। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যরাও এতে অংশ নেন।

    অনুষ্ঠান শেষে আসাদুজ্জামান নূর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।”

    আর কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, “আমরাই পারি।”

    জাতীয় সংগীত গেয়ে বাড়ি ফেরার পথে পোশাককর্মী হোসনে আরা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আওনের পর রইদে খারাপ লাগছিল, অহন ভাল্লাগতেছে। ছোড থাকতে ইশকুলে জাতীয় সংগীত গাইছি। এইবার এতো মানুষের লগে গাইলাম।”

    অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলেও শেষ পর্যন্ত পুরো বিষয়টি ‘দারুণ আনন্দের’ ছিল বলে জানাল নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুলের শিক্ষার্থী নজিবুর রহমান সৈকত।

    তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী মো. আরিফুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাত ৪টায় জেগেছি। ৫ টায় বাসা থেকে (জুরাইন) বের হয়েছি। কলেজ ঘুরে ৭টায় এখানে এসেছি। এতো সব কষ্ট বিশ্ব রেকর্ড করার জন্য।”

    অনুষ্ঠানের আগে বিভিন্ন অঙ্গনের শিল্পীরা অনুষ্ঠানে এসে সংহতি প্রকাশ করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা ছাড়াও সবিনা ইয়াসমিন, সামিনা চৌধুরী, কনকচাঁপা, কনা, শুভ্র দেব, মমতাজ, বাপ্পা মজুমদার, ফকির আমলগীর, মিতা হক, তপন চৌধুরী, এন্ড্রু কিশোর, আইয়ুব বাচ্চুসহ শিল্পীরা মূলমঞ্চে জাতীয় সংগীতে কণ্ঠ মেলান।

    সংহতি প্রকাশ করে চিত্র নায়ক ফেরদৌস বলেন, “একটি স্বপ্ন নিয়ে আমরা এই দেশ গড়েছিলাম। লাল সবুজের পতাকা হাতে আজ এসেছি জাতীয় সংগীত গাইতে।”

    এ আয়োজনের সার্বিক দায়িত্বে ছিল সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ।

    প্যারেড গ্রাউন্ডে আসা কেউ কেউ গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ রকম অন্তত ৩০ জনকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে স্থাপিত সেনাবাহিনীর মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা দেয়া হয়।

    http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article763219.bdnews
  • Biplob Rahman | ২৮ মার্চ ২০১৪ ১৮:২১582764
  • ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর
    মার্চ ২৮, ২০১৪

    আমি যখন এটা লিখছি তখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছরে পা দিয়েছে। একজন মানুষ যখন চুয়াল্লিশ বছরে পা দেয় সে তখন পূর্ণবয়স্ক হয়ে যায়। দেশের জন্যে সেটা সত্যি নয়, চুয়াল্লিশ বছর একটা দেশের জন্যে এমন কিছু বয়স নয়। আমাদের দেশের জন্যে তো নয়ই। এই চুয়াল্লিশ বছরের ভেতর পনেরো বছর দেশটা ছিল মিলিটারি শাসকদের কব্জায়– দেশের মন-মানসিকতা তখন একবারে উল্টোদিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই আমাদের দেশ আসলে শূন্য থেকে শুরু করেনি– নেগেটিভ থেকে শুরু করেছে।

    এই চুয়াল্লিশ বছরেও দেশের কয়েকটা খুব বড় অপ্রাপ্তি রয়েছে। আমার ধারণা, সেগুলো গুছিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত আমরা ঠিকভাবে অগ্রসর হতে পারব না। তার একটা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অবস্থান– আমরা যারা স্বচক্ষে এই দেশটিকে জন্ম নিতে দেখেছি তারা জানি বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু প্রায় সমার্থক দুটি শব্দ। বঙ্গবন্ধুর যদি জন্ম না হত তাহলে আমরা সম্ভবত বাংলাদেশ পেতাম না।

    ১৯৭৫ সালে সেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে এই দেশে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হল যেখানে বঙ্গবন্ধুর সঠিক অবস্থান দূরে থাকুক, এই মানুষটির অস্তিত্বই রীতিমতো মুছে দেওয়া হল। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর নাম প্রথমবার রেডিও-টেলিভিশনে উচ্চারিত হতে শুরু করল। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রচারণা এত ব্যাপক আর পূর্ণাঙ্গ ছিল যে এখনও অনেকেই মনে করে, যে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করে সে বুঝি আওয়ামী লীগের সমর্থক!

    বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্মান দেখানোর বিষয়টি সবচেয়ে উৎকটভাবে দেখিয়েছেন খালেদা জিয়া; বঙ্গবন্ধুকে যেদিন সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে সেই দিনটিকে নিজের জন্মদিনের উৎসব করার দিন হিসেবে বেছে নিয়ে! আমাদের পারিবারিক একজনের জন্মদিন ঘটনাক্রমে নিজেদের অন্য একজনের মৃত্যুদিন হয়ে যাওয়ার কারণে জন্মদিনটি আর সেদিন পালিত হয় না– অথচ বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মানুষের সপরিবারে নিহত হওয়ার দিনটিতে বিছানার মতো বড় কেক কেটে জন্মদিনের উৎসব পালন করা যে কত বড় রুচিহীন কাজ সেটি একটি রাজনৈতিক দল জানে না সেটি বিশ্বাস করা কঠিন।

    এই বিষয়টা থেকে একটা বিষয়ই শুধু নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বিএনপি (এবং তাদের সহযোগী দলগুলো) এখন বঙ্গবন্ধুকে তাঁর যথাযথ সম্মান দিতে রাজি নয়। সত্যি কথা বলতে কী, তাঁকে অসম্মান করাটা তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে।

    অথচ সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, বিএনপি দলটির জন্ম হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর অনেক পরে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে বিএনপি কিংবা তাদের প্রতিষ্ঠাতা কোনো মানুষের সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধিতা হওয়ার কোনো সুযোগ পর্যন্ত ছিল না। তাহলে এই মানুষটিকে তাঁর যথাযথ সম্মান দেখাতে এই দলটির এত অনীহা কেন?

    আমি রাজনীতির বিশ্লেষক নই, রাজনীতির অনেক মারপ্যাঁচ আমি বুঝি না। কিন্তু অন্তত এতটুকু জানি যে ‘কমন সেন্স’ দিয়ে যদি রাজনীতির কোনো একটা বিষয় বোঝা না যায় তাহলে সেখানে অনেক বড় সমস্যা আছে। তাই কোনো রাজনৈতিক দল যদি বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চায়, অথচ সেটা করার জন্যে এই দেশের স্থপতিকেই অস্বীকার করে তাহলে সেটা হচ্ছে ভুল রাজনীতি। ভুল রাজনীতি করলে একটা দল কত দ্রুত ক্ষমতাহীন হয়ে যেতে পারে সেটা বোঝার জন্যে কি আইনস্টাইন হতে হয়? হয় না।

    কাজেই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বিএনপিকে যদি এই দেশের রাজনীতিতে টিকে থাকতে হয় তাহলে তাদের সবার আগে বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা স্বীকার করে নিতে হবে!

    আমরা সব সময়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সম্প্রীতির অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যদি দেশ, দেশের পতাকা, দেশের জাতীয় পতাকার মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ দেশের স্থপতিকে নিয়ে বিভ্রান্তির মাঝে থাকে তাহলে তারা কোন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবে?

    ২.

    এবারের স্বাধীনতা দিবসে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া নিয়ে শুরুতেই একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল, আমরা সবাই সেটা জানি। জটিলতাটি এসেছিল ইসলামী ব্যাংকের অনুদান নিয়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল যে কুলাঙ্গারেরা, তাদের সমর্থনপুষ্ট এই ব্যাংক কী করেছে সেটি তো কারও অজানা নেই! এই মুহূর্তে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ চলছে, সেই বিচারকাজ থামানোর জন্যে দেশে-বিদেশে যে লবিস্ট লাগানো হয়েছে, তাদেরকেও টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করছে এই ব্যাংক– আমাদের কাছে সে রকম গুরুতর অভিযোগ আছে।

    জামায়াতে ইসলামী নামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে দলটি আছে, তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে টাকা-পয়সা আর ব্যবসা-বাণিজ্য। এই ব্যাংকটি দিয়েই সেই টাকা-পয়সা, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেই ব্যাংকটি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্যে টাকা দেবে আর সেই টাকায় আমরা ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইব– এটি যে কত উৎকট একটি রসিকতা সেটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার জানে না সেটা বিশ্বাস করা কঠিন!

    কিন্তু সেটাই ঘটে গিয়েছিল, এই দেশের তরুণেরা প্রথমে এর বিরোধিতা করে সোচ্চার হয়েছিল; তারপর অন্যেরা। এই দেশের মানুষের প্রচণ্ড চাপে সরকার শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছে যে, ইসলামী ব্যাংকের টাকাটা তারা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্যে ব্যবহার করবে না।

    এইটুকু হচ্ছে ভূমিকা। আমি এর পরের কথাটা বলার জন্যে এই ভূমিকাটুকু করেছি। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ইসলামী ব্যাংকের টাকা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্যে ব্যবহার করা না হলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্যে ব্যবহার করা হবে! সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, এই দেশের তরুণ ছেলেমেয়েরা ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ফেলেছে, ইসলামী ব্যাংক যেন সেই দুর্ব্যবহারে মনে কষ্ট না পায় সে জন্যে যেভাবে হোক সরকারের তাদেরকে যখোপযুক্ত সম্মান দেখাতে হবে! তাই তাদের টাকাটা বাংলাদেশের আয়োজিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যবহার করা হবে!

    বেশ কিছুদিন আগে যখন হলমার্ক চার হাজার কোটি টাকা চুরি করেছিল, তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা এমন কিছু বেশি টাকা নয় (শুনে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম, টাকা চুরি করার টার্গেট হিসেবে কত টাকা রাখা যেতে পারে সেখানে এটা একটা নূতন মাত্রা যোগ করেছিল)! যদি চুরি করার জন্যেই হাজার কোটি টাকা খুব বেশি টাকা না হয়, তাহলে ইসলামী ব্যাংকের মাত্র কয়েক কোটি টাকা যেন আমাদের দেশের জাতীয় একটা অনুষ্ঠানে নিতেই হবে? দেশের মানুষের রক্তমাখা টাকা তাদের ফিরিয়ে দিলে কী হত? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে জানতে হবে, ইসলামী ব্যাংকের প্রতি তাদের এই ভালোবাসা আর সহমর্মিতা এই দেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে হতাশ করেছে– আমাকেও হতাশ করেছে।

    শুরুতে বলেছিলাম, দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে হলে মূল কিছু বিষয়ে সবার একমত হতে হবে। বঙ্গবন্ধু যে এই দেশের স্থপতি সেটি হচ্ছে এ রকম একটি বিষয়। এই দেশটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ করে পাওয়া একটি দেশ; তাই মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন নিয়ে এই দেশটি শুরু করা হয়েছিল সেই স্বপ্নকে ভিত্তি করে তার উপর পুরো দেশটি দাঁড় করানো হবে– এই সত্যটিও সে রকম একটি বিষয়।

    আমরা আজকাল খুব ঘন ঘন গণতন্ত্র শব্দটি শুনতে পাই। যখনই কেউ এই শব্দটি উচ্চারণ করেন তখনই কিন্তু তাকে বলতে হবে এই গণতন্ত্রটি দাঁড়ানো থাকবে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তির উপরে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি সরিয়ে একটা গণতন্ত্র তৈরি করব, সেই গণতন্ত্র এই দেশটিকে একটা সাম্প্রদায়িক দেশ তৈরি করে ফেলবে, সকল ধর্মের সকল বর্ণের সকল মানুষ সেই দেশে সমান অধিকার নিয়ে থাকতে পারবে না– সেটা তো হতে পারে না।

    কাজেই ধর্ম ব্যবহার করে রাজনীতি করা গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করা হলেও কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের সঙ্গে খাপ খায় না। গত নির্বাচনের ঠিক আগে আগে নির্বাচন প্রতিহত করা আর যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রতিহত করার আন্দোলন যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল, তখন সন্ত্রাস কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেটা দেশের মানুষের নিজের চোখে দেখার একটা সুযোগ হয়েছিল।

    সেই সন্ত্রাসের নায়ক ছিল জামায়াতে ইসলামী আর তার ছাত্র সংগঠন। একাত্তরে এই দেশটি যুদ্ধাপরাধ করেছিল। চার দশক পরেও সেই যুদ্ধাপরাধের জন্যে তাদের মনে অপরাধবোধ নেই, গ্লানি নেই, একাত্তরের সমান হিংস্রতা নিয়েই তারা এই দেশে তাণ্ডব করতে রাজি আছে।

    আমি অবশ্য এই লেখায় জামায়াতে ইসলামীর সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলতে আসিনি। আমি কিছুদিন আগে দেখা খবরের কাগজের একটা রিপোর্টের কথা বলতে এসেছি যেখানে লেখা হয়েছে উত্তরবঙ্গের কোনো একটি শহরে জামায়াতে ইসলামীর বড় একটা দল অনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে এসেছে। বিষয়টা কি এতই সহজ?

    যে সারাজীবন জামায়াতে ইসলামী করে এসেছে, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের জবাই করেছে, হিন্দুদের বাড়ি লুট করে তাদেরকে দেশছাড়া করেছে, এই কয়েক মাস আগেও পেট্রোল বোমা দিয়ে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে, হিন্দুদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে– রাতাবাতি তারা জামায়াতে ইসলামী থেকে আওয়ামী লীগ হয়ে গেল! তাদের সমস্ত মন-মানসিকতা, চিন্তা করার ধরন, আদর্শ, স্বপ্ন একটা ম্যাজিকের মতো পাল্টে গেল?

    তারা এখন বঙ্গবন্ধুর অনুসারী, মুক্তিযুদ্ধের পতাকাবাহক? এটি কী করে সম্ভব? আমাকে কেউ বুঝিয়ে দেবে? না কি প্রকৃত ব্যাপারটা আরও ভয়ংকর– জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের গ্রহণ করার জন্যে আওয়ামী লীগকেই খানিকটা পাল্টে যেতে হবে? তাদের এখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বেশি বলা যাবে না, বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করতে হবে, হিন্দুধর্মের মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে হবে, পেট্রোল বোমা বানানো শিখতে হবে?

    কেউ কি আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন? যে আদর্শকে আমরা এত গুরুত্ব দিয়ে নিই, রাজনীতিতে সেটা আসলে একটা রঙ-তামাশা?

    এই লেখাটি যখন লিখছি তখন খবর পেলাম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান লন্ডনে ঘোষণা দিয়েছেন, তার বাবা জিয়াউর রহমান যেহেতু ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দিয়েছিলেন তাই তিনিই হচ্ছেন দেশের ‘প্রথম’ প্রেসিডেন্ট! ভাগ্যিস বেচারা জিয়াউর রহমান বেচেঁ নাই। যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই তার গুণধর ছেলের কথাবার্তা শুনে লজ্জায় গলায় দড়ি দিতেন।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/16341
  • Biplob Rahman | ০২ এপ্রিল ২০১৪ ১৮:৫১582765
  • সালেক খোকন
    যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ১০ ‘‘মৃত্যুর পর সম্মানের দরকার নেই’’
    মার্চ ৩০, ২০১৪

    ১৯৬৩ সাল। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে আমরা রেজাল্টের অপেক্ষায়। আব্বা তখন বুক-বাইন্ডার। চাকরি করতেন ঢাকার বাংলাবাজারে। থাকতেন নোয়াববাড়িতে। আমি ওইসময় বেড়াতে আসি আব্বার কাছে। সঙ্গে ছিলেন দূরসম্পর্কের এক ভাই, তালুকদার মঞ্জনু।

    ঢাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। একদিন পরিচিত একজনের মুখে শুনি আর্মিতে লোক নেওয়ার সংবাদটি। ‘‘কাল আর্মিতে লোক ভর্তি করব, যাবি তোরা’’?

    আমরা রাজি হতেই জানিয়ে দেন ঠিকানাটি। ওইদিন সকালেই আমি আর মঞ্জনু রওনা দিই পলাশী ব্যারাকের দিকে। ওখানেই লাইন দিচ্ছিল সবাই। আমরাসহ লাইনে ছিল ৫০ থেকে ৬০ জন। এক সুবেদার দেখে দেখে বাছাই করছিলেন। আমাকে না নিয়ে তিনি আগে পিছে অন্যদের নিয়ে নিচ্ছেন। তাদের নজরে পড়তে আমি আবার লাইনের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। এবারও আমাকে না নিয়ে অন্যদের নেওয়া হল। আমি আগের মতোই আবার লাইনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

    তখন সুবেদার বললেন– ‘‘কেন বার বার সামনে আসছ? তুমি বাচ্চা ছেলে, তোমাকে নেওয়া যাবে না’’।

    আমার খুব রাগ হল। আমি বললাম– ‘‘আপনিও তো আমারই সমান। খাওয়া-দাওয়া করেছেন বলে একটু মোটা হইছেন। কিন্তু আপনার হাইট তো আমার মতোই’’।
    পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. জাহাঙ্গীর খান

    আমার কথা শুনে তিনি হেসে দিলেন। দূরে বসে ঘটনাটি দেখছিলেন রিক্রুটিং অফিসার। আমাকে ডেকে তিনি বাড়ির ঠিকানা জেনে প্রশ্ন করলেন– ‘‘আর্মিতে কেন ভর্তি হতে চাও’’?

    উত্তরে বললাম– ‘‘স্যার, মেট্রিক পরীক্ষা দিছি, রেজাল্ট হয় নাই। ওয়েস্ট পাকিস্তান দেখার খুব শখ’’।

    আমার কথা শুনে তিনি মুচকি হাসলেন। অতঃপর তিনি অর্ডার দিতেই আমার বুকে পড়ল সিল। যোগ দিলাম সিপাহী পদে। আমার আর্মি নম্বর ৬৫৭৮১০৩। প্রথমে চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে, পরে ঢাকার সিগন্যালে এবং সবশেষে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানের জিলংয়ে। সেখানে নিই ছয় মাসের আর্মি ট্রেনিং।

    ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয় পঁয়ষট্টিতে। ট্রেনিং শেষে তখনই আমাদের কসম খাওয়ানো হয়। এরপর পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিয়ালকোটে। ভারতীয় আর্মির বিরুদ্ধে ওখানেই আমরা যুদ্ধ করি। পাকিস্তান সোনবাহিনীতে থাকলেও বাঙালিদের তারা উল্টো চোখে দেখত। ব্যারাকের ভেতর বৈষম্য ছিল অনেক। অফিসার পদে অধিকাংশ ছিল ওদের লোক।

    সত্তরের নির্বাচনের পর ছুটিতে বাড়ি আসি। দেশের অবস্থা তখন অন্যরকম। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ক্ষোভ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছুটি শেষ। তবুও আব্বা আমাকে যেতে দিলেন না। বললেন– ‘‘দেশের কন্ডিশন খারাপ। তোমার আর যাওয়া লাগবে না’’।

    আমি আব্বার কথা ফেলতে পারলাম না। বারবার চিঠি আসে, আমাকে বলা হয় রিপোর্ট করতে। কিন্তু আমি ঢাকাতেই থেকে যাই আব্বার কাছে।

    ৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিবেন রের্সকোস ময়দানে। খবর পেয়ে ওইদিন সকালের দিকেই চলে আসি সেখানে। পাবলিক লাইব্রেরির পাশ দিয়ে ঢুকে দেখি তিলপরিমাণ জায়গা নেই। তবুও বাঁশের লাঠি হাতে একের পর এক মিছিল আসছিল। সবার মুখে একই কথা, শেখ সাহেব আজ কী বলবেন! তিনি ভাষণ শুরু করতেই সমস্বরে সবাই স্লোগান তুলল।

    শেখ সাহেব বললেন– ‘‘সরকারি কর্মচারিদের বলি– আমি যা বলি তা মানতে হবে….। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা কিছু আছে, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে….।’’

    ভাষণ শুনেই মনে হয়েছে দেশটা বুঝি স্বাধীন হয়ে গেল। ওইদিনই বুঝেছিলাম এবার দেশে একটা কিছু হবে।

    পাঠক, এতক্ষণ মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনার কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. জাহাঙ্গীর খানের মুখে। তাঁর পিতার নাম গোলাম রহমান খান এবং মাতা ছবিলা খাতুন। বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার তেবাড়িয়া গ্রামে। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গ্রামের বাড়িতে। তিন ভাই ও এক বোনের সংসারে জাহাঙ্গীর ছিলেন সবার বড়। বাপ-চাচারা সবাই ছিলেন চাকরিজীবী।

    মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি তেবাড়িয়া সলিমাবাদ ইসলামী হাই স্কুলে। তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন ওই স্কুল থেকেই। আজও তাঁর মনে পড়ে বাল্যবন্ধু সুরুজ মিয়া, আবদুল কাইয়ুম, সানোয়ার হোসেন, কাসায়েফের কথা। ওই সময়কার একটি স্মরণীয় ঘটনার কথা শুনি তাঁর জবানিতে–

    ‘‘এখনকার মতো তখন এত ক্লাব ছিল না। আমাদের ফুটবল ক্লাবটির নাম ছিল তেবাড়িয়া সলিমাবাদ স্পোর্টিং ক্লাব। তখন জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতাম। একদিন বন্ধুরা বলে, আজকে যে গোলে হারাতে পারবে, তাদের খাওয়াতে হবে। কী খাবি তোরা? আলু-ভাত দিলেও খাব, ডাইল-ভাতও খাব। সবাই আমরা রাজি হলাম। আমি যে দলে ছিলাম সে দল সেদিন হারল। তাই সন্ধ্যায় সবাই মিল্লা বাজার করি। পাশেই যমুনা নদী। বড় যমুনার একটা শাখা। নৌকা ভাড়া করে আমরা নদীতে ঘুরলাম। খিচুড়ি আর মাংস রান্না হলো নৌকাতেই। খাওয়া শেষে হাত ধুতে গিয়ে নদীতে পড়ে যায় সানোয়ার। শীতের রাত্রে তার সারা শরীর ভিজে হয় চুপচুপা। এ নিয়ে আমাদের সে কী হাসাহাসি!’’

    ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় আর্মি নামার ঘটনা জানালেন মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, ‘‘২৪ মার্চ সারাদিনই নানা গুঞ্জন চলছিল। রাত ১২টার পর গুলির শব্দ পাই। সকালে দেখলাম যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছে। আমরা ঢাকায় থাকি ৪ দিন। তারপর পায়ে হেঁটে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে নবাবগঞ্জ হয়ে মানিকগঞ্জের ভেতর দিয়ে চলে আসি নাগরপুরে।’’

    মুক্তিযুদ্ধে কবে গেলেন?

    প্রশ্ন শুনে তিনি বলেন, ‘‘এপ্রিলের ২৮ তারিখ হিলি বর্ডার দিয়ে আমরা ওপারে যাই। আমার সঙ্গে ছিল পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। ইপিআর কাদেরের কথা এখনও মনে পড়ে। ভারতে বিএসএফ আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। পাকিস্তানি আর্মির পে-বই দেখালে তারা আমাকে বাড়তি কদর করে। তাদের মুখে একবার খবর পেলাম, কলকাতা পার্ক সার্কাসে এসেছেন অসমানী সাহেব। তার সঙ্গে দেখা করতেই তিনি ২৪ জন ট্রেইনড সৈন্যের তালিকায় আমার নাম তুলে দেন। আমরা তখন ইন্ডিয়ান আর্মির পোশাক পরে তাদের সঙ্গে নানা কাজ করতাম।

    আর্মিতে আমি ছিলাম ড্রাইভার। আমাদের কাজ ওদের ড্রাইভারদের সেকেন্ড সিটে বসে থাকা। ওরাই চালাবে। দরকার হলে আমরা কাজ করব। পরের দিন আমরা ইছাপুর অর্ডিনেন্স ফ্যাক্টরি থেকে গাড়ি নিয়ে প্রথমে গৌহাটি, তারপর শিলচর এবং শেষে আসি ধর্মনগরে। সেখানে গাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার ট্রেনে ফিরে আসি। এভাবেই চলছিল সময়টা।

    একবার শিলচর ক্যান্টেমেন্টে এসে দেখি, আমাদের এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) ক্যাম্প। ক্যাপ্টেন হায়দার সাহেব ছিলেন সেটার দায়িত্বে। আমাদের দেখে তিনি খুশি হলেন। ভারতীয় মেজরের কাছ থেকে চেয়ে নিলেন আমাদের ২৪ জনের লিস্ট। এরপর থেকে মাস-শেষে আমরা তিনশ টাকা বেতন নিতাম তার কাছ থেকে। ২ নং সেক্টরে আমরা সরাসরি ছিলাম তার সঙ্গে।’’

    মুক্তিযুদ্ধের সময় এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের ডান হাতের কনুইয়ের হাড়ের কিছু অংশ উড়ে যায় এবং কয়েকটি গুলি লাগে তাঁর তলপেটে। সেদিনের সেই ঘটনাটির কথা শুনি তাঁর ভাষায়–

    ‘‘আমি তখনও ইন্ডিয়ান ট্রুপসের সঙ্গে। পরিকল্পনা হয় আমাদের এফএফ ও ইন্ডিয়ান রেজিমেন্ট একসঙ্গে মুভ করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট দখলে নেওয়ার। ইন্ডিয়ান আর্মি পাঁচশর মতো; আর এফএফ তারও বেশি।

    ২৮ নভেম্বর ১৯৭১। আমরা ছিলাম মেঘালয়ে। রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা। মেঘালয়ে পাহাড়ের এক জায়গায় নামে ইন্ডিয়ান ট্রুপস। ঢালের রাস্তা বেয়ে গাড়ি নিয়ে নামে তারা। একটি গাড়ি চালাচ্ছিলাম আমি। পাকিস্তানি সেনারা ছিল কংস নদীর পশ্চিম পাড়ে। আমরা পূর্বপাড়ে পাহাড়ের ঢালু দিয়ে নেমে আসছি। ওপার থেকে হঠাৎ আমাদের লক্ষ করে গুলি চালানো হয়।

    গুলির শব্দ হতেই আমি ব্রেক কষি। আগুনের মতো ফায়ার আসছিল। সবাই তখন গাড়ি থেকে নেমে যায়। সিগন্যালের ওরা ওয়ারলেসের সাহায্যে যোগাযোগ করে। আমি ড্রাইভিং সিটে বসে কথা বলছিলাম পাশের দুই ইন্ডিয়ান সিপাহীর সঙ্গে। ব্রাশের গুলি প্রথম এসে লাগে আমার ডান হাতের কনুইয়ে। স্টেনগান হাতে নিচে পড়ে যেতেই আরও কয়েকটি গুলি লাগে তলপেটে।

    আমি প্রথমে তেমন কিছু টের পাইনি। মনে হল, কেউ যেন আমার হাতে জোরে বাড়ি দিয়েছে। রক্ত পড়ছিল ঝরঝর করে। পাশে ছিল এক ইন্ডিয়ান জেসিও। সে একটা শার্ট দিয়ে আমার হাতটা পেঁচিয়ে দেয়। পেটে যে গুলি লেগেছে তখনও বুঝিনি। আমার সাথের দুজনও গুলিবিদ্ধ হয়। সারা শরীর হিম হয়ে আসছিল। আমাদের তুলে নিতে হেলিকপ্টার কল করা হয়। কিন্তু তার আগেই আমি জ্ঞান হারাই। ১ মাস ৮ দিন জ্ঞান ছিল না। যখন চোখ মেলি তখন আমি ব্যারাকপুর মেডিকেল হাসপাতালে।’’

    ডান হাতের জখম দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর জানান হাত নিয়ে তাঁর কষ্টের কথাগুলো–

    ‘‘২০০০ সাল পর্যন্ত হাতে অপারেশন হয়েছে ২৬ বার। ১৯৭৩ সালে সরকারিভাবে ২৬ জনকে পাঠানো হয় সুইজারল্যান্ডে। সেখানে আমার হাতে স্ক্রু লাগিয়ে দেওয়া হয়। হাতটা ঝুলেছিল কোনো রকমে। মাঝে মাঝেই ব্যথা হয়ে ফুলে যেত। তখন সারারাত বসে বসে কাঁদতাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন সুইজারল্যান্ডে। কোনো এক সেমিনারে এসেছিলেন তিনি। সেদিনকার ছবি দেখলে আজও সবকিছু মনে পড়ে যায়।’’
    সুইজারল্যান্ডে বঙ্গবন্ধু যখন দেখা করলেন

    [নিচের লিংকে রয়েছে ইউটিউবে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর খানের সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশের ভিডিও:

    https://www.youtube.com/embed/scUKbx4kC5k]

    মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আক্ষেপ করে বলেন–

    ‘‘দেশের জন্য রক্ত দিছি সেটা আর বলতে চাই না। বিয়াল্লিশ বছরে তো একটা লোক আসল না মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার খোঁজ নিতে। আজ তুমি আসলা। আমি তো ছেলেমেয়েরে বলেই দিছি, মরলে যেন কেউ বাসায় না আসে। মরণের পরে মুক্তিযোদ্ধার ওই সম্মান আমার দরকার নাই।’’

    কথা উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর বলেন–

    ‘‘এরশাদ সাহেবের সময় প্রথম তালিকা তৈরি হয়। ওই সময়ই উচিত ছিল তালিকা চূড়ান্ত করা।’’

    তালিকা কেন বাড়ে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন–

    ‘‘বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সবাই চায় তার দলের মুক্তিযোদ্ধা একটু বেশি হোক। রাজনৈতিক কারণে এ তালিকা বাড়ে। আগে শুনছি ইন্ডিয়ান তালিকা মোতাবেক পঙ্গুসহ মুক্তিযোদ্ধা ছিল ১ লাখ ৩০ হাজারের মতো। এখন তো শুনি ৩ লাখের ওপর ভাতা নেয়। বাকিগুলা তাইলে কোথা থেকে আসল? একসময় ৫শ টাকা দিলেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাওয়া যেত। তবে এর জন্য আমরাই দায়ী। কোনো মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফাই না করলে মুক্তিযোদ্ধা বাড়ে কীভাবে? এই তালিকা তাই সিল করে দেওয়া উচিত। তালিকা বাড়লেই কলঙ্ক বাড়বে।’’

    যেমন দেশ চেয়েছিলেন তা কি পেয়েছেন? এমন প্রশ্নে আনমনা হয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর। অতঃপর বলেন–

    ‘‘ওই দেশ আমরা পাই নাই, বাবা। ভেবেছিলাম দেশটা সোনার বাংলা হবে। শেখ মুজিবকে ওসমানী সাহেব বলেছিলেন, স্যার, মুক্তিযুদ্ধে এতগুলা লোক মরল। ওয়ার ফিল্ডের নিয়ম মেনে আরও কিছু লোককে মারতে চাই। শুনে শেখ সাহেব বলেছিলেন, কারে মারুম, এটা আমার ডান হাত, ওটা আমার বাম হাত। এটা চোর, ওটা ভালো মানুষ। এটা ফেরেশতা তো ওইটা শয়তান। সবই তো আমার। ফলে স্বাধীন দেশে রাজাকার, চোর, বদমাশ সবাই থেকে যায়। পরে বঙ্গবন্ধুকেই ওরা মেরে ফেলল। সোনার বাংলা পরিণত হয় শশ্মানে।’’

    বিয়াল্লিশ বছর পর হলেও এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন–

    ‘‘বিচার তো আরও আগেই হওয়া দরকার ছিল। স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শুরুও করেছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার পর দালাল আইন বাতিল হল। জিয়া সাহেব যুদ্ধাপরাধী অনেককেই বিদেশে পাঠালেন, প্রধানমন্ত্রী বানালেন শাহ আজিজকে। পরে তার দলের হাত ধরে রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী হন রাজাকার। জিয়াউর রহমান এদের রাজীতিতে এনেছিলেন। এখন এরা তার দলের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে গেছে।’’

    স্বাধীন দেশে খারাপ-লাগার কথা বলতে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন–

    ‘‘এখন ইলেকশন করেই সবাই জনগণের কথা ভুলে যায়। যে রাজা হয় তার পকেটেই টাকা যায়। কেউ ইলেকশনে খরচ করল ৩ কোটি টাকা। ক্ষমতায় গিয়ে সে টাকা না তুলে জনগণের কাজ করে না। দুই পয়সারও দেশপ্রেম দেখি না তাদের মধ্যে। যে যায় ক্ষমতায় সেই চুরি করে। এ সব দেখলে খুব খারাপ লাগে।’’

    কথা উঠে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তরুণ প্রজন্মের জেগে ওঠা নিয়ে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারীদের প্রতি দোয়া করে তিনি বলেন–

    ‘‘এই গণজাগরণ না হলে এদের বিচার করা যেত না। কাদের মোল্লার ফাঁসিও হত না। তাই যে যাই বলুক, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন আজ ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।’’
    জাহাঙ্গীর খানের মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র

    জাহাঙ্গীর খানের মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র

    স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতির কথা শুনি মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের মুখে–

    ‘‘নিজস্ব রাষ্ট্র আর ফ্লাগ পাইছি। খাইয়া থাহি না থাহি আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। বিদেশি মিশনে আমাদের সৈনিকরা দেশের মুখ উজ্জল করতাছে। গার্মেন্টস সেক্টরের মা-বোনরা দেশের অর্থনীতি বদলাই দিতাছে। এর চেয়ে বেশি ভালোলাগার আর কী হইতে পারে!’’

    মেয়ের ঘরের নাতি-নাতনিদের সঙ্গেই আজ মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর হোসেনের বন্ধুত্ব। তিনি বলেন–

    ‘‘তাদের বলেছি ভালোভাবে লেখাপড়া করতে। বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নয়, বরং ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে।’’

    নানাকে ঘিরে নাতনি ফরিয়া, ফারহা, আদৃতা ও হৃদিতা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চায়। জাহাঙ্গীর তখন তাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান। কোলে ওঠে ছোট হৃদিতা নানার হাতের জখম দেখে। মলিন মুখে তাতে হাত বুলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নানাকে সে প্রশ্ন করে– ‘‘তোমার এখানে কে গুলি করল, নানু? পাকিস্তানিরা? ওদের আমি ধরব, কেন ওরা আমার নানুকে গুলি করল’’।

    অবুঝ নাতনির কথা শুনে বুক ভরে যায় মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের।

    সংক্ষিপ্ত তথ্য

    নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. জাহাঙ্গীর খান।

    তিনি ছিলেন: সেনাবাহিনীর একজন সিপাহী, আর্মি নম্বর ৬৫৭৮১০৩।

    যুদ্ধ করেছেন: ২ নং সেক্টরে।

    যুদ্ধাহত: ২৮ নভেম্বর ১৯৭১, রাতে। হালুয়াঘাট অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে তাঁর ডান হাতের কনুইয়ের হাড়ের কিছু অংশ উড়ে যায় এবং কয়েকটি গুলি লাগে তাঁর তলপেটে। ২০০০ সাল পর্যন্ত তাঁর হাতের অপারেশন হয়েছে ২৬ বার। ১৯৭৩ সালে সরকারিভাবে তাঁকে পাঠানো হয় সুইজারল্যান্ডে। সেখানেই হাতে স্ক্রু লাগিয়ে দেওয়া হয়। হাতটা ঝুলেছিল কোনো রকমে। এখনও মাঝে মাঝে ব্যথা হয়ে ফুলে যায়।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/16402
  • Biplob Rahman | ০২ এপ্রিল ২০১৪ ১৯:০১582766
  • আমি যুদ্ধে যাচ্ছি তুই দোয়া করিস
    ওয়ালিউল্লাহ ওলি
    বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

    যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন করে এখন আমাদের রিক্সা চালাতে হয়, এতে যত না কষ্ট হয় তার থেকে বেশি কষ্ট হয় যখন রাজাকারেরা এই দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে গাড়িতে করে চলাফেরা করে। ঠিক এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের রিক্সাচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: আলাউদ্দিন।

    মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিনের বাড়ী নওগাঁ জেলার সাপাহার থানার শিরণটী গ্রামে। তার বাবার নাম লাল মুহাম্মদ। ১৯৭১ সালে ৭ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন তিনি।

    তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই যুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। পাক হানাদার বাহিনীর ২৫ মার্চের নৃশংসতার খবর ছড়িয়ে পড়লে কৃষিকাজ ছেড়ে চলে যাই ভারতের মালদহের তপন থানার পাড়িলিয়া ক্যাম্পে। যুদ্ধে যাওয়ার আগে মাকে বলি ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের সবাই তো যুদ্ধে যাবে না মা; আমি যুদ্ধে যাচ্ছি তুই দোয়া করিস। তোর আরো দুইটা ছেলে ও একটা মেয়ে থাকল। যাওয়ার সময় মার মনটা একটু খারাপ হল। পরে বলল যা বেটা যা যেতে তো হবেই।

    পরে আমি মাকে বললাম, তুই দোয়া করলে আমি স্বাধীন হয়ে ফিরে আসব। মা আমার মাথায় হাত বুলাল দোয়া করে দিল। আমি চলে গেলাম। যাওয়ার সময় পিছন ফিরে দেখলাম মা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম তুই দেখে আছিস কেন? তুই দোয়া করিস আমি দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসব। মা হাসল আর বলল, যা বেটা দোয়া করে দিলাম তোর বিপদ আসলে বিপদ কেটে যাবে। আর পিছনে ফিরে দেখিনি। চলে গেলাম ভারতের মালদহের তপন থানার পাড়িলিয়া ক্যাম্পে।

    সেখানে ট্রেনিং নিয়ে রাতে ঢুকতাম দেশে। চালাতাম গেরিলা হামলা। প্রথমে নাজমুল হক ও পরে নুরুজ্জামানের অধীনে যুদ্ধ করি ৭নং সেক্টরের নওগাঁ ও রাজশাহী অঞ্চলে। বরাবরের মতো এক রাতে হামলা চালাতে আসি সাপাঁহারের পাক ক্যাম্পে। এসে দেখি সব ফাঁকা, পাক বাহিনীর কোন চিহ্নও নেই আশেপাশে। পরে জানতে পারলাম যুদ্ধ থেমে গেছে। স্বাধীন হয়ে গেছে বাংলাদেশ। আনন্দে ভরে গেল মন।

    নিজের ভাষায় আলাউদ্দিন বলেন, ‘সেদিন যে আনন্দ পাইছিনু এরকম আনন্দ মনে হয় আর কোনদিন পামুনা।’

    আলাউদ্দিন আরো বলে, আমাদের দলে ছিল ১০০-১৫০ জনের মত মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে কেউ মারা গেলে আমাদের জানতে দিত না। আমাদের লোকজনই তাদের সরিয়ে নিত। মাঝে মাঝে বড় কোন আক্রমণে গেলে পাশের ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা এসে আমাদের সহযোগীতা করত।

    মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও আলাউদ্দিন অল্প শিক্ষা বলে কোন চাকরি কপালে জোটেনি। জীবিকার তাগিদ থেকে ভাগ্যকে মেনে নিয়ে উপার্যনের জন্য রিক্সা চালাতে শুরু করেন। কিন্তু তিনি মুক্তিযোদ্ধা বলে তাকে সম্মান করে নওগাঁ এলাকায় তার রিক্সায় কেউ উঠতে চায় না। মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারা তাকে রিক্সা চালাতে মানা করে। যার ফলে তিনি নওগাঁ ছেড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রিক্সা চালাতে আসেন।

    আলাউদ্দিন ক্যাম্পাসের পাশে গেরুয়া গ্রামে একটি ভাড়া বাসায় থাকে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা থাকে নওগাঁয় তার নিজ বাড়িতে। প্রতিদিন তার উপার্জন মাত্র এক থেকে দেড়’শ টাকা। এ স্বল্প উপার্জন দিয়ে তার পরিবার ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে।

    সে জানায়, তার এই অসচ্ছল পরিবারকে সচ্ছল করার ইচ্ছা যতখানি তার থেকে বেশি ইচ্ছা জীবিত অবস্থায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যাওয়া।

    তিনি বর্তমান সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যুদ্ধাপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবী জানান।

    তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মা শান্তি পাবে এবং সে সব মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছে তারাও মানসিক দিক দিয়ে স্বস্তি পাবে।

    বাংলাদেশ সময়: ০০১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১১

    http://www.banglanews24.com/1971/detailsnews.php?nssl=573eec40e4ef4f2089531dd5cbf629f8
  • Biplob Rahman | ০২ এপ্রিল ২০১৪ ১৯:০৩582767
  • এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার অভিযান

    গল্প পড়তে কে চায়? আর গল্প যদি হয় মুক্তিযুদ্ধের তবে তো কথা-ই নেই। বেশ কিছু দিন আগে জামালপুরে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো উৎসবে এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার গল্প শুনিয়েছেন মেজর (অব:) হামিদুল হোসেন তারেক বীরপ্রতীক। সেই গল্পটি লিখিত আকার পুন:প্রকাশ করা হল:

    আমি যখন মুক্তিযুদ্ধে যাই, তখন আমার বয়স ছিল ১৯। আর এই বয়সেই আমি একটি ক্যাম্পের কমান্ডার হয়েছিলাম। আমি ওই অল্প বয়সে হয়তো ভাল যুদ্ধ করেছিলাম, সেজন্য হয়তো কমান্ডার হতে পেরেছিলাম। আমার সাথে আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় এবং অনেক কিশোরও যুদ্ধ করেছে। ঠিক এরকমই ১২ বছরের এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার গল্পই আজ তোমাদের শোনাবো। আমি তখন ছিলাম পশ্চিম দিনাজপুরের ৭নং সেক্টরের একটি ক্যাম্পে। একদিন ক্যাম্পে বসে আছি, হঠাৎ দেখি কান্নার শব্দ। আমি তাবু থেকে বাইরে এসে দেখি আমার সহযোদ্ধারা এক কিশোরকে মারছে। আমি বললাম, ওকে মারো কেন? একজন বলল, স্যার এ চোর। আমাকে দেখে ছেলেটা দৌঁড়ে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরলো এবং বলল, ‘আমি আসলেই চোর স্যার। আমার বাবাও চোর ছিল। মিলিটারীরা তাকে মেরে ফেলেছে। তাই আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য এখানে এসেছি।’ আমি তাকে বললাম, তুই কিভাবে যুদ্ধ করবি। তোর চেয়ে তো রাইফেলের ওজনই বেশি। সে তখন বলল, না স্যার, আমি পারবো। তারপর আমি আমার সহযোদ্ধাদের বললাম, ওকে ট্রেনিং দাও। ট্রেনিংয়ের পর ও কিশোরটি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কয়েকটি অপারেশনে গেল।

    মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন থেকে ফিরে এসে বলল, ও ভাল যুদ্ধ করে। খুব সাহসী। নভেম্বরের মাঝামাঝি আমরা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী মিলিত ভাবে আক্রমন করতে যাবো পশ্চিম দিনাজপুরের মোহনপুরে। আমার সাথে তখন ওই কিশোরটাও ছিল। ওর নাম ছিল সোলায়মান। আমরা ‘সলো’ বলে ডাকতাম। আমরা যখন আক্রমনের স্থান থেকে ১০০ গজ দূরে, তখন ভারতীয় মেজর বললেন, আর যাওয়া যাবে না। তিনি বললেন, আমরা এখান থেকে বাইনোকুলার দিয়ে দেখবো। তখন সলো আমাকে বলল, মেজর সাহেবের কথা রাখেন তো। আমি গিয়ে দেখে আসি ওরা কি করছে? মেজর সাহেব বললেন, না না এখনই মারা যাবে। সলো কথা না শুনে রাইফেলটা আমার কাছে দিয়ে চলে গেলো। যাবার সাথে সাথে পাকিস্তানী আর্মির গুলির শব্দ শোনা গেলে।

    আমরা তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রায় ৪৫ মিনিট পর সলো ফিরে আসলো। সে আমাকে বলল, আমি তো চোর মানুষ স্যার। ব্যাংকারে ঢুকে ট্রানজিস্টর ও রাইফেল দুটি চুরি করে এনেছি। আর ব্যাংকারে একটি গ্রেনেড রেখে এসেছি। যে ব্যাংকারে ঢুকবে সাথে সাথে মারা যাবে। মেজর সাহেব তো অবাক। আমি বললাম, সলো কেমনে পারলি? সলো বলল, আমার ১০ বছরের চুরি করার অভিজ্ঞতা আছে না স্যার।

    শ্রুতিলিখন: আরিফুল ইসলাম আরমান

    http://www.banglanews24.com/1971/detailsnews.php?nssl=cdcb2f5c7b071143529ef7f2705dfbc4
  • Biplob Rahman | ০২ এপ্রিল ২০১৪ ১৯:০৬582768
  • আলিফজান বিবিকে খুঁজে পাওয়া
    মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
    বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

    ঢাকা : দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বারান্দায় যখন আলিফজান বিবির সঙ্গে দেখা হল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়। সারাদিনের ক্লান্তি আর মানুষের মিথ্যাচারে দিকভ্রান্ত হয়ে শেষমেশ দেখা মিলল বীরাঙ্গনার আলিফজান বিবির। ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধা এখন বয়সে ভারে অনেকটাই ন্যুব্জ।

    একাত্তরের পাকবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিতা এ নারীর শরম ভাঙ্গার আগে তাকে লুকিয়ে রেখেছিল এ সমাজ।

    উপজেলার চণ্ডিপুর গ্রামের খাতুনপাড়া বাড়িতে বসবাস করলেও ১২ ডিসেম্বর রাতে স্থাণীয় কাউন্সিলর মোসাহিদ মিঞা বাংলানিউজকে জানান, আলিফজান বিবি নামে কোনও বীরাঙ্গনা এ গ্রামে নেই।

    অবশ্য আলিফজান বিবি বাংলানিউজকে বলেন, মোসাহিদ মিঞা তাকে চেনেন এবং গত ঈদেও তাকে একটি কাপড় সাহায্য করেছেন।

    খাতুনপাড়ায় যাওয়ার রাস্তা ভালো নয়। দিরাই থেকে টমটম করে ঘাটে গিয়ে আবার নদীর পাড় ধরে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছাতে হয় আলিফজানের ঘরে।

    গত ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আউটরিচ প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর রনজিৎ কুমার ‘শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং মানবাধিকার ও শান্তি সম্প্রীতির ভাবধারায় উদ্বুদ্ধকরণ প্রকল্প’র কথা জানান।

    ২০০৯ সালের মে মাসে সংকলিত সংগ্রাহক তালিকা ৬’ এ দেখলাম আলিফজান বিবি’র কথা। ২০০৯ সালে দিরাই উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের মোছা. রুনা বেগম নামে দশম শ্রেণীর একটি মেয়ে তার কথা উল্লেখ করেছে।

    রনজিৎ কুমার থেকে রুনার যে মোবাইল নম্বর পাওয়া গেল তা বর্তমানে বন্ধ।

    বাংলানিউজের এডিটর-ই-চিফ আলমগীর হোসেনকে বিস্তারিত জানালে তিনি উৎসাহ দেন আলিফজান বিবির সন্ধান বের করতে।
    ১২ ডিসেম্বর রাতে সুনামগঞ্জ পৌছেঁ দিরাই পৌরসভার কাউন্সিলর, চণ্ডিপুর গ্রামের কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু কেউ বলতে পারেন না আলিফজান বিবির কথা। দিরাই উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যানকেও ফোন দেওয়া হলে তিনিও বলতে পারলেন না।

    মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলরের কাছেও অজানা আলিফজান।

    দিরাইয়ে চণ্ডিপুর গ্রামের কথা জিজ্ঞাসা করলে দুয়েকজন বললেন, এ নামে কোনও গ্রামই নেই। পরে জানলাম সে গ্রামের নাম এখন চান্দিপুর।

    ‘চণ্ডি’ হিন্দু নাম বলে এখন তা ‘চান্দি’ নামে পরিচিত। আবার গ্রামও নাকি পূর্ব-পশ্চিম দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে।
    ১৩ তারিখ খুব ভোরে উঠে রওনা দিলাম দিরাইয়ের উদ্দেশে। লোগুনায় করে প্রায় দু’ঘণ্টার পথ।

    দিরাই উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকার কাছে জানতে চাইলাম রুনা বেগমের কথা। বললেন রুনা পাশ করে বেরিয়ে গেছে, বর্তমানের কোনও খবর তারা জানেন না।

    এ প্রকল্পটি ছিল আরও প্রায় তিন বছর আগের। সে সময় যিনি প্রধান শিক্ষক এবং দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন তারা দুজনেই এখন অবসরে গেছেন। দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক শোলেল চন্দ্র সাহার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও রুনার ব্যাপারে কোনও তথ্য দিতে পারলেন না।

    স্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা সাহেব অবশেষে রুনার পাশের বাড়ির ৭ম শ্রেণীর একটি মেয়ের থেকে খোঁজ নিয়ে জানালেন, পূর্ব চণ্ডিপুর গ্রামে রুনাদের বাড়ি। আক্তার হোসেনের বাড়ির উত্তর পার্শ্বের বাড়ি।

    আলিফজান বিবি’র কথা তারা বলতে পারলেন না। উপস্থিত শিক্ষকরা মাথায় একটি শঙ্কা ঢুকিয়ে দিলেন, হয় তো রুনা অন্য কারও কাছ থেকে শুনে এ ঘটনা লিখেছে। রুনার বিয়েও হয়ে যেতে পারে। আবার আলিফজান নামে কেউ থাকলেও হয়তো মারা গেছেন।

    স্কুল থেকে বেরিয়ে পূর্ব চণ্ডিপুর গ্রামে যাওয়ার জন্যে মোটর সাইকেলে উঠলাম। নানা ধরনের শঙ্কা’র মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। ঘাটে এসে মোটর সাইকেল ড্রাইভার জানালেন, বাকি পথ হেঁটে যেতে হবে।

    কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, আক্তার হোসেনের বাড়ি কোনটা। উত্তর, ‘সামনে’।

    ঢাকায় এসে সিলেটবাসীর কাছে শুনলাম, ‘হাওর অঞ্চলের মানুষ যদি বলে সামনে, ধরে নিতে হবে, সেই সামনের অর্থ কয়েক কিলোমিটারও হতে পারে।’

    তবে কেউই দিতে পারছিলেন না আলিফজান বিবির খোঁজ। শুধু মাত্র ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ আব্দুর রহমান জানালেন তিনি চিনেন।
    তবে বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন তা বলতে পারেন না। বেশি কথা বাড়ালেন না বৃদ্ধ।

    প্রায় দুই কিলোমিটার মাটির রাস্তায় হেঁটে রুনার ঘরের দেখা পেলাম। জরাজীর্ণ মাটির ঘর। হাঁক দিলে বেরিয়ে আসেন রুনার বড় ভাই।

    জানালেন, রুনা এখন সিলেট শহরে বিএ পড়ছেন। তবে তিনি আলিফজান বিবির খোঁজ দিতে পারলেন।

    বেঁচে আছেন আলিফ জান, রুনা কারও থেকে শুনে বা বানিয়ে কিছু লেখেননি। নিশ্চিত হলাম। এটা আলিফজানের এলাকা। এখানে সবাই তাকে চেনে, সবাই জানে তার ত্যাগের কথা।

    নদীর পাড় ধরে ছোট্ট খুকির পেছন পেছন যেতে থাকলাম সামনে। বুঝতে পারলাম, এ এলাকায় হতদরিদ্রদেরই বাস।
    দৈর্ঘ্যে খাতুনপাড়া অনেক বড় বাড়ি। ঢাকার বস্তিগুলোর মতোই ঘরের সঙ্গে ঘর লাগানো।

    ব্রাকের একটি প্রাথমিক স্কুলও রয়েছে। তার দু’ঘর পরেই আলিফজান বিবির ঘর। মাটির ছোট্ট কুড়ে ঘর। উচ্চতায় আমার চাইতে ছোট সে ঘর। ঘরের সামনেই মাটির চুলা। অন্ধকারে ভেতরে কিছু দেখা যায় না।

    পাশের ঘরের ছালেহা বিবি জানালেন, এখানকার সবার সঙ্গে আলিফজান বিভিন্ন পরিচয়ে মিশে আছে। ছোট ছেলে মেয়েরা সবাই তার নাতি নাতনী।

    এক নাতনীর নিউমোনিয়া হয়েছে চারদিন হলো। দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে। সেখানে খাবার পৌঁছে দিতে গেছেন তিনি।

    কোন রাস্তা দিয়ে গিয়েছে জানতে চেয়ে হাঁটা দিলাম। এ পথ পুরোটাই নদীর পাড় দিয়ে। ঘাটে এসে বুঝলাম, হাসপাতালেই যেতে হবে।

    হাসপাতালের ৩ নং ওয়ার্ড দেখা হলো আলিফজান বিবির সঙ্গে। অভাবের তাড়নায় শরম ভেঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন আলিফজান।

    http://www.banglanews24.com/1971/detailsnews.php?nssl=cf9b2d0406020c56599f9a93708832b5
  • Biplob Rahman | ০২ এপ্রিল ২০১৪ ১৯:০৯582769
  • সংবাদপত্রে ১৯৭১
    শেরিফ আল সায়ার
    বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

    ভুটানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে সবার আগে স্বীকৃতি দেয় হিমালয় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্র ভুটান। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের এক কোণায় খুব ছোট্ট একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘ভুটান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান’। একই সঙ্গে ওই দিনই দৈনিক ইত্তেফাকের আরেকটি সংবাদ ছিল ‘বাংলা দেশের প্রতি ভারতীয় স্বীকৃতিতে চীনের নিন্দা।’ সে সময় অধিকাংশ পত্রিকায় ‘বাংলাদেশ’কে লেখা হতো ‘বাংলা দেশ’।

    যাহোক, সংবাদপত্রে একাত্তর বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর। তবে এটাও ঠিক ইতিহাসের সঙ্গে সংবাদপত্রের সম্পর্ক অতি নিবিড় এবং ঘনিষ্ঠ। ইতিহাসচর্চা কিংবা রচনা দু’টি ক্ষেত্রেই সংবাদপত্রের গুরুত্ব থাকবে। সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার জন্য কিংবা বোঝার জন্য তৎকালীন সংবাদপত্রের ভূমিকা অনেক। এ বছরের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার বিষয় হিসেবে পেয়ে যাই ১৯৭১ সালের সংবাদপত্রের ভূমিকা নিয়ে কাজ করার সুযোগ। বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভে যাই আমি ও রেজওয়ান আহমেদ। রেজওয়ান এ গবেষণায় আমার সহযোগী। যিনি উদ্যোক্তা তিনি আমার শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মাদ আনোয়ার। যুদ্ধে সংবাদপত্রেরও ভূমিকা আছে; এ বিষয়টি নিয়ে স্যারই প্রথম কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অধ্যাপক আনোয়ার ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ-এর প্রকৌশল বিভাগের পরিচালক হিসেবে কর্মরত। তাঁর দিকনির্দেশনায় চলে আমাদের কাজ।

    আমি ও রেজওয়ান একাত্তরের সংবাদপত্রগুলো নিয়ে বসেই কখনো চমকে উঠি; কখনো শিহরিত হই। আমাদের সামনে স্পষ্ট হয় মুক্তিযুদ্ধ কোনো দল বা কোনো ব্যক্তির জন্য ছিল না। আমরা এও বুঝি এটা ছিল সময়ের দাবি। পুরো জাতি স্বাধীনতার সংগ্রামে মাতাল হয়ে পড়েছিল। সেসব সংবাদের বিচ্ছিন্ন কিছু অংশ নিয়েই আমার এই লেখা।

    আমি ৮ মার্চের পত্রিকা দিয়েই শুরু করি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পরদিন ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল ‘পরিষদে যাওয়ার প্রশ্ন বিবেচনা করিতে পারি যদি-’। ভেতরে আছে বঙ্গবন্ধুর শর্তগুলো ও ভাষণের বিবরণ। তবে এক্ষেত্রে ‘দৈনিক সংবাদ’ ছিল এগিয়ে। সরাসরি স্বাধীনতার স্লোগানই ঠাঁই পেয়েছিল শিরোনামে। দৈনিক সংবাদের ৮ মার্চের শিরোনাম ছিল ‘এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম: মুজিব’।

    তবে দুঃজনক বিষয় হলো, বঙ্গবন্ধুর পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ৯ মার্চ, ১৯৭১ আরেকটি ভাষণ দেন। ২ নেতার এক কাতারে চলে আসার একটা নজির স্থাপিত হয়। কিন্তু এ নজিরটি ইতিহাসের পাতায় অনেকটাই অনুপস্থিত হিসেবে আমরা দেখতে পাই। ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ দৈনিক সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘মুজিবের সঙ্গে একযোগে আন্দোলন করিব: ভাসানী’। এ সংবাদের শুরুর লাইনগুলো তুলে দিলাম,

    ‘অশীতিপর বৃদ্ধ রাজনৈতিক নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গতকাল (মঙ্গলবার) পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতাকালে অবিলম্বে বাংলার স্বাধীনতা প্রদানের জন্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহবান জানান। মাওলানা বলেন, ১২ মার্চের মধ্যে যদি স্বাধীনতা দেওয়া না হয় তাহা হইলে আমি ও শেখ মুজিব পুনরায় ১৯৫২ সানের মত একযোগে আন্দোলন করিব- প্রধানমন্ত্রী হইতে আমরা যাইব না।...’

    সে সময়ের উল্লেখযোগ্য ২ নেতা যখন একই কাতারে দাঁড়িয়ে যান তখন জনতার সামনে স্বাধীনতা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ থাকে না; এটাই স্বাভাবিক। বাঙালি জাতি তখন থেকেই পূর্ণ রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে। আমাদের সংবাদপত্রগুলোও সেই স্বপ্নই মানুষকে দেখায়। সাহস দেয়। বাঙালি জাতির জাগরণের নেতা শেখ মুজিবের নানা কথা মালা জায়গা নেয় পত্রিকা জুড়ে। যেমন, ১৫ মার্চ দৈনিক সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বাঙালীরা নতি স্বীকার করিবে না: মুজিব’। অন্যদিকে ১৯ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল ‘এ গণবিস্ফোরণ মেশিনগানেও স্তব্ধ করা যাইবে না’। এমন শিরোনাম মানুষের মনকে যে জাগিয়ে তুলতে পারে তা অবলীলায় বলে দেওয়া যায়।

    বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের পর থেকেই বাঙালি জাতি সব রকমের আক্রমণের প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। সংবাদপত্রগুলো এ বিষয়গুলোর উপরও জোর দেয়। যেমন, ২১ মার্চ দৈনিক সংবাদের ভেতরের পাতায় সব জেলার আন্দোলন, বিক্ষোভের সংবাদগুলো একসঙ্গে প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল ‘মোদের হাড় দিয়ে ভাই জ্বালবো এবার মুক্তির বজ্রানল’।

    ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার পর পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে পড়ে। সরকারি পত্রিকা এবং রাজাকার আলবদর কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ হয়। তবে ইত্তেফাক প্রকাশ হওয়া শুরু করে অক্টোবর মাস থেকে। দৈনিক সংবাদের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। জাতীয় আর্কাইভে যুদ্ধকালীন দৈনিক সংবাদের কোনো কপি পাওয়া যায়নি।

    অক্টোবর থেকে দৈনিক ইত্তেফাক দেখলে দেশে যুদ্ধের পরিস্থিতি বোঝার উপায় নেই। তারপরও খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সরকারের নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিয়ে ইত্তেফাক প্রকাশ করে যুদ্ধের টুকরো টুকরো খবর।

    রাজাকার নিয়ে বহু সংবাদ পাওয়া যাবে ১৯৭১ সালের সংবাদগুলোতে। সরকারি পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তানে ১১ এপ্রিল শিরোনামই ছিল ‘ঢাকায় নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত’। আবার ১২ মে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ‘আরো কতিপয় স্থানে শান্তি কমিটি গঠন’ শিরোনাম সংবাদের ভেতর উল্লেখ আছে বিভিন্ন স্থানে শান্তি কমিটি গঠনের কথা। এমনকি যারা যারা শান্তি কমিটিতে আছে তাদের নামও উল্লেখ আছে এতে।

    পত্রিকাগুলো দেখলে আরো জানা যায়, পাকিস্তানি শাসক ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় এজেন্ট বলে উল্লেখ করত। যেমন, ১৯ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে ‘রাজাকার তৎপরতা’ শিরোনামে সংবাদটি ছিল,

    ‘গতকাল রাজাকাররা রাজশাহী ও যশোরে ২টি পৃথক সংঘর্ষে ২ দল ভারতীয় এজেন্টের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দেয়। রাজশাহী হইতে প্রাপ্ত এক খবরে বলা হয়: গতরাত্রে বড়াই গ্রামে টহলদানরত রাজাকাররা দেখিতে পায় যে, প্রায় ৩০ জন ভারতীয় এজেন্ট লুটপাট করার উদ্দেশ্যে ঐ গ্রামে ঢুকিতেছে। তখন তাহারা ভারতীয় এজেন্টদের প্রতি গুলীবর্ষণ শুরু করে এবং যতবারই তাহারা গ্রামে প্রবেশের চেষ্টা করে ততবারই রাজাকারগণ তাহাদের বাধা দান করে। ইহাতে ৪ জন ভারতীয় এজেন্ট নিহত হয় এবং তাহাদের নিকট হইতে ৪ শত ২ রাউন্ড গুলীসহ ৪ টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়। ...’

    মুক্তিযুদ্ধের সময় কিংবা তার আগে পত্রিকাগুলো বড় ভূমিকা রেখেছে। তারাও যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। সে সময়কার সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছেন। কিন্তু তাদের কথা ইতিহাসে খুব একটা উঠে আসে না।

    সত্যিকথা বলতে কী, মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ইতিহাস এতটাই ব্যাপক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে বিস্তৃত যে, জনগণ-রাজনৈতিক দল-ব্যক্তি, বেসামরিক-আধা সামরিক-সামরিক বাহিনী, বুদ্ধিজীবী-গবেষক, ছাত্র, কৃষক-শ্রমিক-জনতা, সাংবাদিক, নারীসমাজ সকলেরই যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ ও ভূমিকার নিদর্শন রয়ে গেছে। আর এ সবকিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে সংবাদপত্রে। যে কাল যে যুগই হোক না কেন। সময় ও ইতিহাস রক্ষিত থাকে সংবাদে। সম্ভবত এ কারণেই এম.ভি. চার্নলি বলেছেন, ‘সংবাদ হলো আজকের মোড়কে দেওয়া আগামী দিনের ইতিহাস।’

    বাংলাদেশ সময়: ২২১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১১
    http://www.banglanews24.com/1971/detailsnews.php?nssl=0e900ad84f63618452210ab8baae0218
  • Biplob Rahman | ০২ এপ্রিল ২০১৪ ১৯:১০582770
  • ‘বিজয় দিবস’ নিয়ে বাংলানিউজের আড্ডা

    বিজয় দিবসের ৪০ বছরকে সামনে রেখে ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার লেখকপাড়া খ্যাত আজিজ সুপার মার্কেটে বাংলানিউজের উদ্যোগে বিজয় দিবস নিয়ে বিশেষ আড্ডার আয়োজন করা হয়। আড্ডায় লেখক-সাহিত্যকর্মীরা বিজয় দিবস নিয়ে তাদের ভাবনাগুলো প্রকাশ করেন।

    শুরুতে আজিজের ‘অন্তর রেস্তোরাঁয় আলোচনায় অংশ নেন কবি ও মুক্তিযোদ্ধা নূরুল হক, কবি অমিতাভ পাল ও কবি শামীম সিদ্দিকী।

    পরে আজিজের বারান্দায় কথা হয় গল্পকার পারভেজ হোসেন ও শিশু সাহিত্যিক আহমাদ মাযহারের সঙ্গে। বাংলানিউজের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন- ফেরদৌস মাহমুদ, রবাব রঁসা, রহমান মাসুদ, মহিউদ্দিন মাহমুদ ও আশরাফুল ইসলাম

    ‘সংকটের সময়ই একটি জাতির মূল পরিচয় জেগে ওঠে’ : নূরুল হক

    nurul huqবাংলানিউজ : একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং কবি হিসেবে, স্বাধীনতার ৪০ বছরকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

    নূরুল হক : ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। এর মূলে যে বীজটা ছিল তা আমাদের সংবিধানেই প্রোথিত হয়েছিল। এই প্রোথিত বীজের কারণেই সব দল এক হয়ে একটি সার্বজনীন কমিটি গঠন করেছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে দেশ স্বাধীন হলো এবং একটি সংবিধান পাওয়া গেল।

    কিন্তু ১৯৭৫ সালে তার গতিরোধ হলো। আসলে স্বাধীনতা হলো দুই ধরণের মুক্তি। প্রথমটি অর্থনৈতিক মুক্তি, অপরটি মানসিক বা আদর্শগত মুক্তি। আমি এটাকে অবশ্য সাংস্কৃতিক মুক্তি বলেই জানি। স্বাধীনতাটা আমার কাছে এক সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রাম। এ মুক্তির জন্য বাংলাদেশকে অনেকগুলি খাড়ি পার হতে হয়েছিল। এখন এখানে দাঁড়িয়ে আমাদের উদ্দেশ্য কতটা সফল হয়েছে বা হবে তা বুঝতে পারছি না।

    আমাদের জাতির আদর্শ ও অর্থনীতির মূলে ছিল সমাজতন্ত্র। বহু সংগ্রাম করে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পুনরায় আমরা পাকিস্তানি রাজনীতির ভেতরেই রোধ হয়ে গেলাম। যখন কোন রাষ্ট্র সংগ্রাম করে, তখন সে সংগ্রাম হয় সে রাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে নিয়ে। বর্তমানে আমরা খুব সুবিধা দেখতে পাচ্ছি না।

    বাংলানিউজ : একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ কতটা গুরুত্ব পেয়েছে?

    নূরুল হক : মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত আমার লেখা ‘একাত্তরের অসমাপ্ত কবিতা’য় আমি এ বিষয়টি তুলে ধরেছি। কবিতাটি একটি দীর্ঘ কবিতা। এটি আমার ‘একটি গাছের পদপ্রান্তে’ বইতে আপনারা পাবেন। এ লেখায় আমি আমার আবেগ দিয়ে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা।

    বাংলানিউজ : যে আশা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ, তা আজ অনেকখানি ভূ-লুণ্ঠিত, আপনি কী তা মনে করেন?

    নূরুল হক : দেশ এখন পর্যন্ত যথেষ্ট বড় সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তা না হলে গত নির্বাচনে একটি দলকে সবাই এত ভোট দেবে কেন? এখন সে দল হয়ত ব্যর্থ হচ্ছে। তবু দেশ এখন মূল লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশকে আদর্শের দিক থেকে কমপক্ষে একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতেই হবে। আমি মনে করি না আমাদের সব কিছু ভূ-লণ্ঠিত হয়েছে।

    বাংলানিউজ : স্বাধীনতার ৪০ বছর উদযাপিত হচ্ছে এবার, এক যুগ পরে দেশকে-দেশের শিল্পসাহিত্যকে কেমন দেখতে চান?

    নূরুল হক : অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চাই। শিল্প সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকবে-এমনটাই আশা করি। সরকারের কাজকর্মে হতাশ হলেও আমি দেখতে পাচ্ছি যুব সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে।

    আমি মনে করি, সংকটের সময়ই একটি জাতির মূল পরিচয় জেগে ওঠে। সংস্কৃতিই হলো কোন জাতির মূল পরিচয়।

    স্বাধীনতার পরই এদেশে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটতে পারতো : অমিতাভ পাল

    amitav pulবাংলানিউজ : মুক্তিযুদ্ধে সময় আপনার বয়স ছিল কেমন?

    অমিতাভ পাল : যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল নয় বছর। সে হিসেবে আমি দুটি রাষ্ট্রের নাগরিক। জন্মসূত্রে পাকিস্তানি আর জাতিসূত্রে বাংলাদেশি। আমি যুদ্ধ করিনি কিন্তু যুদ্ধ দেখেছি।

    বাংলানিউজ: মুক্তিযুদ্ধের সময়কার আপনার কোন স্মৃতিচারণ।

    অমিতাভ পাল: মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আমাদের ময়মনসিংহের বাড়ি ছেড়ে আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়ি তারাকান্দায় চলে যাই। কিন্তু এক সময় শোনা গেল, তারাকান্দা বাজারে পাক বাহিনী চলে এসেছে।

    তখন ওখান থেকে আবার স্বপরিবারে পালিয়ে মেঘালয়ের শিববাড়ি শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিই। সেদিন দীর্ঘ পথ পা’য়ে হেঁটে ক্যাম্পে পৌঁছে জুতা কেটে খুলতে হয়েছিল। আমরা যখন গ্রামের বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছিলাম, তখন দেখতে পাই আমার পিসির কোলে তার বাচ্চা নেই। আমরা তার কাছে বাচ্চার কথা জানতে চাইলে সে বলে ঘরে খাটে ঘুমিয়ে ছিল। আমরা সেসময় তার হাতে একটি পুটলি দেখতে পাই। এ পুটলি খুলে দেখা গেল এই মা তার সন্তান আনতে ভুলে গেলেও গয়না আনতে ভোলেননি।

    বাংলানিউজ : বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা কী?

    অমিতাভ পাল : উই আর ওয়েটিং ফর গডো। যেমন বঙ্গবন্ধু আমাদের গডো ছিলেন। মালয়শিয়ায় মাহথির মোহাম্মদ, দেশের ক্রান্তিকালে এমন একজনকে লাগেই। বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ করতেন তখন ওই সময়ে নেতারা কি জানতেন এই নেতার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হবে। অথচ তিনি ডিনামাইটের সুইচে টিপ দিলেন। জাতিকে নেতৃত্ব দিতে হলে আসলে একটি জেনারেল লক্ষ্য স্থির করতে হয়।

    বাংলানিউজ : আপনার লেখায় মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে এসেছে?

    অমিতাভ পাল: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার লেখা একটি গল্প রয়েছে-‘অসচরাচর’। তাতে আমার মূল্যায়ন তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। গল্পে রয়েছে-একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রকা- একটি ব্রিজ উড়িয়ে দিতে গভীর রাতে তেজষ্ক্রিয় ডিনামাইট স্থাপন করে সুইচ হাতে ভাবছেন, রাতে কাউকে না দেখিয়ে ব্রিজ ধ্বংস করলে তার বীরত্ব সবার অজানাই থেকে যাবে। এই বোধ থেকে ওই মুক্তিযোদ্ধা চিৎকার করে সবাইকে জানাতে চাচ্ছিল, তখন পাক জান্তাদের বুলেটে আচমকা তার মাথার খুলি উড়ে যায়, সেই সাথে ধ্বংস হয় ব্রিজটিও।

    এই মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রটি গল্পে তরুণদের কাছে এ কাহিনী বলছিল। তখন এক তরুণ জিজ্ঞেস করে এই আপনি কে? তখন সে বলে, সেই থেকে আমি মাথা বা খুলিবিহীন ঘুরছি। -এই ছিল গল্পের মূল কাহিনী। এ থেকে আমি বোঝাতে চেয়েছি, আমাদের নেতা-নেত্রীদের আত্মপ্রকাশের ঝোঁক অত্যন্ত বেশি।

    বাংলানিউজ : আজকে তো বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস এবং পরবর্তী বাংলাদেশ আর আজকে অস্থির পাকিস্তান।

    অমিতাভ পাল : পাকিস্তান রাষ্ট্র একটি অশিক্ষিত লোকের রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে কিছু এলিট লোক আছে, যাদের সন্তানরা অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজে পড়াশোনা করে। তারা যখন জেনে গেল যুদ্ধে তারা হেরে যাচ্ছে,তখন তারা এদেশের শিক্ষিত মানুষদের খুঁজতে গেল। এবং হত্যা করলো। কিন্তু আমাদের দেশ স্বাধীন হলো।

    ইতিহাসে দেখা যায়, শক্তিশালী লোক তাদের কাছের মানুষের হাতেই নিহত হয়। বঙ্গবন্ধুও দেশ স্বাধীনের চার বছরের মাথায় কাছের লোকদের ষড়যন্ত্রে নিহত হলেন। এটা না হলে বা আরও বিশ বছর পর হলে দেশের চিত্র হয়ত অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু তা হলো না। এ হত্যাকাণ্ডের ফলে রাষ্ট্রের কাঠামো চেইঞ্জ হয়নি। সে-ই পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোই থেকে যায়। এতে রাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ে। আর জামায়াতে ইসলামীর মতো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এগিয়ে যায়।

    শেখ মুজিব মারা গেল, অথচ বড় ধরণের কোনো রি-অ্যাকশান দেখা গেল না। এর কারন আমরা তখনও আসলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ফর্মেই থেকে গেছি এবং এখনো রয়েছি। অথচ স্বাধীনতার পরই এদেশে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটতে পারতো। কিন্তু তা হলো না। এটা হলে দেখা যেত কাউকে সরিয়ে দেওয়ার সময় প্রশ্ন জাগত কেন সরিয়ে দিচ্ছি। এটা না ঘটাতে মুক্তিযোদ্ধারাও সন্ত্রাসী হয়ে গেল। কেউ চে গুয়েভারা হলো না। সাংস্কৃতিক বিপ্লব না ঘটায় এতদিনেও আমরা কোনো তারকোভস্কি বা মায়াকোভস্কি পেলাম না।

    বাংলানিউজ : স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তিতে আপনার চাওয়া পাওয়া

    অমিতাভ পাল : আমাদের হাতের মধ্যে ময়লা জমে আছে । যা ধরি তাই-ই ময়লা হয়ে যায়। বিজয় দিবসের ৪০ বছরে এসে আমি শুধু এই বলে প্রার্থনা করি প্রভু আমাদের হাতের ময়লা পরিষ্কার করে দাও।

    ‘ব্যক্তির কোন নিজস্ব পরিচয় নেই’ : শামীম সিদ্দিকী

    shamim siddikiবাংলানিউজ: এই প্রজন্মের একজন হিসেবে আপনার চোখে স্বাধীনতা।

    শামীম সিদ্দিকী: প্রত্যেক মানুষেরই একটি নিজস্ব অস্তিত্ব থাকে, যা হলো সে। এই বোধ যখন মানুষের মধ্যে কাজ করে তখনই তার মনে একটি মানচিত্র জেগে ওঠে। এ বোধই হলো স্বাধীনতা।

    আমি মনে করি, ব্যক্তির কোন নিজস্ব পরিচয় নেই। সময় ও স্থানের পরিপ্রেক্ষিতের মাঝে নিজেকে চিনে নিতে হবে। মনের মানচিত্রে দেশের সাথে আজন্ম পরিচয় অনুধাবন করতে হবে। জানতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সময় ইতিহাসের কী বীভৎস ঘটনা ঘটেছে।

    আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই আমাদের অগ্রজদের প্রতি, যাঁরা আমাদের একটি দেশ দিয়েছেন। শত অপ্রাপ্তির মাঝে এখনো আমাদের যা আছে তাই গর্বের ধন। স্বাধীনতা নিয়ে এটাই আমার গর্বিত ও সমুন্নত ধারণা।

    বাংলানিউজ: বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশ...

    শামীম সিদ্দিকী: আমি মনে করি, এ যাবৎ রাষ্ট্র বহুবার পাল্টেছে কিন্তু দেশটা পাল্টায়নি। তাই দেশ ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য আছে।

    আমরা এই প্রজন্ম রাষ্ট্রকে নতুন ভাবে রচনা করতে চাই। ছোট দেশ, টানাপোড়েন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আশাবাদের জায়গা হচ্ছে, এখানে বিপুল মানবসম্পদ রয়েছে। এই মানবসম্পদের বৈশিষ্ট একবারেই ভিন্ন এবং অনন্য। এই মানবসম্পদ কাজে লাগানো গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

    পৃথিবীর সভ্যতার অবলম্বন হচ্ছে জ্ঞান। আমাদের মানবিক সম্ভবনা এখনো আমরা বিকশিত করতে পারিনি। আমরা মনোরোগে আক্রান্ত। প্রায় ক্ষেত্রেই নিজের বিবেককে স্বার্থের জন্য ডুবিয়ে দিই। তাই নিজেকে আবিষ্কার করার মধ্য দিয়েই আমরা এর সমাধান করবো। এজন্য আমাদের শুধু জ্ঞান আর জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তরুণদের মাঝে বিকশিত হওয়ার আলো দেখতে পাই। বড়রা নৈতিক যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। তবে আশাবাদের কথা হলো, অব্যবহৃত অনেক মণিমুক্তা অচর্চিত রয়ে গেছে।

    আমি বিজয়ের ৪০ বছরে এসে এখন আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে দেখতে চাই।

    ‘সাফল্য এটাই, আমরা স্বাধীন হলাম’ : পারভেজ হোসেন

    parvez hossenবাংলানিউজ : স্বাধীনতার ৪০ বছরকে কিভাবে দেখছেন?

    পারভেজ হোসেন: স্বাধীনতার ৪০ বছর কম সময় নয়, তবে একটি জাতির বিকাশের জন্য এটি বেশি সময়ও নয়। আমাদের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতার মতো বড় ব্যাপার ঘটে গেছে, আমি মনে করি এর পুরোটাই প্রাপ্তি। সাফল্য এটাই, আমরা স্বাধীন হলাম। এখন পৃথিবীর মানচিত্রে দেশকে কিভাবে পরিচিত করবো-সেজন্যই আমরা নিরন্তর লড়াই করছি।

    বাংলানিউজ: কেমন দেশ দেখতে চেয়েছিলেন?

    পারভেজ হোসেন: চলতে চলতে চাওয়া বদলায়। সাফল্য নিঃসন্দেহে দেখতে চাই। তবে সেটা নিজের সাফল্য নয়, দেশের সামগ্রিক সাফল্য।

    ‘স্বপ্নটা আজও ধ্বংস হয়ে যায়নি ’ : আহমাদ মাযহার

    ahmad majharবাংলানিউজ: যুদ্ধকালীন স্মৃতি নিয়ে কিছু বলুন-

    আহমাদ মাযহার : মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে পারিনি, তবে যুদ্ধ দেখেছি। বাড়িতে রেডিও ছিল, বিবিসি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনেছি। সাধারণ মানুষের ঝোঁক দেখেছি-কিভাবে মানুষকে আশাবাদী করেছে। ’৭১ পূর্বে বিশ্ব নিয়ে এত খোঁজ এদেশের মানুষকে আর রাখতে দেখিনি।

    বাংলানিউজ: সম্ভাবনার কথা বলুন...

    আহামাদ মাযহার: আমরা এখনো সম্ভাবনার সুদূর প্রত্যাশার রেখায় পুরোপুরি নেই। তবে ভুললে চলবে না, স্বাধীনতার যুদ্ধ না হলে বাঙালির এ উন্নতি কতটা হতো তা সন্দেহ আছে। ‘৭১ আমাদের স্বপ্নের জাগরণ এনে দিয়েছে। স্বপ্নটা আজও ধ্বংস হয়ে যায়নি। এখনো অনেক বড় ইতিবাচক ঘটনার যোগ লক্ষ করি। নিশ্চয় এগুলো আমাদের পথ দেখাবে।

    বাংলাদেশ সময় ০১১২, ডিসেম্বর ১৬, ২০১১

    http://www.banglanews24.com/1971/detailsnews.php?nssl=0415740eaa4d9decbc8da001d3fd805f
  • Biplob Rahman | ২৩ এপ্রিল ২০১৪ ১৮:১৭582771
  • সালেক খোকন
    যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ১১ ‘‘রাজাকারদের উত্থান দেখে ভাবিনি বিচার হবে’’
    এপ্রিল ২৩, ২০১৪

    ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। বাউড়া থেকে আমাদের ডিফেন্স গাড়ি লালমনিরহাট বড়খাতা রেল স্টেশনের কাছাকাছি এসেছে। সেখানে ছিল পঁচিশ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের শক্তিশালী ঘাঁটি। আমরা পাকিস্তানিদের ওই ঘাঁটি দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করি।

    সূর্য তখন হেলে পড়েছে। আমরাও সশস্ত্র অবস্থায় অগ্রসর হই। মেশিনগান, টমি গান, এসএলআর, টুইঞ্চ মটর প্রভৃতি আমাদের অস্ত্র। কমান্ডে ছিলেন ৬নং সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন। তবে আমাদের গ্রুপকে কমান্ড করতেন ক্যাপ্টেন মতি। ইন্ডিয়ান আর্মিও আমাদের পেছনটায়। তারা আর্টিলারি সার্পোট দিলেই আমরা সামনে এগোই।

    পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা আর্টিলারি ছোড়ে। শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। তা চলে ভোর চারটা পর্যন্ত। আমার কাছে একটি এসএলআর। পাশেই ববিন, তুতুল ও সুবেদার ফজলুর রহমান। ক্রলিং করে সবাই সামনে এগোই। থেমে থেমেই গোলাগুলি চলছে। সুযোগের অপেক্ষায় আমরা ওত পেতে রই।

    ওদের বাঙ্কারের কাছাকাছি ছিল একটি বাঁশঝাড়। আমাদের থেকে মাত্র ৭ শ গজ সামনে। সেখানটায় যেতে পারলেই ওদের কুপোকাত করা যাবে। এই ভেবে সে দিকটায় আমি পা বাড়াই। কিন্তু তখনও জানি না কী ঘটতে পারে! মনেপ্রাণে শুধু একই চিন্তা, দেশকে শক্রমুক্ত করব।

    বাঁশঝাড়ের ভেতর পা রাখতেই হঠাৎ বিকট শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি ছিটকে পড়ি। হালকা ধোয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আবার বাতাসে মিলিয়ে যায়। বুঝে যাই এম ফোরটিন মাইনের বিস্ফোরণে পড়েছি। ডান পা তখন নাড়াতে পারছিলাম না। পায়ের দিকে চোখ পড়তে আঁতকে উঠি। গোড়ালি উড়ে গেছে। চামড়ার আবরণ নেই। হাড্ডি গুঁড়ো হয়ে ঝরছে। রগগুলো ঝুলছে গাছের শিকড়ের মতো। শরীরটা শুধু ঝিমঝিম করছিল। আমি তখনও জ্ঞান হারাইনি। পড়ে আছি আইলের ভেতর। গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিই পা।

    আমায় দেখে এগিয়ে আসে সহযোদ্ধারা। ক্রলিং করে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে কাছে আসে তুতুল ও ববিন। এ সময় কাভারিং ফায়ার দেয় ফজলুর রহমান। তারা আমায় কাঁধে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে।

    আমার অবস্থা খুব ভালো ছিল না। পা ছাড়াও শরীর ও মুখে লেগেছিল অসংখ্য স্প্রিন্টার। চিকিৎসার জন্য ক্যাম্প থেকে তাই পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের বাকডোকরা সিএমএইচ-এ। সেখানেই প্রথম অপারেশন হয়। পরে গ্যাংগ্রিন হয়ে পায়ের মাংসে পচন ধরে। ফলে চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন সময়ে আমাকে পাঠানো হয় ব্যারাকপুর, রাঁচি, নামকুম, খিরকি ও পুনা হাসপাতালে। অপারেশন হয় আরও ছয়বার।

    দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আমরা পুনা হাসপাতালে। কী যে ভালো লেগেছিল সেদিন! নার্সরা আমাদের ফুল দিয়ে সম্মান জানায়। উল্লাস করে মুখে আবির মাখিয়ে দেয়। স্পেশাল খাবারও দেওয়া হয় আমাদের। হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন মেজর মাথুর।

    আমার পিঠ চাপড়ে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘‘তোমারা দেশ তো স্বাধীন হওয়া। আব তুম চালা যাওগে।’’

    তার কথা শুনে খুব দেশে ফিরতে ইচ্ছে করছিল। মায়ের কথা খুব মনে হচ্ছিল। কিন্তু কৃত্রিম পা লাগিয়ে তবেই আমাদের দেশে পাঠানো হবে।

    ৫ জানুয়ারি, ১৯৭২। পুনা হাসপাতালেই আমাদের দেখতে আসেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। আমি বসেছিলাম মেঝেতে। সেদিন আমাদের উৎসাহ দিয়ে তিনি বললেন– ‘‘চিন্তা কর না, পা লাগিয়ে দিলে আবার তোমরা চলতে পারবে। দেশে ফিরলে তোমরা বীরের সম্মান পাবে। তোমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন তোমাদের মাঝে।’’

    ভারতের সাহায্যের জন্য সেদিন আমরাও তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই। ইন্দিরার সঙ্গে সেদিনকার একটি ছবি আমার হাতে তুলে দেন সে সময়কার কমান্ড ইনচার্জ ডা. টিডি দাস। অনেকদিন ভেবেছি ছবিটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে জমা দেব। কিন্তু দেওয়া হয়নি। ছবিটির দিকে তাকালে আজও সব জীবন্ত হয়ে ওঠে।

    মুক্তিযুদ্ধে পা-হারানোর কথা এভাবেই বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জি এম জুলফিকার।

    তার বাড়ি নীলফামারী জেলার শাহীপাড়া গ্রামে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গ্রামের বাড়িতেই। বাবা ডা. জি এম কাদের ছিলেন রংপুর মেডিকেল কলেজের লেকচার অব ফরেনসিক মেডিসিনের প্রফেসর। মা সৈয়দা আক্তার মহল সাধারণ গৃহিনী। পাঁচ ভাই দু’বোনের সংসারে তিনি সবার বড়। ম্যাট্রিক পাস করেন ডোমার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। পরে ভর্তি হন নীলফামারী মহাবিদ্যালয়ে। একাত্তরে তিনি ছিলেন ওই কলেজেরই এইচএসসি পরিক্ষার্থী। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বললেন শৈশব ও কৈশোরের কিছু কথা।

    তাঁর ভাষায়, ‘‘আমাদের স্কুল ছিল এক মাইল দূরে। বন্ধু রাজা মিয়া, শফিকুল, বাবলু, হাশেমসহ দলবেঁধে আমরা স্কাউট করতাম। ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে ছিল আমার নামডাক। হায়ারেও খেলতে যেতাম। এসএসসির সময় আধকপালির মাথাব্যথায় অংক পরীক্ষা হয় খারাপ। ফলে ছয় মার্কসের জন্য ফার্স্ট ডিভিশন পাইনি। রেজাল্ট শুনে বাবার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। তাঁর ইচ্ছে ছিল আমাকে ডাক্তার বানাবেন।’’

    দেশের বৈষম্যের কথা উঠতেই মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার বলেন, ‘‘পূর্ব পাকিস্তানেই উৎপন্ন হত পাট, চা, তামাক ও চামড়া। সেগুলো বিদেশে বিক্রি হলে টাকা চলে যেত করাচিতে। সে টাকায় ডেভলপ করা হত পশ্চিম পাকিস্তানকে। পূর্ব পাকিস্তানে উন্নয়নকাজ হত খুব কম। সেনাবাহিনীর অফিসার, সরকারের বড় বড় পদে বাঙালিদের নেওয়া হত না। আমরা তখন ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপে। বাউলাদা ও মমিনুল ইসলাম ছিলেন নেতা। বৈষম্যের প্রতিবাদে মিছিল বের হত। ইত্তেফাক, গণকণ্ঠ, সংবাদ পত্রিকা এবং বিবিসির মাধ্যমে আমরা পেতাম দেশের খবরগুলো।

    সত্তরের নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু একবার আসেন নীলফামারীতে। ভাষণ দেন নীলফামারী মাঠে। বঙ্গবন্ধুকে সেবারই সরাসরি দেখেন জুলফিকার। সেদিনের অনুভূতির কথা শুনি তাঁর জবানিতে। তাঁর ভাষায়, ‘‘বঙ্গবন্ধুকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম মঞ্চের কাছে। তিনি মঞ্চে ওঠার আগে আমাদের সঙ্গে হাত মেলান। তাঁর ব্যবহারে মনে হয়েছিল আমরা তাঁর অনেক দিনের চেনা। বললেন, ‘কেমন আছিস তোরা? লেখাপড়া কিন্তু ঠিকভাবে করিস।’ বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার কথা মনে গেঁথে গেল। সে থেকে তিনিই ছিলেন আমাদের অনুপ্রেরণা।’’

    জুলফিকারের ছোট চাচা জি এম রাজ্জাক। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের আর্ট ডাইরেক্টর। থাকতেন ঢাকার নারিন্দায়। মার্চের শুরুতেই তিনি বেড়াতে যান চাচার বাড়িতে। ফলে ৭ মার্চে ছুটে আসেন রেসকোর্স ময়দানে। খুব কাছ থেকে শোনেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি।

    জুলফিকার বলেন, ‘‘সবার শেষে ভাষণ শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম..।’ এমন নির্দেশই যেন সবাই চাচ্ছিল। এটা ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান। বঙ্গবন্ধু আরও পরিস্কার করে বললেন, ‘বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।’ ভাষণ শুনে আমরা পুরোপুরি বুঝে যাই সংগ্রাম ছাড়া স্বাধীনতা মিলবে না। ‘

    আপনারা তখন কী করলেন?

    ‘‘নীলফামারী ফিরে শুনি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়েছে গোবিন্দদা ও ইয়াকুব আলীর নেতৃত্বে। ছাত্র ও যুবক বয়সীদের বাঁশ ও লাঠি দিয়ে ট্রেনিং করানো হলো নীলফামারী মাঠে। সৈয়দপুরে ছিল লক্ষাধিক অবাঙালি। তাদের সঙ্গে বাঙালিদের সংঘর্ষের খবর পেতাম প্রতিদিনই। ২৪ মার্চ রাতে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সেনাদের ওপর চড়াও হয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। ফলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা বেরিয়ে আসে ব্যারাক থেকে। তারা প্রতিরোধ গড়ে দশমাইল নামক স্থানে।

    ২৫ মার্চ ঢাকায় আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ডোমার থেকে ইপিআরে বাঙালি সৈন্যরা অস্ত্রসহ চলে আসে নীলফামারীতে। সেখানে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় আনসার, ছাত্র, যুবক ও অন্যান্যরা। ২৭ মার্চের পরে সবাই মিলে আমরাও প্রতিরোধ গড়ি নীলফামারীর দাড়োয়ানি নামক স্থানে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের আর্টিলারির আঘাতে আমরা দুদিনও টিকতে পারি না। ফলে যে যার মতো আত্মগোপন করে। আমরা চলে আসি সীমান্তবর্তী ডোমারে।’’

    ট্রেনিংয়ের কথা উঠতেই মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার বলেন, ‘‘আবদুর রউফ ছিলেন ডোমারের আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি চলে যান ভারতের কুচবিহার জেলার দেওয়ানগঞ্জে। সেখানে কংগ্রেস সদস্য ছিলেন বিরু বাবু। তার সহযোগিতায় তিনি গড়ে তোলেন একটি রিক্রুটিং ক্যাম্প।

    এপ্রিলের ৩ তারিখ। তুতুল, শফিকুল, মান্নান, ববিন, মুক্তা, মানিক, ইলিয়াসসহ আমরা ৩৫ জন সীমান্ত পার হয়ে চলে আসি দেওয়ানগঞ্জ রিক্রুটিং ক্যাম্পে। দুদিন পর চালসা সাব ডিভিশন ধুবগুড়ি রোড হয়ে মেটেলি থানা তাপুরহাট চা বাগান হয়ে শিবুক ব্রিজ পার হয়ে দার্জিলিং পাহাড়ের উইংটং নামক স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমাদের। সেখানে সেনাবাহিনীর একটা পরিত্যক্ত ক্যাম্পে ২৮ দিন ট্রেনিং নিই আমরা। আমি ছিলাম আলফা কোম্পানিতে। শেখ কামালও এই ক্যাম্পে ট্রেনিং নেন। পরে আমাদের কয়েকজনকে ডেমুলেশনের ওপর স্পেশাল ট্রেনিং দেওয়া হয়। ভারতীয় সেনারা আমাদের সাহস দিতেন। ওস্তাদ হাবিলদার প্যাটেলের কথা আজও মনে পড়ে।’’

    কোথায় কোথায় যুদ্ধ করলেন?

    জুলফিকারের উত্তর, ‘‘১১ জন ছিল একটি সেকশনে। ৪০-৪৫ জন করে একটি কোম্পানি। দুটি কোম্পানি এক হয়ে কোর্টগজ নামক স্থানে আমরা তাঁবু গাড়ি। ওখান থেকে মিরগর এলাকায় ঢুকে হিট করে আবার ফিরে আসতাম। সেপ্টেম্বর থেকে আমরা যুক্ত হই সম্মুখ সমরে। ৬নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করি মিরপুর, কোটগজ, তেঁতুলিয়া, বাউড়া, বুড়িমারা, বড়খাতা প্রভৃতি এলাকায়।’’

    তেতাল্লিশ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বিতর্ক কমেনি। অনেক অমুক্তিযোদ্ধার হাতেও চলে এসেছে মুক্তিযোদ্ধার কাগুজে সনদ। মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকারের কাছে প্রশ্ন ছিল, কেন এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়ে?

    উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘তালিকা বাড়ে রাজনৈতিক কারণে। তবে এর জন্য দায়ী গুটিকয়েক মুক্তিযোদ্ধাও। তাদের লোভে বির্তকিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। সরকারের সুবিধা লাভের আশায় তাদের হাত ধরেই অমুক্তিযোদ্ধারা সনদ পেয়েছে। তবে এ তালিকা চূড়ান্ত করার উপযুক্ত সময় ছিল বাহাত্তর সাল। তখন সকল সেক্টর কমান্ডারের কাছেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ছিল।’’
    মুক্তিযোদ্ধারা ধর্ম মানে না এমন কথা শুনতে হয়েছে, আমি নিজেই মসজিদ কমিটির সভাপতি, আমি কি মুসলমান না

    মুক্তিযোদ্ধারা ধর্ম মানে না এমন কথা শুনতে হয়েছে, আমি নিজেই মসজিদ কমিটির সভাপতি, আমি কি মুসলমান না

    কথা ওঠে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের ভূমিকা ও কার্যক্রম নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার বলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রত্যক্ষ একটি ঘটনার কথা। তাঁর ভাষায়–

    ‘‘মিরগর এলাকার ভেতরের দিকে ক্যাম্প ছিল পাকিস্তানি সেনাদের। তাদের চারপাশে প্রায় ৩ মাইল এলাকা ছিল রাজাকারদের নিয়ন্ত্রণে। একবার রেকি করতে ওই এলাকায় যায় আমাদের কোম্পানি কমান্ডার আইয়ুব ও টোআইসি নুরুল। অস্ত্র হিসেবে তাদের সঙ্গে ছিল মাত্র দুটি গ্রেনেড। গ্রামের ভেতর ঢুকতেই রাজাকাররা টের পেয়ে যায়। ওত পেতে তারা তাদের ধরে ফেলে। খবর চলে যায় পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে। ওইদিন রাজাকাররা তাদের ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। তাদের উদ্ধার করতে পরদিনই আমরা গ্রামটিতে আক্রমণ চালাই। আইয়ুব ও নুরুলের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ মিলে একটি আখ খেতের পাশে, আখ জাল দেওয়ার গুড়ের কড়াইয়ে। গ্রেনেডের আঘাতে তাদের চেহারা বিকৃত করে ফেলেছিল তারা। সহযোদ্ধার এমন মৃত্যুতে আমরা হতবিহবল হয়ে পরি। খবর পেয়ে পাশের গ্রাম থেকে ধরে আনি এক রাজাকারকে। পরে তাকে গুলি করে আমরা ফেলে দিই চাওই নদীতে।’’

    স্বাধীনের পর রাজাকারদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হলেও ছোট ছোট অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তিনি বলেন–

    ‘‘বঙ্গবন্ধু আমাদের নেতা ছিলেন। তাঁর ডাকেই যুদ্ধ করেছি, তবুও বলব, তাঁর ওই সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল না। আমরা তো আক্রান্ত হয়েছি ছোট ছোট রাজাকারদের দ্বারাই। তাই তাদেরও বিচারের আওতায় আনা উচিত ছিল।’’

    বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেন জিয়াউর রহমান। বাতিল হয় দালাল আইনটিও। ফলে বিচারের পরিবর্তে রাজনীতিতে জায়গা করে নেয় প্রতিষ্ঠিত রাজাকাররা। সময়ের হাওয়ায় স্বাধীনতাবিরোধীরাই বনে যায় স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী। একজন ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কেমন অনুভব করেছেন সে সময়?

    দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘‘এটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে হুল ফোটানোর মতো। বিষয়টি আমাকে কুড়ে কুড়ে খেত। ব্যথিত হতাম। রাজাকার আজিজকে বঙ্গভবনে আমরা মারতেও গিয়েছিলাম। জিয়াউর রহমান এসে থামিয়েছেন। তাকে বলেছিলাম, ‘কেন রাজাকারকে মন্ত্রী বানালেন? ইতিহাস কলঙ্কিত করলেন?’ আমাদের প্রশ্নের উত্তর তিনি সেদিন দিতে পারেননি।’’

    চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের আজ বিচার হচ্ছে, জাতি হচ্ছে কলঙ্কমুক্ত। এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার বলেন, ‘‘এদের উত্থান দেখে কখনও ভাবিনি বিচার হবে। এখন হচ্ছে, এটাই আশার কথা। দেরিতে হলেও আমাদের বুকের ভেতর থেকে কষ্টের ভার একে একে নেমে যাচ্ছে। আমার অর্জিত রক্ত দিয়ে প্রাপ্ত স্বাধীন দেশে এদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। দেশে আইন আছে, তা না হলে এদের তো গুলি করে মেরে ফেলা উচিত ছিল। এদের শাস্তি দেখে যেতে পারলে শান্তিতে মরতে পারতাম।”

    স্বাধীন দেশে ভালো লাগার কথা বলতে গিয়ে এই বীর বলেন, ‘পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। দেশটা চালাচ্ছে এদেশেরই লোকেরা। এটাই ভালো লাগে। আমরা তো এখন আর পরাধীন নই।’’

    খারাপ লাগার কথা উঠতেই বলেন, ‘‘রাজনৈতিক উত্থান-পতনে দেশ যখন পিছিয়ে যায়। রাজনীতিবিদদের মাঝে যখন স্বার্থচিন্তা ও লোভ দেখি, তখন সত্যি কষ্ট পাই। দেশের কথা ভেবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশের জন্য সবাই মিলে কাজ করলে দেশটা অন্যরকম হত।’’

    যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলনরত গণজাগরণ মঞ্চ জুলফিকারের কাছে স্বাধীনতার পক্ষে নতুন প্রজন্মের জেগে ওঠা। তাঁর ভাষায়, ‘‘এই ছেলেরা সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে সত্য সত্যই থাকে। দেরিতে হলেও সত্য একদিন জাগ্রত হয়, এটাই তার প্রমাণ। ভেবেছিলাম এদের বিচার হবে না। গণজাগরণ মঞ্চ আমাকে আশাবাদী করেছে। এখন আমি মইরা গেলেও এদেশে এদের বিচার হবে। বাংলাদেশ হবে স্বাধীনতার পক্ষের একটি দেশ।’’

    [যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জি এম জুলফিকারের কথা শুনতে ক্লিক করুন--

    ]


    একটি পক্ষ তো বলছে এটা নাস্তিকদের আন্দোলন?

    প্রশ্ন শুনে মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘‘যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল তাদেরও তো তখন বলা হত ইসলামের শক্র। মুক্তিযোদ্ধারা ধর্ম মানে না এমন কথাও আমাদের শুনতে হয়েছে। আমি নিজেই এক মসজিদ কমিটির সভাপতি। তাহলে আমি কি মুসলমান না! মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরাও আল্লাহু আল্লাহু বলেছি, গুলি খাইলে লা-ইলাহা-ইল্লালা বলেছি, সুরা কেরাত পরেছি, নামাজ পড়ছি। আমরাও মুসলমানের পেডে জন্ম নিছি। আমরাও মুসলমান। নিজেদের বাঁচাতে ওরা তো ইসলামকে বিকৃত করেছে। নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে ধর্মটাকে।’’

    নতুন প্রজন্ম এক সময় দেশটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে এমনটাই আশা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকারের। পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘তোমরা নিজের দেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটি যেনে নিও। পূর্বসূরীরা যে ভুল করেছে তোমরা তা কর না। ততটা উন্নত নই আমরা, তবু এ দেশটাই আমার মা। তাকে মায়ের মতোই ভালোবেস।’’

    সংক্ষিপ্ত তথ্য

    নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জি এম জুলফিকার।

    ট্রেনিং নেন: ২৮ দিনের ট্রেনিং নেন ভারতের চালসা সাব ডেভিশন ধুবগুড়ি রোড হয়ে মেটেলি থানা তাপুরহাট চা বাগান হয়ে শিবুক ব্রিজ পার হয়ে দার্জিলিং পাহাড়ের উইংটং নামক স্থানে। তিনি ছিলেন আলফা কোম্পানিতে। শেখ কামালও এই ক্যাম্পেই ট্রেনিং নেন। এছাড়াও তিনি ডেমুলেশনের ওপর স্পেশাল ট্রেনিং নিয়েছেন।

    যুদ্ধ করেছেন: ৬নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন মিরপুর, কোটগজ, তেঁতুলিয়া, বাউড়া, বুড়িমারা, বড়খাতা প্রভৃতি এলাকায়।

    যুদ্ধাহত: ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভোরে। লালমনিরহাট বড়খাতা রেল স্টেশনের কাছাকাছি পাকিস্তানিদের পঁচিশ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট দখলের সময় এম ফোরটিন মাইনের বিস্ফোরণে তাঁর ডান পায়ের গোড়ালি উড়ে যায়। শরীর ও মুখে লাগে অসংখ্য স্প্রিন্টার। চিকিৎসার পরেও গ্যাংগ্রিন হয়ে পায়ের মাংসে পচন ধরে। ফলে অপারেশন হয় আরও ছয়বার। বর্তমানে তিনি হুইল চেয়ারে চলাচল করেন।

    ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/16963
  • Biplob Rahman | ১৪ মে ২০১৪ ২০:১১582772
  • সালেক খোকন
    যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ১২ ‘‘শেখের মাইয়াই আমগো খেয়াল রাখে’’
    মে ১৩, ২০১৪

    তাঁর নাম বাকি মোল্লা। বয়স আটষট্টির মতো। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের গুলির আঘাতে কেটে ফেলতে হয় তাঁর ডান পা। শরীরের ভারে বাঁ পা-ও এখন বেঁকে গিয়েছে। ফলে হাঁটতে পারেন না, শুধু শরীরে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারেন। জীবনের হিসেব তাঁর মিলে না। তাই বুকে পুষে রাখা কষ্ট এবং কান্না-হাসির মাঝে কেটে যাচ্ছে তাঁর দিনগুলি।

    মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লা সম্পর্কে তথ্যগুলো দেন আরেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জি এম জুলফিকার। তাঁকে সঙ্গে নিয়েই একদিন আমরা পা রাখি বাকি মোল্লার বাড়িতে।

    মিরপুর চিড়িয়াখানার ঠিক পাশেই মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স। নামে কমপ্লেক্স হলেও এটি আসলে সরকারি জায়গায় গড়ে ওঠা বস্তি বিশেষ। এখানেই একটি খুপরি ঘরে আমরা খুঁজে পাই মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লাকে। টিনে ঘেরা ছোট্ট ঘর। একটি চৌকি, টেবিল ও একটি হুইলচেয়ার ছাড়া তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। দুজনকে বসতে দেওয়ার মতো আসবাব নেই এ মুক্তিযোদ্ধার ঘরে। যুবক বয়সী একজন পাশের ঘর থেকে নিয়ে এল একটি কাঠের বেঞ্চ। সেখানে বসেই আমরা চোখ রাখি বাকি মোল্লার চোখে।
    বুকে পুষে রাখা কষ্ট এবং কান্না-হাসির মাঝে কেটে যাচ্ছে তাঁর দিনগুলি

    বুকে পুষে রাখা কষ্ট এবং কান্না-হাসির মাঝে কেটে যাচ্ছে তাঁর দিনগুলি

    পরিচয় দিতেই তিনি প্রশ্ন করেন, ‘‘কেন আইছেন?’’

    ‘‘আপনার কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা আর দেশের কথা শুনতে।’’

    তিনি উত্তেজিত হয়ে যান। পরক্ষণেই চোখ ভেজান বুকে পুষে রাখা কষ্টের স্মৃতিগুলো অনুভব করে।

    স্বাধীনতার জন্য শুধু অঙ্গ নয়, এই যোদ্ধা হারিয়েছেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকুও। দেশের জন্য আত্মত্যাগের প্রতিদান তিনি চান না। কিন্তু স্বাধীনতালাভের পর অন্যদের সঙ্গে নিজের জীবনের হিসেবটুকুও তিনি মেলাতে পারে না।

    সেদিন ইন্টারভিউ নেওয়া হল না; তিনি শুধু বললেন– ‘‘আমরা তো ভিখেরির মতো বেঁচে আছি। কর্তব্য ছিল, করে দিছি। এখন যদি হাজারও মাথা ঠুকি, আপনি পারবেন না আমার একটা অঙ্গ ফিরায়া দিতে। পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছি বহুবার। শরীরের ভারে বাম পা-ও বেঁকে গেছে। বসতে পরি না। চলতে পারি না। এত কষ্ট লাগে আমার।’’

    এরপর সপ্তাহ দুয়েক কেটে যায়। মুঠোফোনে বার কয়েক খবর নিই তাঁর। এক সকালে তিনি মনের ভেতর জমে থাকা যুদ্ধদিনের কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। ফোন পেয়েই আমরা চলে আসি তাঁর বাড়ি।

    মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লার বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার (পূর্বে ছিল চারঘাট থানা) হামিদকুড়া গ্রামে। বাবা আব্দুল কুদ্দুস মোল্লা ও মা রমিজান বেওয়ার বড় ছেলে তিনি। ২ ভাই ও ১ বোনের সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। তিনি কৃষিকাজ করতেন।

    বাকির বয়স যখন দশ, তখন হঠাৎ অসুখে মারা যান তাঁর বাবা। কিন্তু মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে থাকতে পারেননি তিনি। বাবার মুখের শেষ কথাগুলো তাই আজও তাঁর কানে বাজে। সে কথা বলতে গিয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না বাকি।

    তাঁর ভাষায়, ‘‘চারঘাটে একটা সরকারি হাসপাতাল ছিল। আমাকে বাবা কইল, ‘আমার শরীর খুব খারাপ। বাবা তুমি, সরকারি হাসপাতাল থাকি ওষুধ আনি দাও।’ চারটা বোতলে গামছা বাঁধি দিলে আমি কোশ তিনেক রাস্তা হাঁটি গেছি। কিন্তু ওষুদ নিয়া আসতে আসতে আমার সন্ধ্যা লাগি গেছে। তখন কোথায় গিয়া উঠি? বেলা ডুবি গেলে আমি এক মামার বাড়িতে উঠলাম। ফজরের আযানের পর আবার বাড়ির দিকে রওনা দিই। আমাদের বাড়ি ছিল উত্তর পাড়ায়। রেললাইন যখন পার হইছি, তখনই আজহার নামে একটা ছেইলে ডাক দিয়ে কইল, তুই কই গেছিলি? আমি কই আব্বার লাইগা ওষুদ আনতে গেছিলাম। ওষুদ কারে খাওয়াবি. তোর বাপ তো নাই, তোর বাপ রাতেই মারা গেছে। কথাডা শুইনাই আমার সে কী কান্দন।’’

    বাবার মৃত্যুর পর বাকি মোল্লার পরিবারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। যে বয়সে শিশুরা স্কুলে যায়, খেলাধুলা করে, সে বয়সেই পরিবারের হাল ধরতে হয় তাঁকে। বাকি বলেন–

    ‘‘ছালবাল কালে আজের, আরামান, কোরবান, জিবা, মতিবারের সঙ্গে বল আর মার্বেল খেলতাম। বাপ যখন মরি গেল তখন তো আর খেলাধুলা নাই। আফসোস করি। বড় পোলা আমি, জমির লাঙল তো ধরতে হবি। কিন্তু তহন আমি তো ছোটমানুষ, লাঙল তো ধরতে পারি না। চিনি হাজি নামে এক লোক ছিলেন গ্রামে। আমার কষ্ট দেখে উনিই আমারে সাহায্য করতেন। বীজ ছিটায়ে দিতেন। জমিতে মই দিয়ে দিতেন। এভাবে চলতে চলতে আমি হাল দেওয়া শিখলাম। তহোন এক টাকা চাইর আনা ছিল এক সের চালের দাম। হাল দিয়া, মাইনসের জমিতে কামলা দিয়া আর ঘাস বাছি চাইলের টাকা জোগাড় করি আর ভাইবোন নিয়ে খাই।’’
    কর্তব্য ছিল, করে দিছি, এখন যদি হাজারও মাথা ঠুকি, পারবেন না আমার একটা অঙ্গ ফিরায়া দিতে

    কর্তব্য ছিল, করে দিছি, এখন যদি হাজারও মাথা ঠুকি, পারবেন না আমার একটা অঙ্গ ফিরায়া দিতে

    দেশের অবস্থা তখন কেমন ছিল?

    বাকি বলেন–

    ‘‘আমি তো নিজের জীবন নিয়াই ব্যস্ত। জমিতে কাজের পাশাপাশি তখন আমি বিস্কুটের ব্যবসা করি। সিরাজগঞ্জে ফেক্টরি থেকে বিস্কুট এনে গ্রামে পাইকারি বিক্রি করতাম। বাজারে গিয়া রেডিও শুনতাম। মানুষের মুখে শুনতাম, দেশ ভালো নাই। পাকিস্তানিরা আমাগো দেখতে পারে না।’’

    বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাকি মোল্লা শোনেন রেডিওতে। আজও সে ভাষণ তাঁকে উদীপ্ত করে। তাঁর ভাষায়–

    ‘‘শেখ মুজিব কইলেন, ভায়েরা আমার।… রক্তের দাগ শুকায় নাই।… তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে… আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না… ।’’

    ২৫ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকায় আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ২৬ মার্চের পর রাজশাহীর গোপালপুর সুগারমিলের সমানে বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে। তারা পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু ভারী অস্ত্রের মুখে টিকতে পারে না।

    মার্চের শেষে ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সৈন্যরা স্থানীয় যুবকদের নিয়ে চারঘাট থানা আক্রমণ করে। অস্ত্র লুট করে তারা ওখানেই অবস্থান নেয়। পরিবার নিয়ে বাকি মোল্লা তখন ভিতরবাগ গ্রামে আশ্রয় নেন। সে সময় থেকেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। তিনি বলেন–

    ‘‘আমার বয়স তখন পঁচিশের মতো। গ্রামের মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে রুটি বানায়া দিত। মজিবর চেয়ারম্যানের নির্দেশে আমরা সে রুটির বস্তা বাঁধি মাথায় করি নিয়া গেছি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, চারঘাট দিয়ার বাজারে।’’

    মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন?

    বাকির উত্তর–

    ‘‘সংসারে তখন আমার তিন ছেলে। বউ আবার অন্তঃসত্ত্বা। পরিবারের মায়া আর প্রবল পিছুটান। পুলিশ, আর্মি আর ইপিআরের বাঙালি সৈন্যরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে যুবকদের যুদ্ধে যাওয়ার তাগাদা দিয়ে বলত, ‘বাবা, তোমরা যদি আমাদের সাথে না আসো, তাইলে দেশ স্বাধীন করা যাবে না। আমাদের দেশ আমাদেরকেই স্বাধীন করতে হবে, তোমরা আসো।’ আমরা প্রশ্ন করতাম, ‘আমরা তো যুদ্ধের কিছুই বুঝি না।’ ‘ট্রেনিং কর যখন অস্ত্র হাতে পাইবা, তখন শক্তি বাড়ব। বুঝন লাগব না।’ তাদের কথায় পরিবারের মায়া ছেড়েই আমি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’’

    ট্রেনিং নিলেন কোথায় ?

    বাকি বলেন–

    ‘‘তখন এপ্রিলের মাঝামাঝি। চারঘাট দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে আমরা ভারতের সাগরপাড়া ক্যাম্পে উঠি। ট্রেনিংয়ের জন্য সেখান থেকে আমাদের পাঠানো হয় পাহাড়পুর ক্যাম্পে। ওখানে আমাদের একমাস রাইফেল ট্রেনিং দেওয়া হয়। কমান্ডার ছিলেন ইপিআরের নায়েক সুবেদার কাশেম। ট্রেনিং শেষে দেশের মাটি ছুঁয়ে আমরা কসম করি, দেশকে শক্রমুক্ত করব। মরতে হয় দেশের মাটিতে মরব। আমাদের অস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের হাতে দেব না। পরে ৭ নং সেক্টরের সাব সেক্টর লালগোলা ডাক বাংলা ক্যাম্পের অধীনে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি।’’

    ট্রেনিং শেষে বাকি মোল্লা প্রথম অপারেশনেই গুলিবিদ্ধ হন। সেদিনের আদ্যোপান্ত শুনি মুক্তিযোদ্ধা বাকির জবানিতে–

    ‘‘১৯৭১ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। রাজশাহীর বাসুদেবপুর অপারেশনে গুলি খাই আমি। খবর ছিল ভিতরবাগ, মইরবাগ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের একটি বহর যাবে নন্দনগাছির দিকে। আমরা মাত্র ২৫-৩০ জন। কমান্ডে নায়েক সুবেদার কাশেম। আমাদের কাছে ছিল মার্কও রাইফেল। রাতে আমরা পজিশন নিই আড়ানি ব্রিজের পাশে। ভোর হয় হয়। পাকিস্তানি সেনারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসছিল। আতঙ্ক তৈরি করে ওরা এভাবেই পথ চলত।’’

    ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই আমরা দু’পাশ থেকে আক্রমণ করি। শুরু হয় গোলাগুলি। গুলি ছুঁড়ে আমি দৌড়ে সামনে এগোতে যাই। অমনি একটা গুলি এসে লাগে আমার ডান পায়ের হাঁটুতে। আমি দুই লাফ গিয়ে ছিটকে পড়ি। শরীরটা তখন দুইটা ঝাড়া দেয়। আমি প্রথম বুঝতে পারি নাই। দেখি পিনপিন করে রক্ত বেরোচ্ছে। পাশেই ছিল সহযোদ্ধা মিল্লাত আলী। তার বুকেও এসে লাগে একটি গুলি। সে চিৎকার দেয়। অতঃপর তার শরীরটা ঝাঁকি দিয়েই নিথর হয়ে যায়। ‘মা গো’ চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখি অন্যপাশে সুধাংশু বাবু। তাঁর মাথার পেছন দিয়ে গুলি লেগে চোখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সব ঘটছে চোখের সামনে। আমি অসহায়ের মতো পড়ে থাকি। মৃত্যুভয় আমাকে তাড়া করে। সহযোদ্ধারা আমাকে টেনে পেছনে এক গ্রামের ভেতর নিয়ে যায়। পরে একটা দরজার পাল্লায় শুইয়ে আমাকে নেওয়া হয় আড়আলীর বাজারে। ওখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর সন্ধ্যায় সাগরপাড়া ক্যাম্পে এবং সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মুর্শিদাবাদের বহরমপুর হাসপাতালে। ওখানেই অপারেশন করে আমার ডান পা হাঁটুর ওপর এক বিঘা থেকে কেটে ফেলা হয়। জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম পাডা নাই। আমি তখন আসমান থেকে জমিনে পড়লাম।’’
    বাহাত্তর সালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বঙ্গবন্ধু দেখতে আসেন বাকিসহ অন্যান্য যুদ্ধাহতদের

    বাহাত্তর সালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বঙ্গবন্ধু দেখতে আসেন বাকিসহ অন্যান্য যুদ্ধাহতদের

    এক পা হারালেও মুক্তিযোদ্ধা বাকি বেঁচে আছেন। এটাই ছিল তাঁর সান্ত্বনা। স্বাধীন দেশে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখের সংসার করবেন। বাড়িতে রেখে আসা অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর কোলে দেখবেন ফুটফুটে নবজাতক। স্বাধীনতার পর এমন স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরে তিনি দ্বিতীয়বার রক্তাক্ত হন। তবে তা দেহে নয়, মনে। বাকি মোল্লার ভাষায়–

    ‘‘আমি স্টেশনে নামি গেণ্ডারির মাঠ দিয়া বাড়ির দিকে যাচ্ছি। এক হাজির পোলা মধু আমারে দূর থেকে দেখে ছুটে আসে। কী রে ভাই বাকি! জড়িয়ে ধরে বলে, আহারে, তোর পরিবারডা মারা গেল। পেটের সন্তানডাও মরিছে। তুই দেখতে পারস নাই। শুনেই আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আমার স্ত্রী কুলসুম বড় ভালো মানুষ ছিল। ব্যবসা করতাম। রাতে না ফেরা পর্যন্ত সে ভাত খেত না। স্বাধীনতার জন্য তারেও হারালাম। এখনও মনে হলে কষ্ট পাই। এত দুঃখ, এত কষ্ট। দুনিয়াডাই ফাঁকিবাজি।’’

    বাহাত্তর সালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বঙ্গবন্ধু একবার দেখতে আসেন বাকিসহ অন্যান্য যুদ্ধাহতদের। সেদিন তিনি সবার হাতে তুলে দেন দুশো করে টাকা। পরে তিনিই তাদের প্রথম ৭৫ টাকা করে ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাকি মোল্লা এমএলএসএস পদে চাকরি পাই ঢাকার জিপিওতে। তিনি বলেন–

    ‘‘চাকুরির দুই বছর খুব কষ্ট করেছি। গাড়ি থেকে পড়েছি কয়েকবার। উঠতে লাগি, রিকশা থাকি পড়েছি তিনবার। মানুষের কত কথা যে সহ্য করেছি। কাউকে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিতাম না। তারপরও চাকুরিডা ধরে ছিলাম।’’

    কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লা বলেন–

    ‘‘ওসমানী সাহেব (আতাউল গনি ওসমানী) থাকা অবস্থাতেই এ তালিকা চুড়ান্ত করা যেত। আর মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ তাদের হাতে বিতরণ না করে সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে বিলি করলে দুই নম্বর মুক্তিযোদ্ধা গজানো কঠিন হত।’’

    এখনও কেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়ে? উত্তরে তিনি দুঃখ করে বলেন–

    ‘‘এখন তো বঙ্গবন্ধু নাই যে তারে দোষ দিমু, ওসমানী সাহেবও নাই। কিছু স্বার্থপর মুক্তিযোদ্ধারাই এর জন্য দায়ী। ২০০৪ সালে অনেক অমুক্তিযোদ্ধাই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখিয়েছে। দুধের সুন্দর পায়েসের মধ্যে যদি কয়েকটি মাছি পড়ে তাইলে কি আপনি খেতে পারবেন? সেই মাছিগুলা হইল তারা। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা না এডি হল দুষ্ট মুক্তিযোদ্ধা।’’

    বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি। তাঁর ভাষায়–

    ‘‘সাধারণ ক্ষমা মস্তবড় ভুল ছিল। বঙ্গবন্ধু তো বড় নেতা ছিলেন। তার মনে ছিল, কারে মারতে কমু, কারে মারুম, সবাই তো আমার ভাই। এই ক্ষমাতেই রাজাকারদের বড় একটি অংশ রেহাই পেয়ে যায়। পরে ওরাই জোট হয়ে বলেছে বঙ্গবন্ধুর গুস্টি রাখমু না ‘’

    বঙ্গবন্ধুর হত্যার কথা বলতে গিয়ে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা অশ্রুসজল হন। তিনি বলেন–

    ‘‘তিনি ছিলেন বাঙালিদের মনের মানুষ। অথচ স্বাধীন দেশে তারেই সপরিবারে মাইরে ফেলা হইছে। তার হত্যার বিচার করা যাবে না বলে আইন করা হইছিল। এর চেয়ে দুঃখের আর কী হইতে পারে।’’

    রাজাকারদের বিচার প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা বাকি বলেন–

    ‘‘বঙ্গবন্ধু থাকলে হয়তো আরও আগেই এদের বিচার করতেন। পরে তো জিয়াউর রহমানও তার দলের হাত ধরে এরা মন্ত্রী হয়। আমি মুক্তিযোদ্ধা বাজার করতে পারি না। এক মাসের বেতনে তখন ১৫ দিনও যায় না। অথচ রাজাকারেরা পতাকা উড়িয়ে গাড়িতে চড়ছে। কষ্টে তখন মরে যেতে ইচ্ছে করত।’’

    মিরপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসনের জন্য কমপ্লেক্স তৈরির বিষয়ে সরকারের কাছে দাবি রেখে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন–

    ‘‘এদেশে শরণার্থী, বাস্তহারাদেরও জায়গা হয়, আমাদের জায়গা হয় না। আজ যদি দেশ স্বাধীন না হত, এত মন্ত্রী কোথা থেকে হত? আজ আমরা গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। কমপ্লেক্স আজ হবে না কাল হবে, পরশু হবে না তরশু হবে। কর্মকর্তারা নানা কথা বলে বুঝ দেয়। অনেকেই বলে পরিত্যক্ত বাড়ি নিতে। আমি কইছি শেখের মাইয়াই বাড়ি করে দিবে। তার সময়েই আমাদের ভাতা বেড়েছে। নইলে পরিবার নিয়া রাস্তায় নামতে হইত। শেখের মাইয়াই আমগো খেয়াল রাখে। সে আশাতেই বসে আছি।’’
    মুক্তিযুদ্ধে যদি না যেতাম তাইলে পঙ্গু হতাম না। পঙ্গুদের কোনো দাম নাই। আপনারা লিখবেন

    মুক্তিযুদ্ধে যদি না যেতাম তাইলে পঙ্গু হতাম না। পঙ্গুদের কোনো দাম নাই। আপনারা লিখবেন

    কষ্ট নিয়ে তিনি বলেন–

    ‘‘মুক্তিযুদ্ধে যদি না যেতাম তাইলে পঙ্গু হতাম না। পঙ্গুদের কোনো দাম নাই। আপনারা লিখবেন। তারপরই কাজ শেষ। এরপর আর খোঁজও রাখবেন না। একটা অঙ্গ না থাকলে কী অবস্থা হয় সেটা আপনারা বুঝবেন না। আজ যদি এক কোটি টাকা দিয়ে আপনার একটা পা কেটে ফেলতে চাই, আপনি কী দিবেন? তাইলে বাজেটের অজুহাত দেখিয়ে কেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কমপ্লেক্সের কাজ বন্ধ রাখা হয়?’’

    মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লার প্রশ্নের উত্তরে আমরা শুধুই নিরব থাকি।

    কী করলে দেশে আরও এগিয়ে যাবে?

    এমন প্রশ্নে এ মুক্তিযোদ্ধা অকপটে বলেন–

    ‘‘কী করলে ভালো হবে, এটা আপনারাই বোঝেন। আপনারা সাংবাদিক, লেখক বা যাই হোন না কেন বুঝে করেন, মন থেকে দায়িত্ব মনে করে করেন, দেশের চিন্তা করে করেন। কোনো দলীয় দৃষ্টিতে না। এ রকম প্রত্যেকে করলেই দেশ বদলে যাবে।’’

    তিনি আরও বলেন–

    ‘‘হাসিনা তো বঙ্গবন্ধুর কন্যা। কিন্তু তিনি তো একা দেশ চালান না। তাঁরও তো দলের লোকজন লাগে। সে সাঙ্গপাঙ্গরা যদি চোর হয়, তাইলে তো দেশ এগোবে না। আমার বিশ্বাস এ সরকার নিজে বস্তা বানানোর চিন্তা না করে দেশ ও দশের জন্য কাজ করবে। দেশটা সত্যিকারভাবে বদলে দেবে।’’

    নতুন প্রজন্ম সবকিছু বোঝে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনেকটাই উজ্জীবিত। তাই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লার আশা, তারাই দেশের সত্যিকারের কাণ্ডারী হবে। দেশকে ভালোবেসে নতুন প্রজন্মই সোনার বাংলা গড়বে।

    সংক্ষিপ্ত তথ্য

    নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. বাকি মোল্লা।

    ট্রেনিং নেন: ভারতের পাহাড়পুর ক্যাম্পে এক মাসের রাইফেল ট্রেনিং নেন। ওখানে তাঁর কমান্ডার ছিলেন ইপিআরের নায়েক সুবেদার কাশেম।

    যুদ্ধ করেছেন: ৭ নং সেক্টরের সাব সেক্টর লালগোলা ডাক বাংলা ক্যাম্পের অধীনে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন।

    যুদ্ধাহত: ১৯৭১ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহে রাজশাহীর বাসুদেবপুর অপারেশনে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাঁর ডান পা হাঁটুর ওপর এক বিঘা থেকে কেটে ফেলা হয়। শরীরের ভারে বাম পা-ও বর্তমানে বেঁকে গেছে।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/17455
  • Biplob Rahman | ১৪ মে ২০১৪ ২০:১৩582773
  • Remembrance| Brave Lady Pritilata
    Md Shahnawaz Khan Chandan

    Pritilata Waddedar (1911-1932) was the first Bengali revolutionary nationalist and first Bengali woman who fought against the division of Bengal. Her bravery and sacrifice for the nation's liberty was a source of great inspiration for the later movements in Bangladesh. On her 103rd birth anniversary we remember the sacrifice of this valiant freedom fighter.

    Pritilata was born to a middle-class family on May 5 1911 in Dhalghat village in Patiya upazila of Chittagong
    Pritilata completed her schooling from Dr Khastagir Government Girls' School of Chittagong
    She got admitted to Eden college of Dhaka for higher secondary education
    Pritilata completed her graduation from Bethune College in Philosophy with distinction

    After completing her education in Calcutta, Pritilata returned to Chittagong and started her career as a school teacher
    Pritilata decided to join the Indian freedom movement
    On 13 June 1932, Pritilata met Surya Sen and Nirmal Sen in their camp
    Along with the revolutionary group of Surya Sen, Pritilata took part in many raids
    In the Jalalabad battle, she took the responsibility of supplying explosives to the revolutionaries

    In 1932, Surya Sen planned to attack the Pahartali European Club which had a signboard that read "Dogs and Indians not allowed”
    Pritilata was told to lead the attack
    Dressing herself as a Punjabi male, Pritilata with her team attacked the club on September 23 at 10:45 pm
    Injured and trapped by the British police, Pritilata swallowed cyanide and committed suicide to avoid arrest

    Bangladeshi writer Selina Hossain calls Pritilata an ideal for every woman
    A trust named Birkannya Pritilata Trust has been founded in her memory
    A dormitory of Jahangirnagar University called Pritilata hall has been named after Pritilata Waddedar

    Published: 12:00 am Friday, May 09, 2014

    http://www.thedailystar.net/the-star/brave-lady-pritilata-23134
  • Biplob Rahman | ২১ মে ২০১৪ ১৯:৪৪582775
  • প্লিজ ইতিহাস বদলাবেন না
    প্রকাশিত: ২:২৮ অপরাহ্ন, মে ১৮, ২০১৪

    প্রভাষ আমিন॥

    গত ১৭ মে দৈনিক প্রথম আলো ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি লেখায় লিখেছে ‘আরএসএসের প্রচারক হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর’। এ নিয়ে তোলপাড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এ নিয়ে বিভিন্নজনের মন্তব্য পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা অভিযোগ। অনেকে বলছেন, প্রথম আলোতে জামায়াতের লোকজন রিক্রুট করা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এটা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ। কেউ কেউ এমনও বলছেন, উলফার টাকায় চলে প্রথম আলো। এইসব অভিযোগের কোনোটাই আমি বিশ্বাস করি না। প্রথম আলোর কর্মীদের অনেককেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তারা কেউ জামায়াত সমর্থক নন। মাঝে মাঝে স্খলন হয় বটে, তবে প্রথম আলো অবশ্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও চেতনাকে ধারণ করে। অনেকে এখানে ষড়যন্ত্র খুঁজছেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এটা নিছকই অদক্ষতা ও অসতর্কতা। সাব-এডিটর হয়তো আক্ষরিক অনুবাদ করতে গিয়ে এই ভুলটি করেছেন। তবে প্রশ্ন হলো, সাব-এডিটর অদক্ষ হলেও নিউজ ম্যানেজাররা কোথায় ছিলেন? তারা কেন তার এই আক্ষরিক অনুবাদকে পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতির সাথে মিলিয়ে শুদ্ধ করলেন না? এত বড় পত্রিকার কাছে এমন অসতর্কতা কাম্য নয়। কারো কারো প্রথম আলো বিদ্বেষকে আমার কাছে ঈর্ষাপ্রসূত মনে হয়েছে।

    এর আগে একাধিকবার প্রথম আলো নিয়ে লেখালেখির কারণে ব্যক্তিগতভাবে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছি। ভেবেছিলাম, প্রথম আলো নিয়ে আর লিখবো না। কিন্তু আজ (১৮ মে) সকালে আজ প্রথম আলোতে ‘প্রকাশিত তথ্যের ব্যাখ্যা’ পড়ে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। তাই মন খারাপ ভাবটা কাটাতেই লিখতে বসা। ব্যাখ্যায় বলা হয়, প্রতিবেদনটির তথ্যের উৎস ছিল বার্তা সংস্থা আইএএনএস। তাই প্রতিবেদনে সূত্রের তথ্য হুবহু রাখা হয়েছে। যদিও আগের দিনের প্রতিবেদনে তথ্য সূত্র হিসেবে বার্তা সংস্থা আইএএনএস’এর নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে প্রথম আলোর এই ব্যাখ্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথম আলোর মতো একটি পত্রিকা একটি বিদেশি বার্তা সংস্থার তথ্য হুবহু উদ্ধৃত করবে কেন? প্রথম আলোর নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতি আছে, তারা কেন আইএএনএস-এর সম্পাদকীয় নীতি হুবহু অনুসরণ করবে? তবে ব্যাখ্যার এর পরের অংশটি আরো ভয়ঙ্কর। বলা হয়েছে ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও শেষ পর্যায়ে ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। হয়তো সে কারণে নিজস্ব প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম কখনো কখনো একে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধও বলে থাকে।‘ কী ভয়ঙ্কর! কোনো কোনো বিদেশি সংবাদমাধ্যম যদি কখনো ১৯৭১ সালের আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে, তাহলে প্রথম আলোর উচিত তার তীব্র প্রতিবাদ জানানো। সত্যি ইতিহাস তুলে ধরা। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে তিন রকমের ইতিহাস বা প্রেক্ষাপট আছে। আমরা শুধু আমাদের প্রেক্ষাপটটাই তুলে ধরেবো। কেউ ভুল করলে, আমরা সেটা ধরিয়ে দেবো। আমরা জোর গলায় বারবার বলবো, ১৯৭১ সালে যা হয়েছে, তা একটি জাতির জন্মযুদ্ধ, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ। শেষ পর্যায়ে ভারত তাতে আমাদের সহায়তা করেছে মাত্র। কিন্তু প্রথম আলো নিজেদের ভুল ঢাকতে গিয়ে বিদেশি সংবাদমাধ্যম আইএএনএস-এর ভয়ঙ্কর ইতিহাস বিকৃতিকেই এক ধরনের স্বীকৃতি দিলো। প্রথম আলোর ব্যাখ্যা পড়ার পর তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের দুয়েকটি বিশ্বাস করতে মন চায়। তবু আমি বিশ্বাস করছি না। সাব-এডিটরের আক্ষরিক অনুবাদের অদক্ষতাকে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতি বলে মানতে চাই না।

    আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বদলানোর প্রথম চেষ্টা নয় এটি। আমাদেও দেশের একটি মহলও বারবার ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করেছে, মুক্তিযুদ্ধকে দলীয়করণের চেষ্টা করেছে। কিছুদিন আগে ভারতীয় ছবি ‘গুন্ডে’তেও একইভাবে ১৯৭১ সালের আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তীব্র আপত্তি আর প্রতিবাদের মুখে যশরাজ ফিল্মস সে জন্য ক্ষমা চেয়ে নিজেদের শুধরে নিয়েছে। ভারতের যশরাজ ফিল্মস ক্ষমা চাইলেও প্রথম আলো ক্ষমা তো চায়ইনি, উল্টো ভুলটি জায়েজ করার চেষ্টা করছে। অনেকে বলার চেষ্টা করছেন, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়েছে, এটা তো ঐতিহাসিক সত্য। না এটা ঐতিহাসিক সত্য নয়, এটা ঐতিহাসিক বিভ্রান্তি। এটা ঠিক ৩ ডিসেম্বর ভারত সরাসরি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু তারপরও এটা কোনোভাবেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নয়। পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ ভারতে করেনি, ভারতীয় বাহিনীর কাছে করেনি; করেছে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে, যৌথ কমান্ডের কাছে।

    প্রথম আলো সবকিছু বদলাতে চায়। আশা করি, প্রথম আলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বদলে দেবে না। বরং কেউ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিতে চাইলে তার তীব্র প্রতিবাদ জানাবে।

    লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

    http://www.banglatribune.com/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%9C-%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%A8%E0%A6%BE/?fb_action_ids=10152187124868165&fb_action_types=og.comments&fb_source=aggregation&fb_aggregation_id=288381481237582
  • Biplob Rahman | ২১ মে ২০১৪ ১৯:৪৬582776
  • প্রথম আলো ঘেরাওয়ে ‘সিপি গ্যাং’

    নিজস্ব প্রতিবেদক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
    Published: 21 May 2014 17:05 BdST Updated: 21 May 2014 17:05 BdST

    বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ’ উল্লেখ করায় প্রথম আলো কার্যালয় ঘেরাও করতে গিয়ে পুলিশের বাধা পেয়েছে ‘সিপি গ্যাং’ নামে একটি অনলাইনভিত্তিক সংগঠন।

    বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে কারওয়ান বাজারের পেট্রোসেন্টার থেকে একটি মিছিল নিয়ে তারা প্রথম আলো কার্যালয়ের দিকে রওনা হয়।

    তাদের এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আগে থেকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে ছিল।

    পুলিশ বাধা দিলে প্রথম আলো কার্যালয়ের দক্ষিণ পাশের সড়কে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দেয় তারা। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থানের পর ৫টার দিকে পেট্রোসেন্টারে ফিরে গিয়ে কর্মসূচি শেষ করে তারা।

    ‘সিপি গ্যাং’ প্রথম আলোর নিবন্ধন বাতিল এবং প্রকাশনা বন্ধের দাবি জানিয়েছে। বিক্ষোভের সময় প্রথম আলোর কয়েকটি কপি পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানায় তারা।

    সংগঠনের আহ্বায়ক রাসেল রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অবিলম্বে প্রথম আলোর লাইসেন্স বাতিল ও প্রকাশনা বন্ধ করতে হবে এবং এর সম্পাদক মতিউর রহমানসহ প্রতিবেদনটি প্রকাশের সাথে যারা যুক্ত ছিলেন, সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।”

    গত শনিবার ‘চা-বিক্রেতা থেকে প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে প্রথম আলোর আন্তর্জাতিক খবরের পাতায় ‘সারাবিশ্বে’ অংশে ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বুলেট পয়েন্ট জীবনী ছাপা হয়।

    এর একটি অংশে বলা হয়, “মোদি আরএসএসের ‘প্রচারক’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর।”

    এরপরই সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে প্রথম আলো।

    মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ফেইসবুকে এক স্ট্যাটাসে প্রথম আলো বর্জনের আহবান জানান।

    এর একদিন পরেই পত্রিকাটি ঘেরাও করতে যায় ‘সিপি গ্যাং’। আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিভিত্তিক সংগঠনগুলোও প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে।
    বাংলাদেশের আরো খবর

    http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article790328.bdnews
  • Biplob Rahman | ২১ মে ২০১৪ ১৯:৪৮582777
  • প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ অবমাননার অভিযোগ
    নিজস্ব প্রতিবেদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
    Published: 18 May 2014 19:05 BdST Updated: 18 May 2014 19:05 BdST

    ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ’ বলায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেইসবুকে সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলা দৈনিক প্রথম আলো।

    শনিবার ‘চা-বিক্রেতা থেকে প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে প্রথম আলোর আন্তর্জাতিক খবরের পাতা ‘সারাবিশ্বে’ ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বুলেট পয়েন্ট জীবনী ছাপা হয়।

    এর একটি অংশে বলা হয়, “মোদি আরএসএসের ‘প্রচারক’ হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর।”

    ওই নিবদ্ধের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক তোপের মুখে পড়ে প্রচার সংখ্যায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা এই দৈনিকটি।

    প্রথম আলোর ওই লেখার স্ক্রিনশট ফেইসবুকে শেয়ার করে জয়দেব নন্দী নামে এক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট লিখেছেন, “'প্রথম আলো' আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকেও অস্বীকার করলো? আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে 'গুন্ডে' সিনেমার মতো পাক-ভারত যুদ্ধ বলে চালানো শুরু করে দিলো? তাহলে এই অবস্থা?”

    নাসিম রূপক ফেইসবুকে লিখেছেন, “১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসাবে আখ্যায়িত করে মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা করলো প্রথম আলো।”

    জয়দেব নন্দীর স্টাটাসে করা মন্তব্যে খান আসাদুজ্জামান মাসুম বলেন, “৭১'র পাক-ভারত যুদ্ধ বলে যারা বলছেন তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া জরুরি। এটা বলে প্রকারান্তরে তারা মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করেন।”

    রোববার পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে ওই কথাটি বদলে দেয়ার পাশাপাশি প্রিন্ট ও অনলাইন সংস্করণে বার্তা সম্পাদকের পক্ষে একটি ব্যাখা ছাপা হয়।

    ব্যাখ্যায় বলা হয়, “চা-বিক্রেতা থেকে প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে গতকাল শনিবার প্রথম আলোর পৃষ্ঠা ৭-এ (সারা বিশ্ব) প্রকাশিত প্রতিবেদনে নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি ‘আরএসএসের প্রচারক হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর।

    “প্রতিবেদনটির তথ্যের উৎস ছিল বার্তা সংস্থা আইএএনএস৷ তাই প্রতিবেদনে সূত্রের তথ্য হুবহু রাখা হয়৷”

    সূত্রের দোহাই দেয়া হলেও ওই লেখাটির কোথাও সূত্রের উল্লেখ ছিলো না।

    প্রথম আলোর ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়, “১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। হয়তো সে কারণে নিজস্ব প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো বিদেশি সংবাদমাধ্যম কখনো কখনো একে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধও বলে থাকে৷ কিন্তু ১৯৭১ সাল বিশ্ব ইতিহাসে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বছর হিসেবেই সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত৷”

    এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘গুন্ডে’ তে মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে উল্লেখ করায় সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সমালোচনার মুখে পড়েছিলো ভারতীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যশরাজ ফিল্মস। পরে এর জন্য ক্ষমা চাওয়া হয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি পক্ষ থেকে।
    http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article789021.bdnews
  • Biplob Rahman | ২১ মে ২০১৪ ১৯:৫০582778
  • প্রথম আলো বর্জনের আহ্বান জয়ের

    জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
    Published: 20 May 2014 14:05 BdST Updated: 20 May 2014 16:05 BdST

    বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ’বলায় প্রথম আলো বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।

    ভারতের নির্বাচনে বিজেপির বিপুল বিজয়ের পর দলটির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদির জীবনীতে একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ওই তথ্য প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোতে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে নিজের ফেইসবুক পেইজে এক পোস্টে এ আহ্বান জানিয়েছেন জয়।

    বহুল পঠিত সংবাদপত্রটির এ ভূমিকার সমালোচনা করে জয় তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় বাংলা পত্রিকা 'প্রথম আলো' আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তান’ যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এর মাধ্যমে তারা একাত্তরের ত্রিশ লাখ শহীদকে অপমান করলো। আমি মনে করি, এটি

    একটি ঘৃণ্য অপরাধ এবং এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবিলম্বে বরখাস্ত করা উচিৎ।”

    তরুণ তথ্য-প্রযুক্তিবিদ জয় বলেন, “যাই হোক, এটা আমাকে খুব অবাক করেনি। আপনি যদি ২০০৭-২০০৮ সালের কথা মনে করেন, তাহলে দেখবেন প্রথম আলো তখন খোলামেলাভাবে সামরিক স্বৈরশাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। প্রথম আলো আবারও প্রমান করলো যে, তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না।

    “এবার তারা নতুন করে প্রমান করলো, তারা বাংলাদেশেও বিশ্বাস করে না। চলুন প্রথম আলো বর্জন করি এবং তাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেই, যারাই বাংলাদেশ সমর্থন করে না আমরা তাদের রুখে দিবো ।”

    গত শনিবার ‘চা-বিক্রেতা থেকে প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে প্রথম আলোর আন্তর্জাতিক খবরের পাতায় ‘সারাবিশ্বে’ অংশে ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বুলেট পয়েন্ট জীবনী ছাপা হয়।

    এর একটি অংশে বলা হয়, “মোদি আরএসএসের ‘প্রচারক’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর।”

    এরপরই সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন সাইটে ব্যাপক তোপের মুখে পড়ে প্রথম আলো।

    http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article789718.bdnews
  • Biplob Rahman | ২১ মে ২০১৪ ১৯:৫২582779
  • প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ

    ঢাবি প্রতিনিধি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
    Published: 20 May 2014 22:05 BdST Updated: 20 May 2014 22:05 BdST

    প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করার পর তার যে ব্যাখ্যা প্রথম আলো দিয়েছে, তাতে ‘সন্তুষ্ট’ না হয়ে সংবাদপত্রটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি সংগঠন।

    মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ‘টিএসসির সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন’ ব্যানারে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে দুই দিনের মধ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

    “তা না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর জেগে উঠবে, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর জেগে উঠলে তার পরিণতি কী হয়- তা একাত্তরে পাকিস্তানিরা বুঝেছিল,” হুঁশিয়ারি দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি শামীমা আক্তার জাহান।

    গত ১৭ মে প্রথম আলোয় ‘চা-বিক্রেতা থেকে প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভারতের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ‘আরএসএসের প্রচারক হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর’।

    ওই দিন কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ করা না হলেও এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পর দিন দেয়া ব্যাখ্যায় প্রথম আলো প্রতিবেদনটির তথ্যের উৎস হিসেবে বার্তা সংস্থা আইএএনএস--এর নাম উল্লেখ করে বলে, প্রতিবেদনে আইএএনএস--এর তথ্য হুবহু রাখা হয়েছে।

    টিএসসির সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করেন, প্রথম আলো বদলে যাও বদলে যাও স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসকে ‘বদলে দেয়ার’ কাজে নেমেছে।

    ‘ইতিহাস বিকৃতির দায়ে মতিউর রহমানকে গ্রেফতার কর’ লেখা প্ল্যাকার্ডও ছিল তাদের সমাবেশে।

    সমাবেশে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক শোয়াইব আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি রিয়াজুল হক রাজু ও সাধারণ সম্পাদক নাবিল আল জাহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সভাপতি মহসীন আলী, স্লোগান ’৭১ সভাপতি ভূঁইয়া মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ, ঢাবি সাইক্লিং ক্লাব সভাপতি আমিনুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
    http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article790057.bdnews
  • Biplob Rahman | ০২ জুলাই ২০১৪ ১৯:৫৮582780
  • মুক্তিযুদ্ধের ই-আর্কাইভ
    লিখেছেন: সাব্বির হোসাইন বিভাগ: মুক্তিযুদ্ধ তারিখ: ১১ আষাঢ় ১৪২১ (জুন ২৫, ২০১৪)

    ____________________________________________________________
    প্রিয় সুধী,

    মুক্তিযুদ্ধের উপর অনলাইন আর্কাইভে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই।

    বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র
    Bangladesh Liberation War Library and Research Centre
    ফেসবুক পেজ

    প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালে; বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণা এবং প্রচার নিয়ে কাজ করছে এই সংগঠন।

    আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক বিকৃতি হয়েছে এবং বর্তমান সময়েও একটি দেশদ্রোহী মহল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
    আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির এই অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করার জন্য, মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে ও সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস চর্চার খাতিরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক “অনলাইন-পাঠাগার/ সংগ্রহশালা” উদ্যোগটি গৃহীত হয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধের বই, দলিল, ছবি, অডিও, ভিডিও ‘বিনামূল্যে’ তরুণ প্রজন্মের হাতের নাগালে পৌঁছে দিতে চাই।

    গত ০৪ মে, ২০১৪ তে আমরা মুক্তিযুদ্ধের উপর আমাদের অনলাইন সংগ্রহশালার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করি। [ওয়েবসাইট লিংক]

    মূলত: মুক্তিযুদ্ধের বই, দলিল, ডকুমেন্টারী, ভিডিও, অডিও, মুভি ও ছবির একটি সংগ্রহশালা; যা বিনামূল্যে সবার জন্য উন্মুক্ত।

    এখানে যে বই, দলিল, ডকুমেন্টারী, ভিডিও, অডিও, মুভি ও ছবি পাওয়া যাচ্ছে, তার কিছু অনলাইনে আগেই বিভিন্নজন আপলোড করেছিলেন এবং বাকিগুলো আমাদের আপলোড করা।

    এম.এম.আর. জালাল ভাই, মাশুকুর রহমান, purposesother, সুমন মাহমুদ, ICSF-এর ওয়েবসাইট, আমার বই ডট কম, গ্রন্থ ডট কম, দেশের বই ব্লগস্পট ডট কম, আমার ব্লগের ইবুক সংগ্রহশালা, বাংলা গ্যালারী ডট কম সহ অনলাইনে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বই, দলিল, ডকুমেন্টারী, ভিডিও, অডিও, মুভি, ছবি আপলোড করেছেন, এমন সকল “ব্যাক্তিবর্গ এবং প্রতিষ্ঠানের” কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

    আমাদের অনলাইন-পাঠাগারের কোন কিছুর জন্য পাঠক থেকে কোন অর্থ আমরা গ্রহণ করি না এবং কারো থেকে কোন অনুদানও আমরা গ্রহণ করি না।

    মূলত: আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরার জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ।

    আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ই-আর্কাইভ ঘুরে আসবার আমন্ত্রণ রইল।

    ধন্যবাদ।
    ভালো থাকুন।
    নিরন্তর শুভ কামনা।

    - সাব্বির হোসাইন।
    প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র।
    আহবায়ক সদস্য, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, চট্টগ্রাম।

    ___________________________________________________________

    আমাদের এই উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করার পিছনে যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলেই নয়-

    মাহবুবুর রহমান জালাল
    মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
    অনলাইনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক দলিল ও তথ্য-উপাত্তের কাজ প্রথম শুরু করেন।

    কাজী মুকুল
    সাধারণ সম্পাদক, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি।

    সাব্বির খান
    আন্তজার্তিক সম্পাদক, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি।

    শওকত বাঙালি
    যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি।

    ডা: নুজহাত চৌধুরী
    শহীদ বুদ্ধিজীবি ডা: আবদুল আলীম চৌধুরীর কন্যা
    যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির দাবিতে আন্দোলনে একদম প্রথম হতে যুক্ত।

    রায়হান রশীদ
    ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম স্ট্র্যাটাজিক ফোরাম।

    এবং একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, মুক্তিযুদ্ধের ই-আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই সংগঠনটির সহযোগীতার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।

    আমাদের সাথে থেকে উৎসাহ যুগিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

    ______________________________________________________________

    এখন পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভে যা যা আছে-

    [ এই লিংকে যেয়ে কনটেন্টের নামের উপর ক্লিক করলে নতুন একটি উইন্ডোতে সেই কনটেন্টটি খুলবে http://www.liberationwarbangladesh.org/p/blog-page_5.html ]

    মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই

    ০১. দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী-এ এস এম সামছুল আরেফীন।
    ০২. একাত্তরের ডায়েরী- বেগম সুফিয়া কামাল।
    ০৩. একাত্তরের দিনগুলি- জাহানারা ইমাম।
    ০৪. আলবদর ১৯৭১- মুনতাসীর মামুন।
    ০৫. মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বি.এল.এফ.)- শেখ মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন।
    ০৬. চরমপত্র- এম আর আখতার মুকুল।
    ০৭. যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা ১৯৭১- আজাদুর রহমান চন্দন।
    ০৮. মুক্তিযুদ্ধ ও নারী- রোকেয়া কবির ও মুজিব মেহেদী।
    ০৯. পাকিস্তানী জেনারেলদের মন- মুনতাসীর মামুন।
    ১০. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর- কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীরবিক্রম।
    ১১. অসমাপ্ত আত্মজীবনী- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
    ১২. অসহযোগ আন্দোলন: একাত্তর – রশীদ হায়দার।
    ১৩. নৃশংস একাত্তর- মোস্তফা হোসেইন।
    ১৪. অপারেশন জ্যাকপট- সেজান মাহমুদ।
    ১৫. বাংলাদেশের জন্ম – রাও ফরমান আলী খান।
    ১৬. জনতার আদালতে জামাতে ইসলামী- শাহরিয়ার কবীর।
    ১৭. একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়।
    ১৮. বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস- লুৎফর রহমান রিটন।
    ১৯. আমি বীরাঙ্গনা বলছি- নীলিমা ইব্রাহিম।
    ২০. গণআদালতের পটভূমি – শাহরিয়ার কবির।
    ২১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – সম্পাদক: হাসান হাফিজুর রহমান – তথ্যমন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
    ২২. ডিসেম্বরের দিনগুলি- নুরুজ্জামান মানিক।
    ২৩. মুক্তিযুদ্ধ ও চারু মজুমদার- নেসার আহমেদ।
    ২৪. মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর : কথোপকথন।
    ২৫. ১৯৭১: চুকনগরে গণহত্যা- মুনতাসীর মামুন।
    ২৬. বেহাত বিপ্লব: ১৯৭১- সলিমুল্লাহ খান।
    ২৭. ছয় দফা- অফিসিয়াল ইশতিহার।
    ২৮. Bangladesh: A Legacy of Blood- Anthony Mascarenhas.
    ২৯. Witness to Surrender- Siddiq Salik.
    ৩০. রাইফেল, রোটি, আওরাত – আনোয়ার পাশা।
    ৩১. ২৬ টি চিত্রে বঙ্গবন্ধু।
    ৩২. বঙ্গবন্ধু কর্মসংকলন।
    ৩৩. আমি মুজিব বলছি- কৃত্তিবাস ওঝা।
    ৩৪. বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র- ড. সুনীল কান্তি দে।
    ৩৫. বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ: সমকালীন সাংবাদিকের দৃষ্টিতে- আমির হোসেন।
    ৩৬. সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু।
    ৩৭. একাত্তরের কন্যা জায়া জননীরা- মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া।
    ৩৮. একাত্তরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা- হামিদুল হোসেন তারেক বীরবিক্রম।
    ৩৯. ফাঁসির মঞ্চে তেরজন- আনোয়ার কবির।
    ৪০. মুখোশের অন্তরালে জামাত- মাওলানা আবদুল আউয়াল।
    ৪১. মওদুদী-জামাত ফেৎনার স্বরূপ- আনোয়ার কবির সম্পাদিত।
    ৪২. সেই রাজাকার- জনকণ্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন।
    ৪৩. শাহবাগের সাথে সংহতি- সম্পাদনা: রেজওয়ান তানিম।
    ৪৪. বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০ থেকে ১৯৭১- ডঃ মোহাম্মদ হাননান।
    ৪৫. জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা- মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া।
    ৪৬. আমি আল বদর বলছি।
    ৪৭. পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী ১৯১ জন- ডঃ এম এ হাসান।
    ৪৮. The Vanquished Generals and The Liberation War of Bangladesh- Muntassir Mamoon.
    ৪৯. গণহত্যা (Genocide)- অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস।
    ৫০. আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর- আবুল মনসুর আহমেদ।
    ৫১. আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম – হুমায়ুন আজাদ।
    ৫২. বাংলাদেশ: প্রথম বিজয় দিবস বার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থ।
    ৫৩. ভাষা আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি-হুমায়ুন আজাদ।
    ৫৪. ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র- রতন লাল চক্রবর্তী।
    ৫৫. History of Freedom Movement in Bangladesh (1947-1973) – Jyoti Sen Gupta.
    ৫৬. একাত্তরের একদল দুষ্টু ছেলে – আনিসুল হক।
    ৫৭. মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগরী – সাথী দাস।
    ৫৮. Memoirs of the Revolution in Bengal, Anno Domini 1757 – John Campbell and William Watts.
    ৫৯. Bengal in 1756-57 – S.C. Hill.
    ৬০. একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার – সম্পাদনা: শাহরিয়ার কবির।
    ৬১. The Intolerable Sufferings of Seventy One – Shahriar Kabir.

    মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ডকুমেন্টারী

    ০১. Dispatches: War Crimes File।
    ০২. মুুক্তিযুদ্ধের ডকুমেন্টারী: বাঙলার জয়।
    ০৩. Dateline Bangladesh ডেটলাইন বাংলাদেশ।
    ০৪. একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের উপর Asian News International (ANI)-এর ডকুমেন্টারী।

    মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ভিডিও ফুটেজ

    ০১. একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণের ফুটেজ।

    মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অডিও

    ০১. চরমপত্র- ২০১৩।
    ০২. বাহাত্তরে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণের অডিও।

    _____________________________________________________________

    সবার প্রতি মুক্তিযুদ্ধের ই-আর্কাইভটি ভ্রমণের আমন্ত্রন রইল।

    মুক্তিযুদ্ধের ই-আর্কাইভ: http://www.liberationwarbangladesh.org/
    ________________
    http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=41689
  • Biplob Rahman | ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ১৮:৫৩582781
  • ঘৃণার জুতার মুখে গোলাম আযম
    রিয়াজুল বাশার, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

    ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি দুপুর, বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে। ফিলিস্তিনে নিহত দুই বাংলাদেশির জানাজা মাত্র শেষ হয়েছে। জানাজায় অংশ নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রধান নেতা গোলাম আযম।

    এমন সময় তার দিকে এগিয়ে এলেন ৩৬ বছরের এক যুবক। ডান হাতে ধরা পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে পরপর দুটি আঘাত করলেন গোলাম আজমের মুখে। প্রথমটি লাগলো কপালে, দ্বিতীয়টি চোয়ালে।

    এরপর ৩২ বছর ধরে এই জুতাপেটার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের প্রতীক হয়ে আছে।

    আর ওই জুতাপেটার ঘটনাটি নিয়ে কয়েকদিন ধরে সংবাদপত্রে খবর ছিল বলে জানিয়েছেন তখনকার তরুণ সাংবাদিক, বর্তমানে দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান।

    প্রত্যক্ষদর্শী একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন সেদিনের জুতাপেটার ঘটনাটি।

    “দুপুর ১১টা থেকে ১২টার মধ্যকার ঘটনা। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইট তখনো হয়নি। মসজিদের সিঁড়ির কয়েক গজ দূরে লাশ রেখে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।”

    “জানাজায় ছাত্র-শিক্ষক-জনতা-বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। জানাজার কিছুক্ষণ আগেই দুটি কার এসে থামে রাস্তার পাশ ঘেঁষে। একটির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসেন গোলাম আযম।”

    স্বাধীনতার ঠিক আগে দেশ ছেড়ে যাওয়া গোলাম আযম ১৯৭৮ সালে ফিরলেও দলীয় অনুষ্ঠানের বাইরে সেটাই ছিল তার প্রকাশ্য কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান।

    সাংবাদিক মুনীরুজ্জামান বলেন, “জিয়াউর রহমান গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর ওইটাই ছিল তার প্রথম পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্স। মানুষ তাকে কীভাবে নেয়, তার একটা টেস্ট কেইসও ছিল ওই দিন।”

    বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ঘটনার বর্ণনাকারী ওই ব্যক্তি নিজেও গোলাম আযমকে জুতাপেটা করেছিলেন।

    তার ভাষায়, “গোলাম আযম আসার পরই আমাদের মধ্যে একটা গুঞ্জন তৈরি হলো। তার আসাটা আমরা মেনে নিতে পারিনি।”

    “বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা একজন মানুষ এভাবে আমাদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে জানাজা পড়বে, আমাদের সমাজে মিশে যাবে, এটা আমাদের ভাবতেও অবাক লাগছিল।”

    “কয়েক মিনিটের মধ্যেই জানাজা শেষ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে ওঠার জন্য এগিয়ে আসেন গোলাম আযম। আমার থেকে তখন ১০-১২ ফুট দূরে। হঠাৎ আমার পায়ের স্যান্ডেল হাতে উঠে এল। এগিয়ে গিয়ে পরপর দুটো আঘাত করলাম। প্রথমটা লাগলো কপালে, দ্বিতীয়টা চেয়ালে।”

    এরপর গোলাম আযমের সঙ্গে থাকা অন্যরা তাকে আড়াল করে গাড়িতে তুলে সেখান থেকে সরে পড়ে বলে জানান ওই ব্যক্তি।

    তিনি জানান, ওই ঘটনার মাত্র দুটি ছবি তুলেছিলেন তখন দৈনিক সংবাদে কাজ করা রশীদ তালুকদার। একটি ছবি পরদিন সংবাদে ছাপা হয়েছিল।

    জুতাপেটার পরপর ঘটনাস্থলের কাছে জামায়াতকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছিলেন এই ব্যক্তি।

    “জিরো পয়েন্টের কিছুটা এগুতেই কয়েকজন এসে জোর করে আমাকে গাড়িতে তুলতে চায়। তাদের সঙ্গে আমার ধস্তাধ্বস্তির এক পর্যায়ে জাসদ নেতা প্রয়াত কাজী আরেফ আহমেদ ও তার সঙ্গীরা এসে আমাকে উদ্ধার করেন।”

    কেন জুতা মারতে গেলেন- জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “চরম ঘৃণা থেকেই তাকে মেরেছিলাম। একজন স্বাধীনতাবিরোধী, একজন দেশদ্রোহী, যারা নেতৃত্ব অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তিনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াবেন- এটা কি মেনে নেয়া যায়?”

    সাংবাদিক মুনীরুজ্জামান বলেন, জানাজায় এসে গোলাম আযম জুতাপেটার পাশাপাশি কিল-ঘুষিও খেয়েছিলেন বলে তারা শুনেছেন।

    “পরদিন তখনকার প্রায় সব পত্রিকাতেই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদে জুতোপেটার ছবিও ছাপা হয়েছিল। একাধিক ছাত্র সংগঠন এ ঘটনা নিয়ে বিবৃতিও দিয়েছিল।”

    বেশ কিছুদিন ধরেই সংবাদপত্রে কলাম লেখকদের লেখনিতে তা উঠে এসেছিল বলে এই সাংবাদিক জানান।

    http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article647136.bdnews
  • Biplob Rahman | ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ১৮:৫৭582782
  • যুদ্ধাপরাধীদের ‘গুরু’ গোলাম আযমের মৃত্যু
    জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

    Published: 2014-10-23 22:36:03.0 BdST Updated: 2014-10-25 18:23:42.0 BdST

    গোলাম আযমের মৃত্যুর ঘোষণা নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া

    গোলাম আযমের মৃত্যুর ঘোষণা নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া

    বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে যার নাম আসে সবার আগে, সেই গোলাম আযম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের সাজা ভোগের মধ্যেই মারা গেছেন।

    ৯২ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে তার, যার আরও ৮৯ বছর কারাভোগ বাকি ছিল।

    বিচারাধীন অবস্থা থেকে এই হাসপাতালে প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের আমির গোলাম আযম। গত বছরের ১৫ জুলাই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে রায়ের পরও এখানেই ছিলেন তিনি।

    ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে প্রসিকিউশন ও আসামি পক্ষের আপিলের শুনানির দিন ঠিক হওয়ার একদিন বাদেই গোলাম আযমের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটার খবর আসে।

    এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাকে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে, তারও কয়েক ঘণ্টা পর মধ্যরাতে সাংবাদিকদের সামনে এসে মৃত্যুর ঘোষণা দেন বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া।

    যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিতদের মধ্যে গোলাম আযমের আগে শাস্তি ভোগের সময় মৃত্যু হয় আব্দুল আলীমের। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার মামলারও কার্যকারিতা শেষ হয়ে যায়।

    গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের রায় দেওয়ার সময় বিচারক বলেছিলেন, আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি পাওনা হলেও বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হল।

    যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের তখনকার আমিরকে।

    তার তার জন্য যে শাস্তি তাকে দেওয়া হয়, তা এক বছর তিন মাস খেটেই মারা গেলেন তিনি। জীবদ্দশায় যিনি একাত্তরের বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য কখনও ক্ষমা কিংবা দুঃখ প্রকাশও করেননি।

    গোলাম আযমের অবস্থার অবনতির খবর শোনার পর হাসপাতালের পরিচালক মজিদ ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “বিকালে তার প্রেসার কমে যায়। এ কারণে ওষুধ দিয়ে প্রেসার স্বাভাবিক রাখা হয়। এক কথায় ওষুধ দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।”

    তখন থেকে গোলাম আযমের কথা বলায় জড়তা দেখা দেয় বলে মজিদ ভূঁইয়া জানান।

    রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হলে শীর্ষ এই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে রাত পৌনে ১২টার দিকে জামায়াত নেতার মৃত্যুর ঘোষণা আসে।

    হাসপাতালের পরিচালক মজিদ ভূঁইয়ার বক্তব্য অনুযায়ী, লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে গোলাম আযমের মৃত্যু হয়।

    বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণগোপাল দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর জামায়াত নেতাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।”

    হাসপাতালে উপস্থিত গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী রাত সোয়া ১১টার দিকে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “মনে হল, আমার বাবা আর নাই। নিস্তেজ অবস্থায় আছেন। তবে তার মৃত্যুর বিষয়ে ডাক্তাররা এখনও আমাকে কিছু জানায়নি।”

    ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের হেফাজতে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন জামায়াত নেতা। সুরতহালের পর ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে ঢাকার জেলার মো. নেছার আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

    রাতেই হাসপাতালে ম্যাজিস্ট্রেট তারিক হাসানের উপস্থিতিতে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু করে দেয় পুলিশ, যা শেষ হয় রাত ৩টায়। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে রাখা হয়েছে।

    তবে ময়নাতদন্তের না করে লাশ হস্তান্তরের জন্য গোলাম আযমের পরিবার ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদন দিয়ে চেয়েছেন। তাদের সকালে যেতে বলেছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

    গোলাম আযমকে মগবাজারে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তার ছেলে আব্দুল্লাহিল আজমী। তবে তা তার অন্য ছেলেরা দেশে ফিরলে কয়েকদিন পর হবে বলে জানান। সেই পর্যন্ত এই যুদ্ধাপরাধীর লাশ থাকবে হিমঘরে।

    ১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে নানাবাড়িতে জন্ম নেওয়া গোলাম আযমের পৈত্রিক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিরগাঁওয়ে।

    ঢাকার ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (এখনকার কবি নজরুল কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি।

    গত শতকের ’৪০ এর দশকে এক মেয়াদে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন গোলাম আযম। ওই সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে জিএস হিসেবে তার একটি স্মারকলিপি দেওয়াকে ‘ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা’ হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস চালায় তার দল জামায়াতে ইসলামী; যদিও পরে তিনি নিজেই তার ওই পদক্ষেপ ভুল ছিল বলে উল্লেখ করেন।

    ছাত্রজীবন শেষে ১৯৫০ থেকে পাঁচবছর রংপুর কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ান গোলাম আযম। ওই সময়ই সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদীর ইসলামী ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন তিনি।

    ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল মওদুদীকে, আর তার শিষ্য গোলাম আযমও একই অপরাধ করেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়।

    ১৯৬৯ সালে গোলাম আযম যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির হন, বাংলার মানুষের স্বাধিকারের আন্দোলন তখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

    একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন গোলাম আযম। এসব আধা সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন চালায়।

    বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও প্রকাশ্যে তদবির চালান এই জামায়াত নেতা।

    মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে যান গোলাম আযম। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাজ্যে।

    ৭ বছর লন্ডনে অবস্থান করার পর ১৯৭৮ এ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে আবার বাংলাদেশে আসেন এই জামায়াত নেতা; তা-ও পাকিস্তানি পাসপোর্টে।

    বাংলাদেশে ফেরার পর ১৯৮১ সালে বায়তুল মোকাররমে একটি জানাজা পড়তে গিয়ে জুতাপেটার শিকার হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের এই নেতা।

    ১৯৯১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেওয়ার পর ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর জামায়াত গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন।

    ওই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি আবার সামনে আসে, যার পরিণতিতে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর এই বিচার শুরুর উদ্যোগ নেয়।

    এর মধ্যে আদালতের এক রায়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পান গোলাম আযম। এরপর ১৯৯৯ সালে তিনি জামায়াতের আমিরের পদ থেকে অবসরে গেলেও দলটির তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে সম্পৃক্ততা বজায় রেখেছিলেন, থাকছিলেন মগবাজারে।

    যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে। পরের বছরের ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে বিচারকরা তাকে কারাগারে পাঠান। তখন থেকেই তিনি বিএসএমএমইউতে ছিলেন এবং বৃহস্পতিবার মারাও গেলেন সেখানে।

    http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article870864.bdnews
  • Biplob Rahman | ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ১৯:০০582783
  • ভাষার প্রশ্নে গোলাম আযমের ‘ভেলকিবাজি’
    মামুনুর রশীদ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

    Published: 2013-07-15 03:53:54.0 BdST Updated: 2013-07-15 05:19:57.0 BdST

    উনিশশ নব্বই দশকের শুরুতে যখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে, ঠিক তখনই বায়ান্নর ‘ভাষা সৈনিক’ হিসাবে শোনা যেতে থাকে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমের নাম।

    রাজধানী ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে সে সময় গোলাম আযমকে ‘ভাষাসৈনিক’ অভিহিত করে চিকা মারা হয়। ভাষা দিবস পালন করতে দেখা যায় একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতকেও।

    ভাষা আন্দোলন গবেষক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর বিষয়টিকে ব্যাখা করেন এভাবে, “১৯৭৮ সালে দেশে ফেরার পর যখন উনি (গোলাম আযম) দেখলেন ধর্মের কথায় আর সুবিধা হচ্ছে না, তখন ৯২ সালে নাগরিকত্ব নেয়ার আগে তিনি ভাষাসৈনিকের তকমা নিলেন। নিজেকে দাবি করলেন একজন ভাষাসৈনিক হিসাবে।”

    ভাষা আন্দোলনের মতো একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ততা জাহির করাকে জামায়াতে ইসলামীর একটি সেই সময়ের একটি ‘রাজনৈতিক কৌশল’ অভিহিত করেন তিনি।

    আর যে সূত্র ধরে জামায়াত সে সময় গোলাম আযমকে ‘ভাষাসৈনিক’ দাবি করে, তার প্রেক্ষাপটও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের কাছে তুলে ধরেন এই বাম নেতা।

    তিনি বলেন, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন৷ সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) পক্ষ থেকে তাকে দেয়া একটি মানপত্রে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়৷

    মানপত্রটি পড়ার কথা ছিল ডাকসুর তখনকার ভিপি অরবিন্দ বোসের। কিন্তু একজন হিন্দু ছাত্রকে দিয়ে মানপত্র পাঠ করালে তা নিয়ে মুসলিম লীগ সরকারে বিরূপ প্রচার হতে পারে- এমন আশঙ্কায় সেই দায়িত্ব পড়ে ডাকসুর তখনকার সেক্রেটারি গোলাম আযমের ওপর।

    বদরুদ্দীন উমর বলেন, “ভাষাসৈনিক হিসাবে গোলাম আযমের দৌড় কিন্তু এ পর্যন্তই।”

    আর সেটুকুও যে গোলাম আযম ‘অনেকখানি চাপে পড়ে’ করেছিলেন, তার প্রমাণ মেলে ১৯৭০ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শুক্কুরে গোলাম আযমের সম্মানে আঞ্জুমানে ইয়ারানে শক্করের উদ্যোগে এক সম্বর্ধনা সভায় তার দেয়া বক্তৃতায়।

    সেখানে তিনি ভাষা আন্দোলনকে আখ্যায়িত করেন ‘মারাত্মক রাজনৈতিক ভুল’ হিসাবে।

    ১৯৭০ সালের ২০ জুন ‘বাংলা ভাষার আন্দোলন করা ভুল হইয়াছে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে গোলাম আযমের সেই বক্তব্য প্রকাশিত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার পঞ্চম পৃষ্ঠায়।

    তাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “মুসলমানদের অধিকাংশ তমদ্দুন ও ধর্মীয় জ্ঞানের ভাণ্ডার উর্দু ভাষায় সংরক্ষিত আছে।”

    জাতীয় ভাষার প্রশ্ন ওঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলকারীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন- তা উল্লেখ করে শ্রোতাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন গোলাম আযম। বলেন, “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে তা মোটেও সঠিক কাজ হয়নি।”

    ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্ততা প্রমাণের ‘রাজনৈতিক কৌশল’ প্রসঙ্গে ‘ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ভেলকিবাজি’ শীর্ষক একটি নিবন্ধও লিখেছেন উমর।

    তিনি বলেন, “এ কাজ তারা এখন আবার নতুন করে শুরু করেছে৷ সম্প্রতি তারা ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে৷ এর কভারে লেখা আছে ‘মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান’৷ সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এরা এখন মাতৃভাষাকে খোদার ‘সেরা দান’ হিসেবে জনগণের কাছে উপস্থিত করার চেষ্টা করছে৷”

    ওই ভিডিওতে গোলাম আযম দুই দফা সাক্ষাৎকারে নিজেকে ভাষা আন্দোলনের ‘একজন সক্রিয় নেতা’ হিসাবে জাহির করার চেষ্টা করেছেন বলেও উল্লেখ করেন উমর।

    ভাষা আন্দোলনে গোলাম আযমের ‘অগত্যা’ অংশগ্রহণের কাহিনী, সেজন্য ১৯৭০ সালের দুঃখ প্রকাশ এবং ভাষা আন্দোলনকে ‘ভুল’ আখ্যায়িত করা, এরপর ১৯৯২ সালে আবার নিজেকে ‘ভাষাসৈনিক’ হিসেবে প্রচার এবং বাংলা ভাষাকে ‘খোদার সেরা দান’ হিসেবে গৌরবান্বিত করার চেষ্টাসহ পুরো বিষয়টিকে বদরুদ্দীন উমর আখ্যায়িত করেন “জামায়াতে ইসলামীর জাদুর খেলা” হিসাবে৷

    তিনি বলেন, “এর সঙ্গে যে প্রকৃত ইসলামী নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই, একথা বলাই বাহুল্য।”

    http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article647178.bdnews
  • Biplob Rahman | ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ১৯:০২582784
  • বদরপ্রধান নিজামীকে যেতে হবে ফাঁসিকাষ্ঠে
    নিজস্ব প্রতিবেদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

    Published: 2014-10-29 12:27:29.0 BdST Updated: 2014-10-29 18:51:32.0 BdST

    মুক্তিযুদ্ধকালে যার পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল, সেই মতিউর রহমান নিজামীকে যেতে হবে ফাঁসিকাষ্ঠে।

    মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রধান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বুধবার জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় দেন।

    ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসাইন ও বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হকও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

    জামায়াতের আজকের আমির নিজামী চার দশক আগে ছিলেন জামায়াতেরই ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান এবং সেই সূত্রে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত আলবদর বাহিনীরও নেতা।

    এছাড়া স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মামলার রায়ে উঠে এসেছে।

    রায়ে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগের মধ্যে বুদ্ধিজীবী গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করা, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

    এর মধ্যে বুদ্ধিজীবী গণহত্যাসহ চার অভিযোগের প্রত্যেকটিতে তাকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

    বিচারক রায়ে বলেন, এই অপরাধের পরও যদি ফাঁসি না দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে বিচারের ব্যর্থতা।

    বাকি চারটি অভিযোগে নিজামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আট অভিযোগে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

    ৭১ বছর বয়সী নিজামী হলেন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করা চতুর্থ রাজনীতিবিদ, আদালত যাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিল। এর আগে চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়।

    বিগত চার দলীয় জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। তার আগে ২০০১-০৩ সময়ে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী।

    সাজা ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালের বাইরে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধা, রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে উপস্থিত জনতা এবং আসামির জেলা পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে উল্লাস প্রকাশ করে।

    অন্যদিকে রায়ের প্রতিবাদে নিজামীর দল তিন দিনের হরতাল ঘোষণা করে।

    রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিজামীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, “এ জাজমেন্ট ন্যায়ভ্রষ্ট জাজমেন্ট। আপিলে অবশ্যই এ জাজমেন্ট টিকবে না। আমরা অত্যন্ত সংক্ষুব্ধ। এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করব।”

    অন্যদিকে প্রসিকিউটর মো. আলী বলেন, “এই রায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”

    মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ মাহবুব-উল-আলম হানিফ।

    এ রায়ে সরকার সন্তুষ্ট জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এ রায় দ্রুত কার্যকর করতে সরকার পদক্ষেপ নেবে।

    তবে জামায়াতের জোটসঙ্গী বিএনপি এবারো রায় নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জনায়নি।

    http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article873406.bdnews
  • Biplob Rahman | ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ১৯:০৪582786
  • *পূর্বোক্ত সংবাদ চলছে::

    স্বাধীনতাবিরোধী থেকে জনপ্রতিনিধি

    শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের উত্তরসূরি হিসাবে ২০০০ সালে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে আসা মতিউর রহমান নিজামীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে।

    স্থানীয় বোয়ালমারি মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করা নিজামী কামিল পাস করেন ১৯৬৩ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে। এরপর প্রাইভেট শিক্ষার্থী হিসাবে ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন।

    মাদ্রাসার ছাত্র থাকা অবস্থায় নিজামী ১৯৬১ সালে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে যুক্ত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও সেই ছাত্রসংঘই ইসলামী ছাত্রশিবির নামে ফিরে আসে।

    ১৯৬৬ থেকে তিন বছর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর একাত্তরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন নিজামী। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতার লড়াই তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।

    ১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে মূলত ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় আলবদর বাহিনী। ছাত্রসংঘের নেতা হিসাবে আলবদরের নেতৃত্বও নিজামীর কাঁধে বর্তায়।

    আলবদর গঠিত হওয়ার পর ২৩ শে এপ্রিল দৈনিক পাকিস্তানে ছাত্রসংঘের সভাপতি নিজামীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়, যাতে বলা হয়, “আলবদর একটি নাম, একটি বিস্ময়। আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা। যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী সেখানেই আলবদর। যেখানে দুস্কৃতকারী সেখানেই আলবদর। ভারতীয় চরদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।”

    ওই বাহিনী সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায় এবং মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে বাঙালি জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করে দিতে পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতার পক্ষের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।

    স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের পর বাংলাদেশ সরকার জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করে।

    বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের আমলে দেশে ফেরার সুযোগ পান জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধকালীন আমির গোলাম আযম। স্বাধীন বাংলায় প্রকাশ্যে রাজনীতিতে ফেরে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দলটি।

    ওই সময় ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত জামায়াতের ঢাকা মহানগর শাখার আমির ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। এরপর ১৯৮৩ সালে পদোন্নতি পেয়ে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হন।

    ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ওই পদে থেকে দলের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পান নিজামী। গোলাম আযম আমিরের পদ থেকে অবসরে গেলে ২০০০ সাল থেকে নিজামীর নেতৃত্বেই পরিচালিত হয় জামায়াতে ইসলামী।

    পাবনা-১ আসন থেকে তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হওয়া নিজামীকে ২০০১ সালে মন্ত্রিত্ব দেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। প্রথমে দুই বছর কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে সরকারের পরের তিন বছর ছিলেন শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্বে।

    ওই সময়েই ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য পাচারের পথে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে, যে মামলার রায়ে চলতি বছর নিজামীর ফাঁসির আদেশ হয়। কন্টেইনার ডিপোর ইজারা নিয়ে গেটকো দুর্নীতি মামলারও আসামি সাবেক শিল্পমন্ত্রী নিজামী।

    ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে জোটসঙ্গী জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী।

    ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে জোটসঙ্গী জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী।

    মামলার পূর্বাপর

    ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেপ্তার করার পর একই বছরের ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

    এরপর ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর জামায়াতের আমিরের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। ২৮ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগ আমলে নেয়।

    এরপর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ২৮ মে জামায়াত আমিরের বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

    তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানের জবানবন্দি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে গত বছর ২৬ অগাস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন মোট ২৬ জন।

    আর নিজামীর পক্ষে তার ছেলে মো. নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। বাকি তিনজন হলেন- অ্যাডভোকেট কে এ হামিদুর রহমান, মো. শামসুল আলম ও আবদুস সালাম মুকুল।

    সাক্ষ্য ও জেরা শেষে গতবছর ৩ থেকে ৬ নভেম্বর প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রথম দফা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত না হওয়ায় তাদের লিখিত যুক্তিতর্ক জমা দিতে বলে ১৩ নভেম্বর মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল।

    এরপর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বদল হওয়ায় চলতি বছর ১৬ থেকে ২৪ মার্চ নতুন করে এ মামলার যুক্তিতর্ক হয়। দ্বিতীয়বারের মতো অপেক্ষায় রাখা হয় মামলার রায়।

    চলতি বছর ২৪ জুন রায়ের তারিখ রাখা হলেও অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীকে হাজির না করায় রায় আবারো পিছিয়ে যায়।

    ট্রাইব্যুনালের দশম রায়

    বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। পলাতক থাকায় তিনি আপিলের সুযোগ পাননি।

    ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।

    যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়, যা কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর।

    ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে গতবছর ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।

    ওই রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদী আপিল করলে চলতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ‘দেইল্যা রাজাকার’ নামে খ্যাত এই জামায়াত নেতার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

    গতবছর ৯ মে ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষের আপিল শুনানি শেষে গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছে আপিল বিভাগ।

    মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উসকানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে গতবছর ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিল ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম রায়।

    রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গত ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়সী জামায়াতগুরু।

    গতবছর ১৭ জুলাই ষষ্ঠ রায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ১ অক্টোবর সপ্তম রায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে। তারাও রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছেন।

    গতবছর ৯ অক্টোবর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত। যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যে ৮৩ বছর বয়সে গত ৩০ অগাস্ট মারা যান আলীম। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ১১ মাস কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলেন তিনি।

    আর বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে গতবছর ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। তারা দুজনেই পলাতক।

    জামায়াত নেতাদের আগের রায়গুলোর সময় ব্যাপক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার থেকেই ট্রাইব্যুনাল ঘিরে নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

    সকালে ট্রাইব্যুনালে আসা সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদেরও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তল্লাশি করে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়।

    রায়ের জন্য আসামি নিজামীকে আগের রাতেই কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বুধবার সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয় একটি প্রিজন ভ্যানে করে।

    আগের রায়ের দিনগুলোর মতো এদিনও সকাল থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে মিছিল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলসহ বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের ট্রাইব্যুনালের বাইরে জড়ো হতে দেখা যায়। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানোর পাশাপাশি দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণারও দাবি তোলেন তারা।

    http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article873406.bdnews
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন