এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৮ মার্চ ২০১৩ ২০:০৪582905
  • অগ্নিঝরা মার্চ
    সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়
    তোফায়েল আহমেদ
    __________________________________
    ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ ছিল সোমবার। আগের দিন ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে চারটি শর্ত দেন। আর সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে দেন ১০টি নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর ওই নির্দেশনা ছিল মূলত সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখা। ফলে ৮ মার্চ থেকে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব। জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত নিরস্ত্র বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর ডাকে প্রতিদিন সশস্ত্র হয়ে উঠতে থাকে। রেডিও-টেলিভিশনের কর্মীদের দাবির মুখে ৮ তারিখ সকাল ৮টায় রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানিচক্র। ভাষণ প্রচারের পর কাজে যোগ দেন রেডিও-টিভির সাধারণ কর্মীরা।
    এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে আট ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার মিটিং করেন ভুট্টো। এ খবরও দ্রুত পেয়ে যান বঙ্গবন্ধু। এ সময় ঢাকায় এবিসি টেলিভিশনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'কারোরই আগুন নিয়ে খেলা উচিত নয়।'
    বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এদিন থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। দিনরাত জঙ্গি মিছিল সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করে। বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশনায় তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যাবলির ওপর বিশেষ নজর রাখা শুরু হয়। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ঘোষণা এবং ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বিবৃতির পর নীতিগতভাবে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আলোচনার চেয়ে শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বেশি প্রাধান্য দেন। বঙ্গবন্ধুর বিবৃতিটি ছিল ৬ মার্চে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের দেওয়া ভাষণের বিপরীতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি জবাব। এ বিবৃতিটি এক ঐতিহাসিক দলিল। বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু জেনারেল ইয়াহিয়ার উদ্দেশে বলেন, "১ মার্চ তারিখে আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। অধিবেশন আকস্মিক ও অবাঞ্ছিতভাবে স্থগিত ঘোষণা করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত নিরস্ত্র বেসামরিক অধিবাসীদের (শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র) ওপর ব্যাপকভাবে গুলি চালানো হয়েছে। গত সপ্তাহে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁরা শহীদ হয়েছেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন খামখেয়ালিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ করতে গিয়ে তাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন। এ শহীদানদের ধ্বংসকারী শক্তি অ্যাখ্যাদান নিঃসন্দেহে সত্যের অপলাপ। প্রকৃতপক্ষে তারাই ধ্বংসকারী শক্তি, যারা বাংলাদেশের বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির জন্য দায়ী। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, গত সপ্তাহে যে বিভীষিকার সৃষ্টি করা হয়েছে, তা দেখার জন্য ইয়াহিয়া ঢাকা আসার সময় করতে পারলেন না। তিনি যাকে সর্বনিম্ন শক্তি প্রয়োগ বলেছেন, তাতেই যদি হাজার হাজার লোক হতাহত হতে পারে, তাহলে তাঁর অভিহিত 'পর্যাপ্ত' শক্তি প্রয়োগের অর্থ কি আমরা সম্পূর্ণ নির্মূল করাই বুঝব?"
    এদিকে পল্টনে এদিন সমাবেশ করে বঙ্গবন্ধুকে বিনা শর্তে সমর্থন দেবেন বলে ঘোষণা করেন মওলানা ভাসানী।
    অন্যদিকে নতুন গভর্নর টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের দ্রুত দেশত্যাগের নির্দেশ দেন। এ সময় বিদেশি সাংবাদিকরা বিশেষ অনুমতি নিয়ে থাকতে চাইলে তাঁদের বিষয়ে প্রথমে আপত্তি ও পরে কঠোর নজরদারি রাখা হলো।
    http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1175&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=11#.UTn0ktbcoSs
  • cb | 41.6.140.217 | ০৯ মার্চ ২০১৩ ০২:৪২582906
  • কি বাজে লোক এই মুজিবর রহমন, বঙ্গবন্ধু তো নয় , বঙ্গশত্রু!!!! :P
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৯ মার্চ ২০১৩ ১৭:৫৮582907
  • টই-এর এই এক মজা! এ-বি-সি-ডি বা ডট-মাইনাস দিয়ে যথেচ্ছ পুচ্ছ নেড়েই খালাশ হওয়া যায়। পাঠ বা পর্যবেক্ষণ বা চিন্তনে খুব কষ্ট কি না!...[কলিকাল ইমো] :ডি
  • cb | 41.6.140.217 | ০৯ মার্চ ২০১৩ ১৮:৪৭582908
  • সেটা যে হচ্ছে না কি করে বোঝা গেল?

    ওসব কলিকাল ইমো নিজের কাছেই রাখুন, নিজেকে এত সুপিরিয়র ভাবার কি আছে?

    আমি যেমন আপনার এই দুর্দান্ত ডকুমেন্টশন আমার মত করে ফলো করছি , সেইরকম ই করতে দিন
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৯ মার্চ ২০১৩ ১৯:২৪582909
  • মাফ চাইছি, আপনাকে ভীষণ চটিয়ে দিয়েছি বলে। কিন্তু এটা ভাট না বলেই সিরিয়াস মন্তব্য আশা করেছিলাম।

    যা হোক। আপনার পাঠে আর বিঘ্ন ঘটবে না। তবে কথা কি না, "নিজেকে সুপিরিয়র" কোনো কালেই ভাবিনি, মৃদু মানুষ, খানিকটা ভুল বুঝেছিলাম-- এই মাত্র।

    শুভেচ্ছা রইলো।

    অফটপিক/ কলিকাল ইমো- একটি দুষ্টুমীর কথা। এপারে ব্লগের অপশব্দ।
  • cb | 41.6.140.217 | ০৯ মার্চ ২০১৩ ১৯:২৯582910
  • বিপ্লবদা, আপনি ভাল করে কাজ করুন, অনেকে আপনাদের চোখ দিয়ে বাংলাদেশ দেখছে
  • a | 132.179.41.213 | ০৯ মার্চ ২০১৩ ১৯:৫১582911
  • এটা ভাটই হচ্ছে!!! কে কার পিছন মেরেছে, সেই আলোচনা!!! মাইরি টাইমপাসেরও লিমিট আছে!! তাও যদি নিরপেক্ষ ডকুমেন্টরি হত!!!
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৯ মার্চ ২০১৩ ২০:৩১582912
  • # cb তাই? অনেক ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্য আমাকে উৎসাহ যোগাচ্ছে।

    চলুক।
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৯ মার্চ ২০১৩ ২০:৩৭582913
  • # a,

    আপনি ঠিক বলেছেন। টইয়ে এই রকম একজন "বিবেক" থাকা খুব দরকার। এতোদিন কোথায় ছিলেন ভাই? :পি
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ১০ মার্চ ২০১৩ ১৬:৪৭582531
  • সংগ্রাম পরিষদ' গড়ে উঠতে থাকল
    তোফায়েল আহমেদ
    ________________________________
    ১৯৭১-এর ৯ মার্চ ছিল মঙ্গলবার। এদিন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বর্ষীয়ান মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী দ্ব্যর্থকণ্ঠে বলেন, 'শেখ মুজিব নির্দেশিত মার্চের মধ্যে কিছু না হলে আমি তাঁর সাথে মিলে ১৯৫২ সালের ন্যায় আন্দোলন শুরু করব।' তিনি বক্তৃতায় জেনারেল ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে আরো বলেন, 'অনেক হয়েছে, আর নয়। তিক্ততা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। লা-কুম দ্বী-নুকুম, ওয়ালিয়া দ্বীন (অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার)।' পল্টনের জনসভায় মওলানা ভাসানীর এ বক্তব্যের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে টেলিফোনে তাঁদের দীর্ঘ আলাপ হয়।

    একই দিন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের বৈঠকে 'স্বাধীন বাংলাদেশ' প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। সভায় কয়েক দিনের আন্দোলনে নিহতদের, বিশেষ করে ছাত্রলীগের নেতা ফারুক ইকবালসহ অন্যদের স্মরণে এক শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে ৯ মার্চ সারা দেশ ছিল অচল। সরকারি-আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস-আদালতের কর্মীরা হরতাল পালন করেন। যেসব অফিস জরুরি প্রয়োজনে খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সেসব অফিস নির্দেশ অনুযায়ী খোলা ছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো সরকারি, বেসরকারি ও বাসাবাড়িতে কালো পতাকা উড্ডীন ছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের নির্দেশে ব্যাংক-বীমা দপ্তরগুলো সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত খোলা ছিল এবং এ সময়ে কড়া নজরদারি ছিল, যাতে কোনো টাকা-পয়সা পশ্চিম পাকিস্তানে চালান হতে না পারে।

    বরাবরের মতো প্রতিদিন সকাল হলেই আমরা ৩২ নম্বরে চলে যেতাম এবং নেতার নির্দেশ মোতাবেক দায়িত্ব বুঝে নিয়ে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়তাম। অসহযোগ আন্দোলনের সার্বিক কাজের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পুরো ঢাকা শহরে ছুটে বেড়াতে হতো। ওই সময়ে নির্বিঘ্নে এসব কাজ সম্পাদনের জন্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম আমাকে একটি গাড়ি দিয়েছিলেন। সেই গাড়িতে করে ছুটে বেড়াতে হয়েছে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। গাড়ির পেছনে একটা ব্যাগ থাকত। সময়টাই এমন ছিল যে কখন কোথায় কী অবস্থায় পড়তে হয় এর কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'ওরা প্রস্তুত হচ্ছে। আমরাও প্রস্তুতি নিচ্ছি। ওদের সময়ের প্রয়োজন। আমাদেরও সময়ের প্রয়োজন। যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে।' আমার এখনো মনে পড়ে ৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন, 'এখন অনেক খেলা হবে। অনেক ষড়যন্ত্র চলবে। আমাদের প্রত্যেককে সজাগ থাকতে হবে এবং যেকোনো মূল্যে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে হবে।' ষড়যন্ত্রের খেলা শুরু হয়েছিল সেটা সুস্পষ্ট হয় ৮ মার্চ। সামরিক বিধি পরিবর্তন করে আসন্ন গণহত্যা সংঘটনে বেলুচিস্তানের কসাইখ্যাত টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। সরকারি মাধ্যম থেকে একদিকে প্রচার করা হচ্ছে সমস্যা সমাধানে অচিরেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা সফরে আসছেন। অন্যদিকে বাঙালি নিধনে কসাই নিয়োগ করা হচ্ছে। রাজশাহীতে অকারণেই সান্ধ্য আইন জারি করে শান্তিপ্রিয় জনসাধারণকে উসকানির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

    অসহযোগ আন্দোলনে নিহত-আহতদের পরিবারকে সাহায্যের জন্য বঙ্গবন্ধুর ডাকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিদিন অর্থ-খাদ্য-রক্ত সাহায্য দিতে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিস এবং মেডিক্যাল কলেজগুলোর সামনে লাইন দিচ্ছে। তত দিনে ঢাকা শহরসহ দেশের প্রায় ৬০-৭০টি স্থানে গোপন এবং প্রকাশ্য সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের মূল কাজ ছিল ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়া। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ছাত্র-যুবকদের স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার জন্য কমিটি করতে সহায়তা করতে হতো। সে সময় এসব কাজে ছাত্রলীগের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ছাত্র-যুবসমাজের মধ্য থেকে যারা আমাদের কাছে এসেছে তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশাবলি স্মরণ করিয়ে দিতাম। কারণ বঙ্গবন্ধু আমাদের শুরু থেকেই বলেছিলেন, 'কোনোরূপ উসকানির মুখেও হঠকারিতা নয়; আমাদের অসহযোগ কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ। ওদের উসকানিমূলক কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না।' আমরা কর্মীদের সেসব সবিস্তারে বুঝিয়ে বলে তা মেনে চলার পরামর্শ দিতাম। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ তখন অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছে। খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম কিভাবে একজন নেতা যৌথতার মধ্য দিয়ে অভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। নেতার নির্দেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সারা দেশে প্রতিদিন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে 'সংগ্রাম পরিষদ' গড়ে উঠতে থাকল এবং আমরাও এগিয়ে যেতে থাকলাম স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণটির দিকে।

    http://www.kalerkantho.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=09-03-2013&type=gold&data=news&pub_no=1176&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=13
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ১০ মার্চ ২০১৩ ১৬:৫০582532
  • অগ্নিঝরা মার্চ
    ঢাকা পরিণত হয় কালো পতাকার শহরে
    তোফায়েল আহমেদ
    ___________________________________________
    আজ ১০ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিন ছিল বুধবার। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ৭ মার্চে সূচিত পূর্বঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তৃতীয় দিবস। সর্বাত্মক অসহযোগে কার্যত পুরো দেশ অচল হয়ে পড়ে। রাজধানী ঢাকায় সরকারি, আধাসরকারি বিভাগের কর্মচারীরা অফিসে অনুপস্থিত থাকেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী বেসরকারি অফিস, ব্যবসাকেন্দ্র খোলা থাকে। স্টেট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সরকারি ট্রেজারিসহ বিভিন্ন ব্যাংক বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী খোলা থাকে। স্বাধিকার আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ঢাকা নগরীর সব বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, বাসভবন, এমনকি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবন এবং রাজারবাগ এলাকায় অবস্থিত পুলিশ বিভাগের অফিসগুলোর শীর্ষেও কালো পতাকা উত্তোলিত ছিল। নগরীর বিভিন্ন সড়কে যানবাহনে কালো পতাকা ছিল। পুরো ঢাকা নগরী যেন কালো পতাকার শহরে পরিণত হয়েছিল। এদিন নারায়ণগঞ্জের সাব জেলের ২২৩ জন কয়েদি পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে দুজন নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। বিগত ৩ ও ৪ মার্চে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে যারা আহত হয়েছিল, এই দিনে তাদের মধ্যে এক কিশোর চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদের মৃত্যুবরণ করে।

    দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি দেশবাসীকে জানানোর জন্য বঙ্গবন্ধু একটি বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই আজ শেষ কথা। বাংলাদেশের জনগণের নামে আমরা যে নির্দেশ দিয়েছি, সেক্রেটারিয়েটসহ সরকারি ও আধাসরকারি অফিস-আদালত, রেলওয়ে, স্থল ও নৌবন্দরে তা পালিত হচ্ছে। যারা মনে করেছিল, শক্তির দাপটে আমাদের ওপর তাদের মত চাপিয়ে দেবে, বিশ্বের কাছে আজ তাদের চেহারা নগ্নভাবে ধরা পড়েছে। বিশ্ব জনমতের কাছে তারা বাংলার নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর শক্তির নগ্ন প্রয়োগের যৌক্তিকতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। এ সত্ত্বেও বিবেকবর্জিত সেই গণবিরোধী শক্তি সশস্ত্র পথই অনুসরণ করে চলছে। তাদের সমরসজ্জা অব্যাহত। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনীর লোকজন ও অস্ত্রশস্ত্র আসছে। রাজশাহী ও রংপুরে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে। বিনাশী শক্তির এ সমাবেশ ঘটিয়েও মনোবাঞ্ছা তাদের পূরণ হয়নি। তাই ক্ষমতাসীন চক্র এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর মারণ আঘাত হানার চক্রান্তে মেতে উঠেছে। সর্বত্র এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বিদেশি বিশেষজ্ঞদেরও তারা ভীতসন্ত্রস্ত করে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করছে। যাবতীয় কাজকর্ম আজ বন্ধ। এমনকি বন্যাদুর্গত এলাকার রিলিফ ও পুনর্বাসনের কাজও স্থগিত। ত্রাণপীড়িতদের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে যে সাহায্য এসেছে, বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত তার হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের কর্মচারীদের অপসারণের অনুমতি দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর লোকেরা বিদেশিদের জীবন ও ধনসম্পত্তি কতটা বিপন্ন করে তুলেছে, মহাসচিবের এমন উদ্যোগে সেই স্বীকৃতি মেলে। জাতিসংঘের সদস্যদের বোঝা উচিত, কেবল জাতিসংঘের সদস্যদের অপসারণের ব্যবস্থা করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কারণ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ওপর গণহত্যার হুমকি। বাংলার মানুষকে গণহত্যার হুমকির মুখে ফেলে রাখা জাতিসংঘ ঘোষিত মৌলিক মানবাধিকার সনদ লঙ্ঘনের শামিল।'

    ৯ মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট এক দাপ্তরিক আদেশে ঢাকার উপ-আবাসিক প্রধান হের কার্লফিৎজ উলফকে প্রয়োজন মনে করলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র স্থানান্তরের ক্ষমতা দেন। জাপান সরকার ঢাকায় অবস্থিত তাদের ১৫০ জন নাগরিককে স্বদেশে ফেরত নেওয়া এবং জার্মান সরকার তাদের নাগরিকদের ব্যাংককে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
    বঙ্গবন্ধু বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতি প্রকৃত ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে ধানমণ্ডির বাসভবনে লন্ডন টাইমস পত্রিকার সাংবাদিককে বলেন, 'সাত কোটি বাঙালি আজ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন এবং যেকোনো মূল্যে এ অধিকার আদায়ে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ পর্যন্ত বাঙালিরা বহু রক্ত দিয়েছে। এবার বাঙালিরা এ রক্ত দেওয়ার পালা শেষ করতে চায়।' বর্তমান গণবিক্ষোভের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'সাত কোটি বাঙালি আজ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি চায়। এ ব্যাপারে তারা কোনো আপস করতে রাজি নয়। ২৩ বছর ধরে এ দেশকে শাসক ও শোষক শ্রেণী কলোনি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বাঙালিরা আজ শাসন ও শোষণের অবসান চায়। খাদ্য সমস্যা সমাধানসহ দেশ ও জনগণের স্বার্থে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রণয়ন করার ক্ষমতা বাঙালিদের নেই। দেশের জনসাধারণ আজ অমানুষিক ও দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। বাংলার মানুষের এসব বিষয় বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরুন।'

    এদিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক প্রদান ও তাহরিখ-ই-ইশতিকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান এদিন করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনবার দেখা করেন এবং উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একান্তে আলোচনা করেন। ঢাকা ত্যাগের সময় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'শেখ মুজিবের ওপর কোনো ধরনের দোষ দেওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না। তিনি সঠিক এবং ন্যায্য ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ছাড়া তাঁর পক্ষে অন্য কোনো ভূমিকা নেওয়া সম্ভব নয়। আমি তাঁর এ অবস্থানকে সমর্থন করি।' বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির প্রতি আসগর খানের সমর্থনসূচক উক্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতারাও তাঁদের মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করেন। ন্যাপের প্রধান ওয়ালী খান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ১৩ মার্চ ঢাকা আসার ঘোষণা দেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি বলেন, 'যদি আমরা পরিষদে না যাই, তবে বুঝতে হবে, আমরা পরোক্ষভাবে ওই সব শক্তিকেই সমর্থন করছি, যারা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় না।' এ সময় তিনি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন, 'ক্ষমতা যাতে হস্তান্তর করা যায়, সে জন্য প্রথমেই আমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের চেষ্টা করতে হবে।'

    একই দলের নেতা মীর গাউশ বখস বেজেঞ্জো জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত চারটি শর্ত মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি তাঁর বিবৃতিতে বলেন, 'শেখ মুজিবের প্রস্তাবগুলোতে শুধু পূর্ব পাকিস্তানেরই নয় বরং সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান এবং পাঞ্জাবের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন ঘটেছে। কোনোভাবেই কল্পনাবিলাসের দ্বারা শেখ মুজিবের প্রস্তাবগুলোকে জাতীয় অখণ্ডতা বা সংহতির জন্য ক্ষতিকর বলা যাবে না।'

    কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি মিয়া মোহাম্মদ খান দৌলতানা এক সংবাদ বিবৃতিতে বলেন, 'একতরফা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, প্রেসিডেন্টকে তা শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করে দূর করতে হবে। তা ছাড়া সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দ্রুত ব্যবস্থাও নিতে হবে।' কাউন্সিল মুসলিম লীগের আরেক বিশিষ্ট নেতা জেড এইচ লারি এক বিবৃতিতে বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার যে দাবি উত্থাপন করেছেন, তা অবিলম্বে মেনে নেওয়া উচিত।' পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এদিন ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত চারটি শর্ত মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। ঢাকায় ন্যাপ (ভাসানী) ও ন্যাপ (মোজাফ্ফর), বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবীদের সংগঠনসমূহ অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল করে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে মিলিত হতে থাকে। যেন এটাই বাঙালির ঠিকানা।

    এদিনে বেলুচিস্তানের কসাইখ্যাত জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ নেন। এ জন্য সরকার কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়। বিকেল ৪টায় গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) টিক্কা খানের শপথ নেওয়ার কথা ছিল। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বদরুদ্দীন আহমদ সিদ্দিকীকে আনতে লোক পাঠানো হয়; কিন্তু বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী শপথ পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান এবং টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান ভেস্তে যায়। দেশবাসীর জন্য এটি ছিল একটি বিজয়ের বার্তা। মানুষ এ ঘটনায় ব্যাপকভাবে উল্লসিত হয়েছিল।
    এদিন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেন এবং তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার সিদ্ধান্তেই অফিস-আদালত চালানোর অঙ্গীকার করেন।

    পরিস্থিতি ক্রমেই এমন উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যাতে বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো দ্রব্যসামগ্রী কিনতে না পারে সে জন্যও জনতা সতর্ক প্রহরা বসিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত প্রতিদিনের নির্দেশ সংগ্রামী জনতা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। খুব কাছ থেকে দেখেছি, এ সময় বঙ্গবন্ধু ধীরস্থিরভাবে সবার সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিটি নির্দেশ দিতেন। তিনি যুবসমাজকে সংগঠিত করতে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং আমাকে দায়িত্ব দেন। ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করার দায়িত্ব দেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ এবং আবদুল কুদ্দুস মাখন- এই চার নেতাকে। আর জাতীয় রাজনৈতিক বিষয়, অসহযোগ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি বিষয়ে আলোচনা করতেন জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানের সঙ্গে। আইনগত ও সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা করতেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম প্রমুখের সঙ্গে। প্রশাসনিক বিষয়ে আলোচনা করতেন আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত আসামি সিএসপি আহমেদ ফজলুর রহমান, শামসুর রহমান খান, রুহুল কুদ্দুসের সঙ্গে। এ ছাড়া সাংবাদিক এ বি এম মূসা, এ কে এম আহসানসহ আরো অনেকের সঙ্গে আলোচনা করতেন। জাতীয় অর্থনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করতেন রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমানসহ অন্যদের সঙ্গে এবং আমরা সবাই নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে, উজাড় করে দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালন করতাম। এভাবেই একটি পরিপূর্ণ টিমওয়ার্কের মধ্য দিয়ে একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সংকটকালীন সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সফলভাবে অতিক্রম করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু সর্বদাই ছিলেন নীতির প্রশ্নে অটল-অবিচল এবং নীতি বা কৌশল প্রণয়নে সবার সঙ্গে আলোচনা করে তবেই সিদ্ধান্ত নিতেন।

    http://www.kalerkantho.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=10-03-2013&type=gold&data=news&pub_no=1177&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=15
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.29 | ১২ মার্চ ২০১৩ ০৮:০৬582533
  • অগ্নিঝরা মার্চ
    সবাইকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো কাজ করতে বলেন ভাসানী
    তোফায়েল আহমেদ
    _____________________________________
    [মার্চ ১১]। একাত্তরে মার্চের এদিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। হাইকোর্টের বিচারপতিসহ সরকারি-আধাসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা তাঁদের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অফিস বর্জন করেন। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো, অসহযোগ সমর্থনকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংস্থা, পেশাজীবীগণ, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির সমর্থনে সোচ্চার হয়ে ওঠে। দেশজুড়ে মানুষের মনে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের অবিচল সংগ্রামী মনোভাব বিরাজ করতে থাকে। এদিন বর্ষীয়ান মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলে এক জনসভায় সব রাজনৈতিক পক্ষকে উদ্দেশ করে বলেন, 'সাত কোটি বাঙালির নেতা শেখ মুজিবের নির্দেশ পালন করুন।'
    অন্যদিকে জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান সামরিক সরকারের উদ্দেশে এক বিবৃতিতে বলেন, 'এক রাষ্ট্রের জোয়ালে আবদ্ধ না থাকলেও দুটি স্বাধীন ভ্রাতৃরাষ্ট্র হিসেবে আমরা পরস্পরের এবং বিশ্বের এই অংশের সমৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারব।'
    ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। পাঞ্জাব প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব খুরশীদ হক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে বৈঠক করেন। বৈঠকে জনাব খুরশীদ আগের দিন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর বৈঠকের বিস্তারিত বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কাম্বেলপুর থেকে নির্বাচিত কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা পীর সাইফুদ্দীন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেন।
    এদিন ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের উপ-আবাসিক প্রতিনিধি কে. উলফ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে যত দিন খুশি বাংলাদেশে থাকার অনুরোধ করে বলেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশে গণহত্যা চালানোর পাঁয়তারা করছে।'
    এদিকে সদ্য ঢাকা ত্যাগ করে এয়ার মার্শাল আসগর খান করাচি প্রত্যাবর্তন করে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, 'কুর্মিটোলায় ক্যান্টনমেন্ট ব্যতীত অন্য কোথাও পাকিস্তানের পতাকা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। কার্যত পূর্ব পাকিস্তানে প্রশাসনের সচিব ও কর্মকর্তারা শেখ মুজিবের নির্দেশ পালন করে চলছেন। সরকারের এখন উচিত শেখ সাহেব প্রদত্ত শর্তগুলো মেনে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।'
    পুরো পাকিস্তানের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল বাস্তবতা উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সমর্থনসূচক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলেও জনাব ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার কিছু বশংবদ রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধুকে ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন না করে আপস-সমঝোতার জন্য বিভিন্নভাবে চাপ দিতে থাকেন। এমতাবস্থায় আজ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান ঢাকায় আগমন করেন।
    এদিন বিচারপতিসহ সব বিভাগের কর্মচারীরা অফিস-আদালত বর্জন অব্যাহত রাখেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী সবকিছু চলতে থাকে।
    বরিশালে এদিন কারাগার ভেঙে ২৪ জন কয়েদি পালিয়ে যায় এবং পুলিশের গুলিতে দুজন নিহত ও ২০ জন আহত হয়। কুমিল্লায়ও অনুরূপ ঘটনায় পুলিশের গুলিতে পাঁচজন নিহত ও শতাধিক লোক আহত হয়। বিগত কয়েক দিনের মতো আজও বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী নিহত ও আহতদের সাহায্যার্থে গঠিত সাহায্য তহবিলে অর্থ সাহায্য দেন।
    স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃচতুষ্টয় এক বিবৃতিতে সামরিক সরকার প্রদত্ত যাবতীয় খেতাব ও উপাধি বর্জনের আহ্বান জানান। সামরিক বাহিনীর চলাচলের ব্যাপারে জনসাধারণকে সহযোগিতা না করার অনুরোধ করেন এবং প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার আগে ছাত্রনেতৃবৃন্দ শর্তারোপ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার আগে ইয়াহিয়া প্রদত্ত ৬ মার্চের বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে।
    আর বঙ্গবন্ধু নীতির প্রশ্নে অবিচল থেকে প্রতিদিন একের পর এক নির্দেশ জারি অব্যাহত রাখেন। জনসাধারণের নামে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ স্বাক্ষরিত নতুন নির্দেশ জারি করা হয়। আর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সানি্নধ্যে থেকে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অবলোকনের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
    আজ যখন স্মৃতির পাতা থেকে সে সব ঘটনা স্মরণ করি কেবলই মনে হয়, সবাইকে ঘিরে সূর্যের মতো দেদীপ্যমান এই মহান মানুষটি গভীর সংকটকালেও হাস্যোজ্জ্বল মুখে সবাইকে সময় দিয়েছেন। আন্তরিকভাবে সবার কথা শুনেছেন এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে অগ্রসর হয়েছেন।

    http://www.kalerkantho.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=11-03-2013&type=gold&data=news&pub_no=1178&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=13
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.29 | ১২ মার্চ ২০১৩ ০৮:২৪582534
  • অগ্নিঝরা মার্চ
    সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করি আমরা
    তোফায়েল আহমেদ
    ____________________________________________________
    রক্তঝরা উত্তাল অসহযোগ আন্দোলনের আজ ছিল দ্বিতীয় পর্যায়ের পঞ্চম দিন। ১৯৭১-এর ১২ মার্চ ছিল শুক্রবার। নজিরবিহীন ও সর্বাত্মক অসহযোগ চলছে। এমনকি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগকেও তা ছাপিয়ে যায়। এদিন আমরা যুবসমাজ ও ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করি। প্রতিদিন সকাল-বিকেল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে রিপোর্ট করি এবং তাঁর পরবর্তী নির্দেশনা নেই। এ দিন বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, ওরা কালক্ষেপণ করছে। ওদের সময় দরকার, আমারও সময় প্রয়োজন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রতিদিন সৈন্য ও অস্ত্র আনছে ঢাকায়। তোমরা তোমাদের কাজ চালিয়ে যাও।
    আমার এখনো মনে পড়ে, ১৭ ফেব্রুয়ারির কথা। বঙ্গবন্ধু আমাদের ডেকেছেন তাঁর বাসভবনে। আমরা চারজন। শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং আমি। সেখানে আরো ছিলেন জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এইচএম কামারুজ্জামান। আমাদের কাছে বসিয়ে চারজনকে উদ্দেশ করে বললেন, 'আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তোমরা কলকাতার এই ঠিকানাটা মুখস্থ করো।' তখন একটি কাগজ-কলম নিয়ে তাতে একটা ঠিকানা লিখে আমাদের বললেন, 'এই ঠিকানাটা তোমরা মুখস্থ করো।' আমার এখনো মনে আছে, "২১ নং রাজেন্দ রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।' এবং বললেন, 'এইটা হবে তোমাদের ঠিকানা। আমি জানি, ওরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। আমাদের সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে।' অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধু আমাদের সহকর্মী জাতীয় পরিষদ সদস্য ডা. আবু হেনাকে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন এই ঠিকানায় সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না। তিনি যে পথে সে সময় কলকাতার এ ঠিকানায় গিয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঠিক সে পথেই আবু হেনা আমাদের কলকাতার ওই ঠিকানায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষারত ছিলেন শ্রী চিত্তরঞ্জন সুতার। তিনি জাতীয় পরিষদ সদস্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে আগেই সেখানে পাঠিয়েছিলেন। অর্থাৎ আগে থেকেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য বঙ্গবন্ধুর সার্বিক প্রস্তুতি ছিল। অসহযোগ পালনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও নির্দেশে বাংলার মানুষ আসন্ন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সেই যুদ্ধ প্রস্তুতিই নিচ্ছিল। প্রতিটি নিরস্ত্র মানুষ সেদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে সশস্ত্র হয়ে উঠছিল।
    এদিকে পাকিস্তানের উভয়াংশের জাতীয় নেতারা রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে বঙ্গবন্ধুর শর্তগুলো মেনে নেওয়ার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি জোর দাবি জানান। ঢাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে ইশতেকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান টানা তৃতীয় দিনের মতো আজও লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'পশ্চিমাঞ্চলের কিছু লোক বলছে, পূর্ব পাকিস্তান যখন যাবেই তখন যত দ্রুত যায় ততই মঙ্গল।' তিনি এসব কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের উদ্দেশ করে বলেন, 'তারা ভেবে দেখেছেন কী, এ পন্থায় তারা রোগীর মৃত্যুকাল উপস্থিত ভেবে তাকে গলা টিপে হত্যা করার পরামর্শ দিচ্ছেন। দেশকে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষায় এই পরিস্থিতিতে অবিলম্বে প্রথম ফ্লাইটেই প্রেসিডেন্টের উচিত ঢাকায় গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুজিবের দেওয়া সব শর্ত মেনে নেওয়া। আমি শেখ সাহেবের ঐতিহাসিক বক্তৃতার পর ঢাকা গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পরিস্থিতি দেখে এসেছি।' বিগত ১০ বছরের পাকিস্তানের রাজনীতির বিস্তারিত তুলে ধরে তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দুবার নিজেই নিজের বিধান লঙ্ঘন করেছেন। এখন সংকট যেভাবে ঘনীভূত হয়েছে তাতে শেখ মুজিব ব্যতীত অন্য কেউ-ই এ সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে পারবে না।' পরিশেষে তিনি তাঁর বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর কথার প্রতিধ্বনি করে বলেন, 'দোষ করলো লাহোর আর গুলি চলল ঢাকায়।' অপরদিকে ন্যাপ (পিকিংপন্থী) সেক্রেটারি জেনারেল সি আর আসলাম সংবাদপত্রে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, 'কোনো দেশপ্রেমিকই শেখ মুজিবের শর্তের বিরোধিতা করতে পারে না।' রাজনৈতিক সংকটের জন্য তিনি ভুট্টোকে দায়ী করে বলেন, 'দেশের সংকটের জন্য একচেটিয়া পুঁজিপতি ও আমরাই দায়ী। ভুট্টো ৩রা মার্চের অধিবেশনে যোগদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করার কারণেই এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।' জাতীয় লীগ সভাপতি আতাউর রহমান খান আজ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এক বৈঠকে মিলিত হন। ময়মনসিংহে এক জনসভায় মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী এ দিনও বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন, 'পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের মুখে লাথি মেরে শেখ মুজিবুর রহমান যদি বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলনে সঠিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হন, তবে ইতিহাসে তিনি কালজয়ী বীররূপে, নেতারূপে অমর হয়ে থাকবেন।' এদিন বিবিসির সংবাদে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আগামী শনিবার রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে আলাপ-আলোচনার জন্য ঢাকা আসছেন।
    এদিকে দেশের সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে মিছিল সহকারে ধানমণ্ডির বাসভবনে আসতে থাকে। সারা দিন এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত সংগ্রামী জনতা বিভিন্ন স্লোগান ধ্বনিতে চারদিক প্রকম্পিত করতে থাকে। এদিন অন্তত দেড় শতাধিক মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে আসে এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। নেতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরকারি আধা সরকারি কর্মচারীরা ঐক্যবদ্ধভাবে অফিস-আদালত বর্জন করে। জনসাধারণ খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দিয়ে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে নবতর অধ্যায়ের সূচনা করে। যথারীতি আজও সারা ঢাকা শহর স্বাধিকার আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে কালো পতাকার শহরে পরিণত ছিল। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকেই সরকার প্রদত্ত খেতাব বর্জন শুরু করেন। জাতীয় পরিষদ সদস্য জহিরউদ্দীন তাঁর "তমঘায়ে হেলাল কায়েদে আজম" খেতাব বর্জনের ঘোষণা দেন। বিশিষ্ট সংবাদ পাঠক সরকার কবীরউদ্দীন রেডিও পাকিস্তান বর্জনের ঘোষণা দেন। এক কথায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশবাসী যে যার অবস্থানে থেকে তাদের অংশগ্রহণ চালিয়ে যেতে থাকে।
    এ ছাড়া স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কাছে কোনো ধরনের তেল-জ্বালানি দ্রব্য বিক্রি না করতে ব্যবসায়ীদের প্রতি ছাত্র নেতারা আহ্বান জানান। এ দিন শহীদদের স্মৃতিতে শোক পালনরত দেশবাসীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে দেশের ১৯টি প্রেক্ষাগৃহের মালিক তাদের সিনেমা হলগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং বঙ্গবন্ধু ঘোষিত আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে ১৩ হাজার ২৫০ টাকা দান করেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত পেশাজীবী, সাংবাদিক সমাজ, চারু ও কারুশিল্পী সবাই মিছিল সহকারে শহীদ মিনার এসে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। এ দিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে, সিএসপি ও ইপিসিএস কর্মকর্তাদের সংগঠন পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম শ্রেণীর প্রশাসকরা এক সভায় মিলিত হয়ে বলেন, 'এখন থেকে আমরা জননেতা শেখ মুজিবের সব নির্দেশ মেনে চলব' এবং এ মর্মে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। গত কয়েক দিনের মতো এ দিনও বগুড়ার কারাগার ভেঙে ২৭ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। পুলিশের গুলিবর্ষণে এ দিনও একজন নিহত ও ১৬ জন আহত হয়।
    অসহযোগের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধীরা যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে না পারে, সে জন্য গত রাত থেকে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যে তৎপরতা শুরু করে তা সর্বমহলের প্রশংসা অর্জন করে। একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন জায়গায় লুটতরাজ শুরু করলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সে জন্য রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পথঘাট ও বিপণিকেন্দ গুলোর সামনে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী অবস্থান গ্রহণ করে এবং পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কার্যত পুরো দেশে তখন আমাদেরই কর্তৃত্ব বহাল হয়। তখন মানুষ আমাদের প্রতি এত ভালোবাসা, দরদ আর সহানুভূতিসম্পন্ন মনোভাব প্রকাশ করেছে, যা ভাষায় বর্ণনাতীত। আমাদের কর্মসূচি পালনকালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশানুযায়ী আমরা যেমন নিজেদের উজাড় করে দিয়েছি, ঠিক তেমনি সর্বস্তরের সাধারণ মানুষও আমাদের প্রতি সশ্রদ্ধ মনোভাব প্রকাশ করেছে এবং সর্ব কাজে আমাদের সাধ্যমতো সর্বোচ্চ সাহায্য করেছে। বঙ্গবন্ধু যেমন আমাদের সবাইকে আস্থায় নিয়েছিলেন, আমরাও তেমনি সংগ্রামী জনতার সঙ্গে আন্তরিকভাবে মিশে গিয়েছিলাম। জনসাধারণও আমাদের আপন করে নিয়েছিলেন। সেদিনের প্রতিটি দিনই ছিল বৈপ্লবিক। আর এ বিপ্লবের প্রধান সমন্বয়ক তথা সর্বাধিনায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অসীম ধৈর্যশক্তি আর সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার অপার দক্ষতা তাঁর কাজে পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছিল। এ আন্দোলন সংগঠিত করতে তিনি আশপাশের সব দক্ষ ব্যক্তিকেই সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগিয়েছেন। প্রত্যেকের পরামর্শকেই গুরুত্ব ও মনোযোগ সহকারে শুনে, এরপর নিজে বুঝে যাচাই করে নিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াটি ছিল যৌথতার ভিত্তিতে নেওয়া যৌক্তিক এবং গণতান্ত্রিক। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখব তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কোনো ভুল ছিল না। আর তাই তো তিনি এই অসহযোগ চলাকালেই জনপ্রিয়তার চরম শিখরে উন্নীত হয়েছিলেন; আসীন হয়েছিলেন বাঙালি জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায়।

    http://www.kalerkantho.com/?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1179&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=11
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.31 | ১৪ মার্চ ২০১৩ ০৯:২৩582535
  • অগ্নিঝরা মার্চ
    বিদেশিরা ঢাকা ছাড়তে থাকে, যা ছিল আসন্ন গণহত্যার ইঙ্গিতবাহী
    তোফায়েল আহমেদ
    __________________________________________________
    একাত্তরের ১৩ মার্চ ছিল শনিবার, অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের ষষ্ঠ দিন। যথারীতি আজও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারি, আধাসরকারি অফিস-আদালত কর্মচারীদের অনুপস্থিতির জন্য বন্ধ থাকে। বেসরকারি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ চলে বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ানুযায়ী।
    স্বাধিকার আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে শোক এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহির্প্রকাশে আজও সর্বত্র কালো পতাকা উত্তোলিত থাকে। এ দিন সিএ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, নৌপরিবহন, ডক, পাটকল ও সুতাকলের শ্রমিক সংগঠন এবং ছাত্র ইউনিয়ন বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হল প্রাঙ্গণে পরিষদের সব আঞ্চলিক শাখার আহ্বায়ক, সম্পাদক ও সদস্যদের সভা আহ্বান করে। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রলীগ লালবাগ আঞ্চলিক শাখার সভা। স্বাধীন বাংলাদেশের দাবিতে নিউজপেপার প্রেস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের একটি বিশাল মিছিল নগরীর প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ শেষে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আসে।
    দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণের দিকে ধাবমান- এ উপলব্ধি থেকে আজ ৪৫ জন জাতিসংঘ কর্মীসহ ২৬৫ জন বিদেশি নাগরিক ঢাকা ত্যাগ করেন। ক্রমান্বয়ে বিদেশিদের দেশত্যাগ ছিল ঢাকায় আসন্ন গণহত্যার ইঙ্গিতবাহী।
    অন্যদিকে পুরো পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপলস পার্টি এবং কাইয়ুম মুসলিম লীগ ব্যতীত অন্য সব রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্বকারী সংখ্যালঘু দলগুলোর যৌথ সভা আজ লাহোরে অনুষ্ঠিত হয়। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা মাওলানা মুফতি মাহমুদের সভাপতিত্বে এ সভায় উপস্থিত ছিলেন কাউন্সিল লীগ নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা এবং সরদার শওকত হায়াৎ খান, জমিয়তে ওলামায়ে পাকিস্তানের শাহ আহমেদ দূররানী, জামায়াতে ইসলামীর আবদুল গাফুর, কনভেনশন লীগের জামাল মোহাম্মদ কোরেজা, জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সদস্য মাওলানা জাফর আহমেদ আনসারী এবং সরদার মাওলা বঙ্ সুমরো। সভায় ওয়ালী ন্যাপের কোনো প্রতিনিধি না থাকলেও তাঁরা সভার সিদ্ধান্তের প্রতি ঐকমত্য জানান। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্বকারী সংখ্যালঘু দলগুলোর সিদ্ধান্তে বলা হয়, 'বর্তমান সংকটের মূল কারণ পারস্পরিক অবিশ্বাস। আমরা মনে করি, অবিলম্বে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় গিয়ে সব অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ও মতদ্বৈধতা দূর করে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে এনে আন্তরিকভাবে ও মুক্ত মনে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চারটি শর্ত মেনে নিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু করবেন। এবং অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে যথাযথ পরিবেশ তৈরি করবেন।' সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় নেতারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে বসতে বাধ্য করেছিলেন এ সভায় গৃহীত প্রস্তাবটি এতদ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
    এদিকে বঙ্গবন্ধুও জাতীয় ঐকমত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আলোচনার দরজা খোলা রাখেন। যেন কোনো মহল স্বাধিকার সংগ্রামের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ তুলতে না পারে। আবার ছাত্র-যুব নেতাদেরও নির্দেশ দিয়ে রাখেন সারা দেশে 'সংগ্রাম পরিষদ' গড়ে তুলতে। কারণ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ধারণা করতে পেরেছিলেন যে পাকিস্তানি সেনাশাসকরা ষড়যন্ত্রের পথেই এগিয়ে যাবেন। আজ যখন ফেলে আসা জীবনের রত্নখচিত সংগ্রামমুখর গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলোর কথা স্মরণ করি তখন ভেবে শিহরিত হই- কতটা দূরদর্শী নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
    এমনই পরিস্থিতিতে সামরিক সরকার নয়া এক ফরমান জারি করে প্রতিরক্ষা খাতের বেতনভুক্ত বেসামরিক কর্মচারীদের ১৫ মার্চের মধ্যে কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে হুঁশিয়ারি দেয়, এই আদেশ অমান্য করলে ছাঁটাই করা হবে। পলাতক হিসেবে সামরিক আদালতে বিচারও হতে পারে। আর এই ফরমানের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, নতুন করে এমন আদেশ জারি জনগণকে উসকানিদানের শামিল। জনসাধারণকে এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।
    আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সব আদেশ-নির্দেশ ও দিকনির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে অসহযোগ আন্দোলনকে সর্বাত্মক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়েছি।

    http://www.kalerkantho.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=13-03-2013&type=gold&data=news&pub_no=1180&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=18
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.31 | ১৪ মার্চ ২০১৩ ০৯:৩৮582537
  • অগ্নিঝরা মার্চ
    সামরিক ফরমানের জবাবে নতুন নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু
    তোফায়েল আহমেদ
    _____________________________________________
    সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এবং জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুর ডাক দেওয়া অহিংস অসহযোগের আজকের দিনটিতেও ঢাকাসহ সারা দেশ থাকে উত্তাল। ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ ছিল রবিবার, ছিল অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সপ্তম দিন। সামরিক সরকারের গতকাল জারি করা ফরমানের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীসহ সারা দেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিক এমপ্লয়িজ অব পাকিস্তানের সমন্বয় কাউন্সিলের সভায় অবিলম্বে এই সামরিক ফরমান বাতিলের দাবি ওঠে। সভা শেষে একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আসে। এখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে চলমান অসহযোগের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন নেতারা সংহতি প্রকাশ করেন।
    ১৯৭১ সালের এই দিনে সকাল সাড়ে ৯টায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সহসভাপতি ও জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামরুজ্জামান। অন্যদিকে ন্যাপ নেতার সঙ্গে ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক গাউস বক্স বেজেঞ্জো।
    এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাধিকার সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। প্রচুর বিদেশি সাংবাদিক খবর সংগ্রহের জন্য আসতে থাকেন। প্রায় প্রতিদিনই বঙ্গবন্ধু কোনো না কোনো বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়ে যান।
    এই দিন অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে সর্বসাধারণের উদ্দেশে এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই সঙ্গে তাঁর নতুন নির্দেশ জারি করা হয়, যা ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের ৩৫ নম্বর নির্দেশনামা বলে বিবেচিত। নতুন এই নির্দেশের মাধ্যমে পূর্ববর্তী সব নির্দেশ ও তার ব্যাখ্যাসমূহ এ নির্দেশের অংশ বলে গণ্য হবে এবং এই নির্দেশ আগামীকাল অর্থাৎ ১৫ মার্চ সোমবার থেকে কার্যকর হবে।
    বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। কেননা আগের দিন উসকানিমূলকভাবে সামরিক ফরমান জারির উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে দমিয়ে দেওয়া। ঠিক এর পরের দিনই ওই আইনের বিপরীতে বঙ্গবন্ধুর নতুন নির্দেশ পেয়ে জনগণের মনোবল আরো দৃঢ় ও সংগ্রামী হয়ে ওঠে।
    এদিকে একই দিনে করাচির নিসতার পার্কে এক জনসভায় জুলফিকার আলী ভুট্টো 'এক পাকিস্তান এবং দুই অঞ্চলে দুই দলের হাতে ক্ষমতা' ফর্মুলা উপস্থাপন করেন। অর্থাৎ পূর্বাংশে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিমাংশে পিপলস পার্টি সরকার গঠন করবে। ভুট্টোর এমন প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন ভাওয়ালপুর ইউনাইটেড ফ্রন্টের নেত্রী বেগম তাহেরা মাসুদ। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের যৌক্তিক দাবি ও শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তিনি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। খোদ পশ্চিম পাকিস্তানেও সমালোচনার ঝড় আরো বেগবান হয়। বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতি তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, 'আমি আশা করি, সাংবিধানিক সংকট নিরসনে যত দ্রুত সম্ভব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে জীর্ণ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে আলোচনা শুরু করবেন।'
    কেবল রাজনৈতিক নেতরাই নন, শিল্পপতি-ব্যবসায়ীগণ তাঁদের শিল্প-ব্যবসা চালু রাখার স্বার্থে সরকারকে দেওয়া স্মারকলিপিতে বলেন, 'দেশের অখণ্ডতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বার্থে অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানের চার দফা মেনে নেওয়া হোক।'
    এদিকে চট্টগ্রাম অভিমুখী খাদ্যবাহী জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করে করাচি নিয়ে যাওয়া হয় আর চট্টগ্রামে নোঙর করে অস্ত্রবাহী জাহাজ সোয়াত। এর প্রতিবাদে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এক বিবৃতিতে বলেন, 'আমরা অবিলম্বে এহেন অপকর্মের পূর্ণ তদন্ত দাবি করছি।'
    এমন পরিস্থিতির মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে, ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য আজ ঢাকায় আসছেন। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছিল খাদ্যের বদলে আসছে অস্ত্র। সামরিক শাসকদের গৃহীত এসব ঘটনা ছিল বিশেষ ইঙ্গিতবহ।

    http://www.kalerkantho.com/?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1181&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=7
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.31 | ১৪ মার্চ ২০১৩ ০৯:৩৮582536
  • অগ্নিঝরা মার্চ
    সামরিক ফরমানের জবাবে নতুন নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু
    তোফায়েল আহমেদ
    _____________________________________________
    সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এবং জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুর ডাক দেওয়া অহিংস অসহযোগের আজকের দিনটিতেও ঢাকাসহ সারা দেশ থাকে উত্তাল। ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ ছিল রবিবার, ছিল অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সপ্তম দিন। সামরিক সরকারের গতকাল জারি করা ফরমানের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীসহ সারা দেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিক এমপ্লয়িজ অব পাকিস্তানের সমন্বয় কাউন্সিলের সভায় অবিলম্বে এই সামরিক ফরমান বাতিলের দাবি ওঠে। সভা শেষে একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আসে। এখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে চলমান অসহযোগের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন নেতারা সংহতি প্রকাশ করেন।
    ১৯৭১ সালের এই দিনে সকাল সাড়ে ৯টায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সহসভাপতি ও জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামরুজ্জামান। অন্যদিকে ন্যাপ নেতার সঙ্গে ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক গাউস বক্স বেজেঞ্জো।
    এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাধিকার সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। প্রচুর বিদেশি সাংবাদিক খবর সংগ্রহের জন্য আসতে থাকেন। প্রায় প্রতিদিনই বঙ্গবন্ধু কোনো না কোনো বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়ে যান।
    এই দিন অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে সর্বসাধারণের উদ্দেশে এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই সঙ্গে তাঁর নতুন নির্দেশ জারি করা হয়, যা ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের ৩৫ নম্বর নির্দেশনামা বলে বিবেচিত। নতুন এই নির্দেশের মাধ্যমে পূর্ববর্তী সব নির্দেশ ও তার ব্যাখ্যাসমূহ এ নির্দেশের অংশ বলে গণ্য হবে এবং এই নির্দেশ আগামীকাল অর্থাৎ ১৫ মার্চ সোমবার থেকে কার্যকর হবে।
    বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। কেননা আগের দিন উসকানিমূলকভাবে সামরিক ফরমান জারির উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে দমিয়ে দেওয়া। ঠিক এর পরের দিনই ওই আইনের বিপরীতে বঙ্গবন্ধুর নতুন নির্দেশ পেয়ে জনগণের মনোবল আরো দৃঢ় ও সংগ্রামী হয়ে ওঠে।
    এদিকে একই দিনে করাচির নিসতার পার্কে এক জনসভায় জুলফিকার আলী ভুট্টো 'এক পাকিস্তান এবং দুই অঞ্চলে দুই দলের হাতে ক্ষমতা' ফর্মুলা উপস্থাপন করেন। অর্থাৎ পূর্বাংশে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিমাংশে পিপলস পার্টি সরকার গঠন করবে। ভুট্টোর এমন প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন ভাওয়ালপুর ইউনাইটেড ফ্রন্টের নেত্রী বেগম তাহেরা মাসুদ। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের যৌক্তিক দাবি ও শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তিনি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। খোদ পশ্চিম পাকিস্তানেও সমালোচনার ঝড় আরো বেগবান হয়। বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতি তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, 'আমি আশা করি, সাংবিধানিক সংকট নিরসনে যত দ্রুত সম্ভব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে জীর্ণ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে আলোচনা শুরু করবেন।'
    কেবল রাজনৈতিক নেতরাই নন, শিল্পপতি-ব্যবসায়ীগণ তাঁদের শিল্প-ব্যবসা চালু রাখার স্বার্থে সরকারকে দেওয়া স্মারকলিপিতে বলেন, 'দেশের অখণ্ডতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বার্থে অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানের চার দফা মেনে নেওয়া হোক।'
    এদিকে চট্টগ্রাম অভিমুখী খাদ্যবাহী জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করে করাচি নিয়ে যাওয়া হয় আর চট্টগ্রামে নোঙর করে অস্ত্রবাহী জাহাজ সোয়াত। এর প্রতিবাদে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এক বিবৃতিতে বলেন, 'আমরা অবিলম্বে এহেন অপকর্মের পূর্ণ তদন্ত দাবি করছি।'
    এমন পরিস্থিতির মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে, ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য আজ ঢাকায় আসছেন। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছিল খাদ্যের বদলে আসছে অস্ত্র। সামরিক শাসকদের গৃহীত এসব ঘটনা ছিল বিশেষ ইঙ্গিতবহ।

    http://www.kalerkantho.com/?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1181&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=7
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.31 | ১৪ মার্চ ২০১৩ ০৯:৪৫582538
  • 'এ প্রজন্ম রাজাকারের বিরুদ্ধে জয় নিয়েই ঘরে ফিরবে'
    সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

    'মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। দেশে যত দিন রাজাকার থাকবে, তত দিন মুক্তিযুদ্ধ চলবে। এবার সেই যুদ্ধে জয়ী হতে ময়দানে নেমেছে নতুন প্রজন্ম। জয় নিয়েই তারা ঘরে ফিরবে।' এভাবেই রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহবান জানালেন বাংলাদেশের একমাত্র আদিবাসী খাসিয়া নারী মুক্তিযোদ্ধা কাকাত হেনইঞ্চিতা ওরফে কাকন বিবি।
    বয়সের ভারে নূ্যব্জ ও রোগে কাতর একাত্তরের এই অসহায় বীরাঙ্গনা প্রজন্মের জাগরণে সংহতি জানিয়ে ঘরে বসে থাকা প্রজন্মকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানান। সম্প্রতি গণজাগরণ নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব কথা বলেন তিনি।
    কাকন বিবি বলেন, 'আমি রাজাকারদের ফাঁসি চাই। এবার তাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত যুদ্ধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা বেঁচে গেলেও এই যুদ্ধে তাদের চূড়ান্ত পরাজয় নিশ্চিত করতে হবে।' তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। রাজাকারের ফাঁসি দিয়েই নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ শেষ করবে। রাজাকারের বিরুদ্ধে সবাইকে লড়াইয়ে নামার আহবান জানান তিনি।
    কাকন বিবি বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের সময় ভিক্ষাবৃত্তির ভান করে মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাদের খবর পৌঁছে দিতাম। ওই সময় রাজাকার-আলবদরদের ঘৃণ্য তৎপরতা ও নির্যাতন দেখেছি। তারা পাকিস্তানি আর্মিদের ক্ষিপ্ত করে মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে পাখির মতো গুলি করে মানুষ মেরেছে। মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি করেছে। অপমান সহ্য করতে না পেরে আমাদের অনেক মা-বোন অপমানে আত্মহত্যা করেছেন। সেই অপমান গণহত্যা আর দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার বদলা নেওয়ার সময়ে এসেছে।' রাজাকারদের বিচার এখন সময়ের দাবি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
    খাসিয়া আদিবাসী কাকাত হেনইঞ্চিতা ওরফে কাকন বিবি স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন। ১৯৯৬ সালে সংবাদপত্রে তাঁর দুর্বিষহ ও সংগ্রামী জীবনের সংবাদ প্রকাশিত হলে তিনি প্রচারের আলোয় আসেন। বর্তমানে সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের সীমান্ত গ্রাম জিরাগাঁও গ্রামে একমাত্র মেয়ে সখিনাকে নিয়ে বসবাস করছেন। কাকন বিবি ৫ নম্বর সেক্টরে মীর শওকতের অধীনে গুপ্তচর হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পৌঁছে দিতেন। তিনি প্রায় ২০টি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে তিনি জাউয়া ব্রিজ ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে তিনি ধরা পড়লে তাঁকে নির্মম নির্যাতন করা হয়। লোহা গরম করে ছ্যাঁকা দিয়ে প্রায় সপ্তাহখানেক বিবস্ত্র করে রাখা হয়।
    এই অসহায় সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধাকে ২০১০ সালে জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠ সম্মাননা দেয়।

    http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1177&cat_id=1&menu_id=56&news_type_id=1&index=14&archiev=yes&arch_date=10-03-2013#.UUFMrNZaBrc
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ১৫ মার্চ ২০১৩ ২০:১৬582539
  • ১৯৭১ এর ওপর একটি অসামান্য সংকলন। শিশু-কিশোররা সংগ্রহ করেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। বলা ভালো, কথ্য ইতিহাস। ছোট ছোট টুকরো কথায় ফুটে উঠেছে ভয়াবহ নির্যাতন-নিস্পেষণ, আর প্রতিরোধের গৌরবের লড়াই। জয় বাংলা!

    ____________

    শ্রুতি '৭১
    http://kidz.bdnews24.com/vMag/Sruti71/#/1/
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.6 | ১৬ মার্চ ২০১৩ ১৩:৪৭582540
  • ১৯৭১ সালের ২৫শ মার্চ সর্ম্পকে দৈনিক সংগ্রাম-এর ভূমিকা।
    লিখেছেন: সুব্রত শুভ
    _______________________________________________
    ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহবান জানান। দেশজুড়ে সে সময় চলছিল অসহযোগ আন্দোলন। সবার মুখে কেবল একটিই স্লোগান ‘পদ্মা যমুনা মেঘনা, তোমার আমার ঠিকানা’ এবং ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। বঙ্গবন্ধুর ডাকে যখন সারাদেশের জনগণ স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক সে সময় ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কাপুরুষের মতন রাতের অন্ধকারে বর্বরের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জনগণের উপর। “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে চলে গণহত্যা। তাই অন্য যে কোন দিনের চেয়ে এই দিনটি আমাদের কাছে একটু আলাদা। ঐ দিন শুধু আমাদের হত্যা-ই শুধু করতে চায় নি আমাদের বাঙালিত্ত্বও নষ্ট করার ব্রত নিয়ে তারা অপারেশনে নেমেছিল। বালুচ কসাই হিসেবে খ্যাত ল্যাফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পশ্চিম পাকিস্তানে থেকে এখানে নিয়ে আসা হয় এবং অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়নের জন্য তাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণর নিযুক্ত করা হয়। পৃথিবীর জখন্যতম এই গণহত্যার যেন কোন সাক্ষী না থাকে সেজন্য বিদেশী সাংবাদিকদের ২৬ মার্চ সকালে ঢাকা থেকে বের করে দেয়া হয়। সাংবাদিকদের সকল আলোকচিত্র, প্রতিবেদন ও নোট বই আটক করে একটি বিমানে তুলে দেয়া হয়। তারপরও সাইমন ড্রীং নামে এক সাংবাদিক ঢাকায় লুকিয়ে থেকে গোপনে ছবি ও প্রতিবেদন বিদেশে প্রেরণ করলে ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর মানুষ এই গণহত্যার সর্ম্পকে জানতে পারে। হৈ চৈ পরে যায় বিশ্বব্যাপী। কিন্তু পাকিস্তান সামরিক জান্তার অপর্কম আড়াল করার জন্য দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাবলে; এগুলো কোন গণহত্যার ছবি নয়,’ ৭০ এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের যে অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয় ঘটেছিল এগুলো তারই ছবি। পাকিস্তানিরা যে আমাদের বাঙালিত্ব নষ্ট করতে চেয়েছিল তার প্রমাণ; লেঃ জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী’র উক্তিতেই-

    “ম্যায় ইস হারামজাদী কওম কি নাসল বদল দুঙ্গা (আমি এই জারজ জাতির বংশগতি বদলে দেব। ”

    ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার পর পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে পড়ে। সরকারি পত্রিকা এবং রাজাকার আলবদর কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ হয়। পত্রিকা বন্ধ হওয়ার পরও তৎকালীন সময়েও মিডিয়ার একটি ভূমিকা ছিল। মিডিয়া যে সবসময় স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে ছিল তাও না। পক্ষে বিপক্ষে মিলিয়ে মিডিয়ার ভূমিকা ছিল। আমাদের দেশের পত্রিকার ও পত্রিকার সাংবাদিকরা স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্মথন দিয়েছিল এবং জীবনের ঝুঁকি নয়ে তারা আমাদের জন্য কলমযুদ্ধ করে গিয়েছিলেন। যে সময় বাঙলার বীর সাংবাদিকরা কলম যুদ্ধ করেছিল ঠিক সেই মুহূর্তে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা স্বাধীনতাকামী মানুষের বিপক্ষে, পাকিস্তানীদের পক্ষে মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তমূলক খবর ছাপে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। সে সময়ে দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক ছিলেন-আখতার ফারুক। সাংবাদিকতার নামে দৈনিক সংগ্রামে বীভৎস কুৎসা, মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ২৫ র্মাচের গণহত্যার প্রতিবাদে সারা বাঙলাদেশে ২৭ মার্চ সর্বত্মক ধর্মঘটের ডাক দেয় বাঙলার জন্যগণ- খবর দৈনিক ইত্তেফাক।

    আলী আকবর টবী “২৫শে মার্চ ১৯৭১, মধ্যরাত সম্পর্কে বলেন-

    “ঘুমন্ত ঢাকাবাসী। হিটলার মুসোলিনি চেঙিস খানের উত্তরসুরী ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডের নায়ক ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাক বর্বর বাহিনী নিরস্ত্র নরনারীর উপর ঝাপিয়ে পড়ল আদিম হিংস্রতায়…ফুটপাতে, রাজপথে, বাসে, ট্রাকে, রিক্সায় জমে উঠল মৃত মানুষের লাশ..চারিদিকে শোকের ছায়া…শোকার্ত মানুষ কাজ ভুলে গেল…ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ অফিস তখনও পুড়ছে..এই শাষরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে কোন সংবাদ বের হতে পারল না। এমনকি সরকারী সংবাদপত্রও নয়। কিন্তু এই অস্বাভাবিকতার মাঝও একটি পত্রিকা বের হল। তার নাম দৈনিক সংগ্রাম। স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র আখতার ফারুক সম্পাদিত পত্রিকাতে গতরাতের নারকীয় হত্যাকান্ড, ধ্বংসযজ্ঞ, ধর্ষন ও লুটপাটের কোন খবরই ছাপা হলো না।”

    ২৫শে মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল ও জহরুল হক হল সহ সারা ঢাকা শহরে তারা হত্যাযজ্ঞ চালায়। এক রাতের মধ্যেই ঢাকা শহরকে মৃত্যুকুপ বানিয়ে ফেলে। দৈনিক ইত্তেফাকে গণহত্যা বন্ধ কর নামে হেড লাইনে সংবাদ প্রকাশিত হয়ে এবং ২৭ মার্চে সমগ্র বাঙলাদেশে হরতালের ডাক দেওয়া হয়। অথচ তৎকালীন পাকিস্তানপন্থী ও জামাতী পত্রিকা “দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা”টি র্নিলজ্জভেবে একের পর এক মিথ্যাচার করেছিল। এমন কী বর্বর হত্যাযজ্ঞকেও তারা সাধুবাদ জানাতে ছাড়ে নি।

    ১৯৭১ সালের সেই কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে পাকিস্তানি বাহিনী ভয়াল হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাদের নারকীয় তাণ্ডবের শিকার হন ওই হলের ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মচারী-কর্মকর্তারা। “দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ” থেকে জানা যায় সে রাতে রোকেয়া হলে আগুন ধরানো হয়েছিল এবং ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়ে বের হবার সময় মেশিন গান দিয়ে গুলি করা হয়। ২৬ মার্চ সকালের দিকে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুম ও ৮৮ ইউনিটের মধ্যে যে কথোপকোথন হয় তা থেকে জানা যায় ক্যাম্পাসে প্রায় ৩০০ ছাত্র নিহত হয়। এছাড়াও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নূরুল্লার ধারণকৃত ভিডিওটি ওয়েব সাইটে আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশবিকতার সাক্ষী হয়ে আছে। ভিডিও চিত্রে দেখা যায় ছাত্রদের দিয়েই জগন্নাথ হলের সামনে গর্ত খোড়া হচ্ছে আবার সেই গর্তেই ছাত্রদের লাশ মাটিচাপা দেয়া হচ্ছে। রোকেয়া হল সর্ম্পকে সুইপার ইন্সপেক্টর সাহেব আলী সাক্ষাৎকারে বলেন-

    ২৮ মার্চ সকালে রেডিওতে সকল কর্মচারীকে কাজে যোগদানের চরম নির্দেশ দিলে আমি পৌরসভায় যাই। পৌরসভার কনজারভেন্সি অফিসার ইদ্রিয় মিঞা আমাকে ডোম দিয়ে অবিলম্বে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা লাশ সরিয়ে ফেলতে বলেন।…

    ৩০ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাদ থেকে ১৮ বছরের এক ছাত্রীর লাশ তুলেছি। তার গায়ে কোন গুলির চিহ্ন ছিল না। দেখলাম তার মাথঅর চুল ছিড়ে ফেলা হয়েছে, লজ্জাস্থান থেকে পেট ফুলে অনেক উপরে উঠে আছে, যোনি পথও রক্তাক্ত। আমি একটি চাদর দিয়ে লাশটি ঢেকে নিচে নামিয়ে আনলাম।”

    ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে সুইপার রাবেয়া খাতুন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এস এফক্যান্টিনে ছিলেন।পুলিশদের প্রতিরোধ ব্যর্থ হবার পরে ধর্ষিত হন রাবেয়া খাতুন। সুইপার বলে প্রাণে বেঁচে যান কারণ রক্ত ও লাশ পরিস্কার করার জন্য তাকে দরকার ছিল সেনাবাহিনীর। এরপরের ঘটনার তিনি যে বিবরণ দিয়েছেন তা এইরকম :

    “২৬ মার্চ ১৯৭১,বিভিন্ন স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেয়েদের ধরে আনা হয়।আসা মাত্রই সৈনিকরা উল্লাসে ফেটে পড়ে।তারা ব্যারাকে ঢুকে প্রতিটি যুবতী,মহিলা এবং বালিকার পরনের কাপড় খুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে ধর্ষণে লিপ্ত হতে থাকে।রাবেয়া খাতুন ড্রেন পরিস্কার করতে করতে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন।পাকসেনারা ধর্ষন করেই থেকে থাকেনি,সেই মেয়েদের বুকের স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দেয়,মাংস তুলে নেয়।মেয়েদের গাল,পেট,ঘাড়,বুক,পিঠ ও কোমরের অংশ তাদের কামড়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়।এভাবে চলতে থাকে প্রতিদিন।যেসব মেয়েরা প্রাথমিকভাবে প্রতিবাদ করত তাদের স্তন ছিড়ে ফেলা হত,যোনি ও গুহ্যদ্বা্রের মধ্যে বন্দুকের নল,বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢূকিয়ে হত্যা করা হত।বহু অল্প বয়স্ক বালিকা উপুর্যুপুরি ধর্ষণে নিহত হয়।এর পরে লাশগুলো ছুরি দিয়ে কেটে বস্তায় ভরে বাইরে ফেলে দেয়া হত।হেড কোয়ার্টারের দুই,তিন এবং চারতলায় এই্ মেয়েদের রাখা হত,মোটা রডের সাথে চুল বেঁধে।এইসব ঝুলন্ত মেয়েদের কোমরে ব্যাটন দিয়ে আঘাত করা হত প্রায় নিয়মিত,কারো কারো স্তন কেটে নেয়া হত,হাসতে হাসতে যোনিপথে ঢুকিয়ে দেওয়া হত লাঠি এবং রাইফেলের নল।কোন কোন সৈনিক উঁচু চেয়ারে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ মেয়েদের বুকে দাঁত লাগিয়ে মাংস ছিড়ে নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ত,কোন মেয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে তখনই হত্যা করা হত।কোন কোন মেয়ের সামনের দাঁত ছিল না,ঠোঁটের দু’দিকের মাংস কামড়ে ছিড়ে নেয়া হয়েছিল,প্রতিটি মেয়ের হাতের আঙ্গুল ভেঙ্গে থেতলে গিয়েছিল লাঠি আর রডের পিটুনিতে।কোন অবস্থাতেই তাঁদের হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হত না,অনেকেই মারা গেছে ঝুলন্ত অবস্থায়।”

    সামু ব্লগের এস্কিমো তার কেইস স্টাডিঃ জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ – পর্ব ৩ (নির্বিচারে নারী হত্যা ও নির্যাতন) তে উল্লেখ করেন- এই বিষয়ে Aubrey Menen নামক এক রিপোর্টার কয়েকটি উদাহরন দিয়েছে। তারমধ্যে সদ্যবিবাহিতা এক তরুনীর নির্যাতনে ঘটনা এইরকম -

    “দুইজন পাকিস্তানী সৈন্য বাসরঘরে ঢুকে পড়লো। অন্যজন বাইরে বন্দুক নিয়ে পাহারায় দাড়িয়ে থাকলো। বাইরের মানুষরা ভিতরে সৈন্যদের ধমকের সুর আর স্বামীটিরর প্রতিবাদ শুনতে পাচ্ছিলো। সেই চিৎকার একসময় থেমে গেল – শুধু শুনা গেল তরুনীর কাতর আর্তনাদ। কয়েক মিনিট পর একটা সৈন্য অবিন্যস্ত সামরিক পোশাকে বেড়িয়ে এলো বাইরের থেকে আরেকটা সৈন্য ভিতরে গেল। এভাবে চলতে থাকলো – যতক্ষন না ছয়টা সৈন্য দ্রুত সেই বাড়ী ত্যাগ করলো। তারপর বাবা ভিতরে গিয়ে দেখতে পেল তার মেয়ে দড়ির বিছানায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আর তার স্বামী মেঝেতে করে ফেলা নিজের বমির উপর উপুর (?) হয়ে পড়ে আছে।“ (Brownmiller, Against Our Will, p. 82) ”

    অথচ দৈনিক সংগ্রাম ৮ এপ্রিল সম্পাদকীয় পাতায় মিথ্যাচার করে লিখলো, রোকেয়া হলে কিছুই হয় নি, অন্য হল থেকে দু’চারটা ছেলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল মাত্র।……..
    উপরে বর্ণিত জলজ্যান্ত হত্যাকাণ্ডকে ভারতীয় মিথ্যা অপপ্রচার বলে উল্লেখ করে দৈনিক সংগ্রাম ভারতীয় অপপ্রাচারের ব্যর্থতা শিরোনাম দিয়ে সম্পাদকীয় পাতায় লিখলো-

    পূর্ব পাকিস্তানের সব গুরুত্বপূর্ণ শহর সামরিকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থেকে স্বাভাবিকতার দিকে ফিরে এলেও ভারতীয় বেতারে এখনও সেগুলোয় যুদ্ধ চলছে।

    ….এমন কি রোকেয়া হলে কিছু হওয়া তো দূরের কথা অন্য হলের দু’চারটা ছেলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বলে জানা যায়।
    ….ভাতৃদ্বন্দ্বে উদ্যত জাতি শক্রর বিরুদ্ধে গলা মিলিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে। নুতন করে জাতীয় মীর জাফরদের (মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আতীয় নেতৃবৃদ্দ-লেখক) তারা চিনবার সুযোগ পেয়েছে। ভারত ও তার এজেন্টদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে যে কোন মূল্যে তারা স্বদেশ ও জাতি রক্ষার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছে।”

    ২ মে, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা ২৫ মার্চ সর্ম্পকে লেখে-পাক সেনাবাহিনীর আগমনের অপেক্ষা করেছে

    ২৫ মার্চের পর থেকে পাকসেনারা যে অঞ্চলেই অনুপ্রবেশ করেছে, সেখানেই ধ্বংসের তাণ্ডব চালিয়েছে। তাই পাকবাহিনীর আগমণের বার্তা পেলেই জনগণ জীবন বাঁচানোর জন্য ঘরবাড়ি সহায়-সম্পদ ছেড়ে পালাতে শুরু করতো। অথচ সেই পাকবাহিনীকেই জনগণের ভাগ্য বিধাতা বানিয়ে দৈনিক সংগ্রাম ২ মে “হিন্দুস্তানী সৈন্যের বর্বরতা” শীর্ষক সম্প্রাদকীয়তে উল্লেখ করলো-

    যেখানে যে অঞ্চলেই ভারতীয় সৈন্যেরা অনুপ্রবেশ করেছে, সেখানকার জনগণ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আমাদের পাক সেনাবাহিনীর আগমণের অপেক্ষার করেছে। পাকবাহিনীর আগমণে শান্তি ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।

    ৩ মে, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা পত্রিকাটি বাঙালি জাতির কালো রাত্রিটিকে পাকিস্তানিদের মুক্তি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কন্যা রইসী বেগম পাকিস্তান সামরিক জান্তার পক্ষে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিটি দৈনিক সংগ্রাম ৩ এপ্রিল প্রথম পাতায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে। ২৬শে মার্চ পাকিস্তানিদের জন্য মুক্তি দিবস শিরোনাম দিয়ে রইসী বেগমের বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়-
    ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ আমাদের সাত কোটি পাকিস্তানিদের জন্য মুক্তি দিবস

    শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুচরেরা চিরদিনের জন্য মঞ্চ থেকে অপসারিত হয়েছে। শয়তানী শক্তিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার শক্তি যেন আমাদের অজেয় সশস্ত্র বাহিনীকে আল্লাহ দান করেন।

    ৮ মে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা সম্পাদকীয়তে ছাপে যে; পাকিস্তান সেনা বাহিনী পাকিস্তান ধ্বংসের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করেছে।

    পাক সামরিক জান্তার ২৫ মার্চ রাতে আদিম উন্মত্ততায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতির ওপর। তাদের হিংস্র নখরে ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত হয় বাঙলার জনপদ। পাক হানাদারদের বর্বর গণহত্যা ও দানবীয় হত্যাযজ্ঞে স্তম্ভিত হয়ে যায় বিশ্ববিবেক। তাদের এই বিবেববর্জিত ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে বিশ্বজনমত। পক্ষান্তরে দৈনিক সংগ্রাম সামরিক জান্তা কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সর্মথন করে এবং খুনি পাক সেনাবাহিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে। পত্রিকাটি পাক সামরিক সরকারের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সর্মথনে নানা খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করায় এবং তাদের নিন্দনীয় কাজে গর্ববোধ করে ৮ মে “সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনা” শিরোনাম দিয়ে সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করে-

    অবৈধ আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গত ২৬শে মার্চ সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে স্বাধীন বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা এঁটে সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন। সামরিক সরকার তা জানতে পেরেই পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাতে আকস্মিক হামলা চালিয়ে তাঁর সে পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেন এবং পাকিস্তানকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন।

    আরও প্রকাশ করে, এ পরিকল্পনার পেছনে ভরতের সক্রিয় সহযোগীতা ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র থেকেই….জাতির পিতা কায়েদে আজমের নাম নিশানা মুছে নতুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠা অভিযান চলেছিল। পাকিস্তানের জাতীয় সংঙ্গীতের বদলে বাঙলাদেশের জাতীয় সংঙ্গীত চালু করা হয়েছিল। অবশেষে তেইশে মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পুড়ে বাঙলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে শুধু মুখেই ঘোষণাটি বাকি রাখা হয়েছিল ২৫শে মার্চের জন্য।

    এরূপ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা প্রশ্নাতীত সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব সশস্ত্র বাহিনীর উপরই ন্যস্ত।.. আমাদের বীর পাকসেনারা পঁয়ষট্টির ভারতীয় প্রত্যক্ষ হামলা ও একাত্তরের ভারতীয় পরোক্ষ হামলা যেরূপ অলৌকিককভাবে প্রতিহত ও বিধ্বস্ত করলো তাতে সত্যিই আমরা গর্ববোধ করছি। “

    ৬ জুন দৈনিক সংগ্রাম ২৫শে মার্চ গণহত্যার জন্য পাকিস্তানিদের অভিনন্দন জানায়।

    ২৫ মার্চ কালরাতে পাক সেনাবাহিনী আধুনিক সমরাস্ত্রে নিয়ে ঘুমস্ত ঢাকাবাসীর উপর আদিম হিংস্রতায় ঝাপিয়ে পড়ে। রাইফেল, মেশিনগান, কামান ও মর্টারের হিংস্র গর্জনে রাতের নিস্তবন্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে পড়ল। হাহাকার, আর্তচিৎকার ও ক্রন্দনে ২৫ মার্চের রাতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। ফুটপাত, রাজপথ ও রিকশায় জড়ে উঠল মৃত মানুষের লাশ। নিমিষেই লাশের শহরে পরিণত হলো ঢাকা। পাকবাহিনীর উদগ্র বর্বরতায় ভূলুণ্ঠিত হলো শহিদ মিনার, আক্রান্ত হলো রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল ও জহরুল হক হল (তৎকালীন- ইকবাল হল), অগ্নি সংযোগে ভষ্মিভূত হলো ইত্তেফাক, সংবাদ ও দি পিপল অফিস। ২৫ মার্চ নারকীয় গণহত্যার খবরে স্তম্ভিত হয়ে যায় বিশ্ববিবেক।

    দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাটি শুধু স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় নয় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও এই পত্রিকার চরিত্র ও ষড়যন্ত্রের ভূমিকা একই ছিল। এই স্বাধীন বাঙলাদেশে এই পত্রিকাটি জামাতের মতন আজো টিকে আছে। পত্রিকার সম্পাদক বদল হলেও পত্রিকার আদর্শ ও দালালি আজো বদলায় নি। জামাত যেমন যুদ্ধাপরাধী দল ঠিক তেমনি তাদের এই মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাটি যুদ্ধাপরাধীর দায়ে সমান ভাবে দুষ্টু। তাই যুদ্ধারাধী দলের সাথে সাথে এই পত্রিকারও বিচার হওয়া উচিত।

    এভাবেই একের পর এক কুৎসা, মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র করে প্রতিনিয়ত বাঙালি জনগণের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল এই পত্রিকাটি। কিন্তু বাঙালির সাহস ও সততার কাছে এদের মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র অচিরেই ধ্বংস হয়ে যায় এবং জন্ম নেয় একটি স্বাধীন দেশ যার নাম “বাঙলাদেশ”। সকল শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও বিরাঙ্গনাদের প্রতি শ্রদ্ধা যাদের ত্যাগের বিনীময়ে একটি স্বাধীন দেশ আমরা পেয়েছি।
    –জয় বাঙলা

    তথ্যসূত্র- দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা- আলী আকবর টাবী, ব্লগ ও উইকিপিডিয়া থেকে।
    http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=34249&plain=true
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ২২ মার্চ ২০১৩ ১৯:৫৫582542
  • আঁদ্রে মালরোর বাংলাদেশ

    মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন বিশিষ্ট ফরাসি লেখক আঁদ্রে মালরো। তাঁর স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সফর নিয়ে ফরাসি টিভির একটি প্রামাণ্যচিত্র পুনরুদ্ধার করা হয়েছে সম্প্রতি। সে সূত্রে বাংলাদেশ ও মালরোর সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ | তারিখ: ২২-০৩-২০১৩
    ________________________________
    আঁদ্রে মালরো (১৯০১-১৯৭৬)
    1 2
    ২১ এপ্রিল ১৯৭৩। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে তিন দিনের সফরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সস্ত্রীক পা রাখলেন সত্তরোর্ধ্ব এক ফরাসি যোদ্ধা—আঁদ্রে মালরো। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরেন লিজিয়ন গঠন করে বাঙালির প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিতে চেয়েছিলেন তিনি। উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বিশ্বজনমতকে। বিশ শতকের বিশিষ্ট লেখক ও ফ্রান্সের দ্য গল সরকারের একসময়ের মন্ত্রী আঁদ্রে মালরো সম্পর্কে পেছনে ফিরে গিয়ে আরও বলতে হবে যে তিনি ফ্রান্সে ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে এবং স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রগতিশীলদের পক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মালরোর যে লড়াই, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির জন্য মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ লড়াই।
    ১৯৭৩ সালে আঁদ্রে মালরোর বাংলাদেশ সফর ছিল অসম্ভব বৈচিত্র্যপূর্ণ। এ সময় তিনি বাংলাদেশের সেই সময়ের রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আন্তরিক পরিবেশে কথা বলেছেন ফ্রান্স ও বাংলাদেশের সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বীরত্ব ও শহীদদের আত্মত্যাগের কথা বারবার স্মরণ করতেও ভোলেননি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গও উঁকি দিয়েছে তাঁর বক্তব্যে। আছে শান্তির কথাও।
    বাংলাদেশে পা রেখে নানা কাজের ফাঁকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে আঁদ্রে মালরো গিয়েছিলেন হাসপাতালে। এক হাত ও এক পা কাটা যুদ্ধাহত এক যুবককে দেখে নিজের মালা খুলে পরিয়ে দিলেন তাঁর গলায়। এর জবাবে যুবকটি তাঁর থেকে কয়েকটি নীল, সাদা ও লাল ফুল নিয়ে মুকুট বানিয়ে পরিয়ে দিলেন মালরোর মাথায়। আঁদ্রে মালরোর বাংলাদেশ ভ্রমণ সম্পর্কে একটি রচনায় এ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ের সঙ্গিনী সোফি দ্য ভিলমোরাঁ।
    মালরোর বাংলাদেশ সফরের উজ্জ্বল কিছু মুহূর্ত সপ্রাণ হয়ে আছে বাংলাদেশ: ইয়ার ওয়ান ফ্রম ডিসপেয়ার টু হোপ নামের এক প্রামাণ্যচিত্রে। মালরোর বাংলাদেশ সফরের সময় তাঁর সঙ্গে ছিল ফরাসি টেলিভিশনের একটি দল। তারাই তৈরি করেছিল এটি। অনেক দিন এই প্রামাণ্যচিত্রের হদিস ছিল না। পরে ঘটনাচক্রে উদ্ধার হওয়া এই ফরাসি প্রামাণ্যচিত্রটি বাংলায় ভাষান্তর করে আলিয়াঁস ফ্রঁসেজের উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তিতে প্রদর্শিত হয়। বাংলা ভাষায় এর নাম দেওয়া হয় বাংলাদেশ: প্রত্যাশার পথে। সে আরেক চমকপ্রদ কাহিনি। ফিলিপ হ্যালফেন পরিচালিত ৩১ মিনিটের এই প্রামাণ্যচিত্রে বন্দী হয়ে আছে বাংলাদেশ নিয়ে আঁদ্রে মালরোর নানা অনুভব আর কথা। ওই কথাগুলোয় যেমন আছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর গভীর উপলব্ধি, তেমনি আছে একজন বিদেশি যোদ্ধার চোখ দিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে দেখার উত্তাপ।
    বিমান থেকে বাংলাদেশে নেমেই পুষ্পসিক্ত অভিনন্দনের জবাবে আর্দ্র হলো আঁদ্রে মালরোর কণ্ঠ, ‘সবাইকে তো বুকে টেনে নেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। পুরো বাংলাদেশকে আমি আমার বুকে জড়িয়ে ধরছি।’
    প্রামাণ্যচিত্রের ক্যামেরা এবার ঘুরে গেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে। এক সাংবাদিক মুজিবকে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি তাঁর কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করেন?’ মুজিব একটিমাত্র বাক্যে মুহূর্তেই উত্তর দিলেন, ‘আমরা তাঁর ভালোবাসা চাই।’
    ২১ এপ্রিল সেই ভালোবাসা যেন মালরো উজাড় করে দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের বক্তৃতায়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, আজ আমি প্রথমবারের মতো এখানে কথা বলছি। এটা পৃথিবীর একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে জীবিতের সংখ্যা মৃতের চেয়ে কম। ফ্রান্সের সব শিক্ষার্থী জানে, আপনাদের শিক্ষক ও সহপাঠীরা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। পৃথিবীর আর কোথাও ছাত্র-শিক্ষকেরা স্বাধীনতার জন্য এত কঠিন ত্যাগ স্বীকার করেননি। তাই আপনারা যাঁরা যুদ্ধ করেছেন, ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীদের আপনারা এটা বলতেই পারেন, আমরা খালি হাতে যুদ্ধ করেছি।’
    শিক্ষর্থীদের তুমুল হাততালি সঙ্গী করে মালরো সেদিন ফিরেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরদিন ২২ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়ে লাল গাউন পরা এই মানবতাবাদী যোদ্ধা বলেন, ‘আপনাদের যেকোনো কবরের ওপর, বুদ্ধিজীবীদের শবদেহভরা কোনো গর্তের ওপর বড় বড় হরফে লিখে দিন: “যাঁরা এখানে শুয়ে আছেন, নিদারুণ কষ্টকর নয়টি মাস খালি হাতে যুদ্ধ করতে তাঁরা একটুও দ্বিধা করেননি।”...আপনারা পৃথিবীকে দেখালেন, যে জাতি হার মানে না, তার আত্মাকে কখনো হত্যা করা যায় না।’
    বক্তব্যের একপর্যায়ে এল তাঁর ধন্যবাদ দেওয়ার পালা। আঁদ্রে মালরো বাংলার সভ্যতার সঙ্গে ফরাসি সভ্যতার রাখিবন্ধন ঘটালেন। তিনি বলেন, ‘আপনাদের আহত যোদ্ধা, যাঁদের সঙ্গে গতকাল দেখা হয়েছে, তাঁদের ও বাংলার আদি সভ্যতার পক্ষ থেকে আমাকে বরণ করার পাশাপাশি আপনারা বরণ করে নিলেন আমার দেশের সভ্যতাকেও। এ উপাধি গ্রহণ করে আমি বাংলাদেশকে বলতে চাই, এখানে এসে আমি সম্মানিত বোধ করছি।’
    এরপর শান্তির বার্তা নিয়ে আঁদ্রে মালরোকে দেখা গেল চট্টগ্রামের রাস্তায়। বাংলার সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ আবারও তাঁর কণ্ঠে, ‘আপনাদের আছে তিন হাজার বছর ধরে আত্মার ভেতর লালিত সভ্যতা।’ তিনি স্মরণ করলেন মহাত্মা গান্ধীকে। শেখ মুজিবকেও মিলিয়ে দিলেন একই সুতোয়, ‘আপনাদের বিপ্লব বাংলার সঙ্গে আমাদের বিপ্লবকে একাত্ম করেছে। ভারত ও আপনাদের বিপ্লবই একমাত্র, যা সর্বাত্মকবাদী নয়। না স্টালিন, না হিটলার, না মাও (জে দং)—কেবল গান্ধী আর শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ব এখনো বিষয়টি বুঝে ওঠেনি। কিন্তু এখনই সময় জেগে ওঠার।’
    সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে যুদ্ধাপরাধী ও আটকে পড়া পাকিস্তানি সেনাদের বিচারের বিষয়েও মন্তব্য করতে হলো তাঁকে। ১৯৭৬ সালে মারা যাওয়া এই মানুষটি বলেন, ‘এতে সন্দেহের লেশমাত্র নেই যে অপরাধীদের শাস্তি পেতে হবে। এটাও ঠিক, এরা যে অপরাধী, আগে সেটা প্রমাণ করতে হবে, ব্যাপারটা আদালতের।’

    প্রামাণ্যচিত্রের খোঁজে
    সবাই যতই বলুন, ‘পাইরেসি বন্ধ হোক,’ কখনো কখনো পাইরেসিকে ‘হ্যাঁ’ বলতেই হচ্ছে। কারণ, পাইরেসির গুণেই আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি প্রামাণ্যচিত্রটি। ফরাসি টেলিভিশনকর্মীদের ধারণ করা চিত্র থেকে ফরাসি ভাষায় ফিলিপ হ্যালফেন নির্মাণ করেন প্রামাণ্যচিত্র। বহুদিন পর্যন্ত এই প্রামাণ্যচিত্রের কোনো খোঁজ ছিল না। পরে ১৯৯৬ সালে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের উদ্যোগে আঁদ্রে মালরোকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানে এটি প্রথম প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়। সে সময় মুজিবুর রহমান খান নামের এক আলোকচিত্রী ভিডিও ক্যামেরায় (ভিএইচএস) এটি আবার ধারণ করেন। শুরু হয় ‘পাইরেসি’-এর প্রথম ধাপ। পরে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের প্রধান গ্রন্থাগারিক জিয়া হায়দার খান ২০০০ সালে এটিকে ডিভিডি ফরম্যাটে রূপান্তর করেন—‘পাইরেসি’-এর দ্বিতীয় ধাপ সমাপ্ত। মজার ব্যাপার হলো, প্রামাণ্যচিত্রটির এই ডিভিডি ফরম্যাটটিই এখন টিকে আছে, নষ্ট হয়ে গেছে মূল সংস্করণটি। ২০১১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তিতে প্রামাণ্যচিত্রের এই ‘পাইরেসি’ সংস্করণটি বাংলা ভাষায় ভাষান্তর করে আবার আরেকটি প্রদর্শনী করেছিল আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ। ওই সময় বাংলায় এর নাম দেওয়া হয় বাংলাদেশ: প্রত্যাশার পথে। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের বর্তমান পরিচালক আলিভিয়ের লিতভিনের উৎসাহে প্রদর্শনীটি হয়েছিল বলে জানা গেছে।

    http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-03-22/news/338449
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ২২ মার্চ ২০১৩ ১৯:৫৮582543
  • এক কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ

    শামীম আমিনুর রহমান | তারিখ: ২২-০৩-২০১৩
    _______________________________
    শরিফ সরোয়ার হোসেন বাচ্চু ১৯৭১ সালের মার্চে ঢাকায় তেজগাঁও পলিটেকনিক হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণী শেষ করে অষ্টম শ্রেণীতে পা রাখল। ঢাকার আর্ট কলেজের অফিস সহকারী বাবা আবদুর রব শরিফ বাচ্চুকে মার্চের আন্দোলনের সময় মাদারীপুরে তার দাদার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। মাদারীপুর পাবলিক ইনস্টিটিউটে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হলেও স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তার আর কোনো ক্লাস করা হয়ে ওঠেনি। পাকিস্তানি বাহিনীর চারদিকে হত্যা, লুণ্ঠন, অত্যাচার বাচ্চুর মনে তীব্র ঘৃণা তৈরি করে। বাচ্চু সুযোগ খুঁজতে থাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার। কিন্তু বয়সে ছোট হওয়ায় তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শুরু করে তার নিজস্ব পথে একাকী মুক্তিযুদ্ধ। সাহায্য ও সঙ্গদানকারী হিসেবে বয়সে তার ছোট এক বন্ধু আদমকে বেছে নেয়। লুকিয়ে লুকিয়ে পোস্টার লিখে তা শহরের দেয়ালে রাতের আঁধারে সেঁটে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার যুদ্ধ শুরু করে। তার ছোট চাচা হারুন শরীফ একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাচ্চু গোপনে সেই ছোট চাচার মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প খুঁজে বের করে। চাচাকে না জানিয়ে সেখানে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝিয়ে লুকিয়ে বাড়িতে গ্রেনেড নিয়ে আসে। সে গ্রেনেড বেশ কয়েকবার ব্যবহার করেছে রাতের আঁধারে। রাতে আর্মির চলন্ত গাড়ি বা পেছন দিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে তার নিজের নিঃসঙ্গ যুদ্ধ চললেও সেই সঙ্গে ভারতেও গিয়েছিল ট্রেনিং নিতে। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় সেখান থেকে তাকে ফিরে আসতে হয়। তবুও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে বাচ্চু। একদিন তার সে সুযোগ সত্যিই এসেছিল।
    মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গোপন খবর আসে যে রাতের আঁধারে পাকিস্তানি বাহিনী মাদারীপুর ত্যাগ করবে। মাদারীপুরের ঘটকের চরে এসে মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তায় মাইন পুঁতে অপেক্ষা করতে থাকে। পরের দিন ৯ ডিসেম্বর ভোরের ক্ষীণ আলোয় আট-নয়টি গাড়িভর্তি পাকিস্তানি সেনারা শহর ত্যাগ করছে। বহরের তৃতীয় গাড়িটি হঠাৎ করেই মাইনে বিধ্বস্ত হয়ে অন্য গাড়িগুলোর পথ বন্ধ করে রাস্তায় পড়ে থাকে। রাস্তার পাশে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা গুলি চালালে আতঙ্কিত পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে ভোরের ক্ষীণ আলোয় পশ্চিম বরাবর দৌড়ে পালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের তাড়া খেয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার আরও পশ্চিমে সমাদ্দার ব্রিজের গোড়ায় আগে রাজাকারদের খোঁড়া আট-নয়টি পরিত্যক্ত পরিখায় তারা আশ্রয় নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজের দুই পাশেই অবস্থান নিয়ে উঁচু সড়কের নিচ থেকে গুলি চালাতে থাকেন। অবস্থানগত কারণে উঁচুতে থাকা পাকিস্তানিরা ও নিচুতে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা কেউই গুলি চালিয়ে সুবিধা করতে পারছিল না। যুদ্ধে খুব অগ্রগতি না হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার পাকিস্তানিদের আশ্রয় নেওয়া পরিখায় গ্রেনেড নিক্ষেপের কথা ভাবলেন। এমনকি বলার সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে চলে আসা বাচ্চু বলল, সে এ কাজটি করতে চায়। কমান্ডার অবাক হলেও বাচ্চুর দৃঢ়তার কাছে হার মানলেন। সেদিনের সেই কিশোর বাচ্চু হাতে গ্রেনেড নিয়ে সড়কের ঢাল বেয়ে সাপের মতো মাটি বেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর খুব কাছে না গিয়ে প্রথম গ্রেনেডটি ছুড়ে মেরে মাটিতে শুয়ে পড়ল। গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্কিত হলো পাকিস্তানিরা। নিরাপদে বাচ্চু ফিরে এল। এরপর বাচ্চু নিজেকে বাঁচিয়ে পুরো দিন ও রাতে রাস্তার ওপারে গিয়ে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে যায়। গ্রেনেডের এই উপদ্রবে পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ল। দ্বিতীয় দিনে ১০ ডিসেম্বর আত্মবিশ্বাসী বাচ্চু খুব কাছাকাছি থেকে গ্রেনেড ছুড়তে চায়। যত কাছ থেকে ছোড়া হবে, ততটাই মারাত্মক হবে সেই আঘাত। খুব কাছে গিয়ে সে সব শক্তি দিয়ে পরিখা বরাবর ছুড়ে মারে গ্রেনেড। বিকট শব্দের সঙ্গে ভেসে আসে হানাদার বাহিনীর আর্তনাদ। এ আনন্দের খবরটা দ্রুত পৌঁছে দিতে হবে। কিছু দূর এগিয়ে রাস্তা দ্রুত লাফিয়ে পার হতে গেলেই শত্রুর একটি বুলেট তার বক্ষ ভেদ করে তাকে স্তব্ধ করে দেয়। রাস্তার ওপর পড়ে থাকে বাচ্চু।
    তখন মধ্যদুপুর। বাচ্চুর টানা গ্রেনেড ছোড়া যেমন পাকিস্তানিদের অনেক ক্ষতি সাধন করেছিল, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় দিয়েছিল অনেকটা এগিয়ে। বাচ্চুর মৃত্যুর চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই বিকেলে প্রায় দেড় শ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। মাদারীপুর হয় শত্রুমুক্ত।
    মাদারীপুর পাবলিক ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তার পাশে বাচ্চুকে সমাহিত করা হয়। মাদারীপুর শহরের প্রধান সড়কের পাশে এই সমাধিটি কারও কারও চোখে পড়ে থাকতে পারে, যদিও এর পেছনে এই দেশের জন্য এক কিশোরের মহান আত্মত্যাগের কথা আমাদের প্রায় সবারই অজানা রয়ে গেছে।
    http://www.prothom-alo.com/detail/news/338477
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ২২ মার্চ ২০১৩ ২০:০০582544
  • মুক্তিযুদ্ধের সৃজনশীল ৪ বই যেভাবে লেখা হলো

    সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছানোর তাগিদ
    সৈয়দ শামসুল হক | তারিখ: ২২-০৩-২০১৩
    __________________________________________
    পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়—সৈয়দ শামসুল হক
    প্রকাশক: বিদ্যা প্রকাশ
    লেখা! কাজটার কোনো কর্মখালি বিজ্ঞাপন নেই, দরখাস্ত নেই, বরখাস্তও নেই। এ কাজ নিজেকেই নিজের দেওয়া। তাই এ থেকে অবসর নেই। কারও কাছে কৈফিয়ত দেওয়ারও দায় নেই। মানুষের গোটা কাজটাকেই দুভাগে ফেলা যায়—অভাব আর স্বভাব। দেশকে যিনি উদ্ধার করেন তিনি তাঁর মানুষের আত্যন্তিক গূঢ় এক অভাব বোধ থেকেই হন কর্মিষ্ঠ। অকারণে যে হেসে ওঠে, ওটাই তার স্বভাব। মানুষের ব্যক্তিত্ব বলে যাকে ঠাহর করি, আসলে সেটি তার স্বভাবেরই ভাবচিত্র।
    এত কথা বলার কারণ, একটা অনুরোধ এসেছে। আমার কাব্যনাট্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নিয়ে এর ভেতর-কথাটি আমাকেই বলতে হবে। অনুরোধ প্রথম আলো পত্রিকার। দিনের সব আলোর ভেতরে ভোরের প্রথম আলোটির কাজ একেবারেই আলাদা। আলাদাই শুধু নয়, অদ্বিতীয় বটে। দিনের আর কোনো আলো নয়, প্রথম আলোটাই অন্ধকার দূর করে। কাজেই এমন কাজের নামের পত্রিকাটির এ অনুরোধ ঠেলা যাচ্ছে না। অগত্যা এই লেখা।
    নাটকটি লিখতে শুরু করি ১৯৭৫ সালের পয়লা মে, শেষ করি মাস দেড়েক পরে, ১৩ জুন রাত দুটোয়। তখন বিবিসির বাংলা বিভাগে কাজ করতাম লন্ডনে। থাকতাম লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড পাড়ায়। দৈবাৎ আমার প্রতিবেশী ছিলেন অভিনেতা রিচার্ড বার্টন। তবে উচ্চ ভাড়া গুনে ও-পাড়ায় থাকার আসল লোভটা ছিল, আমার ফ্ল্যাট থেকে মাত্রই দেড় শ গজ দূরের বাড়িটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থাকতেন ১৯১২ সালে, আর ওই বাড়ির পাশেই ক্রন্দসী উইলো ঘেরা ঝিলের পাড়ে বসে তিনি লিখেছিলেন তাঁর সেই গান—আমার প্রাণের একটি স্বর—সুন্দর বটে তবে অঙ্গদখানি, তারায় তারায় খচিত।
    হ্যাম্পস্টেড থেকে অফিসে যেতে পাতালরেলে লাগত ৪৫ মিনিট, সন্ধেবেলা ফিরতেও তাই। মাথায় তখন পায়ের আওয়াজ! ট্রেনে যেতে যেতে মুখে মুখে রচনা করে চলেছি লাইনের পর লাইন, তারপর অফিসে গিয়ে প্রথম কাজটাই হচ্ছে লাইনগুলো লিখে ফেলা। লিখতাম বিবিসিরই দেওয়া নোটবুকে। রাতে ফিরে আবার সেই ফিরতি পথে মনে মনে বানানো লাইনগুলো লিখে ফেলা। এই করে করে পুরো নাটকটি একদিন শেষ হয়ে যায়। পাণ্ডুলিপির সেই নোটবই দুটি এখনো আমার কাছে আছে। কত যে কাটাকুটি করেছি তার ইয়ত্তা নেই। আমার কোনো লেখাই তরতর করে আসে না। অনেক শ্রম আর ঘামের পরে যদি একটা কিছু হয়!
    পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কিছু হয়েছে কি না, ১৯৭৬-এর ২৬ নভেম্বর এর প্রথম অভিনয় দেখেই কবীর চৌধুরী তখনকার বাংলাদেশ অবজারভার-এ লেখেন—এটি আমাদের নাটকের একটি মাইলস্টোন। অন্যেরা বলাবলি করেন, মুক্তিযুদ্ধের ওপর সবচেয়ে ভালো নাটক এটি। ভাষা-রচনার অনেক মাধ্যমে কাজ করেছি সেই কতকাল থেকে, নাটকে এই প্রথম। আর, প্রথম নাটকেই এতখানি অনুকূল ধ্বনি, আমি কিছুটা হতবাক তো হই-ই। আবার ছিটকেও পড়ি কারও কারও মন্তব্যে। যেমন আমার বন্ধু—মনের মানুষ, তিতাস একটি নদীর নাম, পদ্মা নদীর মাঝির মতো চলচ্চিত্রের প্রযোজক—হাবিব খান খুব তেড়ে উঠে বলেছিলেন, হ্যাঁ! আপনি একজন রাজাকারকে প্রধান চরিত্র করলেন! এমন করে তাকে আঁকলেন যে তার জন্য আমাদের কষ্ট পর্যন্ত হয়! ধিক, আপনার কলমকে!
    কিন্তু সেই তিনিও দ্বিতীয়বার নাটকটি দেখে বুঝেছিলেন কী ছিল আমার বলবার কথাটি। আর সেই কথাটা বলার জন্যই আমার দরকার পড়েছিল একজন রাজাকারের—না! তার নয়, তার মেয়েকেই আমার দরকার ছিল মঞ্চে নিয়ে আসার।
    কারণ? কারণ, ওই মেয়ের মুখ দিয়েই আমার বলিয়ে নেওয়ার দরকার ছিল—ধর্ম কী, আর ধর্মকে রাজনীতির কূট প্রয়োজনে ব্যবহার করাটাই বা কী, আর সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে কীভাবে বিভ্রান্ত করা যায় ধর্মেরই দোহাই দিয়ে। এই সাধারণ মানুষই তো নাটকে বলছে—
    বুঝি না আল্লার
    কুদরত কারে কয়, কারে কয় বিচার আচার।
    যাদের জীবন হইলো জন্তুর লাহান—
    তারে কিছু
    দেও নাই, দিয়াছো ঈমান!

    আর যারে সকলি দিয়াছো, অধিকার
    তারেই দিয়াছো তুমি দুনিয়ার
    ঈমান মাপার! আর আর ওই রাজাকার মাতবরের মেয়ে বলছে—
    পাপ হাজারে হাজার
    মানুষ নিশ্চিন্তে করে, সাক্ষী নাম
    সেই তো আল্লার।
    নাম, আর কিছু নাই, খালি এক নাম,
    নিরাকার নিরঞ্জন নাম,
    নামের কঠিন ক্ষারে লোহাও মোলাম—
    সেই এক নাম।
    নামের তাজ্জব গুণে ধন্য হয়
    পাপের মোকাম।
    এমন আরও অনেক কথা ওই নাটকে আমি লিখি, যা শুনতে হলে আপনাকে রঙ্গমঞ্চে যেতে হবে। জীবন্ত আপনাকে জীবন্ত কুশীলবের সাক্ষাতে সত্যের আগুনে পুড়ে নিখাদ হতে হবে। নাটক তো বইয়ের পাতায় প্রাপ্তব্য নয়, তার জন্ম দাবানল ঘটে মঞ্চের পাটাতনে।
    এ কথা নিজেকে বড় করার জন্য বলা নয়, বলছি এই সত্যটাই, যে, সেই ১৯৭৫ সালেই আমি বুঝেছিলাম এই ধর্মান্ধতা, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, আর ধর্ম দিয়ে সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করাটাই বাংলাদেশের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। কথাটা কবিতায় বললে খুব কম মানুষের কাছে পৌঁছাত, উপন্যাস বা গল্প লিখলে তা বইবন্দী হয়েই থাকত। আমি চেয়েছিলাম সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছাতে, আর তাই, জীবনে প্রথম আমি নাটকের কথা ভাবি, নাটকেই কথাগুলো বলার জন্য কলম ধরি। মুনীর চৌধুরীর কথা মনে পড়ে; সেই ’৫৪ সালেই এক সকালে তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন, তুমি নাটক লেখো না কেন? তোমাকে দিয়ে হবে! পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় লিখতে বসে মুনীর ভাইয়ের কথা বারবার আমার মনে পড়েছে।
    আর, এই যে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, একে মুক্তিযুদ্ধের নাটক বলা হয়, লোকে বলে, আমি বলি না। আমি বলি, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকে আমি ব্যবহার করেছি মাত্র; এবং এই পটভূমি ব্যবহার করে আমাকে বলতে হয়েছে ধর্ম আর ধর্মবিশ্বাস আর রাজনীতিতে ধর্মের অসৎ ব্যবহারের কথা। যদি এ নাটক মানুষের মনে কিছুমাত্র দাগ কেটে থাকে, তবে তা মুক্তিযুদ্ধের অধিক ধর্মসংক্রান্ত ওই বিকট চিত্রটির উদ্ঘাটন কারণেই। আজ বাংলাদেশের দিকে যখন তাকিয়ে দেখি তখন আমার মনে হয়, ১৯৭৫ সালেই সমস্যাটি বোধ হয় ঠিক শনাক্ত করতে পেরেছিলাম।
    আজ আমার মনে হয়, যখন একাত্তরের সেপ্টেম্বরে দেশ ছেড়ে চলে যাই, তখনো আমার মনে হয়েছিল, যুদ্ধটা অন্তত বছর তিনেক চলবে, যদি চলত! তাহলে ওই ধর্মব্যবসায়ীরা নির্মূল হয়ে যেত তত দিনে, আর আমরাও স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এতখানি বিপর্যস্ত হতে দেখতাম না।

    http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-03-22/news/338470
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ২২ মার্চ ২০১৩ ২০:০২582545
  • মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের অনুভূতি
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল | তারিখ: ২২-০৩-২০১৩
    _______________________________________
    আমার বন্ধু রাশেদ— মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    প্রকাশক: কাকলী প্রকাশনী

    আমার বন্ধু রাশেদ বইটি যখন লিখি, তখন আমি আমেরিকায়, দেশে আসব আসব করছি। দীর্ঘদিন থেকে সেই দেশে পড়ে আছি, প্রায় ১৮ বছর, কিন্তু লেখালেখি হয়েছে খুব কম। তার কারণও আছে। আমি এক রকম পাণ্ডুলিপি পাঠাই, অন্য রকম বই হিসেবে বের হয়ে আসে। একবার একটা বই ছাপা হয়ে এল, দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম! আমার লেখার পুরো স্টাইল পাল্টে দেওয়া হয়েছে। পড়ে মনে হয় আমি লিখিনি, অন্য কেউ লিখেছে। দেশে প্রকাশককে ফোন করে কারণ জানতে চাইলাম। তিনি লেখালেখির সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে আমাকে জ্ঞান দিয়ে বিশাল একটা চিঠি লিখলেন। অনেক কষ্ট করে পরে আমি অন্য একজন প্রকাশক দিয়ে আমার স্বল্পজ্ঞানের বইটি আমার মতো করে লেখা হিসেবে বের করতে পেরেছিলাম।
    এর মধ্যে একদিন নিউইয়র্কে শহীদজননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন করে আমাদের সবার প্রিয় একজন মানুষ। আমি একদিন খুব কুণ্ঠিতভাবে হুমায়ূন আহমেদের ভাই হিসেবে পরিচিত হতে গেলাম। দেখি, তিনি আমার যৎসামান্য লেখা দিয়েই আমাকে আলাদাভাবে চেনেন। শুধু তা-ই না, শহীদজননী আমার লেখালেখি নিয়ে খুব দয়ার্দ্র কিছু কথা বললেন। তখন হঠাৎ করে আমার আবার লেখালেখির জন্য একটা উৎসাহ হলো—এক ধাক্কায় দুই দুইটা বই লিখে ফেললাম। তার একটি হচ্ছে আমার বন্ধু রাশেদ।
    এটা মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে লেখা একটা কিশোর উপন্যাস। এটা লেখার সময় আমি চেষ্টা করেছি সেই সময়ের ধারাবাহিকতাটুকু রাখতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ কিসের ভেতর দিয়ে গেছে, সেই ধারণাটাও একটু দিতে চেষ্টা করেছি। এমনিতে আমার কিশোর উপন্যাসের একটা ফর্মুলা আছে, সব সময়ই সেখানে একটা অ্যাডভেঞ্চার থাকে। আর তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমি আমার ছোট ছোট পাঠকের মনে কখনো কোনো কষ্ট দিই না। আমার বন্ধু রাশেদ লেখার সময় আমার মনে হলো, এই বইটি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা, তাই যারা এটি পড়বে, তাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ের একটু সত্যিকারের অনুভূতি পাওয়া দরকার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অচিন্তনীয় বীরত্ব আছে, আকাশছোঁয়া বিজয় আছে, আর সবচেয়ে বেশি আছে স্বজন হারানোর বুকভাঙা কষ্ট। তাই এই বইটাতে আমি খানিকটা কষ্ট ঢুকিয়ে দিয়েছি। এমনভাবে লিখেছি যেন যারা পড়ে, তারা মনে একটু কষ্ট পায়। আমি যেটুকু কষ্ট দিতে চেয়েছিলাম, মনে হয় তার থেকে বেশি দেওয়া হয়ে গেছে, সেটি আমি বুঝেছিলাম আমার ছোট মেয়েটির একটা প্রতিক্রিয়া দেখে।
    তখন আমি মাত্র দেশে ফিরে এসেছি। ছেলেমেয়ে দুজনেই ছোট তখনো। স্বচ্ছন্দে বাংলা পড়তে পারে না। আমাকে তাই মাঝে মাঝে আমার লেখা বই পড়ে শোনাতে হয়। একদিন আমি তাদের আমার বন্ধু রাশেদ পড়ে শোনালাম। পুরোটা শুনে আমার সাত বছরের মেয়েটি কেমন যেন অন্য রকম হয়ে গেল। চুপচাপ বসে থেকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমরা রাতে ঘুমিয়েছি, সে বিছানায় শুয়ে ঘুমহীন চোখে শুয়ে আছে।
    গভীর রাতে সে উত্তেজিত গলায় আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। বলল, ‘আব্বু, তুমি একটা জিনিস জানো?’ আমি বললাম, ‘কী?’ সে আমাকে বলল, ‘বইয়ে লেখা আছে রাশেদকে গুলি করে মেরেছে। কিন্তু তার লাশ তো পাওয়া যায়নি!’ আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না সে কী বলতে চাইছে। কিন্তু তার কথায় সায় দিয়ে বললাম, ‘না, লাশ পাওয়া যায়নি।’ আমার সাত বছরের মেয়ের মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। বলল, ‘তার মানে বুঝেছ? আসলে রাশেদের গুলি লাগেনি। সে মারা যায়নি। পানিতে পড়ে সাঁতার দিয়ে চলে গেছে।’ আমি অবাক হয়ে আমার ছোট মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বললাম, ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। রাশেদের শরীরে গুলি লাগেনি—সে মারা যায়নি। সাঁতরে সে চলে গেছে, সে বেঁচে আছে।’
    আমার মেয়ের বুকের ভার নেমে গেল। তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। গভীর একটা প্রশান্তি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেল।
    আমার ছোট মেয়েটির মতো আরও কত শিশুকে না জানি আমি কষ্ট দিয়েছি! সম্ভব হলে সবাইকে বলে আসতাম যে রাশেদ মারা যায়নি। রাশেদরা আসলে কখনো মারা যায় না।

    http://www.prothom-alo.com/detail/news/338471
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ২২ মার্চ ২০১৩ ২০:০৪582546
  • নিজের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে তৈরি করেছি
    সেলিনা হোসেন | তারিখ: ২২-০৩-২০১৩
    ___________________________________
    হাঙর নদী গ্রেনেড—সেলিনা হোসেন
    প্রকাশক: মুক্তধারা

    ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আমরা থাকি এলিফ্যান্ট রোডে। সায়েন্স ল্যাবরেটরির কলোনির ভেতরে মনীষা বিল্ডিংয়ে। মাত্র দুই দিন আগে এই বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছি ইপিআরটিসির লাল রঙের কোচ নিয়ে আলবদরের সদস্যরা ঢুকেছে কলোনির ভেতরে। ১৪ ডিসেম্বরের ভোর ছিল সেদিন। সকাল সাড়ে আটটা কি নয়টা হবে। তারা তুলে নিয়ে যায় সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে কর্মরত বিজ্ঞানী ড. আমিনউদ্দিন ও ড. সিদ্দিক আহমদকে। মাঝে এক দিন পার হয়েছে।
    এলিফ্যান্ট রোড থেকে আনন্দ উল্লাসের ধ্বনি ভেসে আসছে। চারদিক থেকে খবর আসছে যে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সকাল ১০টা অথবা ১১টা হবে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছে চারদিক। শুনতে পাচ্ছি রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। প্রবল উত্তেজনা অনুভব করি। যাব কি রেসকোর্স ময়দানে? আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের একজন হতে? ভাবলাম, যাওয়াই উচিত। যেমন গিয়েছিলাম ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে। সেদিন এলিফ্যান্ট রোড পুরোটা হেঁটে যেতে হয়েছিল। জনস্রোতের ভেতর রিকশায় ওঠারও সুযোগ ছিল না। আজও হয়তো সেভাবেই যেতে হবে। ঠিক আছে, যাবই। ভাবতে ভাবতে ঘরের দু-চারটা কাজ শেষ করে তৈরি হতে শুরু করি।
    বের হওয়ার আগেই বাড়িতে আসেন আমার খালাতো ভাই আবু ইউসুফ খান। দেখেই চমকে উঠি। শৈশব থেকে দেখা ইউসুফ ভাই তিনি নন। তাঁকে একজন অপরিচিত মানুষ মনে হলো। একমুখ দাড়ি, পিঠে রাইফেল, পরনে মুক্তিযুদ্ধের ইউনিফর্ম। এক রঙের খাকি মোটা কাপড়ের প্যান্ট-শার্ট। যুদ্ধ শুরুর আগে তিনি পাকিস্তান এয়ারফোর্সে চাকরির সূত্রে ডেপুটেশনে সৌদি আরব ছিলেন। যুদ্ধের নয় মাসে তাঁর আর কোনো খবর পাইনি। আজ তিনি আমার সামনে মুক্তিযুদ্ধের এক সাহসী যোদ্ধা।
    তাঁকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলাম।
    আপনি যুদ্ধ করেছেন ইউসুফ ভাই?
    বললেন, সৌদি আরব থেকে লন্ডন হয়ে পালিয়ে আসি ভারতে। তারপর ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করি। তাহের ওই সেক্টরের কমান্ডার ছিল মিত্রবাহিনীর সঙ্গে আমরাই ঢাকায় ঢুকেছি। আমাকে যেতে হবে। তোমার বাসায় আর বসব না।
    দ্রুতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, অন্যরা কেমন আছেন? তাহের ভাই, আনোয়ার, বেলাল, ডলি, জলি—
    তিনি একমুহূর্ত থেমে বললেন, কামালপুর যুদ্ধে তাহের আহত হয়েছে। হাঁটুর কাছ থেকে বাঁ পা উড়ে গেছে। ও তুরা হাসপাতালে আছে। ওর খুব সাহস। সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে।
    আমার চোখে পানি দেখে বললেন, কেঁদো না। আজ আমাদের আনন্দের দিন। দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার গৌরবে দুঃখ ভোলো।
    ইউসুফ ভাই চলে যান। আমি মন খারাপ করে বসে থাকি। শহীদ, মৃত্যু, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষয়ক্ষতির তাণ্ডব, স্বজনহারাদের বেদনা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ—এসবের বিনিময়ে স্বাধীনতা। আজীবন বুকের ভেতর লালন করতে হবে এর সবটুকু। পরক্ষণে চমকে উঠি। বুঝতে পারি, পাশাপাশি ক্রোধ জমা হয়ে থাকবে রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে, যারা মাত্র এক দিন আগে ঢুকেছে এই কলোনির ভেতরে। কোথায় নিয়ে গেল ওরা দুজন বিজ্ঞানীকে? সেই মুহূর্তে এর বেশি কিছু ভাবার সাধ্য ছিল না।
    আধা ঘণ্টার মধ্যে আসেন আমার শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল হাফিজ। না, তিনি ইউসুফ ভাইয়ের মতো পিঠে রাইফেল নিয়ে আসেননি। বললেন, আমি রণক্ষেত্রে সাংবাদিকতা করেছি। বিভিন্ন রণক্ষেত্রে ঘুরেছি। একটু আগে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ঢাকায় এসেছি। আমরাই প্রথম দল। ভাবলাম, তোমাকে দেখে যাই। আর একটি সত্যি ঘটনার কথা বলব। তুমি এই ঘটনা নিয়ে গল্প লিখবে।
    আমি তাঁর দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকি।
    তিনি বললেন, যশোরের কালীগঞ্জ গ্রামের ঘটনা। পাশের ঘরের দুটি ছেলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে যাওয়ার সময় একজন মাকে সালাম করে যায়। তিনি তাদের জন্য দোয়া করেন। কয়েক মাস পরে মুক্তিবাহিনীর দল পাকিস্তানি সেনাদের একটি ক্যাম্প আক্রমণ করে। ওই বাহিনীতে ছেলে দুজন ছিল। ওদের গোলাবারুদ কম থাকায় ওরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে টিকতে না পেরে পিছু হটে। পালাতে থাকে ওরা। খেয়াল করে পাকিস্তানি সেনারা ওদের ধরার জন্য তাড়া করে আসছে। ওরা সেই মায়ের ঘরে আশ্রয় নেয়। বলে, ‘চাচি, আমাদের বাঁচান।’ এর মধ্যে সেনারা এসে বিভিন্ন ঘরের দরজায় লাথি দিতে থাকে। সেই মা বুঝতে পারেন সমূহ বিপদ। তিনি মনে-প্রাণে স্বাধীনতা চান। তাই ঠিক করেন, যোদ্ধা ছেলেদের বাঁচাতে হবে। সেনারা তাঁর দরজায় লাথি দিলে তিনি নিজের ছেলেটিকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেন। তারা তাঁর বসতির উঠোনে ছেলেটিকে গুলি করে চলে যায়।
    দুজন মানুষের কাছ থেকে যুদ্ধের দুই রকম ঘটনা শোনার পর সেদিন আমি আর বাড়ি থেকে বের হতে পারিনি। বিমূঢ় হয়ে বসে ছিলাম। স্বাধীনতা এমনই কঠিন এবং মর্যাদার অর্জন। আমার দুই চোখ ভরে পানি আসে। নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয়। ঘটনাটি আমি অসংখ্যবার ভেবেছি। কেমন করে একজন মা এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটালেন স্বাধীনতা লাভের জন্য! এক অলৌকিক মানুষ মনে হয় সেই মাকে। তিনি আমার প্রাণের অচিন পাখি হয়ে ওঠেন। ঘটনাটি ভেবে আমার শরীর হিম হয়ে গেল। আমি কল্পনায় পাখির ডানা ঝাপটানো টের পেতাম। তারপর নিজের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে তৈরি করেছি। নিজেকে বলেছি, লিখতেই হবে। স্বাধীনতার জন্য রণক্ষেত্রে জীবন দেওয়ার পাশাপাশি এই ঘটনা একই সমান্তরালে অবস্থান করে। ইতিহাসের এই সত্য লিখিত না হলে পরবর্তী প্রজন্ম হারাবে যুদ্ধের গৌরবগাথা। আমি এভাবে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করি। কিন্তু বললেই লেখা হয় না। মাস ছয়েক পেরিয়ে যায়।
    তখন আমি বাংলা একাডেমীতে চাকরি করি। একদিন আমার অফিসে আসেন দু-তিনজন তরুণ। তাঁদের নাম এখন আর মনে নেই। ওঁরা বললেন, আমরা সমকালীন টেরেডাকটিল নামের একটি পত্রিকা বের করব। আপনি গল্প দেবেন।
    আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই।
    গল্প তো আমার মাথার মধ্যে জমা হয়ে আছে। ছোট আকারের একটি গল্প লিখি। গল্পের নাম কী রেখেছিলাম সেটা আর মনে নেই। সমকালীন টেরেডাকটিল যাঁরা প্রকাশ করেছিলেন, তাঁরা পত্রিকার কপি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন। প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কাছ থেকে জানতে পারি, তিনি আমার গল্পটি সিনেমা করা যায় বলে ভেবেছিলেন। এই খবরে আমি প্রবলভাবে উৎসাহিত হই। গল্পটি উপন্যাস করার জন্য লিখতে শুরু করি।
    সেই সময় বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার সম্পাদনা করতেন কবি রফিক আজাদ। তিনি বললেন, আপনার ছোট উপন্যাসটি আমাকে দিন। উত্তরাধিকার-এ ছাপব। আবার আমার খুশি হওয়ার পালা। মনোযোগ দিয়ে লেখা শেষ করে রফিক আজাদকে দিই। তিনি লেখা প্রেসে পাঠান। ছাপার কাজ শুরু হয়। তখন লেটার প্রেসে ছাপার কাজ হতো। আমি যত্ন করে প্রুফ দেখি। একদিন একাডেমীর মহাপরিচালক রফিক আজাদকে ডাকলেন। উত্তরাধিকার-এর বর্তমান সংখ্যায় কী লেখা যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলেন। সূচি দেখে তিনি রাগতস্বরে বললেন, সেলিনা বেগমের লেখা উপন্যাস? এ লেখা যাবে না।
    রফিক আজাদ বললেন, পত্রিকার এই অংশ তো ছাপা হয়ে গেছে।
    তিনি আরও রেগে বললেন, ছাপা হয়েছে তো কী হয়েছে? বাদ দিতে বলেছি, বাদ দেবেন।
    শেষ পর্যন্ত রফিক আজাদকে আমার উপন্যাস বাদ দিতে হলো। আমরা যারা পত্রিকা বিভাগে কাজ করতাম, তারা সবাই শুকনো মুখে ভাবলাম, এই উপন্যাসের সের দরে বিক্রি করার ব্যবস্থা হলো।
    কিন্তু আমি দমলাম না। একটি পত্রিকায় ছাপা না হলো তো কী হলো, আরেকটি পত্রিকায় হতে পারে। আমি সাপ্তাহিক বিচিত্রা অফিসে গেলাম। সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর সঙ্গে কথা হলো। সব শুনে তিনি বললেন, আপনার উপন্যাস আমি ছাপব। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছাপা হলো হাঙর নদী গ্রেনেড। ছোট আকারের উপন্যাসটি বই হিসেবে প্রকাশ করে মুক্তধারা। পরবর্তী মুদ্রণের সময় উপন্যাসটি পরিমার্জনা করে আবার লিখি। এবার আকারে খানিক বড় হয়। প্রতিবারই মনে হয় কিছু থেকে গেল। আবার হয়তো লিখতে হবে।
    ১৯৮৭ সালে উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন আবেদীন কাদের। প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী। ইংরেজি নাম The Shark, The River and The Grenade. ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের কারণে বইটি দেশের সীমানা অতিক্রম করে। ২০০৫ সালে আমেরিকার শিকাগোতে ডকটন কম্যুনিটি কলেজে চার সেমিস্টার পড়িয়েছিলেন অধ্যাপক এমিলি ব্লক। তিনি বইটি নেট থেকে নামিয়েছিলেন। প্যারিসের সরবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পাসকাল জিঙ্কও বইটি নেট থেকে নামিয়েছেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় সাউথ এশিয়ার সাহিত্য। এভাবে এই বই নানা দেশে ভ্রমণ করেছে। ভারতের কেরালা রাজ্যে মালয়ালাম ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
    তার পরও লেখকের তৃষ্ণার বাইরে যেতে পারেনি বইটি। প্রথম প্রকাশের ৩৮ বছর পরে আমি আবার এই উপন্যাসের পরিমার্জনা করছি। জানি না লেখকের নিজের ভেতর থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ কথা কি না। উপন্যাস লেখার নেপথ্য কথা প্রতিটি উপন্যাসের জন্যই ভিন্ন। অন্তত আমার ক্ষেত্রে এটি সত্যি।
    এই উপন্যাসের খুদে পাঠক আট বছর বয়সী সুমাইয়া বুশরা ভোর। উপন্যাসটি পড়ার পরে ও আমাকে প্রশ্ন করেছিল, রইসের খবর কোথায়? আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম, শহীদদের খবর খোঁজার জন্য আমাকে কি আরেকবার উপন্যাসটি লিখতে হবে? ততটুকু আয়ু কি পাব?

    http://www.prothom-alo.com/detail/news/338472
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ২২ মার্চ ২০১৩ ২০:০৮582547
  • এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী
    আনিসুল হক | তারিখ: ২২-০৩-২০১৩
    __________________________________
    মা—আনিসুল হক
    প্রকাশক: সময় প্রকাশন

    ‘আজাদ ভাইয়ের মাকে নিয়ে একটা নাটক লিখে দাও। একুশে টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধের নাটক করব।’
    নাসির উদ্দীন ইউসুফ বললেন আমাকে। আজাদের মায়ের গল্পটা তাঁর মুখ থেকেই প্রথম শোনা, ‘শোনো। আজাদ ভাইয়ের মা ভাত খেতেন না জানো। খুব কষ্ট করেছেন ভদ্রমহিলা। আজাদ ভাই তাঁর একমাত্র সন্তান ছিলেন। একাত্তর সালে আজাদ ভাই ধরা পড়লেন। মা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন রমনা থানায়। আজাদ ভাই বলেছিলেন, আমার জন্য ভাত এনো। মা ভাত নিয়ে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখলেন, ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। আর এই মা ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। এই ১৪টা বছর তিনি কোনো দিনও ভাত খাননি।’
    গল্প শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। আমি বলি, ‘এই গল্প নিয়ে টেলিভিশনের নাটক নয়, আমি একটা উপন্যাস লিখতে চাই। আমাকে বিস্তারিত বলেন।’
    নাসির উদ্দীন ইউসুফ, নাট্যজন ও মুক্তিযোদ্ধা, শূন্যের মধ্যে কী যেন খুঁজছেন, দূরাগত কণ্ঠে বলেন, ‘শোনো, আমি তো আজাদ ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলাম না, ঘনিষ্ঠ ছিলেন হাবিবুল আলম বীর প্রতীক। একটা কাজ করি। আমি তোমাকে হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে বসিয়ে দিই।’
    ২০০২ সাল। একদিন নাসির উদ্দীন ইউসুফ ভাইয়ের পল্টনের বাসায় সন্ধ্যার সময় আমরা বসি। হাবিব ভাই তাঁর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার গল্প বিশদভাবে বলেন। শিমূল ইউসুফ শোনান সেই ভোরের গল্প, যেদিন বালিকা তিনি, গলা সাধছিলেন হারমোনিয়ামে, আর পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘিরে ফেলে তাঁদের বাসা, আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারীর সুরকার আলতাফ মাহমুদের কপালে বেয়নেট চালায় পাকিস্তানিরা, তাঁর কপালের চামড়া ঝুলে পড়ে চোখের ওপরে, তিনি কোদাল চালিয়ে বের করে দিতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা অস্ত্র।
    ওই একই রাতে ধরা পড়েছিলেন আজাদ। তাঁদের বাড়ি থেকে মিলিটারি ধরে নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা ক্রিকেটার জুয়েলসহ অনেককে, আর পাকিস্তানি কর্তার অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি করতে করতে জন্মদিনের পোশাকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন কাজী কামাল (বীর বিক্রম, এখন প্রয়াত)।
    সারা রাত গল্প চলে। ভোরবেলা নাসির উদ্দীনদের বাড়ি থেকে বের হই।
    আস্তে আস্তে আজাদের গল্পটা স্পষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আজাদের মায়ের বিশদ বিবরণটা কই পাওয়া যাবে? মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে। আমি একটা গল্পের ঘোরের মধ্যে নিশিপাওয়া মানুষের মতো তড়পাচ্ছি। অনন্যোপায় হয়ে বিজ্ঞাপন দিই প্রথম আলোয়। একাত্তর সালের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদ, যিনি ধরা পড়েছিলেন জুয়েল, বদি প্রমুখের সঙ্গে, তাঁর কোনো খোঁজ কি কেউ দিতে পারেন। নিচে আমার নাম, আর মোবাইল নম্বর।
    পরের দিন পত্রিকা প্রকাশিত হলে প্রথম আসে উড়ো কল। গালিগালাজ হজম করি। দ্বিতীয় ফোনটি করেন আজাদের দ্বিতীয় মা। যাঁকে আজাদের বাবা বিয়ে করেছিলেন বলে প্রতিবাদে আজাদের মা স্বামীর প্রাসাদোপম বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন সন্তানের হাত ধরে। আশ্রয় নিয়েছিলেন এক ছোট্ট ভাড়া বাসায়।
    মগবাজারে এখন যেখানে কুইনস গার্ডেন সিটি নামে অ্যাপার্টমেন্ট উঠেছে, সেখানে ছিল আজাদের বাবার বাড়ি। তারই পেছনে একটা দোতলা বাসায় থাকতেন আজাদের দ্বিতীয় মা। তিনি আমার সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করেন। আজাদের ছোটবেলার গল্প শোনান বিস্তারিত। তিনিই বলেন, কীভাবে গাড়ি চালিয়ে তিনি আজাদকে নিয়ে গিয়েছিলেন গুলিস্তানে, কিনে দিয়েছিলেন এলভিস প্রিসলির গানের রেকর্ড।
    দ্বিতীয় ফোনটি করেন গাজী আমিন আহমেদ, বামপন্থী রাজনীতিক, আজাদের দূর-সম্পর্কের ভাই, আমি ছুটে যাই তাঁর বাড়িতে। সেখান থেকে আমি সন্ধান পাই আজাদের নিত্যসহচর ও খালাতো ভাই জায়েদের। জায়েদ ভাইকে পাওয়া মানে সোনার খনি পেয়ে যাওয়া। আজাদের বাড়ির খবর, হাঁড়ির খবর, চিঠিপত্র, ফটোগ্রাফ—সব হাতে এসে যায়।
    একজনের পর একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান পাই আমি। কাজী কামাল উদ্দিন থেকে শুরু করে শহিদুল্লাহ খান বাদল—আমি ছুটে যাই সবার কাছে।
    তখন ৫১বর্তী ধারাবাহিক নাটকটার শুটিং হচ্ছে ডিওএইচএস মহাখালীর একটা বাড়িতে। রোজ সেখানে যাই শুটিং দেখার নাম করে, আর সেখানে না থেকে দুই বাড়ি পরে সাংবাদিক শাহাদত চৌধুরীর বাসভবনে ঢুকে পড়ি। দিনের পর দিন শাহাদত চৌধুরী আমাকে বলেন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর গল্প। কফি খেতে খেতে শাহাদত ভাই একবার কাঁদেন, একবার হাসেন।
    আমি আজাদের খালাতো ভাইবোন সবার সঙ্গে কথা বলতে তাঁদের বাড়ি বাড়ি যাই। টগর কিংবা মহুয়া—সবার কাছে আমি গেছি। একদিকে আমি সাক্ষাৎকার নিচ্ছি, বাড়িঘরগুলো দেখতে যাচ্ছি, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের বইপত্র, ইতিহাস পড়ছি। হাবিবুল আলম ভাই তাঁর ব্রেভ অব হার্ট বইয়ের পাণ্ডুলিপি দিয়ে দিলেন, জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র—দিন নাই রাত নাই আমি পড়ে চলেছি। তথ্য মোটামুটি যা পেয়েছি, হয়ে যাবে। এবার দরকার লেখাটাকে সাহিত্য করে তোলার প্রস্তুতি। গোর্কির মা, ব্রেশটের জননী সাহসিকা, মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা—মা নিয়ে কে কোথায় কী লিখেছেন, জোগাড় করে এনে আবারও পড়তে লাগলাম। আমার মতো স্বার্থপর পাঠক জগতে দ্বিতীয়টা নাই, আপনি একটা বই দিয়ে পড়তে বললেই আমি পড়ব না, আলস্যবশতই; কিন্তু যে বই আমার দরকার, সেটা পড়ে ফেলতে আমার পঞ্চ-ইন্দ্রিয় এতটুকুনও শ্রান্ত হবে না।
    তারপর এক সকালে লিখতে শুরু করলাম।
    তিন পৃষ্ঠা লেখা হলো। পছন্দ হলো না। স্রেফ ওই ফাইল বন্ধ করে আরেকটা ফাইল খুললাম।
    আবার প্রথম থেকে লেখা শুরু হলো। মায়ের সেই প্রথম তিন পৃষ্ঠার পরিত্যক্ত পাণ্ডুলিপি আমার কম্পিউটারে এখনো আছে।
    মা উপন্যাসের সংক্ষেপিত সংস্করণ প্রথম বেরোল প্রথম আলোর প্রথম ঈদসংখ্যায় ২০০২ সালে। বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে হইচই। আমাকে চিঠি লিখেছেন লেখকদের মধ্যে জিয়া হায়দার আর রফিকুর রশীদ, পাঠকদের কত চিঠি যে পেলাম। বই হয়ে বেরোল ২০০৩ সালে। এর মধ্যে আরও কয়েকজনের কাছ থেকে আরও নতুন তথ্য পেয়ে বইটাকে বড় করতে হলো ২০০৩ সালেই।
    আমার কাছে আজাদের চিঠিপত্র, ফটোগ্রাফ ইত্যাদি যা ছিল, তা আমি তুলে দেব মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের হাতে। তাই একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনেই। আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ ছিলেন, জায়েদ ভাই ছিলেন, আরও বেশ কজন ঢাকার গেরিলা উপস্থিত ছিলেন সেদিন।
    আজাদের মায়ের প্রিয় গান ছিল—আজি বাংলাদেশের হূদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।
    শিমূল ইউসুফ আমার অনুরোধে সেই গানটা গাইতে শুরু করলেন।
    আমি দর্শকসারিতে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। আমার কান্না কেউ থামাতে পারে না।
    গত দেড়টা বছর আমি ভীষণ একটা আবেগকে আমার বুকের মধ্যে পাথরচাপা দিয়ে রেখেছিলাম। আজ শিমূল ইউসুফের গান আমার বুকের পাথরটাকে সরিয়ে দিল।
    মা বইটি লিখে আমি কী পেয়েছি? একটা ছোট ঘটনা বলি। আজাদের খালাতো ভাই জায়েদ একদিন আমাকে বললেন, আপনার জন্ম কবে?
    আমি বললাম, কেন?
    তিনি বললেন, আপনি বইয়ে এমন কিছু ঘটনা লিখেছেন, যা আমি আপনাকে বলিনি। কিন্তু আপনি সেটা নির্ভুলভাবে লিখেছেন। যেমন আজাদ দাদা করাচি যাওয়ার আগে আমাকে হাতঘড়ি দিয়ে গিয়েছিল, এটা তো আমি আপনাকে বলিনি। আপনি কোথায় পেলেন।
    আমি বললাম, এটা আমি পেয়েছি রবিঠাকুরের ছুটি গল্পে। ফটিক কলকাতায় যাওয়ার সময় মাখনলালকে তার ঘুড়ি নাটাই সব দিয়ে যায়।
    জায়েদ বললেন, ‘না না, হতেই পারে না। আজাদ দাদারও কান বড় ছিল। আপনারও কান বড়। আপনার জন্ম কবে?’
    আমি বললাম, ‘আমার জন্ম ১৯৬৫ সালে, আর আজাদ শহীদ হয়েছেন ১৯৭১ সালে। পাগলামো কইরেন না।’
    আমি জায়েদ ভাইয়ের মনে এই ধন্দ যে তৈরি করতে পেরেছি একটা বই লিখে, একজন লেখক হিসেবে এর চেয়ে বেশি আমি কী চাইতে পারি। তবু বলি, এ দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা বুকের রক্ত দিয়ে আর বীর মায়েরা অশ্রু দিয়ে মায়ের কাহিনি রচনা করেছেন। ব্যর্থতার দায় লেখকের, গৌরবের ভাগ নয়!

    http://www.prothom-alo.com/detail/news/338473
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ২২ মার্চ ২০১৩ ২০:৩২582548
  • শেখ মুজিবুর রহমান
    আহমদ ছফা

    [ দুই বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজ ভাবনাকে এক মলাটের মধ্যে তুলে ধরার বাসনায় কবি গৌতম চৌধুরী গত শতকের ৯০ দশকে কলকাতা থেকে ‘যুক্তাক্ষর’ নামে একটি কাগজ বের করেছিলেন। প্রথম সংখ্যা বেরোয় আগস্ট ১৯৯৪ সালে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার বাংলাভাষীদের লেখা একই মলাটে পেশ করা। ওর মধ্য দিয়ে পরস্পরকে চেনা ও জানা ছিল প্রাথমিক একটি উদ্দেশ্য। কিন্তু আরও বড় আশা ছিল সীমান্তের দুই দিকেই উপমহাদেশের ইতিহাস ও তার ফলাফলকে নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে বিচার করবার চর্চা প্রশস্ত করা এবং তার ইতিবাচক ফল হিশাবে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজ ইতিহাস ভাবনা ইত্যাদির মধ্যে তা আত্মস্থ করা। অল্প কয়েকটি সংখ্যা বেরিয়েছিল, তবুও স্বল্প সময়ের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা উপহার দিয়েছিল ‘যুক্তাক্ষর’। তার মধ্যে রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান সম্বন্ধে আহমদ ছফার এই লেখা। গৌতম চৌধুরীর সৌজন্যে ‘চিন্তা’-র পাঠকদের জন্য লেখাটি এখানে পেশ করা হোল। লেখাটি বেরিয়েছিল মে ১৯৯৬ সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনি হিসাবে।]

    শেখ মুজিবুর রহমান।। আহমদ ছফা
    _____________________________________________
    "খুব সম্ভবত শেখ মুজিব একজন করুণ বীর, তাঁর চরিত্র অবলম্বন করে ভবিষ্যতে সার্থক বিয়োগান্ত নাটক লেখা হবে-কিন্তু তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে বাংলার ইতিহাসের মুক্তি ঘটানো যাবে না।"
    কথা উঠেছে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। এক দল বলছেন,শেখ মুজিব সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি, অন্তত বাংলার শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের একজন। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘জাতির পিতা’ এবং বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত মহানায়ক। তাঁরই সংগ্রামের উত্তাপ উপমহাদেশের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটিতে হাজার হাজার বছরের পরবশ্যতার সমূহ গ্লানি মুছিয়ে দিয়ে একটি নবীন রাষ্ট্র সম্ভাবিত করেছে।

    অন্যরা বলছেন না। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার জাতীয় ইতিহাসের একজন মস্তবড় ‘ভিলেন’ বা ‘খলনায়ক’। তিনি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। মুক্তি এবং স্বাধীনতার নামে তিনি বাংলার জনগণকে তাড়িত করে হতাশা এবং অন্ধকারের গোলকধাঁধার মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছেন।

    নায়ক পুরুষ, বীর এবং ভিলেন এই দুটি প্রবল মত অদ্যাবধি শেখ মুজিবের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হয়ে সর্বত্র ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। প্রকৃতপ্রস্তাবে শেখ মুজিবুর রহমান কী ছিলেন? বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা বীর? না কি মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে প্রতারণাকারী বাগাড়ম্বর সর্বস্ব ক্ষমতাদর্পী একজন মানুষ? বাংলার ইতিহাসে শেখ মুজিব কোন ভূমিকাটি পালন করে গেছেন?

    শেখ মুজিবুর রহমান কী ছিলেন? বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা বীর? না কি মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে প্রতারণাকারী বাগাড়ম্বর সর্বস্ব ক্ষমতাদর্পী একজন মানুষ? না কি, শেখ মুজিব ইতিহাসের সেসব ঘৃণিত ভিলেনদের একজন, যারা জনগণকে মুক্তি এবং স্বাধীনতার নামে জাগায় বটে, কিন্তু সামনে যাওয়ার নাম করে পেছনের দিকে চালনা করে।

    আচ্ছা, শেখ মুজিব কি বাঙালি জাতি, বাংলারে জনগণের কাছে একজন মহান শহিদ? যিনি সপরিবারে ঘৃণ্য গুপ্তঘাতকের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন বটে, কিন্তু বাংলার ইতিহাস পরম আদরে এই মহান সন্তানের রুধির-রঞ্জিত স্মৃতি লাল নিশানের মতো উর্ধ্বে তুলে নিরবধিকাল এই জাতির সামনে চলার প্রেরণার উৎসস্থল হয়ে বিরাজ করবে? জাতির সংকট মুহূর্তে বিমূর্ততার অন্তরাল ভেদ করে তেজীয়ান প্রাণবান মুজিব আবির্ভূত হয়ে করাঙ্গুল প্রসারিত করে সংকট ত্রাণের পথ নির্দেশ করবেন?

    না কি, শেখ মুজিব ইতিহাসের সেসব ঘৃণিত ভিলেনদের একজন, যারা জনগণকে মুক্তি এবং স্বাধীনতার নামে জাগায় বটে, কিন্তু সামনে যাওয়ার নাম করে পেছনের দিকে চালনা করে। একটা সময় পর্যন্ত জনগণ ভিলেনদের কথা শোনে, তাদের নির্দেশ শিরোধার্য করে মেনে নেয়। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারে শয়তানের প্রলোভনে মুগ্ধ হয়ে ফুল-ফসলে ঘেরা সবুজ উপকূলের আশায় পা বাড়িয়ে ভ্রান্ত স্বপ্নের ছলনায় ভ্রান্ত গন্তব্যে এসে উপনীত হয়েছে; তাদের আশা করার , বাসা করার, ভরসা করার কিছুই নেই, আছে শুধু পথ চলার ক্লান্তি, অনিশ্চয়তার হতাশা এবং প্রখর মরুভূমিতে মরীচিকার নিত্যনতুন ছলনা। তখন তারা তাদের ভাগ্যকে ধিক্কার দেয়, অভিশম্পাতের বাণী উচ্চারণ করে বহুরূপী সঙ নেতার নামে, যার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা এবং উচ্চকাংখার পতাকাকে নিরীহ শান্তিপ্রিয় খেটে খাওয়া জনগণ তাদের মুক্তি সনদ বলে ভুল করেছিল। শেখ মুজিবও কি একজন তেমন মানুষ? লক্ষ প্রদীদ জ্বালা স্তুতি নিনাদিত উৎসব মঞ্চের বেদীতলে সপরিবারে যাঁর মৃতদেহ ঢাকা পড়ে রইলে রাজপথে শোকের মাতম উঠল না, ক্রন্দন ধ্বনি আকাশে গিয়ে বিঁধল না, কোথাও বিদ্রোহ-বিক্ষোভের ঢেউ জলস্তম্ভের মতো ফুলে ফুলে জেগে উঠল না। এ কেমন মৃত্যু, এ কেমন পরিণতি শেখ মুজিবের সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের! সব চুপচাপ নিস্তব্ধ! তাহলে কি ধরে নিতে হবে বাংলাদেশের মানুষ যারা তাঁর কথায় হাত ওঠাত, দর্শন মাত্রই জয়ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করত, তাঁর এমন করুণ এমন ভয়ঙ্কর মৃত্যু দেখেও, ‘বাঁচা গেল’ বলে স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। ইতহাসের অন্যান্য প্রতারক ভিলেনদের ভাগ্যে সচরাচর যা ঘটে থাকে, শেখ মুজিবের ভাগ্যেও তাই কি ঘটেছে?

    একটি সদুত্তর প্রয়োজন। কী ছিলেন মুজিব? বীর? প্রতারক? অনমনীয় একগুঁয়ে উচ্চাকাংখী, চরম ক্ষমতালোভী একজন একনায়ক? একটা জবাব টেনে বের করে আনতে না পারলে বাংলার ভাবী ইতিহাসের পরিরেখাটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে না। বারংবার শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভূমিকাটি অনির্ণীত থেকে যাচ্ছে বলেই বাংলার, বাঙালি জাতির, ইতিহাসের পরিক্রমণ পথটি ক্রমাগত ঝাপসা, অস্পষ্ট এবং কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। এই ঐতিহাসিক অলাতচক্র যার মধ্যে দিনের আলোতে সবাই পথ হারায়, রাতে রাতকানা হয়ে থাকে। তবে ভেতর থেকে কেটে চিরে সামনে চলার পাথেয় স্বরূপ একটা অবলম্বন অবশ্যই খাড়া করতে হবে।

    শুধু শেখ মুজিব নয়, উনিশশো একাত্তর সালে যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে গেছে এবং যার গর্ভ থেকে বর্তমানের স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, তার চরিত্রটিও নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

    বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল -প্রোজ্জ্বল এক অচিন্ত্যপূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে দুর্বার গণআন্দোলনটি সৃজিত হয়েছিল তার লক্ষ্যের অস্পষ্টতা, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, এ সমস্ত বিষয়ে কারও দ্বিমত থাকার নয়। তদুপরি স্বায়ওশাসনের আন্দোলন রাতারাতি স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপলাভ ক’রে এশিয়ার একটি সেরা দুর্ধর্ষ বাহিনীর বিপক্ষে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণকে বলির পাঁঠার মতো দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। শেখ মুজিব এবং তাঁর দল আওয়ামি লিগ কারোরই এই প্রচণ্ড-পরিস্থিতির মোকাবেলা করার ক্ষমতা ছিল না। ফল যা হবার হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং মুক্তিসংগ্রাম পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় যাঞ্চা করতে গেল আর তেজোদ্দীপ্ত মুজিব পাকিস্তানের কারাগারে চলে গেলেন। এ হল নিরেট সত্য কথা। যদি আর কিন্তু দিয়ে ইতিহাস রচিত হয় না। যা ঘটেছে তাই-ই ইতিহাস।

    শেখ মুজিবুর রহমান মধ্যশ্রেণীভুক্ত মানুষ-মধ্যশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করাই হল তাঁর আনুপূর্বিক রাজনৈতিক জীবনের সারকথা। এই মুক্তিসংগ্রামের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে, জাতীয় আকাংখার নিরিখে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা বা শিক্ষা কোনটাই তাঁর ছিল না। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মাটি থেকে নির্বাসিত হয়ে ভারতে আশ্রয় ভিক্ষা করতে গেল।

    বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জড়িয়ে পড়া, সোভিয়েত রাশিয়ার সক্রিয় অংশগ্রহণ, ভারত-পকিস্তান যুদ্ধ এবং যুদ্ধে পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয়ের কারণে বর্তমান বাংলাদেশের অভ্যুদয় -- এসকল সত্য যদি সবাই অম্লান বদনে বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারে, তাহলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এ পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের যে একটি ভূমিকা ছিল সেটুকু মেনে নিতে বাধাটা কোথায়? বাংলাদেশের জন্মপ্রক্রিয়ায় ভারত তার স্বার্থ ছিল বলেই ধাত্রীর কাজ করেছে, একথা মথ্যে নয়। কিন্তু পৃথিবীর কোন দেশটি ইতিহাসের কোন পর্যায়ে এক ধরনের না এক ধরনের স্বার্থ ছাড়া অন্য দেশের প্রতি সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করেছে? ভারত পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য আওয়ামি লিগকে সব রকমের সাহায্য সহযোগিতা দিয়েছে এবং রাশিয়া তার দুনিয়া জোড়া সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব অটুট রাখার জন্য পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তো স্বাধীনতা চেয়েছিল এবং স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য সকল শ্রেণীর জনগণ মরনপণ করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। উনিশশো একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে বাংলাদেশের নানা শ্রেণীর মানুষ নানান দৃষ্টিকোণ থেকে যেভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, ক্ষয়িক্ষতি স্বীকার করেছে, বাংলার ইতিহাসের কোনও পর্যায়ে এমন সর্বাত্মক সার্বজনীন জাতীয় যুদ্ধ এবং গণযুদ্ধের সন্ধান কেউ দিতে পারবেন কি?

    মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে-বাংলাদেশ জন্মগ্রহণ করেছে তাকে মেনে নিতে কারও আপত্তি নেই। এমনকি যে সকল শ্রেণী,গোষ্ঠী ও স্বার্থবাদীচক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, তাদের বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিতে বাধছে না। কিন্তু মুজিবের অস্তিবাচক ভূমিকাটুকু মেনে নিতে তাতের ঘোর আপত্তি। এ এক মর্বিড মানসিকতা। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভিযাত্রার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক না থাকার যে লজ্জা, যে গ্লানি, সেটুকু রাখার অপকৌশল হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে তারা অক্ষম।

    অবশ্য কথা উঠতে পারে, উঠতে পারে কেন অবশ্যই উঠবে--বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের অগ্রযাত্রায় এক পর্যায় সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন শেখ মুজিব। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি মধ্যশ্রেণী গড়ে না উঠেছে ততদিন শেখ মুজিব পশ্চিমা পাকিস্তানি ধনিকদের লেজুড়বৃত্তি করেছেন, বাঙালি স্বার্থের বিরোধিতা করতেও কুণ্ঠিত হননি। অনেককাল পর্যন্ত ধনিকদের মতাদর্শই তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল। তাঁর মতো ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির এমন একনিষ্ঠ সেবক তৎকালীন পূর্বপাস্তিানে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যেত কি না সন্দেহ আছে। তিনি তখনই বাঙালি জাতিয়বাদের প্রশ্নটি নিয়ে মাঠে নেমেছেন যখন এদেশে একটি মধ্যশ্রেণী সৃষ্টি হয়ে গেছে। পশ্চিমাদের দ্বারা ক্রমাগত নিগৃহীত হয়ে এই শ্রেণীটি যখন সোচ্চার হতে শিখেছে, সেই সময়েই শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দল আওয়ামি লিগকে মধ্যশ্রেণীর প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হিসেবে দাঁড় করান। সুতরাং শেখ মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাতীয় মধ্যশ্রেণীর জাতীয়তবাদ। যেটি সমাজের শেষিত শ্রেণী নয়। ক্ষুদে শোষক শ্রেণী, বড় শোষক সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সংযোগ তার প্রত্যক্ষ নয়। পাকিস্তনি শোসকদের মাধ্যমেই তার লেনদেন চলছিল। অর্থনৈতিক এবং শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতেই হবে সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের সঙ্গে একটা প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপন করাই ছিল বাঙালি মধ্যশ্যেণীর মূল অভীষ্ট।

    শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের মাধ্যশ্রেণীর দাবিদাওয়ার মোড়ক, যা চিহ্নিত হয়েছিল ‘বাঙলি জাতীয়তাবা’দ নামে, তাই নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন এবং অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে গোটা বাংলাদেশের জনমত তাঁর সপক্ষে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। এটা একমাত্র বক্তব্য নয় -- বারো হাত কাঁকুড়ের তের হাত বীচির মতো, তার পেছনে আরও বক্তব্য রয়েছে। গোড়া থেকেই আওয়ামি লিগের রাজনীতি মূলত পুঁজিবাদী রাজনীতি এবং স্পষ্ট ও প্রকাশ্যভাবে সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করাই ছিল আওয়ামি লিগ দলটির অন্যতম বৈশিষ্টসমূহের একটি।

    বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের অগ্রযাত্রায় এক পর্যায় সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন শেখ মুজিব। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি মধ্যশ্রেণী গড়ে না উঠেছে ততদিন শেখ মুজিব পশ্চিমা পাকিস্তানি ধনিকদের লেজুড়বৃত্তি করেছেন, বাঙালি স্বার্থের বিরোধিতা করতেও কুণ্ঠিত হননি। অনেককাল পর্যন্ত ধনিকদের মতাদর্শই তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল। তাঁর মতো ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির এমন একনিষ্ঠ সেবক তৎকালীন পূর্বপাস্তিানে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যেত কি না সন্দেহ আছে।

    যেসকল বামপন্থি সংগঠন পূর্ববাংলার স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা বলত, দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা উচ্চারণ করত, আওয়ামী লিগ বারবার তাদের বিরোধিতা করেই এসেছে। পাকিস্তানের ইঙ্গমর্কিন সামরিক জোটে অংশগ্রহণের প্রশ্নে সুহরাওয়ার্দি এবং মওলানা ভাসানিকে কেন্দ্র করে সেই যে আওয়ামি লিগ, আওয়মি লিগ এবং ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি নাম নিয়ে দ্বিখণ্ডিত হল, তারপর থেকে বলতে গেলে উনশশো আটষট্টি উনসত্তর সাল পর্যন্তও আওয়ামি লিগ সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে এসেছে। এমকি ছয়দফা যখন বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে তখনও আওয়ামি লিগ সমাজতন্ত্রের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করছে।

    তৎকালীন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে যেসকল বামপন্থী রাজনৈতিক দল প্রথমেই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তাঁদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা শেখ মুজিবুর রহমানের অভূতপূর্ব সাফল্যের অন্যতম কারণ বললে খুব বেশি বলা হবে না। তাঁরা জাতিসত্তার মুক্তির প্রশ্নটি উচ্চরণ করেছিলেন বটে, কিন্তু জাতি যখন ভেতর থেকে জাগ্রত হয়ে দাবি আদায়ের পথে প্রচণ্ড বেগে অগ্রসর হচ্ছিল, তাঁরা কোনও হাল ধরতে পারেননি। এই পরিস্থিতির সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করেছেন শেখ মুজিব এবং তাঁর দল আওয়ামি লিগ। এটা কেন ঘটল, কেমন করে ঘটল, অনেকে অনেক কথা বলবেন। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের দ্বিধাবিভক্তি,বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে তা্র প্রতিক্রিয়া –এক অংশের মস্কোর প্রতি অনবচ্ছিন্ন আনুগত্য এবং অন্য অংশের পিকিংয়ের নির্লজ্জ লেজুড়বৃত্তি-এসব বিষয় অবশ্যই ধর্তব্যের মধ্যে আসবে। তাছাড়া পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ, সেই যুদ্ধে মস্কোর মধ্যস্থতা এবং তার মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান মিলিয়ে এশিয়ায় চীন-বিরোধী একটা ব্লক তৈরি করার সোভিয়েত অভিপ্রায় এবং অন্যদিকে যুদ্ধে সরাসরি চীনের পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন, চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক, মওলানা ভাসানি এবং চীনপন্থী কমিউনিষ্ট পার্টির আয়ুব খানের প্রতি দুর্বলতা, তাছাড়া পশ্চিম বাংলার নকশাল নেতা চারু মজুমদারের সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির মড়কের মতো প্রভাব, বামপন্থী দলগুলোকে জাতিসত্তার মুক্তির দাবি থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। সত্য বটে উনিশশো সত্তরের নির্বাচনের প্রাক্কালে ন্যাপ এবং কমিউনিষ্ট পার্টির মস্কো সমর্থক অংশ জাতিসত্তার মুক্তির দাবিতে আওয়ামি লিগের সঙ্গে একমত পোষণ করে মাঠে নেমেছিলেন, কিন্তু , তখন অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে। নির্বাচনের সময় থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় পর্যন্ত এমন কি তার পরেও শেখ মুজিবুর রহমান যতদিন জীবিত ছিলেন, আওয়ামি লিগের তল্পিবহন করে মস্কোর নামে জয়ধ্বনি উচ্চরণ করা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে সত্যিকার অর্থে পালনীয় কোনও ভূমিকা তাদের ছিল না। বড় তরফের কাছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অম্লান বদনে আত্মসমর্পণ –এ্কে যথার্থ যুক্তফ্রন্ট বলা যাবে কি না তা সত্যি সত্যি বিতর্কের বিষয়।র

    সে যাই হোক, বামপন্থী রাজনীতির অন্যান্য অংশসমূহ সেই যে জাতীয় রাজনীতির প্রধান স্রোতধারা থেকে, মূল শিকড় থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল, সেই খাতে অদ্যাবধি আর ফিরে আসতে পারেননি। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতীয় মধ্যশ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিনিধি। তিনি তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে, তাঁর নিজস্ব শ্রেণীটির স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে মুক্তিসংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। এই জাতীয় মাধ্যশ্রেণীটি দুধের সরের মতো সবেমাত্র ভাসতে সুরু করেছে। আপন মেরুদণ্ডের ওপর থিতু হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা তার নেই। মধ্যশ্রেণীর দাবির সঙ্গে জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে বাংলাদেশের শোষিত মানুষের দাবি সমসূত্রে এসে মেশার ফলে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন নতুন বেগ এবং আবেগ সঞ্চয় করে রাতারাতি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে। বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষ অগ্নিতে পতঙ্গের মতো এই মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ব্যাপ্তি এবং গভীরতার দিক দিয়ে বিচার করলে উনিশশো একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের মতো ঘটনা বাংলার আবহমান ইতিহাসে আর দ্বীতিয়টি নেই ।

    শেখ মুজিবুর রহমান মধ্যশ্রেণীভুক্ত মানুষ-মধ্যশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করাই হল তাঁর আনুপূর্বিক রাজনৈতিক জীবনের সারকথা। এই মুক্তিসংগ্রামের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে, জাতীয় আকাংখার নিরিখে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা বা শিক্ষা কোনটাই তাঁর ছিল না। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মাটি থেকে নির্বাসিত হয়ে ভারতে আশ্রয় ভিক্ষা করতে গেল।

    শেখ মুজিবুর রহমানের দোদুল্যমান নেতৃত্ব এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে ভারতের যুদ্ধে পরিণত হল, এর জন্য অনেকে শেখ মুজিবকে দায়ী করেন এবং তাঁকে জাতীয় বেঈমান ইত্যাদিও আখ্যা দিয়ে থাকেন।

    এ তো হল চিত্রের এক দিক। অপর দিকে দৃষ্টিপাত করলে কী দেখতে পাই? শেখ মুজিবের সুবিধাবাদী দোদুল্যমান নেতৃত্ব নেগেট করতে পারার মতো বিকল্প নেতৃত্বের অস্তিত্বে সেদিন বাংলাদেশে কোথায়? শেখ মুজিবুর রহমানের দোদুল্যমান নেতৃত্ব এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে ভারতের যুদ্ধে পরিণত হল, এর জন্য অনেকে শেখ মুজিকে দায়ী করেন এবং তাঁকে জাতীয় বেঈমান ইত্যাদিও আখ্যা দিয়ে থাকেন। কিন্তু একটার পর একটা ভুলের মাধ্যমে আওয়ামি লিগের বিকল্প নেতৃত্ব নির্মাণের সুযোগ হেলায় অপব্যায় করে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে সাক্ষীগোপালের ভূমিকা পালন করেছেন কিংবা স্থলবিশেষে জাতির শক্রদের সাথে হাত মিলিয়েছেন, তাঁরাই বা জাতির প্রতি এমন কি বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছেন? শেখ মুজিব কী ভূমিকা পালন করেছে, অন্য দশটা রাজনৈতিক দল এবং নেতা কী ভূমিকা পালন করেছেন সেই মানদণ্ডেই তা নির্ণয় করতে হবে। সেদিন যদি শেখ মুজিব তাঁর শ্রেণীগত ভূমিকাটি পালন না করতেন তাহলে কি খুব ভালো করতেন?

    একট প্রশ্ন অবশ্যই জিজ্ঞাস্য। শেখ মুজিব সময়ের সন্তান, না সময়ের পিতা? সেই সময়ের বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক বাস্তবতা বিরাজ করছিল তাতে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা প্রয়োগ করে তিনি তার কতদূর গুণগত পরিবর্তন সাধন করতে পেরেছিলেন? না কি সময়ের স্রোতে বাহিত হয়ে কেবলমাত্র তাঁর ভাবমূর্তিটাই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর রূপে ক্রমাগত অভ্রভেদী হয়ে উঠেছিল। এ প্রশ্নে আমাদের স্পষ্ট উত্তর, শেখ মুজিব সময়ের সন্তান, সময়ের পিতা নন। সেসময়ে বাংলাদেশের সামন্তবাদী মুসলিম লিগ রাজনীতির ক্ষীণতম প্রভাবটুকু আর অবশিষ্ট নেই। বামপন্থী রাজনীতি দিশেহারা, বিপথগামী, শতধা বিচ্ছিন্ন এবং পক্ষাঘাত রোগে আ্ক্রান্ত। মাঠে শেখ মুজিব ছাড়া আর কেউ নেই। আর জাতির অন্তরের মুক্তিপিপাসা সমুদ্রের কটাল জোয়ারের তরঙ্গের মতো ফেটে ফেটে পড়ছে। শেখ মুজিবুর রহমান সেইসময় জাতিকে অঙ্গুলি হেলনে ডাইনে বাঁয়ে সামনে পেছনে যেদিকে ইচ্ছা পরিচালিত করতে পারতেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভয়াবহ প্লাবনে গোটা দেশ ভেসে যাচ্ছে।

    কিন্তু এ কোন বাঙালি জাতীয়তাবাদ? মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্বের ভিত পচে গলে একাকার, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার শেষ শেকড়টাও উপড়ে ফেলে দশ কোটি মানুষের সামনে যে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা মূর্তিমান হয়ে দেখা দিয়েছে তাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বললে ভুল করা হয়না। কিন্তু একটি লাগসই ব্যাখ্যা প্রয়োজন। উনিশশো সাতচল্লিশ সালে হিন্দু জাতীয়তা এবং মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও ভারতীয় রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা স্বীকার করেননি যে হিন্দু জাতীয়তাই হল ভারত রাষ্ট্রের ভিত্তি। মুসলিম জাতীয়তার ভিত ভেঙে বাংলাদেশে যখন নতুনতর জাতীয় সংগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে তখন ভারতের ক্ষমতাসীন শাসক কংগ্রসের তাত্ত্বিকের বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুল সংশোধন হিসাবে ব্যাখ্যা করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তাঁদের মতামত আওয়ামি লিগের চিন্তাধারাকে যে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। জাতীয় সংগ্রাম যখন তুঙ্গে সেইসময় মুজিবের ভক্তরা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ আখ্যা দিচ্ছেন, নতুন ধরনের মুজিব কোট, মুজিব টুপি চালু করছেন। বঙ্গবন্ধু শব্দটির সঙ্গে দেশবন্ধুর একটি সাদৃশ্য অতি সহজে চোখে পড়ে। মুজিব কোটের সঙ্গে জওহরলাল নেহরু ব্যবহৃত জ্যাকেট এবং মুজিব টুপির সঙ্গে সুভাষবসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের টুপির ঈষৎ পরিবর্তিত মিল দেখলে অতি সহজেই বোধাগম্য হয় যে-সকল প্রতীক ব্রিটিশ বিরোধী সংগামে ভারতীয় কংগ্রেস অনুসৃত ভারতীয় জাতীয়তার স্মারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোই সামান্য পরিবর্তিত চেহারায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে নতুনভাবে জেগে উঠতে শুরু করেছে। এমন কি শেখ মুজিবুর রহমানের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনটির কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে আবার মহাত্মা গান্ধীর আদর্শের নব-উত্থান লক্ষ করে অনেক ভারতীয়ই উল্লসিত হয়ে উঠেছিলেন, এ কারণে যে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন অনতিবিলম্বে তা পূর্ণ হতে যাচ্ছে। পাকিস্তান ভেঙ্গে পড়ছে এবং খণ্ডিত ভারত আবার জোড়া লেগে অখণ্ড রূপে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। উনিশশো একাত্তর সালের বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্বের রূপটি দর্শন করে ভারতের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর এ মনোভাব জাগ্রত হওয়া একটুও অস্বাভাবিক নয় যে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে ভারতের সঙ্গে মিলেমিশে না যাক, অন্তত ভারতের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে। সে কারণে অনেকেই শেখ মুজিবুর রহমানকে মহাত্মা গান্ধীর মানসপুত্র বলে অভিহিত করতে কুণ্ঠিত হননি।

    বঙ্গবন্ধু শব্দটির সঙ্গে দেশবন্ধুর একটি সাদৃশ্য অতি সহজে চোখে পড়ে। মুজিব কোটের সঙ্গে জওহরলাল নেহরু ব্যবহৃত জ্যাকেট এবং মুজিব টুপির সঙ্গে সুভাষবসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের টুপির ঈষৎ পরিবর্তিত মিল দেখলে অতি সহজেই বোধাগম্য হয় যে-সকল প্রতীক ব্রিটিশ বিরোধী সংগামে ভারতীয় কংগ্রেস অনুসৃত ভারতীয় জাতীয়তার স্মারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোই সামান্য পরিবর্তিত চেহারায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে নতুনভাবে জেগে উঠতে শুরু করেছে।

    অথচ বাংলাদেশে উনিশশো বাহান্ন সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে উনিশশো আটাষট্টি-উনসত্তরের স্বাধিকার আন্দোলন এবং উনিশশো একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম পর্যন্ত সংগ্রামের ধারাটি এবং ভারতের অবহেলিত রাজ্যগুলোতে তার যে প্রভাব পড়েছে, বিশ্লেষণ করে দেখলে ভারতের শোষিত অঞ্চল এবং জনগোষ্ঠীর শোষণমুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে একটা সাযুজ্য, একটা মিল, একটিা প্রবহমানতা অনায়াসে আবিস্কার করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের কথা ধরা যেতে পারে। এ আন্দোলনের অব্যবহিত পরেই হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তামিল ভাষাভাষী অঞ্চলে এবং সংস্কৃতির অবাধ বিকাশের দাবিতে আন্দোলন এবং বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। পরবতীকালে অন্যান্য ভাষাভাষী অঞ্চলেও কমবেশি এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভারতের রাজ্যসমূহের অনেকগুলোতে যে নতুন করে স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ এবং তুমুল গণসংগ্রাম ভারতীয় ইউনিয়নের ঐক্যের ভিতটিকে একরকম কাঁপিয়ে তুলেছে তার স্বরূপটি উপলব্ধি করলেই বাংলাদেশের জাতীয় সংগ্রামের চরিত্রটি অনাইয়াসে উদঘাটন করা সম্ভব হবে। আসলে ভারতবর্ষ হিন্দু-মুসলমান দু’জাতির দেশ নয়। ভারত বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দেশ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিদায়কালে অবহেলিত অঞ্চল, জনগোষ্ঠী এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ভারতীয় হিন্দু-মুসলমান বুর্জোয়া শ্রেণীর চাপে সোচ্চার এবং মারমুখী হয়ে উঠতে পারেনি। অবহেলিত অঞ্চল এবং জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সংগঠিত হয়ে বুর্জোয়া নেতৃত্বের কোনও চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি এবং আপোষে হিন্দু এবং মুসলিম বুর্জোয়া শ্রেণী দেশবিভাগের ঐক্যমতে পৌছায়। মোটামুটি হিসেবে দশকোটি মুসলমান এবং ত্রিশকোটি হিন্দু ধরে নিয়ে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির বেলায় দু’অঞ্চলের ভৌগোলিক দূরত্ব এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। শুধু মুসলমান পরিচয়টাকেই একমাত্র পরিচয় বলে ধরা হয়েছে। তেমনি হিন্দু পরিচয়ের ক্ষেত্রেও অনেকগুলো পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যকে ধর্তব্যের বিষয় বলেই গণ্য করা হয়নি। হিন্দুদের মধ্যে বর্ণহিন্দু এবং হরিজন রয়েছে। তাদের মধ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক যে ব্যবধান, যে দূরত্ব যে বৈষম্য বিরাজমান তা হিন্দু-মুসলমানের দূরেত্বের চাইতে কম নয়। এ ছাড়াও রয়েছে আদিবাসী এবং শিখ। এক সম্প্রদায় কর্তৃক অন্য সম্প্রদায়ের এক অঞ্চল কর্তৃক অন্য অঞ্চলের শোষণ এবং এক জাতিগোষ্ঠী কর্তৃক অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির নিপীড়ন সমানে চলে আসছে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেরে ভারত বহু জাতি , বহু ভাষা এবং বহু সংস্কৃতির দেশ। এখানে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া কিংবা চীনের মতো একটা বিপ্লব ঘটে গেলে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এই দ্বন্দ্বসমূহের হয়তো নির্বাসন করা সম্ভব হত। ভারতের হিন্দু-মুসলমান বুর্জোয়া তাদের শ্রেণীগত কারণে একটা বিপ্লবের পথরোধ করার উদ্দেশ্যেই ভারত বিভাগকে কবুল করে নিয়েছিল।

    ঐতিহাসিকভাবে ভারত উপমহাদেশের সমস্ত অঞ্চল দীর্ঘকাল একসঙ্গে অবস্থান করার কারণে রাষ্ট্রীয় সীমানা আলাদা হওয়া সত্ত্বেও একের প্রভাব অন্যের উপর পড়তে বাধ্য। এখন আসা যাক বাংলাদেশের জাতীয় সংগ্রামের স্বরূপটি নিরূপণের প্রশ্নে। ভারত বহুভাষিক, বহুজাতিক দেশ। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সেই সত্যকে আরও প্রোজ্জ্বল এবং আরও বাস্তবভাবে তুলে ধরেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে বাংলাদেশের সামনে কতিপয় সুযোগ ছিল। তাই প্রথম চোটেই সে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেড়েছে। অপরপক্ষে ভারতের রাজ্যসমূহের সে সুযোগ ছিল না। ক্রমাগত যতই দিন এগিয়ে যাচ্ছে এই দ্বন্দ্বসমূহ একসার অগ্নিগিরির মতো একটা পর একটা জ্বলে উঠতে আরম্ভ করছে। ভারতীয় রাজনীতি কেন্দ্রমুখী এবং কেন্দ্রবেরোধী এই দুটি ধারা মূলত গোষ্ঠীবিশেষের শোষণ এবং তার বিরুদ্ধে শোষিত অঞ্চল এবং গণগোষ্ঠীসমূহের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ মিলেই গড়ে উঠেছে। শোষিত জাতিসত্তাসমূহের জাতীয়তার দাবি রাষ্ট্রের সহায়তা আরোপিত ভারতীয় জাতীয়তার জগদ্দল পাথরের তলায় চাপা পড়ে রয়েছে। অতি সাম্প্রতিককালে তা পাঞ্জাব, আসাম, কাশ্মীর, মিজেরাম এবং নাগাল্যান্ড ইত্যাদি অঞ্চলে প্রবল ঝঞ্ঝার বেগ নিয়ে জাগ্রত হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে।

    বাংলাদেশের জাতীয়তার যে সংগ্রাম, শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে ভারতে নির্যাতিত জাতিসমূহের সংগ্রামের সঙ্গে তার অনেক বেশি সাযুজ্য। তাই বাংলাদেশের জাতীয়তাকে কিছুতেই মুহাম্মদ আলি জিন্নহর দ্বিজাততত্ত্বের ভুল সংশোধন বলা যাবে না। বরঞ্চ একথা বলাই যুক্তি সঙ্গত যে বাংলাদেশের জাতীয়তার সংগ্রাম ভারতর্ষের বহুজাতীয়তার সংগ্রামের পূর্বাভাস মাত্র। বাঙালি জাতীয়তার এই দুটি পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে শেখ মুজিব প্রথমটাকেই মেনে নিয়েছিলেন,অর্থাৎ তিনি এবং তাঁর দল রাজনীতির ভিত্তি স্বরূপ দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যর্থতাকেই আসল অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। অত্যাচার নির্যাতন এবং অবদমনের কংসকারায় ভারতীয় রাজ্যসমূহের জাতীয়তার যে নতুন অভিধা তৈরি হচ্ছিল, তার সবটুকু দৃষ্টিগোচর নয়। প্রব্ল প্রক্ষোভে কোথাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে, কোথাও একেবারে ভ্রণাবস্থায় সংগুপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশ নিজের মুক্তির সংগ্রাম করতে গিয়ে এই জাতিসত্তাসমূহের সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করেছেন -- এই সত্য মুজিব কিংবা আওয়ামি লিগ কখনও উপলব্ধি করেননি। ব্রিটিশ বিরোধী টুটাফাটা ভারতীয় কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপজীব্য বলে ধরে নিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মধ্যশ্রেণী যাদের অধিকাংশই শুরুতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের পর্যন্ত বিরোধিতা করেছিল তারাই শেখ মুজিবের চারপাশের জুটে সমস্ত পরিবেশটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

    শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তার আসল প্রেক্ষিতটাই নির্ণয় করেননি। গোটা জাতি যখন চূড়ান্ত সংগ্রাম কাঁধে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত তিনি জনগণকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য তৈরি না করে তাদেরকে একটার পর একটা তামাশার মধ্যে ঠেলে দিয়ে অনাবশ্যক সময় হরণ করেছেন। আর ইত্যবসরে পাকিস্তানিরা জাহাজে প্লেন বোঝাই করে পশ্চিমাঞ্চল থেকে সৈন্য এবং মারণাস্ত্র এনে সেনা ছাউনিগুলি বোঝাই করে ফেলেছে। সেই সম্ভাবনায়ময় সময়ের কোনও সুযোগ তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ তাঁর ভয় ছিল, করতে গেলে মধ্যশ্রেণীর নেতৃত্ব কাচের ঘরের মতো চুরমার হয়ে ভেঙে পড়বে। তথাপি জনমতের প্রবল ঝড়ের ঠেলায় তাঁকে স্বাধীনতার নামটি উচ্চারণ করতে হয়েছিল। ব্যাস ওইটুকুই। বস্তুত বাঙালি সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গীতাঞ্জলি নয়, সোনার তরী নয়, ‘আর দাবায়ে রাখাবার পারবা না’। সহস্রাধিক বছরের পরাধীন জীবনের অস্তিত্বের প্রতি সসাসরি অম্বীকৃতি জানিয়ে এই উচ্চারণের মাধ্যমে গোটা জাতির চিত্তলোকে তিনি এমন একটা অনমনীয় আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করেছিলেন যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরাট এক প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এই গৌরব শেখ মুজিবকে অবশ্যই দিতে হবে।

    যা বলছিলাম, শেখ মুজিব সময়ের সন্তান, পিতা নন। ঘটনার গতি তাঁকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল, তিনি ঘটনাস্রোত নিয়ন্ত্রণ করে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের পানে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। সময় শেখ মুজিবকে সৃষ্টি করেছে। অভিনব সম্ভাবনা সম্পন্ন সময়ের স্রষ্টা তিনি নন। তাঁর জাতীয়তার বোধ অতীতের, ভবিষ্যতের নয়। অতীতচারী জাতীয়তার মোহে আবিষ্ট শেখ মুজিব মধ্যযুগীয় নাইটের মতো বীরত্ব সহকারে পাকিস্তানের কারাগারে চলে গেলেন। প্রতিরোধ সংগ্রামে লণ্ড ভণ্ড ছত্রখা হয়ে পড়ল। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিল। ভারত সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র সম্পূর্ণ পালটে যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের দোদুল্যমান এই নেতৃত্ব জাতিকে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জনের পুরোপুরি গৌরব থেকে চিরকালের জন্য বঞ্চিত করছে এবং ভারতের সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জনের মাশুল অনেকদিন পর্যন্ত শোধ করতে হল বাংলাদেশকে।

    বাংলাদেশের জাতীয়তার যে সংগ্রাম, শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে ভারতে নির্যাতিত জাতিসমূহের সংগ্রামের সঙ্গে তার অনেক বেশি সাযুজ্য। তাই বাংলাদেশের জাতীয়তাকে কিছুতেই মুহাম্মদ আলি জিন্নহর দ্বিজাততত্ত্বের ভুল সংশোধন বলা যাবে না। বরঞ্চ একথা বলাই যুক্তি সঙ্গত যে বাংলাদেশের জাতীয়তার সংগ্রাম ভারতর্ষের বহুজাতীয়তার সংগ্রামের পূর্বাভাস মাত্র। বাঙালি জাতীয়তার এই দুটি পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে শেখ মুজিব প্রথমটাকেই মেনে নিয়েছিলেন,অর্থাৎ তিনি এবং তাঁর দল রাজনীতির ভিত্তি স্বরূপ দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যর্থতাকেই আসল অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

    বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম যে ভারতের নিজস্ব যুদ্ধে পরিণত হল তার পেছনে যে কারণটি সক্রিয় তা হল শেখ মুজিবের নেতৃত্বধীন মধ্যশ্রেণীভুক্ত আওয়ামি লিগের শ্রেণীচরিত্র। বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলধিতল মন্থিত করে নতুন ভূখণ্ড জেগে ওঠার মতো প্রতিরোধের প্রবল আকাংখা নিয়ে বাংলাদেশের নিচের দিকের সামাজিক স্তরসমূহ ঠেলে উপরদিকে উঠে এসেছে। এই জাগরিত জনসংখ্যা এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা দর্শন করে শেখ মুজিব আশান্বিত হওয়ার চেয়ে অধিক আতঙ্কিতই হয়েছিলেন। কারণ শেখ মুজিব তাঁর শ্রেণীর দম কতদূর, লক্ষ কোথায়, এদের নিয়ে কতখানি যেতে পারবে,ন জানতেন। এই সংকটপূর্ণ সময়ে একচুল এদিক ওদিক হলে কাচের তৈজসপত্রের মতো নেতৃত্ব যে খানখান হয়ে ভেঙে পড়বে তিনি সে বিষয় বিলক্ষণ অবগত ছিলেন। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা অর্থাৎ যুদ্ধ করবার সংকল্প নিয়ে জেগে ওঠা জাতিকে যুদ্ধ করার প্রস্তুতির দিকে চালিত না করে, তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা পথ বেছে নিলেন। আলোচনার ছল করে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান থেকে নৌপথে, আকাশপথে সৈন্য এনে ব্যারাক ভর্তি করে চরম মুহূর্তটির অপেক্ষা করছেন। পঁচিশে মার্চে রাত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিস্তব্ধ নগরীর নিরস্ত্র জনগণের উপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়ল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল কী? তথাপি বাংলাদেশের জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রাম নির্মূল করা পাকিস্তনি সেনাবাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। জনগণ, হাতের কাছে যা পেয়েছে, তাই দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছে। কামান, বন্দুক, স্যাভার জেটের সামনে বলতে গেলে খালি হাতে কতদূর! খুনি, জল্লাদ ইয়াহিয়া বাহিনীর হাতে মারের পর মার খেয়ে উলঙ্গ অসহায় অবস্থায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

    শেখ মুজিব কিংবা আওয়ামি লিগের যুদ্ধ করার কোনও পূর্ব-পরিকল্পনা থাকলে,ভারত থেকে আগেভাগে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র আনিয়ে রাখতেন। বাংলাদেশের একটা অঞ্চল যদি মুক্তিসেনাদের দখলে থাকত এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ চালানো হত, আমাদের মুক্তিসংগ্রামের চরিত্রটি সম্পূর্ণ পালটে যেতে পারত। আমাদের মুক্তিসেনাদের সাহসের অভাব ছিল না, আত্মত্যাগের বেলায় তারা পরন্মুখ হননি। কিন্তু অভাব ছিল অস্ত্রের। একমাত্র উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের মোকাবিলায় টিকতে না পেরে আমাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম বারবার পিছু হটে শেষ যাত্রার ভারতে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছে। ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কারণে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সম্বন্ধে পাকিস্তানিদের ভ্রান্ত প্রচারণা আন্তর্জাতিক মহলে অনেক সংশয় সৃষ্টি করেছে। বলতে হবে শেখ মুজিব এবং আওয়ামি লিগ নেতৃত্ব ইচ্ছে করে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন অথবা একটি সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কোনও পরিপূর্ণ ধারণাই তাঁদের ছিল না। আশা করি সকলে একমত হবেন বিমান এবং ট্যাংক ধ্বংসী কিছু অস্ত্রসহ শুরুতে অন্তত দু’তিনটি জেলায় ঘাঁটি গেড়ে বসা যেত, বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ওই যুদ্ধ সম্পন্ন করা যেত। পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধটা সরাসরি বাঙালিদের সঙ্গে বাংলাদেশের মাটিতে হলে বাংলাদেশি জনগণের মনেও ভিন্নরকম প্রতিক্রিয়া হত। মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের আগ্রাসী যুদ্ধ মনে করে অনেক দেশপ্রেমিক নাগরিক এ যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। সেটি ঘটতে পারত না।

    ‘গলদ আমাদের চরিত্রের মধ্যে, গ্রহ-নক্ষত্র সে জন্যে দায়ী নয়।’ শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে পর্যালোচনার কালে শেক্সপীয়র উল্লেখিত পাঙক্তিটি খুবই সারগর্ভ এবং তাৎপর্যবহ বলে প্রতীয়মান হবে। মানুষ জীবন দিয়েই তো সবকিছু করে। তার কোনও কর্মই জীবন থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন নয়। শেখ সাহেব তাঁর নিজের সম্পর্কে কিছু লিখেননি বা অন্য কেউই এ পর্যন্ত অনুসন্ধান বা গবেষণা ইত্যাদির সাহায্যে তাঁর জীবনকথা রচনা করেননি। তাঁর ওপর আজতক যেসমস্ত পুস্তক আমাদের দেশে প্রকাশিত হয়েছে তাতে তাঁর মানস গঠনের চরিত্র কেউ তুলে ধরেননি। শেখ মুজিবের পোশাকি জীবন এবং তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের খতিয়ান হয়ত পাওয়া যাবে, কিন্তু ব্যক্তি মুজিবকে সেখানে থেকে খুঁজে বের করা অনেকটা খড়ের গাদায় সূচের তালাশ করার মতই দুরূহ ব্যাপার।

    যে যাই হোক, শেখ সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে কলকাতা শহরে। ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ থেকে আনুমানিক ত্রিশের দশকের একেবারে শেষ এবং চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে তিনি ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র হিসেবে কলকাতা শহরে আসেন। তখন অবিভক্ত বাংলায় শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের মুখ্যমন্ত্রীত্বের কাল। মুসলিম লিগের দাবিতে পাকিস্তান আন্দোলনের হাওয়া জোরেসোরে বইতে শুরু করেছে। কংগ্রেস রাজনীতি গান্ধী এবং সুভাষ বসুর মতাদর্শগত পার্থক্যকে কেন্দ্র করে দুই মেরুতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যুবক মুজিবের কলকাতা আগমনের অনতিকাল পূর্বে সুভাষ বুসু জাপান-জার্মনির সহায়তায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতবর্ষ স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে দেশ থেকে অন্তর্ধান করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লক জাতীয় রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয়। কমিউনিষ্ট পার্টি কলে মিলে কারখানায়, কৃষক সমাজে এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকখানি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। শেখ মুজিবের মতো আত্মপ্রত্যয় সম্পন্ন গতিশীল একজন যুবক কলকাতা শহরে এসে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি অঙ্গিকার ক’রে মুসলিম লিগে নাম লেখালেন। তখনকার পরিবেশ পরিস্থিতির বিচারে এটাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু মুজিবের পরবর্তী কর্মকাণ্ড বিবেচনার মধ্যে ধরলে তা খানিকটা বিস্মিত করে। হুমায়ুন কবিরও ফরিদপুর জেলার মানুষ। তৎকালীন মুসলিম ছাত্রসমাজে তিনি ছিলেন একটা দৃষ্টান্ত। হুমায়ুন কবির কংগ্রেস রাজনীতিতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তৎকালীন পূর্ববাংলার কৃষক সমাজ থেকে আগত কমরেড মুজফফর আহমদ কমিউনিস্ট রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেছেনে। তাঁর (মুজিবের) রাজনৈতিক জীবনের সূচনাপর্বে এ দু’জনের কেউই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। মুজিবের মতো একজন প্রাণবান তোজাদ্দীপ্ত যুবক অতি সহজে নেতাজি সুভাষ বসুর ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগদান করতেন পারতেন, এটা আশা করা মোটেই অন্যায় নয়। কিন্তু তিনি মুসলিম লিগের রাজনীতিকে কবুল করলেন। বাংলার মুসলিম লিগের মধ্যে আবার তিনটি উপদল। একটির নেতৃত্ব চ্ছিল খাজা নাজিমুদ্দিন। সামন্ত ভূস্বামী গোষ্ঠীর লোকেরাই ছিল এই উপদলের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক। অন্য অংশের নেতৃত্বে ছিলেন আবুল হাসিম। রাজনীতি সচেতন, বামপন্থী চিন্তাচেতনায় প্রভাবিত মুসলিম ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এই অংশের ঘোরতর সমর্থক ছিল। এই দুটি ছাড়া তৃতীয় উপদলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হো্সেন শহিদ সুহরাওয়ার্দি। শেখ সাহেব সুহ্‌রাওয়ার্দি সাহেবের উপদলে গিয়ে জুটলেন। সুহরাওয়ার্দি সাহেব সাহেব শহর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন ডাকসাইটে লড়াকু কর্মীবাহিনী সহযোগে আধুনিক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তেলার প্রয়োজনীয়তা সর্বপ্রথম অনুভব করে সেরকম সংগঠন গড়ে তুলতে প্রবৃত্ত হলেন। তাঁর কাছে উদ্দেশ্যই হল প্রধান, উপায় নির্ধারণের বেলায় তাঁর মধ্যে নৈতিকতা বোধের বিশেষ বালাই ছিল না বলে মনে করার কারণে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় শহিদ সুহরাওয়ার্দি দাঙ্গাকারীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন বলে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।

    হুমায়ুন কবির কংগ্রেস রাজনীতিতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তৎকালীন পূর্ববাংলার কৃষক সমাজ থেকে আগত কমরেড মুজফফর আহমদ কমিউনিস্ট রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেছেনে। তাঁর (মুজিবের) রাজনৈতিক জীবনের সূচনাপর্বে এ দু’জনের কেউই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। মুজিবের মতো একজন প্রাণবান তোজাদ্দীপ্ত যুবক অতি সহজে নেতাজি সুভাষ বসুর ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগদান করতেন পারতেন, এটা আশা করা মোটেই অন্যায় নয়। কিন্তু তিনি মুসলিম লিগের রাজনীতিকে কবুল করলেন।

    এইসময় হোসেন সুহরাওয়ার্দির সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচয় ঘটা এবং তাঁর একজন বিশ্বস্ত কর্মীতে পরিণত হওয়া, সবকিছুকে কাকতালীয় ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোন উপায় নেই। পারস্পরিক প্রয়োজনের ভিত্তিতেই এই ধরনের গুরু শিষ্যের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সুহরাওয়ার্দির শিষ্যত্ব গ্রহণ শেখ মুজিবের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। রাজনীতির প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির ধরনটার মূল পরিচয়ও এতে পাওয়া যাবে। তাঁর উচ্চকাংখা ছিল, দৃঢ়তা ছিল, আর ছিল তীব্র গতিশীলতা। কোনও পর্যায়ে রাজনৈতিক আদর্শবাদ তাঁর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। বুদ্ধি মেধা, প্রতিভা কিংবা দূরদর্শিতা কখনও তাঁর মধ্যে অধিক দেখা যায়নি। রাজনীতি বলতে ক্ষমতা, ক্ষমতা দখলের উপায় – এটুকু তালিম তিনি শহিদ সুহরাওয়ার্দি সাহেবের কাছ থেকে ভালোভাবে পেয়েছিলেন। চোখের সামনে যা দেখা যায়, যা স্পর্শ করা, তার বাইরে কোনও কিছুকে তলিয়ে দেখার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা এবং অনমনীয় ইচ্ছাশক্তি এ দুটোই ছিল শেখ মুজিবের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য । জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এ দুটো পরিহার করতে পারেননি। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘পলিটিক্স অব এক্সিজেনসি’; তিনি গোটা জীবনভর সেই ধরনের রাজনীতিই করে গেছেন। সুযোগ যখন তাঁকে যতদূর নিয়ে গেছে, তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষা করেছেন। মওলানা ভাসানি এবং হোসেন শহিদ সুহ্‌রাওয়ার্দির মধ্যে যখন ইঙ্গ-মার্কিন জোটে যোগদান এবং স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে বিভেদ দেখা দেয়­শেখ মুজিব অবলীলায় সুহ্‌রাওয়ার্দিকে সমর্থন দিয়েছেন এবং ইঙ্গ-মার্কিন জোটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। আবার যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সুহ্‌রাওয়ার্দি সরকারের অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে, তার জবাবে সুহ্‌রাওয়ার্দি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে শতকরা আটানব্বই ভাগ স্বায়ত্বশাসন এরই মধ্যে দেওয়া হয়েছে। সেদিন শেখ মুজিব তাঁর নেতার বিরুদ্ধে বলার মতো কিছুই খুঁজে পাননি বরং সুহ্‌রাওয়ার্দি যা বলেছেন তাকে ধ্রুবসত্য ধরে নিয়ে তাঁর নির্দেশ মেনে কাজ করে গেছেন। এটা সত্যি খুব আশ্চর্যের যে, যে-মানুষটিকে বাঙালির ‘জাতির পিতা’ বলে অভিহিত করা হয় সে একই মানুষ উনিশশো পঁয়ষট্টি সনের পূর্বে কখনও বাংলাদেশের রাজনৈতিক গন্তব্য নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামিয়েছেন, এমন কোনও প্রমাণ বড় একটা পাওয়া যায় না। এমনকি সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে যারা পূর্বা বাংলা বলত, তাদেরকে, পাকিস্তান ভিত্তিক দক্ষিণপন্থী অন্যান্য দলের মতো, বিদেশের বিশেষ করে ভারত-রাশিয়ার চর বলে সম্বোধন করতে তিনি বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হননি।

    উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সংখ্যাধিক জনগণ মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করে যে, তাদের আসল বিপদের সময় পাকিস্তান সত্যি সত্যি পাশে এসে দাঁড়াতে সক্ষম নয়। অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি জনগণের যেটুকু নাড়ির যোগ ছিল তার আবেদন একেবারে অবদমিত হয়ে যায়। সেই সময়ে বাঙালি মধ্যশ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামি লিগ ‘ছয় দফা’ দাবি নিয়ে জনগণের সামনে এসে হাজির হয়। এটা উল্লেখ করা নিষ্প্র্যোজন যে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ছয় দফ দাবি ব্যাপক সাড়ার সঞ্চার করে এবং এই আন্দোলনের মাধ্যমেই শেখ মুজিবুর রহমানের নতুন ভাবমূর্তি জাগ্রত হয়। এই সময়ও একটা কথা সত্যি যে আওয়ামি লিগ বা আওয়ামি লিগের অঙ্গ সংঠনসমূহ বিশ্বাসে, আচরণে ছিল চূড়ান্তভাবে সমাজতন্ত্র বিরোধী। উনিশশোসত্তরের নির্বাচনের পর ছাত্ররা যখন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে রাজনীতি স্পিরিট এবং বাহন দুইইহয়ে দাঁড়ায় এবং এগারো দফা কর্মসূচী প্রণয়ন করে, বাধ্য হয়ে আওয়ামি লিগ হাইকমান্ডকে এক ধরনের আপোষমূলক মনোভাব পোষণ করতে হয়। ছয় দফার সংকীর্ণ মধ্যশ্রেণীভিত্তিক রাজনীতি এবং এগারো দফার অধিকতর প্রগতিশীল রাজনীতি একই রাজনৈতিক অঙ্গনে আলাদা আলাদা খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। তেল-জলের মতো দুটি মিশ খায়নি। মুক্তিযুদ্ধ যদি সত্যকার মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠতে পারত, এই রাজনীতির মধ্যে সংশ্লেষ সাধিত হয়ে বৃহত্তর একটা জাতীয় জঙ্গি-ঐক্যের ভিত রচনা করতে পারত। কিন্তু পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ করে বসল। শেখ মুজিব কারারুদ্ধ হলেন, আওয়ামি লিগ নেতৃত্ব ভারতে পলায়ন করল, প্রতিরোধ আন্দোলন চুরমার হয়ে গেল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের নিজস্ব যুদ্ধ হয়ে দাঁড়াল। ভারত আওয়ামি লিগকে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন করার অভিপ্রায়ে যুদ্ধে নেমে পড়ল। কারণ বিলম্বে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চরিত্র পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। পেছন থেকে রাশিয়া এসে জুটল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজিত হল। আর উনিশশো একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হল।

    শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে এলেন। যে ‘উইল টু পাওয়ার’ তিনি অন্তরে লালন করেছেন, সেই আশ্চর্য ক্ষমতামনস্কতা তাঁকে বাংলাদেশের সর্বময় কর্তৃত্বের আসনে বসাল। কিন্তু এ কোন বাংলাদেশ? চারিদিকে ধ্বংসের স্তূপ। বাতাসে রোদন ধ্বনি, হত্যা, লুটপাট সমানে চলছে। আওয়ামি লিগের লোকেরা শবভূক শকুনের মতো চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। কী করবেন শেখ মুজিব? তাঁর কী করার আছে? যে অনমনীয় আকাঙ্ক্ষার আগুন তাঁকে ঠেলে এতদূরে নিয়ে এসেছে, সেই আকাংখাই তাঁকে পাকে পাকে বেঁধে ফেলেছে। পুরাতন বাংলাদেশ নেই, পুরাতন মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁর পেছনে নেই। তাঁকে ঘোষণা দিতে হল, তিনি সমাজতন্ত্র করবেন। আওয়ামি লিগের লোকজন কথা নেড়ে সায় দিল। তিনি দল ভেঙ্গে একদল করলেন। ইতহাসের ঘূর্ণাবর্তে অসহায় বন্দী শেখ মুজিব নিজেও ভালো করে জানতেন না, তিনি কী করতে যাচ্ছেন। পেছনে তিনি ফেরত যেতে পারবেন না, সামনে উত্তাল সমুদ্র, সাঁতার দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাঁর থাকলেও অভ্যেস নেই। তাঁর লোকজন যারা এতদূর তাঁর সঙ্গে এসেছেন, আর যেতে রাজি হবে না। ভেতর থেকে কোনও ভরসা না পেয়ে তিনি বাইরের দিকে তাকাতে আরম্ভ করেছেন। মস্কোপন্থী দলগুলো বুদ্ধিপরামর্শ এবং মন্ত্রণা দিতে এল। শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবনের রাজনীতিতে যা করেননি তাই করতে বাধ্য হলেন। মস্কোর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। তিনি মনে করছেন রশি তাঁর হাতে আছে, কেননা এখনও মানুষ তাঁকে দর্শন মাত্রই জয়ধ্বনি করে, তাঁর কথায় হাত ওঠায়। উষ্ণহৃদয় মুজিব চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়েও বিরোধী দলের নেতার মতো বক্তৃতা দিতে পারেন। এবং হয়তো মনে করেন, এখনও পর্যন্ত ভুখানাঙ্গা মানুষের মনে কণ্ঠস্বরের যাদুমন্ত্রে আশার আলো জ্বালিয়ে তুলতে পারেন। ক্ষমতার উঁচুমঞ্চে অবস্থান করে এখনও মনে করেন বাংলাদেশের জন্য তিনি অনিবার্য। এদিকে ঘটনার নিজস্ব নিয়মে ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। গোটা জীবন ঘটনাটা ঘটে যেতে দিয়ে তিনি অপেক্ষা করেছেন এবং প্রতিবারই ভাগ্য তাঁর প্রতি প্রসন্ন হাসি হেসেছে।

    কিন্তু তিনি না পারলেন পুরনো পুঁজিবাদী অবস্থায় ফিরে যেতে, না পারলেন একটা প্রগতিশীল অর্থনীতির ভিত প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি পাকিস্তানিদের বিচার করতে পারলেন না যেমন, স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতিও তেমন রূঢ় হতে পারলেন না। আবার আপন দলের মানুষ এমনকি আপন পরিবারের লোকজনদেরও স্বেচ্ছাচারিতা নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হলেন। ত্রিশ লাখ, না ধরে নিলাম দশ লাখ মানুষের রক্তের দরিয়ার ওপারে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড প্রচণ্ড হুংকার দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারছেন না। লুটপাট অত্যাচার নির্যাতন খুন গুমখুন সমানে চলছে। ঘটনাস্রোত নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যতই হস্ত প্রসরিত করেন ততই আউলা হয়ে পড়ে। জনগণ তাঁর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে হ্যামলিনের যাদুকরের মতো পেছনে অনুসরণ করেছে। তাঁকে অনুসরণ করার অভ্যেস জনগণের বহুদিনের, ভেড়ার পালের মতো তাদের তাড়িত করার স্বভাবটিও তাঁর বহু পুরনো। তাই তিনি তখনও মনে করতেন তিনি বাংলার মানুষকে ভালোবাসেন, আর বাংলার মানুষও তাঁকে ভালোবাসেন। এরই মধ্যে অন্তিম ঘটনানাটি দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে আসছে। অবশেষে দেখা গেল চৌদ্দই আগষ্টের রাত্রে সপরিবারে গুলিবিদ্ধ মুজিবের দীর্ঘদেহী শরীর চাপচাপ জমাট বাঁধা রক্তের মধ্যে পড়ে আছে নিস্তব্ধ নিথর। হায় রে শেখ মুজিব, তোমার জন্য অশ্রু তোমার জন্য বেদনা।

    উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে কী বলব? শেখ মুজিব কি একজন বীর? না। একজন ভিলেন? তাও না। বীরত্বের উপাদান তাঁর মধ্যে ছিল, কিন্তু ইতিহাসের আসল প্রেক্ষিতের সঙ্গে তার মিল ঘটেনি। তাই তিনি একজন প্রকৃত বীর হয়ে উঠতে পারেননি। খুব সম্ভবত শেখ মুজিব একজন করুণ বীর, তাঁর চরিত্র অবলম্বন করে ভবিষ্যতে সার্থক বিয়োগান্ত নাটক লেখা হবে-কিন্তু তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে বাংলার ইতিহাসের মুক্তি ঘটানো যাবে না।

    (প্রথম প্রকাশিত, গৌতম চৌধুরী সম্পাদিত 'যুক্তাক্ষর' (মে ১৯৯৬)

    http://www.chintaa.com/index.php/chinta/showAerticle/163/bangla
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.63 | ২৬ মার্চ ২০১৩ ০৮:২৮582549
  • মুক্তিযুদ্ধে তারুণ্য : আমরা যদি না জাগি মা...
    জাহিদ হোসাইন খান | তারিখ: ২৪-০৩-২০১৩

    ‘২৫ আগস্ট। সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা। কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বেরিয়েছেন অভিযানে। তাঁরা একটা মাজদা গাড়ি হাইজ্যাক করেছেন। গাড়িটা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের কালভার্ট পেরিয়ে ডানে ঘুরল। ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কে সাত-আটজন পাকিস্তানি সেনা প্রহরারত। সম্ভবত কোনো আর্মি অফিসারের বাড়ি। সেনারা বেশ অসতর্ক অবস্থায় আছে। গাড়ির পেছনে বসে আছেন বদি আর কাজী কামাল। তাঁদের হাতে স্টেনগান। গাড়িটা ওই বাড়ির গেটের কাছে গিয়ে নীরবে গতি কমিয়ে দিল। হাবিবুল আলম বললেন, ‘ফায়ার’। গর্জে উঠল বদি আর কাজী কামালের হাতের স্টেনগান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেনারা লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়। ওই আক্রমণ পরিচালনা করেই তাঁরা নিরস্ত হলেন না। তাঁরা এগিয়ে গেলেন মিরপুর রোডের দিকে। সেখানে সেনারা এরই মধ্যে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ি চেক করতে শুরু করেছে। সেখানে গোটা দুই মিলিটারি ট্রাক ও একটা জিপ দাঁড় করিয়ে রাখা। তাঁদের গাড়ি সেই সেনা তল্লাশির কাছে যেতেই সেনারা অর্ডার করল, হল্ট। এবং ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গর্জে উঠল কাজী কামাল, বদি, স্বপন, রুমীদের অস্ত্র।’ (ব্রেভ অব হার্ট)
    অসম্ভব সাহসী এমন তরুণদের গর্জন আর রণহুংকার কল্পনার মতো মনে হলেও এসব চরিত্র কিন্তু বাস্তব! কাজী কামাল [কাজী কামাল উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম], বদি [শহীদ বদিউল আলম, বীর বিক্রম], স্বপন [কামরুল হক, বীর বিক্রম], আজাদ [শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী], জুয়েল [শহীদ আব্দুল হালিম চৌধুরী, বীর বিক্রম], কাসেদ [শহীদ মুফতি মোহাম্মদ কাসেদ], রুমী [শহীদ শাফি ইমাম রুমী, বীর বিক্রম] ও তাঁদের সহযোদ্ধারা ছিলেন সেই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেওয়া একেকজন টগবগে তরুণপ্রাণ, যাঁদের রক্তে মিশে ছিল স্বাধীনতার নেশা।
    মারকুটে ক্রিকেটার হিসেবে পরিচয় জুয়েল। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে আটক করে কয়েক দিন পর হত্যা করে। জগন্নাথ কলেজ থেকে পাস করা জুয়েল প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার হিসেবে প্রাদেশিক দলের হয়ে কায়েদে আজম ট্রফিতে খেলেছেন।
    শহীদ জুয়েলের সঙ্গে খেলেছেন রকিবুল হাসান [বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক]। রকিবুল জানান, ‘জুয়েলের কথা মনে হলে স্মৃতিকাতর হতে হয়। আমরা একসঙ্গে অনেক খেলেছি। আমরা খেলার সময় একই রুমেও থেকেছি অনেক বার। ও ছিল আক্রমণাত্মক ওপেনার। এ জন্য ও তুফান নামে পরিচিত ছিল। জুয়েল খেলত আজাদ বয়েজ ক্লাব ও মোহামেডান ক্লাবে। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে তিনটি টেস্ট ম্যাচ খেলার জন্য অল পাকিস্তান দলের ক্যাম্পে জুয়েল ডাক পেয়েছিল।’
    মুক্তিবাহিনীর ক্র্যাক প্ল্যাটুনের সদস্য জুয়েল ঢাকার ফার্মগেট ছাড়াও এলিফ্যান্ট রোডের পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশনসহ আরও কয়েক স্থানে গেরিলা অপারেশনে অংশ নেন।
    পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত বাস্কেটবল খেলোয়াড় ছিলেন কাজী কামাল। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স বাস্কেটবল দলে নিয়মিত খেলেছেন তিনি। বাস্কেটবলে পাকিস্তানের জাতীয় অলিম্পিকে একাধিকবার অংশ নেন কাজী কামাল। তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের জাতীয় দলের ট্রায়ালে ডাক পান, কিন্তু দেশমাতৃকার টানে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে।
    ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন মুফতি মোহাম্মদ কাসেদ। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বেশ কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি একজন ভালো দাবাড়ু ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে দাবায় তাঁর র‌্যাঙ্কিং ছিল দুই। ১৯৬৭ সালে তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমান বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগে তৃতীয় বর্ষে পড়তেন। তিতুমীর হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁর সহযোদ্ধাদের চিঠি থেকে জানা যায়, তিনি মুক্তিযুদ্ধে কমান্ডো অ্যাটাকে শহীদ হন।
    ১৯৭১ সালের ২৩ অক্টোবর মনিরামপুরের চিনেটোলা বাজারের পাশের হরিহর নদের ব্রিজের ওপরে হত্যা করা হয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মাশিকুর রহমান তোজো। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রিকে পাশ কাটিয়ে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বীমা-বিষয়ক পরিসংখ্যানবিদ্যা অ্যাকচুয়ারিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন এই বাঙালি সূর্যসন্তান।
    শহীদ আজাদ সিদ্ধেশ্বরী কলেজ থেকে আইএ পাশ করে ভর্তি হন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু দেশের টানে ফিরে এসে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। তাঁর সহপাঠী ছিলেন রমজুল হক [অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]। শহীদ আজাদ সম্পর্কে রমজুল হক বলেন, ‘আজাদসহ আমরা সাতজন মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলাম। সকালে বিভাগের ক্লাস শেষ করে আমরা দুপুর পর্যন্তই ক্যাম্পাসে থাকতাম। দুপুরে আজাদ ও আমি ফরাসি ভাষা শিখতাম। আজাদের অন্য ভাষার গল্প, কবিতা, উপন্যাস নিয়ে বেশ আগ্রহ ছিল। সুযোগ পেলেই সে নিউমার্কেট থেকে ইংরেজি বইপত্র কিনে আনত।’
    ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে মার্স্টাসের পরীক্ষা দেন আজাদ। তারপর মার্চে দেশের টানে ছুটে যান মুক্তিযুদ্ধে। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হয়ে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আজাদ ও তাঁর সহযোদ্ধারা।
    শহীদ বদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। মুক্তিযোদ্ধা বদি মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার নম্বরসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কলা বিভাগের মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ক্যাডেট ছিলেন।
    মেধাবী শিক্ষার্থী শাফি ইমাম রুমী ছিলেন জাহানারা ইমামের [শহীদজননী] ছেলে। তিনি এসএসসিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষাবোর্ডে তৃতীয় স্থান ও এইচএসসিতে অর্জন করেন স্টার মার্কস। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান বুয়েট) ভর্তি হয়েছিলেন। রুমী যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেটের শিকাগো শহরের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি কলেজে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হন। একাত্তরের আগস্টে তাঁর যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ডাক এল মুক্তিযুদ্ধের। আদরের ছেলে রুমী মাকে যুদ্ধে যাওয়ার কথা জানান। মায়ের মন কি আর সহজে টলানো যায়! কী করে আদরের সন্তানকে অনুমতি দেন যুদ্ধে যাওয়ার! কিন্তু রুমী বিবেকবান তরুণ হিসেবে মাকে বলেন, ‘আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব, কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তা-ই চাও, আম্মা?’ মা কি আর মাতৃভূমির দুর্যোগে না করতে পারেন? দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, ‘দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে।’
    এমনই শত সহস্র মেধাবী তরুণের লাল রক্তে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য পতাকা। তাঁদের ত্যাগের প্রাপ্তি তো আমাদের স্বাধীনতা। এই মৃত্যুঞ্জয়ী বীরেরা বেঁচে আছেন আমাদের দেশ ও জাতির আলোকবর্তিকা হয়ে।

    তথ্যসূত্র
    ১. একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম, সন্ধানী প্রকাশনী
    ২. একাত্তরের বীরযোদ্ধা, সম্পাদক: মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন
    ৩. মা, আনিসুল হক, সময় প্রকাশন
    ৪. ব্রেভ অব হার্ট, হাবিবুল আলম বীর প্রতীক, অ্যাকাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি

    http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-03-24/news/339006
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.63 | ২৬ মার্চ ২০১৩ ০৮:৩২582550
  • গোপন মার্কিন দলিল
    স্বাধীনতা ঘোষণার চিন্তা ৩ মার্চেই ওয়াশিংটনকে জানানো হয়
    মিজানুর রহমান খান | তারিখ: ২৬-০৩-২০১৩

    বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পরিকল্পনা নিয়ে একটি চমকপ্রদ তথ্য উদ্ঘাটিত হলো। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ নাকি ২৭ মার্চ—এ নিয়ে বিতর্ক চলছেই। এই প্রেক্ষাপটে সম্ভবত এই প্রথম কোনো মার্কিন দলিল থেকে জানা গেল, একাত্তরের ৩ মার্চেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার চিন্তা এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস খোলার পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছিল।
    মার্কিন কূটনীতিক ক্রেইগ ব্যাক্সটারের কাছে আওয়ামী লীগের পক্ষে এই তথ্য প্রকাশ করেছিলেন পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি পলিটিক্যাল কাউন্সিলর এবং পরে অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। ব্যাক্সটার পরে দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত হন। ব্যাক্সটার একাত্তরে পররাষ্ট্র দপ্তরে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি মারা গেছেন। অধ্যাপক ব্যাক্সটার বাংলাদেশ বিষয়ে একাধিক বই লিখেছেন।
    বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ও তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন মনে করেন, ‘এই নতুন তথ্য উদ্ঘাটন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। মার্কিন সরকারি নথি থেকেই এটা আমরা জানছি। সুতরাং এর সত্যতা নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ দেখি না।’
    প্রথম আলোর কাছে এ বিষয় দলিলটির মূল নথির আলোকচিত্র রয়েছে। এতে দেখা যায়, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে ওই বার্তা পৌঁছাতে ঢাকা থেকে একজন বার্তাবাহক ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিচয় জানা যায়নি।
    কামাল হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের কে বা কাকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তা তাঁর অজানা ছিল। তিনি অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩ মার্চ ডাকা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১ মার্চে ইয়াহিয়া স্থগিত করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু একটি ব্রিফ তৈরি করতে নির্দেশ দেন এবং দেশের বাইরে যে যাবেন, তাঁর কাছেই তা দিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। আমি আবু সাঈদ চৌধুরী ও হোসেন আলীর কাছে এর দুটি অনুলিপি পৌঁছে দিয়েছিলাম।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার সিদ্ধান্ত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে জনাব কিবরিয়ার অবহিত করার বিষয়টিকে ‘সন্দেহাতীতভাবে মুজিবের জ্ঞাতসারে’ এবং মুজিবের পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন।
    উল্লিখিত মার্কিন নথিটির অবিকল তরজমা নিচে তুলে ধরা হলো:
    গোপনীয় তারবার্তা। প্রাপক মার্কিন দূতাবাস, ইসলামাবাদ, মার্কিন কনসাল ঢাকা। বিষয়: স্বাধীনতা বিষয়ে বাঙালি পাক কর্মকর্তা। তারবার্তা প্রস্তুতকারী ব্যাক্সটার। নং স্টেট ০৩৬২৫৫।
    ‘১. ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ব্যাক্সটারের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ করেন পলিটিক্যাল কাউন্সিলর কিবরিয়া। এ সময় তিনি স্পষ্ট করেন যে ডেপুটি চিফ অব মিশন করিম [এস এ করিম, বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রসচিব] এবং পাকিস্তান দূতাবাসের অন্য বাঙালি কর্মকর্তা এবং তিনি তাঁর নিজের পক্ষে “বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার” পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এবং বাঙালি কর্মকর্তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কী হবে, সে বিষয়ে কথা বলতে এসেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, বাঙালি কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই সম্মত হয়েছেন যে স্বাধীনতার ঘোষণার খবর ওয়াশিংটনে পৌঁছামাত্রই করিম ঢাকার নির্দেশনার অপেক্ষায় না থেকে [স্বাধীন বাংলাদেশ] দূতাবাস প্রধানের দায়িত্ব নেবেন। তাঁদের মূল উদ্বেগ হচ্ছে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা দমনে যে অতিরিক্ত [সম্ভাব্য] সেনা অভিযান চালাবে, এর ফলে মাত্র কয়েক দিনের জন্য একটা ছেদ নয়, বরং তা দীর্ঘ বিলম্ব সৃষ্টি করবে। কিবরিয়া দ্রুত মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করেন।
    ২. এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কিবরিয়া পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন এবং আওয়ামী লীগের সামনে থাকা বিকল্পগুলো উল্লেখ করেন এবং বলেন, তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে (“আর পিছিয়ে না আসার পর্যায়ও অতিক্রান্ত হয়েছে”) এখন আর অন্য বিকল্প নেই। সুনির্দিষ্টভাবে কিবরিয়া আরও বলেন, এদিন সকালেই ঢাকা থেকে এক ভদ্রলোক এসেছেন। (কিবরিয়া বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের কর্তৃপক্ষীয় বক্তব্য নিয়েই এসেছেন) তিনি এই বার্তা নিয়ে এসেছেন যে ক্রান্তিকালের জন্য প্রস্তুতি এখনই গ্রহণ করা উচিত হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির মিশ্রণ এবং [ঢাকার] এই বার্তা বিবেচনায় নিয়ে দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের লক্ষ্যে ভিত্তি তৈরির কাজ এখনই শুরু করতে হবে।
    ৩. রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে ইয়াহিয়ার উদ্যোগকে কিবরিয়া যথেষ্ট বিলম্বিত বলে উল্লেখ করেন। সেই সঙ্গে তিনি যোগ করেন যে বাঙালিরা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, তারা আরও একটি সপ্তাহের অপেক্ষা বরদাশত করবে না। এমনকি শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের আগেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে জনগণ সম্ভবত চাপ সৃষ্টি করবে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা ৭ মার্চের পরে যাবে না।
    কিবরিয়া আশঙ্কা করেন, মুজিব ইতস্তত করবেন এবং সে কারণে “বাম চরমপন্থীদের” কাছে তিনি তাঁর নেতৃত্ব হারাবেন। “বাম চরমপন্থীরা” জনতাকে নিজেদের উদ্দেশ্যসাধনে কাজে লাগাবে। কিবরিয়া আরও গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কথিতমতে ইতিমধ্যেই বাঙালি পুলিশকে নিরস্ত্র করেছে এবং ইতিমধ্যে কতিপয় দমনমূলক পদক্ষেপ (আজকের সংবাদপত্র দ্রষ্টব্য) নিয়েছে। তিনি অনুমান করেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী “আমার দেশবাসীর প্রতি কসাইগিরি” চালাতে পারবে বটে। তবে তাতে বড়জোর কার্যকর স্বাধীনতা অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে, কিন্তু তাকে স্তব্ধ করা যাবে না। বরং ‘বর্বরোচিত’ কাণ্ড ঘটালে তা বাঙালি প্রতিরোধকে আরও কঠিন করে তুলবে। তিনি পৌনঃপুনিকভাবে গুরুত্বারোপ করেন যে [স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে] এখন আর পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অন্যরাও সহমত পোষণ করেন।
    ৪. কিবরিয়া জানতে চান, বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবস্থান কী হবে? তিনি এটা বুঝতে পারছেন যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের পরে [মার্কিন] পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকবে না। কিন্তু তাঁর উদ্বেগটা হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং [যুক্তরাষ্ট্র সরকারের] স্বীকৃতি প্রদান (ওপরে যেভাবে উল্লিখিত) বিলম্বিত হতে পারে, তার অন্তর্বর্তীকালে পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কটা কী দাঁড়াবে। ব্যাক্সটার ইঙ্গিত দেন যে আমরা স্বাভাবিকভাবেই এখানে এবং ঢাকার মধ্যে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রাখব। কিন্তু এখানে কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ রক্ষা করা সমীচীন হবে না। কিবরিয়া যুক্তিটি গ্রহণ করলেন। তবে ভবিষ্যতে তাঁরা যে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ করতে পারেন, সেই সম্ভাবনা কিবরিয়া নাকচ করেননি। তিনি একই সঙ্গে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এবং জানতে চান যে চরম প্রয়োজনে পররাষ্ট্র দপ্তরের চ্যানেল ব্যবহার করা যাবে কি না। ব্যাক্সটার সরাসরি এর উত্তর এড়িয়ে বলেছেন, এটা অনিয়মিত, তবে যখন অনুরোধ করা হবে, সেই সময় ও বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে তা বিবেচনা করা হবে।
    ৫. কিবরিয়া কিছু প্রশাসনিক বিষয় নিয়েও কথা বলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পশ্চিম পাকিস্তান তা চ্যালেঞ্জ করবে। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা বিশ্বাস করেন, সেই পরিস্থিতিতে [ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানের] রাষ্ট্রদূত হিলালি তখন পাকিস্তান দূতাবাস থেকে বাঙালি কূটনীতিকদের বহিষ্কারের নির্দেশনা পাবেন এবং তা অনুসরণ করবেন। তিনি তাঁদের বেতন-ভাতাও বন্ধ করে দেবেন। কিবরিয়া এ বিষয়ে কোনো সহায়তা চাননি। কিন্তু বলেছেন, দূতাবাসের মধ্যে বাঙালিরা তখন একটা “পুলিশ পরিস্থিতি” সৃষ্টি করতে পারে। ব্যাক্সটার ইঙ্গিত দেন যে সেটা হবে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক এবং তা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে একটা জটিল অবস্থার মুখে ফেলে দেবে। কিবরিয়া এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন এবং বলেছেন, তিনি তাঁর সহকর্মীদের এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেবেন।
    ৬. কিবরিয়া আলোচনার পুরো সময় একাগ্রচিত্ত ছিলেন। কিবরিয়া বলেন, তিনি ও অন্যদের পাকিস্তানি হিসেবে থাকাটাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাঁরা এটা দেখতে পাচ্ছেন না যে পশ্চিম পাকিস্তান গণতন্ত্রের পথে যাবে এবং সে কারণে একমাত্র বিকল্প হিসেবে এখন তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন দিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, সবার জন্যই সাম্প্রতিক দিনগুলো কঠিন হয়ে পড়েছে এবং নিকট ভবিষ্যতে কোনো সান্ত্বনা নেই। তিনি কথার ইতি টেনে এই মন্তব্য করেন, “আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে অসুখী মানুষে পরিণত হব।’” শেষ।
    উল্লেখ্য, এই নথিটি অনুমোদন করেছেন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেন। তাঁর ছেলে কংগ্রেসম্যান ক্রিস ভ্যান হোলেন বর্তমানে মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের প্রভাবশালী সদস্য। তাঁর বাবা ৯০ বছর বয়সে গত ৩০ জানুয়ারি মারা যান। ৩১ জানুয়ারি ২০১৩ ওয়াশিংটন পোস্ট এক শোকগাথায় বলেছে, ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলতে থাকলেও একাত্তরের বাংলাদেশ সংকট মোকাবিলা করতেই ভ্যান হোলেন তাঁর সর্বশক্তি নিঃশেষ করেছিলেন।’
    জনাব কিবরিয়া ২০০৬ সালে ইউপিএল প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘মার্চ মাসের গোড়া থেকেই আমি ও আমার সহকর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীন বাংলাদেশের দূতাবাস খোলা সম্পর্কে বিভিন্ন পরিকল্পনা করেছিলাম।’
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.63 | ২৬ মার্চ ২০১৩ ০৮:৩৭582551
  • গোপন মার্কিন দলিল
    স্বাধীনতা ঘোষণার চিন্তা ৩ মার্চেই ওয়াশিংটনকে জানানো হয়
    মিজানুর রহমান খান | তারিখ: ২৬-০৩-২০১৩

    http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-03-26/news/339672
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.63 | ২৬ মার্চ ২০১৩ ০৮:৪৫582553
  • অপারেশন জ্যাকপট
    শাহজাহান সিদ্দিকী | তারিখ: ২৬-০৩-২০১৩

    বাঙালি মাত্রই গান ভালোবাসেন। এর বাণী হূদয়কে করে পুলকিত ও বিকশিত। আবার এ গানই যে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিতে পারে বা রণাঙ্গনে হামলার সিগন্যাল হতে পারে, সে কথা কি কেউ ভেবেছে কোনো দিন? বিস্ময়কর ব্যাপার হলেও সত্যি যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দুটি গান শত্রু পাকিস্তান বাহিনীর ওপর হামলা পরিচালনার সংকেত বা সিগন্যাল হিসেবে ব্যবহূত হয়েছিল। আর এই অভিনব পদ্ধতিতে সিগন্যাল পেয়েই ১৯৭১ সালের মধ্য আগস্ট সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় সব কটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক ও নদীবন্দরে একই সময়ে একযোগে পরিচালনা করা হয়েছিল সফল নৌ-কমান্ডো অভিযান। সারা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে শুনেছিল আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা। অপারেশন জ্যাকপটের কথা।
    ১৯৭১ সালে নৌ-কমান্ডো হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। নয় সদস্যবিশিষ্ট আত্মঘাতী দলের দলনেতা হিসেবে অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি ফেরিঘাটে প্রথম নৌ-অপারেশন পরিচালনা করি।
    প্রশিক্ষণ শেষে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন সামুদ্রিক ও নৌবন্দরে অপারেশন পরিচালনার জন্য কয়েকটি দল গঠন করা হয়। দুটি দলকে সড়কপথে পাঠানো হয় খুলনায়। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে আক্রমণ পরিচালনার জন্য তিনটি দলকে সেনাবাহিনীর লরিতে করে ব্যারাকপুর সেনানিবাস হয়ে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে নেওয়া হয়। একটি দলে ছিলাম আমি। ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি ডাকোটা বিমানে করে আমাদের পৌঁছে দেওয়া হয় আগরতলায়। এটা ছিল আমার জীবনে প্রথম বিমানভ্রমণ। আমাদের একটি ক্যাম্পে নেওয়া হয়। নাম ছিল ‘নিউ ক্যাম্প’।
    ৫ বা ৬ আগস্ট সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ (এ ডব্লিউ) চৌধুরীর (বীর উত্তম) নেতৃত্বে ৬০ জন কমান্ডো সড়কপথে হরিণা ক্যাম্প হয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়। তাদের টার্গেট ছিল চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। আমরা বাকিরা নারায়ণগঞ্জে রওনা দেওয়ার অপেক্ষায় থাকি।
    ৭ বা ৮ আগস্ট। ভারতীয় নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট দাস আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তুমি তো সাবমেরিনার আবিদুর রহমানের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ অপারেশনে যাচ্ছ?’ আমি হ্যাঁসূচক জবাব দিতেই তিনি বললেন, ‘না, তোমাকে নারায়ণগঞ্জ যেতে হবে না। কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি ফেরিঘাটে অপারেশন পরিচালনার জন্য নয় সদস্যবিশিষ্ট স্বতন্ত্র একটি কমান্ডো দল হবে। তোমাকে এ দলের লিডার বা দলনেতা মনোনীত করা হয়েছে।’
    লেফটেন্যান্ট দাসের কথা শুনে আমি বিস্মিত এবং একই সঙ্গে আনন্দিত ও রোমাঞ্চিত হই। কারণ সব লক্ষ্যস্থলে অপারেশনের জন্য নৌ-কমান্ডোদের দলনেতা হিসেবে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাবমেরিনারদেরই নিয়োগ করা হয়েছে। আমাকে দলনেতা করা ব্যতিক্রম। অন্যদিকে রোমাঞ্চিত ও আনন্দিত এই ভেবে যে একটি স্বতন্ত্র নৌ-কমান্ডো দলের নেতৃত্ব পাওয়া আমার জন্য খুবই গর্বের এবং সম্মানের বিষয়।
    লেফটেন্যান্ট দাস আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘সামরিক দিক বিবেচনায় দাউদকান্দি ফেরিঘাট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফেরিঘাটটি মেঘনা নদীর কারণে বিচ্ছিন্ন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগস্থলে অবস্থিত। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আনীত শত্রুপক্ষের সামরিক সরঞ্জামাদি, গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র, রসদ ইত্যাদি পারাপার করা হয়ে থাকে এই ফেরিঘাটের মাধ্যমে। এ জন্য দাউদকান্দি ফেরিঘাটটি ধ্বংস করে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। ঘাটের পন্টুনসহ আশপাশে যে কটি ফেরি রয়েছে সেগুলো ধ্বংস করে দিতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে তোমরা এ অভিযানে সফলকাম হবে। তোমার সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে কমান্ডো মতিউর রহমান (বীর উত্তম)।
    আলোচনার এক ফাঁকে বললেন, গান শুনবে—বাংলা গান? আমি মাথা নেড়ে সায় দিতেই তিনি উঠে গিয়ে একটি টেপরেকর্ডার এনে পরপর দুটো পুরোনো দিনের বাংলা গান আমাকে বাজিয়ে শোনালেন। গানগুলোর অন্তরা বা প্রথম কলি ছিল—‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান/ তার বদলে আমি চাই নে কোনো দান’ এবং ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি/ ওরে, তোরা সব উলুধ্বনি কর।’
    শেষে লেফটেন্যান্ট দাস বললেন, আসল কথা। এ গান শুধু গানই নয়, এ গানের আরও অর্থ আছে। আমি অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি বললেন, ‘তোমরা যখন টার্গেটের কাছাকাছি পৌঁছে কোনো গোপন হাইডআউটে থাকবে তখন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে এ গান দুটো শুনতে পাবে। আর গানের মাধ্যমেই সিগন্যাল পাবে কোন দিন এবং কখন নির্ধারিত টার্গেটে হিট করতে হবে। প্রথম গানটি শোনার পর মহিলা শিল্পীর কণ্ঠে গাওয়া দ্বিতীয় গানটি শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। দ্বিতীয় গানটি যখন শুনবে তখন বুঝবে, ২৪ ঘণ্টা পর টার্গেটে আঘাত করতে হবে। এর ভিত্তিতে তোমাদের জিরো আওয়ার ঠিক করে নিতে হবে। সাবধান আর কেউ যেন, এমনকি তোমার সহযোদ্ধাদের মধ্যেও কেউ যেন বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে অপারেশনের সিগন্যাল প্রেরণের বিষয়টি জানতে বা বুঝতে না পারে। দলনেতা হিসেবে তোমাকে একটি ছোট ট্রানজিস্টার দেওয়া হবে।
    আবহাওয়ার রিপোর্ট, চন্দ্র-তিথি, জোয়ার-ভাটা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় বিবেচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে অপারেশনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল। আগস্ট মাসের ১১ তারিখ সন্ধ্যার পর আমি আমার কমান্ডো দলকে নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বকসনগর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। চাঁদপুরের দলও আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন সাবমেরিনের আমিন উল্লাহ শেখ (বীর বিক্রম)। আমাদের পথ দেখিয়ে গন্তব্যস্থানে নিয়ে যাওয়া এবং গোপন হাইড আউটে রাখার ব্যবস্থা করার জন্য সঙ্গে দুজন করে গাইড দেওয়া হয়। প্রত্যেক দলের জন্যই গাইডের ব্যবস্থা ছিল। আমাদের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল একটি করে অটোমেটিক স্টেনগান। প্রয়োজনীয় গুলিসহ একটি ম্যাগাজিন। প্রত্যেকের জন্য এক জোড়া সাঁতার কাটার ফিন্স, একটি লিমপেট মাইন এবং একটি দুদিকে ধারালো কমান্ডো নাইফ। অতিরিক্ত হিসেবে আমার কাছে ছিল একটি ট্রানজিস্টার।
    বকসনগর থেকে রওনা হয়ে আমরা কখনো ধানখেতের আইল ধরে, আবার কখনো বা পায়ে চলা পথ ধরে হেঁটে সামনের দিকে এগোতে থাকি। কিছু দূর যাওয়ার পর চাঁদপুরের দল ভিন্ন পথ ধরে গন্তব্যের দিকে যায়। আর আমরা কুমিল্লার কংশনগর বাজার হয়ে বন্ধরামপুর পৌঁছি।
    ১৩ আগস্ট, ১৯৭১ আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে কাঙ্ক্ষিত সেই গানটি প্রচারিত হয়। আমার অন্য সঙ্গী কমান্ডোরাও আমার সঙ্গে ট্রানজিস্টারে গান শুনছিল। এ গানের মর্মার্থ তারা না বুঝলেও আমি বুঝে গেলাম। ৪৮ ঘণ্টা পর আমাদের অপারেশনে যেতে হবে। গানটি শুনে আমি কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। তবে দ্রুতই আমার আবেগ সংবরণ করি। অপারেশনের প্রাথমিক সিগন্যাল পেয়ে গেছি, এটা কাউকেই বুঝতে দিইনি। রাতের বেলা আমি সহদলনেতা মতিউর রহমানকে (বীর উত্তম) পরামর্শের ছলে বললাম, সফলভাবে অপারেশন পরিচালনা করতে হলে টার্গেট এলাকা আগেভাগে রেকি করে নিলে ভালো হয়। আমার কথায় মতি রাজি হয়ে গেল।
    আমি ও মতি লুঙ্গি ও হাফ শার্ট পরে ভাড়া করা একটি ছইওয়ালা নৌকায় ১৪ আগস্ট সকাল আনুমানিক নয়টার দিকে দাউদকান্দির উদ্দেশে রওনা হই। আমাদের সঙ্গে চটের ব্যাগে ফোল্ডিং করে লুকিয়ে রাখা স্টেনগানটি ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। দাউদকান্দি ফেরিঘাটের উত্তর-পশ্চিমে মেঘনা নদী, আর দক্ষিণে গোমতী নদী। তখন ফেরিঘাটের উত্তর-পশ্চিম দিকে মেঘনা নদীর মাঝখানে একটি ছোট্ট চর ছিল। চর থেকে ফেরিঘাটের সবকিছু দেখা যেত। চরের পাশে কিছুক্ষণের জন্য নৌকা রেখে আমরা লক্ষ করলাম যে ফেরিঘাটের পন্টুন থেকে একটু দূরে পশ্চিম দিকে নদীতে দুটি ভাসমান ফেরি নোঙর করা অবস্থায় আছে। এ দুটি ফেরি আর পন্টুনই হলো আমাদের টার্গেট। অপারেশন এলাকা ও টার্গেট ঠিক করার সময় আমাদের নৌকাটি চলছিল। একপর্যায়ে নৌকার গতি কমিয়ে আমি একটি গামছা পরে নদীতে নেমে পড়ি। ভাবটা এমন যে নদীর পানিতে গোসল করতে নেমেছি। নামার উদ্দেশ্য নদীর পানির স্রোতের বেগ ও গতিধারা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা লাভ। তখন বর্ষাকাল ছিল। ফেরিঘাটটি মেঘনা ও গোমতী নদীর সঙ্গমস্থলে। আরও লক্ষ করলাম বর্ষাকালের ভরা নদীতে স্রোত তেমন নেই। উজানে এবং ভাটিতে সহজেই সাঁতার কেটে যাওয়া যায়। তবে নদীর তীরবর্তী ফসলের জমিতেও অথই পানি থাকায় কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই।
    বন্ধরামপুরে ফিরে আসার পর থেকে শুরু হলো আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে দ্বিতীয় গানটি শোনার জন্য অপেক্ষার পালা। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর আকাশবাণীর নিয়মিত অনুষ্ঠানে হঠাৎ ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি, ও রে! তোরা সব উলুধ্বনি কর’ গানটি শুনতে পেলাম। তার অর্থ তখন থেকে ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর টার্গেটে আঘাত হানতে হবে। আমি মনে মনে হিসাব করে দেখলাম, ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে অর্থাৎ ১৫-১৬ আগস্ট মধ্যবর্তী রাত আমাদের জন্য জিরো আওয়ার। ওই সময় এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে আমাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে হবে।
    সেই রাতে সঙ্গী কমান্ডোদের কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ থাকলাম। ১৫ আগস্ট সকালে সবাইকে ডেকে বললাম, আজ রাতেই আমাদের অপারেশনে যেতে হবে। সন্ধ্যার পর খাওয়া-দাওয়া করে, গায়ে সরিষার তেল মেখে, সুইমিং কস্টিউমসহ যার যার লিমপেট মাইন ও ফিন্স নিয়ে একটি খোলা নৌকাযোগে অপারেশনে বের হয়ে পড়লাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পথিমধ্যে প্রচণ্ড ঝড়-তুফানে পড়ে আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলি। তার ওপর গাইড ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে শীতে কাঁপতে থাকে। অসুস্থ বোধ করায় সে আমাদের সঙ্গে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে। আমরা তাকে কোনোমতেই যেতে রাজি করাতে পারছিলাম না। এদিকে রাতও প্রায় শেষ হয়ে পূর্ব আকাশে ভোরের আলোর আভা ফুটে উঠতে থাকে। এ সময় অপারেশনে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক। এমতাবস্থায় আমাদের অনন্যোপায় হয়ে ওই দিনকার মতো অপারেশন স্থগিত করে অস্থায়ী ঘাঁটিতে ফিরে আসতে হয়।
    যা-ই হোক সংকল্পে অটুট থেকে আমরা পুনরায় প্রস্তুতি নিয়ে ১৬ আগস্ট দিবাগত রাত আনুমানিক একটার সময় দাউদকান্দি ফেরিঘাটের একটি পন্টুন ও দুটি ফেরিতে নৌ-কমান্ডো হামলা পরিচালনা করি। ওই তিনটি টার্গেটে মাইন ফিট করে আমরা পূর্ব নির্দিষ্ট স্থানে রক্ষিত নৌকায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই চারদিক প্রকম্পিত করে একে একে মাইনগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে। আর নৌকায় নিরাপদ দূরত্বে থেকে আমাদের চোখমুখ বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এরপর আর কালবিলম্ব না করে আমরা আমাদের গোপন আস্তানা বন্ধরামপুরের উদ্দেশে নৌকাযোগে দ্রুত রওনা হই। আমাদের হামলায় দাউদকান্দি ফেরিঘাটের একমাত্র পন্টুনটিসহ অদূরে নোঙর করা দুটি ফেরি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পানিতে ডুবে যায়।
    আমাদের মতো অন্যান্য দলও ১৫ আগস্ট, ১৯৭১ সালের মধ্যরাতের পর একই সঙ্গে এই সময়ে চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর, মংলা সামুদ্রিক বন্দর, খুলনা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে সিরিজ নৌ-কমান্ডো হামলা পরিচালনা করে। তারা ডুবিয়ে দেয় সমুদ্রগামী জাহাজ ও বার্জ। ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বহুসংখ্যক নৌযান ও পন্টুন। সব নৌপথে সৃষ্টি হয় মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা। আলোড়ন পড়ে যায় সারা বিশ্বে। এভাবেই সমাপ্ত হয় একটি বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গানের মাধ্যমে পাওয়া সিগন্যাল অনুযায়ী পরিচালিত আমাদের দুর্ধর্ষ নৌ-কমান্ডো অভিযান।
    এরপর বিদেশি জাহাজ চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরে আসতে অস্বীকৃতি জানায়। সামরিক ভাষায় এই নৌ-কমান্ডো হামলা ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে খ্যাত। নৌ-কমান্ডোদের দুর্ধর্ষ ও সফল হামলার পরদিন যুদ্ধবাজ পাকিস্তানি সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণ দেয় এবং বলে, ভারতীয় নৌবাহিনীর ডুবুরিরা এসব আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু তারা ভাবতেই পারেনি বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরাই চালিয়েছে এসব আত্মঘাতী কমান্ডো হামলা। চূর্ণ করে দিয়েছে তাদের সব অহংকার। বাংলাদেশের বিভিন্ন সমুদ্র ও নদীবন্দরে একই সময় পরিচালিত এই সফল নৌ-কমান্ডো হামলা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ এবং বিজয় ত্বরান্বিত করে।
     শাহজাহান সিদ্দিকী বীর বিক্রম: অপারেশন জ্যাকপটের অন্যতম দলনেতা, সাবেক সচিব

    http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-03-25/news/339551
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন