এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Biplob Rahman | ০১ জানুয়ারি ২০১৪ ১৭:১৮582687
  • এক মৃত মুক্তিযোদ্ধার দিনপঞ্জির পাতা থেকে…
    অদিতি ফাল্গুনী | ১৬ december ২০১১ ১০:১৬ পূর্বাহ্ন

    গল্পের লোভে মাঝে মাঝেই আমি এদিক ওদিক ঘুরি। নানা মানুষের সাথে মেশার চেষ্টা করি। মূলতঃ এই গল্প খোঁজার লোভ থেকেই ঢাকার মোহাম্মদপুর কলেজ গেট সংলগ্ন ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগমুক্তি বিশ্রামাগার’-এ গত বছর দশেক ধরে আমার ঘোরাঘুরি। কখনো টানা ঘোরা, আবার কখনো লম্বা সময়ের বিরতিতে যাওয়া। শুধু বিশ্রামাগার নয়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের বারান্দা বা করিডোরেও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা হয়েছে প্রচুর। ২০০০ সালে ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগমুক্তি বিশ্রামাগার’-এ হুইল চেয়ার বন্দি বীরপ্রতীক মোদাস্বার হোসেন মধুর সাথে আমার পরিচয়। কথায় কথায় দেখলাম স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেটের হিসেবে এই ‘স্বল্পশিক্ষিত’ মানুষটির স্বচ্ছ রাজনৈতিক চিন্তার বিন্যাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি একদিকে যেমন রয়েছে তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা, তেমনি রয়েছে ক্ষোভ। কিম্বা, বঙ্গবন্ধুর চেয়েও ‘মুজিব বাহিনী’র কেষ্ট-বিষ্টুদের প্রতিই এই ক্ষোভটা যেন বেশি। মধু, যিনি একাত্তরের যুদ্ধে প্রাক-পঁচিশেই সারাজীবনের মতো চলৎশক্তি হারিয়েছেন, তিনি একদিন আমার হাতে তুলে দিলেন একটি সাদা কাগজের সেলাই করা খাতায় বেশ কিছু পাতা লেখা। মধুর চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধের পরবর্তী কয়েক বছরের ইতিহাস।
    —————————————————————–
    “হঠাৎ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বলে উঠলেন, ‘এ্যাটেনশন প্লিজ!’ সকলের দৃষ্টি ও কান চলে যায় রাষ্ট্রপতির দিকে। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আপনারা মন দিয়ে শুনুন। আমি শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করব। কমিটিতে পুঁজির দরকার।… প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সর্বপ্রথম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটিতে তাঁর এক মাসের বেতন দান করেন।… ক্ষোভে-দুঃখে তখন শুধু পাশে বসা বন্ধু নূরুল আমিনের হাতটা চেপে ধরে শরীরের রাগ মেটালাম। রাজাকারের প্রথম সাহায্যে গঠিত হল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি।” / মোদাস্বার হোসেন মধু বীর প্রতীক
    —————————————————————-
    ফটোকপি করলাম। প্রচুর বানান ভুল। কাঁচা হাতের অক্ষর। তবু, মুক্তিযুদ্ধের অনেক না-বলা কথা আছে তাঁর এই লেখায়। তারপর… তারপর মধ্যবিত্ত জীবনের দৌড়, কর্মব্যস্ততা ও মধুকে আমার ভুলে যাওয়া! মধুর ঐ লেখা আমার কাছে ফাইলবন্দিই হয়ে রইলো। প্রায় বছর দশেক পরে গত বছরের শুরুতে আবার যখন ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগ বিশ্রামাগার’-এ গেলাম, মধুর সহযোদ্ধারা জানালেন মধু মারা গেছেন (এর ভেতর আরো দু/তিন বার গেছিলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই সময়গুলোয় প্রতিবারই গিয়ে শুনেছি যে মধু ক’দিনের জন্য দেশের বাড়ি গেছেন)। মধুর স্ত্রী ছিল জানতাম। তার ছেলে-মেয়ে ক’জন জিজ্ঞাসা করতে গেলে অপর এক হুইল-চেয়ারবন্দি সহযোদ্ধা খুব নির্বিকার ভাবে জানালেন, ‘বিয়া তো করিছিল শেষের দিকি দেশের বাড়ির ঘর দেখা-শুনা করতি আর নিজির কিছু সেবা-যত্নির জন্যি। মাঝে মাঝে দেশের বাড়ি গেলি পর সেবা করার লোক লাগে না? ছেলে-মেয়ে হবি কীভাবে? যুদ্ধে ওর পায়ের মতো পেনিসও উড়ি গিছিল!’ চমকে উঠলাম। মধুর এই কয়েক পাতার অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে মরিয়া হয়ে দেখা করা কিছু তরুণ মুক্তিযোদ্ধার ভেতর জনৈক তরুণের হঠাৎই নিজের হাতে ট্রাউজার ও অন্তর্বাস খুলে হারিয়ে যাওয়া পৌরুষের জন্য হাহাকার করার বেদনার কথা লেখা আছে। বঙ্গবন্ধু তখন দু’হাতে চোখ চাপা দিয়েছিলেন। মধুর হাতে লেখা দিনপঞ্জির পাতায় আবার চোখ বুলাই। হ্যাঁ, যুদ্ধে যে ‘পুরুষত্ব’ হারিয়েছেন সেকথা তিনি নিজেও লিখেছেন।
    madhu_4.jpg…….
    মোদাস্বার হোসেন মধু বীর প্রতীকের ডায়েরির একটি পাতা
    …….
    যাহোক, মধুর মৃত্যুর কথা জেনে ভয়ানক খারাপ লাগলো। এর পরপরই ২০০৯-এর মার্চ থেকে এপ্রিল মাস জুড়ে আমি প্রায় কুড়ি/একুশ জন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। আলোকচিত্রও তুলি। কিন্তু, প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরাটা হারিয়ে যায়। এর পর আর একটি ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে ছবি তুলি। এবার ভাইরাস আক্রমণ। যাহোক, অল্প-স্বল্প কিছু ছবি এখনো আছে। কিন্তু, মধুর ছবিই তো নেই। এই সব আহত বীর যোদ্ধাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি যে সতেরো থেকে পঁচিশের ভেতর হাত, পা, চোখ, কাণ, শিরদাঁড়া তো বটেই… অনেকেই তাদের ‘মেল-অর্গ্যান’ও হারিয়েছেন। এই যে আমি শব্দটি বাংলায় না লিখে ইংরেজিতে লিখলাম, এর কারণ হলো শৈশব থেকে যে ‘রাবীন্দ্রিক’, ‘পিউরিটান’ ও রীতিমতো ‘ভিক্টোরিয়’ শুচিতা-শ্লীলতাবোধে বাঙালী মধ্যবিত্ত বিশেষতঃ বাঙালী মধ্যবিত্ত নারীকে বড় করে তোলা হয়, সেই শিক্ষণের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে একজন নারী লেখক কিছুতেই খুব কড়া সত্যকেও কড়া করে অনেক সময়ই বলতে পারেন না। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধে আপনার-আমার মতো মধ্যবিত্ত অংশগ্রহণ করেছেন খুব কম সংখ্যায়। সমাজের নিম্নবর্গের মানুষই অংশ নিয়েছেন বেশি। ফলে, এই প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ মানুষগুলো… আমি তাদের বিপরীত লিঙ্গের ও বয়সে অনেক ছোট একজন হওয়া সত্ত্বেও… আমাকে ‘মা’ সম্বোধন করেও তারা কোনো রাখ-ঢাক না করেই বলেছেন যুদ্ধে তাদের ‘শিশ্ন’ হারানোর কথা। খুব অকপটভাবে। শ্লীলতা-শুচিতা বোধের কোনো রাখ-ঢাক বা মধ্যবিত্ত ভণিতা ছাড়াই। আমার সো-কল্ড শ্লীলতাবোধ যে অনেক বেশি অশ্লীল, তাও আমি এঁদের কাছ থেকেই শিখলাম। এই ভয়াবহ ইতিহাস শুনতে শুনতে আমার এমনও মনে হয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধে শুধুই নারীর আব্রু হারানোর কথা আমরা পড়েছি এতদিন। পুরুষ যে তার ‘পুরুষত্ব’ হারিয়েছে, সেই ইতিহাসও কি ‘পুরুষতন্ত্র’ই আলোতে আসতে দেয় নি এতদিন? কারণ, নারী তো এমন এক ‘বস্তু’ যার নিগ্রহ বা অবমাননা খুব সহজ ও সম্ভব। কিন্তু, পুরুষ যখন ‘পুরুষত্ব’ হারায়, তখন সেই আখ্যান অন্য পুরুষ কি লিখতে পারে না পুরুষের ভাবমূর্তির অবনমনের ভয়ে?

    ‘মধু’র আত্মজীবনী কিছুটা সংশোধন ও পরিমার্জনা সাপেক্ষে দেওয়া হলো।

    সঙ্কলন ও ভূমিকা: অদিতি ফাল্গুনী
    বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট’ গঠনের মূল ইতিহাস
    মোদাস্বার হোসেন মধু বীর প্রতীক

    ১. মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনের ইতিবৃত্ত

    ১৯৭২ ইং সালের ১০ই জানুয়ারী মাতৃভূমি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য কারা বরণ শেষে বাংলার মাটিতে পা রাখার সাথে সাথেই এক শ্রেণীর কুচক্রী রাজনীতিবিদ সহ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বড় ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধুর সরলতার সুযোগে তাঁকে কান কথায় ভুলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে বাঁকা পথে নিয়ে যাবার জোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু বাংলার নয়নমণি, স্বাধীন বাংলার স্থপতি ভুল পথে অগ্রসর হননি। বিশাল দেহ ও মনের অধিকারী জাতির পিতা বাঙালী মনে করে পিস কমিটির চেয়ারম্যান, মেম্বার, দালাল, রাজাকার ও আলবদরদের সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তবে, তিনি যদি বড় ভাইদের স্বার্থপর কথাগুলো না শুনে রাজাকার আলবদর ও দালালদের নির্যাতন করার কথা শুনতেন, তাঁর হাজার সন্তানের শাহাদাত বরণ ও পঙ্গুত্ব বরণের কথা শুনতেন, তবে কোনদিন তিনি সাধারণ ক্ষমার কথা মুখে উচ্চারণই করতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটিতে পা রাখার পর থেকেই মুজিব বাহিনীর বড় ভাইয়েরা শুধু এটাই তাঁকে বলেছে যে, ‘আপনার নামে বাহিনী তৈরি করে আমরা যুদ্ধ করে বাংলা মা’কে স্বাধীন করেছি।’ ১৯৭২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শুধু মুজিব বাহিনী বলে খ্যাত যোদ্ধাদের কথাই শুনেছেন। অথচ, তাঁর নির্দেশ পেয়ে সর্বপ্রথম বাংলার যে সব কুলি, মজুর, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতীর সন্তান ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছে, শাহাদাত বরণ করেছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, তাঁদের কথা তাঁর কর্ণ পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। যদি করত তবে তাঁর সেই সব সন্তানেরা কোন দিন বাংলার মানুষের নিকট আবর্জনা হয়ে বেঁচে থাকত না।

    যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের রোগ মুক্তি বিশ্রামাগার, কলেজগেট, ঢাকা

    বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার কিছুদিন পর মোহাম্মদপুরের এক সমাজ সেবক শ্রদ্ধেয় মৃত নজরুল ইসলাম চাচা বঙ্গবন্ধুকে সেই বীরঙ্গনাদের (মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে অবস্থানকারী) কথা জানালে চুপিচুপি বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধেয় মৃত নজরুল ইসলামের সাথে বাবর রোডে বীরাঙ্গনাদের দেখতে আসেন। এবং তাদের টাকাসহ জামাকাপড় ও কম্বল প্রদান করেন। প্রতিটি বীরঙ্গনার মাথায় হাত দিয়ে ‘মা’ বলে ডাক দিয়ে তিনি তাঁদের সান্তনা দিয়েছিলেন। বাবর রোড থেকে ফেরার সময় শ্রদ্ধেয় নজরুল চাচা মোহাম্মদপুরের কলেজ গেটে অবস্থানরত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন যে কলেজ গেটে বেশ কিছু পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করেছন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার বিবরণ নজরুল চাচা বঙ্গবন্ধুকে শোনালেও তিনি তখনকার পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং বর্তমানের ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগমুক্তি বিশ্রামগার’-এ যান নি। একটা চিরন্তন সত্য কথা হলো এই যে যোদ্ধা যদি যুদ্ধ করেন তবে তাঁকে শাহাদাত বরণ থেকে শুরু করে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবেই। খাঁটি যোদ্ধাদের মধ্যে অন্ততঃ ১% পার্সেন্ট হলেও যুদ্ধে শাহাদাত বরণ অথবা পঙ্গুত্ত্ব বরণ করবেই। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট পর্যন্ত এখনও কোন শহীদ অথবা পঙ্গু মুজিব বাহিনী খুঁজে পাই নাই। নাই। তাহলে কি এতে করে প্রমাণ হয় না যে মুজিব বাহিনীর ভাইয়েরা কতটুকু যুদ্ধ করেছেন? এবং আদৌ করেছেন কিনা? তার পরেও উক্ত বাহিনীর বড় ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধুকে শুধু ‘মুজিব বাহিনী’র ধারণাই দিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সহ আর কোন বাহিনীর কথা তিনি শোনেননি। জানেননি। কিন্তু যখন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও বিশ্রামাগারে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা হুইল চেয়ার ক্রাচ নিয়ে পঙ্গু অবস্থায় পিতার সাথে দেখা করার জন্য ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে তাঁর বাসস্থান ও গণভবনে যাতায়াত শুরু করল, তাঁকে সময় সুযোগ বুঝে বিরাক্ত করতে লাগল, তখনি তিনি ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের সম্বন্ধে অবগত হতে লাগলেন।

    একদিনের কথা। বঙ্গবন্ধুর গাড়ির চালক ফকিরদ্দীন (আমার সেসময়ের বন্ধু; বর্তমানে ফইক্কা পাগল) একদিন আমাকে গোপনে খবর দিল যে আজ বিকাল ৩:০০ টা হতে ৪:০০ টা নাগাদি বঙ্গবন্ধু গণভবনে নারকেল গাছ লাগাবেন। খবরটা পেয়ে আমি মোদাস্বার হোসেন মধু বীরপ্রতীক, কুমিল্লার মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বীরপ্রতীক, নোয়াখালীর নুরুল আমিন বীরপ্রতীক ও সিলেটের মো. আদূর রহমান তাঁর সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। রহমান ছাড়া আমরা তিনজনই হুইল চেয়ারে চলাচল করি। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক জান্তা বাহিনীর গুলিতে চির জনমের মত পঙ্গু হয়ে পুরুষত্ত্ব পর্যন্ত হারিয়েছি। আর রহমান? গুলি লেগে তার পুরুষাঙ্গের অংশ বিশেষসহ ১টি অণ্ডকোষ পর্যন্ত উড়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু প্রস্তুতি নিচ্ছেন নারকেল গাছ লাগানোর। এমন মুহূর্তে আমরা ৪ জন এক সাথে গণভবনে প্রবেশ করতে গেলে নূর ইসলাম নামে একজন সাধারণ প্রহরী আমাদের বাধা প্রদান করতে উদ্যত হয়। বন্ধু নূরুল আমিন বীর প্রতীক (মৃত) নূর ইসলামকে লাল চোখে ধমক দিয়ে ওঠে, ‘এ্যাই ব্যাটা তুই কেরে? আমরা আমাদের নেতার সাথে দেখা করব। ভাগ!’

    এখনকার মত তখন বঙ্গবন্ধুর মত একজন প্রধানমন্ত্রীর ফটকে কোন ভারী প্রটোকল অথবা হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর গণভবনে বোধ হয় একটি টেলিফোনই ছিল। আমাদের মতো চারজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে গণভবনের একেবারে ভেতরে দেখে ডাক দিলেন, “ফকির!” বঙ্গবন্ধু তাঁর গাড়ীর চালক ফকিরুদ্দীনকে স্নেহ করে ডাকতেন “ফকির।”

    তড়িৎ গতিতে ফকির তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তিনি আমাদের চারজনের দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা কারারে? এরা কী চায়?’ পাতলা মুখের ফকিরউদ্দীন আমাদের কথা বলার পূর্বেই প্রথমে মৃত নুরুল আমিন বীর প্রতীক তাঁর নাম ঠিকানা, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরসহ সব পরিচয় বঙ্গবন্ধুকে জানায়। বাকি আমরা তিনজনও আমাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় তাঁকে দেই। চার জনের মধ্যে আমি মধু, নুরুল আমিন ও নজরুল ইসলাম সহ তিনজনই তাঁকে বলি, ‘আমাদের শরীরে এখনও পাক বাহিনীর বুলেট রয়ে গেছে। ভারতের ডাক্তাররা শরীরের সব গুলি বের করতে পারে নি!’ তিনি নারকেল গাছ লাগাবার কথা ভুলেই গেলেন। ফ্যাল ফ্যাল চোখে কতক্ষণ আমাদের দিকে চেয়ে থেকে ফকিরের দিকে চেয়ে বলে উঠলেন, ‘ফকির, টেলিফোনটি নিয়ে আয়!’

    ফকির দৌড় দিয়ে ঘর থেকে ফোনের তার ছুটিয়ে নিয়ে এলো তাঁর সামনে। তিনি গণভবনের ঘাসের উপর বসে পড়লেন। কাকে যেন টেলিফোনে বললেন I need you now. So please meet me. আমরা বলা শুরু করলাম, ‘আমাদের আরো চিকিৎসা দরকার। আমাদের শরীরের গুলি আপনি বের করে দেন!’ তিনি সেই মুহূর্তে আমাদের মাথায় হাত রেখে বলতে লাগলেন, ‘তোমরা দেশ স্বাধীন করেছ। তোমরা ত’ দেখছ যে দেশের সব কিছু ধ্বংস!’ তাঁর বাকি কথা শেষ করার পূর্বেই সিলেটের রহমান তার প্যান্ট এবং জাঙ্গিয়া খুলে ফেলে একেবারে উলঙ্গ হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘লিডার! আমরা বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা আপনার নির্দেশের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং এমন ভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছি।’

    বঙ্গবন্ধু রহমানের দিকে দেখেই দুই চোখ ঢেকে ফেললেন। কেঁদে ফেললেন। অভিমানী ও উত্তেজিত, অল্পবয়সী মুক্তিযোদ্ধা রহমান আবার বলে উঠলো, ‘আপনার নির্দেশে যা হারিয়েছি ফিরিয়ে দিন। কামলা খেটে যাব। চিকিৎসার দরকার নাই।’
    মুক্তিযুদ্ধে লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ হারা উত্তেজিত রহমান বঙ্গবন্ধুর সামনে কথাগুলো বলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আমরাও অশ্রু সংবরণ করতে পারি নি। বঙ্গবন্ধু ও ফকির… তাঁদের চোখেও পানি। রহমান ও আমরা তিনজন। ইতোমধ্যে ফকিরুদ্দীন একটি গামলায় করে চানাচুর, মুড়ি, সরষের তেল আর পেঁয়াজ দিয়ে মাখিয়ে এনেছে। বঙ্গবন্ধু ফকিরকে নির্দেশ দিলেন, ‘গামলাটা ধরে রাখ। ওরা মুড়ি খাক।’ ফকিরুদ্দীন পাথরের মূর্তির মতো গামলা ধরে দঁড়ালো। আমাদের চারজনকে মুড়ি নিতে ইশারা করে তিনিও আমাদের সাথে একই গামলা থেকে মুড়ি নিয়ে খেতে লাগলেন। আমরা চারজন আর বঙ্গবন্ধু… সব মিলিয়ে পাঁচ জন একসাথে মুড়ি খাচ্ছি। দু/তিন বার মুড়ি হাতে নিয়েছি। হঠাৎই দেখি বঙ্গবন্ধু তাঁর স্নেহ ভাজন গাড়িচালক ফকিরুদ্দীকে ধমক মেরে বললেন, ‘কীরে মুড়ি খাওয়া তোর বাবার নিষেধ আছে? তুই খাচ্ছিস না কেন?’ হায়, তাঁর কাছে আহত মুক্তিযোদ্ধা, গাড়ির চালক হতে শুরু করে সবাই ছিল সমান। সেদিন অর্থাৎ ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে তিনি সেভাবেই অনুভব করেছিলেন। ইতোমধ্যে গণভবনে এসে হাজির হলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী। আমার গর্বিত জীবনে সেদিন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী আর স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের প্রথম সেনাপতির
    কথোপকথন শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। জেনারেল সাহেব এসে প্রধানমন্ত্রীর সামনে সোজা দাঁড়িয়ে মাথা নত করে চোখে চোখ ফেলেছেন। তিনি জেনারেল ওসমানীকে বললেন, ‘জেনারেল, কেমন আছেন? আপনি কি জানেন এরা কারা?’ জেনারেল ওসমানী সিলেটের রহমানকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন বিধায় বললেন, ‘হ্যাঁ, প্রাইম মিনিস্টার। ওরা কলেজের ছাত্র। ওরা আপনারই কথায় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আজ ডিসএবল হয়ে পড়েছে।’ একথা শুনে তিনি আরো বেশি অস্থির হয়ে পড়লেন। জেনারেলসহ সবাই এক সাথে মুড়ি খেলাম। বঙ্গবন্ধু সবার মাখায় হাত দিয়ে স্নেহভরে বলতে লাগলেন, ‘আমি তোদের চিকিৎসা করাবো। তোদের শরীরের ভেতরের গুলিও বের করার ব্যবস্থা করবো।’ আমরা তাঁর স্নেহবিজড়িত সান্ত্বনা নিয়ে ফিরে এলাম গণভবন থেকে। সেদিন আর প্রধানমন্ত্রী গণভবনে নারকেল গাছ লাগাতে পারেননি।

    আজও সেই ফকিরুদ্দীন, গার্ড নূর ইসলাম ও আমি সেদিনের ঘটনাসহ পরের অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছি। প্রায় একমাস পরে সেপ্টেম্বর ৭২-এর ১৪ তারিখ প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধের মহান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনী ওসমানী ও মুক্তিযুদ্ধের চীফ অব স্টাফ জেনারেল এম. এ. রব বীর উত্তমসহ এক আলোচনায় মিলিত হন। এছাড়াও সেদিনের আলোচনায় আরো উপস্থিত ছিলেন যুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একমাত্র জেনারেল ওসমানী ছাড়া প্রত্যেক সেক্টর কমান্ডারকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও প্রত্যেকটি সেক্টরে মেজর, ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট এমনকি সিভিল হতেও মিলিয়ে ৪/৫ অথবা ৫/৬ জন সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তার পর আরো ছিল কোম্পানি কমান্ডার, সেকশন কমান্ডার সহ কত না মুক্তিযোদ্ধা! সবাই মিলিয়েই মুক্তিযুদ্ধ। এই যারা যুদ্ধ করেছে, এদের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে আরও একটি বাহিনী ছিল। যার নাম ছিল মুজিব বাহিনী। বিজয় যখন বাঙালীর দোরগোড়ায়, তখন এরা অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস নাগাদ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সহ গোটা দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে পরিত্যক্ত অস্ত্র কুড়িয়ে ‘জয় বাংলা!’ ‘জয় বাংলা!’ বলে দেশে প্রবেশ করে হয়ে যায় মুজিব বাহিনী। বঙ্গবন্ধুর নামে নাম নেওয়া এই বাহিনী কতটুকু যুদ্ধ করেছেন কি না করেছেন তা’ কোনো ভাবেই বলা সম্ভব নয়। তবে, বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে আহত প্রায় ৫,০০০ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা দেন। এদের মধ্যে একজনও ‘মুজিব বাহিনী’র মুক্তিযোদ্ধা নেই। অথবা, স্বাধীনতার পর এত বছরেও কোনো শহীদ মুজিব বাহিনী পরিবারের কোনো সন্তানকে আমরা দেখতে পাই নাই। এ থেকেই বোঝা যায় যে ‘মুজিব বাহিনী’ দেশের জন্য যুদ্ধ করার পূর্বেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। অথচ ‘মুজিব বাহিনী’র বড় ভাইয়েরা পরিত্যক্ত কিছু অস্ত্র হাতে করে ‘জয় বাংলা’ বলে বাংলাদেশে ঢুকেই হয়ে গেল বড় মুক্তিযোদ্ধা। যাঁরা ছিলেন ছাত্রলীগের বড় ভাই, যাঁরা ছিলেন ছাত্র নেতা… সেই সব বড় ভাইয়েরাও দেশ স্বাধীন হবার পরে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে টানাটানি শুরু করলেন। কুটিল রাজনীতি দিয়ে তাঁরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন। বড় ভাইয়েরা কান কথায় বঙ্গবন্ধুকে ভুলাতে চেয়েছিলেন যে তাঁর নামে গঠিত বাহিনীই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু, যখন প্রকৃত আহত মুক্তিযোদ্ধারা পুরাতন গণভবন অথবা ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেছেন, তখন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে ‘মুজিব বাহিনী’র বাইরেও কত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ছিল! বঙ্গবন্ধু যখন ‘মুজিব বাহিনী’র কোনো যোদ্ধাকে আহত বা পঙ্গু হিসেবে খুঁজে পাননি, তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতিকে আমাদের কথা জিজ্ঞেস করেন। তারপর যখন তিনি দেখলেন যে এই সব কুলি, মজুর, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতীর সন্তান ও স্কুল কলেজের ছাত্ররাই সর্বাগ্রে দেশের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং তারাই আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে বা শহীদ হয়েছে, তখন তিনি সেইসব আহত, পঙ্গু ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভেবে, তাঁদের পরিবারগুলোর ভবিষ্যৎ ভরণ পোষণের কথা ভেবে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গঠন করেন ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাষ্ট।’

    মুক্তিযুদ্ধের চীফ অব স্টাফ মরহুম জেনারেল এম. এ. রব বীর উত্তমকে প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে বঙ্গবন্ধু গঠন করেন ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট।’ ট্রাষ্ট গঠনে স্বর্গীয়া ইন্দিরা গান্ধী ৭২ লক্ষ রুপী বাংলাদেশ সরকারকে অনুদান হিসাবে প্রদান করেন। এই ৭২ লক্ষ রুপীসহ মোট ৪ কোটি টাকা মূলধন ও মিসেস আদমজীর কোকো কোলা কোম্পানী, মিসেস মাদানীর গুলিস্তান সিনেমা হল, চু চিন চৌ রেষ্টুরেন্টসহ গোটা গুলিস্তান ভবন, নাজ সিনেমা, ওয়াইজ ঘাটে মুন সিনেমা, নবাবপুরের মডেল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী, হাটখোলায় হরদেও গ্লাস কোম্পানী, ঢাকার পূর্ণিমা ফিলিং ষ্টেশন, মেটাল প্যাকেজেস কোম্পানী, মিমি চকলেট কোম্পানী, সিরকো সোপ এন্ড কেমিক্যাল কোম্পানী, মিরপুরে বাক্স রাবার কোম্পানী, চট্টগ্রামের ইষ্টার্ন কেমিক্যাল কোম্পানী, হোমেদিয়া ওয়েল কোম্পানী, বাক্সলী পেইন্টস কোম্পানী, আলমাস, দিনার সিনেমাহল সহ মোট পাঁচটি সিনেমা হল ও ১৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং ৮৮, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় একটি একতলা বিল্ডিংসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান নিঃশর্ত দান করে সেগুলো চালনার জন্য বঙ্গবন্ধু গঠন করে দেন ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট।’ মুক্তিযুদ্ধের চীফ অব স্টাফ মরহুম জেনারেল এম এ, রব বীর উত্তম ও মুক্তিযুদ্ধে চার নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সি,আর,দত্ত ছাড়া আর কেউই কল্যাণ ট্রাষ্টকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেন নি। উক্ত দু’জনই শুধুমাত্র সরাসরি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন। বাকি যত জন এসেছেন তারা সবাই এম,ডি, পদে ডেপুটেশনে এসেছেন। দু/তিন বছর থেকে আবার চলে গেছেন। গাড়ি চালক, জি. এম., ডি. জি. এম., এম. ডি. সহ সবাই বিভিন্ন সময়ে ডেপুটেশনে এসেছেন। আবার চলে গেছেন। বাংলাদেশের জীবনে যেমন যেভাবে সরকার বদল হয়েছে ঠিক তেমন ভাবেই কল্যাণ ট্রাষ্টের পরিচালক বা এম, ডি, বদল হয়েছেন। আর দেশকে না চালিয়ে যেমন প্রত্যেকটি সরকার নিজকে চালাতে চেয়েছেন, বিভিন্ন প্রকার আমলার পাল্লায় পড়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট’-ও সেভাবেই চলেছে। বুকভরা আশা নিয়ে যাদের কল্যাণের কথা চিন্তা করে এই ট্রাস্ট গঠিত হয়েছিল, সেই ট্রাস্ট হতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো কল্যাণ আজ পর্যন্ত করা সম্ভব হয় নাই। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল যে এই ট্রাষ্টের আয় থেকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভরণ পোষণ হবে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে। তাঁদের ছেলে মেয়ের বিয়ে হবে। সকল কল্যাণমূলক কাজ করবে কল্যাণ ট্রাষ্ট। কিন্তু তদন্ত করলে দেখা যাবে, কল্যাণ ট্রাষ্টের আয় থেকে কর্মকর্তারা হজ্ব করে হাজী হয়েছেন। বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। রঙ্গিন টি, ভি, ফ্রিজের মালিক হয়েছেন। কিন্তু যাদের কল্যাণের জন্য ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল, তাদের বাড়িতে রঙিন টি, ভি, কিম্বা ফ্রিজের প্রশ্নই ওঠে না। মীরজাফরী রাজনীতি আর আমলাদের কারণেই যেমন দিন দিন দেশটা ধ্বংস হতে চলেছে, আমাদের ট্রাষ্টও আমলাদের হাতে পড়ে বিলুপ্তপ্রায়।

    রাজনৈতিক ভাবে প্রতিটি সরকার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার করেছেন। এম, পি, থেকে মুক্তিযোদ্ধা বড়ভাইয়েরা পর্যন্ত হুইল চেয়ারে চলাচলকারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ যুদ্ধাহত মুক্তি যোদ্ধাদের ব্যবহার করেছে। করে নিজেরা লাভবান হয়েছে। হয়েছে গাড়ি বাড়ির মালিক। কিন্তু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা? তিন বেলা খাবারও তাঁদের ভাগ্যে জোটে না। একটু মাথা গোঁজার ঠাই পর্যন্ত তাঁদের হচ্ছে না। ২৯ বৎসরের বাংলাদেশে এক এক করে এক ডজনের উপর সরকার অতিবাহিত হয়েছে এর মাঝে অর্ধ ডজন বিচারপতি পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করেছেন। কিন্তু দেশমাতৃকার কল্যাণে কেউই সাফল্যব্যঞ্জক উন্নয়নে সক্ষম হন নি। তেমনিভাবে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টের চেয়ারম্যান স্বয়ং দেশের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হয়।

    যাহোক, আগের কথায় ফিরে আসি। মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী ও পঙ্গুত্ব বরণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট প্রতিষ্ঠার পর থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চীফ অফ স্টাফ জেনারেল মরহুম এম. এ. রব বীর উত্তম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সি. আর. দত্ত বীর উত্তম… এই দু’জনই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের এই দুই বীর বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার আমলে কল্যাণ ট্রাষ্টের আয় থেকেই আহত যোদ্ধাদের ভাতা প্রদান করা হত। কল্যাণ ট্রাষ্ট গঠনের মূল ইতিহাসের সারাংশ এই দুই চেয়ারম্যানই কিছু কিছু জানতেন। জেনারেল মরহুম এম. এ. রব. বীর উত্তমের মুখে কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনের ইতিহাস কিছু কিছু শুনেছি। মরহুম জেনারেল এম. এ. রব বীর উত্তম বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টের প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন বলে অনেক কিছুই অবগত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু মাঝে মধ্যে গুরুতর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে অস্থির হয়ে পড়তেন। আমার জানা মতে তখনকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্বর্গীয়া শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও মুক্তিযুদ্ধের তথা বাংলাদেশের প্রথম প্রধান সেনাপতি জেনারেল মরহুম আতাউল গনি ওসমানীও ট্রাষ্ট গঠনের কথা জানতেন। হয়ত আরো অনেক ব্যক্তিত্ব এই গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকতে পারেন যা আমি জানি না। তবে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট আমাদের চোখের সামনে গঠিত হয়েছে বলে ট্রাষ্টের সংবিধানসহ এর জন্ম ইতিহাস আমার জানা।

    এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল। এদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ হতে শুরু করে অনেকেই জানেন আজকের ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগার’ ১৯৭৩-এর মার্চ মাস হতেই ‘আহত, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’ হিসেবে থাকার সময় হতে ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত কোনো দিন বঙ্গবন্ধু কলেজ গেটে অবস্থানরত আহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে আসেননি। যাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে জন্মদাতা পিতা-মাতাকে উপেক্ষা করে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে আহত হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছি, পুরুষত্ব হারিয়েছি… কলেজ গেটে অবস্থানরত সেই আমাদের তিনি দেখতে আসেন নি। কতজন আমাদের দেখতে এসে এবং আমাদের অভিমানের কথা শুনে কেঁদে-কেটে, অশ্রু বিসর্জন করে গেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কেন আমাদের দেখতে আসেন নি? এর উত্তর একমাত্র মোহাম্মদপুরের মরহুম নজরুল চাচা এবং আমি জানতাম। আসলে আমাদের মতো আহত যোদ্ধাদের দু/তিন জনকে দেখলেই তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। কেঁদে ফেলতেন। সান্ত্বনার ভাষাও হারিয়ে ফেলতেন। আর, সেসময় কলেজ গেটের এই বিশ্রামাগারে ২২৯ জন বিভিন্ন প্রকারের পঙ্গু ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা–কারো বুকে, পেটে, কোমরে, কলিজায় গুলি। চির জনমের মত পঙ্গু হয়ে গেছে। হাঁটতে পারে না। হুইল চেয়ারে চলাচল। কারো হাত নেই, কারো পা নেই। কারো শেলের আঘাতে চোখ, নাক নেই। মুখ পোড়া। এক সাথে ২২৯ জন এমনতর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে সহ্য করতে পারতেন না বলেই বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারী ১৯৭২ থেকে ১৪ই আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত কলেজ গেটে মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারে আসেননি। আসতে পারেন নি। এমনটাই আমি শ্রদ্ধেয় মৃত নজরুল চাচার মুখে শুনেছি এবং শুনে কেঁদেছি পর্যন্ত।

    বাবর রোডে অবস্থানরত একটি তিন তলা লাল রঙের বাড়িতে অবস্থান করতেন এই সোনার দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারীনী বীরাঙ্গনারা। সেখানে তাঁরা কতজন থাকতেন তা’ একমাত্র মরহুম নজরুল চাচা আর বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেউই অবগত ছিলেন না। আমরা তাঁদের দূর থেকেই দেখেছি। শুধু একজন বীরাঙ্গনা তাঁর নিজ পরিচয় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারে আসতেন এবং গল্প গুজব করে আমাদের সময় দিতেন। আমার মনে আছে যে তিনি বলেছিলেন তিনি বিএ পাশ এবং তাঁর নাম ’ডলি’। আসল নামটি আমি জানতে পারিনি। আমি বরাবর সাক্ষাৎ হলে সালাম করে তাঁকে ’ডলি আপা’ বলে ডাকতাম। ডলি আপা অনেক বার আহত, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা সেন্টারে এসেছেন। এক সাথে চা খেয়েছেন। বলেছেন, ‘তোরা কিন্তু কম দিস নি। আমি নারী। নারীত্ব লুণ্ঠন করে নেওয়ায় আমার যেমন সব শেষ হয়ে গেছে, তেমনিভাবে তোদেরও তো পুরুষত্ব শেষ হয়ে গেছে। আমার চেয়ে তোরা কি কম? আমি ত’ হাঁটতে পারছি। তোরা ত’ আর কোন দিন হাঁটতেও পারবি না!’

    আমার সেই ডলি আপা নাকি পরে পুলিশের কমিশন চাকুরী পেয়েছিলেন। কিন্তু আজ এখন ডলি আপা কোথায় আছেন কেমন আছেন জানি না! সেদিনের ডলি আপার কথা টেনে বলতে হয় যে জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে পাক জান্তাবাহিনীর বিরুদ্ধে যাঁরা সামনাসামনি যুদ্ধ করেছেন, যাঁরা গেরিলা যুদ্ধ করেছেন, তাদের ক্ষতির কোন হিসাব নাই। মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করতে যেয়ে পাক জান্তাবাহিনী অথবা তাদের এদেশীয় দোসররা দুই লক্ষাধিক মা বোনের ইজ্জত লুটে নিয়েছে। সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে চির জনমের মত পঙ্গু হয়ে গেছে। শুধু চির জনমের মত হাঁটা চলার শক্তি হারায়নি। বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের মত শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের পুরুষত্ব পর্যন্ত হারিয়েছেন। মোহাম্মদপুরের পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব নজরুল ইসলাম (মৃত) চাচার আবেদন আর অনুরোধে বঙ্গবন্ধু মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে অবস্থানরত ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মা, বোন, যাঁরা ইজ্জত হারিয়েছিলেন তাঁদের মাত্র ক’জনকে দেখে আর গণভবনে হুইল চেয়ার ও ক্রাচে ভর করা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে অত্যন্ত অস্থির বোধ করেছেন। এবং এর ফলশ্রুতিতে চার কোটি টাকা মূলধন দিয়ে গঠন করেছিলেন ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট’। মহান মুক্তিযুদ্ধের চীফ অব স্টাফ মরহুম জেনারেল এম. এ. রব বীর উত্তম সাহেবকে সরাসরি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে বলেছিলেন, ‘আমার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শাহাদাত বরণ ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, একমাত্র তাদেরই ট্রাষ্ট থেকে ভাতা ও ভরণ পোষণ প্রদান করা হবে।’

    ২.
    পিছন ফিরে তাকালে আজ মনে হয় দেশ স্বাধীনের পরপরই একটা গোপন ষড়যন্ত্র অবশ্যই হয়েছিল। এবং যতদূর সম্ভব আমাদের শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরাই সেটা করতে বসেছিলেন। যেমন ষড়যন্ত্র হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের খেতাব নিয়ে। এটা সুস্পষ্ট যে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে কোন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা নেই। এই সাত বীরশ্রেষ্ঠ সেনা, বিমান বা নৌবাহিনীর বিভিন্ন পদে আসীন ছিলেন। অথচ, আমার জানা মতে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আমার সাথী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মোহাম্মদ শামসুদ্দীন ও আমি… আমরা দু’জনেই বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের অধীনস্থ ৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা। শামসুদ্দীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাব-সেক্টরে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে একাই ১৮জন পাক সেনা ও ৭/৮ জন রাজাকারকে হত্যা করার পর সাথীদের জীবন রক্ষা করে নিজে সাহাদাত বরণ করেন। অথচ তাঁর বৃদ্ধা মাতা মালেকা খাতুন মাত্র পনেরোশ’ টাকা মাসিক রাষ্টীয় সম্মানী ভাতা ছাড়া আর কিছুই পাননি।

    বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শামসুদ্দীন এফ. এফ. বা ফ্রিডম ফাইটার অর্থাৎ সেনাবাহিনীর বাইরে সাধারণ জনতা হতে রিক্রুট বলে তাঁর ভাগ্যে একটি রাষ্ট্রীয় খেতাব জোটে নি। মুক্তিযুদ্ধের বীর শ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক খেতাবগুলো নিয়ে যেমন একটা টানাটানি ও ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবে বড় ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধুকে নানা রকম কান কথায় ভুলিয়ে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের। অথচ তাঁরাই প্রকৃতপক্ষে নেতার ডাকে সাড়া দিয়ে সর্বপ্রথম অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ভেতর থেকে উঠে আসা এই যোদ্ধারাই হয়েছেন শহীদ। হয়েছেন চিরজনমের মত পঙ্গু। হাঁটতে পারলেও বাকি জীবন শুনতে হয়েছে ‘খোঁড়া’ অপবাদ। মুজিব বাহিনীর বড় ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ২/১টা প্রতিরোধ ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়া পাক জান্তাবাহিনীর সাথে সামনা সামনি যুদ্ধ বলতে গেলে করেনই নি। যদি তারা পাক বাহিনীর সাথে সামনা সামনি যুদ্ধ করতেন তবে অবশ্যই ২/৫ জন যুদ্ধাহত মুজিব বাহিনীর সৈন্য থাকতেন। কিন্তু, আমার জানা মতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টে’র মাধ্যমে রাষ্টীয় সম্মানী ভাতা প্রাপ্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজনও মুজিব বাহিনী নেই। একটি শহীদ পরিবারও শহীদ মুজিব বাহিনীর নেই। তার পরও বড় ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধুকে কান কথা বলেছিলেন, ‘আমরাই আপনার নামে বাহিনী মানে মুজিব বাহিনী গঠন করে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি।’ হয়ত তিনি তাঁর প্রিয়ভাজনদের কান কথায় প্রকৃত উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যুদ্ধাহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভুলেই যেতেন। কিন্তু, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ও হাসপাতালের সামনে মুক্তিযোদ্ধা রেষ্ট হাউস থেকে যখন হুইল চেয়ারে চলাচলকারী সম্পূর্ণ পঙ্গু, হাত কাটা, পা কাটা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা পুরাতন গণভবন ও বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে ভিড় জমাতে লাগল, কান্নাকাটি করতে লাগল কি উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা শুরু করলো, তখন তিনি একদিন বলা চলে বিরক্ত হয়েই জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী সাহেবকে ডেকে আমাদের পরিচয় জানতে চান। জানতে চান আমরা কেমন করে পঙ্গু হলাম। জেনারেল সাহেব আমাদের অনেককে চিনতেন। রহমান নামের এক সিলেটি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা (যার যুদ্ধ অবস্থায় শেলের স্পিন্টার লেগে লিঙ্গটা উড়ে গেছে)- কে দেখিয়ে বললেন, ‘এরা স্কুল, কলেজে পড়ত। আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে এরাই যুদ্ধ করেছে এবং আহত ও পঙ্গু হয়েছে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভারতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পাকবাহিনীর সাথে সামনা সামনি লড়াই করে পঙ্গুত্ত্ব বরণ করেছে। অনেক শাহাদাত বরণও করেছেন।’ বঙ্গবন্ধু মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনলেন এবং জানতে চাইলেন, ‘এদের কে কমান্ড করলো? কার কমান্ডে এরা যুদ্ধ করলো?’ জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী বঙ্গবন্ধুকে জানালেন এই দেশটিকে যুদ্ধের স্বার্থে ১১ ভাগে ভাগ করা হয়। আর বাঙালীর বিচক্ষণ সেনা অফিসারদের এক একটি ভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেনারেলের মুখে বিস্তারিত তথ্য শুনে হতবাক হয়ে গেলেন বাংলাদেশের সেরা মানব। আমাদের মাথায় হাত দিয়ে দোওয়া করলেন। আশ্বাস দিলেন, ‘তোদের চিকিৎসা হবে। তোদের যা দরকার হবে আমি সব ব্যবস্থা করব। তবে কটা দিন তোরা অপেক্ষা কর।’

    এভাবেই কল্যাণ ট্রাস্টের শুরু। প্রথম দুই চেয়ারম্যান অর্থাৎ রব সাহেব ও সি,আর,দত্তের সময় কল্যাণ ট্রাষ্টের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান লাভ করেছে। জিয়াউর রহমান সরকারের পর এরশাদ সরকার ক্ষমতায় এসে অবশ্য আহত মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা শতকরা ৫০ ভাগ বৃদ্ধি করে দেন। কিন্তু, কল্যাণ ট্রাষ্ট থেকে চেয়ারম্যান প্রথা উঠিয়ে দিয়ে এস, ডি, প্রথা চালু করেন। চেয়ারম্যান থাকবেন সরাসরি রাষ্ট্রপ্রধান আর একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিকে ডেপুটেশনে এম,ডি, পদে নিয়োগ করা হবে। ডেপুটেশনে আসা এম, ডি. পরিচালকদের চাকুরীর মেয়াদ হবে দু/তিন বছর। এই এম,ডি,রা কল্যাণ ট্রাষ্টে এসে দেখেন অগাধ সম্পত্তি চারপাশে। ট্রাষ্টের ৫টি লাভজনক সিনেমা হলসহ সব ক’টি প্রতিষ্ঠানই লাভজনক। ট্রাষ্টে ডেপুটেশনে আসা এম,ডি, পরিচালকগণ বেমালুম ভুলে যান এটা কার কল্যাণে ট্রাষ্ট। কাদের কল্যাণে নির্মিত। কর্ম পালনের কথা ভুলে যান। তারা বলেন যে দু/তিন বছরে আর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারদের কি কল্যাণ করা সম্ভব? তাই নিজেরা ট্রাষ্টের টাকায় বিদেশ ঘোরা ও হজ্ব পালন করা শুরু করেন। শুরু করেন বাড়ি নির্মাণ। গাড়ি ক্রয়। আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তার পরেও বিলুপ্ত প্রায় ট্রাষ্টের আজো যে সম্পদ রয়েছে, তাও হাজার কোটি টাকার উর্ধে।

    ৩. যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগ বিশ্রামাগার গঠনের ইতিবৃত্ত
    দীর্ঘ ন’মাস অনেক লড়াইয়ের ফসল ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালী ঘরে উত্তোলন করে। ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষাধিক মা বোনের সম্ভ্রম ও কয়েকশ’ দামাল সন্তানের অঙ্গহানীর বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা লাভের পরপরই বিভিন্ন জেলা থেকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসার প্রয়োজনে রাজধানী ঢাকাতে এসে উপস্থিত হতে থাকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পিজি হাসপাতাল, মহাখালী বক্ষব্যধি হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল অর্থাৎ সবখানেই আহত, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অথবা পাকবাহিনীর গোলার আঘাতে আহত বাঙালী রোগী। সবাই চিকিৎসার প্রয়োজন মনে করে ঢাকায় উপস্থিত। ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাও নিজ মাতৃভূমিতে স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করার জন্য ভারতের হাসপাতালের উন্নত চিকিৎসা ত্যাগ করে মাতৃভূমিতে এসে রাজধানীতে ভীড় জমায়। ফলে, প্রতিটি হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের স্থান সংকুলান অসম্ভব হয়ে পড়ে। হাসপাতালে সাধারণ রোগী চিকিৎসার সাথে সাথে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাও চিকিৎসায় আসলে প্রতিটি হাসপাতালে স্থান সংকুলান কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা মগবাজারের একটি বাড়িকে ‘শুশ্রুষা’ নাম দিয়ে বসবাস করতে থাকেন।

    ‘শুশ্রুষা’র মত শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে ১/৬ ও ১/৩ গজনবী রোডের ২টি বাড়িতে ৪০/৫০ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মেঝেতে শুয়ে (ফ্লোরিং) দিন কাটাতেন আর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা (ড্রেসিং) করাতেন। ১/৬ ও ১/৩ গজনবী রোড। মোহাম্মদপুরের এই বাড়ি দু’টো বিহারীদের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত বাড়ি ছিল। যা পরবর্তী সময়ে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। ১/৬ ও ১/৩ নং বাড়ির লাইনে আরও একটি পরিত্যক্ত বাড়ি ছিল। যেখানে বরিশালের তদানীন্তন এম,পি, এনায়েতুল্লাহ খান বসবাস করতেন। হাসপাতালে সাধারণ রোগীর সাথে উপুর্যুপরি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা করতে বিছানা-পত্র সহ স্থানের অভাব হলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অবস্থানরত ও ১/৬ এবং ১/৩ বাড়িতে অবস্থানরত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে এম, পি, এনায়েতুল্লাহ খানকে অনুরোধ করেন। বলেন, ‘স্যার, আপনার ত’ ঢাকায় আরো বাড়ি আছে। তাই বিহারীদের ফেলে যাওয়া এই বাড়িটি আমাদের বসবাসের জন্য দিয়ে দিলে আমাদের উপকার হত। সেই সাথে হাসপাতালে সাধারণ রোগীদেরও চিকিৎসার সুবিধা হতো।’

    এনায়েতুল্লাহ খানকে বাড়ি ছাড়ার অনুরোধ জানালে এনায়েতুল্লাহ খান রাগান্বিত হয়ে ওঠেন এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের গালিগালাজ দেওয়া শুরু করেন। তার গালাগালি ও চিৎকারে রাস্তার সাধারণ মানুষ থেকে হাসপাতালের ভিতর হতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা এসে হাজির হন কলেজ গেটের ১/১ গজনবী রোড এর বাড়ির সম্মুখে। ততক্ষণে রাগান্বিত এম, পি, এনায়েতুল্লা খান ঘর থেকে তার দু’নলা বন্দুক বের করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের উপর গুলি চালায়। তার বন্দুকের গুলিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ওলি আহাদ ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। ওলি আহাদকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ফাঁকে এনায়েতুল্লা খান পরিবার পরিজন নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লে ঘটনাস্থলে প্রথম এসে হাজির হন কাদের সিদ্দিকী। তিনি গোটা ঘটনা শুনে আর ওলি আহাদের লাশ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। জিজ্ঞেস করেন, ‘কোথায় রাজাকারের বাচ্চা?’ বলে সদর ঘাটের দিকে তাঁর জিপ নিয়ে তড়িৎগতিতে চলে যান। যাবার পূর্বে বলে গেলেন, ‘কোথাও পালাতে পারবেনা হারামীর বাচ্চা। আমি তাকে বের করে ছাড়ব। তোমরা ওর বাড়ির মাল-পত্র বের করে সামনে এক স্থানে গাদা করো। আমি আসছি!’

    তাঁর নির্দেশ পেয়ে শতাধিক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মিলিতভাবে জনসাধারণকে অনুরোধ করে সরিয়ে দিয়ে কলেজ গেটে যেখানে আজ যাত্রী ছাউনি আর সোনালী ব্যাংক, সেখানে খাট, চেয়ার, টেবিল, ওয়াড্রোব, আলমারী, দামী ও সুদৃশ্য সোফা ও শোকেসসহ বিছানা-পত্র সব এক স্থানে স্তূপ করেন। ১৯৭৩ইং সালে এম, পি, এনায়েতুল্লাহ খানের মেয়ের ড্রেসিং টেবিলে তখনকার মূল্যমানের অন্ততঃ দু’লক্ষ টাকার বিভিন্ন প্রসাধনী দ্রব্য পাওয়া যায়। কাদের সিদ্দিকি ফিরে এসে নির্দেশ দেন, ‘জ্বালিয়ে দাও রাজাকারের বাচ্চার বাড়ির মালপত্র!’

    তড়িৎ গতিতে বিহারী কলোনী থেকে পাঁচ সের কেরোসিন তেল এনে ঢেলে দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় সবকিছু। ১/১ নম্বর গজনবী রোডের বাড়িটি পরিষ্কার করে সেই বাড়িতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়েন। সিদ্ধান্ত হয় যে যুদ্ধে পক্ষাঘাতগ্রস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের এই বাড়িতে চিকিৎসাধীন রাখা হবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রতিনিধিত্বকারী দলের সদস্য ডা. জোয়ারদার অতীব আগ্রহান্বিত হয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সার্জিক্যাল খাট সহ বিছানা পত্র চেয়ে একটি আবেদন রাখেন জাতিসংঘ প্রেরিত হাড় বিশেষজ্ঞ (Bone Specialist) ড. রোনাল্ড জেমস্ গার্ষ্ট এম, ডি, কে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী ড. রোনাল্ড জেমস গার্ষ্ট এম, ডি, পেশায় একজন ডাক্তার হলেও ছিলেন মাটির মানুষ। ভারি উদার মনের মানুষ ছিলেন সেই বিদেশী। ১৯৭২ সালে শুধুমাত্র যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতে তিনি ঢাকায় আসেন। প্রতিটি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতেন নিজ সন্তানের মত। আদর করতেন, ব্যবহার করতেন বন্ধুর মত। ড. গার্ষ্ট সহধর্মিনী মেরী গার্ষ্টকেও বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। মেরী গার্ষ্টও মা, বোন ও সেবিকার দায়িত্ব পালন করেছেন প্রতিটি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সাথে। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করে ড. গার্ষ্ট বাংলাদেশ থেকে চলে যান। তবে, বাংলাদেশ সরকারসহ তাঁর ছাত্র ও বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালকদের অনুরোধে প্রতি বছর একবার করে আসার প্রতিশ্রুতি দেন এবং তিনি সেই মাফিক আসতেন। তিনি এখনও নিজ খরচে বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে অনেক কঠিন অপারেশন করেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ খবর নেন। মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারে সপত্নীক দেখা করেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। ক্যামেরায় তাদের ছবি তোলেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক ও জননী ড. রোনাল্ড জেমস গার্ষ্ট ও মেরী গার্ষ্ট যত দিন বাংলাদেশে থেকেছেন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অভিভাবক ও সন্তানের সম্পর্কে থেকেছেন। তাঁদের অমূল্য অবদানের প্রতি স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতিরক্ষা সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপদেষ্টা আসাদুজ্জামান এম.পি. সাহেবের উপস্থিতিতে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জনাব মোদাস্বার হোসেন মধু বীর প্রতীক তাঁর বক্তৃতার মাধ্যম ড. গার্ষ্টকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানায়। জনাব আসাদুজ্জামান এম, পি, ড. গার্ষ্টকে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। ড. গার্ষ্ট বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “যত দিন বাঁচব, আমার ছেলেদের দেখাশুনা করতে পারব।’

    ফিরে আসি আগের কথায়। সেই ১৯৭২ সালে উদারমনস্ক আর এক বাঙালী চিকিৎসক ডা. জোয়ার্দারের অনুরোধে ২৩০টি সার্জিক্যাল খাট ও বিছানা পত্রসহ অনেক কিছুই ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগমুক্তি বিশ্রামাগার’কে প্রদান করা হয়। একটি সার্জিক্যাল খাটের মূল্য প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ১/১ গজনবী রোড এর বাড়িটিতে ক্লিনিক সিস্টেমে খাট বসিয়ে প্রথমে ১। মোদাস্বার হোসেন মধু ২। মো. নুরুল আমিন, ৩। মো. আনোয়ার হোসেন, ৪। মো. নজরুল ইসলাম, ৫। মো. জাফর আলী, ৬। শ্রী মানিক গোপাল দাস, ৭। শুকুর মাহমুদ, ৮। মো. নূরুজ্জামান, ৯। গোলাম মোস্তফা ১০। মোজ্জামেল হোসেন, ১১। মো. আ: রাজ্জাক, ১২। মো. ইউসুফ আলী, ১৩। মোসলেম উদ্দীন, ১৪। মো. আ: সোবহান, ১৫। শ্রী মানিক চন্দ্র ভৌমিক, ১৬। আ. হান্নানসহ মো ১৮ জন গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাকে স্থান করে দেওয়া হল। আরও ছয় জন কয়েকদিন পরে ভর্তি হয়। মোট ২৪ জন পক্ষাঘাতগ্রস্থ মুক্তিযোদ্ধাকে সর্ব প্রথম স্থান দেওয়া হলো। ১/৩ ও ১/৬ নং ২টি বাড়িতেও গাদাগাদি করে ছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। কারো হাত নেই। কারো পা নেই। কেউ একেবারে অক্ষম। কারো মুখ পোড়া। এসব যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান সুরু করে ১/১, ১/৩ ও ১/৬ নম্বর বাড়িতে। ডা. জোয়ার্দার তার একনিষ্ঠ উদ্যোগে তখনকার রাষ্ট্রপতি বিচারপতি মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরী ও ড. গার্ষ্টের সাথে আলোচনা করে, রেডক্রস, ইউনিসেফ, আই, আর, সি, ইউ, এন, ডি, পি, ও ‘সেন্ট্রাল মেলোনাইটে’র মত সাহায্য সংস্থাগুলোকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভবিষ্যৎ পুনর্বাসনকল্পে তাদের সাহায্য সহযোগিতা ও বিভিন্ন প্রকার ভকেশনাল প্রশিক্ষণ দেবার আহ্বান জানান। সাহায্য সংস্থাগুলো সরাসরি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন কল্পে এগিয়ে আসার ঘোষণা ব্যক্ত করেন। ড. গার্ষ্ট খাট, বিছানা, ওষুধ পত্র দেওয়ার পরে ১/১ বাড়ির সম্মুখে একটি হল ঘরে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁশ, বেত, টাইপ, ঘড়ি, ভিডিও, টেপ, টি,ভি, থেকে সেলাইয়ের কাজ পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। যুদ্ধাহত সৈনিকরাও আন্তরিকভাবে সকল শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগলেন। সেসময় সবাই মিলে আলোচনায় বসে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসস্থলটির একটি নাম রাখা হয়। প্রথম নামকরণ করা হয় ইংরেজীতে ‘Disabled Freedom Fighters’ Vocational Rehabilitation Training Centre’। এর বাংলা হলো ‘পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র।’ তিনটা বাড়িতে গাদাগাদি করে অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বসবাস করে ভকেশনাল শিক্ষা নেন। ১/১ ও ১/৩ বাড়ির মাঝখানে ১/২ নম্বর বাড়িটি ছিল একজন ভদ্রমহিলার। ভদ্রমহিলার ঢাকায় আর ৪/৫টা বাড়ি আছে। একদিন ভদ্রমহিলা দেখেন ১/২ গজনবীর বাড়িতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা গাদাগাদি করে অমানবিক ভাবে বসবাস করছেন। ভদ্রমহিলা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট দেখে সাথে সাথে লিডার জাফর চাচাকে বললেন, “এই বাড়িটি আমার। তোমরা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা এখন থেকে এখানেও বসবাস করবে। যতদিন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের ছেলে মেয়েরা বসবাস করবেন, এই বাড়িতে আমার কোন দাবি নাই বা থাকবে না।”

    এভাবেই সেদিন থেকে ১/১, ১/২, ১/৩, ও ১/৬ ৪টি বাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু করে আজকের ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগমুক্তি বিশ্রামাগার’। ভদ্রমহিলা বাড়িটি দান করে দেবার পর থেকেই ঈদ, পরব বা শবেবরাত সহ বিভিন্ন দিনে ভাল খাবার রান্না করে এনে হুইল চেয়ারে চলাচলকারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ হাতে খাওয়াতেন। মায়ের মত আদর করতেন। কোরবানী ঈদে গরু ছাগল নিয়ে আসতেন। দিয়ে যেতেন বিশ্রামাগারে। ভদ্রমহিলাকে আমরা এত শ্রদ্ধা করতাম যে কোন দিন ভদ্রমহিলার নামটি জিজ্ঞেস করতেও সৎসাহস হয়নি। তবে শুনেছিলাম তাঁর স্বামীর নাম জনাব আবুল কাশেম। গত ৭/৮ বছর তাঁকে দেখি না ঠিকই। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে স্মরণ হয় তাঁকে। জানি না সেই মা আজ আর ইহজগতে আছেন কিনা। তিনি বেঁচে থাকলে আমাদের মাঝে না এসে পারতেন না।

    এলো ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫। সাহায্য সংস্থাগুলো তখন আমাদের শিক্ষা ও সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ করে চলে যায়। সাহায্য সংস্থাগুলোর মধ্যে আই, আর, সি, র পরিচালক (Director) মি. মার্শাল বিয়ার হুইল চেয়ারে চলাচলকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতেন। চলে যাবার আগে তিনি হুইল চেয়ারে চলাচলকারী মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের দেশের মানুষ ভাল না। শেখ মুজিবের মত মানুষকে হত্যা করতে পারে?’ মি. মার্শাল বিয়ার অত্যন্ত মিশুক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অল্প অল্প বাংলা তিনি বলতে পারতেন। এখনও তিনি মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারে আসেন। কিন্তু যাঁদের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব বেশি ছিল, সেইসব হুইল চেয়ারধারীদের মধ্যে প্রায় সবাই ইহজগত ত্যাগ করেছেন। মাত্র একজন জীবিত আছেন। তাঁর সাথে গল্প করে কিছু সময় বিশ্রামাগারে কাটিয়ে ফিরে যান মি. মার্শাল বিয়ার।

    পঁচাত্তরের ঘটনার পর সাহায্য সংস্থাগুলো চলে গেলে ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট’ হতে মাসিক পঁচাত্তর টাকা সম্মানী ভাতা ছাড়া আর কোন সুযোগ সুবিধা ছিল না। ১৯৭৩ থেকে ’৭৫ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত রেডক্রস, আই, আর, সি, বা ইউনিসেফ, ইউ, এন, ডি, পি, কি সেন্ট্রাল মেলোনাইটের মতো সাহায্য সংস্থাগুলো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কাপড় বা গুঁড়া দুধ প্রদান সহ নানা সাহায্য সহযোগিতা করতেন। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত দেশে কোন সরকার ছিল কি ছিল না, তা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই অবগত ছিলেন না। কারণ, ঐ সময়টায় সরকারী বেসরকারী কোন ভাবেই কেউ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করেননি। মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের প্রধান মেজর জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ও পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্র পরিচালনার ফাঁকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ খবরও নিতেন। জিয়াউর রহমান একদিকে মন্ত্রী পরিষদে কুখ্যাত রাজাকারদের মন্ত্রিত্ব দিয়ে যেমন পুনর্বাসিত করলেন, আবার অদ্ভুতভাবে হঠাৎ করেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারদের পুনর্বাসনের কিছু পদক্ষেপ হাতে নিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সূত্র ধরে গঠন করলেন একটি কমিটি। জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়ে বিল উত্থাপন করেন যে শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা প্রদান করা হবে রাষ্টীয় কোষাগার থেকে। মিরপুর চিড়িয়াখানার সম্মুখে ১৩ একর জমি কল্যাণ ট্রাষ্টকে লীজ প্রদান করেন। ঠিক হয় এই জমিতে শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের বাসস্থান সমস্যা দূরীকরণে নির্মাণ করা হবে ‘মুক্তিযোদ্ধা পল্লী’। যার নামকরণও করেছিলেন তিনি। ‘মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন’ নামকরণ করে একটি চারতলা ভবনও নির্মিত হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে ভবনে ১৬জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও ৫টি শহীদ পরিবারকে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। মোট ২১টি পরিবার কমপ্লেক্স ভবনের ভিতরে স্থানলাভ করে। কমপ্লেক্স ভবনের পেছনে একটি সুদৃশ্য পুকুরও নির্মাণ করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের নিজ হাতে গঠন করা ‘কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি’র মাধ্যমে সকল প্রকার পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়। ‘কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি’ অনেক পরে গঠন করা হয়। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়ে মাঝে মধ্যেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারে আসতেন। এই নামটিও তাঁরই দেওয়া।

    একদিনের ঘটনা: জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি কল্যাণ ট্রাষ্টের কর্মকর্তাকে অবহিত করে দেখতে এসেছেন বিশ্রামাগারে অবস্থানরত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের। এটা তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়ার ৭/৮ দিন পরের ঘটনা। বিশ্রামাগারে এসে সাইন বোর্ড দেখে বলে উঠলেন, ‘যেহেতু এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে আহত, হুইল চেয়ারে বসে বা ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটেও কাজকর্ম করতে পারে। সেহেতু সাইনবোডটি চেঞ্জ করতে হবে।’ ইতোপূর্বে সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র”। জিয়াউর রহমান ১/১ নম্বর বাড়িতে বসে বলতে লাগলেন, ‘যেহেতু এরা কেউ দুর্ঘটনায় পঙ্গু নয়, সবাই মুক্তিযুদ্ধ করে পঙ্গু… সেহেতু সাইনবোর্ডটি চেঞ্জ করা দরকার। আর সাইনবোর্ডে লিখতে হবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগ মুক্তি বিশ্রামাগার।’ যদিও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কারোরই রোগের মুক্তি ঘটেনি, তবুও সেদিন থেকেই সাইনবোর্ডের লেখা পরিবর্তন হয়ে “যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগমুক্তি বিশ্রামাগার” লেখা হয়। এবং অদ্যাবধি এই নামেই মোহাম্মদপুরের মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারটি চলছে।

    জিয়াউর রহমানের সাথে একটি ব্যক্তিগত ঘটনা ভুলতে পারি না। ১৯৭৯ সালের জুন মাস। রাষ্ট্রপতি আবারো এসেছেন মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারের ১/১ গজনবী রোডের বাড়িতে। এই বাড়িটিতে শুধু হুইল চেয়ারে চলাচলকারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করতেন। বরাবরই জিয়াউর রহমানের সাথে তার বিশ্বস্ত এ.ডি. সি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল মাহফুজুর রহমান (মাহফুজ ভাই) থাকতেন। সেদিন তাঁর সাথে ছিলেন তৎকালীন মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজুর রহমান, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রী আতাউদ্দিন খান, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী এ্যানি ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল জাফর ইমাম বীর বিক্রম, যুব ও ক্রিড়া প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেম। এসময় ৮/১০ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তাদের সামনে হুইল চেয়ারে বসা। পাশের বাড়ি থেকে অন্যান্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাও ৫/১০ জন এসেছেন। হঠাৎ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বলে উঠলেন, ‘এ্যাটেনশন প্লিজ!’ সকলের দৃষ্টি ও কান চলে যায় রাষ্ট্রপতির দিকে। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আপনারা মন দিয়ে শুনুন। আমি শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করব। কমিটিতে পুঁজির দরকার। পুঁজি সংগ্রহের স্বার্থে আমি আপনাদের কাছে প্রথমে চাঁদা দাবি করছি। আপনারা কে কত চাঁদা দিবেন বলেন?’

    সেদিন হুইল চেয়ারে চলাচলকারী একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। তখন সেখানে দু/তিন জন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী থাকা সত্বেও প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সর্বপ্রথম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটিতে তাঁর এক মাসের বেতন দান করেন। রাজনীতির হারজিত শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। ক্ষোভে-দুঃখে তখন শুধু পাশে বসা বন্ধু নূরুল আমিনের হাতটা চেপে ধরে শরীরের রাগ মেটালাম। রাজাকারের প্রথম সাহায্যে গঠিত হল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি। কী ভণ্ডামি! উপস্থিত সকল মন্ত্রী এক মাসের করে বেতন কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটিতে দান করলেন। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীকে সদস্য সচিব, প্রধানমন্ত্রী, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রী, পুনর্বাসন মন্ত্রী, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী, যুব ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীকে সদস্য করে রাষ্ট্রপতি নিজে চেয়ারম্যান হয়ে গঠন করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি। এই কমিটি প্রতি মাসে একটি আলোচনা সভা করবেন এবং তাতে শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণের দিক প্রাধান্য পাবে। কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি হল। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদনে সদস্য সচিব, ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর সাক্ষরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। সেই পরিচয়পত্র দেখিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা সরকারী যানবাহনে বিনা ভাড়ায় চলাচল করতে পারবেন। এ নিয়ম এখনো বলবৎ আছে। বর্তমানে উক্ত পরিচয়পত্রে সাক্ষর দান করেন প্রতিরক্ষা সচিব। রাষ্ট্রপতি তথা কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটির চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান প্রতিটি সিনেমা হলের প্রতিটি টিকেটে ১০ পয়সা করে চাঁদাও ধরেন। তদুপরি মিরপুরে চারতলা একটি ভবন নির্মাণ ছাড়া এই কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি হতে কোন শহীদ পরিবার বা যুদ্ধাহত কোন সৈনিককে একটি টাকাও দেওয়া হয় নি। যদিও এই কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য ৮৬ কোটি টাকা রক্ষিত ছিল এবং এই টাকা খালেদা জিয়ার ক্ষমতায় আসার দিন পর্যন্ত ছিল, তবু কোন কোন কালো হাতের ছায়ার খপ্পরে পড়ে এর একটি টাকাও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ব্যয় হয় নি। সেই ১২ একর জমিতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারেরা আজ বস্তির মতো কিছু একটা তৈরি করে বসবাস করছে। রাজনীতি আর বক্তৃতায় ‘মুক্তিযোদ্ধা পল্লী’র ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে তা রূপ লাভ করছে না। তবে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারবর্গ নিরাশ নয়। অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয় অনিবার্য।

    আর্টস-এ প্রকাশিত লেখা
    মিশেল ফুকোর শৃঙ্খলা ও শাস্তি: জেলখানার জন্ম (ধারাবাহিক অনুবাদ; অসমাপ্ত ১ থেকে ১২ কিস্তি)
    লেখকের প্রয়াণ: শহীদুল জহির ও আমাদের কথাশিল্পের ভুবন
    নগর পিতা বৃষ্টি নামান (গল্প)
    তিতা মিঞার জঙ্গনামা
    মাহমুদুল হকের অনুর পাঠশালা: খঞ্জনা পাখির কাব্য (বইয়ের আলোচনা)
    ‘পারস্যে’: মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা
    বারগির, রেশম ও রসুন বোনার গল্প
    যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার
    ঢাকায় আর্মেনীয়রা
    এক মৃত মুক্তিযোদ্ধার দিনপঞ্জির পাতা থেকে…

    লেখকের আর্টস প্রোফাইল: অদিতি ফাল্গুনী
    ইমেইল: [email protected]

    ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts

    free counters
    Free counters

    ১৯৭১, রোজনামচা
    প্রতিক্রিয়া (৭) »
    প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন Ahmed Bulbul Islam — december ১৯, ২০১১ @ ১:৫১ অপরাহ্ন
    Audity
    Your pen is like a sword !

    প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অমি রহমান পিয়াল — december ২২, ২০১১ @ ৩:৪০ পূর্বাহ্ন
    অদিতি ফাল্গুনী,মনগড়া এক কল্পগাঁথা ফাঁদার জন্য আপনাকে তীব্র ধিক্কার দিয়ে শুরু করছি। বেশীদিন হয়নি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা এবং ধর্ষনের শিকার নারীদের সংখ্যা নিয়ে শর্মিলা বোসের উদ্ভট গবেষণার এবং তথ্যবিকৃতির অপমান সইতে হয়েছে আমাদের। আপনিও ঠিক তার পথেই হাঁটলেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং এর ইতিহাস নিয়ে বিন্দুমাত্র জ্ঞান আপনার থাকলে এই দুঃসাহস কস্মিনকালেও হওয়ার কথা নয় কারো? আপনি সেটা দেখালেন কিসের জোরে? কিসের লোভে? এই অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে এমন ইতিহাস বিকৃতি করে কি কারণে মুক্তিযুদ্ধপ্রেমী নতুন প্রজন্মের সামনে নিজেকে ধিকৃত করার ঝুকি নিলেন?

    কাল্পনিক এক মুক্তিযোদ্ধার বরাতে আপনার গোটা লেখায় হিডেন ম্যাসেজ কি? কি তথ্যগুলো মানুষকে গেলাতে চাইলেন? ১.বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অতি মহৎ, এতই মহৎ যে রাজাকার-আলবদরদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দায়মুক্তি দিয়েছেন। ২. মুজিব আমলে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলো অবহেলিত,মন্ত্রীরা বিহারীদের জায়গাজমি দখল করে নেয়, মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি চলায়। অন্যদিকে স্রেফ তার পন্থীরাই যাবতীয় সুবিধাভোগী। এবং মুজিব বাহিনী নামে এই গোষ্ঠীটি মুক্তিযুদ্ধই করেনি। ৩. সেই বিচারে পুনর্বাসিত স্বাধীনতাবিরোধীরাই বরং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দরদ দেখিয়েছেন, উদাহরণ শাহ আজিজুর রহমান!

    চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে জামাত-শিবিরের যে প্রপোগান্ডা এবং মিথ্যে গল্পগুলো প্রতিদিন নানা রংয়ে নানা ঢংয়ে ব্লগে, ফেসবুক পেইজগুলোতে প্রকাশ পাচ্ছে। তার সমান্তরালেই আপনার লেখার টোন। সেই মেহেরজানের চিত্রনাট্যের রিকনসিলিয়েশন থিওরি। মুক্তিযোদ্ধাদের খারাপ দেখিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি সহানুভূতি আদায়ের গোপন চক্রান্তের (কু)বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশ।

    এই অভিযোগগুলোর বিপরীতে ইতিহাসের দলিল বলছে ১.বঙ্গবন্ধূর সাধারণক্ষমা ঘোষণার আওতায় খুনী, ধর্ষণকারী ও অগ্নিসংযোগকারীদের ক্ষমা করা হয়নি। তাহলে কেনো এই তথ্য বিকৃতি? ২.মুজিব বাহিনী ছিলো একটি এলিট ফোর্স যারা প্রতিটি অঞ্চলে সেল সিস্টেমে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়েছিলো। সমাজতন্ত্রমনা এই বাহিনীর শতকরা আশিভাগ স্বাধীনতার পর জাসদে যোগ দেয় এবং গণবাহিনী গঠন করে। প্রতিপক্ষ হিসেবে রক্ষীবাহিনীতে পায় তাদেরই পুরানো কমরেডদের। চট্টগ্রাম কিভাবে দখল করা হয়েছিলো এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে মুজিব বাহিনীর অপারেশন নিয়ে আপনার কোনো জ্ঞান থাকার কথা নয় অবশ্য। কারণ এই মিশনে তথ্য জানাটা জরুরী নয়। ৩.জিয়ার মুক্তিযোদ্ধাপ্রীতির প্রমাণ তো সেনাবাহিনীর অফিসাররাই দিয়েছেন ঝাঁকে ঝাঁকে লাশ হয়ে।ক্যুয়ের নাটক করে ফাসিতে ঝুলিয়েছেন শত শত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে। ৭২ সালে বীরাঙ্গনাদের জন্য পূনর্বাসন কেন্দ্র থেকে তাদের উৎখাত করেছিলো কে? নীচের লিংকগুলো দেখে নেবেন।

    এনায়েতুল্লাহ খান, অলি আহাদ এরা কারা জানেন না? স্বাধীনতার পর আমাদের ইতিহাস বিকৃতির দুই কারিগর। একজন চীনের টাকা খেয়ে হলিডে নামের পত্রিকা বের করে সারাদেশে অরাজকতার ফান্ড জুগিয়ে গেছেন। অন্যজন ভারতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের ৭ দফার দেশ বিক্রি চুক্তির থিওরি আবিস্কার করেছিলেন যা এখন্ও প্রচার করে যাচ্ছে জামাত শিবির। এদের একজনকে আপনি বানালেন বিহারীদের বাড়ি দখল করা বরিশালের এমপি। আরেকজনকে তার দোনলা বন্দুকের শিকার মুক্তিযোদ্ধা!এমন আজিব কিসিমের জোড়াতালি দিতে দুবারও ভাবলেন না। আপনার গোটা লেখায় এমন প্রচুর কল্পনা এবং ফ্যাক্ট টুইস্টিং আছে যা চাইলেই তুলে ধরা যায়। কিন্তু আগ্রহ পাচ্ছি না। কারণ এতে আপনার উম্মোচিত চালিয়াতি মনোভাবের হ্রাস-বৃদ্ধি হবে না।

    স্বাধীন বাংলাদেশকে একহাত নিতে পাকিস্তানী বয়ফ্রেন্ডদের অনুরোধের ঢেকি গিলেছেন অনেকেই। ওরিয়ানা ফালাচিও মুজিবকে নিয়ে গল্প লিখেছেন। শর্মিলাও দেখিয়েছেন ইতিহাস বিকৃতির শৈল্পিক রূপটা কেমন হতে পারে । আপনিতো দেখি তাদেরও ছাড়িয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন।সোজাসাপ্টা বলি আপনি এজন্য মিথ্যুক,কারণ এনায়েতুল্লাহ খান নামে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত কোনো এমপি ছিলো না, বরিশাল বা অন্য কোনো নির্বাচনী এলাকা থেকে। মিরপুরে অলি আহাদ নামে কোনো মুক্তিযোদ্ধা গুলি খেয়ে মারা যায়নি ৭২-৭৩ সালে। সর্বোপরি যাকে নিয়ে পুরো গল্পটা ফেঁদেছেন সেই মোদাস্বার হোসেন মধু নামে কোনো মুক্তিযোদ্ধার অস্তিত্বই নেই বীরপ্রতীক কিংবা মুক্তিযুদ্ধে অন্য কোনো খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকায়। একটা মিথ্যাকে কি সুন্দর কৌশলে স্টাবলিশ করার ছক, আর সেই ছলে পরিকল্পিত মিথ্যা তথ্য ঢুকিয়ে দেওয়ার কি জঘন্য চর্চা। ছিঃ ।

    ১. বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা সংক্রান্ত দলিল: http://www.amarblog.com/omipial/posts/111505
    ২.মুজিব বাহিনীর ওপর একটি প্রতিবেদন:
    http://www.amarblog.com/omipial/posts/136404
    ৩.স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন বিষয়ক তথ্য:
    http://www.thedailystar.net/forum/2011/march/liberating.htm
    ৪. বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা (আমার কাছে অরিজিনাল গেজেটও আছে):
    http://www.somewhereinblog.net/blog/ragibhasanblog/28779739

    প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সিরাজুল হোসেন — december ২৩, ২০১১ @ ১:০৮ পূর্বাহ্ন
    মুক্তিযুদ্ধ সস্তা আবেগের চাইতে অনেক বড়, এটাকে নিয়ে সাবধানে লেখালেখি করা উচিৎ। ” মুক্তিযুদ্ধে আপনার-আমার মতো মধ্যবিত্ত অংশগ্রহণ করেছেন খুব কম সংখ্যায়” এই তত্থ্যটি আপনি কোথায় পেলেন? ৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এক সূত্রে গাঁথা এবং তার মেধা এবং নেতৃত্ব ছাত্র, শিক্ষক মধ্যবিত্তের।

    ‘শিশ্ন’ উচ্চারণে জড়তা আপনার মনে। গুলিতে-গ্রেনেডে পুরুষাঙ্গ হারানো আর পাক সেনাদের কাছে নারীর শ্লীলতা হারানো কি এক? এ সব কিছু একত্রে ঘোঁট পাকিয়ে লিঙ্গ রাজনীতির ফাইনাল টাচটা কি না দিলেই চলত না?

    প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন azad — december ২৩, ২০১১ @ ১:৫০ পূর্বাহ্ন
    আমার কাছে একটা ক্যামেরা ছিল । যেটা দিয়ে আমি ডুমুরের ফুল, কাঠালের আমসত্ত্ব, সাপের পাঁচ পা এসব অতি বিরল ছবি তুলেছিলাম । কিন্তু ক্যামেরাটি হারিয়ে যায় । তাই ছবিগুলো কাউকে দেখাতে পারিনি - একমাত্র আমার বড় চাচা দেখেছিলেন । তিনি এখন মৃত। অদিতি, আপনার লেখা পড়ে আমার মৃত চাচার কথা মনে পড়ে গেল । তাই আপনাকে ধন্যবাদ ।

    প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাশেদ মাযহার — এপ্রিল ২২, ২০১২ @ ৭:৫১ অপরাহ্ন
    মুক্তিযুদ্ধ খেলো বিষয় নয়। বর্তমান প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা নিয়ে বহু লিখাতো হলো….. তবুতো তরুণ প্রজন্ম সম্মুখ পানে আগুয়ান. ভয় নেই, ১৬ কোটি প্রাণ জেগে আছে আজো…. থাকবে জেগে অনন্তকাল।

    প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মোহাম্মদ মাহাবুবুল আলম মাসুম। — আগস্ট ১৭, ২০১২ @ ৩:৩৩ অপরাহ্ন
    আমরা কি আদৌ আমাদের জাতির ইতিহাসকে সঠিকভাবে জানতে পারবো? নাকি রাজনীতির এই নোংরা খেলা চলতেই থাকবে? আমাদের কি এই অভিশপ্ত অবস্থা থেকে মুক্তি নেই?

    প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন marzia lipi — সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১২ @ ৪:২০ অপরাহ্ন
    Muktijoddhu niye joto vabe somvob joto bar somvob lika

    http://arts.bdnews24.com/?p=4265#more-4265
  • Biplob Rahman | ০১ জানুয়ারি ২০১৪ ১৭:৩২582688
  • যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার
    অদিতি ফাল্গুনী | ২৬ মার্চ ২০১১ ১:৩০ অপরাহ্ন

    ২০০০ সালে ঢাকার কলেজ গেইট এলাকায় অবস্থিত ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট’ পরিচালিত ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগ মুক্তি বিশ্রামাগার’-এ কিছু আহত মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে গেলে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা মোদাচ্ছার হোসেন মধু বীরপ্রতীক একটি সাদা খাতায় লেখা তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক স্মৃতিচারণার কিছু পৃষ্ঠা তুলে দেন। খাতাটা আমি ফটোকপি করে তাঁকে ফিরিয়ে দেই। ভুল বানান ও কাঁচা অক্ষরে লেখা হলেও ঐ স্মৃতিচারণায় স্কুল-কলেজের হিসেবে স্বল্পশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা মধু আমাদের জাতীয় ইতিহাসের কিছু অদেখা ও অজানা তথ্য তুলে ধরেছেন। লেখাটা কোথায় ছাপানো যায় সে নিয়ে বিস্তর ভাবনা সত্ত্বেও দৈনন্দিন জীবনের নানা ব্যস্ততায় এ কাজে আর অগ্রসর হতে পারি নি। ২০০৯ সালে কলেজে গেটের ঐ বিশ্রামাগারে আবার গেলে জানতে পারি যে মধু আর বেঁচে নেই। অপরাধবোধ থেকেই মধুর সতীর্থ অন্যান্য প্রায় বিশ/বাইশ জন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। এই লেখায় সেই বিশ/বাইশ জন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার পত্রস্থ করা হলো। লেখাটির দ্বিতীয় অংশে থাকছে মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক মোদাচ্ছার হোসেন মধুর দিনপঞ্জি।

    ১) মোঃ নূরুল মিঞা,
    পিতা: সুরুজ মিঞা,
    গ্রাম: জিলাদপুর (মতিগঞ্জ বাজার),
    পো: সাতগাঁও,
    থানা: শ্রীমঙ্গল,
    জেলা: মৌলভিবাজার।

    ‘আজ দশ/বারো বছর হয় পুরা হুইল চেয়ারে বসা আমি। যুদ্ধ করছি তিন নম্বর সেক্টরে। যুদ্ধের এক বছর আগে আমি দুই বছর আনসার ট্রেনিংয়ে ছিলাম। আমি বর্ডারের কাছে বাল্লা বিওপিতে ই,পি,আর, …এখন যেটা বি,ডি,আর, .. সেইখানে আনসার ব্যাটালিয়নে চাকরি করতাম। যুদ্ধ বাধলে বর্ডারের ওপার গিয়া দুই সপ্তাহ ট্রেনিং নিলাম। তয় তারিখ এবং সময় ঠিকমতো কইতাম পারি না। সব কথা স্মরণ নাই। ইতিহাস একেবারে আটাইয়া ঘুরাইয়া কইতাম পারি না। আমরা যুদ্ধ করছি খোয়াই নদী, বাল্লা বিওপি, রেমা গার্ডেনের কাছে। ভাদ্রের ১০/১৫ তারিখে সিলেটের একডালা বসন্তপুর প্রাইমারি স্কুলে রাত্রি দশটা/এগারোটার দিকে এ্যাটাক করি। স্কুলটায় পাঞ্জাবিরা ছিল। আমি এল,এম,জি, নিয়া এ্যাটাক করি। ঐ যুদ্ধেই আমার শিরদাঁড়ার পাশে গুলি লাগে। আমার জ্ঞান ছিল না। আমার সাথে যারা ছিল তারা আমাকে বর্ডারের ওপারে নিয়া যায়। ইন্ডিয়ার খোয়াই-আগরতলা-শিলচর-গৌহাটি-লখনৌ-রামগড় নানা হাসপাতালে আমার চিকিৎসা হয়। ভাদ্রের তিন/চার মাস পর দেশ স্বাধীন হয়। ঢাকায় সি,এম,এইচ, হাসপাতালেও কিছুদিন ছিলাম। যুদ্ধের সময় আমার মা জীবিত ছিল। দেশ স্বাধীনের পর আমি আনসার ব্যাটালিয়নে তিনশ’ টাকা বেতনে আবার যোগ দিই। তখনো আমার হুইল চেয়ার লাগতো না। হাঁটা-চলা করতে পারতাম। বিয়া করি। চারটা ছেলে আমার। চারজনই নাইন পাশ। ছোট ছেলে কুয়েতে থাকে। ধীরে ধীরে আমি পুরা পঙ্গু হইতে থাকি। আজ বারো বছর হয় সম্পূর্ণ হুইল চেয়ারে বসা। দেশ স্বাধীনের পর আহত হিসাবে শুরুতে পাইতাম ৭৫ টাকা। এখন হুইল চেয়ারে বসি বইলা মাসে ১৪,৫০০ টাকা পাই। দেশের বাড়িতে হুইল চেয়ার রোগীরে কে দেখবে? তাই এখানেই থাকি।’

    bisihramagar-1.jpg
    যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের রোগ মুক্তি বিশ্রামাগার, কলেজগেট, ঢাকা

    ২) মোহাম্মদ আবু সিদ্দিক
    বয়স: ৫৭,
    গ্রাম: চান্দপুর,
    থানা: মোহনগঞ্জ,
    জেলা: নেত্রকোণা।

    “আমার বয়স ৫৭-এর একটু বেশি। আমার দেশের বাড়ি হইলে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থানার চান্দপুর গ্রাম। যুদ্ধ করছি ৫ নং সেক্টরে, সিলেট জেলার বুলাগঞ্জে। আমাদের পরিবারে আমরা ভাই-বোন ছিলাম আটজন। আমি ছিলাম তিন জনের ছোট। যুদ্ধ যখন শুরু হয়, আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। ভারতের শিলংয়ের মোহনগঞ্জে ২১ দিন ট্রেনিং নিছি। একটা ইওথ ক্যাম্পে এই ট্রেনিং নিছিলাম। আমাদের বাঙালী কমান্ডারের নাম ছিল আব্দুল হামিদ। ইল্ডিয়ান ইনস্ট্রাক্টর আমাদের রাইফেল, এস.এল.আর., গ্রেনেড ও এল.এম.জি. চালানো শিখাইছিলো। আগস্ট মাসে আমরা বর্ডারের চেলাই পার হয়ে দেশের ভিতরে আইসা যুদ্ধ করতে থাকি। আগস্ট মাসে টানা ১০/১৫ দিন যুদ্ধ করছি। এর দুই মাস পর অক্টোবর মাসের ছয় তারিখের এক যুদ্ধে আমি কাবু হই। সেই দিন ছিল মঙ্গলবার। ছাতকের এক ফ্যাক্টরির পাশে রাতে আমরা বিশ জন মুক্তিযোদ্ধা… ফ্যাক্টরির সামনে একটা মরা নদী… নদীর একপাশে আমরা পজিশন নিছি আর একপাশে পাঞ্জাবিরা। তিন জন ঐ যুদ্ধে আহত হইছিলাম। আমি, আলতাফ ও আর একজনের নাম মনে নাই। আমি জ্ঞান হারাইলাম। জ্ঞান ফেরে তিন/চার দিন পর। আমার সাথী যারা ছিল, তারা আমাকে শিলংয়ের হাসপাতালে প্রথম নিয়া গেছিল। জানুয়ারি মাসে শিলং থেকে বিহারের লামকুমের হাসপাতালে আমাকে নেওয়া হয়। দেশে ফিরবার পর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আমাকে গুলিস্তান সিনেমা হলের কেন্টিনে সেলসম্যানের চাকরি দেয়। তার আগেই ১৯৭৫-এ আমি বিয়া করছি। যুদ্ধের পর পর আমার সেক্টর থেকে আমাকে ১,০০০/ টাকা সেইসময়ের টাকার হিসাবে ভাতা দেওয়া হইছিল। এখন আমি অবসরে। গত বছরের জুলাইয়ে আমার এল.পি.আর. শেষ হইছে।”

    ৩) মান্নান আলী (বয়স: ৫৭)
    গ্রাম: রইসপুর,
    থানা: দোয়ারাবাজার,
    জেলা: সুনামগঞ্জ,
    বিভাগ: সিলেট।

    “যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমার বয়স ছিল আঠারো বৎসর। আমি কৃষিকাজ করতাম। তা’ যুদ্ধ যখন শুরু হইলো, আমি কোন ভয়-ডর করলাম না। দেখলাম যে নির্যাতন যেভাবে চলতেছে, মানুষ যেভাবে মরতেছে… মরণ তো লাগবেই একদিন… সবাইরে মারতেছে তো আমার বাঁইচা থাইকা কী লাভ? আমার খালাতো ভাই ছিল মিরাজ আলী। সেই বললো বর্ডারের ওপারে জোয়ান ছেলেদের অস্ত্রের ট্রেনিং দিতেছে। তা’ এপ্রিলের শেষদিকে তার সাথে বর্ডার পার হইলাম। মেঘালয়ে ২১দিন ট্রেনিং করলাম। দৌড়াদৌড়ি, প্যারেড আর পি,টি, কইরা শরীরটা শক্ত করা, রাইফেল, এস.এল.আর. আর গ্রেনেড চালানো ইত্যাদি শিক্ষা হইলো। মে মাসে ছাতকে প্রথম অপারেশন করি। সেই অপারেশনে কিছু রাজাকার আমাদের হাতে ধরা পড়ছিলো। কোম্পানী কমান্ডার আসকির সাহেবের কাছে যখন প্রথম রাজাকারগুলারে নিয়া যাই, তিনি বাহবা দিলেন কিন্তু এইটাও বললেন, ‘যত রাউন্ড গুলি করছো, তত রাউন্ড গুলির হিসাব কিন্তু দিতে হবে।’ আমার নিজের গ্রামের বাড়ি গিয়াও অপারেশন চালাইছি। একবার তো দোলেরগাঁওয়ের ঐখানে রাজাকাররা আমাদের ভয়ে পুষ্করণীতে অস্ত্র ফেইলা পালাচ্ছিল। আমরা কয়েকজন রাজাকারকে ধইরা সোজা গুলি চালাইলাম। মেজর নূরুন্নবী ছিলেন আমাদের সাব-সেক্টর কমান্ডার। ৭ই ডিসেম্বর সুরমা নদীর উত্তর পাড়ে ছাতক বাজারে বিকাল চার ঘটিকায় সম্মুখ যুদ্ধে মাইন বিস্ফোরণে আমি আহত হই। এন্টি-পার্সোনেল মাইন ছিল সেইটা। আমি তখন গাঙ পারাইয়া ছাতক বাজারে উইঠা গেছি। ‘জয় বাংলা’ ডাক দিয়া আমরাই কিনা পাঞ্জাবিদের উল্টা ধাওয়ায় আনতেছিলাম। তখনি পাঞ্জাবিদের পুঁইতা রাখা একটা মাইনে আমার পা পইড়া পা উইড়া যায়। বিকাল চারটায় আমি আহত হই। আমার সাথীরা পাঞ্জাবিদের এ্যাটাকের ভিতর যুদ্ধ করতে করতেই আমারে আস্তে আস্তে সরায় নিয়া যাচ্ছিল। পরদিন ভোর ছয়টায় সীমান্তের ওপারে ভারতের ভোলাগঞ্জ হেডকোয়ার্টারে এ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে আমারে ভর্তি করা হয়। সেইহানোত একমাস থাকার পর মহারাষ্ট্রে পুনায় আর্মি হেডকোয়ার্টার হাসপাতালে আমি আরো ৫/৬ মাস থাকি। আমার অস্ত্রোপচারে ৬০,০০০/ টাকা লাগছিলো। এইটা তখনকার দিনের টাকার হিসাবে বলা। স্বাধীনের পর দেশে ফেরত আসিয়া পর আমি ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে’র ‘ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার’-এ ট্রেনিং নেই। ১৯৭৪ সালে একটা সাবান প্যাকিং ফ্যাক্টরিতে ১৫৫ টাকা বেসিক ওয়েজে চাকরি শুরু করি। বিয়েও করি। দুই ছেলে দুই মেয়ে আছে আমার। বর্তমানে আমি অঙ্গহীন অবহেলিত। তবু, আল্লাহর প্রতি আমি নারাজ না।’

    ৪) কমান্ডার এস,এম, নূর ইসলাম
    বয়স: ৫৮,
    গ্রাম: চিকনহাটি,
    জেলা: নীলফামারি।

    “আমার দেশ হলো বৃহত্তর রংপুরের নীলফামারি জেলার… তখন নীলফামারি থানা ছিল… সেই নীলফামারির চিকনমাটি গ্রামে। যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। আমি তখন মাত্র মেট্রিক পরীক্ষা দিয়া উঠলাম। আমি যুদ্ধ করছি ৬ নম্বর সেক্টরে তেঁতুলিয়া-পঞ্চগড় বর্ডারে। কর্নেল শাহরিয়ার ছিলেন আমাদের সাব-সেক্টর কমান্ডার। মে মাসের প্রথম দিকে আমাদের গ্রাম হতে আমরা প্রায় ৮০-৮৫ জন ছেলে একসাথে বর্ডার ক্রস করি। সেসময় আমাদের ওদিকে ভাসানী-ন্যাপ পলিটিক্সের প্রভাব ছিল। তাই, রাজনৈতিক ভাবে আমরা মোটামুটি সচেতন ছিলাম। এছাড়াও গ্রামে যুদ্ধ শুরুর পরপরই এক রাজাকার চাকুর ভয় দেখিয়ে ছয়/সাত বছরের একটা মেয়েকে রেপ করার পর আমরা অনেকেই খুব কষ্ট পাই ও প্রতিকারের কথা ভাবতে থাকি। যাহোক, দার্জিলিং শিলিগুড়ির পাশে বাগডোগরার কাছে ডাঙ্গার হাট নামে একটা জায়গায় আমরা ২৯ দিন ট্রেনিং নিলাম। রাইফেল, এস.এল.আর., এস.এম.জি., এল.এম.জি., মর্টার, মাইন বা আরো নানা এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার আমরা তখন শিখলাম। বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও আমাকে ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে নেওয়া হলো। বিল্ডিং ওড়ানো, মাইন ওঠানো, ব্রিজ বা টাওয়ার ধবংস করা প্রভৃতি আমি শিখেছিলাম। এমন বেশ কিছু অপারেশন আমি সফলভাবে সম্পন্ন করি। আমাদের নানা অপারেশনের ভেতর উল্লেখযোগ্য একটি অপারেশন হলো পঞ্চগড়ের বোদা থানার বোয়ালমারীর যুদ্ধ। আমরা মোট ১১০ জন বাঙালী এফ,এফ, বা ফ্রিডম ফাইটার এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। এদের ভেতর আমরা দশ জন আবার ছিলাম ইন্টেলিজেন্সের লোক। তিস্তা নদীর পশ্চিম পাড়ে প্রায় ৩ মাইল এলাকা জুড়ে আমরা মাইন পুঁতে রেখেছিলাম। আমরা পজিশন নিয়েছিলাম নদীর পশ্চিম পাড়ে। আর, খান সেনারা ছিল পূর্ব পাড়ে। প্রায় ৭০ জন খান সেনা এই যুদ্ধে মারা যায়। রাশিয়ান মাইন, শর্ট গান ও স্টেনগান আমরা এই যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলাম। আমাদের সোর্স আগের দিনই নদীর পূর্ব পাড়ে খান সেনাদের ঘাঁটি গাড়ার কথা জানালে আমরা ওদের প্রস্তুতি নিয়ে ওঠার আগেই উল্টা দিকে পজিশন নিয়ে যুদ্ধ শুরু করি। বললে বিশ্বাস হবে না, যুদ্ধের পর রক্তে কয়েক মাইল জায়গা মনে হয় চোখের সামনেই লাল হয়ে গেল। আমরা ওদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র-শস্ত্রে প্রায় ৭টা মহিষের গাড়ি বোঝাই করলাম।

    commander-sm-nur-islam-lost-his-one-leg-in-71-when-he-was-just-17-years-old.jpg………
    মুক্তিযোদ্ধা এস,এম, নূর ইসলাম
    ……….
    এছাড়া, পঞ্চগড়ের শিপটিহারিতেও আর একটা সাকসেসফুল অপারেশন করি আমরা। পঞ্চগড়ে পাকিস্তানিদের প্রায় তিন তলা উঁচু বাঙ্কার ছিল। বালুর বস্তা, কলাগাছ এই সব দিয়ে বাঙ্কারটা তারা তৈরি করেছিলো। আগস্টের শেষের দিকে বাঙ্কারের সামনে গিয়ে আমরা হামলা চালাই। এই যুদ্ধে একজন কর্নেল সহ ২জন পাকিস্তানি সৈন্য ও স্থানীয় পিস কমিটির হাফেজ সহ আরো বেশ কিছু রাজাকার আমাদের হাতে ধরা পড়ে। বাকি পাকিস্তানিরা অনেকেই অবশ্য পালিয়ে যায়। ১৭টা বাঙালী মেয়েকে এই বাঙ্কার হতে আমরা উদ্ধার করি। তবে, আমি নিজে যে যুদ্ধে আহত হলাম, সেটা হলো ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখের যুদ্ধ। দিনাজপুর জেলার খানসামা হাটের কাছে নদীর ধারে ভোর পাঁচটায় সম্মুখযুদ্ধ শুরু হলো। সকাল চারটা থেকেই আমরা অবশ্য সৈয়দপুরের দিকে এ্যাডভান্স করা শুরু করি। নদী পার হওয়ার সময় পাকিস্তানিদের সাথে আমরা মুখামুখি হই। ওরা পালাচ্ছিল। আমারা ইন্দো-বাংলা মিত্রশক্তি সংখ্যায় বেশ ভারিই ছিলাম। দুইটা ভারতীয় ব্রিগেডের প্রায় ১০,০০০ সৈন্য ছাড়াও আমরা বাঙালী ফ্রিডম ফাইটারই সংখ্যায় ছিলাম ১২০০ জন। ১৯ গুর্খা রেজিমেন্ট ও পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটা ব্রিগেড আমাদের সাথে ছিল। ৭০/৮০ টা ট্যাঙ্কও ছিল আমাদের সাথে। আমরা যখন নদী ক্রস করছিলাম… প্রায় হাজার খানেক গজ পথ ক্রস করার পর… হঠাৎই একটা মাইন বিস্ফোরিত হয়ে আমি আহত হই। আমাকে ভারতীয় সৈন্যরা এ্যাম্বুলেন্সে তুলে পরে সোজা হেলিকপ্টারে করে ঠাকুরগাঁ আকাশপথের বর্ডার পার হয়ে বাগডোগরা হসপিটালে ভর্তি করে। সেখান হতে পুনার কির্কি ও কোলকাতা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। ১৯৭২-এর জানুয়ারি মাসে আমি কোলকাতা মেডিকেলে চিকিৎসার জন্য শয্যাবন্দি। আমার আব্বা খবর পেয়ে আমাকে সেখানে দেখতে গেলেন। সুস্থ হবার পর দেশে ফিরলে প্রথমে কিছুদিন যশোর ক্যান্টনমেন্ট ও পরে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে আমাকে রাখা হয়। ১৯৭৭-এ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের আওতাভুক্ত ‘যাত্রিক পাবলিকেশন্স্’-এর ছাপাখানায় কম্পোজিটরের চাকরি পাই। ১৯৭৭-৮০ সাল অবধি সেখানেই কাজ করি। পরে নিজেই ছোটখাট ব্যবসা বা কারবারের চেষ্টা করি। ১৯৭৭ সালেই আমার ফুপাতো বোনকে আমি বিয়ে করি। তিন ছেলে ও এক মেয়ে আছে আমার।”

    ৫) কেয়ামুদ্দিন মোল্লা
    বয়স: ৫৫ বৎসর।
    গ্রাম: দীঘিগোয়েলবাড়ি,
    ইউনিয়ন: চরতারাপুর।
    জেলা: পাবনা।

    “১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় আমার বয়েস ছেলো ১৯ বছর। আমরা ছেলাম ছয় ভাই এক বোন। কৃষিকাজ করতাম। একটু-আধটু ক্ষেতের কাজ আর বাদ বাকি সুমায়ে বাপের হোটেলে খাতাম। আমাদের গিরাম কিন্তু চর এলাকার মদ্যি। পদ্মা নদী চারদিকি ঘের দেয়া। এপারে কুষ্টিয়া, ওপারে পাবনা। মধ্যে রাজবাড়ি, পাংশা এই সব জাগা। যুদ্ধ বাঁধলি পরা আমি কুষ্টিয়ার জলঙ্গি বর্ডার পার হইয়ি চুয়াডাঙ্গা থেন মালদা গেলাম। সিখানে গৌড়বাগান ক্যাম্পে রিক্রুট হলাম। দিন চোদ্দ আমাদের পিটি-প্যারেড করিয়ে, শরীরটা একটু ফিট করার পর পাঠালো জলপাইগুড়ির পানিহাটা। সিখানে আরো আঠাশ দিন অস্ত্র ট্রেনিং করার পর জলঙ্গি আসি। সব মিলায়ে প্রায় আট/দশটা অপারেশনে অংশ নিই। পাবনা মেন্টাল হাসপাতালের সামনেও অপারেশন করিচি। আমি আবার যুদ্ধ করিচি ৭ নম্বর সেক্টরে। কর্নেল নূরুজ্জামান ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আর ব্রিগেডিয়ার গিয়াসুল করিম ছিলেন সাব-সেক্টর কমান্ডার। দিনাজপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট আর ইদিকে পাবনার ফুলগাঁ পর্যন্ত এই ৭ নম্বর সেক্টরের মদ্যি ছেলো। এইখানে এট্টা কতা কই: আমার খালাতো ভাই কিন্তু রাজাকার ছেলো। সে থাকতো বুবলিয়া রাজাকার ক্যাম্পে। ইউনিয়ন বোর্ড অপিসে তারা ক্যাম্প করিছিলো। তা’ ঐ ইউনিয়ন বোর্ড অপিসের আট/দশ মাইলের ভেতর কারেন্ট ছেলো না। একবার সন্ধ্যাকালে রাজাকাররা তাদের ক্যাম্পে হ্যাজাক জ্বালিলো আর আমরা বোর্ড অফিসের সামনে গিয়া ফায়ারিং শুরু করলাম। আমারি গুলি পিঠির পর লাগি এক রাজাকার দেখলাম দোতলায় পড়ি গেলো। আমার পাশে ছিলো মঞ্জু। আমার সাথীরা তো রাজাকারদের সাথে আন্ধা-গোন্ধা (এলোপাতাড়ি) গুলি চালাতিছে। একটা গুলি আমরা পায়ের গোড়ালির উপর লাগলো। সাথীরা আমার সাথে সাথে হাতের ব্লেড দিয়ি গুলিটা টাইনে ফাঁড়লো। ভাগ্যি গুলি খুব ভিতরে ঢোকে নাই। উপর দিয়া গিছিলো। আমরা ছিলাম ৩২ জন আর অরা ছিল ৫০ জন। ওরা বিল্ডিংয়ের উপর থেন (থেকে) গুলি চালাইছে আর আমরা নিচ থিকি এল,এম,জি, চার্জ করিছি। এক পর্যায়ে আমরা দু’পক্ষই যুদ্ধ থামাই। কিন্তু, পরের দিন… সে ধরো তোমার জষ্টি-আষাঢ়-শাওন-ভাদর মাসের দিন… দীঘিগোয়েলবাড়ি চরের সামনি দুইটা নৌকায় বিশ জনা করি আমরা চল্লিশ জনা মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে উঠিচি। গাঁয়ের লোক আবার আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ভাল জানতো। মনে করেন একজনের বাড়ি দুইজন খাতাম কি আর একজনের বাড়ি গিয়া পাঁচজন খাতাম এমন আর কি। তা’ আমার সেই রাজাকার খালাতো ভাই মাজে মইদ্যেই আমার বাড়ি গিয়া মা’কে বলছে, ‘খালাম্মা, ওদের সারেন্ডার করতি বলেন। ওদের যুদ্ধ থামাতি বলেন!’ তা’ যে দিনির কতা কচ্চি… সিদিন নদীর ভিতরে ভিতরে চরে তুষের ক্ষেত আর পাটের ক্ষেত… এইসময় দুইটা নৌকায় তো আমরা বিশ জনা করি চল্লিশ জনা মুক্তিযোদ্ধা… কেউ পানিতে আবার কেউ নৌকায় অস্ত্র হাতে… তখনি রাজাকারদের নৌকা আমাদের মুখামুখি। একটা এল,এম,জি,তে কিন্তু ২৮-৩২টা গুলি ভরা যায়। পাঁচ/ছয়টা ম্যাগাজিন থাকে। একজনের কাজ গুলি ভরা, একজনের ম্যাগাজিন টানা আর একজনের ফায়ার করার কাজ করতি হয়। আমাদের সাথে একটা ভাল ব্রিটিশ এল,এম,জি, ছেলো। তা’ আমরা ফায়ার করা শুরু করলাম। দুই জন রাজাকার মারা গেলো। যাগো একজনা আমার খালাতো ভাই। এ ঘটনার পর আজ পর্যন্ত আমার খালার সাথে আমার মা’র কথা হয় নি। আমি এই যুদ্ধে আহত হলাম। ঈশ্বরদী ব্যাক করি বাবুলছড়া ক্যাম্পে আমারে রাকা হলো। এখানে আরো ২৫০ মু্ক্তিযোদ্ধা ছেলো। কিছুদিন বিশ্রাম নেবার পর আবার যুদ্ধের শ্যাষের দিকি আমি অপারেশন শুরু করি। তকন সালিন্দির চরে মেন্টাল হাসপাতালের সামনিই ফাইট চলছে। চারপাশে মিলেশিয়া আর রাজাকার। পূর্ব-উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণ… এই চার দিকে প্রায় ২৫০ মু্ক্তি… মানে বাবুলছড়া ক্যাম্পের সবাই পজিশন নিছে। এইটা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের কতা। তারিক একদম ঠিক ঠিক কতি পারবো না। তা’ সেই রাত একটার দিকে ফায়ার শুরু হলো। যারা গ্রেনেড চালায় তারা শত্রুর পঞ্চাশ গজ ও শুদু বন্দুকঅলারা শত্রুর একশ’ গজের ভিতর থাকি যুদ্ধ শুরু করলো। সকাল পর্যন্ত দুই পক্ষেই গুলি চললো। সকালের দিকি মরতে লাগলো। উভয় পক্ষেই। আমি ২টা শার্টের উপর একটা জাম্পার পরা ছিলাম। একে শীত তাতে গুলিগালার কাজ তাই। সকালবেলায় দেখি কি পানি পিপাসায় আর এক পা নড়তে পারি না। আমার সাথীরা আমারে ডাক্তারবাড়ি নিয়া গিয়া সেলাই দিলো। আমারে কোলকাতায়ও পাঠানো হলো। সেখানে দুই মাস থাকি। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর দেশে আসি। ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালেও ম্যালাদিন থাকলাম। এসময় বিদেশী ডাক্তার ড. গার্স্ট এসে আমাদের জন্য কাজ শুরু করলেন। আমি দেশে ফেরলাম বঙ্গবন্ধু দেশে আসার এক সপ্তার মদ্যি। ঢাকা মেডিকেলে দুই মাস থাকলাম। ১৯৭৩-এ বিশ্রামাগারে উঠলাম। ১৯৭৭ সালে মুন সিনেমা হলে সেলসম্যানের চাকরি পালাম। প্রায় বারো বছর মানে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত চাকরি করলাম। এরপর তো শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্টে নিজিদির মদ্যি কোন্দল। ব্রিগেডিয়ার আমিন চৌধুরী কল্যাণ ট্রাস্টের দায়িত্ব নিলেন। ওনার মেজাজ একটু গরম ছিল আর ঘাড়টাও ছিল ত্যারা। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাকে এক লাখ টাকা দিইচে। আমার দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলে যানবাহন মন্ত্রণালয়ে চাকরি করে। বড় মেয়ে ডিগ্রি পড়ে আর ছোটটা স্কুলে।”

    ৬) মোহাম্মদ বদিউল আলম
    বয়স: ৬৬ বৎসর,
    জন্মস্থান: ফটিকছড়ি থানা
    জেলা: চট্টগ্রাম।

    bullets-pierced-hand-of-ffmohammad-badiul-alam.jpg………
    মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম
    ………
    “আমার জন্ম ১৭ই জুলাই ১৯৪২। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় আমি মুজাহিদি প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম। যুদ্ধের সময় চন্দ্রঘোনা পেপার মিলস-এ আমি মেকানিক্যাল ফিটারের কাজ করতাম। এমনিতে স্কুলে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করছি। ১৯৭০-এর নির্বাচনের সময় আমি শ্রমিক লীগ করতাম। এই সময় আমাদের ফ্যাক্টরিতে লেবার লিডার নির্বাচনে আমি জিতছি। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ শেখ সাবরে পাঞ্জাবিরা ধইরা নিয়া গেল। আমাদের ফ্যাক্টরির মালিক ছিল দাউদ কর্পোরেশন। ওরা পশ্চিমা। বোম্বাইয়া। উর্দু ভাষায় কথা কয়। ফ্যাক্টরির এক বোম্বাইয়া অফিসার ছিল। তার নাম ছিল আবু সোলেমান বাপ্পু। ২৭ তারিখ দিবাগত রাতে এই বাপ্পু সাহেবের কাছে চা নিয়া গেছে আমাদের ফ্যাক্টরির এক বাঙালী বাবুর্চি। তার নাম ছিল নূর হোসেন। বরিশাল বাড়ি ছিল তার। তো নূর হোসেন যখন তার কাছে চা নিয়া গেল, তখন বাপ্পু সাহেব ঠাট্টা করে তাকে বললো, ‘তুমহারা বাপকো তো এ্যারেস্ট করনে বাদ হাম লোগ পাকিস্তান লে যাউঙ্গি। আভি তুমলোগ কিসকো বাপ বুলায়েগা?’ নূর হোসেন চা দিয়া আইসা এই কথা জানাইলে আমাদের মাথায় আগুন চাপলো। ভোর সকালে যখন আজান হইছে, আমরা বাপ্পুরে গিয়া কইলাম যে ‘আপনি একা বিহারী আর আমরা ১৮০ জন বাঙালী। আমাদের খেপাইয়েন না!’ বাপ্পু কী বুঝলো কে জানে… সে গামবুট পইরা, কাঁধে সিঙ্গল ব্যারেল বন্দুক নিয়া একা একাই একটা স্পিডবোটে উইঠা জাম্বুছড়া খাল বাইয়া ওরাছড়ি রিজার্ভ ফরেস্ট পর্যন্ত চললো। এদিকে আমরা বাঙালী লেবারের একটা দল যে পাহাড়ি রাস্তায় ওরাছড়ি পর্যন্ত হাঁইটা যাচ্ছি তারে লক্ষ্য কইরাই, সে কিন্তু তা বোঝে নাই। ওরাছড়ি পৌঁছাইয়া সে হাতে বন্দুক নিয়া হাঁটতেছে, তখন আমরা তারে ঘেরাও করলাম। তারে পাহাড় ডিঙ্গায় ঢালুতে নিয়া গিয়া বললাম, ‘কলমা পড়ো। তুমিও মুসলমান। আমিও মুসলমান। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম।’ ড্রাইভার নূর মহম্মদ তারে গুলি করলো। পরের দিন আমরা চট্টগ্রাম শহরের দিকে গেলাম। ৩০শে মার্চ কাপ্তাই জেটি ঘাটে গিয়া ক্যাপ্টেন হারুনের সাথে দেখা করলাম। ৩১শে মার্চ কালুর ঘাট ব্রিজে গেলে কর্নেল অলির সাথে দেখা হইলো। এপ্রিলের ৪ আর ৫ তারিখে পাকিস্তানি জাহাজ ‘বাবর’ চট্টগ্রাম পোর্টে শেলিং করায় শহরে ঢোকা সম্ভব হইলো না। তখন পিছন দিকের রাস্তা ধইরা বান্দরবান, রুমা পার হইয়া ‘দুমদুইম্যা’ ই,পি,আর, ক্যাম্পে পৌঁছালাম। ১৫ তারিখ ভারতের জারাইছড়ি ক্যাম্পে পৌঁছালাম। বিএসএফ-এর মেজর বাজুবল সিং আমাদের শরণার্থী ক্যাম্পে যেতে বললো। আমরা মোট ২৩ জন শ্রমিক ছিলাম। এদের ভেতর নয় জন ক্যাম্পে গেল। কিন্তু, আমরা আমাদের সাথের পোঁটলার চাদর দিয়া তাঁবু টাঙ্গাইয়া বললাম, ‘আমরা যুদ্ধ করতে চাই। আমাদের ট্রেনিং দাও।’ পরদিন আমাদের আসাম-ভারত দেমাকাগিরি বর্ডারের কাছে পাঠাইলো। সেখানে ছিলেন মেজর তারা সিং। আমরা দেমাকাগিরি টাউনের কলেজ মাঠেও তাঁবু খাড়া করলাম। ২৪ শে এপ্রিল মেজর তারা সিংয়ের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। সেসময় আরো ছিলেন ই.পি.আর.সুবেদার আব্দুর রশিদ, হাবিলদার আব্দুল খালেক, হাবিলদার বদিউল ও আরো এগারো জন গুর্খা সিপাহী। মেজর তারা সিং বললেন, ‘তোমরা কি সত্যি সত্যি তোমাদের দেশ রক্ষা করতে পারবে বলে মনে করো?’ বললাম, ‘পারবো। আমাদের ট্রেনিং দেন।’ ২৮শে এপ্রিল থেকে আমাদের ট্রেনিং দেওয়া শুরু হইলো। ২৩ শে জুলাই পর্যন্ত চললো। ২৪ শে জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটির উপর ঠেকারমুখ নামক জায়গায় প্রথম অপারেশন করি। মেজর তারা সিং আমাদের সাথে ছিলেন। তিন জন পাকিস্তানি গুলিবিদ্ধ হয়। আমরা ১৪ জন শ্রমিক, ইপিআরের ৬ জন সিপাহী, কমান্ডার আব্দুর রশিদ ও মেজর তারা সিং ও আরো ৬জন ইন্ডিয়ান সোলজার ছিল। সবাই মিলা আমরা ছিলাম প্রায় আটাইশ জন। আজো পরিষ্কার মনে আছে ১১:৪০-এ প্রথম আমরা ফায়ারিং শুরু করি। তিন জন পাকিস্তানি সৈন্য মারা গেছিল এই অপারেশনে আর ছয় জন সারেন্ডার করে। ঠেকারমুখের কাছে দুইটা রোড ব্লক কইরা আমরা অপারেশনটা শুরু করছিলাম। এই সময় কিছু চাকমা ছেলে আমাদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। সঞ্জীব কুমার চাকমা নামে এক ছেলে পরের এক যুদ্ধে আমাদের পক্ষে ফাইট দিতে গিয়া মারা যায়।

    …কত কথা মনে আসে। কত আর বলব? মোট পাঁচটা অপারেশনে অংশ নিছি। এই যুদ্ধের সময় ভারত মিত্রপক্ষ হইলেও একবার কিন্তু ইন্ডিয়ানদের সাথে আমাদের কিছু কথা কাটাকাটি হয়। আমাদের কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার আব্দুর রশিদকে মেজর তারা সিং ৩রা আগস্ট বলে কাপ্তাই বাঁধ খুলে দিতে, যাতে চট্টগ্রামে পাকিস্তানিদের পালানোর কোনো পথ না থাকে। কিন্তু, আব্দুর রশিদ বললেন চট্টগ্রামে তো বাঙালীরাও থাকে। কাপ্তাই বাঁধের মুখ খুলে দিলে তারা তো মারা পড়বে। কথা কাটাকাটির পর আব্দুর রশিদকে আসাম-ভারত দেমাকাগিরি হতে এক কিমি দূরে এক ক্যাম্পে ১৭ ঘণ্টা আটক করা হয়। ১৭ ঘণ্টা পর আর তাকে ছাড়া হয়। যাই হউক, ৬ই আগস্ট আমরা আবার অপারেশনে নামি। বান্দরবানের রুমায় ৬ই আগস্ট দিবাগত রাতে রুমা থানায় ৬জন পাঞ্জাবি সহ মোট ১৩/১৪ জন পুলিশ স্টাফকে হারিয়ে থানা দখল করি। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা লড়াই হইছিল। ৮ই আগস্ট বান্দরবান থানা দখল করি। ১৫০ জন পাঞ্জাবি সৈন্যের পাল্টা আমরা ছিলাম মোট ১১৬ জন। আমাদের সাথে ছিল ৬ জন পুলিশ। মুজিব বাহিনীর সদস্যরা গ্রেনেড ক্যারি করছিল। আমাদের ১৪ জন শ্রমিকের কাছে ছিল এস,এল,আর,। আড়াই ঘণ্টা ফাইটিং দিয়ে যুদ্ধে জিতি। আট তারিখ রাত তিনটায় ফায়ারিং শুরু করি আর যুদ্ধ শেষ হয় সকাল সাড়ে পাঁচটায়। এবার ৭ই ডিসেম্বরের যুদ্ধের কথা বলি। এই যুদ্ধের কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না। কাপ্তাই বাঁধের ওপারে… ইন্ডিয়ান বর্ডারে থাকতেই খবর আসলো যে পাঞ্জাবি সৈন্য কাপ্তাই বাঁধ হতে চিটাগাং পোর্টের জেটি পর্যন্ত কন্ট্রোল করছে। আমরা তখন বর্ডার ক্রস শুরু করলাম। ইন্ডিয়ান বর্ডারের যে রুট হতে আমরা ঢুকতাম, সেই রুটে প্রায় দুই দিন দুই রাত হেঁটে তবে পৌঁছানো যাইত। সাথে ক্ষুধা মিটানোর ট্যাবলেট থাকতো। তবে, এইবার আমরা এক পাহাড়ি পরিবারে খাবার চাইলাম। তারা বাঁশ কেটে হাড়ি-পাতিল বানিয়ে আমাদের ডাল, আলু ভর্তা আর ভাত খেতে দিলো। পাঁচ তারিখ দিবাগত রাতে পাঞ্জাবি সৈন্যদের মুখোমুখি পজিশন নিয়ে আমরা ফায়ারিং শুরু করি। কাপ্তাই প্রজেক্টের ২০০ গজ দূর হতে ফায়ারিংয় শুরু হয়। পাঁচ তারিখ সকাল ১১:৩০ টার দিকে ডিউটিতে থাকা ১৯জন পাঞ্জাবি সৈন্য ধরা পড়ে। তাদের কাপ্তাই হাসপাতালে রাখা হয়। পাঁচ হতে সাত তারিখ আমরা কাপ্তাই বাজারের একটা হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করছি। সাত তারিখ আর্মি ক্যান্টনমেন্ট হতে পাঞ্জাবিরা গুলি শুরু করলো। সকাল ৮:৩০ হতে ১২:৪৫ পর্যন্ত যুদ্ধ চললো। ঐ যুদ্ধেই সঞ্জীব কুমার চাকমা ও নূর হোসেন মারা যায়। আমার হাতে-পায়ে গুলি লাগে। আমাকে সাথে সাথে কাপ্তাই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান হতে ১৯শে ডিসেম্বর আমাকে চিটাগাং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ১৯৭২-এর ৯ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিলাম। চিটাগাং কলেজের মাঠে সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকের কাছে হাতিয়ার জমা দিলাম। ১৯ শে জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমাকে শতকরা ৪৫ ভাগ আহত হিসেবে ঘোষণা করা হলো। সরকার আমাকে এসময় রাশিয়া পাঠায়। সেখানে মস্কোতে তিন মাস ২২ দিন থাকি। ১৯৭৫-এ দ্বিতীয় বারের মতো আমাকে রাশিয়া পাঠানো হয়। কম্যুনিস্ট দেশ। সাইবেরিয়ায় ১৪ দিন, লেনিনগ্রাদে ৬ দিন থাকি। ’৭৫-এর ১৯ শে মে আমার পায়ে বোন গ্রাফটিং অপারেশন হয়। দেশে ফিরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে যাই। ১৯৮৪ সালে অনেক বয়সে আমি বিয়া করি। আমার ছয় ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়া হইছে। বাকি সবাই লেখা-পড়া করছে। দুই ভাই এক বোনের সাথে তিন একর জমি আমি ভাগে পাইছি। খাওয়া-খরচ চইলা যায়। ১৯৯০-এ আমি একটা দোকান দিই। সেই দোকানের আয়েও আমার কষ্ট কিছু কমে।”

    ৭) মোহাম্মদ আব্দুল রকিব
    বয়স: ৮০,
    গ্রাম: সোনাখিরা,
    উপজেলা: বিয়ানীবাজার,
    জেলা: সিলেট।

    “আমার বয়স বর্তমানে হইলো আশি বছর। আমার দুই ছেলে দুই মেয়ে। যুদ্ধের সময় আমি ছিলাম কৃষক। যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমার গ্রাম সোনাখিরায় রাজাকারের খুব উৎপাত। যন্ত্রণায় টিঁকতাম পারি না। আমি আওয়ামি লীগ করতাম। যুদ্ধ শুরু হইলে পরা… আমি চিরকালই দ্বিনের মানুষ… লম্বা দাড়ি ছিল… তা’ পাতাইরখণ্ডি মাদ্রাসার মাওলানাকে গিয়া জিজ্ঞাসা করলাম ফ্রন্টে কাজ করার জন্য দাড়ি শেভ করলে গুনাহ্ হয় কিনা। তিনি কইলেন ‘দাড়ি নিয়াই যুদ্ধ করো।’ তিন দিন পর বর্ডারের ওপারে রিক্রুটের লাইনে খাড়া হইলাম। এইটা ভারতের ‘লোহার বল’ ট্রেনিং সেন্টার। তো আমারে লাল কার্ড মানে যুদ্ধে অংশগ্রহণের কার্ড দিছে। কিত্ত, ইন্ডয়ান ব্রিগেডিয়ার আমারে কোন ট্রেনিং দিচ্ছে না। আমার বয়স তখনি চল্লিশের উপর। আবার লম্বা দাড়ি। উনি ভাবছেন আমার অনেক বয়স। তো বাঙালী সুবেদারকে বলছে কি, ‘এ তো মুরব্বি আদমি। একে বেশি কষ্ট দিও না।’ আমি কইলাম, ‘না, আমারে ট্রেনিং দিতে হবে।’ তিন মাস ট্রেনিং নিলাম। রাইফল, এল.এম.জি., স্টেনগান… সব কিছু চালানো শিখলাম। তিনমাস পর আমারে কইলো ফ্রন্টে যাইতে। পয়লা কইলো যে আপনি লাতু যান গিয়া। কইলাম লাতু আমি যাইমু না। তখন কয় আপনি যান গিয়া বালিয়া ক্যান্টনমেন্ট, ৪ নং সেক্টর। গেলাম। সেইখান থেকে আমারে ইস্যু করছে দত্ত বাবু আর কর্নেল ওসমানী। আমারে কয়, ‘সামনে খোরমা টি গার্ডেনে এক ব্যাটালিয়ন পাঞ্জাবি সৈন্য আছে। তুমি অপারশনে যাবার আগে রেকি করো।’ আমি তাদের কাছে চারদিন সময় নিলাম আর কইলাম, ‘আমি অপারেশনে আর্মি, ইন্ডিয়ান আর্মি কি বি.এস.এফ., নিতাম না। দশ/বারোজন মুক্তিযোদ্ধা শুধু সাথে নিমু।’ তো সেইমতো রেকি করার পর খোরমা টি গার্ডেনের চারপাশ ঘেরিয়া ব্রাশ ফায়ার করার পর রিপোর্ট দিলাম। তারপর ইন্ডিয়ান আর্মি কিতা করছে আমি কইতাম পারি না। খোরমা টি গার্ডেনের পর চাম্পারণ টি গার্ডেন আর কাঁঠালবাড়ি টি গার্ডেনেও অপারেশন করি। কাঁঠালবাড়িয়া অপারেশনের সময় লাড়িতে (নিতম্বে) আর পায়ে গুলি লাগে। যুদ্ধের পর কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পত্তি কোকাকোলায় কয়েক বছর কাজ করি। এখন কেরাণীগঞ্জে থাকি। বর্তমানে ঘরে আমার দুই ছেলে দুই মেয়ে আছে।”

    ৮) আতাউর রহমান খান
    মুক্তিযোদ্ধা থানা কমান্ডার
    বিয়ানীবাজার, সিলেট।

    “যুদ্ধের সময় আমি ছিলাম খুলনা বি,এল, কলেজের সাধারণ সম্পাদক এবং ছাত্রলীগের খুলনা শাখার সম্পাদক। ২৫ শে মার্চ রাত একটায় জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক সালাহউদ্দিন ইউসুফ আমাকে বললেন, ‘ঢাকাতে হামলা হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন যার যার এলাকা মুক্ত রাখতে।’ তখন খুলনার মহিলা এম,পি, মুন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ানের সাথে খুলনা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে গেলে ৩২ জন ইপিআর সদস্য আমাদের সাথে আসে। ২৬ শে মার্চ সকালে আমরা খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে গাছ কেটে ব্লক দিই। সেনাবাহিনী এসে দুই ট্রাক গাছ সরানো শুরু করলে ইপিআর সদস্যরা পাল্টা আমাদের পক্ষে লড়াই করলো। এদিকে সার্জেন্ট জহুর হত্যার পর ইতোমধ্যেই ‘জয় বাংলা বাহিনী’ ও ‘স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ তৈরি হয়ে গেছে। ২৭ শে মার্চ পিপলস জুট মিল, ক্রিসেন্ট জুট মিল ও নিউজ প্রিন্ট মিলের শ্রমিকদের সাথে কথা হলো। এসময় প্রায় ২০,০০০ শ্রমিক ছিল এই এলাকায়। মার্চ গেল। এপ্রিলের ৭ তারিখের পর যশোর ক্যান্টনমেন্ট হতে শতাধিক পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মি খুলনার পথে কামান দেখাতে দেখাতে চলে গেল। এরই ভেতর খবর পেলাম যে ফরিদপুরে ওবায়দুর রহমান মুক্তাঞ্চল করেছে। আমরা বিশ জনের মতো যুবক ছেলে তখন কাশিয়ানী রাস্তা দিয়ে ১৭ দিন পায়ে হেঁটে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌঁছলাম। রামদিয়া কলেজের ভিপি সহ বিশ জন ছাত্র ও দু’জন শিক্ষক আমাদের সাথে ছিল। তা সেই ভেড়ামারাতেও দেখি বর্ডারে যাবার রাস্তা বন্ধ। তখন যশোর বেনাপোল রুটে ভারতে নদীয়া শান্তিপুরের কৃষ্ণমোহন কলেজে আশ্রয় নিলাম। যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমার চুল ও দাড়ি অনেক লম্বা ছিল। আমি ছাত্রলীগ করলেও বামপন্থী তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খানের কথাবার্তা আমাকে মুগ্ধ করতো। মনে মনে আমি তাঁকে খুব সম্মান করতাম।

    …তা যেকথা বলছিলাম। ভারতে যাবার পর নদীয়া থেকে ট্রেনে কৃষ্ণমোহন কলেজে গেলে কলেজের ছেলেরা আমাদের তালা খুলে থাকতে দিয়েছে। এর ভেতর পথে আমরা কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। মুসলিম বাড়ি ইচ্ছা করেই অ্যাভয়েড করতাম। মুসলিমদের ব্যপারে বলা তো যায় না যে তারা চীনপন্থী না পাকিস্তানপন্থী, জামাত না আওয়ামী লীগ। নদীয়া পৌঁছবার পর আমাদের এই বিশ জনের দলের হিন্দু ছেলেরা তাদের আত্মীয়দের বাড়ি খুঁজে-টুজে চলে গেল। আমাদের দলের আমি, রেজাউল (কুষ্টিয়া বাড়ি) ও আনোয়ার হোসেন কোলকাতার বাংলাদেশ মিশন অফিসে গেলাম। সেখানে হাইকমিশনার ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীর সাথেও দেখা হলো। কোলকাতা থেকে সিলেট-আসাম বর্ডারের করিমগঞ্জ গেলাম। ওসমানী বললেন, ‘তুমি তো অরিজিন্যালি সিলেটের ছেলে। পড়াশোনার জন্য খুলনার বি,এল, কলেজে পড়ছো। কিন্তু, তুমি তো খুলনা-কুষ্টিয়া বর্ডার এলাকার ভাষা ভাল জানো না, রাস্তা ভাল চেনো না। বরং সিলেট যাও। সেখানে যুদ্ধের কাজ বেটার করতে পারবে।’ সিলেটে গিয়ে দেখা হলো আব্দুস সামাদ আজাদ ও এমপি আব্দুর রহিম, আখতার ভাই ও ড. চঞ্চলের সাথে। আমাকে মুজিব বাহিনীতে নেওয়া হলো। এরপর আগরতলা বর্ডারে কাজ করছি। তবে, আমি সরাসরি যুদ্ধের চেয়ে প্রচার ও জনসংযোগেই বেশি ছিলাম। এসময় শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, মোস্তাক আহমেদ, আ.স.ম. আব্দুর রব সহ অনেকের সাথেই দেখা হয়েছিল।”

    comrades-passing-life-2.jpg
    বিশ্রামাগারে মুক্তিযোদ্ধারা

    ৯) অনিল কুমার রায়
    জন্মস্থান: ফুলবাড়ি থানা,
    বয়স: ৫৬ বৎসর।

    “আমি যুদ্ধ করছি ৭ নম্বর সেক্টরে। দিনাজপুরের অর্ধেক, বগুড়া, বৃহত্তর পাবনা ও বৃহত্তর রাজশাহী ছিল এই ৭ নম্বর সেক্টরের আওতায়। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ১৭। আমি তখন এসএসসি পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ফুলবাড়ি থানার পাঁচ মাইল দক্ষিণে বাড়াইহাট গ্রাম আর দুই মাইল উত্তরে দইমারি গ্রাম। আমরা এই দুই গ্রামের মাঝামাঝি থাকতাম। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনী ও রাজাকারদের প্রধান টার্গেট ছিলো হিন্দু জনগোষ্ঠি, সেহেতু এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই আমরা বর্ডার পার হয়ে ওপার বাংলার পশ্চিম দিনাজপুরের কুমারগঞ্জ থানার খলসামায় একটা টিনের ছাউনি ঘরে গোটা পরিবারসুদ্ধ উঠলাম। আমার বাবা ছিলেন কৃষক। পাঁচ ভাইয়ের ভেতর আমি ছিলাম চতুর্থ। আমাদের কোন বোন ছিল না। আমার ভেতর যুদ্ধে যাবার একটা ইচ্ছা ছিলই। আরো যখন গোটা ফ্যামিলি একটা নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে, আমার কোন পিছুটান রইলো না।

    জুলাইয়ের শেষে ডাঙ্গারহাট নামক স্থানে একটা ট্রানজিট ক্যাম্পে আমি সহ মোট আটটি ছেলে ভর্তি হলাম। ১৪ই আগস্ট আমরা উচ্চতর একটি সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পানিঘাটাতে গেলাম। পানিঘাটাতে এক মাস ট্রেনিং পেলাম। দুই ইঞ্চি মর্টার, এলএমজ, এসএলআর, থ্রিনটথ্রি, হাই অ্যান্ড লো দু’ধরনের এক্সপ্লোসিভস্ হ্যান্ডেল বা অপারেট করা শিখলাম। এছাড়াও, মাইন বিশেষতঃ অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ও অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন বা ব্যুবি ট্র্যাপ প্রস্তুত করা কি বসানো এসব কিছুই শিখেছি। অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইল ১০ থেকে ২০ পাউন্ড ওজনের ভেতর হলেই অনায়াসে বার্স্ট হয়। এটা আবার বেস টাইপ ও জাম্পিং টাইপ… দু’ ধরনেরই আছে। অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইন সাধারণতঃ ১৫০ পাউন্ডের মতো ওজন হয়। ট্রেনিং ক্যাম্পে এক্সপ্লোসিভসের ব্যবহার আমি বিশেষ ভাবে শিখলাম। ধরা যাক, এক পাউন্ড এক্সপ্লোসিভসে আমি এক ইঞ্চি কাঠ বা স্টিল কাটবো কি বার্স্ট করবো। দুই ইঞ্চি কাঠ বা স্টিল কাটবো তিন পাউন্ড এক্সপ্লোসিভসে ইত্যাদি। কত কী করেছি! পাকিস্তানি কম্যুনিকেশনস ধবংস করতে গিয়ে রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া, কৃষক ও রাখাল সেজে ক্যামোফ্লেজ করা…

    আমার প্রধান স্মরণীয় কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধ অপারেশন হলো ফুলবাড়ি থানার মাচুয়াপাড়া (এটাই প্রথম যুদ্ধ যেখানে বিপক্ষের দু’জন নিহত ও চারজন আহত হয়েছিল), রাঙামাটি (সবাই পালিয়ে গেছিল, দু’জন রাজাকারকে ধরা হয়), পার্বতীপুর থানার চৌহাটির যুদ্ধ (যে যুদ্ধে আমরা দু’জন বিহারীকে মারি), খোলাহাটি রেল লাইনের উপর যুদ্ধ, রংপুরের বদরগঞ্জ যুদ্ধ ও দিনাজপুরের মহারাজা স্কুলের যুদ্ধ যেখানে আমি আহত হই ও একটি পা হারাই। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি আমরা বড়পুকুরিয়া রেল লাইনের অপারেশন করি। বড়পুকুরিয়া রেললাইনে চার/পাঁচজন রাজাকার রেকির মাধ্যমে পাহারা দিত। সেই পাহারা এড়িয়ে রেল লাইনের সামনে ব্রিজের কাছে রাত এগারোটার দিকে বারুদ, কর্টেস, সেফটি ফিউজ, জিসি প্রাইমা, ডেটোনেটর জড়ো করে ফায়ারিং দিলাম। কোথাও কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। রাজাকাররা হয়তো পাহারায় একটু ঢিলা দিয়েছিল। আশপাশে চেক করে, কাউকে না পেয়ে ব্রিজ উড়ানোর সরঞ্জামাদি ব্রিজে ফিট করলাম। প্রয়োজনমতো জিসি প্রাইমার, কর্টেস, সেফটি ফিউজ সংযোগ করে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যার যার পজিশনে থাকলাম। ব্রিজ ওড়ানোর পর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন সুবেদার নায়েব আলীর কাছে রিপোর্ট করলাম। দু’দিন পরে ক্যাপ্টেন বললেন ‘মাচুয়াপাড়ায় পাকিস্তানি ক্যাম্প আছে। ক্যাম্প উড়াতে হবে। ইউ আর সিলেক্টেড। ঠিক সন্ধ্যার সময় খলসামা সীমান্ত গ্রাম অতিক্রম করে দেড় মাইল ভেতরে পাক সেনাদের ক্যাম্পের কাছে যাবে। ঐ ক্যাম্পে প্রায় ১০০ জন পাকিস্তানি সৈন্য আছে।’ সন্ধ্যায় খেয়ে ১৯/২০শে সেপ্টেম্বর রওনা দিলাম। রাত আটটার দিকে বর্ডার ক্রস করে হাঁটা শুরু করলাম। ধানক্ষেতে হাঁটুর উপর পানি। না যায় হাঁটা, না যায় সাঁতার কাটা। মূল টার্গেটের শ’ খানেক গজের ভেতর এসে পজিশন নিলাম। পাঁচ মাইল পেছন হতে মিত্র বাহিনী আর্টিলারি কাভারেজ দিচ্ছে। আমরা তো পজিশন নিয়েছি। আর্টিলারি কাভারেজ শুরু হয়েছে। একশো রাউন্ড শেলিং ফায়ারের ভেতর আমরা মুক্তিযোদ্ধারা অ্যাডভান্স করছি। পাকিস্তানিদের ভেতর ২০/২৫ জনের লাশ পড়লো। আমাদের দু’জন মুক্তিযোদ্ধা ‘অন দ্য স্পট’ মারা গেল।

    আমি নিজে আমার পা হারাই ৬ই জানুয়ারি দিনাজপুর মহারাজা স্কুলের এক যুদ্ধে। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় নিয়াজিরা আত্মসমর্পণ করলেও দেশের ভেতরে নানা জায়গায় তখনো পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ চলছিল। ৬ই জানুয়ারি আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বর্ডার ক্রস করে দিনাজপুর শহরের মহারাজা স্কুলে এসে ক্যাম্প বানালাম। কিন্তু, আশপাশে পাকবাহিনী মাইন পুঁতে রেখেছিল। হঠাৎ এক মাইন বিস্ফোরণে তৎকালীন মহারাজা স্কুলসহ আশপাশের পাঁচশ’ গজের ভেতর সব ঘরবাড়ি ধূলিস্যাৎ হয়। প্রায় ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়ে কোনোমতে বেঁচে যান। আমার পা আমি ঐ বিস্ফোরণেই হারাই। এরপর দিনাজপুর সদর, রংপুর সদর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ও মগবাজার সুশ্রী হাইশে আমি চিকিৎসা নেই। সোহরাওয়ার্দ্দি হাসপাতাল থেকে ১৯৭৪ সালে আমি প্রথম পা পাই। এটা ব্যবহার করেছি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। কোনো কোনো কৃত্রিম পা ‘লাইফ’ পায় মানে অনেকদিন চলে। দ্বিতীয় পা ভারতের পুনা থেকে পেয়েছি। এটা সেই ১৯৮৪ সাল হতে আজ অবধি ব্যবহার করছি। স্বাধীনতার পরে সরকারের প্রশাসনে আমি একটা ছোট-খাট চাকরি পাই। সেটাই আজো করছি। আমার এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে লালমাটিয়া কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ছে। ছেলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। কষ্টের ভেতর শিরদাঁড়া, উরু ও সুস্থ পা’টাতে মাঝে মাঝে খুব ব্যথা হয়।”

    ১০) মোহাম্মদ মানিক আলী
    বয়স: ৫৫
    জন্মস্থান: বিয়ানিবাজার, সিলেট।
    বর্তমান পেশা: টেলিফোন প্রকৌশলী।
    বৈবাহিক অবস্থান: বিবাহিত।

    “মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৭ বৎসর। বাবা কৃষক ছিলেন। মেট্রিক পরীক্ষা দেবার পরের বছরই যুদ্ধ শুরু হয়। আমি এপ্রিল মাসে ৪ নং সেক্টরে মেজর সি,আর, দত্তের অধীনে যুদ্ধ করেছি। সিলেট হতে করিমগঞ্জ হয়ে লাতু ট্রানজিট ক্যাম্পে যাই। স্টেনগান ও রাইফেল চালানো, মাইন প্রস্তুত করা… প্রায় ৪৪ ধরনের মাইন প্রস্তুত করার কাজ আমি আড়াই থেকে তিন মাসে শিখে উঠি। পাক বাহিনীর সাথে একটা অপারেশনের কথা খুব মনে পড়ে। আমরা জিতেছিলাম সেই অপারেশনে। জকিগঞ্জ ক্যাম্পে ঈদের আগের দিন আমরা ঘেরাও করি। ওরা কিন্তু সংখ্যায় প্রায় ২০০/৩০০ জন ছিল। ভোররাত চারটার দিকে আমরা অ্যাটাক করি। পাক বাহিনীর ওয়্যারলেস তার ও টেলিফোন সংযোগ আমরা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম। রাস্তা কেটে যানবাহন চলাচলের পথও বন্ধ করে দিই। পরদিন সকাল ১১টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলে। মিত্র বাহিনী পাকিস্তানি এক ক্যাপ্টেনকে বন্দি করে। সেনাবাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা, মুজিব বাহিনী, পুলিশ ও ইপিআর সবাই মিলে আমরা কাজ করেছি।

    তবে, আমি আমার দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি ও ডান হাতের পাতা হারাই ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১। আমাকে অথরিটি নির্দেশ দিয়েছিল যেন এয়ারপোর্ট হতে সিলেট শহরের দিকে ঢোকার পথে মাইন বসিয়ে রাখি। কিন্তু, আমার কাছে ফিউজ কাটার কিছু ছিল না। মুচড়ে ছিঁড়তে গিয়ে গান পাউডার বা বারুদ হাতের ভেতর বার্স্ট করে ও দুই চোখও আহত হয়। ভোর পাঁচটায় আমাকে আসামের করিমগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দশ/পনেরো দিন সেখানে চিকিৎসার পর আমাকে নিয়ে আসা হয় সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেক্টর কমান্ডার কর্নেল ওসমানী আমাকে রেকমেন্ডেশন লেটার দিলে সেই চিঠির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু আমাকে হাঙ্গেরিতে টেলিফোন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর একটি তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্সে পড়তে পাঠান। ’৭৪-এর আগস্ট হতে ’৭৭ পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনার পর দেশে ফিরে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে চাকরি পাই। টেলিফোন সুপারিনটেনডেন্টের চাকরি। বর্তমানে ঢাকার ৩০, পুরানা পল্টনের একটা বাড়িতে আছি। আমার তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে উকিল। ছোট ছেলে সুজন ইউডাতে বিবিএ অনার্স পড়ছে। ওই আমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে ডাক্তারের কাছে যাওয়া, কল্যাণ ট্রাস্টে বা বিশ্রামাগারে আসা এসব কাজে সাহায্য করে।

    অল্প বয়সে দু’চোখ হারিয়েছি বলে দুঃখ হয় কিনা? তা তো হয়ই! তবে, অন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধার তুলনায় আমি বরং স্বাচ্ছন্দ্যে আছি। অনেকে অনেক কষ্টে আছেন। তাদের কথা ভেবে বড় দুঃখ হয়।”

    ১১) আব্দুস সামাদ

    “যুদ্ধে আমার হাত ভাঙ্গছে, চোখ একটা নষ্ট হইছে আর কানের পর্দা ফাটছে। তবু, আল্লাহর রহমত যে আমার মাত্র কুড়ি পার্সেন্ট ইনজুরি হইছে। আমি পুরা পঙ্গু হই নাই। দেশ আমার কুমিল্লার বিবাড়িয়ার নবীনগর। বর্তমানে থাকি রংপুর। শেখ সাব আমারে ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে একটা এনিমি সম্পত্তি দিয়া গেছে। অল্প এক/দুই বিঘা জমি। তা সেই জমির পাশে এক বিহারী এখন দালান উঠাচ্ছে। জীবনে কোনো শান্তি পাইলাম না। আটটা ছেলে-মেয়ে। আমার এক কড়া সম্পত্তি নাই। জায়গা-জমি নাই। চিকিৎসা পাচ্ছি না, ভাতা পাচ্ছি না। হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর একবার বঙ্গভবনে দেখা করতে গেছিলাম। ওনার সময় নাই।”

    ১২) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বীর বিক্রম বীর প্রতীক

    ff-golam-mostafa-bir-bikram-bir-pratik-golam-mostafa-with-his-grandson.jpg……..
    নাতি কোলে মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বীর বিক্রম বীর প্রতীক
    ……..
    “আমার দেশ ছিল কুমিল্লার বিবি বাজারে। আমি তিন নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করছি। ‘জেড’ ফোর্স, ‘কে’ ফোর্স ও ‘এস’ ফোর্সের ভেতর আমি যুদ্ধ করেছি ‘এস’ ফোর্সের আওতায়। আমি ছিলাম সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীর সদস্য। ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা-দোহার এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে আমি আহত হয়ে চিরতরে হুইল চেয়ারের আশ্রয় গ্রহণ করি। ডিসেম্বরের এক তারিখ মাধবপুর (হবিগঞ্জ) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানার মাঝখানে চান্দুয়া ডাকবাংলো যাবার পথে খবর এলো যে সরাইল থানার শাহবাজপুর ব্রিজের কাছে পাঞ্জাবিরা আছে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু শাহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম ছিলেন আমাদের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার। একটা ব্যাটালিয়ন সাধারণতঃ চারটা কোম্পানীর সমন্বয়ে গঠিত হয়। চান্দুয়া বা ভোপালপুর ব্রিজের কাছে এসে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু শাহ মোহাম্মদ বীর বিক্রম ও ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন ‘জয় বাংলা’ বলে পাক বাহিনীর গাড়ির সামনে গিয়ে ব্রাশ ফায়ার শুরু করলেন। নায়েক মূর্তজা অ্যাকশন নিয়ে ব্রিজের একপাশে ও নায়েক আবুল কালাম আজাদ অপর পাশে গিয়ে ব্রাশ ফায়ার শুরু করেন। কোম্পানী কমান্ডার টোয়াইসি সিপাহী আদম আলীও যুদ্ধে ছিলেন। হাবিলদার রফিক, সিপাহী মজিবর সহ অনেকেই এই যুদ্ধে ছিলেন আমার সাথী। ১৮/১৯ জন পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের কাছে হেরে গেল। আমি এই যুদ্ধেই গুরুতর আহত হই। আহত হবার পর আমাকে গৌহাটি, পুনা, লাখনৌয়ের কমান্ডো হাসপাতাল সহ নানা হাসপাতালে নেওয়া হয়। আমাকে স্বাধীনতার পর সরকার হতে বিদেশে চিকিৎসার জন্য ১৯৭৫-এর নভেম্বর মাসে পাঠানো হয়। আমি দেশে ফিরি আর ১৯৭৭ এর অক্টোবরে। আমার চার ছেলে। এক ছেলে সামনে লেবার হিসেবে বিদেশে যাবে। এক ছেলে বিয়ে করেছে। দুই ছেলে ড্রাইভিং ও ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করে। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধে আমার সাহসিকতার অবদান হিসেবে বীর প্রতীক উপাধি ছাড়াও আমাকে সেনাবাহিনীতে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যুদ্ধের পর থেকে আমি পূর্ণ পঙ্গু।”

    ১৩) মোহাম্মদ শুকুর আলী

    “আমি ৪ নম্বর সেক্টরে লালমনিরহাটে যুদ্ধ করছি। ইপিআরে ছিলাম। যুদ্ধের সময় আমার বয়স ধরেন ৩০/৩২ হবে। যুদ্ধে আমার হাতে ও পায়ে গুলি লাগছে। আমার ছয় মেয়ে, দুই ছেলে। তিন মেয়ের বিয়া দিছি। এক ছেলে আইএ পড়ছে। বড় ছেলে ড্রাইভারি করে।”

    ১৪) গোলাম মোস্তফা চৌধুরী

    “আমার বাড়ি নোয়াখালি। তবে, যুদ্ধ করছি শেরপুরে। বাবা শেরপুরে পাটের ব্যবসা করতেন। আমরা ছিলাম চার ভাই তিন বোন। আমি যুদ্ধের ট্রেনিং নেই মেঘালয়ের তুরায়। এপ্রিলের ১৪ তারিখ এই ট্রেনিং শুরু হয়। মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জে বিএসএফ ক্যাপ্টেন নেগি আমাদের তাঁবু দিল। প্রায় একশোর মতো ছেলে আমরা জড়ো হইছিলাম। প্রাথমিক ট্রেনিংয়ের পর কারো পোড়াখাসিয়া, কারো মাহেন্দ্রগঞ্জ আবার কারো বাহাদুরাবাদ ঘাটে দায়িত্ব পড়ে। আমাকে দেওয়া হলো পোড়াখাসিয়া ক্যাম্পে। রাজারবাগ পুলিশের আলম সাহেব ঐ ক্যাম্পে সেকেন্ড ইন কমান্ড বা টু-আই-সি’র দায়িত্বে ছিল। কর্নেল তাহের ছিলেন আমাদের সেক্টর কমান্ডার।

    ’৭১-এর মাঝামাঝি পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে আমাদের প্রথম মুখামুখি সংঘর্ষ হয়। তখন জুন মাস। তেনাছড়া ব্রিজ উড়াইতে আমরা প্রায় দেড়শ ছেলে রাত তিনটা কি সাড়ে তিনটায় সুরমা নদীর ব্রিজের উপর উঠে দেখি গাড়ির আলো। পাঞ্জাবিদের গাড়ির আলো। আমি ডিনামাইটে আগুন দিলাম। পাঞ্জাবিদের তিনটা গাড়ি নষ্ট হইলো। অনেক বিহারী আহত হইলো। বর্ডারের এক পাশে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আর এক পাশে বদর বাহিনী ও বিহারীদের ক্যাম্প। আমাদের সাথে ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এসএলআর, স্টেনগান ও লাইট মেশিন গান। সেই প্রথম দিনের অপারেশনে খুব ভয় পাইছিলাম। পরে ধীরে ধীরে ভয় কাটে আমার। শ্রীবর্দি, বক্সিগঞ্জ, কামালপুর, শেরপুর, ভায়াডাঙা, নক্সি এইসব জায়গায় অনেক অপারেশন করছি আমি। আমরা শ্রীবর্দী থানার বিহারী ক্যাম্প ও বক্সিগঞ্জ, ঝিনাইগাতি আর কামালপুরের বিহারী ক্যাম্পও উড়ায় দিছি। তাহের ছিলেন মাহেন্দ্রগঞ্জে। কাগিলাখুরার যুদ্ধে কয়েকজন বিহারী আমার পিঠে ও পেটের ডানদিকে বেয়োনেট চার্জ করে। তখন কর্ণজোড়া পাহাড়ের দীনেশ চৌধুরী তার বাবার সম্পত্তি বিক্রি করে আমাকে এক মাস সেবা শুশ্রুষা করে। নভেম্বরের ২৮ তারিখ আমরা বিহারীদের কাছে ‘সারেন্ডার লেটার’ পাঠানোর নোটিশ দিই। শেষ যুদ্ধ হয়েছিল ময়মনসিংহের শেরপুরে। এখন তো শেরপুর নিজেই আলাদা জেলা। আমি এক মাস বিশ্রামের পর এই শেষ যুদ্ধে অংশ নিই। যুদ্ধ শেষে ১১ নম্বর সেক্টরের সবাই আমরা জমায়েত হয়ে অস্ত্র জমা দিই। ১৯৭৫ পর্যন্ত আমি রক্ষীবাহিনীর রিক্রুটিং অফিসার হিসেবে কাজ করি। পরের ত্রিশ বছর আমি তেল ফেরি করে বেড়িয়েছি। ২০০২ ও ২০০৩-এ ব্রেইন স্ট্রোক হয়ে আমার শরীরের শতকরা ৪১ ভাগ পঙ্গু হয়ে পড়ে। ১৯৭৬ সালে আমি বিয়ে করেছি। আমার চার ছেলে আর এক মেয়ে। বড় ছেলে একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। মাসে ছয় হাজার টাকা বেতন। মেজ ছেলে এমএ পাস করে চাকরি করছে। বড় মেয়ে বিএ পাস করে বিয়ে হয়েছে। সেজ ছেলে ম্যাট্রিক পাশ করেছে। আজ ৩৪ বছর হয় ভাড়াবাড়িতে আছি। নিজের বাড়ি হয় নাই।”

    ১৫) আব্দুল লতিফ ভুঁইয়া

    “আমি যুদ্ধ করছি ২ নম্বর সেক্টরে। ঢাকার দক্ষিণাঞ্চলে কসবা-কুমিল্লা হতে নোয়াখালি এলাকায় আমাদের ফিল্ড ছিল। যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র বাইশ বছর। আমি যুদ্ধের শুরুতে ঢাকার পূর্ব কাফরুলে ছিলাম। এপ্রিলের পনেরো তারিখ আমি প্রথম ক্যাম্পে গিয়া নাম লেখাই। রাজারবাগ পুলিশ স্টেশনের হাবিলদার আব্দুল মালিক আমাদের বারো আনি ট্রেনিং দেন। ভারতের বালাটোলা (কোলকাতা)-য় ২৮ দিন ছিলাম। মে মাসের দিকে কসবায় আমার প্রথম দায়িত্ব পড়ে। আমি আট/দশটা অপারেশনে অংশ নিই। ঢাকা আর নোয়াখালির নানা জায়গায় আমি গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। মনে আছে কসবার ওপার থেকে কাঁধে এলএমজি করে রেঞ্জের ভেতর এনে টার্গেট করে গুলি করেছি। মে মাস। কসবা রেল স্টেশনে শত শত আর্মি আর রাজাকার ঘাঁটি গেড়েছে। রাতের দিকে আমরা ভৈরবের উদ্দেশ্যে মার্চ করলাম। ব্রিজ ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরের দিন আমরা নদীর ওপারে পজিশন নিয়ে মিলিটারির সাথে ঠিক সাড়ে চার ঘণ্টা যুদ্ধ হলো। এছাড়াও মুন্সিগঞ্জের দিকে ছোট ছোট যুদ্ধ হয়েছে। ভাদ্র মাসে বেলোনিয়া বর্ডার পার হয়ে একটা বড় পাট ক্ষেতে লুকাইছি। পাক বাহিনী নৌকাযোগে মার্চ করে যাচ্ছিল। আমরা সেই যুদ্ধে তাদের হারাই। কিন্তু আহত হই ৬ই ডিসেম্বর নোয়াখালির মিরগঞ্জ থানার যুদ্ধে। ভোর ৫টা থেকে পাঞ্জাবি ও রাজাকারের লগে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। আনুমানিক ১:০০ টার দিকে ডান পা নষ্ট হয়ে যায়। পায়ে গুলি লাগার পর এমনি হুঁশ হারাই যে আর ১১ দিন পর জ্ঞান ফেরে। ডান পায়ে তখন ব্যান্ডেজ। পুরো ডান পাটাই এভাবে নষ্ট হয়ে যায়। লক্ষীপুর সদর হাসপাতালে প্রথম দিন দশেক থাকার পর আমাকে ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। ১৯৭৫-এর জুলাইয়ে আমি বিয়ে করছি। চার ছেলে আমার। বড় ছেলে মেট্রিক পাস করে ছোট-খাট কাজ করে। মাঝারো ছেলে বিয়ে করে আলাদা। ছোট ছেলে আইএ ফেল। আমি সূতার ব্যবসা করি। আজ পনেরো-কুড়ি বচ্ছর ধরে এই সূতার ব্যবসাই করছি।”

    ১৬) সোলেমান সর্দার (বয়স: ৮০)

    “যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ৪০ বছর। নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানার জয়পুর গ্রামে আমার দেশের বাড়ি। আমি ছিলেম সাইকেলের মেকানিক। ’৭১-এর ২৮ শে মার্চ আমরা যশোর ক্যান্টনমেন্টের দিকে রওনা হলেম। সাথে আমাদের ঢাল, সড়কি, দাও ছিল। এর ভেতরেই খবর পেয়িছি যে ক্যান্টনমেন্টের রেল লাইনের বাম দিকে আনসার, পুলিশ আর সেনাবাহিনীর বাঙালীরা নাকি সব জড়ো হয়িছে। তা দুপুর বারোটার দিকে যাত্রা শুরু করে তিন ঘণ্টা পর পৌঁছে দেখি বিডিআর ইপিআর কি একটা পিঁপড়ে কিছু নেই। আমরা চলি আলাম নড়াইলের দিকি। ইটনায় লোহাগড়া হাইস্কুল ও কলেজে আমরা ট্রেনিং নেওয়া শুরু কল্লাম। এপ্রিল মাসে রাজাকাররা আমাকে অ্যারেস্ট করে থানায় দিলে। তা লোহাগড়া থানার ওসি হাতে মোল্লা আমার পরিচিত পুলিশ। সে আমাকে ছেড়ে দিলে। থানা হতি ছাড়া পেয়িই মোতালেব মিঞা ধানের মিলের সামনে নবগঙ্গা নদী সাঁতরে পার হইয়ি বাড়ি গিয়ি মাকে বলিচি, ‘মা, আমাকে লুঙ্গি ও শার্ট দাও।’ মা আমাকে লুঙ্গি আর শার্ট দেবার পর সাঁতরায় দাদাবাড়ির দিকি রওনা দিলাম। রাত্রি বারোটায় আমার চাচা আমার সাথে দেখা কল্লে। ওখান থেকে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় মামাবাড়ি চলে গেলাম। পরের দিন সকালবেলা ভাত খাতিছি। এসময় কিছু নক্সাল এসে মামারে কোপাতি চাচ্ছিলো। ওরা মামাবাড়িতে মজুদ টিন আর পাট নিতি আসছিল। আমি দৌড়ে দু/তিন ঘর পর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ হতে রাইফেল এনে ’বিলাঙ্ক ফায়ার (ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার)’ দিলাম। নয় জন নক্সালকেই আমরা আটক করলাম। মে মাসের দিকে ভারত চলে গেলাম। বাগদায়। বাগদার টালিখোলা ক্যাম্প হতে বেগুনদিয়া ক্যাম্প গেলাম। ভিজে-পুড়ে এমন দু/তিনটা টেন্ট বদলালাম। দেখি বেগুনদিয়া ক্যাম্পে ট্রেনিং নিতে প্রায় ২০০-২৫০ ছেলে জড়ো হয়েছে। ছেলেদের টেস্ট হলো যে তাদের প্রশিক্ষণ আছে কিনা। ২০-২৩ দিন ছিলাম সেখানে। তারপরই সরাসরি অপারেশনে। ভাটিয়াপাড়া, বোয়ালমারি, আলফাডাঙ্গা, শিরিরাম, লাহুড়িয়া, লোহাগড়া আর কালারবাজারে বেশির ভাগ যুদ্ধ করিছি। সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা হলো আলফাডাঙ্গায়। নভেম্বর মাসে। আলফাডাঙ্গার ক্যাম্পে আমরা মোট ছিলেম দেড়শ জনা। শেষ রাত্তিরির দিকি মানে তিনটার দিকি সংবাদ পাই যে দেড়শ রাজাকার আর জনা পঞ্চাশ পাঞ্জাবি বোয়ালমারির পানে আসতিচে। ওরা পজিশন নিল বোয়ালমারী বাজারের হাবিব ব্যাঙ্ক… দেশ স্বাধীনির পর যারে কই সোনালী ব্যাঙ্ক… সেই সোনালী ব্যাঙ্কের শাখার অফিসিরি সামনে। বিকেল পাঁটচা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। বিপক্ষের ১২টা লাশ, দেড় কেজি সোনা আর দশ হাজার টাকা আমাদের হাতে আসে। সন্ধ্যায় বোয়ালমারী হতি নৌকো করি যাতিচি। আটজন ছিলাম একটা নৌকায়। ছয়জন ভারত যাবে। আর দু’জন আহত। এমন সময় রাজাকাররা আবার নদীর পার হতি গুলি করিছে। আমার ডান হাতের কনুইয়ে লাগলো। আট নম্বর সেক্টরের বয়রা ক্যাম্পে গিয়ি সোনা ও টাকা জমা দিলাম। আরো প্রায় এক মাস যুদ্ধ করলাম। ডিসেম্বর মাসে পা দেবার দু’দিন আগে কাশিমপুর যুদ্ধে বাঁ পায়ের উরু ও নিতম্বে গুলি লাগে। যুদ্ধে ত’ ব্যথা পাবার ভয় করলে চলে না। কথা কবার সময় নাই। ক্যাম্পেই সেবা চললো।”

    ১৭) মোহাম্মদ অলিলুর রহমান,
    গ্রাম: সাশুনিয়া, থানা: মোকসেদপুর
    জেলা: গোপালগঞ্জ।

    “যুদ্ধের সময় আমি খুলনার খালিশপুরে ফুলতলায় ইস্টার্ন জুট মিলে চাকরি করতাম। বয়স তখন চব্বিশ। আমরা ছিলাম দুই ভাই দুই বোন। বাবা কৃষক ছিলো। তা যুদ্ধ শুরু হবার আগেই বাবার মৃত্যু হয়। আমি মেট্রিক পাশ করতে পারি নাই। ইস্টার্ন জুট মিলের ফিনিশিং সেকশনে হেড সর্দার হিসেবে কাজ করছি। ২৮ শে মার্চ দিবাগত রাত্রে আমি আমার কমান্ডার ও আর্মির সুবেদার শামসুল হক মোল্লার নেতৃত্বে ইস্টার্ন জুট মিলের ক্যাম্প লুট করি। সাতটা রাইফেল আমাদের হাতে চলে আসে। ২৯ শে মার্চ আমরা কাশিয়ানী থানায় আসি। রাতে হাইস্কুলে ক্যাম্প করি। রাজাকারদের তাড়ায় টাড়ায় আরো কিছু অস্ত্র উদ্ধার করি। মোকসেদপুর থানার কানপর্দি গ্রামে আর্মির মেজর (অব:) আজিজ মোল্লা ছেলেদের ট্রেনিং দিচ্ছিলেন। যোগ দিলাম। আর্মি, বিডিআর (তখন ইপিআর), রিটায়ার্ড আর্মি-পুলিশ-বিডিআর সবাই ছিল এই ক্যাম্পে। ইপিআরের জাফর আহমেদ মল্লিক, আব্দুল মজিদ তালুকদার এরা সবাই আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ৯ই আগস্ট মোকসেদপুর থানায় হামলা করলাম। এটা ছিল সোমবার দিনগত রাত ১১:০০ টার মতো। পাক বাহিনীর সাত জন আর্মি, পিস কমিটির চেয়ারম্যান ওহাব মিয়া, আমাদের পক্ষে ১১জন পুলিশ সহ প্রায় আঠারো-কুড়ি জন জখম। আমরা ছিলাম প্রায় ২০০ জন। রাত দুইটার দিকে আমাদের গুলি শেষ হয়। উল্লাপাড়ার কর্নেল আলতাফ লোক পাঠায়ে গুলি পাঠানোর খবর দিচ্ছেন। এই সময় চাঁদহাটের পথ হয়ে আজিজ এলো দুই প্যাকেট গুলি নিয়ি। সে এসেই থানার বাইরের বাগানে বসে আমাদের ভেতর সব গুলি ভাগ করে দিল। এদিকে সারা রাত ধরিই কিন্তু গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতিছিল। কিছুক্ষণ বিরতির পর ভোর চারটায় আবার যুদ্ধ শুরু হলো। আমরা ত থানার বাইরের বাগানে পজিশন নিছি। আর রাজাকার ও পাঞ্জাবিরা থানায় পজিশন নিছে। থানার ছাদের উপর চারজন রাজাকার ছিল টহলে। তাদের দিকি গুলি ছুঁড়লি তারা অন্য দিক দিয়ি লাফায়ি পড়লো। আমাদের ভেতর তিনজনা মাথায় বালির বস্তা বান্ধি থানার দক্ষিণ কোণা দিয়ি ঢুকি গ্রেনেড চার্জ করলো। এদের ভেতর একজন ছেলেন লুৎফর রহমান, একজন ইপিআর সুবেদার মেজর আব্দুল জলিল ও অপরজনা আমি। গ্রেনেডের গোলায় থানার ভিতরি আগুন লাগলো। তখন বটগাছের মগডালে বসি আমাদের দলের জাফর মল্লিক থানার পানে বিলাঙ্ক ফায়ার শুরু করলো। এলোপাথাড়ি গুলি শুরু হলো। শত্রুপক্ষের ওরা কেউ বাঁচলো না। থানায় ঢুকি পর গ্রামের মানুষকে চাল-ডাল-কাপড় দিলাম। অস্ত্র ও গোলাবারুদ… মনে করো সে প্রায় ১৫/২০টা রাইফেল নিলাম। এরপরপরই ভারত চলি গেলাম। কারণ আওয়ামী লীগ ঘোষণা করলো যে ভারত থেকে ট্রেনিং না নিয়ি যুদ্ধ করলি রাজাকার ঘোষণা করবে। কাজেই ভারত গেলাম। ট্রেনিং নিয়ি ফেরার পর আবার যুদ্ধ করিছি তোমার মোকসেদপুরের বামনডাঙ্গা, জলিরপাড়ের শিন্দাঘাট, ফরিদপুর শহর, কাশিয়ানীর ফুতরা গ্রাম, ভাইটেপাড়া (ভাটিয়াপাড়া)। ভাইটেপাড়ায় নভেম্বরের সতেরো তারিখের যুদ্ধটা ছিল জমজমাট। খুলনা থেকে আর্মি আসছে ভাইটেপাড়ায়। ফুকরা বাজারে পজিশন নিছি দুপুর বারোটায়। হাজার দেড় দুই অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, পুলিশ সব অবস্থান নিছে ফুকরা বাজার আর ফুকরা চরে। মধুমতী নদীর সামনে থেকে দুইটা লঞ্চ বোঝাই পাঞ্জাবি সৈন্য যাবে। ভাইটেমারার ওদিকে আমাদের সেন্ট্রি ছিল। পাঞ্জাবিরা দুইটা ঘানি নৌকায় সাইলেন্সার ফিট করছে। আমাদের সেন্ট্রিরা বুঝতে পারে। ফুকরার চরে এসে আর্মি ও রাজাকার গুলি শুরু করে। আমরা বাজার ছেড়ে চরে চলে আসি। গোলাগুলি শুরু হয়। দুটো নৌকা ডুবিয়ে দেই। দুপক্ষেই প্রচুর মানুষ নিহত হয়। বেলা তিনটার দিকে আমার চোখের নিচে, পাছা আর উরুতে গুলি লাগে। বাম দিকে ধানক্ষেতের উপর পড়ে গেলাম। ভারতের বনগ্রাম সাব-ডিভিশনের একটা হাসপাতালে ১২-১৫ দিন কাটালাম। ১৮ ডিসেম্বর ভাইটেপাড়ায় আরো একটা যুদ্ধ হলো। এই যুদ্ধে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, যশোরের অনেক যোদ্ধা অংশ নিয়েছে। এবার যুদ্ধ শুরু হলো রাত ১২টার পর। পাঞ্জাবিদের বাঙ্কার ছিল পাশেই। খুলনার গোয়ালপাড়া পাওয়ার হাউস থেকে গরম পানি ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িতে করে এনে ফায়ার সার্ভিসের ফিতা ও বয়া দিয়ে গরম পানি ভাইটেপাড়ায় মাটির নিচে খানেদের বাঙ্কারে আমরা ছুঁড়ে মারি। তখন বেলা বারোটা বাজে। বেলুচ আর পাঞ্জাবি মিলিয়ে ২৫ জন আর ১০০ জন রাজাকার এতে মারা যায়। এই যুদ্ধে মেজর মঞ্জুর, মেজর জলিল ও মেজর জয়নাল আবেদীন সবাই একসাথে ছিলেন। একটা কথা। পাঞ্জাবিদের বাঙ্কারে কিন্তু আমরা গুলি করতে পারি নি। বরং ওরা দূরবীণ দিয়ে দেখে দেখে আমাদের তিন জনকে গুলি করে। ক্যাপ্টেন বাবুলের দাড়ির ভেতর দিয়ে গুলি লেগে মাথার বাইরে দিয়ে বের হয়। ইপিআরের জাফর আহমেদের বাঁ পায়ে গুলি লেগে বাঁ পায়ের নিম্নাংশ ভেঙে যায়। কাজি আনোয়ার হোসেনের তলপেটে গুলি লাগে। বাঙ্কারের ভেতর গরম পানি পাইপ দিয়ে ফেললে ওরা সব আধা ঘণ্টার ভেতর সারেন্ডার করে বের হলে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাঙ্কারে পাওয়া গুলি আমরা দখল করি। আর বাঙ্কারে পাওয়া চাল, ডাল, লবণ, মরিচ এলাকার লোকদের দিয়ে দিই। আঠারোটা বাঙালী মেয়েকেও আমরা বাঙ্কার থেকে উদ্ধার করি। তাদের মুখ ও বুকের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। অত্যাচারে ক্ষত-বিক্ষত। সেই কথা ভাবলে এখনো চোখে পানি চলে আসে।

    মিলে গিয়ে পাঁচ/ছয় দিন চাকরি করার পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশে এলাম। কেন জানি কারখানায় কাজে নতুন করে মন বসাতে পারলাম না। দেশে ফিরে কৃষিকাজ করা শুরু করলাম। বিয়ে করলাম স্বাধীনের ছয়/সাত বছর পর। আমার এখন দুইটা মেয়ে। বড় মেয়ে ঘরেই থাকে। ছোট মেয়ে ক্লাস এইটে পড়ে। নানা অসুখে ভুগছি। হার্টের সমস্যা, পিত্তথলিতে পাথর, ব্রেনে সমস্যা আর ডায়াবেটিস। সাম্প্রতিক সময়ে আমার ৩০% ডিজএ্যাবিলিটি কমায় ৫% করে ভাতা দেওয়ায় মাসিক ছয়শো টাকা করে ভাতা পাই।’

    ১৮) শামসুল হক

    আমার বাড়ি দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ থানার রঘুনাথপুর গ্রাম। বর্তমানে আমার বয়স ৫৮ বৎসর। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ২২/২৩-এর মতো। ১৯৬৯-এর শেষের দিকে আমি সিপাহী (কনস্টেবল) হিসেবে পুলিশে যোগ দিই। পড়াশোনা করেছি ক্লাস এইট পর্যন্ত। ’৭১-এর জুনে আমি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাথে যুদ্ধে যোগ দিই। বিরামপুর-হিলি-নওয়াবগঞ্জ বর্ডারে যুদ্ধ করেছি। ডাক্তার মহব্বত জান ও কর্নেল রেজা (বর্তমানে মেজর জেনারেল) আমাদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।

    আমার ছিল দুই বোন। মা বাবাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেছিলেন। মা’র অন্যত্র বিয়ে হয়। আমি সারদা ট্রেনিং ক্যাম্পে (রোল ৬৭২, ডিআইজি খালেদ সাহেবের নেতৃত্বে, দিনাজপুর ৬৫) মুক্তিবাহিনী অর্থাৎ ছাত্র-কৃষক ট্রেনিং নেই। উল্লেখযোগ্য অপারেশনের ভেতর বিরামপুর আর ডাঙ্গাপাড়ায় অংশ নিয়েছি।

    বিরামপুরের চুরকুইয়ে সোলেমান বিহারীর ক্যাম্প ছিল। বড় রাইস মিলের ভেতর ১২ জন বিহারী রাজাকার ছিল। আমাদের দলে আমি, জিন্নাহ, মুসলিম, ফজলু আর ইন্ডিয়ান ফোর্সের ১২/১৩ জন ছিল। সকাল দশটার দিকে… তারিখ ভাল মনে নেই… আমরা কয়েকজন রাইফেল, গ্রেনেড, এলএমজি আর এসএলআর নিয়ে প্রস্তুত। আমার হাতে ছিল থ্রি নট থ্রি। রাজাকারদের দোতলা ক্যাম্প ঘেরাও দিয়ে ফায়ারিং করি। এক ঘণ্টা ফায়ারিং চলে। আমরা এক ঘণ্টা ধরে ফায়ারিং করি। এই যুদ্ধে আমাদের কেউ আহত হয়নি। বরং আমরাই প্রতিপক্ষের লাশ নিছি।

    আজো মনে পড়ে ডাঙ্গাপাড়ার যুদ্ধ। ভারত থেকে পার্টি আসছে আমাদের সাহায্য করতে। পাকসেনারা জানত যে ভারত থেকে সৈন্যরা আসছে। তাই পাকিস্তানিরা এমন বম্বিং শুরু করলো যে ইন্ডিয়া থেকে যারা সাহায্য করতে আসছে, তারা সবাই মারা গেল। আমরা তখন যুদ্ধের কৌশল হিসাবে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়লাম। রামভদ্রপুর আর নয়াপাড়া অঞ্চলেও আমরা কিছু রাজাকার মেরেছি। বিরামপুরের সোলেমান বিহারীর ক্যাম্পের কথায় আবার ফিরে আসি। ঐ যুদ্ধে জিতবার পর আমরা ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের কাছে হাতিয়ার জমা দিতে গেলাম। তখন হিলি বর্ডারে ভারতীয়দের কাছ থেকে তিন ট্রাক মাইন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আর একটা দল দিনাজপুর ফিরছিল। সন্ধ্যাবেলায় সেই মাইন আমরা মাটিতে পুঁতছিলাম। এসময় একটা মাইন বিস্ফোরিত হয়ে আমি জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম রংপুর হাসপাতালে। মনে হলো আমার গোর আজাব হচ্ছে। এক মাস চিকিৎসা চললো। ইঞ্জেকশন আর ইঞ্জেকশন। শুরুতে কথা বলতে পারতাম না। ২/৩ মাস পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডান উরু থেকে মাইন বের করা হয়। মাইন অর্থ মাইনের স্প্লিন্টার। সরকার থেকে এরপর আমাকে জার্মানি পাঠানো হয়। এক বছর চিকিৎসা করা হলো। ১৯৭২-এর শেষে দেশে ফিরলাম বিদেশ থেকে। মাসে ৭৫ টাকা করে ভাতা। বঙ্গবন্ধু আমাকে সাড়ে চার বিঘা জমি দিয়েছেন যা বন বিভাগের লোকরা বর্তমানে জোরদখল করেছে। আমার জমির দাগ নম্বর হলো দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ থানায় হরিপুর বিট জমি (২৬০০/২৯ দাগ)। খাজনা দিচ্ছি নিয়মিত। আমার কাছে জমির রেকর্ডও আছে। কিন্তু, বনবিভাগ গত ৬/৭ বছর ধরে একটু একটু করে দখল করছে। হেলিকপ্টার (ইউক্যালিপটাস) আর আকাশমণি গাছ লাগিয়ে বনবিভাগ এই জমিগুলো দখল করছে। বর্তমানে আমার দখলে আছে আড়াই বিঘা জমি। এই আড়াই বিঘা জমিতেই যা ফসল হয়, তার উপর আমার সম্বৎসর খোরাকি নির্ভর করে। রঘুনাথপুরে আমার পৈতৃক ভিটাও আছে। মা মারা গেছে। বিয়ে করেছি ১৯৭৭/৭৮-এর দিকে। দুই ছেলে দুই মেয়ে আমার। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। ছেলে দুটো মেট্রিক পাশ করেছে। আমার ৫০% ডিসএ্যাবিলিটি আছে। আগে ৫৬২৫ টাকা পেতাম। সম্প্রতি ভাতা আরো ১১০০ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে ৬৭০০ টাকা করে পাচ্ছি। মাঝখানে কিছুদিন শরীর খুব খারাপ গেল। প্রস্রাব হতে কষ্ট হতো। খাওয়ার খরচ, ওষুধের খরচ সব মিলিয়ে মাসে প্রায় দশ হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে যায়।

    ১৯) সামছুর আলী মণ্ডল
    সার্শা, যশোর

    সামছুর আলীর স্ত্রীর ভাষ্য: ” উনি খেলাধূলা করতেন। যুদ্ধের শুরুর দিকে একবার উনি দক্ষিণ বর্ডারে খেলতি গেছেন। খেলা থেকে ফিরে এইসি বাঘাছড়া এলাকায় দ্যাখেন লাশের পর লাশ। ঐ রাত্তিরিই উনি আরো দু’জনাকে সাথে করে নিয়ে ভারতের হাতিপুর চইলে গেলেন। তিনমাস পর এক রাত্তিরি দেখা করতি আসছিলেন। আমার শাশুড়ি তাকে পিঠাসিটা বানায়ে খাইয়েছিল। তারপর আবার উনি বর্ডারে চইলে গেলেন যুদ্ধে। ওনার গুলি লাগছে ৭ই নভেম্বর। বাম সাইডে শেল। কামানের গুলি লাগছে।”

    সামছুর আলীর নিজের ভাষ্যে: “আমি ছিলাম লাইন পজিশেনে। ক্রলিং করে যাচ্ছিলাম। এক গুর্খা সৈন্য আর এক বাঙালী মারা পড়লো। আমার বাম সাইডে শেলের গুলি লাগবার পর আমাকে বশিরহাট হয়ে বারাকপুর মেডিকেলে নিয়ে গেছিলো আমার সাথীরা। এই আহত হবার আগে আমি রেসলিং খেলতাম, পাঁচ সের চালের ভাত খাতাম। মনে আছে, যুদ্ধে যাবার আগে ট্রেনিং শেষ করে হাতিয়ার নিয়ে বাড়ি আসলাম। মা তিনরকম পিঠা বানালেন। ছিটা রুটি পিঠা। ঐ পিঠাই খালাম এক ধামা। তারপর বানালেন খোলা মুচি পিঠা। সেই পিঠা খায়ে যুদ্ধে গেলাম। যুদ্ধে কডা শত্রু মারিচি? ও অগোনা। যুদ্ধের শেষের দিকে ত’ আহত হলাম। আজ বারো বছর ধরে সম্পূর্ণ প্যারালাইজড। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কোকা কোলায় প্যারালাইজড হবার আগে চাকরি করেছি। বছর কয়েক হয় ডান সাইডে স্ট্রোক হয়ে শরীরটা আমার একটু বেশিই খারাপ হয়ে গেছে। সিএমএইচে আমার একটা কিডনি বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন ছেলি চাকরি করে।”

    ২০) মোহাম্মদ শামসুদ্দিন (বয়স: ৬৫)
    ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর

    “১৯৬৪ সাল অবধি আমি ছিলাম ছাত্র। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছি। ১৯৬৪-’৭১ সাল অবধি আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছি। একটা ব্যপার, যুদ্ধের সময় আমার মা বেঁচে ছিল না। তবে, বাবা বেঁচে ছিল। আমরা ছিলাম সাত ভাই এক বোন। আমি ছিলাম ৪র্থ নম্বর।

    ’৭১-এর এপ্রিলের নয় তারিখে আমরা ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরার আগরতলার জিরো পয়েন্ট বা বিষ্ণুপুরে পৌঁছে যাই। আমরা মোট আঠারো জন ছিলাম দলে। আমিই অধিনায়ক ছিলাম। ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ানিং কলেজে তিন দিন ছিলাম। ঐ তিন দিনেই আরো আশি জন আমাদের সাথে যোগ দিল। আমি তাদের দায়িত্বে ছিলাম। আমি ট্রেনিং নিয়েছি ভারতের শিমলাতে। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট ইব্রাহিম (তখন মেজর ছিলেন) আমাদের দলের নেতৃত্বে দিয়েছেন। শিমলায় সাত দিন পিটি প্যারেড করার পর আমাদের আসামের ইন্দ্রনগর পাঠানো হয়। সেখানে এক মাস এক সপ্তাহ ট্রেনিং চলে। কর্নেল বাগচি ছিলেন সেই ট্রেনিং সেন্টারের ইন-চার্জ।

    প্রথম পাঁচ মাস আমরা যুদ্ধ করেছি ৪নম্বর সেক্টরে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর সি. আর. দত্ত। তিন নম্বর সেক্টরে ছিলেন মেজর শফিউল্লা। মেজর এ. এন. এম. নূরুজ্জামানও ছিলেন। ’৭১-এর ৩রা জুলাই আমরা কানাইঘাট থানা রেইড করি। কানাইঘাট থানার সড়কের বাজারে আমরা একটা ব্রিজ ভাঙি। আর শরিফগঞ্জ বাজারে একটা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙি। ফলে তিনটা থানা বন্যা প্লাবিত হওয়ায় পাকবাহিনী ঐ তিন থানার কোন বাঙ্কারে আর থাকতে পারে নি। এই অপারেশনের জন্য আমরা ত্রিশ জন সন্ধ্যাবেলা জালালপুর ক্যাম্প থেকে রওনা শুরু করি। তিন রাতে ২৪ মাইল হাঁটি। তিন দিন আমরা উপাস। চলার পথে গাছের ডাব, নারকেল কি কাঁচকলা পেড়ে খাচ্ছি। ঐ একমাত্র খাওয়া। রাত তিনটার দিকে পাকিস্তানি ক্যাম্পেও হামলা চালাই। আমাদের এক সহযোদ্ধা রেবতী মোহন দাশ ঐ যুদ্ধে আহত হলেন।

    সেপ্টেম্বর মাসে আমরা আমলাছিট ইপিআর ক্যাম্প মুক্ত এলাকা হিসেবে প্রথম জয় করি। সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখ আমাকে ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়। এই সেক্টরের আওতায় আমি প্রথম যে অপারেশনে অংশ নিই, তাতে আটগ্রাম নামে একটি গ্রামে আমাকে যুদ্ধে অংশ নিতে হয়। এই যুদ্ধে আমরা ছিলাম ১৫০ জন। গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন মাহবুবুর রহমান সাদি চৌধুরী।

    আমরা জানতাম যে পাঞ্জাবিদের ক্যাম্পে আমাদের আক্রমণ করতে হবে। দুপুরের দিকেই রওনা হই। সূর্য ডোবার সাথে সাথে স্পটে পৌঁছানোর পরপরই আমরা পাক আর্মির তিন জনকে ক্যাপচার করি। পাক আর্মির সংখ্যা ছিল ৭০-এর উপর। আমরা দেড়শো জন তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে আক্রমণ চালালাম। আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র ছিল এসএলআর, ব্রিটিশ এলএমজি, এসএমজি, থ্রি নট থ্রি, দুই ইঞ্চি মর্টার। তা তিন গ্রুপে তিনজন কমান্ডার। মাহবুবুর রব সাদি, মণি আর আশরাফুল হক বীরপ্রতীক। তিন ঘণ্টা ধরে গুলি বিনিময় হলো। তিন জন পাক আর্মিকে হ্যান্ডস-আপ করিয়ে আমাদের কমান্ডাররা তাদের পাঠিয়ে দিলেন আসামের নাসিমপুর ক্যাম্পে।

    ’৭১-এর ১৪ই আগস্টের একটা অপারেশনের কথাও মনে পড়ে। দিবাগত রাতে আমরা এ্যাটাকে যাই। কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ থানার আশপাশের এলাকায় এই অপারেশনটি করা হয়েছিল। শত্রুপক্ষ ছিল ২৫০ গজ তফাতে। সুরমা নদীর ওপার থেকে গুলি করলাম আমরা।… কোনটা রেখে কোনটার কথা যে বলি? ১লা ডিসেম্বরের অপারেশনের কথাই ধরেন। রাত দশটার দিকে আখাউরার অন্তর্গত আজমপুর রেলওয়ে স্টেশনের পাশে বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে পড়ি। ঢুকবার পরপরই আমাদের এই অপারেশনের কমান্ডার মতিন সাহেব বললেন যার যার বাঙ্কার নিজেরা খুঁড়ে নিতে। আমি ১লা থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর অবধি যুদ্ধ করি। এক হাজার গজ দূরে পাকিস্তানিরা ২০ ইঞ্চি পুরু দেয়াল তৈরি করেছিল। হাতের বামদিকে মিত্রবাহিনী। ডানে ইলেভেন্থ বেঙ্গল। তিন প্লাটুন (৩x৩৭=১১১) বাঙালী সৈন্য। মিত্রবাহিনীর প্রচুর সৈন্য ছিল। ভারি কামান, রকেট লঞ্চার সবই ছিল আমাদের। এই যুদ্ধে আহত হয়ে আমি আগরতলা হাসপাতালে ভর্তি হই। এক সপ্তাহ ছিলাম সেখানে। পরে আখাউরা শহীদ স্মৃতি হাসপাতালেও থাকি কিছুদিন। আমার কী হয়েছিল? পুরো বাঙ্কার একপাশে বিধ্বস্ত হয়ে আমার পিঠের উপর পড়ে ও আমার মেরুদণ্ডের সন্ধিতন্তু ছিঁড়ে যায়। দেশ স্বাধীন হবার পর ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে’র প্রধান কল্যাণ কর্মকর্তা কাজি আনওয়ারুল করিম চিঠি দিয়ে আমাকে সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে উন্নততর চিকিৎসার জন্য পাঠালো। সোহরাওয়ার্দিতে আবার ড. ক্যাপ্টেন চৌধুরী আমাকে বিশ্রামাগারে রেফার করলেন। ১৯৭৮ সালের মে মাসে আমাকে হাঙ্গেরি পাঠানো হয়। তিন মাস আমি হাঙ্গেরি থাকি। সেখানেই আমাকে হুইল চেয়ার দেয়া হয়। এরশাদ তখন সেনাপ্রধান। হাঙ্গেরি থেকে ফিরে এসে অবধি হুইল চেয়ারেই চলাফেরা করছি এতগুলো বছর। আমার তিন মেয়ে। বিহারিদের পরিত্যক্ত এই বাড়িটির একটি অংশ হোটেল হিসেবে ভাড়া দিয়ে মাসে ১৩,০০০ টাকা পাই, আর একটি অংশ ডিসপেন্সারি হিসেবে ভাড়া দিয়ে ১৮,০০০ টাকা পাই। আহত মুক্তিযোদ্ধার ভাতা হিসেবেও মাসে কিছু টাকা পাই। এভাবেই চলছে।”

    ২১) মোসলেম উদ্দিন (বয়স: ৭৭),
    গ্রাম: কমলাপুর, ডাকঘর: কমলাপুর
    উপজেলা: কুষ্টিয়া সদর
    জেলা: কুষ্টিয়া।

    “যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ৩৯ বৎসর। তখনি ৪/৫টা সন্তান আমার। আমি ছিলাম স্থানীয় আনসারের থানা কমান্ডার। গোডাউনে চাকরি করতাম। ’৭১-এর ২৮শে মার্চ অস্ত্র নিয়ে পালাই। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম ও ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ডিআইজি দেলোয়ার হোসেন ছিলেন আমার একই গ্রামের মানুষ। ওনরাই আমার সাথে মুক্তিযুদ্ধ কী, মুক্তিযুদ্ধে কেন বাঙালী হিসেবে যোগদান করা আমাদের কর্তব্য… এসব বিষয়ে যোগাযোগ করেছিলেন। ওনরা ত’ ছিলেনই। সেইসাথে কুমারখালির কিবরিয়া সাহেব আর চুয়াডাঙ্গা ক্যান্টনমেন্টের মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, হাবিলদার আব্দুল হালিম… আমরা সবাই দলবদ্ধ হলাম। ৩১শে মার্চ রাত বারোটায় কুষ্টিয়া শহরে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা সবাই ফায়ারিং শুরু করি। শহরের জিলা স্কুলে প্রায় দুইশোর মত পাকিস্তানি সৈন্য ছিল। আমরা সেখানে আক্রমণ চালালাম। ওরাও পাল্টা উত্তর দিতে শুরু করলো। আমার সহকারী আব্দুল হামিদ এই ফায়ারিং-পাল্টা ফায়ারিংয়ে মারা গেল। পাঞ্জাবিরা হারলো। ভোর ছয়টা পর্যন্ত এমন ফায়ারিং চললো। পাঁচ/ছয়টা লাশ পড়েছিল। জিলা স্কুল ক্যাম্পে রাত ভোর হলে দুটো মেয়ের লাশ পাওয়া গেছিল। পাকিস্তানিরা বাবলাতলায় এসে ক্যাম্প তৈরি করে আমাদের সাথে যুদ্ধ করলো। পাকিস্তানিরা ওখানে নয় দিন ছিল। এই যুদ্ধেও আমরা জয়ী হলাম। এরপর হলো বংশীতলার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমাদের ৮০/৮৫ জন মারা গেছিলো। বংশীতলা যুদ্ধের পর পাইকারি হারে গ্রাম পোড়ানো শুরু হলো। বংশীতলা, শালঘরমধুয়া… আশ-পাশের সব গ্রাম পুড়তে লাগলো। ১৭ জন আনসার সহ পালায়ে আলাম। টাউন থেকে দুই কিলোমিটার ভিতরে। সেবার গুলি পায়ে লাগে বার হয়েছিল! এমন কত যুদ্ধ! কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলবো? দেশ স্বাধীনের পর চাকরি করতি করতি তাও ছাড়ে দিলাম। এখন প্রায়ই জ্বর আর বুকি ব্যথা থাকে।

    অক্টোবরে করিমপুর গেলাম। বালিয়াপাড়া থেকে খবর পেয়ে আসিচিল। পিরায় ১০০ পাকিস্তানি সৈন্য ছিল। আমরা ছিলাম ৫০ জন। দুই জন মারা পড়লো। বেনাপোল বর্ডার হয়ে ইন্ডিয়ান সোলজাররা আসেছিল। যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দিলাম কুষ্টিয়ার পুলিশ লাইনে। ১৯৭২-এর ১৫ই জানুয়ারি রক্ষী বাহিনীতে যোগ দিই। যুদ্ধের পর আমার আরো তিনটি সন্তান হয়েছে। পানিতে ডুবে এক মেয়ে মারা গেছে। ঢাকার পিলখানায় আমি ১৯৭২-’৭৫ সাল অবধি রক্ষীবাহিনীতে কাজ করেছি। আমি ছিলাম বাহিনীর ‘সি’ কম্পানিতে। যুদ্ধের সময় আমার প্রায় ৮-৯ বিঘা জমি ছিল। বর্তমানে মাত্র ৪-৫ বিঘা আছে। আমার এক ছেলে বর্তমানে মাছের ব্যবসা করে, এক ছেলে অপসোনিন কোম্পানির ড্রাইভার, এক ছেলে মিস্ত্রী। আমি মাসে ১৩৫০ টাকা ভাতা পাই।”

    ২২) মোহাম্মদ সবুর আলী সর্দার (বয়স: ৫৫)

    “যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৭ বছর। আমার দেশ হলো সাতক্ষীরার দেবহাটা থানার চিনিডাঙ্গা গ্রাম। পাকিস্তান আমলে অল্পবয়সী ছেলেরা মুজাহিদ ট্রেনিং নিতো। তিন মাসে দেড়শো টাকা করে পেতাম। পড়াশুনা মোটেই জানতাম না। যুদ্ধের পরে নাম সই করতি শিখিচি। কিন্তু, যুদ্ধ শুরু হলে ওদের সাথে না যেইয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলাম। মে মাসের মাঝামাঝি পাক আর্মি সাতক্ষীরায় এলো। য্যাকন যুদ্ধ শুরু হলো, তখন আমাকে ডেকেছিল। দেবহাটায় ইপিআর ক্যাম্পে বিহারী ছিল। আমরা পঁচিশ জন মুজাহিদ ট্রেনিং পাওয়া ছেলে বিহারী ইপিআরদের ধরে ভারতে চালান দিলাম। বাঙালী ইপিআর যশোর ক্যান্টনমেন্টে আসে। আমরা ক্যাম্প চৌকি দিতাম। খাদ্য সপ্তাহে খাইতাম। বেলাক (স্মাগলিং) করে পাবলিক যা পয়সা পাতো, আমাদের দেতো। মাছ, কচ্ছপ, দুধ, সব্জি আমাদের দেতো। খাতি খাতি ভারত থেকে আমাদের অস্তর দিল। তখন বেভেন্ন জায়গায় আমরা যুদ্ধ করতি চলে গেলাম। মে মাসের পর আমরা প্রায়ই তকিপুর, চব্বিশ পরগণা… বর্ডার ক্রস করতাম। দুই মাইল পারোতাম (পার হতাম)। নৌকায় পালায়ি থাকতাম। খাল দিয়া ব্রিজের এপারে যুদ্ধ করতি করতি আমরা এপাশে চলে আলাম। রাত ১০:০০ টার পর চলে আলাম। ক্যাম্পে আসলাম। ভোরে রেডিওতে বললো যে পাকিস্তানিরা চইলে গেছে। একটা গরু মাইন বিস্ফোরনে মারা গেছে। সাব-সেক্টর কমান্ডার শাহজাহান মাস্টার বললো, ‘মাইন অপসারণ করতে হবে। নয় অনেকেই মারা যাবে।’

    চার জন (আমি–সবুর আলী, আব্দুল সোবহান–মাগ্রি গ্রাম, মনসুর–খেজুরবাড়িয়া, আব্দুল ওয়াহাব–দেবহাটা) মাইন তোলা শুরু করলাম। আমি চেক করি, আব্দুল সোবহান বেয়নেট দিয়ে খুঁচায় তোলে, ওয়াহাব ইপিআর ক্যাম্পে রেখে আসে, মনসুর রেডি করে। ২০টা মাইন তোলা হয়ে গেছে। ২১ নম্বর মাইনটা তিন হাত দূরে। কোথাও সূতা, কোথাও তিনটা তারের মাথায় লাল ইঁটের খোওয়া আছে। সেই খোওয়া তুললি মাইনের মাথায় পড়লি আমি সবুর আলী আর আমার সাথি আব্দুল সোবহান সেন্সলেস হয়ে যাই। ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। মনসুর আলী আমাদের ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। ভারতে সন্ধ্যার দিকে জ্ঞান ফেরে। খবর পেয়ে শুনি ওহাব মারা গেছে। ত’ আহত হবার পর ডান হাত আর একত্র মুঠো করতে পারি না। বারাকপুর হাসপাতালে ভর্তি হইছিলাম। ডান হাতে, বাম ঘাড়ে ও গর্দানে শেলিংয়ের টুকরো ও বাম পাশে শেলিং লাগে। ভারতে রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতাম। পালায় আসলাম। ওখান থেকে এইসে দেখি কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ভাই ও সাব-সেক্টর কমান্ডার মিলে কালিগঞ্জ বরাবর একটা বড় যুদ্ধে অংশ নিতে যাচ্ছে। আমি সাব-সেক্টর কমান্ডারকে বললাম, ‘আমি যাব।’

    উনি বললেন, ‘তোমার হাত খারাপ।’

    ‘একটা এসএমজি দেন।’

    কিছু খাওয়া দাওয়া করে, রেস্ট নিয়ে যুদ্ধে রওনা হলাম। যেই আমরা নৌকায় ওটপো, সেই ‘জয় বাংলা’ বলতি বলটি একটা খান সেনার লাশ নিয়ি লেফটেন্যান্ট বেগ কালিগঞ্জ থেকে ইন্ডিয়া চলে আসলো। আমাদের আর যুদ্ধে যেতে হলো না। ক্যাম্পে এইসে নিজের মা’র সাথে দেখা করলাম। আবার একটা যুদ্ধে যাই। মেজর এম, এ, জলিল নবম সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বললেন, ‘পারুলিয়া ব্রিজের দু’পাশে খান সেনা। উড়ানো যায় কিনা? ঐ ব্রিজটা কি ভাঙ্গা যাবে?’

    আমি বললাম, ‘যাবে।’

    ‘কীভাবে ভাঙ্গবা?’

    বুঝায় বললাম। আমি আসলে ব্রিজ ওড়ানো, বাড়ি ওড়ানোর মত কাজই যুদ্ধে বেশি করেছি। আমরা ২৫ জনই ব্রিজ ওড়ানোর জন্য মাল-পত্তর, বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ে রওনা হলাম। রওনা হলি কালিগঞ্জ থেকে লেফটেন্যান্ট বেগ আমাদের ক্যাম্পে এসে বললো, ‘ওরা কোথায় যাচ্ছে?’

    ‘পারুলিয়ায় ব্রিজ ওড়াতে যাচ্ছি।’

    ‘আমরাও যাব।’

    এবার ওনাদের নিয়ি আমরা পারুলিয়ায় ব্রিজ ওড়াতে আসি। জুনির শেষ হবে খুব সম্ভাব। কি জুলাই মাসের পরতম ভাগ। ব্রিজির দুই পাশে খান সেনা বাঙ্কার করিয়া, এলএমজি ও মেশিন গান পাতিয়া বসি আছে। ২০ জনের মতো খান সেনা ও ২০ জনের মতো রাজাকার। এবার আমি ও লেফটেন্যান্ট বেগ আরো সাতজন ছেলেকে নিইয়ি খেজুরবাগে নদীতি মাঝখানে নামলাম। নদীতে নেমে সাঁতার দিইয়ি, মাঝখানের খুঁটি (পিলার) দিয়ি ব্রিজি উঠি এক্সপ্লোসিভস্ ফিট করি। লেফটেন্যান্ট বেগ নিজের হাতে ফিট করে। আমি দেখায় দিই। যখন চলি আসলাম আমাদের খেজুরবাগ গ্রামের নিকটে, তখন পুবদিকির ব্রিজির গার্ডার গেল। গেলি আমরা রাজাকার পিরায় কুড়ি জন ছিল ব্রিজির পর… মারা যায়। লেফটেন্যান্ট বেগের এলএমজির একটি গুলি ভরা মাগাজিন রেখে আসে। খুঁজি আর পাওয়া যায় নাই। আমি গাইডার (গাইড) হিসাবে চললাম। খুলনার শিরামণিতে শেষ যুদ্ধ। ডিসেম্বর মাসের কথা। নৌকায় করে পুঁটিমারী থেকে ব্যাংদা আসি (সাতক্ষীরা থানা)। ওখানে রাজাকারদের সাথে কিছু যুদ্ধ হলো। রাজাকার কিছু পলায় যায়। ওরা ছিল ৩০০/৩৫০ মতো। আমরা ছিলাম দুইশো/ সওয়া দুইশো মতো। একশোর মতো রাজাকার যাচ্ছে। আমরা ৩০/৪০ জন হাতিয়ার হাতে জঙ্গলে কি নদীতে রাজাকার আর খান সেনাদের ঘিরে ধরতাম। ও মাথায় দশজন ঘেরি ধরবে, এ মাথায় আরো দশজন… এই ভাবে।

    তা’ ডিসেম্বর মাসে ঈদির দিন। গল্লাবাড়িতে পাক সেনা ও ভারতীয় সেনার বিশাল যুদ্ধ হয়। তিন দিন যুদ্ধ হয়। মাংসের গন্ধে, মানুষ মরার গন্ধে চারপাশ একাকার। পেলেন থেকে বোমা পড়তিচে। সুন্দরবন কলেজ যেন ভূতের বাড়ি। সেখানে রাত কাটাতাম। সাতক্ষীরায় মিলিশিয়া ক্যাম্পে ওসমানীর সার্টিফিকেট নিয়ি বাড়ি ফিরলাম। মিথ্যি কথা বলতি কি? দুই ছেইলি আর চার মেইয়ে নিয়ে এই শরীরে আমি ত’ কাম করে খাওয়াতে পারি নাই। আমার বউ পরের বাড়ি কাজ করেছে। নাইট গার্ডের চাকরির চেষ্টা করিচি। ডান হাতির জন্য হয় নাই। দুই বিঘা জমি বিক্রি করে ষোলশ’ টাকা পেলাম। খুব কম-সম খেইয়ি চলে। বড় ছেলে জাল টানে। ছোট ছেলে ফাইভে পড়ছে। মেয়ে তিনটা বিয়ে হইয়েছে। স্বামীরা নেয় না। তিন মেয়ে বাড়িতে আছে। বর্তমানে আমার কুড়ি পার্সেন্ট ডিসএ্যাবিলিটি। আগে ৩০% ছিল। মাসে ৫,০০০ টাকা ভাতা পাই।”

    http://arts.bdnews24.com/?p=3561
  • Biplob Rahman | ০১ জানুয়ারি ২০১৪ ১৭:৩৩582689
  • International War Crimes Tribunal: A performance review
    Mozammel H. Khan

    It was January 29, 2009, in the maiden sitting of the 9th Parliament, albeit in the absence of the main opposition BNP, a resolution was passed calling on the government to ensure immediate trial of the war criminals. Planning Minister A.K. Khandaker, who was the deputy chief of staff of the Liberation Forces, and currently the president of the Sector Commanders Forum, which has been spearheading the nation-wide campaign to try the war criminals, thanked parliament for adopting the resolution. In his words: "People will sleep in peace tonight. For many, it's the beginning of the end of the torment they have been enduring for 38 long years." The prime minister, echoing the sentiment of the house declared: "Trial of the war criminals is now a demand of the nation”.
    From the very inception, the main opposition BNP was trying to confuse the people by making a differentiation between crime against humanity and war crimes. As set out in the Statute of International Criminal Court (ICC) signed in Rome in 2002: "Crimes against humanity include crimes such as the extermination of civilians, enslavement, torture, rape, forced pregnancy, persecution on political, racial, national, ethnic, cultural, religious or gender grounds, and enforced disappearances -- but only when they are part of a widespread or systematic attack directed against a civilian population." Crimes against humanity are only distinguishable from war crimes in that they not only apply in the context of war -- they apply in times of war and peace. In the context of the trial in question, this refers to crimes committed during the 1971 Liberation War.
    To maintain international standard and to meet the requirements of the Rome Statute, the Bangladesh cabinet, upon recommendation of the law commission, approved the International Crimes Tribunal (Amendment) 2009 on July 6, 2009, aiming to try those involved in acts against humanity during the 1971 Liberation War. It was further amended on February 17, 2013 in the wake of the verdict against Quader Mollah. The amendments provided that a political party that had worked against the liberation of Bangladesh could be tried on the same charges as individuals. It also empowered the government, informants and complainants to appeal against any verdict of the war crimes tribunals with the Appellate Division, the right until then was given only to the defendants.
    The tribunals adopted numerous practices that uphold all possible rights of the accused. The accused are given adequate time and facilities to prepare their cases. Prosecutors must furnish them a list of witnesses along with the copies of recorded statements and documents upon which they intend to rely. Defendants also have an unfettered right to call witnesses and to cross examine prosecution witnesses. All of this is in keeping with the International Covenant on Civil and Political Rights, which is the global standard for civil and political rights.
    A press release from ICC in Hague on March 24, 2010 said, "Bangladesh has become the first South Asian country to ratify the pact that established the International Criminal Court (ICC) and gave it a mandate for trying people accused of genocide, crimes against humanity and war crimes”. ICC President, Judge Sang-Hyun Song, noted that “By ratifying the Rome Statute, Bangladesh will become the first State Party in South Asia. I applaud its decision to join the growing commitment of states to end impunity for war crimes, crimes against humanity and genocide. Bangladesh's upcoming 1971 war crimes trials will be held under its recently amended International Crimes (Tribunals) Act 1973”.
    The International Bar Association stated that, "1973 Legislation, together with the 2009 amending text, provides a system which is broadly compatible with current international standards”. Human Rights Watch (HRW), which initially supported the establishment of the tribunal, has criticised it on issues of fairness and transparency, as well as reported harassment of lawyers and witnesses representing the accused. Since then HRW has been a bitter critic of the ICT and trial process, citing, in most cases, unfounded and unsubstantiated reasons. Quite contrary to the HRW's apprehensions of “harassment of lawyers and witnesses representing the accused”, it was the prosecution witnesses who fell victim to the vengeance of supporters of the accused and convicts.
    With the overwhelming mandate to try the war criminals, the government of the day started the trials in March 2010. The judges who are presiding over the trials in two tribunals were either serving justices of High Court or were given the appointment equivalent to the judges of the highest court of the land. At this time, trials of ten perpetrators, three of them in ICT-1 and seven in ICT-2 have been completed, while a few others are in the dock. None of them are strangers to us, rather, are nationally known as direct abettors of the gruesome crimes ever committed against us as a people. Trials were conducted in presence of their duly appointed lawyers and the media, both local and international. So far only one convict has been executed after the appellate division of the Supreme Court turned down his review petition and his intention not to ask for the mercy of the President of the Republic.
    Many of the critics of the ICT and its proceedings tried to create a smokescreen by portraying the executed convict as a victim of mistaken identity, who, in their words, had no part in the crimes committed against our people. However, this has been cleared by a resolution of the Pakistani parliament where it was reiterated, “Mollah had been hanged for supporting Pakistan in 1971 till the very end before the creation of Bangladesh”.
    LUBP, a leading political website of Pakistan had the following to say in its editorial vis-à-vis the resolution in the Pakistani parliament: “On 13 December 2013, Abdul Quader Molla, a top leader of Jamaat-e-Islami was hanged for raping Bengali women and mass killing Bengali men and children. The unspeakable horror Abdul Quader Molla wreaked on his innocent victims was that they wanted to live as free human beings in their own homeland. But Abdul Quader Molla wanted them to continue to be slaves of the corrupt generals of then West Pakistan. Led by Pakistan's pro-Taliban Interior Minister Choudhury Nisar Khan, the Takfiri-Deobandis not only condemned the hanging, but also justified the rape of thousands of Bengali women and mass killing of Bengali men, women and children”.
    From the inception of the trials, the odds have been high. It was a daunting task for the prosecutors to collect evidences and witnesses for the horrendous crimes that were committed some 42 years ago. During the greater part of that period the parties and people those who were in state power were neither in favour of the trials nor contemplated that the trials would ever take place. In many cases, the documentary evidences pertaining to the crimes were systematically destroyed. Also many of the direct witnesses of the crimes that happened 42 years ago have passed away. In the face of the killings of several witnesses by the supporters of the convicts, it was risky for the witnesses to come forward to testify. The risk was more frightening for the fact that the main opposition party is not only opposed to the trial but has issued threat such as, “if voted to power BNP would try those involved in the war crimes trials”.
    Except for Bangladesh, nowhere in history the defeated force that was responsible for committing genocide is allowed to function as a legal political party. Prior to Nuremberg trials, the Nazi Party of the Third Reich was banned once and for all. Likewise in recent times (1996-2012), during the trials for genocide of ethnic Tutsis by the ethnic Hutus in Rwanda, Akazu, the party of the Hutu extremists, became a non-existent entity after they were defeated by Rwandan Patriotic Front that took control of the country.
    Main criticisms of the ICT are emanating from a London-based weekly, The Economist, which seems to a have fallen prey to the huge financial coffer of the Jamaat-e-Islami. There are various reports elucidating various estimates as to how much Jamaati coffers have spilled to the western side of the Atlantic. A recent editorial in the NY Times made exactly identical assertions as being done in the Economist almost every other week.
    An uncalled for observation by the Chairman of a US House Committee, casting aspersion on the integrity of the trial process, reflected his ignorance of the plight of our people in 1971. By the same token, recent telephone calls by US Secretary of State John Kerry and UN Secretary General to Bangladesh PM, reportedly asking to halt Quader Mollah's execution, reflected a flagrant disregard for the absolutely transparent judicial process of a sovereign state, unlike what has been happening in the so-called trials in Guantanamo.
    It was surprising that this kind of request came from a distinguished former US Senator, that too from the State of the Kennedys, the political idols of many our freedom fighters, who must be aware that it was Pakistan's pro-Taliban Interior Minister Choudhury Nisar Khan who piloted the resolution of condemnation in Pakistan parliament and it was the Pakistani Taliban who issued threat to blast the Bangladesh Embassy in Islamabad following the execution of the first convict in the much-awaited trial, which the people of Bangladesh do not consider as reprisal or retribution, but a simple but long-overdue justice.

    The writer is the Convener, Canadian Committee for Human Rights and Democracy in Bangladesh.

    Published: 12:01 am Wednesday, January 01, 2014
    http://www.thedailystar.net/new-year-special-2014/international-war-crimes-tribunal-a-performance-review-4679
  • PM | 181.4.66.204 | ১৪ জানুয়ারি ২০১৪ ০৯:০৬582691
  • Anthony Mascarenhas এর লেখা আরেকবার পড়লাম। শিরদারা দিয়ে আবার হিম স্রোত বয়ে গেলো আবার। ইনি-ই বোধ হয় বাংলাদেশ জেনোসাইড এর প্রথম হুইসল ব্লোয়ার। মজার কথা হলো, পাকিস্তান আর্মি-ই ওঁকে পুর্ব-পাকিস্তানে আমন্ত্রন করে আরো অনেক পঃ পাকিস্থানী সাংবাদিকের সাথে। অবস্থা সরোজমিনে দেখার জন্য। ভদ্রলোক পাকিস্তানি সাংবাদিক, করাচির একটা কাগজের সহকারী এডিটর। তারপরে যা হলো তা ইতিহাস। ১৩ই জুন ১৯৭১, সানডে টাইমস এ দু পাতা জুড়ে তাঁর রিপোর্টিং বেরোলো। এই একটা লেখাই পাকিস্থানী প্রপাগান্ডা মেসিনকে ধুলিস্বাত করে দিয়েছিলো। পশ্চিমী মানুষ পাকিস্তানী প্রপাগন্ডার বাইরে গিয়ে প্রথম দেখলো কি হচ্ছে বাংলাদেশে। এইটাই হলো পশ্চিমী জনমত তৈরীর প্রথম ধাপ। যাঁরা আগে পড়েননি তাঁরা পড়ে নিন-

    পার্ট-১

    http://archive.thedailystar.net/beta2/news/genocide/

    পার্ট-২

    http://archive.thedailystar.net/beta2/news/genocide-2/
  • Biplob Rahman | ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ১৩:৫২582692
  • # পিটি, # পিএম,

    গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনের জন্য অনেক ধন্যবাদ। চলুক।
  • Biplob Rahman | ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ১৩:৫৩582693
  • বাঙলাদেশের কথা --হুমায়ূন আজাদ

    ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করো না; আমি তা মূহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।
    তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
    জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি,
    অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমন্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,
    মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন
    ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না; আমি
    তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, – তার অনেক কারণ রয়েছে ।
    তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।

    https://www.facebook.com/humayun.azad.2009/posts/10152744328390694?stream_ref=10
  • Biplob Rahman | ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ১৩:৫৪582694
  • আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম
    লেখকঃ হুমায়ুন আজাদ

    ২৫-এ মার্চের পর সব বাঙালিরই, নিজেদের জীবন নিয়ে নিরন্তর ভয়ের মধ্যেও, পরস্পরের কাছে সবচেয়ে বড়ো ও আবেগকাতর প্রশ্নটি ছিলো, ‘মুজিব কোথায়? তিনি কি বেঁচে আছেন?’ তাদের মনে হতো মুজিব বেঁচে থাকলে তারাও বেঁচে থাকবে, মুক্তির বাসনা বেঁচে থাকবে। ২৮-এ মার্চে যখন প্রথম উদ্বেলিত উত্তেজিত কম্পিত স্বরে মেজর জিয়ার ঘোষণাপাঠ শুনলাম, তখনই জেনে আলোড়িত হলাম যে মুজিব বেঁচে আছেন; এটা এক মহাস্বস্তি ও প্রেরণা নিয়ে এসেছিলো; তখন বুঝতে পারলাম মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

    ২৬-এ মার্চের দুপুরে আকাশবাণী বাঙলা ও ইংরেজীতে বারবার ঘোষণা করছিলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে, সিভিল ওয়ার হ্যাজ ব্রোকেন আউট ইন ইস্ট পাকিস্তান’, তাতে ভয় পেয়েছিলাম, কেননা গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না, এবং ভয়াবহ ধারণা ছিলো, কিন্তু ২৮-এ মার্চে তা পরিণত হয় মুক্তিযুদ্ধে।

    ওই ঘোষণায় বাঙলা ও ইংরেজীতে, কম্পিত ও আবেগস্পন্দিত কণ্ঠে স্পষ্ট করে বলা হয়, যদিও খুবই অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো, যে মুজিব জীবিত আছেন, তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুজিবের পক্ষে ঘোষণা পাঠ করছেন একজন মেজর, যাঁর নাম মেজর জিয়া।

    কে মেজর জিয়া? তাঁর নাম তো কখনো শুনি নি।

    একটি ঘোষণাপাঠের ফলে, তাঁর কাঁপাকাঁপা কণ্ঠের আবেগ, মুহূর্তেই তিনি এক নতুন নায়ক হিশেবে দেখা দেন। অনেক সময় হঠাৎ কেউ কেউ অসাধারণ হয়ে ওঠেন, এজন্যে লাগে সুযোগ ও আকস্মিকতা। কেউ হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বা আইনস্টাইন হয়ে উঠতে পারেন না, কিন্তু কেউ কেউ হঠাৎ মেজর জিয়া হয়ে উঠে সারা দেশকে আলোড়িত করতে পারেন। এটা হঠাৎ আকাশে মহাগোলমাল থেকে উদ্ভুত নক্ষত্রের মতো। কিংবদন্তি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে মুহূর্তেই, আকস্মিকভাবে, ঐতিহাসিক সুযোগে; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বা আইনস্টাইন হওয়ার জন্য লাগে দীর্ঘ সাধনা।

    ওই কাঁপাকাঁপা, অনভ্যস্ত, স্খলিত বাঙলা ও ইংরেজি ঘোষণাটির আগে আমরা কি কেউ জানতাম কে মেজর জিয়া? তাঁর কণ্ঠস্বর ও ঘোষণা আমাদের সঞ্জীবিত করেছিলো, কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিলো আমাদের? কোনো ধারণা ছিলো না, কিন্তু মুহুর্তেই ধারণা হয়ে যায়, আমরা কল্পনায় একজন অদম্য তরুণ মেজর ও যোদ্ধাকে দেখতে পাই। তিনি যদি বলতেন, ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বলছি’, তাহলেও তিনি এতোটা দাগ কাটতে পারতেন না, আমরা হয়তো একজন ক্লান্ত বুড়ো মেজরের কথা ভাবতাম, যে পদোন্নতি পায় নি, দেহে শিথিল হয়ে গেছে, কেননা ওইটিই বাঙালিদের জন্য স্বাভাবিক ছিলো পাকিস্তানে; মেজর ও জিয়া, এ-দুটি শব্দের সমাবেশ খুবই উদ্দীপক ছিলো।

    তবে এটি ছিলো এক ঐতিহাসিক আকস্মিকতা ও সুযোগ, যাতে একজন সাধারণ মেজর অসাধারণ যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন, সারা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি অপরিহার্য ছিলেন না, কালুরঘাটের বেতারযন্ত্রীরা যদি অন্য কোনো মেজরকে পেতেন, তাকে দিয়ে ঘোষণা করাতেন, তাহলে তিনিই হয়ে উঠতেন কিংবদন্তি।

    https://www.facebook.com/humayun.azad.2009/posts/10153717390840694?stream_ref=10
  • Biplob Rahman | ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ১৩:৫৮582695
  • " মুজিবের দুর্ভাগ্য তিনি বাঙলাদেশের স্থপতি হলেও ওয়াশিংটন বা গান্ধী বা জিন্নার মর্যাদা তিবি পাননি। এর জন্যে দায়ী তাঁর সুবিধাবাদী পুজোরিরা ও ঈর্ষাকাতররা; পুজোরিরা মুজিবকে বিধাতা করে তুলতে গিয়ে তাঁকে সামান্য মানুষে পরিণত করে,ঈর্ষাকাতররা তাঁকে হাস্যকর উপদেবতায় পরিণত করার চেষ্টা করতে থাকে।

    তাঁর স্তাবকের, পুজোরির, সংখ্যা হয়ে উঠেছিলো নক্ষত্রপুঞ্জের সমান।

    পুজোরিরা তাঁকে জাতির জনক উপাধি দেয়ার জন্যে মেতে ওঠে।

    ‘জাতির জনক’ ধারণাটিই অনেকের কাছে ছিলো আপত্তিকর; ‘পিতা’, ‘জনক’ ধারনাগুলো তখন আগের মতো আকর্ষণীয় ছিলো না। পিতা? জনক? খুবই সামন্তবাদই ধারণা- কবিরা যখন লিখছিলেন, ‘পিতৃহত্যার নান্দীপাঠে ফাল্গুন ফুরোয়’, তখন ‘জাতির পিতা’ হওয়ার বাসনা খুব উল্লাসের ব্যাপার ছিলো না।

    স্থপতি বা স্রষ্টা? বেশ, কিন্তু পিতা-খুব সুখকর নয়।

    পাকিস্তানে ‘কায়েদে আজম’ দেখে দেখে আমরা খুবই বিরক্ত ছিলাম। পুজোরিরা তাঁকে ঐশ্বরিক করে তুলতে চায়, ‘জাতির জনক’ করতে চায়, যা নিয়ে মাতামাতি দরকার ছিলো না, একদিন সহজেই তিনি এ-মর্যাদা পেতেন। সুবিধাবাদী পুজোরিরা তাঁর নামে সৃষ্টি করতে থাকে নানা মতবাদ, দর্শন, যার মধ্যে সবচেয়ে উপহাসের বিষয় হয়ে উঠেছিলো ‘মুজিববাদ’।

    সাধারন মানুষ হয়তো বোকা, কিছুই বোঝে না, তারা শুধু মিছিল করতে পারে; কিন্তু রাজনীতিবিদদের নামে প্রচারিত মতবাদকে তারা হাস্যকর ও ক্ষমতার অপব্যবহার বলেই মনে করে; আর চতুর যারা, তারা তা উৎপাদন করে হিংস্রভাবে প্রচার করে।

    পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ্গুলো জ্ঞানীদের প্রগাঢ় জ্ঞানচর্চা ও তাত্বিক কাঠামো রচনার পরিণতি; আর ক্ষমতাসীন নেতাদের নামে প্রচারিত মতবাদ্গুলো হাস্যকর,তুচ্ছ,জনগণের ওপর পীড়ন। ওগুলো সাধারণত তাঁরা নিজেরা তৈরি করেন না, করে তাঁদের নিম্নমানের স্তাবক বুদ্ধিজীবীরা। পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ‘গরু’ সম্পর্কে একটি শুদ্ধ ও ভালো রচনা লেখাও দুরূহ কাজ।"

    আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম
    লেখকঃ হুমায়ুন আজাদ

    https://www.facebook.com/humayun.azad.2009/posts/10153672173215694?stream_ref=10
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১১:৫৩582697
  • তথ্যপ্রযুক্তিতে বিপ্লব
    নওশাদ জামিল

    চলছে তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। অনেকের ভাবনা, প্রযুক্তির জগতে অবাধ বিচরণ করতে হলে চাই ইংরেজি ভাষায় ব্যাপক দখল। একসময় কথাটার শতভাগ যৌক্তিকতা থাকলেও আজ আর তা অকাট্য নয়। শতভাগ ইংরেজি না জানলেও বাংলা ভাষায়ই প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব।
    জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ তথ্যপ্রযুক্তিতে যেসব দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে সাফল্যের শীর্ষে অবস্থান করছে- সেসব দেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যবহার করছে মাতৃভাষাই। দীর্ঘদিন পর হলেও আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তিতে প্রতিদিনই বাড়ছে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার। বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন বাংলাতেই তথ্যপ্রযুক্তির নানা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে। কম্পিউটারে লেখালেখি থেকে শুরু করে ওয়েবসাইট নির্মাণ, ই-মেইল আদান-প্রদান, ব্লগিং, ব্যাংকিসহ নানা কাজ হচ্ছে মহান ভাষা আন্দোলনের ফসল আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাতেই।
    বাংলা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুকেও। ব্লগেও বাংলার জয়জয়কার। প্রবেশ ঘটেছে মোবাইল ফোনেও। বাংলাতেই আদান-প্রদান হচ্ছে বার্তা। এ ছাড়া মোবাইল হ্যান্ডসেটে বাংলা কি-প্যাড থাকা বাধ্যতামূলক হয়েছে। এর ফলে প্রযুক্তি ব্যবহার সহজ হয়েছে, দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা ভাষা। সব মিলিয়ে আধুনিক বিশ্বে ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে মাতৃভাষা বাংলা।
    ভাষাসৈনিক ও রবীন্দ্র গবেষক ড. আহমদ রফিক বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার যত ব্যবহার বাড়বে, আমরা ততই উপকৃত হব। মাতৃভাষা বাংলায় জ্ঞান অর্জন, সর্বক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন- এ দাবি আমাদের দীর্ঘ ৬০ বছরের। ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই আমরা সর্বক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারের দাবি জানিয়েছিলাম। এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার বাড়লে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহারও বাড়বে।’
    জানা যায়, অতীতে কম্পিউটারে বাংলা লেখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো। একটার সঙ্গে অন্যটার মিল ছিল সামান্যই। সর্বজনীন ইউনিকোড আবিষ্কারের ফলে এতে বাংলায় লেখা হচ্ছে। ফলে তথ্যপ্রযুক্তিতে বেড়েছে বাংলার বিবিধ ব্যবহার। এখন কম্পিউটারে বাংলা ভাষা লেখা যাচ্ছে নানাভাবেই। বিজয়, অভ্র, কিংবা অন্য কোনো কি-বোর্ড লে-আউট ব্যবহার করে বাংলায় লেখালেখি চলছে হরদম। ভাষা গবেষক, তাত্ত্বিক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার এই পদচারণকে বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করছেন।
    তথ্যপ্রযুক্তিসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধাগুলো গ্রহণ করে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া দেশগুলো প্রযুক্তিতে ব্যবহার করছে নিজ নিজ মাতৃভাষা। চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, সুইডেন, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে তথ্যপ্রযুক্তিতে মাতৃভাষার ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য এসেছে। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মানুষও তথ্যপ্রযুক্তিকে মাতৃভাষায় ব্যবহারের উপযোগী করে নিয়েছে।
    প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণার সময় তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছিলেন। আলোচিত সেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বা ‘ভিশন ২০২১’ নামে রূপকল্পও ঘোষণা করেছিলেন। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার আবারও ঘোষণা দিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তিতে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার। ইতিমধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে একটি ইউনিকোড ফন্ট তৈরির। সরকারি উদ্যোগে তৈরি বাংলা ইউনিকোড এই ফন্টের নাম ‘আমার বর্ণমালা’।

    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/02/01/47367#sthash.YlFG423G.dpuf
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১১:৫৬582698
  • সিয়েরা লিয়নের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি
    নওশাদ জামিল

    ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের বছরেই বহু দূরের এক দেশে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা অর্জন করে এক বিরল সম্মান। প্রায় অচেনা-অজানা সেই দেশ। বাংলাদেশের অনেক মানুষই হয়তো জানে না সেই দেশটির নামও। কিন্তু সে দেশের নাগরিকরা ঠিকই জানে বাংলাদেশকে এবং বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে। প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ সিয়েরা লিয়ন সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বাংলাকে। এ রকম বিরল স্বীকৃতি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য কম গৌরবের নয়।

    সিয়েরা লিয়ন সরকার ২০০২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর ফলে পশ্চিম আফ্রিকার এ দেশটিতে বাংলা ভাষার প্রচলন শুরু হয়। সেখানকার দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকার মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলছেন, ভাব বিনিময় করছেন। কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়েও পড়ানো হচ্ছে বাংলা ভাষা। জানা যায়, ইংরেজি ছাড়াও সেখানে আরো প্রায় ২০টি ভাষা প্রচলিত। এর মধ্যে বাংলাও একটি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার এ এক বিরল অর্জন। দেশটির সরকারি নাম সিয়েরা লিয়ন প্রজাতন্ত্র। ‘সিয়েরা লিয়ন’ নামটি এসেছে স্পেনীয় ভাষা থেকে। এ নামের অর্থ সিংহীর পর্বত। আয়তনে দেশটি বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেকের সমান অর্থাৎ ২৭ হাজার ৬৯৯ বর্গমাইল। আর জনসংখ্যা ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী মাত্র ৬১ লাখ ৯০ হাজার ২৮০।
    দূরের এ দেশটিতে বাংলা ভাষা প্রবেশের ইতিহাস অনেকটা রূপকথার মতো। গল্পের শুরু এক যুগ আগে। এ গল্পের নায়ক একজন নন, অনেকেই। তাঁরা প্রত্যেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য।

    যুদ্ধবিধ্বস্ত সিয়েরা লিয়নে ১৯৯৯ সালে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয় জাতিসংঘ। তখন বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ সিয়েরা লিয়নে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগ দেয়। বাংলাদেশ থেকে ৭৭৫ জন সেনাসদস্যের দলটি সিয়েরা লিয়নের দক্ষিণাঞ্চলে দায়িত্ব নেয়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ থেকে আরো সেনাসদস্য সিয়েরা লিয়ন যান এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার ৩০০ জন সেনা একত্রে সিয়েরা লিয়নে কর্মরত ছিলেন। এরপর আরো সেনাসদস্য যান সেখানে। সর্বমোট প্রায় ১২ হাজার সেনাসদস্য সিয়েরা লিয়নে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের সেনাদল তাঁদের নিয়মিত সামরিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি আরো অনেক উদ্যোগ নেয়। দেশটিতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনার জন্য বিবদমান বিভিন্ন জাতির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। তাঁদের মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

    ওই সময়েই ঘটতে থাকে ভাষার আদান-প্রদান। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সেনাসদস্যরা ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাও ব্যবহার করতে থাকেন। বাংলা ভাষার প্রতি ধীরে ধীরে আগ্রহ প্রকাশ করেন স্থানীয় লোকজন। তাঁরা বাংলা ভাষা বোঝার চেষ্টা করেন। পরে অনেকেই ভালোবেসে ফেলেন বাংলা ভাষা।

    ওই সময় বাংলাদেশি সেনারা বিভিন্ন স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন ও মেরামতের কাজ করেন। বিভিন্ন গ্রামে স্থানীয়দের বাংলা অক্ষরজ্ঞান দেন। সহজে রপ্তযোগ্য ভাষা হিসেবে, সেখানকার অনেক মানুষ বাংলায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। অনেকে তা আয়ত্ত করে অতি সহজে খুব স্বল্প সময়ে। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হতে থাকেন। স্থানীয়রা বিশেষত তরুণ-তরুণীরা বাংলায় কথা বলতে শিখে যান। বিভিন্ন সভায় স্থানীয়রা বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করেন। তখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয়দের বাঙালি নাচ ও গান পরিবেশন করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ সেনাদলের আন্তরিকতা ও পরিশ্রমের ফলে সিয়েরা লিয়নে বাংলা ভাষা একপর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। স্থানীয়রা কাজ চালানোর মতো বাংলা ভাষা শিখে যান। এর ফলে সিয়েরা লিয়নের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাব্বা বাংলা ভাষাকে দেশটির অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন।

    বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে সিয়েরা লিয়নের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কাব্বা ২০০৩ সালের ২১ অক্টোবর তিন দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরে আসেন। সে সময় বাংলাদেশ ও সিয়েরা লিয়নের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কথা হয়। এর পর প্রাথমিকভাবে দেশটির পুনর্গঠনে ও শিক্ষা বিস্তারে বাংলাদেশ কিছু উদ্যোগ নেয়। আশা করা যায়, বাংলাদেশ ও সিয়েরা লিয়নের মধ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধ হলে দেশটিতে বাংলা ভাষা প্রাধান্য বিস্তার করবে।
    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/02/02/47674#sthash.RV8pYyRf.dpuf
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১১:৫৮582699
  • বাংলার গৌরব ব্লগ, ব্লগাজিন ই-ম্যাগে
    বিপ্লব রহমান

    যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবিতে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ গণবিস্ফোরণের পর ‘ব্লগ’, ‘ফেসবুক’, মাইক্রো ব্লগ ‘টুইটার’ ইত্যাদি এখন খুব পরিচিত শব্দ। এর মধ্যে ‘ব্লগ’ কথাটিই সবচেয়ে এগিয়ে। মতান্তরে, সামাজিক গণযোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকও একটি বড় মাপের ব্লগ। আরব বসন্তের পর প্রজন্ম শাহবাগ আরেকবার বিশ্ববাসীকে জানান দিয়ে গেছে ব্লগের অন্তর্নিহিত শক্তি তথা প্রযুক্তির উৎকর্ষে বাংলা ব্লগের অমিত সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিক বর্ণ সংকেতায়ন বা ইউনিকোডে বাংলা ভাষা যুক্ত হওয়ার পর এই ভাষায় ওয়েবসাইট নির্মাণের পাশাপাশি এখন দ্রুত ভাষার গৌরব ছড়িয়ে পড়েছে ব্লগ, ব্লগাজিন ও ইলেকট্রনিক-ম্যাগাজিন বা ই-ম্যাগে।

    ব্লগ, ব্লগাজিন ও অনলাইনপত্রের সবচেয়ে বড় সুবিধা এই যে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই যখন তখন মোবাইল ফোন, নোট প্যাড, নোটবুক, ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটার টিপে এসব ওয়েবসাইটে লেখা পড়া যায়। এ জন্য দোকানে গিয়ে পত্র-পত্রিকা কেনার প্রয়োজন নেই। পাশাপাশি যে কেউই সেখানে লিখে ফেলতে পারে পছন্দসই লেখা। এ জন্য পেশাদার লেখক হওয়ারও প্রয়োজন নেই। প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে এসব মাধ্যমের আরেকটি বড় পার্থক্য হচ্ছে, বিকল্প এই গণযোগাযোগমাধ্যমগুলোতে কোনো লেখা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় লেখাটির নিচে মন্তব্যের ঘরে। সেখানেও চলে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, প্রশংসা, এমনকি নিন্দাও। আবার একটি লেখার বিতর্ক জন্ম দেয় আরো অনেক চিন্তাশীল লেখারও।

    খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘ওয়েবলগ’ কথাটি থেকে ‘ব্লগ’ কথাটির জন্ম। ১৯৯৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রথম এর সূচনা করেন জর্ন বার্গার নামের এক আমেরিকান। আদি ব্লগারদের তিনি একজন, প্রথম দিকের ব্লগ সাইটের উদ্যোক্তা তো বটেই। ১৯৯৯ সালের এপ্রিল-মে মাসের দিকে পিটার নামের একজন ‘ওয়েবলগ’কে আরো সহজ করে ‘উই ব্লগ’ কথাটি ব্যবহার করেন। সেখান থেকে জনপ্রিয়তা পায় ‘ব্লগ’ শব্দটি। শেষ পর্যন্ত এটিই হয়ে উঠেছে তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠস্বর, প্রথাবিরোধী মত প্রকাশের ফোরাম। বিশ্বব্যাপী নানা ভাষায় ছড়িয়ে পড়েছে স্বেচ্ছাশ্রমের এই আয়োজন।

    অন্যদের তুলনায় আমাদের দেশে ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়েছে মাত্র সেদিন। সেই তুলনায় বছর আটেকের পথ চলায় বাংলা ব্লগে ঘটেছে উল্লম্ফন। ‘বাঁধ ভাঙার আওয়াজ’ স্লোগান নিয়ে ২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রথম যাত্রা শুরু করে বাংলা ব্লগ সামহয়্যার ইনব্লগ ডটনেট। এটিই এখন বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় ব্লগ, এর নিবন্ধিত সদস্যসংখ্যা অর্ধসহস্রাধিক। এরপর তৈরি হয়েছে সচলায়তন ডটকম, আমারব্লগ ডটকম, নির্মাণব্লগ ডটকম, মুক্তমনা ডটকম, নাগরিকব্লগ ডটকম, উন্মোচন ডটনেট ইত্যাদি। প্রতিটি ব্লগ সাইটের রয়েছে নিজস্ব নীতিমালা ও মেজাজ। এসব নীতিমালা মেনে ব্লগাররা সেখানে লেখালেখি করে, বিনিময় করে নিজস্ব ভাবনা। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ব্লগাররা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পাশাপাশি সমবেত হয় একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসে। আবার দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন অথবা বন্যা, খরা, শীত উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে চাঁদা সংগ্রহ করে ব্লগাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবশেষ রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়ই ব্লগাররা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে তৈরি করেছে অনন্য উদাহরণ। এ ছাড়া বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, নিউজ পোর্টাল, উন্নয়ন সংস্থারও রয়েছে নিজস্ব ভাবধারার ব্লগ সাইট।

    বাংলা ব্লগের পাশাপাশি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাংলা ভাষায় অনলাইনপত্র বা ইলেকট্রনিক ম্যাগাজিন সংক্ষেপে ই-ম্যাগ বা অনলাইনপত্র। আবার একই সঙ্গে ব্লগ ও ই-ম্যাগের বৈশিষ্ট্য নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ব্লগাজিন। বিজ্ঞান, দর্শনসহ গুরুতর বিষয় নিয়ে প্রায় এক দশক আগে তৈরি হয় ই-ম্যাগ মুক্তমনা ডটকম। পাঠক সম্পৃক্ততা বাড়াতে বছর সাতেক আগে এই সাইটকে ব্লগে রূপান্তর করার পর এটি এখন পরিণত হয়েছে প্রধান সারির বাংলা ব্লগে। ওপার বাংলার এক দশকের পুরনো ই-ম্যাগ গুরুচণ্ডালী ডটকম গত বছর রূপান্তরিত হয়েছে ব্লগাজিনে। এ ছাড়া মেঘবার্তা ডটইনফো, মঙ্গলধ্বনি ডটনেট, সাপলুডু ডটনেট নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমান জনপ্রিয়। সাপলুডু ডটকমের সাইটে সৃজনশীল লেখালেখির পাশাপাশি রয়েছে ভিডিও ফুটেজ, অডিও সংগীত, ফটো ফিচার ইত্যাদি।

    ব্লগ, ব্লগাজিন ও ই-ম্যাগে বাংলা ভাষার প্রসার বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ইউনিভার্সিটি অফ আলাবামা অ্যাট বার্মিংহামের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রাগিব হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, গত কয়েক বছরে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে। ইন্টারনেটে বাংলা কন্টেন্ট, ওয়েবসাইট এসব এখন প্রচুর। বছর পাঁচেক আগে যেমন গুটিকয়েক সাইট আর উইকিপিডিয়া ছাড়া তেমন বাংলা কন্টেন্ট ছিল না, এখন চিত্রটা পাল্টে গেছে পুরাপুরি।

    ব্লগার রাগিব হাসান আরো বলেন, ‘খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বাংলা ব্লগ, ব্লগাজিন ও ই-ম্যাগ। আর মোবাইল ফোন, ফেসবুক, সর্বত্র বাংলায় সবাই আজ লেখেন, পড়েন, প্রকাশ করেন মনের আবেগ-অনুভূতি। শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে শিক্ষক ডটকম, খান একাডেমি বাংলার মতো সাইট এসে এই ভাষাতেই সারা বিশ্বের সব জ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। আশা করি, ভবিষ্যতের দিনগুলাতেও এভাবেই এগিয়ে যাবে আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা।’

    ওপার বাংলার ব্লগাজিন গুরুচণ্ডালী ডটকমের অন্যতম সম্পাদক ঈপ্সিতা পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গুরুচণ্ডালী আসলে একটি নিখিল বিশ্ব বাঙালিদের ইন্টারনেট ঠেক। আপনি এখানে বসে রান্নাবান্না বা অফিসের কাজের ফাঁকে বসে আড্ডাও দিতে পারেন, মতামত, তর্ক-বিতর্ক, এমনকি গান বা সিনেমার ফাইলের লিংকও আদান-প্রদান করতে পারেন। তার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে, বিভিন্ন সময়ে লেখা কলাম, প্রবন্ধ, ধারাবাহিক বা গল্প-কবিতাও পড়তে পারেন। এসবের মধ্যে কোনো কোনো লেখার লেখক আপনি নিজেও হতে পারেন।’

    তিনি বলেন, ‘গুরুচণ্ডালীতে আছে মুখ্যত দুই ধরনের বিভাগ। একটি মডারেটেড (ই-ম্যাগ), যেখানে বাছাই করা কিছু লেখা তুলে রাখা হয়। আরেকটি আনমডারেটেড (ব্লগ)। ওটি চলে সম্পূর্ণভাবে আপনার খেয়ালখুশিমতো। যা লিখবেন, তা-ই প্রকাশিত হবে মুহূর্তের মধ্যে।’

    ই-ম্যাগ সাপলুডু ডটকমের সম্পাদক মোল্লা সাগর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনলাইন এমন একটি শক্তিশালী মাধ্যম, যা ধীরে ধীরে অন্য সব মাধ্যমকে গিলে ফেলছে। এই ভাবনা থেকে স্বাধীন মতপ্রকাশের মাধ্যম সাপলুডু ডটকমে গত চার বছরে আমরা একে একে যুক্ত করেছি অডিও সংগীত, সাক্ষাৎকার, হাস্য কৌতুক, ভিডিও ফুটেজ, ফটো, ফটো ফিচার ইত্যাদি। ক্রমেই বাড়ছে এর পাঠক ও উৎকর্ষতা।’

    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/02/03/48076#sthash.a2rZoKiF.dpuf
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১১:৫৯582700
  • বায়ান্নর চেতনায় অধিকার আদায় আসামেও
    নওশাদ জামিল

    পটভূমি ভিন্ন। তবে দাবিটা ছিল এক ও অভিন্ন। বাংলার দামাল ছেলেরা মায়ের ভাষার জন্য শহীদ হয়েছেন, অধিকার আদায় করেছেন- বায়ান্নর সেই চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ঠিক ৯ বছর পর ভারতের আসাম প্রদেশের বরাক উপত্যকায় রচিত হয় আরেক গৌরবের ইতিহাস। বায়ান্নর মতো বাঙালির মায়ের ভাষার অধিকার অর্জনের এ ইতিহাসও রক্তভেজা।

    ১৯৬১ সালের ১৯ মে। মাতৃভাষা বাংলার অধিকার অর্জনে ‘জান দেব, জবান দেব না’ স্লোগানে ফেটে পড়েছিলেন আসামের বাঙালিরা। ভাষার অধিকার আদায়ের সেই আন্দোলনে ওই দিন আসামের শিলচর রেলস্টেশনে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন ১১ জন বাঙালি তরুণ-তরুণী। এর পরই দাবি মানতে বাধ্য হয় আসাম রাজ্য সরকার। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আজ আসামের দ্বিতীয় রাজ্যভাষা বাংলা। পাশাপাশি আসামের বরাক উপত্যকার প্রধান সরকারি ভাষাও বাংলা। আর সেই দিনটিকে স্মরণ করে গোটা ভারতে ১৯ মে পালিত হয় ‘জাতীয় মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে।

    আসামের গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ও লেখক-গবেষক সুশান্ত কর দীর্ঘদিন ধরে আসামের ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় এ প্রতিবেদকের। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল আসামের বাঙালিদের। মূলত বায়ান্নর চেতনা ধরেই আসামেও বাংলার অধিকার অর্জন হয়েছে। গোটা বাঙালি জাতির জন্য এ এক গৌরবান্বিত ইতিহাস।’ সুশান্ত কর বলেন, ‘শিলচরের যে রেলস্টেশনে ১১ বাঙালি আত্মদান করেন, ইতিমধ্যে সেই মহান শহীদদের প্রতি প্রদ্ধা জানিয়ে ওই রেলস্টেশনের নাম ভাষাশহীদ স্টেশন করেছে ভারত সরকার।’

    ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’-এর অন্তর্ভুক্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে মূলত বহুভাষী জনগোষ্ঠীর বসবাস। প্রধান সরকারি ভাষা অসমিয়া। অন্যান্য ভাষার তুলনায় অসমিয়া জনগোষ্ঠী ছিল সংখ্যালঘু। তার পরও ওই ভাষাকেই করা হয় রাজ্যভাষা। ১৯৬০ সালে আসাম রাজ্য সরকার ‘আসাম রাজ্যভাষা আইন ১৯৬০’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করে। এতে তৎকালীন কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করার প্রস্তাব করেন। এতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় অন্যান্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীও। আসামের বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ, কাছাড়, হাইলাকান্দি, শিলচর ইত্যাদি এলাকা মূলত বাঙালি অধ্যুষিত। সেখানে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠে দুর্বার আন্দোলন। চলতে থাকে ছাত্র ধর্মঘট, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান বর্জন, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, করিমগঞ্জে সর্বদলীয় প্রতিবাদ দিবস ও হরতাল কর্মসূচি।
    ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯৬১ সালের ১৯ মে সর্বত্র বন্ধ্ ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রশাসনকে অচল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আন্দোলনকারী বাঙালিরা। ১৯ মে সকাল থেকেই ‘জান দেব, জবান দেব না’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ে গোটা বাঙালি সমাজ। এতে গোটা উপত্যকায় ভেঙে পড়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। হাজার হাজার বাঙালি জড়ো হতে থাকে শিলচর রেলস্টেশনে। দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে শিলচর রেলস্টেশনে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কোনো ধরনের প্ররোচনা ছাড়াই গুলি চালায় ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনী বিএসএফ। এতে ঘটনাস্থলে ৯ জনসহ শহীদ হন ১১ জন। তাঁরা হচ্ছেন কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ, কানাইলাল নিয়োগী, হীতেশ বিশ্বাস, সুনীল সরকার, কুমুদ দাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, বীরেন্দ্র সূত্রধর ও সত্যেন্দ্র দেব।

    জানা যায়, শহীদদের সবারই বয়স ছিল ২৫ বছরের মধ্যে। এ ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শিলচরে বিশাল শোক মিছিল বের হয়। তার পরই ১১ শহীদের শেষকৃত্য হয় শিলচর শ্মশানে। আজও সেই শ্মশানে এ ১১ শহীদের স্মরণে ১১টি স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। শুধু তা-ই নয়, শিলচর স্টেশনের সামনে যেখানে এ হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, সেখানে গড়ে উঠেছে স্মৃতিস্তম্ভ- ১১ শহীদের নামে ১১টি স্তম্ভ। আর শিলচর শহরের গান্ধীবাগে তাঁদের স্মরণে গড়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়েও গড়ে উঠেছে শহীদ স্তম্ভ।

    প্রতিবছরের ১৯ মে আসামের বরাক উপত্যকায় নানামাত্রিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার অধিকার দাবিতে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিতেও ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্থানীয় শহীদ মিনারগুলোতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়।
    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/02/04/48421#sthash.gXSZ7Uet.dpuf
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:০২582701
  • ই-বুকে স্বচ্ছন্দ পথচলা
    বিপ্লব রহমান

    ছাপাখানা আবিষ্কার হয়েছিল ৬০০ বছর আগে। সেই থেকে বইয়ের দাপুটে পথচলা। এরই ধারাবাহিকতায় বইয়ের জগতে বড় বিপ্লবটি ঘটিয়েছে ইলেকট্রনিক-বই বা ই-বুক। তবে তা গতানুগতিক মলাট বাঁধাই নয়। অনলাইনে পাঠক তার কাক্সিক্ষত বইটি সহজেই পড়ে নিতে পারে কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রেখে। ডাউনলোড করে প্রিন্টও নিতে পারে। এ জন্য দোকানে গিয়ে বই কেনার বা গ্রন্থাগারে গিয়ে বই ধার করার ঝক্কি-ঝামেলা নেই। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় কম্পিউটারে ই-বুক পড়া যেমন যায়, তেমনি ই-বুক পড়ার জন্য রয়েছে আলাদা ই-বুক রিডার। গত কয়েক বছরে স্মার্ট ফোন থেকেও সহজলভ্য হয়েছে ই-বুক পাঠ। মোবাইল ফোনেই আজকাল কয়েক হাজার ই-বুক রাখা যায়।

    বছর দশেক ধরে অন্যান্য ভাষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা ভাষাতেও তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ই-বুক। বিনা মূল্যে ই-বুক পাঠের সুবিধার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সাইটে বাংলা ভাষার ই-বুক অনলাইনে বিক্রিও হচ্ছে। ই-বুকের কল্যাণে ক্রমেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা ভাষাভাষীর পাঠচর্চা। বাংলা পেয়েছে নতুন মাত্রা। বাংলাদেশ সরকার স্কুল-কলেজের প্রায় সব পাঠ্য বইকে ই-বুক আকারে প্রকাশ করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে এসব বইপত্র বিনা মূল্যে ডাউনলোড করা যায়। সে সুবাদে শিক্ষার্থীরা আজকাল কম্পিউটার, ল্যাপটপ এমনকি মোবাইল ফোনেই তাদের পাঠ্য বই পড়তে পারছে। এটা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী অগ্রগতি।

    ওয়াকিবহালরা বলছেন, ই-বুকের কল্যাণে ভাষা যেমন পেয়েছে গতিশীলতা, তেমনি এতে বইয়ের প্রকাশনা খরচও কমে গেছে। পাশাপাশি সর্বত্র বইয়ের বিস্তার ঘটানোর সুযোগ বেড়েছে অভাবনীয়ভাবে। একেকটি ই-বুক রিডারে হাজার হাজার বই ডাউনলোড করে রেখে পড়া যায় বলে কাগুজে বই সংরক্ষণের জন্য বিশাল পাঠকক্ষ বা শত শত বইয়ের আলমারি আর প্রয়োজন নেই। ধারণা করা হচ্ছে, ই-বুকের দ্রুত অগ্রযাত্রার কল্যাণে আগামী কয়েক শতাব্দীতে ‘বইয়ের বোঝা’ কথাটি ধীরে ধীরে চলে যাবে জাদুঘরে। বেশির ভাগ ই-বুক পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফরমেট বা পিডিএফ আকারে তৈরি হয় বলে তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান রাখে, এমন যে কেউই তৈরি করতে পারে নিজস্ব ই-বুক। পরে এটি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে সংযুক্ত করে পাঠকের কাছে তা জানান দেওয়ার অপেক্ষা। অনলাইন বিজ্ঞাপনের ফলে ই-বুকের ক্রেতা ও পাঠক দুই-ই বেড়ে চলেছে দ্রুতগতিতে।

    খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলা ই-বুক প্রথম দিকে তৈরি হয় স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত বিভিন্ন ব্লগ সাইটে। ব্লগারদের নির্বাচিত লেখা নিয়ে প্রথম ই-বুক তৈরি করে বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় ব্লগ সাইট সামহোয়ারইনব্লগ ডট নেট। এখন সচলায়তন ডটকম, আমারব্লগ ডটকম, মুক্তমনা ডটকমসহ অন্যান্য ব্লগ সাইটও ব্লগারদের বাছাই করা লেখা নিয়ে নিয়মিত ই-বুক প্রকাশ করে চলেছে। মুক্তমনা ডটকমে বিনা মূল্যের ই-বুক ছাড়াও বিজ্ঞান, দর্শন, বিবর্তন ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন গ্রন্থ ক্রেডিট কার্ডে ই-বুক আকারে কেনার ব্যবস্থাও রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রথম সঞ্চালনবিহীন ব্লগ সাইট আমারব্লগ ডটকমে রয়েছে ই-বুকের জন্য আলাদা বিভাগ। সেখানে ব্লগাররা নিজস্ব ই-বুক সংরক্ষণ করতে পারেন। এ ছাড়া মেধাস্বত্বের আওতামুক্ত চিরায়ত বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব বই-ই এখন অনলাইনে বিনা মূল্যের ই-বুক আকারে সুলভ। দেশের কয়েকটি নিউজ পোর্টালেও চিরায়ত বাংলা সাহিত্যের বেশ কয়েকটি ই-বুক সংযুক্ত করা হয়েছে।

    ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহামের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রাগিব হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলা ভাষায় ই-বুকের ধারণাটি আস্তে আস্তে বিকশিত হচ্ছে। বছর দুয়েক আগে যেমন বাংলাতে ই-বুক ছিল না বললেই চলে, এখন সে চিত্র পাল্টেছে। অনেক নবীন প্রকাশক এবং লেখক প্রথাগত বইয়ের পাশাপাশি ই-বুক প্রকাশ করছেন। আমার বিশ্বাস, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ই-বুক রিডারের প্রচলন বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে বাংলা ই-বুকের চাহিদাও।’
    আমারব্লগ ডটকমের নির্মাতা সুশান্ত দাসগুপ্ত বলেন, ‘ই-বুক বর্তমানে তথ্যসংগ্রহের জনপ্রিয় ডিজিটাল মাধ্যম। অনলাইনে বেশ কিছু বাংলা ব্লগ ব্লগারদের নির্বাচিত লেখাগুলোকে ই-বুক আকারে প্রকাশ করছে। চর্চা হচ্ছে ম্ক্তুচিন্তার, ছড়িয়ে যাচ্ছে জ্ঞান, উপকৃত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম, দেশ ও জাতি।

    পাশাপাশি সরকার ই-বুক আকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সংযুক্ত করেছে স্কুল ও কলেজের অধিকাংশ পাঠ্য বই। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে এভাবেই ই-বুকগুলো আমাদের পথচলাকে বেগবান করছে।’

    করাচি প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক মাসকাওয়াথ আহসান বলেন, ‘প্রকাশনার ক্ষেত্রে ই-বুক হচ্ছে সমসাময়িক বাস্তবতায় রীতিমতো একটি ভিন্ন মাত্রার উল্লম্ফন। ঠিক যে কারণে মানুষ হাতে লেখা চিঠির কথা ভুলে ই-মেইল চর্চার যুগে ঢুকে পড়েছে, একই কারণে তৈরি হয়েছে ই-বুকের জনপ্রিয়তা। ছাপার বইয়ের আবেদন চিরন্তন ঠিকই; কিন্তু লেখকের বরাবরের আকাক্সক্ষা থাকে আরো বেশিসংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছানোর। ই-বুক মুহূর্তেই অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। এটি ছাপানোর বিষয় নেই বলে কাগজ নষ্ট হচ্ছে না। সেই দিক থেকে ই-বুক পরিবেশবান্ধব। এসব দিক বিবেচনায় বাংলা ভাষাতেও ঘটছে ই-বুকের প্রসার।’

    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/02/05/48792#sthash.h9DIce1r.dpuf
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:০৫582702
  • আমাদের বিশ্বকোষ
    বিপ্লব রহমান

    শিক্ষা-দীক্ষা বা গবেষণায় মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার বিকল্প নেই। অমর একুশের গৌরবের অগ্রযাত্রায় এখন হাতের নাগালে ইন্টারনেটভিত্তিক মুক্ত বিশ্বকোষ বাংলা উইকিপিডিয়া [http://bn.wikipedia.org/, সংক্ষেপে বাংলা উইকি। বছর কয়েক আগেও যেখানে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের প্রয়োজনীয় বিষয়ে জ্ঞানচর্চার জন্য কিনতে হতো বিদেশি ভাষার দামি বিশ্বকোষ অথবা ধরনা দিতে হতো বিভিন্ন লাইব্রেরিতে, এখন সেখানে যে কেউ কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের বোতাম টিপেই বিনা মূল্যে পেতে পারেন নির্ভরযোগ্য তথ্য ও ছবি। প্রয়োজনমতো তথ্য ও ছবি ডাউনলোড করে সংরক্ষণ এবং প্রিন্ট আউটও নেওয়া যায়। কিছুদিন আগে বাংলা উইকির মোবাইল ভার্সন [http://bn.wikipedia.org/] চালু হওয়ায় কমদামি মোবাইল ফোনেও এটি এখন সহজলভ্য। বলা ভালো, উইকির মতো বাংলা উইকিও পরিচালিত হচ্ছে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে। সাইটটি সমৃদ্ধ করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী অসংখ্য উইকিপিডিয়ান। এরই মধ্যে বাংলা উইকি পূর্ণ করতে চলেছে অর্জনের এক দশক। সমগ্র উইকিপিডিয়ায় যুক্ত হওয়া বিশ্বের ২৮৫টি ভাষার মধ্যে এভাবেই বাংলার এখন দাপুটে পদচারণ।

    বাংলা উইকিপিডিয়ার [http://bn.wikipedia.org/] যাত্রা শুরু ২০০৪ সালে। সেই থেকে ঘটছে এর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি। চলতি বছর বাংলা উইকির পূর্তি হবে ১০ বছর। প্রায় এক দশকের পথচলায় এটি পরিণত হয়েছে বাংলা ভাষায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় তথ্যভাণ্ডার। পাশাপাশি ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় বাংলা ওয়েবসাইটও। বাংলা উইকির আকার এখন এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ার থেকেও কয়েক গুণ বেশি বড়। অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলা উইকি এখন অনেক সমৃদ্ধিশালী। ২০১২ সালে এই সাইটে নিবন্ধ সংখ্যা ছিল প্রায় ২৪ হাজার। আর এখন সাইটটিতে মোট নিবন্ধের সংখ্যা ২৮ হাজার ছাড়িয়েছে। পাশাপাশি এতে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হাজার হাজার ছবি। আগের তুলনায় এর ব্যবহার বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। এ ছাড়া উপমহাদেশের প্রধান ভাষার উইকির মধ্যে এর অবস্থান এখন সম্ভবত সর্বোচ্চ স্থানে।

    বাংলা উইকির অন্যতম উদ্যোক্তা ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহামের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রাগিব হাসান। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বাংলা উইকির নেপথ্যে রয়েছে এক দল বাংলাভাষী তরুণ-তরুণীর প্রায় ১০ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম। সবার সমবেত প্রয়াসে সাইটটি আজ এত দূর এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘আসলে উইকিপিডিয়া হলো জনমানুষের তৈরি, জনমানুষের জন্য লেখা বিশ্বকোষ। সবার সমবেত প্রয়াস এবং চেষ্টায় বাংলা উইকি এগোবে সামনের দিকে, এটিই আমার বিশ্বাস।’

    উইকিপিডিয়ার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের কোষাধ্যক্ষ ও নির্বাহী পরিষদ সদস্য আলী হায়দার খান বাংলা উইকির দশকপূর্তিতে তাদের নানা পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘এখন বাংলা উইকিতে অনেক নতুন অবদানকারী যুক্ত হয়েছেন। প্রতি মাসে প্রায় পাঁচ শ নতুন নিবন্ধ এতে যোগ হচ্ছে। আমরা উইকিপিডিয়া বাংলাদেশের পক্ষে চলতি বছর থেকে জোরদার প্রচার-প্রচারণা শুরু করব। আয়োজন করা হবে কর্মশালা, সেমিনার ও প্রতিযোগিতা। এতে অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ বাংলা উইকি সম্পর্কে জানতে পারবে। পাশাপাশি বাড়বে এর ব্যবহার। স্বেচ্ছাশ্রমে সাইটটিতে অবদানকারীদের অংশগ্রহণও বাড়বে।’

    উইকিপিডিয়ান আলী হায়দার খান বলেন, ‘এ পর্যন্ত বাংলা উইকির যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা চাই একে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি উইকির কাতারে নিয়ে আসতে। এ ছাড়া এই জ্ঞানভাণ্ডারকে আমরা ছড়িয়ে দিতে চাই দেশের সব স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, শহর-গ্রামে তো বটেই, এমনকি আমরা পৌঁছাতে চাই সারা বিশ্বের সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষের নাগালে। এককথায়, অদূর ভবিষ্যতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চায় বাংলা উইকি হবে একটি অন্যতম মাধ্যম, এটিই আমাদের চাওয়া।’

    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/02/06/49128#sthash.MsQRglcW.dpuf
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:০৭582703
  • জেলা তথ্য বাতায়নে দখিনা হাওয়া
    বিপ্লব রহমান

    কোনো জেলা সম্পর্কে সাধারণ তথ্য পাওয়া একটি কঠিন কাজ। সরকারি পর্যায়েও আছে বেড়াজাল। ছোট কোনো তথ্যের জন্যও ধরনা দিতে হবে বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগে। আবার লাইব্রেরিতে গিয়ে পুস্তক-সাময়িকী ঘাঁটাঘাঁটিতে অনেক ঝক্কি। উপরন্তু বাজারের বইপত্রের তথ্য কতখানি নির্ভরযোগ্য, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। তবে এই অচলায়তনে দখিনা হাওয়া হয়ে আসে ওয়েবসাইট। ‘বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন’ বিভিন্ন জেলার ছোট-বড় নানা তথ্য নিয়ে ছড়িয়ে আছে বিশ্বময়। ইন্টারনেটের সহায়তায় সাইটে ঢুকলেই সব তথ্য চলে আসে হাতের নাগালে।

    একুশের গৌরবের পথচলায় সরকারি উদ্যোগে উন্মুক্ত হয়েছে তথ্যের এই খিড়কি দুয়ার। খোদ বাংলাদেশ সরকার এসব তথ্যের জোগানদাতা বলে গবেষণা ও লেখাপড়ায় নিশ্চিন্তে ব্যবহার করা যায় এই ওয়েবসাইটের তথ্যসূত্র। কম দামি স্মার্টফোন থেকেও এই সাইটটি ব্রাউজ করা যায়।

    জানা যায়, বছর সাতেক আগে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় নেওয়া হয় ‘একসেস টু ইনফরমেশন’ বা এটুআই প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় ২০০৬-২০১১ সালে। এটুআই প্রকল্পে বাংলা বর্ণ সংকেতায়ন বা বাংলা হরফে ইউনিকোডে নির্মাণ করা হয় bdgovportal.com। নির্মাণে অনেক ত্রুটি থাকলেও সাইটটি অনেকের জন্যই অতি প্রয়োজনীয়। নেভিগেশন কি বা সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে কাক্সিক্ষত বিভাগ, মন্ত্রণালয় ও জেলা তথ্য বাতায়ন থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া সম্ভব। একেকটি বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিভাগ। এ কারণে সমন্বিত এই উদ্যোগটি অনেক সুশৃঙ্খল। আবার কাক্সিক্ষত জেলার নাম ইংরেজিতে লিখে তার পাশে ডটগভ ডটবিডি লিখলেই ব্যবহারকারী সরাসরি প্রবেশ করতে পারেন সংশ্লিষ্ট জেলা তথ্য বাতায়নে [যেমন, dhaka.gov.bd।

    প্রতিটি জেলা তথ্য বাতায়নে যোগ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, সরকারি অফিস, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, ই-সেবা, ফটো গ্যালারি, নোটিশ বোর্ড, কৃষি, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা, পর্যটন ও ঐতিহ্য, প্রকৌশল ও যোগাযোগ, মানবসম্পদ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিবিধ ইত্যাদি বিভাগ। এ ছাড়া সাইটের প্রচ্ছদ বা নীড়পাতার ডান পাশে দেওয়া রয়েছে নানা প্রয়োজনীয় সরকারি পরিষেবার লিংক। এর মধ্যে ই-বুক, জাতীয় ই-তথ্যকোষ, জাতীয় ফরম ডাউনলোড, নাগরিক আবেদন, দাপ্তরিক আবেদন, নকলের জন্য আবেদন, সর্বশেষ অবস্থা জানুন, ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির আবেদন ফরম, ভূমি অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত তথ্য প্রাপ্তির আবেদনপত্র, তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা ইত্যাদি অন্যতম।

    প্রতিটি জেলা তথ্য বাতায়নের একেকটি বিভাগে রয়েছে বিভিন্ন অনুবিভাগ। যেমন- জেলা সম্পর্কিত তথ্য বিভাগে একনজরে জেলা, জেলার পরিচিতি, জনপ্রতিনিধি, পত্রপত্রিকা, বিশেষ অর্জন, ইতিহাস-ঐহিত্য বিভাগে পুরাকীর্তির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, ভাষা ও সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের তালিকা, প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব, খেলাধুলা ও বিনোদন, স্থানীয় প্রশাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, নদ-নদী, অর্থনীতি বিভাগে প্রাকৃতিক সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, হাট-বাজার, হোটেল ও আবাসন ইত্যাদি অনুবিভাগ রয়েছে।
    আধুনিক ওয়েব ডিজাইনের বিচারে সাইটটি অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। মূল সাইটের প্রচ্ছদের ‘অনলাইন কি’সহ কয়েকটি ফিচার সক্রিয় নয়। আবার ‘আইনশৃঙ্খলা’ বিষয়ে একই ফিচার রয়েছে দুটি। এসব সাইটের মোবাইল বা লো গ্রাফিক্স ভার্সন নেই বলে কম দামি মোবাইল ও মন্থর গতির ইন্টারনেট থেকে সাইটগুলো ব্রাউজ করা কষ্টসাধ্য।

    বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লেখালেখি এবং গবেষণার জন্য নানা বই-পত্রের পাশাপাশি অনলাইন তথ্যের ওপর নির্ভর করেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগে এ ধরনের সাইট নির্মাণ অবশ্যই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এটি বাংলা ভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা বাড়াচ্ছে। জাতীয় তথ্য বাতায়ন ও জেলা তথ্য বাতায়ন গতিশীল করেছে অবাধ তথ্য প্রবাহকে। সবচেয়ে বড় কথা, এতে স্বল্প পরিসরে প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ভুল তথ্য দেওয়া হয়নি।’

    তিনি আরো বলেন, ‘এখন দরকার ওয়েবসাইটগুলো প্রয়োজনীয় উন্নয়ন এবং এর বিষয়বস্তুর উৎকর্ষতা বৃদ্ধি। প্রায়ই দেখা যায়, আমাদের দেশে একটি কাজ শুরু হলে পরে সেটিকে এগিয়ে নেওয়া হয় না। আমি আশা করব, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার এ ধরনের তথ্য সেবা অব্যাহত রাখবে। তথ্য-প্রযুক্তি যেন সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে সুলভে পৌঁছে, সে জন্য নেবে জরুরি সব উদ্যোগ।’

    প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক মাসকাওয়াথ আহসান বলেন, ‘জাতীয় তথ্য বাতায়নে জেলাভিত্তিক যে ওয়েবসাইট চালু হয়েছে, তা নাগরিককে অধিকাংশের মাতৃভাষা বাংলায় রাষ্ট্রীয় সেবা প্রদানে সহায়তা করছে। তবে ওয়েবসাইট ইন্টারনেট স্পিডের সঙ্গে সম্পর্কিত। সে ক্ষেত্রে এই ওয়েবসাইটে রঙিন ছবির ব্যবহার কমানো জরুরি। এ ক্ষেত্রে চিত্রের চেয়ে তথ্যের ওপর জোর দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘জেলা বাতায়নগুলোর তথ্য-সংবাদও নিয়মিত হালনাগাদ করা আবশ্যক। অন্যথায় তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর ভবিষ্যতে এই সাইট যদি ই-গভর্ন্যান্সে অবদান রাখতে পারে, তবেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাজ হয়ে উঠবে অর্থবহ।’

    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/02/07/49627#sthash.GlqYZscZ.dpuf
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:০৯582704
  • পূর্ণতা এলো ব্যাকরণে
    আজিজুল পারভেজ

    বাংলা ভাষার বয়স হাজার বছরেরও বেশি। আর এই ভাষার ব্যাকরণ লেখা শুরু হয়েছে প্রায় পৌনে তিন শ বছর আগে। এই দীর্ঘ সময়েও বাংলার কোনো নিজস্ব ব্যাকরণ রচিত হয়নি। অবশেষে কাজটি সম্পন্ন করেছে ভাষা আন্দোলনের ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাংলা একাডেমি। ২০১১ সালে প্রকাশ করেছে ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’। এটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সদ্য প্রয়াত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছিলেন-

    ‘রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী, ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর এবং মুক্তিযুদ্ধের চল্লিশ বছরপূর্তিতে প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বিশ্বের ত্রিশ কোটি বাংলা ভাষাভাষীর জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।’
    জানা যায়, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনার প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে। ভারতবর্ষে আগত ধর্মপ্রচারকদের উদ্দেশ করে গোয়ার তদানীন্তন গভর্নর নির্দেশ জারি করেন, তাঁদের ছয় মাসের মধ্যে স্থানীয় ভাষা শিখতে হবে। এই প্রেক্ষাপটেই পর্তুগিজ পাদরি মানোএল্-দা-আস্সুম্পসাঁও রচনা করেন বাংলা পর্তুগিজ শব্দকোষ- Vocabulario em Idioma Bengalla e Portuguez। এটি পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় ১৭৪৩ সালে। মূলত শব্দকোষ হলেও বাংলা ভাষার ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্যও এতে ছিল। মানোএল্ যখন এই ব্যাকরণ রচনা করেন, তখন বাংলা ভাষা শেখা বা শেখানোর আদর্শ কোনো পদ্ধতি ছিল না। তখন বাংলা হরফ তৈরি না হওয়ায় ব্যাকরণটি রোমান হরফে মুদ্রিত হয়েছিল।

    বাংলা অক্ষরে প্রথম মুদ্রিত ব্যাকরণটিও বিদেশির লেখা। ১৭৭৮ সালে লিখেছিলেন প্রাচ্যবিদ ও ভাষাতাত্ত্বিক নাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড। বাংলা ভাষা শেখা ও শেখানোর ক্ষেত্রে এটি ছিল প্রথম উল্লে­খযোগ্য প্রচেষ্টা। এর পরের উল্লেখযোগ্য ব্যাকরণটিও বিদেশির কাছ থেকে পাওয়া। বহুভাষাবিদ ধর্মযাজক উইলিয়াম কেরি সেটি রচনা করেন ১৮০১ সালে। এটিও রচিত হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়।
    বাঙালির হাতে বাংলা ব্যাকরণ রচনার সূচনা হয় উনিশ শতকের গোড়ায়। ১৮০৭ সালে প্রকাশিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ হলো বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ। বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত থেকে একেবারে আলাদা ভাষার মর্যাদা দিয়ে ব্যাকরণ রচনায় প্রথম উদ্যোগী হন রামমোহন রায়। তিনি প্রথমে বাংলা ব্যাকরণ লেখেন ইংরেজি ভাষায়। তখন বাংলা ব্যাকরণ-ভাবনা মূলত সীমাবদ্ধ ছিল স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের বেড়াজালে। তা ছাড়া সেসব ব্যাকরণের প্রণেতারা ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। তাঁরা ঢালাওভাবে সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুকরণ ও অনুসরণে ছিলেন অভ্যস্ত। অবশ্য কেউ কেউ ইংরেজি ব্যাকরণের কাঠামোতে বাংলা ভাষার নিয়ম-শৃঙ্খলা সন্ধানে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাব-বলয় থেকে তাঁরাও বেরিয়ে আসতে পারেননি।

    এভাবে শতবর্ষেরও আগে বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ বরেণ্য বাঙালি এ ধরনের ব্যাকরণ রচনার গুরুত্ব তুলে ধরেন বিশ শতকের গোড়ায়। এরপর বাংলা ভাষার অনেক পণ্ডিত ব্যাকরণ প্রণয়নের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা ভাষার স্বকীয় ব্যাকরণ লেখার কাজটি অসম্পন্নই থেকে যায়। অবশেষে বাংলা একাডেমি সেই কাক্সিক্ষত কাজটি সম্পন্ন করেছে।

    পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সহযোগিতায় বাংলা ভাষার সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ প্রমিত ব্যাকরণ প্রণয়ন ও প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের উদ্যোগের ফসল এ ব্যাকরণ। বাংলাদেশের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এবং পশ্চিমবঙ্গের অধ্যাপক পবিত্র সরকার পালন করেছেন সম্পাদনার দায়িত্ব। উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পশ্চিমবঙ্গের কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং বাংলাদেশের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

    ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে দুই বাংলার পণ্ডিতদের এটিই প্রথম যৌথ প্রয়াস। এতে স্থান পেয়েছে দুই বাংলার ২৪ জন ব্যাকরণবিদের রচনা। এ কাজের মধ্য দিয়ে বাঙালি মনীষার বিগত শতবর্ষের ভাষাচিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। বাংলা ব্যাকরণচর্চার ক্ষেত্রে এটিই প্রথম সমবেত প্রাতিষ্ঠানিক ও ঐতিহাসিক প্রয়াস। ব্যাকরণ বিশেষজ্ঞ মাহবুবুল হকের মতে, গোটা বাঙালি জাতির জন্য এটি গর্ব করার মতো একটি ঐতিহাসিক সাফল্য।

    সম্পাদনা পরিষদ তাদের ভূমিকায় বলেছে, বিশ্বের বাংলাভাষী মানুষের আনুষ্ঠানিক ভাষার বিশ্লেষণ ও বর্ণনাই এ ব্যাকরণ রচনার লক্ষ্য। এটি কোনো পাঠ্যপুস্তক নয়, সর্বশ্রেণীর ভাষাসচেতন পাঠকের জন্য এই ব্যাকরণ রচিত।

    প্রকাশের পর বাঙালি পাঠক সমাজ ব্যাকরণটি বিপুল উৎসাহে গ্রহণ করে। ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া ভূয়সী প্রশংসা করেছে- 'Chalti Bangla finally gets Grammer of its own''। এক বছরের মধ্যেই প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায়, প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় সংস্করণ। সর্বশেষ গত মাসে ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ’ নামে একটি অখণ্ড সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছে।

    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/02/08/49910#sthash.W7MnJAAi.dpuf
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:১২582705
  • ক্ষুদ্রজাতি পড়বে নিজ ভাষাতেই
    বিপ্লব রহমান

    একুশের গৌরবের পথচলায় বাংলার পাশাপাশি ক্ষুদ্রজাতির মাতৃভাষাও হয়েছে সমুন্নত। কয়েকটি ক্ষুদ্রজাতির প্রধান ভাষায় লিখিত চর্চা বহু বছর ধরে চলছে বেসরকারি উদ্যোগে। শুধু তা-ই নয়, পাহাড় ও সমতলে বেসরকারি উদ্যোগে চলছে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্রজাতির নিজ নিজ ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর এবারই প্রথম খোদ সরকারই এগিয়ে এসেছে এই মহতি উদ্যোগ বাস্তবায়নে।

    দেশের প্রায় ৭০টি ক্ষুদ্রজাতির প্রায় ২৫ লাখ মানুষ হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় ব্যবহার করছেন নিজস্ব মাতৃভাষা। পাশাপাশি বাঙালির সঙ্গে ভাব বিনিময়ে তাঁরা ব্যবহার করেন বাংলা। প্রতিটি ক্ষুদ্রজাতির রয়েছে নিজস্ব প্রাচীন ভাষা, রীতিনীতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। তবে কয়েকটি ক্ষুদ্রজাতির ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। এ জন্য তাঁরা রোমান ও বাংলা হরফ ব্যবহার করেন। আবার চর্চার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক ক্ষুদ্রজাতির ভাষা।

    এ অবস্থায় প্রধান কয়েকটি ক্ষুদ্রজাতির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায়, তাদের নিজস্ব ভাষায় পাঠদানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ভাষাগুলো হচ্ছে, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, গারো ও সাদ্রি। এর মধ্যে সাদ্রি ব্যবহার করেন উত্তরবঙ্গে বসবাসকারী ওঁরাও, মুণ্ডা, মালো, মাহাতো, রাজোয়ার, তেলি, বাগদি, লহরা, কর্মকারসহ ১৫টি ক্ষুদ্রজাতি। পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্তত দুই দশক ধরে বেসরকারি উদ্যোগে চলছে নিজস্ব বর্ণমালায় চাকমা ও মারমা ভাষার প্রাথমিক বিদ্যালয়।

    এসব বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাতৃভাষায় পাঠ দেন সংশ্লিষ্ট ভাষার শিক্ষক। আর পাঠ্যবইও লেখা হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে। কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থাও এই উদ্যোগের সঙ্গে আছে।
    অন্যদিকে সাঁওতাল, গারো, ত্রিপুরা ও সাদ্রি- এই চার ভাষায় লিখিত চর্চা থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নেই পর্যাপ্ত বই। এ জন্য সরকারি উদ্যোগে এবং ক্ষুদ্রজাতির বুদ্ধিজীবীদের তত্ত্বাবধানে এই চারটি ভাষায় এখন পাঠ্যবই লেখার কাজ চলছে। এরপর ক্ষুদ্রজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে সরকারি উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট ভাষায় পারদর্শী শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শুরু হবে পাঠদান। নিজস্ব হরফ বা বর্ণমালা না থাকায় গারো ও ত্রিপুরা ভাষায় রোমান হরফে এবং বাংলা বর্ণমালায় সাদ্রি ভাষায় লেখা হচ্ছে পাঠ্যবই। তবে বর্ণমালার বিতর্ক মীমাংসার অপেক্ষায় রয়েছে সাঁওতালি ভাষা। বাংলাদেশের সাঁওতালরা বহু বছর ধরে একই সঙ্গে রোমান ও বাংলা হরফে নিজ ভাষার চর্চা করছেন। প্রাথমিক পর্বের লেখাপড়ায়ও চলছে এই দুই বর্ণমালা। তাই বিতর্কটি মিটে যাওয়ার পর এ বিষয়ে সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ব্যবহারিক দিক চিন্তা করে অধিকাংশের মত বাংলা হরফেই সাঁওতালি ভাষায় লেখাপড়ার কাজ এগিয়ে নেওয়ার।

    এসব বিষয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারির গৌরব হচ্ছে সব মাতৃভাষার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা। তাই বহু ভাষাভাষির বাংলাদেশে ক্ষুদ্রজাতি অন্তত প্রাথমিক শিক্ষাটুকু নিজ নিজ মাতৃভাষায় লাভ করবে, এটি একটি মৌলিক মানবিক অধিকার। দেরিতে হলেও সরকার ক্ষুদ্রজাতির বহু বছরের এই দাবিতে সাড়া দিয়েছে। এখন আমরা চাই, এর দ্রুত বাস্তবায়ন।’ তিনি বলেন, ‘পাশাপাশি আমরা নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য বিষয়ে গবেষণা ও অধ্যয়নের জন্য চাই একটি ক্ষুদ্রজাতির একাডেমি।’

    সাঁওতালি ভাষার বর্ণমালা বিতর্কের বিষয়ে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন সরেণ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে বহু বছর ধরে বাংলা বর্ণমালায়ই চলছে সাঁওতালি ভাষায় লেখাপড়া। আমরা নিজেরাও শৈশবে বাংলা হরফেই সাঁওতালি শিখেছি। কিন্তু শিশুদের পাঠদানে রোমান হরফ চালু করা হলে পরবর্তী সময় তাকে অন্যান্য বিষয়ে লেখাপড়ার জন্য আবার নতুন করে শিখতে হয় বাংলা বর্ণমালা। অর্থাৎ শিশুর ওপর চেপে বসে দুটি বর্ণমালা।’ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর এই নেতা আরো বলেন, ‘রোমান হরফে সাঁওতালি শেখার কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই। কারণ আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া সব বাংলা ভাষাতেই। আমরা রোমান হরফ গ্রহণ করলে উন্নয়নের মূল জনস্রোত থেকেই পিছিয়ে পড়ব।’

    অন্যদিকে রোমান হরফের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন নওগাঁর ধামইরহাট মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক আলবার্ট সরেণ। তিনি বলেন, ‘মিশনারি শিক্ষার হাত ধরে ১৮৪৫ সাল থেকে এই উপমহাদেশে রোমান হরফে চলছে সাঁওতালি ভাষায় লেখাপড়া, সাহিত্যচর্চা ও গবেষণা। ভারতের ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, ওড়িষা, বিহার, আসাম, পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে বহু বছর ধরে চলছে রোমান হরফে লেখাপড়া। নব্বইয়ের দশকে আমাদের দেশে বাংলা বর্ণমালায় শুরু হয়েছে সাঁওতালি ভাষার চর্চা। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিকতার স্বার্থে আমরা রোমান হরফেই প্রাথমিক শিক্ষা চাই। অন্যথায় সারা বিশ্বের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিজ ভাষায় ভাব বিনিময়ে আমরা পিছিয়ে পড়ব। এ ছাড়া বাংলা হরফে সাঁওতালি ভাষার উচ্চারণও সঠিক হয় না।’

    সাঁওতাল শিক্ষার্থী সুভাষ চন্দ্র হেমরম রাজশাহীর নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর আইন বিভাগে পড়ছেন। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য ক্ষুদ্রজাতির মতো আমরাও ঘরের বাইরে ব্যবহারিক কাজে বাংলাভাষা ব্যবহার করি। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা হরফে সাঁওতালি ভাষা শেখা আমার জন্য সহজ হয়েছে। পরে এই বর্ণমালাতেই আমাকে লেখাপড়া করতে হয়েছে বলে নতুন করে আর শিখতে হয়নি।’

    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/02/09/50254#sthash.lcejpDY1.dpuf
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:১৪582706
  • অনলাইন জাতীয় ই-তথ্যকোষ
    বিপ্লব রহমান

    গবেষণা, নিয়মিত লেখাপড়া ও সিলেবাসবহির্ভূত নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য এত দিন নির্ভরতা ছিল বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের বইপত্রের ওপর। কিন্তু এসব বইয়ের তথ্যাবলি কতটুকু নির্ভরশীল, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকেই যায়। এ ক্ষেত্রে সাইবার বিশ্বের বিশাল তথ্যভাণ্ডার বড় বিকল্প সন্দেহ নেই। তবে সমস্যা হলো- বেশির ভাগ তথ্যই মেলে ইংরেজি ভাষায়। আবার নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে সরকারি দপ্তরগুলোর দ্বারস্থ হয়েও পোহাতে হয় নানা ঝক্কি-ঝামেলা। এতসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এগিয়ে এসেছে সরকার।

    প্রযুক্তির অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে বছর দুয়েক আগে সরকারি উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে অনলাইন জাতীয় ই-তথ্যকোষ (রহভড়শড়ংয.মড়া.নফ)। মাতৃভাষার গৌরব ছড়িয়ে দিতে ‘জীবন ও জীবিকাভিত্তিক তথ্যভাণ্ডারটি তৈরি করা হয়েছে পুরোপুরি বাংলা ভাষায়। তথ্য-উপাত্ত অধিকাংশই সরকারি পর্যায়ের বলে গবেষক, শিক্ষার্থী ও অনুসন্ধিৎসু মাত্রই এর ওপর নির্ভর করতে পারেন নিশ্চিন্তে। ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে এমন মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারের মাধ্যমে সহজেই এসব তথ্য যে কেউ ডাউনলোড করতে পারেন। নিতে পারেন প্রয়োজনীয় তথ্য বা ছবির প্রিন্টও। এ ছাড়া গত বছর চালু হওয়া তৃতীয় প্রজন্মের দ্রুতগতির থ্রি-জি ইন্টারনেট সংযোগ তথ্য-প্রযুক্তিকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। এই পর্যায়ে জাতীয় ই-তথ্যকোষের কল্যাণে এখন যেমন গ্রন্থাগার বা সরকারি দপ্তরে গিয়ে ভারী ভারী বইপত্র বা পুরনো নথি ঘেঁটে দেখার প্রয়োজন অনেকটাই কমে আসছে। সময়ের সাশ্রয়ও হচ্ছে অনেক।

    খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় ই-তথ্যকোষ। প্রায় দেড় শ সরকারি ও অর্ধশত দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান এই তথ্যকোষে তথ্য দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে জাতীয় ই-তথ্যকোষ। তথ্যকোষটিতে সন্নিবেশ করা হয়েছে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইন ও মানবাধিকার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অকৃষি উদ্যোগ, পর্যটন, কর্মসংস্থান, নাগরিক সেবা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-সংক্রান্ত তথ্য। উপরন্তু তথ্যগুলো পরিবেশন করা হয়েছে অডিও, ভিডিও, অ্যানিমেশন, তথ্যচিত্র বা লিখিত আকারে।

    জাতীয় ই-তথ্যকোষে প্রাথমিক পর্যায়ে যোগ করা হয় ৫০ হাজার পৃষ্ঠা। সঙ্গে চার ঘণ্টার অডিও এবং ২২ ঘণ্টার ভিডিও ফুটেজ। তথ্যকোষে একটি বাংলা সার্চ ইঞ্জিন সংযুক্ত থাকায় যেকোনো তথ্য খুব সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। বিষয়ভিত্তিক অনুসন্ধানের পাশাপাশি কাক্সিক্ষত তথ্যের প্রধান প্রধান শব্দ বাংলায় লিখে সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে দ্রুত প্রয়োজনীয় তথ্যটি পাওয়া সম্ভব। যারা বাংলায় টাইপ করতে অভ্যস্ত নয়, তাদের কথা চিন্তা করে সার্চ ইঞ্জিনে যুক্ত করা হয়েছে ভার্চুয়াল কি-বোর্ড।
    পরিকল্পনা রয়েছে, জাতীয় ই-তথ্যকোষটির অনলাইন ও অফলাইন দুটি ভার্সন নির্মাণের। অফলাইন ভার্সনটি মিলবে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে। এটি তিন মাস অন্তর হালনাগাদ করা হবে। তবে অনলাইন ভার্সন বরাবরই উন্মুক্ত থাকছে সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীর জন্য।

    জাতীয় ই-তথ্যকোষের সাইট ঘুরে দেখা যায়, অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি তথ্য এতে সংযুক্ত রয়েছে। উপরন্তু এতে মিলবে বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ও সেবাদানকারী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লিংক, নানা আইনের ডিজিটাল ভার্সন, মোবাইল তথ্য সেবা ইত্যাদি বিভাগ। তবে একনজরে সাইটটির প্রচ্ছদ বা ইন্টারফেস খুব দৃষ্টিনন্দন নয়। পুরো সাইটটির মোবাইল ভার্সন বা লো গ্রাফিক্স ভার্সন নেই বলে কম গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট থেকে এটি দেখা মুশকিল। ছবিগুলো পুরোপুরি স্টুডিও পিকচারের মতো, আনুষ্ঠানিক। এতে নেই বিষয় বৈচিত্র্য বা একই তথ্যের অসংখ্য সন্নিবেশ। যাত্রা শুরুর পর গত দুই বছরে এর উন্নতি হয়েছে খুবই কম।

    প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক মাসকাওয়াথ আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের প্রান্তিক মানুষের জন্য পেশাভিত্তিক যে তথ্য প্রয়োজন তা রয়েছে এই ই-তথ্যকোষে। এসব তথ্যের খোঁজ-খবর নিতে সরকারি অফিসে গিয়ে আমরা নাকানি-চুবানি খাচ্ছি বছরের পর বছর ধরে। আপাত সামান্য একটি তথ্য না জানার কারণে কৃষক, শ্রমিক এবং দরিদ্র মানুষকে বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তথ্যের দারিদ্র্য তাদের পিছিয়ে দিয়েছে জীবন-জীবিকার নানা ক্ষেত্রে। সম্ভবত এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে এই তথ্যকোষে যোগ করা হয়েছে প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়। এটি ব্যবহার করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, জাতীয় ই-তথ্যকোষ একটি ভার্চুয়াল ইউনিভার্সিটির মতো।’

    মাসকাওয়াথ আহসান আরো বলেন, ‘গ্রামপর্যায়ে আমরা ইন্টারনেটের যে স্পিডটুকু দিতে পারছি, তাতে খুব বেশি রঙিন ছবিযুক্ত ওয়েবসাইট ব্রাউজিং কষ্টকর হতে পারে। আড়ম্বরহীন রূপসজ্জার ওয়েবসাইট কম গতির ইন্টারনেটে পড়া সহজ। সৌন্দর্যের চেয়ে সাইটটিতে বর্ণিত তথ্য পড়তে পারাটা বেশি জরুরি।’

    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/02/10/50639#sthash.jPZmUzOc.dpuf
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:২৪582708
  • বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল
    উর্দুর লাল ঝান্ডা
    মিজানুর রহমান খান | আপডেট: ০২:২২, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

    বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখেছে, তার প্রমাণ মেলে ওই সময়ের কিছু গোপন দলিলে। এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম কিস্তি আজ

    বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিলখাজা নাজিমউদ্দিনের সেই বিতর্কিত উক্তি ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ জনগণের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, সে সম্পর্কে ১৯৫২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে একটি গোপন প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন ঢাকার মার্কিন কনসাল জন ডব্লিউ বাউলিং। তাঁর এই প্রতিবেদনে বায়ান্নর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহটির অর্থনীতি, রাজনীতি এবং বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি রাজনীতিকদের মনোভাবের একটি চিত্র আঁকা আছে।

    আড়াই পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী গত ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় এক জনসভায় স্পষ্টভাবে বলেছেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তাঁর এ বক্তব্যে ঢাকার অধিকাংশ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। ভাষণটি তার বিষয়বস্তু ও ধরন উভয় দিক থেকে দুর্ভাগ্যজনক। প্রধানমন্ত্রী যে শুধু তাঁর বাঙালি শ্রোতামণ্ডলীর সামনে উর্দুর লাল ঝান্ডা উড়িয়েছেন শুধু তা-ই নয়, একই সঙ্গে লিয়াকত আলী খান সর্বদাই যে ধরনের সহজ ‘রাজপথের’ ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা এড়িয়ে তিনি ফার্সিজাত কষ্টবোধ্য উর্দুর মিশেল দিয়ে ভাষণ দিয়েছেন।

    লক্ষণীয় যে মার্কিন কনসাল এ পর্যায়ে টিপ্পনি কাটেন, প্রধানমন্ত্রীর এ রকম ধারার ভাষণ দেওয়ার কোনো বাস্তবসম্মত কারণ অনুমান করতে ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেট অসমর্থ। বাউলিং উল্লেখ করেন, এটা স্বাভাবিক যে তাঁর জনসভায় উপস্থিত ব্যক্তিদের অন্তত অর্ধেকের কম হবে না, উর্দু সম্পর্কে যাদের কোনো জ্ঞান নেই। এবং এক-তৃতীয়াংশের বেশি হবে না, যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর আড়ম্বরপূর্ণ ভাষা, যা উচ্চারণে তিনি বাঙালি উচ্চারণভঙ্গিই ব্যবহার করেছিলেন, তাঁরা তা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি অবশ্য ভিত্তিহীনভাবে উল্লেখ করেন যে বাংলা লিখতে আরবি হস্তলিপির পরিবর্তে সাধারণ হস্তলিপি শিগগিরই প্রচলন করা হবে। স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা তাঁর অমন ভাষণ সম্পর্কে যাঁদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন। এবং প্রায় ১৫ হাজার বাঙালি এ জন্য তাঁর প্রতি বেশ বৈরীভাব দেখাতে উদগ্রীব হন। এবং তাঁঁরা তাঁর ভাষণের প্রতি কোনো ধরনের উৎসাহ দেখাননি। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সোহরাওয়ার্দীর ওপর বেশ কটূভাষায় রাজনৈতিক আক্রমণ ছিল, যা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের মর্যাদায় আঘাত হানবে।

    বাউলিং আরও মন্তব্য করেন, ওই ভাষণের প্রতিক্রিয়া ছিল একেবারেই প্রত্যাশিত। স্থানীয় সংবাদপত্র ভাষা ইস্যুতে সপ্তাহজুড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্য কলেজগুলোর ছাত্র সংগঠন ১০ দিনের ধর্মঘটে যোগ দেয়। এবং পথচারীদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের মধ্য দিয়ে বিরাট মিছিল বের হয় এবং বামপন্থীদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘সর্বদলীয়’ সভা ডাকা হয়। প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ-প্রধান ভাসানী এতে সভাপতিত্ব করেন। এর প্রতি সাধারণভাবে আওয়ামী-লীগপন্থী বুদ্ধিজীবীরা সমর্থন দেন। ঢাকায় ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। সম্ভবত সেটা সফলও হবে।

    ২৭ জানুয়ারির বিতর্কিত ভাষণ যে বাঙালি নাকচ করেছিল, সেটা খাজা নাজিমউদ্দিন বিবেচনায় নিয়েছিলেন। তিনি কিছুটা হলেও নতি স্বীকার করেন। বাউলিং লিখেছেন, সপ্তাহান্তে প্রধানমন্ত্রী গ্রামে ছিলেন। সেখানকার জনসভায় তিনি বাংলায় বক্তৃতা করেন। তিনি আর সোহরাওয়ার্দীর নাম নেননি। ভাষা প্রশ্নে আর কোনো কথাই বলেননি। জনতা তাঁকে ভালোভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছে।

    http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/136801/%E0%A6%89%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0_%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B2_%E0%A6%9D%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A6%BE
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:২৭582709
  • বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল
    পাকিস্তানের ঐক্য ঝুঁকিতে পড়ল
    মিজানুর রহমান খান | আপডেট: ০২:৪৮, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

    মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ দ্বিতীয় কিস্তি

    বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিলএকুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনায় পাকিস্তানের ঐক্য ঝুঁকিতে পড়ল। ১৯৫২ সালের ৮ মার্চ করাচি থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় এ মন্তব্য করেছিলেন পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব চার্লস দ্য উইদার্স। তিনি আসলে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পক্ষে ওই বার্তাটি পাঠান। পাঁচ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে (করাচি ডেসপ্যাচ ১০৭৮) ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সমগ্র পাকিস্তানে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য ঘটনার মূল্যায়ন ছিল।

    ওই সময়ের মার্কিন কূটনীতিকেরা একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে নির্দিষ্ট করতে প্রধানত ‘রায়ট’ (দাঙ্গা)
    এবং ‘ডিস্টারবেন্স (গোলযোগ) কথাটি ব্যবহার করেছেন।

    চার্লস দ্য উইদার্সের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফেব্রুয়ারি মাসে দুটি ঘটনা ঘটে। একটি ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা প্রশ্নে বাঙালিদের ওপর গুলিবর্ষণ। আর দ্বিতীয়টি ২৪ ফেব্রুয়ারি লাহোরে গোলযোগ।

    উইদার্সের বর্ণনায়, ‘অভ্যন্তরীণভাবে পূর্ববঙ্গে বিক্ষোভ এবং পরে ভাষা প্রশ্নে ঢাকায় দাঙ্গা, যা মূলত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়। তাতে তিনি বাঙালিদের কাছে পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘটনার পর লাহোরে একটি গোলযোগ দেখা দেয়। সেটা ঘটে ২৪ ফেব্রুয়ারি। সেখানকার বিক্ষোভকারীরা পাঞ্জাবের খাদ্য ঘাটতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

    প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিম উদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় গোটা প্রদেশে বিক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। এর জের ধরে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দুদিনের দাঙ্গা বাধে। হামিদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী সংবাদপত্র পাকিস্তান অবজারভার, পূর্ববঙ্গের রাজনীতিক, ছাত্র এবং বামপন্থী সংগঠনগুলো প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। ১৩ ফেব্রুয়ারি অবজারভার বন্ধ করে দেওয়া হয়। পূর্ববঙ্গের সরকার এ জন্য অবজারভার-এ প্রকাশিত একটি ‘অ-ইসলামি’ সম্পাদকীয় প্রকাশকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে এবং পত্রিকাটির মালিক চৌধুরী এবং তার সম্পাদক আবদুস সালামকে গ্রেপ্তার করে।

    এখানে লক্ষণীয় যে, এই প্রতিবেদনে ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতি মার্কিন দূতাবাসের প্রচ্ছন্ন দরদ প্রকাশ পায়। উইদার্সের ভাষায়, ‘২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা একটি সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছিল। এবং তারা মিছিল ও সমাবেশের ওপর তার আগের দিন বহাল করা নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেছিল। ছাত্ররা এতটাই সহিংস হয়ে ওঠে যে পুলিশ গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। এতে কয়েকজন ছাত্র নিহত এবং অনেকেই আহত হয়। পরদিন পুলিশ পুনরায় গুলিবর্ষণ করতে বাধ্য হয় এবং তার একই ফলাফল ঘটে। পরদিন সেনাবাহিনীকে ডেকে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। এখনো প্রদেশটিতে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। ছোট আকারের প্রাদেশিক শহরগুলোতে সভা-সমাবেশ, ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে।’

    তবে চার্লস উইদার্স মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পক্ষে এই মূল্যায়নও করেন, ‘পেছন ফিরে তাকালে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে ফেব্রুয়ারির ওই দাঙ্গার গভীর ভিত্তি রয়েছে। ভাষা প্রশ্নে বাঙালিদের জনপ্রিয় ভাবাবেগ রয়েছে। এবং সেটার নেতৃত্বে ছিলেন প্রাদেশিকতাবাদী ব্যক্তিবর্গ।’

    মার্কিন কূটনীতিক এরপরই উল্লেখ করেন, ‘কমিউনিস্ট এবং হিন্দু সংখ্যালঘুরা দৃশ্যপটে এসেছেন পরে। পূর্ববঙ্গের সরকার এ ঘটনার জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করতে সচেষ্ট হয়েছে। এবং পূর্ববঙ্গ সরকারের কথায়, এ ঘটনার জন্য তারাই (কমিউনিস্ট এবং হিন্দু সংখ্যালঘু) দায়ী, ‘‘যারা তাদের পাকিস্তানের বাইরে থেকে উৎসাহ জুগিয়ে থাকে’’। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ছাত্র ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ও কমিউনিস্ট অধ্যাপকেরা রয়েছেন।’

    এ পর্যায়ে চার্লস উইদার্স মন্তব্য করেন, ‘পাকিস্তানের ঐক্য ভাষা প্রশ্নে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিষয়টি মার্চ মাসে গণপরিষদের অধিবেশনে উত্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে। পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাস বিশ্বাস করে যে যদিও ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারির দাঙ্গার পটভূমিতে পূর্ববঙ্গের আইনসভা সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব পাস করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভাষার বিষয়টি গণপরিষদে সম্ভবত কিছু সময় ধরে ঝুলিয়ে রাখা হবে।’

    উল্লেখ্য, পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।

    http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/137752/%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%90%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%AF_%E0%A6%9D%E0%A7%81%E0%A6%81%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87_%E0%A6%AA%E0%A7%9C%E0%A6%B2
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:২৯582710
  • বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল
    বিদেশি চক্রান্তের ধুয়া
    মিজানুর রহমান খান | আপডেট: ০২:২৯, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

    বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিলমার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ তৃতীয় কিস্তি

    পাকিস্তানের বিশিষ্ট সাংবাদিক জিয়াউদ্দিন আহমেদ সুলেরি সংক্ষেপে পরিচিত ছিলেন জেড এ সুলেরি হিসেবে। মুসলিম লীগার ও সেনাবাহিনীর প্রতি সহানুভূতিশীল সাংবাদিক হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশ্চিত করেছিলেন যে বাঙালিরা উর্দুকে শত্রু ভাবেনি। তারা উর্দুর পরিবর্তে বাংলা ভাষা চায়নি। উর্দুকে তারা দমাতে চায়নি। কোনো উগ্রতা থেকেও নয়। তারা কেবলই বাংলার প্রতি তাদের ভালোবাসা, গভীর অনুরক্তি এবং তাদের প্রদেশের জন্য গর্বিত হতে চেয়েছে।

    একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাকালে সুলেরি ঢাকায় ছিলেন। করাচিতে ফিরে ১৯৫২ সালের ১০ মার্চ তাঁর সম্পাদিত ইভনিং টাইমস-এ একটি নিবন্ধ লেখেন। শিরোনাম ছিল ‘পূর্ব ফ্রন্টে সত্য ও গল্প: ঢাকা সফরের অনুভূতি’। এতে তিনি দেখান যে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন নিজেকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ‘বিদেশি চক্রান্ত’ হিসেবে অপবাদ দিয়েছিলেন। সুলেরি মুসলিম লীগ থেকে তাঁকে বহিষ্কারের সুপারিশ করেছিলেন। এই নিবন্ধের বিষয়ে পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাসের পক্ষে ১৯৫২ সালের ১২ মার্চ একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন দ্বিতীয় সচিব চার্লস ডি. উইদার্স। উইদার্স লিখেছেন, পাকিস্তান অবজারভার বন্ধ করে দেওয়ার পটভূমিতে কাউন্সিল অব পাকিস্তান এডিটরস থেকে জেড এ সুলেরিকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। মার্কিন দূতাবাস মনে করে, সুলেরি একজন যোগ্য সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক।

    এটা লক্ষণীয় যে জেড এ সুলেরির একটি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের দৃষ্টিভঙ্গির মিল রয়েছে বলে চার্লস ডি. উইদার্স ওয়াশিংটনকে অবহিত করেছিলেন। আর তা হলো সুলেরির ভাষায়, একুশে ফেব্রুয়ারির পরের পরিস্থিতিকে ‘ধ্বংসকারী শক্তি’ ব্যবহার করতে চেয়েছে। সুলেরি তাঁর নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে পুলিশ ছাত্রদের তাদের হলগুলোতে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। তার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে ও যত্রতত্র একই হাতের লেখার পোস্টারের ছড়াছড়ি দেখে তিনি বিস্মিত হন। এমনকি তিনি দাবি করেন যে একই ধরনের পোস্টার ঢাকা থেকে ছয় দিনের ভ্রমণ দূরত্বের সন্দ্বীপেও দেখা গিয়েছিল।

    চার্লস ডি. উইদার্সের বর্ণনামতে, সুলেরি লিখেছেন, একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলিবর্ষণের পরে—তার পূর্ববৃত্তান্ত যা-ই হোক না কেন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার যে দাবি পূর্ববঙ্গে উঠেছে, তা খাঁটি ও ব্যাপকভিত্তিক। সুলেরি গুরুত্বারোপ করেন যে বাংলার প্রতি বাঙালিদের দৃঢ় মনোভাব সত্ত্বেও উর্দু ও উর্দুভাষীদের প্রতি তাদের কোনো বৈরিতা নেই। তারা বাংলাকে একটি অতিরিক্ত রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দেখতে চাইছে। বাংলার জন্য তাদের এ গভীর অনুভূতির নেপথ্যে রয়েছে ব্রিটিশ নীতি। তারা অবিভক্ত বাংলায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি চালু করেছিল। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বাংলা প্রকৃতপক্ষে মুসলিম মেধাবী চিন্তাবিদদের ফসল। বাংলার মধ্যে সংস্কৃত যেটুকু ঢুকেছে, তা হলো অবিভক্ত বাংলায় ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু আধিপত্যের কারণে। এবং এটাই সত্য যে বাংলা একটি সরল ভাষা এবং তাতে সহজেই নতুন উর্দু শব্দ একীভূত করা সম্ভব। এবং এভাবেই বাংলা এমন একটি ভাষার কাছাকাছি রূপ ধারণ করেছে, যা তাকে উপমহাদেশের ইতিহাসে ইসলামি চিন্তাধারার জিম্মাদার করে তুলেছে। সুলেরি আবেদন রেখেছেন যে বাংলার দাবি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এ ইস্যু অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

    চার্লস ডি. উইদার্স এরপর বলেন, নিবন্ধের দ্বিতীয় অংশে সুলেরি উল্লেখ করেছেন, গোলযোগের আগে বাংলা ভাষার আন্দোলন ‘সম্পূর্ণরূপে দেশীয় ও দেশপ্রেমমূলক’। এবং সেটা এমন মোটেই নয় যে, যেটা ব্যাপকভাবে অভিযোগ করা হচ্ছে যে ‘বিদেশি ও কমিউনিস্ট চক্র’ কারসাজি করেছে। তিনি পূর্ববঙ্গের নেতাদের অভিযুক্ত করেন এই বলে যে তাঁরা বাংলা ভাষা আন্দোলনের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেননি এবং জনপ্রিয় ভাবাবেগকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি এ বিষয়টি নির্দিষ্ট করেন যে ধ্বংসকারী শক্তি দ্রুত বিষয়টি লুফে নেয়।

    বিদেশি ও কমিউনিস্টদের প্রতি সুলেরির ইঙ্গিত সমর্থন করে উইদার্স মন্তব্য করেন যে ‘তাদের দ্বারা পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার যে চেষ্টার কথা সুলেরি লিখেছেন, মার্কিন দূতাবাস তা বিশ্বাস করে।’

    http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/138457/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF_%E0%A6%9A%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%A7%E0%A7%81%E0%A7%9F%E0%A6%BE
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:৩১582711
  • বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল
    নূরুল আমীনের মধ্যরাতের পদত্যাগ
    মিজানুর রহমান খান | আপডেট: ০২:০৯, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

    মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ চতুর্থ কিস্তি
    বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল৬২ বছর পরে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেল যে একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলিবর্ষণের ঘটনায় মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন ছাত্র-জনতার উত্তাল দাবির মুখে পদত্যাগ করতে চূড়ান্তভাবে মনস্থির করেছিলেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। নূরুল আমীন পদত্যাগপত্র লিখেছিলেন। তিনি ওই দিন গভীর রাতে পদত্যাগ ঘোষণা করার পরিকল্পনা করেছিলেন।

    ১৯৫২ সালের ১ মার্চ ঢাকা থেকে মার্কিন কনসাল জন ডব্লিউ বাউলিং ওয়াশিংটনে পাঠানো এক বার্তায় ওই তথ্য উল্লেখ করেছিলেন। ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ঢাকার দাঙ্গা শিরোনামে পাঠানো ওই গোপন বার্তায় বাউলিং আরও জানিয়েছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মুখ্য সচিব আজিজ আহমেদের নেতৃত্বাধীন একদল সরকারি কর্মকর্তা তাঁকে ওই রাতে পদত্যাগ করা থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন।’ উল্লেখ্য, পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মুখ্য সচিব আজিজ আহমেদ ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট একজন প্রভাবশালী আমলা। পরে তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব হয়েছিলেন।

    ভাষা গবেষক আহমদ রফিক গতকাল নিশ্চিত করেন যে ওই সময় ছাত্ররা ‘নূরুল আমীনের কল্লা চাই’ স্লোগানে ফেটে পড়েছিল। তাঁর সরকারের পতন ঘটারও জোর গুজব ছিল। তাঁর পদত্যাগ চেয়ে দৈনিক আজাদ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল। কিন্তু তিনি যে সত্যিই পদত্যাগপত্র তৈরি করেছিলেন এ কথা এই প্রথম উদ্ঘাটিত হলো।

    মার্কিন কনসাল জন বাউলিং তাঁর ওই তারবার্তায় ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহের ঢাকার পুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। এতে নূরুল আমীন সরকারের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন সমর্থন প্রকাশ পায়। এর অন্যতম কারণ হলো, নূরুল আমীন সরকারের পতন ঘটলে পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্টদের শক্তি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

    বাউলিং তাঁর প্রতিবেদনটির শুরুতেই মন্তব্য করেন, ‘পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে ঢাকার দাঙ্গা থেকে উদ্ভূত সবচেয়ে তীব্র রাজনৈতিক সংকটের প্রাথমিক পর্যায় পূর্ব বাংলার সরকার সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে অন্তত আজ পর্যন্ত মোকাবিলা করতে পেরেছে। এশিয়ার এ অংশে কমিউনিজম ঘাঁটি গেড়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে এর বেশির ভাগ শীর্ষ নেতা আসন গাড়তে পারেননি। অন্তত অস্থায়ীভাবে হলেও তাঁদের উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা ঠেকানো গেছে। তাঁদের তাড়া করা সম্ভব হয়েছে।’

    ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অন্তত সাময়িকভাবে দাঙ্গা বন্ধ হয়েছে। প্রদেশটি তার স্বাভাবিক অর্থনৈতিক জীবনে ফিরেছে। ঢাকার শীর্ষস্থানীয় কমিউনিস্ট এবং কমিউনিস্টপন্থী নেতাদের কারাগারে রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি বিশৃঙ্খলার মূল কেন্দ্র সেটা বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা বেশির ভাগ শহুরে জনগণের বৈরিতার সম্মুখীন। তারা যদিও ক্ষমতা সংহত করতে পেরেছে। কিন্তু এখন তাদের আইনসভার আগামী অধিবেশন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বাত্মক লড়াই চালাতে হবে।’
    নূরুল আমীনের পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি জানান, মুখ্যমন্ত্রী পদে নূরুল আমীনের বহাল থাকা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর মন্ত্রিসভার অন্তত দুজন সদস্য এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অ্যাসেম্বলিতে নূরুল আমীনের প্রতি সমর্থন দ্রুত কমে যাচ্ছে। ভাষার প্রশ্নে নূরুল আমীন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অত্যন্ত তিক্ত ছিলেন। কারণ, ভাষা প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে একটি ‘পাঞ্চিং ব্যাগ’ (মুষ্টাঘাত করার থলে) হিসেবে ব্যবহার করছিল। কেন্দ্রের সাধারণ রাজনৈতিক যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি তাঁর আস্থা হারিয়েছিলেন। তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুখ্য সচিবের নেতৃত্বাধীন সরকারি কর্মকর্তাদের একটি গ্রুপের পীড়াপীড়িতে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। ওই গ্রুপটি তাঁকে অবহিত করেন যে ফজলুল হকের ভীমরতি ঘটেছে। এবং ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী হলে তাঁর মন্ত্রিসভায় কমিউনিস্টদের প্রতি অনুরাগী এবং যুক্ত বাংলার সমর্থকদের প্রাধান্য ঘটবে। নূরুল আমীন সরকারের পতন ঘটার অর্থ হবে পূর্ব পাকিস্তান অধ্যায়ের অবসান পর্বের সূচনা। ওই সব কর্মকর্তা তাই শপথ নিয়েছিলেন যে, যদি মন্ত্রিসভার পতন ঘটে তাহলে তাঁরাও সবাই পদত্যাগ করবেন।

    http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/139186/%E0%A6%A8%E0%A7%82%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B2_%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%AE%E0%A6%A7%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%AA%E0%A6%A6%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%97
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:৩৩582712
  • বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল
    কমিউনিস্টরাই ছাত্রদের খেপিয়ে তুলেছে
    মিজানুর রহমান খান | আপডেট: ০২:২৩, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

    বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিলমার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পঞ্চম কিস্তি

    ভাষা আন্দোলন জোরদার করতে ছাত্রদের খেপিয়ে তুলেছিল কমিউনিস্টরা। এর আগে তারা ঘাপটি মেরে ছিল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট নাশকতাকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ এম মালিকের এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত হয়েছিল ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেট।

    ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জন ডব্লিউ বাউলিং বায়ান্নর ১৪ মার্চের পূর্ববর্তী ৭ দিনের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ দিয়ে ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ১৫ মার্চ পাঠানো ওই বার্তায় তিনি লেখেন, গোটা সপ্তাহে কোথাও সহিংসতা ঘটেনি। গোটা প্রদেশজুড়ে অর্থনৈতিক জীবন ছিল স্বাভাবিক। ৪৫ জনের বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেশির ভাগই জেলা শহরগুলো থেকে। এর আগে গ্রেপ্তারকৃত প্রায় ৮৫ জন, যাঁদের অধিকাংশই ঢাকার ছাত্র, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর নেপথ্যে পূর্ববঙ্গ সরকারের কৌশলগত চাল রয়েছে। আর সেটা হলো

    নাশকতাকারী শক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির প্রতি বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের সম্পূর্ণ অনুমোদন সাপেক্ষে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সাম্প্রতিক দাঙ্গার দায়ে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছে। তবে এর মধ্যে নাশকতাকারীদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

    বাউলিং উল্লেখ করেন, নূরুল আমীন সরকারের কতিপয় মুখপাত্র তাঁদের কিছু ভাষণে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে চরম সহিংস আক্রমণ চালাচ্ছেন। আর নূরুল আমীন বলেছেন, অন্যান্য কাজ গুছিয়ে নিয়ে তিনি নিজেই কমিউনিস্টবিরোধী প্রচারণায় অংশ নিতে শিগগিরই প্রদেশ সফরে নামবেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশতার অবশ্য বুদ্ধি করে তাঁর ঢাকা অবস্থানকালে এ বিষয়ে নীরব থেকেছেন। কিন্তু অপর সঙ্গী বাঙালি মন্ত্রী এ এম মালিক জনগণের সামনে নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিলেন। এ পর্যায়ে মার্কিন কনসাল উল্লেখ করেন, মালিকের দেওয়া বিবৃতির একটি কৌতূহলোদ্দীপক অংশ এই বার্তার সঙ্গে পাঠানো হলো। তাঁর অভিমতের সঙ্গে মার্কিন কনস্যুলেটের সাধারণ মতৈক্য রয়েছে।
    ১৯৫২ সালের ১০ মার্চ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ এম মালিকের দেওয়া সেই বিবৃতিতে লেখা ছিল, ‘বর্তমান গোলযোগের বহু আগে আমি যখন প্রাদেশিক মন্ত্রী ছিলাম, তখন আমি জেনেছিলাম নাশকতাকারী চক্র এই প্রদেশে তৎপর রয়েছে। কিন্তু তাদের চিহ্নিত করা খুবই কঠিন ছিল। তাদের কিংবা তাদের সংগঠনকে চিহ্নিত করার মতো নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া সম্ভব ছিল না। সৌভাগ্যবশত এসব সংগঠন এখনো পর্যন্ত তাদের ক্যুদেতার (সহিংসতা অথবা অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন) পরিকল্পনা সফল করতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত নয়। তারা ভাষার প্রশ্নে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও আমাদের জনগণের তরুণ অংশের স্বপ্ন কাজে লাগাতে চেয়েছিল। নাশকতাকারী সংগঠনগুলো সম্ভবত ভবিষ্যতে কোনো সুবিধা করতে পারবে না জেনে ভাষা আন্দোলনের আড়ালে অতি উত্তেজিত হয়ে তড়িঘড়ি নেমে পড়েছিল। তারা পরিস্থিতির ওপর দ্রুত নিয়ন্ত্রণ নেয়। এবং আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ ভাষা আন্দোলন পরিচালনায় নির্দেশনা দেয়। তারা ছাত্র ও তাদের সংগঠনগুলোকে আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক দুভাবেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। সব নাশকতাকারী সংগঠন, হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিবর্গ এবং যারা বর্তমান সরকারের চোখে চোখ রাখতে চায় না, তারা এককাতারে দাঁড়িয়েছে। প্রকাশ্যে আইন ও শৃঙ্খলার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে। ট্রেন ও তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে তাদের তৎপরতা রয়েছে। রাস্তায় গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ করা হয়েছে।

    তারা সূক্ষ্ম এবং খুবই চাতুর্যপূর্ণভাবে সরকারের ক্ষমতাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। তারা যদি সফল হয়, তাহলে তারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দেবে। সেই দাসত্ব কে জানে কত শতাব্দী ধরে চলবে। মালেক আল্লাহকে ধন্যবাদ জানান এই বলে যে ভাষা আন্দোলনের ফলে ওই নাশকতাকারী সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় তাদের চেনা যেত না।

    http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/139963/%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%87_%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%96%E0%A7%87%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87_%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:৩৪582713
  • বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল
    ৩ গোষ্ঠীর পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র
    মিজানুর রহমান খান | আপডেট: ০২:৪৬, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

    বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিলমার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ষষ্ঠ কিস্তি

    একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনায় তিনটি গোষ্ঠীর দ্বারা পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন।

    ১৯৫২ সালের ২১ জুন ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকান কনসাল গ্রে ব্রিম ওয়াশিংটনকে নূরুল আমীনের ওই মনোভাব সম্পর্কে জানিয়েছিলেন।

    ঢাকার আমেরিকান কনসাল গ্রে ব্রিম তাঁর ১১০ নম্বর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন ২১ ফেব্রুয়ারির দাঙ্গার (আমেরিকান দলিলে একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনকে ‘দাঙ্গা’ লেখা হয়েছে) প্রায় চার মাস পর পুরো ঘটনার একটি সরকারি ভাষ্য প্রকাশ করেছেন। দিনটি ছিল ১৪ জুন ১৯৫২। ওই দিন তিনি ময়মনসিংহ জেলার মুসলিম লীগের কর্মীদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। ব্রিম তাঁর ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, নূরুল আমীন একুশে ফেব্রুয়ারির দাঙ্গা কেন ঘটেছিল এবং তার উৎপত্তির কারণ এবং ওই দাঙ্গাকালে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, তা পর্যালোচনা করেন। এবং তিনি ঘোষণা দেন, তাঁর কাছে চূড়ান্ত প্রমাণ রয়েছে যে, ২১ ফেব্রুয়ারির দাঙ্গার পেছনে তিনটি গোষ্ঠীর হাত রয়েছে। কমিউনিস্ট, অন্যান্য বিদেশি এজেন্ট এবং রাজনৈতিক অশুভ চক্র। এই তিন গোষ্ঠী মিলে প্রদেশের ভেতর থেকে প্রদেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করেছিল।

    মার্কিন কনসালের বিবরণ অনুযায়ী, কমিউনিস্টরা যে এর সঙ্গে জড়িত, তার প্রমাণ হিসেবে নূরুল আমীন কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি কমিউনিস্ট পত্রিকার উদ্ধৃতি দেন। ওই পত্রিকাটি পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের প্রতি দলীয় (কমিউনিস্ট পার্টি) সহায়তা প্রদান সঠিকভাবে এগোচ্ছে বলে উৎসাহিত করেছে। এ ছাড়া বিদেশি এজেন্টদের সংশ্লিষ্টতারও প্রমাণ হাজির করেন তিনি। ময়মনসিংহের ওই মুসলিম লীগের সম্মেলনে তিনি তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে নাটকীয়ভাবে একটি গোপন দলিল উপস্থাপন করেন। ওই দলিলটি প্রস্তুত করার একটি তারিখ রয়েছে। সেটি হলো, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। নূরুল আমীন বলেন, এটি এমন একটি সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সার্কুলার, যেটির সদর দপ্তর পাকিস্তানের বাইরে অবস্থিত। ১২ ফেব্রুয়ারির ওই সার্কুলারে সংগঠনের সদস্যদের ভাষা আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়। তিনি জনস্বার্থে ওই সংগঠনের নাম প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন। হতাশ রাজনীতিকদের সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে, তারা সবাই পরিচিত মুখ। এবং তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দাঙ্গার ঘটনার মিশ্রণ ঘটিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করা। মার্কিন কনসাল এ পর্যায়ে মন্তব্য করেন যে, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে যদিও সেভাবে যুক্ত বাংলার প্রবক্তাদের কথা উল্লেখ করেননি, কিন্তু স্পষ্টতই তাঁদের নাম তাঁর মনে রয়েছে।

    নূরুল আমীন ওই সম্মেলনে ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা নিয়েও কথা বলেন। তাঁর ভাষায় তিনি এই গুজব বিশ্বাস করেন না যে, মুসলিম লীগ অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। তিনি এ কথা স্মরণ করিয়ে তাঁর শ্রোতাদের উদ্বুদ্ধ করেন যে, মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান অবিচ্ছেদ্য। সবশেষে তিনি ‘দক্ষিণপন্থীদের’ প্রতি তাঁর শুভেচ্ছার হাত প্রসারিত করেন। তিনি মন্তব্য করেন, তাঁকে বলা হয়েছে মুসলিম লীগ এবং জমিয়ত-ই-উলামা-ই-ইসলামের মধ্যে বিচ্ছেদের অনুভূতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সেটা ঠিক নয়, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন যে মুসলিম লীগ জমিয়তের মতাদর্শই ধারণ করে।

    ব্রিমের এই প্রতিবেদন থেকে আরও দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধের গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেটা এখনো চলমান বলে তিনি ওয়াশিংটনকে নিশ্চিত করেন। ব্রিম লিখেছেন, এ সপ্তাহে কোনো ঘোষণা না দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী করাচিতে ঝটিকা সফর করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী পাসপোর্ট পদ্ধতি নিয়ে ঢাকায় বৈঠক করেছেন। করাচিতে যাওয়ার পথে তিনি কলকাতায় যাত্রাবিরতি করেছিলেন। এখন ঘোষণা করা হয়েছে যে, ভিসা পদ্ধতি ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে। এবং ছয় ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন মেয়াদে বৈধতা দিয়ে ভিসা ইস্যু করা হবে।

    মার্কিন কনসাল আরও উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনমত মুখ্য সচিব আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে চলে গেছে। তিনি বাঙালি নন। তাই কনসাল বিশ্বাস করেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে প্রদেশগত অনুভূতিরই প্রতিফলন ঘটেছে।

    http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/140809/%E0%A7%A9_%E0%A6%97%E0%A7%8B%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A0%E0%A7%80%E0%A6%B0_%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8_%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A6%BE%E0%A6%B0_%E0%A6%B7%E0%A7%9C%E0%A6%AF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:৩৫582714
  • বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল
    রক্তমাখা শার্টের ভয়ে ভিসি অপসারিত হননি
    মিজানুর রহমান খান | আপডেট: ০২:৪৩, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

    বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিলমার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ সপ্তম কিস্তি

    একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার শোধ নিতে মুসলিম লীগ সরকার উপাচার্য অপসারণসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনর্গঠন করার নীলনকশা তৈরি করেছিল। কিন্তু ‘শহীদ ছাত্রদের রক্তমাখা শার্টের স্মৃতি’ নতুন করে তাদের তাড়া করতে পারে, এই আশঙ্কায় সরকার সে নীলনকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেনি।

    ১৯৫২ সালের ১৫ মার্চ এবং ১৪ জুনে পাঠানো দুটি পৃথক বার্তা থেকে এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. এস এম হোসেন বাঙালি ছিলেন না। কিন্তু তিনি বাংলা ভাষার আন্দোলন ও তার সমর্থকদের সপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।

    এস এম হোসেন ১৯৪৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৩ সালের ৮ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। মার্কিন কনসাল লিখেছেন, পাকিস্তান সরকার ফেব্রুয়ারির দাঙ্গার জন্য তাঁকেও দায়ী করে থাকে। ১৪ জুনের বার্তায় ব্রিম লিখেছেন, তাঁকে অপসারণ করা হলে সরকারের ভাবমূর্তিতে দাগ লেগে যাবে। শহীদ ছাত্রদের রক্তমাখা শার্ট আবার আন্দোলিত হবে। আর সেটা আসন্ন নির্বাচনের আগে সরকারের জন্য বিব্রতকর হতে পারে।

    ১৯৫২ সালের ১৪ জুন আমেরিকান কনসাল গ্রে ব্রিম ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠান যে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্গঠনের যে তোড়জোড় আগে শোনা গিয়েছিল, তা এখন বাস্তবায়ন করার কোনো ইঙ্গিত নেই। বেসরকারি সূত্রগুলো অভিযোগ করছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্গঠনে হাত দিতে সরকার এখন ভয় পাচ্ছে। কারণ এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সরাতে হবে।

    মার্কিন কনসাল ব্রিম ওই বার্তায় র্িলখেছেন, ‘কিন্তু যাই হোক না কেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি মরে যায়নি। চেক বংশোদ্ভূত অধ্যাপক ড. নিউম্যান কট্টর কমিউনিস্টবিরোধী হিসেবে পরিচিত। তাঁকে অপসারণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন উপাচার্য। এ জন্য ৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদের একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে। এ সময় অধ্যাপক নিউম্যানকে অপসারণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এখন একজন মাত্র ব্যক্তি আছেন, যিনি তাঁকে বাঁচাতে পারেন। আর তিনি হলেন ড. আই এইচ জুবেরি (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি)। তিনি ইংরেজি বিভাগের প্রধান এবং প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল অফিসার। কিন্তু ওই বৈঠকের সময় তিনি লন্ডনে থাকবেন।’

    ১৯৫২ সালের ১৫ মার্চ ঢাকার মার্কিন কন্স্যুলেট ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিল যে, ‘নূরুল আমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠন দেখতে চান। তবে সেটা করতে গিয়ে যেন তাঁর রাজনৈতিক ক্ষতি না হয়, সেটা তাঁকে ভাবতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে পাস করাতে তিনি একটি প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করেছিলেন। নূরুল আমীন ওই প্রস্তাবে এটা ঢুকিয়েছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকার করে নেবে যে, তাদের শিক্ষাঙ্গনে রাষ্ট্রবিরোধী মহলের নাশকতামূলক তৎপরতা রয়েছে। এবং তাদের নির্মূল করার জন্য একাডেমিক কাউন্সিল অনুষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ়তার সঙ্গে পুনর্ব্যক্ত করছে। সুনির্দিষ্টভাবে কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট পার্টির নিন্দা করা হয়েছে। কিন্তু নূরুল আমীন পরে এটা দেখে অবাক হন যে, একাডেমিক কাউন্সিল যে প্রস্তাব পাস করেছে তাতে কমিউনিস্ট বিরোধিতার অংশটি বাদ পড়েছে। উপাচার্য এখন একান্তে স্বীকার করছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তিনি এবং ১০০ জনেরও বেশি শিক্ষক পদত্যাগ করবেন।’

    মার্কিন কনসাল অবশ্য ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের এই হুমকিকে কনস্যুলেট গুরুত্ব দিতে নারাজ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই তা নিয়েছেন। সে কারণে প্রকাশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সমালোচনা করবেন কি না, সে বিষয়ে এখনো তিনি মনস্থির করতে পারেননি।

    http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/141655/%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%96%E0%A6%BE_%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%AD%E0%A7%9F%E0%A7%87_%E0%A6%AD%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A6%BF_%E0%A6%85%E0%A6%AA%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A4_%E0%A6%B9%E0%A6%A8%E0%A6%A8%E0%A6%BF
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:৩৮582715
  • ভারত ও হিন্দুদের দোষারোপ
    মিজানুর রহমান খান | আপডেট: ০১:২৩, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

    বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল: মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ অষ্টম কিস্তি

    কিছু হলেই হিন্দুদের দোষারোপ করার একটা প্রবণতা আছে। এর পেছনে রয়েছে ২০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত একটি মনস্তাত্ত্বিক ধারার পটভূমি।

    একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার চেষ্টা সম্পর্কে ঢাকার আমেরিকান কনসাল জন ডব্লিউ বাউলিং বায়ান্নর ১ মার্চ ওয়াশিংটনে পাঠানো বার্তায় এ মন্তব্য করেছিলেন।

    বাউলিং বলেন, ‘বর্তমান গোলযোগকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে দেখানোর অল্পই সম্ভাবনা আছে। কতিপয় সরকারি মুখপত্র (যেমন মর্নিং নিউজ) কমিউনিস্টদের সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা ভারত সরকারকে খলনায়ক হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এটা সরকারিভাবে করা হয়নি।’
    রক্তপাতের পটভূমিতে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির প্রস্তাব পাস করলেও তারা সব সময় ভেবেছে, এর পেছনে প্রকৃতপক্ষে ‘বিদেশি হাত’ আছে। কমিউনিস্টদের এ জন্য তারা দায়ী করলেও চূড়ান্ত অর্থে তারা কার্যত অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল ভারত ও হিন্দু সম্প্রদায়কে। ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ এ দৃষ্টিভঙ্গির বড় মুখপত্র ছিল। বায়ান্নর ২৫ ফেব্রুয়ারি বাউলিং এক বার্তায় মন্তব্য করেন, মর্নিং নিউজ পরিস্থিতির জন্য কমিউনিস্ট ও হিন্দুদের দায়ী করেছে।

    এদিন আইনসভার দুই মুসলিম সদস্যের সঙ্গে দুই হিন্দু কংগ্রেসম্যানকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
    ১৯৫২ সালের ৮ মার্চ মার্কিন কনসাল জন ডব্লিউ বাউলিং ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিলেন, কিছু কর্মকর্তা যুক্তি দিচ্ছিলেন যে আগামী হেমন্তের আগে আইনসভার অধিবেশন আর ডাকা উচিত হবে না। শুধু বাজেট পাস করাতে ২৪ ঘণ্টার জন্য প্রদেশের ওপর ৯২ক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় শাসন বলবৎ রাখা হবে। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বেশ আস্থাশীল যে আইনসভার ওপর তিনি তাঁর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারবেন।

    কনস্যুলেট বিশ্বাস করে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আইনসভার অধিবেশন ডাকা হবে। তবে বিক্ষোভকারীদের চাপ সামলাতে এ অধিবেশনের স্থান পরিবর্তন করা হতে পারে।

    ভাষা আন্দোলনকারীরা ৫ মার্চ ধর্মঘট ডেকেছিলেন। কিন্তু তা কেন সফল হয়নি ওই বার্তায় তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বাউলিং। তাঁর মতে, প্রধানত দুই কারণে ধর্মঘট ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমত, আংশিক কারণ হলো কার্যকর পুলিশি নিয়ন্ত্রণ। দ্বিতীয়ত, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সরাসরি ‘মহল্লা সরদারদের’ কাছে ধরনা দেওয়া। এই সরদারেরা, বাউলিংয়ের ভাষায় ঢাকার নবাবদের এখনো শক্তিশালী
    উত্তরাধিকারী বহন করছে এবং ঢাকার অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ওপর তাদের প্রচণ্ড প্রভাব রয়েছে।

    বাউলিং তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, একুশে ফেব্রুয়ারির ‘দাঙ্গা’র পর সবচেয়ে অস্বস্তিকর বিষয় হলো, কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা এবং মর্নিং নিউজ ভারত সরকার কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে নাশকতাকারীদের সম্পৃক্ততা চিহ্নিত করতে চাইছে। সরকারের বক্তৃতাগুলোতে এর আভাস রয়েছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ বেতার ভাষণ, যা এই প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, তাকে দুভাবে দেখা যেতে পারে। হয় তিনি দাঙ্গার জন্য বিদেশি কমিউনিস্টসহ (পূর্ব পাকিস্তানের) কমিউনিস্টদের দায়ী করেছেন বা অন্যথায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষগুলোর অংশগ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। মর্নিং নিউজ কমিউনিস্টদের দোষারোপ করে ঝড় তুলেছে। আবার তার ভূমিকার মধ্যেও সাম্প্রদায়িক আবেগ উসকে দেওয়ার চেষ্টা আছে।

    বাউলিং এরপর লিখেছেন, ঢাকা কনস্যুলেট অবশ্য সাম্প্রদায়িক গন্ডগোলের আশঙ্কা তেমন গুরুতর হতে পারে বলে মনে করে না। ঢাকার জনমতের বিশ্লেষণ করে কনস্যুলেট দেখেছে যে জনগণের আনুমানিক ৫০ ভাগ যদিও বর্তমানে সরকারকে সমর্থন করছে। তবে তাদের মধ্যকার বৃহৎ অংশটিই ফেব্রুয়ারির গোলযোগকে সাম্প্রদায়িক ঝামেলার সঙ্গে যুক্ত করতে নারাজ। বরং প্রবণতা হচ্ছে কমিউনিস্ট এবং ‘যুক্ত বঙ্গওয়ালাদের’ সমানভাবে অভিযুক্ত করা। এদের উভয় শিবির কলকাতার সদর দপ্তরের নির্দেশে পরিচালিত হয় বলে বদ্ধমূল জনপ্রিয় বিশ্বাস রয়েছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অবশ্য সেভাবে হিন্দুদের অভিযুক্ত করেন না। বরং তারা তাদের প্রকাশ্য বিবৃতিগুলোতে একটা ম্যাকিয়াভেলীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটানোর কথা স্বীকার করতেও প্রস্তুত আছেন।

    বায়ান্নর ৩ মার্চ দেওয়া বেতার ভাষণে নূরুল আমীন বলেছিলেন, তিনি ভারাক্রান্ত হূদয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি নিহত ব্যক্তিদের প্রতি তিনি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। কতিপয় কমিউনিস্ট ও বিদেশি দালালদের ষড়যন্ত্র অঙ্কুরেই বিনাশ করা হয়েছে। এর পেছনে সক্রিয় আছে, সেই শক্তি যারা কখনো পাকিস্তান মানতে পারেনি। তারা কেবল সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে ছিল। রাষ্ট্রের শত্রুদের পাতা ফাঁদে আমাদের অনেকেই যেভাবে পা দিয়েছে, তা আমাকে আহত করেছে। মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ভাষার প্রশ্ন প্রকৃত প্রশ্ন ছিল না। এর পেছনে নিশ্চয় অশুভ একটা কিছু আছে।

    নূরুল আমীন তাঁর ভাষণে নির্দিষ্টভাবে বলেন, ‘বর্তমানের ঝুঁকিটা বুঝতে আমি আপনাদের সীমান্তের বাইরে তাকাতে বলি। কেবল পাকিস্তানই নয়, ইসলামও আজ কাঠগড়ায়। আমরা ইসলামকে ব্যর্থ হতে দেব না।’ পরিহাস হলো, চার বছর পরে পূর্ব পাকিস্তান সফর শেষে ফিরে মাওলানা আবুল আলা মওদুদি ওই একই ফতোয়া দিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ হিন্দু প্রভাবিত। স্বায়ত্তশাসনের দাবি ইসলামবিরোধী।

    http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/142147/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4_%E0%A6%93_%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%A6%E0%A7%8B%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%AA
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:৩৯582716
  • বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল
    জিন্নাহ বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষা করতে চেয়েছিলেন
    মিজানুর রহমান খান | আপডেট: ০২:০০, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

    মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ নবম কিস্তি

    জিন্নাহ বাঙালিকে একটি ছাড় দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষার মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন।
    ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি করাচির মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পক্ষে দ্বিতীয় সচিব ‘চার্লস ডি উইদার্স পাকিস্তানের প্রাদেশিকতাবাদ’ শীর্ষক এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাতে ওই তথ্য দেন।

    ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রীদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সম্মেলনে গৃহীত একটি প্রস্তাব পূর্ব বাংলায় ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হিসেবে পর্যায়ক্রমে উর্দু প্রচলন করা হবে। এটা পাকিস্তানের বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য একটি অভিশপ্ত বিষয়। আবার ছাত্রদের সামনে রেখে প্রাদেশিকতা-বাদীদের জন্য এটা একটা বিরাট মওকা। ১৯৪৮ সালের গোড়ায় জিন্নাহ তখন একটি ব্যক্তিগত আবেদন রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শেষ পর্যন্ত উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। তিনি অবশ্য একটি ছাড় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাংলা প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গণ্য হতে পারে। জিন্নাহ বাঙালিদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে প্রাদেশিকতাবাদ রাষ্ট্রের দেহে বিষতুল্য। তা পাকিস্তানের জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

    ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ পাকিস্তানের মার্কিন কনস্যুলেটের অ্যাটাশে টমাস ডব্লিউ সাইমন শীর্ষক একটি এয়ার মেইল পাঠিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে।

    এতে তিনি লিখেছিলেন ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর সপক্ষে করাচিতে পাকিস্তানের গণপরিষদে বক্তব্য দেন। এর ফলে ঢাকায় তাঁর অবস্থান দুর্বলতর হয়েছে। তিনি কবে ঢাকায় ফিরবেন, তা নির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব।

    ওই মার্কিন অ্যাটাশে লিখেছিলেন, বাঙালি মুসলমানরা বাংলায় কথা বলেন। এই ভাষার একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাদেশিক মূল্য রয়েছে। কী মুসলিম, কী হিন্দু, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তাঁরা গর্ববোধ করে। ১৯৪৭ সালের শেষ মাসগুলোতে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য উর্দু ভাষার প্রচলন প্রশ্নে আলোচনা চলে। এ সময়ে স্কুলগুলোতে বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষা প্রচলনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট (ভিসি) একজন বিশিষ্ট মুসলমান। তিনি আমার (বার্তা লেখক) কাছে প্রকাশ্যে উল্লেখ করেন যে বাংলার পরিবর্তে উর্দুু চালু অসম্ভব। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীরা যখন বাঙালিদের সামনে কথা বলেন, তখন তাঁরা বাংলা বা ইংরেজিতে কথা বলতে বাধ্য হন। ছাত্ররা উর্দু প্রচলনের বিরুদ্ধে পৌনঃপুনিকভাবে প্রতিবাদ করে চলেছে। পূর্ব বাংলার মানুষ প্রায় ধরেই নিয়েছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হবে। কিন্তু তারা বিস্মিত হয় যে তাদেরই প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি করাচিতে ঘোষণা করেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অনুভূতি হচ্ছে, উর্দুই হবে একমাত্র ভাষা। উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা (বহু ভাষাভাষী রাষ্ট্রে যে ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম বলে স্বীকৃত) হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।

    মার্কিন অ্যাটাশে এরপর লিখেছেন, বাঙালিদের তরফে এর প্রতিক্রিয়া ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ছাত্ররা পরদিনই মিছিল বের করে। এই লেখা পর্যন্ত দুটো সাধারণ ধর্মঘটের খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৯৪৮ সালের ১ মার্চ একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে উপযুক্ত সময়ে ভাষা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। সরকার যে পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল, তারও প্রমাণ মেলে ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সরকার প্রদেশের জনগণকে সতর্ক করে দিচ্ছে যে পাকিস্তানের শত্রুরা এই সিদ্ধান্ত থেকে ফায়দা নিতে ইতিমধ্যেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা এই প্রদেশের মুসলমানদের বিভক্ত করতে চাইছে।’

    এর ১৮ দিন পরে জিন্নাহ ঢাকায় ‘উর্দু কেবল উর্দু’ মর্মে বিতর্কিত বক্তৃতা করেছিলেন।

    http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/143005/%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B9_%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%87_%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95_%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A6%BE_%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%87_%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%A8
  • Biplob Rahman | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:৪২582717
  • বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল
    সোহরাওয়ার্দীর প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা
    মিজানুর রহমান খান | আপডেট: ০১:৪৫, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

    মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ দশম কিস্তি

    বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা প্রশ্নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তখন তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি।

    ১৯৫৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মার্কিন কনসাল গ্রে ব্রিম ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিলেন, যুক্তফ্রন্টে নতুন করে চিড় ধরেছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর অধ্যাপক কাজী কামারুজ্জামান ভাষা প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে একটি জ্বালাময়ী বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁর কথায়, মওলানা ভাসানীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পুনরায় শোষণ করার জন্য সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর কোটারি গোষ্ঠী পুনর্বার ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত করছে। আওয়ামী মুসলিম লীগে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একজন প্রকৃত নেতা হতে পারেন না। কারণ, তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবি সমর্থন করেন না এবং তাঁর ‘সর্ব পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ’ও সমর্থন করে না। অধ্যাপক কাজী কামারুজ্জামান তাঁর ওই বৃিবতিতে বলেন, এই গ্রুপটি ভাসানীকে পাশ কাটিয়ে যুক্তফ্রন্টের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে এবং মুসলিম লীগ তাদের দিয়েই বাঙালির ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে।

    গ্রে ব্রিমের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ‘কামারুজ্জামানের ওই বিবৃতিকে সমর্থন করে অনেক আওয়ামী লীগার ও সমমনোভাবসম্পন্ন নেতারা বিবৃতি দিয়েছিলেন। ঢাকা শহর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আলী আমজাদ খান তথাকথিত যুক্তফ্রন্টের পর্দার আড়ালে দুরভিসন্ধিপূর্ণ খেলার নিন্দা করেন।

    ভাষা প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী নানা সময়ে বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা পালন করেন বলে প্রতীয়মান হয়। ১৯৫১ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকার মার্কিন কনসাল চার্লস ডি উইদার্স তাঁর পূর্ব পাকিস্তানে সফর সম্পর্কে একটি বার্তা পাঠান। সোহরাওয়ার্দী এ সময় জনসভাগুলোতে বাংলা ও উর্দু মিশিয়ে বক্তৃতা করেন। উইদার্স লিখেছেন, ‘আমরা অবহিত হয়েছি যে সোহরাওয়ার্দী কার্যত জনতাকে তাঁর হাতের তালুতে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি কখনো উর্দু, কখনো বাংলায় কথা বলেন। তিনি সমবেত জনতার সকল অংশকে সন্তুষ্ট করতে সফল হয়েছিলেন। সন্দেহাতীতভাবে সোহরাওয়ার্দী একজন চালাক মানুষ। দুটি বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা তাঁর উদ্ভাবনপটুতার উদাহরণ তৈরি করে। নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করে তিনি জনগণকে বলেন, তাঁরা কি জানতেন নিরাপত্তা আইনে কী আছে? এরপর তিনি বলেন, যখন কেউ সরকারের সমালোচনা করে, তখন পুলিশ এগিয়ে আসে এবং বিচার ছাড়াই তাদের কারাগারে প্রেরণ করে। আবার ভাষার ইস্যুতে তিনি মন্তব্য করেন যে উর্দু হওয়া উচিত রাষ্ট্রভাষা। এটা শুনে যখন কতিপয় বাঙালি তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করেন, তখন তিনি তাঁদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, পাকিস্তানের কোনো রাষ্ট্রভাষা ছিল কি না। তখন তিনি যুক্তিজাল বিস্তার করেন যে রাষ্ট্রভাষা হবে বাঙালির জন্য বাংলা, পাঞ্জাবিদের জন্য পাঞ্জাবি, সিন্ধিদের জন্য সিন্ধি প্রভৃতি।

    ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত একটি পত্রিকার ক্লিপিংয়ে দেখা গেল, সোহরাওয়ার্দী ঢাকার আরমানিটোলা পার্কে আয়োজিত এক জনসভায় বলেন, ‘উর্দুর সঙ্গে বাংলা সর্বত্র পাঠ্য হওয়া উচিত। তাঁর এই উক্তি শুনে শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে এবং অনেকেই জনসভা ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। কেউ কেউ চিৎকার করে বলেন, কায়েদে আজম তো ইতিমধ্যে আমাদের বলেছেন, কেবল উর্দুই হওয়া উচিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সোহরাওয়ার্দী তখন বলেন, ‘তিনিও কায়েদের সঙ্গে একমত। তবে কথা হলো, কায়েদে যখন যা-ই বলবেন, তা সব সময় সবটুকু সঠিক হতে পারে না। আমরা যা ভাবি সে অনুযায়ী কাজ করার অধিকার আমাদের আছে।’

    চুয়ান্নর ঐতিহাসিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পরে করাচিতে সোহরাওয়ার্দী একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। এ সম্পর্কে করাচির মার্কিন দূতাবাস ১৯৫৪ সালের ২০ মার্চ একটি প্রতিবেদন পাঠান। এতে দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দী নির্দিষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাকে অবশ্যই পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।

    http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/143851/%E0%A6%B8%E0%A7%8B%E0%A6%B9%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%80%E0%A6%B0_%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7_%E0%A6%AD%E0%A7%82%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE
  • Biplob Rahman | ০২ মার্চ ২০১৪ ১৫:৩৩582719
  • নিউজ পোর্টালের গর্বিত পথচলা
    বিপ্লব রহমান

    আন্তর্জাতিক বর্ণ সংকেতায়ন বা ইউনিকোডে বাংলা ভাষার লিপি যুক্ত হয়েছে বছর আটেক আগে। মুক্ত ইউনিকোড বাংলা ফন্ট অভ্র’র হাত ধরে এরপর অনলাইনে বাংলা ভাষার শুধুই এগিয়ে চলা। এ ভাষাতেই এখন তৈরি হচ্ছে জনমুখী নানা ওয়েবসাইট। বাংলাতেই গড়ে উঠেছে ইন্টারনেটভিত্তিক অসংখ্য সংবাদমাধ্যম বা নিউজ পোর্টাল। অভ্র ছাড়াও ইউনিকোডে যুক্ত হয়েছে আরো অনেক বাংলা ফন্ট। সাইবার বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে মহান একুশের অর্জন।

    খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, বাংলায় নিউজ পোর্টাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে ওপার বাংলার তুলনায় বাংলাদেশ বহুগুণে এগিয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগের দাম কমে আসায় এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। কালের কণ্ঠসহ দেশের প্রধান সারির বাংলা সংবাদপত্রগুলোও বেশ কয়েক বছর ধরে অনলাইনে প্রচার করছে তাৎক্ষণিক সংবাদ ও ছবি। থাকছে ভিডিওচিত্রও। প্রতি মুহূর্তের সংবাদ ও বিনোদনের জন্য খবরপিপাসু সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীরা টেলিভিশন ছাড়াও এখন গুরুত্ব দিচ্ছেন অনলাইন সংবাদকে।
    পরিষেবামূলক বিভিন্ন ধরনের পোর্টালও বাংলা ভাষায় তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশেই। এর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ, জ্বালানি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ের পোর্টাল বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

    ইন্টারনেট ব্যবহারবিষয়ক জরিপ সংস্থা আলেক্সার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় নিউজ পোর্টাল চার হাজারের বেশি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নিউজ পোর্টালের সংখ্যা শতাধিক। এসব ওয়েবসাইটের নিবিড় পাঠক (ইউনিক ভিউয়ার) সংখ্যা এরই মধ্যে ছাড়িয়েছে ১৫ লাখ।
    বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিন কোটি ছাড়িয়েছে। মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন প্রায় দুই কোটি ৮৭ লাখ মানুষ।

    অন্যদিকে প্রতিবেশী ভারতে জি-মিডিয়া গ্রুপের ২৪ ঘণ্টা ডটকম ছাড়া বাংলায় তেমন কোনো নিউজ পোর্টালই নেই। আলেক্সা জরিপে এই সাইটটির অবস্থান ভারতে ৮৩ তম। তাজা খবরও এতে পাওয়া যায় না। ওপার বাংলায় প্রধান সারির সব দৈনিকেরই অনলাইন সংস্করণ রয়েছে। তবে শীর্ষ দৈনিক ‘আনন্দবাজার’ ও ‘বর্তমান ছাড়া’ বাংলা ভাষার অন্যান্য সংবাদপত্রে তাৎক্ষণিক সংবাদ প্রচারের ব্যবস্থা নেই। আবার এসব সাইটেও তাৎক্ষণিক সংবাদ প্রচারের সংখ্যা খুব সীমিত।

    ওপার বাংলার লেখক ও ব্লগার শুভ্র ভট্টাচার্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত মেধাবী ছেলেমেয়েদের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে বাংলা ভাষা ত্যাগ। মধ্যম মেধার ছেলেমেয়েরা চাকরি ও পেশার ক্ষেত্রে দিল্লি-মুম্বাইমুখী। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের আরেক রঙ্গ হলো- বাংলা ভাষার প্রতি মুখ বেঁকিয়ে নাক সিটকিয়ে ইংরেজি-হিন্দিতে কে কত বড় পণ্ডিত তা জাহির করতে শিক্ষিত ব্যক্তিরাও তৎপর। ডেস্কটপ, ল্যাপটপের অভাব নেই। শুধু বাংলা লেখার উপায়টাই তাদের জানা নেই বিশেষ। হাতে হাতে মোবাইল। কিন্তু এসএমএস করতে এরা রোমান হরফেই বেশি স্বচ্ছন্দ। যে বাঙালি নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলে গর্বিত হয়, তাদের কাছে আর আশা করার কী থাকতে পারে।’

    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/02/11/50955#sthash.ijbvhu4G.dpuf
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন