এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Biplob Rahman | ১২ অক্টোবর ২০১৩ ১৯:৫৮582587
  • লেখকঃ সাখাওয়াত হোসেন। ফেবু পেজ: সাপ্তাহিক সেবা পাঠক ফোরাম
    ____
    ১১ অক্টোবর ২০১৩ শুক্রবার শহীদ কমরেড ওয়াজেদ আলী ও কামরুজ্জামান মনা’র ৩৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী
    কোন কোন মৃত্যু ইতিহাস হয়ে যায়। অমর হয়ে থাকে মানুষের হৃদয়ে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জন¯্রােতে উদ্বেল জোয়ার আনে। আমাদের দেশে সা¤্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ ও আমলা দালাল পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে যে বীর যোদ্ধারা শহীদ হয়েছেন কমরেড ওয়াজেদ আলী তাঁদেরই একজন।

    বাংলা ১৩৪৮ সালে ২ মাঘ ওয়াজেদ আলী কোটচাঁদপুরে মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান। পিতা হাজী মোঃ রহিমউদ্দিন, গ্রাম-পাইকপাড়া, থানা-কালীগঞ্জ, জেলা-ঝিনাইদহ। দশ ভাই দু’বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি বড়। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৬১ সালে কালীগঞ্জ হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ছাত্র রাজনীতি করার কারণে ঐ কলেজের অধ্যক্ষ আইএসসি পরীক্ষায় অঘোষিতভাবে দু’বার তাঁকে বহিস্কার করেন। পরে তিনি ঝিনাইদহ কেশবচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। যশোর এমএম কলেজ থেকে ’৬৮ সালে বিএসসি পাশ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন করতেন এবং মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অনুসারী হন। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি শ্রমিক-কৃষকসহ ব্যাপক জনগণের শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্ত করবার চিন্তা করতেন। ১৯৬৮ সালে মোবারকগঞ্জ চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়ে শ্রমিকদের উপর নির্যাতন-অত্যাচার ও ন্যায্য পারিশ্রমিক না দেওয়াসহ অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলেন। অফিসার ও শ্রমিকদের সাথে সংঘর্ষ হয়। এ সময় শ্রমিকসহ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে মিল কর্তৃপক্ষ। আদালতে উপস্থিত না হওয়ার কারণে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে। পরে এই আন্দোলনে শ্রমিকদের বিজয় হয়।

    ওয়াজেদ আলী রাজনীতির সাথে সাথে কোলাবাজার হাই স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। এ অঞ্চলে ব্যাপক কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন। কৃষকদের নিয়ে নদী সিকস্তি আন্দোলন করেন। তাঁর নেতৃত্বে দরিদ্র কৃষকরা জোতদার-মহাজনদের কাছ থেকে নদীর চর ভূমি ছিনিয়ে নেন। কামারাইল আন্দোলনে ৩৫ জনের সাথে ওয়াজেদ আলী’র নামেও মামলা দায়ের করে জোতদারেরা। এই মামলায় ১৫ জনের জেল হলে তাদের সংসারের সকল দায়ভার সাংগঠনিকভাবে বহন করার দায়িত্ব নেন তিনি।

    ১৯৬৯ সালে কালীগঞ্জে হাট খাজনা দ্বিগুণ করা হলে কৃষকদের নিয়ে অতিরিক্ত হাট খাজনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং এ আন্দোলন সফল হয়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্যাপক জোয়ারের সৃষ্টি হয়।

    কমরেড ওয়াজেদ আলী নিপীড়িত কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আত্মপ্রতিষ্ঠার চিন্তা ত্যাগ করে শ্রমিক-কৃষকের মুক্তির লক্ষ্যে সার্বক্ষণিকভাবে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেন। একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে ওয়াজেদ আলী কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর, ঝিনাইদহ, শালিখা, বাঘারপাড়া ও মাগুরা থানা প্রভৃতি এলাকায় কৃষক আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অপরিসীম ভূমিকা রাখেন।

    ১৯৭২ সালের শেষ দিকে মুজিব সরকারের ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী রক্ষীবাহিনী কালীগঞ্জে ক্যাম্প করে। আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীদের নির্মম অত্যাচার, হত্যা, নারী ধর্ষণ, নির্যাতনে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। একই সাথে প্রগতিশীল নেতা কর্মীদের এবং তাদের পরিবারের উপর আক্রমণসহ অন্যায় অত্যাচার শুরু করে। ওয়াজেদ আলী অভয় দেওয়ার জন্য অত্যাচারিত পরিবারগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং বিরোচিত সাহস যোগাতেন।

    শেখ মুজিব একাত্তরে রাজাকার, আলবদর ও দালালদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং পাশাপাশি বলেন “নকশাল দেখলেই গুলিকরো”। তার এই স্বৈরাচারী নির্দেশের হাজারো অপব্যবহার ঘটেছে বাংলাদেশে। মুজিব সরকার ও তার রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসী বাহিনী এই নির্দেশকে হত্যার লাইসেন্স হিসেবে গ্রহণ করে নিধন করে চলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ব্যক্তিগত শত্রু, এমনকি ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের। ১৯৭৪ সালের ১১ অক্টোবর কোলাবাজার সংলগ্ন একটি গ্রামে ওয়াজেদ আলী যখন অবস্থান করছিলেন সে সময় গোপন সূত্রে খবর পেয়ে যুবলীগের সহযোগিতায় কালীগঞ্জের রক্ষিবাহিনী সাদা পোশাকে অস্ত্র লুকিয়ে ঐ গ্রামে অবস্থান নেয় সকাল দশটার দিকে। আরো আধা ঘন্টা পর কয়েক গাড়ী রক্ষিবাহিনী এসে পৌঁছায় ঐ গ্রামে। সংবাদ পেয়ে ওয়াজেদ আলী বাড়ি থেকে বের হবার পর পরই সাদা পোশাকধারী ঘাতকরা তাদের পিছু নেয় এবং আক্রমণ করে। অন্যান্য নেতাদের বাঁচানোর জন্য ওয়াজেদ আলী মরিয়া হয়ে ওঠেন। সঙ্গীদের পিছু হটার পথ দেখিয়ে দিয়ে কামরুজ্জামান (মনা)সহ ওয়াজেদ আলী রক্ষীবাহিনীর পথ রোধ করে দাঁড়ান। সঙ্গী কামরুজ্জামান রক্ষীবাহিনীর গুলিতে গুরুতর আহত হন। এক পর্যায়ে স্থানীয় যুবলীগের গুন্ডাদের সহায়তায় রক্ষীবাহিনী এগিয়ে আসতে থাকে। তারা গুলি ছুড়ে আহত করে ওয়াজেদকে।

    ১৯৭৪ সালে ১১ অক্টোবরের বেলা সাড়ে ৩টা তখন। আহত অবস্থায় গরুর গাড়িতে করে রক্ষীবাহিনী কালীগঞ্জ পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে আসে। ঐ দিন ছিল হাটবার। আহত অবস্থায় ওয়াজেদ আলী বিরোচিতভাবে হাটের কৃষক জনতাকে আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য আহ্বান জানাতে থাকেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ঘাতক রক্ষীবাহিনী। তারা হাটের মাঝে তাকে আর কথা বলতে দেয়নি। আগে থেকেই গাড়ির সাথে তাঁর দেহ বাধা ছিল। এ অবস্থায় কাপড় দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে এবং তাকে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটাতে থাকে। এমনি নির্মম প্রহারের মধ্য দিয়ে থানা পরিষদ রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পরিচিত জন আর কেউ দেখতে পায়নি তাঁকে। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, “আমি ঢাকা যাওয়ার পথে ফেরিতে দেখেছি রক্ষীবাহিনীর সাথে বাধা অবস্থায়।” বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় ওয়াজেদকে ঢাকায় নিয়ে হত্যা করা হয়।
    প্রগতিশীল রাজনীতি করার কারণে তাঁর পরিবারের ওপর থানা পুলিশ, বিশেষ করে রক্ষীবাহিনীরা অসংখ্যবার অত্যাচার-নির্যাতন করেছে। ধরে নিয়ে গিয়েছে তার ভাইদের। তাদের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন করা হয়। শিশু সন্তানদের হত্যার হুমকি এবং বাড়ি লুটপাট করা হয়।
    ওয়াজেদ আলী কৈশোর থেকেই একজন দক্ষ ফুটবল খেলোয়ার ও তিক্ষèধী ক্রিকেটার ছিলেন। কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, যশোর, ঝিনাইদহ, নড়াইলসহ বিভিন্ন এলাকায় সকর স্তরের মানুষের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল। খুনী মুজিব সরকার অকালে ছিনিয়ে নিয়েছে একটি তরতাজা প্রাণ। ওয়াজেদ আলীর মত হাজার হাজার প্রগতিশীল কৃষক নেতা কর্মীদের রক্ত ঝরিয়ে এদেশের শোষক-শাসক শ্রেণী চেয়েছে কৃষক জনতার আন্দোলন-বিদ্রোহকে অংকুরেই বিনষ্ট করে দিতে। কিন্তু কৃষক আন্দোলনকে হত্যা করা যায় না। ইতিহাস তাই বলে। শহীদ কমরেড ওয়াজেদ আলীরা অমর। তাঁদের মহান আত্মত্যাগ আজো অনুসরণীয়।
    ___
    https://www.facebook.com/photo.php?fbid=313114402163812&set=a.294209804054272.1073741826.289016307906955&type=1
  • Biplob Rahman | ১২ অক্টোবর ২০১৩ ২০:০৭582588
  • মুক্তিযুদ্ধে নারী: ভূমিকা পর্ব
    লিখেছেন: শনিবারের চিঠি
    ____

    মুক্তিযুদ্ধ।

    যে কোনো বিচারেই বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাস। বাঙালি তাঁর আত্মোৎসর্গের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শনের মধ্য দিয়ে পেয়েছে তাঁর স্বাধীনতা; যে স্বাধীনতা কেবল একটি ভূ-খণ্ডেরই নয়, যে স্বাধীনতা সামগ্রিক অর্থে তাঁর অবিনাশী মুক্তির চিহ্নমালা। উনিশশো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তাই কেবল নয় মাসের ঘটনাই নয়, এর সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে তেইশ বছরের পাকিস্তানি শাসনের ক্ষত-বিক্ষত আখ্যান, জড়িয়ে আছে বাঙালির উদ্বেল মুক্তি-আকাঙ্ক্ষা।

    মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি অঙশগ্রহণ করেছিলো কেবল চেতনার আলোতে দাঁড়িয়েই নয়, এর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলো বছরের পর বছর বাঙালির লাঞ্ছনার ইতিহাস। নয়মাসের গেরিলা যুদ্ধ তাই কেবল পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা-নারী নির্যাতন আর বর্বরতার বিরুদ্ধেই ছিলো না, ছিলো ‘পাকিস্তানি ভূত দর্শন’- এর বিরুদ্ধে এবঙ আরও মোটা দাগে বললে, সাতচল্লিশে যে ধর্মভিত্তিক দ্বি-জাতিতত্ত্বে দেশভাগ হয়েছিলো- তার বিরুদ্ধে। সাঙস্কৃতিক-সামাজিক কিঙবা রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য ছাড়াই পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান একই অঙশে থাকলো, কেবল ধর্মের ভিত্তিতে। তাই একাত্তরের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির যে বিজয়, তা কেবল পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই বিজয় নয়; সামগ্রিকভাবেই এ বিজয় ‘পাকিস্তানি অপ-আদর্শ’-এর বিরুদ্ধে এবঙ ধর্মের ভিত্তিকে জাতিগত বিভাজনের বিরুদ্ধে।

    একাত্তর পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বাঙালি দেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। কিন্তু একাত্তরে তো কেবল অবকাঠামোরই ধ্বঙস হয়নি, নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে বুদ্ধিজীবী বাঙালিদের যাঁদের মেধার আলো অত্যন্ত প্রয়োজন ছিলো মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশে। বাহাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হলো সঙবিধান, যার পবিত্র স্পর্শে ফুটে উঠলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সূর্য। কিন্তু পঁচাত্তরের পরই দৃশ্যপট বদলে গেলো। এরপর দীর্ঘ সময় বাঙলাদেশ ছিলো সামরিকতন্ত্র ও মোল্লাতন্ত্রের ভয়াল মেঘমালার নিচে।

    মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচিত হয়েছে নানাভাবে। তথ্যকেন্দ্রীক এবঙ তত্ত্বকেন্দ্রীক। কিন্তু একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে কতোটুকু মূল প্রেক্ষাপটকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বা যেটুকু দেযা প্রয়োজন ছিলো, তা উঠে এসেছে। বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান নানাভাবে আলোচনায় এলেও তা কতোটুকু নারীর গৌরবকে তুলে এনেছে এবঙ কতোটুকু তুলে এনেছে নারীর লাঞ্ছনার ইতিহাস, তা বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ সামগ্রিক প্রশ্নেই একটি যুদ্ধ, যার মধ্যে রয়েছে নারীর গৌরবোজ্জ্বল অঙশগ্রহণের সাতকাহন। অনেকে জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন। ফিরে নাও আসতে পারে জেনেও সন্তানকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেন। ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অস্ত্র পাচার করেন, অস্ত্র লুকিয়ে রাখেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দান করেন। সাঙগঠনিক কাজে যুক্ত থেকে ঝুঁকি নিয়ে চিঠিপত্র আদান-প্রদান করেন। ভিক্ষুক সেজে পাক-হানাদারদের ক্যাম্পের তথ্য সঙগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দলে, ক্যাম্পে ক্যাম্পে, ফিল্ড হাসপাতালে সেবিকার কাজ করেন। অনেকে ফাস্ট এইড ট্রেনিঙসহ অস্ত্র চালনা ট্রেনিঙ ও গেরিলা ট্রেনিঙ নেন। অনেক নারীই সেদিন বিভিন্ন শিবিরে রান্না-বান্নার দায়িত্ব পালন করেন, কেউবা নিয়োজিত থাকেন জনমত সঙগঠনে ও যুদ্ধের জন্য অর্থ সঙগ্রহ করতে আবার কেউবা গানের স্কোয়াডে অঙশ নিয়ে, স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রে অঙশগ্রহণ করে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্লান্তি ভুলিয়ে তাঁদেরকে উজ্জীবিত করতে তৎপর থাকেন। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে আমাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে এই নারীদের সাহসী তৎপরতা, উৎসাহ, উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

    কিন্তু ১৯৭১ সালের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের উপর সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন গ্রন্থাবলী রচিত হলেও মুক্তিযুদ্ধে নারীদের গৌরবময় অবদানের উপর সুস্পষ্ট তেমন কোনো গ্রন্থ আমার চোখে পড়েনি। এটা আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতাও হতে পারে। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে গ্রন্থগুলোর সন্ধান লাভ আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে, তার অধিকাঙশই বর্ণনামূলক, যার মূলে রয়েছে স্মৃতিচারণ, ধারাবর্ণনা, সমকালীন রাজনীতি, যুদ্ধের অবস্থা, সাঙগঠনিক দিকের বর্ণনা ও বিশ্লেষণ। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থপঞ্জিতে [১] মুক্তিযুদ্ধের বইকে কতোগুলো বিষয়ভিত্তিক শিরোনামে ভাগ করেছেন, সেগুলো হলো:

    ক. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার প্রয়াস ও মূল্যায়ন;
    খ. অবরুদ্ধ দেশ;
    গ. প্রবাসী সরকার ও সঙগঠন ইত্যাদি;
    ঘ. বিদেশীর দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ;
    ঙ. মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন;
    চ. জেলা বা শহর পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ;
    ছ. গণহত্যা;
    জ. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

    আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন এসব বিভাজন পূর্ণাঙ্গ নয় বলে আরও কিছু সঙযোজন এনে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থপঞ্জি প্রণয়নের চেষ্টা করেছেন [২]। তা হলো:

    ক. মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি
    খ. মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক ইতিহাস রচনার প্রয়াস বা মূল্যায়ন;
    গ. প্রবাসী সরকার ও প্রবাসে বাঙালির প্রতিক্রিয়া;
    ঘ. মুক্তিযুদ্ধে বৈদেশিক প্রতিক্রিয়া;
    ঙ. পাকিস্তানি ও পাকিস্তনপন্থীদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ
    চ. মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গন বা সশস্ত্র সঙগ্রাম;
    ছ. অবরুদ্ধ বাঙলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ;
    জ. দলিলপত্র ও আলোকচিত্র;
    ঝ. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ;
    ঞ. সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ;
    ট. মুক্তিযুদ্ধে অন্যান্য বই ইত্যাদি।

    এ সমস্ত বিভাজনে মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজের অবদানের কোনো উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা গ্রন্থসমূহ শ্রেণীবিন্যাস করতে গিয়ে মুনতাসীর মামুন এবঙ দেলোয়ার হোসেন এমন কোনো গ্রন্থ পাননি, যা মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান বিষয়ক। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখাগুলি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯৭২-৭৫ সময়কালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিছু লেখালেখি হলেও ১৯৭৫-৯০ সাল পর্যন্ত এ বিষয়ে খুবই কম লেখালেখি হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর পুনরায় লেখালেখি শুরু হয় এবঙ ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতিদিনই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখা বের হচ্ছে। কিন্তু এ সকল লেখাতেও নারী মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় অনুপস্থিত। এ পর্যন্ত রচিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ (যেগুলো পাঠের সুযোগ হয়েছে) নারীর ভূমিকা যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, তা নিম্নরূপ:

    ক. কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত পনেরো খণ্ডের দলিলপত্রের [৩] তের হাজার পৃষ্ঠা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের উপর তেমেন কোনো আলোচনা স্থান লাভ করেনি। শুধু অষ্টম খণ্ডে কিছু নির্যাতিতা নারীর সাক্ষাৎকার রয়েছে, যা থেকে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক সুদীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এদেশের নারী সমাজের উপর যে বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিক অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড সঙঘটিত হয়েছে তার বিবরণ পাওয়া যায়।

    খ. ফোরকান বেগম তাঁর রচিত গ্রন্থে [৪] তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে অঙশগ্রহণের মাধ্যমে যে অবদান রেখেছেন, তা মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন। তবে এ গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়িত না হলেও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান মূল্যায়নের প্রাথমিক প্রয়াস বলা যায়।

    গ. তপন কুমার দে তাঁর রচিত গ্রন্থে [৫] বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো, তা কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

    ঘ. শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর রচিত গ্রন্থে [৬] মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ঢাকার ঘটনাবলী দিনলিপি আকারে উপস্থাপন করেছেন। পহেলা মার্চ, ১৯৭১ থেকে শুরু করে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি ঘটনাবলী তুলে ধরেছেন। এই গ্রন্থটিতে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ফ্রেমের প্রাধান্য থাকলেও গেরিলা অপারেশন, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও পাকবাহিনীর অমানবিক নির্যাতন নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। তবে তাঁর গ্রন্থে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বা মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের কথা বিশদভাবে উঠে আসেনি।

    ঙ. বেগম সুফিয়া কামাল তাঁর রচিত গ্রন্থে [৭] দেশের ভিতর থেকে মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। আলাদা শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজের অঙশগ্রহণের কথা বর্ণনা না করলেও তাঁর ডায়রিতে মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজের সক্রিয় অঙশগ্রহণের চিত্র তুলে ধরেছেন।

    চ. বেগম মুশতারী শফী তাঁর রচিত গ্রন্থে [৮] চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ সঙগঠিত হবার প্রাক্কালের ইতিহাস তুলে ধরেছেন গুরুত্বপূর্ণ দিকের অবলোকনে। ব্যক্তিগত জীবনের আখ্যান পেরিয়ে সুজিবনগর সরকার ও স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সঙশ্লিষ্ট নারী-পুরুষের মুক্তিযুদ্ধে অঙশগ্রহণের নিরপেক্ষ বিবরণ দিয়েছেন। এছাড়া এখানে ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।

    ছ. বেগম মুশতারী শফী রচিত অপর গ্রন্থে [৯] মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের সঙগ্রামী নারীদের সাহসী অবদানের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। যদিও চট্টগ্রামের গ্রামগঞ্জের নারীদের নানা ভূমিকা থাকলেও সবকিছু এই গ্রন্থে লেখকের পক্ষে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। তারপরও তাঁর এই অঞ্চলভিত্তিক লেখা গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধে নারীর সাহসী অবদানের মূল্যায়ন করা হয়েছে।

    জ. সাইদুজ্জামান রওশন, তুষার আবদুল্লাহ সম্পাদিত গ্রন্থে [১০] মুক্তিযুদ্ধে অঙশগ্রহণকারী কিছু নারীর স্মৃতিচারণমূলক অভিজ্ঞতার বর্ণনা থাকলেও এখানে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি।

    ঝ. ফরিদা আক্তার সম্পাদিত গ্রন্থটি [১১] তার নামকরণেই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। তবে এই গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এ গ্রন্থের আলোকেই মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের ক্ষীণ উপস্থাপনের একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। আশ্চর্য হলেও সত্য, ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত গ্রন্থেও তিনি কী যুক্তিতে ‘মহিলা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তা আমার বোধগম্য নয়। স্মৃতিচারণমূলক অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত এ গ্রন্থে কতিপয় নারী মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা ফুটে উঠলেও, তা কোনো সামগ্রিক রূপ ধারণ করেনি।

    উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে নারীরা যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, সে বিষয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ কিঙবা প্রবন্ধসমূহের কোনোটিতেই সামগ্রিক অর্থে গবেষণা বিচারে নারীর ভূমিকা উঠে আসেনি। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের প্রশ্নে অধিকাঙশ ক্ষেত্রেই সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিক্ষিপ্ত আলোচনা হয়েছে, কিন্তু গবেষকের দৃষ্টিকোণ থেকে গৃহীত হয়নি তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সিদ্ধান্ত। ২০০৭ সালে বাঙলা একাডেমি শাহনাজ পারভিনের একটি গ্রন্থ [১২] প্রকাশ করে, যেখানে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আন্দোলনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অবদানের আলোচনা করা হয়, এবঙ তার আলোকেই আসে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের বিষয়টি। সন্দেহ নেই, লেখক যথেষ্ঠ পরিশ্রম করেছেন এবঙ চেষ্টা করেছেন যথাসাধ্য মূল বিষয়গুলো তুলে আনতে, কিন্তু এর জন্য গ্রন্থটির আকার যা হবার কথা ছিলো, তা হয়নি। ফলে অনেকক্ষেত্রেই লেখককে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে নয়, লেখককের বিবেচনাবোধের জায়গা থেকে। ফলে সম্পূর্ণ না হলেও আঙশিক, কখনও কখনও খাপছাড়া ইতিহাস উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান সম্বন্ধে।

    মুক্তিযুদ্ধে নারীর কী অবদান, এবঙ কোন কোন ক্ষেত্রে তা কীভাবে প্রভাব ফেলেছিলো, তার একটি বিস্তারিত লেখা তৈরি করাই এই নিবন্ধটির উদ্দেশ্য। ঠিক কী কী বিষয় নিয়ে সামনে আলোচনা করবো, তা এখনই ঠিক উল্লেখ করা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ- পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে তথ্য ও গবেষণালব্ধ গ্রন্থের উপর।

    মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেমন আলোকোজ্জ্বল এবঙ বর্ণিল আখ্যানে আকাশমুখী, তেমনি এ মহাসঙগ্রামে নারীর অঙশগ্রহণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট ও সুলিখিত গবেষণা না থাকায়, তার আভার খামতি থেকে যায়, সন্দেহ নেই। সেই তাড়না থেকেই এ যাত্রা; জানি না কতোদূর যেতে পারবে লেখাটি।

    তথ্যসূত্র

    ১. মুনতাসীর মামুন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বই’, একুশের প্রবন্ধ ৯০ (ঢাকা: বাঙলা একাডেমি, ১৯৯০), পৃষ্ঠা: ২২-৪১
    ২. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থপঞ্জী (ঢাকা: মূলধারা, ১৯৯১), পৃষ্ঠা: ১৬-১৭
    ৩. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ঢাকা: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তথ্য মন্ত্রণলালয়, ১৯৮৪)
    ৪. ফোরকান বেগম, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারী, (ঢাকা: সুমি প্রিন্টিঙ প্রেস এন্ড প্যাকেজিঙ, ১৯৯৮)।
    ৫. তপন কুমার দে, ‘মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজ’, (ঢাকা: নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ১৯৯৮)
    ৬. জাহানারা ইমাম, ‘একাত্তরের দিনগুলি’ (ঢাকা: সন্ধানী প্রকাশনী, ১৯৮৬)
    ৭. সুফিয়া কামাল, একাত্তরের ডায়রী, (ঢাকা: জ্ঞান প্রকাশন, ১৯৮৯)
    ৮. বেগম মুশতারী শফী, স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন (ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী, ১৯৯২)
    ৯. বেগম মুশতারী শফী, মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী (চট্টগ্রাম: প্রিয়ম প্রকাশনী, ১৯৯২)
    ১০. সাইদুজ্জামান রওশন, তুষার আবদুল্লাহ (সম্পাদিত), একাত্তরের অগ্নিকন্যা, (ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী, ১৯৯৭)
    ১১. ফরিদা আক্তার সম্পাদিত, ‘মহিলা মুক্তিযোদ্ধা’, (ঢাকা: নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা, ১৯৯৪)

    ২৫ আশ্বিন, ১৪২০
    ___
    http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=37740
  • Biplob Rahman | ১২ অক্টোবর ২০১৩ ২০:১২582589
  • স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল-পর্ব দুই
    লেখকঃ সাব্বির হোসাইন
    ___________
    জিন্নাহর অখন্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন আজ রক্তস্নাত

    পাকিস্তানের পূর্বাংশের রাজধানী ঢাকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে; অখন্ড পাকিস্তানের শেষ আশার প্রদীপ নিভে গেছে।
    পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর দ্বিজাতি ত্বত্তের ভিত্তিতে শুধুমাত্র ধর্মের মেলবন্ধনের উপর নির্ভর করে ভৌগলিকভাবে বিশাল ভারতকে মাঝখানে রেখে পরস্পর হতে হাজার মাইল দূরে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটো অংশকে একত্রিত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে, ধর্ম ব্যাতীত পাকিস্তানের দু’অংশের মানুষদের কোন কিছুতেই মিল নেই।
    পাকিস্তানের পূর্বাংশে সাত কোটি বাঙালীর বসবাস। এই পূর্বাংশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত বাঙালীর নেতা শেখ মুজিবর রহমান এবং পূর্ণ কেন্দ্রীয় শাসনের পক্ষপাতী পশ্চিমাংশের নেতা ভূট্টোর মাঝে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আশা যখন দেখা যাচ্ছিল, ঠিক তখনই পূর্বাংশে গৃহযুদ্ধ শুরু হলো।

    উদ্ভুত সংকটের জন্য ভূট্টোকে দায়ী করা হচ্ছে…

    সত্তরের ডিসেম্বরে অনুষ্টিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের নেতা ভূট্টোর পিপল’স পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও পূর্বাংশের নেতা শেখ মুজিবের আওয়ামীলীগ পুরো পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। কিন্তু ভূট্টো বাঙালীর স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিরোধীতা করায় সংসদ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
    গণতান্ত্রিক সরকার কাঠামো গঠনের জন্য মুজিব, ভূট্টো ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার মাঝে আলোচনাকে আরো সময় দেয়ার উদ্দেশ্য এই সপ্তাহের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জাতীয় সংসদের কার্যক্রম স্থগিত করে ইয়াহিয়া বলেন, পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখতে সেনাবাহিনী যেকোন পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
    মুজিব-ভূট্টোকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত অচলাবস্থা নিরসনের জন্য এই সপ্তাহের শুরুতে শেখ মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া বারো দিন আগে ঢাকায় এসেছিল। পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলগুলোর ও সামরিক সরকারের প্রধানরা এই আলোচনায় যোগ দেয়। ভূট্টোও এই আলোচনায় অংশ নেবার সম্মতি জানিয়েছিল। কিন্তু ভূট্টো, তার দাবি মানা না হলে জাতীয় সংসদ বর্জনের হুমকি দিয়েছিল।
    আলোচনাটি পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছিল, ইয়াহিয়া অখন্ড পাকিস্তান রক্ষার্থে পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে সমঝোতা সৃষ্টি করতে পারবেন। এই আশায় পশ্চিম-পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো “বিবাদ মীমাংসিত” শিরোনামে খবর প্রকাশ করেছিল। কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তানী সৈন্য ও পুলিশের সাথে নিপীড়িত বাঙালীর সংঘর্ষ লেগেই আছে। তিন সপ্তাহ আগে, এরকম এক সংঘর্ষে সরকারিভাবে ১৭২ জন বাঙালী নিহত হবার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

    নিঁচু জাত…

    পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পশ্চিমাংশের মানুষরা পূর্বাংশের বাঙালীদের নিঁচু জাতের মানুষ ভেবে এসেছে। পদে পদে বাঙালীদের নিষ্পেষণ করেছে। পশ্চিম-পাকিস্তানের নিপীড়ন হতে বাঙালীদের বাঁচাতে শেখ মুজিব পূর্ব-পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন।
    এখানে সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি হলো, পূর্ব-পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য শেখ মুজিব দাবি উত্থাপন করলে, ভূট্টোও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবি করে কিন্তু কোন এক অজানা কারণে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে মিল থাকার পরও মুজিব-ভূট্টো শেষ পর্যন্ত একমত হতে পারলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানীদের চোখে বাঙালীরা নিঁচু জাত, এটাই কি অনৈক্যর মূল কারণ?
    স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে শেখ মুজিবের আহবানে বাঙালীরা অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন করছিল। অন্যদিকে, পশ্চিম-পাকিস্তানীরা ‘আন্দোলন’ নসাৎ করতে পূর্ব-পাকিস্তানে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে ও কারফিউ জারি করে জনজীবন অতিষ্ট করে তুলেছে।

    চাপের মুখে ইয়াহিয়া…

    ইয়াহিয়ার অধীনে অনুষ্ঠিত সত্তরের ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনের উদ্দেশ্য ছিল, সামরিক সরকার হতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে তুলে দেয়া কিন্তু অনেক ‘উর্ধ্ধতন পশ্চিম-পাকিস্তানী সেনা-অফিসার’ বিষয়টিকে মেনে নিতে পারেনি। এর প্রেক্ষিতে, পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের রাজধানী করাচীতে সেনা অভ্যুত্থান হবার আশংকা করা হয়েছিল।
    অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ‘সামরিক সরকারের অধীন অখন্ড পাকিস্তান’ চায়, এমন ‘উর্ধ্ধতন পশ্চিম-পাকিস্তানী সেনা-অফিসারদের’ চাপে ইয়াহিয়া বাঙালীদের নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে। যার ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে পূর্ব-পাকিস্তান; বাঙালীদের স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলা দেশ’।

    ---
    http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=37695
  • Biplob Rahman | ০১ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৮:০৩582590
  • বীরঙ্গনার বিপর্যয়গাথা:
    আমার লাশ দাহের সময় মুক্তিযোদ্ধারা যেন পাশে দাঁড়ায়
    অমিতাভ দাশ হিমুন, গাইবান্ধা
    _____________________
    ‘মা’ বলে ডাক দিতেই জং ধরা টিনের দরজা খুলে গেল। একটি শিশুর হাত ধরে উঠানে বেরিয়ে এলেন রাজকুমারী ফুলমতি রানী রবিদাস। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার এই ফুলমতি। ষাটোর্ধ্ব এই ‘বীরাঙ্গনা’ এখন আর কারো সাহায্য ছাড়া একা চলতে পারেন না। সারা শরীরে অসুস্থতার চিহ্ন। কপালে বলিরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
    সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ নির্বাক থাকলেন। তারপর একসময় মুখ খুললেন বীরাঙ্গনা, ‘বছর বছর এত কিছু বলে কী লাভ? আমি তো টাকাপয়সা চাইনি। এত দিন পরও আমার প্রাপ্য সম্মান আর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলাম না। সম্মান হিসেবে গত ৪২ বছরে পেয়েছি দুই বান্ডিল ঢেউটিন আর স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া সম্মাননা।’ পাকিস্তানি বাহিনীর পাষণ্ডদের হাতে লাঞ্ছিত, অপমানিত এই নারী ৪২ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় সম্মানের জন্য ঘুরেছেন প্রশাসন, রাজনীতিক ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে। তারপরও সেই সম্মান অর্জন করতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন ছাড়াও গোটা জেলার সচেতন মানুষের কাছে বীরাঙ্গনা হিসেবে পরিচিত তিনি। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে থেকে গেছেন উপেক্ষিত, অবহেলিত দেশের জন্য সম্ভ্রমহারানো এই দুঃখিনী মা।
    গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলা সদরের উত্তরপাড়া এলাকার রাস্তার ধারে খাস জমিতে টিন, বাঁশ আর খড়ের তৈরি বাড়িতে ছেলে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে বাস করেন ফুলমতি রানী। এই বাড়িতেই স্বামী ফসিরাম রবিদাসকে বেঁধে রেখে ফুলমতির ওপর স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় কয়েক দিন ধরে নির্যাতন চালায় পাকিস্তানি সেনারা। সেদিনকার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এককালের রূপবতী ফুলমতির নিষ্প্রভ চোখ দুটোতে হঠাৎ যেন আগুন জ্বলে ওঠে। বলেন, সাদুল্যাপুরের আশপাশের এলাকায় হানাদারদের ঠেকাতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধযুদ্ধের সময় ফসিরাম বিভিন্নভাবে তাদের সহায়তা করে। একাত্তরের এপ্রিল মাসে হানাদাররা সাদুল্যাপুরের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি ক্যাম্প করলে মুক্তিযোদ্ধারা ধীরে ধীরে নিরাপদে সরে যায়। অনেকেই ফুলমতিদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বললেও তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। নানা অছিলায় রাজাকাররা বাড়ির চারপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করত। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি একদিন দুপুরে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল আচমকা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তাঁর স্বামীকে অস্ত্রের মুখে বেঁধে ফেলে তারা ফুলমতির ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দিয়ে দিনের পর দিন চলে একই অত্যাচার। চোখভরা জল নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করেন এই অসহায় নারী।
    সাদুল্যাপুর ডিগ্রি কলেজের সাবেক সহকারী অধ্যাপক মুক্তিযোদ্ধা আনসার আলী সরকার জানান, নির্যাতিত হওয়ার পর একটি যুবতী গৃহবধূর তীব্র শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার দৃশ্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা স্বচক্ষে দেখেছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ইউনিয়ন পরিষদ, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, স্থানীয় প্রশাসনের প্রত্যয়নপত্র জমা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তিনি স্বীকৃতির আবেদন করেছেন। বহুবার নিজে গিয়ে ও ছেলেকে পাঠিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। অথচ মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও অনেকে ত্বরিত গতিতে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পেয়েছেন।
    চোখ মুছতে মুছতে রাজকুমারী ফুলমতি শোনালেন তাঁর দুঃখগাথা। চার ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। ১৯৮৮ সালে স্বামীকে হারিয়ে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাঁকে। দিন এনে দিন খাওয়া সংসারে অনেক লড়াই-সংগ্রাম করেই ছেলেমেয়েদের বড় করতে হয়েছে। একপর্যায়ে বংশানুক্রমিক জুতা সেলাই পেশায়ও নামতে হয়েছে তাঁকে। মেয়ে সপ্তমী রানীর বিয়ে দেওয়ার পর তৃতীয় ছেলে কলেজছাত্র মনিরাজের ওপর ভর করেই বেঁচে আছেন তিনি। অন্য ছেলেরা আলাদা হয়ে গেলেও ছোট ছেলে সুজন ও এক নাতনি আছে তাঁর সংসারে। দিন দিন তাঁর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে। জোরে কথা না বললে কানেও তেমন শোনেন না। শরীরে কর্মক্ষমতা নেই বললেই চলে। মাঝেমধ্যে তলপেটের ব্যথায় ছটফট করেন। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হলেও স্মৃতিশক্তি এখনো কমেনি। স্মৃতিতে ভেসে ওঠা পাকিস্তানি বাহিনীর সেই নির্যাতনের দৃশ্যগুলো এখনো তাড়া করে ফেরে তাঁকে।
    ফুলমতি বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল তাঁর কাছে এসেছিল। ওই ঘটনার পর মনের দিক থেকে ভেঙে পড়লেও মুক্তিযোদ্ধাদের সান্ত্বনা তাঁকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন আমাকে মা ডেকে বলেছিল, দেশের জন্য আপনার এই মহান আত্মত্যাগের কথা জাতি কোনো দিন ভুলবে না। কিন্তু স্বাধীনতার পর একে একে ৪২ বছর পার হলো। আমি আমার ত্যাগের স্বীকৃতি পাইনি। এ জন্য মনে এখন আর কোনো ক্ষোভও নেই। তবে হতাশা আছে।’
    ফুলমতি রানীর কলেজপড়ুয়া ছেলে মনিরাজ জানান, দেশের জন্য মায়ের এমন ত্যাগের কথা শুনে তাঁর গর্ব হলেও দুঃখ পেতে হয় রাষ্ট্রের এমন অবহেলার কথা ভেবে। রবিদাস সম্প্রদায়ের মানুষ না হলে হয়তো এত দিনে তাঁর মায়ের স্বীকৃতি মিলত। তিনি বলেন, আশা ছিল মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার সরকারের সময় তাঁর মা ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে ভূষিত হবেন। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।
    স্থানীয় কলেজ শিক্ষক তাজুল ইসলাম রেজা বলেন, ফুলমতির আর্থিক সংগতি থাকলে হয়তো এই পরিস্থিতির শিকার হতে হতো না। হয়তো স্বীকৃতিও পেতেন তিনি। তিনি বলেন, তাঁর নিজের বসবাসের জন্য কোনো ভিটেমাটিও নেই। মাথা গোঁজার জন্য অন্তত স্থায়ীভাবে ঘরবাড়ি করে দেওয়া দরকার।
    সাদুল্যাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মেছের উদ্দিন সরকার বলেন, সংসদের পক্ষ থেকে যাচাই-বাছাইকালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফুলমতি রানীর নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু তাঁর নাম ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে গেজেটে অন্তর্ভুক্তির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
    জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মাহমুদুল হক শাহজাদা বলেন, ‘কেন ফুলমতির বীরাঙ্গনা খেতাব জুটছে না তা তিনিও বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, ফুলমতিদের ত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে না পারলে আমরা বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হব।’
    জেলা পরিষদের প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ শামসউল আলম হীরু বলেন, জেলা পরিষদ এই বীরাঙ্গনাকে সম্মাননা জানিয়েছে। তিনি নিজে তাঁর জন্য সুপারিশ করেছেন।
    বিদায় নেওয়ার সময় রাজকুমারী ফুলমতি বললেন, ‘বাবা লিখে দিস, আমার মৃত্যুর পর লাশ দাহ করার সময় যেন মুক্তিযোদ্ধারা আমার সন্তানদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়ায়। সেটাই হবে আমার বড় স্বীকৃতি।’

    http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2013/12/01/26154
  • Biplob Rahman | ০১ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৮:০৭582591
  • স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও মেলেনি সনদ-সম্মাননা
    আশরাফ-উল-আলম
    ________________________________
    স্বাধীনতার ৪২ বছর পার হলো, কিন্তু একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের কোনো সনদ মেলেনি আজও। মেলেনি কোনো সম্মাননাও। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ গত ২০ বছরে দুইবার ক্ষমতায় এলেও বীরাঙ্গনাদের সরকারি স্বীকৃতি, তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়নি।
    স্বাধীনতার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় লাঞ্ছিত, নির্যাতিত নারীদের বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়েছিলেন। তাঁদের ভরণপোষণসহ পুনর্বাসনের ভার রাষ্ট্র নেবে- এ ধরনের কথাও দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর বীরাঙ্গনাদের দিকে কোনো সরকার মুখ ফিরে তাকায়নি। শুধু বীরাঙ্গনা খেতাবটিই রয়ে গেছে তাঁদের। যাঁদের সম্মানের বিনিময়ে, ত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা, আজও তাঁদের মুক্তিযোদ্ধার সনদ না পাওয়া রাষ্ট্রের ব্যর্থতা- এ কথা বলা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। দেশের সচেতন মহল থেকেও বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। এমনকি বীরাঙ্গনারাও মুক্তিযুদ্ধের সনদসহ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি করে আসছেন। কিন্তু ফল হয়নি কিছুই। বীরাঙ্গনারা রয়ে গেছেন অবহেলিতই।
    দেশের বিশিষ্টজনরা মনে করেন, বীরাঙ্গনাদের ত্যাগের বিনিময়েও স্বাধীনতা এসেছিল। কাজেই তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের সনদ দেওয়া উচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করার অধিকার তাঁদেরও রয়েছে। তাঁদের সন্তানসহ ওয়ারিশরা একই সুবিধা পাবে- এটাই তো স্বাভাবিক। বীরাঙ্গনার অবদান অস্বীকার করা অমানবিক বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
    মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরও দেশে বীরাঙ্গনাদের প্রকৃত সংখ্যা কত, এরও হিসাব করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বীরাঙ্গনাদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্য ড. নীলিমা ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ‘নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র’ গঠন করে বঙ্গবন্ধু সরকার। জেলায় জেলায় এ কেন্দ্র বীরাঙ্গনাদের তালিকা করে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের নির্মমভাবে হত্যার পর এসব পুনর্বাসন কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়।
    খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতা অর্জনের ৪২ বছর পার হওয়ায় এই দীর্ঘ সময়ে নীরবে নিভৃতে হারিয়ে গেছেন বীর মায়েদের অনেকেই। স্বল্প যে কজন বীর নারী এখনো রয়েছেন নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে, তাঁদের ভাগ্যে জোটেনি কিছুই। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটিও যোগ হয়নি তাঁদের নামের পাশে। উল্টো সমাজ-সংসারের কাছ থেকে অনেকের ভাগ্যে জুটেছে আরো বেশি লাঞ্ছনা, হয়রানি আর নির্যাতন। সমাজের অনেকেই তাঁদের স্বাভাবিক চোখে দেখেনি।
    মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও খাবার সরবরাহ, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রুষা থেকে শুরু করে গোয়েন্দাগিরি, সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর অনেকে আটক হন রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। শিকার হন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের। সম্ভ্রম হারান। এই বীরাঙ্গনাদের অনেকে এখনো বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। তাঁদের আবাসনের ব্যবস্থা নেই। ক্ষুধার অন্ন নেই। খোঁজখবর নিতে গিয়ে এ রকম অনেক চিত্র দেখা গেছে।
    সরকারিভাবেও বীরাঙ্গনাদের খোঁজখবর নেওয়া হয়নি কখনো। কোনো শুমারিও হয়নি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম জনসভায় বলেছিলেন, দুই থেকে আড়াই লাখ নারী যুদ্ধে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পরে এ সংখ্যাটিকেই সরকারি পরিসংখ্যান হিসেবে গণ্য করা হয়।
    ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর গণহত্যাবিষয়ক একটি বিশেষ প্রকাশনা থেকে জানা যায়, দুই থেকে আড়াই লাখের পরিসংখ্যানটি সে সময়ের সরকারি কর্মকর্তারা অনুমানের ভিত্তিতে তৈরি করেছিলেন। তাঁদের হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশের থানাগুলোর ২৭০টিই পাকিস্তানি সেনাদের দখলে ছিল। প্রতিদিন গড়ে দুজন করে নিখোঁজ নারীর হিসাব অনুযায়ী লাঞ্ছিত মহিলার সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ। ১৯৭২ সালে ওয়ারক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি একাত্তরের নারী নির্যাতনের একটি সামগ্রিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে জানা যায়, একাত্তরে বন্দি ও নির্যাতিতার সংখ্যা চার লাখ ৬৮ হাজার। এর মধ্যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার তিন লাখ সাত হাজার ৬০০ এবং বিভিন্নভাবে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি ও নির্যাতিত নারী এক লাখ ৪০ হাজার ৪০০। সরকারের একজন কর্মচারী হয়েও মুক্তি মেলেনি, এমন নারীর সংখ্যাও ছিল অগণিত। এ ছাড়া যুদ্ধের সময়ে শুধু শারীরিক নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি পাকিস্তানি বাহিনী, ৭৫৫ নারীকে ‘কমফোর্ট গার্ল’ হিসেবে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তারা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অপহরণ করে নিয়ে এসব নারীকে করাচি ও কোয়েটার বন্দিশিবিরগুলোতে রাখা হয়। তাঁদের ওপর অমানুষিক দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। যুদ্ধকালে কমপক্ষে ২৫ হাজার নারী পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা হন।
    স্বাধীনতার পর বিভিন্ন দেশের বেসরকারি সংগঠন এ দেশে এসে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও বীরাঙ্গনাদের তালিকা তৈরি করে। ওই সব সংগঠনের হিসাব মতে বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা অনেক বেশি। তালিকা ছাড়াও আরো অনেক বীরাঙ্গনা ছিলেন। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে এসব তালিকায় নাম লেখাতে চাননি। সরকারি কোনো তালিকা নেই। অনেকে স্বীকার করেননি যে তাঁরা বীরাঙ্গনা ছিলেন। তবে পরিবার ও সমাজ কিছু নারীকে নির্যাতিত হিসেবে চিহ্নিত করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাঁরা অমানবিক জীবন যাপন করছেন এখনো। তাঁরা সরকারিভাবে স্বীকৃতি চান, পুনর্বাসন চান।
    মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিরাজগঞ্জ জেলার ৩০ জন বীরাঙ্গনাকে সঙ্গে নিয়ে একই মঞ্চে ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁদের ‘মা’ ডেকেছিলেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেদিনের সেই স্মৃতি ছাড়া বীরাঙ্গনাদের ঝুলিতে আনন্দের-সুখের-সম্মানের আর কোনো স্মৃতি নেই। অনেক জেলার বীরাঙ্গনাদের সেই স্মৃতিও নেই। তাঁদের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। জোটেনি এতটুকু আশ্রয়। এমনকি সংসার হারানো, স্বামী তাড়ানো, সমাজের অবহেলিত, নিগৃহীত এই যে নারীরা প্রাণান্তকর সংগ্রাম করে চলেছেন, তাঁদের জন্য ন্যূনতম ভাতাও কখনো বরাদ্দ হয়নি। ২০১২ সালে সরকারের পক্ষ থেকে বীরাঙ্গনাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সমান সম্মানী ভাতা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো তা চালু করা হয়নি। প্রায় দেড় লাখ মুক্তিযোদ্ধা এ ভাতা পেয়ে থাকেন।
    একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক যে এখনো বীরাঙ্গনাদের সরকারিভাবে কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর এবার নিয়ে দুইবার স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তারাও বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি দেয়নি। এটা আরো দুর্ভাগ্যজনক।’
    শাহরিয়ার কবির বলেন, এখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি ক্ষমতায়। বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযুদ্ধের সনদ বা সরকারিভাবে স্বীকৃতি এ বিজয়ের মাসেই দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, এখনো বীরাঙ্গনারা অর্ধাহারে-অনাহারে থাকেন। চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে জীবন চালাচ্ছেন। অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁদের পুনর্বাসন সরকারিভাবে হওয়া উচিত। একাত্তরে নির্যাতনের শিকার অনেকেই সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে বীরাঙ্গনা হিসেবে নিজেকে স্বীকার করতে চান না। তবে বেশ কিছু নারীকে সমাজ ও পরিবার বীরাঙ্গনা হিসেবে চিহ্নিত করলেও তাঁরা অবহেলার পাত্রী হয়ে আছেন। এটাও অমানবিক। তাঁদের পুনর্বাসন ও স্বীকৃতি সরকারিভাবে হওয়া উচিত বলে শাহরিয়ার কবির মনে করেন।
    জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. এস এন আনোয়ারা বেগম বলেন, একাত্তরে নির্যাতিতাদের সরকারিভাবে স্বীকৃতি বা সনদ দেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়ে গেছেন। এটাই তাঁদের স্বীকৃতি। বীরাঙ্গনাদের অনেকে মারা গেছেন। এখনো অনেকে জীবিত রয়েছেন। সমাজও তাঁদের বীরাঙ্গনা হিসেবে দেখে। তাঁদের অবশ্যই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা উচিত।
    এ বছর শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে মুক্তিযোদ্ধা-জনতা মহাসমাবেশে একাত্তরের বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চান। সিরাজগঞ্জ থেকে আসা সূর্য বেগম, রাহেলা বেগম, করিমন বেগম, নুরজাহান, আয়শা বেগম, রাজু বালা, সামসুন নাহার, জ্যোৎøা, রহিমা বেগম, গোপালগঞ্জ থেকে শেখ ফাতেমা আলী, রংপুরের মোমেনা বেগম, যশোরের রাইসা বেগম ও নারিন্দার সাবিহা বেগমের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় এ দাবি। তাঁরা পুনর্বাসনেরও দাবি জানান।
    গত ২৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় গ্রন্থাগারের সেমিনার কক্ষে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র নারী কমান্ডার আশালতা বৈদ্যের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একাত্তরের বীরাঙ্গনারা এসেছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার খালেদা বেগম, লাইলী বেগম, মুন্সীগঞ্জের কাঞ্চনমালাসহ আরো অনেকে এসেছিলেন এ অনুষ্ঠানে। তাঁরা ড. মহীউদ্দীনের পা জড়িয়ে ধরে সরকারি স্বীকৃতি ও মুক্তিযোদ্ধার সনদ দাবি করেন। তাঁরা জানান, এখনো তাঁরা সমাজে অবহেলিত। তাঁরা আর কিছু চান না, শুধু স্বীকৃতিটা চান।
    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2013/12/01/26155#sthash.80eojkJM.dpuf
  • Biplob Rahman | ০১ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৮:১০582592
  • বাংলাদেশের বন্ধু নোরা শরীফ আর নেই
    কালের কণ্ঠ ডেস্ক

    বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ পদকপ্রাপ্ত ব্রিটিশ-আইরিশ নাগরিক ব্যারিস্টার নোরা শরীফ আর নেই। গত শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ১১টায় লন্ডনে নিজ বাসভবনে তিনি ইন্তেকাল করেন। ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের সহধর্মিণী মিসেস নোরা শরীফ দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
    জীবনের শেষ লগ্নে নোরা শরীফ নিজ বাসভবনেই অবস্থান করছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। মৃত্যুশয্যায় স্বামী সুলতান শরীফ ছিলেন তাঁর পাশে। তিনি স্বামী সুলতান শরীফ, মেয়ে ফৌজিয়াসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ব্যারিস্টার নোরা শরীফকে গত বছর ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ পদকে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার।
    জন্মসূত্রে আইরিশ নাগরিক ব্যারিস্টার নোরা শরীফ শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই নয়, এর আগে থেকেই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৭ সালে সুলতান শরীফের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই এই সংগ্রামী নারীর ঘনিষ্ঠতা শুরু হয় ব্রিটেনের বাঙালিদের সঙ্গে। সুলতান শরীফের কাছ থেকে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ভারত ভাগের পর পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি, বাঙালিদের প্রতি পশ্চিমাদের বৈষম্যনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জেনে বাঙালিদের বিষয়ে আগ্রহী হন এ আইরিশ নাগরিক। ছয় দফা আন্দোলনের শুরু থেকেই নোরা সরাসরি যুক্ত হন এ আন্দোলনে। এরই মধ্যে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ব্রিটেনে ছয় দফা আন্দোলনের তৎকালীন তরুণ নেতা সুলতান শরীফের সঙ্গে। ছয় দফা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়তে নোরা শরীফ লিফলেট হাতে ছুটে বেড়িয়েছেন ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে। পরে ’৬৯-এর গণ-অভুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রতিটি সামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নোরা শরীফ ছিলেন সক্রিয় সহযোগী। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলে এর বিরুদ্ধে দেশের মতো ব্রিটেনেও গড়ে ওঠে তুমুল আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্রিটিশ জনগণের সহানুভূতি আদায়ে স্বামী সুলতান শরীফ ও অন্য সহকর্মীদের নিয়ে দিনের পর দিন ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর চষে বেড়িয়েছেন নোরা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রয়াত ব্রিটিশ এমপি ও মন্ত্রী লর্ড পিটার শোসহ অন্যান্য ব্রিটিশ এমপির সমর্থন আদায়ে নোরা শরীফের ভূমিকা বাঙালির ইতিহাসের অংশ।
    মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পর ১৯৭২ সালে নোরা প্রথম বাংলাদেশ সফর করেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধেও রাজপথে ছিলেন নোরা শরীফ। সাম্প্রতিক সময়ে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পক্ষেও জনমত সংগ্রহে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিশেষ ভূমিকা রেখে গেছেন ব্যারিস্টার নোরা শরীফ। এ বছরের শুরুর দিকে ‘শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ’ গড়ে উঠলে এর সমর্থনেও ব্রিটেনের তরুণ বাংলাদেশিদের সঙ্গে নোরা ছিলেন রাজপথে। গণজাগরণ মঞ্চ, আইসিটি সাপোর্ট ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় সংগঠনগুলোর উদ্যোগে ট্রাফালগার স্কোয়ার, হাইডপার্ক কর্নার, লন্ডনের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে আয়োজিত কর্মসূচিগুলোতেও নোরা শরীফের ছিল সরব উপস্থিতি।
    নোরা শরীফের মৃত্যুর খবরে লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটিতে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। গভীর রাত পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু এই মহীয়সী নারীর মহা প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রতিনিধি, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছুটে যান নোরার বাসায়। এ সময় নোরার স্বামী ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সুলতান শরীফকে সান্ত্বনা দেন তাঁরা। গতকাল এ প্রতিবেদন তৈরি করা পর্যন্ত ব্যারিস্টার নোর শরীফের দাফন সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সূত্র : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।
    প্রধানমন্ত্রীর শোক : বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার’ অনারপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব ব্রিটিশ নাগরিক ব্যারিস্টার নোরা শরীফের ইন্তেকালে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাসস জানায়, গতকাল প্রধানমন্ত্রী তাঁর শোকবাণীতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পর দেশ গঠনে নোরা শরীফের অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
    - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2013/12/01/26164#sthash.ic3iALne.dpuf
  • Biplob Rahman | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৬:০০582593
  • বীরঙ্গনার বিপর্যয়গাথা
    মৃত্যুই ভালো ভেবে হাওরের পানিতে ঝাঁপ দেন
    রাসমণি চক্রবর্তী
    _____________________________________________
    নাসরুল আনোয়ার ও শফিক আদনান, মিঠামইন (কিশোরগঞ্জ) থেকে

    একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাস। হাওরে 'আফাল' (উত্তাল ঢেউয়ের উন্মাদনা), সঙ্গে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের আতঙ্ক। ভয়ে কম্পমান হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলো। চলছে নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও নারী নির্যাতন। চোখের সামনে উজাড় হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। হাওরের পানিতে ভেসে যাচ্ছে লাশ আর লাশ। সব মিলিয়ে বিভীষিকার কালো ছায়ায় আচ্ছন্ন কিশোরগঞ্জের হাওর জনপদ ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম। এমনই একদিনের কোনো এক রাতে খুব গোপনে বিয়ে হয়ে যায় মিঠামইন সদরের মেয়ে রাসমণি চক্রবর্তীর। বর মিঠামইনের কাটাখাল ইউনিয়নের ছত্রিশ-ঢালারগাঁও গ্রামের কালিকান্ত চক্রবর্তী। ১৪ বছরের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বাবা রামলোচন পরিবারের অন্য সদস্যদের পাশের কেওয়ারজোড় গ্রামে পাঠিয়ে দেন।

    রাসমণির বিয়ের ঠিক চার দিন পর ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা নৌকাযোগে গিয়ে পুরো ছত্রিশ-ঢালারগাঁও গ্রাম ঘিরে ফেলে। তাদের সহযোগিতা করে কেওয়ারজোড় গ্রামের দালাল সাহেব আলী, তার ছেলে 'কুখ্যাত' রাজাকার কমান্ডার কোরবান আলী, মাওলানা আবু তাহের, ঘাগড়া এলাকার ইদ্রিস আলী মৌলভী (ইদু মোল্লা), সোলায়মান, খুর্শিদ, মতি মিয়া, আবদুল হকসহ আরো বেশকিছু স্থানীয় রাজাকার।

    শত ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামের প্রায় সবাই দরিদ্র জেলে। তবে দু-একজনের আছে প্রচুর ভূ-সম্পত্তি। রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী পুরো গ্রামের সব বাড়িঘর একে একে পুড়িয়ে দিয়ে লুটতরাজের উৎসবে মেতে ওঠে। শুধু তাই নয়, গ্রাম থেকে প্রায় ৭৫ জন নিরীহ নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে ছিলেন নববিবাহিত রাসমণি, তাঁর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িসহ বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজনও।

    সেই ভয়াল দিনগুলোর দুঃসহ স্মৃতির কথা চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে বর্ণনা করলেন রাসমণি। 'আমাকে আর আমার শাশুড়িকে একটি নৌকায় তোলা হয়। সেখানে আরো অনেক নারী ছিল। দেখলাম, আমার স্বামীসহ অন্যদের আরেকটি নৌকায় তোলা হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার স্বামীকে গুলি করে জলে ফেলে দেয় ওরা। স্বামীর ফুফাতো ভাই ক্ষিতিষ ও ক্ষিতিনকে একই কায়দায় হত্যা করে তারা। আমরা তখন ভয়ে কাঁদতেও ভুলে গেছি। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লেও মুখে কোনো শব্দ করতে পারছিলাম না। সহ্য করতে না পেরে যারা শব্দ করে কাঁদছিল, তাদেরও নির্মমভাবে পেটানো হয়। মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একটা শিশুকে পানিতে ছুড়ে মারতে দেখলাম। শ্বশুরকে নৌকা চালানোর দায়িত্ব দেওয়ায় তাঁকে মারা হয়নি।'

    রাসমণি বলেন, 'এভাবে পথে অনেককে গুলি করে পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে আমোদফুর্তিতে মেতে ওঠে ওরা। যারা জীবিত ছিল তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ইটনার আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে অল্পবয়স্ক মেয়েদের আলাদা করে অন্যদের পরের দিন ইটনা সদরসংলগ্ন ওয়্যারলেস অফিসে স্থাপন করা রাজাকার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইটনা আর্মি ক্যাম্পে রাতে অন্য মেয়েদের সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যাওয়া হয়। সবার ওপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।'

    সম্ভ্রম হারিয়েও অসীম সাহস ও নিজের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে প্রাণে বেঁচে আসা বীরাঙ্গনা রাসমণির বয়স এখনো ৬০ পার হয়নি। মিঠামইন সদরের সরকারহাটিতে ছোট ভাই দরিদ্র দেবরাজ চক্রবর্তীর আশ্রয়ে আছেন তিনি। শরীরে অসুখ-বিসুখ বাসা বেঁধেছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেন না। জোটে না ভালো খাবার। একাত্তরের ভয়াল স্মৃতিগুলো কিছুতেই ভুলতে পারেন না তিনি। নির্ঘুম রাতে ওই সব দিনের স্মৃতি আওড়ে কেবল প্রলাপ বকেন। ছোট ভাই দেবরাজ বলেন, 'স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমার সর্বস্বান্ত বোনের জন্য কেউ কিছু করেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার কত কিছু করছে, কিন্তু আমার বোনের পাত (বাসন) শূন্যই রয়ে গেল।'

    রাসমণি বলে চলেন, "সন্ধ্যার দিকে তাঁকেসহ কমবয়সী নারীদের আর্মি ক্যাম্পের কয়েকটি কক্ষে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। ক্ষুুধা-তৃষ্ণায় কাতর নারীদের একটু পানি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। ভেতরে গিয়ে দেখি, সেখানে ক্ষতবিক্ষত আরো অনেক নারী মৃত্যুর প্রহর গুনছে। কেউ কেউ 'একটু জল দাও, জল দাও' বলে ক্ষীণকণ্ঠে কাতরাচ্ছে। নির্যাতনে মারাত্মক আহত কারো আবার কথা বলারও শক্তি ছিল না। পুরো মেঝে রক্তে ভাসছে। গভীর রাতে কয়েকজন সৈন্য এসে আমাকে নিয়ে যায়।"

    রাসমণি বলেন, 'দুই-আড়াই ঘণ্টা পর রক্তাক্ত অবস্থায় আমাকে আবার রেখে যায় আগের ঘরে। মাথায় চিন্তা আসে, ওরা তো নির্যাতন করে মেরেই ফেলবে। এ জীবনের চেয়ে নিজেই মরে যাওয়া ভালো। কিছুটা শক্তি ফিরে পেলে ওই ঘরের ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বের হয়ে হাওরের পানিতে ঝাঁপ দেই। সারা রাত হাওরের পানিতে ভাসতে ভাসতে ইটনার উদ্ধারগাঁও গ্রামের পাড়ে কোনো রকমে উঠি। তখন ভোর হয়ে গেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। পরে শুনেছিলাম, অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে এ গ্রামের দুজন মুসলমান নারী আমাকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। পরে তাদের সেবা ও সহায়তায় অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠি।'

    রাসমণি বলেন, 'ওই সময় মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন কারো কোনো খোঁজ নেই। কে কোথায় আছে জানা ছিল না। পরে লোকজনের সহযোগিতায় কয়েক দিন পর ছত্রিশ গ্রামে ফিরে গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির দেখা পাই। কিন্তু বিরান গ্রামে বসবাস করার কোনো উপায় ছিল না। এর কয়েক দিন পর বাবা আমাকে দেখতে যান। বাবা আমাকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন। আমিও বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কত দিন পর একটু আদর পেলাম।'

    রাসমণির ছোট ভাই দেবরাজ চক্রবর্তী ছোট একটি ভাঙা ঘরে স্ত্রী, সন্তান ও বোনকে নিয়ে থাকেন। তিনি গ্রামে গ্রামে পান-সুপারি ফেরি করে বেচেন। যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চলে না। আর্থিক অনটনের কারণে বোনের জন্য তেমন কিছুই করতে পারেন না। দেবরাজ বলেন, 'বোন রাসমণি আর বিয়ে করেননি। শ্বশুরও শেষ পর্যন্ত তাঁকে বঞ্চিত করেছেন। স্বামীর সহায়সম্পত্তি থাকলেও কিছুই দেওয়া হয়নি তাঁকে। নিঃস্ব অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। এর মধ্যে বাবাও মারা যান। আমরা তখন ছোট। আমার বোন নেমে পড়েন আরেক যুদ্ধে। মাঠে-ঘাটে ধান কুড়িয়ে, সবজি সংগ্রহ করে, নদীতে মাছ ধরে নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছেন। বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাঁর ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। আমি কেন, দেশও তো আমার বোনের কাছে ঋণী। কিন্তু দেশ তাঁর দায়িত্ব পালন করেনি।'

    মিঠামইন বাজারের হোমিও চিকিৎসক ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাস হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছিলেন। তিনি জানান, হাওর এলাকার বহু গ্রাম ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। হাওর এলাকা দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে যাতায়াত করত। তাই হাওরের প্রতি পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিশেষ নজর ছিল। আর যেহেতু হিন্দু নিধনই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, তাই হাওরের গ্রামগুলোতে তাদের অত্যাচার-নির্যাতন ছিল মাত্রাতিরিক্ত।

    জানা গেছে, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাসমণিরও ডাক পড়ে। ২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একাত্তরে অসামান্য অবদানের জন্য 'মুক্তিযোদ্ধা নারী' হিসেবে রাসমণি সম্মাননা পান। এর আগে ২০০৮ সালে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বীরাঙ্গনা হিসেবে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। মিঠামইন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সদ্য প্রয়াত রফিকুল আলম রতন ব্যক্তিগতভাবে রাসমণিকে আর্থিক সহযোগিতা করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর এ টাকাও বন্ধ হয়ে গেছে।

    রাসমণি আক্ষেপ করে বলেন, 'রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আমার প্রতিবেশী। তিনি স্পিকার থাকাকালে তাঁর সঙ্গে দুবার দেখা করে আমার দুর্দশার কথা বলে কিছু একটা করার অনুরোধ করেছিলাম। তিনি এখন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। হয়তো মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমার কথা ভুলে গেছেন।' তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'দেখি, অনেক অমুক্তিযোদ্ধাও আজ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে। অনেকে অনেক সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না।'

    ১৯৭৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে রাসমণিকে নগদ এক হাজার টাকা দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাসমণিকে প্রশংসা ও শুভেচ্ছাপত্র দেন। বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত সেই প্রশংসাপত্রটি আজও যত্ন করে ঘরে রেখে দিয়েছেন রাসমণি। এটাই তাঁর একমাত্র গর্বের ধন।

    http://www.kalerkantho.com/online/biranganar-biporjoygatha/2013/12/02/26627#sthash.BHBi9JwU.dpuf
  • Biplob Rahman | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৬:০৩582594
  • বীরঙ্গনার বিপর্যয়গাথা
    প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধে, তারপর সবার আড়ালে
    নূরজাহান বেগম
    ____________________________________
    রফিকুল ইসলাম, বরিশাল

    একাত্তরে টানা ৪৪ দিন আটকা ছিলেন পাকিস্তানিদের বন্দিশিবিরে। দেশ স্বাধীনের পর সেখান থেকে উদ্ধার হলেন। কিন্তু ফিরে যেতে পারলেন না পরিবারে। চেষ্টা করেছিলেন বেশ কয়েকবার। দূরদূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন আপনজনেরা। কারণ তখনো বীরাঙ্গনা নূরজাহান বেগমকে (১৬) মেনে নেননি স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ, সংসার, পরিবার, এমনকি সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধারাও।
    এখানেই শেষ নয়। লাঞ্ছিত বীরাঙ্গনাকে প্রয়োজন হলে বিয়ে করে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সহযোদ্ধা কম্পানি কমান্ডার; লজ্জায়, ঘৃণায়, অপমানে, অভিমানে তাঁর কাছেও ফিরে যাননি নূরজাহান। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় গৌরবোদীপ্ত রাজধানীর জনারণ্যে মিশে গিয়ে মুক্তি সংগ্রামী নূরজাহান শুরু করেছিলেন আরেক জীবনসংগ্রাম। অজানা মানুষের ভিড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বস্তিতে। ঝিয়ের কাজের পাশাপাশি মহিলা-মুর্দার গোসল, প্রসূতির ধাত্রীর কাজ কোনোটিই বাদ দেননি তিনি।
    পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে সর্বস্বহারা বীরাঙ্গনা নূরজাহান বেগম আজ জীবনসায়াহ্নে। ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বললেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী আমাকে প্রাণে না মারলেও আমার আÍার অপমৃত্যু ঘটিয়েছে। বাবা শহীদ হয়েছেন, স্বামী নেই, ছেলেও পঙ্গু। পাশাপাশি দুঃসহ এই একাকিত্ব সবই একাত্তরের অবদান। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো স্বীকৃতি পেলাম না।’
    শহীদ হলেন বাবা : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নূরজাহান বেগম ওরফে নূরী কিশোরী। থাকেন পৈতৃক ভিটা গৌরনদীর বাটাজোর ইউনিয়নের বাংকুরাত (চন্দ্রহার) গ্রামে। জুনের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী হানা দেয় গৌরনদীতে। ওরা বাঙালিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল। অন্যান্য গ্রামবাসী পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেও নূরীর বয়োবৃদ্ধ বাবা মোহাম্মদ ফকির ভিটে-মাটির মায়ার জালে আটকা পড়েন।
    এমনি একদিন সকালবেলা পাকিস্তানি হানাদাররা এসে চড়াও হয় তাদের ঘরে। নূরী আÍরক্ষার জন্য পুকুরে নেমে লুকিয়েছেন, তখন হানাদাররা গানপাউডার লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাঁদের ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ। রাইফেলের বাঁটের আঘাতে গুরুতর আহত বাবা কিছু দিনের মধ্যেই মারা যান।
    সদ্য বিধবা মাকে নিয়ে নূরী তখন দিশেহারা। একমাত্র ভাই আব্দুর রব সে সময় কাজ করতেন খুলনার একটি বরফকলে। যুদ্ধের সময় তার সঙ্গেও পরিবারের যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন। ফলে কয়েকটি মাস নূরী আর তাঁর বৃদ্ধ মাকে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াতে হয়েছে। অন্ধকার নামলে পোড়া ভিটায় এসে কোনোমতে রাত কাটিয়েছেন।
    পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধে : শহীদ পিতা আদর করে যে মেয়ের নাম রেখেছিলেন নূরজাহান-বিশ্বের আলো, তাঁর বুকে তখন দেশপ্রেম আর প্রতিশোধের আগুন। সেই আগুনের উত্তাপে পাগলীনিপ্রায় নূরী যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তাই বিধবা মাকে এক নিকটাÍীয়ের জিম্মায় রেখে ছুটে যান স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুর হোসেন ওরফে নুরু কমান্ডারের কাছে। অনুনয়-বিনয় করলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ আর প্রশিক্ষণ গ্রহণের।
    কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতিগত কারণে ওই বয়সী মেয়েকে ক্যাম্পে রাখা সমীচীন মনে করলেন না নুরু কমান্ডার। তিনি নূরীকে বুঝিয়েসুজিয়ে পাঠিয়ে দিলেন গ্রামের বাড়িতে। এবারে নূরী গেলেন কিছু দূরের আরেক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের কমান্ডার নিজাম উদ্দীনের কাছে। তিনিও একই অজুহাত দেখিয়ে ফিরিয়ে দিলেন নূরীকে। এর পরও যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মনোবল হারালেন না তিনি। আবার এলেন নুরু কমান্ডারের কাছে। তাঁর হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ জানালেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ না দিলে আÍহননের হুমকি দিলেন। অবশেষে নুরু কমান্ডার সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ নূরীকে দায়িত্ব দিলেন সংবাদ আদান-প্রদানকারী, গুপ্তচর বা ইনফর্মার হিসেবে। বিচিত্র বেশ, পরিচয় ও যোগাযোগে নূরী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পগুলোরর মধ্যে তথ্য-সংযোগ রক্ষার পাশাপাশি হানাদার-দোসর রাজাকারদের মনোবল ভাঙার কাজেও লিপ্ত ছিলেন।
    গুপ্তচরের সময় গুলিবিদ্ধ : বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের শিকারপুর খেয়াঘাট ছিল তখন হানাদারদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ঘাঁটি। মহাসড়কের পাশে গৌরনদী কলেজে স্থানীয় কমান্ডপোস্ট তৈরি করে হানাদার ও তাদের দোসররা শিকারপুর, মাহিলাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় তৈরি করেছিল ফাঁড়ি ও বাঙ্কার। শিকারপুরে এ ধরনেরই এক রাজাকার ক্যাম্পে ছিলেন নূরজাহানের দূরসম্পর্কের খালু বিলুবাড়ী গ্রামের রাজাকার সুরত আলী। তার মারফর হানাদার হায়েনাদের অনেক গুরুপূর্ণ খবর আনতেন নূরজাহান।
    ওই ক্যাম্পের রাজাকাররা পালাতে এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চায় বলে নূরজাহানের মাধ্যমে একদিন খবর আসে নূরু কমান্ডারের কাছে। এ ব্যাপারে আরো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়ে ৫ নভেম্বর নূরজাহানকে পাঠানো হয় রাজাকারদের শিকারপুরের ক্যাম্পে। কিন্তু তত দিনে হানাদার ও তাদের দোসরদের একটি অংশ নূরজাহানের চালচালনে সন্দেহজনক গতিবিধি খুঁজে পাওয়ায় তাঁর ওপর নজর রাখতে শুরু করে। এ অবস্থাতেই ৫ নভেম্বর শিকারপুর রাজাকার ক্যাম্পের কাছে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে গৌরনদীর দিকে হতে আগত একটি মিলিটারি কনভয়ের সামনে পড়েন নূরজাহান।
    হানাদার দোসররা তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের চর হিসেবে চিনতে পেরে থামতে বললে নূরজাহান দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এরপর ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ করে ধরাশায়ী করা হয় নূরজাহানকে। মহাসড়কের ওপর ফেলেই রাইফেলের বাঁট দিয়ে মেরে থেঁতলে দেওয়া হয় তাঁর মাথাসহ পুরো শরীর। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তথ্য আদায়ের জন্য ওই অবস্থায় তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় শিকারপুর ক্যাম্পে। সেখানে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা ও লাঞ্ছনা-নিপীড়নের পর কোনো পল না হওয়ায় ৭ নভেম্বর তাঁকে পাঠানো হয় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আঞ্চলিক কেন্দ্র গৌরনদী কলেজ মিলিটারি ক্যাম্পে।
    দুঃসহ ৪৪ দিন : ৭ নভেম্বর থেকে দীর্ঘ ৪৪টি দিন মুক্তিবাহিনীর হাতে হানাদার ক্যাম্পের পতন হওয়া পর্যন্ত (১৮ ডিসেম্বর) নূরীর জীবনে শুধুই পাকিস্তানি পশুদের নির্যাতনের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার ইতিহাস। নির্যাতনের ফাঁকে ফাঁকে গুপ্তচর হিসেবে তথ্য উদ্ধারের জন্য জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়া ও জনমতে ত্রাস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কলেজের পুকুরে পৌষ-মাঘের শীতে গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো নূরজাহানকে।
    দেশ স্বাধীনের দুই দিন পরে ১৮ ডিসেম্বর পতন ঘটে গৌরনদী কলেজের মিলিটারি ক্যাম্পের। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয় ক্যাম্পপ্রধান ক্যাপ্টেন কাহহারসহ দুই শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার। ওই সময়েই ক্যাম্প হতে মুক্তিবাহিনী উদ্ধার করে নূরজাহানসহ ১৪ জন বাঙালি বীরাঙ্গনাকে। তৎকালীন পরিবেশের প্রতিকূলতায় তাঁদের নাম-পরিচয় তালিকাভুক্তকরণ, চিকিৎসা বা প্রাপ্য সম্মান প্রদানের কোনো ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি।
    ২৯ বছর আড়ালে : হানাদার হায়েনাদের গ্রাসে অনেক বাঙালি নারী উচ্ছিষ্ট হয়েছেন ধরে নিয়ে বীরাঙ্গনাদের হত্যা বা নর্দমার পাঁকে ঠেলে দিতে চেয়েছে অনেকেই। আত্মীয়স্বজন, সহযোদ্ধা ও সমাজের কাছ থেকে এই আচরণ আরো বড় অপমান হয়ে দেখা দিয়েছিল নূরজাহানের কাছে। বিধবা মায়ের মায়ায় আত্মহনন থেকে নিবৃত্ত থাকলেও অসীম মানসিক কষ্ট বয়ে বেড়ান সেই থেকে।
    শত অপমান ও লাঞ্ছনার মধ্যেও বীরাঙ্গনা নূরজাহান বেঁচে রইলেন দুজন মহৎপ্রাণ মানুষের সেবা আর আশ্রয়ে। তাঁদেরই একজন ধানমণ্ডি লেকের পারে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছের মানুষ দেলোয়ার হোসেন। তাঁরই মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের কোনো একসময় ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়িতে সাক্ষাৎ পেলেন জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের। বঙ্গবন্ধু তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের অবদান ধারণ ও মূল্যায়নের উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হবে।’
    যাঁর নির্দেশে শুরু হয়েছিল এই মুক্তিযুদ্ধ, স্বয়ং তাঁর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে নূরজাহান ফিরে পেলেন নতুন করে বাঁচার আশা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেষ হয়ে গেল সব স্বপ্ন। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। মীরপুরে পূর্ব কাজীপাড়ার মাতুব্বরের পুকুরপাড়ের বস্তিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিলেন। সেখানে থেকেই জীবনধারণের জন্য বস্তির আশপাশের বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ শুরু করলেন বীরাঙ্গনা নূরজাহান।
    নতুন জীবনও দিল ফাঁকি : ১৯৭৬ সালের কোনো একসময় নূরজাহানের সঙ্গে পরিচয় হয় গোপালগঞ্জ এলাকার আরেক মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামানের। বীরাঙ্গনা পরিচয় জেনেই তিনি নূরজাহানকে বিয়ে করে সম্মান জানাতে চান। কামরুজ্জামান (৫৫) তখন ঢাকায় দিনমজুরি ও রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু ওই স্বামী-সংসারের সুখও নূরজাহানের কপালে সয়নি বেশি দিন। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে একমাত্র সন্তান সাদেকুজ্জামান সুমনকে (তিন মাস) রেখে মারা যান মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান।
    এরপর সন্তান প্রতিপালনের তাগিদে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ভিশন’র সহযোগিতায় ধাত্রীবিদ্যার প্রশিক্ষণ নেন নূরজাহান। ঝিয়ের কাজের পাশাপাশি বস্তিতে মহিলা মুর্দার গোসল আর প্রসূতিদের দাইয়ের কাজ করতেন। এ কাজেরই একপর্যায়ে মা-বাবা পরিত্যক্ত এক নবজাতক কন্যাকে বুকে আশ্রয় দিয়েছেন এই বীরাঙ্গনা জননী। সেই কন্যা দোলনের বয়স এখন ২৫ বছর। বিয়ে দিয়েছেন, পেয়েছেন নাতি-নাতনি।
    তাঁদের নিয়েই আছেন নূরজাহান। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি একটিবারের জন্যও আ্ত্মীয়স্বজনের কাছে যাননি। তাঁরাও নূরজাহানকে এড়িয়ে চলেছেন। একমাত্র ভাই আব্দুর রব ঢাকায় থাকলেও বোনের খোঁজ নেননি।
    গর্বিত ছেলের একটিই আক্ষেপ : মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী বলেন, ১৯৯৯ সালের ফেব্র“য়ারিতে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তিকরণ ও বাছাইয়ের সভায় গৌরনদী কলেজে পাওয়া এলাকার বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী বাটাজোড়ের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালেব নূরজাহানকে খুঁজে ঢাকা থেকে বরিশালে পাঠান। ২০০০ সালের ১৭ এপ্রিল ‘মুজিবনগর দিবসে’ বরিশাল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তাঁকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। পরে তিনি আবার ফিরে যান ঢাকার মিরপুরে।
    বীরাঙ্গনা নূরজাহান বেগমের ছেলে সুমন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রতিপক্ষের লোকজন ১৯৯৬ সালে সুমনের ওপর হামলা চালিয়ে তাঁর ডান হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এর পর থেকে মা তাঁর ছেলেকে যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন। মিরপুর এলাকায় তিনি ছোট একটি দোকান দিয়েছেন। মায়ের বীরাঙ্গনা পরিচিতিতে গর্বিত ছেলে সুমনের শুধু একটিই আক্ষেপ-দাদা আর নানাবাড়ির আত্মীয়রা তাঁর মাকে মেনে নেয়নি।

    http://www.kalerkantho.com/online/biranganar-biporjoygatha/2013/12/03/26963#sthash.R5cZwCIm.dpuf
  • Biplob Rahman | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৬:০৫582595
  • দুর্বিষহ যন্ত্রণার ৩৮ বছর কাটল স্বামীর সেবা পেয়ে
    মোমতাজ বেগম
    ________________________________________
    শাহীন আকন্দ, গাজীপুর

    গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের লতিফপুর গ্রামের রমিজ উদ্দিন মোড়লের স্ত্রী মোমতাজ বেগম। দেবর আলাউদ্দিন মোড়ল জসিম দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। সে কারণে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রোশে পড়ে পরিবারটি। অমানুষিক নির্যাতনের পর বেঁচে থাকার স্পৃহা হারিয়ে ফেলেছিলেন বীরাঙ্গনা মোমতাজ। কিন্তু স্বামীর সশ্রদ্ধ ভালোবাসা তাঁকে বিধ্বস্ত জীবন নিয়েও বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়ে আসছে।
    রমিজ উদ্দিন মোড়ল সহায়-সম্বল সব কিছু বিক্রি করে অসুস্থ স্ত্রী মোমতাজের চিকিৎসা করিয়েছেন। বীরাঙ্গনা স্ত্রীর চিকিৎসায় সরকারি-বেসরকারি কোনো দান-অনুদান পাননি তিনি। তাতেও কোনো আক্ষেপ ছিল না রমিজের। তিনি প্রচণ্ড কষ্ট পেতেন বীরাঙ্গনা স্ত্রীর প্রতি প্রতিবেশী কারো বিদ্রুপ-শ্লেষে। ভাঙা শরীর নিয়ে কৃষিশ্রম বিক্রি করেছেন রমিজ। ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরে তিনি নিজের হাতে রান্না করে অসুস্থ স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন। কিন্তু প্রায় আড়াই মাস ধরে রমিজ উদ্দিন নিজেও গুরুতর অসুস্থ। অর্থের অভাবে চিকিৎসা মিলছে না। উপার্জনের কেউ না থাকায় স্বজন-প্রতিবেশীদের অনুকম্পায় একদিন দুই মুঠো ডাল-ভাত জুটলেও পরদিন উপোষ দিতে হচ্ছে। অথচ স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪২ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি তাঁর অমূল্য ত্যাগের। তবে জীবন সায়াহ্নে তিনি আর বীরাঙ্গনার সম্মান চান না। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান। জীবদ্দশার কষ্টকে তিনি হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সম্মান চান বীরাঙ্গনা মোমতাজ।
    স্ত্রীর ওপর পাকিস্তানি সেনাদের পৈশাচিক নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রমিজ উদ্দিন। ভারি কণ্ঠে বলেন, তাঁর ছোট ভাই আলাউদ্দিন মোড়ল জসিম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ফলে গ্রামের রাজাকাররা তাঁদের পরিবারের প্রতি ক্ষিপ্ত ছিল। দিন-রাত রাজাকাররা বাড়ি এসে জসিমের খোঁজ করত। পাকিস্তানি সেনারা শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে তাঁবু ফেলে। একাত্তরের ৭ জুন সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে কাপাসিয়ার তরগাঁও ইউনিয়নের বাগিয়ায় অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। নদীর এপার লতিফপুর গ্রামে তাঁবু ফেলা পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে মুক্তিযোদ্ধারা বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। সাড়ে চার ঘণ্টার গুলিবিনিময়ে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
    বিকেলের দিকে স্থানীয় সাত-আটজন রাজাকারসমেত একদল পাকিস্তানি সেনা অতর্কিতে রমিজদের বাড়িতে হানা দেয়। প্রথমে তারা মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন মোড়ল জসিমের খোঁজ করে। কোনো সাড়া না পেয়ে বাড়িতে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে সেনারা। একপর্যায়ে বন্দুক উঁচিয়ে ঘরে ঢুকে চৌকির নিচে চার নারীকে খুঁজে পায়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মোমতাজ বেগম। তখন তিনি ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। হানাদাররা তাঁকে জোর করে তুলে নিয়ে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
    সারা রাত অনেক খোঁজাখুঁজির পর গ্রামের একটি আখক্ষেতের ভেতর মোমতাজের রক্তাক্ত অসাড় দেহ পাওয়া যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে রমিজ উদ্দিন নৌকাযোগে ঢাকায় নিয়ে যান। ভর্তি করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। টানা চার বছর চিকিৎসা চলে মোমতাজের। তিনি বেঁচে গেলেও স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরে আসেননি।
    রমিজ উদ্দিন জানান, নির্যাতনে মোমতাজের গর্ভের সন্তান মারা যায়। হাসপাতালে ৯ দফা অস্ত্রোপচার হয়। অবশেষে তাঁর জীবন বাঁচাতে যৌনাঙ্গ ও মলদ্বার অস্ত্রোপচার করে বন্ধ করে দেন চিকিৎসকরা। নাভির খানিকটা নিচে পেট কেটে বিকল্প পয়ঃনালি তৈরি করে দেন। এভাবেই জীবনের পরবর্তী ৩৮টি বছর পার করছেন এই বীরাঙ্গনা।
    স্মৃতিচারণা করে মোমতাজ বেগম জানান, পাকিস্তানি পিশাচরা স্থানীয় রাজাকারদের নিয়ে বাড়িতে হানা দিলে ঘরের দরজার খিল এঁটে শাশুড়ি ও দুই জাকে নিয়ে চৌকির নিচে এক কোণে জবুথবু হয়ে বসে থাকেন। সেনারা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ার পর দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে। তারা চৌকির নিচে চার নারীকে দেখতে পেয়ে বন্দুকের বাঁট দিয়ে গুঁতিয়ে বের করে এনে মোমতাজকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর বয়স তখন ২২ বছর। দুই কন্যার জননী তিনি। বড় মেয়ে নিলুফা ইয়াসমীন ও ছোট মেয়ে জাকিয়া সুলতানা। দুই মেয়ের বিয়ে দিলেও দুজনেরই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা।
    স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত রমিজ উদ্দিনও আড়াই মাস ধরে লিভারের জটিল রোগে আক্রান্ত। গত ২৯ অক্টোবর ঢাকার মিডফোর্ট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু টাকার অভাবে ১৭ দিন পর চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাঁকে।
    তীব্র অভাব ও অসুস্থতায় দুর্বিষহ জীবন কাটলেও কারো কাছে হাত পাততে রাজি নন এই বীরাঙ্গনা। মোমতাজের ভাষায়, ‘না খাইয়া মইরা যায়াম, ভিক্ষা করতাম না গো বাবা।’
    স্বাধীনতার ৪২ বছর পার হলেও মোমতাজ বেগম কোনো ধরনের স্বীকৃতি পাননি। কোথাও কখনো ধরনাও দেননি।
    শ্রীপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সিরাজ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, মোমতাজ স্বীকৃতির জন্য কখনো আসেননি। ১৯৯৮ সালে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। বীরাঙ্গনা হিসেবে গেজেটে মোমতাজ বেগমের নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
    গাজীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের মতো বীরাঙ্গনাদের সরকারি কোনো ভাতা নেই। মোমতাজের দুর্দশার কথা জেনে তাঁর জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি বাড়ি করে দেওয়ার সুপারিশ করেছিলাম। সেটা পাস হয়েছে। গত ১৫ মে বাড়ি নির্মাণের জন্য টেন্ডার হয়েছে। ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ইতিমধ্যে বাড়ির কাজ শুরু হয়েছে।’

    http://www.kalerkantho.com/online/biranganar-biporjoygatha/2013/12/03/27090#sthash.Vh7rdcOd.dpuf
  • Biplob Rahman | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৮:০০582597
  • বীরঙ্গনার বিপর্যয়গাথা
    জামায়াত-শিবিরের লোকজন এখনো আঙুল তুলে দেখায়...
    দুলজান নেছা
    তারিকুল হক তারিক, কুষ্টিয়া
    __________________________________________________
    মুক্তিযুদ্ধের দুই দশক পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ‘মুক্তিযুুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গড়ে ওঠে। তাদের উদ্যোগে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ অনুষ্ঠিত গণ-আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য কুষ্টিয়ার কুমারখালীর বীরাঙ্গনা দুলজান নেছা ঢাকায় গিয়েছিলেন। একাত্তরে তাঁর ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের চালানো নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বাড়ি ফেরার পর এলাকাবাসী তাঁকে ‘একঘরে’ করে দেয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, পিপাসার পানিটুকুও দেওয়া বন্ধ করে দেয় প্রতিবেশীরা। দুই বছর ধরে এ অবস্থা চলার পর স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতারা গ্রামে গিয়ে তাঁর গৌরবজনক অবদানের কথা তুলে ধরায় সেই অবস্থার অবসান ঘটে বটে, কিন্তু গ্রামবাসীর অনেকের অবহেলা আর উপহাসের হাত থেকে তাঁকে বাঁচাতে পারেনি কেউ। রাজাকারদের দোসর ও অনুসারী জামায়াত-শিবিরের লোকজন এখনো আঙুল তুলে দেখায়, ওই যে দুলজানের বাড়ি।
    তাই এখনো গুমরে কাঁদতে হয় বীরাঙ্গনা দুলজানকে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পেরোলেও আজও সামাজিক লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা সহ্য করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাঁকে। আজও তিনি শরীরে সে সময়ের নির্যাতনের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। ভুগছেন জটিল রোগে। চিকিৎসা তো দূরের কথা, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিটুকুও ভাগ্যে জোটেনি তাঁর।
    একাত্তরের সেই নির্যাতনের কথা মনে করে কেঁদে ফেলেন দুলজান। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘রাজাকারদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় উঠলিও দেশের জন্যি এতো ত্যাগ স্বীকার করলাম, আমার নাম ওই তালিকায় উইঠল না। বয়সও শেষ। তাই মরার আগে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজের নামডা দেখি যাতি চাই।’
    কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের দয়রামপুর গ্রামে দুলজান নেছার বাড়ির উঠানে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরের এক ভোররাতে পদ্মার পারে তাঁদের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এরপর নির্যাতন শেষে রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে তাঁর সারা শরীর রক্তাক্ত করে দেয়। এখনো বুক ও পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। শুধু তাই নয়, হানাদারদের অমানুষিক নির্যাতনে তাঁর পঙ্গু স্বামী মুক্তিযোদ্ধা তেছের আলী মণ্ডল দীর্ঘ রোগ ভোগের পর বিনা চিকিৎসায় ২০০২ সালে মারা যান। দুলজান বলেন, ‘আমিও ওই পথের পানে আছি। বুকের ব্যথায় কাজ-কাম করতি পারিনি বাবা। ওষুধ কিনার পয়সা নেই। বাড়িতে মুরগি ডিম দেয়। সেই ডিম বেচে ওষুধ কিনে খাচ্ছি।’
    দুই ছেলে আর তিন মেয়ের জননী দুলজান নেছা আক্ষেপ করে বলেন, সুস্থ-সবল মানুষ বিয়ে করে না বলে অন্ধ-খোঁড়া দেখে আমার মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু একাত্তরে আমার ওই অবস্থার জন্যই এক মেয়ে ময়নার সুখের সংসার পর্যন্ত ভেঙে গেছে। সেই মেয়ে এখন কুষ্টিয়া শহরে মেসে ঝিয়ের কাজ করে। বড় ছেলে শরিফুল মাঠে কৃষি কাজ করে। ছোট ছেলে খোকন দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে এখন অন্যের দোকানের কর্মচারীর কাজ করে। বড় মেয়ে শাহানা ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করে আর এক মেয়ে পারভিন শ্বশুরবাড়িতে।
    বীরাঙ্গনা দুলজান নেছা জানান, একাত্তরের নির্যাতনের বিষয়টি চাপাই ছিল। কেউ জানত না। কিন্তু গণ-আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার পর সব জানাজানি হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আমিসহ আমার পাশের বাড়ির অন্য দুই বীরাঙ্গনাকেও আমার মতো বিপাকে পড়তে হয়। দুলজানের কথা, আমার যা হওয়ার হয়ে গেছে। এই অবস্থা যেন পৃথিবীর আর কোনো নারীর না হয়।’
    দুলজানের বড় ছেলে শরিফুল মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনার কাছে জোড়হাত করছি, আমার মাকে নিয়ে আর কিত্তি করবেন না। অনেক হয়ছে। আমরা বড় হয়ছি। সমাজে চলতি হয়। নানান সমস্যা হয়। পারলি দেশের জন্যি আমার মার অবদানের জন্যি তার প্রাপ্য সম্মানটুকুন দিবার চেষ্টা করেন। আল্লা আপনাগের ভালো করবে।’
    দুলজানের মেয়ে শাহানা মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার মায়ের অবদানের স্বীকৃতির জন্য আমি নিজে বহুবার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান ও সচিবের কাছে গিয়েছি। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। আর কত কষ্ট করলে আমার মা মরার আগে তাঁর সম্মানটুকু পাবেন?’
    এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নাছিম উদ্দিন আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর নির্যাতিত অসহায় বীরাঙ্গনাদের সংগঠিত করে পুনর্বাসনের মাধ্যমে তাঁদের বেঁচে থাকার অবলম্বন তৈরি করা হয়েছিল, যার সুফলও অনেকে পেয়েছেন। কিন্তু কুষ্টিয়ার দুলজান নেছাসহ কয়েকজন বীরাঙ্গনার তেমন কিছুই হয়নি। যাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা এসেছে, তাঁদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি যথাযথ পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আরো অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে বলে আমি মনে করি।’
    কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর কিছুদিন আগে আমি দুলজান নেছাসহ কুমারখালীর চার বিরাঙ্গনার গৌরবময় ত্যাগের স্বীকৃতির ব্যাপারে মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে অবহিত করেছি। আশা করি, তাঁরা তাঁদের পাপ্য সম্মানটুকু পাবেন।

    http://www.kalerkantho.com/online/biranganar-biporjoygatha/2013/12/05/27544#sthash.U8yxwDPB.dpuf
  • Biplob Rahman | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৮:০২582598
  • বীরঙ্গনার বিপর্যয়গাথা
    শেষমেশ ভারতে নিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়

    জোহরা বেগম
    বিশ্বজিৎ পাল বাবু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
    ____________________________________
    শীতের সকাল। দাদির সঙ্গে বসে ভুসির আগুনে তাপ পোহাচ্ছিলেন ১৪-১৫ বছরের জোহরা। বাবা জমিতে, মা পুকুরঘাটে।
    হঠাৎ তাঁদের বাড়িতে একদল পোশাকধারী পাকিস্তানি সেনার হানা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জোহরাকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যায় ওরা।
    জোহরার আর্তনাদ আর বৃদ্ধা দাদির চিৎকারেও কারো মন গলেনি। জোহরাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের একটি ক্যাম্পে। পরদিন সকালে জোহরাকে যখন সেখান থেকে নিয়ে আসা হয়, তখন তিনি ছিলেন জ্ঞানহীন।
    একাত্তরের সময়কার সেই স্মৃতি মনে করে জোহরা বেগম একটু বিচলিত, কিছুটা লজ্জিত। এ প্রতিবেদককে বললেন, ‘অহন অ দুনিয়াডা অন্ধকার লাগে। কী অইল হেই দিন! মহিলারার কাছে তো তাঁর ইজ্জত, সম্মানডাঅই বড়। হেই দিন যদি মইরা যাইতাম গা, হেইডাঅই বালা আছিল। এই ঘটনার লাইগ্যা আমার বিয়া লইয়া যে কত জামেলা অইছে! না পাইরা আমার মা-বাফে আমারে ইন্ডিয়া নিয়া বিয়া দিছে।’
    ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের আবদুল্লাপুর গ্রামের বাসিন্দা এই বীরাঙ্গনা জোহরা বেগম। বয়স এখন ৫৬-৫৭ বছর। স্বামী রুস্তম মিয়া মারা গেছেন। বাবা ইদ্রিস মোল্লাও মারা গেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৪২ বছরেও বীরাঙ্গনা জোহরা বেগমের মেলেনি কোনো সরকারি স্বীকৃতি। এমনকি একাত্তরে নির্যাতিতাদের যে ‘বীরাঙ্গনা’ বলা হয়, সেটাও জানেন না তিনি। বরং দেশ স্বাধীনের পর মানুষের কটু কথা নিয়মিত পীড়া দিয়ে আসছে তাঁকে।
    কখনো আর্থিক সংগতি আসেনি জোহরা বেগমের। এখনো ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা। থাকেন চাচাতো ভাইদের বাড়িতে। তাঁর গর্ভের সন্তান তিনজন- দুই মেয়ে ও এক ছেলে। স্বামীর আগের সংসারে আছে তিন মেয়ে। সব মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে একটি পলিথিন কম্পানিতে কাজ করে। অন্যের দয়া-দক্ষিণায় কোনোমতে দিন কাটে জোহরার।
    প্রতিবেশী মুক্তিযোদ্ধা মো. ছায়েব আলী বলেন, ‘আমাদের এলাকার দুজন বীরাঙ্গনার খোঁজ নিতে কয়েক মাস আগে সরকারি কিছু লোকজন এসেছিলেন। তাঁরা আমার বাড়িতে বসেই বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকারি কোনো স্বীকৃতি বা অনুদান তাঁদের ভাগ্যে জোটেনি।’
    আখাউড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক দপ্তর সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন পাখি বলেন, ‘আখাউড়ায় পাঁচজন বীরাঙ্গনা আছেন। তাঁদের মতো সারা দেশের বীরাঙ্গনারা আজও অবহেলিত। স্বাধীনতার ৪২ বছরেও তাঁদের সরকারি কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। আমরা চাই মৃত্যুর আগে যেন তাঁরা সরকারি স্বীকৃতি পেয়ে যান।’
    প্রতিবেশী আরেক বীরাঙ্গনা সুফিয়া বেগমের দেওয়া তথ্যমতেই খোঁজ মেলে জোহরা বেগমের। আরেক বীরাঙ্গনা সুফিয়াদের বাড়িতেই ডেকে আনা হয় জোহরা বেগমকে। এ পর্যন্ত কোনো সরকারি সহযোগিতা মিলেছে কি না জানতে চাইলে মাথা নেড়ে না সূচক উত্তর দেন তিনি। একাত্তরের সময়কার ঘটনা জানতে চাইতেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন। পাশে থাকা দুটি শিশুকে চলে যেতে বললেন। কিছু সময় চুপ থাকার পর বর্ণনা করলেন সেদিনকার নির্যাতনের কথা। বললেন, ‘বাবা, কইতে কষ্ট অয়। অহন অ নীরবে থাকলে হেই কতা মনে অয়। চোখের পানিতে বুক ভাইসসা যায়গা। একটা ক্যাম্পে নিয়া আমারে একদিন আটকাইয়া রাহে। আমার বাবা-মা গেলেঅ হেরা ছাড়ছে না। পরদিন সকাল বেলা এলাকার মুরুব্বি জমসিদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, আরু মিয়া (সবাই প্রয়াত) আমারে ক্যাম্পে থেইক্কা উদ্ধার কইরা লাইয়া আয়ে। আমার তহন গিয়ান আছিল না। মা-বাফে কত ডাক্তার দেহাইয়া যে আমারে বালা করছে! মেলা দিন হেই যন্ত্রণা বোগ করছি।’
    স্বাধীনতার সময় জোহরা বেগমের পরিবার ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় চলে যায়। কিন্তু সেখানে থাকার মতো তেমন কোনো ব্যবস্থা না হওয়ায় আবার দেশে চলে আসে। তাঁদের বাড়ির পাশেই ছিল পাকিস্তানি ক্যাম্প। ওই ক্যাম্পের লোকজন প্রায়ই বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করত।
    জোহরা বেগম জানান, তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময়ই অর্ধেক মরে গিয়েছিলেন ভয়ে। পরে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করলে অজ্ঞান হয়ে যান। দেশ স্বাধীনের পর এসব নিয়ে নানাজনে নানা কথা বলে। এ কারণে তাঁর বিয়ে দেওয়া নিয়ে পরিবারের সবাই খুব সমস্যার মধ্যে পড়েন। ঘটনার সাত-আট বছর পরে তাঁকে ভারতের আগরতলায় নেয়ে বিয়ে দেওয়া হয়।
    জোহরা বেগম বলেন, আগের বউ মইরা যাওয়া তাইনের (স্বামী) ঘরে তহন তিনডা মাইয়া আছিল। বিয়ার ফরে আমার স্বামীর কাছে মাইনস্যে নানান কতা কয়। একদিন স্বামী আইয়া আমারে কতাডা হাছানি জিগাইছে। আমি সব কইছি। তখন আমারে তাইনে কইছে, ‘আমারে কইছ কইছ। এইসব কতা আর কেউর কাছে কইবা না। এমনকি পুলা-মাইয়ার কাছে অ না। আমার স্বামী নির্যাতনের কতা মাইন্না নিয়া আমারে আর কোনো দিন কিছু কইছে না।’
    জোহরা বেগমের কাছ থেকে জানা যায়, ২০-২২ বছর আগে স্বামী মারা গেলে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। তাঁর গর্ভের তিন সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের সময় সবাই সহযোগিতা করেন। একমাত্র ছেলে পলিথিনের কম্পানিতে কাজ শিখছেন। কোনো রকমে টেনে টুনে চলছে তাঁর সংসার।
    কথা বলার শেষ পর্যায়ে অনুমতি নিয়ে জোহরা বেগমের ছবি তোলা হয়। পত্রিকায় ছবি ছাপলে আবার লোকজন নানা মন্তব্য করে কি না- এমন প্রশ্ন তিনি ছুড়ে দেন এ প্রতিবেদকের কাছে। আবার পরক্ষণেই ছবি ছাপার অনুমতি দিয়ে বলেন, ‘বাবারা, আফনেরা যা বালা মনে করেন, তাই কইরেন। একাত্তরেই তো...।

    http://www.kalerkantho.com/online/biranganar-biporjoygatha/2013/12/06/27888#sthash.Dq3X38DX.dpuf
  • Biplob Rahman | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৩ ২০:০০582599
  • বীরঙ্গনার বিপর্যয়গাথা
    যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে সান্ত্বনা দেন স্বামী
    লাইলি বেগম

    শামীম খান, মাগুরা
    _________________________________
    দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল ৪টা। উঠোনের এক কোণে মাটির উনুনে (চুলোয়) তখনো ভাতের হাঁড়িতে চাল ফুটছে। ধোঁয়াচ্ছন্ন উনুনের এক পাশে বসে আছেন লাইলি বেগম। উনুনের আগুন অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে অবিরত ভেতরে ঠেলছেন পাটকাঠি। এ যেন সুদীর্ঘ ৪২ বছর ধরে বহমান কষ্টক্লিষ্ট জীবন-সংগ্রামেরই প্রতীকী চিত্র।
    এত দেরিতে রান্নার কারণ জানতে চাইলে খুব সহজ ও সাবলীল স্বীকারোক্তি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মদনপুর গ্রামের বীরাঙ্গনা লাইলি বেগমের। জানালেন, কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে চলছে সংসার। স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসেন একসময় রিকশা ভ্যান চালিয়ে সংসার টানতেন। এখন শারীরিক কারণে বেকার। বাবার মতো একইভাবে ভ্যান চালিয়ে এখন সংসার টানে দুই ছেলে খোকন ও সোহাগ। তাদের সারা দিনের আয়ে কোনো রকমে খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন পাঁচ ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিসহ আট সদস্যের এই সংসারের সবাই।
    বীরাঙ্গনা লাইলি বেগমের কাছ থেকে জানা যায়, বেশির ভাগ দিন সকাল বেলা চলে ভাত ও পেঁপে সিদ্ধ দিয়ে। পরের বেলা বিকেলে চলবে ভাত ও শাক-সবজি দিয়ে। দুবারের বেশি রান্না কোনোদিনই হয় না। মাছ-মাংস বিশেষ কোনো দিন ছাড়া একেবারেই জোটে না। আর মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে একচিলতে জমি ও ভাঙাচোরা দুই খানা টিনের ঘর।
    লাইলি বেগম বলেন, ‘সারা জীবন শুধু শুনিই গেলাম বীরাঙ্গনা, বীরাঙ্গনা। বিয়াল্লিশ বছরে একখান কাগজ (সনদ) পর্যন্ত পালাম না। এই শুনি অমুকের ঠাহা দিচ্ছে, তমুকের ঘর দিচ্ছে। আমাগের দিকি তো কেউ মুখ তুলে চায় না! আমার কথা নাই বাদই দিলাম। আমার স্বামী তো একজন মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করছে। একখান কাগজের জন্যি মেলা বছর ধরে সেই তো দুয়োরে দুয়োরে ঘুরতিচে।’ লাইলি বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘আসলে কেউ কারুর না। নিজির মা-বাপ, তাঁরাই আর খবর নিল না! যুদ্ধের পর কোনোদিন আর বাপের বাড়ি যাতি পারলাম না। মরার সময় তাগের মুখখান পর্যন্ত দেখতি পারলাম না।’
    মা-বাবার কথা উঠতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন লাইলি বেগম। জানা গেল, পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের খবর পেয়ে লোকলজ্জার ভয়ে লাইলির বাবা একই উপজেলার রায়নগর গ্রামের মোবারক মোল্যা ও মা ফুলজান বেগম আর কোনোদিন তার খোঁজ নেননি। এমনকি বাবার বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারেও তাঁরা নিষেধ করেছেন। তাঁরা কেউই বেঁচে নেই। কিন্তু লাইলি বেগমের সবচেয়ে ভয় ছিল যাকে নিয়ে, সেই মুক্তিযোদ্ধা স্বামী দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঘরে ফিরে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি ও তাঁর ভাই মশিউর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণেই পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা তাঁদের বাড়ি টার্গেট করেছিল। কাউকে না পেয়ে নববধূ লাইলিকে ধরে নিয়ে বর্বর নির্যাতন চালিয়েছিল। সুতরাং এ দায় লাইলির নয়। এ দায় বরং তাদের সবার।
    সেদিনের ঘটনার বিষয়ে জানা যায়, মাত্র ১৫-১৬ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় শ্রীপুরের মদনপুর গ্রামের মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। পরের বছরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর স্বামী যশোর অঞ্চলে ৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর শ্রীপুর বাহিনীর প্রধান আকবর হোসেন মিয়ার দলে যোগ দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একই সঙ্গে যুদ্ধে যান তাঁর দেবর মশিউর। পাকি সেনাদের শ্রীপুর অঞ্চলের ক্যাম্পটি ছিল তাঁদের বাড়ির খুব কাছাকাছি। যুদ্ধের শেষভাগে এক দুপুরে হঠাৎ গুলির শব্দে গোটা গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে। এ সময় ছয়-সাতজনের একদল পাকি সেনা লাইলি বেগমের বাড়িতে ঢুকে তাঁকে তাড়া করে। আতঙ্কিত লাইলি প্রতিবেশী আনোয়ারুল কবির আজমের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। পাকিস্তানি সেনারা লাইলিকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য আনোয়ারুল আজম ও তাঁর স্ত্রীকে গালাগাল করে ও অস্ত্র তাক করে প্রাণনাশের হুমকি দেয়।
    আনোয়ারুল আজম সেনাদের বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে একপর্যায়ে পাকি সেনারা টেনে-হিঁচড়ে লাইলিকে ঘর থেকে বের করে পাশের জঙ্গলে নিয়ে নির্যাতন চালায়। পরে তাঁর এক দাদা শ্বশুর অচেতন অবস্থায় তাঁকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে বাড়িতে এনে চিকিৎসা দেন।
    মনোয়ার হোসেন বলেন, তাঁর স্ত্রী লাইলির মতো বীরাঙ্গনাদের ত্যাগকে তিনি শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। কিন্তু কষ্ট পান যখন ভাবেন, এঁদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। এমনকি সরকারিভাবে তাঁদের স্বীকৃতি পর্যন্ত জোটেনি।
    মনোয়ার হোসেন মোল্যার দাবি, শুধু সরকারি স্বীকৃতি নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের মতো বীরাঙ্গনাদেরও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। একই দাবি লাইলির ছেলে খোকন মোল্যা, সোহাগ মোল্যাসহ অন্যদের। মনোয়ার হোসেন মোল্যা এ প্রসঙ্গে আরো জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে তিনি শ্রীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু তাঁর অবস্থা লাইলি বেগমের মতোই। একটি সনদের জন্য এখনো সংগ্রাম করছেন তিনি। একটু ভালোভাবে বাঁচার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী লাইলি বেগম ইট ভাঙার কাজ পর্যন্ত করেছেন। অন্যের কামলা খেটেছেন। নিজে ভ্যান চালিয়েছেন। এখন শারীরিক ক্ষমতা না থাকায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে বিনা বেতনে কাজ করছেন। সংসার চলছে ছেলেদের ভ্যান চালনার টাকায়।
    লাইলি বেগমের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হোসেন মিয়া বলেন, ‘লাইলির ঘটনার পরপরই আমাদের কাছে খবর আসে; কিন্তু তখন কিছুই করার ছিল না। তবে পরবর্তী সময়ে সে যাতে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়, সে ব্যাপারে আমরা মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র পাঠিয়েছি। এখনো কোনো ফল পাইনি। তার স্বামীর ব্যাপারে একইভাবে চেষ্টা চলছে। সে আমার অধীনেই যুদ্ধ করেছিল।’

    http://www.kalerkantho.com/online/biranganar-biporjoygatha/2013/12/07/28161#sthash.qPj4bo43.dpuf
  • Biplob Rahman | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:২৬582600
  • বীরঙ্গনার বিপর্যয়গাথা
    গণজাগরণ মঞ্চে বক্তব্য দেওয়ায় মেয়ে পেল তালাক
    রাহেলা বেগম

    আরিফুজ্জামান তুহিন, সিরাজগঞ্জ থেকে ফিরে
    _____________________________________
    একাত্তরের একদিনের কথা। বগুড়া থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি সিরাজগঞ্জে এসে পৌঁছায়। শহরে নির্বিচারে ঘরবাড়ি পোড়াতে থাকে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকাররা। রাহেলা বেগম ও তাঁর স্বামী বেলগাতি গ্রামের এক হিন্দুবাড়িতে আশ্রয় নেন। ওই বাড়িতে তাঁরা ছাড়াও আরো তিন নারী একটি ঘরে লুকিয়ে ছিলেন। ঘরে ঢুকে পড়ে হানাদাররা। নারীদের ওপর চালায় অকথ্য নির্যাতন। স্বামীর সামনেই রাহেলার ওপর চলে এ নির্যাতন। এ ঘটনার পর রাহেলা বেগমকে তালাক দেন তাঁর স্বামী।
    এত বছর পরও অভিমানে বীরাঙ্গনা রাহেলা বেগম স্বামীর নামটিও বলতে চাননি এ প্রতিবেদককে। শুধু জানান, পাঁচ বছর পর আবার বিয়ে হয় তাঁর। দ্বিতীয় স্বামী মারা গেছেন বছর সাতেক আগে। দুই সন্তানের মধ্যে ছেলেটি পড়ালেখা করেছেন স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। তবে বীরাঙ্গনা মায়ের ছেলে হওয়ায় কোথাও চাকরি হয়নি তাঁর। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়ও নাম ওঠেনি এই বীরাঙ্গনার। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে রাহেলাকে ‘দলকানা’ ইতিহাসবিদরা সযত্নে বাদ দিয়েছেন।
    চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’-এর আন্দোলন শুরু হলে রাহেলা বেগমকে আনা হয়েছিল সেখানে। গণজাগরণ মঞ্চের হাজার হাজার মানুষের সামনে বক্তব্যও দিয়েছিলেন এই বীরাঙ্গনা। বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলেও তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছিল। তবে গণমাধ্যমে তাঁর ওপর একাত্তরের নির্যাতনের কথা প্রকাশ্যে বলার কারণে ঘটে যায় আরেক বিপর্যয়। সমাজপতিদের কাছে প্রায় বিস্মৃত ‘খারাপ মেয়ে’ আখ্যাটি আবার তাঁর গায়ে সেঁটে দেওয়া হয়।
    শুধু তা-ই নয়, গণজাগরণ মঞ্চে বক্তব্য দেওয়ার পর রাহেলার মেয়ে চম্পাকে তাঁর স্বামী মিলন তিন সন্তানসহ তালাক দেন। চম্পা এখন বীরাঙ্গনা মায়ের অভাবের সংসারে এসে উঠেছেন।
    সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাহেলা থাকেন সিরাজগঞ্জের সয়াধানগড়া বাসস্ট্যান্ডের পাশে পুকুরপাড় বস্তিতে। এ বস্তির জায়গা সরকার অধিগ্রহণ করেছে। অধিগ্রহণের চিঠিও জেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া হয়েছে বস্তিবাসীকে। যেকোনো সময় উচ্ছেদ হতে পারেন বীরাঙ্গনা রাহেলা।
    সিরাজগঞ্জে বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেন সখিনা হোসেন ও নারী মুক্তিযোদ্ধা আমেনা বেগম। গ্রামে গ্রামে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে ৩৫ জন বীরাঙ্গনাকে বের করেন এই দুই নারী। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিরাজগঞ্জে আসেন। বঙ্গবন্ধু ওই ৩৫ জন বীরাঙ্গনাকে সঙ্গে নিয়ে এক মঞ্চে ওঠেন। সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনাদের ‘মা’ বলে ডাকেন। সেদিনকার সেই সম্মান ছাড়া বীরাঙ্গনাদের স্মৃতিতে আনন্দ-সুখের আর কোনো স্মৃতি নেই।
    ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে পুনর্বাসন কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। ৩৫ জন বীরাঙ্গনার মধ্যে এরই মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর সবার যেমন জানাজা অথবা সৎকার হয়, এ বীরাঙ্গনাদের ক্ষেত্রে তাও হয়নি। সমাজপতিরা এখনো বীরাঙ্গনাদের দেখে ‘খারাপ মেয়ে’ হিসেবে।
    সারা দেশের বীরাঙ্গনাদের মতো সিরাজগঞ্জের রাহেলা বেগমও মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাননি। বঙ্গবন্ধু যতই বীরাঙ্গনাদের ‘মা’ ডেকে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন, তাতে কি আর বর্তমান আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মন গলে! এমন মন্তব্য সচেতন মানুষের। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দাবিদার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারেরও বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার ব্যাপারে কোনো তৎপরতা না থাকায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদগুলো পড়েছে বেকায়দায়।
    সিরাজগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার গাজী সোহরাব আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মৌখিকভাবে জানিয়েছি বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য; কিন্তু সরকার এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি।’
    ৩৫ জন বীরাঙ্গনাকে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে আনার কাজ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আমেনা বেগম। এখনো সুখে-দুঃখে জীবিত বীরাঙ্গনাদের সঙ্গেই আছেন এই নারী মুক্তিযোদ্ধা। হাল ছাড়েননি বীরাঙ্গনাদের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ওঠানোর ব্যাপারে। সরকারের বিভিন্ন স্থানে দরখাস্ত করছেন তিনি।
    কালের কণ্ঠকে আমেনা বেগম বলেন, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম উঠলে স্থায়ী একটা ভাতা পেতেন বীরাঙ্গনারা। তাঁদের সন্তানরাও মুক্তিযোদ্ধা সনদের সুফল পেত।

    http://www.kalerkantho.com/online/biranganar-biporjoygatha/2013/12/08/28487#sthash.hlFZvPwP.dpuf
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৮:৩৪582601
  • বীরঙ্গনার বিপর্যয়গাথা
    মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িতে আনার পর শুরু হয় আমার আরেক যুদ্ধ
    নুরজাহান বেগম

    জাহাঙ্গীর হোসেন, রাজবাড়ী
    _________________________________________
    ১৯৭১ সালে ১৩ বছরের কিশোরী নুরজাহানও রেহাই পাননি পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকারদের নখর থেকে। প্রথমে মা ও ছোট ভাইকে মারপিট করে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় ওরা। তারপর রাজাকাররা নুরজাহানকে তুলে দেয় বিহারিদের হাতে।
    একটি বন্ধ ঘরে আটকে রেখে দিনে এক কী দুই বেলা খাবার দিয়ে রাতে নরপশুরা হামলে পড়ত অতটুকু মেয়ের ওপর। চিৎকার করে কাঁদলেও বাঁচাতে আসত না কেউ। এভাবে প্রায় দুই মাস অমানুষিক নির্যাতন সইতে হয়েছে মেয়েটিকে।
    একাত্তরের এই বীরাঙ্গনা নুরজাহান বেগমের বয়স এখন ৫৫ বছর। দুঃসহ দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘আমার মতো আরো ১২-১৩ জন মেয়েকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। দুজন মারাও যায়। যাঁরা বেঁচে ছিলাম, তাঁরা প্রতিনিয়ত ডাকতাম বিধাতাকে। বলতাম, এই হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা করো তুমি। বিধাতা হয়তো আমার কথা শুনেছেন। দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধারা হায়েনাদের পরাজিত করে এবং আমাকে উদ্ধার করে।’
    বীরাঙ্গনা নুরজাহানের বাড়ি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। তাঁর স্বামীর নাম মোকাররম হোসেন। নুরজাহান বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে উদ্ধার করে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার পর শুরু হয় আমার আরেক যুদ্ধ। টানা এক মাস চিকিৎসা নিতে হয় আমাকে। সুস্থ হওয়ার পর বুঝতে পারি, আমি যেন চিড়িয়াখানার কোনো জন্তু। প্রতিবেশীরা সামনে কিছু না বললেও লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখত। মাঝে মধ্যে কটুকথা বলত। মনের দুঃখে এ জীবন শেষ করে দেওয়ার চিন্তা করেছি বহুবার। কিন্তু বৃদ্ধ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে যেতাম সে সব ভাবনা। আমার মায়ের নাম মানু বিবি। আমাকে নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না মা ও ছোট ভাইয়ের। আমাকে কে বিয়ে করবে?’
    তারপর ১৯৭৩ সালের প্রথম দিকে বিস্ময়করভাবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার চৌগাছি গ্রামের মনির উদ্দিন মোল্লার ছেলে মোকাররম হোসেন মোল্লা। সেই মহৎ ঘটনার কথা শোনা যাক মহান ব্যক্তিটির মুখেই।
    মোকাররম হোসেন বলেন, ‘আমিও তখন বয়সে কিশোর। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মাগুরার চৌগাছিতে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের নানা রকম সহযোগিতা করতাম। তাই মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের প্রতি আমার এক ধরনের দুর্বলতা ছিল। নুরজাহানের বাড়ির পাশে ছিল আমার এক চাচাতো বোনের বাড়ি। ১৯৭৩ সালে ওই চাচাতো বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দেখা হয় মাগুরায় যুদ্ধ করা বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে কয়েক দিন সময় কাটানোর পর নুরজাহান সম্পর্কে আমি বিষদ জানতে পারি। তাঁর প্রতি আমার মমতা সৃষ্টি হয়। আমি তাঁকে বিয়ে করি। তবে বিয়ের পর নানাজনের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে কটুকথা। এমনকি বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান হলেও তাঁরা আমাদের এই বিয়ে মেনে নেননি। কোনো উপায় না দেখে শ্বশুরালয়েই বসবাস শুরু করি। সে সময় থেকেই আমি দর্জির কাজ করি। টাকার অভাবে বাজারে কোনো দোকান নিতে পারিনি। বাড়িতেই কোনো রকমে চালিয়ে আসছি এ পেশা। সংসার চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।’
    মোকররম হোসেন আরো বলেন, ‘নরপশুরা নুরজাহানকে ধরে নিয়ে গেছে, অত্যাচার করেছে। এটা তো তাঁর দোষ নয়। যারা এমন করেছে, তাদের দোষ। আমি মানুষ। তাই আমি নুরজাহানের পাশে দাঁড়িয়েছি। একটি অসহায় মেয়ের বেঁচে থাকার জন্য একটু অবলম্বন হয়েছি। তা ছাড়া সে তো খুব ভালো মেয়ে। একজন ভালো মানুষকে ভালোবাসাই তো মানুষের প্রধান ধর্ম।’
    নুরজাহান বলেন, ‘মা মারা গেছে। বর্তমানে আমি ভাইয়ের দেওয়া ১২ শতাংশ জমিতে কোনো রকমে ঘর করে বসবাস করছি। আমার এক ছেলে, চার মেয়ে। অসুস্থতা পেয়ে বসেছে আমাকে। চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, আর ছেলেকে ভাইদের সহযোগিতায় বিদেশে পাঠিয়েছি। আমাকে সহযোগিতা করতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা অনেক দৌড়ঝাঁপ করলেও কাজের কাজ হয়নি কিছুই। স্বাধীনতার ৪২ বছর পার হলেও পাইনি কোনো সরকারি সহযোগিতা। এতে আমার কোনো দুঃখ নেই। তবে সরকারিভাবে কোনো স্বীকৃতি পেলে মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। আমার স্বামী, সন্তান, ভাইয়েরাও পেত সামাজিকভাবে সম্মান। শেষ জীবনে এটুকু সম্মান আশা করা তো দোষের নয়।’
    নুরজাহানের ছোট ভাই কোবেদ সেখ বলেন, “তিন বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। মা আর বোনই ছিল আমার সব। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছনের ঘরের মাটির ডোয়ায় আমি ‘জয় বাংলা’ লিখেছিলাম। আর এটিই ছিল আমার অপরাধ। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে রাজকাররা আমাদের বাড়িতে হামলা চালায়। লুটপাট করে। আমার মাকে রাইফেল দিয়ে আঘাত করে। আমার হাত বেঁধে ফেলে। তারপর আমাদের চোখের সামনেই ওরা নুরজাহানকে তুলে নিয়ে যায়। ওই ঘটনার ১২ দিন পর এলাকায় একটি গুলির শব্দ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজাকাররা আমাদের কয়েকজনকে আটক করে পাশের সোনাপুর বাজারের আজিজ মিয়ার রুটির দোকানে নিয়ে যায়। আমাকে এবং পাশের গ্রামের জমির উদ্দিন মুন্সি ও বাবলু মাস্টারকে জ্বলন্ত লাকড়ির মধ্যে ফেলে দেয়। আগুনে আমাদের তিনজনেরই শরীর ঝলসে যায়। সেই পোড়া দাগ এখনো আছে।’
    তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ, খলিলুর রহমান, আবদুল লতিফ, শহর আলীসহ তাঁদের সঙ্গীরা একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর রাজবাড়ীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যৌথভাবে জেলা শহরের বিহারি কলোনিতে (বর্তমান নিউ কলোনি) অপারেশন চালান। এ সময় তাঁরা নুরজাহানকে উদ্ধার করেন এবং আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেন। আমি ওই সব মুক্তিযোদ্ধার কাছে চিরঋণী।’
    জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল হোসেন বলেন, ‘এলাকার বীরাঙ্গনাদের খোঁজার উদ্যোগ আমরা নিয়েছিলাম। কিন্তু অনেকে মুখ খুলতে চান না। আবার অনেকে দেশ বা এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। তবে বীরাঙ্গনা নুরজাহানকে আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। তাঁর জন্য কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
    বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, ‘নুরজাহান বেগম একজন বীরাঙ্গনা। তাঁকে সহযোগিতা করার চেষ্টা আমরা করছি। উপজেলা পরিষদের মাসিক মিটিংয়ে আলোচনার পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

    - See more at: http://www.kalerkantho.com/online/biranganar-biporjoygatha/2013/12/09/28835#sthash.9dhk5ltL.dpuf
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:১৬582602
  • দেশের একমাত্র আদিবাসী বীরবিক্রম ইউকেচিং
    এস বাসু দাশ, জেলা প্রতিনিধি
    বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর . কম
    ...................................................................................
    বান্দরবান : বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি এই ৩ পার্বত্য জেলাসহ সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ইউকেচিং হচ্ছেন একমাত্র বীরবিক্রম উপাধিপ্রাপ্ত আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা।

    মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের কথা এসে যায় ইতিহাসের পাতা উল্টালেই। যদিও
    অভাব-অনটন এখন ৭৭ বছর বয়সী এই বীরবিক্রমের নিত্য সঙ্গী। তিনি এখন চিন্তিত তার বাকি জীবন ও সন্তানদের ভবিষ্‌য়্‌ৎ নিয়ে।

    ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। ২৫ মার্চ ইপিআরের নায়েক হিসেবে তিনি রংপুরের হাতিবান্ধা বিওপিতে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে রংপুর ৬ নম্বর সেক্টরে মেজর বাশারের নেতৃত্বে ৯ বাংলাদেশি ইপিআর সৈনিককে নিয়ে পাটগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেন। দেশকে পাক হানাদার মুক্ত করতে বিওপিতে কর্মরত ১ বিহারি ও ২ পাঞ্জাবিকে হত্যা করেন তিনি। টানা নয় মাস সম্মুখ যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেন তিনি।

    বাংলাদেশ সরকারের দেয়া খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৬৭৬ জন। এর মধ্যে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৮ জন বীরউত্তম, ১৭৫ জন বীরবিক্রম ও ৪২৬ জনকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করে সরকার।

    স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ইউকেচিংকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করে সরকার।

    ইউকেচিং বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন।

    বীরবিক্রম ইউকেচিং বাংলানিউজকে জানান, অভাব নিত্যসঙ্গী হলেও তিনি তার ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দেননি কোনদিন, কারও কাছে হাত পাতেননি। ২ ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার চালাতে তার বেশ কষ্ট হয়। তার ছেলে মেয়েরা সাঙ্গু নদীর চরে অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে যা আয় করেন তা দিয়ে কোন মতে প্রতিদিনের আহারের জোগাড় হচ্ছে।

    বান্দরবানের সাঙ্গু নদীর তীর ঘেঁষে পাহাড়ের পাদদেশে লাংগিপাড়ায় ১ জীর্ণশীর্ণ ঘরে পরিবার নিয়ে বাস করতেন ইউকেচিং। পরে ২০১০ সালে বান্দরবান ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের পক্ষ থেকে তার বাড়িটি পুননির্মাণ করে দেয়া হয়। গত বছর তার নামে স্থানীয় ১টি সড়কেরও নামকরণ করা হয়।

    গত বছরের ১৩ অক্টোবর তার হাতে দেড় লক্ষ টাকার চেক তুলে দেয় জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মাননা ভাতা পেলেও এর বাইরে তেমন কোন আর্থিক সহায়তা পাননি তিনি।

    এরপরও এই বীরবিক্রম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ করে আমি মহাখুশি, ১টি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, নতুন লাল সবুজের পতাকা পেয়েছি, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে। ’

    তবে স্থানীয় অনেকে মনে করেন, দেশের অন্য বীরবিক্রম উপাধিপ্রাপ্তদের মতো ইউকেচিংয়ের সম্মান এবং সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি।

    বাংলাদেশ সময় : ১৫৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১১
    ---
    লিংক http://www.banglanews24.com/l/details.php ? nssl=601ae2494ebe4209648c3b6d750350d4
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:১৮582603
  • মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী
    লিখেছেন Mithusilak Murmu on April 22 , 2011
    ...................................................................................
    ২৫শে মার্চ ১৯৭১ । মধ্যরাতের সামান্য পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষোনা দিলেন । ইতোপূর্বে ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমূদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ’ । এই দিনেই বাংলার সর্বস্তরের মানুষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল । প্রস্তুত হয়েছিল দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়সমূহ।

    রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানাতেই ৬২ জন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার তালিকা পাওয়া যায় । শহীদ ফাদার উইলিয়াম ইভান্স এবং হারুণ-অর-রশিদ এর লেখা থেকে জানা যায় দিনাজপুর জেলার ওরাঁও ও সান্তালদের ১০০০ জনের সমন্বয়ে বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল ।

    ময়মন্সিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, নেত্রকোণা এলাকার গারো, হাজং, কোচ জনগোষ্ঠীগুলো থেকে প্রায় পনেরশত আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । ১১৫ জন ছিল শুধু হালূয়াঘাট এলাকা থেকেই ।

    বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরিদের মধ্যেই কমপক্ষে ৫০ জনের অধিক সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন । অনেকে জীবন দিয়েছেন দেশের জন্য, তাদের মধ্যে গিরিশ সিংহ ও ভুবন সিংহ উল্লেখযোগ্য । সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার সদর, কুলাউড়া, বড়লেখা, চুনারুঘাট, মাধবপুর, বৈকন্ঠপুর, গোয়াইনঘাট সিলেট সদর ও ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ৮৩টি বাগান এলাকার আদিবাসী ও চা জনগষ্ঠীর কমপক্ষে ৬০২ জন শহীদ, আহত ৪৩, নির্যাতিত ৮৩ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেকে ।

    মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল পুরো বাগানের কর্মী, কর্মকর্তা এবং সাধারণ জনগণ ।

    মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রং বলেন, ‘ দেশ স্বাধীন করার জন্যই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম অন্য কোন কারণে নয় । তাই মৃত্যূ কিংবা অন্য কোন কিছুই বড় বিষয় ছিল না । দেশ স্বাধীন করাই তখন মূল লক্ষ্য ছিল । তাছাড়াও যোদ্ধারা আদর্শ নিয়ে যুদ্ধ করে ’ । তিনি আরও বলেন, ‘ শরণার্থী শিবির থেকে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে দেশ মাতৃকার জন্য মহ্‌ৎ কাজ বলে প্রতীয়মান হয়েছিল ’ । মনিপুরী কবি ‘ নীলচান ’ ও ‘ কারাম নীলবাবু সিংহ ’ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, কমপক্ষে একজন পাকি খাকসেনাকে হত্যা না করা পর্যন্ত অন্নের সাথে ব্যঞ্জন খাবেন না । বা কোন কিছু খাবেন না, স্রেফ নুনভাত খাবেন । নীলবাবু আর নীলচানকে ব্যঞ্জনের জন্য দীর্ঘদীন অপেক্ষা করতে হয় নি ।

    মৌলভীবাজার কমলগঞ্জের আনন্দমোহন সিংহ বলেন, ‘ আমার চারজন সহযোদ্ধা এ লড়াইয়ে শহীদ হন । মৃত্যূকালে তাদের বাবা-মাকে দেখাশোনা করার কথা বলেছিল সহযোদ্ধা বন্ধুরা । কিন্তু যুদ্ধশেষে তাদের বাড়ি ফিরে বাড়ির কোন চিহ্নই খুজে পাওয়া যায় নি । তিনি বলেন, ‘ যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে নিজের বাড়িই অচেনা লাগছিল নিজের কাছে । শুধু ভিটেমাটি ছাড়া কিছুই ছিলো না ’ ।

    ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনি আত্মসমর্পন করলে বিজয়ের বেশে ঘরে ফিরলে মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র রিছিল দেখেছিলেন, ঘরবাড়ি ভূ-সম্পত্তি, ক্ষেতের ফসল ও গবাদি পশুসহ আরও অনেক কিছুই ফিরে পান নি । পাকি বাহিনী ও তাদের দোসররা তাদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে নিয়ে যায় । ক্ষেতের ফসল ও গরু বাছুর নিয়ে যায় । ক্ষয় ক্ষতির পরিমান ছিলো ১ লক্ষ্য ৫০ হাজার তাকার মত ।

    দেশমাতৃকার টানেই আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা কোমল কর্মক্ষম হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, কোন অংশেই তাদের অংশগ্রহণকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই । শত্রুর হাতে জীবন উৎসর্গ করেছেন লড়াই করে, শারীরিক পঙ্গুত্ব নিয়ে অনেকে জীবিত রয়েছেন । হিন্দু অভিদা নিয়ে লক্ষ্য লক্ষ্য আদিবাসীকে নিজ বসতভিতা থেকে বিতাড়ন করেছে, হারিয়েছে সহায়-সম্পদসহ সবকিছুই । ধর্ষিত হয়েছে অগণিত নারী ।

    শহীদ ফাদার উইলিয়াম ইভান্স এবং হারুণ-অর-রশিদ এর লেখা থেকে আরও জানা যায়,পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীরা বিভিন্ন জনকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন ‘Hindus are enemies of our country. They will be driven out of the country. Those who give them shelter will also be driven out of the country.’ ভারতের মাটিতে শরণার্থী হিসেবে লক্ষ্য লক্ষ্য আদিবাসী আশ্রয় নিয়েছে, অনাহার অর্ধাহারে, রোগে শোকে, চিকিৎসার অভাবে নিরাময়যোগ্য রগে হারিয়ে গেছে পরিবার থেকে চিরদিনের জন্য । মুক্তিযুদ্ধে নি:সংগ হয়েছে মায়ের কোল, স্ত্রীর ভালবাসা, সন্তানের অপেক্ষমান হৃদয় ।

    দেশ স্বাধিন হয়েছে, স্বাধীন বাংলার মুক্তির ইতিহাস রচনায় আদিবাসীরা উপেক্ষিত, বাদ পড়েছে বা তাদের বিষয়ে লেখার দরকার নেই । পবিত্র সংবিধানে তাইতো আদিবাসীদের স্থান সংকুলান হয় নি ।

    বাংলাদেশ শত্রু শক্তির কবল থেকে মুক্ত হয়েছে কিন্তু যুদ্ধের সৈনিকদের অবদান জাতি,দেশ জানতে পারে নি । ইতিহাস লেখক, গবেষকগণ এড়িয়ে গেছেন নিভৃতচারী এসব আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসীপূর্ণ অবদানগুলো । ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত গবেষণার জন্য প্রধান উৎস হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ১৫ খন্ডের দলীলপত্র ।

    এসব দলীলের মধ্যে আদিবাসীদের ভুমিকার কথা বলতে গেলে উল্লেখমাত্র নেই । কেবল ভারতের ত্‌ৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধী মেঘালয় সফরে গেলে সে সময় বাংলাদেশের গারো শরনার্থীরা তাকে যে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন তা মুদ্রিত হয়েছে । আর রয়েছে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার অভিমত যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের কাজে আদিবাসীদের সহায়তা দরকার । এই পর্যন্তই।

    মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যেমন বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ কর্তৃক ‘ শ্রেষ্ঠ ইতিহাস গ্রন্থের মর্যাদাপ্রাপ্ত মাইদুল হাসান লিখিত মূলধারা-৭১ ’ সেখানেও আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা উপেক্ষিত । মাইদুল হাসান ছিলেন একাত্তরের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের সচিব । অথচ স্মৃতিসম্ভার এবং দুস্প্রাপ্য ডকুমেন্টস-এ সমৃদ্ধ এই গ্রন্থটিতেও আদিবাসীর ঠাই হয় নি ।

    তাই এই ব্লগের প্রধান সমর সরেন সহ ব্লগ সঞ্চালকদের মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অবদান নিয়ে একটি বিভাগ খোলার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি ।
    ----
    http://w4study.com/ ? p=1503
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:১৯582605
  • "পাক বাহিনীরা পার্বত্য জেলা সদর রাঙ্গামাটি ও মহকুমা সদর রামগড় এবং বান্দরবান দখল করার পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ঘাঁটি স্থাপন করে এবং ঘাঁটিসমূহ সুদৃঢ় করে নেয়। তারা বিভিন্ন এলাকায় শাখা কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় রাজাকার বাহিনী ও হিলরাজ বাহিনী গঠন করে এবং বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে বর্বর অত্যাচার চালায় ও ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। পাকবাহিনী রামগড়, গুইমারা, মানিকছড়িসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে পাহাড়ী রমনীদের জোর পূর্বক ধরে নিয়ে অমানুষিকভাবে ধর্ষণ করে এবং ক্যাম্পে উলঙ্গ অবস্থায় বন্দী করে রাখে।

    "১নং সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়। এই দল গঠনের নেতৃত্ব দেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। এটি পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ কোম্পানী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। শ্রী ত্রিপুরাকে কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এই কোম্পানীর অধীনে গ্রুপ নং- ৯১, ৯২, ৯৩, ৯৪ এবং ৯৫ সংযুক্ত করা হয়। উক্ত গ্রুপগুলির ট্রেনিং কেন্দ্র ছিল ভারতের অম্পি নগর এবং ১নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার হরিণা। ১নং সেক্টরের অধীনে হরিণা থেকে ৩০ কি: মি: দূরবর্তী সীমান্ত এলাকা ভারতের বৈষ্ণবপুরে আগস্ট মাসের প্রথম দিকে সাব-সেক্টর স্থাপন করা হয়। সেখানে অবস্থানরত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করা হয়।

    "পার্বত্য এলাকায় অবস্থানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের সুবিধা, শত্রুপক্ষের ঘাঁটি আক্রমণ এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার অন্তর্গত নাকাপা, কুমারীপাড়া, পাগলা পাড়া, মানিকছড়ি, ডাইনছড়ি, যোগ্যাছলা ও গাড়ীটানা এলাকার গহীন অরণ্যে মুক্তিবাহিনীর গোপন ক্যাম্প বা আশ্রয়স্থল করা হয়। এই সমস্ত গোপন গেরিলা ক্যাম্পে ঐ এলাকার হেডম্যান কার্বারীসহ সকল স্তরের জনগণ খাদ্যশস্য সরবরাহ করত এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ঐ সমস্ত এলাকার জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পাকবাহিনীর গতিবিধি এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে সাহায্য করত।"

    http://www.dcrangamati.gov.bd/index.php ? option=com_content&view=article&id=83&Itemid=94
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:১৯582604
  • মহাকাব্যের অগ্রন্থিত কবিতা : মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী
    লিখেছেন: চারু হক
    .....................................
    গণহত্যার ইতিহাসে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক মানুষ নিহত হয়েছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক গণহত্যায়। কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাওয়া এই নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিল এদেশের আপামর জনসাধারণ ; এদেশের বাঙালি ছাড়াও অর্ধশতাধিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, যারা কখনো আদিবাসী, কখনো উপজাতি, কখনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন অভিধায় অভিহিত। অস্তিত্বে জড়িয়ে থাকা, চেতনায় মিশে থাকা প্রতিবাদের ভাষা দিয়ে ইতিহাসের অধ্যায়ে অধ্যায়ে সংগ্রামী মহাকাব্যের এ স্রষ্টারাই ভারতবর্ষে বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে ১ম বিদ্রোহ করেছিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০- ১৮০০), গারো বিদ্রোহ (১৭৭৫-১৮০২), চাকমা বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০০), খাসি বিদ্রোহ (১৭৮৩), ময়মনসিংহের কৃষক বিদ্রোহ (১৮১২-১৮৩০), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-১৮৫৭), মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৫৭), তেভাগা বিদ্রোহ (১৯৪৬-১৯৪৭), টংক বিদ্রোহ, নাচোল বিদ্রোহ প্রভৃতির পথ ধরেই তাঁদের সমুখে আসে মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১)।

    এ মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালি জাতির পাশাপাশি রক্ত ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সনাতনসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত সমরদক্ষ পাকিস্তানী সেনাদের সমুখে দাঁড়িয়েছে বাঙালি ছাড়াও অর্ধ-শতাধিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ- সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, মুরং, ত্রিপুরা, গারো, হাজং প্রভৃতি।

    উপমহাদেশের বিদ্রোহ-সংগ্রামের ইতিহাসে সমুঙ্কÄল সাঁওতালদের বাংলাদেশে বসতি উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে। উত্তরবঙ্গে পাকিস্তানীদের প্রধান ঘাঁটি রংপুর ক্যান্টনমেন্টে ছিল ২৩তম ব্রিগেড হেড-কোয়ার্টার। ২৩ মার্চ পাকিস্তানি লে . আব্বাসের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রংপুরসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। হিন্দু বিবেচনা করে পার্শ্ববর্তী সাঁওতাল গ্রামগুলোতে চালায় অত্যাচারের স্টীমরোলার। এ পরিস্থিতিতে দা-কুড়াল, তীর-ধনুকের মতো আদিম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রংপুর সেনানিবাস আক্রমণের মতো দু:সাহসিক কাজে এগিয়ে আসে সাঁওতালরা। ২৮ মার্চ হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ বাঙালি ও আদিবাসী সকাল ১১ টায় ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হয়। গোপন চর মারফত আগেভাগেই ঘেরাও-এর কথা জেনে যাওয়া পাকিস্তানীরা রাতেই সেখানকার বাঙালি অফিসার ও সেনাদের বন্দি করে এবং ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলার প্রস্ততি নেয়। পদব্রজে সহস্র মানুষের অগ্রগামী স্রোত দেখে পাশবিক আক্রোশে গর্জে ওঠে তাদের অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। শত শত বাঙালি ও আদিবাসীর রক্তে রক্ত-বর্ণ হয়ে যায় ঘাঘট নদীর জল। এদেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় ৩০ হাজার সাঁওতাল। তিনশ ’ রও বেশি সাঁওতাল কেবল রংপুর থেকেই প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দিনাজপুরের ওরাওঁ ও সাঁওতাল মিলে প্রায় ১০০০ জনের একটি বিশাল মুক্তিবাহিনী ঐ এলাকায় অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করে। একইভাবে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, নেত্রকোণার গারো-হাজং-কোচ-ডালু প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫০০ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সাঁওতালদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রেরণা যোগান সাঁওতালনেতা সাগরাম মাঝি। গোদাগাড়ি রাজশাহীর বিশ্বনাথ টুডু ছিলেন প্লাটুন কমান্ডার। মক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় সাঁওতাল খ্রিষ্টান যাজক ফাদার লুকাশ মারান্ডিকে, রাজশাহীর কাশিঘুটুতে ১১ জনকে এবং রংপুরের উপকণ্ঠে ২০০ জন সাঁওতালকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। নির্মম লৈঙ্গিক নির্যাতন করা হয় গোদাগাড়ির আদাড়পাড়া গ্রামের মালতী টুডুসহ বেশ কয়েকজন নারীকে।

    মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধপর্বেই মণিপুরী-অধ্যুষিত মৌলভিবাজারের ভানুগাছ, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, ছাতকের কোম্পানিগঞ্জ ও সিলেটে পাকসেনারা নৃশংসভাবে হত্যা করে নিরপরাধ ছাত্র, যুবা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে। আদিম লালসার শিকার হয় অসংখ্য মণিপুরী নারী। ১২ আগস্ট মৌলভীবাজারের ভানুবিলের মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ব্রাহ্মণ সার্বভৌম শর্মাকে হত্যা করা হয়। নিহত হন মাধবপুর গ্রামের গিরীন্দ্র সিংহ, গিরীন্দ্র সিংহ প্রমুখ। এভাবে মৌলভীবাজার, কুলাউড়া, বড়লেখা, চুনারুঘাট, মাধবপুর, বৈকুণ্ঠপুর, গোয়াইনঘাট, হবিগঞ্জের কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, সিলেট সদর ও ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ৮৩ টি বাগান এলাকার আদিবাসী চা-জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৬০২ জনকে হত্যা করে। কামারছড়ায় পাকসেনাদের ক্যাম্পে বাংকার খনন ও জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্যে পালাক্রমে স্বেচ্ছাশ্রমে বাধ্য করা হত ভানুবিলের প্রতিটি মণিপুরীকে। জঙ্গলে কাজ করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কৃষ্ণ কুমার সিংহ, কুলেশ্বর সিংহসহ বেশ কয়েকজন আদিবাসী যুবক পালিয়ে ভারত গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। কেবল গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধ নয়, শব্দশিল্প, চিত্রশিল্প, নৃত্যশিল্প প্রভৃতির মধ্যদিয়েও মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহায়তা করেছেন অনিতা সিংহ, সাধন সিংহ, বানী সিনহা প্রমুখ। নন্দেশ্বর সিংহ, বিজয় সিংহ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক কয়েকশত মুক্তিসেনার বাহিনী গড়ে তুলতে অসীম ভূমিকা রাখেন।

    বর্মিদের অত্যাচারে সবকিছু হারিয়ে এদেশে স্থিতু হয়েছিল রাখাইনরা। অভিজ্ঞতায় স্বাধীনতা হারানোর বেদনা, চেতনায় পরাধীনতা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষার বশেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্ব রাখেন অসংখ্য রাখাইন। তেমন কয়েকজন উল্লেখযোগ্য বীরযোদ্ধা- কক্সবাজারের উ-মংয়াইন, উ-ক্যহ্লাচিং, পটুয়াখালী-বরগুনার উ-উসিটমং, রামুর মংয়াইন, মহেশখালীর মংহ্লা প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধকালে রাখাইনদের কেউ কেউ নিজেদের ‘ চায়না বৌদ্ধ ’ পরিচয় দিয়ে রক্ষা পেলেও পাকিস্তানি নৃশংসতায় নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল অধিকাংশ রাখাইন জনপদ। মে মাসে মহেশখালীর ঠাকুরতলা বৌদ্ধ বিহারে পাকসেনারা অনুপ্রবেশ করে বিনা অপরাধে বিহারের মহাথেরো উ-তেজিন্দাসহ ছয় জনকে গুলি করে হত্যা করে। বৌদ্ধ বিহারের ৬২টি রৌপ্য মূর্তি লুণ্ঠন ও কয়েকটি শ্বেত পাথরের মূর্তি ধ্বংস করে। দক্ষিণ রাখাইন পাড়ার বৌদ্ধ বিহারের সেবায় নিয়োজিত তিনজন নিরপরাধ রাখাইনকে আগুণে পুড়ে হত্যা করে।

    অন্যদিকে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় একাত্তরে পাকিস্তানীদের পক্ষ নিয়ে কাজ করায় সকল চাকমাদের ঢালাওভাবে পাকিস্তানের দালাল বলা হয়। পাকিস্তানপর্বে এদেরকে ভারতপন্থী, আবার ’ ৭১ ও পরবর্তীপর্বে বলা হয় পাকিস্তানপন্থী। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন রকম। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চাকমারা। ১ লক্ষ চাকমা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তাদের মধ্যে পাকসরকারের প্রতি ক্ষোভ ছিল সহজাত। তাই চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ’ ৭১-এ পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও চাকমা রাজ পরিবারের অন্যতম সদস্য কে . কে রায় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। প্রখ্যাত চাকমা নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে সক্রিয় অংশগ্রহণে প্রস্তুতি নিয়েছিল অসংখ্য চাকমা ছাত্র ও যুবক। তাঁদের ভাষ্যমতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের তদানীন্তন জেলা প্রশাসক এইচ . টি . ইমাম এবং স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা সাইদুর রহমানের ষড়যন্ত্রে চাকমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এর অনেক প্রামাণ্য উদাহরণের মধ্যে উল্লেখ্য- রসময় চাকমা, তাতিন্দ্রলাল চাকমা প্রমুখ। প্রশিক্ষণের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারত গিয়েও বিফল মনোরথে ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁদের। সঙ্গে ছিলেন আরও অনেক আদিবাসী তরুণ যুবক। যুদ্ধে অংশ নিতে না পেরে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের সনাতন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুযোগ বুঝে বিচ্ছিন্নভাবে পাকিস্তানীদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন এবং অন্যদিকে কেউ কেউ হতাশ হয়ে পাকিস্তানীদের ইন্ধনে রাজাকার বাহিনীতে নিযুক্ত হয়েছেন। অথচ পরবর্তী সময়ে এ কতিপয় চাকমা রাজাকারের জন্য নির্মম মাশুল দিতে হয়েছে আপামর চাকমা জনগোষ্ঠীকে।

    মুক্তিযুদ্ধের বিজয়োত্তর অব্যাহতিকালেই মুক্তিযোদ্ধা নামধারী কতিপয় দল চাকমাপ্রধান কুকিছড়া, পানছড়ি, কানুনগোপাড়ায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গণহত্যা ও লুটপাটের মহোৎসব চালায়। খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গার আসালং, বড়বিল, তাইন্দ্যং এবং তবলছড়ি মৌড়ার গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে যে দলটি মাটিরাঙ্গা হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে, সে দলটি পানছড়ি এবং দীঘিনালার বেশ কয়েকটি আদিবাসী গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং কিছুসংখ্যক আদিবাসীকে হত্যা করে। আবার বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যেসকল চাকমা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাঁদের প্রতি পরবর্তীতে শীতল আচরণ করা হয়। যুদ্ধকালীন বীরত্বের স্বীকৃতির রেকর্ড অনুযায়ী ৩ জন চাকমা মুক্তিযোদ্ধাকে বিধান মোতাবেক খেতাবে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও, পরবর্তীতে তা অকার্যকর রয়ে যায়।

    খাগড়াছড়ি মং রাজা মং প্রু সেইন সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। যুদ্ধকালে মানিকছড়ি রাজবাড়িতে আশ্রয়শিবির এবং ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, মুজিবনগর সরকারকে অর্থ-সহায়তা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিজের কয়েকটি গাড়ি এবং ত্রিশটির বেশি আগ্নেয়াস্ত্র প্রদান করেছেন। এরপর তিনি ত্রিপুরার সাব্রুম এবং সেখান থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে রূপাইছড়ি শরণার্থী-শিবিরে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের কাজে নিয়োজিত হন। এরপর নিরাপত্তার খাতিরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে আগরতলায় পাঠিয়ে অনারারি কর্নেল উপাধি দেয়। এসময় তিনি আখাউড়া অপারেশনসহ বেশ কয়েকটি সফল অপারেশনে পুরোভাগে থেকে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেন।

    অথচ সংবিধানে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব অস্বীকার করার মতই মক্তিযুদ্ধে তাঁদের ত্যাগ ও অবদানকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ ও গবেষকগণ এড়িয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের এ সাহসী উপাদানগুলো। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার আকড়গ্রন্থ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ১৫ খন্ডের দলিলপত্রে উল্লেখ নেই এঁদের অবদানগাঁথা। এমনকি বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ ইতিহাস গ্রন্থের মর্যাদা লাভকারী মূলধারা ’ ৭১ (মঈদুল হাসান) এও আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অবদান ঊপেক্ষিত।

    http://mukto - mona.com/bangla_blog/ ? p=20828#comments
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:২০582606
  • কাঁকন বিবি: খাসিয়া মুক্তি বেটি
    ইফতেখার আমিন
    ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬ : ৫৮
    .....................................................................................
    পাকিস্তানী মেজর তাঁকে দেখে বলেছিলেন- একেতো বাঙালী মনে হয়না, মনে হয় অন্য জাত। হ্যাঁ তিনি বাঙালী নন, তিনি খাসিয়া নারী। খাসিয়া মুক্তি বেটি হিসেবেই তিনি অধিক পরিচিত তাঁর এলাকায়। জাতিগত পরিচয়ের বাইরে তিনি নিজেকে মানুষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন মুক্তির কাতারে। অথচ এই সংগ্রামী আদিবাসী যোদ্ধার কছে পৌছাতে আমাদের সময় লেগেছে যুগের বেশী। সে সমস্যা কাঁকন বিবির নয় . সমস্যা আমাদের। অতি স ¤ প্রতি প্রধানমন্ত্রী সম্মাননা এবং আর্থিক সাহায্য তুলে দেন এই মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনার হাতে। এই বীরমাতার প্রতি বিনম্র শোদ্ধায় আজকের লেখা।

    মাতৃসূত্রীয় খাসিয়া পরিবারে জন্ম এই কাঁকনের। বর্তমানে তিনি কাঁকন বিবি হিসেবে অধিক পরিচিত এই খাসিয়া নরীর নাম কাকাত হেনইঞ্চিতা। ১৯৪৮ সালে সুনামগঞ্জের সীমান্তের কাছে নওত্রই গ্রামে এক খাসিয়া পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবার নাম নেহা ও মায়ের নাম দামেলি নেয়তা। তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট কাঁকন। মায়ের গর্ভে থাকতে বাবাকে আর জন্মের দেড় মাস পরে মাকে হারান তিনি। তারপর নানীর হাত ঘুরে বড় বোনের কাছে হয় তাঁর আশ্রয়।

    তাঁর বড় বোন কাপলি নিয়তা আনসার বাহিনীতে কর্মরত এক মুসলমান কমান্ডারকে বিয়ে করেন। সেই সূত্রে বোনের সাথে কাতলবাড়ীতে কাটে কাঁকন বিবির শৈশবের বেশী আর কৈশরের একটা বড় অংশ। হঠাৎ করেই বড় বোনের উদ্যোগে ধর্মপরিবর্তন করে মুসলমান হয়ে যান কাঁকন। তখন তার নাম হয় নুরজাহান। এরপর সুনামগঞ্জে ফিরে বিয়ে করেন শহীদ উদ্দিনকে। বিয়ের পরপরই একটি ছেলে হয়ে মারা যায় কাঁকন বিবির। শুধু তাই নয় এভাবে পাঁচ পাঁচটি ছেলে মারা যাবার পর একমাত্র কন্যা সখিনা পেটে থাকা অবস্থায় তাঁর প্রথম স্বামী তাঁকে তালাক দেন। পরবর্তীতে বোনের উদ্যোগে বোগলা ক্যাম্পের সীমান্ত রক্ষী আব্দুল মজিদ খানকে বিয়ে করেন কাঁকন।

    একাত্তরের শুরুতে কাঁকন বিবির স্বামী তার দেশ পাকিস্তানকে রক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ভুলে যান স্ত্রী কাঁকনের কথা। এই অবস্থায় কাঁকন বিবি অর্থনৈতিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করেন। তখন পর্যন্ত এই যুদ্ধ এবং যুদ্ধের কারণ নিয়ে মাথা ঘামানের মতো অবস্থা তাঁর ছিলনা। তবে এই খোঁজার মধ্যে দিয়েই কাঁকন বিবি আবিস্কার করেন ভনক এক পৃথিবীতে। দেখেন শ্রেষ্ঠ জল্লাদখানা গুলোর অত্যাচার। এই ব্যাপারে তিনি বলেন- আমি খানা খোরাক লাগি তাকে তালাশ করি, যেয়ে দেখি মা বোনরে ধরিয়া ধরিয়া আনিছে, ওরা বয়স একবারেই ছুটু ছুটু। এই ছুটু ছুটু মেয়ে থাইকা ধরিয়া ধরিয়া আনিছে রাজাকাররা, শুধু আনিয়াই থুইনাই, রাইখা রাইখা তাগো ইজ্জত মারিতেছে, এইডা বলিতে অহনু শরম লাগে, মনে অহনও কেমন কেমন লাগে, কচি কচি মুকগুইলি মন টানে। স্বামীকে খুঁজতে গিয়ে কাঁকন বিবি একদিন ধরা পরে পাকিস্তানীদের হাতে। রাজাকাররা তাঁকে ধর্ষণসহ নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন করে। পাকিস্তানী সৈন্যরা তাঁকে টেংরা ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনীর লোক হিসেবে সন্দেহ করে নির্মম অত্যাচার চালায়। লোহার শিক গরম করে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে ঢুকিয়ে দিয়ে তথ্য আদায়ের চেষ্ট করে। কাঁকন বিবি বলেন যে তার স্বামী পাঞ্জাবী সৈন্য কিন্তু এখন তিনি স্বামীর কোন ঠিকানা জানেন না। এরপর পাকিস্তানীরা ওয়ালেসের মাধ্যমে খবর নিয়ে কাঁকন বিবির কথার সত্যতা খুঁজে পায়।

    এরপর তারা ভাবে তাঁর স্বামী যেহেতু পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করে তাহলে কাঁকনও তাদের পক্ষে কাজ করতে অবাধ্য হবেনা। তারা কাঁকন বিবিকে একটি কাগজ দিয়ে বলে পাকিস্তানীরা ধরলে এই কাগজ দেখাতে, কিন্তু মুক্তিবাহিনী ধরলে না দেখাতে। তারা তাঁকে ভিক্ষুক সেজে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর সংগ্রহ করতে বলে। প্রথমে ভয়ে কাঁকন বিবি তাতে রাজি হয় কারণ সে বুঝতে পারে এটা না করলে তাঁকে হত্যা করা হবে।

    এরপর থেকে তাঁকে হাজিরা দিতে হতো বিভিন্ন পাকিস্তানী ক্যাম্পে। কেননা হাজিরা না দিলে তাঁর জীবনের ভয় ছিল। কিন্তু পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পে যাতায়াতের সুবাদে তিনি দেখেন বাঙালী নারীদের উপর ভবহ অত্যাচার, দেখেন কীভাবে বাঙালী লোকজনকে ধরে এনে অত্যাচার করছে। এরপর হঠাৎই তাঁর মত পাল্টে যায়। এতোদিনের যাপিত ভয় কোথায় যেন পালিয়ে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন অসম্ভব সাহসী এক নারী। এরপর তিনি মুক্তিবাহিনীর কাছে এসে সব খুলে বলেন। মুক্তিবাহিনীও তাকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করে এবং সফল হয়। তারপরই মুক্তিযোদ্ধারা দেখেন কাঁকন বিবির সব ভবহ রুপ। এরপর থেকে কাঁকন বিবি নিয়মিত ভাবে খবর সংগ্রহ করতে থাকেন মুক্তিবাহিনীর কাছে, পাকিস্তানীরা কোথায় ক্যাম্প গেড়েছে, কোথায় কখন কিভাবে আক্রমনের পরিকল্পনা করছে, এইসব। যা মুক্তিবাহিনীকে সফলতা এনে দেয়। এরপর কাঁকন বিবি চলে আসেন ৫ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী এবং ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিনের কাছে। সেখানে গিয়ে তিনি ৫নং সেক্টরের লক্ষীপুর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য কারার সুযোগ পান। এরপর সুযোগ পেয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাজ করার। শহীদ কোম্পানীতে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও অস্ত্র সরবারহ করতেন।

    আগষ্টে এই অঞ্চলে পাকিস্তানীদের প্রতিরোধের পরিকল্পনা চলছিল। মুক্তবাহিনী গভীর রাতে ব্রিজ ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। এবং এর পুরো দায়িত্ব পড়ে কাঁকনের উপর। কাঁকন অপারেশন সফল করার জন্য কলাগাছের ভেলায় করে বোমা, অস্ত্র ও অন্যান্য রসদ বহন করে একাই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জার্ডিয়া সেতুর কাছে পৌছান। তাঁর সিগন্যাল পেয়ে অন্য কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সেখানে পৌছান। মাইন বিস্ফোরণে এই সেতু ধ্বংসের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব কাঁকন বিবির। এই এলাকার সবগুলো গেরিলা অপারেশন এ অংশ নেনে তিনি। মহব্বতপুর, কান্দাগাঁয়ের যুদ্ধ,বসরাই টেংরাটিলার যুদ্ধ, বেটিরগাঁও নুরপুরের যুদ্ধ, দোয়ারাবাজারের যুদ্ধ, টেবলাইয়ের যুদ্ধ, সিলাইর পাড়ের যুদ্ধ, পূর্ব বাংলার যুদ্ধ এই রকম ২০টির মতো যুদ্ধে তিনি সামনে থেকে অংশগ্রহন করেন। তিনি অস্ত্র চালাননি সত্যি কিন্তু গোলা বারুদ অস্ত্র বয়ে বেড়িয়েছেন। এমনকি পাকিস্তানীদের গোলাবারুদ চুরি করে পৌছে দিয়েছেন মুক্তিবাহিনীর কছে।

    নভেম্বর মাসের দিকে তিনি গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তারপর তার উপর যে নির্মম পৈচাশিক অত্যাচার চালানো হয় তার যন্ত্রণা হয়তো ভুলে গেছেন তিনি কিন্তু সেই নির্মমতার চি ‎ হ্ন এখনো মুছে যায়নি তাঁর শরীর থেকে।

    বাংলাদের স্বাধীন হবার পর এলাকায় খাসিয়া মুক্তিবেটি নামে পরিচিত হলেও তাঁর ওপর দিয়ে বয়ে যায় অসংখ্য ঝড়। একপ্রকার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন এই অসীম সাহসী নারী। এমনকি ভাইদের কাছে গেলেও তারা তাঁকে গ্রহণ করেনি।অভীষণ লজ্জার হলেও সত্য আশ্রয়হীন এই সাহসী যোদ্ধা জীবনধারনের জন্য একসময় শুরু করেন ভিক্ষাবৃত্তি। এসময় লক্ষীপুর গ্রামের দিনমজুর আব্দুল করিম যে ঘরটায় হাঁস মুরগী রাখতেন সেই ঘরে তাঁর কাঁকন বিবিকে থাকতে আশ্রয় দেন।

    দৈনিক সংবাদ প্রথম মিডিয়াতে তুলে আনে এই বীর সাহসী নারীকে। তার ফলশ্র “ তিতে ১৯৯৭ সালে নারী প্রগতি সংঘ তাঁকে ঢাকায় এনে সংবর্ধিত করে। বর্তমানে একমাত্র কন্যা সখিনার স্বামী আব্দুল রফিকের কাছে থাকেন কাঁকন বিবি। শেষ জীবনে যুদ্ধের বীরগাঁথার স্মৃতি, অত্যাচারের যন্ত্রণা, নির্মমতার চি ‎ হ্ন, অনেক যোগ্য সম্মান না পাওয়ার অক্ষেপ, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত জীবন নিয়ে মৃত্যুর দিন গুনছেন আমাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন, আদিবাসী খাসিয়া নারী, খাসিয়া মুক্তিবেটি- কাঁকন বিবি।

    http://www.somewhereinblog.net/blog/shobdoshoily/29066020#c7399292
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:২১582608
  • মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অবদানের স্বীকৃতি নেই
    মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিং মৃত!
    নওশাদ জামিল
    .....................................................................................
    বাঙালিদের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ ছিল আদিবাসীদেরও লড়াই। গবেষণা তথ্যে জানা যায়, বৃহত্তর রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অসংখ্য আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁদের মধ্যে দুজন পান রাষ্ট্রীয় খেতাব। তবে অধিকাংশ আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় নেই। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়েও এ বিষয়ে নেই কোনো তথ্য-উপাত্ত।

    মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পূর্ণ তালিকা মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের ( ) কোথাও পাওয়া যায়নি আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, নাম কিংবা ছবি। আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিং বীর বিক্রম সম্পর্কে দেওয়া হয়েছে ভুল তথ্য। সাইটটির 'বীর বিক্রম' তালিকায় তাঁকে মৃত বলা হয়েছে! লেখা আছে, 'মরহুম নায়েক সুবাদার ইউ কে চিং বীর বিক্রম'।

    অন্য আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি বীর প্রতীক সম্পর্কে ওয়েবসাইটে কোনো তথ্য নেই। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম জানান, তালিকা সম্পূর্ণ নয়। এতে কিছু ভুল-ভ্রান্তি আছে। ইউ কে চিংকে মৃত বলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'খুবই অন্যায় হয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে এটা ঠিক করা হবে।'

    মুক্তিযুদ্ধের উপ-সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ বলেন, 'কয়েকজন আদিবাসী নেতা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ আদিবাসী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। তাঁদের মধ্যে অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মাননা দেওয়া উচিত।'

    গবেষক আইয়ুব হোসেন ও চারু হকের 'মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী' শীর্ষক বইয়ে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের নাম পাওয়া যায়। মাঠপর্যায়ে গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহের মধ্য দিয়ে তাঁরা তালিকা প্রস্তুত করেন। বইটিতে ২৪ জন আদিবাসী মণিপুরী মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও ঠিকানা রয়েছে। মণিপুরীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন ১০ জন। গারো মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আছে ১৯০ জনের নাম ও ঠিকানা। সাঁওতাল, মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, ওঁরাও, মুণ্ডা ও রাখাইন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় যথাক্রমে ৮৯, ৬৯, ১২, ২৭, ৪, ৪ ও ৭ জনের নাম-ঠিকানা রয়েছে।

    গবেষক আইয়ুব হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রাথমিকভাবে এ তালিকা করা হয়েছে। এটা পূর্ণাঙ্গ নয়। আমরা মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছি।'

    আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক আদিবাসীর ঘরবাড়িতে লুটপাট ও ধ্বংস করা হয়েছিল। অসংখ্য আদিবাসী নারী নির্যাতিত হন। কিন্তু আদিবাসীদের অসামান্য অবদান আজও সেভাবে স্বীকৃত নয়।'

    গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, 'আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার এত বছর পরেও অবহেলিত ও বঞ্চিত। তাঁরা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয়ও দিতে চান না। সামাজিকভাবেও তাঁরা পাননি কোনো মর্যাদা।'

    খেতাবপ্রাপ্ত দুই আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিং বীর বিক্রম ও কাঁকন বিবি ভালো নেই। অসুস্থতা তাঁদের নিত্যসঙ্গী। আর্থিক টানাপড়েন তো আছেই। টাকার অভাবে চিকিৎসা পাননি ইউ কে চিং।

    বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'পাহাড়ে-জঙ্গলে থাকি। বছরে দুইটা দিন এলে শুধু খোঁজ নেয়।' মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে পরিবেশিত তথ্য শুনে তিনি হাসেন। এরপর অভিমানের সুরে বলেন, 'আমি তো মৃতের মতৈ বেঁচে আছি।

    দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২৭ মার্চ ২০১০।
    http://www.kalerkantho.com/~dailykal/ ? view=details&archiev=yes&arch_date=27 - 03 - 2010&type=gold&data=Loan&pub_no=117&cat_id=1&menu_id=17&news_type_id=1&index=0
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:২২582609
  • সেবস্তিয়ান মার্ডী : এক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা
    সালেক খোকন
    July 6th , 2011
    .....................................................................................
    মাদলের তাল ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাড়ছে এতদল নারী কন্ঠের সমবেত গানের সুর। গানের সাথে তাল মিলিয়ে নাচছে তারা। হলদে শাড়ি জড়ানো শরীর। হাতে সাদা শাখা আর খোপায় লাল জবা ফুল। হাত ধরাধরি করে পা মিলিয়ে নাচছে তারা। দুএকটা পা জড়িয়ে আছে নূপুরগুলো। ধুতি আর পাগড়ি পড়া এক আদিবাসী উদাসী ঢঙে মাদল বাজাচ্ছে। চারপাশে ঘিরে আছে গ্রামের সুধিজনেরা। এভাবেই চলছিল সাঁওতালদের খেমটা নাচের আসরটি।
    খেমটা নাচের এই দলটি সেবস্তিয়ান মার্ডীর। সেবস্তিয়ান বেশ আমোদি। খানিকটা নাচ-গান পাগলও। বিনে পয়সাতেই তার দলটি নাচ করে আশেপাশের আদিবাসী গ্রামগুলোতে। বিশেষ করে পূজার সময়টাতে এদের পাওয়াই দায়।

    অন্যের জমিতে চাষ করে যা পায় তাই দিয়ে কোনরকমে চলে সেবস্তিয়ানের পরিবারটি। আছে নানা অভাব অনটন। তবুও গান ছাড়ে না সেবস্তিয়ান। মাঝে মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে থাকে পুরোন মাদল আর ডিংগাটি। টাকা জমিয়ে বাদ্যগুলো কোন রকমে ঠিক করতে পারলেই আবারও শুরু হয় নাচগানের আসর।

    দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম বেতুড়া। এ গ্রামেই আদিবাসীদের নাচ হচ্ছিল ‘ হামরা দিনাজপুরিয়া ’ নামের অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান ঘিরে প্রতি বছরই এখানে চলে আদিবাসীদের তীরধনুক নিক্ষেপ, তুমরি খেলা ছাড়াও বাঙালি কৃষকদের জন্য মজার সব আয়োজন। সে অর্থে এটি এ অঞ্চলের আদিবাসী ও বাঙালিদের মিলন মেলা।

    পুরষ্কার বিতরণের পর শুরু হয় সেবস্তিয়ান মার্ডীর নেতৃত্বে সাঁওতালদের খেমটা নাচ। আমরা নাচ দেখছি মুগ্‌ধ হয়ে। স্থানীয় সাংবাদিক ও অনুষ্ঠানটির প্রধান উদ্যোগতা এম এ কুদ্দুস। পাশ থেকে সে জানালো সেবস্তিয়ান একজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা। কুদ্দুসের কথায় আমরা খানিকটা অবাক হই। আরো অবাক হই যখন জানি তিনি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সনদধারী কোন মুক্তিযোদ্ধা নন। সনদহীন নিভৃত এক মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি নিজেকে তেমন পরিচিত করেন না। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার কোন আক্ষেপ আর চাওয়া পাওয়াও নেই।

    বিকেলের দিকে অনুষ্ঠান শেষ হতেই সেবস্তিয়ান ফিরে যান তার দলটি নিয়ে। খানিকপরে আমরাও রওনা হই সেবস্তিয়ানের বাড়িমুখো। আমাদের সঙ্গি হয় এম এ কুদ্দুস।

    বুড়ির হাটের পাশ দিয়ে দুএকটা বাড়ি পেরোতেই কোন জনবসতি চোখে পড়ে না। চারপাশে শুধুই ধানক্ষেত। দূরে চোখে পড়ে মাটি আর ছনে ছাওয়া দুএকটা বাড়ি। কুদ্দুস জানলো এখানে এক সময় সাঁওতালদেরই আধিক্য ছিল। সন্ধ্যে হলেই আদিবাসী পাড়াগুলো থেকে ভেসে আসতো বাদল আর মাদলের শব্দ। সাঁওতালদের সেই অবস্থা এখন আর নেই। চরম দারিদ্রতায় অধিকাংশই ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রীস্টান হয়েছে। কিন্ত তবুও দারিদ্রতা তাদের পিছু ছাড়ে নি। তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে তাদের ধর্ম কেন্দ্রিক সংষ্কৃতিগুলো। কুদ্দুস জানালো সেবস্তিয়ানের পরিবার বহুপূর্বেই ধর্মান্তরিত হয়েছে। ফলে একধরণের ধর্মকেন্দ্রিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে সেবস্তিয়ানসহ আদিবাসী পরিবারগুলো। খ্রীস্টাদের কাছে তারা আজ ‘ আদিবাসী ’ । আর নিজ জাতির মানুষদের কাছে তারা জাতিত্যাগী ‘ খ্রীস্টান ’ । ফলে এক ধরণের দু:খবোধ নিয়েই টিকে আছে ধর্মান্তরিত আদিবাসীরা।

    দূর থেকে সেবস্তিয়ানের বাড়ি দেখান কুদ্দুস। আমরা সে দিকেই এগৈ। যেতে যেতে কুদ্দুসের সাথে কথা চলে দিনাজপুরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। এম এ কাফি সরকারের মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর বইয়ের উদ্বৃতি দিয়ে সে জানালো দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শুরু হয় কুটিবাড়ী থেকে। দিনাজপুর-রংপুর জেলা নিয়ে ছিল তখনকার ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর দিনাজপুর সেক্টর। সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল শহরের দক্ষিণ -পশ্চিম উপকন্ঠ কাঞ্চন নদীর তীরে কুঠিবাড়ীতে।

    সাতাশে মার্চ ১৯৭১। কুটিবাড়ীর আম বাগানে পাওয়া যায় ১৭ জন নিরাপরাধ বাঙালির লাশ। তাদের হত্যা করেছিল পাঠান পাঞ্জাবী অবাঙ্গালী ইপিআররা। আটাশে মার্চ বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলো পাঠান পাঞ্জাবি অফিসাররা। সে থেকেই শুরু। কুটিবাড়ির ক ’ জন বাঙালি ইপিআর জওয়ানই শুরু করেছিলেন সেই সংগ্রাম। কথায় কথায় আমরা সেবস্তিয়ানের বাড়ির কাছাকাছি চলে আসি।

    আমাদের খবর পেয়ে ছোট্ট একটি মাটির ঘর থেকে বের হয়ে আসে সেবস্তিয়ান। জোহার বলে খাটিয়া টেনে বসতে দেয় আমাদের। আপনি তো একজন মুক্তিযোদ্ধা। এমন প্রশ্নে সেবস্তিয়ান নিশ্চুপ থাকে। উত্তর না দিয়ে বলে, ‘ বাবু কি হবে আর এসব শুনে ’ । স্মৃতি হাতরে সেবস্তিয়ান বলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা কাহিনী।

    রাগদা মার্ডী আর মেরী মুরমুর ছেলে সেবস্তিয়ানের মার্ডী। বাবা মা ধুমধাম করে কসবা মিশনের ছারা হাজদার সাথে বিয়ে দেয় সেবস্তিয়ানের। বিয়ের বেশ কিছুদিন পরেই শুরু হয় যুদ্ধ। সেবস্তিয়ানের গ্রামের ওপারে পশ্চিম দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জ থানার রাধিকাপুর স্টেশন। সেবস্তিয়ান জানালো সে সময়টাতে তারা দেখতো দলে দলে লোক তাদের সর্বস্ব ফেলে সীমান্তপথে ভারতে যাচ্ছে।

    এক সময় তারাও পূর্বপুরুষের ভিটাবাড়ি ফেলে পাড়ি জমায় ভারতের শরণার্থী শিবিরে। তারা থাকতো গঙ্গারামপুরের কাছে শীববাড়ি ইয়োথ ক্যাম্পের পাশেই। দেশ থেকে আসা লোকদের দু:খগাথা কাহিনী শুনতেন এই যোদ্ধা। কিন্ত নিজের পরিবার ফেলে যুদ্ধে যাওয়ার কথা তিনি চিন্তাও করতে পারতেন না। নিজের জীবনের প্রতি এক ধরণের মায়া ছিল তার। অকপটেই সে কথাগুলো বলছেন সেবস্তিয়ান।

    এক সময় সেবস্তিয়ানের পরিচয় হয় জর্জ ভাইয়ের সাথে। জর্জ ভাই ছিলেন শীববাড়ি ইয়োথ ক্যাম্পের ৭ নং হামজাপুর সাব সেন্টারের কমান্ডার। তিনি সেবস্তিয়ানসহ শিবিরের আশেপাশের তরুণ ও যুবকদের যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করতেন। সেবস্তিয়ান বলেন জর্জ ভাই বলতেন, ‘ চলেন যুদ্ধ করি, দেশে ফিরি, দেশ হলো মায়ের মতোন, আমরা তাকে দুসমনের হাতে ফেলে রাখতে পারি না ’ । বলতে বলতেই সেবস্তিয়ানের চোখ ভিজে যায়। জর্জ ভাইয়ের কথা আজো তার হৃদয়ে বাজে। মূলত জর্জ ভাইয়ের উৎসাহেই নিজের মাকে ফেলে দেশমাতাকে রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে যায় সেবস্তিয়ান।

    ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকের কথা। পরিচিত লিয়াকত, আলী সেক্রেটারী,পিউস, জহোনাসহ প্রায় ৫০জন ট্রেনিং নেন শিববাড়ীর তালদীঘিতে। সেবাস্তিয়ান জানালো তাদের মধ্যে সাহসী যোদ্ধা ছিল পিউস। তারা যুদ্ধ করতো রামসাগর এলাকায়। তবে জর্জ ভাই অধিকাংশ সময়েই তাকে ক্যাম্পের দায়িত্বে ব্যস্ত রাখতেন।

    আদিবাসী বলে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলনা কোন জাতপাত। সবার মা ছিল দেশ। তাকে মুক্ত করাই ছিল লক্ষ্য। মুচকি হেসে সেবস্তিয়ান সাঁওতাল ভাষায় বলেন, ‘ যত হরগি মওজ গেলে তাহেনা বইহা লিকা ’ অর্থ্যাৎ সবাই ছিলাম ভাই ভাই হিংসা বিদ্বেষ ছিলো না।

    যুদ্ধের সময়ের সহযোদ্ধাদের কথা মনে হলে এখনো তার মন কাদে। প্রতিদিন ক্যাম্প থেকে বেড়োত এক একটা দল। দুএকজনের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল সেবস্তিয়ানের। অপারেশন থেকে ফিরার পর সে দেখতো তার সেই বন্ধুটি ফিরে নি। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে। অনেকেই ফিরতো রক্তাক্ত হয়ে। কত জনই শহীদ হয়েছে অথচ তাদের পকেটে পাওয়া যেত প্রিয়জনকে লিখা কয়েকটা চিঠি।

    সেবস্তিয়ান জানালো দেশ স্বাধীনের পর তারা সবাই জড়ো হয় দিনাজপুর স্টেডিয়ামে। কয়েকদিন থাকার পরে চলে আসেন নিজের ভিটায়। শুরু করেন পূর্বপুরুষদের কৃষি পেশা।

    মুক্তিযুদ্ধের সনদপত্রের কথা উঠতেই চুপ হয়ে যান সেবস্তিয়ান। ভবিষ্যতে সুবিধার কথা চিন্তা করে তো কেউ মুক্তিযুদ্ধে যায় নি। যুদ্ধের পরে কাগজপত্রগুলো পড়ে ছিল ঘরে। একবারের বন্যায় ভেসে যায় অধিকাংশ কাগজগুলৈ । এখন অবলম্বন শুধু ক্যাম্পের ডিসচার্জ সনদটি।
    বাড়ি সীমান্তবর্তী হওয়ায় কি ভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেতে হয় তা জানা ছিল না সেবস্তিয়ানের। তার পাল্টা প্রশ্ন , ‘ সনদ দিয়েই কি মুক্তিযোদ্ধাদের চেনা যায় ’ । সে জানালো যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য। আজ যখন দেশ হলো আইন হলো তখন দেখি মুক্তিযুদ্ধের সনদ নিয়ে অমুক্তিযোদ্ধারাও পাচ্ছে সরকারী সম্মান ও সহযোগিতা।

    জাতীয় দিবসগুলোতে উপজেলা সদরে সরকারিভাবে চলে কুচকাওয়াজ আর মুক্তিযোদ্ধদের সংবর্ধনার। বেতুড়া থেকে সেই অনুষ্ঠান দেখতে যান সেবস্তিয়ান। দূর থেকে দেখেন মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনার অনুষ্ঠানটি। কিন্ত সরকারি কাগুজে সনদ না থাকায় কোন সম্মান মিলে না এই যোদ্ধার। ফলে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাড়ি ফিরেন সেবস্তিয়ান।

    মুক্তিযোদ্ধা সেবস্তিয়ান বিষয়ে আমাদের কথা হয় দিনাজপুর জেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার সিদ্দিক গজনবী , বিরল উপজেলার ডেপুটি কমান্ডার রহমান আলী ও জর্জ ভাইয়ের ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা রবাট আরএন দাশের সঙ্গে। তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন সেবস্তিয়ান একজন মুক্তিযোদ্ধা। একই সাথে তারা দু:খ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সেবস্তিয়ানের নাম না থাকায়। বিরলের ডেপুটি কমান্ডার জানালেন স্বাধীনের পর সেবস্তিয়ান সনদদের জন্য যোগাযোগ না করায় তার সনদ মিলে নি। সনদ না থাকলে কি কোন চিহিঋত মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানিত করা যায় না। এমন প্রশ্নে নি:চুপ থাকেন তিনি।

    সেবস্তিয়ানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমরা ফিরতি পথ ধরি। সন্ধ্যা পেরিয়ে তখন রাত। চারপাশে ¯ ই œ গ্‌ধ জো ¯œ আর আলো। মনে ভাবনা আসে স্বাধীনের এতো বছর পরে সরকারি নিয়মের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে মিলবে কি মুক্তিযোদ্ধা সেবস্তিয়ানের কাগুজে সনদ কিংবা কোন সম্মান। নাকি মুক্তিযুদ্ধে সহযোদ্ধাদের স্মৃতি বুকে নিয়েই শেষ হয়ে যাবে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা সেবস্তিয়ান মার্ডীর জীবন প্রদীপ।

    http://www.salekkhokon.me/ ? p=486
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:২৩582610
  • নিজ দেশে পরবাসী এক মুক্তিযোদ্ধা আদিবাসী
    লিখেছেন : সালেক খোকন
    তারিখ : শুক্র, ১৫ জ্যান ২০১০, ০৩ : ২৮ PM
    ......................................................................

    ডিসেম্বর মাস।অআনন্দ আর কান্নার বিজয়ের মাস।অচারদিকে চলছে বিজয় উদ্যাপনের নানা আয়োজন।অদিনাজপুর শহর থেকে রওনা হয়েছি একজন মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে।অশহর পেরিয়ে চরপড়া কষ্টের পুর্ণভবা নদী।অব্যস্ত ব্রীজ থেকে এখন আর কেউ আগ্রহ নিয়ে নদী পানে তাকায় না।অব্রীজ পেরিয়ে সোজা বিরলের পথ।অধানকাটার পর দু ’ দিকের বিস্তীর্ণ মাঠে পড়ে আছে অজস্র ধান গাছের মোথা। দূরে কোন গ্রাম্যবাজার থেকে ভেসে আসছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন গানের ভাঙ্গা ভাঙ্গা সুর, ‘ তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে ’ ।অগানের তালেই চলছি আমরা। মাঝে মধ্যেই সাইড দিতে হচ্ছে ছোট ভটভটি আর বাবরি চুল সাদৃশ্য ধান বোঝাই বড় ট্রলিকে। ভটভটি আর ট্রলিগুলোতে পত পত করে উড়ছে লাল সবুজের পতাকা । ডিসেম্বর তাই সকলের পতাকা ওড়ানোর স্বাধীনতার মাস।

    আট কিলো পথ পেরিয়ে পৌছে গেলাম বিরল উপজেলা সদরে।অদিনটি ১৪ ডিসেম্বর।অমুক্তিযুদ্ধের নানা স্লোগান লেখা বড় বড় ব্যানার ঝুলছে সবখানে।অবিজয় মেলা, মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা আর শিশু-কিশোরদের কুচকাওয়াজসহ নানা আয়োজনের টানটান প্র ¯ ত্ততি চলছে।অএবারই প্রথম ঘটা করে উদযাপন করা হচ্ছে ‘ বিরল মুক্ত দিবস ’ । সাংসদদের পদচারণা,৭১এ মুক্তিযোদ্ধাদের নানা স্মৃতিচারণ আর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সরকারের নানা উদ্যোগের কথা জানবে বিরলবাসী।অকি š ত্ত এ সব অনুষ্ঠানে সম্মানিত হওয়া কোন মুক্তিযোদ্ধার কাছে আমরা যাচ্ছি না।

    দিনাজপুরের এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার রবাট আর এন দাসদের।অবড় ভাই জর্জ জে এম দাস (জর্জ ভাই),জেমস এম দাশ (লুইস) ও এন্টনী এন এন দাসসহ পরিবারের ৫জনই ১৯৭১এ যুদ্ধ করেছেন ৭ নং সেক্টরে।অবর্তমানে রবাট মুজিব নগর কর্মচারী কল্যাণ সংসদের যুগ্ম মহাসচিব।অতাঁর কাছ থেকে জেনেই আমরা খুঁজতে বের হয়েছি সেই মুক্তিযোদ্ধা আদিবাসীকে। যে মুক্তিযোদ্ধার সম্প্রদায়টিও নি:শব্দে হারিয়ে যাচ্ছে এদেশ থেকে। কোন রকমে টিকে আছে মাত্র ১৯টি পরিবার।অসম্প্রদায়টির নাম আদিবাসী ‘ কড়া ’ সম্প্রদায়। ১৯৭১ সালে এই সম্প্রদায়ের এক যুবক বঙ্গবন্ধুর ডাকে উজ্জীবিত হয়ে অন্যান্য বাঙালিদের সাথে ঝাপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে।অকি š ত্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখন আর তিনি নিজেকে পরিচয় দেন না।অনিজেকে লুকিয়ে রাখা এই মুক্তিযোদ্ধার নাম শতীশ কড়া। সবাই ডাকে সাতান কড়া নামে।

    বিরল সদর থেকে ভারাডাংগী মুখো পথটি শেষ হয়েছে সোজা ভারতের কাটা তারের বেড়ার কাছাকাছি গিয়ে। সীমান্তের ওপারে ভারতের কুসমন্ডি থানা।অআর এ পাশে বাংলাদেশের বৈরাগীপাড়া। বিকেলের দিকে আমরা পৌছে গেলাম বৈরাগীপাড়ায়। হাতেগোনা দশ থেকে পনেরটি বাড়ী এখানে। কি š ত্ত সেখানে মুক্তিযোদ্ধা সাতান কড়ার বাড়ী খুঁজে পাওয়া গেল না। লোকমুখে শুনে বহুকষ্টে একটি ছোট দোকানের সামনে পাওয়া গেল এই অভিমানী মুক্তিযোদ্ধাকে।১৯৮৭ সালে কুষ্টরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি পঙ্গু হয়ে গিয়েছেন। চলছেন খুড়িয়ে খুড়িয়ে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে আগ্রহী নন তিনি। নিজের বাড়ী কোন দিকে জানতে চাইলে, কোন উত্তর মিলে না। জানা যায় একসময় সীমান্তবর্তী চক ফসল গ্রামে তার ভিটাবাড়ীসহ ৩৬একর জমি ছিল।অস্থানীয় ভুমিদস্যুরা জোর করে সেই জমি দখল নিয়ে নিলে সাতান চলে আসে এই গ্রামে।অএখানের প্রতিটি বাড়ীই এখন মুক্তিযোদ্ধা সাতান কড়ার বাড়ী। গ্রামের লোকদের দয় এবাড়ি ওবাড়ি রাত কাটিয়ে দিন কাটছে ৬৫ বছর বয়ষ্ক এই মুক্তিযোদ্ধার।

    রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে সাতান প্রবল ভাবে আবেগ তারিত হয়ে ওঠে।অগ্রামের যুবকদের সংঘবদ্ধ করে ‘ কড়া ’ ভাষায় বলতে থাকে, ‘ চালা দেশ স্বাধীন কারূয়ে, সবইন মিলকে দেশ স্বাধীন করূয়ে ’ । যুদ্ধ শুরু হলে দেশকে মুক্ত করতে স্থানীয় ইদ্রিস আলী, মজিবর, নুরুল,দেবেন,বকুল, কাশেম বিসতী ও জাসেফসহ পরিচিত প্রায় ১১জন গোপনে সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে যাওয়ার।অবাবা, মা আর স্ত্রীকে না জানিয়েই গোপনে চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। প্রথমে শিব বাড়ী ইয়ুথ ক্যাম্পে এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে শিলিগুড়ির পানিঘাটা থানায় ট্রেনিং নেন।অট্রেনিং শেষে চলে আসেন বড়গ্রাম ক্যাম্পে। ৭নং সেক্টরের অধীনে কমান্ডার ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন হিলির নিকটবর্তী গ্রামগুলোতে।অকার জন্য দেশ স্বাধীন করেছেন, জানতে চাইলে নিজ সম্প্রদায়ের ভাষায় বলেন- ‘ দেশ থেতুর হাম স্বাধীন করৈয়ে, হামার নিজের থেতুল স্বাধীন নাহি কারৈয়ে ’ (নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য স্বাধীনতা এনেছি)। আমাদের অনুরোধের চাপে মলিন মুখে বলতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের নানা কাহিনী।

    যুদ্ধের সময় অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মত সাতানও না খেয়ে কাটিয়েছেন বহুদিন, কত রাত কাটিয়েছেন ডোবার পানির মধ্যে,ঘুমিয়েছেন গোরস্থানে।অযুদ্ধের সময়ে সহযোদ্ধাদের মৃত্যু যন্ত্রণা দেখেছেন কাছ থেকে।অযুদ্ধকালীন সময়ে হানাদার আর রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারের কথা শুনে নিজের পরিবারের কথা মনে করে সাতানের মন কেঁদে উঠত।অসে সময় এদেশের প্রতিটি পরিবারই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার।অসহযোদ্ধা খলিল,কবির,রফিক,নয়ন,নুরু মিলে একটি গ্রামকে শত্র “ মুক্ত করার কথা বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সাতান আবেগ তারিত হয়ে পরেন।অসে সময় তাঁর মাথায় বিধে যায় গ্রেনেডের ¯ ইপ্রন্টার।অযুদ্ধের শেষের দিকে মুক্ত এলাকা ছাড়ার আগে হানাদাররা টিউবওয়েলগুলোতে বিষ ঢেলে রাখতো।অসে টিউবওয়েলের পানি খেয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর বহু সহযোদ্ধার করুণ মুখগুলো দেখেছেন এই মুক্তিযোদ্ধা। সে সব স্মৃতির কথা বলতে বলতে মাঝে মধ্যেই তার চোখ ভিজে যাচ্ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয় দিনাজপুর স্টেডিয়ামে।অতখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশিদ। অস্ত্র জমা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সাতান কড়া ফিরে আসেন নিজ সম্প্রদায়ের কৃষিকাজে।

    মুক্তিযুদ্ধের সময় আদিবাসী-বাঙালি একসাথে যুদ্ধ করলেও স্বাধীনের পর সব কিছু বদলে যেতে থাকে।অসাতান আক্ষেপ করে বলেন, ‘ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হলো আর আমরা হয়ে গেলাম সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায় ’ ।অস্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ার বিষয়টি জানলেও এর প্রক্রিয়া সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতেন না সাতান।অকাগুজে সনদ দেখিয়ে সুবিধা লাভের বিষয়টিতেও আগ্রহী নন তিনি।অফলে অযতে œ পড়ে থাকে ক্যাম্প থেকে পাওয়া কাগজগুলো।অপরবর্তীতে বন্যার পানিতে ভেসে যায় সেগুলো। কেন সনদপত্র করালেন না, জানতে চাইলে সাতান অকপটে বলেন, ‘ কি হবে ঐ কাগুজে সনদ দিয়ে।অযুদ্ধ করেছি বঙ্গবন্ধুর ডাকে, দেশ স্বাধীন করেছি - মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এর থেকে আর বড় কি পাওয়ার আছে ’ ।

    স্থানীয় ভূমিদস্যুদের হুমকির ভয়ে ২০ বছর আগে ভারতে চলে যায় সাতানের ছেলে মেয়েরা।অসে সময় পরিবারের সদস্যরা জোর করেও ভারতে নিতে পারেনি এই মুক্তিযোদ্ধাকে।অযুদ্ধকরে স্বাধীন করা এই প্রিয় দেশটিতেই মাটি কামড়িয়ে পড়ে থাকেন সাতান।অযুদ্ধের সময় বাঙালিদের কাধে কাধ রেখে যুদ্ধ করে এ দেশকে স্বাধীন করেছেন যে আদিবাসী যুবকটি, নিজের জমি থাকতেও সে আজ নিজ দেশে পরবাসী।আন্যের জমিতে নিড়ানোর মতো হালকা কাজ করে যা উপার্জন করেন তা দিয়েই কোন রকমে চলে যাচ্ছে তাঁর জীবন।

    মুক্তিযোদ্ধের ৩৮ বছর পর সাতানের আফসোস হয় যখন দেখেন অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারেরা কাগুজে সনদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গিয়েছে। স্বাধীনের পরে পাওয়া এ দেশকে নিয়ে কোন আক্ষেপ বা কষ্ট আছে কিনা, জানতে চাইলে এই মুক্তিযোদ্ধা ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। ভেজা চোখে বলেন, ‘ যার ডাকে যুদ্ধ করলাম তাকে তো স্বাধীন দেশেই বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না, তার পরিবারের সকলকেই হত্যা করা হলো, এখনও কোনই বিচার হলো না,একইভাবে বিচার হলো না রাজাকারদের, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটাই বড় দু:খ ’ ।

    মুক্তিযোদ্ধা এই আদিবাসীর সাথে যতই কথা বলছিলাম ততই তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হচ্ছিল। কাগুঁজে সনদ না থাকায় কোন ডিসেম্বরেই সাতানের মতো মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানিত হন না। দেশের জন্য যে যুদ্ধ করল, দেশে থাকার কারণে যাকে ফেলে পরিবারের প্রিয় মানুষগুলো চলে গেল, সেই মুক্তিযোদ্ধার নিজের জমি আজ অন্যের দখলে।

    এদেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরী হয়নি অদ্যাবধি।অযার উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন ছিল যুদ্ধের পর পরই। অথচ অবাক আর লজ্জিত হতে হয় যখন দেখা যায় অমুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারেরাও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নিচ্ছেন, পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান। সরকার পরিবর্তনের পর পরই পরিবর্তীত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। সে সুযোগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদপত্র পায় অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারেরাও। ফলে স্বাধীনতার পর থেকে নানা দলে বিভক্ত হয়ে পড়ছে জাতির সূর্য সন্তানেরা।অমুক্তিযুদ্ধের ৩৮ বছর পরেও এদেশে সাতান কড়ার মতো নিভৃত, বঞ্চিত,ত্যাগী ও অভিমানী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে পাওয়া যায়।অযাদের কোন কাগুজে সনদ নেই।অআছে দেশের জন্য বুকভরা ভালবাসা।অযারা যুদ্ধ করেছিল শুধুই দেশের স্বার্থে।

    মুক্তিযোদ্ধা সাতান কড়া যখন মারা যাবে কাগুজে সনদপত্র না থাকায় তখনও মিলবে না কোন রাষ্ট্রীয় সম্মান। কি š ত্ত তাতে সব হারা এই মুক্তিযোদ্ধার কি এসে যাবে। বরং লজ্জিত হতে হবে এ দেশকে, এ জাতিকে।

    http://www.sachalayatan.com/guest_writer/29782
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:৩২582611
  • পাহাড়ের মুক্তিযুদ্ধ: অন্য আলোয় দেখা
    --বিপ্লব রহমান
    _______________________________________
    [সাবেক চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধকে বহুবছর ধরে বিভ্রান্তির ঘেরাটোপে রাখা হয়েছে। খাটো করে দেখা হয়েছে পাহাড়ি জনগণের মুক্তিযুদ্ধ তথা ১৯৭১ সালে তাদের সব ধরণের চরম আত্নত্যাগের ইতিহাস। একই সঙ্গে সারাদেশে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের আত্নত্যাগকেও অনেক ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করার অপপ্রয়াস চালানো হয়। এ কারণে লেখার শিরোনামে 'অন্য আলোয় দেখা' কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। বলা ভালো, এটি মুক্তিযুদ্ধের ওপর কোনো গুঢ় গবেষণাকর্ম নয়; এটি নিছকই পাহাড়ের মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি আলোচনার অবতারণা মাত্র।]

    প্রথম পর্ব

    পাহাড়ের হত্যাযজ্ঞ পর্ব: একটি অপ্রকাশিত দলিল
    ১৯৬০ কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে কাপ্তাই জলবিদ্যুত নির্মাণ করা হলে প্রায় এক লাখ পাহাড়ি মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েন। তাদের অনেকেই প্রধানত ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে তখনকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ত্রিপুরা রাজার সঙ্গে সাাতে এলে ত্রিপুরার পাহাড়ি শরণার্থীরা আট পৃষ্ঠার পুস্তিকা আকারে তাকে একটি স্মারক লিপি হস্তান্তর করেন। সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি ১৯৭১-৭২ সালে পাকিস্তানী বাহিনী, কতিপয় বিপথগামী মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশ রাইফেলস, বিডিআর (এখন বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ, বিজিবি) সদস্য কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরস্ত্র পাহাড়ি জনপদে চালানো একাধিক একাধিক হত্যাযজ্ঞ, লুঠতরাজ ও অপারেশনের রোমহর্ষক বর্ণনা দেওয়া হয়।

    ১৯৭১ সালে তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় যেমন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তেমনি মং রাজা মং প্র“ সেইন আবার মুক্তিযুদ্ধের পে কাজ করেছেন। সে সময় রাজা মং প্র“ সেইন মুক্তিবাহিনীর জন্য নিজ প্রাসাদ উজাড় করে দেন। মুক্তিযোদ্ধারা তার প্রাসাদে থেকেই যুদ্ধ করেছিলেন, বহু সাহায্য পেয়েছিলেন। এছাড়া পাহাড়ি নেতা এমএন লারমা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। চাকমা রাজার কাকা শ্রী কেকে রায়ও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। কিন্তু শুধু সন্দেহের বশে তাকে ত্রিপুরায় আটক করা হয়েছিল। স্মারকলিপিটিতে এসব বিষয়ও তুলে ধরা হয়। এই অধ্যায়টি আমরা পরের পর্বগুলোতে আলোচনা করবো।

    এই লেখক ১৯৯৬-৯৭ সালে এপারের পাহাড়ি শরণার্থীদের ওপর সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরির জন্য তথ্য-সাংবাদিকতার পেশাগত কাজে একাধিকবার ত্রিপুরা রাজ্য সফর করেন। সে সময় ত্রিপুরার স্থায়ী বাসিন্দা, স্কুল শিক ও বর্ষিয়ান পাহাড়ি নেতা শ্র“তরঞ্জন (এসআর) খীসা লেখককে দুর্লভ স্মারকলিপির একটি কপি হস্তান্তর করেন। এসআর খীসার ছোট ভাই ভবদত্ত খীসা ছিলেন রাঙামাটির একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক।
    প্রসঙ্গত, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে পাহাড়িদের যে প্রতিনিধি দল ওই স্মারকলিপিটি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে এসআর খীসা নিজেও ছিলেন। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিলেও পরে তা আর কখনোই পূরণ হয়নি। দৃশ্যত, তিনি হয়তো এ নিয়ে তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে বিব্রত করতে চাননি। পাহাড়ের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পাশাপাশি চাপা পড়ে গেছে ওই চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন পর্বটিও।

    ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে দেওয়া ইংরেজী স্মারকলিপিটির প্রচ্ছদে লেখা হয়:

    MEMORANDUM OF THE TRIBAL PEOPLE OF TRIPURA TO THE PRIME MINISTER OF INDIA.
    ON
    POLITICAL DEVELOPMENT IN THE CHITTAGONG HILL TRACTS FROM 1947-1972.
    ON
    Killing, raps, arson and loot committed by the MUKTIBAHINI and the BANGLADESH RIFELS before and the after liberation of Bangladesh. The forceful occupation of Tribal lands by the Muslim of Bangladesh.
    ON
    Violation of the CHARATER OF HUMAN RIGHTS and the Principals of Secularism
    ON
    Stoppage of rising the height of the ‘KAPTAI HYDEL PROJECT DAM’ to supply electricity to Tripura and Mizoram.
    ON
    Humble suggestion put forth by the Tribals of Tripura for implementation in the Chittagong Hill Tracts.
    এতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের প্রত্য মদদে ১৯৭১ সালের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দেওয়া হয়। যেখানে দেখা যায় রাজাকার নিধনের নামে চাকমাদের সে সময় স্রেফ জবাই করা হয়েছিল! এতে বলা হয়:

    …. During this time Mr. KK Roy, an uncle of Chakma Chief and an Awami League nominee to the provincial Assembly from from Chittagong Hill Tracts crossed into India with an intention of contacting Awami League hierarchy and explaining matters. But he was apprehended and arrested by Tripura police at Subrum on April 22, on the instruction of HT IMAM and B. Rahman, the SP of Chittagong Hill Tracts.
    Mr. Imam after crossing into the India became the administrator of the Bangladesh Eastern Zonal office in Tripura. In absolute violation of the principals of secularism he unleashed in India a vicious anti-Chakma campaign. Leading dailies published at random his fabricated stories openly denouncing the Chakma and their chief as Pak-Mizo collaborators. He malicious propaganda incited and encouraged the Mukti Bahini to adopt the inhuman slogan ‘SLAUGHTER THE CHAKMAS’. As a result of this policy hundreds of tribals, mainly Chakmas, have been butchered, their homes burned, their place of religion ransacked, their women raped and their land forcibly occupied…
    এরপর স্মারকলিপিতে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয় আওয়ামী লীগ, মুক্তিবাহিনী, বিডিআর নামধারী কতিপয় সন্ত্রাসীরা একের পর এক গণহত্যা, গণধর্ষণ, লুণ্ঠন ও জ্বালাও-পোড়াও অপারেশনের সব নৃশংস ঘটনা।

    এর মধ্যে ১৯৭১ এর মে মাসে ক্যাপ্টেন খালেক ও জমাদার খায়রুজ্জামানের নেতৃত্বে রাঙামাটির তবলছড়ি, তনদাং, রামসিরা, দেওয়ানপাড়া এবং রামগড় অপারেশন, ৫ ডিসেম্বর পানছড়ির শীলাছড়ি অপারেশন (৩২ জন নিহত), ১৪ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি অপারেশন (২২জন নিহত), ২১ ডিসেম্বর দীঘিনালার তারাবনিয়া অপারেশন ( নয়জন নিহত) উল্লেখ যোগ্য। ১৯৭২ সালের ফেব্র“য়ারিতে রাঙামাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে বিডিআর সদস্যরা বিস্তৃর্ণ পাহাড়ে দফায় দফায় অপারেশন চালিয়ে হত্যা, ধর্ষন ও লুঠতরাজ করে। এরমধ্যে ২২ মার্চ ধালিয়া গ্রামে, ২২ ও ২৩ এপ্রিল বরইরাগি বাজারে, ৩০ এপ্রিল মাইচছড়িতে, ৮ মে খাগড়াছড়ির তারাবনিয়া, লোগাং বাজার অপারেশন উল্লেখযোগ্য। ২৯ মার্চ ১৯৭২ সালে প্রায় ২০০ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী রামগড়ের মানিকছড়ি, চিকনপাড়া, সাঙ্গুপাড়া, পাক্কামুড়া ও গোদাতলা গ্রামে একযোগে অপারেশন চালায়। ঘটনার তদন্তের নামে ২ এপ্রিল পুলিশ বাহিনী একই গ্রামগুলোতে আবারো তল্লাসী অভিযান চালায়। …

    রাঙামাটি মুক্ত হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতারা রাজকার আখ্যা দিয়ে বহু সংখ্যক পাহাড়ি জনসাধারণকে আটক করে। সে সময় মং রাজা ও সরকারের আদিবাসী উপদেষ্টা প্রু সেইন আটকৃতদের মুক্তি দাবি করে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে টেলিগ্রাম করেন। স্মারকলিপিতে উল্লেখিত টেলিগ্রামটি নিম্নরূপ:

    ‘VISITED RANGAMATI ON SIXTH INSTANT STOP EXTREMELY AGGRIEVED TO FIND INNOCENT TRIBAL PEOPLE ARRESTED INDISCRIMINATELY AS ALLEGED COLLABORATORS STOP EARNESTLY REQUESTED INSTRUCT CIVIL ADMINISTRATION IMMEDIATE RELEASE OF ALL TRIBALS SO FAR ARRESTED WITHOUT PREJUDICE AND FURTHER ARREST BE CEASED STOP= MONG RAJA AND THE TRIBAL ADVISOR TO BANGLADESH’


    ছবি: শহীদ খগেন্দ্র নাথ চাকমা, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লার মুরাদনগরে সার্কেল ইন্সপেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে পাকিস্তানী বাহিনীর কর্তৃক নিহত হন, তন্দ্রা চাকমা। ইন্দিরা গান্ধীকে দেওয়া স্মারকলিপির ইমেজ, লেখক।

    দ্বিতীয় পর্ব

    ত্রিদিব রায়ের ভূমিকা, ১৯৭১
    লেখার শুরুতেই বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অমি রহমান পিয়ালকে উদ্ধৃত করা যাক। এই লেখকের পাহাড়ের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি খসড়া নোটে তথ্য ঘাটতি দেখা দেওয়ায় অরপিকে ইমেল করে ১৯৭১ সালে সাবেক চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের ভূমিকাসহ এ সংক্রান্ত মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছিল। ওই ইমেইল বার্তার জবাবে তিনি একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে খুব চমৎকার করে তুলে ধরেন পুরো বিষয়। অরপি বলছেন:

    অমি রহমান পিয়াল
    জুন ২৫, ২০১১ at ৮ : ৫৯ অপরাহ্ণ লিঙ্ক
    সুপ্রিয় বিপ্লব রহমান, আপনার মেইল পেয়ে পোস্টটি পড়লাম এবং অনুরোধ রাখতেই আমার বক্তব্য রাখলাম। বিব্রতবোধ করছি এইজন্য যে সে বক্তব্য আপনার পোস্টের বক্তব্য সমর্থন নাও করতে পারে। তার আগে বলে নিচ্ছি যে আমি আরাফাতুর রহমানের লেখাটা পড়িনি। আপনারটা পড়েই আমার যা বলার বলছি। কোনো বাতুলতা নিজগুণে ক্ষমা করবেন।

    প্রথমে আসি আদিবাসী রাজাকার প্রসঙ্গে।অবাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলো। পক্ষে এবং বিপক্ষে। এখানে লক্ষণীয় তাদের বসবাসের জায়গাটা সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় সেখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী- দুইপক্ষই ছিলো ভীষণভাবে ত্ৎপর। এই পর্যায়ে এসে আদিবাসীরা গোষ্ঠীগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় তারা কোন পক্ষে যাবে। সাওতাল এবং গারোরা সরাসরি পাকিস্তানের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। চাকমারা পক্ষে।(মগরা নিরপেক্ষ অবস্থান নিলেও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছে আবার পাকিস্তানীদের বার্মায় পালাতেও সাহায্য করেছে।)এটা গোষ্ঠীগত সিদ্ধান্ত, গোষ্ঠী প্রধানের নির্দেশ। এখানে সমর্থন অর্থে বলা হয়েছে। এই সমর্থনের অর্থ ইনটেলিজেন্স, আশ্রয় এবং লোকবল দিয়ে সহায়তা।

    প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর হয়ে গারোরা লড়েছেন, সাওতালরা লড়েছেন। ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ এবং ইপিআরের সদস্য যেসব আদিবাসী ছিলেন তারা লড়েছেন। এদের মধ্যে মারমা-মুরং-গারো-লুসাই সব গোষ্ঠীই ছিলেন,ছিলেন চাকমারাও। তারা তাদের সম্প্রদায়গত সিদ্ধান্তের বদলে প্রায়োরিটি দিয়েছেন কর্তব্যবোধ এবং ক্যামোরেডরিকে।

    চাকমাদের জন্য এই সিদ্ধান্তটা এসেছে রাজা ত্রিদিব রায়ের তরফে।অতিনি গোষ্ঠীপ্রধান। এপ্রিলের শুরুতেই রাঙ্গামাটিতে পাকিস্তান থার্ড কমান্ডো ব্যাটেলিয়ান অবস্থান নেয়। স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের এলিট কমান্ডোদের প্রধান মেজর জহির আলম খান (শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করেছিলেন তিনিই) ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে দেখা করে সবধরণের সহায়তার প্রতিশ্রুতি পান। সঙ্গে যোগ দেয় লালডেঙ্গার নেতৃত্বাধীন মিজোদের একটি ব্রিগেড। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে মুক্তিবাহিনী এবং বিএসএফের সম্ভাব্য ত্ৎপরতা এবং তা ঠেকানোর জন্য সহায়তার কথা ছিলো সে প্রতিশ্রুতিতে। শুধু ত্রিদিব রায়ের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দলই নয়, রাঙ্গামাটিতে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস (ইপিসিঈফ) প্রাথমিকভাবে যোগ দেয় প্রায় শ ’ তিনেক চাকমা। যুদ্ধশেষে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের সংখ্যাটা এক মাসে ছিলো দেড় হাজারের ওপর। যদিও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় তাদের সবাইকেই পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

    এমনকি দুর্গমতার কারণে পাহাড়ের অধিকাংশ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের কোনো ঢেউই লাগেনি- আপনার এই কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। ৩ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার অনেক আগে থেকেই পাহাড় ছিলো উত্তাল। এখানে অপারেশনাল ছিলো মেজর জেনারেল সুজয় সিং উবানের তত্বাবধানে থাকা মুজিব বাহিনীর একটা অংশ (শেখ মনির নেতৃত্বাধীন) এবং উদ্বাস্তু তিব্বতীদের নিয়ে গড়া স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। চেহারায় সাদৃশ্য থাকার কারণে (মঙ্গোলয়েড) তিব্বতীরা নভেম্বরের শুরু থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশনে নামে (অপারেশন মাউন্টেন ঈগল)। এই লড়াইয়ে পাকিস্তানীদের পাহাড়ে গাইড এবং ইন্টেলিজেন্স দিয়ে সহায়তার দায়িত্ব পালন করে ইপিসিঈফের চাকমারা।

    এখন ত্রিদিব রায়কে আপনি স্রেফ পাকিস্তানের একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক বা যে তকমাই দিতে চান না কেনো, তার প্রাথমিক পরিচয় তিনি চাকমাদের রাজা। এমন যদি হতো তিনি শুধু রাঙ্গামাটির চাকমাদের রাজা, বা অন্যরা তাকে রাজা বলে স্বীকার করতো না তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু রাজার দায় তার গোষ্ঠীর ওপর খানিকটা বর্তায় বৈকি!পার্বত্য চট্টগ্রামের দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে (সেগুলো বেশ চমকপ্রদ একদিন শেয়ার করা যাবে) চাকমারা তাই রাজার নির্দেশই পালন করেছে। কিংবা সে নির্দেশের বিপক্ষে যায়নি। ত্রিদিব রায় শুধু তার গোষ্ঠীকেই সহায়তার নির্দেশ দিয়ে বসে থাকেননি। নিজে মাঠে নেমেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক সমর্থন আদায় করতে গেছেন কলম্বো, সেখানে সিংহলীজ ছাত্রদের ধিক্কার শুনে ফিরেছেন। স্বাধীনতার পরপর পাকিস্তানকে সহায়তার জন্য যে ১২ জনের নাগরিকত্ব বাতিল এবং সহায়সম্পত্তি ক্রোক করা হয় আদালতের নির্দেশে সে তালিকায় গোলাম আজমের সঙ্গে রাজা ত্রিদিব রায়ও আছেন। তিনি নাগরিকত্ব ফিরে পেতে কোনো তদবির করেননি। যদিও সহায়সম্পত্তি ফিরে পেয়েছেন।
    প্রশ্ন উঠতে পারে যে যুক্তিতে গোলাম আজমের বিচার করা যায়, সেই একই যুক্তিতে ত্রিদিব রায়কেও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় কিনা। আমার ধারণা যায়, যদিও তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে সে দেশেই রয়ে গেছেন, কয়েকদফা মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ধরাছোয়ার বাইরেই। বাকি থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তাকারী অক্সিলারি ফোর্সের চাকমারা। এরা সাধারণ ক্ষমা পেয়েছে। এদের কারো বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ এব লুটপাটের অভিযোগ ছিলো না। দে জাস্ট মার্চড এলং ফলৈং দেয়ার কিং। তবে সেরকম কোনো প্রমাণ নিয়ে কেউ যদি আসে, তাহলে নিশ্চয়ই তাদেরও বিচার করা যাবে। ব্যাস এটুকুই।

    আগেই বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে ত্ৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় যেমন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তেমনি মং রাজা মং প্রু “ সেইন আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। সে সময় রাজা মং প্র “ সেইন মুক্তিবাহিনীর জন্য নিজ প্রাসাদ উজাড় করে দেন। মুক্তিযোদ্ধারা তার প্রাসাদে থেকেই যুদ্ধ করেছিলেন, বহু সাহায্য পেয়েছিলেন। এছাড়া পাহাড়ি নেতা এমএন লারমা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। চাকমা রাজার কাকা শ্রী কেকে রায়ও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। কিন্তু শুধু সন্দেহের বশে তাকে ত্রিপুরায় আটক করা হয়েছিল। পাহাড়িদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়টি আমরা তৃতীয় ও শেষ পর্বে আলোচনা করবো।

    ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) জহির আলম খান পাকিস্তান ডিফেন্স জার্নালে একটি সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের কথাও ছিলো (একাত্তরের মাঝপথে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া হয়)। সেখানে ত্রিদিব রায়ের অনুসারী চাকমাদের একাংশের সহায়তার বিষয়ে মতামত হচ্ছে :
    The Chakma and the Mizo tribesmen co-operated with the Pakistan Army in 1971. You were closely associated with them. How was the experience?

    We landed in Rangamati just after nightfall, the next morning I called on Raja Tridiv Roy, the Chakma Chief, He lived in an old bungalow on an island separated from the mainland by a channel about fifty yards wide.
    I explained to the Raja that the army had come to re-establish the control of the Pakistan Government on the Hill Tracts and asked for his co-operation in maintaining peace and to keep me informed about any rebel movement, concentration and activity, the Raja agreed and co-operated right upto the surrender. At the request of our government Raja Tridiv Roy came to West Pakistan before our surrender in East Pakistan, he was our ambassador in a number of countries and now lives in Islamabad.
    [লিংক]

    সাবেক চাকমা রাজা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিদেশেও সক্রিয় ছিলেন। ২৬ সেপ্টেম্বর মার্কিন দূতাবাসের গোপন তারবার্তায় জানায়, রাজা ত্রিদিব রায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসেবে শ্রীলঙ্কা যান। তারবার্তাটি নিম্নরূপ:

    Department of State
    TELEGRAM
    CONFIDENTIAL 444
    COLOMB 03360 270603 Z
    19
    ACTION NEA-11
    INFO : OCT-01 EUR-14 CIAE-00 DODE-00 PM-06 H-02 INR-06 L-03 NSAE-00 NSC-10 P-
    03 RSC-01 PRS-01 SS-14 USIA-12 10-12 SP-02 ORM-03 AID-20 RSR-01 EA-11 /133 W
    ……….060184
    P 261110 Z NOV 71
    FM AMEMBASSY COLOMBO
    TO SECSTATE WASHDC 7259
    INFO AMEMBASSY ISLAMABAD
    AMEMBASSY LONDON
    AMEMBASSY NEW DELHI
    USMISSION USUN
    CONFIDENTIAL COLOMBO 3360
    SUBJ : PRESIDENT YAHYA KHAN’S SPECIAL ENVOY TO CEYLON
    1. SUMMARY: Raja Tridiv Roy in Ceylon as representative of GOP President Khan. Main thrust of mission seems aimed at Ceylon’s Buddhist majority. Roy suggests Pakistan would welcome Bandaranaike’s involvement in Indo-Pak dispute. Local interest in dispute running quite high. End summary.
    2. Raja Tridiv Roy, identified by press reports as quote Pres Yahya Khan’s special envoy to ceylon unquote arrived Colombo Nov 25 and is scheduled meet with PM Bandaranike on Nov 26. Roy accompanied on visit by S.L. Leghari, director of Foreign Affairs, GOP. Roy identified as hereditary chief Chakma community in Chittagong hills, quote one of the largest Buddhist groups in East Pakistan unquote. In addition to scheduled meetings with PM and other cabinet members he has met with representatives of All-Ceylon Buddhist Congress and Young Men’s Buddhist Association.
    3. Main reason for Roy visit reportedly is to convey to PM Bandaranaike President Khan’s assessment quote of the serious threat to peace posed by the full¬scale assaults on Pakistan’s borders …and to explain to Mrs Bandaranaike the treatment meted out to minorities, particularly to Buddhists in East Pakistan. Unquote.
    4. In Nov 26 Sun Roy stated that quote all countries have high regard or Prime Minister Bandaranaike. Any formula put forward by her to ease the situation in East Pakistan would be most welcome. Unquote. With regard refugee problem, Roy stated that quote Pakistan has opened the door for the refugees to return to their homeland,
    but India is trying to discourage them from going home in order to increase tensions in the area. Unquote. Published itinerary calls for him to visit Thailand, Nepal and Burma following visit here.
    5. Roy visit seems to be bringing Pakistan question back to front burner in local debates. Group calling itself Ceylon Committee for Human Rights in Bangla Desh was refused interview with Roy and promptly branded him quote an outcast.. .who cannot reconcile the teachings of the compassionate Buddha with murder, rape and pillage by the military clique whose cause he had come here to espouse. Unquote. Nov 26 Daily News editorial roundly criticized both sides in the conflict but placed major blame for military activity on India, arguing that quote anybody who believes that Pakistan, in her present plight, would launch a war against India should surely have his brains washed again in the holy Ganges. Unquote.
    6. Comment: Roy’s suggestion that intervention by PM Bandaranaike would be welcomed by Pakistan raises possibility that such role may be attempted again. As shown by Indian Ocean Peace Zone proposal, PM Bandaranaike is seeking new prestige in international arena. Successful involvement in Indo-Pak dispute could earn for her that prestige as well as score domestic points because of the increased interest in the conflict here in Ceylon. GP-3
    STRAUSZ-HUPE
    Source: The American Papers – Secret and Confidential India.Pakistan.Bangladesh Documents 1965-1973, University Press Limited, p.73 – 733

    ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দৈনিক বাংলায় একটি তালিকা ছাপা হয় যেখানে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সহায়তার অভিযোগে দালাল আইনে অভিযুক্তদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়; নুরুল আমিন, সবুর খান, গোলাম আযমসহ দালালদের সে তালিকায় ৮ নম্বরে ছিলো ত্রিদিব রায়ের নাম।

    [লিংক]

    এদিকে জনৈক আরাফাতুর রহমান জানাচ্ছেন:

    চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের সহযোগিতায় রাঙামাটিতে গণহত্যা চলে। এই সময়ে রাঙামাটি মুক্ত করতে যাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র এবং এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ইফতেখারসহ ৮-১০ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।
    চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় তার বির্তকিত বই The Departed Melody-তে লেখেন, ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল সকালে তিনি (রাজা ত্রিদিব রায়) তার ভগ্নিপতি কর্নেল হিউম, ম্যাজিট্রেট মোনায়েম চৌধুরী, মোঃ হজরত আলী এবং আরো কয়েকজন বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাসহ চট্টগ্রামের নতুন পাড়ায় অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টার-এর পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী এবং রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে আসা আরো কয়েকজন বাঙালি ঢাকা থেকে আসা জুনিয়র অফিসারকে সঙ্গে করে কাপ্তাইয়ে যাবেন। ঠিক সেদিনই বিকেলে কাপ্তাই থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল কয়েকটি লঞ্চ এবং স্পিডবোট নিয়ে রাঙামাটি আসে এবং বিনা প্রতিরোধে দখল করে নেয়।

    এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত (ফেব্রু-২০১১) ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’ বইয়ে জামালউদ্দিন লেখেন, ‘…অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাক দালাল খ্যাত চিহ্নিত এক উপজাতীয় নেতার (রাজা ত্রিদিব রায়) বিশ্বাসঘাতকতায় ঐ দিনই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী রাঙামাটিতে এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছার সাথে সাথে সেখানে ওৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈনিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ফেলে। এই দলের মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইফতেখার।’ [পৃষ্ঠা ৩৭৯-৩৮০]

    এর আগে রাঙামাটি মহকুমা সদরের এসডিও আবদুল আলী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে দুটি স্পিডবোটে করে মহালছড়ি থেকে রাঙামাটি আসেন। স্পিডবোটে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এস এম কালাম, আবদুল শুকুর, শফিকুল ইসলাম, মামুন, সামসুল হক মাস্টার এবং রাঙামাটি হাইস্কুলের তদানীন্তন হেডমাস্টার রহমান আলীর ছেলে ইফতেখার। এর মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার জন্য আবদুল আলীকে রাঙামাটিতে পুলিশ লাইনের এক ব্যারাকে আটক করে রেখে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্লেড দিয়ে আঁচড় দেয়া হয়েছিল। এরপর সেসব জায়গায় লবণ দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া তাকে একটি জিপের পিছনে বেঁধে টেনে রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছিল। সূত্র : ‘মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শরবিন্দু শেখর চাকমা, (অঙ্কুর প্রকাশনী, জানু-২০০৬ পৃষ্ঠা ২৫]।
    [লিংক]

    তবে ওই লেখক তার লেখায় মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা বেমালুম চেপে যান। এমনকি লেখাটি যে কেউ পড়লে ধারণা জন্মাতে পারে যে, ১৯৭১ এ আদিবাসী মাত্রই ত্রিদিব রায়ের অনুসারি তথা রাজাকার ছিলেন! তিনি ভুলে যান কথিত ‘আদিবাসী রাজাকারের বংশধর’, বর্তমান চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় ১৯৭১ এ মাত্র ১১ বছরের বালক ছিলেন এবং পিতার কৃতকর্মের দায়ভার কোনোভাবেই তার ওপর বর্তায় না এবং চাকমা রাজা হিসেবে তার এ পর্যন্ত সমস্ত কর্মকাণ্ড আদিবাসী তথা বাংলাদেশের স্বার্থই রক্ষা করে। বিশিষ্ট আদিবাসী গবেষক রাজা দেবাশীষ পার্বত্য সমস্যা নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য গবেষণাগ্রন্থ, প্রবন্ধ, নিবন্ধ; এমনকি ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির খসড়াটিও তারই করা। চাকমা ভাষায় রয়েছে তার লেখা ও সুর করা অসংখ্য গান এবং গুনি এই ব্যক্তি বাঁশির সুরে ধরেছেন পাহাড়ি লোক ঐতিহ্য। সংক্ষেপে, রাজপরিবারের আশিবার্দে নয়, নিজস্ব যোগ্যতায় বর্তমান চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় পরিনত হয়েছেন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বে।

    কিন্তু আরাফাতুর রহমান উগ্র জাতিগত বিদ্বেষজনিত কারণে আরো লেখেন:

    এই যুদ্ধাপরাধীদের বংশধররা বংশপরম্পরায় বাংলাদেশের বিরোধিতা করে আসছে। বর্তমান আমরা তাদেরই আবার দেশের প্রতিনিধি বানিয়েছি বিশ্বদরবারে, জাতিসংঘে। যুদ্ধাপরাধী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় এবং বিচারপতি সায়েমের উপদেষ্টা ত্রিদিব রায়ের মা বিনীতা রায়ের বংশধর এবং উত্তরাধিকারী দেবাশীষ রায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজামী ও মুজাহিদের মতো তার গাড়িতেও বাংলাদেশের পতাকা উড়েছে। তিনি সম্প্রতি মেক্সিকোর কানকুনে শেষ হয়ে যাওয়া জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের পক্ষে কাজ করেছেন। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংগঠন ইউএনএফসিসিসি (UNFCCC) এবং ইউ এন পার্মানেন্ট ফোরাম অন ইনডিজিনাস ইস্যুর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। (সূত্র : প্রথম আলো, ০২ জানুয়ারি ২০১১)
    রাজাকার ফজলুল কাদের চৌধুরীর পুত্র হিসেবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী যদি ওআইসির (ঙওঈ) মহাসচিব পদের জন্য নির্বাচন করে দেশের ভাবর্মূতি নষ্ট করতে পারে তাহলে কেন ত্রিদিব রায়ের মতো প্রমাণিত রাজাকারের পুত্র বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে? এখন তো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত সরকার। তাদের অপরাধের কেন বিচার হবে না?

    [লিংক]

    এ যেনো আমতত্ত্ব। আম গাছে তো আমই ফলে নাকি? ফকাচৌ’র পুত্র সাকাচৌ যুদ্ধাপরাধী হলে ত্রিদিব পুত্র দেবাশীষ কেনো বালক রাজাকার হবেন না? লা জবাব গরলীকরণ!!

    ছবি: ত্রিদিব রায়, ১৯৭০, জুলফিকার আলী ভূট্টোর সঙ্গে, ১৯৭২, চট্টগামে দ্বিতীয় রাণী এলিজাবেথের সঙ্গে, ১৯৬১ এবং বর্তমান সময়ে, আন্তর্জাল।

    শেষ পর্ব

    পাহাড়িদের প্রতিরোধ লড়াই, ১৯৭১

    পুনর্বার বলা ভালো, ১৯৭১ সালে ত্ৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় যেমন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তেমনি মং রাজা মং প্রু “ সেইন আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। সে সময় রাজা মং প্রু “ সেইন মুক্তিবাহিনীর জন্য নিজ প্রাসাদ উজাড় করে দেন। মুক্তিযোদ্ধারা তার প্রাসাদে থেকেই যুদ্ধ করেছিলেন, বহু সাহায্য পেয়েছিলেন। এছাড়া পাহাড়ি নেতা এমএন লারমা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। চাকমা রাজার কাকা শ্রী কেকে রায়ও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। কিন্তু শুধু সন্দেহের বশে তাকে ত্রিপুরায় আটক করা হয়েছিল। পাহাড়িদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়টি আমরা চলতি তৃতীয় ও শেষ পর্বে আলোচনা করছি।

    ‘৭১ এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সামরিক জান্তা গণহত্যা শুধু করলে সারাদেশের মতো পাহাড়েও তরুণ ছাত্র-যুবারা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্নক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এই প্রতিরোধ লড়াইয়ে সে সময় বাঙালিদের পাশাপাশি পাহাড়ি আদিবাসীরা সমানভাবে অংশ নিয়েছিলেন। কাজেই ত্রিদিব রায় ও তার অনুসারী মুষ্টিমেয়দের পাকিস্তানপন্থী ভূমিকাকে কেন্দ্র করে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম বা সারাদেশের আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বরং কার্যত অমন চেষ্টা উগ্র জাতিগত বিদ্বেষ ও ইতিহাস বিকৃতিকেই উস্কে দেয় মাত্র।

    খোদ সরকারের রাঙামাটি জেলার তথ্য বাতায়নে বলা হচ্ছে:

    ১৯৭১ এর মার্চ মাসে রাঙ্গামাটি জেলা সদরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজের ত্ৎকালীন ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান এবং সুনীল কান্তি দে এর নেতৃত্বে।

    মুক্তিযুদ্ধকালীন রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়িতে অবস্থিত ফারুয়া ও শুকরছড়ির মোহনায় পাক সামরিক ঘাঁটি ছিল। সেখানে পাঞ্জাবী, রাজাকার, আলবদরসহ ২৫০ জন সৈন্য অবস্থান করত। সেখানে পাক সেনাবাহিনীর কয়েকটি স্টীমার ও গানবোটও ছিল। আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে পাইলট মান্নানসহ মুক্তি বাহিনীর একটি দল পাহাড়ী এলাকায় পথ হারিয়ে রাতের অন্ধকারে ফারুয়াস্থ পাক বাহিনীর ক্যাম্পের অভ্যন্তরে এসে পড়ে। তারা চাকমাদের সহায়তায় নৌকায় করে শুকরছড়ি এলাকায় নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যায়।

    ১৭ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল সিং ওভান এবং শেখ ফজলুল হক মনি ভারতীয় হেলিকপ্টারযোগে রাঙ্গামাটির পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং মাঠে অবতরণ করেন। এখানে তাঁদের অভ্যর্থনা জানান ত্ৎকালীন ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান, আবদুর রশীদ, মোঃ ফিরোজ আহম্মদ, মনীষ দেওয়ান (পরবর্তীতে কর্ণেল)সহ হাজারো ছাত্র-জনতা।
    [লিংক]

    এতে পাহাড়িদের প্রতিরোধ লড়াইয়ের পাশাপাশি সাধারণ নিরস্ত্র পাহাড়ি জনতার চরম আত্নত্যাগের কথা তুলে ধরে আরো বলা হয়:
    পাক বাহিনীরা পার্বত্য জেলা সদর রাঙ্গামাটি ও মহকুমা সদর রামগড় এবং বান্দরবান দখল করার পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ঘাঁটি স্থাপন করে এবং ঘাঁটিসমূহ সুদৃঢ় করে নেয়। তারা বিভিন্ন এলাকায় শাখা কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় রাজাকার বাহিনী ও হিলরাজ বাহিনী গঠন করে এবং বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে বর্বর অত্যাচার চালায় ও ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। পাকবাহিনী রামগড়, গুইমারা, মানিকছড়িসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে পাহাড়ী রমনীদের জোর পূর্বক ধরে নিয়ে অমানুষিকভাবে ধর্ষণ করে এবং ক্যাম্পে উলঙ্গ অবস্থায় বন্দী করে রাখে।

    ১নং সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়। এই দল গঠনের নেতৃত্ব দেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। এটি পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ কোম্পানী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। শ্রী ত্রিপুরাকে কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এই কোম্পানীর অধীনে গ্রুপ নং- ৯১, ৯২, ৯৩, ৯৪ এবং ৯৫ সংযুক্ত করা হয়। উক্ত গ্রুপগুলির ট্রেনিং কেন্দ্র ছিল ভারতের অম্পি নগর এবং ১নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার হরিণা। ১নং সেক্টরের অধীনে হরিণা থেকে ৩০ কিঃ মিঃ দূরবর্তী সীমান্ত এলাকা ভারতের বৈষ্ণবপুরে আগস্ট মাসের প্রথম দিকে সাব-সেক্টর স্থাপন করা হয়। সেখানে অবস্থানরত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করা হয়।
    পার্বত্য এলাকায় অবস্থানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের সুবিধা, শত্রুপক্ষের ঘাঁটি আক্রমণ এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার অন্তর্গত নাকাপা, কুমারীপাড়া, পাগলা পাড়া, মানিকছড়ি, ডাইনছড়ি, যোগ্যাছলা ও গাড়ীটানা এলাকার গহীন অরণ্যে মুক্তিবাহিনীর গোপন ক্যাম্প বা আশ্রয়স্থল করা হয়। এই সমস্ত গোপন গেরিলা ক্যাম্পে ঐ এলাকার হেডম্যান কার্বারীসহ সকল স্তরের জনগণ খাদ্যশস্য সরবরাহ করত এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ঐ সমস্ত এলাকার জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পাকবাহিনীর গতিবিধি এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে সাহায্য করত।
    [লিংক]

    অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় অবদান রাখা এমএন লারমা ও মং রাজা রাজা মং প্রু সাইন প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আদিবাসী গবেষক মঙ্গল কুমার চাকমা তার ‘মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্যাঞ্চলের জুম্ম জনগণ ও প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়’ নামক ’ লেখায় জানাচ্ছেন :

    … সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে জুম্ম ছাত্র-যুবকরাও আন্দোলনে যোগ দিতে সংগঠিত হতে থাকে। ত্ৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জুম্ম ছাত্র-যুবকদেরও উদ্বুদ্ধ করেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী-লীগের প্রাথী কোকনদাক্ষ রায়ও (রাজা ত্রিদিব রায়ের কাকা) মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়েছিলেন। এ-সময় কয়েকশো জুম্ম ছাত্র-যুবকও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়েছিলো। প্রথম অবস্থায় তারা অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে এইচ টি ইমামের প্ররোচনায় জুম্ম ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ-সময় ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কোকনদাক্ষ রায়কেও কোনো অজুহাত ছাড়াই গ্রেফতার করা হয়। ফলে অনেক জুম্ম ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পেরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ফেরত আসে।…
    [লিংক]

    মঙ্গল কুমার চাকমা আরো জানান:

    মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন মং সার্কেলের ত্ৎকালীন রাজা মং প্র¦ সাইন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে-সাথে যখন শতো-শতো লোক পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে যাচ্ছিল, তখন তিনি খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়িস্থ রাজবাড়ীতে তাদের খাওয়া-দাওয়া-সহ নানাভাবে সহায়তা প্রদান করেন। পাক-সেনারা রামগড় দখল করার পূর্বেই তিনি ত্রিপুরা পালিয়ে যান। সেখানে গিয়েও তিনি বসে থাকেননি। কর্ণেলের ব্যাজ পরে তিনি কুমিল্লার আখাউড়াতে যুদ্ধ করেছিলেন। সেজন্য পাক সেনারা মানিকছড়িতে এসে রাজবাড়ী, ত্ৎসংলগ্ন বৌদ্ধ মন্দির ও গ্রামের জুম্মদের ঘারবাড়ী ধ্বংস ও লুটপাট করে।

    ত্ৎসময়ে ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেল (ইপিআর) বাহিনীতে কিছু জুম্ম ছিলো। তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে রমণী রঞ্জন চাকমা রামগড় সেক্টরে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিহত হন। সিপাহী হেমরঞ্জন চাকমা বগুড়া সেক্টরে নিখোঁজ হন। তার লাশও পাওয়া যায়নি। সিপাই অ্যামি মারমাও বগুড়া সেক্টরে যুদ্ধে শহীদ হন। পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অসম সাহসিকতার জন্য বান্দরবানের অধিবাসী ত্ৎকালীন ইপিআরের রাইফেলম্যান উখ্য জিং মারমাকে যুদ্ধের পরে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। অভাব-অনটনের মধ্যে কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করছেন বান্দরবান শহরে।

    সে-সময় পূর্ব পাকিস্তান পুলিস-বাহিনীতেও কিছু জুম্ম চাকরীরত ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম বিমলেশ্বর দেওয়ান ও ত্রিপুরা কান্তি চাকমা-সহ ২০ / ২২ জন জুম্ম সিভিল কর্মকর্তা ও কর্মচারী ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে বরেন ত্রিপুরা, কৃপাসুখ চাকমা ও আনন্দ বাঁশী চাকমা ছিলেন অন্যতম।

    মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর বাহিনী ও ইপিআর বাহিনী নিয়ে রাঙ্গামাটি হয়ে ত্রিপুরা পাড়ি দিয়েছিলেন। জিয়া বাহিনী-সহ রাঙ্গামাটি পৌঁছলে জুম্ম জনগণই তাদেরকে খাদ্য ও অন্যান্য রসদ যুগিয়েছিলো। রাঙ্গামাটি জেলার বন্দুকভাঙ্গায় যেখানে বর্তমানে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফের সমাধিক্ষেত্র রয়েছে, সেখানে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধের পর মেজর জিয়া তাঁর বাহিনী নিয়ে জুম্মদের গ্রামের ভিতর দিয়ে নানিয়ারচর, মহালছড়ি ও খাগড়াছড়ি হয়ে রামগড় সীমান্তে চলে যান। সে-সময় গ্রামে-গ্রামে জুম্ম গ্রামবাসীরা মেজর জিয়ার বাহিনীকে খাদ্য-সহ নানাভাবে সহায়তা করেছিলো। কথিত আছে, খাগড়াছড়ি জেলার কমলছড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে চেঙ্গী নদী পার হওয়ার সময় নদীতে হাঁটু পানি থাকায় যাতে জুতা-প্যান্ট ভিজে নষ্ট না হয় সে-জন্য কমলছড়ি গ্রামের জনৈক মৃগাঙ্গ চাকমা মেজর জিয়াকে পিঠে তুলে নদী পার করে দেন। জিয়ার বাহিনীকে সহায়তা দেয়ার জন্য পাক-বাহিনী মহালছড়ির সভ্য মহাজন, গৌরাঙ্গ দেওয়ান ও চিত্তরঞ্জন কার্বারীকে ধরে নিয়ে যায়। পাকবাহিনী তাদেরকে আর ফেরত দেয়নি। তাদের লাশও পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, এজন্য অনেক জুম্ম নারী বিভিন্ন জায়গায় পাক সেনা সদস্যের ধর্ষণেরও শিকার হয়।
    [লিংক]

    পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সে সময় যে অল্প কয়েকজন পাহাড়ি আদিবাসী নিরাপত্তা বিভাগে সরকারি চাকরিতে ছিলেন, তাদের মধ্য অন্যদম শহীদ খগেন্দ্র নাথ চাকমা (দ্রষ্টব্য: সূচনা ছবি, তন্দ্রা চাকমা)। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লার মুরাদনগরে সার্কেল ইন্সপেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শ্রী খগেন্দ্র নাথ চাকমা পাকিস্তানী বাহিনীর কর্তৃক নিহত হন।

    অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের প্রায় ৭৫ টি ভাষাগত সংখ্যালঘু জনজাতি্‌ আদিবাসী- মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ইউকে চিং হচ্ছেন একমাত্র বীরবিক্রম উপাধিপ্রাপ্ত আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা। তিনিও সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস– ইপিআর’ এ কর্তব্যরত অবস্থায় ১৯৭১ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে।

    ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইপিআরের নায়েক হিসেবে তিনি রংপুরের হাতিবান্ধা বিওপিতে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে রংপুর ৬ নম্বর সেক্টরে মেজর বাশারের নেতৃত্বে নয়জন বাঙালি ইপিআর সৈনিককে নিয়ে পাটগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেন। দেশকে পাক হানাদার মুক্ত করতে বিওপিতে কর্মরত একজন বিহারি ও দুজন পাঞ্জাবিকে হত্যা করেন তিনি। টানা নয় মাস সম্মুখ যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেন ইউকে চিং। তবে যদিও অভাব-অনটন এখন ৭৭ বছর বয়সী এই বীরবিক্রমের নিত্য সঙ্গী। অসংখ্য পদক বা সরকারি সন্মাননা — কোনটিই এই বীর যোদ্ধার বাকি জীবন ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারছে না (দ্রষ্টব্য ছবি: বাংলানিউজ টোয়েন্টফোর ডটকম)।
    [লিংক]

    স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে ভাষাগত সংখ্যালঘু জনজাতি গোষ্ঠিগুলো উপেক্ষিত থেকে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পাতায় উপেক্ষিত থেকে যায় আদিবাসী, উপেক্ষিত থেকে যায় ১৯৭১ এর তাদের প্রতিরোধ লড়াই, সব ধরণের আত্নগ্যাগ, এমন কি মুক্তিযুদ্ধের শেষপ্রান্তেও এসে মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ রাইফেলস — বিডিআর নামধারী কতিপয় বিপথগামী দুর্বৃত্তের হত্যাযজ্ঞ, যা এই ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে বর্ণনা করা হয়েছে।

    তাই বাংলাদেশ যেমন বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতির দেশ, এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও তেমনি বহু জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের আত্নত্যাগের ইতিহাসে বর্ণিল।
    —-
    সংযুক্ত:

    এক। মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী, সংকোলন, গুরুচণ্ডালি ডটকম।

    দুই। দেশের ৭৫ টি আদিবাসী জাতি: বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহায়তায় সারাদেশে অনুসন্ধান চালিয়ে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস গত ২৮ নভেম্বর ২০১০ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের উদ্দেশ্য তাদের সুপারিশ তুলে ধরে। ‘আদিবাসী জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি বিষয়ক সুপারিশমালা’ শীর্ষক বক্তব্যে ককাস ৭৫টি ভাষিক সংখ্যালঘু জনজাতির তথ্য প্রকাশ করে।
    এই ৭৫টি আদিবাসী জাতিসমূহ হচ্ছে: ১. অধিকারী, ২. অসম/অহম/অহমীয়া, ৩. ওঁরাও/উঁরাও, ৪. কন্দ/কন্ধ/খন্দ কড়া, ৫. কাউর, ৬. কুর্মি/মাহতো, ৭. কর্মকার, ৮.কড়া/করোয়া, ৯. কর্নিদাস, ১০. কোচ, ১১, কোল, ১২. খারিয়া/ খেরিয়া, ১৩. খুমি/খামি, ১৪.খিয়াং, ১৫. খাসি, ১৬. খারওয়ার, ১৭. গন্ড/ গন্ডি/গঞ্জু, ১৮. গড়াইৎ/গড়াত, ১৯. গারো, ২০. গোর্খা, ২১, গৌড়, ২২. চন্ডাল, ২৩. চাকমা, ২৪. চাক, ২৫. ছত্রী, ২৬. ডালু, ২৭. ডোম, ২৮. ত্রিপুরা/টিপরা, ২৯. তঞ্চগ্যা, ৩০. তুরি/ তুরিয়া, ৩১. তেলী, ৩২. নুনিয়া, ৩৩. পল্ল/পলিয়া, ৩৪. পাত্র, ৩৫. পাহান, ৩৬. পাহাড়িয়া, ৩৭. পাংখু/পাংখোয়া, ৩৮. পুন্ড্র/ পোদ, ৩৯. বম, ৪০. বর্মণ, ৪১. বাউরি, ৪২. বাগদী/ বাকতি, ৪৩. বানাই, ৪৪. বাড়াইক, ৪৫. বাদিয়া/বেদিয়া, ৪৬. বীন/বিন্দ, ৪৭. বোনাজ/বুনা, ৪৮. ভর, ৪৯. ভূমিজ, ৫০. ভূঁইয়া, ৫১. ভূঁইমালী, ৫২. মারমা, ৫৩. মারমি/মুরমি, ৫৪. মালো/মাল, ৫৫. মাহালী, ৫৬. মাহাতো, ৫৭. মনিপুরী, ৫৮. মিরধা, ৫৯. মুন্ডা, ৬০. মুরারি/মুরিয়ারি, ৬১. মুষহর, ৬২. ম্রো/মুরং, ৬৩. রাওতিরা, ৬৪. রবিদাস, ৬৫. রাখাইন, ৬৬. রাজোয়াড়, ৬৭. রাই, ৬৮. রাজবংশী, ৬৯. রানা-কর্মকার, ৭০. লুসাই, ৭১. লোহার/লহরা, ৭২. শবর, ৭৩. সাউ, ৭৪. সান্তাল/সাঁওতাল এবং ৭৫. হাজং।
    ককাসের তথ্য অনুযায়ী, এই জনজাতিসমূহের আনুমানিক লোকসংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ।

    তিন। একটি প্রাসঙ্গিক দাবিনামা:

    সরকারের উদ্দেশ্য মণিপুরী সমাজ কল্যাণ সমিতি’র ১৪ দফা দাবির অন্যতম —

    ১। যাচাই বাছাইক্রমে মণিপুরী শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের তালিকাভুক্ত করণ। পর্যায়ক্রমে তা সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্বার জন্য কার্যকর করা।
    ২। ঐতিহাসিক বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, মহান ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও অংশগ্রহনকারী বীর মণিপুরী বীর মুক্তিযুদ্ধাদের নাম তালিকা খচিত দৃষ্টি নন্দন ‘স্বাধীনতা স্তম্্ভ’ মণিপুরী অধুøষিত মৌলবীবাজারের কমলগঞ্জস্থ মণিপুরী ললিতকলা একাডেমী প্রাঙ্গনে নির্মাণ। অনুসন্ধানক্রমে অন্যান্য সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্বার এমন গৌরবের কিছু থেকে থাকলে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা।…

    http://biplobcht.blogspot.com/2013/06/blog-post_23.html
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:৩৩582612
  • আদিবাসী সাহসী মুক্তিযোদ্ধা খগেন্দ্রলাল চাকমা
    লিখেছেন : তন্দ্রা চাকমা •
    প্রকাশকাল : 27 ডিসেম্বর 2011 - 7:24 অপরাহ্ন
    .....................................................................................
    দীর্ঘদিন ধরে উনাকে নিয়ে লিখব লিখব করে সময় করতে পারছিলাম না। তথ্য উপাত্ত যা ছিল তা যথেস্ট নয় । আমি আবার ভীষণ খুতখুতে স্বভাবের তাই তথ্য যোগাড় করার জন্য আমি আমার বড় বোনকে ফোন দিলাম সে তার দেবর রতন চাকমা র ফোন নাম্বার দিল । এখানে উল্লেখ্য উনি আমার বড় বোনের শ্বশুর। ফোন নাম্বার পাওয়া সঙ্কেÄও প্রায় এক সপ্তাহ লাগলো উনাকে ফোন করতে । বিজয় দিবস পার হয়ে প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলল কেবল আজ ফোন করে তথ্য নিতে পারলাম । তাহলে রতন চাকমার মুখ থেকে শোন যাক উনার কথা।

    ১৯৭১ সালে উনি ছিলেন মুরাদনগর থানার সার্কেল ইনস্পেক্টর। শুধু তাই নয় তিনি মুরাদনগর, হোমনা, বাঞ্ছারামপুর ও দেবীদ্বার এই ৪ থানার ও দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিলেন । সে সময় রতন ছচাকমা মাত্র এক ১৩ কি ১৪ বছরের এক কিশোর

    তখন উনি মানে রতন চাকমা ক্যাডেট কলেজের ভাইভা যাতে ভাল করতে পারেন সেজন্য ওখানে বাবার তত্তাবধানে এক গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়ছিলেন । এর মধ্যে একদিন উনি মানে রতন দাদা বুঝতে পারলেন উনার বাবার কাছে থানার লোকজন ছাড়া আর ও কিছু লোকজনের আনাগোনা আবিস্কার করলেন। উনারা বিভিন্ন নক্সা নিয়ে প্রতি রাতে মিটিং করতেন। যেহেতু কিশোর বয়স তাই কৌতূহল ও বেশী একরাতে রতন দা উনার বাবার রুম এ আড়ি পাতলেন, সেদিন জানতে পারলেন ইলিয়ট গঞ্জ ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান হচ্ছে। কোন দিকে যাবে কার পজিসন কোথায় হবে, কোথায় ডিনা মাইট বসানো হবে এই বিষয়ে প্ল্যান হচ্ছিল। ঠিক তার পরদিনই ঢাকা চট্টগ্রাম রোডের ইলিয়ট গঞ্জ ব্রীজ উড়িয়ে দেয়া হয় । সময়টা ছি i ল এপ্রিল এর শেষ সপ্তাহ অথবা মে মাসের প্রথম দিকে । আমি রতন দাদা কে তারিখটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনার ঠিক মনে নেই কবে। এই অপারেশন এর নেতৃত্ব দেন মুরাদনগর এলাকার মুক্তি বাহিনির কমান্ডার এবং বীর মুক্তি যোদ্ধা খগেন্দ্রলাল চাকমা । রতন দাদা আমাকে মুক্তি যোদ্ধা কাম্প কমান্ডার এর নাম জানতেন না । এই ঘটনার দুই দিন পর মুক্তি বাহিনির এই দলটি মুরাদনগর ছেড়ে আরও অন্যদিকে অপারেশন করতে চলে যায় । ইতিমধ্যে ঐ এলাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান বিষয়টি জানতে পারেন । তারা পাকিস্তানী সেনা বাহিনিকে বিষয়টি অবহিত করেন । এখানে উল্লেখ্য যে তদানীন্তন কুমিল্লা জেলার ডি, এস, পি পাক আর্মি কে সহযোগিতা করেন। ইলিয়ট গঞ্জ ব্রিজ উড়ানোর কয়েকদিন পর পাক আর্মি একদিন

    হঠাত করে পুরো মুরাদনগর ঘিরে ফেলে। দিনটা ছিল ৫ই মে ১৯৭১ । ঐদিন থানায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সবাইকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় । পাক আর্মি কিশোর রতন দাদা কে ও ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে সবাইকে কুমিল্লা টাউনে নিয়ে যাওয়ার পর রতন দাদা কে একজন বিহারি আর ও এর হাতে দেওয়া হয়। যেহেতু বন্দি দের দুই টিমে ভাগ করা হয় । একদিন রতন দাদা আবিস্কার করলেন উনার বাবা ও অন্য টিমের আর কেও নেই। সেই সময় এর অনুভূতি বলতে গিয়ে রতন দা যা বলেছিলেন প্রথমে নাকি তাকে মেরে ফে লার কথা। কিন্তু বিহারী আর ও এর দ হওয়াতে তিনি বেচে ছিলেন । তিনি মানে রতন দাদা কুমিল্লার পুলিশ ক্লাব এ প্রায় ৩ মাস ছিলেন । পরে উনাকে একজন চাটগা বাড়ি এমন এস আই এর সহযোগিতায় চিটাগাং পাঠিয়ে দেওয়া হয় । উনি উনাদের চকবাজারের বাসায় গিয়ে দেখেন বাসায় কেউ নেই সব মালামাল লুট হইয়ে গেছে। পরে আবার উনি রাঙ্গামাটি ফিরে আসেন। এসে উনার মায়ের এক কাজিন এর বাসায় উঠেন । পরে মা ও আর সবার সাথে দেখা হয় ।

    রতন দাদার কাছ থেকে যা জানতে পেরেছি তা হল খগেন্দ্রলাল চাকমা কে কুমিল্লা ক্যান্টন মেন্ট এ ধরে নিয়ে আর ৩ জন হিন্দু এস আই সহ উনাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু আর যারা মুসলমান ছিলেন তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কুমিল্লা পুলিশ লাইনে এখন ও শহীদ দের স্মরণে যে স্মৃতি সৌধটি আছে সেখানে ৩ নাম্বার তালিকায় উনার নাম আছে । স্বাধীনতার প্রায় ৬ বছর পর খগেন্দ্র লাল চাকমার পরিবারের সাথে আমার দেখা হইয়েছিল । তখন ও দেখেছি পিসি মানে উনার স্ত্রী বিশ্বাস করতেন উনি ফিরে আসবেন । পরে ১৯৮০ সালের দিকে কেবল পিসি বুঝলেন উনি কখনও ফিরবেন না । এখানে বলা ভাল উনার বড় ছেলে ডাক্তার কিশলয় চাকমার সাথে আমার বড় বনের বিয়ে হইয় ১৯৭৭। উনার পরিবার এখনও মুক্তি যোদ্ধা তালিকায় অন্তরভুক্ত হন নি তাই সেজন্য কোন সরকারী সুবিধা ও পাননি । এই দেশের জন্য বিশষ করে কুমিল্লা অঞ্চল কে শত্রু মুক্ত করার জন্য যার এত সাহসী অবদান তার পরিবার কেন স্বীকৃতি পাবেনা। মাত্র তত্তাবধয়ক সরকার এর আমলে প্রথম তার নামে স্মৃতি স্তম্ভ হয় রাঙ্গামাটি শহরে ঢোকার মুখে ।

    আমার এই লেখা লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে যাদের কেউ মনে রাখেনা তাদের কথা লেখা । এখনকার কিছু লেখকের লেখা পরলে মনে হয় যুদ্ধ কেবল উনারা একা করেছেন আর কেউ করেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ দের অবদান আছে সে কথা সবাই ভুলে গেছে। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে এই দেশ কখনও সত্যিকার গনতান্ত্রিক দেশে পরিণত হবে না ।

    http://unmochon.net/node/1259
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:৩৪582614
  • Yu K Ching’s aspirations remain distant dreams
    Liberation thru the eyes of a non - Bangalee FF→

    Noman Chowdhury , back from Bandarban
    .................................................................

    He fought for independence in 1971 to see a pluralist , democratic Bangladesh where all citizens would enjoy equal rights and privileges.

    At 79 , Yu K Ching Marma sees his aspirations from the authorities in independent Bangladesh not reflected in reality as he , as one of ethnic minority groups , feels discriminated.

    “My dreams are yet to come true as our aspirations have not been reflected in the activities of the successive governments , ” he told daily sun in an interview at his house on 13 December.

    Ching , the lone freedom fighter from ethnic people who has been awarded Bir Bikrom , the third highest gallantry award , said he took part in the war to free the motherland from the Pakistani domination although most freedom fighters were imbued with the spirit of Bangalee nationalism.

    “We wanted to establish brotherhood between the Bangalees and the hilly people , ” said Ching who was born in Banderban in 1932. He joined the East Pakistan Rifles in 1952 and fought guerrilla war in northern districts in 1971.

    Going down the memory lane , he said he had joined the battle immediately after “the Operation Search Light” , the military crackdown launched by the Pakistani junta on 25 March , 1971 to stop the people of Bangladesh from establishing their rights.

    In the war process , the valiant freedom fighter had killed as many as 10 Pakistani soldiers and three local collaborators known as Razakars. He expresses solidarity with the demand for trial of war criminals.

    The ethnic leader is still vocal for realising the rights of the hill people. “Indigenous people are yet to enjoy the fruits of independence as they have been deprived of rights’ , ” he said.

    He added that the Chittagong Hill Tracts Peace Accord , signed on 2 December 1997 to end bush war in the CHT , is yet to bring any fruit to the CHT people.

    Ching , who had developed close relationship with commander of Eastern front , India’s Lt General Jagajit Singh Aurora , refused to accept Indian citizenship. He said he is ‘not well either’ here in independent Bangladesh.

    “I have to run a 15 - member family with my limited state honorarium , ” he said. He urged Prime Minister Sheikh Hasina to give him some state support until his death.

    Ching , who was given the Bir Bikrom title on 15 December , 1973 , expressed his anger at the killing of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman and said the country would have been in a state , had Bangabandhu not been killed on 15 August 1975.

    He also brushed aside criticism at that time that Bangabandhu was trying to make Bangladesh a part of India by signing the 25 - year long friendship treaty. “Look , what is happening today ? Agreements are being signed with India but there are no problems , ” he said.

    The war hero also vented his anguish at the divisive political culture , saying that the hostilities are not good for the progress of the country. He urged major political parties not to do conflicting politics.

    http://www.daily - sun.com/details_yes_16 - 12 - 2011_yu - k - ching%E2%80%99s - aspirations - remain - distant - dreams_423_5_2_1_2.html
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:৩৪582613
  • বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ গিরীন্দ্র সিংহ
    ০৯ ই মার্চ, ২০০৮ রাত ১১ : ১২
    কুঙ্গো থাঙ
    ..................................................................................................................
    বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য জাতিসত্তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল অনেকেই বিষয়টা প্রায় ভূলে থাকতে চান । ফলে ইতিহাসের পাতা থেকে বাদ পড়ে যায় তারা। হিসাব-নিকাশ না করে কেবল অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ কীভাবে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ইতিহাসের পাতা থেকে বাদ পড়ে যায় সেই পরিচ্ছেদ।

    ... এ রকমই এক শহীদের নাম গিরীন্দ্র সিংহ । জাতিগত পরিচয়ে মণিপুরী − বিষ্ণুপ্রিয়া আদিবাসী সম্প্রদায়ভূক্ত। জন্ম তার ১৯৩০ সালে ত্‌ৎকালীন মৌলবীবাজার মহকুমার কমলগনে্‌জর মাধবপুরে আউলেকি গ্রামে।

    ... মনিপুরী গ্রামের পেছনে নদী সংলগ্ন শ্বশানঘাট থেকে পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের সাথে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার সংগঠন ও নেতৃত্তে ছিলেন গিরীন্দ্র। সাধারন অস্ত্র লাঠি, বর্শা এবং আরো নানান প্রাচীন অস্ত্রকে সম্বল করে পরিচালিত হয় এই লড়াই। রক্তে লাল হয় ধলাই নদীর পানি। ১৯৭১ সালের আগষ্টের ১২ তারিখে হানাদাররা মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সমাজের পুরোহিত সার্বভৌম শর্মাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে। এরপর ফুঁসে উঠে গিরীন্দ্রের নেতৃত্তে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সমাজের তরুন সম্প্রদায়। মুক্তিবাহিনীতে মণিপুরী যোদ্‌দ্‌ধাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাবুসেণা সিংহ, থইবা সিংহ, নিমাই সিংহ, বাসন্তী সিংহ, বসন্তকুমার সিংহ, পদ্মাসেন সিংহ, রবীন্দ্র সিংহ, আনন্দ সিংহ, মন্ত্রী সিংহ, নীলমণি চ্যাটার্জ্জিসহ অসংখ্য বীর তরুন জীবন বাজি রেখে মাতৃভূমি রক্ষার যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। কেউ অস্ত্র হাতে,কেউ সংবাদবাহক হিসাবে, কেউ বা সংগঠকের ভূমিকায়, আর গিরীন্দ্র ছিলেন তাদের মধ্যমণি।

    গিরীন্দ্র ছিলেন অসীম সাহসি ও অসাধারন দৈহিক ক্ষমতার অধিকারী। যুদ্ধের পাশাপাশি মাধবপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবারদাবার সরবরাহের দ্বায়িত্ব ছিল তার উপর। মাঝেমধ্যে গোপনে এস ভীতসন্ত্রস্ত মণিপুরীদের অভয় দিয়ে আবার ফিরে যেতেন কর্তব্যস্থলে। মাগুরছড়ায় মাইন পাতার কাজ তাকে দেয়া হয়।

    ... আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজার সময় (সেবছর অবশ্য শুধু ঘটপুজো হয়েছিল) মাধবপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অপারেশনের সময় শত্রুসৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন । এরপর তাকে জীপে করে ধলাই ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সপ্তাহখানেক আটকে রেখে নৃশংসভাবে শারীরিক নির্যাতন চালিয়েও তার কাজ থেকে কোন তথ্য বের করতে না পেরে তাকে হত্যা করে লাশ ধলাই নদীতে ভাসিয়ে দেয় পাকবাহিনী ও তার দোসররা। যে ধলাই নদীর তীর থেকে অকুতোভয় এই মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রামের ডাক দিয়ে মণিপুরী তরুনদের উজ্জিবীত করেছিলেন, সেই ধলাইয়ের পানিতেই তার সমাধি ঘটে।

    ... স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মযজ্ঞের অন্যতম এই কারিগরের পরিবার ও উত্তরসুরিরা কেউ আজ পর্যন্ত রাস্ট্রের কাছ থেকে কোন আনুকুল্য পায়নি, কারণ গিরীন্দ্রকে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সাটিফিকেট বা পদক দিয়ে জাতে তোলা হয়নি ।

    ... কয়েক বছর আগে স্থানীয় উদ্যোগে শিববাজারের মণিপুরী ললিতকলা একাডেমী প্রাঙ্গনে শহীদ গিরীন্দ্র সিংহের একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। অভাবক্লিষ্ট গিরীন্দ্রের উত্তরসুরিরা সেই স্মৃতিস্তম্ভের দিকে তাকিয়ে পাওয়া ন্যুনতম সান্তনায় রাস্ট্রের উদাসীনতাকে কখনৈ মেনে নিতে পারেনা।

    বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ গিরীন্দ্র সম্বন্ধে বিস্তারিত একটি নিবন্ধ আজকের প্রথম আলোতে (০৯ মার্চ , ২০০৮) ছাপা হয়েছে। আগ্রহী পাঠক প্রথম আলোর ১১ পৃষ্ঠায় লেখাটি পড়তে পারেন ।

    http://www.somewhereinblog.net/blog/kungothangblog/28777840
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:৩৫582616
  • বীরগাঁথা ৭১ : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখা কয়েকজন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক ও সংস্কৃতিকর্মী
    কুঙ্গ থাঙ
    ...................................
    উপনিবেশবিরোধী কৃষক আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ উভয় সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে ভুমিকা রেখেছিল সিলেটের একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়। সংখ্যাতাঙ্কিÄক বিচারে তাদের ত্যাগ, তিতীক্ষা ও অবদানের কথা ক্ষুদ্র হলেও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় তাদের কথা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন – যদিও মুক্তিযুদ্ধে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীসহ দেশের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর অসামান্য ভূমিকা ও অংশগ্রহনের কথা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের প্রচারযন্ত্রে আজো উপেক্ষিত।

    পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক সীমাহীন অবহেলা, উপেক্ষা, বঞ্চনা ও নিপীড়ন মণিপুরীদের চরম অস্তিত্বসংকটে ফেলে দেয়। এর সাথে যোগ হয়েছিল দেশমাতৃকার টান এবং অন্যায় আর শোষনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চিরন্তন মণিপুরী ঐতিহ্য। স্কুলে পড়া তরুণ থেকে শুরু করে ক্ষেতে খামারে কাজ করা অশিক্ষিত মণিপুরী কৃষক হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। কেউ নেয় সংগঠকের ভূমিকা। কেউ সীমান্তে বাস্তুহারা মানুষ পারাপারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। সম্ভ্রম বাঁচাতে দীর্ঘ নয়মাস মণিপুরী নারীকে গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে হয়। মণিপুরী বৃদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দান ও সহযোগিতা করে। মণিপুরী গৃহবধু আহত মুক্তিযোদ্ধার সেবা শুশ্রুষার দ্বায়িত্ব নেয়। যারা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত, তারা সীমান্তের ওপারের আসাম ত্রিপুরা হাইলাকান্দি আগরতলায় গান গেয়ে নেচে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহে নামে। এরা সবাই নিজেদের মতো মাতৃভুমি রক্ষার সংগ্রামে অংশ নিয়েছে, কারো অবদান কারো থেকে কম নয়।

    এ লেখায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা সিলেট বিভাগের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক ও সংস্কৃতিকর্মীর কথা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হবে।

    শ্রীকৃষ্ণকুমার সিংহ, পিতা : শ্রীরতন সিংহ, গ্রাম : উত্তর ভানুবিল, ডাকঘর : আদমপুর বাজার, থানা : কমলগঞ্জ, জেলা : মৌলবীবাজার
    কৃষ্ণকুমার সিংহ এমন পরিবারের সন্তান যার পুর্বপুরুষরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা রাখেন। ১৪ই আগস্ট ১৯৭১ তার বাড়িতে পাক বাহিনীর দোসররা হানা দিয়ে লুটপাট ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পরদিনই রাগী এই তরুন দা হাতে বেড়িয়ে পড়েন এবং দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে ভারতের কৈলাশহরে পৌছান। হাতে দা থাকায় ভারতীয় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে কৈলাশহরের ভারতের আইবিএ ’ র জেরায় উত্তীর্ন হন এবং হাফলং এ ট্রেনিং নেন। কৃষ্ণকুমার মাইননিক্ষেপে দক্ষ ছিলেন। তিনি গুয়াইসনগর, ওয়াপাড়া, ভাড়াউড়া, ফুলবাড়ী . ধলাই ক্যাম্প এবং কামারছড়া ক্যাম্পের অভিযানে সাহসী ভুমিকা রাখেন।

    ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে কৃষ্ণকুমার শ্রীমংগলে সরকারের প্রতিনিধি দলের কাছে অস্ত্র জমা দেন। স্বাধীনতার পর সরকারের রেভিনিউ বিভাগে তিনি একটি ছোট চাকরি পান। তবে এরপরে তার শরীর ভেঙে পড়ে এবং কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। বর্তমানে বাকশক্তি হারিয়ে কোনরকমে দিন কাটাচ্ছেন।

    শ্রীসার্বভৌম শর্মা, গ্রাম : ভানুবিল, ডাকঘর : আদমপুর বাজার, থানা : কমলগঞ্জ, জেলা : মৌলবীবাজার
    শ্রীসার্বভৌম শর্মা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সমাজের বিখ্যাত একজন পুরোহিত। তার পুর্বপুরুষ বৈকুণ্ঠনাথ শর্মা ছিলেন ১৯৩০ সালে পৃথিমপাশার জমিদার আলী আমজাদ খাঁর বিরুদ্ধে পরিচালিত কৃষক আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা। মুক্তিযুদ্ধে তার অবস্থান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার অপরাধে ১২ ই আগষ্ট পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর চোখ বাধাঁ অবস্থায় ভানুবিলের পুর্বদিকে জংগলে তার লাশ পাওয়া যায়।

    শ্রীসতীশচন্দ্র সিংহ, পিতা : মুরুলীচাঁন সিংহ, গ্রাম : তিলকপুর, ডাকঘর : কমলগঞ্জ, জেলা : মৌলবীবাজার
    সতীশচন্দ্র ১৯৭১ সালে শ্রীমংগল কলেজে বি . এ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। শ্রীমংগলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবেশের পরদিনই তিনি আসামের লোয়ার হাফলং চলে যান। সেখানে এম . ভি কৃষ্ণন নামের ভারতীয় সামরিক অফিসারের অধীনে তিনি গেরিলা ট্রেনিং গ্রহন করেন। জুলাই মাসে ক্যাপ্টেন ফখরুলের অধীনে মুজিববাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের পাথরখোলায় প্রবেশ করেন। তারা ছিলেন ৩১ পলিটব্যুরোর। সতীশচন্দ্র শমশেরনগর বিমান ঘাঁটির অপারেশনে অংশ নেন। ঐদিন ত্রুটিপুর্ণ ডিরেকশনের কারণে হেলিকপ্টারের ব্রাশফায়ারে তিনি আহত হন, তবে তার ৫ জন সহযোদ্ধা নিহত হন। স্বাধীনতার পর মৌলবীবাজারে সতীশচন্দ্র অস্ত্র হস্তান্তর করেন।

    শ্রীনীলকান্ত সিংহ, পিতা : চাউরেল সিংহ, গ্রাম : নবালুনগর, থানা : কোম্পানীগঞ্জ, জেলা : সিলেট
    ছাতক হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্র নীলকান্ত যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে কুইঘাট হয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পথে একটি শরনার্থী দলকে অসম সাহসিকতায় দস্যুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদে শরনার্থী ক্যাম্পে পৌছে দেন। সেখানে তার সহপাঠী সাংবাদিক অতীশচন্দ্র দাসের সাথে দেখা হয় এবং কিছুদিন ক্যাম্প পরিচালনার দ্বায়িত্বে থাকেন। তারপর চন্দ্রনাথপুরে মি . বাগচী নামের সামরিক অফিসারের অধীনে প্রশিক্ষন নেন। সিলেটের বড়লেখার লাঠিটিলা বর্ডারে মেজর ডালিমের নেতৃত্বে কয়েকটি যুদ্ধ অংশ নেন। এরপর হাকালুকির হাওরে পাকিস্তানিদের সাথে ভবহ একটি সংঘর্ষ হয়। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ধরনের পরাজয় বরন করতে হয়। নীলকান্তসহ মাত্র ৬ জন প্রানে রক্ষা পেয়ে ফিরে আসেন। স্বাধীনতার পর সিলেট জামিয়া মাদ্রাসায় মেজর সি আর দত্তের কাছে অস্ত্রসমর্পন করেন। বর্তমানে জৈন্তাপুর থানা হাসপাতালে একজন কর্মচারী হিসাবে কাজ করছেন।

    শ্রীব্রজমোহন সিংহ, পিতা : শ্রীবটা সিংহ, গ্রাম : ছড়াপাথারি, ডাকঘর : পাত্রখোলা, থানা : কমলগঞ্জ, জেলা : মৌলবীবাজার
    সহজ সরল কৃষক ব্রজমোহনকে জমিতে হালচাষ করা অবস্থায় রাজাকারেরা আটক করে এবং চোখ বেধেঁ মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে ব্যাংকার খনন করার কাজে লাগানো হলে তিনি কৌশলে পালিয়ে ত্রিপুরার কৈলাশহর চলে যান। ট্রেনিং নেয়ার পর ক্যাপ্টেন আব্দুস সালামের অধীনে সিলেট শহরে অপারেশনে অংশ নেন। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমাদের অধীনে কৈলাশহর ও কমলপুর সীমান্তে কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর শ্রীমংগল ওয়াপদা অফিসে অস্ত্র জমা দেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আয়োজিত প্রথম ঢাকা সম্মেলনে তিনি উপস্থিত ছিলেন। কয়েক বছর আগে দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করতে করতে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

    শ্রীগিরীন্দ্র সিংহ, গ্রাম : মাধবপুর(আউলেকি), ডাক কেরামতনগর, থানা : কমলগঞ্জ, জেলা : মৌলবীবাজার
    মনিপুরী ঘোড়ামারা গ্রামের পেছনে নদী সংলগ্ন শ্বশানঘাট থেকে পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের সাথে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার সংগঠন ও নেতৃত্তে ছিলেন গিরীন্দ্র। সাধারন অস্ত্র লাঠি, বর্শা এবং আরো নানান প্রাচীন অস্ত্রকে সম্বল করে পরিচালিত হয় এই লড়াই। গিরীন্দ্র ছিলেন অসম সাহসি ও অসাধারন দৈহিক ক্ষমতার অধিকারী। যুদ্ধের পাশাপাশি মাধবপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবারদাবার সরবরাহের দ্বায়িত্ব ছিল তার উপর। মাধবপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অপারেশনের সময় শত্রুসৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন । ধলাই ক্যাম্পে সপ্তাহখানেক আটকে রেখে নৃশংসভাবে শারীরিক নির্যাতন চালিয়েও তার কাজ থেকে কোন তথ্য বের করতে না পেরে তাকে হত্যা করে লাশ ধলাই নদীতে ভাসিয়ে দেয় পাকবাহিনী ও তার দোসররা। শহীদ গিরীন্দ্র সিংহ কে নিয়ে একটি লেখা পড়ুন - এখানে

    মণি সিংহ, গ্রাম : মাঝের গাঁও, থানা : ছাতক, জেলা : সুনামগঞ্জ
    ছাতক এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর হত্যা লুঠতরাজ শুরু হলে মণি সিংহ তার কয়েকজন বন্ধ ধের সিংহ, ব্রজ সিংহ, মনে সিংহ, হীরেন সিংহসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে সীমান্তবর্তী নামাইল ক্যাম্পে হাজির হল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে। বুটাং এবং শিলঙে প্রশিক্ষন গ্রহনের পর প্রথম অপারেশনে যান ৫ নং সেক্টরে ভোলাগঞ্জে। ১২ ডিসেম্বর সিলেটের শালুটিকর বিমান ঘাটিতে ৩ প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শত্রুসেন্যদের আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করা হয়, সেই অভিযানে অগ্রনী ভুমিকা রাখেন মণি সিংহ। দেশ স্বাধীন হবার পর সিলেট আলীয়া মাদ্রাসায় কর্ণেল শওকত আলীর কাছে অস্ত্র হস্তান্তর করেন। যুদ্ধের সুখস্মৃতি নিয়ে মণি সিংহ এখন কৃষিকাজ করে জীবন চালান।

    ভুবন সিংহ, গ্রাম : ঘোড়ামারা, ডাক : আদমপুর বাজার, থানা : কমলগঞ্জ, জেলা : মৌলবীবাজার
    ভুবন সিংহকে যুদ্ধকালীন সময়ে জরুরি বার্তা সংগ্রহের কাজ করতেন। কৈলাশহর, আগরতলা এবং ভানুগাছ ছিল তার কর্মক্ষেত্র। বাড়ীতে পরিবার পরিজন রেখে একাই ভারতে চলে গিয়েছিলেন। এরপর সংবাদ সংগ্রহ এবং শরনার্থী পারাপারের কাজে নিয়মিত সীমান্তের এপার -ওপারে যাতায়াত করতে থাকেন। সেপ্টেম্বর মাসে পাথরখোলা বর্ডারে পাকছাউনির কাছে তিনি শত্রুসৈন্যের হাতে ধরা পড়েন। তারপর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার হাত পা বেঁধে শমসেরনগর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। পথে জোড়ামন্ডপের রাস্তার সামনে এক বৃদ্ধকে দেখে তিনি শেষবারের মতো চিৎকার করে তার পরিবারের কথা জানতে চান। শমসেরনগর ক্যাম্পে নির্যাতনের পর তাকে মেরে ফেলে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।

    রবীন্দ্র কুমার সিংহ, পিতা : ফাল্গুনী সিংহ, গ্রাম : তিলকপুর, ডাক : কমলগঞ্জ, থানা : কমলগঞ্জ, জেলা : মৌলবীবাজার
    ১৯৭১ সন সিলেট এম সি কলেজের গণিত বিভাগের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন রবীন্দ্র কুমার সিংহ। যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথেই ভারতে চলে যান মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। সেখানে স্বল্পকালীন ট্রেনিং শেষ করে শমশেরনগর ও কামারছড়া এলাকায় বেশ কয়েকটি সফল অভিযানে অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণকুমার সিংহের বন থেকে জানা যায় কামারছড়া অঞ্চলের পাঞ্জাবি ছাউনিতে গেরিলা আক্রমনের সময় তিনি ঐ অঞ্চলের ম্যাপ রবীন্দ্র কুমার সিংহের হাতে হস্তান্তর করেন। যুদ্ধের পাশাপাশি শানীয় রাজাকার ও পাক বাহিনীর দোসরদের চিহ্নিত করে তাদের খুজেঁ বের করার কাজ করতেন।

    স্বাধীনতার পর অনার্স ও মাস্টার্স ১ম শ্রেনীতে পাশ করার পর তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ে সেকশন অফিসার এবং পরে তার সততার কারণে তিনি বাংলাদেশ সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রীন একান্ত সচিব হিসাবে পদোন্নতি পান। ১৯৭৯ সনের ২৭ আগষ্ট ঢাকার আজিমপুরে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সশস্ত্র হামলায় তিনি নিহত হন।

    থইবা সিংহ, গ্রাম : তেঁতইগাও, ডাক : আদমপুর বাজার, থানা : কমলগঞ্জ, জেলা : মৌলবীবাজার
    স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সুনামগঞ্জের মহকুমা সদরে কাঠমিস্ত্রীর কাজ করতেন। তিনি মেঘালয়ের শিলং এর বালা ক্যাম্পে ১৫ / ২০ দিন থাকার পর ভারতীয় মেজর বাথ সিং এর তঙ্কÄ¡বধানে ট্রেনিং নেন। প্রথম অপারেশন ছিল ঢাউকির মুক্তাপুরে, তারপর তাহেরপুর রাতাছড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে কমান্ডার মানিক চৌধুরীর অধীনে দিরাই, কর্ণফুলী . শাল্লা ও জয়কলস এ গেরিলাযুদ্ধে অংশ নেন। বর্তমানে কৃষিকাজ করে সংসার চালান।

    নন্দলাল সিংহ . গ্রাম : নবালুচর, থানা : কোম্পানিগঞ্জ, জেলা : সিলেট
    ১৯৭১ যুদ্ধ শুরু হবার পরপরই নন্দলাল সিংহ সপরিবারে ভারতে আশ্রয় নেন। সেখানে পরিবারের সদস্যদের ইছামতি ডিঙরায় শরনার্থী ক্যাম্পে রেখে মেঘালয়েল জোয়াই তে প্রশিক্ষনের জন্য চলে যান। প্রথম অপারেশন ছিল ভোলাগঞ্জের বিলাজোড়ে। তারপর বাদঘাটে এবং পরে প্লাটুন কমান্ডার মুসলিম মিয়ার অধীনে গোয়মারায় যুদ্ধ করেন। শালুটিকর বিমান ঘাটি ও তেলিঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ে অগ্রনী ভুমিকা রাখেন নন্দলাল। স্বাধীনতার পর সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় কর্ণেল শওকত আলীর কাছে অস্ত্র জমা দেন। পুলিশ বাহিনীতে চাকরি পেয়েছিলেন কিন্তু তা ছেড়ে বাড়ীতে কৃষিকাজ করছেন।

    বিদ্যাধন সিংহ, গ্রাম : ভানুবিল, ডাক : আদমপুর বাজার, থানা : কমলগঞ্জ, জেলা মৌলবীবাজার
    ১৯৭১ সালের এপ্রিলে বিদ্যাধন সিংহের বাড়ীতে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হামলা চালায়। সেদিন সন্ধ্যায় ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে ভোররাতে ডলুগাও পৌছান। সেখানে স্বেচ্ছায় ডিআইবির হাতে আটক হন। তারপর নিজের ইচ্ছার কথা জানালে তাকে ট্রেনিং এর জন্য হাফলং পাঠানো হয়। বিদ্যাধন সিংহ কমলপুরের বালিগাও ক্যাম্পে এবং পরে গুরুত্তপুর্ন ধলাই ক্যাম্পের একটি অপারেশনে অংশ নেন। ভারতীয় সীমান্ত থেকে চরাশ গজ দুরের এই আউটপোস্টে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানীবাহিনীর মধ্যে কয়েকদফা সংঘর্ষ হয়েছিল। এই ধলাই আউপোস্ট শত্রুমুক্ত করতেই প্রাণ দিয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। দেশ স্বাধীন হলে বিদ্যাধন শ্রীমঙ্গল ওয়াপদায় এসে অস্ত্র জমা দেন। ১৯৯১ সালে তিনি ২ পুত্র ও ১ কন্যা রেখে মারা যান।

    ব্রজমোহন সিংহ, গ্রাম : মাঝের গাঁও, থানা : কোম্পানিগঞ্জ, জেলা : সিলেট
    টেইলার ব্রজমোহন সিংহ পেশাগত কাজের জন্যে আগরতলায় থাকতেন। যুদ্ধ শুরু হলে বাড়ীতে বাবা-মাকে দেখার জন্য দেশে আসেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে যাবেন। তারপর মেঘালয়ের শিলং এ ভারতীয় সামরিক অফিসার রলরাম সিং এবং ইম্ফালের কুঞ্জ সিং এর তঙ্কÄ¡বধানে ট্রেনিং রাভ করেন। জৈন্তা অঞ্চলের মুক্তাপুর এবং কালাইনছড়ি ছিল ব্রজমোহন সিংহের প্রথম অপারেশন। এরপর কমান্ডার আলমগীরের নেতৃত্বে ভোলাগঞ্জে কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। বর্তমানে হতদরিদ্র হয়ে অন্যের জমি বর্গাচাষ করে দিনযাপন করছেন।

    নিমাই সিংহ, গ্রাম : মাধবপুর, ডাকঘর : পাত্রখোলা, থানা : কমলগঞ্জ, জেলা : মৌলবীবাজার
    ছাত্রাবস্থায় নিমাই সিংহ ছিলেন ছাত্রলীগ কর্মী। প্রথমে ভারতে একটি শরনার্থী শিবিরের জীপগাড়ীর হেলপার হয়ে কাজ করতেন। পরে হাফলং লোয়ার বনে ভারতীয় সামরিক অফিসার হনুমান সিং এর কাছে ৩ মাস ২১ দিন প্রশিক্ষন নেবার পর ৪ নং সেক্টরে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানের অধীনে কমলপুর সীমান্তে নিয়োজিত হন। এরপর কমান্ডার আবুল কাশেমের অধীনে কুমারঘাট, শ্রীমঙ্গল, আখাউরা এবং খোয়াই এ কয়েকটি অভিযানে অংশ নেন। দেশ স্বাধীন হবার পর শ্রীমঙ্গলে অস্ত্র জমা দেন। পরে ১৫ দিনের মিলিশিয়া ট্রেনিং এ অংশ নেন। বর্তমানে আনসার বাহিনীর সাথে যুক্ত আছেন।

    বিশ্বম্ভর সিংহ, গ্রাম : বালিগাঁও,ডাকঘর : কেরামতনগর, থানা : কমলগঞ্জ, জেলা : মৌলবীবাজার
    স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার ভাই কৃপাময় সিংহকে নিয়ে শরনার্থী শিবিরে উঠেন। তারপর নৌমুজা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখান।অসেখান থেকে শিলচরের লোয়ারবন ট্রেনিং সেন্টারে ১ মাস ১০ দিন ট্রেনিং নেন। ক্যাপ্টেন ধীর সিং এর তঙ্কÄ¡বধানে ট্রেনিং সমাপ্তির পর কমান্ডার হাবিবুর রহমানের অধীনে চাতলাপুর বর্ডার অপারেশন ডিফেন্সে কাজ করেন। বিওপি, কামারছড়া চাতলাপুরে তিনি অপারেশনে ডিফেন্সে গুরুত্তপূর্ন দ্বায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর মৌলবীবাজার ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে অস্ত্র জমা দেন। ১৯৭৪ সালে শ্রীমঙ্গল কলেজ থেকে এইচ . এস . সি পাশ করার পর চেস্টা করেও একটি চাকুরি জুটাতে না পেরে মনক্ষুন্ন হয়ে কৃষিকাজে মন দেন।

    দীনমনি সিংহ, গ্রাম : পুরান বালুচর, থানা : কোম্পানিগঞ্জ, জেলা : সিলেট
    ‘ ৭১ এ দীনমনি ছিলেন ৯ম শ্রেনীর ছাত্র। মে মাসে কোম্পানিগঞ্জে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ দীনমনিকে উৎসাহিত করে তোলে। বাড়ীর কাউকে না জানিয়ে তিনি তার বন্ধু স্বপন, মণি ও নন্দলালের সাথে সীমান্ত পাড়ি দেন। ইছামতি ইয়ুথ ক্যাম্পে তার ট্রেনিং হয়। ট্রেনিং শেষে ভোলাগঞ্জ ৫নং সাবসেক্টরে অপারেশনে যোগ দেন। কমান্ডার ফখরুলের নেতৃত্বে পরিচালিত ঐ অভিযানে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল এবং তারা সারারাত জেগে ভোলাগঞ্জের মোরায় শত্রুসৈন্যদের ঘাটিতে হামলা করেন। সেদিন গোলবারুদ ও অস্ত্রস্বল্পতার কারণে তারা ব্যাক করেন কিন্তু পরদিন শত্রুসৈন্যদের ঐ ক্যাম্পটি শুণ্য হতে দেখা যায়। তার স্মৃতিচারন থেকে জানা যায়, ঐদিন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সুরমা নদীর পাড়ে কিছু রাজাকারকে ধরে ফেলে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এদের প্রাণে না মেরে সামান্য উত্তমমধ্যম দিয়ে ছেড়ে দেন এবং ‘ জয়বাংলা ’ শ্লোগান দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য করান। বর্তমানেছাতক থানার লাকেশ্বর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত আছেন।

    বাপ্পী সিংহ, গ্রাম : বালিগাঁও, ডাকঘর : কেরামতনগর, থানা : কমলগঞ্জ, জেলা : মৌলবীবাজার
    সঙ্গীত শিল্পী বাপ্পী সিংহ এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেশের গান গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে ত্রিপুরায় আমতলী অস্থায়ী ক্যাম্পে ১৫ দিন কাটান। তারপর হাফলং এ ট্রেনিং নেন ও পরে হবিগঞ্জের কমান্ডার মানিক চৌধুরীর অধীনে কয়েকটি অপারেশনে যোগ দেন। যুদ্ধকালীন সময়ে সহযোদ্ধাদের দেশাত্তবোধক গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি জে এল উইং এ ফাস্ট নেলস পাওয়ার, সিলেটের মাইন কালেকশন, আর্মস এন্ড এমুনিশন সাপ্লাই ইত্যাদির কাজ করেন। স্বাধীনতার পর অস্ত্র জমা দেন শ্রীমঙ্গলের ওয়াপদাতে। বর্তমানে নানান সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত আছেন।

    চলবে …

    —
    তথ্যসূত্র:
    ১ . দৈনিক সিলেট বাণী (নভে : -ডিসেম্বর ‘ ৯৩) – জহিরুক হক চৌ : সম্পাদিত
    ২ . স্বা : সংগ্রামে বা : মণিপুরী সমাজ (১৯০১ -১৯৭১)- রণজিত সিংহ, ১৯৯৭
    ৩ . ইথাক (বি: ম: পত্রিকা), ডিসেম্বর ১৯৯৭ সংখ্যা
    ৪ . বৃহত্তর সিলেটের দুইশত বছরের আন্দোলন – তাজুল মোহাম্মদ

    —
    http://w4study.com/ ? p=2606
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:৩৫582615
  • আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি খুবই জরুরি
    লেখক: Mithusilak Murmu
    .....................................................................................
    জয়পুরহাটের আদিবাসী সাঁওতাল বীর মুক্তিযোদ্ধা নবীন মুরমুর সঙ্গে বেশ কয়েক মাস আগে পরিচিত হয়েছি। ঢাকায় চার্চ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে এক মিটিংয়ে তার সঙ্গে পরিচয়। এই প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধার টাইটেল এবং আমার টাইটেল একই হওয়ায় আমিই প্রথমে তাকে কাকা বলে সম্বোধন করি। এরপর থেকে মাঝে মধ্যেই আলাপ আলোচনা হয় পরিবার, সমাজ, দেশ ইত্যাদি নিয়ে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মোবাইল ফোনে আমাকে জানালেন, জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে মহান মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের শহীদ চার মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতির উদ্দেশে ভাস্কর্য উন্মোচন করা হবে।অভাস্কর্যটি নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল রাজশাহী চারুকলা ইনস্টিটিউট। গত ১৭ ডিসেম্বর জয়পুরহাট জেলার জেলা প্রশাসক অশোক কুমার বিশ্বাস আদিবাসীয় অস্ত্র হাতে নারী-পুরুষ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন। এই চারজনই (শহীদ খোকা হেমরম, পিতা- লক্ষণ হেমরম ; শহীদ মন্টু হেমরম, পিতা-লক্ষণ হেমরম ; শহীদ যোহন সরেন, পিতা- কালু সরেন ; শহীদ ফিলিপ সরেন, পিতা- লক্ষণ সরেন) ছিলেন আদিবাসী সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রাম নন্দইলের। এছাড়াও ১৬ ডিসেম্বর জেলায় বর্তমানে বসবাসরত ২৩ আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন জেলা প্রশাসক মহোদয়। আলাপ প্রসঙ্গেই এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জানালেন, জয়পুরহাট সদর উপজেলা ও পাঁচবিবি উপজেলার ৩৪ জন আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, এদের মধ্যে সাতজন (মি . উপেন মালো, গ্রাম- ভানাইকুসলা ; মি . সামুয়েল সরেনসহ আরও পাঁচজন) বীর মুক্তিযোদ্ধা রাতের অন্ধকারে দেশ ত্যাগ করেছেন। উৎসাহী হয়ে জানতে চাইলাম, কেন তারা দেশ ত্যাগ করেছেন? জানালেন আরেক করুণ ইতিহাস।

    মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির পর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকা-এর পরবর্তীকালে বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র সমর্পণ করেনি এবং এলাকায় ডাকাতির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে স্থানীয় প্রশাসন তাদের ধরে নিয়ে যায়। নবীন মুরমুকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জয়পুরহাট সদরে। প্রথম ছয় মাস জেলখানায় থেকেছেন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তিনি জড়িত নন। অত:পর তাকে আরও ছয় মাস লেগেছিল নির্দোষ প্রমাণ করতে, নির্দোষ প্রমাণ হয়েই বের হয়ে এসেছিলেন। পর্যায়ক্রমে সেই সাতজনও নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন কিন্তু তাদের হৃদয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল তা আর নিরাময় হয়নি। দু:খ, বেদনায়, অভিমানে এবং ক্ষোভে স্বাধীন বাংলাদেশকে গুডবাই জানিয়েছেন। স্বাধীনতার পরবর্তীতে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা বুদু লাকড়া, মুক্তিযোদ্ধা শিবু মুরমু, মুক্তিযোদ্ধা শিবলাল মুরমু, মুক্তিযোদ্ধা বাবুরাম টুডু, মুক্তিযোদ্ধা দেবেন টুডুসহ আরও অনেকে রাতের অন্ধকারে দেশত্যাগ করেছেন, চোখের জল মুছতে মুছতে। অনেক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাকে আমার মাতৃভূমি ঠাঁই দিতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধা নবীন মুরমু আরও জানিয়েছেন, এখনো আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রশাসনের কাছ থেকে নানান বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন, অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।

    ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করলাম ‘ বাদপড়া মণিপুরি শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তির দাবি ’ (সংবাদ ১৭ . ১২ . ২০১১) এবং দৈনিক প্রথম আলো আয়োজিত ‘ স্বাধীনতার ৪০ বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি ’ (১৭ . ১২ . ২০১১) শীর্ষক আলোচনায় সাবেক রাষ্ট্রদূত এস এস চাকমা অভিযোগের সুরেই বলেছেন, ‘ একাত্তরে আদিবাসীরা বিচ্ছিন্নভাবে যার যার অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা দিয়েছেন। মং রাজার যে অবদান, আদিবাসী মংরা যে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তা ইতিহাসে উঠে আসেনি। ’ মহান বিজয় দিবসের ৪০তম বার্ষিকীতে মণিপুরি সমাজকল্যাণ সমিতি বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে সিলেটের জিন্দাবাজারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এরপর সমিতির নেতারা ‘ মহান বিজয় দিবসের ৪০তম বার্ষিকীতে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ গিরিন্দ্র সিংহ, সার্বভে০ম শর্ম্মা, ভুবেন সিংহসহ বাদপড়া অন্য শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম রাষ্ট্রীয় তালিকাভুক্তির দাবি জানিয়েছেন। ’ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বার বার প্রণয়ন করছেন, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী কিংবা অমুক্তিযোদ্ধা ব্যক্তিদের নামও তালিকায়, গেজেটে প্রকাশিত হচ্ছে, যা মুক্তচিন্তার ব্যক্তিদের ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে। প্রত আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা সুধীর চন্দ্র মাজহী (হাঁসদা) ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আস্ফালনে জীবিতকালে কোন তালিকায় নাম সংযোজিত করতে অপারগতা জানিয়েছিলেন। আমরা দেখেছি, রংপুর সদরে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভে কয়েকজন শহীদের নাম উল্লেখ না থাকায় জোট সরকারের সময়ে কে বা কারা এটা ভেঙে ফেলেছিল। এরপর তা আর নির্মাণ করা হয়নি। কয়েকজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদপড়া এবং কয়েকজন অমুক্তিযোদ্ধা ও একজন চিহ্নিত রাজাকারের নাম শহীদ স্মৃতি ফলকে স্থান পাওয়ায় সাতক্ষীরায় নির্মিত ফলকটি আজও উদ্বোধন করা হয়নি।

    রাষ্ট্র আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের করেছে চরম অবহেলা, সরকার করেছে বৈষম্য এবং প্রতিবেশীরা সহনশীলতা ভুলে গিয়ে সহিংসতার রূপ ধারণ করেছে। অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতা সংবলিত যে রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন মুক্তিযোদ্ধারা দেখেছিলেন তা আজও স্বপ্নই রয়ে গেছে। আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন হলেই আদিবাসী, খ্রিস্টান, বে০দ্ধ, হিন্দু, মুসলমানরা সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে পারবে। কবি আবদুস সালাম (আজাদ) লিখেছেন _

    ‘… হিন্দু বে০দ্ধ মুসলিম খ্রিস্টান আদিবাসী সবাই একাকার

    দেশ গড়ার কাজে আছে সবার সমাধিকার।

    তাজা বুকের রক্ত দিয়ে কিনেছি লাল সবুজের পতাকা

    স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার _ আছে কথা বলার অধিকার

    বাংলা আমার বাংলা তোমার বাংলা সবার। ’

    http://w4study.com/ ? p=2443
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:৩৬582617
  • ফেবু থেকে নেওয়া:
    -------------------
    NOTE FROM Ali Mahmed:
    "উক্য চিং এবং তাঁর অভিনব প্রতিবাদ!

    (এই লেখাটা আগেও পোস্ট করেছি কিন্তু টাইমলাইনে এখন নাই। রিপোস্ট। এই সমসস্ত লেখা প্রয়োজনে আমি রিপোষ্ট-ত্রিপোষ্ট-ফোরপোষ্টও করব। যারা পূর্বে পড়েছেন তারা এখান থেকেই বিদায় নিয়ে অন্য কোনো পড়ায় মন দিন। আদিউস)

    কাল যে লেখাটা লিখেছিলাম, মিসেস রাবেয়া খাতুনের কথা:
    https://www.facebook.com/ali.mahmed1971/posts/10151488939132335
    ওখানে তাঁর বর্ণনার সবটা আমি কিন্তু দেইনি কেবল "এদের উপর শুধু চরম শারীরিক অত্যাচারই করেই এরা থেমে থাকেনি- অবলীলায় কেটে ফেলেছে, ছিঁড়ে ফেলেছে শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো...!" এটা লিখে মেয়েদের উপর নির্যাতনের ভয়াবহতা, বীভৎসতা বোঝাবার চেষ্টা করেছি।
    আমাদের নারীদের প্রতি পাক-বাহিনীর আচরণ এমন বীভৎস ছিল যার বর্ণনা লিখতেও বুকের জোর লাগে। সেই জোর আমার নাই! এসব পড়ার জন্যও আসলে শক্ত নার্ভ দরকার! আমি যেটা আগেও বলেছি, পাক-আর্মি, এরা আসলে যোদ্ধা ছিল না, ছিল সাইকোপ্যাথ! এই সাইকোপ্যাথদের পুরুষাঙ্গ কেটে রাস্তায় শুইয়ে রাখার মত প্রতিবাদ করেছিলেন, 'উক্য চিং'। জঙ্গলে চলে কেবল জঙ্গলের আইন...।

    একমাত্র আদিবাসি উক্য চিং বীর বিক্রম। তিন পার্বত্য জেলার একমাত্র আদিবাসি বীর বিক্রম। তিনি বাংলাদেশের ১৭৫ জন বীর বিক্রমের একজন।
    ৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যার হাতে এলএমজি, গ্রেনেড, মর্টার গর্জে উঠেছে বারবার। মাতৃভূমিকে বর্বর পাক-হানাদার বাহিনীর কবল থেকে স্বাধীন করতে মরণপণ যুদ্ধে যিনি ১৩ জন সদস্য নিয়ে অংশগ্রহন করেছেন। দুঃসাহসী এ যোদ্ধার প্রতিটি অভিযান শত্রুসেনার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। একের পর এক বর্বর পাকিস্তানি সেনারা লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে।

    কেবল একটা ঘটনার কথা বলি:
    ভুরুঙ্গমারীর যুদ্ধে উক্য চিংদের সাফল্য ছিল অন্যদের জন্য অহংকার করার মত! মুক্তাঞ্চল থেকে স্বয়ং মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ছুটে এসেছিলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যুদ্ধের সাফল্যের কারণ জানতে চেয়েছিলেন। তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেন, উক্য চিংদের বান্কারের মুখে একটা এলএমজির ট্রিগারে রশি বেঁধে সেই রশিটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অনেক দূরে। সেখান থেকে রশিতে টান দিয়ে অনেকটা রিমোট কন্ট্রোলের মত এলএমজি ব্যবহার করা হয়েছে!

    উক্য চিং একবার একটি ছোট্ট ব্রিজের নীচে সার্চ করে দেখেন সাত-সাতটি রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন নারীদেহ। তখনও কারো জামায় শোভা পাচ্ছে ঝকঝকে ফাউন্টেন। বুঝতে সমস্যা হয় না এরা স্কুল-কলেজের ছাত্রী, বয়স ১৬ থেকে ১৮। পাক বাহিনী দ্বারা চরম পৈশাচিক নির্যাতনের পর এদের হত্যা করে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

    এই উক্য চিং, বাঙালী নারীদের ওপর পাক সৈন্যদের বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদে যিনি পাক বাহিনীর ১ কমান্ডারসহ সাত সেনাকে ধরে তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রেখেছিলেন।

    মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার যে অল্প পড়াশোনা কিন্তু তারপরও আর কোথাও এমন প্রতিবাদ আর কেউ করেছিলেন বলে অন্তত আমার জানা নাই। অথচ এই অগ্নিপুরুষকে এক বিজয় দিবসে বান্দরবান টাউন হলে ১০০ টাকার প্রাইজ বন্ড দিয়ে সম্মানিত (!) করা হয়েছিল!
    অশ্রুসজল চোখে উক্য চিং বীর বিক্রম তখন প্রশ্ন রেখেছিলেন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার কাছে, 'কেন এই প্রাইজ বন্ড দিয়ে আমাদের লজ্জা দেয়া'?"
    http://www.guruchandali.com/guruchandali.Controller?portletId=8&porlet
    Page=2&contentType=content&uri=content1324204680893#writehere
  • Biplob Rahman | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:৩৮582619
  • মুখ ও মুখোশ…
    --বিপ্লব রহমান
    ________________________
    দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দয়ায় পাওয়া নয়
    ছাত্র অবস্থায় আপনার কবিতা পড়ে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম। সদ্য যুদ্ধ ফেরৎ কবি, আপনি ১৯৭১ এর বারুদের সৌরভ ছড়িয়ে লিখেছিলেন:

    আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছো বিপ্লবের সামনে
    আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছো ইতিহাসের সামনে
    হাতে দিয়েছো স্টেনগান
    আঙ্গুল ভর্তি ট্রিগার
    এখন আমার আর ফেরার কোনো পথ নেই…

    নব্বইয়ের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের কালে সামরিক জান্তা এরশাদের পুলিশ বাহিনী ছাত্র মিছিলে ট্রাক তুলে দিয়েছিলো। ঘটনাস্থলেই ট্রাক চাপায় মারা গিয়েছিলেন ছাত্রকর্মী সেলিম-দেলোয়ার। আমাদের ইস্কুলের দেওয়ালে আন্দোলনকারীরা বেনামে চিকা মেরেছিলো: ট্রাক চাপা দিয়েছো, আন্দোলন থামেনি, ট্যাংক চাপা দিলেও আন্দোলন থামবে না। আর আপনি লিখেছিলেন, ‘লেফটেনেন্ট জেনারেলের ট্রাক!’

    কবিতার বইটি সেই সময় বইমেলায় খুব চলেছিলো। পরে সেটি সরকার বাজেয়াপ্ত করে। আপনাকে জেলও খাটতে হয়। ১৯৮৬-৮৭ তে আমারদের সাংস্কৃতিক সম্মেলনে টিএসসি’র নীচতলার হলরুমটি ছিলো কানায় কানায় পূর্ণ। প্রয়াত লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন এর সভাপতি। তিনিই সম্মেলনের পোস্টারের মূল শ্লোগান লিখেছিলেন, এখনো মনে আছে। সেখানে লেখা ছিলো, শিল্প-সাহিত্য বিপ্লবকে দিক ভাষা, বিপ্লব শিল্প-সাহিত্যকে দেবে মুক্তি। সম্মেলনে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম আপনাকে। বক্তৃতার বদলে আপনি নিজেই হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে ছেঁড়া গলায় গান ধরেছিলেন, যুদ্ধ ফেরৎ স্বরচিত কবিতাকে সুর দিয়ে গানে বলেছিলেন,

    এই নষ্ট শহরে, নাম না জানা যে কোনো মাস্তান…
    বিনির্মাণকালে
    পরে এইসব গান, কথামালা, আবৃত্তি অডিও ক্যাসেট বন্দীও হয়েছিলো, সেটিও আমাদের সংগ্রহে ছিলো দীর্ঘদিন। আর এই গানটিই দেখুন, কিছুদিন আগে ‘দলছুট’ সঞ্জিব চৌধুরী গেয়ে কি সুনামই কুড়িয়েছেন! নতুন করে গাওয়া গানে সবই আছে, কিন্তু আমাদের কিশোর বেলায় আপনার কণ্ঠে যে শোনা গানে যে বিপ্লব স্পৃহা খুঁজে পেয়েছিলাম, তার ঘাটতি তাতে ধরা পড়ে মারাত্নক। দ্রুত আমাদের ছাত্রত্ব ফুরাতে থাকে, আমরা বড়ো হতে থাকি নানান পাঠ-পর্যবেক্ষণে, এমনকি আপনার লেখার চিন্তনেও। সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজে’ সে সময় নিয়মিত আপনার কলাম পাঠ ও এ নিয়ে বিতর্ক জমিয়ে তোলা আমাদের বৈকালিক অভ্যাসে পরিনত হতে থাকে। ততদিনে আপনি বিদেশী টাকা ও পরামর্শে খুলেছেন, উন্নয়ন বিষয়ক নীরিক্ষা ও গবেষণা — উবিনীগ। ‘চিন্তা’ নামে আপনার সম্পাদিত অনিয়মত পত্রিকাটিও আমাদের আড্ডায় প্রাণ পায়। মনে আছে, দিনাজপুরে ইয়াসমিন নামে কিশোরীকে পুলিশের গণধর্ষন করে মেরে ফেললে সারা দিনাজপুরে অভূতপূর্ব জনবিক্ষোভ ঘটে। সারাদেশে এর বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। ‘চিন্তা’ সে সময় খুব সাহসের সঙ্গেই ইয়াসমিন সংখ্যা প্রকাশ করেছিলো। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’, ‘বিচিন্তা’ বা ‘খবরের কাগজ’ এ নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করতে সাহস পায়নি। এনজিও ঘেঁষা বলে আমাদের শ্রদ্ধা অনেকটাই টলে গেলেও আমরা তখনো আপনার মেধাবী লেখার ভক্তই ছিলাম।

    মাঝে আপনি অগ্রসর লেখক আহমদ ছফার সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ছফাকে সেই প্রথম ও শেষবারের মতো ক্ষিপ্ত ও অশালীন ভাষায় আপনাকে পাল্টা আক্রমণ করে কলম ধরতে দেখি। আপনি নিয়মিত কলামে বলেছিলেন, এনজিওগুলো নাকি এদেশে সমাজ বিনির্মান করছে, যা রাষ্ট্র বিপ্লবকে এগিয়ে নিচ্ছে! আপনার এই নয়া তত্ত্বের বিরুদ্ধে ছফা খুব রূঢ় ভাষায় যা লিখলেন, ভদ্র করে বললে, তা দাঁড়ায় অনেকটা এরকম, গনিকার পুত্র হে, আপনি নিজে এনজিও ব্যবসা করছেন, করুন না, রাষ্ট্র বিপ্লবের অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন কেনো?

    এ নিয়ে সেই সময় খুব হইচই হয়। আমরা আপনার সর্ম্পকে সেই প্রথম সতর্ক বার্তা পাই। ততদিনে আমরা প্রায় সকলেই অনেকটা কলম ঘষে সাংবাদিকতার কষ্টকর পেশায় নাম লিখিয়েছি। আমাদের কেউ কেউ ছফাকে সমর্থন করে সংবাদপত্রে পাঠ প্রতিক্রয়া লিখে থাকবে, আমরা এ-ও মনে করতে পারি।

    পরে আপনি মেতে ওঠেন লালন-চিন্তনে। কবি, আপনি কবিতা উৎসবে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করলেন নতুন কথা: নবীর যুগ শেষ, এখন কবির যুগ শুরু। …আমরা নড়েচড়ে বসেছি, আপনার কথা, কবিতা ও লেখনীতে আমাদের চিন্তার যাচাই-বাছাই বেড়েছে, মুগ্ধতা আর নয়, তার মেয়াদ ফুরিয়েছিলো রাষ্ট্র বিপ্লবের সঙ্গা নির্ধারণের কালেই । এমনকি আপনার নয়া কৃষি আন্দোলন নামক জৈব কৃষি ব্যবস্থার ‘প্রবর্তন’ বা লালন সাঁই কেন্দ্রীক ‘নব প্রাণ’ আমাদের মনে দাগ কাটেনি। তখনও আমরা আপনাকে ঢেঁড়া চিহ্নের নীচেই রেখেছি, একেবারে বাতিল করিনি।

    ব্রুটাস! তুমিও?
    ২০০৫ সালের দিকে লাদেন-তালেবান উত্থানের কালে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট ঘেঁসে মোল্লার বড় বড় সমাবেশ করতে থাকে। সরকারি আস্কারায় প্রকাশ্যে ম্লোগান ওঠে: আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান! পাঁচ টাকায় লাদেনের একে-৪৭ সহ নূরানী চেহারার পোস্টার বিকায় বিস্তর। আপনি প্রেসক্লবের সেমিনারে সে সময় বয়ান করে বলেছিলেন, তালেবানরা সকলেই নাকি মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে আপনারা যে কারণে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন, তালেবানরা নাকি একই কারণে মুক্তিযুদ্ধ করছে। …

    এ নিয়ে নানান মহলে আপনাকে তুলোধুনো করা হতে থাকে। আমরা তালাশ করে জানতে পাই, বিএনপি-জামাতী ঘুনপোকা বাসা বেঁধেছে আপনার করোটিতে। তারাই আপনাকে তখন চালিত করছে, তারাই আপনার মগজ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, ইসলামী বিপ্লবের মুখপত্র ইনকিলাবে কলাম লেখাচ্ছে। তালেবান সমর্থিত সভা-সেমিনারে কবিবর, আপনার ডাক পড়ছে নিয়মিত।… ইসলামী ব্যাংকের টাকায় করা দৈনিক ‘নয়া দিগন্তে’ কলামিস্ট হিসেবে আপনার কদর বাড়ে।

    আমরা তরুণ সাংবাদিকরা গোপন দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে তালেবানী তত্ত্বের ফেরিওয়ালা কবি, আপনার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করি, ১৯৭১ এর রক্তের দায় থেকেই। আমরা জেদ করে বসি, আপনাকে প্রকাশ্যে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে, মাফ চাইতে হবে।…ডান, বাম, মধ্যপন্থী তাবৎ বাঘা সাংবাদিকরা আমাদের সমর্থন জানিয়ে যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেয়। …আমরা মনস্চক্ষে দেখতে পাই, ‘৭১ এর স্টেনগান নয়, লাদেনের একে-৪৭ তাক করে আপনি কুৎসিত দেঁতো হাসি হাসছেন। বেগুনি রঙের শয়তানি আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে আপনার চশমার কাঁচ ভেদ করে।…

    না হে সাবেক কবি, ভুল মুক্তিযোদ্ধা, আপনি বক্তব্য ফিরিয়ে নেননি, মাফও চাননি। পাল্টা বিবৃতি দিয়ে পুরো ঘটনাই আপনি অস্বীকার করলেন। ধোঁয়াশা তৈরি করে দাবি করলেন, সংবাদপত্র নাকি আপনার বক্তব্য বিকৃত করে প্রকাশ করেছে। আদৌ আপনি ওই সেমিনারে তেমন কোনো বক্তব্যই দেননি!

    ইনকিলাব-নয়া দিগন্তের কলাম চাপা পড়তে থাকে আমাদের সকলের সম্মিলিত ঘৃণার স্তম্ভের নীচে। কবিরাজ (অব.) রাইসু এক্সপ্রেসের ভক্তিবাদের সুতোয় বিডিনিউজের মতামত বিভাগে আপনি পুচ্ছ নেড়ে আবার প্রগতির ভেক ধরেন। দৈনিক আমার দেশ নামক নিউজপ্রিন্ট ও অক্ষরের অপচয় সরকার বন্ধ করতে চাইলে আপনি মতামত জানান এভাবে, এটি সরকারের ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ, বাক স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ — ইত্যাদি। আমাদের অনেকের কাছেও সে সময় এটিকে আওয়ামী বাড়িবাড়ি বলে মনে হয়। তবে আমরা এই তালেবানী দৈনিক ও আপনার ভাষ্য আদৌ আমলে নেই না; একে একরকম উপেক্ষাই করি। …

    তোমারে বধিবে যে…
    গণদাবিতে শাহবাগের মোহনায় গণজাগরণ-গণবিস্ফোরণে নতুন করে লেখা হতে থাকে অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আমরা প্রজন্ম ‘৭১ ব্লগার, ছাত্র, সাংবাদিক, শিক্ষক, জনতা এক-দুজন করে জড়ো হতে হতে জনসমূদ্রে পরিনত হই। আমাদের আহার, ঘুম, বিশ্রামের সময় থাকে না…বউ-বাচ্চা, বন্ধু-বান্ধব, বৃদ্ধ বাবা-মা’সহ আমরা সদলবলে জড়ো হতে থাকি। তখন ও এখনকার মুক্তিযোদ্ধারা ওঙ্কার দিয়ে বলে: বিচার চাই! বিচার চাই!

    সারাদেশে, জেলায়, জেলায়, উপজেলায়, থানা শহরে, এবার বাংলায়, ওপার বাংলায়, পাহাড় ও সমতলে, দিকে দিকে, দশদিগন্তে জ্বলে ওঠে সব প্রাণ, ৪২ বছরের ঋণের শোধ চাই! সব হিস্যার অবসান চাই! লাল-সবুজ বাংলায় হায়নার পদচারণা আর নয়! …

    শোন মৌলবাদের নাতি
    তুমি যে ধর্মেরই হও,
    আমি নিরপেক্ষতাবাদী
    তুমি আমার বন্ধু নও।
    [কবির সুমন]

    ইতিহাসের অনিবার্য মিমাংসারকালে বাংলাদেশ যখন এই গুঢ় প্রশ্নের মুখোমুখি, দেশ মৌলবাদের লেজে মধ্যযুগে ফিরে যাবে, না প্রগতির পথে মুক্তির আলোয় হাঁটবে, তখন শেষ মরণ কামড় বসায় জামাত-শিবির। গলা কেটে ব্লগার খুন. জাতীয় মসজিদে হামলা, সাংবাদিকদের পিটিয়ে নাস্তানাবুদ, শহীদ মিনারে আগুন, পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, তাণ্ডবের পর তাণ্ডব। …

    এরপর যুদ্ধাপরাধী বাঁচাতে জামাতি হরতালে সহিংসতায় পুলিশসহ নিহত হন প্রায় ৪০ জন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একে “১৯৭১ এর গণহত্যার সামিল” বলে আমাদের “গণহত্যা”র সঙ্গা শিক্ষা দেন। আমরা মেকাপ বিহীন ম্যাডামের সংবাদ সম্মেলনে যেনো বিএনপি’র জামাতে অবলুপ্তির ঘোষণাই শুনি। ম্যাডাম জিয়ার বয়ানে যেনো সেদিন গোলাম আজমই ১৯৭১ এর বর্বোরচিত “গণহত্যা”কে উপহাস করে দম্ভের সঙ্গে বলেন, “একাত্তরে আমরা ভুল করিনি!”

    আর আমাদের আলোচ্য ফসিলাইজড কবি, এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধেরকালে আপনিও কি না খোলস ছেড়ে, মুখোশ নামিয়ে, ওই ট্রাশ দৈনিকেই কলাম লিখলেন একই সুরে, দাঁড়ালেন গণজাগরণের বিপক্ষে:

    দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে পুলিশ যেভাবে মানুষ হত্যা করেছে, তাকে ‘নির্বিচার গণহত্যা’ ছাড়া মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের দিক থেকে আর কিছুই বলা যায় না। বিক্ষোভ ও মিছিল দেখলেই গুলি করার নির্দেশ পালন করছে পুলিশ। মনে হচ্ছে বাংলাদেশে ‘হত্যার উত্সব’ চলছে। কাদের মোল্লার রায়ে কেন তাকে ফাঁসি দেয়া হলো না, এ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারির ছয় তারিখ থেকে শাহবাগে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছে। দাবি করছে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার নয়; যেভাবেই হোক ফাঁসি দিতে হবে। ফাঁসির রায় ছাড়া শাহবাগ ঘরে ফিরবে না। আদালতের ওপর এ অন্যায় চাপ অব্যাহত রাখা হয়েছে। এটা ঘটছে প্রকাশ্যে। পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় ক্ষমতার চাপ।
    [লিংক]
    সবশেষ, নির্বাচনের প্রশ্নে বিএনপি-জামাত-হেফাজত একের পর এক সহিংস হরতাল দিতে থাকলে, গণমাধ্যম কার্যালয়, বিচারপতির বাসভাবন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের স্বাক্ষী, মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, সাংবাদিকদের বাসভবনে বোমা হামলা হতে থাকলে কবিবর, আপনি ইটিভি'র সংলাপে স্পষ্ট উচ্চারণে বর্তমান সংঘাত ও প্রাণহানীর জন্য গণমাধ্যমকে এন্তার বিষোদগার করেন। আবারো স্বাক্ষী সাফাই দেন সন্ত্রাসের পক্ষে।

    আপনার ভাষ্যমতে, গণমাধ্যমগুলো এখন নাকি গণবিবোধী ভূমিকায় নেমেছে। সেখানে সাধারণ মানুষের কথা মোটেই আসছে না। সাধারণ মানুষের যখন মত প্রকাশের পথ বন্ধ হয়ে যায়, তখন নাকি এ ধরণের বোমা হামলা স্বাভাবিক ঘটনা। একুশের রাতের অনুষ্ঠানে সেদিন আপনি বলেন,

    [৭১ টিভিতে] পটকা ফাটানো কমই হয়েছে, এটি আরো হওয়া উচিৎ।
    [লিংক]
    বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
    রাজনীতিকের ধমনী শিরায়
    সুবিধাবাদের পাপ।
    বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
    বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ…

    [রুদ্র মুহম্মাদ শহীদুল্লাহ]
    এর চেয়ে অধিক বাক্যে আপনাকে ধীক্কার দিতে আর রুচি হয় না, হে আমাদের বালক বেলার স্বপ্নের কবি, ছিঃ!!

    http://biplobcht.blogspot.com/2013/03/blog-post_4.html
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন