এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 154.160.226.53 | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৪:৫৮582872
  • বড় দামী সব লেখা, বিশেষতঃ শাহবাগ আন্দোলনের এই মুহুর্তে, দেশের ইতিহাস যেন জানতে পারে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম।
  • Yan | 161.141.84.239 | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৬:২৬582873
  • ত্যানা প্যাঁচানো নিয়ে দিব্যি মজার ছলে আসল কথাগুলো বলে দিয়েছেন চরম উদাস। এই যে লেখাটা।

    http://www.sachalayatan.com/udash/47904#comment-576207
  • debu | 180.213.132.253 | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৭:০১582874
  • আমর তখন বয়েস হবে ৯-১০ ,সেই সময় বহু মুক্তি যোধ্যা দেখেছি যারা কোনো যুধ্যো করেই নি (বেল্ঘরিআ,বারসাত,দমদম এলাকায় থাকতো),যুধ্যো করেছিলো তো indian Army ।পরে সেই সব মুক্তি যুধ্যোরা বড়ো সরকারি পদে চাগ্রি পায়।
  • Yan | 161.141.84.172 | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৭:১৯582875
  • বাপরে! দেবু এসব কী বলছেন! কী সব ইতিহাস !!!!!
    একটা দেশের ত্রিশ লক্ষ লোক মারা গেল যুদ্ধে ও অত্যাচারে, আর বলছেন যুদ্ধটা পুরোটাই করলো অন্যে ????
  • ঐশিক | 132.181.132.130 | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১০:৫৪582876
  • বিপ্লব দা, আপনার কথা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম অনেক ধন্যবাদ
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ২০:৫১582877
  • যারা নোটগুলো নজরে রেখেছেন, পড়েছেন, সকলকে জানাই বিনীত কৃতজ্ঞতা।

    জয় বাংলা!
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.22 | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১৬:২৭582878
  • শহিদুল হক মামার সাক্ষাৎকার।
    লিখেছেন: সুব্রত শুভ
    _________________________________________________
    শহিদুল হক মামা। ১৯৭১ সালের বীর মুক্তিযুদ্ধে যিনি সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। গেরিলা বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বর্পূণ কাজে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। মিরপুরে কাদের মোল্লা ও বিহারীদের নির্মম ধ্বংসলীলা তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। এছাড়াও তিনি ৬৬ -তে ছয় দফা , ৬৯-তে গণঅভ্যুত্থানে সরাসরি জড়িত ছিলেন। মিরপুর তিনিই বিহারীদের সামনে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন সাহসের সঙ্গে। শহিদুল হক মামা কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতা অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন এছাড়াও যুদ্ধাপরাধী ফাঁসির দাবীতে শাহবাগ চত্ত্বরের আন্দোলনে তিনি যোগ দিয়েছেন। এছাড়াও এই সাক্ষাৎকারে তিনি সরকারের দূর্বলতা সসর্ম্পকেও স্পষ্টভাবে কথা বলেছেন। সেই অকুতোভয় মানুষটিকে সবাই মামা বলেই ডাকে। বর্তমানে তিনি সুইডেনে বসবাস করছেন।

    প্রশ্ন- মামা, একাত্তরে আপনার ভূমিকা কী ছিল তা যদি একটু বলতেন। সাথে গেরিলা বাহিনী ও মামা বাহিনী সর্ম্পকে যদি কিছু বলতেন।

    মামা- একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ডাক এবং এর আগের ঘটনা গুলো সর্ম্পকে যদি না বলি তাহলে মিরপুরের সঠিক চিত্রটা আসবে না। এই যে জল্লাদ কাদের মোল্লা, এই যে জামাতী ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ, মুসলীমলীগ, কনভেনশন মুসলিমলীগ এবং বিহারীরা এরা যে দুর্গ এখানে তৈরী করেছে। কারণ তারা মনে করত মিরপুর তাদের আবাসভূমি এবং এটা মহাজিরের এলাকা। হাতে গোনা কয়েক শ বাঙালি থাকত কলোনির ভেতরে। এটা কল্পনাই করা যায় না; পানি তে থেকে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। ১৯৬০ দশকে আমরা যখন এখানে (মিরপুর) করা শুরু করি, ৬২ তে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে লড়াই করিছি, ৬৬ সনে ছয় দফা, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের এগার দফা আর তখন থেকেই তাদের সাথে আমাদের লড়াই শুরু হয়ে গেল। তারা ছয় দফা ও এগার দফার বিপক্ষে প্রাচীর তৈরী করল। পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে বাঘ বলে পরিচিত; খান আবদুল কাইয়ুম খানকে, এই জামায়াতী ইসলাম আর এই বিহারী মহাজিররা তাতে ওখান থেকে দাওয়াত করে নিয়ে আসল ছয়দফা ও এগার দফার বিপক্ষে কথা বলার জন্য। যখন আমরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ করলাম এটার আহবায়ক আমি ছিলাম। আমাদের সাথী বন্ধুরা মিলে আমরা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করলাম। কায়ুক খান আসল বর্তমান যে ক্রিকেট মাঠ তখন তা এমনি মাঠ ছিল সে জায়গায়। সে তার ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান সর্ম্পকে বলে- “ শেখ মুজিবুর গাদ্দার হে, পাকিস্তানকা দুশমন হে”

    একথা শোনার পর আমরা আর বিলম্ব না করে প্রাণের মায়া ত্যাগর করে ঝাপিয়ে পড়লাম স্টেজে। তাদের এতো বড় সাহস! যখন গণঅভ্যুত্থান, সারা পৃথিবীর পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর খবর পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে আর তখন কিনা সে এই কথা বলে। ঝাপিয়ে পড়ার পর আমাদে উপর হামলা শুরু হল; গণপিটুনি আর গণধোলাই। আমার সাথে ছিল খুন সুনামধন্য আমার বিশিষ্ট বন্ধু যারা সাথে আমি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি তার নাম এডভোকেট শাহ আলম। এই মিরপুরেই তাদের বাড়ি ছিল। শহীদ স্মৃতি স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সে ছিল এবং গর্ভনিং বোর্ডের মেম্বারও সে ছিল। আমাদের সাথে সাথে হায়দার, জিল্লুল, কাশেম,হাশেম কেউ বাদ নেই কিন্তু আমাকে আর আমিনকে পিটাতে পিটাতে মেরে ফেলছিল। আমিনকে ডাস্টবিনে ফেলে দিল; ভেবেছিল সে মারা গেছে। আর আমাকে নিয়ে গেল থানায়। ফেন খুলে যে হারে পিটিয়েছে আর কী বলব। একেকটা বাড়ি মেরে বলে জয় বাঙল আর বলবি? কিন্তু আমি তারপরেও বলি “জয় বাঙলা”।

    এই যে এতো অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে তারপরেও এদের সাথে তালে তাল মিলিয়ে সংগ্রাম করে গেছি। ৭০-এ নির্বাচনে এই এলাকা থেকে কুক্ষাত গোলাম আযম নির্বাচন করেছিল। মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও তেঁজগাও এক অংশ নিয়ে এই নির্বাচন হয়। গোলাম আযম দাড়ি-পাল্লা নিয়ে এই নির্বাচন করেছিল। আর গোলাম আযমের সেক্রেটারি ছিল কাদের মোল্লা। তার পক্ষ হয়ে এই কাদের মোল্লা নির্বাচনী প্রচার অভিযান চালিয়েছিল। আর আমরা জীবনের বাজি রেখে বঙ্গবন্ধুর আপন জন; এডভোকেট জহির উদ্দিন তাকে মেম্বার অব ন্যাশেনাল এসেম্বলির প্রার্থী হিসেবে দেওয়া হল আর প্রভিশনাল এসেম্বলির প্রার্থী হিসেবে দেওয়া হল মোশারফ হোসেন কে। আমরা দুইজনকেই নির্বাচনে জয়ী করিয়ে বিজয়ীর মুকুট পড়ালাম। আর এই হারের প্রতিহিংসা বিহারীরা ও আমাদের শত্রুরা মনে পুষে রেখেছিল। তারা প্রকাশ করেনি শুধু অপেক্ষা করেছিল এর প্রতিশোধ নেবার জন্য। ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে সারা দেশে অপরেশন সার্চ লাইট কে কেন্দ্র করে যে পৌশাচিক খুন-খারাবি ও ধ্বংশলীলা শুরু হয়েছিল মিরপুর এর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। এই কাদের মোল্লাকে দেখেছিলাম সে আনন্দে আত্মহারা। সে বিহারীদেরকে নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে, বাড়ি বাড়ি আগুন লাগাচ্ছে। সে চিৎকার করে বলছে, হুংকুর করে বলছে “ কাহা তেরা বাংলাদেশ ? দেখ এবারা তামাশা দেখ ধামাকা দেখ”

    এই যে পাগলের মতন খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাদেরকে। আমরাই তখন নৌকার প্রতীক নিয়ে ছিলাম, আমরাই তখন বাঙালির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিলাম। কিন্তু তখন আমি ৭১-এর রণাঙ্গনে চলে গিলাম। আমার মনে এতো ব্যাথা এতো বেদনা এতো কষ্ট ছিল কারণ আমি লাশের উপর পাড়ি দিয়ে গেলাম। আমাকে ধরার জন্য তারা আমার পেছন পেছন ছুটছিল। কাদের মোল্লা আর বিহারীরা আমার পেছনে ছুটছে আর বলছে “পাকড়াও পাকড়াও শহিদ আয়া”। আমি প্রাণ পণে ছুপে বেড়াচ্ছি আর তারা চর্তুদিকে গুলি করছে। আর এই অবস্থা দেখে পশু-পাখিও দৌড়াচ্ছে, রাস্তার কুকুর গুলো পর্যন্ত দৌড়াচ্ছে জান বাঁচাবার জন্য।

    আজকে দেশ স্বাধীন হল। নিরান্নব্বই হাজারের মতন খান সেনারা এই জল্লাদরা আত্মসমর্পণ করল সোহরাওয়ার্দী উদ্দ্যানে কিন্তু স্বাধীনতার পরও মিরপুর ছিল ব্যতিক্রম। এরা পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে রেখেছিল। আমাদের প্রতি এদের একটা প্রতিহিংসা ছিল আগ থেকেই। তার এক নাম্বার কারণটি হল; আমি ২৩শে মার্চ পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে ফেলি এবং বাংলাদেশের পতাকা উড়ালাম। যেটাতে মানচিত্র আঁকা ছিল। এখন আমার নিজেকেও নিজের বিশ্বাস হয় না আমি কোন সাহসে ঐ উপড়ে উঠেছিলাম। তুঙ্গে উঠে পাকিস্তানী পতাকা ফেলে দিয়ে আমাদের স্বাধীন বাঙলার পতাকা উড়ালাম। আমার সাথে যে সমস্ত সহকর্মী ও সাথী ছিল তারাও ভীতু ছিল না। তারা আমাকে সহযোগীতা করেছিল এই পতাকা উড়াবার জন্য। আর হাজার হাজার বিহারী তামাশা দেখছিল; এই ২৩-শে মার্চে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে দিয়ে এই বাংলাদেশের পতাকা উড়ালাম।

    আজকে আমার এই দেশ যা ত্রিশ লক্ষের জীবনের রক্তের বিনীময়ে অর্জিত। আর এই হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে ঘাপটি মেরে বসেছিল এই মিরপুরে। আমরা পালাক্রমে মিরপুর আসছিলাম ইনভেস্টিগেশন করার জন্য কার এতো বড় সাহস যে কিনা পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়ে রেখেছে। আমার সাথে অনেকের কথা হল তারা বলছে- না হামারা বাংলাদেশ বানায়া, ইনকো দোবারা পাকিস্তান বানায়েগা। এই যে তাদের এতো দম্ভ কারণ তাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র মজুদ ছিল। কিন্তু আমরা তখন তা বুঝতে পারি নি।

    আমি যখন এক থেকে ১১ নাম্বার ১২ নাম্বার ঘুরে এই ইদগাও কাছে আসার সাথে সাথে চর্তুদিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়ে গেল। আমি যে জিপে ছিলাম তা উল্টে যায়। ওখানে আগ থেকেই বাংকার ছিল। আমরাও তাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দিই কারণ আমাদের কাছেও অস্ত্র ছিল। কিন্তু আমরা টিকতে পারলাম না। সে যুদ্ধে রফিক মারা গেল। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে সাংবাদিকদের বলেছিলেন- আর শহিদ নয় এবার গাজী হয়ে বাঁচব।

    এই রফিকের লাশ নিয়ে গেলাম গণভবনে। খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু ছুটে আসলেন। বঙ্গবন্ধু আশ্চর্য হয়ে গেলেন। আমরা তখন বললাম- আমরা রফিকের মা কে কী জবাব দেব? আপনি বলেছিলেন; আর শহিদ নয় এবার গাজী হয়ে বাঁচব।
    উনি তখন ঘাবড়িয়ে গিয়ে সেনা বাহিনীর প্রধানকে খবর দিলেন সাথে খালেক মোশারফকেও খবর দিলেন। এবং আদেশ করলেন যতদ্রুত সম্ভব মিরপুর মুক্ত কর। কিন্তু কী দেখলাম! এদের যে দূর্গ এদের যে অস্ত্র-শস্ত্র। এদের কাছে মনে হয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিন কোম্পানি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আর অসংখ্য বাঙালিরা আন্দন উল্লামে মিরপুরে ঢুকেছিল তারা প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারে নি। তাদের শরীরের এক টুকরা মাংস পর্যন্ত আনা সম্ভব হয় নি। এই মিরপুর ৩১ জানুয়ারি মুক্ত হল। এখন প্রশ্ন; এই স্বাধীন বাঙলার মাটিতে এই জহির রায়হানকে জীবন দিতে হল, এখানে জীবন দিতে হল লেফ্যানেন্ট সেলিমকে এছাড়াও অসংখ্য বাঙালি পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। বাবা-মা, ভাই-বোনকে সবাইকে টুকরা টুকরা করল। তোরাব আলীর মায়ের বয়স ছিল ৯০ বছর এই পরিবারকেও নির্মমভাবে খুন করেছে। বাড়ি বাড়িতে গিয়ে তারা খুন করেছে। আমাদের বন্ধু মতিউর রহামানকে কসাইয়ের খাটে রেখে টুকরা টুকরা করেছে। মতিন চৌধুরীর এক আত্মীয় সে পাগল ছিল তাকেও বাদ দেয় নি তারা। তাকেও টুকরা টুকরা করেছে। ডেকোরেটর নুর হোসেন যে কিনা সত্তরে বিশাল নৌকা উপহার দিয়েছিল পেন্ডেল করে। তারা তার শ্বশুরকে জবাই করল তার শালাকেও জবাই করল। আজকের ট্রাইব্যুনালে আমি বিবেকের তাড়নায় সাক্ষী দিলাম। আমি সাক্ষী দেওয়ার সময়ও আঘাত প্রাপ্ত হলাম যাতে আমি সাক্ষী দিতে না পারি। আমার পা দিয়ে রক্ত ঝড়ছে তারপরও আমি আদালতে আসলাম সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য। এই যে পাশেই কিশোরগঞ্জ মেডিক্যাল সেন্টার সেখানে আপনারা জিজ্ঞেস করতে পারেন সেখানে ডাক্তার আমাকে বার বার সর্তক করে দিচ্ছে যে; আপনার দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া উচিত তা না হলে আপনাকে বাঁচানো যাবে না, আপনার পা কেটে ফেলতে হতে পারে। আপনি ডায়াবেটিসের রোগী । সাক্ষ্য শেয় হওয়ার পর, জেরা শেষ হবার সাথে সাথে ঐ রাতেই আমি সুইজারল্যান্ডে চলে গেলাম আর ওখানেই চিকিৎসা করালাম।

    এই যে বিশাল মিরপুর; এটার একটি অংশের ইনভেসটিগেশান হল কিন্তু আরেক অংশেও যে হত্যা হল কিন্তু ট্র্যাইব্রুনালে ঐ অংশকে উপেক্ষা করে কেন যে তার তদন্ত শেষ করল তা আমার বোধে আসে নি।

    প্রশ্ন- কাদের মোল্লা ছাড়া আর কাদেরকে চেনেন যারা সরাসরি হত্যায় জড়িত ছিল?

    মামা- তোরাব আলীর বাসা ছিল আমার আগের বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের পথ। তোরাব আলীর পরিবার ছিল একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ছিল তা মিরপুরের সবাই জানত। আমি বিনীত ভাবে বলে আসছিলাম তোরাব আলীর ছেলে যে কিনা তখন ছোট ছিল কিন্তু এখন সে তার পরিবার হত্যার বিচার চায়। কিন্তু কোন অদৃশ্যের হাতের কারণে তাকে ট্র্যাইব্যুনালে সাক্ষী করা হল না তা আমার জানা নেই। এই জবাব কে দেবে? কেরানীগঞ্জে এই মামলার কন্টিনিউশন দরকার ছিল না। সমগ্র মিরপুরে কাদের মোল্লা জল্লাদের হত্যালীলা, হাক্কা গুণ্ডা, হাশেম, হাশমির, নেহাল, হাশেম চ্যায়ারম্যান এই যে আব্বাসরা যে তাণ্ডব চালাল কিন্তু আজকে দুঃখ হয় তাই বিবেকের তাড়নায় সাক্ষী দিয়ে গেলাম, দৃঢ়তার সাথে দিয়ে গেলাম, সাহসের সাথে দিয়ে গেলাম এই সাক্ষ্য। তাদের কোন এডভোকেট আমাকে কাবু করতে পারে নি।

    প্রশ্ন- আপনি কার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন? অভিযোগগুলো কী কী ছিল?

    মামা- বর্তমান ট্রাইব্যুনাল আমাদের জনগণের দাবী ছিল। গত নির্বাচনে বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা জয়ী হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে। সেই ধারাবাহিকতায় এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হল এবং এই ট্রাইব্রুনালে আমি কাদের মোল্লা বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়ে দিলাম এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এই খুন-খারাবি, হত্যা, নির্যাতন, অগ্নি সংযোগ যা দেখেছিলাম তাই আমি বিজ্ঞ বিচারপতিদের কাছে উপস্থাপন করি। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো ছিল- হত্যা, লণ্ঠন, ধর্ষণ, ভয়-ভীতি সকল অভিযোগই ছিল এই কসাই মোল্লা বিরুদ্ধে।

    প্রশ্ন- কাদের মোল্লার রায়ে আপনার অভিমত কী?

    মামা- বুক ভরা আসা নিয়ে সুইডেন থেকে আসছিলাম। অন্তত আমি ন্যায় বিচার পাব। যারা মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে, গণহত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ন্যায় বিচার পাব আদালত থেকে। ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ নেই। আমার অভিযোগ হচ্ছে রায়ের বিরুদ্ধে। যে রায় সারা দেশবাসীকে নাড়া দিল। প্রত্যাশিত এই রায়ে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হল না। আমার সাথে অনেক তরুণদের সাথে আদালত চত্ত্বরে দেখা হল, মিডিয়ার সাথে দেখা হল; তাদের সবাইকে আমি বলেছি Universal truth- যা আমাকে বেদনার সাথে বলতে হচ্ছে- Justice delay justice deny .

    প্রশ্ন- আপনি কী কাদের মোল্লাকে সরাসরি এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে দেখেছিলেন?

    মামা- আর্ন্তজাতিক মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালে আমি যে সাক্ষ্য দিলাম রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষ হয়ে। তার যত খুন হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, ভয়-ভীতি সব কিছুই দেখেছি সত্তরের নির্বাচন থেকে এবং দৃঢ়তার সাথে সাহসের সাথে আমি আদালতকে সব কিছু বলেছি। এবং সাক্ষ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে তার মৃত্যুদণ্ড হাওয়া বাঞ্চনীয় ছিল। আমি মিডিয়ার কাছে বলেছি- পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসির হুকুর ছিল। সে অস্ত্র দিয়ে কাউকে গুলি করে নি। সে হুকুমের আসামী হয়েছিল। আর সেই হিসেবেই তার শাস্তি হল। অন্য দিকে জল্লাদ কাদের মোল্লার এতো হত্যা লুণ্ঠন, কবি মেহেরুন্নেসা থেকে শুরু করে বাঙলা কলেজের ছাত্র শহিদ পল্লব (টুনটুনি) যে ছিলেটি আমাদের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে মিছিলে ছিল তাকেও হত্যা করা হল নির্মম পৌশাচিক ভাবে। তার আঙুল গুলো কেটে দিল হত্যার পর গাছে ঝুলাল। এতো কিছুর পরও কীভাবে আর কী কথা বললে এই কাদের মোল্লার ফাঁসি হতো।

    প্রশ্ন- বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে আপনার কী কোন অভিযোগ বা ক্ষোভ আছে? জামাত-শিবির সর্ম্পকে আপনার মতামত যদি একটু জানান।

    মামা- আজকের কাদের মোল্লারা পাকিস্তানী খান সেনাদের; রাজাকার, আলবদর, জামাতী ইসলামী ও বদর বাহিনী গ্রেজেট নটিফিকেশনের মাধ্যমে তাদেরকে সেনা বাহিনীতে যোগ করে নেওয়া হয়েছে। এই কাদের মোল্লা, মতিউর রহমান নিজামীরা পাকিস্তানী খান সেনাদের মতন- রেশন, খাদ্য, চিকিৎসা যা ছিল সবাই কিন্তু তারাও ভোগ করেছিল গ্রেজেট নটিফিকেশনের মাধ্যমে। এই জিনিসটাও তো বলা উচিত ছিল আমাদের রাষ্ট্রপক্ষের উকিলদের। এটাও তো একটা দলিল।

    আপনারা জানেন সংবিধানে জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল, কনভেনশন মুসলীমলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল, কাউন্সিল মুসলিম দল সহ সকল বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এই জিয়াউর রহমান ক্ষমতার মতলবে এসে এদেরকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে দেয়। ৭৩-এ যেসব যুদ্ধপরাধী বন্দি ছিল তাদেরকে রাজবন্দি হিসেবে মুক্তজীবনে ফিরিয়ে আনলেন। তাদের রাজনৈতিক সংগঠন যেটা নিষিদ্ধ ছিল তাদেরকেও রাজনীতি করার অনুমতি দিয়ে দিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় হত্যার পর হত্যা, খুন-খারাবি শুরু হয়েছিল যেসব মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা হারিয়েছি, যারা নামী দামী, যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিল, যারা বিভিন্ন সেক্টর কমেন্ডার ছিল, যারা বীর উত্তম খেতাব নিয়ে ভূষিত তাদেরকে পালাক্রমে হত্যা করা হয়। এই যে কিবরিয়া সাহেব; যিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের একজন বিজ্ঞ কুটনৈতিক ছিলেন। যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিউ ইয়কে জন হ্যারিসনের সাথে কাজ করেছেন মুক্তিযোদ্ধদেরকে সাহায্য করার জন্য। এই স্বাধীন বাঙলার মাটিতে তাকে গ্রেনেট মেরে হত্যা করল। আজ পর্যন্ত আসামীদেরকে শনাক্ত করা হল না, গ্রেফতার করা হল না। তা নিয়ে নাটক চলছে। আমাদের বাঙলা একাডেমিতে ড.হুমায়ুন আজদকে আঘত করা হল। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গিয়েও তাকে ডিজিটাল একশনের কারণে তাকে জীবন দিতে হল প্রবাসে। এখন একুশে আগস্টে বোমা বাজি করল, এতো গুলো গ্রেনেট ছুড়ে মারল। এমনকি গোয়ান্দা বিভাগের লোকেরা এতে সরাসরি জড়িত ছিল- ডি.জি.এফ.আই, এন.এস.আই, স্পেশাল ব্রাঞ্চ। এরাই প্রোটেকশন দিয়ে গ্রেনেড গুলো এখানে ছুড়ে মারল। এতে কারা জীবন দিল? এই আমাদের স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির সৈনিকরা। এখন আমার কথা হচ্ছে; আর কতো লাশ পড়লে সরকারের টনক নড়বে আর কবে জামাত-শিবিরের রাজনীতি বাতিল করবে? এটাই আমার আজকে প্রশ্ন।

    প্রশ্ন- যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কোন দূর্বলতা কী আপনি দেখেন?
    মামা- অবশ্যই। আমি নিজে দেখেছি রাষ্ট্রপক্ষের উকিলদের ভেতরে গ্রুপিং। এমনও দেখেছি কাদের মোল্লার যাবতজীবন কারাদণ্ডে আরেকটা গ্রুপ মুচকি মুচকি হাসছে। আমি তো সেখানে উপস্থিত ছিলাম আর সবার চোখ দেখলেই তো বোঝা যায়। আপনি দেখানেই যান সেখানেই দেখবেন দলদলি এমনকি বারকাউন্সিলেও দলাদলি। রাষ্ট্রপক্ষ কেন বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করল না তা আমি জানি না। যারা ক্রিমিনাল আইনে বিশেষজ্ঞ তারা মাঝে মাঝে টক শো তে আসে অথচ তাদের নিয়োগ করা হল না। যারা হাইকোর্টে প্রেকটিস করছে তাদের কেন এখানে আনা হয়েছে তা আমি বুঝলাম না।
    দুঃখভরা মন নিয়ে সাক্ষ্য দিয়ে গেলাম আবার আদালতের রায় শুনে হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে এখন শাহবাগ চত্ত্বরে আমি আমার সন্তানদের মাঝে আছি। আমি প্রতিদিনই যাচ্চি তাদের সাহস দিচ্ছি আমি বলেছি এই জল্লাদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আমি ফিরে যাচ্ছি না সুইডেনে। শাহবাগের ছেলে-মেয়েরাই আমার সন্তান আর আমি হলাম এদের অভিভাবক।

    প্রশ্ন- এই যে শাহবাগ আন্দোলন। এই যে তরুণদের জাগরণ তা কিন্তু সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে গেছে। এমনকি বিশ্বের যেখানেই বাঙালি আছে সেখানেও তারা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে। তারা তাদের অবস্থান অনুযায়ী প্রতিবাদ করছে। এই যে জাগরণটা এতে কী বাংলাদেশের কোন পরিবর্তন হতে পারে, বাঙালি কী আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে ৭১-এর মতন?

    মামা- ঘুরে দাঁড়াতে পারে না তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে গেছে। পারে আমি বলব না কারণ আমি প্রতিদিনই শাহবাগে সাক্ষী। হাজার হাজার লাখ লাখ লোক আসছে। শিশু কন্যা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ যুবক এমনকি খেটে খাওয়া মানুষজন পর্যন্ত আসছে এই শাহবাগে। যার বয়স আঁশি যার চলার শক্তি নাই তাদেরকে কোলে করে নিয়ে আসছে। রাজনীতিবিদরা যেটা করতে পারে নাই সেটে এই ব্লগের ছেলেরা প্রজন্ম ৭১ সৃষ্টি করে গেছে। তাদের কারণেই সারা বিশ্ব আজ জেগে গেছে। আমি দৃঢ়তার সাথে আবারো বলছি এই শাহবাগে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি; তুই রাজাকার তুই রাজাকার, সারা বাঙলা ঘেরেও কর জামাত-শিবির খতম কর। শাহবাগ আন্দোলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হৃদয়েও দাগ কেটেছে তাৎখনিকভাবে মন্ত্রীপরিষদের মিটিং ডাকা হল, আইন তৈরী করা হল, সংশোধন করা হল। শাহবাগের ধ্বংনি-প্রতিধ্বংনি এই গণভবনকেও কাঁপিয়ে দিল, সংসদকে কাঁপিয়ে দিল এই আমার সূর্য সন্তানরা। ফাঁসি দিতেই হবে এর আগে আমরা রাজপথ ছাড়ব না। তা না হলে সকলে চামড়া আমরা তুলে দেব।

    প্রশ্ন- আন্দোলন সর্ম্পকে আপনার ভাবনা যদি বলতেন।

    মামা- একাত্ততা ঘোষণা পার্লামেন্টে অলরেডি করেছে। তারা সহানাভূতি জানিয়েছে এবং আমরা যে আন্দোলনের যে ঝড় যে তুফান যে আওয়াজ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এমনকি বাংলাদেশ ছেড়ে সারা বিশ্বে সব জায়গায় তারা মাঠে নেমেছে। একি আওয়াজ এই জল্লাদের ফাঁসি চাই। এখন সরকার যদি জেগে জেগে ঘুমায়। প্রতিদিনের এই বিশাল বিশাল জনসমুদ্র দেখে যদি এদের টনক না নড়ে তাহলে এই তরুণরা জানে কীভাবে এদের ঘুম ভাঙাতে হয়। কারণ এই তরুণরা বিরতিহীনভাবে আন্দোলনকে ধরে রেখেছে আমি আশাবাদী আমাদের রাজনীতিবিদরা এদের থেকে শিক্ষা নেবে। মহাজোট বা রাজনৈতিক কোন দল যদি আজ ডাক দিত তাহলে এতো লোক আসত না। দলীয় কর্মীরা আসত কিন্তু দেশবাসী আসত না। আমি আশাবাদী। আমি প্রতিদিন শাহবাগ যাচ্ছি এবং যাব। ফসল ঘরে নিয়েই আমি যাব। যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি ছাড়া এই রায় কেউ মেনে নেবে না। আর এই দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। কেন সরকার প্রথমে বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দিল না? নরমাল উকিল দিয়ে এতো বড় মামলা গুলোকে সরকার পরিচালনা করেছেন। অর্থের অভাব ছিল? আমি জানি না।

    তবে আমার মাঝে মাঝে দুঃখ হয়। এই শাহবাগ সর্ম্পকে বেরিস্টার রফিকুল হক সাহেব যে উক্তি করেছেন তিনি কী ভুলে গেছেন; এই মিরপুরে তার ভাইকে জবাই করেছিল বিহারীরা? হয়তো তিনি ভুলে যেতে পারেন। যদি বিবেকের তাড়নায় জল্লাদের বিপক্ষে ভলিন্টিয়ার হিসেবে যদি দাঁড়াতেন কারণ তার ভাইও এই মিরপুরে জীবন দিয়েছেন। তাই বিজ্ঞ আইনজীবি হিসেবে তিনি ভলেন্টিয়ার হিসেবে সার্ভিস দিতে পারতেন। হয়তো তিনি ভুলে গেছেন। আপন ভাই হোক চাচত ভাই হোক আপনারা জিজ্ঞেস করেন কেউ কী বিহারীদের জীবন দিয়েছিল কিনা?

    প্রশ্ন- বাচ্চু রাজাকার পালিয়ে গেল এ সর্ম্পকে আপনার মতামত?

    মামা- এই যে বাচ্চু রাজাকার পালিয়ে গেল চিন্তা করতে পারেন। আমার প্রশাসন কোথায় ছিল? কোথায় ছিল আমাদের হোম মিনিস্ট্রি? কোথায় ছিল আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ? কেউ নজর রাখে নাই। তিনি ভি.ভি.আই.পি হিসেবে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গেলেন। শত্রু আমাদের মাঝেই আছে প্রতিক্ষণে আমার সজার দৃষ্টি রাখতে হবে। শাহবাগের আন্দোলন যেন কেউ নষ্ট করতে না পারে। ফাঁসি ছাড়া আমি ঘরে ফিরব না। মৃত্যু হলে এখানেই হবে। তবু মাথা নামাবো না। জয় বাঙলা।

    প্রশ্ন- শেষ প্রশ্ন। আপনার একটি অপারেশন সর্ম্পকে যদি এই তরুণ সমাজকে বলে যেতেন।

    মামা- আমাদেরকে যদি ঢাকার অপারেশনে না পাঠাত তাহলে এই কুক্ষাত মোনেম খানকে কেউ মারতে পারত না। মোনেম খানের কোন অকর্স্মাৎ মৃত্যু হয় নাই। আমরা গেরিলারা তাকে হত্যা করি। এছাড়া আরো অনেক জল্লাদকে আমরা হত্যা করি। হোটেল ইন্টারনেশেনাল ইন্টার কন্টিনেন্টাল এখানে বিস্ফোরণের শব্দে পৃথিবীকে জানান দিল যে গেরিলা ওয়ার স্টাটিং।

    সাক্ষাৎকার গ্রহণ-সুব্রত শুভ
    সহযোগিতায়- ফড়িং ক্যামেলিয়া।
    কৃতজ্ঞতা প্রকাশ- রুদ্র সাইফুল।
    ______________________
    http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=33957
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.22 | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১৬:৩৫582879
  • মুক্তিযুদ্ধের ছবি সংকলন, কিশোর পারেখের: "বাংলাদেশ : আ ব্রুটাল বার্থ "
    লিখেছেনঃ আমার ব্লগ গবেষণা
    ___________________________________________________

    আমার ব্লগের জন্ম হয়েছে শুধু মাত্র ১৯৭১ এর চেতনাকে আন্তর্জালে তুলে ধরার জন্য, তা অক্ষুন্ন রাখার জন্য।স্বাধীনতার চেতনার ব্যাপারে আমার ব্লগের কোন আপোষ নেই। আমরা চাই ১৯৭১ এর ইতিহাস আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানুক-জানুক পাক বাহিনীর অত্যাচারের কাহিনী, জানুক আমাদের সুর্য সন্তানদের রুখে দাড়াবার কাহিনী- জানুক আমাদের স্বাধীনতার জন্য কি ধরনের মূল্য চুকোতে হয়েছে।

    আগামী প্রজন্মকে জানাবার চেষ্টায় ''আমার ব্লগ গবেষণা ফাউন্ডেশন '' পাঠকদের উপহার দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময় তোলা ছবি নিয়ে ভারতীয় ফটোগ্রাফার কিশোর পারেখের সেই ক্লাসিক, "বাংলাদেশ : আ ব্রুটাল বার্থ "। ১৯৭১ এর অনেক ইতিহাস হারিয়ে গেছে, অনেক ইতিহাস ভুল ভাবে উপস্হাপন করা হয়েছে, আমার ব্লগের এই উপহার সেই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনবে। ভুল ইতিহাসকে শুদ্ধ করতে সাহায্য করবে।

    কাউসার রুশো'র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধের ছবি যারা তুলেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রশীদ তালুকদার, আনোয়ার হোসেন, মোজাম্মেল হোসেন, মনজুর আলম বেগ, মোহাম্মদ আলম, আফতাব আহমেদ প্রমুখ। এছাড়া ছিলেন ডন ম্যাককালিন, রেইমন্ড ডিপারডন, মার্ক রিবান্ড, ম্যারি অ্যালেন মার্ক, রঘু রাই, মেরিলিন সিলভারস্টোন, কনটাক্ট প্রেসের ডেভিড বার্নেট, ম্যাগনাম ফটোজ-এর ইরানী ফটোগ্রাফার আব্বাস এবং সে সময়ে ঢাকায় দায়িত্বপালনরত বিদেশী ফটোসাংবাদিকরা। কিন্তু তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেছিলেন। মাত্র ৮ দিনে তাঁর তোলা ৬৭টি ছবি মুক্তিযুদ্ধের এক অসামান্য দলিল হয়ে আছে। তিনি কিশোর পারেখ।

    কিশোরের জন্ম ১৯৩০ সালে। ভারতে । ১৯৫৬ সালে ২৬ বছরের কিশোর যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় ভর্তি হন তার প্রিয় বিষয় ফিল্মে। ফিল্ম নিয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি ঝুঁকে পড়েন ফটোগ্রাফিতে। কিশোর লাইফ ম্যাগাজিন এবং ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ফটোগ্রাফার্স অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি কনটেস্টে সাতটি ক্যাটেগরির মধ্যে ছয়টিতে পুরষ্কার জিতে নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সর্বপ্রথম লাইম লাইটে আসেন।

    ১৯৬১ সালে শিক্ষা শেষে মাতৃভূমিতে ফিরে এসে তিনি চেষ্টা করেন তাঁর মেধা বম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজে লাগাতে। কিশোরের ধারণা ছিল দেশে আসার পরপরই বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তাকে লুফে নেবে। কিন্তু তা হয়নি। তবে ভারতের প্রভাবশালী বিড়ালা পরিবার কিশোরের মেধা দেখে তাঁকে কাজের সুযোগ করে দেন। কিশোর যোগ দেন তাদের পত্রিকা দ্য হিন্দুস্তান টাইমসের চিফ ফটোগ্রাফার হিসেবে। এর পর ছয় বছর কিশোর কাজ করেন ফটো জার্নালিস্ট হিসেবে। বদলে দেন ইনডিয়ান প্রেস ফটোগ্রাফির চেহারা। '৬১ থেকে '৬৭ সালকে বলা হয় ইনডিয়ান প্রেস ফটেগ্রাফির স্বর্ণযুগ। কিশোর ফটো রিপোর্টের গোটা ফরম্যাটই পাল্টে দেন। ডকুমেন্টেশন বাদ দিয়ে তিনি চলে যান সাবজেক্টের গভীরে। বিহারের দূর্ভিক্ষ কভার করতে গিয়ে তিনি তাঁর মেধার পূর্নাঙ্গ প্রতিফলন ঘটান। জওহরলাল নেহেরুর জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে প্রাঞ্জল ডকুমেন্টেশন কিশোরের ছবি। নেহেরুর মৃত্যুর পর কিশোর পারেখের প্রদর্শনী ভারতীয়দের জন্য হয়ে ওঠে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা জানানোর স্থান।

    ৬৭ সালের পর কিশোর পারেখ ফটো জার্নালিজম ছেড়ে দেন। চলে যান সিঙ্গাপুর ও হংকং-এ। যোগ দেন দ্য এশিয়া ম্যাগাজিনে। সেখানে তিনি এক্সক্লুসিভ কিছু ফটো সিরিজ করেন । এরপর তিনি কাজ করেন দ্য প্যাসিফিক ম্যাগাজিন লিমিটেডে। সেখানে ছিলেন ফটো এডিটর।

    মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কিশোর যখন ট্রাভেল এবং ফ্যাশন ফটোগ্রাফিতে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসবেন। দ্রুত ৪০ রোল ফিল্ম যোগাড় করে তিনি ভারতে চলে আসেন। এক বন্ধু তাকে পৌছে দেয় বর্ডারে। জোর করে তিনি ৮ ডিসেম্বর ঢুকে পড়েন প্রেস হেলিকপ্টারে। কিশোর ১৬ তারিখ বিজয় অর্জন পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিলেন । এরপর ফিরে গিয়ে টানা তিন দিন তিন রাত ফিল্ম ডেভেলপ করেন আর ৬৭টি সফল ফটোগ্রাফ নিয়ে বের হন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত কম সময়ে এত সফল ফটোগ্রাফি আর কেউ করতে পারেননি । এ ছবিগুলো নিয়েই তিনি বাংলাদেশ : আ ব্রুটাল বার্থ নামে একটি ফটোগ্রাফি বই প্রকাশ করেন। ভারত সরকার তাঁর ছবি দেখে বইটির ২০ হাজার কপি অর্ডার দেন।

    মুক্তিযুদ্ধের পর কিশোর ফিরে যান কমার্শিয়াল ফটোগ্রাফির পেশায়। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আর ফিরেননি প্রেস ফটেগ্রাফিতে। সারা জীবন তিনি লড়াই করেছেন ফটো সাংবাদিকতাকে সামনে আনার জন্য। নিজের কাজ করে গেছেন যে কোন মূল্যে। কথিত আছে ফটোগ্রাফারের ভূমিকা পালনকালে নেহেরু জেদি পারেখকে চড় মেরেছিলেন ।

    ১৯৮২ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে হিমালয় পর্বতে ছবি তোলার সময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এ অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন শিল্পী।

    মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সমব্যথি এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এভাবে ফ্রেমবন্দী করে রাখার জন্য কিশোর পারেখকে স্যালুট। জয় বাংলা ।

    ।।।।। ডাউনলোড লিংক ।।।।।

    বিশেষ নোট: আমার ব্লগ গবেষণা ফাউন্ডেশন এর হাতে যে বইটি আছে , সেটি খুব পুরনো। আমরা চেষ্টা করছি ভালো নতুন প্রিন্ট সংগ্রহ করতে।
    ________________
    http://www.amarblog.com/research/posts/136308
  • debu | 180.213.132.253 | ০২ মার্চ ২০১৩ ০৪:২৩582880
  • যা দেখেছি তা লিখেছি
    বাংলা দেশের লোকেরা মারতে পারেনি রাজাকার দের( অল্পোসসোল্পো হবে) ।indian soldier রাই রাজাকারদের মেরে ছিলো, এরেস্ট করে ছিলো ৪০০০০ এর বেশি
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ১৮:৩৯582882
  • "অগ্নিঝরা মার্চ
    জে. ইয়াহিয়ার একতরফা ঘোষণায় জনতা ফেটে পড়ে
    তোফায়েল আহমেদ

    শুরু হলো অগ্নিঝরা মার্চ। ১৯৭১ সালে এই মাসটি বাংলার মানুষের গর্বের মাস। এ মাসের ২৬ তারিখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বাঙালি জাতি তাদের রুখে দাঁড়ায়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর ৯ মাস রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করি আমরা। কিন্তু এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরুর আগে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে। সত্তরে ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের মধ্যেও নির্বাচনের কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়েছে বাঙালি জাতিকে। দুর্ভাগ্য, নির্বাচনে জেতার পরও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। অবশেষে আন্দোলন ও যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে।
    সত্তরের নির্বাচনের আগে আইয়ুব খানের পতনের পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা নিলেন। তখন সামরিক শাসনের মধ্যে 'লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার' তথা সংক্ষেপে এলএফও জারি করা হলো এবং এই এলএফওর অধীনেই বঙ্গবন্ধুকে সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনের কঠিন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হলো। নির্বাচনে বাংলার মানুষ ছয় দফার পক্ষে এক ঐতিহাসিক গণরায় প্রদান করে। নির্বাচনী ফলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে বাঙালিদের জন্য সংরক্ষিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের ২৮৮টিতে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু নির্বাচনী ফল ঘোষণার পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু নবনির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে শপথবাক্য পাঠ করান। সেদিন বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেন, 'ছয় দফা আজ আমার বা আমার দলের নয়; ছয় দফা আজ বাংলার মানুষের সম্পদে পরিণত হয়েছে। যদি কেউ এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে।'
    এরপর জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি বৈঠকের পর বৈঠক চলে। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেন ১২ ও ১৩ জানুয়ারি। পরে পিপলস পার্টি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোও ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেন ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার এক গভীর ষড়যন্ত্রও শুরু করেন ইয়াহিয়া। আর তিনি ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করেন ভুট্টোকে।
    ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা অনুযায়ী বাংলার মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য ১৯৭১-এর ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়া খান তাঁর ভাষণে বলেন, 'আমি আমাদের জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের তারিখ ৩ মার্চ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলাম। বিগত কয়েক সপ্তাহে অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাকে দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, ঐকমত্যে পৌঁছবার পরিবর্তে আমাদের কোন কোন নেতা অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। ...সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, অর্থাৎ পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া ভারত কর্তৃক সৃষ্ট সাধারণ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সার্বিক অবস্থাকে আরো জটিল করে তুলেছে। অতএব আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান পরবর্তী কোন তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।' সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু মুজিবের সঙ্গে কোনোরূপ আলোচনা ব্যতিরেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক একতরফাভাবে ঘোষিত এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
    এদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ছয় দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয়ে স্লোগানে স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তুলছিল। তখন বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারা দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত। পেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনব। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।' পরে এক সংবাদ সম্মেলনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রাথমিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং বলেন, ৬ মার্চ পর্যন্ত সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল আর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। বিকেল ৩টায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পল্টন ময়দানের স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় যোগদান করি। সেখানে আমি আমার বক্তৃতায় বলি, 'আর ৬ দফা ও ১১ দফা নয়। এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবে। আর এই ১ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আজ আমরাও শপথ নিলাম-বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।' শতসহস্র মিছিলে জনসমুদ্রে পরিণত হলো পল্টন ময়দান। প্রতিবাদ সভায় আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশমতো আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশ পেয়ে ছাত্রলীগ নেতারা সর্বজনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন এক বৈঠকে বিকেলে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে 'স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে। একমাত্র ছাত্রলীগ নেতারাই সব ধরনের ঝুঁকির মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেন।"

    http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&archiev=yes&arch_date=01-03-2013&type=gold&data=news&pub_no=1168&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=13#.UTc8L6LcoSs
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ১৮:৪২582883
  • "অগ্নিঝরা মার্চ
    উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা
    তোফায়েল আহমেদ

    ষড়যন্ত্র তখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ১৯৭১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সম্ভবত এর আগে ১৭ জানুয়ারি লারকানা বৈঠক এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকে বাঙালি হত্যার চক্রান্ত ও নীলনকশা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। পিন্ডি থেকে করাচি ফিরে গিয়ে ভুট্টো স্পষ্ট জানিয়ে দেন, 'জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই।' ক্রমেই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে পাকিস্তানের সামরিকচক্র সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির অকুণ্ঠ রায়কে বানচাল করার জন্য ভুট্টোকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করছে এবং ভুট্টো নিজেও সানন্দে ব্যবহৃত হচ্ছেন। এর ফলশ্রুতিতেই ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের ডাকা
    অধিবেশন স্থগিত করেন, যার প্রতিবাদে পরদিন হরতাল ডাকেন বঙ্গবন্ধু।
    আজ ২ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় এবং তাঁর নির্দেশে সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এ পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন। পরে এ পতাকা নিয়ে আন্দোলিত রাজপথ মুখর হয়ে ওঠে স্লোগানে স্লোগানে- 'জাগো জাগো, বাঙালি জাগো'; 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা'; 'স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব'; 'বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে'; 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি'; 'তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ'; 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো'; 'পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা'; 'পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা'; 'ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'; 'স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ছাত্রনেতাদের বিশাল একটি মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে সমবেত হয়। এদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে দুজন প্রাণ হারান। সংবাদ পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন এবং ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে অর্ধদিবস হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
    সামরিক কর্তৃপক্ষ সান্ধ্য আইন জারি করলে জনতা তা অমান্য করে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর কুশপুত্তলিকা দাহ করে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং সেনাবাহিনী বিনা উসকানিতে গুলিবর্ষণ করলে নগরীর বিভিন্ন স্থানে মিছিল সহিংস হয়ে ওঠে।
    এদিন হরতালে আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রগতিশীল সংগঠনগুলো স্বতঃস্ফূর্ত হরতালে অংশ নেয়। তাদের পক্ষ থেকেও নানা কর্মসূচি পালন করা হয়।"

    http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&archiev=yes&arch_date=02-03-2013&type=gold&data=news&pub_no=1169&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=11#.UTc-SaLcoSs
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ১৮:৪৪582884
  • "অগ্নিঝরা মার্চ
    ইশতেহার পাঠ ও জাতীয় সংগীত ঘোষণা করা হয়
    তোফায়েল আহমেদ

    আজ ৩ মার্চ। জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পর মার্চের এ দিনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হয়ে চলেছে। ইয়াহিয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ব্যবহার করে বাংলার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন তা যেমন স্পষ্ট, তেমনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এ দেশের মানুষও স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে।
    এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুও কঠোর অবস্থান নেন। এর আগেই আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধু চক্রান্তকারীদের হুঁশিয়ার করে দেন, 'ফ্যাসিস্ট পন্থা পরিহার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরুর শাসন মেনে নিয়ে দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখুন। জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা বানচাল করবেন না। গণতান্ত্রিক রায় নস্যাৎ করার মতো আগুন নিয়ে খেলবেন না।' তিনি আরো বলেন, 'দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দেওয়া অধিকারবলে আমরা ছয় দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করব। সাত কোটি বাঙালির বুকে মেশিনগান বসিয়েও কেউ ঠেকাতে পার বা না।'
    মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই মানসিকভাবে একটি প্রস্তুতি চলছে। তার ধারাবাহিকতায় এ দিন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হয়। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। ইশতেহারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ নাথ ঠাকুর রচিত 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটিকে জাতীয় সংগীত নির্বাচিত করা হয়। লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ অনুষ্ঠানটি ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য দিন। এ দিনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তাঁর বক্তৃতায় অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি করেন। আর জনতার উদ্দেশে অফিস-আদালত বন্ধ রেখে, খাজনা-ট্যাঙ্ না দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ দিনের ঐতিহাসিক সভায় আমার বক্তৃতায়ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের প্রতিধ্বনি করে কর্মসূচি সফল করতে দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই। এ দিন বাংলার মাটি শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিতে ৭১ জন নিহত হন। সারা দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।"
    http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&archiev=yes&arch_date=03-03-2013&type=gold&data=news&pub_no=1170&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=12#.UTc_E6LcoSs
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ১৯:০২582885
  • "অগ্নিঝরা মার্চ
    বাংলায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালিত হতে থাকে
    তোফায়েল আহমেদ

    ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ। পরিস্থিতি দিন দিন পাল্টাতে থাকে। পাকিস্তানি সামরিক শাসকের নিয়ন্ত্রণ যতই হাল্কা হয়, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ততই পালিত হতে থাকে। মূলত বাংলা তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চলছে। পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের মুখে বঙ্গবন্ধু অনমনীয় মনোভাব পোষণ করেন। আপস নয়- এমন মনোভাব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশও পরিচালিত হতে থাকে তাঁর নির্দেশে। বঙ্গবন্ধু যেভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন, দেশের মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। আজ ৪ মার্চ, এই দিনে বঙ্গবন্ধুর ডাকে আধা বেলা হরতাল পালন করা হয়। পাশাপাশি পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান সারা দেশে কারফিউ জারি করেন। হরতাল ও কারফিউ মিলে দেশে তখন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করে।
    বাঙালিরা পাকিস্তানি সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছেন। এই দিনও বঙ্গবন্ধু ঘোষিত পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় সাময়িকভাবে কারফিউ তুলে নেওয়া হলেও চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুরে তা বলবৎ থাকে। খুলনায় হরতাল পালনকালে নিরস্ত্র জনতার ওপর সেনাবাহিনীর বিক্ষিপ্ত গুলীবর্ষণে ছয়জন নিহত হয় ও ২২ জন আহত হয়। চট্টগ্রামে এই দিনও সেনাবাহিনীর গুলিতে দুই দিন মিলে সর্বমোট ১২০ জন নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হয়। সারা দেশে আহতদের সুচিকিৎসার্থে বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে শত সহস্র মানুষ লাইন দিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে। ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
    এ রকম উত্তাল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে আওয়ামী লীগের এক মুলতবি সভায় ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে সংগ্রামের নতুন দিক-নির্দেশনায় বলেন, 'আজ আওয়ামী লীগ নয়, গোটা বাঙালি জাতিই অগ্নি-পরীক্ষার সম্মুখীন। আমাদের সামনে আজ দুটো পথ খোলা আছে। একটি সর্বাত্মক ত্যাগ স্বীকারের জন্য নিজেদের মনোবল অটুট রেখে অবিচলভাবে পূর্ণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া। অথবা ভুট্টো-ইয়াহিয়ার কথামতো সবকিছু মেনে নেওয়া।' নিজের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আপনারা জানেন, আমি সারা জীবন ক্ষমতার মসনদ তুচ্ছ জ্ঞান করে দেশ ও জাতির কাছে আমার জীবন মর্টগেজ রেখেছি। বাংলার মানুষ গুলি খেয়ে বন্দুকের নলের কাছে বুক পেতে দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে আমাকে মুক্ত করে এনেছে। আমার ছয় দফা কর্মসূচির প্রতি ম্যান্ডেট দিয়েছে। এখন শহীদের পবিত্র আত্মত্যাগের প্রতি অশ্রদ্ধা জানিয়ে পাকিস্তানিদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে অবমাননাকর শর্তে কী করে ক্ষমতায় যাই।' এরপর বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের মধ্যে সারা দেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাঠামো তৈরির নির্দেশ দেন। এই দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের নতুন নামকরণ করেন, 'ঢাকা বেতার কেন্দ্র'। পাকিস্তান টেলিভিশনের নাম পাল্টে 'ঢাকা টেলিভিশন' নাম দিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতে থাকে।"
    http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&archiev=yes&arch_date=04-03-2013&type=gold&data=news&pub_no=1171&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=15#.UTdC86LcoSs
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ১৯:০৪582886
  • "অগ্নিঝরা মার্চ
    গণবিস্ফোরণ ঠেকাতে ৯ জনকে হত্যা করে সেনাবাহিনী
    তোফায়েল আহমেদ

    পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমেই গণবিস্ফোরণে রূপ নিচ্ছে। আন্দোলনে দিশাহারা স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া হত্যার মাধ্যমে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বাঙালিদের হত্যা করছে। আজও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে টঙ্গীতে ৬, খুলনা ২ ও রাজশাহীতে একজন মারা যায়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। অবস্থা অনুধাবন করে তাহরিক-ই-ইশতিকলাল পার্টির প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আসগর খান পাকিস্তানের সংহতি বিপন্ন মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান।
    আজ ৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এ দিনে সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। হরতালের পক্ষে বাঙালি জাতি রাস্তায় নেমে আসে। সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয় টঙ্গীতে। খুলনা ও রাজশাহীতেও বড় সমাবেশ হয়। টঙ্গীতে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে হরতালের সমর্থনে রাস্তায় নেমে আসে এবং বিক্ষোভ-সমাবেশ করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মিছিলে গুলি করলে ছয়জন প্রাণ হারান। আহত হন ৩৫ জন। খুলনা ও রাজশাহীতেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গুলি চালায়। ফলে খুলনায় দুজন এবং রাজশাহীতে আরো একজন নিহত হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে অনেক লোক আহত হয়।
    এ ঘটনার প্রতিবাদে বিকেলে আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে এক বিশাল লাঠি মিছিল বের হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে ব্যাংকিং লেনদেনের ওপর নূতন নির্দেশ দেওয়া হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এ দিন চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট ও দেশের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরেন। যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আওয়ামী লীগ একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে। এ দিন তাহরিক-ই-ইশতিকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান পাকিস্তানের সংহতি বিপন্ন উল্লেখ করে অবিলম্বে শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান।"
    http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&archiev=yes&arch_date=05-03-2013&type=gold&data=news&pub_no=1172&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=9#.UTdDpaLcoSs
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ১৯:০৬582887
  • "অগ্নিঝরা মার্চ
    কসাই টিক্কা খানকে গভর্নর নিয়োগ দেন ইয়াহিয়া
    তোফায়েল আহমেদ

    আজ ৬ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে সারা দেশে ষষ্ঠ দিনের মতো সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বিগত কয়েক দিনে সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সংগ্রামী বাংলা সভা-সমাবেশ ও মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে। সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে আসে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হতে থাকে। হরতাল চলাকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙে ৩৪১ জন কারাবন্দি পালিয়ে যায়। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে সাতজন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়।
    জেনারেল ইয়াহিয়া এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও 'খ' অঞ্চলের সামরিক শাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে সরিয়ে 'বেলুচিস্তানের কসাই'খ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে উভয় পদে নিয়োগের ঘোষণা দেন।
    গত কয়েক দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলার জনগণকে দায়ী করে জেনারেল ইয়াহিয়া এদিন বেতার ভাষণও দেন। আগের দিন ৫ মার্চ ইয়াহিয়া ও জুলফিকার আলী ভুট্টো পাঁচ ঘণ্টা গোপন বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে তাঁরা যে খসড়া তৈরি করেছিলেন, বক্তৃতায় সেটিই প্রতিফলিত হয়। ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে বেতার ভাষণে বলেন, 'যা-ই ঘটুক না কেন, যত দিন পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাঁর হুকুমে থাকবে এবং যত দিন তিনি রাষ্ট্রপ্রধান আছেন, তত দিন তিনি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্তানের সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করবেন।' ইয়াহিয়ার ভাষণের পর পরই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়ার্কিং কমিটির যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণের প্রতিবাদে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ কয়েকটি স্থানে স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল হয়।
    এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, 'পরিস্থিতি রক্ষা করার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। বাকি বিষয় আগামীকাল শেখ মুজিবের বক্তৃতায় জানতে পারবেন।' কার্যত সারা দেশের মানুষ এদিন থেকে অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে যে আগামীকাল ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে পরবর্তী কী দিকনির্দেশনা আসে। এদিন আমি এক বিবৃতিতে ৭ মার্চের ভাষণ রেসকোর্স থেকে সরাসরি প্রচারের জন্য ঢাকা বেতারকেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানাই। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতালের পর দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ব্যাংক খোলা রাখা হয় এবং যেসব অফিসে বেতন দেওয়া হয়নি তাদের বেতন প্রদান করা হয়।"
    http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&archiev=yes&arch_date=06-03-2013&type=gold&data=news&pub_no=1173&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=9#.UTdEG6LcoSs
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ১৯:৩০582888
  • NOTE: তোফায়েল আহমেদ সর্ম্পকে কয়েকটি তথ্য:
    _____________________________________

    # ১৯৬৬-৬৭ মেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) নির্বাচিত সহ-সভাপতি (ভিপি) ছিলেন। ১৯৬৮-৬৯-এ গণজাগরণ ও ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন তিনি ডাকসুর ভিপি হিসেবে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জতীয় পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয় লাভ করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধে তিনি মুজিব বাহিনীর অঞ্চল ভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত চার প্রধানের একজন ছিলেন।

    #১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তীতে ১৪ জানুয়ারী ১৯৭২ তারিখে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সচিবের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করেন। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন তিনি শেখ হাসিনা সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

    http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%A4%E0%A7%8B%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%87%E0%A6%B2_%E0%A6%86%E0%A6%B9%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%A6

    # মুক্তিযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট বিরোধী "মুজিব বাহিনী"র অন্যতম নেতা; যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বিদ্রোহ দমনে গঠিত বিশেষ সরকারি বাহিনী "রক্ষী বাহিনী"র ও অন্যতম প্রধান ছিলেন তোফায়েল আহমেদ।

    http://en.wikipedia.org/wiki/Jatiyo_Rakkhi_Bahini
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ১৯:৩৩582889
  • সিরাজুল আলম খান
    উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

    সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ছাত্র নেতা।

    সিরাজুল আলম খান মেধাবী ছাত্র হিসাবে শিক্ষায়তনে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৩-’৬৪ এবং ১৯৬৪-’৬৫ এই দুই বছর তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি বাঙালির ‘জাতীয় রাষ্ট্র’ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষে ১৯৬২ সনে গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন। নিউক্লিয়াস ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নমেও পরিচিত। এই উদ্যোগে তাঁর প্রধান সহকর্মী ছিলেন আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ।

    ১৯৬২-’৭১ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, ৬-দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলন, ১১-দফা আন্দোলন পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করে এই ‘নিউক্লিয়াস’। আন্দোলনের এক পর্যযে গড়ে তোলা হয় ‘নিউক্লিয়াসে’র রাজনৈতিক উইং বি.এল.এফ এবং সামরিক ‘জয় বাংলা বাহিনী’। স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে ‘জয় বাংলা’ সহ সকল স্লোগান নির্ধারণ এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে “...এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” বাক্যসমূহের সংযোজনের কৃতিত্ব ‘নিউক্লিয়াসে’র। এইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিরাজুল আলম খানের ভুমিকা ছিল মুখ্য। ’৬৯-’৭০ সনে গন-আন্দোলনের চাপে ভেঙে পড়া পাকিস্তানী শাসনের সমান্তরালে ‘নিউক্লিয়াসে’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠন করা হয় ছাত্র-ব্রিগেড, যুব-ব্রিগেড, শ্রমিক-ব্রিগেড, নারী-ব্রিগেড, কৃষক-ব্রিগেড, সার্জেন্ট জহুর বাহিনী। এদের সদস্যরাএ ভেঙ্গে পডা পাকিস্তানী শাসনের পরিবর্তে যানবাহন চলাচল, ট্রেন-স্টীমার চালু রাখা, শিল্প-কারখানা উৎপাদন আব্যাহত রাখা এবং থানা পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খ্লা রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করে। নিউক্লিয়াসের সদস্যদের দ্বারা এইসব দূরুহ কাজ সাম্পাদনের জন্য কৌশল ও পরিকল্পনাও ‘নিউক্লিয়াসে’র। ১৯৭০-’৭১ সন নাগাদ বি.এল.ইফ এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজারে। এদের প্রত্যেকেই মুক্তি্যুদ্ধ চলাকালে উন্নত সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত হন এবং ‘মুজিব বাহিনী’ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্হ ১১টি সেক্টরের পাশাপাশি ৪টি সেক্টরের বিভক্ত করে বি.এল.এফ-এর সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা ও কৌশল ছিল কেবল ভিন্ন ধরনের নয়, অনেক উন্নতমানের এবং বিজ্ঞানসম্মত। বি.এল.এফ-এর চার প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক, আব্দুর রাজ্জক এবং তোফায়েল আহমেদ। ১৯৭১ সনের ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় উদ্বোধনী সভা স্হগিত ঘোষণার পর পরই ২রা মার্চ বাংলাদেশর প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণসহ ৩রা মার্চ ‘স্বাধীন বাংলার ইশ্‌তেহার’ ঘোশণার পরিকল্পনাও ‘নিউক্লিয়াসে’র। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে এই দুটি কাজ ছিলো প্রথম দিকনির্দেশনা। আর এই দুই গুরুদায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে আ স ম আবদূর রব এবং সাজাহান সিরাজ। ১৯৭০ সনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের নির্বাচিত করার দায়িত্ব পালন করে বি.এল.এফ। নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণ-আন্দোলনে গড়ে ওঠা জনমতকে সাংবিধানিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গণরায়ে পরিণত করার এই কৌশলও নির্ধারণ করে বি.এল.এফ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সানন্দে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেন। আন্দোলন, নির্বাচন, সমান্তরাল প্রশাসন এবং আসন্ন সশস্ত্র সংগ্রামকে হিসাবে নিয়ে বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তোলার কৃতিত্ব সিরাজুল আলম খানের।

    ১৯৭১ সনে স্বাধীনতার পর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ ও চরিত্র বদলে যায়। গড়ে ওঠে একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ১৯৭৫ সনের ৭ই নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘সিপাহী জনতার গণ-অভ্যুত্থান’ বাঙ্গালির জাতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। জাসদ গঠন এবং ‘সিপাহী জনতার গণ-অভ্যুত্থান’ এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আর এই দুটি বৃহৎ ঘটনার নায়ক ছিলেন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব এবং কর্ণেল আবু তাহের।

    সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় ৭ বছর কারাভোগ করেন। সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেল জীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজ বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে উঠে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৬-’৯৭ সনে। আর্থ-সামাজিক বিশেষনে সিরাজুল আলম খানের তাত্বিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়। মার্কসীয় ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে’র আলোকে বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসাবে বিভক্ত করে ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক’ মডেল হাজির করেছেন সিরাজুল আলম খান। চিরাচরিত পার্লামেন্টারী ধাঁচের ‘অঞ্চল ভিত্তিক’ প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শ্রম,কর্ম, পেশায় নিয়োজিত সমাজ শক্তি সমূহের ‘বিষয় ভিত্তিক’ প্রতিনিত্বের ব্যবস্থা সংবলিত ‘দুই কক্ষ’ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, ফেডারেল সরকার ব্যস্থা প্রবর্তন, বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন, উপজেলা পর্যায়ে স্ব-শাসিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক আইন ব্যবস'া ও শাসন কাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মডেল উত্থাপন করেন তিনি। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সমূহের স্বীকৃতির প্রয়োজনও তাঁর চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশকে শিল্পায়ন করার লক্ষ্যে প্রবাসীদের অথায়নে ‘উপজেলা শিল্প এলাকা’ এবং ‘পৌর শিল্প এলাকা’ গঠন করার তাঁর প্রস্তাব ইতোমধ্যেই সবার দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘মাইক্রো ক্রেডিট’ ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং ‘সামাজিক ব্যবসা’ (Social Business) এর সমর্থক তিনি। ৬৭ বছর বয়স্ক সিরাজুল আলম খান এখন দেশে-বিদেশে ‘রাজনৈতিক তাত্বিক ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে পরিচিত।

    তাঁর দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ছাত্র-যুব নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এক বিষ্ময়কর ব্যাপার। রাজনৈতিক তত্ত্ব উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেল প্রণয়নে তাঁর প্রধান সহযোগীরা হলেন ড. জিল্লুর রহমান খান, প্রফেসর রাজিয়া আহমেদ এবং মহিউদ্দিন আহমদ।
    ব্যক্তিগত জীবনে সিরাজুল আলম খান অবিবাহিত।

    http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%81%E0%A6%B2_%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A6%AE_%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%A8
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ১৯:৩৭582890
  • আবু তাহের
    উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

    জন্মনভেম্বর ১৪, ১৯৩৮ (বয়স ৭৪)
    মৃত্যুজুলাই ২১, ১৯৭৬ (৩৭ বছর)
    যে জন্য পরিচিত: মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার

    কর্ণেল আবু তাহের (নভেম্বর ১৪, ১৯৩৮ - জুলাই ২১, ১৯৭৬) একজন বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক বাহিনীর কর্নেল, এবং বামপন্থী বিপ্লবের নেতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার।

    জন্ম ও শিক্ষাজীবন

    আবু তাহের আসাম প্রদেশের বাদারপুরে ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর জন্ম গ্রহন করেন। পরে আসাম থেকে তার পরিবার বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলায় আসেন। তাঁর বাবার নাম মহিউদ্দিন আহমেদ এবং মায়ের নাম আশরাফুন্নেছা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করেন চট্টগ্রামের প্রবর্তক স্কুল ও কুমিল্লার ইউসুফ স্কুল থেকে। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যামিক পরীক্ষা পাস করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যান এবং গবেষণা ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করেন । [১]

    ১৯৬১ সালে পাকিস্তান আর্মি তে অফিসার হিসাবে যোগদান করেন এবং ১৯৬২ সালে কমিশন প্রাপ্তি হন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে কাশ্মীর আর শিয়ালকোট সেক্টরে যুদ্ধ করেন তিনি৷ সে যুদ্ধে তিনি আহতও হন৷ একমাত্র বাঙালি অফিসার হিসাবে তাঁকে 'মেরুন প্যারাস্যুট উইং' নামক সম্মাননা প্রদান করা হয়৷

    মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা

    পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার হিসাবে তাহের কমান্ডো প্রশিক্ষণ লাভ করেন ও পরে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাহের সম্মুখ সমরে আহত হন, ও এক পা হারান। কর্নেল তাহেরের সব ভাইবোন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে ১১ নং সেক্টরে যৌথভাবে যুদ্ধ করেছেন। [২] মুক্তিযুদ্ধের পরে তাহের প্রথমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্নেল পদে দায়িত্ব পালন করেন, কিন্তু মতবিরোধের জন্য পদত্যাগ করেন। তিনি বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর তাঁর নেতৃত্বে সিপাহি-জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়, যা খালেদ মোশাররফ এর সরকারের পতন ঘটায়, এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে কারামুক্ত করে। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের সরকারের আনীত এক হত্যা মামলায় ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই তাহেরকে ফাঁসী দেয়া হয়।

    http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%AC%E0%A7%81_%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A7%87%E0%A6%B0
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ১৯:৪৪582891
  • ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ
    মেহেদী হাসান বাবু.
    Published: 2013-03-06 11:27:32.0 Updated: 2013-03-06 11:52:02.0

    বাঙালি স্বাধীনতার ইতিহাসে মার্চ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। কারণ ’৭১ সালের এই মার্চ মাসেরই ২৫ তারিখ গভীর রাতে, মানে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এসেছিলো; মনে আছে নিশ্চয়ই? শুধু তাই না, ২৫ মার্চ গভীর রাতে, এদেশের নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী; সে ঘটনাও তো তোমাদের জানা আছে। আরও একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কিন্তু ঘটেছিলো এই মাসে। সেটি হচ্ছে- ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। আর সে ঐতিহাসিক ভাষণটি কে দিয়েছিলো, মনে আছে তো? হ্যাঁ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

    ১৯৪৭ সালে তল্পিতল্পা গুটিয়ে, ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায় ব্রিটিশ শাসকরা। কিন্তু যাওয়ার আগে, উপমহাদেশকে দুইটি পৃথক রাষ্ট্রে ভাগ করে দিয়ে যায় ওরা- ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের আবার দু’টি অংশ ছিলো- পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। হ্যাঁ, আমাদের বাংলাদেশ তখন ছিলো পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর থেকেই, পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের বাঙালিদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালিয়ে আসছিলো। যেন আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দামই ছিলোনা তাদের কাছে। মনে নেই, আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানালে, কীভাবে তারা আমাদের ওপর গুলি চালিয়েছিলো। হত্যা করেছিলো রফিক, শফিক, বরকত, সালাম, জব্বারসহ নাম-না-জানা আরও কতোজনকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমাদের দাবির কাছে তাদের মাথা নত করতেই হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি নিয়ে, তবেই শান্ত হয়েছিল বাঙালিরা।

    এরপর আমাদের ওপর আরও কত অন্যায়-অবিচার যে করেছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা, তার কোন ইয়ত্তা নেই। অনেকদিন ধরে মুখ বুজে সহ্য করে গেছে বাঙালিরা। কিন্তু কতোদিন আর এভাবে চুপ করে থাকা যায় বলো? শেষ পর্যন্ত, ঠিকই বাঙালিরা গর্জে ওঠে। ’৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুরো পাকিস্তানেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু সে সময়কার পাকিস্তানিরা যে অনেক মন্দ ছিলো, সে তো তোমাদের আগেই বলেছি। ওরা করলো কী, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পরেও আওয়ামী লীগের হাতে শাসনক্ষমতা দিলো না। আসলে তারা চেয়েছিলো, দেশের পুরো ক্ষমতা নিজেদের হাতেই রাখতে।

    কিন্তু বাঙালিরা কী আর এতো সহজে তা হতে দেবে? কক্ষনো না। শুরু হলো দুর্বার আন্দোলন। ’৭১ সালের ২ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালিত হলো। সেদিনই, এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ৩ থেকে ৬ তারিখ, প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হরতাল পালিত হলো। ৩ মার্চ পালন করা হলো শোক দিবস। সেইসঙ্গে ঘোষণা করা হলো, ৭ মার্চ দুপুর ২টায় ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল গণসমাবেশ আয়োজিত হবে; সেখানে ভাষণ দেবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হ্যাঁ, এই ভাষণটিকেই বলা হয় ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। ভালো কথা, রেসকোর্স ময়দান চিনেছো তো? যেটা কিনা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে চেনো তোমরা।

    কিন্তু এই ৭ মার্চের ভাষণ এতো ঐতিহাসিক আর গুরুত্বপূর্ণ কেন? আসলে, ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা-ই অন্তর্নিহিত ছিলো। বঙ্গবন্ধু তার এ ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিকামী বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। মানুষের মাঝে মুক্তির আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তুলেছিলেন। সেই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের টনকও নড়িয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

    ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে সেদিন লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠলেন। তারপর ১৯ মিনিটের এক অলিখিত ভাষণ দিলেন; যেন বাংলার মানুষের বুকের কথাগুলোই বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে উচ্চারিত হলো। অচিরেই, ভাষণটির একটি লিখিত ভাষ্যও বিতরণ করা হয়েছিলো। সেই লিখিত ভাষ্যটি অবশ্য তাজউদ্দীন আহমদ কিছুটা পরিমার্জন করে দিয়েছিলেন।

    কি বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণে? ভাষণ শুরু করেছিলেন এইভাবে- ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’

    এরপর শেখ মুজিব পাকিস্তান আমলের বিগত আন্দোলনগুলোর কথা বললেন- ‘তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম।’

    তারপর, তখন বাঙালির ওপর যে অত্যাচার করা হচ্ছিলো, তার কথাও বললেন- ‘কি পেলাম আমরা? যে আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের ওপর হচ্ছে গুলি। ... জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে, কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। ... আমি বলেছি, কিসের বৈঠক বসবো, কার সঙ্গে বসবো? যারা মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসবো? ... ২৫ তারিখে এসেম্ব^লি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘ওই শহীদের রক্তের উপর পা দিয়ে কিছুতেই মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।’
    তিনি ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। কিন্তু হরতাল হলে তো অনেক গরীব দিন-আনে-দিন খায় মানুষের অনেক কষ্ট হয়; সাধারণ মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আর তাই, তিনি সাধারণ মানুষের যাতে কষ্ট না হয়, সে ব্যবস্থা করার জন্যও বললেন- ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে; শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমিগভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না।’

    আর তারপরই তিনি প্রতিরোধের ডাক দেন- ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষেরে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’

    সবশেষে, তিনি উচ্চারণ করলেন সেই অমর বাণী- ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

    শেষ করার আগে, আরেকটা কথা বলে রাখি। তোমাদের অনেকেই হয়তো ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটার পুরোটুকু পড়তে চাও, তাই না? উইকিপিডিয়ার সহযোগী প্রতিষ্ঠান উইকিসংকলনে কিন্তু পুরো ভাষণটাই আছে। চাইলে তোমরা পড়তে পারো, নিচে পেইজটার লিঙ্ক দিয়ে দিলাম-

    ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ
    http://bangla.bdnews24.com/kidz/article598932.bdnews
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ১৯:৪৮582893
  • সাতই মার্চের ভাষণ
    শেখ মুজিবুর রহমান

    রেসকোর্সে ময়দানে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণ।

    আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবাই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।

    আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো, এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তেইশ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাঙলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল' জারি করে দশ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম।
    তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলায় নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো; এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।

    জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করলাম, আপনারা আসুন বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসেন, তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপর হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হল।

    ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসাবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্দুকের মুখে মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।

    আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।

    কি পেলাম আমরা? যে আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে, কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডাকব।

    আমি বলেছি, কিসের বৈঠক বসবে, কার সঙ্গে বসবো? যারা মানুষের বুকের রক্ত নিয়ছে তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন।
    ভাইয়েরা আমার,

    ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের উপর পা দিয়ে কিছুতেই মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। এসেম্বলি কল করেছে। আমার দাবি মানতে হবে: প্রথম, সামরিক আইন মার্শাল ল' উইথড্র করতে হবে, সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।

    আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে; শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমিগভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো. ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না।

    ২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল,- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষের দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।

    আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়ে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবো না। মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান বাঙালি অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনেন, তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে যাতে মানুষ তাদের ময়নাপত্র নিবার পারে। কিন্তু পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে চালাবেন। কিন্তু যদি এদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্‌। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। জয় বাংলা।

    http://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%87_%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A6%A3
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ২০:০৩582894
  • মুজিব বাহিনী
    মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রহস্যময় অধ্যায়

    যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্রই আন্দোলনের মূল নেতা বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে চলে গেছেন কারাগারে। শীর্ষস্থানীয় নেতারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। সারা দেশে তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রক্তের হোলিখেলা। এ রকম অগোছালো অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে মাত্র ৯ মাসের মাথায় বিজয় ছিনিয়ে আনার ঘটনা তাই পৃথিবীর ইতিহাসে অদ্বিতীয়।

    কিন্তু এই মুক্তিযুদ্ধ সহজ ছিল না। নেতৃত্ব থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত ছিল নানা রকম ঘাত-প্রতিঘাত। তেমনই একটি অধ্যায়_মুজিব বাহিনী। অভিযোগ আছে, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীর অজ্ঞাতে এবং ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয় এই বাহিনী। ইতিহাস খুঁড়ে সেই বাহিনীর আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন
    অমি রহমান পিয়াল
    ______________________________________

    (...মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে বড় অংশটি এসেছিল ছাত্রদের মধ্য থেকে। তারা একই সঙ্গে ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের অনুসারী। আদর্শগত সংঘাত এবং ভিন্ন নেতৃত্বকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা তাদের মধ্যে প্রবল। সেদিক থেকে আদর্শ গেরিলা ছিলেন মাটি থেকে উঠে আসা কৃষক শ্রেণীর লোকজন। তাঁদের মিথ্যা অহম ছিল না, একজোড়া জাঙ্গলবুটের জন্য হাপিত্যেশও তাঁরা করেননি, খাবার না পেলে খাননি, পরিধেয় বা বিছানা নিয়েও মাথা ঘামাননি। স্রেফ স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে তাঁরা মাটি কামড়ে লড়ে গেছেন...মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে ভারতীয় সামরিক হাই কমান্ডের মূল্যায়ন)

    মুক্তিযুদ্ধের মাঝপথে আচমকাই রণাঙ্গনে নতুন একটি নাম ছড়িয়ে পড়ল_মুজিব বাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি গণবাহিনীর যোদ্ধারা যখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছেন, তখন আচমকা একটি নতুন বাহিনী কী কারণে কিভাবে জন্ম নিল, তা ছিল এক বড় রহস্য। তারা মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বাধীন ছিল না। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী কিংবা পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল অরোরাও তাদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পাননি। মূলত মার্চের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ছাত্রলীগের তিন জঙ্গি ছাত্রনেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও সিরাজুল আলম খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগিনা যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন এই বাহিনীর নেতৃত্বে। অভিযোগ আছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা Research & Analysis Wing (RAW)এর বিশেষ তত্ত্বাবধানে এবং বিখ্যাত সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সুজন সিং উবানের ট্রেনিংয়ে ১০ হাজার সদস্যের এই এলিট বাহিনী যতখানি মুক্তিযুদ্ধ করেছে তারও বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছে বামপন্থী নির্মূল অভিযানে। অথচ মুজিব বাহিনী সম্পর্কে জানতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে হাসানুল হক ইনুর মতো বামপন্থী নেতা-কর্মীরাও মুজিব বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইনু ছিলেন মুজিব বাহিনীর রাজনৈতিক প্রশিক্ষকদের একজন। মুজিব বাহিনীর অনেকেই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে নামার সুযোগ পাননি। আবার স্বাধীনতার পর তাঁরাই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়েছেন রক্ষীবাহিনী ও গণবাহিনীর আদলে।

    রহস্যময় 'সানী ভিলা'
    কলকাতা ভবানীপুর পার্কের পাশে হালকা গোলাপি রঙের একটি দোতলা বাড়ি। বাসিন্দাদের নাম তপুবাবু, রাজুবাবু, সরোজবাবু, মনিবাবু, মধুবাবু। আশপাশের মানুষ তা-ই জানে। কিন্তু ঠিকানা ধরে যখন কেউ সেখানে যায় তখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় ছদ্মনামগুলো। তপু ওরফে তোফায়েল আহমেদ, রাজু ওরফে আবদুর রাজ্জাক, সরোজ আ কা সিরাজুল আলম খান, ফজলুল হক মনি ওরফে মনিবাবু এবং বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী মুন্সীগঞ্জের মহিউদ্দিন বা মন্টুবাবু। ৯ নম্বর সেক্টর থেকে নির্দেশ পেয়ে আসা বরিশাল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুর রহমান মোস্তফার জবানিতে : বাড়ির দোতলায় একটি কক্ষে তোফায়েল ভাই, রাজ্জাক ভাইসহ আরো কয়েকজন আমাকে নিয়ে বৈঠক করলেন। ওই বৈঠকে বসে জানলাম, আগরতলায় শেখ ফজলুল হক মনিসহ ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও কৃষক লীগের ভারতে আগত সদস্যদের নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আগরতলাতে হেডকোয়ার্টার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নাকি বেশ কয়েক হাজার মুজিব বাহিনীর সদস্য ভারতের পার্বত্য দুর্গম এলাকা টেন্ডুয়াতে (তানদুয়া) প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ট্রেনিং নেওয়া আরম্ভ করেছেন।

    ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোডের 'সানী ভিলা' নামের এই বাড়িটির মালিক প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সুতার। পিরোজপুরের বাটনাতলার এই অধিবাসী পাকিস্তান কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন এবং কংগ্রেস নেতা প্রণব কুমার সেনের মেয়েকে বিয়ে করেন। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে জয়ী হন, অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে ভারতে চলে যান। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আবারও নির্বাচিত হন এবং ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের ভাষ্য অনুযায়ী চিত্তরঞ্জনের মাধ্যমেই মেজর জেনারেল উবানের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁদের। মার্চের উত্তাল দিনগুলো শুরু হওয়ার অনেক আগেই (১৮ ফেব্রুয়ারি) বঙ্গবন্ধু উলি্লখিত চার নেতাকে এই বাড়িটির ঠিকানা দিয়ে দেন এবং চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করে অস্ত্র ও ভারতীয় সহায়তা নেওয়ার নির্দেশ দেন। অবশ্য ২৫ মার্চের আগে আরেকবার ডা. আবু হেনাকে ছাত্রনেতাদের প্রতিনিধি হিসেবে সুতারের কাছে পাঠানো হয় সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি না জানতে। মোটামুটি 'সানী ভিলা'কেই ধরে নেওয়া যায় 'মুজিব বাহিনী'র জন্মস্থান হিসেবে। এখানেই উবানের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রস্তাবিত বাহিনীর খসড়া পরিকল্পনাটি জানান মনি-সিরাজ-রাজ্জাক-তোফায়েল। এই বৈঠকে সুতার ছাড়া উপস্থিত ছিলেন আ স ম আবদুর রবও।

    'জয় বাংলা বাহিনী'র উত্তরসূরি
    এই পর্যায়ে এসে আমাদের কিছু চমকপ্রদ প্রাসঙ্গিক ইতিহাস জানা হয়। মুজিব বাহিনীর পেছনে যাঁরা ছিলেন তাঁরা একই সঙ্গে আবার সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদেরও সদস্য, যার সূচনা সেই ১৯৬২ সালে। বলা হয়, ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী এই সংগঠনটির মূল পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে একদম শুরু থেকেই। ১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খান, রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করার জন্য এই বিপ্লবী পরিষদের জন্ম দেন। ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদ বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এটির অস্তিত্ব প্রকাশ হয় ১৯৭২ সালে যখন ছাত্রলীগে মতভেদ চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং সিরাজুল আলম খান তাঁর অধীনদের নিয়ে জাসদ গড়তে যান। বঙ্গবন্ধুকে এ সম্পর্কে জানানো হয় ১৯৬৯ সালে তিনি 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' থেকে মুক্ত হয়ে ফেরার পর। রাজ্জাকের ভাষ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধ যখন প্রায় অনিবার্য রূপ নিতে যাচ্ছে তার আগে মনি ও তোফায়েলকে এই পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করেন তাঁরা। এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৮ জানুয়ারি (মাসুদুল হকের ভাষ্যে ফেব্রুয়ারি হবে) একান্ত বৈঠক করেন। সেখানেই তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয় সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে। চারজনকে এই রূপরেখার কো-অর্ডিনেটর করা হয়।

    বিপ্লবী পরিষদে তাজউদ্দীন আহমদকে অন্তর্ভুক্ত করতে নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। মার্চের পর সবাই ঠিকানামতো (সানী ভিলা) গিয়ে জানতে পারেন তাজউদ্দীন সেখানে যাননি। তিনি প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন।

    তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, এই পরিকল্পনাটি আরো আগেই নিয়েছিলেন মুজিব। ১৯৬৯ সালে লন্ডন থেকে ফেরার পর তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য তাঁর একটি বিশেষ পরিকল্পনার কথা জানান। আর এই উদ্দেশ্যে প্রতি মাসে ২৫ জন নির্বাচিত যোদ্ধাকে ভারতে বিশেষ ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। যোদ্ধা বাছাইয়ের দায়িত্ব পান মনি-সিরাজ-রাজ্জাক ও তোফায়েল। কিন্তু এর মধ্যেই সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় পরিকল্পনাটি স্থগিত রাখা হয়। ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় নিহত সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে ছাত্রলীগ। আর এর একাংশ থেকে '১৫ ফেব্রুয়ারি বাহিনী' নামে একটি দল মার্চপাস্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরে। এই মিছিলে ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তবে এই বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে ফজলুল হক মনি এবং ডাকসু সহসভাপতি আ স ম রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন কিছুই জানতেন না। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নগর ছাত্রলীগ সভাপতি মফিজুর রহমান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু। এখানে স্পষ্টতই চার নেতার মধ্যে আদর্শগত ক্ষেত্রে খানিকটা মতবিরোধের আঁচ পাওয়া যায়। আর তার প্রকাশ সে বছরই ১২ আগস্ট ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সেখানে ৩৬-৯ ভোটে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাবটি পাস হয়। নূরে আলম সিদ্দিকী, মাখনসহ যাঁরা বিরোধিতা করেন তাঁরা সবাই শেখ মনির অনুসারী। মনি তখন ছাত্র নন, কিন্তু ছাত্রলীগের একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর অনুসারীদের হারিয়ে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন অংশটির এই জয় দুজনের শীতল সম্পর্ককে আরো শীতল করে দেয়। আর এর প্রভাব মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনীতে তেমন না পড়লেও স্বাধীনতার পর মারাত্মক রূপ নেয় এবং রক্ষীবাহিনী-গণবাহিনীর সংঘর্ষে এর ভয়াবহ প্রকাশ ঘটে। যুদ্ধকালীন আবদুর রাজ্জাকই মূলত সিরাজ-মনির মধ্যকার ভারসাম্য বজায় রাখতে অবদান রাখেন। তবে মুজিব বাহিনীর মূল পরিকল্পনায় তখনকার ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাজাহান সিরাজকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। দুজনেই মনির অনুসারী ছিলেন।

    বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের ওই ট্রাম্পের আগে জন্ম 'জয় বাংলা বাহিনী'র। মূলত ছয় দফার ঘোষণা বার্ষিকী ৭ জুনকে সামনে রেখে এটি গঠিত হয়। '১৫ ফেব্রুয়ারি বাহিনী'র সদস্যরা স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত নন_এই বিচারে আরেকটু জঙ্গি হিসেবে এই সংগঠনের জন্ম। সিদ্ধান্ত হয়, সেদিন শহীদ মিনার থেকে পূর্ণ সামরিক কায়দায় মার্চপাস্ট করে তাঁরা পল্টন ময়দান যাবেন। পল্টনে সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানাতে শ্রমিক লীগের কর্মসূচি আর তাতে গার্ড অব অনার দেওয়ার কথা ছাত্রলীগের। আগের রাতে, অর্থাৎ ৬ জুন ইকবাল হলে 'জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা'র নকশা করেন কুমিল্লা থেকে হঠাৎ ঢাকায় আসায় শিব নারায়ণ দাস। এটিই পরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকায় পরিণত হয়। ৪২ বলাকা ভবনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অফিসের লাগোয়া 'নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্স' থেকে তৈরি হয় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র সংবলিত সেই প্রথম পতাকা, যা সেলাই করেন আবদুল খালেক মোহাম্মদী। 'জয় বাংলা বাহিনী' পরিকল্পনা মতো মার্চ করে পল্টনে যায়, কিন্তু পতাকাটি গোটানো অবস্থায় বয়ে নিয়ে যান আ স ম রব। মিছিলে ওড়ে ছাত্রলীগের পতাকা, যা থাকে ইনুর হাতে। অভিবাদন মঞ্চে হাঁটু গেড়ে মুজিবকে পতাকাটি উপহার দেন রব। মুজিব সেটা খুলে দেখেন এবং আবার গুটিয়ে রবকে ফেরত দেন। এর পর এটি ইনুর হাত ঘুরে হাতে পান ছাত্রলীগ নগর সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আবার ওড়ে সেই 'জয় বাংলা বাহিনী'র পতাকা। এর পর তা হয়ে যায় জাতির পতাকা, জাতীয় পতাকা। শেখ মুজিব জানতেন 'জয় বাংলা বাহিনী'র অস্তিত্বের কথা। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের বদলে প্রতিরোধ দিবস পালন করে আওয়ামী লীগ। সেদিন পল্টনে আবারও ওড়ে পতাকা। আর এদিন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে নিজের বাসা থেকে দর্শনার্থীদের উদ্দেশে মুজিবের বক্তৃতায় আসে 'জয় বাংলা বাহিনী'র নাম। মার্চজুড়েই এরা ডামি রাইফেল নিয়ে ছাত্রলীগকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। মোটামুটি একটা মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া হয় সশস্ত্র সংগ্রামের।

    তাজউদ্দীনের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করেই মুজিব বাহিনী!
    ফেব্রুয়ারিতে মুজিবের সঙ্গে চার ছাত্রনেতার বৈঠকের ব্যাপারটি তাজউদ্দীনের গোচরে ছিল। কিন্তু কলকাতায় যাওয়ার পর তাঁদের উপেক্ষা করে একক সিদ্ধান্তে এগিয়ে যান তিনি। বিভিন্ন সূত্রে এটা আগেও অনেকবার উল্লেখ হয়েছে যে তাজউদ্দীনের এই প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ একদমই মেনে নিতে পারেননি শেখ মনিসহ বাকিরা। তাঁদের দাবি ছিল, মুক্তিযুদ্ধ চলবে একটি বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলের অধীনে আর এর নেতৃত্ব দেবেন তাঁরা চারজন_বঙ্গবন্ধু তাঁদেরই মনোনীত করে গেছেন এ জন্য। গ্রহণযোগ্যতা ও অন্যান্য প্রেক্ষাপটে এই দাবিটি উপেক্ষা করা অবশ্যই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে উপকৃত করেছে।

    তাজউদ্দীনের ব্যাপারে এই তরুণ নেতাদের বড় অভিযোগটি ছিল বঙ্গবন্ধু আর ফিরবেন না_এটা ধরে নিয়ে তাজউদ্দীন যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। পাশাপাশি তিনি মওলানা ভাসানীসহ বাম দলগুলোর সদস্যদেরও গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর পেছনে আমীর-উল ইসলাম ও মাঈদুল ইসলামকে (মূলধারা '৭১-এর লেখক) দায়ী করেন তাঁরা। তাঁদের আশঙ্কা জাগে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব বামপন্থীদের কবজায় চলে যাবে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স নামের একটি বিশেষ বাহিনীর পরিকল্পনা নেন চারজন। আর তার 'মুজিব বাহিনী' নামকরণের পেছনে কারণ মুজিববাদ (জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র) কায়েম। এ বিষয়ে উবান লিখেছেন, Because of their single-minded loyalty to Mujib and their closeness to him, they were more eager to be known as the Mujib Bahini. They had been issuing certificates of genuineness, selecting from their old colleagues. Choosing enough sacrificing, upright and faithful men from Bangladesh, they were putting pressure that they should receive unconventional training in fighting techniques unlike the commando training received by members of the Mukti Bahini.

    'স্যামস বয়েজ' : ভারতের গোপনে লালিত সংগঠন
    ১৯৭১ সালের মে মাসের শুরুতে 'সানী ভিলা'র সেই বৈঠকে উবানকে তাঁদের পরিকল্পনা জানান চার নেতা। উবান তাঁর বইয়ে লিখেছেন, পরিকল্পনাটি তাঁর খুবই পছন্দ হয়। মুজিব বাহিনীর গঠন এবং প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি পুরোটাই গোপনে ব্যবস্থা করা হয়; আর এ ব্যাপারে ভারতীয় সেনাপ্রধান এবং ওয়ার কাউন্সিল হেড জেনারেল স্যাম মানেকশ ছাড়া আর কেউই কিছু জানতেন না। এ কারণে মুজিব বাহিনীকে 'স্যামস বয়েজ' নামে উল্লেখ করত ভারতীয় বাহিনী। উবান জানাচ্ছেন, পরে তাজউদ্দীনকে মানেকশ সরাসরি বলেছেন যে সেনাবাহিনীর বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য মানেকশ নিজেই গড়ে তুলেছেন এই বাহিনী। তিব্বতিদের নিয়ে গড়া স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সফল রূপকার উবানকে দায়িত্বটা দেওয়া হয় ওপর মহল থেকে। 'র'প্রধান আরএন কাও, যিনি একই সঙ্গে ভারতীয় কেবিনেট সেক্রেটারিয়েটের সচিবও ছিলেন, উবান মুজিব বাহিনী বিষয়ে সরাসরি শুধু তাঁকেই রিপোর্ট করতেন। ২৯ মে মোট ২৫০ জনের প্রথম দলটি দেরাদুনের দেড় কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি শহর তানদুয়ায় প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে। মেঘালয়ের হাফলংয়ে আরেকটি ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়, কিন্তু একটি ব্যাচ সেখানে ট্রেনিং নেওয়ার পর ক্যাম্পটি তুলে নেওয়া হয়। প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণে ছিল ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা। এঁদের মধ্যে উল্লেখ্য মেজর মালহোত্রা, যিনি পরে রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণেরও দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের মধ্যে থেকে আটজনকে বাছাই করা হয় প্রশিক্ষক হিসেবে_হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আ ফ ম মাহবুবুল হক, রফিকুজ্জামান, মাসুদ আহমেদ রুমী (প্রয়াত ক্রীড়া সাংবাদিক), সৈয়দ আহমদ ফারুক, তৌফিক আহমদ ও মোহনলাল সোম। পরে প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়ে ৫২ করা হয়, ২০ নভেম্বর ১৯৭১ মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে পর্যন্ত ১০ হাজার মুজিব বাহিনী সদস্য প্রশিক্ষণ নেন। নেতাদের মধ্যে রাজ্জাকই প্রথম ব্যাচের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ সামরিক ট্রেনিং নেন, বাকিরা নেন প্রাথমিক প্রশিক্ষণ।

    মুজিব বাহিনীর সাংগঠনিক রূপরেখা
    বাংলাদেশকে মোট চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয় মুজিব বাহিনীর অপারেশনের জন্য। উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টর কমান্ডার ছিলেন সিরাজুল আলম খান, যাঁর আওতায় ছিল বৃহত্তর রংপুর, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর। তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি। দক্ষিণাঞ্চলীয় সেক্টর (বৃহত্তর খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী) ছিল তোফায়েল আহমেদের অধীনে, সহঅধিনায়ক ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ। শেখ ফজলুল হক মনির কমান্ডে ছিল পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর (বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট এবং ঢাকা জেলার কিছু অংশ), তাঁর সহঅধিনায়ক ছিলেন আ স ম রব ও মাখন। আবদুর রাজ্জাকের দায়িত্বে ছিল কেন্দ্রীয় সেক্টর, যা গঠিত ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল এবং ঢাকা নিয়ে। তাঁর সহঅধিনায়ক ছিলেন সৈয়দ আহমদ। চার নেতা ছিলেন জেনারেল সমমর্যাদার, তাঁদের যাতায়াতের জন্য হেলিকপ্টার বরাদ্দ ছিল, প্রত্যেক সেক্টরের জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ ছিল, যা বণ্টনের দায়িত্ব ছিল নেতাদের হাতে।
    আলাদা ওয়্যারলেস সিস্টেম, আলাদা কোডের অধীনে মুজিব বাহিনী ছিল আদতে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের একদল যোদ্ধা। পাঁচ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা নিয়ে এই বাহিনী গঠন করা হয়। প্রাথমিক পরিকল্পনায় ছিল দেশের মধ্যে ছোট ছোট পকেট তৈরি। সেসব পকেটে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানানো। প্রতিটি থানায় (বর্তমানে যা উপজেলা) পাঁচজনের একটি সেল তৈরি করা হতো, যার দায়িত্বে থাকতেন একজন সংগঠক ও তাঁর সহকারী। আশ্রয়স্থলের জন্য একজন নেতা থাকতেন এবং বাকি দুজনের দায়িত্ব ছিল বাহকের। এরপর সেখানে যোদ্ধারা আশ্রয় নিয়ে লড়াই শুরু করবেন, প্রতিবিপ্লবী ও দালালদের হত্যা করবেন। আর মুক্তাঞ্চল তৈরি হওয়ার পর তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে মুজিববাদের ভিত্তিতে।

    মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্ব ছিনতাই!
    বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া
    সে সময় কলকাতা থেকে আওয়ামী লীগের প্রচারপত্র হিসেবে বের হতো সাপ্তাহিক জয় বাংলা। কিন্তু আলোড়ন তুলল শেখ মনি সম্পাদিত সাপ্তাহিক বাংলার বাণী। একদল তরুণ সাংবাদিকের এই পত্রিকাটি অল্প সময়ে গ্রহণযোগ্যতা পেল পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক মহলে।
    বাংলার বাণীর খবর প্রকাশের ধরনে রুষ্ট হলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ওসমানী। বাংলার বাণীতে বাংলাদেশের যেকোনো রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের যেসব সাফল্যের খবর ছাপা হতো তাতে মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিবাহিনী না লিখে মুজিব বাহিনী লেখা হতো। মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের ভাষ্যে : বাংলার বাণীতে যেদিন প্রথম মুক্তিবাহিনীর স্থলে মুজিব বাহিনী লেখা হলো, সেদিন জেনারেল ওসমানী আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে খুবই কড়া ভাষায় বললেন, নজরুল সাহেব, মুজিব বাহিনী কী? ওসব কারা লিখছে? কেন লিখছে? আপনি এ সম্পর্কে তদন্ত করে জানাবেন আর বলবেন যেন ভবিষ্যতে মুজিব বাহিনী আর না লেখা হয়; এতে করে আমাদের নিয়মিত বাহিনীতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।

    দিন কয়েক পর নজরুল জানালেন তাঁর তদন্তের ফল। 'বললাম, স্যার এই পত্রিকা শেখ ফজলুল হক মনি সাহেবের। এ কথা বলতেই জেনারেল সাহেবের উন্নত গোঁফগুলো নুয়ে গেল। এরপর হু বলে একটা গম্ভীর ধরনের শ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে। খানিক পর ওসমানীর মুখ থেকে বেরোল : সব কিছুতে একটা ডিসিপ্লিন আছে। এখানে আমরা রং-তামাশা করতে আসিনি। বিদেশের মাটিতে আমরা যে বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য দেখাচ্ছি, তা জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয় নজরুল সাহেব। এতে আমাদের সম্পর্কে এদের ধারণা খুব খারাপ হবে। আর আমাদের এই অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার কথা কি মনে করেন কলকাতার এই চার দেয়ালের ভেতরে বন্দি থাকবে? শত্রুপক্ষ এর সুবিধা নিশ্চয়ই নেবে। আপনি-আমি এখানে বসে বসে নানা বাহিনী গঠন করি, আর যে ছেলেটি বাংলাদেশের পথে-জঙ্গলে কিংবা নদীতে ট্রিগারে আঙুল লাগিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে শত্রু হননের অপেক্ষায় বসে রয়েছে, তার কথা কি আমরা চিন্তা করি? বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনব।'

    মুজিব বাহিনীর হুজুগেই জিয়া বাহিনী
    মুজিব বাহিনী নিয়ে ওসমানীর সংশয় অমূলক ছিল না। প্রবাসী সরকারের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে একটি বাহিনী গড়ে উঠলে এবং সেই বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে চেইন অব কমান্ড নষ্ট হতে বাধ্য। মুক্তিযুদ্ধের শেষার্ধে জিয়াকে যখন এক নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব ছেড়ে একটি ব্রিগেড গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয়, জিয়া সেই ব্রিগেডের নাম রাখলেন 'জিয়া বাহিনী'। এমনিতে ওসমানী 'মুজিব বাহিনী' নিয়ে ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিলেন, জিয়ার এই পদক্ষেপ আগুনে ঘি ঢালল। ওসমানী জিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক কমান্ডকে অস্বীকার করার অভিযোগ এনে তাঁর নেতৃত্ব কেড়ে নিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিলেন। সিদ্ধান্তটি সত্যি কার্যকর করা হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা কি হতো ভাবতেই শিউরে উঠি, তবে তা হয়নি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বিচক্ষণতার কারণে। তিনি ওসমানীর সিদ্ধান্তটি বাতিল করে আরো দুটি বাহিনী গঠন করার পাল্টা নির্দেশ দিলেন। 'খালেদ বাহিনী' ও 'সফিউল্লাহ বাহিনী'র জন্ম এভাবেই। আমরা যাদের জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও এস ফোর্স হিসেবে চিনি।

    আসা যাক তাজউদ্দীনের প্রতিক্রিয়ায়। তিনি বিরক্ত হলেও নিরুপায় ছিলেন। তবে উবান লিখেছেন অন্যভাবে : অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার মানেই অপরিহার্যভাবে মি. তাজউদ্দীন। তিনি মুজিব বাহিনী নেতাদের দুই চোখে দেখতে পারতেন না এবং তাদের প্রতিটি অভিযোগকে বাজে কথা বলে উড়িয়ে দিতেন।

    মুক্তিবাহিনীর মুখোমুখি
    'মুজিব বাহিনী' নামে একটি সংগঠন মাঠে নেমেছে_এটা প্রথম জানাজানি হয় আগস্টের শুরুতে। তখনই বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর পরিচয়গত সংঘাত সৃষ্টি হয়। ২ নম্বর সেক্টরে খালেদ মোশাররফের বাহিনীর চ্যালেঞ্জে পড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পোশাক পরা অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ মুজিব বাহিনীর ৪০ সদস্য। পরে উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে বিষয়টির সমাধান হয়। ৯ নম্বর সেক্টরেও ঘটে এমন ঘটনা। মেজর জলিল এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন : 'আমার সেক্টরে হিঙ্গেলগঞ্জ ফিল্ডে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাঁরা ২২ জনকে গ্রেপ্তার করেন। তারা তখন ভেতরে অনুপ্রবেশ করছিল। সেখানে তাদের চ্যালেঞ্জ করা হয়। এক ভদ্রলোক নিজেকে ক্যাপ্টেন জিকু (জাসদ নেতা নূরে আলম জিকু) বলে পরিচয় দেন। তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয়।'

    এই অবস্থায় মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে কলকাতার হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন মুজিব বাহিনীর নেতারা। ভারত সরকারের পক্ষে ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ প্রতিনিধি ডিপি ধর এতে অংশ নেন আর মুজিবনগর সরকারের তরফে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। সেপ্টেম্বর মাসে আরেকটি বৈঠক হলেও প্রথমবারই একটি আপসরফায় আসে দুপক্ষ। বৈঠকে শাজাহান সিরাজকে মুজিব বাহিনী ও তাজউদ্দীন সরকারের মধ্যে লিয়াজোঁ রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়, ওসমানী, তাজউদ্দীন কিংবা অরোরা কারোই এই বাহিনীর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো তাঁদের জানানো হবে।

    মুজিব বাহিনীর যুদ্ধ : উদ্দেশ্য বামপন্থী নির্মূল!
    এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, মুক্তিবাহিনীর রিক্রুটের জায়গাগুলোতে (যুব শিবির) আওয়ামী লীগ নেতারা স্ক্রিনিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁদের কাজ ছিল মুক্তিবাহিনীতে যেন আওয়ামী ঘরানার বাইরে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রবেশ না ঘটে। কিন্তু তার পরও তা ঠেকানো যায়নি। উবান লিখেছেন, The training camps had to depend on the certificates given by the National Assembly Members (MNA) appointed by the provisional government about the sincerity of the trainees. MNAs used to issue the certificates, blindly based on the list prepared by the Bengali officers, but some of these trainees had a future political motive.

    উবান জুলাইয়ের দিকে ব্যক্তিগতভাবে এ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে অভিযোগ করেছিলেন। মেজর জিয়া ও খালেদ মোশাররফসহ বেশ কয়েকজন সামরিক অফিসারের বিরুদ্ধে তাঁর সেই অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন যে মুক্তিবাহিনীতে এদের প্রশ্রয়ে কিছু নকশালপন্থী এবং চীনপন্থী পাকিস্তানি এজেন্টের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাঁর সেই অভিযোগে রাশেদ খান মেনন ও তাঁর ভাইদের নাম উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি বলেন, জিয়া-খালেদরা ব্যক্তিগত বাহিনী তৈরি করছেন, যার মাধ্যমে স্বাধীনতার পর ক্ষমতা দখল করার মতলব আঁটছেন। সে সময় কমরেড ফরহাদের নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা আলাদাভাবে ট্রেনিং নিচ্ছিলেন। নিচ্ছিলেন চীনপন্থী ন্যাপ ভাসানীর সদস্যরাও। এ সময় বারবার সর্বদলীয় একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল তাজউদ্দীনকে।

    মুজিব বাহিনীর নেতারাও এ নিয়ে বারবার অভিযোগ করেছেন যে ভারত সরকার নকশালপন্থী-চীনপন্থীদেরও ট্রেনিং দিচ্ছে এবং এ ব্যাপারে তাঁদের অপছন্দের কথাও তাঁরা উবানকে জানিয়েছেন। উবানের লেখাতে জানা গেছে, বামপন্থীদের এই প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি তাঁরও পছন্দ ছিল না। তাঁর আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বামপন্থীরা নকশাল আন্দোলনের মতো কোনো সংগঠন গড়ে তুলবে।

    কিন্তু উবান এবং মুজিব বাহিনী নেতাদের এই উদ্বেগ কোনো কাজে আসেনি। র-এর প্রধান আর এন কাও সরাসরিই উবানকে জানান, মওলানা ভাসানীর অনুসারী এবং অন্য বামপন্থীদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছা আছে, বাংলাদেশ সরকার মনে করে, বামপন্থীরাও মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

    আর এন কাও মুজিব বাহিনীর নেতাদের বলার জন্য উবানকে বলেন যে ব্যাপারটি মুজিব বাহিনীর নেতাদের পছন্দ না হলেও 'হজম' করতে হবে। মুজিব বাহিনীই ভারত সরকারের একক উদ্দেশ্য নয়, এর বাইরেও ভারতের অন্যান্য এজেন্ডা আছে। মুজিব বাহিনীকে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকারও পরামর্শ দেন কাও।

    এ পর্যায়ে এসে পড়ে 'মুজিব বাহিনী'র বামপন্থী নির্মূল অভিযান বিষয়ে প্রচারণা। এ ক্ষেত্রে এটি উল্লেখ না করলেই নয়, মুজিব বাহিনীর রাজনৈতিক মোটিভেশনে সমাজতন্ত্র ছিল প্রধান বিষয় এবং তাদের ৮০ ভাগই ছিলেন বামধারায় উৎসর্গকৃত। পরবর্তী সময়ে জাসদ গঠনে এঁরাই নিয়েছিলেন মূল ভূমিকা। তার পরও এই অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ করে ঢাকার অদূরে সাভারে সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির সেকেন্ড ইন কমান্ডসহ পাঁচ সদস্যকে হত্যা করেন মুজিব বাহিনীর সদস্যরা। পাশাপাশি এ-ও আমাদের মনে রাখা দরকার, দেশের ভেতরে থাকা চীনপন্থী সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর কয়েকটি শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিলেও গণচীনের মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে তারাও অবস্থান পাল্টায় এবং মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে। সর্বহারা, মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপ, তোয়াহা গ্রুপ সবার সঙ্গেই এই সংঘর্ষ চলতে থাকে।

    তাজউদ্দীন হত্যাচেষ্টা
    মূলধারা-৭১-এ মঈদুল হাসান দাবি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে হত্যা করার জন্য মুজিবনগরে ঘাতক পাঠিয়েছিল মুজিব বাহিনী। সেই ঘাতক পরবর্তী সময়ে মুজিবনগরে আত্মসমর্পণ করে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মুজিব বাহিনীর নেতারা। বিভিন্ন সময় তাঁরা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে অভিযোগটিকে বানোয়াট বলেছেন।
    তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'একটা মুক্তিযুদ্ধ চলছে এবং যারাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে বন্ধু রাষ্ট্রে গিয়ে, সেখানে তাজউদ্দীন আহমদকে তারাই হত্যার ষড়যন্ত্র করছে_এ ধরনের কল্পনা বা এই ধরনের চিন্তাভাবনা মঈদুল হাসানরাই করতে পারেন।'
    তবে মঈদুল হাসানের বই ছাড়া অন্য কোথাও এ ঘটনার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

    মুজিব বাহিনীর অর্জন কী?
    মুজিব বাহিনী কি উল্লেখ করার মতো যুদ্ধ করেছে? নাকি আওয়ামী লীগবিরোধী আর কমিউনিস্ট নিধনেই নিয়োজিত থেকেছে। প্রসঙ্গতই উল্লেখ করা যেতে পারে আবদুর রাজ্জাকের ভাষ্য। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, 'আমরা কমিউনিস্টদের হত্যা করার নির্দেশ দিইনি। আমাদের বৈঠকে এ ধরনের কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রশ্ন এলে আমাদের চারজনের বৈঠক হতো। হ্যাঁ, আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল যদি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের বাহিনী আমাদের আক্রমণ করে তাহলে প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। এড়াতে না পারলে প্রতিরোধ করব। কিন্তু কমিউনিস্ট বাহিনীর সঙ্গে কোনো সংঘর্ষ হয়নি। আর কমিউনিস্ট বাহিনী তো ভেতরে ঢুকতেই পারেনি। তখন তো তারা ট্রেনিংই নিচ্ছে। কমিউনিস্ট বাহিনী আসলে যুদ্ধে যেতেই পারেনি। আমাদের বাহিনী ট্রেনিং নিয়ে ভেতরে ঢুকেছে।'

    এখানে বোঝা যাচ্ছে, রাজ্জাক কমিউনিস্ট বাহিনী বলতে বুঝিয়েছেন দেশের বাইরে থেকে ট্রেনিং নিয়ে অনুপ্রবেশ করা বামদলীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। কিন্তু অনেকেই বলেন, দেশের অভ্যন্তরে থাকা চীনাপন্থী কমিউনিস্টদের হত্যা করায় মুজিব বাহিনীর অংশগ্রহণ ছিল।

    মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী খুব বেশি যুদ্ধ করেছে, এমনটা পাওয়া যায় না। বরং এই বাহিনী প্রস্তুত হচ্ছিল দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য। মুজিব বাহিনী আসলে যে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ পরিকল্পনার ফসল, সে বিষয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'আমরা তো সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে পারিনি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল মুজিব বাহিনী প্রথমে ভেতরে ঢুকবে। তারপর অস্ত্রশালা তৈরি করবে। এর পর আশ্রয়স্থল গড়ে তুলবে। তারপর সংগঠন গড়ে তুলবে_মুজিব বাহিনীর সংগঠন। এরপর থানা কমান্ড করবে। থানা কমান্ড করার পর প্রথম কার্যক্রম হবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী, অর্থাৎ রাজাকারদের ওপর হামলা চালানো, তাদের সরবরাহ লাইনের ওপর হামলা চালানো। গেরিলা কৌশলে ওদের দুর্বল করে দেবে।

    সর্বশেষ হলো, ওরা যখন দুর্বল হয়ে পড়বে, তখন পাকবাহিনীর ওপর আঘাত হানো। আমরা তখন এ কাজই করছি। প্রাথমিক কাজ আমাদের মোটামুটি হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত সদস্যরা যেখানে যেতে পেরেছে, সেখানেই থানা কমান্ড হয়ে গেছে। আমরা জনগণের সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করছি। কিছু কিছু রাজাকারও খতম হচ্ছে। কিন্তু মূল জায়গাটা, মানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামনে না পড়লে যুদ্ধ করিনি। দু-চার জায়গায় সামনে পড়ে গেছি, লড়াই হয়েছে। আমরা তো যুদ্ধ শুরুই করিনি। আমাদের তো পাঁচ বছরের পরিকল্পনা_প্রথম বছর কী করব, তৃতীয় ও চতুর্থ বছরে কী করব। তারপর সরকার গঠন করব। এই ছিল আমাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা। আমরা যদি সফল হতাম, তাহলে কোনো ঘাস থাকত না। আগাছা থাকত না। সমাজদেহ থেকে সব আগাছা উপড়ে ফেলতাম। প্রতিবিপ্লবীদের থাকতে হতো না। হয় মোটিভেট হয়ে এদিকে আসতে হতো, নইলে নিশ্চিহ্ন হতে হতো।'

    শেষ লাইন কয়টিই আসলে বলে দেয় সব কথা। মুজিববাদী সমাজতন্ত্র যা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র হিসেবে তার দ্বিতীয় বিপ্লব তথা বাকশালে উল্লেখ করেছিলেন মুজিব, তা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বা মাওবাদী ঘরানায় কতখানি গ্রহণযোগ্য ছিল, তা পরের ব্যাপার। কিন্তু এই দলগুলো ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ঠেকানোর নামে স্বাধীনতার পরও যুদ্ধ চালিয়ে গেছে।

    এ ক্ষেত্রে না বললেই নয় যে মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার তার বেশির ভাগই শেখ মনির অংশটির বিরুদ্ধে। অধ্যাপক আহসাবউদ্দীন আহমেদ নামে একজন 'ইন্দিরা গান্ধীর বিচার চাই' নামের একটি বই উৎসর্গ করেছেন ১৬ বামপন্থীর উদ্দেশে, যাঁদের ১৪ জনকে নাকি মুজিব বাহিনী সদস্যরা হত্যা করেছেন। এঁরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার নাপোড়া পাহাড়ে ঘুমন্ত অবস্থায় ব্রাশফায়ারে হত্যার শিকার হন। একইভাবে সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় কাজী জাফর-মেনন গ্রুপের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির নেতা সৈয়দ কামেল বখতের হত্যার দায়ও মুজিব বাহিনীর ওপর চাপিয়েছেন তাঁর বড় ভাই এরশাদ সরকারের প্রতিমন্ত্রী দিদার বখত। নরসিংদীতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেও লড়াইয়ে একপর্যায়ে সমঝোতা করেন সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক। এ ছাড়া পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে বন্দি ও রাঙামাটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা স্বপন চৌধুরীকে (ছাত্রলীগের সম্মেলনে সমাজতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবনার উদ্যোক্তা) গুম করার অভিযোগও ওঠে শেখ মনি গ্রুপের বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে অভিযোগগুলো বেশির ভাগই এসেছে স্বাধীনতার পর জাসদে যোগ দেওয়া নেতাদের তরফে এবং তখন তাঁদের প্রতিপক্ষ হিসেবে বড় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন শেখ মনি। স্বাধীনতার পর পর যখন মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণের অনুরোধ করে ভারতীয় বাহিনী ও দেশে ফেরা বাংলাদেশ সরকার, তখন মনিই রুখে দাঁড়ান এই বলে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে না ফেরা পর্যন্ত তাঁর দলের কোনো সদস্য অস্ত্র নামিয়ে রাখবে না।

    ইতিহাসের রহস্যময় অংশ
    মুজিবনগর সরকারের অলক্ষ্যে গড়ে ওঠা 'মুজিব বাহিনী' শেষ বিচারে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যও উপকারী কোনো সংগঠন হিসেবে কাজে আসেনি, যার প্রমাণ মিলেছে স্বাধীনতার পর। মুজিবনগর সরকারকে বিরক্ত না করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকা কিংবা অনুগতদের আদর্শিক লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধকরণ কিংবা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে র-এর নীলনকশার বাস্তবায়ন_যেভাবেই এর মূল্যায়ন করা হোক না কেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুজিব বাহিনী বরাবরই রয়ে গেছে রহস্যঘেরা।

    http://www.kalerkantho.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=27-03-2011&feature=yes&type=gold&data=Travel&pub_no=468&cat_id=3&menu_id=77&news_type_id=1&index=2
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ২০:১৬582895
  • বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে একটাই ইনডেমনিটি : সেটা মুক্তিযোদ্ধাদের
    ২২ শে নভেম্বর, ২০০৯ ভোর ৪:২৮ |

    অমি রহমান পিয়াল
    ____________________________________________

    ১৯৭৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যাসহ সকল অপরাধকে ক্ষমা করা হয়েছে , তাদের বিরুদ্ধে কোনোমতেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলা যাবে না এই আদেশ বলে। এই আইনে লেখা হয়েছ :

    1
    1. (1) This Order may be called the Bangladesh National Liberation Struggle (Indemnity) Order, 1973.

    (2) It shall come into force at once and shall be deemed to have taken effect on the 26th day of the March, 1972.

    2
    2. No suit, prosecution or other legal proceeding shall lie in any Court against any person for or on account of or in respect of any act done during the period from the 1st day of March, 1971 to the 16th day of December, 1971, in connection with the struggle for national liberation or for maintenance or restoration of order up to the 28th day of February, 1972.
    3
    3. A public prosecutor shall, upon the Government certifying that a case against any person in the service of the Republic or against any other person for or on account of or in respect of any act done by him during the period from the 1st day of March, 1971, and the 28th day of February, 1972, is an act done in connection with national liberation struggle or for maintenance or restoration of order, apply to the court and upon submission of such application the court shall not proceed further with the case, which shall be deemed to be withdrawn, and the accused person shall forthwith be discharged.

    4
    4. The Government may make rules for carrying out the purposes of this Order.
    যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে মরিয়া জামাত-শিবিরের পেইড ব্লগাররা প্রোপোগান্ডা ছড়াচ্ছে রক্ষী বাহিনী নিয়ে, তাদের নাকি সকল আইনের উপর রেখে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছিলো মুজিবের শাসনামলে। ডাহা মিথ্যে বলছে এইসব বাংলাদেশ বিদ্বেষী মোনাফেকরা। জামাতি টাকায় (শুকরশাবক মোশতাক আহমেদের ভাগিনা) দৈনিক আমার দেশে ফালতু সব আইনের কথা তুলছে এই শুয়েরের দল।
    রক্ষীবাহিনী বিষয়ে একটা আইনই আছে , তা সেনাবাহিনীতে তাদের আত্তিকরণ আইন। যা প্রণীত হয়েছিলো ৯ই অক্টোবর ১৯৭৫, যদিও তা কার্যকর ধরা হয়েছে সে বছরের ৩রা সেপ্টেম্বর থেকে। মুজিব নিশ্চয়ই কবর থেকে উঠে এসে সেই আইন জারি করেননি। নিজেরা গর্দভ, পাবলিকরেও ভাবে তাই।

    http://www.somewhereinblog.net/blog/omipialblog/29047651
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৬ মার্চ ২০১৩ ২০:২০582896
  • বাংলা সাব-টাইটেল ও স্ক্রিপ্টসহ জামাতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবু আলা মওদুদীর পুত্র সৈয়দ হায়দার ফারুক মৌদুদীর সাক্ষাৎকার
    লিখেছেনঃ আমার ব্লগ গবেষণা ... (তারিখঃ বুধবার, ০৬/০৩/২০১৩ - ০৫:২১)
    _________________________________________________________

    জামাতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবু আলা মওদুদীর পুত্র সৈয়দ হায়দার ফারুক মৌদুদীর সাক্ষাৎকারটি পাকিস্তানের রয়েল টিভিতে প্রচারিত হয়েছিল ২৮ মে ২০১১ সালে। উর্দুতে দেওয়া এ সাক্ষাৎকারে জামাতে ইসলাম এবং জামাতের পাকিস্তানভিত্তিক ছাত্র সংগঠন জমীয়াতের রাজনীতি, বাংলাদেশের গণহত্যায় জামাত-জমীয়াতের (পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামী ছাত্রসংঘ/বর্তমানে ছাত্র শিবির) ভূমিকা এবং তার বাবার সাথে জামাতের সম্পর্কের নানাদিক উঠে এসেছে।

    সাক্ষাৎকারটির উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলা সাবটাইটেল যোগ করে এখানে তুলে ধরা হলো। আশাকরি জামাতে ইসলামের ইসলামের নাম ভাঙিয়ে ভন্ডামী রাজনীতির মুখোশ খুলতে একটু হলেও কাজে লাগবে।

    ১ম অংশঃ

    এখানে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে জামাত এবং তাদের ছাত্র সংগঠন দলগতভাবে গণহত্যার সাথে জড়িত ছিল সে বিষয় সহ সেসময়ের রাজনীতির কিছু অংশ উঠে এসেছে।

    উপস্থাপক:
    আজকে আপনাদের সামনে পরিচয় দিচ্ছি সৈয়দ আবু আলা মওদুদী সাহেবের ছেলে সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদীর সাথে যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে একাই দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারে। শাহ সাহেব আসসালামুয়ালেকুম

    ফারুক মৌদুদী:
    ওয়ালাইকুমআসসালাম।

    উপস্থাপক:
    বর্তমান অবস্থা এমন কেন, কী হচ্ছে এসব?

    ফারুক মৌদুদী:
    প্রথম কথা হচ্ছে ঐসব লোকেরা কোথায় যারা সৈয়দের সাথে কাজ করেছে, আজকের বাস্তবতায় জামাত জমীয়ত-এর হাতে চলে গেছে। কাজী হোসাইন আহমেদ, মনিরুল হাসান এরা সকলে জমীয়ত-এর লোক। ইয়াকাদবুলুদ, হাবিল ইদ্রিস এরা সবাই জমীয়তের লোক। জমীয়ত আমাদের এখানে বদমায়েশি, গুন্ডাগিরি, ধ্বংসযজ্ঞ, খুন যা যা করেছে এখন ওরা সেটা জামাতের উপর ভর করে সারাদেশে তা করার চেষ্টা করছে। আপনার সম্ভবত মনে নাই যে গোলবারে মুজিবের ছিল তারা তাকে ঐ মিটিং করতে দেয়নি এবং সে মিটিং-এ আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। এরপর শেখ মুজিব বলেছিল মওদুদী তুমি আমার মাটিতে পা রেখে দেখাও এবং একটা মিটিং করে দেখাও। তারপর আমার বাবা ওখানে গিয়ে পল্টন পর্যন্ত পৌছাতে পারে নাই। পরে এরা ভাষানীর উপর প্রতিশোধ নিয়েছে তাকে চড়-থাপ্পড় মেরেছে, দাড়ি ধরে টেনেছে এবং তার চোখে মরিচ দিয়েছে। এরপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সাথে মিলে ওখানে আলবদর ও আলশামস গঠন করে এবং খুররাম মুরাদ আলবদর ও আলশামস-এর ইনচার্জে ছিল। হামিদুর রহমান কমিশন বলেছে; ঐ শয়তান খুররাম মুরাদ পনের জন পনের জন করে বাঙালীদের লাইনে দাড় করিয়ে থ্রিনটথ্রি দিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। ঐ লোকগুলো ধর্মের নামে যে গুন্ডাগিরি-বদমায়েশি করেছে এখন আমরা তার শিকার হচ্ছি।

    ২য় অংশঃ

    এখানে পাকিস্তান জামাত নেতাদের দুর্নীতি এবং তাদের আয়ের উৎস নিয়ে কথা বলেছেন। একই বিষয় বাংলাদেশের জামাত নেতাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদদের আয়ের উৎস কী আমরা কি জানি? তাদের বর্তমান এত সম্পদ কীভাবে এল??

    ফারুক:

    মাফ করবেন জামাত গরীব কি না আমি জানিনা তবে জামাতে যারা আসছে তারা কোটিপতি। জামায়াতে ইসলামী দেশের নামে যে লুটপাট করেছে তার প্রমাণ রাখি তবে আপনার চোখ খুলে যাবে। কাজী তার সাক্ষাৎকারে বলেছে তার বাবার ঘরে একটা বাতি জ্বলত কিন্তু এখন তার ইসলামাবাদে বাড়ী দেখেন। এখন কাজী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কী কাজ করছেন, এসব কোথা থেকে এসেছে। সে নিজে বলেছে ১৪ কোটি রুপি নেওয়াজ শরীফের কাছ থেকে নিয়েছে, সেসব টাকার হিসাব কোথায়?

    ৩য় অংশঃ

    জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদী তার নয় ছেলেমেয়ের একজনকেও জামাতে ইসলামের সাথে সংযুক্ত হতে দেননি। মওদুদীর ছেলের মতে একজন মাদক ব্যবসায়ী নিজে মাদকের কারবার করলেও তার ছেলেমেয়েদের যেমন তা থেকে দূরে রাখেন তেমনি তার বাবা তাদের দূরে রেখেছেন। এবং কেন কেন রেখেছেন তাও বলেছেন।

    উপস্থাপক:

    তাহলে আমাকে বলেন জামায়াতে ইসলামী কি কাজী হুসাইন আহম্মেদের ছেলের পৈত্তৃক সম্পত্তি, আর খলীল আহম্মেদের বাচ্চাদের পৈত্তৃক সম্পত্তি জামায়াতে ইসলামী?

    ফারুক মৌদুদী::
    দেখেন জামাতে ইসলামী মাওলানা মওদুদীর ছেলেদের পৈত্তৃক সম্পত্তি না।

    উপস্থাপক:
    কেন?

    ফারুক মৌদুদী:
    উনি আমাদের জামাত ও জমীয়ত থেকে এমনভাবে দূরে রেখেছেন যেভাবে মাদক বিক্রি করা কিছু লোক আছে না যারা মাদকদ্রব্য ঘরে নিয়ে আসেনা বাইরে রেখে আসে। মাদক ব্যবসায়ীর মত উনি আমাদের একইভাবে জামাত থেকে দূরে রেখেছেন। আমরা ওনার প্রতি কৃতজ্ঞ যে উনি আমাদের জমিয়ত থেকে দূরে রেখেছেন। আমাদের নয় ভাইবোনের মধ্যে কেউ-ই জামাত বা জমিয়তের সাথে ছিল না কেউ না। উনি আমাদেরকে এমনভাবে দূরে রেখেছেন যে মাদক ব্যবসায়ীরা যেমন ঘরে আসবার সময় মাদক বাইরে রেখে আসে তেমনি আমাদের বাবা জমীয়তের সবকিছু থেকে আমাদের দূরে রাখতেন। আমরা জামাতের কোন মিটিং দূও থেকে দেখলেও তিনি বলতেন এখানে তোমাদের কী কাজ? এখানে কী করছ? আমাদের একদম বাইরে রেখেছেন জমীয়ত থেকে।

    উপস্থাপক:
    কিন্তু তার উদ্দেশ্য কী ছিল?

    ফারুক মৌদুদী::
    কারন উনি জানতেন এর ফলাফল কী হবে। কিন্তু তারপরও দেখেন আমাদের উপর গুন্ডাগিরি, বদমায়েশি করেছে।

    ৪র্থ অংশঃ

    জামাতে ইসলামী জন্মকাল হতেই যে একটি ফ্যাসিস্ট দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটা এখানে উঠে এসেছে। তার মতে জামাত একটি ধর্মীয় বদমাশের দল।

    উপস্থাপক:
    আচ্ছা স্যার, জামাট কি মওদুদীর মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়েছিল?

    ফারুক মৌদুদী:
    দেখেন কথা হচ্ছে ঐযে... জামাতের আমীরের বিরুদ্ধে যাওয়া হলো কাফেরের সমান। আমি একটি কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি যখন জামাতের শুরু হয়েছিল ১৯৪১ সালে, তখন মাওলানা আবুল কালাম আযাদ আমার বাবাকে বলেছিলেন, “তোমরা যে দল বানাচ্ছ তার গঠন-কাঠামো কেমন হবে?” আমার বাবা ওনাকে জামাতের সংবিধান দিলে উনি বলেছিলেন, ‘আগামীকাল এ বিষয়ে জানাব’। পরেরদিন সেটা পড়ে উনি বলেছিলেন এটা ফ্যাসিস্ট দলে পরিণত হবে। এখানে সকল ক্ষমতা তো জামাতের আমীরকে দেওয়া হয়েছে, সেনাপ্রধানের মত যাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবেনা। আল্লাহ পাকিস্তানীদের এই ধর্মীয় বদমাশদের হাত থেকে রক্ষা করুক।

    উপস্থাপক:
    আমার মনে আছে আমি মিয়া তোফায়েল আহম্মদ স্যারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। উনি বলেছিলেন- আমি হুসাইনকে যে জামাত দিয়েছিলাম তা দুধের মত পরিষ্কার বা সাদা ছিল কিন্তু উনি তাতে পানি মিশিয়ে মিশিয়ে লাচ্ছি বানিয়ে ফেলেছেন। মিয়াসাহেবর নিজ জীবনে হুসাইন সাহেব সম্পর্কে এ ধারণা ছিল। উনি বলেছিলেন মিয়া সাহেবের জীবনে এমনকিছু সৃষ্টি হয়েছিল যার জন্য যে জামাতে ইসলাম তার নিজের আসল লক্ষ্য থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।

    ৫ম অংশঃ

    মাওলানা মওদুদী তার শেষ জীবনে তার নিজের প্রতিষ্ঠিত দল জামাতে ইসলামী হতে প্রতারিত হয়েছিলেন। এমন কি মওদুদীর মৃত্যুর পেছনে জামাতকে দায়ী করেছেন মাওলানা মওদুদীর ছেলে। তার মতে তারা এখন তার বাবার করে যাওয়া পাপের শাস্তি ভোগ করছে।

    উপস্থাপক:
    মিয়া সাহেবের (মিয়া তোফায়েল আহম্মেদ) জীবনে এমনকিছু সৃষ্টি হয়েছিল যার জন্য যে জামাতে ইসলাম তার নিজের আসল লক্ষ্য থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।

    ফারুক মৌদুদী:
    দেখুন আমাদের সবথেকে বড় যে দুঃখ বা হতাশা হলো মিয়া সাহেব যিনি আমার বাবার নিকট ব্যক্তি ছিলেন। যখন আমার বাবা আমেরিকা থেকে চিঠি লিখলেন যে হাসপাতালে বিল পরিশোধ করতে হবে কিন্ত আমি আমার ছেলেদের কাছ থেকে টাকা নিতে চাই না। আমা যে রয়েলিটি জমা আছে সেখান থেকে টাকা টা যদি দিতেন। তার উত্তরে মিয়া সাহেব তখন জবাব দেন, জামাতে রয়েলিটি জমা করা আপনার কাজ কিন্তু ব্যক্তিগত খরচের জন্য জামাতে ইসলাম না। আমার মা সেই চিঠি দেখে কেঁদে ফেলেন এবং ইন্নানিল্লাহে বলে চিঠি রেখে দেন। ২য়ত, আহমেদ ফারুক সাহেব বেঁচে আছেন আমি ওনার সাথে আপনাকে ফোনে কথা বলিয়ে দিতে পারি। উনি আমাকে বলেছেন বাবার সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, উনি সুস্থ্য হয়ে উঠছিলেন। আমরা পরেরদিন ওনাকে হাসপাতাল থেকে নিতে যাচ্ছিলাম তখন খুররাম মুরাদ আসে এবং বলে জামতের আমীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আছে যা ওনাকে বলতে হবে। ড. আহমেদ ফারুক সাহেব তাকে জানান এই মুহুর্তে ওনার সাথে এসব বিষয়ে কথা বলায় ডাক্তারের নিষেধ আছে। তখন খুররাম বলে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আমাকে দিতেই হবে। তখন ফারুক সাহেব বাবাকে গিয়ে সেটা জানালো। বাবা বললেন কী সংবাদ আছে, আচ্ছা ঠিক আছে ডেকে দাও। ফারুক সাহেব ওনাকে নিয়ে গেলেন এবং ভেতরে গিয়ে গিয়ে খুররাম মুরাদ ফারুক সাহেব কে বলে- আপনি জামাতের কেউ নন, আপনি বাইরে চলে যান, আপনার সামনে এগুলো বলা যাবে না। তারপর উনি বাইরে গেলেন এবং দুই মিনিট পরে বাবার বড় ধরনের হার্ট অ্যাটাক হয়। জানিনা এই বদমাশ কি করেছিল, ওনার মুখের উপর থুথু ফেলেছে নাকি দাড়ি ধরে টেনেছে না কাপড় ধরেছে না গালি দিয়েছে আমি বলতে পারব না শুধু জানি হার্ট এ্যাটাক। এরপর উনি ফেরার পর আমি মিয়া সাহেবের কাছে যাই এবং বলি কি সংবাদ ছিল যা উনি সহ্য করতে পারেননি। উনি বললেন, “আমি তো কোন সংবাদ দেইনি। কে বলেছে আমি সংবাদ পাঠিয়েছি! এখানে আমার ভুল কোথায়!” তারপর খুররামের কাছে যাই এবং বলি মিয়া সাহেব তো এসব বলছেন। সে বলে, তোমার বাবার কি দাম আছে, তোমার বাবার বই কে পড়ত? তুমি কি বলতে এসেছ? বই তো সবার আমার পড়ে”। বদমাশের এ সব কথা শুনে আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। এ সব রেকর্ড কথা। ডাক্তার সাহেব কে জিজ্ঞাস করেন আমি আপনাকে ফোনে কথা বলিয়ে দিতে পারি। এটা একদম সত্যি কথা। আমি জানিনা আমার বাবা এই কাজ কেন করেছিল, কী কারনে করেছিল আর আমি ওনার কাজের কেমন শাস্তি পাচ্ছি, খোদা জানেন।

    http://www.amarblog.com/research/posts/161613
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.25 | ০৭ মার্চ ২০১৩ ১২:১৮582897
  • ফেবু'র একটি নোট:
    ____________________________

    ["পশ্চিমবঙ্গে জামাতি সক্রিয়তা : একটি আহ্বান
    by Kafir Mahasina on Thursday, March 7, 2013 at 12:32am ·
    শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে দেখি এখন বেশ একটা শোরগোল চলছে। সব খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলোকে দেখি হঠাৎ করেই আন্দোলনকে সমর্থন করতে শশব্যস্ত হয়ে পড়েছে, যেন বেশ একখানা গরম খবর পাওয়া গেছে! খবরের কাগজ পরে আর দুই-চারদিন ইন্টারনেট ঘেঁটে নতুন নতুন আবিষ্কার করা ‘রাজাকার’, ‘জামাত’ ইত্যাদি শব্দগুলো সাধারন মানুষ, বিশেশত ছাত্র ও যুবসমাজের মুখে মুখে ফিরছে। বিভিন্ন কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো দেখি শাহবাগ আন্দোলনকে সমর্থন করতে উঠে পড়ে লেগেছে, খানিকটা ফ্যাশনের মতো।

    মনে হতে পারে, এ নিয়ে আমি ব্যঙ্গ করছি কেন ? করার সঙ্গত কারণ আছে। যাদের কাছে বাংলাদেশ মানে শুধু ঢাকা ইলিশ আর হাসিনা, যারা জানেই না বাংলাদেশের পরিস্থিতি কি, যারা চেনে না বাংলাদেশের এই নতুন প্রজন্মকে, তারা আচমকা এমন রাস্তায় দাঁড়িয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে ‘জয় বাংলা’ আর ‘রাজাকার হটাও’ ব্যানার নিয়ে চিল্লাচ্ছে -- ব্যঙ্গ না করে থাকা যায়!
    যারা এসব করছেন তাদেরকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। আপনারা জানেন, বাংলাদেশি তরুণ তরুণীরা কাদের নিষিদ্ধ করতে এইভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে নেমেছে? সারা রাত জেগে আন্দোলনকারীদের সচেতন করেছে কাদের নতুন নতুন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে? কারা এই জামাতী ? ঠিক জানেন না, তাই তো! না জানাটাই স্বাভাবিক। কেননা খবরের কাগজের রিপোর্টারগুলোর এখনো পর্যন্ত সময় হয়ে ওঠেনি তলিয়ে দেখার জন্য একটু খোঁজাখুঁজি করার। তবে যেহেতু এই আন্দোলনের প্রথম থেকে আমি প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী, তাই কিছুটা বলার অধিকার তো থাকেই, বলাটা কর্তব্যও ।

    জামাত বলতে বাংলাদেশে বোঝায় ‘জামাআত ই ইসলামী’ নামে একটি আন্তর্জাতিক গোঁড়াপন্থি সুন্নি মুসলিম ধর্মিয় সংগঠনের বাংলাদেশ-শাখাকে, যার জন্ম ১৯৪১ সালে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে লাহোরে (বর্তমানে পাকিস্তানে) এবং জন্মদাতা সৈয়দ আবুল আলা মউদুদী।
    এই সংগঠনটির সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য—
    ১) ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এদের ভূমিকা শূন্য, কিন্তু ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টিতে এদের বিশাল ভূমিকা।
    ২) এই সংগঠনটি তৈরি করা হয় পলিটিক্যাল ইসলামের প্রচার করতে। পলিটিক্যাল ইসলামের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের ইসলামী-করন। অর্থাৎ এরা যে রাষ্ট্রেই থাক না কেন এদের উদ্দেশ্য একটাই রাষ্ট্রটিকে মধ্যযুগীয় আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করা।
    ৩) বর্তমানে (পাকিস্তান ছাড়া) ভারত এবং বাংলাদেশে সক্রিয় থাকলেও এই সংগঠন কালও পাকিস্তানী ছিল আজও পাকিস্তানী এবং ভবিষ্যতেও পাকিস্তানীই থাকবে।
    ৪) যারা মনে করেন যে ইসলাম সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে না, তাদের জানিয়ে রাখি এরা কিন্তু সন্ত্রাসবাদীদের শিরোমণি ওসামা বিন লাদেন কে প্রকৃত মুসলিম এবং জেহাদ-কারী শহিদ বলে মনে করেছেন এবং সর্বত্রই ভারতবর্ষ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এরা লাদেনের প্রতীকী জানাযার অনুষ্ঠান করেছে। এই তিনটি দেশে সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থনে এরা কথা বলে এসেছে এবং ধারাবাহিকভাবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের উপর সন্ত্রাসী আক্রমণ চলিয়েছে।
    ৫) ইসলামের সমালচনা এরা সহ্য করে না, কিন্তু অন্যধর্মের সমালচনা করার কোনও সুযোগ হাতছাড়া করে না।কেউ ইসলামের বিরোধিতা করলে কিম্বা মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ইসলামী জীবনযাপন না করলে এরা তাদের শত্রু গণ্য করে।

    বাংলাদেশে নিত্যদিন জামাতিরা অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে। অমুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের বাড়িতে কোনও কারণ ছাড়াই আচমকা আক্র্মন ধর্ষণ হত্যা করে তাদের মধ্যে স্থায়ী সন্ত্রাস সৃষ্টি করে রাখতে এরা বদ্ধপরিকর। এরা পয়লা বৈশাখ পালনের বিরুদ্ধে, একুশে ফেব্রুয়ারির বিপক্ষে, বসন্তোৎসবের বিপক্ষে, রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে, বাংলাদেশের স্বাধীনতারও বিপক্ষে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এরা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা ও তার পরবর্তি সময়ে এদের ইসলামীকরনের চোটে দেশের অমুসলিমরা তো বটেই এমনকি শিক্ষিত মুসলিম সমাজও শশব্যস্ত। দেশের একাধিক বুদ্ধিজীবীকে খুন বা খুনের চেষ্টা এরা করেছে এবং করে চলেছে।

    তাই দীর্ঘদিন পরে হলেও স্বাধীনচেতা আধুনিক মনস্ক সমাজ তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে গন আন্দোলন শুরু করেছে। কিন্তু যতই আন্দোলন তারা করুক না কেন, জামাত কে নিষিদ্ধ করা সহজ হবে না । কেন না এরা আজ বাংলাদেশের সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে জায়গা করে নিয়েছে। তবু সেলাম বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে তারা অন্তত লড়াইটা শুরু করতে পেরেছে।

    এ তো গেল বাংলাদেশের কথা। আজ আমার কলম ধরার কারণ অন্য। এই জামাত এ ইসলামীর ভারতীয় সংগঠন কিছুদিন ধরে আস্তে আস্তে ভারতে সক্রিয় হয়ে উঠছে। অনুকূল পরিবেশে পশ্চিমবঙ্গে তো ইদানীং অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে তারা ছোট বড় ইসলামী দল গুলোকে একত্রিত করছে। তাদের মূল লক্ষ্য সারা ভারতে মুসলিম দলগুলোকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা। এই ব্যাপারে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশের জামাত শাখা। গত জানুয়ারির শেষ পনেরদিন ধরে সারা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি শহরে তারা প্রচার চালিয়েছে। অমুসলিমদের এবং মুসলিমদের মধ্যে পুস্তিকা বিলি করেছে। ভারতের ইসলামী- করন জরুরি এমন কিছু বিশয়ের পুস্তিকাও বিলি করেছে। অবশ্য পুস্তক বিলির সময় নাম জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল। কেননা অমুসলিমদের জন্য বই আলাদা, মুসলিমদের জন্য আলাদা।

    এরা পশ্চিমবঙ্গে ইতিমধ্যেই অনেকগুলি মুসলিম দলকে একত্রিত করে ফেলেছে। বাংলাদেশে আন্দোলনের বিপক্ষে প্রচার করছে পশ্চিমবঙ্গে। আন্দোলনকারীদের কাফির আর ইসলামবিরোধী বিদেশি মদত-পুষ্ট বলেও প্রচার করছে। এই বাংলার মুসলিমরা কেবলমাত্র এদের জন্য বাংলাদেশের গনআন্দোলনকে সমর্থন করছে না। ভারতবর্ষের মাননীয় রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরের আগে তাকে হুমকির স্বরে বার বার আর্জি জানিয়েছে, যাতে করে তিনি কোনও ভাবেই ‘ইসলাম বিরোধী’ বাংলাদেশের সরকারের সাথে কোনও যোগাযোগ না রাখেন। বাংলাদেশে ভারতবর্শের রাষ্ট্রপতি যাওয়ার পর তার অতিথিশালার বাইরের বোমা বিস্ফোরণের সাথে এর সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য কোনও বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয় না। (তবু মাননীয় রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের হাত শক্ত করেছেন বলে অন্তত স্বস্তি বোধ করছি একজন ভারতবাসী হিসাবে। যে জামাতরা ভারত সরকারকে ভিলেন তৈরির চেষ্টা সর্বান্তকরণে করে থাকে, সেখানে তাদের গালে ভারত সপাটে চড়টা মারতে পেরেছে। ) আজ সমস্যা পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার ভোটের জন্য যে মুসলিম-তোষণ শুরু করেছিল সেটা এখন ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এক বছরে হাফ ডজন মুসলিম পত্রিকা, মুখ্যমন্ত্রীর যত্রতত্র হিজাবী বেশে নিজেকে উপস্থাপন কলকাতার বুকে শরিয়তি স্টাইলে অনার কিলিং, পুলিশকে দিনে দুপুরে সর্বসমক্ষে হত্যা, একাধিকবার দক্ষিণ ২৪ পরগনায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুটপাট, পোড়ান এবং মহিলা ধর্ষণ স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে পরিচালনা করছে কারা!

    পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এইসব বিষয়ে একেবারেই যে সচেতন নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নয়ত তিস্তা জলবন্টন চুক্তি নিয়ে ভারত সরকারের সাথে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মতবিরোধ এবং শেষ মুহুর্তে মুখ্যমন্ত্রীর বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত পরিমাণ জল দিতে না চাওয়া যে কেবলমাত্র বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ হাসিনা সরকার কে বিপদে ফেলা ছাড়া আর কিছু নয়, তা খুব সহজেই এই দেশের মানুষ বুঝতে পারতো। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কাদের কথায় চলছে আর কাদের হাত শক্ত করছে তা জলের মতো পরিষ্কার হলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুশজন এসব বুঝতে পারছে না বা বোঝার প্রয়োজন বোধ করছে না।

    যাইহোক, এইসব বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। আমি বলতে চাই পশ্চিমবঙ্গ একটি ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছে, ভবিষ্যতে কিন্তু এর পরিণতি আরও ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানুষেরাও প্রথমে বুঝতে পারেনি যে জামাতদের ইসলামের নামে সমর্থন করার ফল কি হতে পারে, আজ তারা তার খেসারত দিচ্ছে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গও আজ সেই একই ভুল করছে। যা এখনি ফল দিতে শুরু করেছে। মিডিয়া এই সাম্প্রদায়িক হিংসার খবর গুলোকে চেপে দিয়ে আরও সর্বনাশ করছে। এভাবে পেইন কিলার দিয়ে রোগ সারানো যে অসম্ভব তা কেউ বুঝতে চাইছে না (কিম্বা হয়ত সরকারী চাপ আছে)। তবে সামনের দিনগুলো আরও ভয়ঙ্কর হতে চলেছে এই বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন, যে বুদ্ধিজীবীরা এখন চুপ আছেন, নীরবে থেকে এড়িয়ে চলছেন, কাল যখন সহ্য করতে না পেরে মুখ খুলবেন তখন হয়ত বাংলাদেশের হুমায়ুন আজাদ আর আহমেদ রাজীব দের অবস্থা হবে।

    মাননীয় রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় বড়সড় সাংবাদিক সম্মেলন করে জামাতে ইসলামী ( এবং তাদের ছত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ মুসলিম দলগুলি সম্মিলিত ভাবে) যা দাবী করেছে, তার সারমর্ম এরকম—
    ১) বাংলদেশ নাকি আন্দলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেলোয়ার হোসেন সাইদীকে ফাঁসীর নির্দেশের পর থেকে।
    ২) কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই বাংলাদেশে মুসলিম ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে।
    ৩) পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষজন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে এমনতর ইসলাম বিরোধিতা দেখে।
    ৪) বাংলাদেশের আন্দোলন আদতে নাকি সরকার বিরোধী আন্দোলন, সরকার এই আন্দোলনে গনহত্যা চালাচ্ছে।

    এই দাবীগুলি যে সর্বৈব মিথ্যা তা বলাই বাহুল্য। মজার কথা হল, এত বড় একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এত কথা বলা হলেও কোনও সাংবাদিককে একটিও প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। এইজন্য সাংবাদিকরা ক্ষোভে ফেটে পরেন সম্মেলন শেষে। এবং প্রশ্ন করার অধিকারের কথা বললে মুসলিম নেতারা একজন সাংবাদিককে বেশ মারধর করেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে।
    আমি পশ্চিমবঙ্গের এই ছাত্র ও যুবসমাজকে জানাতে চাই, এখন আমাদের বাংলাদেশের কথা পরে ভাবলেও চলবে। বাংলাদেশে যা পরিস্থিতি, তাতে জামাত এ ইসলামী ও তার সহযোগীদের পক্ষে খুব একটা সুবিধা হবে না সেখানে থাকা। তারা যেন তেন প্রকারেণ পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে চাইছে (এবং ঢুকছে), কেননা এটাই তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এখানে একবার চলে এলে তাদের আশ্রয় দেবে এখানকার জামাত সংগঠন এবং রাজ্যসরকার। তখন এরা দুই বাংলায় তাদের ক্রিয়াকলাপ চালাতে পারবে নিরাপদে। ফলে দুই বাংলার ধর্মনিরপেক্ষতা কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে পড়বে। চানক্যের একটি কথা মনে পরে গেল। তিনি বলছেন, “অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা নাও কেননা, সব ভুল নিজে করে শেখার মতো যথেষ্ট দিন তুমি একটা জীবনে পাবে না”।আমাদের অবিলম্বে উচিত বাংলাদেশের অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া।

    আগামী ২৬ শে মার্চ শহিদ মিনার ময়দানে জামাতে ইসলামী(হিন্দ) এবং তাদের সহযোগীদের বিরাট সমাবেশ করা হবে। আমি পশ্চিমবঙ্গের সচেতন ছাত্র ও যুবসমাজকে আহ্বান জানাই, বাংলাদেশের আন্দোলনকে সমর্থনের পাসাপাসি পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতে এদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সরব হন, প্রতিবাদ জানান। বাংলাদেশের মানুষ যেমন এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে আপনারাও রুখে দাঁড়ান।"]

    https://www.facebook.com/notes/kafir-mahasina/%E0%A6%AA%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%AE%E0%A6%AC%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%87-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%B8%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%86%E0%A6%B9%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A8/221272338018625
  • কল্লোল | 125.242.244.172 | ০৭ মার্চ ২০১৩ ১২:৪৮582898
  • কাফির কেন এতোটা চটে গেছেন জানি না। তবে উনি জামাত সম্পর্কে যেসব তথ্য দিলেন তা তো আমাদের অজানা নয়।
    যুদ্ধপরাধীদের শাস্তি চাই এ স্লোগান তো বহু আগে থেকেই ছিলো। আলী ক্ষমতায় আসার পর জোরদার হয়। এতোদিন দেখে দেখে মানুষ এবার নিজেই পথে নেমেছে।
    পশ্চিম বাংলায় পরিস্থিতি ভালো না। ইসলামী মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পন করে বসে আছে বাম-তৃণ-কং। তসলিমাকে তাড়ানো হয়েছে, রুশদী আসার নামেই গন্ডোগোল হচ্ছে এবং তাতে ধুনো দিচ্ছে শাসকদল। বিরোধীরা চুপ।
    এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কিছু মানুষ যে শহবাগ আন্দোলনের প্রতি সহমর্মীতা জ্ঞাপন করছেন, সেটাই আশার কথা।
    তবে হ্যাঁ, শাহবাগ মিডিয়ায় আসছে তাই লোকে মোমবাত্তি জ্বালাচ্ছে ও গান বাঁধছে - সেটা ভালো। তবে এপারে এরকম উদ্যোগ রামুর ঘটনায় হলে আরও ভালো লাগতো।
  • siki | 132.177.190.82 | ০৭ মার্চ ২০১৩ ১৬:৫৮582899
  • কল্লোলদা, এই ব্যঙ্গের লক্ষ্য হয় তো আমি বা আমার মতন এপার বাংলার লোকজন। শাহবাগের আগে কিন্তু আমি রাজাকার কথাটার মানেই জানতাম না। ফেসবুকে বা অন্যত্র বাংলাদেশীদের আলোচনায় অত্যন্ত বিরক্ত, বোর ফীল করতাম, কারণ ওরা দু-কথার পরেই তিন নম্বর কথায় "তুই পাকিপন্থী", "তুই রাজাকার", "তুই জামাত" ইত্যাদি বলে একে অপরকে গাল পেড়ে থাকেন এবং তারপর অবশ্যম্ভাবী বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এই জামাতি, রাজাকার, পাকিপন্থী, শব্দগুলোর উৎস কী, আমি দীর্ঘদিন জানতাম না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পড়েছি ইতিহাসের বইতে, সামান্য উল্লেখমাত্র, তার বাইরে পড়ি নি। গণহত্যার ঘটনাও পড়েছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের হত্যালীলা, দিনের পর দিন ধরে খানসেনাদের করে চলা লাগাতার ধর্ষণ খুন ইত্যাদির অনেক গল্প পড়েছি, কিন্তু আমার ধারণা ছিল ও সব উনিশশো একাত্তর সালে যা হয়েছিল হয়ে গেছে, এখন তো বাংলাদেশ স্বাধীন, এখনকার ছেলেমেয়েগুলো তা হলে এইসব নিয়ে এত গলা ফাটায় কেন, রুনা লায়লা পাঞ্জাবি উর্দু ভাষায় গান গাইলে তাকে নিকৃষ্টভাষায় গালাগাল কেন দেয় এখনকার বাংলাদেশীরা।

    বুঝতে পারতাম না। আর তাতেই দূরত্ব বেড়ে গেছিল আরও। ফেসবুক আর ব্লগ সাইটে চরে বেড়ানো বাংলাদেশীদের তাই আমি, স্বীকার করি আজ, বরদাস্ত করতে পারতাম না। যেখানেই যাও, দু কথার পর তিন কথায় সেই এক টপিক।

    ঠিক কতখানি অবিচার, কতখানি রাগ, ক্ষোভ, বেদনা পুষে রাখলে যে একটা দেশের একটা প্রজন্ম, দুটো প্রজন্ম এইভাবে ফুঁসে উঠতে পারে, বুঝলাম যখন শাহবাগ সামনে এল। সেই থেকে পড়ছি। পড়ে যাচ্ছি। এখন সমস্ত বুঝছি। ক্ষোভের উৎস। বেদনার অন্তস্থলকে ছুঁতে পারছি।

    আমাকে মুগ্ধ করছে এই আন্দোলন একটা কারণে। ঐ চত্বরে, বাংলাদেশের এখানে ওখানে গড়ে ওঠা অসংখ্য প্রতিবাদ জমায়েতে যে মুখগুলো বসে আছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, তাদের দাবির যাথার্থ্য নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই, কিন্তু যেটা আমায় মুগ্ধ করছে, তারা কিন্তু কেউ উনিশশো একাত্তর দেখে নি। তারা সবাই জন্মেছে একাত্তরের পরে। কিছু পরে, অনেক পরে। কিন্তু দেশের টান, ভাষার টান তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে গেছে এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে। রাজাকার-জামাতী অপরাধীদের যোগ্য শাস্তির দাবিতে তাদের প্রতিবাদ তাই এত স্পষ্ট।

    আমরা পারব? ভারতীয়রা? এপারের বাঙালিরা? উনিশশো সাতচল্লিশের পর থেকে আজ পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতিতে তো অনেক নোংরামো দেখলাম। সুব্রত মুখার্জির শাস্তির দাবিতে জেগে উঠতে পারবে নকশাল আমলের হত্যালীলা দেখা বাঙালি? নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে এককাট্টা হতে পারবে অন্তত একশোটা গুজরাতি?

    আমরা পারি নি এখনও। বাংলাদেশ কিন্তু পেরে দেখিয়েছে। নিজের না-জানার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে তাই, আমি শাহবাগের পাশে আছি। বিপ্লবের লেখা দিয়ে জানছি অনেক কিছু। আরও জানার ইচ্ছে বেড়ে যাচ্ছে।
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.31 | ০৮ মার্চ ২০১৩ ০০:৫৯582900
  • # কল্লোল, # সিকি,

    ঘটনা পরম্পরা এবং পরিপ্রেক্ষিত না জানার কারণে আপনাদের টুকরো আলোচনা অনেকটাই ধরতে পারছি না; তবে এ থেকেও নানান তথ্য ও চিন্তার খোরাক পাচ্ছি, নিজেও শিখছি।

    সিকির শেষ পয়েন্টটিকেই আমি খুব বেশী সমর্থন করছি। এমনকি তার শ্রদ্ধাবোধটুকুও।

    যতদূর মনে আছে, এর আগে পুরনো কোনো টইয়ে গুচ'তে ফারুক ওয়াসিফের আজম খান বিষয়ক একটি নোটের ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছিলাম। এ নিয়ে কল্লোল দা'র সঙ্গে বেশ কিছুটা এঁড়ে তর্ক, উষ্ণা প্রকাশ ও অসৌজন্য আচরণও যথেষ্ট করেছি [এখনো ভাবলে লজ্জা পাই, অনুগ্রহ করে মার্জনা করবেন]।

    গুচ'তে প্রকাশিত ওই লেখায় ফারুক এরকম একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন যে, ১৯৭১ এর বিপ্লবটি বেহাত হয়ে গিয়েছে, এমনকি প্রয়াত পপ সম্রাট ও মুক্তিযোদ্ধা আজম খানেরও।

    এর বিপরীতে সে সময় আমি যা বলতে চেয়েছি, তা অনেকটা এ রকম:

    ফারুকের ওই তত্ত্বের প্রচার মানে হচ্ছে খুব জেনেশুনে বিভ্রান্তি ছড়ানো। একে মিথ্যাচার বলাই ভালো। এর উৎস উগ্র জাতীয়তাবাদ, যার শেকড় প্রায়-মৌলবাদ তথা ফ্যাসিবাদ।

    কারণ, ১৯৭১ এর জনযুদ্ধটি রাষ্ট্র বিপ্লব ছিল না, শুধু একটি ভূখণ্ড স্বাধীন করার লড়াইও নয়, এটি ছিল সত্যিকার অর্থে মুক্তির লড়াই -- মুক্তিযুদ্ধ। একারণে এতে খুব সাধারণ মানুষ, ছাত্র-শ্রমিক-জনতা, জাতীয়তাবাদী, বিপ্লবী, অতি বিপ্লবী, ডান-বাম, এমনকি উগ্র বাম [চীনাপন্থী, যেমন, এসএস, ইবিসিপি], মৃদূ বাম [মস্কোপন্থী], ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু [আদিবাসী] কাতারে কাতারে যোগ দেয়।

    কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব থাকায় এটি শুধু 'বাংলা দেশ' নামক স্বাধীনতা অর্জনেই তারা সমাপ্তি টানতে চায়, অর্জনটিও এককভাবে তারাই দাবি করে [মুক্তির মহামন্ত্র 'জয় বাংলা' শ্লোগানটিও আ'লীগ ছিনতাই করে সাথে 'জয় বঙ্গবন্ধু' জুড়ে দিয়ে দলীয়করণ করে, যেটি ৪২ বছর পর গণজাগরণ আন্দোলন নতুন করে আবার সাধারণের শ্লোগান হিসেবে পুন:প্রতিষ্ঠা করেছে], পরবর্তীতে বিএনপিও মুক্তিযুদ্ধটি [তাদের ভাষায় -- স্বাধীনতার যুদ্ধ] তাদের একক কৃতীত্ব হিসেবে জাহির করে, দুই দল এ নিয়ে বিস্তর ইতরপনায় প্রতিযোগিতায় নামে [২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমানের ছবি টাঙানো নিয়ে বন্দুক যুদ্ধে লাশও পড়েছে], কারো পিতা বা স্বামীর দয়ায় দেশ স্বাধীন হয়েছে, কাজেই তারাই এদেশের বৈধ ইজারাদার -- এটি প্রতিষ্ঠায় ৪২ বছর ধরে প্রত্যক্ষভাবে স্বৈরশাসন ও পরোক্ষভাবে সামরিক স্বৈরশাসন বহাল রাখে [বা মদদ দেয়]।

    উগ্র জাতীয়তাবাদী দর্শন বলেই তারা মুক্তিযুদ্ধে সব মানুষের, সকল ধর্ম, বর্ণ, ভাষাভাষী ও দলের অংশগ্রহণ অস্বীকার করে, সংবিধানে ৭২টি আদিবাসীর ভাষা ও অস্তিত্ব মেলে না... এই দর্শন বলেই ৪২ বছর ধরে দেশ শাসিত [এবং অতি অবশ্যই শোষিত] হচ্ছে, ফলত: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বৈষষ্যহীন ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অধরাই থেকে গেছে, যেনোতেনো ভাবে পাঁচ বছর পার করে নতুন মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিতে 'গণতন্ত্র'কে শুধু ভোটের বাক্সে বন্দী করে আবারো ক্ষমতায় আসে। ...বালি ঘড়ি কেবলই উল্টে যায়, বালি আর বালি। ...

    আজম খানের মুক্তিযুদ্ধটি [এবং সাড়ে সাতকোটি সকল মুক্তিযোদ্ধার] বাস্তবে আদৌ সে রকম দর্শন ও প্রয়োগের ছিলো না, এতে বিপ্লবী উপদান যথেষ্টই থাকলেও ১৯৭১এর জনযুদ্ধটি রাষ্ট্র বিপ্লবও ছিলো না, এটি ছিলো সব ধরণের শোষণ মুক্তির লড়াই [আশু লড়াই অতি অবশ্যই স্বাধীনতা], ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা ফুরিয়েও যায় না, বেহাতও হয় না, [আজম খানের ভাষায়, … "এখন দেশ গড়ার গান করছি। দেশের দুঃসময়ে আমাদের আমি এই প্রজন্মকে অন্য এক মুক্তির গান শোনাতে চাই। কারণ এ দেশেরার অর্থনৈতিক মুক্তি, প্রগতিশীল চিন্তা – চেতনার মুক্তি এখনো আসেনি।…"] অর্থাৎ তার মুক্তিযুদ্ধ/ বিপ্লবটি বেহাতও হয়নি, শেষ হয়েও যায়নি। এটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সকলের। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মুক্তির সংগ্রামটিকে এগিয়ে নিতে হয়।...

    ইত্যাদি, ইত্যাদি।

    http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=20228

    এখন আমরা যারা প্রজন্ম '৭১, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বা তারো পরে জন্ম, তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি ঠিকই, আমরা অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধটিকে সমাপ্ত করার তথা এগিয়ে নেওয়ার অন্তর্নিহিত তাগিদ বরাবরই অনুভব করেছি, আমাদের পূর্বসূরি কাছ থেকেই এটি প্রাপ্ত, নানান পাঠ ও পর্যবেক্ষণ এবং শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তো বটেই, একারণেই শাহবাগের গণজাগরণ-গণবিস্ফোরণ সম্ভব হয়, এটি সত্যিকার অর্থেই হয়ে ওঠে দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ [গুচ'র টইয়ের বিতর্কে যেমনটি বলেছিলাম, তারই এখন বাস্তব রূপ দেখা যাচ্ছে, এ কথাটি গুচ'র সাম্প্রতিক নোট 'জেগে থাকে শাহবাগ! জেগে থাকে বাংলা!'তে বিস্তারিত বলা আছে]। ...

    এই প্রেক্ষাপটেই শাহবাগের তারুণ্য জেগে ওঠে, সেই সূত্রে বাংলাদেশ, ঐতিহাসিক কারণেই পশ্চিম বঙ্গে রাতারাতি আরেকটি শাহবাগের মোহনা তৈরি হয় না...কেন হয় না, সেটি অবশ্য আপনারাই ভালো ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
    ____
    এ সুযোগে জানাই, যারা এই টইয়ে নজর রাখছেন, অংশ নিচ্ছেন, তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা রইলো।
    জয় বাংলা!
  • বিপ্লব রহমান | 127.18.231.31 | ০৮ মার্চ ২০১৩ ০১:১৩582901
  • পুনশ্চ: একটি বিষয় খুব ইন্টারেস্টিং। আমরা যারা প্রজন্ম '৭১, তাদের অসংখ্য নাম -- বিপ্লব, মুক্তি, স্বাধীন, নিশান, সবুজ, জয়, ...ইত্যাদি রয়েছে। কি ছেলের, কি মেয়ের। পূর্বসূরিদের মুক্তির চেতনাটি এতোটাই মারত্নক, ভিসুভিয়াস সমান! ...

    সেল্যুট।।
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৮ মার্চ ২০১৩ ১৯:৩৯582902
  • শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ
    লিখেছেন: আবিদুল ইসলাম • প্রকাশকাল: 7 মার্চ 2013 - 11:20পূর্বাহ্ন
    ___________________________________________________________
    লোপামুদ্রা মিত্রের একটা গান আছে: "এই কাঁটাতার, জঙ্গি বিমান- এই পতাকা রাষ্ট্র নয়" ...

    এই গানের গীতিকার কে এটা আমি জানি না। কিন্তু যিনিই হোন, তার যে রাষ্ট্র সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল না সেটা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। রাষ্ট্র হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী কর্তৃক অপরাপর শ্রেণীসমূহের ওপর আধিপত্য বিস্তার এবং বলপ্রয়োগের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। আর এই প্রতিষ্ঠানের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার যে লড়াই বিদ্যমান থাকে, সেটাই হলো রাজনীতি। এ বিষয়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক খুব চমৎকার একটা কথা বলেছেন: "একটা জাতির রাজনীতি হচ্ছে, সমাজের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর অবস্থান ও ক্ষমতা নির্ধারণের সংগ্রাম।" বিভিন্ন শ্রেণীর নির্দিষ্ট মতাদর্শ থাকে, সেই মতাদর্শের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রক্ষমতায় তার দখল প্রতিষ্ঠার পর যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বুর্জোয়া রাজনীতিতে এই মতাদর্শ, লক্ষ্যের অনেকটাই থাকে অনুল্লিখিত, অনুচ্চারিত। তারা নিজেদের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের পেছনে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সমাবেশ ঘটিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করে, কিন্তু রাষ্ট্রের মালিকানা লাভের পর নিজের শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধারই তার প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। আর এই স্বার্থোদ্ধারের প্রশ্নে সেনানিবাস, আন্তর্জাতিকভাবে আইনের দ্বারা চিহ্নিত সীমানা (কাঁটাতার, জঙ্গি বিমান) এবং সেই সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অন্যান্য অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হলো রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার মূল হাতিয়ার।

    শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণকেও এই প্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে। সংসদীয় রাজনীতিক হিসেবে তার নেতৃত্বগুণ ছিল অসাধারণ, মানুষের চিন্তার পালস তিনি ধরতে পারতেন। একজন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ হিসেবে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর জাতিগত নিপীড়নের বিষয়টি তিনি সঠিকভাবে সামনে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। এই কারণে তার পেছনে ঘটেছিল বিপুল জনসমাগম। অন্যদিকে কমিউনিস্ট রাজনীতিকদের একটা বড় অংশই তখন রাষ্ট্রীয় শোষণ-নিপীড়নের ক্ষেত্রে জাতিগত বৈশিষ্ট্যের প্রশ্নটিকে সামনে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যে কারণে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের নেতৃত্ব তারা দিতে পারেন নি। সেই হিসেবে ৭ মার্চের ভাষণের একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। কিন্তু শেখ মুজিব এই বক্তৃতা যখন দিতে দাঁড়ালেন তার চোখে কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল না। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাথে জয়লাভ করেছিলেন, তার ইচ্ছে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক শাসক গোষ্ঠীর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির মাধ্যমে হলেও একটি সরকার গঠন করা। এরজন্য তিনি ভুট্টো এবং ইয়াহিয়ার সাথে বৈঠকে বসেছিলেন। কিন্তু ৭ মার্চে তিনি যে বললেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'- এটি বলার জন্য তার ওপর তৎকালীন ছাত্রনেতাদের প্রেশার ছিল। রেসকোর্স ময়দানের বিপুল জনসমাগম ছিল তার জন্য পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর কাছে নিজের জনসমর্থনের ব্যাপকতা প্রদর্শন করে একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি এবং দর কষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধির অপূর্ব সুযোগ। কিন্তু ইয়াহিয়া সহ পাকিস্তানী গোষ্ঠী এই জনসমর্থন দেখে তার হাতে ক্ষমতা অর্পণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারা বহু আগে থেকেই সামরিক উপায়ে এই সমস্যা মোকাবেলার ফন্দি এঁটেছিল।

    ৭ মার্চের ভাষণকে যদি স্বাধীনতার ঘোষণা বলে ধরে নেয়া যায় তাহলে সেদিন থেকেই মুক্তির লড়াই শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট সেনাবাহিনী যখন নিরীহ বাঙালি জনগণের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন এদেশের জনগণ ছিল সম্পূর্ণরূপে অপ্রস্তুত অবস্থায়। নিজের লোকজনের মাধ্যমে শেখ মুজিব পাকিস্তানী শাসকদের সৈন্য সমাবেশ, সামরিক প্রস্তুতি, অস্ত্রশস্ত্র আমদানির খবর পাওয়ার পরও বাঙালি অফিসারদেরকে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে কোনো নির্দেশনা দেন নি, যদিও বলা হয় যে দেশ নাকি তখন চলছিল অলিখিতভাবে তার আঙুলের ইশারায়। উপরন্তু তাজউদ্দীন আহমদ যখন ৩২ নম্বর বাসভবনে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে গিয়ে শেখ মুজিবকে সেটি পাঠ করার জন্য অনুরোধ করেন তখন তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানান। তার ভয় ছিল এর মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হলে পরবর্তীতে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে তার বিচার করতে পারে! বলাই বাহুল্য তারা সেটি করে নি, শেখ মুজিব যুদ্ধের নয় মাস এবং তারপরেও বেশ কিছুদিন পাকিস্তানিদের নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে ভালোভাবেই সময় কাটিয়েছিলেন। দেশজুড়ে এই নয় মাসে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী যে হিংস্র তাণ্ডব চালিয়েছিল, যে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ সহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করেছিল তার কোনো কিছু শেখ মুজিবের পরিবারের লোকজনেরকেও স্পর্শ করে নি। এটা এক ঐতিহাসিক সত্য, যা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

    তাহলে ৭ মার্চে শেখ মুজিবের ভাষণকে আমরা কোন পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করব? শেখ মুজিব সংসদীয় রাজনীতিক ছিলেন, ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক। তিনি পাকিস্তানি শাসকদের জাতিগত নিপীড়ন-শোষণের বিপরীতে বাংলার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষাকে তার নেতৃত্বগুণে এক নতুন পর্যায়ে উপনীত করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের তৎকালীন যে আশা-আকাঙ্ক্ষা, যার সাথে পাকিস্তান-কেন্দ্রিক শাসক গোষ্ঠীর স্বার্থ ছিল সাংঘর্ষিক- সেটিকে যথার্থ রাজনৈতিক উপায়ে মোকাবেলা করা তার দ্বারা সম্ভব ছিল না। একদিকে বিপুল জনগণের আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন- যার সাথে ছিল তরুণ ছাত্রনেতাদের চাপ, অন্যদিকে সংসদীয় কাঠামোর মধ্যে পাকিস্তানি শাসকদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি ও সমঝোতার প্রশ্ন- এই উভয় সঙ্কটে পড়ে তিনি ছিলেন দোদুল্যমানতার ভেতরে, যা তাকে পাকিস্তানি শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতা ও সামরিক উপায়ে সঙ্কট মোকাবেলার প্রস্তুতির বিপরীতে এদেশের জনগণকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু ৭ মার্চের সমাবেশে যে জনগণ বিপুল সংখ্যায় উপস্থিত হয়ে শেখ মুজিবের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন তাদের চোখে ছিল মুক্ত, স্বাধীন দেশের স্বপ্ন, তারা চেয়েছিলেন ২৪ বছরের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়ে রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বাঁচা ও জীবন যাপনের অধিকার।

    কিন্তু যেটা পূর্বেই বলেছি, শ্রেণীবৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র হলো একটি শ্রেণী কর্তৃক অন্য শ্রেণীসমূহের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার প্রধানতম প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের বাঙালি বলে যাদের আমরা অভিহিত করি, তারাও কোনো অখণ্ড সত্তা ছিল না। সেখানেও সব মানুষের স্বার্থ ও অগ্রাধিকার অভিন্ন ছিল না। ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে বাঙালিদের যে ক্ষুদ্র অংশ সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সাথে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে অবর্তীণ হয়েছিল- তাদের সাথে এদেশের কৃষক-শ্রমিক সহ অন্যান্য শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থের জায়গায় ছিল বিপুল প্রভেদ। স্বাধীন বাংলাদেশের গত চার দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই সত্য ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত হয়েছে।

    http://unmochon.net/node/2170
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০৮ মার্চ ২০১৩ ২০:০০582904
  • একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়কেরা—বদরুদ্দীন উমর
    _________________________________________________
    ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা য্দ্ধু নিয়ে আজ পর্যন্ত বিস্তর কথাবার্তা সভাসমিতি, বৈদ্যুতিক মাধমে হয়েছে। রাশি রাশি লেখা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। অনেকে গ্রন্থাকারেও এ বিষয়ে লিখেছেন। এ সব কিছুকেই স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বলে দাবি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যা লক্ষ্য করার বিষয় তা হল, এর বিপুল অধিকাংশই দলীয় প্রচারধর্মী। এর সাথে বাস্তব ঘটনা, তথ্য উপাত্তের কোনো সম্পর্ক নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে ১৯৭১ সালের এই যুদ্ধকে দলীয়করণের প্রচেষ্টাই এই সব অবাস্তব এবং তথ্য উপাত্তহীন আলোচনা, কথাবার্তা ও লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য। কোনো যোগ্য ঐতিহাসিক বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে এই ধরনের আলোচনায় প্রবৃত্ত হননি। যে দুই-একজন এ বিষয়ে এভাবে কিছু কথা বলেছেন তাঁরা কেউই ইতিহাস চর্চা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিষ্ঠার সঙ্গে নয়, কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র হিসেবেই ইতিহাসের নামে এমনভাবে ঘটনা সাজিয়েছেন যা ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এগুলো ইচ্ছাকৃত মিথ্যা এ কারণে যে, বাস্তব ঘটনা ও তথ্য উপাত্তের সাথে, এ সবের বিশ্লেষণের সাথে, এঁদের এই তথাকথিত ইতিহাস চর্চার কোনো সম্পর্ক নেই। উপরন্তু এসব সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেই তাঁরা এ কাজ করেছেন।

    স্বাধীনতা যুদ্ধের সব গুরুত্বপূর্ণ দিকের আলোচনা তার মধ্যে না থাকলেও, ১৯৭১ সালে ভারতের জমিনে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীনে স্বাধীনতা যুদ্ধ, যা সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত, কিভাবে পরিচালিত হয়েছিল তার একটি বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যপূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ’৭১’-এ।

    এই গ্রন্থটিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হিসেবে আখ্যায়িত করা না গেলেও সে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এটি একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনার যোগ্য।

    মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার সাথে দলীয় প্রচারধর্মী অসংখ্য বইয়ের ভিড়ে ‘একটি নির্দলীয় ইতিহাস’ বলে উল্লিখিত গোলাম মুরশিদ-এর ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ নামে একটি বই ‘প্রথমা’ প্রকাশনী থেকে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির বিজ্ঞাপন দেখে আকৃষ্ট হয়ে আমি সেটি কিনে এনে পড়ার পর রীতিমতো হতাশ হলাম। কারণ এটি চাঁচাছোলা দলীয় ইতিহাস না হলেও একে আওয়ামী ঘরাণার ইতিহাসে বলে সহজেই আখ্যায়িত করা চলে। যাঁরা আগ্রহী তাঁরা বইটি সংগ্রহ করে পড়তে পারেন, কিন্তু আমি বইটি পড়ে একেবারে হতাশ হয়েছি এ জন্য যে, এতে লেখকের রাজনৈতিক জ্ঞান, ইতিহাস জ্ঞান, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, পরিস্থিতিগত সাক্ষ্য (Circumstantial evidence) ব্যবহার ইত্যাদির কোনো পরিচয় নেই। “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে” মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী নায়ক বানিয়ে এতে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা হয়েছে তার সঙ্গে আওয়ামী ঘরাণার দলীয় ইতিহাসগুলোর কোনো গুণগত পার্থক্য নেই।

    একই প্রকাশক কর্তৃক ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন’ নামে একটি বই ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়েছে। এই কথোপকথনে অংশগ্রহণকারী হলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ ও বর্তমানে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পরিকল্পনা মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল এ.কে. খোন্দকার, মূলধারা ’৭১ গ্রন্থের রচয়িতা মঈদুল হাসান এবং পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সাবেক সিনিয়র অফিসার এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গঠিত যুব শিবিরের মহাপরিচালক এস.আর মীর্জা। বইটির ভূমিকা লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ক্ষেত্রের সভাপতি অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহম্মদ।

    মৌখিক ইতিহাস (Oral history) বলতে যা বোঝায় এটি হল, সেই ঘরণার অন্তর্ভুক্ত মুক্তিযুদ্ধের এক ইতিহাস। একই সঙ্গে এটি হল ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচয়িতাদের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আকর গ্রন্থ। আমি মনে করি, এই কথোপকথনে তিন জনের একজনেও কোনো মিথ্যা বা বানোয়াট কথা বলেননি এবং তাঁরা প্রত্যেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ও ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। এদিক দিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ওপর যা কিছু প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে ঐতিহাসিক আকর গ্রন্থ হিসেবে এটি একেবারেই তুলনাবিহীন। এই কথোপকথন পড়ে আমি নিজে আরও প্রীত হয়েছি এ কারণে যে, ১৯৭২ সাল থেকে প্রায় এককভাবে, ধারাবাহিকভাবে ও বিরামহীনভাবে আমি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যে সব কথা বলে এসেছি তারই প্রবল সমর্থন এই কথোপকথনের মধ্যে আছে।

    আমি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সত্য নিষ্ঠার সঙ্গে যে সব কথা বলে এসেছি তাতে আওয়ামী লীগ ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা কেউই আমার লেখার উপজীব্য ও বক্তব্যের ওপর কোনো উল্লেখযোগ্য আলোচনা না করে সকলেই আমার ওপর ব্যক্তিগত গালাগালি বর্ষণ করে সত্য ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। লক্ষ্য করার বিষয় যে, সেই একই কথা ওপরে উল্লিখিত বইটির তিন কথক বলা সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত কোনো আওয়ামী লীগ নেতা, আওয়ামী ঘরাণার কোনো বুদ্ধিজীবী এবং ঐতিহাসিক নামধারী ব্যক্তিই এর কোনো প্রতিবাদ করেননি। না করারই কথা, কারণ কথোপকথনে অংশগ্রহণকারীরা বদরুদ্দীন উমর নন যে, দেশের স্বাধীনতাবিরোধী বলে তাঁদেরকে ইচ্ছেমতো গালাগালি দেওয়া যায়। তাঁরা হলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালে ভারতে অবস্থানকারী মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক। এঁদের মুখে হাত দেওয়া সহজ তো নয়ই, সম্ভবও নয়। সেটা সম্ভব হলে বইটি প্রকাশের পর শেখ হাসিনা এ.কে. খোন্দকারকে নিশ্চিতভাবে তাঁর মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করতেন। কিন্তু তাঁর অবস্থানের কারণে বইটির বক্তব্য নিয়ে খোন্দকারের গায়ে হাত দেওয়ার ক্ষমতা হাসিনারও নেই। এই একই কারণে দালালি ও চামচাগিরিতে অভ্যস্ত আওয়ামী ঘরাণার কোনো বুদ্ধিজীবীও আজ পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে সাহস করে এগিয়ে আসেননি।

    আলোচ্য বইটিতে যে কথোপকথন লিপিবদ্ধ হয়েছে তা কতকগুলো বিষয়ে বিভক্ত আছে, যেমন অসহযোগ আন্দোলন, প্রতিরোধ যুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণা, সশস্ত্র লড়াই, সেনাবাহিনীর মনস্তত্ত্ব, যুব শিবির প্রসঙ্গ, গেরিলা তৎপরতা, মুজিব বাহিনী, স্বাধীনতার পরবর্তী প্রসঙ্গে ইত্যাদি। আমি এখানে সব প্রসঙ্গ আলোচনা না করে একে সীমাবদ্ধ রাখবো অসহযোগ আন্দোলন ও স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যে। কারণ এ বিষয়গুলোর ওপরই আমি নিজে অনেক বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে আমার দুই খণ্ডে প্রকাশিত বই Emergence of Bangladesh এবং অন্যান্য রচনায়। প্রথমে এসব বিষয়ে আমার বক্তব্য খুব সংক্ষেপে উল্লেখ করে আমি আলোচ্য বইটির কথকদের বক্তব্য কিছুটা বিশদভাবে উল্লেখ করব। এ জন্য তাঁদের কথার অনেক উদ্ধৃতি আমাকে এখানে প্রয়োজনবশত দিতে হবে।

    আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালে যে ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল তার ভিত্তিতেই তারা ১৯৭০ সালের নির্বাচন করেছিল। জয়লাভ করলে ৬ দফা তারা বাস্তবায়ন করবে এই ছিল ভোটারদের কাছে তাদের প্রতিশ্রুতি। শুধু ভোটারদের কাছেই নয়, ছাত্র লীগের কর্মীসহ আওয়ামী লীগের কর্মীদের কাছেও তারা এই প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ ছিল। এ প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও নির্বাচনের পর পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সঙ্গে আলোচনার সময় এ নিয়ে দুই পক্ষে কিছু দরকষাকষির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুটি আসন ছাড়া বাকি সব আসনেই জয়লাভ করে একক দল হিসেবে পাকিস্তান সংবিধান সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায়, কোনো আপোষ আওয়ামী লীগের পক্ষে কঠিন হয়। এ নিয়ে ছাত্র লীগ নেতৃত্ব এবং আওয়ামী লীগের তরুণ নেতারা দলীয় নেতৃত্ব, বিশেষতঃ শেখ মুজিবের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

    ৬ দফা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হলে এই অঞ্চলে যে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হত তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজির স্বার্থ আঘাতপ্রাপ্ত হতো এবং পূর্ব পাকিস্তানে স্থানীয় পুঁজির বিকাশ দ্রুততর হতো। এ জন্য উভয় পক্ষে যে সমঝোতার প্রয়োজন ছিল তাতে আওয়ামী লীগকে ৬ দফার থেকে কিছু ছাড় দিতেই হতো। এ নিয়েই শেখ মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়ার ও সেই সাথে ভুট্টোর আলোচনা চলে। এ ক্ষেত্রে আপোষের প্রশ্ন অবশ্যই ছিল। কারণ সেটা না হলে আলোচনার প্রাথমিক শর্তই পূরণ হত না। কিন্তু শেখ মুজিবের ওপর ছাত্র লীগ এবং অন্যদের চাপ ছিল ৬ দফার ক্ষেত্রে কোনো রকম আপোষ না করার। শেখ মুজিব চাইছিলেন পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন আদায় করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে। এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা তাঁর এজেন্ডায় ছিল না। কিন্তু এজেন্ডায় এটা না থাকলেও শুধু ছাত্রলীগই নয়, দেশের বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দল, তাদের ছাত্র সংগঠন ও দেশের জনগণ রাজনৈতিকভাবে তখন এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল যাতে স্বাধীনতা তাদের এজেন্ডায় এসে গিয়েছিল। রাস্তায় তখন আওয়াজ উঠেছিল, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাঙলাদেশ স্বাধীন করো। ঢাকার দেওয়ালে দেওয়ালে তখন এই আহ্বান জানিয়ে অনেক চিকাও মারা হয়েছিল। ১ মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা দেওয়ার পর এই পরিস্থিতি দ্রুত পরিপক্ব হচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির মধ্যে এই পরিবর্তন ঘটতে থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব নিজে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আপোষ করারই পক্ষপাতী ছিলেন। ৭ মার্চ ছাত্রলীগ নেতাদের চাপে রেসকোর্স ময়দানে তিনি ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ইত্যাদি বলে দেশের জনগণকে লাঠিসোঁটা নিয়ে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানালেও, নিজের বক্তৃতা শেষ করেছিলেন ‘জয় পাকিস্তান’ বলে। আমি এটা নিজের কানে শুনেছিলাম। এ কবি শামসুর রাহমান ‘কালের ধূলোয় লেখা’ নামে লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে, সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল কাজী ………….. লিখেছেন তার একাত্তরের যুদ্ধের স্মৃতি কথায়, বিচারপতি হাবিবুর রহমান লিখেচেছন ‘বাংলাদেশের তারিখ’ নামে তাঁর বইটিতে ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমদ একাত্তরের ওপর লিখিত তাঁর ‘ জ্যোস্না ও জননীর …………’ নামক উপন্যাসের …………. লিখেছেন যে, অনেকের কাছে তিনি এ ধরনের কথা শুনেছেন আওয়ামী ভাবধারার মানুষ। সে সময় টেপ রের্কডারের প্রচলন হয়নি। কাজেই ব্যক্তিগতভাবে কেউ টেপে ধারণ করেন নি। রেডিওর কর্তৃত্ব তাই মার্চের পর আওয়ামী লীগের লোকদের হাতে পড়ায় তারা এই অংশে তাদের স্বভাবসিদ্ধ মিথাচারী অভ্যাসের কারণে মুছে ফেলেছিল। কাজেই তার কোন শাব্দিক রেকর্ডের কোন অস্তিত্ব আজ আর নেই। ৮ই মার্চের কোন পত্রিকাতেই ঐ বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ তখন ছাপা হয় নি। কিন্তু সেটাই ছিল বাস্তব সত্য এবং তৎকালে শেখ মুজিবের সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

    ৭ মার্চ-এর পর থেকে যুদ্ধে যাওয়া অথবা কোনো প্রকার যুদ্ধ প্রস্তুতির ধারেকাছে না গিয়ে তিনি গান্ধীবাদী পদ্ধতিতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন এবং ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা আসার পর তাঁর সঙ্গে আলোচনা চালাতে থাকেন। এই আলোচনা নিশ্চয়ই স্বাধীন বাঙলাদেশের জন্য হচ্ছিলো না, হচ্ছিলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির উদ্দেশ্যে। শেখ মুজিব যেহেতু আওয়ামী লীগের একক নেতা ছিলেন কাজেই তাঁর এই অবস্থানের জন্য স্বাধীনতার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের কোনও রাজনৈতিক নির্দেশনা ও যুদ্ধ প্রস্তুতি ছিল না। বস্তুতপক্ষে শেখ মুজিব স্বায়ত্তশাসনের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রামে বড়ো আকারে ভূমিকা রাখলেও একজন সংসদীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থাকার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের সঙ্গে আপোষ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ কারণে জাতির অতি সংকটজনক মুহূর্তে তাঁর নেতৃত্ব ধসে পড়ে। তিনি দেশবাসীকে যুদ্ধে যাওয়ার ডাক দিয়ে নিজে সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে ঘরে বসে থাকেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি যে, এক মহা মিথ্যার দৃষ্টান্ত এতে সন্দেহ নেই। শুধু একটি দলের নয়, নিজেকে সমগ্র জাতির নেতা হিসেবে দাবি করে, জনগণকে যুদ্ধে যাওয়ার কথা বলে শেখ মুজিব যেভাবে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তার তূল্য ঘটনা কোনো দেশে ঘটেনি। এমন কোনো দেশ নেই যার নেতা বা সিপাহসালার অন্যদেরকে যুদ্ধে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে নিজে শত্রুর কাছে কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ করেছেন।

    এর ফলে যা ঘটেছিল তা হলো, আওয়ামী লীগ মহলে পুরোদস্তুর হতবুদ্ধিতা। এই হতবুদ্ধিতা থেকে যুদ্ধে যাওয়ার চিন্তার পরিবর্তে নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর চিন্তাই তাঁদেরকে তাড়িত করে এবং তাঁরা দেশের জনগণকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর কাছে সমর্পণ করে, তাদের নিষ্ঠুর নির্যাতন ও খুনখারাবীর মধ্যে রেখে দেশ ত্যাগ করে ভারতে পলায়ন করেন। সেখানে গিয়ে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ণ দায়িত্ব তাঁরা ভারত সরকারের ওপর অর্পণ করে সহযোগীর ভূমিকায় মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল, যার বিস্তারিত কিছু বিবরণ উপরোক্ত কথোপকথনের মধ্যে আছে। একটি দেশ নিজেদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্য দেশের সাহায্য অবশ্যই চাইতে ও নিতে পারে। কিন্তু নিজের দেশের মাটি থেকে দলে দলে পালিয়ে যেয়ে অন্য দেশে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ চালালে সে যুদ্ধের যা পরিণতি হওয়ার তাই হয়েছিল। ভারত সরকার তাদেরকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছিল। শুধু তাই নয়, যে ছাত্রলীগ নেতারা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা ভারতে গিয়ে কোনো যুদ্ধ করেন নি। ভারতীয় সরকার ও সামরিক বাহিনীর মার্কিনপন্থী অংশের নিয়ন্ত্রণে ‘মুজিব বাহিনী’তে থেকে তারা সবক নিয়েছিল কিভাবে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাঙলাদেশে, সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে তা ধ্বংস করতে হবে। বস্তুতপক্ষে তাদেরকে একটি ফ্যাসিস্ট বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থাই জেনারেল ওভান্দের নেতৃত্বে করা হয়েছিল। বাঙলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডাররা স্বাধীন ভূমিকা পালনে অক্ষম হয়ে অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে কতখানি দুর্বল, এমনকি পঙ্গু, অবস্থায় ছিলেন তার বর্ণনাও এই কথোপকথনে আছে।

    স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার পর এ দেশে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন কিভাবে দেশে লুটপাট, চুরি-দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করে একটি নোতুন লুণ্ঠনজীবী শ্রেণী গঠন করেছিল তার কথা আমি আমার অসংখ্য প্রবন্ধে লিখেছি। আলোচ্য কথোপকথনে অংশগ্রহণকারীরাও এ বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। এই ভূমিকার পর এবার আমি ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’ শীর্ষক বইটি থেকে বিভিন্ন বিষয়ে কথকদের বক্তব্য উদ্ধৃতির আকারে উপস্থাপিত করব।

    আওয়ামী লীগের যুদ্ধপ্রস্তুতি এবং যুদ্ধ-সম্পর্কিত রাজনৈতিক অবস্থান প্রসঙ্গে এ কে খোন্দকার বলেন, “আমি ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে দেখছি তারা সৈন্য-সামন্ত ও রসদ বাড়িয়েই যাচ্ছে এবং এই কথা আমি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার এস আর মীর্জা, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজাকে জানাই এবং তাঁদের বলি, এই সংবাদ যেন আওয়ামী নেতৃত্বকে জানানো হয়। আমি তাঁদের বলেছি, কীভাবে প্রতিদিন পাকিস্তান থেকে সৈন্য-সামন্ত ও কমান্ডো আসছে, কিভাবে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আসছে। ওই সব কথাই বলার জন্য তাঁদের বলেছিলাম। তাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন বলে আমি জানি।” (পৃ: ১৯-২০)

    এ বিষয়ে এস.আর মীর্জা বলেন, “১৯৭২ সালের মার্চ মাসে আমি লক্ষ করলাম, পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। আমি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলাম। ২ মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বিমান বাহিনীর অফিসে গিয়ে আমি জানতে চেষ্টা করি কী হচ্ছে, কী হতে চলেছে। আমি কথা বলি এ.কে খোন্দকারের সঙ্গে। তিনি আমার জায়গাতেই বদলি হয়ে এসেছিলেন। আমি তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম…। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আওয়ামী লীগের কোনো যুদ্ধপ্রস্তুতি আছে কি না এবং তা জানার জন্য আমাকে বললেন। যুদ্ধ বলতে ওই বাঁশের লাঠি দিয়ে নয়! অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ। তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের এক নেতা ছিল আমার আত্মীয়। ওই অবস্থায় আমি তাকে গিয়ে বললাম, আওয়ামী লীগের যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পর্কে আমাকে অবহিত করার জন্য। দুদিন পর সে আমাকে জানাল, আওয়ামী লীগের কোনো প্রকার যুদ্ধপ্রস্তুতি নেই, এমনিতেই আন্দোলন চলছে।” (পৃ: ১১)

    এ প্রসঙ্গে এ.কে. খোন্দকার আরও বলেন, “আমি খুব গভীরভাবে পাকিস্তানী বাহিনীর তৎপরতা লক্ষ করতাম এবং এই খবরগুলো অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার এস.আর. মীর্জা এবং অন্যদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ মহলে পৌঁছে দিতাম । কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্য ও হতাশার বিষয় হল, এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে আমাদের কেউ কিছু জানায়নি। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পথে। কিন্তু আমাদের করণীয় কী- এ প্রসঙ্গে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। কোনো নির্দেশ আমরা পাইনি। এ থেকে আমাদের অর্থাৎ কর্মরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের মনে হয়েছিল, আসলে আওয়ামী লীগের দিক থেকে কোনো প্রকার যুদ্ধপ্রস্তুতি নেই। এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো চিন্তাভাবনাও তাদের ছিল বলে মনে হয়নি। ফলে ২৫ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করল, তখন এটা প্রতিরোধের জন্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এটা ছিল বাস্তব সত্য।” (পৃ: ৮)

    আওয়ামী লীগের যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পর্কে মঈদুল হাসান বলেন, “১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে থেকেই পাকিস্তান তার সৈন্যবল পূর্ব পাকিস্তানে বাড়াতে শুরু করে। সেই সময় অনেকে মনে করত, একটা বিশাল রক্তপাত হতে চলেছে এখানে। এই সময়ে আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব আসফ-উদ-দৌলার বড় ভাই মসিহ-উদ-দৌলা তখন ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোর কমান্ডার অফিসে জেনারেল স্টাফ ছিলেন, কোর কমান্ডারের জি-২, ইনটেলিজেন্সের দায়িত্বে। তিনি তখন মেজর ছিলেন। ওদের আরেক ভাই আনিস-উদ-দৌলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আনোয়ারুল আলম। তিনি আমারও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মার্চের ৩ তারিখে ওদের কাছ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি সম্পর্কে গোপন নানা তথ্য জানতে পারার পর আনোয়ারুল আলম আমার সঙ্গে দেখা করেন। তথ্যগুলো উচ্চতর রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে পৌঁছানো দরকার, তাই তথ্য সরবরাহকারী তাঁকে অনুরোধ করেছেন বলে তিনি আমাকে জানান। পাকিস্তানী আক্রমণের প্রস্তুতি এতটাই এগিয়েছে যে এর মধ্যেই রংপুর থেকে ট্যাংকবহর ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে এবং তাতে রাবার বেল্ট লাগানো হচ্ছে ঢাকা শহরের পথে আক্রমণ বা তৎপরতা চালানোর উপযোগী করে।” (পৃ: ১৩)। এর পর ৫ মার্চ সন্ধ্যায় আনোয়ারুল আলম আবার মঈদুল হাসানের সঙ্গে দেখা করেন ও অন্য কিছু তথ্য প্রদান করেন। মঈদুল হাসান বলেন, “আমি ওই দিনই অর্থাৎ ৫ মার্চ রাত সাড়ে ৯টায় গেলাম শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে।… আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে মেজর দৌলার দেওয়া তথ্য, পাকিস্তানের হামলা বা আক্রমণ-প্রস্তুতি, ট্যাংকবহরকে ঢাকা শহরে চলাচলের জন্য প্রস্তুত করার সংবাদ, এমনকি তথ্যদাতার পারিবারিক পরিচয়ও প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলাম। আমি যা অনুমান করেছিলাম, তিনি শুনেই বললেন, ‘আমি সব জানি’। আমি তাঁকে বললাম, আরও সংবাদ আছে দেওয়ার।… আমার সব কথা শুনে একটু চুপ করে থেকে শেখ মুজিবুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাজউদ্দীন জানে ব্যাপারটা?’ আমি বললাম, ‘না কেবল আপনিই জানতে পারলেন, সেটাই দিন তাদের অনুরোধ।’ ‘তাহলে আপনি তাজউদ্দীনের সঙ্গে আলাপ করে নেন’, শেখ মুজিব এ কথা বলে আমার সঙ্গে আলোচনা শেষ করলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে বেরিয়ে রাত ১০টার দিকে তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে যাই। তাঁকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলি। তার পরেও অনেক প্রশ্ন করে আরও বিষয় তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন। সব শেষে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মুজিব ভাইয়ের কথা শুনে আপনার কী মনে হল? তিনি কেন আপনাকে আমার কাছে পাঠালেন?’ আমি বললাম, ‘তিনি হয়তো এ ব্যাপারে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চান না। আবার খবরটা অগ্রাহ্য করতেও পারলেন না। তাই আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। দায়-দায়িত্ব এখন আপনার।’ তাজউদ্দীন হেসে বললেন, ‘এই তো আপনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি বুঝে গেছেন।’ এমনিভাবে ওই রকম একটি উদ্যোগের সম্ভাবনা তখন বাদ পড়ে”। (পৃ: ১৩-১৬)

    তাজউদ্দীনের এই হাসি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ আওয়ামী লীগে শেখ মুজিবই ছিলেন সর্বময় কর্তা ও কর্তৃত্ব। সব কিছুই তিনি করতেন এবং সব রকম সিদ্ধান্ত, বিশেষতঃ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও তিনি নিতেন এককভাবে। তাতে গণতন্ত্রের কোনো স্থান, কারও সঙ্গে পরামর্শের কোনো ব্যাপার ছিল না। কাজেই এ ক্ষেত্রে মঈদুল হাসানের সব কথা শোনার পর এ বিষয়ে কিছু না করার সিদ্ধান্ত নিয়েই তাঁকে সরাসরি তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে বলে শেখ মুজিব বেশ কৌশলের সঙ্গে ব্যাপারটি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাজউদ্দীনের হাসির এটাই ছিল মর্মার্থ।

    এ সময় ছাত্রলীগের ছেলেরা ৬ দফা নিয়ে কোনো আপোষ না করা এবং স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবের ওপর চাপ দিচ্ছিল। অন্য দিকে, আওয়ামী লীগের লোকেরা, বিশেষতঃ জাতীয় পরিষদের সদস্যরা, চাইছিলেন ৬ দফাকে সামনে রেখে একটা সম্মানজনক আপোষ রফা। শেখ মুজিব নিজেও ছিলেন এই মতাবলম্বী। কিন্তু জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর ৬ দফা নিয়ে কোনো আপোষ-মীমাংসায় যাওয়া তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল। কারণ সেই অবস্থায় ছাত্রলীগের ছেলেদের চাপ এমন ছিল যা মোকাবেলার ক্ষমতা শেখ মুজিবের ছিল না।

    তিনি এই অবস্থায় ছিলেন এক উভয় সঙ্কটের মধ্যে। এই উভয় সঙ্কট তাঁর থাকত না যদি তিনি নিজে ৬ দফা নিয়ে আপোষের পক্ষে না থাকতেন এবং বাঙলাদেশের স্বাধীনতার পরিবর্তে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন না দেখতেন। তাঁর অবস্থা এমন ছিল যে, মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তিনি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী কর্তৃক জনগণের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণের ব্যাপারটি জানা সত্ত্বেও স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য বাঙালী সামরিক বাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ এবং যুদ্ধ সংগঠিত করার ব্যাপারে কিছুই করেননি। তিনি সংসদীয় রাজনীতিতে অভ্যস্ত ছিলেন, কাজেই সামরিক ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত হওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, এ কথা বলে তাঁর পক্ষের ওকালতকারীরা যে যুক্তি দিয়ে থাকেন তার কোনো অর্থ নেই। আসলে তিনি নিজে পাকিস্তান থেকে একেবারে বের হয়ে স্বাধীন বাঙলাদেশ গঠনের পক্ষপাতী না থাকার জন্যই তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ২৫ মার্চ বস্তুতপক্ষে তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধসে পড়েছিল। এটাই ছিল পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর কাছে ঘরে বসে তাঁর আত্মসমর্পণের প্রতীকী তাৎপর্য।

    ইয়াহিয়া খান যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর এক সর্বাত্মক আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা করেছিল সে বিষয়ে শেখ মুজিব যথেষ্ট ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। এ বিষয়ে মঈদুল হাসান যে ঘটনার কথা বলেন তার মাধ্যমেই এর প্রমাণ ভালোভাবে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে নেতৃত্ব কেন একটি পরিষ্কার সিদ্ধান্ত আসতে পারেননি, সেটা ভাবাবেগমুক্তভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে আরেকটি ছোট ঘটনার কথা বলি। ২২ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রধান আবদুল ওয়ালি খান, গাউস বক্স বেজেঞ্জো, ওদিকের এবং এদিকের আরও কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি আমার বাসায় নিয়ন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। স্থানীয় নিমন্ত্রিতদের মধ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে জীবিত ব্যক্তি হিসেবে একমাত্র বদরুদ্দীন উমরের কথাই মনে করতে পারি। ওয়ালি খান এসেই বললেন, আমি আজ সকালে ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস করি, ‘কী তোমার সর্বশেষ অবস্থা?’ ইয়াহিয়া বলেন, ‘আমি যেখানে এসে দাঁড়িয়ে গেছি, সেখান থেকে বেরোতে হলে, ‘আই হ্যাভ টু শুট মাই ওয়ে থ্রু।’ আমি খবরটা শেখ মুজিবকে দেওয়া দরকার মনে করে গেলাম তাঁর আছে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জানেন, ইয়াহিয়া কী করতে পারে? এ কথা বলতেই শেখ সাহেব বললেন, ‘হি উড হ্যাভ টু শুট হিজ ওয়ে থ্রু’। ওয়ালি বললেন, ‘ইয়াহিয়া খানের কথা হুবহু শেখ মুজিবের মুখে শুনে আমি থ বনে গেলাম’। তিনি আরও বললেন, ‘তাহলে ওঁদের দুজনার মধ্যে আগেই কথা হয়েছে। (পৃ: ১৭-১৮)

    কিন্তু শুধু ইয়াহিয়া খানের সাথেই নয়। আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গেও তাঁর কথা হয়েছিল। তাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এ বিষয়ে মঈদুল হাসান বলেন, “অন্যদিকে আমেরিকানরাও জানত। প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ১০ মার্চ ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড শেখ মুজিবের এক গোপন প্রতিনিধি আলমগীর রহমানকে প্রথম খবরটা জানান যে, ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকায় আসছেন তাঁর সঙ্গে আলোচনার জন্য। ইয়াহিয়া ও মুজিবের বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য তাঁর একটা পরিকল্পনা আছে। আর্চার ব্লাড সে কথা স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো একটি প্রতিবেদনেও উল্লেখ করেন। কিন্তু সেই গোপন পরিকল্পনা আজও অবমুক্ত হয়নি। বস্তুত ১০ মার্চের পর থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত কী দীর্ঘ ১৮ দিনের অধিকাংশ দলিলই এ পর্যন্ত প্রকাশিত না হওয়ায় ওই দুঃসময়ে আমেরিকার ভূমিকা কী ছিল। কীভাবে ও কাদের তারা প্রভাবিত করেছিল, সে ইতিহাস এখনো অজ্ঞাত।” (পৃ: ১৮)

    আসলে ইয়াহিয়া ১৫ মার্চ ঢাকা আসার পর আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডও ঢাকায় আসেন। তাঁর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানেরও যোগাযোগ ও সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু এ সবের কোনো রিপোর্ট দেখা যায় না। কারণ এই যোগাযোগ ও সাক্ষাৎ খোলাখুলিভাবে না হয়ে গোপনে হয়েছিল। এ কারণেই এই সাক্ষাৎ এবং এ সময়ে শেখ মুজিব, ইয়াহিয়া ও ফারল্যান্ডের মধ্যে যে সব কথাবার্তা, পরিকল্পনা হয়েছিল সে ব্যাপারে আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট যে সব ডেসপ্যাচ ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছিল এখনো পর্যন্ত তা অবমুক্ত হয়নি।

    Emergence of Bangladesh নামে আমার বইটি লেখার সময়েও আমি দেখেছিলাম The American Papers. Department of state United States of America. Secret and confidential. India, Pakistan, Bangladesh. Documents 1965-73 compiled and selected by Roedad Khan. University Press Limited’) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাথে বাঙলাদেশ সংক্রান্ত যে সব আদান-প্রদান ঐ সময় ইসলামাবাদ ও ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে হয়েছিল তাতে মার্চ ১৬ থেকে ২৮ পর্যন্ত তার কোনো উল্লেখ American Papers এ নেই। অর্থাৎ… ঐ সময় আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ও কনসাল ঢাকায় জেনারেল ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের সঙ্গে যে সব আলাপ-আলোচনা ও পরিকল্পনা করেছিলেন এবং ২৫ তারিখের অব্যবহিত পরেও ঘটনার সঙ্গে আমেরিকানদের কী সম্পর্ক ছিল তার কোনো হদিস American Papers-এর মধ্যে নেই। এর থেকে বোঝা যায় যে, তখন যে সব কথাবার্তা এবং পরিকল্পনা তাঁদের মধ্যে হয়েছিল সেটা এখনো পর্র্যন্ত প্রকাশযোগ্য নয়। সেগুলো তাদের পক্ষ থেকে এখনো গোপন রাখা দরকার। এ কারণে ঐ দলিলপত্র এখনো আমেরিকানরা অবমুক্ত করেনি।

    সকলকে পালিয়ে যেতে এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে যুদ্ধে যেতে পরামর্শ দিলেও শেখ মুজিব নিজে ঘরে বসে যেভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন সেটা থেকে মনে হয়, ইয়াহিয়া খান ও আমেরিকান রাষ্ট্রদূত তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সম্পর্কে তাঁকে নিশ্চিত করেছিল। এই নিশ্চয়তার ওপর নির্ভর করেই শেখ মুজিব বাড়ীতে বসে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। খুব সম্ভবত তাঁকে এই আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, ব্যাপকভাবে কিছু দমন-পীড়ন করার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে আবার তাঁরা টেবিলে বসে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করবেন। এক দিকে ছাত্র লীগের চাপ এবং অন্য দিকে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ সদস্যদের চাপের মধ্যে পড়ে এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং অসহায় অবস্থায় এভাবে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর কছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাঁর আর করার কিছুই ছিল না। যেহেতু স্বাধীনতা ঘোষণার চিন্তা তাঁর মাথায় ছিল না, এ জন্য যুদ্ধে যাওয়ার প্রশ্নও তাঁর ছিল না। তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে অনেক মিথ্যা আওয়ামী লীগ মহলে তৈরী করা হলেও তিনি তার ধারে কাছে যেতেও সম্মত ছিলেন না। এ বিষয়ে মঈদুল হাসানের কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “২৫ মার্চ সন্ধেবেলা, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন চলে যান এ দেশ থেকে, তখন একটা চরম সংকটপূর্ণ অবস্থার মতো হয়। সবাই ভাবতে থাকেন, তাহলে এখন কী করণীয়। এই সময় তাজউদ্দীন আহমদসহ আরও কিছু নেতা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে, অর্থাৎ শেখ মুজিবের বাড়িতে সমবেত ছিলেন। সেখানে এক ফাঁকে তাজউদ্দিন আহমদ একটি টেপ রেকর্ডার এবং ছোট্ট একটা খসড়া ঘোষণা শেখ সাহেবকে দিয়ে সেটা তাঁকে পড়তে বলেন। এ ঘটনা তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে আমার শোনা। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই আমি যখন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি, তখন তাজউদ্দীন আহমদকে এ ব্যাপারে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ঘোষণা তাজউদ্দীন আহমদের নিজের লেখা। লেখাটা ছিল এমন- পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের আক্রমণ করেছে অতর্কিতভাবে। তারা সর্বত্র দমননীতি শুরু করেছে। এই অবস্থায় আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং আমি বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে। এই খসড়া ঘোষণাটি শেখ মুজিবর রহমানকে দেওয়ার পর সেটা তিনি পড়লেন। কিন্তু এ বিষয়ে কিছুই বললেন না, নিশ্চুপ রইলেন। তাজউদ্দীন আহমদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি যখন তাঁকে বললেন, ‘মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে, কেননা কালকে কী হবে, আমাদের সবাইকে যদি গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, তাহলে কেউ জানবে না, কী তাদের করতে হবে। এই ঘোষণা কোনো না কোনো জায়গা থেকে কপি করে আমরা জানাব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায় তাহলে সেটাই করা হবে’। শেখ সাহেব তখন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে একটা দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।’ এ কথার পিঠে তাজউদ্দীন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাত সম্ভবত নয়টার পর পরই ৩২ নম্বর ছেড়ে চলে যান’’। (পৃ: ২৭-২৮)

    পাকিস্তানীরা দেশদ্রোহের জন্য বিচার করবে এই চিন্তা যাঁর মাথায় ছিল এবং এর ভয়ে যিনি ভীত ছিলেন, তিনি প্রকৃত কোনও মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ঘোষণা ইত্যাদির নায়ক যে হতে পারেন না, এটা নিয়ে তো বিতর্কের কিছু নেই। আসলে তিনি ইয়াহিয়া ও ফারল্যান্ডের সঙ্গে যে পরিকল্পনা করেছিলেন তাতে বাঙলাদেশের স্বাধীনতার কোনও ব্যাপার ছিল না। যা ছিল তা হচ্ছে নোতুন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যাপার।

    এটা ঠিক যে, ইয়াহিয়া ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা গিয়েছিল যে, জনগণের ওপর একটি আক্রমণ আসছে এবং লড়াই ছাড়া কোনো বিকল্প আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু ভেঙে পড়া শেখ মুজিবের তখন করণীয় কিছু ছিল না, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া। স্বাধীনতা ঘোষণা যদি শেখ মুজিবের চিন্তায় থাকতো তাহলে তাজউদ্দীনের খসড়া অনুযায়ী হোক, অথবা তাঁর নিজের তৈরি হোক, স্বাধীনতার ঘোষণা রেডিও মারফত অবশ্যই দেওয়া যেত কারণ তখনো পর্যন্ত রেডিও তাঁদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। তাছাড়া অন্য গুরুত্বপূর্ণ উপায় ছিল ঢাকার ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে একটা ফোন করে এই ঘোষণাপত্র দিয়ে দেওয়া, যেখানে তখন শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক ঢাকার খবর সংগ্রহের জন্য উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মাধ্যমে এ খবর সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু শেখ মুজিব এ কাজ না করে আওয়ামী লীগের প্রচার মতো তাঁর তথাকথিত স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়্যারলেসের এক অদক্ষ কর্মীর মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা ঢাকার কেউ জানলো না। সেটা চলে গেল চট্টগ্রামে!! এর থেকে বড় গাঁজাখোরি গল্প আর কী হতে পারে? কিন্তু এই গাঁজাখোরি গল্প বা প্রকাণ্ড মিথ্যাই এখন সরকারী পর্যায়ে বাঙলাদেশের ইতিহাসের এক সত্য হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে!

    এ প্রসঙ্গে মঈদুল হাসান আরও বলেন, “স্বাধীনতার ঘোষণার ওই যে ছোট্ট খসড়াটি তাজউদ্দীন আহমদ তৈরি করেছিলেন, ২৬ মার্চ সেটার প্রায় একই রকমের ঘোষণা দেখি, একই সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য কাগজে প্রচারিত হতে, ভারতের কাগজেও হয়েছে। সুতরাং আমি ধরে নিতে পারি, সেই সময় তাজউদ্দীন আহমদ যে খসড়া করেছিলেন, সেটা অন্য কাউকে তিনি হয়তো দিয়েছিলেন। …. পরবর্তীকালে ঘটনার প্রায় এক বছর পর বলা হয়, ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার ঠিক আগে শেখ সাহেব নিজে ইপিআরের সিগন্যালের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় খবর পাঠান। (পৃ: ২৯)

    তাজউদ্দীনের যে খসড়াটি শেখ মুজিব ভয়ের বশবর্তী হয়ে টেপ রেকর্ডারের সামনে পড়তে সম্মত হননি, সেটাই এভাবে প্রচারিত হয়েছে এবং এটাকেই শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা বলে আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের ঘরাণার বুদ্ধিজীবীরা জোর গলায় প্রচার করছেন। এভাবেই বাঙলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস রচিত হচ্ছে। চট্টগ্রামস্থ রেডিও পাকিস্তানের কয়েকজন কর্মী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা নামে একটি খসড়া তৈরী করেন। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক এমএ হান্নানকে দিয়ে তাঁরা সেটি পাঠ করান। একজন নিম্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতার ঘোষণার কোনো উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। তাছাড়া সেটি শুনতে পেয়েছিল খুব অল্প কিছু লোক, যারা ছিল চট্টগ্রামে বা তার আশপাশে। পরে ঐ বেতারকর্মীরা মেজর জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ ঘোষণার একটা খসড়া দিয়ে তাঁকে রেডিওতে সেটি পাঠের জন্য অনুরোধ করেন। জিয়া তাতে সহজেই সম্মত হন এবং তিনি ঘোষণাতে কিছু পরিবর্তন করে ২৭ মার্চ সেটি পাঠ করেন, যাতে তিনি নিজেকে বাঙলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে উল্লেখ করেন। পরে এই ভাষ্য পরিবর্তন করে তিনি তাঁর ঘোষণাটি শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষ থেকে প্রচার করছেন বলে উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে আলোচ্য বইটির তিন কথকই কথা বলেন।

    একে খোন্দকার: “এখানে একটি কথা বলব, এই যে ২৭ তারিখে মেজর জিয়াকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী, এঁরাই কিন্তু এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ সত্যগুলো আমাদের মনে রাখতেই হবে- অর্থাৎ যা ঘটেছে। এঁরাই নিজ উদ্যোগে মেজর জিয়ার কাছে গিয়েছিলেন, মেজর জিয়া তাঁদের কাছে যাননি। তবে এটা ঠিক, জিয়া তাঁদের প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি। … আমি নিজে জানি, যুদ্ধের সময় জানি, যুদ্ধের পরবর্তী সময়েও জানি যে মেজর জিয়ার এই ঘোষণাটি পড়ার ফলে সারাদেশের ভেতরে এবং সীমান্তে যত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, হ্যাঁ, এইবার বাংলাদেশ একটা যুদ্ধে নামল।” (পৃ: ৩০-৩১)

    মঈদুল হাসান: ‘আমি অন্যের কথা কী বলব, মেজর জিয়ার বেতার ঘোষণা শুনে নিজে আমি মনে করেছিলাম যে, না, সত্যি তাহলে সামরিক বাহিনীর বিপুলসংখ্যক লোক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। এটা আমার মনে বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং আমি উৎসাহিত বোধ করি। আমি আশেপাশে যাঁদের চিনতাম তাঁরাও এই ঘোষণায় উৎসাহিত হন। কাজেই জিয়ার সেই সময়টুকুর সেই অবদান খাটো করার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু তিনিই সবকিছু করেছেন। তিনিই ঘোষণা দেওয়ার ফলে স্বাধীনতা এসেছে- সেটা তো গ্রহণযোগ্য নয়।” (পৃ: ৩১)

    এস আর মীর্জা : “২৭ মার্চ বিকেলে পরিষ্কার শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। এই ঘোষণা শুনে আমি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এই ভেবে যে, হ্যাঁ, এখন মানুষ স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কারণ তাদের সঙ্গে বাঙালি সৈন্যরাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে। … মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কোনো আলোচনা বা বিতর্ক আমি শুনিনি। এ বিতর্ক শুরু হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে। শেখ মুজিব যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন এ নিয়ে কোনো কথা কেউ উত্থাপন করেননি বা বিতর্ক হয়নি। এমনকি জিয়াউর রহমানের শাসনকালেও এ ব্যাপারে কথা ওঠেনি। এটা শুরু হল সম্ভবত ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর কয়েক বছর পর। ১৯৯১ সালে বিএনপি নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ জিয়াকে খাটো করার চেষ্টা করে। এর পর থেকেই এ বিবাদটা প্রকট আকার ধারণ করে।” (পৃ: ৩৫-৩৬)

    স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক সম্পর্কে একে খোন্দকার বলেন, “শুধু আমার ঢাকার অবস্থানকালেই নয়, গোটা মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল ধরেই কিন্তু এই ঘোষণা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি বা কোনো মতবিভেদ আমরা শুনিনি। … এ ঘোষণা নিয়ে যে বিভ্রান্তি, সেই বিভ্রান্তির খুব একটা মূল্য নেই এ জন্য যে, এই ঘোষণা কখন হয়েছিল, কে দিয়েছিল, কোথায় দিয়েছিল- সেটার অপেক্ষা না করে স্বাধীনতাযুদ্ধ কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছিল ২৫ মার্চ রাতেই। তবে জিয়ার ২৭ মার্চ ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে এবং বাঙলাদেশের বাইরে যারা ছিল, তাদের মধ্যে যে একটা প্রচণ্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্ক কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়।” (পৃ: ৩৪)

    সঠিকভাবেই এ সব বক্তব্যে বলা হয়েছে যে, মেজর জিয়ার ঘোষণা সেই সংকটজনক মুহূর্তে জনগণের মধ্যে বিরাট উঃসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। এদিক দিয়ে সেই ঘোষণার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। কিন্তু এ নিয়ে বিএনপি যেভাবে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক, জনগণের মুক্তিদাতা ইত্যাদি বলে প্রচার করে এটা এক বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার। জিয়াকে পুঁজি করে যারা রাজনীতি করে তারা নিজেদের দলীয় স্বার্থে এ কাজ করে থাকে। আসলে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা নিয়ে যে সব কথাবার্তা ও প্রচার কাজ করা হয় তার থেকে মনে হয় যে, এ দেশে জনগণ বলে কিছু ছিল না, জনগণের সংগ্রাম বলে কিছু ছিল না, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর আক্রমণের মুখে তাদের প্রতিরোধের কোনো শক্তি ছিল না। কাজেই কোনো না কোনো ব্যক্তির যুদ্ধ ঘোষণার দিকে তাকিয়ে তাঁরা বসে ছিলেন। কিন্তু ঘটনা সেভাবে ঘটেনি। প্রথম থেকেই জনগণ নিজেই এই স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁরাই ছিলেন এই যুদ্ধের মূল শক্তি। তাঁদের এই শক্তি ও তার ব্যবহার ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব, সেক্টর কমান্ডারবৃন্দ এমনকি ভারতীয় সরকার ও সামরিক বাহিনী পর্যন্ত কারও ক্ষমতা ছিল না বাঙলাদেশ স্বাধীন করার। যে জনগণকে নিষ্ঠুর পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর আক্রমণের মুখে রেখে শেখ মুজিবর রহমান দেশ ও জনগণের শত্রু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে বাড়ীতে বসে আত্মসমর্পণ করে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন, যে জনগণকে নিরস্ত্র এবং অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতৃত্ব প্রাথমিকভাবে নিজেদের প্রাণ রক্ষার জন্য দৌড় দিয়ে ভারতে একত্রিত হয়েছিলেন, যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বাঙলাদেশ স্বাধীন করার দায়িত্ব ভারত সরকারের ওপর ন্যস্ত করে যুদ্ধে তাদের সহযোগী হিসেবে, তাদের তাবেদারের ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের কোনো ঘোষণা বা নির্দেশের জন্য জনগণ অপেক্ষা করেননি। জনগণ নিজেই স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এই প্রকৃত নায়ককে সম্পূর্ণ আড়ালে রেখে বাঙলাদেশের নোতুন শাসকশ্রেণী ও তাদের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল নিজ নিজ দলনেতাকে মুক্তিযুদ্ধের নায়ক বানানোর চেষ্টায় যে সব রাশি রাশি মিথ্যার জন্ম দিয়েছে সেগুলো ইতিহাসের আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই নয়। আবর্জনার স্তূপেই তা নিক্ষিপ্ত হবে।

    ২৭.০৫.২০১০

    [সংস্কৃতি জুন ২০১০ সংখ্যা থেকে দ্রোহ ছোট কাগজে প্রকাশিত]

    http://www.droho.net/?p=1781
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন