এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সে | 203.108.233.65 | ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৬:২৭644834
  • Q যে ডকুমেন্টারীটা বানাচ্ছিলেন সেটা কি হয়ে গেছে? কেউ কি জানেন?
  • /\ | 127.194.216.98 | ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ২৩:০৯644835
  • কিউর ডকু পোস্ট প্রোডাকশন চলছে বোধয়।
    এগুলো ডকুমেন্টেশনের স্বার্থে থাকুক।


    https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10203622905006038&set=gm.1464379473849366&type=1

    'ভাসান' | আড়িয়াদহ
    আয়োজিত

    অনুষ্ঠানের শুরুতে নবারুণ ভট্টাচার্যকে নিয়ে আমাদের তরফে একটি ভিডিও নোট দেখানো হবে এবং তারপর ওঁর ওপর তৈরি একটি তথ্যচিত্র থাকছে ১৩ মিনিট দৈর্ঘ্যের l ছবিটি তৈরি করেছেন পাভেল ।

    কথা :

    রবিশংকর বল l বিমল দেব । পাভেল । সৌরভ মুখোপাধ্যায় । সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় । অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় l রাজীব চৌধুরি |

    আমরা চাইছি কথা হোক ওঁর কাজ (পদ্য ,গদ্য , নাটক ,পত্রিকা-করা ) এবং যাপন নিয়ে কিছু কথা শুনতে জানতে ও জানাতে।

    আপনি আসুন |
    সবাইকে সংগে নিয়ে আসুন
    এবং শেষ পর্যন্ত থাকুন ।

    আমরা অপেক্ষায় রইলাম |

    আগামি ২৩ তারিখ তথাগত ভট্টাচার্য ( বাও) ওঁর মা-কে নিয়ে (প্রণতি বৌদি ) দিল্লি চলে যাচ্ছেন তাই ওইদিন মা-ছেলে আসতে পারছেন না |

    আয়োজন : 'ভাসান '

    contact : gouri bhattacharyya : 9143728704

    kamarhati samaj sadan ( kamarhati najrul mancha er aktalar auditorium | 1, feeder road , B T Road , Rathtala |
    kamarhati municipality bhavan |

    pathanirdesh |
    kolkata , burrackpore, belghoria theke
    rathtala stoppage |
    uttarpara theke kheyaghat perieye auto kore aasa jai |

    ভিডিও যা তুললাম, তার সাইজ তো ৮ জিবি দেখাচ্ছে। তাও বেশ খানিকক্ষণ পরে ঢুকেছি। কিভাবে প্রসেস করে সাইজ কমাতে হয় জানি না। জেনে করে আপলোডাচ্ছি। শুনলাম অডিও রেকর্ডিং হয়েছে, কিন্তু কিভাবে পাওয়া যাবে বা আদৌ পাওয়া যাবে কিনা জানিনা।

    ইতিমধ্যে দেখলাম ইউটিউবে নবারুন দিয়ে সার্চালে বেশ কিছু ইন্টারভিউ ও কবিতা পাঠের ক্লিপিংস আছে। উৎসাহীরা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
  • সে | 203.108.233.65 | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১১:৩৭644836
  • যে যাই বলুক না কেন ভাষাবন্ধন লাটে উঠবেই।
  • /\ | 212.79.203.43 | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১২:৩৬644837
  • না উঠলে লাভ কিছু হবে? নবারুণ ভট্টাচার্যের জায়গায় কে সম্পাদক হবে? হলে তাতে ভালো কিছু হবার আশা আছে?
  • সে | 203.108.233.65 | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৩:৫৭644838
  • সেই জন্যেই তো বললাম।
  • ranjan roy | 24.98.67.4 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ২৩:৫৪644839
  • আপাততঃ বোধহয় রাজীব বাবুর সম্পাদনায় বেরোচ্ছে। অরুণ সোমের অনুবাদে বুলগাকভের " মাস্টার এন্ড মার্গারিটা" ও বেরোচ্ছে বলে শুনলাম।
  • /\ | 127.194.215.167 | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ২১:৩৯644840
  • http://aainanagar.com/2013/11/15/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%9F/

    কাঙ্গাল মালসাট
    NOVEMBER 15, 2013 / AAINANAGAR
    সুতনয়া চক্রবর্তী

    ”অনেক দিন ধরেই নানা লোকের কাছ থেকে ফ্যাতাড়ু, কাঙ্গাল মালসাট ইত্যাদি সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা শুনে আসছি, “না পড়লে বুঝবি না কেন এত ঘ্যামা” জাতীয়। পড়ে ফেলার পর একটু অবাকই লাগল, যে মানুষগুলো লিঙ্গবৈষম্যের নানা দিক নিয়ে এত সচেতন, তারা একবারও বলল না এ বইগুলোর এদিকটার কথা? তাই কথাটা পাড়া।

    আমি ক্রান্তিকারী নওজোয়ান সভা নামে একটি সংগঠনে আছি, নারীবাদ, পুঁজিকে-বাদ ইত্যাদি ব্যাপারে আগ্রহী।” – সুতনয়া

    কাঙ্গাল মালসাট বইয়ের পেছনে লেখা, “বাংলা সাহিত্যে ফ্যাতাড়ুদের আবির্ভাব এক মহাচমকপ্রদ ঘটনা… ফ্যাতাড়ুদের আবির্ভাব গৌরবের নাকি ভয়ের, আনন্দের নাকি ডুকরে কেঁদে ওঠার — এ বিষয়ে কোন স্থির সিদ্ধান্তে আমরা এখনও উপনীত হতে পারিনি।”

    মহা চমকপ্রদ সন্দেহ নেই। ভাষায়, বাচনভঙ্গীতে, গল্পের বিষয়বস্তুতে বিলকুল চমকপ্রদ। ফ্লোটেল হানা, সাহিত্য সম্মেলন বানচাল, ফ্যাশন প্যারেড ছত্রভঙ্গ – জঞ্জাল-পোকা-দুর্গন্ধ-গু-মুতের মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষ সেই জঞ্জাল ইত্যাদি দিয়েই আক্রমণ করে, তাদেরকে জঞ্জালে রেখে যারা শৌখিনতায় থাকে তাদের।

    তা এ ব্যাপারটা আমাদের অনেকের বেশ ভালই লাগে। নানা লোক তাদের ফ্যাতাড়ুপ্রেম ঘোষণা করে। কেউ নিজেদেরকে ফেসবুকে ফ্যাতাড়ু উপাধি দেয়।

    ফ্যাতাড়ু-চোক্তাররা লিঙ্গসাম্য নিয়ে বিশেষ চিন্তিত এমন কোন ইঙ্গিত গল্প থেকে পাওয়া যায় না। (কোন কিছু নিয়েই খুব সময় নিয়ে চিন্তা করেন তাঁরা এমন নয়।) ফ্যাতাড়ুপুঙ্গব ডি এস এক মেয়েকে কনুই মারেন, কবি পুরন্দর ভাট এক “একলা মেয়েকে সাইজ করার (মানে ঠিক জানিনা, তবে খুব সুবিধের বলে তো মালুম হয় না) ধান্দা” করেছিলেন, এক বড়লোকের গাড়িতে ঢুকে গিয়ে “ঢেমনি মাগি” প্ল্যান কেঁচিয়ে দিল। এবিষয়ে আরেক ফ্যাতাড়ু মদনের মত, অমন “হারামি মাগি”র “গলা টিপে দিতে হয়”।

    লেখকও যে তাঁর বর্ণনায় লিঙ্গসাম্যের খুব পরোয়া করেছেন তা নয়। নারীচরিত্রগুলির বর্ণনায় চেহারা, পোশাক ও হাবভাবের বাইরে খুব বেশি কিছু আসেনি। ডি এসের বউ কালো, মোটা, “কোলাব্যাঙের” মত দেখতে, ডি এসকে ছেড়ে চলে গেছিল, বেচামণি হাসে কাঁদে কথা বলে, বেগম জনসন ফন্দি করে, বাকিরাও হাঁটে চলে কথা বলে। মোটের ওপর, কোন মানুষকে খুব ওপর-ওপর দেখলে যা চোখে পড়ে, নড়া-চড়া ইত্যাদি। তার কাজকর্মের পেছনে ভয় পাওয়া ইত্যাদির থেকে সূক্ষ্মতর কোন অনুভূতির কোন উল্লেখ নেই। এই উল্লেখ কিন্তু প্রধান-অপ্রধান বেশ কিছু পুরুষচরিত্রের ক্ষেত্রে আছে। ভদির ভাবনার (কথা বলা নয়) বর্ণনা এসেছে। কমরেড আচার্যর ভাবনার বর্ণনা আছে। বেচামণির নেই। এমনকি বেগম জনসনেরও নেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষের পোশাকের উল্লেখ না থাকলেও মেয়েদের পোশাকের উল্লেখ এসেছে, সে পোশাক সমাজে ওই অবস্থায় সাধারণভাবে পরিহিত পোশাকের চেয়ে বিশেষ আলাদা না হলেও। দুটি ছেলের মধ্যে আলোচনার উদাহরণ পাওয়া যাবে কাঙ্গাল মালসাট বা ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাকে। দুটি মেয়ের মধ্যে আলোচনা – নেই। অপ্রধান নারীচরিত্রগুলি নিয়ে পুরুষদের ভাবনার উল্লেখটা নারীর যৌন আবেদনের রেটিং-কেন্দ্রিক - জোয়ারদার ‘বাবু’র স্বগতোক্তি রয়েছে তাঁর স্ত্রী ললিতার চেহারা সম্পর্কে। মেঘমালা সম্পর্কেও একাধিক পুরুষের অনুরূপ মন্তব্য রয়েছে। পুরুষের যৌন আবেদন নিয়ে নারী বা পুরুষের ভাবনার বর্ণনা – নেই। আর মেয়েদের চেহারার বর্ণনার ফোকাস মেয়েদের সেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা হাবভাব যার সাথে যৌন “আবেদনে”র (হ্যাঁ, যৌন আবেদন শব্দটা অসুবিধেজনক) প্রচলিত ধারণা জড়িত। একটি উদাহরণ দেখা যাক – “গোলাপি লিপিস্টিক চুলবুলে ঠোঁট আবছা ফাঁক করে ট্রেইনি নার্স মিস চাঁপা এসে ফিসফিসিয়ে উঠল”।

    কিন্তু তাতে অসুবিধে কি? নারীকে যৌনভাবে দেখাটায় কি অসুবিধে? – একেবারেই না। তাহলে কি গল্প কেবল পুরুষের একধরণের বিষমকামী যৌন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে লেখায় বিরোধ? – না। গল্পে নারীচরিত্রগুলির ওপর-ওপর বর্ণনা, চিন্তা-অনুভূতির উল্লেখ না থাকায় অসুবিধে? – না। সব মিলিয়ে অসুবিধে? – না।

    তবে এতক্ষণ এসব নিয়ে এত ঘ্যান ঘ্যানের কি মানে হল?

    আসলে, অসুবিধেটা শুধু গল্পের মধ্যে খুঁজতে যাওয়াটা ভুল। মানুষের চিন্তাভাবনার ওপর সেই গল্পের প্রভাবের ওপরে নির্ভর করে যে রকমের অসুবিধে, তার কথাই এখানে বলার। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। একটা ছেলের তিরুপতির ভিড় সিঁড়ির ওপর “বোমা! বোমা!” বলে চেঁচিয়ে ওঠা আর এক নাটকের সংলাপে “বোমা! বোমা!” বলে চেঁচিয়ে ওঠা – এই দুটোর মধ্যে কোন চেঁচানিতে আপনার অসুবিধে থাকতে পারে? শুধু যদি আমরা অসুবিধে খুঁজতে যাই “বোমা!” চেঁচানিটার মধ্যে, তাহলে দুক্ষেত্রেই হয় অসুবিধে থাকবে নয় থাকবে না। কিন্তু আমরা সেই চেঁচানিটা তার পরিস্থিতির সাপেক্ষে বিচার করি, তাই নয় কি? গল্পটার পরিস্থিতির ক্ষেত্রে এখানে আমাদের বিচার্য মানুষের চিন্তার ওপর গল্পটার প্রভাব।

    ব্যাপারটা একটু বড় হয়ে গেল না কি? কত রকম মানুষ আছেন, তাঁদের ওপর কত রকম প্রভাব পড়তে পারে গল্পটার। ঠিকই। তাই শুরু করা যাক এই ধারণাকে স্বীকার করে যে ১) বর্তমানে সমাজে একটা বেশ বড়সড় অংশ আছে যারা নারীর চিন্তা-অনুভূতি নিয়ে মাথা বিশেষ ঘামায় না। আশা করি এ বিষয়ে খুব দ্বিমত নেই। এই অংশটি যে তাদের মতামত সম্পর্কে খুব নীরব নন তা বাসে-ট্রামে-ইন্টারনেট ফোরামের কথাবার্তা শুনলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। এঁদের মধ্যে একাংশ বামপন্থী রাজনীতির সাথেও যুক্ত। পরিবারের মধ্যে এখনও আমরা অনেকে চোখের সামনেই দেখতে পাই নারীর চিন্তা-অনুভূতি-মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রচুর উদাহরণ। এমনকি ভারত রাষ্ট্রও এখনও বৈবাহিক ধর্ষণকে আইনত স্বীকার করে না।

    ২) আমাদের পরিস্থিতি, বা চারপাশের পরিমণ্ডল, আমাদের কাজকর্ম ও চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে। এও এমন কিছু কথা নয়, মানুষকে ত তার পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করছেই। সবাই পারিপার্শ্বিকের একই জিনিসের প্রভাবে একই কাজ করছে তাও নয়।

    এমন একটা পরিস্থিতি, যেখানে নারীর চিন্তা-অনুভূতি-মতামতের গুরুত্ব অনেক ক্ষেত্রেই খুবই কম, সেরকম পরিস্থিতিতে কাঙ্গাল মালসাট – ফ্যাতাড়ুর কি কোনও সাধারণ প্রভাব রয়েছে? বলা মুশকিল।

    কিন্তু, ফ্যাতাড়ু-কাঙ্গাল মালসাট নিয়ে বহু বিষয়ে প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত প্রচুর মানুষের বিপুল উচ্ছ্বাস রয়েছে, কিন্তু ফ্যাতাড়ু-কাঙ্গাল মালসাট যে দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা, এই গল্পগুলির মধ্যে যে নারীর চিন্তা-অনুভূতি অনুপস্থিত, সে কথাটা এত উচ্ছ্বাস যাঁরা দেখাচ্ছেন তাঁদের কেউ একবারো বলছেন না?

    তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে কিছু সম্ভাবনা আছে। হতে পারে কেউ ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন ও ধরে নিয়েছেন যে - যাঁরা পড়েছেন তাঁরা নারীকে এভাবে দেখাটা সমর্থন করেন না? কিন্তু এমন ধারণা যদি কেউ করে থাকেন তাহলে বলতে হবে তিনি ১) ও ২) এর বাস্তব সম্পর্কে অবগত নন বা অবগত হয়েও তাঁর বিচারে সেটা প্রতিফলিত হয়নি।

    হতে পারে কেউ লক্ষ্যই করেন নি? তবে তাঁকে লক্ষ্য করানোটাই এই লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য। এবং ১) এর বাস্তব যে গল্পের পরিপ্রেক্ষিতের অংশ, তাও মনে করান।

    হতে পারে কেউ লক্ষ্য করেছেন, কিন্তু ভেবেছেন যে এই বিষয়টার কোনও সেরকম প্রভাব নেই, তাই এ নিয়ে বলে কোনও লাভ নেই, তাই তিনি চুপ আছেন। কিন্তু এমন ভাবনারই বা কারণ কি? যদি কোনও বামপন্থী মনে করতে পারেন (এবং বেশিরভাগই মনে করেন) যে সংস্কৃতির মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গীগুলি রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা জরুরি, তবে সে কথা এখানে খাটবে না কেন? বরং এই বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা কোন দৃষ্টিভঙ্গিকে চিনতে সুবিধে করতে পারে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার দরজা খুলে দিতে পারে।

    কিন্তু আরেকটা ভয়ানক সম্ভাবনাও আছে। হতেই পারে কেউ কেউ ভাবেন, নারীমুক্তি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই? ওসব নিয়ে চর্চা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়? বা নারীমুক্তির কথা অর্থনৈতিক লড়াই জেতার পরে ভাবা যাবে?

    তবে তাঁকে এটাই বলার, যে আমরা তা মনে করি না!!

    শেষ করার আগে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নেওয়া ভাল। এই গল্পতে একরকম দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যবহার হয়েছে মানেই লেখকও সেই দৃষ্টিভঙ্গিরই লোক, এরকম ধারণা করাও যৌক্তিক নয়। শিশুসাহিত্য যাঁরা লেখেন, তাঁরাও অনেকে চেষ্টা করেন তাঁদের শিশু মনস্তত্ত্ব, ভাষাজ্ঞান ইত্যাদির ধারণা অনুযায়ী লিখতে। তার মানেই এই নয় যে তাঁরাও ওই মনস্তত্বের লোক। আর ফ্যাতাড়ু-কাঙ্গাল মালসাট ভাল লাগার মানেই এই নয় যে পাঠক নারী সম্পর্কে ঐ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। ভাল লাগার নানা কারণ হতে পারে।

  • /\ | 127.194.215.167 | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ২২:৫৭644841
  • এই সময় অবিচুয়ারি (১ আগস্ট ২০১৪)

    মাথা উঁচু রেখেই বিদায় নবারুণের

    নিঃসঙ্গ টিলার উপরে থাকা একটা কোনও গাছ বা রেন ফরেস্টের গভীর জঙ্গলে , অচেনা কোনও গাছে একটি পাতা নির্দিষ্ট করে রাখা আছে প্রতিটি মানুষের জন্য৷ জীবনের চলন আসলে সেই পাতাটারই খোঁজ করে যাওয়া৷ টানা ঘ্যানঘেনে বৃষ্টির পর ঝলমলিয়ে রোদ ওঠা এক বিকেলে সেই পাতাটাকে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলেন নবারুণ ভট্টাচার্য৷ আর সেই সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল বাংলা সাহিত্যের একটি অমোঘ অধ্যায়৷ ৬৬ বছর বয়সে৷ মেরুদণ্ডসম্পন্ন বাঙালি মননের অন্যতম প্রতিনিধির বিদায়ের প্রহর গোনা শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক দিন ধরেই৷ অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত নবারুণের শেষ কয়েকটি দিন কেটেছে ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারে৷ কর্কটের থাবা একে একে শরীরের সবক ’টি অঙ্গ বিকল করে দিলেও লড়াই চালাচ্ছিল তাঁর হূদযন্ত্র৷ বৃহস্পতিবার বিকেল চারটে কুড়ি নাগাদ থামল সেটাও৷ দীর্ঘ চার দশকের সাহিত্য জীবনে চিরকাল প্রতিষ্ঠানকে সযত্নে ও সোচ্চারে এড়িয়ে থেকেছেন তিনি৷ মৃত্যুর সময়েও তাঁর পাশে ভিড় করতে পারেনি কর্তাভজা সাংস্কৃতিক জগত্৷ রাজনৈতিক কূটকৌশল ও ব্যক্তিগত স্বার্থপূরণে সদাব্যস্ত বঙ্গীয় বৌদ্ধিক জীবনের বাইরে বরাবরই নিঃসঙ্গ অস্তিত্ব নবারুণের৷ হয়তো আপসহীনতার কবচকুণ্ডল নিয়েই জন্মেছিলেন ১৯৪৮ সালে বহরমপুরে৷ বাবা বিজন ভট্টাচার্য এবং মা মহাশ্বেতা দেবী --- দু’জনেই নিজস্ব রীতিতে জন্ম দিয়েছেন বাঙালির প্রতিবাদের ভাষার৷ অন্য দিকে ছিলেন তাঁর মায়ের কাকা ঋত্বিক ঘটক৷ বারেবারে যিনি ছায়া ফেলেছেন নবারুণের কবিতায় , গদ্যে , প্রতিবাদে , জীবনযাপনে৷ জন্মসূত্রে ও পারিবারিক আবহে প্রান্ত বামপন্থী চেতনার ধারাটিকে তিনি বহন করেছেন আজীবন৷ কিন্ত্ত গোঁড়া ভাবে নয় , নিজের মতো করে , নিজস্ব ভাবনায় জারিত করে৷ প্রথমে পড়াশোনা করেছেন বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে৷ পরে আশুতোষ কলেজে ভূতত্ত্ব ও সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে৷ তাঁর কৈশোর ও যৌবনে দেখা ষাট -সত্তরের কলকাতা বারবার ফিরে এসেছে আদ্যন্ত আরবান এই মানুষটির গল্পে -কবিতায় -উপন্যাসে৷ ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আঠেরো বছর চাকরি করেছেন সোভিয়েত ইনফরমেশন সংবাদ সংস্থায়৷

    সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সেই চাকরি খোয়াতে হয় তাঁকে৷ কমিউনিজমের পতনকে তিনি মনে করতেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি৷ হয়তো তাতে মিশে গিয়েছিল ব্যক্তিগত বহু যন্ত্রণাও৷ যদিও সমসময়ের জনস্মৃতিতে নবারুণ ভট্টাচার্যের পরিচয় ঔপন্যাসিক হিসেবে , তাঁর আত্মপ্রকাশ কবিতা দিয়েই৷ প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না ’৷ এই শিরোনামটি বাংলার কাব্য -ইতিহাসের বহু -উদ্ধৃত পংক্তিগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে থাকবে বহুদিন৷ ষাট -সত্তরের উত্তাল সময়ে বহু যুবকের মতো নবারুণও ঝাঁপ দিয়েছিলেন র্যাডিকাল বাম -রাজনীতির তরঙ্গবিক্ষোভে৷ সেই অগ্নিগর্ভ সময়ের অভিজ্ঞান তাঁর কবিতার শরীরে৷ পরবর্তী জীবনে গল্প -উপন্যাস তাঁর সময়ের অনেকটা কেড়ে নিলেও , বন্ধ হয়নি কবির কলম৷ সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছেন বিদেশি কবিতার অনুবাদ৷ কবিতার পাশাপাশিই শুরু হয়েছিল তাঁর গল্প লেখার অধ্যায়৷ প্রথম গল্প ‘ভাসান ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৮ সালে ‘পরিচয় ’ পত্রিকায়৷ প্রথম গল্প সংকলন ১৯৮৭ সালে - ‘হালাল ঝাণ্ডা ও অন্যান্য গল্প ’৷ শেষ গল্পগ্রন্থ ‘আংশিক চন্দ্রগ্রহণ ’৷ বুভুক্ষুর ক্ষুধা নিয়ে বই পড়তেন , কিন্ত্ত লেখক হিসেবে বড়ই কৃপণ৷ চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে গল্প লিখেছেন মাত্র ১০৬টি৷ উপন্যাস আটখানা৷ শেষ উপন্যাস ‘মবলগে নভেল ’-এর অন্তিম কিস্তিটা আর লেখা হল না তাঁর৷ বাংলা সাহিত্যের শবের লেপতোশকের তলায় ডিনামাইট গোঁজার কাজটা অনেক দিন ধরেই করে আসছিলেন নবারুণ৷ বিস্ফোরণটা ঘটাল সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (’৯৭ ) জয়ী ‘হারবার্ট’৷ এবং তার পর ‘ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক ’ ও ‘কাঙাল মালসাট ’৷ অচিরেই ফ্যাতাড়ু ও চোক্তাররা বাঙালি যুবমানসে কাল্টের চেহারা নিল৷ ক্ষয়ে যেতে থাকা বিবর্ণ সময়ে একটা অন্তর্ঘাতের অপেক্ষায় ছিল বাঙালি তরুণরা৷ নবারুণ তাদের সেই আয়ুধের খোঁজ দিলেন৷ মনে রাখা দরকার , অন্তর্ঘাতমূলক প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখা এর আগেও বাংলা সাহিত্যে হয়নি এমন নয় , কিন্ত্ত এমন বিপুল জনপ্রিয়তা এই প্রথম৷ হয়তো ফ্যাতাড়ুর উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তায় কিছুটা ঢাকাই পড়ে গিয়েছিলেন অন্য নবারুণ , যিনি সমান সতেজ ও আপসহীন৷ ’৯৬ সালে পেয়েছিলেন বঙ্কিম পুরস্কার৷ ২০০৭ সালে সিঙ্গুর -নন্দীগ্রামে ঘটনার প্রতিবাদে সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন , যা তাঁর আপসহীন মনোভাবেরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ৷ কবিতা -গল্প -উপন্যাসের পাশাপাশি সমান পরিশ্রমে এবং মনোযোগে নবারুণ সম্পাদনা করেছেন ‘ভাষাবন্ধন ’ পত্রিকার৷ কিন্ত্ত বঙ্গজন সাহিত্য নিয়ে যতটা মুখের কথা খরচ করেন , সেই পরিমাণ গাঁটের কড়ি খসাতে তাদের ততটাই অনীহা৷ অর্থাভাবে মাসিক থেকে ত্রৈমাসিক হয়ে যায় ‘ভাষাবন্ধন ’৷ আঘাত পেলেও নবারুণ মাথা নোয়াননি৷ নিকটজনের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছেন শেষ দিন পর্যন্ত৷

    সেই একরোখা মাথাটা উঁচু রেখেই মিলিয়ে গেলেন নবারুণ৷ বর্ষণশেষে রোদ ঝলমলে কলকাতার আকাশে৷

    ১৯৪৮ -২০১৪ নবারুণ ভট্টাচার্য৷




    'সুখের মুহূর্তে নবারুণ কান মলে দেন' - বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত (এই সময়, ৩রা আগস্ট, রবিবার)

    সুখের মুহূর্তে নবারুণ কান মুলে দেন

    সুখের মুহূর্তে নবারুণ কান মুলে দেন‘অঙ্ক মিলছে কিন্ত্ত একটা কালো বহমান ফাঁক থেকে যাচ্ছে যার ওপরে রয়েছে একটা ব্রিজ , যার ওপরে , রাতে গাড়ির আলোয় দেখা যায় তিনটি মেয়ে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচছে আর সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছে চিতামানুষ৷ ’ চিতামানুষ , ২০০১প্রতিটি বাঁকে , সৃষ্টি -জীবন যেখানে পরিত্রাণ বা স্বস্তি খোঁজে , বিলাপে ব্যস্ত হয় , বা হয়তো সামান্য বিলাসের চাহিদায় অস্থির হয়ে ওঠে , অমোঘ কোনও নিয়মে নবারুণ ভট্টাচার্য মাথা নিচু মানুষের সঙ্গেই থেকেছেন৷ প্রতি দিনের বিপুল সীমাবদ্ধতা , অতি সচেতন অতি সংবেদনশীল মানুষকেও যা আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখে , তাকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিলেন ভদ্রলোক , নেহাত্ই ‘ভদ্রলোক ’ থেকে যেতে চাননি বলে৷ একটা হই হই উজ্জ্বল কুচোকাচাদের রেস্তোঁরায় চিতা বা টিগার সেজে যে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলে , এই খেলা হাত নাড়া , খিলখিল খুশির মধ্যে থাকা দিনটা যখন বেশ খানিকটা রাত হয় , তখন চিতামানুষ , পুরো মানুষ হতে হতে সাইকেলে বাড়ি ফেরে৷ অন্ধকারের দিকে৷ অতি সাধারণ অন্ধকার , কোনও স্বপ্নের সওয়ারি সে পথে যাতায়াত করেন না , কোনও ভোরের সম্ভাবনা নেই , সকাল একটা আছে , তখন আবার মজার বাঘ সাজার পালা , বাচ্চারা হাসবে বলে৷ বাংলা ভাষায় চল্লিশ বছর ধরে সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে কোনও দিনই বিষয়ের খোঁজে তাঁকে এই সব মানুষদের বিশেষ খুঁজতে হয়নি , রুগ্ন চেহারা তীব্র দৃষ্টির সামনে তাঁরা এমনিই এসে দাঁড়িয়েছেন , যেমন আমাদের সামনেও দাঁড়ান , তবে ওই আর কি , আমরা তাঁদের অতিক্রম করে মেনুতে চোখ রেখেছি , ইনি রাখেননি৷

    বেশি লেখেননি , আবার ইলিয়াস বা ওয়ালিউল্লহর মতো একেবারে এক আঙুলে শেষ হয় , এ রকম মিতাচারও করেননি৷ গল্প , নভেলা লিখেছেন বেশ কিছু৷ ‘হারবার্ট’-এর আগের নবারুণ আর ফ্যাতাড়ুদের পরের নবারুণ অপেক্ষাকৃত ভাবে স্বল্প পরিচিত৷ সিনেমা দিয়ে বই চেনার মধ্যে আমি বলব না তেমন অসম্মান কিছু আছে , সিনেমা দিয়ে সিনেমা শেখা বাদ না পড়লেই হল , তবে আমি সিনেমাভক্ত নই, নেহাতই ঊনবিংশ শতকীয় শান্তিনিকেতনস্থ ব্রাহ্ম বিদ্যালয়ে একনিষ্ঠ নির্জীব সুবোধদের মতোই ছাপার অক্ষরে আবিষ্ট৷ যত চিত্কার সবই শিশু পাঠাগারে , গলা তোলার সাহস নাই৷

    কিন্ত্ত আমি বিনীত ভাবে বাংলা -সাহিত্যপ্রেমী পাঠককে এই বইটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করব৷ একটি বিশেষ উপলব্ধির ‘উত্তরকাল ’-এর গল্প সংগ্রহ হিসেবে ভবিষ্যতে পরিগণিত হলে আশ্চর্য হব না৷ আজ আবেগরুদ্ধ হয়ে আছি , দাবিটা অন্তত করে যাই৷

    যৌবন খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিপ্লব স্বপ্নে কেটেছে , তখনও হয়তো নিছক শব্দ -সমার্থ-ইটিমোলোজিতে যথেষ্ট প্রগতি না হওয়ায় জীবনে স্বাধীনতা বলতে এস ইউ ভি র গতি বোঝানো যেত না , পরাজয়ের তীব্র বিস্বাদ হয়তো কোনও দিনই যায়নি , বামপন্থী রাজনীতির মধ্যে প্রায় -সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃহনন -সমৃদ্ধ বিশুদ্ধতার চর্চা লেখক নবারুণকে সুখী করেছিল এই দাবি রাজনৈতিক বিরোধী হিসেবেও সমর্থন করতে পারব না , এর পরে শুধুই হার , সোভিয়েত -এর পতন , সমাজ বদলানোর কাজে যাঁদের বন্ধু হিসেবে পাওয়ার কথা তাঁরা ছন্নছাড়া অথবা বন্ধুত্বের প্রয়োজন বোধ করেন না , খানিকটা জোর করে তাঁদের গল্পে এনে তাঁদের ফ্যাত ফ্যাত সাঁই সাঁই শব্দে ওড়াতে হয় , প্রগতিবাদী প্রতিষ্ঠানকে শান্তিতে ঘুমোতে দিলে চলে না , আবার চালু রাখতে হয় রিজার্ভিস্ট লাইন , নইলে পাড়ার প্রোমোটারির সুখস্বপ্নচারণার জগতে সম্ভাব্য প্রতিবাদীর অবগাহনের ঘটনাও তো কম না , বা বাংলার রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়ার বছর চারেক , তীব্র গতিতে ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাব বৃদ্ধি , এবং তার পরে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির রাজনীতির দাপট , এতগুলো অভিঘাতকে শুধুই সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার না করে , বার বার হেরে যাওয়াদের দলে থাকার চেষ্টা করা , এই দীর্ঘ যুদ্ধে গাজার কিশোরের মতোই হাতে শুধু পাটকেল এই ভদ্রলোকের৷ এই যাত্রায় , আমার অন্তত মনে হয়েছে , বিশ্বায়নের পরের পশ্চিম বা উত্তর ভারতের পরিবর্তিত বা নতুন গড়ে ওঠা বিপিও -শহর গুলিকে দেখার অভিজ্ঞতা লেখককে একটা ভাবনার নতুন জগতে নিয়ে এসেছিল৷ সেটা একলা চিতামানুষদের জগত্ , যারা সেজে উঠছে , বাচ্চাদের সঙ্গে খেলবে বলে , রাতে অন্ধকারের দিকে সাইকেল চালাচ্ছে৷ এই চিতামানুষের হয়তো লালবাজারের কুচকাওয়াজে উপর থেকে ময়লা ছুঁড়ে মারার সাহস নেই৷ জোট বাঁধা সেখানে আর একটু পিছিয়ে , প্রাতিষ্ঠানিক প্রগতিবাদীরাও সেখানে কেঁচো মাত্র৷ সেখানে রায়ট যারা সরাসরি করে তাদের থেকে একটু আলাদা করে রাখার সম্মান দিয়ে সদাশিবের মতো চরিত্রকে তুলে আনতে হয় , যে ব্যর্থ হচ্ছে , বাচ্চা একটা ছেলেকে বাঁচাতে৷ কারণ সাধারণ মানুষ , যাদের ফ্যাতাড়ু হওয়ার কথা তারা অনেকেই রায়ট করছে , অন্যান্য চোক্তার কিংবা ফ্যাতাড়ুদের হয়তো কেটেই মেরে ফেলছে৷ (আব্বা - ২০০২ )৷

    এমনিতে শপিং মলে বা শুধুই উড়ালপুলে যেমন উন্নয়ন দেখেননি , তেমনই ঘুগনি রুটি অটোওয়ালা বাস স্ট্যান্ডের আড্ডা , আদি গঙ্গার পাশে কিংবা গাঁজা পার্কের বাংলুর আড্ডার মধ্যে পরিবর্তন সম্ভাবনা যে দেখেছিলেন , তার তো আর ভূগোল ইতিহাস নেই তা তো না , সম্ভাবনার তো একটা ঐতিহ্য থাকে , সে যতই সংকুচিত হোক , কিন্ত্ত ‘এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ’ ইস্পাত -কাচের শহরগুলোতে একটু মানুষ খুঁজে পাশে দাঁড়াচ্ছেন , একটু বেছে নিচ্ছেন , একটু চিন্তায় আছেন , কারা আবার দাঙ্গাবাজের দলে নাম লেখান৷ গরিব বা হেরো মানুষ মানেই তারা জোট বাঁধছে , বা রেগে গেলে বা মজার শখ চাপলে , বিষ্ঠাও ছুড়ে মারতে পারে , এমতি রসিক সমাধান ও সেখানে হয়তো পাচ্ছেন না৷ নতুন করে শুরু করছেন , ঊনবিংশ শতকে সাহিত্যে জমিদার -নন্দনদের দাপট থেকে সাহিত্যের মুক্তির জন্য যেমন শুরু করেছিলেন , ফকির মোহন সেনাপতি , ওড়িয়া সাহিত্যে , কিংবা মুন্সী প্রেমচন্দ৷ একলা কিছু চরিত্র তুলে এনেছিলেন , সংরক্ষণশীল একটা সমাজের নিচু তলা থেকে৷ (‘ছ মান আট গুন্ঠ’-র ভোগিয়া /সড়িয়া , ‘বিধবার ছেলে অনন্ত ’-র মা ও ছেলে৷ সম্ভবত রুশ বিপ্লবের আগে লেখা ) ভাষাবন্ধনেরও একটা ভূগোল ইতিহাস থাকে , বিশেষত বিশ্বসাহিত্যের এই পাঠসুখ -আবদ্ধ বৃদ্ধিমুখী উচ্চাশা আক্রান্ত সময়ে৷ ওই বিপুল পড়াশুনোর জগত্ থেকে মুখ তুলে , মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময় ঠিক খুঁজে নিয়েছেন৷ যথেষ্ট নিয়মিত৷

    ব্যক্তিগত ভাবে আমি খানিকটা ন্যাকা আদেখলা পাঠক -কনজিউমার , টলস্টয় থেকে বলিউডি নায়িকার বিজ্ঞাপন সব কিছুতে গদ গদ হয়ে পড়ি , মনে হয় এমনটি আর দেখিনি , মনে হয় আহা কবে অমন রাশভারি হব , কবে অমন তন্বী হব , কবে অমন ইংরেজি বলব , কবে গার্সিয়া মার্কেজের মতো গোঁফ হবে , কবে গুন্টার গ্রাসের মতো পাইপ খাব , কবে ঊনষাট হব , সারামাগোর মতো সাড়া ফেলে দেব , কবে তমুকের মত গান গাইব , এ এক আশ্চর্য হীনমন্যতা৷ যতই মিছিলে চেঁচাই আর সমবেদনায় কাতর হই, একলা আয়না -মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছি গভীর ভাবে বলে মনে হয় না , শুধু নবারুণ ভট্টাচার্য এই সব সুখের মুহূর্তে রেগুলার কান মুলে মুখ ঘুরিয়ে দেবেন , এ কী অন্যায় কথা !‘আংশিক চন্দ্রগ্রহণ ’ এই ছিটকে আসা আলো থেকে মুখ ফেরানোর সৌভাগ্য হলে , কী কী চোখে পড়তে পারে , তার মেনু মাত্র , সাধ্যের মধ্যেই , পড়তে চাইলে আটকাবে না৷

    নবারুণ ভট্টাচার্য কারণ তিনি নেহাত্ ‘ভদ্রলোক ’ থাকতে চান না৷ শেষ গল্পগ্রন্থেও৷ কিন্ত্ত ভাবনার জগত্টা এখানে নতুন৷ লিখছেন বোধিসত্ত্ব দাশগুন্ত আংশিক চন্দ্রগ্রহণ নবারুণ ভট্টাচার্য ভাষাবন্ধন৷ ১০০ টাকা

    chhabi; সুযাত্র ঘোষ৷
  • aranya | 78.38.243.218 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৫২644842
  • 'কিন্তু, ফ্যাতাড়ু-কাঙ্গাল মালসাট নিয়ে বহু বিষয়ে প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত প্রচুর মানুষের বিপুল উচ্ছ্বাস রয়েছে, কিন্তু ফ্যাতাড়ু-কাঙ্গাল মালসাট যে দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা, এই গল্পগুলির মধ্যে যে নারীর চিন্তা-অনুভূতি অনুপস্থিত, সে কথাটা এত উচ্ছ্বাস যাঁরা দেখাচ্ছেন তাঁদের কেউ একবারো বলছেন না?'

    - সুতনয়ার লেখাটা ভাল লাগল।
  • /\ | 127.194.215.167 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:২৩644844
  • এই সময় রবিবারোয়ারি ১০ই আগস্ট ২০১৪ (নবারুণ স্মরণ)
    নবারুণ ভট্টাচার্যের প্রতিকৃতি শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায়৷

    ০১) দূর থেকেই ক্ষমা চেয়েছি বাপ্পার কাছে - মহাশ্বেতা দেবী (সাক্ষাৎকার - রাহুল দাশগুপ্ত)
    ০২) জীবনে একটি বস্ত্তই পাননি ৷ মাতৃস্নেহ - তথাগত ভট্টাচার্য
    ০৩) বমির দাগ - সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
    ০৪) মহাযানের আয়না - বিমল দেব
    ০৫) লে ধড়াদ্ধড় লে / লে ধড়াদ্ধড় লে - সুমন মুখোপাধ্যায়
    ০৬) বারুদ মানুষ - চিন্ময় গুহ
    ০৭) ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ সাঁই সাঁই - দেবেশ চট্টোপাধ্যায়
    ০৮) নবারুণদা বিষয়ে দু-একটি কথা - গৌতম মিত্র
    ০৯) বিশ্বের শেষ কমিউনিস্ট - কিউ
    ১০) পেট্রল ঢেলে অগ্নিনির্বাপন - সুরজিত্ সেন
    ১১) নবারুণের ঘুঘুচক্কর - হিরণ মিত্র
    ১২) নবারুণদা ও একটি প্রগাঢ় কেলো - বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী
    ১৩) মধ্যবিত্তের সক্রিয় রাজনীতি বড়জোর ফ্রিভলাস ফ্যাতাড়ুদের খিস্তিবিলাস? - অমিতাভ মালাকার
    ১৪) সূর্যের গ্রেনেড - সুনন্দন চক্রবর্তী
    ১৫) পরিত্রাণের উপায় নেই - সৌরভ মুখোপাধ্যায়
    ১৬) একটা নক্ষত্র মেঘলা আকাশে, এই প্রবল শ্রাবণেও - কমল চক্রবর্তী
    ১৭) নপুংসকতার ক্যানসার থেকে আমরা মুক্তি পাব নবারুন? - অনিল আচার্য
    ১৮) ড্রপসিন ওরা নামাবে নামাক - সুপ্রতিম রায়
    ১৯) জেগে থাকার স্বপ্ন - সুমন্ত মুখোপাধ্যায়
    ২০) কাঠকয়লার সাতরঙা কবিতা - সার্থক রায়চৌধুরী
    ২১) ট্রাজিক ফ্যাতাড়ু, ম্যাজিক ফ্যাতাড়ু - এই সময় শারদীয় ২০১৩ থেকে নবারুণ ভট্টাচার্যের একটি গল্পের পুনর্মুদ্রণ

    ==========================================================================

    দূর থেকেই ক্ষমা চেয়েছি বাপ্পার কাছে

    ওকে যে আমি ইচ্ছা করে ছেড়ে এসেছিলাম , তা নয়৷ আমাকে দুনিয়া হয়তো খুব নিষ্ঠুর মা হিসাবেই দেখবে৷ ’ একান্ত সাক্ষাত্কারে মহাশ্বেতা দেবী ৷ আলাপে রাহুল দাশগুন্ত

    মনে হয় , আমার বিষয়ে আমার ছেলে শুধুই ক্রিটিকাল ছিল না , ওর মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংও ছিল৷ অ্যাট দ্য এন্ড অফ মাই লাইফ , আজ সেই হাহাকার নেই যে , তাকে চোখে দেখিনি কত দিন৷

    রাহুল দাশগুন্ত : আপনি এক বার লিখেছিলেন , ‘হাজার চুরাশির মা ’ বইয়ে ব্রতীর শৈশবচিত্র তো আমার ছেলে নবারুণেরই শৈশব৷ ওঁর শৈশব নিয়ে যদি কিছু বলেন৷ মহাশ্বেতা দেবী : আমার ছেলেকে তোমরা নবারুণ বলে চেনো৷ ওর ডাকনাম , বাপ্পা৷ আর আমি তো ওকে ‘বাবু’ বলে ডাকতাম৷ বাবুর জন্ম , ১৯৪৮ সালে৷ দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে৷ আমি তখন বাবা -মা ’র কাছে ছিলাম৷ ও বাড়িতেই জন্মেছে৷ ওর জন্মের পর আমার বাবা মনীশ ঘটক অসম্ভব আনন্দ পেয়েছিলেন৷ একদম শিশুর মতো হয়ে উঠেছিলেন৷ বলেছিলেন , তোমরা মনে রেখো , ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বই সবার আগে হবে৷ মা যেন এর মধ্যে মাথা না গলান ! বাবু ছিল ‘তুতুল ’ মানে আমার বাবার বড়ো নাতি৷ কলকাতায় এলেই বাবুর জন্য বাবা চকোলেট আনতেন৷ ‘পাতাবাহার ’ আর ‘শিলালিপি ’ উপহার দিয়েছিলেন৷ বাপ্পা খুবই দুরন্ত ছিল৷ বাবা ওকে বাগে আনার চেষ্টা করতেন৷ পারতেন না৷ সত্তর দশকের গোড়ায় বাপ্পার ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না ’ প্রকাশিত হয়৷ বইটি পড়ে বাবা ওকে একটা পোস্ট কার্ডও পাঠান৷ লেখাটার বেশ তারিফ করেছিলেন উনি৷ বাপ্পার জন্মের পর বিজনও খুব খুশি ছিলেন৷ বাপ্পাকে নিয়ে ওঁর বাবা কত কবিতা আর গান যে বানিয়েছিলেন , তা বলে শেষ করা যাবে না৷ বিজন বলতেন , আমাকে একদম বাধা দেবে না৷ ছোটবেলায় শিশুরা মা -সর্বস্ব হয় ঠিকই , কিন্ত্ত এ ব্যাপারে বাবাকেও যথেষ্ট আমল দিতে হবে৷ মা তাকে যত ভালোবাসে , বাবা কিছু কম ভালোবাসে না !বাপ্পাকে যখন ছেড়ে এলেন , সেই সময়কার কথা কিছু যদি বলেন৷ আমার ছেলের ১৪ বছর বয়সে স্বামীকে ছেড়ে এসেছিলাম৷ ঠিক করেছিলাম , একা থাকব৷ এমন নয় যে , বিজন আমাকে কোনো বাধা দিয়েছিলেন৷ উনি আমার সব কাজেই আমাকে অসম্ভব উত্সাহ দিয়েছেন৷ বলা যায় , সম্পূর্ণ স্বাধীনতা৷ আমার অসম্ভব স্বাধীনতা ছিল৷ আমার সব কিছু, প্রতিটি কাজকর্মেই তিনি থাকতেন৷ মানুষ হিসাবে অসম্ভব খোলামেলা৷ আর একদম খাঁটি শিল্পী৷ কিশোর নবারুণ আর বিজনকে ছেড়ে আমি বালিগঞ্জ স্টেশন রোডে জ্যোতির্ময় বসুর গেস্ট হাউসের একটা ছোটো ঘর ভাড়া নিয়ে চলে আসি৷ মনে করেছিলাম , আমার ‘একলা হওয়া ’ খুব দরকার৷ একলা ছিলাম , এটাও সত্যি৷ সন্তান জন্মানোর পর নিজের সাধ্যমতো চেষ্টায় তাকে বড়ো করতে লাগলাম৷ এমন নয় যে , আমার সঙ্গে বিজনের কোনো বড়োসড়ো ঝগড়া হয়েছে৷ কোনো কথা -কাটাকাটিও হয়নি , যা হয়েছে সে যত্সামান্য মতবিরোধ৷ অত্যন্ত তুচ্ছ কারণে৷ বাট আই ওয়াজ ফোর্সড টু লিভ মাই সান৷ ১৪ বছর বয়সে সেই যে নবারুণকে ছেড়ে আসি , তারপর আর আমাদের একসাথে থাকা হয়নি বলতে গেলে৷ কিন্ত্ত ওকে ছেড়ে আসলেও ওর লেখাপড়ার খরচ ও অন্যান্য সব কিছুর দেখাশুনো সাধ্যমতো পিছন থেকে আমিই করতাম৷ বিজনও চেয়েছিল , যতটা সময় একসঙ্গে থাকা যায়৷ বিজনের দিক থেকে কোনও বাধাও ছিল না৷ বাপ্পার বাবা যেভাবে স্নেহ আর যত্নে ওকে মানুষ করেছিল , তার কোনও তুলনা হয় না৷ তারপর একটা সময় পর ওর বিয়েও হয়ে যায় , নিজের একটা স্বতন্ত্র পরিবারও হয়৷ বাপ্পার সঙ্গে যোগাযোগটা আমার ছিলই৷ তারপর ক্রমে সেই যোগাযোগ ক্ষীণ হতে শুরু করে৷ আমি মাঝে মাঝে চিঠি লিখতাম , উত্তর পেতাম না৷ সে সব কথা আজ আর তুলতেও ইচ্ছা করে না৷ আমি দীর্ঘ দিন যে বিজনকে ছেড়ে ছিলাম , তার পিছনে আমাদের দু’জনের মধ্যেকার ভুল -বোঝাবুঝি সম্পূর্ণ দায়ী৷ পরে এ -জন্য আমি যথেষ্ট অনুশোচনা করেছি৷ আর বাপ্পার সঙ্গে তো মনের দিক থেকে আমি সব সময়ই জড়িয়ে ছিলাম৷ ওকে যে আমি ইচ্ছা করে ছেড়ে এসেছিলাম , তা নয়৷ সবটাই আমার হাতের বাইরে চলে গেছিল৷ আমাকে দুনিয়া হয়তো খুব নিষ্ঠুর মা হিসাবেই দেখবে৷

    নবারুণদার লেখা আপনার কেমন লাগতো ? খুব পজিটিভ আর খুব পাওয়ারফুল৷ কবিতা -গল্প -উপন্যাস , সবকিছুতেই ও দক্ষতা দেখিয়ে গেছে ! ওঁর লেখা বেরোলেই আমি সাধ্যমতো জোগাড় করে পড়তাম৷ কারণ সেই লেখার মধ্যেই আমার ছেলেকে আমি খুঁজে পেতাম৷ ও যা লিখেছে , নিজের হাতে কলম দিয়ে লিখেছে , সেটাই আমার কাছে বিরাট পাওয়া৷ লেখক হিসাবে ও যে দাঁড়িয়েছে , এটা আমার কাছে একটা মস্ত বড় প্রান্তি৷ বাপ্পা তো অনেক লেখেনি৷ ওর লেখা ওর সমসাময়িকদের চেয়ে অন্য রকম , ভিন্ন স্বাদের ছিল৷ ও লিখতেই এসেছিল৷ ওর লেখা যে মানুষের ভালো লেগেছে , স্বীকৃতি পেয়েছে , এটাই তো সবচেয়ে ইতিবাচক ব্যাপার৷ ভবিষ্যতে ওর লেখা থেকে যাবে এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওনা৷ বাবা না ছেলে , কার কথা আপনার বেশি মনে পড়ে ?বাপ্পা , আমার ছেলের কথাই খুব বেশি করে মনে পড়ে৷ হ্যাঁ, বিজনের থেকেও বেশি৷ বিজন খুব আনন্দময় মানুষ ছিলেন৷ অসম্ভব দারিদ্রের মধ্যে বড়ো হয়েছেন৷ আমাকে উনি ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন৷ আর নবারুণ ? আমি তার মা৷ অথচ আমরা তো বেশি দিন একসঙ্গে থাকি নি৷ ও আসলে বাবার খুব কাছের ছিল৷ ওদের দু’জনের কাছেই আমি একটা রিয়েলিটি৷ ‘অ্যাজ আ পার্সন আই এক্সিস্ট৷ ’ এটা ওদের দু’জনের কেউই অস্বীকার করতে পারবে না৷ মনে হয় , আমার বিষয়ে আমার ছেলে শুধুই ক্রিটিকাল ছিল না , ওর মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংও ছিল৷ অ্যাট দ্য এন্ড অফ মাই লাইফ , আজ সেই হাহাকার নেই যে , তাকে চোখে দেখিনি কত দিন৷ এক সময় খুব মনে হতো , আমার ছেলেকে আমি জানতে চাই , তার সঙ্গে কথা বলতে চাই , তাকে আমার বাড়িতে আনতে চাই , কাছে পেতে চাই৷ ইচ্ছা করত , তার হাত ধরে নিয়ে আসি৷ সে -ও নিশ্চয়ই আমাকে গ্রহণ করবে , ভালোবাসবে৷ ‘হি ইজ বর্ন অফ মি ’, এই সম্পর্কটা তো কেউ কোনও দিন অস্বীকার করতে পারবে না ! অন্যরা দূর থেকেই আমার বিচার করে যাবে৷ কিন্ত্ত আমার ভিতরটা কি কেউ দেখতে পাচ্ছে ? কেউ জানে , আমার ভিতরে কী হয় ? দূর থেকে কত বার যে ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে গেছি , নিজের ছেলের কাছে , ‘কনটিনিউয়াস ’, কেউ জানে তা ? কত বার মনে হয়েছে , আমি মা , আমারই তো আগে যাওয়া উচিত৷ ও আমার কাছে একটা মস্ত বড় রিয়েলিটি হয়ে ছিল , ও যে আছে সেটাই , মনে হতো , চাইলেই তো যে কোনও সময় গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে পারবো ! ও কেমন আছে , কী লিখছে , কী ভাবছে , এইসব চিন্তা আমাকে অস্থির করে তুলতো৷ আরও মনে হত , ও কি আমার কথা ভাবে ? আমি কেমন আছি জিগ্যেস করে ? আমার লেখা পড়ে ? ওকে যে সে ভাবে আমি কাছে পাই নি , তার মধ্যে আমারও ভুল অনেকটাই আছে৷ কিন্ত্ত বাপ্পা বা ওর বাবা আমাকে কখনও কোনও সমালোচনা করেনি৷ আজ মনে হয় , কেন করে নি ? করলে ভালো হত৷ নবারুণদাকে যাঁরা চেনেন না , তাদের জন্য যদি কিছু বলেন ...বাপ্পা বই -পাগল ছিল৷ বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসতো৷ ওর মতো ছেলের নিজস্ব একটা জগত্ থাকবেই৷ সেই জগতেই ও থাকত৷ ও একেবারে বইয়ের জঙ্গলের মধ্যে শিকারী হয়ে ঘুরে বেড়াতো৷ ওর চেনাজানা জঙ্গল ! বিজন নাটক লিখত , আমি গল্প -উপন্যাস৷ বাপ্পা শুরুই করেছিল কবিতা দিয়ে৷ ওর একটা কবিতা খুব মনে পড়ে , ‘একটা কথার ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে / সারা শহর উথাল -পাথাল , ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে / ফাটবে চিবুক, পোড় খাবে বুক, একটা নদী উতল হয়ে ’, আর মনে পড়ছে না ! কিছু দিন পর ও খুব মন দিয়ে গল্প লিখতে শুরু করল৷ বই পড়ার পাশাপাশি ও খেতেও খুব ভালোবাসতো৷ মাংসের একটা রান্না আমি করতাম , পুরনো দিনের , রেজালা , সেটা ছিল ওর খুব পছন্দের৷ রেজালা ছিল কম ঝোলের , আর সেটাই বাপ্পা ভালোবাসতো৷ মাংসটাই বেশি মনে পড়ে৷ আমি তখন জীবনে খুবই ব্যস্ত৷ খুব যে গুছিয়ে রান্নাবান্না করে ওকে খাওয়াবো , সেটা আর হয়ে উঠতো না৷ রান্নাবান্না করতামও কালেভদ্রে৷ ও সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসত৷ কিন্ত্ত ওকে নিয়ে সিনেমা যাওয়া -টাওয়াও আমার খুব একটা হয় নি৷ ছোটবেলায় খুব দুরন্ত হলেও , ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই ও যেন বদলে যেতে শুরু করলো৷ জীবনের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস হয়ে গেল৷ অ্যাজ আ সিরিয়াস পার্সন , ওর নিজের ইনটিগ্রিটি , ওর নিজের ডেপথ গড়ে উঠেছিল৷ ও কী করতে চায় বা না চায় , সে বিষয়ে ওর নিজের মনেই খুব স্পষ্ট ধারণা তৈরি গেছিল৷ ওকে গভীর ভাবে চিন্তা করতে দেখতাম৷ বাপ্পা এই রকমই ছিল ...গত দশ বছরে আপনাদের মধ্যে যোগাযোগ আর ছিলো না বললেই চলে ...আসলে বাপ্পা ওর নিজের জীবন ও পরিবার নিয়ে আলাদা হয়ে গেছিল৷ আমার কাজ , আমার একাকিত্ব , আমার ব্যস্ততা নিয়ে আমিও সরে থেকেছি৷ মনে আছে , আমার নাতি তথাগতকে সমস্ত কলেজ স্ট্রিট তিন -চার দিন ঘুরে ঘুরে প্রথম পাতার পর৷

    বিভূতিভূষণের যত বই পেরেছি জোগাড় করে জন্মদিনে দিয়েছিলাম৷ কী মধুর স্মৃতি সেটা আমার জীবনের ! আমি তো ওদের সবাইকে নিয়েই থাকতে চেয়েছি৷ কিন্ত্ত শুধু পরিবার তো কখনও আমার জীবন ছিল না ! আমার অন্যান্য দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা বরাবরই ছিল৷ সে ব্যাপারে কখনও আমার পরিবার নিজেদের জড়াতে চায়নি৷ আমি যখন বিভিন্ন আদিবাসী গ্রামে যেতে আরম্ভ করেছি , তখনও বাপ্পা আমার কাছে থাকে নি৷ বয়স হলে মা -বাবারা ছেলেমেয়েদের কাছেই থাকতে চায়৷ কিন্ত্ত আমার আর অতীতে ফিরে যেতে ইচ্ছা করেনি৷ দূর থেকেই আমার ছেলের খোঁজ নিতাম৷ ওর শুভকামনা করতাম৷ ওকে ভালোবাসতাম৷ ওর সাফল্য কামনা করতাম৷ কখনও মনে হতো , সব মিটিয়ে ফেলা যাক৷ আমিও আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করি৷ পরে বুঝতাম , সে আর হয় না৷ আর সে সব সম্ভব নয় ! শেষ বছরগুলোয় আর কোনও ভাবেই আমাদের দেখাসাক্ষাত্ সম্ভব হয়ে ওঠেনি ! অথচ ওকেই , আমার ছেলেকে , আজ সবচেয়ে বেশি দেখতে ইচ্ছা করছে৷


    ■পাশের ছবিতে : বাল্যে নবারুণ ভট্টাচার্য বাবা বিজন ভট্টাচার্য ও মা মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গেছবি সৌজন্য : বিজন ভট্টাচার্য রচনাসংগ্রহ (প্রথম খণ্ড ), দে’জ পাবলিশিং৷



    জীবনে একটি বস্ত্তই পাননি ৷মাতৃস্নেহ

    বাবার জীবনে একটি ব্যক্তিরই গভীর প্রভাব ছিল৷ আমার ঠাকুর্দা, বিজন ভট্টাচার্য, যিনি একাধারে ছিলেন বাবার পিতা , মাতা এবং ‘মেন্টর ’৷ ’ লিখছেন তথাগত ভট্টাচার্য

    কুকুর , বিড়াল এবং পাখি আমাদের বাগানটার মধ্যে ঠাসাঠাসি করে থাকত৷ পশু , পাখি , পোকামাকড় , ঝোপঝাড় , আগাছা সবই বাবার পৃথিবীতে খুব গভীর জায়গা নিয়ে হাজির ছিল৷

    বাবার চলে যাওয়ার মুহূর্তে আপনারা অনেকেই জানিয়েছেন , পাশে আছি৷ ‘সলিডারিটি ’-র সেই সব বার্তা (হঁ্যা , ‘সলিডারিটি ’-ই বলব , ‘শোক ’ শব্দটা এখানে অপ্রয়োজনীয় ) আমরা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বীকার করি৷ প্রত্যেককে আলাদা ভাবে উত্তর দেওয়া অঙ্কের হিসেবেই অসম্ভব , তার জন্য দুঃখিত৷ আমার বাবা এমন কিছু নীতিতে (‘প্রিন্সিপল ’ অর্থে) আস্থা রাখতেন , যেগুলো আজকের দুনিয়ার সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না৷ হয়তো ভালোই হয়েছে যে এই পৃথিবীটা তাঁকে আর বেশিদিন সহ্য করতে হল না৷ তবে , যত দিন বাংলা ভাষা থাকবে , গরিব , লুম্পেন , দুনিয়ার যত বাতিল , ক্ষমতাহীন মানুষেরা থাকবেন , তত দিন বাবার লেখালিখি সম্ভবত প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না৷

    ২০০৩ -এ অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমরা একটা মাসিক সাহিত্যপত্রিকা শুরু করেছিলাম , ভাষাবন্ধন৷ পরে সেটা ত্রৈমাসিক হয়ে যায়৷ সেই অভিযাত্রা বন্ধ হবে না৷ বাবার পক্ষে পত্রিকাটা চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ কোনও রকম প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য গ্রহণে অস্বীকৃত ছিলেন তিনি৷ মেরুদণ্ডটি ছিল ঋজু, বাংলার হালফিল বুদ্ধিজীবী মহলে যেটা কার্যত দুর্লভই বলা চলে৷ তবে , আপনারা যদি পত্রিকাটি চালানোর ব্যাপারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনও রকম সাহায্য করতে চান , স্বাগত জানাব৷

    চতুর্দিকে যে ভাবে নানাবিধ গুজব , দাবি -দাওয়া ইত্যাদি উড়ছে , সেই সূত্রে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করে নেওয়া জরুরি৷ ১. আমার বাবা কোনও রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠানের থেকে কোনও রকম সাহায্য পাননি৷ চানওনি কখনও৷ আমাদের পরিবারও এই রকম কোনও সাহায্য প্রার্থনা করেনি বা গ্রহণ করেনি৷ তাঁর কোনও সাহায্য দরকারই ছিল না৷ ২. বাবার জীবনে মাত্র একটি ব্যক্তিরই গভীর প্রভাব ছিল৷ তিনি আমার ঠাকুর্দা, বিজন ভট্টাচার্য, যিনি একাধারে ছিলেন বাবার পিতা , মাতা এবং ‘মেন্টর ’ (জানি না , এই শব্দটির যথাযথ বাংলা প্রতিশব্দ কী হবে )৷ আমার বাবাকে বুঝতে হলে , তিনি যে অনমনীয় শিরদাঁড়াটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন , তার একটা আঁচ অন্তত পেতে হলে ‘পদাতিক ’ ছবিটি দেখতে পারেন , বিশেষ করে ছবিটির শেষের দিকে সেই অংশটুকু যেখানে আমার ঠাকুর্দা বলছেন , ‘আমি কিন্ত্ত কখনও কোনও কম্প্রোমাইজ করিনি ’৷ এটাই আমাদের পরিবার৷ বাবার জীবনে আর যাঁরা এসেছেন , তাঁরা বিখ্যাত হোন বা না -ই হোন , তাঁদের সঙ্গে তাঁর রক্তের সম্পর্ক থাক বা না -ই থাক , বলে রাখা ভালো , বাবার কাছে তাঁরা সকলেই ছিলেন সেই পেটের অসুখটার মতো , যা চার বছরে এক বার দিন তিনেকের জন্য হবেই৷

    ৩ . জীবনের অন্তিম শ্বাসটি পর্যন্ত বাবা মার্কসবাদে আস্থা হারাননি৷ তবে , যে শ্রেণিহীন , ন্যায়বান বিশ্বে তিনি আস্থা রাখতেন , সেটা নিছক এই মানুষী সমাজের গণ্ডিতে বন্দি থাকেনি৷ আপনারা অনেকেই , যাঁরা আমাকে ছোটবেলায় দেখেছেন , আমাদের বাড়ি আসতেন , তাঁদের মনে পড়তে পারে আমাদের বাড়িটা ছিল দিব্যি একটা পশুপাখির পুনর্বাসন কেন্দ্র গোছের , সেখানে কুকুর , বিড়াল এবং পাখি (আহত এবং নাদুসনুদুস উভয়ই ) আমাদের বাগানটার মধ্যে বেশ ঠাসাঠাসি করে থাকত৷ পশু , পাখি , পোকামাকড় , ছোটখাট ঝোপঝাড় , আগাছা এই সবই বাবার নিজস্ব পৃথিবীতে খুব গভীর জায়গা নিয়ে হাজির ছিল৷

    ৪ . বাবা ছিলেন খুব গভীর অর্থে ‘স্পিরিচুয়াল ’, যদিও প্রথা -আচার ইত্যাদিতে একেবারেই বিশ্বাস করতেন না৷ তাঁর একটা ‘ফেথ ’ ছিল৷ জানি , আপনাদের কারও কারও খটকা লাগবে , কিন্ত্ত এক বার যদি মার্কসবাদের যুক্তিটাকে নিছক এই মানবসমাজের বাইরে আরও ছড়ানো একটা পৃথিবীর প্রেক্ষিতে দেখেন , বুঝতে পারবেন , আলোটা কোথায়৷ আপনাকে ঘুরতে হবে , খুঁটিয়ে দেখতে হবে , অনুভব করতে হবে জীবনের নানা কোণ -কুলুঙ্গি৷ এই জীবনটার সঙ্গে জুড়ে থাকতে হবে , আবার একই সঙ্গে তাকে বাইরে থেকে দেখাটাও জরুরি৷ এটাও উপলব্ধি করা জরুরি যে , সরল , অনাড়ম্বর জীবনযাপনের একমাত্র রাস্তা হল অহিংসা৷ আপনাদের অনেকের পক্ষেই এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে , মার্শাল ভদি , মেজর বল্লভ বক্সি , ফ্যাতাড়ুদের স্রষ্টার অন্দরমহলটি এ রকম ছিল , কিন্ত্ত কিছু কিছু বিষয় তো সত্যি লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায় , শুধুমাত্র সন্তানই তার বাবা সম্পর্কে যে সব কথা জানতে পারে , অন্য কেউ না৷ বাবা বৌদ্ধ এবং হিন্দুধর্ম নিয়ে গভীর ভাবে পড়াশোনা করতেন৷ একটা বিশেষ জায়গা ছিল , যেখানে তিনি ধ্যানে বসতেন৷ আমরা জানি , এখনও বসেন , যদিও তাঁর শরীরটা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে৷

    বাবা যে পরিমাণ স্বীকৃতি , কাল্ট স্টেটাস এবং পাঠকমণ্ডলী অর্জন করেছিলেন , সেটাই হয়তো প্রমাণ করে দশকের পর দশক তাঁর লেখালিখি একই রকম প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে৷ এই সূত্রে আমি জানাতে চাই যে , নিউ ইয়র্ক-স্থিত নিউ ডিরেকশনস ‘হারবার্ট’ ছাপছে৷ একটি জার্মান সংস্করণেরও কাজ চলছে৷ ভারতের একটি নামি প্রকাশনা সংস্থা তাঁর অন্য পাঁচটি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক স্তরে৷ বাবার লেখা ছিল বিশিষ্ট ভাবে আধুনিক , অন্তর্দৃষ্টিতে ক্ষুরধার , আন্তর্জাতিক এবং আরবান৷ বাবার পড়াশোনা ছিল যাকে বলে ‘এনসাইক্লোপিডিক ’৷ প্রায় যে কোনও বিষয় নিয়েই তাঁর সামনে খাপ খোলাটা কঠিন ছিল৷ দেখেশুনে মনে হচ্ছে , পুকুরের তেলাপিয়া আর গঙ্গাসাগরে পেঁৗছেই খুশি নয় , এ বার সে হুমকি দিচ্ছে , নির্ঘাত্ মহাসাগর পেরোবে৷

    ব্যক্তিগত জীবনে বাবা আশ্চর্য একটি সহযাত্রী পেয়েছিলেন৷ আমার মা৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন বিনষ্ট হওয়ার পর বাবা যখন কর্মহীন , মায়ের অপরিসীম শক্তি এবং সাহচর্যেই সেই দুঃসময়ে ভেসে থাকতে পেরেছিলেন৷ আমার স্ত্রী এবং পুত্রের সঙ্গেও বাবার যোগাযোগ ছিল দারুণ৷ এই সূত্রে জানাই , আইটিইউ -য়ের অন্তিম সন্ত্রাসে প্রবেশের আগে বাবা শুনেছিলেন ‘উই শ্যাল ওভারকাম ’৷ বাবার শোনা শেষ গান৷ নীলা , আমার স্ত্রী , গেয়েছিল৷ আমার ছেলে স্বয়ম ওঁকে ‘বাপ্পা ’ বলত৷ বাবা ‘দাদু’ ডাকের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন , বুড়োই তো হননি , তা হলে ‘দাদু’ কীসের ? যে পাত্রে বাবার ভস্মাবশেষ রাখা আছে , তাকে স্বয়ম এখনও ‘বাপ্পা ’ই বলে৷ বাবার দেহাবশেষ আমরা গঙ্গায় ভাসাইনি৷ তিনি বাড়িতে আমাদের সঙ্গেই থাকবেন৷

    সে দিন নীলা গানটি গাওয়ার আগে বাবাকে আমি দুটো গান শুনিয়েছিলাম৷ ফোন থেকে৷ বাবার খুব প্রিয় দুটো গান৷ লেওনার্ড কোহেন -এর ‘ওয়েটিং ফর দ্য মিরাকল ’ আর মুকেশের গলায় ‘জিনা ইহাঁ মরনা ইহাঁ’৷ তখন বাবা প্রায় বাক্শক্তিরহিত৷ স্মিত হাসির রেখা ফুটল মুখে , চোখদুটো বন্ধ করলেন৷ মুকেশ তখন গাইছেন , ‘কাল খেল মে হম হো না হো , গর্দিশ মে তারে রহেঙ্গে সদা /ভুলেঙ্গে হম ভুলেঙ্গে উও , পর হম তুমহারে রহেঙ্গে সদা ’!ব্যক্তিগত জীবনে বাবা শুধু একটি জিনিস থেকেই বঞ্চিত ছিলেন৷ মাতৃস্নেহ৷ কিন্ত্ত , জন্মদাত্রীর সেই শূন্যস্থানটি পূর্ণ করে দিয়েছিলেন বাবার বাবা , বিজন ভট্টাচার্য৷ বন্ধু, সহকর্মী , সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের মধ্যে অনেক আশ্চর্য সাথী পেয়েছিলেন তিনি৷ সিপিআইএমএল লিবারেশনের সদস্যরা তাঁর অন্তিম দিনটি পর্যন্ত পাশে ছিলেন৷ ছিলেন ভাষাবন্ধন -এর সহকর্মীরা৷

    গত মে মাসের শেষে বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি প্রসঙ্গে জনৈক পাঠক তাঁকে একটি মেসেজ করেন৷ বাবা জবাব দেন ১ অগস্ট৷ বাবার সেই জবাবি মেসেজ তিনি আমাকে ফরওয়ার্ড করেছেন৷ দেখছি , বাবা তাঁকে লিখছেন , ‘কেঁদো না৷ আমি এখন যে অবস্থায় আছি , তাকে এগজিস্টেনশিয়ালিস্টরা বলেন বর্ডারলাইন সিচুয়েশন৷ আত্মমর্যাদা এবং সাহস অক্ষুণ্ণ রেখে আমাকে তার মুখোমুখি হতে হবে --- নবারুণ ’৷

    (সংক্ষেপিত )
    ফেসবুকের মূল ইংরেজি রচনা থেকে অনুদিত


  • /\ | 127.194.215.167 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:২৫644845


  • বমির দাগ

    আমাদের অন্তত বমি করার স্বাধীনতা ছিল নবারুণ৷ ‘পিস হ্যাভেন ’-এ তুমি ঘুমিয়ে থাকবে৷ কিন্ত্ত সেখানেও পরিত্যক্তদের জন্য কোনও আলাদা কক্ষ নেই৷ এই সভ্যতা সবাইকেই অ্যাকোমোডেট করে৷ যারা চে গুয়েভারা হতে চেয়েছিল তারা চাপরাশি হতে পেরেছে৷ নবারুণ তোমায় চলে যাওয়াই ভালো৷ ’ লিখছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়৷

    যারা চেকভের কেরানি , ভগবান ও শয়তানের এলাকার বাইরে যারা , সেই সব তুচ্ছ, জীর্ণ নরনারী যারা সংগঠনে নেই , ফেসবুকেও না , তাদের জন্য ইস্তাহার লিখে গেল নবারুণ ভট্টাচার্য৷ নবারুণের লেখা আসলে বমনরহস্য৷ অবাধ্যতার অনার্য মস্করা৷ অথচ নবারুণ দেখেছিল বাতাসে বিপদের গন্ধ

    গাজায় তিন জন অবরুদ্ধ শিশু দেওয়ালের ফাটল দিয়ে দেখছিল আকাশের দেবতা তাদের জন্য উড়োজাহাজ থেকে লজেন্স ফেলে দিচ্ছেন৷ মিরাটে কারফিউ শিথিল হলে জনৈকা গৃহবধূ কেরোসিন আনতে গিয়ে দেখলেন দোকানের ঝাপ বন্ধ৷ জনৈক বিচারপতি সে দিনের মতো অধিবেশন সমান্তির ঘোষণা করতে চলেছেন৷ বিকেল চারটে বেজে কুড়ি মিনিট৷ আমার বন্ধু নবারুণ শেষ বার , এই শেষ বার ছোটোলোকেদের গায়ের ঘামের গন্ধ জড়ানো হাওয়া ফুসফুসে ঢুকিয়ে নিলেন৷ আর না ---কোথায় গেল ভান গখের ছবি --- ছেঁড়া মেঘের আক্রোশ ? কোথায় গেল ঋত্বিক ঘটকের ছবির মতো বিপন্নতা ? মেট্রো স্টেশন থেকে মেয়েরা গলগল করে বেরিয়ে আসছে --- শিশু ও মুদ্রা তাদের জঠরে৷ বি -মুভির অরণ্যদেব লোকাল আশালতাকে এসএমএস করে৷ রাষ্ট্রপুঞ্জে চাঁদ উঠবে ঃ পেট্রোডলারের বিষাদপ্রতিমা৷ আর ময়নাগুড়ি ও ভেনিজুয়েলায় ক্ষুধা মানুষকে চাবুক মারবে রোরুদ্যমানিনী আফ্রিকার মতো৷ নবারুণ আমি বুঝতে পারছি শেষ পর্যন্ত রাগের সাদা ফেনা ছাড়া কিছুই থাকবে না৷

    কবরডাঙা পার হয়ে ঠাকুরপুকুর পৌঁছতে পৌঁছতে আমার পাঁচটা হবেই৷ আবার ‘টেরিবল ফাইভ ইন দি আফটার নুন ’৷ মনে আছে তোমার , চল্লিশ বছর আগে দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে আমাদের চোয়াল শক্ত হতে জানত --- ‘ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা বাজে … কি মারাত্মক পাঁচটা বাজল তখন !’ আমরা জানতাম ইতিহাসের ঘর যে রাতে ঝড়ে ভেঙে পড়ে , বিপর্যয় যদি ধাবমান মহিষের শিংয়ে নটরাজ হয়ে দেখা দেয় তবে ও তত্ক্ষণাত্ লোরকা ইগনাশিওর জন্য শোকগাথা লিখে উঠতে পারেন৷ মৃত্যু যেখানে নারীর স্তনদ্বয়ের মতো প্রলয়তুল্য৷ তুমি ছিলে আমাদের শেষ মাতাদর যে তাচ্ছিল্য নিয়ে থুতু ফেলতে পারত৷ আজ আমাদের রক্তের গলি উপগলিতে আর কোনও ব্যারিকেড রইল না নবারুণ৷ এই সব চ্যানেল আর পুচকে সাংবাদিক এখন তোমার অসমান্ত আত্মজীবনী নিজেরাই সমান্ত করার দায়িত্ব নেবে৷ চল , আবার , রাসবিহারীর মোড়ে আড্ডা দেই৷ চল , আমি তোমায় রেখে আসি ঈশ্বরের হাতে৷ স্বর্গের অবিনশ্বর রেস্তোরাঁয় তুমি সমস্ত বন্ধুপরিজনকে ফিরে পাবে --- তোমার বাবা বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক থেকে অনন্য পর্যন্ত সব্বাইকে৷ নবারুণ এমন যন্ত্রণা নেই যা তোমার নির্যাতিত লালের তুলনা৷ আজ তুমি মুক্ত৷ আজ তোমার অভ্যর্থনা৷ তোমার সেই যুবকবেলার আলো আর সুর তুমি ফিরে পাবে৷

    মনে আছে তোমার --- রাজা রাজেন্দ্র রোডে প্রথম দিনের আড্ডা৷ অদূরে বিজনবাবু দাঁত মাজছিলেন , আমি একটু থমকে দাঁড়াই৷ তোমার ছোট্টো ঘর --- মায়াকোভস্কির ছবি --- তুমি কপট গাম্ভীর্যে বলেছিলে --- ‘এই তোশকে বিজন ভট্টাচার্য ঋত্বিক ঘটকের বমির দাগ আছে৷ এখানে কোন মাজাকি চলবে না গুরু!’ নবারুণ আমরা তো ‘মাজাকি ’ ছাড়াই দেখতাম অবসন্ন ঋত্বিক চন্দ্রকুমার স্টোর্স-এর সিঁড়িতে এলিয়ে আছেন , আমরা দেখতাম জর্জ বিশ্বাস পানের দোকানে , তুমি বিষ্ণু দে’র বাড়ি থেকে এসে অনন্যর খোঁজ করতে --- নবারুণ আমরা তখন ‘খোচড় ’দের চিনতে পারতাম৷ ভিয়েতনাম ছিল , গিনি বিসাও ছিল , চুল্লির প্রহরে আমরা আত্মা সেঁকে নিতে পারতাম৷ ‘প্রত্যাখ্যান ’ শব্দটা বলা হলেই মনে হত মধুবাতা ঋতায়তে৷ ‘প্রত্যাখ্যাত ’ মানিক -ঋত্বিক -জীবনানন্দের নামে সমুদ্রের নোনা জল মধুগন্ধী হয়ে উঠত৷ আমাদের অন্তত বমি করার স্বাধীনতা ছিল নবারুণ৷ আজ ‘পিস হ্যাভেন ’-এ তুমি ঘুমিয়ে থাকবে৷ কিন্ত্ত সেখানেও পরিত্যক্তদের জন্য কোনও আলাদা কক্ষ নেই৷ এই সভ্যতা সবাইকেই অ্যাকোমোডেট করে৷ যারা চে গুয়েভারা হতে চেয়েছিল তারা চাপরাশি হতে পেরেছে৷ নবারুণ তোমায় চলে যাওয়াই ভালো৷ আজ হোচিমিন সরণি জুড়ে শপিংমল৷

    আমি জানি তুমি তোমার মতো করে ভবিতব্য বুঝতে পেরেছিলে৷ আমাদের কথা হত৷ পাতাল থেকে আমরা চিরকুট বিনিময় করতাম৷ আমরা দেখতাম হ্যামলিনের বাঁশি কেউ বাজায় না তবু যত ইঁদুর নদী তীরে দাঁড়িয়ে৷ কিছু একটা হতে চাইছে আজকের কলকাতার লোক৷ ডিজিটাল প্রশাসন ঠোঁটে বমির দাগ রাখার অনুমতি দেয় না৷ তা -ই পূজ্যপাদদের বিবস্ত্র করে আমোদ পেতে হল তোমার৷ হূদয় নামক বস্ত্তটি বুকের বাঁ দিকে থাকে বলেই মানুষের ধারণা৷ উপরন্ত্ত মানুষ যূথবদ্ধ জীব৷ তবু আত্মার বামফ্রন্ট গড়ে ওঠেনি আজও৷ ভাগ্যক্রমে একা করবার মতো কিছু কাজ মানুষের কররেখায় নির্দিষ্ট হয়ে আছে৷ যেমন কবিতা লেখা৷ যেমন শ্রাবণের অন্ধকারে বিদ্যুল্লতার মতো বিদ্রুপে ঝলসে উঠে নিজেকে চিরে ফালাফালা করা৷

    মনে হয় একবার ভিকতর উগো বলেছিলেন রাজতন্ত্রে আলসে লোক থাকে , প্রজাতন্ত্রে ভবঘুরে৷ তা হলে আমরা আজ কারা ? আমরা কি শিল্পসমাজে , অলীক শহরে , পুনরুত্থিত গণতন্ত্রে , ঝুপড়ি ও আকাশচুম্বনে উদ্বৃত্ত থেকে যাব নবারুণ ? আমাদের চিঠিতে সিলমোহর পড়বে না ? দেশজুড়ে রূপসীরা প্রসব করছে ব্যাঙ্কলোনের ইতিকথা , ক্যুইজ সফল যুবক পা মিলিয়ে নিচ্ছে আবৃত্তির মিছিলে , বাথরুমের দরজা হাট করে খুলে রেখে সাবানসুন্দরীরা স্নান সেরে নিল টিভির পর্দায়৷ ভান গখ , উন্মাদ ও নিঃসঙ্গ , বারোটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন নক্ষত্রখচিত রাত্রি৷ হেগেল বলেছিলেন মিনার্ভার প্যাঁচা অন্ধকারেই ওড়ে৷ নবারুণের ফ্যাতাড়ুদেরও ডানা আছে৷

    বিদায়মুহূর্তে মানুষকে একা দেখতে ভালো লাগে৷ তন্ত উনুনের আঁচে কি বিভা ! নবারুণকে দেবদূতেদের মতো অপরূপ দেখায়৷ অন্তর্ঘাতের উত্তরাধিকার জমা রেখে সে চলে গেল৷ ‘এক সাথে বেড়াল ও বেড়ালের -মুখে -ধরা -ইঁদুর হাসাতে এমন আশ্চর্য শক্তি ছিলো ভূয়োদর্শী যুবার ’--- যে তার শোকপ্রস্তাব লেখার জন্য কি জীবনানন্দকে ডাকা জরুরি ? জানি না , কিন্ত্ত যারা চেকভের কেরানি , ভগবান ও শয়তানের এলাকার বাইরে যারা , সেই সব তুচ্ছ, জীর্ণ নরনারী যারা সংগঠনে নেই , ফেসবুকেও না তাদের জন্য ইস্তাহার লিখে গেল নবারুণ ভট্টাচার্য৷ নবারুণের লেখা আসলে বমনরহস্য৷ অবাধ্যতার অনার্য মস্করা৷ অথচ নবারুণ দেখেছিল বাতাসে বিপদের গন্ধ ঢের৷ সে নিজের রচনার সূত্রে বিদ্রোহ -বিপণি খুলে ফেলছে না তো ? নিজের লেখা থেকে তৈরি এক ছায়াছবির পোস্টার প্রসঙ্গে এক দিন আমার কাছে সে ভয়ের কথা প্রকাশ করেওছিল৷ এই উত্তর -বিশ্বায়ন নাগরিক যে বাতানুকুল আড্ডায় অভ্যস্ত তার কাপুচিনোর চুমুকে সাহিত্য পড়ার যে মলাট বিলাসিতা সেই পরিসরে তো চে গুয়েভারাও টি-শার্টে! এই যুবক বা যুবতী খিস্তি তরঙ্গেও এক ধরনের অজ্ঞাতকে জানার সুযোগ পেয়ে যায়৷ নবারুণকে তার বিপন্ন ঘাতক মনে হবে ? ‘চুদুরবুদুর ’ তার রসনাবিলাস নির্মাণ করতেই পারে৷ নতুন গন্ধনাশক , নতুন বাথরুম টাইলসের মতোই নতুন এ ভাষা৷ শহরের উদীয়মান মধ্যবিত্ত , বাংলা উপন্যাসের দাম যেহেতু কম , সস্তার বেঙ্গল প্যাকেজে , দুঃখদুর্দশা সত্ত্বেও গরিবেরাও সে আমোদ পায় , তার যে গোপন সুড়ঙ্গ আছে --- নবারুণের সৌজন্যে এ তথ্য জানতে পারে৷ এ ইচ্ছে মধ্যবিত্ত অপরাধবোধকে প্রশমিত করার মুদ্রিত ভায়াগ্রা যার সম্মানমূল্য আছে --- আমার এই কথার উত্তরে নবারুণকে আমি বিষণ্ণ ও চিন্তিত দেখেছিলাম৷

    আসলে তো সমস্ত জীবন ধরে সে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুঃশাসনীয় ’ গল্পের একটি সংযোজনী ও প্রতি -প্রস্তাব জুড়তে চেয়েছিল যাতে বাচ্চাদের কাছে হাসি -খুশি মুখে গোপন ধাঁধাটি ফাস করা যায় যে ‘এ মা তুমি ল্যাংটো !’ তার প্রয়াস কত দূর সফল হল না জানি না কিন্ত্ত আমাদের চেনা উপাখ্যানে নবারুণ , আমাদের সহজীবী ও সহযোদ্ধা , অন্য রকম ওয়াচ টাওয়ার৷ তার দেখা পরিচিত স্তনবিভাজিকা ও সুরেলা ব্যর্থতার থেকে অনেক দূরে সদ্য মৃত ইতিহাস ও সদ্যোজাত নাগরিকের সংলাপের অন্তর্বর্তী বেদনার !
  • /\ | 127.194.215.167 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৩২644846


  • মহাযানের আয়না

    আন্তোনিও গ্রামশি -র লেখা পড়াতেন৷ রাজনীতি ছাড়া সাহিত্য নবারুণদা ভাবতেই পারতেন না৷ মজা করে বলতেন , রাজনীতি না বুঝলে নির্বোধ হয়ে যাবি৷ ’ লিখছেন বিমল দেব ৷

    সারস্বত সাধনার চর্চা যাঁরা করেছেন , তাঁদের খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন৷ জনার্দন চক্রবর্তী , যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি , দীনেশচন্দ্র সেন , রবীন্দ্রকুমার দাশগুন্ত , বিনয় ঘোষের বই পড়তে বলতেন৷ ‘

    নবারুণ ভট্টাচার্য আমাদের শিখিয়েছেন প্রত্যাখ্যানের ভাষা৷ আমাদের ‘নো ’ বলা শিখিয়েছেন৷ প্রশ্ন করা প্র্যাকটিস করিয়েছেন৷ লেখালেখির প্রচলিত ছক ভেঙে বেরিয়েছেন৷ কলোনিয়াল হ্যাংওভার ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন৷ রুলিং ক্লাসের ভ্যালুজ ও তাদের মান্য ভাষাকে তিনি হাসির খোরাক মনে করেছেন৷ এ সব কথা অনেকেই জানেন৷ আমি সে সব বলতে যাব না৷ একান্ত ব্যক্তিগত কথা৷ তাঁর সঙ্গে নিবিড় সখ্যের কথাই বলতে চাইছি৷ আসলে ইচ্ছে করছে অনেক --- অনেক স্মৃতির যাপন , তার বর্ণমালাকে ফিরে ফিরে পড়তে৷ ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে বসে হঠাত্ কেমন যেন হয়ে গেলাম৷ বিড় বিড় করে সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলাম নবারুণদার সঙ্গে একাকী৷ নবারুণদার ছেলে তথাগত টের পেয়েছিল৷ হয়তো ও বলতে চাইছিল , এটা মানসিক হাসপাতাল নয়৷

    নবারুণদাকে প্রথম দেখি ১৯৭৪ সালের এক শীতকালে৷ ভবানীপুরের রাজেন্দ্র রোডের বাড়িতে৷ তখন আমার বয়স টেনেটুনে বাইশ৷ পৃথিবীটা যেন হাতের মুঠোয়৷ নিজেকে সবজান্তা মনে করেই বিজন ভট্টাচার্যর সাক্ষাত্কার নিতে গিয়েছিলাম৷ আবোল তাবোল প্রশ্ন করেছিলাম৷ এখন ভাবলে হাসি পায়৷ সে দিন এক জন যুবককে দেখি৷ পাকা গমের মতো গায়ের রং৷ অসামান্য চোখ৷ বিজনবাবু বললেন , ও হচ্ছে আমার ছেলে নবারুণ৷ ডাকনাম বাপ্পা৷ সেই দিন সেই বাড়িতেই প্রথম দেখা নবারুণদা৷ তার পরে বহু বছর অমৃতায়ন রেস্টুরেন্টের রঁদেভুতে৷ গল্ফগ্রিনের বাড়িতে সন্তাহে দু’দিন৷ কাজে এবং অকাজে৷ বেশির ভাগ দিন আলোচনা করতেন , ফিল্ম নাটক রাজনীতি নিয়ে৷ কখনও বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে৷ নবারুণদা বলতেন , বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে মার্কসবাদের একটা মিটিং পয়েন্ট আছে৷ এমনকী অধ্যাত্মবাদীদের সম্পর্কেও তাঁর ছিল আকর্ষণ৷ কারণ প্রকৃত ভারতবর্ষের মূলস্রোতকে জানার আগ্রহ৷ গোপীনাথ কবিরাজের ‘জ্ঞানগঞ্জ ’ পড়তে বলতেন৷ সারস্বত সাধনার চর্চা যাঁরা করেছেন , তাঁদের খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন৷ জনার্দন চক্রবর্তী , যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি , দীনেশচন্দ্র সেন , রবীন্দ্রকুমার দাশগুন্ত , বিনয় ঘোষের বই পড়তে বলতেন৷ নবারুণদার নির্দেশেই পড়েছি জনার্দন চক্রবর্তীর আত্মজীবনী ‘স্মৃতিভারে ’৷ আসলে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা তিনি মিলিয়েছেন নানা ভাবে৷ তাঁর মেধাবী অণ্বেষণে আমার মতো ‘ফ্যাতাড়ু ’-কেও সহযাত্রী করেছিলেন৷ আমি পিছিয়ে থাকা পরিবারের ছেলে৷ নবারুণ ভট্টাচার্য-র সান্নিধ্য না পেলে কোনও লেখাই লিখতে পারতাম না৷ এমনকী কথাও বলতে পারতাম না৷ আমি চির বেকার৷ লাথখোর বলা যায়৷ আমাকে শিক্ষিত করতে তাঁকে কম ঝকমারি পোহাতে হয়নি৷ নবারুণদা ছিলেন প্রকৃত অর্থে স্মার্ট৷

    আধুনিক পৃথিবীকে জানার জন্য রাজনীতির প্রসঙ্গ বার বার ফিরে এসেছে সান্ধ্য আলোচনায়৷ লেনিন লুকাচ আন্তোনিও গ্রামশি -র লেখা পড়াতেন৷ লুকাচের ‘ইয়ং হেগেল ’ তাঁরই নির্দেশে পড়েছি৷ আমি অনুরোধ বলব না , নির্দেশ বলতেই ভালো লাগে৷ রাজনীতি ছাড়া সাহিত্য নবারুণদা ভাবতেই পারতেন না৷ মজা করে বলতেন , রাজনীতি না বুঝলে নির্বোধ হয়ে যাবি৷ কবিতা যেন ডিলিরিয়াম না হয় , খেয়াল রাখতে বলতেন৷ আন্তর্জাতিক ভাষায় লিখতে বলতেন৷ ‘ভাষাবন্ধন ’ পত্রিকার প্রায় প্রতি সংখ্যায় আমি লিখেছি৷ লিটল ম্যাগাজিনের রিভিউ আমাকে দিয়েই করিয়েছেন৷ এর কারণ আমার জানা নেই৷ ২০১১ সালে আমার কাব্যগ্রন্থ ‘ডুবোজাহাজে কার্নিভাল ’ বের করেছিলেন নবারুণদা ও প্রণতি বউদি৷ ‘বিজন ভট্টাচার্য স্মৃতি সম্মান ’ পুরস্কার প্রান্তি তাঁরই উত্সাহে৷ আজ ভাবলে অবাক লাগে৷ আমাকে মানুষ করা যেন তাঁর নৈতিক দায়িত্ব৷ আসলে হারিয়ে যাওয়া হেরে যাওয়া মানুষের প্রতি ছিল অসীম ভালোবাসা৷ এ এক আশ্চর্য মানুষ৷ নবারুণদার মতো আশ্চর্য মানুষ খুব কম দেখা যায়৷ আশ্চর্য তাঁর পড়াশুনো৷ স্পোর্টস অ্যানথ্রপোলজি ক্লিনিকাল ট্রায়ালের ষড়যন্ত্র কর্পোরেটের থাবা দালির পৃথিবী স্তানিস্লাভ্স্কি বুনুয়েল টাওয়ার অফ সাইলেন্স চাইক্ভস্কি নর্মান বেথুন যুগান্তর চক্রবর্তীর কবিতা হাজারিবাগ জেলে কবি মুরারী বেহালার ইতিহাস কলকাতায় বব ডিলান অ্যানি সালিভান নীহার মুন্সি ও চক্ষুচিকিত্সা মানিকবাবুর ডায়েরি রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃস্বপ্ন ’ এমনকী জনি ওয়াকার৷ এ রকম নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতেন৷ আশ্চর্য সেই আলোচনা৷ অভিজ্ঞতাকে প্রাণায়িত করার জন্যই বামপন্থার সঙ্গে লগ্ন হওয়া৷ তিনি বিশ্বাস করতেন , বামপন্থা শুধু পার্টি নয় , একটা দৃষ্টিভঙ্গি৷ এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর প্রতিটি লেখায় প্রতিফলিত৷ আমি মনে করি , তাঁর লেখার বিষয় প্রান্তিক মানুষ নয় , উদ্বৃত্ত মানুষ৷ আসলে তাঁর কাজ সম্পর্কে কোনও আলোচনাই সম্পূর্ণ নয়৷ তাঁকে কোনও ফ্রেমেই বেঁধে রাখা যায় না৷ ‘মহাযানের আয়না ’ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখা৷ একটা মিথকে এক অনন্য ডিসকোর্সের মধ্যে নিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে লগ্ন করে দিলেন৷ এই মতামতে তিনি মুচকি হাসতেন৷ সেই আশ্চর্য হাসি আর দেখতে পাব না৷ আজ যখন আমরা ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে আছি , ঠিক তখনই তিনি চলে গেলেন৷ নিঃসঙ্গ ও অভিভাবকহীন হয়ে মনে হচ্ছে , কলকাতা এখন একটা ফাঁকা শহর৷



    লে ধড়াদ্ধড় লেলে ধড়াদ্ধড় লে

    ‘নবারুণদা সঙ্গেই থাকবেন , আছেন৷ এই কার্নিভাল , এই ‘বুজরুকির সার্কাস ’ ছেড়ে কোনও ফ্যাতাড়ু , তাঁর মতো এক জন নিষ্ঠাবান অন্তর্ঘাতী কখনও মৃত্যুর নির্লিন্তিতে চলে যেতে পারেন ?’ লিখছেন সুমন মুখোপাধ্যায়

    যে দিন হারবার্ট-এর পাণ্ডুলিপি তুলে দিয়েছিলেন প্রকাশকের হাতে , সে দিন মাটিতে শুয়ে কেঁদেছিলেন৷ ওঁর মনে হয়েছিল এর থেকে নির্মম , নিষ্ঠুর ঘটনা আর কী থাকতে পারে ?

    ‘ভালো করে ঘুমোক৷ ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে’ --- ‘হারবার্ট’ উপন্যাসের এই অমোঘ প্রথম বাক্যটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল যখন নবারুণদাকে ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে দেখলাম, তীব্র যন্ত্রণায় কখনও চোখ খুলে তাকাচ্ছেন, কখনও বা চলে যাচ্ছেন অতল অজ্ঞানে৷ এ রকম অসীম আশ্বস্ততার আদর, ভালোবাসার ঘোষণা, কারুণ্যের বিদ্রোহ নিয়ে কবে কোন আধুনিক আখ্যান শুরু হয়েছে? না, নবারুণদা কোনও নির্বিকল্প অজ্ঞানে চলে যাওয়ার মানুষ নন৷ মাকে এক বার বলেছিলেন, যে কোনও দিন ধ্যানস্থ অবস্থায় সম্পূর্ণ চোখ বুজবি না৷ সব সময় আধবোজা রাখবি, যাতে আত্মস্থতার তূরীয় আনন্দে চারপাশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়৷ বুদ্ধকে দেখবি, অর্ধনিমীলিত চোখে ধ্যানস্থ৷ মানুষের সঙ্গে, বাস্তব অস্তিত্বের সঙ্গে সব সময় যেন একটা সম্বন্ধ থাকে৷ নবারুণদা আমাকে হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই শেষ প্রশ্নটা করেছিলেন, ‘নেক্সট...?’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘নেক্সট শো?’ ‘নাটকের?’ তার আর উত্তর আসেনি৷ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কিছু দিন আগেই ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কাজগুলোর আপডেট কী?’ কাজগুলো বলতে নতুন নাটক ‘যারা আগুন লাগায়’-এর মহড়া ও অভিনয় এবং ‘অটো’ ছবির প্রস্ত্ততি৷ ‘যারা আগুন লাগায়’ নাটকটা নবারুণদা’র অনুবাদ৷ তেরোই জুলাইয়ের প্রথম অভিনয় দেখতে আসার প্রবল ইচ্ছে ছিল৷ কিন্ত্ত আগের দিন জানালেন, ঠিক ‘কনফিডেন্স’ পাচ্ছেন না দু’ঘণ্টা বসে থাকার৷ আর ‘অটো’ ছবির চিত্রনাট্য শোনানোর কথা ছিল হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পরেই৷ সেটা আর হয়ে উঠল না৷ এ রকম আগে কখনও ঘটেনি৷ নবারুণদা কোনও দিন চিত্রনাট্য পড়তে চাননি৷ শুনতে চাইতেন৷ শুনে কখনও দীর্ঘ আলোচনা করতেন না৷ শুধু দু’একটা ডিটেল্স বলতেন৷ ‘হারবার্ট’ শোনার পর অনেক ক্ষণ চুপ করেছিলেন৷ বুঝতে পারছিলাম না ওঁর মনে কী চলছে৷ কারণ আমাকে আগে বলেছিলেন, যে দিন ‘হারবার্ট’-এর পাণ্ডুলিপি ছাপার জন্যে তুলে দিয়েছিলেন প্রকাশকের হাতে, সে দিন মাটিতে শুয়ে কেঁদেছিলেন৷ ওঁর মনে হয়েছিল এর থেকে নির্মম, নিষ্ঠুর ঘটনা আর কী থাকতে পারে? যখন এ রকম একটা ব্যক্তিগত ইতিহাসকে, অন্তরতম মনের ভালাবাসা, যন্ত্রণা, বিষাদ, আনন্দকে প্রকাশ করে দিতে হয়, সামাজিক করতে হয়, সর্বজনীন করতে হয়৷ বা শেষ পর্যন্ত বাজারি করতে হয়৷ তা হলে কি নবারুণদা’র মনে এমন কোনও দ্বন্দ্ব কাজ করছে উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ বিষয়ে! নীরবতা ভেঙে বললেন, হারবার্ট কয়েক বালতি জল গায়ে ঢেলে নিজেই চৌবাচ্চার মধ্যে লাফিয়ে পড়বে৷ এ রকম একটা অনিবার্য, নির্দিষ্ট ডিটেল চলচ্চিত্রের ভাষায় বিস্ফার ঘটায়৷ যাঁরা ছবিটা দেখেছেন, তাঁরা জানেন এই দৃশ্যের অভিঘাত কী হয়েছিল৷ ‘পিউ কাঁহা’ বলার সুরটা কেমন হবে সেটাও দেখিয়েছিলেন৷ বা ‘মহানগর@কলকাতা’-য় চন্দ্রগহণের সময় রাস্তায় যারা গেরনদান চাইছিল তারা কী ভাবে সেই ভিক্ষের আর্তি ধ্বনিত করে সেটাও অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন৷ নবারুণদা এক বার ‘চেতনা’-র মহড়া কক্ষে এসে বিজন ভট্টাচার্যের ‘দেবীগর্জন’ নাটকটা পাঠ করেছিলেন৷ সে শুধু অভিনয় পাঠ নয়৷ তার সঙ্গে নাটকের প্রতিটা গান গেয়ে বুঝিয়েছিলেন তাঁর রক্তে কী প্রতিভা বইছে৷ এটা বোধ হয় কেউ জানেন না, এমনকী কবীর সুমনকেও বলিনি যে ‘কাঙাল মালসাট’ ছবির প্রস্ত্ততির সময় আমি এক বার দন্ডবায়স চরিত্রে অভিনয় করার অনুরোধ করেছিলাম নবারুণদাকে৷ আমার চোখের দিকে অনেক ক্ষণ তাকিয়েছিলেন,মনে মনে গভীরে কিছু একটা ভাবছিলেন৷ যেন নিজেকে দেখার চেষ্টা করছেন বা নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন সেই প্রাগৈতিহাসিক কাকের ভূমিকায়, যে চরিত্র তাঁর নিজেরই হাতে গড়া৷ মনে হয় না খুব একটা অপছন্দের ছিল৷ কিন্ত্ত তার পর শুটিং সম্পর্কে একটা বিশিষ্ট, অমোঘ শব্দ প্রয়োগ করে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন৷ নবারুণদা’র গল্প বা উপন্যাস ভিত্তি করে আমি তিনটে ছবি করেছি৷ কিন্ত্ত সর্বসাকুল্যে তিনি দু’দিন মাত্র শুটিংয়ে এসেছিলেন৷ এক বার হারবার্ট অর্থাত্ শুভাশিসের অভিনয় দেখতে৷ আর এক বার ‘মহানগর@কলকাতা’-র শুটিংয়ে বীরেনের চরিত্রে অরুণবাবুর চরিত্রায়ণ দেখতে৷ বাকিটা ছবি শেষ হওয়ার পরই দেখেছেন৷ মনে পড়ে ‘হারবার্ট’-এর প্রথম প্রদর্শনী৷ পাশের বসে লেখক৷ ‘আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার চোখের সামনে, আমার এত কালের দেখা পুরনো দুনিয়াটা পাল্টে যাচ্ছে, ভেঙেচুরে, তছনছ হয়ে, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ছে পুরনো দিনগুলো৷ ঝড় আসছে একটা’--- এই কবিতা বলতে বলতে পুলিশ হেফাজতে হাসপাতালের লোহার বেডের সঙ্গে পায়ে শেকল বাঁধা বিনু, রাতের অন্ধকারে মাও সে তুং-এর ছবি আঁকতে গিয়ে পুলিশের গুলি খাওয়া বিনু যখন রক্ত বমি করতে করতে মারা যাচ্ছে, তখন নবারুণদা হঠাত্ উঠে বেরিয়ে গেলেন৷ আমার বুকের মধ্যে দুরমুশ৷ এ রকম একটা দৃশ্যের চলচ্চিত্রায়ণ লেখকের অপছন্দ হল? কিছু ক্ষণ পর বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ দেখলাম এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন একটা সিগারেট ধরিয়ে৷ কাছে গিয়ে দেখলাম চোখে ভর্তি জল৷ শিশুর মতো কাঁদছিলেন৷ ‘দূর, এ রকম একটা কষ্টের দৃশ্য দেখা যায় নাকি? বিনুর মৃত্যু দেখা যায়?’ আবার কেঁদে ফেললেন৷ কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আবার হল-এ গিয়ে বসেছিলেন বাকি ছবিটা দেখার জন্যে৷ শেষ দিকে নবারুণদা’র নিবিড়, অন্তরস্পর্শী, অন্তর্ঘাতী চোখ দুটো হলুদ হয়ে গিয়েছিল৷ সেই চোখ দেখে মনে পড়েছিল, ‘ব্ল্যাকে মাল খেলে কখনও হলুদ হ্যালোজনের জোনে যেও না৷’ উদ্ধৃতি ঠিক আছে কিনা যাচাই করতে গিয়ে ‘ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক’ বইটা খুলে দেখি বইটা নবারুণদা’র উপহার দেওয়া৷ ২৪/০২/২০০১-এব দিনটায় সই করা --- To Red Riding Hood. নবারুণদা আমাকে লাল নামেই ডাকতেন৷ এমনকী ‘অন্ধ বেড়াল ও অন্যান্য গল্প’ (ভাষাবন্ধন ২০০৯) বইটা আমাকেই উত্সর্গ করা৷ ‘সুমন মুখোপাধ্যায় ওরফে লালকে’৷ নবারুণদা যখন মুখের দিকে তাকালেন, ওঁর হলুদ চোখ দুটো দেখে অনেক স্মৃতি গজগজিয়ে উঠে এল৷ উঠে এল সেই সময়ের কথা, যখন বাপ্পাদা একটা খয়েরি রঙের মারুতি ৮০০ চালাতেন৷ আমি অনেক বার চড়েছি ওই গাড়িতে৷ গাড়িতে বসে কাঁচা হুইস্কি টেনেছি রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে৷ এক বার গল্ফ গ্রিনের বাসস্ট্যান্ডটা পেরিয়ে গাড়ি করে কোথাও একটা যাচ্ছি দুজনে৷ স্ট্যান্ডে তখন কয়েক জন প্যাসেঞ্জার বাস-মিনিবাসের অপেক্ষায়৷ নবারুণদা বলল, ‘ওই যে মালগুলো বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে, ওরা আমাকে গাড়িটা চালাতে দেখলেই কী বলে জানিস? ওই বাপের ছেলে হয়ে মারুতি হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়ায়৷ তা বাঁ*, বিজন ভট্টাচর্যের ছেলে বলে রাস্তার মোড়ে গামছা পরে ভিক্ষে করলে ভালো লাগত?’ নবারুণদা এখন হলুদ হ্যালোজনের ফট ফট আলোয়, চোখের মণিতে হলুদ মায়া বিলোতে বিলোতে নির্ঘাত কাউকে ফ্যাতাড়ুর মন্ত্রে দীক্ষিত করছেন৷ যে ভাবে মদন হলুদ হ্যালোজেনের আলোর ধাতব স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে ডি এস-কে ওড়বার মন্ত্রগুন্তি দিয়েছিল৷ ফ্যাতাড়ুদের সংখ্যা বাড়ছে, ক্রমাগত বাড়ছে, প্রতিনিয়ত বাড়বে৷ আকাশ ফুঁড়ে, কালিমাখা ভূতের মতো মেঘগুলো সরিয়ে, সাঁতলা লাগা চাঁদের পাশ দিয়ে, ফ্যাতাড়ুদের সম্রাট ওদের নিয়ে নেমে আসবে চরম অন্তর্ঘাত হানতে৷ সঙ্গে চেনা অনেকেই রয়েছে, যেমন মদন, পুরন্দর, বলাই ড্রাইভার, কালমন, মিউচুয়াল ম্যান, মোগলাই, বীরেন, অন্ধ বেড়াল, অনেকগুলো ঘেয়ো কুকুর, টিকটিকি, আরশোলা, নানা ধরনের পোকা, উড়নতুবড়ির মশলা, ডিনামাইটের টুকরো, ছেঁড়া ঘুড়ি, পোড়া দেশলাই কাঠি ইত্যাদি৷ আবার অচেনা মানুষ, জন্ত্ত, বস্ত্তরাও আছে৷ কোনও ঢপবাজকে রেয়াত করবেন না, কোনও দিন করেননি৷ কিন্ত্ত এত মানুষকে পাশে নিয়ে সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতির পরিসরে শুধু একা হয়েছেন, আরও একা হয়েছেন, একক হয়েছেন, পূর্ণ হয়েছেন, ‘পুরনো কিছুই থাকবে না একা হয়ে যাওয়া ছাড়া৷’ এই একক সংঘর্ষের খতিয়ান, বুকের রক্ত দিয়ে লিখতে লিখতে, শরীরের অনেক ভেতরে মারণ বৃক্ষ লালন করেছেন৷ এক বছরও অপেক্ষা করলেন না৷ এই সে দিন ২০১৩-র ২ অগস্ট ‘কাঙাল মালসাট’ মুক্তি পেল৷ আমরা অনেক রাত্তিরে, সব হড়কে যাওয়া গরমে, পেটের অন্তেরা থেকে চপ, চানা আর হুইস্কি, রাম, বরফ জল সব গ্যাঁজগেজিয়ে উগরে আনতে আনতে ল্যান্সডাউনের ফুটপাতে বসে বসে সেলিব্রেট করছিলাম৷ ‘যাক! কাঙাল মালসাট ছবি হয়ে বেরিয়ে গেছে৷ আমার বোকা** হেভি ফুর্তি৷’ নবারুণদা’র সঙ্গে আমার শেষ কয়েকটা এনকাউন্টারের সারমর্ম হল, ‘দুনিয়াটা ভোগে গেছে৷’ কিন্ত্ত এর মধ্যেই মনে মনে খসড়া করছিলেন নতুন উপন্যাসের৷ শুনেছিলাম সেই আখ্যানের টুকরোটাকরা৷ হঠাত্ এক দিন রবীন্দ্রনাথের একটা নাটক নিয়ে ছবি করার কথা বললেন আমাকে৷ আমি সম্পূর্ণ বিস্মিত হয়েছিলাম এই প্রস্তাব শুনে৷ জানি না, কোনও দিন সে কাজ করে উঠতে পারব কি না, কিন্ত্ত চেষ্টা করব৷ তার পর বলেছিলেন, এটা আবার ফস করে ছেড়ে দিস না বাজারে৷ কোনও গেঁড়ে আবার মেরে দেবে৷ নবারুণদা’র কাছে ঋণ অনেক৷ জীবন, যাপন, মানবেন্দ্রনাথ, গ্রসম্যান, ক্যালভিনো, হরিগোপালের ঠেক, এসেনিন, স্বপ্নের মধ্যে বার্তা পাওয়া আরও কত কী৷ নবারুণদা সঙ্গেই থাকবেন, আছেন৷ এই কার্নিভাল, এই ‘বুজরুকির সার্কাস’ ছেড়ে কোনও ফ্যাতাড়ু, তাঁর মতো এক জন নিষ্ঠাবান অন্তর্ঘাতী কখনও মৃত্যুর নির্লিন্তিতে চলে যেতে পারেন? নবারুণদা কোনও দিন চলে যাওয়াতে বিশ্বাস করেননি৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নবারুণদা নিজের যাপন দিয়ে, সাহিত্য শৈলী দিয়ে যে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি এলাকা তৈরি করেছেন, একাই রক্ষা করেছেন, টেরেনের প্রশ্নে দ্ব্যর্থহীন থেকেছেন, তিনি এ সব ছেড়ে চলে যাওয়ার আপস--- করবেন না৷ এখন স্ট্র্যাটেজিক রিট্রিট৷ এর পরেই পুরোদস্ত্তর খোলতাই --- লে ধড়াদ্ধড়, লে ধড়াদ্ধড়৷

    ■ উপরে ব্যবহূত পেন্টিংয়ের নাম ‘হারবাট’র্‌৷ শিল্পী শুভব্রত নন্দী
  • /\ | 127.194.215.167 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৪২644847




  • নবারুণদা বিষয়ে দু-একটি কথা ...

    প্রায়ই একটা কথা বলতেন৷ কার্নিভাল৷ লাথি -ঝাঁটা খেতে খেতে , খড়কুটো হয়ে ভাসতে ভাসতে , মার্জিনে চলে যাওয়া মানুষেরাও উত্সবে মেতে উঠতে পারে৷ ’ লিখছেন গৌতম মিত্র

    ■‘কখনও আশ্চর্য রকমের মরমি৷ আমাদের পাড়ায় একটি কাপড়ের দোকান আছে যেখানে সারা দিনে এক জন ক্রেতারও পা পড়ে না৷ নবারুণদা এটিও যে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেছেন কথা প্রসঙ্গে তা জানলাম৷ দোকানি মেয়েটির প্রতি সমবেদনা নবারুণদার কথায় ঝরে পড়ছিল৷

    এই তো কয়েক মাস আগের ঘটনা৷ রাত আটটা , চার -পাঁচটা কুকুর নিজেদের মধ্যে বাক -বিতণ্ডায় মত্ত৷ আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে ‘লুব্ধক’-এর স্রষ্টা নিবিষ্ট হয়ে তা প্রত্যক্ষ করছেন৷ আমি যে পাশে গিয়ে অনেক ক্ষণ হল দাঁড়িয়েছি খেয়াল করেননি৷ আমিও চাইনি এই বিরল মুহূর্তটি খতম হোক৷ নবারুণদা জানতেন ভালো জাতের বংশ পরিচয়ে গরীয়ান দামি কুকুরদের দিয়ে কাজটা হবে না৷ রাস্তার কুকুর , যাকে আমরা নেড়ি বলে অভিহিত করি , যাদের খাবার জোগাড়ের ঠিকঠিকানা নেই , ইঁট পাটকেল খেয়ে যাদের খোঁড়া হয়ে যেতে হয় , একলাই যারা জান দিয়ে লড়ে যেতে জানে , তাদের উপর ভরসা রাখা যায়৷ ভাবছিলাম ‘লুব্ধক’-এরই অমোঘ পংক্তি , ‘কুকুর -সমুদ্রের ওপরে উড়ছিল ছায়াপথ ধরে ছায়া -কুকুরেরা৷ ’তো নবারুণদা এ রকমই৷ গত কুড়ি বছরে যত বার দেখা হয়েছে , প্রতি বারই এক অন্য রকম স্রষ্টাকে আবিষ্কার করেছি৷ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত নিজের হাতে বাজার করতেন৷ রাত্রে প্রায়ই হাঁটতে বেরোতেন৷ নবারুণদার লেখা আক্ষরিক অর্থেই গতর দিয়ে লেখা৷ শরীর প্রায় প্রতিটি লেখাতেই এক প্রধান চরিত্র৷ তা বলে হারবার্টের মতো উপন্যাস তো শুধু শরীর দিয়ে লেখা হয় না , তার জন্য একটা আস্ত মগজও যে চাই৷ মনে পড়ে এক দিন খুব আবেগতাড়িত হয়ে , ঘরে ঢুকতেই ডান দিকে যে বইঠাসা ঘর তার দিকে আঙুল তুলে বলেছিলেন যারা হারবার্টের পুরস্কার -প্রান্তি নিয়ে নানা কথা বলে তারা তো আর জানে না , এই লেখাটি তৈরি করতে কত দিন ধরে ফুটপাতে কত বই খুঁজে বেড়িয়েছি৷

    নবারুণদা এ রকমই৷ এক দিন আমার বাড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছেন৷ আমি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের একটি বইমেলা সম্পর্কে অবগত না থাকার জন্য বিস্ময় প্রকাশ করতে বলে উঠলেন , না জেনে ভালোই করেছিস , ওটা তো হরিণঘাটার বইমেলা৷ কথায় এত তীক্ষ্ণ শ্লেষ , তরবারির মতো ঝলসে ওঠা কথা৷ ‘আরও বেশি , বেশি করে আমরা একটি মৃতের শহরে যাকে ইংরেজিতে বলে নেক্রোপলিস , তার মধ্যে বাস করছি৷ মুখে মানছি না কিন্ত্ত মৃত হয়ে থাকা , মৃতদের সঙ্গে থাকা ও মৃতদের সঙ্গ দেওয়াতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছি দিনকে দিন৷ ’ অথচ কখনও কখনও আশ্চর্য রকমের মরমি৷ আমাদের পাড়ায় একটি কাপড়ের দোকান আছে যেখানে সারা দিনে এক জন ক্রেতারও পা পড়ে না৷ নবারুণদা এটিও যে খুঁটিয়ে লক্ষ করেছেন এক দিন কথা প্রসঙ্গে তা জানলাম৷ দোকানি মেয়েটির প্রতি সমবেদনা নবারুণদার কথায় ঝরে পড়ছিল৷ আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম এক জন প্রকৃত লেখককে কতটা সজাগ থকতে হয়৷ একটা বিরাট কালো কড়াই তখন যেন একটা বিরাট কচ্ছপ হয়ে যায়৷ খোলার উপরে চিকমিক করছে জল৷ শেকল ছিঁড়ে চলে যেতে চাইছে কোথাও৷

    নবারুণদা এ রকমই৷ প্রায়ই একটা কথা বলতেন৷ কার্নিভাল৷ লাথি -ঝাঁটা খেতে খেতে , কোণঠাসা হতে হতে , খড়কুটো হয়ে ভাসতে ভাসতে , মার্জিনে চলে যাওয়া মানুষেরাও উত্সবে মেতে উঠতে পারে৷ এটাকে তিনি খুব সমীহ করতেন৷ বলতেন আমি এই স্পিরিটটাকে খুব উপভোগ করি৷ কোথাও রাতে আলো জ্বালিয়ে ফুটবল বা ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে , দেখি নবারুণদা দাঁড়িয়ে পড়েছেন৷ জীবনের প্রতি এই টান , মমত্ব , একনিষ্ঠতা ও দায়বদ্ধতা লেখক নবারুণ ভট্টাচার্যকে তিলতিল করে গড়ে তুলেছে৷ সেলুনের মেঝেতে পড়ে থাকা কাটা চুলের মতো অর্থহীন স্বপ্নেও আলো ফেলেছেন লেখক৷ ব্রয়লার নাটক , ব্রয়লার উপন্যাস , ব্রয়লার ছবি , ব্রয়লার সমালোচনা , ব্রয়লার পত্রিকার ভিড়ে নবারুণদার লেখা ভীষণ জ্যান্ত৷ ‘চৌবাচ্চার তেলাপিয়া গঙ্গাসাগরে চলল৷ ’ঘুরে ফিরে এক জন লেখকের কথা প্রায়ই বলতেন , মিখাইল বুলগাকভ৷ কত বার যে আমাকে বলেছেন বুলগাকভের একটি জীবনী সংগ্রহ করে দিতে৷ শেষ পর্যন্ত তা পেরেছিলাম৷ বুলগাকভ নিয়ে এক বার বলা শুরু করলে থামতে চাইতেন না৷ ‘Manuscript don’t burn…’ নবারুণদার একটি প্রিয় পংক্তি৷ ফ্যাতাড়ুদের এই গাঙ্গেয় উপত্যকার জল , বাতাস , মাটিতে বেড়ে উঠতে দেখা গেলেও কোথাও যেন ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা ’র তির্যক ছায়া৷ আমি এই প্রশ্নটা নবারুণদাকে কোনও দিন করিনি৷ এখন ভাবি ঠিকই করেছি৷ উত্তরটা তো নবারুণদাই দিয়ে গিয়েছেন৷ ‘…পেরেক যার / তাকিয়া তার৷ ’ আর এক জন লেখকের কথাও খুব বলতেন নেলসন অ্যালগ্রেন৷ আসলে নবারুণদার পছন্দের লেখকদের মধ্যেই নবারুণদার লেখার ঠারঠোর জানা হয়ে যায়৷ সিমোন দ্য বোভোয়া ’র প্রেমিক অ্যালগ্রেন যেমন মাতাল , বেশ্যা , দালাল , ঠগ , জোচ্চোর , মাদকাসক্ত , ভণ্ড , রাজনীতিবিদদের নিয়ে গল্প , উপন্যাস লিখেছেন , নবারুণদার লিখন -জগত্ও তো এদের নিয়েই৷

    ওয়াল্টার বেঞ্জামিনকে নিয়ে বই লিখতে আমাকে বার বার অনুরোধ করেছেন৷ আমি শুরুও করেছিলাম৷ কিন্ত্ত তার পর তো নবারুণদা দিল্লি চলে গেলেন৷ আমি ভাবি কেন বেঞ্জামিনকেই বেছে নিলেন৷ বেঞ্জামিনের মতোই নবারুণদাও কি নিজেকে ইতিহাসের আবর্জনা -কুড়ানি ভাবতেন না ! ‘সকলেই জানে যে কলকাতার ওপরের পাটির দাঁতগুলো বাঁধানো৷ সকলেই জানে যে কলকাতার নীচের পাটির এবড়ো -খেবড়ো দাঁতগুলি বাঁধানো নয়৷ সেগুলি হল বেঢপ উঁচু উঁচু বাড়ি৷ ’ এই উপলব্ধিতে পৌঁছতে গেলে বেঞ্জামিনকে আত্মস্থ না করলে কি হয় ? রাণু ঘোষের তথ্যচিত্র ‘কোয়ার্টার নাম্বার ৪ /১১’ দেখানোর জন্য কত বার যে শিশুর মতো আবদার করেছেন৷ এখন ভাবি কেন আরও একটু সময় দিলাম না৷ দিল্লি থেকে ফিরছেন জেনেছি , আমি প্রায় জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছি নবারুণদাকে৷ মৃদু হেসে কত কথা হল৷ চিন্ময় গুহর ছোট্টো একটি বার্তা৷ ৩১ জুলাই , বিকেল ৫টা কুড়ি৷ নবারুণদা চলে গেলেন৷ ‘এই চেয়ে থাকার মধ্যে ঘুম নেই , গাঢ়তর ঘুম মৃত্যুও নেই , জাগরণ নেই , মন নেই , চৈতন্য নেই , অচৈতন্য নেই , সুস্থির জলের মধ্যেও যেমন তরঙ্গ থাকে তেমন এই চেয়ে থাকার মধ্যে রয়েছে , উপচে উপচে , এক অপলক অপার করুণা …৷ ’

    গৌতম মিত্র -এর লেখার সঙ্গে ব্যবহূত ডান দিকের নিচে নবারুণ ভট্টাচার্যের ছবিটি তুলেছেন সুযাত্র ঘোষ৷
    ==========================================================================

    ফ্যাঁত্ ফ্যাঁত্ সাঁই সাঁই

    যাবতীয় বাওয়ালি এবং ক্যাচড়া পেরিয়ে ফ্যাতাড়ু শেষ অবধি শো -এর জন্য তৈরি হল৷ নবারুণদাকে ক্লোজ্ড ডোর শো -তে ডাকলাম৷ শেষ হলে দেখি চুপ করে বসে আছেন৷ পাশে গিয়ে বসতেই জড়িয়ে ধরে বললেন --- তুই আবার আমাকে নাটকে ফিরিয়ে আনলি৷ ’ লিখছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়৷

    প্রথমে রিহার্সাল রুমে নানা খসড়ার কাজ শুরু করলাম , তার একটা ছিল খিস্তির ওয়ার্কশপ৷ সারা ক্ষণ অভিনেতারা একে অন্যের সঙ্গে বিভিন্ন রকম চলিত খিস্তি বা নিজ আবিষ্কৃত খিস্তিতে কথা বলবেন , কিন্ত্ত খিস্তিকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না৷

    ২০০২ -এর শীতকাল , তখন সদ্য ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল ’ মঞ্চস্থ হয়েছে৷ দলের একটি ছেলে , রাজর্ষি দে , এক দিন আমাকে জানাল সে নবারুণদার ‘ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক ’-এর নাট্যরূপ দিয়েছে , আমাকে শোনাতে চায়৷ শুনলাম , এর আগে গল্পগুলো পড়া ছিল , কিন্ত্ত নাটক করব ভাবিনি কোনও দিন৷ শোনার পর মনে হল একটা চেষ্টা করে দেখাই যাক না৷ দলের সবাইকে পড়ে শোনালাম৷ তখন দলে প্রায় জনা তিরিশেক ছেলের গড় বয়স চব্বিশ -পঁচিশ , তারা উত্তেজিত৷ দু’জন মধ্যবয়স্ক সদস্য ‘ফ্যাতাড়ু ’ হলে দল ছেড়ে যাবেন বলে শাসালেন এবং ছেড়েও গেলেন৷ এ রকম একটা অবস্থায় ‘ফ্যাতাড়ু ’ করার সিদ্ধান্ত নিলাম৷ নবারুণদার বাড়িতে নাটক করার অনুমতি নিতে গেলাম৷ সব শুনে মুচকি হেসে যা বলেছিলেন তার আক্ষরিক অর্থ ঋণাত্মক হলেও ভিতরে ভিতরে ‘চার্জ’ করে দিয়েছিলেন৷ অনুমতি দিয়েও দিলেন৷ আমার অভিনেতাদের অনেকেই বহিরঙ্গে এবং অন্তরঙ্গে ফ্যাতাড়ু জীবন যাপন করেনি কোনও দিন৷ অবভাষার প্রয়োগও করেনি তারা৷

    প্রথমে রিহার্সাল রুমে নানা খসড়ার কাজ শুরু করলাম , তার একটা ছিল খিস্তির ওয়ার্কশপ৷ সারা ক্ষণ অভিনেতারা একে অন্যের সঙ্গে বিভিন্ন রকম চলিত খিস্তি বা নিজ আবিষ্কৃত খিস্তিতে কথা বলবেন , কিন্ত্ত খিস্তিকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না৷

    ওটা অন্যান্য শব্দের মতোই স্বাভাবিক ভাবে আসবে এবং বিভিন্ন আবেগের সঙ্গে মিশেল ঘটাতে হবে৷
    এই সময়টাতে ৷

    লাল (সুমন মুখোপাধ্যায় ) আর আমি ঠিক করলাম সারকারিনায় নিয়মিত নাটক করব৷ ও ‘কাঙাল মালসাট ’ আর আমি ‘ফ্যাতাড়ু ’৷ আমি সারকারিনায় কাজ শুরু করলাম৷ আমাদের সঙ্গে হল -এর মালিক অমর ঘোষ বসলেন , সঙ্গে শ্যামানন্দ জালানও ছিলেন৷ কিন্ত্ত উনি শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন না , আমি কাশী বিশ্বনাথে ফিরে এলাম৷ ফলে শুরুতে যে নাটকটার এরিনা আর রিভলভিং স্পেসের মতো একটা ছবি তৈরি হচ্ছিল , সেটা আবার চৌকো প্রসেনিয়ামের ধাঁচায় নিয়ে আসতে হল৷

    কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে টুকরো কাজ শুরু হল৷ অভিনেতারা শব্দকে অবচেতনে নিয়ে শরীর আর আবেগের সঙ্গে সংযুক্তির প্রাথমিক কাজগুলো করছিলেন৷ সঙ্গে ছিলেন অঞ্জন দেব৷ এই নাটকে স্পেসগুলো বদলে যায় মুহূর্তে--- মালের ঠেক , রাস্তা , আপিসে উড়ন্ত ফ্যাতাড়ু , বাড়ির ছাদ , দ্বিতীয় হুগলি সেতু, ফ্লোটেল , কার্জন পার্ক, কবিতা সম্মেলনের অফিস , আবার রাস্তা , ‘মাই ইন্ডিয়া ’ সিনেমা হলে কবি সম্মেলন , অন্য একটা পার্ক, নবনী ধরের বাড়ি , হসপিটালের রিসেপশন , হসপিটালের বেড , আবার অন্য একটা পার্ক, রাজধানী এক্সপ্রেসের কম্পার্টমেন্ট , দিল্লির আকাশে উড়ন্ত ফ্যাতাড়ু , বঙ্গভবন , ফেরার রাজধানী , আবারও পার্ক, কলামন্দির , মালের ঠেক৷ লাল দায়িত্ব নিল মঞ্চসজ্জার এবং বিদেশে চলে গেল৷ আমি আর কাউকে মঞ্চের জন্য বললাম না , নিজেই একটা চেষ্টা করতে আরম্ভ করলাম৷ কিন্ত্ত কিছুতেই ধরতাই পাচ্ছিলাম না৷ এটুকু বুঝতে পারছিলাম স্পেসটা পালটে যাবে গোটাটাই , নাটকের গতির সঙ্গে৷ অনেক রকম ভাবনা আসছিল৷ আমাদের আলোর সুদীপ সান্যাল এখনও মজা করে বলে , আমি যা যা বাতিল করতে করতে গিয়েছিলাম তাতে আরও গোটা পাঁচেক ‘ফ্যাতাড়ু ’ হতে পারত৷ সুন্দর সাজানো -গোছানো মঞ্চ চাইছিলাম না , একটু অসম্পূর্ণ, কাঁচা ব্যাপারটা নাটকটা চাইছিল৷ এমতাবস্থায় এক দিন ফুল চার্জড্ হয়ে রাত দুটো নাগাদ বাবুঘাটের সিঁড়িতে চিত হয়ে শুয়ে উল্টো দিকে দেখি সেই দ্বিতীয় হুগলি সেতু, ইংরেজি ‘V’-এর মতো দুটো লাইন , ব্যস পেয়ে গেলাম , রাস্তায় চরম উত্তেজনা প্রকাশ করায় পুলিশ ধরল , ছেড়েও দিল৷ ওখান থেকে সোজা কার্জন পার্ক, ইঁদুরদের ঠেকে৷ ও মা হঠাত্ দেখি স্ট্যাচুটা সামনে ছিল , পিছনে চলে গেল৷ আবারও উত্তেজনা , এ বার অবশ্য পুলিশ আসেনি৷

    ধরতাই পেয়ে গেলাম৷ এক একটা স্পেসকে তার মূল চরিত্রের রেখা দিয়ে প্রকাশ করে বাস্তবতা থেকে সরে আসতে লাগলাম৷ এক একটা মঞ্চ সামগ্রী বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করা হল৷ মঞ্চে চলে এল চাকা লাগানো দুটো ট্রলি , দুটো স্ট্রেচার , তিনটে খাট , একটা দরজার ফ্রেম , দুটো টেবিল , দুটো রেলিং , একটা বেঞ্চ --- এগুলো নিয়েই গোটা নাটকটার ছবি তৈরি হতে লাগল৷ একটা দৃশ্য থেকে আর একটা দৃশ্যে যেতে গিয়ে আচমকাই একটা গান চলে এল৷ পুরন্দরের ‘বড়লোকের ছেঁয়া করছে টেঁয়া -টেঁয়া ’ কবিতাটায় একটা সুর দিয়ে ফেললাম৷ সবাই নাচতেও আরম্ভ করল , হারমোনিয়ামের সঙ্গে একটা কলসি আর খঞ্জনি বাজানো হল৷ প্রতিটা দৃশ্যান্তরেই গান ঢুকে গেল , নাচও৷ মঞ্চও পালটে যেত এর সঙ্গে৷ তবে সবটা কোরিওগ্রাফ্ড্ নয় , ইচ্ছে করেই একটু অগোছালো রেখেছিলাম৷ এর মধ্যে ‘চন্দ্রবিন্দু’ ঢুকে পড়ল , অনিন্দ্য -উপল -চন্দ্রিলরা গোটা একটা গান লিখে সুর দিয়ে ফেলল --- ‘হুলাবিলা ’৷ আর ‘ওঁয়া -ওঁয়া ’, ‘লিঃ -লিঃ ’ ইত্যকার শব্দবন্ধে একটা সাউন্ডস্কেপ তৈরি হল৷ ‘সেরা বাঙালি ’র সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পুরন্দর একটা কবিতা পড়বে ঠিক করলাম৷ নবারুণদাকে বলতে গোটা একটা কবিতা লিখে দিলেন নাটকের জন্য , ‘ড্রপসিন , ওরা নামাবে , নামাক / টেনে যাক সুখে ডুডু ও তামাক / থার্ড-রেলে বসে মেট্রো থামাক / আমাদের ছেঁ* গেল বা *…৷ ’ ফ্যাতাড়ুদের ওড়ার জন্য অনেক কিছু ভেবেছিলাম প্রথমে , পরে সব বাতিল করে শুধু স্ট্রেচার আর ট্রলি ব্যবহার করলাম৷ রুদ্রনীল ঘোষ , দেবরঞ্জন নাগ আর স্বপন রায় তিন মূল ফ্যাতাড়ু --- পুরন্দর , ডি এস আর মদন , সঙ্গে গোটা তিরিশেক ফ্যাতাড়ুর ক্যাচাল শুরু হল মঞ্চে৷ রাতের অ্যাকশনগুলোর জন্য হ্যান্ড পাপেট ফ্যাতাড়ু বা পার্কে ইঁদুর পাপেটের নাচও হল এবং ওই রাতের মতো মঞ্চে স্ট্যাচুও গেল ঘুরে৷ নাটকের আলোর থেকে ছায়ার প্রাধান্য ছিল বেশি , বিশেষ করে রাতে৷ কোনও মেকআপ ব্যবহার করিনি৷ যাই হোক যাবতীয় বাওয়ালি এবং ক্যাচড়া পেরিয়ে ‘ফ্যাতাড়ু ’ শো -এর জন্য তৈরি হল৷ নবারুণদাকে ক্লোজ্ড ডোর শো -তে ডাকলাম৷ শেষ হলে দেখি চুপ করে বসে আছেন৷ পাশে গিয়ে বসতেই জড়িয়ে ধরে বললেন , ‘তুই আবার আমাকে নাটকে ফিরিয়ে আনলি৷ ’ফ্যাঁত্ ফ্যাঁত্ সাঁই সাঁই--- নবারুণদা৷ ■৷

    দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের লেখার সঙ্গে ব্যবহূত ‘ফ্যাতাড়ু ’ নাটকের ছবিটি তুলেছেন প্রণব বসু৷ লেখকের সৌজন্যে প্রান্তএই পাতায় নবারুণ ভট্টাচার্যের তিনটি প্রতিকৃতি সৌজন্য : কিউ
  • /\ | 127.194.215.167 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৪৯644848


  • বিশ্বের শেষ কমিউনিস্ট

    আমার কল্পনার ডিনার টেবিলে যে লোকগুলো সশব্দে মাংসের হাড় চিবোয় , তার মধ্যে নবারুণদাকে রোজ দেখি৷ ’ লিখছেন কিউ৷

    ■নবারুণদার বাস্তব ও নবারুণদার কল্পনার সংঘাতই আমার ছবিটার কেন্দ্রবিন্দু৷ ...ওনার যে ইউটোপিয়ান ট্রুথ --- যেটাকে বলা যায় পরস্পরবিরোধী বাস্তব , আমার সিনেমাটা সেটারই একটা প্রোজেকশন৷

    ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকারদের ব্যাপারে একটা বদনাম প্রায়ই শোনা যায় , যে তাঁরা ইতিউতি ঘুরে বেড়ান , লোকজনের সঙ্গে আলাপ করেন , তার অন্যতম কারণ পরের ছবিটা করতে হবে৷ তাই ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকারদের জর্জরিত ও নিপীড়িত বিভিন্ন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার , নার্সিংহোম ও আরোগ্য নিকেতনে শ্যেন দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়৷ আমি এটা জানি কারণ ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার হতে গেলে ভালো রিসার্চ করতে হয়৷ ভালো রিসার্চার হওয়া সত্ত্বেও আমি ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার হতে পারলাম না , কারণ ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকারদের মূল ব্যাপারটাই হচ্ছে সময়জ্ঞান , যা আমার আগেও ছিল না , এখনও নেই৷ যদিও বা একটা জিনিস ঠিক সময়ে শুরু করলাম তো শেষ করতে পারি না৷ সুতরাং বলা বাহুল্য , নবারুণদার উপরে যে ফিল্ম বানাবো কিংবা বানানো উচিত , কী বানানো যায় অথবা বানানো দরকার --- এর কোনওটাই আমার মাথায় আসেনি৷ এই বিষয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে আমি একটি ফিচার ফিল্ম করেছি , সেটার নাম ‘গাণ্ডু’৷

    এক নিশুতি রাতে ওভারডোজে সুরজিত্দার সঙ্গে বাংলা লেখালিখি নিয়ে কথা হচ্ছিল , এমন সময় বিদ্দ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ে গেল , নিজেদের কাছে ক্যামেরা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও , অফিস থেকে আধমাইল দূরে নবারুণ ভট্টাচার্য বলে এক জন প্রবাদপ্রতিম লেখক থাকেন , যিনি আমাদের সময়ের একমাত্র র্যাডিক্যাল লেখক --- এটা জানার পরও আমি যদি তাঁকে নিয়ে ফিল্ম না করি তা হলে ইতিহাস তো আমাকে ক্ষমা করবেই না এমনকী রৌরব নরকেও আমার স্থান হবে না৷ সস্তা চমকদার কথা বলে হাততালি কুড়নোর অভ্যাস আমার ছোটোবেলা থেকে৷ তাই একটু আগে যা বললাম সেটা ভুলে যাওয়াই ভালো৷ ডকুমেন্টারি ফিল্ম করা সত্যিই কঠিন একটি চেষ্টা৷ শুধুমাত্র ক্যামেরা আর সাউন্ড সম্বল করে একটি সত্যির পিছনে বছরের পর বছর ছুটে বেড়ানো এবং নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সেটাকে একটা সিনেম্যাটিক বাস্তবতা দেওয়া মোটেই সোজা নয়৷ ভারতবর্ষের ডকুমেন্টারি ফিল্ম কালচার বেশ পুরোনো ও অত্যন্ত সমৃদ্ধ৷ অনেক বিচিত্র পরিচালক অনেক বিচিত্র ভাবে ইনভেস্টিগেটিভ ডকুমেন্টারি করেছেন কেউ কেউ তার থেকে দু’পা এগিয়ে , আজকাল যেটাকে ক্রিয়েটিভ ডকুমেন্টারি বলা হচ্ছে , সেটাও করেছেন , এবং তার বয়সও বেশ পুরোনো৷ আমাদের দেশে গত শতকের ৭০-এর দশক থেকেই এই দু’ধরনের ডকুমেণ্টারি ফিল্ম হচ্ছে৷ এ ক্ষেত্রে আমার কাছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে , সম্প্রতি শেষ হওয়া কমল স্বরূপ পরিচালিত ‘রঙ্গভূমি ’, যা দাদাসাহেব ফালকের উপর নির্মিত৷ কমল স্বরূপের মতো লুম্পেন চিত্রপরিচালক আমাদের দেশে বিরল৷ নবারুণদার লেখার মতোই কমলের ফিল্ম আমাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে৷ শ্যুটিং শুরু করার প্রথম দু’দিনের মধ্যে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমি নিজে শ্যুট করলে নবারুণদা এবং ওনার স্ত্রী এক ধরনের উত্কণ্ঠা বোধ করছেন৷ তাঁদের এই উত্কণ্ঠা থেকে মুক্তি দেবার কোনও রাস্তা আমার কাছে ছিল না৷ তাই ঠিক করলাম নবারুণদার ওই গল্ফগ্রিনের ফ্ল্যাটের ভেতরে আমি শ্যুট করব না৷ শুধু তাই নয় , আমি শ্যুটিংয়ের ত্রিসীমানায় যাব না৷ ঠিক হল , সুরজিত্দা , আমাদের এক ফরাসি ডকুমেণ্টারি ফিল্মমেকার বন্ধু আদ্রিয়া (যে তখন আমাদের সঙ্গে ছিল ) আর অনুরাগ নামে দিল্লির একটি বাচ্চা ছেলে , যে তখন আমাকে অ্যাসিস্ট করত --- এরা যাবে নবারুণদার বাড়িতে শ্যুট করতে৷ এই টিমটা বেশ কয়েক দিন নবারুণদার ফ্ল্যাটে , বিজয়গড় বাজারে আর ওনার পুরনো পাড়া ভবানিপুরের গাঁজা -পার্ক এলাকায় শ্যুট করল৷ ছবির এই অংশটা একেবারেই বাস্তবধর্মী৷ যেটাকে পিয়োর ডকুমেন্টেশন বলা যায়৷

    আমার সমস্যাটা হল , যে , আমি যত বার নবারুণদাকে শ্যুট করছি উনি আমার কাছে কিছুতেই সাবজেক্ট হতে পারছিলেন না৷ প্রায় ছ’আট মাস শ্যুট করার পরও একটা দ্বিধা , একটা দ্বন্দ্ব কাজ করছিল৷ ভেবে দেখলাম এই সিনেমাটা কিছুতেই পিয়োর ডকুমেন্টেশন হবে না বা হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ তার কারণ হল নবারুণদা বার বার করে আমার কাছে একটা গল্পের চরিত্র হয়ে ফিরে আসছেন৷ ওনার ঘোর বাস্তবতাও আমাকে একটা মায়াবী চেতনায় ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে৷ ওনার ফ্ল্যাটের অগোছালো বইয়ের স্তপ , তার ফাঁকে ফিল্ম ও থিয়েটারের পোস্টার , মিউজিক সিস্টেম , টেবিলে চায়ের কাপ , অ্যাশট্রে --- সবই আমার কাছে আর্ট ডিরেক্টরের তৈরি করা সেট৷ ড্রয়িং রুমে বসে নবারুণদার সিগারেট খাওয়া আমার কাছে মার্লন ব্র্যান্ডোর মতো৷ তা হলে আমি কী ভাবে ছবিটাকে দেখব ? প্রথমত সাদাকালোয়৷ সাদাকালো হয়ে গেলেই সেখান থেকে অনেক রকম ভুল বোঝাবুঝি , মায়া , এ সব কাটিয়ে ওঠার একটা প্রচেষ্টা করা যায়৷ যদিও এখনও সেই ম্যাজিক রিয়ালিজমের জগত্ থেকে বেরনো সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে৷ এটাও আমার কাছে পরিস্কার হল , যে , নবারুণদার বাস্তব ও নবারুণদার কল্পনার সংঘাতই আমার ছবিটার কেন্দ্রবিন্দু৷ সিনেমার নাটকীয় সম্ভাবনাটি এই সংঘাত থেকেই তৈরি হবে৷ ওনার যে ইউটোপিয়ান ট্রুথ --- যেটাকে বলা যায় পরস্পরবিরোধী বাস্তব , আমার সিনেমাটা সেটারই একটা প্রোজেকশন৷ ওনার লেখা দুটো গল্প নিয়ে কাজ করা হল , একটা বাস্তবের গল্প আর একটা কল্পনার গল্প৷ যেখানে বাস্তবের ওপর কল্পনার বিরাট ছাপ থাকবে আর কল্পনার ওপর বাস্তবের প্রেসার কুকার বসানো৷ বেছে নেওয়া হল ‘মিউচুয়াল ম্যান ’ ও ‘ফ্যাশন প্যারেডে ফ্যাতাড়ু ’৷

    এই সিনেমার আর একটি চরিত্র নবারুণদার স্ত্রী , প্রণতিদি , বয়সে নবারুণদার থেকে একটু বড়ো , নবারুণের যোগ্য সঙ্গিনী৷ মাথার অবস্থাও নবারুণদার মতো৷ সুতরাং সুখের সংসার৷ যেহেতু নবারুণদা অসুস্থ, তাই প্রণতিদি নবারুণদার প্রত্যেকটি পদক্ষেপ অনুসরণ করেন এবং সেই কারণে এই সিনেমায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রায় একটি নির্বাক চরিত্র হিসেবে থেকে গেলেন৷ আর একটা কথা , শ্যুটিং শুরু করার ২/৩ দিনের মধ্যেই নবারুণদা আমাকে আর সুরজিত্দাকে বলেন , যে , ‘ভেবে দেখলাম , তোরা হচ্ছিস ঘোড়েল মাল৷ যাদের নিয়ে কারও চিন্তা করার দরকার নেই , যারা নিজেদের চিন্তা নিজেরাই ভালো করতে পারে ’৷ এই সিনেমাটা নবারুণদার সাহিত্যের বিশ্লেষণ নয় , তাঁর রাজনৈতিক চেতনার প্রচার বা ব্যাখ্যা নয় বা গুরুদক্ষিণাও নয়৷ আমার কল্পনার ডিনার টেবিলে যে লোকগুলো সশব্দে মাংসের হাড় চিবোয় , তার মধ্যে নবারুণদাকে রোজ দেখি৷ সেই টেবিলে বসা অন্য মানুষদের পৃথিবী যে চোখে দেখে , আমি রোজ চাই পৃথিবী নবারুণদাকেও সেই চোখে দেখুক৷ শুধু বাংলায় লিখেছেন বলে নবারুণদা চিরকাল মোহনবাগানের গোলকিপার হয়ে কাটিয়ে দেবেন সেটা ঠিক নয়৷ আমার কাছে নবারুণ আরভিন ওয়েলশ , নবারুণ হান্টার এস থমসন , নবারুণ হেনরি মিলার৷

    ==========================================================================



    পেট্রল ঢেলে অগ্নিনির্বাপণ

    বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে কতিপয় লেখক তাঁদের লেখায় ভাষাসন্ত্রাস ছড়িয়েছেন , নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁদের অন্যতম৷ ’ লিখছেন সুরজিত্ সেন

    শুধু মানুষই সব , আর বাকি যা আছে সেগুলো কিছু নয় , মানে প্রাণী বা ঈশ্বর --- এই একবগ্গা মার্কসবাদী তত্ত্ব থেকে সরে এসেছিলেন নবারুণ৷ তাই তাঁর ‘লুব্ধক ’ উপন্যাসে শহর শাসন করে কুকুররা৷

    নবারুণ ভট্টাচার্য ওই স্বপ্ন দেখেন এবং তাঁর বিভিন্ন লেখায় ওই স্বপ্নের কথা বার বার উঠে এসেছে , শিরোনামে যা বলা হয়েছে৷ যিনি নিজেকে কম্যুনিস্ট বলে মনে করেন৷ ‘কম্যুনিস্টরা আপনাকে অ্যাকসেপ্ট করে ?’ এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন , ‘করে না তো ’৷ বললাম , ‘আমি তো আপনাকে এক জন অ্যানার্কিস্ট লেখক বলেই মনে করি ’৷ উনি বললেন , ‘আমি অবশ্য তা মনে করি না ’৷ কথা এগিয়েছিল প্রুধোঁ, বাকুনিন , ক্রপটকিন নিয়ে , তবে তর্ক আর এগোয়নি৷ মানতেই হবে , বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে কতিপয় লেখক তাঁদের লেখায় ভাষাসন্ত্রাস ছড়িয়েছেন , নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁদের অন্যতম৷ যে ভাষাসন্ত্রাসে বাংলা সাহিত্যের সাজানো ড্রয়িংরুমটি তছনছ৷ সাধারণত , বাংলা গল্প উপন্যাসে যে খোকা গদ্যভাষার কলকাকলি চলে , নবারুণের অঙ্গুঠাছাপ দেওয়া ভাষাটি তার উপর আরডিএক্স -এর মতো ফেটে পড়ে৷ এই চেষ্টা যে গদ্যলেখকরা করেছেন , এই মূহুর্তে মনে পড়ছে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় , উদয়ন ঘোষ , বাসুদেব দাশগুন্ত , সুবিমল মিশ্র বা কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের কথা , আরও অনেকে আছেন বা এখনও করছেন মলয় রায়চৌধুরী , কিন্ত্ত তাঁরা নবারুণের মতো জনপ্রিয়তা পাননি৷ নবারুণ শুধু যে সাহস করে ভাষার লক্ষণরেখার বাইরে পা রাখতে পেরেছেন বলেই তাঁর এই জনপ্রিয়তা তা নয় , একই সঙ্গে গল্প বলার ভঙ্গিমায় নিজেকে নাকচও করে দেন তিনি৷ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে একটি প্রবন্ধে তথাকথিত উপন্যাস কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলে নবারুণ যখন তাঁকে উদ্ধৃত করে বলেন , ‘আমার উপন্যাস কতখানি উপন্যাস হয়ে উঠেছে , সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে ’--- তখন এই বাক্যে কোথাও নবারুণের নিজের উচ্চারণও কি লুকিয়ে নেই ? ৪৯ বছর বয়সে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেলেন নবারুণ তাঁর ‘হারবার্ট’ উপন্যাসের জন্য৷ এক বার এই পুরস্কারটি পেয়ে গেলে যে কোনও বাঙালি লেখক বুঝে নেয় সাহিত্যের ইতিহাসে তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে গেল৷ সে বাকি জীবনটা ওই পুরস্কারের দেখাশোনা করেই কাটিয়ে দেয়৷ নবারুণ এর উল্টোটাই করেছেন৷ পুরস্কার পরবর্তী তাঁর উপন্যাস ‘কাঙাল মালসাট ’-এ যে ভাষাসন্ত্রাস আমরা দেখতে পাই , তাতে ওই সরকারি পুরস্কারদাতারা লজ্জাই পেয়েছেন বোধহয়৷ উপন্যাসটি পড়ে এক বাম সরকারি পণ্ডিত বলেছিলেন , ‘এ যেহেতু মান্য ভাষায় লেখা নয় , তাই এ লেখা থাকবে না ’৷ প্রসঙ্গত , গত শতকের সাতের দশকের শেষে রুশ কম্যুনিস্ট পার্টির মহাতাত্ত্বিক মিখাইল সুশলভের হাতে জমা পড়ে ‘লাইফ অ্যান্ড ফেট ’ উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি , ছাপা হবে কি হবে না জানার জন্য৷ ভাসিলি গ্রসম্যানের লেখা এই উপন্যাসটি পড়ে কমরেড সুশলভ বলেছিলেন যে , আগামী ২০০ বছরেও এটা ছাপা হবে না৷ পরের ইতিহাস সবাই জানেন৷ গ্রসম্যান বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে থেকে গিয়েছেন আর কমরেড সুশলভ কোথায় কেউ জানে না৷ পুরস্কার নিয়ে আর একটি কথা বলার , বামফ্রন্ট জমানার শেষের দিকে রাজ্যের প্রধান পাণ্ডা কম্যুনিস্ট পার্টিটির অত্যাচারের প্রতিবাদে তাদের দেওয়া বছরওয়ারি সাহিত্য পুরস্কারটি (বঙ্কিম পুরস্কার ) ফেরত দিয়েছিলেন নবারুণ৷ আমি আর অ্যানথ্রোপসেন্ট্রিক নইএ রকমই বলেছিলেন এক সাক্ষাত্ কারে৷ শুধু মানুষই সব , আর বাকি যা আছে সেগুলো কিছু নয় , মানে প্রাণী বা ঈশ্বর --- এই একবগ্গা মার্কসবাদী তত্ত্ব থেকে সরে এসেছিলেন নবারুণ৷ তাই তাঁর ‘লুব্ধক ’ উপন্যাসে শহর শাসন করে কুকুররা৷ ‘কাঙাল মালসাট ’-এ উড়ে আসে দণ্ডবায়স বা দাঁড়কাক৷ ছোটো গল্পের শিরোনাম হয়ে ওঠে অন্ধবেড়াল৷ ‘বেবি কে ’--- উপন্যাসে পাঁচিলের উপর বসে থাকে বিরাট কালো রাজহাঁস৷ বন্ধু পীযুষ ভট্টাচার্যর উপন্যাসের প্রয়োজনে উট সম্পর্কে যাবতীয় গবেষণা নিজ দায়িত্বে করেন৷ তাঁর লেখায় এমন মানুষ আসে যে উড়তে পারে বা এমন মানুষ যে পেট্রোল খেয়ে বেঁচে থাকে৷ জীবনের নানা অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, গোপন পগারপাঁচিল টপকে এগোতে গিয়ে নবারুণ ফাঁদে পড়েছিলেন অ্যালকোহলিজমের , নিজেই ফাঁদ কেটে বেরিয়েছেন৷ আঙুলে মুনস্টোন গ্রহরত্ন ধারণ করেছেন আবার খুলেও ফেলেছেন৷ এই তো গত জুলাইয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের মরশুমে ওনার গল্ফগ্রিনের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম হাতের কব্জিতে বাঁধা বিপত্তারিণীর লাল সুতো৷ তন্ত্র সম্পর্কে খুব আগ্রহ৷ পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তন্ত্র পরিচয় ’ বইটি অনেক দিন পর ছাপা হওয়ায় আমার কাছে পড়তে চাইলেন৷ গত বছরে ওনার ফ্ল্যাটের মেঝেতে মার্বেল বসানো হচ্ছে দেখে মুচকি হেসে বললাম , ‘কী হচ্ছে এ সব ’? নবারুণ হো হো করে হেসে বললেন , ‘আই থিংক লেফট অ্যান্ড লিভ রাইট’৷ কম্যুনিস্ট নবারুণকে চট করে মেপে ফেলা যাবে না বঙ্গীয় মার্কসবাদের মলিন ও শতছিন্ন দর্জিফিতে দিয়ে , উনি ওই মাপকাঠির বাইরে বাঁচেন৷ ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথার মাঝে অবধারিত খিস্তি , ওঁর মতে ওটাও মানুষের তৈরি ভাষা , ভাবপ্রকাশের মাধ্যম৷ কাঙাল ও বুলগাকভ মিখাইল আফানাসজেভিচ বুলগাকভ --- এই রাশিয়ান ঔপন্যাসিকটি নবারুণের প্রিয় লেখকদের একজন৷ বুলগাকভ ১৯২৮ সালে মস্কো আর্ট থিয়েটারে নাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে কাজ করবার সময় ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা ’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন৷ এটির ছায়া পড়েছে নবারুণের ‘কাঙাল মালসাট ’-এ৷ তত্কালীন রুশ সর্বাধিনায়ক স্ট্যালিন সেই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়ে লেখককে ফোন করে বলেন যে , এই উপন্যাস কিছুতেই ছাপানো যাবে না৷ এর কিছু দিন পরে বুলগাকভ স্ট্যালিনকে জানান যে , তিনি চিরকালের জন্য রাশিয়া ছেড়ে ফ্রান্সে চলে যেতে চান৷ স্ট্যালিন সে অনুমতিও দেননি৷ রাগে ক্ষোভে উনি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলেন৷ কিছু দিন পর উনি আবার উপন্যাসটি স্মৃতি থেকে লিখতে শুরু করেন৷ ওঁর মৃত্যুর অনেক পর ওনার তৃতীয় স্ত্রী বোধহয় আমেরিকায় বইটি প্রকাশ করেন৷ বইটির শুরুতে বুলগাকভ লেখেন , ‘পাণ্ডুলিপি পোড়ে না ’৷ এটি নবারুণের প্রিয় উদ্ধৃতি, ‘কাঙাল মালসাট ’ উপন্যাসের শুরুতে আছে৷ এই উপন্যাসে দেখা যায় শয়তান অধ্যাপকের বেশে মস্কো শহরে এসেছে৷ এই কাহিনিতে একটা কালো বেড়াল আছে , নাম বেহেমথ৷ সে ভদকা খায় , গুলি চালায় , দাবা খেলে আর সর্বক্ষণ খিস্তি দিয়ে কথা বলে৷ এই বেড়ালটিকে দেখে মনে পড়েছিল ‘কাঙাল মালসাট ’-এর দণ্ডবায়সের কথা৷ আর বেজডম বলে এক কবির কথা আছে , যাকে কেউ পাত্তা দেয় না , কবি পুরন্দর ভাটের মতো৷ এমনকী বেগম জনসনেরও খোঁজ পাওয়া যাবে ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা ’ তে৷

    নবারুণ বললেন , ‘দ্যাখ , স্ট্যালিন বলেছিলেন , যে , উপন্যাসটা ছাপাই যাবে না৷ উপন্যাসটা ছাপা হল , কিন্ত্ত সোভিয়েত রাশিয়া থাকল না৷ স্ট্যালিনের টেবিলের কাঁচের নিচে একটা নামের তালিকা থাকত যার উপরে লেখা ছিল ‘ডু নট টাচ ’, মানে যাদের মারা যাবে না বা সাইবেরিয়ায় কি গুলাগে পাঠানো যাবে না৷ মিখাইল আফানাসজেভিচ বুলগাকভের নাম সেই তালিকায় ছিল ’৷ অথচ সোভিয়েত রাশিয়া নিয়ে নবারুণ অসম্ভব রোম্যান্টিক৷ আমাদের অফিস ওভারডোজে সন্ধে পার করা আড্ডায় কিঞ্চিত পানের পর বললেন , ‘সোভিয়েত রাশিয়াই যখন থাকল না , তখন আমিই বা এই পৃথিবীতে থেকে কী করব ’? রাগ , অভিমান আর আয়না মান্য বাংলা ভাষা নিয়ে রাগ ছিল তাঁর৷ নবারুণ বলেন , ‘ভাষাকে রক্তহীন , অযৌন , প্লাস্টিকগন্ধী ও ঢ্যামনা করে দেওয়ার একটা চেষ্টা আছেই৷ আমাদের কাজ হল এই সব সচেষ্টদের বাংলা মতে ক্যালানো৷ আগে তেরপল চাপা৷ তার পর খেঁটো বাঁশ ’৷ ঋত্বিক ঘটকের ওপর নবারুণের তীব্র অভিমান৷ কারণ উনি ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো ’ র শ্যুটিং চলাকালীন নবারুণকে বলেছিলেন , ‘দ্যাখো বাবা , আমি তো আর বেশি দিন বাঁচব না , আর মাত্র তিনটি ছবি করে যাব ’৷ ঋত্বিকের পক্ষে এই কথা রাখা সম্ভব হয়নি , কিন্ত্ত নবারুণ মনে করেন ঋত্বিক কথা রাখেননি৷ বছর তিনেক আগের এক বিকেলে ভবানীপুরের যদুবাবুর বাজার বা লোকমুখে জগুবাবুর বাজারের দোতলায় ৭৯ বছরের পুরোনো পানশালা ‘তৃন্তি বার ’-এর ভেতর বিরাট আয়নাটা দেখিয়ে বললেন , ‘এই যে আয়নাটা দেখছিস , এই আয়নাটা কাকে কাকে দেখেছে জানিস ? শোন তা হলে , ঋত্বিক ঘটক , বিজন ভট্টাচার্য, হরিসাধন দাশগুন্ত , সুভাষ মুখোপাধ্যায়৷ এঁরা সব এই আয়নাটার ভেতর ঢুকে গেছেন , এক দিন আমিও ঢুকে যাব ’৷

    শুরুতে যে কথা হচ্ছিল , যে , পেট্রল দিয়ে আগুন নেভানোর স্বপ্ন একজন কম্যুনিস্ট কী করে দেখবেন ? একজন অ্যানার্কিস্টের পক্ষেই তা দেখা সম্ভব , কিন্ত্ত আমাদের প্রিয় রোম্যান্টিক কম্যুনিস্ট লেখকটি তা মানবেন না৷ কমরেড নবারুণ ভট্টাচার্য…৷

    ■ছবি সৌজন্য : কিউ
  • /\ | 127.194.215.167 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫৪644849


  • নবারুণের ঘুঘুচক্কর

    যত দিন শাসকের বেয়নেটের খোঁচা থাকবে , খবরদারি থাকবে , চোখরাঙানি থাকবে , সাক্ষীকে হাপিশ করা থাকবে , তত দিনই মুণ্ডচ্ছেদ হয়তো থাকবে৷ ’ লিখছেন হিরণ মিত্র৷

    ‘টিনের দরজায় সবই শুনছিল বড়িলাল৷ বড়িলালকে কেউ যেন আবার আগ বাড়িয়ে নধর স্পাই বা কিম ফিলবি গোছের কিছু ভেবে না বসে৷ আগেই বলা হয়েছে যে বড়িলাল হল সাক্ষী৷ পৃথিবীতে যা কিছু ঘটুক না কেন তার একজন সাক্ষী থাকবেই৷ অবশ্য তাকে যে মানুষ হতেই হবে এমন কোনো সরকারি নিয়ম নেই৷ সে একটা হাঁড়ি পাতিল বা বগিথালা বা পেদো গন্ধপাতার গাছ বা এক চোখকানা হুলো --- যা কিছু হতে পারে৷ দুনিয়াদার নানা কৌশলে কার সঙ্গে কার যে ঘেঁষপোট করে রেখেছে তা বোঝার সাধ্যি কারও নেই৷ এ নিয়ে অধিক উচ্চবাচ্য না করাই ভালো৷ ’আজকে সাক্ষী খুবই বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ‘মাস্টারমশাই আপনি কিছুই দেখেননি ’ আজ আন্তবাক্য৷ সবার সবই কিছুই দেখা , শোনা , জানা , বলা বারণ৷ কে বারণ করল ? কেন বারণ করল ? বারণ করার অর্থই বা কী ?‘--- জোয়ারদার , তোমার হেডগিয়ারটা খুললে না ? মিনিমাম এটিকেট৷ ঘাড়ে ব্যথা বলে …--- ইয়েস সার৷

    জোয়ারদার পা ঠুকে দাঁড়িয়ে উঠে বাঁ হাত দিয়ে হেলমেটটি ওপরে তোলেন৷ ফলে মুণ্ডসমেত হেলমেটটি ওপরে উঠে যায় ও ফুলের গোছা নেবার জন্য কবন্ধ ডানহাতটি বাড়িয়ে দেয়৷ রোজা ও অন্য সুন্দরীরা গোলাপের মতোই ঝরে যায়৷ মানে সহসা ক্লোরোফর্ম করা হল এরকম ভাব দেখিয়ে চোখ উল্টে ধুপধাপ পড়তে থাকে৷ মি । ঘোষাল চিত্কার করে ওঠেন৷

    --- মাথা নেই৷ সার , মাথা নেই৷ ভূত !হেলমেটের ভেতর থেকে জোয়ারদারের মুণ্ড বেরিয়ে পড়তে যাওয়ার মুখে ডান হাত দিয়ে জোয়ারদার তাকে ধরে ফেলে এবং চুলের মুঠি ধরে গলায় বসায়৷

    --- ভূত -ফুত নয় সার৷ মাইনর একটু অ্যাডজাস্টমেন্ট হলেই ঠিক হয়ে যাবে৷

    সি ।এম চটে যান৷

    --- এই অবস্থায় ডিউটি করছেন আপনি ? মাথা আলাদা অবস্থায়৷ এ জিনিস আমি কখনোই সহ্য করব না৷ ’ওদের সবাই ফ্যাতাড়ুরা ঘিরে রেখেছিল৷ বাংলায় বহু সময় বহু ফ্যাতাড়ু গোপন কার্যকলাপ চালিয়েছে৷ আমি ঘটনাচক্রে কয়েক জনকে পেয়েছিলাম যাদের ফ্যাতাড়ু বলে সন্দেহ করতাম৷ ষাট -সত্তর দশকে কবি দীপক মজুমদার , গল্পকার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়৷ আমাদেরও ইচ্ছে করত , আগ্রহ ছিল ফ্যাতাড়ু হয়ে ওঠার৷

    নবারুণের সঙ্গে আলাপ হয় অনেক পরে৷ ‘হারবার্ট’ চলচ্চিত্র বানায় সুমন মুখোপাধ্যায়৷ আমি সামান্য কাজে ছিলাম৷ কিন্ত্ত এই চলচ্চিত্র বানাবার প্রস্ত্ততি হিসেবে , সময় , পরিবেশ , চরিত্র , তার ব্যবহার , রঙ , দৃশ্য , সব কিছুকেই পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে ঘুরতে হল বিস্তর৷ উত্তর কলকাতা , পথঘাট , মানুষজন , এঁকে রাখা , ছবি তুলে রাখা , দেখে রাখা৷ ভিতরটা তৈরি হচ্ছে সাথে সাথেই , একটা প্রক্রিয়া৷ ষাটের দশকে পুরোপুরি কলকাতায় চলে আসি৷ মফস্ সল শহরের ছেলে৷ নানা দুর্দশার সাক্ষী৷ বড়ো শহরে এসে নানা বিচিত্র মানুষজনের মধ্যে থেকে দেখা , বোঝা শুরু হল৷ ছবি আঁকি৷ রঙ খাতা নিয়ে ঘোরাফেরা৷ বিচিত্র মানুষেরা এক সকালে দেখলাম খাতা থেকে উঠে চার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে , বিচিত্র আচরণ করছে৷ অনেক পরে জানলাম এরা রাত্রে ফ্যাতাড়ু বনে যায় , সাঁই সাঁই ফ্যাত ফ্যাত মন্ত্র পড়ে আকাশে উড়ে যায়৷ গু ফেলে নানা জায়গায়৷ সে এক বিষম কাণ্ড৷ পুলিশ অফিসার জোয়ারদারের মাথাটা ওরা চাকতি দিয়ে কেটে ফেলেছিল৷ তখন থে‌ে কই জোয়ারদার হেলমেট পরে ওটা মাইনর অ্যাডজাস্টমেন্ট করে রেখেছে৷ সাউথ সিটি মলে চতুরঙ্গ -এর প্রিমিয়ার শো হয়৷ নবারুণও ছিল৷ চতুরঙ্গ -ও বানায় সুমন মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নিয়ে৷ ও ছবি দেখতে এসেছে৷ দু’জনে বেরিয়ে এসেছি শো শেষে৷ বেরনোর জায়গাটা আলো -ঝলমলে , সুগন্ধ ছড়ানো , ঝাঁ চকচকে করিডর৷ নবারুণ করুণ মুখ করে আমায় বলল , ‘এখানে আমি আসতে পারি না , ঢুকি না , নিজেকে বিপন্ন লাগে৷ ’ ‘এত অস্বস্তি নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকি৷ দমবন্ধ হয়ে যায়৷ ’ তাই ফুটে বেরোতে লাগল নানা লেখায়৷ আমার আঁকার কাজ , আমি ওর মতোই বিপন্ন৷ দীপক মজুমদারকেও এমন একই রকম বিপন্ন দেখেছি৷ মহানগর @কলকাতা --- তিনটে গল্প নিয়ে আবার চলচ্চিত্র বানাল সুমন মুখোপাধ্যায়৷ আমি ভিড়ে গেলাম , ওই সামান্য কাজে৷ চরকিপাক শুরু হল , শহরের প্রান্তে৷ তখনই নানা শুটিং স্পটে ওই গোপন পরিচয়ে নানা ফ্যাতাড়ুর সাক্ষাত্ পাই৷ এদেরকে সাধারণত অসামাজিক বলে সবাই৷ তখন প্রশ্ন জাগে সমাজ কী ? তার ভব্যতা , তার শৃঙ্খল , তার সভ্যতা একটা বাইরের ঝাঁ চকচকে মোড়ক , অনেক কিছু আড়াল করছে৷ নবারুণ সেই মোড়কটা ছিঁড়ে ফেলেছিল৷ ছিঁড়তে বাধ্য হয়েছিল৷ অসময়ে তার চলে যাওয়া৷ সে দিন শহর থেকে বহু দূরে ছিলাম বলে প্রাণের সেলাম জানাতে পারিনি৷ দূর থেকে মাথা নিচু করে ছিলাম৷ চুপচাপ বসে ছিলাম৷ এমন নয় আমিও অমন হয়ে উঠতে পারব , তবু পুরো জীবনটা যে বিকল্পের খোঁজে ব্যস্ত থেকেছি , নানা সঙ্গে থেকে জীবিত থাকার চেষ্টা করেছি , মাথাটা নোয়াতে পারিনি , তার প্রেরণা তো অন্যতম এক জন প্রিয় লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য৷ ভাষা , বাক্য , প্রকাশ , এগুলো তো নানা খেলা৷ এ খেলা খেলতে দীপক , সন্দীপন , উত্পলকে দেখেছি৷ কাছের লোক নবারুণ বয়সে ছোট হলেও , আত্মিক উষ্ণতা পেয়েছি৷ শীর্ণ হাতটার স্পর্শ চেয়েছি৷ ভিতরের কথাগুলো , ছবির ভিতর আউড়ে গেছি বার বার৷ একটা চেতনার স্পর্শ পাওয়া৷ আমাদের চারপাশটা , যেমন এক দিকে শিল্পভাবনায় ইউরোপ ঘিরে রেখেছে , আবার তারাই ছাঁচ ভেঙেছে৷ ছবির সঙ্গে সাহিত্য , কবিতা , ভিন্ন সুর , ভিন্ন রসদ , ভিন্ন দৃশ্য দেখিয়েছে৷ আমাদের আড় ভেঙে দিয়েছে , ক্লান্তি দূর করেছে৷ চমকে উঠেছি৷ এক সময় যেমন মহীনের ঘোড়ার সঙ্গে ঘুরেছি , গৌতম চট্টোপাধ্যায় আমার ছবির পাশে তাল ঠুকেছে , তেমনই , নবারুণের লেখনী৷ রক্ত ঝরতে দেখলাম , রঙরেখার চলন পাল্টে দিল৷ রক্ত , বমি , গু, পেচ্ছাপ , কালি , রঙ , ভাসিয়ে দিল ক্যানভাস৷ আমার নিজের অপর আমায় বানায় , অপর আমায় দেখায়৷ আমি এই ভাবে ‘অপর ’ হয়ে যেতে পছন্দ করি৷ এক সময় ফেরার কোনও রাস্তা থাকে না৷ ফিরতে সে চায়ও না৷ নবারুণও ফিরতে চায়নি৷ দুর্গম , প্রতিবাদী , অনিশ্চিত , বক্রোক্তিভরা ভাষা ও দৃশ্যের কোথাও হয়তো সমান্তি ঘটল৷ কিন্ত্ত ভাবনাটা বেঁচে রইল , দেখাটা বেঁচে রইল , সাক্ষী বেঁচে রইল , ফ্যাতাড়ুরা বেঁচে রইল৷ যত দিন শাসকের বেয়নেটের খোঁচা থাকবে , খবরদারি থাকবে , চোখরাঙানি থাকবে , সাক্ষীকে হাপিশ করা থাকবে , তত দিনই মুণ্ডচ্ছেদ হয়তো থাকবে৷ কে করবে , কেন করবে , কখন করবে , কে জানে ?নবারুণ এমন একটা কাজ শুরু করে দিয়ে গেছে , এ বোঝা -না -বোঝার বাইরে , অনুধাবনের বাইরে , একটা অস্তিত্ব , একটা সাক্ষী , একটা নজরে রাখা বোধ , চেতনায় কড়া নাড়া৷ শব্দ ক্রমশ বাড়তেই থাকবে৷ নিশ্চিত সুখী ঘর ভেঙে পড়বে সেই আওয়াজে , পুড়ে যাবে সব কিছু৷

    সম্প্রতি তাঁর অনুবাদের নাটক ‘যারা আগুন লাগায় ’, তাতেও আমি অংশ নিতে পারলাম৷ আবারও একটা প্রক্রিয়ার শুরু হল৷

    নবারুণকে সেলাম৷ নবারুণের বিধান ছিল --- ‘আমাদের গুষ্টির নিয়ম হচ্ছে জন্মে জন্মে আমরা একবার করে মহাচক্রের খেলা , মহামণ্ডলের ঘুঘুচক্কর দেখিয়ে যাব৷ ’
    ==========================================================================

    নবারুণদাও একটি প্রগাঢ় কেলো

    ‘একটা চেষ্টা জারি থাকা জরুরি৷ ফ্যাতাড়ু অ্যান্ড কোং -এর ম্যানেজিং ডিরেক্টরশিপ থেকে নবারুণদাকে মুক্ত করে আনার৷ ’ লিখছেন বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী

    ■নবারুণদার বামপন্থী প্রতীতী আর একটু জটিল , বহুমাত্রিক৷ ভারতে এবং অন্যত্রও , মার্কসবাদীরা যে বামপন্থাকে গভীর থেকে গভীরতর গাড্ডায় ফেলেছেন , সে ব্যাপারে নবারুণদার কোনও সংশয় ছিল না৷

    নবারুণদা মারা গিয়ে একটি প্রগাঢ় কেলোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে৷ যেমন পিস হাভেন -এর সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম চাট্টি নিরীহ পুলিশ বলাবলি করছে নবারুণ ভট্টাচার্য মহান সাহিত্যিক ছিলেন৷ এ রকম আরও কেলো হতে যাচ্ছে৷ ফেসবুক এবং হয়তো অন্যত্রও তার চিহ্ন চোখে পড়ছে৷ রাজাও বানিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এবং তার সঙ্গে সেঁটে যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যের খিস্তিধারার ভগীরথের শিরোপাটি৷ ফেসবুকের দেওয়াল দেখলে বোঝার উপায় নেই নবারুণদা পুরন্দর ভাটের ছড়া আর কাঙাল মালসাট ছাড়া আর কিছু লিখেছেন৷ নবারুণদা বলতেন --- এই রকমই হয়৷ ৷

    যখন একটা জাতের ডিপলিটিসাইজেশন এবং অশিক্ষার বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় , তখন তারা মূল ভুলে স্থলেই মাতে৷ কাজেই নবারুণদাকে খোপবন্দি হওয়া থেকে বাঁচানোর আশা খুবই কম৷ তবুও একটা চেষ্টা জারি থাকা জরুরি৷ ফ্যাতাড়ু অ্যান্ড কোং -এর ম্যানেজিং ডিরেক্টরশিপ থেকে নবারুণদাকে মুক্ত করে আনার৷ কারণ , ক্ষমতা খিস্তিকে ভয় করে না৷ কিন্ত্ত ভাবা প্র্যাকটিস করাটাকে ভয় পায়৷

    নবারুণদাকে যতটা পড়েছি এবং খুব সামান্য সময় ধরে যেটুকু জেনেছি , তাতে এটা অন্তত স্পষ্ট যে নবারুণদা নাছোড়বান্দা , এবং আপসহীন ভাবে বাংলা সাহিত্যের আদলটি ভেঙেছেন এবং গড়েছেন , কিন্ত্ত কখনই তিনি পিতৃদ্রোহী নন৷ বরং উল্টোটাই সত্যি৷ বঙ্কিম -রবীন্দ্রনাথ -বিভূতিভূষণ -জীবনানন্দ তাঁর কাছে ব্যাখ্যাতীত রহস্য৷ রবীন্দ্রনাথকে কী ভাবে বর্ণনা করবেন বুঝতে না পেরে এক বার বলেই ফেললেন --- ‘লোকটা কী ছিল ? ভূত ? না ৷

    পাগল ?’ বিভূভিূষণে তাঁর অপরিসীম দুর্বলতা৷ তাঁর শমীবৃক্ষ ছিলেন বিজন -ঋত্বিক -জ্যোতিরিন্দ্র -হেমাঙ্গ৷ বারংবার তাঁদের কাছে ফিরতে হত শস্ত্রের খোঁজে৷ হয়তো প্রতি দিন , প্রতি মুহূর্তে৷ তাঁদের কথা বলতে গিয়ে প্রকাশ্যে কেঁদে ফেলতেন৷ কেন ? ভেবেছেন কোনও দিন ? অতএব , হে ফেসবুক -গাত্রে -মুতিয়া -আইনভাঙা বাঙালি পাঠকগণ , এটা জেনে রাখুন নবারুণ ভট্টাচার্যকে চিনতে হলে আপনাদের ফিরতেই হবে এই মানুষগুলির কাছে , যাদের নবারুণদা চিহ্নিত করতেন এই ‘ইতর দেশের ’ ‘উদ্বৃত্ত মানুষ ’ হিসেবে৷ নতুবা হাতে পড়ে থাকবে অই খিস্তিটুকুই, যা আপনাদের জানাতে নবারুণ ভট্টাচার্য হাতে কলম তুলে নেননি৷ কাজেই উনিশ ও বিশ শতক জুড়ে বঙ্গীয় চিন্তাজগতের যে মোমবাতি ও মশালগুলি জ্বলেছিল , নবারুণদাকে যদি তাদের অবশিষ্ট গুটিকয়েকের অন্যতম বলি , নবারুণদা তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে মোলায়েম খিস্তি দিতে পারেন , কিন্ত্ত আমি নিশ্চিত তিনি আমার কান মুলে দেবেন না৷

    তার কারণ আছে৷ বাঙালির ভাবনার জগতে যাঁরা ওলটপালট ঘটিয়েছেন , বা ঘটানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করে গিয়েছেন , তাঁদের সবারই দু’টি সুলক্ষণ ছিল৷ জ্ঞানচর্চা, এবং , অবশ্যই নিপীড়িতের পাশে দাঁড়াবার অঙ্গীকার , যা ভারতে বিশ শতকে বামপন্থা নামে পরিচিত হল৷ নবারুণদা এই বুধমণ্ডলীরই জাতক৷

    ‘এখন কী পড়ছিস ?’ এই প্রশ্নটা থেকে নবারুণদা কখনও আমাকে মুক্তি দেননি৷ এবং , এই প্রশ্নটা এত নিয়মিত ভাবে আর কেউ কখনও করেওনি৷ পড়া মানে লাগামছাড়া পড়া , সম্পূর্ণ অহৈতুকী পাঠাভ্যাস৷ এটি বুর্জোয়া , সেটি আঁতেল , ওটি ট্র্যাশ ইত্যাদি যে সব ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক বাছবিচার আমাদের রক্তে খেলা করে , সে সব কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে পড়া৷ নবারুণদার মুখে বহু বার শুনেছি --- নাথিং হিউম্যান ইজ এলিয়েন টু মি৷ নবারুণদা শেষ যে বইটি আমাকে পড়তে বলেছিলেন , তার নাম ‘মিউজিক অফ দ্য স্পিনিং হুইল ’৷ গান্ধীকে নিয়ে লেখা বই৷ লেখক সুধীন্দ্র কুলকানি৷ নবারুণদা বইটি পড়ে মহা -ইমপ্রেসড৷ এখন যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁরা গোবিন্দচন্দ্র দাসের কবিতা পড়েন কিনা জানি না৷ নবারুণদার অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিলেন গোবিন্দ দাস৷ ‘কাঙাল মালসাট ’-এ তাঁর রেফারেন্স আসার অনেক আগে গোবিন্দদাসি ঢঙে নবারুণদা লিখেছিলেন ‘স্বদেশ গাথা ’৷ ‘হারবার্ট’-এ একের পরে এক উনিশ শতকের কবির রেফারেন্স , নবারুণদার ভাষায় , ‘স্রেফ চ্যাংড়ামি নয় ’৷ বদলে যেতে থাকা একটি শহরের আদলকে ধরতে এই কণ্ঠগুলো তাঁর কাছে ভীষণ জরুরি ছিল৷ ইতিহাস না জানলে নতুন ইতিহাস তৈরি করা যায় না৷ নবারুণদা জানতেন৷

    নবারুণদার বামপন্থী প্রতীতী আর একটু জটিল , বহুমাত্রিক৷ ভারতে এবং অন্যত্রও , মার্কসবাদীরা যে বামপন্থাকে গভীর থেকে গভীরতর গাড্ডায় ফেলেছেন , সে ব্যাপারে নবারুণদার কোনও সংশয় ছিল না৷ উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারছি না --- ‘আজকের অবস্থানে পার্টিবাজি করে বেশি দূর এগোনো যাবে না সেটা বোধ হয় আর নতুন করে বলার দরকার নেই৷ … আজ মনে হয় যাঁরা অভ্রান্ত বলে এখনো পূজিত হচ্ছেন তাঁদের অবস্থানটাও প্রভূত গোলমেলে৷ বিপ্লব কারো ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি নয়৷ এবং বিপ্লব ও মুক্তির দুনিয়ায় মৌলবাদ অচল ’৷ সংঘে আস্থা টলেনি কখনও , কিন্ত্ত তার সঙ্গে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন ব্যক্তির মুক্তি ছাড়া বিপ্লব অসম্পূর্ণ থাকে৷ এবং ব্যক্তিগত বোধের ক্ষেত্রে এমন অনেক কিছুই আছে , যা কেঠো মার্কসবাদী ফর্মুলা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না৷ এক বার বলেছিলেন , ‘মার্কস -এর মেয়ের সুইসাইডের কোনও ব্যাখ্যা মার্কসবাদে আছে ?’ অনন্য রায়ের সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার যে গল্পটি বলেছিলেন , তাকেও বাঁধা যাবে না কোনও মার্কসিয় নাগপাশে৷ বৌদ্ধ দর্শনে আগ্রহের শুরুও এই অবস্থান থেকেই৷ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নিম্নবর্গের মানুষদের চিন্তাভাবনা , অর্থাত্ ‘ফোক উইজডম ’ সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধা৷ কাজেই বামাক্ষ্যাপা ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীরাও নবারুণদাকে ভাবাতেন৷ সোভিয়েত রাশিয়া নিয়ে এক ধরনের দোলাচল ছিল৷ জানতেন সেই বনিয়াদে অসংখ্য নিরীহ মানুষের এবং লেখক -শিল্পীর রক্ত মিশে আছে , এবং সে কথাও লিখেছেন৷ আবার সোভিয়েত সম্পর্কে নস্টালজিক মুগ্ধতাও কাটেনি৷ ‘কাঙাল মালসাট ’-এর অন্তর্ঘাত যে অনিবার্য সেটা যেমন মানতেন , তার সঙ্গে এটাও বলেছেন যে পুরো ব্যাপারটাই শেষ পর্যন্ত ‘হাস্যকর , ননসেন্স ’, টুইডিলডাম -টুইডিলডি ’র যুদ্ধু-যুদ্ধু খেলা৷ দুর্ভাগ্য সেই বাঙালি যুবকের , যে নবারুণদার কান্না ভুলে নবারুণোচিত রগড়কেই সময় পাল্টাবার নয়া টেমপ্লেট বলে ধরে নিল৷

    উপরের ছবি সৌজন্য ঃ কিউ
    মাঝের ও নিচের ছবি ঃ সুযাত্র ঘোষ
  • a x | 138.249.1.198 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫৫644850
  • সুতনয়ার লেখাটা ভালো লাগল। আজই সকালে এই নিয়ে কথা হচ্ছিল একজনের সাথে।

    কস্তুরী কিছু লেখার ইংরেজি অনুবাদ করেছে, সাথে ছবির কোলাজ - এইখানে আছে, জানিনা সবাই দেখতে পাবে কিনা -
    https://www.facebook.com/notes/kas-turi/translating-nabarun/10152705827614866
  • /\ | 127.194.215.167 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:০০644851


  • মধ্যবিত্তের সক্রিয় রাজনীতি বড়োজোর ফ্রিভলাস ফ্যাতাড়ুদের খিস্তি বিলাস ?

    মাড়োয়ারির বিয়েতে পচা শামুক , কবিসম্মেলনে আরশোলা ফেলাটা বিপ্লবীয়ানা নিশ্চয়ই , খিস্তি খিল্লির ভাষা আবিষ্কারও , তবে তার সঙ্গে অমিতাভ বচ্চনের দিওয়ারে ক্রোধ প্রকাশের আদলের ফারাক আদতে নেই৷ ’ লিখছেন অমিতাভ মালাকার

    আমাদের মতোই খোড়োরবির ভাইয়ের মগজে যে সে রকম জায়গা খালি পড়ে ছিল সে ইঙ্গিত আমাদের নবারুণ দিয়েছেন৷ কিন্ত্ত তার সঙ্গে হার্বার্টের দেখা হয় না মগজের ফাঁকা তাল কাটা পরিসরে ৷ তবে কি হার্বার্টের আত্মহত্যা ব্যতীত আর কোনও রাস্তাই খোলা ছিল না ?

    নব্বইয়ের দশকে খুব অল্প দিনের ফারাকে দু’দুখানা বিস্ফোরণের ধাক্কায় আমাদের বাংলা উপন্যাস পাঠের অভ্যস্ত তরিকা এবং সাহিত্যের ভাষা সম্পর্কিত ধারণা যারপরনাই ঝাঁকুনি খেল৷ নবারুণ ভট্টাচার্যের হার্বার্ট আর ইলিয়াসের খোয়াবনামা প্রকাশের মধ্যে সময়ের ব্যবধান খুব বেশি নয়৷ উপন্যাস দুটির ক্ষেত্রেই একটি ব্যাপারে কোনও মাজাকি নেই৷ তমিজের বাপ আর হার্বার্ট-এর হাল সাকিনটি দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল একেবারে অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ ধরে ইঞ্চি মেপে৷ নিজগিরিরডাঙার মানুষটির পা যে কাদায় গাঁথতে হয় , সেটির উত্তর পূর্ব আসমান জমিনের সীমানা -বেড় আবাদের হিসেবে , আবাদ হাসিল , তার জন্যে লড়াই , কোথায় গাছ কেটে সাফ হবে , কোথায় জলা , সে জলের কত গভীরে বাঘাড় মাছ , কোন সিথানে পাকুড় আর বট আর বকের উড়াল , সে দিয়ে নির্দিষ্ট হয় তমিজের বাপের স্বপ্ন কোন পথে আসবে যাবে , ভবানী পাঠকরে লয়ে দুঃখ বিলাপের সুর কোন তরফে ফিরবে৷ সে খোয়াবের একখানা কেতাবও আবিষ্কার করেন ইলিয়াস , আর তার পর তমিজের বাপকে সে স্বপ্নের ভেতরে স্থায়ী আবাস গড়ে থেকে যেতে বাধ্য করেন৷ হার্বার্টের ক্ষেত্রেও ওই স্থানাঙ্ক নির্ধারণটি জরুরি বিবেচনা করেছিলেন নবারুণ৷ বেচার মিষ্টির দোকান , সাহেব পাড়ার রাস্তা , প্রবাসী আত্মীয়ের ঠিকানার চাইতেও জরুরি তার ওই ঘরখানা৷ সেখানেই প্রথম , কেউ এসে পৌঁছনোর আগে ওর মৃতদেহটিকে পোকারা দখল করে নেয়৷ স্থানাঙ্ক নির্ধারণের দায়িত্ব নেয় আরশোলা , টিকটিকি , বরফ -রক্ত -জলে চোবানো হাত --- সে হাত তো তখন আর হার্বার্টের নয় --- একটা বন্দি হয়ে পড়া মাছি আর রক্ত মাখা নতুন --- অবশ্য সেটা তখন আর নতুন কিনা সে নিয়ে তর্ক হতেই পারে --- ব্লেডের ওপর নিজেদের সম্পূর্ণ দখলিস্বত্ব কায়েম করতে সক্ষম লাল পিঁপড়ের সারি৷ অনুপস্থিত ছিলেন বটে এক জন , ঘরের বাইরে জানলায় শরীর ঘষে ঘষে শেষমেশ ফিকে হয়ে যাওয়া পরিটি ঢুকতে পারেনি বন্ধ দরজা ঠেলে৷

    এরা সকলেই বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে জুটেছিল , এবং মাছিটি যেমন ফাঁক পেয়ে উড়ে পালায় , লাশ নামানোর সময় , ঔপন্যাসিকের ঔদাসীন্যবশতই হয়তো , এদের বিস্তারিত খবর পাওয়া যায়নি৷ তবে ওইখানেই যত গেরো৷ আসমানে ভাসমান ভোকাট্টা ঘুড়ির মতোই কলকাতার বাড়িতে এসে পৌঁছোয় হার্বার্ট, পুরনো যাবতীয় যা কিছু সব উপড়ে৷ বাপ মা দেখা করতে আসেন বটে অদৃশ্য থাকতে পারার সুযোগে , তবে তারাও অন্তর্হিত হন ওই পরির মতোই৷ ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়৷ সিঁড়ির তলায় বারান্দার এক কোণে হার্বার্টের খাটিয়া -ঠিকানায় পরিবর্তন ঘটে বিনুর মৃত্যুর পর , সে -ও যেন পরের জমিতে বসত বাঁধা ফাঁকা জায়গার সুযোগে৷ কিন্ত্ত সব সময়ই ঠিকানা একটা তৈরি হয়ই , যদিও তা ধার করা , বিনুর মৃত্যুর পর বুকে চেপে বসা পুলিশের ভয়ের মতোই৷ পরলোকতত্ত্বের কেতাব থেকে অনেক দিন ধরে আমদানিকৃত অন্য এক কিসিমের বাস্তবতার জট পাকানো হিসেব তার মগজে ঠাঁই পেয়েছিল হয়তো ইশকুলের পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটিকে নবারুণ গোড়াতেই নিকেশ করেন বলে৷ ছাদের গঙ্গাজলের ট্যাঙ্কটিতে হার্বার্টের যে জগত্ , সেটির ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা৷ এক দিকে বুকির ছাদ সবটা জুড়ে থাকে তার অনুপস্থিতিকেই সম্বল করে , আর বাকিটা ভোকাট্টা ঘুড়ির অপেক্ষায় থম মেরে থাকা আকাশ৷ এ ক্ষেত্রে কালিক মাত্রাটিও গুরুত্বপূর্ণ, শোবার ঘরের মতোই৷ হার্বার্ট ছাদের কোণটুকু দখল করে যখন গঙ্গার জল আসা বন্ধ হওয়ার মুখে৷ হার্বার্টের জগত্ এই শূন্যতাগুলি দিয়ে তৈরি হয়৷ বুকি নেই , ট্যাঙ্কে জল নেই , ঘরে বিনু নেই৷ যে দিন এই ‘নেই ’-এর বৃত্তটি সম্পূর্ণ, নিশ্ছিদ্র , অভেদ্য হয়ে উঠল , ছুঁয়ে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন মানুষগুলি বরাবরের মতো হারিয়ে গেল , সে দিনই যেন হার্বার্টও হয়ে উঠল তার নিজের জীবনের গল্পের নায়ক , একাই৷ সে ওই ছাদ , দরজা লাগানো যায় এমন একটা ঘর আর খুব পোক্ত একটা খাটের ত্রিভুজ আবিষ্কারের আনন্দে অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্ক গড়ে তুলল সেগুলির ভেতর আর থাকতে লাগল সেথায়৷

    যে জানলায় পরি এসে গা ঘষেছিল , সে জানলা দিয়ে হার্বার্ট বাইরে তাকায়নি কোনও দিন৷ সে তমিজের বাপের চোখের সামনে ঝুলে থাকা বকের উড়ালের মতোই গায়ে অলেস্টার চাপিয়ে , নীলচে চোখ আর তিরিশের দশকের হলিউডি নায়কদের ছায়ায় আবডালে পথে বেরোয়৷ তমিজ গ্রাম ছেড়ে , বাপের খোয়াবের উত্তরাধিকার জলাঞ্জলি দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে স্বপ্ন দেখে৷ ফকিরি খোয়াবনামার কেতাবি অর্থের আচ্ছাদনটি ছেড়ে বেরোয় সে৷ হার্বার্ট টানা ফেলে যাওয়া খোলস একটার পর একটা চাপায় নিজের গায়ে৷ এই মৃত্যু উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ার পথ সে পায়নি কোনও কালে , খোঁজেওনি৷ হয়তো যে জানলায় পরি এসে অপেক্ষা করেছিল সে গবাক্ষ দিয়ে বাইরে তাকানো চলত , তমিজ চাঁদনি রাতে মাঠ ভরা সবুজ ধানের চারা বাতাসে আন্দোলিত হতে দেখেছিল যে ভাবে , সে ভাবে চাইলে হয়তো হার্বার্টেরও চোখে পড়ত দুজনের পিঠে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে স্লোগান লিখতে লিখতে এক যুবক পুলিশের গুলি খেয়ে মাটিতে পড়ে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলেছে অনির্দিষ্ট কোথাও , কিন্ত্ত সে ওই অনিশ্চিতের দিকে তাকায়নি কোনও দিন৷ নাকি এই স্বপ্নলোকে হার্বার্টের পা কাদায় সম্পূর্ণ গেঁথে ফেলাই ছিল নবারুণের রাজনৈতিক অভিপ্রায় ? নবারুণ মৃত্যু উপত্যকার প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাস গায়ে মাখলেও , সেটিকে দেশ বলে মানতে অস্বীকার করেন , সেটির দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারেন ভেতরে আর বাইরে যাওয়ার পথ দুটিই সমান খোলা রাখতে পারার জন্য৷ তমিজের বাপ আর হার্বার্টের প্রয়োজন কি তবে ওই অন্ধকূপটির অমোঘতা নিরবিচ্ছিন্ন রূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই , স্বপ্ন আর স্বপ্নদেখিয়েদের ইতিহাসের লাশ কাটা টেবিলে ফেলে নাড়িভুঁড়ি বের করে আনতেই কি ওই আয়োজন ? সে কারণেই কি তলস্তয় আর দস্তয়েভস্কি থেকে সোজা চেকফ -এ না পৌঁছে শেড্রিনের গোলোভলিয়ভস -এ দম বন্ধ গোলক ধাঁধায় ফেঁসে যাওয়াটিকে জরুরি মনে করতেন শুধু মাত্র উপন্যাসের ইতিহাস অনুধাবনের জন্যেই নয় , উপন্যাসের ভাষা নিজেকে ভেঙে গড়ে সামাজিক , অর্থনৈতিক ইতিহাসকে কী ভাবে বিশ্লেষণ করে চলে সেটিকেও হাতে ধরা গোলমাল পাকিয়ে প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যাওয়া তাসগুলো পড়ে বোঝার জন্য ?ক্যাট ব্যাট ওয়াটার ডগ ফিশ হয়তো বাস্তব অবস্থা ছেড়ে ছিটকে বেরনোর একটা উপায় , মগজে নিরন্তর জট পাকানো চিন্তা থেকে মুক্তির পথ , তবে তা হার্বার্টকে অ -বাস্তব আর কোনও পরিসরে নিয়ে গিয়ে ফেলে না৷ হ্রীং ক্রীং ইত্যাদি যে শব্দগুলো পরলোক সম্বন্ধীয় কেতাবগুলো থেকে সে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে , তারই অনুরূপ এক শব্দজগত্ সে তৈরি করে চলে নিজের চারপাশে , আর তার স্বপ্নে হাজির হওয়া , বা স্বপ্নে থেকে জন্মানো চরিত্রদের মতোই সেগুলো বাস্তবের বুনিয়াদি চরিত্রটিকে আঘাত করে না , বদল আনতে পারে না কোনও৷ পিঁপড়ে আরশোলাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হলে হয়তো হত , পরির সঙ্গে কথোপকথন হয়তো নতুন ভাষার জন্ম দিত৷ ফুটপাথে বিনুর গা ঘষটানো রক্তের দাগও তাই দেওয়াল , সিঁড়ি , পথ , ঘাট পেড়িয়ে উজান ছুট হার্বার্টের কামরায় এসে পৌঁছয়নি যেমনটা আমরা দেখি ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিট্যুড -এ৷ তা হলে হয়তো নতুন ভাষা তৈরি হত৷ যে জাদু বাস্তবতা শব্দকে নতুন অর্থ জোগায় , লেখকদের বাধ্য করে বাস্তবধর্মিতার সুস্থ ভাষাবন্ধনে আমরণ অঙ্গীকারবদ্ধ থাকার খোচরবৃত্তি পরিহার করে ল্যাজামুড়োর সুসংবদ্ধ জবানি ঘাঁটা গল্প ফাঁদতে , এক হারবার্টের জীবন থেকে অমনি আটকা পড়ে যাওয়া অন্য হাজারটা জীবনে পৌঁছতে , সে রাজনীতির ঐতিহাসিক ক্ষেত্রটি তৈরি হয়ে থাকত৷ বহু বহু বিস্মৃত মৃত্যুর স্মৃতি বহন করে চলা আমাদের মতোই খোড়োরবির ভাইয়ের মগজে যে সে রকম জায়গা খালি পড়ে ছিল সে ইঙ্গিত আমাদের নবারুণ দিয়েছেন৷ কিন্ত্ত তার সঙ্গে হার্বার্টের দেখা হয় না মগজের ফাঁকা তাল কাটা পরিসরে৷ তবে কি হার্বার্টের আত্মহত্যা ব্যতীত আর কোনও রাস্তাই খোলা ছিল না ? এই মৃত্যু উপত্যকায় মৃতের শয্যায় শুয়ে জীবন্মৃতের ভয়গুলোকে ফাঁকতালে পেয়ে গিয়ে সেগুলোকেই জাপটে ধরে মৃত্যুর অপেক্ষাই কি ভাষাহীন এই জাতির এক মাত্র নিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যত ? মধ্যবিত্তের সক্রিয় রাজনীতি বলতে বড়োজোর ফ্রিভলাস ফ্যাতারুদের খিস্তি বিলাস ? বই বিক্রির হিসেব কী বলে ? মাড়োয়ারির বিয়েতে পচা শামুক, কবিসম্মেলনে আরশোলা ফেলাটা বিপ্লবীয়ানা নিশ্চয়ই , খিস্তি খিল্লির ভাষা আবিষ্কারও , তবে তার সঙ্গে অমিতাভ বচ্চনের দিওয়ারে ক্রোধ প্রকাশের আদলের ফারাক আদতে নেই৷ যতক্ষণ পড়লাম ততক্ষণই আয়ু৷ কিন্ত্ত উপন্যাসের যে ভাষা জগতে নবারুণের সচেতন কারিকুরি সেখানে মালের বোতল হাতে গড়াগড়ি দেওয়ার উপায় একেবারেই নেই৷ সেথায় নস্ত্রাদামুসের আত্মহত্যা নামক গল্পের বেঢপ বাচ্চা একা একা রাস্তায় বেরোয় , কথোপকথনের চরিত্র সিলিং ফ্যানের তলায় টেবিলের উপর চেয়ার সাজিয়ে ফ্যানে দড়ি বাঁধার গল্প বলে , সেখানে অন্ধ বেড়াল দেখে সব৷ নিশ্চিত মৃত্যুর খোঁজে ওই সাজানোর অছিলাটা গুরুত্বপূর্ণ, শব্দের পিঠে শব্দ বসানোর মতোই কথা না -কথার ওই জগতে৷ ফ্যাতাড়ুদের খিস্তি -উল্লাসে বাঙালি মধ্যবিত্ত ন্যাকা সাহিত্যসচেতনরা মাতবে , মহাশ্বেতা দেবীর ছেলের জন্মদিন মৃত্যুদিন পালন করবে , সেটাই হয়তো চেয়েছিলেন নবারুণ৷ কাঙাল মালসাট -এর কোথাও , বা ফ্যাতাড়ুদের বা তার পাঠকদের জীবনে এমন কোনও পাগলামোর ইঙ্গিত নেই যা এই অভ্যস্ত জীবন থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারে৷ হারবার্টকেও দেয়নি আর সেটা আদ্যোপান্ত অর্গানাইজ্ড পলিটিক্স্-এ বিশ্বাসী নবারুণের সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত৷ ফৌত হয়ে যাক এরা , মরে , পচে , লোট হয়ে যাক সব , তার পর যদি মৃত্যু থেকে জীবনের সাধ জন্মায়৷

    ■ছবি সৌজন্য : কিউ

    ==========================================================================



    সূর্যের গ্রেনেড

    ভদ্দরলোকদের মসৃণ পশ্চাদ্দেশে নবারুণ গদ্যের লাথি নিক্ষেপ করবেন ৷ তবু বাংলা কবিতার পাঠকের মনে থেকে যাবে তাঁর অবিনাশী আগুনের বর্ণমালা৷ ’ লিখছেন সুনন্দন চক্রবর্তী৷

    কবিতাই তো একমাত্র তরোয়াল ও ঢাল৷ সাচ্চা বিপ্লবীরা ওই কবচকুণ্ডল নিয়েই জন্মান / এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশী শত্রুকে অনায়াসে দেহচ্ছেদন করে দান করে দেন সেই কবচকুণ্ডল৷ মহাভারতে এমনটাই ঘটে থাকে৷ আর কবিতা মাত্র দু’রকম আগুন দিয়ে লেখা যেতে পারে৷ ভালোবাসার অথবা বোমা আর বন্দুকের৷ ষাট আর সত্তর দশকের অপাপবিদ্ধ স্বপ্নাদিষ্ট উপাখ্যান তাই বলে৷ এই গল্পটির পুনরাবৃত্তি না করে নবারুণ ভট্টাচার্য-এর কবিতার মুখোমুখি হওয়া সম্ভব নয়৷

    তাঁর কবিতা চড়ান্ত ও নিশ্চিত ভাবে ওই দু-দশকেরই কবিতা৷ বড়ো জোর তার পরের অর্ধায়ু সহজাত কবচকুণ্ডল ত্যাগ করার পর পুরন্দর ভাট -এর জবানিতে তিনি লক্ষ্যভেদী কিছু মস্করা করেছেন বটে কিন্ত্ত তাঁর পাঠকেরা এই আক্ষেপ করতেই পারেন যে নবারুণের জিয়া অনেকটাই কবিতা থেকে উবে গিয়েছিল৷

    কবিতা এবং পার্টির হোলটাইমারদের প্রথম পুরুষ সুভাষ মুখোপাধ্যায়৷ সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা এবং রাজনীতি কৈশোর অতিক্রান্ত হওয়ার সুযোগ পায়নি৷ সারা জীবন অগ্নিশুদ্ধ থেকেছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ বাংলা কবিতার ইতিহাসে একটি বিপ্লবী সাম্যবাদী রাষ্ট্র স্থাপনের যে লড়াই এঁরা চালিয়েছিলেন সেই সারিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় সহযোদ্ধা কবিকুল সামিল হয়েছিলেন ওই ষাট আর সত্তর দশকে৷ নতুন করে পূজিত হয়েছিলেন রাম বসু আর মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়৷ তীব্র জটিল নকশায় মণিভূষণ ভট্টাচার্য লিখছিলেন এক সংযুদ্ধ দেশের অগ্নিবর্ণ দিনলিপি৷ বিপ্লবের কুহকী রোমান্সের জাল বুনছিলেন মৃদুল দাশগুন্ত৷ শ্লেষ আর রাগের কামারশালায় কবিতার কিরীচ শাণিত করছিলেন অমিতাভ দাশগুন্ত৷ বিষণ্ণ সহিষ্ণুতা নিয়ে জেলখানার দেওয়ালে বড়ো হরফের কবিতা ফুটিয়ে তুলেছিলেন সমীর রায়৷ বিস্ফোরক জয়দেব বসু তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে৷ সদ্য লেখা কবিতা পরিমার্জনের আগেই নিহত হচ্ছেন দ্রোণাচার্য ঘোষ৷ জেলের ভিতর পুলিশের লাঠিতে নিহত তিমির এবং আরও অগণিত তরুণ পঠান্তর ঘটাচ্ছে বেদনাহত , বিকেববিদ্ধ শঙ্খ ঘোষের কবিতায়৷ এই মানচিত্রের বুকেই হালাল ঝাণ্ডা গেড়েছিলেন নবারুণ তাঁর প্রবাদপ্রতিম কবিতা ‘এই মৃত্যু -উপত্যকা আমার দেশ না ’ নিয়ে৷ কোনও পরাজয় , কোনও পিছিয়ে আসা তাঁর সৃষ্টি শিথিল করতে পারেনি৷

    সমালোচকরা যখন তাঁর অতিশয়োক্তিগুলির সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করবেন আমাদের মনে রাখতে হবে তাঁর কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে কবিতার শহরকে ঘিরে ফেলবার পরিকল্পনা বা তাঁর সন্তডিঙা মধুকর দিয়ে সেভেন্থ ফ্লিটকে রুখে দেওয়ার ঘোষণা কোনও শূন্যগর্ভ আস্ফালন নয় যার পিছনে রয়েছে এক দশকের বালকোচিত দুঃসাহস৷ এই সমসাময়িকতাকে অতিক্রম করে একটি ঐতিহাসিক ধারার মধ্যে নবারুণ নিজেকে আর নিজের চারপাশটাকে দেখতে পান৷ তাঁর কবিতার বেপরোয়া হিম্মত আসে ঠিক সেইখান থেকে৷

    যখন কলকাতা থেকে ট্রাম হটিয়ে দেওয়ার কথা চলছে তখন ট্রামকে সম্বোধন করে নবারুণ বলেছিলেন তিনিও ট্রামের মতোই ধীরগতি , জেদি , অলাভজনক , বিদ্যুতের স্পর্শ বিনা অন্ধকার৷ কিন্ত্ত তাঁর মনে আছে ট্রামের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলা মিছিল , ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণিতে বসে গাওয়া বেসুরো বিদ্রোহের গান৷ সময়ের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে যাওয়ার এই বিষাদ কিন্ত্ত তাঁকে বেশিক্ষণ আচ্ছন্ন রাখতে পারেনি৷ কারণ ভদ্র , সফল , প্রযুক্তি -কণ্টকাকীর্ণ, লাভজনক লগ্নির যে দুনিয়া তাকে তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করতেন৷

    তাঁর কবিতার লব্জয় বরাবরই কিছু অশৈরণ ছিল৷ সচেতন ভাবেই৷ কিন্ত্ত খেয়াল করলে দেখা যাবে তাঁর একেবারে প্রথম দিকের কবিতার ভাষা যতটা দামাল ততটা উচ্ছৃঙ্খল নয়৷ ‘যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় / আমি তাকে ঘৃণা করি ’ বা ‘একটা কুঁড়ি বারুদগন্ধে মাতাল করে ফুটবে কবে / সারা শহর উথাল পাথাল , ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে ’ বাক্যগুলো ঠিকরে উঠেছে বটে কিন্ত্ত একদম সমাজচ্যুত হয়ে মার্জিনের বাইরে গিয়ে পড়েনি৷

    প্রথম যখন কবিতা লিখতে শুরু করেন নবারুণ তখন তাঁর কাছে আর পাঁচ জন ‘কমিটেড ’ কবির মতোই দু’টি প্রাথমিক প্রশ্ন--- যখন গ্রামবাসীরা তাদের চার জন মৃত কমরেডের মৃতদেহের জন্যে মর্গের বাইরে অপেক্ষা করছে , যখন এক জন শ্রমিক --- তার ইউনিয়ন দুর্বল --- আত্মহত্যার কথা ভাবছে , যখন পোস্টার আর প্যাকিং বাক্সের ঘরে খাওয়ার পাবার অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পড়ছে অনেকগুলো বাচ্চা তখন কি শিল্পচর্চা করা তাঁকে মানায় ? তখন কি নিজের নিয়ে ভাবার সময় ? তাই খুব ভালো লিখলেও একটাও ফাঁসি থামানো যাবে না জেনেই তিনি পেট্রোল আর আগুনের কবিতা লিখছেন৷ অনায়াসে লিখছেন ‘দেখো , আকাশের উত্তোলিত হাতে সূর্যের গ্রেনেড৷ ’কিন্ত্ত তাঁর স্বপ্নলালিত বিপ্লব অনেক আকাশেই নিষ্প্রদীপ হয়ে আসবে অতঃপর৷ তাঁর কাছে ঘৃণ্য সফল কীটেরাই রাজ করবে৷ আর এই ধ্বস্ত, দষ্ট , বিদীর্ণ, রোগগ্রস্ত দেশের মাটিতে কিলবিল করা আদমের বাচ্চারা ছটফট করবে , হাঁসফাঁস করবে , খিস্তি ছোটাবে৷ একটা কবিতা লিখে আর কতটা হট্টগোল বাধানো যায়৷ হয়তো এই ভেবেই ভদ্দরলোকদের মসৃণ পশ্চাদ্দেশ লক্ষ্য করে নবারুণ গদ্যের লাথি নিক্ষেপ করবেন একের পর এক৷ পুরন্দর ভাট হিড়িক মারবে কবিতাকে৷ কিন্ত্ত তবু বাংলা কবিতার পাঠকের মনে থেকে যাবে তাঁর অবিনাশী আগুনের বর্ণমালা৷ নবারুণ ভট্টাচার্য এক বোতল মদ৷ তাঁকে খেলে আপনার নেশা হবে৷

    ■ছবি : সুযাত্র ঘোষ
  • /\ | 127.194.215.167 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:০৭644852


  • পরিত্রাণের উপায় নাই

    ২০০১ থেকে ২০১৪৷ মাঝে জলস্রোতের মতো সময়৷ সামনে তিন নবারুণ ভট্টাচার্য৷ শিক্ষক -সহযাত্রী -ছাত্র৷ আর এক উপলব্ধি , তরুণদের উপরেই ভরসা রাখতে হয়৷ লিখছেন সৌরভ মুখোপাধ্যায়

    যে উপন্যাস পড়ে , যে উপন্যাস প্রকাশ করতে করতে আমরা ভেবেছিলাম কেয়া দিয়া , বইমেলায় প্রথম ৫ দিনে টেনেটুনে ৫০ কপি ... নবারুণদা কেয়ারই করছেন না এ সব৷

    ২০০১ -এর মাঝখান৷ আমাদের প্রকাশন সংস্থার বয়স তখন মাত্র আড়াই৷ পাগলের মতো তখন খুঁজে চলেছি সেই বই৷ প্রতি মুহূর্তে পাখির চোখের সন্ধানে রাখছি সেই বই, যা কি না প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য প্রস্ত্তত করবে প্রকাশকের এবং প্রকাশনের৷ এবং একই সঙ্গে হাল ধরবে বাণিজ্য তরণীর৷ কিন্ত্ত এ হেন স্বর্ণহরিণীটি কোন অরণ্যে লুকিয়ে , সেই সোনার পাথরবাটিতে কে সন্ধেবেলার চা খাচ্ছেন তা খুঁজে বের করা তত সহজ ছিল না৷ আর ছিল না বলেই এক ঘরোয়া আড্ডায় আমার আর স্বাতীর হাতে বন্ধু শ্রীজাত কোনও ভূমিকা ছাড়াই তুলে দিল এক ক্যাটক্যাটে নীল আর ঘিয়ে প্রচ্ছদের চটি বোর্ড বাঁধাই --- ‘ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক ’৷ লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য৷ শ্রীজাতকে দিয়েছিল অনির্বাণ৷ প্রমা প্রকাশনীর বই৷ শ্রীজাত ছোট্টো করে বলেছিল --- জাস্ট পড়ে দ্যাখ৷ ফেটে যাবি৷ পড়লাম এবং ফেটে গেলাম৷ সশব্দে , বিস্ফোরণই বলা যায়৷ ‘হারবার্ট’ পড়িনি তার আগে৷ তিনটি বা চারটি ছোটো গল্প ছাড়া কিছুই পড়িনি৷ প্রমা -য় ফ্যাতাড়ু সিরিজের উপন্যাস ধারাবাহিক বেরোচ্ছে৷ ‘কাঙাল মালসাট ’৷ দুটো কিস্তি বেরিয়েছে , কেউ জানে না৷ ‘দ্যাখ -না , যদি হয়৷ ’ বলে ব্যাগ থেকে সে দুটো কিস্তিও বেরলো শ্রীজাত ’র৷ পর পর বোমার আঘাত সে মুহূর্তে আমরা প্রায় বিপর্যস্ত৷ স্নান -খাওয়া মাথায়৷ আড্ডার দুপুর গড়িয়ে বিকেল৷ নবারুণ ভট্টাচার্যে ডুবে শেষ ফ্যাতাড়ু এবং মালসাটের প্রথম দুই অধ্যায়৷ তিন জন এক সঙ্গে পড়া , সুতরাং পাঠ এবং প্রতিক্রিয়া অন্তে একটাই সিদ্ধান্ত --- এক্ষুণি কথা বলতে হবে৷ এক্ষুণি …৷ তখনও মোবাইলের এত হাঁউমাউ হয়নি , বাড়ির ফোন থেকে নম্বর জোগাড় করে বাড়ির ফোনে ফোন রিং হচ্ছে আর মনে মনে বলছি --- কিচ্ছু চাই না , শুধু অন্য কেউ , মানে অন্য প্রকাশন যেন আগে কথা না বলেন৷ মনে আছে এখনও , ফোনটা ধরতে বেশ কিছুটা সময় নিয়েছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য৷ তখনও তো তাই৷ আলাপই হয়নি৷ ফোন তুললেন৷ নাম এবং প্রকাশনের নাম বলেই জিজ্ঞেস করলাম --- কাঙাল মালসাট কেউ নিয়েছেন ? উনি শিশুর মতো বিস্ময়ে ফিরতি জিজ্ঞেস করেছিলেন --- কে আবার নেবে ? কেনই বা নেবে ? অতঃপর সরাসরি বই করার প্রস্তাবনা৷ তখন তো মাথাতেই নেই উনি আকাদেমি এবং আরও সব পেয়ে গিয়েছেন তত দিনে৷ এ ভাবে প্রস্তাব করাই যায় না৷ মাথায় একটাই চিন্তা --- মালসাট চাই৷ একটু থামলেন নবারুণ ভট্টাচার্য৷ তার পর ও প্রান্তে থেমে থেমে বললেন --- আগে কেউ বলেনি৷ আপনারা বললেন , যদি শেষ করতে পারি , আপনাদেরকেই দেব৷ রাখলাম৷ ফোন কেটে গেল৷ এই প্রথম মোলাকাত৷ নবারুণ ভট্টাচার্যর সঙ্গে৷

    সেই ২০০১ থেকে এই ২০১৪৷ মাত্র ১৩টাই তো বছর৷ জলের তোড়ে মনে হল বেরিয়ে গেল হাতের ফাঁক দিয়ে৷ আর তার মাঝে আগুনের মতো দেখে নিতে পারলাম এক জন শিক্ষক , এক জন সহযাত্রী এবং এক জন ছাত্রকে৷ তত দিনে লেখালেখির ছাত্র হিসেবে দেখছি এক জন পেশাদার লেখক কী ভাবে বুনে চলেন তাঁর শিল্পকে৷ হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত নবারুণ ভট্টাচার্য এক জন পেশাদার লেখক৷ টাকা পয়সার পেশাদারিত্ব নয় , যাপনে ও লিখনে পেশাদারিত্ব৷ প্রকাশককে কথা দিলে লেখকের না -হওয়া লেখাকে শেষ করতে যতটা লাগে ততটাই পেশাদারিত্ব৷ তত দিনে আমাকে উনি আপনি থেকে তুই৷ তত দিনে ফোনে --- এগোচ্ছে বুঝলি ! তত দিনে এক দিন সকালে ফোন --- নেমে গেছে রে ! নিয়ে যাস , আজ নিস৷ আমার , আমাদের হয়ে ওঠার নষ্ট হয়ে যাওয়া সময়ে এ -ও তো শেখালেন আমায় একজন সদ্যপরিচিত মানুষ --- ছোটোদের উপর ভরসা রাখতে হয়৷ তরুণদের উপরেই ভরসা রাখতে হয়৷ এই তো আমার শিক্ষক নবারুণ৷

    কী তুমুল পরিশ্রমে ২০০৩ -এর বইমেলায় মালসাটের প্রকাশ৷ সে বছরই বইমেলায় বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ফিসফাস জারি --- নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে এই বই৷ ভাষা ব্যবহার , ভাষার প্রয়োগ৷ আমরা উত্সাহিত হব না নিরুত্সাহিত বোঝার আগেই নবারুণদার উচ্চারণ --- তবুও তো কিছু একটা হবে --- কী বলিস ! আমাদের উত্সাহের পারদ মুহূর্তে চড়ে গেল দশ গুণ৷ কিন্ত্ত বিক্রির এ কী হাল ! যে উপন্যাস পড়ে , যে উপন্যাস প্রকাশ করতে করতে আমরা ভেবেছিলাম কেয়া দিয়া , বইমেলায় প্রথম ৫ দিনে টেনেটুনে ৫০ কপি৷ আমরা এ বার নিজেদের ভবিষ্যত্ ও দূরদৃষ্টি নিয়ে যথেষ্ট সন্দিগ্ধ৷ নবারুণদা কেয়ারই করছেন না এ সব৷ পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছেন স্টলে৷ শিশুর মতো হাসছেন হা হা করে৷ মাঝে মধ্যে চোখ টিপে বলছেন --- আরে ৫০০ ছেপেছিস তো --- বিক্রি না হলে আমিই নিয়ে নেব৷ মাস দুয়েক দ্যাখ না৷ আমরা দেখছি --- এক জন আকাদেমি , নরসিংহ দাস , কালিদাস সম্মান পাওয়া লেখক এ সব বলেন , বলতে পারেন , এই ভাবে ভরসা জোগান ছোটো প্রকাশককে৷ এই ভাবে ! দেখলাম৷ সত্যিই দেখলাম বইমেলা শেষ হয়ে যাবার পর মার্চের তৃতীয় সন্তাহ থেকে৷ দেখলাম বাংলা উপন্যাসের বিক্রির গল্পকথাকে৷ যা এত দিন শুনে এসেছি প্রবীণ প্রকাশকদের কাছে৷ যা নাকি পাঁচ বা ছয় দশকে ছিল৷ সেই দেখা এখনও দেখছি৷ ওই যে , সহযাত্রী নবারুণ ভট্টাচার্য! যিনি কোনও প্রাতিষ্ঠানিকতার ধার না ধরে নিয়েই একটা প্রতিষ্ঠান৷ আর শেখালেন৷ লেখক ও প্রকাশক সহযাত্রী৷ কাঁধে কাঁধ রেখে চলতে হয়৷ তবেই রাইফেল থেকে গুলি ছিটকে বেরোয়৷ নইলে ব্যাকফায়ার হয়ে যাবার চান্স থাকে খুব৷ পাখির চোখ এ ক্ষেত্রে একটা৷ কিন্ত্ত লক্ষ্যভেদ দু’জনের৷ শেখালেন --- সহযাত্রী নবারুণ৷

    ২০০৯৷ জলস্রোত বয়ে চলেছে আঙুলের ফাঁক দিয়ে৷ মধ্যিখানের ছয় -সাত বছরে সন্তর্ষি আর নবারুণ ভট্টাচার্য এক অপূর্ব মিথোজীবিতায় আশ্লিষ্ট৷ এর মধ্যিখানে নবারুণদার আয়োজন ‘ভাষাবন্ধন ’ প্রকাশনের৷ পত্রিকা তো ছিলই৷ এ বার প্রকাশন৷ খুব সত্যি বলছি , মনে মনে প্রমাদ গুনেছিলাম৷ শঙ্কিত হয়েছিলাম৷ একটু দুঃখও কি পাইনি কোথাও ? পেয়েছিলাম তো৷ নিশ্চিত পেয়েছিলাম৷ ভেবেছিলাম লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য এ বার তাঁর নিজস্ব প্রকাশনের৷ এ -ও জানি আড়ালে থাকা অনেক কালীচরণ হেসেওছিলেন মুচকি মুচকি৷ দ্যাখ্ কেমন লাগে ! তা দেখলাম৷ সত্যিই দেখলাম এক জন নতুন নবারুণ ভট্টাচার্যকে , যিনি এক লহমায় ২৯ বছরের ছোটো একজন মানুষের কাছে ছাত্র হয়ে যান প্রকাশনার প্রথম পাঠ নিতে৷ দ্বিধাবিভক্ত আমার মনকে ফোন করে বলেন --- ‘সৌরভ এই কয়েকটা ব্যাপার , এই বিভিন্ন কাগজের ফারাক , এই ছাপা বাঁধাইয়ের উনিশবিশগুলো একটু বলে দিবি আমাদের৷ ’ প্রণাম করারও সুযোগ পাই না , শুধু বিস্ময়ে হাঁ হয়ে থাকি এই অপূর্ব মানুষটির দিকে৷ আমার সন্দেহজনক মনকে কাঁচকলা দেখিয়ে সন্তর্ষি’র হাতে তুলে দেন টাটকা নতুন বই--- বেবি K পারিজাত৷ নিজেকে ক্রমাগত থাপ্পড় মারা ছাড়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না আমার৷ আর এই বয়সে এসে নবারুণদা ক্রমাগত শিখে চলেন প্রকাশনার প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় পাঠ , মগজ আর মেধার যুগলবন্দিতে প্রকাশ করে ফেলেন নিখঁুত সব প্রযোজনা৷ আমি পুনর্মূষিক ভবঃ হই৷ ‘ভাষাবন্ধন ’-এর বই হাতে নেড়েচেড়ে বাধ্য ছাত্রের মতো শিখতে চাই প্রকাশনার কৃত্কৌশল৷ শেখান ছাত্র ও শিক্ষক নবারুণ৷

    সেই ২০০১ আর এই ২০১৪৷ মাঝখানে জলস্রোতের মতো সময়৷ আমার সামনে তিন জন নবারুণ ভট্টাচার্য৷ তিন জন ফ্যাতাড়ু৷ শিক্ষক -সহযাত্রী -ছাত্র৷ তিন জনই ফিস ফিস করে আমায় বলছেন --- পরিত্রাণের উপায় নাই ! ফ্যাঁত ফ্যাঁত সাঁই সাঁই৷ আমি উড়ে যাব৷ তিন জনের সঙ্গেই …

    ছবি : সুযাত্র ঘোষ




    ড্রপসিন ওরা নামাবে নামাক

    অমন একটা আস্ত আগ্নেয়গিরি যাঁর ভিতর , তাকে কী পোড়াবে সামান্য একটা বৈদ্যুতিক চুল্লি ? ফুঃ ! লিখছেন সুপ্রতিম রায়

    ‘আমরা হুড়োহুড়ি করছি , গুঁতোগুঁতি করছি , দেদার বকে যাচ্ছি , এবং দৌড়চ্ছি৷ প্রকৃতপক্ষে আমরা বসে আছি শুধু একটা নাড়াচাড়ার ওপর৷ আমরা , মানে কমিউনিস্ট শিল্পীরা ’ - ঋত্বিক ঘটক, অন দ্য কালচারাল ফ্রন্টস্বভাবতই ভারতীয় ‘বাবু’ কমিউনিস্টরা এ সব সমালোচনা নিতে পারল না এবং ঋত্বিককে বহিষ্কার করল পার্টি থেকে৷ ভাগ্যিস৷ বামপন্থা যদি উদার হয় তবে কমিউনিস্টরা এত গোঁড়া হয় কী করে জানা নেই৷ ঋত্বিকের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম ; ‘প্রাগৈতিহাসিক ’, ‘ছিনিয়ে খায়নি কেন ’-র জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও পার্টির চক্ষুশূল হন৷ না চাইলেও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ এসেই যায় এর কারণ কি শুধুই আমাদের পূর্বের নাটক ‘প্রাগৈতিহাসিক ’ হওয়ার কারণ ! ‘প্রাগৈতিহাসিক ’ থেকে ‘ফ্যাতাড়ুর কিস্ সা ’৷

    শুধু কি সাব -অল্টার্নদের জীবন টানছে আমায় ? উত্তর কলকাতার প্রকৃত মধ্যবিত্ত পরিবার , বাংলা মিডিয়ামে পড়া এই আমি , যাদের ‘হাই ’, ‘হ্যালো ’র পর তিন নম্বর ইংরাজি শব্দ বলতে চারবার কোঁত্ গিলতে হয় তাদের ‘না পাওয়ার রঙ ’, কী রকম হয় তা নিয়ে আকাশকুসুম ভাবার দরকার পড়ে না৷ রকে , চা -আড্ডায় , নেশার ঠেকে ফ্যাতাড়ুদের আমরা চিনি৷ ফ্যাতাড়ু জীবনযাপন বোঝার জন্য ত্যাগী হয়ে আমাদের সংসার থেকে আলাদা হতে হয় না৷ বুঝতে পারি ফ্যাতাড়ুদের নিয়ে নাটক না করাটা যেন আমাদের মতো মানুষদের একটা ক্ষমাহীন অপরাধ৷

    এই সময়টাতে ফ্যাতাড়ুদের দরকার , ঠিক যেমন কয়েক বছর আগে মনে হয়েছিল এই ঝাঁ চক্ চকে মঞ্চতে এই মুহূর্তে ভিখুকে দরকার৷ প্রাগৈতিহাসিক , ফ্যাতাড়ুর কিস্ সা - বুঝি যোগ আছে , মিল আছে - অন্তর্ঘাত ! বোধোদয় হয় , আসলে নেতারা মূর্খ ছিলেন না , ছিলেন অতিবুদ্ধিমান৷ যে গল্প মননে অন্তর্ঘাত ঘটায় সে সাহিত্য কোনও রেজিমেন্টেড পার্টি সহ্য করতে পারে না৷ আমার নাটকে ফ্যাতাড়ুদের আগে মানিকের ভিখু সেই অন্তর্ঘাতটা ঘটায়৷ এটা আমার একান্তই কূট মস্তিষ্কের ভাবনা যে এই সময়ে দাঁড়িয়ে অন্তর্ঘাতহীন শিল্পের খুব একটা মানে দাঁড়ায় না৷

    নাটকের প্রথম খসড়া শেষ , এবার ক্যাপ্টেনকে ফ্যাতাড়ুর কিস্ সা নাটকটি পড়ানো ও আলোচনার পালা৷ নাটকের খসড়া বদলাতে থাকে৷ এর মাঝে এমনও ঘটে অসুস্থতার জন্য আগের দিনের কথাবার্তা নবারুণদা সব ভুলে গেছেন , আবার গোড়া থেকে শুরু৷ নিজে হাতে খসড়া এডিট --- কমরেড নবারুণদা৷ এক দিন আড্ডাচ্ছলে বললেন ‘শোন আমি লিখছি পলিটিক্যাল কন্সাসনেস থেকে কন্সাসলি , তুই নাটকটা বানাচ্ছিস পলিটিক্যাল কন্সাসনেস থেকে কন্সাসলি৷ কিন্ত্ত একটা কথা মাথায় রাখবি যে ফ্যাতাড়ুরা কিন্ত্ত মারিগেল্লা পড়েনি ’৷ এর মাঝে ঘটে চলেছে রাজনৈতিক -সাংস্কৃতিক ডামাডোল খিচুড়ি ও কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি৷ খসড়া অবশেষে শেষ হয়৷ নবারুণদা নাটকটা শুনলেন , শুনে বললেন ‘সে তো হল , কিন্ত্ত করবি কোথায় ? হল তো দেবে না তোকে৷ ’ আমাদের মতো দলের যা হয় , আর্থিক কারণে মহলা খুব ধীরে ধীরে৷ আমার মনে তখন ফ্যাতাড়ুদের ওড়বার দৃশ্যভাবনা৷ নবারুণের ফ্যাতাড়ুরা উড়বে , মানে ? ওড়া মানে তো মাটিতে পা না পড়া , ওড়া মানে তো বাজপাখির মতো ওপর থেকে নজর করা , ওড়া মানে তো নজরবন্দি করা গোটা একটা শহরকে৷ ফ্যাতাড়ুরাও ওড়ে , চিল চড়াইও ওড়ে , বোলতাও ওড়ে , চামচিকেও ওড়ে , যুদ্ধবিমানও ওড়ে৷ অবশেষে আমাদের ফ্যাতাড়ু ওড়ে৷ এর মাঝেমাঝে রাতের বেলা ফোন , রোঁয়াফোলানো হুলোবেড়ালের চাপা গোঙানির মতো স্বর ‘কীরে ? কত দূর ? কবে করবি নাটকটা?’ আমার উত্তর ‘ইয়ে ...মানে একটু টাইম লাগবে এখনও ’৷ ‘ধ্যুস্ ৷ তা হলে আর লড়বি কবে ? নামা নামা জমিয়ে নামা৷ এক্কেবারে ** মেরে দে **দের ’৷

    গত ২ সেপ্টেম্বর ফ্যাতাড়ুর কিস্ সা ’র প্রথম শো৷ নবারুণদা মঞ্চে উঠে বলেন ‘বোঝা যাচ্ছে ফ্যাতাড়ুরা মঞ্চে , পর্দায় আসছে , তাদের আটকানো যাচ্ছে না ’৷ আমার ভয় হতে থাকে ফ্যাতাড়ুরা শুধু মঞ্চে , পর্দাতেই আটকে থাকবে না তো ! বুঝলাম তিনি যথেষ্ট খুশি - চার্জড্ ৷ অনেক কথার পর যেটা প্রাপ্য সেটা হল নবারুণদা একটা প্রস্তাব দিল ‘তোদের রিহার্সাল কবে কবে হয় ? আমি কয়েক দিন রিহার্সালে যাবো৷ নাটকের কয়েকটা মুহূর্ত নিয়ে আমার কিছু ভাবনা আছে সেটা ওখানেই বলব ’৷ তার পরে আর এক প্রস্তাব ‘আচ্ছা শোন্ , এ বার এই নাটকটা নিয়ে এমন অডিয়েন্সের কাছে যেতে হবে যেখানে তারা আমার টেক্সটের সঙ্গে পরিচিত নয় আর তোর নাটক সম্পর্কেও তারা জানে না৷ সেখানকার লোকেদের ফিডব্যাকটা ইম্ পরটেন্ট৷ আমিও যাব , যদি শরীরটা ঠিক থাকে ’৷ কিন্তু সেই শরীর ঠিকটাই কাল হল৷ মারণ অসুখ ‘পৃথিবীর শেষ কমিউনিষ্ট ’এর শরীরের অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে চলেছে৷ নবারুণদার ভবিষ্যত্বাণী সত্যি হল , ফ্যাতাড়ুর কিস্ সা কলকাতার হলের মুখাপেক্ষী হয়ে প্রায় এক বছর শীতঘুমে চলে গেল৷ নবারুণদা বলেছিলেন গোটা চারেক শো -এর পর আবার দেখবেন নাটকটা৷ ১১ অগষ্ট শিশির মঞ্চে ফ্যাতাড়ুর কিস্ সা ’র পঞ্চম অভিনয়৷ ফ্যাতাড়ুরা উড়বে , ড্যামেজ করবে , বাওয়াল করবে কিন্ত্ত কন্ডাক্টর আসবেন না আর৷

    বাদল সরকার নেই , নবারুণ ভট্টাচার্য চলে গেলেন৷ সাংস্কৃতিক ভাবে অনাথ বোধ করছি খুব৷ ঋত্বিক , নবারুণরা পুড়লে ব্রহ্মান্ড ছাই হয়৷ এখন নবারুণ পুড়ছে৷ ছাই-ধোঁয়া হয়ে শহরের বাতাসে মিশছে নবারুণ বিষ৷ নবারুণ পুড়ছে৷ একাডেমি , নন্দনের পর্দায় , কলেজ স্ট্রিটের বইগুলোর পাতায় , শপিং মলের কাচে লেগে থাকছে চাবুকের দাগ৷ মোছা যাচ্ছে না৷ নবারুণ পুড়ছে৷ শিল্পী -বুদ্ধিজীবীদের গালে লেগে থাকছে পাঁচ আঙুলের ছাপ , লুকানো যাচ্ছে না৷ নবারুণ পুড়ছে৷ হে কলকাতা এই সময়ের বাংলার শেষ পিপল্ স রাইটার -এর ছাই-ধোঁয়া বিষ হয়ে তোমার বাতাসে মিশছে --- এবার সামলাও হুজ্জুত৷ আমার শুভেচ্ছা রইল৷

    সারা দিন নবারুণদার কাছে কাছেই ছিলাম , শুধু শ্মশানে আর যাইনি৷ কারণ আমি বিশ্বাস করি একটা মানুষ দু-দু’বার পুড়তে পারেনা৷ হ্যাঁ, নবারুণদাকে পুড়তে দেখেছি ভাষাবন্ধনের ঐ চেয়ারটায় বসে , দেখেছি বাড়ির ঐ সোফাটায় বসে নবারুণদা পুড়ছে৷ যার ভিতরে একটা আস্ত আগ্নেয়গিরি তাকে কিনা পুড়িয়ে দেবে ঐ পুরসভার সামান্য একটা বৈদ্যুতিক চুল্লি ?! – ফুঃ !
  • /\ | 127.194.215.167 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৪644853


  • একটা নক্ষত্র মেঘলা আকাশে , এই প্রবল শ্রাবণেও

    ■ কমল চক্রবর্তী

    বহু আগেই নবারুণ টের পায় , আমাদের খেল খতম ৷ ফলে , ভিড় থেকে , তথাকথিত বাণিজ্য পত্রিকা এবং ছাপাভুবন থেকে দূরে ৷ লোভ , আকাঙ্খাহীন , নির্জন ৷

    হ্যাঁ, আমরা ‘বাপ্পা ’, ডাকতাম৷ কারণ একটা হয়েছিল ! আমাদের শহর জামশেদপুরে , তখন বিজন ভট্টাচার্যের নাটক , ‘দেবীগর্জন ’, ‘লাশ ঘুইরা যাউক ’, ‘গর্ভবতী জননী ’, ‘জবান বন্দী ’ পর পর , অভিনীত৷ প্রদীপ চক্রবর্তী , অরিন্দম দাশগুন্তের পরিচালনায় , খুবই জনপ্রিয়৷ আমার যেমন ধারা , লগে লগে থাকা৷ ওই ওদের সঙ্গে সঙ্গে৷ যদ্দূর মনে পড়ে , জগুবাবুর বাজারে , বিজন ভট্টাচার্য৷ এবং সিঁড়ির পাশে , বড়ো জোর দশ বাই দশ৷ খুপচি৷ যতটা বিজনদার শুয়ে থাকার সাড়ে তিন হাত ! ওই দেবালয়ে , ‘বাপ্পা ’৷ একটু কুড়ির কাছাকাছি৷ জাগ্রত অথচ কম কথার৷ ওষুধ , খাবার , এই সবই নীরবে৷ দেবদূত প্রতিম তাকে সেই শুরু৷

    ১৯৪৮ , তেসরা জুন৷ ৩১ অগস্ট , ২০১৪৷ শেষ কথা বিনায়ক সেনের মুক্তি উপলক্ষে , ইউনিভার্সিটিতে৷ আরও অনেকের সঙ্গে , নবারুণ৷ নবারুণ , সে দিনও যথারীতি আদর্শ জর্জরিত , নিখাদ , অনির্বাণ৷ বিনায়কের জন্য তার অবিচলিত কথা শুনতে শুনতে ফের কি মনে পড়েছিল , ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না ’৷

    কোনও দলদাস ছিলেন না৷ আমাদের ব্যথিত চরিত্র , আমাদের লোভ এবং অস্তিত্ব বিপন্নতা বার বার , স্বপ্নহীন , চরিত্রহীন , ধূসর করেছে৷ এ বার বাপ্পা , তার বাবার ওই দশ বাই দশের নীরব , মুক্তো সন্ধানী , এক বিজন -বালক ! বিজনদার ডাক , অনমনীয় প্রভূত , সে অবশ্যই পুরোটা৷ ফলে , চরিত্রে বামপন্থী হলেও কলঙ্কিত নয়৷ পরিচ্ছন্ন , তার সঙ্গে পরবর্তী দেখাশুনোগুলি , বইমেলায় , কখনও চা অবধি৷ কথা হত৷ মৃদু, অনুচ্চারিত হাসি ও টুকরো টুকরো বাক্য৷ ভালোবাসা অফুরন্ত৷ খোচা খোচা দাড়ি , উজ্জ্বল চোখ , ‘নবারুণ ’, তার নাম কে রেখেছিলেন , বিজন ভট্টাচার্য না মহাশ্বেতা দেবী ?--- কী লিখছ ? চায়ে চুমুক! কিছু না , শুধু ভিড়৷

    ‘অনেকেই জানেন যে প্রকৃত স্পিরিচুয়ালিস্টরা ঠিক দুপুরে বা গভীর রাতে , অতিরিক্ত ঠান্ডায় বা গ্রীষ্মে কিংবা ঝড় , বৃষ্টি , বাজ পড়ার সময় অপরলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করা পছন্দ করেন না কারণ এ রকম সময় ভূত -প্রেতই বেশি আসে৷ মুক্ত আত্মারা প্রায় আসে না বললেই চলে৷ কিন্ত্ত কে শোনে কার কথা৷ তা ছাড়া হারবার্টের তখন থামার সময় ছিল না৷ ’এই অসামান্য , তার৷ তার সিগনেচার৷ আজ যখন বাংলা ভাষা , হ্যাঁ, সিগনেচারহীন , ধূসর , ম্যাড়ম্যাড়ে , পাশুটে , অন্ধ লাগা , ডেঙ্গুলাগা , ন্যাবালাগা চেতনা , হায় , তাকে ! ওঃ , বাপ্পা ! ওঃ , আমার চেতনার নির্মম আদরগুলি , ‘দশ বাই দশ ’ জগুবাজার মনস্ক এক অদম্য , যন্ত্রণা এবং নির্মাণের একক যাত্রা৷ তা হলে , বাপ্পা কি ভিতরে ভিতরে , শৈশবেই , ঝরাপাতা কুড়োন ! তার বস্তা বোঝাই পাতাগুলি , গলিঘঁুচি থেকে , নর্দমা , আস্তাকুড় থেকে , ঝরা !ইতিমধ্যে অধ্যাপিকা , প্রণতি , তার৷ বাড়িঘর , স্বাস্থ্য , ডালের বাটি , সোপকেস৷ প্রণতি কতটা ! কারণ , নবারুণ প্রত্যহ খুঁজে পাচ্ছে , বিলা , ভোগে , ছেতরে , বাওয়াল ... কী অবলীলায় এক অতিমানবিক , অমুদ্রণযোগ্য , আশ্চর্য জগত্৷ যেখানে লঘুগুরু, নেই৷ নেই শব্দের তথাকথিত সাহিত্যিক ধরতাই৷ তার প্রয়োজনে , সমস্ত৷ যতটা আমাদের৷ আমাদের উচ্চবর্ণের উন্নাসিকতা , ‘ব্রাহ্ম মানসিকতা ’, ওঃ বাপ্পা ! গুরু৷

    তোমাকে বহুত্ মিস করছি ! তুমি আমাদের জীবনের , আমরা যারা তত্সম , তদ্ভব , ভুবনের নয় , তাদের আদর্শ৷ মনে পড়ে , এক বার তোমাকে নিয়ে শঙ্খ ঘোষের প্রতিবেদন৷ তোমার মতোই একরোখা , প্রভূত , বিশাল হবার কথা , হাজার হাজার গদ্যকার , স্বপ্নে৷ নবারুণ ! জানি হয় না৷ নবারুণ এক দূরতম দ্বীপ৷ কত তরুণ , হালাল ঝাণ্ডা , অন্ধ বেড়াল , ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক ও অন্যান্য , যুদ্ধপরিস্থিতি , খেলা নগর , কাঙাল মালসাট , হারবার্ট, বইমেলায় , শুধু ওই কিনেই৷ হ্যাঁ, নবারুণের সঙ্গে দেখা , তার ‘ভাষাবন্ধন ’ পত্রিকার , কপি , সংগ্রহ৷ কারণ নবারুণ , দয়া করেও ভিড়ে যায়নি৷ কারণ সে নিজে একটা প্রতিষ্ঠান৷ এবং কখনও মনে হয়েছে , সে , বর্তমান বাংলা ভাষার হালহাকিকত্ চাল চলন , হাগামোতা , গর্ভ, বিয়োনো খবর রাখত না৷ কারণ তার আত্মিক জন্ম , জগুবাবু বাজারের দশ বাই দশ , সিঁড়ির নিচের এক পূজা -বেদিতে৷ সময় -পুরোহিতের অতি বর্ণময় , বাপ্পা ! যার ছেলের নাম , ‘তথাগত ’৷ মা , মহাশ্বেতা৷ কাকা -দাদু, ঋত্বিক ঘটক৷ মহাশ্বেতার বাবা , মানে দাদু, মণীশ ঘটক! বাবা বিজন ভট্টাচার্য, ‘ঈশ্বর কই পালাও ? কইলকাতায় কত মজা !’ ‘রাইত কত হইল ’! ভাবা যায় , শিক্ষা , জীবন , বোধ , মর্মবাণী , পথ , পথিক , প্রতি দিন৷ ঈর্ষণীয় যাত্রা ! তবে বাপ্পা একাকিত্বের , রাজা ! বিজন বিহারী !বাপ্পা , জন্মে দেখছে , ক্রন্দনশীল এক মহানগরের ইতিকথা মুঠোয় , মা , বাবা ! দেখছে , ‘শিক্ষক ’, ‘শিক্ষিকা ’ গৃহে৷ পিঠের ঝোলায় সে , মা , ঝাঁসির পথে পথে৷ এক বাঙালি মা৷ ‘কবি বন্ধ্যঘটির জীবনী ’ উদ্ধারকারী এক ঈশ্বর-প্রতিম -মা৷ হ্যাঁ, তবে , সে , নবারুণ , না ! তবে কাঙাল মালসাট৷ আরও ফেলে দেওয়া , হারিয়ে যাওয়া ভুবনের অক্ষর -মালা ! নিবিড়৷ বাপ্পা , একটু ভুগছিল৷ সে বার , বলল না৷ অগ্ন্যাশয়ে , মারণ৷ বাপ্পা , ভুগছিল , কারণ বাবা , মা , যে দেশের জন্য , মাটির জন্য , তা ক্রমে অর্থহীন ! হয়তো ! বাপ্পা , ভুগছিল , একটা ধূসর , লেপ্টে , ঘেটে একাকার পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র , বিষণ্ণ ! ক্রম -অপস্রিয়মাণ বিশ্বাস , অভিযান , নিবেদন , স্বপ্নকুঞ্জ!--- চল একটু চা ! এত ধুলো , ভিড় , কথার শিল্পী -মোহর , ওঃ ! তা ছাড়া , নবারুণ , সরে যাচ্ছে৷ জনজীবনের মেনস্ট্রিম থেকে , হারবার্টে৷ কতটা তার , কতটা বানানো ! কতটা অনিবার্য গল্প না ইতিহাস বা তথ্যচিত্র , ওই মালসাট৷

    ‘নীচে মেথর এসে বালতির বরফগলা রক্তগোলা জল নিয়ে গিয়ে নর্দমাতে ঢালল৷ বোতল , কাটলেটের হাড় , মরা আরশোলা , ব্লেড , সিগারেটের টুকরো , ছাই --- সব ফেলল৷ বাকি রামটুকু চুক করে মেরে দিল৷ ঘর ধোয়া হল৷ ’‘পশ্চিমে এর আগে , সূর্য লাট খাওয়ার মনোমুগ্ধকর রক্তিমাভা মেঘে মেঘে মমতা বিস্তার করেছিল৷ পাশেই যে জলাভূমি তার পেছনে রেললাইন এবং মাঠ দিয়ে ওয়াগনব্রেকাররা ছিল হরিণের মতো ধাবমান৷ ’বহু দিন আগেই নবারুণ টের পায় , আমাদের খেল খতম৷ ফলে , ভিড় থেকে , তথাকথিত বাণিজ্য পত্রিকা এবং ছাপাভুবন থেকে দূরে৷ লোভ , আকাঙ্খাহীন , নির্জন৷ যারা তাকে , আকাদেমি বা বঙ্কিম এবং আর যা যা , তিনি উল্টেও দেখেননি ! বরং প্রতিবাদে ফেরত৷ উদাসীনতা তার৷ এত প্রগাঢ় , বিমূর্ত ও খানিক ! তেজোদ্দীন্ত তাকে , দশ বাই দশ , ওই অবহেলিত গৃহ থেকে , আঁজলা ভরে , জেদ , ভালোবাসা , একাকিত্ব , এক অমানবিক নিসঙ্গতা৷ অথচ , বিন্দাস৷ যেমন অগ্ন্যাশয় আশ্রিত মৃত্যুকে তু তু ডেকে , ক্যানসার ছুঁড়ে ! হ্যাঁ, এতটাই ! ক্যানসার , --- তাকে এই নাও৷

    বোম্বে৷ ব্যথাতুর প্রিয়জন ! তবু এক উদাসীন পথিকের এই দায়হীন , একক যাত্রা৷ কোনও প্রচার পত্রিকা , বাণিজ্য পত্র , সরকারি ঘাঁতঘোঁত , নবারুণের বিষয় , না ! যদিও প্রায় দু’যুগ সোভিয়েত দেশের দন্তরে৷ এবং সোভিয়েত৷ তবু সেই সোনালি বর্ণমালার কোনও অধিকার বোধ , প্রাভদা প্রকাশনী , না৷

    বাপ্পা , চিনতাম কম ! কারণ , প্রায়ই সমস্ত তাসই লুকনো৷ --- ভাষাবন্ধনে , কবিতা পাঠাও !--- হুঁ৷

    কটাই বা মানুষ ! ফুলগুলো সরাও আমার লাগছে ! আসলে , এই আট ন ’টি গ্রন্থও তিনি সযত্নে সরিয়ে রাখতেন৷ প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নয় ! এ তো বঙ্গজীবনের অঙ্গ ! ‘প্রতিষ্ঠান ’ অজ্ঞতা ! কারণ , জেদে বিজন ভট্টাচার্য, মননে ঋত্বিক ঘটক, বিন্যাসে মহাশ্বেতা , এক স্বরচিত প্রতিষ্ঠান৷

    ‘এবং সন্ধ্যায় ছাদে সে অবসন্ন ও আধা -অজ্ঞান হয়ে পড়ে৷ সে সময় আকাশে সন্তর্ষি, মৃগশিরা , কোয়াসার , পালসার , ব্ল্যাকহোল , হোয়াইট ডোয়ার্ফ, রেড জায়েন্ট --- সব শালাই ছিল৷ ’ হ্যাঁ, একটা নক্ষত্র মেঘলা আকাশেও৷ এই প্রবল শ্রাবণে !

    প্রতিকৃতি : কৃষ্ণেন্দু চাকী৷

    ==========================================================================



    নপুংসকতার ক্যানসার থেকে আমরা মুক্তি পাব নবারুণ ?

    ■ অনিল আচার্য

    তিক্ত , বিরক্ত , ক্রুদ্ধ ও অসহায় এক কথাশিল্পী তোড়ে খিস্তি করছে , কেন না এই বাস্তবতা তাঁর কাছে অসহ্য এবং ঘৃণার ৷ ৷

    ‘নবারুণ , তোমার মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম এস এম এস -এ৷ তোমার এক জন নিয়মিত পাঠক খবর পাঠাল , ‘৩১ জুলাই বিকেল চারটে কুড়ি মিনিটে আজ বৃহস্পতিবার নবারুণদা মারা গেলেন৷ ’ কোনও মানুষই অমর নয় , ফলে এই মৃত্যুও স্বাভাবিক৷ আমরা জানতাম অগ্ন্যাশয়ে ক্যানসারে ভুগছো তুমি এবং তীব্র যন্ত্রণায় এই অসুখে বাঁচা খুবই কঠিন৷ তবু এর -ই মধ্যে তুমি ‘ভাষাবন্ধন ’ পত্রিকার জন্য ভাবছিলে৷ কিন্ত্ত কী আশ্চর্য, তোমার মৃত্যুর পর তোমার সেই প্রবাদপ্রতিম কবিতা , ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না ’ আর এক বার পড়ে ফেললাম৷ অনেক দিন হল দেখা হয়নি৷ সেই দু-বছর আগে শারদীয় অনুষ্টুপে লেখার সুবাদে এসেছিলে৷ তুমি এখন সেলিব্রিটি লেখক৷ এখন তোমার অনেক ভক্ত পাঠক , যাঁরা বয়সে তরুণ হয়তো , সেই সত্তরের কবিতা তেমন করে পড়বে না , যেমন করে আমরা তোমার সমবয়সীরা পড়েছিলাম৷ তারা হয়তো তোমারই কবিতা পড়ছে তোমার অলটার -ইগো কবি পুরন্দর ভাট -এর বয়ানে , মজাও পাচ্ছে খুব৷ তারা হয়তো তোমার সাবভার্সিভ টেক্সট-এর ভক্ত৷ তিক্ত , বিরক্ত , ক্রুদ্ধ ও অসহায় এক কথাশিল্পী তোড়ে খিস্তি করছে , কেন না এই বাস্তবতা তাঁর কাছে অসহ্য এবং ঘৃণার৷ হঠাত্ কোথা থেকে দুঃস্বপ্নে বিজন ভট্টাচার্য আমাকে সেই ডায়ালগ আবার শোনালেন , ‘রাইত কত হইল , উত্তর মেলে না ? কইলকাতা … আহা কী বীভত্স মজা৷ ’ আসলে ‘কাঙাল মালসাট ’, ফ্যাতাড়ুদের সেই বীভত্স মজা৷ সব শৃঙ্খলা ও জাতীয় উত্সবের ভণ্ডামিকে খিস্তি করা , ভদ্র মুখোশ ভেঙে চুরমার করার এই টেক্সট বাংলায় এক নতুন ঘরানার জন্ম দিয়েছিল যা ঘটক-বিজন সমন্বয়ের এক যৌথ যৌতুকই হয়তো বা৷

    তোমার শবদেহের মিছিলে বা শ্মশানে আমি যাইনি , কারণ তোমার কর্কট রোগ শারীরিক , আর আমরা এই সময় যে নপুংসকতার ক্যানসারে ভুগছি , তার থেকে মুক্তি হবে কি ? আর এখন বলতে ইচ্ছে করে তোমার সত্তরের কবিতার পঙ্ক্তি --- ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না / এ -জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ তোমার দেশ না / এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না / এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না৷ ’ তুমি ঠিক সেই নবারুণই ছিলে , শেষ দিন পর্যন্ত৷ আমি অন্তত তাই জানি৷ তোমার কবিতার বইয়ে তুমি লিখেছিলে ‘…যে আধিপত্যের রাজনীতি আজ অপ্রতিরোধ্য অসত্যতায় পরিণত হয়েছে , তার চাপে অন্য অনেক মানুষের মতো আমারও অবস্থা নাজেহাল ’--- যে কথা আজ ২০১৪ -তে আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি৷ শিল্প সাহিত্য সিনেমা নাটক -এর লোকজন রোমান স্টাইলে ক্রীতদাস বাজারে বিক্রি হচ্ছে৷ ভিড় করছে ক্ষমতালোভী ও অর্থলোভী কবি ও শিল্পীরা৷ তোমাকে সে বাজারে কেউ দ্যাখেনি৷ অথচ তুমি চাইলে অনেক কিছুই তো পেতে পারতে , কেন চাইলে না , নবারুণ ? মনে হয় তোমার ভিতরের প্রতিবাদী -সত্তা তোমাকে বিবেকহীন ও লোভী হতে দেয়নি৷ তুমি কবিতায় সে কথা সরবে ঘোষণা করেছিলে --- ‘যখন জানি মৃত্যু ভালবাসা ছাড়া কিছু নয় / আমাকে হত্যা করলে / বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাবে / আমার বিনাশ নেই ’৷ তোমার ‘শেষ ইচ্ছে ’ কবিতায় সেই দিনগুলোতেও তুমি তো আজকের বাস্তবতার কথা ভেবেই যেন বলেছিলে --- ‘আমি মরে গেলে / আমি শব্দ দিয়ে সে বাড়িটা তৈরি করেছি / সেটা কান্নায় ভেঙে পড়বে / তাতে অবাক হবার কিছু নেই৷ ’ তোমার ভাষায় বলি , কুখ্যাত কিছু ‘ক্যালানে ক্রীতদাস ’-এর মতো আমি তোমার শেষ যাত্রাকে কলুষিত করিনি , নীরবে শ্রদ্ধা জানিয়েছি , এক পত্রিকার সম্পাদক ও সহযাত্রী হিসেবে৷

    আমাদের বয়সী , আমাদের চাইতে সামান্য বড়ো বা ছোটো , যারা ষাট থেকে সত্তরের মধ্যে কিশোর বা যুবক ছিল , তারা একে একে চলে যাচ্ছে৷ কেউ শয্যাশায়ী , কেউ সব ছেড়ে বিবাগী৷ এ সব ভাবতেও কেমন বিষণ্ণ লাগে৷ শুধু আমি নই , বয়স্ক মানুষরা আজ বিষাদ -ব্যাধিতে আক্রান্ত৷ কিন্ত্ত অনুষ্টুপের সত্তরের সেই দিনগুলোতে আমরা কী উত্সাহে কাজ করেছি৷ রঞ্জিত সাহা , সাহানা , কল্যাণ মাইতি , প্রবীর এবং অবশ্যই দীপেন্দুদা৷ রঞ্জিত ও সাহানা রাত জেগে প্রুফ দেখত৷ এক বার পুলক মারাত্মক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আমার বাড়িতে ছিল৷ সাহানা রাত জেগে তার সেবা করেছে৷ আসলে এটাও ছিল পত্রিকা করার অঙ্গ৷ কল্যাণ মাইতি ছিল আমাদের মধ্যে তরুণতর৷ সে ভালো আঁকতে পারত , অনুষ্টুপের বেশ কয়েকটি প্রচ্ছদ তাঁরই করা৷ পরবর্তীকালে সে সুন্দর বাংলায় Good Bye, Mr. Chips অনুবাদ করেছিল কথাশিল্পের অবনী রায়ের উত্সাহে৷ বঙ্গবাসী কলেজিয়েট স্কুলের ইংরেজির প্রিয় শিক্ষক কল্যাণ মাইতি সেরিব্রাল অ্যাটাকে আজ এক যুগেরও বেশি শয্যাশায়ী৷ তাঁর স্ত্রী সুমনা মাইতি তার সেবাযত্নের কোনও খামতি রাখেনি , দিনরাত স্বামী -সেবা করেছে , যা আজকের দিনে হয়তো বিরল৷ দু-তিন বছর হল সে -ও ব্লাড -ক্যানসারে হঠাত্ই মারা গেল৷ নানা কাজে ব্যস্ত থাকার ফলে খবর রাখা কঠিন হয়ে পড়ে৷ ফলে বিবেকের পীড়া অনুভব করি৷ এই তো হয় , দীর্ঘকালীন শয্যাশায়ী অসহায় মানুষকে ক্রমশ এক ধরনের অবহেলার শিকার হতে হয় , এ কথা তো সবাই জানেন৷

    এখন সে কথা ভাবলে কেমন বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে মন৷ বিধান ছাত্রাবাস থেকে রঞ্জিত সাহা বয়সে বড়ো হলেও আমার ঐকান্তিক বন্ধু৷ সে কবিতা লিখতে বদ্ধপরিকর ছিল , কিন্ত্ত আমি জানতাম রবীন্দ্রগানটা সে ভালোই গাইত৷ গীতবিতান থেকে সে ও তাঁর স্ত্রী অনুরাধা পাশ করেছিল৷ রঞ্জিত বরাহনগরে ভিক্টোরিয়া স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক ছিল , পরে গান শিখত সুবিনয় রায় -এর কাছে৷ অনুরাধা প্রথমে সুদূর কালনা ও পরে ব্যান্ডেলে একটি স্কুলে পড়াত৷ অনুরাধার কণ্ঠে ‘থাকতে দে না , আপন মনে আমায় থাকতে দে না ’ পল কক্সের ‘কলকাতা ’ শীর্ষক ডক্যুমেন্টারিতে বিধৃত হয়েছে , যেমন হয়েছে পীযূষকান্তির ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে ’৷ পীযূষকান্তি অকস্মাত্ প্রয়াত হয়েছেন৷ ব্লাড সুগারের আক্রমণে কিডনি বিপর্যস্ত হওয়ায় রঞ্জিতের স্ত্রী সুগায়িকা অনুরাধাও আর নেই৷ তার অনেক আগে থেকেই প্রায় বছর তিরিশেক রঞ্জিতের সঙ্গে অনুষ্টুপের সম্পর্ক ছিন্ন৷ অথচ আমরা ছিলাম পরম বন্ধু৷ শুনেছি , এখন সে জগত্ সংসার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেকে অর্গলবদ্ধ করে চরম একাকিত্বে নিজেকে নির্বাসিত করেছে৷

    এত সব বিষাদময় ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে চারপাশে৷ কত জনকে যে একে -একে হারিয়েছি যারা এক সময় ছিল অত্যন্ত আপনজন , তা ভাবলে সম্পাদকের কঠোর মন বেদনমথিত হয়ে ওঠে৷ কিন্ত্ত ব্যক্তি -আমি ও সম্পাদক -আমি এই চরম বৈপরীত্যের সংঘাতে সম্পাদক -আমি ক্ষত -বিক্ষত হয়েও কী ভাবে বেঁচে আছে এই অর্ধ শতাব্দী ধরে সেই ট্রাজেডি বিবৃত করা আমার সাধ্যাতীত৷
  • /\ | 127.194.215.167 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৯644855


  • জেগে থাকার স্বপ্ন

    ‘ভাষাবন্ধন ’-এর শেষ সংখ্যার প্রচ্ছদের আদল হঠাত্ই লাল রঙে মুড়ে দিয়েছিলেন নবারুণ৷ লিখেছিলেন এমন এক সম্পাদকীয় , যেন এপিটাফ৷ লিখছেন সুমন্ত মুখোপাধ্যায়৷

    ছোটো কাগজ যে সাহিত্য ব্যবসার সিঁড়ি হতে পারে না , সে যে একটা রাজনীতি , একটা অবস্থান , তিন হাত দাঁড়াবার জায়গা --- সেই কথাটা বর্ষার নালায় আধুলির মতো এক দিন হারিয়ে গেল ৷ ব্যাপারটা নবারুণ জানতেন ৷

    নবারুণ ভট্টাচার্য একটা স্বপ্ন দেখাতেন৷ স্বপ্নটা বিপ্লবের৷ বিশাল তার কলকব্জা , আমাদের সামনে আছে , পিছনে আছে , সব জায়গায় আছে৷ ঠিক কবে আর কখন যে গা ঝাড়া দিয়ে ছুটে আসবে সে , আর ফেটে পড়বে চতুর্দিকে --- হারবার্ট সরকারের মতো আমরাও কেউ তা জানি না৷ যেখানে যত বিপ্লবের গল্প , আয়োজন আর ইতিহাস --- নবারুণ মন দিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন৷ এক বার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন : বিপ্লবটা আমার কাছে একটা প্রত্যক্ষ প্রয়োজনীয়তা৷

    বলেছিলেন শিশুমৃত্যু , অপুষ্টি আর অনাহারের কথা৷ পেরুর রাস্তায় অস্ট্রিয়ার কবি এরিক ফ্রিয়েট দেখেন বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়ে এক শিশু , ঘায়ে পচে মরে যাচ্ছে৷ চিত্কার করছে৷ দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে সারা গা থেকে৷ নবারুণ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এরিকের লেখার কথা : যেহেতু ওর শিরদাঁড়াটা বাঁকিয়ে দিয়েছে , যেহেতু ওর চিত্কার থামছে না , যেহেতু ওর পচা গন্ধ ছুটছে চতুর্দিকে , যেহেতু ও এত দুর্বল আর ঠিক তাই বাঁচবে না , সেই কারণেই যার দোষ সেই সিস্টেমও বাঁচবে না ! ---বলেছিলেন নবারুণ এই ভাবেই বাস্তবটাকে দেখতে দেখতে লেখক বিপ্লবের পথে গিয়ে দাঁড়ায়৷ তাই বিপ্লব অনেকখানি ফাঁকা সময় জুড়ে রাস্তাঘাট থেকে কুড়িয়ে নিতে থাকে ইস্তেহার৷ ‘বিপ্লব একটা প্রজেক্ট ’৷ একটা স্বপ্ন৷ এক সম্ভাবনা৷

    ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ‘ওয়ান ওয়ে স্ট্রিট ’-এর এক টুকরোয় লেখেন মস্ত এক যন্ত্রের কথা৷ যার সামনে সাদামাটা লোক হাঁ করে তাকিয়ে থাকে৷ যেমন একটা স্টিম ইঞ্জিন , অফসেট যন্ত্র, অথবা টিভি সেটের ভেতরের মালমশলা ! যে কাজ জানে সে জানে কোথায় এক ফোঁটা তেল দিয়ে চাপ দিতে হবে লিভারে৷ অথবা জুড়ে দিতে হবে তার৷ নবারুণ ঠিক এ ভাবেই ওঁর স্বপ্নটাকে জানতেন৷ জানতেন এক এক করে ঘুমিয়ে পড়বে মানুষ৷ কিন্ত্ত স্বপ্ন জেগে বসে থাকবে৷ ওঁর সমস্ত কথা , চিন্তা , কাজ আর লেখা একটা সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য৷ ঠিক এইখান থেকেই দু’হাজার তিন সালের গোড়ায় নবারুণ শুরু করেন ‘ভাষাবন্ধন ’ মাসিক সাহিত্য পত্রিকা৷ দশ বছর পর দু’হাজার তেরো সালে তা হয়ে দাঁড়ায় ত্রৈমাসিক৷ দাম খুব কম৷ এখনও তার বাত্সরিক গ্রাহক চাঁদা : দেড়শো টাকা !পারি কমিউনের পরে , পারি শহরের প্ল্যান অনেকটা বদলানোর চেষ্টা করা হয়৷ সমান্তরাল আর যুক্ত সব রাস্তার কথা ভাবা হয়৷ না , সৌন্দর্যের কারণে নয় , কমিউনের সময় মস্ত ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ব্যারিকেড৷ নবারুণের অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল নাগরিক বিপ্লবের নানা মডেল , গেরিলা ওয়ারফেয়ার৷ আর ঠিক ব্যারিকেড -এর কথা মাথায় রেখেই শুরু হয়েছিল ‘ভাষাবন্ধন ’৷ এখানে ভাষাগুলোর নিজস্ব বন্ধনের থেকেও জরুরি একটা প্রতিরোধ তৈরি করা৷ ভাষা দিয়ে শব্দ দিয়ে লড়াই --- বাজারি সাহিত্য রুচির বিরুদ্ধে৷ সেই স্বপ্নেরই অংশ হিসেবে৷

    দু’হাজার তিন সালে , বাংলার সাহিত্যরুচিতে যে সব সাহিত্য পত্রিকা প্রায় -নবজাগরণ এনেছিল তাদের একটির পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়৷ উদযাপনে হাজির ছিলেন সারা ভারতের সাহিত্যিকেরা৷ বাংলা ছোটো কাগজের বাঘের চামড়া কিন্ত্ত তত দিনে খসে গিয়েছে৷ শুধু একটি নয় , এই নতুন সহস্রাব্দের গোড়ায় বাংলা ছোটো কাগজগুলো দেখলে দিশেহারা লাগবে৷ তার কোনও রাজনীতি নেই , লক্ষ্য নেই , পরিকল্পনা নেই ! তিনশো চারশো কখনও পাঁচশো টাকা দামের ঢাউস সংখ্যাগুলো সংকলন ছাড়া কিছু নয়৷ পুরনো নামকরা ছোটো কাগজ পুরনো নামকরা বড়ো লেখকদের নিয়ে ‘এই শেষ ’ সংখ্যা করে চলেছেন৷ কখনও সম্পাদকের গুণে সংগ্রহযোগ্য কিন্ত্ত কখনওই পথ চেয়ে বসে থাকবার মতো নয়৷ ছোটো কাগজ যে কখনওই সাহিত্য ব্যবসার সিঁড়ি হতে পারে না , সে যে একটা রাজনীতি , একটা অবস্থান , একটা চিন্তাসূত্র, তিন হাত দাঁড়াবার জায়গা --- সেই কথাটা বর্ষার নালায় আধুলির মতো এক দিন হারিয়ে গেল৷ ব্যাপারটা নবারুণ জানতেন৷ তাই ‘ভাষাবন্ধন ’-এর কথা তাঁকে ভাবতে হয়েছিল৷ ভাবতে হয়েছিল প্রকাশনার কথা৷

    এটা সুনিশ্চিত যে কাগজটা কখনওই ‘Tel quel’-এর মতো জাত বিদ্রোহী তাত্ত্বিকতার মুখপত্র নয়৷ তত্ত্বের শুকনো চর্চায় ওঁর মন ছিল না৷ ‘কৃত্তিবাস ’ বা আরও আরও পত্রিকার মতো ‘তরুণ কবিদের মুখপত্র ’ বা অভিনব গল্প উপন্যাসের পরীক্ষাগারও নয়৷ ‘বারোমাস ’, ‘এক্ষণ ’, ‘অনুষ্টুপ ’ বা ‘ধ্রুবপদ ’-এর মতো জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র হয়ে ওঠাও ভাষাবন্ধনের লক্ষ্য ছিল না৷ ‘ভাষাবন্ধন ’ সাধারণ ছোটো কাগজের মতো ‘প্রথম সংখ্যা থেকেই দেখিয়ে দেব ’--- ভাব নিয়ে আসেনি৷ এখানে একটা চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করা ছিল নবারুণের লক্ষ্য৷ একে একে এই পরিসরে অনেক সময় ধরে আসবে যারা তারা জেগে থাকাকে সমর্থন করবে৷ আর ছিল প্রশ্ন তৈরি করা৷ যেমন করেছিলেন নবপর্যায়ের প্রথম সংখ্যার ভূমিকায়৷ জর্জ লুই বোর্হেস -কে নিয়ে লিখতে গিয়ে সম্পাদক জানাচ্ছেন যে জুন্টাকে সমর্থন করা বোর্হেস কখনও জানতেই চাননি টর্চার চেম্বারে কতখানি চিত্কার জমে আছে বিপ্লবী তরুণদের৷ তাঁর সাহিত্যের কোনও বিচার কী ভাবে করব আমরা ? লিখছেন : আমরা চাই প্রশ্নগুলো উঠুক৷ স্থিতাবস্থায় অভ্যস্ত , তথ্যের ভিড়ে নাজেহাল , প্রচারিত মিথ্যার বিষে অবশ মনগুলো ভাবুক বাছাই করতে শিখুক, সেরে উঠুক৷ সাহিত্যের প্রেক্ষিতেই এই কথাগুলো উচ্চারিত হল৷

    একটা সম্পূর্ণ গুলিয়ে যাওয়া সাহিত্যরুচির সামনে এসে দাঁড়িয়ে নবারুণকে শুরু করতে হচ্ছিল অনেকটা পেছিয়ে গিয়ে৷ উনিশশো ষাট , সত্তর অথবা আশির ছোটো পত্রিকাগুলোর এই সমস্যা ছিল না৷ তাঁরা অনেকেই ঠিক করে নিতেন কাকে লেখা বলে আর কাকে নয়৷ একটা স্পষ্ট ভাগ ছিল , ভালো হোক আর মন্দ হোক , একটা কোনও অবস্থান তৈরি করা ঢের সহজ ছিল৷ নয়ের দশক থেকে ব্যাপারটা গুলিয়ে যায়৷ এই হারিয়ে যাওয়া অংশটাকেই চেপে ধরতে চেয়েছিলেন নবারুণ৷ ভালো ভালো লেখা জোগাড় করে ছাপা তাঁর কাজ ছিল না৷ তাঁর লক্ষ্য ছিল এক বৈপ্লবিক জনরুচি৷ কাঙাল মালসাটের কায়দায়৷ এক প্রায় অপঠিত বক্তৃতায় তিনি লিখেছিলেন --- এটা খুব তিক্ত ভাবে অনুভব করেছিলেন চে গুয়েভারা৷ তিনি বলেছিলেন মানুষকে খাওয়ানো পরানো যদি একমাত্র সমস্যা হয় , তা হলে একটা নব্য পুঁঁজিবাদ তৈরি করলেই তো হবে৷ তা হলে ভারত সরকার চাইলে চা -বাগানে অনাহারে মৃত্যু আটকাতে পারত না ? আমাদের রাজ্য সরকার পারত না ? …কিন্ত্ত না , খাবারটা পৌঁছনো যাচ্ছে না৷ খাবার আছে --- রেস্টুরেন্টে আছে , গোডাউনে আছে , বাজারে আছে , দোকানে আছে৷ এটা করা যায় , কিন্ত্ত যেটা করা যায় না সেটা হল --- নতুন মানুষ তৈরির প্রশ্ন এবং পুরোটাকে জড়িয়ে ভাবার প্রশ্ন৷

    এই নতুন সাহিত্যরুচির তাগিদেই ‘ভাষাবন্ধন ’ দন্তরে হাজির হওয়া যে কোনও মানুষকেই প্রশ্ন করতেন নবারুণ : ভালো নতুন বই কী পড়লি ? লিখতে বলতেন বুক রিভিউ , বাংলা গল্প কবিতা বা উপন্যাস নয় , সেখানে অনেক বেশি জোর পড়ত ‘আলোর মিছিল ’, বা ‘অলিন্দ ’ অংশে৷ যেখানে থাকতেন বিশ্বসাহিত্যের দিক্পালেরা আর তাঁদের কাজ৷ এই সমস্ত খণ্ড টুকরোকে শেষ পর্যন্ত কবিতার মতো এক একটা ভূমিকায় বেঁধে ফেলতেন সম্পাদক৷ সব মিলিয়ে দেখা দিচ্ছিল একটা ব্যারিকেড৷ যার ভিতর একে একে নেমে আসছিলেন ভাস্কর চক্রবর্তী বা অনন্য রায়৷ অনেক প্রান্তিক মানুষ৷ এমির কুস্ত্তরিকা নবারুণের অন্যতম প্রিয় সিনেমা পরিচালক৷ প্রায় সেই আদলেই একটা আন্ডারগ্রাউন্ড বানিয়েছিলেন নবারুণ৷ সাদা কালোয় যেখানে মৃত মানুষ জেগে উঠে কথা বলে !সত্যিকারের একটা রাজনীতি তৈরি হতে অনেকটা সময় লাগে৷ শেষ সংখ্যা ভাষাবন্ধন হঠাত্ই প্রচ্ছদের আদল ভেবে লাল রঙে মুড়ে দিয়েছিলেন নবারুণ৷ লিখেছিলেন এমন এক সম্পাদকীয় যাকে মনে হতে পারে এপিটাফ৷ ছোটো এক অফিসঘরে ছোট্টো এই দশ বছরে , নবারুণ একটা কাজ করছিলেন৷ একজন অ্যাক্টিভিস্ট -এর কাজ৷ লিখেছিলেন : সব থেকে যেটা ভয়ঙ্কর সেটা হচ্ছে Self-estrangement! আমার তো একটা সম্ভাবনা আছে৷ আমি হয়তো লিখতে পারতাম ভালো , কিন্ত্ত আমি তার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি ! এই যে একটা Plethora of Problems, এই যে সমাজকে বিকৃত করছে এই সমাজটাকে পাল্টাবার স্বপ্নটাই বিপ্লবের স্বপ্ন৷

    সেই স্বপ্ন এখনও ভাষাবন্ধন অফিসে জেগে আছে৷ টেবিলে নতুন সংখ্যার সম্পাদকীয় লেখা বাকি৷ পেছনে দেওয়াল জোড়া ভ্যান গখ৷

    ==========================================================================



    কাঠকয়লার সাতরঙা কবিতা

    কয়েকটি শব্দ এবং সংযোজক শব্দবন্ধ ছাড়া এই লেখাটি নবারুণ ভট্টাচার্যের প্রকাশিত কবিতার একটি কোলাজ৷ ফলে লেখাটি নবারুণ ভট্টাচার্যের৷ আমি একজন অতন্ত্র পাঠকের ভূমিকা পালন করেছি মাত্র৷

    লেখো বিপ্ পরা বিপ্লবী আর হামবাগ সংগ্রামীদের আমরা হাফপ্যান্ট আর ইয়ো -ইয়ো উপহার দিয়ে থাকি ৷ দেওয়ালে দেওয়ালে লেখো --- আমরা একক র্যাডিকাল৷ মলোটভ ককটেলের ফর্মুলা , লটকে দাও পাটা মাইনের ডিটেইলড্ ডিজাইন৷

    নির্ভীক এক নিশান উড়ছে , …নির্জন৷ কোনও হাত তোকে ধরে আছে কি না সে জানে না৷ কোনও হাত তাকে ধরে রাখতে এগিয়ে আসবে কি না সে জানতে চায় না৷ সে উড়তে জানে৷ উড়ে থাকতে জানে৷ জানে তার সংগ্রহে আছে অকিঞ্চিত্কর কিছু ছায়াপথ৷ টিভির পর্দার মতো পক্ষীহীন নীলাভ আকাশ৷ সে জানে একটা পাখি মরে গেলে কতটা আকাশ ফুরিয়ে যায়৷ জানে মেঘেদের কোনও হাসপাতাল নেই --- অথচ বেঁচে থাকার একটা অলৌকিক আয়না রয়েচে . সে এক শূন্যতার প্রতিশব্দ৷ কাউকে মুক্তি দেবার দায়িত্ব তার নয় , অনেক চেষ্টা করেও তারাদের জ্বর সে সারাতে পারেনি৷ তবু, অস্তিত্বের একটা নীল আলো আছে৷ প্রজাপতি চলে যাবার পরেও তার আলো রং থাকে স্থির , বোঝা যায় প্রতিটি বীজের মধ্যে রয়েছে গাছের উল্লাস৷ ঘড়ির বাইরের সময় সে দেখেছে৷ সে দেখেছে ফটোগ্রাফের উল্টো দিকের সাদা রং৷ সে জানে গলায় শান্ত দড়ি বেঁধে বালতি রোজ কুড়োতে ঝাঁপ দেয় , যাকে ঝলসে সাদা হাত যায় বাল্ব৷ যে দেশের রাত্রি বারুদের মতো ছোঁয়া যায় , যে দেশের বুভুক্ষু মানুষ বালি , রোদ্দুর , লোহা , লরির চাকা , মৃত্যু খেয়ে ফেলে তার আকাশে কী ভাবে সূর্য হাতের শিরা কেটে আকাশ লাল করে তলিয়ে যায় রোজ৷ সে ওড়ে আর ভাবে হঠাত্ জমে যাওয়া নির্বাক স্বচ্ছ ফোয়ারার গায়ে আঁকা ছবিগুলো কী ভাবে নিঝুম স্বপ্ন হয়ে উঠছে৷ বুঝতে পারে যখন সমুদ্র অপেক্ষা করছে নৌকোর , যখন নৌকো অপেক্ষা করছে নদীর তখন শরীরে যে ভাবে ছুরি ঢুকে যায় --- ইঁদুর মারা তুঁতে নীল কী ভাবে মিশে যাচ্ছে আকাশে৷ সে বোঝে মরা মাছেরা শীতকাতুরে নয়৷ জানে কেমন লাগে অক্সিজেনের অভাব তবু নিরুত্তাপ সে৷ সে জানে মানুষের অনেক আগে পাখি ও প্রজাপতিরা চাঁদে গিয়েছিল৷ ‘তুমি কি শুনতে পাও ’--- আমি প্রশ্ন করি৷ সার্চলাইটের ঝলসানো আলোয় স্থির দৃষ্টি রেখে সে দেখতে পায় ছাই হয়ে যাচ্ছে চেজ ম্যানহাটন ব্যাঙ্ক , চিলি , রোডেশিয়া , দক্ষিণ কোরিয়ার কারখানা৷ চিত্কার করছে ফ্যাকাশে মানুষ , সামনে হস্তমৈথুনের পর বিমর্ষ দেবদূত হাতে বেঁকা ছুরি ধারালো চাঁদ হয়ে ঝলসে উঠছে রাতের তারায় , আর রাত একটা কালো পুলিশভ্যান যার লুকিং গ্লাসের ভেতর ভেসে উঠছে মরা বেড়ালেরা , দখল জুট মিল , হেরে যাওয়া স্টেডিয়াম , জিততে থাকা মহানগর , রক্তমাখা গ্রাম , উপড়ে ফেলা শহিদ বেদী --- নীচে গড়াগড়ি খাচ্ছে ফারাও আর তার চাকরদের মমি যাদের বুকে ঝলমল করছে গণহত্যার মেডেল৷ নির্নিমেষ সে দেখে চলে ফাঁকা একটা অ্যাম্বুলেন্স পাক খাচ্ছে একটা উদ্ভট শহরে , চালকের আসনে একটা ক্লাউন , তার টায়ার আঁকড়ে আছে অনাথ আশ্রমের শেষ প্রার্থনা , রাস্তায় গড়াচ্ছে জ্বলন্ত হেডলাইট চাকা , ছেঁড়া ডানলোপিলো৷ ও দিকে কবিতার পাতার মতো টিকিট ওড়াতে ওড়াতে মাঠের মধ্যে দিয়ে চলে যাচ্ছে ট্রাম৷ স্টিমার ঘাটায় ভিড় করছে ভয় অথচ পকেটে একটা বিড়ি নিয়েই অসম্ভব খুশি হচ্ছে পোর্টশ্রমিকেরা যাদের মধ্যে চিকচিক করে উঠছে একটা নদী৷ মৃত খরগোশকে কাশফুল ভেবে ভুল করছে প্রজাপতিরা , চোখের মতো দেখতে গাছের পাতায় রাংতা টুকরো টুকরো করে তবুও তারা উড়িয়ে দিচ্ছে রোদ্দুর৷ রাতের আকাশে দেশান্তরী হাঁসেরা ঠোঁটে করে নিয়ে চলেছে মায়াবী লণ্ঠন আর নিচে রাস্তা পার হচ্ছে একটা পিঁপড়ে৷ নির্বিকার এই উড়ে চলা তোমার ভালো লাগে ? কীসের জন্য , কাদের জন্য তোমার এই স্থিত অস্থিরতা ? ‘বল , অন্তত আমাকে একান্তে গোপনে বল৷ ’ সে নিরুত্তর৷ তার ছায়া ঘনীভূত হয়ে এক আশ্চর্য কবন্ধের আকার নেয় , সেই ছায়া বলে ওঠে --- ফিসফিস করার সময় এটা নয়৷ এখনও অন্ধকারে তুতলে উঠছে ইনস্যাস , ৯ এম এম , এল এমজি৷ যারা ফেরার , লোপাট , যারা অন্ধকারে জন্মেছে৷ যারা হেরে যাওয়া স্ট্রাইক , বিধ্বস্ত ব্যারিকেড , শ্রমিক বস্তির পুড়ে যাওয়া ছাইয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে৷ যে সব শিশুরা ছোটো ছোটো মোমবাতির মতো জ্বলে যাচ্ছে৷ ওই যে তিন পা ’ওলা কুকুর , এক পা নিয়ে যুদ্ধে লড়া মানুষ , যে কাটা হাতে এখনও বেড়ে উঠছে নখ তাদের চিত্কার করে বল --- যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় তাকে আমরা ঘৃণা করি৷ যে শিক্ষক , বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানি প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না ঘৃণা করি আমরা তাদের৷ বল --- রাত্রিদিন ইন্টারোগেশন আর থ্যাতলানো নখের মধ্যে ছুঁচ ফুটিয়ে নুন দেবার পরও অসম্ভব আনন্দ হচ্ছিল আমাদের৷ আমরা শব্দ করিনি৷ স্পষ্ট ঘোষণা কর --- তিরিশ হাজার লাশের দিব্যি আমাদের হত্যা করলে বাংলার সব কটা মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে পড়তে আমরা এখনও প্রস্ত্তত৷ জানিয়ে দাও কাঁধের উপর সূর্য ডোবা আর মাথার উপর সূর্যোদয় অবধি লড়াই জারি থাকবে৷ কারণ স্বপ্নের হাত আমরা দেখেছি , তাকে গড়ে তুলতে হলে ভেঙেচুরে ফেলতে হবে ঘুম৷ ভীষণ দুঃখের রাতের হাতও দেখেছি , তার সকাল আসছে৷ যখন পিঠ পিছিয়ে যাচ্ছে দেওয়ালের দিকে , যখন দেওয়াল এগিয়ে আসছে ক্রমশ৷ যখন ধরে নেওয়া হচ্ছে সবটাই অবশ্যম্ভাবী , পূর্ব নির্ধারিত তখন চিত্কার করে উঠতে হবে৷ আমৃত্যু রেখে যেতে হবে প্রতিবাদ৷ চেঁচিয়ে বলতে হবে --- এ যদি সমাজ হয় , আমরা তবে সমাজবিরোধী৷ মনে করিয়ে দেওয়া ভালো --- আমরা ছোটো ছোটো দল এক হলে , আমাদের জার্সির ফালিগুলো জুড়লে দেখা দেবে ক্ষ্যাপা বাউলের সেই আশ্চর্য জোব্বা যা দেখে জোনাকির আলোয় ঝলসে যাবে লক্ষ্যমুগ্ধ স্নাইপারের চোখ৷ ভেঙে পড়বে স্যানিটারি পার্লামেন্ট , সাম্রাজ্যবাদী ক্যাবারে৷ যারা লাথি মারে ইতিহাস তাদের মুছে ফেলে৷ যারা লাথি খায় তারাই হাত মুঠো করে উঠে দাঁড়ায়৷ খোলা চিঠি দিয়ে জানায় --- আমাদের হারানোর বলতে আছে হীনমন্যতা , আমিত্ব , নিজেকে না চিনতে পারা৷ জানাও চোখে চোখ , চশমায় চশমা ঠেকিয়ে যদি কেউ ভিক্ষা দেবার ধৃষ্টতা দেখাতে চায় , আমরাও ছিনিয়ে নেবার মতো সাহসী হতে জানি৷ প্রত্যেককে বল নিজেদের সেই হাতের উপর বিশ্বাস রাখতে যে হাত হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তারাদের মেডেল বানায়৷ মনে রাখতে হবে --- যে লেখা , যে স্লোগান , যে কবিতা বুড়ো আর কুকুরদের সামনে আগুন হয়ে জ্বলে উঠতে পারে না , তাদের পুড়িয়ে দেওয়াই ভালো৷ তার জন্য যদি লিরিকের গলায় পা রাখতে হয় বা পোস্টারের জিভে যক্ষারোগীর কফ চাটতে হয় তা হলেও অসুবিধে নেই৷ কারণ প্রথিতযশা গান্ডু হবার থেকে অপমানিত রেবেল হওয়া ভালো যাদের ফাটা চশমায় ছড়িয়ে পড়ে দূর নক্ষত্রের বিস্ফোরণের আলো৷ নোটিশ দিয়ে জানাও --- মৃত যে ডাক্তারেরা এখনও ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ায় তাদের নিবিড় সম্মোহক সৃষ্টি ও কর্তব্যপরায়ণতার জন্য আমরা জয়ধ্বনি দিচ্ছি৷ বাতিল স্টিমরোলারদের কাছে শুনে নিচ্ছি একটা নতুন রাস্তা বানাবার গল্প৷ আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি কালো পতাকা , মর্গের রোদ্দুর , কোণের বিকেল , মরচে পড়া ব্লেড আর বার বার পাতা ওল্টানো একটা বই৷ আমরা রাস্তার বাচ্চাদের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছি শব্দ , আপেল আর বিস্কুট৷ পুলিশ ভ্যানগুলোকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে স্কুলবাসে পরিণত করার প্রস্তাব আনছি আমরা৷ চিঠি ফেলার বাক্সের মধ্যে সযত্নে আগলে রাখছি চড়ুইদের বাসা৷ চোখ ওপড়ানো মানুষদের জন্যে আমরা বুনে রাখছি আঙুল দিয়ে ছুঁতে পারার গান৷ বহুতল বাড়ির মধ্যে আটকে পড়া ফড়িং আর প্রজাপতিদের বেরোতে দেওয়ার জন্য পাথর ছুঁড়ে ভেঙে দিচ্ছি বোবা আর দুর্বোধ্য দামি কাচ৷ ঠান্ডা জলের তলায় মাছেদের জ্বর হলে তাদের মাথায় জলের পট্টি বুলিয়ে চলেছি আর এ সব করবার জন্যে একটা ছোট্টো শহরে গিয়ে যে রেকর্ড বা প্যারাম্বুলেটর বিক্রি করতে হতে পারে বা ডাকাতি করতে হতে পারে বাচ্চাদের খেলনা ট্রেনে বা বাসে , এ কথাও বলে রাখছি সকলকে৷ আমরা জানি যারা বোমা ফেলে উড়িয়ে দিচ্ছে হাত তারাই নকল হাতের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে হেসে৷ আমরা জানতে চাইছি --- ক্যানো হত্যাকারী অপেক্ষায় আছে জেনেও প্রতিরোধহীন ঘুমিয়ে পড়ছে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ? গরিবরা ক্যানো বুঝতে পারছে না তাদের নিয়ে কেউ ক্যানো লিখতে চাইছে না একটা কবিতা ? ক্যানো তারা গুলিয়ে ফেলছে তাদের পাশে লোকনাথ না লেনিন ? কেন হামাস্, বরানগর , লালগড় বললেই কথা ঘুরিয়ে নিচ্ছে ভদ্দরলোকেরা ! আর কে তখন হয়ে উঠছে আমাদের আশ্রয় ! কে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে দেওয়ালের সামনে , বলছে --- পেচ্ছাপ করো নেতাদের মুখে৷ লেখো --- আমরা স্মৃতি নিংড়ে বেঁচে থাকা জাঙিয়া -ওয়ার্ডরোব -পর্দার আড়ালে নিশ্বাস নিইনি কোনও দিন৷ লেখো বিপ্ পরা বিপ্লবী আর হামবাগ সংগ্রামীদের আমরা হাফপ্যান্ট আর ইয়ো -ইয়ো উপহার দিয়ে থাকি৷ দেওয়ালে দেওয়ালে লেখো --- আমরা একক র্যাডিকাল৷ মলোটভ ককটেলের ফর্মুলা , লটকে দাও পাটা মাইনের ডিটেইলড্ ডিজাইন৷ লেখো --- দুশো আশিটা লাশের বদলে দুটো লাশ ফেলতে হবে , ইচ্ছুকরা অ্যাপ্লাই করুন৷ আরও লেখো --- ম্যামথ স্নেহ , কালচার্ড কাম , ম্যানডেটরি মাস্টারবেশন আর বালের বামে আমরা বিশ্বাস করি না৷ লিখে দাও --- ঘূর্ণির ভিতরে যে জলপোকা ঘোরে তার ডানায় সাতরং পাক খেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আর সম্প্রচারিত হচ্ছে প্রতিটি রেডিও স্টেশন থেকে৷ প্রতিবেদন পাঠাও --- আমরা একরোখা ধাতবতায় বিশ্বাসী৷ আমরা ফাঁকা ফুটবল স্টেডিয়াম , বাতাসের হাসিমুখ ফটোগ্রাফ , হতভম্ব ঘুড়ি , ধর্মঘটের দিনের শহর , লোডশেডিংয়ের সময় টিভি -র পর্দা , এবং যারা বুলেটকে লিপস্টিক করেছে তাদের বিশ্বাস করি কিন্ত্ত অন্ধকার অবৈদ্যুতিক দাঁতউঁচু শহরের কালা হয়ে যাওয়া শব্দ আর থার্ডক্লাস নীরবতাকে বিশ্বাস করি না৷ দেওয়াল দখল করে লেখো --- পাওয়ার লুমের মৌনতা , থমকে থাকা কনভয় বেল্ট , ছাদভাঙা কোয়ার্টার , বেলিলিয়াস , হাইডরোড , দুর্গাপুরের গল্প কারণ পতন নিয়ে চিন্তিত থাকা ভালো , কেননা তার মধ্যে উত্থানের প্রতিশ্রীতি থাকে --- যেন রাতের ঝড়ে জেলে নৌকার আলো , এই নেই , এই দৃশ্যমান৷ মনে করিয়ে দাও --- মূক ও বধিরদের ইস্কুলের মতো নিস্তব্ধতায় নিজেদের বেঁচে থাকা ঘেন্না করতে হবে৷ পাঠানো S.O.S. আয়নায় ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলে অন্যের পাঠানো S.O.S পুনঃপ্রচার করাটা জরুরি৷ খবরের কাগজ যদি মুখ মোছার জন্য হয় , পুলিশের খাতা ব্যবহার করতে হবে রক্ত মুছে ফেলার জন্য৷ জানাও মিডিয়া একটি প্রাত্যহিক কফিন যেখানে মৃতের দূরদৃষ্টির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় … অবিচল একটি নিশান উড়ছে৷ তার গায়ে গায়ে ফুটে উঠছে লেখা --- তুমি কি পুকুরের পাশে মুখ বুজে ফুটতে পারবে রৌদ্রে বৃষ্টিতে অপমানিত দেশজ মাদকপাতার মতো ? যদি না পারো তুমি বিপ্লবের উত্তরাধিকারী নও৷ আর নিচে , অনেক অনেক নিচে আমাদের পৃথিবীর সব ক’টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ধুলো পড়া কাচে আঙুল বুলিয়ে কেউ লিখে চলেছে কাঠকয়লার সাতরঙা কবিতার সারি৷
    ■নবারুণ ভট্টাচার্যের প্রতিকৃতি: সুযাত্র ঘোষ
  • /\ | 127.194.215.167 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২১644856


  • ট্র্যাজিক ফ্যাতাড়ু , ম্যাজিক ফ্যাতাড়ু

    নবারুণ ভট্টাচার্য

    নানা টাইপের গলতাবাজি , জালি ও খজড়ামির যে ননস্টপ হর্রা চলেছে তার মধ্যে ঘ্যাম ঘ্যাম সব পাবলিক যখন ল্যাঙট পরে আখড়ায় নেমে পড়েছে তখন সোশ্যাল ল্যাডারের তলায় যারা কেঁচো -কেন্নোর মতো থাকে তারা জাঁদরেল স্নেকদের দেখাদেখি যে নিজেরাও নানা রকম ধান্দার মতলবে মশগুল হয়ে উঠবে , সেটা বলাই বাহুল্য৷ খেলাটার নাম যে সাপ -লুডো সেটা সবাই জেনে ফেলেছে৷ মই ধরতে পারলে তো কথাই নেই৷ সাপ হলেও চলবে৷ এই টাইমটার স্লোগান হল --- গপাগপ্, ঘপাঘপ্৷ এই ফলারের লোভ ও খিদে যে আমাদের অতিপরিচিত ডি এস -কেও তাতিয়ে তুলবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ আমাদের চেনা অন্য দু’জন ফ্যাতাড়ুর মধ্যে মদন ও পুরন্দর , সম্পূর্ণ অন্য কারণে এই ঝাঁকের কই হয়নি৷ পুরন্দর ভাট , একে ব্যর্থ কবি , তায় আবার এক্স -হাফ -নকশাল৷ সে এ সব নিয়ে মটকা ঘামায় না৷ ওদের লিডার মদন সবিশেষ বিচারবুদ্ধি ধরে এবং ভালো করেই জানে যে চার দিকে গজিয়ে ওঠা গ্যাঁজলা দেখে ব্রয়লারের দলে ভিড়ে গেলে কেব্ল ফল্ট ছাড়া কিছুই ভাগ্যে জুটবে না৷ প্লাস বেশি তেড়িবেড়ি করলে অতীব ক্ষমতাধর ফ্যাতাড়ু কমিউনিটি থেকে কাচি হয়ে ছাঁটমাল বনে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা এবং সেটা হলে আম , ছালা , হাঁড়ি , তবিল --- সবই ভোগে চলে যাবে৷ পুরন্দরের একটি রিসেন্ট কাব্যপ্রয়াসে এই ব্যাপারটাই মোলায়েম ও মোক্ষম স্টাইলে পাকড়াও হয়েছে৷

    ‘চারিধারে ঠগ ও ছেনালবুনিয়াছে শত মায়াজাল৷ ভিড়েছো কি তলাবে সদলেবরং বাঁচিতে যদি চাওভুলে যাও ধান্দার ভাওছিপে ছিপে টেনে যাও মালধিকিধিকি ঠুকে যাও তালভুলিও না বঙ্গবীর -বঙ্গবীরাঙ্গণাচারিধারে ঠগ ও ছেনালবুনিতেছে শত মায়াজাল৷ ’প্ল্যানটা আগেই ছকা ছিল৷ ডি এস -এর বউ ছেলেকে নিয়ে বর্ধমানে বাপের বাড়ি৷ মদন আর পুরন্দর সকাল সকাল ডি এস -এর বাড়ি পৌঁছে যাবে৷ তার পর দিনভর খানাপিনা মৌজমস্তি হবে৷ ফ্যাতাড়ুদের যেমন হামেশাই হয়ে থাকে৷ হাঁটতে হাঁটতে পুরন্দর বলল ------ একটা খবর তোমায় দিয়ে রাখি মদনদা৷ আমাদের পাড়ায় নাড়ু নামে একটা পাতাখোর টাইপের পাবলিক আচে , বুজলে ? সারা দিন স্টুডিও পাড়ায় ঘুরঘুর করে৷ দু-একটা ফিল্মে ক্রাউড সিনে নেমেওচে৷ ও -ই বলছিল কতাটা৷ --- কী ?--- ওই যে চিটফান্ডগুলো কেলিয়ে পড়েচে , সেই কারণে চল্লিশটার বেশি ছবি নাকি মায়ের ভোগে৷ একেবারে কান্নাকাটি পড়ে গেচে৷

    --- জোচ্চোরের বাড়ি ফলার খেতে গেলে এ রকমই হবে৷

    --- এক -এক সময় ভাবি মদনদা , ভুক্কাড় হলেও আমরা কিন্ত্ত ভালোই আচি৷ খাচ্চি কম , কিন্ত্ত কাউকে শালা ঠকাচ্চি না , কারও ভাত মারচি না৷

    --- সেই তো৷ ফ্যাতাড়ুরা কোনও জালির মধ্যে নেই৷ অথচ চাইলে আমরা লাখ লাখ টাকা হাতাতে পারি৷ ওভারনাইট৷

    --- কী ভাবে ?--- ভেরি ইজি৷ উড়ে উড়ে যাব৷ বড়ো বড়ো ফ্ল্যাটবাড়ির টঙে সব কোটিপতি থাকে৷ হয়তো মাল -ফাল খেয়ে নোট গুনতে গুনতে ঘুমিয়েই পড়ল৷ প্লাস হিরে , সোনা --- গয়নার বাক্স৷ সব হাতাতে পারলে এক রাত্তিরেই শালা রাজা৷ কিন্ত্ত করব না৷

    --- ফ্যাতাড়ুরা কি কিচুই ঝাড়ে না ?--- ওই টুকটাক, চপ -ফপ , দু-চারটে ভালো মালের বোতল , তা -ও ভেরি রেয়ার৷ মনে রাকবে , আমাদের আসলি কাজটা হল মালদারদের লাইফটা ক্যাঁচড়া করে ঘেঁটে দেওয়া৷ ঘেঁটে দাও , দিয়ে কেটে পড়৷ ড্যামেজ , ড্যামেজ৷

    --- আচ্ছা ডি এস -এর কী হয়েচে বলতো ?--- কেন ?--- সব সময় একটা মনমরা মনমরা ভাব৷ কাউকে আওয়াজ দিচ্চে না৷ হুলিয়া পাকাচ্চে না৷ সুইসাইড -ফুইসাইড না করে বসে৷ ডিপ্রেশন হলে লোকে আজকাল বেমক্কা ঝুলে পড়চে বা নিট ফলিডল মেরে দিচ্চে৷

    --- ও সব ভেব না৷ ডি এস যা তেঁটিয়া মাল ! ও করবে সুইসাইড ? পেঁয়াজ , তার পর গিয়ে তরকারিপাতির দামটা একটু পড়তে দাও৷ দেকবে মাল ফের খোলতাই হয়ে উটবে৷ তবু আমাদের উচিত ও ম্যাদা মেরে যাচ্চে দেকলেই একটু বুস্টার দিয়ে দেওয়া৷ এই বাংলা বাজারে কখন যে কী হয় কিছুই বলা যায় না৷ কেউ জানত সারদা বা রোজ ভ্যালি দাঁত কেলিয়ে চিতপটাং হয়ে যাবে ? ও সব গলতায় আবার মালকড়ি রাখোনি তো ?--- খেপেচ ! ঘর ভাড়া গুনতেই পাইন ফেটে দরজা হয়ে যাচ্চে৷

    --- তা যা বলেচ৷

    --- কী হবে বলো তো ?--- দ্যাকো ভায়া , তোমরা তো আবার কলি -ফলি মানো না৷ এ তো পহেলা ঝাঁকি হ্যায় , কাশী মথুরা বাকি হ্যায়৷ ঘুঘুচক্করের খেলা আরও জমবে৷ পুজোটা ভালোয় ভালোয় কাটলে হয়৷

    ডি এস -এর একতলা বাড়ির দরজায় পৌঁছে মদন আর পুরন্দর তাজ্জব হলে গেল৷ নড়বড়ে দরজার উপরে গজাল দিয়ে একটা কালো টিন লাগানো যেটা কস্মিনকালেও ছিল না৷ তার উপরে ত্যাড়াব্যাঁকা করে হলদে রং দিয়ে লেখা ,‘জগদম্বা স্পোর্টিং ক্লাব ’দরজার ও পারে বিকট জোরে এফ এম -এ রেডিও মির্চি বাজছে৷ তত্সহ নাক ডাকার আওয়াজ৷ দরজাটা ঠেলতেই ক্যাঁ করে শব্দ করে খুলে গেল৷ ঘরে বাল্ব জ্বলছে৷ ডি এস , সবুজ আবীর মাখা , লুঙ্গি পরে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে৷ ভাঙাচোরা একটা রেডিও তারস্বরে বেজে চলেছে৷ ঘরের কোণে তড়কার ভাঁড়৷ আধখাওয়া রুটির টুকরো৷ খালি পাঁইটের বোতল৷ শালপাতা৷ বিস্তর পিঁপড়ে৷ ডি এস ঘুমের মধ্যেই কুঁচকি চুলকোল৷ তার পর আঁউ আঁউ করে কী সব বিড়বিড় করতে লাগল৷ মুখে আলতো হাসি৷ পুরন্দর বলল ------ ডিলিরিয়াম হচ্চে৷

    --- হওয়াচ্চি ডিলিরিয়াম৷

    এক টুকরো কাগজ পাকিয়ে ডি এস -এর নাকে সুড়সুড়ি দিল মদন৷ খিক খিক করে হেসে উঠে ডি এস -এর ঘুমটা ভেঙে গেল৷ ধড়মড়িয়ে উঠে বসল৷ --- অ্যাঁঃ কে ? কে ?--- কে এ বার ভালো করে বুজবে৷ অলরেডি তো একটা পাঁইট সাঁটিয়ে দিয়েচ৷

    --- না , না , অল্প একটু ছিল৷ সকালে মেরে দিলুম৷

    --- তা এখন তা হলে আর খাবে না !--- খাব না মানে ? এখন তো বেশি করে খাব৷ ছ ’লাখ টাকার মালিকরা সকাল থেকে মাল খায়৷ অবশ্য তোমাদের মতো ফালতু লোম্বা এ সব জানবে কী করে ?--- ছ ’লাখ টাকা কার ?--- কার আবার ? আমার৷

    --- মানে সিক্স লাখস ?--- ইয়েস৷

    --- ব্যাঙ্ক ডাকাতদের দলে ভিড়েচ নাকি ?--- নো৷

    --- তবে ?--- ন্যায়্য পথে ছ ’লাখ টাকা কামিয়ে ফেলেচি বলতে পার৷ যদিও হাতে আসেনি৷

    --- বুজলাম না !--- রোসো৷ মুতে এসে বুজিয়ে দিচ্চি৷

    --- যাও৷

    পুরন্দর ঘাবড়ে গিয়েছে৷

    --- ব্যাটা নিঘ্ঘাত্ লটারি -ফটারি মেরে দিয়েচে৷

    --- ওকে তো জন্মেও লটারির টিকিট কাটতে দেকিনি !--- তবে যে ভাবে বলচে মনে হচ্চে কিচু একটা হয়েচে৷ কারণ পাঁচও নয় , সাতও নয় , বলচে ছয়৷ হোয়াই ?--- আসুক৷ বের কচ্চি৷

    ডি এস ফিরে এল৷ এসে লুঙ্গির গিঁটটা শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে বলল ------ ন্যানো গাড়িটাই নিয়ে নেব৷ বুজলে৷ বিলিতি মাল ছাড়া খাব না৷ ডেলি পাঁঠা , মুরগি৷ তোমরাও চড়বে৷ খাবে৷ ছ ’লাখ বলে কতা৷ হুঁ হুঁ বাবা , এর নাম হল ডি এস৷ ডিরেক্টর স্পেশাল৷

    --- পেয়ে গেচ ?--- কী ?--- ছ ’লাখ ?--- আসচে৷

    --- লটারি ?--- না৷

    --- ডাকাতিও না ?--- নো৷

    --- তবে ?--- বলচি৷ মাল ঢালো৷ গলাটা না ভেজালে হচ্চে না৷

    পুরন্দর ব্যাগ থেকে বাংলার বোতল বের করে৷ ঢালা হয়৷ স্টার্ট হয় চার্জিং৷ ডি এস মদনের একটা চারমিনার ধরায়৷ মদনও চুমুক মারার আগে পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে দু-পাটি ফলস দাঁত পরে নিয়েছে৷

    --- টাকাটা তিন খেপে পাব৷ বুজেচ ? দুই, দুই, দুই করে৷ তিন দু’গুনে ছয়৷ একেবারে কড়কড়িয়া নোট৷

    --- তো , তোমার ওই তিন খেপের টাকাটা আসবে কোতা থেকে ?--- আসবে , যে সে জায়গা নয়৷ একেবারে গভরমেন্টের ঘর থেকে৷ --- কোন গভরমেন্ট ?--- কেন , আমাদের গভরমেন্ট৷ দিদির৷ --- তা তোমায় দিতে যাবে কেন ?--- বলচি৷ কান খুলকে শুন লেও৷ ফার্স্ট দু’লাখ !ডি এস চোখ বন্ধ করে ভাবছে৷ ঠিক হাসছে না৷ কিন্ত্ত গাবদা থোবড়াটায় একটা হাসি হাসি গন্ধ লেগে৷

    --- কী হল ? ঘাপটি হয়ে গেলে যে৷

    --- বলচি৷ চোখ বুজে সিনটা এক বার ভেবে নিলাম৷ শুনে আবার ঘাবড়ে যেও না৷ বাড়ির পেছনেই মুতখানার পার্কটা দেকেচ তো ?--- দেকেচি৷ হাফ ন্যাড়া একটা নিমগাছ আর একটা ভাঙা বেঞ্চি রয়েচে যার পিঠ নেই৷

    --- গুড , গুড৷ ওই পার্ক থেকেই রোলারুলি কান্না শোনা গেল !--- কার ?--- আমার বউ আর ছেলের৷ --- কেন ?--- আগে পুরোটা শুনবে তো৷ আমি পড়ে আচি৷ ডেডবডি৷ বেঞ্চির তলায়৷ মুকে গ্যাঁজলা৷ পাশে খালি বোতল৷ --- ডেডবডি মানে ?--- মানে পটলিফায়েড৷ বউ ছেলে হাঁউমাঁউ করে বুজিয়ে দেবে যে চোলাই খেয়ে ফিনিশ৷ সিম্পল কেস৷ এ বার জানো তো চোলাই খেয়ে মরলে দু’লাখ৷ ব্যস , ফার্স্ট পক্কড়ের দু’লাখ ঘরে ঢুকে গেল৷ --- বাল৷ হবে না৷

    --- কেন হবে না ? হোয়াই ? চোলাই খেয়ে মরেচি৷ মরিনি৷ মটকা মেরে পড়ে আচি৷ হোয়াই হবে না ?--- বলচি৷ ফার্স্টেই পুলিশ এসে চ্যাংদোলা করে কাঁটাপুকুর নিয়ে যাবে৷ ফাঁড়াই করবে , সেলাই করবে৷ অন্তেরা , নাড়িভুঁড়ি সব বের করে টেস্ট করবে৷ রিপোর্ট দেবে৷ এগুলো ভেবেচ ?ডি এস ঘাবড়ে গিয়েছে--- আমি তো ভাবলুম ভিড়ভাট্টা কেটে গেলে উঠে ধাঁ হয়ে যাব৷ --- দ্যাকো , তুমি খজড়া হতে পার , কিন্ত্ত তোমার চেয়ে ডবল সব খজড়া উপরে বসে আচে৷

    --- ঠিক আচে৷ ঠিক আচে৷ দু’লাখ ছেড়ে দিলুম৷ বাকি চার লাখে কেউ খাবলা মারতে পারবে না৷ দু’লাখ না হয় ভগবানের দিব্যি করে দিলাম৷

    --- এর পরের দু’লাখের পক্কড়টা শুনি৷

    --- ঘ্যামা প্ল্যান এটা৷ দরজাতেই গাঁক গাঁক করে জানিয়ে রেখেচি--- কী জানিয়েচ ?--- কেন , দ্যাকোনি ? অত বড়ো বড়ো করে লেখা৷ জগদম্বা স্পোর্টিং ক্লাব৷ জানো নিশ্চয়ই , ক্লাব হলেই দু’লাখ করে দিচ্চে৷

    --- তোমার ওই ঢপের ক্লাবকে দিতে যাবে কেন ? কী খেলা হয় এখানে ?--- বললেই হল৷ বল খেলা হয়৷ ক্রিকেট হয়৷ ডাংগুলি হয়৷ লুডো হয়৷

    --- জানো এর জন্যে এনকোয়ারি হবে৷ কে তোমার ক্লাবের মেম্বার ? কোন দাদা ব্যাক করচে তোমার জগদম্বা স্পোর্টিংকে ? এ ছাড়াও অডিট রিপোর্ট-ফিপোর্ট, হাজারটা হ্যাপা৷ আর তোমার পাড়ায় খোঁজ নিলেই জেনে যাবে যে গোটাটাই চপ৷ তকন ফ্রড কেসে পড়ে জেলের ঘানি টানবে প্লাস অ্যারেস্ট হওয়ার পর বেধড়ক ক্যালানি তো আচেই৷

    --- তা হলে এটাও হবে না ?--- না৷

    --- তার মানে বলচ যে দুই দুই চার লাখ হাওয়া ?--- হাওয়া৷ এর পরের দু’লাখের ধান্দাটা শুনি এ বার !--- এটা কেউ ঠেকাতে পারবে না৷ হয়ে বসে আচে একেবারে৷ হেব্বি ছক৷

    --- দুটো তো শুনলুম৷ লাস্টেরটা শুনি৷

    --- এটা সলিড প্ল্যান৷ বর্ধমানে আমার শ্বশুরবাড়িতে একটা জং -ধরা , কুঁদোফাটা একটা দোনলা বন্দুক আচে৷ সেই সায়েবদের টাইমের মাল৷ হেভি ওয়েট৷ তুমি বা পুরন্দর পিঠে নিলে দাঁড়াতে পারবে না৷ ওই মালটা এনে স্যাটাস্যাট একটু তেলন্যাকড়া দিয়ে রগড়া দিয়ে দেব৷ তার পর গটমট করে থানায় ঢুকে বড়োবাবুর টেবিলে রেকে বলব --- আমি সার আর মাওবাদী করব না৷ তাই বন্দুক জমা দিতে এসেচি৷ একন দিদি একটু হেল্প করলে একটা কীত্তনের দল খুলব৷ বুড়োবুড়ি টেঁসে গেলে গাইতে গাইতে যাব৷ বড়োবাবু সিন্দুক খুলে দু’লাখ টাকা দিয়ে দেবে৷ --- বড়োবাবু সিন্দুক না খুলে লক -আপ খুলে পোঁদে এক লাথ মেরে তোমাকে ঢুকিয়ে দেবে৷

    --- কেন ? আমি মাওবাদী হতে পারি না ?--- পার না৷ মাওবাদীরা তোমার মতো ভ্যাঁসকা মাল নয়৷ ওরা কী চালায় জানো ?--- কী ?--- এ কে ফর্টিসেভেন , ইনস্যাস রাইফেল , আরও কত কী৷ তোমার ওই মান্ধাতার আমলের দোনলা মালটা বরং লোহার দরে ঝাড়লেই কয়েকটা টাকা পেতে পার৷ পুলিশকে গান্ডু বানাবে তুমি ? উল্টে বেধড়ক ক্যালানি খেয়ে চালান হয়ে যাবে৷ লাস্ট দু’লাখটাও হল না৷ এ বারে হাতে হ্যারিকেন নিয়ে তোমার ওই মুতখানার পার্কে গিয়ে বসে থাকো৷

    ডি এস ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল৷ --- হল না৷ ছ ’লাখ হল না৷ সব গেল ! স …ব গেল ! হল না৷ আ …মা …র ন্যানো গাড়ি হল না৷ ডুকরে ডুকরে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদে -টেঁদে শেষে ফোঁপাতে লাগল ডি এস৷ পুরন্দরেরও চোখে জল৷

    --- এ বার থামো৷ চলো , ঝটাঝট বোতলটা ফিনিশ করে আমরা বেরিয়ে পড়ি৷ তার পর ফাঁকা পেলে উড়ে যাব নিজেদের খেয়ালে৷ একটা কতা ডি এস তোমাকে আজ বলচি মনে রাকবে৷

    --- কী ?--- ছ ’লাখ কেন , ছ ’কোটি বা ছ ’হাজার কোটি টাকার মালিকও অনেক আছে৷ কিন্ত্ত তারা কেউ ফ্যাতাড়ু নয়৷ পারবে শালারা আমাদের মতো ফ্যাঁত্ ফ্যাঁত্ সাঁই সাঁই করে উড়তে ? পারবে ? কথাটা মানলে ?ডি এস ফোঁপাতে ফোঁপাতেই মাথা নেড়ে জানায় --- হ্যাঁ৷

    প্রথম প্রকাশ ‘এই সময় শারদীয় ২০১৩ ’
    অলঙ্করণ : কৃষ্ণেন্দু চাকী
  • pi | 192.66.14.150 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৮:২১644857
  • সুতনয়া যা লিখেছে, তার বেশ কিছু কথা কাঙাল মালসাট ও ফ্যাতাড়ুদের অন্য কিস্সা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছিল। ভাটে সে নিয়ে কথাও হয়েছিল। টইতে তর্কও বোধহয়।
  • সে | 203.108.233.65 | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৭:২৩644858
  • এ নিয়ে বেশ কিছু গবেষক ইতিমধ্যেই পেপার লিখছেন।
  • /\ | 127.194.208.141 | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৫৮644859
  • নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস - রাহুল দাশগুপ্ত (কালের কষ্টিপাথর সেপ্টেম্বর ২০১৪)

    http://www.ekashtipathar.com/01092014/Home.aspx
  • সে | 203.108.233.65 | ০৮ অক্টোবর ২০১৪ ২৩:০৪644860
  • এইমাত্র একটা অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার পড়ে উঠলাম।
  • .... | 118.171.159.41 | ২২ জানুয়ারি ২০১৫ ১৯:২৯644861
  • ১) পিতৃস্মৃতি - তথাগত ভট্টাচার্য http://parabaas.com/PB58/LEKHA/pTathagata58.shtml
    ২) মৃত্যু উপত্যকা থেকে প্রতিবাদের কবিতাঃ নবারুণ ভট্টাচার্য - রাজীব চৌধুরী http://parabaas.com/PB58/LEKHA/pRajib58.shtml
    ৩) শেষ অধ্যায় - কুন্তল ঘোষ http://parabaas.com/PB58/LEKHA/pKuntal58.shtml
    ৪) হিরো অফ আওয়ার টাইম - গৌতম সেনগুপ্ত http://parabaas.com/PB58/LEKHA/pGoutam58.shtml

    পিতৃস্মৃতি
    তথাগত ভট্টাচার্য

    "প্রথিতযশা প্রৌঢ় হওয়ার থেকে/অপমানিত বালক হওয়া ভালো"। সেই অপমানিত বালক যখন নিজের বাবা, ভালো লাগা ছাড়াও একটা গর্বের অনুভূতিও হয় বইকি। তার সঙ্গে একটা ভাগ্যের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধও কাজ করে। এই পাঁচমেশালী ঝালমুড়ি ব্যাপারটা এই কারণে নয় যে আমার বাবার একজন শক্তিশালী লেখক হিসেবে নামডাক ছিল বা থাকবে। কারণটা আলাদা। এরকমও তো হতে পারত যে এ বাড়িতে আমার জন্ম হল না। সেই বাড়িতে কেউ বই পড়ত না। সেই বাড়ির ছেলেকে হয় ডাক্তার নয় মোক্তার হতে হত। রাজনৈতিক পরিবর্তনের চিন্তা ভোটের ইভিএম মেশিনে-ই বন্ধ হয়ে থাকত। সেটা যে হয়নি, এটা আমার বাপের ভাগ্যি।

    আমার বাবা আমায় কোন বেদবাক্য বা বাণী দিয়ে যায়নি। একটা জিনিস তাকে দেখে শিখেছি যে প্রথাগত ব্যাকরণ যদি ভাঙতে হয়, নিজের জীবনটা নিয়েও কিছুটা ছিনিমিনি খেলার প্রয়োজন। আমার জীবনের লক্ষহীনতা নিয়ে অনেকেই অনেক সময়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা এই নৈরাজ্যের সিস্টেমটা ধরতে পারেননি।

    আমার জীবনে আমার বাবা বা মা কোনওদিনও কোন লাগাম পরায় নি। পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল যা খুশি করার। বাবা শুধু একটাই কথা ছোটবেলায় বলে দিয়েছিল। এটা আমার দাদু বিজন ভট্টাচার্য বাবাকে বলে গিয়েছিলেন। আমার ছেলের বয়স নয়। সেও এটা জেনে গেছে। "জীবনে সবকিছু করবে। যা ইচ্ছে তাই। তবে এমন কিছু করবে না যে দিনের শেষে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে পারছো না।"

    ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে যখন গ্রেপ্তার হই, অনেক সতীর্থরাই পুলিশের থেকে বাড়ির রোষের ভয়ে বেশি কেঁপেছিল। সৌভাগ্যবশত সেই চাপ আমায় নিতে হয়নি।

    বাবার পড়াশুনোর পরিধি ছিল অভাবনীয়। তার কিছুটা হয়তো একটা জৈব বা মৌলিক কারণে পেয়েছি। ওই চরিয়েই আমি খাই। এই একটা ব্যাপারে বাবার অনুপস্থিতি আমায় ভোগাবে। "এখন কি পড়ছিস?" এটা আর কেউ বোধহয় জিজ্ঞেস করবে না। বইয়ের পাঁজা নিয়ে আমার দিল্লীর বাড়ি থেকে ট্রেনে চেপে ফিরবে না। আমাকেও আমার গলফগ্রীনের বাড়ি থেকে বই নিয়ে যেতে কোন অনুমতি নিতে হবে না। বাবার একটা বড় আফশোষের জায়গা ছিল। বাংলা সাহিত্যে এই মিডিওক্রিটির মিছিলের মূল কারণ বাবা ভাবত বই না পড়ার ফল। পৃথিবী এবং ভারতের বিভিন্ন কোণে কি ধরনের ভাবনা-চিন্তা হচ্ছে এবং লেখকেরা কিরকম লেখাতে মন দিচ্ছেন, এ বিষয়ে বাবার গভীর পড়াশুনো ছিল। কিছুটা সেই জায়গা থেকেই ২০০৩ সালে আমরা 'ভাষাবন্ধন' পত্রিকা শুরু করি। বাবার লেখায় যে একটা সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রার আন্তর্জাতিক, আধুনিক ও নগরীয় স্বাদ আছে, তা অগাধ পড়াশুনো ছাড়া আসে না। ভালো সাহিত্য পড়লে একটা ব্যাপার হয়। নিজেকে যা-তা লেখার থেকে আড়াল করা যায়।

    বাবার লেখার মধ্যে লোকে প্রতিবাদকে বেশি করে খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু তার মধ্যের স্বপ্নের মৌলিক ব্যাপারটা অনেকেই ধরতে পারেননি। একটা আমূল পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে যে বড় হয়েছিল, তার যখন স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, জীবনে বহু অপমান, প্রত্যাখ্যান, কষ্ট, দুঃখ যার সাথী, তার মধ্যে একটা পিছিয়ে পড়া বা কষ্ট পাওয়া মানুষদের জন্য একটা সহমর্মিতা তৈরি হয়। এই সহমর্মিতা আমাদের মজ্জাগত। এর জন্য আমাদের কোন প্রশিক্ষণ শিবিরে যেতে হয়নি। জীবনের নানা ছোট-বড় ঘটনা ও উপলব্ধি থেকে এটা আসে। এই সহমর্মিতা থেকেই তৈরি হয় ঠিক-বেঠিকের ধারণা। এর থেকেই তৈরি হয় ঋজু মেরুদণ্ড, না বিকিয়ে যাবার আত্মপ্রতিশ্রুতি। ওখান থেকেই বাবার লেখা আসত। আর তাই বাবা শব্দকে আতসবাজির মতো ফাটাতে আর কখনও ফুলের মতো ফোটাতে পারতো।

    আমার বাবার জীবনে আমার মার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা যদি না সামাল দিতেন, তবে বাবার চাকরি যাবার পরে আমরা খড়কুটোর মতো ভেসে যেতাম। তখন সংসারে আমাদের আর্থিক টান, আমি তখন স্কুলে পড়ি। বাবা মনের দিক থেকেও ভেঙে পড়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বাবাকে অসম্ভব কষ্ট দিয়েছিল। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারত না। ওই সাংঘাতিক বেদনার থেকেই 'হারবার্ট' এর জন্ম। বাবা লিখছে, হাউ হাউ করে কাঁদছে। এর থেকে একটা জিনিস আমি বুঝেছি। ভালো কোন কাজ নিরাপদ অবস্থান, আরাম ও মনের শান্তির থেকে আসেনা।

    ওসব ভাত-ঘুমের সাহিত্যচর্চা করা বাবার কাজ ছিল না। বাবা যেসব লেখকদের কদর করতেন, তারাও সেরকম সাহিত্যে বিশ্বাসী ছিলেন না। যে বই শেষ করে পাঠক নিশ্চিন্ত মনে আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, তার মলাটে তাই বাবার নাম কখনও দেখা যায়নি।

    বাবা এই সিস্টেমের অংশীদার হিসেবে নিজেকে কখনও দেখেনি। রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক মহল থেকে একাধিকবার সমঝোতার বার্তা এসেছে। সেগুলো বাবা কাউকে বলতও না। যে সিস্টেমে তার কোন বিশ্বাস ছিল না, তার থেকে কিছু পাওয়ার আশা বা নেওয়ার ইচ্ছে বাবার ছিল না। বাবা তাই শুধু সেই সিস্টেম বা তার দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কলম ধরেনি, তার লেখার মধ্যে দিয়ে গড়ে তুলেছিল এক "অল্তের্নতিভে রেঅলিত্য" যেখানে লাথি-ঝাঁটা খাওয়া মানুষরা শুধু রুখে দাঁড়াতেই পারে না, বরং সিস্টেম এবং তার অংশীদারদের খলখলে করেও ছেড়ে দিতে পারে। এই স্বপ্ন চিরন্তন। এই স্বপ্ন ইতিহাসের পর্যায়ে পর্যায়ে ফিরে এসেছে। নবারুণ ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে এই স্বপ্ন শেষ হবে না। তাই বাবা বেঁচে থাকবে। যতদিন সমাজের 'কেউ না রা' তাদের মর্যাদার লড়াই জারি রাখবে, বাবার লেখাও ততদিন থাকবে।
    
    (পরবাস-৫৮, নভেম্বর ২০১৪)

    মৃত্যু উপত্যকা থেকে প্রতিবাদের কবিতাঃ নবারুণ ভট্টাচার্য
    রাজীব চৌধুরী

    প্রথম কবিতার বইটি প্রকাশের আগেই কাব্যগ্রন্থের নাম-কবিতাটি রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করে এক যুবক কবিকে সেদিন বাংলার পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছিল। পরে হিন্দিতে এই বইটির কবিতাগুলি অনুবাদ হয়ে যখন প্রকাশিত হল, তার সূচনায় কবি মঙ্গলেশ ডবরাল লিখেছিলেন, রাষ্ট্রসত্তার দ্বারা সৃষ্ট আতঙ্ক এবং সাধারণ মানুষের জীবনকে অমানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি করে দেওয়ার বিরুদ্ধে রাগ এবং যুদ্ধঘোষণা করেছেন নবারুণ।

    মানুষের পরাজয়, দুর্ভোগ আর তারই হাত ধরে মৃত্যু এবং আত্মহত্যার একের পর এক আলেখ্য নবারুণ এঁকে চলেন তাঁর কবিতায়—পাশাপাশি গল্পে বা উপন্যাসেও। দারিদ্রসীমার নীচে থাকা অগণিত মানুষ; যারা সর্বহারা মানুষ—তাদের যাপনচিত্র, তাদের টিঁকে থাকার স্বপ্ন বা বেঁচে থাকার আশ্চর্য কৌশলগুলিও তাঁর কবিতা জুড়ে। শুধু মানুষ কেন, এই প্রাণমণ্ডলের উদ্ভিদ বা প্রাণী— যারা যেভাবে যেখানে বিপন্ন, নবারুণের কবিতা তাদেরই পক্ষে। 'শীতে জমে মরে যাওয়া বুড়ো ভিখিরির গান' কবিতায় লিখেছেনঃ

    এন।জিও-রা কি জানে যে আমার
    আর দরকার নেই সহৃদয় কম্বল
    বা সাহেবদের বাতিল জামার
    সবারই কি শীত করছে এমন
    না শুধুই আমার

    গাছেদের কি শীত করছে এমন
    কুকুরদেরও কি শীত করছে এমন
    রাস্তা, সিনেমাহল, টিপকল, রেস্তোরাঁ, বিউটি পার্লার
    সকলেরই কি শীত করছে এমন
    মথ, পাখিষ মেঘ, মদ, গ্রহ
    সবারই কি শীত করছে এমন—
    'কর্পোরেট সোসাল রেসপন্সিবিলিটি'র মতো সোনার পাথরবাটিকে প্রত্যাখ্যান করে তাঁর কবিতার সর্বহারা মানুষ। লুব্ধক উপন্যাসে শহরের কুকুরেরা অসহিষ্ণু মানুষদের ছেড়ে দল বেঁধে চলে যায়—যারা পরিবেশ-বান্ধব সেজে সেমিনার করে, তাদের!

    এদের পাশে কি মধ্যবিত্তেরা রয়েছে? মানুষ ভুলে যাচ্ছে এদের হয়ে প্রতিবাদ করতে। বেশি সোচ্চার প্রতিবাদের ভাষাও যে এরকম সময়ে ভোঁতা মেরে যায়—নবারুণ তা জানেন। নবারুণের প্রতিবাদের কথাগুলি তাই গুপ্তঘাতকের ছুরির মতো। একটা নিষ্ঠুর সময়ে নিষ্ঠুরতর মৃত্যুর বর্ণনাগুলিকে এমনভাবে কবিতায় তুলে ধরেন, যেন তাতে কারোরই কোনো তাপ উত্তাপ নেই। আর এটাই তো আমরা করে থাকি! এই চেনা ভাষাকেই যখন কবিতায় ধরে আমাদের হাতে ফিরিয়ে দেন তখন বিস্মিত হয়ে দেখতে হয়—তা কতটাই অচেনা হতে পারে! আমাদেরই অভ্যাস, আমাদেরই নিষ্ক্রিয়তাকে আমাদের কাছে সমর্পণ করে বুঝিয়ে দেওয়া হয় প্রতিবাদের কবিতা কেমন হতে পারে!

    তাঁর লেখা 'রেস্তোরাঁর খাদ্যতালিকা'টির একাংশ—

    আমিষঃ
    শিশুদের টাটকা চোখ, আঙুল, নিহত
    হরিজনের ঝলসানো মাংস, ভূপাল থেকে
    আনা নীলাভ বাছুর, ফলিডলে মারা মাছ,
    রাস্তায় সংগৃহীত চাপ চাপ রক্ত, প্রত্যন্ত
    অঞ্চলে পাওয়া হাড়, অর্ধদগ্ধ করোটি
    অ্যাকসিডেন্টের ঘিলু, তরুণ চর্বি, আস্ত বনসাই মানুষ

    মিষ্টান্নঃ
    বিষুব অরণ্যের কান্নাভরা ক্লান্ত অধঃপতিত আঙুর
    মৃত প্রেম যা মিষ্টি চিউইংগামের মতো খাওয়া যায়
    নরম ক্যাসেট বা রেকর্ড, যে সুন্দরীরা খবর পড়েন,
    চিত্রতারকা, মিছরি মেশানো মদ, ধুরন্ধর বিপ্লবী
    নেতার তৈরি সন্দেশ, এইডস চুম্বন
    নগরায়নের স্রোতে মানুষ যারা রেস্তোরাঁয় প্রায়শই খেতে যান, খেতে গিয়ে আগে দেখেন খাদ্যতালিকাটিকে—সেই পরিচিত খাদ্যভাষাশৈলীকে উপস্থাপিত করা হয় তাদেরই সামনে—এইভাবে।

    'মৃত্যু উপত্যকা'-য় একটা অদ্ভুত চিত্রকল্প ছিল একটি কবিতায়—'ম্যাচবাক্সের মানুষ'। মানুষেরা যেখানে দেশলাইয়ের বাক্সে এক একটা দেশলাইকাঠির মতো।

    ফ্যাকাশে অনেক মানুষ এখানে থাকে
    অর্থহীন ও নিতান্ত বরবাদ।।।।
    বদরাগী এরা মিশকালো সেই রাগ
    জমাট আঁকড়ে রয়েছে তাদের মাথা।
    কিন্তু এই রাগের পরিণতি অদ্ভুত—
    বারুদ মাখানো তাদের ঘরের দেওয়াল
    সেই দেওয়ালেতে মাথা ঠুকে কী যে চায়
    অর্থহীন ও নিতান্ত বরবাদ
    ফ্যাকাশে আগুনে নিজেরাই জ্বলে যায়
    মাথা জুড়ে যে বারুদের মতন ক্ষোভ আর রাগ জমে, যারা বারুদেরই দেওয়ালে মাথা ঠোকে তাদের বারুদে 'ভেজা-ভাব' ধরে গেলে সেই ফ্যাকাশে আগুন শেষে তাদেরই পোড়ায়! এই বারুদ এই আগুন আর দেশলাই নিয়ে পরেও নবারুণ লিখবেন পরবর্তী 'মুখে মেঘের রুমাল বাঁধা' কাব্যগ্রন্থে। সেখানে তাঁর 'পাঠকের কাছে প্রশ্ন'—
    মানুষ যদি বিদ্রোহ করতে ভুলে যায়
    তখন তাকে মনে করিয়ে দেওয়া
    কি পাপ?।।।

    কত জায়গায় তো ফেলি আমি দেশলাই
    একবারও ভুল করে নয়
    যদি কেউ আগুন জ্বালায়।

    ভয় করে, এর পরে হয়তো একদিন
    মানুষ আগুন জ্বালাতে ভুলে যাবে।
    পুলকেশ মণ্ডল ও জয়া মিত্র সম্পাদিত 'সেই দশক' নামে সত্তর দশকের স্মৃতি স্মরণিকাটিতে নবারুণ একটা ছোট্ট গদ্য লিখেছিলেন 'পেট্রল দিয়ে আগুন নেভাবার স্বপ্ন'। এই বিরোধাভাসপূর্ণ নামটির আড়ালে রয়েছে তাঁরই একটি কবিতা, নাম 'পেট্রল আর আগুনের কবিতা'। পরে 'পারিজাত ও বেবি। কে' সিরিজের গল্পগুলিতে বিশ্ব অর্থনীতির খেলাঘরে এই তরলটিকে নিয়ে সিরিয়াস ছেলেখেলার মতো যাদু বাস্তবকে তিনি অন্যভাবে তুলে ধরবেন। কিন্তু এই কবিতায় সেই পুড়ে যাওয়া বারুদ মানুষদের এক এক টুকরো আগুনের ফুলকিতে তিনি ঢেলে দেন আশ্চর্য অগ্নিনির্বাপক তরল! প্রতিবাদের এই বক্রোক্তি মনে করায় যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের এতটাই নিরাপদ স্থিতিবাচক শীতঘুমের মধ্যে থেকেই ঘটে আকস্মিক বিস্ফোরণ! যেমন ঘটেছিল 'হারবার্ট' উপন্যাসের শেষে!
    ধুলোর ঝড়ের মধ্যে
    চোখ বন্ধ করে
    আমি হাঁটতে শিখিনি

    একদিন পেট্রল দিয়ে
    সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব
    সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব
    পেট্রল দিয়ে
    ধুলোর ঝড়ে যে চোখ খুলে হাঁটে—সেটাই তাঁর প্রতিবাদের চিত্রকল্প। 'পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট'-এর মতো গল্পের পটভূমিকা ২০২০, অর্থাৎ যে সময় এখনও আসেনি সেই সময়ের গল্প। সেখানে নবারুণ দেখছেন পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট মারা যাচ্ছেন—অর্থাৎ একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় বামপন্থার পরিসম্পাতিসূচক পূর্ণচ্ছেদচিহ্নটির। কিন্তু কাহিনির শেষে প্রায় এক ইস্তাহারেরই সমাপ্তিসূচক আশাবাদী ঘোষণার মতো তিনি দেখেন সমগ্র বিশ্ব জুড়ে তার পুনরভ্যুত্থান ঘটাচ্ছে সাধারণ মানুষ; কোণঠাসা মানুষ—তারা প্রতিবাদ করবেই। 'লাল কার্ড হাতে ছোট-ছোট ফুটবল দলের গান' কবিতায় তাই এরা সোচ্চারে বলবে—
    আমাদের মার খাওয়াটাই তো ইতিহাস
    আর আমাদের মারাটাই যেন নিয়ম।।।
    আমাদের রোগা রোগা কোচ, মুষ্টিমেয় সমর্থক
    ছেঁড়া বুট, নড়বড়ে তাঁবু, ভেজা বল
    হাঁটুর তলায় কালশিটে, কপালে ফেট্টিবাঁধা
    কিন্তু ভাবুন তো একবার
    কতদিন ধরে কী লড়াইটাই না আমরা চালিয়ে যাচ্ছি
    সবাই এক হলে লড়াই-এর চেহারাটাই তো পালটে যাবে
    সত্যি কথা লুকিয়ে রাখতে আমরা ঘৃণা বোধ করি
    তাই স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দিচ্ছি
    যারা লাথি মারে ইতিহাস তাদের মুছে ফেলে
    যারা লাথি খায় তারাই হাতমুঠো ক'রে উঠে দাঁড়ায়
    মার খাবার আর বঞ্চিত, প্রতারিত হবার কথা নানাভাবে লিখতে লিখতে ১৯৯৫-তে নবারুণ লিখলেন 'ফ্যাতাড়ু' নামের গল্প। জন্ম নিল এক কবি পুরন্দর ভাট ও তার কবিতা। তথাকথিত ভদ্রলোক এবং রুচিশীলতা আঘাতপ্রাপ্ত হলে—প্রতিবাদী কবিতার এক অন্য স্বরকে উন্মোচিত করলেন নবারুণ। প্রতিবাদী কবিতার প্রতিবাদের ভাষাও কখনো গতবাঁধা কোনো কোনো চেনা রাস্তার পথিক হয়ে ওঠে। নবারুণও স্বীকার করেছেন যে এ ধারায় তিনি অধমর্ণ। একটি দৈনিক পত্রিকায় নিজের প্রথম বই, অর্থাৎ 'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না' কাব্যগ্রন্থটির সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন—

    মৃত্যু উপত্যকা লেখার সময় আমি জানতাম, যে রাস্তায় আমি পা দিয়েছি, সেই রাস্তায় অনেক জ্যোতিষ্ক, অনেক মহাজন হেঁটে গিয়েছেন; দেশে ও বিদেশে।

    এদের নিয়ে বা এদের উৎসর্গ করে নবারুণ লিখেছেন কবিতা। 'বিদেশি ফুলে রক্তের ছিটে' বইতে তিনি অনুবাদও করেছেন ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, পাবলো নেরুদা, নাজিম হিকমেত এবং আরও অনেক প্রিয় কবির রচনা। বইয়ের মুখবন্ধে তিনি পাঠককে মনে করিয়ে দেন এই অনুবাদের ভাষার শৈলীতে কিভাবে মিশে রয়েছে তাঁর নিজেরই কাব্যভাষা! অনুবাদ করার জন্য কবিতা যে কবি-পাঠকটি নির্বাচন করে নেন—সেখানেও তিনি স্বধর্ম পালনেরই পক্ষে! অনন্য রায় তাঁর বন্ধু, সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর সুভাষকাকা, কবি সমীর রায় বা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে ওসিপ মান্দেলস্তাম, ভ্লাদিমির মায়াকোভ্‌স্কি সকলকেই তিনি টেনে নিয়েছেন নানাভাবে তাঁর কবিতার মৃত্যু উপত্যকা থেকে প্রতিবাদ জানাবার বৃত্তে। আর সেখান থেকেই শুরু পুরন্দর ভাটের পথচলা। যে কবি ঘোষণা করেছেন যে, কথাসাহিত্যিক বলে লোকে তাকে একটু আধটু চিনলেও তিনি আসলে একজন কবিই। নবারুণের কথাসাহিত্য থেকেই তাই বোধহয় জন্ম নিল পুরন্দর ভাট। যার অপভাষাসরিৎসাগর যুগপৎ নিন্দিত ও নন্দিত। এই মুহূর্তে তা থেকেই কিছুটা রেখেঢেকে অথচ তার স্বাদের পরিচয়বাহী একটি প্রতিবাদী কবিতা—

    বিশ্ব ধ্বংস

    নিউক্লিয়ার যুদ্ধে
    বিশ্ব যেবার ধ্বংস হয়ে যায়
    গোটা মানব সংসারই যখন
    ছাইয়ের গাদা
    সব দেশ যখন শেষ
    তারও পরে বেরিয়েছিল
    শারদীয়া 'দেশ'
    অপ্রকাশিত, এক আঁটি
    রাণুকে ভানুদাদা
    নজরটান দেওয়া যেতে পারে ওই 'এক আঁটি' শব্দদুটির ওপরে।

    (পরবাস-৫৮, নভেম্বর ২০১৪)

    শেষ অধ্যায়
    কুন্তল ঘোষ

    নবারুণ ভট্টাচার্য খ্যাতনামা সাহিত্যিক, বস্তুতঃ আমার মতন সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের কোনও সম্ভাবনা এমনিতে থাকার কথা নয়। কিন্তু পরিচয় হল, এবং তাঁর সঙ্গে কিছুটা অন্তরঙ্গতাও হল, তবে তা অত্যন্ত অল্প সময়ের জন্য।

    তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয় তো বেশ কিছুকাল, বইমেলা, সাহিত্যসভা আর টেলিভিশনের পর্দায় দেখা, কিছুটা দূরত্ব রেখে, একজন মানুষকে সামগ্রিক ভাবে চেনার জন্য যা যথেষ্ট নয়। পরিচয় হল হঠাৎ। একদিন ছোটবেলার বন্ধু রঞ্জন (যে নিজেও চিকিৎসক) তার একেবারে নিজস্ব ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করল, গলফগ্রীনে গিয়ে কোনও ক্যান্সার রোগী দেখা সম্ভব কিনা, সময়টা মে মাসের শেষের দিক। রোগীর পরিচয় পেয়ে আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলাম, তারপর হাঁ বললাম। সে সময়ে আমার অবস্থা ঠিক বলে বোঝানো মুস্কিল। গত দশবছর শেষ পর্যায়ের ক্যান্সার রোগী দেখে আসছি। অনেক নামী লোককেই দেখেছি, কিন্তু নবারুণ ভট্টাচার্য সেই বিশিষ্টদের থেকে আলাদা, সেটা কিছুটা জানা আছে। মনটা খারাপও হয়ে গেল, কেননা তাঁর অসুখের যে বিবরণ শোনা গেল, তাতে খুব বেশীদিন সময় পাওয়া যাবে না।

    নির্দিষ্ট দিনে রঞ্জনের সঙ্গেই গেলাম, আর প্রায় একঘন্টা পর যখন তাঁর বাড়ি থেকে বেরোলাম ততক্ষণে তিনি হয়ে গেছেন 'নবারুণদা'। তাঁর প্রথম কথাটাই ছিল "তোমার কথা রঞ্জনের কাছে অনেক শুনেছি"। আমি তখন দেখছি - রোগা, শরীরে ভয়ঙ্কর অ্রেঅতি অের এর বিভিন্ন চিহ্ন ধারণ করেও উজ্জ্বল চোখের ধার এতটুকু কমেনি। মনে হল, হ্যাঁ কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে যিনি আমাদের যাবতীয় মধ্যবিত্ততাকে চুরমার করেছেন, আর তুলে এনেছেন সুবল্তের্ন দের জীবনচিত্র, তাঁর তো এরকমই চোখ হওয়ার কথা।

    তারপরে বার চারেক তাঁর বাড়ি যাওয়া, আর প্রতিবারই সমসাময়িক কাল সম্পর্কে, রাজনীতি ও সমাজ সম্বন্ধে তাঁর কাছ থেকে টুকরো টুকরো কথা জেনে নেওয়া। এটুকু বুঝলাম তাঁর সাহিত্য ও জীবনচর্যাকে আলাদা করা যাবেনা, মনেপ্রাণে একটি রদিল দর্শনের ওপর তাঁর বিশ্বাস টলানো যাবেনা। আর সমাজের নীচুতলার ওপর তাঁর ভালবাসা তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এমনি এমনি ঝরে পড়েনি। যদিও তিনি অত্যন্ত স্বল্পবাক, তাঁর মধ্যেই কিছু কিছু কথায় আমার এরকম ধারণা হয়েছিল।

    নিজের রোগযন্ত্রণা সম্বন্ধেও তাঁর কাছ থেকে জোর করে জেনে নিতে হত। কখনই অন্য অনেক রোগীদের মতন যন্ত্রণাকাতর ছিলেন না। কিন্তু সমসাময়িক কোনও অনিয়ম, অন্যায়ের কথা ওঠামাত্র তাঁর চোখ হত যন্ত্রণাকাতর। সাধারণতঃ শেষ পর্যায়ের রোগীরা নিজের ও পরিজনদের সম্পর্কে ভাবে, তাঁর ভাবনা ছিল অন্যরকমের।

    যাইহোক, চিকিৎসক হিসেবে আমি জানতাম আমার বিশেষ কিছু করার নেই। অল্লিঅতিওন অর্থাৎ কিছুটা কষ্ট কমানোর চেষ্টাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। তাঁকে নার্সিং হোমে ভর্তি করিয়ে একটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টকর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরের জমা জল বার করা হত, লেগেছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে বলতেন — "শোন তুমি এত ভালভাবে এটা করলে, আমার কোনও কষ্ট হয়নি"।

    আস্তে আস্তে দিন ফুরিয়ে আসছিল। তিনি নিজেও তা জানতেন। তবু কোনও অনুযোগ তিনি করতেন না। আমি জানতাম মিরাক্‌ল ছাড়া কোনও ভাবেই তাঁর আয়ু বাড়ানো সম্ভব নয়।

    ১৮ই জুলাই তিনি আবার নার্সিং হোমে ভর্তি হলেন। ২২ তারিখে নিয়ে যাওয়া হল ঠাকুরপুকুরের ক্যান্সার সেন্টার ওয়েলফেয়ার হোমে, কেননা জণ্ডিস দেখা দিয়েছিল। কেবিনে রেখে তাঁর চিকিৎসা চলল, প্রতিদিনই অবস্থার অবনতি হতে লাগল, সুপ্পোর্তিভে মেদিিনে দেওয়া সত্ত্বেও, তবু যতবারই দেখতে গেছি, কোনও শারীরিক কষ্ট নিয়ে উচ্চকিত অনুযোগ নেই। শুনেছেন কবিতা, গান — নিজের পছন্দ মতন। বাইরের মানুষের ভীড়, মিডিয়া-র দাপাদাপিতে হয়তো অস্বস্তি বোধ করেছেন। তবে সে সময়েও পছন্দের মানুষের কাছেও ছিলেন অনর্গল।

    ২৮ তারিখ ছিল সোমবার, সকালেই অবস্থার অবনতি হওয়াতে ঈঊ-তে নিয়ে যাওয়া হল। শেষের দিনটি ছাড়া সবসময়েই বলেছেন, ঠিক আছি। ৩১শে জুলাই ৪টা ২০ মিনিটে লড়াই শেষ হল। আমার মনে হল — একটা চলমান লড়াই থামল--কিন্তু আসলে আর একটা লড়াই শুরু হল। যে ফ্যাতাড়ুদের জন্য তাঁর কলম আগুন ঝরিয়েছে — তারা শেষ দেখবেই। সে সময়ে হয়তো নবারুণদা সামনে থাকবেন না — অথবা অদৃশ্য থেকে সেই তুমুল প্যান্ডিমনিয়ম দেখবেন। আশেপাশে যে চারপেয়েরা অদৃশ্য দাঁত, নখ বার করেছে--তারা সাবধান! প্রোটোকলের জন্য আমার মতন অনেকেই সেই ৩১ তারিখ যে শ্লোগান দিতে পারেনি তারা বলবে — নবারুণদা অমর রহে! লঙ লিভ্‌ ফ্যাতাড়ু!!

    (ফ্যাতাড়ু সম্বন্ধে পরবাসে পূর্বে প্রকাশিত দু'টি লেখা দেখা যেতে পারেঃ তপোধীর ভট্টাচার্যের কার্নিভালের বিস্ফোরণঃ নবারুণ ভট্টাচার্যের কথাসাহিত্য এবং পারমিতা দাস-এর ফ্যাতাড়ুদের ওপর টপ-টেন &আ--সম্পাদক)
    
    (পরবাস-৫৮, নভেম্বর ২০১৪)

    হিরো অফ আওয়ার টাইম
    গৌতম সেনগুপ্ত

    কোনো কিছু খুব বেশি, খুব বেশিরকম বেশি জানলে ২০-মিনিটে বলা খুব কঠিন। একটা বিখ্যাত চিঠির কথা মনে পড়ছে। সাড়ে সাত পাতা লম্বা সেই চিঠির শেষ দুলাইন ছিল অনেকটা এরকম, তুমি বিষয়টা ছোটো করে জানতে চেয়েছো। হাতে সময় কম, তাই চিঠিটা লম্বা হয়ে গেল।

    আমাদের পারিবারিক দৈনন্দিনে নবারুণদা ছিলেন একটা বড়সড় মেঘের মতো। ঠিক যেমনটা এরোপ্লেন থেকে দেখা যায়। চারদিকে ভয়ংকর রোদ। তার মধ্যেই ছোটো ছোটো দ্বীপের মতো, টুকরো টুকরো ছায়া। আমাদের বাড়িতে নবারুণদা যতোটা লেখক, তার চেয়েও অনেক বেশি, দাদা। রাগি বড়দা। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ব্লু খদ্দরের শার্ট পরে, লম্বা সরু আঙুল তুলে নবারুণদা আমার স্ত্রীকে বলছেন, 'সে কি তোমাদের মেডিক্লেম নেই! তোমরা কি ইললিটারেট, গ্র্যাজুয়েট নও?' কথাটা শুনে নবারুণদার ছেলে তথাগত, মিষ্টি হেসে জানালো, 'বাবার ছিল না'।

    নবারুণদাকে প্রথম কোনো সভায় দেখেছি নাকি যারা আগুন লাগায় নাটকে মনে নেই। তবে প্রথম আলাপ নাইন্টি ফাইভে, প্রতিক্ষণ দপ্তরে। সেই প্রথম শারদীয়ায় লেখা বেরিয়েছে আমার। প্রতিক্ষণের শেষ শারদীয়া। ডেকে পাঠিয়েছেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শ্রী দেবেশ রায়। সেই বিকেলে দেবেশদার ঘরে চাঁদের হাট। একদম কোণে, একটু কাত হয়ে বসে আছেন নবারুণদা। খদ্দরের শার্ট। রংটা সম্ভবত পিংক। গোটানো জিনস্‌। পায়ের ওপর পা। এক পায়ে চটি। অন্য পায়ের চটিটা মেঝেতে।

    ঢোকামাত্র দেবেশবাবু বললেন, 'এই যে গৌতম, আপনার ফ্যান ক্লাবের প্রেসিডেন্ট'। একটা ত্যারচা লুক, 'সেনগুপ্ত?' মাথা নাড়ার আঙুল তুলে বললেন, 'ভালো হচ্ছে, মালটা ওঘরে।' মাল? 'ক্যাশ, ক্যাশ। ওটা আগে, কথা পরে।' ক্যাশ নিয়ে আসার পর শুরু হয়েছিল কথা। থামে নি। মৃত্যুর মাস ৫/৬ আগে অব্দি টানা।

    কিছু প্লেয়ার থাকে অলটাইম পড়পড়। কিন্তু পড়ে না, গোল করে বেরিয়ে যায়। যেমন, জর্জ বেস্ট। নবারুণদা ওরকম, ঠিক ওরকম, দ্য বেস্ট। এত এতবার মৃত্যুকে ডজ ড্রিব্‌ল করেছেন, ওঁর ভাষায়, 'চুক্কি মেরে', বেরিয়ে গেছেন যে এক-এক সময় মনে হতো, মাইকেলের সেই অমোঘ লাইনটা বোধহয় মিথ্যেই হয়ে যাবে। না, হল না। চলে গেলেন। এই চিরস্থায়ী অনুপস্থিতির সামনে আর কিই বা করা যায়, চুপ করে বসে থাকা ছাড়া?

    আমার সঙ্গে নবারুণদার দেখা হত কম, আড্ডাটা মূলত ফোনেই। যেটুকু দেখা, দুপুরে, বৌদি বেরিয়ে যাবার পর। তারপর যা ঘটতো, সহজেই অনুমেয়। তারও পর, বেরিয়ে পড়া, নবারুণদার ভাষায়, 'পাগলা চক্কর'। খিদে পেলে দুটো 'রেস্টুরেন্ট' বাঁধা। একটা ভেজ, বাসবদার, প্রয়াত বাসব দাশগুপ্তের ডালহৌসির অফিস। অন্যটা, নন-ভেজ, তারাতলায় রামকুমারদার, বিশিষ্ট লেখক রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের অফিস।

    নবারুণদা মুডে থাকলে, অনেক সময় না থাকলে তা আনতে, গল্প শোনাতেন। সবই বিদেশি (কালেভদ্রে দিশি) বিপ্লবী, তাত্ত্বিক-লেখকদের গল্প। ওঁর গলায় সে-গল্প যাঁরা শুনেছেন তাঁরা জানেন। খেয়াল রাখতে হবে, নবারুণদা শুধু লেখক নন, একজন প্রথম শ্রেণীর অভিনেতা/নির্দেশক। আর, 'ওয়ান অ্যাণ্ড ওনলি সন অফ দ্য গ্রেট বিজন ভট্‌চারিয়া।'

    প্রথম গল্পটা সন্ধের। প্যারিসের সেই শনিবারের সন্ধেতে শ্রমিক বস্তির গলিতে সবাই মাতাল। বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক বাবার প্রাসাদোপম বাড়ি ছেড়ে মিশেল ফুকো তখন চলে এসেছেন এই গলির শেষ মাথায় একটা ছাপোষা ফ্ল্যাটে। তাঁর বাড়ি খুঁজছে এক তরুণ। সেই মদির সন্ধেয় কেউ তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। শেষটায় দয়া হল এক বুড়োর। গেলাসের দিকে তাকিয়ে সে বললো, 'কি করে লোকটা?' তরুণ শুরু করে দিল ফুকোর বিভার কথা। কাজ হচ্ছে দেখে অন্যান্য বৈশিষ্টের কথা, পোলোনেবা, নেড়া মাথা, সমকাম। বুড়ো বললো, 'সে সব তো হল আমাদের জন্য কিছু করেছে? আদৌ কিছু করেছে কি?' 'আরে, উনি তো তোমাদের অধিকারের জন্যই লড়াই করেন'। এই প্রথম গ্লাস থেকে মুখ তোলে বুড়ো। ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে বলে, 'আমাদের জন্য যাঁরা লড়াই করেন, তাঁদের সবার নাম জাঁ পল সার্ত্র।'

    দ্বিতীয় গল্পটা রাতের। গভীর রাতের। লন্ডনে সেবার ঠাণ্ডা পড়েছিল খুব। টেবিলে কলম রেখে উঠে দাঁড়ালেন মহালেখক চালর্স ডিকেন্স। আপনমনে বললেন, 'লোকে বলে আমি ইংরিজি ভাষার গর্ব। আমি আছি বলেই ভাষাটা আছে। এই লন্ডন শহরের প্রতিটা ধুলো আমার চেনা। শুনেছি এখানকার সমস্ত ম্যাপ ধ্বংস হয়ে গেলেও শুধু আমার লেখা থেকেই তা ফের তৈরি করে নেওয়া যাবে। চলো হে ডিকেন্স, একবার পায়ে হেঁটে দেখে নেওয়া যাক শহরটা। সূঁচের মতো হাওয়া কোট ফুঁড়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে হাড়। দূরে ঠাণ্ডায় হল্লা করছে যে মাতালগুলো, এদের আমি চিনি না। দু-একটা দলছুট বারবণিতা এখনো খদ্দেরের আশায়! না, এদের আমি চিনি না। আর ওই যে বাচ্চা কোলে মেয়েটি, আগুনের ভেতর ঢুকে পড়তে চাইছে বারবার, ভাবছে, হয়তো বেঁচে যাবে। না, ওকেও আমি চিনি না। ছোঃ, দুপয়সার কলমপেষা মজুর। ছোঃ ছোঃ ছোঃ। যা, যা। শহর চিনতে এসেছিস। যা, লেখার টেবিলে ফিরে যা। আর নোংরা কর পরিষ্কার সাদা পাতাগুলোকে।'

    নবারুণদার লেখা নিয়ে কথা বলা আমাকে মানায় না আমি জানি। তবু কিছু কথা উঠে পড়লো 'কিউ' খ্যাত কৌশিকের তথ্যচিত্রের সুবাদে। আর কৌশিকের সাগরেদ সুরজিৎ জানতে চাইছিলেন সাবভার্সানের কথা। ওঁরা অন্তর্ঘাত দিয়েই পড়েছেন নবারুণকে। ঠিকই পড়েছেন। কিন্তু তারপরও একটা প্রশ্ন, ছোট একটা খটকা থেকেই যায়। ধরা যাক আদ্যন্ত রোমান্টিকের রোমান্সটাই যদি সরে যায়। মানে সেই তাঁকে, দেখা যাবে প্রতিদিন, পোস্টারে, দেওয়ালে দেওয়ালে কিন্তু অভিশাপ এমনই দেখা হবে না। কি করবে সেই প্রেমিকা? তার সরল ভাষা কি বদলে যাবে না তীক্ষ্ণ অপভাষায়? সে কি মুখে পেট্রোল নিয়ে ছুঁড়ে দেবে না আগুন?

    আমার পড়ায় নবারুণদা একজন আদ্যন্ত রোমান্টিক মানুষ, যাঁর স্বপ্ন জুড়ে থাকতো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। কিউদের ওই সাক্ষাৎকারে আমি একটা গল্প বলেছিলাম। অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়ি ফিরছি। দূরে একটা আলো। কাছে গিয়ে দেখি শীর্ণ একটা মোমবাতি। আর তার চেয়েও রোগা একটা ছেলে লাল রঙ লাগাচ্ছে কাস্তে হাতুড়ির ওপরের তারাটায়। ওই ছেলেটা, ওই ছেলেগুলো নবারুণদা।

    পরদিন রাতে ফোন, কি দিয়েছিস, পুরো বিশ্বনাথ, টোকায় তার।

    — হবে না। হিরো অফ আওয়ার টাইম।

    ব্যাস, কান্না চালু। বাসবদার স্মৃতিসভায় বক্তৃতাটা খুব বেশি হলে দু লাইন। বাকি পুরোটাই কান্না। নবারুণদা আমি শেষ দেখেছিলাম চলে যাবার দিন তিনেক আগে। হ্যাঁ, আমিও ওরকম। না, না, সেসব কথায় যাবো না আমি। বদলে দুটো লেখা পড়বো। প্রথম অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে। ওটা গল্প নয়, সম্পাদকীয়। দ্বিতীয়টা গল্প। অন্ধবেড়াল। তার শেষটা।

    স্টপওয়াচ
    পারি কমিউনের সময় কমিউনার্ভরা রাস্তায় বেরিয়ে শহরের বড় বড় ঘড়িগুলোকে গুলি করেছিল। বলেছিল ওই ঘড়িতে রয়েছে শাসকের সময়। আমরা নিজেদের সময় কায়েম করতে চাই। এটা জাল্টের বেঞ্জামিনের লেখায় আছে। হারবার্ট মার্কিউসের একটি প্রবন্ধেও ঘটনাটির উল্লেখ পেয়েছি। যাই হোক, ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে হল আমাদের লেখাগুলো এক একটা স্টপওয়াচ, পাঠক পড়তে শুরু করলে চলতে শুরু করে। এক একসময় চলেও না। অলৌকিক এই স্টপওয়াচ ধরতে পারে লেখকের, পাঠকের ও তাদের বাইরের সময়। বাতিল, অকেজো বা ফালতু ঘড়ি বানিয়ে কোনো লাভ নেই।

    অন্ধবেড়াল

    ।।। সেই ভয়াবহ ঝড়ের ওপরে শেষ অবধি অন্ধ বেড়ালের ভাগ্য নির্ভর করে রয়েছে। নদীতে তখন ফুঁসে ফুঁসে উঠবে দু-মানুষ ঢেউ। সেরকম খ্যাপা জলোচ্ছাস হলে বাঁধ ধ্বসে যাবে। আর এরকম ঘটনা ঘটার আগে থেকেই যে দুর্যোগ অবধারিত শুরু হয়ে যায় তার ফলে সেই মেয়েটার বাচ্চা দুটোকে নিয়ে এপারে আসাও অসম্ভব। জলের ধাক্কায় আর উন্মত্ত বাতাসের দাপটে হোটেলটা যখন কেঁপে কেঁপে উঠবে, নদীর দিকে খুঁটিগুলো যখন একটা একটা করে টলে যেতে থাকবে তখন হোটেল মালিক বাসনকোসন আর চেয়ার টেবিলগুলো সামনের গলির ওপারে যে রকের মতো জায়গাটা আছে সেখানে নিয়ে গিয়ে ডাঁই করে রাখতে পারে। এপাশ-ওপাশ দুলতে থাকা লণ্ঠনটাও সে নিতে ভুলবে না। কিন্তু জল বেড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলেও তা শুরু হবে টাল খাওয়া দিকটার থেকে। অন্ধ বেড়াল তখন বড়জোর অপেক্ষাকৃত উঁচু উলটো দিকটায় সরে যেতে পারে। কিন্তু ওঘর ছেড়ে বেরোবে না। এখানেও দুটো সম্ভাবনা রইল। ঘরটাতে আস্তে আস্তে জল বাড়তে পারে অথবা এক ঝটকায় দোতলা সমেত হোটেলটার গোটা কাঠামোটাই নদীতে ধ্বসে পড়তে পারে। এর কোনো একটা হলে অন্ধ বেড়ালের কিছু করার নেই। হয় জল তাকে ছাপিয়ে উঠবে নয়তো ঘরের সঙ্গেই সে নদীতে তলিয়ে যাবে। কিন্তু ঝড় যদি কোনো কারণে রাস্তা পালটায় বা অত ভয়াবহ না হয় তাহলে হোটেলটা যেমন আছে তেমনই থাকবে। এবং, টেবিলের তলায়, অন্ধকারে বসে থাকবে অন্ধ বেড়াল। সকালে এসে বাচ্চাদুটোও দেখতে পাবে যে, চেনা জায়গাতেই সে চুপ করে বসে রয়েছে।

    [এটা কোনো প্রবন্ধ নয়। ২০১৪-র ২২ সেপ্টেম্বর, বিশিষ্ট লেখক নবারুণ ভট্টাচার্যের স্মরণ অনুষ্ঠানে বলা। সাহিত্য অকাদেমির আমন্ত্রণপত্রে বলার সময়টা নির্দিষ্ট করা ছিল, ২০ মিনিট।]
    
    (পরবাস-৫৮, নভেম্বর ২০১৪)
  • aranya | 154.160.226.93 | ২২ জানুয়ারি ২০১৫ ২২:৫৩644862
  • সত্যিই, হিরো অফ আওয়ার টাইম - নবারুণ। থ্যাংকস .... , লেখাগুলোর জন্য
  • .# | 118.171.159.41 | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ১৫:০৫644863
  • খুব চাইছি একটা নবারুণ ভট্টাচার্য স্পেশাল ইস্যু হোক গুরুচন্ডালির তরফ থেকে। প্রথমে ওয়েবেই হোক। পরে সেখান থেকে বেছে বুছে, আরো কিছু প্রয়োজনে যোগ করে সম্ভব হলে কাগু ইস্যু বা চটি হবে, বা হবে না।

    এখনও অবধি যেটুকু দেখেছি নবারুণের উপর কাজ, প্রথম "অক্ষরেখা" র করা বিশেষ সংখ্যা। প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ফেব্রুয়ারি ২০০৮ আর "এই সময়"এর করা রবিবারোয়ারি টা ছাড়া তেমন জুতের কিছু হয় নি। এর মধ্যে ভাষাবন্ধন বের করল অগ্রন্থিত কবিতা, সাক্ষাৎকার সমগ্র, বের করবে পত্রিকার নবারুণ স্পেশাল ইস্যু। মোটামুটি জানা যায় কারা কারা সেখানে লিখবে। প্রতিষ্ঠিত ও ক্লোজ সার্কেলের লোকজন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিঃসন্দেহে। অপেক্ষায় আছি।

    "চার্বাক" একটা স্পেশাল ইস্যু করবে বলে কাজ করছে। মূলতঃ নবারুণের স্বল্পজ্ঞাত দিকগুলো নিয়ে, যেমন নাটক নির্দেশনা, এডিটর হিসেবে নানান পত্রিকা চালানো, এসব।

    "বাঘের বাচ্চা" ওদের সুবিমল মিশ্র সংখ্যার পর নেক্সট ইস্যু করছে নবারুণ কে নিয়ে। আশা করছি লেখক গোষ্ঠীটা একই থাকবে, লিটিল ম্যাগের সুবিমল ঘেঁষা লোকজন ও বন্ধুরা, লালা (প্রচেতা ঘোষ), মৌলিনাথ বিশ্বাস, ধীমান দাশগুপ্ত ইত্যাদি।

    আমি মনে করছি নবারুনকে মন দিয়ে পড়া আরেকটা বড় পাঠকগোষ্ঠীর ক্রিটিকাল এক্সপ্রেশন ধরে রাখা জরুরী। এবং সেটা নবারুণ সাহিত্যের পাঠ-প্রতিক্রিয়ার নিরিখে। মেমোয়ার্স এবং মেমোয়ার্সের বাইরেও।

    ১) গুরুচন্ডালির লোকজনঃ

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল ঘোষদস্তিদার, বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী, সুমেরু মুখোপাধ্যায় বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত, বিক্রম পাকরাশি, ইন্দ্রাণী দত্ত, কৃষ্ণকলি রায়, প্রগতি চট্টোপাধ্যায়, সম্বিৎ বসু, পারমিতা দাশ, পারমিতা চ্যাটার্জি, দময়ন্তী তালুকদার, ইপ্সিতা পালভৌমিক, সোনালী সেনগুপ্ত, সৈকত দাস অধিকারী, মিঠুন ভৌমিক, শুচিস্মিতা সরকার, পিনকী মিত্র, কৃশানু মজুমদার, একক, সোমনাথ রায়, ঋদ্ধিমান লায়েক, কৌশিক চক্রবর্তী, সৈকত২, দীপ্তেন্দা, যোষিতা ঘোষাল, শিবির, নিশান, সিদ্ধার্থ, কল্লোল দাশগুপ্ত, রঞ্জন রায়, অচিন্ত্যরূপ রায়, রুদ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার, তাপস দাস, দেবতোষ দাস ও আরো অনেক অনেক এই গ্রুপের লোকজন - নিজেদের পাঠপ্রতিক্রিয়া আর নবারুণের লেখকসত্তা যেভাবে দেখছেন সেটা ডিটেলে লিখলে আমি মনে করি, চলতি বাজারের সমালোচনার বাইরের অনেক দিক, অনেক দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসবে। এদের কেউ কেউ অলরেডি লিখেছেন, কিন্তু মনে করছি না তাঁরা তাঁদের অনুভূতির সমস্তটা লিখে ফেলতে পেরেছেন। ওয়েবে লেখার ভলিউমটা সমস্যা হবে না, বিস্তৃত লেখা চাই।।

    ২) যাদবপুর ও অন্যান্য কলেজপড়ুয়া এখনকার রীডাররা - যাদের সাথে পাইরা হোককলরবের সূত্রে কাছাকাছি, এদের পাঠপ্রতিক্রিয়া ফেসবুকের স্বল্প পরিসরে নয়, ডিটেলে চাই।

    ৩) ফেসবুকের প্রচুর জনতা, যারা গুরু সূত্রে কাছাকাছি এবং নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখার পাঠক, নিজেরাও ভালো লেখে, স্পেশালি ভেবে পড়ে ও পড়ে ভাবে। এই সূত্রে আগের অর্কুট জগতের চেনা মুখগুলো ও মনে করছি, ক্যালকমের লোকজন, অভীক ইত্যাদি।

    ৪) নবারুণ ভট্টাচার্যের চেনা ও কাছের কিছু মানুষ যাদের সান্নিধ্যে আমি এসেছি, আরো অনেকেই এরকম কিছু মানুষকে জানবেন, তাদের থেকে লেখা চাওয়া টা দুশ্কর হবে, তাদের থেকে আমি খুব ক্রিটিকাল সমালোচনাও আশা করি না। কিন্তু মেমোয়ার্সের জায়গা থেকে এদের স্মৃতিচারণ রেকর্ড করে পরে ট্রানস্ক্রাইব করে নিলে একটা বড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিকোলাজ পাওয়া যাবে। কলকাতায় রুশ দূতাবাসের সোভিয়েত দেশ এর অফিসে তখন যাঁরা সহকর্মী ছিলেন, তাদের স্মৃতিসাক্ষ্য যেমন নেওয়া যেতে পারে, তেমনি নবান্ন নাট্যদলের লোকেদেরও।

    ৫) সৈকত বন্দ্যো ও আরো লোকজনের লেখালেখির জগতের লিটিল ম্যাগাজিনের বন্ধুরা - অপর এর গ্রুপ, বিষয়মুখ এর গ্রুপ, রসাতল এর গ্রুপ কৌরব ইত্যাদিদের যারা এখনও সেভাবে নিজেদের এক্সপ্রেশন লিপিবদ্ধ করেন নি, তাদের রিকোয়েস্ট করা যেতে পারে। শিবাদিত্য দাশগুপ্ত, দেবজ্যোতি গুহ, দেবাশিস গুপ্ত, চন্দন গোস্বামী, সব্যসাচী সেন, সৌম্যেন পাল, কৌশিক মজুমদার, এরকম বেশ কিছু পাঠকের চোখ দিয়ে দেখতে চাইছি। ফেমিস্টদের চোখ থেকে ও LGBT দের চোখ থেকে নবারুণের লেখালেখি ইত্যাদিও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, যদি পাওয়া যায়।

    ৬) পুরোনো বাংললাইভের ও কিছু লোকজনের লেখা আমি এই ইস্যুতে চাইবো।

    ৭) কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখকের এক্সপ্রেশন - যাঁরা ভাষাবন্ধন, চার্বাক, বাঘের বাচ্চার এফর্টের বাইরে থেকে যাবেন, তাদের ক্যাপচার করা জরুরী মনে হয়। এই লিস্ট টা বাকীদের সাথে কথা বলে সাজেশনমতো তৈরি করা যায়। যেমন, দেবর্ষি সারগী, অমর মিত্র, নলিনী বেরা, সোহরাব হোসেন, রবিশংকর বল। বা বাংলাদেশের লেখকেরা, জাকির তালুকদার, শাহদুজ্জামান।

    ৮) জানিনা কেউ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নবারুণকে নিয়ে কাজ করছেন কীনা। পি এইচ ডি।

    আমি নিজে বিবলিওগ্রাফিটা করেছি, সব বই, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, গদ্য, নাটকের নাম দিয়ে, সেটা আরো ডিটেল-এ সব এডিসনের সব কভার ফটো সহ করা সম্ভব। রাজীব চৌধুরির সাথে বসে সেটা করে ফেলতে পারব। তবে প্রিন্ট মিডিয়ামে সেটা করাটা যত খরচ সাপেক্ষ হবে, ওয়েবে সেটা করা ততই সহজ। তবে রাজীব চৌধুরীর করা কাজটা, ভাষাবন্ধনে, দেখলে বোঝা যাবে আমার করার আদৌ আর দরকার হবে কিনা। একদিন কাগজের কাজটার পরে মনে হয়েছে আরো কিছু করা যায়।

    অনেকের নাম এখন মাথায় আসল না, কিন্তু কালেক্টিভ ক্রাউড সোর্সিং পদ্ধতিতে লোকে তাদের চেনা সিরিয়াস পাঠকদের থেকে লেখা চেয়ে অন্তত ওয়েব ইস্যুটা এনরিচ করতে পারেন। পরে এই সামগ্রিক লেখালেখি থেকে বাছাই করে প্রিন্ট ইস্যুর কথা ভাবা যেতে পারে।

    অগ্রন্থিত / অপ্রকাশিত নবারুণ
    ==================
    অপ্রকাশিত আশা করি আর কিছু পাওয়া যাবে না।

    অগ্রন্থিত র মধ্যে আমার যা জানা -
    ১) ভাষাবন্ধনের সমস্ত সম্পাদকীয়। এগুলো ওরা আলাদা কিছু করবে না। কিছু কিছু হয়তো অ্যাকোয়ারিয়াম আর আনাড়ীর নাড়িজ্ঞানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে। কিন্তু সবগুলো একসাথে দু-মলাটের মধ্যে আনার কথা ভাবা যায়। আমার কাছে ভাষাবন্ধনের ৯০% সংখ্যা আছে। বাকিগুলো ওদের অফিস থেকে ছবি তুলে আনলেই হবে।

    ২) ফ্যাতাড়ুর দুটো অগ্রন্থিত গল্প এখনো আছে। ওগুলো কুম্ভীপাকের পরের এডিশনে ঢুকে যাবে জানি।

    ৩) "মানস" বলে কাগজটাতে (অজয় গুপ্ত সম্পাদিত, ওঁর কাছেও এখন কোনো কপি নেই) "ইংরিজি ভাষায় তত্কালীন প্রকাশিত রাজনীতি আশ্রিত বইয়ের অ্যাপ্রিশিয়েশন" হিসেবে বেশ কয়েকটা লেখা আছে, বাংলা ভাষাতেই।

    ৪) একটা কৃষি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, ইংরিজিতে, সেখান থেকে editorial গুলো খুঁজতে হবে। নাম জানতে পারিনি এখনো।

    ৫) রেড লাইট এরিয়ার মেয়েদের নিয়ে একটি পত্রিকা "আবার বণিতা" সম্পাদনা করতেন, যেখানে যৌনকর্মীদের নিজেদের লেখায় নিজেদের কথা থাকতো। সেখানে ভারতের প্রথম এইডস রোগীর ভাষ্য ছিল, নিজের ভাষায় নিজের কথা। ওতে নবারুণ-এর লেখা ছিল না, তবে এডিটোরিয়াল থাকতে পারে। সন্তোষপুরের ইন্দ্রাণী সিংহ-র কাছে পাওয়া যেতে পারে। ওটা দূর্বার নয় অন্য গোষ্ঠীর কাগজ ছিল।

    ৬) পরিচয়, প্রমা, সাহিত্যপত্র ধরে খুঁজতে হবে কোনো অগ্রন্থিত লেখা রয়ে গেছে কিনা। পরিচয়ে থাকতে পারে।

    ৭) নিজে বলেছিলেন সোভিয়েত দেশ পত্রিকায় ওঁর অনুবাদ করা বিদেশী সাহিত্য রয়েছে। খুঁজে বার করতে হবে। সোভিয়েত দেশ এমনিতেই পাওয়া যায় না।

    ৮) কোনো পত্রিকায় কোনো সাক্ষাৎকার যদি থেকে থাকে যা সাক্ষাৎকার সমগ্রের বাইরে থেকে গেছে, সেগুলো খোঁজা বা কোনো অনুষ্ঠানের বক্তৃতা ক্লিপিংস পেলে তার ট্রান্সক্রাইব এগুলো ও ভাবা যেতে পারে।

    ৯) কোনো পত্রিকায় থেকে যাওয়া অগ্রন্থিত লেখা থাকতে পারে কিনা নজর রাখা।

    ১০) "সপ্তাহ" পত্রিকায় এখনো বেশ কিছু অগ্রন্থিত লেখা আছে, নামে, ছদ্মনামে (সুমন্ত ভট্টাচার্য)। এগুলো ও চার্বাক ও পরে ভাষাবন্ধন ছাপাবেই। তবে ওদের কাজটা দেরি হবে। পরের বইমেলার আগে মনে হয় না কিছু হবে। সপ্তাহ থেকেও লেখাগুলো তোলা সম্ভব। পুরো আর্কাইভটাই দিলীপ চক্রবর্তীর কাছে, ও প্রথম দিকটা ভূপেশ ভবনে আছে।

    ১১) "বিচিন্তা" তে কিছু অগ্রন্থিত লেখা আছে। এটা পাওয়া যাবে সপ্তাহ পত্রিকার দিলীপ চক্রবর্তী র কাছে, তাছাড়াও প্রথম তিন বছর আছে ভূপেশ গুপ্ত ভবনে ভবানী সেন পাঠাগারে।
    তবে এটাও চার্বাক রিপ্রিন্ট করবে। তখন ওরা লেখাগুলো তুলতে একবার যাবে। পরে ভাষাবন্ধন আবার অগ্রন্থিত নবারুণ করার জন্য সেগুলো তুলতে যাবে, কারণ রাজীব চৌধুরী অন্যের কাজের উপর ভরসা না করে নিজে আবার খুঁটিয়ে মূল টেক্সট নিয়ে এসে কাজ করবে। এ সবের আগেই গুরুচন্ডালি লেখাগুলো ছাপতে পারে।
  • ... | 118.171.159.41 | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ১৬:৫৬644864
  • "অক্ষরেখা" প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ফেব্রুয়ারি ২০০৮

    ১) একটি স্বরসন্ধিঃ নব + অরুণ - অজয় গুপ্ত
    ২) হারবার্ট বাবাকে হারবার্ট হতে দেয়নি - তথাগত ভট্টাচার্য
    ৩) হে সখা - "চিরসখা" - পীযুষ ভট্টাচার্য
    ৪) ভূতিয়া ললাট লিখন - রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়
    ৫) এই অন্ন কি নবান্ন নয় - সুভাষ ঘোষাল
    ৬) নবারুণ ভট্টাচার্য সখা আঁতলেমি কারে কয়? - অরুণা মুখোপাধ্যায়
    ৭) নবারুণ ভট্টাচার্যের কথাবস্তু ঃ এক প্রতিস্পর্ধী অ্যাজেন্ডা - রমাপ্রসাদ নাগ
    ৮) মানুষের অপমান যাকে রাগিয়ে দেয় - হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
    ৯) কথার কিস্তি - খেলাপের খি - সুমন ভট্টাচার্য
    ১০) নবারুণি ভাষা অথবা ফ্যাতাড়ুভাষ্য একটি নড়বড়ে প্রতিবেদন - সত্রাজিৎ গোস্বামী
    ১১) হারবার্ট উপন্যাসের রাজনীতি - ড. অরূপ কুমার দাস
    ১২) নিরাময়-অযোগ্য এক প্যারানোইয়া - মানস ঘোষ
    ১৩) কার্নিভালের বিস্ফোরণ - তপোধীর ভট্টাচার্য
    ১৪) কাঙাল মালসাট ঃ সহজপাঠ কঠিনপাঠ - অভীক মজুমদার
    ১৫) ধুলোর ঝড়ের মধ্যে চোখ খুলে - অভিজিৎ মুখার্জি
    ১৬) খেলনা নগর ঃ বর্জ্যজগতের রহস্যকথা - শ্যামলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়
    ১৭) অন্তর্ঘাতের নিজস্ব বয়ান - শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
    ১৮) যুদ্ধপরিস্থিতির অন্দর-বাহির - প্রগতি শীল
    ১৯) ভোগী বর্তমান সময়ে আগামীদিনের এক অসামান্য কাহিনী পাঠ - অসিত কর্মকার
    ২০) নবারুণের বোম্বাচাক - রামকুমার মুখোপাধ্যায়
    ২১) অন্ধ বেড়াল - অনির্বাণ রায়
    ২২) নবারুণের লেখক সত্তার সন্ধানে - বীরেন্দ্র চক্রবর্তী
    ২৩) নবারুণ ভট্টাচার্যের ছোটগল্প - শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায়
    ২৪) আমাকে সহজভাবে নাও -শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
    ২৫) সাক্ষাৎকার - নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথাবার্তা - (দেবেশ রায়, প্রতিক্ষণ মে, ১৯৯৪)
    ২৬) সাক্ষাৎকার - "দুনম্বরী একটা সময়ের মধ্যে আমরা বাস করছি ... " - (মল্লার, ৩০-০৬-২০০৩, ক্যাসেট থেকে লিপিতে সহায়তা পারমিতা চন্দ)
    ২৭) সাক্ষাৎকার - উপার্জনের উদ্দেশ্যে আমি লিখি না - (হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, তথ্যকেন্দ্র)
    ২৮) সাক্ষাৎকার - নবান্ন নাট্যগোষ্ঠীর "নবারুণ ভট্টাচার্যে"র সাথে ... - শ্রীশঙ্খ (শারদীয়া বলাগড় বার্তা, ১৩৯২)

    অগ্রন্থিত গদ্য
    ১) কবিতা সম্বন্ধে সাত পাঁচ কিছু ভাবনা
    ২) দূরপল্লার দৌড় ও কবিতা বিষয়ক গদ্য
    ৩) ফালতু এবং অপ্রয়োজনীয়
    ৪) ভাবছি এখন
    ৬) আমিও রিফ্লেক্টর ধরেছিলাম
    ৭) ঋত্বিক- আমার অস্কার, আমার অঙ্গীকার
    ৮) বিনোদন প্রসঙ্গে
    ৯) ভাষাঃ জনৈক সাহিত্যকর্মীর উপলব্ধি
    ১০) গণবিষানের নাটক / বন্ধ কারখানার গেটে
    গল্ফ্‌গ্রীণে জনৈক লেখক
    ১১) চিন থেকে ফিরে
    ১২) গ্রেট সোভিয়েত সার্কাসের ক্লাউন

    নবারুণ ভট্টাচার্যের রচনাপঞ্জী ও গ্রন্থপঞ্জী - রাজীব চৌধুরী
  • .... | 127.194.205.52 | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ২১:৫৬644867
  • রক্তমাংস শ্রাবন ১৪২১, আগস্ট ২০১৪

    ১) সম্পাদকীয়ঃ এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
    ২) কবিতাঃ "তামাম" - নবারুণ ভট্টাচার্য
    ৩) বমির দাগ - সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় (পুনর্মুদ্রিত)
    ৪) বিপ্লবীর সোনারুপো - রবিশংকর বল
    ৫) ইতরের দেশে বসে শরণ - চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
    ৬) গণতন্ত্রের কনসেপ্টটাই অগণতান্ত্রিক - অরুণাংশু ভট্টাচার্য
    ৭) অন্তর্ঘাতের উত্তরাধিকার - হিন্দোল ভট্টাচার্য
    ৮) মৃতের সহিত কথোপকথন - গৌতম ঘোষদস্তিদার
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন