এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • .... | 118.171.159.41 | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ১৩:০১644868
  • রবিশস্য -- (বইমেলা ২০১৫) সম্পাদক ধীরাজ বোস, ৯৮৩০১০৭৬৩০

    ১) নবারুণ ভট্টাচার্যঃ নির্মাণে/বিনির্মাণে - বিমল দেব
    ২) নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্পঃ বিশ্বজিৎ পাণ্ডা
    ৩) নবারুণ বিষয়ক একটি ঢ্যামনা বাতেলা - শুভেন্দু দাশগুপ্ত
    ৪) নবারুণের কথা - অনীক রুদ্র
  • তাপস দাশ | 126.203.211.36 | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ২৩:৫৫644869
  • অনেকে, যারা বাংলাভাষী নন, বলেছেন যে তাঁরা নবারুণের কবিতা পড়তে আগ্রহী l হিন্দিতে বেশ কিছু কাজ হয়েছে কিন্তু ইংলিশে প্রায় হয়নি। এই দুটো কবিতা এখানে দেওয়া হল, (এক গুচ্ছ বুলেটপ্রুফ কবিতা ও চড়াই)- আপনাদের মতামত জানাবেন

    A BUNCH OF BULLETPROOF POEMS
    A bunch of bulletproof poems
    stands in front of the firing squad
    With their shirt buttons open,
    fearless they stand

    A bird’s bleeding beak
    hangs biting a giant metal clock’s hand
    Harpooned whales watch this with inverted eyes
    The stars, in the light they sent out light years back,
    see blankness dissolve in the blood stained sea
    The great flag freezes in fear atop the lead pipe

    Numbness overpowers the head of the city
    Cold wind from abattoirs
    chase school children
    Those lost in love become still photographs
    between one kiss and the next
    Stones sweat
    The ticking heart of the terror bomb loses pace
    Lawyers in black coats with dirty pockets walk
    with the moon as their pocket watch

    This piece of news just came in
    that long before man,
    birds and butterflies had made it to the moon

    Just now, it is learnt
    that apocalyptic melting has started in each of the poles
    71 Nobel Laureate scientists have just confirmed
    that people do not watch television after death

    When all the newspapers of the world
    say there is no future
    When all political leaders concede
    that their last efforts have failed
    When the inevitable missiles fly
    Between fixed deposits, the vacuum grows
    And between fingers,
    Burns the last cigarette of the world

    Then, yes, right then

    A bunch of bulletproof poems
    stands in front of the firing squad
    With their shirt buttons open,
    fearless they stand
    ...........................................................
    Translated by Tathagata Bhattacharya

    THE SPARROW / Nabarun Bhattacharya
    Though not drunk
    And neither suffering from a stroke,
    my feet wobble
    A tremor rises through my heart, my brain

    The mobile towers screech and scream
    The sparrows lie dead
    The sky, they had, had run out
    Their skies stolen by bandits

    He lies there, forlorn.
    The fallen sparrow
    What are those patterns on its feathers – camouflage?
    Battered on his eyes and lips, has he turned blue?
    Lies around him dust and hay, an AK-47
    This is how ended this transaction

    Can you please stop making sound, you distinguished vultures?
    Would you stop preaching your hoarse sermons?
    Let us, for sometime, without the help of the hearing aid,
    listen to the songs of the sparrows

    Translated by Tathagata Bhattacharya
    (Different people had reacted differently to the death of Kishenji (Koteshwar Rao). He had a hearing problem and used a hearing aid. The security forces had traced the location of his mobile phone. Writer and poet Nabarun Bhattacharya expressed what he had to say through this poem.)
  • .... | 118.171.159.41 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ১৪:২৪644871
  • এটা এইত্তো একটু উপরেই পোস্ট করেছি Date:22 Jan 2015 -- 07:29 PM
  • সে | 188.83.87.102 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ১৬:৪৫644872
  • ঠিক, ঠিক।
  • .... | 127.194.200.184 | ০১ আগস্ট ২০১৫ ০০:৪৫644874
  • ভাষাবন্ধন সংখ্যাটা এখনো করে উঠতে পারে নি, কোনোদিন পারবে কিনা নিশ্চয়তা নেই।

    ভাষাবন্ধন করবে বলেই, অতটা ডিটেলে করতে পারবে ন বুঝে, 'বাঘের বাচ্চা' ওদের পরের ইস্যুটা নবারুণকে না নিয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত কে নিয়ে করল।

    চার্বাকের ছেলেটির ফোন নং হারানোয় আর যোগাযোগ করতে পারিনি। ওরা কিছু এগলো কিনা, আদৌ ইস্যু টা করবে কিনা জানা হয় নি।

    অগ্রন্থিত-গুলোর মধ্যে যেটুকু জানানোর, মানস সম্বন্ধে ভুল বলেছিলাম, ওতে নবারুণ কখনো কিছু লেখেন নি। বুক অ্যাপ্রিসিয়েশনগুলো বিচিন্তাতে ছিল।
  • h | 127.194.247.121 | ০১ আগস্ট ২০১৫ ১০:০৫644875
  • ওপরের টা কি সোমনাথ? নবারুণ সংখ্যা বেরিয়েছে ভাষাবন্ধনের। কাল ই হাতে এসেছে।
  • /\ | 127.194.203.136 | ০২ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:৪৬644876
  • http://www.aihik.in/aihik/Content/9/

    মলোটভ ককটেল
    ==========
    সম্পাদকীয়
    ১) ফিরে এসো আগুন - অদ্বয় চৌধুরী

    সতর্কীকরণ
    =======
    ২) মিথ্যে ভাঙার ভাষা** - নবারুণ ভট্টাচার্য

    চাঁদের চোয়াল
    ========
    ৩) নবারুণের প্রেত ও অনুপস্থিতির বিশ্বাসঃ ‘ও হরিনাথ, আছে আছে, সব আছে, সব সত্যি’ - অর্ক চট্টোপাধ্যায়
    ৪) স্মৃতি-যোদ্ধা নবারুণ - হিন্দোল পালিত

    নিউক্লিয়ার উইন্টার
    ===========
    ৫) হন্যমান আত্ম সমীপে এক বিক্ষুব্ধ কথক ~ নবারুণ সাহিত্যে আত্মহত্যা - কৌশিক দত্ত
    ৬) মৃত্যুর নবারুণ ধর্মীতা - শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ

    মাংসনগরে, পণ্যের বাজারে
    ==================
    ৭) শেষ মাতাদর - অগ্নি রায়
    ৮) একটা সাধারণ মেয়ে কি লিখতে পারতেন না, নবারুণ? - অধীশা সরকার
    ৯) গুপ্তঘাতক ও ক্রান্তদর্শী - মালিনী ভট্টাচার্য

    অতন্দ্র বিমান
    ==========
    ১০) নবারুণ ভট্টাচার্যের সিনে-রচনা - পরিচয় পাত্র
    ১১) নবারুণের লেখায় ইতিহাসবোধ - অভিজিৎ বসাক

    প্রতি কর্তৃপক্ষকে
    ===========
    ১২) বিকল্প কথননীতি - অদ্বয় চৌধুরী
    ১৩) নবারুণ ভট্টাচার্য সেটাই করেন - অনুপম মুখোপাধ্যায়

    বরফ আর আগুন
    ===========
    ১৪) প্রতিবাদের পাঠক্রম - সম্রাট সেনগুপ্ত
    ১৫) বিপ্লব, প্রতিরোধ, বিচিত্র – নবারুণ ভট্টাচার্যের আন্তর্পাঠ - দিব্যকুসুম রায়

    রাতের সার্কাস
    ==========
    ১৬) নাটকে নবারুণ, নাটুকে নবারুণ - সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
    ১৭) তাহাদের কথাঃ মনুষ্যেতরর রাজনীতি - ঈশানী বসু

    হলুদ হ্যালোজেন
    =============
    ১৮) ফ্যাতাড়ুঃ কল্কী ও তার ঘোড়ার রগড় - সিদ্ধার্থ বসু
    ১৯) ফ্যাতাড়ুদের কুহক বিভ্রম, ফ্লাইং হিউম্যান বিইংস ও নবারুণের স্যাটায়ার সমূহ - পাপড়ি রহমান

    আগুনের মুখ
    ==========
    ২০) নবারুণ ও বিপ্লব! - রক্তিম ঘোষ
    ২১) অ-ক্যাননীয় নবারুণ - শতাব্দী দাশ

    জ্যোৎস্নার তল্লাসী আলোয়
    ===============
    ২২) মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে নবারুণ পাঠ - রমিত দে
    ২৩) দূরপাল্লার একাকী দৌড়বীর - সরোজ দরবার
    ২৪) হাংরি জেনারেশন এবং নবারুণ ভট্টাচার্যঃ তুলনামূলক পাঠ - প্রবুদ্ধ ঘোষ

    বিকল্প রণনীতি
    ==============
    ২৫) তোমাদের কী শীত করছে এমন? - অনীক রুদ্র
    ২৬) এখনও আকাশ লাল।।। কখনও ঝাণ্ডা, কখনও চাপ চাপ - জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
  • সে | 198.155.168.109 | ০২ জানুয়ারি ২০১৬ ০৯:০৯644878
  • দারুণ
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১৭:০৯644879
  • http://www.aihik.in/aihik/Content/9/

    ফিরে এসো আগুন
    অদ্বয় চৌধুরী

    বিরাট, আদিগন্তবিস্তৃত কাচের দেওয়াল। ওপারে, হাজার হাজার কাক আছড়ে পড়ে সেই দেওয়ালের ওপর। কাচে ঠোকরায়, ডানা ঝাপটায়, ধাক্কা মারে, অথচ শব্দহীন। সেই অসংখ্য কাক ক্রমশ একটি দাঁড়কাকে রূপান্তরিত হয়। হারবার্ট এসে দাঁড়ায়। স্থির, অবিচল। তারপর, প্রচণ্ড এক শব্দে, এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে, ভেঙে পড়ে সেই কাচের দেওয়াল।

    হারবার্ট ফিরে আসে।

    “এর অনেক আগেই বিনুর কথামতো চিলছাদে হারবার্ট অনেক কিছু পুড়িয়েছে। দেশব্রতী, দক্ষিণ দেশ, চট্টগ্রামে ছাপানো একটি গেরিলা যুদ্ধের বাংলা ম্যানুয়াল, কিউবার ট্রাইকন্টিনেন্টাল পত্রিকা থেকে সংগৃহীত মলোটভ ককটেলের নকশা, রেড বুক, কিছু চিঠি। একটু একটু করে পুড়িয়েছে যাতে ধোঁয়া কম হয়। কেউ বুঝতেও পারেনি।”

    হারবার্ট পুড়িয়েছিল। মলোটভ ককটেলের নকশা। একটু একটু করে। যাতে কেউ বুঝতে না পারে।

    বুঝতে পারি না। আমরা কেউ। কিন্তু, নবারুণ? তিনি বুঝেছিলেন,
    “সবকিছুই পুড়ছে।
    যদিও আগুন দেখা যাচ্ছে না।
    তবে একসময় তা দৃশ্যমান হবেই।”

    হারবার্টও পুড়ছে। চিলছাদে জ্বালানো আগুনে। যে আগুনে সে একদিন পুড়িয়েছিল মলোটভ ককটেলের নকশা। এখন, ধিকিধিকি জ্বলা সেই অদৃশ্য আগুনের মাঝে সে খোঁজে সেই নকশা। তবেই তো নেভানো যাবে অদৃশ্য আগুন। মলোটভ ককটেলের দৃশ্যতঃ ঝলসানো আগুন দিয়ে—

    হারবার্ট ফিরে এসেছে। নবারুণ ভট্টাচার্যর প্রথম মৃত্যুদিনে। ‘মলোটভ ককটেল’ সংখ্যায়। এখানে, মলোটভ ককটেলের নকশা সন্ধান জারী থাকে। হারবার্ট জারী রাখে। নিজের হাত পুড়িয়ে— শরীর পুড়িয়ে। সে আগুনে আমরাও, হারবার্টের মতো, হাত পোড়াব— পোড়াব শরীর, মন, মনন। তবেই তো আগুন নিভবে। তবেই তো ঘটবে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ।

    ‘মলোটভ ককটেল’।
    ============================================

    মিথ্যে ভাঙার ভাষা**

    নবারুণ ভট্টাচার্য

    মুখ ও মুখোশ শীর্ষক এ আলোচনার পরিসর বিস্তৃত। তাই এ বিষয়টি আলোচনার সূচনা করা হোক আমাদের আপন সমাজ থেকেই। উনিশ শতকের বাবু সংস্কৃতি থেকে হালফিলের বাঙালি সমাজ। এ সমাজের মুখোশের প্রতি আনুগত্য সীমাহীন। যে মুখোশকে ছিঁড়তে আমার ফ্যাতাড়ুরা ঘুরে বেড়ায় এ শহর, এ রাজ্যের গোটা আকাশে।

    কী লিখি, কেন লিখি?
    যেকোনো সাহিত্যিকের কাজই হল পুরোটা expose করা, innate গণ্ডগোল, লুকিয়ে থাকা সত্যের অবয়বটাকে সদৃশ করে তোলা। আর সবটাই আমি করি একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। আমি আপামরই একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যাঁর মধ্যে প্রত্যক্ষ রাজনীতি কোনও দিনই ছিল না, নেই; অথচ সেই আমি ‘মানুষটা’ই রাজনীতি বাদ দিয়ে বড় অনুন্নত। আর লেখাটা আমার politics-এর extension, এমনকী আমার অস্তিত্বের প্রকাশও বটে। সমাজের প্রতি আমার অনুভূতি, তথাকথিত প্রচলিত মধ্যবিত্ত সমাজের থেকে একদমই বিরূপ। তাকে গ্রহণ না করেই আমি লিখছি, লিখব। শুধু লেখার বিষয়বস্তু নয়; তার গঠন, শৈলী, ভাষা, লেখার আদর্শ পুরোটাতেই তার ছাপ ফেলে যায়। আর বাঙালী সমাজ একটা এলিয়েনেশন-এর শিকার। আজ কালচারাল স্টল ওয়ার্ট বলতে একটা refined mediocrity-কে বোঝায়। পুরোটা এতোটাই সাংঘাতিক পর্যায়ে গেছে যে বাঙালি নতুন করে ভাবতে পারছে না। কেন বা তার কারণ বিশ্লেষণী ক্ষমতা অবশ্য আমার সহজাত নয়। বাঙালী খুব স্থিতাবস্থা ভালোবাসে। ত্রিশোর্ধ বছরের স্থিতাবস্থা মানুষ ভাঙলেও পুরো কর্মকাণ্ডের ফল কিন্তু ‘পুনঃ মুষিক ভব’। পঁয়ত্রিশ বছরের এই অচলায়তন ভেঙে কী হল সেটাও অবশ্য যথেষ্ট চিন্তাযোগ্য। বিনায়ক সেন ছাড়া পাওয়ার পর একটি সভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গবাসীও সদ্য কারাগারের লৌহ কপাটকে তুচ্ছ করেছে। তবে সেই মুক্তির সাময়িকতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল আমার আর সেই সন্দেহকে সত্যি প্রমাণিত করেই সেই সাময়িক স্থিতাবস্থার প্রত্যাবর্তন— ফলাফল আমরা গাড্ডায়! অবশ্য এগুলোকে আমি খুব একটা পাত্তা দিই না। ইতিহাসে অনেক কিছু ঘটে আবার ধুয়ে মুছে যায়। খুব বেশি পাত্তা এদের যেমন প্রাপ্য নয় আর ওদের ফ্যাসিস্ট Demagogy-র পরিণতি সুখকর নয়।

    মুখোশহীন চরিত্রের সন্ধানে
    ‘আগুনমুখো’–র যে ছেলেটা আগুন ছুঁড়তে ছুঁড়তে ক্লান্ত হয়ে বমি করে, মিছিল তাকে ফেলে চলে যায়। তবু সে সেই মিছিলে আবার ফিরতে চায়। বস্তুত, একটা বড়ো জনযাত্রা কখনই থেমে থাকতে পারে না, যে অসুস্থ হয় তাকেই সাময়িকভাবে সরে যেতে হয়। কিন্তু তার মিছিলে ফিরে যাওয়ার প্রয়াস কিন্তু থেকেই যায়— সেটা কাম্য। তবে সে মিছিল কিন্তু মুখোশ নয়, ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা, ফুটে ওঠা একাকী চরিত্রগুলি আমার জীবনের রাস্তা থেকেই কুড়ানো নুড়ি। যা কিছু ঘটে তার অংশগ্রহণেই লেখাগুলোকে খুঁজি, লেখার ধান্দা নিয়ে আমি reality-তে যাই না, কারণ এ reality-ই আমাকে সব কিছু দিয়েছে। আর তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়াসই হল আমার লেখা। ফ্যাতাড়ুরা কোনও সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফসল নয়। অবচেতন মনের কোণে তাদের জন্ম, আবার অবসরের চিন্তায় তাদের শৈশব, কৈশোর আমি কখনও না লিখলেও, মাথার মধ্যে চরিত্রগুলো থাবা বসায়। এভাবেই চিন্তাগুলো সঠিক সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের পরিপূর্ণ করে তোলে।

    সাদা মুখোশ
    মুখোশ সম্বন্ধে বলতে পারি, পুরো ব্যাপারটাই হল প্রয়োজনীয়তা, অর্থাৎ কী কারণে মুখোশটা পরবে? একজন ক্রান্তিকারী পরবে মুখোশ, তার মুখোশটাই তখন অবস্থার কথা বলবে, সেই উদ্দেশ্য কিন্তু স্বাগত। এই মুখোশই আবার হতে পারে মুখের পরিবর্ত। এক মানুষের হাজার সত্তা তো থাকতেই পারে। যেমন লেখক পরিচিতি নিয়ে আমি রাস্তায় বেরোতে পারিনা, আমার চরিত্রগুলো খুঁজে পাওয়ার তাগিদটা তখন বড় হয়ে ওঠে বলে। নানাভাবে নানাস্থানে মিশতে হয় বলেই কিন্তু আমার হাজারটা মুখোশ নেই। আমি সচেতনতাকে সঙ্গী বাছলে মুখোশ তখন অবাঞ্ছিত। ক্ষতিকর মুখোশ ভাঙায় আমি বিশ্বাসী আর নিরামিষ মুখোশ অনেকাংশেই মিশে যায় মুখের সঙ্গে— সে মিশে যাক। যেমন বলতে পারি সন্তানের সামনে রাশভারি সাজা কিন্তু নিন্দনীয় মুখোশের বিজ্ঞাপন নয়। মুখোশের মোদ্দা কথাটাই হল প্রয়োজন পূরণে তার আগমন হলেও পরবর্তী ক্ষেত্রে তার ঔচিত্য হল প্রকৃতপক্ষে নান্দনিক অনুভূতির প্রকাশ মাত্র। ইতালিতে একটি প্রেমের উৎসবই হয় মাস্ক নিয়ে— ভেনেসিয়ান মাস্ক— হয় মেক্সিকোতেও। এগুলোর প্রত্যেকটাই একটা সামাজিক বার্তা বহন করে।

    কালো মুখোশ
    মধ্যবিত্ত সমাজ এক অদ্ভুত hypocrisy-তে আক্রান্ত। যে যা নয় তা দেখাতে— আর যা সে নিজে তা দেখতে চায় না। এই hypocrisy-র জালে সে ছটফট করে। এর আদর্শ উদাহরণ যে বাঙালি বুদ্ধিজীবি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের মুখে বসে গেছে শঠতা, আড়ালে রাখতে চাওয়া মুখোশগুলো— That has got to be combated। রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী ও মিথ্যাচারের মুখোশ কিন্তু ভয়ঙ্কর। অথবা উন্নততর মানবিকতা ‘দেখানোর’ প্রয়াসের অন্তরালে গর্জে ওঠা কালোবাজারি ব্যক্তিত্বই প্রকৃত মুখোশ। যা কিছু দৃশ্যমান, যেমন ভারতীয় গণতন্ত্র এক বৃহৎ মুখোশ। ‘দেশ’, ‘হাসপাতাল’ উদ্দেশ্য বিচ্যুত আজ, তারাও মুখোশ। সত্তরের আন্দোলন ছিল এমনই এক মুখোশ ভাঙার খেলা, যা কিন্তু বাহ্যিক ভাবে ব্যর্থ হলেও প্রকৃতপক্ষে ব্যর্থ নয়। যে কোনও আন্দোলন কালের নিয়মে নিঃশব্দ হয়, গভীরে চলে যায়, আর্টের্জিয় জলের মতো ফিরে আসে আবার। আমি অপরাজেয় সংগ্রামে বিশ্বাসী। তারই প্রেক্ষিতে বলতে পারি কোনও আন্দোলনই ব্যর্থ হয় না। সত্তরের আন্দোলনের সাফল্য এটাই যে সেই সময় সমগ্র রাজ্যের নজর এনে দিল কৃষক ও তাদের জমির ওপর। প্রথম বামফ্রন্ট সরকার দিল গরিব চাষিকে জমির পাট্টা। ভাগচাষী, খেত-শ্রমিকরা পেল আইনি জমির মালিকানার স্বাদ। তবে মুখ পাল্টায়, নাহলে কমিউনিস্টদের মধ্যে ফুটে উঠলো কংগ্রেসি কালচার! তবে বাঙালিরও কিছু চারিত্রিক দোষ ছিলো, যার মধ্যে একটি হল বাবু কালচার। যার দ্বারা প্রভাবিত ওই ধূতি-পাঞ্জাবি পরা মুখ্যমন্ত্রীগণ যাদের কার্যকলাপ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তার নজির মিলল সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে। আর তার সুযোগ নিয়ে যারা ক্ষমতায় এল তারা আরও বেশি খারাপ। যেমন আমি মনে করি, আজকে যদি ওই বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে সে আগের রূপ কখনোই ধারণ করতে পারে না। ইতিহাস সহবত শেখায়, চাগায়।

    মুখোশ সমাজে গরিবেরা
    এই প্রসঙ্গে বলি, জীবনের বেশিরভাগটাই ট্র্যাজিক। আনন্দের মুহুর্ত জীবনে হাতে গোনা, ট্র্যাজেডিটাকেই ধারাবাহিকভাবে বহন করে যেতে হয়। আর গরিব মানুষ তো দুঃখের সলিলেই সমাধিস্থ থাকে। অবশ্য তারা সেটাকে পাত্তা দেয় না, আর পাত্তা দিলেও তো তাদের জীবন সমস্যামুক্ত হবে না। দৈনন্দিন প্রাত্যহিক বঞ্চনা স্বীকার করে যে ছেলেটা জিন্‌স পরে রিকশা চালায় সে তার জিন্সের ব্র্যান্ড না থাকা সত্বেও কিন্তু খুশি। তাদের কথা বলতেই আবির্ভাব ফ্যাতাড়ুদের, যারা প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞাত পরিচয় জনমিছিল, তারা শ্রমজীবি হতে পারে বা কৃষক। তাদের এই মুখোশহীন সংগ্রাম কিন্তু চলবেই। তবে যে গরিব সিপিএম বিনা কারণে প্রাণ হারাচ্ছে মাওবাদীদের হাতে, তাদের কোন দোষ নেই। তারা তো মাওবাদীদের শ্রেণীশত্রুও নয়। তারা কী? শুধুমাত্র বঞ্চনার শিকার, যা তাদের ললাটে লিখন হয়েছে বুর্জোয়া politics-এর দেশে।
    মুখোশের জন্ম, মুখোশের পরিবার— সাধারণ মানুষের শৈশবেই তাকে মুখোশ পরিয়ে দেওয়া হয়। সে তার অভিভাবককে মিথ্যাচারী হতে না দেখলে, সে কখনোই মিথ্যা বলবে না। পরোপকারী অভিভাবকের সন্তান কখোনই গড়ে তোলে না স্বার্থমুখর খাদক সমাজ। ভোগবাদ এ সমাজের এক বড়ো কলঙ্ক। ভোগের পিছনে দৌড়ানো ছেলেটি কখন যে নিজেই হয়ে ওঠে ভুক্ত, সে বুঝতেও পারেনা। Consumer world-এর এটাই মূল উপজীব্য যে সেই সংস্কৃতিকে সে খাদ্য হিসাবে বেছে নেয়। Consumer world-এর মুখোশের গভীরতা অনেক বেশি। তা কামড়ে বসে এই সমাজ ব্যবস্থার প্রতিটি অঙ্গে।

    Masked Media, Masked Literature
    কয়েক বছর আগে ভারত, কিউবা সহ কয়েকটি দেশ মিলে Non-align news pool তৈরী করেছিল। যার প্রতিকী উদ্দেশ্যই হল, ক্যালিফোর্নিয়ার একটি Night club-এ চারজন Bar-girl-এর অগ্নিদগ্ধ হওয়ার থেকে কোনও বন্যায় মৃত চল্লিশ হাজারের খবরের তাৎপর্য বা ওজন অনেক বেশি। মিথ্যারূপ তুলে ধরে নিজ স্বার্থ্যাচারণকারী গণমাধ্যমই তো আসলে মুখোশ। Political calculation করে যারা কাউকে ফেলে, কাউকে তোলে, হাওয়া তৈরী করে, শ্বাসরূদ্ধও করে। আর এই অসংখ্য মুখোশের দাবিতে, আক্রমণে মানুষ আজ ঘুরপাক খাচ্ছে, টেলিভিশন শো-তে বসা কয়েকটা নির্দিষ্ট ‘কুমিরের ছানা’ নির্দিষ্ট ওপিনিয়ন তৈরী করছে। এরা কারা? কেন আমি এদের কথা শুনব? আমার তো নিজস্ব মস্তিষ্ক আছে, আমি নিজে বিচার করব। অথচ মানুষ শুনছেও এইসব পূর্বনির্ধারিত কর্মকাণ্ড।
    মুখোশের সাহিত্যও খুব শক্তিশালী, তবে আমি সেগুলো পড়িনা, এগুলো just nonsense। যারা তাদের লেখার সম্ভার নিয়ে আসছে তাদের অনেকেই কিন্তু মুখোশহীন, ইদানীং দেখছি market-টাই প্রধান; যদিও বিভুতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়র কাছে ছিল সাহিত্যি তপস্যা, আর যদি মানুষ সেই nonsense লেখা পড়ে, পড়ুক; আমি তাদের সর্বদা গুরুত্ব দিয়ে চলার মানুষও নই। ওদের প্রতি আমার কোনও বিশেষ দায় না রেখেই বলছি আমি নিজ মর্জির মালিক।

    গান্ধী, বুদ্ধ ও ইতিহাস
    ধর্মপ্রবর্তকদের মুখোশ নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। মতান্তরে, গান্ধীজিরও নাকি মুখোশ ছিল। তবে তাদের মুখোশহীন কার্যকলাপই আমায় আকৃষ্ট করে। They are great human symbols। তাদের ইতিহাস থেকে অনেক কিছুই শিক্ষণীয়। আর ইতিহাস— সে বড়ো নির্মম; কালের নিয়মে সে ছুড়ে ফেলে দেয় অপ্রকৃতদের। আর সেই ইতিহাসই আমার বড় প্রিয়। আটষট্টির ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় সৈনিক হয়ে বলতে পারি যে আমি সেই ইতিহাসের ঘ্রাণ নিয়েই বেঁচে আছি। এ ইতিহাস আমায় বড়ই ভাবায়, আবার এ ইতিহাসই শতশত মুখোশের অন্তিম চিতার আগুন, সে আগুনের সাক্ষী।

    আদর্শ সমাজ ও মুখোশ
    আমরা সবাই আদর্শ সমাজকে ছুঁতে চাই। যদিও তার বাস্তবতা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। মানুষ আদর্শ সমাজ গড়তে কিঞ্চিৎ হলেও অসফল হবে। তবুও আশাবাদী যে সমাজ হবে মুখোশহীন আর সেই অভিযান নিয়েই আবার ফিরে আসবে ফ্যাতাড়ুরা, উড়ে বেড়াবে মুখশহীন সমাজের বুকে। আর এবার তারা প্রবেশ করবে high thinking world দিয়েই।
    অপেক্ষায় থাকুন।
    ** ঐহিক সাহিত্য পত্রিকার ২০১৩ বইমেলা সংখ্যা “মুখ ও মুখোশ”-এ ‘কথনের আয়না’ বিভাগে প্রকাশিত। অনুলিখন: শৌনক চ্যাটার্জী।

    ==================================================

    নবারুণের প্রেত ও অনুপস্থিতির বিশ্বাসঃ ‘ও হরিনাথ, আছে আছে, সব আছে, সব সত্যি’

    অর্ক চট্টোপাধ্যায়

    “A ghost is an emotion bent out of shape condemned to repeat itself time and time again until it rights the wrong that was done.”

    ---- মামা (২০১৩), স্প্যানিশ-ক্যানাডিয়া�� � হরর ফিল্মে নামহীন এক পার্শ্বচরিত্রের সংলাপ

    নবারুণের প্রেতেরা কি পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে ভুল ঠিক করতে চায়? কি ভুলের ডাকে তারা ফিরে আসে রাত-বিরেতে? আত্ম-সংশোধন নাকি জগত সংশোধন? কোনটা চায় তারা? তারা কি আদৌ ভুল শুধরোতে পারে নাকি শুধরোতে গিয়ে বারবার ভুল করে ফ্যালে? তারা কি সত্যিই অনুভবের দোসর নাকি শরীর থাকে তাদের? ভূতেদের উগরোতে গেলে শরীরে ফিরিয়ে আনতে হয় কি? এই শবসাধনা অলীক অতীত থেকে আসে নাকি অসম্ভব ভবিষ্যৎ থেকে? নাকি অতীত এখানে ভবিষ্যতে আর ভবিষ্যৎ অতীতে প্রেতস্থ হয়? নবারুণের মৃত্যুদিন উপলক্ষে অধুনা প্রেতপ্রাপ্ত লেখকের প্রেতভাবনা নিয়ে লিখতে বসে সর্বাগ্রে মনে হচ্ছে রেফারেন্সের প্রেত কিম্বা প্রেত-রেফারেন্সের কথা। অন্য কাহিনীর, অন্য সময়ের, অন্যান্য স্বরের এবং অন্য জীবন-মরণের ছায়া আদল কিভাবে (ইন্টার)-টেক্সচুয়াল প্রেত হয়ে ওঠে তা নবারুণের থেকে ভালো ক’জন লেখক জানেন?হারবার্টের প্রত্যেক অধ্যায় শুরু হয় উনিশ শতকের বাংলা কবিতার যেসব পঙতি দিয়ে সেগুলোর আধুনিকতার সাথে উপন্যাসে বিম্বিত অপসৃয়মান পুরনো কলকাতার সম্পর্ক কি প্রেতসম্পর্ক নয়? গদ্যের আবডালে এসকল প্রেতকাব্য নবারুণের নিজের ভাষায় বলতে গেলে ‘ইতিহাসের ফাঁকগুলোকে সাজানো।’ অন্যদিকে লুব্ধকের শরীরে যেভাবে সেঁধিয়ে যায় বুল্গাকভের হার্ট অফ আ ডগ বা চে গেভারার দিনলিপি, তাও কি এক প্রেত-রেফারেন্স নয়।

    ঋত্বিক ঘটক স্মরণে নবারুণ নিজেই স্বীকার করেছেন যে হারবার্টের বিনু সুবর্ণরেখার বিনুর ছদ্ম-সম্প্রসারণ। নবারুণ বলেছেন হারবার্টের বিনু বড় হয়ে উঠেছে সুবর্ণরেখার শেষ দৃশ্য থেকে যেখানে সে তার মামার সাথে নদী পেরিয়ে ‘নতুন বাড়িতে’ যাবার কথা বলে। সেই নতুন বাড়ি ঋত্বিকের সিনেম্যাটিক ভবিষ্যতের স্তম্ভ— যেখানে বাগানে প্রজাপতি ওড়ে, চারপাশ ঢেকে থাকে নীল পাহাড়। অথচ সিনেমা কখনোই সেই ‘নতুন বাড়িতে’ পৌছয় না। তা ভবিষ্যতের স্বপ্নে প্রেতপুরী হয়ে থেকে যায় যেন। নবারুণ বলেছেন ছোট্ট বিনু বড় হয়ে সত্তরের নকশাল-বাড়ি আন্দোলনের সময় সেই ‘নতুন বাড়ি’ই বানাতে চেয়েছে। এ যদি নবারুণের লেখায় প্রেতের একটি স্তরায়ন হয় তবে বিক্রমের পীঠে আরেক বেতাল এসে জুড়ে বসে, সিনেমা বা বই থেকে নয়, জীবন নামক বৃহত্তর এক টেক্সট থেকে। সুবর্ণরেখার বালক বিনুর ভূমিকায় আমরা যাকে দেখি তিনি নবারুণের ভাই শ্রীমান অশোক ভট্টাচার্য এবং নবারুণ ঋত্বিক সংক্রান্ত ঐ বক্তৃতায় নিজেই জানান যে শ্রীমান অশোক, তার ভাই, পরে জলে ডুবে মারা যায়। এই তথ্যের কুহক থেকে উঠে আসে আরেক প্রেত। পাঠকদের কি চিনতে অসুবিধা হয় হারবার্টের খোড়োরবির মধ্যে নবারুণের ভাই অশোককে? কিম্বা বিনুকে? প্রেত তো এমনই এক আত্মস্থ অপরঃ অপর সময়ের অতীত এবং অতীত সময়ের অপরঃ

    অথচ শত শত বছর ধরে চাঁদের আলোয় বা শীতের ভোরে কুয়াশায় তার প্রেম নিয়ে খোড়োরবি ঐ মরণজলে ভেসে থাকবে । তাকে ঘিরে মতসকন্যারা ওলটপালট করবে যারা কাঁদলেও তাদের চোখের জল কেউ দেখতে পাবে না।

    হারবার্ট জানে জলে ডুবে মরে গেলেও সে ডাকলে তার বন্ধু রবি আসবে। এই বন্ধুবিশ্বাস, অপরের আগমন নিয়ে এই প্রত্যয় নবারুণের প্রেতভাবনার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রেতেরা নবারুণের বন্ধু। সত্তরের মৃত্যু উপত্যকার লাশেরা নবারুণের ৯০এর উপন্যাসগুলিতে ইতিহাসের প্রেত হয়ে ফিরে আসে। প্রেতবন্ধুর কথা ফরাসী দার্শনিক জাঁক দেরিদাও বলেছেন তাঁর পলিটিক্স অফ ফ্রেন্ডশিপ গ্রন্থে, নীৎশে প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়েঃ

    These friends returned as the phantom of our past - in sum, our memory, the silhouette of the ghost who not only appears to us […] but an invisible past, hence a past that can speak, and speak to us in an icy voice, 'as if we were hearing ourselves'. [...] Not the past friend, but the friend to come. Now what is coming is still spectral, and it must be loved as such. As if there were never anything but spectres, on both sides of all opposition, on both sides of the present, in the past and in the future. All phenomena of friendship, all things and all beings to be loved, belong to spectrality.

    রাজনৈতিক সক্রিয়তার অতীতের এই প্রেত-সমাবেশ নবারুণের লিখন-জীবনের চরাচর জুড়ে, যেখানে যাপন, পঠন ও লিখন কোন এক একক সময়গ্রন্থি ধরে পরস্পরের পাশাপাশি আর ওপর-নীচ এসে বসে রয়েছে। লেখা কি প্ল্যানচেট নয়? লেখক কি শতসহস্র অযাপিত জীবনমরণ সম্ভাবনার মিডিয়াম নন?

    রেফারেন্স যখন ইকোর অনুরণনে টেক্সটের নারসিসাসকে খুঁজতে থাকে অবিরত, আর নারসিসাস জলে শুধুই নিজের ছায়া দেখে, ইকোর স্বর শুনতে পায় না, তখন সেই অনুরণন প্রেতপ্রাপ্ত হয়। প্রতীস্ব যেখানে অপরকে দেখতে পায়না, সেখানেও অপরের প্রেত প্রতিধ্বনি রয়ে যায়। নারসিসাসের আশেপাশেই রয়ে যায় ইকো। অমন মরণজলেই তো ভেসে উঠেছিলো রবি। স্বপ্নের অদ্রাব্য তরলের বাস্তুভিটা থেকে হারবার্টের কাছে ফিরে এসেছিলো। তারপর বিনু। আর তারপর মৃত্যুর স্বপ্নে বিনুর পাঠ করা সেই মন্দ্রাক্ষরঃ বারাসাতের শহীদ সমীর মিত্রের লেখা কবিতা। সেও তো বিশ্বাসের এক টেক্সট যা প্রেত হয়ে ফিরে এসেছে হারবার্টের স্বপ্নে। দেশজ প্রেততত্ত্বের স্বপ্নাদেশের ঐতিহ্যকে বারবার নবারুণ অবচেতন প্রেতের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন হারবার্ট উপন্যাসে। যেমন বিনুর স্বপ্নাদেশে হারবার্টের ডায়েরিপ্রাপ্তি। তাই ঘুমিয়ে পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবার আশ্বাস মিলেছে। আজ নবারুণের প্রেত যখন যাপনময় ভবিষ্যৎ থেকে নিজের অবিনশ্বরতা জ্ঞাপন করছে তখন সেই ভবিষ্যতকে ভাবতে আমাদের কোন পরলোক কল্পনায় যেতে হচ্ছে না। নবারুণের প্রেতেরা শেষ হিসেবে ইহলৌকিক। তাদের বিশ্বাস করতে হয় বদলের নিশানের মত কিন্তু এর জন্য কোন অতিন্দ্রীয় ঊর্ধ্বলোকে বিশ্বাস করার দরকার হয় না। এই বিশ্বাস রাজনৈতিক, ধর্মীয় নয়। এই রাজনৈতিক প্রত্যয়, নেই জেনেও আছে’র বিশ্বাস; নবারুণের নৈরাজ্যবাদী অবস্থানে কিছু হবার নয় জেনেও লড়াইয়ের বিশ্বাস। এই বিশ্বাস ‘মার্ক্সবাদ সত্য কারণ আমি উহা বিশ্বাস করি’ জাতীয় বিশ্বাস নয় যা মার্ক্সকে রাজনীতি ও দর্শনের পরিসর থেকে ধর্মীয় ডগমার দিকে নিয়ে যায়।

    নবারুণের প্রেত বর্তমানের ক্রিপ্টে উপ্ত অতীত যা একদিন না একদিন ভবিষ্যৎ হয়ে দেখা দেয়। সেই একদিন কোথায় কবে কখন কেউ জানে না। অথচ সেই প্রেত বিস্ফোরণ ঘটবেই আর রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে এই ঘটনার ধারাপাত অপাঠ্য থেকে যাবে। এই প্রেত হারবার্টের খাটে ২০ বছর আগে বিনুর লুকোনো ডায়নামাইট যা কিনা চুল্লীতে তার বিছানা ঢোকাতেই ফেটে পড়ে। গোলকায়িত বহুতলের নীচে লুকিয়ে থাকে যুদ্ধ পরিস্থিতির বন্দুক। তিন দশক ধরে রিভলভারের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা একটিমাত্র গুলি হত্যা ডেকে আনে উদ্বৃত্ত সামাজিক খেলাধুলায়। এরা সবাই সময় তথা ইতিহাসের প্রেত, ইহজগতের প্রেত যারা ইতিহাসের একেকটা সন্ধিক্ষণে ধামাচাপা পড়ে গেলেও ইহজগতেই অন্য সময়ের ভেতর এসে হঠাৎ একদিন আঘাত হানে। তবে নবারুণ সবসময় প্রেতেদের বন্ধু এটা বলা কঠিন। বন্ধু না হলেও তিনি এদের ডকুমেন্ট করতে চান। হারবার্টের বিস্ফোরণ বা যুদ্ধ পরিস্থিতির বন্দুকদল অসম্ভব বিপ্লবের ছেনালি নিয়ে আসে, কিন্তু ‘আমার কোন ভয় নেই তো’ গল্পে ৭০ দশকের চাইনিজ রিভলভারের ব্যারেলে ৩০ বছর যাবত আটকে থাকা একটি বুলেট কোন শ্রেণীশত্রুকে অপসারণ করে না, অপসৃত হয় ভীত ত্রস্ত এক কমন ম্যান যে পরিবর্তনশীল সমাজে ক্রমেই উদ্বৃত্ত হয়ে উঠেছিলো। প্রেত-অবশেষ এখানে বিপ্লবকে উদ্বৃত্ত করে দিয়ে রাজনীতির লুম্পেনাইজেশনের নিশান হয়ে যায়। ২০১৫র বাংলায় রাজনীতির এই লুম্পেনাইজেশন যখন চূড়ান্ত এবং অসীম, তখন নবারুণীয় প্রেতের প্রাসঙ্গিকতাও একইরকমভাবে গগনচুম্বী। প্রতীকী পরিসরে নবারুণের প্রেতভাবনার ভিত্তিকে তাই কোন সরল অর্থে প্রতিস্পর্ধী বলা মুশকিল; বরং ভৌতিক প্রত্যাবর্তনের এই অবশেষ রাজনীতির প্রেতায়নকে বিপ্লব এবং প্রতিবিপ্লব এই উভয় মেরুর নৈরাজ্য থেকেই দেখতে জানে।

    হারবার্ট লেখেঃ “মানুষ যদি ১ হয় তাহলে ০ হল মরা মানুষ। মরা মানুষ = ১+০-১= খোড়োরবি।” এই গাণিতিক সূত্রটির উপাদানগুলির অবস্থান খেয়াল করলেও একভাবে বোঝা যায়, যে মৃত্যু মানুষকে মরা মানুষ বানিয়ে প্রেতের দিকে নিয়ে যায়, নবারুণের তাকে রোপণ করতে ধর্মকল্পিত পরলোক লাগে না। ১ গুণতে গেলে ০ থেকে শুরু করতে হয়। প্রেত খোড়োরবি যদি ০ হয় তবে তার ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুই অন্তরমেরু হিসেবে তার দুদিকে থাকে দুটি ১। একটি ১ যোগ হয় আর অন্যটি বিয়োগ। যোগ বিয়োগের শেষে আবার আমরা ০ তেই ফিরে আসি। নবারুণের সমীকরণে শূন্যের অবস্থান, দুটি ১ এর বাইরে নয়, বরং ভিতরে । ০ কে দুদিক থেকে বেষ্টন করে রয়েছে দুই ১। আমরাও তো এভাবেই আমাদের ভবিষ্যতের মরদেহকে বয়ে বেড়াই আমাদের জ্যান্ত শরীরে। নবারুণ একটি ইন্টারভিউয়ে বলেনঃ

    আমি যতই যুক্তি দিয়ে বুঝি মৃত্যু কি সে সম্বন্ধে জানা আমার শেষ হয়নি। হয়তো যে মোমেন্টে আমি মরব আমি জানতে পারব বা পারব না কিন্তু ওই মুহূর্তটাকেও আমায় ধরতে হবে, জানতে হবে। এই ইন্টারনাল problems যা মানুষ ফেস করে আমরা শ্মশানে গেলে ফেস করি। কোন প্রিয়জনকে যখন শেষবারের মতো চলে যেতে দেখি--- এগুলোর ব্যাখ্যা আমরা জানি না।

    নবারুণের লেখায় প্রেত তার নিজস্ব ধারা ও প্রতর্ক নিয়ে আসে। চিলছাদ থেকে হারবার্ট খুঁজে পায় দুটি বই যা তার ‘মৃতের সহিত কথোপকথনে’ পাথেয় হয়ঃ শ্রী মৃণালকান্তি ঘোষ ভক্তিভূষণের পরলোকের কথা ও কালীবর বেদান্তবাগীশের পরলোক রহস্য। উপন্যাসে এই বইগুলির কাট আপ কোলাজও ব্যবহার করেন লেখক। ‘ভূতের জলসায় গোপাল ভাঁড়’ এবং ‘সার্কাসে ভূতের উপদ্রব’এর মত সাহিত্যিক রেফারেন্সও থাকে এই প্রেতপাঠে। উপন্যাসের পঞ্চম অধ্যায়ে নবারুণ যখন হারবার্টের প্র্যাকটিসকে দেশজ ও পাশ্চাত্য প্রেততত্ত্বের পরিসরে স্থাপন করেন তখন বারবার হারবার্টের দেশজ প্রেতালাপের সাথে ইউরোপের প্যারাসাইকোলজির দূরত্ব দর্শিত হয়; কিন্তু দূরত্বও তো সম্পর্ক থেকেই তৈরি হয়। হারবার্ট সরকারের প্রেত উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক বাংলার প্রেত-অবশেষ, যার বলে হারু হারবার্ট হয় বা হারবার্ট হারু। তার বাবার বাবুয়ানি থেকে তার শরীরে উঠে আসা এই প্রেতনাম ‘হারবার্ট’ তাকে মার্ক করতে ছাড়ে না। আর নিজেরই অজান্তে নকশালি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেই সাহেবি নামকেই শেষপর্যন্ত আন-মার্ক করে হারু। ঔপনিবেশিক জ্ঞানের লেনদেনে ভারতীয় প্রেততত্ত্বে সাংস্কৃতিক সংকরায়নের হাওয়া লেগে উনিশ শতকের কলকাতায় প্ল্যানচেট ব্যপারটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। হারবার্ট উপন্যাস জুড়ে পরলোকের কথা ও পরলোক রহস্য -এর উদ্ধৃতি ব্যবহার করে নবারুণ প্রেততত্ত্বের এই ঔপনিবেশিক এবং ঐতিহাসিক সংকরায়নকে বারবার ডকুমেন্ট করে যান। ভারতীয় লোকবিশ্বাস ও পাশ্চাত্য প্যারাসাইকোলজির এই সংকর-প্রতর্ক মূলধারার পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী কাঠামোর চিন্তানির্যাসকে কটাক্ষ করে যায়। স্বপ্নলোকের অবচেতন থেকে উঠে আসা এইসব সশরীরী অশরীরীরা স্বপ্নের অপরজগতকে ইহজাগতিক (materialist) করে তোলে।

    সদ্য কলেজে ওঠা একটি ছেলে যাবার সময় হারবার্টকে বলে, সে যা বলছে, সবই ‘ভেগ’, ‘কংক্রিট’ কিছু সে বলতে পারছে না। এই ‘ভেগনেস’ তথা অস্পষ্টতা অপাঠ্যতার দিকে হেলে থাকে; যুক্তির রৈখিক পাঠকে সমস্যায়িত করে তোলে। এই অস্পষ্টতা নবারুণীয় প্রেতের স্বাক্ষর। এই প্রেতেরা বিমূর্ত হলেও সংক্রামক। যুক্তিবাদী সমিতির সাথে হারবার্টের কথোপকথনে ‘ইংরিজি মারানো’ যুক্তিবাদের উল্টোদিকে হারবার্ট সরকারের ‘বাংলা খিস্তির’ ‘দোবেড়ের চ্যাং’ বিশ্বাস, দ্বান্দ্বিকতার প্রতর্ক তৈরি করে। আর শেষে মৃত্যু-পরবর্তী বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে নবারুণের প্রেতযান পরলোক থেকে ইহলোকে ফিরে আসে। ভোগী তাই শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অবক্ষয় আর অপঘাতে মরতে থাকা প্রেতেদের দুনিয়াকে আলাদা করে দেখে নাঃ

    ঘরে ঘরে দেখ পোয়াতি মেয়ে ফলিডল খেয়ে মরতেচে, ধস্সন হচ্ছেন, আর ঐ গুয়োর ব্যাটা মদ্দগুলো মদ-গ্যাঁজা ছেড়ে এখন সব ট্যাবলেট খাচ্ছে। অপঘাতে মরতেচে বলে অশরীলীর সংখ্যা কত বেড়ে গেছে হদিশ করা যায় না--ও আমরা বুঝতি পারি-- হল্লাভূত, যক, কন্ধকাটা, জলাবুড়ি, একনিড়ে, গুমো, পেঁচো, গলায় দড়ে--ও সে যে কী কান্ড কী বলব আপনারে—

    নবারুণের বিশ্বাস গল্পের প্রেতবিশ্বাস, অন্ধবিশ্বাস বা ধর্মীয় ডগমা নয়। তাই ‘এক টুকরো নাইলনের দড়ি’ গল্পের জগদীশ পাল যতই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতীদের মরণদড়ি সংগ্রহ করে নিজের ভাগ্য ফেরাতে চান আর দড়ির বলে ফাঁড়া কেটে যাবে ভেবে নিশ্চিত হয়ে যান, দড়ি কিন্তু শেষে কোন কাজই দেয় না। হাসপাতালের চৌহদ্দিতে তিনি যখন এই তান্ত্রিক বিশ্বাসের গল্প করেন কাহিনীর কথককে, তখন তার ছেলে ফুটবল মাঠে চোট পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসারত। যতই তিনি দড়ি আগলে ভাবেন ছেলের কিছু হবে না, গল্পের শেষ বাক্য নির্দ্বিধায় ঘোষণা করে পরদিন সকালেই হাসপাতালে ছেলেটির মৃত্যুর কথা। এ হল নবারুণীয় প্রেতভাবনার আরেক পীঠ যেখানে অতিযৌক্তিক আর যুক্তিহীন বিশ্বাসের মধ্যে এক ভেদরেখা চোখে পড়ে। বিশ্বাস নিজের চারপাশে যে গল্প রচনা করে তা সবসময় বাস্তবতায় মেশে না, অনেকসময় নিছকই নিজের মধ্যে আটক হয়ে থেকে যায়। কিন্তু তাও তো সাধারণ মানুষ এমন সব ওপিয়াম নিয়েই বাঁচে আর কমন ম্যানের এই বেঁচে থাকাকে অ্যাজ ইট ইজ ডকুমেন্ট করতে নবারুণ কখনো পিছপা হন না।

    হারবার্ট কিম্বা ভোগী--এইসব চরিত্রেরা কি আদৌ কোন প্রেতাবেশ জানে? এরা কি স্রেফ বুজরুকি করে নাকি যুক্তিজালের বাইরে কোন এক সমান্তরাল অথচ ইহজাগতিক অপর পৃথিবীর ইন্ধন যুগিয়ে যায়? নবারুণ এই প্রশ্নটা তোলেন কিন্তু এর নিষ্পত্তি ঘটান না। তাঁর নৈরাজ্যে, অতি-যৌক্তিক, উদ্বৃত্ত এই সাধারণ লোকেরা গোলকায়িত নাগরিকতার চলনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে না নিতে পেরে একে একে অন্তর্হিত হয়। হারবার্ট আত্মহত্যা করে আর ভোগীকে মরতে হয় কাতানের কোপে। এই আত্মঘাতীদের ভূত নামানো বা ভবিষ্যত বলতে পারাটা সত্যি না মিথ্যে সেই প্রশ্নটা গৌণ। নবারুণের কাছে এদের গুরুত্ব হল এদের ট্র্যাজিক ভ্যালু। এদের প্র্যাকটিস পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির করায়ত্ত হবার আগেই লেখক নবারুণ এদের প্লট থেকে তথা পৃথিবী থেকেও সরিয়ে নেন। ডায়নামাইট তাও ফাটে। ভোগীকে নিয়ে সিনেমা তাও থেকে যায়। মৃত্যু-পরবর্তী এইসব প্রেত-অবশেষের মধ্যে দিয়েই নবারুণের পরলোক ইহলোকে ফিরে আসে। ফিরে আসে দ্বান্দ্বিক এক বাস্তবতায়। ধর্ম ও কুসংস্কারের ট্রোপগুলিকে ব্যবহার করলেও নবারুণ শেষপর্যন্ত এদের স্যাবোটাজ করতে ছাড়েন না। তিনি প্রেততত্ত্ব ও পরলোকতত্ত্বের সংকরায়িত সাংস্কৃতিক প্রতর্কগুলির মধ্যে দিয়ে নিজের গদ্যের রসায়নকে চালিত করে শেষে তাদের অপরত্বকে কোন অতীন্দ্রিয় ঊর্দ্ধজগতে স্থান না দিয়ে মাটিতে নামিয়ে আনেন। নবারুণের প্রেতেরা যুক্তির রৈখিক চালচিত্রের বাইরে, বদলের প্রত্যয়কে হেরে গিয়েও বিশ্বাস করতে শেখায়। ভোগীর ত্যাগ, যাকে নবারুণ অব্যর্থভাবে ‘acquisitive society’ বলেছেন, তার বিপরীত স্রোতে পরাজয়ের প্রটেস্ট হয়ে থেকে যায়।

    এই বিশ্বাস আর কিছু না হলেও গল্পের বিশ্বাস। যেকোনো গল্প পড়তে গেলে, শুনতে গেলে, দেখতে গেলে যেমন তার অনুপস্থিত জগতকে, অনুপস্থিত চরিত্রগুলোকে আর না ঘটা ঘটনাগুলোকে বিশ্বাস করতে হয়। আমরা নবারুণের উপন্যাসগুলো পড়ার সময় জানি অমন কোন অন্ধ বেড়াল নেই, অমন কোন হারবার্ট নেই, নেই লুব্ধকের ছায়া কুকুরেরা, আমরা জানি নেই তবু পড়তে গেলে আছে বলে বিশ্বাস করতে হয়। নবারুণীয় প্রেতের বিশ্বাসবোধ অলৌকিককে অতিলৌকিক দিয়ে ঘিরে রাখে। বিস্ফোরণ না হলেও ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বাস রাখতে হয় প্রেতেদের বিস্ফোরণে।

    গ্রন্থসূত্রঃ

    নবারুণ ভট্টাচার্য, উপন্যাস সমগ্র।
    জাঁক দেরিদা, পলিটিক্স অফ ফ্রেন্ডশিপ।
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১৭:১৬644880
  • http://www.aihik.in/aihik/Content/9/

    স্মৃতি-যোদ্ধা নবারুণ

    হিন্দোল পালিত

    “১৯৯২ সালের মে দিবস। রাশিয়াতে বরিস ইয়েলৎসিন জব্বর ভুতের জলসা বসিয়েছেন। লাখ লাখ কমিউনিস্ট ক্যাপিটালিজমের ভুত দেখছে। সলঝেনিৎসিনের ছদ্মবেশে রাসপুটিন ফিরে আসছে। যুগোসশ্লাভিয়া ভেঙ্গে পড়ছে। ক্রোশিয়ান টেনিস খেলোয়াড় গোরান ইভানিসেভিচ ভাবছে প্রচণ্ড গতিতে সার্ভ করে জিম কুরিয়ার বা আন্দ্রেই আগাসিকে পুঁতে ফেলবে। শেষবার এক দেশের দল হিসেবে সুইডেনে খেলতে যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল কমনওয়েলথ্ অফ ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেটস বা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন। একীভূত জার্মানি ভেবে পাচ্ছে না কাদের দিয়ে দল গড়বে— পূর্ব না পশ্চিম? বম্বেতে বসে হরশদ মেহতা বলে একটা লোক দিল্লি থেকে ছক অনুমোদনের টেলিফোন পাবে বলে অপেক্ষা করছিল। পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, আলবেনিয়া জুড়ে মহা হট্টগোল। কমিউনিজম কেলিয়ে পড়েছে।”
    (ভট্টাচার্য, ২০১০:৪৯)

    সময় যখন সত্যিই ‘out of joint’, বছরান্তের মস্কোতে যখন একটাও আস্ত চকোলেট থাকে না, চিনে যখন মাঠে শস্য খেয়ে নেওয়ার অপরাধে রাষ্ট্রীয় অভিযান চালিয়ে চড়াই পাখিদের দেদার খুন করা হয়, যখন লিবেরাল ডেমক্র্যাটদের শীর্ষমুখ ফুকুয়্যামা সদম্ভে আস্ফালন করেন, ‘End of History is here’, তখন বোধহয় আত্মবিস্মৃত হওয়াটাই শ্রেয়। তবে সবাই যে এমনটা পারেন, তা নয়। নবারুণ ভট্টাচার্য যেমন পারেননি।

    নবারুণের নিজের কথায়, “গোলকায়নের অশুভ আবর্তের আবহাওয়ায় অঙ্গীকারের ফলায় সুখী মরচে ধরতে পারে। লেখক হিসেবে আমার কাছে এটা গোল্লায় যাওয়া। অথচ কর্মসূচীতে ছিল কেল্লাদখল।” কিন্তু কেল্লাদখলের অস্ত্র কোথায়? কোথায় সেই চেতনার শমী গাছ? ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রণজয় যেমন মাটি খুঁড়ে চলে অস্ত্রের সন্ধানে, নবারুণ ডুব সাঁতারে স্পর্শ করেন তাঁর স্মৃতির তল, কুড়িয়ে আনেন অস্ত্রে শান দেওয়ার পাথর। অঙ্গীকারের ফলা আলোর বর্শা হয়ে ওঠে। নিউক্লিয়ার উইন্টার চিরে কুচকাওয়াজ করতে থাকে নবারুণের স্মৃতি-যোদ্ধারা।

    নবারুণের প্রায় প্রতিটি লেখাতেই এই স্মৃতি-যোদ্ধাদের অনায়াস যাতায়াত। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা বরং বেছে নিই তাঁর উপন্যাস দ্বয়ীকে – ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ ও ‘লুব্ধক’। প্রথমে আসি ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’র কথায়। ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকায় ১৯৯৫ এর শারদ সংখ্যায় এই উপন্যাস প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের নক্ষত্র চরিত্র রণজয় সত্তরের রহস্য জ্যোৎস্নায় রাইফেল কাঁধে হাঁটার দুর্জয় স্পর্ধা দেখিয়েছিল। প্রত্যাশিত ভাবেই ‘সন্ধ্যার মুখে নামা ছায়া গুপ্তচরেরা’ তাকে রেয়াত করেনি। তীব্র আলোর আলপিন বা গোপনাঙ্গে অজস্র সিগারেটের ছোবল তাকে অব-ব্যক্তি বা না-মানুষ বানানোর চেষ্টা করে। কিন্তু রণজয় হার মানেনি।

    যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও রণজয় খুঁজে চলে যুদ্ধ পরিস্থিতি। নব্বই এর সুখী সময়েও সে বাতাসে বারুদের গন্ধ পায়, আতশবাজি উদ্ভাসিত কালীপূজোর রাতে তার লড়াই চলে ছায়া-স্নাইপারের সাথে। ঘাঁটি এলাকা বাঁচানোর মরিয়া যুদ্ধে সে খুঁজে চলে গোপন অস্ত্রাগার। রাইফেলগুলোর ওপর বাড়ি উঠে যাওয়ার বাস্তবতা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এই উপন্যাস পাঠকালীন আমাদের একটা বড় ঝাঁকুনি লাগে। আচ্ছা, সময় রণজয়কে অস্বীকার করল, নাকি রণজয় সময়কে?

    নবারুণ যেমন প্রতিমুহূর্তে জানান দেন, “চেতনা থেকে যদি সত্তর অন্তর্হিত হয়, তাহলে আত্মপরিচয় বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।” ঠিক একই ভাবে রণজয় তার কোমরে থাকা তিনফলা নিড়ানিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচে, বুকের ভিতর নিরন্তর স্তালিনগ্রাদের তুষারপাত অনুভব করে। যোদ্ধার সেরা যোদ্ধা রণজয় চ্যালেঞ্জ করে বসে time – space co-ordinate কে। প্রবল ঘৃণা ভরে বর্তমানকে প্রত্যাখ্যান করে আঁকড়ে ধরে অতীতকে। কলকাতার উত্তাপে অনুভব করে সাইবেরিয়ার শীতকে।
    প্রখ্যাত সোসিওলজিস্ট Maurice Halbwachs-এর ‘On Collective Memory’ নাম্নী গ্রন্থের নিবিড় পাঠ হয়ত আমাদের রণজয়ের মহাকাব্যিক লড়াইকে আরেকটু বুঝতে সাহায্য করবে। Halbwachs বলছেন, “whereas in our present society we occupy a definite position and subject to the constraints that go with it, memory gives us the illusion of living in the midst of groups which do not imprison us, which impose themselves on us only so far and so long we accept them… Not only we roam freely within these groups, going from one to another, but within each of them— even when we have decided to linger with the main thought— we will not encounter this feeling of human constraints in the same degree that we strongly experience today. This is because the people whom we remember no longer exist or, having moved more or less away from us, represent only a dead society in our eyes— or at least a society so different from the one in which we presently live that most of its commandments are superannuated.” (Halbwachs, 1992:50)

    উপন্যাসের একটি অংশে আমরা রণজয়কে দেখতে পাই যাদবপুরের অতিপরিচিত লেনিন মূর্তির সামনে। কমরেড লেনিন বক্তৃতা করছেন। সামনে জনসমুদ্র। ব্যানার, পতাকা, ফেস্টুন উড়ছে। রনজয়ের হাতে ঝুলন্ত পলিথিনের নোংরা প্যাকেটে পাউরুটি। সে লেনিনের মূর্তির সাথে কথা বলছে, তার গাল গড়িয়ে জল নামছে। বারংবার পড়া সত্তেও উপন্যাসের এই অংশটুকু আমাদের বিহ্বল করে। স্মৃতি-যোদ্ধা রণজয় এক লাফে টপকে যায় বর্তমান–অতীতের বাইনারিকে। সকল ঘেরাটোপের বাইরে দাঁড়িয়ে সে নিজের বাস্তবতা নির্মাণ করে। সময়-ঘোড়াকে নিজস্ব লাগামে ছোটায় সে। সে শুধু অতীত-কারাগারের অন্ধ বাসিন্দা নয়। অজস্র পড়া বইয়ের স্মৃতি, অসংখ্য সাদা-কালো ফোটোগ্রাফের স্মৃতি, অগুন্তি ফিল্মের মন্তাজের স্মৃতি তার চেতনার মগ্ন-মৈনাককে ভাসিয়ে তোলে। গড়ে তোলে সে বিকল্প বাস্তব। অন্য খাতে বইতে থাকা পৃথিবী রণজয়ের কাঁধে হাত রেখে বলে ‘এ বাবু, বাবু! ও তো সিরিফ স্ট্যাচু আছে। আপনি ডাকলে কথা করবে! কেয়া বেকার লেনিন, লেনিন করছেন।’ রণজয় সামান্য হাসে। Time–Space নিয়ে এমন ট্র্যাপিজের খেল সবার কম্মো নয়।

    আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ‘লুব্ধক’। ‘দিশা’ সাহিত্য পত্রিকায় ২০০০ সালে এই উপন্যাসটির আত্মপ্রকাশ। এই উপন্যাসটি আমাদের নিয়ে যায় নতুন সহস্রাব্দের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা নার্সিসাস শহর কলকাতায়। সৌন্দর্যের একটি নিজস্ব ধাঁচা এই শহর নির্মাণ করে এবং যে বা যারা এই ধাঁচাকে অস্বীকার করার প্রতিস্পর্ধা দেখায়, তাকে বা তাদের যেতে হয় শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত পিঁজরাপোল নামক Waste Land-টিতে।

    শহর জুড়ে চলতে থাকা নিধন যজ্ঞের প্রথম বলি হয় রাস্তায়, অলিতে গলিতে, পার্কের ভাঙা বেঞ্চের তলায় বা মন্দিরের চাতালে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কুকুরেরা। প্রতিরাতে অন্ধকার বেয়ে নেমে আসে কুকুর ধরার গাড়িগুলো। প্রতিটা কুকুর-ঠাসা গাড়ি পৌঁছে যায় পিঁজরাপোল নামক মৃত্যু উপত্যকায়। প্রতিটা পিঁজরাপোলে মৃত, মৃতপ্রায়, অর্ধমৃত কুকুরেরা তাকিয়ে থাকে নবাগত অতিথিদের দিকে। ‘মৃতের সঙ্গে থাকলে মৃত্যুর চৌম্বকক্ষেত্রের ঠাণ্ডা টান না চাইলেও অনুভব করতে হয় ও স্নায়ুতে স্নায়ুতে ধীর লয়ে অবশ সঙ্গীতের মত ছড়িয়ে পড়ে আত্মসমর্পন’।

    শহর জুড়ে এই অপূর্ব হত্যা কার্নিভাল থেকে বাঁচতে অসহায় সারমেয়রা আশ্রয় নেয় তাদের নিজস্ব উপকথায়। যে উপকথায় বলা আছে যে, যখনই কুকুরেরা বিপদে পড়বে, কুকুর-তারা লুব্ধকের নির্দেশে ছায়া-কুকুরেরা ছায়া-মেঘের আড়াল সরিয়ে নেমে আসবে কুকুরদের বাঁচাতে। যদিও ছায়া-কুকুরদের কেউ কখনও দেখেনি বা কেউ দেখেছে বলে শোনেনি, তবুও এই হিবাচি-প্রহরে এই প্রাচীন উপকথাই কুকুরদের ভরসা দেয়।

    আসলে শুধু পানীয় জল, খাবার বা আশ্রয়স্থল নয়, প্রতিটি কমিউনিটি গড়ে ওঠে একটি নিজস্ব স্মৃতি-ভাণ্ডারকে সম্বল করে। কমিউনিটির শুরুর গল্প, বেড়ে ওঠার গল্প, চলার গল্প কিছুটা বাস্তব আর অনেকটা কল্পনার মিশেলে রচনা করে এই স্মৃতিকাব্য। কাহিনীসূত্র এক মুখ থেকে আর এক মুখে ছড়ায়, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে গড়ায়, কল্পনার জল-বাতাস লাগে, আরো সমৃদ্ধ হয় স্মৃতিকথা। অস্তিত্বের সংকটকালে এই স্মৃতিরাই ব্যুহ নির্মাণ করে, অ্যাসিডে জ্বলতে থাকা কানকে জলে ডোবানোর তৃপ্তি দেয়। Halbwachs সাহেব আরো নিখুঁত ভাবে এই Phenomenon বর্ণনা করেন তাঁর ‘The Collective Memory of the Family’ নামক রচনায়: “In the most traditional societies of today, each family has its proper mentality, its memories which it alone commemorates, and its secrets that are revealed only to its members. But these memories, as in the religious traditions of the family antiquity, consist not only of a series of individual images of past. They are at the same time models, examples, and elements of teaching. They express the general attitude of the group, they not only reproduce its history but also define its nature and qualities and weakness… Sometimes it is the place or the region from which the family originated or it is the characteristic of this or that family member that becomes more or less mysterious symbol for the common ground from which the family members acquire their distinctive traits. In any case, the various elements of this type that are retained from the past provide a framework for family memory, which it tries to reserve intact, and to which, so to speak, is the traditional armour of the family.” (Halbwachs, 1992:57)

    গোটা শহরটাই যখন প্রায় পিঁজরাপোল হয়ে উঠছে, বাকি থাকা কয়েকটি কুকুর ও বেড়াল যখন হন্নে হয়ে আড়াল খুঁজছে, তখনই আরেকটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটে:
    “বিভিন্ন পাড়ায়, গুরুত্বপূর্ণ সব মোড় ও দরকারি রাস্তার মাঝখানে ধরা দেবার জন্য জ্ঞানবৃদ্ধ কিছু কুকুর হয় বসে বসে ঝিমোচ্ছে, গায়ে মাছি বসলেও তাড়াচ্ছে না বা সামনের দুই থাবার মধ্যে মাথাটা রেখে দু-চোখ মেলে নির্লিপ্তভাবে বিশ্ব-সংসারে কি ঘটে চলেছে দেখছে এবং অজানা কোনো শব্দতরঙ্গের সংকেত ধরার জন্যেই যেন তাদের কানগুলো রাডারের মতো দিক পাল্টাচ্ছে। কুকুর ধরার একটা বিশাল অভিযান চলছে। সেটা সকলেরই জানা। তার মধ্যে এই প্রবীণ কুকুরদের আগ বাড়িয়ে ধরা দিতে আসা কারো কারো চোখে তাজ্জব ঠেকলেও ঠেকতে পারে। এবং সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের সেটা হল কুকুর-ধরা গাড়ি এসে দাঁড়াতেই এরা গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিল।” (ভট্টাচার্য, ২০১০:৪০২)

    এই বৃদ্ধ ‘সূর্য উপাসকরা’ তীব্র গরম, জলাভাব, মৃত্যু চৌম্বক, আকাশে চিল-শকুনের ঘুণচক্করকে উপেক্ষা করে ঘোলাটে চোখে কুকুর-মণ্ডলের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমাদের প্রশ্ন জাগে— আসন্ন মৃত্যুকে উপেক্ষা করার এমন শক্তি তারা পেল কি ভাবে? তবে কি বৃদ্ধেরা আগেই ঝড়ের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল? তাদের ছানিতে নিভে আসা চোখে কি আগেই ধরা পড়েছিল ছায়া-কুকুরদের ছায়া-মরুতে বালি ওড়ানোর দৃশ্য? অজস্রবার রোদে ভিজে, বৃষ্টিতে পুড়ে, বুটজুতো পড়া পা, বড় গাড়ির রাক্ষুসে চাকা সামলে, আঁধলা ইট বা শীতের দিনে বালতি ভরা ঠাণ্ডা জলের রসিকতা এড়িয়ে এই বৃদ্ধ সারমেয়রাও আজ স্মৃতি-যোদ্ধা। এই Plague নগরীর আধুনিক Tiresius তারা।

    নবারুণ বারংবার আমাদের মনে করান, “আন্দোলনটাকে ভুলে যাওয়া, ভুলিয়ে দেওয়ার মধ্যেও একটা রাজনীতি আছে”। Claudius-ও Hamlet-কে তার পিতৃশোক ভুলতে বলেছিল। শোকের কালো আলখাল্লা খুলে মদের ফোয়ারায় ভাসতে বলেছিল। Hamlet তা করেনি। তাই এখনও Elsinore এর সন্ধ্যায় সে তার বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। তিনফলা নিড়ানি দিয়ে রণজয় তার অতীত খুঁড়ে চলে। বৃদ্ধ কুকুরেরা অমোঘ মৃত্যুর সামনেও তাকিয়ে থাকে বৃহৎ কুকুর-মণ্ডলের দিকে। স্মৃতি-যোদ্ধাদের বুটের আওয়াজ থামার নয়।

    “ওরা কারা যারা রাইফেল কাঁধে হাঁটছে
    তারা সারা রাত রাইফেল কাঁধে হাঁটছে
    পায়ে ব্যাথা নিয়ে রাইফেল কাঁধে হাঁটছে
    জ্যোৎস্নায় ওরা রাইফেল কাঁধে হাঁটছে” (ভট্টাচার্য,২০০৯:৮৬)

    সহায়ক গ্রন্থ
    ১। নবারুণ ভট্টাচার্য। ‘উপন্যাস সমগ্র’। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ২০১০, মুদ্রন।
    ২। Maurice Halbwachs. ‘On Collective Memories’.
    Ed. And Trans. Lewis A. Coser. Chicago: University of Chicago Press,
    1992.Print.
    ৩। নবারুণ ভট্টাচার্য। ‘রাতের সার্কাস’। বিজয়গড়: ভাষাবন্ধন, ২০০৯, মুদ্রন।

    কৃতজ্ঞতা স্বীকার
    পিনাকী দে
    সম্রাট সেনগুপ্ত
    প্রিতেশ চক্রবর্তী

    ====================================================

    হন্যমান আত্ম সমীপে এক বিক্ষুব্ধ কথক ~ নবারুণ সাহিত্যে আত্মহত্যা

    কৌশিক দত্ত

    আলোর পথযাত্রী, প্রকৃত প্রস্তাবে, যূথবদ্ধ আরশোলা। শ্রেণীচরিত্রে তারা চিরঞ্জীব। নর্দমা থেকে স্ট্রীট ল্যাম্প অভিমুখে তাদের উড়ান। সেই নালা, রাস্তা বা দত্তদের দরজা এঁটো করে কোকা বমি করলেও তাদের কিছু যায় আসে না। ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে, এই বিশ্বাস নিয়ে টলোমলো চলে যাওয়া বন্ধুদের ফেলে যাওয়াশালাপাতায় ভাঙাচোড়া চপ তাদের বাঁচিয়ে রাখে রাত বাড়লে। কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তি আরশোলা মরণশীল। শ্যাঁৎলা ধরা দেয়াল আত্মমগ্ন একক আরশোলার জন্য ক্ষুধার্ত টিকটিকি পাঠায়। এই হন্যমানতার দৃশ্যপটে রক্তের গন্ধওলা জলে বাঁ হাতের কবজি ডুবিয়ে শুয়ে থাকে ইহলোক আর পরলোকের কথাবার্তায় মাতাল এক লোক। সে নিজে হয়ে ওঠেমৃত্যুর এক মৃগয়াভূমি। কালো পিঁপড়েরা সুন্তুষ্ট থাকে তার দাঁতের ফাঁকে আটকানো খাবারে, কিন্তু মাংসাশী লাল ও ডেঁয়ো পতঙ্গ ও কীটেরা বেছে নেয় হারবার্টের নাসারন্ধ্র, জিভ, মাড়ি, চোখ। ঝিঁঝিঁ পোকার তারিফযোগ্য অর্কেস্ট্রার তালে তালে আত্ম ও অপর-হত্যার দৃশ্য ‘ওকে’ হয়ে যায় এক টেকে। বন্ধ কাচের ওপাশে ডানা ঘষা পরী সব দেখে এবং ভিতরে আসতে না পেরে দোকানে ফিরে যায় ভোর হবার আগেই।
    এইভাবে মৃত্যুর ঘটমানতাকে বাঙালি পাঠকের জীবন লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মেরেছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। ১৯৯৩। চার বছর আগের তিয়েন-আনমেইন স্কোয়ার, তিন বছর আগে কোলকাতার দ্বারপ্রান্তে ধর্ষিত ও মৃত তিন মহিলা, দুবছর আগের গালফ ওয়ার অথবা শ্রীপেরেমবুদুরে অচানক ফেটে যাওয়া একটি বিশ্বাসযোগ্য ফুলের তোড়া বা পুষ্পবাহী নারী, আগের বছর ভেঙে পড়া বাবরি মসজিদ, সদ্য ঘটতে চলা এবং শেষ অব্দি ১২ মার্চ ঘটে যাওয়া মুম্বাই বিস্ফোরণ, অথবা নরসিম্বা-মনমোহনীয় ভারত সরকারের সোনা বেচা নিও-লিবেরাল অর্থনীতি (বা তার পূর্বসূরী লাইসেন্স রাজাবাবু), ছিয়াশির রাশিয়ায় পেরেস্ত্রৈকা বা হোপ ছিয়াশির আসরে বলিউড নায়িকার পাশে বসা এক প্রবীণ (বা প্রাক্তন) কম্যুনিস্টের লিগ্যাসি, দুবছর না যেতে সেই রুশ দেশে সমষ্টির লৌহমুষ্টি থেকে ব্যক্তির আজাদি এবং গালফ ওয়ার শুরুর সমসময়ে সোভিয়েত সুপারস্ট্রাকচারের চুড়ান্ত ভেঙে পড়া... বন-বাদার-গাঁ উজিয়ে বাজার শুধু বাজার, আর বাজারে নিত্যি ভাঙন-উন্মোচন-নবীকরণ... ছ’শ কোটি আরশোলা বা পেরিপ্লানাটা আমেরিকানা এবং মাংসাশী লাল পিঁপড়ে তখন চারিদিকে নানারকম মৃত্যুর আয়োজন সযত্নে সাজিয়ে রাখছিল। লেখার খাতার বাইরে ঘটে চলা এসব হত্যা ও মেটামর্ফসিসের অনুষঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্পে উপন্যাসে দগদগে হয়ে থাকা আত্মহত্যাদের অরাজনৈতিক পাঠ প্রায় অসম্ভব।
    ‘হারবার্ট’-এর চেয়েও ‘ভোগী’ উপন্যাসে আরো বেশী রাজনৈতিক হয়ে ওঠে আত্মহত্যার প্রকল্পটি। হারবার্টসরকার এক নাগরিক উচ্চবংশীয় অন্ত্যেবাসী। সে মূলত বাঁচতে চেয়েছিল যে কোনো উপায়ে, এমনকি তার আত্মবোধ আজীবন আহত হবার পরেও, যতক্ষণ না তা চুড়ান্তভাবে নিহত হয়। মৃত্যুকে আশ্রয় করে, মৃতদের ব্যবহার করে বজায় থেকেছে স্রেফ বেঁচে থাকার জন্যে বেঁচে থাকার চেষ্টা, যে বাঁচার মধ্যে বেঁচে থাকাটুকুর বাইরে জীবনের কোনো নিহিতার্থ না খুঁজলেও চলে।নিহত হারবার্টের শরীর আর অবশিষ্ট অস্তিত্বটুকুকেই হারবার্ট স্বহস্তে হনন করেছিল দ্বিতীয়বার। অপরপক্ষেভোগী নাগরিকের দৃষ্টি ও সমাজতত্বে চুড়ান্ত অপর। বিশ্বায়ন, উন্নয়ন বা বাজার যে বর্গের মানুষকে নিয়ে বিশেষ ভাবিত নয়, প্রয়োজনের বোড়ে বা অবর্জনা ফেলার আস্তাকুঁড় হিসেবে মাঝে মাঝে একটু-আধটু ব্যবহার করার সম্ভাবনাটুকু বাদ দিলে... সেই প্রায় অদৃশ্য সমাজের এক ‘নাম না জানা’ মানুষ। তার পরিচয় শুধু তার আত্মহত্যার প্রস্তুতিতে। সে মরবে, খানিক যীশুর মতো, খানিক এথনিক ওরিয়েন্টের বিচিত্র সাধুর মতো। সে নিয়ে যাব পৃথিবীর পাপ সাথে করে। সে মরবে, মুক্ত হবার জন্যে। সে ভোগ করে মরবে বলে।শুধু নামহীনতাই তার পরিচয়হীনতার একমাত্র পরিচয় নয়। টিলা পেরিয়ে সমুদ্রের ধারে পৌঁছানোর পর, পাথরের উপর এবং শানানো কাতানের নীচে গলা দেবার পর, গর্দানচ্যুত মাথা সমুদ্রের ঢেউ লেগে দুলে ওঠার পর সে সহসা হয়ে যায় এক চিত্র নির্মাতার কাল্পনিক চরিত্র। আত্মহত্যার পরবর্তী এই কাহিনী-হত্যায় এক বিচিত্র মানুষ সম্পূর্ণ অনস্তিত্বে পরিণত হয়। বস্তুত তার আত্মহত্যার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয় এভাবে... এমনকি পাঠকের কল্পনায় বেঁচে থাকা অস্তিত্বটুকুর বিলুপ্তিতে।
    ‘অ্যাক্সিডেন্ট’, ‘নস্ত্রাদামুসের আত্মহত্যা’, ‘মিউচুয়াল ম্যান’, ইত্যাদি ছোটগল্পে গুলিয়ে যায় হত্যা আর আত্মহত্যা। স্পষ্ট জানা যায় না কে মারছে আর কে মরছে। ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্যে থৈ পাওয়া যায় না এইসব মৃত্যুর। সন্দেহ হয় এই মৃত্যুরা সামূহিক। যেন একটা শহর, একটা সমাজ, একটা গ্রহ আত্মহত্যা করছে।
    এইখানে এসে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়। আসলে হত্যা আর আত্মহত্যার মধ্যে তফাৎ কী? মানুষ কি কখনো একা একা মরতে পারে? নিজেকে না মেরে অপরকে বা অপরকে অক্ষত রেখে নিজেকে হত্যা করা কি সম্ভব? মৃত্যু কখন হত্যা হয়ে ওঠে? কতটা গভীরভাবে হত্যা করতে পারলে তবে মৃত্যু সম্যক সম্পন্ন হয়? কোন হত্যাকে আত্মহত্যা বলে? স্ববধবিলাস আর স্বমেহনের মধ্যে কোথায় মিল আর কোথায় অমিল? আত্মহনন কি নিছক পলায়ন? শুধু দুঃখের আর পরাজয়ের ইতিবৃত্ত? কামিকাজে যোদ্ধা, ভালবাসা হারানো তরুণ, কার্ল মার্ক্সের দুই কন্যা, গতর হারানো প্রাক্তন বেশ্যা, বাতিল বৃদ্ধ... সবার আত্মহত্যার কাহিনী বা কারণ একসূত্রে গাঁথা সম্ভব? প্রশ্নবিদ্ধ, শিশ্নবিদ্ধ আর শরবিদ্ধ হবার মধ্যে মিল বা অমিল কতখানি এবং কী কী? কেবল প্রশ্নের অভিঘাতে কি ধ্বংস করা যায় সৌধ; হত্যা করা যায় অপর এবং আত্মকে?
    ‘দ্য মিথ অব সিসিফাস’-এর শুরুতেই কামু বলেছেন, দুনিয়ায় একটাই প্রকৃত গুরুত্বপূর্ন দার্শনিক সমস্যা আছে আর সেটা হল আত্মহত্যা। জীবন বেঁচে থাকার যোগ্য কি না, সেই বিচারই দর্শনের মূল প্রশ্ন অথবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর। জীবনের মানে খুঁজতে গিয়ে বা অর্থ আরোপ করতে গিয়ে, কী আশ্চর্য, মানুষ কখনো মৃত্যুকে বেছে নেয়। নীতি, ধর্ম, আদর্শ যা কিছু অবলম্বন করে ব্যষ্টি বা সমষ্টি বাঁচতে চায়, সেই সব অবলম্বনদেরই বাঁচাতে গিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ে হত্যা বা আত্মহত্যায়। এর সমান্তরালে অনেক অনেক মানুষ জীবনের (আপাত) অর্থহীনতার মধ্যেই... অর্থহীনতাকে সহজে নিয়েই পূর্ণ সময় বেঁচে থাকে। তাহলে কী মূল্য বাঁচার সেই সব অবলম্বনের, যারা জীবনকে ব্যাহত করে? জীবনকে অর্থবহ করতে আদর্শের বলি হয় ভাইপো বিনু, অথচ অর্থহীনতার সাথে স্বচ্ছন্দ হারবার্ট বেঁচে থাকে। দুরূহ মৃত্যুর মধ্যে জীবনের পরিণতি খুঁজে পায় ভোগী, কিন্তু হারবার্ট, কোকা, ডাক্তার, ধননা বেঁচে থাকে পরীস্পর্শহীনতার মধ্যেও সহজে।
    কামুর সাথে নবারুণের অমিল বিস্তর রাজনীতিতে, বিদ্রোহে, অস্তিবাদে, জয়ে এবং পরাজয়ে। কিন্তু নবারুণ ভট্টাচার্যের মনুষ্য প্রোটাগোনিস্টরাও প্রায়শঅ্যাবসার্ডিটির স্রোতে বহমান। নবারুণের সাহিত্যে এই অ্যাবাসার্ডিটি অন্য মাত্রা পেয়েছে এলিটিজমের প্রতিস্পর্ধায় নিম্নবর্গীয় অপরের জীবনপ্রবাহের প্রতীক হয়ে উঠে। তাই এই সব চরিত্রে বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া অনুভব করতে জাদু-বাস্তবতার মায়াজালের আড়ালে এই অসম্ভাব্যতা বা অ্যাবাসার্ডিটিকে ছোঁয়া প্রয়োজন।
    তাহলে এরা মরে কেন? প্রেমহীনতায়, স্বপ্নহীনতায়, অর্থহীনতায় (নৈতিক ও অর্থনৈতিক) টিঁকে থাকতে জানা হারবার্ট কেন ডান হাতে তুলে নেয় ব্লেড আর তাকে চলে যেতে দেয় বাঁ হাতের কাছে বিপজ্জনকভাবে? এ কি আত্মহত্যা নাকি হত্যা? স্পষ্টতই হারবার্ট হারবার্টকে খুন করেছে দেখার পরেও কি পাঠকের দায় থাকে খুনি খুঁজে বেড়ানোর? কামু বলেছিলেন, জানা প্রয়োজন যে বিপর্যস্ত লোকটি এইমাত্র আত্মহত্যা করল, আজ তার কোনো বন্ধু কি তার সাথে অবন্ধুসুলভ ব্যবহার করেছিল? সে তাহলে দোষী, কারণ অসহায়তা থেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার জন্যে অনুঘটকের কাজ হয়ত সেই করে থাকতে পারে। তাহলে কি হারবার্টকে হত্যা করলেন যুক্তিবাদী ঘোষবাবু বা সিগারেট টানতে থাকা সাংবাদিক মেয়ে?নাকি ধননা আর তার দুই ছেলে? হারবার্টের অকালপ্রয়াত বাপ? সিফিলিসগ্রস্ত জ্যাঠা?অথবা জ্বরের ঘোরে দেখা দেওয়া ধুঁই? বা বিনুর সেই লুকোনো ডায়েরি? অথবা সেই ডায়রির কথা মনে পড়ে যাবার আকস্মিকতা, যা ‘পরলোকের কথা’ আর ‘পরলোক রহস্য’ নামক বইদুটির সাথে ষড়যন্ত্র করে হারবার্টকে ঠেলে দিয়েছিল মৃতের সহিত কথোপকথনের অফিসের দিকে? অথবা হয়ত খোঁড়ো রবি, যে তাকে প্রথম দেখিয়েছিল আত্মহত্যাকে বেছে নেবার যোগ্য এক সম্ভাব্য পথ হিসেবে; ঠিক যেমন সংগৃহিত দু’শ ঊনত্রিশটি অন্তিম টেস্টামেন্ট বা মরণেচ্ছুর বিদায়ী জবানবন্দি দুর্নিবার হাউন্ড কুকুরের মতো নেটিভ শশক রেবন্তর সংহারের কারণ ও হেতু হয়েছিল। অবশ্য কারণ বা হেতু হবার ক্ষমতা সম্পন্ন সবকিছুই কার্য বা পরিণতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, বা তার নির্ণায়ক ভূমিকা পুণরাবৃত্ত হবে, তার কোনো মানে নেই। দু’শ ঊনত্রিশ প্লাস এক হাতে নিয়ে আপনি চিরকূটে সুইসাইড নোটের বদলে লিখতে পারেন একোয়া টাইকটিস, মকরধ্বজ বটিকা, ডায়াপেপসিন এবং এন্টেরোস্ট্রেপ। আসল প্রশ্ন হল, আপনি কোথায় যেতে চান? অমরত্ব আর ইচ্ছামৃত্যুর মধ্যে কোনটি বেছে নিতে চান?
    কেন বারবার আত্মহত্যার অনুষঙ্গ নবারুণের লেখায় ফিরে আসে? ব্যক্তি মানুষটিকে না চিনে, শুধু তাঁর উপন্যাস আর গল্পের মধ্যে শিং উঁচিয়ে থাকা আত্মহত্যাগুলো দেখে কি বলা সম্ভব? অংশত সম্ভব, এবং অংশতই। পূর্ণ বোঝাপড়া তুমুল অ্যাবসার্ড। ‘রেবন্তর স্ববধবিলাস’ গল্পে তীব্রভাবে পৃথক কিছু মানুষের বহুমাত্রিক সুইসাইড নোট এবং আত্মহননের প্রেক্ষিত এক নোটিস বোর্ডে পাশাপাশি টাঙিয়ে তিনি যেন নিজের সারা জীবনের স্ববধভাবনার সংক্ষিপ্তসার রচনা করেছেন। একটি ছোটগল্পের মধ্যে আত্মহত্যার এমন বিশ্বরূপধারী উপস্থিতি সাহিত্যের অন্য কোনো সিন্দুকে আছে কিনা আমার জানা নেই।
    ‘লিখনে কি ঘটে’ প্রবন্ধে অমিয়ভূষণ মজুমদার বলেছেন যোগী, মাতাল, শিল্পী, সাহিত্যিক সকলেই নিজের মতো করে বাস্তবের অপ্রিয় উপস্থিতি থেকে পালানোর চেষ্টা করে। ঘুম হল দৈনন্দিন পলায়নের সহজতম উদাহরণ। নিশি-স্বপ্নের মতো দিবাস্বপ্নও বাস্তবের লাগাম এড়ানো এক ‘এস্কেপ’। যোগীর সমাধি বা সাহিত্যিকের নিজস্ব জগত রচনা এই পলায়নের অন্য রূপ। নবারুণ ভট্টাচার্যের চরিত্রেরা অনেকেই মদের আশ্রয়ে চলে যায় রোজ। বাস্তবের রুক্ষতা থেকে এই তাদের মোটাদাগের পলায়ন। জাদু-বাস্তবতার আলয়ে গল্পের সহসা চলে যাওয়াকেওবস্তু-বিশ্বে�� � যুক্তিকাঠামোর সীমাবদ্ধতা থেকেএক ধরণের পলায়ন ভাবা যেতেই পারে। আত্মহত্যা কি তাহলে চূড়ান্ত পলায়ন? শ্যাম সমান মরণ? “নিরাপদ সাহিত্যের ঢ্যামনামি” সজ্ঞানে এড়িয়ে চলা লেখক কি শুধু এক পলায়নের কাছে ফিরে যেতেন বার বার? অন্যতর অজস্র কাব্যিক পলায়ন-পথ তো খোলাই ছিল তাঁর সামনে! নাকি এই আপাত পলায়নের ভেতরে লুকোনো থেকেছে এক গূঢ় সাবোতাজ? হত্যা আর আত্মহত্যা সেখানে একই মুদ্রার দুই পিঠ, অথবা দুই পিঠ মিলে একত্রে একটি মুদ্রা... যারা একত্রে অবস্থান করে এবং সংঘটিত হয়... ফিদায়েঁ যোদ্ধার মতো দুম-দুম ধ্বংস করে চুল্লি ও শ্মশান?
    ঐ একই প্রবন্ধে অমিয়কুমার নিজেই স্বীকার করেছেন পলায়নে ফাঁক থাকে... স্বপ্ন সর্বদা ঘুমকে নিশ্চিত করে না, বরং তার মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে ‘উচ্চ চিৎকার’। দিবাস্বপ্নেও এমন ঘটে থাকে; সাহিত্যেও। “লিখনেও এরকম হয় যে, আমরা ক্রোধ, দ্রোহ, অসূয়া থেকে উচ্চ চিৎকার করি। ... মনে হতে থাকে, ক্রোধ ইত্যাদি থেকে নিষ্কৃতি, বিরতি নয়, সেগুলোকে আরও উত্তপ্ত করাই এসব লিখনের উদ্দেশ্য।” অর্থাৎ পলায়ন বা শান্তি সাহিত্যিকের উদ্দিষ্ট নাও হতে পারে। কিন্তু অমিয়কুমার সাহিত্যের রস প্রতিষ্ঠা নিয়ে মূলত ভাবিত, তাই তাঁর “সন্দেহ হতে থাকে, সেই ক্রোধের উচ্চচিৎকার যা রসকে বিতাড়িত করে তাকে সাহিত্য বলা যাবে কিনা?” এই জায়গায় তাঁর সাথে নবারুণ ভট্টাচার্যের সাহিত্য ভাবনার তফাৎ আছে। সাহিত্যেররসোত্তীর্ণ হবার কিছু প্রকরণকে নবারুণ ‘এলিটিজম’ বলবেন সন্দেহ নেই। উপরন্তু অমিয়কুমার যেভাবে বলেছেন, “ট্রমা থেকে পলায়ন করতেই হয়,” এবং ‘ট্রমা’-র যে তালিকা তিনি দিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট যে তিনি ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণের তত্বগুলি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। কিন্তু কেবলমাত্র ফ্রয়েডীয় বীক্ষার আলোকে নবারুণের চরিত্রদের আত্মহত্যাকে বুঝতে চেষ্টা করলে ভুল হবে বলেই আমি মনে করি। সব আত্মহনন শৈশবের স্মৃতি থেকে পালানোর প্রচেষ্টা নয়। মৃত্যু কখনো কোথাও অনস্বীকার্য রাজনীতিক। মৃত্যুকামী কখনো নিজের কাঁধে করে সমুদ্রে নিয়ে যায় জগতের পাপের বোঝা, কখনো তার বিশাল শরীর আর অবোধ চোখে লেগে থাকে যুদ্ধ-বিমান আর বোমার সম্বন্ধে অজ্ঞতা এবং অবজ্ঞা, কখনো তার তোষকে বোনা থাকে শ্মশানঘাতি বিস্ফোরণ।
    মনে হয়, সাহিত্যের তোষকে ডিনামাইট স্টিকের মতো অভিসন্ধীমূলকভাবে বুনে দেওয়া ইতস্তত উচ্চচিৎকার নবারুণের সবচেয়ে বড় মাপের আত্মহত্যা, যা বস্তুত হত্যার অপর পিঠ। জ্ঞানঋদ্ধ ডিসকোর্স আর মনোগ্রাহী (প্রায়শ প্রায় সুললিত) সাহিত্য-ভাষার মাঝখানে নোংরা পেন্টুল পরে দাঁড়িয়ে পড়ে বস্তিবাসী খিস্তি আর অন্ত্যজ শব্দ-উপমা-আঙ্গিক। তারা উচ্চবিত্ত নাগরিক ললিতকলাকে হত্যা করে, না তাদের সাথে ষড়যন্ত্র করে নিরাপদ সাহিত্য তার পলায়নের প্রয়াস সমেত আত্মহত্যা করে, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। আমি একে সজ্ঞান এবং প্রবলভাবে রাজনৈতিক আত্মহত্যা মনে করি। এই আত্মহত্যা অতি লক্ষ্যণীয় সাফল্যের সাথে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানকে আলোড়িত করেছে। চুল্লির সুইচ অফ করেও তাকে ঠেকানো যায়নি, যদিও সব বিস্ফোরণের মতোই তার উত্তরাধিকার কিছু স্যাটেলাইট বিস্ফোরণের সাথে খানিক বর্জ্য সৃষ্টি করেছে... ভাষার এই সজ্ঞান আত্মহত্যাকে অনেকেই আত্মসাত করার চেষ্টা করেছেন যথোপযুক্ত বোধ, শ্রম বা সম্মান ছাড়াই।

    অথচ আত্মহত্যাকে বুঝতে গেলে এই হন্যমানতার সাথেও সাবোতাজ করতে হয়।ঠিক যখন আমি এই লেখাটি প্রথমবার শেষ করলাম, খানিকটা নবারুণীয় আঙ্গিক এবং ভাষা ধার করে, তখনই আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করল। মনে হল, নবারুণ ভট্টাচার্যের বিষয়ে লেখা বা কথোপকথন এইরকম ছাঁচেই হবে বা হতে হবে, পাঠকের এই প্রত্যাশার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা একান্ত প্রয়োজন; নইলে তাঁর সম্বন্ধে লেখার (অ)নৈতিক অধিকার জন্মায় না। অগত্যা লেখাটি তার আঙ্গিক সমেত আত্মহত্যা করল। তারপর ছাই থেকে এই জন্ম, যেমনটি হয়ে থাকে অপঘাতের ক্ষেত্রে... নাইলনের দড়ি গলায় দেবার আগে এবং পরে যেমন বদলে যায় বর্তমান এবং প্রাক্তন মানুষের রূপ ও চরিত্র।
    এইসব হনন পেরিয়ে এখন রইলে তুমি হে নাগরিক, তুমি হে পুলিশ... তুমি এবং তোমার ট্রাম। ট্রাম লাইনের উপর হঠাৎ এসে দাঁড়ালো শববাহী অন্ধ-বোবা-কালা এবং ফাঁকা খুলিওয়ালা চারটি লোক। ট্রামের ধাক্কায় তারা মরল না এবং তোমার পুলিশ অনেক সশস্ত্র পরিশ্রমের শেষে জানতে পারল যে তাদের কাছ থেকে কিছুই জানা সম্ভব নয়।
    অথবা হন্যমানতা পেরিয়ে বেঁচে থাকল মিউচুয়াল ম্যান, কমন ম্যান, আরশোলা আর কালো পিঁপড়ে। এরা কেউ ফেকলু পাঁচু নয়। মরণশীল নয়। দুই থানায় কেস খায় আর তিন ঠেকে চোলাই। হত্যা বা আত্মহত্যা এদের বিনষ্ট করতে পারে না। “ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।”বেঁচে থাকা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তার মধ্যে আসলে যা বেঁচে থাকে, তা হল বেঁচে থাকার অভ্যেস। আর বাঁচে সিস্টেম।
    “মিউচুয়াল ম্যান ছিল। মরে গেল। মিউচুয়াল ম্যান এসে গেল। এই মিউচুয়াল ম্যানও মরে যাবে। মিউচুয়াল ম্যান এসেও যাবে। মিউচুয়াল ম্যান থাকবে।”
    ঘড়ি থেমে গেলে, সময় মুক্ত হয়। জনৈক যন্তর যে কবিও ছিল, সে এই সার কথা বুঝতে পেরে লিখে যায়, “ঘড়ির বাইরে খুঁজে নেব এক সময় হারানো দেশ।” আসলে জীবনের মতো মৃত্যুও এক কনস্ট্রাক্ট। ততটা চরম কিছু নয়। বহমানতার কাছে তাকেও আত্মসমর্পণ করতে হয়। দু’শ ত্রিশটা সুইসাইড নোট বগলদাবা করে কেউ সস্ত্রীক পুরো যাত্রা করে।নিহিলিজমের ভেতর দিয়ে যেতে যেতেই মানুষ চলে যায় তার নঞঅর্থক নাগালের বাইরে। মৃত্যু স্বয়ং, তাৎক্ষণিক ভাবে হলেও, আত্মহত্যা করে।হেথায় হোক, হোথায় হোক... আত্মা অথবা সিস্টেমের সৌজন্যে... থেকে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প সম্ভাবনা নেই। মৃত্যুর এহেন মৃত্যুর সাথে সাথে আত্মহত্যার বৃত্ত পূর্ণ হয়।
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১৭:২৩644881
  • http://www.aihik.in/aihik/Content/9/

    মৃত্যুর নবারুণ ধর্মীতা

    শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ

    মৃত্যুর সব চাইতে মজা হল যে সে নিশ্চিত। জন্ম ততটা নিশ্চিত না। নারী পুরুষের সঙ্গমে জন্ম হবেই এমন কোনো কথা নেই। সেখানে কাজ করছে চান্স ফ্যাক্টর অথবা প্রোবাবিলিটি। কিন্তু যা জন্মাচ্ছে তার মৃত্যু হবেই। বিজ্ঞান ক্লোনিং করছে। মানুষের ক্ষেত্রেও ধরা যাক ক্লোনিং শুরু হল। তাতেও কিন্তু মৃত্যু আসছে। যে দেহে তার প্রাথমিক মনন এবং আমিত্ব গড়ে উঠেছে সেই দেহ ছেড়ে তাকে অন্য দেহ নিতে হবে। চেতনাও যে এক হবে তার এখনো কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ ব্যতিরেকে অন্য কোনো ভাবেও যদি মানুষকে অমর করার চেষ্টা করাও হয় তাহলেও দেহ উপাদানের ক্ষয়িষ্ণুতার কারণে তাকে বদলাতেই হবে। অতএব আবারো মৃত্যু। মৃত্যুর এই নিশ্চিত উপস্থিতি থেকে শুরু হচ্ছে আমাদের জীবন প্রবাহ।
    মৃত্যুকে নিয়ে আমাদের চেতনায় তাই একটি স্বরাঘাত থেকেই থাকে। লেখকের মধ্যে আরো বেশী করে তার চিহ্ন থেকে যায়। ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গল্প লেখক, কবি, গীতিকার সকলেই কোনো না কোনো আঙ্গিকে কোনো না কোনো ভাবে মৃত্যুকে রচনা করে থাকেন। জাতি বা রাষ্ট্র মৃত্যুকে রচনা করে থাকে। আদিম মানুষ মৃতদেহকে কবর দিচ্ছে। মৃতের ব্যবহৃত বস্তু কবরে দিচ্ছে পরবর্তী ব্যবহারযোগ্যতার কারণে। যেভাবে পরমাত্মীয়র বিদেশযাত্রায় তার সঙ্গের বিষয়বস্তু গুছিয়ে দেওয়া হয়। এই গুছিয়ে দেওয়ার মধ্যে থাকে তার প্রতি শুভেচ্ছা। এবং এই গুছিয়ে দেওয়া যখন মৃতর ক্ষেত্রে হয় তখন থাকে আত্মপরিচর্যার একটি ধরণও।
    মৃত্যু মানে শেষ একে মানতে পারা কঠিন কাজ। অতএব মৃতের পরবর্তী জীবনের কল্পনা। এই মৃতটির যদি পরবর্তী জীবন থেকে থাকে, তাহলে আমারও থাকবে। জীবন পেয়ে গেলে, জীবনের রস পেয়ে গেলে মৃত্যুকে মানতে পারা কঠিনতর। যখন গোষ্ঠীতে ধনবৈষম্য এসে দাঁড়ায়নি তখন সকলের জন্যই এ রসের সমান অবস্থান। অন্যান্য আকাঙ্খাগুলিতে জীবনে কম-বেশী চোট খেলেও তা পূরণের সম্ভাবনা অথবা তাকে প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনার জন্যও সময় জীবনে দীর্ঘ হওয়া আবশ্যক। সেই দীর্ঘের কোনো অবসান হয় না। এক আকাঙ্খা থেকে অন্য আকাঙ্খার জন্ম হয়, বাড়তে থাকে। এই বৃদ্ধিই মানুষকে নিয়ে গিয়েছে অমরত্বের খোঁজে।
    ধনবৈষম্যের সমাজে এই অমরত্বের খোঁজ একদলের পক্ষে আবশ্যিক হয়ে উঠেছে, অন্যদলের ক্ষেত্রে এ খোঁজের গুরুত্বও কমেছে। ফ্যারাওদের দেহ রাখা হচ্ছে পিরামিডে। তার ভেতরে তার জন্য যাবতীয় ধনরত্নাদি, বিলাস সামগ্রী জীবনের যাবতীয় প্রয়োজন এবং তার ব্যবহারের বিষয় সব সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেওয়ালে দেওয়ালে এঁকে দেওয়া হয়েছে জীবনের কার্ণিভাল। মৃত্যুর প্রখর গাম্ভীর্যকে ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে ফ্যারাও-এর ক্ষমতা। শিল্প ঐতিহাসিক ভ্যান লুন এই কার্ণিভালকে ধরেছেন। আবার শাসিতের জন্য কিন্তু পিরামিড না।
    যদি পয়সা খরচ করার জোর থাকে তাহলে মৃতদেহের নাকের ফুঁটো দিয়ে লোহার আঁকশি ঢুকিয়ে ঘিলু-টিলু টেনে বের করে নেওয়া হবে। বাকী যা বেরোবে না তা ওষুধ দিয়ে বের করা হবে। পেটের দু পাশ ফ্লিট ছুরি দিয়ে কেটে বের করে নেওয়া হবে অন্ত্র ও পাকস্থলী। তারপরে আরো নানা পদ্ধতির ব্যবহার আছে। কিন্তু পয়সা না থাকলে এ সব কিছুই করবে না। সোজা পায়ুদ্বার দিয়ে সিডারের তেল ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। বন্ধ করে দেওয়া হবে পায়ুদ্বার। সেই তেল বেশ কিছুদিন শরীরে থেকে ওই পেছন দিয়েই গলিয়ে বের করে দেবে অন্ত্রাশয় ইত্যাদি। আরো পদ্ধতি তারপরে ব্যবহৃত হবে।
    মিশরে মমি তৈরীর পদ্ধতি এগুলো। সোজা কথায় ফ্যারাও হলে পেছনে কিছু হবে না। কিন্তু গরীব হলে মরে গেলেও পেছন মারা হবে। সে কাজ চলতে থাকবে সাধারণ মমি বানানোর পদ্ধতি থেকে সাধারণ কবরের দিকে। এমনকি শাভান্তি পুতুলের সংখ্যার উপস্থিতিতেও তার প্রভাব। প্রাচীন মিশরে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য যে সব নির্মাণ সে সব নির্মাণের জন্য অধিবাসীদের বছরে একদিন করে স্বেচ্ছাশ্রম দিতেই হত। অসুস্থ হলে বা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে তার জন্য বদলি শ্রমিক পাঠাতে হত।
    যে ধনী সে অবশ্যই বদলি শ্রমিক পাঠাত। মিশরীয় বিশ্বাস জীবনে যা যা কিছু ঘটে, যা যা কিছু লাগে তার সবটাই লাগে মৃত্যুর পরেও। আইসিসের দরবারেও এমন শ্রম দিতে হয়। অতএব সেই দরবারে শ্রম দেবার জন্যও ধনী লোকটি যতবছর ধরে যতজন বদলি শ্রমিক পাঠিয়েছে ততগুলো শাভান্তি পুতুল তার সমাধিতে দিতে হবে। সেই পুতুলের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায় সমাজে এর ধনগত অবস্থান কেমন! এভাবেই মৃত্যু নির্মিত হতে থেকেছে সমাজে ও রাষ্ট্রে।
    এই নির্মাণের বিপরীতে জমে উঠেছে নবারুণের মৃত্যু খেলা। 'মসোলিয়াম' এ মার্শাল ভদিকে মমি করে টাকা ঊপার্জনের ফিকিরটা দেখলেই একটা সূত্র বেরিয়ে আসে। সেই মমি করে রাখা এবং সেই মমিকে দেখিয়ে জনগণ ও পয়সাওলাদের থেকে মাল কামিয়ে নিয়ে ফ্যাতাড়ু, চোক্তার সমূহকে পালন-পোষণ করা। এবং অবশ্যই বুলগাকভের খেলা এ না। বুলগাকভের শয়তান এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা অনেক বেশী গুরুগম্ভীর। তাঁরা মৃত্যু নিয়ে তির্যক না। নবারুণের ভদি, দন্ডবায়স, বেগম জনসন অথবা বন বেড়াল যথেষ্ট বাঁক সম্পন্ন।
    এই বাঁকেরও জন্ম মৃত্যু থেকে। কিন্তু সোভিয়েত দেশে মৃত্যু এবং বাংলায় মৃত্যুর মধ্যে ফারাক রয়েছে। সে ফারাক রচনার ক্ষেত্রও রয়েছে। 'খোঁচড়' গল্পটাকে যদি প্রাথমিক ক্ষেত্র ধরি তাহলে ফারাক আঁকতে সুবিধে। এবং আমরা বিপ্রতীপেই কথা বলব। পুলিশের পোষা খুনের ঘাড়ের কাছের চুলকানিটা খসখস করলেই খুনের সম্ভাবনা জাগে। অস্থির যৌনতা, পায়ুকাম, রিভলভার সব মিলে মিশে একটি সত্তর দশক জেগে ওঠে। যে দশকে পশ্চিমবঙ্গে গভর্নর ডায়াস মানুষের উপকারী পশুদের অবস্থা নিয়ে খুব চিন্তিত থাকেন এবং এমার্জেন্সির মধ্যে দিয়ে অজস্র লাশ কাশীপুর-বরানগর-গান্ধী নগর - যাদবপুর-নকশালবাড়ি কত কত জায়গা থেকে আরো অন্ধকারের দিকে মার্চ করে চলে যায়।
    সত্তরের দশক মুক্তির দশক। সত্তরের দশক তেভাগা-তেলেঙ্গানার বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত উত্তর দেবার দশক। ব্রিটিশের পায়ের তলায় নানা জাতি মিশ্রিত এক মহাভূমি ধুঁকছিল। তার কিছু শব্দ আমরা 'নবান্ন'-তে শুনেছি এবং শুনতে পাইনি। বিজন ভট্টাচার্য্যের নাটকটির শুরুর দৃশ্যে বাঁশ ফাটার আওয়াজ শোনা যায় নেপথ্যে, যখন গ্রামে হামলা হয়। গুলির শব্দ ছিল সে সব। নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন, সোভিয়েতের সঙ্গে ব্রিটিশের বন্ধুত্বের জন্য ফ্যাসীবিরোধী জোটের যুক্তি মেনে সে শব্দ হয়ে গিয়েছিল বাঁশ ফাটার শব্দ।
    সেই বাঁশ ফাটার শব্দ ১৯৪৭-এর পরে আর সম্পাদিত হল না। বুলেটে, রাইফেলে আছড়ে পরছিল। তেভাগা-তেলেঙ্গানায় জনতা লড়াই দিতে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। নবারুণের 'বুড়া কাহার' আখ্যানে সেই বুড়া কাহার যে রাইফেল লুকিয়েছিল, তার কাছে চলেছেন সদ্য নির্বাচিত এম এল এ অনিলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বুড়া কাহার পুরোনো কমরেড। জোতদারকে জায়গা ছাড়েনি আজ-ও। অনিলচন্দ্রের গাড়িতে জোতদারকে ভেট তুলতে দেয় না। অনিলচন্দ্র ফিরে যান, ছেচল্লিশের কমরেড, অ্যাসেম্ব্‌লিতে জানাবেন রাস্তা দরকার, পানীয় জল দরকার ইত্যাদি। চাপ দেবেন।
    অনিলবাবু ফিরে যাবার সময় বুড়া কাহারকে জোতদারের লোক মারে। সেই রণক্ষেত্রে বুড়া কাহার রণদামামা বাজায় একা। আওয়াওয়াওয়াওয়াওয়া! কত লোক এই আওয়াজে একসময় পাল্টা দিত। রাইফেল আর দশটা গুলি লুকোনো। অনিলবাবু - রাজাবাবুদের জমানা হলে জমা দেবে বুড়া কাহার। অনিলবাবু বলে যান জমানা হয়নি, পরের ভোটে যদি হেরে যান তাহলে হবে না। বুড়া কাহারের একা যুদ্ধে আজ কেউ নেই। কেউ আসে না। সব কেমন শান্ত হয়ে গেছে। দৌলতের ব্যাটা ফরমান, জোতদারের ব্যাটা জোতদার মেরে যায় তাকে। পুলিশ এসে দাঙ্গার অভিযোগে ধরে নিয়ে যায় বুড়া কাহারকে।
    না, এই প্রেক্ষাপটে মৃত্যু নেই। মৃত্যুর ভূমিকা আঁকা আছে। সেই মৃত্যু আসবে 'খোঁচড়'-এ। গৌতম বিশ্বাসকে খুন করতে বেরোবে থানা থেকে ঘাতকের দল। পাড়ার জলসার মধ্যেই প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে দেবে। এক রাউন্ড-এ হয়ে যেত, দু রাউন্ড লাগল, হাত বেশী চুলকেছে ঘাতকের বলে। এই হাত আবার অনেকটাই ব্রেখটের 'লার্নিং প্লে'-র উল্টো মত। সমবায়কে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া বেশী বুদ্ধিমত্তার কাজ। ব্যক্তির চেয়ে সমবায়ের দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী বেশী। এই ছিল ব্রেখটের 'দ্য মেসার টেকেন' নাটকটির মূল বিষয়। এখানে ঘাতকের হাত অতি ক্ষুদ্র এক সমবায়ের দাসত্ব করছে। ইন্দিরা গান্ধীর এমার্জেন্সির দাসত্ব করছে। কংগ্রেস ক্লিকের দাসত্ব করছে।
    হেইনে ম্যুলারের পালটা নাটক 'মাউসার' যেখানে দুই ব্যক্তি ক এবং খ দোলাচলে ভুগতে থাকে, তাদের কাজ বিপ্লবের শত্রুকে খুন করা। দুজনেই দোলাচলে আক্রান্ত হয়। খ-কে বিপ্লবের স্বার্থে খুন করেছিল ক। পার্টির আদেশে। ধীরে ধীরে সে খুন করার মধ্যে একধরণের যৌনতার উত্তেজনা পাচ্ছিল। সেই উত্তেজনা একদিন চলে যায়। সে আর খুন করতে পারে না। দোলাচলে পরে। সে দোলাচলের জন্য যখন তাকে মিলিটারি কোর্ট অভিযুক্ত করে তখন সে মেনে নেয় সে দোষী। সমবায়ের সিদ্ধান্তকে সে কাজে পরিণত করতে পারছে না। নাটকের কোরাসের যে মিলিটারি কোর্টের কাজ করছে তার সঙ্গে মিলিত হয়েই সে একসময় নিজেরও মৃত্যুদন্ড দাবী করে। ব্যক্তি সমবায়ের মধ্যে হারিয়ে যায়।
    'প্রতিবিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক' আখ্যানে নবারুণ আবার ফিরিয়ে দেন আমাদের সমবায় থেকে ব্যক্তির সঙ্কটে। ম্যুলারের বিপ্রতীপে তিনি এই চরিত্রটিকে আঁকেন যে ভালবেসেছিল, বন্দী ও নির্যাতিত হয়েছিল। যে নিজেকে অনেকদিন যত্ন নেয়নি বলে একদিন যত্নও করতে গেছিল। সে যত্নের পরিণতিতে নিজেকে তার মত আরো কারোর সহযোগিতায় খুন করে। বা আত্মহত্যা করে। করে কি? নবারুণ ধোঁয়াশা রেখে দিয়েছেন। বা রাখেননি। যখন আমরা জানতে পারি যে ম্যুলারের নাটকে খ একদিন ক দ্বারা খুন হবে এবং সম্ভাব্য গ ক-কে খুন করবে আবার। এই শৃঙ্খল ভাঙতে, ধরা পরে অত্যাচারিত না হতে চেয়ে নবারুণের চরিত্রটি তার বিপ্লব সম্ভাবনাকে খুন করে শান্ত স্নিগ্ধ বৌদ্ধ হয়ে বসে। ট্রেনে ওঠে। শেষবারের মত বুধগ্রহ থেকে কলকাতা এসে ফিরে যাবে বলে। আর একটি বিভৎস মৃত্যুকে নবারুণ অতি উদাসীনতার সঙ্গে লিখে দিয়ে যান। চরিত্রটির মাথা রেলের কামরা থেকে বাইরে করে ঘুমন্ত দুলতে থাকা অবস্থায় লাইট পোস্টে লেগে গুঁড়িয়ে, থেঁতলে যায়।
    মৃত্যু খুব স্বাভাবিকতায় এসে দাঁড়ায় না। এইখান থেকে বিজন ভট্টাচার্য্যের বিপরীত রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেন নবারুণ।
    "যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
    আমি তাকে ঘৃণা করি-
    যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
    আমি তাকে ঘৃণা করি-
    যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
    প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
    আমি তাকে ঘৃণা করি-
    আটজন মৃতদেহ
    চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
    আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
    আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
    আমি চীৎকার করে উঠি
    আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
    আমি উন্মাদ হয়ে যাব
    আত্মহ্ত্যা করব
    যা ইচ্ছা চায় তাই করব।"
    - এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
    মিশরের ফ্যারাও-এর মৃত্যুর মধ্যে যে মৃত্যুকে অস্বীকার করার লোভী প্রবণতা ছিল তা নবারুণের জন্য না। সত্তরের আগুন ক্রমে নিবে আসে। ভেঙে যেতে থাকে বিপ্লবী সংগঠন দল উপদলে। তার মধ্যেই 'যুদ্ধ-পরিস্থিতি'-র রণজয় পাগলখানা থেকে বেরিয়ে ট্রেনে উঠে বসে। কথায় কথায় লোকজনকে বুঝিয়ে দেয় সে নকশাল। খোঁচড় গল্পের ঘাতক বসাকের চেহারা পেয়ে যায়। লুড়কুৎগুলোকে খুন করে করে যে পোক্ত হয়েছে। রণজয় বুড়া কাহারের মত লুকিয়ে রাখা রাইফেলের খোঁজে আসে কলকাতায়। তার বুধগ্রহ, তার মুক্তাঞ্চল যা মুক্তির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে তার স্বপ্নে, সেই মুক্তাঞ্চল রক্ষা করতে রাইফেল লাগবে। প্রতিবিপ্লবী সে নয়।
    সত্তরের ঘাতক বসাককে এর আগে একবার সে অ্যাটেম্পট করেছে। বসাক মরেনি। বসাক ভেবে পায় না কী করে উন্মাদ রণজয় তাকে মনে রাখে। রণজয় কি বসাককে মনে রাখে? নাকি রণজয় মৃত্যুকে মনে রাখে? অজস্র অসংখ্য মৃত্যুই তাকে ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনে কলকাতা। যুদ্ধপরিস্থিতিতে ফিরিয়ে আনে। পঞ্চাশে সদ্য ক্ষমতা এল বলে চলেছে, কাজ হচ্ছে এবং হবে। ষাটে বোঝা যাচ্ছিল কাজ হবার থেকে অনেক বেশী অকাজ হচ্ছে। শাসক কংগ্রেসের নেতাদের একচ্ছত্র দুর্নীতি এবং নগ্ন ক্ষমতায়ন, আর উন্নয়নের নামে দেশের যাবতীয় আর্থিক রাজনৈতিক স্বাধীনতা বেচে দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে এভাবে বেশীদিন নেই। ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়-এর রাস্তা ধরে এল নকশালবাড়ি।
    নকশাল আন্দোলন ভেঙেছে নানা কারণে। সে কথার দিনকাল আজ নয়। কিন্তু সত্তর পরবর্তী বেশ কিছুকাল স্বপ্নগুলো রয়ে গিয়েছে আঁচে। রক্তের দাগ, ডুমো মাছির তৃষ্ণা, ঘেমো কারখানার দিনরাত্রি তখনো অনেকের যাপনের অঙ্গ। বুলেটের খোলগুলো, বোমার দাগ সব ধুয়ে দেওয়া যায়নি জলে। সেই সব দাগছাপের মৃত্যু উঠে এসেছে নবারুণের কলমে। সে তখন নির্মম। পাঠকের সত্তর পরবর্তী যে শান্তিপ্রবাহ, যে তিল-তুলসী জীবন, যে দিবানিদ্রার সাহিত্য তাতে রক্ত স্প্রে করে দিতে উঠে এসেছে মৃত্যু।
    কিন্তু তখনো শুরু হয়নি কার্ণিভ্যাল। থমকে আছে। ওই লাইনগুলোর আক্ষেপে থমকে আছে। 'সব মরণ নয় সমান'। প্রতিক্রিয়াশীলের মৃত্যু হাসের পালকের মত, বিপ্লবীর মৃত্যু পাহাড়ের। তখনো উঠে আসছে মাত্র কয়েকশো বন্দুক নিয়ে শুরু হয়েছিল লং মার্চ। বেশীরভাগ অস্ত্র সাধারণ জীবনের অস্ত্র। শত্রুর থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে সে অস্ত্রে সজ্জিত হতে হবে। নইলে অস্ত্র কেনার সামর্থ্য কই? অথবা অস্ত্র কিনতে গিয়ে মাদক পাচার চক্রের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে। বিপ্লব বে-লাইন হয়ে যেতে পারে।
    নকশালবাড়িতেও পুলিশ ও জোতদারের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। যে হরেকৃষ্ণ কোঙার সুন্দরবনে গিয়ে কৃষককে লাঠি ধরতে বলছেন সেই হরেকৃষ্ণ কোঙারই শিলিগুড়ির পার্টি অফিস থেকে নামিয়ে দিতে চাইছেন কমরেড মাও-এর ছবি। শিলিগুড়ির কমরেডরা পার্টি লাইন মানে না। পার্টির কোন লাইন? একবার লাইন হচ্ছে ব্রিটিশ বন্ধু, একবার লাইন হচ্ছে শত্রু। একবার লাইন হচ্ছে তেভাগা সামলানোর ক্ষমতা নেই, অন্যবার লাইন হচ্ছে ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়। কোন লাইন? কোন পার্টি? ভেঙেছে এর মধ্যেই। সি পি আই ভেঙ সি পি আই (মার্কসিস্ট)। লাইন ঠিক হচ্ছে না তবু। সি পি আই লেজুড় হয়েছে কং-এর। দিল্লী থেকে আসল গাই/ সঙ্গে বাছুর সি পি আই। তারপর? তাদের সঙ্গেই আবার হাত মিলিয়ে জোট? কোনটা লাইন? উল্টোদিকে আট দলিলের দিন উঠে এসেছে। এই সব স্রোতের মধ্যে আচমকাই নকশালবাড়িতে কৃষক বিদ্রোহে ফেটে পরল।
    যুক্তফ্রন্ট। কোঙারবাবুদের মন্ত্রীত্ব। 'কালচার না বোঝা' এক পরবর্তীর রেকর্ডধারী মুখ্যমন্ত্রী তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁদের পুলিশ গুলি চালিয়ে দিল। বুড়া কাহারকে তো ধরে নিয়ে গিয়েছে মাত্র। এখানে পুলিশ শুইয়ে দিল কৃষক রমণী, কৃষক সন্তানদের। পুলিশ কার? রাজ্য কার? দেশ কার? আর যার হোক নয় চাষার! এই সব বিষ্ফোরণের টুকরো আশিতেও বেঁচে ছিল। গন্ধ ছিল বারুদের। তখনো পি ডাবলু জি, এম সি সি, পার্টি ইউনিটি আলাদা। সি পি আই মাওয়িস্ট জন্ম নেয়নি। লিবারেশন তখনো মুখোশ খুলে সোজা সংসদীয় লেজুড় হবার রাস্তা ধরেনি। কাজেই নবারুণের লেখার মধ্যে থেকে যে সব মৃত্যু উঠে আসছে তা ভারী।
    তা মানবিকও! অস্ত্র, বিপ্লব, বর্বরতা ছাড়াও মৃত্যু আসে। যেমন ফোয়ারার গল্পে, দেহোপোজীবিনী ফোয়ারার জন্য তার মস্তান প্রেমিকের আকুলতা উঠে এল। এবং সে রাস্তাও আসলে আরেক সামান্য মৃত্যুর অথচ অসামান্য মৃত্যুর হাত ধরে আঁকা। ফোয়ারাকে আমরা যে গল্পে পেলাম সেখানে বেঁটেদাকে পাওয়া গেল। মাসের চারতারিখে মদ খেতে আসে। মাইনে পায় বলে। বাড়িতে বোবা মেয়ে আছে, মা মরা। মানে বেঁটেদার বৌ মরে গিয়েছে। এই মরে যাওয়া বেঁটেকে দুনিয়ায় বার করে দিয়েছে। সে দুনিয়া হাইরাইজের না, এসি ঘরের না, স্কচ, হুইস্কি, ব্লেন্ডারস প্রাইডের না। বউ মরে গেলে সেখানে লোক আরেকটা বউ খোঁজে না, বেশ্যার ঘরে গিয়ে শুয়ে আসে না। সেখানে মানুষ শোয় খুকীর বা খোকার জন্ম হবে বলে।
    পুরোনো এক ধারাচলতি দুনিয়ায় বেঁটে থাকে। পাঠককে নিয়ে যান নবারুণ সেই জীবনের দেশে। এবং মৃত্যু সেখানে খুব অসম্মানিত। ফোয়ারার মাস্তান প্রেমিক যে কালে চাইনিজ স্টেন চালিয়েছে, সে মাস্তানি ছেড়ে ট্যাক্সি নামিয়েছে। ফোয়ারার কাছে যায়। ফোয়ারা, বেঁটে, সেই প্রেমিক, রিক্সাওয়ালা পাঁচুগোপাল যে মানুষের খামোখা ভাল করে, বোবা মেয়েদের দেশে আমেরিকান জাহাজী আসে। অনেক টাকা, মদ, সিগারেট নিয়ে। ফোয়ারাকে অসুখ দিয়ে যায়। তার থেকে প্রেমিকের হতে পারে। প্রেমিক ফোয়ারাকে নিয়ে হাতুড়ে ডাক্তার পেরিয়ে মেডিকেলে যায়। সেখান থেকে আমেরিকান জাহাজীর আনা রোগ, আমেরিকান ডাক্তারে দেখে যায়। মানে বাজার খুলে গিয়েছে। প্রভুরা মৃত্যু এনে দেন আহ্লাদ মাখ্যে, প্রভুরাই বুঝে যান কেমন মৃত্যু এল। প্রভুদের নিরাপত্তায় এইডসে কোটি কোটি ডলার ফুটে যায়, ক্যান্সার থেকে ম্যালেরিয়া অচ্ছুৎ থাকে। যত বেশী গরীব দেশের রোগ তত বেশী নীচে তার নাম্বার রাষ্ট্রপুঞ্জে। মাস্তানের বাড়িতে নিজের বৌ পরে থাকে। যখন বোঝে যে ফোয়ারার বাঁচার আশা কম তখন তাকে নিয়ে আলাদা বাসা ভাড়া করে। ফোয়ারার মৃত্যুকে সম্মান দিতে সে উঠে দাঁড়ায়।
    না, এ দেশের নীতি নৈতিকতা আলাদা। মিলবে না কারো সঙ্গে। রবিবাসরীয় গল্পের পাঠক বা ইন্টারনেট চমকে বাঁচা পাঠকের দেশ এ না। এখানে পরকীয়ার চমৎকার সুগন্ধ এবং কাঠের মেঝেতে চলাফেরা, দার্জিলিং-এ অপঘাতে মৃত্যু থেকে মিষ্টি মিষ্টি শোক-দুঃখ, দামী তাঁতের শাড়ি পরা পরিচারিকা এ সব নেই। এখানে যে যা করে করবে বলে করে। অগ্র-পশ্চাৎ তারা খুব ভাবে, ভেবে থই পায় না বলে যা পারে করে। ভাল হলে ভাল, মন্দ হলে তারা নিরুপায় ছিল। হাসপাতালে মাঝরাত্রের সেই জগদীশবাবু এই দুনিয়ার বাসিন্দা। তার পকেটে অপঘাতে মৃত্যুর নাইলন দড়ি থাকে। তাই দিয়ে জীবনকে সে বেশ ম্যানেজ করে এনেছে বলে দাবী করে। তার গল্পেও সমান্তরালভাবে বয়ে চলে রাশিয়ায় গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রৈ�� �ার খবর। গল্পের শেষে বোঝা যায় না জগদীশবাবু জীবিত কী মৃত! অর্থাৎ এটি একটি ভূতের গল্প এই সম্ভাবনা জাগিয়ে গল্প শেষ হয়ে যায়। এবং শেষ হয় না।
    এই ভূত, প্রেত, তাবিজ, কবজ, ঝাড়ফুঁক মাখা মৃত্যুর আরেক আখ্যান ফিরে আসবে 'হার্বার্ট'-এ। যৌক্তিক দুনিয়া থেকে সরে যাচ্ছে পরাজিত মানুষের দল। সরে যাচ্ছে তারা যাদের রেশন কার্ডের জীবন থেকে সোশ্যাল সিকিউরিটি নাম্বারে যাওয়ার কোনো মানে অবশিষ্ট নেই। দুই নামে আড়ালেই তারা এক ভাবেই বঞ্চিত, শোষিত এবং এই যাতায়াতের মধ্যে তারা আরো আরো বেশী থেঁতলে যাবে। তারা আঁকড়ে ধরছে অস্ত্র। না, বন্দুক নেই তাদের। তাদের রগুড়ে নুনু কামান হবে কোনোদিন। তার আগে তাদের আছে শুধু অভিশাপ দেবার ক্ষমতা। বিজন ভট্টাচার্য্য বলতেন যতকাল দেশের লোক দেবদেবীকে নাচাতে পারবে ততকাল তিনি সে নাচকে নিয়ে কাজ করবেন। বিজনের দেবীগর্জনে শোষিত নারী অথবা ঋত্বিকের যুক্তি-তর্ক-গল্পতে ছৌ নাচের আদলে বঙ্গবালা নাচবেই সেই নাচ। সেই আশা নবারুণে অভিশাপ হয়ে আসছে। ভীত, ত্রস্ত, না পারা মানুষ নিজেকে নিজের উচ্চতা থেকে বাড়িয়ে নিচ্ছে এই অন্ধকার কুসংস্কারের ঢেউ-এ চড়ে। সে আসলে সম্মান চেয়েছে। ডিগনিটি অব লাইফ না থাকায় সে ডিগনিটি অব ডেথ পাচ্ছে না। তাই,
    "চৌবাচ্চার তেলাপিয়া গঙ্গাসাগরে চললো।
    দোবেড়ের চ্যাং দেকবি? দোবেড়ের চ্যাং
    দেকবি? ক্যাট ব্যাট ওয়াটার ডগ ফিশ"
    হারবার্ট সরকারের সুইসাইড নোট। এখান থেকে কার্ণিভ্যাল শুরু হয়ে গেছে। বাখতিন কথিত ডায়ালজিকের খেলাও চলেছে অবিরল। কিন্তু কার্ণিভ্যাল শুধু বাখতিনের হলে এখানেই লেখা শেষ হয়ে যেতে পারত। হল না। এ কার্ণিভ্যাল নিতান্ত দেশজও বটে। চড়কের মেলায় পিঠে লোহা ফুঁড়ে যারা চড়কের গাছে চড়কির মত শূন্যে ঘোরে তাদের যন্ত্রণার পূজো। এ পূজো ঠিক রবীন্দ্রসঙ্গীতের 'আমার ব্যাথার পূজা' দিয়ে বোঝা যাবে না। শরীর যন্ত্রণা পায়। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে জান চলে যায়। এত প্রাচুর্য্যের দুনিয়ায় ক্লান্ত লড়াকু মানুষ। হাতে তার কিছুই আসে না। সব নিয়ে যায় অনেক উপরে থাকা চিল-শকুনের লোভ। মানুষের মত তাদেরও দেখতে, তবু মানুষের মত নয় কিছুতেই। কেন হয়?
    অপরাধ আছে নিশ্চই! জন্মজন্মান্তরের অপরাধ ফাঁদা হয়েছে এই উপমহাদেশে। এখানে মিশরের গল্পটা অনেক দূর এগিয়েছে। মৃত্যুর আগেই জীবনেই স্তর করে দেওয়া হয়েছে। বর্ণ বিভাজন দীর্ঘকাল সামলেছে অনেক কিছু। শাসকের ক্ষমতার রাস্তায় এ এক দারুণ হাতিয়ার। নানা ধরণের শাসক এসেছে, সকলেই কোনো না কোনো পাপের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে শাসিতের ঘাড়ে। কখনো জন্মান্তরের পাপ, কখনো কাফের হবার পাপ তো কখনো বর্বর অইউরোপীয় হবার পাপ। সে সব পাপ মেনে নিয়ে নিতান্ত দেশজ পদ্ধতিতেই চড়কের গাছে ঝুলে গেছে মানুষ। কাফকার K-ও যেমন একদা ভাবতে চেষ্টা করেছিল যে তার পাপ আছে বলেই সিস্টেম তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করছে, তেমনই তার বহু আগে থেকে এখানে মানুষ অপরাধী। বহু আগে থেকে মানুষ গোটা দুনিয়ায় নানা ধর্মের ব্যবস্থায় শরীরকে যন্ত্রণা দিয়ে পাপস্খালন করে। এবং সেই সব মানুষেরা আদপেই দরিদ্র অথবা ক্ষমতাবৃত্তের বাইরের বেশী। তাদের যন্ত্রণার কার্ণিভ্যাল থেকে উঠে আসে কার্ণিভ্যাল।
    সে কার্ণিভ্যালের জন্ম আমরা দেখি 'ভোগী' উপন্যাসে। মৃত্যু ঘিরেই এ কার্ণিভ্যাল রচিত। 'ভোগী' এক সাধারণ মানুষ। একদিন সে হঠাৎ দৈববাণী পায় সে 'ভোগী'। তার অলৌকিক ক্ষমতা আছে কিছু। এবারে সে ভোগ করবে। যা চাইবে সাধারণ জীবনের কাছে, মানুষের কাছে তাকে তা দিতে হবে। মানে যারা বিশ্বাস করবে তাকে তারা দেবে। কিছুদিন ভোগ করবে, মানুষের যথাসম্ভব ভাল করবে, তারপরে একদিন চলে যাবে। তার ডাক আসবে। সমুদ্রতীরে তাকে বলি দেবে এক জহ্লাদ। অন্য কেউ, অন্য কোথাও ভোগী হবার ডাক পাবে। ইটালো ক্যালভিনোর গল্পে এমন এক দেশ এবং রাজনেতাদের কথা উঠে এসেছিল, যারা নির্বাচিত হত, দেশ শাসন করত এবং অবশেষে জনগণ তাদের বলি দিত উৎসব করে। নবারুণের লেখায় এই ভোগ ও মৃত্যু উঠে আসে এক রাজনৈতিক স্টেটমেন্টের মত। যারা পায়নি কিছু, হ্যাভ নটস, তাদের থেকে ভোগী আসে। তারা কিছু ভোগ করে। সামান্য সে সব ভোগ। তারা ভাল করে এবং তারা বলি হয়। সুনির্বাচিত এক স্টেটমেন্ট। যা কিছু মানুষের ছিল তাই কুক্ষিগত করার বিরুদ্ধে আবার সেই যন্ত্রণার আড়ালে এক প্রতিবাদ। হিংস্র না, খুব মায়াময়।
    এই মায়াময়তা ছেয়ে আছে ফ্যাতারুদের মধ্যে। চোক্তারদের মধ্যে। তাদের ভাবনা এবং কাজের মধ্যে। যুদ্ধ মানে হত্যা না, খুন না, শুধু জীবনের নীচের দিক থেকে দুর্গন্ধগুলোকে উপরের দিকে ছুঁড়ে মারা। যাতে তারা আছে এই কথাটা জানা যায়, এই তথ্যটা চাপা না থাকে। এবং তারা যে আছে, তাদের যে পুতিগন্ধময় অস্তিত্বের খোপে এঁটে রাখা সেই খোপ নিয়ে তারা উৎসব শুরু করে। শিশুর মত সেই উৎসব। সেই কার্ণিভ্যালে মৃত্যু মমির তামাশা হয়ে যায়। বেঁচে থাকা যেখানে ধুরন্ধর তামাশা সেখানে মৃত্যু নিয়ে এক হৈ হৈ শুরু হয়ে যায়। সেই হৈ হৈ এক খেলা, জেনে নিয়ে, মেনে নিয়ে খেলা যে মৃত্যু অমোঘ। অথচ তার আগের জীবন কদাকার হলে মৃত্যুও নোংরা হয়ে ওঠে। এই বিভৎস জীবনের উপমহাদেশে, জীবনের মান বাড়ানোর বক্র খেলা উঠে আসে মার্শাল ভদির মমিতে। সব স্তরের, সব শ্রেণীর মানুষের চিন্তা-স্থবিরতাকে জিভ ভেঙচে সেই মৃত্যু-তামাশা চলে যায়। মৃত্যুর কার্ণিভ্যাল সংলগ্ন হয়ে থাকে জীবনের ছায়া, যে ছায়া তার সম্মান দাবী করে চলে।

    ==================================================

    শেষ মাতাদর

    অগ্নি রায়

    এই সভ্যতা সবাইকেই অ্যাকোমোডেট করে। যারা চে গুয়েভারা হতে চেয়েছিল তারা চাপরাশি হতে পেরেছে। নবারুণ, তোমার চলে যাওয়াই ভাল। আজ হো চি মিন সরণি জুড়ে শপিংমল।
    --সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
    সদ্য লিটারেট দাদা বৌদির কোলেপিঠের আহ্লাদে বেড়ে উঠে, অকাদেমির প্রসাদী ফুল বুকপকেটে রেখে যে সব স্পনসরকরোজ্জ্বলেরা কবিতা এবং পাল্প ফিকশনের নামে ছড়াচ্ছেন লোকাল ট্রেন খ্যাত মাজন আর মলম, তাঁদের বাতানুকূল ফিলগুড ডানলোপিলোতে একটি একটি করে ডিনামাইট স্টিক পুঁততে পুঁততে দিগন্তের দিকে ওই তো হেঁটে চলেছেন নবারুণ ভট্টাচার্য।

    শারীরিক প্রয়াণের পর এখনও পর্যন্ত যে এক বছরের পথ চললেন তিনি সেদিকে তাকালে এই ছবিটাই ফ্রেম কেড়ে নিচ্ছে। সেই কবেই তো ছাপার হরফে নবারুণ ভট্টাচার্য ঘোষণা দিয়েছিলেন যে এই অস্থির কুটিল সময়ে দাঁড়িয়ে ‘নিরাপদ সাহিত্যের ঢ্যামনামি’ তিনি করবেন না।

    ‘নিরাপদ সাহিত্য’ কী ও কেন এই নিয়ে অনেকবার অনেক প্রসঙ্গে কথা হয়েছিল নবারুণদার সঙ্গে। কথা হয়েছিল সেই সব সেফ এবং পলিটিকালি কারেক্ট, শপিংমল-কাঁপানো কবি পরিচালক সাহিত্যিকদের নিয়েও, যাদের অনেকেই অধুনা সরকারি কমিটিগুলির মেম্বারশিপ কুপনের জন্য আখাম্বা জিভ বের করে দৌড়াচ্ছেন। যেন গান, কবিতা, নাটকমেলার বাঁশ ও শালুর টেন্ডারটিও ছাড়া
    যাবে না! যতক্ষণ পিচে রান আছে চেটে লে ভাই, জিলে ল্লে (তিন দশক আগে কিমি কাৎকার খচিত টারজান ছবিতে বাপ্পি লাহিড়ীর সেই গানটি এখানে স্মরণীয়)! চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে একঘণ্টা ঠিকঠাক খাঁজে ও খোপে ঘানির তেল ঢাললে বাকি জন্মটা যদি গাদা পেটি-সহ ঘ্যাম ঘ্যাম মাছ ভেজে খাওয়া যায়, তবে তো সেটাই ফায়দামন্দ। ফাঁকে ফোকড়ে পেজ থ্রি-র ডবকিনীর সঙ্গে নঙ্কাই-পঙ্কাই খেলো, জার্সি গরুর মত রূপসীদের নিয়ে ফিতে কাটো সকাল সন্ধ্যায়। সে ছবি প্রচারমাধ্যম আলো করুক। সাহিত্যযশ তখন এমন খেলবে যেন বিজ্ঞাপনের কন্যার কেশদামে জবাকুসুমের মস্তকলন্দর! চাড্ডি অপোজিশনও পোষা হবে মেজারার দিয়ে মাপা।

    মোদ্দা এই তো ব্যাপার?

    নবারুণ ভট্টাচার্যের সাহিত্য যাপনের স্থানাঙ্ক যদি এই মানচিত্রে খুঁজতে যাই তবে দুর্গন্ধ গোলকধাঁধার মধ্যে ষন্ডমানব মিনটারের দিকে কৃতসংকল্প থিসিউস যাত্রার ছবিটাই ভেসে ওঠে যেন। যার হাতে খাপ খোলা তলোয়ার। বিষয়বস্তুকে যা ভাষার ধার বা ‘এজ’ দিয়ে বারবার আক্রমণ করেছে সবটুকু আদায় উসুল করে নেওয়ার জন্য। আমাদের যৌবন কেটে গিয়েছে দিব্যি এই জেনেই যে ঈশ্বর এবং কবিতা বা ছবির কাছে কেউ মধ্য মেধা আশা করে না। কিন্তু আজ-কাল-পরশু যখন মাঝারি এবং নিম্ন মেধাকে স্টেজে তুলে টুনি-বাতাসা দিয়ে উৎসব কীর্তন করছে— তখন ঠিক এক বছর আগে প্রয়াত এই সাহিত্যিকের ওই চাবুক উক্তিটিকে আবার ফিরে দেখতে ইচ্ছা করে।

    শহরের রাতচরা গ্লোসাইন যারা এখনও বাইফোকাল অ্যাডজাস্ট করে পড়তে পারেন, তারা মাত্রই জানেন, যে ষাটের দশকে সিয়া (সি আই এ) যেভাবে বেনামে ডলার ঢালত আভা গার্দ প্রয়াসকে কিনে নিতে, চেষ্টা করা হত তাদের গলার স্বর, লেখার কলম, দেখার চোখ, গিটারের তার— মোটা, ধুর ও বেতো করে দেওয়ার— অধুনা বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে সেটাই হয়ে আসছে। ও মশা ও মাছি ও প্রেম ও হাসি— এখন সব্বাইকে যে মহামায়ার দোকান স্পনসর করে থাকে! বরাত অবশ্য এক একক্ষেত্রে এক এক রকম।

    নবারুণের একটি ব্যাকহ্যান্ড স্ম্যাশ এখানে উদ্ধৃত করি। ‘‘আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, যে তাগিদ থেকে আমি লিখি তার সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক রদবদলের যে বিচিত্র ও ট্রাজিক সময়ের আমি সাক্ষী তার অনুরণন আমার আখ্যানে রয়েছে— কখনও আমি অংশীদার এবং সব সময়ই ভিক্টিম।’’ নিজেকে তৃতীয় বিশ্বের লেখক বলে মার্কা মেরে দিয়ে তিনি এ কথাও বলছেন, ‘‘অমানবিকতা এবং তৎসংশ্লিষ্ট আবশ্যিক যে বুজরুকির সার্কাসের মধ্যে আমরা রয়েছি তার সঙ্গে কোনওরকম আপোষ অসম্ভব।’’

    এখানে একটি কথা বলে নেওয়া খুব জরুরি। বিজন ভট্টাচার্য এবং ঘটক পরিবারের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া লাল নিশানটি (যা তাঁর কবচকুণ্ডলও বলা চলে) যে শেষপর্যন্ত গোটা বিশ্বেই একটি স্বপ্নে পরিণত হচ্ছে তা বুঝতে না পারার মত কাণ্ডজ্ঞানহীন নবারুণ ভট্টাচার্য ছিলেন না। সোভিয়েত পতনের শব্দ তাঁর ঘরের দরজাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ক্রমে। কমিউনিজমের পথে মুক্তির দিশা ক্রমশ স্বৈরতান্ত্রিক গুলাগে পরিণত, এবং ক্রমশ তার তাসের ঘরের পরিণতিপ্রাপ্তি তিনি দেখেছেন। নবারুণের বোঝার বাকি ছিল না, পাস্তেরনাক, মায়াকোভস্কি, সনঝেনেতসিন, আখমাতোভার মত লেখক-কবিদের নিয়তি। আর তাই বোধহয় তাঁর প্রথম যৌবন বা মধ্য বয়সের লাল পতাকার স্বপ্ন বিশ্বাস শেষপর্যন্ত জাদুবাস্তব, ইলিউশান এবং কখনও কখনও ফ্যান্টাসির চেহারা পেয়ে গিয়েছে। অনেকেই জানেন, পাশ্চাত্য ধ্রুপদী মিউজিকের আকর্ণ ভক্ত ছিলেন নবারুণদা। তাঁর অন্যতম প্রিয় কম্পোজার চাইকভস্কির শেষ সিম্ফনির (‘প্যাথেটিক’) শেষ মুভমেন্ট ‘ল্যামোন্টোসো’-র মতই পুড়তে পুড়তে শেষ হয়েছে তাঁর বিশ্বাসের রূপবদল। পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে তাঁর ‘খেলনানগর’ উপন্যাসের মত। যেখানে সমস্ত লাশ ডাঁই করে সাজিয়ে পেট্রল জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়।

    এই প্রসঙ্গে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের নবারুণ সম্পর্কে একটি মন্তব্য মনে করা যেতে পারে। সন্দীপন বলছেন, ‘তার (নবারুণের) পকেট খুঁজলে পাওয়া যাবে গজ ফিতে। গোপনে বা আড়চোখে সর্বদাই নবারুণ দেখে চলেছে কে কতটা বাড় বেড়েছে।’ রাজনৈতিক বিশ্বাসের এই ধ্বস্ত কালবেলায় দাঁড়িয়ে ওই আগুনেরও হিসাব তিনি তলে তলে করে গিয়েছেন তাঁর জীবন ও সাহিত্যে। একইসঙ্গে দু’টি প্রক্রিয়াকে তিনি দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন। এক, সুপরিকল্পিতভাবে গত কয়েক দশক ধরে সহজলভ্য এবং রংদার পণ্যের গোত্রে নামিয়ে আনা হচ্ছে সাহিত্যকে। সহজপাঠ্য এবং পাউডার চর্চিত করা হচ্ছে গদ্যভাষা। দুই, ক্ষমতাকেন্দ্র বা শাসক সুকৌশলে সমস্ত কিছুকেই তার নিজের ভিতরে নিয়ে নিচ্ছে। স্বাধীনতা, পরিবর্তন, গণতন্ত্র, মৈত্রীর ধাপ্পা মেরে বাইরে থাকা আভা গার্দ, থার্ড স্টিম, আন্ডারগ্রাউন্ডের সমস্ত নোটস-এর উপর প্যান অপ্টিকান আলো ফেলা হচ্ছে। ক্ষমতার চূড়ায় বসে রয়েছে মুখহীন জোকারটি। তার নজরদারি এবং খবরদারির বাইরে যেন কিছু না থাকে। গোটা নবারুণ-সাহিত্য এই প্যান অপ্টিকান আলোর বিরুদ্ধে একটি পাল্টা এবং তির্যক আলো ফেলতে ফেলতে গিয়েছে বলে আমার ধারণা। যে আলো ছাড়েনি কাউকে। যে সব গণমাধ্যম, রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র, পুঁজিবাজার— বাইরে থেকে যাদের স্বরূপ চট করে বোঝা যায় না— ফ্যাতাড়ু বাহিনী তার উপরে নিরন্তর বিষ্ঠা বর্জনই করেনি, তাদের ন্যাংটো করে ছেড়েছে। নবারুণ জানেন, শুধুমাত্র গুজরাত, পশ্চিমবঙ্গ বা গোবলয়ের ব্যাপার এ নয়, গোটা বিশ্বেই সাংস্কৃতিক দমননীতির মধ্যে এই অদৃশ্য মেঘনাদবাহিনী কীভাবে ছড়িয়ে রয়েছে।

    স্টিফেন স্পেনডার তাঁর ‘দ্য সিচুয়েশন অব ইয়ং রেবেলস’ প্রবন্ধে ষাটের দশকের মার্কিন মুলুকের সিআইএ-র যে ভূমিকার কথা জানিয়েছেন, একটু দেশকাল এবং চামড়ার রং বদলে নিলে, আহা তা যেন আমাদের এই বঙ্গসমাজেও খাপে খাপ হয়ে যায়। স্পেন্ডার সাহেব বলেছেন, ‘যুব সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং আন্দোলনগুলিকে কখনও বেনামে ছদ্মবন্ধুর বেশে ডলার যুগিয়ে গিয়েছে সিআইএ। কথনও কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডাম বা অন্য কোনও সংস্থার নামে উদার হস্তে অর্থ ঢালা হয়েছে বিভিন্ন তথাকথিত আভা গার্দ পত্রপত্রিকাকে। তাঁর কথায়, গোপনে এই সমস্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলিকে কোথাও ভোঁতা করে দিয়ে কখনও নিজেদের রাজনৈতিক কাজে লাগিয়ে পত্রপত্রিকার স্বাধীনতার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের চোখে পাগল এবং বদমাশ দুই অনুপযুক্ত। এরা যুক্তির বাইরে। কেননা বাইরে রাখলে তাদের শাসন করা যাচ্ছিল না।

    সোভিয়েত ইউনিয়নের বিষণ্ণ পতনঘণ্টা শোনার পরেও যে সলতেটি নবারুণ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন তাঁর শেষদিন পর্যন্ত সেটি এই ক্ষমতার মেঘনাদ অবতারের বিরুদ্ধেই। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘আমি এই সভ্য সমাজ সম্পর্কে খুব স্কেপটিক। এদের দৌড় আমার জানা আছে। সে তো আমরা বাংলার বুদ্ধিজীবীদের সাম্প্রতিক চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি। এরা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের যে ঘরানা, ঐতিহ্য সবটাকে নষ্ট করবে। ...এইভাবে এরা সোল্ড আউট হয়ে গেল। লজ্জার ব্যাপার। কি সিনেমা, কি থিয়েটার, কি পেইন্টিং বিভিন্ন ফ্রন্টের লোকেরা এই যে ব্যাপারটা করল তা খুবই লজ্জার, নিন্দার এবং দে হ্যাভ গট টু বি কমব্যাটেড। এবং আমি তা করব। এটা হচ্ছে আমার রাজনৈতিক দায়িত্ব। ফ্যাতাড়ুরা টোটালি আমার পলিটিক্যাল কনসাসনেসের এক্সটেনশান।’’

    এটা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না। পশ্চিমবঙ্গের মার্ক্সিজমকে যিনি চিরটাকাল ‘ভালগার মার্ক্সিজম, এবং ‘মেকানিকাল মার্ক্সিজম’ বলে আখ্যা দিয়ে গেলেন, নিজে আনখশির কমিউনিস্ট হয়েও মনে করলেন, ‘ভুল মার্ক্সবাদ আমাদের দেশের বারোটা বাজিয়েছে’, ফ্যাতাড়ু সন্ত্রাসকে যে তিনি তাঁর অন্যতম প্রহরণ করবেন— সেটাই যেন স্বাভাবিক। এই প্রসঙ্গে নবারুণ-পাঠক তাঁর কৃশকায় গল্পগ্রন্থটিকেও (‘প্রেম ও পাগল’) আবার স্মরণ করতে পারেন। উপন্যাস ও গল্পের যৌক্তিক কাঠামোর আধারেই তিনি কাজ করেছেন। কিন্তু অজস্র দগদগে চিহ্ন সারা শরীরে নিয়ে গদ্য সেই কাঠামো থেকে প্রায়ই বেরিয়ে গিয়েছে। চলে গিয়েছে যুক্তির আউটসাইডে। যুক্তি ও যুক্তিহীনতা, অর্থ এবং অর্থহীনতা, পলিটিক্যাল মিথ ও ফ্যান্টাসি, নিরাপদ জীবন এবং অন্ত্যজ রেললাইনের পাশের ছাইগাদার জীবনের মধ্যে তাঁর লেখা নড়াচড়া করছে। যেখানে তৈরি হচ্ছে এবং বহুদিন ধরে চলতেই থাকবে নতুন নতুন বিস্ফোরণের সম্ভাবনা।

    কমোডকে রাজসিংহাসন হিসাবে যারা দিব্যি চালিয়ে দিচ্ছে, সেই ‘এনলাইটেন্ড’ শাসককূলের রক্তচাপ ক্রমশই বাড়িয়ে দিয়ে।

    =====================================================

    একটা সাধারণ মেয়ে কি লিখতে পারতেন না, নবারুণ?

    অধীশা সরকার

    বেচামণিকে মনে আছে? আমাদের ‘কাঙাল মালসাট’-এর বেচামণি গো। মনে আছে তো? এবার, নবারুণকে নিয়ে এই এক জ্বালা। একবার পড়লে যা মনে হবে, দু’বার পড়লে মনে হবে ঠিক তার উলটো। প্রথমবার পড়ে ভাবলাম, এই বেচামণির কাজটা কি এই গপ্পে? মাঝেসাঝে ভরটর হয়, ভাট বকে। তাতে গল্পের অ্যাম্বিয়েন্স তৈরী হয়। ভদির বেটার হাফ হওয়ার সুবাদে সবরকম প্ল্যানপ্রোগ্রামেই সে আছে, টুকুস-টাকুস মন্তব্যও করছে, কিন্তু তার কথায় তো আর কিছু হচ্ছে না। বেচামণিকে কেমন একটা নেপথ্য শিল্পী মনে হয়েছিল প্রথমবার কাঙাল মালসাট পড়ে। তারপর, আবার পড়লাম। তখন কিন্তু মনে হল, নেপথ্যে যে আছে, তার ভূমিকাটা বেশ বড় মাপের। ক্যানভাসে ছবি আঁকার সময়ে একটা বেস কালার দিতে হয় না, সেরকম। ওই রংটা তো দেখাও যায় না তেমন। কিন্তু ওটা না থাকলে ছবিটা ধরে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা মুশকিল হত। সেরকমই, ভদির জীবনে ও ফ্যাতাড়ু-চোক্তারের মিলিত বিদ্রোহঘোষণার আয়োজনে, বেচামণি যেন নেপথ্যের সেই ক্যানভাস, সেই সুপারভাইজিং ম্যানেজার, যে কিনা একটু দূর থেকে নজর রাখছে, কার্য্য-কারণ মনে করিয়ে দিচ্ছে, আর প্রয়োজনে এখানে একটু প্যাঁচ মেরে, সেখানে একটু পেরেক ঠুকে, প্ল্যানপ্রোগ্রাম মেরামত করে দিচ্ছে। বেচামণির গুরুত্ব কাঙাল মালসাটে যাকে বলে ‘বিটুইন দ্য লাইনস’।
    মজা পেলাম একটা ছোট্ট জিনিস লক্ষ্য করে। ভদিকে বেচামণি ‘গদি’ বলে ডাকে। কেন? কারণ ‘সোয়ামী’র নাম মুখে আনতে নেই। এই অব্ধি শুনেই নারীবাদীরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন তো? স্বাভাবিক। কিন্তু, এক মিনিট। স্বামীর নাম ধরে না ডেকে বেচামণি কি ‘উনি’ বা ‘ওগো’ বলছে? উঁহু। সে নামটা একটু পালটে নিয়ে সেই নাম ধরেই ডাকছে কিন্তু। ভদিকে বলছে গদি। মানে, ভদিকে একটা নতুন নাম দিয়ে, সেই নাম ধরেই ডাকছে। এইটা বুঝতে পেরে অন্তর থেকে ধ্বনিত হয়েছিল, ‘সাব্বাশ!’
    নবারুণের শিকড় যদি বুঝতে হয়, তাহলে ‘সাবভার্শান’ শব্দটা মাথায় রাখতে হবে। নবারুণ যাদের কথা বলেন, তারা সমাজের নর্দমার তলায় বাস করে। সিমোন দ্য ব্যুভিওর পৌঁছয়নি তাদের কাছে। এমনকি, আমাদের ঘরের মেয়ে তসলিমা নাসরিনও নয়। তাদের সমাজে বৌ বরকে নাম ধরে ডাকেনা, এটা নিয়ম। সবচেয়ে খাণ্ডারনি বৌটিও এটা শুধুই নিয়ম বলে মেনে চলে, বরকে দু’বেলা ঝ্যাঁটা মারলেও। সেখানে এটাই লক্ষণীয়, যে বেচামণি নিয়মটা মানছে না। বরং, নিয়মটার প্যারোডি করছে একরকম। তাকে বলা হয়েছে স্বামীর নাম ধরে না ডাকতে। সে এই নিয়মটাকে আক্ষরিক নিয়েছে। যা স্বামীর পরিচিত নাম, তা ধরে ডাকছে না। টেকনিক্যালি কারেক্ট আছে সে। একটা নতুন নাম দিয়ে সেটা ধরে ডাকছে। নিয়মের ফাঁক বের করে সেই ফাঁক দিয়ে জিভ ভ্যাঙাচ্ছে। ধরতে গেলে উড়ে পালাবে। ফ্যাঁত ফ্যাঁত, সাঁই সাঁই।
    এই হল এক নবারুণের নারী। সাবভার্সিভ। নেপথ্যের পরিচালিকা। যার বাইরেটা মোটাসোটা আহ্লাদী গিন্নীর, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মাতাহারি মেটিরিয়াল। সে অর্থে, বেশ রোমহর্ষক।
    আবার পুরন্দর ভাটের স্বপ্নের নারী আরেকরকম।
    “হব না ননদ, হব না জায়া
    হব সরকারী হোমের আয়া।
    সুপারের সনে, যাব কচুবনে
    রচিতে নধর মিলনমায়া।
    না রবে পিত্তি, না রবে হায়া।
    হয় এসপার, নয় ওসপার
    দেখিবে জগৎ যুগলছায়া
    হব না ননদ, হব না জায়া”
    এখানে তো প্রত্যক্ষভাবে চূড়ান্ত নারীবাদী ছবি তুলে ধরেছেন নবারুণ। সেই আয়া রচনা করেছেন, যে ননদ ও জায়া হয়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের শিকলবদ্ধ হতে পরিষ্কার অস্বীকার করছে। বরং সুপাররুপী শ্যামরায়ের সঙ্গে যমুনার অভাবে কচুবনে যুগলছায়া রচনাই তার অভিসন্ধি। ‘না রবে পিত্তি, না রবে হায়া’। সেক্সুয়াল ফ্রিডম। নারী তার নিজের শরীরের অধিকার নিজে বুঝে নিচ্ছে। লজ্জাশরমের চোখরাঙানিকে বক দেখিয়ে। এখানেও সাবভার্শান। সে তো আর নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বয়স্থা বেকার মেয়ে হয়ে এই যৌন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে পারে না, তা সম্ভব নয়। ফলে, সে আয়ার প্রফেশন বেছে নিচ্ছে, যাতে হাতের কাছে সুপার ও কচুবন দুইই পাওয়া যায়। উপরন্তু, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিয়ে ‘নৈতিক’ বাগড়া সামলাতেও যাতে সে সক্ষম হয়। এক ঢিলে দুই পাখি, তথা ফ্যাঁত ফ্যাঁত, সাঁই সাঁই।
    কাঙাল মালসাটের মেয়েরা এমনই। subversive and subtle। কিন্তু তারা কোনোভাবেই সফিস্টিকেশনের প্যাকেজে মোড়া পুতুল নয়। আঁতলামির ওড়নাঢাকা বিবিসাহেব নয়। তারা লক্ষীকান্তপুর লোকাল মার্কা। কিন্তু তারা নারী হিসেবে উন্নত। উন্নতির এক অন্য রাস্তা আবিষ্কার করেছে তারা। ঝাণ্ডা নিয়ে ভাংচুর নয়, মিষ্টি হেসে চোখ মেরে বা ল্যাং মেরে কাজ আদায়। নিয়মের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ নয়, মুচকি হেসে নিয়ম ব্যাপারটাকে স্রেফ পাত্তা না দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া। আজকালকার ভাষায় একটি শব্দে তাদের ‘বিন্দাস’ বলা যেতে পারে।
    অথচ, আবার, কি আশ্চর্য্য, পুরন্দর ভাটের লেখা এই কবিতাটা পড়ে মদন বলে ওঠে— “তোমার দু’টো গানেই দেকচি মেয়েদের হ্যাটা করার একটা ধান্দা”। তাই বলি, নবারুণ খুব ট্রিকি। তাঁকে সহজে বোঝা যায়না। তাছাড়া, এমনিতেও, গল্পের কোন চরিত্রটা যে আসলে লেখক তা তো খুব ধোঁয়াটে একটা বিষয়। কারণ এই কাঙাল মালসাটেই আবার, একটু পরের দিকে, এই ছড়াটি পাওয়া যায়।
    “জানি না লো দিদি, কোন দোষে বিধি,
    এই কুলাঙ্গার কূলে।
    মোরে পাঠাইয়া, রাখিল গাঁথিয়া,
    বিরহ বিশাল শূলে”।
    “এইমত ট্র্যাজিক অবস্থায় আসিয়া পড়িল কাঙাল মালসাট। সাহারা দেবার কেহই নাই... তাই সে কোনো ধর্মান্ধ রাম-খচড়া রচিত ‘বিধবা-গঞ্জনা’ নামক ‘বিষাদ-ভাণ্ডার’ হইতে ওই গানটাই কাঁদিয়া উঠিল”। এই অব্ধি পড়েই মনে হয়, আজও বিধবাদের ‘সাহারা দেবার কেহই নাই’ একথাও ঠিকই, কিন্তু তাদের কি ‘সাহারা’ (মরুভূমি নয়) প্রয়োজন? তবে, ওই যে বললাম... নবারুণ খুবই ট্রিকি। হঠাৎ আবার ‘রাম-খচড়া’ শব্দবন্ধটিও চোখে পড়ে যায় কিনা? আর বিধবা-গঞ্জনা আর বিষাদ-ভাণ্ডার এই দুই শব্দের প্রয়োগ কোটমার্কের মধ্যে হল কেন? – এই প্রশ্ন মাথায় কুটকুট করতে থাকে।
    অন্যদিকে, ডিএস, মদন, পুরন্দর ‘ঢেমনি মাগী’ সম্বোধন করে থাকে পুকুরধারের একলা মেয়েকে। তাকে ‘সাইজ করার ধান্দা’ করে। কিন্তু যেই বড়লোক আসে ‘মোটরগাড়ি বাগিয়ে’, অমনি সেই মেয়ে তাতে উঠে পড়ে। ক্লাস স্ট্রাগল। সে তো বুঝলাম। হ্যাভস অ্যান্ড হ্যাভ নটস। কিন্তু হ্যাভ নটের পীড়া বোঝাতে গিয়ে নবারুণ ‘ঢেমনি মাগী’ ব্যাপারটাকে সেই কমোডিটি হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন যা হ্যাভ’দের আছে, আর হ্যাভ নট’দের নেই। খুবই ছোট্ট রেফারেন্স, সন্দেহ নেই। কিন্তু আশঙ্কার কারণ হিসেবে যথেষ্ট। যে সমাজের কথা নবারুণ কাঙাল মালসাটে তুলে ধরেন সে সমাজে এমনটাই স্বাভাবিক তা মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু... যা ‘স্বাভাবিক’ তার সাহিত্যে প্রতিফলন কি সর্বদাই শুধু স্বাভাবিকতার খাতিরেই, এবং গল্পের অ্যাম্বিয়েন্স এবং প্লটের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার খাতিরেই, অবিকল অমনটাই থেকে যাবে? স্বাভাবিকের অস্বাভাবিকতা কি ফ্যাতাড়ুদের চোখে পড়বে না, এক্ষেত্রে? কারণ, দু’একটা অক্ষর দিয়ে তৈরী একটা বা দু’টো শব্দের ক্ষমতাও কখনো কখনো শব্দটির চেয়ে অনেক বৃহৎ। কারণ শব্দ বহন করে মানে, আর মানে বহন করে ইতিহাস ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। যেমন শব্দের মানে এই জিনিসগুলো বহন করে, একইভাবে, গঠনও করে। এই বহন আর গঠন সম্বন্ধে নবারুণ কি খানিকটা উদাসীন নন?
    বলা যায় না। চমকপ্রদভাবে, ‘মসোলিয়াম’ উপন্যাসে এসে হাজির হয় ‘খানদানি খানকি’। নাম শুনেই যারা হাঁহাঁ করে উঠবেন তাঁরা বাকিটাও পড়ুন। এই নারীচরিত্র এন্ট্রি নিয়েই এই বক্তব্য রাখে –
    “- বিজনেস ইজ বিজনেস। কক সাহেবের নিকট হইতে তিনমাসে যে পরিমাণ রেস্ত কামাইব তাহা দশ বছর কলকেতার বাবুদের সহিত খিটকেল খেলা করিলেও জুটিবে না। ইহা সত্য যে খানকি জীবনে তোমাকেই আমি প্রেমিক বলিয়া পাইয়াছি। কিন্তু সে কারণে জাত ব্যবসায় লালবাতি জ্বালাইতে পারি না।
    - তিনমাস পরে যে তুমি ফিরিয়া আসিবে তাহার কি কোনো গ্যারান্টি আছে?
    - বিচিত্র এ জীবনে কোনোকিছুতেই গ্যারান্টি নাই শিবনাথ। গরানহাটা হইতে খানকিজীবন শুরু করিয়া আজ কক সাহেবের দয়ায় মাল্টায় যাইতেছি – এমনটি যে হইবে তাহা কি জানা ছিল? ভাবিতাম লম্ফ জ্বালাইয়া পোকা ধরিয়া ধরিয়া কোলাব্যাঙের ন্যায় লাইফ কাটিবে। বলা যায় না, মাল্টা হইতে আবার কোনো সাহেব নয়া বুকিং করিয়া কোনো অজানা বন্দরে লইয়া যায়”।
    যদি না এমন চিত্তাকর্ষক নামের নায়িকা একথা বলত, আর যদি না ব্যবসার খুঁটিনাটি বলা থাকত, খুব আলাদা করা যেত কি সংলাপকে আজকের যে কোনো ‘কেরিয়ার-কনশাস’ উচ্চমধ্যবিত্ত তরুণীর ‘অ্যামবিশাস’ বক্তব্যের সঙ্গে? এখানেই নবারুণের ফ্যাতাড়ুবৃত্তি, আবারো, এবং সাবভার্শন। যৌনকর্মীকে উনি ‘খানকি’ বলেন বটে, কিন্তু তাকে ‘ভিক্টিম’ বানান না। সে এক সফল ব্যবসায়ী, এবং সেটা নবারুণের কলমে খুবই সোজাসুজি আসে। সেভাবে ভেবে দেখতে গেলে, যে হাতে কলম ধরে লিখছে সে লেখা বিক্রি হবে বলে, সেও তো শরীরের অংশ বিশেষই বিক্রি করছে, তার মানে। শরীর বিক্রি সেই অর্থে কে না করছে? এবং, যা বিক্রি হচ্ছে তা তো ক্রেতা আছে বলেই বিক্রি হচ্ছে। তবে যৌনকর্মীকে একজন সোজাসাপটা ব্যবসায়ী হিসেবে দেখতে অসুবিধে কোথায়? অনেকেই হয়তো আগেও এ প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু নবারুণ কোনো প্রশ্ন তোলেননি। তিনি শুধু খুব স্বাভাবিকভাবে তাঁর নিজস্ব লজিক দিয়েই দেখেছেন ‘খানদানি খানকি’কে।
    এবার যাওয়া যাক অন্যান্য লেখায়। যেমন হারবার্ট। আর তার কাঁচের শো-কেসে দেখা পরি থেকে বুকির স্তন দর্শনের অভিজ্ঞতা। ‘নারী’ ব্যাপারটাকে মনুষ্যপ্রজাতির প্রাণীসমুহ হিসেবে না দেখে একটা ‘কনসেপ্ট’ হিসেবে দেখা। পুরুষের ইল্যুশনে আর যৌবনোদ্গমের প্রাক্কালে নারীমূর্তির যে ভূমিকা, শুধু সেটুকুই। আর অন্যদিকে হারবার্টের জেঠিমা। রীতিমত ডিস্ফাঙ্কশনাল স্বামীকেও যিনি পরম শ্রদ্ধায় বয়ে নিয়ে চলেছেন। অন্যদিকে হারবার্ট আর তার কাকার মধ্যে যে বিরোধ তা থেকে পরোক্ষভাবে হারবার্টকে রক্ষা করলেও, সংসারে তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারে যেমনটা হয়ে থাকে আর কি। মাঝে মাঝে নস্টালজিয়াগ্রস্ত হয়ে গান ধরেন – ‘সখী, কেমনে যমুনাজলে যাই?’ ওই, যেমনটা হয়ে থাকে আর কি। হারবার্টের নারীরা সাবভার্সিভ নন। তাঁরা শুধুই প্লট এলিমেন্ট। বা তার সামান্য বেশী কিছু। নবারুণের ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ উপন্যাসের মেখলাও তাই। উদ্বিগ্ন হওয়া, কান্নাকাটি করা, শোকার্ত হওয়া, ‘ভালো’ প্রমাণিত হওয়া, এবং শেষপর্যন্ত এসবের মাধ্যমে একটি নিটোল ট্র্যাজিক হিরোইন হয়ে ওঠা— এছাড়া মেখলার কিছুই করার ছিল না। বিপ্লবের স্বার্থে বলিপ্রদত্ত সেই নারী কি ‘মহান’? কে জানে। কিন্তু তাঁর এই মহত্ব কতটা আরোপিত একজন মেয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সেটাও প্রশ্ন। প্রশ্ন এটাও, যে ‘বিপ্লবের সেবাদাসী’ হওয়ার মধ্যে আদৌ কি কোনো স্বাতন্ত্র আছে? উপন্যাস হয়তো সেই ট্র্যাজিক হিরোইনই দাবী করেছিল। সে কথা লেখকই জানেন। কিন্তু পাঠক? সেও কি দাবী করেছিল মেখলার চরিত্রে একজন ট্র্যাজিক হিরোইন? হয়তো সেও করেছিল। বা করেনি। অথবা, লেখকের কাজ পাঠকের মন রেখে চলা নয়। তবে, লেখকের কাজ কি পাঠকের মন তৈরী করা নয়?
    আবার, অন্যদিকে তাকানো যাক। নবারুণের সেই লাস্যময়ী অনন্যা যার নাম ফোয়ারা। সেই ফোয়ারা, যে গলির মুখে এসে দাঁড়ালে “বৌ পাশে ভদ্দরলোকেরা হাঁদা বনে গরমে যেত”। “ফোয়ারা শুকিয়ে যাচ্ছে আর লোক এত বড়, এত বিদ্বান যে জানবেই না?” বোঝা যায়, নবারুণের চোখ জ্বালা করে ফোয়ারার জন্য। ফোয়ারা যদি মরে যায় তিনি নিলাম হয়ে যাবেন। এতটাই, যে ফোয়ারার গভীর অসুখ তাঁর ভেতরেও বাসা বাঁধে। তাই তাঁর সঙ্গে ফোয়ারার মাখামাখি বেশ কয়েকটা গল্পেই তাঁর “দেমাকের শিকড় ছিঁড়ে” প্রকাশিত হয়ে পড়েছে, অপ্রকাশিত থাকতে পারেনি আর।
    নবারুণের নারীদের নিয়ে এই দোলাচল বেশ অবাক করে। উনি ওনার নারীদের নিয়ে অনেকটাই ভাবেন, মনে হয়। কখনো আবার মনে হয়, তেমন ভাবেনও না। ওঁর গল্পের বুনোটে খুব স্বাভাবিকভাবে যে নারীরা উঠে আসে তাদের উনি নেড়েচেড়ে দেখেন। মাঝেমধ্যে, খেয়ালখুশি মত, তাদের এক আশ্চর্য্য সুপারউওম্যান বানিয়ে ছাড়েন। আবার, মাঝেমধ্যে, তাদের প্রতি অসম্ভব নির্লিপ্তি দেখা যায় লেখকের। নারীর ব্যাপারে নবারুণ কি তবে দোটানায় ছিলেন? নাকি গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি কখনো নারীকে?
    এসব প্রশ্ন অনেক বড় ক্যানভাস দাবী করে। তবে এর বাইরেও নবারুণের লেখা থেকে একটা সত্য উঠে আসে তাঁর নারীচরিত্রদের সম্বন্ধে। তাদের তৈরী করা হয়েছে এক অতিমাত্রায় রোম্যান্টিসাইজড ইডিওলজিক্যাল একটা মডেলে। তাদের মধ্যে ধুসর উপত্যকা খুবই কম, পুরুষচরিত্রদের তুলনায়। নবারুণের বেচামণি বা খানদানি খানকি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী একটা দু’টো ছবি দিয়ে যেতে পারে পাঠককে, কিন্তু নবারুণের দেখা নারীর সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে একরকম ডিসকাউন্ট করেই চলে, বলা যায়।
    তবে, উল্টোদিকে এও বলা যেতেই পারে যে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি কোনটা সেটা কে ঠিক করে দেবে? বেচামণি বা ফোয়ারার যে সামাজিক অবস্থান, সেখানে তাদের ছবিটা বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ফুটে উঠেছে। তাও ঠিক। তবু... নারীসত্বার যে দিকগুলো একদিকে নারীবাদী এবং অন্যদিকে মিসোজিনিস্ট হওয়ার জন্য সবচেয়ে বিতর্কিত, সবচেয়ে রগরগে এবং সবচেয়ে এক্সট্রিম, শুধু সেগুলো নিয়েই কেন ঘেঁটে গেছেন নবারুণ? কেন তাঁর নারীরা হয় উগ্র নয় ম্যাদামারা? হয় তারা অ-সাধারণ অথবা তারা শুধুই গল্পে ঠেকনা দিতে রয়েছে। নবারুণ কি একটা সাধারণ মেয়ের গল্প লিখতে পারতেন না? সেও কি ফ্যাতাড়ু হয়ে ওঠার চান্স পেতে পারত না? এর পর মনে পড়ল বেবি খানকি’র কথা। বেশ কয়েকটা গল্পে সেই পেট্রলখেকো বারাঙ্গনার দেখা পাওয়া গেছে। “ভেরি স্পেশাল। হার ওনলি ফুড ইজ পেট্রল’। শেষ পর্য্যন্ত ‘আমেরিকান পেট্রোম্যাক্স’ গল্পে ৩৭ জন আমেরিকান সোলজার তাকে টেবিলের ওপর তুলে নাচাতে লাগল আর মুখে গুঁজে দিল একটা কিং-সাইজ মার্লবোরো সিগারেট। তারপর ‘বেবি কে’ আকা বেবি খানকি ইতিহাস, থুড়ি, মলোটভ ককটেল হয়ে গেল। যেমন হা্রবার্টের মৃতদেহ হয়ে গিয়েছিল মানববোমা। না, বেবি কে প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবী নারী নয়, হারবার্টও বিদ্রোহী পুরুষ নয়। তারা দু’জনেই নবারুণের বিদ্রোহী সত্বার এক একটি বিস্ফোরনীয় প্রতিফলন। তাদের দিয়েই বিস্ফোরণ ঘটান নবারুণ, কিন্তু তারা সে কথা নিজেরা জানে না। কিন্তু হারবার্টের ওই মানববোমা হয়ে যাওয়ার মূহুর্ত পর্য্যন্ত তার জীবনের যে ধারাবাহিকতা, তার মধ্যে দিয়ে একটা রক্ত-মাংসের মানুষ পাই আমি পাঠক হিসেবে। কিন্তু বেবি খানকির স্বতন্ত্রতাটা তাকে ম্যাজিক রিয়ালিজম’এর আওতায় ফেলে দেয়। রিয়াল হয়ে সে ওঠেনা। হয়ত, সে দরকারও নেই। তার ভুমিকা ওটুকুই। প্রশ্ন হল, তার ভুমিকা ওইটুকুই বা কেন? নবারুণের খানকিরাও স্বভাবতই অসাধারণ। নবারুণ কি একটি সাধারণ, রক্তমাংসের খানকির গল্পও লিখতে পারতেন না?

    ===============================

    গুপ্তঘাতক ও ক্রান্তদর্শী

    মালিনী ভট্টাচার্য

    বিভিন্ন শহরের রক্তস্নাত রাজপথ দিয়ে হেঁটে চলে একটি মানুষ, সমস্ত ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করে। সে এটা করতে পারে তার কারণ সে মাঝে মাঝে পরিণত হয় এক দণ্ডবায়সে। তখন সে স্বচ্ছন্দে উড়ে যায় রাশিয়া, কোরিয়া, ইরাক, ইরান এমন কি তার নিজের শহর কলকাতায়। তখন তার এক অদ্ভুত ক্ষমতা জন্মায়। তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো অর্জন করে ত্রিকাল দর্শনের ক্ষমতা। সে অনুসন্ধান করে “এত রক্ত কেন?” সে উত্তর খোঁজে অতীত থেকে বর্তমানের কিছু চরিত্রের মাধ্যমে যারা তার মানসচক্ষে ফুটে ওঠে। টাইম মেশিনে কিছুটা পিছিয়ে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সদ্যলব্ধ স্বাধীনতা পাওয়া এবং দাঙ্গার স্মৃতি বুকে আঁকড়ানো কলকাতায় সে দেখে ললিতকুমার ও তার সদ্যজাত পুত্র হারবার্টকে।

    “হারবার্ট সরকার। পিতা ললিতকুমার। মাতা শোভারাণী। হারবার্টের আবির্ভাব ১৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৯। ললিতকুমার যুদ্ধের বাজারে কামানো টাকা ফিল্মে লড়িয়ে বুরবক বনে যান। ১৯৫০-এ হারবার্টের এক বছরের জন্মদিনের পরে পরেই চলচ্চিত্রে ব্যর্থ নায়িকা মিস রুবীর সঙ্গে দার্জিলিং-কার্শিয়াং রুটে জিপ দুর্ঘটনায় আরও দুই আরোহী ও ড্রাইভার সমেত খতম।”

    ললিতকুমারের বর্ণনায় বেশ একজন ‘মনে ইঙ্গ, রূপে বঙ্গ’ ভদ্রলোককে আমরা দেখি যাঁর নবজাতক পুত্রের নাম তিনি ‘হারবার্ট’ রেখেছেন। তখন কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর সময়। অতএব বিবেকানন্দের ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থের “সাধ করে শিখেছিনু সাহেবানি কত, গোরার বুটের তলে সবই হইল হত” হওয়ার মত, বা বলা ভালো শ্বেতাঙ্গ মনিবকে খুশি করার জন্য ভেক ধরার প্রশ্ন ওঠে না। তবু নবজাতকের নাম ‘হারবার্ট’, হারাধন নয়। কেন এমন ঘটলো তা পর্যালোচনা করতে করতে দন্ডবায়সবুঝল যে স্বাধীনতা লাভকরলেও বেশীরভাগ মানুষ এখনও রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর মতাবলম্বী হয়ে বিশ্বাস করে যে White Man’s Burden অনুযায়ী, বাদামী বা কালো চামড়ার মানুষজন নিকৃষ্ট প্রকৃতির এবং তাদের যা কিছু আলোকপ্রাপ্তি হয়েছে তা ওই সাহেব প্রভুদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে এবং পরে ক্রমাগত বিরোধী আন্দোলন হয়ে থাকলেও কোথাও এই ধারণা সকলের মজ্জাগত হয়ে গেছে। তার থেকে আজও বঙ্গদেশে ‘জাম্বো’, ‘টিউলিপ’, ‘কিটো’, ‘ব্রুনো’-দের ছড়াছড়ি।

    হারবার্টের সেরকমই এক উত্তরসূরির নাম ‘টয়’। নামটি ভারী ইঙ্গিতবহ। আজকের যুগের ব্যস্ত বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের অবস্থানের কিছুটা নির্ধারকও হয়তো।। ইঁদুরদৌড়ে দৌড়তে দৌড়তে বাবা-মায়েরা কুমোরটুলিতে না হোক ফার্টিলিটি ক্লিনিকে অবশ্যই অর্ডার দিয়ে আসে এক নবজাতকের। সঙ্গে থাকে কিছু জন্মসূত্রে পাওয়া যাবে এমন কাঙ্ক্ষিত গুণের ফিরিস্তি। অবশ্য যে শিশু প্রাকৃতিক নিয়মে ভূমিষ্ঠ হয় তার ক্ষেত্রেও কিন্তু এই ফিরিস্তির ব্যত্যয় হয় না। এই গুণাবলীর অন্যতম হচ্ছে বিজ্ঞান মনষ্কতা। যথেষ্ট যুগোপযোগী চাহিদা। যতটা ‘ক্লিনিকাল’ মাইন্ড, ততটাই ‘পড়শির ঈর্ষা— অভিভাবকের গর্ব’। সেই চাহিদার ফলে একটি শিশুমন কখন পরিণত হচ্ছে নিষ্ঠুর প্রাণীহন্তায় তা চক্ষুগোচর হলেও মনোগোচর হয় না। অনেক সময় মনস্তত্ত্ববিদ হলেও নয়। তাই অ্যাক্যুয়ারিয়ামের সমস্ত মাছকে ইমারসন হিটার ডুবিয়ে মেরে ফেলার পরও টয় রেহাই পায় কারণ কিছুদিন বাদে টয়ের বাবা-মা ‘বিদেশী’ ম্যাগাজিনের মাধ্যমে জানতে পারে জনৈক ফরাসি মনস্তত্ত্ববিদ বলেছেন “যে রকম ঠাণ্ডা মাথায়, নির্লিপ্তভাবে এরা (ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কয়েকজন হত্যাপরাধী শিশু) নিজেদের অপরাধের বর্ণনা দিয়েছে তাতে মনে হয় যে এর মধ্যে কোথাও একটা বিজ্ঞানমনষ্কতার ব্যাপারও রয়েছে”। টয়ের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মধ্যে রয়েছে ভবিষ্যতের বড় বৈজ্ঞানিক হওয়ার সম্ভাবনা। তাই টয়ের বাবা-মা এবং মনোবিদ আপাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু চাঁদের উলটো পিঠের মতোই টয় যে কোনদিন ‘দ্য ভেল্ট’ গল্পের ওয়েন্ডী-পিটারের মতো পিতৃ-মাতৃ ঘাতক বা স্কুলে আক্রমণ করে শতাধিক লোকের প্রাণ নাশ করা কিশোরদের মতো ঠাণ্ডা মাথার নরহন্তা হয়ে উঠতে পারে তা কারুর মনে হয় না।

    দণ্ডবায়স উপলব্ধি করল যে নেশা, যে মাদক এখনো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষমতা ধরে রেখেছে তা অনেকটা স্লো পয়জনিং-এর মতো। দশক ভেদে কাল ভেদে এর অনেক নাম— ইকোনমিক ইম্পেরিয়ালিজম, কালচারাল ইম্পেরিয়ালিজম বা এক কথায় নিওকলোনিয়ালিজম। ঘর-বারান্দা এবং গৃহী মানুষদের মনস্তত্ত্বের আঙিনা ছেড়ে বিশ্ব দরবারে রয়েছে কিছু দলিল দস্তাবেজ। যেমন জাঁ-পল সার্ত্র তাঁর ‘কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড নিওকলোনিয়ালিজম’ গ্রন্থে ওরিয়েন্টালদের প্রতি অক্সিডেন্টালদের মনোভাব ব্যক্ত করে বলেছেন,
    “But the basic attitude has not changed: the natives are killed less frequently but they are scorned collectively, which is the civilized form of massacre; the aristocratic pleasure of counting the differences is sevoured.”
    অতএব এই ‘ডিফারেন্স’ মেটাতে এবং হেয় হওয়া এড়াতে সকলে বদ্ধ পরিকর। এই মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান কিন্তু শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের ঔপনিবেশ স্থাপনের থেকেও এক সাংঘাতিক আক্রমণ। ক্বোয়ামে ক্র্যুমা’র বক্তব্য অনুযায়ী,
    “In place of colonialism, as the main instrument of imperialism, we have today neocolonialism… [which] like colonialism, is an attempt to export the social conflict of the capitalist countries…”
    এই যে ‘সোশ্যাল কনফ্লিক্ট’ তার রপ্তানির প্রারম্ভিক সূচনা কিন্তু ঘটে কতকগুলি শৌখিন সামগ্রীর মাধ্যমে— অন্য স্বাদের খাবার, পানীয়, ভিন্ন পরিধান ইত্যাদি। যারা নিয়ে আসে তাদের নাম মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। এই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জনপ্রিয় দুটি প্রোডাক্ট দেখে বা চেখে দণ্ডবায়সের মন গুনগুন করে বলে ওঠে—
    “ঢেপসিরা পেপসিতে লাগায় চুমুক
    যত বড় পাছা তার তত বড় বুক”,
    আর
    “বোকা ছেলে পুচুপুচু কোকাকোলা খায়
    বোকাচোদা বাপ তার পয়সা যোগায়”।

    এবার দণ্ডবায়স দেখে এই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলির কাজের ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি কি দাঁড়াচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে ‘আউটসোর্সিং’ শব্দটি এখন অতীব পরিচিত। বিভিন্ন বড় বড় ব্র্যান্ড তাদের ফ্যাক্টরি, আউটলেট আর শোরুম এইসব ধুঁকতে থাকা দেশগুলোয় খুলেছে। সে বিস্ময়ে হিসেব করে নাইকি কারখানার সি.ই.ও একদিনে যত রোজগার করেন তা ওখানকার এক সাধারণ শ্রমিকের ‘৯৮৬৪৪’ বছরের আয়! এবং সেখানে বহিরাগত ডেভিড যখন শ্রমিক আইন এবং অধিকারের প্রশ্নে আন্দোলন করতে চায় তখন আশ্চর্যভাবে সে অপহৃত হয় সে দেশেরই গুণ্ডাদের দ্বারা এবং প্রাণে বাঁচে ইয়োরোপীয়, বা বলা ভালো শ্বেতাঙ্গ হওয়ার দৌলতে। মাল্টিন্যাশনালরা বোঝে তথাকথিত ‘ভালো’ জিনিসের এই ভরা বাজারে খারাপগুলো চালিয়ে দিতে পারলেই বা মন্দ কি! পেপসি খেয়ে ঢেপসি হওয়ায় যে শারীরিক স্বাস্থ্যের অবনতির লক্ষণ চোখে পরেতা তো সবে মাত্র কলির সন্ধ্যে। সিসা মেশানো নুডলস্ খেলে ওই ‘আনকালচার্ড ব্রুট’ গুলোর কি আর এমন যাবে-আসবে! বা যদি ওদের দেশে রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা যায় নিজেদের নাগরিকদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ব্যাহত না করে? বা যদি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ও তার ফলাফলের জন্য ওই দেশগুলোর, আর ওখানকার গিনিপিগগুলোর, ব্যবহার করা যায়? কেমন হয় তবে? বেশী কিছু না— সৃষ্টি হতে পারে এক ‘খেলনা নগরের’।

    দণ্ডবায়স ভবিষ্যতের গর্ভে এমন একটা শহরের দেখা পায় যেখানে আছে অতীতের রক্তলোলুপ অধুনা অচল পুতুলের কারখানা, আছে বিষাক্ত একটি নদী, আছে রোগক্লিষ্ট, পুতুলের মতো কিছু জীবন্মৃত মানুষ, আছে শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা রাখা হাতকাটার দল, আছে ভয়ে সাদামুখ, আছে বুদ্ধিবৃত্তি স্থগিত হয়ে যাওয়া বামন, আছে পেপসির বড় ভাই কাফিড্রিলের নেশা, এক্সপায়ারি ডেট পার হওয়া ক্যানড্ ফুড— এবং— তবুও আছে প্রেম, আছে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা, বন্ধ কারখানা খোলার আশা রাখা ‘৮’ ও ‘৯’। এছাড়াও খেলনা নগরের প্রতীক, বা বলা ভালো অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে আছেন একটি আধপোড়া বার্বি পুতুল যিনি এই সভ্যতার শ্মশানে উচ্চতম স্থানটিতে বিরাজ করেন। বারবারা বা আদুরে সম্বোধনে ‘বার্বি’ এক বালিকার আবদারে প্রথম তৈরি করেছিলেন তার মার্কিন খেলনা কোম্পানিতে কাজ করা মা। মেয়ের আশ মিটছিল না ছোট পুতুল খেলে— তার প্রয়োজন ছিল এমন পুতুলের যে বেশ প্রাপ্তবয়স্কসুলভ কাজ করবে। যেমন ধরা যাক নিজের রূপ-যৌবনের কুহক দিয়ে অন্যের মাধ্যমে স্বার্থসিদ্ধি। আশ্চর্যভাবে সুদূর পশ্চিমের সেই বালিকার ইচ্ছে বহুল জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বর্তমানে খেলনা নগরের ধ্বংসস্তূপে তার দেখা মেলার কারণও কিন্তু সেই কারখানার মালিকের মেয়ের খুব প্রিয় পাত্রী হওয়া। এই খেলনা নগরে যা কিছুই বলি হোক— জন্তু বা মানুষ— সবই তার সামনে লম্বিত হয়।

    দৈনন্দিন গতানুগতিকতা ভেঙে একদিন খেলনা নগরে আবির্ভূত হয় একটি শকুন। বেশ্যারা নিদান দেয় যে তা অশুভ শক্তির ও মৃত্যুর প্রতীক। শকুন ছাড়াও পুতুল ঘোরানোর মাধ্যমে ফুটে ওঠে তাদের কুসংস্কার। দণ্ডবায়স শোনে খেলনা নগর থেকে অনেক দূরে বিনু নিজের হারবার্ট কাকাকে কুসংস্কার সম্বন্ধে বোঝাচ্ছে—
    “যতদিন হাতে গোনা কয়েকটি লোক লাখ লাখ মানুষকে বোকা বানিয়ে খাটিয়ে মারবে, তাদের ঠকাবে, ততদিন ভূত, তারপর তোমার গিয়ে ঠাকুর-দেবতা-ধর্ম— এই সবই চলবে।”
    হাতকাটা ও তার দলবল শকুনটাকে নিকেশ করে ভাবে মৃত্যুকে এড়ানো গেছে। কিন্তু যে মৃত্যু মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তা তাদের চোখ এড়িয়ে মৃত শকুনের পেটের ঝুলন্ত ধাতব তার ও ব্যাটারি হয়ে উপহাস করে। আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে যখন সকলে উল্লসিত তখন বিপদ কখন যে উইন্ডচিটারের রূপ ধরে এসে দাঁড়ায় তা সকলের নজর এড়িয়ে যায়।

    অদ্ভুত জীব উইন্ডচিটার। সে নিজে পরিশেষে নিজের সংজ্ঞা দেয় শুধুমাত্র ‘চিটার’ হিসাবে। সে একদিকে স্বপ্ন দেখায় বিপ্লবের, একদিকে শাসন কায়েম রাখার বন্দোবস্ত করে। সে খেলনা নগরকে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলে, আবার বামন সমেত সেখান থেকে পালানোর ব্যবস্থাও করে। যদি ডান হাতে নির্দেশ করে আনে জীবনদায়ী পরিশ্রুত জল, তবে বাঁ হাতে তাতে অবলীলায় বিষ মিশিয়ে সূচনা করে অ্যাপোক্যালিপ্টিক যুদ্ধের। উইন্ডচিটারের আগমন ঘটে হলিউডি সিনেমার আগত অ্যাপোক্যালিপ্স থেকে একা হাতে সমগ্র মানবজাতির রক্ষাকারী হিরোর মতো, অথবা আমেরিকান ডি.সি কমিকসের সুপারহিরোর মতো, কিন্তু এখানে আদতে তার ভূমিকা বিপরীত। সে স্বয়ং অ্যাপোক্যালিপ্সের অনুঘটক। এই ‘রোল রিভার্সাল’ অন্য রূপে, অন্য মাত্রায়, এক নিদারুণ ব্যঙ্গের মাধ্যমে দণ্ডবায়সের আপনজন ফ্যাতাড়ুদের মধ্যেও দৃষ্ট হয়। ফ্যাতাড়ুরা ডি.সি কমিকসের সুপারহিরো ব্যাটম্যান বা সুপারম্যানের মতোই ‘ফ্যান্টাসটিক’ ক্ষমতার অধিকারী। তারা উড়তে পারে। কিন্তু তারা আদতে অ্যান্টি-সুপারহিরো— তারা এই সিউডো-সুপারহিরোইজমকে শেষ পর্যন্ত ব্যঙ্গ করে। তারা কোন ইউটোপিয়ান পৃথিবীতে আমাদের নিয়ে যাওয়ার বদলে এক ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীকে তুলে ধরে। যে সিস্টেমের চরম অবজ্ঞার ফলেই তাদের জন্ম হয়েছে, এবং যে সিস্টেম ক্রমাগত আমাদেরও পুতুল বানিয়ে চলেছে— সেই সিস্টেমকে আক্রমণের মাধ্যমে তারা তার ঘাটতি, অক্ষমতা, অসহায়তাকে তুলে ধরে। এই সিস্টেমও কিন্তু অপরাজেয় নয়! ফ্যাতাড়ুরা হয়ে ওঠে সিস্টেমের বিরুদ্ধে সর্বদা অবহেলিত, লাথ খাওয়া মানুষের প্রতিভূ। কিন্তু উইন্ডচিটার তা নয়। সে সিস্টেমেরই প্রতিভূ। এই ‘উইন্ডচিটার’ আসলে সেই অশুভ এবং অসীম শক্তিধর দেশগুলির প্রতীক যারা চাইলে প্রবৃত্ত হতে পারত তৃতীয় বিশ্বের কল্যাণেকিন্তু আদতে যারা কেবলমাত্র সেগুলিকে নিজেদের অর্থনীতির সাহায্যকারী খোলাবাজার হিসেবে দেখে এবং প্রয়োজন ফুরোলে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার নামে চূর্ণ করে দেয়। উইন্ডচিটার খেলনা নগরের সমস্ত প্রতিকূলতার হাওয়ার বিরুদ্ধে বর্ম হতে পারত কিন্তু সে ‘চিটার’ তাই নির্মম ভাবে নরমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলো সকলের। প্রেমিকযুগল কুমার ও জিশাকে দেশান্তরী করার কথা রেখেছিলো জিপবন্দী ব্যাগে তাদের মৃতদেহ গবেষণাগারে স্থানান্তরিত করে। ব্যবচ্ছেদে হয়তো নর-নারীদেহে ফিশনের প্রভাব ছাড়াও বিশ্লেষণ করা হবে কিভাবে এত অভাব-অনটনে প্রেম বেঁচে থাকে!

    প্রবল ক্ষমতাশালী হওয়ার পরেও কিন্তু একটা জিনিস অস্বীকার করতে পারেনি উইন্ডচিটার। কম্যুনিস্টদের হত্যা করা অত সহজ নয়। তাই ‘৮’ আর ‘৯’-এর হয়েছিল ‘স্পেশাল বন্দোবস্ত’। হাতকাটাদের দলের প্রাণঘাতী প্রহারের পর তাদের উলটো করা মৃতদেহ ঝোলানো হয়েছিল বার্বিদেবীর সম্মুখে। বলা যায়না যদি নিউক্লিয়ার ফিশনও ওদের না মারতে পারে! এবং তার আশঙ্কা অমূলক না। তাই ‘পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট’ মারা যাবার রাতেই বাল্টিক নৌ বহরের নাবিকরা বিদ্রোহ করবে, ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্টরা অভ্যুত্থান ঘটাবে, অস্ট্রেলিয়ার বন্দরে ছড়িয়ে পড়বে ধর্মঘট, বলিভিয়ায় টিন শ্রমিকরা বিদ্রোহ করবে, আর “লেনিন ও চে-র ছবি নিয়ে লাতিন আমেরিকার প্রত্যেকটা রাজধানী অচল করে দেবে ছাত্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ। শ্রমিক ধর্মঘটে অচল হয়ে যাবে ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস, স্পেন... খবর আসবে আফ্রিকা থেকে, আরব দুনিয়া...”। ‘৯/১১’ গল্পে অনেক দূরে রাশিয়ায় দুই কম্যুনিস্টকে দেখা যাবে নতুন একটি খেলা সম্বন্ধে আলোচনা করতে যাতে বিভিন্ন জিনিসকে গুঁড়িয়ে ধূলিস্যাৎ করলেই বেশি করে পয়েন্ট পাওয়া যায়। এমন খেলা খেলছে মূলত আরব সহ বিভিন্ন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মানুষ। এক সময়ে এই খেলা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সীমানা পেরিয়ে হয়ে ওঠে রিয়েল। বিশ্বের সর্ব শক্তিমান দেশের স্পর্ধিত মাথা খেলার ছলেই পরিণত হয় গ্রাউন্ড জিরোতে। খেলা একই, অথচ টেবিল ঘুরে গেছে— আর্থার কোনান ডয়েলের অমোঘ বাক্যের মতো— “Violence, in truth, does recoil upon the violent”। তখন দন্ডবায়সের কানে ভেসে আসে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের ডেভেলপিং একটি দেশের সর্বহারা হারবার্টের সদর্প ঘোষণা—
    “বাওয়াল কেউ থামাতে পারবে না বাবা। সায়েবরা তো রাতদিন ধরে মারল। পারল? সায়েবরা হেদিয়ে গেল তো এরা এল— আরে বাবা ইংরিজি ঝাড়লে যদি বাওয়াল ঠেকানো যেত তাহলে আর দেখতে হত না...”

    তবে কম্যুনিস্টদের মত উইন্ডচিটাররাও কিন্তু রক্তবীজের ঝাড়। ক্রমাগত আক্রমণ চলতে থাকে আফগানিস্তানের মত রাষ্ট্রে— জঙ্গিদের সন্ধানে বলি হয় সাধারণ মানুষ। দণ্ডবায়স তার লড়াই থামায় না। না, সে ঘাতক নয়। তার কাজ শুধুমাত্র উইন্ডচিটারদের রক্ষাকর্তার ভণ্ড মুখোশ টেনে খুলে ফেলার— স্বরূপ প্রকাশ করার গুপ্তঘাতকদের। সেই লড়াই সে চালিয়ে যায়, আজীবন— আমৃত্যু। তার মানুষ অবতারের নামেই যে তার কাজ লুকনো আছে। সে জানে তাকে সমস্ত অজ্ঞানতার অন্ধকার ও গুপ্তঘাতকদের ষড়যন্ত্রকে শাণিত আলোকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে— “সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে হবে। নকড়া ছকড়া করে ফাঁৎরা ফাঁই করে বিশ্ব সংসারে একটা তাণ্ডব লাগিয়ে দিতে হবে”। দণ্ডবায়সের অপর নাম যে ‘নবারুণ’!
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১৭:২৮644882
  • http://www.aihik.in/aihik/Content/9/

    নবারুণ ভট্টাচার্যের সিনে-রচনা

    পরিচয় পাত্র

    এই মিতায়তন রচনাটি নবারুণ ভট্টাচার্যের সাহিত্য থেকে নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রতি খুব একটা উৎসাহ দেখাতে চায় না। অবশ্য এ কথাও সত্য যে তাঁর কাহিনী অবলম্বনে ছবি তৈরি হয়েছে সাকুল্যে গোটাতিনেক, সবকটির পরিচালকই সুমন মুখোপাধ্যায় (এ ছাড়াও ছবি হয়ত থাকতে পারে, আমার জানা নেই)। এই অ্যাডাপটেশন গুলি নিয়ে নানাজন নানাজায়গায় লিখেছেন অল্পবিস্তর। এখানে এইসব ছবি প্রসঙ্গ আসবেও ঘটনাচক্রে, কিন্তু এই প্রবন্ধের মূল আগ্রহ নিবদ্ধ হয়েছে একটি অন্য এবং অপেক্ষাকৃত অচেনা প্রদেশে। এ রচনাটি কথা বলতে চাইছে নবারুণের ছবি ভাবনা নিয়ে, অন্তত যেটুকু বোঝা যায় তাঁর ফিকশন এবং নন-ফিকশন থেকে। সিনেমা কিভাবে নবারুণের কাছে ধরা দিয়েছে, কোন অবয়বে এসেছে তাঁর গল্প-উপন্যাসে এবং সাক্ষাৎকারে, তার একটা সংক্ষিপ্ত হিসেবনিকেশ করতে চাইছে। তা থেকে তাঁর রচনাবলম্বনে নির্মিত ছবিগুলির নানাদিকও উঠে আসতে পারে।

    বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিশিষ্ট কুশীলবদের মধ্যে কাউকে কাউকে বেশ ভালরকমের সিনেফাইল বলা যেতে পারে। সুবিমল মিশ্রের রচনায় তাঁর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গোদার বা এঞ্জেলোপুলসের ছবি দেখার, নানা কাণ্ড করে হলে প্রবেশাধিকার পাওয়ার কথা আছে। আরও বিস্তারিত লিখেছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, তাঁর আত্মজীবনীপ্রতিম রচনাগুলিতে। ১৯৯০ আর ১৯৯৪ এর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়া (ইফি) দেখার বিবরণ দিয়েছেন সন্দীপন, বিশেষ করে কিছু পছন্দের ছবির, যে তালিকায় পড়ে কুরোসাওয়ার শেষ ছবি ‘মাদাদায়ো’, কিসলওস্কির ‘আ শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট কিলিং’ বা থিও এঞ্জেলোপুলসের ‘ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’। নবারুণের ছবি ভাবনা এঁদের থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র, প্রধানত রাজনৈতিক ভিন্নতার কারণে। মনে রাখা ভাল সন্দীপন সিপিআইএম ঘনিষ্ঠ ছিলেন, নবারুণের মত রাজনৈতিক ডিসিডেণ্ট নন। নবারুণের সিনেমা উৎসাহ, তাঁর সাহিত্যোৎসাহের মতই, রাজনীতি সম্পর্কিত।

    বিভিন্ন সাক্ষাৎকার এবং অন্যান্য রচনা থেকে দেখা যায় নবারুণ বারবার যেসব ছবির কথা বলছেন তার মধ্যে পড়ে তাঁরই আত্মীয় ঋত্বিক ঘটকের ছবি, সোভিয়েত সিনেমা, জিলো পনটিকার্ভোর ‘ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ ইত্যাদি। সোভিয়েত সিনেমার ক্ষেত্রে যেমন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর পছন্দের তালিকায় আইজেনস্টাইন রয়েছেন প্রথম সারিতে। রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিষয়ে নানা তথ্যচিত্র বা ‘ফল অব বার্লিন’ এর মত ওয়র প্রোপাগ্যাণ্ডা। আমাদের দেশের লিটারারী ও কালচারাল র্যা্ডিকালিজমের (আমাদের কালচারাল র্যা ডিকালিজম বিষয়ে প্রিয়ম্বদা গোপালের বইটি পড়ে দেখা যেতে পারে) একদা বহতা ধারার অন্যতম এবং সম্ভবত সর্বশেষ যথার্থ উত্তরসূরি নবারুণ, তাঁর ছবি উৎসাহেও সেটি বেশ স্পষ্ট। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসি জার্মানির সোভিয়েত আক্রমণ ভারতীয় গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবী সংঘকে উদ্বিগ্ন করেছিল। বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ান ছবিগুলি তাই কমিউনিস্ট পার্টির কাছে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হয়ে ওঠে পরবর্তীকালে। আইজেনস্টাইনের যে ছবিটির কথা ‘হারবার্ট’ উপন্যাসে এনেছেন নবারুণ সেটি ‘আলেকজান্দার নেভস্কি’। মনে রাখা দরকার আইজেনস্টাইন এই ছবিটি করেছিলেন ত্রিশের দশকের শেষে, যখন নাৎসি জার্মানি এবং সোশ্যালিস্ট সোভিয়েতের মধ্যে সম্পর্কের পারদ চড়ছে। ত্রয়োদশ শতকের রুশ প্রিন্স আলেকাজন্দার নেভস্কি বিখ্যাত ‘ব্যাটল অন আইসে’ পরাস্ত করেছিলেন জার্মান এবং এস্তোনিয়ান আক্রমণকারীদের, রক্ষা করেছিলেন রাশিয়াকে, মৃত্যুর পরে তাঁকে ক্যাননাইজ করেছিল রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ। ইতিহাসের রূপকে জার্মান ইনভেডারদের উপরে সেই রুশ জাতীয়তাবাদী বিজয়কেই স্মরণ করিয়েছেন আইজেনস্টাইন, ছবি নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যেই যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। ‘আলেকাজান্দার নেভস্কি’ এবং ‘ফল অব বার্লিন’ দুই ছবিই স্মরণীয় আর একটি কারণে, রুশ ধ্রুপদী সংগীতের দুই নক্ষত্র, যথাক্রমে প্রোকোফিয়েভ এবং শস্তাকোভিচ, এই দুই ছবির সুরসৃজন করেন। বস্তুত সোভিয়েত সংস্কৃতির, বিপ্লব পরবর্তী সিনেমার, গুরুত্বপূর্ণ দলিল এই ছবিগুলি। ঋত্বিক ঘটক বিষয়ক অন্য এক সাক্ষাৎকারে নবারুণ গ্রিগোরি কোজিন্তসেভের ‘হ্যামলেট’ এর নামভূমিকায় ইননোকেন্তি স্মোকতুনোভস্কির অভিনয়ের কথাও বলেন। এইভাবে প্রাক-তারকোভস্কি সোভিয়েত সিনেমার নানা দিক নিয়েই নবারুণ বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করেছেন।

    ‘হারবার্ট’ উপন্যাসে সিনেমা আলোচনার কিছু পর্ব পর্বান্তর মনে করা যেতে পারে। ললিতকুমারের ফিল্ম নির্মাণ ব্যবসায় প্রসঙ্গে এসেছে তাঁর সংগৃহীত অ্যালবামের কথা, যেটিতে বোঝাই ক্লাসিকাল হলিউডের চিত্রতারকাদের ছবি। সেই অ্যালবাম দেখেই বড় হচ্ছে কিশোর হারবার্ট, পরে বামপন্থী আন্দোলনের শরিক দাদার সৌজন্যে তার দেখা হয় সোভিয়েত সিনেমা। সিনেমা বিষয়ক একটি সাক্ষাৎকারে নবারুণ ক্লাসিকাল হলিউড এবং তার সাদা কালো সিনেমাটোগ্রাফি প্রসঙ্গ আনবেন। ঋত্বিক বিষয়ে বলতে গিয়ে বিমল রায়ের কাছে সাদা কালো সিনেমাটোগ্রাফি শেখার কথা উঠবে। সিনেমা ঋত্বিকের মতোই তাঁর কাছেও ডিসকার্সিভ, সন্দর্ভপ্রতিম। সাক্ষাৎকারে বলছেন “ফিল্ম একটা দাস ক্যাপিটাল হতে পারে”। মনে রাখা ভাল দাস ক্যাপিটালকে চলচ্চিত্রায়িত করতে চেয়েওছিলেন সেই আইজেনস্টাইন। সোভিয়েত সিনেমার বিপ্লব পরবর্তী পর্যায়ের দিকে এই ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি। অন্যদিকে ঋত্বিকের ছবির শ্যুটিং সংক্রান্ত নানা স্মৃতি ফিরে আসে নবারুণের কাছে, কোমল গান্ধারের সেই বিখ্যাত খণ্ডিত রেললাইনের দৃশ্য বা সুবর্ণরেখার রেসকোর্স, সীতার পাতাল প্রবেশের প্রথম দিনেই ঈশ্বরের ভগিনীগমন, এসব বারবার তাঁর কথায় ফিরে আসে। যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো নিয়ে ঋত্বিকের সঙ্গে মতান্তর, পরবর্তীকালে মত পরিবর্তনের কথাও আসে। শেষোক্ত ছবিটির ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক নবারুণের কাছে স্পষ্ট, তিনি হরেকৃষ্ণ কোঙারের সঙ্গে নকশাল নেতাকর্মীদের আলোচনার প্রসঙ্গ আনেন। সুবর্ণরেখার শিশু বিনু হারবার্টে ফিরে আসে নকশাল যুবক হয়ে, নবারুণের নিজের বয়ানেই সেই সচেতন প্রয়াসের সাক্ষ্য মেলে। ‘ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ নিয়ে তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের প্রেক্ষাপটে এক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধই লিখেছিলেন নবারুণ। অর্থাৎ নবারুণের ছবি-ভাবনা থেকে সেসময়ের ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন, যা বাম কালচারাল র্যা ডিকালিজমের একটা স্বাভাবিক ফসল, সে সম্পর্কে একটা নির্দিষ্ট ছবি মেলে। ফিল্ম সোসাইটির ইতিহাস চিন্তা যারা করছেন, যেমন ইতিহাসবিদ রচনা মজুমদার, তাঁদের কাছে এ জাতীয় লিটারারী সোর্স গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

    হালফিলের ছবি সম্পর্কেও নবারুণ যে খবর রাখতেন তার প্রমাণ মেলে ঋত্বিক আলোচনায় তিনি যখন জাফর পানাহির উপরে ফিল্মমেকিংগত নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। নবারুণের রচনা সম্পর্কে, অন্য অনেক মার্ক্সবাদী শিল্পীর মতই, জেন্ডার সম্পর্কে কিছুটা অসংবেদনশীলতার অভিযোগ আছে, সমকামিতা বিষয়ে তাঁর বক্তব্যে এই অসচেতনতার কিছুটা প্রতিফলন ঘটে। তাই নবারুণ আত্মপক্ষ সমর্থনে সমকামিতা বিষয়ক একটি ক্লাসিক ছবির প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন, ভিসকন্তির ‘ডেথ ইন ভেনিস’।

    নবারুণের রচনায় সিনেমা প্রসঙ্গ কিন্তু হারবার্টে থেমে থাকেনা। চলতেই থাকে। এবং এ বিষয়ে যে রচনাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সেটি, বলা বাহুল্য, ‘ভোগী’। কিন্তু নবারুণের সিনেমা ভাবনা বা বৃহত্তর অর্থে সংস্কৃতিভাবনাকে ছুঁতে না পারলে তাকে পর্দায় আনা যায় না। আমি ‘কাঙাল মালসাট’ দেখিনি, ‘মহানগর @কলকাতা’ নবারুণের কয়েকটি ছোটগল্প অবলম্বনে এবং সেগুলি খুব প্রতিনিধিত্বমূলক নয় বলেই মনে হয়েছে। ‘লুব্ধক’ ছবি হবে বলে শোনা যায়, কবে হবে জানি না। কিন্তু হারবার্ট, যা প্রথম দর্শনে আমাদের অনেককেই মুগ্ধ করেছিল, তার দিকে এখন তাকালে নানা ফাঁক দেখতে পাই। অনেকসময়েই তাকে উপন্যাসের প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ মনে হয়। ছবির যে দৃশ্যটি আমার মনে রীতিমত দাগ কেটে গিয়েছিল সেটির আবেদন অবশ্য অনেকখানি থেকেই গেছে, সেই প্রেসিডেন্সীর সিঁড়ির সঙ্গে ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ এর ওডেসা স্টেপস সিকোয়েন্সের জাক্সটাপোজিশন। সুমন সচেতনভাবেই পোটেমকিন এনেছিলেন, আলেকজান্দার নেভস্কির বদলে, কেননা আইজেনস্টাইনের যুদ্ধজাহাজ অনেক বেশি আইকনিক, ওডেসা সিঁড়ি আরও বেশি করে প্রতিনিধিত্বমূলক এবং সার্বজনীন, নেভস্কির স্লাভ জাতীয়তাবাদ সেখানে অনুপস্থিত।

    কিন্তু এরপরেও নবারুণের রাজনীতি আর সিনেমার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে কথা বাকি থেকে যায়। নবারুণ স্তালিন সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর ভূমিকায়। সোভিয়েতে নাৎসি আগ্রাসনের সেই সময় ভারতীয় বামপন্থী শিল্পীদের প্রভাবিত করেছে, করছে এবং পরেও করবে, ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ উপন্যাসে তার অজস্র ছাপ থেকে গেছে। তাঁর রচনায় আইজেনস্টাইনের যে ছবি প্রসঙ্গ আসে না সেটি হল ‘ইভান দ্য টেরিবল’। এ ছবি যে স্তালিনকেই লক্ষ্য করে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই, তৃতীয় পর্ব তাই নির্মাণ করাও সম্ভব হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে নবারুণের সিনেমা চিন্তা পার্টিজান একটা জায়গাতেই আটকে থাকে কিনা। এই প্রশ্নের উত্তর এবার একটু খোঁজা যেতে পারে।

    ঋত্বিক আলোচনায় নবারুণ যে কজন ফিল্মমেকারকে বন্ধনীভুক্ত করেন তাদের তালিকা নিম্নরূপঃ তারকোভস্কি, বার্গম্যান, সকুরভ। এই তালিকাই কার্যত নবারুণের জাত চিনিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয় সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমে শিল্পের সার্থকতা তিনি খোঁজেন না, এবং সেই খোঁজাকে ‘ভালগার মার্ক্সিজম’ নামে আখ্যায়িত করতেও তিনি ক্লান্তিহীন। তালিকার নামগুলি ভাবা যাক। প্রত্যেকেই কপিবুক বামপন্থীদের কাছে অচ্ছুৎপ্রায়। বার্গম্যানের অস্তিত্ববাদী জিজ্ঞাসা, প্রাক-খ্রিষ্টীয় এবং খ্রিষ্টীয় ইমেজ ভাবনা, আংশিক ভাববাদী দর্শন অনেককেই অখুশি করেছে, ঋত্বিককেও করেছে। তারকোভস্কির সঙ্গে সোভিয়েত রাষ্ট্রের দীর্ঘ দ্বৈরথ সর্বজনবিদিত। আর আলেক্সান্দর সকুরভ? তাঁর এস্থেটিক আর ন্যারেটিভ কোনকিছুই তো সরকারি বামপন্থীদের পছন্দ নয়, পছন্দ নয় তাঁর লং টেক নির্ভর কুখ্যাত মন্থরতা, তাঁর স্লাভ জাতীয়তাবাদের নিশান উড়িয়ে পশ্চিম ইউরোপের উন্নাসিক পর্যটককে নাজেহাল করা। আর সকুরভ ততোধিক বিচ্যুত হন, হতেই থাকেন তাঁর জন্য নির্ধারিত মাত্রা থেকে। একনায়কসুলভ ক্ষমতার অসহ্য ধ্বংসাত্মক প্রবণতা নিয়ে তাঁর টেট্রালজি হিটলার, লেনিন, হিরোহিতো সফর সেরে শেষে ইতিহাস ছেড়ে আশ্রয় নেয় মিথে, শেষ ছবির নায়ক ফাউস্ট। প্রচলিত বামপন্থীর কাছে এই ইতিহাসপাঠ সমস্যাজনক। লেনিন বিষয়ক ছবিটি কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আন্দোলনের চাপে বন্ধও করতে হয়েছিল। নবারুণ প্রমাণ করেন পার্টিজান সিনেমা দর্শন তাঁর নয়, তাঁর ছবি ভাবনা অনেক বেশি ইনক্লুসিভ। তাই ‘ভোগী’র মত একটি মক-ফিল্ম তিনি নির্মাণ করতে পারেন, মক-এপিকের মতই। মক-এপিক অষ্টাদশ শতকের ইংল্যান্ডে যারা লিখতেন, ড্রাইডেন ও পোপ, তারা নিজেদের সমসময়কে এপিকের অনুপযুক্ত বলেই গণ্য করেছেন, তাই মক-এপিক। নবারুণের কাছে তাঁর রিয়্যালিটিতে মহৎ সিনেমা অনুপযুক্ত, ফেস্টিভ্যাল-টুয়ারিং বাংলা সিনেমার বাগাড়ম্বর তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, নয়ত ভোগীর শেষাংশ অন্যরূপ হত। তাঁর রচনার সিনেম্যাটিক পসিবিলিটি কতখানি অসীম হতে পারে তা শুধু বুঝিয়ে দেয় ভোগীর উপসংহার বাদে বাকি টেক্সটটুকু।

    ঋত্বিক ঘটক তাঁর সময়ে দাঁড়িয়ে সিগফ্রিড ক্রাকাউয়েরকে পড়তে গিয়ে খুব সুবিচার করতে পারেন নি। ক্রাকাউয়েরের বাস্তবতার অনুপুঙ্খ চিত্রায়ণের দাবী আর আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার অবসানে হতাশা তাঁর অত্যন্ত অসংগত মনে হয়েছিল। তিনি তাঁর প্রিয় ফেলিনির ছবির উদাহরণ দিয়ে, সোভিয়েত রাষ্ট্রের নানা সাফল্যের দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আজ ক্রাকাউয়ের আর ঋত্বিক দুজনকেই নতুন করে পড়া হচ্ছে। মিরিয়াম হ্যানসেনের ব্যাখ্যায় বোঝা যাচ্ছে ক্রাকাউয়ের আসলে মডার্নিটির ঐতিহাসিক-দার্শনিক ব্যাখ্যাকেই রূপকের মধ্যে দিয়ে ধরতে চান, ধরতে চান আইডিওলজির নানা অস্বচ্ছ অঞ্চলকে। রিয়ালিজম তাঁর কাছে একটি স্টাইলগত, এস্থেটিক প্র্যাকটিস, সিনেমা মাধ্যমের কোন সারসত্য নয়। দুজনেই আধুনিক মানুষের ক্যাপিটালিস্ট-ইন্ডাস�� �ট্রিয়াল মডার্নিটির বিপর্যয় নিয়ে উদ্বেলিত।

    এই উদ্বেগ থেকেই ঋত্বিক ইন্ডিজিনাস সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের কথা বলেন, যদিও সিনেমা ভাবনায় তিনি ট্রান্সন্যাশনাল। নবারুণের সাহিত্যও সেই দিকেই পৌঁছয়, ভালগার মার্ক্সিজম যাকে ব্যাখ্যা করতে পারবে না। ভোগীর আদত গল্পটা পার্টিজান সিনেমা রুচিকে প্রশ্ন করবে, প্রশ্ন করবে ফেস্টিভ্যাল-বিহারী জনবিচ্ছিন্ন ফিল্মমেকারকেও। তাই তারকোভস্কির ‘স্যাক্রিফাইস’ প্রসঙ্গ আসে ভোগীতে, তাই নবারুণের কণ্ঠে আলেক্সান্দর সকুরভ, যাঁকে জারিস্ট বলে ভাবতে ভালবাসেন অনেক বাম। ‘রাশিয়ান আর্ক’ উনিশ শতকীয় পশ্চিম ইউরোপের পর্যটকের গেজের সামনে রাশিয়াকে ডিফেণ্ড করে, পুশকিনের কটু সমালোচনায় রত ফরাসী অভিজাতটিকে তর্কে নামায়। অভিজাত হওয়া সত্ত্বেও ডিসেম্বর বিদ্রোহে যোগদানকারী যে কবিকে লেনিন রুশ জাতীয় সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসিয়ে গেছেন। ফেস্টিভ্যাল ভ্রাম্যমাণ বাংলা ‘অন্যধারার’ সিনেমার কাছে ভোগী তাই না মেলা অংক, দুর্বোধ্য ডাক, “বদর গাজী বাপ/ কেউটে কুমীর ভল্লুক/ যেন করতে পারি সাফ...”

    ======================================

    নবারুণের লেখায় ইতিহাসবোধ

    অভিজিৎ বসাক

    “I mourn, therefore I am.”
    - Derrida

    ইতিহাসের স্বরূপ, তার সত্যতা বিষয়ে প্রাক-প্রাধান্য, তার আদত ‘গুণ’-গত ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবে ভারতে নয়। ইউরোপ ও আমেরিকায়। ভারত ইতিহাস বা দর্শন চর্চা ভুলেছে বহুদিন। সেই সত্তরের দশকেই উত্তাল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সময়। ভুখা বাঙালীর স্বতঃস্ফূর্ত আলিঙ্গন অনিশ্চয়তা, রক্তপাত, ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী চিন্তাধারার। এরই মধ্যে উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য, কিংবা মহাশ্বেতা দেবী’র লেখায় ধরা পরে সেই আগুনে সময়ের কাহিনী। এঁরা প্রত্যেকেই একটি বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আজীবন লিখেছেন। কোন প্রাতিষ্ঠানিক চোখ রাঙানিকে পাত্তা না দিয়ে। বিজন ভট্টাচার্য ও মহাশ্বেতার ছেলে নবারুণ যে এই ট্র্যাডিশন বজায় রাখবেন তাতে কোন আশ্চর্য হবার কিছু নেই। জাদুকর আনন্দদের মজার তল্পিবাহক বানিয়ে তাঁর লেখায় ইতিহাস আসে কখনও জাদু বাস্তবতার কাঠামোয় কখনও বা কঠিন বাস্তবতার রক্ত মেখে। গতানুগতিক ইতিহাস ও সাহিত্য চর্চার যে জঙ্গম আমাদের আরও চাইতে বাধা দেয়, বা মুড়ি মুড়কি মূলক নরম নরম লেখায় ভুলিয়ে রাখে, নবারুণ সেই গঠনতন্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে বলতে পারেন যে তাঁর লেখায় বিস্ফোরণের আলকেমি আছে। পাঠকরা স্বাগত, কিন্তু তাঁদের আনন্দ ধারায় আঘাত পড়লে দায়িত্ব লেখকের নয়। নবারুণ সেই বিরল লেখক গোষ্ঠীর মধ্যে পড়েন যাঁরা পাঠক তৈরী করেন, যাঁদের জন্য পাঠক নিজেদের প্রস্তুত করেন। নবারুণের ইতিহাস বোধে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিক আদানপ্রদান বিষয়ক এই লেখায় মূলত তাঁর গদ্য সংকলনগুলোই আলোচ্য। বিলাপ্য সময়ের আখ্যানে আমোদ-রিরংসার প্রতি-পাঠ তৈরীর প্রচেষ্টা— এই ভাবে দেখা যেতে পারে নবারুণের ইতিহাস সচেতনতা/চেতনাকে। নিষ্ঠুর বাস্তবিকতাকে এড়িয়ে না গিয়ে মোকাবিলা করেছেন তিনি এপথেই। ব্যর্থ ক্ষুদ্র অবমূল্যায়ন-দীর্ণ সমাজে বিপ্লবের কার্নিভাল। ওলট পালট হয়ে যায় সব সমীকরণ। আলোচনার স্বার্থে বিলাপী নবারুণ বেশি আসেন, কিন্তু সেই আলোচনার পরেই দেখবো আমোদগেড়ে নবারুণের প্রতিশোধ। পুরন্দর ভাটের ডিসেন্টিং চর্ভট্টি যেভাবে মধ্যবিত্ত লেখাভ্যাসে আঘাত করে, তার পাঠাভ্যাসকে ছারখার করে দেয়, তেমনি সে জড়বৎ-তুষ্ট মানসিকতাকে বালখিল্য’র (pun অনুপান নয় এখানে) স্তরে নামিয়ে দেয়। যে গদ্যসাহিত্যগুলি আলোচ্য সেখানে নবারুণ যে রূপরেখ নির্ণয় করেন তা তাঁর সমস্ত লেখাতেই সমান ভাবে ফলিত তা বলাই বাহুল্য। কমিটেড লেখক মাত্রেই এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। নবারুণের কমিটমেন্ট নিয়ে আমার কিছু বলার ধৃষ্টতা নেই।
    শুরু করা যেতে পারে ‘অ্যাকোয়ারিয়াম’ প্রবন্ধিকাগুচ্ছ দিয়ে। লুব্ধক-কে নবারুণের প্রকাশক বলেছেন কুকুর নিয়ে লেখা প্রথম বাংলা উপন্যাস। নবারুণের ভাষায় তাঁর বহুদিনের ইচ্ছের ফসল। লুব্ধক ফ্যাতাড়ুদের জান্তব রূপ মাত্র। রাশিয়া নিয়ে নবারুণের দুর্বলতা সর্বজন বিদিত। কাঙাল মালসাট শুরুই হয় বুলগাকভ দিয়ে। লুব্ধক আসলে লাইকা’র বাংলা সংস্করণ। নেড়ি কুকুর, যারা ব্রাত্য, যারা আদুরে নয়, তারাই যে ‘অসাধ্য সাধন’ করতে পারে নবারুণ তা বিশ্বাস করতেন। লাইকা ও লুব্ধক দুজনেই নেড়ি কুকুর। এই উপমার ভেতরের রাজনীতি পরিষ্কার যখন লেখক স্পষ্টই বলেন: “শুধু কুকুরদের আওতায় ভাবনাটাকে গচ্ছিত না রেখে আরও ছড়িয়ে দিতে পারি আমরা।’’ তবে বাঙালী নবারুণ ফিরে আসেন আরও তীব্র ভাবে। “লজ্জা, এ কি লজ্জা” প্রবন্ধিকায় ১৯৬৯ সালে পুজোয় বেরনো গানকে তিনি ৭০ থেকে ৭২-এর রাজনৈতিক সময়ের সাথে কনট্রাস্ট করে দেখান যে আত্ম বিস্মৃত বাঙালী ২০০৯-এর পুজোতেও জঙ্গল মহলের ঘটনায় বিচলিত হয় না। “মানুষও লজ্জা পেতে ভুলে গেছে”। কাঙ্গাল মালসাট সিনেমা’র দণ্ড বায়স কবীর সুমনের ফেসবুক প্রোফাইল-এর ডিসপ্লে ফটো বলে “ছত্রধর মাহাতর মুক্তি চাই”। ২০১৫ সালে। এলিট সাহিত্য চর্চার ব্যাপারেও নবারুণের মত স্পষ্ট। নাগরিক মোলায়েম আদেখলাপনাকে তিনি অযোগ্য বলে জানিয়ে দেন “ভাববার নাটক” প্রবন্ধিকায়। “খুব সহজ বিষয়— চা বাগানে অনাহারে এক বালিকার মৃত্যু। এরকম তো হয়েই থাকে।’’ সেই অপটু পরিবেশনার ব্যঞ্জনা আসলে শুরু হয় নাটকের শেষে। “গ্রিনরুমে শ্রমিক মেয়েদের কান্না আর থামে না। শোক ও বিলাপ চলতেই থাকে।’’ পেটের জ্বালার চুরি— নবারুণ বলেছেন এই সমস্যাকে। “কিছু আশা, কিছু ভয়”-এ ‘সত্যম’ কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে তিনি বৃহত্তর গ্যাংস্টার ক্যাপিটালিজমকে তৃতীয় বিশ্বের লেখক হয়েও কাঠগড়ায় প্রশ্ন করেন। তেমনি তিনি প্রশ্ন করেন সুশীল সমাজকে, প্রগতিশীলদের। অকুতোভয় নিয়ম ভঙ্গকারী দুর্বৃত্তদের নবারুণ ফ্যাতাড়ু বানিয়ে তোলেন কারণ প্রগতিশীলদের কোনো গতি নেই। আর নেই বলেই ‘নেটো’য় মারে দই। সব, নবারুণের ভাষায়, “গুবলেট! গুবলেট!’’ আর এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল “ফিউম্যান রাইটস”। “ঘাড় ধাক্কা” নামক লেখায় পাই ২০০৯ সালে ভারতের মানব উন্নয়ন সূচকে স্থান ১৩৪ তম। তবে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত, দেশ থেকে বিদেশ— সর্বত্রই নবারুণের দূরদৃষ্টি ব্যাপ্ত। “নির্বাচন, নর-বানর ও মামায়েভ পাহাড়” প্রবন্ধিকায় তিনি রুশ অর্থোডক্স চার্চ ও শাসক গোষ্ঠীর আঁতাত নিয়ে আশঙ্কিত হন জুন-জুলাই ২০০১-এ। ২১শে জুলাই, ২০১৫-তে বিখ্যাত ঐতিহাসিক টিমথি স্নাইডার তাঁর লেখা “Edge of Europe, End of Europe”-এ একই বিষয় তুলে ধরেন। অ্যাকোয়ারিয়াম-এর শেষ ক’টি প্রবন্ধ নন্দীগ্রামের সময় নিয়ে। বাংলার কম্যুনিস্ট শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নবারুণের জবান। তিনি নন্দীগ্রামের গণহত্যার সাথে পৃথিবীর সব গণহত্যার মিল খুঁজে পান। ১৯৩৭ সালের স্পেনের গৃহযুদ্ধ বা ১৯৬৭ সালের ভিয়েতনামে মার্কিন মারণ তাণ্ডবের কথা তাঁর মনে পরে। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখক-বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা নিয়ে চিন্তিত হন। জুলুম সিপাহীদের বিরুদ্ধে কলম সিপাহীদের প্রতিবাদ সার্বিক নয়। তবে লেখক যেহেতু বারেবারে নিজেকে হিস্টরিকালি অপ্টিমিস্ট বলে এসেছেন তাঁর আশা “যে ভবিষ্যতে এই প্রতিবাদ আরও ব্যাপক হবে, একটা সদাজাগ্রত প্রহরায় পরিণত হবে যাতে ট্রিগারে আঙ্গুল রাখার আগে ঘাতককে দুবার নয়, অনেকবার ভাবতে হবে।’’ “গান্ধীনগরে রাত্রির অন্ধকারে...” প্রবন্ধিকায় চারিত্রিক কৌতুক বোধে নবারুণ খেয়াল করেন “দেখার সেই তালিকায় নবতম সংযোজন গান্ধীনগরের রাত্রির অন্ধকারে নন্দীগ্রামে সূর্যোদয়। হইল ভালো কথা, সে-ও রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে!” বাংলা কলম-সিপাহীদের নাটের গুরুর জন্মদিন যেন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
    “আনাড়ির নাড়িজ্ঞান” প্রবন্ধ সংকলনের কেন্দ্রিকতা বহুমুখী। নবারুণ এখানে যেমন তাঁর স্বভাবগত রাজনৈতিক বোধে সোচ্চার তেমনি আবার তিনি তাঁর ছোটবেলা নিয়ে স্মৃতিমেদুর। পরবর্তী “কথাবার্তা” বইএ দেখব এই স্মৃতি চারণাও কি ভাবে ইতিহাস-রাজনীতি সমীকরণের বাইরে নয়। তবে “আনাড়ির নাড়িজ্ঞান”-এ ইতিহাস আসে বৈষয়িক নানাবিধতার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই। লেখক শুরু করেন ১৯৬৭ সালে লেখা তাঁর “ভাসান” গল্পকে মনে করে। সে প্রসঙ্গে উঠে আসে তাঁর প্রকাশক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা নিয়ে তাঁর ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্মৃতিচারণা। “সোনালি বাঘ-প্রেতের কথা: জীবনানন্দের তিনটি গল্প” আলোচনা প্রসঙ্গে আসে ১৯২৯ সালের ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশ এবং ১৯৩৪ পর্যন্ত অর্থনৈতিক মন্দা’র কথা। আসে ৪৩ এর মন্বন্তর এর প্রসঙ্গ আর বাঙালী অর্থ পিশাচদের ফিরে দেখা। এরই মধ্যে তিনি এও খেয়াল করেন যে ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত বিভূতিভূষণের “পথের পাঁচালী”তে “পুনরাবৃত্তি বাদ দিয়েও ১১৮টি খাদ্যের পদের উল্লেখ আছে।’’ না, সেই সময়ে খাদ্য বিলাসিতায় মগ্ন হন নি বিভূতিভূষণ। নেহাতই দীন খাবার সে সব। নোনাপাতার পান, তেলাকুচার পটল, কিংবা ডুমুরের সুক্তুনি। আর আছে পানসে পায়েসের কথা। নবারুণ এর চোখ এসব এড়ায় না, কারণ তিনি “পথের পাঁচালী”কে দুর্ভিক্ষের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে পাঠ করেন। এর পরেই নবারুণ চিন ও সোভিয়েত দেশ এর বৈভবময় আইডিওলজিকাল কপর্দক শূন্যতা বিলাপ করতেও দ্বিধা করেন না। এসব তাঁর নিজের চোখেই দেখা। নিজের চোখে দেখা কাগ্রামের জগদ্ধাত্রী পুজো। সেখানে দেবী মূর্তি আর রমজানের ঘোড়া একই শিল্পীর হাতে তৈরী। “সাদামাটা কিছু বারোয়ারী মণ্ডপ”-এর পুজো ভবিষ্যতের সার্বজনীন উৎসবের বার্তা আনে। “হাওলাওয়ালাদের হালাল করো” প্রবন্ধে নবারুণ স্বীকার করেন যে “ছোটবেলা আমার খুব যুদ্ধের গল্প, যুদ্ধের ইতিহাস ও বিবরণ পড়ার শখ ছিল।’’ চীন রাশিয়া’র যুদ্ধ থেকে কিউবা নকশাল-এর সময় পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর ইতিহাস পড়ার পরে নবারুণের মনে হয়েছে “নির্মম, হিংস্র ও নিষ্ঠুর শতাব্দীটা আসলে আউসভিৎজ-এই শেষ হয়ে গেছে। কৃত্রিম উপায়ে তাকে ১৯৯৯-এর অন্তিম অবধি বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে...”। অবশ্য নবারুণের মতে সময়ও পণ্য: “জল বা বাতাসের মতোই চুরি হয়ে যেতে পারে। হচ্ছেও।... জাল নোটের মতোই চলছে জাল সময়।’’ প্রবন্ধের নাম “ঘড়ি-ঘরের জেলখানা”। “অপারেশন গ্রীন হান্ট: মোকাবিলা কোন পথে” প্রবন্ধে নবারুণ ব্যাপক মানুষের অভ্যুত্থান নিয়ে কথা বলেন। ইউ.পি.এ. আমলে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সরকার যে দমন নীতি নেয় তার নাম অপারেশন গ্রীন হান্ট। নবারুণ এই নামকরণকে প্রশ্ন করেন। গ্রীন শব্দের মধ্যে যে ভালো গুণ নিহিত থাকে তাকে তোয়াক্কা না করে এই নাম কেন তা খুঁজতে গিয়ে লেখক মত দেন যে এর সাথে নিশ্চয়ই আমেরিকার গ্রীন বেরে সৈন্য বাহিনীর কোন মিল আছে। এই গ্রীন বেরেরাই ভিয়েতনামে গিয়ে মৃত্যুর পাশবিক নিদান দিয়েছিল প্রান্তিক মানুষদের। গ্রীন হান্ট এর উদ্দেশ্য অনেকটাই একই রকম। “লালগড়” প্রবন্ধেও ব্যাপক আন্দোলনের ডাক। এই দুই প্রবন্ধে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও উঠে আসে। সেলিব্রিটিদের পলিটিক্স ও পলিটিকাল দালালদের কথা। প্রথমটি থেকে নবারুণের কোন আশা নেই। কিন্তু দ্বিতীয় গোষ্ঠী আরও ভয়ানক। লাল জামা আর লাল চশমা পড়া সখের কম্যুনিস্ট যাদের উদ্দেশ্যই হল পাবলিসিটির ক্ষীর খেয়ে নেওয়া, সেইসব মানুষরা যে তাঁদের নাগরিক হাওয়া মহল ছাড়তে রাজি নন তা নবারুণ হাড়ে হাড়ে জানেন। মধ্যে প্রাণ যায় প্রান্তিক মানুষদের বা গুটি কতক আদর্শে ডানপিটে তরুণদের। শুধু একটাই আশার কথা বার বার তার প্রবন্ধে ফিরে ফিরে আসে। ভবিষ্যতের সময় হয়ত কিছুটা আলাদা, কিছুটা প্রাণোচ্ছল হবে। “কমরেড” (কবীর) সুমন প্রসঙ্গে আলাপচারিতায় নবারুণ এভাবেই ষাট সত্তর আশির দশক থেকে অনাগত ভবিষ্যৎকে মিলিয়ে দেন। বিপ্লবী গানের, মানুষের গানের সুরে।
    নবারুণের বলিষ্ঠ রাজনীতি জারিত ইতিহাস চেতনা আবারও স্বর পায় এই বছরের গোড়ায় প্রকাশিত “কথাবার্তা” সংলাপ সংকলনে। তড়িঘড়ি প্রকাশনের তাগিদে প্রচুর মুদ্রণ প্রমাদ, ও সম্পাদকীয় অনাবধনতায় বই-এর বক্তব্য কিছু জায়গায় বিঘ্নিত ও ঘোলাটে হওয়া সত্ত্বেও সব ছাপিয়ে উঠে আসে নবারুণের অটল বিশ্বাসের ছবি। তাঁর লেখার রাজনৈতিক বক্তব্যের শিকড় নবারুণ খুঁজে পান নিজের সময়ে, নিজের দেশে। মানুষের অপমান লাঞ্ছনা বঞ্চনার কথা তাঁর গল্প উপন্যাস কবিতায় ফিরে আসে। অত্যাচার তাঁকে ক্রুদ্ধ করে। এই “এথিকাল” রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই তাঁর সাহিত্য। “আমার রাজনৈতিক জীবন থেকেই আমি হিস্টরিকালি অপ্টিমিস্ট।’’ “নবারুণ ভট্টাচার্য উবাচ” আত্মকথনে তিনি বলেন “... লেখকরা সহজাতভাবেই বেশি সেনসিটিভ।’’ নকশাল থেকে নন্দীগ্রাম সবেতেই তিনি ভীষণ অন্তরালোড়ন বোধ করেন। “ভিতরে ভিতরে প্রবল একটা কষ্ট। এই কষ্ট থেকেই লেখাটা আসে।’’ ক্যাপিটালের আঘাত নেমে এসেছে সমস্ত শ্রেণীর মানুষের ওপরে। এর বিরুদ্ধেই নবারুণের লেখা। পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লবের সারৎসার খোঁজেন নবারুণ। “সত্তরের গোড়ায় সেই সময়ে শ্রীলঙ্কায় ট্রটস্কাইটদের যে অভ্যুত্থান ঘটেছিল আমি তাকে সমর্থন জানিয়েছিলাম’’, বলেন তিনি “আমি চাই লোকে আমাকে কমিউনিস্ট কবি ও লেখক হিসেবেই মনে রাখুক” শিরনামী সংলাপে। তাঁর নকশাল আন্দোলন বা তেভাগা আন্দোলনের প্রতি দুর্বলতা কোন বিচ্ছিন্ন বা ‘লোকাল’ রাজনীতির পরিচায়ক নয়। হয়ত এই কারণেই সময় ব্যাপারটাও ‘লোকাল’ নয় তাঁর কাছে। তিনি উত্তরআধুনিক কন্ডিশন এ বিশ্বাসী নন। আবার অক্ষয়কুমার বড়াল বা মানকুমারী বসুকে তিনি সমকালীন বলে মনে করেন। গোবিন্দচন্দ্র দাস-এর কবিতার এনার্জি তাকে উদ্বুদ্ধ করে। “জীবনে আমরা যা যা অনুভব করি সেগুলো ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাঁরা অনুভব করেছিলেন যেমন ইতিহাসগত ভাবে আজকে আমি করছি”- নবারুণ বলেন প্রথম দুজন অগ্রজ কবি সম্বন্ধে “দুনম্বরী একটা সময়ের মধ্যে আমরা বাস করছি...” সংলাপে। কলকাতার সময় গতি কোথাও যেন আটকে গেছে। প্রাণহীন। জয়েসের ডাবলিন এর মত। “এটা কি কোন জ্যান্ত শহর? ...এটা একটা প্রেতের শহর’’ (পাতা, ৩০)। আশির দশকেই, বৈপ্লবিক সত্ত্বার সাথেই মৃত্যু হয় এই শহরের। যে কারণেই হয়ত তাঁর লেখায় লোকেল তৈরী হয় চরিত্রের মতোই। কাল্পনিক ভাবে (৩৪)। এই মৃত নগরের ইতিহাস তিনি রচনা করেন তাঁর লেখায় যেখানে বৈপ্লবিক সময়-এর ভূত ফিরে ফিরে তাড়া করে এই শহরের জড় মানসকে, জন মানুষকে।
    নবারুণের কথাবার্তা বা গদ্য সাহিত্যে কয়েকটি বিষয় বার বার আবর্তিত হয়। স্ল্যাং-এর ব্যবহার, তাঁর রাজনৈতিক বোধ, তাঁর দেখা সময়, তাঁর বিচিত্র নিম্নবর্গ ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা। এসব নিয়ে তিনি বারবার কথা বলেছেন কারণ তাঁকে বুঝতে গেলে এসব ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হতে হবে। আর ফিরে আসে ঋত্বিক ঘটক, বিজন ভট্টাচার্য ও মহাশ্বেতা দেবীর কথা। প্রথম দুজন নবারুণ কে জীবনের পাঠ দেন। তাঁদের ইতিহাসনিষ্ঠতা, প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করে যাবার অঙ্গীকার, বাজার এর সাথে আপোষহীন সংগ্রাম এসব নবারুণ আত্মীকরণ করেছেন। তথাপি, মহাশ্বেতা এই বলয়ের বাইরে কোন অন্য ক্ষতের ইঙ্গিত দেন। এই ক্ষত আরও গভীর হয় নবারুণের বিশ্বাস ধারাবাহিক ভাবে আহত হবার প্রবাহে। “আমার যখন বারো বছর বয়স তখন মা চলে গেলেন। এই ঘটনাটা আমার কৈশোরের জীবনকে খুব প্রভাবিত করেছিল। সেই ট্রমা পরবর্তী জীবনকেও তাড়া করে ফিরেছে। ...মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা আমার চরিত্রকে অনেকটা মোল্ড করেছে— দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলাতে অনেক সাহায্য করেছে” (কথাবার্তা, ৫৬)। এই ভিত্ত্যাঘাত বা ফাউন্ডেশনাল ট্রমা কিভাবে নবারুণকে ইতিহাস নিয়ে সেনসিটিভ করেছে, বা তাঁর লেখা কিভাবে এই ট্রমা’র সাথে যুঝ্যমান তা নিয়ে বিস্তৃত লেখার পরিসর বা অবকাশ এই লেখায় নেই। তবে সামান্য কথা বলা যেতেই পারে। আধুনিক ট্রমা তত্ত্বের কথায় বললে ইতিহাস, তা ব্যক্তিগত, বা জাতি/সমষ্টিগত যাই হোক, আসলে ক্ষতঋদ্ধ। বিশেষ করে ফাউন্ডেশনাল ট্রমা পরিচয় তৈরী’র ব্যাপারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নবারুণকে বারংবার সোভিয়েত পতন, বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের (রাজ)নৈতিক অবক্ষয়, চিনের ক্যাপিটালিজমকে আলিঙ্গন করা, বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টিক্র্যাসি এসব ভয়ানক ক্রাইসিস-এর মধ্যে নিয়ে যায়। এর সাথে গোলকায়ন, পুঁজিবাদ, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ, বুদ্ধিজীবীদের জাড্যতা, বৈপ্লবিক সম্ভাবনার অপমৃত্যু— তিনি ভীষণ বিচলিত ছিলেন, ক্রুদ্ধ ছিলেন। “কষ্ট থেকেই লেখাটা আসে”, তিনি বলেছেন। ধর্ষিতাদের পুঞ্জীকৃত জামা কাপড়ের মধ্যে একটি বাচ্চা মেয়ের ফ্রক দেখে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন (কথাবার্তা, ১৬)। অন্যের অপমান, লাঞ্ছনা (৫৯), মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া (৬১)— বিভিন্ন ভাবে তিনি মর্মাহত হয়েছেন। “৮৪ সালে আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে যাই। সেখানেও আমি দেখি অনেক অমানবিক ঘটনা। আমার কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন একটা সাংঘাতিক ঘটনা, আমার সমস্ত অস্তিত্বকে বিদীর্ণ করে দিয়েছে এই অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার অভিঘাতে আমি ‘হারবার্ট’ লেখার প্রয়োজনবোধ করেছিলাম তীব্রভাবে” (৭৪)। “হারবার্ট” একটি আদ্যোপান্ত ট্রমাটিক টেক্সট। “আ ... টুল অফ হিস্ট্রি” (১৫১) “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না”-ও। বারাসাতের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নবারুণের প্রতিবাদ। তবে নবারুণ এই বিলাপমগ্নতায় আচ্ছন্ন হন নি। তাঁর “এথিকস” বোধ তাঁকে সাবভার্সন করতে শেখায়। এ একধরণের working through the trauma। আসে ফ্যাতাড়ুরা। “আ গ্র্যান্ড ডিজাইন অফ সাবভার্সন” (১৪৭)। তৈরী হয় প্রতি-ইতিহাস বা এমনকি বিপ্রতীপ-ইতিহাসের সম্ভাবনা। সাবভার্সন, ট্রান্সগ্রেসন, প্রথা ভাঙ্গা (১৩৬) এসব ট্রমার বিরুদ্ধে প্রতিরোধিক রম্যানুরাগ (jouissance –এর ভালো বাংলা আমার জানা নেই) তৈরী করে। লাকাঁ দ্রষ্টব্য এ ব্যাপারে। নবারুণ নিজেও নিজেকে “আমদগেড়ে” বলেছেন। প্রাত্যহিক জীবনে তিনি “দৈন্য”ন্দিনতার আনন্দ দেখেছেন। দুঃখ নয়। এক “celebration of life’’(৪৮)। ফ্যাতাড়ুরা খিস্তি করে, গণ্ডগোল পাকায়। Disruption নিয়ে আসে। প্রান্ত এভাবেই কেন্দ্র কে নিয়ে ছেলে খেলা করবে। ফ্যাতাড়ুদের যাবতীয় প্রান্তদোষ আসলে তাঁদের প্রতি নবারুণের সম্মান (২০)। পুরন্দর ভাট তো নবারুণ বই অন্য কেউ নয়! অপরায়ন (otherization) এর গভীর চক্রান্তকে এভাবেই বিচলিত করতে হয়। ক্ষমতার খোয়াবনামায় ফ্যাতাড়ুরা দুঃস্বপ্নের মত haunt করে। প্রত্যাহত করে কেন্দ্রের ঔপনিবেশিক ট্রমাটাইজেশনের ক্ষমতা কে।
    অপর-কে অপর বলে মেনে নিয়ে তাঁকে সেভাবেই সম্মান করে তাঁদের অস্তিত্ব কে স্বীকার করে নেওয়া কে ফরাসী দার্শনিক ইমানুয়েল লেভিনাস এথিকাল এগজিসটেন্সের পরাকাষ্ঠা বলে মনে করেন। ক্ষমতায়িতাত্ম (empowered ‘self’)-এর এথিকাল অ্যাক্টিভিটি কি হবে তা নির্ণয় করবে ব্রাত্য/প্রান্তজনেরা�� �। সেই কারণেই হয়ত নবারুণের লেখায় দলছুট, প্রান্তিক, ‘নেড়ি’ হাভাতে চরিত্রের এত দাপাদাপি। তাঁদের স্বীকার করতেই হবে আমাদের মত বিলাসি-প্রিভিলেজেড মুল্যায়ণকারীদের। এঁদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্র যন্ত্র চলতে চেষ্টা করলে বিনুদের লুকিয়ে রাখা ডিনামাইট হারবার্টদের মৃতদেহের মধ্যে দিয়ে বিস্ফোরণ আনবেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা। নুনু কামান বা বাল কবিতা সবেতেই আছে ইতিহাস বদলের আভাস, অনাগতের ইঙ্গিত। অস্ত্র চিনে নিতে হবে। ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে হবে। সাথে থাকছেন কমরেড নবারুণ।*

    *একটি বিশদতর লেখার অংশ, তাই গাঠনিক অসামঞ্জস্য ও অনেক কিছুই অব্যাখ্যায়িত হয়তো থেকে গেলো। দায় লেখকের।

    ===============================

    বিকল্প কথননীতি

    অদ্বয় চৌধুরী

    “ফিনিশ হতে আর মিনিট পাঁচেক টাইম আছে গল্পটার।”

    একটা মার্ডারের তোড়জোড় চলছে। একটি মিনিবাস ঢুকছে। সেই বাসে আছে সেই ব্যক্তি যাকে খুন করা হবে। আছে কি নেই সেটা অবশ্য তখনো জানা যায় না। কিন্তু তার থাকবার সম্ভাবনা আছে। এদিকে অপেক্ষারত দুই খুনী তৈরি। এইরকম এক টানটান উত্তেজনার মুহূর্তে কথক, অথবা লেখক, ঘোষণা করলেন গল্পটা ‘ফিনিশ’ হতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। মুহূর্তে পাঠকদের এক উত্তেজনাকর কাল্পনিক অবস্থা থেকে নামিয়ে আনলেন উত্তেজনাহীন বাস্তবে। এই সমস্ত ঘটনাই আসলে একটা গল্প, বাস্তব নয়। এই বাস্তব কিন্তু রূঢ় নয়, বরং এক আরামদায়ক বাস্তব যে বাস্তবে খুনের মতো কোন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে চলেছে না বলে পাঠক আশ্বস্ত হয়। ওই খুনটা আসলে গল্পে ঘটবে। হ্যাঁ, এখানে পাঠক ধরেই নেবে খুন হতে যাওয়া মানুষটা ঐ বাসে আছে এবং ঐ খুনটা ঘটবেই, গল্পে হলেও, কারণ গল্পটা ‘ফিনিশ’ হতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি আছে, ঐ লোকটার ‘ফিনিশ’ হতে যতটুকু সময় বাকি আছে ঠিক ততটুকুই। এবং এখানেই যাবতীয় ট্যুইস্ট অ্যান্ড টার্ন তাদের যাবতীয় জাদুবিদ্যার মাধ্যমে অদ্ভুত ভেল্কী দেখাতে শুরু করে। যে সম্ভাব্য ‘ফিনিশের’ প্রতি ইঙ্গিত করেন লেখক অথবা কথক সেই ফিনিশের বদলে আসল গল্পটা বরং শুরু হয় এই জায়গা থেকেই। অনেক কিছু ঘটে, অনেক চরিত্র আসে। শেষ পর্যন্ত মার্ডারটা কিন্তু ঘটে না, তবে ঘটার মতো এক পরিস্থিতিতে গিয়ে শেষ হয়ে যায় ‘চাঁদের চোয়াল’ গল্পটা।

    গল্পের মসৃণ উড়ানকে বেমক্কা এক ন্যারেটিভ জার্ক-এর মাধ্যমে তছনছ করে দেওয়ার এই প্রবণতা নবারুণের ন্যারেটিভ টেকনিককে করে তোলে স্বতন্ত্র। নবারুণ প্রথমে এক মায়াবী আবহ সৃষ্টি করেন যাতে পাঠকরা পুরোপুরি মগ্ন হয়ে পড়লে তিনি অদ্ভুত এক আকস্মিক অথচ সাবলীল ধাক্কায় সেই মোহময়ী আবরণকে ভেঙে চূর্ণ করেন। পাঠকদের টেনে বার করে আনেন গল্পের মেকী আবহের বাইরে। তারপর এক বা বহু সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত করে লেখকের সর্বজ্ঞ সত্ত্বা পরিত্যাগ করে পাঠকদের স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেন সেই মোক্ষম সন্ধিস্থলে ও সন্ধিক্ষণে যেখানে গল্পটি এক সম্ভাব্য অন্তিম বাঁকের মুখে অপেক্ষমাণ এবং যখন পাঠক উদগ্র বাসনায় অপেক্ষারত গল্পটির একটি নির্দিষ্ট অন্তিম পরিণতির জন্য। এই আয়োজনে অপ্রস্তুত পাঠক অনেক সময়ই বিপন্ন বোধ করে। এই বিপন্ন বোধ জাগ্রত করাই কিন্তু নবারুণের উদ্দেশ্য। তিনি চান তাঁর পাঠক কোনরকম আগাম সতর্কতামূলক প্রস্তুতি ছাড়া যেন তাঁর গল্পপাঠে উদ্যোগী না হয়। কারণ প্রথাগত লিখনশৈলী ও অভ্যাসকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তিনি এক নতুন কথনশৈলী আমদানি করেন যেখানে “পাঠকের সঙ্গে একটা সজীব দ্বৈরথে প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হতে চান নবারুণ”। [রাজীব চৌধুরী]।

    পাঠকের সঙ্গে নবারুণের ‘দ্বৈরথ’ কতটা ‘সজীব’, পাঠকের নবারুণ-পাঠপূর্ব মহড়ার প্রয়োজনীয়তার কারণ, তাঁর গল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও পড়ে থাকা সম্ভাবনার ব্যাপ্তি ও পরিধি ঠিক কতটা হতে পারে তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন হয়ে ওঠে ‘অন্ধ বেড়াল’ গল্পের পরিসমাপ্তি:
    “জলের ধাক্কায় আর উন্মত্ত বাতাসের দাপটে হোটেলটা যখন কেঁপে কেঁপে উঠবে, নদীর দিকের খুঁটিগুলো যখন একটা একটা করে টলে যেতে থাকবে তখন হোটেল মালিক বাসনকোসন আর চেয়ার টেবিলগুলো সামনের গলির ওপারে যে রকের মতো জায়গাটা আছে সেখানে নিয়ে গিয়ে ডাঁই করে রাখতে পারে। এপাশ-ওপাশ দুলতে থাকা লন্ঠনটাও সে নিতে ভুলবে না। কিন্তু জল বেড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলেও তা শুরু হবে টাল খাওয়া দিকটার থেকে। অন্ধ বেড়াল তখন বড়োজোর অপেক্ষাকৃত উঁচু দিকটায় সরে যেতে পারে। কিন্তু ও ঘর ছেড়ে বেরোবে না। এখানেও দুটো সম্ভাবনা রইল। ঘরটাতে আস্তে আস্তে জল বাড়তে পারে অথবা এক ঝটকায় দোতলাসমেত হোটেলটার গোটা কাঠামোটাই নদীতে ধ্বসে পড়তে পারে। এর যে কোন একটা হলে অন্ধ বেড়ালের কিছু করার নেই। হয় জল তাকে ছাপিয়ে উঠবে নয়তো ঘরের সঙ্গেই সে নদীতে তলিয়ে যাবে। কিন্তু ঝড় যদি কোন কারণে রাস্তা পালটায় বা অত ভয়াবহ না হয় তাহলে হোটেলটা যেমন আছে তেমনই থাকবে। এবং টেবিলের তলায়, অন্ধকারে বসে থাকবে অন্ধ বেড়াল। সকালে এসে বাচ্চাদুটোও দেখতে পাবে যে চেনা জায়গাতেই সে চুপ করে বসে রয়েছে।”
    এখানেই গল্পটি শেষ হয়। শেষ হয় কথকের কাজ; লেখকের কাজও। কিন্তু লেখকের হাত ছেড়ে পাঠকের স্বাধীন বিচরণ শুরু হয় এখান থেকেই, সম্ভাবনাময় এই বিস্তৃত উন্মুক্ত প্রান্তরে। এখান থেকেই আরও একটা, বা আরও একাধিক গল্প শুরু করা যায় কিন্তু। একটি গল্প শেষ হওয়ার পর সেই গল্পের এন্ড পয়েন্ট থেকেই আরও এক বা একাধিক গল্প লেখক নিজেই লিখেছেন অবশ্য। যেমন ‘অটো’ উপন্যাসের পরবর্তী গল্প হিসাবে উপস্থিত হয় ‘মিউচুয়াল ম্যান’ এবং ‘কড়াই’ গল্প দুটি। আবার, ‘অটো’ উপন্যাসটি নিজেই ‘আমার কোন ভয় নেই তো?’ গল্পের সমান্তরাল পাঠ হিসাবে উঠে আসে। এভাবেই নবারুণের লেখায় নিয়ত চলতে থাকে গল্প নিয়ে সামগ্রিক পরীক্ষা, এবং সাথে সাথে পাঠকদের পরীক্ষাও।

    পাঠক-পরীক্ষার আরও একটি মোক্ষম অস্ত্র হল আন্তর্পাঠ। স্ট্রীম অফ কনশাসনেস টেকনিকের হাত ধরে নবারুণের কথনের ফাঁকে ফাঁকে অনায়াসে ঢুকে পড়ে কোন নিখাদ ঐতিহাসিক ঘটনা, অথবা অন্য কোন টেক্সট। ‘হারবার্ট’ থেকে একটি উদাহরণ দেখা যাক:
    “ঐ পরীর দিকে তাকিয়ে হারবার্ট কানে মৃতা পশ্চিমী নারীদের গান শুনতে পেয়েছিল। সেই গান দল বেঁধে বিলাপ করতে করতে এসে ধোঁয়াধুলো মাখা দোকানের কাচে ধাক্কা মারে। হায় নগ্ন পরী! জার্মান মেশিনগানের সামনে সেই রুশী যুবতী যেন— নগ্ন, দুহাত দিয়ে বুক ঢেকে দৌড়চ্ছে কালো মাটির ওপর। শুনতে সে কোন কথাই চাইছে না। ব্যস্ত পথচারীরা চুপ করে থাকলে শুনতে পেত যে হারবার্ট গুমরে গুমরে মুগ্ধ হয়ে কাঁদছে এবং সেই পরী ক্রমশ ওপরে উঠছে— তার গাল ঘষে দিচ্ছে দড়ি মইতে বাঁধা বিরাট বেলুন। শীতের পার্ক স্ট্রীটে একঝলক রেফ্রিজারেটরের হাওয়া এসে হারবার্টকে জড়িয়ে ধরে। হারবার্ট অলেস্টরের কলারটা তুলে দেয় এবং তাকে হলিউড ছাড়া এখন অন্য কিছু ভাবা অসম্ভব। এখনও বিকেল আছে। তখনও বিকেল ছিল। এরপর অন্ধকার ছেয়ে এলে পরীও লুকোতে শুরু করবে। গাড়ির আলো কখনো কখনো তাকে চমকে দেবে। মনে হবে তার ঠোঁট নড়ছে। অন্ধদুটো চোখে হলুদ আলো জ্বলছে। হারবার্ট ফিসফিস করে বলেছিল— জেপটে জুপটে থাকো এখন। ফের আসবখন।”
    এখানে ‘দ্য ফল অফ বার্লিন’ সিনেমার দৃশ্য অনায়াসে ঢুকে পড়ে গল্পকথনের স্বাভাবিক ছন্দের মধ্যে। কাহিনী এগোয়, কিন্তু অদ্ভুত এক মোলায়েম ঝাঁকুনির মধ্যে দিয়ে। কাহিনীর এই অস্বাভাবিক গতি ও ছন্দ, এই ন্যারেটিভ জার্ক, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এইরকম আপাতঅপ্রয়োজনীয় আন্তর্পাঠের নিবেশ নিঃসন্দেহে আনাড়ি পাঠককে এক অনভিপ্রেত বিপন্নতার দিকে ঠেলে দেয়। সাথে সাথে লেখকের কোন গোপন অভিসন্ধির ইঙ্গিতও কি উঠে আসে না এখানে, এই নির্বাচিত আন্তর্পাঠের অভিনিবেশের মাধ্যমে? কোন গভীর রাজনৈতিক অভিসন্ধির আভাস?

    আভাস উঠে আসে অবশ্যই। জাঁ-পল সার্ত্র লেখকের অবস্থান বিচার করতে গিয়ে বলেছেন, “…the writer’s duty is to take sides against all injustices, wherever they may come from. And as our writings would have no meaning if we did not set up as our goal the eventual coming of the freedom by means of socialism, it is important in each case to stress the fact that there have been violations of formal and personal liberties or material oppression or both.” সমাজ ও সময়ের প্রতি দায়িত্বশীল লেখক হিসাবে প্রবল রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পন্ন নবারুণের কোন এক পক্ষ অবলম্বন ছিল অনিবার্য। সেই পক্ষ ছিল মার্ক্সবাদের পক্ষ, রাষ্ট্রশক্তির নিপীড়নের বিরোধী পক্ষ, প্রলেতারিয়েতদের পক্ষ, সশস্ত্র বিপ্লবের পক্ষ। এই রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বনের ফলে তাঁর গল্পে পরোক্ষে, অথবা প্রত্যক্ষভাবেই, মিশে যায় ইস্তেহার। এই অসম মিশ্রণটাও ঘটে কিন্তু ন্যারেটিভ জার্কের মাধ্যমেই। বিপ্লবী অভিঘাতে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে লেখক-কথক-পাঠক সম্পর্কের অন্তর্বর্তী প্রাচীর:
    “সারা দুনিয়া জুড়ে কমিউনিস্টরা ফিরে আসবে। হ্যাঁ। আসবে। তবে তার জন্যে আগামী সতেরো বছর বা তারও বেশী সময়ের প্রত্যেকটা ঘণ্টা ও প্রত্যেকটা মিনিট কাজে লাগাতে হবে। সারা পৃথিবী জুড়ে কমিউনিস্টরা ফিরে আসবে। আসবেই। আর দশ নয়, দশ হাজার দিন ধরে দুনিয়া কাঁপবে।
    সেই কথাটাই এই গল্পের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হল।”
    গল্পের মাধ্যমে এখানে তিনি জানিয়ে দেন তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস যা আসলে ইস্তেহারের নামান্তর। লেখক নবারুণের বৃহৎ রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার মাধ্যম হয়ে ওঠে তাঁর কথনশৈলী।

    মাধ্যম হয়ে ওঠেন নবারুণ নিজেও, লেখক হিসাবে, লেখকের দায়বদ্ধতা থেকে। সাহিত্যের সংজ্ঞা নিরূপণের পথে সার্ত্র বলেছেন, “The writer is, par excellence, a mediator and his commitment is to mediation.” লেখকের দায়বদ্ধতাকে মেনে নিয়ে তাঁর সমকাল— সমকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক অবস্থাকে তুলে ধরার একটি মাধ্যম হয়ে ওঠেন নবারুণ নিজে। এই প্রক্রিয়ায় তাঁর কাহিনীকে এক সত্যবচনের ছাপ দেওয়া ভীষণ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। সেই আয়োজনও সম্পন্ন হয় তাঁর ব্যবহৃত কথনশৈলীর মাধ্যমেই। ‘কাকতাড়ুয়া’ গল্পে তাঁর কাহিনীকে সরাসরি সত্যবচনের মোহর লাগানো হয় গল্প শুরু হওয়ার আগেই, লেখার একদম শুরুতেই, তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে তুলে ধরা কিছু আপাতসত্য ঘটনার বিবরণীতে, যা লেখকের বিবৃতি হিসাবে গ্রাহ্য হতে পারে।
    [নির্দিষ্ট ঘটনাটি ১৯৭৯ সালের আগস্ট মাসে ঘটেছে, ১৫ তারিখে। কয়েকটি ক্ষেত্রে জায়গা ও লোকের নাম পালটানো হয়েছে। রচনার মধ্যে গম্ভীরা, গণপত রাম, নির্ভয়-পাসোয়ান ও ভারত বিন্দের নাম পাওয়া যাবে। এঁরা বিহারের জমিদার ও পুলিস বাহিনীর আক্রমণে নিহত অসংখ্য ক্ষেতমজুর ও হরিজন নেতার মধ্যে কয়েকজন। রচনাটির কোনো অংশই কাল্পনিক নয়।]
    এই বিবৃতির মাধ্যমে পাঠককে লেখক সচেতন করে তোলেন আগত কাহিনীর সত্যতার প্রতি; এবং পাঠকের কাছে প্রত্যাশা করেন এক গুরুতর ইতিহাসের নিবিড় পাঠ। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি অপেক্ষারত পাঠকের গম্ভীর ও মনোযোগী অবস্থানকে ভেঙে দেন সুচারু প্রক্রিয়ায়:
    “কাকতাড়ুয়া এক চোখে দেখল জিপটা ধুলো উড়িয়ে চলেছে।”
    গল্পকে সত্যবচনের তকমা লাগিয়ে যে ঘটনাবলী বিবৃত হয় তা জীবন্ত মানুষের বদলে একটি নিষ্প্রাণ কাকতাড়ুয়ার পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে দেখা! এক চোখ কানা নির্বাক না-মানুষ কাকতাড়ুয়া সামঞ্জস্যহীন হত্যার নিরন্তর বর্ণনা দিয়ে চলে। এই প্রক্রিয়ায় প্রহেলিকাময় হয়ে ওঠে সত্য-মিথ্যার বিভাজনরেখা। এভাবেই নবারুণ ক্রমাগত ভেঙে চলেন সমস্ত প্রাচীর, অতিক্রম করেন সমস্ত সীমারেখা— কল্পনা ও ইতিহাসের, গল্প ও ইস্তেহারের, সত্য ও মিথ্যার, বাস্তব ও অবাস্তবের, লেখক-কথক ও পাঠকের।

    না-মানুষ কাকতাড়ুয়ার মতোই নির্বাক না-মানুষ একটি কুকুরের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণিত হয় ‘স্টীমরোলার’ গল্পের থ্যাঁতলানো বিপ্লব-কাহিনী। এই বিকল্প দৃষ্টিকোণের ব্যবহারও নবারুণের কথনশৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্যরূপে ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠে তাঁর বিকল্প রাজনৈতিক রণনীতির। এই বিকল্প রাজনৈতিক রণনীতির আরও গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসাবে উঠে আসে ‘ভাসান’ গল্পটি যে গল্পের কথক হল একটি মৃতদেহ। নবারুণের একদম প্রথম গল্পতেই কথক হিসাবে মৃতদেহের ব্যবহার সূচীত করে পরবর্তীতে তাঁর বৈপ্লবিক রাজনৈতিক যুদ্ধের অন্যতম জাদুবাস্তবীয় হাতিয়ার: প্রেতের ব্যক্তিসত্তারোপ। এই রণকৌশলের বাস্তবায়নে পরে মসোলিয়াম জেগে উঠে গঠন করে জীবিত ও মৃতদের বৈপ্লবিক আঁতাত। বিপ্লবের এন্ড পয়েন্ট মৃত্যু নয়, বরং মৃত্যুর পর, মৃত-জীবিতের বিপ্রতীপ আঁতাতের মাধ্যমে বিপ্লব নবজন্ম লাভ করে। মৃতদেহকে কথক হিসাবে উপস্থাপনার মাধ্যমে নবারুণের সর্বপ্রথম গল্প থেকেই কথনশৈলীর রাজনৈতিকরণ প্রকট হয়ে ওঠে। পাশাপাশি, এক অন্য প্রেক্ষিতে, কথক তথা লেখকের মৃত্যুর আভাসও সূচিত করে এই উপস্থাপনা। এ হল উত্তরাধুনিক প্রেক্ষিত। উত্তরাধুনিকতাবাদ ও মার্ক্সবাদের স্ববিরোধী সহাবস্থান নবারুণের গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য— মতাদর্শগত ভাবে মার্ক্সবাদরূপী এক গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের সমর্থক হলেও উপস্থাপনায় ভীষণভাবেই তা উত্তরাধুনিক। শুধুমাত্র উপস্থাপনা নয়, কিছু ক্ষেত্রে বিষয়গত ভাবেও নবারুণের গল্প হয়ে ওঠে উত্তরাধুনিক। এমনকি, কথনশৈলীও বহন করে সেই ভাবধারা। সেও এক অন্য রাজনৈতিক চেতনা, কিন্তু সেই রাজনীতি হল লিটল্ ন্যারেটিভের রাজনীতি— লিটল্ ম্যাগাজিনের রাজনীতি। ‘ফোয়ারার জন্য দুশ্চিন্তা’ গল্পে এই বিপ্রতীপ ভাষ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়:
    “ফোয়ারার কথা এর আগে দুটো গল্পে আমি রটিয়েছিলাম। কিন্তু বেশি কেউ জানতে পারেনি। জানার কথাও নয়। কারণ গল্পদুটো বেরিয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনে। সেগুলো নিয়ে কেউ টিভি-র ছবি বা ফিল্ম— কিছুই করেনি। তাই কেউ জানতেও পারেনি। ফোয়ারাকে নিয়ে আমার তিন নম্বর গল্পও রুজপমেটম মাখা কোনো বড়ো কাগজে সায়া পরে বেরোচ্ছে না।... এবারেও লিটল ম্যাগাজিন...।”
    বালজাক পাঠপ্রতিক্রিয়ায় রোলাঁ বার্ত যে প্রশ্ন তুলেছিলেন— “Who is speaking here?”, আমরাও সেই একই প্রশ্ন তুলতে পারি— এখানে বক্তা কে? গল্পটির কোনো চরিত্র? নাকি, কথক? নাকি, লেখক নিজেই? এখানে চরিত্র-কথক-লেখকের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় এক আপাদমস্তক রাজনৈতিক ভাষ্য। তথাকথিত মূলধারার উচ্চবর্গীয় বড়ো কাগজ ও বিকল্পধারার প্রান্তবর্গীয় ছোট কাগজের দ্বন্দ্বমূলক অবস্থান, এবং সেই দ্বন্দ্বমূলক রাজনৈতিক সমীকরণে নবারুণের একটি নির্দিষ্ট পক্ষাবলম্বন। সেই পক্ষ অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রান্তজ উপাদানের প্রতি। তাঁর অবস্থান বরাবরই অবহেলিতদের পক্ষেই থাকে।

    অবহেলিতদের পক্ষাবলম্বনের জন্যেই, হয়তো বা, রাজনৈতিকভাবে নবারুণ ঝুঁকে থাকেন পাঠকদের প্রতি, কারণ “Classical criticism has never paid any attention to the reader; for it, the writer is the only person in literature!” [রোলাঁ বার্ত]। পাঠকদের চিরকালীন অবহেলিত ও প্রান্তিক অবস্থান ঘোচাতে নবারুণ লিখনশৈলীর রাজনৈতিকরণ ঘটান। তিনি গল্পের নির্মাণ, তার বিষয় ও বক্তব্যকে মান্যতা দেওয়া এবং না দেওয়ার সমান স্বাধীনতা দেন পাঠকদের; পাঠকদের করে তোলেন লেখকের সমতুল। এ হল উত্তরগঠনবাদী ভাবধারা। তাঁর ‘জনৈক নৈরাজ্যবাদীর সংবাদ’ নামক গল্পের কথনশৈলী বহন করে উত্তরগঠনবাদের তত্ত্বকথা:
    “এই লোকটির কথা শুনেছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছে। আমার ওই বন্ধু হল মনোযোগ চিকিৎসক। এখন তার প্রতিপত্তি পসার অনেক বেড়েছে। তখন তেমন হয়নি। সরকারি হাসপাতালে তখন সে ছিল। তার কাছেই এসেছিল। নৈরাজ্যবাদী। এইটুকু বলার পরে বাকিটুকু একটি অনুচ্ছেদেই হয়তো শেষ করে দেওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু এক্ষেত্রে আমারা একটি গল্পের শর্তাধীন, তাই অন্যভাবে এগোতে হবে। আমরা যেভাবে ব্যাপারটি সাজাব সেভাবে সম্ভবত ব্যাপারটা ঘটেনি। কিন্তু অন্যভাবে সাজানোর অধিকার আমাদের কেউ কি দিয়েছে? দেয়নি! লেখা ব্যাপারটাই এক হাতের স্বেচ্ছাচার। এ-সব হল খটকা। রয়ে গেছে। যাবেও।”
    এখানে যে লেখক সে নিজের অস্তিত্বের অপ্রয়োজনীয়তাকেই গুরুত্বসহকারে তুলে ধরে। লেখক যাত্রা করে এক অমোঘ অনস্তিত্বের দিকে; এবং গল্প, এক উৎসহীন সত্তা রূপে, রয়ে যায় ‘নিউট্রাল’ অবস্থানে যেখানে পাঠকের উপর কোন আরোপিত ব্যাখ্যা বা ভাষ্যের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় না, কারণ বার্তের ব্যাখ্যানুসারে “…writing is the destruction of every voice, of every point of origin. Writing is that neutral, composite, oblique space where our subject slips away, the negative where all identity is lost, starting with the very identity of the body writing.” লেখকের এই অনস্তিত্বই লেখাকে করে তোলে অবরোধমুক্ত যা নবারুণের গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

    অবরোধমুক্ত কাহিনী, অথবা কাহিনীর অবরোধমুক্ত গঠন এক বৃহত্তর সত্যের ধারক হয়ে ওঠে— বহমানতার এক নিশ্চিৎ আভাস আরোপ করে। এই বিষয়ে নবারূণ নিজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
    “আমার মনে হয়েছে উপন্যাস একটা ধারাবাহিকতায় পৌঁছে শেষ হয়। অর্থাৎ উপন্যাসে সব দরজা বন্ধ হয় না— খোলা থাকে, এর পরও জীবন চলবে, কাহিনী চলবে। আমি যা উপন্যাস পড়েছি— রুশ উপন্যাস, জার্মান-ফরাসি উপন্যাস, সোভিয়েত উপন্যাস— সে সবেই দেখেছি এই চলমানতার বোধটা এনে ছেদ টানা হচ্ছে। সেই চলমানতার বোধটা না আসা পর্যন্ত গল্প চলতে থাকে।”
    এই চিন্তাধারা অনুসরণ করেই “হারবার্ট” উপন্যাসটি যেখান থেকে শুরু হয়েছিল সেখানেই ফিরে আসে, এবং সেই স্থান থেকে আর একটু এগিয়ে, বহমানতার স্বাক্ষর সূচীত করে, শেষ হয়। আসলে, যদি সামগ্রিক আঙ্গিকে বিচার করা হয়, অনিবার্যভাবে দেখা যায় নবারুণের আখ্যানগঠন, তাঁর কথননীতি এ সবই তাঁর বৃহত্তর বিকল্প রণনীতি সন্ধানের হাতিয়ার। এই সন্ধান প্রক্রিয়া জারী থাকে চিরকাল। নবারুণ জারী রাখেন। কারণ, বিকল্প মানেই অগুণতি; এবং, ফলস্বরূপ, অগুণতি বিকল্পের সন্ধানপ্রক্রিয়া এক চিরন্তনী প্রক্রিয়া। বিকল্প রণনীতির সন্ধানপ্রক্রিয়া কোনদিনই ‘ফিনিশ’ হয়ে যায় না, ‘ফিনিশ’ হতে পারে না!

    উৎস ও ঋণ:
    ১) “উপন্যাস সমগ্র”, নবারুণ ভট্টাচার্য
    ২) “শ্রেষ্ঠ গল্প”, নবারুণ ভট্টাচার্য
    ৩) ‘নবারুণ ভট্টাচার্যর শ্রেষ্ঠ গল্প’, রাজীব চৌধুরী; “শ্রেষ্ঠ গল্প”, নবারুণ ভট্টাচার্য
    ৪) ‘Situation of the writer in 1947’, Jean-Paul Sartre
    ৫) ‘For Whom Does One Write’; “What is Literature”, Jean-Paul Sartre
    ৬) ‘The Death of the Author’; “Image-Music-Text”, Roland Barthes
    ৭) “The Norton Anthology of Theory and Criticism”, Edited by B., Vincent Leitch
    ৮) ‘নবাররুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথাবার্তা’, “কথাবার্তা”, নবারুণ ভট্টাচার্য
    ৯) ‘নবারুণ স্মরণ: বিষণ্ণতা, দহন এবং দ্রোহপরিস্থিতি’, অর্ক চট্টোপাধ্যায়

    ==========================================

    নবারুণ ভট্টাচার্য সেটাই করেন

    অনুপম মুখোপাধ্যায়

    একজন নবারুণ ভট্টাচার্য কী করেন? তিনি সেটাই করেন, যেটা একজন টেকচাঁদ ঠাকুর করেছিলেন, একজন কালীপ্রসন্ন সিংহ করেছিলেন, কিন্তু একজন বঙ্কিম করতে চাননি। নবারুণ লোকসাহিত্য করেন। লোকের জন্য লেখেন। কৃষ্টির জন্য নয়, সাহিত্যের জন্য ভাষাকে নিয়োজিত করেন। এই কাজ আমাদের সমকালে আর কেউ করেননি, করলেও ব্যর্থ হয়েছেন, ওই মোমেন্টাম তাঁদের ছিল না, নেই।
    আজ অবিশ্যি লোকসাহিত্য আর জনপ্রিয় সাহিত্য আমাদের এখানে ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে।
    এবং ভিকটোরিয়ান শুচিতার বোধ আমাদের আজও ছেড়ে যায়নি। আমাদের সিনেমায় কোনো বৃদ্ধের বুকে ছোরা মারা দ্যাখানো যায়, ভিলেনের গুলিতে শিশু হিরোর চোখের সামনে লুটিয়ে পড়া বাবা-মাকে দ্যাখানো যায়, কিন্তু অভিনেত্রীর স্তন দ্যাখানো যায়না। মগনলাল মেঘরাজ যেমন বিষকে ‘খারাব জিনিস’ মনে করতেন, আমরা স্তনকে অসভ্য জিনিস মনে করি। আমরা স্তনকে ভয় পাই। আমরা উন্মুক্ত যোনি বা খোলা লিঙ্গের দিকে তাকাতে চাইনা। এদিকে হন্যে হয়ে খুঁজি ‘ছত্রাক’ সিনেমার সেই ক্লিপিং যেখানে পাওলি দামের যোনি চাটছেন অনুব্রত, বা ‘গান্ডু’-তে যেখানে অনুব্রতর লিঙ্গ চুষছেন ঋ। দ্যাখার পরে ‘ইশ! এই মেইছেলেটার কি কোনো হিত্তিপিত্তি নেই গো!’ বলে সেটাকে মেশিন থেকে ডিলিট করে দিই, কিন্তু মনে রেখে দিই।
    সেক্স জিনিসটা সাহেবদের জন্য। অথবা আদিবাসীদের জন্য।
    আমরা নাগরিক বাঙালি।
    আমরা সভ্য। আমরা সম্ভ্রান্ত। আমরা শিশুর মতো সরল ও যৌনভাবে সৎ।
    এখনকার গল্প এবং উপন্যাস লেখা হচ্ছে টিন এজারদের জন্য, অর্থাৎ বাজারচলতি লেখকরা জেনে গেছেন, তাঁদের পাঠকদের মানসিক বয়স খুব অল্প, এবং তারা দার্জিলিং থেকে সুন্দরবন অবধি ছড়িয়ে থাকা ভাষাপৃথিবীটির বাংলা ও অ-বাংলা সম্পর্কে অজ্ঞ। আজকের সফল লেখকদের টার্গেট হল সেইসব পাঠক যারা দশ বছর বয়সে কাকাবাবু-সন্তু, ষোল বছর বয়সে তসলিমা নাসরিন পড়ে, এবং তারপর ‘পড়ার সময়’ তারা বেশ কিছুদিন পায়না, পরবর্তীকালে পূজাবার্ষিকী দেশ এমনকি আনন্দমেলা-র মাধ্যমে তারা পড়ার ইচ্ছায় ফিরে আসতে চায়। আমাদের ৯৯.৯৯ % শিক্ষিত বাঙালি লিটল ম্যাগাজিন কাকে বলে জানেই না। ওটাকে তারা পুজোর স্যুভেনিরের চেয়ে আলাদা কিছু ঠাহর করতে পারেনা।
    এরমধ্যে একজন নবারুণের ভাষা। সেই ভাষা, যার অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির স্বাভাবিকতা।
    বঙ্কিমের হাতে জন্ম নেওয়া এবং রবীন্দ্রনাথের হাতে পরিপক্কতা পাওয়া ব্রিটিশ বাংলাকে, তথা বাংলিশকে আক্রমণ করেছিলেন নবারুণ। তাঁর ভাষা এলিট নয়, অথচ অভিজাত। গ্রামবাংলার চন্ডীমন্ডপের আলোচনায় আড্ডায় বিচারসভায় যে স্বাভাবিক বাংলা কেউ-কেউ ব্যবহার করতেন, যা নির্দোষ অথচ লক্ষবেধী, সেটারই এক আশ্চর্য রূপ আমরা নবারুণের গদ্যে পাই। ‘তোর বিছনায় তোর বৌকে চুদে দিয়ে চলে গেল, আর তুই বোকাচোদা পাশে শুয়ে শুয়েও টের পেলিনি!’ অথবা ‘কচি তুই সরে শু, তোর মাসি এসছে।’ অথবা ‘পোঁদে নাই ইন্দি / ভজে রে গোবিন্দী!’ অথবা ‘গাই বেচে দে, দুধ কিনে খা।’ অথবা ‘পোঁদ মারো, ঘটি হারাও।’ অথবা ‘খাপে খাপ, পঞ্চুর বাপ।’... এরকম বাক্য আজও লোকায়ত বঙ্গভূমিতে কান পাতলেই শোনা যায়, বাপ রেগে গিয়ে ছেলেকে বলেন, ‘হতভাগা, তুই মানুষ, না ন্যাড়?!’ কিন্তু বাংলা উপন্যাস বা গল্প তাদের ব্যবহার করে না। একটি গান সবুজ ধানজমিতে ছড়িয়ে পড়তে শোনা যায়... ‘লে হুড়কা’ অথবা ‘আয় না খুকি চড় না আমার হিরো সাইকেলে/ রডে বসে বেড়াতে যাবি...’
    এই বাক্যগুলো ‘শ্রাবণমাসের সকালবেলায় মেঘ কাটিয়া গিয়ে কলিকাতার আকাশ নির্মল রৌদ্রে ভরিয়া গেছে।’ বা ‘অমিত রায় ব্যারিস্টার।’-এর চেয়ে অনেকবেশি জীবন ও মাটির গন্ধে ভরপুর, এটা যিনি অস্বীকার করবেন, তিনি বঙ্গজীবনের কেউ নন।
    বাংলা উপন্যাস নাকি তার সাহসের সর্বোচ্চ সীমা দেখায় সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’-তে। ‘প্রজাপতি’ বা ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’-তে আমি সাহস দেখতে পাইনা, শুধু অবক্ষয়ের প্রতি আর অস্বাভাবিকতার প্রতি শহুরে ও এলিট লেখকদের ক্লস্ট্রোফোবিক বিরক্তিই দেখতে পেয়েছি। কিন্তু যৌন শব্দাবলীকে অচ্ছুৎ রেখে শুধু সঙ্গমের বিবরণ বা নায়িকার শরীরের বর্ণনা বাংলা উপন্যাসকে অস্বাভাবিক করে রেখেছে। সে সমরেশ বসুর ভাষা হোক, বা তসলিমা নাসরিনের... শেষ অবধি আমরা এলিট ভাষাই পেয়েছি। টেকচাঁদ বা হুতোম ফসিল হয়ে রয়ে গেছেন আমাদের টেবিলে ও শেলফে।
    এ এক পরম সৌভাগ্য যে নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁর জেনেটিক কোড মহাশ্বেতার চেয়ে, বিজনের চেয়ে টেকচাঁদ-হুতোমের থেকেই পেয়েছেন। মেন্ডেলের সূত্রগুলো বেকার হয়ে গেছে।
    একজন অজিত রায়ের (‘যোজন ভাইরাস’) যে সীমাবদ্ধতা, সেটাকে অতিক্রম করেই নবারুণের যাত্রার শুরুটা হয়। একজন অজিত রায় ব্যক্তিগত বলয়ে রয়ে যান, কিন্তু নবারুণ ব্যক্তির বাহিরে নিজেকে উপস্থিত করেন। নবারুণের ভাষাকে সন্দেহ করা যায় না। অজিত রায়ের ভাষা সমষ্টি থেকে ব্যক্তির দিকে আসে। তিনি দ্রোহী। অজিত রায়ের ভাষার জোর তাই তাঁর বেপরোয়াপনা। বাহিরের লোক ভাবেন নিজেকে। আর একজন নবারুণের ভাষা ব্যক্তি থেকে সমষ্টির দিকে যায়। সে তিনি স্ল্যাং ব্যবহার করুন, আর না-ই করুন। নবারুণ একজন লোকসাহিত্যিক। তিনি বিপ্লবী। ভিতরের লোক বিবেচনা করেন নিজেকে। তাঁর ভাষার জোর তাঁর আন্তরিকতা।
    নবারুণ তাঁর ভাষাকে বন্দুক হিসেবে প্রয়োগ করেছিলেন। ১ অস্বস্তিকর বন্দুক। সেটা ফায়ার করতে হয়না, সেটা যে আছে এটাই যথেষ্ট।
    লিঙ্গের মতো। লিঙ্গের মতো নয়।
    সাহিত্য তিনি মনোরঞ্জনের জন্য করতে আসেননি। একেকটি শব্দকে একেকটি বুলেট হিসেবে রেখেছেন, সেটা ছুটে যায়নি, স্থির হয়ে থেকেছে, বারুদ সঞ্চয় করেছে।
    শুক্রাণুর মতো।
    শুক্রাণুর মতো নয়।
    শুধু এটাই দেখার, নবারুণের জেনেটিক কোড বাংলা গদ্যসাহিত্যে কোন ফুল ফোটায়, ক’টা fool-কে ফোটায়।
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১৭:৪০644883
  • http://www.aihik.in/aihik/Content/9/

    প্রতিবাদের পাঠক্রম
    সম্রাট সেনগুপ্ত

    আলোচনা হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম নিয়ে… আলোচনা চলছিল ইংরেজী সাহিত্যের সিলেবাস নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে। একের মত— অধ্যাপকের দায়িত্ব একটি বইয়ের কেতাবি ইতিহাস— তার সমালোচনার বিভিন্ন ঘরানা তুলে ধরা নব ছাত্রকুলের মাঝে যথাসম্ভব নিরাবেগ ভাষ্যে। অতঃপর কি হবে তার বাছাই— কোন পাঠ সে গ্রহণ অথবা বর্জন করবে, অথবা কি হবে তার নিজস্ব ভাষ্য তা ঠিক করবে সে নিজে। অন্য বন্ধুর মতে কোন পাঠই নয় নিরপেক্ষ, তাই মান্য পাঠের অন্তর্নিহিত রাজনীতির অনুসন্ধানই অধ্যাপকের উদ্দেশ্য। তার কাজ প্রান্তে থাকা স্বর— প্রান্তভাষ্যের মাধ্যমে একটি বইকে আলোকিত করা ও সেই সঙ্গে তুলে ধরা সেই কেতাবের পাঠক্রমে অবস্থানের রাজনৈতিক গুরুত্ব। তারই সাথে স্বভাবতই উচিৎ যা বাইরে আছে তৎকালীন মান্য পাঠক্রমের, তাকে ব্রাত্যায়নের পরিকল্পটাও বুঝিয়ে দেওয়া। সিলেবাসের এই মেকিং ও আনমেকিংই নির্মাণ করে অনুবাদের রাজনীতিকেও। গ্যেটে বা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বসাহিত্যের যে ধারনা তার মধ্যে আছে বিশ্বমানবের ও বিশ্বআত্মনের ঐক্য। ঐ ঐক্যই বিশ্বের নানা প্রান্তের ও দেশের সীমা অতিক্রম করে এক মানবতাবাদী অসীমের রচনা করে। এক মানবতাবাদী দর্শন দীর্ঘদিনই সাহিত্য পাঠের চালিকা শক্তি। তারই প্রভাব আমরা দেখেছি জাতীয়তাবাদী সাহিত্যপাঠ এবং তুলনামূলক সাহিত্যপাঠ উভয় ক্ষেত্রেই। হয় এক জাতীর (জার্মান অথবা ব্রিটিশ অথবা ভারতীয়) মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের বয়ান, নয়ত মানুষের সাধারণ মানবিক গুণ গুলো যাচাইয়ের তুলনামূলক মানদণ্ড— এই ছিল অনুবাদের উদ্দেশ্য। অনুবাদের মাধ্যমে নিজের দেশের সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব অথবা অনুবাদের মাধ্যমে অন্যদেশের অথবা অঞ্চলের সাথে নিজের দেশ ও অঞ্চলের তুলনামূলক বিচারই ছিল মূল।
    বিশ শতকের ছয়ের দশক থেকেই এই মানবতার ধারনায় ব্যাপক ভাবে ছেদ পড়ে। সংস্কৃতি ও মানবতা যে দেশ-কাল সাপেক্ষে নির্মাণ এবং যে কোন নির্মাণেই যে থেকে যায় উপেক্ষা ও বিস্মৃতি তা আলোচিত হতে থাকে তামাম বুদ্ধিজীবী সমাজে। তার একটা কারণ অবশ্যই মানবতাবাদের শেষ পরাকাষ্ঠা মার্ক্সীয় চিন্তার দ্বারা উদ্ভূত আদর্শবাদের চোখের সামনে স্বৈরাচারী শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়া অথবা জনসমর্থন হারানো। এর ফলে খোলে নিপীড়নের নানা মুখ— তার নানা ইতিহাস। কেবল শ্রেণী নয়, তার সাথে যুক্ত হয় লিঙ্গ, বর্ণ, জাতি, ধর্ম, যৌনতা ও ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক ভেদ ষড়যন্ত্রের পাঠ। সাহিত্য এবং তার পাঠের রাজনীতি সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে— বিশেষত যখন এবং যেহেতু সাহিত্যের কোন সরাসরি বাস্তবতার দাবী নেই, বরং তার আছে বাস্তবের সমগ্রতার প্রতিরূপ হয়ে ওঠার ক্ষমতা। তাই তো সাহিত্যের মতো করে এবং সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে পুনঃপাঠ করা যেতে পারে বাস্তবতার দাবী যুক্ত ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের মান্য সনদগুলিকে। সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে বোঝা যেতে পারে কারা অবহেলিত— বঞ্চিত ও ইতিহাসের পাতায় অদৃশ্য অথবা কদর্যভাবে পরিবেশিত। সেই মতো পাঠ করা যেতে পারে ইতিহাস। এই চিন্তার ছায়া স্বভাবতই সাহিত্যের মান্য পাঠক্রমকে চ্যালেঞ্জ জানায়।

    ইংরেজীতে পাঠক্রম বোঝাতে অনেক সময় canon শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এই শব্দের মূল অর্থ ধর্মীয় নীতিশিক্ষামালা যা এক সাধক গোষ্ঠীর অবশ্যপাঠ্য। এর মাধ্যমে এক মতবাদ নির্মিত হয়। তাই পাঠক্রম সর্বদা গভীর ভাবে রাজনৈতিক। তার ছায়া অবশ্যই বিদ্যায়তনিক সাহিত্যপাঠেও বর্তমান এবং ছয়ের দশকের রাজনৈতিক চিন্তার প্রশ্নবাণ সেই রাজনীতিকে পুনর্নির্মিত হতে সাহায্য করে— সিলেবাসে ঢুকে পড়ে কালো মানুষের সাহিত্য, নারীবাদী সাহিত্য, ভারতীয় সাহিত্য, সাম্প্রতিককালের দলিত সাহিত্য ইত্যাদি। ইংরেজী সাহিত্যের প্রেক্ষিতে দুঃখ করেন অধ্যাপক হ্যারল্ড ব্লুম ব্রিটিশ ক্যাননের ঐতিহ্যময় যুগাবসানে। তার মতে কি যে পড়বো বুঝে ওঠা দায় এই রিষ আক্রান্ত (ইংরেজীতে জার্মান শব্দ ধার করে বলেন “ressentiment”) রাজনৈতিক বাতাবরণে। এখানে জার্মান দার্শনিক নীৎশে বর্ণিত ressentiment শব্দটির অর্থ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লেখেন “The slave revolt in morality begins when ressentiment itself becomes creative and gives birth to values... while every noble morality develops from a triumphant affirmation of itself, slave morality from the outsets says No to what is “outside”, what is “different”, what is “not itself” and this No is its creative deed”। এই না বলবার— প্রতিবাদের, প্রতিরোধের রাজনীতিই নির্মাণ করে নবারুণের অনুবাদ শিল্পকে। তার সাথে চলতে থাকে ডায়ালগ— প্রতিরোধ ব্যর্থ হওয়ার যন্ত্রণা, বিপ্লবের মধ্যে প্রতিবিপ্লবের প্রেত ছায়া এবং তদজনিত হতাশা, উদ্বেগ, আবেগ ও প্রতিরোধের পুনর্বিচার, হেরে গিয়েও, ব্যর্থ হয়েও প্রতিরোধী মুহূর্তগুলির সসম্মান ইত্যাদি। তাই নবারুণের প্রতিরোধ সরলরৈখিক হিউম্যানিস্ট নয়। বরং তার সাহিত্যকর্মের মতো অনুবাদেও রয়েছে ভাববাদী, মানবতাবাদী, লিবারাল, এমনকি মার্ক্সীয় সব-খোল চাবির গভীর সমালোচনা। তবুও রয়েছে সেই বয়ানে এক আশ্চর্য সরল বিশ্বাস— ভবিষ্যতের প্রতি। প্রতিবাদের মধ্যেই আসবে বদল এই প্রত্যয় থেকে যায় চূড়ান্ত গ্লানির মধ্যেও। এই দায়বদ্ধতাই করিয়ে নিয়েছে নবারুণ ভট্টাচার্যকে দিয়ে এই বিক্ষিপ্ত অনুবাদগুলি যার মধ্যে আপাতত নেই কোন দেশ ও কালের সমান্তরালতা। শিক্ষকের মতো অনুবাদকের কি দায়িত্ব কোন ভাষা, দেশ অথবা সময়ের “প্রধান” কাজগুলিকে পরিচিত করা, নাকি তার দায়িত্ব সাহিত্যের মান্য পাঠক্রমের বাইরে থাকা, সমাজের মূলস্রোতে উপেক্ষিত প্রান্তস্বরকে অনুবাদ করা— এক প্রতিবাদী সাহিত্যের বিকল্প বয়ান নির্মাণ? নবারুণের অনুবাদ কর্মের মূল— সামাজিক দায়িত্বের নির্ধারণ থেকে প্রান্তবাসীর প্রতি অন্তহীন দায়বদ্ধতার পথে এই যাত্রা। তাঁর নিজের সাহিত্যকর্মও আসলে এই ভাবধারারই অনুবাদ যার বিষয় নবারুণ কর্তৃক অনুদিত ব্রেশটের নাটকের শিরোনাম ধার করে বলা চলে— “যে না বলে”। এই না বলার রাজনীতি আত্মসুরক্ষাবাদী— ভাল থাকার নামে, সুরক্ষার নামে মগ্ন মানবতাবাদী দর্শনকে আক্রমণ করে। ওপরে Genealogy of Morals গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত নীৎশের জবানীতে বলা চলে “this No is its creative deed”।
    অনুবাদ সম্পর্কিত প্রবন্ধ “Translation as Culture”-এ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক সংস্কৃতিকে এক ক্রমাগত অনুবাদ প্রক্রিয়া মনে করেন। অনুবাদ সেখানে হরেক কিসিমের চিন্তা ও ভাবধারাকে নিজের মাতৃভাষায় অন্তর্ভুক্ত করা। এর মাধ্যমেই নির্মিত হয় সংস্কৃতি। মাতৃভাষা এক ঋণ এবং সেই ঋণ শোধের উপায় এই অনন্ত অনুবাদ কর্ম। এখন কথা হল আমরা কি মাতৃভাষা ও তার দানকে মাপবো এক জাতীয়তাবাদী প্রকল্পে? আমরা কি তবে তাকে মাপবো মানবতাবাদী প্রকল্পে? প্রথম ক্ষেত্রে অনুবাদের আদর্শ হয়ত হবে সাহিত্য আকাডেমির অনুবাদ প্রকল্পের মতো যেখানে প্রধান ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে অনুবাদের মাধ্যমে এক ভারতীয় সংস্কৃতির মানচিত্র তৈরি হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অনুবাদ প্রকল্প ধাবিত হয় এক মানবতাবাদী তুলনামূলকতায় যেখানে দেশ-কাল নির্বিশেষে যোগাযোগ স্থাপন হয়ে ওঠে মুখ্য। নবারুণ ভট্টাচার্যের অনুবাদ সংকলন বিদেশি ফুলে রক্তের ছিটে এর মধ্যে কোন ধারণারই বশবর্তী নয়। কি তবে নবারুণের মাতৃভাষা? কোন সাধারণ ভাষায় অনুদিত হতে থাকেন নবারুণ? যে কবি লেখেন “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না”, কি তার ভাষা, দেশ, সময়কাল? মার্ক্সীয় ঘরানায় দীক্ষিত, দলিত, অন্ত্যজ, উপজাতীয় মানুষের জীবন লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী ও প্রতিরোধের, নবান্নের নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের পুত্র নবারুণের ঋণ কার কাছে? কাদের কাছে? সমস্ত অনুবাদই এক সদা অসম্ভব সদা অসম্পূর্ণ প্রক্রিয়া। কখনোই পরিশুদ্ধ হয় না ঋণ। যে সময়কাল ও সংস্কৃতির কাছে তিনি ঋণী তা পরিশুদ্ধ হয়ে গেলে তো স্তব্ধ হয়ে যায় সব কথা। কিন্তু সেই হেতুই অতীতের সাথে, অপরের কাছে অপরিসীম ঋণ শোধ করতে নবারুণ চালান ডায়ালগ। সেই ডায়ালগে নিয়ে আসেন নানা দেশের ও সময়ের সাহিত্য, যুক্ত করেন বর্তমানের সাথে— যুক্ত করেন বিশ-একুশ শতকের ষাট-সত্তরের দশক ও তার পরবর্তী সময়ের প্রতিবাদী বঙ্গীয় ও ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যের সাথে। এভাবেই জাতীয়তাবাদী ও মানবতাবাদী ঐক্যের বিপরীতে তিনি খাড়া করেন এক বিকল্প ঐক্যকে— নির্মাণ করেন এক প্রতিবাদের পাঠক্রম। আগামী পাঠক আশা করি সেই ঐক্যকে খুঁজতে আবিষ্কার করবেন সেইসব লেখকদের অন্য কবিতা— মেলাবেন নবারুণের নিজের কবিতার সাথে আর অতঃপর নিজের লেখায় যুক্ত করবেন সেই ভাবধারা— হয়ে উঠবেন প্রতিরোধের প্রতিস্পর্ধী অনুবাদক।
    নবারুণের কাব্যাদর্শ নীৎশীয় কায়দায় মানবতাবাদী দর্শনে নিয়ত হাতুড়ি চালনা। ভাববাদী ও সংশোধনবাদী চেতনার বুঝিয়ে কাজ হাসিল করে নেওয়ার বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মেকি ছলনাময় ছকের বিরুদ্ধে নবারুণী এই বিকল্প রণনীতি স্পষ্ট তাঁর কাব্যগ্রন্থ সমূহের নামেই— এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না, পুলিস করে মানুষ শিকার, বুলেটপ্রুফ কবিতা ইত্যাদিতে, এমনকি অনুবাদ গ্রন্থটির নামকরণেও— বিদেশি ফুলে রক্তের ছিটে। এই বই একগুচ্ছ কবিতা, কিছু ক্ষীণতনু প্রবন্ধ ও দুটি ছোট নাটকের সংকলন। নবারুণ লেখেন “লেখাগুলি বাছাই করার মধ্যে আমার রাজনৈতিক অবস্থান আশা করি পাঠকদের চোখ এড়াবে না”। প্রথম কবিতা থেকেই তা স্পষ্ট—
    দিনের পর দিন
    আর বছরের পর বছর
    বিগ্রহেরা ভূলুণ্ঠিত হয়
    এবং বিগ্রহেরা মাথা তোলে
    আজ
    আমি উপাসনা করি
    হাতুড়ি
    (“হাতুড়ি”)
    মার্কিন কবি কার্ল স্যান্ডবার্গের কবিতা নিশ্চয়ই মনে করাবে নীৎশের হাতুড়ির দর্শন— “হাতুড়ি যখন কথা বলে” (ঈশ্বরের আলো-আঁধারি) যেখানে লেখেন তিনি— “This new law table do I put over you, O my brothers: Become hard!” এই নব কাব্যাদর্শ আর আইনই নবারুণকেও প্রাণিত করে— শানিত করে। কারো মনে পড়তে পারে নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখা নকশাল আন্দোলন নিয়ে প্রবন্ধ “পেট্রল দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা”:
    ধুলোর ঝড়ের মধ্যে
    চোখ বন্ধ করে
    আমি হাঁটতে শিখিনি

    একদিন পেট্রল দিয়ে—
    সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব
    সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব
    পেট্রল দিয়ে—

    নবারুণের উদ্দেশ্য অবশ্য কেবল রোম্যান্টিক বিপ্লবী চেতনার আলোয় পৃথিবীকে দেখার নয়। তাঁর কবিতার মতো অনুবাদের বাছাইয়েও মিশে থাকে এক নীরব দুঃখ যা এক জায়মান সংঘর্ষের বিলীয়মান বিস্মৃতপ্রায় দাগছাপ হয়ে কেবলই অস্বস্তিতে ফেলে পণ্যলোভী, আত্মসুখী ও সুরক্ষিত মধ্যবিত্তকে। উক্ত প্রবন্ধে তিনি লেখেন— “এই প্রামাণ্য ইতিহাসের দরকার আজ বড় বেশি। বিশেষ করে সর্বগ্রাসী ভোগবাদের মধ্যে যে প্রজন্ম বড় হচ্ছে… বলার চেষ্টা হচ্ছে মতাদর্শের যুগ শেষ, রাজনৈতিক গণতন্ত্রের যুগ শেষ— এখন চলবে কর্পোরেট ডেমোক্রেসির খেলা”। নবারুণের এই নীরব দুঃখের সাক্ষ্য যেন সোভিয়েত রাশিয়ার কবি লেভ ওজেরেভের নৌকার দাঁড় নিয়ে লেখা কবিতাটি:
    সমুদ্রপাড়ের বালিতে একটা নৌকোর দাঁড় পড়ে আছে
    সে আমাকে ব্যাপ্তি আর গতি সম্বন্ধে অনেক বেশি বলে
    (“একটা নৌকোর দাঁড় পড়ে আছে”)
    এই নীরব দাঁড় কতো না লড়াইয়ের স্মৃতি বহন করে। জিন্দেগীর অকূল পাথারে সংগ্রামের ভুলে যাওয়া বিপ্লবী এই দাঁড়। তার নীরবতার মধ্যে শোনা যায় বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ— যে অভিধায় একদিন বর্ণিত হয়েছিল নকশালবাড়ির প্রথম লড়াই পিকিং রেডিওতে। এই দাঁড়ের মতোই সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের ভিড়ে ভুলে যাওয়া লেনিনের তোবড়ানো বাসন, যাকে নিয়ে নবারুণের নিজের কবিতা—
    একজন রাজনীতিককে আমি দেখিনি
    অথচ দেখেছিলাম
    তাঁর রান্নাঘরে রাখা আছে সাদামাটা তোবড়ানো বাসন
    তিনি লেনিন।
    (“তোবড়ানো বাসন”)
    নবারুণের কবিতা এই ভুলে যাওয়া আদর্শের কঙ্কাল যা আমাদের নিওলিবারাল ভোগবাদী জীবনে প্রেত কঙ্কাল হয়ে জেগে থাকে। বস্তুকে কবিতায় রূপান্তর এক উত্তর-মানবতাবাদী চিন্তার লক্ষণ যা আদর্শের মূল সুরটিকে ধরে রেখেও তার পতন ও ক্ষয়ের যন্ত্রণাঋদ্ধ ইতিহাসকে খোঁজে। প্রাচীন জাপানি কবি কোবাইয়াশি ইসসার হাইকুতে ধরা থাকে সেই ক্ষণিকের বসন্ত-আগমনে জাগ্রত বোধি যা আশাবাদের ঝলক হয়ে জ্বলে ওঠে সময়ের কোন কোন মুহূর্তে—
    এখন শুরু হচ্ছে
    ভবিষ্যৎ বুদ্ধের রাজত্ব…
    বসন্তের পাইন গাছ
    (“এখন শুরু হচ্ছে”)

    এভাবেই বিদ্রোহের প্রাচীন ও নবীন গতায়াতের চেতনায় ধরা থাকে ভবিষ্যতের বসন্ত। মানুষই বলবে শেষ কথা— তার চেতনা ইভান দ্রাকের “বালতির গান” কাব্যের বালতির মতো। সে বালতিতে কি থাকবে তা মানুষের ওপরই নির্ভর করে আর যার মধ্যে মানুষের অনুপস্থিতি নিয়ে আসে অনন্ত আকাশ— শূন্যতা। এই শূন্যতা উত্তর-মানবতাবাদী প্রতিবাদ-শিল্পী নবারুণ ভট্টাচার্যের সাহিত্য-কর্ম জুড়ে। তার মধ্যে আছে বিষণ্ণতা কিন্তু তা শেষ কথা নয়। বিপ্লবের কথা বলতে গেলেই তৈরি হয় পেট্রল দিয়ে আগুন নেভানোর irony। এখানে দুই ধরনের আগুনের কথা বলা চলে। এক প্রকার আগুন যা ভোগবাদের, শাসক ও শোষকের অন্তহীন লোভ ও সর্বগ্রাসী আগ্রাসন, পিছিয়ে পড়া প্রান্তিকদের ওপর, যা ক্রমশঃ প্লাবিত করে বিশ-একুশ শতকের সুখী মধ্যবিত্তকে। অপরদিকে আরেক আগুন হল বিস্ফোরণের— পেট্রল ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টায়। সেই চেষ্টায় এক নীরব ব্যথার উপস্থিতি নবারুণ স্বীকার করেন। কিন্তু এই বিস্ফোরণ অবশ্যম্ভাবী। অগ্নির বৃহৎ ক্ষুধায় খাণ্ডবদাহন কে আটকায়? তাঁর হারবার্ট উপন্যাসে আমরা দেখেছি এমনি অচেতন, স্বতঃস্ফূর্ত, আকস্মিক বিস্ফোরণ যার বীজ বপ্ত হয় সত্তরের বিদ্রোহ উত্তাল কলকাতায়। নবারুণ সেই বিস্ফোরণের কথা বলেন চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মির “তিনটি এটম বোমা” কবিতার অনুবাদে যেখানে বিস্ফোরণ ভাঙে “হাজার বছরের কুসংস্কারের শেকলকে”। তবুও ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো বিদায় জানায় ১৯৯১-এর ১৯ আগস্ট রাশিয়াতে ব্যর্থ ক্যু বিপ্লবের রক্তপতাকাকে—
    কতিপয় খচ্চর তোমাকে বিদেশি মুদ্রায়
    বেচে দিচ্ছে— ডলার, ফ্র্যাঙ্ক, ইয়েন
    …কিন্তু লালপতাকা আমি তোমাকে জড়িয়ে আদর করছি
    আর দেখো আমার চোখে কত কান্না।
    (“বিদায় আমাদের রক্তপতাকা”)
    সেই কান্নার আগুন বারে বারে ফিরে আসে বিস্ফোরণ হয়ে। সেই বিস্ফোরণ বিপ্লবের— প্রতিরোধের সব ছিদ্র বন্ধ করে দেওয়া বিশ্ব-গৃহে মুক্তির অগ্নিসংযোগ যা আকস্মিক। মুক্ত বাজারের পৃথিবীর প্রতিটি কোন ম্যানেজমেন্টের খেলায়, বিকল্প রণকৌশল এই দহন, আপাত নিরীহের হঠাৎ জ্বলে ওঠা। “যারা আগুন লাগায়” ম্যাক্স ফিশের নাটক। অনুবাদের শেষে নবারুণ লেখেন— “ওকলাহোমার বিস্ফোরণ বা টোকিও-র পাতাল রেলে মারণ-গ্যাস দেখে আমি বিস্মিত হই না। অমানবিক, অনান্তরিক, ভোগবাদী এক বিকৃত ব্যবস্থা ওই জাতীয় বিকৃত প্রতিশোধের জন্ম দিতে বাধ্য। আগুন লাগছে। লাগবে। এটাই সত্যি খবর”। বিশ্বনিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষাবাদী প্রকল্পের বড়দারা বিডেরম্যানের মতোই বিশ্বাস করে ভালো খাইয়ে পড়িয়ে খুশ করলেই দূরীভূত হবে অগ্নিসংযোগের সম্ভাবনা— নিজের অজান্তেই তুলে দেন দেশলাই অগ্নিসংযোগের কাণ্ডারিদের হাতে। সে বৃথাই বোঝাতে চায়— “আরে বাবা, ধনীই হই আর গরিবই হই, আমরা কি একই ঈশ্বরের সন্তান নই? তবে এটাও ঠিক যে সবাই সমান নয়। ঈশ্বরের কৃপায় সক্ষম ও অক্ষম থাকবেই। তা বলে হাত মেলাতে পারব না? দরকার একটু আদর্শবাদ… একটু… একটু”। এই স্ট্র্যাটেজির বিরুদ্ধে চোখের সামনেই খেলার ছলে স্মিটস ও আইজেনরিংরা জমাতে থাকে পেট্রলের জ্যারিকেন— চেয়ে নেয় দেশলাই শ্রেণী শত্রুর থেকে। এই বিস্ফোরণের সম্ভাবনা লেগে থাকে নবারুণের লেখার গায়ে গায়ে— তাঁর “বেবি কে” সিরিজের গল্পগুলিতে দাহ্য হয়ে ওঠে বিশ্বায়নের ভোগ্যপণ্য মানব শরীর— পেট্রল খাকি বেবি কে অথবা বেবি খানকির দেহ আমেরিকান সোলজারদের সিগারে হয়ে ওঠে মানববোমা— জায়েন্ট মলোটভ ককটেল। বেবি কে পারিজাত বইয়ের ভূমিকায় লেখেন— “সবকিছুই পুড়ছে। যদিও আগুন দেখা যাচ্ছে না। তবে একসময় তা দৃশ্যমান হবেই”। মানবতাবাদের ছদ্ম ভালোমানুষিকে ভেদ করে এই অগ্নি-দর্শন। দেরিদার “অফ স্পিরিট” গ্রন্থের প্রচ্ছদ কারো মনে পড়তে পারে— অফ স্পিরিট নামের চারিধারে প্রজ্বলিত বহ্নি শিখা। হাইডেগারের কাব্যচিন্তার ব্যাখ্যায় তিনি দেখান কিভাবে স্পিরিট অথবা বিশ্ব-আত্মনের মধ্যে সবসময়ে থাকে জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা। এই জ্বলনে স্পিরিট নিজেকে নবনির্মিত করে— মুক্ত করে নিজেরই থাকবন্দী থেকে নিজেকে।
    উত্তর ৯/১১ বিশ্বের দার্শনিক চিন্তায় এইসব কথা— কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট তথা নিয়ন্ত্রণের রাজনীতির বিকৃতি অন্বেষণে গুরুত্বপূর্ণ। যে দুই আগুনের কথা বলা হয়েছে তা বারে বারে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। মানুষের অন্তহীন ভালো থাকার ইচ্ছার আগুন যা একবগ্গা হিংস্র এবং ক্ষমতার প্রান্তে থাকা সর্বহারাদের প্রতি উদাসীন, তার প্রতিরোধে জ্বলে ওঠে প্রতিরোধের আচমকা পেট্রল। নবারুণ এই উত্তর-মানবতাবাদী প্রতিরোধের অনুবাদক যেমন তার ভিনদেশীয় সাহিত্যের ভাষান্তরে, তেমনি নিজের লেখালেখিতে— “৯/১১”, “পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট”, “টেররিস্ট” ইত্যাদি গল্পগুলি সেই সাক্ষ্য বহন করে। ৯/১১-র মৃতদের স্মৃতির প্রতি শোকবার্তা ক্রমশঃ প্রলম্বিত ও বিলম্বিত হতে থাকে ইমানুয়েল অর্তিজের কবিতা “কবিতাটা শুরু করার আগে এক মুহূর্তের নীরবতা”-র অনুবাদে যেখানে প্যালেস্টাইন থেকে শুরু করে আফ্রিকা, হিরোসিমা, ভিয়েতনাম, নিকারাগুয়া, এল সালভাদর অবধি ছড়িয়ে পড়ে অপঘাত মৃত্যুর শোক—
    এই কবিতাটা আমি শুরু করার আগে
    তুমি এক মুহূর্তের নীরবতা চেয়েছিলে
    তুমি বিলাপ করছ যে পৃথিবীটা আর আগের মতো হবে না
    এবং আমরা আশা করছি কখনোই তা হবে না।
    চিরকাল যেমন ছিল।
    (“কবিতাটা শুরু করার আগে এক মুহূর্তের নীরবতা”)

    এই শোকবার্তার আগুন স্থির থাকতে দেয় না নবারুণের গদ্য-পদ্যকে। শেল্ডন পোলক তাঁর সম্পাদিত “Literary Cultures in History” বইয়ের ভূমিকায় সাহিত্য আকাডেমির অনুবাদ প্রকল্পের সমালোচনা করে বলেন, কেবল আগে থাকতে চিন্তিত এক ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় সংস্কৃতির ধারণাই ওই অনুবাদ প্রকল্পের মূলে। এই ধারণা সাহিত্যের কোন সংজ্ঞা দেয় না। যে কোন ভারতীয় রচনার কল্পিত ভারতীয়ত্বই সেখানে মাপকাঠি, যদিও আঞ্চলিক সাহিত্যগুলি প্রায়শই সেই ঐক্যের ধারণা সম্পর্কে সচেতন হয়ে রচিত হয়নি। অর্থাৎ সাহিত্যের অনুবাদ প্রকল্প থেকে পাওয়া যেতে পারে সাহিত্যের কোন সাধারণ সংজ্ঞা এই আশা আমরা করতেই পারি। অথবা এমনও হতে পারে যে অনুবাদের মধ্য দিয়েই তৈরি হল সাহিত্যের এক রাজনৈতিক অর্থ। অধ্যাপক টেরি ঈগলটন তাঁর “Literary Theory— An Introduction” বইয়ে দেখিয়েছেন মূল্যায়নের মধ্যেই থেকে যায় কাকে বলব সাহিত্য তার রাজনীতি। এভাবেই বদলায় পাঠক্রম। নবারুণের অনুবাদেও নির্মিত হয় এক ভিন্ন বিশ্বসাহিত্যের ধারনা— এক ভিন্ন সাহিত্যের ধারণা ও বিশ্বের ধারণা। যেমন ৯/১১-এ মৃতদের প্রতি শোকজ্ঞাপন হয়ে ওঠে এক নবতর, ভিন্নতর বিশ্ববিষাদ— এক শোকবাহী বিশ্বচেতনা, তেমনি তাঁর লেখা এক কবিতায় (“একটি পারিবারিক কবিতা”, অগ্রন্থিত কবিতা) তিনি নিজের পরিবারের কথা বলতে গিয়ে ছিটকে যান স্বৈরাচারী আক্রমণে খুন হয়ে যাওয়া নানা দেশ ও রাষ্ট্রের অসহায় পরিবারের অবর্ণনায়। বিস্ফোরণের মতো এইসব মৃত্যুও গ্লোবাল পিস প্রোগ্রামের কাণ্ডারিদের কাছে এক দুঃসহ অবর্ণনা। এই উপস্থাপনের অসম্ভাবনার মধ্যে দিয়েই অনুদিত হয় নবারুণ ভট্টাচার্যের সাহিত্যের ধারণা— জারিত হয় এক ভিন্ন ঐক্য— “বাতাসে বাতাসে রয়েছে আমাদেরই শেষ নিঃশ্বাস”। এই ঐক্যের নাম দেওয়া যেতে পারে অপরাবাস্তব— অথবা অপরের বাস্তব— খুন হয়ে যাওয়া, বিস্ফোরণে জ্বলে ওঠা মানুষের বাস্তব যাকে ইংরেজীতে আমরা বলব— the aesthetics of the othereal— the reality of the other। এই বাস্তব পরাবাস্তবের মতোই সম্ভাবনার মধ্যে এক লুকানো সম্ভাবনা, কিন্তু তাকে আমরা কখনই করতে পারি না সম্পূর্ণ অনুবাদ। অনুবাদ নিয়ে এই লেখা অসমাপ্তই থেকে যাবে— থেকে যাবে প্রতিবন্ধী। অনুবাদের এই অপচেষ্টার শেষ তবে হোক আমার নিজের করা নবারুণের এক কবিতার কয়েক লাইন ইংরেজীতে—
    Touching with fingers
    I felt all— face, nose, throat
    Holding railings I realized it is jail
    Cold weight of manacles around neck
    Wind and rain came searching for me
    Felt philosophy is brail
    (“Disabled Three”)
    জেলের প্রায়ান্ধকার প্রকোষ্ঠে ছুঁড়ে দেওয়া সংগ্রামীর অভিজ্ঞতা গরাদ ছুঁয়ে দেখা— অনুভব করা বন্দি দশা। Felt philosophy— অর্থাৎ জীবন দিয়ে অনুভব করা দর্শন। নবারুণের মূল পাঠ ছিল— “অনুভব শিক্ষা হল ব্রেল”। ব্রেল— অন্ধের পাঠপ্রক্রিয়া— এই তো অপরের বাস্তব পাঠের— তাকে অনুবাদের দর্শন। অনুবাদের অছিলায় তাকে felt philosophy নামক মানবতাবাদী চিন্তনের পুনঃপাঠ-অনুবাদ করে তুললাম। অনুভবই তো এখানে অসম্ভব— তা অন্ধকার জেলে বন্দীর হাত দিয়ে অনুভব করা বন্দী দশা— অন্ধের অক্ষর পাঠ। কিন্তু এই আত্মদর্শনের মাধ্যমে সোচ্চারিত— প্রতিবন্ধী নয় এ অন্ধ! সে যে পাঠ করতে পারে তার বন্দী দশা! অনুবাদ এভাবেই এগোয়।

    ===========================================

    বিপ্লব, প্রতিরোধ, বিচিত্র – নবারুণ ভট্টাচার্যের আন্তর্পাঠ
    দিব্যকুসুম রায়
    ‘ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি ’ শব্দটির কোনও সঠিক প্রতিশব্দ জানা না থাকায়, ‘আন্তর্পাঠ’ শব্দটি ব্যবহার করতে হল। এ কথা আমি নিজের বিভিন্ন লেখায় একাধিকবার বলেছি যে বিশেষতঃ মৃত্যুর পর নবারুণ ভট্টাচার্য একজন ‘কাল্ট’- একধরণের সাবকালচারাল প্রতিভূ, যার মতাদর্শ এবং তৎসঞ্জাত বাণী কিছু সমমনস্ক, সমধর্মী, স্রোতের বিপরীতে হাঁটা মানুষকে প্রেরণা জাগায়। দুই গোলার্ধের পাঁচ-দশকীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে এমত কাল্টের সংখ্যা কম নয়, এবং তা নিয়ে আলোচনা আমার উদ্দেশ্যও নয়। নবারুণের আন্তর্পাঠ সম্পর্কে এ কথা মনে হবার কারণ— এই কাল্টিজম লেখকের ক্ষতিই করেছে; বৌদ্ধিক-পাঠের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশী। ঐহিকের পক্ষ থেকে আমায় যখন লিখতে বলা হয়, সাগ্রহ সম্মতির সঙ্গে কিছুটা সংশয় আমায় পীড়িত করে। আন্তর্পাঠ, আমার মতে, কৈতববাদের সমতুল্য না; আর নবারুণের নব্য পাঠকগোষ্ঠী, ব্যতিক্রম বাদ দিলে, এক বিশেষ পাঠ ও তার প্রকরণ নিয়ে কিছু বেশী উৎসাহী। অনস্বীকার্য, লেখকের সমগ্র আখ্যানবিশ্বের গ্রহণযোগ্যতার ভেদ থাকবেই; সমগ্র লেখা খুঁটিয়ে পড়ে তবেই কেউ সামগ্রিক মতামত দেবে— এরকম দাবী নবারুণদা নিজেও পাঠকের কাছে করতেননা সম্ভবত। অন্যদিকে আবার zeitgeist কথা কয়ে ওঠে— আমরা নবারুণকে ক্রমাগতঃ ঠেলে নিয়ে যেতে থাকি একধরণের বিপ্রতীপ অবস্থানের দিকেঃ ফ্যাতাড়ু, চোক্তার ভদি, কাটামুন্ডুর নাচ, নুনুকামান প্রভৃতি শব্দবন্ধ ওঁকে আমাদের— উন্নয়নমুখী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর— প্রতিবাদবিলাসের হাতিয়ার করে তোলে; আমরা যতই একাত্ম হই ‘কাঙাল মালসাট’-এ, ততই আসলে দূরে সরে যান লেখক নিজে। এ পর্যায়ে, একটু সাহস করে বলা যাক, নবারুণ যথার্থ সিরিয়াস সাহিত্যালোচনা থেকে সর্বার্থে অদৃশ্য।
    নবারুণ মানেই ফ্যাতাড়ু না, নবারুণ মানেই সাবকালচারাল বুলি আউড়ে নিজেদের শ্রেণীসচেতন দুঃখবিলাসে ইন্ধন জোগানো না। এই ‘না’-টুকু নবারুণদা অন্ততঃ দুহাজার সন পর্যন্ত অতি-জোরালো ভাবে পরিবেশন করেছেন নিজের গদ্যসাহিত্যে, আকাদেমীয় রহস্যবাদের কুয়াশায় মুড়ে যাওয়ার আগে। ওনার লেখার সাম্প্রতিক আলোচনায় ‘বিস্ফোরক’ শব্দটি প্রায়ই ব্যবহৃত হয়, সে অকারণে নয়, যদিও কিছুটা সত্যদর্শীতার অভাব রয়েছে। বাস্তবিকই নবারুণদা অস্বীকার করেছেন প্রচুর- আঘাত, ধ্বংস, নিষ্ঠুর আত্মন্মোচন, কাচের বাসন সপাটে আছড়ে চুরমার করে ফেলার স্পর্ধা- সম্মোহক যতটা, বিপজ্জনক তার চেয়ে ঢের বেশী। যেহেতু নবারুণের আখ্যানবিশ্বের আন্তর্পাঠ আজকের উপজীব্য, তাই প্রথমেই আমরা নিজেকে যথাসম্ভব আলাদা করে নিই ওঁর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপ্তি থেকে- এ লেখায় ফ্যাতাড়ুর প্রসঙ্গ এলেও নবারুণ ভট্টাচার্যকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী শহুরে ভাট হিসেবে দেখা হবে না। বরং ওনার লেখা যে সর্বার্থেই প্রতিরোধী, এমনকি নিজেকেও সে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে সক্ষম, তা নিয়ে সামান্য আলোচনার চেষ্টা করা হবে। আলোচনার সুবিধার জন্য গোটা আর্গুমেন্টটিকে কমবেশি প্রকাশকাল অনুযায়ী, তিনভাগে ভাগ করা গেল। যার মধ্যে প্রথম ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশক, যখন লেখক বিপ্লববাদী প্রতিরোধের বিশ্বাসে স্থির। দ্বিতীয় পাঠ আমাদের নিয়ে যায় নব্বইয়ের দশকের উপান্তে, যখন বিপ্লবী জাড্য কিছুটা ম্রিয়মাণ, এবং প্রতিরোধের মার্জিনেও কিছুটা ছায়া ফেলে রেখেছে সোভিয়েতোত্তর বিষণ্ণতা। এ পর্যায়ে নবারুণ কিছু সংশয়বাদী – দুর্বল নন, কিন্তু ক্লান্ত; প্রতিরোধ ভুলে যাচ্ছেন না, কিন্তু অস্তিত্ববাদের সংকটগ্রস্থ। তৃতীয় পর্যায় আমাদের চেনা পরিবৃত্ত— প্রতিরোধ এবার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠানবিরোধী, দ্বিতীয় পাঠের সংশয়কে আত্মস্থ করে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শিখেছে সে। নবারুণ এবার জানেন যে নবযুগ হয়ত আসবে না, কিন্তু তার জন্য ঘটমান প্রবাহকে মেনে নেবার কোনও যুক্তি নেই। প্রতিরোধ চলবে— “ড্যামেজ করো... ড্যামেজ”— এবং অন্তিমে পড়ে থাকবে অস্বীকার। আবারও মনে করিয়ে দেওয়া যাক, তিন পর্যায়েই নবারুণের উপজীব্য— “না”। এই নেতিটুকুর সঙ্গে জড়িত আশা, হতাশা এবং এই দুইয়ের অনুপস্থিতি— সেই হল আমাদের আলোচনার ভরকেন্দ্র।
    প্রথমেই আমাদের বুঝে নিতে হবে যে নবারুণের কালক্রমিক আন্তর্পাঠ কঠিন শুধু না, ক্ষেত্রবিশেষে বিপজ্জনক। সাধারণভাবে ‘কালক্রমিক আন্তর্পাঠ’ বলতে আমরা বুঝি লেখকের আখ্যানবিশ্বের মূল যোজক বা connecting argument এর বিশ্লেষণ। এর সারার্থ এই নয় যে লেখক সারাজীবন একই আদর্শ বা বিশ্বদর্শন নিয়ে লিখে চলেছেন। ভাবাদর্শ যতই দৃঢ়ভিত্তিক হোক না কেন, পাল্টায়; আশা, হতাশা, প্রাপ্তি, বেদনাবোধ, ক্ষোভ, বিশ্বাস ইত্যাদির সাপেক্ষে। ফলে তার বিশ্লেষণও একরৈখিক হবেনা— ধরে নেওয়া যায়। নবারুণদার ক্ষেত্রে বিষয়টি দ্বিগুণ জটিল যেহেতু ওঁর ক্ষেত্রে এই বিবর্তনটি ঘটেছে তিন ধাপে, এবং প্রচুর ওভারল্যাপিং সহকারে। কিন্তু তাও মনোযোগী পাঠকের পক্ষে নবারুণদার মতাদর্শগত সরণের একটা সূচক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব না। সত্তর থেকে আশির দশকের কথাই ধরিঃ ১৯৭০ সালে ‘সপ্তাহ’ প্রত্রিকায় বেরোল ‘স্টিমরোলার’— নবারুণের প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে দ্বিতীয়। গ্রীষ্মের এক নিদাঘে, কোনও অজানা সময়ে ও শহরে, আচমকা মূর্তিমান বিভীষিকার মত আবির্ভূত হয় এক বিধ্বংসী স্টিমরোলার, যার চালকের আসনে এক বৃদ্ধ শ্রমিক। পৃথিবী নিষ্ঠুর এবং শ্রেণীবিভক্ত, শ্রমিকরা শোষিত অথচ কাঁচঘেরা অফিসঘরে ফুলে ফেঁপে উঠছে মালিকেরা, রাস্তার কুকুরের জন্যও বিন্দুমাত্র ছায়া নেই কোথাও— এরকম অবস্থায় অবদমিত রাগ হুংকারসহ ফেটে পড়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। প্রাণহানি হয়না, কিন্তু স্টিমরোলারের চাকায় গুঁড়িয়ে যায় একের পর এক দামী গাড়ি, আগুন ছিটকে পড়ে, তার আঁচ গায়ে লাগে অফিসবর্তীদের। পুলিশের গুলিতে মারা যায় শ্রমিক, কিন্তু ততক্ষনে স্টিমরোলার ভয় ধরিয়ে দিয়েছে স্থবির সিস্টেমের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দশকপ্রান্তে পৌঁছে নবারুণদা লিখলেন ‘কাকতাড়ুয়া’ (‘সপ্তাহ’, ১৯৭৯)— তথ্যগল্প। ঐ বছরের ১৬ই অগস্ট ঘটে যাওয়া একটি বাস্তব হত্যাকান্ড নবারুণদার মূল উপজীব্য। ঐ রাত্রে বিষাণপুরের ঠাকুর সম্প্রদায়ের পোষা গুন্ডার হাতে খুন হয় নির্ভয় পাসোয়ান, স্থানীয় হরিজন আন্দোলনের নেতা। ঘুমন্ত নির্ভয়ের মাথা কেটে ছুঁড়ে ফেলা হয় জঙ্গলে, প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে সরাইবাজারের জনতা, রক্তপাত হয় আরো, কিন্তু অবশেষটুকু লুঠ করে নেয় সিস্টেম। শিবিরে ভাগ হয়ে যায় প্রতিবাদ, অন্যদিকে চলে আসে তথাকথিক বামপন্থী বুদ্ধিজীবি, পুলিশ কেস নিতে অস্বীকার করে। “রাত দুটোর পর কুকুরগুলো আকাশের দিকে মুখ তুলে কাঁদে”। নবারুণ জানানঃ নিপীড়িতশ্রেণী ঐক্যবদ্ধ যদি বা হয়, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ছলচাতুরী করে ঠিকই বৈপ্লবিক জাড্যটুকু হরণ করে আনবে। তবে প্রতিবাদ তাতে থামে না।
    এই দুটি গল্প স্রেফ উদাহরণ, কিন্তু বৈপ্লবিক আশাবাদটুকু বোঝা যাচ্ছে বোধহয়। ইতিহাসের টালমাটাল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নবারুণ অতন্দ্র চোখ রেখেছেন এক সোনালী ভবিষ্যতের দিকে, কারণ বিপ্লব আসবেই, এবং তার দ্যোতক হিসেবে মাঝেমাঝেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে প্রতিহিংসা, রোষ এবং প্রতিরোধ। এক নির্ভয় পাসোয়ানের মৃত্যু থেকে জন্ম হয় সারসাওয়া, আলাওলি, চৌথামের আরও অজস্র শ্রমিক নেতার। একইভাবে, বৃদ্ধ শ্রমিক গভীর কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় অফিসওয়ালাদের শিরদাঁড়ায়, তাকে মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করা হলেও মনে রাখে রাস্তার কুকুর। অর্থাৎ, এ পর্যায়ে, বিপ্লব ও তজ্জনিত আশাবাদ যেন একটি সিগনিফায়ার— এই অবধি বলেই যতি টানা যাক, কারণ এবার আমরা চোখ ফেরাব পূর্বকথিত ওভারল্যাপিং-এর প্রসঙ্গে। ওভারল্যাপিং শৈলীসংক্রান্ত ততটা নয়, যতটা মতাদর্শগত। সত্তর থেকে আশির দশকের গল্পে একাধিক উদাহরণ রয়েছে এই সুদৃঢ় বৈপ্লবিক চেতনার সরণের। ‘ভাসান’ (‘পরিচয়’, ১৯৬৮), অর্থাৎ নবারুণের প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্পের নায়ক এক পাগল, যার বসবাস এক বিচিত্র অস্তিবাচক পৃথিবীতে। গল্পর শুরু থেকেই সে মৃত, কিন্তু তার বিদেহী অস্তিত্ব পরম মমতায় নশ্বর শরীরটিকে বিলিয়ে দেয় পোকামাকড় ও পশুদের খাদ্য হিসেবে। নির্মম শহুরে জীবন ফিরেও তাকায় না সেই দিকে, শুধু ঠায় জেগে বসে এক পাগলি। নবারুণ কি চরম প্রান্তিকীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদোন্মুখ? অবশ্যই। এতেও কী রয়েছে অনাগত বিপ্লবের ছায়া? নিশ্চিত হওয়া মুশকিল। প্রতিরোধ এখানেও আছে— পাগলের ভাষা, জীবনবোধ সবই সাধারণ দৃষ্টিতে সুদূর, তার রহস্যময় অস্তিবাদের কারণও হয়ত সমগ্র প্রান্তিক প্রাণমন্ডলকে একত্রিত করতে চাওয়া, কিন্তু কোনও সহিংস প্রতিরোধ নেই এখানে, ঠিক যেমন নেই এই লেখার প্রায় তিন দশক দূরবর্তী ‘অন্ধ বেড়াল’ (‘প্রতিক্ষণ’, ১৯৯৭) গল্পে। নবারুণদার আন্তর্পাঠের সমস্যাটি এভাবে স্পষ্ট হয়ে আসেঃ আমরা বুঝি ওঁর আখ্যানবিশ্বের পূর্ণচ্ছেদ বলে কিছু নেই, কালানুক্রমিক ভেদ যদি করিও, বারবার তা প্রতিহত হয় লেখকের আদর্শগত সরণের পুর্বাভাসের জন্য। নবারুণের লেখা ক্রমিক না, বরং ভবিষ্যতের চিন্তাধারার বীজ বর্তমানে ছড়িয়ে রাখাতে নবারুণদার উৎসাহ বেশী। ‘অন্ধ বেড়ালের’ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গল্পের ঠিক কেন্দ্রে নিষ্কম্প পাথরের মত বসে থাকে এক অন্ধ বেড়াল নদীর ওপর হেলে পড়া কোনও হোটেলের টেবিলের তলায়, জীবন বয়ে চলে তার চারদিকে— রাজনৈতিক হত্যা, প্রেমিক প্রেমিকার আত্মহনন, মানুষের লালসা আর সুবিধাভোগ, অপ্রত্যাশিত করুণা এবং মনুষ্যত্বের আঁচ। কিন্তু অন্ধ বেড়াল স্থির— প্রতীকী প্রতিরোধের মতই, গল্পের শেষে যখন হোটেলশুদ্ধ হেলে পড়ে বানের দিকে, অন্ধ বেড়াল তাও ঠায় বসে থাকে। জীবন যে প্রান্তিককে নড়াতে পারেনি, মৃত্যুও তাকে ভয় দেখাতে পারেনা। কঠোর প্রতিকূলতার মুখে একগুঁয়ে জীবনের প্রতিবাদ, এর চেয়ে জোরালো, যুদ্ধোন্মুখ কিছুর কথা নবারুণদা এ গল্পে এনেছেন কি? বলা, আবারও, কঠিন।
    অন্ধ বেড়ালের দু বছর আগে নবারুণের অধুনা আইকনিক ফ্যাতাড়ু প্রকাশ পেল ‘প্রমা’ পত্রিকায়, এবার সঙ্গে সঙ্গেই সূচনা হল এক নতুন নবারুণীয় কথনের। প্রথমে বিপ্লব, পরে স্থৈর্য, এবং তৃতীয় পর্যায়ে অদ্ভুত রস – এরকম ত্রিধারায় আখ্যানবিশ্বকে বেঁধে ফেলার লোভ, আলোচ্য লেখক নবারুণ না হলে, সামলানো মুশকিল, এবং আবারও আমরা দেখি কিভাবে লেখকের পরিবর্তনশীল মতাদর্শ একটা কালক্রমিক রূপ নিতে নিতেও থেমে যাচ্ছে কোথাও, প্রবেশের আগেই ঘোষণা করে দিচ্ছে নিজের উপস্থিতির। ২০০০ সন থেকে ঐ দশকের মাঝামাঝি অবধি গল্পগুলির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলেই আমার প্রস্তাবটি স্পষ্ট হয়ে আসার কথা। অদ্ভুত রস— অ্যানার্কি, মুখ ভ্যাংচানো, চোরাগোপ্তা ড্যামেজ— এ পর্যায়ে হয়ত প্রধান, আর ফ্যাতাড়ুর বিখাত গল্পগুলোও কমবেশী এই সময়ে প্রকাশিত, কিন্তু পাশাপাশি রয়েছে “পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট” (২০০৩), “সব শেষ হয়ে যাচ্ছে” (২০০৪), “কড়াই” (২০০৫), “সাংহাইতে এক সন্ধ্যা” (২০০৩)। ফ্যাতাড়ুর (১৯৯৫) আবির্ভাবকে আর আকস্মিক বলে মনে হয়না যখন দেখি পূর্বকথিত দুটো পর্যায়েরই অশরীর এখানে উপস্থিত— বিপ্লবের আশাবাদ এবং প্রতিরোধী স্থৈর্য। নবারুণদা হয়ত সরে এসেছেন বিপ্লবের একমাত্রিক সংজ্ঞা থেকে, তবু বারেবারেই যেন পিছনে ফিরে যেতে চান, ছুঁয়ে দেখতে প্রতিরোধের লাল করাঙ্কের অবশেষটুকু। দুঃখবিলাস? সম্ভবত না, কারন পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট যদিও মারা যান একা, আর তার প্রয়াণে উল্লসিত হয় পৃথিবী, গল্পের শেষে নবারুণ সত্তর দশকের মতই অবিচল, নিশ্চিত- “সারা পৃথিবী জুড়ে কমিউনিস্টরা ফিরে আসবে। আসবেই। আর দশ নয়, দশ হাজার দিন ধরে দুনিয়া কাঁপবে”।
    নবারুণ ভট্টাচার্যের কাল্টিস্ট পাঠ থেকে কতখানি সরে এসেছি আমরা! ‘না’ শব্দটি নির্দ্বিধায় খুলে ফেলেছে পোশাক, লীন হয়ে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে, আমরা বুঝতে পারছি ‘না’ বলার— প্রতিরোধ করার— দরজা অবারিত করার রকমফের। “বসন্ত উৎসবে ফ্যাতাড়ু” (২০০৪)-তে ফ্যাতাড়ুরা খেপিয়ে দেয় গোটা বস্তিকে, জনরোষ আছড়ে পরে হিমগিরি আপার্টমেন্টের বসন্ত উৎসবের প্রাঙ্গণে, তুমুল প্রহসনে শেষ হয় বড়োলোকদের এলিট অশ্লীলতা। একই বছরে নবারুণদা আবার বিষণ্ণতার সর্বশেষ ধাপে— “সব শেষ হয়ে যাচ্ছে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে সব শেষ হয়ে...”। নিউক্লিয়ার উইন্টার ঘনিয়ে এসেছে পৃথিবীতেঃ “সবই অনিত্য, সবই দুঃখ”। আংশিক আত্মজৈবনিক এই গল্পে নবারুণ ‘ব্রয়লার’ জীবনকে আক্রমণ করেন ঠিকই, কিন্তু এই প্রতিরোধ “অন্ধ বেড়াল”-এর প্রতিরোধ— অনড় থেকে অপেক্ষা করা কখন ঘনিয়ে আসবে প্রলয়। ‘না’- কিন্তু বর্জনের ‘না’, যুদ্ধের নয়। “কড়াই”-এর শেষ দৃশ্যে এক বিভ্রম আসে, কথক দেখে ল্যাম্পপোস্টের আলোর তলায় বাঁধা কড়াই যেন চিড়িয়াখানার অতিকায় কচ্ছপ, শেকল ছিঁড়ে চলে যেতে চাইছে কোথাও। মুখ ভ্যাংচানো, ড্যামেজ, রাগী পৌরুষ, স্থবির প্রতিরোধ, ইতিহাস আর বিষণ্ণতা— সব পাশাপাশি, যদিও “সব শেষ হয়ে যাচ্ছে”।
    তাই কাল্টিফিকেশন দিয়ে নবারুণকে মাপা সম্ভব না, যতই কৈতববাদের মত শোনাক। বিপ্লব, স্থৈর্য আর ড্যামেজ— এই ত্রিধারায় কোনও ফর্মূলার আভাস পাওয়া গেলেও যেতে পারে, কিন্তু মতাদর্শগত বিবর্তনের দিক দিয়ে নবারুণ যতটা বৈপ্লবিক, ততটাই মধ্যবর্তী; যতটা নিশ্চিত, ঠিক ততখানিই চিন্তিত। তাহলে কি নবারুণের লেখায় আদপে কোনও বিবর্তন নেই? নবারুণ কি সেই বিরলতমদের মধ্যে একজন যারা চিরকালীনভাবেই তাৎক্ষণিক? কিভাবে টানা যায় নবারুণ ভট্টাচার্যের আন্তর্পাঠের রূপরেখা? কোথায় থেমে বলা চলে অভীষ্টের অস্তিসূচক বাচন? নবারুণদা হাসেন, আমরা খুঁজতে থাকি।

    গ্রন্থপঞ্জী

    নবারুণ ভট্টাচার্য, উপন্যাস সমগ্র, (কলকাতাঃ দে’জ পাবলিশিং, ২০১০)।
    শ্রেষ্ঠ গল্প, (কলকাতাঃ দে’জ পাবলিশিং, ২০০৬)।

    =============================

    নাটকে নবারুণ, নাটুকে নবারুণ
    সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়

    ‘সম্পাদকবাবু কয়েচেন নাটক ও নবারুণ নিয়ে লিখতে; তা নাটক তো নবারুণের সব্বাঙ্গে!’

    মৃণাল সেনের বিখ্যাত একটি ছবির প্রথম সংলাপের আদলে এই রচনার প্রথম পংক্তিটি লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না, কারণ আকাল যেমন বঙ্গভূশরীরের সর্বাঙ্গে, নাটকও তেমনি ব্যাপ্ত চরাচর হয়ে ছিল নবারুণ ভট্টাচার্যের মন-জমিনে। ছিল... ব্যাকরণ মতে অতীতকাল। এভাবে লিখতে হচ্ছে, কিন্তু খারাপ লাগছে লিখতে, কারণ নবারুণদাকে তো অতীতকালে ফেলা যায় না। যেমন নাটককেও ফেলা যায় না অতীতে। নাটক সবসময় বর্তমানের বুকের ওপর বসে দাড়ি উপড়োচ্ছে, কতকটা নবারুণের মতোই। সুতরাং নাটক-বর্তমান-নবারুণ — এই শব্দবন্ধটি সবসময় যূথবদ্ধ।

    যাঁর বাবা ছিলেন বাংলা নাট্যসাহিত্যের এক কর্ণধার, যাঁর মা-র কলমে গদ্যের পাশাপাশি নাটকও ঝরেছে ‘জল’-এর মতো, তাঁর তো নাটুকে হওয়ারই কথা, না টুকেই, স্বয়ম্ভূ বিদ্যমানতায়। রক্তবীজ ছিল তাঁর নাট্যকল্পে। বছর তিনেক আগে বিজন ভট্টাচার্যকে ঘিরে একটি অনুষ্ঠানে নবারুণদা প্রধান অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন। একেবারে প্রথম সারিতে বসতে হয়েছিল। সেদিনের অনুষ্ঠানের একটি অংশ ছিল ‘নবান্ন’ থেকে কয়েকটি দৃশ্যের পাঠ। মাইক মুখে নিয়ে অভিনেতাদের দল পাঠ করছেন বিজনবাবুর আইকনিক নাটকের কয়েকটি আইকনিক দৃশ্য। পাঠ যে খুব অসাধারণ হচ্ছে তা নয়। আমি বসে আছি কয়েক সারি পিছনে। ভাবছি নবারুণদার মনে কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি আদৌ? নাকি শুনতে হয়, তাই শুনছেন? নাকি অভিনয়ের মান নিয়ে উষ্মায় ছটফট করছেন? বুঝতে পারছি না।

    এদিকে নাটকের মূল চরিত্র, অর্ধোন্মাদ বুড়ো প্রধান সংলাপ বলে চলেছে,

    “আর কত চেঁচাব বাবু দুটো ভাতের জন্যে! তোমরা কি সব বধির হয়ে গেছ বাবু — কিছু কানে শোন না? অন্তর কি সব তোমাদের পাষাণ হয়ে গেছে বাবু! ও বাবারা — বাবু — কত অন্ন তোমাদের রাস্তায় ছড়াছড়ি যাচ্ছে বাবু, আর এই বুড়ো মানুষটারে একমুঠো অন্ন দিতে তোমাদের মন সরে না বাবু! বাবু তোমাদের কি প্রাণ নেই বাবু!” (‘নবান্ন’, দ্বিতীয় অঙ্ক, তৃতীয় দৃশ্য)

    হঠাৎ খেয়াল করলাম, নবারুণদার পিঠটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। প্রথম ঝটকায় ঠিক বুঝতে পারিনি কেন। কয়েক মুহূর্ত পরে বুঝলাম, নবারুণ কাঁদছেন...

    নাটকের পাতায় বৃষ্টি পড়ছে
    নবারুণ কাঁদছেন
    নবারুণ কাঁদছেন, সেদিন
    নবান্নে ফসল ফলেনি তাই
    ছিল না অপ্রতু্ল যদিও
    সে যুগের কৃতার্থ নিদান
    পিতরৌ সম্ভারে তমোঘ্ন
    এ যুগেও কৃতঘ্ন চলেছে তাই...(‘অসম্পর্ক’, সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়; পৃষ্ঠা ৪৪)

    পিতার লেখনীর সঙ্গে সেদিন একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন পুত্র। একাত্ম হয়েই তো ছিলেন। বিজন-সংলাপ তাই নবারুণ-সংলাপও। তাই, নাটক না লিখলেও, নবারুণের গদ্যে চরিত্রেরা কথা বলে নাট্য-সংলাপের স্বাভাবিকতায়। বিজনবাবুর লেখন-বীজাণু ভীষণভাবে উপস্থিত ছিল নবারুণের কলমে।
    “‘হার্বার্ট’ বা ‘কাঙাল মালসাট’ ছবি ও নাটক করার সময়ে আমায় একটিও সংলাপ নতুন করে লিখতে হয়নি। সব কাজ নবারুণদা করে রেখে গেছিলেন। আমায় শুধু একটু সাজিয়ে নিতে হয়েছিল। কথ্য ভাষার একটা ন্যাচরাল রিদিম, ন্যাচরাল ইডিয়ম থাকে, যাকে সংলাপে ধরতে হয়, নাট্যকারেরা যেটা পারেন। নবারুণদাও সেটা পারতেন। অনায়াসে। সেই অর্থে তিনি তো নাট্যকারই।” --বললেন নাট্য ও চিত্রপরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। “আমার অভিনেতাদেরও ওই সংলাপে বিশেষ রদবদল বা ইম্প্রোভাইজ করতে দেখিনি। যেমনটা লেখা, তেমনটা বলা। কোন ফারাক নেই।”

    নবারুণের সংলাপ বিষয়ে ‘ফ্যাতাড়ু’ নাটকের পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ও একই কথা বললেন। মনে রাখা প্রয়োজন, দেবেশই প্রথম নবারুণের গল্পকে মঞ্চরূপ দিয়েছিলেন, নিরীক্ষার দালান পেরিয়ে ফ্যাতাড়ুদের হাজির করেছিলেন স্টেজে এবং জনপ্রিয় করেছিলেন। ডি.এস বা মদন বা পুরন্দর ভাটের মত চরিত্র যে তাঁদের চোখা ও অকপট সংলাপ নিয়ে, তথাকথিত ‘ভদ্রতা’-র ঘোমটা ছাড়াই, মঞ্চে উঠে আসতে পারে, তাদের কথন যে মঞ্চ-সংলাপ হয়ে উঠতে পারে, গতানুগতিক অর্থে কোনো প্লট ছাড়াও যে ফ্যাতাড়ুদের নিয়ে নাটক করা সম্ভব, এটা দেবেশই দর্শিয়ে দিয়েছিলেন। ফ্যাতাড়ুদের জীবন কেমন হতে পারে জানার জন্য, নিজেকে বিপদে ফেলতেও দ্বিধা করেননি। করতে গিয়ে বুঝেছেন, নবারুণের সংলাপও সেই ‘ডেঞ্জারাস লিভিং’-এরই সংলাপ। তাই ভিন্ন ভিন্ন গল্পকে একসূত্রে বাঁধার চেষ্টাও তেমন করেননি। ফ্যাতাড়ুদের মঞ্চে ছেড়ে দিয়েছেন তাদের সমস্ত anarchy-সমেৎ।
    “নাটকটা যেন কতকটা নিজেই নিজেকে গড়ে নিয়েছিল। ইন ফ্যাক্ট, নবারুণদা স্টেজ রিহার্সাল দেখে যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন নতুন কোনো ডায়ালগ লিখে দিতে হবে কিনা, তখন শুধুমাত্র নাটকটার শেষে পুরন্দরের একটা climactic কবিতা লিখতে বলেছিলাম ওঁকে। আর কিচ্ছু লেখাতে হয়নি। সংলাপ সব ওই গদ্যের মধ্যেই গাঁথা ছিল।”
    বলা বাহুল্য, ২০০৪-এ প্রথম মঞ্চায়নের পর, ‘ফ্যাতাড়ু’ নাটকটি বারবার ফিরে এসেছে বাংলা মঞ্চে। শুধু দেবেশ চট্টোপাধ্যায় ও সংসৃতিই নয়, গোত্রহীন সম্প্রতি মঞ্চস্থ করেছেন ‘ফ্যাতাড়ুর কিস্সা’। বছর কয়েক আগে থিয়েটার ওয়ার্কশপ মঞ্চে এনেছিলেন নবারুণের আর একটি উপন্যাস ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’-র নাট্যায়ন।

    কিন্তু নবারুণ ভট্টাচার্যের এতগুলি কীর্তিকে মঞ্চে ও পর্দায় হাজির বোধহয় সুমনের মতো এমন সফলভাবে আর কেউ করতে পারেননি। তিন-তিনটি ছবি: ‘হার্বার্ট’, ‘মহানগর@কলকাতা’ (যার মধ্যে আবার তিনটি আলাদা অথচ সংলগ্ন গল্প) ও ‘কাঙাল মালসাট’। তিন-তিনখানি নাটক: ‘কাঙাল মালসাট’, ‘যারা আগুন লাগায়’ ও সম্প্রতি দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় ‘খিলোনা নগর’ (হিন্দিতে)। এদের মধ্যে দ্বিতীয়টি নবারুণ অনূদিত। এই অনুবাদ নাটকটি সম্বন্ধে দু-চার কথা বলা দরকার। ম্যাক্স ফ্রিশ-এর মূল জার্মান এই নাটকের (Biedermann und die Brandstifter, বা ইংরেজিতে, The Fireraisers-এর) তর্জমা আগেও হয়েছে। সে তর্জমা মূলানুগ ও জার্মান-তথা-ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সসামঞ্জস হওয়া সত্ত্বেও, ছিল কাষ্ঠ ও খটমট, মূলত অ্যাকাডেমিক। কিন্তু নবারুণ ভট্টাচার্যের অনুবাদ, তর্জমাকরণের থিওরির সমস্ত শর্ত বজায় রেখেও, ‘নাটক’ হয়ে উঠেছে। সুমন মুখোপাধ্যায়ের সমকালীন, রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতায় ঠাসা মঞ্চায়নটি দেখতে দেখতে কেবল মনে হয়, শুধু নাটকের বিষয়গুণে বা নির্দেশনার মুন্সীয়ানায় নয়, সংলাপের সমসাময়িকতার জোরেই যেন বিদেশি নাটক কখন স্বদেশী হয়ে উঠেছে। একবারের জন্যেও মনে হয় না নাটকটি ভিন্ন এক কালে, ভিন্ন এক দেশে, ভিন্ন এক সমাজ ওসংস্কৃতির পটভূমিতে লেখা। তার কৃতিত্ব যতখানি নাট্যকারের, যতখানি নির্দেশকের, যতটা অভিনেতাদের, ততখানিই অনুবাদকের। বিশেষকরে তার সংলাপ-লেখন ক্ষমতার জোরে।

    পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ের সামনে সুযোগ ছিল দুটি অনুবাদের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার।
    “কিন্তু আমি নবারুণদার অনুবাদটাই বেছে নিয়েছিলাম। নবারুণদার কলমে যেন নাট্যকার স্বয়ং ভর করেছিলেন। ফলত, অনুবাদ তার মূলানুগত্য না হারিয়েও মুখের ভাষা হয়ে ফুটে বেরোচ্ছিল। এই একই ব্যাপার এই নাটকে কোরাসের গানগুলির ক্ষেত্রেও। নবারুণদার মুখেই শুনেছি, উনি নিজেও আগে একবার এই নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন। খুব সক্রিয়ভাবে থিয়েটার না করলেও, সরাসরি নাটক না লিখলেও, নবারুণদার একটা বিরাট ইন্টারেস্ট এরিয়া ছিল নাটক। উনি ভীষণভাবে চাইতেন ওঁর বাবার, বিজনবাবুর নাটকগুলো নতুন করে মঞ্চস্থ হোক। একবার আমাদের দলে এসে বিজনবাবুর একটি নাটক পড়েও শুনিয়েছিলেন।”

    ২০১৩তে এই অধম যখন প্রবাসী জীবন ত্যাগ করে পাকাপাকিভাবে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখন নবারুণদা শর্ত দিয়েছিলেন, “তুই কলকাতায় এসে বাবার নাটক করবি, নয়তো ঝামেলা হবে। ফ্যাতাড়ুদের লেলিয়ে দেব।” ২০১৪-২০১৫তে বিজন ভট্টাচার্যের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে নবারুণদা বলেছিলেন নতুন করে ‘নবান্ন’ করতে। ইতিহাসভিত্তিক এক্সিবিশন সহ নাটকটির পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা। পরিকল্পনা বেশ ভালোই এগোচ্ছিল, কিন্তু মাঝপথে বাধ সাধল নবারুণদার অসুস্থতা ও মাত্র আট মাসের মাথায় তাঁর মৃত্যু। মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও — নবারুণদা তখন হাসপাতালে, জ্ঞান আসছে যাচ্ছে — আমার হাত ধরে কানে কানে বলেছিলেন,
    “নাটকটা কিন্তু আমরা করবই। তুই ছাড়বি না।”
    কাকে নিয়ে করব, নবারুণদা? যখন ‘নবান্ন’ নামটা পর্যন্ত বর্গীরা কেড়ে নিয়ে গিয়ে সরকারী ইমারতের নেমপ্লেটে বসিয়ে দেয়, তখন সাহস দেবে কে? কোথায় তুমি? প্রথম সারিতে তুমি বসে না থাকলে স্টেজে উঠব কোন ভরসায় এই খারাপ সময়ে?

    নাটক না লিখলেও নবারুণদা ছিলেন আনখ-সমুদ্দুর একজন নাটকের লোক। নাট্যস্বজন নন, নাটকের স্বজন। নাটকীয়তা ও নাট্যসংলাপের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, চলত, দৌড়ত, বিপ্লব করত তাঁর কবিতা ও গদ্য। উদাহরণস্বরূপ দাখিল করা যায়, ‘খারাপ সময়’ —

    খারাপ সময় কখনও একলা আসে না
    তার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আসে
    তাদের বুটের রঙ কালো
    খারাপ সময় এলে
    রুমাল দিয়ে হাসি মুছে ফেলতে হয়
    ফুসফুস গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়
    জুয়ার বাজার মরা জন্তুর মতো ফুলতে থাকে
    ভালোবাসার গলা কামড়ে ধরে
    ঝুলতে থাকে ভয়
    ল্যাম্পপোস্টের ওপর থেকে
    হতভাগ্যরা গলায় দড়ি
    দিয়ে ঝোলে
    তাদের ছায়ায় কালোবাজারীরা
    লুকোচুরি খেলে
    ভি. ডি. বেশ্যার দালাল আর
    জেমস বণ্ডরা রাস্তায়
    কিলবিল করে
    ভিড় ঠেলে সাইরেন বাজিয়ে
    পুলিশভ্যান চলে যায়
    তার মধ্যে পুলিশ বসে থাকে
    তাদের বুটের রঙ তাদের
    ঠোঁটের মতো কালো
    তাদের ঘড়িতে খারাপ সময়। (‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’; পৃষ্ঠা ২৬)

    এ কবিতা তো উৎপল দত্তের ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ নাটকের সংলাপ হতেই পারত। আসলে এ নগর, এ রাজ্য, এ দেশ যতদিন দুঃস্বপ্নের কবলে থাকবে, নবারুণের কবিতাও ততদিনই এক অলিখিত নাটকীয় প্লটের বল্গাহারা, ছেঁড়া ও ছুঁড়ে দেওয়া সংলাপ। কারণ,
    সবচেয়ে ভাবার কথা হল
    ভরসারা নয়
    ভয়রাই কথা রাখে... (‘রাতের সার্কাস’, উৎসর্গ)

    নবারুণদার গদ্যে, গল্পে, উপন্যাসে চিরাচরিত আখ্যান-ভিত্তিকতার স্থাপত্য বা নির্মিতি নেই। আছে নাটকীয়তার ডেটোনেশন, সংলাপের বিস্ফোটকতা, নাশকতা। চলতি পথের উলটা-পথিক যিনি, যাঁর কাব্যে-গদ্যে সেই বিরোধী স্রোতেরই দিক্‌-তর্জনি, তিনি নাটক লিখলে হয়ত এক বিপরীত ধর্মী নাট্যদ্রোহের হদিশ পাওয়া যেত। একটি radical dramaturgy-র সন্ধান, যার কিছু ইঙ্গিতমাত্র মিলেছে সুমন ও দেবেশের নাট্যরূপে। নবারুণের নিজের কলমে সেই নাট্য-আকৃতির চেহারাটা ঠিক কেমন হতো তা পরখ করে দেখার সুযোগ আর ঘটলনা। ‘লুব্ধক’-এর সুললিত গদ্য থেকে ‘কাঙাল মালসাট’-এর খিস্তি-ঠাস বাক্যালাপ, কিম্বা ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’-এর কাব্যভাষ থেকে পুরন্দরের ন্যাংটা লিরিক — এসবের মধ্যেই তো ভরপুর নাট্যবীজ। তা না হলে ফ্যাতাড়ুদের নিয়ে এতগুলো নাটকই বা মঞ্চে গজিয়ে উঠল কোন বীজের জোরে, কিম্বা ‘হার্বার্ট’-এর মতো দেওয়াল-ভাঙা ছবি? বা ‘কাঙাল মালসাট’-এর মতো উদাহরক-বদলকরা আখ্যানোত্তর চলচ্চিত্র? আফশোস শুধু এই, যে নবারুণ যেন নাট্যসাহিত্যের প্রাসাদগাত্র ভাঙার সমস্ত প্রস্তুতিটুকু করেও, বারুদের স্তুপ সাজিয়েও, বোমার সলতেতে আগুন দেবার ঠিক আগেই চোখ মেরে উঠে চলে গেলেন। উড়ে গেলেন, ইতিহাস-দর্শানো সেই দণ্ডবায়সের মত। দায়ভার পড়ে রইল তাদের কাঁধে, যারা আগুন লাগায়...।

    =============================================

    তাহাদের কথা: মনুষ্যেতরর রাজনীতি
    ঈশানী বসু

    ঈশপের নীতিকথা থেকে অ্যারিস্টোফেনিসের নাটক, বিভিন্ন দেশের লোককাহিনী এবং উপকথায়, লিউইস ক্যারল থেকে সুকুমার রায়ের গল্পে প্রায়শই কথা বলা জীব জন্তুর দেখা মেলে। এদের উপস্থিতি আবার অনেক সময় নিছক রূপকের ভূমিকায় সীমাবদ্ধ না থেকে হয়ে ওঠে অনন্য সৃষ্টি লেখকের জাদু লেখনীর জোরে- যেমন ক্যারলের চেশায়ার বিড়াল, তলস্তয়ের ঘোড়া, বুল্গাকভের কুকুর, অরওয়েলের নিপীড়িত পশু খামার, উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনি, চড়ুই ও মজন্তালী, সুকুমার রায়ের কাক্কেশ্বর কুচকুচে, হিজি বিজ বিজ প্রমুখ। নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ও গল্পে যে সবাক ও নির্বাক পশুদের দেখা মেলে তাদেরও শুধু রূপক বলে দাঁড়ি টানা কঠিন। প্রসঙ্গত এই প্রাণীদের ভূমিকা অনুযায়ী এদের দুটি ভাগে ফেলা যায়- এক, নির্ভেজাল গোবেচারা প্রাণী যারা প্রকৃতি অপেক্ষা মানুষের খামখেয়াল ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার শিকার হয় (অন্ধ বেড়াল, বেড়াল ছানা, মাছ, কাঁকড়া, কুকুর) দুই, তেজীয়ান, পরম বুদ্ধিমান প্রাণী যার বুদ্ধি ও কৌশলের দৌড় মানুষকেও হার মানায় (দণ্ডবায়স, বনবেড়াল)।

    এই দ্বিতীয় শ্রেণী আবার উগ্র সোশালিস্টিক, তারা ভয় দেখিয়ে, ধমকে চমকে, ভোজবাজির খেলা (পড়ুন চাকতি, বশীকরণ, ভুতুড়ে স্বপ্ন, মমি শিল্প) খেলে প্রতিষ্ঠানকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। প্রসঙ্গত প্রাচীন গ্রীক পুরাণে দাঁড়কাক সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর (যিনি গান বাজনা, শিল্পকলা, দৈব বাণীরও দেবতা) অনুচর ও মর্ত্যের মানুষের কাছে দেবতাদের বাণী পৌঁছে দেওয়ার ভারপ্রাপ্ত দূত। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান উপকথায় আবার দেবরাজ ওডিনের পোষা দুই দাঁড়কাক হুগিন (চিন্তা) ও মুনিন (স্মৃতি) তার কাছে দিন দুনিয়ার সব খবর নিয়ে আসে। ‘যোগ বশিষ্ঠে’ আমরা আবার ভূশুণ্ডী বা ভূশুণ্ড নামের এক দাঁড়কাকরূপী বৃদ্ধ ত্রিকালজ্ঞ মুনির দেখা পাই যিনি মেরু পর্বতের কল্পতরু বৃক্ষে বাস করেন ও পূর্বযুগের নিখুঁত বিবরণ দেন। কাক্কেশ্বর নিজেকে এরই উত্তরসুরী বলে দাবী করে। নবারুণের ‘কাঙাল মালসাট’ উপন্যাসের অতিকায় দণ্ডবায়স বা দাঁড়কাক এরকম কোন দাবী না করলেও সে যে পুরাকালের কাকের মতোই সুচতুর, জ্ঞানবৃদ্ধ ও জ্ঞানপাপী তাতে সন্দেহ থাকে না। লোককথা, বা বলা ভালো ‘বিস্ট ফেবলের’ আঙ্গিকে সে ‘ট্রিক্সটার’ (ঠগ)-এর ভূমিকা অক্লেশে পালন করে। তবে তার সাথে কাক্কেশ্বর কুচকুচের থেকে পঞ্চতন্ত্রের স্থিরজীবীর মিলই বেশি, যে কৌশলে শত্রু প্যাঁচাকূলকে সমূলে বিনাশ করেছিল। অবশ্য স্থিরজীবীর উদ্দেশ্য ছিল কাকদের রাজা মেঘবর্ণের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করা আর আমাদের সর্বজ্ঞ দাঁড়কাকটির প্রতিষ্ঠানকে নানা দিক থেকে আঘাত হেনে কাহিল করা। এই উলটো পুরাণের নেপথ্যে আছে তারই ‘মাস্টারপ্ল্যান’, যা অনুগত সৈনিকের মত পালন করে মার্শাল ভদি (চোক্তার) ও তার সাঙ্গপাঙ্গ, ফ্যাতাড়ু মায় পুলিশ গোলাপ মল্লিক। সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা এই প্রাণীটি মোটেই পরমহংস নন, দলবলের সাথে দিব্যি বাংলা খেতে খেতে রণকৌশল, স্বামী নিগমানন্দের বানী বাৎলে দেন। অন্যদিকে গোরা ভূতদের সাথেও তার দারুণ র্যা পো, স্বয়ং বেগম জনসন তার বন্ধু ও বুদ্ধিদাত্রী। ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন গুলে বেটে খাওয়া এই জীবটি অগত্যা শ্রেণীশত্রুদের ওপর অতর্কিতে হানা দিয়ে নকল কমরেডের মুখোশ খুলে দেয়, চাকতির মাধ্যমে ‘লোবোটমি’ করে পুঁজিপতিদের মস্তিষ্ক ঘুলিয়ে দেয়, মিউজিয়ামের অপদার্থ, সাহেবভক্ত কিউরেটর, সমালোচককে জ্ঞানের বহরে ঘায়েল করে, দুর্নীতিপরায়ণ নগরপালের শিরশ্ছেদ করে।

    ‘মসোলিয়ম’ উপন্যাসে দাঁড়কাকটির প্রত্যাবর্তন ঘটে, বন বেড়ালের সাথে জোট বেঁধে আরও ‘স্যাবোট্যাজ’ ঘটাতে। এই বিজ্ঞ বন বেড়ালটি যে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’র মার্জারী মহাশয়ারই উগ্র মূর্তি তা মনে করার বিলক্ষণ জায়গা আছে-
    “দেখ আমি চোর বটে, কিন্তু আমি কি সাধ করিয়া চোর হইয়াছি? খাইতে পাইলে কে চোর হয়? দেখ যাঁহারা বড় বড় সাধু, চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন, তাঁহারা অনেকে চোর অপেক্ষাও অধার্মিক। তাঁহাদের চুরি করিবার প্রয়োজন নাই বলিয়াই চুরি করেন না, কিন্তু তাঁহাদের প্রয়োজনাতীত ধন থাকিতেও চোরের প্রতি যে মুখ তুলে চাহেন না, ইহাতেই চোর চুরি করে। অধর্ম চোরের নহে— চোরে যে চুরি করে সে অধর্ম ধনীর।” (‘বিড়াল’, কমলাকান্তের দপ্তর)
    যুগান্তরে সে বিনম্র সোশ্যালিস্ট নয়, পুরদস্তুর বাঘের বাচ্চার মত তেজীয়ান বন বেড়াল। হ য ব র ল’র বেড়ালের মত রূপ/কায়া পাল্টানোর মন্তরে সে এক লহমায় বেড়াল ছানা থেকে হিংস্র বন বেড়াল রূপ ধারণ করে কমরেড আচার্যর ডাকা গোপন মিটিং এ জল ঢেলে দেয়। এ বেড়াল অদ্ভুত রসের (‘নন্‌সেন্স’) আমদানি করে না, মার্কসবাদ, মিশরীয় কাম রাশিয়ান মমিবিদ্যা, ভোজবাজি রপ্ত করে সে তার স্যাঙাত দাঁড়কাকের মতই ঘোর প্রতিষ্ঠান বিরোধী কার্যকলাপে (সরকারী পরিকল্পনা বানচাল করা, পুলিশ, কমরেড ও ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়ে কাজ উদ্ধার করায়) লিপ্ত হয়। সে, দাঁড়কাক ও বেগম জনসন (ভূত) মিলে ছকে ফেলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখানোর নতুন মাস্টারপ্ল্যান— ভদিকে মমি সাজিয়ে দেদার পয়সা পেটার এবং তা হাতেনাতে করেও দেখায়। স্বভাবতই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে যে এই সুতার্কিক, দার্শনিক, পরম জ্ঞানী জীবগুলি যারা নীৎশে, নিগমানন্দ, জোসেফ টাউনসেন্ড, গ্রেগর মেন্ডেল, মায় লেনিন-স্তালিনের ইতিহাস আওড়ায়, ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সবই যাদের নখদর্পণে, তারা কি সত্যিই নিছক কাক ও বেড়াল হতে পারে? দাঁড়কাকের জবানবন্দীতে সে সাক্ষাত ভোজবাজী বিশারদ আত্মারাম সরকারের উত্তরসূরি ও ভদির বাবাও বটে, যা ইঙ্গিত দেয় তার সূক্ষ্ম দেহ ধারণ করার ক্ষমতাকে, অর্থাৎ সে হয় কাকবেশী জাদুকর নয় জাদু কাক—
    “- পরকায়া- প্রবেশ, ভেরি ইজি। ভদির বডিতে আমি ঢুকে যাব। ভদি ঢুকবে আমার বডিতে। হাগলে হেগে মরবে দাঁড়কাক। ভদি যেরকম রয়্যাল স্টাইলে মমি হয়ে আচে তেমনই থাকবে।” (মসোলিয়ম)

    প্রাণীদের ‘বিস্ট ফেবল’ অনুরূপ ছলচাতুরী ও আগ্রাসী মনোভাবের বিপরীত মেরুতে রয়েছে নবারুণের ছোট গল্পের অন্ধ বেড়ালটি। অসহায়, বৃদ্ধ বেড়ালটি অখ্যাত হোটেল মালিকের বিধবা চাকরানীর ছেলেমেয়েদের দয়া দাক্ষিণ্যে বেঁচে থাকে, যাকে বলে সাবঅলটার্নের বাড়া! অন্ধ হলেও অ্যালান পো-এর কালো বেড়ালের করাল জিঘাংসা বা ক্ষোভের লেশ মাত্র নেই তার গায়। বোমা গুলির আওয়াজেও সে নিশ্চেষ্ট, টেবিলের নিচের আশ্রয় ত্যাগ করে না। হয়ত কোনোদিন নদীর জল এসে গ্রাস করে নেবে তার একদা নিরাপদ স্থানটুকু, না বুঝে তার সাথেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে সে, মরবে ‘কুকুর বেড়ালের মত’ কারণ প্রায়শই খেতে দিতে ভুলে যাওয়া ব্যস্ত হোটেল মালিকের নিশ্চয়ই তাকে সরিয়ে দেবার কথা মনে পড়বে না। তার গল্প করতে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে বেড়াল ছানাদের অন্ধ করে তাদের ওপর বীভৎস পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর সত্যি ঘটনার অবতারণা করে নবারুণ মনে করিয়ে দেন বিজ্ঞানের অগ্রগতির পায়ে নিরীহ পশুদের প্রতিনিয়ত বলি হওয়া, এবং মানুষের ওপর নির্ভরশীল গৃহপালিত জীবদের করুণ পরিণতি।

    ‘টয়’ গল্পে মিথিল ও মিমির ছোট্ট ছেলে টয় খেলার ছলে অ্যাকোয়ারিয়ামের রঙিন মাছদের ইমারসন হিটার চুবিয়ে মেরে ফেলে। বাবা মা তাকে মনোবিদের কাছে নিয়ে গিয়ে এই শুনে আশ্বস্ত হন যে ছেলেটি এই কাজ বিজ্ঞানমনস্ক কৌতূহল থেকে করেছে। এ কথা বলাই বাহুল্য যে তারা মৃত মাছেদের শোকের থেকে ছেলের বিকারেই বেশি শকড্ হয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে ছেলেটির নামকরণ ‘টয়’ আমাদের কিং লিয়ার নাটকের গ্লস্টারের বেদনাময় উক্তি “As flies to wanton boys are we to th’ gods. They kill us for their sport.” করিয়ে দিতে বাধ্য।

    ‘ম্যালোরি’ গল্পটিতে আবার মিথিল এক ব্যাগ জীবন্ত কাঁকড়াকে ডীপফ্রিজে বন্দী করে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। অথচ সে অমূল্যর কথা মত ওদের জল ভরা গামলায় ছেড়ে দিলেই পারত। ফ্রিজের তাপমান ইচ্ছে করে কমানোয় যাতে কাঁকড়াগুলো ঠাণ্ডায় মরে জব্দ হয় আবার মাংসটাও তাজা থাকে, তার মধ্যে এক নিষ্ঠুর উদাসীনতা কাজ করে। গল্পের পরিশেষে পরিবেশিত টীকাগুলি মনে করিয়ে দেয় এক অবোধ বালকের পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যে বাতিল ফ্রিজে আটকা পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর ধূসর ইতিহাস ও নাৎসি বাহিনীর লাল ফৌজের সৈন্যদের ঠাণ্ডায় জমিয়ে মারার ধান্দা। এসবের অবতারণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় হতভাগ্য কাঁকড়া গুলোর নিয়তি সমান দুঃখের, অন্যদিকে আবার শুধু বাঙালিকে কাঁকড়া বলেই লেখক থেমে যাচ্ছেন না, সমগ্র প্রজাতিটাই এরকম নিজের মধ্যে খেয়োখেয়ি করেই গেল সেটাও বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

    ইংরাজি প্রবাদবাক্য ‘এভরি ডগ হ্যাজ হিজ ডে’র মূর্ত রূপ হল লুব্ধক উপন্যাসটি। কথাচ্ছলে নবারুণ একে ‘কুকুর উপকথা’ও বলেছেন। নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ধাঁচে অসহায়, গোবেচারা কুকুরদের নিশ্চিহ্ন করার নিষ্ঠুর হত্যালীলায় মাতে কলকাতা। ‘গেস্টাপো’ সদৃশ সাঁড়াশি আক্রমণ, পিঁজরাপোলে নির্বাসন, তিল তিল করে না খেতে দিয়ে শুকিয়ে মারা কুকুরের দল ও তাদেরই কিছু অংশের আত্মগোপন ও কলকাতা থেকে ‘মহাপ্রস্থান’ বা ‘এক্সোডাস’ বারংবার মনে করায় ইহুদী বন্দিদের ওপর নাৎসিদের অকথ্য অত্যাচার ও তাদের লুকিয়ে থাকা ও পালানোর ইতিহাস।
    “-আসলে কলকাতাটাকে যেভাবে ওরা সাজাতে চাইছে সেই ছবিটার মধ্যে আমরা খুবই বেমানান।
    -সে না হয় হল, কিন্তু আগেই প্রশ্ন উঠবে যে কলকাতাটা কি কেবল ওদের? হঠাৎ ওরা বাদে অন্যরা ফেলনা হয়ে গেল?”
    জিপসি ও কান গজানোর মধ্যে এই কথোপকথনে শ্রেণী সংগ্রামেরও মূল বক্তব্য উঠে আসে। মানুষ ও কুকুর যথাক্রমে ধনী (have) ও সর্বহারার (have not) ভূমিকা পালন করে।

    কিন্তু এক মাঘে শীত যায় না বা শেলির বিখ্যাত উক্তি “If Winter comes, can Spring be far behind?” অনুসরণ করেই হোক, এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কুকুররাও তলে তলে বিদ্রোহ ভাঁজতে থাকে ছায়া কুকুরদের নেতৃত্বে। সিরিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জের দুটি তারা, ক্যানিস মেজর ও মাইনরকে গ্রীক পৌরাণিক শিকারী অরিয়নের অন্যতম শিকারী কুকুরের আরেক রূপ বলে গণ্য করা হয়। যারা ‘লেপাস’ (শশক) এবং ‘টরাস’ (বৃক্ষ) নক্ষত্রকে আকাশ পথে তাড়া করে বেরায়। আবার তাদের সাথে প্রাচীন গ্রীসের চাঁদের দেবী, আর্তেমিসের শিকারি কুকুরদের মিল উল্লেখযোগ্য। ওভিডের ‘মেটামরফসিস’ অনুযায়ী আরেক প্রবাদ প্রতীম শিকারী অ্যাক্তিয়ন কৌমার্যের দেবী আর্তেমিসকে স্নানরতা অবস্থায় দেখে ফেললে রুষ্ট হয়ে তিনি তাকে একটি হরিণে রূপান্তরিত করেন। না চিনতে পেরে নিজেরই অনুগত শিকারী কুকুরদের হাতে তার প্রাণ যায়। রবার্ট গ্রেভস-এর ‘গ্রীক মিথস’ বইতে আবার এই আর্তেমিসই হিংসুটে অ্যাপোলোর কথায় ভুলে সমুদ্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অরিয়নকে নরাধম ক্যানাডন ভেবে তীর ছুঁড়ে মেরে ফেলেন এবং ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাকে নক্ষত্রে রূপান্তরিত করেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে নবারুণ শিকারীর শিকারে রূপান্তরিত হওয়ার মেটাফোরটি অসাধারণভাবে ব্যক্ত করেছেন—
    “কলকাতা এমন এক অসাড়, অপেক্ষমান পিঁজরাপোল। তার শাস্তি মৃত্যু।”
    প্রসঙ্গত কুকুরদের দলপতি লাইকা আবার সোভিয়েত রাশিয়ার মহাকাশযান স্পুটনিকের তথা মহাকাশে মানুষের আগে যাওয়া অন্যতম প্রাণী (পড়ুন কুকুর) ও বিজ্ঞানের বহু পশুবলির একজনও বটে। যাই হোক, তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে পৃথিবীতে (কলকাতায়) নেমে আসে খোদ আনুবিস যাকে দেখে বৈজ্ঞানিকরা খাবি খেতে খেতে বোঝেন কাজটা ভালো হয়নি, শেয়াল/কুকুরমুখী মিশরীয় দেবতাটি স্বয়ং মৃত্যুর দেবতা কি না! আসলে নিরীহ কুকুরদের ওপর অকারণ অত্যাচার দেখে অমোঘ নিদান ঘোষণা করেছে লুব্ধক বা সিরিয়াস (কুকুর) নক্ষত্র, (যেখান থেকে আফ্রিকার ডোগোন উপজাতিকে জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি শেখাতে এসেছিল ‘নম্মস’ বলে ভিনগ্রহের অত্যাধুনিক জীবরা) কলকাতা মাত্র সাত ঘণ্টা ব্যবধানে এক গ্রহাণুর আঘাতে চিরতরে মিলিয়ে যাবে। অতঃপর এই চরম স্বার্থপর শহর ছেড়ে পালে পালে কুকুর চলে যেতে থাকে, ট্রাক, বাস, গাড়ি, ট্রাফিক সার্জেন্টকে অচল করে রেখে, যাকে ‘এক্সোডাস’ তকমা দিয়ে ক্যামেরায় বন্দী করতে তৎপর হয়ে ওঠে বিবিসি ও সিএনএন। মোশীর সাথে এমনিভাবে মিশর ত্যাগ করেছিল হাজার হাজার মুক্ত ইজরায়েলী, লোহিত সাগরে ডুবে ধ্বংস হয়েছিল তাদের মারতে আসা মিশরীয় ফারাওয়ের সৈন্য বাহিনী। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে নির্বিচারে কুকুর নিধন, কুকুর প্রজাতি ও কতিপয় পশুপ্রেমী ব্যতীত কোথাও বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করেনি, অথচ একদিন কুকুরের ভিড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাই হয়ে উঠল ব্রেকিং নিউজ!

    অন্যদিকে আবার বাদামী, বাহান্ন ও তদ্রূপ সাহসী কুকুরদের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা বিলক্ষণ মনে করিয়ে দেয় রুশ বিপ্লবের আণ্ডারগ্রাউণ্ড অপারেশনের কথা, রোজকার মার খেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখা প্রোলেতারিয়েতকে, যার অপেক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনে’। ‘পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট’ গল্পে রুবাকভের মৃত্যুর পড়ে যেমন নতুন করে জেগে ওঠে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ, পাঁজরভাঙা, অন্ধ, দিকভ্রান্ত, অস্থিচর্মসার বুড়ো কুকুরদের ‘কোল্যাটারাল’ ও স্বেচ্ছামরণই জন্ম দেয় কুকুরদের বিদ্রোহ।
    “আর দশ নয়, দশ হাজার বছর দিন ধরে দুনিয়া কাঁপবে।”

    এভাবেই ‘আন্ডারডগ’দের কথা, তাদের শোষণ ও ছিবড়ে করে দেওয়ার রাজনীতির কারবার উঠে আসে ‘ইকো-মার্ক্সিস্ট’ নবারুণের কলমে। মার্ক্সবাদ যে শুধু সাম্যবাদ ও স্বাধীনতার বুলি কপচানো নয়, তার সাথে মানুষের পাশাপাশি পশুপাখি, সমগ্র প্রকৃতিরও স্বার্থ যুক্ত তাই ঘোষণা করে তার বলিষ্ঠ লেখা।
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১৭:৪৬644884
  • http://www.aihik.in/aihik/Content/9/

    ফ্যাতাড়ু: কল্কী ও তার ঘোড়ার রগড়
    সিদ্ধার্থ বসু

    “পরিহাসের রসিকতায় উৎসারিত হয়ে
    সৈন্য, নটী, দালাল, ভাঁড়, ব্রাত্য, সার্থবাহের ঘরে
    স্বচ্ছলতা আশা আপোষ কাড়াকাড়ি বিলাস ব্যর্থতায়
    দেখেছিলাম কল্কী ও তার ঘোড়া রগড় করে”
    (‘যদিও আজ তোমার চোখে’, জীবনানন্দ দাশ)

    সমগ্র ফ্যাতাড়ু-সৃষ্টির— এবং এমনকি ‘হারবার্ট’, ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’, ‘লুব্ধক’ ইত্যাকার তথাকথিত সিরিয়াস উপন্যাস এবং আরো অজস্র গল্পেও— নবারুণ ভট্টাচার্যের পিভটাল থিম আমার মতে ওই দু’ লাইন: ‘সনি বা আকাই, কিছুই দেখিনা মোরা/ ঝামেলা পাকাই’| কিন্তু আসলে কি সত্যি কোনো পক্ষভেদ করেন না নবারুণ? একেবারে রাজনৈতিক অর্থেই কি নিরপেক্ষ বলতে পারি আমরা তাঁকে? হ্যাঁ, সনি বা আকাই-এর মধ্যে কোনো তফাত তিনি করেন না প্রকৃতই| কিন্তু আরো ধ্রুপদী ও আরো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে? না| সেখানে তিনি একেবারে ঘোষিতভাবেই পক্ষপাতদোষে দুষ্ট: প্রথম উপন্যাস ‘হারবার্ট’ এবং বহুশ্রুত নামের প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ থেকেই| ‘রাতের সার্কাস’ কবিতাগ্রন্থের ‘আমি কার সঙ্গে’ শীর্ষক কবিতায় পাই: যার চালচুলো নেই/ যে জানে/ শেষ হিসেবে/ চুল্লিই তার ঘর—/ সে কেন/ তোয়াক্কা করবে/ ক্যাবারে শহর/ .../ মরি আর বাঁচি/ কলম আর কাগজ নিয়ে/ আমি কিন্তু ঠায়/ তার সঙ্গে আছি’|

    ফ্যাতাড়ুদের প্রথম আত্মপ্রকাশের গল্পেই পাওয়া যায় মানুষকে অনেক ঘেঁটে-ঘুঁটে নতুন করে বানাবার শেষতম সুফল এই ফ্যাতাড়ুদের মূলগত কোয়ালিফিকেশন: বড় বড় অফিসে গিয়ে বহুক্ষণ অবহেলার অপেক্ষা সইতে সইতে মনে মনে খিস্তি করা, নাক খুঁটে চেয়ারের হাতলে লাগানো, নখ দিয়ে খুঁচিয়ে গদি ছেঁড়া, ল্যাভেটরিতে ঢুকে আয়না ভাঙ্গা, বেসিন ফাটানো, এবং দেয়ালে নোংরা কথা লেখা| হোপলেস কেস, আধমরা, লাথখোর ছেলে, খুচরো চিটিংবাজ, উটকো দোকানদার, খিদিরপুর, একবালপুর, কাঁটাপুকুর, সোনাগাছি, গরানহাটা, ভাল্লুকপাড়ার মাগ, হিজড়ে, আলবাল পদ্যগদ্য লেখক ‘সব মিলে কতগুলো সব?/ ওরা নয়, সহসা ওদের হয়ে আমি, কাউকে শুধায়ে কোনো ঠিকমত জবাব পাই নি’ (‘এইসব দিনরাত্রি’, জীবনানন্দ দাশ)| এবং এদের প্রোগ্রাম বা অপারেশন হলো ড্যামেজ: ‘না, না, খুনজখম নয়| ভয় দেখানো| নোংরা করা| ভণ্ডুল করে দেওয়া|’ হাতিয়ার বলতে মুড়ো ঝাঁটা, ভাঙ্গা উনুন, পচা শামুক, পচা আলুর দম ও পাঁঠার মাথার উৎকট ঘুগনি, সেলুন থেকে কুড়োন কাটা চুল, বেডপ্যান এবং তত্সহ বিষ্ঠা ও ছনছন মুত| তা এরা সব কারা? এদের ‘সম্রাট নেই, সেনাপতি নেই;/ তাদের হৃদয়ে কোনো সভাপতি নেই/ .../ স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণী নিম্নশ্রেণী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিধি থেকে ঝরে/ এরা তবু মৃত নয়; অন্তবিহীন কাল মৃতবৎ ঘোরে’ (‘এইসব দিনরাত্রি’; জীবনান্দ দাশ)। তাই কি নয়? সেই তারাই যেন এরা| এই ফ্যাতাড়ুরা| শুধু তফাতটা হলো, জীবনানন্দীয় ‘অন্তহীন নক্ষত্রের আলো’ যে ‘দীনতা’ তার শিকার হয়েই তাদের শেষ নয়, তারা প্রতিআক্রমণ করে এই দীনতাকে— নিজেদের দীন-হীন স্থিতি ও অক্ষমতাটুকু নিয়েই, দীনতাকেই সম্বল করে তারা প্রত্যাঘাত করতে চায় এই দীনতার কোনো আধোচেনা, অস্পষ্ট, বা অনেক ক্ষেত্রেই অচেনা উৎসের বিরুদ্ধে| হ্যাঁ| খুব গোদা শোনালেও নবারুণের কুশীলবরা সকলেই সাধারণ মানুষের পক্ষে| ভুল হলো| এরা নিজেরাই সকলে অতি সাধারণ সব মানুষ| এরা ‘জানে না কোথায় গেলে মানুষের সমাজের পারিশ্রমিকের/ মতন নির্দিষ্ট কোনো শ্রমের বিধান পাওয়া যাবে;/ জানে না কোথায় গেলে জল তেল খাদ্য পাওয়া যাবে;/ অথবা কোথায় মুক্ত পরিচ্ছন্ন বাতাসের সিন্ধুতীর আছে’ (‘এইসব দিনরাত্রি’, জীবনানন্দ দাশ)| এমনকি আরেকটু আগ বাড়িয়ে হয়ত এমনটাও বলে ফেলা যায় যে এরা ঠিক সাধারণ নয়, এদের অস্তিত্ব স্থিতিধর্মী নয়, বরং অন্তর্ঘাতমূলক| হারবার্ট থেকেই এই অবস্থানের চলা শুরু| মৃতের সহিত কথোপকথন-এর হারবার্ট যেন রেশনাল যুক্তিবাদিতার মুখের ওপর একটা বেপরোয়া চড়| যে রেশনালিটি মানুষকে খেতে-পরতে দেয় না, তিলমাত্র অবাধ্য হলে উৎপীড়ন করে, আর ‘রাজনীতি করতে’ গেলে প্রথমে পাগল বলে ও তারপর গুলি করে, তার এখনো জানতে বহুত দেরী আছে যে কে কোথায় বিস্ফোরণ ঘটাবে হঠাৎ| নবারুণের এই ‘রাজনীতি করা’ কুশীলবরা অবশ্য আক্ষরিক অর্থে রাজনীতিমনস্ক নয় কেউ-ই| কিন্তু প্রচলন বা প্রতিষ্ঠা-র বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে রাজনৈতিক হয়ে ওঠা ছাড়া আর কীই বা করতে পারত বা পেরেছে তারা?

    উৎপল দত্তের কালজয়ী নাটক ‘টিনের তলোয়ার’-এর শুরুর দিকে এক প্রান্তবাসী মানুষ জঞ্জাল ঘাঁটতে ঘাঁটতে ‘বাংলার গ্যারিক’কে ছুঁড়ে দেয়: ‘আমায় লিয়ে লাটক ফাঁদতে পারবে? আমায় লিয়ে? উহুঁম! চাটুজ্যে বামুনের জাত যাবে না তাতে?’ এবং এই ‘আমার’ পরিচয় দিতে গিয়ে সে শুধু বলে: ‘আমি কলকেতার তলায় থাকি’| তা এই তলায়-থাকা মানুষদের লিয়েই আমাদের ভটচায্যি বামুন কিন্তু আগাগোড়া নিয়োজিত| অথবা, শুধু মানুষ-ই নয়, কুকুর-বেড়ালদের জন্যেও সমান সংযোগে লিপ্ত তিনি| লুব্ধক, কালপুরুষের কুকুর-নক্ষত্র, যেন হয়ে ওঠে শহর পত্তনের উপজাত বর্জ্য যত অকালকুষ্মাণ্ডদের প্রতীক, যারা কিনা বেচতে কিনতে পারবে না বড় বড় ব্যবসায়ীদের মালমশলা| নবারুণের নিজের কথাতেই পাই, “ফ্যাতাড়ুরা টোটালি আমার পলিটিকাল কনশাসনেসের এক্সটেনশন”| আর এই পলিটিক্স প্রিচ করার ক্ষেত্রে মুখের ভাষাকে এক আদ্যন্ত প্রাসঙ্গিক হাতিয়ার করে তুলতে অন্ত্যজ মানুষদের ব্যবহার করেন যোদ্ধার সাজে, যুদ্ধে সামিল হয় তাদের নিজস্ব ভোকাবুলারি: ‘বোকাছেলে পুচু পুচু কোকাকোলা খায়/ বোকাচোদা বাপ তার পয়সা যোগায়’ কিম্বা ‘আয় মোরা সব গরিব যত/ বাঁধব জবর জোট/ একসুরে আয় বলব তেড়ে/ ভোটমারানি ফোট’| কিম্বা ‘এবে শোন পুলিশ পুঙ্গব/ আঁটি-বাঁধা কোঁকড়ার ঝাঁট/ মরা তোরে ডরাই থোড়াই/ বলে কবি পুরন্দর ভাট’— যেন তুষার রায়ের নিরীহ ‘পুলিশ ওরে পুলিশ/ কবি দেখে টুপিটা তোর খুলিস’-এর শরীরে একমুঠ বিষ-পিঁপড়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে| কবি পুরন্দরের সুইসাইড নোট শেষ হয় তুমুল ইঙ্গিতবহ ‘এক পা স্বর্গে এক পা নরকে ঝোলা/ একটি কামান, দুটি কামানের গোলা’ দিয়ে| আবার কোথাও বা তুমুল দার্শনিক সত্য: ‘সবাই বাগায় সবাই লাগায়/ সকলেরই হবে অন্ত/ আজ যেই শিশু করিতেছে হিসু/ কালই কেলাবে দন্ত’| সেইরকমই ‘গাছ হতে দেখো ঝরে টোপাকুল/ কেহ সি.পি.এম, কেহ তৃনমূল/ ডাইনোর দলে ভিড়িবে সকলই/ কাঁপি সন্ন্যাস রোগে/ আর যাহা বাকি তাহাও যাইবে/ মহাকাল জলযোগে’|

    কিন্তু নবারুণ খুব সোজা খেলুড়ে নন| মারাদোনার চেয়েও মারাত্মক তাঁর ড্রিবলিং| মেসির চাইতে অনেক জটিল তাঁর মেশিনারি| আর তাই ‘ভোটমারানি ফোট’ কবিতা শেষ হওয়ামাত্র পুরন্দরকে শুনতে হয় ‘নকশাল বলে ধরতে পারে কিন্তু’| আর অমনি পুরন্দর নামায় তার ‘দেশপ্রেমের কবিতাও আছে’: ‘কারগিলে হাড়গিলে ঠোকরাতে আসে/ বাজপেয়ী বাজপাখি ছেড়ে দিয়ে হাসে’; এবং তার ঠিক পরে পরেই ‘মাল্টিনেশনালের বিরুদ্ধেও লিখেছি’ বলে পুরন্দর আওড়ায় তার কোক ও পেপসি সমৃদ্ধ লাইন কটি| ‘বড়লোকের গাড়ির টায়ার/ ফুটো করে লাগাও ফায়ার/ নজরটুকু রাখবে যেন/ আঁচটুকু না লাগে আয়ার’-এ শ্রেণীসচেতনতার খোশবাই ধরতে না ধরতেই তাই ডি.এস. বলে ওঠে ‘কিন্তু আয়াকে ছাড়া হবে কেন? ফিমেল বলে?’ এবং সেখান থেকে শেষতক ‘আয়া যদি ডবকা হয় তাহলে কিন্তু ছাড়াছুড়ি নেই’ পর্যন্ত যায় কথার স্রোত| অর্থাৎ ‘গরিব যত’ বা সর্বহারাদের ‘জবর জোট’ মালটি অমন চিবুনো নয়, যে চট করে চিউইংগামের মত চ্যাপ্টা করে দেওয়া যাবে, আহা কেরেস্তানি ইউটোপিয়া থেকে গড বাদ দিলেই হলো-র মত করে| নবারুণের ‘সাবজেক্ট কিন্তু বড়লোক ভার্সাস গরিব’, ‘কিন্তু গোটাটাকে ধরা হয়েছে হাগার অ্যাঙ্গেল থেকে’ অর্থাৎ: ‘চেয়ার-পায়খানাতে হাগে বড়লোক/ বড়লোক কাগজেতে হেগো পোঁদ মোছে/ গরিবেরা মাঠে হাগে, তেড়ে আসে জোঁক/ গরিব নালার জলে হেগো পোঁদ ছোঁচে’| এবং পদ্য নামতে না নামতেই ডি.এস.-এর: ‘ক্যাঁচা হয়েছে গুরু| খাওয়া-দাওয়াতেই নয়, হাগার কেসেও হারামিপনা|’ অন্যত্র: ‘যতই তাকাও আড়ে আড়ে, হঠাৎ এসে ঢুকবে গাঁড়ে/ বাম্বু-ভিলার রেকটোকিলার গাঁটপাকানো বাঁশ/ আজ্ঞাবহ দাসবাবাজি আজ্ঞাবহ দাস’ এর অমোঘ সন্ত্রাস|

    এই কোটি কোটি মানুষের মুখের ভাষা ব্যবহারের মধ্যে যৌনতার ভূমিকা নিয়ে নবারুণ বলেন: ‘আমি কোনদিন এক্সপ্রেসিভলি সেক্সুয়ালিটি নিয়ে লিখি না| আমার ‘যৌনতা’র ব্যবহার মোস্টলি মজা, হিউমার| সেক্সুয়ালিটি মানুষের এমন একটা ব্যক্তিগত এলাকা, যেটা নিয়ে কিছু করতে গেলে আমাকে একটু ভাবতে হবে| আমার তো ডি.এইচ.লরেন্সের মত ক্ষমতা নেই’| অর্থাৎ ‘সেক্সিস্ট নবারুণ’ তকমা নিয়েও আবার ভেবে দেখতে হয় সমালোচকদের| যৌন অভিব্যক্তি নয়, “মাথায় শুধু একটা বুজভুম্বুলে চিন্তা ছিল যে, একটা গ্র্যান্ড খচরামি করতে হবে, বড় করে ফাঁসিয়ে দিতে হবে| সে থেকেই শুরু” হয় নবারুণের তুলকালাম ‘কাঙাল মালসাট’| টেকচাঁদ বা হুতমের সার্থক উত্তরাধিকার তাঁর ওপর বর্তেছে: ‘কে হে মূঢ় পড়িতেছ পানু/ নত মুখে হও নতজানু/ পাইলট মরে হেগে/ জেটপ্লেন ধায় বেগে/ রানুকে ধরিল বুঝি ভানু’ বঙ্গসংস্কৃতির মাফিয়াদের ধরে ফেলে হাতেনাতে| এবং ‘সঠিক যৌনকেশ/ ওই গেল বেঁকে/ সঠিক যৌনকেশ শোভে নানা ঠেকে/ সঠিক যৌনকেশ/ ওই করে রব/ ধন্য কহে দেশবাসী/ কিবা বৈভব’ ভাট কবিতায় বামালসমেত ফেঁসে যায় আমাদের পলিটিকাল কারেক্টনেস|

    “আমরা দণ্ডিত হয়ে জীবনের সভা দেখে যাই/ মহাপুরুষের উক্তি চারিদিকে কোলাহল করে” (‘মনোকণিকা: সাবলীল’; জীবনানন্দ দাশ)। পাতি কথায় রাজনীতির তত্ত্ব নয়, আধুনিক মানুষের আপাদমস্তক রাজনৈতিক আইডেন্টিটি নিয়েই কারবার নবারুণের| আর সেইখান থেকেই উঠে আসে তাঁর অশ্লীলতা, অবাধে কিন্তু সুকৌশলে খিস্তির ব্যবহার, এবং ক্ষমতাকেন্দ্রকে শুধু চ্যালেঞ্জ নয় একেবারে ঠাট্টা-মস্করার স্তরে নামিয়ে আনা তাঁর অভিসন্ধিমূলক উদ্ভটরস| যেখানে ক্ষমতার প্রত্যাঘাতে গু-মুত হলো সবচেয়ে এফেক্টিভ হাতিয়ার| তত্ত্ব পরিষ্কার: ‘গাঁড় মারি তোর মোটরগাড়ির/ গাঁড় মারি তোর শপিং মলের/ বুঝবি যখন আসবে তেড়ে/ নেংটো মজুর সাবানকলের’| কিন্তু রাস্তা খুব সোজাসাপ্টা নয়| যেখানে চোক্তার ভদির ‘সবরকম অশুভ অনুষ্ঠানে ঘর ভাড়া দেওয়া’ যেন হারবার্ট এর কথা মনে করিয়ে দিয়ে যায় আরেকবার| পুলিশের বড়কর্তাকে কালীপূজোর হুজ্জত সামলাতে খবদ্দারী ফলাতে গিয়ে নাকাল হয়ে ফিরতে হয় ভুতের হাতে, এক্কেবারে আলো-ঝলমল কলকেতা শহরের গা-ঘেঁষা অন্ধকারে| কমরেড আচার্যর সঙ্গে মোলাকাত হয় ঝুলন্ত স্থিরচিত্র থেকে সরাসরি পার্টি-অফিসের ঘরে ল্যান্ড করা স্ট্যালিনের| মিলিটারি ব্যবস্থাকে টুসকি মারার মত অবজ্ঞায় ভদি আর সর্খেলের বাতচিত হয় ‘ওভার অ্যান্ড আউট’ সহযোগে সৈনিক রীতি মেনে| এবং সর্খেলের খোঁড়াখুঁড়ির ফসল হয় এক ‘নুনু কামান’ যার প্রথম ব্যবহারের অব্যবহিত ফল দেখতে পাই ‘রিট্রিট, রিট্রিট! কামানের সঙ্গে নো গাঁড় মারামারি’| চাকতির খেল জমে উঠতে আমরা পাই বি-হেডেড সব মন্ত্রী-সান্ত্রী-নেতা দের যারা আবার হেলমেট কষে মাথাটিকে যথাস্থানে ধরে রেখেছেন| এ আক্রমণ সদলবল এবং সশস্ত্র| কিন্তু এর গতিপথ নির্ধারণ করে দিতে কোনো মাথাভারী আঁভা গার্দ বসে নেই কোনো উঁচু চুড়োয়| তাদের যুদ্ধের মতই তাদের অস্ত্রশস্ত্রও অভিনব ও আনকোরা| আর অবসিনিটি সেখানে এক ব্রহ্মাস্ত্র যা বাজার গরম করে না, ফুঁড়ে ফেলে, আক্ষরিক অর্থেই পেনিট্রেট করে| কবিসম্মেলনে মালতীলতা পাহাড়িকে ডি.এস.-এর: ‘....আমরা মা-বোনদের ইজ্জত দিতে জানি... গোঁড়গেলের ন্যাজ দিয়ে কান খুঁচিয়েছেন.... দেখা হবে, পাকা দেখা’ এবং তারপর বস্তা বস্তা আরশোলাসহ ‘বড়লোকের ছেঁয়া/ করছে টেঁয়া টেঁয়া/ বড়লোকের ছেঁয়ি/ করছে টেঁয়ি টেঁয়ি’— তীব্র অট্টবিদ্রুপে বাঙালির কচিদুর্বাদলশ্যাম কাব্যপ্রেমের মুখ ঘষে দেয় বিচিত্র বাস্তবের তপ্ত জমিতে| ‘মানুষটা মরে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি/ কেউ দেয়—বিনি দামে— তবে কার লাভ’ (‘লঘু মুহূর্ত’, জীবনানন্দ দাশ) এই নিয়ে সালিশি করতে তারা একবারের জন্যও বিচ্যুত হয় না| তাই খরা-বন্যা ধ্বস্ত বিপর্যস্ত এলাকায় জনদরদী নেত্রী আভা-র উদ্দেশ্যে, পুরন্দর নয়, বিপন্ন মানুষেরাই গান ধরে: ‘আভা দিদির মাই লো/ সবাই মিলে খাইলো’ এবং তারপর ‘উদরাময় হইলো’| মাইলো বিলোতে আসা আভাদিদির ‘মাই আর লো’র মাঝখানে শূন্যস্থানটি আমদের বিদ্ধ করে| তথাকথিত শ্লীলতা আর সফিস্টিকেশনের ঢাকনা ছিঁড়ে-ফেঁড়ে যায়|

    মানুষ সর্বদা যদি নরকের পথ বেছে নিত—
    (স্বর্গে পৌছুবার লোভ সিদ্ধার্থও গিয়েছিল ভুলে,)
    অথবা বিষম মদ স্বতই গেলাসে ঢেলে নিত,
    পরচুলা এঁটে নিত স্বাভাবিক চুলে,
    সর্বদা এসব কাজ করে যেত যদি
    যেমন সে প্রায়শই করে,
    পরচুলা তবে কার সন্দেহের বস্তু হত, আহা,
    অথবা মুখোশ খুলে খুশি হত কে নিজের মুখের রগড়ে|’
    (‘মনোকণিকা: মানুষ সর্বদা যদি’; জীবনানন্দ দাশ)।
    ‘কাঙাল মালসাট’-এর এক অধ্যায়ে পাই গঙ্গার দু’ পার থেকে ভূতেদের বস্তা বস্তা উড়ন তুবড়ি চার্জ-এর রোমহর্ষক বিবরণ: ‘মাঝেমধ্যে একটা আধটা পটাশ বা ইলেকট্রিক ঝাড়ের উড়ন রাতকে দিন করে দিচ্ছে| সেই শৈল্পিক আভায় দীন ও আনন্দময় ভূতগুলিকে স্পষ্টতর দেখায়| বেশিরভাগই খালি গা ও গামছা পরা| এদেরই বাড়ির মেয়ে ভূতেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে মশলা ঝেড়েছে, গুঁড়িয়েছে, ছেঁকেছে, রোদে দিয়েছে|... অবশ্য কলকাতার লোকেদের এটা জানা দরকার যে কালীপূজোর পরদিন ভোরে যে শীর্ণ শিশুরা আধপোড়া বা নিভে যাওয়া বাজি কুড়োতে বেরোয় তারা ভূত নয় বরং ছোট সাইজের জ্যান্ত মানুষ| ছেঁড়া প্যান্ট দিয়ে নুনু বা পোঁদ দেখা গেলেও তারা লজ্জা পায় না| ওই আধা-ন্যাংটো হাড়-জিরজিরে শিশুদের প্রতি কাঙাল মালসাটের উপহার’: বন্দুকের বারুদের মেশাবার অনুপাত এবং ‘এ বিষয়ে আর যা যা করণীয় তা ঠিক সাহিত্যের আওতায় পড়ে না’| উদ্দেশ্যপূর্ণ হিউমারের মুখোশ খসে গিয়ে সত্যিকারের মুখ বেরিয়ে পড়ে নবারুণের— যে মুখ একজন স্বঘোষিত বিদ্রোহীর মুখ— যে তার স্বরচিত কুশীলবদের নিয়ে পারি জমায় সেই দেশে, যাকে ‘উড়ো নদী বলে;/ সেইখানে হাড়হাভাতে ও হাড় এসে জলে/ মুখ দ্যাখে— যতদিন মুখ দেখা চলে’ (‘লঘু মুহূর্ত’, জীবনানন্দ দাশ)|

    ==================================================

    ফ্যাতাড়ুদের কুহক বিভ্রম, ফ্লাইং হিউম্যান বিইংস ও নবারুণের স্যাটায়ার সমূহ
    পাপড়ি রহমান

    তান্ত্রিক সাধকদের চাইতেও কলম সাধকেরা যে অধিক ক্ষমতাধর ও কুহক বিস্তারি, নবারুণ ভট্টাচার্য তা যথাযথ প্রমাণ করে গেছেন। তন্ত্রমন্ত্রের জোরে মনি হারা ফণির মতো আমরা যতোটা আচ্ছণ্ণ থাকি, বশীঃকরণের কার্যকারণে যতোটা নমঃ নমঃ থাকি, নবারুণের সিকাডশন তার চাইতেও ঢের গুন বেশি! এ কারণেই আমরা নবারুণের বিমুগ্ধ পাঠক হয়ে উঠি। আমাদের বিমুগ্ধতা শুধু নবারুণেই থেমে থাকে না, তা অচিরেই ফ্যাতাড়ু পযর্ন্ত গড়ায়।
    ফ্যাতাড়ু?
    ফ্যাতাড়ু কে? ফ্যাতাড়ূ কাহারা?
    হু আর দে? ইহারা কি?
    এই প্রশ্নের উত্তরে শুনতে পাই-
    বুঝতে পারছি না স্যার। ফ্লাইং হিউম্যান বিংস।
    (ফ্যাতাডুর বোম্বাচাক, পৃষ্ঠা নং ৩৫)
    ফলে নবারুণের জন্য আমরা যতোটা আকুলি-বিকুলি করি, ফ্যাতাড়ুর জন্যও ততোটাই।
    ফ্যাৎ ফ্যাৎ সাঁই সাঁই করে উড়তে থাকে ফ্যাতাড়ুর দল! তাদের সংগে আমি বা আপনিও কি উড়তে শুরু করি না?
    ফ্যাতাড়ু-- নবারুণের কলম সাধনার গুনে যাদের জন্ম হয়েছে।
    ফের হয়তো আপনার বা আমার মস্তিস্কে এই প্রশ্ন চিড়বিড়িয়ে ওঠে-
    ধুস—বলবেন তো ফ্যাতাড়ু আসলে কে?
    কিংবা সামান্য ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই কথা বারংবার ঘ্যানঘ্যানাতে থাকি--
    ফ্যাতাড়ুরা আসলে কি?
    জবাব কিন্তু একেবারে ওষ্ঠের আগাতেই রয়েছে--
    ঠিক কী তা বলতে পারব না। তবে ফ্যাতাড়ুরা হল খুব স্পেশাল। বুঝলে?
    ইতিহাসে দেখবে কত মহাপুরুষ মানুষকে নতুন করে বানাবার জন্য কত ফন্দি বাতলেছে। আমার তো মনে হয় অনেক ঘেঁটেঘুঁটে শেষমেশ এই ফ্যাতাড়ুই তৈরি হয়েছে। (পৃষ্ঠা নং-১৩)
    নবারুণ ভট্টাচার্যের বয়ানে ফ্যাতাড়ু-ব্যাখ্যা এই রকম। কিন্তু ফের যদি আমার বা আপনার কৌতুহল বাড়ে বা বাড়তেই থাকে তাহলে কি?

    ফ্যাতাড়ু হলো ফ্যাতাড়ু। ফ্যাতাড়ু আদতে আপনি বা আমি। তুমি বা সে। পর বা অপরও বলা যায়। তবে ফ্যাতাড়ুসিরিজ ভাল করে পড়ে-টড়ে অধীত বিদ্যা বলে বলতে পারি--
    ফ্যাতাড়ুরা হলো পোড়-খাওয়া মারমুখী জনগণ!
    ফ্যাতাড়ু হলো ঘুমিয়ে থাকা মানুষের জাগ্রত বিবেক। মানুষের অন্তরের অভ্যন্তরে থাকা ‘সুপ্ত-সু’। এবং এই ‘সুপ্ত-সু’ এর সৌন্দর্য অবর্ণনীয়।যেমন ঘোর-বর্ষাকালে নিকুলি বিলের সৌন্দর্য!বিলের অফুরন্ত জলরাশি আর তাতে অগণন ঢেউদের নাচন, নিরুদ্দেশের পানে দুর্মর ছুটে-চলা। নিকুলির অগাধ জলের চাদরের তলায় ভয়ে কম্পমান শাপলার কোমল-ডাঁটা! সেই কোমলতার উপর স্বলজ্জ ফুটে থাকা কুমুদের নয়াভিরাম পাপড়ি!মৃত্যু নিশ্চিত আছে জেনেও তার বেঁচে থাকা! যে কোনো মুহূর্তে বিশাল ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনাটুকু জেনেও তার ফুটে থাকা!ফুটতে ফুটতে কোমল থেকে কোমলতর হয়ে ওঠা!
    আজকের পৃথিবী যেখানে ‘কু’তে ‘কু’ তেপরিপূর্ণ, কুচিন্তা আর কুতর্কের আবাসস্থল—সেখানে ‘সু’ মানেই তো শুভ। শুভবার্তার ইঙ্গিতবহ! ফলে ‘সু’ এর আবির্ভাব মাত্রই সুবাতাস। সুচিন্তা। সুকর্ম। আর সুফলাফল।মানুষের অন্তর্গত সৌন্দর্যের নাম ‘সু’। আর যাবতীয় মন্দ কিছুই তো ‘কু’! কু মানেই অধর্ম।কালো।কুৎসিত।অন াচার।স্বৈরাচার আর অন্ধকার। এই ‘কু’এর প্রতি বিদ্রোহ জানান দিতেই ফ্যাতাড়ুদের ফ্যাতাড়ু হয়ে ওঠা।
    ফলে ফ্যাতাড়ুদের সু-গৌষ্ঠির স্টিকার দেয়া যেতে পারে। এই ফ্যাতাড়ুরাই তো পৃথিবীর মানুষের ভুল-ভাল, লোভ-লালসা, আর অসততার বিরুদ্ধাচার করে যাচ্ছে। আদতে এই ফ্যাতাড়ু নবারুণ নিজেই। নবারুণেরস্ব-রূপান্তর�� � যার রয়েছে উড়িবার স্বপ্নডানা! এই ডানাই তাকে রাখে জাল-জটলার বাইরে।অন্যের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মনে মনে এই স্বপ্নডানাতে ভর করেই হয়তো তিনি উড়তে চেয়েছিলেন।জানতেন, ওইভাবে উড়তে পারলে এই সমাজে একদিন পরিবর্তন আনা সম্ভবপর হয়ে উঠবে।এই জাতির যত নষ্টামি, ভ্রষ্টামি আর অন্ধতার পায়ে কুঠারাঘাত করা যাবে।
    স্বপ্নডানা মেলে উড়িবার আনন্দ একবার নবারুণের অনুভবে দেখা যাক---
    ‘চোখ খুলতেই ডি এস দেখল হলদে হ্যালোজেনের আলোগুলো চিড়িক চিড়িক করে ঘুরপাক খাচ্ছে, পাশে মদন নেই, সারা শরীরে পোকার পাখা গজাবার অবিমৃষ্য আনন্দ, রোমকূপে রোমকূপে পালানো বউয়ের আর্তচুম্বন, অন্যদিকে মহাকাশ থেকে গ্যাগারিনের বালকসুলভ মুখের নিষ্পাপ হাসি, অমনি ওপরের দিকে তাকিয়ে ডি এস দেখল...
    ...চৌকাঠে হলদে হ্যালোজেন আলোর পাশে উড়ন্ত মদন আকাশে থেমে আছে। আস্তে আস্তে হাত নাড়ছে আকাশের এক জায়গায় স্থিতু থাকার জন্য। দুপাটি নকল দাঁতের ওপরে হলুদ হ্যালোজেন সোনালি আভা তৈরি করছে।’
    (পৃষ্ঠা নং ১৩)
    ফ্যাতাড়ু বনে যাওয়া মানে স্বাধীন হয়ে যাওয়া। বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নেয়া।
    পরাধীন থাকা মানেই দাসত্ব স্বীকার করে নেয়া। পরাধীনতা, গ্লানি, জোচ্চোরি, মানুষে মানুষে তীব্র বিভেদ—এসবই তো সমাজ তথা রাষ্ট্রের উপর প্রভাব ফেলে। ক্রমে সমাজ তথা রাষ্ট্রের অবস্থা হয়ে ওঠে ‘বোঁদপড়া’ ডোবার জলের অনুরূপ।
    ‘বোঁদপড়া’ ডোবার জল এতটাই দূষিত যে, জলের দূর্গন্ধে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে! আর ফ্যাতাড়ুরা কিনা ওই জলেই বোম্বাচাক বানাতে পারে! এই জলবোমার বিস্ফোরনে যে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, তার কাছে এটম বোমার বিস্ফোরক কোন ছার? তবেঅই ডোবার বাসিন্দাদের যে জীবনচর্যা, তাও কিন্তু ভেবে দেখবার মতো বিষয়। কই-মাগুর-শিঙ্গি-শামুকে র চামড়া-মাংসের আকার-প্রকার বদলে এক্কেবারে রাবারের মতো হয়ে গেছে! ফ্যাতাড়ুদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্রের চাইতে অই ডোবার জলই অধিক চাহিদা সম্পন্ন! কারণ তারা জানে অযথা রক্তপাতে বৃথাই সময় ক্ষেপন, কাজের কাজ কিচ্ছুটি হবার নয়। পরিবর্তন ঘটাতে চাইলে ঘটে বুদ্ধি থাকা চাই। তোপ-কোপের সাহায্যে যে বদল তার আয়ূ ক্ষণস্থায়ী। রক্তপাতে, জীবন নিধনে শুধু সহিংসতা বাড়তে পারে, মূলের পরিবর্তন একেবারেই অসম্ভব!
    ‘সেই বোঁদপড়া ডোবার জল। পোকামাকড়, জার্মস থিকথিক করছে। কাকশকুনও ধারে বাড়ে যাবে না। পিচকিরি দিয়ে বেলুনে ঢুকিয়েছি।গিঁট দিয়ে বেঁধেছি জলবোমা।’
    ফ্যাতাড়ুরা জানে, পঁচাজলের বোম্বাচাক মেরেই কত কি যে হাসিল করা যায় ! অনাচারের আখড়া বিলকুল হাপিস করা যায়। বন্ধুক, বোমা, ককটেল,চাপাতি, ভোজালির দরকার নেই। ফ্যাতাড়ুদের অস্ত্র শামুক পঁচা আর বোঁদপড়া ডোবার জল।আর ওতেই কেল্লা ফতে হয়ে যায়!
    ফ্যাতাড়ু গৌষ্ঠীর যাবতীয় মিশনই সাকসেসফুল হয়ে ওঠে। তাদের ধরা খাওয়ার কোনো স্কোপ-ই নাই! ধরা খেতে খেতেই তারা উড়ে যেতে পারে। ব্যাটম্যানদের মতো সাঁই সাঁই ফ্যাৎ ফ্যাৎ করে যত্রতত্র পগাড় পার হতে পারে। যার রয়েছে উড়িবার ডানা, তাকে কিভাবেই বা আটকানো যায়? নবারুণও তাদের আটকাতে চেয়েছেন বলে মনে হয় না। ফলে ফ্যাতাড়ুরা সর্বত্রই গমন করে।
    বইমেলায়, শুভবিবাহে, বিশ্বকাপে, কবি সম্মেলনে, বাংলা সাহিত্যে, এমনকি সাধু সমাগমে। ছোল, ঢপিস্ট ও সংস্কৃতি সচেতন খোঁয়াড়ে ফ্যাতাড়ুরা অর্থ, যশ, খ্যাতির কিছুই নবারুণের গোলায় তুলে দেয় নি—যা দিয়েছে তা নিজের মতো করে বেঁচে থাকা, আর জীবনের অফুরন্ত রসদ!
    নিরন্তর যে প্রতিহিংসার আগুন আমাদের মধ্যে কখনও ধিকি ধিকি, কখনও ধুকধুক করেই চলেছে—যা কেলিয়ে পড়লেও নিভতে পারে না---তা অনেকাংশেই চরিতার্থ করার পথ ফ্যাতাড়ুরা আমাদের দেখিয়েছে।তা মায়ার খেলা দিয়ে হোক বা বোঁদপড়া ডোবার জল দিয়ে হোক।
    ফ্যাতাড়ুদের নানান কুহকের সংগে পরিচিত হতে হতে আমরা এও জেনে ফেলি যে, বৃথাই এই বিভ্রম! এই মায়াজাল বিস্তার ছলনা মাত্র!এই ছলনাটুকু না-করলে কিভাবেই বা সকল কিছু বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব ছিল? অই মায়াজাল না বিছালে ইস্পিতকে হস্তগত করা দূরহ হয়ে পড়ত। মায়া বিস্তারের ফলে আমরাআমাদের ইস্পিতকে লভি। লভি বড় সহজে। আর মায়াটুকু থেকে যায় ভূতলে। অবলুণ্ঠিতভাবে।
    ফ্লাইং হিউম্যান বিংস—এই না হলে ফ্যাতাড়ুদের কার্যকারণ হজম করা সহজ হতো না।
    ছিলাম চোদু, হলাম সাধু
    হতেই দেখি আজব বাঁড়া।
    হিপ পকেটে, বুক পকেটে
    ফাকিং ফরেন নোটের তাড়া
    ফ্যাতাড়ুদের এইরূপছবক তাহলে মাঠেই মারা যেত!

    সমাজের যত অসংগতি, জাল-জোচ্চরি, ফেরেববাজি, হিংসা-দ্বেষ, ‘কু’ বিষয়াদি—আর সেসবের প্রতি ঘৃণা-রাগ-বিদ্রুপ ইত্যাদি এস্টাবলিশ করতে গেলে ফ্যাতাড়ু না-হয়ে উপায় কি? পাঁড়-মাতাল না-হলে কি করে সম্ভব চোখ-কান বুঁজে এতসব যাতনা বয়ে বেড়ানো?
    নবারুণের এই কুহক বিস্তার,মায়ার খেলা আদতে এক ধরণের প্রতিবাদ। তিনি তো জানতেন এই সমাজের আগা-পাশ-তলা সবই বোঁদপড়া ডোবার জলের মতন দূষিত। দূর্গ্ধযুক্ত ও অপেয়।
    বাঙালির তরে যদি
    বাঙালি না কাঁদে
    চুতিয়া বলিয়া তাকে
    ডাকো ভীমনাদে

    হয়তো এই সব কারণেই লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য ম্যালেরিয়া নয়, কুইনাইন সারাতেই তৎপর ছিলেন। তিনি জানতেন বাঙালি জাতির পচন কাণ্ডে নয়, মূলে। আর মূলে পচন ধরলে বৃক্ষের উত্থান কিছুতেই সম্ভবপর নয়!
    (রচনাকালঃ ২৯ জুন ২০১৫)

    ===============

    নবারুণ ও বিপ্লব!
    রক্তিম ঘোষ

    “রাষ্ট্র ও বিপ্লব” বইতে লেনিন লিখেছিলেন, “What is now happening to Marx's theory has, in the course of history, happened repeatedly to the theories of revolutionary thinkers and leaders of oppressed classes fighting for emancipation. During the lifetime of great revolutionaries, the oppressing classes constantly hounded them, received their theories with the most savage malice, the most furious hatred and the most unscrupulous campaigns of lies and slander. After their death, attempts are made to convert them into harmless icons, to canonize them, so to say, and to hallow their names to a certain extent for the “consolation” of the oppressed classes and with the object of duping the latter, while at the same time robbing the revolutionary theory of its substance, blunting its revolutionary edge and vulgarizing it. Today, the bourgeoisie and the opportunists within the labor movement concur in this doctoring of Marxism. They omit, obscure, or distort the revolutionary side of this theory, its revolutionary soul. They push to the foreground and extol what is or seems acceptable to the bourgeoisie.”
    Subaltern –এর এতো ভদ্র ভাষায় খিস্তি পোষায় না। বাঙালীর বাচ্চা আবার এটুকু ইঞ্জিরি না মারালে পারে না। এক কথায় বললেই হয়, “বানচোদরা মানুষ না অ্যামিবা”, কে জানে?

    কথা হল যে নবারুণ না মহান না বিপ্লবী। আমি বলছি না, আসলে উনি এর কোনটা বলেই নিজেকে বোধহয় দাবী করেন নি। নবারুণ এখন একটা মৃত শরীর, যা গত বছর আগুনে জ্বলে গেছে। মগজটাও ছার পায় নি। কিন্তু বিপ্লবই বলুন আর মৃত মানুষ, বাজার বানায় বেশ ভালো। Emotion বিক্রি করে ব্যবসা চলে রমরমিয়ে। মৃতের সাথে বিপ্লবের দূরতম সম্পর্ক থাকলে তো আর কোন কথাই থাকে না। নবারুণের সাথে সম্পর্কটা অতটাও দূরের ছিল না তাই— কিন্তু, নবারুণ চলে যাওয়ার পর ফ্যাতাড়ুরা পরে আছে শুধু। বাকিটা? পণ্য আর কি! তাই ‘নবারুণ ও বিপ্লব’ বলে কোন বিষয়ের বাস্তব অস্তিত্ব নেই। আছে একটা সময়। তা নেহাতই past tense.
    ------------------------
    “Social justice goes through the history of Zorastrianism. Fighting evil underlies its essence, the Gathas are looking after the poor, separating what’s good and what is not.”— Prof. Skjaevvo.

    এ সময় এ পৃথিবীর কথা-
    যে পৃথিবীর বুকে শ্বাস নিই— হেঁটে চলি,
    কথা বলি পারম্পরিক অভ্যাসে,
    যেখানে নিজের ছায়াকেও ভয় হয়।
    জন্মায় একদলা ঘৃণা— একাকীত্বের দলন।
    ছায়ার ওপারে জানি আলো থাকে—
    ভয় ভেঙে চোখ খুলি;
    দেখা যাক, আকাশকে ছুঁতে পারি কিনা।

    বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুই ঐতিহাসিক অধ্যায়; নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দিকে দুই ধাপ এগোন আর মার্ক্সবাদের ঐতিহাসিক সারবত্তাকে বাস্তবের মাটিতে প্রতিষ্ঠা দান; এ সমস্তটাই গত শতাব্দীতে এ পৃথিবীর মাটিতে যুগান্তর এনেছিল। সোভিয়েত রাশিয়া আর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন রচনা করেছিল শৃঙ্খলিত জনতার মুক্তির মহাকাব্য। সারা পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবি নিপীড়িত মানুষ বিভোর হয়েছিলেন মুক্তির স্বপ্নে, সামিল হয়েছিলেন সচেতন উদ্যোগে। বাস্তবের মাটিতে সত্যকে আর ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার জীবন্ত দিশাকে সামনে পেয়ে বিশ্বজুড়ে মুক্তিসন্ধানী মানুষ যখন আপোষহীন সংগ্রামে এগিয়ে চলেছেন, ঠিক তখনই ধাক্কা এল। পতন হল রুশ সোভিয়েত আর বিপ্লবী চীনের। শুধু পতনই হল না হাঁটা শুরু হল ১৮০ ডিগ্রী বিপরীতে। স্বপ্নভঙ্গের এই ইতিহাসও বিগত শতাব্দীতেই ফেলে এসেছি আমরা। আর আজ কমিউনিস্ট আন্দলনের দেড়শ বছর পার করে আমাদের সামনে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক শিবিরহীন, বাস্তব বিকল্পহীন এক পৃথিবী।

    এ এমন এক সময়, যখন বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদের একচেটিয়া বিশ্বায়নী আগ্রাসন তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর নখে ফালা ফালা করে দিচ্ছে এই পৃথিবীর মাটি-সম্পদ আর মানুষের জীবন। বিপরীতে যমজ সন্তান হয়ে বেঁচে আছে শ্রেনীসংগ্রাম তার নিজের নিয়মেই। কিন্তু মার্ক্সবাদী মতাদর্শের নেতৃত্ব সেই সংগ্রামগুলিতে প্রায় অনুপস্থিত। ফাঁকা জায়গা দখল করেছে কোথাও সংগঠনহীন স্বতঃস্ফূর্ততার মতাদর্শ, কোথাও বা ধর্মীয় মৌলবাদ। আর বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদ, নিপীড়ন আর লুঠের ছককে নিত্যনৈমিত্তিক সাজিয়ে চলেছে নিত্যনতুন কায়দায় সংগঠিতভাবে, এমনকি প্রগতিশীলতার মুখোশেও।

    আমাদের দেশেও সংগঠিত কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক শতক পূর্ণ হতে চলল। দীর্ঘ বিভ্রান্তি— দিশাহীনতা— দোদুল্যমানতা— পথ খোঁজার পর্ব পেরিয়ে ৬৭ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বিপ্লবী লাইনেরও অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হবার মুখে। বিপ্লবী আন্দোলনের এই ধারা অসংখ্য আত্মত্যাগ, রক্ত–ঘাম-চোখের জল, দ্বন্দ্ব-সংঘাত পেরিয়ে বাস্তবের মাটিতে এখনও আপোষহীন এবং জীবন্ত। একই সাথে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রশ্নে সে আক্রান্ত ভিতরে বাইরে দুদিক থেকে। মূলত ভিতরের দিক থেকেই বলা চলে। এ রাজ্যের দিকে তাকালে দেখতে পাব তার অসংগঠিত ছিন্ন ভিন্ন দিশাহীন চেহারা। এ বাংলায় ঐতিহাসিক নন্দীগ্রাম-লালগড় আন্দোলনের পরবর্তীকালে বিশেষভাবে, বাস্তবত অনেক আগে থেকেই, মূলত সংশোধনবাদী, গ্রুপবাজী আর সামাজিক ফ্যাসিবাদী রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাসের সৌজন্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে মার্ক্সবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা ও অবিশ্বাসের জমি তৈরি হয়েই ছিল। লালগড় আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে বিপ্লবী শক্তির দোদুল্যমান ও নেতিবাচক দিশাহীন ভূমিকা সেই সঙ্কটকে আরও পুষ্ট করেছে। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বায়ন ও উদারনীতির প্রভাব অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তো বটেই, বাজারী পণ্যায়ন আর সংস্কৃতি ছাপ ফেলতে শুরু করেছে এমনকি দূরবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতেও। বাংলার রাজনীতিতে সামগ্রিকভাবে দিশাহীনতা গেঁড়ে বসেছে। প্রতিবাদী আন্দোলনগুলি বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে অব্যাহত থাকলেও কার্যত দিশাহীন এবং গতানুগতিকতার ধারাবাহিকতায় আচ্ছন্ন।

    চিন্তাশীল মানুষরা কি তাই বলে হারিয়ে গেছেন? অনেকেই যাননি। তাঁদের চিন্তা বেড়েছে, প্রশ্ন বেড়েছে, বেড়েছে দিশাহীনতাও। আর নিপীড়িত মানুষের সামনে গতানুগতিক আন্দোলন বিশ্বাসভঙ্গ আপোষ ও শেষ পর্যন্ত হতাশা বাদ দিলে অন্য কোন বাস্তব বিকল্পের প্রশ্ন সামনে নেই।

    তাই দেশটাকে, তাই জন্মভুমি বাংলাকে যেন কেমন অচেনা ঠেকে। এ যুগের আতশ কাঁচে সব কিছু দেখবার চেনবার অভ্যাস হয়ে গেছে কিনা। এক একটা জলজ্যান্ত মিথ আমাদের ভাবনায় গেঁড়ে বসে আছে। সবটাই কেমন আগে আগে ভেবে ফেলি। এটা ঠিক ওটা ভুল। এক লাইনের উত্তর। ব্যস! সব ঠিক ভুলের ঠেকা নিয়ে বসে আছে কতগুলো মিথ। সত্যের অনুসন্ধান করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে সবাই। নিজের দেশকে দেশের মানুষকে মিথ দিয়ে চেনা সম্ভব আদৌ! চলমান বর্তমানকে! আজ্ঞে না... মিথ মানে পুরাণের গপ্পোকথা মাত্র নয়। মিথেরও শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। এ যুগে মার্ক্সবাদী মিথ, নকশাল মিথ, হিন্দুত্ব মিথ, ইসলামী মিথ, নাস্তিকতা মিথ, জাতীয়তা মিথ, দেশপ্রেম মিথ, নৈরাজ্য মিথ, ইত্যাদি বহু বহু মিথ দেখা যায়। যার সাথে বাস্তবে সেগুলো যা তার কোন সম্পর্ক নেই। আজকের বাস্তবতার সাথে সেইসব বিষয়ের সম্পর্ক কি সেটা উপলব্ধিরও কোন চেষ্টা নেই। এক একজন— এক বা একাধিক দল এক একটা মিথের মালিকানা নিয়ে বসে আছে। বাজারে যেমন চলে আর কি। বেশির ভাগই সুবিধাবাদী কারণে, কম সংখ্যক না বুঝে অভ্যাসে। না চেনে যা ধরে এগোতে চায় তাকে। না চেনে মানুষ কি চায় তাকে। না চেনে বর্তমান সময়কে। না চেনে এ দেশটাকে, এদেশের মানুষকে। তাদের ঐতিহ্য–সংস্কৃতি–চেতন া-ইতিহাসকে। বর্তমানের ঘনীভূত সঙ্কটের গুরুত্ব উপলব্ধি করা তা দূরের বিষয়।

    ফলে তীর ছোটে ভুল স্রোতে, যদিও স্রোতটা চেনা। যারা রাজা হয়ে বসতে চায় তাদের জন্য ঠিকই আছে। কিন্তু যারা আত্মত্যাগে পিছপা নন, মানুষের মুক্তি আর প্রকৃত স্বাধীনতার টানে যারা ছুটছেন যুগ যুগ ধরে নানা দেশে মানুষের মাঝে, নানা নামে— নানা পন্থায়— নানান পরিচয়ে? তাঁরাও যে আটকে যাচ্ছেন প্রভূত সততা আর আন্তরিকতা নিয়েও সংকীর্ণ মিথ গণ্ডির মাঝে। ভাঙতে কেই বা চায়? না ভেঙে গতানুগতিক ছোটাছুটির অনুশীলনটাই সহজ বোধহয়।

    এ যেন একলব্যের গল্প। নিজের চেষ্টায়, নিজের শ্রমে অর্জিত জ্ঞান— ধনুর্বিদ্যা। দ্রোণ তাঁর কখনই শিক্ষক ছিলেন না। বরং দিয়েছিলেন অস্বীকৃতি। এদিকে কি প্রশ্নহীন আনুগত্যে কতদিনের অর্জিত জ্ঞান— ফলিত প্রয়োগের হাতিয়ার বুড়ো আঙুলখানা কেটে সঁপে দেন দ্রোণের পায়ে। এও এক মিথ। আনুগত্যের মিথ। গুরুবাদের মিথ। আত্মসমর্পণের মিথ।

    এখানেই ব্যাতিক্রম কর্ণের মতো লোকেরা।
    “সূত জননীরে ছলি
    আজ যদি রাজ জননীরে মাতা বলি
    ------------
    ----------
    তবে ধিক মোরে”

    “জয়ী হোক রাজা হোক পাণ্ডব সন্তান” কামনা করে পথে নামেন পথের সন্ধানে। ঘোষণা করে যান মানুষের মর্যাদা মূল্যবোধ। যাকে ভাঙিয়ে আপোষ হয়— ব্যাবসা হয়, তাকেই আঁকড়ে শেষ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেন। ভাতৃঘাতী তীর ছুটে আসুক, রথের চাকা তাকে তুলতেই হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য। মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য। সত্যকে আঁকড়ে ধরা মুক্তির সন্ধানে।

    বেঁচে থাক মানুষের প্রকৃত সুখ আর স্বাধীনতা সন্ধানীদের আপোষহীন পথ কেটে পথ বানানোর অনুশীলন, মনের জানলা খোলা রেখে— বাজুক আত্মসম্মানের সুর ফল্গুধারার মতো।
    “সূতপুত্র আমি, রাধা মোর মাতা
    এর চেয়ে নাহি মোর অধিক গৌরব।”
    এতো গেল বিপ্লবের কথা । নবারুণ কোথায় ?
    --------------------

    এতো অবাক কাণ্ড! শক্তিশেলের লক্ষ্মণের পাশে দাঁড়িয়ে বাতাসা চিবোনো মুখ নিয়ে হনুমান তাকিয়ে দেখছিল আকশ থেকে নেমে আসা লোহার ডিম। সময়ের তা পেয়ে ডিম ফুটে ওঠে। নবারুণ চোখ রাখেন মহাযানের আয়নায়। “আয়না অন্ধকার। তারপর তার কোণা দিয়ে বিদ্যুৎ চমকাবার আলো চিড় খায়। সমস্ত আয়নাটা জুড়ে ঠাণ্ডা আগুনের ঢেউ ওঠে। আবছা থেকে স্পষ্ট হয় এক একটা ছবি। ফের মিলিয়ে যায়। জায়গা, মানুষ, নাম, দেশ, সময় কিছুই জানে না দুখী...”। নবারুণ ভাবা practice শুরু করেন। ধমনীতে এসে লাগে সুবর্ণরেখার ছোঁয়া। “হাজার হাজার মানুষের মিছিল। ঢাল দিয়ে মুখ ঢাকা পুলিশরা দৌড়ে আসছে। সাঁজোয়া সেই ঢেউ-এর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয় মানুষের। লাঠি চলে, আতসবাজির মতো ধোঁয়া ছড়িয়ে উড়ে যায় টিয়ার গ্যাসের সেল, গুলি চলে। মানুষ গুলি খেয়ে পড়ে যায়। মানুষের রাগী সমুদ্র আছড়াতে আছড়াতে এগিয়ে আসে। পুলিশের গাড়ি উল্টে যায়। জ্বলে ওঠে। ফাঁকা রাস্তায় জুতো, চটি, চশমা পড়ে। এখানে ওখানে টায়ার জ্বলছে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে।”

    নবারুণ হিসাব কষতে বসেন। স্তালিন জমানা। গুলাগ কেসে মরা কনদ্রাতিয়েভ। পার্জে। “নেপলিয়নিক ওয়ার থেকে শুরু করে রাফলি পঞ্চাশ বছর ধরে ডিউরেশনের তিনটে ওয়েভ আইডেনটিফাই করার পরে,... পঁচিশ বছরের আপসার্জ... আবার ধরো টু অ্যান্ড হাফ ডিকেড ধরে ডিক্লাইন...” সাইকেল ঘুরে চলেছে। নবারুণ হয়ত অসহায় বোধ করছেন। ২০১১-এর লালগড়। জনসভায় বক্তব্য রেখে নেমে দেখলেন, পরবর্তী বক্তা মা-মাটি-মানুষের জয়ধ্বনি তুলছে। আর একদল ৩৪ বছরী বিপ্লবীরা তখনও অভ্যেসে খুঁজে চলেছেন, বন্দুকের নলে এখনও নিরোধ লাগানো কেন? এতো কম আদিবাসী মরল?

    এর অনেক দিন পর শ্মশান যাত্রার আগে পরে মৃতদেহের কপিরাইট চেয়ে কোন কোন বিপ্লবী দল লাফিয়ে উঠবে, নবারুণ জানতেন। জানতেন না শুধু, তারাই আবার শুয়োরের মতো বাঁশে লাশ ঝুলিয়ে নেওয়া সিআরপিএফ–এর “শহীদ” দের নামে স্টেডিয়াম চেয়ে আন্দোলনে নামবে। অথচ কনদ্রাতিয়েভ সাইকেলে নবারুণ ঘুরতে থাকেন। ভেসে ওঠে বিনুর মুখ। ক্যাট – ব্যাট – ওয়াটার – ডগ – ফিস। রয়ে যায় শুধু বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ গ্রাম বাংলার চিরস্থায়ী দুর্ভিক্ষ হয়ে। আবার চোখ চলে যায় মহাযানের আয়নায়। “এই বরফ ঠেলে রেল ইঞ্জিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বক্তৃতা করছেন লেনিন। ওভারঅল পরা শ্রমিকদের মিছিল এগোয়। সামনে হাঁটছেন কার্ললিবনেঘট্, রোজা লুক্সেমবুর্গ। কারাগারে নোট বইতে এক টুকরো পেন্সিল দিয়ে নিবিষ্ট মনে লিখে চলেছেন আন্তোনিও গ্রামসি। ফাঁসির দড়ি পরানো হচ্ছে জুলিয়াস ফুচিকের গলায়। সাইগনের রাস্তায় নিজের গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে বসে আছেন ধ্যানমগ্ন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ— জার্মান পরিখার মধ্যে স্টেনগান হাতে লাফিয়ে পড়ছে লাল ফৌজ। রক্ত, মাংস, কাদা, বরফ, ভাঙা ট্যাঙ্কের লোহা, বুলেট সব মিশে যাচ্ছে। খুন করা হচ্ছে প্যাট্রিস লুমুম্বাকে লাল্বাজার সেন্ট্রাল লক-আপের মধ্যে চারু মজুমদারের মুখ।” দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে ক্রমশ। নবারুণ খুঁজতে থাকেন পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্টকে।
    ---------------------

    পায়ে পায়ে ঠোক্কর লাগাটা নতুন নয়। কিন্তু টেনে প্রণাম মেরে উঠে দাঁড়ানোর অভ্যাসে শিরদাঁড়া ধনুকের মত বেঁকে গিয়েছে কত যুগ আগে। কেমন ছিলার মত সটান খাড়া হয়, আর বয়সের জং থেকে বেরিয়ে আসে মট মট শব্দ। যদিও সাঁঝবেলায় পিদিম আর ধূপ কাঠির জগত পেড়িয়ে আলোছায়ার খেলায়, হঠাৎ করে মৃত্যুকে চিনেছিল। ঠিক মৃত্যু বলা যায় কিনা জানি না, কিন্তু তার তো সেরকমই মনে হত তখন। মুহূর্তের মধ্যে মনে হত কেউ পড়ে নিচ্ছে তার মনের কথা, তার ভিতর আরও একটা অন্য কেউ, তার ভিতর আর এক— আর সবটার অন্য কেউ যেন সে নিজে। একম অদ্বিতীয়ম নিজেকে খুঁজে পেয়ে মনে হয়েছিল মৃত্যুকে ছোঁয়া যায়। আবিষ্কারের রাতেই হ্যালির ধুমকেতুর থেকে একটা অগ্নিপিণ্ড ছুটে এসে ভস্মীভূত হয়েছিল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। ষোড়শ শতকের মায়া উপকথা যে পুঁথির পাতায় সাজানো ছিল, অনেকটা তার পোড়া গন্ধের মত আভাস নাকে ভেসে আসে। সভ্য স্প্যানিশদের জ্বালানো সপ্তদশ অগ্নিকুণ্ডের আঁচ এসে গায়ে লাগে। প্যালেস্তাইন জ্বলছে। অদৃশ্য কোনও তৃতীয় পায়ে আবার হোঁচট লাগে। নিজের ভিতর অন্য কেউ, এই স্ব এবং পরাধীনতাকে প্রথম সভ্যতার অসুখ বলে জেনেছিল।

    অতএব বিদায়ের কাল। দর্শনের অসুখ নাকি নবারুণ নিজের মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করলেন? তারপরে— এই অন্ধকারে কালীঘাটের প্রাচীন মরা গঙ্গার পাশের শ্মশানের অন্ধকারে কয়েকটা করোটিকে হেসে উঠতে দেখা গেল। দূর থেকে মানুষের কলরব; বোধহয় শ্মশান যাত্রী। তাল রেখে কয়েকটা শিয়ালও ডেকে উঠলো: যব তক সুরয চান্দ রহেগা...। প্যালেস্তাইনের আকাশে যখন রকেট উড়ে আসছে একের পর এক, তখনই টেক অফ করলেন ফ্যাতাড়ুদের সৃষ্টিকর্তা। সাথে উন্মত্ত কয়েকটা উড়ন্ত চাকতি। ধিরে ধিরে ছুটতে শুরু করল নানা দিকে, কবন্ধ সমাজের উত্থিত শোষণের মুণ্ডুর দিকে তাক করে। মৃত্যু উপত্যকা জুড়ে হায়নার হাসির শব্দ ম্লান হয়ে ভেসে উঠলো আদিম অকৃত্রিম ফ্যাত ফ্যাত সাঁই সাঁই। কুমীরের কান্নায় আকাশ ঢেকে যাওয়ার আগে unpredictable বিস্ফোরণের সাবধান বাণী শুনিয়ে গেল যেন। প্রাসাদ গাত্রের দেওয়াল জুড়ে মুতের আঁশটে ঘ্রাণ ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠলো। গরীবের চোখের জল আর মুতের ঘ্রাণ সৃষ্টি ও শুকিয়ে ধ্বংস হওয়া যখন প্রাকৃতিক অভ্যাসে পরিণত, তখন নবারুণ চুল্লীতে চোখ বুজে ভস্মীভূত হবার আগে শেষ স্বপ্ন দেখছিলেন— "মাঝরাতে কারা রাইফেল কাঁধে হাঁটছে!"

    ==============================

    অ-ক্যাননীয় নবারুণ
    শতাব্দী দাশ

    “যে পৃথিবী রয়েছে আমাকে ঘিরে, আমি তাকে লেজিটিমাইজ্‌ড হতে দিতে চাই না। অতএব আমি এটাকে সারাক্ষণ আক্রমণ করি ও করব”।

    নবারুণ নিঃসঙ্গ নিশানের মতোই উড়বেন, স্ব-সাহিত্যকে বলবেন গেরিলাযুদ্ধ বা ‘মলোটভ কক্‌টেলের ফর্মুলা’ বা ‘পাটা মাইনের ডিটেইল্‌ড ডিজাইন’। সাহিত্যের ‘ক্যানন’ (Canon) বা কানন নিয়ে তাঁর ‘চুদুরবুদুর’ থাকার কথা নয়। ছিলও না।

    বাংলা সাহিত্যের ক্যানন-মানচিত্র নির্মাণের রাজনীতিটি বড় আলাদা কিছু নয়। মান্য লেখক, মান্য লেখা, মান্য ভাষা স্থির হয় নির্দিষ্ট প্রকাশন-সংস্থার/গুলির কাচঘরে। জাতি-বর্ণ-লিঙ্গের চেনা ছকে খেলা চলে। এমনও শোনা যায়, ‘একজন সংখ্যালঘু লেখক’ ‘দুজন মহিলা কবি/ঔপন্যাসিক’ ইত্যাদি সহজ ফর্মুলায় ‘পলিটিক্যাল কারেক্টনেস’ রক্ষাও করা যায়। মান্যরুচির ড্রয়িংরুমে তা নিয়ে কান্নাকাটি, হল্লাহাটি হয়। কারণ সে-হেন সাহিত্যের অলিন্দে বিচরণ করাও একরকম প্রিভিলেজ। কিন্তু অদ্বৈত মল্লবর্মণ বা কমলকুমার, জগদীশ গুপ্ত বা অমিয়ভূষণ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বা দেবেশ রায়, গীতা চট্টোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপ্নময়, ঝড়েশ্বর –এঁদের মেধা ও মননের ধাক্কায় জল-অচল-বর্গ ভেঙে যেতেও সময় লাগে না।

    আর নবারুণ তো ঘোষিত ভাবেই,স্বভাব-স্পর্ধায় অ-ক্যাননীয়। রাজনীতিটাই প্রত্যাখ্যানের, অস্বীকারের, বর্জনের। শুধু প্রতিষ্ঠানের মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে ‘লেখক’ বলে কুমীরছানার মতো বারবার তুলে ধরার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান নয়, চারপাশের ভুল ঘটমান, ভুল বিশ্বায়ন, ভুল সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ, ভুল এলিটিস্‌ম্‌, ভুল বামপন্থা— নিরন্তর বর্জন করতে করতে এগোচ্ছেন তিনি— একক র্যা ডিক্যাল। কখনও হারছেন, কোণঠাসা হচ্ছেন— ‘ভাসান’-এর পাগলের মতো, ‘বিকল্প রণনীতি’র অধ্যাপকের মতো, যারা পিছু হঠতে হঠতে ব্যক্তিগত পরিসরটুকুতে একান্ত নিজস্ব রণনীতির আশ্রয় নেয়। আবার কখনও জিতছেন— সেই জিতে যাওয়া আনরিয়েল, ম্যাজিক-রিয়েল, পোষ্টমডার্ন, মেটাফিজিক্যাল— যাই হোক্‌ না কেন। কারণ ফ্যাতাড়ুদের ডিরেক্টর-জেনারেলের মাথার ভেতর ‘ড্যামেজ করতে হবে সুযোগ পেলেই’ এই বোধ কাজ করে। এঁকে ক্যাননচ্যুত করতে তাই কোনো বহিঃ-রাজনীতির দরকারই বা কী? তিনি প্রতীতিগত ভাবেই, নিজ আয়াসেই বা অনায়াসেই, ‘নিজের মুদ্রাদোষে’ অ-ক্যাননীয়।

    সত্তরের নক্‌শাল আন্দোলনকে রাষ্ট্রশক্তি থেঁতলে দেওয়ার পর রাজ্যে এল সংসদীয় বামপন্থা। কিছু প্রতিস্পর্ধী স্বর তাও থেকে গেল, বিপ্লবের ভূত যাদের ঘাড় থেকে নামানো রেজিমেন্টেড বামদলের পক্ষেও অসম্ভব। ক্রমে সোভিয়েতের পতন ঘটল, বিশ্বের রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হল, বিপক্ষবিহীন প্রথম বিশ্বের হাতে জমতে লাগল পুঁজি। তৃতীয় বিশ্বে সেই ক্যাপিটাল চালানোর নাম হয়ে গেল বিশ্বায়ন। এমন কি, রাজ্যের বামেরাও কেন্দ্রীয় উদারনীতিতে সায় দিলেন ১৯৯৪-এ। এই লক্ষ্যভ্রষ্ট, আদর্শভ্রষ্ট পৃথিবীতে নবারুণ তাঁর ‘ব্যক্তিগত ফিউচারিজ্‌ম’-এর একটি রূপরেখা আঁকলেন অগত্যা। এই উলটপুরাণের পাল্টা ইমেজ তৈরি করাই হয়ে গেল শিল্পী হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক দায়িত্ব। উড়ালপুল আর শপিংমলের শহরকে তিনি শুধু বর্জনই করলেন না, বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ খুঁজতে লাগলেন অটোস্ট্যান্ড, রিকশাস্ট্যান্ড, আদিগঙ্গা, চোলাইয়ের ঠেকের মানুষজনের মধ্যে। এই অনুসন্ধানের ভূগোল-ইতিহাস তো আছেই। মার্ক্স-এর কথা, তাঁর বিপ্লবতত্ত্ব ও রাষ্ট্রতন্ত্রের প্রয়োজনীয় ও আবশ্যিক সংযোজন হিসেবে গ্রামশি ও আলথুসার-এর তত্ত্বাবলী— সবেতেই প্রোলেতেরিয়েতরাই বিপ্লবের পুরোধা। সাবঅল্টার্ন সাহিত্যিক হিসেবে নবারুণ সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং ‘সাবঅল্টার্ন’ শব্দটির গ্রামশি-কৃত ব্যবহারটিই নবারুণ-সাহিত্যের জন্যে সুপ্রযোজ্য। অর্থাৎ, যে র্যানন্ডম জনতাকে পলিটিসাইজ করা যায় ও করতে হবে, যাদের রাজনৈতিকরণ করতে হবে বৃহত্তর বিপ্লবের স্বার্থে। এই ‘সাবঅল্টার্ন’ শব্দটিই আশির দশকে ভারতীয় তাত্ত্বিকরা ব্যবহার করেন উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক শোষিতদের বোঝাতে। কিন্তু এই সাবঅল্টার্নদের মোবিলাই্জ করে কারা? সাবঅল্টার্নরা যেহেতু ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে, তাই তাদেরকে দিনবদলের/ পরিবর্তনের এজেন্ট হিসেবে দেখেন ইন্টেলিজেন্সিয়া এবং তাকে রোমান্টিসাইজ করার প্রবণতাও বিরল নয়— এমনটাই দাবি করেন গায়ত্রী স্পিভাক্। নবারুণের প্রতিরোধের সাহিত্যধারাটিও মোটামুটি এই পথের অনুসারী।

    নবারুণের প্রথমদিকের সাহিত্যে আমরা পাই বিপ্লববোধসম্পন্ন আপোষহীন চরিত্রদের— ‘ভাসান’-এর পাগল বা ‘বিকল্প রণনীতি’র মহীতোষেরা। আবার অদ্ভুত একলা মানুষেরা— বারেন, সদাশিব, চিতামানুষ— এদের একাকীত্ব ‘মার্ক্সিস্ট এলিয়েনেশন’ মনে করিয়ে দেয়। সিস্‌মোগ্রাফের মতো সংবেদনশীলতায় নবারুণ নতমস্তক মানুষের প্রতিটি হেরে যাওয়া আর অসহায়তার হিসেব রাখেন। ‘নস্ত্রাদামুসের আত্মহত্যার’র লেখক মেলান অতিকায় বালক আর তার পিতার অসহায়ত্বের সাথে বিশ্বজনীন ক্যাটাস্ট্রফিকে। ‘আমার কোনো ভয় নেই তো?’ আর্তনাদে সমবেদনার হাত রাখেন।

    অন্যদিকে, ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ বিপ্লবী উচ্চারণ হিসেবে একটা মিথ হয়ে ওঠে। এর সূত্রে হিন্দিবলয়ে ও সর্বভারতীয় স্তরে তাঁর বিপ্লবী পরিচিতি। ‘আটজন মৃতদেহ আমার চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে’— এই আটজনকে কিন্তু বরানগর বারাসতে মেরে রেখে গিয়েছিল নক্‌শালরাই, রাজনৈতিকভাবে যাদের নবারুণের সমর্থন করার কথা। বাঁধাধরা রাজনীতির গতে তাঁকে ফেলা মুশকিল। আশির দশকের মাঝামাঝি, আরনাল ও কানসরার গণহত্যা নিয়ে আবার লিখেছেন ‘পুলিশ করে মানুষ শিকার’। তাঁর কবিতায় সাম্প্রতিকতা আছে, কিন্তু প্রোপাগান্ডা নেই, রাজনৈতিক মেসেজ আছে, কিন্তু শ্লোগানধর্মীতা নেই। বরং আছে অদ্ভুত সব পোয়েটিক ইমেজারি। ‘এ মৃত্যু উপত্যকা’র একটি কবিতায় মানুষরা দেশলাই বাক্সের মধ্যে এক একটি কাঠির মতো শুয়ে থাকে (ম্যাচবাক্সের মানুষ) :

    বারুদ-মাখানো তাদের ঘরের দেওয়াল
    সেই দেওয়ালেতে মাথা ঠুকে কী যে চায়
    অর্থহীন ও নিতান্ত বরবাদ
    ফ্যাকাশে আগুনে নিজেরাই জ্বলে যায়।

    কিন্তু নাশকতার ইন্ধন থেকেই যায়। পেট্রোল দিয়ে আগুন নেভানোর স্বপ্নের দেখা মেলে তাঁর এক ছোট নন-ফিক্‌টিসাস্‌ গদ্যে। বা ‘পেট্রোল আর আগুনের কবিতা’য়। পরে ‘পারিজাত ও বেবি-কে’-তে এই তরল যাদুবাস্তবের বিধ্বংসী উপাদান হয়ে ওঠে।

    আবার কবি নবারুণের রূপকল্প সবক্ষেত্রেই নাশক নয়। ‘আকাশ তখন আমার লেখার টেবিল/ ঠাণ্ডা পেপার-ওয়েট হবে চাঁদ’ আমাদের অভিভূত করে। ‘লুব্ধকে’ দেখি— ‘অলৌকিক ভিক্ষাপাত্রের মতো চাঁদ/ দাঁতে কামড়ে ছুটে যাচ্ছে রাতের কুকুর...’

    কবিতার পথটি কিন্তু এরপর তিনি তাঁর গদ্যের জগতেও খোলা রাখবেন। বরং সেখানে বাস্তব থেকে পরাবাস্তবে তাঁর যাতায়াত আরও সহজ হবে। কবিতায় যদি বা তিনি মূলধারার আঙ্গিক ও ভাষার প্রভাব এড়াতে পারেন না, বা চান না, গদ্যে তিনি তা দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। কবি হিসেবে যেমন তিনি নিজেকে ‘এলিয়টের প্রভাবমুক্ত’ বলে ঘোষণা করেন এবং নেরুদা-এলুয়ার-মায়াকভ্� ��স্কি-হিকমেত এর আন্তর্জাতিক পরিসরটি বেছে নেন, গদ্যেও তিনি ছকে বাঁধা রিয়ালিজ্‌ম্‌-এর বাইরে একটা রাস্তা খুঁজে নেন গ্রসম্যান বা বুলগাকভ-এর মাধ্যমে— সোভিয়েত পর্যায়ের সাহিত্যিক হয়েও যাঁরা তথাকথিত রিয়ালিস্ট না। নব্বইয়ের দশকে ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ আর নবারুণের ‘হারবার্ট’ অভ্যস্ত নিশ্চিন্ততাকে আঘাত করল। হারবার্ট বুজরুকির সার্কাসকে বুজরুকি দিয়েই ভ্যাঙায়। একটি বহুস্তরী ন্যারেটিভে নবারুণ অবলীলায় ভিন্ন ভিন্ন মেরুতে যাতায়াত করেন— রিয়াল-আনরিয়াল, লজিক্যাল-ইল্‌লজিক্যা�� �। একদিকে হারবার্টের পরলোকগত জীবনের রহস্যানুসন্ধান, অন্যদিকে কমিউনিস্ট-পার্টির অনুষ্ঠানে ‘ফল অফ্‌ বার্লিন’ ডকুমেন্টারি দেখা। যুক্তিবাদীরা ভূতকাল নিয়ে হারবার্টের নাড়াচাড়া বিদ্রূপ করে, অথচ হারবার্টকে আসলে চালিত করে নক্‌শাল আমলেরই ভূত। সে র্যাতশনালিস্টদের কাছে হেরে গিয়েও আদায় করে সমবেদনা। পুঁজির আগ্রাসনে দ্রুত বদলে যাওয়া চারপাশের বিরুদ্ধে হারবার্টের প্রতিবাদ অতি ভঙ্গুর। তাও বিনুর লেপের তলায় বেঁধে রাখা ডিনামাইট ইলেকট্রিক-চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটায়। লেখক তাঁর প্রতীতি জানান— কখন কে কোথায় বিস্ফোরণ ঘটাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের তা বুঝতে এখনো বাকি আছে।

    দেবেশ রায় এক আশ্চর্য দৃপ্ত ভঙ্গি লক্ষ্য করেন উপন্যাসটিতে, যেখানে “এইটুকু আয়তনের একটি উপন্যাসে এত বংশলতিকা, বাড়িঘর, শহর, মানুষজনকে যে ঔপন্যাসিক আঁটাতে পেরেছেন তার প্রধান কারণ তাঁর ভাষা। শহুরে খিস্তি, রাস্তার বুলি, বাড়িঘরের সেকেলে বাচন, কথাবলার তেরছা ঢং মিলিয়ে ...একটা বিশিষ্ট ভাষারীতি তৈরি করেছেন। ঔপন্যাসিকের ক্ষমতা আঙুলের ডগায় না থাকলে ভাষাকে দিয়ে এ কাজ করানো যায় না”। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক্‌ও এই ভাষাকে বলেছেন : ‘a daunting mix of street slang, deadpan reportage and nineteenth century spiritual prose’.

    ‘ভোগী’তে গঠনশৈলী একরৈখিক, তুলনায় সরল। কিন্তু হারবার্টের মতো সে-ও এক বিপন্ন লুপ্তপ্রায় জীব— সে ভুবনায়িত সময়ে বিপজ্জনক সারল্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। ‘অটো’তে আবার অসহায় মানুষটিই হয়ে ওঠে ঘাতক। কারণ ‘যে মৃত্যু উপত্যকায় নবারুণের চরিত্ররা অনবরত ঘোরাফেরা করে, সেখানে মানুষের দুটোই চেহারা— হয় নিঃশব্দ ঘাতকের, না হলে অসহায় আত্মহননকারীর বা পরাজিতের’।

    হারবার্টের পর নক্‌শালবাড়ির বিপ্লবী রাজনীতি সরাসরি ফেরে ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’তে । প্রৌঢ় রণজয়, একদা গেরিলা যোদ্ধা, বর্তমানে মানসিক ভারসাম্যহীন, স্বয়ং বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার এমবডিমেন্ট উদারনৈতিক অর্থনীতির যুগে সে গেরিলা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। নবারুণ একরৈখিক ন্যারেটিভ, এমন কি, কাহিনীও বর্জন করেন। রণজয় ও অন্যান্যদের টুকরো টুকরো কথা ও চিন্তারাশির কোলাজ একটি পরিস্থিতি গড়ে দেয়— যুদ্ধ পরিস্থিতি।

    ‘লুব্ধকে’ কুকুরেরা রাতের অন্ধকারে ধ্বংসাভিমুখী শহর ছেড়ে চলে যায়। প্রাণমন্ডলের সাম্যবাদের সাথে আমরা অন্ত্যজের প্রত্যাখ্যানের স্পর্ধার ফ্ল্যাশও দেখতে পাই কি? ‘খেলনানগর’-এ তেজস্ক্রিয় নিরীক্ষায় ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের কঙ্কালের সামনে প্রথমেই পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, শক্‌-থেরাপিতে লেখক অবিচল থাকেন।

    ‘ফ্যাতাড়ু’দের আবির্ভাব যখন হল, ততদিনে সংঘবদ্ধ শ্রেণীসংগ্রামে বোধহয় আস্থা হারিয়েছেন লেখক। কিন্তু বিশ্বায়ন বা নব্য-উপনিবেশবাদের একবগ্গা মাস্তানিও মেনে নেওয়া যায় না। পুঁজিবাদ মানুষকে একই মাপে ছেঁটে ফেলবে, সাম্রাজ্যবাদ স্থির করবে কিভাবে প্রতিটি মানুষ ভাববে, দেখবে, রিঅ্যাক্ট করবে (বা করবে না), এই নিয়ত স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনে র সময়, উন্নয়নের নামে মানুষের অপমানের সময় লেখক তো মেটাস্টেটমেন্টই দেবেন। রাজনৈতিক ব্যঙ্গের চোখে রিয়েলিটিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি ম্যাজিক রিয়েলে পৌঁছচ্ছেন। আন্তর্জাতিক জোট নয়, ছোট প্রেক্ষিতে অন্তর্ঘাত— যে কোনো মূল্যে স্থিতাবস্থাকে ডিস্টার্ব করাই উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে: ‘কিছুই দেখিনা মোরা, শুনি আর খাই/ ওই একটাই কাজ— ঝামেলা পাকাই’। যা কিছু প্রাতিষ্ঠানিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক— সব কিছুকেই ফ্যাতাড়ুরা সন্দেহের চোখে দেখে। তারা নৈরাজ্যবাদী, কিন্তু মে-দিবসের বিদ্রোহীরাও কি ছিল না অ্যানার্কিস্ট? তারা অস্বীকার আর অসন্তোষের স্বর। প্রকৃতই, তাদের শৃঙ্খল আর পলিটিক্যাল কারেক্টনেস ছাড়া হারানোর কিছু নেই। শুধু ফ্লোটেলে, সভা-সমিতিতে, ফ্যাশন প্যারেড, আই-পি-এল-এ, এমন কি সুশীল মিছিলে ভাঙচুর করা আর হাঙ্গামা বাধানো তাদের প্রিয় বিনোদন। ‘জীবন্ত উড়ুক্কু মানুষ’দের ‘ওড়া’র ক্ষমতা থেকেই শুরু হয় মুখ বন্ধ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে সাবভার্সান। একে পোষ্টমডার্ন বলেছেন অনেকে। অনেকে বলছেন বাখতিনিয়ান, কারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কার্নিভ্যালের এ এক লাগাতার উদ্‌যাপন, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও আমোদগেঁড়ের মতো বেঁচে থাকার রাজকীয় উৎসব। কিন্তু ত্রৈলোক্যনাথের পর এমন উদ্ভটরসই বা আমরা কবে দেখেছি বাংলা গদ্যে? অবশ্যই ‘ফ্যাতাড়ু’ বিনাশবাদী, গঠনবাদী নয়। এ হেন অন্তর্ঘাতের তীব্রতা, ব্যাপ্তি ও ফলাফল নিয়ে আদপেই নবারুণ ভাবিত নন। কিন্তু ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বুর্জোয়া সমাজের উপর এই শেষ পদাঘাতটিরও প্রয়োজন ছিল। তারা অতীন্দ্রিয়, কিন্তু রিয়্যালিটি ব্যাপারটাই কি প্রশ্নাতীত? কলকাতা শহরের যে মানচিত্র আমরা জানি, তার ঠিক উল্টো মানচিত্রের সন্ধান দেয় তারা, এবং কোনটি বাস্তব— তা সফলভাবে গুলিয়ে দেয়।

    ‘কাঙাল মালসাট’-এ আর ‘মসোলিয়াম’-এ ফ্যাতাড়ুর গল্প ধীরে ধীরে বহুস্তরিক হয়, চোক্তাররা আসে, আসে দাঁড়কাক, বেগম জনসন ‘বুলগাকভের মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা’র ছায়া স্পষ্টতর হয়। যেখানে প্রফেসর উল্যান্ড আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা মস্কো দাপিয়ে বেড়ায় আর গুঁড়িয়ে দেয় শহুরে এলিটিজ্ম্, যাদের মধ্যে আছে বেহেমথ নামের খিস্তিবাজ কালো বেড়াল, যে ভালোবাসে দাবা, ভোদকা আর পিস্তল। বেজডম নামের পাত্তা-না-পাওয়া কবিও আছে, খানিক আমাদের পুরন্দর ভাটের মতো— পুরন্দর, যার প্রতিটি কবিতা আসলে নবারুণের রাজনৈতিক প্যামফ্লেট।

    এইভাবে নবারুণের সাহিত্যকোষটিকে যদি আমরা একটি ইউনিট হিসেবে দেখি, তবে তাঁর বহুমুখী দর্শনের উদ্ভাস হয়তো আমরা পাব, কিন্তু প্রতিষ্ঠান-বিরোধীতার অবাধ্য একবগ্গা একটানা রেওয়াজ চলতেই থাকে। এবং ক্যানন সংক্রান্ত আলোচনাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।

    নবারুণের ভাষা তাঁর রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজিরই আরেক দিক। অদ্বৈত মল্লবর্মন, দেবেশ রায়, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় বা ইলিয়াসের মতো এক নিজস্ব ভাষা তৈরি করে নেন তিনি। আদপে যা হেটারোগ্লসিয়া। তৈরি করে নেন, কারণ ‘লেখকের যদি তিলমাত্র অথেন্‌টিসিটি থাকে, তাকে নিজের ভাষায় কথা বলতেই হবে। সাহিত্যে খিস্তির ব্যবহার নিয়ে যেকোনো সমালোচনাই তিনি অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। ক্যাননীয় সাহিত্যে যা মান্য ভাষা, তাকে ‘সিন্‌থেটিক’ ভেবে বর্জন করেছেন। যে ভাষায় মিউচুয়ালম্যান হারবার্ট, ফ্যাতাড়ু, চোক্তাররা কথা বলে, সেই লক্ষ মানুষের কথ্যভাষা, জীবনধারণের, আনন্দের, দুঃখের ভাষা দিয়েও তিনি তথাকথিত মান্যভাষাকে চ্যালেঞ্জ করেন। বলেন, ‘আমি আমার সাহিত্যে খিস্তি ব্যবহার করি মানুষকে সম্মানিত করতে’। ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আমি কোনো ভাল্‌গারিটি করিনি’। হারবার্ট-এ প্রতিটি পরিচ্ছেদের শুরুতে ব্যবহার করেন অষ্টাদশ বা ঊনবিংশ শতকের বাংলা কবিতা, কারণ সেই ভাষায় মানকুমারী বসু, বা অক্ষয়কুমার বড়ালের ভাষায়, তিনি ‘এনার্জি’র একটা স্রোত দেখতে পান, যে ‘এনার্জি’ সাধারণ যাপনের নিত্যনৈমিত্তিকতা থেকে আসে।

    আমরা নবারুণের ‘ফর্ম’ বা ভাষা নিয়ে উল্লম্ফন করতেই থাকি, করাটা অস্বাভাবিকও নয়, কিন্তু তিনি বার বার মনে করিয়ে দিতে থাকেন যাবতীয় ফর্ম, যাবতীয় কৃৎকৌশল তিনি শুধুমাত্র কন্‌টেন্টের প্রয়োজনে আনেন। তাঁর সৃষ্টিকর্ম একটি ইন্টারডিসিপ্লিনারি প্রসেস। অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতিকে বাদ দিয়ে যা পড়া যায় না। তা ফর্ম নিয়ে নিরীক্ষামাত্র যে নয়, তা প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাডেমিশিয়াকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেন।

    ক্যানন ও নবারুণ সংক্রান্ত এই আলোচনায় মৃত্যু-পূর্ববর্তী সময়ে যে কাল্ট ফিগার, রক্‌স্টার নবারুণ— তাঁকে নিয়েও দু’চার কথা বলতে হয়। ফ্যাতাড়ু-উত্তর সময়ে বাংলা সাহিত্যে তিনি নিজেই এক প্যারালাল প্রতিষ্ঠান। আসলে এই ফ্যাতাড়ুইজ্‌ম্‌ বা ফ্যাতাড়ুডমেরও একটা কমোডিটি ভ্যালু আছে, তা লেখকের অভিপ্রেত হোক বা না হোক। কারণ, ফ্যাতাড়ুরা উইশ-ফুলফিলমেন্টের দ্যোতক। সমাজতত্ত্বের রিলেটিভ ডিপ্রাইভেশন নীতি অনুসারে ফ্যাতাড়ুদের রগড়ে অনেকেই ডিপ্রাইভেশনের সাময়িক উপশম খোঁজেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় বা বাস্তবে, স্বঘোষিত ফ্যাতাড়ু যেসব যুবা ও যুবতী, তারা ফ্যাতাড়ুর রগড়ের আড়ালে তার কান্না, তার ট্র্যাজিক মুখ দেখে কি? নবারুণের কথায় যা ‘অন্ত্যজের স্পনটেনিয়াস এক্সপ্রেশন অফ প্যাশন’ তা ইন্টেলিজেন্‌সিয়ার খিস্তিবিলাসে পরিণত হয় না তো? নবারুণ কিন্তু রাজনীতির পথ ধরে তাঁর বিপ্রতীপ সাংস্কৃতিক (Counter Cultural) উচ্চারণে পৌঁছেছিলেন। ফ্যানডম উল্টো পথে হাঁটে— সৃষ্ট ভাষা ও ভাষ্য ধরে রাজনীতিতে পৌঁছতে চায়, বা চায় না। বাংলা সাহিত্যে প্রতিস্পর্ধী সংস্কৃতি কেন পুরুষালি ও পুরুষ-প্রধান, এবং তা হলেও তা কেন বিশ্লেষণযোগ্য নয়, তা আলোচিত হয় না। কিউ-এর ছবিতেও নবারুণ বলেন, রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষাকে emasculate করেন, অর্থাৎ রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী পৌরুষের ভাষাই তিনি ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কারণ তাঁর শৈল্পিক স্ট্র্যাটেজিতে সেটাই প্রয়োজনীয়। এইভাবে যে শুধু ‘অটো’, ‘ভোগী’ বা ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’র নবারুণ ঢাকা পড়ে যান তাই নয়, গৌণ হয়ে যান মহাজানিক নবারুণ, হারিয়ে যান কেঠো মার্ক্সবাদকে অস্বীকার করা নবারুণ। চরাচরের প্রতিটি জীব ও জড়ের বেঁচে থাকা বা টিকে থাকা নিয়ে উৎকণ্ঠিত ইকো-কমিউনিস্ট নবারুণ হারিয়ে যান, যিনি মার্ক্সীয় সাম্য-কে বৃহত্তর জগতের প্রেক্ষিতে দেখেন—

    গাছেদেরও কি শীত করছে এমন
    কুকুরদেরও কি করছে এমন
    রাস্তা, সিনেমাহল, টিপকল, রেস্তোরাঁ
    বিউটি পার্লার
    সকলেরই কি শীত করছে এমন ?

    (শীতে জমে যাওয়া মরা ভিখিরির গান)

    আইকন নির্মাণের প্রক্রিয়ায় এই বহুস্তরী নবারুণ হারিয়ে যান বলেই মনে হয়। কেন? সহমর্মিতা, ভালোবাসা ততটা ম্যাস্কুলাইন নয় বলে?

    অবশ্য শুধু লিঙ্গ-রাজনীতি নয়, যৌনতা থেকেও নবারুণ-সাহিত্য যোজন দূরত্ব রক্ষা করে। আর এখানেই হাংরি প্রজন্মের প্রতিষ্ঠান-বিরোধীতার সাথে তাঁর তফাৎ তৈরি হয়। তুষার রায় থেকে সমীর রায়চৌধুরী থেকে মলয় রায়চৌধুরী— এঁরা জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করেছিলেন। তাঁরা যৌনতা নিয়ে মুখর, অস্তিত্ববাদী সংকট নিয়েও। বিশ্ব-রাজনীতির টানাপড়েন সেখানে ব্যাকড্রপ। কিন্তু নবারুণের সাহিত্য তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতারই প্রসারণ। নবারুণের বিষয়, আঙ্গিক, ভাষা সবই যে ভয়ংকর রকম প্রকাশ্যভাবে নাশকতাবাদী, তার স্পষ্ট উচ্চারণ :

    কত জায়গায় তো ফেলি আমি দেশলাই
    একবারও ভুল করে নয়,
    যদি কেউ আগুন
    জ্বালায়...
    (পাঠকের কাছে প্রশ্ন)

    তাঁকে নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা তাই দিনের শেষে বৃথা মনে হয়। কারণ যখন শুধু প্রায়োগিক নয়, তাত্ত্বিক-জগতেও মার্ক্সবাদ ধাক্কা খাচ্ছে, পোস্টমডার্নিজম্, পোস্টস্ট্রাক্চারালিজ ম্-এর ছেনি-হাতুড়ি নিয়ে ভাঙাচোরা হচ্ছে, বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি, তখনও নবারুণ এসবকে ‘দু’দিনের ভাইরাস’ বলছেন; বলছেন, যেমন বলেছিলেন সার্ত্র– ‘সবই আছে মার্কসে’। খুঁজে নেওয়ার অপেক্ষা। বলছেন, আদর্শবাদকে ‘ফালতু’ বলে নাকচ করতে তিনি দেবেন না। তিনি মানবেন না যে, ‘মতাদর্শ নিছকই হাত উড়ে যাওয়া মানুষের ফাঁকা আস্তিন যা গুটিয়ে ফেলে কোনো লাভ নেই’। তিনি অন্ধবেড়ালের মতো ঝঞ্ঝার রাতে বিধ্বস্ত হোটেলের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকবেন। যদিও আবার বলবেন, ‘অথচ কথা ছিল গল্প শোনার ও শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ার... কিন্তু সব শেষ হয়ে যাচ্ছে’ (সব শেষ হয়ে যাচ্ছে)— যা প্রায় প্রলাপের মতো শোনাবে, কিন্তু আমরা মাথা নত করে শিখব ‘না’ বলতে, আপোষহীন প্রত্যাখ্যান শিখব। এবং ক্যাননে বা প্রতিষ্ঠানে তাঁর অনুপস্থিতি নিয়ে মাথাটি ঘামাব না। কারণ এ নিয়েও মোক্ষম কামানটি দেগে গেছেন তিনি:

    নিউক্লিয়ার যুদ্ধে
    বিশ্ব যেবার ধ্বংস হয়ে যায়
    গোটা মানব সংসারই যখন
    ছাইয়ের গাদা
    সব দেশ যখন শেষ
    তারও পরে বেরিয়েছিল
    শারদীয়া দেশ
    অপ্রকাশিত, এক আঁটি
    রাণুকে ভানুদাদা।

    ‘Manuscripts do not burn’— বুলগাকভ-এর এই আত্মজৈবনিক বচনের অনুবাদ করে কাঙাল মালসাটের এপিগ্রাফে লিখেছিলেন— ‘পান্ডুলিপিরা পোড়ে না’। ক্যানন-কে পদাঘাত করার কাজটি কি তখনই সুসম্পন্ন হয় নি?
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১৭:৫৪644885
  • http://www.aihik.in/aihik/Content/9/

    মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে নবারুণ পাঠ
    রমিত দে

    বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন নবারুণ, এবং হয়ত সার্বিকভাবে মার্ক্সীয় রাজনৈতিক চেতনা ও শিল্পচেতনার অনুসারী হয়েই তিনি তাঁর সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের তত্ত্ব খুঁজেছেন বারবারে।খুঁজেছেন নিম্নবর্গের চেতনার নথিপত্র। এমনকি তাঁর এই মতাদর্শের সুক্ষ অনুরণন আমরা পাই তাঁরই গল্পসংকলের ভূমিকায়। যেখানে তিনি বলছেন- ‘“দলিত মথিত মানুষ ও তাদের জীবনের এক বিচিত্র ক্যালাইডোস্কোপের মধ্যে আমার জীবন কাটছে। চারপাশে তাই আমি দেখি। কিন্তু চূড়ান্ত নিরিখে এই বাস্তবকে আমি চিরস্থায়ী বলে মানি না। বাস্তবকে পালটাতে হবে। হবেই। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় চেতনা তৈরী করার ক্ষেত্রে সাহিত্যের অবশ্যই একটা বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ...। গোটা দুনিয়ার মানুষকে এক নিষ্ঠুর ‘ভুলা মাসানের পাকে’ ফেলে দেওয়া হয়েছে। এই অপদেবতাকে আমি ঘৃণা করি এবং তার নিঃশর্ত মৃত্যু চাই। সে আমাকে নতিস্বীকার করাতে চায়। বোঝাতে চায় যে ইতিহাসের সামনে আর কোনো পথ নেই, মতাদর্শ নিছকই হাত উড়ে যাওয়া মানুষের ফাঁকা আস্তিন যা গুটিয়ে কোনো লাভ নেই। সে যত একগুঁয়ে আমিও তার কথা বুঝতে ততটাই নারাজ। শেষ হাসিটা অপদেবতা নয়, মানুষই হাসবে। ইতিহাস সেই ভরসাই দেয়।“...এ তো গেল নবারুনের ব্যাক্তিগত মতাদর্শের ধারনা যা তাঁর সাহিত্যে বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু একজন পাঠক হিসেবে কেবল তার গল্পে বাস্তবতা আছে সমাজ আছে নিম্নবর্গ আছে অভিজ্ঞতা বিনিময় আছে এমন মত দিলে তাঁর গল্পের উপন্যাসের সামগ্রিক সৃষ্টির নিবিড় পাঠ অসম্পূর্ণ থাকে বলেই মনে হয় কারণ নবারুণের মত একজন সাহিত্যিক কেবল জীবনবাস্তবতার ছবিই আঁকেননি বরং একজাতীয় মনোবিজ্ঞানের চর্চাও করেছেন আর তাই তার কথাসাহিত্যে প্রতিবিম্বিত হয়েছে বিভিন্ন আকারে । হয়ত এই অস্পষ্ট নির্দেশগুলো, ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির-ব্যক্তির সাথে সমাজের-সমাজের সাথে প্রাত্যহিক জীবনের এই সজ্ঞান ও নির্জ্ঞান সংঘাতগুলোকেই আমরা মার্ক্সীয় সাহিত্যতত্ত্বের আলোয় তার গল্পের চরিত্র তার ডায়ালেকটিক তার ভাষা এবং সামগ্রিক ডিসকোর্সটিকে ফেলে দেখতে পারি ...
    এখন শুরুতেই খুব সরল কথায় দেখা যাক মার্ক্সীয় ক্রিটিসিজম ব্যাপারটা ঠিক কি ! সাহিত্য আলোচনা করতে গিয়ে যে বিভিন্ন ব্যাখান বিভিন্ন মূল্যায়ন তার মধ্যেই এটি একটি।অন্যান্য শ্রেনি থেকে পার্থক্য বলতে মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্ব সমাজ ও সাহিত্যকে পারস্পরিক সংলগ্ন বলে মনে করে।মনে করে মানুষের যাবতীয় মনন যাবতীয় মতাদর্শ সমাজ ও অর্থনীতির বিন্যাসের সাথে সুস্পষ্টভাবে বিন্যস্ত। অর্থাৎ সাহিত্য নিজেই একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান সেখানে। মার্ক্স তাঁর ক্যাপিটালেই বলেছিলেন মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে থাকে উৎপাদনের হাত ধরে গড়ে ওঠা কিছু অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং সেই ভিত্তির উপরই গড়ে ওঠে একাধিক উপরিসৌধ যার মধ্যে সাহিত্য অন্যতম। সেই সাহিত্যের মধ্যে সেই ভাষার মধ্যে মানুষের অস্তিত্বই আসলে লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে আছে দৈনন্দিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অস্তিত্ব বজায় রাখার সাক্ষ্য । যেকোনো একটি দেশের একটি সমাজের সাধারন ভিত্তিই হল উৎপাদন পদ্ধতি আর তাই পুঁজিবাদী তৃতীয় বিশ্বে শাসন ও শোষনই হয়ে উঠেছে নবারুণের সাহিত্যভিত্তি। তারই উপরিসৌধ হিসেবে ভাবনাগুলোকে টান দিয়েছেন ডমিন্যান্টদের সাথে প্রলাতেরীয়েতদের সামাজিক সম্পর্কের প্রক্রিয়াটিতে। কতৃর্ত্বের অধিকার প্রভুত্বের অধিকার শাসনের অধিকারের সাথে সাথে গভীরভাবে অনুসন্ধান করে গেছেন সাবল্টার্ন জগতটিকে। সেখানে পরনির্ভরতার মধ্যেও আছে প্রতিবাদের , পরিবর্তনের মনন, প্রতিরোধের নানান অভিনব পন্থার মধ্যে দিয়ে আছে একটি প্রতিবিপ্লবের ইংগিত আর এই প্রতিবিপ্লব তো মার্ক্সীয় চেতনাতেই জারিত। লেখক নবারুন তাকে ভাষা দিয়েছেন যা আদতে একটি ভাবেরই বাহন। এখন আমাদের পাঠকের কাজ লেখকের এই যে সম্ভাব্য অভিজ্ঞতা লুকিয়ে আছে পাঠের মধ্যে তার আবিষ্করণ কারণ মার্ক্সীয় সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে নবারুণকে পাঠ করতে হলে আমাদের পাঠককে পাঠ অন্তর্নিহিত সেই প্রত্যাশার দিগন্তটিকে খুলে দিতে হবে।
    নবারুণের গল্পের পাঠকৃতির নিহিতার্থকে মার্ক্সিস্ট পারস্পেকটিভ থেকে ইন্টারপ্রেট করতে হলে আমরা মার্ক্স তাত্ত্বিক পিয়ের মাশারির “থিওরি অফ লিটেটারি প্রোডাকশনে’র মত কিছু আধুনিক তত্ত্বের দ্বারস্থ হতে পারি। স্রষ্টা ও পাঠউপভোক্তার পারস্পরিক অভিঘাতে গ্রহনতত্ত্বের যে রসায়ন বা গ্রাহক সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে অতীত পাঠের বয়ানে নতুন পাঠের সম্ভাবনার যে খোঁজ ষাট সত্তরের দশক থেকে সাহিত্য সমালোচনার পরিপূরক হয়ে উঠল সেখানে মাশারি তাঁর “থিওরি অফ লিটেটারি প্রোডাকশনে’র দর্পণে একজন মনস্বী পাঠকের কাছে মূলত কি দাবী করলেন ! মাশারির বক্ত্যবের মূলে ছিল দুটি উপাদ্য- প্রথমত-what does the text say-এবং দ্বিতীয়ত-what does the text not say…& why does it not say it… মাশারি মনে করতেন সাহিত্যের প্রতিটি সৃজনের মাঝেই কিছু না কিছু রহস্য আছে কিছু না কিছু অব্যক্ত এবং একজন প্রকৃত পাঠক ও প্রথম শ্রেনীর উপভোক্তার কাজই হল পাঠের গভীরে লুকিয়ে থাকা ওই অব্যক্ত শূন্যায়তনকে আবিষ্কার করে তার বহুমাত্রিক মূল্যায়ন প্রদান করা। মাশারি যেকোনো সাহিত্যের মধ্যবর্তী এই গ্যাপ এবং সাইলেন্সগুলোতে থেমেছেন বারেবারে এবং পাঠককেও থামতে বলেছেন গল্পের ভেতরের লাক্ষণিক বা Symptomatical এলিমেন্টগুলোর কাছে , কারণ লেখকের লেখাচিত্র অনেকটা আয়নার মত, সেখানে বাস্তব থেকে উঠে আসা একটা মতাদর্শ বা দর্শনের প্রতিফলন থাকে কিন্তু একটি গল্পকে ভাবপ্রকাশের উপযোগী এবং নান্দনিক শৈলী প্রদান করতে গেলে সম্পূর্ণ বাস্তব বা হিস্টোরিকাল রিয়েলিটি সবসময় স্পর্শ করা সম্ভব নয়। লেখক তাঁর নিজের মত করে সমাজের , বাস্তবের ফ্র্যাগমেন্ট্রেড ইমেজগুলোকে নির্মাণ করেন এবং পাঠক সেই নির্মাণে লুকিয়ে থাকা ফাঁক দিয়েই পাঠের পুনগর্ঠন ও পুনর্নবীকরন ঘটাতে পারে। মাশারির যুক্তিতর্ক ধরে নবারুণের গল্পপাঠের মার্ক্সীয় আলোচনায় প্রথমেই আমাদের এমনই কিছু লাক্ষণিক উপকরনের কাছে অথবা বলা ভালো কিছু আপাত অদৃশ্য প্রশ্নের মুখোমখি হওয়া উচিত।যা থেকে নবারুনের গল্প উপন্যাসে মার্ক্সীয় বীক্ষনটির সুস্পষ্টতা সহজেই পরিলক্ষিত হয়।প্রশ্নগুলি কেমন হতে পারে !-
    ক-তাঁর রচনায় সাবঅল্টার্ন কিংবা নিম্নবর্গের যে বিপুল ও বহুমাত্রিক সংগঠন ও বিন্যাস দেখা যাচ্ছে তার পাশাপাশি কি সমাজের ক্ষমতাবানদের চিত্রায়নও কি নবারুণের সাহিত্যে মানবমনস্তত্ত্বের অংশীদার হয়ে উঠেছে? যদি হয়েই থাকে তবে কি তারাও সমানভাবে মনোযোগ আকর্ষন করেছে গল্পের পরিকাঠামো বা সাহিত্যের আঙ্গিকে?
    খ-তাঁর সাহিত্য দর্শণের রক্তে মাংসে কি লেগে রয়েছে কোনো ক্লাস কনফ্লিক্ট? বিমূর্ত বা মূর্ত রূপে কি দৃশ্যায়িত হয়েছে শ্রেনী বিভাজনের , বিচ্ছিন্নতার প্রজাতিগত বাস্তবতা?
    গ-চরিত্রের বিন্যাসে ,ভাষায় তাঁর , সামুয়িক ডিসকোর্স ও ডিকশনে কি উঠে এসেছে অ্যালিয়েনেশন বা বিচ্ছিন্নবোধের ন্যারেটিভ? অস্তি কি সেখানে সমাজ ও মানুষের মাঝের আইডেনটিটিহীন এক উদ্ভট রসায়ন?
    ঘ- চরিত্রগুলির মধ্যে আর্থ সামাজিক মাত্রার পাশাপাশি একটি কালচেতনাও কি বর্তমান? অর্থাৎ যে সংস্কৃতি বা যে সময়ের থেকে উঠে আসছে তারা সেই বাস্তবেরই সেই সংস্কৃতিরই গুনিতক হয়ে নির্মিত হচ্ছে !
    ঙ-কোনোরকম কনস্পিসিয়াস কনজাম্পসন লক্ষ্য করা যাচ্ছে কি চরিত্রগুলির মধ্যে?
    ইত্যাদি একাধিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারে নবারুণের চরিত্ররা। এবং পাঠ ও পাঠকের মাঝের রিসেপটিভ স্টাডি থেকে নবারুণের গল্প উপন্যাস ও তাঁর সামগ্রিক সৃজনীর আর্কিটাইপে মার্ক্সবাদী ধ্যানধারনার সংশ্লেষ আমরা লক্ষ্য করতে পারি। আলোচনার পরিসর সীমিত তাই আমরা প্রথম তিনটি প্রশ্নকেই একটি সারনীতে লিপিবদ্ধ করে দেখি নিটোল নিঁভাজ মেলোড্রামা কিংবা বুর্জোয়া রোমান্টিসিজমের বাইরে , মুদ্রিত টেক্সটের বাইরে নবারুণের সেই গোপণ সাবটেক্সটিকেঃ-




    এভাবে ধীরেধীরে মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বের সূচকগুলির নিরিখে নবারুণের গল্পের প্রেডিকেট লজিকগুলো থেকে আমরা সহজেই ভেতরের অদৃশ্য দ্বন্ধাত্মক ডিসকোর্সটিকে ঢুকে পড়তে পারি। তাঁর গল্পের ন্যারেটিভ বা শিরদাঁড়া থেকেই স্বীকৃত ফ্যাতারু বা চোক্তারের মত চরিত্রদের মধ্যে দিয়ে যে কল্পবিশ্বকে মাঝে মাঝেই নির্মাণ করে তুলেছেন নবারুন তা কেবল নিছক কোনো সিনট্যাকটিক্স এক্সপেরিমেন্ট নয় বা প্রতীকের মাধ্যমে পাঠকের সাথে অতিযোগাযোগও নয় বরং এটা এক ধরনের চোরা বিপ্লব বলা যেতে পারে যা ধীরে ধীরে প্রতিদিনের অভ্যস্ত জগতকে সাহিত্যের সাবটেক্সট করে তুলছে , সৃষ্টির উৎস যে সমাজ তার সাথেই যুগলবন্দী খেলছে সাহিত্য এবং শেষমেশ একটি মানবসত্তায় স্থিত হতে চাইছে।
    মার্ক্সের মতে পুঁজিতন্ত্রী সমাজে উৎপাদন প্রথা ও বিনিময় ব্যবস্থা এই দুইয়ের উপরই নির্ধারিত হয়ে রয়েছে বুর্জোয়া অর্থনৈতিক সমাজ কাঠামো। আর এই পুঁজিতন্ত্রী উৎপাদনের বিশেষ বিয়োজনই একটি সমাজকে ক্রমাগত নিয়ে চলে শ্রেনী সংঘর্ষের দিকে। এই শ্রেনী সংঘর্ষ অবশ্যই বুর্জোয়া আর প্রলেতারীয়দের মধ্যেকার সংঘর্ষ। নির্দিষ্ট একটি শ্রম ব্যয় করে একদল তা মূল্য উপার্জন করে অথচ অন্যজন সেই শ্রম সময় ব্যয় করা মূল্যের দাম ঠিক করে, অর্থাৎ মানবসমাজের ফাঁকে ফাঁকেই রয়েছে একধরনের পন্য পৌত্তলিকতা যা থেকে শ্রম বিভাজন এবং যা থেকে শ্রেনী সংঘর্ষ ; মার্ক্স দেখিয়েছেন এই সংর্ঘষ একদিকে যেমন পুঁজিপতির সাথে শ্রমিকের তেমনি অন্যদিকে এটা বিশেষ দুটো আর্থসামাজিক শ্রেনীসম্বন্ধের সংঘর্ষ , আসলে মার্কস তো কখনো কোনো একটি ব্যাক্তিকে একটি সামাজিক সম্বন্ধের বিকাশ ও উদ্ভবের জন্য দায়ী করেননি বরং তার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা শ্রেনীস্বার্থের প্রভাবকেই বিশেষ মূল্য দিতে চেয়েছেন। কারণ কেবল অর্থনীতির বিচারে এরা দুটি ভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধি নয় সাথে সাথে চিন্তনেরও দুটি সমান্তরাল প্রতিনিধিত্ব করছে বুর্জোয়া ও প্রলেতারীয় সমাজ। স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক সূত্রের সাথে সাথে ভিন্ন সমাজসূত্র দ্বারাও এরা নিয়ন্ত্রিত। ফলে মার্কসের মতানুযায়ী এই শ্রেনীসংঘর্ষ তত্ত্ব যতটা না স্থুল বিত্তসম্পর্কের ততটাই তা ভাবাদর্শগত আর এই ক্লাস কনফ্রন্টেশনের মধ্যেই মার্কস লক্ষ্য করেছিলেন ডায়ালেকটিক মেটিরিয়ালিজমের মত বিষয়টি যা আসলে শ্রেনী সংঘর্ষের থেকেও বেশী কিছু, যেখানে সামাজিক এই বিরোধগুলির মধ্যেই পরিবর্তনের ভাষা লুকিয়ে আছে। এখন এই ডায়ালেকটিকের প্রকৃতিটি আদতে কি? মার্কস বলছেন যেকোনো দ্বন্ধ যেকোনো সামাজিক সংঘাত যেকোনো অভাবের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে নিরন্তর পরিবর্তনের নিরন্তর পূর্ণতার সম্ভাবনা। All Changes is the product of the struggle between opposites generated by contradictions inherent in all event, ideas, and movement”- অর্থাৎ যেকোনো একটি সামাজিক কাঠামোর মাঝেই লুকিয়ে আছে একাধিক অ্যান্টিথিসিস আর এই থিসিস অ্যান্টিথিসিস একে অপরের সাথে কোলাইড করেই গড়ে উঠছে নতুন সিন্থেসেথিস যা আবার তার মধ্যে জন্ম দিচ্ছে নতুন অ্যান্টিথিসিসের। এবং এই তর্ক চলছে যা বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রন করছে। এখন মার্কসীয় তত্ত্ব বলছে মানুষের চেতনা তার সত্তাকে নির্ধারন করেনা বরং মানুষের সামাজিক সত্তাই তার চেতনাকে নির্ধারণ করে ; মানুষের যাবতীয় মননগত আর্দশগত প্রনালী হল তার বাস্তব সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের ফসল । মনে হতে পারেই আমরা কি নবারুণের সাহিত্যপাঠ থেকে সরে আসছি? না, বরং পৌঁছোতে চাইছি সেই মার্কসীয় সাহিত্যবীক্ষণের কাছে যেখানে নবারুণের চরিত্ররা ভিন্ন সামাজিক অবস্থান থেকে উঠে আসছে , যেখানে তাদের চেতনার আকার আয়তন মাত্রা ও ঘাতের প্রতিফলনও ভিন্ন। প্রাথমিকভাবে এই বাস্তবকেই তারা চিরস্থায়ী মনে করে নেয় ঠিক যেভাবে প্রতিযুগে শাসকশ্রেনির ধারনা বা বুর্জোয়া সংস্কৃতি প্রাধান্য লাভ করে। কিন্তু বিবর্তনের পথ একটা থাকে আর নবারুন সেই অনুসন্ধানের আঁচটাই প্রলেতারীয়দের মধ্যে উসকে দিয়েছেন, অভিজাততান্ত্রিক হাতকড়াটা খুলে ফেলার ভাষাটা শিখিয়ে দিতে চেয়েছেন মাংস রক্তে হাড়ে মজ্জায় প্রত্যাখান মাখামাখি মানুষগুলোকে। তার চরিত্ররা যেন বারবার বিরোধ করছে , প্রতিবিপ্লব চাইছে। বিপুল জনগনের এই স্বতঃস্ফূর্ত অনুভবগুলিকেই নবারুণ ভাষার শরীর দিয়েছেন তার সার্বিক সাহিত্যকর্মে । যেমন “পাঁচুগোপাল” গল্পটিকে দেখা যাক। মফস্বল থেকে ফার্স্ট ট্রেনে কলকাতা এসে পাঁচুগোপাল রিকসা চালায় আর তার বউ মৌরি ওভারব্রিজ সংলগ্ন বেপাত্তা রংবাজদের এলাকায় ডাল কলে কাজ করে। কিছু নিম্নবর্গীয় চেতনার ন্যারেটিভে নবারুণ চরিত্রটির প্রাথমিক খসড়া নির্মাণ করেছেন। যেমন সে ভাবে রিকসা চালিয়ে টাকা জমিয়ে দেশে গিয়ে বিড়ির দোকান দেবে, তারা খসা দেখবে অদ্ভুত এক মাঠে দাঁড়িয়ে, কিংবা ঠাকুরের প্রতি তার নির্দোষ ও সরল ভক্তি এমনকি তার বাচ্চাকাচ্চা না হওয়াও যে আসলে ঠাকুরের ব্যাপার এসবের মধ্যে কোথাও যেন দুর্বল থেকে দুর্বলতম একটি আইডেনটিটিহীন মানুষকে আমরা পাচ্ছি যে মেনে নিয়েছে এই অনস্তিত্ব এই অর্থহীনতাই তার অস্তিত্বের আশ্রয় , আর তাই এই প্রি এক্সিটিং আইডেনটিটি নিয়েই সে চলতি সমাজের হিসেব মেনে বেঁচে থাকার মানুষ। সাথে সাথে পাঁচুগোপাল চরিত্রটির মধ্যে নবারুণ ঢেলে দিয়েছেন একটি অ্যাবসার্ডিটি, তা হল মৃতের প্রতি পাঁচুগোপালের আন্তরিক ও জ্যান্ত টান। শশ্মানে বসে একটি নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে পাঁচুগোপাল শবদেহ লক্ষ্য করে , লক্ষ্য করে জ্যান্ত মানুষের মরা পুতুল। এই আপাত অযুক্তিময়তায় মৃতের সাথে কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে নবারুণ কি পাঁচুগোপালকে আপাত বাস্তবতার কাছে বসিয়ে গেলেন? ঘূর্ণায়মান রাষ্ট্রচক্রের মাঝে কিছু অনড় যোগাযোগাহীন অস্তিবাদী উপস্থিতির সামনে ! এখন মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বের ডায়ালেকটিক সূত্রটিকে আবার দেখা যাক। মার্কসীয় তত্ত্ব সরাসরি বলছে উৎপাদনের ভেতর যোগদান করে মানুষকে যে নির্দিষ্ট কতকগুলি সম্পর্কের ভেতর ঢুকতে হয় সেখানে তার মত প্রাধান্য পায় না , প্রাধান্য পায় উৎপাদনের ভেতর লেগে থাকা অর্থনৈতিক গড়নটি। এখান থেকেই গড়ে ওঠে সোসাল কনসাসনেস; অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেনী ভাবতে থাকে পুঁজিবাদী সমাজের তারাই শেষ মহান মানুষ এবং এটা তাদের কাছে বিশেষভাবে প্রাকৃতিক ও ন্যায্য বলেই প্রতীত হয়; অন্যদিকে প্রলেতারীয় অসহায় অদ্ভুত অযৌক্তিক বঞ্চিত মানুষগুলো কোথাও যেন প্রাথমিকভাবে ওই খন্ডিত স্বাধীনতাতেই তাদের গুঁড়ো গুঁড়ো করে ভেঙে থাকা বা ছাই হয়ে উড়ে বেড়ানোটাকেই মেনে নেয়। এখানেই মার্কসের ফলস কনসাসনেস’র(False Consciousness) ধারনাটা মান্যতা পায়, যার সংজ্ঞাতেই বলা হচ্ছে- “People’s acceptance of an unfavourable social sysem without protestor questioning, that is, as the logical way for things to be”...নবারুনের পাঁচুগোপাল আসলে সেই খন্ডিত স্বাধীনতার মানুষ আর এই ন্যারেটিভকেই আরো তীক্ষ্ণ করে তুললেন নবারুণ যখন বললেন- “ লোডশেডিং। কুপকুপে অন্ধকার। আমরা ছোটোরাস্তা দিয়ে ঝকঝকে আলোয় এলাম। অথচ পাঁচুগোপালের রিকসায় আলো ছিল না। পাঁচুগোপাল একটা প্রাইভেট গাড়িকে কিছুতেই সাইড দিচ্ছিল না। সাইড দিলে তো আর হেডলাইটের আলো পাওয়া যাবে না। বড়লোক আলো দেখাবে। গরীব উতরে যাবে।“...
    আবার এই মার্কসীয় তত্ত্বই বলছে সকল সামাজিক ধারনা ও অবস্থানই আপন নিরসনকে ডেকে আনে এবং পুনরায় নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে। যেকোনো ধারনা সমাজে বহুকাল থাকতে থাকতে প্রকৃত , অকৃত্রিম ইত্যাদি শব্দে জারিত হয় কিন্তু একটা সময় তাদের জরাগ্রস্থতার প্রশ্নও ওঠে এবং তখন তার বিরুদ্ধে শুরু হয় মানসিক বিরোধিতা,শুরু হয় একধরনের বিরোধী চিন্তন। নবারুণ ‘পাঁচুগোপালে’র মত একাধিক নীরব নির্জন হয়ে থাকা চরিত্রের মধ্যে এই বিরোধিতার আত্মবিশ্বাসটুকু চার্জড করতে চেয়েছেন বারেবারে। সোশাল এনস্লেভমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে প্রান্তবাসী চরিত্রটিকে একধরনের ছটফটানি একধরনের জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছেন। ‘পাঁচুগোপাল’ গল্পের একেবারে শেষে এসে লেখক অনুভূতিশূন্য কিছু মৃত মানুষের অক্ষরমালা নিয়ে চিড়ফাড় করে দেখতে চেয়েছেন শ্রেনীবিভক্ত সমাজের খন্ডিত নির্জীব পরাধীন সাবলর্টান মানুষগুলোর মাঝে লুকিয়ে থাকা বারুদটুকু। গল্পের সমাপ্তির আগে একটা ছবি তুলে ধরেছেন নবারুন; যেখানে দেখা যাছে পার্টির ক্যাডাররা চোলাই মদ বেচার অপরাধে মারতে মারতে একটা ছেলেকে উদোম ন্যাংটো করে খোয়াবরাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে স্টেশনে নিয়ে আসছে। মার খেয়ে সে পড়ছে, উঠছে আবার পড়ছে। আর তাকে একটা কথা বারবার স্লোগানের মত বলানো হচ্ছে- “ আমি চোলাই বিক্রি করি, ব্লাডার আমার বুকে”- মার থামছে না, এমনকি যখন লোকটা মরে যায় সেটা বোঝার পরেও মার চলতে থাকে। চারপাশের মানুষ এ অভিজ্ঞতা দেখছে সামাজিক সচেতনতা বাড়াবার প্রয়োজনে। আসলে এই চোলাইয়ের অপরাধে মার খাওয়া ছেলেটি একটি এটারনাল সাফারিংসের প্রশ্ন আমাদের তুলে ধরে। এখানে মার খাওয়ার কথা হচ্ছে কিন্তু জেহাদকথা নেই, বেঁচে থাকার মূল্য খুঁজতে মানিয়ে নেওয়ার কথা হচ্ছে। বুর্জোয়াশ্রেনী যে শাসনযন্ত্রে কেবল প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা করেনা সাথে সাথে সার্বিক সামাজিক মননে গড়ে তোলে একধরনের হেগেমনি ; এখানে তাদের নিজস্ব স্লোগান ঝুলিয়ে দিয়ে সমান্তরাল আধিপত্যময় ডিসকোর্স নির্মাণ করছে। কিন্তু ওই ছেলেটি আসলে প্রকান্ডঃ কোনো হিমশৈলের চূড়াটুকু মাত্র যাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যাকে নির্মোক পড়া মধ্যবিত্ত সমাজ লুকিয়ে দেখছে দর্শকের ভূমিকায়। কিন্তু হিমশৈলের আপাত অদৃশ্য অংশটিরও তো একটা ভাষা থাকে, একটা প্রতিস্পর্ধী বয়ান । পাঁচুগোপাল সেই আপাত অদৃশ্য অংশ , সেই সাবলর্টান মেটাফর যার মধ্যে দিয়ে নবারুণ একটা প্রতিবিপ্লব চাইছেন, মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বের এই সেই প্রোডাকটিভ ফোর্স যা সনাতনী সমাজ ও উচ্চবর্গ থেকে নিম্নবর্গের চেতনার বৈপরীত্যকে চিহ্নিত করতে চায় এবং সামন্ততান্ত্রিক বাস্তববাদ থেকে নবারুন বারেবারে সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের গভীরে প্রবেশ করতে চান। প্রখ্যাত মার্কসবাদী তাত্ত্বিক লুই আলতুসের তাঁর প্রোডাকটিভ থিওরি দিয়ে ব্যাখা করেছিলেন কিভাবে কোনো সাহিত্য বা শিল্পবস্তু সামাজিক ভিত্তির পরিবর্তন করতে পারে। তাঁর মতে শিল্প সাহিত্যও একটি মতাদর্শগত সংগ্রামের ক্ষেত্র এবং একজন সাহিত্যিক তার নিজস্ব সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তার কালচারাল আর্টিফ্যাক্টের মধ্যে দিয়ে শ্রেনীবিভক্ত মানুষগুলির একটি নতুন মানসক্রিয়া গড়ে তুলতে পারেন। নবারুনও আসলে অ্যালিয়েনেটেড সত্তাদের , প্রলাতেরীয়দের তাঁর ব্যক্তিগত সাহিত্যের দৃশ গন্ধ শব্দ স্পর্শের বয়নে একটি প্রোডাকটিভ ফোর্স করে তুলেছেন। পাঁচুগোপালের মৃত্যু কিভাবে হবে কিংবা আদৌ তার মৃত্যু না হয়ে পুনঃর্জন্ম হবে কিনা এজাতীয় প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে নবারুণ নিজেকেই যেন এক আত্মঘাতী পরীক্ষায় নামিয়েছেন। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে গ্যাস চেম্বারে বা ইলেকট্রিক চেয়ারে মৃত্যু চাননি পাঁচুগোপালের বরং খালের পাশে যে বিরাট চোলাই তৈরীর কারখানা যেখানে বিরাট মালিক আসে পুলিশ আসে নেতা আসে ক্যাডার আসে রাষ্ট্র আসে পুঁজিবাদ আসে সেই খালের জলে চোলাই তৈরীর নোংরা আর বিষের সর ফেলা বন্ধ করতে চাইবে পাঁচুগোপাল , মালিক তাকে হয়ত বলবে চোলাই কারখানায় সে কাজ চায় কিনা এবং তা শুনে সে ভ্যাটের জালায় থান ইঁট মারবে, মালিকের পায়ের তলায় পিষে পিষে হয়ত মারা যাবে পাঁচুগোপাল। তবে কি বহুদিন ধরে অন্য এক পাঁচুগোপালকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন নবারুণ ! সদ্যপ্রয়াত কবি সুমিতেশ সরকারের দুটো অমোঘ লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে- “ বহুদিন ধরে তুমি লোকটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছ/ আর লোকটাও খুঁজে বেড়াচ্ছে তোমাকে”..হ্যাঁ একজন পাঁচুগোপাল প্রতিনিয়ত অন্য এক পাঁচুগোপালকে খুঁজে বেড়াচ্ছে যে অনায়াসে ওই ভ্যাটের জালায় থান ইঁট মারবে , যে অবলীলায় বৃহৎ পুঁজি আর সামাজ্যবাদের কাছে নতিস্বীকার না করে মানুষের নতুন বাজার খুঁজবে; পাশাপাশি একজন নবারুন খুঁজে ফিরছেন নতুন এক নবারুনকে। কল্পস্বর্গবাদী হয়ে বেঁচে থাকা যার কাম্য নয় বরং মানুষের একটি নিঃশর্ত হাসিই তার চাহিদা। পাঁচুগোপালের মৃত্যুচিন্তা পাঁচুগোপালের নিজস্ব নয় বরং নবারুন তার সাহিত্যশৈলীতে একটি মতাদর্শকে মৃত্যু নাম্নী একটি টেকস্টের অন্তর্ভূত করতে চেয়েছেন। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে তিনি আসলে মানুষের ওই প্রকৃত হাসিটাকেই উদ্ধার করতে চাইছেন যা চাপা পড়ে গেছে “ভুলা মাসানের পাকে”। পাঁচুগোপালের মৃত্যুচিন্তার মত একটি স্বপ্নলব্ধ ইউটোপিয়ান ডিসকোর্সের মধ্যে দিয়েও নবারুন আসলে বারেবারে শব্দের কাঠামোর ওপর দীর্ঘকালীন একটি ক্লাস কনফ্রন্টেশনের ছবি এঁকে চলেছেন। একটি মতাদর্শের, যে মতাদর্শ মার্কসীয় নৈতিকতা প্রাণিত।
    মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বের অন্যতম উত্তরসূরী পিয়ের মাশারি তাঁর A Theory of Literary Production(1966) গ্রন্থে বলছেন লেখক এই মতাদর্শকে পাঠের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখেন একেবারে প্রাকৃতিক ভাবে কারণ মতাদর্শ স্ব্য়ং অদৃশ্য একটি জিনিস এবং যেকোনো পাঠের শেষে পাঠক মনোবিশ্লেষকের ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়ে তুলে নিতে চাইবে ওই মতাদর্শের প্রাণটিকে, একটি বিষয় হিসেবে তাকে চিহ্নিত করবে । নবারুণ তাঁর মার্কসীয় মতাদর্শকেও পাঁচুগোপালের মত চরিত্রের রূপ আঙ্গিকে জড়িয়ে রেখেছেন , তাই তো তার মৃত্যুদৃশ্যের কল্পনাতেও তাকে কেবল নিম্নবর্গের ভীরু অনুগত নিষ্ক্রিয় একটি জীব হিসেবে দেখতে চাননি নবারুন বরং তাকে দিয়েছেন একটি রাজনৈতিক বিরোধের ফর্ম্যাট।তাকে সক্রিয় করে তুলেছেন প্রতিপক্ষ হিসেবে, প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছেন, আর নিম্নবর্গের চেতনার এই আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যতার মধ্যে দিয়ে নবারুন তার মার্কসীয় মননের নবসংকলনই পৌছতে চেয়েছেন পাঠকের সামগ্রিক পাঠে। পাতি বুর্জোয়া অস্তিত্বের কাছে রাজনৈতিক পরিনতি হিসেবে পাঁচুগোপালের মত অলীক চরিত্ররা কেবল যে ব্যর্থতার ছবি নয়, বরং এই পাঠ থেকে আরও একটি চিত্ররূপ নির্মাণ হয়ে চলেছে আর তা হল একটি চরিত্রের শ্রেনীবিভক্ত সমাজের আইরনি থেকে ধীর ধীরে নিম্নবর্গীয় আইকন হয়ে ওঠা । শ্রেনীচেতনার বৈপরীত্য গভীর ভাবে অনুভব করেছেন বলেই হয়ত নবারুনের গল্প উপন্যাসের একাধিক চরিত্র সে হার্বাট হোক বা ফ্যাতাড়ু তাদের মধ্যে একধরনের সম্ভাবনাময় অঞ্চল গড়ে দিতে পেরেছেন নবারুন যেখানে পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে বিরোধের সম্ভাবনা আছে সম্ভাবনা আছে প্রলেতারীয়দের নিজস্ব বিবর্তন ও উত্তোরণের। আসলে তাঁর গল্পের একাধিক চরিত্রদের দিয়ে একটি মৌলিক পরিবর্তনের প্রশ্ন তুলেছেন নবারুণ।
    যেকোনো পাঠের মার্কসীয় আলোচনাতেই মতাদর্শ বা আইডিওলজি একটি তাৎপর্যময় অংশ।মূলতঃ পন্য ও মূল্যের বন্টনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজে স্বাভাবিকভাবেই ডমিন্যান্ট ক্লাসের মতাদর্শটিকেই ডিকটেট করতে দেখা যায় । এবং মার্ক্সের মতে শুরু থেকেই শিল্প ও সাহিত্য তাতে প্রচ্ছন্ন মদতদাতার ভূমিকা নিয়েছে। পাঠকের অজান্তেই সে ঢুকিয়ে দিয়েছে বুর্জোয়া সমাজনীতির স্ট্যাটাস কিও। এবং দেখা .যায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পরশ্রমজীবী শ্রেনীগুলির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে শিল্পসাহিত্য সেভাবে সোচ্চার নয়। কিন্তু যেকোনো সাহিত্যের মার্ক্সীয় বীক্ষণে সাহিত্যকর্মটিকে কেবল অ্যাস্থেটিক অবজেক্ট হিসেবে না দেখে দেখা হয় একটি বিশেষ সংস্কৃতির আর্থসামাজিক অংশ হিসেবে। ফলে সামাজিক প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মার্ক্সীয় সাহিত্যতত্ত্বে বাস্তবধর্মী মনস্তত্ত্বের অনুসন্ধান থাকবে সেটাই স্বাভাবিক এবং রাজনৈতিক প্রসঙ্গ থেকেও তাকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয় । মার্কসীয় সাহিত্য তাত্ত্বিক জেমসন বলছেন সমাজের প্রতিফলনই শুধু নয় মার্কসীয় সাহিত্য তত্ত্বর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একটি সাহিত্যের প্রায় সমস্ত উপলব্ধির সাথে রয়েছে রাজনৈতিক পাঠ রাজনৈতিক ব্যাখা,অর্থাৎ মতাদর্শকে সরাসরি সাহিত্যের বিষয় হিসেবে ব্যাখা করতে চেয়েছেন তিনি-“It is only at this price- that of the simultaneous recognition of the ideological and Utopian functions of the artistic text- that a Marxist cultural study can hope to play its part in political praxis, which remains, of course, what Marxism is all about…”-তবে জেমসনের থেকে কিছুটা ভিন্ন লুই আলতুসের মার্কসীয় সৌন্দর্যতত্ত্বের ব্যাখা । আলতুসেরর মতে শিল্প শুধু মতাদর্শের প্রকাশ নয় বরং জ্ঞান ও মতাদর্শের মধ্যবর্তী একটি এলাকায় শিল্পের অবস্থান। আর মার্ক্সীয় সাহিত্য তত্ত্বের বয়ানে মতাদর্শগত এই একাধিক দ্বন্ধতা বারবার আমাদের নিয়ে চলে একটি গভীর প্রশ্নের দিকে তা হল কোনো সাহিত্যসৃষ্টিকে আমরা কিভাবে দেখব ? ক্রিয়েশন না প্রোডাকশন হিসেবে ! সামাজিক অবস্থান বা রাজনৈতিক পটপ্রসঙ্গতার মধ্যে দিয়ে নবারুণের গল্পে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগে আমরা দেখে নিই মার্কসীয় সাহিত্য তাত্ত্বিক পিয়ের মাশারির এ সম্পর্কিত কিছু মূল্যবান ব্যাখা। মাশারি তাঁর “A theory of Literary Production”গ্রন্থে তিনি বলছেন ক্রিয়েশন একপ্রকারের সেলফ মাল্টিপ্লিকেশন, নিজেকেই নিজের পুনঃপ্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টা বলা চলে। নিজের ভেতরের ‘আমি’টাকে খুঁজে পাওয়ার একধরনের কন্টিন্যুয়াল ইনভেস্টিগেশন। ফলে ক্রিয়েশনে একজন মানুষ ধারবাহিকভাবে সেই বাস্তবকেই গড়ে তোলার চেষ্টা করে যা আসলে এখনও বাস্তব হয়ে ওঠেনি। এবং ধীর ধীরে সে বিচ্ছিন্ন কল্পজগতে প্রবেশ করে সেই অপর অন্য আমিটাকে খুঁজে পেতে এবং প্রজাতি সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই মানুষটা আসলে ম্যান উইথআউট ম্যান। মার্ক্সীয় সাহিত্যতত্ত্বের নিরিখে মাশারি বলছেন এই অ্যালিয়েনেটেড মানুষকে যখন একজন লেখক তার লেখনীর মাংসল বৃত্তান্তে বাস্তব করে তোলার চেষ্টা করেন তখন শিল্প ক্রিয়েশন না হয়ে একধরনের প্রোডাকশন হয়ে ওঠে। লেখক শিল্পী সেখানে একজন ক্রিয়েটরের ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে ওই বিশেষ অবস্থা বিশেষ সমাজের এলিমেন্ট হয়ে ওঠেন। কারণ সেখানে লেখক অ্যালিয়েনেটেড মানুষের মধ্যে দিয়ে ক্রাইসিস অফ ক্রিয়েশন খুঁজবেন, নিজে অ্যালিয়েনেটেড হতে চাইবেন না।
    আর তাই মার্ক্সীয় সাহিত্যতত্ত্বের মতে সাহিত্য আসলে সমাজেরই একটি ক্ষুদ্র সংসস্করণ এবং তার নিজের নির্দিষ্ট কিছু আইডিওলোজিকাল ফাংশান রয়েছে। এবং সাহিত্যের এই আইডিওলোজিকাল ফাংশানটি সরাসরি লেখকের মতাদর্শের সাথে সংযুক্ত। বাস্তবতারহিত স্বর্গীয় তাড়না বা কোনো আধ্যাত্মিক সত্তার অনুপ্রেরণায় সাহিত্য সৃজনের প্রতি মার্ক্সীয় সাহিত্যতত্ত্ব প্রথম থেকেই খড়গহস্ত বরং সেখানে শিল্পের প্রেক্ষাপটে রয়েছে রক্তমাংসের পটভূমি। আর্থসামাজিক ক্ষমতার এক বিশেষ ধরনের বিন্যাস ও প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই মার্ক্সীয় সাহিত্যতত্ত্ব গড়ে উঠেছে।পণ্য ও উৎপাদনের সাথে মার্ক্স যেমন অর্থনৈতিক অবস্থানের ধাঁচ গড়েছেন তেমনি প্রথম থেকেই মার্কসীয় তত্ত্ব সমাজ পরিবর্তন ও সে সম্পর্কিত আন্দোলন এবং সাহিত্য রচনা এ দুটিকেই পরস্পর সম্পৃক্ত বলে দাবী করেছে। মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্ব বিকাশের অনেক আগেই স্ব্য়ং কার্ল মার্কস ১৮৫৯ এ তাঁর “Critics of Political Economy” তে নিজেই বলছেন – “The mode of production of material life determines altogether the social, political, and intellectual life process. It is not the consciousness of men that determines their being, but on the contrary their social being, that determines their consciousness”- মার্ক্সীয় ডায়ালেকটিক হেগেলীয় ডায়ালেকটিক থেকে ভিন্ন ছিল মূলত আদর্শবাদ হতে মানবতাভিত্তিক বাস্তববাদ অবধি। হেগেলের ডায়েলেকটিক আইডিয়া ভিত্তিক যেখানে মার্ক্স তার ডায়ালেকটিকের মূলে রেখেছেন বস্তুকে কারণ তিনি সমাজের মধ্যে থেকে সমাজকে আক্রমণের প্রশ্ন তুলেছিলেন। তার বিষয় সামাজিক তার চরিত্ররাও নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট। হেগেলীয় অতীন্দ্রবাদের থেকে মার্ক্সীয় মানবতাভিত্তিক বাস্তববাদ মানুষকে নিয়ে তার ভিত্তি রচনা করে এবং মানুষ যেহেতু সমাজের অংশ তাই সমাজের বাইরের কোনো কিছুকেই মার্কস তার মতাদর্শের ভিত্তি করেননি। মার্ক্সীয় সাহিত্যতত্ত্বে তাই সমাজের বাস্তববাদ সমর্থিত হল এবং সেখানে সমাজ থেকে উঠে আসা চরিত্রদের দিয়ে স্বীয় সমাজকেই বিদ্রুপের একটি ক্ষেত্র তৈরী হল। এবং রুশ মার্ক্সবাদের জনক প্লেখানভের পর গেয়র্গ লুকাচই মার্ক্সীয় সাহিত্যত্ত্বের প্রথম প্রাসংগিক ব্যাখা দিলেন। লুকাচ বললেন সমাজকে জানতে হবে লেখককে এবং সেটাও সামগ্রিক সমাজকে, এবং চরিত্রের বিমূর্তার কোনো স্থান নেই বরং সেখানে চরিত্র সরাসরি সমাজের অংশীদার হয়ে কথা বলবে।মার্কসীয়তত্ত্বে র দিক দিয়ে দেখলে লুকাচ একাধিক বাস্তববাদী চিন্তার বিকাশ যেমন ঘটিয়েছিলেন তেমনি শিল্প রাজনীতি এবং সাহিত্যের সহাবস্থান ও অংশীদারিত্বের উপর সরাসরি জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু লুকাচ পরবর্তী সময়ে মার্ক্সীয় সাহিত্যতত্ত্বে একাধিক মতবাদ ও চিন্তনের মিশ্রণ ঘটেছে এবং কোনো সাহিত্যপাঠে মার্ক্সীয়সৌন্দর্য তত্ত্বের ব্যাখায় চরিত্রের মূর্ততার প্রশ্নটা বারবার খন্ডন হয়েছে। সামাজিক ও আর্থরাজনৈতিক পটপ্রসংগ থেকে উঠে আসা চরিত্র ও আবহের সাথে কোথাও কোথাও শিল্পীর হাত ধরে ঢুকে পড়েছে অস্তিত্বগত অ্যাবসার্ডিটির নতুন মাত্রা। এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মার্ক্সীয় সাহিত্যতত্ত্বের মিশ্রনে নবারুণের সাহিত্যপাঠে আমরা সবসময় এই সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের ছবিটা পাইনা , কোথাও যেন সেখানে লুকাচ পরবর্তী ফ্র্যাঙ্কফুট স্কুলের মার্কসীয় নন্দন তত্ত্বের স্বর লক্ষ্য করা যায়। ফ্র্যাঙ্কফুট স্কুলের মার্ক্সীয় নন্দন তাত্ত্বিকরা বললেন সাহিত্যের সাথে বাস্তবের সংস্পর্শ সরাসরি নয় বরং কিছুটা ফাঁক থাকে , থাকে কিছুটা দূরত্ব আর এই দূরত্বই সাহিত্যকে শিল্পকে তাৎপর্যময় করে তোলে। অর্থাৎ সাহিত্যের আঙ্গিক বা সংগঠন একটি সুনির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থানের দিকে কাহিনীটিকে ক্রমাগত পাকাপোক্তভাবে নিজের দিকে জড়িয়ে নিতে চাইবে। ফলে এখানে বিষয় নয়, আঙ্গিকে রয়েছে সাহিত্যের মূল দিশাটি , যা মার্ক্সীয় বিশ্লেষনের সাথে সাহিত্যের পাঠের আলোচনায় বিশেষ ভূমিকা গ্রহন করে। এই প্রসংগে আমরা নবারুণের “৪+১” গল্পটিকে আমাদের আলোচনার বিষয় করতে পারি। চারজন শববাহক ও তাদের কাঁধে নেওয়া একটি মৃতদেহকে নিয়ে গল্পের ব্যক্তিমাত্রিক টেকস্টটি শুরু করেছেন নবারুণ; বৃষ্টির দিনে ট্রামের ধাক্কা খাওয়ার পর থেকে তাদের নিয়ে শুরু হয় গল্পের নাটকীয়তা। কি ছিল তাদের কাঁধে? যদি মৃতদেই হয় তবে ওই মৃতদেহটি কার? তার নাম কি? তার কেউ আছে? কিভাবে সে মারা গেছিল? যারা কাঁধে নিয়েছিল ওই চারজন শববাহক, তারাই বা কে ছিল? কেউ আছে তাদের? ওই মৃতদেহ কি কোনো বুবিট্র্যাপ? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে করা কোনো গোপণ চক্রান্তের অংশ? এই হাজারো ক্যাওস দিয়ে কাহিনি থেকে তুলে আনার চেষ্টা হল আসল কথাকে অথচ আসল কথাটিই শেষমশ উদ্ধার হলনা কারণ প্রমাণ হল ওই চারজন শববাহকের চারজনই মূক বধির ও অন্ধ। এখানে চরিত্রগুলি প্রায় সবই ইউটোপিক কিন্তু যে আঙ্গিকে চরিত্রগুলিকে দিয়ে নবারুণ কথা বলিয়েছেন ( কিংবা বলা ভালো চরিত্রগুলির না-বলা কথার পারস্পরিক মিঁজ-অ-সেন তৈরী করেছেন) তা আমাদের একটা বাস্তব সম্পর্কিত ভিস্যুয়াল লিটেরেচারের দিকে নিয়ে চলে। আমরা যেন ওই প্রতিটা সংলাপের মধ্যে দিয়ে ছুঁতে পারছি মানুষের অনিশ্চিয়তা আর অস্তিত্বহীনতার অনুষঙ্গগুলোকে। গল্পটির কয়েকটা সংলাপকে নেওয়া যাক, দেখা যাক কিভাবে তারা কল্পনা থেকে মুক্ত করে দিচ্ছে একটি কল্পবাস্তব চরিত্রকে এবং ক্রমশ তার চিন্তাসূত্রকে রূপ দিচ্ছে বাস্তববাদের প্রতিপাদনে-




    নবারুনের কৃত চরিত্রগুলির মধ্যে এভাবেই একধরনের শৈল্পিক ক্যালিগ্রাফি কখনও সরাসরি বাস্তবকে না ছুঁয়েও পাঠকের মধ্যে ট্রান্সক্রিয়েট করে দিচ্ছে বাস্তববাদী কিছু ব্যাঙ্গাত্মক ইঙ্গিত , মানবতার কিছু বৈধ প্রশ্ন, বেঁচে থাকার কিছু তর্কাতীত ব্যঞ্জনা যেখান থেকে পাঠক সমাজতন্ত্রের আরও গভীরে প্রবেশ করছে, নবারুণের সাহিত্যজ রূপ-আঙ্গিকের মাধ্যমে এবং চরিত্রগুলির মনোবিশ্লেষনের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করছে বাস্তবের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভটিকে। সামাজিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এই বাস্তবধর্মী মনস্তত্ত্বের অনুসন্ধান আদতে মার্কসীয় ভাবনাসুতোগুলোকেই ধীরে ধীরে গুটিয়ে আনে। স্ট্রাকচারাল মার্ক্সিজমে যে ট্রান্স ইন্ডিভিস্যুয়াল মেন্টাল স্ট্রাকচারের কথা বলা হয়েছে , নবারুণের চরিত্ররাও যেন তেমনিই ব্যক্তিমাত্রিক কাট আপ থেকে বেরিয়ে এসে গুলিয়ে যাচ্ছে বৃহত্তর মানুষের মিথস্ক্রিয়ায়। রাষ্ট্রীয় জাঁতাকল থেকে বেরোতে না পারা একটা সমাজ এবং তার রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার সাথে মানিয়ে নেওয়া পুলিশ চিকিৎসক স্বরাষ্ট্র দপ্তর অবধি কিছু মনিটরিং মেশিনের মধ্যে দিয়ে এই যে একটা সোশাল ইম্পোটেন্সি গড়ে ওঠা নবারুণ তাঁর এক্সপ্যান্ডেড লিটেরেচারে সেই গল্পটাকেই ধরতে চেয়েছেন বারেবারে। যার মধ্যে সমাজের শরীর ও রাষ্ট্রের শরীরের পারস্পরিক সংক্রমণের প্রশ্নটি গুরুতর। বুর্জোয়া শরীর দিয়ে যে পোষ মানিয়ে দেওয়া হয়েছে সমাজের শরীরটাকে।“নিম্নবর্গে র ইতিহাস”র কিছু অংশ এখানেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে যেখানে সামাজিক শরীর ও বুর্জোয়া শরীরের প্রসঙ্গ এনে গৌতম ভদ্র বলছেন- “ সামাজিক শরীরকে বদলে বুর্জোয়া শরীর করার যে ঐতিহাসিক যজ্ঞ, আধুনিক রাষ্ট্রই তার প্রধান হোতা ও আধুনিকতার মতাশ্রয়ী শিক্ষিত মানুষেরা তার পুরোহিতশ্রেনী। আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য পরিষ্কার, সমাজকে ‘পোষ’ মানানো এবং ‘শরীর’ এর প্রশ্নটিকে ‘সামাজিক’ রাজনীতি বা রাষ্ট্রবিরোধী চিন্তার বাইরে নিয়ে আসা।‘-“৪+১” গল্পে এভাবেই তো একটি বুর্জোয়া শরীর গড়ে উঠছে সমাজকে ব্যবহার করে, সমাজের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত ওই পুলিশ ডাক্তার প্রশাসন থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত সামন্তপ্রভুদের ব্যবহার করে , আর ওই কৃত্রিম প্রভুত্বের তলায় চাপা পড়ে আছে নিন্মবর্গীয় সাধারন মানুষের ইতিহাস। তাদের স্বর শোনা যাচ্ছে না, জানতে পারা যাচ্ছেনা তাদের অস্তিত্বের মোটিফ ও মেটাফর। নবারুনের গল্পের কেন্দ্র থেকে পরিধি অবধি এই সামাজিক ঘূর্ণিপ্রক্রিয়া পাঠককে বারবার একটি তর্কের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে-তা হল একটি অলিখিত শৃঙ্খলামুক্তির আখ্যান, নিম্নবর্গের একটি অকথিত ভাষার আখ্যান, তাই হয়ত গল্পের শেষে এসে ক্বেউ কেউ ওই থমকে যাওয়া চার জন বোবা কালা অন্ধ শববাহকের পারস্পরিক ফিসফিসানি শুনতে পায়, শুনতে পায় তাদের নিজেদের মধ্যে চাপা হাসির শব্দ। যে সাবল্টার্ন স্টাডিজ নবারুণের গল্পের মূলছাঁচ সেখানে যেমন সমাজের ভগ্ন ও ভগ্নাংশের কথকতা রয়েছে তেমনি রয়েছে কিছু ব্যক্তিগত আনডিসক্লোসড কন্ঠস্বর। তিনি তো বাস্তবকে দীর্ঘস্থায়ী বলে মনে করেননি কখনই বরং বাস্তবকে পালটাতে চেয়েছেন, চেয়েছেন ‘প্রতিবিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক’।
    ব্যক্তি নবারুণের সাথে যোগাযোগের কোনো জায়গা নেই, আমরা কেবল তার চরিত্রদের মনঃসমীক্ষণের সাথে যুক্ত। আমরা কেউ মনবিশেষজ্ঞ নই কেবল সাধারন পাঠকমাত্র অথচ তাঁর সৃষ্টির একত্বের মাঝে তিনি যে বহুত্বের বর্হিজগত বানিয়েছেন তাতে ওই প্রতীকের খেলা ধরে আমরা সহজেই একটি সমীকরণে পৌঁছে যাই , আর তা হল মার্কসীয় আত্মবীক্ষন। শ্রম বিভাজন বা ডিভিশন অফ লেবারের সাথে মার্ক্স যে বিচ্ছিন্নতাকে যুক্ত করেছিলেন সেই বিচ্ছিনতারই এক নতুন বিন্যাস গড়েছেন নবারুণ, বিচ্ছিন্নতার ভূখন্ডে টেনে এনেছেন সবকটি মানবিক সূত্রকে আর গড়েছেন একধরনের এক্সপ্যান্ডেড লিটেরেচার। মার্ক্স বলতেন উৎপাদনশক্তি বিকশিত হতে হতে এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায় যে প্রচলিত বিত্ত-সম্পর্কাদির সাথে তার বিরোধ হতে বাধ্য আর ওই উৎপাদন শক্তিকে শৃঙ্খলিত করতে সচেষ্ট হয় বিত্ত-সম্পর্ক আর তখনই উদ্ভুত হয় সমাজ বিপ্ল্বব বা সোসাল রিভোল্যুশন। নবারুণও কি এই বিচ্ছিন্নতার অবসানের সাক্ষীই হতে চেয়েছিলেন? নাহলে কেন তিব্বতী গুরু লং চেংপাকে দিয়ে বলালেন-“ এই বিশ্বে আর আমি থাকব না, থাকব মৃত্যুহীনতার মহান শান্তির ঘেরাটোপে। এ কথাও কি শান্তি দেবে? যখন চারিদিকে আলো ঝলসাবে, দপ করে জ্বলে ওঠার জন্যে যখন প্রত্যেকটা অনু প্রত্যেকটা কার্বন জোড়ের অলঙ্কার, টোপোলজির চার-রঙর প্রবলেম এমন কি তখনও যদি প্রত্যেকটা প্যারামবুলেটর,প্রত্য�� �কটা দুধের বোতল, প্রত্যেকটা ললিপপ , প্রথম জন্মদিনের ভিডিও টেপ- সকলে অধীর হয়ে ওঠে? এ সময়ে কি কেউ থাকবে?
    আসলে এ কথা তো নবারুণের ...
    সব শেষ হয়ে যাওয়ার আগে সব শুরুর এ অপেক্ষাও ...

    *****************************

    দূরপাল্লার একাকী দৌড়বীর
    সরোজ দরবার

    ‘অভিভাবক ও গুরুজনদের সম্বন্ধে কিছু লেখাই কঠিন। মূল্যায়ণের তো প্রশ্নই ওঠে না’ – সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখতে গিয়ে এ নবারুণীয় অনুভূতি দিয়েই গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর নান্দীমুখ করতে পারি। সত্যি লেখা কঠিন, কেননা মানুষটা যখন নবারুণ ভট্টাচার্য। ‘ছোটলোকের গায়ের ঘামের গন্ধ’ জড়ানো পৃথিবীর হাওয়া যিনি শেষবার ফুসফুসে টেনে নেওয়ার পর যখন বন্ধু সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলে ওঠেন, ‘তুমি ছিলে আমাদের শেষ মাতাদর যে তাচ্ছিল্য নিয়ে থুতু ফেলতে পারত। আজ আমাদের রক্তের গলি উপগলিতে কোনও ব্যারিকেড রইল না নবারুণ। এইসব চ্যানেল আর পুচকে সাংবাদিক এখন তোমার অসমাপ্ত আত্মজীবনী নিজেরাই সমাপ্ত করার দায়িত্ব নেবে।’, তখন ভয় হয়, এই নির্বোধ দায়িত্বের ফাঁদে অজান্তেই পা দিয়ে ফেলছি না তো! সত্যিই তো জীবনানন্দকে নির্জন অভিধা দিয়ে বাঙালি যেমন তার ফ্যাসিনেশনে দাগা বুলিয়ে তৃপ্তি পায়, নবারুণকে নিয়েও সে তেমনই স্বনির্মিত খিস্তিপ্রবণ, বিপ্লব-বিপ্লব মুখোশটিকে স্টাডিরুমের দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখে আত্মপ্রসাদ লাভ করবে এ আর আশ্চর্য কী! এবং করেওছে। আজ আর কোনওকিছুই অপ্রকাশ্য নয়, কোনও কিছুই সম্পাদিত হওয়ার অপেক্ষা রাখে না। অতএব তাঁর মৃত্যুর পর নেশাতুর, টি-শার্টে চে-র ছবিওয়ালা কষ্টকল্পিত বিপ্লবীরা ব্যাপক খিস্তি সমৃদ্ধ বাচনে চেতন ভগত কিংবা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মুন্ডপাত করে নবারুণ-প্রণয় ব্যক্ত করেছেন জোর গলায়। ব্যক্তি আক্রমণে নবারুণ কি আদৌ খুশি হতেন? যাঁরা তাঁকে জানতেন, তাঁরাই জানেন। এবং সময়ের কী প্রগাঢ় ঠাট্টা, বছর ঘুরতে না ঘুরতে, সেই সব ছদ্মবিপ্লবীরা যখন প্রতিষ্ঠানের তেলে-ঝোলে-নালে মাখামাখি হয়ে ভেজা সপসপে জামা লুকনোর পথ না পেয়ে এর ওর চৌকাঠে মাথা কুটছেন, তখন আর একবারও এসে পড়েছে আমাদের নিজেদের মূল্যায়ণের তিথি। হ্যাঁ গুরুজনের মূল্যায়ণ করা যায় না, তাঁকে সামনে রেখে নিজের অপরাধ ও অক্ষমতাটিকে সনাক্ত করা যায়।
    সহযোদ্ধা ও সহজীবি সঞ্জয়বাবু সেদিন আক্ষেপ করেছিলেন, কেননা, তিনি দেখেছেন, পিস হ্যাভেনেও পরিত্যক্তদের জন্য কোনও আলাদা কক্ষ নেই। ‘এই সভ্যতা সবাইকেই অ্যাকোমোডেট করে। যারা চে গুয়েভারা তারা চাপরাশি হতে পেরেছে। নবারুণ তোমার চলে যাওয়াই ভালো। আজ হোচিমিন সরণি জুড়ে শপিংমল’- তাঁর এ কথার সূত্রেই দেখি এই ক’দিনেই নবারুণকেও আমরা চলতি বিন্যাসে অ্যাকোমোডেট করে ফেলেছি বা চেষ্টা চালাচ্ছি জোরকদমে। সমস্ত গজলের ঐশ্বর্য নিয়েও কাজী নজরুল ইসলাম যেমন কিছুতেই প্রেমের কবি হবেন না, বিদ্রোহীর চিরকেলে ট্যাগ নিয়ে সংস্কৃতির শপিংমলে প্রদর্শিত হবেন, নবারুণকেও তেমনি আমরা খিস্তি-ফ্যাতাড়ু-আগুন-চ ুল্লি-বমন-থুতু মেশানো ককটেলের একটা বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলা হবে, দিতে চাওয়া হবে বিপ্লবী গোছের কিছু একটা অভিধা, যার সমার্থক শব্দ বোধহয় এখনও অভিধান খুঁজে পায়নি। পায়নি কারণ, নবারুণকে শেষমেশ অ্যাকোমেডেট করতে গেলেও সভ্যতার কিছু সমস্যা ও অক্ষমতা থেকে যায়। খিস্তি আর পুরন্দর ভাটের কিছু কবিতার নিরিখে যারা নবারুণকে চলতি খোপের ভিতর সেঁধিয়ে ফেলতে চান, তাঁরা বোধহয় প্রাতিষ্ঠানিকতার ছলনাময় ‘মাজাকি’টাকেই প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেন। আসলে বোধহয় একদিকে থাকে তাঁর স্বরচিত সাম্রাজ্য। যা অস্থির অস্তিত্বের স্থানাংক নির্ণয়। ওই যাঁরা সত্যিই চে হতে চেয়ে চাপরাশি হয়ে গেল, ওই যাঁরা তিরিশ বছর রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থার বাঁধানো খাতায় কলমপেষা শেষ করে ফুলগুলি সব কোথায় গেল বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তাঁদের সবার হয়ে বাস্তবতার প্রসারিত এক ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকেন নবারুণের ফ্যাতাড়ুরা। আমাদের সময় তাঁর ভাষায় আমোদ পায়, দেখে এই মল অধ্যুষিত শহরে ফ্যাতাড়ুরা উড়ে বেড়ায় বটে কিন্তু তেমন কোনও নাশকতার জন্ম দেয় না। ফলত প্রত্যাখানের ঔদ্ধত্য, অস্বীকারের ঐশ্বর্য ইত্যাদি যখন কথার কথা হয়ে ফুলদানিতে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে পড়ে, আর বিস্ফোরণের সম্ভাবনা যখন একটা নিরাপদ বিপ্লবের খেলনাবাটিতে পর্যবসিত হয়, তখন আমাদের প্রয়োজন হয় আর এক নবারুণকে খোঁজ করার। ফ্যাতাড়ুরা যে আর বিশেষ কিছু করতে পারবে না, সে বোধহয় তাঁদের স্রষ্টাও জানতেন, তাহলে কেন তাদের এমন করে ওড়ালেন? না করিয়েই বা কী করবেন? গোড়ায় তো থেকে যাচ্ছে সেই প্রাথমিক প্রশ্ন-
    ‘অনেক গ্রামবাসী
    তাদের চারজন কমরেডের মৃতদেহের জন্যে
    শহরতালুকের মর্গের বাইরে
    সকাল থেকে বসে আছে!

    একজন শ্রমিক
    হায় কি দুর্বল তার ইউনিয়ন
    রেললাইনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে
    আত্মহত্যা করলে কি বাঁচা যাবে?

    অনেকগুলো বাচ্চা
    পোস্টারের কাগজ আর প্যাকিংবাক্সের ঘরে
    খেলে খেলে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে
    ওদের মা ফিরলে তবে খেতে দেবে।

    এখন কি আমার শিল্পচর্চা করা মানায়?’’
    আমরা দেখতে পাই মৃদুভাষী অথচ তীক্ষ্ণ এক নবারুণকে। বিস্ফোরণ আর হবে না জেনেও হয়ত যিনি বিস্ফোরণের সম্ভাবনাটিকে জিইয়ে রাখেন। আমরা দেখতে পাই সেই নবারুণকে, বইমেলার অতি ভিড়ের মধ্যেও যাঁকে একাকী বসে থাকতে দেখেছেন হয়ত অনেকেই। আশাপাশে লোক ছিল না কি? ছিল তো। তবু তিনি একাই বসে ছিলেন সেদিন, ঠিক যেমন তাঁর হারবার্ট, ফ্যাতাড়ুদের থেকে একটু দূরে, স্বতন্ত্রতায় বসে থাকে তাঁর প্রবন্ধগুলি।
    ছবিতে আমরা যখন গ্রামের দৃশ্য দেখি তখন এক ধরনের রোম্যান্টিকতা আমাদের মধ্যে কাজ করে। আহা এই ছিল আমাদের গ্রাম গোছের ব্যাপার। ‘পথের পাঁচালী’র সূত্রেও অপু-দুর্গার রেল দেখা, কাশবনের ঢেউ ইত্যাদি নিয়ে কম রোমান্টিসিজম তো ঢেউ তোলে না। কিন্তু নবারুণের চোখে ‘পথের পাঁচালী’ যেভাবে ধরা পড়ে, আমরা বুঝতে পারি অস্বীকারের আঁতুড়ঘর কোন অনুভব আর দৃষ্টিতে নির্মিত। যে শিল্পবোধ জীবন ব্যতিরেকে কোনও কিছুকেই শিল্পের শিরোপা দিতে নারাজ, সেই বোধ নবারুণকে দিয়ে বলিয়ে নেয়, ‘ ‘পথের পাঁচালী’ আমার কাছে নিয়ন্ত্রিত দুর্ভিক্ষের এক কাহিনী, যে দুর্ভিক্ষ খুব ধীরে ধীরে, বছরের পর বছর ধরে চলে। চলতেই থাকে। এক একে করে সে শিকারও বেছে নেয়- আপাতদৃষ্টিতে সে সব মৃত্যু অপুষ্টিজনিত বলে মনে হয়, কিন্তু তার পেছনে রয়েছে ক্ষুধা ও ক্ষুধাজনিত অপুষ্টি।’’ যে অপু, দুর্গা জন্মাবধি ভালো কিছু খেতে পায় না, একদিন বাড়িতে ভালো খাবার দাবার হলে সেদিনটি স্মরণীয় উৎসব হয়ে ওঠে তাদের নিয়ে বাঙালির রোম্যান্টিকতা পাঠ্যবই অবলম্বন করে যতই ডালপালা মেলুক না কেন, নবারুণের চোখ অক্ষরের আড়ালে ধারাবাহিক দুর্ভিক্ষের অশনিসংকেত ঠিকই চিনতে পারে। এবং বিভূতিভূষণ অবধারিতভাবেই তাঁর কাছে অন্য মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। উপনিবেশ সাহিত্যের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে যখন লেখক বিচলিত ও সংগ্রামী থাকেন, তাঁরই মিলিত রূপ তিনি দেখেছেন বিভূতিভূষণের মধ্যে- ‘ক্ষুধার আশ্চর্য আখ্যান সৃষ্টিকারী বিভূতিভূষণের মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের গুণাবলী কমবেশি মিশ্রণে রয়েছে বলে আমি মনে করি। এও মনে করি যে সচেতনভাবে দলিল সৃষ্টি করার দায় স্বীকার করে সাহিত্যসৃষ্টির যে একমাত্র অর্থবহ মানবিক ধারা আছে এবং সেই পথে যাঁরা চলেছেন ও চলবেন তাঁরা সকলেই বিভূতিভূষণের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে থাকবেন।’ বিভূতিভূষণের এ মূল্যায়ণ আমাদের চিনতে সাহায্য করে নবারুণ ভট্টাচার্যকে। আমরা বুঝি, ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’ আমাদের কপচানোই সার হবে যদি না আমরা ধরতে পারি তাঁর ভিতর বসত করা সেই দূরপাল্লার দৌড়বীরটিকে, যাদের একা একাই দীর্ঘ, দীর্ঘতম পথ পেরোতে হয়।
    প্রবন্ধ, সাহিত্যবাসরে যা নাকি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে পরিগণিত এবং তা সঠিক কি না তা নিয়ে বিস্তর তর্ক-আলোচনা আছে, তা তার স্বভাবগুণেই আমাদের ঠেলে দেয় চিন্তা সরণির দিকে। গল্পে-উপন্যাসেও যে পরিসর তৈরি করে দেন অনেক লেখক, নবারুণ তো বটেই, তবু সেখানে ঝোঁকটা থাকে কাহিনির এগনোর দিকে। ফলত যে ভাবনার দিকে ঠেলে দিতে চান, তা কখনও সফল, কখনও বন্ধ্যা। প্রবন্ধ, তার আত্মপ্রশ্নধর্মিতার খাতিরেই নিজেই প্রবেশ করে সে সাম্রাজ্যে, হাত ধরে তাঁর পাঠকের। নবারুণের এই লেখাগুলিও আমাদের তাই দেয় তাঁর ভাবনাজগতের অদ্বিতীয় চাবিকাঠি। এবং সহসা মোহভঙ্গে আমরা দেখি, তাঁরই তৈরি করা খিস্তিপ্রবণতা আসলে একটা সম্মোহন, যার লোভে লোভে হয়ত তাঁর চেতনার কাছে পৌঁছব- এমনটাই আশা ছিল তাঁর। বুঝি, সেটাকেই মিথ করে তোলা মুর্খামি ছাড়া আর কিছু নয়। যেমন একদিন নবারুণের নিজেরই ভুল ভেঙেছিল জীবনানন্দের মুখোমুখি পড়ে। ‘... যথাসময়ে কেতাবি জ্ঞানে নিজেকে যারপরনাই সমৃদ্ধ ও আশ্চর্য মনে করে সেসব বুকনি ব্যবহারে রপ্ত হলাম- নেচার রোম্যান্টিসিজম, পরাবাস্তবতা, বিষণ্ণতা, মৃত্যুচেতনা, অতীত-বর্তমান সমীকরণ তৎসহ রহস্যময়ীদের উল্লেখ যাঁরা আসিরিয়া, ব্যবিলন থেকে শুরু করে বাংলায় ছিলেন, আছেন, থাকবেন।’ এবং তারপর, ‘ এরকম অনেক কিছু জেনে বেশ ভালোই ছিলাম। এরও পরে তাঁর গদ্যের সঙ্গে পরিচয় হয়। আগেকার অনেক হেশাব-কেতাবই গুলিয়ে গেল।’ আমরা বুঝতে পারি স্বয়ং নবারুণের ক্ষেত্রেও আমাদের এই গুলিয়ে যাওয়াটা একান্ত জরুরি। ‘তিনি ছিলেন আমাদের অস্বীকারের ভাষা’ বলে যে বা যাঁরা অস্বীকারকে ছলনা করে তাঁর গায়ে খিস্তি ও নির্বিষ আগুনের যুগপৎ ট্যাগ লাগিয়ে কুকর্ম সেরে রাখতে চান, এই গুলিয়ে যাওয়া আমাদের সে সব থেকে উদ্ধার করবে। সঞ্জয়বাবু বন্ধুস্মরণে বলেছিলেন, সেদিন তাঁরা খোচড় চিনতে পারতেন। চিনতে পারাটা আজ বোধহয় আরও বেশি করে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
    ‘আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, যে তাগিদ থেকে আমি লিখি তার সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক রদবদলের যে বিচিত্র ও ট্রাজিক সময়ের আমি সাক্ষী তার অনুরণন আমার আখ্যানে রয়েছে- কখনও আমি অংশীদার এবং সব সময়েই ভিক্টিম। তৃতীয় বিশ্বের একজন লেখক হিসেবে এটাই আমার উপলব্ধি। বিচ্ছিন্নতার কষ্টকর একাকীত্ব থেকে কোনো একটা অণ্বয়ে যাওয়ার চেষ্টা আশা করি পাঠকের চোখ এড়াবে না’- উপন্যাস সমগ্রের ভূমিকায় এ কথা লিখেছিলেন তিনি। লেখার মধ্যে দিয়েই তাঁর যৌবনে লেখা ইতিহাসে সাড়া দিয়েছিলেন। সময়ের পরিহাসেই সে অবস্থান থেকে তাঁকে সরে আসতে হয়েছে। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন কোথাও একটা সত্তর থেকে গেছে। এইটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে তিনি জোর দিয়ে বলছেন, ‘ চেতনা থেকে সত্তর যদি অন্তর্হিত হয়, তাহলে আত্মপরিচয় বলে আর কিছু অবিশিষ্ট থাকবে না।’ তাই আখ্যানে যে অণ্বয়ে পৌঁছনোর চেষ্টা তিনি করেন, ব্যক্তিগত গদ্যে দেখি এক ভবিষ্যতের উৎসবের স্বপ্ন তাঁর লেখায় উঁকি দিয়ে যায়। যে ঋত্বিক তাঁর অস্কার এবং অঙ্গীকার তিনি তো বলেইছিলেন, ‘দেশটা ক্রমশ ইতরের দেশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর কোন সৎ শিল্পীরই নিজের দেশকে ইতর বলে দেখানো উচিত না। ব্যাপারটা অধার্মিক।’ ১৩৭১ সালে শারদীয়া পরিচয় পত্রিকায় ঋত্বিক যা বলেছিলেন, শারদীয়া পত্রিকা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই নবারুণ তাই আফসোস করে বলেন, ইতরের দেশ হয়ে দাঁড়ানোর আর বাকি কিছু আছে? এ এমন একটা সময় যখন, ‘ গোলকায়নের আমিষ আবহাওয়ায়, বে-আব্রু অসভ্যতা আকণ্ঠ ভোগের কার্নিভালে গোটা ব্যাপারটাই আর যেমনই হোক একটা ঐতিহ্যের বিচিত্র এক্সপ্রেসনে আবদ্ধ নেই, ন্যাক্কারজনক একটি ঢ্যামনামিতে পর্যবসিত হয়েছে।’ এবং এ কথা শুধু পুজোসংখ্যার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না, বরং গোটা সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিমন্ডলকে তীর্যক কটাক্ষে বিদ্ধ করে। নবারুণ দ্বর্থ্যহীনভাবে আমাদের জানিয়ে দেন, ‘সাহিত্য ও অন্যান্য শিল্প গতানুগতিক ভূষি মালে পরিণত হয়, শেষ বিশ্লেষণে যার একটা লক্ষ্য রয়েছে- রাজনৈতিক শান্তিকল্যাণ রক্ষা করা।’ তিনি নিজে কোনওদিন তার পরোয়া করেননি, কেননা শুরুতেই তাঁর সভাবসিদ্ধ ডিসক্লেমার, তাঁর লেখার সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। আমরা মিলিয়ে নিতে পারি বিচ্ছিন্নতার কষ্টকর যে একাকীত্ব থেকে আখ্যানে তিনি মুক্তি খুঁজেছেন, সেই যন্ত্রণাদীর্ণ মুহূর্তগুলিকে। মার্শাল টিটোর ‘মিলিটারি রাইটিংস’ বইটি তিনি খুঁজছিলেন, কেননা, ‘লেখাতে নয় হাতে নাতে কাজে লাগাতে চাই বলেই। অন্তত হঠকারী একটা কিছু করে ফেলতে তো পারা চাই। অন্তত সম্ভাব্য কিছু একটা নিয়ে ভাবতে ও ভাবনাটাকে চারিয়ে দিতে চেষ্টা তো করাই যায়।’ আমরা বুঝতে পারি কেন তাঁর আখ্যানে শেষমেশ বেঁচে থাকে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা। এবং তিনি একে ‘মতাদর্শের দায়’ বলেই মনে করেন। ‘ লেখাকে হতে হবে সমসময়ের দলিল। এটা আজকাল হামেসাই বলা হয়। আমিও অস্বীকার করি না। কিন্তু অসংখ্য দলিল, উন্নতমানের সাহিত্য, বাঘা বাঘা লেখক- সবই থাকল কিন্তু চোরধাউড়, স্কাউন্ড্রেল, লুম্পেনরা দেদার সরফরাজী করে গেল- এটাই বা কেমন কথা?’ সুতরাং ফ্যাতাড়ুরা থাকে। জরুরি যা কিছু তিনি টুকরো টুকরো করে বলে যান, কিন্তু নিজেকে রিপিট করেন না। এও তাঁর শৈলীর চমৎকারী। বক্তব্য এক হলে পুনরাবৃত্তির ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন বহু তাবড় প্রাবন্ধিকই, নবারুণ সেখানেও স্বভাবসিদ্ধভাবেই ব্যতিক্রম।
    সত্তর চলে গিয়েছে, কিন্তু ‘ভগ্নউরু হতাশ্বাস’ যে লেখকের স্বপ্নে চে গুয়েভারার মৃত অবস্থার ছবি যীশু খ্রিস্ট হয়ে ধরা দিতে থাকে এবং তাঁর চারপাশে যখন ‘মাথাকাটা কবন্ধ ব্রয়লারের সমাজ’ বানানোর সর্বগ্রাসী চক্রান্ত চলতে থাকে, তখন বিশ্বস্ত কমরেডটি আর কী করতে পারেন? আখ্যানের আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে তিনি নোট পাঠিয়ে যেতে পারেন ভাবীকালের উৎসবের জন্য। এছাড়া আরও একটু সুবিধা করে দিয়ে তাঁর আত্মার কিছু অংশ গুঁজে রাখেন তাঁর প্রবন্ধ তথা গদ্যগুলিতে। চলতি সমীকরণের বাইরে আমাদের খোঁজ সে সবের কাছাকাছি পৌঁছলেই ইউটোপিয়ার সম্ভাবনা সত্যি হলেও হতে পারে, অন্তত সে সম্ভাব্যকে চারিয়ে দিতে তো দোষ নেই। খিস্তি-অস্বীকার-অঙ্গী� ��ার ইত্যাদি পাঁচমেশালির প্রাতিষ্ঠানিক ছেনালি অবশ্য ব্যারিকেড হয়ে সেই সন্ধানের সামনে এখনও দাঁড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু কে না জানে, নবারুণ বিশ্বাস করতেন, এবং আমরাও করব যে, ‘ব্যারিকেড রাস্তা বন্ধ করে ঠিকই আবার নতুন রাস্তা দেখিয়েও দেয়।’

    ==============================================

    হাংরি জেনারেশন এবং নবারুণ ভট্টাচার্যঃ তুলনামূলক পাঠ
    প্রবুদ্ধ ঘোষ
    বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার শব্দ তখনই শোনা যায়, যখন তা শোনার জন্যে কেউ থাকে। নবারুণ এই শব্দ শোনানোর কাজটাই করতে চান; সচেতনভাবে। তাঁর অধিকাংশ লেখার কেন্দ্রীয় চরিত্ররা কোনো ‘ইডিওলজি’ বা মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত, তারা রাষ্ট্র-সমাজ নির্মিত হেজিমনি মাথায় নিয়েই দিন গুজরান করে। আর, সাহিত্যের কাজ কী? ক্যাথারসিস করা? মানে, মোক্ষণ? না, বরং নবারুণ বা হাংরিদের লেখা প্রতিমুহূর্তে ক্যাথারসিসের উল্টোদিকে হাঁটে। মোক্ষণ করা, শান্তি দেওয়া তার কাজ নয় বরং আপাতশান্তির বোধটাকে আঘাত করাই মূল উদ্দেশ্য!
    ‘আমার কোনো ভয় নেই তো?’ গল্পের বীরেন। সমস্ত মধ্যবিত্তের মুখের কথা সে বলেঃ আমার ভয় নেই তো? অথচ, যতই সাবধানে পা ফেলুক, যতই ঘর বাঁচিয়ে সন্তর্পণে ‘সেফ্‌’ থাকার চেষ্টা করুক, মরতে তাকে হবেই। ‘স্টিমরোলার’ গল্পে হঠাৎই যেন পেয়ে যাওয়া বিকল্প রণনীতি। শ্রমের শোষণ আর পুঁজির সামনে অসহায় হেরে যেতে যেতে হঠাৎই জ্বলে উঠে, কোনো এক বিপজ্জনক বিন্দুতে শ্রমিকটি প্রবল আক্রোশে ফেটে পড়ে ও তার শ্রমশক্তি শুষে নেওয়া বিদেশি দামি গাড়িগুলিকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। আর, আশ্চর্যভাবে নবারুণের গল্পে দু’শ্রেণির লোক থাকে স্পষ্টতঃ। একদল যারা বিশ্বায়নী বাহুল্যে গা-ভাসিয়ে দেয়। আর, অন্যদিকে তাদেরই বিপরীতে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা কী উৎসাহে বাঁচার রসদ খুঁজে নেয়। সে ভাঙ্গছে নিয়ত, তার সব কিছুই ক্ষয়ে যাচ্ছে, তবুও সে মরছে না। তারা মান্য চলিত ভাষার পরোয়া করে না, তারা উচ্চবিত্তের ‘সফিস্টিকেশন’-এর পরোয়া করে না। তারা শুধু বেঁচে থাকাটা উদ্‌যাপন করে চলে। হ্যাঁ, হয়তো তারা টিঁকবে না, তবুও অসম লড়াইয়ের উদ্‌যাপন। ‘পাঁচুগোপাল’ গল্পে কোনোমতে দিন-গুজরান পাঁচুগোপাল সেই অসম লড়াইয়ের কল্পবাস্তবের মুখ। ‘পাঁচুগোপাল একদিন ওই খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে জলে নোংরা ফেলা বন্ধ করতে বলবে। ওরা শুনবে না। ওকে ধরে মালিকের কাছে নিয়ে যাবে। মালিক জানতে চাইবে ও চোলাই কারখানায় কাজ চায় কিনা। পাঁচুগোপাল ভ্যাটের জালায় থান ইট মারবে। ওরা তখন পাঁচুগোপালকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। ও মরবে চোলাইয়ের মালিকের পায়ের তলায়। রক্ত বেরোবে ওর মুখ দিয়ে। ও মরবে।... সুখের কথা যে পাঁচুগোপাল এখনও মরেনি। এখনও ও নিজের মতো করে বেঁচে আছে।’ [পাঁচুগোপাল] বেঁচে থাকার উদ্‌যাপন ও মধ্যবিত্ত অবস্থান থেকে উঠে আসা তীব্র শ্রেণিঘৃণা ’৬০ র দশকের শেষদিকে যুদ্ধবাস্তব সময়ের সুভাষ ঘোষের লেখাতেও দেখি- “প্রত্যেক যুদ্ধরত হিন্দুজেনারেল বুকে হাত দিয়ে বলুন দিকিনি তিনি কী করবেন যদি তাঁর সামনে স্বয়ং ব্যাস-বাল্মীকি এসে দাঁড়ান- বা খ্রিস্টজেনারেলের সামনে স্বয়ং যীশু- বৌদ্ধ সেনানায়কের সামনে গৃহত্যাগী রাজকুমারবুদ্ধ যদি- তিনি কী অস্ত্র সংবরণ করবেন?... এই বধ্যভূমির মাঝে দাঁড়িয়ে যদি মনে করেন আপনি সংখ্যালঘু- আসুন বুর্জোয়াদের বেডরুম লোপাট করি- ডাইনিং হল লুট করি-”। অথচ, এই যুদ্ধবিরোধিতা যে আদৌ যুদ্ধ থামাতে পারে না, সেটা নিশ্চিত। বস্তুতঃ, কোনো গান-কবিতা-সাহিত্যই কি আদৌ যুদ্ধ রুখতে পারে? এমনকি, এরপরেও মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে অবধারিত ‘ইনসিওরেন্স’ এবং সমস্তরকম সুরক্ষার আওতায় থেকে নির্বিঘ্ন জীবনটাই প্রার্থনা করবে, তাও জানা। সেই বীরেনের মতই, ‘আমার কোনো ভয় নেই তো?’ দশকের পর দশক এই আপ্তবাক্য তো চিরন্তন। হাংরিদের বা নবারুণের লেখায় তারই সোচ্চার উচ্চারণ। আর, নবারুণ সেই অন্ধকারের মধ্যেই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষদের মধ্যে অর্গ্যানিক ইণ্টেলেকচুয়াল-এর সন্ধান করেন। যদিও সে পথই যে ‘ঠিক’ এমন কোনো মাথার দিব্যি নেই, কিন্তু সেও একটা পথ। আর, যেকোনো দিন সেই পথেই বিষ্ফোরণটা হতে পারে।

    নবারুণের গল্পগুলির অন্যতম প্রধান মোটিফ হচ্ছে মার্ডার এবং অস্বাভাবিক মৃত্যু। বিশেষতঃ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষেরা স্বপ্ন দেখতে দেখতেই হঠাৎ যেন হারিয়ে যায়; অথবা, মানুষগুলো মরে যায়, স্বপ্ন মরে না! অথবা, এভাবেও কি ভাবা যেতে পারে যে, তাদের আত্মহত্যা আসলে দৈনন্দিন সমাজের নিয়মগুলোকেই অস্বীকার করা? আর, তাদের মার্ডার হয়ে যাওয়া আদতে রাষ্ট্রের ‘সুশাসন’-কেই চ্যালেঞ্জ জানায়? ‘আমার কোনো ভয় নেই তো?’ গল্পের মধ্যেও এই বাক্যমধ্যবর্তী নীরবতা দশক-মধ্যবর্তী নীরবতায় বদলে যায়, তাই ’৭১-’৭২ সালে কলকাতায় আসা রিভলভার থেকে বেরোনো গুলি ২০০৪ সালের আপাতশান্ত সময়ের এক মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে খুন করে। অন্যদিকে, হাংরি জেনারেশনের লেখার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মাবিষ্কার। হাংরিদের ‘ক্ষুধা’ বিষয়ে তাঁদের নিজস্ব মতামত এই ক্ষুধা আসলে নিজেকে দগ্ধ করে সত্য আবিষ্কারের ক্ষুধা। সত্য, যা ক্রমাগতঃ এমনকি নিজেকেও ছিঁড়েখুঁড়ে উন্মোচিত করে চলে। তাকাই তুষার রায়ের একটি কবিতার দিকে- “দামী সাবান গায়ে ঘষে ঘষেও ফর্সা হতে পারছো না বলে দুঃখ?/ তাহলে কোমরে ব্লেড ঘুরিয়ে দু-হাতে গেঞ্জি তোলো চামড়ার/ অমনি বেরিয়ে পড়বে কি আশ্চর্য আপেল রং রক্তাভ/ আর আজীবন জ্বলুনি থেকেও কি তীব্র তীক্ষ্ণ জ্বালা/ শালা , অথবা আপন মাংসয় দাঁত দিয়ে তুমি আত্মায় পৌঁছও।” [আত্মায় পৌঁছওঃ তুষার]। অথবা, ফাল্গুনী রায়ের কবিতায়, “আমার বুকের ভিতর লোভ অথচ হৃদয় খুঁজতে গিয়ে বুকের ভিতরে/ রক্তমাংসের গন্ধ পাচ্ছি কেবল”।

    আজ স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; প্রকাশ্যে চুম্বন করে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাধানিষেধ ও সমাজের প্রচলিত ‘ট্যাবু’গুলিকে। এই বিদ্রোহ কিন্তু ’৬০ এর দশক থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকেরা। সমস্তরকম গোঁড়ামি এবং ‘ঢাকঢাকগুড়গুড়’ বিষয়ের ভিতে টান মেরেছেন। সাহিত্য বহু আগেই ভবিষ্যতের কোনো এক আন্দোলনের কথা স্বীকার করে যাচ্ছে- তার নিজের মত করে, নিজের প্রকাশে। না, নিশ্চিতভাবেই সাহিত্যের কাজ ভবিষ্যৎদর্শন নয়; কিন্তু হ্যাঁ, সাহিত্যের অন্যতম কাজ ভবিষ্যতের সামাজিক আন্দোলনের, সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রগুলোর হদিশ দিয়ে যাওয়া। ফাল্গুনী রায় যখন কবিতায় বলে, ‘শুধুই রাধিকা নয়, গণিকাও ঋতুমতী হয়’, তখন কি আজকের এই আন্দোলনের কথাই মনে হয় না? যেখানে, ঋতুমতী হওয়া কোনো ‘লজ্জা’র বিষয় নয়, ‘অশুদ্ধি’র বিষয় নয়, বরং তা স্বাভাবিক জৈবনিক প্রক্রিয়া। আর, প্রতিমুহূর্তের এই আত্মজৈবনিক বিষয়গুলিই উঠে আসে হাংরি জেনারেশনের লেখায়। বা, সগর্ব্ব মানুষ-প্রমাণ ‘আমি মানুষ একজন প্রেম-পেচ্ছাপ দুটোই করতে পারি’’। এগুলো তো দৈনন্দিন। এগুলো তো স্বাভাবিক। তা’লে? আসলে, ‘শুদ্ধতা’-র একটা অর্থহীন ধোঁয়াশাবোধ তো তৈরি করেই দেয় সমাজ, একটা বর্ডারলাইন। সাহিত্যের নায়ক রক্তমাংসের মতো হবে কিন্তু তার ক্ষুধা-রেচন ইত্যাদি থাকবেনা বা পুরাণচরিত্রদের শারীরবৃত্তীয় কার্য নেই! এই ‘মেকি’ ধারণাসমূহ লালন করে আসা আতুপুতু প্রতিষ্ঠানগুলো যখন হাড়-মজ্জা-বোধ জীবন্ত হতে দেখে তখন ‘অশ্লীল সংস্কৃতি’ ছাপ্পা মারে। সমাজের জড়তা, মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির মুখোশগুলো খুলে দেয় টান মেরে। আর, তাই ‘নিষিদ্ধ’, অশ্লীল মনে হয় এদের লেখাগুলি। হাংরি-দের যেখানে মূল বক্তব্যই ছিল প্রতিটি লেখায় ও সাহিত্যযাপনে আত্মউন্মোচন, সেখানে এই বিষয়গুলি স্বাভাবিক বীক্ষাতেই উঠে এসেছে। এবং, ‘সাহিত্য বিক্রির জন্যে আরোপিত যৌনতা’ বনাম ‘শিল্প ও জীবনের সাথে সম্পৃক্ত যৌনতা’ এই বিতর্কের ডিস্‌কোর্স তৈরি করেছে। অন্যদিকে, নবারুণের লেখায় রাজনীতি সচেতনতা অনেক প্রাধান্য পায়। তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখার ক্ষেত্রে তিনিও ‘বাজার চাহিদার যোগানে সাহিত্য’ এই ধারণার সঘোষ বিরোধিতা করেছেন। শারীরবৃত্তীয় চাহিদাগুলির সাথে বৌদ্ধিক চাহিদা যে জড়িত, সেটা তাঁর লেখাতেও আসে। তবে, অনেকাংশে আসে রাজনৈতিক অবক্ষয়, অসহায়তা, শ্রেণিচিত্র এবং প্রতিরোধ। নবারুণ যখন ফ্যাতাড়ুর প্রতিটি বচনে, তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়েই মধ্যবিত্তের না-পারা গুলোর উন্মুখ উড়ান দেখাতে চান, তখন মনে মনে ফ্যাতাড়ুদের মত সেই কাজগুলি করতে চাওয়া সত্ত্বেও এতদিনের সমাজনির্মিত তথাকথিত সুষ্ঠু ‘সাহিত্যবোধ’ মেনে নিতে পারেনা সেই ভাষা, সেই কর্মকাণ্ড! বড়লোকের গাড়ি দেখলেই টায়ার ফুটো করে দেওয়ার ইচ্ছে, দামি অফিসে গিয়ে হতাশা লুকোতে গদিতে নাক খুঁটে আসা, মেয়ে দেখলেই অবদমিত কামনা জেগে ওঠা কিন্তু ফের ‘ইগো’-র আচরণে পরিশীলিত থাকা, জ্ঞানীগুণীসমাবেশে ভণ্ডলোকেদের ‘সংস্কৃতিবান সাধু’ হয়ে ওঠার বিরুদ্ধে সঘোষ আওয়াজ তোলা মধ্যবিত্তের বৌদ্ধিক স্তরে এগুলো চলতে থাকে। কিন্তু, সে শেষপর্যন্ত নীরব দর্শকের মতই মেনে নেয়; আর, নবারুণ তাঁর গল্পের চরিত্রদের দাঁড় করিয়ে রাখেন এগুলোরই প্রতিবাদে। নিজেদের মত করে বিকল্প রণকৌশল খুঁজে নেয় তারা। সুভাষ ঘোষের গদ্যে থাকে সমস্ত ধড়িবাজ, রাজনীতিবাজ, সঞ্চয়িতাবাজ, পলিসিবাজ, নামকাতুরে মানুষের কথা; যারা আপাতনিশ্চিন্ততার মোড়কে মুড়ে রাখে নিজেদের দৈনন্দিন আর গান্ধীর বাঁদরের মতই কিচ্ছু না-দেখে না-শুনে না-বলে কাটিয়ে দিতে চায় রাত-দিন। আর, প্রাতিষ্ঠানিকতা এদেরই ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজেকে ‘শিল্প’ বলে দাবি করে অন্য সম্ভাবনাগুলো নষ্ট করে দেয়। বেঁচে থাকাটা একটা দায় একটা নিয়ম হয়ে ওঠে পণ্যসমাজে। আর, সেই পণ্যসময়ে বেঁচে থেকে কিচ্ছু না-পেয়ে বেঁচে থেকে হতাশার অবিমৃষ্য বোধ তৈরি হয়। ’৬০-’৭০ র দশকের ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবক্ষয়, মধ্যবিত্তের আশাহীনতার অভিঘাত নৈরাশ্যের জন্ম দেয়; এমনকি সাহিত্যেও। আর, সেই নৈরাশ্যকে এড়িয়ে গিয়ে কবিতা বা গদ্য লেখা যায় না। অরুণেশ ঘোষ তাঁর ‘কিচ্ছু নেই’ সময়কে লিখছেন- ‘১ পাগল এই শহরের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে তার লেঙ্গট/ ১ সিফিলিস রুগী পতাকা হাতে মিছিলের আগে/ ১ রোবট নিজেকে মনে করে আগামীকালের শাসক/ ১ মূর্খ ঘুমিয়ে থাকে শহর-শুদ্ধ জেগে ওঠার সময়... শীতের ভোর রাত্রে- মধ্যবিত্তের স্বপ্নহীনতার ভেতর/ আমাকে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে বেশ্যাপাড়ার মেয়েরা’। এই স্বপ্নহীনতাকে বাড়িয়ে তোলে পুঁজিবাদের দমবন্ধ চেপে বসা। ভারতের তথা বাংলার অর্থনীতি-মডেলকে সাজানোর দোহাই দিয়ে বিদেশি শস্যবীজ এবং সবুজ বিপ্লবের সাথেই আমদানি হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আর, নগরায়ণের মুখ খুলতে থাকে। ’৯০ র দশকের পরে যে বীভৎস হাঁ-তে ঢুকে যেতে থাকবে ভারতবর্ষের একের পর এক গ্রাম-মফস্বল।

    ১৯৬৮ সালে বিনয় ঘোষ ‘কলকাতার তরুণের মন’ নামক প্রবন্ধে লিখছেন- “গোলামরা সব উঁচুদরের ঊর্ধ্বলোকের গোলাম, আগেকার কালের মতো তাঁদের হাত-পায়ের ডাণ্ডাবেড়ি দেখা যায় না। তাঁদের ‘স্টেটাস’ আছে, ‘কমফর্ট’ আছে, ‘লিবার্টি’ আছে। তাঁরা নানাশ্রেণীর ব্যুরোক্র্যাট টেকনোক্র্যাট ম্যানেজার ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার সেলস-প্রমোটার বা ‘অ্যাড-মেন’- যাঁরা যন্ত্রের মতো সমাজটাকে চালাচ্ছেন। ব্যক্তিগত ভোগ-স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাধীনতার একটা লোভনীয় মরীচিকা সৃষ্টি করছেন তাঁরা সাধারণ মানুষের সামনে এবং দিনের পর দিন বিজ্ঞাপনের শতকৌশলে নেশার পিল খাইয়ে সেই ভোগস্বাধীনতার স্বপ্নে তাদের মশগুল করে রাখছেন।”। ’৬০-’৭০ র অবক্ষয়ী অথচ পণ্যপ্রিয় ভোগসমাজের কথা সেইসময়ের মতন করেই লেখেন হাংরি গল্পকাররা। আর, ভবিষ্যতের পণ্যসমাজের একটা আভাসও থাকে। “আপাতত প্রতীয়মান ধূম্রজালে জড়ানো ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর একজন দৈত্যভৃত্য- ঃ আপনার গোলাম আকা কি হুকুম যা বলবেন যা চাইবেন জীবনে তাই হাজির... একটি সিগারেট। ...একটি সিগারেট। পাঁচ বছরে একটি টিভি সেট। দশ বছরে একটি গাড়ি আর বিশ বছরে সিগারেট খেতে খেতে একবার সারা দুনিয়ায় চক্কর দেব। বাতাস স্তব্ধ। অবাক হঠাৎ মেঘের আকাশ-কাঁপানো অট্টহাসি।”[ঘটনাদ্বয় ও তাদের সাজসজ্জাঃ রবিউল] বস্তুতঃ, ১৯৪৭-এ ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে এই সংস্কৃতির মধ্যে দিয়েই যাচ্ছিল ভারতীয় সমাজ। বিনয় ঘোষের এই প্রবন্ধের যে সমাজবর্ণনা, তা অবিকল রয়েছে বিশ্বায়ন পরবর্তী আজকের সমাজেও। নবারুণের ‘কনগ্র্যাচ্যুলেশন’ গল্পটির পাঠ নেওয়া যেতে পারে। গল্পের প্রোট্যাগনিস্ট শাশ্বত স্টেটাস, কমফর্ট অর্জন করেছে। বিশ্বায়নের গলিঘুঁজি চিনে সে আজ সফলতমদের মধ্যে একজন। প্রত্যেকে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। এই সফলতার শিখরে শেষ অবধি তাকে একটি ‘অপ্‌শন’ বেছে নিতে বলা হয়, তার মৃত্যুর অপ্‌শন। আশ্চর্য, সেটা মিলে যায় তার সৌভাগ্যের নম্বর-৪ এর সাথে। আর, এখানেই মনে পড়ে জাঁ বোর্দ্রিয়ারের পণ্যসমাজ ও উত্তর-আধুনিকতার হাইপার-রিয়ালিটির ধারণা। অতিরিক্ত পণ্যচাহিদায় ও ভোগের আতিশয্যে বাস্তব মরে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ‘কমোডিটি ফেটিসিজম’ বা পণ্যাকর্ষণ; সেখানে পণ্যকে ব্যবহার করতে করতে মানুষ পণ্য হয়ে যাচ্ছে। তার জীবন ও যাপন সমস্তটাই পুঁজিবাদী উৎপাদনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর, কোনো বস্তুকে ভোগ করার অর্থ শুধুমাত্র প্রয়োজনীয়তা বা মানসিক আনন্দের থাকছে না, তা সংস্কৃতিক প্রয়োজনের বৃহত্তর ক্ষেত্রও তৈরি করে নিচ্ছে। আর, তখনই প্রকৃত বাস্তবের থেকে বেরিয়ে একটা হাইপার-রিয়ালিটি বা অধিবাস্তব তৈরি করে নিতে হচ্ছে। আদতে কিন্তু মানুষটা মরে যাচ্ছে। তবুও সে এক অদ্ভূত ভোগ্য-পণ্য বোধের মধ্যে দিয়েই চলেছে। যা আপাত তৃপ্তির। ‘কনগ্র্যাচ্যুলেশন’ গল্পের শাশ্বতর মতই। অথবা, ‘কোল্ড ফায়ার’ গল্পের সেই চরিত্ররা; যারা বিলাস-ব্যাসনে অভ্যস্ত এতটাই যে মৃত্যু-পরবর্তী চিতার তাপ, শ্মশানের নরকাবস্থা থেকেও আরাম চায়, তাই সুখানুভূতি নিতে নিতে ‘কোল্ড ফায়ার’ বা বরফশীতল অগ্নিচুল্লীতে মরার জন্যে এবং বিশেষ ডিস্‌কাউণ্টের ব্যবস্থাও করে যায়। এতটাই পণ্যসঙ্গমে অভ্যস্ত তারা। বোর্দ্রিয়ারের মতে, উত্তর-আধুনিক সমাজে শ্রেণিবিভাগ আর শুধুমাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকছে না, বরং তা এখন নির্ভর করছে ভোগের ওপর। কে কোন পণ্য ভোগ করছে, তার ‘ব্র্যাণ্ড’ এবং দামের ওপর নির্ভর করছে তার শ্রেণিঅবস্থান। অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন, পণ্যকৌশলে ভুলিয়ে দিতে চাওয়া দেশকাল-ইতিহাস আর, এমনকি প্রকৃত যৌনতা, সামাজিকতা সবকিছুরই মৃত্যু ঘটছে- তখনই অধিবাস্তব টেনে নিয়ে চলেছে ‘ভার্চ্যুয়াল’ জগতে, এই সত্য তো হাংরি জেনারেশন এর লেখাতেও উদ্ঘাটিত হয়েছে! বস্তুতঃ, তাঁদের লেখায় তাঁরা এটাকেই আক্রমণ শানাতে চেয়েছেন। আজকের ‘ফেসবুক-ট্যুইটার রিয়ালিটি’ তে দাঁড়িয়ে দূরদর্শী মনে হয় এই লেখাগুলো; নবারুণের ‘ক্লোন-ব্রয়লার’ সংক্রান্ত গল্পগুলি।

    বুঝে নেওয়া দরকার হাংরি-প্রজন্মের সাহিত্য আন্দোলনের নিভন্ত আগুন এবং সেই আগুনে শাসক-রাষ্ট্রের ক্রমাগত শান্তির জল ঢেলে যাওয়া; অথচ সেই নিভু আগুনের থেকে ফিনিক্সের জেগে ওঠা। নিওফ্যাসিজম্‌ বিশ্বব্যাপী ঠাণ্ডাযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকেই ঘর গোছাতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক ভাবে দখল চালানো তো বটেই, তার সাথেই থাকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আগ্রাসন। আর, পুঁজিবাদ নতুন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তার উৎপাদন-পদ্ধতিকে খাপ খাইয়ে নিতে চায়, তেমনি সাহিত্যকেও যেহেতু পুঁজিবাদ পণ্য হিসেবেই দেখে, তাই তার উৎপাদন-কৌশলেও নতুন ফর্মুলা নিয়ে আসতে চায়। আর, সেই ফর্ম্যুলার অন্যতম হল, একদা যা ছিল প্রান্তিক, যা ছিল শাসকের ‘ডিস্‌কোর্সের’ বাইরে, তাকেই কেন্দ্রের দিকে ঢুকিয়ে দেওয়া, শাসকের ‘ডিস্‌কোর্সে’ তাকেও ঢুকিয়ে নেওয়া। হাংরি প্রজন্মের আন্দোলনের সময় যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি তাদের ‘প্রান্তিক’ করে রেখেছিল, পরে সময়-সুযোগ বুঝে তাকেই প্রতিষ্ঠানের কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকিয়ে নেয়। অ্যাণ্টি-কাল্‌চার ও কি বাজার-কাল্‌চার এ ঢুকে পড়ে? যখন তার প্রভাব এড়ানো যায়না আর, যখন ছাই হয়েও ফিনিক্স পাখির মতো জ্বলে ওঠে ফের তার ভাষা-সংস্কৃতি তখন বাজার নতুন ভাবে নামে? প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয় বিগত সব প্রত্যাঘাতগুলো? একদা ‘ওরা অশ্লীল’ বলে চেঁচানো সাহিত্যিকেরাও লিখে ফেলেন হাংরি-দের কথা। বাণিজ্যিক ছবি হয়, সেখানে হাংরি-লেখক রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে প্রুফ-চেক্‌ করাতে মুখিয়ে থাকে। এ-ও তো এক সংস্কৃতি। প্রতিস্পর্ধাকে নমনীয় করে, দোষারোপ গুলোকে বড়ো করে প্রতিস্পর্ধী-সংস্কৃত�� �র ‘সংস্কৃতি’-কে ভুলিয়ে দেওয়া। কারণগুলোকে ভুলিয়ে দেওয়া, প্রেক্ষাপট ও প্রেক্ষিতকে গুলিয়ে দেওয়া। পণ্যমুখর পুঁজিবাদে লেখক ও লেখাদের পণ্য করে তোলা, বিপণন কৌশলে চমক! আসলে, ভোগবাদ, পুঁজির সংস্কৃতি তার নীতি বদলায় না, কৌশল বদলে ফেলে। বিশেষতঃ ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’-র পর থেকে সচেতনভাবে তৃতীয় বিশ্বের উপর চাপিয়ে দেওয়া উদারনীতি-নয়া উপনিবেশ-লো ইণ্টেন্‌সিটি কনফ্লিক্ট এই ত্রিশূল সর্বতোভাবে সংস্কৃতিকেও নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বায়ন ‘প্রান্তিক’দের সাহিত্যে থাবা বসায়। কিন্তু, নবারুণ তাঁর লেখায় ইচ্ছে করেই তাই ‘প্রান্তিকতা’র কথা ব্যক্ত করেন। প্রতিষ্ঠানের আদর পাওয়া সাহিত্যছাঁচ বাঁচিয়েই নিজের লেখায় ছাঁচ গড়ে রাখেন। বাজার তার বাইরে কিছুই রাখতে চায় না, তার নিজের স্বার্থেই। ’৬০-’৭০ দশকে সাহিত্যে যৌনতা-জীবন বিষয়ক প্রকাশ্য আলোচনাকে নিন্দা করেও, পরে তাকেই সাহিত্যবিক্রির মূল ‘পুঁজি’ করেছে মূলধারার সাহিত্য; এই উদাহরণ আরো রয়েছে। তাই, নবারুণের লেখা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কৌশলকেও আক্রমণ করে।

    হাংরিদের ক্ষেত্রে বৃহত্তর ক্ষেত্র থেকে সরে এসে ক্রমেই ‘আত্ম’কে উন্মোচন করায় জোর দেওয়া। এবং, অন্যদিকে নবারুণের লেখায় ‘আত্ম’ থেকে বেরিয়ে বৃহত্তর আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পৃক্তির চেষ্টা। ক্ষুধার্ত কবিরা দেখেছে প্রতিশ্রুতির গলিত শব, দেখেছে একের পর এক মিছিল ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার হয়ে যায়। আর, তাই বিমুখতা তৈরি করে নিয়েছে রাজনীতি থেকে। সুবো আচার্যের কবিতায়- ‘নই কর্তাভজা স্বাধীনতা-সেবী- রুশচীন বহ্ন্যুৎসবে আমার/ কোনো আহুতি নাই- ইন্দিরা কেন গান্ধী হয়ে গেল এ নিয়ে/ ভাবনা নাই’। হয়তো, রাজনৈতিক দিশাহীনতা এবং নির্দিষ্ট বিকল্পের সন্ধানহীন গোলোকধাঁধাতে আটকে থেকেছিলেন ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকরা; তাকেই এক নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবয়ব দিয়ে বিকল্পের সন্ধান ও বিষ্ফোরণের সম্ভাবনাগুলো তুলে আনতে চাইলেন নবারুণ। নবারুণের প্রতিরোধ শুধু প্রতিষ্ঠানকেই নয়; বরং তাঁর প্রতিবাদ বুদ্ধিজীবিদের দোদুল্যমানতার প্রতিও। ফ্যাতাড়ুরা সেইসব বুদ্ধিজীবিদের ঘৃণা করে। নকশাল আন্দোলন পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে মোড়বদল হয়েছে। নকশাল আন্দোলনের স্বপ্ন, বাস্তব এবং অভিঘাত সেই ’৭০ র দশক থেকেই পাতার পর পাতা ভরে বাঙালি তথা বিশ্ব পাঠককে উপহার দিয়েছে বহু সাহিত্য। আর, তারই সাথে শুরু হয়েছে ‘অ্যাপলিটিসাইজেশন’ বা ‘নিরাজনীতিকরণের’ পদ্ধতি। নকশাল আন্দোলন মধ্যবিত্ত রোম্যাণ্টিকতা ও কাঁচা প্রেমের মতো, বামপন্থা মানেই তা ভ্রষ্ট সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখায় এবং আসলে নিরাজনীতিই মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলে! এহেন ভাবনাগুলোকে সচেতন ভাবেই প্রতিষ্ঠান্নগুলোর মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হতে লাগল। বিশেষতঃ ’৮০ র দশকের বাংলা সাহিত্য থেকেই। আর, ’৯০ পরবর্তী প্রাতিষ্ঠানিক ও ‘এলিট’ পত্রিকার সাহিত্যগুলি কিছু অবয়ববাদী বা স্ট্রাক্‌চারালিস্ট ধাঁচা(স্টিরিওটাইপ) এনে ফেলল। যেমন, নকশাল ছেলেটি লেখাপড়ায় মারাত্মক ব্রিলিয়াণ্ট ছিল, ‘ভুল’ রাজনীতির পাল্লায় পড়ে গ্রামে গেল রাজনীতি শিখতে ও ডি-ক্লাস্‌ড হতে, তার প্রেমিকা উচ্চবিত্ত ঘরের এবং যৌনসম্পর্কের বিশদ অনর্থক বর্ণনা, পুলিশের গুলিতে বা অত্যাচারে পঙ্গু হল, আদতে লড়াইটা এবং মতাদর্শটা ব্যর্থ হল এবং অ্যাপলিটিক্সের ওপরে সমাজসেবার ওপরে ভরসা রাখল ব্যর্থ নায়ক! এই অবয়ববাদী ধাঁচায় ফেলে প্রতিষ্ঠানগুলি বিক্রি বাড়াতে লাগল তাদের সাহিত্যের। আর, তার সাথেই ক্রমে ‘সক্রিয় রাজনীতি’ ও বামপন্থা থেকে বিমুখ করে দিতে লাগল বিশ্বায়ন পরবর্তী প্রজন্মকে। আর, নবারুণ কোথাও গিয়ে এই ধাঁচাটাই ভাঙ্গতে চাইলেন। যদিও এই শাসক-নির্মিত ও বাজার-নির্মিত ধাঁচা ভাঙ্গার লেখায় তিনি ‘প্রান্তিক’, বোধহয় তাইজন্যেই নিয়ত এত সোচ্চার তিনি। “ক্লোনেরাই সরবরাহ করে চলেছে ব্রয়লার নাটক, ব্রয়লার উপন্যাস, ব্রয়লার কবিতা, ব্রয়লার ছবি, ব্রয়লার সমালোচনা, ব্রয়লার পত্রিকা। ক্লোন, ব্রয়লার, মিডিয়ক্রিটি- সব শব্দকে গিলে রূপসী রাক্ষসীর মতো দাঁড়িয়ে আছে সেলফোন হাতে একটি শব্দ- সেলিব্রিটি।”

    নবারুণের গল্পের আরেকটি উল্লেখযোগ্য জায়গা হচ্ছে ইণ্টারটেক্সচ্যুয়ালিট ি বা পাঠমধ্যান্তর। একই নাম এবং চরিত্ররা ফিরে আসছে বিভিন্ন গল্পে। কিন্তু, এই গল্পগুলি কিন্তু সিক্যোয়েল নয় বা ফ্যাতাড়ুর মতন সিরিজ হিসেবে লেখা নয়। এলিট ম্যাগাজিন বনাম লিটিল ম্যাগাজিন এবং বিখ্যাত বনাম অখ্যাত এই বাইনারি অপোজিটে দাঁড়িয়ে একপ্রকার বিনির্মাণ হিসেবেই উঠে আসে ‘ফোয়ারা’। ‘টয়’ গল্পের স্বচ্ছল-ফ্ল্যাটবাসী-স� ��স্থসাংস্কৃতিক মিথিল ফিরে আসে ‘ম্যালোরি’ গল্পে। দু’টি গল্পেই একটি সাধারণ সূত্র থাকে, তা হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথায় খুন অথবা, বিজ্ঞানমনস্কতায় খুন। আসলে, এই অনুতাপহীন বীভৎসতা প্রতিমুহূর্তে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। আবু ঘ্রাইবের কারাগারে, ছত্তিশগড়-লালগড়ের থানায়। বিজ্ঞানীরা নিত্যনতুন আবিষ্কার করেন হত্যাপদ্ধতিকে নিখুঁত করতে আরো। মনে পড়ে যায় ‘আগন্তুক’ ছবিতে মনমোহন মিত্রের সেই সংলাপঃ “সভ্য তারাই যারা একটি বোতাম টিপে দুটি শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে; আর, সভ্য তারাই যারা সেই বোতাম টেপার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।” টয়-মিথিল-মিমিরা আসলে সেই সভ্যতারই সফল ধারক ও বাহক। আর, হাংরি-দের গল্পের এবং গদ্যের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হচ্ছে, মুক্তসমাপ্তি। অর্থাৎ, কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন না লেখক; হয়তো স্থির সিদ্ধান্ত হয় না কোনও। অন্ততঃ, যে সময়ে তাঁরা লিখছেন, সেই সময়ে অচঞ্চল বিশ্বাস কিছু নেই, কোনও স্থিতি নেই, সিদ্ধান্তে আসার ভিত্তি নেই। বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘বমন রহস্য’ গল্পে আশাহীন এবং আলোহীন ভোগবাদী সমাজের প্রতি ঘৃণা ঠিকরে বেরোয়। গল্পের শেষ লাইন- “বমি করে যাই রক্তাক্ত পথের উপরে। সমস্ত চর্বিত মাংসের টুকরো, সমস্ত জীবন ভোর খেয়ে যাওয়া মাংসের টুকরো আমি বমি উগরে বার করতে থাকি। বমির তোড়ে আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।”। পাঠকের যথেচ্ছ স্বাধীনতা থাকে, জীবনের সাথে মিলিয়ে পরিণতি ভাবার; সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেওয়ার দায় লেখকের নয়।

    হাংরি লেখকেরা তাঁদের লেখালেখিতে জোর দিচ্ছেন পাঠের ওপর। অর্থাৎ, লেখকের ভাষাগত চাতুর্য, শব্দলালিত্য আর বিচার্য নয় বরং বিচার্য পাঠবস্তুটি। ন্যারেটিভের ক্ষেত্রে হাংরি-দের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রানিং কমেণ্টারির মতোন অর্থাৎ, চলন্ত ধারাভাষ্যের মতো সাহিত্য। যা ঘটছে, যা অভিজ্ঞতা সেটাকেই গল্প বা কবিতায় তুলে আনা। কবিতা সম্পর্কে প্লেটোসহ বহু প্রাচীনপন্থীর মতামত এই ছিল যে, কবিতা বাস্তব থেকে দূরে নিয়ে যায় চেতনাকে। অথচ, হাংরি-দের কবিতা পড়লে কিন্তু তার উল্টোটাই মনে হয়। বড়ো বেশিই যেন বাস্তবের গহ্বরে ঢুকিয়ে নিতে চাইছে পাঠককে, সঙ্গে নিজেরাও। নৈর্ব্যক্তিকতাকে প্রত্যাখ্যান করে হইহই করে লেখক নিজেকেও এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে লেখার মধ্যেই। এর ফলে কবিতার চিরাচরিত সম্বোধক-সম্বোধিত বা অ্যাড্রেসার-অ্যাড্রে�� �ি নিয়ম ধাক্কা খাচ্ছে। সাহিত্য আর ততটা দূর থেকে বসে, নিরাপদে লেখার বিষয় থাকছে না; যখন পৃথিবী পুড়ছে ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে তখন লেখাও পুড়তে বাধ্য। ‘ফিকশন’ বা কল্পকাহিনীর ‘জন্‌র’-র ক্ষেত্রে নিয়ম ওলটপালট করেন নবারুণ। ফিক্‌শন-এর অলিখিত শর্তই হচ্ছে যে, সেখানে ঘটনার উল্লেখ থাকবে কিন্তু সরাসরি নামোল্লেখ থাকবে না কিছুর। গল্পে কোনো তথ্য বা রেফারেন্স থাকলেও, তার টীকা লেখার দায় নিশ্চয় লেখকের নয়। অর্থাৎ, বাস্তব আর কলপনার মধ্যে ফারাক রাখা। কিন্তু, নবারুণ সচেতনভাবেই ভাঙ্গেন এইটা। তাঁর বহু লেখায় সরাসরি রাজনৈতিক দল সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপি ইত্যাদির নামোল্লেখ থাকে। তাঁর ‘কাকতাড়ুয়া’ গল্পের শুরুতে বলে রাখেন “নির্দিষ্ট ঘটনাটি ১৯৭৯ সালের আগস্ট মাসে ঘটেছে, ১৫ তারিখে... রচনাটির কোনো অংশই কাল্পনিক নয়।” বস্তুতঃ, কাল্পনিক সাহিত্য লেখার দায়ও যেন তাঁর নয়। বরং, ভারতের ‘স্বাধীনতা দিবসে’ বিহারে দলিত-নিধন ও উচ্চবর্ণ-শ্রেণির আধিকার প্রতিষ্ঠার বাস্তবতাই ভারতীয় সাহিত্যের এতদিনের অনূক্ত কথন। ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ গল্পের বাস্তবতা পশ্চিমবঙ্গের যে কোনো কারখানার। ইউনিয়ন-মালিকের আঁতাত এবং একের পর এক শ্রমিকের অপমৃত্যু, শ্রমিক শোষণ; অথচ গণমাধ্যম সেই শোষক শক্তিরই অংশীদার। আর, এ গল্পের শেষেও পাঠকের কাল্পনিক গল্পপাঠের মৌতাত ভেঙ্গে নবারুণ জানান যে, ‘প্রত্যেকটি তথ্য সত্য। মোহিনী মিলের ঘটনাবলীর সূত্র বন্ধু রতন চক্রবর্তীর রিপোর্ট।’ আর, হয়তো প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সূত্র ধরেই সরাসরি বিদেশি ব্র্যাণ্ড, বহুজাতিক সংস্থার সরাসরি নামোল্লেখ। ‘৯৮৬৪৪’ গল্পে আডিডাস, পুমা, নাইকি, রিবক ইত্যাদির নাম সরাসরি থাকে। সাধারণতঃ কোনো লেখায় ব্র্যাণ্ডের নামোল্লেখ থাকে তার মার্কেটিং করার জন্যে অথবা, ‘মার্কেটিং পলিসি ইন নেগেটিভ ওয়ে’ তে করার জন্যে। কিন্তু, নবারুণ তা করেন না, বরং সচেতনভাবে তিনি বিশ্বায়নবিরোধিতা ও পণ্যবিরোধিতা করে যান। বলেন, যে, ব্র্যাণ্ডেড জিনিস পরাটাই ফ্যাশন। ফের মনে পড়ে বোর্দ্রিয়ারের তত্ত্ব। নবারুণ বারবার বহুজাতিক ও শোষক পণ্যের উল্লেখ কেন রাখেন? “ইন্দোনেশিয়াতে ‘নাইকি’ কোম্পানির কনট্র্যাক্ট শ্রমিকরা পায় দিনে ২.৬০ ডলার। ‘নাইকি’-র চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ফিল নাইট এক বছরে যত টাকা কামান তত টাকা রোজগার করতে হলে একজন কনট্র্যাক্ট শ্রমিককে ৯৮,৬৪৪ বছর ধরে জুতো বানাতে হবে।” [৯৮৬৪৪]। সংখ্যাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার খেলা চলে ‘আংশিক চন্দ্রগ্রহণ’ গল্পেও। উচ্চমধ্যবিত্ত, অতিস্বচ্ছল রোহিতের মাসমাইনে ৬০,০০০ আর ব্রিটিশ-আমেরিকান মিলিটারি ‘কম্বোপ্যাক’ ইরাকে খুন করেছে ৯৮,০০০। অর্থাৎ, এই তফাৎটা মাত্র ৩৮,০০০। এই সহজ অঙ্ক ও সংখ্যাতত্ত্ব বুঝে ফেললে জীবন মসৃণ আর না বুঝলেই অস্বস্তি বাড়বে।

    নবারুণ কবিতার সংজ্ঞাও একপ্রকার নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। ঠিক যেভাবে হাংরি-রা তাদের কবিতার ধারণা স্বতন্ত্র করে দিচ্ছেন। নবারুণের কবিতা চিরাচরিত চাঁদ-ফুল-তারার রোম্যাণ্টিকতা অস্বীকার করে। কবিতা যে ‘লেখার’ নয়, বরং কবিতা ‘হয়ে ওঠার’ বিষয়, তা স্পষ্টতর হয় অস্থির সময়ে- “কবিতা এখনই লেখার সময়/ ইস্তাহারে দেওয়ালে স্টেনসিলে/ নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে/ এখনই কবিতা লেখা যায়...”। কবিতার আসন্ন সম্ভাবনাও লিখে রাখেন শেষ পংক্তিগুলিতে। “কবিতার জ্বলন্ত মশাল/ কবিতার মলোটভ ককটেল/ কবিতার টলউইন অগ্নিশিখা/ এই আগুনের আকাঙ্খাতে আছড়ে পড়ুক”। আর, এখানেই কবিতাকে নতুনভাবে সাজিয়ে নেওয়ার ভাবনার সাথে মিল পাওয়া যায় হাংরি-দের। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা থেকে প্রথম হাংরি বুলেটিন বেরোয় ইংরাজিতে। ‘Weekly manifesto of hungry generation’, যার সম্পাদক দেবী রায়, মুখ্যনেতা শক্তি চ্যাটার্জ্জী এবং ক্রিয়েটর মলয় রায়চৌধুরি। তার প্রথম অনুচ্ছেদ- “Poetry is no more a civilizing maneuver, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual Hunger.” কবিতা কোনো নিরপেক্ষতার মাপকাঠি নয়, কবিতা শুধুমাত্র ছন্দ-শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখার নান্দনিকতা নয়। বরং, অসহ্য জীবনকে তার মধ্যে প্রতিটি ছত্রে রেখে দেওয়া, অনন্ত বিস্ফারের সম্ভাবনায়। আর, এখানেই মনে পড়ে মারাঠি কবি নামদেও ধাসালের লেখা। দলিত জীবনের আখ্যান এবং প্রতিটি পংক্তিতে উল্লেখযোগ্য ঘৃণা; এই ঘৃণাই আসলে জীবন, এখান থেকে ভালবাসার জন্ম। হাংরি-দের লেখায় আত্ম-কে আবিষ্কার, জীবনের কেন্দ্রের মূল উৎস গুলোয় ফেরা, সন্ধান করা অসুখের উৎসের। কবিতা থেকে কবিতাযাপন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ক্রাইসিস-গুলোকে চিনে নিতে নিতে প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠা। কবিতা মানে বাস্তব থেকে দূরে সরার, অথবা কিছু মিথ্যে স্তোকবাক্য দিয়ে বাস্তবকে আড়াল করার চেষ্টা আর নেই; চাঁদ ফুল তারা নদী আর অতটাও সুন্দর নেই যে তারাই হয়ে উঠতে পারে ‘Aesthetics’-র মাপকাঠি। এস্থেটিক্‌স-ও নিয়ন্ত্রিত হয় পুঁজির দ্বারা, পুঁজির স্বার্থেই! সেই এস্থেটিক্‌স কে প্রবল বিক্ষোভে উপহাস করেন ফাল্গুনী রায়ও- “রাজহাঁস ও ফুলবিষয়ক কবিতাগুলি আমি মাংস রাঁধার জন্যেই দিয়েছিলাম উনোনে...”। বরং দৈনন্দিন যুদ্ধদীর্ণ ‘অসুস্থ’ জীবন থেকেই উঠে আসে ‘Aesthetics’-র সারবত্তা। আর, কবির নিশ্চয়ই দায়বদ্ধতা থাকে সমাজের প্রতি; হাংরি-দের সেই নিজেকে, ভাষাকে, কবিতাকে ছিঁড়েখুঁড়ে সত্যের কাছাকাছি পৌছানোর ঔপনিষদীয় উপলব্ধি নবারুণেরও- “একটা মিথ্যে কবিতা যত মিথ্যে কথা বলতে পারে/ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেণ্টও তা পারে না/ কিন্তু একটা সত্যি কবিতা/ ঘুমন্ত শিশুদের সারারাত বিমান আক্রমণ থেকে/ আড়াল করে”।

    রাষ্ট্রের ভণ্ডামিগুলো, ‘আদার্‌’ ছাপ্পা মেরে দেওয়াগুলো, ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া’র গড্ডালিকা স্রোতগুলোর পালটা স্রোত সাহিত্যে-জীবনযাপনে আসে। আর, ‘সংস্কৃতি’ ঠিক করে দেওয়া কর্তারা থাকবে, ততটাই থাকবে সেই ‘সংস্কৃতিকে’ প্রত্যাখ্যান। হয়তো সমান্তরাল, তবু থাকবে। প্রবলভাবেই। সমাজশাসকেরা বরাবরই নিজেদের মত করে হেজিমনি চাপিয়ে দেয়, শাসনের ডিস্‌কোর্সের অভিমুখে দাঁড় করাতে চায় সব্বাইকে। আর, যখনই তার বিরুদ্ধে স্বর ওঠে, তা সে সাহিত্যেই হোক বা অন্য কোথাও, তাকে দমিয়ে দেওয়া হয়। ব্রাত্য করে রাখা হয় ‘সংস্কৃতি’-র শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে। জাতীয় সাহিত্যের মাপকাঠিতে ‘অশ্লীল’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে প্রতিপন্ন হয় এই সাহিত্যগুলো। ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখাকে বিশ্লেষণ না করেই তাকে দাগিয়ে দেওয়া হয় এবং পরে তাকেই আত্তীকরণ করে বাজারজাত পণ্য করার প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা। নবারুণের জীবন-রাজনীতি-সাহিত্য সম্পৃক্ত হওয়ায়, তাকেও বঞ্চনা সহ্য করতে হয়। কিন্তু, তথাকথিত ‘নিম্নবর্গের’ এই সাহিত্যগুলোই প্রয়োজন হয়, যদি ভারতীয় সাহিত্যের ওলট-পালট, এগিয়ে চলাকে খুঁজতে হয়। বিশেষতঃ পণ্যসঙ্গমরত সমাজে যেখানে জীবন-মানুষ-শিল্প সবটাই ক্রমপণ্য হয়ে যাচ্ছে, তখন বিরোধিতার স্বর, রাষ্ট্রদ্রোহিতার স্বরগুলোর হয়তো বেশিই প্রয়োজন; দ্রোহকে আরো ক্ষুরধার, শাণিত এবং সত্যসন্ধানী করে তুলতে।

    ভাবনা সহায়তা-
    ঘোষ বিনয়, মেট্রোপলিটন মন, মধ্যবিত্ত, বিদ্রোহ; Baudrillard Jean, The Consumer Society: Myths and Structures; Macherey Pierre, A Theory of Literary Production; Sieghild Bogumil, ‘A new ethics of Comparative Literature: Methodological considerations’; নবারুণ ভট্টাচার্যের প্রকাশিত বই, হাংরি জেনারেশনের প্রকাশিত লেখাসমূহ এবং আন্তর্জাল।
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১৭:৫৮644886
  • http://www.aihik.in/aihik/Content/9/

    তোমাদের কী শীত করছে এমন?
    অনীক রুদ্র

    যথাস্থিতির পরিধি ছাড়িয়ে এই দেখা, জাড্য অতিক্রান্ত কবিকে যা নিয়ে যায় চিরস্পর্শী গভীরতার অনুভবে। মানুষের প্রতি, দেশ ও সামাজিক বিপন্নতা কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থার ভয়ঙ্কর ও করুণতরো সংকটে, নিজস্ব ঢঙে, ভঙ্গি ও ভাষায় তিনি প্রতিস্পর্ধী রচনা করে যান ‘শীতে জমে মরে-যাওয়া বুড়ো ভিখিরির গান’— কবিতা থেকে যা ছুঁতে চাইছে গানের ব্যপ্তি অথবা আর্তি।
    ‘তোমাদের কী শীত করছে এমন
    বা শুধুই আমার’

    কিন্তু বুড়ো ভিখিরির জন্য সময় শেষ তখন, সূচিত তার মৃত্যুবার্তা যখন ঠাণ্ডায় জমে গেছে গীটার, ক্যারল নিভে যায় শহরের হ্যালজেন, নিয়ন। অন্য আর এক প্রবীন শীতে যে বৃদ্ধ মানুষটি আত্মরক্ষার্থে জড়িয়ে নিয়েছিল নির্বাচনী পোস্টার, ছেঁড়া পলিথিন ব্যাগ, পতাকার কাপড় তার পাঁজর ঘিরে। এন-জি-ওরা তো জানে না তার জন্য এই শীতে দরকার ছিল হয়ত একখানি ‘সহৃদয় কম্বল’ বা নিদেন পক্ষে সাহেবদের বাতিল কোন জামা... এবং এই কালান্তর শীতে জমে মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি অনুভব করছে সে এখন। একজন বৃদ্ধ সম্বলসহায়হীন আর্ত ভিখিরি রাজধানী শহর দিল্লিতে ফুটপাথের কোন এক কোণে প্রবল ঠাণ্ডায় জমে মরে যাচ্ছে। খুব অনন্য কোন দৃশ্য বা দৃশ্যান্তর? প্রকৃতির প্রকোপে গ্রীষ্ম, শীত, বা বর্ষীয় অসম যুদ্ধে আমাদের দেশে মানুষ কি মরে না?

    কয়েকবছর আগের একটা শীতে কবি তখন দিল্লিতে, থার্মোমিটার বা তাপমানযন্ত্রের পারদ যখন বেশ নিম্নগামী, বেশ কিছু আশ্রয়হীন, গৃহহারা মানুষ সেই শীতের প্রকোপে সারা উত্তরভারত জুড়ে যাদের মৃত্যু ঘটেছিল। আমাদের এই বুড়ো ভিখিরিও তাদের মতো একটি সংখ্যা ছিলেন। তার চলভাষ যন্ত্র থেকে কোলকাতায় একটা সকালে কম্পিত কন্ঠে ব্যথিত নবারুণ আমাকে জানিয়েছিলেন এই মর্মান্তিক সংবাদ। এক নাচার বৃদ্ধের তিল-তিল করে দেখা সেই মৃত্যু দৃশ্য কবিকে কি মারাত্মক ভাবেই না বিড়ম্বিত ও বিচলিত করেছিল যার অব্যবহিত পরেই তিনি রচনা করেন এই কবিতা। যা আসলে বুড়ো ভিখিরির ‘গান’ নামে প্রকাশিত হয়। নবারুণের দীর্ঘ কয়েকটি কবিতার সংকলনে যা ‘অতন্দ্র বিমান’ শিরোনামের একটি কাব্যগ্রন্থে সম্প্রতি পাওয়া যাচ্ছে।

    নির্মাণশৈলীর ক্ষেত্রে কবির অনুকরণীয় ভক্তির নিজস্বতা, শ্লেষপ্রয়োগ বা ততোধিক আকর্ষণীয় হাড়-হিমকরা মৃত্যুদৃশ্যের এমন বর্ণনা প্রায় ক্যালাইডোস্কোপিক। ঘটনা ও তজ্জনিত দৃশ্যানুষঙ্গের উপস্থাপনা হয়ত পুনারুধুনিক নবারুণকে এভাবেই মানায়। পণ্ডিতেরা বা প্রথাগত সাহিত্য-আলোচকরা অনেকেই বিশ্বাস করেন, নিজের অনুভবকে সর্বজনীন করে তোলার সার্থকতাই কবিতারও কঠিন কাজ। তাই নির্মাণ বিষয়ে তার কথনভঙ্গি, মারাত্মক সংশ্লিষ্ট ঘটনাপুঞ্জের কোলাজ বানানোর মধ্য দিয়ে শৈত্যপ্রাবল্যে এক বৃদ্ধের মৃত্যুর আগে যে তীব্র যন্ত্রণা, তার ধারাভাষ্যে যার নাম দিলেন কবি ‘গান’, হয়ে উঠলো সাংকেতিক এবং সাংঘাতিক, স্তব্ধ বিমূঢ় করে দেওয়ার মতো। পাঠককেও তিনি সরাসরি জানাতে চাইলেন
    ‘তোমাদেরও কী শীত করছে এমন’

    এই যে প্রশ্ন চিহ্ন, যা আমাদের ভীত, সন্ত্রস্ত ও বিপন্নতার দিকে ঠেলে দেয় বা দেবে! কালান্তক এ শীতলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে। অসম যুদ্ধ মেনে নিয়েও একজনের বেঁচে থাকার চিৎকার যা কিনা অন্য অর্থে চিৎকৃতও নয়; আমাদের দেশের শহর বা প্রান্তিক গ্রামের বাস্তবতা। সামাজিক ও রাজনীতিক অবস্থানকে ঝাঁকিয়ে দিতে পারে। ঘুরে ফিরে যাচাই করে জমাট হয়ে ওঠা অবশ্যম্ভাবী কোন মৃত্যুযন্ত্রণা।

    না, এই কবিতা মৃত্যু-চেতনার শুধু নয়, বাঁচতে শেখানোরও সঙ্গীত। উঠে দাঁড়াও বন্ধু। সব যুদ্ধ যেতা যায়না আর যুদ্ধ তো থামেনা নবারুণের কবিতায়।

    শীতে জমে মরে যাওয়া বুড়ো ভিখিরি গান

    সবারই কী শীত করছে এমন
    না শুধুই আমার
    তোমাদের কী শীত করছে এমন
    না শুধুই আমার

    ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নাক দিয়ে
    ছুটে যাচ্ছে কত অশ্বশক্তির গাড়ি
    গাড়ির কাঁচের মধ্যে সফল আমিষ
    অ্যালকোহলের ওমে দ্রুততর লয়ে চলা নাড়ি

    হেডলাইটের ঐ দুর্ধর্ষ আলো
    কিছুটা মাখতে পারলে লাগত বা ভালো
    কিন্তু সময় শেষ বুড়ো ভিখিরির জন্যে
    অত শত গাড়ির থামার
    সবারই কী শীত করছে এমন
    না শুধুই আমার

    গির্জায় নিথর ঘণ্টা
    ঠাণ্ডায় জমে গেছে গিটার, ক্যারোল
    নিভে গেছে শহরের হ্যালোজেন, নিয়ন
    বহুতল ক্যাসেরোলে মোবাইল ডাকে
    অথচ বাজতে গিয়ে থেমে গেছে ফুটপাথে
    ড্রামসেট, ব্যাঞ্জো ও তুখোড় ড্রামার
    সবারই কী শীত করছে এমন
    না শুধুই আমার

    এবং আগের বা অন্য প্রবীণ শীতে
    জড়িয়েছি পাঁজর ঘিরে
    নির্বাচনী পোস্টার, ছেঁড়া পলিব্যাগ,
    পতাকার কাপড়
    লেপটে, বেঁধেছি দিয়ে
    ফেলে দেওয়া দড়ি বা কখনও কুড়োনো
    ক্যাসেটের ফিতে
    এন.জি.ও.-রা কী জানে যে আমার
    আর দরকার নেই সহৃদয় কম্বল
    বা সাহেবদের বাতিল জামার
    সবারই কী শীত করছে এমন
    না শুধুই আমার
    গাছেদের কী শীত করছে এমন
    কুকুরদেরও কী শীত করছে এমন
    রাস্তা, সিনেমাহল, টিপকল, রেস্তোরাঁ, বিউটি পার্লার
    সকলেরই কী শীত করছে এমন
    মথ, পাখি, মেঘ, মদ, গ্রহ
    সবারই কী শীত করছে এমন
    শীত কী এমনই থাকছে বুকে, পিঠে ভালবেসে, ঘেঁষে
    শীত কী ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কখনও বা চুপ ম্লান হেসে।
    কি মেডেল জিতে নেবে শীত
    সোনা, রুপো, ব্রোঞ্জ না তামার
    সবারই কী শীত করছে এমন
    না শুধুই আমার

    বুড়ো ভিখিরির এই জমে মরে যাওয়া গানে
    রক্তের সব লোহা মন্ত্রমুগ্ধ জড়ো হয় সমুদ্রের টানে
    সেই স্রোতে সাংকেতিক, সামুদ্রিক, চোরা
    সহসা জমাট হয়ে নির্বাক আকার নেওয়া স্বচ্ছ ফোয়ারা
    থার্মোমিটারের পারা শুধুই শিখেছে খেলা
    তলায় নামার
    সবারই কী শীত করছে এমন
    না শুধুই আমার

    যে অবস্থায় ভাপ-ওঠা দুধ, সুপ বা চা
    বা স্রেফ গরম জলই খেতে ভালো লাগে
    সে অবস্থাটাও আমি পেরিয়ে এসেছি
    পেরিয়ে এসেছি একটু আগে
    ঠাণ্ডায় গাঢ় ঢেউ বয়ে চলেছেই
    যেভাবে সীমান্ত পেরিয়ে চলে যায় ঠাণ্ডা রেলের লাইন
    যেভাবে চলে যায় যুদ্ধ বন্দীদের নিয়ে ঠাণ্ডা কামরা
    সেভাবেই পৌঁছতে অভ্যস্ত আমরা
    যেখানে কাঁটাতার নেই, পুলিশের লাথি নেই
    প্রয়োজন নেই পবিত্র ভোটপত্র বা হলফনামার
    সবারই কী শীত করছে এমন
    না শুধুই আমার

    মবিল মোছার তুলো, ঘাস, খড়, কুটোকাটা
    ফুলের টুক্লির কাঠ, বরবাদ টায়ার, জুতো
    সবই আগুন হতে দেখেছি তো
    এই বন্ধ চোখে
    বুকের উনুন জ্বলে অরন্ধনে, অন্তহীন শোকে
    তাও মন্দের ভালো
    ছেদচিহ্নটির খুব কাছে
    অসাড় মৃত্যু থেকে মুক্তি দেবে বলে
    চুল্লি দাঁড়িয়ে আছে
    অসাড় মৃত্যু থেকে মুক্তি দেবে বলে
    চুল্লি দাঁড়িয়ে আছে
    দাউ দাউ আগুনের কোনো দরকার নেই
    ফাঁকা উপমার
    সবারই কী শীত করছে এমন
    না শুধুই আমার
    তোমাদেরও কী শীত করছে এমন
    না শুধুই আমার।

    =============================================

    এখনও আকাশ লাল... কখনও ঝাণ্ডা, কখনও চাপ চাপ
    জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

    একদিন পেট্রল দিয়ে
    সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব
    সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব
    পেট্রল দিয়ে

    এক সময় যখন বাংলা গানে আকাল নিয়ে খুব আলোচনা বিতর্ক হ’ত নব্বইয়ের দশকে, তখন গম্ভীর ভাবে কেউ কেউ বলতেন ‘সেই পুরনো গানগুলোই এখনও শুনতে হয়...’, আর কেউ কেউ একটু সাহস করে বলতেন ‘সুমন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতারাও তো চেষ্টা করছে...’। ‘জীবনমুখী’ শব্দের ব্যবহারে রেকর্ডিং সংস্থার ফাটকা বাজারে চলেছিল খুব। কিন্তু এই ‘জীবনমুখী’ শব্দের প্রয়োগ নিয়ে রক্ষণশীলেরা দু’দশক ধরে সেই গায়কের মুণ্ডপাত করেন, যাঁর অ্যালবামে ব্যবহার হয়েছিল ওই শব্দ। কিন্তু গরমাগরমির মধ্যেই অনেকে বেশ টের পেয়েছিলেন... সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত, শিলাজিত-দের হাত ধরে যে ধারাটা আসছে (যদিও প্রত্যেকের নিজেস্ব পথ, অন্যের থেকে ভীষণ ভাবে আলাদা, স্বতন্ত্র) তা উড়িয়ে দেওয়ার নয়, ওটা থেকে যাবে। মজার কথা, একবিংশ শতাব্দীতে ঢুকে যখন বাংলা ব্যান্ডের জোয়ার এসেছে তখন বেশ কিছু ব্যাণ্ড-এর সদস্যকে বলতে শোনা গেল – ‘আমরাই বাংলা গানের স্রোতা ফিরিয়ে আনলাম।’ তাদের যখন, মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে সুমনের অবদানের কথা... প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ডের সদস্য তাঁর ‘সবজান্তা বিতর্ক-বাগিস’ হাবভাব নিয়ে উকিলের মত বলছেন ‘হ্যাঁ... সুমন তো থাকবেই... কিন্তু সুমনের গানের যারা স্রোতা, তাঁরা কিন্তু ডেডিকেটেড স্রোতা। এবং তাঁরাই ওনার গান শোনেন। সব কথার মানে বুঝতে পারেন... রিলেট করতে পারেন।’ নবারুণ-সাহিত্য প্রসঙ্গে কিছু ভাবতে বসলেও, কেন জানি না অবদানের কথাটা এই ভাবেই মাথায় আসে। বাংলা সাহিত্যে নবারুণ ভট্টাচার্য এবং তাঁর থেকে যাওয়া (রাজ করাও বলা চলে) এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত, যেখানে তিনি যে কাজটা রেখে গেছেন... তা থেকে যাবেই, অথচ নবারুণের লেখার যারা নিবেদিত পাঠক, সেখানেই তাঁর বিশেষ জায়গা। শব্দের জটিলতা বা ভাবের ব্যঞ্জনা নয়... নবারুণের একদম ‘সমাজে কফিনে পেড়েক ঠোকা’-র মত দমাদম হাতুড়ির আঘাতের শব্দ তোলা এই লেখাগুলো, আসলে হয়ত... সকলের জন্য নয়। ঠিক যেমন নিট হুইস্কি, অভ্যেস ছাড়া যে কেউ গলায় ঢেলে দিতে পারবে না। গলা জ্বলে কষ্ট পাওয়া অবস্বম্ভাবী... আর সাধ করে এমন কষ্ট পেতে কেই বা চায়? একের পর এক... সুনীল, জয় গোস্বামী, ভাস্কর, প্রভৃতি প্রতিষ্ঠ কবিদের কবিতা পড়তে পড়তে হঠাৎ যদি কারও চোখের সামনে এভাবে পেট্রল দিয়ে আগুন নেভানোর লাইন ঝলসে ওঠে। তখনই বুঝতে হবে... এই কবিতা একেবারেই অন্য কারও, অন্য এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই লেখা। ঝিম মেরে ‘মুখর বাদল দিনে’ বসে বসে কবিতা পড়া পাঠকের কলার ধরে একবার ঝাঁকিয়ে দেওয়া... ‘যে পৃথিবীতে বাস করছ সেখানে শুধু বাদল নেই... পেট্রল আর আগুনও আছে!’

    নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা, প্রবন্ধ, গদ্য, গল্প এবং উপন্যাস (বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারগুলোই বা বাদ দিই কি করে?) একে একে ভাগ করলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দীর্ঘ আলোচনার যথেষ্ট জ্বালানী রয়েছে। কয়েক মাস আগে একটি সাহিত্য পত্রিকায় দেখলাম একটি প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ, নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা, গল্প এবং উপন্যাসকে নিয়ে আলোচনা। এমন আলোচনার সত্যিই প্রয়োজন, এবং নবারুণ-সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতার দশকে দশকে পুনর্মূল্যায়নের জন্যই বেশি করে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু না, এই আলাদা আলাদা বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাইছি না এখন। সবার আগে, যে জিনিসটা অন্যরকম করে ভাবাতে বাধ্য করে তা হ’ল নবারুণের স্পিরিট। সৃষ্টির মধ্যে সেই স্পিরিট এতটাই জীবন্ত যে ঝকঝকে কাস্তের মত ঝলসে ওঠে অন্ধকারে... পুলিশ ভ্যানের হেডলাইটের আলোয়, কিংবা হলুদ নিওন ল্যাম্পে, কিংবা নিছক বুভুক্ষু জ্যোৎসনায়। ওই স্ট্যান্ড আউট অ্যাপ্রোচটাই ঘাড় ধরে ভাবায়, ভাবতে বাধ্য করে। তাই নবারুণ-সাহিত্যের তথ্যগত আলোচনা, বিস্তারিত বিশ্লেষণ (যা বিশেষজ্ঞদের কর্তব্য বাঁচিয়ে রাখা)... সব কিছুর আগে, মনে হয় ওই স্পিরিট টাকে অনুভব করার একটা একাগ্র এবং সৎ প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সেও এক প্রকার অনুধাবন, একটা বোধ কিংবা চেতনার অদ্বিতীয় প্রকাশ কে চেনার অধ্যাবসায়। এই চেনাটুকু না হ’লে... কখনও অস্ত্রের ফলায় ঝলকানো আলো থেকে বাঁচতে, আবার কখনও পচনশীল মৃতদেহ’র বিভৎসতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে মুখ ঢাকতে হবে বার বার।

    নবারুণ-সাহিত্য গলধঃকরণ করাটাই সকলের কাজ নয়। এটা একটা কটূ সত্য, এ’কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এবং অবশ্যই, তারাই বেশি করে নবারুণের লেখার কাছে ফিরে আসবেন, যারা কোথাও না কোথাও সেই লেখার মধ্যে যে বার্তা, যে চেতনা... তাঁর সঙ্গে একাত্ম বোধ করেছেন। সচেতন-অবচেতনে বুঝতে পেরেছেন ‘এ ফুল-মেঘ নিয়ে ভাল থাকার সময় নয়... মানুষ সারা রাত কাঁদছে, সেই রাতের শেষ নেই’ এই সত্যকে অস্বীকার করে সাহিত্য টিকবে না। আর, একজন মানুষ কেবল এই দিকটা বার বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। এই অনুভব যাদের ইতিমধ্যে হয়েছে, নবারুণ তাঁদের কাছে নমস্য, নবারুণের লেখা তাদের কাছে আফিমের নেশা, ফিরে আসতেই হবে বার বার... আয়নায় নিজেকে দেখতে, সমাজের কদর্য চেহারাটা দেখতে। ওনার নিজেরই কথা ছিল, ল্যাবেরটরীতে রসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে বিস্ফোরণ করা যায়... ওনার এক্সপেরিমেণ্টেশন সেই বিস্ফোরণের জন্য। সেই কারণেই, কবিতাগুলি এমন জ্বলন্ত। গল্পগুলো আরামকেদারায় বসে বা খাটে শুয়ে শুয়ে গল্প পড়া পাঠক/পাঠিকা-কে বার বার অস্বস্তিতে ফেলবে। উপন্যাসগুলিও খুব বেশি দীর্ঘ নয়... ঠিক যতটা বলার প্রয়োজন, ততটা চিনিয়ে দিয়েই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া এক আখ্যানের মত। আক্ষরিক অর্থেই শ্রাপনেল! বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে যাবে চারিদিকে -
    “চুলকুনিটা দপদপ করে লাফায়, চোয়ালটা ঝুলে পড়েছে... মুখের মধ্যে থুথুর ঘূর্ণী... চোখ দু’টো ঠাণ্ডা... মরা শকুনের চোখ... ট্রিগারের ওপর কালচে নখওয়ালা আঙুল জড়িয়ে আছে... সাপ... জিভ ধারালো ভাঙা দাঁতে লেগে চিরে যাবার মতো তীব্র একটা মুহূর্ত...”

    বামপন্থাকে যেভাবে আমরা চিনেছি, মানে পশ্চিমবঙ্গের তারা যারা আশির দশকে জন্মেছে... তারা দেখেছে বামপন্থা মানে বামফ্রণ্ট। বামফ্রণ্ট মানে সিপিএম। আর এদিকে, সে অর্থে খুব কম সাহিত্যিকই বামপন্থার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে সাহিত্য রচনা করেছেন। সমরেশ মজুমদার উপন্যাস বা গল্পে নক্সাল আন্দোলন এবং বামপন্থার সামাজিক মূল্যায়নের ছবি অনেক জায়গায় ফুটে উঠলেও তার বেশির ভাগটাই বাণিজ্যিক সফল উপন্যাসের রসদ নিয়ে চলেছে ভেতরে। মূল বামপন্থাকে মেরুদণ্ড করে এগোয়নি কখনও। আর হাতে গোণা যাদের লেখার মধ্যে বামপন্থার বোধ পাওয়া যায়, তাঁদের একজন মহাশ্বেতা দেবী। মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় ভীষণ ভাবে এসেছে শ্রেণী আন্দোলনের কথা, বিদ্রোহের কথা, নক্সাল আন্দোলনের ইতিহাস। আর হয়ত সেই ধারারই উত্তরাধিকার থেকে ওনার পুত্র নবারুণের মনে এসেছিল বামপন্থি রাজনৈতিক চেতনা ভ্রুণ। নবারুণ ভট্টাচার্যের সচেষ্ট ভাবে বামপন্থাকে চিনিয়ে দেওয়ার যে অঙ্গীকার, তা বার বার লেখার মধ্যে ফুটে উঠেছে। উনি যেন বুঝতে পারতেন... কলকাতা শহরে বসে, বা পশ্চিমবাংলার জেলায়, সদরে বসে মানুষজন বামপন্থা বলে যাকে চিনছে, তা কতটা বিচ্যুতির পথে... ভীষণ প্রয়োজন পৃথিবী জুড়ে বামপন্থার বিবর্তন আর আসল চেহারাটা তাদের দেখানো। তাই শহরের বাইরে এখানে ওখানে জমে থাকা বামপন্থী মনোভাবের উল্লেখ ফিরে ফিরে আসে। বিদ্রোহ যে কোনও প্রতিষ্ঠিত দলের সম্পত্তি বা দায়বদ্ধতা নয়, তাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়। যেন আমরা কখনও অধিকার পাওয়ার প্রত্যাশা এমন ভাবে না করি, যে কোন রাজনৈতিক দল তা আমাদের পাইয়ে দেবে। রাজনৈতিক দল হলেই ক্রমে তা সুবিধাবাদী মানুষের প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান এলেই পুঁজিবাদের গন্ধ লেগে যাবে একসময়... তা সে দল যদি বামপন্থীও হয় তাও। ক্ষমতা এবং মসনদে বসা ব্যাপারটাও একই রকম। না হ’লে প্রাণের বন্ধু ফিদেল এর সঙ্গে চে’র দূরত্ব কেনই বা তৈরী হ’ত? শতাব্দীব্যাপী (আসলে তারও অনেক পুরন, বিংশ শতাব্দী ঐতিহাসিক ভাবে সারা বিশ্বে বেশি প্রাসঙ্গিক) বামপন্থার যে জোয়ার... বলশেভিক আন্দোলন, লং মার্চ, ভিয়েতনাম, কিউবা এবং ভারতবর্ষেও এদিক ওদিক স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠা... তা সত্ত্বেও যে শেষের দিকে এসে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতন, ভারতে কমিউনিস্ট মনোভাবের অবক্ষয়... পৃথিবী জুড়ে ধীরে ধীরে বামপন্থার হারিয়ে যাওয়া (বলা চলে সুবিধাবাদী পুঁজিবাদীদের বাকি সব কিছু গ্রাস করে নেওয়া), এর মধ্যেও নবারুণ অদ্ভুত ভাবে আশাবাদী। এই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু করা বা না করার ওপর যে স্পিরিট অফ কমিউনিজ্‌ম আদৌ নির্ভর করে না, এবং করবেও না কোনওদিন... এ কথাটা স্পষ্ট জানিয়ে গেছেন তিনি। ইন্দোনেশিয়ার কথা বলতে গিয়েই, '৯৮৬৪৪'-এ একটা গল্পের মাঝে উঠে এসেছে ১৯৬৭-এ কি করে প্রেসিডেন্ট সুহার্তো-র আমলে বিদেশী লগ্নিকরণের পুঁজিবাদী ধারা ইন্দোনেশিয়ায় দানা বাঁধছে। "চালু হ'ল ফরেইন ইনভেস্টমেণ্টস... শুরু হ'ল কিকব্যাক, ঘুষ ও ফ্রাঞ্চাইসি বিতরণের খেলা।" ওটা না’হয় ইন্দোনেশিয়ার প্রসঙ্গ, কিন্তু পাঠকেরা একটু ভাবুন তো? স্বাধীনতার পর যে ভারতবর্ষ, বিশেষ করে গত ত্রিশবছরে দেশের যে বাণিজ্যনীতি এবং অর্থনৈতিক কৌশল, তাহ’লে ওই ইন্দোনেশিয়া পালটে ইন্ডিয়া লিখলেও কি বড় বেশি ভুল হবে? অথচ ইন্দোনেশিয়ার মত কমিউনিস্ট নিধন কিন্তু এদেশের ইতিহাসে হয় নি। শোষণ চললেও হয় নি... কারণ সেইরকম শক্তিশালী বামপন্থী আন্দোলনেরও নজির নেই। যা আছে, তা বিচ্ছিন্ন আন্দোলন (যা ঐক্যবদ্ধ দূরদর্শী নয়) অথবা রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডা ওড়ানো। লাল ঝাণ্ডা থেকে হালাল ঝাণ্ডা। রাজনৈতিক দলের লাগানো লাল ঝাণ্ডা কে তাই ভালুকের মত নাচতে নাচতে গিনি বলে ‘হালাল ঝাণ্ডা... হালাল ঝাণ্ডা’। কাকতাড়ুয়া নীরবে সব কিছু দেখতে থাকে... সব কিছুই বোঝে, নিজের মত করে –
    “ ঠাকুর ধর্মনাথ ভোটে দাঁড়াবে বলে জানা গেছে... হেডলাইটের ঝলসানো আলোয় দেখা যায় খাকি শার্ট পরা একচোখা কাকতাড়ুয়া দাঁত বার করে হিহি করে হাসছে... কাকতাড়ুয়ার ভোট নেই।”

    " 'পারাং' - একরকমের দেশি কুঠার। কমিউনিস্টদের কান বস্তা করে জমা পড়ত পুরস্কারের লোভে। সারা দুনিয়ে গণতন্ত্রপ্রেমী খানকির ছেলেগুলো মুখে লুপ লাগিয়ে বসেছিল।" ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলন, আর গনহত্যার ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে কোনও ইতিহাসবিদ হয়ত এই ভাবে লিখতে পারবেন না। ওটা নবারুণ, এবং এই কেবল নবারুণই পারতেন... পলিটিকালি কারেক্ট সেলফ প্রোক্লেমড ইন্টেলেকচুয়াল বাঙালীদের দ্বারা হবে না। আর ওটা যদি কেউ করতে চানও এখন, নবারুণপন্থী হয়ে... তাহ'লেও তার কতটা সৎ আর কতটা অনুকরণ তা স্পষ্ট বোঝা যাবে, অন্ততঃ 'ফ্যাৎ ফ্যাৎ সাঁই সাঁই' মার্গে উদ্বুদ্ধ নবারুণ-পাঠকরা ঠিক ধরে ফেলবেন। নবারুণ ভট্টাচার্যের একাধিক কাজের মধ্যে দিয়ে এই ভাবেই বিদেশের প্রেক্ষাপটগুলো দেখার চেষ্টাটা থেকে গেছে। সে যে সবসময় ঠাস বামপন্থী দৃষ্টি, তা নয়। বামপন্থা ঘুরে ফিরে এসেছে ঠিকই... তবে তা এসেছে তৎকালীন সামাজিক পরিকাঠামোর মধ্যেই, কিংবা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। সোভিয়েতের ভাঙনের জের চলে আসে কথোপকথনে, রাষ্ট্রের স্বপ্নভঙ্গের এক ভিন্ন ছবি... ‘নেকলেস’ গল্পের মধ্যেই, যেখানে কেজিবির কথা উঠে এসেছে - ঘুমিয়ে সময় কাটাচ্ছে, জেগে উঠে ভাবছে ভাল কিছু দেখবে। আসলে ‘নেকলেস’ গল্পটা জুড়েই এরকম বাইরের জানলা দিয়ে নানারকম আলো-বাতাস এসেছে... কখনও হাম্ফ্রি বোগার্ট, তো কখনও ‘ফা জিন’, কখনও ৭০০ বছরের পুরনো ঘরানা উ দাং শন। আবার কোথাও অন্য কোনও গল্পের ফাঁকে এসেছে জাপানী স্কচ ‘সান্তোরি’ কিংবা চীনের সিগারেট ‘হংতাশান’-এর কথা। গল্প কিংবা উপন্যাসের সংখ্যা হয়ত বিশাল নয়, কিন্তু তাও যা রয়েছে... আর তাঁর মধ্যে নবারুণ ভট্টাচার্যের অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের যে প্রতিফলন ফুটে ওঠে তা আন্তরিক শ্রদ্ধা দাবী করে। সত্যজিৎ রায়ের গল্পে সিধু জ্যাঠা চরিত্রের রূপায়ন অনেকেই বলেন ওটা সত্যজিৎ রায়ের নিজেরই একটা দিক – মনের জানলাটা খুলে রেখে দেওয়া, যাতে বাইরের আলো-বাতাস ঢোকে। তাহ’লে নবারুণ ভট্টাচার্যই বা সেই সিধু জ্যাঠার থেকে কোন অংশে কম হলেন? বাংলা সাহিত্যে সমসাময়িক অন্য সকলের লেখার মধ্যে, কেবলমাত্র Diversity of International Topics -এর জন্যেই ভীষণ ভাবে নবারুণ স্বতন্ত্র হয়ে থাকতে পারেন। কতটা পড়াশুনো এবং তার মধ্যে দিয়ে একটা চেতনার অর্জন ঘটলে যে কলম ধরার সৎ-সাহস নিজে থেকেই দুঃসাহস হয়ে উঠতে পারে, তা এই পোড়া দেশে একটা নবারুণ এসেছিল বলেই অনেক হতভাগ্য জানতে পেরেছে (স্বীকার করবে কি না সেটা পরের কথা)।

    তখন আমাদের ফ্যাকাশে চোখে ঘুম আসে
    স্বপ্নের ঝাঁকুনিতে আমরা থরথর করে কাঁপি
    আমাদের নিয়ে রাত চলতে থাকে

    রাত একটা পুলিশভ্যান
    রাত একটা কালো পুলিশভ্যান

    এই দুঃসাহসিকতাই সমাজের গভীর থেকে গভীরতর ক্ষতগুলোকে বার বার ফিরিয়ে এনেছে আমাদের চোখের সামনে। ‘কালো পুলিশভ্যান’ চিনতে কলকাতার মানুষের সত্তর দশক দেখা বোধহয় খুব জরুরি নয়। আর রাজনৈতিক দলের জবরদখল করা বামপন্থার যে রোম্যান্টিসিজ্‌ম, তার সেই ব্যর্থ চেষ্টার বাইরে রাতে চিরে এগোনো পুলিশভ্যানের ভেতরের স্বপ্নগুলোকে রেখে যাওয়ার দুঃসাহসটা দেখাতে পেরেছিলেন নবারুণ। সেই প্রশাসন-বিরোধীতা, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, অধিকারের জন্য লড়াই... সে ফিরে ফিরে আসবেই এক দেশ থেকে আর এক দেশের সাহিত্যিকের কলমে, শিল্পীর তুলির টানে, কবির চিন্তায়... কিন্তু নবারুণের উদ্দেশ্যই ছিল জ্বলন্ত কয়লার টুকরো গুলোকে জ্বলন্ত অবস্থাতেই আমাদের সামনে এনে ফেলা। যাতে দেখলে বোঝা যায়, জ্বলন্ত অবস্থায় সেটা কেমন লাগে রাতের অন্ধকার। দিনের ছাইটা তো সংবাদ পত্রের সাজানো খবরেই পড়ে নেবে লোকজন চা খেতে খেতে।
    আর, তারই সঙ্গে থেকে গেছে লেখার মধ্যেও একটা ভাঙা-গড়ার খেলা, এক স্বতন্ত্র পরিবেষণ যা নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক মানের। টয় গল্পে একটি ছোট ছেলে ইমার্শন হিটার দিয়ে অ্যাকুয়ারিয়ামের সব মাছ মেরে ফেলছে... আর তার সঙ্গেই লাগসই ভাবে জুড়ে দেওয়া ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্সে হত্যাপরাধী শিশুদের কথা, যারা ঠাণ্ডা মাথায় নির্লিপ্ত ভাবে হত্যার বর্ণনা দিয়েছে। সাধারণ মা-বাবার পিলে চমকে উঠতে পারে... কিন্তু ছেলেটির বাবা-মা নিশ্চিন্ত হ’তে পারছে। ঠিক যে ভাবে, আমরাও নিশ্চিন্ত থাকি, আমাদের চারপাশে প্রতিদিনের নৃশংসতা দিনের পর দিন দেখতে দেখতে। আরও বেশি মনে থেকে যায় শেষ রাতে গল্পের সেই শেষ ক’টা লাইন যেখানে পাঠকের কানে ‘হরিবোল’ ধ্বনির মাঝেই ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে “এত জল নিয়ে ভিজে ভারী ফুলে ওঠা রাত কোনো একটা বেওয়ারিশ তারিখহীন ঘোলাটে সকালের দিকে চলেছে... কাল হয়তো কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটবে না... আবার কাল তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু হতে পারে।” আর এসবের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে চলেছে জানিয়ে দেওয়া, বুঝিয়ে দেওয়া, মনে করিয়ে দেওয়া... চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রক্রিয়াকে আরও তীব্র করে তোলা, আরও ঝাঁঝালো করে তোলা। নাকের সামনে অ্যামোনিয়া না ধরলে হুঁস ফিরবে না। যেখানে শকের দরকার, সেখানে হৃৎপিণ্ডের ছন্দ ফিরিয়ে আনার জন্য শকই দিতে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞান। আর নবারুন-সাহিত্য জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এমনই সব শক্যুমেন্টরি। ঠিক যতটা বলা দরকার ততটাই কথা। যে প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড়াতে চাইছে না লোকে সেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ছেড়ে দেওয়া। যে দৃশ্যটা দেখে মুখ ফিরিয়ে নেব আমরা, সেই দৃশ্যটাকেই একদম বিস্তারিত ভাবে চোখের সামনে তুলে ধরা। ‘হালাল ঝাণ্ডা’-য় গিনির পায়ের মালাই চাকি কেটে প্ল্যাটিনামের চাকতি উপড়ে নিয়ে যাওয়ার ওই বিবরণ, কেবল ওনার হাতেই সম্ভব। উনিই পারতেন ‘৪+১’ গল্পে লাশ এবং শববাহকদের মাধ্যমে আমাদের অতগুলো প্রশ্নের সামনে এসে দাড় করিয়ে দিতে। সমস্ত দুঃসাহস, ক্লাস, চরম টাইমিং সেন্স নিয়ে নবারুণ ভট্টাচার্য নিজের সৃষ্টিগুলোর মধ্যেই নিজে একটা এনিগ্‌মা। তাঁকে শ্রদ্ধা বা সম্মান করা যায়, কিন্তু তাঁর ঘরানাকে ধরে তাঁর মত করে লেখার চেষ্টা আর বোধহয় সম্ভব নয় (অন্ততঃ এখন তো একেবারেই নয়)। কারণ তার জন্য সবার আগে দরকার ওই চেতনা এবং বোধ কে লালন করতে শেখা, যেটা না থাকলে বাকি সবটাই কৃত্তিম অথবা দেখনদারি অনুকরণ মাত্র।

    তখন আমৃত্যু লিখে যাব প্রতিবাদ
    উন্মত্ত হিংস্র ও ক্রুদ্ধ নিরবধি
    এ যদি সমাজ হয়
    তবে আমি সমাজবিরোধী।

    ঐ দেখো, সকালের পূব
    জ্বলে যাচ্ছে নিশানের লালে
    বিপ্লবের মৃত্যু হয় না জিভ কেটে নিলে
    বা ফাঁসিতে ঝোলালে।

    নবারুণ ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক অবস্থান, এবং তার মতামত নিয়ে কোনও দিনই দ্বিচারিতা দেখা যায় নি। হয়ত সেই কারণেই আশ্চর্যজনক ভাবে জীবদ্দশায় বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলিও তাকে কাছে পায়নি (বা নিজেরাও কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেনি সেভাবে), এবং এখনও ওনার রাজনৈতিক মতামত নিয়ে বিস্তারে আলোচনা করতে গিয়ে একটু ভাববেন, হয়ত কিছু কথা সচেতন ভাবিয়ে এড়িয়ে যাবেন বর্তমান পরিস্থিতিতে। হারবার্ট-এর ওপর চলচ্চিত্র সমলোচিত হয়েছিল, কাঙালমালশাট-এর ওপর চলচ্চিত্রটি মুক্তিই পেলো না (বলা যায় মুক্তি পেতে দেওয়া হ’ল না)। পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় স্বাধীন ভাবে (বলা যায় বেসরকারী ভাবে) আন্তর্জালে ছড়িয়ে দিতে পারতেন... কিন্তু জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে শত্রুতা করা বিবেচকের কাজ বলে মন হয়নি ওনার (স্বাভাবিক ভাবেই)। সুতরাং বোঝাই যায়, সেই খানে দাঁড়িয়ে মসোলিয়াম, খেলনা নগর কিংবা যুদ্ধ পরিস্থিতির মত উপন্যাস নিয়ে কাজ কি প্রভাব ফেলতে পারে!
    সোভিয়েতের পতনকে উনি সরাসরি কমিউনিস্টযুগের অবসান বলে মেনে নিতে না চাইলেও, যেভাবে 'Post Communism era' বলে একবিংশ শতাব্দীকে চিহ্নিত করতেন, তাতে স্পষ্ট বোঝা যেত, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন কি ভাবে ওনার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। স্বপ্নভঙ্গের হতাশা স্পষ্ট।
    “পৃথিবীকে বেশ কয়েকশো বার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক্‌ করে দেওয়া যায় এরকম কয়েক হাজার নিউক্লিয়ার মিসাইল তাদের সাইলোতে ঘুমিয়ে থাকল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দেবার মতো বিশাল সামরিক বাহিনী, পুলিশ, কেজিবি, লক্ষ লক্ষ পার্টি সদস্য সব হয়ে গেল ঠুঁটো জগন্নাথ। ঘটনাটিকে আমরা বিশ্বের বৃহত্তম প্যারালিসিস বলে অভিহিত করতে পারি।” – ঠিক এই কথা গুলোই পেয়েছি আমরা ‘পৃথিবী শেষ কমিউনিস্ট’ গল্পের শুরুতে। অথচ একই সঙ্গে তার প্রতিটা গল্পে-উপন্যাসে প্রশাসন, শাসক এবং শোষকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব কে জাগিয়ে তোলার আহ্বান দেখতে পাই। দেখতে পাই সশস্ত্র বিপ্লবকে সমর্থনের সরাসরি স্বীকারোক্তি। ‘৯/১১’, ‘টেররিস্ট’, ‘চীন ২০০২’, ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘প্রতিবিল্পব দীর্ঘজীবী হোক’... এমন গল্পগুলোয় খুব স্পষ্টভাবে সেই সমর্থনের ইঙ্গিত নজরে আসে। এবং একসময় সাক্ষাৎকারেও সরাসরি বলেছেন (মাওবাদী আন্দোলন, কিষেনজী বা ছত্রধর মাহাতো প্রসঙ্গে) – প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে এমন বিপ্লব, আন্দোলন আসবেই। যাদের লড়ার ক্ষমতা আছে, অস্ত্র আছে তাড়া সেই ভাবেই লড়বে। ও কোনওদিনই বন্ধ হবে না... বন্ধ হওয়ার নয়।
    হয়ত বিভিন্ন দেশে এইভাবে লালিত বিদ্রোহ (তার সশস্ত্র হওয়ায় রাষ্ট্রের কতটা মঙ্গল সে ভিন্ন বিতর্কের বিষয়) এবং বামপন্থী লড়াইয়ের রোমান্টিসিজ্‌মকে জিইয়ে রাখার ইচ্ছে (যা প্রকৃত অর্থে তাঁদের হাত ধরে এসেছে যারা বামপন্থা জনক কিংবা ধারক এক একটি রাষ্ট্রে) নবারুণকে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে সৃষ্টি করতে। হয়ত এই অনুপ্রেরণার মধ্যেই উনি আশাবাদী হ’তে পারতেন বামপন্থার এই চরম দুঃসময়... যেখানে বামপন্থা/পুঁজিবাদী নিয়ে ভাবারই সময় নেই সুবিধাবাদী হয়ে উঠতে অভ্যস্ত নিউক্লিয়ার সমাজের। সেখানেও বসেও তিনি স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস দেখিয়েছেন, সেই দিনটির যা ২০২০ তে আসবে... যেদিন থেকে দুনিয়া কাঁপানো দশহাজার দিনের সূচনা হবে বলে এক বামপন্থী মুষ্টিবদ্ধ শপথকে বাঁচিয়ে রাখা, এক পবিত্র বামপন্থীর স্বপ্নে।

    নবারুণ ভট্টাচার্য, কিংবা নবারুণ-সাহিত্য নিয়ে কিছু লিখতে গেলে, বা প্রকাশ করতে গেলেও হাড়ে হাড়ে অনুভব করি... উনি যা নিজে রেখে গেছেন, তার মধ্যেই সব বলা আছে। আর উনি নিজেই নিজের মনের কথা যে ভাবে রেখে গেছেন, অন্য কেউ তার থেকে বেশি কিছু ওনার অবর্তমানে বলতে পারবে না সেভাবে। স্মৃতি ভাগ করে নিতে পারে, কিংবা ব্যক্তিগত ধারণা (যেমন হয়ত আমি করলাম)। কিন্তু নবারুণ-এর বিশ্লেষণের কাজটা করতে গেলে সেই গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোই করা হবে। প্রতিটা কবিতা, গল্প এবং ওনার সাক্ষাৎকারের মধ্যে দিয়ে ওনাকে ফিরে দেখা, আমাদের মাঝে সচেতন ভাবে এই সূর্যকে বাঁচিয়ে রাখা, মনের মাঝে লালন করার প্রয়াস (কেবল প্রয়াসই, কারণ আগুন ধরে রাখার মত মন সকলের হয় না... সে প্রত্যাশা বাতুলতা মাত্র)। উনি পেরেছিলেন... রাজনৈতিক দলের জবরদখলে থাকা বামপন্থা, কারখানা ধর্মঘট বা কলেজ ইউনিয়নের ছেলেখেলা হয়ে যাওয়া ‘ইনকিলাব’-এর লাল ঝাণ্ডাকে অন্য ভাবে পাঠকের অন্দরমহল অবধি ঠেলে দিতে, যাতে উদাসীনতাটা কিছুটা হলেও কমে। সব কিছু বলে দেওয়া বা বুঝিয়ে দেওয়া হবে না। প্রশ্ন থাকবে, ফাঁক থাকবে দু’টো কথার মাঝে... তার মধ্যে দিয়েই মানুষকে পথ খুঁজে পেতে হবে... গল্পের মধ্যে গল্প... তার মধ্যে বেঁচে থাকা। বাংলা সাহিত্যে একেবারে স্বতন্ত্র এক ঘরানার মালিক নবারুণ ভট্টাচার্যের ছিল সৎ প্রয়াস, এবং প্রত্যাশাহীন ভাবে নিজের কাজটা আমাদের কাছে রেখে যাওয়ার ইচ্ছে... যার মধ্যে মানুষের নিজেকে আর সমাজকে দেখার এবং চেনার সৎ সাহসটা যেন বেঁচে থাকে। সাহিত্যবাণিজ্যের রাজধানীতে একরকম এক পেশে বামপন্থী সাহিত্যিকের তকমা নিয়ে, এবং ডেডিকেটেড নবারুণ-পাঠকদের মধ্যেই আলোচিত থেকে যাওয়া নবারুণ... তাঁকেও বৃহত্তর সমাজের উদাসীনতা বা জনসাধারণের এইভাবে চেতনালুপ্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের দাশ হয়ে থাকা, ঘুণ পোকার মত কষ্ট দিতো। আর সেই আক্ষেপ আর কষ্টগুলোই তিনি রক্তক্ষরনের মত পাতায় পাতায় রেখে গেছেন... প্রজন্মের জন্য, আগামীর জন্য।

    আমি জানি
    খুব ভাল লিখলেও
    একটাও ফাঁসি
    থামানো যাবে না
    আমি জানি
    গরিবদের ভয় দেখানোর জন্য
    এই সব কিছু..
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১৮:০০644887
  • http://anyapatra.com/nabarun_3/
    অন্যপত্র (অনলাইন বাংলা পত্রিকা)

    নবারুণ এবং বিদ্রোহ বিস্ফোরণের সম্ভবনা প্রভৃতি

    সৌভিক ঘোষাল

    শতাব্দীর সন্ধিলগ্নে রাষ্ট্রবিপ্লবের মহড়া অথবা কাঙালদের মালসাট বা আস্ফালন বৃত্তান্ত

    ঘাটের দু ধারে বসার রোয়াক। বাঁ দিকটাতে তিনজন বসেছিল। একজন ঢ্যাঙা, একজন বেঁটে মোটা আর তিননম্বরকে দেখলেই বোঝা যায় পাগলাখ্যাঁচা। … এই ফাঁকে বলে নেওয়া যাক যে, বাঁ দিকের তিনজন হল ফ্যাতাড়ু যারা গোপন একটি মন্ত্রের বলে উড়তে পারে এবং নানা ধরণের অনুষ্ঠান বা সুখের সংসারে ব্যাগড়া দিয়ে থাকে। ফ্যাতাড়ু আরও অনেক আছে। কিন্তু আপাতত এই তিনজনকে চিনলেই কাফি। ঢ্যাঙা মালটা হল মদন। ওর ফলস দাঁত পকেটে থাকে। বেঁটে কালো মোটাটা হল ডি এস। ওই নামে একটি হুইস্কি আছে—ডিরেক্টরস স্পেশাল। ওর তোবড়ানো-মচকানো ব্রিফকেসের দু পাশে নাম ও পদবির আদ্যক্ষর সাঁটা আছে যদিও পড়া কঠিন। তিন নম্বর স্যাম্পেলটা হল কবি পুরন্দর ভাট।

    পাঠকের সাথে ফ্যাতাড়ুদের নবারুণ প্রথম পরিচয় করালেন খানিকটা অনাড়ম্বরভাবেই। কিন্তু ফ্যাতাড়ুরা ও তাদের চমকপ্রদ কার্যকলাপ (মালসাট কথাটির অর্থ ‘মল্ল আস্ফোট‘ বা ‘বানরদের হাতের আস্ফালন‘, দ্র। বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ। ১৭৬২, সাহিত্য সংসদ)। সমকালীন বাংলা আখ্যান সাহিত্য ও সেই পরিধি পেরিয়ে সার্বিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এমনকী সমাজতত্ত্ব রাজনীতি জগতেও সাড়ম্বর চর্চার বিষয় হয়ে উঠল অনতিবিলম্বেই। ১৯৯৯-এর শেষ মাসটিতে প্রমা পত্রিকায় প্রথমবারের জন্য ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেন নবারুণ, কাঙাল মালসাট -এর দ্বিতীয় কিস্তি নতুন শতাব্দীর প্রথম মাসে ফ্যাতাড়ুদের পরিচয় নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে।কাঙাল মালসাট ছাড়াও বিভিন্ন ছোটগল্প সংকলনে ফ্যাতাড়ুরা এসেছে, যেমন ‘ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক‘ বা ‘ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক‘-এ। ফ্যাতাড়ুদের বিচিত্র কার্যকলাপের এপিসোডিক বিবরণ সেখানে পাওয়া যাবে। আপাতত আমাদের আলোচনা কাঙাল মালসাট -কে নিয়েই।

    কাঙাল মালসাট -এ ফ্যাতাড়ুদের প্রথম উন্মোচন, যেখানে ফ্যাতাড়ু আর চাকতিদের যৌথ ফ্রন্ট ওয়ার ঘোষণা করে লালবাজার তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। এর আগে নকশালবাড়ি ও সেই সূত্রে ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’-এর ধারণাকে নবারুণ নানাভাবে নিয়ে এসেছেন হারবার্ট ও যুদ্ধ পরিস্থিতি -তে। নকশালবাড়ির কিছু উল্লেখ কাঙাল মালসাট -এও আছে, কিন্তু তার খানিক অপরিকল্পিত প্রস্তুতির কথাই এখানে ইঙ্গিত করেন নবারুণ। তবে নয়া রাষ্ট্রবিপ্লবে সেখান থেকে প্রেরণা নেওয়ার ব্যাপারটা অবশ্যই আছেঃ

    নকশালদের কোনও পরিকল্পনা ছিল কি? থাকলেও আগেভাবেই তো তারা মরে গেলো।

    অথবাঃ

    প্রথমে আর সি পি আই, পরে নকশাল – সবই আনপ্রিপেয়ার্ড স্ট্রাগল। অথচ স্বপ্ন দেখা তো থামেনি। সেই বন্দুক আজ আমরা হাতে হাতে, ঘরে ঘরে …

    রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় পুরোদস্তুর এক মিলিটারি স্ট্র্যাটেজির কথা ভাবে ফ্যাতাড়ু-চাকতি যৌথ ফ্রন্টের কমান্ডার মার্শাল ভদি এবং উপন্যাসের অগ্রসরণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্রমশ সেই পরিকল্পনার সাথে পরিচিত হই। অবশ্যই কাঙাল মালসাট একটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক উপন্যাস, কিন্তু ফ্যাতাড়ু-চাকতিদের রাজনীতিটা টানা কোনও ন্যারেটিভ বা বর্ণনার মধ্য দিয়ে এখানে আভাসিত নয়। বরং চলতি রাষ্ট্র ও রাজনীতি কাঠামোর একটি পুরোদস্তুর ক্রিটিক হিসেবেই তাদের যাবতীয় কার্যকলাপ। সেই রাষ্ট্র ও রাজনীতি কাঠামোর বিভিন্ন দিকগুলিকে নবারুণ উপন্যাসের বিভিন্ন পরিসরে ছড়িয়ে রাখেন। ফ্যাতাড়ুদের ডিসরাপশান-অভিমুখী কার্যকলাপের সঙ্গে আখ্যানের এই প্যাটার্নটা বিশেষ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

    এই উপন্যাস যখন লিখছেন নবারুণ তখন ভারতে নব্য উদার অর্থনীতির জমানা এক দশকের বেশি সময় অতিক্রম করে ফেলেছে। সমস্ত কিছু সহ ছোটোদের খেলাধুলাকেও পণ্য বানানোর কারবার সাফল্য পেয়েছে, পাড়ায় পাড়ায় রমরমিয়ে চলছে ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পঃ

    আজ বাঙালি অন্য নানা খেলার মতো ফুটবলেও কেলিয়ে পরেছে এবং ক্রিকেট বা টেনিসে গুচ্ছের টাকা বলে বাঙালি বাপ মায়েরা বাচ্চাগুলোকে হ্যাঁচকা টানে ঘুম থেকে তুলে মাঠে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে নাকি হুদো হুদো কোচ, যারা বরং কোচোয়ান হলে আরও ভালো হত।

    ফ্রেডরিক জেমসন যাকে ‘কালচারাল লজিক অব লেট ক্যাপিটালিজম’ বলেছিলেন পোস্টমর্ডানিজম নামাঙ্কিত তাঁর বিখ্যাত বইয়ে, তা তখন ভালোরকম ফ্যাশানেবল। দেরিদা-ফুকো-লাঁকা-বাখতিন আদি ব্যক্তিবর্গ উচ্চারিত হন, কিন্তু তাদের চিন্তার ছকভাঙা প্যাটার্নের বাইরে থাকতেই পছন্দ করে এ সব আউড়ানো বুদ্ধিজীবী আজ্ঞাবহ দাসকুল। বস্তুতপক্ষে কাক কাকের মাংস খায় না এই প্রবাদকে এড়িয়ে গিয়েই সমকালীন বুদ্ধিজীবী মহল বা লেখক সমাজকে নিয়ে নবারুণ ভালোরকম তামাশা করেছেন এখানেঃ

    আজ বাঙালি কথায় কথায় সেমিনারে বাখতিন ফুকো ঝাড়ে, ভবানীপুর এলাকায় পাঞ্জাবি ও গুজরাটিদের দাপট ও রোয়াব সম্বন্ধে গ্রামসির হেজিমনি তত্ত্ব আওড়ায়, বিগ ব্যাং হইতে স্মল ব্যাঙাচি সকলই তার নখের ডগায় ডগোমগো হইয়া রহিয়াছে…

    কিন্তু আসলে বুলি-সর্বস্ব এরা আজ্ঞাবহ দাস বই অন্য কিছু নয়। পুরন্দর ভাটের কয়েকটি ‘অমোঘ লাইন’-এর মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ক্রিটিকটাকে স্যাটায়ারের বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন নবারুণঃ

    আজ্ঞাবহ দাস, ওরে আজ্ঞাবহ দাস

    সারা জীবন বাঁধলি আঁটি,

    ছিঁড়লি বালের ঘাস,

    আজ্ঞাবহ দাসমহাশয়, আজ্ঞাবহ দাস!

    যতই তাকাস আড়ে আড়ে,

    হঠাৎ এসে ঢুকবে গাঁড়ে,

    বাম্বু ভিলার রেকটো –কিলার,

    গাঁট –পাকানো বাঁশ,

    আজ্ঞাবহ দাস রে আমার, আজ্ঞাবহ দাস।

    বুদ্ধিজীবীদের ক্ষমতাধরের সঙ্গে হাঁটার স্পৃহা ও সময়বিশেষে নিরপেক্ষ থাকার আড়ালে গা-বাঁচানো মনোভাবটি নবারুণ আবার ফিরিয়ে আনেন স্বাক্ষরিত নির্বিষ সব বয়ান প্রকাশনার মধ্যে দিয়ে দায় সারার মানসিকতার সূত্রেঃ

    এ কথা কে না জানে কোথাও কোনো গুরূত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে বাংলার বুদ্ধিজীবীরা কালবিলম্ব না করেই সদলবলে একটি ঘোষনাপত্র বা আবেদন বা একটি ফাঁকা থ্রেট প্রকাশ করে থাকেন যাতে বড় থেকে ছোট, শুডঢা থেকে কেঁচকি, লেখক শিল্পী, গায়ক, নৃত্যশিল্পী, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্র শিল্পী থেকে শুরু করে সকলেই সই দিয়ে নিজেরাও বাঁচেন অন্যদের বারটা বাজাবার রসদ যোগান। শুধু এই ধরনের আবেদনে বা প্রতিবাদপত্রে সই করেই অনেকে লেখক বলে নিজেদের পরিচিত করতে পেরেছেন। কেউই এই ধরণের ব্যাপারে সই দেওয়া থেকে বাদ পড়তে চান না। বাদ পরে গেলে খচে লাল হয়ে যান।

    ফ্যাতাড়ু ও রাষ্ট্রশক্তির যুদ্ধের সময়ে তারা নাকি লিখেছিল, ‘সংগ্রাম যেমন দরকার তেমন বিশ্রামেরও দরকার। শেষোক্ত প্রয়োজনটি আমাদের খুবই বেশি।‘

    উপন্যাস রচনার সমকালে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার শিল্পায়ন উন্নয়নের নতুন মডেলের কথা সোচ্চারে সামনে আনছিল। নবারুণ কিন্তু ‘ক্লাস লাইন’ থেকে সরেননি একটুকুও। শিল্পায়নের ঢক্কানিনাদের তলায় আসলে বহমান বি-শিল্পায়নের বাস্তব ছবিটা তুলে আনেন তিনি। উপন্যাসের সপ্তম পর্বে ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডভেলপমেন্ট কর্পোরেশন-এর সম্মেলন ও সেই সূত্রে ‘পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে নতুন জোয়ার আসছে’ এই সরকারি প্রচারকে নিয়ে রঙ্গতামাশা রয়েছে, রয়েছে উন্নয়নের সামগ্রিক মডেলটিকে নিয়েই তীব্র খেউড়। বস্তুত, চাকতি ও ফ্যাতাড়ুদের দ্বারা সাবঅল্টার্ন সাবভার্শান-এর ব্যাকড্রপ হিসেবে এই পলিটিকাল ক্রিটিকটাকেই ক্রমশ সামনে আনতে থাকেন নবারুণঃ

    আজ চেয়ারম্যান (উক্ত ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের) শালা নার্সিংহোমে গেছে, এর পরে দেখবি কি হয়। কোনো ঢপবাজকে আমরা রেয়াত করব না। কম করে ৫০ হাজার ছোট বড় কারখানা হয় বন্ধ নয় হাঁপের টানে ধুঁকছে। সেদিকে কারো খেয়াল নেই, বাড়া ডাউনস্ট্রিম মারাচ্ছে। ফরমুলা ওয়ান রেসিং! হোটেল! কার পার্কিং প্লাজা! সামলাও এবার চাকতি।

    বন্ধ কলকারখানার প্রসঙ্গ যেমন এখানে আসে, তেমনই আসে হকার উচ্ছেদ অভিযানের কথাও। আমাদের ভুলে যাওয়ার নয়, উপন্যাস রচনার কাছাকাছি সময়ে হকার উচ্ছেদ তথা ‘অপারেশন সানশাইন’ নিয়ে বিপুল আলোড়নের কথা।

    অভিমুখ বদলের পেছনের কারণকে সামনে আনেন নবারুণ। স্পষ্টভাবেই। লেফট ফ্রন্ট সরকার নিও লিবারাল অর্থনৈতিক নীতিমালার সঙ্গে কীভাবে আস্তে আস্তে সমীকৃত হয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখান তিনি। ধরে দেন বদলে যাওয়া নেতৃত্বের চেহারাটিও। সিএম-এর মধ্যে যদি জ্যোতি বসুর ছায়া দেখি আমরা, তবে কমরেড আচার্য নিশ্চিতভাবেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর আদলটিকে মনে করিয়ে দেয়। সমকালীন সিপিএম-এ ‘দু লাইন’-এর দ্বন্দ্বও এখানে এসেছে, এসেছে তার মধ্যে কমরেড আচার্যর দোদুল্যমান অবস্থানের কথা।

    উপন্যাস রচনার সেই সময়টিতে সিপিএম-এর মধ্যে সমীর পুততুণ্ড, সৈফুদ্দিন চৌধুরীরা তখন প্রকাশ্যেই ‘বাধাহীন উন্নয়ন’-এর পক্ষে সওয়াল করছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার কথা বলছেন। সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক লাইন গ্রহণের প্রশ্নে কমরেড আচার্যর মতো অনেকেই তখন দোদুল্যমান। আসলে দক্ষিণমুখী অভিযাত্রার প্রবক্তাদের নিয়ে সাংগঠনিকভাবে কী করা হবে, দ্বন্দ্ব এখানেই তো সীমিত ছিল না, পুঁজিবাদী উন্নয়নকে ব্যবহার করে নেওয়া যায় কিনা, সেই ভাবনায় কমরেড আচার্যরাও বেশ দ্বিধাগ্রস্ত তখন। পরবর্তী এক দশকের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, সে যাত্রায় দক্ষিণপন্থী অভিযাত্রীরা পার্টির বাইরে চলে গেলেও ক্রমশ উন্নততর বামফ্রন্টের নামে গোটা সরকার ও তার প্রধান নায়কেরা নিজেরাই সরবে দক্ষিণমুখী অভিযাত্রায় সামিল হয়েছেন। সে পর্ব অবশ্য উপন্যাসের আলোচ্য সীমা-চৌহদ্দির বাইরে। এখানে কমরেড স্ট্যালিনের সঙ্গে আধা তন্দ্রার ঘোরে থাকা কমরেড আচার্যর যে কল্পসংলাপ শুনিয়েছেন নবারুণ, তা আসলে বিপ্লবী বামপন্থা ও সংশোধনবাদী প্রবণতার মধ্যে চলমান দ্বিরালাপইঃ

    ‘বিপ্লব করেছিস? কাকে বলে জানিস?…করিস ত শালা ভোট। আর কিছু করতে পারবি বলেও ত শালা মনে হয় না। যেগুলো আলটু ফালটু গাঁইগুঁই করছে সেগুলোকে এত তোয়াজ করছিস কেন?…‘

    ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমরা ওদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যেখানে দু মাস বরাদ্দ সেখানে তিন মাস …‘

    ‘ওদের কথা বাদ দে। তর মনটা কোন দিকে? সেটা কি ঠিক করেছিস ?…‘

    ‘কিছু তো ভেবে উঠতে পারছি না।‘

    ‘কুকুর যেভাবে বমির কাছে ফিরে যায় সেভাবেই ওরা বুর্জোয়া গলতায় গিয়ে ঢুকবে…‘

    কমরেড আচার্য তার দোদুল্যমানতা নিয়েও শেষমেষ সিএম-এর নির্দেশে প্রধান শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠকে হাজির থাকেন। ফ্যাতাড়ু চোক্তাররা তাদের কার্যকলাপ শুরু করতেই সিএম পুলিশ কমিশনারকে রাষ্ট্রযন্ত্রের যা করার তা করতে নির্দেশ দেন, কেবল মানবাধিকার কমিশনের সম্ভাব্য ফ্যাকড়াগুলি মাথায় রেখে।

    নবারুণ আমাদের চেনা কথাটাই আর একবার মনে করিয়ে দেন যে, এই গোটা পরগাছা শ্রমজীবী ঠকানো আর্থিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখা হয় রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার প্রধান সশস্ত্র অঙ্গ পুলিশ/মিলিটারি দিয়ে। ফ্যাতাড়ু/চাকতিরা তাই রাষ্ট্রযন্ত্রের কলকাতার হেডকোয়ার্টার লালবাজার ও অন্যান্য থানাগুলির ওপর এবং তার কর্তাব্যক্তিদের ওপর ‘ওয়ার ডিক্লেয়ার’ করে। এই যুদ্ধের দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্বের বর্ণনা নবারুণ বিভিন্ন পর্বে দিয়েছেন। বোমার বারুদের মশলার ভাগ থেকে ছোটো পর্তুগিজ কামানের ব্যবহার, চাকতি ও ফ্যাতাড়ুদের ওড়ার ক্ষমতাকে বোমারু বিমানবাহিনী হিসেবে কাজে লাগানোর নিপুণ পরিকল্পনা, ম্যানহোলের ভেতর থেকে আচমকা বেরিয়ে এসে শত্রুপক্ষকে চমকিত ও ঘায়েল করার কৌশলগুলি প্রায় গেরিলা ওয়ারফেয়ার ম্যানুয়াল থেকেই যেন নিয়ে এসে তাকে ফ্যান্টাসাইজ করেন নবারুণ।

    নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের কথা এখানে আছে, তার ফ্যান্টাসিধর্মীতা আমাদের চোখ এড়ায় না। কিন্তু ফ্যান্টাসি নির্মাণের মধ্যেও নবারুণ তাঁর ‘ক্লাস লাইন’কে ধরে রাখেন। একদিকে সরকার পক্ষ থেকে যখন উন্নয়ন শিল্পায়নের ফ্যান্টাসি রচনা করে মুক্ত পুঁজির লুঠেরা চরিত্রকে অবাধ বিচরণের জায়গা দেওয়া হয়, তখন তার বিপ্রতীপে নবারুণ রাষ্ট্রবিপ্লবের ফ্যান্টাসি নির্মাণ করেন নিম্নবর্গের মানুষগুলিকে তার সেনাবাহিনীর পুরোভাগে রেখে। দেখান তাদের আগ্রাসনের সামনে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র পিছু হটে এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে শেষমেষ আপোষরফায় বাধ্য হয়। ঘরে বাইরে পিছু হঠার বাস্তবিক সময়ে ফ্যান্টাসির জগতে হলেও রাষ্ট্রবিপ্লব পরিকল্পনার দুরন্ত বৈপ্লবিক স্পর্ধাই কাঙাল মালসাট -কে বিশিষ্ট করে তোলে।
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১৮:০৫644889
  • http://www.shobdoneer.com/nazneenkhalil/69109
    শব্দনীড়

    স্মরণঃ চলে গেলেন নবারুণ ভট্টাচার্য
    নাজনীন খলিল | অক্টোবর ২৬, ২০১৫ | ২০:৫২

    যেতে হয়। কেউ কেউ যায় জানান দিয়েই। কোন দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগতে ভুগতে। সুন্দর এই বেঁচে থাকাকে প্রাণপণে আঁকড়ে থাকতে চেয়েও থাকতে পারে না। আর কেউ যায় একেবারেই আকস্মিক, অচিন্ত্যনীয় যাত্রায়। যেভাবেই হোক সব যাত্রাই চারপাশের চেনাজানা পরিমণ্ডলে এক গভীর ছাপ রেখে যায়। আমরা আমাদের প্রিয় মানুষগুলোকে হারাতে চাইনা কিছুতেই।



    ৩১ জুলাই ২০১৪ চলে গেলেন নবারুণ মাত্র ৬৬ বৎসর বয়সেই। দুরারোগ্য কর্কট তাঁকে ছিনিয়ে নিল জীবনের কাছ থেকে। আমাদের কাছ থেকে। প্রথিতযশা সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী এবং বিজন ভট্টাচার্যের সফল উত্তরসুরী। জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন। ১৯৯৩ সালে আকাদেমী পুরস্কার পান ‘হারবার্ট’ উপন্যাসের জন্য। এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না, কাঙাল মালসাট, লুব্ধক, হালালঝান্ডা এবং অন্যান্য, মহাজনের আয়না, ফ্যাতাড়ু, রাতের সার্কাস এবং আনাড়ির নারীজ্ঞান—তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ।

    ‘এই মৃত্য উপত্যকা আমার দেশ না’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ বিপুল সমাদৃত পাঠক মহলে।

    আমার বিনাশ নেই-
    বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব
    আমার বিনাশ নেই-
    সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে
    বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন
    মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।

    ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ যতবার এই কবিতা পড়েছি এবং শুনেছি আমার মানসে ভেসে উঠেছে মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’-এর ছবি। আমি নবারুণের মাঝে একসাথে দেখেছি মা মহাশ্বেতা এবং ছেলে নরারুণের যৌথ উচ্চারণের এক অনবদ্য যুগলবন্দি।

    ‘বাংলাদেশ যতদিন থাকবে
    মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন’
    নবারুণ চলে গিয়েও থাকবেন। আমাদের মাঝে। বাংলাদেশের নিঃশ্বাসের মাঝে।

  • /\ | 69.160.210.3 | ০৭ জানুয়ারি ২০১৬ ১৮:৪২644890
  • ভাষাবন্ধন নবারুণ সংখ্যা ২০১৫ ত্রয়োদশ বর্ষ (১৬০ পাতা, ৫০ টাকা)

    ১) সম্পাদকীয় - ৩
    ২) নবারুণ ভট্টাচার্যর পাণ্ডুলিপি থেকে ... অগ্রস্থিত কবিতা ও একটি ছোটো কাব্যগ্রস্থের পাণ্ডুলিপি সংকলন - ৬
    ৩) বাপ্পা আর আমি আর ।।। সুবীর বসু - ২৩
    ৪) আমার বন্ধু নবারুণ - শ্যামলকুমার গঙ্গোপাধ্যায় - ৩৪
    ৫) নবারুণের অবাস্তব কিংবা আসল বাস্তব - শুভেন্দু দাশগুপ্ত - ৩৮
    ৬) আমরা পাশাপাশিই আছি - পীযুষ ভট্টাচার্য - ৪১
    ৭) একটি কালো ম্যাকিনটোশ - নীলাঞ্জনা ভৌমিক - ৪৪
    ৮) নবারুণ নয়, বাপ্পা - সোমা মুখোপাধ্যায় - ৪৬
    ৯) বাপ্পা - সারী লাহিড়ী - ৪৮
    ১০) বাপ্পদা : শ্রী নবারুণ ভট্টাচার্য -অজয় কুমার আচার্য - ৪৯
    ১১) একটি কমিউনিস্ট পার্টি ও নবারুণদা, এবং পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ - অমিত দাশগুপ্ত - ৫২
    ১২) নবারুণদা - অগ্নি রায় - ৫৮
    ১৩) নবারুণদা - শৰ্মিষ্ঠা রায় - ৬১
    ১৪) ২৯ বছর পর... - সুরজিৎ সেন - ৬৪
    ১৫) অন্তরে আজ দেখব - পার্থপ্রতিম মণ্ডল - ৬৬
    ১৬) একটি মিসিং লিংকের প্রতি প্রার্থনা - দেবাশিস ঠাকুর - ৭১
    ১৭) নবারুণদা : দ্বন্দুের রূপরেখা বা সহ অনুভূতির এক আখ্যান - কৌশিক গুহ - ৭৬
    ১৮) অসহায়তা এবং অসমসাহস - বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত - ৮০
    ১৯) ব্ল্যাক সোয়ান ও নবারুণ : প্রতিজ্ঞানের নন্দনতত্ত্ব - তন্ময় ভৌমিক - ৯৪
    ২০) ডায়াসপোরা ও ফ্যাতাড়ুর কলকাতা - কৌশিক চক্রবর্তী - ১০০
    ২১) কবির মৃত্যু - ভাস্কর ঘোষ - ১২০
    ২২) আড়বেলে, বিজন ভট্টাচার্য ও ব্যক্তিগত নবারুণদা - শুভঙ্কর দাস - ১২১
    ২৩) নবারুণ : স্মৃতি বিস্মৃতি ও কল্পকথা - প্রণতি ভট্টাচার্য - ১২৭
    ২৪) আমার বাবা - তথাগত ভট্টাচার্য - ১৩২
    ২৫) নবারুণ ভট্টাচার্যর গ্রন্থপঞ্জি - সংকলনঃ রাজীব চৌধুরি ১৩৭
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৭ জানুয়ারি ২০১৬ ১৮:৪৪644891
  • http://anyanishad.blogspot.in/2014/08/blog-post_350.html

    সাপ্তাহিক 'অন্যনিষাদ'
    সম্পাদনা - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

    কবি নবারুণ ভট্টাচার্য কে
    - মমতা দাস (ভট্টাচার্য)

    কবি চলে যান
    তাঁর অস্ত্র, তাঁর শব্দ ফেলে রেখে
    বিবাগী ভ্রমর চলে যান।
    কখনো শব্দরা
    সশব্দে জেগে উঠে বিপ্লব হবে।
    প্রতিবাদে, প্রতিরোধে সোচ্চার
    জীবনের তুমুল উদ্ভবে।
    ঘুমাও শ্রান্ত কবি,
    ভবিষ্যত জেগে আছে হেথা
    পৃথিবীর কোণে কোণে
    রেখে যাবে তোমার বারতা !
    হয়ত এখন-ও তারা ছোট বুদ্বুদ
    হয়ত তারুণ্য আজ-ও স্বপ্নেই বুঁদ ,
    তোমার শব্দরাশি কাজ করে
    নিভৃত নীরবে,
    যখন ভাঙ্গবে ঘুম শব্দ গৌরবে ,
    আশা রাখি বিপ্লব হবে !!
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৭ জানুয়ারি ২০১৬ ১৮:৫১644892
  • http://www.aadorernouka.in/adorernauka/Recent_Lit_Article/329/%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%9C%20%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0%20%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE%20%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A7%87%E0%A6%A8%20%E0%A6%AB%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A7%81/%20%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%A3%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%95%E0%A7%87/%20%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%BE%20%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A7%9C%E0%A7%87%20%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A7%9F%20%E0%A6%A8%E0%A6%BE.html

    আদরের নৌকা

    সেলাম ক্যাপ্টেন ফ্যাতাড়ু/ নবারুণলোকে/ পান্ডুলিপিরা পুড়ে যায় না
    সরোজ দরবার



    ‘ভালো করে ঘুমোক। ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে। - এভাবেই শুরু হয়েছিল ৯৭ এর অকাদেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত তাঁর উপন্যাস। অথচ এবার সব ঠিক হল না বলেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। এবং আমরা কাঙাল হলাম। খানিকটা স্পর্ধা কমে গেল। তবু সত্যিই কি কমে গেল? আমরা কি জানতাম না, হ্যালোজেনের হলুদ আলোয় ফ্যাতাড়ু একদিন ঠিক উড়ে যায়? জানতাম হয়তো। আর তাই আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই মনে পড়ে যায়, সেই হিসেবটা। ‘মানুষ যদি ১ হয় তাহলে ০ হল মরা মানুষ। মানুষ+মরা মানুষ=১+০=১’। অতএব হিসেব তো বরাবর আছে। ‘আস্ত’ মানুষটা তো থেকেই যাচ্ছেন।
    কিন্তু মুশকিল হল, এই ‘আস্ত’ মানুষ কথাটাতে যে তিনি স্বয়ং বিশ্বাস করেন না। রবীন্দ্রনাথ ও নস্ত্রাদামুসকে নিয়ে একটি লেখা লিখতে গিয়ে গোরাতেই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ রবীন্দ্রনাথ ‘আস্ত’ মানুষদের কাছে নমস্য। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে বোঝেন। আমি ‘আস্ত’ মানুষ কোন অর্থেই নই। টুকরো টাকরা, কিছুটা ফ্লুকে লেখক হয়ে যাওয়া। প্রায় নিউরোটিক একটি প্রাণী যে দিশাহার এবং যে কোনো সময়ে যে জাহাজটায় চড়ে সে স্টুপিডগিরি করে বেড়াচ্ছে সেটা টাইটানিকের একটা প্যাথেটিক ক্যারিকেচার হয়ে যেতে পারে।’ ঠিক এই পূর্ণচ্ছেদের সামনে দাঁড়িয়েই আমরা ফিরে দেখতে পারি একটা স্পর্ধার ইতিবৃত্ত। কিংবা বলা ভালো, নতুন করে স্পর্ধিত হতে পারি। ‘পান্ডুলিপিরা পুড়ে যায় না', মিখাইল বুলগাকভের এ উক্তিতে তিনি নিজেই যে প্রবল বিশ্বাস করতেন। সুতরাং আজ আমরা স্পর্ধা হারানোর কথা বলব না, বরং আকাশভরা সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণের মধ্যে নিজের সমগ্র অস্তিত্ব আবিষ্কার করেও তথাকথিত ‘আস্ত’ হওয়া থেকে কেউ কীভাবে নিজেকে সচেতন ও সুকঠিনভাবে সরিয়ে রাখতে পারেন, সেই স্পর্ধার স্ফুলিঙ্গতেই চোখ ফেরাব। সে উত্তরও তিনি দিয়ে গেছেন, ‘ অবশ্য আস্ত মানুষরাও যে সুবিধের মাল নয় সেটাও ঠিক কথা। ব্রয়লারও একটা আস্ত পাখি। এই ‘ the new post cold war situation of globalization and universal co modification’ – এর কুৎসিত, হতাশ, দুর্গন্ধময় পরিবেশে সব কিছুই ফালতু বলে মনে হয়। সত্যিই কি স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ হয়েছিল? যদি হয়ে থাকে তাহলে এটা কোন পৃথিবী?’ এই সব প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের মগজ যখন আপনিই ফালাফালা হয়, তখন হয়তোবা খানিকটা আন্দাজ করতে পারি কেন ‘আস্ত’ থাকাকে প্রবল ও তীক্ষ্ণ ভাষায় অস্বীকার করেছিলেন মিতবাক মানুষটি।
    একদিক থেকে মনে হয়, তাঁর সাজিয়ে যাওয়া অক্ষররা আসলে অস্বীকারেরই কথামালা। বেচামণির বশীকরণ মন্ত্র পড়া নিয়ে ভদির খচে যাওয়া ও সে সূত্রে বিবাদের একটু পরে গিয়েই লখক বলবেন, ‘কিন্তু এই বিবাদে জড়িয়ে পড়লে আমাদের চলবে না। মাগি-মদ্দার কারবারে আদ্যিকাল থেকেই এই ঢং। ঠাকুর দেবতারাও এই লাইনে যথেষ্ট বলশালী। এসব চলবেই এবং এর রকমফের নিয়ে আধবুড়ো কিছু গান্ডু শারদীয়া কত কী-তে আধলা নামাবে এবং বাঙালি পাঠকরা মলাঙ্গা লেন বা মঙ্গোলিয়া, যেখানেই থাকুক না কেন সেগুলি পড়ে ফেলবে। পড়ে তো ফেলেই। এই অসুখের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ট্রিটমেন্ট হল হনুমানের বাচ্চা। কিন্তু সেখানেও ফ্যাকড়া। পশুপ্রেমীরা হাঁউ হাঁউ করে উঠবে। নিরপরাধ, ঐতিহ্যবাহী, রামভক্ত, হনুমানের বাচ্চাদের আপনারা কোথায় পাঠাচ্ছেন! জায়গাটা খাঁচা হলেও বা একটা কথা ছিল।’ ভাষাবন্ধনের মুচকি হাসিটা থামলে আমরা ঠিকই বুঝে যাই, নবাআরুণ মোটেও আমাদের হাসাতে চাইছেন না। বরং তাঁর কলম নির্দেশ ঐ ‘অসুখ’টার দিকে। কীসের অসুখ? যে কারণে কামুর ‘ আ হ্যাপি ডেথ’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তাঁর অসুবিধা হয়েছিল। মূলগত কিছু প্রশ্নের উত্তরকে ঢাকা দিয়ে শৌখিন শিল্পের মজদুরীই এই অসুখ। ‘রজার বেকনের ভষায় এই চূড়ান্ত প্রশ্নগুলির প্রস্তাবিত উত্তর ঈশ্বরকে নিবেদিত কুমারীর মতোই বন্ধ্যা থেকে যায়।’ – নবারুণ নিজেই এ কথা জানতেন। সুতরাং ‘বন্ধ্যা মিথ্যাচারের সাহিত্য’ আর ‘সিন্থেটিক অতিকথার সাহিত্য’ কোনওটাই তাঁর ধাতে সয় না। ঋত্বিক জাঁর কাছে যুগপৎ অঙ্গীকার এবং অস্কার, ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতা নিয়ে আধুনিকতার প্রশ্নগুলি বুঝতে যাওয়ার বিপজ্জনক’ চেষ্টা দেখে তাঁর যে লোম পুড়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং জলের উজ্জ্বল শষ্যরা বাবুঘাটের কুমারী মাছে পরিণত হয়ে গেলে, এবং ‘কমলকুমারের রোমশ রসিকতা ও সান্ধ্য ভাষাসমৃদ্ধ ক্লিনিকাল রিয়ালিজম ‘বাঙলা ভাষার অদ্বিতীয়’ মার্কসবাদীদে লেখকদের কাছেও শ্রেষ্ঠত্বে অনাদ্যন্ত’ বলে প্রতীয়মান হলে তাঁর পুরন্ধর ভাট দ্বিধাহীন হয়ে সাহিত্য সভ্যতার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেছে,
    ‘ আজ্ঞাবহ দাস, ওরে আজ্ঞাবহ দাস
    সারাজীবন বাঁধলি আঁটি,
    ছিঁড়লি বালের ঘাস,
    আজ্ঞাবহ দাসমহাশয়, আজ্ঞাবহ দাস!
    আজ্ঞাবহ দাসবাবাজী, আজ্ঞাবহ দাস’
    যতই তাকাস আড়ে আড়ে,
    হঠাৎ এসে ধুকবে গাঁড়ে,
    বাম্বু-ভিলার রেকটো কিলার,
    গাঁট-পাকানো বাঁশ,
    আজ্ঞাবহ দাস রে আমার, আজ্ঞাবহ দাস।’
    বলা বাহুল্য এ কবিতা ছিল ‘ পায়খানা ধোলাই করার অ্যাসিডের সুইমিং পুলে যে লেখকরা বারমুডা পরিয়া লাফাইতে বদ্ধপরিকর, তাহাদের জন্য রচিত।’ আসলে ঐ সান্ধ্য ভাষা শব্দটি যদি ধার নিই, তাহলে তো বোঝা যায় আসলে এই তুমুল ও অমোঘ ঠাট্টার শব্দে আসলে তিনি ধরিয়ে দিতে চাইছিলেন, সাহিত্যের ‘আসল কথাটা’ কী। ‘ সাহিত্যের ‘আসল কথাটা’ হচ্ছে দুনিয়াটাকে পালটে মানুষের স্বাধীন হউএ ওঠার উপযুক্ত চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা। যে সাহিত্য মানুষের psychological space’ কে এই আশ্চর্জ সংগ্রামের উপযোগী ও বিস্তৃত দ্বান্দ্বিক গতি এনে দেয় না, সেই সাহিত্য ভালো না। তাতে অনেক চটক, জমক, যতিরঙ্গ, শৈলি ও খুচরো কারুকার্জ থাকলেও কথাটা মিথ্যে হয়ে যায় না।’ অর্থাৎ এইটেই হল আসল কথা। এবং এই মুহূর্তে আমরা বুঝতে পারি, আসলে অস্বীকার নয়, তিনি আমাদের ডেকে নিয়ে স্বীকারের দিকে। যে স্বীকার নিজের কাছে নিজেকে। যেখানে দুনিয়ার ঠকানোর চেয়েও নিজেরই ঠকানোর সম্ভবনা থাকে ষোলআনা। নবারুণ আমাদের সেই রক্ষাকবচটা বেঁধে দেন। অস্বীকারের সোপান ধরে স্বীকারে পৌঁছনো। ‘ the duty of every revolutionary is to make revolution’ চে-এর এ কথার মতোই তিনি জানতেন, ‘ ব্যারিকেড রাস্তা বন্ধ করে ঠিকই, আবার নতুন রাস্তা দেখিয়েও দেয়।’
    এই বিপ্লবে বিশ্বাস হারনানি বলেই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’। যে সময়ে দাঁড়িয়ে ২৪ ঘণ্টা অন্যের উপর নির্ভরশীল থেকে, ‘ ভাবনার বেলায় নিজের অস্তিত্বের বেলুন ফঁপানো ও কয়েকটি পণ্যের বাজারদর ও ম্যাগাজিনের রসদ নিয়ে’ খুব ভালো কবিতা লেখা বা ছবি আঁকা , গান গাওয়া সম্ভব কিনা তা নিয়ে তিনি নিজেই সন্দিহান, যে সময়ে তিনি নিজেই জানেন মাঝারি মাপের হয়ে যাওয়াটাই সহজ পন্থা এবং ‘ব্রয়লার মুরগী হওয়ার থেকে কাক হওয়া অনেক ভালো, সেই সময়েও তিনি, এবং সম্ভবত একমাত্র তিনিই বলতে পারেন, ‘ শত আঘাত,সহস্র পরাজয়, লক্ষ মরণ – কোনও কিছুই আমাকে বিপ্লব ও মুক্তির পথ থেকে সরাতে পারবে না। তার কারণ, আমি রাজপথে ফেলে রাখা বোমা নই। আমি মানুষ। আমি লিখি। এবং আমি সংক্রামক। আমার ক্রাচের শব্দ আপনাকে ডাকছে।’ এই হল অবস্থানের সেই স্থানাঙ্ক অসীম পথের সঙ্গে যে সম্পর্ক পাতিয়ে নেয়। ফলত তাঁর অভিমুখ হয়ে ওঠে শিকড়ের দিকে, এবং সেখান থেকেই সে খুঁজে নেয় আধুনিকতার উৎসমুখ। আর তাই কবিতাকেও তিনি নামতে বলেছিলেন, শহরতলীতে। কেননা তিনি জানতেন, ‘ বিষয়টিকে নিয়ে যদি বা ভাবনা কিছু হয়, কাজ হয় বড় কম। ফলে অজান্তেই কবিতা অন্য সব শিল্পের মতোই পিছু হটতে থাকে। বিগত (কয়েকজন বেঁচেও আছেন অসার নিয়মে)কবিদের কয়েকটি আশ্রম আছে। যার থেকে কবির বদলে আমরা পেয়েছি কবি ও কবিতার কিছু জেরক্স কপি। ... এবং তৎসহ বিশাল মাফিয়া ক্ষমতার মত রয়েছে দৈনিক-সাপ্তাহিক- সাহিত্য বণিকের খোলা বাজার-এরা রণ-পা পরা বামন প্রায় প্রসূতি সদনের মত নিয়ন মেনে পরপর ছেড়ে যাচ্ছে, সম্ববত এরা পোলট্রি-বিজ্ঞানের দ্বারা অনুপ্রাণিত।’ আর তাই কবিতার স্বার্থেই চেয়েছিলেন কবিতা নিয়ে আন্দোলন। একদা এক রিকসা চালকের মুখে শুনেছিলেন, ‘নক্ষত্ররা ঘন হয়ে এলে বৃষ্টি হবে’ –এর মতো লাইন। আর তাই চেয়েছিলেন, ‘দুনম্বরী সভ্যতায়, দু নম্বরী মানসিকতায়’ আটকে না থেকে কবিতা যেন শহরতলীতে পৌঁছয়। অবশ্য আজ আমরা নিশ্চয়ই মনে রাখব, অহেতুক ‘কমরেড’ সম্বোধন করলেই কেউ বিপ্লবী হয়ে যায় না, আর দিস্তি দিস্তি খিস্তি লিখলেও কেউ নবারুণ ভট্টাচার্জ হন না। সুতরাং তাঁর পথের অভিমুখটি খুঁজে পাওয়াই আজ আমাদের একমাত্র অঙ্গীকার হওয়া উচিত। নচেৎ আলখাল্লার দেশে আরও কিছু মাঝি মাল্লার ভিড় বাড়বে বই কমবে না। ‘দু নম্বরী’র সতর্কবার্তাটা এখানে অত্যন্ত আবশ্যক নইলে সেই, ‘ ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ... ’
    শিল্পী আর টেলিভিশন সেটের মধ্যে এক কলমের আঁচড়ে পার্থক্য করে দিতে পারতেন বলেই তিনি জাতশিল্পী। এক লেখার মধ্যপর্বে লিখেছিলেন, মৃত্যুতে বিজ্ঞান শেষ হয় হোক। আমার ধারণায় মৃত্যুর পরে স্বপ্নের পর স্বপ্নের পর স্বপ্ন... ’। আজ আমাদেরও ধারণা তাইই। মৃত্যুর পরে স্বপ্নের পর স্বপ্নের পর সাঁই সাঁই ফ্যাৎ ফ্যাৎ। কেননা আমরা তো এখনো দিব্যি শুনতে পাচ্ছি, তিনি বলছেন, ‘ ...কিছু না বলা কথা ট্রাজিক অবলার মতো নির্বাক থেকে বার বার সেমিজে চোখ মুছুক এমনটি নিশ্চিয়ই হওয়া বাঞ্ছিত নয়, বাঞ্চতিত তো নেভার-ই নয়।’
    ফ্যাতাড়ুরা উড়ে যায়, পুড়ে যায় না।
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৭ জানুয়ারি ২০১৬ ১৯:২৩644893




  • https://bn.wordpress.com/tag/%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%A3-%E0%A6%AD%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF/

    লাল সংবাদ/Red News
    অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সংবাদ / News of rebellion against oppression

    যুদ্ধ পরিস্থিতিঃ রাষ্ট্র ও বিপ্লব এবং নবারুণ (নবারুণ ভট্টাচার্য স্মরণে)
    ------------- সৌভিক ঘোষাল



    হারবার্ট এর পর নকশালবাড়ির বিপ্লবী রাজনীতি রাষ্ট্র ও বিপ্লবের আঙিনায় নবারুণ আবার ফিরলেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে। মাঝে লিখেছেন ভোগী। হারবার্ট-এ নকশালবাড়ির যোদ্ধা বিনু ছিল এক পার্শ্বচরিত্র আর নায়ক হারবার্ট তাতে নেহাতই ক্ষীণভাবে ক্ষণিক সময়ের জন্য যুক্ত। যুদ্ধ পরিস্থিতির নায়ক রণজয় কিন্তু সরাসরি নকশালবাড়ি রাজনীতির মানুষ তার স্মৃতি আর সত্তা বিপ্লবী ভাবনায় জারিত। একদা গেরিলা যোদ্ধা ও বর্তমানে মানসিক ভারসাম্য হারানো প্রৌঢ় যে রণজয়কে আমরা এই আখ্যানে দেখি, সে সত্তরের আগুনঝরা সময়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে রণে নেমেছিল এবং ধাক্কার মুখে পড়েছিল। রণজয় ও তার বিপ্লব প্রচেষ্টা রাষ্ট্রের তীব্র দমননীতি এবং আরো কিছু কারণে আপাত পরাজিত, কিন্তু লড়াইয়ের অঙ্গীকারে তারপরেও আত্মজাগ্রত। সময়টা সত্তরের পর। কেটে গেছে আরো পঁচিশ বছর। কিন্তু ১৯৯৪-তে যে বছর সিপিআই নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারও আপোশ করে নিল কেন্দ্রের নয়া উদারনীতির সঙ্গে যখন রাষ্ট্রের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য লুকিয়ে রাখা রাইফেলের স্তূপের ওপর উঠে গেল ফ্ল্যাটবাড়ি সে বছরও রণজয় গেরিলা যুদ্ধ আর বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাতেই নিবিষ্ট। বাস্তবতা মেনেই সমাজ সংসার আর পারিবারিক শুভানুধ্যায়ীদের তৎপরতায় তার স্থান হয় মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কিন্তু সেখানে থাকলেও বিপ্লবের নির্মম শত্রু রাষ্ট্রের সতর্ক পাহারাদার যেমন দেবী রায়ের ডানহাত বসাক তার ভয় থেকে মুক্ত হতে পারে না কারণ ‘শ্রেণিশত্রু লিক্যুইডেট’ করার কাজ শেষ হয়নি।

    যুদ্ধ পরিস্থিতি উপন্যাসের নায়ক রণজয় বস্তুত বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার এক এমবডিমেন্ট । তার চেতনায় ভিড় করে ছিল আছে চিরকাল থাকবে রুশ বিপ্লব চিন বিপ্লব মার্কিন আগ্রাসন ও নাপাম বোমার মুখে ভিয়েতনামের প্রতিবাদী প্রতিরোধ ফ্যাসিবাদবিরোধী নকশালবাড়ির বিপ্লবী কর্মকাণ্ড কমরেড লেনিন, কমরেড স্ট্যালিন, কমরেড মাও সে তুং কমরেড ও শ্রদ্ধেয় নেতা চারু মজুমদার। ভিড় করে আছে অসংখ্য সহযোদ্ধা কমরেড যারা স্বপ্ন দেখেছে, লড়াই করেছে, অত্যাচারিত হয়েছে, শহিদ হয়েছে বারাসাতে, বেলেঘাটায়, বরানগরে, কাশীপুরে, সন্তোষপুরে, মেদিনীপুরে, মুর্শিদাবাদে পুলিশ লক আপে ময়দানে দিনের আলোয় রাতের অন্ধকারে। বস্তুতপক্ষে যুদ্ধ পরিস্থিতি উপন্যাসটি একই সঙ্গে সত্তরের উত্তুঙ্গ দিনকালের বিশ্বস্ত দিনলিপি, আবার আবহমান বিপ্লবী স্বপ্নের চিরায়ত নির্যাস হিসেবে আমাদের সামনে হাজির থাকে।

    যুদ্ধ পরিস্থিতি উপন্যাসে একটানা কোনো কাহিনি নেই। আছে রণজয় ও তার কাছাকাছি থাকা কিছু মানুষের জীবনের টুকরো টুকরো কিছু কথা। রণজয়-এর মধ্য দিয়ে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতিকেই আসলে নবারুণ এখানে সামনে এনেছেন। প্রত্যক্ষত, নকশালবাড়ি আন্দোলন এই যুদ্ধ পরিস্থিতির কেন্দ্রে কিন্তু তাকে ঘিরে আছে আরো আরো যুদ্ধ পরিস্থিতি যার কোনোটা রাশিয়ার পেট্রোগ্রাডে কোনোটা চিনের লং মার্চে কোনোটা ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আবার কোনোটা স্পেনে ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী হামলার বিরুদ্ধে কোনোটা নাৎসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চলমান। আখ্যানকার নবারুণ ব্যক্তিগতভাবেও যে নকশালবাড়ির বিপ্লবী রাজনীতি দ্বারা কতটা প্রাণিত হয়েছিলেন, সেটা বিভিন্ন সময়ে নানা সাক্ষাৎকারে খোলাখুলি জানিয়েছেন। ১৯৯৮ তথ্যকেন্দ্র পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন-

    সত্তরের আন্দোলন দ্বারা যে আমি প্রভাবিত হয়েছিলাম একথা তো সবাই জানে। আমার রেসপন্সটা কিন্তু ছিল লেখক হিসেবেই। আমার যেটা দায় সেটা আমি লেখা দিয়েই পূরণ করে দিয়েছি। সত্তরের ত্যাগটা যদি আমাদের এখানে কেউ অস্বীকার করে বা ভুলে যায় তাহলে সে খুব অন্যায় কাজ করবে। (নবারুণ ভট্টাচার্যর উপন্যাস সমগ্রর গ্রন্থ পরিচিতি থেকে গৃহীত)

    উপন্যাসের মেরুদণ্ড যুদ্ধ পরিস্থিতি হওয়ায় এখানে স্বাভাবিকভাবেই সশস্ত্র অভ্যুত্থান ও গেরিলা রণনীতি নিয়ে বিস্তৃত বয়ান আছে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের পর্বে বিশেষত প্রথম দিকে চারু মজুমদারের নির্দেশ ছিল ঘরোয়া অস্ত্র ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। কৃষকদের মধ্যে থেকেই বানিয়ে নিতে হবে আর্মড ইউনিট। চেয়ারম্যান মাও শিখিয়েছিলেন, অস্ত্র যেন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ না করে রাজনীতি যেন অস্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মধ্যবিত্ত স্তর থেকে আসা বুদ্ধিজীবী কমরেডদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের দিকে একটা ঝোঁক ছিলই। রণজয় চারু মজুমদারকে বোঝার চেষ্টা করেছে:

    রাত করে কোনও সভা ? সেখানে গেরিলা অ্যাকশন সম্বন্ধে কমরেড মজুমদারের কথাগুলো বোঝার ও বোঝানোর চেষ্টা করা ?বুদ্ধিজীবী সংগ্রামী হিসেবে সঙ্গে একটা ছোট পিস্তল ছিল ? কিন্তু কমরেড লড়াই এর এই স্তরে কোনোরকম আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা উচিত নয়। রণজয় কুপির আলোটার দিকে এগোয়। গেরিলা ইউনিটকে সম্পূর্ণভাবে দা বল্লম সরকি কাস্তের ওপর আস্থা রাখতে হবে। না কমরেড এটা দেশী বন্দুক কেনা বা তৈরি করা বা বন্দুক দখলের পক্ষে উপযুক্ত সময় নয়। হাতে বন্দুক পেলেই কি আমরা দখলে রাখতে পারব না। পুলিশ ঠিক ওগুলো দখল করে নেবে।

    আন্দোলনের পরবর্তী পর্বে রাষ্ট্রের দমননীতির বিরুদ্ধে রণকৌশল বদলাতে হয়। বন্দুক দখল ও ব্যবহারের ওপর জোর পড়ে:

    ওখানে একটা লোকাল অপারেশন চলছে। তাকে প্রতিহত করতে কোণঠাসা করতে চূর্ণ করতে দরকার অস্ত্রের। চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে চীনা গণমুক্তি ফৌজ ৩২০ টি রাইফেল নিয়ে বিপ্লবী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমরা না হয় ৬০ টি রাইফেল আর ২০০ টি পাইপগান নিয়ে আমাদের প্রথম গণমুক্তি ফৌজ তৈরি করব।

    মাও সে তুং-এর গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কিত নির্দেশিকাকে রণজয়ের ভাবনাসূত্রে সরাসরি তুলে এনেছেন নবারুণ:

    ঘাঁটি এলাকা গড়ে তুলতে হলে প্রথমে চাই একটি স্থায়ী সৈন্যবাহিনী এবং চাই রাজনীতি সচেতন জনতা। এই দুটি শর্ত পালিত হলেই টেরেনের প্রশ্ন আসে। টেরেনের প্রশ্নের দুটি দিক আছে। একটা প্রাকৃতিক এবং অন্যটা নিজেদের হাতে তৈরি করা। সমতলভূমিতে ঘাঁটি এলাকা হতে পারে। তার প্রমাণ জাপ বিরোধী যুদ্ধের সময় পিকিং শহরের উপকণ্ঠে সাতটি এরকম ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল।



    গ্রামাঞ্চলে কৃষক আন্দোলনের ওপর ভর করেই এগোতে চেয়েছিল নকশালবাড়ির মুক্তিসংগ্রাম আর তাই ছাত্র-যুবদের ডাক দেওয়া হয়েছিল । তরুণ শিক্ষক ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র রণজয় এই ডাকে সারা দিয়েই গিয়েছিল উত্তরবঙ্গে। গিয়েছিল শ্রদ্ধেয় নেতার নির্দেশ মেনে ভূমিহীন কৃষকের সঙ্গে একাত্ম হতে। এরকমই আরো অজস্র নবীন প্রাণ সাথী হয়েছিল রণজয়ের। বাস্তবের এক চরিত্র যাদবপুরের স্নাতকোত্তরের বাংলা বিভাগের ছাত্র সম্ভাবনাময় সাহিত্যিক তিমিরবরণ সিংহর কর্মকাণ্ড ও শহিদ হওয়ার প্রসঙ্গ এখানে এনেছেন নবারুণ। এসেছে বাস্তব ও বাস্তবকল্প এরকম আরো অনেক চরিত্র।

    বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে শোধনবাদী চিন্তার মোকাবিলা করেই এগোতে হয় নকশালবাড়ি আন্দোলন ও তার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই দিশা ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে শুধু নয় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনেই সতর্কবার্তা হিসেবে বারবার এসেছে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে নবারুণ এখানে সেগুলি ছুঁয়ে গিয়েছেন। কমিউনিস্ট শিবিরের মধ্যেকার টু লাইন স্ট্রাগল বস্তুতপক্ষে এখানে জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই লড়াইকে রণজয়ের আত্মস্থ করার সূত্রে। রণজয় স্মরণ করে মাও-এর সেই অমোঘ উক্তি: বিপ্লব কোনও ভোজসভা নয়। সূচিশিল্প বা প্রবন্ধ রচনা নয় । রণজয় তার পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকে জানে:

    বিপ্লবের পথে শ্রেণি শত্রুরা ছাড়াও মেকি বিপ্লবী ও দালাল গুপ্তচরদের বাধা থাকবেই- সেই কাউটস্কি, বার্নস্টাইন থেকে শুরু করে মেনশেভিক জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, বুখারিন, ট্রটস্কি, লি শাও চিদের কথা ভুললে চলবে না। ভুললে চলবে না ডাঙ্গেচক্র, নয়া সংশোধনবাদী ও খোকনচক্রের কথা।

    তবে রণজয় যাদের শোধনবাদী পণ্ডিত বলেছে তাদের বই থেকেও প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণের বিষয়ে কোনো ছুৎমার্গ দেখায়নি। ইতিহাসবিদ সুশোভন সরকারের কথা এখানে এসেছে। বস্তুতপক্ষে, যুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলার এক বিরাট পাঠ-প্রস্তুতির তালিকা হাজির করেন নবারুণ। ছেলে কোবা পড়বে এ সব বই প্রস্তুত হবে আগামী এক যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য এমনই ভাবে রণজয়:

    কোবা বড় হয়ে দুনিয়া কাঁপানো দশদিন পড়বে। চাপায়েভের গল্প পড়বে। ধীরে বহে সাগরে মিলায়ে ডন পড়বে। পড়বে ডাইসন কার্তার এর সোভিয়েত বিজ্ঞান, লিও কিয়াচেলি নতুন দিনের আল্‌ ডিয়ানা লেভিন এর সোভিয়েত রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা, দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ছোটদের সোভিয়েত, তিন খণ্ডে অমল দাশগুপ্ত, রবীন্দ্র মজুমদার ও অনিল কুমার সিংহের অনুবাদে ১৯৪২ সালের স্ট্যালিন পুরস্কার পাওয়া পারীর পত্‌ লু সুন, লাও চাও, তিৎ লিঙ ও অন্যান্য পাঁচজনের লেখা এগারোটি গল্প নীহার দাশগুপ্তের অনুবাদে গোর্কির নবজাতক…



    ছাত্র কৌশিককে ইতিহাসের তরুণ শিক্ষক রণজয় পাঠক্রমের বাইরে গিয়েই এক ব্যাপ্ত জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল পড়তে দিয়েছিল অনেক বই:

    রণজয় কৌশিককে একটার পর একটা বই পড়তে দিত। ঘন্টার পর ঘন্টা ওকে যুদ্ধের গল্প স্তালিনগ্রাদ লং মার্চ ভিয়েতনাম কিউবার মুক্তিযুদ্ধ বর্ণনা করে যেত।

    রণজয়ের স্মৃতি আর সত্তার মধ্যে সংযোগের উপায় হিসেবে রাস্তা থেকে খুঁজে পাওয়া মানুষটিকে অনেক দিন আগে তারই দেওয়া বইগুলি দেখানোর কথা ভাবে কৌশিক:

    কৌশিকের মনে হল রণজয়দার সই করা একটা বই নিয়ে গিয়ে বলবে যে বইটা চিনতে পারছে কিনা। যেমন, ভিলহেলম লিবনেখত এর ‘অন দা পলিটিকাল পোজিশন অফ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি’ বা কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে ক্লারা সেৎকিন-আমার স্মৃতিতে লেনিন অথবা রিডার্স গাইড টু দা মার্কসিস্ট ক্লাসিকস -মরিস কনফোর্থের -লরেন্স অ্যান্ড উইশার্ট লিমিটেড, ১৯৫৩ বা গিওর্গি দিমিত্রভের ইউনাইটেড ফ্রন্ট অব দা ওয়ার্কিং ক্লাস এগেন্সট ফ্যাসিজম।

    একটি বিপ্লব প্রচেষ্টা শত্রুর আক্রমণ ও অন্যান্য কারণে কিছুটা পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এ জন্যই যারা নকশালবাড়ি আন্দোলন তথা ভারতে বিপ্লব প্রচেষ্টার পোস্টমর্টেম শুরু করে দিয়েছিলেন, নবারুণ বা তার উপন্যাসের নায়ক রণজয় তাদের বিপ্রতীপ মেরুতে অবস্থান করেন। বাস্তবের মাটিতেও আমরা দেখেছি সত্তরের ব্যর্থতা ও ভুলগুলি থেকে নিজস্ব নিজস্ব বিশ্লেষণ অনুযায়ী শিক্ষা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু দৃপ্ত বলিষ্ঠতায় বিপ্লবী গণ আন্দোলনগুলি গড়ে উঠছে বিহারের আরা ভোজপুরের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত হিন্দি বলয়ে অন্ধ্রের বারুদ বিস্ফোরিত হচ্ছে আদিবাদী বাসভূমিগুলিতে। গণ আন্দোলনের ঢেউয়ে ঢেউয়ে রাষ্ট্রের দমন-পীড়নকে উপেক্ষা করে নকশালবাড়ির শপথকে তেভাগা তেলেঙ্গানার উত্তরাধিকারকে মনে রাখা হচ্ছে। এজন্য দরকার ছিল সত্তরের ধাক্কার পর সংহত হওয়ার তৈরি হওয়ার জেদটা। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনকেও এরকম ধাক্কা ও পুনর্গঠনের পর্বের মুখোমুখি হতে হয়েছে। চিনে সাংহাই বিপর্যয়ের পর বা রাশিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলনের সাময়িক স্থিতাবস্থার পর এরকম পরিস্থিতি এসেছিল। পিছু হঠার জন্য নয় নতুন শুরুর প্রস্তুতির জন্যই বিপ্লবী আন্দোলনে কখনো কখনো ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড টু স্টেপ ব্যাক জাতীয় কৌশলের দরকার হয়। এই উপন্যাসে লেনিনের শিক্ষাকে সরাসরি সামনে আনা হয়েছে আগামী দিনে রাষ্ট্র ও বিপ্লবের আরেকটি নতুন অধ্যায় লেখার জন্যই:

    পৃথিবীব্যাপী বিপ্লবের প্রথম জলোচ্ছ্বাস সরে গেছে। দ্বিতীয়টি এখনো ওঠেনি। এ বিষয়ে কোনোরকম বিভ্রম পোষণ করা আমাদের পক্ষে বিপজ্জনক হবে। আমরা সম্রাট জারেক্স নই যিনি সমুদ্রকে শেকল দিয়ে আঘাত করতে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনা পরম্পরাকে এইভাবে বোঝার অর্থ কি চুপ করে বসে থাকা অর্থাৎ লড়াই পরিত্যাগ করা। আমাদের তৈরি হতে হবে খুব ভালো করে তৈরি হতে হবে যাতে ভবিষ্যতে বিপ্লবের ঢেউ এলে তাকে সজ্ঞানে ও সবলে সম্যকভাবে কাজে লাগাতে পারি।

    লেখকঃ সৌভিক ঘোষাল
  • /\ | 69.160.210.3 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৯:৪৪644895
  • সন্ধেবেলার ঝাল চানাচুর কিংবা মিয়োনো চিঁড়েভাজা...
    -------------------------------------------------সৌপর্ণ অধিকারী

    মুজতবা আলী একবার বলেছিলেন, জার্মানিতে গ্যেটে প্রতিবিম্বিত হয়েছিলেন হাইনরিখ হাইনের আরশিতে...

    এভারেস্ট মাপতে সে যুগে যেরকম ছায়ার অতিভুজ থেকে ট্রিগোনোমেট্রির অঙ্ক করতে হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই মনে হয়, সব লেখক, সব স্রষ্টাকেই মাপার জন্য, স্কেল করার জন্য একটা রেফারেন্স ফ্রেমের দরকার হয়...

    ঊনবিংশ শতকে দ্বারকানাথ ঠাকুরের "ঋণং কৃত্বা স্কচ পিবেৎ" ফাঁপা আভিজাত্য থেকে বেরিয়ে এসে কাজ শুরু করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ... পরবর্তীকালে ছেলে রবীন্দ্রনাথের আরশিতে একসাথে ধরা পড়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর এবং রামমোহন (বেঙ্গল রেনেসাঁর গোড়ার তিন সুতো)...

    রবীন্দ্রনাথকে মাপার জন্য বোধহয় সময়ের থেকে ভালো আরশি আর কিছু হতে পারে না...

    দুর্ভাগ্য মুজতবা আলী বা নবারুণ ভট্টাচার্যকে মাপার রেফারেন্স ফ্রেমটাই আমাদের হাতে নেই...

    মুজতবা আলী নিয়ে বাংলার গবেষকরা পাতার পর পাতা গবেষণাপত্র ছাপিয়ে ফেলেছেন... এই অধম (দুর্ভাগ্যবশতঃ) বিজ্ঞানের ছাত্রের ওপথ না মাড়ানোই ভালো...

    রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিকতার শ্রেষ্ঠ চেহারাটা... এবং সেই প্রাতিষ্ঠানিকতা পরবর্তীতে প্যাঁ-পোঁ রবীন্দ্রসঙ্গীত "বিশেষ অজ্ঞ"দের হাতে পড়ে কোন লেভেলে যেতে পারে, সেটাও...

    নবারুণ প্রতিষ্ঠানের ধার ধারেননি... এমনকী, সাধারণভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরোধিতা করাটাও যেভাবে প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে, সেই দিকটারও নয়...

    প্রসঙ্গতঃ, পশ্চিমবঙ্গে নাকি যা না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয় (মতান্তরে পড়তে হয় না, পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয়), সেই বহুল প্রচারিত প্রথম সারির সংবাদপত্র গোষ্ঠীও প্রাতিষ্ঠানিকতা-প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা -দুটো বেচেই খায়...

    কাজেই এই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাটাও বেসিক্যালি ঘুরিয়ে নাক দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়...

    সভ্য-শিক্ষিত বাঙালি সমাজের বোধহয় মুখের ভাষায় যেটা বেরোয়, সেটা ছাপার অক্ষরে দেখতে এখনো বুক ফাটে... কাজেই, মূলধারার সাহিত্যে সমসাময়িক কথ্য ভাষার অভাবটা যথেষ্টই প্রকট... রাবীন্দ্রিক হ্যাংওভার...

    ঠিক এই জায়গাটাতেই হালকা করে টোকা মেরে যান নবারুণ... নাকের সামনে আয়না ধরে ১৫ দিনের না-কাটা দাড়ি দেখানোর ক্ষমতা সবার থাকে না... বিশেষতঃ, এই ফেয়ারনেস ক্রিমের বাজারে...

    খালাসিটোলার গন্ধ, কলাবাগানের গোরুর কাবাবের রেসিপি, রাজাবাজারের জবাইখানা, মেডিক্যাল কলেজের মর্গের পেছনের বস্তি, খিদিরপুরের জাহাজিপাড়া এবং তার সাথে কলকাতা শহরে কোনমতে জোটানো বাইক, সাইকেল, স্কুটার, বাস, ট্রাম চেপে ঘোরা মানুষের ঘামের গন্ধ, ঘরফেরতা মজুরের মুখের এক-মাইল দূর থেকে পাওয়া দেশি মদের গন্ধ- বাদ দিয়ে কলকাতা হয় না...

    পৃথিবীতে মনে হয় না, এমন কোনো শহর আছে, যেখানে জীবন আর সাজানো সভ্যতা পাশাপাশি চলেছে...

    সাহিত্যের দরবারে এই জীবনটারই একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন নবারুণ... "ফায়ারম্যান" লেখার ক্ষমতা সবার থাকে না...

    কিংবা আর্নেস্ট ম্যান্ডেল থেকে নিকোলাই কন্দ্রাতিয়েফ পর্যন্ত যাতায়াতও সবার থাকে না...

    ** গ্যেটে = গোয়্থে
    http://www.guruchandali.com/guruchandali.Controller?portletId=8&porletPage=2&contentType=content&uri=content1446035809322
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১৩:১৮644896
  • আখ্যান - ১
    নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্ট : আলোচনাপত্র
    মার্চ ১৯৯৬
    সম্পাদনা : আফসার আমেদ, অনিশ্চয় চক্রবর্তী

    ১। আখ্যান প্রসঙ্গে দু-চার কথা - রামকুমার মুখোপাধ্যায়
    ২। সংকলন কেন - আফসার আমেদ, অনিশ্চয় চক্রবর্তী
    ৩। "হারবার্ট" - বাংলা উপন্যাসে নতুন ধারা - শুভময় মন্ডল
    ৪। সংযোজন - শিলাদিত্য সেন
    ৫। "হারবার্ট" - পাঠান্তরে - সাধন চট্টোপাধ্যায়
    ৬। সংযোজন - নলিনী বেরা
    ৭। "হারবার্ট"-এর চরিত্র চিত্রণ - স্বপ্নময় চক্রবর্তী
    ৮। সংযোজন - অনিশ্চয় চক্রবর্তী
    ৯। "হারবার্ট" - পঞ্চভৌতিক উল্লাস - সুব্রত মুখোপাধ্যায়
    ১০। সংযোজন - তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
    ১১। "হারবার্ট" প্রসঙ্গে - নবারুণ ভট্টাচার্য
    ১২। নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথাবার্তা - দেবেশ রায়
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১১:১০644897
  • প্রসঙ্গ নবারুণ
    ক্যানেস্তারা
    সম্পাদক : প্রত্যুষ বন্দ্যোপাধ্যায়
    শীত প্রকাশ, ২০১৫
    ২০ টাকা

    ১। প্রসঙ্গত - প্রত্যুষ বন্দ্যোপাধ্যায়
    ২। ঋত্বিককে খুন করা হয়েছে - এটা আমরা যেন না ভুলি - নবারুণ ভট্টাচার্য (অডিও থেকে লিপিবদ্ধকরণ : সুরঙ্গমা চট্টোপাধ্যায়)
    ৩। বিষয় 'হারবার্ট' - অমিতাভ দেব চৌধুরী
    ৪। যে মশাল আলো দেখায় - শুভঙ্কর দাশ
    ৫। গেরিলা যুদ্ধের সেনাপতি - অগ্নি রায়
    ৬। নবারুণ : একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি - দেবাশিস ঠাকুর
  • /\ | 69.160.210.3 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১৯:২৭644898
  • কালের কষ্টিপাথর
    ৩য় বর্ষ ৩য় সংখ্যা সেপ্টেম্বর ২০১৪ আশ্বিন ১৪২১

    ১। নবারুণ অস্তাচলে
    ২। নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস - রাহুল দাশগুপ্ত
  • /\ | 127.194.201.201 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১৩:৪১644900
  • নবান্ন ২৫ বর্ষ, বইমেলা সংখ্যা ১৪২১
    ১। সম্পাদকীয়
    স্মরণঃ নবারুণ ভট্টাচার্য
    ২। নবারুণ ভট্টাচার্যের দুটি কবিতা ('অমর প্রদীপ" ও "Time Scale - তেভাগা / নক্সাল")
    ৩। নবারুণ ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার ("লালগড়ের সমস্যা আসলে আভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের সমস্যা" - অমিত দাশগুপ্তের সাথে কথাবার্তা)
    ৪। A Writer's Mission - Nabarun Bhattacharya (Abstract of the paper presented at business session II of the seminar on 19 February, 2010)
    ৫। নবারুণ (কবিতা) - অভিজিৎ মজুমদার
    ৬। আমৃত্যু নবারুণের চেতনায় জাগরুক ছিল সত্তর - প্রণতি ভট্টাচার্য
    ৭। একটি কমিউনিস্ট পার্টি ও নবারুণদা - অমিত দাশগুপ্ত
    ৮। নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখালেখি - রাজীব চৌধুরী
    ৯। সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য - শর্মিষ্ঠা রায়
    ১০। নবারুণ ভট্টাচার্য প্রসংগে - অশোক চট্টোপাধ্যায়
    ১১। নবারুণ ভট্টাচার্যঃ পাঠ পাঠক্রমের খাসড়া - বিমল দেব
    ১২। কমরেড নবারুন - অনীক রুদ্র
    ১৩। নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস সমগ্র - অনিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
    ১৪। নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্প - অপূর্ব বিশ্বাস
    ১৫। নবারুণদা - প্রণয় কৃষ্ণ
    ১৬। ভয় - নির্মাল্য রায়
    ১৭। আমার দাদা নবারুণদা - মিতা দাস
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন