এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • সর্ষেঃ অন্যভাবে, অন্যরকম লাদাখ

    সিকি লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ১২ জুন ২০১৫ | ২৪৪০১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শঙ্খ | 127.194.242.158 | ১৪ জুন ২০১৫ ২০:১৮678812
  • শেরিল স্ট্রেইডের ওয়াইল্ড (https://www.goodreads.com/book/show/12262741-wild) মনে পড়ে যাচ্ছে (বইটা পড়ুন, সিনেমাটা বড়ই আর্টিফিসিয়াল হয়েছে)। একা একটি মেয়ের PCTবা প্যাসিফিক ক্রেস্ট ট্রেইল হাইকিং (হাজার মাইলের ওপরে পথ) এর বিবরণ। সেখানে শেরিল একটা মস্ত বড় ব্যাগে প্রচুর জিনিসপত্র ভরে জার্নি স্টার্ট করে যার ওজন আর বেঢপ সাইজে তাকে কুঁজো হয়ে পথ চলতে হয়।
    চলা শুরু করার পরে জুতোর ঘষা খেয়ে শেরিলের পা রক্তারক্তি হয়ে যায়, খসে যায় পায়ের নখ। সিকির এখনো অবধি হাতের নুনছাল উঠেছে।
    শেরিলের গল্প শুরু হয় একটা পাহাড়ে ওঠার সময় একপাটি জুতো খুলে নিচে খাদে পড়ে যাওয়া দিয়ে, আরেকপাটি সে ছুঁড়ে মারে নিষ্ফল আক্রোশে। সিকি শুরু করলো পাঁচ লিটারের জেরিক্যানের শহীদ হয়ে যাওয়া দিয়ে।

    বেশ পাল্লা দিয়ে দুজনের ট্রাভেলগ চলেছে, কি বলেন?

    একটা তফাৎ, শেরিল তার ব্যাগের নাম দিয়েছিল 'মনস্টার'। আর সিকির ব্যাগের নাম 'সতীশ শাহের মৃতদেহ'।

    লা জবাব শেরিল সিকি!
  • শ্রী সদা | 24.99.76.255 | ১৪ জুন ২০১৫ ২০:২৪678813
  • জ্জিও কাকা। চলুক, চলুক।
  • সিকি | ১৪ জুন ২০১৫ ২২:১৪678814
  • থেঙ্কু :) থেঙ্কু সবাইকে, খেয়ে উঠে বসছি।
  • dd | 116.51.131.188 | ১৪ জুন ২০১৫ ২২:৩২678815
  • আ মোলো যা। আবার খাওয়ার কি দরকার? না খেলেই নয়?

    এইসব তুচ্ছু তামোসিক ব্যাপার যতো কম থাকে ততোই ভালো।
  • kumu | 11.39.34.59 | ১৪ জুন ২০১৫ ২২:৪৯678816
  • ইকি একটা মানুষ খাবে না?
    সিকি ,এদের কথা শুনো না।ভাল করে খাও।কাছে হলে আমার অলৌকিক পটলের দোলমা পাঠিয়ে দিতাম।
  • | 24.99.51.19 | ১৪ জুন ২০১৫ ২২:৫৩678817
  • অলৌকিক পটলের দোরমা!! বলো কী কুমু দি!! ঃ)
  • সিকি | ১৪ জুন ২০১৫ ২২:৫৫678818
  • না, মেটেচচ্চড়ি বানিয়েছিলাম। খেয়ে উঠলাম, সাথে আলুকুমড়োর ছেঁচকি।
  • SS | 172.234.120.18 | ১৪ জুন ২০১৫ ২২:৫৮678819
  • ঃ)) DD
    সত্যি, খাওয়াদাওয়া করার কী দরকার!

    দারুন লাগছে পড়তে! এভাবে একা বেরিয়ে পড়ার মজাই আলাদা। প্রথম প্রথম একটু আনাড়ি লাগে। বার দুয়েক পরে অভ্যস্ত হয়ে গেলে কেমন নেশা হয়ে যায়।
  • সিকি | ১৫ জুন ২০১৫ ০০:২৬678820
  • ঘড়িতে প্রায় দুটো বাজে। জালন্ধর আরও পঞ্চাশ কিলোমিটার। একটা দোকান দেখে সেখানে জলের বোতল কিনলাম। নিমেষের মধ্যে শেষ করে ফেললাম এক লিটার জল। খানিক স্বস্তি পেয়ে বাইকের স্পিড বাড়ালাম। দেখতে দেখতে এসে গেল জালন্ধর সিটি। এইখান থেকে ডানদিকে টারন নিতে হএ জম্মুর জন্য। সোজা রাস্তা ঢুকে গেছে শহরের মধ্যে। ডানদিকে পরের মাইলস্টোন দেখাচ্ছে, পাঠানকোট। একশো কিলোমিটার। দুটো বেজে গেছে, খাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই, তবুও, খালিপেটে যাওয়া ঠিক নয়। একটা ভদ্রগোছের খাবার জায়গা দেখতে হবে।

    জালন্ধর শহরের সীমা পেরোতেই শহুরে ভাবটা কমে এল। চারপাশে ফসলের ক্ষেত, সাধারণ দোকানপাট, নয় তো কিলোমিটারের পর কিলোমিটার ফাঁকা রাস্তা। ছশো কিলোমিটারের দুই তৃতীয়াংশ মেরে দিয়েছি। বাকি আর দুশো মত কিলোমিটার।

    একটা ছোট ধাবা মত জায়গায় গাড়ি থামালাম। লোকটা গড়গড় করে বলে গেল কী পাওয়া যাবে - রাজমা চাওল, কঢ়ি চাওল, ছোলে চাওল ... পনীরের তরকারিও পাওয়া যাবে। তাই সই। ভাত আর পনীরের তরকারি।

    ভাত এল, মুখে দেওয়া যায় না এমন অখাদ্য তার টেস্ট। কোনওরকমে খানিক পেটে ঢোকালাম। জগে করে জল দিয়েছে, তার মধ্যে কোথা থেকে কে জানে, একখণ্ড বরফের ডেলা দিয়ে দিয়েছে জল ঠাণ্ডা রাখার জন্য। বরফের ডেলাটা কোথায় রাখা ছিল কে জানে, গুচ্ছখানেক কালো কালো নোংরা ভেসে বেড়াচ্ছে জলের ওপর। তাই দিয়েই কোনওরকমে খাচ্ছি, আঙুলের ডগায় ডগায় ব্যথা, ভাত মাখতে পর্যন্ত অসুবিধে হচ্ছে।

    খেতে খেতে হঠাৎ দেখি, খুব কাছেই ট্রেনের আওয়াজ। তার পরেই দেখি রাস্তার ঠিক উল্টোদিক দিয়ে কুঝিকঝিক করে ছুটে চলেছে একটা ট্রেন। পাঠানকোটের দিকে।



    খেয়ে উঠে আবার এক বোতল জল কিনলাম। দড়ি খুলে আবার লাগেজ বাঁধলাম। প্রত্যেকবারের মতই এবারেও মনে হল, এইবারে বুঝি ঠিকমত বাঁধা হয়েছে। ... নিজের তো খাওয়া হল, এইবারে বাইককে খেতে দিতে হয়। সোয়া চারশো কিলোমিটার চলে এসেছি, সঙ্গের পেট্রলের ক্যান তো রাজপথকে উৎসর্গ করে এসেছি, এইবারে তেল ভরতে হবে।

    পেট্রল পাম্পের কমতি নেই এই রাস্তায়। খানিক এগোতেই পাম্প পেলাম, ট্যাঙ্ক ফুল করিয়ে নিলাম। শেডের ছায়ায় খানিক দাঁড়িয়ে ভাবলাম, একটু চকলেট খাই, এনার্জি আসতে পারে। চকলেট খেয়ে জল খাই।

    ছোট ছোট ক্যাডবেরিজের প্যাকেট নিয়ে বেরিয়েছিলাম, রাস্তায় খাবার জন্য। একটা প্যাকেট খুলতে গিয়ে দেখি, প্রচণ্ড গরমে ভেতরে সব ক্যাডবেরি গলে জল হয়ে গেছে। চেটে চেটে কোনওরকমে খেলাম। চারটে বাজে। এইবারে রোদ পড়ছে, আর ততটা অস্বস্তি হচ্ছে না, কিন্তু হাতের আঙুলে ভীষণ ঝিঁঝি ধরার মত অনুভূতি হচ্ছে। হাতের গায়ের ব্যথা তো আছেই।

    না, লাগেজ আর সে রকম ঝামেলা করল না। আস্তে আস্তে পাঠানকোটের দিকে এগোতে থাকলাম।



    বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এসে পৌঁছলাম জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের মুখে। এখান থেকে আরো একশো কিলোমিটার দূরে গেলে জম্মু সিটি। সুন্দর মসৃণ রাস্তা।



    সন্ধ্যে প্রায় সাতটার সময়ে জম্মু শহরে এন্ট্রি নিলাম। এইবারে হোটেল খুঁজতে হবে। কিন্তু, হাইওয়ের ধারে তো কোথাও কোনও হোটেল দেখছি না! একটা পুলিশকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, বাসস্যান্ডের কাছে অনেক হোটেল আছে। অতএব চলো বাসস্ট্যান্ডের দিকে।

    প্রচুর এই রাস্তা, সেই রাস্তা, মাঝে ভুল ইনপুট পেয়ে বাজারে দোকানে গাড়িতে বাইকে জ্যামজমাট একটা দীর্ঘ গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে খানিক গোলোকধাঁধার মত ঘুরপাক খেলাম, তারপরে আবার দিক ঠিক করে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। প্রথমেই চোখে পড়ল, কী একটা যেন, যাত্রী নিবাস। রুম আছে? আছে, তবে এসি রুম, সাড়ে তেরশো টাকা ভাড়া।

    আমার তখন যা অবস্থা, দু হাজার চাইলেও আমার আর না করবার ক্ষমতা ছিল না। ছশো কিলোমিটার চলেছি, এই উচ্চণ্ড গরমে। এখনও জিভ নাড়াতে পারছি না। ঘড়িতে কাঁটা রাত সাড়ে আটটা পেরিয়ে পৌনে নটার দিকে এগোচ্ছে। রুম বুক করে নিচে নেমে এলাম, লাগেজ খুলতে হবে। দড়িদড়া খোলাপড়া - সারাদিনের শেষে এখন আমার কাছে জলভাত।

    জামাকাপড় বদলে খাটের ওপর চিত হলাম। এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় আস্তে আস্তে শরীরে সাড় আসতে লাগল। হিসেব করলাম, সারাদিনে প্রায় সাত বোতল, মানে সাত লিটার জল খেয়েছি। একবারও টয়লেট যাই নি।

    গ্লুকোজ এনেছিলাম, একটা গ্লাস চেয়ে নিয়ে গ্লুকোজ জলে গুলে পর পর তিন গ্লাস খেলাম। টয়লেট পেল এইবারে।

    ফ্রেশ হয়ে বাইরে থেকে একটা লে'জ-এর প্যাকেট আর একটা কোকের বোতল নিয়ে এলাম। এই দিয়েই আজ ডিনার সারি, আর বেশি কিছু খাবার ইচ্ছে নেই। কাল আবার সকাল সকাল বেরোতে হবে। সিকিনীকে ফোন করলাম। খেয়ে দেয়ে কম্বলটা টেনে নিলাম। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে।

    কিন্তু, ঘুমোতে পারছি না কেন? জীবনে প্রথম, সারাদিন এই রকম বাইক রাইডিং-এর পর রাতেও তার হ্যাংওভার কাটছে না। চোখ বুজলেই খালি মনে হচ্ছে, আমি বাইক চালাচ্ছি, আর এই সামনে একটা ট্রাকে গিয়ে বোধ হয় সপাটে ধাক্কা মারলাম। চোখ খুলে গেল, কই, না তো! আমি তো বাইক চালাচ্ছি না, আমি তো বিছানায় শুয়ে আছি। ... আবার চোখ বুজলাম, আবার মনে হতে লাগল, ফোকাস সরে যাচ্ছে, আমি চোখ বুজছি কেন? পেছন থেকে প্রচণ্ড গতিতে একটা ট্রাক ছুটে আসছে ... আমি চোখ বুজলেই ও আমাকে পিষে দিয়ে বেরিয়ে যাবে, চোখ বুজলে চলবে না, ওয়েক আপ, সিকি, ওয়েক আপ, আবার চমকে জেগে ওঠা, না তো, আমি তো হোটেলের বিছানায়, সুন্দর এসি চলছে, গরম নেই একটুও। আবার চোখ জুড়িয়ে আসছে, আবার ট্রাকেরা এগিয়ে আসছে আমাকে পিষে ফেলার জন্য ...

    কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। সকাল সাড়ে ছটায় ঘুম ভেঙে গেল, জানলা দিয়ে দেখি, আকাশে কালো মেঘ, রিমঝিমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে।

    এসিটা বন্ধ করে উঠলাম বিছানা ছেড়ে।

    আমার একলা জার্নির আজ দ্বিতীয় দিন শুরু হল।
  • Arpan | 125.118.152.218 | ১৫ জুন ২০১৫ ০০:৩৯678822
  • যা তা।
  • pharida | 11.39.32.46 | ১৫ জুন ২০১৫ ০৭:৪২678823
  • অসাধারণ। বারবার পড়ার মতো।
  • oishik | 47.228.105.168 | ১৫ জুন ২০১৫ ০৮:২৪678824
  • durunto
  • | 183.17.193.253 | ১৫ জুন ২০১৫ ০৮:৪২678825
  • আমি আবার এই জম্মু পৌঁছে যাবার আগে পর্যন্ত ভাবছিলাম,কাহিনীতে টুইস্ট আসবে- সুখদীপ নির্ঘাত মাঝরাস্তায় যোগ দেবেঃ)

    হাত চালাও।
  • Bratin | 122.79.36.71 | ১৫ জুন ২০১৫ ০৯:০৩678826
  • "সিকি দিনে দুবার টয়লেটে যায়" ঃ প্রাচীন অরণ্য প্রবাদ। ঃ))

    জোকস অ্যাপার্ট দুরন্ত হচ্ছে সিকি। তোমার সাথে সাথে আমরাও নিজেদের উত্তেজনার আচে সেকে নিচ্ছি ( নো চন্দ্রবিন্দু)
  • একক | 24.99.34.201 | ১৫ জুন ২০১৫ ১১:১৬678827
  • বাঞ্জি কর্ড আর নাইলন দড়ি গুলিয়েছ শুনে এট্টু খ্যাকখ্যাক হাসলুম। দারুন লেখা হচ্ছে ,চলুক ! :)
  • Rit | 213.110.246.25 | ১৫ জুন ২০১৫ ১১:৫৩678828
  • সিকি দা,
    ফাটিয়ে দিচ্ছো। চলুক।
  • ন্যাড়া | 109.72.224.255 | ১৫ জুন ২০১৫ ১২:৪৩678829
  • Zen and the art of motorcycle maintenance আজকাল আর কেউ পড়ে না? এরপরে কেউ বাইকে লম্বা টুর করলে পড়ে নিতে রেকো দিই।
  • aranya | 154.160.226.92 | ১৫ জুন ২০১৫ ২৩:৩৬678830
  • ব্যাপক লাগছে পড়তে। সিকি-র বহুদিনের সযত্নলালিত এক স্বপ্ন পূরন হয়েছে, এটা একটা দারুণ ব্যাপার।
    স্বপ্নপূরণ তো জীবনে খুব একটা ঘটে না
  • sm | 233.223.159.253 | ১৫ জুন ২০১৫ ২৩:৫২678831
  • মহায়, এত অপেক্ষা করালে হয়? আমাদের অন্য কাজও তো আছে, নাকি? কতবার আর পাতা রিফ্রেশ করব?
  • aranya | 154.160.226.92 | ১৫ জুন ২০১৫ ২৩:৫৮678833
  • এই যে সিকি, লাদাখ ঘুরে এল, আর এ অধমের অ্যা-আফ্রিকা যাওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হচ্চে না। সিকি-র লেখা পড়তে ভাল লাগচে, আবার নিজের জন্য হাল্কা করে মন খারাপ-ও হচ্চে ( ঈর্ষা নয় বলেই মনে হয়, বাট হু নোজ, মনের গহনে কি আছে কে বলতে পারে)।

    তো এ টই-তে ভ্রমণ গরিমা বা অ্যাডভেঞ্চার গরিমা প্রকাশ পাচ্ছে বলে কি সিকি-কে লিখতে নিষেধ করব?

    তাপসের উদ্দেশ্যে এ প্রশ্ন রাখলাম। গরিমা-কে নিন্দা করতে হলে শুধু ধনগরিমা-র নিন্দে করলে কি চলবে, অন্য গরিমারা তো বানের জলে ভেসে আসে নি :-)
  • সিকি | ১৬ জুন ২০১৫ ০৭:৫৫678834
  • ছাঃ চাঃ। কাল সারাদিন সময় পাই নি। দু সপ্তাহ ছুটিতে থেকে অনেক কিছুতে পিছিয়ে পড়েছি।

    আজ লিখছি।
  • Bratin | 122.79.36.78 | ১৬ জুন ২০১৫ ০৮:৫৫678835
  • হোক হোক
  • সিকি | ১৬ জুন ২০১৫ ১০:৩৮678836
  • ৩১শে মে ২০১৫ - দ্বিতীয় দিন

    হোটেল থেকে বাইরে এলাম। কাল রাতে এদের রিসেপশনের কাচের ঘরের ভেতর মোটরসাইকেলটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। ঠিকঠাকই আছে। বেরিয়ে পড়ার জন্য তৈরি সে, কিন্তু আমার গায়ে আঙুলে প্রচণ্ড ব্যথা। ... সে তো হবারই ছিল, প্রথম দিনেই এক ধাক্কায় এতটা পথ, তার ওপরে এতবার করে লাগেজ খোলা বাঁধা, মানসিক প্রস্তুতি যতই থাক, শারীরিক প্রস্তুতি তো আমার শূন্যের ঘরে, সে তো আমি জানি। কখনও কোনওরকমের ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করি নি, ভারি জিনিস বলতে বাজারের ব্যাগ তোলা-নামানো করেছি। তার বাইরে তো কিছুই করি নি কখনও। ভোলিনি স্প্রে লাগিয়ে শুয়েছিলাম কাল রাতে, তাতে একটু সীমার মধ্যে আছে ব্যথা, কিন্তু পুরোপুরি তো এক রাত্রে যাওয়া সম্ভব নয়। এখন পর পর চারদিন জার্নি, তারপরে রেস্ট মিলবে। আজ দ্বিতীয় দিন। আজ আর অতটা নয়, কালকের থেকে কম পথ। তিনশো কিলোমিটার, অতএব একটু দেরি করে বেরোলেও চলতে পারে, তবে কালকের পুরো পথটাই ছিল সমতলের পথ, আজ পুরো পাহাড়ী পথ, কালকের মত স্পিড উঠবে না।

    আকাশ মেঘলা। সামনে রাস্তার অন্য পারে ফলবিক্রেতারা বসেছে তাদের ঝাঁকা নিয়ে। টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছে। কালকের শুকনো গরমের সঙ্গে আজকের সকালের কোনও মিল নেই। রিসেপশনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বৃষ্টি কি এখানে রোজই হচ্ছে, নাকি আজই প্রথম হল? লোকটা জানাল, কাল রাত থেকেই মেঘ হয়েছে, আজই প্রথম বৃষ্টি হল। চিন্তার কিছু নেই, কমে যাবে।

    তা কমে গেল। আটটা নাগাদ আকাশ ফর্সা হতে শুরু করল, বৃষ্টি ধরে গেল। আমি জামাকাপড়ের ওপরে রেনস্যুট চাপিয়ে নিচে গেলাম লাগেজ বাঁধতে।

    ভায়াটেরার লাগেজ ব্যাগ আজ খুব সহজেই লেগে গেল। স্ট্র্যাপগুলো কোনখান দিয়ে গলিয়ে কোনখানে বেল্টে লাগালে ওটা শক্তপোক্তভাবে লেগে যায়, সেটা এইবারে বুঝে নিয়েছি। কাল ব্যাগটা লাগিয়েছিলামই ভুলভাবে, তাই দুটোই ঝামেলা করছিল। অন্তত একটা ব্যাগের ঝামেলা তো মিটল। এইবারে এর ওপরে দ্বিতীয় ব্যাগটা। সেই নাইলন দড়ি, সেই ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন, সেই বাঁধা শেষ হবার পরে দেখা - যে প্রান্ত থেকে কষে বাঁধা শুরু করেছিলাম, সেইদিকটা লুজ হয়ে ঢলঢল করছে, অতএব, সেদিকেও আবার খুলে কষে বাঁধা।

    পৌনে নটা নাগাদ স্টার্ট করলাম। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে উঁকি মারছে নীল রঙ, যে নীল দিল্লিতে দেখা যায় না। সূর্যের ঝিলিক আসছে তার মধ্যে দিয়ে, কিন্তু সে ঝিলিকে আজ তেমন তাপ নেই। একটু এগোতেই জম্মু শহরের বাইরে এসে পড়লাম, চমৎকার হাইওয়ে শুরু হল। একেবারে এক্সপ্রেসওয়ে। পাহাড় কেটে ঢেউখেলানো রাস্তা, ঠিক যেমন বিদেশে দেখা যায়, পিন পড়লে কুড়িয়ে নেওয়া যায় এত ঝকঝকে। দুধারে লালচে খয়েরি রঙের পাহাড়, অল্প অল্প উঁচু আভাস দিচ্ছে আসল হিমালয় খুব বেশি দূরে নেই। বাইক উড়িয়ে দিলাম। এটা টোল রোড, তবে টু হুইলারের জন্য কোনও টোল নেই।



    ঘণ্টাখানেক চলার পরে রাস্তার ধারের একটা দোকানে থামলাম কিছু খেয়ে নেবার জন্য। লাগেজের দিকে তাকিয়ে মনে হল ঠিকঠাকই আছে বাঁধা। খেয়েদেয়ে আবার শুরু করলাম। যতক্ষণ খাচ্ছিলাম ততক্ষণে উৎসুক জনতার ভিড় জমতে শুরু করেছিল বাইক ঘিরে, বেশির ভাগ ট্যুরিস্ট, কিছু লোকাল ড্রাইভার, তবে প্রশ্ন শুরু হবার আগেই আমি স্টার্ট দিলাম বাইকে। আবার ওড়া শুরু।



    হাল্কা ছোট ছোট দুটো টানেল এল। কী সুন্দর আলো দিয়ে সাজানো। তার পরে টোল বুথও এল, আমি পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।



    সামনে বোর্ডে বড় বড় করে লেখা কাটরা-উধমপুর-পাটনিটপ-শ্রীনগর, সঙ্গে একটা সোজা তীরচিহ্ন। কী রকম সন্দেহ হচ্ছিল, কাটরা তো বৈষ্ণোদেবী যাবার রাস্তা, সেটা তো শ্রীনগরের পথে পড়ে না, ওটা তো জম্মু থেকে অন্য রুট! আমি ২০০১ সালে বৈষ্ণোদেবী গেছিলাম। যাই হোক, যেতে যেতে এক সময়ে দেখি, রাস্তার ভালোত্ব কমে এল, তারপরে রাস্তা সরু হয়ে ভাঙাচোরা পথ, আর কোথাও কোনও সাইনেজ নেই। রাস্তা বাম্পি হতেই পেছনে ব্যাগের নাচন শুরু হল, ফলে মাঝে আবার দু-দুবার থেকে ব্যাগ শক্ত করে বাঁধতে হল। কীভাবে যে আলগা হয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই বুঝতে পারছি না। হাতের গাঁটে গাঁটে তখন তীব্র যন্ত্রণা - আর ভালো লাগছে না।

    মাঝে এক জায়গায় চেকিং পয়েন্ট, কারবাইনধারী জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ আমাকে থামাল সাইডে। কোথায় যাচ্ছো? কোথা থেকে আসছো? ... বললাম। ব্যাগ মে কেয়া হ্যায়? তা-ও বললাম। একলা যাচ্ছো? সাথে কেউ নেই? মিথ্যে বললাম এইবারে, হ্যাঁ আছে, আগে বেরিয়ে গেছে, আমি পেছন পেছন আসছি। কে জানে, একলা শুনলে যদি হ্যারাস করার চেষ্টা করে? পুলিশ এইবারে বলল, ব্যাগমে দারু কা বোতল তো নেহি হ্যায়?

    তাই বলো। এইবারে পয়েন্টে এসেছে, একগাল হেসে বললাম, না নেই। আমি দারু খাই টাই না। পুলিশ বলে, তা হলে ব্যাগ সার্চ করি?

    আমি বললাম, হ্যাঁ, করতে পারো, তবে এই দড়িদড়া খুলতে কিন্তু আধঘণ্টা লাগে, আর বাঁধতে আধঘণ্টা। আমাকে আজ শ্রীনগর পৌঁছতে হবে, এইবার বলো, খুলব কি খুলব না।

    পুলিশ কী ভেবে কাটিয়ে দিল, হাতের ইশারায় বলল, এগিয়ে যেতে, আমি এগিয়ে গেলাম।

    চলতে চলতে হঠাৎ একটা চকের সামনে এসে থমকে গেলাম। চারদিকে চার রাস্তা গেছে, চতুর্দিকে বৈষ্ণোদেবী সংক্রান্ত হোর্ডিং পোস্টার, এর মধ্যে কোন রুট নেবার?

    চকে ছিল এক ট্রাফিক পুলিশ, তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, উধমপুর হয়ে শ্রীনগর তো অন্য রুট, সেটা আমি হাইওয়েতেই মিস করে এসেছি, এটা কাটরা, এখান থেকে বৈষ্ণোদেবীর যাত্রা শুরু হয়। আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে পাঁচ কিলোমিটার, তার পরে বাঁদিকে টার্ন নিলে উধমপুরের কানেক্টর রাস্তা পাবো।

    রাস্তা তখন জঘন্য - যেমন হয়ে থাকে টিপিকালি যে কোনও তীর্থস্থানের। ভাঙা রাস্তা, অজস্র ভক্তিমান পেডেস্ট্রিয়ান, ঘোড়া, খচ্চর, তাদের নাদি - সে এক পুঁদিচ্চেরি কেস। বাইক ঘোরালাম। পুলিশের কথা মত পাঁচ কিলোমিটার এগোতে বাঁদিকে কাটও পেলাম, জিজ্ঞেস করে জানলাম, এটাই উধমপুরের কানেক্টর, সোজা পনেরো কিলোমিটার গেলে আবার সেই স্বপ্নের হাইওয়েতে পড়ব, তারপরে সেই রাস্তা ধরে সি-ধা শ্রীনগর।

    গলির মুখে একটা দোকান, দোকানদারই সমস্ত বলে দিল। আমি বাইকটাকে সাইডস্ট্যান্ডে দিয়ে নেমে দাঁড়ালাম। একটু জল খেতে হবে এইবারে - গরম বাড়ছে। সতেশ শাহের ডেডবডিও ডানদিকে বিপজ্জনকভাবে হেলে পড়েছে, ওকে আবার বাঁধতে হবে, দোকানদারটি ভালো, ওকে রিকোয়েস্ট করলে বোধ হয় সাহায্য করে দেবে। আগে একটু জল খাই।

    মোবাইল বের করে দেখি তখন দ আর অরিজিতের মেসেজ, অরিজিত নাকি আগের দিন জোজিলা পাস পার হতে গিয়ে তিন ঘণ্টা আটকে ছিল ল্যান্ডস্লাইডের জন্য। ওরা পার হবার পরেই আবার স্লাইড হয়ে সারাদিনের জন্য রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। আমি যেন ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে এগোই।

    জোজিলা পেরোবার কথা আমার পরদিন। আগে তো শ্রীনগর পৌঁছই তারপরে দেখা যাবে - জোজিলা মাঝেমধ্যে এমনিই বন্ধ হয়, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয় না, কারণ লাদাখের সাথে শ্রীনগরের ওই একটিই লাইফলাইন। দোকানদারটিকে বলতে সে সানন্দে রাজি হয়ে গেল লাগেজ বেঁধে দিতে, বলল, আগে বাইককে মেন স্ট্যান্ডে লাগাও।

    ইতিমধ্যে পেছনে এসে গেছে মূর্তিমান যমদূতের মত একটা বিশাল ট্রাক, সে ঢুকবে পাশের গলিতে, আমার বাইকের জন্য সে ঢুকতে পারছে না, আমাকে তাই সাইড করতে হবে।

    বাইক পিছোলাম, কিন্তু মেন স্ট্যান্ড দিতে গিয়ে হল এক চিত্তির। ওপরে যে সতীশ শাহের মৃতদেহ ডানদিকে হেলে রয়েছেন, সেটা ভুলে গেছিলাম। সাইড স্ট্যান্ড (এটা বাইকের বাঁদিকে থাকে) থেকে সোজা করতেই লাগেজ সমেত পুরো বাইকের ওজন শিফট হয়ে গেল ডানদিকে, আমি দুহাতেও আর ধরে রাখতে পারলাম না, চোখের সামনে সপাটে ডানদিকে লাগেজ-সমেত আছাড় খেয়ে পড়ল আমার বাইক, ডানদিকের ভিউ ফাইন্ডারটা কড়াৎ করে ডান্ডাসমেত ভেঙে গিয়ে ট্রাকের নিচে, সেই ডান্ডার ওপরেই বসানো ছিল আমার হেলমেট, সেটা গড়িয়ে ট্রাকের ডানদিকের চাকার ঠিক তলায়।

    বাইকের ওজন আটানব্বই কিলো, সে সমধ্যে আমার সম্যক ধারণা ছিল, কিন্তু লাগেজসমেত যে ওজন আরও চল্লিশ কিলো বেড়ে গেছে, সেটা বুঝতে পারি নি, আর সেই একশো আটত্রিশ কিলো পুরোটা ডানদিকে শিফট হয়ে গেলে আমার ক্ষমতা কী তাকে বাঁদিকে টেনে ধরব? আমার নিজের ওজন তো ষাট কিলো।

    ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। আমার এত প্রিয় বাইক, তাকে দ্বিতীয় দিনেই কানা করে দিলাম! লোকজন ধরাধরি করে বাইকটা সোজা করে দিল, মেন স্ট্যান্ডে দাঁড়ও করিয়ে দিল। আমি দৌড়ে গিয়ে চাকার তলা থেকে হেলমেটটা উদ্ধার করে আনলাম। আমি আর সেই দোকানদার, দুজনে মিলে আবার সেই ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন বাঁধলাম, দোকানদার বলল, নাইলনের দড়ি কখনও থাকে না টাইট, পিছলে পিছলে সরে যায় ঝাঁকুনি পেলেই। তুমি সুতলি দড়ি, মানে পাটের দড়ি সামনে কোথাও পেলে কিনে নাও, ঐটা দিয়ে ভালো বাঁধা যাবে।

    এইসব দড়িদড়া পাওয়া যায় হার্ডওয়্যারের দোকানে, তা কাটরায় আর হার্ডওয়্যারের দোকান পাই কোথায়। বেঁধেছেঁদে আবার জল খেয়ে উঠলাম। এইবারে ডান দিকের ভিউ ফাইন্ডার নেই। ডানদিক থেকে কেউ ওভারটেক করতে এলে দেখতে পাবো না, অতএব এক্সট্রিমলি কশাস হয়ে চালাতে হবে।

    ধীরে ধীরে পনেরো কিলোমিটার পার হয়ে আবার সেই ভালো রাস্তা পেলাম, এইবারে সামনেই দেখি লেখা আছে উধমপুর-পাটনিটপ-শ্রীনগর। বাইক থামিয়ে আবার দড়ি কষে বাঁধলাম, তারপরে এগোতে থাকলাম।



    অনেকটা এগোবার পরে জম্মু সিটির চৌহদ্দী ছাড়িয়ে এক্সপ্রেসওয়ের সীমা খতম হল। তারপরে সাধারণ রাস্তা। মসৃণ নয়, তবে খুব বাজেও নয়। গঢ়ী বলে একটা জায়গায় এসে দেখি রাস্তার বাঁদিকে একটা হার্ডওয়্যারের দোকান, তাতে বিভিন্ন জিনিসের সাথে সামনে লাইন দিয়ে ঝুলছে বিভিন্ন থিকনেসের নাইলনের দড়ি। বাইক থামালাম। কমবয়েসী একটি ছেলে, তাকে বললাম, এই বিত্তান্তো, আমাকে আজ সন্ধ্যের মধ্যে শ্রীনগর যেতেই হবে। তোমার যে দড়িটা মনে হয় এই লাগেজ বাঁধার পক্ষে আদর্শ, সেইটা দিয়ে একটু লাগেজ বেঁধে দাও, লাগেজ যেন একটুও না হেলে।

    ছেলেটি এক্সপার্ট। জাস্ট একলা হাতে দড়িদড়া খুলে আমাকে বলল, বাঁধা ঠিকই হয়েছিল, কিন্তু আপনার দড়িটা ছোট। সে নিজেই একটা দড়ি নিয়ে এল সবুজ রঙের। তারপরে এমন কষে বাঁধল, বাম্পি রাস্তা তো কোন ছাড়, বাইক ঠেলে খাদে ফেলে দিলেও বাইক ভেঙে যাবে কিন্তু বাঁধন আলগা হবে না। দেখে জাস্ট মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

    পুরো কাজটার জন্য সে নিল শুধু দড়ির দাম, কুড়ি টাকা। ঘড়িতে তখন বেলা বারোটা, সূর্যের তেজ চড়ছে, রেনকোটের ভেতরে ঘেমেনেয়ে যাচ্ছি। রেনকোট খুলে পিঠের ব্যাগে ঢোকালাম, বসতে গিয়ে দেখি - সে এমন বেঁধেছে, সে বাঁধন শক্ত তো হয়েছে বটেই, খেসারত হিসেবে আমার বসার সীটের আয়তন কমে গেছে। এখন আমি যতই রোগা হই, আমার ছাপুর একটা তো বেসিক আয়তন আছে, সেটুকু রাখতে গিয়ে সম্মুখভাগ বাজেভাবে বাইকের ট্যাঙ্কারে চেপ্টে যাচ্ছে।

    কী করব? আবার খুলে বাঁধব? ছেলেটা এত সুন্দর বেঁধে দিয়েছে, এইবারে আমি খুললে যদি আর বাঁধতে না পারি? থাক, কষ্ট করেই না হয় যাই। মাঝে মাঝে একটু দাঁড়িয়ে কোমর সিধে করে নেব।

    বললে বিশ্বাস করবেন না, সত্যিই সারাদিন, ওইভাবে চালিয়ে আমি শ্রীনগর পৌঁছেছিলাম। লাগেজ আর এক ইঞ্চিও হেলে নি।

    বেলা প্রায় আড়াইটের সময়ে পাটনিটপ। পাহাড়ের মাথায়, এইবারে বেশ শীত করতে লাগল। কিন্তু সোয়েটার সমস্তই ব্যাগে, সে ত কঠিন বাঁধনে বদ্ধ। ততক্ষণে রাস্তা যথেষ্ট খারাপ হয়ে গেছে। নুড়িপাথর বিছনো রাস্তা, সর্পিল পাকদণ্ডী, ডানদিকের ভিউ ফাইন্ডার নেই, বসার জায়গা কমে এতটুকুনি, তার মধ্যে আর কতটুকুই বা শীত লাগে! রেনকোটটা বের করে পরলাম, ওটা পিঠের ব্যাগে আছে।



    পাটনি টপের পরে আবার ডিসেন্ড। আবার গরম, অনেকটা নামার পরে একটা কী যেন জায়গা, সেখানে দাঁড়িয়ে লাঞ্চ সারলাম। শরীর তখন একেবারেই বইছে না। হোয়াটস্যাপ খুলে বাড়িতে খবর দিলাম। খেলাম। আরও ট্যুরিস্ট খেতে এসেছে এখানে, সবাই শ্রীনগর যাচ্ছে, কিংবা শ্রীনগর থেকে এসেছে বৈষ্ণোদেবী দর্শনে। একটি বাঙালি ফ্যামিলির সাথে খানিক হ্যাজ হল, ওই "বাইক নিয়ে এসেছো", "এতদূর চালিয়ছো", "ওব্বাবা" এইসব এক্সপ্রেশনগুলো এখন বেশ পুরনো হয়ে এসেছে। প্রায় চারটে বাজে, দিন শেষ হয়ে আসছে, শ্রীনগর এখনও প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে, জওহর টানেল নব্বই কিমি, ঐটি পেরোলে তবে শ্রীনগর ভ্যালিতে এন্ট্রি।

    একটানা একঘেয়ে বাইক চালিয়ে যাচ্ছি, পাহাড়ি রাস্তা, কখনও বেশ ভালো, কখনও মন্দের ভালো, কখন বেশ খারাপ, সেই বুঝে গতি বাড়িয়ে কমিয়ে চলছি।

    জওহর টানেলের দু কিলোমিটার আগে একটা চেকপোস্ট। এক বয়স্ক ভদ্রলোক থামালেন, সেই একই গতের প্রশ্ন, কোত্থেকে আসছি, কোথায় যাচ্ছি, সঙ্গে কে কে আছে। আমার মুখের অবস্থা দেখে কী মনে হল, তিনি জলের জাগ নিয়ে এলেন। জল খাও। রেস্ট নাও, তার পরে এগিও। চা খাবে?

    নাঃ, চা নয়, আমি জলই খেতে চাই। গলা শুকিয়ে কাঠ। বাইক সাইড করে একটু বসলাম। উনি ঘুরে ঘুরে আমার বাইকটা দেখলেন, সামনে ভিউ ফাইন্ডার মিরর নেই কেন জানলেন, বাইকের কোন মডেল, এই মডেলের স্পেশালিটি কী, সমস্ত জেনে খুব খুব তারিফ করলেন আমার প্রচেষ্টার। আমি হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠলাম খানিক পর। এইবেরে এগোই। উনি হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানালেন। একটু এগোতেই দেখি লাইন দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সামনে দূরে দেখা যাচ্ছে জওহর টানেল। খানিক দূরে দূরে এলএমজিধারী সেনাবাহিনীর জওয়ান। তারা আমাকে ইশারা করল, বাইকওয়ালেঁ আগে চলা জাও। আমি গাড়িগুলিকে পাশ কাটিয়ে সোজা চলে গেলাম টানেলের মুখে। ক্যামেরা বের করে টানেলের ছবি নিতে যাবো, এমন সময়ে টানেল গেল খুলে আর হুড়মুড়দূর করে প্রথম সামনে দাঁড়ানো গোটাদশেক বাইক ঢুকে পড়ল টানেলের মধ্যে। আমিও পড়িমড়ি করে ক্যামেরা ঢুকিয়ে বাইকে স্টার্ট দিলাম। প্রথমে বাইক, তার পরে গাড়ি, পর পর ঢুকে গেলাম জওহর টানেলে। এখানে ওভারটেকিং নিষিদ্ধ।

    ২৫৩১ মিটার। প্রায় আড়াই কিলোমিটার লম্বা এই টানেলের ভেতরে একটু ভ্যাপসা গন্ধ, তবে অসহনীয় কিছু নয়। পার হতেই দেখি অন্য রকমের পাহাড়, সুন্দর গাছপালায় ছাওয়া শ্রীনগর ভ্যালি দেখা যাচ্ছে। একটা বাঁকের মুখে খানিকটা জায়গা করা, সেখান থেকে ভালো ভিউ পাওয়া যায়, জায়গাটার নাম টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট।





    জায়গাটার নাম বানিহাল। টিপিটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে টানেলের এইবারে, গরম আর নেই, হাল্কা ঠাণ্ডা। একটু দূরে সাইনেজ বলছে শ্রীনগর আরও আশি কিলোমিটার, এর পরে অনন্তনাগ, অবন্তীপুরা, পামপোর হয়ে শ্রীনগর। জম্মু থেকে শ্রীনগর মোট তিনশো কিলোমিটার, তার দুশোর ওপর পেরিয়ে এসেছি, আর একশো মত বাকি রয়েছে।

    অনন্তনাগ এসে গেলাম দেখতে দেখতে। শ্রীনগর আর ৬৮ কিমি। লম্বা জার্নির শেষদিকে এমন হয়, তখন সামান্য পঞ্চাশ, এমনকি দশ কিলোমিটারও মনে হয়, শেষ হতে চাইছে না।



    (আপাতত এই পর্যন্ত, বাকিটা রাতে শেষ করব)
  • quark | 24.139.199.12 | ১৬ জুন ২০১৫ ১১:২৪678837
  • দুটো লাগেজসহ বাইকে চড়া সিকির কোন ছবি নাই?
  • সিকি | ১৬ জুন ২০১৫ ১৩:০৮678838
  • বাইক চালালে বেশি ছবি আশা কইরেন্না। কেবল টানেলের ভেতরকার ছবিটা ছাড়া সবই মোবাইলে তোলা।

    তবে আছে। দুটো লাগেজসমেত বাইকের ছবি আছে, সিকির ছবিও আছে। ক্রমশ প্রকাশ্য।
  • lcm | 118.91.116.131 | ১৬ জুন ২০১৫ ১৩:২৭678839
  • সিকির লাগেজ
  • সিকি | ১৬ জুন ২০১৫ ১৩:৪০678840
  • অ্যাকদম :)))
  • Div0 | 132.166.94.242 | ১৬ জুন ২০১৫ ১৭:০৩678841
  • বেড়ে হচ্ছে সিকি। রিয়ারভিউ মিরর ভেঙে যাওয়া শুনে একটু দুঃখু পেলাম। তোরটার ওয়েট তো খুপই ভালো। আমারটার ড্রাই ওয়েট দেড়শ' কেজি + (একটুও বাড়িয়ে বলছি না)। ফুল বডি ফেয়ারিং পরে থাকার ফল। এটাকে নিয়ে যাবো না ফর শ্যিওর।

    আর তুই যদি একটা সেলফি স্টিক নিতিস তাইলে এরম থেমে-নেমে ফোটু তুলতে হত না। ফুল মোশনে নিজের ছপি তুলতে পারতি। আপাততঃ এইটুকুই। তবে একা এই জার্নি শুরু করার জন্য ধক থাকতে হয় (অথবা পেল্লায় বুকের পাটা)। সেজন্য তোকে আরেক রাইডারের তরফ থেকে স্যাল্যুট :)

  • সিকি | ১৬ জুন ২০১৫ ১৭:০৮678842
  • সান্দা থ্যাঙ্কু। সেলফি স্টিকের থেকেও বেশি কাজের জিনিস হত গো-প্রো। এ যা তাকলাগানো রাস্তা, গো প্রো ছাড়া কেউই এর জাস্টিস করতে পারত না।

    তবে ওয়েট মাডি, গল্প এখনও সবে শুরু হয়েছে।
  • Div0 | 132.166.94.242 | ১৬ জুন ২০১৫ ১৭:১৪678844
  • গো প্রো ডিফল্ট চয়েজ :p তবে এমন উত্তাল দাম একটু ভালো এইচডি গুলোর। আর হেলমেটে আটকাবি যে, এরম হেলমেট গড়িয়ে গেলে আর দেখতে হত না। যাই হোক, লেখ তুই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন