এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • সর্ষেঃ অন্যভাবে, অন্যরকম লাদাখ

    সিকি লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ১২ জুন ২০১৫ | ২৪৮২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Arpan | 125.118.52.72 | ৩০ জুন ২০১৫ ০৯:০২678720
  • বারবার অন্যের গার্লফ্রেন্ডের মুখে "ইয়ে ভ্যাজ হ্যায় না" শুনলে কনফিউজড হয়ে যাবার চান্স খুবই বেশি। ; )
  • সিকি | ৩০ জুন ২০১৫ ১০:৫৯678721
  • অপ্পন ;-)

    সান্দা, আমি কিনা বাংলা মিডিয়াম, তাই ইংরেজিতে ইমপ্রম্পচু বলতে গেলে আমায় এট্টু পেটে ডুবুরি নামাতে হয়। :)

    এমনিই, কখনও কথা বলে বলে তো ভিডো তুলি নি, এই প্রথমবারের জন্য, তাই জড়তা কাটছিল না।
  • vix | 125.112.74.130 | ৩০ জুন ২০১৫ ১১:২৬678722
  • "মানালি কল্পা সাংলা চিটকুল (এটি হল হিমাচল প্রদেশে চীন সীমান্তে শেষ ভারতীয় গ্রাম, রাস্তা নাকি লাদাখের চেয়েও দুর্গম)"।
    না না ।পিচ রাস্তা , দু লেন ।
    সিমলা থেকে গেলে তাপরি, রামপুরের পেরিয়ে সারাহান হচ্ছে কিন্নরের গেটওয়ে। আরেকটু এগিয়ে করছাম থেকে রিকং পিও কল্পা এক দিকের রাস্তা,( ইন্দো টিবেটান বর্ডার রোড - ওই রাস্তা ধরে আরো এগোলে কাজ স্পিতি তে পৌছনো যায় ) , আর রকচাম চিট্কুল আরেক দিকের রাস্তা,চিট্কুলের রাস্তা শুধু রকচাম থেকে একটু খারাপ । ১৯৯৭ , ২০০৭ দুবার আমি চারচাকার গাড়ি তে গেছি ফ্যামিলি সমেত কোনো চাপ নেই। আর্মি চিট্কুল পর্যন্ত গাড়ি যেতে দেয় , ওখানে হোম স্টে ও আছে ।
    তবে কিন্নরে লাদাখের মত রাস্তা নয়,অনেকটা সিকিমের মত রাস্তা । তুলনায় মানালি হয়ে লে রাস্তা খুব ই সুন্দর ।
  • S | 139.115.2.75 | ৩০ জুন ২০১৫ ১১:৩২678723
  • সিকিবাবু, সময় করে ছবিগুলোর একটু নাম করন করে দিন। খুব ভালো লাগছে দেখতে।
  • সিকি | ৩০ জুন ২০১৫ ১১:৩৫678724
  • vixকে ধন্যবাদ তথ্যগুলোর জন্য। যদি siki.guru জিমেলে একটা মেল করতে পারেন তা হলে আরও একটু তথ্য জেনে নিতাম অফলাইনে।

    S, নামকরণ করব। এখনও এটা শেষ হলে এর ইংরেজি ভার্সন লিখতে হবে - দু দুটো সাইটের লোকে মুখিয়ে আছে। তার মাঝেই সময় বের করতে হবে।
  • সিকি | ৩০ জুন ২০১৫ ১২:৫৩678725
  • ৭ই জুন ২০১৫ - নবম দিন

    ঝকঝকে রোদ্দুরে বেরিয়ে এলাম। আকাশে হাল্কা সাদা মেঘ, আর তার চারপাশে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া লাদাখের বিখ্যাত নীল আকাশ! হায় রে, এই আকাশ আর দুদিন আগে পেলে প্যাংগং-এর কত ভালো ছবি উঠত। যাক গে, যা গেছে তা গেছে।

    নিচে নামলাম চায়ের দোকানে। কালকের বাঙালি ফ্যামিলির আর দেখা পেলাম না, তারা হয় তো লেপ ছেড়ে বেরোন নি। আসাদজির সঙ্গে দেখা হল। সদাহাস্যময় মানুষটি এক রকম জোর করে টেনে নিয়ে গেলেন, চা খাওয়ালেন। আরও দুটি ছেলের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। একেবারে ইয়ং ছেলে - চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়েস। কাল যে দুটো বুলেট দেখছিলাম, সেগুলো এদের। কেরালার ছেলে, ইন্ডিয়ান নেভিতে কাজ করে, লাক্ষাদ্বীপে পোস্টেড। লাদাখ বেড়াতে এসেছে। মোটামুটি ভালোই হিন্দি বলে। দিব্যি আলাপ জমে উঠল।

    সকাল বেলার খারদুং গ্রামের রাস্তা।


    নাম-না-জানা পাখি - লাদাখে এদের খুব দেখা মেলে।


    চায়ের দোকানের ছোট্ট বাচ্চাটা -


    সকালবেলার দৃশ্য




    আকাশে হেলিকপ্টার পাক খাচ্ছে। এটা এখানকার রুটিন। সারাদিন ধরে আর্মির হেলিকপ্টার পাসগুলোতে টহল দেয়, কেউ কোথাও ফেঁসে গেছে কিনা দেখার জন্য। আসাদজি কি সেই কর্নেলসাবকে একবার ফোন করবেন?

    আসাদজি বললেন, দশটা নাগাদ করব। এখন তো একটু রোদ পুইয়ে নিই, এমন সুন্দর রোদ উঠেছে। বারবার ফোন করলে কর্নেলসাব বিরক্ত হতে পারেন।

    তা ঠিক। বসে গল্পগুজব হল। দিল্লির গল্প, কেরালার গল্প। অরুণ বলে কেরালিয়ান ছেলেটার ফোন নম্বর নিয়ে নিলাম, যখন কেরালা যাবার প্ল্যান করব, ওর সাথে যোগাযোগ হবে, কোচিতে ওদের বড় বাড়ি আছে, সেখানে আমাদের নেমন্তন্ন করে রাখল। এইভাবে আস্তে আস্তে নটা বাজল, সোয়া নটা নাগাদ দেখতে পেলাম হুশ হুশ করে কতকগুলো ইনোভা কোয়ালিস ট্যাভেরা নেমে এল খারদুং লা-র দিক থেকে, তার পরে আরও কিছু, তার পরে আরও আরও আরও গাড়ি, ট্যুরিস্টবোঝাই গাড়ি সব চলেছে নুব্রার দিকে।

    জয় গুরু, খারদুং লা খুলেছে তার মানে। আসাদজি দোকানদারের কাছ থেকে মোবাইল চেয়ে নিয়ে কর্নেলকে ফোন করলেন। কর্নেল জানালেন হ্যাঁ, খারদুং লা খুলেছে, এখন লে-র দিক থেকে ট্র্যাফিক ছাড়া হচ্ছে। একটার সময়ে নুব্রার দিক থেকে ট্র্যাফিক খুলবে। আমরা যেন সাড়ে বারোটা নাগাদ নর্থ পুলু পৌঁছে যাই। ... আমাদের অবস্থা তখন, সেই বিয়াঙ্কা কাস্তাফিওরের যাবার খবরে ক্যাপ্টেন হ্যাডকের যেমন আনন্দ হয়েছিল, সেই রকমের এক্সট্যাসি। অবশেষে আজ খারদুং লা জয় হবে নিজের বাইকে।

    দশটা দশ নাগাদ উল্টোদিক থেকে বেশ কয়েকটা মোটরসাইকের গ্যাং আসতে শুরু করল। এরা তার মানে খবর পেয়েছে নুব্রাতে বসে, এইবারে জড়ো হচ্ছে একে একে। দু চারটে দল বেরিয়ে যাবার পরে দেখি দূর থেকে দুটো চেনা মোটরসাইকেল এগিয়ে আসছে - একটা বুলেট, একটা অ্যাভেঞ্জার।

    তিন থেকে আবার আমরা পাঁচ হলাম। পাঁচ না বলে এখন সাত বলাই ভালো, কেরালার ছেলেদুটোও রয়েছে। আসাদজি তো গাড়ি নিয়ে যাবেন ভায়রাভাইয়ের সাথে - কোয়ালিস। গুরদীপ আর সুমিতের গল্প শুনলাম। তুর্তুক নয়, ওরা গেছিল পানামিকের দিকে। পানামিক সেক্টরে পৌঁছে সেখানে ইন্ডিয়ান আর্মিদের আপ্যায়ন পেয়েছে, তারা ওদের কাজু কিশমিশ ফ্রুট জুস খুব খাইয়েছে, তারপরে ওরা ফেরত এসে কাল খালসারে রাত কাটিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে এই এসেছে। দুজনেই আর্মির এই আপ্যায়নে খুব খুব খুশি। (আগের বারে আমি আর্মির আপ্যায়নের এক্সট্রিম লেভেল অবধি এনজয় করে এসেছি, সুতরাং আমার কাছে ব্যাপারটা নতুন নয়)

    সাড়ে এগারোটা নাগাদ হোমস্টে-র বিল মিটিয়ে আমরা সবাই স্টার্ট করলাম। বিবেক আবার ঘ্যানঘ্যান করে দুখানা ডায়ামক্স নিয়ে নিল। গুরদীপ জনান্তিকে আমাকে বলল, এরা তো বিয়ের পরে কনট্রাসেপ্টিভ পিলের বদলে ডায়ামক্সই খাবে মনে হচ্ছে।

    খানিকক্ষণের মধ্যেই নর্থ পুলু পৌঁছে গেলাম, সেখানে তখন সারি সারি গাড়ির মেলা বসে গেছে, কয়েকশো গাড়ি।


    উল্টোদিক থেকে তখনও গাড়ি আসছে - লে-র দিক থেকে।


    বারোটা বাজে। টু হুইলারদের এন্ট্রি করতে হবে - এন্ট্রি সেরে এলাম। প্রচুর লোক তখন হাজির হচ্ছে, দিল্লি, পঞ্জাব, রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা, অস্ট্রিয়া। আলাপ হল, গল্পগুজব হল। চকলেট এক্সচেঞ্জ হল।

    ঠিক একটার সময়ে নুব্রার দিক থেকে গাড়ি ছাড়া হল। যে কোনও পাসেই এটা নিয়ম - প্রথমে যাবে টু হুইলার, তার পরে ফোর হুইলার, শেষে ভারী ট্রাক, সিক্স হুইলার ইত্যাদি। আমরা সবার আগে বেরিয়ে গেলাম। ভালো রাস্তা একেবারে ভ্যানিশ - আবার সেই এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা, ঝাঁকুনি, বরফগলা জলে মিশে সে এক এক্সপিরিয়েন্স। খানিক ওপরে ওঠার পরেই বুঝতে পারলাম, বাইকের টানতে কষ্ট হচ্ছে, তবে আজ আর বন্ধ হল না, সুন্দর চলতে থাকল।

    আগের বারের সঙ্গে এবারের অভিজ্ঞতার তফাৎ হচ্ছে, বরফ সাঙ্ঘাতিক বেশি। কী লেভেলে স্নো-ফল হয়েছিল তার আন্দাজ পাচ্ছি, যত ওপরে উঠছি, তত। ক্রমশ দেখলাম মাটিতেও কাদায় বরফে মাখামাখি। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে উঠছি, বেশি পাওয়ারের গাড়িগুলো ক্রমশ আমাকে ওভারটেক করে বেরিয়ে যাচ্ছে, একবার দূর থেকে খারদুং লা টপ দেখা গেল, তারপরে আবার বাঁকে হারিয়ে গেল। আর বোধ হয় দু চার কিলোমিটার দূরে। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, অক্সিজেনের কমতি বেশ বোঝা যাচ্ছে, খুব হাল্কা চালে চালাতে লাগলাম, কোনওভাবে যেন শ্বাসের গতি না বেড়ে যায়।

    কিন্তু কোথা হইতে কী হইয়া গেল, একটা জায়গায় এসে - বুঝতে পারি নি, বাইকের চাকা চলে গেল বরফের ওপরে, দুদিকে এবং রাস্তার মাঝেও চাপ চাপ বরফ, জাস্ট সামনের গাড়ির টায়ারের দাগ ধরে চলা উচিত এইসব রাস্তায়, চলছিলামও তাই, কিন্তু বরফে একবারের জন্য চলে গেল সামনের চাকা, স্কিড করল, আমি ব্যালেন্স হারালাম, এবং ছিটকে পড়লাম।

    লিখছি বটে "ছিটকে পড়লাম", আসলে পড়লাম যারপরনাই নরম একটা কুশনের ওপর, থুপুস করে। পাশে ডাঁই করে রাখা বরফের ওপরে। বাইকটা এদিকে কাত, আমি ওদিকে কাত। একটুও লাগে নি, কিন্তু পাছে নিশ্বাসের গতি বেড়ে যায়, তাই কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে রইলাম বরফের ওপরেই। পেছন থেকে দুটো গাড়ির ড্রাইভার বেরিয়ে এসে ধরাধরি করে আমার বাইকটাকে দাঁড় করাল, আমার লাগে নি জেনে নিশ্চিন্ত হল, আমাকেও হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিল।

    দেখলাম, বাইকের ইঞ্জিনের জায়গাটা দিয়ে হাল্কা হাল্কা ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ভয়ে ভয়ে এক মিনিট পরে বাটন দাবালাম। গাড়ি একবারে স্টার্ট হল, যেন কিছুই হয় নি। ফার্স্ট গিয়ারে ফেলে গাড়ি একটু এগোতেই দেখি সামনে খারদুং লা টপ। আমি টপ থেকে জাস্ট একশো মিটার আগে পড়ে গেছিলাম।

    খারদুং লা টপ বরফে বরফে ভর্তি। আগের বারে যে পাঁচিল দেখেছিলাম, সেই পাঁচিল এইবারে উধাও, বরফের মধ্যে জাস্ট জেগে রয়েছে বোর্ডটা।







    প্রিয়াঙ্কাকে বলতে সে আমার একটা ছবি তুলে দিল। তাড়াহুড়োয় ঘোমটা খুলতেই ভুলে গেছিলাম। এতও কিছু ঠাণ্ডা ছিল না।


    ভিডিও তুলব বলে মোবাইলটা বের করতে গেলাম, দেখি ছটা মিসড কল, দুটো মেসেজ, আর, আর, ফুল সিগন্যাল। এয়ারটেল, রোমিং। খারদুং লা টপে এয়ারটেল পোঁছে গেছে? ভিডিও তোলার কথা ভুলে গিয়ে সিকিনীকে আর বাবাকে পর পর ফোন করলাম, তিন দিন প্রায় নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলাম, আর প্রথম ফোন করছি কে-টপ থেকে। ভাবা যায়?









    এর পর ডিসেন্ড। সেই একই রকমের ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে দুলকি চালে যখন সাউথ পুলু এসে পৌঁছলাম, তখন বাকে সাড়ে তিনটে। একটা ছোট চায়ের দোকান সেখানে, আর্মির জন্য। সেখানে বসে ম্যাগি আর কফি খেলাম। খানিক বাদে সুমিত এল, মুখটা শুকনো। কী ব্যাপার? ওর অ্যাভেঞ্জারের শকার ভেঙে গেছে, ও-ও নাকি একবার পড়ে গেছিল। এখন শকার না সারানো গেলে বাকি রাস্তা কভার করা সম্ভব নয়। আমাকে বলল, সিকিস্যার, আমি আজ দেখছি যদি লে-তে গিয়ে সারানো যায়, না হলে কাল সারিয়ে তার পরেই বেরোব।

    আমার মনে তখন কী যেন হয়ে গেল। এতদিন একসাথে চলেছি, একে অপরের গাড়ি ঠেলে দিয়েছি, স্পেশালি গুরদীপ প্রায় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার গ্লাভস উদ্ধার করে এনে দিয়েছে, আর আমি আমার নিজের কথা ভেবে ওদের ছেড়ে ফ্লাইটে ফিরে যাবো, বাইক কার্গোতে বুক করে?... না, যাই ঘটুক। এখন যাত্রাশেষ পর্যন্ত আমরা একসাথেই থাকব।

    সাউথ পুলুর পরে আবার ঝকঝকে রাস্তা। প্রায় সাড়ে পাঁচটার সময়ে লে-তে ফিরলাম, আবার মিসেস লিন্ডার গেস্টহাউসে ওঠা। এইবারে লাভবার্ডসের জন্য আলাদা ঘর, আর আমরা তিনজনে একটা ঘর নিলাম, এক্সট্রা বেডসমেত।

    টুকটাক শপিং হল, আমি নিজের জন্য একটা বাফ কিনলাম - এতদিন এদের মাথায় দেখেছি, এটাকে যে বাফ বলে জানতাম না। দীর্ঘক্ষণ হেলমেট পরে থাকলে চুলের ক্ষতি হয়, ঘাম বসে। বাফ জড়ানো থাকলে চুল বেঁচে যায়। সুমিত আমাদের তিনজনের জন্য একটা একটা করে লাদাখ ফ্ল্যাগ কিনে দিল, বাইকে লাগানোর জন্য। তড়িঘড়ি অ্যাভেঞ্জারের "শকার"-এর খোঁজ করা হল, শকার কেনাও হল, কিন্তু আজ রোববার, লে পুরো বন্ধ। কাল সকাল নটার আগে কিছু করা যাবে না।



    বিবেক প্রিয়াঙ্কার উপায় নেই, তারা ভোরবেলাই বেরোবে, তাদের তিনদিনে দিল্লি পৌঁছে অফিস জয়েন করতে হবে। নেভির ছেলেদুটোও ভোর সাড়ে পাঁচটায় স্টার্ট করবে, সুমিত আমাকে বলল, সিকিস্যার, আপনি ওদের সাথেই বেরিয়ে যান, আমি আর গুরদীপ পরে আসব, খামোকা আমার জন্য কেন লেট করবেন?

    আমি তখন মন বদলে ফেলেছি, আর যাই হোক, আমার অফিসের তাড়া নেই। আমি সুমিত গুরদীপের সাথেই আসব। এই দুজনের সাথে আমি যতটা সেফ সিকিওর্ড অনুভব করি - সেটা বাকিদের সাথে হবে না। একটা বন্ডেজ গড়ে উঠেছে আমাদের তিনজনের মধ্যে। সেটাকে স্বার্থপরের মত ভাঙা যায় না। সুমিতের কাঁধে হাত রেখে বললাম, গুরু, চাপ নিও না, আমরা দিল্লি পর্যন্ত একসাথেই যাবো। আমার বাইকেও ইঞ্জিন অয়েল ঢালতে হবে, চেন টাইট করতে হবে, একসাথেই রিপেয়ার করে কাল আমরা বেরোব।

    রাতে গ্র্যান্ড ডিনার হল - চাইনিজ। গলা পর্যন্ত ভরে আমরা হোটেলে ফিরলাম। বিবেক প্রিয়াঙ্কার সাথে হ্যান্ডশেক হল, ওরা কাল ভোর ভোর বেরিয়ে যাবে, আপাতত আর দেখা হবে না। ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে ঘুম। কাল থেকে ফেরার যাত্রা শুরু। চারদিনেরই টার্গেট রাখছি, যদিও সুমিতকে তিনদিনেই পৌঁছতে হবে। মানালি রুট এবারে হল না। ফির কভি। গুরদীপ ততক্ষণে চিটকুল আর স্পিতির গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে আমার কান ঝালাপালা করে দিয়েছে, কথা দিলাম, আবার আমরা একসাথে বেরোব, সময়সুযোগ হলেই।
  • Div0 | 132.167.213.135 | ৩০ জুন ২০১৫ ২৩:২৫678726
  • সিকি, 10:59 AM, আমি অক্সিজেন কম থাকার জন্য হাঁপ ধরছিল কিনা বুঝতে চাইছিলাম। যাগগে।
  • Manish | 127.200.92.76 | ০১ জুলাই ২০১৫ ১০:১৫678727
  • শমীক , আজকে আপডেট হবেতো।একদম মজে গিয়েছি।
  • de | 24.139.119.175 | ০১ জুলাই ২০১৫ ১১:৪৩678728
  • দারুণ! ফটোগুলো রোদ্দুর ওঠার পর কি ভালো উঠেছে!
  • সিকি | ০১ জুলাই ২০১৫ ১৬:০৫678730
  • ৮ই জুন ২০১৫ - দশম দিন

    ঠিক ছিল, একই রাস্তা দিয়ে যখন ফেরা হবে, আর কোথাও থামাথামি নেই, যতক্ষণ না গায়ে ব্যথা হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা চলব, সম্ভব হলে আজকের মধ্যেই সোনমার্গ বা শ্রীনগর পৌঁছে যাব। কিন্তু আপাতত সুমিতের বাইকের শক-অ্যাবজর্ভার - যাকে চলতি ভাষায় "শকার" বলা হয় (ভাবো - দুটোর মানে পুরোপুরি উলটো, শকার আর শক-অ্যাবজর্ভার) ফিট না করিয়ে বেরনোর কোনও উপায় নেই। তাই ঠিক হল আজ আমরা যাবো কারগিল পর্যন্ত। পরের দিনগুলোয় যত বেশি সম্ভব টানব।

    দোকানপাট খোলে সাড়ে নটা নাগাদ। সেই মত ধীরেসুস্থে ব্রেকফাস্ট সেরে গেস্ট হাউসে চেক আউট করে নটার সময়ে স্টার্ট করলাম। অসংখ্য স্মৃতি পেছনে ফেলে আমরা লে থেকে বেরোবার পথ ধরলাম। পেট্রল পাম্প থেকে একটু এগিয়ে এয়ারপোর্ট রোডের দিকে একটা মোড় থেকে একটু বাঁদিকে ডাইভার্সন নিয়ে মেকানিক শপ। সুমিত তো আগের দিনই শকার কিনে রেখেছিল, আমি একটা ইঞ্জিন অয়েল কিনে নিলাম। আমাদের তিনজনকার বাইকেরই অল্পবিস্তর চেক আপ হল, ব্রেক টাইট, চেন টাইট, ইঞ্জিন অয়েল ঢালা।

    সব সেরে সাড়ে এগারোটা নাগাদ ফাইনাল স্টার্ট করা হল। মন খুবই খারাপ, মানালি রুট হল না। গুরদীপেরও মন খারাপ। সবাই মিলে বললাম, আবার হবে। আবার আসব। এবার মানালি দিয়ে এসে সো-কার, সোমোরিরি দেখে মানালি দিয়েই ফিরে যাবো।

    লে ছেড়ে বেরিয়ে নিমুর দিকে একটু এগোতেই আকাশ আবার কালো হয়ে এল, সঙ্গে বৃষ্টি। আবার গাড়ি থামিয়ে রেনকোট পরতে হল।

    নিমু পৌঁছবার আগেই অবশ্য বৃষ্টি থেমে গেল। এখানে মেঘ প্রায় মাথার কাছাকাছি উচ্চতায় থাকে বলে তাদের তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাওয়া যায়। নিমু যখন ঢুকলাম, তখন সামনে নীল আকাশ। রানওয়ের মত মসৃণ রাস্তা। উড়িয়ে দিলাম গাড়ি - ওড়াতে গিয়ে দেখতে পেলাম, পাহাড়ী রাস্তায় গাড়িতে স্পিড তোলা অত সহজ নয়, স্পেশালি যখন পেছনে লাগেজ বাঁধা থাকে। সেন্ট্রিপিটাল ফোর্স কাজ করে বাঁকের সময়ে, ফলে ব্রেক মারতে গেলেও ডানদিকে টার্ন নেবার সময়ে বাইকের পেছনদিকে একটা বাঁদিকে হেলে যাবার টেনডেন্সি চলে আসে।



    যাই হোক, ক্রমশ পেরিয়ে গেলাম লামায়ুরু, আলচি, ফোটুলা - মাঝে একটা কী যেন নাম গ্রামের, সেখানে বসে খানিক ম্যাগি আর চা খেলাম। মাথার ওপরে নীল আকাশে সাদা মেঘেরা ভাসছে।






    এর পর ফোটুলাও পেরিয়ে গেলাম। খানিক এগিয়ে একটা বাঁকের মুখে আবার খানিক বসে বিশ্রাম নিলাম - সামনেই মুলবেক, সেটা পেরোলেই তো কারগিল। সামনে পাহাড়ে একপাল ভেড়া চরছে নিশ্চিন্তে।

    ফিরতে সত্যিই ইচ্ছে করছে না।





    এর পরে মুলবেক পেরোলাম, সামনে দশ কিলোমিটার মত খারাপ রাস্তা, ধীরে ধীরে যাচ্ছি, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, সুন্দর একটা রামধনু উঠেছে। ... ক্যামেরা তখন ব্যাগবন্দী, ব্যাগ আটকানো বাইকের পেছনে, বের করা সম্ভব ছিল না - তাই রামধনু দেখতে দেখতে এগোলাম। সন্ধ্যের ঠিক মুখে কারগিল পৌঁছনো গেল। এবারে অন্য একটা হোটেলে।

    খুব সুন্দর হোটেলের ভিউটা, একদম পার্কিং-এর সামনের ঘরটা পেলাম, ফলে আমাদের বাইক থেকে আর লাগেজ খুলতে হল না। জাস্ট ঘরে ঢুকলাম, খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ও হ্যাঁ, দিনের আলো নেভার আগে পার্কিং-এর পেছনে নেচে নেচে বয়ে চলা সুরু নদীর ভিডিও নিতে ভুলি নি।



    কারগিলে কেন জার্নি শেষ করলাম? ... কারণ, কারগিলের পরে দ্রাস, ষাট কিলোমিটার আগে। দ্রাসে কোনও থাকার জন্য হোটেল নেই। একটা না দুটো গেস্ট হাউস - খালি না থাকার চান্সই বেশি। আর দ্রাসের পরেই সাঙ্ঘাতিক খারাপ রাস্তা শুরু হবে - জোজিলা পাস হয়ে সোনমার্গ। দ্রাসে পৌঁছতেই আমাদের অন্ধকার হয়ে যেত, আর অন্ধকারে জোজিলা পাস ক্রস করার মত বোকামো একেবারে করা উচিত নয় - তাই কারগিল।

    কাল ভোর পাঁচটায় ওঠা, আর ছটার মধ্যে বেরনো। সাড়ে সাতটার মধ্যে যাতে দ্রাস পৌঁছতে পারি, আর জোজিলা পাস পেরিয়ে বারোটার মধ্যে শ্রীনগর পেরোতে পারি।
  • সিকি | ০১ জুলাই ২০১৫ ১৬:০৯678731
  • নাইলন দড়ি আর বানজি কর্ডের তফাতটা লক্ষ্য করুন - ফেরার সময়ে লাগেজ বেঁধেছি বানজি দিয়ে, এক ইঞ্চি নড়ে নি, আরেকটা কাজ করেছিলাম, নিচের ব্যাগে ঠেসেঠুসে মালপত্র ঢুকিয়ে ওপরের ব্যাগটা ফাঁকা রেখেছিলাম, যাতে বাইক বেশি না হেলে, আর দ্বিতীয়ত, এইবারে আমরা নিচে নামব, গরম বাড়বে, গা থেকে একটা একটা করে খোলস ছাড়াতে হবে, সেগুলো ভরার জন্য ওপরের ব্যাগটা খালি রাখতে হয়েছিল।
  • সুকি | 129.160.188.5 | ০১ জুলাই ২০১৫ ১৬:৩৩678732
  • লেখা ও ছবি খুবই উপভোগ করেছি/করছি। দারুন সুন্দর -
  • de | 69.185.236.54 | ০১ জুলাই ২০১৫ ১৭:৫২678733
  • সত্যি, ওই দিকের পাহাড়ী প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে খাবার বলতে সেই ম্যাগী বা ম্যাগীরই স্যুপ আর চা। এই ম্যাগী ব্যানের ফলে এখন ওদিকে কি খাবার পাওয়া যাবে কে জানে!
  • সিকি | ০১ জুলাই ২০১৫ ২৩:২৯678734
  • ৯ই জুন ২০১৫ - একাদশ দিন

    স্বর্গ থেকে ক্রমশই দূরে সরে আসছি। কারগিলে মনোরম ঠাণ্ডা ছিল - রাতে একটা কম্বল চাপা দিয়ে তোফা ঘুম হল, অবশ্য তার আগে টিভি চালিয়ে নব্বইয়ের দশকের একটা ঝুল সিনেমা দেখে উপভোগ করতে ছাড়ি নি আমরা। সকাল সাড়ে পাঁচটায় উঠে পড়লাম সক্কলে। কাল রাতেই হোটেলের বিল মেটানো হয়ে গেছে, জাস্ট ওঠা, মুখ ধুয়ে জামাকাপড় পরা, আর বেরিয়ে পড়া। লাগেজ তো বাইকেই বাঁধা আছে।

    স্টার্ট করতে করতে সাড়ে ছটা বেজেই গেল, দেরি না করে এগিয়ে গেলাম। আর কোথাও থামাথামি নেই। কারগিল শহর পেরোতেই চারিদিক নির্জন, কেবল পাহাড়, ভোরবেলার রোদের মিষ্টি আলোছায়ার খেলা, আর পাশ দিয়ে নাচের ছন্দে বয়ে চলা সুরু নদী। কারগিল থেকে দ্রাসের রাস্তা যে এত সুন্দর, আগে কেন খেয়াল করি নি? ... মনে পড়ল, এই রাস্তায় আমি এসেছি এর আগে দুবার। এক ২০১২ সালে, আর দুই, কদিন আগেই। প্রথমবারে গাড়িতে বসে ছিলাম, কোনওভাবে মিস করে গেছি। আর দ্বিতীয়বারে তো অন্ধকারে পেরিয়েছি। আজ প্রকৃতির রূপ দেখে মোহিত হয়ে গেলাম - কেবলই মনে হচ্ছিল, গাড়ি থামিয়ে খানিক ছবি নিই, ভিডিও তুলি। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হচ্ছে - না, আর কোথাও থামাথামি নয়, সম্ভব হলে আজ রাতের মধ্যে জম্মু, না পারলে উধমপুর পর্যন্ত তো পৌঁছতেই হবে, যাতে তিনদিনে দিল্লি ফেরা যায়।

    লে থেকে তিনদিনে দিল্লি ফেরার ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভবই বলা যায়, অত্যন্ত স্ট্যামিনা না থাকলে সাড়ে তেরোশো কিলোমিটার তিনদিনে কভার করা বেশ চাপের ব্যাপার, আর আমরা তো তিনদিনও নয়, আড়াইদিন হাতে নিয়ে নেমেছি। বিবেক-প্রিয়াঙ্কা কাল ভোরে বেরিয়ে পড়েছিল, আমরা বেরিয়েছি দুপুর পার করে। অর্ধেক দিন কাল লে-তেই নষ্ট হয়েছে, দেখা যাক, কতদূর পৌঁছনো যায় আজ।

    দ্রাস যত কাছে এগিয়ে আসছে, আমরা নিচের দিকে নামছি, কিন্তু ঠাণ্ডা যেন বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। একটু পরেই দেখলাম অলমোস্ট আমাদের লেভেলে সামনের পাহাড়ে একটা ঝর্ণা ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত জমে আছে। আশেপাশে পাহাড়ের গায়ে বরফের ছোপ। শীতের প্রকোপ চার লেয়ার পেরিয়ে গায়ের চামড়ায় মালুম দিচ্ছে। সত্যিই অদ্ভূত অবস্থান এই দ্রাসের, লে থেকে এতটা নিচে হয়েও দ্রাস হল পৃথিবীর সেকেন্ড কোল্ডেস্ট ইনহ্যাবিটেটেড প্লেস। শীতকালে এখানে মাইনাস ষাট ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত টেম্পারেচার নেমে যায়।

    সাতটা কুড়িতে আমরা দ্রাস পৌঁছে গেলাম। হাল্কা বিরতি, চা বিস্কুট আর পকোড়া দিয়ে জলখাবার সারা হল। তারপর আবার এগনো।

    দ্রাসের সাইনবোর্ডটা পেরোতে যতটুকু সময়, তার পরেই ভাঙাচোরা রাস্তা শুরু। খানিক এগোতেই গাড়ির লম্বা লাইন, ছোট্ট একটা নদীর ওপর সরু ব্রিজ, আর সেই ব্রিজ পেরোচ্ছে উল্টোদিক থেকে আসা মিলিটারি ট্রাকের দল। একটার পর একটা, একটার পর একটা, একটার পর একটা ... যতদূর চোখ যায়, ওই ওখানে একটা বাঁক আছে রাস্তায়, কেবলই দেখছি একটা করে ট্রাক বেরিয়ে আসছে সেই বাঁক থেকে। বেশ খানিকক্ষণ বাদে একটা ট্রাকের দয়া হল, সে ব্রিজের আগে সাইড করে দাঁড়িয়ে আমাদের ইশারা করল পার হয়ে আসতে।

    এর পর রাস্তার অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল, চালচামড়া ওঠা, পাথরভরা রাস্তা। এতটা কি খারাপ ছিল আসার দিন? কে জানে, মনে পড়ল না।

    প্রায় তিরিশ কিলোমিটার এইভাবে চলার পরে আচমকা রাস্তা ভালো হয়ে গেল, আবার স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। খানিক বাদেই গুমরি পৌঁছে গেলাম। গুমরি চেকপোস্টে ট্রাফিক আটকে রাখা ছিল, কারণ সোনমার্গের দিক থেকে ট্রাফিক আসছিল। আমরা যাওয়ামাত্র দ্রাসের দিকের ট্র্যাফিক ছেড়ে দেওয়া হল। আমরা উঠতে শুরু করলাম জোজিলার দিকে।

    এই নিয়ে তিনবার জোজিলায় পা পড়ল। সেই দু হাজার বারোতে একবার, আর কপালের ফেরে এইবারে দু বার। খানিক এগোতে আবার রাস্তা খারাপ, তারপরে রাস্তার দুপাশে অল্পবিস্তর বরফের স্তুপ, আর তার পরে দূর থেকে দেখা গেল জোজিলা পাস।



    পাঁচ মিনিটের বিরতি দিলাম জোজিলায়, ততক্ষণেই ছেঁকে ধরেছিল চা-কফি-ম্যাগি-স্লেজওলাদের দল। কোনওরকমে ওদের পাশ কাটিয়ে আবার চলা শুরু, কিন্তু আবার খানিক দূর যেতে না যেতেই - জ্যাম। সারি সারি ট্রাক, ট্যুরিস্টবোঝাই গাড়ি, প্রাইভেট গাড়ি, স-ব দাঁড়িয়ে। কী ব্যাপার? না আগে রাস্তা বন্ধ। কেন? ট্রাক ফেঁসে গেছে। সকাল থেকেই সব্বাই দাঁড়িয়ে, যতক্ষণ না ব্রো এসে সেই ট্রাক সরাতে পারবে, ততক্ষণের জন্য রাস্তা বন্ধ।

    তখন সকাল দশটা বাজে। একটা একটা করে গাড়ি কাটিয়ে এগোতে শুরু করলাম আমি আর গুরদীপ। সুমিত আগে বেরিয়ে গেছে, ওকে দেখা যাচ্ছে না - নিশ্চয়ই আগে কোথাও ওয়েট করবে আমাদের জন্য।

    একটা ... দুটো ... দশটা ... পনেরোটা ... কুড়িটা ... চল্লিশটা ... কত যে গাড়ির পাশ দিয়ে এগোলাম, আর খেয়াল নেই, অনন্ত জ্যাম, কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। সবাই ধৈর্যভরে অপেক্ষা করছে।

    শেষমেশ আটকে গেলাম একটা ট্রাকের পেছনে এসে। রাস্তাটা সরু, এদিকে পাহাড়ের দেওয়াল, ওদিকে খাদ, ট্রাকটা এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, কোনওদিক দিয়েই সেভাবে বেরোবার উপায় নেই।

    ভালোভাবে অ্যানালাইজ করে যা বুঝলাম, খাদের সাইডে যেটুকু জায়গা আছে, সেখান দিয়ে আমার বাইক বেরিয়ে যাবে। খুব সাবধানে বের করতে হবে অবশ্য, একটু এদিক ওদিক হলেই খাদের নিচে ... হাল্কা হাল্কা করে ক্লাচ ছেড়ে, হ্যান্ডেল সোজা রেখে দিব্যি আরামসে পেরিয়ে এলাম, সামনে পরের ট্রাকটার আগে একটু ফাঁকা জায়গা, সেখানে বাইক দাঁড় করিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম।

    গুরদীপ আটকে পড়েছে। পালসার যত সহজে বেরিয়েছে, দুদিকে লাদাখ ক্যারিয়ার আটকানো বুলেট তো অত সহজে বেরোতে পারবে না, তার জন্য বেশি স্পেস চাই। ফিরে এলাম আবার জায়গাটা দেখবার জন্য, এইবার উল্টোদিক থেকে ওই খাদের ধারের স্পেসটা দেখে আমার বুক কেঁপে গেল, আমি এইখান দিয়ে পেরিয়ে এসেছি? আক্ষরিক অর্থে লাইফ রিস্ক করে পেরিয়েছি, বুঝতেই পারি নি কী ডেঞ্জারাস রকমের সরু স্পেস! অজান্তেই একবার ঢোঁক গিললাম।

    সামনে আবার বাইক এগিয়ে যাবার জন্য জায়গা আছে, কিন্তু গুরদীপকে ছেড়ে এগনো সম্ভব নয়। ট্রাকওলাকে বললাম একটু আগিয়ে পিছিয়ে ট্রাকটাকে আরেকটু সাইড করে রাখতে, ড্রাইভার জাস্ট পাত্তাই দিল না। শেষমেশ পাহাড়ের সাইডেই যেটুকু স্পেস ছিল, গুরদীপ বলল, ওখান দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব, যদি কয়েকটা পাথর সরিয়ে দেওয়া যায়। ... তাই হল। দুজনে মিলে সামনে পড়ে থাকা কয়েকটা পাথর হাত লাগিয়ে সরিয়ে ফেললাম, গুরদীপের বাইক তাদের পাশ কাটিয়ে টুক করে ট্রাকের সামনে চলে এল।

    এর পরে জ্যাম খুব অল্পই অবশিষ্ট ছিল, জ্যামের একেবারে সামনে এসে দেখলাম দুই বরফের দেওয়ালের মাঝে পাথরের খাঁজে ইন্ডিয়ান অয়েলের একটা ট্যাঙ্কারের চাকা বসে গেছে। এমনভাবে বসেছে, এগোতে বা পিছোতে গেলেই ট্যাঙ্কার কাত হয়ে খাদে পড়ে যাবে। সোনমার্গের দিক থেকে ক্রেন এসেছে - চেষ্টা চলছে ট্যাঙ্কারটাকে উদ্ধার করার। দুদিকেই তুমুল জ্যাম।







    তবে বেশিক্ষণ ওয়েট করতে হল না, খানিক বাদেই ট্যাঙ্কার উদ্ধার হল, ব্রো এবং আর্মির জওয়ানেরা মিলে উল্টোদিকের ট্রাফিক সব সাইড করে দিল, আমরা বেরোবার রাস্তা পেয়ে গেলাম। কিছু পাথর, কিছু জল, কিছু মাটি - এইসবের ওপর দিয়ে আরও প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার চলার পরে আবার সামনে কাশ্মীর ভ্যালি দেখতে পেলাম।



    সোনমার্গের সেই রেস্টুরেন্ট - যেখানে গুরদীপ আর সুমিতের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, সেইখানে যখন পৌঁছলাম, তখন বাজে সাড়ে বারোটা। ঝটপট কিছু খাবারের অর্ডার দিলাম, বাড়িতে ফোন করলাম। এইবারে ননস্টপ, অন্তত শ্রীনগরে থামার কোনও সীন নেই।

    সোয়া একটাতে আবার শুরু হল পথ চলা। মন্দাকিনী নদীর পাশ দিয়ে সুন্দর রাস্তা, তারপরে আবার খানিক ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে শ্রীনগরে যখন পৌঁছলাম, তখন পিঠ তেতেপুড়ে একসা - এত গরম। একটা কোথাও থামা দরকার, এই জ্যাকেট সোয়েটার খুলে হাল্কা হতে হবে। কিন্তু শ্রীনগরের মধ্যে হাইওয়ে এত চওড়া যে ধারেকাছে কোথাও ছায়া নেই থামবার জন্য। ওইভাবেই এগোতে থাকলাম, চলতে চলতে এক সময়ে আমরা শ্রীনগর পারও হয়ে গেলাম। শ্রীনগরের বাইরে সোপোর বলে একটা জায়গা আছে, সেইখানে একটা জলখাবারের দোকানের সামনে থামলাম। গা থেকে ধরাচূড়ো খুলে কোল্ড ড্রিঙ্কস অর্ডার দিলাম, তেষ্টা পেয়েছে বেজায়।

    (আবার কাল। এবার ঘুমোতে যাই)
  • সিকি | ০২ জুলাই ২০১৫ ০৯:৪৭678735
  • ... কাল একটু ভুল লিখেছি লাস্ট প্যারায়, সোপোর নয়, যেখানে দাঁড়ালাম, জায়গাটা হল পামপোর। এই সেই জায়গা, যেখানে আসার দিন বৃষ্টির জন্য দাঁড়িয়েছিলাম, আর লোকাল কাশ্মীরিরা আমাকে প্রায় ঘিরে ধরেছিল। সেদিন বৃষ্টিতে শীতে কাঁপছিলাম, আজ রোদে তেতেপুড়ে যাচ্ছি।

    জ্যাকেট, পুলোভার খুলে ফেললাম, অল্প কষ্ট হলেও জামার নিচে থার্মাল ইনারটা খুললাম না, কারণ এই কাশ্মীর ভ্যালি শেষ হলেই আবার পাহাড় শুরু হবে, গরম কমে যাবে।

    দেখতে দেখতে পামপোর পেরোলাম, তাওপরে লেথিপোরা, অবন্তীপোরা, কাজিগুন্দ - এইখানেই সেই সারি সারি ক্রিকেট ব্যাটের দোকান, এখন আর আলাদা করে কিছু মনে হচ্ছে না, জাস্ট ঐ, সান্দা যেমন বলল, ক্রুজ কন্ট্রোল, আমি যেটাকে বলছিলাম অটো মোড, ওই অটো-মোডে চলেছি তো চলেছি। সকাল থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার পেরিয়ে এসেছি, বিকেল সাড়ে চারটে মত বাজে, এখন জম্মু আরও আড়াইশো কিলোমিটার। জম্মুর হাইওয়ে ধরে নিয়েছি, মোটামুটি চলনসই রাস্তা, যদিও সরু, কিন্তু নির্জন, সোজা রাস্তা, মাঝেমধ্যে দু একটা ছোট ছোট জনবসতি পড়ছে, সেইখানে একটু ট্রাফিক, তা ছাড়া শুধু চরৈবেতি, চরৈবেতি, আর কিছু দেখার নেই, কোথাও দাঁড়াবার নেই।

    সোয়া পাঁচটায় জওহর টানেল পার হলাম। টানেলের ভেতরে আরেকটু হলেই সুমিত বাইক স্কিড করে পড়ে যাচ্ছিল, মাঝে কাদা জমে ছিল, যাই হোক, সামলে নিয়ে টানেল থেকে বেরিয়ে আবার একটু দাঁড়ালাম। বনিহাল। এবারে আবার পেটে কিছু না দিলে নয়। গুরদীপ সুমিতের স্টেপল ফুড আলু পরোটা, আমার হল ব্রেড অমলেট। মজার ব্যাপার, টানেলের এপারে ওপারে ওয়েদার অদ্ভুত রকমের আলাদা, টেম্পারেচারও আলাদা হয়, এদিকে জম্মু ভ্যালি, ওদিকে কাশ্মীর ভ্যালি। কাশ্মীর থেকে ঢুকলাম যখন সব শুকনো, টানেলের ভেতর দিয়ে যখন বনিহালে ঢুকলাম - জম্মুর দিকে, টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তা ভিজে। স্নো-পিকের আর কোনও দেখা নেই।

    খেতে খেতে আলোচনা হল, আজ সম্ভবত জম্মু পৌঁছনো সম্ভব নয়। এখনও জম্মু প্রায় দুশো কিলোমিটার, বাজে প্রায় সোয়া ছটা। পাহাড়ি রাস্তায় অ্যাভারেজ তিরিশ-চল্লিশের বেশি স্পিড ওঠানো যাবে না - সেক্ষেত্রে দুশো কিলোমিটার পার করতে পাঁচ থেকে ছ ঘন্টা লাগবে, ননস্টপ চললেও। উধমপুর জম্মু থেকে সত্তর কিলোমিটার আগে, টার্গেট উধমপুরই রাখা হোক। সুমিত বলল, অত টার্গেট রাখার কিছু নেই, চলতে থাকি, রাত নটা সাড়ে নটার সময়ে যেখানে পৌঁছব, সেখানেই স্টে করব।

    ধীরে ধীরে অন্ধকার নামল। আসার দিন একা এসেছিলাম, প্রথমবারের জন্য নতুন রাস্তা, চলার আনন্দ বেশি ছিল, রাস্তার অবস্থার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখি নি, আর সকাল সকাল জম্মু থেকে বেরিয়েছিলাম, সারা রাস্তায় খুব বেশি ট্র্যাফিকও পাই নি - সেদিন ছিল রবিবার। আর আজ? একে তো অন্ধকার, তার ওপর মাঝেমধ্যে টিপিটিপি বৃষ্টি, আর উল্টোদিক থেকে - মানে জম্মুর দিক থেকে, আসতে থাকা কাউন্টলেস ট্রাক, ট্যাক্সি। হেডলাইটে কখনও চোখ ধাঁধিয়ে যায়, পরক্ষণেই রাস্তার গর্তে পড়ে বাইক লাফিয়ে ওঠে, সাথে সাথে ব্রেক মেরে বাইক স্লো করতে হয়, সেই ট্রাকের ক্যারাভান পেরিয়ে যাবার পর দেখা যায় সামনে জম্মুর দিকে চলেছে আরও দশটা ট্রাকের ক্যারাভান, তাদের একটা একটা করে ওভারটেক করা - এ যে কী অপরিসীম নার্ভের ওপর জোর লাগে, সেদিনের সন্ধ্যেটা আমি ভুলব না। যত রকমের অবস্ট্যাকল হওয়া সম্ভব অন্ধকার পাহাড়ী রাস্তায়, সমস্ত এক্সপিরিয়েন্স হয়ে গেছিল ওই এক সন্ধ্যেয়। রাস্তা একনাগাড়ে খারাপও নয়, একনাগাড়ে ভালোও নয়, কখন যে খারাপ রাস্তা আসে, কখন যে ভালো রাস্তা আসে, - মানে জম্মু শ্রীনগর রুটটা এই রকম, প্রথমদিকে মনে হবে, বাঃ, দারুণ রাস্তা তো, খানিক বাদে মনে হবে, বেশির ভাগটাই ভালো, মাঝেমধ্যে দু একটা খারাপ প্যাচ। ঘন্টাদেড়েকের মধ্যে মতটা পুরো একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যায় - তখন মনে হয়, আসলে বেশির ভাগ রাস্তাই খারাপ, কয়েকটা প্যাচ আসলে ভালো, তারপরে আবার মনে হয়, না না, বেশির ভাগ রাস্তাই আসলে ভালো ... এই করতে করতে ডেস্টিনেশনে পৌঁছে বোঝা যায় - রাস্তাটা আসলে ভালো আর খারাপ মিশিয়ে - ফিফটি ফিফটি।

    দাঁড়ালে তাও দু চারটে কথা বলার সুযোগ জোটে, একনাগাড়ে চলতে থাকলে খানিক বাদে একটা একঘেয়েমি গ্রাস করে। এই অন্ধকার, ট্রাকের সাথে নেগোশিয়েশন - মাথাটা কেমন যেন জ্যাম হয়ে যায়। নিজের মনেই একটা গান ধরলাম, তারপরে কী মনে হল, গানটা থামিয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল একটা ছড়া - একেবারেই আনরিলেটেড, আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকেবাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে। যতটা মনে ছিল, বিড়বিড় করে বকলাম, তার পরেই মাথায় এল জব কোই বাত বিগড় জায়ে - খানিক পরে খেয়াল করলাম আমি আবার ছড়া বলছি - আমি যখন ছোট ছিলাম, খেলতে যেতাম মেঘের দলে।

    এগুলো কি পাগলামির লক্ষণ? কে জানে? লে-তে গিয়ে যেটা আর সইতে হয় নি, সেই গায়ের ব্যথা ফিরে আসছে আবার। পিঠ টনটন করছে, হাতের আঙুলে সাড় নেই, জাস্ট নিজেকে এন্টারটেইন জরার অছিলায় কখনও ছড়া কাটছি, কখনও গান গাইছি - সে-ও আর কতক্ষণ ভালো লাগে? একটা সময়ে চুপ করে গেলাম নিজে নিজেই।

    রামবন পার হলাম, ঘড়িতে তখন আটটা কুড়ি। একটা চায়ের দোকান দেখে থামালাম। সুমিত প্রচণ্ড চা খায়, আমি দিনে দুবারের বেশি খাই না, আমি একটা ছোট লিমকার বোতল নিলাম। দোকানের সামনে তখন দাঁড়িয়ে ছিল একটা হাইওয়ে পুলিশ পেট্রল ভ্যান। জেঅ্যান্ডকে পুলিশের কয়েকটা কনস্টেবল আর একজন সর্দার পুলিশ অফিসার সেখানে তখন চা খাচ্ছিল। তিনখানা লাগেজবোঝাই বাইক দেখে এগিয়ে এল - লে যাচ্ছো?

    আমরা বললাম, না না, লে থেকে আসছি। শুনেই সর্দারের চোখ কপালে, লে থেকে আসছো? কটার সময়ে স্টার্ট করেছিলে?

    সর্দারকে আশ্বস্ত করলাম, না না, আজ সকালে আমরা কারগিল থেকে স্টার্ট করেছি। সাড়ে ছটায়। সর্দারের বিস্ময় তাও কমে না - কারগিল থেকে আসছো? উরেবাবা! এতটা নিজে নিজে চালিয়ে এসেছো? উরেবাবা! পারলে কী করে? উরেবাবা!

    তা, এসেছি কম না। সাড়ে তিনশো কিলোমিটার তো হবেই কারগিল থেকে। পাহাড়ি রাস্তায় সাড়ে তিনশো কিলোমিটার খুব একটা কম দূরত্ব নয়, তার ওপর এই রকমের ট্রাফিক, আর এই রাস্তার কন্ডিশনে। সকাল বেলায় আবার জোজিলা পাসও পেরিয়েছি, ওখানে জ্যামটা না হলে হয় তো এতক্ষণে আমরা পাটনি টপ পৌঁছে যেতাম। পাটনি টপ এখান থেকে আরও পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে।

    চা লিমকা খেয়ে সর্দারকে গুডবাই জানিয়ে আবার শুরু করলাম, হাত আর চাইছে না বাইকের হ্যান্ডেল ধরতে, অদ্ভূত শিরা টেনে টেনে ধরছে এইবারে। উধমপুরও বোধ হয় সম্ভব নয়, তা হলে পাটনি টপে?

    সেই ভালো, পাটনিটপে ঠাণ্ডা থাকে, (এটা জম্মু আর শ্রীনগরের মাঝে হায়েস্ট পয়েন্ট) আরামসে রাতে ঘুমনো যাবে। ... এগোলাম। নিকষ কালো অন্ধকার। য়ালো বলতে শুধু আমাদের বাইকের হেডলাইট। খানিক বাদে আবিষ্কার করলাম, আমি বিড়বিড় করছি, টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার।

    জোর করে চুপ করালাম নিজেকে। ক্লান্তিতে মাথা ভারী হয়ে আসছে, আর চলতে পারছি না। সামনে সুমিত, কিন্তু গুরদীপকে পেছনে দেখা যাচ্ছে না। একটু দাঁড়ালাম। খানিক পরে গুরদীপ এল, সে-ও আর টানতে পারছে না। আবার এগোলাম, আবার একটু বাদে পেছনে হারিয়ে গেল গুরদীপ। সামনে এবং পেছনে ট্রাকেদের ক্যারাভানের কোনও কমতি নেই, এই অবস্থায় মিনিটে মিনিটে ট্র্যাক রাখা সম্ভবও নয়।

    অনেকটা এগিয়ে যখন পাটনিটপ আর দশ কিলোমিটার মতন বাকি, সুমিত আবার দাঁড়াল, আমিও দাঁড়ালাম। বেশ খানিকক্ষণ বাদে ধীরে ধীরে গুরদীপ এল। ওকে চাঙ্গা করলাম এই বলে, আর মাত্র দশ কিলোমিটার, আজ পাটনিটপেই থাকব। এইবারে গুরদীপকে আমাদের আগে রাখা হল, ও যতই আস্তে চলুক, আমরা ওকে ওভারটেক করব না। পেছনে ধীরে ধীরে আমি আর সুমিত চলছি।

    রাত সাড়ে নটায় পাটনিটপে পৌঁছলাম। এক জায়গাতেই পর পর লাইন দিয়ে বেশ কয়েকটা হোটেল, ওর মধ্যেই একটা শস্তা দেখে হোটেলে তিন বেডের রুম নিয়ে আমরা চেক ইন করলাম। খাবারের অর্ডার করলাম। জম্মু এখনও একশো কিলোমিটার দূরে রয়ে গেল। মানে, আজকের ট্র্যাভেল, চারশো কিলোমিটার। কাল মেগা-রান। সুমিতকে কাল দিল্লি পৌঁছতেই হবে, পরশুদিন সকাল দশটায় ওর ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং আছে।

    দিল্লি এখনও সাতশো কিলোমিটার। জম্মুর পরে কী লেভেলের গরম, সে আমরা সবাই জানি। আমি জানি, আমি পারব না, বললাম, তোমরা এগিয়ে যেও, আমি যেখানে মনে হবে, পারব না - সেখানে হোটেল খুঁজে থেকে যাবো। আমার জন্য তোমরা আটকে থেকো না।

    গুরদীপ বলল, সিকিস্যার, আপনি চিন্তা করবেন না। আমার বাড়ি আম্বালায়। আম্বালা, দিল্লি থেকে ঠিক দুশো কিলোমিটার আগে। কালকের টার্গেট পাঁচশো কিলোমিটার রাখুন, রাতে আমাদের গ্রামের বাড়িতে আপনি গেস্ট। রাতে আমাদের ঘরে আপনাকে আসলি পঞ্জাবী আলু-পরাঠা খাওয়াবো। সকালে চা লস্যি খেয়ে আপনি দিল্লি চলে যাবেন, আমি রোববার স্টার্ট করব।

    তাই সই। খানিকক্ষণ ফর্মালিটি করে অবশেষে এই প্ল্যানই ঠিক হল। আম্বালা অ্যাট এনি কস্ট, সমস্যা হলে গুরদীপের গ্রামের বাড়িতে থেকে যাওয়া, না হলে সোজা দিল্লি।

    সিকিনীকে ফোন করলাম, সিকিনী বলল, তোর বাবাকে এক্ষুনি ফোন কর, উনি খুব চিন্তা করছেন। - কেন, চিন্তা কেন?

    - আজ খারদুং লা পাসে ল্যান্ডস্লাইড হয়েছে, দুজন মারা গেছেন - বাঙালি। আমাকে দু বার ফোন করেছেন তোকে না পেয়ে - আমি বলেছি যে তুই গতকালই লে থেকে বেরিয়ে এসেছিস, আজ দুপুরে তুই সোনমার্গ থেকে ফোনও করেছিস, কিন্তু তুই নিজে একবার কথা বলে নে, বুড়ো মানুষ, টেনশন করছেন।

    বাবাকেও ফোন করে আশ্বস্ত করলাম।

    রুমটা খুব একটা পদের না, শস্তা দেখতে গিয়ে রুমের পরিচ্ছন্নতাটা দেখা হয় নি, যাই হোক, কোনওরকমে খাওয়াদাওয়া সেরে সারা গায়ে ভোলিনি স্প্রে লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

    কাল কি দিল্লি হবে? পারব, পৌঁছতে?
  • Manish | 127.200.89.192 | ০৩ জুলাই ২০১৫ ০৯:৩৮678736
  • আজ অফিস আসার সময় এই ad টা দেখলাম একটি Petrol Pump এ। শ্মীকের জন্য তুলে দিলাম।

    I often relax at my first home. The rough & tough Terrain।
  • Manish | 127.200.89.192 | ০৩ জুলাই ২০১৫ ১০:০৩678737
  • শমীকের জন্য।
  • সিকি | ০৩ জুলাই ২০১৫ ১০:৫৫678738
  • থ্যাংকস। :)
  • kd | 127.194.233.28 | ০৪ জুলাই ২০১৫ ২২:১৯678739
  • পুরো টইটা পড়লুম। এক কথায়,দারুণ।

    প্রশ্নঃ ডায়ামক্স কি?
    একটা অবসার্ভেশন। বিবেক/প্রিয়ান্কা যে রাত সিকির সঙ্গে এক ঘরে ছিলো, একমাত্র সেদিনই বিবেক সিকির কাছ থেকে ডায়ামক্স চায় নি। তার মানে, আমি গেস করছি, এটা আইদার কন্ট্রাসেপ্টিভ অর ভায়াগ্রা টাইপ কিছু।
    কিন্তু আসল প্রশ্ন হ'লো এই যে, সিকি সঙ্গে করে এতগুলো নিয়ে গ্যালো কেনো? সিকিনী কি জানে?
    ঃ)
  • - | 109.133.152.163 | ০৪ জুলাই ২০১৫ ২৩:১৫678742
  • কেডির খুঁটি দেখলে প্রায়শই হনুর ভালুকের গল্পের সেশ লাইনটা মনে পড়ে যায় ঃ-D
  • সিকি | ০৪ জুলাই ২০১৫ ২৩:৪৮678743
  • ১০ই জুন ২০১৫ - দ্বাদশ দিন

    ঘুম ভাঙল সাড়ে সাতটায় - কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না। পাশে সুমিত তারস্বরে এবং গুরদীপ মৃদুস্বরে নাক ডেকে চলেছে। আমার কিনা নাক ডাকে না, আমি তাই নাক ডাকার আওয়াজ একদম সহ্য করতে পারি না, অবিশ্যি খুব ঘুম পেয়ে গেল অন্য ব্যাপার। যাই হোক, ধাক্কাধাক্কি দিয়ে তুললাম তাদেরকে। বাথরুমটা অতি জঘন্য, এখানে চান করার প্রশ্নই আসে না, তায় ঠাণ্ডাটাও বেশ ভালোই সকালের দিকে - তাই তৈরি হতে বেশি সময় লাগল না।

    ঘরের সামনেই বাইক দাঁড় করানো ছিল - তাই লাগেজ খোলবার দরকার হয় নি। বাইরে বেরিয়ে সামনের চায়ের দোকান থেকে অল্প করে একটু চা আর আলু চিপস ইত্যাদি খেলাম। নটার সময়ে স্টার্ট করা গেল।

    গায়ের ব্যথা মরে নি, যদিও এক রাতের ঘুমে আর ভোলিনির স্পর্শে একটু হলেও আয়ত্ত্বের মধ্যে ব্যথা। কিন্তু রাস্তা কি ভুলতে দেয়? নটা মানে বেশ বেলা, সমস্ত ট্রাফিক নেমে পড়েছে রাস্তায়, হলেই বা পাহাড়ের রাস্তা, ট্রাকের কোনও কমতি নেই, হয় উল্টোদিক থেকে আসা ট্রাককে পাশ দাও, নয় তো সামনে চলতে থাকা ট্রাককে রিস্ক নিয়ে ওভারটেক করো, আর তেমনি ভাঙাচোরা রাস্তা।

    উধমপুর আসার একটু আগে রাস্তা ভালো হয়ে গেল। উধমপুরে পাহাড় মোটামুটি শেষ, সেই রকমের উঁচু পাকদণ্ডী রাস্তা আর নেই। মোটামুটি ভদ্রগোছের। সাড়ে দশটার সময়ে উধমপুরের মার্কেটে আমরা থামলাম, ভারী কিছু খেয়ে নেবার জন্যে। সিঙারা, পকোড়া, আর কোল্ড ড্রিঙ্কস। খেতে খেতে বিশ্বদুনিয়া নিয়ে খানিক ভাট হল - দেখলাম সুমিত ছেলেটা বেশ পড়াশোনা করা। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা কি ইরান সিরিয়ার সংকট নিয়ে আমার থেকেও বেশি খবর রাখে। এবং বেশ ব্যালান্সড ভিউ - এদিকে গুরদীপই খালি কাশ্মীরিদের খিস্তি মেরে যাচ্ছে প্রথম দিন থেকে। শালা চুতিয়া কাশ্মীরিদের একটা পয়সাও হেল্প করা উচিত নয়, শালাগুলো পাকিস্তানে চলে যায় না কেন - ইন্ডিয়ার জঞ্জাল বালের দল - ঢ্যামনা - ইত্যাদি বেশ কয়েকদিন ধরেই শুনছি ওর জবানিতে। বেসিকালি - আমাদের ফেরার পথে শ্রীনগরে এক সেকেন্ডের জন্যেও না থেমে প্রথম স্ন্যাক্স কোল্ড ড্রিঙ্কস খাবার জন্য পামপোরে থামার কারণও সেই গুরদীপই। শালা চুতিয়াদের শহর শ্রীনগরে আমি একটা পয়সাও খরচা করব না।

    আমি শুনেছি, আর কাটিয়ে দিয়েছি - হতে পারে কোনও বাজে অভিজ্ঞতা - হতে পারে কাশ্মীরিদের নিয়ে কিছু বেসিক মাইন্ডসেট - যেটা প্রায় সমস্ত উত্তর ভারতীয়দেরই আছে, আলাদা করে আর জিজ্ঞেস করি নি। আজ, উধমপুরে সিঙারা খেতে বসে যখন কথায় কথায় বাংলাদেশ আর ইরান আর সিরিয়া উঠে এল, তখন মনে হল এইটাই সঠিক সময় গুরদীপকে জিজ্ঞেস করার - কেসটা কী? কাশ্মীরও নয়, স্পেশালি শ্রীনগরের নাম শুনলেই গুরদীপ কেমন তেলেবেগুনে জ্বলে যায়, এমনিতে বেশ শান্ত ছেলে।

    গল্পটা শুনলাম, গুরদীপের ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা নয়, সেকেন্ড হ্যান্ড অভিজ্ঞতা। সেই যে যাবার দিনে মথুরা থেকে আসা মাঝবয়েসী বুলেট কাপলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কারগিল ওয়ার মেমোরিয়ালের সামনে? সুমিত-গুসদেপদের সাথে তাঁদের প্রথম আলাপ হয় শ্রীনগরেই। দুই পার্টিই হাউসবোটে ছিল। এইবারে শিকারায় চড়ে ঘুরতে বেরিয়েছে, সেইখানে পাশ দিয়ে একটা শিকারা যাচ্ছিল - তাতে গরম গরম চিকেন শিক কাবাব ঝলসানো হচ্ছিল। মথুরার কাপল সেই শিকারাওলাকে জিজ্ঞেস করে, শিককাবাব কত করে - তাতে নাকি শিকারাওলা খুব মুখ বেঁকিয়ে জানায়, ইয়ে আপনে ঘরবালোঁ কে লিয়ে হ্যায়, তুম ভিখারী ইন্ডিয়ানলোগোঁ কে লিয়ে নেহি হ্যায়। বলে শিকারা নিয়ে চলে যায় অন্যদিকে। এঁরা ঘটনার আকস্মিকতায় এতই হতভম্ব হয়ে গেছিলেন যে প্রতিবাদ করার কথাও মাথায় আসে নি। গুরদীপরা শুনেছে, পরে, এঁদের কাছ থেকে - গুরদীপের মধ্যে হাল্কা করে মুসলিম হেট্রেড ছিলই, এই ঘটনা শোনার পরে স্পেশালি শ্রীনগর শহরটাই ওর কুনজরে চলে যায়।

    চায়ে-পে-চর্চা করে এই সব মনোভাব সারানো সম্ভব নয়, তাই হাল্কা করে ওকে বললাম, একটা দুটো ইনস্ট্যান্স দিয়ে এইভাবে পুরো একটা শহর বা কমিউনিটিকে জাজ কোরো না। মানুষ তো আলাদা হয় - এখানে অনেকেই ইন্ডিয়ার পার্ট হিসেবে নিজেদের মানতে চায় না, তার কারণও আছে, আফস্পা বলে একটা আইন চলে - এইসব নিয়ে খানিক হ্যাজ হল। যাই হোক, সোয়া এগারোটার সময়ে আমরা আবার উঠলাম এবং বাইকে স্টারট দিলাম। সকাল বেলার পাটনিটপের ঠাণ্ডা আর নেই, এখানে বেশ গরম, জ্যাকেট খুলে বানজি কর্ডে আটকে নিলাম, গায়ে এখন জাস্ট একটা সোয়েটার - জম্মু ছাড়িয়ে খুলব।

    অনেকটা এগিয়ে, কোন জায়গা কে জানে, রাস্তাটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সুমিত আর গুরদীপ দুজনেই পেছনে। মোড়ের মাথায় একটা পুলিশ পোস্ট। জিজ্ঞেস করে জানলাম, সোজা রাস্তাটি জম্মু যাচ্ছে - বাঁদিকেরটি নয়। বেশ খানিকক্ষণ বাদে সুমিত এল, তাকে হাঁইমাই করে ডেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম, সে-ও এল সঠিক রাস্তায়, এবার দুজনেই ওয়েট করতে থকলাম গুরদীপের জন্য।

    গুরদীপ এল খানিক বাদেই - আমরা যেমন তিনমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে একবার ইতস্তত করেছি, তারপরে পুলিশকে জিজ্ঞেস করে বা অন্যের হাঁকডাক শুনে সঠিক রাস্তায় এসেছি, গুরদীপ সেসবের ধার দিয়েই গেল না - রাস্তার এদিকে দাঁড়িয়ে দেখলাম, গুরদীপ এল, সোজা বাঁদিকের রাস্তায় বেরিয়ে গেল তিরবেগে।

    খাইসে। ওকে এবার ফিরিয়ে আনতে হবে। সুমিতকে বললাম, তুমি দাঁড়াও, আমি ধরে আনছি। বলে বাইকে স্টার্ট দিয়ে ফুলস্পিডে এগোলাম।

    অনেকদূর, প্রায় সাত আট কিলোমিটার দূরে গিয়ে গুরদীপের দেখা পেলাম। তারস্বরে হর্ন মেরে যাচ্ছি, গুরদীপ শুনতেই পাচ্ছে না - ফুলস্পিডে চালাচ্ছে ওর বুলেট, আমার ক্ষমতা কী ওকে ধরি।

    প্রায় আরও আড়াই কিলোমিটার পরে গিয়ে ওকে থামাতে পারলাম। আবার ফেরত সেই আমড়াতলার মোড়ে, তারপরে আবার জম্মুর দিকে এগনো। খানিক বাদেই জম্মুর অ্যাপ্রোচের সেই স্বপ্নের হাইওয়ের ওপরে গিয়ে পড়লাম, ছোট ছোট টানেল, দুদিকে লালচে ছোট ছোট টিলা-পাহাড়, আর রানওয়ের মত রাস্তা।

    জম্মু সিটিতে ঢোকার আর প্রশ্ন নেই - বাইপাস ধরে নিয়ে সোজা জম্মুর বাইরে। খানিকক্ষণের মধ্যেই দুপুর দেড়টার গরম টের পেলাম। প্রথমে একটা বড়সড় চকে দাঁড়ানো হল - রোদে দাঁড়ানো যাচ্ছে না, এত তেজ। সেখানে দাঁড়িয়ে পর পর এক গ্লাস লেবুজল আর দু গ্লাস গন্নে কা রস, মানে আখের রস খেলাম সবাই মিলে। খানিক বল এল। আবার এগোলাম, তিরিশ কিলোমিটার এগিয়ে আবার থামা, গলার ভেতর পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ, এক লিটার জলের বোতল কিনে - তিনজন তিন ঢোঁকে শেষ করে ফেললাম। আবার এগনো - পাঠানকোট এখনও অনেক দূর। জালন্ধর দুশো কিলোমিটার। আমরা সকাল থেকে সবে একশো মত কিলোমিটার এসেছি - আজকের টার্গেট ছিল সাতশো।

    আবার সেই প্রথম দিনের মত স্মৃতি ফিরে আসছে - গায়ের মধ্যে জামাগেঞ্জি ফুটন্ত কাপড়ের মত লাগছে। জিভ শুকিয়ে ভারী, গলার ভেতর পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছে। তফাত এটুকুই - আসার দিনে মুখ ঢাকা ছিল হেলমেটে, আজ হেলমেট আর মুখের মাঝে একটা কাপড়ের লেয়ার জড়িয়ে নিয়েছি - বাফ বলে, নাক মুখ ঢেকে চালাছহি, ফলে একটু কম কাহিল লাগছে।

    কিন্তু ... আজ এ রকম হচ্ছে কেন? এখনও জমু কাশ্মীরের চৌহদ্দি পেরোই নি, অলরেডি তিনবার দাঁড়িয়ে বান্টা (আমাদের ফটাশ জল), গন্নে কা রস, শিকঞ্জী (লেবু শরবৎ) খেয়েছি, তবু গরমের প্রকোপ ছাপিয়ে অদ্ভূত একটা ফীলিং হচ্ছে আজ - অসম্ভব কনসেন্ট্রেশনের কমতি ঘটছে। বাইক বা যে কোনও গাড়ি চালাতে যে টুকু অ্যালার্টনেসের দরকার হয়, সেই অ্যালার্ট থাকতে পারছি না মনে হচ্ছে। এখন আমরা সমতল রাস্তায়, পাহাড় দূরে সরে গেছে, ট্রাফিক বেড়ে গেছে সেই পরিমাণে - পাশ দিয়ে হুশ হুশ করে বড় বড় গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে, কেমন মনে হচ্ছে, আমি কনসেন্ট্রেট করে চালাতে পারছি না। এতদিন ধরে গাড়ি চালাচ্ছি, কখনও এই ধরণের ফীলিং হয় নি, কেমন মনে হচ্ছে, আমি পারলে এইখানেই রাস্তার ধারে শুয়ে পড়ব, যেন আমি কতকাল ঘুমোই নি।

    ভয় পেয়ে স্পীড কমিয়ে দিলাম, চল্লিশ-পঞ্চাশ। কিন্তু তাতেও লাভ হল না, কেমন মনে হচ্ছে ব্যালান্স রাখতে পারছি না, জাস্ট পড়ব আর ঘুমিয়ে পড়ব। এ এক্সপিরিয়েন্স কখনও হয় নি আমার। এ কি ডিহাইড্রেশনের ফল?

    সুমিত গুরদীপ নব্বইয়ের স্পিড তুলে বেরিয়ে গেছে কোন আগে, কিন্তু আমি আর এগোতে পারব বলে মনে হচ্ছে না - কিন্তু সেটা তো ওদের জানাতে হবে। ওদের দেখা যাচ্ছে না।

    মরীয়া হয়ে স্পিড তুললাম। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-পঁচাত্তর-আশি-নব্বই। দূরে দেখা যাচ্ছে ওদের। আরও বাড়াতে হবে। শরের মনের সমস্ত অ্যালার্টনেস, কনসেন্ট্রেশন একত্র করে স্পিড আরও বাড়ালাম, পঁচানব্বই - সামনে মনে হল ওরা থামছে। ... হ্যাঁ, থামছে। আবার বান্টা খাবে। আমি পৌঁছলাম ওদের কাছে। পেটের মধ্যে আগের খাওয়া জল শরবৎ খলবল করছে, গলা থেকে জিভ শুকনো। একটা গ্লাস তুলে সুমিত বলছে, স্যার, নিম্বুপানি পিওগে? আমার চোখে ঝাপসা লাগছে, জিভ নড়ছে না - বললাম, কিচ্ছু খেতে চাই না, সামনে যেখানে ছায়া পাবো, আমি - বেশি না, জাস্ট আধঘণ্টা - একটু ঘুমোতে চাই। তোমরা চাইলে এগিয়ে যেতে পারো, আমি আর পারছি না।

    ওরা বোধ হয় বুঝল - বলল, চিন্তা করবেন না, আপনি এগিয়ে যান, সামনে যেখানে প্রথম ধাবা পাবেন, সেইখানে চারপাই নিয়ে শুয়ে পড়ুন, আমরা পেছন পেছন আসছি।

    তাই হোক, বলে আমি আবার এগিয়ে গেলাম ওদের পেছনে রেখে। বেশ খানিকটা এগিয়ে দেখলাম বাঁদিকে একটা ধাবা, বেশ গাছপালার ছায়া আছে, আর বেশ কয়েকটা চারপাই-খাটিয়া বিছানো আছে। আমি সেইখানে গিয়ে দাঁড়াতেই, যেমন হয়, ধাবার লোক এসে, আইয়ে, খানা মিলেগা, ব্যায়ঠিয়ে, এইসব বলতে শুরু করল, আমি বললাম, দাঁড়াও, আমার সাথে আরও লোক আছে, তারা আসছে।

    খানিক বাদেই সুমিত-গুরদীপ চলে এল, আমি জাস্ট বললাম, তোমরা চাইলে এখানে লাঞ্চ করে নাও, আমার লাগেজটা দেখো - বলে চেয়ারে বসেই টেবিলে মাথা রেখে ঘুম দিলাম।

    ঘুম, কিন্তু ঘুম নয়, আধঘুম যেন, ঘুমের মধ্যেই শুনতে পাচ্ছি, ধাবার ভেতরে বক্সে পুরনো দিনের হিন্দি গান বাজছে - মহম্মদ রফি, আশা ভোঁসলে, এটা কি বাণী জয়রাম? - শুনতে পাচ্ছি, ওরা লস্যি খাবে বলছে, - শুনতে পাচ্ছি, ধাবার মালিক বলছে, গরমি বহোত হ্যায়, য়ঁহা সে দো কিলোমিটার আগে এক নহর হ্যায়, বঁহা ঠন্ডা পানি মিলেগা, চাহো তো জা কর নহা কে আ জাও। -শুনতে পাচ্ছি, ওরা বলছে, দরকার নেই - শুনতে পাচ্ছি, ওরা খাবার অর্ডার দিচ্ছে। কী রকম একটা বেহুঁশ অবস্থায় ছিলাম, খানিকক্ষণের জন্য। ধীরে ধীরে ঘোরভাবটা কাটল। উঠে জল চাইলাম। পর পর দু গ্লাস জল খেলাম। এইবারে মনে হল একটু ধাতস্থ লাগছে। উঠে বসলাম। আধঘণ্টার জায়গায় প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ঘুমিয়েছি। মাথা এখন অনেকটা ফ্রেশ লাগছে, আর সেই ঝিমভাবটা নেই। গরমও কম লাগছে। মুখ তুলে দেখলাম, নিমগাছ মাথার ওপরে। শুনেছি নিমগাছের ছায়া ঠাণ্ডা হয়।

    আস্তে আস্তে উঠলাম। রাস্তার ধারে হাতমুখ ধোবার জন্য একটা জলের ড্রাম রাখা ছিল ধাবার তরফে, আর একটা ভাঙা জাগ, মগ হিসেবে। জাগে করে জল তুলে থাবড়ে থাবড়ে মাথামুখঘাড় সব ভেজালাম। আবার এক গ্লাস জল খেলাম। জলটা মুখেমাথাতেই শুকিয়ে গেছে ততক্ষণে - আবার এক জাগ জল তুলে মুখেমাথায়ঘাড়ে। তারপর আবার বাফ দিয়ে মুখ ঢেকে বাইকে স্টার্ট দিলাম। বিকেল চারটে কুড়ি।

    আআহ্‌! হাওয়া আর তত গরম লাগছে না, বেশ ঠাণ্ডা। ফুরফুরে হাওয়ায় বেশ শান্তি হচ্ছে, আর কোনও কনসেন্ট্রেশনের অভাব নেই - এবার আমি চালাতে পারব। ...কিন্তু সে আরামও আর বেশিক্ষণ রইল না। খানিক বাদেই মুখের জল শুকিয়ে গিয়ে আবার লু-এর ঝাপটা লাগতে লাগল, আবার গলা থেকে জিভ শুকিয়ে মোটা হয়ে যাচ্ছে। এটা অবশ্য আমার একার হচ্ছে না, সবারই হচ্ছে, আবার দাঁড়ানো, আবার বান্টা বা আখের রস। এইবারে আখওলার কাছ থেকে আবার এক মগ জল চেয়ে সবাই মাথায় হুশ হুশ করে ঢেলে নিয়ে হেলমেট চাপালাম। আমাদের নিশ্চয়ই তখন পুরো কাকতাড়ুয়ার মতন দেখাচ্ছিল, কেউ ছবি তুলে রাখে নি, চুলগুলো সব আঠা-আঠা হয়ে গেছে, মুখের চারপাশে নুন নুন স্বাদ, গায়ে জামা চিপটে বসেছে, জুতোর ভেতরে পায়ের যে কী অবস্থা নিজেই বুঝতে পারছি না, কেবল সাড় আছে, এই পর্যন্ত।

    পাঠানকোট ক্রমশ এগিয়ে আসছে। এই স্ট্রেচটায় অনেকখানি রাস্তা জুড়ে রাস্তার পাশ দিয়ে যায় রেললাইন, কী সব অদ্ভূত নামের স্টেশন, এক্টার নাম উঁচি বস্‌সি, তার পরে আরেকটা স্টেশন এল, তার নাম কালা বকরা। ছোট ছোট জনপদ। পেরোলেই খেত দুপাশে, মাঝখানে মসৃণ হাইওয়ে। টিপিকাল পঞ্জাব।

    পাঠানকোট পেরোলাম, নব্বই কিলোমিটার আগে জালন্ধর। জালন্ধরে হাইওয়েতে একটা টার্ন আছে, বাঁদিকে ঘুরতে হবে। মনে জোর এনে চালিয়ে একসময়ে সেখানেও পৌঁছে গেলাম, টার্ন ঘুরে জালন্ধর সিটির বাইরে এসে বুঝলাম, আবার গলা না ভেজালে এগনো সম্ভব নয়। সুমিত গুরদীপ পেছনে কোথায় রয়ে গেছে কে জানে, বলাই আছে, আম্বালাতে পৌঁছে আমরা রি-ইউনাইট হবার চেষ্টা করব, তার আগে একে অপরের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। একটা শিকঞ্জীওলার ছাতার তলায় এসে বসলাম, একগ্লাস লেবু শরবৎ খেয়ে আবার প্রাণ ফিরে এল। ছেলেটাকে বললাম, তোমার এখানে একটু বসি? সে বেশ দাঁত কেলিয়ে বলল, বসুন না। কোথায় যাবেন? বললাম, আম্বালা - সে বলল, সে তো বহুদূর, এখন সামনে আসবে ফাগুয়ারা, তারপরে লুধিয়ানা, তারপরে খন্না, তার পরে আসবে আম্বালা।

    আমি ফ্যাকাশে হেসে বললাম, এই তো, এখন ছটা বাজে, আরেকটু পরেই সূরয ঢল জায়েগা, তব ইতনি তকলিফ নেহি হোগি। শরবতওলাও ঘাড় নাড়িয়ে বলল, হাঁ, আজ গরমি কুছ জাদা হি হ্যায়, সারা রিকর্ড আজ তোড় দিয়া লাগতা-সি।

    সোয়া ছটা অবধি বসে আবার বাইকে স্টার্ট দিয়েছি, দেখি পাশ দিয়ে গুরদীপ আর সুমিত বেরিয়ে গেল - এগিয়ে গিয়ে ওদের ধরলাম, কী ব্যাপার, তোমরা এতক্ষণ পরে? ভুল রাস্তায় চলে গেছিলে নাকি? - ওরা বলল, না না, আমরাও শিকঞ্জী খাচ্ছিলাম।

    সাড়ে ছটা নাগাদ গরম কমতে থাকল, আর অতটা কষ্ট তখন হচ্ছে না - আমার তো একেই একটা ভিউ ফাইন্ডার ভাঙা, অন্যটা দিয়ে পেছনে দেখার চেষ্টা করছিলাম সুমিত আর গুরদীপ পেছনে আছে কিনা - পেছনে তাকিয়েই কেমন অন্যরকম লাগল, আকাশটা এত কালো লাগছে কেন? আমি কি সানগ্লাস পরে আছি, আর সন্ধ্যে হয়ে এসেছে বলে এমন লাগছে?

    খানিকটা এগিয়ে দাঁড়ালাম, ওরা অনেক পেছনে চলে গেছিল, চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে পেছনে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেলাম, আকাশ ভর্তি কালো মেঘ, আর সেই মেঘ খুব তাড়াতাড়ি ছেয়ে যাচ্ছে পুরো আকাশে। জয়গুরু, বৃষ্টি হবে? হোক হোক!

    লুধিয়ানা এগিয়ে আসছে। এই স্ট্রেচটা খুব খারাপ রাস্তা, আর ভয়ঙ্কর জ্যামজট হয়। একটা ফ্লাইওভার তৈরি হচ্ছে, ফলে খানিক ডাইভার্সন আছে, আর সেখানে তিনদিক থেকে অটোরিক্সা ঠেলাগাড়ি চারচাকা দুচাকা সব্বাই মিলে একদম ক-রে কমললোচন শ্রীহরি খ-রে খগআসনে মুরারি কেস। আর ঠিক সেইখানেই ঘটল ঘটনাটা।

    পেছন থেকে একটা তুমুল হাওয়া এল, আর নির্মীয়মান ফ্লাইওভারের ঠিক পাশে তখন আমরা, সেই ফ্লাইওভারের ওপর যত বালি-মাটি-স্টোনচিপস জমা করা ছিল, সমস্ত একসাথে উড়িয়ে নিয়ে একটা প্রকাণ্ড কুণ্ডলী তৈরি হল, আর সেটা আছড়ে পড়ল আশেপাশে। নিমেষে চারদিক অন্ধকার, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, জ্যাম আরও তিনগুণ বেড়ে গেল, সমস্ত গাড়ির হেডলাইট জ্বলে গেল, আর চারদিক ঝাপসা।

    আঁধি, আঁধি। ধূলোঝড়। দিল্লিতে বসে অনেক আঁধি দেখেছি, এমন মেগাসাইজের আঁধি দেখি নি কখনও। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সাইজের কুণ্ডলী সব - চারপাশের ধূলোবালি নিয়ে উঠছে, আছড়ে পড়ছে, উঠছে, আছড়ে পড়ছে। আর সে কী দৃশ্য, সামনে দুটোর পরে তিনটে গাড়ি দেখা যাচ্ছে না, ভিজিবিলিটি প্রায় জিরো, পুরো মনে হচ্ছে কেউ যেন জলরঙ দিয়ে ধূসর রঙে লেপে দিয়েছে চারিদিক। লাকিলি সুমিত আর গুরদীপকে স্পট করলাম, একে অপরের ব্লিঙ্কার দেখে দেখে ফলো করতে থাকলাম। খানিক বাদেই আমরা লুধিয়ানা শহর পেরিয়ে এলাম।

    পেরিয়ে তো এলাম, কিন্তু আঁধি তো থামে নি। ফাঁকা জায়গায় হাওয়ার তাণ্ডব আরও তীব্র। এইখানে আমি বুঝলাম পালসারের মাহাত্ম্য। আমাদের সবারই মাথামুখচোখনাক-সারা গা প্রপারলি ঢাকা, ফলে উড়ন্ত ধূলোবালিতে আমাদের চালাতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না, কিন্তু হাওয়ার ঝাপটা সত্ত্বেও আমি খুব আরামসে পালসার নিয়ে ষাটের ওপর স্পিড তুলে এগিয়ে যাচ্ছি, আর ক্ষণে ক্ষণে সুমিতদের হারিয়ে ফেলছি। একবার অনেকখানি এগিয়ে যাবার পরে সুমিতদের জন্য অপেক্ষা করছি, ওরা এল, এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার চালাতে অসুবিধে হচ্ছে না? আমরা তো চল্লিশের ওপরে তুলতেই পারছি না, বুলেট হেলে যাচ্ছে হাওয়ার ধাক্কায়।

    সে কী কথা? বুলেট হেলে যাচ্ছে, আর পালসার হেলছে না? ঝড়ের তেজ কমে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, রাস্তায় ট্র্যাফিকও কমে গেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। আবার এগোতে থাকলাম, মাঝে মাঝেই গতি কমিয়ে দিতে হচ্ছিল ওদের সাথ দেবার জন্য।

    খান্না পেরোলাম রাত আটটায়। অন্ধকার ঘনিয়ে গেছে, হাল্কা বৃষ্টি হচ্ছে শুধু, শরীরে তেমান আর কোনও ক্লান্তি নেই, গলা শুকিয়ে যাওয়া নেই, এখন মনে হচ্ছে, চাইলে আমি আরও সাত আট ঘণ্টা টেনে দিতে পারি - কিন্তু না, আজ বেশি চাপ নেব না, আম্বালায় গুরদীপের বাড়িতে থাকাই মনস্থ করলাম। গুরদীপ বলল, চলুন স্যার, গ্রামের বাড়ি দেখবেন -

    অনেকক্ষণ চলার পরে হরিয়ানা ঢুকলাম। বাঁদিকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একটা দুটো মল, হোটেল, মোটেল, ঝকমক করছে আলোর বন্যায়। সেই রকম একটা মোটেলের ধারে এসে গুরদীপ সবাইকে দাঁড়াতে বলল, এটা রাজপুরা - এখান থেকে আম্বালা আরও কুড়ি কিলোমিটার।

    মোটেলে খানিক পনীর পকোড়া আর কোল্ড ড্রিঙ্কস খেলাম, খিদেও পেয়েছিল। রাত সোয়া নটা। আর কুড়ি কিলোমিটার এগোলেই কি গুরদীপের বাড়ি? - না না, আম্বালার ক্রসিং থেকে আরও কুড়ি কিলোমিটার এগোলে শাহবাদ। সেই শাহবাদের জংশন থেকে বাঁদিকে দশ কিলোমিটার ভেতরে গুরদীপের গ্রাম। মানে, এখান থেকে কুড়ি প্লাস কুড়ি প্লাস দশ - পঞ্চাশ কিলোমিটার আরো।

    নটা চল্লিশে স্টার্ট করলাম - এবং, বেশ খানিকটা - প্রায় দশ কিলোমিটার যাবার পরে প্রথম রাজপুরার সাইনবোর্ড দেখলাম, মানে, যেখানটায় আমরা রাজপুরা ভেবে থেমেছিলাম, সেটা রাজপুরা ছিল না। এইখান থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার।
    সা
    আম্বালা আসতে আসতে বৃষ্টি থেমে গেল, হাওয়াও পালটে আবার শুকনো হয়ে গেল - মানে এদিকে বৃষ্টি হয় নি।

    রাত দশটা চল্লিশে সেই শাহবাদ ফ্লাইওভারের নিচে এসে দাঁড়ালাম সবাই। সুমিতের থামলে চলবে না, ওকে আজ রাতের মধ্যেই দিল্লি পৌঁছতে হবে - দিল্লি এখান থেকে আরো দুশো কিলোমিটার। গুরদীপ আর আমি এখানেই থামব আজ। সবাই হাতে হাত মেলালাম, কাঁধে কাঁধ মেলালাম, বুকে জড়িয়ে ধরলাম একে অপরকে। যাত্রা প্রায় শেষের মুখে। কথা দিলাম, পরে কখনও আমরা নয়ডায় মীট করব।

    সুমিত বেরিয়ে গেল, আমার পকেটে তখন মোবাইল বাজছে, সিকিনীর ফোন, এত রাত হয়ে গেছে, তবু ফোন করি নি - বললাম, গুরদীপের বাড়িতে থাকব, আর দশ কিলোমিটার চলতে হবে। বললাম, বাবাকেও জানিয়ে দিতে, আমি আর ফোন করছি না এখন। ফোন রেখে বাঁদিকে বেঁকলাম আমরা।

    গ্রামের রাস্তা বটে, কিন্তু সুন্দর মসৃণ। সরু পাকা রাস্তা, দুধারে লম্বা লম্বা গাছের সারি, পুরো বুলেভার্ড, মাঝখানে আমরা দুটি মোটরসাইকেল চলেছি, আমাদের হেডলাইটের আলোর বন্যায় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। চারদিকে জনপ্রাণী নেই।

    সোয়া এগারোটায় ঢুকলাম গুরদীপের "গ্রামের বাড়ি"। চারদিকে ক্ষেতখামার, কিন্তু সমস্ত বাড়িই পাকা, দোতলা বা তিনতলা। সম্পন্ন চাষীদের ঘর সব। পাক্কা পঞ্জাবী ফ্যামিলি - যাদের সাথে দেখা হলে নমস্কার বা নমস্তে বলা যায় না, বলতে হয় সৎশ্রী অকাল জী। আমার মুখ দিয়ে অবশ্য ওসব বেরনো মুশকিল, আমি হাতজোড় করে নমস্কারই জানালাম। গুরদীপের বাবা পুরো সর্দার, পাগড়িদাড়িসম্বলিত। গুরদীপ সর্দার নয়। এটা জানতাম শিখ ফ্যামিলিতে সবাইকে ব্যাপটাইজড না হলেও চলে, জাস্ট বংশের এক ছেলে হলেই হয়। জিজ্ঞেস করে জানলাম, গুরদীপের দাদা সর্দার। গুরদীপ তাই সর্দার হবার চাপ নেয় নি।

    কতদিন বাদে কে জানে, চান করলাম, শ্যাম্পু মাখলাম। সাড়ে বারোটায় খেতে বসলাম, গরম গরম রুটি, ঢ্যাঁড়শভাজা, ডাল, ভাত, দই। গুরদীপের ছোট্ট দশমাসের ছেলে, প্রথমে তো বাবাকে দেখে চিনতেই পারছিল না, তারপরে বাবার কোল ছেড়ে আর নড়েই না, বাবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল শেষে।



    আমাদেরও আর শরীর চলছিল না। খেয়ে উঠে ঘুমিয়ে পড়তে এতটুকু সময় লাগল না। সারাদিন ওই গরম সহ্য করার পর রাতের এসি খুব আরাম দিচ্ছিল।

    ======================================================================================
    ১১ই জুন, ২০১৫ - ত্রয়োদশ দিন

    সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। গুরদীপ নিয়ে গেল ছাদে, সেখান থেকে খানিক গ্রামের শোভা দর্শন হল। বাংলার গ্রামের সঙ্গে পঞ্জাবের গ্রামের কোনও মিলই নেই। তাগড়াই তাগড়াই জাঠ গরু, দূরে ময়ূর দেখা যাচ্ছে, ক্ষেতের কোনওদিক সবুজ, কোনওদিক সোনালী।

    ব্রেকফাস্ট হল ঘিয়ে চোবানো আলু পরোটা আর দই দিয়ে। গুরদীপের কাঁধে হাত রেখে বললাম, গুরদীপ, এবার তা হলে বিদায় দাও, এগোই - এর পরে আবার রোদ চড়ে যাবে, এগনো মুশকিল হবে।

    আজ বৃহস্পতিবার। গুরদীপ এখন এখানেই থাকবে। রবিবার ও ফ্যামিলি নিয়ে নয়ডা ফিরবে, আজকে আমার শেষ দুশো কিলোমিটার একা জার্নি। নটা কুড়ি নাগাদ স্টার্ট করলাম। যেতে যেতেই গরম বেড়ে গেল, দু জায়গায় দাঁড়িয়ে আবার শিকঞ্জী বা লেবু শরবৎ খেতে হল। পৌনে বারোটা নাগাদ প্রথম যখন রাস্তাজোড়া সাইনবোর্ডটা দেখতে পেলাম - ওয়েলকাম টু ন্যাশনাল ক্যাপিটাল ডেলহি, সমস্ত ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে গেল, নিমেষে। পেরেছি, আমি পেরেছি, দীর্ঘ বারো দিনের জার্নি শেষ করে এখন আমি বাড়ি থেকে আর মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূর।

    এর পর? আলিপুর-মুকারবা চক-মজনু কা টিলা-শাহদরা-দিলশাদ গার্ডেন-আনন্দ বিহার পেরিয়ে বাড়ি আসতে কতক্ষণই বা লাগে? ... তা লাগে, দিল্লির ট্র্যাফিক, দিল্লির জ্যাম। সাড়ে বারোটায় বাড়ির পার্কিং-এ এসে দাঁড়ালাম। সিকিনী তো অফিসে, মেয়েকে ফোন করে বললাম ফ্রিজ থেকে দুটো জলের বোতল নিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে পার্কিং-এ আসতে।

    মেয়ে তো বাবাকে দেখে পুউরো চমকে চৌতিরিশ। দেখার মত চেহারা হয়েছিল - সানগ্লাসের দাগ ধরে চোখের চারপাশ সাদা, বাকি মুখটা ঝুপ্পুস কালো, একেবারে জায়েন্ট প্যান্ডার মতন। ঘরে ঢুকে প্রথমে চিতপাত। একে একে সিকিনীকে ফোন করলাম, বাবাকে ফোন করলাম - বাবা তো নিজের জন্মে এমন পাগলামি কখনও শোনে নি - কেউ মোটরসাইকেল নিয়ে দিল্লি থেকে কাশ্মীরের শেষমাথায় যেতে পারে - বেদম টেনশনে ছিল বেচারা, আমার ঘরে ফেরার খবর পেয়ে খুব শান্তি পেল। এই শান্তির ডিক্লারেশনটাই আমার কাছে খুব বড় পাওনা, আমিও বোধ হয় শান্তি পেলাম।

    পেলাম কি?

    রাতের দিকে সুমিতকে ফোন করলাম। সুমিত আগের দিন রাত সাড়ে তিনটেয় দিল্লি পৌঁছেছিল, পরদিন সকালে অফিসে মীটিং সেরে ঘুমিয়েছে।

    নিজেকে চেনার তাগিদ ছিল, নিজের সামনাসামনি হবার দরকার ছিল। হয়েছি। কিন্তু চিনলাম কি নিজেকে? জানি না। শহরের চেনা ছকে ঢুকলে নিজের কাছে নিজেই কেমন অচেনা হয়ে যাই। আরও দুচারবার বেরিয়ে পড়তে হবে হয় তো শেষরাতে, এবার বেশি ম্যাচিওরিটি নিয়ে, বেশি ভালো প্রিপারেশন নিয়ে। এবার অন্য কোনও রুটে, অন্য কোনও গন্তব্যে। ঘরের মধ্যে একলা বসে থাকি যখন, আমাকে ভেতর থেকে তাড়া দেয় আরেকটা কেউ, তাড়া দিচ্ছে এখনও। অপেক্ষায় আছি, কতদিনে এই তাড়া খাওয়াটা অসহ্য হয়ে ওঠে। আবার রাস্তায় নামব। নামবই।
  • সিকি | ০৪ জুলাই ২০১৫ ২৩:৫০678744
  • কাবলিদা :)

    ডায়ামক্স হল হাই অল্টিটিউডে মোশন সিকনেস কাটাবার ওষুধ। মূলত অক্সিজেনের অভাবে অনেকের শরীর খারাপ হয়, ডায়ামক্স সেই সময়ে শরীরকে অক্সিজেনের সাপ্লাই দেয় হার্টবীট বাড়িয়ে।
  • | 183.17.193.253 | ০৫ জুলাই ২০১৫ ০০:৫৫678745
  • এই বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছেটুকু হয়তো সবারই আছে-বাস্তবে করে ফেলার জন্যে কোনো অভিনন্দনই যথেষ্ট নাঃ)
    লেখাটার সঙ্গে বেশ চলছিলাম।শেষ হয়ে গেলো দেখে একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রোজ একবার এসে দেখে যাওয়ার পালা সাঙ্গ হলো..

    বিবেক আর প্রিয়াংকার সঙ্গে ফোনে কথা হলো?তারা ঠিক আছে তো?
  • i | 134.149.71.88 | ০৫ জুলাই ২০১৫ ০৩:০৬678746
  • এই যে ভেতরের একজন সম্পূর্ণ অন্য কেউ তাড়া দেয় -লোকটা বেরিয়ে পড়ে তখন -নাইলন দড়ি দিয়ে লাগেজ বেঁধে-খুব যে সবল শরীর স্বাস্থ্য তাও নয়-বাড়িতে ছোটো মেয়ে, স্ত্রী-অচেনা পথে তবু সে একলা বেরিয়ে পড়ে তার সমস্ত অপারগতা নিয়েও..লেখা আর ছবির থেকেও এই ব্যাপারটা অসম্ভব দাগ কেটেছে মনে। কোনদিন যদি পারি একটা টেখার ইচ্ছে রইল এইরকম চরিত্র নিয়ে।
    আর একটা ব্যাপার হল লেখার শুরুতে 'বাঁধাকপিবিহীন' শব্দটা চোখে আর মনে কট কট করে লেগেছিল -সেই সঙ্গে একটা আশা নিয়ে লেখাটা ফলো করেছি-গোটা জার্নির শেষে এই শব্দ ব্যবহার আর থাকবে না।তাই হয়েছে। এটাই আসল জার্নি তা নয়, কিন্তু আমার কাছে এই ব্যাপারটা খুব বড় মনে হয়েছে-লেখাটা এই আশা নিয়ে ফলো করেছিলাম বলেই হয়ত।
    ভালো থাকো সিকি।
    জয় হো।
  • kumu | 11.39.32.18 | ০৫ জুলাই ২০১৫ ০৮:২৪678747
  • তাড়া,তাড়া।
    পথের মায়া জানে শুধু পথিক।
    এই পথিককে অভিনন্দন,সফল দীর্ঘ যাত্রার জন্য ও এই অসাধারণ লেখাটির জন্য।
    ভবিষ্যতের সব যাত্রা এমনই সফল হোক।বন্ধুত্বে ও আনন্দে পূর্ণ থাক।
  • ফরিদা | ০৫ জুলাই ২০১৫ ০৮:৫৬678748
  • কোনো বাহবাই যথেষ্ট নয়। বিগ হাগ্স ডুড।
  • san | 113.245.14.65 | ০৫ জুলাই ২০১৫ ০৯:০৩678749
  • অনেক অনেক অভিনন্দন -
  • সিকি | ০৫ জুলাই ২০১৫ ০৯:৪৩678750
  • সবাইকে ধন্যবাদ, আরও ছোটখাটো টুকরোটাকরা স্মৃতি মনে আসছে, সেগুলো লিখব, সকলের মন্তব্যের আলাদা করে উত্তর দেব, আমার নিজেরও হয় তো আরও কিছু লেখার আছে, বলার আছে, লেখার শেষে যে লেখা পড়ে থাকে তলানি হিসেবে, লিখব।

    আপাতত মামীকে লিখি, বিবেক প্রিয়াঙ্কা আগের দিন রাতেই দিল্লি ফিরেছিল, প্রিয়াঙ্কার নাইট শিফটের কাজ, সেটা সেরে সে পরদিন সকালে ঘুমিয়েছিল। যত দুবলা ভেবেছিলাম, তত দুবলা নয় কেউই। পুপ্পুর সর্দির খবর আর নিই নি।

    এখন আমরা ভার্চুয়ালি আছি, একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপে। ছবি এক্সচেঞ্জ করছি। আমার ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্টে বিবেক তনওয়ার আর গুরদীপ সিংকে পেয়ে যাবে সবাই, আর বিবেকের প্রোফাইল থেকে প্রিয়াঙ্কা খান্ডেলওয়ালকেও সহজেই খুঁজে পেয়ে যাবে। :)
  • Rectangular Parallelepiped | 117.167.108.171 | ০৫ জুলাই ২০১৫ ০৯:৫১678751
  • লাদাখ আমার বিশেষ ভালো লাগেনি। কাজেই সেই গল্পে যাবো না। কিন্তু সিকির ট্রাভেলগ পড়ে স্পেলবাউন্ড। গাড়ি টাড়ির ব্যাপারে আমি সেফটি ফার্স্ট মেনে চলি - তাই পার্টনার যাবে না শোনার পর আমি ট্রিপই বাতিল করে দিতাম। রিস্ক নিয়ে একা বেরিয়ে পড়ার ক্ষমতা আমার নেই। সিকির আছে, তাই কুদোস।
  • kumu | 11.39.32.18 | ০৫ জুলাই ২০১৫ ০৯:৫৬678753
  • ফরিদা আমাদের সকলের হয়ে একটু লিখে দাওনা এই অসামান্য যাত্রাটিকে ভেবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন