রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন স্বভাব-শিল্পী। তিনি যেমন সুগায়ক, গীতিকার ও সুরকার ছিলেন তেমনি হারমোনিয়াম, সেতার ও পিয়ানো বাজাতেন দক্ষতার সঙ্গে। সময়ের আগে প্রেসিডেন্সি কলেজের পাট চুকিয়ে ছিলেন সঙ্গীতপ্রিয়তার কারণে। বিষ্ণু চক্রবর্তী ও তৎকালীন বিখ্যাত গায়ক যদুভট্ট এর কাছে তালিম নেওয়ার পরও শ্রীকণ্ঠ সিংহ এবং মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে সঙ্গীত চর্চা করতেন। শুধু তাই নয় যন্ত্র সঙ্গীতেও তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। মুসলমান ওস্তাদের কাছে বেহালা আর দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের কাছে পিয়ানো বাজানো শিখেছিলেন। সঙ্গীতের সকল ধারাতেই তাঁর আগ্রহ ছিল। নিজেও শিখতেন আর অন্যদের উৎসাহ দিতেন। বাংলা গানের সুর নিয়েও নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। তিনি বাংলা গানে পাশ্চাত্য সুরের প্রবর্তন করেন। বিভিন্ন রাগের মিশ্রণে নতুন সুর তৈরি করতেন। তখন ঠাকুরবাড়িতে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবিঠাকুরের সব ভাইয়েরা ব্রাহ্ম সঙ্গীত রচনা করতেন। জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুর ব্রাহ্ম সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশী গান, উচ্চাঙ্গ ব্রহ্মসঙ্গীত, হাসির গান রচনা করেছিলেন আর কোনো কোনো গানে সুরও দিয়েছিলেন। ‘ঐ যে দেখা যায় আনন্দ ধাম অপূর্ব’ গানটিতে সিন্ধুবিজয় রাগ ব্যবহার করেন। ‘কেন আনিলের গো এ ঘোর সংসারে’ গানটিতে সিন্ধুরা রাগ ব্যবহার করেন। ‘তাহারা চরণ ছায়ে’ গানে কেদারা ও ‘অন্তরে ভজরে তালে’ ভুপালী রাগ ব্যবহার করেন। রবীন্দ্রনাথ বাল্মিকী প্রতিভায় ও কালমৃগয়াতে বেশ কিছু গানে তাঁর নির্দেশেই পাশ্চাত্য সুর আইরিশ মেলোডির সুর যোগ করেন। তিনি ইটালিয়ান সুরের সঙ্গে ঝিঁঝিট রাগ মিশিয়ে ইটালিয়ান ঝিঁঝিট নামে একটি নতুন সুর সৃষ্টি করেছিলেন। এই ধরনের আরও কয়েকটি নতুন সুর হল-আইরিশ বিলাবল, স্কচ কেদারা, স্কচ ভুপালী, স্প্যানিশ বাউল ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম গান বাঁধার প্রেরণার উৎস ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর একথা রবীন্দ্রনাথের কথা থেকেই জানা যায়। “এ সময়ে পিয়ানো বাজাইয়া জ্যোতিদাদা নূতন নূতন সুর তৈরি করায় মাতিয়াছিলেন। প্রত্যহই তাহার অঙ্গুলি নৃত্যের সঙ্গে সুর বর্ষণ হইতে থাকিত। আমি এবং অক্ষয়বাবু তাহার সেই সদ্যজাত সুরগুলিকে কথা দিয়া বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টায় ছিলাম। গান বাঁধিবার শিক্ষানবীশ এইরূপে আমার আয়ত্ব হইয়াছিল”। সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারের কথা ভেবে তিনি ‘বীণাবাদিনী’ নামে একটি বাংলা সঙ্গীত পত্রিকা প্রবর্তন করেন। বর্তমানে আ কার মাত্রিক স্বরলিপি পদ্ধতির সংস্কার সাধন করেন তিনিই। এই পদ্ধতির জনক রাজা শৌরীন্দ্রমোহন। সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করার জন্য ‘ভারত সঙ্গীত সমাজ’ গঠন করেন। এ ধরনের আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যেমন – ‘সঞ্জীবন সভা’, ‘বিদ্দ্বজন সমাগম’।
তিনি শুধু সঙ্গীতচর্চা আর সঙ্গীত পত্রিকা প্রবর্তন করেই সন্তুষ্ট থাকেন নি। নানা দিকে তাঁর আগ্রহের সীমা ছিল না। তিনি ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত নাট্যকার। ‘এমন কর্ম আর করব না’ নামে একটি নাটক লেখেন পরে যার নাম হয় অলীকবাবু। তাঁর বিখ্যাত নাটক সরোজিনী বাংলা নাট্যজগতে সাড়া জাগিয়েছিল। গীতিনাট্যগুলি খ্যাতিলাভের ক্ষেত্রে বিশেষ পিছিয়ে থাকেনি - অশ্রুমতি, ধ্যানভঙ্গ, স্বপ্নময়ী, বসন্ত লীলা, পূর্ণবসন্ত ইত্যাদি বেশ খ্যাতি লাভ করেছিল। জ্যোতিরিন্দ্র নাথ সম্বন্ধে অবনীন্দ্রনাথের উক্তি -
“তখন জ্যোতিকাকামশায় নাট্যজগতে অদ্বিতীয়, অপ্রতিহত প্রতাপ তাঁর। বইয়ের বাজার ছেয়ে গিয়েছিল তাঁর বইয়ে বইয়ে। জায়গায় জায়গায় তাঁর নাটক অভিনয় হত।”
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িটি সাহিত্য ও সঙ্গীত জগতের বহুমূল্য রত্নে ভরপুর ছিল। রবি প্রতিভার হীরক ছটায় সবই ম্রিয়মান হয়ে গেছে, জ্যোতিরিন্দ্র নাথ ও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলা নাট্যসাহিত্য ও সঙ্গীতের জগতে তাঁর অবদান তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
তথ্যসূত্র - রবীন্দ্রনৃত্যের রূপরেখা- শম্ভুনাথ ঘোষ ও অনিন্দিতা ঘোষ।