কখনো কখনো পকেটে হাত বাড়ায়। আজ এক চিলতে দেখে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ফ্লাইওভারে অবস্থানকালে সে অনেক নীচের দিগন্ত ছাড়িয়ে যাওয়া সরু রেলপথখানি প্রতিদিন একবার হলেও দেখে নেয়, লাইনের বস্তিগুলোতে চলা জীবনপ্রবাহ তাকে বিষাদগ্রস্ত করে, সামাজিক বৈষম্য নিয়ে চিন্তার খোরাক দান করে। সেখান থেকে ফ্লাইওভারে উঠে আসা হাতই হয়ত তার চোখের সামনে প্রসারিত হয়। কিন্তু একই হাত বার বার এলে বিস্বাদ লাগে ব্যাপারটা। পাতা হাতের বাজারও একই অর্থনীতি চলে মনে হয়, পাতা হাতেও নতুনত্ব চাই, ভিন্ন গল্পের স্বাদ চাই হাতের বিবৃতিতে। ... ...
ভালবাসি, ভালবাসি! সবাই এই মুহূর্তে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বিদেশকে। আর সবার ভালোবাসা-ভরা কথা নিষিক্ত করে চলেছে বিদেশকে। খুবই ভাল, ভাল সব কথা। শুনতে শুনতে বিদেশের নিজেরই নিজেকে কেমন অজানা অচেনা মনে হচ্ছে। বাব্বা এত গুণ তার ছিল তাই তো জানত না সে! ... ... ...
সকালে উঠে মশারি সরিয়ে নামতেই চোখ গেল সামনে রাখা টেবিলের দিকে। আর যেতেই মাথাটা গরম হয়ে গেল অবিনাশবাবুর। কাল একটু রাতের দিকে মাসকাবারি মুদির জিনিসপত্র ডেলিভারি দিয়েছিল। তুলে রাখার ইচ্ছে হয় নি বলে টেবিলের ওপর সব রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সানলাইট সাবান ছিল, মশলা, তেল আর তার সঙ্গে পাঁচ কেজি চাল। বাকি সব ঠিক থাকলেও চালের প্যাকেটের প্লাস্টিক কুটিকুটি করে কাটা, চাল ছড়িয়ে আছে টেবিলের ওপর যার কিছুটা মেঝেতেও গড়িয়ে নেমেছে। ইঁদুর! ... ...
কিন্তু সেই ছিল আমার সত্যিকারের স্মার্ট ফোন… না ভুল হচ্ছে, স্মার্ট বললে তাকে অপমান করা হয়, সেই ছিল স্মার্টেস্ট। আমার সেই ফোনটার একটা জীবন ছিল, সে আমার কথা শুনতো, আমায় বুঝতো। সে যে আমাকে চিনতে পারত, বিশ্বাস হয় না? হাতে নিলে টের পেতেন, কেমন গাইগুই করছে! তার একটা ভাষা ছিল - আমি বুঝতে পারতাম; তার একটা আলতো স্পন্দন - সে শুধু আমার কাছেই ধরা দিত। তারও ছিল চাওয়া-পাওয়া, আমায় সে মুখ ফুটে বলেনি, কিন্তু আমি জানতাম, আমি তার কান্না অনুভব করতে পারতাম। কিন্তু কি যে হল! কি করে এতটা অমানুষ হয়ে গিয়েছিলাম? ... ...
তিন-চারদিন পরের কথা। রাস্তার নারকীয় জ্যাম আমার অফিস টাইমের আয়ু আধা ঘন্টা কমিয়ে দিয়ে মেজাজকে সপ্তমে তুলে রেখেছিল। এই সময়টুকুতে কতটুকু এগিয়ে যেতে পারতাম দিনের কাজে, যতবারই ভাবছিলাম, আমার স্নায়ুদেশ ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল। কোন কাজে মন বসছিল না। নিতান্ত অনিচ্ছায় সেদিনের স্থিতিপত্র হাতে তুলে নিতেই চোখ চলে গেল ঋণের ফিগারে। বেড়েই চলেছে, প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ে, মনে হয়, দুনিয়ার শেষদিন পর্যন্ত বেড়ে চলবে, কারণ যত না ঋণ শোধ হয়, তার থেকে অনেক অনেক বেশী ঋণ অশোধিত থাকে এই পৃথিবীতে। প্রায় মগ্ন হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু একটা ছায়া সংকেত আমায় চোখ তুলতে বাধ্য করল, দেখি দুলাল একটা ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে, সেই আগের মত, কিছুটা বাঁকানো, ঝুঁকে পড়া দেহ, আর চোখ তেমনি আবডালে রাখা। ... ...
"কোনো মেসেজ এলে তোমরা যখন মোবাইলের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে হাসিহাসি মুখে কিছু টাইপ করো , সেই মুহূর্তের ছবি কেউ তোমাকে তুলে দেখিয়েছে? " প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি নিঃসঙ্গতা বেসিনে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখেচোখে রাগের ছাপ। রাগলে নিঃসঙ্গতার সুন্দর গোল মুখ চৌকো হয়ে যায়। নাম না করতেই এসে গেছে , অবশ্য এমনিতেও অনেকদিন বাঁচবে, নিঃসঙ্গতা তো অবিনশ্বর। ... ...
“ইস্ কী গরম! কতবার না বলছি, জানালাগুলো খোলা রাখবা! আলো-বাতাস নাই ঘরটাতে, এই জন্যই তো অসুখ-বিসুখ ছাড়ে না’’ বলেই পর্দাটা টানতে শুরু করলো সুহা। ওর মা এভাবে বলতো, এখনো বলে, সংসার থা করে জাঁকিয়ে বসেছে, অথচ এখনো ভাইয়ের উপর শাসনটুকু চালানো চাই। এদিকে পর্দাটা ছিল ভারি, আর সুহার কোমল হাতে তা পুরো মেলতে সময় নিচ্ছিল। ওদিকে আস্তে আস্তে বিভিন্ন টুকরো জোড়া লেগে লেগে একটি আস্ত বাড়ি গড়ে উঠছিল জানালার ওপারে। যখন পুরো পর্দাটা সরে গেল, একটি অচেনা জগতের দরজা যেন খুলে গেল আমার চোখের সামনে। এই ঘোর অমাবস্যাতেও সেখানে আলোর বন্যা। তার তীব্র প্রদাহ শুষে নিল আমার সব, থেমে গেল ভাবনা, চিন্তা, স্পন্দন। শুধু এইটুকু মনে আছে, মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত পৃথিবী আমার উপর চাপা পড়ল যেন। ... ...
সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা মারে একটা লরি। গাড়ির মালিক উকিল। সে পুলিশের দ্বারস্থ হয় কিন্তু পুলিশ তাকে শেষ অবধি বুঝিয়ে দেয় তার গাড়ি কে কোন লরি নয় একটা গরু ধাক্কা মেরেছে। ... ...
বাবা গাছগুলোকে নিয়ে পড়ে থাকলো। দিন নেই, রাত নেই - ওগুলোকে জলখাবার খাওয়াল, রোদে গোসল করিয়ে আনলো, দোকান থেকে মালমশলা কিনে নিজের হাতে বেঁটে আর পিষে স্প্রে করলো। বাবার মত অবসর থাকলে আমিও তো করতুম! চাকরি খোঁজা, ট্যুইশানির পাশাপাশি ক্লাব চালানো দুটো! পাড়ার কতগুলি ছেলেপুলে আমার দিকে তাকিয়ে, তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আসে, শলা-পরামর্শ, আপোস-রফা; মাঝে মাঝে ট্যুর থাকে, ট্রেকিং চলে। আমি আনমনে গাছগুলি আর বাবাকে দেখতে থাকি। বাবা গাছগুলির সাথে এমনি মিশে থাকে যে, কোনটা গাছ, আর কোনটা বাবা -আলাদা করে চিনতে পারি না, প্রবল এক দৃষ্টি বিভ্রমে ভুগতে থাকি। ... ...
দুইদিন পর রোজিনা আচলের কাপড় ঘঁষতে ঘঁষতে যখন ছেলের জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনা করা শুরু করেছিল, রওশানারা তাকে থামিয়ে দিয়ে কণ্ঠটা চিকুন করে জানতে চেয়েছিলেন, “আগে ক, পোলার কুনো ব্যারাম আছেনি?” এক গাল হেসে দিয়ে রোজিনা মোটা কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছিল, “ যেই হারে ব্যায়াম করে, ব্যারাম আইবো কোথ থনে? নিশ্চিন্ত থাহেন ফুবুয়াম্মা, পোলারে একটা কাশ দিতেও হুনে নাই কেউ কহনো। ‘’ ... ...
আচমকা একটা খটখট শব্দটা শুনতে পেল - বন্ধুটির ট্যবলেট পর্দায় স্থির হল মোরসালিনের প্রজেক্টর। ভাবনায় ডুবে রয়েছে তার হৃদয়ের বন্ধু; তার আচমকা, অস্বাভাবিক মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। হঠাৎ কি মনে করে মোরসালিনের লেখাসমেত ইমেইলগুলো এক সাথে করল সে। নিঃশ্বাস পড়ছে না মোরসালিনের, শিহরিত নেত্রে চেয়ে রয়েছে বন্ধুটির ইমেইল পেইজে, হয়ত এখুনি কোন সম্পাদকের কাছে প্রেরিত হবে। ... ...
দিল্লির নয়ন-মনোহর গম্বুজের তলে যুবরাজ বুঘরার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ত! সাপের থেকেও পেঁচানো এর প্রাসাদ, ভয়ংকর কুটিল এর খিলান! এদিকে যে খেয়ালী ও আত্মভোলা যুবরাজকে নিয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না, সে-ই তাকেই তিনি পাঠালেন বাংলায়, যার বিদ্রোহের ঘনঘটায় অষ্টপ্রহর শংকিত থাকতো দিল্লীর দরবার। ফরমানটা জারি হওয়ার পর থেকেই নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন বুঘরা; কী জানি কোন অচেনা মুল্লুকে তার বলী হতে যাচ্ছে! কিন্তু যতই এগিয়ে আসছিল একটি নদীবিধৌত সবুজ আঁচল , মন-প্রাণ জুড়িয়ে আসছিল বুঘরার, আর মনে হচ্ছিল, এতদিন বুঝি এর অপেক্ষাতেই ছিলেন! বাংলার প্রকৃতি ছিল খেয়ালি -এমন ঘনঘোর বর্ষা এমন অঝোর ধারায়, এক টানে, এক সুরে - আর কোথাও দেখেননি বুঘরা! খেয়ালি বাংলা ও বুঘরা হয়ে উঠলেন হরিহর আত্মা! আজ সেই আত্মাকেই ছেড়ে দেয়ার কাতর আহবান উঠে এসেছে পিতার কণ্ঠে! কিন্তু কি করে সম্ভব! কি করে! ... ...
মেনকা নিশ্চয় হ্যালুসিনেট করছিল। এইসব ডিজিটাল সহকারীদের মাঝে মাঝে গল্প বলতে বললে একদম বানিয়ে বানিয়ে এসব গাঁজাখুরি গল্প বলে। ... ...
স্নিগ্ধার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছে ননদ রূপা। তার কাছে শোনা হয়ে গেছে কয়েদিদের মধ্যে খুনীদের একটু কম সন্দেহের চোখে দেখা হয়। নিতান্ত পেশাদার খুনী না হলে তারা হয়তো উত্তেজনার মূহুর্তে অপরাধ করে ফেলে কিন্তু স্বভাব অপরাধী হয় না। চোররা সবচেয়ে খারাপ। ডাকাতরা মাঝারি। নিখিল আবার ঠিক চোরডাকাত কিছুই নয়। ফরেস্টে কাঠ চুরির কেসে ফেঁসে গেছে। কোন কাঠমাফিয়ার হয়ে জেল খাটতে রাজি হয়েছিল, অর্থের বিনিময়ে। মায়ের অসুখ। টাকার খুব দরকার। ভেবেছিল কিছুদিন কয়েদ খেটে ছাড়া পেয়ে যাবে। তারপর যা হয়, মামলাই উঠছে না।... ... ...