যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ঐতিহ্যের মধ্যে র্যাগিং-এর ঘটনাগুলিকে (একটি বীভৎস মৃত্যুর ঘটনার পাশাপাশি যখন বহু বছর ধরে হয়ে আসা অত্যাচারের বিভিন্ন বয়ান উঠে আসছে) কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে, এইটা আমাদের ভাববার বিষয়। ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে র্যাগিং একটি অতিসংক্রামিত সামাজিক ব্যাধি। বিভিন্ন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০০০ সাল থেকে ভারতের বিচারব্যবস্থা এবং শিক্ষানিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি র্যাগিং প্রতিরোধে কড়া ব্যবস্থার নিদান দেয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ব্যবস্থাগুলির প্রায় কোনওটিই লাগু হয়নি। এবং ছাত্রদের মধ্যেও র্যাগিং বিরোধী কোনও সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। বরং, এই কথা শোনা গেছে, ২০০৭ সালে নির্বাচিত ছাত্রপ্রতিনিধিরা র্যাগিংকারীদের শাস্তির বিরোধিতা না করায় বাকি ছাত্রদের একটি অতিসরব দলের চাপে তাদের পদত্যাগ করতে হয়। আমরা জানি, র্যাগিং পরম্পরামেনে চলে। জুনিয়র ব্যাচের ছাত্ররা পরের বছরের জুনিয়র ব্যাচকে র্যাগ করে। এক প্রতিষ্ঠানের র্যাগিং-এর গল্প শুনে আরেক প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা র্যাগিং-এ উদ্বুদ্ধ হয়। সম্ভবতঃ সেই ধারা ধরেই কলোনিপ্রভুদের বহু বদঅভ্যেসের মতন এই প্রথাও এদেশের শিক্ষিত সমাজে ঢুকেছিল। আর, পরম্পরা হিসেবে একটি অপরাধকে বহুজনের মধ্যে মান্যতা দিয়ে দিলে, তথাকথিত বিবেকবান ব্যক্তিও অনেকক্ষেত্রে তাতে লিপ্ত হতে সংকোচ বোধ করেন না। কিন্তু, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহাসিকভাবে এ পরম্পরার বাহক, তা তো ঠিক এর বিপরীতমুখী। ... ...
১৯৩৬ সালের বসন্ত কাল। আর মাস খানেক বাদেই রয়েছে ইউএসএর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল বিভাগে ভর্তির পরীক্ষা। সেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেই এখন বেশ কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বছর বাইশের তরুণী জিন ফ্রান্সেস ট্যাটলক (Jean Frances Tatlock)। তা নাহলে এতক্ষণে হয়তো তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কোনও কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার সক্রিয় কর্মী তিনি। ট্যাটলকের জন্ম ইউএসএর বিখ্যাত পঞ্চ হ্রদ তীরবর্তী মিচিগান প্রদেশে। তবে বর্তমানে পশ্চিম ইউএসএর ক্যালিফর্নিয়া প্রদেশের বার্কলে শহরের বাসিন্দা তিনি। বার্কলে শহরের কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের ঘরোয়া সভাই হোক বা ডক শ্রমিকদের পথসভা- সর্বত্র হাজির থাকেন তিনি। কিন্তু ইদানীংকালের সভা সমিতিতে বড় একটা দেখা যাচ্ছে না তাঁকে। ওই যে, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল বিভাগে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ... ...
ফেসবুকের ওই পোস্টটার মধ্যে হয়তো আঠা ছিল। আর স্ক্রল ডাউন করতে পারলাম না। একজন লিখেছেন, ‘স্বপ্নদীপের মৃত্যু নিয়ে এই শোরগোলের আয়ু আর মাত্র কয়েকদিন, যে কদিনের মধ্যে নতুন কিছু এসে এই ঘটনাকে চাপা না দিয়ে দেয়।’ দিন তিনচারেক আগের সেই পোস্টের ভবিষ্যৎ-বাণী ফলতে দেখেছি ইতিমধ্যেই। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন, বিগ ডে মহা-ধামাকায় তেলের সঙ্গে আটা ফ্রি আর অনলাইন খুচরো বিপণিতে নতুন কোনও ফোন উদ্বোধনের লিমিটেড টাইম ডিলের গর্জনে ক্রমশ আড়ালে চলে যাচ্ছে স্বপ্নদীপের মৃত্যু। কবীরের সুমনের গানে ছিল, 'শ্লোগান পাল্টে হয়ে যায় ফিসফাস'। এমন শিরোনামও ক্রমশ পর্যবসিত হবে টুকরো খবরে। তারপরে, আমাদের মন থেকে স্রেফ মুছে যাবে এই অকালপ্রয়াণ। পুজো এগিয়ে আসছে ক্রমশ। আশ্বিনের শারদপ্রাতে, বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ উৎসবে নিজেদের গায়ে জরির ঝালর পরব সবাই। আজকে যে খবরে মন উথালপাথাল, তা জাঙ্ক হতে দেরি নেই আর। ... ...
“যেদিন আমার শ্বশুড় বাড়িতে আগুন দিল, তখন চারদিকে কানাকানি, গুনগুন হচ্ছে। তখন আমি বুঝতে পারছি, কী একটি ঘটনা ঘটছে কিন্তু আমাকে কেউ আর প্রকাশ করে না। তখন আমি খুব অস্থির হয়ে গেছি জানার জন্য- ‘তোমরা বলো না কেন? কী হয়েছে?’ কেউ বলতে চায় না। আমি মামার বাড়ির দালানে ছিলাম। কাউকে না বলে লুকিয়ে আমি ছাদের উপর গিয়েছি। যেয়ে দেখি ছাদ থেকে—নৌকা দিয়ে মিলিটারিরা আমার বিছানা, আমার বালিশ, আমার তোষক, আমার কোল বালিশ, আমার বেড কাভার— আমি এগুলো দেখে চিনে ফেলেছি। ওরা নৌকায় আরাম করে শুয়ে। আমি তখন চিৎকার করছি। আমার বান্ধবীরা— খালাতো, মামাতো বোনরা ছিল। ওরা দৌড়ে গিয়েছে আমাকে থামানোর জন্য। তখন তো জেনেই ফেলেছি যে আমার শ্বশুড় বাড়িতে আগুন দিয়েছে।...” ... ...
যাদবপুর, যাদবপুর, যাদবপুর….কান ঝালাপালা করছে… যেন পৃথিবীর আর কোথাও আমরা হেনস্তা করি না…. যেন আমাদের হাতে রক্ত লেগে নেই! আমার ছাদে গিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে….না-আ-আ-আ। এই হেনস্তা প্রতিনিয়ত, প্রতি মূহূর্তে হয়ে চলেছে। বিভিন্ন ফর্মে। আর তার ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কত কত জীবন। স্বপ্নদীপ মরে গেছে। সবাই মরে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিছু বিশাল না শুকোনো ক্ষত নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ৱ্যাগিং আসলে ক্ষমতার ভাষা, জোর ফলানোর ভাষা। সে ভাষা কোথায় নেই? আমরা “অপর”কে সম্মান দিতে জানি? জানলে আভিজাত্যের প্রতিমূর্তি জয়া বচ্চন ফিল্মফেয়ারের মঞ্চে ঋতুপর্ণর হাতে বটুয়া ধরাতেন না। জানলে শিক্ষক থেকে অফিসের বস অব্দি আমরা সবাই আমাদের অধস্তনদের সঙ্গে ক্ষমতার ভাষা ব্যবহার করতাম না। আমাদের স্কুলে-কলেজে শারীরিক শাস্তি বন্ধ করার জন্য আইন আনতে হত না। ... ...
ওপরের গল্পটা বাংলার বা ভারতের বা পৃথিবীর হাজার হাজার ছেলের গল্প। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কখনো এর চেয়েও অনেক হাজারগুণ বেশি bullying আর সিস্টেম্যাটিক হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়। তাদের মধ্যে কিছু স্বপ্নদীপ থাকে, যাদের উপর অত্যাচার এমনভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় যে বেচারাদের আর লড়াই করার ইচ্ছেটুকুও আর বেঁচে থাকে না। উপরের গল্পের ছেলেটা লড়াইটা লড়তে পেরেছিল। যুদ্ধটা ওর জন্য অতটাও কঠিন ছিল না। একটা একটা করে স্বপ্নদীপ নিভে যায়। আমাদের অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠে। জনমানসে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে। বাজারি আনন্দের পাতায় ঝলসে ওঠে সাংবাদিক/সাহিত্যিক/সম্পাদকের কলম। প্রাক্তন হেনস্থাকারী রাস্তায় নামে কালো পতাকা নিয়ে। টিভির পর্দায় মুচমুচে গসিপ। বাইট দিয়ে চলে যায় কলেজ পড়ুয়া, পথচারী, চেনা জানা মুখ। পণ্ডিত লোকজন সিপিএম তৃণমূলের কাজিয়ায় মন দেন। শ্রেণী সংগ্রামের যোদ্ধারা শহর-মফস্বলের দ্বান্দ্বিকতার গভীর বিশ্লেষণ করেন। ... ...
‘দ্য ম্যান উইথ নো নেমে’র মাথায় উঠল ছেঁড়াফাটা বাদামি টুপি, গায়ে কোঁচকানো কাপড়চোপড়, হাতে রইল পুরনো ০.৪৫ রিভলভার। এমনই এক চরিত্র যে নিজের আর্থিক মুনাফা ছাড়া অন্য কোন বিষয়েই আগ্রহ দেখায় না বিশেষ। এবং যার নৈতিকতা পেন্ডুলামের মত সতত দোদুল্যমান। তাকে একবার মনে হয় ন্যায়পরায়ণ, আবার পরমুহূর্তেই মনে হয় দুর্নীতিগ্রস্ত। ছবির সর্বত্র ‘দ্য ম্যান উইথ নো নেম’কে ভাল এবং খারাপের মধ্যে যে কোন একটা দিককে বেছে নিতে হয়। দর্শক হিসেবে আমরাও ধন্দে থাকি, কোনও এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কী হবে তার প্রতিক্রিয়া? দর্শকের পক্ষে গল্পের ভবিষ্যদ্বাণী খাড়া করাটাই অসম্ভব হয়ে ওঠে। আর এটাই হল ছবিতে তৈরি হওয়া বেশ কিছু শক্তিশালী মুহূর্তের জ্বালানী। এই নামহীন মানুষটি আগ বাড়িয়ে অন্যদের রক্ষা-টক্ষা করে না, অন্যায়-টন্যায় সংঘটিত হচ্ছে দেখলেও থাকে নিরুত্তাপ উদাসীন, এবং ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের উপকার করে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সে নিশ্চিত হচ্ছেন এই উপকারের বিনিময়ে সেও উপকৃত হবে। ... ...
লিলিয়ানার মুখে জার্মানে ‘আমি চঞ্চল হে’ শুনে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। একটি ইয়ুগোস্লাভিয়ান মেয়ে তার আপন ভাষায় ‘আমি চঞ্চল হে’ পড়ে সেটি সে এক বাঙালিকে শোনালো জার্মান তর্জমায়! দেশ ছাড়ার আগেই শুনে এসেছি - পূর্ব ইউরোপের বহু দেশে ‘আওয়ারা’ ছবির কল্যাণে রাজ কাপুর একটি সুপরিচিত নাম। পারিবারিক সূত্রেও তার সত্যতা উপলদ্ধি করেছি – শুধু রাশিয়া, ইউক্রেনে নয় - রোমানিয়াতেও রাজ কাপুরের নাম কিছু লোক এখনও মনে রেখেছেন। কিন্তু লিলিয়ানার ভারত রাজ কাপুরের নয়, রবীন্দ্রনাথের। বলকানের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়লে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতির আরও সন্ধান পেয়েছি – এমনকি ভয়ভোদিনার (সার্বিয়া) রাজধানী নোভি সাদ শহরে দেখেছি জাতীয় থিয়েটারের সামনের ফুটপাথে (হলিউডের স্টার ওয়াকের মতন) মার্বেলে খোদিত আছে ‘১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথ সেখানে পদার্পণ করেছিলেন’। ... ...
এসকেলেপিয়াস, আমরা বোধ করি সবাই জানি, প্রাচীন গ্রিসের মেডিসিনের পৌরাণিক দেবতা। তাঁর মন্দিরে যাবার জন্য, অবশ্যই রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে, এই আকুলতা। মন্দির, মঠ, চার্চগুলোতে আর্ত মানুষের নিরাময় করার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকত সে আদিম কাল থেকে। ইউরোপের উদাহরণে আবার ফিরে আসব। তার আগে ভারতের প্রথম আয়ুর্বেদ গ্রন্থ তথা শাস্ত্র বলে স্বীকৃত চরক-সংহিতারও সংকলনকালের সময়কালের কিছু আগে পরে (আয়ুর্বেদের সবচেয়ে মান্য গবেষক মিউলেনবেল্ডের মতে এ সময়কাল খুব বেশি হলে ১৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের আগে হতে পারেনা, বা খুব বেশি হলে ১০০ খ্রিস্টাব্দ – মিউলেবেল্ড, A History of Indian Medical Literature, IA, পৃঃ ১১৪) বৌদ্ধযুগে কিছু হাসপাতালের হদিশ পাওয়া যায়। ... ...
স্বাধীনতার পর আমি রোকেয়া হলে ফিরে আসি। এক রুমে আমরা তিনজন থাকতাম। রুমে এসে দেখি আমাদের ডেস্ক উলটাপালটা, বইপত্র ছড়ানো ছিটানো, আমার বিছানা বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত। রক্তাক্ত বিছানা, বড় বড় রক্তের ছোপ, ততদিনে কালো হয়ে গেছে। এখানে কোনো মেয়েকে ধরে এনে ধর্ষণ করে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সারা ঘরে রক্তের পচা গন্ধ। এখনো মনে হয়—কোন মেয়ে ছিল সে? পাকিস্তান আর্মির যে মেজর ছিল, সে নাকি মন্ত্রী হয়েছিল পাকিস্তানের। তাদের কোনো বিচার হয়নি এখন পর্যন্ত। ... ...
টাটা এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের ৭৭তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে কিছু বলবার জন্য আপনাদের আমন্ত্রণ পেয়ে আমি একই সঙ্গে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ এবং যারপরনাই সংকুচিত। দেশের প্রাচীনতম কর্মী সংগঠনগুলোর অন্যতম এই সংগঠনের বিপুল প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতি ও অর্জিত অভিজ্ঞতার তুলনায় আমার জ্ঞান অতি তুচ্ছ। সুতরাং আজকের এই সভায় এমন কিছু বোধ হয় বলতে পারব না, যা আপনাদের অজানা। তা সত্ত্বেও আপনাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি এই কারণে যে, জানা কথাগুলোও বারবার বলার প্রয়োজন হয়। এটাই জ্ঞানীদের অভিমত। যে বাস্তবতায় আমরা দিন কাটাই তাকে যদি বদলাবার দরকার হয়, অথচ কাম্য পরিবর্তনটি আসে না, তাহলে পরিবর্তনের প্রয়োজন ও উপায় নিয়ে আমাদের কথা বলে যেতেই হবে। যেমন, আমাদের যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তানুশীলক অমর্ত্য সেনকে বারবার একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, আপনি পুরনো কথাগুলোই বারবার বলে যাচ্ছেন, নতুন কিছু বলছেন না, কেন? তাঁর উত্তরটি অপরিবর্তিত, যতক্ষণ পুরনো সমস্যাগুলো থাকবে ততক্ষণ সেগুলো নিয়ে কথা বলে যেতে হবে, কারণ নতুন কথা বলার জন্য নতুন বাস্তবতার প্রয়োজন। ... ...
এবারের অধিবেশন দুব্রভনিক। ক্রোয়েশিয়ায় আমার যাতায়াত আছে, জাগ্রেবের সঙ্গে মোলাকাত হলো কয়েকবার। তবে দুব্রভনিক একবারে আলাদা। এক অসামান্য শহর যাকে ভূমধ্যসাগরের মুক্তো বলা হয়—পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। লাল টালির ছাত! প্রথমবার ছবি দেখেই মনে হয়েছিল সমুদ্রের ভেতরে গিয়ে শহর ও কেল্লা বানানোর কি প্রয়োজন ছিল? ডাঙ্গায় জমিজমা কি অপ্রতুল? অনেক ঝড় ঝাপটা বিশেষ করে সাড়ে চারশো বছর আগের বিধ্বংসী ভূমিকম্প, ১৯৯২-১৯৯৫ সালের গৃহযুদ্ধ – এই সব সামলেও দুব্রভনিক একবারে পিকচার পোস্টকার্ডের শহর। কাশীকে হার মানানো সরু সরু গলি। সেখানে পসরা সাজিয়ে বসে আছেন দোকানিরা। চলমান জনতার স্রোত। সকল ইউরোপীয় ভাষা শোনা যায়! স্ত্রাদুন নামক ৩০০ মিটারের সদর পথে হাঁটলে মনে হয় একটা রূপকথার ভেতরে ঢুকে পড়েছি স্বপ্নে। ঘুম ভাঙলেই হয়তো দেখব লন্ডন টিউবে বসে আছি! ... ...
কুকিদের একাংশ দাবি করছে যে কেন্দ্রীয় সরকার মণিপুরের ৬টি জেলার ৬৭ হাজার হেক্টর জমি পাম তেল উৎপাদনের জন্য চিনহিত করেছে। বিজেপি সরকারের পেটোয়া শিল্পপতিদের হাতে ঐ জমি যাতে বিনা বাধায় তুলে দেওয়া যায়, সেজন্য দাঙ্গা লাগিয়ে আগে থাকতেই জনজাতিদের হটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই অভিযোগও যে অমূলক নয় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই প্রসঙ্গে রাজ্য সরকারের পরস্পরবিরোধী বয়ান। মণিপুরের তথ্য কমিশনার এই অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও গুয়াহাটিতে খুব সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উত্তরপূর্বাঞ্চলের পাম চাষ সম্পর্কিত আলোচনায় হাজির মণিপুরের কৃষি অধিকর্তা ও রাজ্য পাম অয়েল মিশনের উপদেষ্টাকে সামনে রেখে গোদরেজ কম্পানি জানিয়েছে, গত বছরই মোট ৭টি জেলায় পাম চাষের জন্য সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে। সংখ্যালঘু কুকি অধ্যুষিত চুড়াচাঁদপুর তাদের মধ্যে একটি ( সূত্র, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩শে জুলাই। ২০২৩)। অন্তর্জালে ঘুরে বেড়ানো একটি ভিডিওর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ... ...
দোষটা কি শুধুমাত্র অতিমারীই? অতিমারীর কাঁধে বন্দুক রেখে কোনো বৃহত্তর শক্তি তাঁর স্বার্থসিদ্ধির জন্য ময়দানে নেমে পড়েনি তো? প্রশ্নটা গুরুতর। এবং পাপী মনে প্রশ্নটা আসছে এই কারণেই যে, অতিমারী আগে-পরে বিগত পাঁচ বছরের রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাবে, কমবেশী প্রতিবছরই গড়ে প্রায় দু-মাস করে গরমের ছুটি দেওয়া হয়েছে স্কুলগুলোতে। এর পাশাপাশি রয়েছে গড়ে প্রতি বছর একটি করে ভোট-উৎসব, যার জন্য কমবেশি পনেরো দিন থেকে এক মাস স্কুল-বাড়িগুলো অধিগ্রহণ করা হয়। যেদিন এই নিবন্ধটি লিখছি, সেদিনকার সংবাদপত্রেই এই মর্মে প্রতিবেদন রয়েছে যে, দুমাস গরমের ছুটি এবং একমাস পঞ্চায়েত জনিত ছুটির পর দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার একটি স্কুলে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি দশ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে, ফলে ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধান শিক্ষককেই মাইক হাতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচারে নামতে হয়েছে। ... ...
গোড়াতেই নিজেদেরকে প্রশ্ন করা যায় – এরকম হিংস্রতা, রক্তপাত, অবান্তর মৃত্যু, সরকারি সম্পত্তির ধ্বংস আমাদের কাছে খুব অজানা বা অপ্রত্যাশিত ছিল কী? ওপরে যে ছবিটি আছে সেরকম ছবি তো আমরা যখন তখন দেখে থাকি। আমাদের স্নায়ু বা চিন্তার ওপরে আদৌ কোন ছাপ ফেলে কি? আমরা তো সইয়ে নিয়েছি। আমাদের স্নায়ুতন্ত্র, মনন, অনুভূতি বা, একটু বাড়িয়ে বললে, আমাদের সুকুমার প্রবৃত্তি এগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। Numbing of our collective consciousness – আমাদের সামগ্রিক চেতনার বিবশতা। কিন্তু এগুলো তো একদিনে হয়নি। ধাপে ধাপে, প্রতি মুহূর্তে সমস্ত রকমের মিডিয়ার অপার মহিমায়, ছাপার অক্ষরে এবং নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় (যদি কখনো কিছু হয়ে থাকে) আমরা একটি অসংবেদনশীল পিণ্ডে পরিণত হচ্ছি? যদি সমাজতত্ত্ব এবং আমাদের পারিবারিক জীবনের প্রেক্ষিতে দেখি তাহলে সবচেয়ে ক্ষতিকারক যে ফলাফল জন্ম নিচ্ছে তার চরিত্র হল শিশু থেকে কিশোর এবং সদ্য যৌবনে পা-রাখা (বাংলা শুধু নয়, সমগ্র ভারত জুড়েই) প্রজন্ম একে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিচ্ছে। এমনকি হিংস্রতার মাঝে আমোদও পাচ্ছে। ... ...
ডে স্কুলে একবার আমাদের স্কুলে একজন অঙ্কের টিচার এলেন। সারনেম মান্ডি। অর্থাৎ শিডিউলড ট্রাইব। তিনি যে কিছুই জানেন না—সেটা প্রমাণ করার জন্যে আমাদের চেষ্টার খামতি ছিল না। সেই বয়সে মব মেন্টালিটিতে তাঁর প্রতি কী মনোভাব ছিল আমার—সেটা ভাবলে এখনো লজ্জাই পাই।এমন নয় যে আমাদের স্কুলে বাকি অঙ্কের মাস্টাররা সকলে রামানুজনের মত ব্রিলিয়ান্ট ছিলেন, কিন্তু ঐ যে জাত—ঐতেই আমরা বুঝে গেছিলাম, যে উনি কিচ্ছু জানেন না। জাতের দোহাই দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। এ নিয়ে কথাও হত আমাদের মধ্যে। একটু উঁচু ক্লাসে উঠলে অনেক বলত এসব কথা। ... ...
রুচিকা গিরহোত্রার কথা হয়ত কারোর কারোর মনে থাকবে। এই চৌদ্দ বছরের লন টেনিস প্লেয়ারটি হরিয়ানার লন টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও পুলিশ অফিসার রাঠোরের দ্বারা যৌন নিগৃহীত হয় ১৯৯০ সালে। ঘটনার তিনদিন বাদে মেয়েটি নালিশ জানায়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ অফিসারের দোষও ধরা পড়ে। কিন্তু এফ আই আর হয় না। ইতিমধ্যে রাঠোরের চাপে মেয়েটি নিজের স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়। তার দাদার বিরুদ্ধে ছটি কেস রুজু করা হয়। রাঠোরের সমর্থনে রাজপুত সভার সদস্যরা রুচিকার বাড়ির সামনে দিয়ে প্রসেসন করে, তাঁকে রাস্তাঘাটে রেন্ডি বলে অভিহিত করা হয়। ক্রমাগত মানসিক নির্যাতনে মেয়েটি ১৯৯৩ সালে আত্মহত্যা করে। কত বছর বয়স তখন ওর? আর সেই পুলিশ অফিসারের কি হয়? ... ...
নাহ, সীতা ও বোধহয় এঁদের থেকে ভালো ছিলেন, ওনার আসে পাশে রাবণ নিযুক্ত চেড়ি রা সর্বদাই মুখের কাছে খাদ্য বস্তু, এটা ওটা ধরছেন, রাবণ মাঝে মধ্যে এসে মিষ্টি কথায় চিঁড়ে ভেজাবার চেষ্টা করছেন আর সীতার সেখানে কাজ বলতে যাকে বলে "ল্যাদ" খাওয়া আর মাঝে মাঝে রামের নাম ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠা। "এঁরা" বলতে এদেশে অর্থাৎ আমেরিকায় যে সমস্ত সদ্য বিবাহিতা নারী ভারত থেকে স্বেচ্ছায় এসে উপস্থিত হন তাঁদের গল্প কিন্তু অন্য। সিনেমায় দেখা আমেরিকা আর শিকড় উপড়ে আসা অভিবাসী ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মধ্যে বিশাল ফারাক। কুড়ি বছর আগে সেটা আরোই কঠিন ছিল কারণ বর্তমানে ইন্টারনেট, হোয়াটসঅ্যাপ, বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, স্থানীয় অঞ্চলে ভারতীয় দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি, ভারতীয়দের জোট বেঁধে নির্দিষ্ট শহরে থাকা ইত্যাদি বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত যেন একেবারে হাতের মুঠোয় এসে গেছে, তবুও যে সমস্ত সমস্যা রয়ে গেছে তা চিরন্তন। ... ...
এমন এক প্রলয়ের কালে আমরা যারা স্বপ্ন দেখতে জানি, তারা অন্ধ ও বধির হয়ে যাই নি, আমরা যারা সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বুকে নিয়ে পথ হাঁটি সেই স্বপ্ন আজ আমাদের তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছে। স্বপ্নভঙ্গকে আমরা হতাশার প্লাবনে ভেসে যেতে দেইনি বরং স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটার অভ্যাস আমাদের ডুব দিতে শিখিয়েছে সমস্যার গভীরতম তলদেশে। আমরা এই প্রচন্ড প্রলয়ের মুখে লাথি মেরে এখনও রাস্তায় বা আলোচনা সভায় প্রতিবাদ জারী রাখার সাথে সাথে স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি সাম্যবাদের বিজয়ের, সাম্যবাদী তত্ত্বের অগ্রগতির, নতুন করে সমস্ত ভাবনা-চিন্তাকে সজীব ও সৃজনশীল করে তোলার। ... ...
বাইনারি দুনিয়ায় কোনও লিঙ্কে ক্লিক করতে না করতেই দেখি, পর্দাজুড়ে হুটোপাটি করছে শেয়ার করার বিভিন্ন আয়োজন। আমার এক কবিবন্ধুর কথায়, “সুরাসিক্ত লিঙ্ক আঁকশি বাড়িয়ে বিষ-আলিঙ্গনের কথা বলে।” যখন কোনও খবর পড়ি, পনেরো সেকেন্ড যেতে না যেতেই দেখি, লাইক করার হরেক টুল নেমে আসছে স্ক্রিন জুড়ে। পড়া স্তব্ধ করে দিয়ে বলে, লাইক করো আগে। কিভাবে করতে চাও বলো। তুবড়ির ফুলকির মতো উড়ে আসে হোয়্যাটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম আর ইমেলে শেয়ার করার আইকন। কোনও বিষন্ন খবরে তুমুল রেগে এমন অপশন বন্ধ করে দিয়ে দেখেছি, দশ সেকেন্ড পরে ফের হাজির হয়েছে অপশন অমনিবাস। মানেটা হল, শুধু আমি পড়লেই হবে না, মেঘের ওপাশ থেকে গর্জনের মতো তা বিলিয়ে দিতে হবে বিশ্বচরাচরে। আমি জানি, প্রতিটি লিঙ্কের পর্দার ওপারের ডেটাবেস আমার শেয়ার করার দলিলের খবর রাখে। যত বেশি শেয়ার করব, সংস্থার আরও বড় প্রিয়পাত্র হব আমি। আমার সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে ফুটে উঠবে ওই সংস্থার এমন খবরের আরও, আরও ফিড। পালাবার পথ নেই। ... ...