আমরা ঝটপট শহুরে ক্লেদাক্ত জামাকাপড় ছেড়ে ফেলে টুপি-মোজা-জ্যাকেট সম্বলিত হয়ে চল্লুম রান্নাঘরের পানে, সেখানে তখন অপেক্ষা করছে গরমাগরম মোমো আর কফি। সেই সন্ধ্যায় আমরা দু'রকম জায়গার চারজন মানুষ গল্প করতে করতে কখন একাত্ম হয়ে গেছিলাম টের পাইনি। হুঁশ ফিরলো জীবন দা, যে কিনা এই হোমস্টের মালিক তার কথায়। 'এখানে অনেক গেস্ট আসেন, কিন্তু সেরকম কোনো সাইট সিইং, বাজার-মল, সিনেমা হল এসব কিচ্ছু না থাকায় ফিরে চলে যান একদিন বাদেই।' হায়রে Mall, Hall ও কোলাহল প্রেমী বাঙালী, প্রকৃতির কাছে এসেও প্রকৃতিকে না ছুঁয়ে সেই গতানুগতিক "এখানে দেখার কী আছে"? আমাদের এখানে একদিন থেকে পরদিন মূলখারকা চলে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তাগাথাং ঢুকেই আমরা ঠিক করে ফেলেছিলাম একদিনে আমাদের মন ভরবে না। ... ...
আমি রুকু বিনায়ক। সবাই বলে আমি বুদ্ধু। ভোঁদাই। মা আমাকে গাধা বলে না মুনা বলে। পাপা বলে পুচাই। আমার দুটো হাত,দশটা হাতের আঙ্গুল,দুটো চোখ আছে,যা দিয়ে আমি ছবি আঁকা। পাপা মা বলে আমার অটিজম আছে। অটিজম কী আমি জানিনা। তবে আমি একটু কেমন যেন। আমার গাড়ীর চাকা,টেবিল ফ্যান,ছোট ছোট রবারের পুতুল ,রং,তুলি পেন্সিল ভালো লাগে। আমি লাফাতে ভালোবাসি। এ দেয়াল থেকে ও দেয়াল। সব দেয়ালে হাতের চাপ,সব দেয়ালে সর্দি,নাকের পোঁটা লাগে। মা বলে যাতা। আর মোছে। এই শিশুদিবসে বিনায়করুকু গুরুচণ্ডা৯কে ছাপতে দিয়েছে তার ডায়েরির কিছু পাতা, বেড়ানোর গল্প, আর ছবি। বিনায়করুকুর সঙ্গে একটু বেড়িয়ে আসি এদিক ওদিক। ... ...
বাঙালিরা, বিশেষ করে শহর কলকাতার উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত বাঙালি নিজেকে উদার এবং সহিষ্ণু বলে গর্ব অনুভব করে। সেটা খুব একটা মিথ্যেও নয়, কারণ অন্য জাতে বা ধর্মে বিয়ে করার মতো যেসব কান্ড ভারতের অন্যান্য জায়গায়, বিশেষ করে তথাকথিত গোবলয়ের মতো জায়গায় হলে গোলযোগের চূড়ান্ত হত, সেসবও কলকাতায় হামেশাই হয়ে থাকে। এই উদাতার অনেকটাই আসলে বাঙালি নবজাগরণের ফল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রাজা রামমোহন রায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা| স্বাধীনতা-উত্তর যুগেও বিশেষ করে ৩৪ বছরের নাস্তিক, কমিউনিস্ট শাসনও রাজনীতিতে জাত-পাত যাতে না ঢোকে তার শক্তপোক্ত বন্দোবস্তো করেছিল। কিন্তু, বলাবাহুল্য, অবস্থা চিরকালই এমন ছিল না| উনবিংশ শতকের শুরুতে, কলকাতা যখন টানা পশ্চিমী প্রভাবের আওতায়, তখনও, হিন্দু সমাজ, এমনকি কলকাতার হিন্দু সম্প্রদায়ও ছিল ভয়ংকরভাবে রক্ষণশীল। আর এই সময়েই ঘটেছিল শহরের বৃহত্তম কেচ্ছাটি। কালীপ্রসাদী হাঙ্গামা নামে কুখ্যাত এই কেলেঙ্কারিটির জল গড়িয়ে গিয়েছিল বহুদূর। এতে জড়িয়ে গিয়েছিল শহরের অনেক নামীদামী পরিবার, জল গড়িয়েছিল নানা ধর্মের উপাসনাস্থলে, যার মধ্যে কলকাতার বিখ্যাত হিন্দু মন্দির কালিঘাটও ছিল| ... ...
বাংলায় দুর্গাপুজোর প্রচলনের ইতিহাস বহু পুরনো। মোগল আমল থেকেই। রমেশ শাস্ত্রী মহাশয়ের পরামর্শে রাজশাহী জেলার তাহেরপুরে রাজা কংসনারায়ণ ষোড়শ শতাব্দীতে সাড়ে আট লক্ষ টাকা ব্যয় করে প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রচলন করেন। পরে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজশাহী জেলারই ভাদুড়িয়ার রাজা জগৎনারায়ণ প্রায় ন'লক্ষ টাকা ব্যয় করে বাসন্তী দুর্গোৎসব করেন। তারপর থেকে বিভিন্ন হিন্দু রাজা ভুঁইয়ারা এই দুই পুজো আরম্ভ করেন। আস্তে আস্তে শারদীয় দুর্গোৎসব বাংলার গ্রামসমাজের একটা লোকোৎসবে পরিণত হয়। সেই সময়ের যৌথ পরিবারের একটা মিলনোৎসব ছিল এই দুর্গা পুজো। যেখানে যারা যারা থাকত সবাই এসে মিলিত হত এই পুজো উপলক্ষ্য। প্রথমে হত পারিবারিক মিলন সমাবেশ, তারপর গ্রামের সকলেরই সেই পুজোতে সারা পড়ে যেত। প্রত্যেকেই কেউ না কেউ কোনো না কোনো কাজের দায়িত্ব নিয়ে নিত তা পুজো যার বাড়িতেই হোক না কেন। উৎসবের সেই পরিবেশে ওই একটা দিনের জন্য যেন জাতপাতের বাধনটা কিছুটা হলেও শিথিল হয়ে যেত। পরবর্তীতে এই যৌথতা থেকেই বারোয়ারি পুজোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়। ... ...
রঞ্জনরা ফিরে আসার পর বাবুর বাড়ির ছেলে দুপুরে খেতে বসেছে। হ্যাঁ ঠিক, এ একেবারে ধ্রুব যে, জীবনের শেষ সুখাদ্যটি আমি সেদিন রঞ্জনের জননীর হাতে খেয়েছিলাম। অথচ গৃহস্বামীর কী কুণ্ঠা! "এ মানুষে খায় নাকি? এ তো আমরা খাই। এ তুমি কী করিকি খাব গো?" কাদা কাদা ভেজা মাটির ওপর পেতে দেওয়া রঞ্জনের মায়ের পরণের শাড়ির ওপর খেতে বসেছে তিনটি মানুষ। সামনে গালে হাত রঞ্জনের মা। লাল আকাঁড়া ডুমোচালের ফেনাভাত। ঝড়ে ভেঙে পড়া পেঁপেগাছের ডগার কোঁড়ের তরকারি। তেঁতুলফুল পাতার চচ্চড়ি আর ডোবা-ভাসা ধেনো চিংড়ির টক। এই মাত্র খাদ্যতালিকা। চিরজাগরুক অমৃতের জিহ্বাস্নান। স্বাদ কী বস্তু? রন্ধনশৈলী কেমন হলে স্বাদকে জাপটে ধরা যায়? রন্ধন কাকেই বা বলে? ... ...
ভুঁইপটকা ছিল দেওয়ালে বা মেঝেয় ছুঁড়ে মারার জন্য - জোর আওয়াজ। কম্বাশন বাই প্রেশার, অর্থাৎ ভুঁইপটকা আর পেটোর মশলায় তফাৎ ছিলো না কোনো, পুলিশ তাই বেআইনি করে দেয়। এবছরে, আশ্চর্য, আবার সেগুলিকে বাজারে দেখছি, তা প্রায় তিরিশ বছর বাদে। চপেরই মতো, পেটো ইন্ডাস্ট্রিও কি কুটির শিল্প হিসাবে সরকারি তকমা পেলো তাহলে? ... ...
'বেজাতে' বিয়ে বলে নিজ মহল্লায় দামামা বেজেছিল। পাত্র ডাক্তার এই কথাটা কর্পূর হয়ে 'হিন্দু ছেলে' এটাই প্রচার হয়েছিল। তো, এই কালী পুজো নিয়ে আমার এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। কালীমা আমার প্রতিদিনের। ছাত্রজীবন থেকে কলেজ টানা সময় জুড়ে আমায় 'মা কালী' বলে পথে ঘাটে ডেকে দিত কেউ। অবশ্যই পুরুষকণ্ঠ। কখনো পেছন ফিরে দেখিনি। দেখতে নেই এটাই ছিল পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা। তখন অবশ্য আমি খুব ভয় পেতাম এই ডাকে। লজ্জা হত খুব। কী এমন আছে এই চেহারায়? নিজের মাও মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলতেন, আমার পেটের মেয়ে এমন কালো কীকরে?বুঝতাম না এই সমাজে মেয়েদের কেন কালোরঙ হওয়া বারণ ? কেন এত নেগেটিভ? তারপর মাথায় সিঁদুর চড়ানোর পর আমায় কেউ কোনদিন 'মা কালী' বলে ডাকেনি। সিঁদুর ছাড়ার পরও। জানিনা, বিবাহিত মেয়েদের বুঝি সব মাফ। ধীরে ধীরে নিজের গায়ের রং ও চেহারার সঙ্গে কম্ফর্টেবল হয়ে গেলাম। নিজেকেই ভালবেসে ফেললাম। বিয়ের আগেই জানতাম আমার স্বামী কালীভক্ত। বিয়ে রেজেষ্ট্রির আগের দিনই সে নিয়ে যায় আমায় দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি পুজো দিতে। সেখানেই লাইনে দাঁড়িয়ে সে জানায় আমার কাছে তার একটিই দাবি। মন্দিরে তার পাশে দাঁড়িয়ে পুজো দিতে হবে ও প্রসাদ খেতে হবে। তার এই ভক্তি একইভাবে সন্তানের মধ্যে জন্ম নিল । প্রতিদিনই ড্রাইভার অভিযোগ করত মেয়ে স্কুলের পথে যেখানেই মন্দির দেখছে গাড়ীর কাচ নামাতে বলছে। নেমে পড়ে প্রণাম করছে। এরপর আমার নিজের বাড়িতে মেয়ের পছন্দের কালী মায়ের ওয়াল হ্যাঙ্গিং লাগানো হল। তার নিজের পূজা করার জায়গা ক'রে দেওয়া হল। আনা হল লাল কাপড়,ঘণ্টা,কর্পূর, সিদুর,গঙ্গাজল,ধূপকাঠি। কাছের মন্দিরের পুরোহিতের কাছে গিয়ে লিখে আনা হল মন্ত্র। আমার মা এখানেই কখনো কখনো কোরান পাঠ করতেন, নামাজ পড়তেন। আমার বাবা কালীপুজোর জন্য চারটে করে জবাফুল এনে দিতেন বাজার থেকে প্রতিদিন। ... ...
এরপরে এল আমার টিউশনকাল। কালীপুজোর দিন সব ক্লাসই ছুটি থাকত। অতএব পরের দিন থেকে ভাই-ফোঁটা অব্দি ফিরতি পথে চলত আমাদের টো-টো সফর। তবে সমস্যা হল, বারাসত আজও যে কারণে বি(?)খ্যাত, উন্নয়নের মত যেখানে সেখানে দাঁড়ানো মাতাল আর কন্যাশ্রী হারে উড়ে আসা ইভটিজিং, এসবের কল্যাণে মায়ের টেনশন এবং সে চক্করে রাতে প্যান্ডেল ঘোরা প্ল্যান ছিল এক্কেরে নট অ্যালাউড। ... ...
দীপাবলীতে পরিচিতদের বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়ে ছাদে কচিকাঁচাদের নিয়ে ফানুশ ওড়াতে ওড়াতে পরিবারের একজন হয়ে যাওয়ার মধ্যে যে প্রাপ্তি, জমিয়ে খাওয়াদাওয়ায় যে আত্মীয়তা, তা ধর্মের উর্ধ্বে অবস্থান করে। ভাতৃদ্বিতীয়ার মঙ্গলফোঁটা যমের দুয়ারে সত্যিই কাঁটা না দেয় কিনা সেই তর্ক উসকে দেওয়া আড্ডায় বসে দেখেছি, এইসব রীতি-রেওয়াজ সামাজিক মেলবন্ধনের জায়গা তৈরী করে দিয়েছে অজান্তেই। অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধর্মীয় চিন্তাভাবনার পৃথক অবস্থানের মধ্যেই রুনুরা নিজের বোনের মতো হয়ে উঠেছে। ... ...
চান্দু ঠাকুমা সুন্দরবন লােকালে যখন ভােরবেলা ওঠে, তখন ভিড় একেবারেই নেই বললেই চলে। বিশেষ করে লেডিজ কম্পার্টমেন্টে। চান্দুটা আজও খুব বায়না ধরেছিল-আমি তাের সঙ্গে কলকাতা যাব। কিন্তু এক বস্তা শাকপাতা ঘাড়ে করে, নাতির হাত ধরে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানাে চাট্টিখানি কথা না। তাই আসবার সময় জিলিপি আনবাে, ব্যাটবল আনবো এই সব প্রলােভন দেখিয়ে কোনােরকমে ঠেকিয়ে রেখে এসেছে। একটানা ভুগতে ভুগতে চান্দুর স্বভাবটাও বড় খ্যান খ্যান হয়ে গেছে। চার মা মােমিনার এক কথাপ্রতিদিন ঐসব ঘতামাতার শাক-পাতা গিলিয়ে গিলিয়ে ছেলেটার আমের ধাত কাটতে দেয় না বুড়িটা। মােমিনা যখন মুখ ছােটায়, তখন ঠিক একইভাবেই বলে। শয়তান বুড়ি, ভাতার খেয়েছিস। ... ...
প্রায় এক সপ্তাহ সেই ফোনের অপেক্ষা করেছিল শতদ্রু। আসে নি। আর এই এক সপ্তাহে ধীরে ধীরে ওই অজানা অবয়বটা আকৃতি নিয়েছিল ওর মাথায়। সেই অবয়বটার দেহ সুগঠিত ও পিচ্ছিল, দুটো বাড়ানো সরু হাতের শেষে আঁকশির মত দাঁড়া, ঘন ভুরুর নীচে দীঘল চোখে মায়া ও মোহ, আর শ্রীলেখা মিত্রর মত ভারী ঠোঁঠের তলায় তীক্ষ্ণ মাদকভরা একটা লুকোনো হুল। শতদ্রু এরপর আর দেরি করে নি। বহুদিন ধরে লুকিয়ে রাখা সেই বিছের ছবিগুলো এয়ারমেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল কলকাতায় রাজীব ঘোষের অফিসের ঠিকানায়। এক ঝটকায় বিছেটার সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়েছিল নিজের জীবন থেকে। তখন কে জানত, আবার ন বছর বাদে এভাবে বিছেটা ওর সামনে এসে দাঁড়াবে? এই রকম করুণ, থ্যাঁৎলানো, মৃতপ্রায় অবস্থায়? ... ...
ফোন করতে যাবে ঠিক সেই সময়ে ধড়মড় করে উঠে বসলো কাক ভিজে হওয়া চিমসে একটা লোক। সামনের লুকিং গ্লাসে ঠিক মতো মুখটাও দেখতে পেল না বল্টু। গাড়ি বুকিং হয়েছে খাল পাড় পর্যন্ত। “দাদা একদম ভিজে গেছেন। আমার কাছে একটা পরিষ্কার তোয়ালে আছে। একটু মুছে নেবেন?” বল্টুর কোন কথার উত্তর দেয় না লোকটা। বল্টু নিজেও কোন কথা বাড়ায় না। একেই অনেক রাত। চারপাশে গাড়ির সংখ্যা কম। নেশা-টেশা করে আছে কিনা সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। যাক তার চেয়ে তার নতুন গাড়ির সিট ভিজুক। কিছুক্ষণ পরে শুধু হাওয়ার মতো ফিসফিস করে লোকটা বলে “আপনার বইটা একটু দেখতে পারি?” বল্টুর মনেই ছিল না তার সিটের পাশেই রাখা বই। ‘কলকাতার গোলকধাঁধা’। কিন্তু এই অন্ধকারে বৃষ্টি আর বিদ্যুতের মাঝে লোকটা বইটা দেখতে পেল কী করে? ... ...
রুবির বাঘের নাম শান্তনু। বাঘ যেমন হয়-পেল্লায়, ডোরা কাটা, বিশাল খণ্ড ত ল্যাজ। ভারি বলিষ্ঠ থাবা ঘিরে সাদা নরম রোঁয়া। বিষণ্ণ পোখরাজ চোখ। কানের পিছনে, থাবায় গভীর ক্ষতচিহ্ন। এখন রাত বারোটায় মোড়ের মিষ্টির দোকানের ঝাঁপ বন্ধ - দু ধাপ সিঁড়ির নিচে ভাঙা ফুটপাথ-সেখানে এক ছটাক ঘাসের দখল নিয়ে কাড়াকাড়ি স্ট্রীটলাইট আর জ্যোৎস্নার; দুটো লাল গাড়ি পর পর পার্ক করা। মিত্র সুইটস আর গাড়ির মাঝখানে ঐ জ্যোৎস্নার ওপর হিসি করছিল শান্তনু - আকাশের দিকে মুখ, সামনের দুপায়ে শরীরের সম্পূর্ণ ভর, পিছনের পা ভাঁজ করা এবং লম্বা ল্যাজ মাটির সঙ্গে সমান্তরাল-ওর পিঠের ডোরা এই মুহূর্তের চাঁদের আলোয় সিপিয়া আর সাদা। রুবির হাতে একটা বড় কালো চাদর ভাঁজ করা; সে শান্তনুর পিঠে হাত রেখে সটান দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছিল। রুবি যেন এক বন্ধ দরজার পাল্লা-যার আড়ালে বসে, প্রকৃতির ডাকে নিশ্চিন্তে সাড়া দিচ্ছিল শান্তনু- ঝাঁঝালো বুনো গন্ধ সিঁড়ির ধাপ বেয়ে পৌঁছোচ্ছিল মিত্র সুইটসের সাইনবোর্ড অবধি, ঘাসের ওপর চাঁদের আলো তরল আর হলুদ হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশঃ। ... ...
সে অনেক দিন আগের কথা। বছর ত্রিশ তো হবেই। আমরা থাকতাম ময়মনসিংহ শহরের আমলাপাড়া এলাকায়, তখ্নও সেই শহরে কিছু বাংলো বাড়ি অবশিষ্ট ছিল, তাদের সামনে ছিল মাঠ, পেছনে বাগান, বড় আঙ্গিনা বা পুকুর। আমরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সে বাড়িটা ছিল দোতলা, পুরনো জমিদার বাড়ি, সামনে প্রায় বিঘাখানেক ফাঁকা জমি। ঐ শহরে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটবাড়ির ধারণা তখনও আসে নি, কিন্তু আমাদের বাড়িতে তিনটে পরিবার ভাড়া থাকত। ওপরে একটি, নিচে দুটি। বাড়িওয়ালা এমনভাবে নিচের তলাটি ভাগ করে দিয়েছিলেন যাতে অন্য অংশটির ভাড়াটেদের দেখা না যায়। বাড়ির সামনে একদিকে একটা বড় আম গাছ, অন্যদিকে গাঁদা আর জবার ছোট বাগান। তারকানাথ রায় রোড থেকে শুরু করে ঘাসের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথটা একটা ছোট সিঁড়ির তিন চারটা ধাপ বেয়ে উঠে এসেছে নিচু বারান্দায়। ... ...
মঙ্গলার ওদিকে এক গোঁ কিছুতেই পণ দিয়ে বিয়ে করবে না সে। এই নিয়ে কম অশান্তি হয় নি মা বাপের সাথে। এমন এক পাত্রের মাকে মঙ্গলা বলে ফেলেছিল ‘আপনারা শহরে গিয়ে মন্দিরের সামনে আঁচল পেতে বসতে পারেন তো, শুনেছি দিনে পাঁচ ছয় হাজার রোজগার হয়। ও দুই তিন মাস বসলেই আপনার বেশ ক লাখ ...’ কথা শেষ করতে পারে নি, মায়ের ঠাস সপাটে নামে মঙ্গলার গালে। ছোট বোনটাকে ধরে সামলায় নিজেকে, শান্ত পায়ে গিয়ে মাছমাংস কোটার বঁটিটা আর একগাছা নারকেল দড়ি এনে মায়ের সামনে ধরে বলে ‘হাত পা বেঁধে গলা কাটো আমার, নাতো পণ দিলে আমি তোমাদেরই কেটে ফেলব হয়ত।’ ... ...
রুমিকে শেখাই। দুজনে খেতে এলে মুখোমুখি বসতে হয়। কার্টেসি। এসেই ধপ করে পাশে বসে পড়ছিলো। যা যা বলি, যে সিকোয়েন্স-এ খেতে বলি, রুমি মন দিয়ে শোনে। আমার ওকে নতুন করে তোলার ইচ্ছেটাকে বুঝেই যেন শুষে নেয়। একটুও যেন বাদ না যায়, এমন অতন্দ্র হয়ে শোনে। ... ...
স্যার, এইবার আমি আমার পিতার কথা বলব, আমার মনে হচ্ছে যে মানুষের জীবনের সাথে তার পিতার জীবন জড়িত, ফলে আমার বিষয়ে বলতে গেলে আমার পিতার কথা আসবে, আমার বিষয়ে বুঝতে আমার পিতার বিষয়ে বুঝতে হবে। আপনি কি মনে করেন এই ব্যাপারে? বলব কি স্যার? হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন। আমার পিতার নাম ছিল আরশাদ মিয়া। তবে লোকে তাকে ডাকত কাবিল কবিরাজ নামে। তিন গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াইতেন আর অনেক অনেক লতাপাতা সংগ্রহ করতেন। আর আমাদের বাড়ির পাশে ছিল সামান্য ধান্য ক্ষেত। সেখানে চাষবাসও করতেন অল্প অল্প। আচ্ছা এই মুহুর্তে, এই ধান্য জমির কথা স্মরণে আসায় আমার দাদাজির কথা মনে হলো আমার। তিনি আমার পিতার পিতা। ফলে তিনিও আমার সাথে সংযুক্ত, তাই ধান্য জমি সংশ্লিষ্ট অদ্ভুত ঘটনাটি আমার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, বলব কি স্যার? ওকে বলুন। ... ...
টুকুন কোঁচড় থেকে ডিমগুলো বের করতেই সক্কলে হাঁ হয়ে গেল! নদীর ধারে এমন হুটোপাটির চড়ুইভাতি, তাতে আবার ডিম! তার ওপর আধাআধি ভাগাভাগি নয়, মাথাপিছু একটা করে গোটা ডিম! প্রথম চোটে আনন্দে কথা ফুটল না কারো মুখে। তারপর বিস্ময় একটু থিতোতেই হইহই করে উঠল কচিকাঁচার দল। যক্ষের ধনের মতো ডিমগুলো কোথায় রাখবে তাই নিয়ে টগবগ করতে লাগল নানান মতামত। আজ ওদের চড়ুইভাতি। বিল্বপত্র গ্রামের একধার দিয়ে বয়ে গেছে রূপনারায়ণ। নদীতটের এই অঞ্চলটা ফাঁকা। উঁচুনিচু। এদিকে-ওদিকে ঘাসের গুছি, শুকিয়ে যাওয়া কাশ আর বেতঝোপ। ফেরিঘাটও নেই কাছাকাছি। জনহীন হওয়ায় এইখানটা ছেলেপুলেদের ভারি প্রিয়। কখনও ওরা দলবেঁধে খেলতে আসে, কখনও বা জলে ঝাঁপিয়ে সাঁতার কাটে। ... ...
বিরতির সময় পলাশের সাথে দুই সেকশনের কয়েক জন খেলোয়ারের মধ্যে কী কথা হয়েছে সেটা হারাধন জানে না। কিন্তু খেলা আবার শুরু হবার পর থেকে দেখা গেলো বল বার বার তার প্রান্তে চেপে আসছে। হারাধন প্রাণপনে বল ফেরাতে থাকে। একপর্যায়ে বলের দখল নিয়ে সৃষ্ট এক জটলায় কেউ একজন হারাধনকে খুব জোরে ধাক্কা মারে। তাল সামলাতে না পেরে সে পড়ে যেতে হঠাৎ কে যেন তার বাঁ হাতের উপর লাফিয়ে পড়ে। সেটা কি সেকশন-এ’র মোটকা সাদমান নাকি সেকশন-বি’র বখা বাদল সেটা বোঝা যায় না, তবে হারাধনের কবজিতে কড়াৎ করে একটা শব্দ হয়। তারপর তীব্র ব্যথায় তার আর কিছু মনে থাকে না। ... ...
কবিতা লেখা ও পড়ার, কবিতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবার পরেই অবশ্যম্ভাবী প্রশ্ন আসে, তার বহুমুখী অভিঘাত নিয়ে। যেহেতু কবিতা একটি মাধ্যম যেখানে একজন লেখক ও পাঠক একটি স্বতন্ত্র পথে নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় করছেন, তাই এই বিষয়ে কোন সাধারণ উপলব্ধি বলে কিছু হয়না। আমরা এরকম বলতে পারিনা যে জীবনানন্দের বনলতা সেন যা বলতে চেয়েছিলেন তার "মানে" ঠিক এই। কবি ও পাঠকের কথোপথন অনেকটা দুটি মানুষের মধ্যে একান্ত নিভৃত টেলিফোনে বাক্যালাপের মত হয়ে দাঁড়ায়। আগে একটা সময় মনে করা হত এই কথোপকথনের নিজস্ব ব্যাকরণ থাকা উচিত, কালক্রমে সেই মজবুত বাঁধন অনেক আলগা হয়েছে। এখন লেখক ও পাঠক দুজনের ব্যক্তিগত যাপন ও দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাব নির্দিষ্ট করে দেয় লেখায় কী থাকবে, পাঠকের সেই জিনিস ভালো লাগবে কিনা, এবং ব্যাকরণ বহির্ভূত কবিতা বলে সেইভাবে আর হয়ত কিছু নেই, যদি কবিতার সার্থকতা ভালো লাগা দিয়ে নির্ধারিত হয়। অবশ্য ভালো লাগার বাইরেও, শিল্পবোধ বা বহুদিন ধরে মানুষকে ভাবিয়ে তোলার নিরিখেও কবিতার ভালোমন্দ বিচার হয়, এবং কী সেই আশ্চর্য ভারসাম্য যা কবিতাকে কালজয়ী ও পাঠকের অন্তরঙ্গ করে, সেই কূট তর্ক আপাতত আমরা সরিয়ে রাখবো। নাট্যমঞ্চে যেমন আলোর বৃত্ত ফেলে ফেলে ঠিক করা হয় দর্শকের কী দেখা উচিত, সেইভাবে জীবনদর্শনের ফোকাস দিয়ে কবি ঠিক করেন কী লিখবেন, পাঠক ঠিক করেন সে জিনিস তার পছন্দের কিনা। এই দ্বন্দ্ব, এই কখনও ভালো কখনও খারাপ লাগার চর্চাকেই কেউ কেউ কবি ও পাঠকের মধ্যে ঘটে চলা নিরন্তর লড়াই বলেছেন। উৎসব সংখ্যা দ্বিতীয় পর্বের কবিতা। এই পর্বে লিখেছেন যশোধরা রায়চৌধুরী, চিরশ্রী দেবনাথ, হিন্দোল ভট্টাচার্য, সাম্যব্রত জোয়ারদার, হীরক সরকার, সোমনাথ রায়, জগন্নাথদেব মন্ডল এবং সোনালী সেনগুপ্ত। ... ...