যে বাড়িতে সত্যপীরের পালা, সে বাড়ির ছেলে মেয়েরা লোকেদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসতো। সত্যপীরের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করতেন তাঁর হাতে থাকতো একটা বিরাট সাদা চামর। সেটা মাথায় বুলিয়ে তিনি আশির্বাদ করতেন। হিন্দু মুসলমান সবাই সেই আশির্বাদ নিতেন। ১০-২০ পয়সা করে দিতেন মায়েরা সত্যপীরের পালায়। কিশোর ঘোষালদা লিখেছেন, ১৯৮০ র মাঝামাঝি সত্যপীর সত্যনারায়ণ হয়ে গেল। তা, সত্যপীরের পালায় হিন্দু মুসলমান একতার কথা থাকতো। ... ...
স্যর স্ট্র্যাফোর্ড আর দ্বিতীয়বার দেখা করেননি গান্ধীর সঙ্গে, করে লাভ ছিল না। তিনি অবিশ্যি সত্যি-সত্যিই ভারতের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন, সেরকমই পরিকল্পনা ছিল তাঁর, কিন্তু সেই পরিকল্পনার ধার ধারতেন না তাঁর বস, উইনস্টন চার্চিল। সেই সময়কার ভাইসরয় লিনলিদগোও চার্চিলেরই দলে। ক্রিপ্সের মতো অনেক সোশ্যালিস্ট দেখা আছে তাঁদের। হামবাগ সব! জওহরলাল আর সেই সময়কার কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি মৌলানা আজাদ অবিশ্যি ক্রিপসের সঙ্গে একমতই ছিলেন, ছিলেন এমনকি রাজাগোপালাচারিও, যদিও লীগের ব্যাপারে কংগ্রেসের অবস্থানের প্রতিবাদে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন রাজাগোপালাচারি নিজে। এখন গান্ধী একাই বিরোধীপক্ষ, যদিও নিজে গান্ধী মনে করেন না তা। তিনি মনে করেন সমস্ত দেশবাসী তাঁর পক্ষে। তিনি একবার সঙ্কেত দিলেই প্রায় প্রতিটি ভারতবাসী নেমে পড়বে রাস্তায়, তাদের মুখে থাকবে একটাই কথা, ভারত-ছাড়! যদি নিজে থেকে না ছাড়, আমরাই ছাড়াব তোমাদের। করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে! ... ...
শুকনো পাতা দিয়ে বানানো গদিতে ভল্লা শুয়ে আছে। আজ পাঁচদিন হল সে একইভাবে শুয়ে আছে, নিশ্চেতন। তার মাথার কাছে বসে আছেন জুজাকের বউ। জুজাক দাঁড়িয়ে আছেন পায়ের দিকে। আর নিচু হয়ে বৃদ্ধ কবিরাজ হাতের নাড়ি পরখ করছেন ভল্লার। কিছুক্ষণ পর কবিরাজ ভল্লার হাতটা নামিয়ে দিলেন, বিছানায়। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “জুজাক, আমার মন বলছে, ছোকরা এ যাত্রায় বেঁচে গেল। হতভাগার বাপ-মায়ের কপাল ভালো বলতে হবে।” ... ...
ব্যস, এই সুযোগের অপেক্ষাতেই তো ছেনু ছিল, এক ছুটে দুধের গ্লাস হাতে তেতলার সিঁড়িতে উঠে পড়ল। এবার পা টিপে টিপে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সিঁড়ি দিয়ে তেতলায় পৌঁছে ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ আছে কিনা। যখন দেখতে পেল চারিদিক ফাঁকা, কেউ তার দিকে নজর রাখছে না, তখন গ্লাস থেকে এমন করে এক চুমুক দুধ খেলো, যাতে চলকে কিছুটা দুধ মুখ বেয়ে নেমে আসে, তারপর একটা বিচ্ছিরি মুখ করে কোনোক্রমে ঢোঁক গিলে সেই এক চুমুক দুধ গলা দিয়ে চালান করে নিচু হয়ে বসে ড্রেনের মুখটায় বাকি দুধটা আস্তে করে ঢালতে লাগল। ঢালতে ঢালতেও কড়া নজর চারদিকে, এই বুঝি কেউ দেখে ফেলল। ধীরে ধীরে পুরো দুধটাই ঢালা হয়ে গেলে আস্তে করে উঠে আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। ... ...
ব্রাতিস্লাভায় সিটি ব্যাঙ্কের নবীন কর্মী মারেক পটোমা বলেছিল নিজের দেশ না হলে আইস হকিতে স্লোভাক প্লেয়ারদের জায়গা জুটবে না তাই আমরা আলাদা হয়েছি! দেশ ভাগের এর চেয়ে জোরালো যুক্তি আমি অন্তত খুঁজে পাই নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে উইলসন ডকট্রিন মাফিক ইউরোপে স্বায়ত্ত শাসনের যে দাবি উঠেছিল তার ফলে পুরনো অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ বিশেষ মিলে তৈরি হলো চেকোস্লোভাকিয়া, এই মাত্তর ১৯১৮ সালে। ক্যাথলিক ধর্মের প্রাধান্য দুই অঞ্চলে, চেকের সঙ্গে স্লোভাক ভাষা প্রায় ৮৫% মেলে; আমার প্রাক্তন সহকর্মী ইভেতার (এখন আবু ধাবিতে) কাছে গল্প শুনেছি – অফিসে সে কিছু নিয়ে আলোচনা করছে এক চেক কলিগের সঙ্গে। আরেক স্থানীয় সহকর্মী জিজ্ঞেস করে, তোমরা কোন ভাষায় কথা বলছ? ইভেতা বলে, নিজের নিজের মতন, আমি স্লোভাক এবং উনি বলছেন চেক! আমাদের হিন্দি/উর্দু সংলাপের মতন। ... ...
উত্তরবঙ্গে কয়েকটি সপ্তাহ কাটিয়ে বুঝে গেলাম এইবারে এক সম্পূর্ণ আলাদা দুনিয়ায় এসে হাজির হয়েছি। এবং এখান থেকে আর আগের জগতে ফিরে যাওয়ার কথা বড়োরা কেউ ভাবছে না। মন বসাতে সময় লেগেছিল। তারপর একটু একটু করে সেই নতুন জগৎ আমায় ঘিরে নিল। ... টান এক মজার অনুভূতি। যে তিন বছর উত্তরবঙ্গে ছিলাম, যখন তখন ভাবতাম কবে আমাদের দমদম ক্যান্টনমেন্টের ভাড়াবাড়ির ঘরে ফিরব। আর উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার কয়েকবছর পর থেকে কি যে এক চোরাটান ছেয়ে থেকে অস্তিত্ব জুড়ে – সেই তোর্সাতীর-এর জন্য! ... ...
রণোভাইয়ের সঙ্গে আমার বেশ জমে গেল। আমার বাবার মতো দিলদরিয়া গোছের মানুষ। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চাইলে বললেন, কাল বাসায় আসুন ১২ টা নাগাদ। ধানমন্ডিতে বাড়ি। দেখলাম সবাই চেনেন বাড়িটি। কথা শেষ ঊঠছি। বললেন, আরে যাবেন কোথায়? খেয়ে যাবেন। একসঙ্গে বের হবো। তাঁর মা, স্ত্রী, ভাই, ভাইয়ের বৌ, মেয়ে রাণা, ভাইঝি পুতুল--সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। মেয়ে রাণা তখন দশম শ্রেণিতে পড়েন। আস্তে আস্তে অনুচ্চস্বরে টেলিফোনে কথা বলতেন। খাওয়ার টেবিল দেখি নানান খাবারে ভর্তি। এটা কিন্তু ঘোষিত দাওয়াত না। এত খাবার বাড়ির টেবিলে আগে দেখিনি। আমাদের এখানে তখন তো জামাইকেও আট দশ পদের বেশি খাওয়াতে দেখিনি। আইবুড়ো ভাত হলে আলাদা। ভাত, পোলাও, বিরিয়ানি, ইলিশ, কাঁচকি--সব আছে। এই প্রথম আমার কাঁচকি খাওয়া। খেতে ভালোবাসি। তাও সংকোচ হচ্ছিল। বললেন, আরে এই বয়সে এত ভেবেচিন্তে খেলে হবে, খান। ... ...
গিরিবালা দেবী আর প্রমীলা দুজনেই বললেন, নজরুলের সঙ্গে অরবিন্দর সূক্ষ্মদেহে দেখা হবার কথা নজরুল আগেও অনেকবার বলেছে। শুধু তাঁদেরই নয়, বলেছে আরও অনেককেই। কেউ বিশ্বাস করেছে, কেউ করেনি। তাতে কিছুই আসে-যায়নি নজরুলের, তবে এবারের মতো এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েনি আগে। এবার এতটাই অসুস্থ নজরুল যে অফিসে যেতে পারল না বেশ কয়েকদিন। এদিকে কলকাতার য়্যুনিভার্সিটি থেকে ইন্টারমীডিয়েট পরীক্ষায় বাংলার পরীক্ষক নির্বাচিত করে তার কাছে একরাশ উত্তরপত্র আর পরীক্ষকের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলী পাঠিয়ে দিয়েছে য়্যুনিভার্সিটি। নবযুগে নজরুলের সহকারী কালীপদ গুহ ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরীক্ষকের কাজ করেছে আগে। সে-ই উত্তরপত্র পরীক্ষায় নজরুলকে সাহায্য করতে শুরু করল। ফজলুল হক সাহেব নজরুলকে জানিয়েছেন, শরীর যতদিন সম্পূর্ণ ভালো না হয় ততদিন তার অফিসে আসার প্রয়োজন নেই। অমলেন্দু বা কালীপদদের ডাকিয়ে এনে বাড়িতে বসেই পত্রিকা সম্পাদনার কাজও চালিয়ে যেতে পারে সে। এই সুযোগে কালীপদ থাকতেই শুরু করল নজরুলের বাড়িতে, এখন নজরুলের যে অবস্থা তাতে ঘড়ি-ধরে কাজ করা তো সম্ভব নয় তার পক্ষে। চব্বিশ-ঘন্টায় যখনই কাজের মূড আসবে তখনই কাজ! সেই সময় কালীপদ সঙ্গে না-থাকলে কি চলবে? ... ...
গতকাল সারা দিন ও রাত একটানা হেঁটেছে ভল্লা। একে তো তার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। যন্ত্রণা এবং ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে তার শরীর। তবু সে হেঁটেছে অবিরাম। আজ রাত্রির আট প্রহরে সে এসে পৌঁছল বিশাল এক সরোবরের পাশে। বীজপুর চটির জনাই তাকে দিক নির্দেশ করে বলেছিল, এই পথ ধরে একদম নাক বরাবর গেলে ডানদিকে একটা সরোবর পাবি। ওই সরোবরটা ছোট্ট একটা পাহাড়ের কোলে। ওখান থেকে নিচের দিকে তাকালে দেখতে পাবি – যতদূর চোখ যায় – ছোটছোট ঝাড়ি আর কাঁটাঝোপের জঙ্গলে ভরা ঢালু জমি। তার মানে তুই নোনাপুর গ্রামের চৌহদ্দিতে পৌঁছে গেলি। ভল্লার মনে হল এটাই সেই সরোবর। জনাই আরও বলেছিল, ওই সরোবরের পশ্চিম পাড়ে দাঁড়ালেই তোর ডানদিকে দেখতে পাবি একটা পায়েচলা সরুপথ নেমে গেছে সাপের মতো এঁকেবেঁকে। ওই রাস্তা ধরে, খুব বেশি না, আধক্রোশেরও কম, হাঁটলেই পেয়ে যাবি, নোনাপুরের গ্রামপ্রধানের বাসা। নাম জুজাক। এমনিতে লোক খারাপ না, তবে বড্ডো বদরাগী। একবার রেগে গেলে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তবে ওর বউটা খুব ভালো। মনে খুব মায়া-মমতা। ... ...
প্রায় ষাট বছর আগের এই ফলকে বানান অন্য রকম হলেও জওহরলাল নেহরুকে চিনলাম। ইংরেজি বাদে প্রায় কোনো ইউরোপীয় ভাষায় ‘জ’ ধ্বনির সমার্থক কোন অক্ষর নেই। স্লোভাকে ডি জেড দিয়ে সেই ধ্বনি সৃষ্টি করা হয়েছে (জার্মান ভাষায় এই একই ধাঁচে লেখা হয়) কিন্তু নেহরুর পরে যিনি উল্লেখিত,তাঁকে আমরা চিনি অন্য নামে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির নাম পরিবর্তন করে তাঁকে গান্ধিওভা বানানো হয়েছে। তাঁরও ছাড় নেই, তাঁকেও পরিচিত হতে হবে স্লোভাক কায়দায়,স্বামীর নামের সাথে ‘ওভা’ যুক্ত হয়ে। বিশ বছর বাদে,১৯৫৮ সালের কার্লোভি ভারি (জার্মান কারলসবাদ,চার্লসের স্নানাগার!) ফিলম ফেস্টিভালে মাদার ইন্ডিয়া ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেলেন নারগিসোভা! এখানে একটু শর্টকাট নেওয়া হয়েছিল,সঠিক আইন মানলে পুরস্কার ফলকে লেখা হতো নারগিস রাশিদোভা (তাঁর বাবার নাম আবদুল রাশিদ) সুনীল দত্তের সঙ্গে ততদিনে বিয়েটা হলে তিনি হতেন নারগিস দত্তভা (প্রসঙ্গত এক মেক্সিকান অভিনেত্রীকে বাদ দিলে কার্লোভি ভারি ফেস্টিভালে নন কমিউনিস্ট দেশের কেউ পাত্তা পেতেন না – নারগিস সেই ট্র্যাডিশন ভাঙ্গেন,এর পরে ১৯৭২ সালে রঞ্জিত মল্লিক ইন্টারভিউ ছবির জন্য বেষ্ট অ্যাকটর এ্যাওয়ার্ড পান)। স্লোভাকিয়াতে ফিল্মের পোষ্টারে,খবর কাগজে,টেলিভিশনে শ্যারন স্টোন হন শারনে স্টোনোভা, মেরিলিন মনরো হয়ে যান মেরিলিন মনরোভা। ... ...
এই ঘটনা হতবাক করে দিল গ্রামকে। ইটপূজা হল গাজন তলা তথা ওলাইচণ্ডী পূজার বারোয়ারি তলায়। বারোয়ারি তলায় বর্ষার পর একটা বাঁশের মাচা করা হতো আড্ডার জন্য। দুগোদার মুদি দোকান বড়দের দখলে থাকতো বেশিরভাগ সময়। ১৫-২৫ ভিড় করতো বাঁশের মাচায়। হিন্দু মুসলমান একসঙ্গেই আড্ডা। বন্ধুদের আবার হিন্দু মুসলমান কী? কিন্তু সেই বন্ধুদের কেউ কেউ ইটপূজার উদ্যোক্তা। কদিন আগেই একসঙ্গে কার্তিক ঠাকুর ফেলেছে নতুন বিয়েওলা বাড়িতে। তাঁদের কেউ কেউ পূজা না করে ঠাকুর ফেলে দেওয়ায় একসঙ্গে সেই ঠাকুর তুলে এনে খিচুড়ি খাওয়া হয়েছে। আর তাদের কেউ কেউ বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির গড়ার জন্য ইট পাঠাচ্ছে গ্রাম থেকে! ... ...
পুলিশ যখন তাঁকে রাস্তায় প্রথম দেখতে পায় তখন ভোর হয়ে আসছে। ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে ব্যারাকপুরের দিক থেকে কলকাতার দিকে তিনি আসছিলেন হেঁটে হেঁটে। এখন যুদ্ধের সময়, বড় বড় মিলিটারি ট্রাক রাতের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে আসা-যাওয়া করছে। নজরুলের চলার ভঙ্গি খানিকটা মাতালের পদক্ষেপের মতো ছিল। যে-কনস্টেব্ল্ প্রথম তাঁকে দেখে, সে একজন মাতাল বলেই মনে করেছিল তাঁকে, এবং লোকটা যখন-তখন লরির ধাক্কায় পড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কাতেই তাঁকে থামিয়েছিল। কথাবার্তা এতই অসংলগ্ন যে, কিছুই না-বুঝতে পেরে, আরও দুয়েকজনের সাহায্যে সে তাঁকে থানায় নিয়ে আসে। ... ...
এমন একটা দিন যায় না যেদিন অন্তত একবার তাঁর গানের কোন কলি, কবিতার কোন পংক্তি, নাটকের কোন সংলাপ বা কোন চিত্রকর্মের কথা স্মরণ করা হয়নি। অথচ এমন ত নয়, তাঁর বিপুল সৃষ্টির এক কুচির বেশী কিছু পড়া হয়েছে আমার! আবার তাঁকে বাদ দিয়ে আর কিছুই পড়িনি, শুনিনি, দেখিনি এমনও ত নয়! তবু তাঁর কাছে না এসে উপায় থাকে না। তবে তাঁর যে সৃষ্টি সেই শৈশব-কৈশোর-প্রথম যৌবনে আদৌ সেভাবে বুঝিনি তা হচ্ছে তাঁর গান। যত দিন গেছে, জীবন যত পাক খেয়েছে, তলিয়ে গেছে, আর ভেসে উঠেছে, তত বেশী করে আমার আশ্রয় মিলেছে তাঁর গানে। ছোট বেলায় গানের চরণগুলি আসত-যেত, হাওয়া যেমন আসে, যায়, সহজ-সরল, সাবলীল, একান্তই পরিচিত। যত দিন গেল, গানগুলি বয়ে আনতে লাগল অনাঘ্রাত সুগন্ধ, অশ্রুত বাণী, অদেখা রূপ। একেক বিকেলে, সন্ধ্যায়, মোহন সিংয়ের কন্ঠে যখন অমৃত-বাণী ছড়িয়ে পড়ে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমার চেতনা, আমার শরীর বসে থাকে চুপটি করে, আর অঝোর ধারে কোথা হতে উপচে আসে শ্রাবণ, বন্ধ দু চোখ বেয়ে। নাই থাকল আমার কোন জীবনদেবতা। আমার নিজস্ব বেদনা আরও কোন বৃহত্তর বেদনায় মিলেমিশে আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ... ...
রাজধানী শহর থেকে প্রায় পঁচিশ যোজন দূরের অনন্তপুর চটিতে ভল্লা যখন পৌঁছল, রাত্রি তখন প্রথম প্রহর পেরিয়ে গেছে। রাজধানী থেকে সে রওনা হয়েছিল শেষ রাত্রে। তারপর একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে এতদূরে আসা। অবশ্য মাঝে জঙ্গলের মধ্যে এক সরোবরের ধারে গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিল। বিশ্রাম দিয়েছিল তার ঘোড়াটাকেও। সরোবরের তীরে প্রচুর সবুজ আর সতেজ ঘাসের সন্ধান পেয়ে, ঘোড়াটা তার সদ্ব্যবহার করতে বিলম্ব করেনি। ওই অবসরে সেও দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছিল। পুঁটলিতে বাঁধা চিঁড়ে সরোবরের জলে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে মেখে সপাসপ মেরে দিয়েছিল। তারপর গামছা পেতে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম। ঘুম নয়, বিশ্রামই। প্রথম কথা ঘোড়াটাকে চোখে চোখে রাখতে হচ্ছিল। দ্বিতীয় কথা বিগত রাত্রিতে সে একবিন্দুও ঘুমোতে পারেনি, তার ওপর এই দীর্ঘ পথশ্রম। চোখের পাতা একবার বন্ধ করলেই, সে নির্ঘাৎ ঘুমিয়ে পড়বে – সেক্ষেত্রে তার যাত্রাভঙ্গ হবে। যে চটিতে আজই রাত্রে তার পৌঁছনোর কথা সেখানে পৌঁছতে পারবে না। অতএব অর্ধ প্রহর বিশ্রামের পর সে ঘোড়ায় চড়ে ছুটতে শুরু করেছিল তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। ... ...
এখন এই বেলা আড়াই প্রহরে রাজপথে পথচারীর সংখ্যা বেশ কম। কয়েকজন রাজপুরুষ ঘোড়ার পিঠে দুলকি চালে নগর পরিদর্শন করছে। সকালের প্রথম প্রহরান্ত থেকেই বিপণিতে ক্রেতাদের ভিড় জমতে থাকে। এখন পথের দুধারের বিপণিগুলিও প্রায় ক্রেতাহীন। সূর্যের তেজ যত বাড়তে থাকে নাগরিক ক্রেতারা গৃহাভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। এই সময় বরং আশপাশের গ্রাম থেকে আসে গ্রাম্য লোকজন - ঘোড়া কিংবা গোশকটে। তাদের আশাতেই বণিকরা শূণ্য বিপণিতে ধৈর্য ধরে বসে থাকে। পড়শি বণিকদের সঙ্গে গল্পসল্প করে সময় কাটায়। সাধারণতঃ এই গ্রাম্য ক্রেতারা সরল হয়। কথার তুবড়িতে তাদের ভুলিয়ে ফেলা যায় সহজেই। তাদের সঙ্গে কিছুটা তঞ্চকতা করে, নাগরিক ক্রেতাদের তুলনায় বেশ দুকড়ি উপরিলাভ করে নিতে পারে বণিকেরা। তবে আজকাল গ্রাম্য ক্রেতারাও শহরমুখো হচ্ছে কম। আজকাল কিছুকিছু বণিক, গাধার পিঠে, বলদের গাড়িতে পসরা সাজিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ঘরের মেয়েরা সরাসরি তাদের পছন্দ মতো বাসন-কোসন, রান্নার সরঞ্জাম, মশলাপাতি, কাপড়চোপড়, প্রসাধনী সামগ্রী হাতে নিয়ে, নেড়েচেড়ে, দেখেশুনে কিনতে পারে। কারণ শহরে আসে পুরুষরা। ... ...
সেদিন সকালে তেতলার পিসিমার ঘরে বসে এক মনে ড্রয়ার ঘাঁটছিল ছেনু। ওটা আসলে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথের রত্ন ভান্ডার। যত রাজ্যের উদ্ভট জিনিসের ভিড় থেকে মনমতো জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে একটা বল্টু লাগানো লম্বা স্ক্রু ভারি পছন্দ হয়েছে, বল্টুটা খুলতে যাবে, ঠিক এমন সময় দোতলা থেকে হইচই কানে এল। শেয়ালদার মতো ব্যস্ত এলাকায় হট্টগোল তো সর্বক্ষণ লেগেই আছে, কিন্তু এই হইচই এর শব্দটা ভারি মিঠে, আর তার মধ্যে একটা চেনা চেনা গলাও উঁকি দিচ্ছে, তাই ছেনু আর থাকতে পারলো না, স্ক্রুটা ফেলে রেখে সিঁড়ি দিয়ে এক দৌড়ে নিচে নেমে এল। ... ...
একদা ইউরোপের মাঝখানে কোথাও বসবাস করতেন স্লাভ জাতি। কালে খাদ্যের অকুলান হলো, নিয়মিত তুরকিক অভিযানে জীবন বিপর্যস্ত–দেড় হাজার বছর আগে ভাগ্য সন্ধানে তাঁরা ইউরোপের তিন দিকে বেরিয়ে পড়লেন। পোল্যান্ডের প্রচলিত লোকগাথা অনুযায়ী তিন স্লাভিক ভাই, লেখ চেখ রুশ গেলেন তিন দিকে–উত্তর দিকে লেখ, পুবে রুশ দক্ষিণে চেখ। লেখ বাসা বাঁধলেন আজকের পোল্যান্ডে (লেখ নামক বিয়ার তাঁর নামকে অমর করে রেখেছে) বেলারুশ; রুশ যেখানে থামলেন সেটি আজকের রাশিয়া, ইউক্রেন (আক্ষরিক অর্থে সীমানা), চেখ ভাই গেলেন দক্ষিণে, আজকের বলকান অবধি। কালক্রমে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেন সকলে। পশ্চিমে কেন যান নি তার কোন ব্যাখ্যা পাই নি। হয়তো বর্বর গথ ভিসিগথ জাতির নৃশংস আচরণের কাহিনী শুনেছিলেন অথবা এই তিন অঞ্চলে তাঁরা পেলেন বাসযোগ্য ভূমি; লোভ বাড়ান নি। ... ...
প্রকৃতি একটু একটু করে খুলে দিচ্ছিল তার জাদু-দরজা। ঘরের একদিকের দেয়ালের পাশে ছিল লম্বা লম্বা পাতার কিছু গাছ। তাতে অদ্ভুত দেখতে কিছু কলি। ধীরে ধীরে কলিরা বড় হচ্ছিল। হঠাৎ এক সকালে দেখি, কলি নয়, ফুল। কি অবিশ্বাস্য সুন্দর ফুল! বাবাকে গিয়ে ধরলাম, কি ফুল বাবা? বাবা বলল, কলাবতী। এমন ও ফুল হয়, এমন ও নাম হয়! আমার চেতনার কূল ভাসিয়ে বাজতে থাকে কলাবতী, কলাবতী, কলাবতী। তারপর একদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে। গায়ে সেদিন অল্প অল্প জ্বর। মা বলে, – আজ আর দুজনের কারো, স্কুলে গিয়া কাজ নাই। আমি চাদর মুড়ি দিয়ে হাত-পা ঢেকে বিছানায় বসে থাকি, জানালার পাশে। দেখি, কলাবতী বৃষ্টিতে স্নান করে। পাতার গা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে – টুপ – – টুপ, টুপ টুপ। ফুলের গা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে – টুপ – – টুপ, টুপ টুপ। ঠাকু’মা এসে পাশে দাঁড়ায়। – কেমন আছ অহন? – ভালো। – জলীয় বাতাস লাগাইও না। জ্বর বাড়ব। জানালার পাল্লা অনেকটা বন্ধ হয়। একটু ফাঁক রাখা থাকে–নাতির জন্য, কলাবতীর জন্য। ছোট দু’ ভাই এবার ঘিরে আসে, – ঠাকুমা গল্প বলো। ... ...
এই মুহূর্তে বার বার একটা নাম শোনা যাচ্ছে। সোনাম ওয়াংচুক। অনেকেই হয়তো বলবেন যে লাদাখ নিয়ে নতুন রাজনীতির আবর্ত তৈরি হচ্ছে এই নামটিকে ঘিরে। কিন্তু যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেটা সফল হলে এবং বিভিন্ন জায়গায় আরও কয়েক দশক আগে শুরু হলে হিমালয়ের প্রকৃতি কিছুটা হলেও বাঁচত। ... ...
রবিবুড়োর ডাকঘর থেকে একটা ছোট অংশ ছিল আমাদের পাঠ্যবইয়ে, অমল ও দইওআলা শিরোনামে। দিদিমণিরা সেটাই বেছে নিলেন মঞ্চস্থ করার জন্য। সম্ভবত: প্রচুর পটর-পটর করার যোগ্যতায় আমি মনোনীত হলাম অমল-এর ভূমিকায়। চতুর্থ শ্রেণীর এক শ্রীমান হল দইওআলা।সেই প্রথম জেনেছিলাম রিহার্সাল কাকে বলে। শেষ ক্লাস-এর পরে শুরু হত। ভাল লাগত, তবে একটু ক্লান্ত হয়ে যেতাম – আমার তো কবে সব মুখস্ত হয়ে গেছে, ভাব ভঙ্গী সহ! দিদিমণিরা মাঝে মাঝে আলোচনা করতেন কেমন করে মঞ্চসজ্জা করলে বা আর কি কি করলে নাটকটা একেবারে সত্যির মত করে তোলা যায়। সেই সব কিছু কিছু শুনে আমার ধারণা হয়েছিল যে আসল অনুষ্ঠানের দিন আমাকে দইওআলা ছেলেটির হাত দিয়ে একটা সত্যি দই-য়ের ভাঁড় দেওয়া হবে। আমার কাছে নাটকের আসল আকর্ষণ ছিল সেটা এবং সেই নিয়ে ভিতরে ভিতরে খুব উৎফুল্ল থাকতাম। ... ...