এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • কারাগার, বধ্যভূমি ও একঝাঁক স্মৃতি বুলেট

    kallol
    অন্যান্য | ২৬ অক্টোবর ২০০৬ | ১৩৩৬০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kallol | 122.167.72.216 | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১৭:৫২695665
  • প্রথম রাতে সবাইকেই একটা ওয়ার্ডে থাকতে হয়, তার নাম আমদানী ওয়ার্ড। সার্থকনামা। নামেই মালুম করিয়ে দেয় দেওয়ালের ওপারে তোমার মানুষ স্বত্তাকে বিসর্জন দিয়ে আসা হয়েছে। এখানে তুমি চলে ফিরে বেড়ানো বস্তু মাত্র। আমাদের জেলের অগ্রজরা আগেই খবর দিয়ে রেখেছিলেন তাই আমাদের আমদানী ওয়ার্ডের ""শাসক""দের হাতে হেনস্তা হতে হয় নি। তল্লাসীর নামে সোজাসুজি যৌন পীড়ণ। টাকা পয়সা বা বিড়ি সিগারেট লুকানো আছে কি না তা দেখতে, জামা কাপড় খুলিয়ে যৌনাঙ্গ টিপে দেখা। সেটা চার পাঁচ জনে মিলে করে। তবে সবাই যে তাতে খুব অসোয়াস্তি বোধ করে তাও নয়। কিংবা ওটাই বোধহয় পাল্টা চাল। অসোয়াস্তি প্রকাশ করলেই বেশী হেনস্তা। সেটা না করলেই অল্পে রেহাই।
    ক্ষমতাকে ক্রমশ: তার অলিগলিতে দেখতে পাচ্ছি। যারা এই কর্মটি চালায়, তারা নিজেরাও বন্দী, সাজাপ্রাপ্ত বন্দী। তারাই অন্য বন্দীদের উপর কি নির্দ্বিধায় ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায়।
    এই প্রসঙ্গে মনে পড়লো। প্রথমবার জেলে কিন্তু এই অভিজ্ঞতা হয়নি। ৬৭-৭০এর নকশাল আন্দোলন ভুল ঠিক যাই হোক না কেন, ক্ষমতাকে কোথাও কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। এবার খবর দেওয়া ছিলো বলে আমাদের ছাড় দেওয়া হলো। তা না হলে......। কিন্তু সেবার কারুর উপরেই এটা করা হচ্ছিলো না।

  • kallol | 122.167.77.171 | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১০:০২695666
  • রাত কাটলো। ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত আমরা কথা বলছিলাম। কোথায় কাদের সাথে থাকবো। এই ব্যাপারটার ফয়সলা অবশ্য তাড়াতাড়িই হয়ে গেলো। যেখানে সঞ্জয়দা সেখানেই আমরা।
    সঞ্জয়দা (সঞ্জয় মিত্র) এপিডিআর-এর প্রাণপুরুষ। অসম্ভব সুন্দর আর খোলা মনের একটা মানুষ। ৬০-এর প্রথম দিককার যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ার (বোধহয় মেকানিকাল)। তারপর সব ছেড়েছুড়ে কম্যুনিষ্ট পার্টি। নকশালবাড়ি আন্দোলনে সঞ্জয়দারা (সঞ্জয়দা, সুভাষদা, ভারতীদি, দিলীপদা....) সিপিআইএমএলএ যোগ দেয় নি। অনেকগুলো ব্যাপারে মতের ফারাক ছিলো। প্রধান ফারাকটা ছিলো লড়াইয়ের চরিত্র নিয়ে। ওঁরাই একমাত্র গোষ্ঠী যাঁরা মনে করতেন ভারত একটা আধা সামন্ততান্ত্রিক-আধা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র, কিন্তু প্রধান দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যবাদ। অন্য সব গোষ্ঠীই মনে করতেন সামন্তবাদই প্রধান দ্বন্দ্ব। ফলে লড়াইটা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তির লড়াই। তাই বিপ্লবী যুক্তফ্রন্ট চাই। ফলত: এঁরা, গণসংগঠন করার কথা বলতেন। রাজাবাজারে বই বাঁধাই শ্রমিকদের মধ্যে আর ন্যাশনাল মেডিকাল কলেজে ছাত্রদের মধ্যে এঁরা কাজ করতেন। পরে দারুন একটা ছাত্রদের পত্রিকা চালাতেন। বীক্ষণ। সম্পাদক ছিলো প্রদীপ। দারুন স্লোগান তুলতো। খুব হাসিখুশি আর মজার ছেলে ছিলো। খুবই অল্প বয়সে মারা গেলো। খাওয়াদাওয়ার প্রচন্ড অনিয়মের ফলে মারাত্মক রকমের গ্যাস্টাইটিসে ভুগতো। কিন্তু তখনকার বাঙ্গালী কমিউনিষ্টদের চলতি মুল্যবোধে নিজের শরীর নিয়ে চিন্তা করাটাই বিচ্যুতি। ফল অকালে, অকারনে ঝরে যাওয়া। প্রদীপের সম্পাদনায় রঘুদার (রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়) ""শৈশব"" ধারাবাহিক ছাপা হতো।
    ""শৈশব""-এর প্রসঙ্গ যখন এলো তখন বলি। আমাকে ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্রের মত মানুষ বইটা পড়তে বলেছিলেন এই বলে - ""পথের পাঁচালীর পর এতো শক্তিশালী উপন্যাস বাংলা ভাষায় কম লেখা হয়েছে।'' উপন্যাসটার মূল চরিত্র অপুর বয়সী একটি ছেলে, যে দেশভগের ফলে মায়ের হাত ধরে এসে পড়েছে কলকাতার বস্তিতে। যার বাবা নিরুদ্দেশ। তার বেড়ে ওঠা। একদম anti অপু চরিত্র। এই anti-র বাংলা করতে পারলাম না। যোগাড় করতে পারলে সকলে পোড়ো।
  • sucheta | 202.63.56.114 | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১১:১২695667
  • কল্লোলদা,
    আপনার এই স্মৃতিকথা খুব আগ্রহের সাথে ফলো করছি। আপনাদের সেই তীব্র আবেগ এই জমানায় বসে অনুভব করা সম্ভব নয়। দুরন্ত সেই সময়ের সঠিক মূল্যায়নও কখোনও হয়তো হবে না, কিন্তু সেই সময়ের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে যে মান্যতা আপনারা পেয়েছেন, তাকে অস্বীকার করলেও মুছে ফেলা বোধহয় একেবারে যাবেনা কিছুতেই।
    বীক্ষণ সম্পর্কে আপনার কাছেই প্রথম শুনেছি। আমাদের ম্যাগাজিনের নাম বীক্ষণ রাখার আগে অন্য অনেক নাম ঠিক করলেও হঠাৎ ই একদিন এই নাম মাথায় এলো। উত্তরবঙ্গ ও কোলকাতায় খোঁজ নিয়ে জানলাম যে এই নামে কোনও ম্যাগাজিন নেই। প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হোয়ে যাওয়ার পর আপনার সাথে কথা হলো। আপনার বলা এই বীক্ষণের খোঁজ করেছিলাম এবার দেশে। কিন্তু কোথাও সেভাবে কিছু জানতে পারিনি। এখনো কারো কাছে হয়তো খুঁজে পেতে পাওয়া যেতেই পারে। ঐ পত্রিকায় নিয়মিত যাঁরা লিখতেন তাঁদের কথাও একটু বলুন। ঐ লেখক গোষ্ঠির কোনো লেখক প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, পরে? এখনো লিখছেন এরকম কেউ আছেন, জানেন? কৌতুহল, আর কিছুনা।

    একটু বেশি তাড়াতাড়ি লিখুন, ভালো থাকুন খুব।

    সুচেতা
  • kallol | 122.167.66.99 | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১১:২৪695668
  • সুচেতা... ঐ যে লিখেছি রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে আছেন। আনন্দবাজারে ফোন করলে পেয়ে যাবে। আমার কথা বোলো যদি কথা হয়।
    আর অন্যদের মধ্যে উৎপলেন্দু - এই রে পদবীটা ভুলে গেছি - চক্রবর্তিই তো। আরে চলচ্চিত্রকার উৎপলেন্দু.... দেবশিশু, ময়নাতদন্ত-এর পরিচালক।
    অবশ্য ওরা তখন অন্য নামে লিখতন। রঘুদা শংকর বসু নামে আর উৎপলেন্দু স্বর্ণ মিত্র নামে।

  • kallol | 122.167.86.128 | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ২০:০৬695669
  • ভোর। এই শব্দটি জীবনানন্দের ""শিকার'' কবিতটিতে যে ভাবে এসেছে, তেমন বোধহয় অন্য কোথাও আসে নি। ঠিক তেমনভাবেই ভোর এলো।
    যারা ""শিকার'' পড়োনি তাদের জন্য :

    ভোর ;
    আকাশের রঙ ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল;
    চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ।
    পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো;
    কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে মুক্তো
    আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিল
    হাজার হাজার বছর আগে এক রাতে তেমনি- -
    তেমনি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনো।

    হিমের রাতে শরীর 'উম্‌' রাখবার জন্য দেশোয়ালীরা সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে---
    মোরোগফুলের মতো লাল আগুন;
    শুকনো অশ্বত্থপাতা দুমড়ে এখনো আগুন জ্বলছে তাদের;
    সূর্যের আলোয় তার রঙ কুম্‌কুমের মতো নেই আর;
    হয়ে গেছে রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছের মতো।
    সকালের আলোয় টলমল শিশিরে চারিদিকের বন ও আকাশ
    ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতো ঝিলমিল করছে।

    ভোর;
    সারারাত চিতবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে
    নক্ষত্রহীন, মেহগিনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে
    অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে
    সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিল।
    এসেছে সে ভোরের আলোয় নেমে;
    কচি বাতাবিলেবুর মতো সবুজ সুগন্ধি ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে;
    নদীর তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউয়ে সে নামল--
    ঘুনহীন ক্লান্ত বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতো একটা আবেগ দেওয়ার জন্য
    অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিড়েঁ ভোরের রৌদ্রের মতো
    একট বিস্তীর্ণ উল্লস পাবার জন্য;
    এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সোনার বর্শার মতো জেগে উঠে
    সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য।

    একটা অদ্ভুত শব্দ।
    নদীর জল মচকাফলের মতো লাল।

    আগুন জ্বলল আবার--উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরী হয়ে এলো।
    নক্ষত্রের নিচে ঘাসের বিছনায় বসে অনেক পুরনো শিশিরভেজ গল্প;
    সিগারেটের ধোঁয়া;
    টেরিকাটা কয়েকটা মানুষের মাথা;
    এলোমেলো কয়েকটা বন্দুক--হিম--নিস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম।
  • kallol | 192.77.110.18 | ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১৩:০৯695670
  • সকাল হতে অন্য সকলের সাথে আমাদেরও নিয়ে যাওয়া হলো একটা খোলা যায়গায়। বাঁধানো চাতালে সারী দিয়ে উবু হয়ে বসতে হবে। এইটা লক্ষণীয়। উবু হয়ে বসাটা। মানুষগুলো সারী দিয়ে দাঁড়াতে পারতো, কিংবা মাটিতে আসন করে সারী দিয়ে বসতে পারতো। কিন্তু জেলের দস্তুর - উবু হয়ে বসা। উবু হয়ে বসার মধ্যে একটা হীনমণ্যতা সংক্রামণের প্রকল্প আছে। নিজের থেকে উঁচু পর্যায়ের মানুষের সামনে দাঁড়ানো বা আসন করে বসাটা অবাধ্যতার লক্ষণ বলে ধরা হত (এখনো হয়), তাই বশ্যতা দেখানোর নানান শরীরী ভাষার এও একটা।
    আমরা অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকলাম। সামনে একটা টেবিলে জেলার বসেছেন। নতুন কয়েদীর নাম ডাকা হচ্ছে। তারপর তার হাতে অ্যালুমিনিয়ামের থালা আর কম্বল দিয়ে তার ওয়ার্ড নির্দিষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। সেই সেই ওয়ার্ডের মেট তাদের লাইন করে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কি করব। একটা ব্যাপার পরিস্কার আমাদের ডাকা হবে সবার শেষে। এর মধ্যে দেখি দূর থেকে সঞ্জয়দা দুহাতে দুটো এনামেলের মগ আর এক গাল হাসি নিয়ে আসছে। ও: এরকম পরিবেশে চেনা মুখ, খুব ভরসার চেনামুখ দেখতে পেলে যে কি হয়, তা লিখে বোঝানোর মত এলেম আমর নেই।
  • kallol | 192.77.110.18 | ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১৪:২৭695671
  • সঞ্জয়দা কাছে এলে বোঝা গেলো, এনামেলের মগ দুটোর ওপর দুপিস বেশ মোটা পাঁউরুটি আছে, আর এনামেলের মগে চা। আমরা চা পাঁউরুটি (পাঁউরুটিতে মাখনও মাখানো ছিলো) খেতে খেতে সঞ্জয়দা জেলারের সাথে কি সব কথা বলছিলো। এর মধ্যে সাদা শার্ট আর মেরুন লুঙ্গী পরা শ্যামলা পানা গোলগাল একজন আসতেই সঞ্জয়দা বলে উঠলো
    - এই তো অসিত এসে গেছে।
    আমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দিলো।
    - অসিত, অসিত সিন্‌হা। আমাদের ফাইলের কনভেনার।
    তারপর অসিতদাকে বললো
    - এই কল্লোল আর এই হলো দেবাশিস। এরা দুজনেই এপিডিআর করতো। এবার তুমি কথা বলে নাও।
    অসিতদা ওঁদের রাজনৈতিক অবস্থানের কথা বলছিলেন। ওঁরা মনে করেন কোঅর্ডিনেশন কমিটি থেকে সিপিআইএমএল গঠনের প্রক্রিয়া ভুল ছিলো। তাই নতুন করে তাঙ্কিÄক লড়াই চালিয়ে পার্টি গড়ার দিকে যেতে হবে। জানতাম এটা কানু সান্যালদের লাইন। আমাদেরও একই মত। কিন্তু আরো নানান বিষয়ে মতপার্থক্য থাকায় আমরা ওঁদের গোষ্ঠীতে যোগ দেই নি।
    যাই হোক এখানে সেটা বিবেচ্য নয়। প্রাথমিক জায়গাটায় মিল আছে তাই, আমরা ওদের সাথে থাকতে পারি। আমাদের ফাইলের পরিচয় ""নো পার্টি ফাইল''। ভৌগলিক অবস্থান - প্রেসিডেন্সী জেলের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনের যে জায়গাটাকে ""সাতখাতা'' বলে তার দোতলায় ১৭ আর ২০ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে আমাদের ""নো পার্টি ফাইল''। মাঝখানে ১৮ আর ১৯ নম্বর ওয়ার্ড হলো পার্টি ফাইল। যাঁরা মনে করেন সিপিআইএমএল গঠন সঠিক ছিলো। সেখানে বিনোদ মিশ্রর সিপিআইএমএল (তখন বলা হতো প্রো চারু-অ্যান্টি লিন) সত্যনারায়ন সিন্‌হার সিপিআইএমএল, কৌশিক ব্যানার্জিদের ইউনিটি কমিটি এরকম নানা গোষ্ঠী।
    আর আমাদের নো পার্টি ফাইলে কানু সান্যাল গোষ্ঠী, সোমনাথ ঘোষদের গোষ্ঠী, এছাড়া, বেশীরভাগই আমাদের মতো কোনো গোষ্ঠীতে না থাকা মানুষজন।
    আমাদের থালা কম্বল নিতে হলো না। ওগুলো ওয়ার্ডে পৌঁছে যাবে। কাঁধের জোলায় জামাকাপড়, গামছা নিয়ে হাজির হলাম ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে। ওখানেই সঞ্জয়দাও আছে। একটা জানালার সামনে আমাদের কম্বল পাতা হলো। আমি আর দেবাশিস আমাদের দুটো কম্বলের একটা বড় করে পাতলাম, অন্যটা গায় দেওয়া যাবে বলে রাখা হলো। সারা ওয়ার্ডে আমরাই শুধু এক কম্বল ভাগ করে শুতাম।
    গুছিয়ে বসতে না বসতেই উল্টোদিকের কম্বল থেকে একজন বেশ বৈঠকি মেজাজের বয়স্ক মানুষ হাঁক পাড়লেন,
    - এই যে মানিকজোড় একবার এদিকে আসা হোক।
    তাকিয়ে দেখি ওনার পাশের কম্বলে তারকদা - আমাদের ১০৫ মুক্তারামের তারকদা - হাসছেন।
  • ranjan roy | 122.168.90.18 | ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ২২:৪২695672
  • ভাই কল্লোল,
    রাঘব বা রঘু, ভজা,সুনু আর বেঙ্গল পটারির কিছু শ্রমিক-এদের কথা তোমার লেখায় আমার খুব মনে পড়ছে। মনে পড়ছে অকালে ঝরে যাওয়া বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান-গোসাবায় মারা যাওয়া সুব্রতর কথা।
    আবেগতাড়িত হয়ে নীচে লিখছি ক'টি লাইন:-

    নিশির ডাকের মত মাঝরাতে তিনবার সমুদ্রগর্জন,
    দরজায় খিল আঁটা, সাড়া দিল তবু তিনজন।
    বাইরে ফুঁসছে ঝড়, ফুলে ওঠে সিংহের কেশর,
    সমুদ্রঘোড়ায় চড়ে চলে গেল ওরা তিনজন।।

    ঝড় কবে থেমে গেছে , মরাচাঁদে লেগেছে গ্রহণ,
    নৌকোসব ফিরে এল, ফেরেনি তো' ওরা তিন জন।
    বালিতে পায়ের দাগ মুছে দিলো জোয়ারের জল,
    একা একা ঘরে ফিরি, হা-হা করে চন্দনের বন।।
  • sucheta | 202.63.56.114 | ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ২২:৫৪695673
  • থ্যান্‌ক ইউ, কল্লোলদা। নিশ্চয় বলবো।
  • kallol | 122.167.97.77 | ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ২৩:০২695675
  • প্রিয় রঞ্জন.... আমি ধন্য। আমার এই সামান্য স্মৃতিচারণ, যদি কাউকে দিয়ে ""হা হা করে চন্দনের বন'' এর মতো পংক্তি লিখিয়ে নেয়, সে আমার কত বড় ভাগ্য, আমি কি করে বোঝাই।
    ভালো থেকো।
  • kallol | 192.77.110.18 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১২:৩৭695676
  • পাশাপাশি চার কম্বলে চার বয়স্ক মানুষ। তারকদা, পরিমলদা (যিনি আমাদের হাঁক পেড়েছিলেন), সমীরদা (কবি সমীর রায়) আর সুধাংশুদা। অদ্ভুত মজার চার চরিত্র।
    তারকদা। ঠনঠনে-মুক্তারামের বৈঠকী মানুষ। কিন্তু মনে প্রাণে কমিউনিষ্ট। তঙ্কেÄর তত ধার ধারেন না - পোড় খাওয়া সৎ ট্রেডইউনিয়ান কর্মী। পুরোনো কমিউনিষ্ট পার্টির নানান গল্পের ভান্ডার। হিন্দি ভাষায় গালাগালির মজুত ঈর্ষনীয়। তবে তার ব্যবহার খুব সীমিত প্রয়োজনভিত্তিক। একটু গোলগাল, কিন্তু মোটের উপর টানটান চেহারা।
    সমীরদা। কবি, মৃদুভাষী, এমসিসির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন (তখনও ""দক্ষিণ দেশ'' গোষ্ঠী বলেই বেশী পরিচিত)। আপাদমস্তক ভদ্র। গালাগালি দেওয়াটা একদম অপছন্দের। আড্ডায় ভালো শ্রোতা। ঢিলাঢালা চেহারা। মুখটা দেখলেই হজবরল-র ন্যাড়ার ছবি মনে পড়ে যাবে। কিন্তু আদর্শের প্রশ্নে ঘাড় ত্যাড়া করে বেশ লড়ে যেতে পারেন।
    পরিমলদা। এক্কেবারে উত্তর কলকাতার বৈঠকী মানুষ। মেজাজে দিলখুশ জমিদার। নিজেকে মাঝে মাঝে গরানহাটা না কৈখালীর জমিদার বলে দাবীও করতেন। তাই নিয়ে কেউ ""ফিউডাল'' বলে খোঁটা দিলে বাজখাঁই গালায় - আরে রাখ্‌ তোর ফিউডাল..... বলে স্রেফ উড়িয়ে দিতেন, কোন রকম যুক্তি তর্কের ধার না ধেরে। গভীর কোন বিষয় নিয়ে কথা হলেই সুধাংশুর ডাক পড়ত - অ্যাই সুধাংশু, দ্যাখ্‌ তো কি বলছে। পরে আমায় বুঝিয়ে বলিস। সুধাংশু যদি কখনো বলার চেষ্টা করেছে - আপনিও শুনুন না। তার উত্তর হতো - তাহলে আর তোকে এখানে নিয়ে এলুম কেন ! এরপর আর কোনো কথা হয় ? উত্তর কলকাত্তাই গালাগালির চলন্ত ভান্ডার। এবং তার ব্যবহারে অকুতোভয়, অক্লান্ত। তাতে বেশ উদ্ভাবনী শক্তিও ছিলো। একবার কাকে যেন ""খচ্চরের ল্যাজ'' বলেছিলেন। সে রাগবে কি ? বরং কাচুমাচু হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলো - মানে ! পরিমলদা তাকে সস্নেহে বুঝিয়েছিলেন - খচ্চর তো ঠিকমতো হতে পারলি না - শুধু খচ্চরের গু মেখেই নেচে গেলি। বোঝো।
  • kallol | 192.77.110.18 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১৩:২০695677
  • সুধাংশুদা। ৪০ দশকের আত্মভোলা, বিনয়ী, সর্বগ্রাসী পড়ুয়া, মোটা চশমা, ঝোলা গোঁফ, মৃদু এবং অল্পভাষী, ভারতীয় ""ত্যাগ''-এর আদর্শে প্রাণিত গোঁড়া কমিউনিষ্ট। মানুষ হিসাবে অত বিনয়ী আর গুণী মানুষ আমি প্রায় দেখিনি। কোন সময় কেউ যদি ওনার কোন গুনের প্রশংসা ওনার সামনে করে ফেলেছে, লজ্জা পেয়ে অদ্ভুত সব বাহানায় প্রায় দৌড় মারতেন সেখান থেকে। ইংরাজীটা খুব ভালো জানতেন। এতটাই দখল ছিলো যে আমাদের স্টাডি সার্কেলে (আমি, সঞ্জয়দা, দেবাশিস, সমীরদা, তারকদা, পরিমলদা, দীপকদা (দীপক বিশ্বাস), অবিনাশদা, দিলীপদা, আর এক সুধাংশুদা-এঁরা তিন জনই হোসিয়ারী শ্রমিক ইউনিয়ানের) মরিস কনফর্থের ""ডায়লেক্টিকাল মেটিরিয়ালিজম'' পুরো এক পাতা পড়ে সে পাতাটার বাংলা করে যেতেন গড়গড় করে, যেন বাংলাটা পাশের পতায় লেখা আছে।
    অদ্ভুত ভাবে পরিমলদার সব অত্যাচার, গালাগালি, আবদার হাসিমুখে সইতেন। কিছু বললে, বলতেন - ও তো ঐ রকমই চিরকাল, ছেলেবেলা থেকেই। আর ছোট বড় নির্বিষেশে আপনি বলতেন সবাইকে।
  • kallol | 192.77.110.18 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১৭:২৭695678
  • প্রথম দিকে দফায় দফায় নানান গোষ্ঠীর মানুষজন ""আলোচনা'' করতে আসতেন। উদ্দেশ্য গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি। আমাদের সাথে অনেক কিছুতেই মতে মিলতো না। আমরা গণসংগঠন করার কথা বলতাম - কেউ কেউ একমত। আমরা বৃহত্তর বাম ঐক্যের কথা বলতাম (সিপিএম সমেত)- অনেকেই একমত নয়। কেউ কেউ বিচ্যুতিও বলেছেন। আমরা দীর্ঘস্থায়ী তাঙ্কিÄক / প্রায়োগিক লড়াই-এর মধ্য দিয়ে নতুন পার্টি / নতুন নেতৃত্বের উঠে আসার কথা বলতাম - প্রথমটার ক্ষেত্রে অনেকে একমত (তাঙ্কিÄক / প্রায়োগিক লড়াই), পরেরটা শুনেই, বিশেষ করে নতুন নেতৃত্বের কথা উঠলেই আমাদের সক্কলে একবাক্যে - বিলোপবাদী বলে দিত। আমরা গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলতাম - তাতে সকলেরই এক রায় - ধুর, গণতন্ত্রই নেই, তার আবার গণতান্ত্রিক অধিকার !! ফলে গোষ্ঠীগুলো মাসখানেকের মধ্যে উৎসাহ হারালো। কিন্তু ""আলোচনা'' শুনে অন্য অনেকে বন্ধু হল।
    পাশের কম্বলের শান্তনুদা (আসলে সৌমেন গুহ - রুনু গুহ মামলার - অর্চনা গুহের দাদা, লতিকা গুহের জীবন সঙ্গী), কানুদাদের গ্রুপের দীপকদা (চারুবাবুর ডানহাত দীপক বিশ্বাস), তারকদা, সমীরদা, সুধাংশুদা, ফলত: পরিমলদাও। সঞ্জয়দার সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হতে থাকলো।
    এর মধ্যে নভেম্বর বিপ্লব দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান। নাটক হবে, গান হবে। আমি গানের দলে - আমাদের গানের লিডার শান্তনুদা। গানের দলে আরও দুজনের সাথে জমে গেলো - ডেবরার কৃষক নেতা নিতাই দাস আর শ্রীকাকুলামের নাগেশ্বর রাও। নাগু - সুব্বারাও পণিগ্রাহীর ট্রুপে গান গাইতো। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমরা তিনজনেই খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেলাম। আমি নিতাইদা আর নাগুকে প্রতুলদার গান (তখন ""জেন''-এর গান), হেমাঙ্গদার গান, পুরোনো আইপিটি এর গান শেখাতাম। নিতাইদা মেঘনাদের গান (তালতলার সব্যসাচীদা - গোপীবল্লভপুরে লড়াইয়ে গেছিলো), সাঁওতালী গান আর নগু আমাদের সুব্বারাওয়ের গান শেখাতো। মাঝে মাঝে শান্তনুদা পিট সিগার/জোন বেসের গান শোনাতো। সঞ্জয়দাও যোগ দিতো হ্যারিবেলা ফন্তের গান নিয়ে। গানে গানে ঝলমল করে উঠতো আমাদের ওয়ার্ড।

  • kallol | 192.77.110.18 | ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১১:২৬695679
  • আমাদের ওয়ার্ডগুলোর গড়ন লম্বাটে। আমরা যে ওয়ার্ডে থাকতাম সেটা ১৭ নম্বর। উত্তর-দক্ষিনে লম্বা। পূব-পশ্চিমে জানালা ছিলো ১৫টি, আর সব কটাই ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত। ওয়ার্ডগুলো আয়তনে সত্যিই বিশাল। মাপটা এরকম - জানালা বরাবর এক সারীতে ১৫ জনের কম্বল বিছানো। গড়ে কম্বলের প্রস্থ (ভাঁজ করে মেঝেতে পাতা অবস্থায়) ৩ ফুট। দুটো কম্বলের মাঝে এক ফুটের ফাঁক। মানে ঘরটি লম্বায় প্রায় ৬০ ফুট, চওড়ায় ২০ ফুট তো বটেই । এক একটি ওয়ার্ডে গড়ে ৩০ জন থাকতেন। সেভাবে দেখলে বেশ রাজসিক ব্যবস্থা। আলিপুর বেলভেডিয়ার-এর মতো অভিজাত এলাকায় দোতলায় ওরকম একটা ঘরে থাকাটা তো যাকে বলে ডি-লা-গ্র্যান্ডি-মেফিস্টোফিলিস-ইয়াক ইয়াক....। কিন্তু এটা শুধুই রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য, যারা প্রথম শ্রেণীর বন্দী। জেলের আইনে শ্রেণীভাগটা মোটামুটি এরকম ছিলো (আমার যতদূর মনে আছে। কিছু এদিক ওদিকও হতে পারে)- বন্দীর পরিবারের বছরে ১০০০০ টাকা বা তার উপর রোজগার, বন্দীর শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক বা তার উপর, রাজনৈতিক অভিযোগে বন্দী - এরা প্রথম শ্রেণীর সুবিধার জন্য আদালতে আপীল করতে পারতেন।
    কাজেই আমার দ্বিতীয় সরকারী অতিথিশালার বর্ণনা শুনে সাধারন ভাবে জেল সম্পর্কে কোন ধারনা গড়ে না তোলাই ভালো। আমি শুধুই আমার অভিজ্ঞতার কথাই বলছি, আমার খন্ডিত দেখার কথা।
    সকালে চা পাউরুটি-মাখন আর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সপ্তাহে একদিন ডিম সেদ্ধ। এই যে মাখন আর ডিমসেদ্ধ এগুলো ছিলো ""মেদিকাল ডায়েট''। আমাদের ৬০ জনের মধ্যে প্রায় ১০/১৫ জনের নানান কারনে ""মেডিকাল ডায়েট'' ছিলো। ওদের জন্য আসা ডিম আর মাখন দিয়ে আমাদের ৬০ জনের দিব্যি হয়ে যেত। দুপুরে ভাত-ডাল-তরকারী। সপ্তাহে একদিন মাছ/মাংস (এত ছোটো পিস হতে পারে জেলে না গেলে কাউকে বিশ্বাস করানো যাবে না)। খাবার পরিমান মোটামুটি ভালই। খাবারের মান ও রান্না খুব সুবিধাজনক না হলেও ""জেলের ভাত'' বলে ভাবলে - মানিয়ে যেত।
    বিকালে চা। রাতে আবারও দুপুরের মতই।
    অনেকের বাড়ি থেকেই বিড়ি আসতো। সিগারেট দিতে চাইলে বাড়ির লোককে বলে দেওয়া হতো শুধু চারমিনার দিতে। কারন যে টাকায় এক প্যাকেট ভালো সিগারেট হয়, ঐ একই টাকায় অনেক বেশী বিড়ি হবে। অনেকের বাড়ির বিড়ি পাঠানোর ক্ষমতাও ছিলো না। অনেকের বাড়ির লোকজন যোগাযোগই রাখতো না। তাই আমাদের পাওয়া সব বিড়ি-সিগারেট(চারমিনার) কমিউনের ভাঁড়ারে জমা হতো। আমরা সকালে তিনটে বিড়ি, বিকালে তিনটে বিড়ি পেতাম। রবিবার বিকালে একটা চারমিনার। ফলে সকলেই একরকম খাবার আর ধোঁয়া পেত।
    ভাঁড়ার সামলাতো দুজনে ""বড় পিসিমা''-""ছোটো পিসিমা'' - স্বপনদা আর কেশব। খুব কড়া গোছের দুর্নীতি শুণ্য প্রশাসন। কোনভাবেই একটা বেশী বিড়িও যোগাড় করা যেত না।
    তবে বিপ্লবী বুদ্ধি বলে কথা। আমরা মিনি কমিউন বানাতাম। সঞ্জয়দা-আমি-দীপকদা তিনজনের মিনি কমিউন। শর্ত যে যখন বিড়ি ধরাবে বাকি দুজনকে কাউন্টার দিতে হবে। বিড়ি হয়তো ছটাই টানা হবে এক এক জনের। সেটা বড়কথা নয় - দিনে আঠারো বার বিড়ি টানা যাবে - সেটা অনেক বড় ব্যাপার ।
  • d | 192.85.47.2 | ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১৫:৩৯695680
  • বন্দীর পরিবারের বাৎসরিক রোজগার কেন দেখা হয়? "প্রথম শ্রেণীর' কিছু সুযোগ সুবিধা কি ক্রয়যোগ্য?
  • kallol | 192.77.110.18 | ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১৬:২১695681
  • আমি যুক্তিটা জানি না তবে আন্দাজ করতে পারি। ভারতের কারাগার আইন তৈরী হয়েছিলো ১৮৯৪-এ। তখন চিন্তা ছিলো কোনো ""ভদ্রলোক''কে যদি কোন কারনে জেলে যেতে হয়, তবে যেন ""কষ্ট'' না পায়। তাই পরিবারের আয়ের কথা ওঠে। এখন এই শ্রেনী বিভাগ তুলে দেওয়া হয়েছে।
  • kallol | 192.77.110.18 | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১২:১৬695682
  • নিতাইদার কাছে গল্প শুনতাম ডেবরার কৃষক আন্দোলনের। কিভাবে অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির কৃষক সংগঠক দেবেন দাস ডেবরা অঞলে কৃষক সভা গড়ে তুললেন।
    নিতাইদা হাফ প্যান্ট পড়া বয়স থেকেই দেবেনবাবুর সাথে ঘুরে বেড়াতো। দেবেন বাবুই লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কোন ইস্কুলে নয়, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুরে ঘুরে সংগঠন গড়ে তোলার ফাঁকে ফাঁকে রাতে কি ভোরবেলা চলতো পড়াশোনা। নিতাইদা তখন দশ কি এগারো। এটা তেভাগা আন্দোলনের ঠিক আগের সময়টা। তেভাগার ঢেউ লাগলো মেদিনীপুরেও। তখন থেকেই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো সদ্য কিশোর মানুষটা লড়াইয়ের আগুনে পুড়ে তৈরী হচ্ছিলো। আদিবাসী কৃষক সাথীদের সাথে ওঠা বসা করতে করতে, সাঁওতালী, মুন্ডারী, হো, এরকম পাঁচ-ছটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতো নিতাইদা। আর সেই সময় থেকেই প্রাণের বন্ধু গুনাথদা, গুনধর মুর্মু।
    ৪৭ থেকে ৬৪ সিপিআই-এর কৃষক সংগঠক হিসাবে মেদিনীপুরে এই দুই বন্ধুর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম থেকে গ্রামে, মহকুমা থেকে মহকুমায়। সঙ্গে তখন যোগ দিয়েছে মেদিনীপুর শহরের ল' পাশ করা তরুন ভবদেব মন্ডল। ভবদেবদা ওদের চাইতে বয়সে কিছুটা বড়ই। এই ত্রয়ীর নাম তখন মেদিনীপুরের সাধারন কৃষকের মুখে মুখে।
    ৬৪তে পার্টি ভাগ। পিতৃপ্রতিম দেবেন দাসের সাথে তাঙ্কিÄক লড়াই। ওরা চলে এলো নতুন পার্টি মার্কসবাদী কমিউনিষ্ট পার্টিতে, দেবেনবাবু রয়ে গেলেন সিপিআইতেই।
  • kallol | 192.77.110.18 | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১২:৩০695683
  • এর পর পরই আন্দোলনের জোয়ারে পশ্চিম বাংলা ভেসে গেলো। শিক্ষকদের আন্দোলন, কালাকানুন বিরোধী আন্দোলন এবং অবশ্যই খাদ্য আন্দোলন। কিছুকাল আগেই ৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের পর জাতীয়তাবাদের আড়ালে কমিউনিষ্ট বিরোধীতার যে কদর্য উন্মেষ ঘটেছিলো তা এক ঝটকায় অতীত হয়ে গেলো। মানুষ স্বতস্ফুর্ত ভাবে বাম দলগুলোর সঙ্গে চলতে শুরু করল। ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি, চাকরীর আকাল, মানুষের মনে ক্ষোভ জমা করছিলো।
    আমার মনে আছে ১৯৬৫ সালে রুই-কাৎলা ৫ টাকা কিলো হল। চালও তাই। বাবা বাড়িতে মাকে বলছিলেন - এবার থেকে একবেলা নিরামিশ আর রুটি। বাঙ্গালী ঐ সময়েই রাতে রুটি খাওয়া চালু করল। দুধের দাম বাড়ায় - সয়াবীন বেটে সেই দুধ খাওয়া শুরু হল আমাদের। কেমন একটা তরকারী তরকারী গন্ধ থাকতো বলে এক ফোঁটা ভ্যানিলা দেওয়া হতো সেই দুধে। ব্যস্‌, কেমন আইসক্রিম-আইসক্রিম গন্ধ হয়ে যেত।
    ঐ সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটের ফলশ্রুতিতে বাম দলগুলোর আন্দোলনের ডাকে তাই লড়াইয়ের বান ডাকলো। পুলিশের লাঠি-গুলি আর বাম কর্মীদের পেটো (পাটের সুতলি দড়ি দিয়ে বাঁধা হাতবোমা)। কলকাতা আর মফ:স্বলের রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। শহিদের নামে শপথ নিয়ে আগুন খেলা - বাংলার যৌবন তখন ভিয়েৎনাম-কিউবা-কঙ্গোর গেরিলা বাহিনী। প্রতিটি কিশোরের রক্তে তখন চে গুয়েভারা (তখন ঐ নামেই ডাকা হত স্বপ্নের নায়ককে) বা নগুয়েন ভ্যান ত্রয়।
    কিন্তু এ তো শহর বা শহরতলির গল্প। গ্রামে তখন অন্য একটা লড়াই ইতিহাসের মোড় ঘোরাচ্ছে।

  • kallol | 192.77.110.18 | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১৫:৪০695684
  • গ্রাম বাংলায় তখন বিভিন্ন বামদলের কৃষক সংগঠনের ডাকে চলছে জমি দখলের লড়াই। জমিদারী বিলোপ আইন বা জমির ঊর্দ্ধসীমা আইন ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চাইতে পশ্চিম বাংলায় কিছুটা ঠিকঠাক ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিলো। হয়তো অন্যান্য রাজ্যের চাইতে লোকসংখ্যা অনেক বেশী হওয়াতে, অন্যান্য রাজ্যের মত (বিশেষ করে উত্তরভারতের রাজ্যগুলোর মত) বিশাল বিশাল জোতের মালিক তেমন ছিলো না। তবু নামে বেনামে, গায়ের জোরে ছোট বড় জোতের মালিক থেকেই গেলো। স্থানীয় কৃষক সভা জোতদারদের এইসব বেআইনী জমি চিহ্নিত করতো। তারপর, সময় মত সশস্ত্র মিছিল করে সেই জমিতে লাল ঝান্ডা পুঁতে তা দখল করা হতো। দখলী জমি গরিব আর ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিলি করা হত। জমি দখলের এই লড়াইয়ে সশস্ত্র মোকবিলা চলতো জোতদার আর কিষান সভাগুলোর মধ্যে। বাংলার গ্রাম ক্রমশ: ""শ্রেণী সংগ্রামের'' উৎসভূমি হয়ে উঠছিলো। এই জমির লাড়াইয়ের তীব্রতা বাড়ছিলো দিন দিন। শেষ পর্যন্ত ঘটে গেলো নকশালবাড়ি।

  • kallol | 122.167.99.249 | ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ১৬:১৮695686
  • কিন্তু গন্ডোগোলটা পেকে উঠছিলো অনেক আগে থেকে। গ্রামের লড়াইগুলো বড় বেশী একজায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। জোতদারের জমি দখল করছিলো কৃষকেরা। বিলি করা হচ্ছিলো গরিব আর ভূমিহীন কৃষককে। তারপর ? যাকে বিলি করা হল, তার বীজধান কেনার সামর্থ নেই, হাল বলদের জোগাড় নেই। এবার সে চাষটা করে কি দিয়ে ? ফলে বীজধান আর হাল-বলদের চক্করে সেই জমি আবার সেই জোতদারের কাছে বাঁধা পড়লো। পরের বছর আবার সেই জমি দখল হলো। এই যে কাল চক্করটা, এটা বুঝতে বুঝতে ৬৪ থেকে ৬৭-৬৮ লেগে গেলো। নিতাইদারা দিশেহারা। পার্টি এর কোন সমাধান দিতে পারছে না। নেতাদের একটাই কথা - বিপ্লব না হলে এর কোন সমাধান নেই। সাধারন মানুষ নাকি এই চক্করটার ফেরে পরেই বুঝবে যে আসলে ""বিপ্লব''টা করতে হবে। মনে আছে, নিতাইদা বলেছিলো, মেদিনীপুর সদর পার্টি অপিসে এই মহান যুক্তি হজম করে ফিরে এসে যখন নিতাইদ-গুনাথদা-ভবদেবদা সে কথা গ্রামের কমরেডদের বল্লেন, তখন একজন চেঁচিয়ে উঠে বলেছিলো - ইতো ঝ্যাখন সি বুঝে, সি বিপ্লোব করুন না কেনে ?
    - উত্তর মেলে না।
    দাবী উঠলো পার্টি বীজধান আর হাল-বলদের বন্দোবস্তো করুক।
    - উত্তর মেলে না।
    এরকম একটা অসহায়তার পটভূমিতে হঠাৎ নকশালবাড়ি - চারু মজুমদার - খতমের লাইন। জোতদারটাকে খতম কর। নিতাইদাদের মনে হল হয়তো এটাই ঐ কালচক্করের বাইরে বেরুনোর রাস্তা। তাতে ইন্ধন যোগাতে অসীম চাটুজ্যেদের মত নামডাকওয়ালা নেতারা গ্রামে চলে এলেন ""লড়াইয়ের নেতা'' হয়ে। ঐসব বালখিল্য নেতাদের হাতে পড়ে কৃষক আন্দোলনের যা হবার তাই হলো।
    আমরা যারা তখনকার শহুরে বাম, তারা যে গ্রাম কতটা কম চিনতাম-বুঝতাম তার প্রমাণ আমি নিজেকে দিয়ে পেয়েছি কিছুটা পরেই - ঐ ডেবরাতেই। সে কথা যথাসময়ে হবে।
  • kallol | 220.226.209.5 | ২৯ অক্টোবর ২০০৭ ১৩:১১695687
  • এই বিষয়টা নিয়ে আমারও খুব ধন্ধ ছিলো। যে সব কৃষকরা ঐ খতমের লাইনকে মেনে নিলো, তাদের অনেকেই দীর্ঘদিনের লড়াকু আর পোড় খাওয়া মানুষ। শহরের মধ্যবিত্ত ছাত্র-যুবক খতমের লাইনে ভেসে যাবে, এ আর বড় কথা কি !
    নিতাইদার কথায় জবাব পেয়ে গেলাম মোক্ষম। তাছাড়া এখন মনে হয়, কমিউনিষ্ট পার্টি গুলোর সংষ্কৃতি নিতাইদাদের শিখিয়েছে উপরতলার (নেতৃত্বের) সিদ্ধান্তকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে। সেটাও একটা কারন হতে পারে। তাই প্রশ্ন ওঠে - শহুরে মধ্যবিত্ত পার্টি কর্মীদের থেকেই বারবার। সে সিপিআই-সিপিএম ভাঙ্গনই হোক বা সিপিএম-নকশাল ভাগ। বা পরবর্তী কালের নকশালদের মধ্যেকার ভাগাভাগি। বা এমনকি পরের দিকে সিপিএম-এর থেকে বেরিয়ে আসা। ১৯৭৪এর ১লা মে বেরিয়ে এলেন পীযূষ দাশগুপ্ত আর সুধাংশু পালিত। এদের কথা আর কেউ মনে রাখে নি, তাই একটু পরিচয় দিয়ে রাখি।
    পীযূষ দাশগুপ্ত - তখন People's Democracyর দায়িত্বে ছিলেন।
    সুধাংশু পালিত - কোলকাতা জেলার সম্পাদক মন্ডলীতে ছিলেন। ১৯৬৯এ শিক্ষা সেলের দায়িত্বে ছিলেন। পার্টির তরফে ABTA দেখতেন। এঁদের ঝামেলা ছিলো প্রমোদ দাশগুপ্তের সাথে। তখন বলা হতো দুই PDGর লড়াই।
    পরে উল্লেখযোগ্য বেরিয়ে আসা - সঈফুদ্দিন। এরা সকলেই মধ্যবিত্ত এবং নেতা।
    সেই হিসাবে অন্তত ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টিগুলোতে তো চিরকালই মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত-উচ্চজাতের পুরুষ ছড়ি ঘুরিয়েছে ঘোরাচ্ছে। এমনকি বৃন্দাকেও প্রচুর ঝামেলা করতে হয়েছে, প্রকাশ কারাতের বউ, JNU ফেরৎ হওয়া সঙ্কেÄও। নিকট অতীতে কলকাতায় নজরুল মঞ্চে সিপিএমএর সর্বভারতীয় কোন সম্মেলনে এটা ঘটে।
  • r | 59.162.191.115 | ২৯ অক্টোবর ২০০৭ ১৩:৩৮695688
  • বৃন্দা কারাত জে এন ইউ ফেরৎ নন।
  • kallol | 220.226.209.5 | ২৯ অক্টোবর ২০০৭ ১৮:১৬695689
  • হয়তো আমার ভুল। বৃন্দার কথা আমার বন্ধু সুজাতর কাছে শুনেছি। ও যখন JNUতে ছিলো ১৯৮০-৮২ নাগাদ, তখন ওর কাছে প্রকাশ আর বৃন্দার কথা শুনেছি। ওরা হোলির দিন জগদীশ টাইটলার ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের সাথে ঝামেলায় নেতৃত্ব দিয়েছিলো। জগদীশ টাইটলার তখন বসন্ত কুঞ্জ-মুনিরকা এলাকার ""টাইট্‌লার দাদা""। এরা প্রত্যেকবার হোলিতে JNU campusএ ঢুকে মেয়েদের ওপর চড়াও হতো। প্রসঙ্গত: এই ঝামেলায় জগদীশ টাইটলার এন্ড কোং খুব পিটানি খেয়েছিলো। এর পর থেকেই JNU campusএ বাইরের লোক ঢুকলে সিকিউরিটিকে বলে ঢুকতে হত কোথয় সে যাবে। এটা এখন শুধু গাড়ি করে বা একসাথে অনেক বাইক নিয়ে ঢুকলে মানতে হয়।
  • kallol | 220.226.209.5 | ৩১ অক্টোবর ২০০৭ ১১:৩২695690
  • এইভাবে কাটছিলো বেশ। বেশ বললাম এই কারনে - একবার যদি এই সত্যিটাকে মেনে নেওয়া যায়, যে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আইনী উপায় এখন সবই বন্ধ, তাহলে ব্যাপারটা খারাপ কি? প্রায় ১২০ জন বন্ধু বা হতে পারে বন্ধুদের সাথে আলিপুরের মত জায়গায় বিশাল বড় বাড়িতে বিশাল জনালার পাশে থাকা খাওয়ার চিন্তা ছাড়া আড্ডা দিতে দিতে গান করতে করতে দিন কাটানো - খারাপ কি? আমার তো ভালই লাগতো। অবশ্য যাঁরা অনেকদিন ধরে ছিলেন তাঁরা অন্য মত পোষন করতেই পারেন। মাঝে মাঝে বাইরের কথা মনে হলে মন খারাপ যে হতো না তা নয়, কিন্তু মোটের উপরে বলা যায় দিব্যি ছিলাম।
    মাঝে মাঝে উদ্ভট সব কান্ড ঘটত।
    একদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর তাস পেটানো হচ্ছে। ব্রে। আমি, পরিমলদা, তরকদা আর নানু। নানুর পরিচয় - নানু সুনীতিবাবুর সঙ্গে ছিলো। সুনীতিবাবু সিপিআইএমএলএর ইংরাজি পত্রিকা লিবারেশন-এর (যে নামটা পরে বিনোদ মিশ্ররা ব্যবহার করে ওদের পার্টির নামে) সম্পাদক ছিলেন। নানু, সুনীতিবাবুকে পত্রিকার কাজে সহায়তা করতো। নানু লম্বায় মেরেকেটে পাঁচ ফুট। বেশ নাদুস নুদুস গড়ন। গায়ের রং শ্যামলা। বেশ হাই পাওয়ারের চশমা এবং গাল ভর্তি ঘন দাড়িতে সাংঘাতিক আঁতেল চেহারা। এহেন নানু সব ছেড়ে শান্তনুদাকে (সৌমেন গুহ) ডায়লেক্টিকাল মেটিরিয়ালিজমের ক্লাসে চুপি চুপি বলেছিলো - আপনি ডায়লেকট বলছেন কেন? কথাটা তো ডায়রেক্ট......... ব্যস, নানু ক্যাচ কট কট।
    এমনটা নয় যে ইংরাজি না জানাটা অপরাধ। কিন্তু এর আগে পর্যন্ত নানু যে হাওয়াটা নিয়ে চলত (ইংরাজি পত্রিকার সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে) সেটা বেশ গন্ডোগোলের। খুব গম্ভীর হয়ে প্রচুর বই পড়ত, যার মধ্যে ইংরাজি বইও সংখ্যায় বেশ। তবে পড়ত খুব তাড়াতাড়ি।
    এই ""তাড়াতাড়ি""-তে একটা কিস্‌সা মনে পড়লো - শুনিয়ে রাখি। হয়তো অনেকে আগেই পড়েছে/শুনেছে। তাতে কি? রসগোল্লা বা ইলিশ মাছ কি মানুষ একবার খেয়েছি বলে আর খায় না?
  • kallol | 220.226.209.5 | ৩১ অক্টোবর ২০০৭ ১১:৫২695691
  • কিস্‌সাটি আমাগো ঢাহা শওরের।
    এক বুজুর্গ ছ্যাকরা গাড়ি ডাকা করাইছেন। ত্যানার স্টেশনে যাইতে লাগে। ত্যানার দুইতালায় ঘর। জামা কাপড় পরনের ফাঁকে ফাঁকে বারান্দায় আইস্যা কুট্টির ওপর হাঁক পাড়তেছেন - এক্কারে ছুটাইয়া যাবি। গাড়ি যদি মিছ হইছে - তয় তরই একদিন কি আমারই একদিন।
    কুট্টি কওয়ার চ্যাষ্টা করছিলো - আফনে জলদি করেন কত্তা। তা হেয়ার কথা হুনে ক্যাডায়।
    কত্তা শ্যাষম্যাস বহু সময় পর সিঁড়ির আগায় দেহা দিলেন অ্যাবং তাড়াহুড়ায় পাও ফিছলাইয়া এক্কারে যারে কয় ফফাত ধরণীতল।
    কুট্টি আইস্যা ত্যানায় তুলে আর কয় - আহা, কত্তার এহানে লাগসে, কত্তার ওহানে লাগসে , তয় কত্তা আইসেন বড় তাড়াতাড়ি!
  • kallol | 220.226.209.5 | ০২ নভেম্বর ২০০৭ ১৬:০৭695692
  • হ্যাঁ, যা বলছিলাম। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে তাস পেটানো চলছে। ব্রে। তারকদা, পরিমলদা, নানু আর আমি। পরিমলদার যতরকম খিটকেল বুদ্ধি। দু দান খেলার পর বলে - ধুর জমছে না। এইবার যে ব্রে হবে, তকে ব্যা করে ডাকতে হবে। তরকদা মজা পেয়ে রাজি হয়ে গেলো। আমি আর নানুও রাজি। পাকে চক্রে নানুই ব্রে। নানু তো কিছুতেই ডাকবে না । পরিমলদাও ছড়বে না। শেষকালে তারকদা বুদ্ধি দিলো, আমাদের থালা-বাসন-বিড়ি-চা রাখার জায়গা-টা একটা কোমর সমান দেওয়ালের পিছনে, তার আড়ালে গিয়ে ডাকতে।
    আমাদের ওয়ার্ডটা উত্তর-দক্ষিণে লম্বাটে। দক্ষিণের দেওয়ালের থেকে ফুট চারেক ছেড়ে ঐ কোমর সমান দেওয়ালটা ছিলো। ওখানে আমাদের কমিউনের এজমালি বস্তু সকল রাখা থাকতো। একরকম আমাদের ভাঁড়ার।
    নানু তো তার আড়ালে গিয়ে ব্যা করে পেল্লায় এক ডাক ছেড়েছে। তখন সারা ওয়ার্ড দিবা নিদ্রায় বিভোর। হঠাৎ ওরকম একটা ভয়ানক রকমের বিটকেলে আওয়াজে সকলেই ধরফড়িয়ে উঠে ভীষন শোরগোল লাগিয়ে দিলো। কি ব্যাপার? কে এমন আওয়াজ করলে ?
    এমন সময় নানু দেওয়ালের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়ালো। ঐ দেওয়ালের ওপারে ওকে দেখেই সকলে হাঁ হাঁ করে উঠলো
    - তুই ওখানে কি কচ্ছিস?
    - আমায় পরিমলদা ব্যা ডাকতে বললো যে।
    সকলে ক্ষেপে গিয়ে এই মারে কি সেই মারে। সমীরদা বয়স্ক মানুষ, সকলের মান্য। তিনি বললেন
    - আহা, এতোদিনে ওর আত্মোপলব্ধি ঘটছে, ওকে আর বকাবকি কোরো না।
    দু একজন পরিমলদাকে কি যেন বলতে গেছিলো, তাদের উনি পাত্তাই দিলেন না।
  • kallol | 220.226.209.5 | ০৭ নভেম্বর ২০০৭ ১৫:৪০695693
  • আমাদের সকালের আড্ডা বসত তারকদা-সমীরদা-পরিমলদার কম্বলে। সেখানে ঐ তিন টগবগে প্রৌঢ় ছাড়া অর্বাচীন এ অধম, দেবাশিস, সুধাংশুদা, দিলীপদা, অবিনাশদা, আর এক সুধাংশুদা (এরা তিনজনেই ""বডি-কাটার"" ইউনিয়ানের)। যথারীতি পরিমলদা মধ্যমণি। মূলত: রাজনৈতিক লাইন নিয়ে কথা হতো। বেশীরভাগটাই সিপিআইএমএলএর রাজনৈতিক লাইনের ভুল ভ্রান্তি নিয়ে। সমীরদা ততদিনে নকশালদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত কবি। ""রণপায়ে হেঁটে যাব"" বই বেরিয়ে গেছে। তাই নানান জন তাদের নানান সাংষ্কৃতিক কর্মকান্ডের ফসল নিয়ে হাজির হতেন সমীরদার কাছে। মতামত চাই। বেশীরভাগই কবিতা, কেউ কেউ গল্প নিয়ে আসতেন। সমীরদা খুব ধৈর্য্য ধরে সেসব শুনতেন এবং মতামত দিতেন। তবে উৎসাহ দিতেন সবাইকে। ভালো হোক খারাপ হোক, প্রত্যেককে লিখে যেতে বলতেন, খুব অন্তর থেকে। একমাত্র নিমাইদা (ঘোষ) আসতেন তার চিত্রকর্ম নিয়ে। সমীরদা হেন মানুষও তখন বেকায়দায় পড়তেন। প্রথম প্রথম - "আমি কি বুঝি" গোছের আত্মরক্ষা মূলক ঢাল নিয়ে বাঁচতে চাইলেও, শেষ পর্যন্ত বাঁচেন নি। তাই, বেশ হয়েছে, বলে পাশ কাটাতেন। বা কখনো কখনো নিমাইদাকেই বুঝিয়ে বলতে বলতেন বিষয়বস্তু। সে এক কান্ডো - নিমাইদা বোঝাচ্ছেন, সমীরদা সোনা মুখ করে শুনছেন।
    এ পর্ব শেষ হলে যখন নিমাইদা সব শিল্পকর্ম গুছিয়ে নিয়ে উঠছেন, ঠিক তখন ওয়ার্ডের ও কোনা থেকে দীপকদা দুলে দুলে সুর করে আবৃত্তি করতেন - নিমাই ঘোষ / নিমাই ঘোষ / আঁকছে গরু / হচ্ছে মোষ। প্রথম প্রথম নিমাইদা ভীষন প্রতিবাদ করতেন। একবার নাকি ব্যাপার ""প্রতিবাদের ভাষা""র গন্ডী পেরিয়ে ""প্রতিরোধের আগুন""-এ পৌঁছে যাচ্ছিলো। সবাই মিলে সামাল দেয়। তারপর থেকে আগুন নিমাইদার চোখেই সীমাবদ্ধ থাকতো।
  • ranjan roy | 122.168.90.18 | ০৭ নভেম্বর ২০০৭ ২১:৩২695694
  • কল্লোল,
    ভাই রাগ কোরো না যেন। বয়সের সঙ্গে স্মৃতি প্রবঞ্চনা করতে পারে। দীপকদার ছড়াটা ব্যাপক। কিন্তু চারু মজুমদার ধরা পড়ার পর একটা গুজব উঠেছিলো-- ওনার কোন বিশ্বস্ত সঙ্গী জুডাস হয়েছে। কোন প্রিয়ব্রত বা কোন দীপক। আজ সত্যিমিথ্যে কিছু বলতে পারবে?
  • kallol | 122.167.109.27 | ০৭ নভেম্বর ২০০৭ ২২:২০695695
  • না রঞ্জন, রাগ করবো কেন? যা জেনেছি-শুনেছি-দেখেছি সেসব নিজের রংএ রাঙ্গিয়ে তোমাদের কাছে হাজির করা। হ্যাঁ, নিজের রংএ। এই ঘটনাগুলো আমার সেদিনের বিশ্বাস, আজকের আমার জীবনবোধের আয়নায় প্রতিফলিত। চারুবাবুর ধরা পরার ঘটনা দীপকদার কাছেই শোনা। যেমন শুনেছি তেমনই বলব। কে দায়ী কে দায়ী নয় বলা খুব সহজ নয়, অন্তত: সব শুনে আমার তাই মনে হয়ছিলো, আজও হয়।
  • kallol | 122.167.109.27 | ০৮ নভেম্বর ২০০৭ ০০:৩৯695697
  • এইবার জেলে এসে প্রথম যার সাথে, যাকে বলে ঠিকঠাক আলাপ হওয়া, তা হলো দীপকদার সাথেই। কম্বল-টম্বল ঠিকঠাক করে গুছিয়ে বসার পর,তারকদা-সমীরদা-পরিমলদার কম্বল ঘুরে আসতেই সঞ্জয়দার সাথে আমাদের কম্বলে আসলেন মাঝারী চেহারার শ্যামলা এক মানুষ, তার ধুসর চোখে বিষন্নতা আর বন্ধুত্বের প্রচন্ড পিপাসা। দীপক বিশ্বাস। চারুবাবুর ছায়া সঙ্গী, চটেরহাট-ইসলামপুরের গেরিলা বাহিনীর কমানডেন্ট............ চারুবাবুর শেল্টার বলে দেওয়া এবং শেষ পর্যন্ত সম্ভবত: ৮২ সালে চারুপন্থী এক গোষ্ঠীর হাতে খুন হয়ে যাওয়া - দীপক বিশ্বাস।
    দীপকদার সাথে গোটা ওয়ার্ডে হাতে গোনা কয়কজন ছাড়া কেউ মিশতো না। চারুবাবুকে ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ছাড়াও আর একটা বড় কারন হলো, একটা সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা। বিশ্বাসঘাতক বোধহয় তবু ভালো, তাকে ছকে ফেলা যায়। কিন্তু ""পাগল""? ছকের বাইরের মানুষের সাথে সম্পর্ক তথাকথিত ছক ভাঙ্গতে যাওয়া বিপ্লবীদের কাছেও খুব স্বস্তিকর ছিলো না।

    আমার কেমন যেন মানুষটাকে প্রথম থেকেই ভালো লেগে গেলো। এক ভালোবাসার ভীখারী অন্য কাঙ্গালটিকে মূহুর্তে চিনে নিয়েছিলো। আলাপের প্রথমেই অমল হেসে মানুষটা বিড়ি বাড়িয়ে দিয়ে বলল - হোক।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন