এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • ফেসবুক থেকে কিছু পুরনো লেখা

    sosen
    অন্যান্য | ১৮ আগস্ট ২০১২ | ১৮০২৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • sosen | 111.63.136.179 | ০৪ জানুয়ারি ২০১৪ ১২:২৭569964
  • একরকম মিশে যাওয়া। রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতে নিজের ঘরের রান্নাটি সেরে, শিশু ও বৃদ্ধদের খাবারদাবার ঠিক করে, মাটির ঘর হলে দাওয়াটি নিকিয়ে একটা বাজারের ব্যাগে মুড়ি, ধোয়া গামছা বেঁধে ভোরের বাসে বা ট্রেনে দলে দলে স্রোতের মত উঠে পড়েন যাঁরা, সল্টলেকে, গড়িয়ায়, ল্যান্সডাউনে ঝকঝকে বা তত- ঝকঝকে-নয় একটি বাড়িতে পৌঁছে বাইরের কাপড়টি ছেড়ে একটি দ্বিতীয় সংসারের হাল ধরেন, আর সেই সংসারের এক-ই বয়েসের মহিলারা নাকে মুখে কিছু গুঁজে, এক-ই ভাবে প্রভূত নির্দেশাবলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে , হয়ত ছয় সাত মাসের বাচ্চার সারা দিনের ব্রেস্টমিল্কের যোগান রেখে দৌড়ে বেরিয়ে যান, গাড়িতে, অটোতে , রিক্সায়, ট্রেনে, আর যেতে যেতে ধাক্কা খান, ঝগড়া করেন এক-ই রকম আর একজনের সাথে, একজন রাত্রে ঘুমের অভাবে বিরক্ত তো অন্যজন কাজের চাপে, পায়ে পা লাগলেই ছিটকে ওঠেন, চেঁচিয়ে ওঠেন, নখ দাঁত বেরিয়ে আসে। ঠিক ঐরকম ঝগড়া দেখতে পাওয়া যায় সাউথ সেকশনে ফেরার লেডিজ কামরায়, যে কামরা গুলি দলে দলে মেয়ে উগরে দিতে থাকে ক্যানিং, লক্ষ্মীনারায়ণপুর, সুভাষগ্রামে, ভাষা আলাদা, প্রকাশ আলাদা কিন্তু ঘুরে ঘুরে সব মিশে যায়, এক রকম, এক-ই রকম। কিন্তু যেখানে এই সংসার নেই? সেখানে কে কতটা নারী, কতটা পুরুষ, হিসেব কতটা সার্কুলার?

    সিস্টারহুড। চিলড্রেন অফ ভায়োলেন্স পড়তে পড়তে এই খোঁজ, এই মিশে যাওয়ার ভাষা জানতে ইচ্ছে করে । যখন নোটের খাতা হাতে, ওষুধ, শুকনো খাবার, স্বাস্থ্যের হদিস নিয়ে শহরের ফুট্পাথ্গুলোতে, স্টেশনে, বস্তিতে হেঁটে যাই, কয়েকজন, নাকে রুমাল চেপে, তেলচিটে বিছানা, উকুন, তিন চার বছরের শিশুর মুখে কদর্য গালাগালি, তখন মাঝে মাঝেই সব কিছুকে একটা পিন্ড মনে হয়। ক্লেদের পিন্ড, শ্লেষ্মা, ন্যাকড়া, ঘাম, দুর্গন্ধ মিলে একটা নামহীন জনপিন্ড। কি করে ওর মধ্য থেকে নারী আর পুরুষকে আলাদা করা যায়, শিশু আর পুর্ণবযস্ককে? হলুদ দাঁত, লোভী চোখে ওরা ঘিরে আসে। টাকা চায়, ওষুধ, স্বাস্থ্য, কাপড় বা আশ্রয় নয়, টাকা। সস্তা নেশার প্রলোভন। আর ওই চিটচিটে বিছানা কি সহস্র মানুষের দৃষ্টি ওদের মিলিত হতে, জন্ম দিতেও বাধা দেয় না। অন্য নেশা না মিললে যৌনতাও এক নেশা বৈকি। আমি জানতে পারি, স্টেশনের সদ্য কিশোরী মেয়েরা বুকে হাত দেওয়ার বিনিময়ে চা-বিস্কুট পায় কোনো চায়ের দোকানির থেকে, কোনো কোনো ডেইলি প্যাসেঞ্জার কিংবা ফল বিক্রেতার থেকে, ছোট ছেলেরাও পিছিয়ে থাকেনা। শরীর বিভিন্নভাবে তাদের এক ও একমাত্র পণ্য, যেমন কখনো তার দুর্দশাকে শো-কেস করে, তেমন কখনো তাকে আরো সরাসরি ব্যবহার করে। নারী ও পুরুষের মধ্যে গালাগালিতেও নেই কোনো ফারাক, উভয়েই সম্ভব ও অসম্ভবভাবে বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়া ও জন্মপরিচয়ের ফর্দ নিয়ে চিত্কার করে। কোনটা কার পক্ষে সম্ভব সে বিচার কেউ করে না।

    এদের মধ্যে থেকেই আমাদের খুঁজে বের করতে হয় আগুন। অস্মিতার মত। চন্দ্রার মত। সিস্টারহুড অনতিক্রম্য বিধান নয়, আগুনের এত কম উত্স দেখে আমার তা-ই মনে হতে থাকে।
  • san | 133.63.144.228 | ০৪ জানুয়ারি ২০১৪ ১৩:২২569965
  • এইটা ছাপার অক্ষরে দেখতে চাই।
  • sosen | 125.241.5.55 | ০৫ জানুয়ারি ২০১৪ ২০:২০569966
  • কি অদ্ভূত এই মনখারাপের বিকেলগুলো। এই বিষণ্ণতাগুলো। এই দূরবীনের অন্য প্রান্তে বসে থাকাটা। সব দৃশ্য কেমন দুরে সরে যায়। জ্বর হলেও আমার অমনি হত। ঘরটা হঠাত কি বড় হয়ে যায়, মনে হয় বিছানাটা ছোট্ট, আরো ছোট্ট আমি,এককোনে শুয়ে আছি, মানুষেরা যারা চলাফেরা করছেন তারা কত কত দুরে---
    ৯০ না ৯১ সনে, বাড়ির সামনের মাঠে পর্দা ফেলে সাদা কালো সিনেমা "শিল্পী" আর রঙিন সিনেমা " রোটি কাপরা আউর মকান" চলেছিল। অনেক রাত অব্দি খোলা আকাশের নিচে থাকলে ঠান্ডা লাগে। লাগবেই। তারপর জ্বরের মধ্যে সাদা কালো ছবির রিল ঘুরে চলে। মাথার ভিতর।
    ঐটা এক ধরনের বিষণ্ণতা। খেয়ালের বিষণ্ণতা।
    একদিন কলেজে কোন কোন গান দিয়ে কাকে কাকে চেনানো যায় এই নিয়ে আড্ডা হচ্ছিল যখন, এক বন্ধু বলে ওঠে" সোনালীর জন্য একটাই গান এপ্রপ্রিয়েট। যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা--"
    আমার ব্যথা যে কিসের? বিষণ্ণতা আমাকে লেপ-কম্বলের মত আরাম দেয়। ওর আড়াল ছেড়ে আমি নড়তে চাই না। খুশি, সে বড় অপরিচিত, তার কাছে বেশিক্ষণ থাকতে আমার ভাল্লাগে না। দূর দূর পিছিয়ে যখন ভাবতে থাকি, একটি প্রাণখোলা হাসির মুহূর্ত একটু ছটফটে আনন্দ, বয়সোচিত কিছুই দেখতে পাইনে। অকালবৃদ্ধতার গ্রাস জাঁকিয়ে বসেছে ভিতরটুকু জুড়ে, কি তার শীতের কাঁপন।
    সেই একটা ছোট্ট দোকান ছিল দমদম পার্কে, যখন আমার দুনিয়ায় জল ছিল, উত্তাপ নয়। মন্টুদার বইয়ের দোকান। স্টেশনারি দোকান। সেখানে স্টিকার পাওয়া যেত, লেবেল, পান্ডব গোয়েন্দার বই, নন্টে ফন্টের কমিক্স। তার পাশে রোল, সিঙ্গারার দোকান। একটু এদিকে হেঁটে এলে একটা বস্তি, যেটা গিয়ে দমদমপার্ক বাজারে শেষ হয়েছে। তার পর দোলাদি আর তুনাদিদের বাড়ি। আমার ধারণা ছিল ওরা কাজিন, যদিও দুটো আলাদা বাড়ি ছিল, আর চেহারায় কোনো মিল ছিল না, তা-ও ওদের সবাই এক-নি:শ্বাসে দোলা-তুনা বলত। তুনাদি মিষ্টি দেখতে, মোটা সোটা, ফর্সা, লাল হয়ে যেত অল্প পরিশ্রমেই, হাঁপিয়ে যেত। আর দোলাদি লম্বা, তীক্ষ্ণ মুখশ্রী , বেশ সুন্দরী, পাড়ার ছেলেদের হার্টথ্রব , যদিও ওরা একটু বাইরে থাকত পাড়ার, কিন্তু সব-ই তো পাড়ায়, খেলা ধুলো, বন্ধু বান্ধব, ব্যাডমিন্টন, খো খো, গাদি, কবাডি। তুনাদির দিদি ছিল অণাদি। তনুশ্রী ও অনুশ্রী। তুনাদির মতই দেখতে তার ছবিগুলো, কিন্তু সেই ছবির সঙ্গে মানুষটার কোনো মিল দেখিনি।

    অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল অণাদির। বিয়ের অল্প পরে জরায়ুতে ক্যান্সার ধরা পড়ে। চিকিত্সায় জরায়ুটি বাদ যায়, আর অণাদি ও বেকার একটা অর্গ্যান-এর মত বাদ পড়ে যায় শ্বশুরবাড়ি থেকে। তাকে ফিরিয়ে নেয়নি তার শিক্ষিত, স্কুল শিক্ষক স্বামী, ব্যাঙ্ক চাকুরে শ্বশুর, অবস্থাপন্ন বাড়ির সঙ্গে অনুষ্ঠান করে গাঁথা এগ্রিমেন্ট। তার আইনত বিচ্ছেদ হয়েছিল কিনা ঠিক জানিনা। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও ফিরে যাওয়ার কোনো সুরাহা যখন হয়না তখন অণাদি অ্যাসিড খাওয়ার চেষ্টা করে, নিজের মুখেও অ্যাসিড ঢেলে দেয়। সে বেঁচে যায় অবশ্য। তাকে যদি বাঁচা বলো। ওই রকম করে বাঁচাকে বাঁচা বলে কিনা, চন্দ্রার সাথে দেখা হওয়ার আগে আমি জানিনি।

    স্কুলের বাস থেকে নামলেই বিকেলের হালকা লেবু রং রোদে ছাদে অণাদিকে দেখতে পেতাম। সে ক্ষতবিক্ষত মুখ ঢাকত না। বাইরেও যেত না অবশ্য। তবে , দোলাদি ফিসফিসে গলায় জানিয়েছিল, একাধিকবার পাড়ার ছেলেদের সাথে, প্লাম্বার থেকে শুরু করে ইলেক্ত্রিশিয়ানদের সাথে ঐসব বাজে কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে অণাদি। তার পর থেকে তাকে আর দোতলার নিচে নামতে দেওয়া হয়না।
    আমি অণাদির মুখ ছাড়া আর কোনো দেহাংশ দেখিনি। সেসব কি জ্বলেছিল? জ্বললেও গলে যখন যায়নি, খিদে পাওয়া তো অস্বাভাবিক নয়! অণাদির কথাই সহসা মনে পড়েছিলো, যখন চন্দ্রা, পার্ক সার্কাস বস্তির চন্দ্রার সাথে দেখা হয় প্রতিষ্ঠানের ছোট্ট ঘরে।
    তখন চামড়ার কারখানায় কাজ করত চন্দ্রা। কারখানা ঝাঁটানোর কাজ। সমস্ত লেদার স্ক্রেপিং তুলে রাখার কাজ। ছোট চামড়ারও অনেক দাম। আসলে চামড়ার-ই দাম। তাই ছোট্ট বয়সে চটক-অলা চন্দ্রাকে নাকি পণ ছাড়াই বিয়ে করেছিল এক " হারামখোর" । তারপর কিছুদিন গেলে চামড়া ছিঁড়ে গেলে, বহু ব্যবহারেও যখন চন্দ্রার সন্তান হয়না, তখন মারধর শুরু হয়, তারপর অন্য এক মেয়েকে ঘরে নিয়ে আসে তার স্বামী। চন্দ্রা অবশ্য তাতে আপত্তি করেনি। আপত্তি করতে সে শেখেওনি। তার স্বামীর যৌনাকাঙ্খা খুবই বেশি ছিল, তার থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছিল বরং। তাকে গতরে খাটতে হত, পাঁচবাড়ি কাজ করতে হত, তাতেও তার তেমন আপত্তি ছিল না। কিন্তু একদিন পাম্পস্টোভ আচমকা ফেটে গিয়ে পুড়ে গেল চন্দ্রা।
    হাসপাতালে ফেলে দিয়ে এসেছিল তার স্বামী। মেঝেতে শুয়ে, আর পাঁচ জন পরিত্যক্তার মত পোড়া ক্ষতর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে যায় চন্দ্রা। ইনফেকশন-ও হয়নি তার, শুধু বুক থেকে মুখ পুড়েছিল। কিন্তু স্বামীর ঘরে আর ঢুকতে পায়না সে। তাকে মেরে তাড়িয়ে দিতে চায় স্বামী। বস্তির লোকজন সালিশি করায় তাকে দেড়শ টাকা দেয় শেষ পর্যন্ত। তাই নিয়ে চন্দ্রা নীলরতন হাসপাতালের সামনে গিয়ে বসে। আর কেউ নেই তার। বাপের ঘর কুচবিহারে প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে সে আজ বারো বছর যায়নি, কি করে যেতে হয় জানেনা, কেউ আছে কিনা তা-ও জানেনা । যে বাড়িগুলোতে সে কাজ করত, তাঁরা অন্য লোক রেখেছেন, সকলেই তার পোড়া মুখ দেখে কেঁপে ওঠে, গৃহস্থালীর কাজ আর পায়না সে।
    তারপর, চন্দ্রার লড়াই। কোনো অমন-ই মেঝেতে পড়ে থাকা রোগিনীর সাথে আলাপ হয়েছিল তার, যে তার আত্মীয়কে বলে এই চামড়ার কারখানার কাজটি জুটিয়ে দেয় তাকে। প্রথমে প্রায় কিছুই পেত না সে। পার্ক সার্কাস স্টেশনে থাকত। সেখান থেকে পাঁচ ছ বছরের স্বাবলম্বনের লড়াই তাকে এইটুকু জমি দিয়েছে।
    ওই স্টেশনে থাকাকালীন-ই এন জি ও র কর্মীরা তাকে সনাক্ত করে। চন্দ্রার গৃহস্থালীর হাত-টি গুছানো। শুকনো সময়ে বড়বাজার থেকে গরম মশলা কিনে সমান মাপে মিশিয়ে হামানদিস্তায় গুড়ো করে রোদ খাইয়ে সে আমাদের দেয়। আমরা মহিলা শিল্পসমিতিতে তা পাঠিয়ে দিই। যখন চন্দ্রার সাথে পরিচয়, তখন এরকম বেশ কয়েকজন মেয়ে বউকে জুটিয়ে সে কাজের পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে ফেলেছে। সঞ্চয়ী, হিসেবী, পরিশ্রমী সে, আমাদের অ্যাসেট।
    পোড়া মুখের উপর হাত বুলিয়ে সে ফিসফিস করে বলে " একটা যদি ছেলে থাকত আমার-এমনি করে আমায় তাড়িয়ে দিতে পারত, বলো দিদি? আমার পেট-ই শত্তুর হলো আমার।"
    আমি তাকে জিগেশ করি, খুব লজ্জা করে আমার, তাও জিগেশ করি-" ছেলে কেন? মেয়ে কেন নয়?"
    পোড়া চোখের পাতার নিচ দিয়ে তার ছাই ছাই ভর্ত্সনাময় চোখ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠোঁটে বাঁকা হাসি, আর কিসের যেন একটা খিদে। আমি চুপ করে যাই, খাতা বন্ধ করে উঠে তার মশলা গুছোতে থাকি। তাকে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে একলা ছেড়ে দিই।

    শেয়ালদা থেকে দুশো সতের বাসে উঠে ঘন্টাখানেকের রাস্তা বাড়ি, হলুদ আলোয় কলকাতার দিকে তাকিয়ে আমাকে বিষাদ ঘিরতে থাকে। কিন্তু আমি তো পুড়িনি, মার -ও খাইনি, সন্তানধারণের দিন-ও চলে যায়নি আমার, তবে কেন এ বিষাদ আমার মনে হয়? একান্ত আমার-ই!আমি-ই চন্দ্রা বা অণাদি হতে পারতাম, হতে হতে হঠাত অন্য কেউ হয়ে গিয়েছি, এ যেন একধরনের গিল্ট। ব্যথা আছে, ওরা কেন টের পায়না, কেন হাসে? ব্যথার ওজন কতটা জানিনা, কিন্তু চাপ বেঁধে ফুসফুসে তাকে ঢুকতে দেখতে পাই।

    মনে হয়, পরীক্ষায় এবার নির্ঘাত ফেল করব।
  • | ০৫ জানুয়ারি ২০১৪ ২০:৫৭569967
  • এইসব অনাম্নী অঙ্গনারা ....... কখনও হয়ত আমিও লিখব এরকম দু চারজনের কথা।
  • sosen | 125.242.250.27 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৪ ০৯:২৫569968
  • এই দ্যাখো। ঘূর্ণিপাকের মত ঘুরতে ঘুরতে যেখানে এসে পড়লুম সেখান থেকে আর বেরনোই যায় না যে। সবার সব কথা মনেও নেই, শুধু মুখ, মুখ অজস্র মুখ, ছোটবেলার এক রং, কিশোরবেলার আর এক, আর যৌবনের আর এক রং, ছিল বুঝি? তখন সবটাই দপদপে আগুনের রং দেখাতো, এই এক বেলা থেকে আরেক বেলায় বয়ে যাওয়া টেরও পাইনি তেমন করে। আজ বেশ খানিক দূরে সরে এসে, উপরের ছাইরঙা চাদরটা উঠিয়ে নিলে অনেক রকম সবুজ দেখতে পাই। ঘূর্ণির দিকে বয়ে যাওয়ার আগে চারপাশের সেই সব সবুজের গল্প বলব না?
    যেমন ধরো সেই সব ভাড়াবাড়ির গল্প। সেই সব এক নম্বর , দু নম্বর , তিন নম্বর পুকুরের গল্প। মন্দিরের গল্প। ছোট্ট শৈশব আমার, সেই পুকুর ঘেরা জনপদে, সেই নির্ভয়, নিশ্চিন্ত সময়, তাকেই তো শৈশব বলে? খুব-ই ক্ষনস্থায়ী সে সময়, কিন্তু মনে পড়ে বৃষ্টির পর মাঠের জমা জলে ব্যাঙাচি দেখে কালির দোয়াতে করে তা তুলে নিয়ে আসা। মনে পড়ে কেজি স্কুল,যেখানে এক বছর পড়েছিলুম, একখানা কাঠের ঘোড়া ছিল; মনে পড়ে প্রথম বন্ধু অমিতের সঙ্গে একদিন পাউডার আর পাতাকুচি মিশিয়ে ক্যান্সারের ওষুধ তৈরী করে আনন্দে বিহবল হওয়া, মনে পড়ে পুতুলের বিয়ে, সিল্কি নামে কুকুরটি, মনাদির বাড়িতে ট্রান্ক ভরা চটি গোয়েন্দা গল্পের বই, করমচা গাছ । মনে পড়ে জীবনে প্রথমবার মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় কি অবাক হয়ে ভেবেছিলাম , মরে যাচ্ছি নাকি? মনে পড়ে সেই মায়ের আধবোনা আসন , যার উপর পুতুলের সাম্রাজ্যের ম্যাপ এঁকেছিলুম, মনে পড়ে সোভিয়েত নারী থেকে ফ্যাশন পাতার মেয়েদের কেটে নিয়ে কার্ড বোর্ডের উপর সেঁটে পুতুল তৈরী করা, কত কত গল্প। সেসব না লিখে রাখলে ভুলে যাবো যে। তাদের জোর নেই, সেই সব রোদেলা দুপুর, বন্যার দিন, বাঙ্গুরের জল জমা, পঞ্চাশ পয়সায় পাঁচটা জিলিপি, হালকা আলাপের মত, জোরালো ঝড় এসে তাদের ঢেকে দেয় সহজেই। কিন্তু তাদের কি ছেড়ে যাওয়া যায়? এই তো আর কদিন, তারপরেই হু হু করে চলে আসে অন্ধকারের দিন, নিষ্পাপ শব্দটা শুনলে যখন হাস্যকর হিন্দী ছবি মনে হয়, ইতি তোমার মা কিংবা পলাশ পড়লে মনে হয় কি ঘ্যানঘেনে সেন্টিমেন্ট, রাত্রে মাথা ধরলে স্বমেহনে তাড়াতাড়ি ঘুম চলে আসে এটাও জানা হয়ে যায়, গোল হয়ে বসে কানে কানে ফোনাফুনি খেললে শেষ অবধি শব্দের বিকৃতিতে অকারণ হেসে লুটিয়ে পড়ার দিন চলে যায় স্টেশন ছেড়ে। দাঁড়িয়ে থাকে এক শুকনো গুঁড়ির গাছ, সবুজ তার সেই মাথায়, কত্তো উপরে, কেই বা সেই সবুজ চামড়ায় হাত বুলোয়। গায়ে ক্ষুদে লিখে যায় অমুক প্লাস অমুক।
    উবে যাওয়া শিশিরকণাদের এক্ষুনি ধরে না রাখলে মুশকিল যে।
  • | 24.97.245.68 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৪ ০৯:৫১569969
  • \

    .
  • sosen | 125.242.250.27 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৪ ০৯:৫৭569970
  • দমুদি, ইসকা ক্যা মতলব? :-)))
  • Tim | 188.91.253.21 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:০৬569971
  • ইয়ে কারুকার্য হ্যায়
  • | 24.97.245.68 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:০৯569972
  • টিমিকে আমি হাতের সামনে পাই কোনোদিন!!! :-X :-X :-X
  • a x | 86.31.217.192 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:১৯569974
  • আমি আবার ভাবলাম শিশিরকণা যাতে উবে না যায় তারজন্য দমু ছাতাচাপা দিচ্ছে।
  • Bhagidaar | 218.107.71.70 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:৪৯569975
  • \ = মারকাটারি হয়েছে
    । = বক্তব্য শেষ
  • sosen | 24.139.199.11 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১৩:০৭569976
  • এটা পড়লেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে। আর লিখতে পারছিনা :)))
  • ম্যামি | 69.93.255.155 | ১৯ জানুয়ারি ২০১৪ ১৩:১৬569977
  • ঐশ্বর্যময় লেখা। বাংলা সাহিত্যে নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে কি? মধ্যিখানে কি খরা গেছে? আমি হয়তো জানি না, অনেকদিন বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে যোগ ছিল না বলে জানি না।
  • sosen | 111.63.222.72 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৪ ১৯:০১569978
  • একদম ছোট্ট বেলার স্মৃতিতে ঝাঁপ দিলে কতটা কল্পনা আর কতটা সত্যি বোঝা কঠিন হয়ে ওঠে। কে জানে এই সব ফোঁটা ফোঁটা কুয়াশা স্মৃতির ঠিক কতটা ছিল বাস্তবে! সে একটা ছোট্ট জায়গার মধ্যেই যাযাবরবৃত্তি। বাগুইআটিতে চাল পট্টির মধ্যে দিয়ে যেতে হত সে লাল সিমেন্টের মেঝেওলা দোতলা বাড়িতে যেখানে ইয়াব্বড় নাকওলা একটা রোগা তুলতুলে বাচ্চাকে নৈহাটির এক হাসপাতাল থেকে, শ্যামনগরে প্রথম কয়মাস পার করে নিয়ে আসা হয়েছিল । বাড়িঅলার মেয়েরা নাকি নতুন খেলনা পেয়ে বেজায় আনন্দিত হয়েছিল। চতুর্দিকে চালের দোকান, মুখ খোলা বড় বড় বস্তায় বিভিন্ন রকম চাল, চালের সুবাস, কাগজের উপর দামের আঁকিবুঁকি মাঝখানে গুঁজে রাখা। বাগুই আটির দিকে যেতে ছিল, এখনো বুঝি আছে বিনোদিনী সিনেমা। সেখানে মায়ের আঁচলধরা হয়ে সিনেমা দেখতে যেতুম, কখনো কখনো বুঝি শেলীতেও। সাদা কালো সিনেমার পর্দা দিব্যি চোখে ভাসে এখনো,উত্তম সুচিত্রা সুপ্রিয়ার বড় বড় মুখ, আর অন্ধকারে মায়েদের পায়ের ফাঁকে থুপ থাপ বিফল ঘোরাঘুরির চেষ্টা।
    তারপর সেখান থেকে আর একটা বাড়ি, সাতগেছের বটতলায়। কেন জানিনা সে বাড়ির তেমন কিছু মনে পড়ে না। সন্ধেরাত্রে বাবার বুকের ওপর শুয়ে কবিতা শোনা ছাড়া। আর এই বাড়িতে থাকতেই বোধহয় কেজি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম, একদিন মোড়ের মাথা থেকে দৌড়ে আসতে গিয়ে ধুপুস উল্টে পড়ে শিশু হাঁটু ও হাত কেটে ছড়ে খুবলে কি সে সাংঘাতিক দশা। বোধহয় তত সাংঘাতিক ছিল না কিন্তু স্মৃতিতে সে সব কুচি রক্তের দানা বড্ড ভয় দেখায়।
    সেখান থেকে দমদম পার্কের ইস্কুলের মাঠের উল্টোবাগে। সেখানে বড় বড় ঘর, সামনে বারান্দা, পাশের ভাড়াটে মিঠু-রিঠু কাকু, তাদের মা। পাশের ছোট্ট বাড়িতে কে যেন এক কাকু থাকতেন, ফুলে ঘেরা তাঁর বাড়িটি আমার শিশু চোখে একটা উত্সবের মত ছিল। মনে হত বিলেতেও এমনি বাড়ি থাকে। সেই বাড়ির উপর-ছাদে থাকত কিম, আমার-চেয়ে একটুখানিক বড় । সে আমায় পড়তে দিয়েছিল একটা বাংলা টারজানের সাদা কালো ছবির বই। তাই দেখে ছোটকাকার কাছে আবদার করলে বাকি বইগুলিও মিলেছিল। সেই বই আমি এখনো খুঁজি। সে কি আশ্চর্য সাদা কালোর জগত, সব কিছুই সাদা-কালো, মায়াময়, কেবল বোগেনভিলিয়ার লালে ঢেকে যাওয়া গেটগুলো রঙিন।
    খুব বক বক করতাম মনে হয়। সে তো আর আমি নই, অন্য কোনো পাকা বুড়ি বাচ্চা, তাই ভাবতে কি অবাক লাগে গো। একবার স্কুলের সে মস্ত মাঠে গানের ফাংশন হচ্ছিল। অন্তরা চৌধুরী গান গাইছিল, তাতেও আমার বকবকানি একটুও বন্ধ হচ্ছিল না। শেষে পাশের বাড়ির কাকু আমায় বললেন, চুপ করে বসে থাকলে প্রাইজ দেবেন। কি প্রাইজ, কি প্রাইজ, খুবসে উত্যক্ত করার পর , বই নেওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করে চুপটি করে বসে রইলাম। তাপ্পর একদিন সে প্রাইজ পাওয়া গেল-নজরুলের "ভোরের পাখি"।
    সেই এককুচি বাচ্চা রিনরিনে গলায় তিনতলা বাড়ির উপর নিচ ঘুরে ঘুরে মহানন্দে আবৃত্তি করে বেড়ায়" ওরে ও ভোরের পাখি/ আমি চলিলাম তোদের কন্ঠে আমার কন্ঠ রাখি--" তারপর একসময় সে ভারী বিষণ্ন হয়ে যায়। সিঁড়ির এককোনায় গোল গোল রুলি পরা হাত গালে দিয়ে বসে ভাবতে থাকে, আহা, ঠিক মরে যাওয়ার আগেই বুঝি নজরুল এই কবিতা লিখে গেলেন। সেই দৃশ্য কল্পনা করে তার চোখে জল আসে, কোকড়া কোকড়া চুলের ক্যালেন্ডারের নজরুল হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কোনো মতে মৃত্যুশয্যা থেকে ঘাড় তুলে এই কবিতা লিখছেন, ভেবে সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। এই অবস্থায় ছোটকাকা তাকে কোলে করে তুলে নিয়ে গিয়ে খুব জেরা করে কান্নার কারণ বের করে নেয়, আর তারপর হো হো করে হাসে।
    খুব অভিমান হয় ছোট্ট মেয়ের। ছোট্ট বুকে ছোট্ট মতন এয়ার বাবল।
  • sosen | 125.241.28.190 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৪ ১৯:৫৮569979
  • একখানা আসন ছিল আধ বোনা। তাতে ছিল বিভিন্ন রঙের চৌকো চৌকো কিউব কিছুটা, তারপর একটা কলকা তোলার চেষ্টা, তারপর কেন কে জানে মা আসনটা আর করেনি। এবার সেই আসন যদি তুমি পাতো, আর তার কোনায় কোনায় পুতুলদের বসাও , মাঝখান দিয়ে সমুদ্দুর ভেবে কাগজের নৌকো চালাও, তাহলেই কেমন করে যেন এলাচের গন্ধ-অলা দ্বীপ ভেসে ওঠে চতুদ্দিকে, ন্যাংটা পুটো রোগা প্লাস্টিকের পুতুল পলকে আয়েষা কিংবা ওসমান হয় , বন্দী আমার প্রাণেশ্বর, বলে পটাং করে মুচ্ছো যায়, কিংবা মনোরমার মত সাদা কাপড় পরে পশুপতির চিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। যে সব কঠিন কঠিন অর্থ না বোঝা গয়নার মত কথা পড়ি সেগুলো কেমন করে ওই আসনের উপর ঘটনা হয়ে ওঠে। সেই পুঁচকে একা একা বিড় বিড় করে আসনের ওপর ঝুঁকে। এই খেলায় কিছুতেই সে আর কাউকে সামিল করতে পারে না।
    জঙ্গল আছে, দুর্ভেদ্য জঙ্গল। সেখানে ক্লেটন আর তার বউ সিঁটিয়ে থাকে, বন্দুক দিয়ে গরিলা তাড়ায়, কালা ঘুরে বেড়ায়। সেই জঙ্গলকে অবিশ্যি সব সময় পাওয়া যায়না। কারণ সেই জঙ্গল হলো আসলে পুঁচকের বাবার ঘন কোকড়া চুল। বাবা দুপুরে ঘুমুলে পরেই সেই জঙ্গলের অধিকার তার সম্পূর্ণ। জন্তু জানোয়ার কম নেই তার, বিনাকার টিউবের সঙ্গে অনেক অমন পাওয়া যায়, তা ছাড়া এমনি প্যাকেট ভরেও সেসব কিনে আনে কাকা, বাবা, মামা, মাসিদের দল। লিলিপুট-ও মেলে ঝুলনের আগে, বা রথের মেলায় নাগেরবাজারে। সেই সব বাবার চুলের মধ্যে দিব্বি বসে যায়, বিড়বিড় গল্প জমে ওঠে।
    এমনকি রাত্তিরে ঘুম না এলে বা ভেঙ্গে গেলেও গল্পেরা সঙ্গ দেয় বৈকি। আঙ্গুল বুলিয়ে বিছানার চাদরে খেলনা বাটির বায়বীয় অস্তিত্ব , প্রফুল্লর ঘর সংসার, রামায়ণ মহাভারত। বঙ্কিমের বইটার হাড় মাস কি আর সাধে আলগা? এই বিড় বিড় করার কারণেই পরে তাকে ইস্কুলে ভারী হ্যাটা খেতে হয়। কিন্তু সে তো পরের কথা।
    এ ছাড়া যখন তখন মামাবাড়ি, সে তো তার সাম্রাজ্য। সেখানে মস্ত উনুন হাঁই হাঁই করে সারা দিন জ্বলে, দশ বারোটা মানুষ রোজ পাত পাড়ে। খাটের তলায় আমের ঝুড়ির উপর কম্বল চাপা দেওয়া থাকে, ভোরে দাদুর সাথে রিকশ' চড়ে বাজার যাওয়া যায়। আম কুশি করে দাঁতে কেটে দেয় মাসীরা, দুই হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নরম করে দেয়। সেই মস্ত হিমসাগর দু-হাতে কোনো মতে ধরে চুষে খেতে হয়, বারান্দায় বসে। সাদা টেপ জামার ফিতে কাঁধ থেকে ঢলে পড়ে, তাতে পাঁচটা হাঁস সেলাই করা। তারপর সেই আমের রস মাখা জামা খুলে দাদু আচ্ছাসে তেল মাখিয়ে দেয়, হাপুস হুপুস করে গামলায় চান রোদ ভরা উঠোনে, তাপ্পর সারা দুপুর এ বারান্দা থেকে ও বারান্দায় গল্পের গড়াগড়ি, নবকল্লোল, খেলা, বর্তমান। গঙ্গার হাওয়ায় ভেসে আসে সকলদীপের সাইকেলের ঘন্টি।
  • kanti | 113.24.190.192 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৪ ২০:২৬569980
  • তুমি কেমন কোরে গান কর হে গুণী, আমী অবাক হোয়ে শুনি।
  • aranya | 154.160.226.53 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ০৭:৪২569981
  • বড় ভাল
  • ঐশিক | 133.252.160.213 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:৩১569982
  • বড্ড ভালো, বেশি ভালো
  • sosen | 24.139.199.11 | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৫:৩৭569983
  • একটু তুলে রাখি, কেউ কিছু মনে করবেন্না
  • sosen | 111.63.224.229 | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৮:৪১569985
  • তো, এইসব তো হারিয়ে যাওয়ার কথা। তাই অক্ষরগুলো-ও হারিয়ে যাওয়া, ট্যারাব্যাঁকা, শব্দগুলো ভুল ভাল। একের পরে আরেক বসে কেমন একধরনের জটলা করে, তার অর্থ কিছুই বোধগম্য হয়না। কিন্তু তাও বাবা যখন আমাকে পেটের উপরে শুইয়ে হাতে সেই বইগুলো তুলে নেয়, কিম্বা কখনো স্মৃতি থেকে কিছুমিছু বলতে থাকে, জাদু-কম্বল আমাকে ঢেকে নেয়। সে রূপকথার দেশ ঠাকুরমার ঝুলির চেয়ে ঢের ভালো। ঠাকুরমার ঝুলির ওই রাজা রানীদের তো আমি চিনিনা, কিন্তু হাড়পাহাড়ের দিকে চেয়ে চেয়ে যে রাজকন্যার স্তন হিম হয়ে গেছে তাকে আমি চিনি, স্তন মানে আমি জানিনা কিন্তু অভিধান খুলে বানান করে পড়ি নারীর বক্ষদেশ, পয়োধর ইত্যাদি। তার চিবুকে হাত দিয়ে সাধলে আর কি হবে, বুকের ভিতর সবটা ঠান্ডা হয়ে জমে গেছে তার , কীর্তিনাশা পাশ দিয়ে জমি খুঁড়ে খুঁড়ে চলে গেলেও আর এই নিদ্রা ভাঙ্গে না। কিসের কষ্ট রাজকন্যার? এইসব বোধ আমার চামড়ায় কাঁটা দেওয়ায়। আমি ভয় পাই, আবোল তাবোলে পালাতে চাই কিন্তু মাথার মধ্যে গজগজ করে "হেমন্তের অরন্যে আমি পোস্টম্যান" আর হলুদ পাতার মধ্যে খাকি পোশাক পরে চিঠির তাড়া হাতে বাবাকে স্বপ্ন দেখে আমি ফুঁপিয়ে উঠি।
    বাড়িরা বদলে যায়, স্কুল-ও বদলে যায়, বদলে যায় বন্ধুরা। যদিও ছোট্টবেলার ছোট্টস্কুলের বন্ধু অমিত আর অরিজিত বহুকাল থেকে যায় সাথে। অরিজিতের বাবা যখন মারা যান তখন খুব-ই ছোট আমরা, স্মৃতিতে সেই বহুকাল রুগ্ন মানুষটির শুয়ে থাকা মূর্তি তবুও থেকে গেছে। মাথা ন্যাড়া বোকা সোকা অরিজিতকে খুব জ্বালাতাম আমি ও অমিত, তবু সে আমাদের ছেড়ে যেত না। হৃদয়পুরের জমি ভরে ওঠে আরো নানাবিধ মানুষে, জানি আজ যদি তাদের খুঁজতে যাই, একটুও ভালো লাগবে না খুঁজে পেলে। আমি খুঁজি না। আমি ডুব দিয়ে থাকি এই ছোট্ট শৈশবপুকুরে, যখন-ই চারপাশে বল্লম উঁচিয়ে ওঠে।
    দমদম পার্কের সেই বাড়ির বাড়িওলার ছিল দুই ছেলে, তারা যমজ কিনা মনে পড়ে না, তাদের নাম ছিল লরেন্স আর ট্যারেন্স। ফর্সা কটাচোখো , সেই দুটো বাচ্চা আমার সমবয়েসী বা আমার চেয়ে বড় ছিল, তাদের ঠাকুরদা ঠাকুমাও থাকতেন তাদের সাথে। কিন্তু আমার সবচেয়ে আগ্রহ ছিল লরেন্স ট্যারেন্স-এর মা কে কেন্দ্র করে। কিছু মানসিক অসুস্থতা ছিল তাঁর, বেশির ভাগ সময়েই তাঁকে ঘরে লোহার গ্রিল টেনে বন্ধ করে রাখা হত। তাও মাঝে মাঝেই দুপুর গড়ালে দেখতে পেতাম সিঁড়ি বেয়ে এক ফর্সা উদ্ভ্রান্ত মহিলা নেমে আসছেন, পরনে বিস্রস্ত নাইটি, ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল। তখন নাইটি পরা তেমন একটা অভ্যাসের মধ্যে ছিল না সাধারণ ঘরে। এসে তিনি আমার মা, মিঠু রিঠু কাকার মায়ের কাছে অভিযোগ করতেন , দিদি, আমার ভালো শাড়িগুলো সব ওরা নিয়ে নিয়েছে, আমাকে সাজতে দেয়না, ইত্যাদি। বোধহয় পয়সা-ও চাইতেন। মা আমাকে হুস হুস করে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিত, আমি পর্দার আড়াল থেকে দেখতাম। ভারী মায়া হত। তারপর মায়েরা উপরে কাউকে ডাকত, বিষাদিত সেই নারীকে কেউ উপরে নিয়ে যেত। আমি মনমরা হয়ে ভাবতাম কেন ওনাকে একটা শাড়ি দেওয়া হয় না?
    অনেক পরে একদিন শুনি লরেন্স ট্যারেন্স-এর মধ্যে কোনো একজন আত্মহত্যা করেছে; এই স্মৃতি যা সম্পূর্ণ হারিয়ে গিয়েছিল কোথাও, হুর্মুড়িয়ে ফিরে আসে। লাল সিমেন্টের সিঁড়িতে মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে এক নাইটি পরিহিতা মহিলা। এখন নিশ্চয় আমি তাঁর চেয়ে বয়সে বড়। কি হয়েছিল তাঁর, কে জানে।
    কি হয়েছিল মিলির, সে-ও তো আমি জানিনা। এই বাড়ির এক বাড়ি পরেই আরেক পুকুর পাড়া, যেখানে মিলির সঙ্গে দীর্ঘ ছুটির দুপুর কাটিয়েছি আমি , বেশ ক'বছর। এক-ই স্কুলে পড়তাম, এক-ই ক্লাসে। মিলি ছিল লাজুক, শান্ত এক মেয়ে, দুই বোনের ছোট, বাবা জ্যাঠাকে নিয়ে বাড়ির পাঁচ ভাইবোনের সবচেয়ে ছোট। কত কুকুর সে বাড়িতে, বিরাট বাড়ি, অন্তত আমার তাই মনে হত। গরমের দুপুরে টেলিফোনে ব্ল্যাঙ্ক কল করতাম আমরা, একলা ঘরে, মিলির জন্মদিনে রুমালি রুটি খাওয়া হয়নি আমার, তার আগে কখনই আমি রুমালি রুটি খাইনি, দেখিও নি, রাত হয়ে যাচ্ছে বলে বাবা এসে সবার সামনে বকতে বকতে নিয়ে যায়, মিলির মা ভারী অপ্রস্তুত হয়ে যান, বার বার আমায় কিছু খাইয়ে দিতে চান, সবাই তাকিয়ে দ্যাখে, আমি চোখের জল মুছতে মুছতে বাবার সাথে চলে যাই। অথচ সে বাড়ি আর কতই বা দূরে?
    কি করে মিলি শেষে পাগল হয়ে গেল, সে আমি এখনো বুঝতে পারিনি। অনেক বছর পর রেলিং-এ মুখ গুঁজে তার চেনা -অচেনা শীর্ণ মুখ দেখি, তখন সে সম্পূর্ণ উন্মাদ, ভায়োলেন্টও।
  • aranya | 154.160.226.53 | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৯:০৬569986
  • বিষাদ চতুর্দিকে -তাও কি ভাল
  • sosen | 111.218.53.28 | ০১ মার্চ ২০১৪ ০৯:৫৩569987
  • সেই একটা সবুজ, স-বু-জ মাঠ। তার এককোনায় গোয়াল, গোয়ালে একটা গরু, আর দুটো অসম বয়সের বাছুর, রানীমাসির গরু বলে তার নাম রানীগরু। ওর জ্বালায় গেট খুলে রাখতে পারে না এ পাড়ার মানুষজন। কালো গেটের উপরে হুর্কো, ও-মা শিং ঢুকিয়ে টক করে হুর্কো খুলে ফেলা রানীগরুর কাছে কিছুই না। দজ্জাল, দস্যি গরু, তেমনি মালিক তার, উভয়ের বকর বকর আর হাম্বারবে দুপুর গুলো পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। আর তার সাথে ওপাশের বাড়ি থেকে মিঠঠুঊঊ মিঠঠুঊঊ করে টিয়ার চিল চিত্কার। দুপুরগুলো হাতছানি দেয়। খাটের ওপর মা ঘুমিয়ে পড়লে সন্তর্পণে খিল নামিয়ে পিছনের বাগান। এটা তমালকাকাদের বাড়ি।
    বাগানে ভর ভর্তি পেয়ারা গাছ। তাতে ভর্তি কাঠ পিপড়ে। কাঠপিপড়ে কামড়ালে আমার সর্বাঙ্গে লাল লাল চাকা বেরিয়ে যায়, নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, তাই আমি কাঠ পিপড়ে ভয় পাই। বাগান জুড়ে শুকনো পাতা, মচর মচর শব্দ তার। হাঁপানির রুগী অনিমেষকাকার শ্বাসের সাই সাই, তাকে বেড় দিয়ে বাড়ির সামনের দিকে গেলে দেখা যায় গরু আর রানিমাসী ছায়ায় শুয়ে ঘুম দিচ্ছেন। কালো কালো দাঁত রানীমাসির।
    সাইকেল চালিয়ে সেই দাদাটা পাশের বাড়ি ঢুকে যায়, অমিতদের বাড়ি। যার একটা চোখ ঢ্যালা হয়ে বেরিয়ে এসেছে। খুব ভয়ংকর দেখতে । মা বলেছিল ছোটবেলায় ইস্কুলে পড়তে নাকি কে ওর চোখে পেন্সিলের খোঁচা দিয়েছিল, তাইতে করে অমনি ---যে কোনো দিন নাকি ফেটে যাবে ওর চোখ , আর তখন কি হবে তা কেউ জানে না। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে ওই বেরিয়ে আসা সাদা গোল্লাটা দেখি, তার ওপর লাল লাল শিরা, এত্ত বড়। খুব বিচ্ছিরি দেখতে, কিন্তু বিচ্ছিরির একটা টান আছে।
    ও বাড়িতে এখনো বাইক আসে নি, বাইক এলে তার সাথে অমিতের বাবা জ্যেঠু বোবাদের ইস্কুল থেকে ফেরেন। তিনটে থেকে অমিতের বাবার কাছে বোবা-কালা ছেলেরা পড়তে আসে। তারা হাউ হাউ করে কিসব বলে, তার এক বর্ণ-ও আমি বুঝি না। জেঠু এক একজনকে সামনে বসিয়ে একটা আঙ্গুল তাদের গলায় চেপে রাখেন, আর জিভ বার করে, এত্ত বড় হাঁ দেখিয়ে টেনে টেনে বলেন "ক্যাট। ডগ। অরেঞ্জ। "
    গোঁফ দাড়ি উঠে যাওয়া, বড় সড় ছেলেটা প্রাণপণে, আধ ঘন্টার চেষ্টায় বলে "তোলেন"। জেঠুর কপাল ঘর্মাক্ত হয়ে যায়।
    বড় বড় সাদা দাঁত দেখিয়ে তারা হাসে। আমার খুব বিরক্ত লাগে। ওরা কিছু পারে না কেন? শুনতে পারে না, সে ঠিক আছে, বই পড়তে না পারার কি ?
    এদিকে অমিতের বাবা ভীষণ রাগী। কিন্তু ওদের পড়াবার সময় একটুও রাগেন না। এদিকে আমাকে বইয়ের আলমারির সামনে ঘুরুং ঘুর করতে দেখলে চোখ পাকিয়ে এমন তাকান, যে রক্ত জল হয়ে যায়। আমি পালায়। বই কেউ এমনি চাবি বন্ধ করে রাখতে পারে? অমিত এখনো ঘুমায়, কাকিমা চা বসান। আমি কাকিমার হাতে পাতে ঘুর ঘুর করি, ওবাড়ি থেকে বিষম রেগে মা চলে আসে-"আবার তুই না ঘুমিয়ে পাড়া বেড়াচ্ছিস? " কাকিমা মা-কে ছোট্ট নীল নকশা-অলা কাপে চা দিয়ে বসিয়ে ফেলেন।
    মা আর কাকিমা আরাম করে বিকেলের রোদে বসে চা খায়। আমাদের টিভি তখন ছোটকাকার নতুন বাড়ি, তাই এই বাড়িতেই টিভি। একটু পরে বিশেষ বিশেষ খবর হবে। কালো ফিতে দাঁতে চেপে কোমর পেরানো চুলে টান টান বিনুনি বাঁধবে মা।
    রানিমাসীর গোয়ালে বিচুলির ধোয়া ওঠে। দমদম পার্কে খুব মশা।
  • aranya | 78.38.243.218 | ০১ মার্চ ২০১৪ ১০:২৮569988
  • বাঃ
  • sosen | 111.63.163.167 | ০২ মার্চ ২০১৪ ০৯:০৯569989
  • মাঠের এককোনায় গোয়াল আর ধার ঘেঁষে একটা অদ্ভুত গল্প গল্প বাড়ি। সেই ম্যাপগুলো আঁকার জন্য কেমন হাত নিশপিশ করে উঠলো। ওই বাড়িতে থাকে সাদা চুলওলা ফিটফাট বুড়ি দিদা আর টুক টুক লাঠি হাতে হেঁটে বেড়ানো, তত -সাদা চুল নয় দাদু। আর মাঝে মাঝে আসে একজন, কিংবা দুজন, কিংবা তিনজন।
    একজন খুব লম্বা, চোখে চশমা, খুব সুন্দর মেয়েমানুষ। সে দ্বিতীয়জনের মা, দ্বিতীয়জন টুকটুকে ফর্সা , রামকৃষ্ণ মিশনে পড়া এক ছোট মত ছেলে। তারা ছুটিতে আসে। কখনো তৃতীয়জন-ও আসে, গম্ভীর গোঁফওলা বাবা।
    দ্বিতীয়জনকে আমি ভাই বলি। কে শিখিয়েছিলো মনে নেই। তাদের বাড়িতে জানলায় হালকা লেসের পর্দা ঝোলে। কেমন গুছিয়ে রাখা থাকে ঘরদোর, পাট পাট করে টানা থাকে লাল হলুদ কালো চৌকো খোপ -ওলা চাদর। ছোট্ট পুরনো বেতের টেবিলে একটা স্টিলের থালায় মুঠো মুঠো গন্ধরাজ, অপরাজিতা, দু একটা জবা সাজানো থাকে। ওদের বাড়ি বেড়ার গেট ঠেলে ঢুকলেই বুড়ি দিদা মিষ্টি হেসে একটা ছোট্ট কাঁসার প্লেটে একটা গুড়ের বাতাসা, মাটির কুঁজোর মিষ্টি গন্ধ-ওলা এক গ্লাস জল দেন। ঐরকম শরত্চন্দ্রের বইয়ে আছে।
    আমাদের বাড়িতে ফুল ঠাকুরের সামনে স্তুপ করে দেওয়া হয়। নৈলে গাছে থাকে। আমাদের বাড়ি চাদরের উপর চাদর পাতেনা কেউ। উঠোন ভরা শুকনো পাতা কেউ ঝাঁট দেয়না। আমরা অন্যরকম, ওরা অন্যরকম। আমাদের বি-শা-ল বাথরুম, শ্যাওলা পড়া, পা টিপে টিপে শ্যাওলা বাঁচিয়ে যেতে হয়। চানঘরের মধ্যে একখানা বাথরুম-ঘর। এত্ত বড় বড় প্লাস্টিকের বালতি, গামলা, ঠান্ডা ভিজে স্যাঁতসেতে, সামনে টিউকল।
    ওদের ছোট্ট ছোট্ট বাথরুম, ঘরের থেকে দূরে, কিন্তু খটখটে শুকনো। ওদের চানের ঘরে কল নেই, ঝকঝকে ছোট ছোট স্টিলের বালতি করে জল নিয়ে যেতে হয়, কিন্তু বাঁধানো টিউকলপাড়ে একটু আড়াল করা, রোদ পড়ে, ঐখানে মিষ্টি গন্ধের রসুন জ্বাল দেওয়া সর্ষে -তেল মেখে ভাই স্নান করে। আমিও ওদের বাড়িতে স্নান করার বায়না তুলে খুব বকা খাই।
    এক রাশি মাটি এনে দেয় বুড়ো দাদু। আমি আর ভাই মাটির বাড়ি বানাই , দোতলা বাড়ি। রোজ একটু একটু করে। ছোট ছোট কাঠের টুকরো, স্টোন চিপস, ইঁটের টুকরো। নখের কোণে মাটি ময়লা ঢুকে ব্যথা করতে থাকে। অমিত মাঝে মাঝে খেলায় যোগ দেওয়ার চেষ্টা করে বীতশ্রদ্ধ হয়। চশমা চোখে ভাইকে সে বেশি পছন্দ করেনা। ভাই দৌড়াদৌড়ি কম করে, ছবি আঁকে, বাড়ি বানায়। আমরা গল্পের বই পড়ি। অমিত হাতে পায়ে বেজায় দুষ্টু। এসব তার পোষায় না। ফাঁক পেলেই সে আমাকে ঠ্যাঙ্গায়, তারপর কাকিমার হাতে বেদম পিট্টি খায়। তখন আমারি গলার কাছটা ব্যথা করে, আমি কাঁদতে থাকি। তাই দেখে কাকিমা স্কেল ফেলে দেয়।
    সন্ধ্যেবেলা ভাইকে ওর মা পড়াতে বসান। তার আগে হাত জোড় করে বেসুরো ও সুরো গলায় ওরা গায় -জয় সদগুরু ইস্বরপ্রাপক হে।
    আমি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের রামকৃষ্ণের মোটা সোটা বইটি নামাই। কথামৃত। বীরেশ্বর বিবেকানন্দ। ছোট্ট ছোট্ট হাতে বইগুলো যেমন যেমন যেমন ভাজা ভাজা হতে থাকে তেমনি আমার মুখস্থ হয়ে যায় সেই বিষম কান্না এনে দেওয়া অচিন্ত্যকুমারীয় নাটুকে জীবনকথা। প্রতি পাতা উল্টোলেই কান্না। কি মুশকিল।
  • sosen | 111.63.145.192 | ০২ মার্চ ২০১৪ ১১:৪০569990
  • মিশন থেকেই কিনা কে জানে , ছবিতে বিবেকানন্দ বই আসে ভাইদের বাড়ি, সবুজ সবুজ মলাট। যদিও বড়দের বিবেকানন্দ পড়ে সব গল্প জেনে ফেলেছি, তাও এই বইটার ছবিগুলো খুব সুন্দর। বিশেষ করে স্বামীজির পোষা ছাগল, আরো সব জন্তুর ছবিটা। ভাই আমাকে জানায় সাধু হতে গেলে প্রথমে জীবে প্রেম করতে হবে, মহারাজ বলেছেন।
    জীবে প্রেম কি করে করা যায়, এই চিন্তায় আমরা ব্যাকুল হয়ে পড়ি। তারপর ঠিক করা যায়, ছাগল পোষা হলো জীবে প্রেমের প্রথম ধাপ।
    ছাগল কোথায় পাওয়া যায়? মাথা ঘামিয়ে মনে হয়, রানীমাসিকে জিগ্গেস করতে হবে। কখনো সখনো গলায় দড়ি বাঁধা ছাগল এদিক ওদিক দেখা যায় বৈকি। রানীমাসি বলতে পারবে।
    দুপুরবেলায় রানীমাসি যখন ঘাসের উপর পাটি পেতে শুয়ে থাকে, তখন গুটি গুটি গিয়ে হাজির হই দুজনে। "ছাগল কোথায় পাওয়া যায়?"
    প্রশ্ন বুঝতেই অনেকক্ষণ লাগে রানীমাসির। সে ভারী অবাক হয়ে যায়, সাগোল নিয়া তরা কি করবি! সাগোল তো আসে,ঘোষগো সাগোল, বেণুগো সাগোল।
    এ ওর মুখের দিকে চেয়ে আমরা বলি, ছবি আঁকব।
    কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় ঘোষেদের বা বেণুদের কারোর ছাগলেরই বাচ্চা নেই, যা কিনা পোষা যায়। আর তারা রানীগরুর থেকে কম ভয়ানক নয়।প্যাঁচানো শিং, দাড়িঅলা। স্থিতধী । এদিকে বার বার বেণুদাদের ছাগলের আশেপাশে উঁকি মারায় বেণুদা একদিন খপ করে আমাদের ধরে ফ্যালে। " এই, তরা রোজ রোজ এখানে কিডা করস! "
    উত্তর না পেয়ে দুজনকেই দাদুর কাছে ধরে নিয়ে যায়। ততক্ষণে দুজনেই কান্না জুড়ব জুড়ব।
    দাদু অবশ্য মোটেই হাসে না আমাদের জীবে প্রেম পরিকল্পনা শুনে। ঠান্ডা ঠান্ডা মিষ্টি মিষ্টি গলায় বলে " সে তো খুব ভালো কথা দাদা, কিন্তু তুমি চলে গেলে, আর সোনাদিদি ইস্কুল চলে গেলে কে ওই ছাগল দেখবে বলো দেখি। আমরা কি পারি? তারচেয়ে তোমরা রানীগরুর বাছুরকে খাওয়াও না কেন? আর সকালে পাখিদের মুড়ি?"
    দুই হবু সাধু বেজায় খুশি হয়ে যায়। রানিমাসির আড়ালে দাঁড়িয়ে রানীগরু কটমট করে দ্যাখে। আমরা বাছুরকে শাকপাতা বিচুলি খাইয়ে গম্ভীর গলায় বলি "জয় রামকৃষ্ণ!"
    দাওয়ায় বসে বুড়োবুড়ি ফিকফিকিয়ে হাসে, আমরা ফিরলেই গম্ভীর হয়ে একজন মোটা চশমার আড়ালে উল বোনে, এক জন খবরের কাগজে মনোনিবেশ করে।
  • | ০২ মার্চ ২০১৪ ১১:৫১569991
  • :-)
  • | ০২ মার্চ ২০১৪ ১১:৫২569992
  • টেনিদা থেকে সুষেণ সকলেরই জীবে প্রেম ছগল দিয়ে। :-)
  • siki | 132.177.196.167 | ০২ মার্চ ২০১৪ ১৭:২৫569993
  • এই লেখা পড়ে মনে হয় জীবন পূর্ণ হয়ে গেছে। এর পর আর মরে গেলেও খেদ নেই।
  • sumit roy | 184.44.188.234 | ০২ মার্চ ২০১৪ ২১:১৩569994
  • সোসেন কি লীলা মজুমদারের সঙ্গে এক পাড়ায় বড়ো হয়েছেন? সাধু, আপনার কলম দীর্ঘজীবী হোক!
  • sosen | 111.218.36.215 | ০৩ মার্চ ২০১৪ ১৮:২৭569997
  • একটা নিয্ঝুম বড়বেলার দুপুরে , যখন হাতে কাজ থাকলেও বিশেষ কিছু করতে ইচ্ছে করে না, দোতলার জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে চোখ ঝলসে যায় পলাশের লাল রঙে, হোমওয়ার্কের খাতা মনে পড়ে যায় , তখন আনমনে হাতে কাগজ টেনে নিই। তারপর কালো পেনের টানে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করি আমার শৈশব।
    সেই বাড়িগুলোর কোনো ছবি নেই। ছবি নেই অমিতদের তিনতলা, গলিঘুঁজিতে হারিয়ে যাওয়ার মত মস্ত, হাটখোলা শরিকি বাড়ির, ছবি নেই আমার পেয়ারা গাছের, ছবি নেই রানিমাসির, সত্যি সত্যি বুড়ির চুলের মত কোমর অব্দি ভ্যানিলা-চুল অলা দিদার, বাপ্পাদাদের টিয়াপাখির। সেই চেয়ারটার, যেখানে রোদে বসে থাকতাম ছাদে।
    ওই সব বাড়ি ভেঙ্গে মিশে গেছে মাটিতে। ওখানে এখন গীতা এপার্টমেন্ট, মৃণালিনী এপার্টমেন্ট। কোথাও অমুক স্টোর, তো কোথাও তমুক সাইবার ক্যাফে। ভাঙ্গা গড়ার মধ্যে দিয়ে শৈশব আমার হারিয়ে গেছে, স্মৃতি খুঁড়ে খুঁড়ে তাকে একটু একটু তুলে আনার চেষ্টা করি কাগজে, এক দুপুর । মাঝে মাঝে স্মৃতির মধ্যে মস্ত খোঁদল। কি ছিল ওই সবুজ দরজার পিছনে, বাড়ি, না বাগান? এখানে গাছ ছিল, না ফাঁকা ? ওখান দিয়েই কি অনিলকাকার সাইকেল আসতো, কাগজ ছুঁড়তে ছুঁড়তে? ওখানে রাস্তা ছিল, না মাঠ?
    আমি হাতড়ে বেড়াই। বিকেল পড়ে আসে।

    এখন তারা এমন :


    আর আমার কাগজ-পেনের শৈশব? সেখানে জায়গাই কম পড়ে যায়। দেওয়ালে ঠেসান দেওয়া বাইক, পুরনো ঝাঁটা, হাতে গড়া মাটির কেল্লা---এসব তো ধরতেই পারিনে। আধের বেশি অধরা থেকে যায় ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন