এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • ফেসবুক থেকে কিছু পুরনো লেখা

    sosen
    অন্যান্য | ১৮ আগস্ট ২০১২ | ১৮০১২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • sosen | 111.218.36.215 | ০৩ মার্চ ২০১৪ ১৯:০৬569998
  • একটু একটু নিজেকে দেখতে পাই । এই যে আমার ডান হাতের দিকে পাঁচিল ঘেরা বাড়ি, ভিতরে অনেকখানি খোলা জায়গা, সুরকি দেওয়া রাস্তা, তিনকোনা পাথর বসানো ধারে? ঐটি আমার বাড়ি। ওর নিচের তলায় একটি ঘরে আমরা থাকি, একটি ঘরে অনিমেষ কাকা, আরেকটি ঘরে পল্লব্কাকা-কাকিমা। বাম পাশে ওই টিনের চালের নিচে আমাদের আরেকটি ঘর ও রান্নাঘর। তা পেরিয়ে এলে এজমালি স্নানের ঘর। উপরতলায় একটি ঘর ও চিলেকোঠা, রান্নার ঘর তমালকাকার, আর এজমালি ছাদ। ওই ছাদে চেয়ার পাতা থাকে, যেখানে গরমের দুপুরে আমি বসে থাকি তো বসেই থাকি, রোদ্দুরে আমার চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে, মাথা তপ্ত ঝাঁ ঝাঁ করে, কিন্তু চোখের পাতা ওই গরম হাওয়ার মধ্যে আঙ্গুলে ডললে, বন্ধ চোখের সামনে বিভিন্ন রঙের পোকারা নড়ে চড়ে বেড়ায়। হওয়ায় সোনালী , লাল, ময়ুরকন্ঠি ধুলিকণা দেখা যায়, গরম বলে একটু একটু হাওয়ার কাঁপুনিও দেখা যায়। সেসব আমার ভারী মজা লাগে।
    গেট খুলে বেরিয়ে উল্টোবাগে গেলেই রাংচিতার বেড়ার আড়ালে ভাইদের বাড়ি, আর পাঁচিল টপকালে অমিতদের। একটু হেঁটে গেলেই পিছনে মাঠ, বৃষ্টি হলে সেখানে ফোকরে ফোকরে জল জমে, তাতে কিলবিল করে ছোট্ট সুন্দরী ছানা মাছেরা ঘুরে বেড়ায়। অমিত বলে ওগুলো বড় হলে শিঙ্গি মাছ হবে। আমি বলি " না, কক্ষনো না।"
    অমিত বলে "তাহলে তুই-ই বল, কি মাছ?"
    সেটা আমি বলতে পারি না, কিন্তু মনে হয় সবুজ ঘাসের মধ্যে চকচকে জলে ঘুরে বেড়ানো মাছেরা অন্যরকম। তাদের রুপোলি গা, নাকে নথ হবে একদিন।
    আমাকে চুপচাপ দেখে অমিত মতলব ভাঁজে, "এককাজ করি চল, মাছগুলোকে পুষি" ।
    আমি খুশি হয়ে উঠি, কিসে করে পুষবো?
    এসব কাজে অমিতের জুড়ি নেই। সে তিনটে সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে তার দাদার নতুন হওয়া নিজের চিলেকোঠা ঘরে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে অধ-ফাঁকা সুলেখা কালির দোয়াত খুঁজে আনলো। তাতে জল, মুড়ি ইত্যাদি সমেত আমরা মাছেদের তুলে আনি। সিঁড়ির নিচে রাখি।
    মাছেরা এত মনোযোগ সত্ত্বেও যতই বড় হয় ততই কদাকার হয়। চোখ গুলো গুলটি গুলটি হয়ে বেরিয়ে আসে। আমরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। শেষটায় একদিন আমাকে ওই দোয়াত হাতে নিয়ে দেখে মা অবাক হয়ে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে , তারপর ওয়াক করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। "হতভাগা ছেলে মেয়েদুটোর অবস্থা দ্যাখো, কোত্থেকে একগাদা ব্যাঙাচি ধরে নিয়ে এসেছে । "
    আমাদের চোখের জল উপছে আসে। গুম গুম পা ফেলে আমি অমিতদের বাড়ি চলে যাই, পিছনে অমিত কাঁচুমাচু। ছাদে পা ছড়িয়ে বসে সে আমায় সান্ত্বনা দেয়, "চিন্তা করিস না। ওদের বুদ্ধি নেই। একদিন তুই আর আমি ক্যান্সারের ওষুধ বানাবো, সেদিন দেখবি ওদের মুখটা কেমন হয়। "
    আমার সন্দেহ হয়, "আমরা কি করে বানাবো ? "
    "কেন? তোদের যে হোমিওপ্যাথি ওষুধ দ্যায় প্রভাস্কাকা? ওগুলো কি করে আবিষ্কার করে? পাউডারের সঙ্গে পাতার রস মিশিয়েই তো! "
    ভেবে দেখি তা ঠিক। অশ্রুধারা মুছে ফেলি। সামনে বড় লক্ষ্য। এসব তুচ্ছ বাধায় আর বিচলিত হব না, এই ভেবে ফের পাঁচিল টপকে বাড়ি যাই। চোখের জল মুছে জামার কুঁচি ভিজে ভিজে, কেঁদে চোখ ঘুম ঘুম।
  • Blank | 180.153.65.102 | ০৩ মার্চ ২০১৪ ১৯:২৩569999
  • মাটির পুকুর বানিয়ে তেচোখা মাছ ছারতুম ছোটবেলায় আর মাটির নীচ থেকে অভ্র আবিষ্কার করেছিলুম কয়েকবার।
    পড়ছি সোসেনদি।
  • jhumjhumi | 127.194.245.94 | ০৩ মার্চ ২০১৪ ২০:৪৬570000
  • পড়ছি। আমার শৈশব যদিও অন্যরকম, তবুও মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক কিছু।
  • Du | 230.225.0.38 | ০৪ মার্চ ২০১৪ ১০:০৭570001
  • ভারি ভালো।
  • sosen | 125.241.44.252 | ১৫ মার্চ ২০১৪ ১৫:০৪570002
  • আমার খুব কানের ভিতর ইনফেকশন হয়। কি করে হয় কে জানে। সবাই বলে স্নান করতে গিয়ে কানে জল ঢোকাই। আমায় কেউ একলা স্নান করতে দিতে চায়না। আর আমিও ফাঁক পেলেই টুক্করে সেই ইয়াবড় বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দি।
    আমাদের শোবার ঘরের দেড়গুন সেই বাথরুম। ল্যাট্রিন তার মধ্যে একখানি আলাদা ঘর, দরজাওয়ালা। বাদবাকি শ্যাওলার ছোপ ধরা, উঁচু ছাদের ঠান্ডা ঘর। ট্যান্ক নেই, তাই বালতি বালতি জল ধরা থাকে। সে কত বড় বড় বালতি। একটা ছোট্ট টুল। তার উপর দাঁড়িয়ে আমি একখানা বালতির ভিতর নেমে পড়ি। আমার গলা অবধি সেই বালতি। সেইটা আমার বাথটাব হয়। আধো আঁধারে লাক্স সাবানের ফেনায় ডুবে আমি হাজার রকম গল্প বানাই, নিজের সাথে বকবক করি । কাঠের দরজায় দুমদুম করে মা ডাকতে থাকে। এর মধ্যে কখন যে কানে জল টল ঢোকে।
    রাতে কানে প্রবল ব্যথা, এত ব্যথা যে চিত্কার করে কাঁদতে থাকি রাত ভোর। বাবা বিনিদ্র রাত আমায় পিঠে ফেলে ঘুরে বেড়ায়। শোয়ানো যায় না। তারপর ফিসফিসে গলায় কথা বলে এক টোটকা আনা হয়। সে ভারী অদ্ভুত টোটকা। আধ চামচ মানুষের বুকের দুধ। বোধহয়, পাশের ভাড়াটে পল্লব কাকাদের ছেলে বাপি তখন মায়ের কোলে। তার মায়ের কাছ থেকেই আনা হয়। আমাকে কাত করে শুইয়ে কানে ঢেলে দেওয়া হয় সেই দুধ, পাঁচ মিনিট পরে ফিরিয়ে শোয়ালে আবার কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। চট চট করে, আর একটা অন্যরকম গন্ধ পাই, তার কিছুক্ষণ পর আশ্চর্যজনক ভাবে ব্যথা কমে আসে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
    পরে অবিশ্যি হোমিওপ্যাথি ওষুধ দেওয়া হয়। সেই মিষ্টি পাউডারের পুরিয়া । কিন্তু আজ অবধি তিন তিন বার ওই টোটকা আমাকে দেওয়া হয়েছে, প্রতিবার ব্যথার উপশম হয়েছে। কি করে উপশম হয়, কে জানে!
    সেজকাকা আমার ছোট্ট ছোট্ট গোল হাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলে আমি নাকি বড় হলে ডাক্তার হব। বলে মিটি মিটি হাসে। হবোই তো, হবোই। প্রভাসকাকার মত ফর্সা, ঝাঁকড়াচুলো সুন্দর মতন ডাক্তার। ইতিমধ্যে অবিশ্যি প্রভাসকাকা আমার কান ফুটো করে দিতে গেলে আমি এমন পরিত্রাহি চেঁচাই আর হাত পা চ্চুঁড়ি যে ফুটো বেঁকে যায়। আজ অব্দি আমার কানে সেই বাঁকা মত ফুটো। তাতে একটা রুপোর সরু রিং ঢুকিয়ে রাখা হয়, নিম্কাঠি ট্রিটমেন্টের পর।
    ওই কান ফুটো করার ব্যাপার হয় চার নম্বর পাম্পহাউসের পাশের চেম্বারে কি? নুপুরকাকুদের বাড়ির পাশে? পাম্প হাউস গুলোতে যে ভূত থাকে এ সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। বৃষ্টি আঁকা শ্রাবণ মাসের আনন্দমেলায় ঐরকম একটা গল্প ছিল। তখনও চারপাশে এত বহুতলের ছড়াছড়ি হয়নি। তিনতলা বাড়ি দেখলেই আমরা তাজ্জব বনে যেতাম, আকাশের তারা নেমে এসে মাথা ছুঁয়ে যাবে মনে হত। উপর থেকে পৃথিবীকে সেদিন যেমন অবাস্তব মনে হত, এত বছর পেরিয়ে এসেও তার ঘোর এতটুকু কাটেনি। উপরে ওঠা মানেই যেন মাটির সব সুখ দু:খ নিচে রেখে দিয়ে উপরে উঠে যাওয়া। পাম্প হাউস গুলো অমনি উঁচু, ছোট্ট ছোট্ট কুটিল কালো চোখের মত জানলা, লম্বা উঁচু লোহার সিঁড়ি। ওর উপর পুতুলের মত লোকজন চলাফেরা করে,সিঁড়ি বেয়ে ওঠে । নিচে নেমে এলে আবার পৃথিবীর লোক হয়ে যায়। উপরে সবাই কেমন ঝুলনের পুতুল। ইস্কুলের মাঠের পাশে উল্টোদিকের বাড়ির বেঙ্কু-মানা র রাশি রাশি রান্নাবাটি, আমার-ও ছিল, বেঙ্কুর মা ওকে সত্যি সত্যি তরকারী দিতেন ছোট্ট ছোট্ট করে কেটে, সেইসব আমরা রান্না করতাম---ওই উপরেও অমনি পুতুলের সংসার দেখা যায় বুঝি। খুব ইচ্ছে হত পাম্পহাউসের মাথায় চড়তে।
    পল্লব্কাকার বউ পল্লব্কাকিমা দাওয়ায় রোদ্দুরে বসে ছোট্ট বাপিকে দুধ খাওয়ায়, এক কাত করে। আমি কাছে বসে জুলজুল করে দেখি। দুধ খাওয়া হয়ে গেলে বাপি যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন আস্তে আস্তে ওর ছোট্ট ফুলের পাপড়ির মত ঠোঁট দুটো আলগা হয়ে যায়, হাত দুটো ঢলে পড়ে। একেবারেই পুতুলের মত। নীল ব্লাউজের নিচ থেকে বেরিয়ে থাকা কাকিমার বুকে, কালো বৃন্তের ডগায় এক ফোঁটা সাদা দুধ ঝকমক করে, তারপর কাকিমা ব্লাউজ নামিয়ে ফেললে, ব্লাউজের চূড়া ঠিক একফোঁটা ভিজে যায়। ঐটাই আমার কানে দেওয়া হয়েছিল। মনে পড়ে।
    কাকিমা আমার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা মিষ্টি হাসে, "কি রে, কি দেখিস?" কাকিমার মুখে কেমন বড় হয়ে যাওয়ার গৌরব জ্বলজ্বল করে। আমি জিগ্যেস করে ফেলি "আচ্ছা কাকিমা, তোমার বুকে এমনি দুধ কি করে হয়?"
    কাকিমা ফিক করে হেসে ফেলে, " এই যে, ভাইটা খাবে বলে। তাই "
    "কিন্তু কি করে হয়? সবার বুকেই দুধ থাকে অমনি?"
    কাকিমা আধো হাসি, আধো চিন্তিত মুখে ভাবে, ঠোঁট টিপে, তারপর বলে, "না, হাসপাতাল থেকে ভাই আনার সময় ডাক্তাররা ভরে দেয়।"
    "কেমন করে ভরলো? ইনজেকশন দিয়ে?" আমার আরো অনেক প্রশ্ন, কিন্তু কাকিমা এবার খিল খিল করে হেসে বলে" ঠিক বলেছিস" বলে আমার গাল টিপে দেয়। আমি ভীষণ লজ্জা পাই, কি যেন আমার জানার কথা ছিল, কিন্তু জানিনা, এইরকম মনে হয়,কান গরম হয়ে যায়। কিন্তু বাড়িতে কোনো বইয়ে এইসব লেখা নেই তো।

    আমি গম্ভীর মুখ করে অমিতকে জানাই, ক্যান্সারের ওষুধ বানাতে গেলে বুকের দুধের পাউডার চাই। আমার কানের ব্যথা তো ওতেই কমল, ওর সাথে আরো অনেক কিছু মেশাতে হবে ঠিক-ই, কিন্তু ব্যথা কমানোর জন্য ঐটে চাই।
    অমিত বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, তারপর হাঁ-মুখ বুজিয়ে বলে "ধ্যাত! "
  • সিকি | ১৫ মার্চ ২০১৪ ১৫:৫৮570003
  • :)
  • sosen | 111.63.192.46 | ২৩ মার্চ ২০১৪ ১০:৫২570004
  • ইস্কুলে আঁখি একটা গান গায়-ভালোবাসিলে যদি সে ভালো না বাসে, কেন সে দেখা দিল
    গানটা আমার খুব ভাল্লাগে। শুনে শুনে তুলে ফেলার চেষ্টা করি।
    আমাদের বাড়ি সারা দিন রেডিও চলে। একটু ভাঙ্গা গলায় নিঁখুত সুরে মা গান গেয়ে চলে তার সাথে, তরকারী কাটতে কাটতে, উনুনে কড়াই বসাতে বসাতে, এমনকি আমার অঙ্কের খাতায় সরল শুধরে দিতে দিতে । মামাবাড়িতে দোদন পান সাজতে সাজতে বলে, তোর মায়ের চিরকালই অমন গানের শখ। গান চালিয়ে অঙ্ক করার জন্য কম বকুনি খেয়েছে?
    মায়ের গলায় সব গানই কেমন ভালো লাগে। রেডিওর চেয়ে ঢের বেশি ভালো।
    পায়েলকে গান শেখাতে আসেন বুড়ো প্রফুল্লমাস্টারমশাই। আমি পাশে বসে থাকি। আমার কথা শুনে মাস্টারমশাই আমাকে জিগেশ করেন তুমি গান শেখ, খুকি?
    আমি ঘাড় নাড়ি। পায়েল তাড়াতাড়ি বলে ও খুব ভালো কবিতা বলে। পায়েলটা খুব ভালো মানুষ, তাও আমার পায়েলের উপর খুব বিরক্তি হয়। গান আর কবিতা কি একরকম? চেষ্টা করলেও কবিতা থেকে অমনি মুচড়ানো বের করতে পারি না। কেমন দলা পাকানো বুকের মাঝখানটায়-"মন রে মোর আঁধারে হোস নে দিশাহারা---"
    খুব মন দিয়ে গান শুনি, তারপর মাঝে মাঝে নিজে গুন গুন করি। কেউ শোনে না। আস্তে আস্তে একটু একটু সাহস বাড়লে মা-র সামনেও গেয়ে ফেলি। মা অবশ্য খেয়ালও করে না।
    তারপর একদিন সাহস করে অমিত আর অরিজিতের সামনে গাই। অমিত বলে, এরম করে কেন গাইছিস, চেপে চেপে? গলা ছেড়ে গা। এইরকম তো নয় গানটা।
    কিরম তালে?
    অমিত গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে "রানার চলেছে তাই ঝুম ঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে --" আমি অবাক হয়ে যাই, এই রকম-ই তো গানটা , সত্যি তো , আমার গলা দিয়ে কেন বেরয় না? বুকের মাঝখানটায় আওয়াজ ঠিকঠাক থাকে, তারপর গলার কোলে এসে কেমন থমকে যায়, আমি গিলে ফেলি গান। কষ্টের ডেলার মত। এই কষ্ট আমার সঙ্গে লেগে থাকবে সারাজীবন।
    অরিজিত বড় বড় ঘোড়া-দাঁত বের করে বলে "তোর সুর নেই তো, তাই"
    আমার ভয়ানক রাগ হয়, দুম দুম পা ফেলে ঘরে গিয়ে খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ি। টেপজামার নিচে রোগা পিঠ উঠতে নামতে থাকে। খেলা ভঙ্গ করার জন্য অমিত অরিজিতকে দুদ্দাড় পিটিয়ে দেয়, মা বলে, ওই দ্যাখো, আবার ঝগড়া করে এসেছে।
    অমিতের দাদা ইংরিজিতে ব্যাক পায়। ব্যাক পাওয়া কি তা আমরা ঠিক জানিনা, কিন্তু বিমর্ষ আবহাওয়া চতুর্দিকে। খালি রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজে দাদার রেকর্ডারে, চিলেকোঠা থেকে । অচিরেই বোঝা যায়, অমিতের সঙ্গীতপ্রতিভা জন্মগত, স্বভাবজ । তার গলায় দেবব্রতর ক্যাসেটের গানগুলি অবিকল শোনা যায়, সবাই খুব প্রশংসা করে। আমার লজ্জা হয়, গলা মেলাতে পারিনা, কিন্তু কি-একরকম করে অমনি মনে মনে গান গাওয়া অভ্যেস হয়ে যায়।
    আমি গীতাঞ্জলির গানগুলি নিজের মনে বেসুরো সুর দিয়ে গাই। পরে যখন গানের সত্যিকারের সুর শুনি তখন ওই দুই সুরেরা আমার মাথায় ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। কোনটা যে সত্যি গান বুঝতেই পারিনা।
    পায়েল যা যা গানের ইস্কুলে শেখে সব আমাকে শেখানোর চেষ্টা করে। আমি দিব্যি হারমোনিয়াম ধরতে পারি। শুধু গাইতে পারিনা। টনটন করে স্বরনালী।
  • JAW | 175.12.252.212 | ২৪ মার্চ ২০১৪ ১৪:২২570005
  • অপূর্ব। বরাবরের মত অপেক্ষায় রইলাম পরের পর্বের জন্য।
  • nina | 78.37.233.36 | ২৫ মার্চ ২০১৪ ০৫:০৩570006
  • ----অপেক্ষায় রইলাম, মুগ্ধতা নিয়ে
  • sosen | 125.241.27.48 | ২৮ মার্চ ২০১৪ ০৯:৫০570008
  • আমি ছোটো। কিন্তু বুয়া আরো ছোটো। বুয়া তিন বাড়ি দূর থেকে টলমল পায়ে খালি খালি চলে আসে। আচ্ছা, ওর নাম বুয়া, না ওর মায়ের নাম? কালো, মাঝারি চেহারার, বেশ তীক্ষ্ণ মুখশ্রীর মহিলা। ঠিক মনে করতে পারিনা, আচ্ছা ধরে নেওয়া যাক ওই ছানা মে'র নামই বুয়া। সে আমার ফ্রক ধরে টেনে টেনে দাঁড়ায়, তাই ফ্রক পরে থাকা তো ম্যান্ডেটরি হয়ে পড়ে। কেমন নরম নরম গোল গোল হাত, দানাঅলা রূপার বালা, তোড়া পায়ে। কালো পুঁতির মত চোখ। উলুর ঝুলুর চুল। ঠিক জ্যান্ত পুতুল একটা, শ্যামলা রঙের। তাকে আমাদের বাড়ি রেখে দিয়ে তার মা নিশ্চিন্তে কোন ইস্কুলে পড়াতে চলে যায়। সে ধুপুস ধুপুস পড়ে আবার ওঠে আবার পড়ে ---আমি শশব্যস্ত হয়ে ছোটো ছোটো হাতে মোটা চাদর নামিয়ে এনে মেঝেতে পেতে দি, কিন্তু সে ওই চাদরের মধ্যে থাকতে চায়না। খিল খিল হাসে , চাদরে জড়িয়ে গিয়ে বেরোতে পারে না, দি-ই, দি -ই, বলে ডাকে। তার পর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে হঠাত। মা তখন তাকে ঘাড়ে ফেলে বাড়ি দিয়ে আসে তার দিদিমার কাছে।
    আরেকটা ছানা মে' মাঝে মাঝে আসে। আমার খুড়তুত বোন। সে ফস্সা টুকটুকে, সোজা সোজা কালো চুল, গোল গোল বড় বড় বাদামী চোখ। তার পেটে একটা সত্যিকারের বাদামী জরুল। চতুদ্দিকে পুতুলেরা কেমন জ্যান্ত।
    আমার পুতুল মেয়ের সঙ্গে মনাদির পুতুল ছেলের বিয়ের সম্বন্ধ করি।
    একখানা জুতোর হলুদ বাক্সে সুতো বেঁধে তারে ফুল দিয়ে সাজিয়ে বরের গাড়ি হয়। তাতে করে বর আসে, সেই গলির ওপার থেকে। সাথে পায়েল, মামন ছোটন , পুটু, ধৃতিদি, মনাদি। আর মনাদির এক বন্ধু, তাকে ঠিক দুগ্গা ঠাকুরের মত দেখতে। মা লুচি , ঘুগনি, চানাচুর, পায়েস খেতে দেয় সবাইকে। কি মজা!
    কিন্তু রোগা মত মেয়ে পুতুলটা নিয়ে চলে গেলে আর অত ভাল্লাগেনা। একটু রাগ-ই হয়।
    মনাদির বাড়ি আসলে মামাবাড়ি। সেখানে অনেক মামা, মামী, মাসি, দাদু আর আছে এক ট্রান্ক পাতলা রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের বই। সেগুলো পাওয়া যায়, কিন্তু মনাদি খুব জেদী, আর খামখেয়ালী, আর রেগে গেলেই বইগুলো দেয়না। শুধু তাই নয়, সব ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বাবা-মরা মেয়ের খুব রাগ, তাই তখন ওকে সবাই শান্ত করতে বসে।
    আমি মাঝে মাঝে বুয়াদের বাড়িতেও খেলি, তাদের বাড়ির তিনতলায় এক মারোয়ারী কাকিমা থাকেন, তিন মেয়ে , এক ছেলেকে নিয়ে। তারা সবাই খুব ফর্সা, সবল হাত পা, মেয়েদের লম্বা সরু বিনুনি। আমাকে নিয়ে গিয়ে কুমারী পূজা করেন কাকিমা, পাঁচ টাকা, মিষ্টি, আর নতুন লাল চুন্নি দিয়ে। আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন,বুয়ার-ও । বুয়া খিল খিল করে হাসে। আমার বেশ গর্ব হয়।
    বিভিন্ন রকম ঘর। বইয়ে,বইয়ের বাইরে। পায়েলদের ঝকঝকে আধুনিক আসবাবে ভরা ঘর, ভীষণ যত্নময় বাবা, মনাদির না থাকা বাবা আর আদরে ভরা ঘর, এই সব মিলিয়ে কয়েকটা স্বপ্ন স্বপ্ন বাড়ি তৈরী হয় মাথার মধ্যে, ইঁটের পর ইঁটের পরত সাজিয়ে। একটা নিজঝুম গরমের দেশ, কিংবা একটা পাহাড়ি শহর, একটা ছোটো বাড়ি, সামনে রাংচিতার বেড়া, একখানা কুয়ো। কাদের নিয়ে যাব সেখানে ভাবি।
    কি ভালো সে সময় , যখন স্বপ্নের উপকরণ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়না-ছোটো ছোটো গল্পের ও বাস্তবের শিশুরা সেই ঘর ভরে রাখে কলকাকলিতে। কেউ আমার চুল উঠে যাওয়া ডলিপুতুল, তো কেউ বুয়া, কেউ আমার চুষি মুখে গোলাপী রঙের সদ্যজাত মাসতুত বোন, যাকে গোলাপী মশারির নিচে রাখতে হয়, যাকে কয়দিন আগে বেনারসী পরিয়ে অন্য কোথায় ছেড়ে দিয়ে এলুম। আমার চোখে ওরা সব আমার ডলস হাউস ভরে থাকে, এখনো, লাল ছোপ ধরা গাল, নরম ঠোঁটে হাসি, বাদামী চুল, কালো চুল, সোনালী আভাধরা লাল চুল, হালকা পুতুল-প্লাস্টিকের গন্ধ, জনসন বেবি পাউডারের গন্ধ। খেলনা মানুষজন, যারা কখনো দুরে যায়না, ফ্রক ধরে ঝুলতেই থাকে, ওদের নিয়ে আমি মিটিঙে বসি, পড়াতে যাই, মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে নিই। নরম মাখনের মত চামড়া। ভালবাসার মধ্যে আঙ্গুল বসে যায়, চোখে একটু বাষ্প আসে। কেউ দেখতে পায়না।
  • | ২৮ মার্চ ২০১৪ ১০:৩১570009
  • আহা ...
  • sosen | 125.241.19.143 | ২৯ মার্চ ২০১৪ ২১:১১570010
  • গঙ্গার কোল ঘেঁষে কালীবাড়ি। শীত পড়লে, জল -টল-টল ঘাটের উপর কুয়াশা নেমে আসে। ঘাটে দাঁড়ালে দেখা যায় চন্দননগরের ভোঁ। ছোট ছোট খেলনার মত নৌকো ভেসে ভেসে যায়। সন্ধের ঝোঁকে একসাথে হলুদ আলো জ্বলে, নদীর ঢেউয়ে গামছা আছড়ায় সান্ধ্য স্নান করুয়েরা। ধুলো-কাদা মেখে ছোট -বড় ছেলেরা তরুণদলের মাঠ থেকে ফেরে। হাতে বল। সাইকেলে ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়েরা খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে পড়তে যায়। এটা শ্যামনগর।
    লাল সোয়েটারে মুড়ে আমি পৌষমেলা যাই। কখনো মাসিদের হাত ধরে। কখনো বাবুমামার সাথে। দাদু টাকা দ্যায়, বড়মামা টাকা দ্যায়। ছোটমামা শোলা খুদে সরস্বতী ঠাকুর বের করতে থাকলে আমি কাছে গিয়ে বসি। থার্মোকল ধরে রাখতে হয়। আস্তে আস্তে থার্মোকল কেটে বেরিয়ে আসে পীরতলা যুবক সংঘ। রাত্তিরে আলো জ্বালিয়ে রাখলে চেঁচামেচি হয়। সাদা-কালো টিভিতে হেমন্তের সাক্ষাত্কার, ঝোলাগুড় দিয়ে পরোটা।
    পৌষমেলা থেকে কত কিছু কিনতে হয়। সারা বছরের যোগান। হাত -পা নড়া প্লাস্টিকের পুতুল, দুটো আড়াই টাকা। এক ধামি রান্নাবাটি। কখনো উনুনটা খুব সত্যিকারের তো কখনো কুকারটা। জনতা স্টোভও পাওয়া যায়। সব এলুমিনির। এক এক গোছা প্লাস্টিকের চুড়ি, ফুল ফুল ক্লিপ, নীল, গোলাপী, হলুদ। সামারকুল কাপড়ের নীল-হলুদ-গোলাপী এ-লাইন জামা উঠেছিল, সেবার পুজোয়, তাত্থেকে সেই রঙের প্লাস্টিকের চাবির গোছা দুলত, তার সাথে ম্যাচ করে প্লাস্টিকের হেয়ার ব্যান্ড। শীতে আমার মাথায় চুল থাকে। এত মোটা মোটা চুল। অনেক গোছ। তাতে দুটো ঝুঁটি হয়। রঙিন চকচকে গার্টার মেলে প্যাকেটে, ঐগুলো চুলের। তখনও রাবার ব্যান্ড বলতে শিখিনি।
    সকালে একবার মানসমামার সাথে পৌষমেলায় যাই তো বিকেলে আবার একবার। সব কিছুই কি সুন্দর, সব কিছু আমার লাগে না, তাই লোভ-ও হয়না--শুধু দেখতে ভাল্লাগে--এত বড় কড়াইযে ছ্যাঁক করে মস্ত অমৃতি, জিলিপি ছাড়ে , কুল কুল করে তেল। পাশ দিয়ে বাবল বাবল হয়।
    গার্লস স্কুলের পাশে দই-ফুচকা পাওয়া যায়, একটা চার -কামড়ে খেতে হয়।

    পৌষমেলা ফুরনোর দিন বাবুমামার দিন, সেদিন ঠিক ঠিক সময় আপিস থেকে ফিরে বাবুমামা আমায় বগলদাবা করে হাঁটা দ্যায় মেলার পানে। ধুপুস করে এক ঝুড়ির সামনে নামিয়ে দেয়।
    ভাষাতীত উল্লাসে আমি লাফিয়ে উঠি --- ব্যাডমিন্টন র্যাকেট !!! অবিশ্যি তখনও আমরা ব্যাট বলতাম আর কক!
    আমার সাইজ মত, কাঠের নয়, ঝকঝকে ইস্টিলের, লাল মুঠো-অলা ব্যাডমিন্টন ব্যাট, সাথে প্লাস্টিকের কক, নিয়ে বাড়ি ফিরি যুদ্ধজয়ের উল্লাসে। নিজেকে কি বিশাল বড়লোক মনে হয়। ৩৫ টাকা দাম আমার ব্যাটের, তবে!
    এতদিন মনাদির একটা , পায়েলের একটা রয়াকেট দিয়ে খেলতাম, পায়েল তো কক পড়ে গেলে দান ছেড়ে দিত, কিন্তু মনাদি বড়, ওর পড়ত-ও না, আর মর্জি মত দান ছাড়ত। এইবার! আমি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে যাই, উল্লসিত , আমাকে তো আর খেলায় না নিয়ে পারবে না!
    দমদম পার্ক এসেই, লাফাতে লাফাতে ছুটি ব্যাট দেখাতে। মোটেই খুশি হয় না মনাদি। কিন্তু অন্য খুদেরা খুব খুশি হয়। খেলা জমে ওঠে।
    কার্যকালে দেখা যায়, যে আমি নিজেকে ভারী ভালোমানুষ আর উদার ভাবতাম, সেই আমিও মনাদির মতই। দান পড়ে গেলে আমার রাগ হয়। অন্য কেউ আমার ব্যাট নিয়ে যখন খেলে, তখন আমি অধৈর্য্যের মত পা ঠুকি। আমার তো, আমার। সেই প্রথম "আমার" বোধ। আমার ব্যাট তবে আমি কেন দাঁড়িয়ে থাকি? অন্যায় দাবিপত্তর করতে থাকি। কে বলে ছোটরা ক্ষমতা বোঝে না! এই যে আমার কথা না শুনলে ব্যাট নিয়ে চলে যাব বলি! পায়েলের ব্যাটটা কাঠের, পুরনো, বড়দের-ও। সেটা নিয়ে খেলতে প্রায় কেউ-ই পারে না। কাজেই, আমার ব্যাট! আমার দান শিগগির।
    একদিন প্রবল প্রবল ঝগড়া হয়--আর মনাদি কেমন হিস্টেরিক হয়ে গিয়ে প্রথমে নিজের ব্যাটটা দিয়ে নিজের মাথায় ঠাঁই করে মারে। কপালটা ফুলে যায়। আমরা কেমন অবাক হয়ে যাই। তারপর মনাদি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি সব বলে আমায়। সব বাজে কথা, ঝগরুটে, হিংসুটে, পাকা মেয়ে। আমার খুব রাগ হয়, অন্ধ, অসহায় রাগ। আমি বাজে কথা বলতে পারিনা, কান্না পায়--আমি লোহার গেটের উপর নিজের ব্যাট জোরে ছুঁড়ে দিই, সেটা সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে যায়। তার পর বাঁকা ব্যাট হাতে নিয়ে জলে অন্ধ চোখে হন হন করে হাঁটতে থাকি। বাড়ির দিকে।
    বাড়িতে খুব কাঁদি , ব্যাট বাঁকানোর জন্য খুব বকুনি খাই। তারপর আস্তে আস্তে রাগ কমে যায়। খুব মন খারাপ করে।
    আমি আর মনাদির বাড়ি যাই না। কিন্তু ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে ইস্কুল বাসে উঠতে যাই। আড়চোখে তাকাতে তাকাতে। করমচা গাছটা ক্যামন মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দায় দাদু চেয়ারে বসে আনন্দবাজার পড়েন।
    নিজের উপর ভারী রাগ হয়। ভাবতে চেষ্টা করি, ছোট্ট মাথা বলে, বুড়ো মানুষের মত মাথা নেড়ে নেড়ে বলে, তুমি খুব দুষ্টু বাপু। এতদিন তো নিজের কিছু ছিল না, যেই কিনা একটা ব্যাট হলো, অমনি এত! ঠিক-ই তো। খুব হিংসুটে তুমি। কেউ ভালবাসবে না তোমায়।
    আমার চোখে এমনি এমনি জল আসে। মন্দিরের দিকে চেয়ে বলি, ঠাকুর, আর করবো না।
  • sosen | 125.241.76.154 | ৩০ মার্চ ২০১৪ ১২:১০570011
  • টিপি টিপি পায়ে মোরাম বেছানো রাস্তার সামনে আসি। আবার ফিরে যাই।
    ভিতরে ওরা কলরব করে খেলে। আমার না থাকা, এমনকি আমার চক্চকে ব্যাটের না থাকায় তেমন কোনো প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয় না। এদিকে আমি কি ভাবছিলাম, আমি না থাকলে, খেলাই হবে না, ওরা আমায় ডাকতে আসবে? যেমন আমি রাগ করে চলে গেলেও পরদিন আবার অমিত ডাকতে আসে? কিন্তু ওর সাথে তো আমি হিংসে করিনা। হিংসে করেছি বলেই না ওরা আমায় একঘরে করে দিল। কই, কেউ তো ডাকতে এলো না।
    গেটের থাম্বাটার আড়ালে দাঁড়িয়ে এইসব আকাশপাতাল ভাবি। না এলেও হয় তো এখানে খেলতে। কিন্তু ওই যে অমন করে চলে গেছি--ওরম করে যেতে আমি চাইনি তো। কি ভাবলো ওরা আমায়, কে জানে।

    এরম দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে স্নিগ্ধ চেহারার মনাদির ছোটোমাসির হাতে ধরা পড়ে যাই। উনি "কি রে, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? " বলে গেট খুলে ধরেন।

    একবার ভাবি, দৌড়ে পালিয়ে যাব, নাকি। তারপর, গুটি গুটি ঢুকে পড়ি। খেলার প্রাঙ্গনে গিয়ে দাঁড়াই।
    লক এন্ড কি খেলা হচ্ছিল, বোধহয়। সবাই থমকে দাঁড়িয়ে যায়। এক মুহূর্তকে মনে হয় বেশ কয়েক মিনিট। সবাইকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। কি-রকম অনাহুত লাগে, ভয়ংকর চোখ জ্বালা করে। পায়ের নিচটা সুড়সুড় করে দৌড়ে পালিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু পা গেঁথে দাঁড়িয়ে থাকি।

    প্রথম কথা বলে মামন, আমার চেয়ে এক বছরের ছোট মামন, সে বেশ জেদী গলায় বলে "এই তো সোনা এসেছে, ও এবার চোর হবে, দেরী করে এলে চোর।"
    অপেক্ষাকৃত বড়রা মনাদির মুখের দিকে একবার তাকায়, তারপর সবাই হঠাত একমত হয়ে যায়। চোর হওয়ার সামান্য জরিমানা দিয়ে আমি খেলায় ঢুকে যাই। মনাদির কি মনে হচ্ছে সেসব কেউ জিগায় না, খেলার মধ্যে আপনা থেকেই সব কেমন গুলে গলে যায়।

    ঝগড়া করেছি ভেবে নিজেকে হদ্দ বোকা মনে হয়, মনাদির দাদুর কাছ থেকে কিশোর রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ আর রবার্ট ব্লেক নিয়ে বেজায় খুশিমনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কুলকুলিয়ে হাসি পায়। ব্যাঁকা ব্যাট, ৩৫ টাকার ব্যাট ঘরের কোণে অনাদৃত পড়ে থাকে। গরম এসে যাবে, তখন কে-ই বা আর ব্যাডমিন্টন খেলবে। করমচা গাছে ভরে উঠবে লাল সবুজ ছোপ অলা করমচা, কি সুন্দর দেখতে- সেগুলো নুন দিয়ে খেতে গিয়ে দাঁত টকে যাবে, আর ধৃতিদি কারেন্ট নিয়ে আসবে, জিভে ছোঁয়ালেই শিহরণ। যা এজমালি, তা ভারী ভালো। যা কিনা কাড়াকাড়ি করে নেওয়া চলে। গলা জোর করে "আমার" বলতে হয়না, এমনি-ই আমার, আমাদের।

    ঠাকুর, তুমি খুবভালো। এবার আনন্দমেলায় যেন ট্যাঁপা-মদনার গল্প দিও।
  • I | ৩০ মার্চ ২০১৪ ১৩:৪০570012
  • ওয়া কত্তা, অমৃতে আর এতে যে কোনো তপাত নেই গো !
  • সিকি | ৩০ মার্চ ২০১৪ ১৪:৫৬570013
  • সত্যি অমৃত। মহান সাহিত্য তৈরি হতে দেখছি।
  • kumu | 133.63.112.65 | ৩০ মার্চ ২০১৪ ২০:১৩570014
  • amett keman keu jaane? kintu eilekhaa barh aashcharJ.
  • ranjan roy | 24.99.186.161 | ৩০ মার্চ ২০১৪ ২০:২৪570015
  • কি আনন্দ! কি আনন্দ! এমন লেখা পড়ে মনটা খুব ভাল হয়ে গেল।
    নিজের ব্যক্তিগত দুঃখকষ্ট সব ভুলিয়ে দিল।
    'ইহা কি অমৃত'?
  • sosen | 125.241.64.224 | ৩০ মার্চ ২০১৪ ২০:৪৫570016
  • এক টুকরো সাদা রঙের চট। তার চারপাশ পুরনো শাড়ির পাড় দিয়ে মুড়তে হয়। বাঁকা বাঁকা সেলাই দিয়ে। সেটাকে বলে হেম স্টিচ।
    সেই প্রথম বুঝতে পারলুম, ডান বাঁ চিনতে পারিনা। ডান দিক থেকে বাঁ দিকে ফোঁড় বললে মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে যায়। এমনিও তো উল্টো লিখি, ইংরিজি J , L । বাংলা এত পড়ি যে চোখের সামনে ভেসে ওঠে, অসুবিধা হয়না। কিন্তু আভাদি খালি বলেন বাঁ দিকে সুতো তোলো, ডান দিকে ঘোরাও। কোনটা ডান, কোনটা বাঁ, কিছুতেই মনে থাকে না , সেলাই করার সময় আরো গুবলেট হয়ে যায়। গোটা বর্ডার উল্টোদিকে হেম করি। সেটা আবার খুলতে হয়।
    সক্কাল সক্কাল, আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই সাইকেল নিয়ে বাবা ভোঁ উধাও। মা ছুটিদ্দিনে আমায় নিয়ে বাজার যায়। আলুর দোকানের সামনে বসলে আলুওলা একটা ছোট ঝুড়ি দেবে। তাতে দেখে দেখে গোল আলু ভরতে হয়। হাতে লাল মাটি লাগে, সেটা মোছার জন্য একটা সাদা গেঞ্জি ছেঁড়া আছে । ফ্রকে মুছলে মা টেনে এক চড় দেবে বলেছে। বাজারের এক কোণে নীলুকাকা থাকে। আমাদের আসতে দেখলেই ঝুপ ঝুপ একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে দুটো গাঁদার ছোট্ট মালা, একমুঠো কুচি ফুল, দোপাটির পাপড়ি, চাট্টে অপরাজিতা, ঘাস আর বেলপাতা ভরে গিঁট্টু মেরে বাড়িয়ে ধরে। মা ওকে চার আনা দেয়।
    বড় বড় মোটা মোটা মালা থাকে, রজনীগন্ধার, কি ভালো গন্ধ। আমি মায়ের হাত ধরে টানি, ঐগুলো দেখাই। মা হাত ঝাড়া দিয়ে বলে চল চল।
    মিষ্টির দোকান থেকে আমার বরাদ্দ দুটো জিলিপি, পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে মিন্টুকাকা বলে, দিন বৌদি, ব্যাগ বাড়িতে দিয়ে আসি। মা মিন্টুকাকাকে ব্যাগ দিয়ে দ্যায়। ব্যাগ টা খুব ভারী তো। মা'র রোগা নাকের ডগাটা ঘেমে যায়।
    মা খুব ঘামে। গরমকালে সারাদিন, সারা গা ভেজা থাকে। শাড়িও ভিজে যায়। ইয়াব্বড় বিনুনি থেকে তেল, ঘাম সব মিলে কেমন গন্ধ আসে। খুব ভালো না গন্ধটা, কিন্তু মায়ের গন্ধ। ঝাঁঝাঁলো।
    দেশ থেকে একটা দাদু, একটা ঠাকুমা আর দুটো পিসি আসে। এদের আমি কক্ষনো দেখিনি। কোথায় ছিল কে জানে। ঠাকুমা মানে তো ওই সুন্দর ছবি, সুচিত্রা সেনের চেয়েও সুন্দর, জয়া পর্দার চেয়েও সুন্দর। দেওয়ালে ঝোলে। "জয়া প্রদা, জয়া পর্দা না রে " অমিত আমাকে শুধরে দেয়। "ওই হলো"
    অমিত সুর করে গেয়েও দেয়, গোরি হ্যায় কাঁলাইয়া; আমি ঝাঁঝিয়ে উঠি , "ধ্যাত, চুপ কর।" কত অচেনা লোক বাড়িতে থাকবে রে বাবা। ভাল্লাগে?
    এরম দাদু হয় নাকি? দাদুরা তো কেমন মিষ্টি মতন, মোটা মতম, দুপুরে সাদা চুল তুলে দিলে পয়সা দেয়, দিদিভাই বলে ডাকে। এই দাদু রান্নাঘরের লাগোয়া বড় ঘরে শুয়ে থাকে তো শুয়ে থাকে। আর খালি খিটখিট করে। দুর্বোধ্য ভাষায়। আমি কাছে গেলেও ক্যামন যেন করে, মা -কে ও খালি বকে । পিসিগুলো-ও ভালো না। একদিন আমি বলেছি, এই দাদুটা বিচ্ছিরি, অমনি বাবাকে নালিশ করে দিল। বাবাও য্যানো কেমন একটা হয়ে গেছে। খুব রেগে গেল, মেরেই দিত আমায়। আমি ভ্যাঁ। বাবা পরে বলল, ওই দাদুটা আমার বাবা তো, আমি যেমন তোমার বাবা। দাদুটার শরীর খারাপ তো। ওরম বলতে হয়না।
    কিন্তু ওই দাদুকে আমার ভাল্লাগে না। ঠাকুমাকেও না। কিন্তু ঠাকুমাটা একদিন বঁটি দিয়ে কি সুন্দর পেন্সিল কেটে দিল। মাটি দিয়ে পুতুল বানাতে শিখিয়ে দিল, রথের পুতুল। তা-ও। দোদনের গায়ে কেমন সুন্দর গন্ধ,পানের , আরো কত মশলার। এর গায়ে গন্ধ নেই।
    স্বপ্নাপিসি ফর্সা, দেখতে ভালো লাগে। স্বপ্নাপিসি দরজা বন্ধ করে আমায় একদিন নাচ শেখালো। এক দুই তিন চার করে। বেশ তো। বেশ গানও গায়। ছোটপিসিটা দেখতে খুব খারাপ, খুব রাগ করে খালি খালি, আমাদের খাট জুড়ে বসে হারমোনিয়াম নিয়ে গান গায়, মোটেই ভাল্লাগে না। খেলার জায়গাগুলো সব বেদখল হয়ে যায়, খেতে বসে বই পড়লে সময় লাগে, অন্যদের খেতে দেরী হয় বলে সবাই রেগে যায়। বাবা ভীষণ জোরে বকে। ওরা বলে সুনদার মাইয়াটা অবাইধ্য,বদমাশ। আমি কেমন হারিয়ে যাই নিজের বাড়িতেই। এতদিন তো বই পড়তে কেউ বাধা দেয়নি! কাজের চাপে ব্যস্ত মা-কে আর দেখতে পাই না, চুল গুলো উসকো হয়ে যায়। এরা এমন রুখুমত কেন?

    তারপর রুক্ষতা ভাসানোর জন্য এক অসময়ী বৃষ্টি আসে। সে কি বৃষ্টি। পাঁচ পুকুর সমুদ্দুর হয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে। বাড়ির ভিতরে জল থৈ থৈ করে। তাস্সাথে মাছ। বৃষ্টি থামেই না আর, কেউ বাজারে যায়না, ঘরের মধ্যে গুটিসুটি হয়ে গল্প করে। দাঁতন গ্রামে কত বড় আমবাগান, পেয়ারা বাগান । মা বিয়ে হয়ে সেখেনে গিয়ে নাকি আমবাগান থেকে আর আসেই না। টুপটাপ আম পেয়ারা পড়ে, সেইসব কুড়োয় আর খায়। সেই গল্প, গরম চা, পেঁয়াজি , খিচুড়ি। পল্লব্কাকা, কাকিমা সবার ছুটি। অমিত ছাদের থেকে চেঁচিয়ে কি বলে, ধারাপাতের শব্দে কিছুই শুনতে পাইনে। পল্লব্কাকা, কাকিমা আপিস যায়না, বাবা কয়েকদিন কারখানা যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। অনিমেষকাকার হাঁপানির টান বেড়ে যায়। সে সম্ভবত ছিয়াশি সাল। বাঙ্গুর, দমদমপার্ক জলমগ্ন।

    এই বর্ষণকালে থান ইঁট দিয়ে উঁচু করা খাটের তলায় ঢুকে আমি এক সেট আশ্চর্য বই পড়ে ফেলি। তার লেখকের নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পল্লব্কাকা সে বই লাইব্রেরির থেকে নিয়েসছিলো। চুরি করে পড়তে হয়, কেউ অত খ্যাল রাখে না যদিও। সে বই-ও ঠিক বন্যার মত। কাঁদায়, হাসায়, ভাসায়। বিমূঢ় হয়ে থাকি। কখনো অপর্ণা হই, কখনো সর্বজয়া, কখনো লীলা। কখনো ঘুমের মধ্যে ইন্দির ঠাকরুনের মুখের কাছে মাছি উড়তে দেখে ফুঁপিয়ে উঠি, অমা, এ তো আমার বড়মা। অমনি ঝুলে পড়া বুক, অমনি নরম দু আঙ্গুলে টানা যায় ঢোলা চামড়া, একটু খাওয়ার জন্য অমনি ঘ্যানঘ্যান--
    মামারবাড়ি যাওয়ার জন্য মন কেমন করে।
  • সে | 203.108.233.65 | ৩০ মার্চ ২০১৪ ২১:২৮570017
  • চুরাশি সাল।
  • sosen | 125.241.64.224 | ৩০ মার্চ ২০১৪ ২১:৪১570019
  • না: চুরাশি নয়, ছিয়াশি-ই । পুজোর আগে। সেপ্টেম্বর অক্টোবর।
  • সে | 203.108.233.65 | ৩০ মার্চ ২০১৪ ২১:৪৮570020
  • তা হবে। চুরাশিরটা দেখেছি ভয়ঙ্কর বন্যা জুলাই টুলাইয়ে। ছিয়াশিতে দেশে ছিলাম না।
  • sosen | 125.241.27.5 | ০৫ এপ্রিল ২০১৪ ১৯:১৬570021
  • দেখতে খারাপ হলে লোকের বিয়ে হয়না। সে শুধু গল্পের বইতেই নয়, এমনিও হয়না। এই জানলাম। জানতে পেরে কেমন বিভ্রান্ত হয়ে যাই।
    ছোটপিসিকে দেখতে আসে প্রায়দিন-ই কারা সব। ষ্টুডিওতে গিয়ে ফোটো তুলিয়ে আনা হয়, সাদা কালো, চেয়ারে বসে, আঁচল লুটিয়ে। মায়ের একটা ল্যাকমে ন্যাচারাল রঙের লিপস্টিক আছে, একটা শক্ত জমে যাওয়া ফেস পাউডার আছে। আর আছে চেসমী আর বসন্ত মালতী স্নো । সেইগুলো কাজে লাগে। একটা চিমটে দিয়ে নাক মুখ কুঁচকে ছোটপিসি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভুরুর চুল, গোঁফ ইত্যাদি টেনে টেনে তোলে। আমি বায়না করায় একদিন আমার-ও ভুরুর একটা চুল টেনে তুলে দিল। বাপরে, কি যন্ত্রণা, আমি ফুঁপিয়ে উঠি, কিন্তু নিজেই তুলতে চেয়েছি তাই সামলে নিই। ওসব করেই বা কি এমন আলাদা লাগে, কিছু বুঝতে পারিনা। মিষ্টি আর সিঙ্গাড়া আসে আর মা আমাকে তাড়িয়ে দেয়। আমি অমিতদের বাড়ি গিয়ে খেলি।
    মনে জল্পনা হয়। সুন্দর কে? সুন্দর কি তিলোত্তমার মত? সুগঠিত সুগোল ললাট, অপ্রশস্ত নহে, অথচ অতিপ্রশস্তও নহে, নিশীথ-কৌমুদীদীপ্ত নদীর ন্যায় প্রশান্তভাব-প্রকাশক; তৎপার্শ্বে অতি নিবিড়-বর্ণ কুঞ্চিতালক কেশসকল ভ্রূযুগে, কপোলে, গণ্ডে, অংসে, উরসে আসিয়া পড়িয়াছে; মস্তকের পশ্চাদ্ভাগের অন্ধকারময় কেশরাশি সুবিন্যস্ত মুক্তাহারে গ্রথিত রহিয়াছে---- চক্ষু দুটি অতি প্রশস্ত, অতি সুঠাম, অতি শান্তজ্যোতি:। কিন্তু বেশ, এইরকম তো সবাইকেই দেখতে। বরম সর্বজয়ার তেল চকচকে কপালে ল্যাপ্টানো সিঁদুরের ফোঁটা ভাবলে মনাদির সেই তিন বন্ধুর কথা মনে হয়---একজন বন্ধু, তার এক দিদি, এক বোন। মনে মনে আমি তাদের বিমলা, তিলোত্তমা আর ইন্দিরা নাম দি। তাদের খুঁটিয়ে দেখলে সুন্দর বোঝা যায় বৈকি। কিন্তু, ছোটপিসি কালো, ঠোঁট দুটো মোটা, মুখে অসন্তোষের রং ছাই ছাই ছোপ, দেখতে ভালো নয়। আমি তাহলে কি? দেখতে ভালো, না দেখতে ভালো নই? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বুঝতে পারিনা।
    অমিত এককথায় সেরে দেয় আরে, তুই তো ছোট।
    সেজমাসি আসে, লম্বা, হিলহিলে, পানপাতার মত মুখ, উজ্জ্বল কালো রং, ঠাকুরের মত টানা টানা দুই চোখ। সবাই বলে গায়ের রং ফর্সা হলে কত সুন্দরী হত সে। বাড়ির মধ্যে খালি সুন্দর, অসুন্দর, রং চুল চামড়া চোখ নিয়ে গল্পে বেজায় বিরক্তি ধরে যায়। আমি খাতায় অনেক মুখের ছবি আঁকি। অনেক অনেক মুখের ছবি। নিঁখুত নাক, পাতলা ঠোঁট। দেখে সবাই বলে, কি ভালো আঁকে, ছোটমামার গুণ পেয়েছে।
    কিন্তু আমি সুন্দরকে ছুঁতে চাই। সেটা বলতে পারিনা, বোঝাতেও পারিনা। কালো আর মোটা মানে অসুন্দর। ফর্সা আর কি জানি কিসব মিলিয়ে সুন্দর হয়। ঠিক কি কে জানে।
    এই যেমন অরুণকাকার বোনেরা , তারা আমার কেমন কেমন পিসি হয়--তারা অসুন্দর। কিন্তু তারা সবাই ফর্সা। যুক্তি কিছুই খাটেনা। বেশ বিভ্রান্ত লাগে এই সুন্দর ব্যাপারটা নিয়ে। এদিকে বন্যার মধ্যে একদিন চা করার সসপ্যানে একটা বেচারা সাপ ঢুকে কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে ছিল। মোটা জলঢোঁড়া সাপ, হলুদের ওপর বড় বড় খয়েরি ছোপ গায়ে। চা করতে গিয়ে মা চিত্কার করে সসপ্যানটা ফেলে দ্যায়, আর ছোটপিসি দরজার খিল দিয়ে ভয়ংকর জোরে এঁকে বেঁকে যাওয়া সাপের ওপর বাড়ি মারে। থেঁতলে যাওয়া পেট নিয়ে হাঁচোড় পাঁচোড় করে সাপটা তাও জলে নেমে যায়। মনাপিসির মুখটা কি হিংস্র দেখায়। আমার গা গুলিয়ে যায়, আর কান্না পায়। সাপটা তো কিছুই করেনি। খালি চামড়া দিয়েই কি সুন্দর হয় তাহলে? নাকি আরো অজানা সব জিনিস, যা বড়রা কেউ কিছু জানেনা, লিখিয়েরা বইতে লেখেনি। খালি লীলা মজুমদার একটু জানেন, শৈলেন ঘোষ একটু। কিন্তু ওনারা তো আনন্দমেলায় লেখেন, সে তো বড় বড় মোটা বই নয়!

    বাড়িতে কেবলি রাগারাগি হয়। আর হিসেব কষাকষি। সবাই টান-অলা একধরনের রুক্ষ বাংলায় সবাইকে তুই করসো? তুই গেসো? এমনি করে কথা বলে। কি রকম বাজে লাগে। এর মধ্যে একদিন রবিবাসরীয় কাগজে বেরোয় "ম্যাডোনার নগ্ননৃত্য" । তাই পড়ে আমি ব্যোমকে যাই। নগ্ন মানে উলঙ্গ তো। তাই হয়ে কি কেউ নাচে? আফ্রিকায় উপজাতিরা ছাড়া?
    বাবাকে জিগ্যেস করায় বাবা বেজায় বিরক্ত হয়। অগত্যা মেন্টাল নোট রাখি। প্রবন্ধ পড়ে ম্যাডোনা কি জিনিস সেটা বুঝতে পারিনি বিশেষ। পরে চোখে পড়লে খুঁজে দেখব। তার কিছুদিন বাদে বাবা আমায় লাইব্রেরির কার্ড করে দেয়। স্বর্গ হাতে পেলাম মনে হয়।
    যদিও লাইব্রেরি সেই চার নম্বরে। কে নিয়ে যায় রোজদিন! ইস্কুল থেকে ফিরেই মায়ের হাত ধরে ঝুলতে থাকি।
  • sosen | 125.241.27.5 | ০৫ এপ্রিল ২০১৪ ১৯:৫০570022
  • পরিধি বাড়ে।
    চারনম্বর আর তিননন্বরের মাঝে নির্ভীকদের বাড়ি।
    কেজি স্কুলের উল্টোদিকে কৃষ্ণা, আর তার যমজভাই নাট-বল্টুর বাড়ি।
    চারনম্বরের ঘাটের পাশে টুসিদের বাড়ি।
    ছেলেদের ইস্কুলের উল্টোবাগে, পুরনো বাড়ির গলিতে মিষ্টুদের বাড়ি। আরো আছে, তিন নম্বরের তানিয়াদির বাড়ি, উর্মিদের বাড়ি, সুদেষ্ণাদির বাড়ি, যার কাছ থেকে আমি পুরনো বই পাই ইস্কুলের। ক্লাসের সব বই নতুন কেনার কোনো রেওয়াজ ছিল না। সুদেষ্ণাদির বই অবশ্য নতুনসম-ই থাকে। তা ছাড়া কিছু বই কিনতে হয়, যেমন কার্সিভ রাইটিং, যেমন আঁকার বই, সেসব কিনতে চয়নিকায় যেতে হয়,নাগেরবাজার। প্রত্যেক বইয়ের সাথে চয়নিকা লেখা মলাট দেয়, আরো কিছু ঐরকম মলাট কেনা হয় পুরনো বইয়ে লাগানোর জন্য। আমার একটা স্কুল ব্যাগ আর সেজমাসির একটা চামড়ার ব্যাগ কিনতে হয়। আমার ব্যাগ তো সেই, ডাকব্যাক, খাদি রং, ক্যানভাস, পিঠে দুদিকে স্ট্র্যাপ লাগানো। পুরনো ব্যাগটা ছিন্নভিন্ন, সেটা খেলার বাক্সে যায়।
    লাইব্রেরিতে আমি সময়মত গেলেও অনেকসময় দিদিরা সময়মত আসেননা। তখন মা আমাকে কেজি ইস্কুলের সামনে স্লিপ আর দোলনা চড়তে দিয়ে কৃষ্ণার মায়ের সাথে গল্প করে। কৃষ্ণা নাকি আমার সাথে কেজি ইস্কুলে পড়ত, এখনো পড়ে। আমি তো নতুন ইস্কুলে চলে গেছি। তার দুই যমজ ভাই নাট আর বল্টু, বাপরে, তারা কি দুষ্টু। কৃষ্ণা দের বাড়িটি আমার অদ্ভূত লাগে। একটা বিরাট বড়, খড় ছাওয়া ঘর। ব্যাস ওই একটা ঘর। ঘরের মধ্যে মধ্যে বাঁশের খুঁটি। মাঝ বরাবর দুটো খাট। এককোনায় জনতা স্টোভ, রান্নার ব্যবস্থা। অন্য কোনায় নিচু নিচু কাঠের তিনটি ডেস্ক। পালিশ নাই। সামনে আসন পাতা। ডেস্কে বই, পরিপাটি গুছোনো, কৃষ্ণার, নাট বল্টুর। একটা মিটসেফ , একটা কাঠের আলনা, দুইটি ট্রান্ক। ও আসল কথাই বলতে ভুলে যাই, মেঝে ও দেওয়াল মাটির, দেওয়ালে মাটির প্রলেপ। বাইরে বাথরুম ।
    আমার চোখে বাড়িটা অবাক দেশের অবাক বাড়ি লাগে। মা বলে ওটাকে আটচালা বলে।
    কৃষ্ণা প্রকৃতই কৃষ্ণা, তার হাসিটি বেজায় মিষ্টি, কিন্তু তেমন চালাক চতুর কি পড়ুয়ে কোনটাই না। আমি তাকে বলি তোর-ও যদি যমজ বোন থাকত, আর তার রং যদি ফর্সা হত, তাহলে তার নাম হত শুক্লা।
    এর মধ্যে থেকে সে কালো, এইটুকুই অনুধাবন করে কৃষ্ণা গোমড়া হয়ে যায়। হয়ত তার গোমড়া হওয়ার কারণ সে নিজেই বোঝেনা, আমি তো আরোই বুঝিনা। বাড়িতে এসে মা বেশি পাকা পাকা কথা বলার জন্য এক ধমক দেয়।
    আজকাল যত বই পড়ি, তত ধমক খাই। কিন্তু যা পড়ি তা ভাগ করার মত কাউকে খুঁজে পাইনা। তাই এদিক ওদিক সদ্যলব্ধ জ্ঞান বিতরণ করি আর সবাই বলে কি পাকা মেয়েটা , দেখেছ!
  • sosen | 125.241.55.128 | ০৫ এপ্রিল ২০১৪ ২২:৫৫570023
  • উপনিষদ, গীতা এসব সংস্কৃত, তারপর বাংলা অক্ষরে সংস্কৃত( যা পড়তে ভীষণ ভাল্লাগে) তারপর বাংলা করে দেওয়া আছে। মোটা ডাবল কাগজের মলাট, বইয়ের শিরদাঁড়ায় সাদা কাগজের ওপর নাম লেখা। বাবার গোটা গোটা হাতে। সেইগুলো মুখস্ত করে অঞ্জলিঠাকুমার সামনে বলতে হয়। ঠাকুমাদের গোটা বাড়ি আমার সামনে হাতজোড় করে ঐসব শোলোক শুনতে বসে পড়ে, আমি বুঝি বা শাপভ্রষ্ট দেবদেবতা। চারতলা উঁচু কোয়ার্টার, আটটা ফ্ল্যাট, এরা সবাই ঠাকুর দেবতার বেজায় ভক্ত। এ আমাকে ডেকে নিয়ে যায় পায়েস খেতে, তো ও লুচি তরকারি। মনুকাকা বলে এই মাইয়াটার পড়াশুনা আর হইবনা তগো লাইগ্যা। শিওরে উঠাইয়া রাখছ। আমিও সুযোগ বুঝে ঠাকুমাকে জানিয়ে দি, গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, আলুসেদ্ধ আর ঘি ভাত হলো সাত্ত্বিক আহার, সাথে একটা ডিমের মামলেট চলতে পারে। এইটা অবিশ্যি ধরা পড়ে যায়, মাছ না খাওয়ার বাহানা। সবাই হেসে লুটোপুটি খায়।
    নিচের তলায় কুলটি আর তার মা থাকেন। কুলটির বাবা বর্ধমানে চাকরি করেন, প্রায় আসেন-ই না বাড়ি। কুলটির মায়ের একঘর জোড়া ঠাকুর দেবতার মূর্তি। তার সামনে তিনি হাত জোড় করে বসে থাকেন, চোখ দিয়ে অঝোর জল গড়ায়। কেন কে জানে। কুলটির এক ঘর খেলনা, সেই লোভে আমি ওদের ঘরে ঢুকি, কিন্তু ঢুকলেই শ্লোক ইত্যাদি না বলে আমার ছাড় নেই। কুলটির মা আমায় পয়লা বৈশাখের জন্য একটা জামা দেন, সাদা গোলাপী ফুলফুল জামা, ঠাকুরের পায়ে ছুঁইয়ে বিড়বিড় করেন। আমি ভয় পাই। উনি এত দুখী কেন?
    কুলটি তার বিষাদাচ্ছন্ন মুখটি তুলে বলে, আমার বাবা আসে না যে, তাই।
    কুলটি আমারই বয়েসী কি একবছরের বড়। বাবা আছেন, মরে যাননি, কিন্তু আসেননা এ আমি বুঝতে পারিনা। কুলটি আমাকে তার বড় বড় পুতুল, সাইকেল ইত্যাদি অবহেলা ভরে খেলতে দিয়ে দেয়। কি এক দু:খ ওদের ঠাকুরঘরের ধূপের ধোঁয়ায় কুন্ডলী পাকিয়ে উপরদিকে উঠতে থাকে।
    আমি গরমের ছুটিতে কদিন ট্যাংরা বেড়াতে এসেছি তো। মাইমাঠাকুমার বাড়ি।
    ঠাকুমা আমাকে কার একটা বাড়িতে নিয়ে যায়, সেখানে এক ধর্মগুরু এসেছেন, তিনি নাকি মিঠুন চক্রবর্তীর গুরুদেব, তিনি নাকি হিমালয় পরিব্রাজন সেরে এই সমতলে পা দিয়েছেন। তাঁর তেল চুকচুকে চেহারাটি দেখে অবশ্য হিমালয় জনিত কৃচ্ছের বিশেষ আন্দাজ পাইনা। ঘর ভর্তি লোকজন, অগুরু চন্দনের গন্ধ, কি বিচ্ছিরি লাগে, কিন্তু মন্দিরেই এই গন্ধ খুব সুন্দর লাগে তো। কেন?

    মন্দিরে পুতুল-ঠাকুর দেখতে ভাল্লাগে, ছবিতে ঠাকুর দেখতে ভাল্লাগে , খেলনার মত, কিন্তু মানুষ-ঠাকুর আমার ভাল্লাগে না। আমার বমি পায়।
    ঠাকুমা আমাকে সামনে টেনে এনে বলে এই যে সিঙ্কুলি, তোর যা মনে চায় বাবাকে জিগ্গেস কর।
    আমিও থতমত খেয়ে জিগ্গেস করে ফেলি, আমি এনুয়াল পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করব তো?
    ঘরে হাসির লহর বয়ে যায়, ঠাকুমা তাড়াতাড়ি বলে, আহা ওসব নয়, জ্ঞানের কথা, ঠাকুরের কথা।
    আমি খানিকক্ষণ ভদ্রলোককে মন দিয়ে দেখি, তারপর অবজ্ঞাভরে বলে দিই দূর, ঠাকুরের কথা তো বইতেই আছে, আমি সব জানি।

    চকচকে কপালে ভুরুর একটু কুঁচকে ওঠা দেখতে পাই, বালিকার অবজ্ঞায় গুরুদেবকে প্রশ্রয়ের হাসি হাসতেই হয়, কিন্তু কুঁচকে ওঠাটুকু দেখে আমার খুব আনন্দ হয়। একরকম হিংস্র আনন্দ। বাড়ি আসতে আসতে ঠাকুমা আর কুলটির মা আমাকে বলতে থাকেন "ও সিঙ্কুলি, ওরম কেন বললে মা? "

    আমি স্বভাববিরুদ্ধ ঝাঁঝিয়ে উঠে বলি , তোমরা ওনাকে পুজো করছিলে কেন? মানুষ কি ঠাকুর হতে পারে নাকি !
  • এমেম | 69.93.194.124 | ০৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০570024
  • ভালো লাগছে।
  • sosen | 125.242.231.138 | ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ১১:৪৯570025
  • পয়লা বৈশাখ মানেই সাদা টেপজামা। তাতে তিনটে হাঁসের ছানা আর একটা মা হাঁস, কমলা, নীল কালো সুতোয় সেলাই করা। কিছু হালখাতা, কিছু কোল্ড ড্রিঙ্কস। এর মধ্যে কোল্ড ড্রিঙ্কস বেজায় ভালো লাগে, কিন্তু কেউ পুরোটা খেতে দিলে তো।
    পয়লা বৈশাখ বললে, আরো একজনের কথা খুব মনে পড়ে । তাঁর কথা সময় অনুযায়ী পরে আসা উচিত, কিন্তু কার কি এসে যায়, আজ যদি বলি?

    সে বাড়িটা ছিল দরমার বাড়ি, তার , টালির চাল, সারাদিন সেলাই মেশিন চলত। বাড়ির ধার ঘেঁষে, চালের ওপর, লাউ, কুমড়ো লতিয়ে উঠত। সেই বাড়িতে এক মাসি ছিল, সীমামাসি। আর তার বুড়ি মা।
    এই জমির পাশ ঘেঁষেই সীমামাসির ভাইয়ের বাড়ি ছিল। কিন্তু ভাই, ভাইয়ের বউ , মোটেই দেখত না মা-দিদিকে। খোঁজ নিত, পয়সার দরকার পড়লে। সীমামাসিও রাত জাগার পরিমান আর একটু বাড়িয়ে ফেলত, আরো বেশি ব্লাউজ সেলাই করত, তাঁর প্রায়ান্ধ মা আরো বেশি ব্লাউজে হেম করত। মাঝে মাঝে প্রতিবেশীদের কাছে অল্প বিস্তর টাকা পয়সা চাইত। সাধারণ, মধ্যবয়স্ক, অত্যন্ত সরল সেই মানুষটিকে মনে পড়ে, সময়ের অনেক আগেই আজ সে আর নেই। শেষ কৈশোরে জয়ের সেলাই দিদিমনি পড়ে অকস্মাত তারই মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল।

    স্বপ্নামাসির জীবন ছিল একখানা বাংলা ক্যালেন্ডার, একটা পাঁজি। সপ্তাহের প্রতিটিদিন-ই যে আসলে এক একটি পুণ্যতিথি, এ তত্ত্ব তার কাছ থেকেই জানা, সকলকে জানতেই হত। ভোর ছ' টা থেকে পাড়ার বেশ ক্ষুদেদের সে পড়াত, আটটা অব্দি। তারপর প্রত্যেককে বাড়ি দিয়ে আসতো , ব্যস্ত মায়েদের সময় নেই বলে। যেন এক মা হাঁস, তার পিছনে সারি সারি ছানারা রাস্তা বেয়ে চলেছে। ফেরার পথে সে পুকুরে এক ডুব দিয়ে, গায়ে একটি গামছা জড়িয়ে বাড়ি যেত। আর যাওয়ার পথে সৌভাগ্যধন্য সব বাড়িতে দাঁড়িয়ে একটিবার বলে যেত, আজ পাঁজিতে অমুক তিথি, আজ কলা, কিংবা কুমড়ো খাওয়া নিষেধ, আজ এগারোটা থেকে তিনটের মধ্যে পুবমুখী যাত্রা যেন কেউ না করে, করলে দোষ কাটানোর জন্য যেন একটু লেবু ছুঁইয়ে দেওয়া হয় মুখে, ইত্যাদি। সেই সময় আমাদের বাড়ির মত বিভিন্ন বাড়ি থেকে একটু লাউয়ের খোলা, একটু বাড়তি কুমড়ো , কটি নীলকন্ঠ ফুল সে নিয়ে যেত। এই দৈনন্দিন ব্যবস্থায় সকলেই খোপে খোপে বসে গিয়েছিল, ঘড়ির সময় ধরে।
    মা-হাঁসী হতে না পারার অসোয়াস্তি জুড়ে থাকত সীমামাসির নিভৃতিতে। ঠাকুরে অগাধ বিশ্বাস ছিল তার, এই সময়ে হয়ত তার বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি। কেউ তার জন্য পাত্র দেখেনি, সবাই জানত তাদের বাড়ি জমিটিও দয়াপরবশ এক মহাজনের কাছে বাঁধা, নিতান্ত দয়ায় পড়ে যিনি ওদের তাগাদা তো দ্যান, কিন্তু উঠিয়ে দিতে পারেননা। আজকের দিন হলে কি হত, জানিনা, যখন ফ্ল্যাটের, চার দেওয়ালের জন্য দুটি ফুলের মত শিশুকে মেরে সেই ফ্ল্যাটেই গোর'স্থ করা যায়। না, তখন-ও সেই সেকেলে পাড়ার উপর লতানো ছাউনির মত উজিয়ে ছিল মায়া। এ বাড়ির বৌমার দিন কাটত ওবাড়ির শিশুকন্যাকে নিজের ছেলের সাথে খাইয়ে, স্নান করিয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, দরকার হলে দুটি গুমগুম কিল দিয়ে। কেউ কিছু বলতে আসতনা।
    অমন করেই সীমামাসিরও দিন কাটত বৈকি। অনুকুলঠাকুরের গান গেয়ে। ভারতের সাধক পড়ে। আর পাড়ার সব কুচিদের প্রশ্রয়ে স্নেহে মাথায় তুলে। লজেন্স, টফি, খেলনা না পেলেও দেহময় ঢলতে থাকা স্নেহের আদর, সে শিশুরা বোঝে বৈকি।
    আমার উপর সীমামাসির স্নেহ ছিল মাত্রাজ্ঞান ছাড়া। একটু বড় আমি, কিন্তু আমি যে এই সব মোটা মোটা ঠাকুরের বই পড়ে ফেলেছি, সে বিস্ময় তার কাটতে চাইত না, সর্বদা লেগে থাকত ড্যাবা ড্যাবা গরুর মত কালো চোখে। এই বিশেষত্বের কারণে সীমামাসির নিগূঢ় জীবনের কিছু কিছু আমাকে শুনতে হত। তার মধ্যে ভর-ভর্তি হয়ে থাকত কোনো এক আর্শিনগরে একটি বাড়ির স্বপ্ন, স্বামী-পুত্রে ভরন্ত, সেলাই মেশিনহীন, বন্ধকী যন্ত্রণাহীন এক নিজস্ব বাঁচার স্বপ্ন। ক্লাস নাইন পাশ সীমামাসি জানতনা, ব্লাউজ সেলাই করা ছাড়া আর কি দিয়ে, কি করে সেই জীবনে পৌঁছানো যায়, তাই তার একমাত্র জড়ানো জাপ্টানো ছিল তার ঠাকুরকে ঘিরে, তার প্রাণের ঠাকুর, যেন কোনো নিয়মবিধিতে ভুল না হয়।
    বোকা সীমামাসি নিশ্চিত জানত, ঠাকুর একদিন তার প্রার্থনা শুনবেন। নিজে নিজে পাড়ার বিভিন্ন ঘটকঠাকুরুনেদের কল্যাণে সে বয়স্ক দোজবরে পাত্রদের খোঁজ বার করত। তারা সীমামাসীকে ঠকাত, পয়সা নিত, কিন্তু শেষ অব্দি কেউ আসতো না। এমনকি দেখতেও না।
    সেই সব দিনে, যখন কারো আসার কথা থাকত, বিকেলে সীমামাসি গা ধুয়ে বাড়ি যেত। হয়ত সাজগোজ-ও বা করত, হয়ত সস্তা চিনেমাটির প্লেটে রসগোল্লাও সাজাত। ঠিক জানিনা। জানতে পারতাম, রাত সাড়ে আটটায় মুখ কাঁচুমাঁচু করে যখন সে মায়ের কাছে এসে বসত, সিরিয়াল দেখতে দেখতে ফিসফিসে শব্দে গল্প করত। মা তাকে বকতো, কিছুই ঠিকঠাক না শুনেও জিগ স পাজল সাজানোর মত আমি বুঝে যেতাম।
    আমার কাছে এসে বসত সীমামাসি। কেমন নিজের সাফাই গাওয়ার মত করে বলত, ঠাকুর তো বলেছেন, চেষ্টা করতে হয়, চেষ্টা ছাড়তে নেই।
    আমি সায় দিতাম। পূর্বাপর আমার জানার কথাও না, কিন্তু মজা পেতাম।
    সীমামাসি নিজের হাতখানা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলত "একটা আঙ্গুল ধরতো!"
    সেই বয়েসেই আমি বেশ মনস্তত্ত্ব বুঝতাম মনে হয়, তাই খপ করে ধরতাম কড়ে আঙ্গুল। সবচেয়ে শেষে মানুষ যার উপর বাজি ধরে।
    বেশিরভাগ দিন-ই সীমামাসির মুখখানা আলোকিত হয়ে উঠত।। মাঝে মাঝে আমার সাজের বাক্স থেকে পাথরের বা পুঁতির মালা বার করে দিয়ে বলতাম, এই যে, এটার হুক থেকে শুরু করে একটা পাথর আমি ধরব, আর তুমি গুনে দেখো ওটা জোড় পাথর , না বিজোড়। জোড় হলে হ্যাঁ, বিজোড় হলে না।
    নিষ্ঠুর রসিকতায় এটাও জুড়ে দিতাম, আমার এতে সব ঠিক মিলে যায়।
    সে মন দিয়ে গুনতে থাকত। শেষ পাথরে আসার আগেই গুলিয়ে যেত সব। আবার করে করত। অসহায়, বিশ্বাসী, তন্নিষ্ঠ সেই মুখখানা চোখের সামনে দেখতে পাই। মিলে গেলে ভয়ানক খুশি হয়ে যেত। বলত বাচ্চারা ভগবানের রূপ, তোর হাত দিয়ে এসেছে, এবার সত্যি হবেই।
    কি জানি কি সত্যি হবে। কোনদিন জানতেও চাইনি, কিছু সত্যি হয়েছিল কিনা। আমার খেলার এক পুতুলই ছিল বৈকি সে।
    এমন আরো কতজন আছে , কে জানে।

    কোনো লাক-চার্ম-ই কাজ করেনি তার। যখন ভয়ানক আগুন-দিন আমাকে বড় করে দিচ্ছিল, তখন একদিন খবর পাই, স্টেজ থ্রি ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে তার। সমস্ত শরীরে বিষ ছড়ানোর আগে অবধি সে কোনো ডাক্তারের কাছেও যায়নি, পাছে কেউ তার ব্যথা বেদনার কথা জেনে যায়, তার আর বিয়ে না হয়। রোগ ধরা পড়ার পর সারা শরীর চেঁছে বাদ দিয়েও আর বিশেষ সুরাহা হয়নি।
    তার মারা যাওয়ার খবর সেদিন আমার উপর তেমন কোনো ছাপ ফেলেনি। আজ, কেন জানিনা, পয়লা বৈশাখ এলে , সাদা টেপজামা, একপাল হাঁস , হাঁসের ছানার সঙ্গে খালি খালিই সেই ম্লান পুঁতি গুনতে থাকা হাতদুটো, "বৌদি, আজ কিন্তু সংক্রান্তি" বলে, ভিজে গায়ে হাঁক পেড়ে যাওয়া মানুষটাকে, আর কতকগুলো নিষ্ঠুর মজার দিনকে মনে পড়ে । আর সেই পুঁতির মালার রংগুলো। নীল, কমলা। কালো।
  • sosen | 125.242.231.138 | ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ১১:৫৬570026
  • তৃতীয় প্যারাতে "সীমামাসির জীবন ছিল " পড়ুন
  • san | 52.104.27.198 | ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ১২:০১570027
  • সাদা টেপজামায় হাঁসের ছানা পড়েই একঝলকে পুরনো দিন ফেরৎ এল :-)
  • | ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ১২:৩৯570028
  • :'((
  • sosen | 125.241.69.66 | ২০ এপ্রিল ২০১৪ ১২:২৪570030
  • কিন্তু একবার, হাঁসের ছানা জামা ছাড়াও, একটা পোলকা ডট কিংবা ছোট্ট ছোট্ট ববি প্রিন্টের জামাও পেয়েছিলাম। আর সেই সময় হঠাত আনন্দমেলা কি বড়, আর চকচকে হয়ে উঠলো। সোভিয়েত নারী কোত্থেকে বাড়িতে আসতো, কে আনত, কে জানে। কিন্তু তার ফ্যাশন পাতা থেকে লম্বা সুন্দরী মেয়েদের আমি যত্ন করে কেটে নিতাম। তারপর কার্ড বোর্ডের উপরে তাদের সেঁটে দিতাম, দু একবার হাত পা নাড়াচাড়ার মত ইঞ্জিনিয়ারিং করার চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি। কিন্তু তারাই তো পরত, সেই পোলকা ডটের স্কার্ট? লালকমল নীলকমল বলে ( তাই কি?) একখানা ছোটদের পত্রিকা বেরোত। তাতে এক রাশিয়ান কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর অনুবাদ থাকত। এর সবটা কখনই আমার হাতে এসে পৌঁছয়নি, কিন্তু ভোরের ট্রামে এক মহিলা কন্ডাক্টর, সেই গল্পে, নীল লাল ছবি -তার সঙ্গে সেই সময়ের ট্যাংরা, সি আই টি রোড, মামাদাদুদের বাড়ি, টিঙ্কু মাসি, সোমা মাসির লোরেটো ইস্কুল মিলে মিশে যায়। সেই ট্যাংরা ঠিক চায়না টাউন নয়, কিন্তু চীনেদের প্রায়ই দেখা যায় লম্বা বারান্দা থেকে। বেজায় শক্ত শুকতলার চিনে জুতো পাওয়া যায়, বিকেলে ঠং ঠং আওয়াজ করতে করতে একটা টিনের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে আসে "গরম , কুড়মুড়ে প্যা-টি-স "। শোনপাপড়ি কড়াই ডেকচি করে না, কাঁচের ঠেলা গাড়িতে বিক্রি হয়, তার সাথে তিলের মিষ্টি, ফ্রুটকেক, গোল গোল বনবন। সাদার উপর স্ট্রবেরি -গোলাপী কিংবা অরেঞ্জ বনবনে নকশা তার ওপর। এইগুলোর স্বাদ কেমন আলাদা। মামুদাদু বলে, এই মিষ্টি ওরা পার্ক স্ট্রিট থেকে আনে।
    পার্ক স্ট্রিট আমি চিনি না।
    কিন্তু তা-ও আমি ববি প্রিন্টকে পোলকা ডট বলি। শব্দটায় কেমন টান, অলস দুপুরের, সোনালী বিনুনির, কৃষক মেয়ের, গমের খেতের রং, বিন্দু বিন্দু করে ছড়ানো। সেই জামাটা বড় প্রিয় ছিল আমার। কিন্তু, যেমন হারিয়ে গেছে সোভিয়েত নারী, তেমনি ববি প্রিন্ট-ও হারিয়ে যায়। টেপজামাই হারিয়ে যায়। তার জায়গায় ঘটি হাতা গোলাপী সাদা শিফনের জামা আসে, গার্ডেন থেকে কেনা। সেজকাকা কিনে দ্যায়। এইটা পুজোয় পরবি, বলে মা তুলে রাখে। আমার-ও অবশ্য সে জামায় মন টানে না। আনন্দমেলায় সেবার বেরোলো ভিন্টেজ কার র‌্যালি নিয়ে পিকলু, ছোটকাকা আর ঠাকুমার সেই রহস্য গল্প। আমি এর ওর কাছে বায়না করি, ওই র‌্যালি দেখতে নিয়ে যায় যদি কেউ। বাড়িতে কেউ এসবের নামই শোনে নাই। বাবা শেষে বলে, আচ্ছা, তোকে একদিন নিলাম দেখাতে নিয়ে যাব।
    সে যাওয়া আর হয়নি অবশ্য। শুধু বই পড়েই আমি নাহুম চিনি, ফিরিঙ্গি পাড়া চিনি। গরম আইসক্রিম-ও চিনে ফেলি। গঙ্গার ধার, ইডেন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন