এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বেঁচে আছিঃ প্রেমে-অপ্রেমে

    ranjan roy
    অন্যান্য | ০১ অক্টোবর ২০১৪ | ২১৮৪৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ranjan roy | 132.176.143.102 | ০১ নভেম্বর ২০১৪ ১৮:৫০650876
  • বড়কা কমরেড একঘুম দিয়ে উঠে অনেকটা ভাত খেল। আলুসেদ্ধ, ডাল আর পেঁয়াজ-কাঁচালংকা। তারপর ভর দুপুরে হাঁটা ধরল। ওর কাছে সাইকেল নেই।মাইল দুয়েক গেলে বাসরাস্তা। সেখান থেকে বাস বা ভাড়ার মোটরগাড়ি করে ঘন্টাক্খানেক পরে বহেরাগোড়া। তারপর আরো আধঘন্টার পথ পেরিয়ে তবে ওর গ্রাম আমলাগোড়া।
    সমীরদা গুম হয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসেছিল। আস্তে আস্তে কিছুটা ওর মুখ থেকে কিছুটা বড়কার মুখ থেকে শুনে যা বুঝলাম তাতে আমার পিলে চমকে গেল।
    কাল সমীরদা বহেরাগোড়া গেছল কর্মীসভার মিটিং নিতে। কিন্তু গিয়ে দেখে গ্রামবাসীদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। তিনজন ওকে টেনে নিয়ে একটা ঘরে ধানের মরাইয়ের পেছনে লুকিয়ে থাকতে বলল। সমীরদা অবাক।
    জানা গেল মহকুমা সদর থেকে শাসক দলের একজন নেতা প্রায় জনাতিরিশেক সশস্ত্র দল নিয়ে গ্রামের সীমান্তে এসে মুখিয়াকে হুমকি দিচ্ছে।বলছে-- কোলকাতা থেকে একজন বঙ্গালী দিকু এসেছে এদিকের শান্ত গ্রামজীবনকে অশান্ত করতে। ওকে আমাদের হাতে তুলে দাও। শালো কে টাঙি দিয়ে দু'টুকরো করব। আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে লোকখেপানো সহ্য করব না।
    ওদের দলে সাঁওতাল-দিকু সবরকমই আছে। এদিকে গাঁয়ে বেশির ভাগ পুরুষ হাটে গেছে, ঘরে মহিলারাই রয়েছে বেশি।
    মুখিয়া বলছে যে ও তো আমাদের ডাগদরবাবু। লোকখেপায় না, লোকের ভালো করে।
    -- ওসব আমাদের জানা আছে। ওকে আমাদের হাতে তুলে দাও।
    --- ও তো এখানে থাকে না। মাঝে মাঝে আসে। ঈখন গাঁয়ে নাই।
    --- আমরা খবর পেয়েছি যে ও এখানে আছে। ভালয় ভালয় তুলে দাও মুখিয়া, নইলে তোমাদের গ্রামের লোকজনকে জাতের বাইরে করে দেব।
    ইতিমধ্যে হুড়মুড় করে এসে গেল তিনজল সাঁওতাল মেয়ে। এসে হড়বড় করে কিছু বলল বড়কা কমরেডকে।
    মুখিয়া খবর পাঠিয়েছে যে একটা সমঝোতা হয়েছে। দিকু ডাগদারকে ওদের সামনে হাজির করা হবে। ওদের নেতা বংশীধর মাহাতো। একটু রগচটা কিন্তু ভালো মানুষ। দুজনের মধ্যে সবার সামনে বাতচিত হবে।
    যদি বঙ্গালী দিকু প্রমাণ করতে পারে যে ওর কোন বদ মতলব নেই তাহলে ছেড়ে দেওয়া হবে, নইলে--!
    তখন বড়কা আর দুজন স্থানীয় কমরেড রওনা দিল যেখানে ওদের সাথে মুখিয়া অপেক্ষায় আছে।
    আমার বুক কেঁপে ওঠে।
    --- তুমি ভয় পাওনি?
    ব্যস্‌, সমীরদা ফর্মে এসে গেল।
    --- পাইনি আবার! কিন্তু উপায় নেই। যা থাকে কপালে ভেবে হাঁটা দিলাম। হয়ে যাক এস্পার-ওস্পার।
  • ranjan roy | 132.176.143.102 | ০১ নভেম্বর ২০১৪ ১৯:৫৬650877
  • --বুঝলে শান্তি, এমন সময় চারপাশের বাড়িগুলো থেকে বেরিয়ে এল গোটা দশেক মেঝেন, মানে সাঁওতাল মেয়ে। বলল, ডর নাই ডাগদারবাবু। তুই ভলা আদমী বটিস্‌। কুনো ডর নাই। তু যা সিনা তানকে বাত কর্‌। কুছু হোবে নাই। বাত বিগড় যায়ে তো হমরা আছি। মাঈলোগ। মাঈপিলা গিয়ে উর সামনে ডাঁড়াব। তুর কুনো ডর নাই।
    বুঝলে শান্তি, আমার ভয় কমে গেল।
    দাঁড়ালাম ওদের সামনে। ওরা প্রায় বিশ-তিরিশ, হাতে লাঠি-টাঙি-তির-কাঁড়। আমরা জনা ছয়, হাত খালি। তিনদিকে ঘর, মাঝখানে খালি জায়গা, ওরা দাঁড়িয়েছে পালাবার জায়গাটা আটকে। কোথাও কোন লোকজন নেই। মেয়ের দল কোথায়? একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে একটু হতাশ হলাম। বড়কা কমরেড বুঝতে পেরে আমার হাতে চাপ দিল। ফিসফিস করে বলল-- ভাবেন কেনে? মাঈলোগ তিনদিকের ঘরের দরজার আড়ালে লামবন্দী হইয়েছে।
    আবার তাকালাম।
    এবার যেন মেয়েদের নিঃশব্দ উপস্থিতি টের পেলাম।
    মুখিয়ার ভণিতার পর বাতচিত শুরু হল।
    প্রথম প্রশ্ন করল বংশীধর।
    -- হে দিকু, ইঁহা আইছিস কেনে?
    --- লোকের ইলাজ করতে, রোগবালাই ভাল করতে।
    -- ঝুট বাত।
    -- সচ্‌ বাত। গাঁওকে মাঈপিলা, মাঝি-মেঝেন সবকো পুছ।
    --- তু কলকাতা ছোড় ইঁহা? কেনে? ইঁহা গরীব লোগ, পৈসা দিবেক নাই।
    ---পৈসা নেহি, গরীব কা ভালা। পৈসা কামানা তো তোর সদর যাবো।
    -- সিধা বাত কর, বহেরাগোড়া কেনে?
    --- বহুত গরীবলোগ, হাসপাতাল নাহি, ডাগদর নাহি। শস্তা ইলাজ, অচ্ছা ইলাজ।
    -- কৌন ভেজা ইঁহা?
    --- হমারে সাথীলোগ।
    -- কৌন তেরা সাথী?
    -- দোস্তলোগ।
    -- ওরা কি করে?
    -- গরীবের সেবা করে।
    -- তোর দলের নাম কী?
    -- জনতা সেবা দল।
    -- দেখ, হমার সরকার, গরীব কা সরকার। তু লোগ ভড়্কানে আয়া?
    -- নহীঁ, সেবা করনে।
    -- তেরা ঝুট পকড়া গয়া। তু তিনগাঁও কে দরখাস্ত নেহি বনায়া? বিডিও সাহেব কে অফিস নেহি ভেজা?
    -- হাঁ, ভেজা। তো?
    -- এ কাম হমর সরকার কে বারে মেঁ লোগোঁ কা দিমাগ খারাপ করনা নেই?
    -- না মাহাতোজী। দেখ, আমাদের সরকার গরীবের সরকার। কিন্তু ইখানে দশগাঁও এর ভেতর একটা ডাক্তার নেই, হাসপাতাল নেই। সাপে কামড়ালে লোক মরে, ইনজেকশন নেই।
    --- একলা সরকার কত করবে? ধীরে ধীরে হবে।
    --- একদম ঠিক বাত মাহাতোজী। পর সবসে পহলে কিস গাঁও কা হোগা? জিস গাঁও আওয়াজ উঠায়েগা।
    -- কেনে?
    -- ঘোর কলিকাল। জবতক বাচ্চা নহীঁ রোতী, মা ভী দুধ নহীঁ পিলাতি। জো সরকার কে পাস জোর সে রোয়েগা, উসকা কাম পহলে হোগা, ঠিক বাত মাহাতোজী?
    --- বাত তো ঠিক । লেকিন তু ক্যা কাম করতা?
    --- আমি লোককে বোঝই, দরখাস্ত মুসাবিদা করি। বলেন তো আপনার দলের হয়েও লিখে দেব।
    সরকার যেই শুনবে, ইখানে হেল্থ সেন্টার খুলে দেবে, টিউকল বসিয়ে দেবে, মচ্ছর মারতে ডিডিটি দেবে আমার কাজ শেষ। আমি অন্য গাঁয়ে চলে যাব, সিখানে গিয়ে অলখ জাগাবো।
    বংশীধর মাহাতো নিজের লোকজনের সঙ্গে নীচু গলায় কিছু পরামর্শ করে। ওদের একজন চেঁচিয়ে বলে -- ই সব লাটক। খবর আছে ই নকশাল বটেক। হাতিয়ার আছে উর পাস।
    বংশীধর চোখ পাকিয়ে তাকায়।
    আমি বলি-- ঝুট বাত, গলত বাত। আমার ঘর, সাঁওতাল সাথীদের ঘর তালাশ করেন বটে। কোন হাতিয়ার নাই।
    ওরা আমার ধুতি ব্যাগ সব সার্চ করে।
    বেরিয়ে আসে গোটা কয় আকুপাংচারের সুঁচ, আর হোমিওপ্যাথির গুলি।
    সেই লোকটা চেঁচিয়ে ওঠে-- ই দেখেন গ, দেখেন সব্বজন! ই সুঁই আর বিষবড়ি। ই লোক মারবার হাতিয়ার।
    ওদের ক্রুদ্ধ দৃষ্টির সামনে আমি গোটাকয় নাক্স ভমিকার গুলি খেয়ে ফেলি। কড়মড় করে চিবোতে থাকি। ওরা ভয়মিশ্রিত চোখে আমাকে দেখতে থাকে।
    তারপর একটা ছুঁচ তুলে নিয়ে নিজের হাতে ফুটিয়ে দিই।
    তারপর একটা ছুঁচ হাতে নিয়ে সেই লোকটার দিকে এগিয়ে যাই। সে সভয়ে পিছু হতে। ওদের সাথীরা টাঙি-লাঠি বাগিয়ে ধরে।
    বংশীধর ওদের হাত তুলে থামায়।
    -- তুর মতলবটা কী বটে?
    -- আমি তোদের সুঁই ইলাজ দেখাচ্ছি। দেখ মাহাতোজী, ভয় পেও না। তোমার কোমরে ব্যথা আছে না? এই হাঁটু এগিয়ে দাও।
    মাহাতো চুপ, আমি ওর পায়ে হাত বোলাই।
    -- দেখ, ইখানে একটা ফুটো আছে। ইখানে একটুস সুঁই ঢোকাব তো তোমার হাতের বুড়ো আঙুল নড়ে উঠবে।
    আমি হোকু পয়েন্টে ছুঁচ ঢোকাই, আধ মিলিমিটার। ওর বুড়ো আঙুলে যেন বিজলির শক লাগল।
    ও লাফিয়ে হটে গিয়ে আমাকে ভয়মিশ্রিত শ্রদ
  • ranjan roy | 132.176.143.102 | ০১ নভেম্বর ২০১৪ ২০:১৩650878
  • ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতে থাকে। এবার মুখিয়া এগিয়ে আসে।
    --ইবার আমার ডাগদরবাবুকে ছাড়ান দেও।
    ওরা চলে যায়। যাবার আগে মুখিয়াকে সতর্ক করে যায়। এখন তো ঠিক লাগছে। কিন্তু ভবিষ্যতে কোন অন্যরকম খবর পেলে --?
    আমি দমবন্ধ করে শুনছিলাম। এবার সমীরদাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। -- আর ওই গ্রামে যেতে হবে না।
    সমীরদা বড়কা কমরেডের উপস্থিতিতে লজ্জা পায়। কমরেড বলে-- সিটা বইললে হবেক নাই দিদিমণি। হমার গাঁও, মাঝি-মেঝেন ডাগদরকে ছাড়বেক নাই!
    এবার ও চলে যায়। বাস রাস্তা দু মাইল যে!
    সমীরদা আমার মাথায় আলতো করে চাঁটি মারতে মারতে বলে-- ভয় পাস্‌ না পাগলি। দেখলি তো ওই সাঁওতাল মেয়েগুলো ভয় পায় নি। কমরেড মাও বলেছেন -- গেরিলাদের জনগনের মধ্যে জলের ভেতর মাছের মত মিশে থাকত এ হবে। ওটাই সুরক্ষা।
    আমার মন মানে না। বলি- ওইসব পাগলামো ছেড়ে দাও। চল, অন্য কোথাও গিয়ে খেটে খাব। কিন্তু এই অলুক্ষুণে রাস্তায় আর নয়। কথা দাও।
    সমীরদা আমার হাত আস্তে করে ছাড়িয়ে নেয়। একটা কলাইকরা থালা তুলে নিয়ে নীচু পর্দায় বাজাতে আর গাইতে থাকেঃ
    " ঊরূ রাং ঊরূ রাং! পিতলে বান্ধাবো ডাং,
    মারবো ডাংয়ের বাড়ি, ঘুচাবো জমিনদারি।"
  • সে | 188.83.87.102 | ০২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:৪৪650879
  • পড়ে ফেলেছি।
  • সিকি | ০২ নভেম্বর ২০১৪ ২৩:০৬650880
  • পড়ছি।
  • Amit Sengupta | 116.51.42.142 | ০৩ নভেম্বর ২০১৪ ০০:১১650881
  • দারুণ ভাল লাগছে।
  • d | 144.159.168.72 | ০৩ নভেম্বর ২০১৪ ১৪:০৮650882
  • ও-ও রঞ্জনদা
  • Du | 230.225.0.38 | ০৩ নভেম্বর ২০১৪ ১৪:২৭650883
  • মাঝে মাঝে এই গান, কবিতা, পাঁচালীগুলোর জন্য আরও জমে যায়।
  • সে | 203.108.233.65 | ০৪ নভেম্বর ২০১৪ ১৬:০২650884
  • রঞ্জনদা, এটা কী হচ্ছে? আর লেখা কই?
  • | 183.17.193.253 | ০৪ নভেম্বর ২০১৪ ১৮:৩৬650886
  • দুদিন বাদ পড়ে গেলো যেঃ(
  • # | 212.79.203.43 | ০৫ নভেম্বর ২০১৪ ১৭:৪৭650887
  • গানটার পরের লাইন বোধয় "বদ-বাবুদের পাঠাবো যমের বাড়ি", নাকি ?
  • ranjan roy | 132.176.164.50 | ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ০৫:২৫650888
  • ডিঃ জ্বর ইত্যাদি।

    @#,
    হতেই পারে। প্রয়াত অজিত পান্ডের গলায় ১৯৬৮ তে মাত্র একবার শুনেছিলাম।
  • | 183.17.193.253 | ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ০৭:৫০650889
  • তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো। সবাই হাঁ করে বসে আছেঃ)
  • ranjan roy | 132.176.164.50 | ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ০৯:৫৪650890
  • ২)
    নাঃ, সমীরদার ভাবগতিক মোটেই ভাল বুঝছি না। আমার কথা কানেই তুলছে না। সেই বহেরাগোড়ার ঘটনার পর থেকে ও যেন বেড়াল থেকে বাঘ হয়ে গেছে। হাড়কাটা গলির দিনগুলোর সেই ক্লান্ত, দ্বিধাগ্রস্ত মানুষটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এখন কথাবার্তায় চালচলনে একটা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস উঁকি দিচ্ছে।
    আর এই বাড়াবাড়ি রকমের সবজান্তা আত্মবিশ্বাসকে আমি ভয় পাই। এই বিশ্বাসে মানুষ আগুনে ঝাঁপ দেয়, নিজেকে ছোটখাট ভগবান বা দেবতা ভাবতে থাকে।
    আবার এই আত্মবিশ্বাসে মানুষের চেহারায় একটা আভা দেখা যায়, তাতে ওকে দশজনের ভীড়ে আলাদা করে চোখে পড়ে। এমন আভা প্রথম দেখেছিলাম আমাদের সেই ছোট্ট শহরে, যখন সমীরদা আমাদের বাড়িতে এসে আমার বাবার চোখে চোখ রেখে বলেছিল-
    'কাকু, আমি আপনার মেয়ে খুকুকে বিয়ে করতে চাই। কাজেই আপনি আর ওর জন্য পাত্র দেখবেন না।'
    মানছি, এই আত্মবিশ্বাস, এই আভা অনেকের চোখে ঘোর লাগায়। আমারও লেগেছিল।
    আচ্ছা, এই আভা আমার বাবার বা অন্য কোন চেনা লোকের চেহারায় কেন ছিল না? ছিল না, নাকি দেখতে পাইনি?
    তাহলে আজকের ঘটনাকে কী বলব?
  • ranjan roy | 132.176.164.50 | ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ১০:৪৩650891
  • সকালবেলা।
    ও রোজকার মত চান করে খেয়ে ঝোলাটোলা নিয়ে সাইকেল চাপতে যাবে এমন সময় একজন ধুতিপাঞ্জাবী পরা কাঁচাপাকা চুলের ভদ্রলোক এসে দরজায় দাঁড়ালেন।
    -- আপুনি ডাগদার?
    সমীরদা কিছু না বলে তাকাল।
    --- একটা বেপদ হয়েছে। আপুনি সাহায্য না করলে--। ভেতরে আসি?

    এইধরণের লোক আমাদের কাছে আগে আসে নি। ঘরের মধ্যে ঢুকে আমাকে দেখে একটু থমকাল।
    -- যা বলার ওর সামনেই বলুন, কোন অসুবিধে নেই। কী হয়েছে আপনার?
    --- আমার নয়, ঘরের লোকের। মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে, দু'মাস হল। শুরু হওয়ার ওষুধ দিতে হবে।
    --- মহিলাকে নিয়ে আসুন।
    --- কেনে? ঘরের মেইয়ে্কে আপুনার সামনে আনতে হবে কেনে? অসুখ তো বইলে দিলাম। ওষুধ দিবে নাই?
    -- এটা ওষুধের দোকান নয়। আমি হোমিওপ্যাথি করি। রোগী দেখে ওষুধ দিতে হয়, রোগ শুনে নয়।
    --- কেনে বুইঝতে পারছ না ডাগদার? উ আসবে নাই। গেরামের বড় ঘরের বালবিধবা। তার ওষুধ দিয়ে পেট খসাতে হবে। নইলে তারে গলায় দড়ি দিতে হবেক।
    সমীরদা উঠে দাঁড়ায়, লোকটাও ওঠে।
    -- আমি গর্ভপাতের ওষুধ জানি না। প্রাণ নষ্ট করি না। আপনি এখন আসুন।
    --- কত টাকা নিবে তুমি ডাগদর? বেব্স্থা হইয়ে যাবে। নামী বড় পরিবার। মালদার। তুমি টাকার জন্যি ভেব না। খালি কাজটা কর।

    সমীরদা দপ করে জ্বলে ওঠে। কোন ক্থা না বলে লোকটাকে সোজা ঠেলতে ঠেলতে বাইরে নিয়ে যায়। আমি ওকে আটকাতে দৌড়ে যাই। লোকটা চলে যাবার আগে একবার ঘুরে দাঁড়ায়। একবার আমাকে দেখে তারপর ওকে। হিসহিসিয়ে বলে-- ইটা ঠিক লয় ডাগদর। তুমার ঘরে সোন্দরপারা ডাগর বৌ, তুমি টুকুন মাকুন্দ বটেক, তবু জুয়ান মরদ। এতদিনেও বৌয়ের শরীর ভারি হয় নাই, টসকায় নাই। আর তুমি বুইলছ মাসিক ধর্ম শুরুর ওষুধ তুমার জানা নাই? ইটা ঠিক লয়।
  • সে | 203.108.233.65 | ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ১৪:২৯650892
  • লেখাটা ঘটনা থেকে ঘটনান্তরে নিয়ে যাচ্ছে। ভালো লাগছে।
  • AS | 125.187.62.205 | ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ১৯:৫৫650893
  • খুব ভালো লাগছে
  • ranjan roy | 132.176.132.13 | ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ০৭:১৪650894
  • লোকটা চলে গেল। কিন্তু যাবার সময় কাটা কাটা কথাগুলো! গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। আর একটা চাপা শাসানির স্বর ছিল কি?
    সমীরদা রাগে ছটফট করল। তারপর সাইকেলটা তুলে রাখল।
    -- আজ আর বেরোব না, বুঝলে লতা! আমাকে ধমক দিয়ে গেল! আমি কি ওর খাই না পরি? শালা ভেড়ুয়া! জোতদারের পা-চাটা কুকুর। আবার তোমাকে নিয়ে নোংরা ইঙ্গিত! ওর আমি---।
    --- তুমি ওকে চেন?
    --- পরিচয় নেই, কিন্তু ভাল করে চিনি। শিবরাম মাহাতো। এখানকার বড় জোতদার দাস পরিবারের গোমস্তা মত। ওর মালিকের গুষ্টির নোংরামি চাপা দিতে আমকে অ্যাবর্শনের ওষুধ দিতে হবে? শালা!
    -- আচ্ছা, তুমি আমাকে যে ওষুধগুলো দাও সেগুলো কি?
    ---- ওতে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভ হবে না।
    ---- আমার কোন ক্ষতি হবে না তো?
    --- না, না! ওগুলো বিষ নয়, হোমিওপ্যাথির ওষুধ।
    --- বাবাও তো হোমিও করে। ওতে তো অনেক বিষ আছে। যেমন অ্যাকোনাইট হল সেঁকোবিষ, তারপর আর্সেনিক আছে, তারপর সালফার।
    --- এই হল অল্পবিদ্যাভয়ংকরী! আরে ওগুলো সোজাসুজি অ্যালোপ্যাথির মত করে দিলে তবে বিষ আর হোমিও মতে ডায়্ল্যুশন করে মাইক্রোডোজে দিলে--
    --- অমৃত। তাই তো?
    --- আমি এরকম বলিনি তো?
    ---- বলনি, কিন্তু বলতে চাও, তাই না!
    আমার গলায় কি একটা ব্যঙ্গের সুর?
    সমীরদা চোখ গোল গোল করে আমাকে দেখল।
    তারপর একটু হেসে বলল-- বাঃ, মুখে বেশ বুলি ফুটেছে দেখছি। পাখি কথা বলতে শিখেছে। বেশ।
    --- ভয় পাচ্ছ সমীরদা? পাখি বুলি শিখেছে, উড়তে শিখবে, শেষে একদিন ডানা মেলে ফুরুৎ যদি হয়?
    ---- এসব কি বলছ লতা?
    --- ভেবে দেখ। পাখি ভাববে, না মানুষ ? পাখি হলে শেকল চাই,খাঁচা চাই। যতদিন তোমার শেখানো বুলি বলবে ততদিন শিকের ফাঁক দিয়ে ছোলা আর লংকা দেবে। আর যেদিন তোমার বাঁধাবুলি বলতে চাইবে না ? নিজেই খাঁচা খুলে উড়িয়ে দেবে, বিপ্লবের স্বার্থে।
    ---- মানে?
    --- কেন? তোমাদের মাওয়ের মতন!
    --- তোমার এই কথাটায় আমার আপত্তি। চেয়ারম্যান মাও কি তোমার আমার সবার মহান শিক্ষক ও গাইড নন?
    ----- আরে আমি ভদ্রলোককে চিনি না, জানি না।এটুকু পড়েছি যে উনি নিজের দেশকে স্বাধীন করেছেন। যেমন আমাদের গান্ধীজি; যেমন বাংলাদেশের মুজিবর রহমান। উনি আজ চীনের সবচেয়ে বড় নেতা। খামোখা আমার শিক্ষক হতে যাবেন কেন?
  • ranjan roy | 132.176.132.13 | ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ০৭:৫৯650895
  • রাগে সমীরদার কথা আটকে যায়। মুখ লাল, দুবার বিষম খায়। আমি ভয়ে ভয়ে জলের ঘটি এগিয়ে দিই।
    ---- কার সঙ্গে চেয়ারম্যানের তুলন করলে লতা? মুজিবর?ও বিপ্লবী? বিপ্লব আমদানী করা যায় বাইরে থেকে? ও তো ভারতের চর! ভারতীয় আর্মির সাহায্যে ক্ষমতা দখল করে ঢাকায় একটা পুতুল সরকার বনিয়েছিল। ওরা ইন্দিরা ও ব্রেজনেভের ইশারায় দেশ চালাত।
    --- কিন্তু আমার দিদা তো বাংলাদেশের। দিদা বলেছে যে ওঁকে দেশের সবাই ভালবাসত। ওকে পাকিস্তানের দালালেরা মেরে ফেলেছে?
    --- বাংলাদেশে থাকলেই সব জানা যায় না। ভারতে থেকেই কি সবাই সব বোঝে? তাহলে তো হয়েই যেত।শোন, ওকে মেরেছে সিআইয়ের দালাল ফৌজি অফিসাররা।
    --- কেন?
    --- আরে বল্লাম তো, ও ছিল ভারত ও রাশিয়ার মানে কেজিবির দালাল। মারা গেল সিআইএ ও কেজিবির হালুয়া-রুটি ভাগাভাগির ঝগড়ায়। বাংলাদেশে ও শুধু তোমার দিদা না, আমাদের কমরেডরাও আছে।
    --- আচ্ছা, কাটান দাও। আমি অতশত জানি না। বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো অসহায় মেয়েমানুষ। তোমার মত মহান পুরুষ আমাকে আশ্রয় দিয়েছে।
    --- এসব বলবে না লতা। একদম না। আমি তোমাকে আশ্রয় দিই নি, ভালবেসে বুকে করে রেখেছি। আর কোলকাতার ওই দিনগুলিতে , ওই নোংরা পাড়ায় তোমার অমানুষিক পরিশ্রম আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আমি মুখে বলত লজ্জা পাই, কিন্তু একমুহূর্তের জন্যেও --।

    আমার বুকের ভেতর জমে থাকা খোয়াইয়ের রুক্ষ্মতাকে ভিজিয়ে দেয় কোপাই , ভাসিয়ে দেয় ময়ুরাক্ষ্মী, আর দারুকেশ্বরেও বান ডাকে।

    অনেক অনেক পরে টের পাই বাইরে রোদ্দূর পড়ে যাচ্ছে। মেলে দেওয়া কাপড়গুলো তুলে আনতে হবে। তাই আমার বুকের ওপর থেকে সমীরদার হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে বসি। ঢক্ঢক করে জল খাই। হটাৎ পেটের ভেতরে চাঁই চাঁই করে ওঠে খিদে।ভাবি-- চালে ডালে চড়িয়ে দিই গে।
    উনুনের দিকে যেতে যেতে ওর দিকে তাকাই। ছোট্ট শিশুর মত ঘুমিয়ে আছে মানুষটা। মুখটা একটু খোলা, অল্প অল্প নাক ডাকছে। আর পারি নে! দ্রুত কাছে গিয়ে একটা চুমু খাই। দুটো, তিনটে।
    সমীরদা ধড়মড়িয়ে উঠে বসে।
    -- একি,এত বেলা হয়ে গেছে? ডাকনি কেন, লতা? এর পরে বহেরাগোড়ার শেষ বাসটাও চলে যাবে।
    ---- ওমা, তুমি যে বললে আজ আর যাবে না?
    -- না, না। সে হয় না। কমরেডরা সব অপেক্ষা করে আছে। আজকে ওখানে আমাদের কোর কমিটির বৈঠক। আমাকে যেতেই হবে।
    ও উঠে চোখেমুখে জল দিয়ে এক ঘটি জল খায়। তারপর সাইকেল তুলে রওনা হয়ে যায়।
    যাবার আগে বলে-- সাবধানে থেক লতা। আজকে রাতে ফিরতে পারব না। কাল দুপুরের আগে ফিরে আসব।
    আমি নির্বাক।
  • ranjan roy | 132.176.168.168 | ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ১৩:৫৮650897
  • ৪)
    একটু একটু করে এই জীবনে হাঁফ ধরে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা দিন একইরকম। আজ-কাল-পরশু সব মিলে মিশে একাকার। দুপুরে ভাত ঘুম দিয়ে উঠে ভাবতে থাকি-- আমি কী করব? শুধু ভাত রাঁধব, বাসন মাজব? ঘর মু্ছব, জল আনব আর কাপড় কাচব?
    এই আমার নিয়তি?
    আচ্ছা, সেই স্কুলের বেড়া টপকানোর আগে যদি ক্রিশ্চান হয়ে যেতাম?
    দেখেছি,ওদের মেয়েরা বেশ সহজে নার্সের বা লোয়ার ক্লাসে স্কুল টিচারের চাকরি পেয়ে যায়।
    সেই ছোট্ট খনিশহরের মিশনের স্কুলে গানের ক্লাসে একটা কালো বই দেওয়া হত, পাঁচ টাকায়।
    তাতে ছিল হাল্লেলুইয়া , কুম্বায়া ও গড কুম্বায়া আর হিন্দিতে 'খুশি খুশি মানাও, খুশি খুশি মানাও, বোলো প্রভু কী জয় জয় জয়।
    আমার গাইতে ভাল লাগত, তাই ওদের সঙ্গে নিজে থেকেই গাইতাম। একদিন সিস্টার অন্য ছেলেমেয়েদের বকলেন।
    -- দ্যাখ তো, একটি হিন্দু মেয়ে কেমন আবেগ দিয়ে সুরে গাইছে! আর তোমরা মসীহী পরিবারের ছেলেমেয়ে; তোমরা এত বেসুরো কেন? তোমাদের বিশ্বাস এমন জং ধরা কেন? লর্ড কিন্তু ওপর থেকে সব দেখছেন।
    আমি প্রতি সপ্তাহে স্কুলে বাইবেল ক্লাসে যেতাম। অন্য ধরণের অন্য দেশের অচেনা সব গল্প। ভালো লাগত। কিন্তু একদিন মাকে বললাম-- জানো মা, এই যে তোমাকে বাবাকে এত খাটতে হচ্ছে, আমাকেও কাঠকাটা, কয়লাভাঙা আর কুয়োর থেকে বালতি বালতি জল তোলা -এই সব করতে হচ্ছে--এসবের কোন দরকার ছিল না।
    ---মানে?
    -- আমরা অন্যের দোষে শাস্তি পাচ্ছি।
    ---- আদম ও ঈভের দোষে।
    -- ওরা আবার কে?
    --- আমাদের দাদুর দাদুর দাদুর দাদুর দাদু আর দিদার দিদার দিদার দিদার দিদা।
    --- যত্ত ফালতু কথা! তা ওরা কী করেছিল?
    ---- শয়তানের কথা শুনে ইডেন গার্ডেন থেকে আপেল পেড়ে খেয়েছিল। তাতে ঈভের গর্ভ হল। ভগবান গেলেন রেগে। উনি শাপ দিলেন যে এই লোভের জন্যে এখন থেকে মানুষ ডায়রেক্ট জন্মাবে না। সমস্ত মেয়েদের বাচ্চার জন্ম দিতে দশ মাস গর্ভধারণের কষ্ট পেতে হবে। আর সমস্ত মানুষকে বেঁচে থাকার জন্যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করতে হবে। তাই বাবাকে রোজ ভোঁ বাজলেই সাইকেল করে খাদানে যেতে হয়।
    ঠিক বুঝেছি না, মা?
    --- ছাই বুঝেছিস। আর একবার যদি বাইবেল ক্লাসে যেতে দেখি তো মেরে ঠ্যাং ভেঙে খোঁড়া করে দেব।

    মা মানা করলেও লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েকবার গেছি। কিন্তু শেষের দিকে এতবার ফাদার আমাদের পাপে জন্ম, পাপের বেতন মৃত্যু আর পাপস্বীকার, পাপের জন্যে অনুতাপ করার কথা বললেন যে আমার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। আস্তে আস্তে যাওয়া ছেড়ে দিলাম।
  • ranjan roy | 132.176.168.168 | ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ১৪:৪৭650898
  • আমাদের বাড়িতে একটা দু'ব্যান্ডের বুশ ট্রানজিস্টার ছিল। মা ছাড়া কেউ হাত দিতে পারত না, শেষের দিকে দাদা।
    মা গান শুনতে ভালবাসত,-সিনেমার গান। আমার কান খাড়া হয়ে থাকত বিবিধ ভারতী, রেডিও সিলোন আর রায়পুর রেডিওর জন্যে।
    খুব ভাল লাগত উদাত্ত গলার কিশোর আর সুরেলা মহম্মদ রফি। হেমন্ত ও মুকেশ কেমন যেন চাপা আওয়াজ। ওদিকে লতার চেয়েও আশা ভোঁসলে।
    রায়পুর রেডিওর প্রভাতী নামের সকালের অনুষ্ঠানে শুনতে পেতাম ভজন, কাওয়ালি, কীর্তন।
    কোলকাতার হাড়কাটা গলিতেও পাশের ঘরে, পান দোকানে হয় রেডিও নয় ক্যাসেট বাজত। এই অজ পাড়াগাঁয়ে লোকের ঘরে আলো নেই তো এইসব বিলাসিতা!
    কথাটা আমার নয়, সমীরদার।
    বলেছিলাম সারাদিন একা একা থাকি, গান শুনতে পেলে সময় কেটে যাবে। যদি কোথা থেকে চেয়ে চিন্তে একটা পুরনো-টুরনো রেডিও এনে দেয়!
    কি ভুল যে করলাম! এনে তো দিল না, উল্টে এক লম্বা লেকচার শুনিয়ে দিল।
    আমরা নাকি এখানে পেটি-বুর্জোয়া ঘরকন্না করতে আসি নি। এইসব রান্নাবাটি-পুতুলখেলা নাকি প্যানপেনে ব্যাপার। এই টেমি জ্বলা গাঁয়ে ট্রানজিস্টারে গান শোনার স্বপ্ন দেখা নাকি বিলাসিতা। ব্যাটারি চালিয়ে গান অনেক খরচের ব্যাপার। তাছাড়া এই শান্ত চুপচাপ পরিবেশে গাঁক গাঁক করে হিন্দি গান বাজালে লোকে সন্দেহের চোখে দেখবে।
    আমি দুহাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলাম-- বুঝেছি, বুঝেছি! যতদিন না গ্রামের প্রত্যেকটি লোকের ঘরে বিজলি আসবে, যতদিন না শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের সরকার ক্ষমতায় আসবে , এককথায়, যতদিন না বিপ্লব হবে , ততদিন আমার পক্ষে একা রেডিও বাজিয়ে হিন্দি গান শোনা শুধু বিলাসিতা নয়, মধ্যবিত্ত অপসংস্কৃতিও বটে! কি, ঠিক বললাম তো?
    সমীরদা চুপ। আমি ছাড়ি নি।
    -- দেখলে তো, আমি কেমন ছাত্রী? তোমাদের কথাবার্তার ধরন বেশ রপ্ত করেচি। এবার আমাকে তোমাদের দলের কিছু কাজ দাও না!

    সমীরদা উদ্দীপিত।
    --তুমি আমাদের সঙ্গে কাজ করবে লতা? দেখ, আমি তোমাকে কোনরকম জোরাজুরি করছি না। ভাল করে ভেবে দেখ ।নিজের মনকে জিজ্ঞাসা কর; বারেবারে। এই রাস্তায় ফুল নেই কাঁটা আছে। নাম নেই, বদনাম আছে। ভেবে দেখ। রাজি হলে তোমাকে এই এলাকায় মহিলা সংগঠন গড়তে লাগিয়ে দেব। আমি জানি তুমি পারবে।
    আমি ওর কাঁধে মাথা রাখি।
  • সে | 188.83.87.102 | ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ১৭:৩৩650899
  • অদ্ভুত সুন্দর।
  • ranjan roy | 132.176.168.168 | ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ২১:৫৯650900
  • না, আমাকে তক্ষুণি দলের কাজ দেওয়া হয় নি। কিন্তু আমার আর সমীরদার মধ্যে একটা অন্য রকম পরিবর্তন এসেছে। ঠিক বলে বোঝাতে পারছি না। আসলে আমিই কি বুঝেছি ছাই!
    এর মধ্যে কখন ফাল্গুন মাস, হোলি তেওহার এল আর চলে গেল --ঠিকমত টের পেলাম না। শুধু শীত চলে গিয়ে একটু গরম গরম ভাব, তবু রাত্তিরে কাঁথামুড়ি দিতে হয়।আর সকাল সন্ধ্যে কোকিল ডেকে ডেকে ফাটিয়ে দেয়।
    তখন মনে পড়ে যে আমাদের ছোট্ট শহরগুলোতে হুল্লাট হোলি খেলা হত। সকাল বেলায় রং-পিচকারি দিয়ে শুরু, বেলা বাড়ার সঙ্গে হলুদ-সবুজ-কালো-বাঁদুরে। তারপর গোবর ও নোংরা কাদা। শেষে দল বেঁধে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে পরা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে গুজিয়া,নিমকি , বরফি ও শরবত। কোন কোন বরফি ও শরবতে ভাঙের মিশেল।
    কিছু কিছু দুষ্টু ছেলেরা আলু কেটে তাতে অসভ্য কথা লিখে রং লাগিয়ে লোকের বুকে ছাপ মেরে দেয়। কিন্তু এই একটা দিন, কেউ কাউকে বকে না। বলে-- বুরা না মানো হোলি হ্যায়। কিন্তু বেলা একটা নাগাদ সব শেষ। সেদিন আমরা দল বেঁধে পুকুরে গিয়ে মেয়েদের ঘাটে স্নান করি। সন্ধ্যেবেলা শুধু আবির বা ফাগ লাগানো যাবে।
    কতদিন হোলি খেলিনি! দু-দুটো বছর।
    আরও একটা ব্যাপার আছে। দুবেলা পুকুর থেকে জল আনতে গেলে টের পাই। পুকুর পাড়ে জল আনার রাস্তার দুপাশে আমগাছে মুকুল ধরেছে। আমাদের শহরে হিন্দিতে বলত- পেড় বৌরায়া হ্যায়।
    সেই গন্ধে কেমন একটা মাদক ভাব।
    কিন্তু আসল কথাটা হল এই গন্ধটা আজকাল সমীরদার শরীরে পাচ্ছি, বিশেষ করে যখন ওর বুকে মাথা রাখি। ওকে বলতে লজ্জা করে।
  • ranjan roy | 132.176.168.168 | ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ২৩:০০650901
  • সেদিন সমীরদা বলল--আজ দুপুরের খাওয়াটা একটু তাড়াতাড়ি সেরে নাও।
    -- কেন?
    --- একটা সারপ্রাইজ দেব।
    --মানে?
    -- তোমাকে একজায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাব।

    বলে কি লোকটা! মাথাটাথা খারাপ হল নাকি? এই দুবছরের মধ্যে দু'জায়গায় সংসার পেতেছি। কোলকাতার গলিঘুঁজি আর রাঢ়বাংলার এই অজ পাড়াগাঁয়ে। সব সময় একটা হুসহাস ফিসফাস ভূতুড়ে ভূতুড়ে ভাব। বন্ধ থেকেছি ঘরের চার দেয়ালের ভেতর। বাইরে যাওয়া মানে সেই চামড়ার কারখানার খাটুনি আর মুদিদোকান থেকে কাঁকর বাছার কাজ আনা।
    বুকের ভেতর অনেক পাখি হুস করে উড়ে গেল।
    --- আমি না জেনে যাব না। কোথায় নিয়ে যাবে?
    ---- গাজনের মেলায়, চড়কপূজো দেখতে।
    --- সে আবার কি!
    ---- চৈত্রসংক্রান্তিতে শিবের গাজন হয়। ভক্তরা উপোস করে এই মেলায় নীল মানে শিবের পূজো করে। খুব বড় মেলা হয়। কাছাকাছি দশটা গাঁয়ের লোক আসে। বাণ মারার খেলা হয়। আর চড়ক মানে খুব উঁচু চরকি মত, তাতে পিঠ ফুঁড়ে ভক্তরা নাগরদোলার মত চরকি পাক খায়। এসব শহরের লোক দেখতে পায় না। চল, দেখে আসি।গাঁটে কিছু বাড়তি পয়সা আছে। মেলায় দোকান থেকে পাঁপড় কিনে খাব 'খন।
    --- জায়গাটা কোথায়? কতদূরে?
    ---- বাসে পাক্কা আড়াই ঘন্টা। রূপুসকুন্ডি বলে দুমকা বর্ডারের কাছে এক পাহাড়ি গাঁয়ে। নাও, তাড়াতাড়ি তৈরি হও।

    আজ আমি ভাল করে চুল বাঁধি, বেশ টানটান করে। আমার দিদা এমন করে বাঁধতে শিখিয়েছিল। টিনের বাক্স থেকে একটা নীল ঘতিহাতা ব্লাউজ আর লাল শাড়ি বের করে পরি। সেই যে বিয়ের রেজিস্ট্রির পরে দিদা একটা লোকের হাত দিয়ে পাঠিয়েছিল।
    ও আমাকে অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।
    -- কী ব্যাপার? অমন করে কী দেখছ?
    -- না, মানে এই লাল শাড়িতে তোমাকে অন্যরকম লগছে। আগে যদি-।
    --- আগে যদি কী?
    সমীরদা চুপ করে থাকে।
    আমি বলি-- বাক্যি হরে গেল? বেশ, একটা গান শুনবে? লালশাড়ির গান? বাংলাদেশের; দিদা শিখিয়েছিল।
    ওর সম্মতির অপেক্ষা না করে আমি নীচু গলায় গেয়ে উঠিঃ

    " বাড়িতে রাঙাবৌ আসিয়া,
    কথা কয় রাঙামুখে হাসিয়া,
    আমার বাঁশি বাজে তারিয়া নারিয়া রে।

    পাড়ায় পাড়ায় বেড়ায় বৌ যে লালশাড়ি পড়িয়া,
    লালমোরগের রঙিন পাখা নাড়িয়া চাড়িয়া,
    ও ভাইরে, ঝলমল কি চলমল করিয়া।

    বৌ তো নয় সে হলুদপাখি এসেছে উড়িয়া,
    সরষের ক্ষেত হতে ভুলিয়া,
    মনে করে রাখি তারে পিঞ্জিরায় ভরিয়া,
    নইলে যাবে সে উড়িয়া,
    ও ভাইরে, ফুরফুর কি তুরতুর করিয়া।।"

    সমীরদা হেসে বলে--- তোমার দিদিমাবুড়ির বেশ রস আছে তো! খালি ওই ল'আলমোরগের রঙিন পাখা" ঠিক হজম হচ্ছে না। তুমি পাড়ায় পাড়ায় লালমোরগের পাখা হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছ ভাবলেই পেটের মধ্যে কেমন --।
    -- দিদা বলত, এইডা শ্যাকের গান , অরা মোরগের পাখা দিয়া হাওয়া খাইতেই পারে। হিন্দুবাড়িতে এমুন হয় না।
    -- ধ্যেৎ, যত সাম্প্রদয়িক কথাবার্তা। ঢের হয়েছে, এখন চল তো!
  • ranjan roy | 132.176.200.242 | ০৯ নভেম্বর ২০১৪ ১৩:২৪650902
  • সাইকেলের পেছনে কোন ক্যারিয়ার নেই, তাই সামনে রডে বসিয়ে চালাচ্ছে সমীরদা। আমি এভাবে অভ্যস্ত নই। বেশ লাগছে; যাকগে মিনিট দশের মধ্যেই বাস-রাস্তা এসে গেল।
    ওমা! এ যে অনেক লোক, ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-বুড়ি সব মেলায় যাবে। অনেকের পরনে উজ্বল রঙের পোষাক। অপেক্ষা করছে বাস আসবে বলে।
    যেখানে বাস থামবে তার পাশে রাস্তার ধারে একটা চালাঘর মত, সেখানে মাটির হাঁড়িতে ঠান্ডা জল, গুড় আর ছোলা রাখা আছে। একজন একচোখ-নষ্ট শণের মত চুল সাঁওতাল বুড়ি বসে সবাইকে ঢেলে দিচ্ছে।
    বাস আসতেই সবাই হুড়মুড় করে বাসের ছাদে উঠে পড়ল। আমি ও সমীরদা ভেতরে ঢুকলাম, এগোয় কার সাধ্যি ! ও অসহায় ভবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে এমন সময় একজন মাঝবয়সী লোক নিজের সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
    আমাকে বলল-- টুকুন বসেন আজ্ঞেঁ!
    তারপর সমীরদার পাশে দাঁড়িয়ে এবারের মেলার গতিপ্রকৃতি নিয়ে দিব্যি গল্প জুড়ে দিল। সমীরদাও অল্প সময়ে অস্বস্তি কাটিয়ে ওর সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠল। আমার লোকটাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি যেন!
    লোকটা পান চিবুচ্ছিল। একটু পরে দুটো লোকের মাথার ওপর দিয়ে জানলার কাছে মুখ এনে পিচ করে বাইরে পিক ফেলল। তারপর কাঁধের গামছা দিয়ে মুখ মুছে আমার দিকে তাকিয়ে কেমন হাসল। হাসতেই দেখা গেল ওর ধাতু দিয়ে সিল করা দুটো দাঁত।
    আমি চমকে উঠলাম।
    লোকটা শিবরাম মাহাতো। দুমাস আগে আমাদের বাড়িতে গর্ভপাতের ওষুধ চাইতে এসে ধমকে গেছল।
    আমার মেলা বেড়ানোর শখ ফিকে হয়ে গেল।
  • ranjan roy | 132.176.200.242 | ০৯ নভেম্বর ২০১৪ ১৪:৪৩650903
  • মেলা দেখে মাথা ঘুরে গেল।
    একটা পাহাড়ি টিলা মত , তার পেছনে একটা নদী বাঁক নিয়েছে। কিন্তু বাসরাস্তা থেকে আধমাইলটাক দূর। সমীরদা বাসের মাথা থেকে খালাসীর সাহায্যে সাইকেল নামিয়ে আমাকে ফের রডে বসিয়ে টিলার ওপারে নদীর বাঁকের পাশে মেলাস্থানে নিয়ে গেল। সেখানে একটা জিলিপির দোকানে চেনা লোকের কাছে সাইকেল রেখে আমাকে বলল-- হাত ধরে থাক, নইলে হারিয়ে যাবে।
    আমি ঝাঁঝিয়ে উঠলাম।
    বাচ্চা মেয়ে নাকি যে হারিয়ে যাবো! বললাম -- নিজের মত করে ঘুরে ঘুরে মেলা দেখবো। হাতটাত ধরে ঘুরে বেড়াতে পারব না। আর অলাদা হয়ে পড়লে শেষে ওই জিলিপির দোকানে ফিরে যাব, সেখানে অপেক্ষা করব।
    -- আরিব্বাস্‌, তঁয় বাঘিন বটেক!
    এবার আমি হেসে বলি -চল। আর ওর হাত ধরে ঘুরে বেড়াই। এইসব জিলিপি-বেগুনি-ফুলুরি আর চায়ের দোকনই কতগুলো! এছাড়া আছে লাঙলের ফাল-দা-কোদাল- গাঁইতি-ছুরি-কাঁচির কামারের দোকান, পাশে একটু হাপর জ্বালিয়ে কাজ চলছে। রয়েছে চাকি-বেলন-- বঁটি কড়াই হাতাখুন্তির দোকান। কোথাও বিক্রি হচ্ছে গামছা , লাল শাড়ি, ধুতি ও মেয়েদের টিপ, কাজল আর চুলের ফিতে। সাঁওতাল মেয়েদের ভিড় ভেঙে পড়ছে কাঁচের চুড়ির দোকানে।
    ওসব দিকে বেশি তাকাইনে। এক তো টাকাকড়ি নেই আর মাত্র দু'বছর হল ঘর ছেড়েছি, একবছর কোলকাতা। এখনো এই সব গ্রামীণ জামাকাপড় প্রসাধন চুলের গন্ধতেল, কাঁটা, নকল খোঁপা ঠিক হজম হয় না।
    আমার মধ্যবিত্ত থেকে ডি-ক্লাসড হয়ে মজুরনী-কিষাণী হওয়ার কোন শখ নেই, ও যাই বলুক।
    তবে ওদের অধিকারের জন্যে বা অবস্থা ফেরাতে কিছু করতে হলে তাতে থাকব, এই পর্য্যন্ত।
    খেয়াল হল, এখানে ওর বেশ কিছু চেনা লোক আছে। ওরা একজন দুজন করে আসে, ওর সঙ্গে দাঁড়িয়ে নানান কথা বলে, গল্প করে , আবার চলে যায়। যাবার আগে আমাকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে। তারপর আমরা আর একটু এগোই।
    ব্যাপারটা আমার কাছে বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়াল। শেষে ওই বলল-- তুমি নিজের মত করে ঘুরে দেখ একটু। কোন ভয় নেই। আমার কমরেডরা রয়েছে।
    আমি এগোতে লাগলাম। আসল মজা হল-- বেশ কিছু লোক সারা গয়ে ছাই মেখে শিব সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার কিছু ছেলে দূর্গাঠাকুর সেজে ওদের সঙ্গে নাচছে। লোকে ভীড় করে দাঁড়িয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ নাক-কান ফুঁড়ে রেখেছে। ভগবানকে তুষ্ট করতে নিজেরা কত কষ্ট করছে!
    একজন আমার দিকে এগিয়ে এল। ওমা, ওর দেখি নাক-কান নয়, সোজা জিভ এঁফোড়-ওফোঁড়!
    আমার গা গুলিয়ে উঠল। মাথা ঘুরে গেল। কেউ আমার হাত ধরেছে। দেখি সমীরদা।
    -- ভয় পেয়ো না। এদের বুঝতে চেষ্টা কর। দূর্গাপূজো হল বড়লোক আর মধ্যবিত্তদের উৎসব। আর চড়ক বা নীলের পূজো হল প্রান্তিক খেটেখাওয়া মানুষদের উৎসব। এইসম্য ঘরের ধান শেষ। খাওয়া জোটে না ঠিক মত, তাই ধর্মের নামে উপোস করে গাঁজা খেয়ে ক্ষিদে ভুলে এরা চোতমাসটা কাঠিয়ে দেয়। ওদিকে চল। দেখবে চড়কের আসল রূপ।
    যা দেখলাম তাতে মাথাখারাপ হবার জোগাড়। বিশাল উঁচু বাঁশ পোতা রয়েছে। তাতে দুতো বাঁশ আড়া আড়ি করে গাঁথা। তার সঙ্গে পিঠে লোহার হুক মত গেঁথে চারটে মানুষ পাক খাচ্ছে। উৎসব না হাতি!
    যত্ত ফালতু কথা। আমার মনে হল পেটের ভেতরের সব ভাত বেড়িয়ে আসবে।
    এবার আমিই ওর হাত ধরে টানলাম। অন্যদিকে চল।
    মূলথানের পাশে খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে গোবর লেপে একটু বেদি মত করা। সেখানে একজন সুন্দর করে সাজা শিবকে ঘিরে খোল-কত্তাল বাজিয়ে ভক্তের দল গাইছেঃ
    কোরাসঃ বাবার লাগিল গাজন,
    শিবের লাগিল গাজন।
    ব্যোম ভোলে! ব্যোম ভোলে!
    মূল গায়কঃ পেটেতে ভাত নাই ও শিব,
    ঘরেতে নাই ধান।
    কী দিয়া বাঁচাবো ও শিব
    ছেল্যা-পুল্যার জান।

    কোরাসঃ বাবার লাগিল গাজন,
    বুড়োশিবের লাগিল গাজন।
    ব্যোম ভোলে! ব্যোম ভোলে!
  • ranjan roy | 132.176.200.242 | ০৯ নভেম্বর ২০১৪ ১৪:৫৭650904
  • আরে! ওই মূল গায়ককে যে আমি চিনি। ও তো সেই ঝুঁটিবাঁধা লোকটা যে আমাদের বাড়িতে সর্পগন্ধার গাছ লাগাতে এসেছিল আর আমাকে বাউল গান শুনিয়ে গেছল।
    আমি উত্তেজিত হয়ে সমীরদার দিকে মুখ তুলে তাকালাম। ও আমার হাতে চাপ দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল-- লতা, এ হল আমাদের দলের কালচারাল স্কোয়াড। আমার নিজের হাতে তৈরি। আর একটু দেখ।
    মঞ্চে মূল গায়ক দাঁড়িয়েছে আছে। শুধু ওর সঙ্গে ঢোলক নিয়ে একজন, অন্যেরা নেমে গেছে। দেখলাম ওদের দুজনের পায়ে ঘুঙুর
    বাঁধা।
    অন্য গান, অন্য সুর, অন্য কথা, অন্য লয়। শুরু হলঃ

    " শুনেন শুনেন সভাজন গ', শুনেন শুনেন সভাজন,
    দেশে আবার হবে নির্বাচন ভাই, আবার হবে নির্বাচন,
    শুনেন শুনেন সভাজন।

    বিশবছরের নির্বাচনে কত মন্ত্রী এল গেল,
    সকলেরই একই রা', শাসন সেতো রয়েই গেল।
    মন্ত্রীত্বেরই ঢাক বেজেছে, শাসকরা আনন্দে নাচে,
    শ্রমিক -কৃষক গলদঘর্ম ক্ষেত-খামারে কারখানায়।
    শুনেন শুনেন সভাজন।।
    কতক্ষণ শুনছিলাম মনে নেই। মেলায় ভীড় বাড়ছে। হ্যারিকেন, টেমি ও হ্যাজাকবাতি জ্বলে উঠছে। আমি অন্যমনস্ক।
    কাঁধে হাত পড়ল সমীরদার। চল লতা। আর দেরি হলে শেষ বাসটা পাব না।
  • সে | 188.83.87.102 | ০৯ নভেম্বর ২০১৪ ১৬:০৩650905
  • নেশা ধরে যাচ্ছে এই লেখটার।
  • সে | 203.108.233.65 | ১২ নভেম্বর ২০১৪ ১৩:৪৬650906
  • রঞ্জনদা কোথায় গেলেন?
  • ranjan roy | 132.176.8.199 | ১২ নভেম্বর ২০১৪ ২৩:৩৪650908
  • চড়কের মেলা গেল। এখন বৈশাখের মাঝামাঝি। রোদের তাপ বেশ বেড়েছে। মাঝে মাঝে বাউলে বাতাসে হাওয়া ঘুরপাক খায়।ধুলো শুকনো পাতা কাগজ পত্তর সব উড়িয়ে নিয়ে যায়। স্থানীয় মেয়েরা বলে এ হল অতৃপ্ত আত্মার কারসাজি, ছেলেখেলা।
    সমীরদা বলে-- দূর পাগলি! একে বলে চৈতালি ঘূর্ণি।
    দুপুরে মাঝে মধ্যে বাতাস পড়ে যায়। তখন কেমন পাগল পাগল লাগে। আঁচল দিয়ে নিজেকে হাওয়া করি আর ভরদুপুরে চাটাই পেতে আঁচল বিছিয়ে দোর বন্ধ করে আদুল গায়ে ঘুমনোর চেষ্টা করি।
    সাঁতার শিখিনি, তাই পুকুরে গেলে ঘাটের কাছে বুকজলে দাঁড়িয়ে গোটা কয় ডুব দিয়ে সাবধানে স্নান সেরে নেই। এই গাঁয়ের মেয়েরা কেমন জল ছিটিয়ে সাঁতার কেটে হৈচৈ করে স্নান করে। কেউ কেউ কলসী বুকে করে পা দাপিয়ে ভেসে বেড়ায়।
    কোথাও আমার বুকের মধ্যে একটা গোপন হিংসে চাড়া দিয়ে ওঠে।
    সমীরদা আজকাল ভারি ব্যস্ত। কোথায় কোথায় গিয়ে যেন বৈঠক করছে-- নির্বাচন বয়কট আরও কত কি!
    মাঝে মাঝে ঝারখন্ড এলাকায় ঢুকে দুমকার দিকের গাঁয়েও যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে বলছে-- তেন্দুপাতা সংগ্রহের মজদূরি বাড়াতে হবে। এতে নাকি ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে।
    দলের রাজ্য নেতৃত্ব খুশি। কমরেড সমীর এখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা জোনাল কমিটির নেতা। সব জায়গায় নাকি কমরেড সমীরকে চাইছে!
    আমি অতশত বুঝিনা। দল ওর মাসোহারা বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করেছে এতেই আমি খুশি। তবে এত বড় এলাকা জুড়ে কাজ করতে হচ্ছে বলে ও আজকাল মাঝে মধ্যেই রাত্তিরে ফিরতে পারে না।
    তবে আমাকে খবর পাঠিয়ে দেয়। কখনো দুমকা থেকে আসা বাসের কন্ডাক্টরের হাতে কোন চিরকূট, কখনো সেই ঝুঁটি বাঁধা বাউল মত লোক, আর কখনো আমাদের বড়কা কমরেড।
    এরা সবাই আসলে সন্ধ্যের মধ্যে আসে, নইলে পরে দিন সকালে। এসে দরজায় টোকা দেয়। থেমে থেমে, দুটো করে, তিনবার। আমি দরজার কাছে এসে কে শুধোলে ওরা নীচুগলায় বলে-- মা ঠাকরুণ আমি, বা দিদিভাই আমি।
    কিন্তু সেদিন রাত আটটায় দরজার শেকলে নাড়া পড়ল। ভাবলাম -- সমীরদা।
    কিন্তু বাইরে থেকে অচেনা গলায় -- বৌদি, আমি ডাক্তারবাবুর চিঠি নিয়ে এসেছি।
    আমি ভয় পেলাম। কিন্তু হ্যারিকেনের ফিতে উঁচু করে বললাম-- একটু দাঁড়ান!
    তারপর বাঁ-হাতে হ্যারিকেন উঁচু করে ধরে ডান হাতে কাটারি বাগিয়ে দরজা খুললাম।
    মাঝবয়েসী লোকটি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর গায়ে একটা পাতলা সূতির চাদর জড়ানো, বাঁহাতে খেঁটো লাঠি।
    ও বোধহয় আমাকে এই মূর্তিতে দেখবে আশা করেনি। চমকে এক পা পিছিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল-- ভয় পাবেন না, বৌদি। আমিও কমরেড। ডাক্তারবাবুর চিঠি নিয়ে এসেছি আর কিছু টাকা।
    আমি দরজা ছাড়ি নি।
    --- কিন্তু আপনি কমরেড এ'সময়ে কেন? আপনাদের ডাক্তারবাবুর তো কড়া নির্দেশ আছে রাত্তিরে দরজা না খুলতে! অন্যান্য কমরেডরা তো কেউ এ'সময়ে আসেন না?
    --- আপনি ঠিকই বলেছেন।নির্দেশ সেইরাকমই বটে। কিন্তু কি করব! সবকিছু অমন নিয়ম মেনে হয় নাকি! এই দেখুন না , বিকেলেই আসছিলাম। কিন্তু মেয়েটার প্রবল জ্বর, কোলে করে ডাক্তারখানায় নিয়ে যেতে হল। তাই দেরি হয়ে গেল।
    আমার গলার স্বর নরম হয়।
    --- এত তাড়াহুড়োর কি ছিল? সকালে আসতেই পারতেন।
    --- না বৌদি। ডাক্তারবাবু পইপই করে বলে দিয়েছেন যেন আজকের মধ্যেই এই পাঁচশ টাকা আপনার হাতে তুলে দেওয়া হয়। আপনার হাত নাকি একদম খালি। তাই।
    আমি এইবার গলে যাই। লোকটা আমার ভালোর জন্যেই এসেছে আর আমি কি না! আমার মনটাই দিন দিন ছোট আর সন্দেহপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে।
    --- ভেতরে আসুন।
    লোকটা আমাকে গুনে গুনে পাঁচশ' টাকা দেয়, নোটগুলো পুরনো , তা হোক গে।
    লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে। তারপর জর্দাখাওয়া কালো দাঁত দেখিয়ে হাসে।
    --- আচ্ছা, আপনি একা একা থাকেন, মানে বেশির ভাগ দিন, ভয় করে না?
    --উপায় কি?
    -- না, না। একদম ভয় পাবেন না। ডাক্তারবাবু না থাকলেও আমরা তো আছি। একদিন আপনাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। আসবেন কিন্তু!
    লোকটা চলে গেল।
    এমনিতে বিশেষ কিছু নয়। কিন্তু ওর তাকানো, কথা বলার ধরন, গলর স্বর আমার কেমন যেন লাগল। তবে সমীরদা ওকে বিশ্বাস করে, এতগুলো টাকা ওর হাত দিয়ে পাঠিয়েছে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন