এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বেঁচে আছিঃ প্রেমে-অপ্রেমে

    ranjan roy
    অন্যান্য | ০১ অক্টোবর ২০১৪ | ২৪০৪১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ranjan roy | 24.97.28.97 | ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৭:০৫651009
  • এক-দু'দিনের মধ্যেই সকালে উঠে চায়ের জল চাপিয়ে দেওয়াটা মানিকদার নিত্যকর্মের লিস্টিতে ঢুকে গেল। এছাড়া মাটিতে বাবু হয়ে বসে তরকারি কোটা, একটু ফাঁক পেলে এঁটো বাসনপত্তর মেজে ধুয়ে তুলে ফেলা এসব যেন উনি এ'বাড়িতে বহুদিন ধরে করেছেন।
    আমার ওজর-আপত্তি উনি মৃদু হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমার কাছে মুখ্য আকর্ষণ হল ওঁর গল্প বলা। উনি দারুণ সব গল্পের ভান্ডার, আর বলার কায়দাটাও তেমনই। খানিকটা আমার সেই ছেড়ে আসা বাংলাদেশি দিদিমার মত।
    আজকাল আমি সকাল সকাল রান্না করে ডিউটিতে চলে যাই। কিন্তু মনের মধ্যে কোথায় একটা কিছু হয়--কতক্ষণে সন্ধ্যে হবে, ডিউটি শেষ হবে, বাড়ি ফিরব, আর চায়ের কাপ নিয়ে গল্প শুনতে বসে পড়ব।
    এখনও আমাদের মূল রান্নাটা সকালেই হয়, ডাল-তরকারি। রাতে শুধু রুটি বা ভাত করতে হয়।
    তবে মানিকদা নিয়মিত চাল বেছে রাখেন। আমি ঘরে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে বাইরের পোষাক বদলাতে বদলাতে উনি হাসিমুখে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাজির করেন।
    এর মধ্যে সমীরদা আবার মহারাষ্ট্রে চলে যায়, ফিরে আসে দিন তিনেক পরে। বাড়িতে থাকি আমি আর মানিকদা। আমি খুব অস্বস্তিতে পড়ি। ঘর যে মাত্র একটা। মানিকদা অনায়াসে বারান্দায় শোয়ার প্রস্তাব দেন। আমি না করে দিই,।
    বর্ষা নেমেছে। এই শহরের বাইরে এবড়ো-খেবড়ো মাঠ, ঝোপ ঝাড়, নালা-নর্দমা। সাপ-বিচ্ছুর উপদ্রব খুব বেশি। শহরের সরকারি হাসপাতালে এন্টি-ভেনিন সিরাম নিয়মিত সাপ্লাই হয় না। অনেক ডাক্তার ঠিক করে এভিএস ইনজেক্শন দিতে পারেন না। ফলে করাত বা বোড়া কামড়ালে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম।আমি ডাক্তারবাবুর থেকে কার্বলিক এসিড এনে বাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে দিই। তবু ভয় থেকেই যায়।
    তাই আমরা ওই একটি ঘরেই শুই,-- আমি রান্নার জায়গাটার দিকের কোণায় আর মানিকদা দরজাটার দিকে। সাপ-বিচ্ছুর ভয়ে দরজায় আগল দিয়ে কপাটের নীচের ফাঁকে পুরনো খবরের কাগজ গোল করে পাকিয়ে গুঁজে দিই।
    আর কেউই লাইট নেভাই না। ওই একবাতি কানেকশন, গরীবের সম্বল। কোন বিল দিতে হয় না। আমার সম্মান বাঁচে। নিজের কাছে নিজে ছোট হই না। ভাল হোক কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংয়ের।
    আমি সারাদিন খাটা-খাটনির পর সহজেই নিজের কোনায় চাদর বিছিয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে পড়ি। মানিকদা একটু রাত অব্দি বই পড়ে তবে ঘুমোন। কখনও কখনও বিড়ির কটু গন্ধে টের পাই--জেগে আছেন।
    তবে আমাদের তো বাথরুম নেই, এ'পাড়ায় কারোরই নেই। আসলে এদিকের গাঁয়ে গঞ্জে এর চলনই নেই। ছোট-বাইরে, বড় -বাইরে সবই ঘরের বাইরে সারতে হয়। আর মাঝরাত্তিরে ছোট-বাইরে? সেটা সবাই নিজের নিজের দাওয়া থেকে নেমে ঘরের সামনে ধূলোবালিতেই মেরে দেয়। আমার প্রথম প্রথম অস্বস্তি হত, এখন সয়ে গেছে। তবু সাপের ভয়ে একটা পেন্সিল টর্চ মত জ্বালিয়ে নিয়ে আগল খুলে বেরই।
    কখনো কখনো টের পাই মানিকদা জেগে আছেন। হ্যাঁ, লজ্জার বোধটা চলে যায় নি।
  • de | 24.139.119.172 | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ১০:৫৮651010
  • মদনগোপাল এসে ভালো টইগুলোকে ডুবিয়ে দিচ্চে - তুলে রাখি!
  • সে | 188.83.87.102 | ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৮:৪৯651011
  • তারপরে কী হোলো?
  • asmita | 162.79.255.200 | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৩২651012
  • ছোট বাইরে করতে আরো কত দিন?
  • ranjan roy | 24.97.160.99 | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৮:৪৭651013
  • কিন্তু কোথায় কিছু একটা খটকা লাগছে। ও যেন আমার এই পড়ে পাওয়া দাদার আগমনে খুব একটা খুশি নয়।
    মহারাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে কোথায় বাড়িতে আসর জমিয়ে বসবে তা না একটা প্যাঁচামার্কা মুখ করে বসে থাকে।
    আমি যখন ওকে মানিকদার বলা গল্পগুলো আবার শোনাই তখন ও কোন উৎসাহ দেখায় না। হয় এক কাপ চা করে আনতে বলে নয় একটা বই নিয়ে তাতে মুখ গুঁজে দেয়।
    হল কি? ভদ্রলোককে তো আমি আনি নি; চিনিই না। ওই এনেছে; হ্যাঁ, দলের নির্দেশে। তবে? এই তবেটাই আমাকে কুরে কুরে খায়। পুরুষের যৌন ঈর্ষা? হবেও বা। কিন্তু সমীরদাকে এমন ভাবতে আমার খারাপ লাগে।
    একথা সত্যি যে মানিকদা ঘরে আছেন বলে আমি ও সমীরদা একটুও ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পাই নি। মাস দুয়েক হয়ে গেল। এই কমরেড দাদাটির যে ঘর থেকে বেশি বেরনো বারণ। পার্টিই বারণ করেছে। কেউ কিছু স্পষ্ট করে বলেনি। কিন্তু আন্দাজ করি উনি আন্ডারগ্রাউন্ড আছেন, হয়ত অন্য কোন রাজ্যে পুলিশের হুলিয়া বেরিয়েছে।
    -- বুঝলে লতা, তুমি হচ্ছ ভূমিসুতা।লাঙলের ফালে উঠে আসা বৈদেহী।
    --ঠিক বুঝলাম না দাদা।
    -- দেখ, সীতা কে জনক রাজা হলকর্ষণের সময় পেয়েছিলেন। এক পরিত্যক্ত শিশু, অসহায়। ঠান্ডা মাটিতে শুয়ে ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদছে। সেই শিশু কালে কালে বেড়ে উঠল। রাম তাকে জিতে নিলেন। আর রাম-অন্ত প্রাণ সীতা তাঁর সঙ্গে অনুগমন করলেন, বনে জঙ্গলে, রাক্ষসের রাজত্বে।
    এইবার তোমার কথাটা মিলিয়ে নাও। বাপ-মা পরিত্যাগ করল। অসহায় আশ্রয়হীন বাচ্চা মেয়েটিকে আমাদের কমরেড তুলে নিল। কৃতজ্ঞ মেয়েটি তাকে অনুগমন করে কোথায় না কোথায় গেল! হাড়কাটা গলি রাক্ষসরাজত্ব ছাড়া আর কি!
    আর আজ এই পর্ণকুটিরে রাজনন্দিনী সীতা!

    আমি ছাড়ি না।
    --কিন্তু দাদা, পুরোটা তো মিলল না। আমি শিশু নই; হ্যাঁ কেঁদেছি। তবে ওঁয়া ওঁয়া করে নয়। হাপুস হুপুস করে। আর আমার জন্যে স্বয়ম্বর হল কোথায়।
    -- হয় নি আবার! আরও সম্বন্ধ আসে নি? একের পর এক? বুড়ো-হাবড়া যাই হোক। আর দিদিমা যে বাংলাদেশি ধনী পাত্রের খোঁজ এনেছিলেন?
    --কিন্তু হরধনু ভঙ্গ?
    -কেন নয়? সমীর যে তোমার বাবাকে গিয়ে চমকালো? সেটা আমাদের সমাজে হরধনু ভাঙ্গার মতই।
    -- কিন্তু সীতা তো সসম্মানে অযোধ্যায় ফিরে গেলেন। রাজরাণী হলেন। আর আমি তো মেথরাণী। রাজ্যে ফিরে যাবার কোন চান্স দেখছি না। ও যেভাবে পার্টি নিয়ে মেতে আছে! এক যদি কো ভূতের রাজার বর পাই?
    -- হবে হবে; সব হবে। নিজের দেশে ফিরে যাবে। আমি বলছি। মনে কর আমিই ভূতের রাজা। আমি সব দেখে বলছি-- এ না হলে লীলে পোষ্টাই হয় না।
    -- ও আবার কি কথা!
    -- আমার নয়, ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের। মানে বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় না।
    --আপনি ঠাকুর, মানে ভগবান মানেন? আপনি না কমরেড?
    --- না, মানি না। কিন্তু উনি তো ঐতিহাসিক চরিত্র। বিশেষ কালখন্ডে এসে বাংলার ইতিহাসে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে গেছেন। সেটি অস্বীকার করার তো কোন কারণ দেখি না।
    -- যাই বলুন দাদা, অতশত বুঝি না। কিন্তু সীতার গল্পের সঙ্গে আমার গল্প পুরোপুরি মিলছে না।
  • ranjan roy | 24.97.160.99 | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৯:০৯651014
  • --কোন দুটো জিনিস পুরোপুরি মেলে না। মিলতে পারে না। এমন কি বিয়ের সময় যে তোমাদের গো-বলয়ে পাত্র-পাত্রীর ৩২ গুণ বা লক্ষণ মিলিয়ে দেখা হয় তার সবগুলো কি মেলে? ৩২ এর মধ্যে ২৭ কি ২৮ মিললেই রাজযোটক।
    সব তুলনাই তিন পায়ের উপর দাঁড়ায়, চার পায়ে নয়।
    -- এটা হেব্বি দিলেন দাদা!
    -- আরে আমার কথা নয়। মুজতবা আলী সায়েবের। তুমি চিনবে না। বাংলা সাহিত্যের বড় লেখক। শোন, রামায়ণ হল রূপক। এ'ভাবে ভাবলেই মিলটা চোখে পড়বে।
    --কিন্তু দাদা, রাম অশেষ গুণবান। মর্যাদা-পুরুষোত্তম। তবু লোকের কথায় কানাঘুষোয় সীতাকে গর্ভবর্তী অবস্থায় বনে পাঠালেন?
    এটা আপনি কি করে মেলাবেন?
    --মানে?
    --সমীরদা আর যাই হোক, কখনও অমন নিষ্ঠুর হবে না। আমার সঙ্গে অমন ব্যবহার করবে না। তাই আমার আর সীতা হওয়া হল না।
    এই বলে আমি হেসে উঠি।
    দাদা অন্যমনস্ক হয়ে যান। কিছু একটা ভাবতে থাকেন।তারপর যেন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে আমাকে দেখতে থাকেন। আমি অস্বস্তি বোধ করি।
    --কী হল দাদা?
    --শোন, রামের মুক্তবুদ্ধিকে আবিল করেছিল রাজা হিসেবে তার কর্তব্যবোধ, তার নিষ্ঠুরতা নয়। নইলে আর একটা বিয়ে করত, সীতার জন্যে কষ্ট পেত না।
    -- তাই কি? তাহলে বাল্মীকির সার্টিফিকেটে র পরও কেন সীতাকে আগুনে প্রবেশ করতে বললেন?
    -- আমি এ নিয়ে আজ আর কথা বলতে চাইনে, এ'প্রসঙ্গ থাক।

    কিন্তু আমার মাথা ঘুরতে থাকে। প্রজাদের কানাঘুষো? রাজধর্ম?
    না, সমীরদা কোন রাজা নয়। কিন্তু পুরুষের অহংকার? নিজেকে মহান দেখানোর লোভ? পার্টির নির্দেশ?
    মানিকদা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিলেন। এবার উঠে দাঁড়ালেন।
    --স্নান করতে যাচ্ছি। একটা কথা বলি।
    আমি পাগল ছাগল পথ হারানো মানুষ। আমার কথার কোন দাম নেই। তবু তোমায় আশীর্বাদ করি বোন, ভ্গবান না করুন, তোমার জীবনেও যদি অগ্নিপরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসে সেদিন যেন সীতার মতই অহংকারী পুরুষের সামনে বিদ্রোহে ফেটে পড়তে পারো! সীতার মতই।
    --সীতার মত? সীতা আবার কবে বিদ্রোহ করলেন? উনি তো পাতালে সেঁদিয়ে গেলেন!
    --ওটাই বিদ্রোহ! আদর্শ রামরাজ্যের গালে এক থাপ্পাড়, ত্রেতা যুগের নিরিখে। তুমি কলিযুগের সীতা। ব্যস্‌। আর কথা নয়।
  • ranjan roy | 24.97.23.196 | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ২২:৩৯651015
  • ৩)
    সেদিন সকালবেলা। তৈরি হয়ে ডাক্তারখানায় যাব বলে দাওয়া থেকে খালি নেমেছি, পথ আটকে দাঁড়াল দুজন --একজন বছর পনের ষোলর কিশোরী আর সঙ্গে ওর হাত ধরে আর একটি বাচ্চা ছেলে, বয়্স সাত-আট।
    বাচ্চাটা কেমন বোবা লেগে আছে, শুধু বড় বড় চোখে আমাকে দেখছে। আর মেয়েটা আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদছে।
    --- জলদি চলো সিস্টার বহিনি! মোর দাঈ মর জাহী। ওমন মোর দাঈ লা মার ডারি।
    (শীগ্রি চল নার্সদিদি গো! ওরা আমার মাকে মেরে ফেলল!)
    -- আরে কে তোরা? কোথায় থাকিস? তোর মাকে কারা মেরে ফেলবে?
    অনেক ছাড়া ছাড়া কথা, কান্নাকাটি ও হেঁচকির ফাঁকে যা বুঝলাম-- নিষাদপাড়ার বিধবা শনিচরিন বাঈয়ের জীবনসংকট। পাশের দুটো বাড়ির লোকজন ওকে খুঁটিতে বেঁধে বেধড়ক ঠ্যাঙাচ্ছে। ও নাকি ডাইন, দুটো বাচ্চা ও একটা জোয়ান পুরুষের রক্ত চুষে খেয়েছে!
    এই দুটো বাচ্চা মার সঙ্গে থাকে। শনিচরী লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে নিজের ও দুটো বাচ্চার পেট চালায়।
    আমার তো শুনেই মাথা ঘুরতে লেগেছে। কী করি কী করি করতে করতে ঘর থেকে ফার্স্ট এইড্‌ বক্স তুলে নিয়ে বললাম--চল্‌, তোদের মার কিছু হবে না।
    পেছন পেছন জামায় হাত গলাতে গলাতে মানিকদা ও বেরিয়ে এল।
    -- পা চালাও লতা! আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে।
    তাড়াহুড়ো করেও পায়ে হেঁটে দশ মিনিট লেগে গেল।
    নিষাদপাড়া পৌঁছে দুটো লাইনের পেছনে শনিচরীদের বাড়ি।
    কিন্তু ওদের বাড়ি অবদি যেতে হল না।
    প্রথম মোড়ের মাথাতে একটা বড় নিম গাছ। তার গায়ে পিছমোড়া করে বাঁধা একটি বছর চল্লিশের কালোকোলো ডাঁটো চেহারার মহিলা। তাকে ঘিরে জনা কুড়ি মেয়ে মদ্দ। সমানে তার গায়ে পড়ছে জুতোর বাড়ি, চটির বাড়ি। সবচেয়ে বেশি হিংস্র মেয়ের দল। কেউ কেউ ওর চুলের মুঠি ধরে মাথা ঠুকে দিচ্ছে। কেউ কয়েক ঘা বেলনের বাড়ি কষিয়ে দিচ্ছে।
    মেয়েটা কোন শব্দ করছে না, হয়ত শক্তিই নেই। ওর গায়ের কাপড় এলোমেলো। কষ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে আর মুখটা বীভৎস ভাবে খিমচে বা আঁচড়ে দেওয়া।
    পুরুষদের বেশিরভাগই তামাসা দেখতে জড়ো হয়েছে। অধিকাংশের চোখ ওর উদোম বুকের দিকে। তবে দু-একজন গায়ে হাত তুলতেও ছাড়ছে না।
    মেয়েদের উগ্র গালাগালির স্রোত বয়ে চলেছে। বেশির ভাগই এই মেয়েটির মৃত্যু কামনা করছে।
    আমি হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে ওঠার আগেই একটি মেয়ে ঘরের ভেতর থেকে কাঠকাটার কুড়ুল নিয়ে তেড়ে এল।
    আমি বিপদ বুঝে দৌড়ে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরলাম। ধস্তাধস্তি করে টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে ছিটকে পড়েছি। এবার তো ও কুড়ুল দিয়ে বন্দী মেয়েটির মাথা দু-ফাঁক করে দেবে!
    কিন্তু আমি যে বাচ্চাদুটোকে কথা দিয়েছি ওদের মার কিছু হবে না!
    হামাগুড়ি দিয়ে পাশে সরে উঠে দাঁড়াতে দেখি মানিকদা! কেড়ে নিয়েছেন কুড়ুলটা।
    গর্জন করে উঠেছেন,-- হট যাও, মুহল্লেওয়ালোঁ! ছোড়ো ইস লড়কিকো। ইয়ে মর জায়েগী তো তুম সব ফাঁসি চড়োগে।
    আমি গায়ের ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলি--ইতনে লোগ খাড়ে খাড়ে তামাশা দেখ রহেঁ হো! কিসী নে ইয়ে পাগলপন কো রোক নে কোশিশ নহী কী? কায়র লোগ!
    কয়েকজন আমাকে চিনতে পেরে এগিয়ে আসে,-- এ সিস্টারবাঈ, তুম বিচ মেঁ মত পড়ো! ইয়ে অপনী নিজী মামলা হ্যায়। তুম জাও ইহাঁ সে।
  • সে | 188.83.87.102 | ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৮651016
  • কোনো মন্তব্য করা যায় না।
  • de | 24.139.119.172 | ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ১৬:৩৭651017
  • সত্যি!
  • asmita | 162.79.255.200 | ২০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৪:১৫651019
  • তারপর?
  • ranjan roy | 24.99.237.37 | ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ২৩:০৯651020
  • --- কাহে কী নিজী মামলা? বীচ সড়ক পর এক অউরত কো সব মিলকে পিট রহে অউর বাকি লোগ খড়ে খড়ে তামাশা দেখ রহে--- ফির নিজী মামলা? এইসা হী হ্যায় তো অপনা ঘরকে অন্দর যাও।
    এবার এগিয়ে আসে মেয়ের দল।
    --- ক্যা কর লোগে তুম?
    --- দেখতে যাও। সবসে পহলে ইস বেসহারা কো অসপাতাল লে জাউঙ্গী। অউর তুম সবকো পোলিস বুলা কর অন্দর করাউঙ্গী, অউর জিন মর্দলোগ খড়ে হোকর সবকো উকসা রহে থেঁ উন সব কো ভী।
    মানিকদাকে বলি-- ভাইয়া, যাইয়ে, জলদি পোলিস বুলাইয়ে।
    কী আশ্চর্য! মানিকদা কেমন থিতিয়ে গেলেন, এক পা নড়লেন না।
    এই অবস্থায় ভীড় একটু সাহস ফিরে পায়।
    -- যা যা! বুলা লে পোলিস বাপ কো! হম লোগ ভী বতায়েঙ্গে!

    আমি এই সব ধমকী তে একটুও বিচলিত হই নি। বলি--
    ক্যা বতাওগী? এক বেসহারা অউরতকো মার রহে হো, জিনকে ছোটে দো বিটিয়াঁ হ্যাঁয়।
    তোমাদের লজ্জা করে না? ও কী করেছে?
    -- কী করেছে! সেটা আগে জেনে নাও। ওই বেওয়া শনিচরিন হল ডাইন, যে পুরুষের দিকে তাকায় তার বুকের রক্ত শুকিয়ে যায়। সে ফ্যাকাশে হয়, জ্বরে পরে, তারপর মরে যায়।
    --- যত্ত গাঁজাখুরি গাল- গল্প। কার রক্ত চুষে খেয়েছে?
    --- আগে সবটা শোন তো নার্সদিদি! আমাদের পুন্নি,চারপাড়ার। ওর স্বামী মহেত্তর, হাট্টাকাট্টা সাজোয়ান, এই গোঁফ। দিব্যি কারখানায় মাল বইতো, লোডার না কি বলে।
    এই ডাইনি ওকে তুক করে, কিছুদিন ধরে ও সাঁঝের বেলা ওই ডাইনের ঝোপড়ির আশে পাশে ঘুর ঘুর করছিল--সবাই দেখেছে। পতি-পত্নীর মধ্যে এ নিয়ে ঝগড়াও হয়েছে।
    তারপর মাসখানেক হয় নি, মহেত্তর দুবলা হতে লাগল। ক্ষিদে কমে গেল। সারা শরীর হলদেটে , গায়ে জ্বর। গতকাল মারা গেছে।
    -- ধ্যেৎ, মহেত্তর তো আগে আমাদের ডাক্তারখানায় এসে্ছিল। আমাদের ডাক্তারবাবুই ওকে সরকারি হাসপাতালে যেতে বলেছিলেন। ওর পীলিয়া হয়েছিল। জল খারাপ হলে হয়। এবার বৃষ্টি হতে দেরি হয়েছিল। আর ওদের কাজের জায়গায় গন্দা পানি।
    ও বোধহয় সরকারি হাসপাতালে যায় নি, তাহলে বেঁচে যেত।
  • ranjan roy | 24.99.90.49 | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৬:০০651021
  • ওরা একটু থমকে যায়।
    কিন্তু একটি মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে এগিয়ে আসে। বলে-- সব মিথ্যে কথা। এই সিস্টারবাঈ ডাইনকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। ওর ডাক্তার আমার স্বামীকে সরকারি হাসপাতাল দেখিয়ে দিল। সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম ওদের ওষুধে খালি জ্বর বন্ধ হয়েছিল। কমজোরি হওয়া আর ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া সারে নি। তখন নয়াগাঁওয়ের বৈগা ফিরতরামকে ডেকে আনলাম। ভৈরোঁ বাবার থানে কালী মূর্গার বলি দিলাম। তিন বোতল মহুয়া দিলাম আর একশ' টাকা।
    ও গুনে বলল যে ডাইন তুক করেছে। তাই আমার স্বামী দুবলা হয়ে যাচ্ছে, রক্ত টেনে নিচ্ছে। ওষুধ কাজ করছে না। আর তিনদিনের মাথায় ও মরে গেল।
    আজ আমার ঘর ভাঙল। কাল তোমাদের কারও কপাল পুড়বে। তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে?
    ব্যস্‌, আগুনে ঘি পড়ল যেন।
    একধাক্কায় আমাকে সরিয়ে দিয়ে জনাদশেক উন্মত্ত মহিলা ঝাঁপিয়ে পড়ল শনিচরিনের উপর। অশ্রাব্য গালির সঙ্গে মার।যে যেমন পারছে, হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই দিয়ে। গাছের ভাঙা ডাল, আধলা ইঁট--যা হোক।
    আমি হতভম্ব; কেঁদে ফেলি। বাংলায় চেঁচিয়ে উঠি-- ও মানিকদা, শীগগির থানায় যান। পুলিশ ডেকে আনুন। দেরি করলে মেয়েটা মরে যাবে।
    কিন্তু ওনার পা যেন সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো।
    হটাৎ চোখে পড়ে পবন। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে। সমীরদার সঙ্গে আমার ঘরে এসেছিল। স্থানীয় শ্রমিক। লড়াকু।সমীরদার মতে অনেক সম্ভাবনা আছে।
    আমি দৌড়ে গিয়ে ওর সামনে হাত জোড় করি।
    ---কমরেড, সাইকেল নিয়ে যান। পুলিশ নিয়ে আসুন। নইলে মেয়েটা মরে যাবে।
    ও এক মুহুর্ত আমাকে দেখে। তারপর কোন কথা না বলে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা সাইকেলগুলোর একটা নিয়ে বেরিয়ে যায়।
    আমি এবার মেয়েটার দিকে তাকাই। উন্মত্ত জনতা ওকে মাটিতে পেড়ে ফেলেছে। গায়ের কাপড় শতচ্ছিন্ন।
    এবার মেয়েদের সঙ্গে কিছু পুরুষও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দুজন আমাকে ধরে ফেলে, হাত পেছনে মুচড়ে দেয়। আমি প্রাণপণে একটাই বাক্য বলতে থাকি-- উসকো অসপাতাল লে চলো। ভাইয়ামন! দাঈ-দাদামন! উসে লে চলো।
    একটা বড় পাথর।মাথার উপর তুলে ধরে একজন এগিয়ে আসছে। মাপা পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে মাটিতে পড়ে থাকা নারীটির অর্ধচেতন শরীরের দিকে। বিড় বিড় করছে-- হারামজাদী ডাইন! আপন আদমী লা খায়েহস্‌, মোর বেটা লা খায়েহস্‌, আজ তোর গন্দে খেল খতম। তোর কালা জাদু কী আখরী দিন।
    আমি বুঝতে পারি কী হতে যাচ্ছে। আমার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোয় না। কিন্তু কিন্তু এই লোকটাকে যে আমি চিনি!
    চোখের সামনে একটা কালো পর্দা নেমে আসে।
  • adhuli | 190.148.69.210 | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৬:৩২651022
  • হায় আমাদের শাইনিং ইন্ডিয়া। রঞ্জন-দা, ইন্ডিয়া থেকে ভারত যে এত দুরের দেশ, এই লেখাগুলো থেকে বুঝতে পারি। এই দুরত্ব ঘুচে যেতে আরো কত-শ বছর লাগবে কে জানে-?
  • ranjan roy | 24.99.147.42 | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৬:৪১651023
  • ৪)
    কেমন তাড়াহুড়ো করে কেটে গেছে দুটি মাস।
    শীতের শেষ। আমার খালি মনে পড়ে সেই মাইনিং টাউনশিপে পাশের বাড়ির মন্ডলদাদুর ছড়া। উনি আমাদের ঋতুচক্র শেখাতে এটা বলেছিলেন।
    আমরা স্কিপিং করতে করতে এমনি ছড়া কাটতামঃ
    " গ্রীষ্ম গেল, বর্ষা এল, শরত,হেমন্ত;
    সবার শেষে আসবে জানি-শীত-বসন্ত।"
    কিন্তু আমার জীবনেও ঘটনা ঘটে চলেছে একস্প্রেস ট্রেনের গতিতে।
    মানিকদাকে চলে যেতে হয়েছে। দলের নির্দেশ।তার জন্যে আমিই নাকি দায়ী!

    আসলে সেই নিষাদপাড়ায় গণপ্রহারে শনিচরিন এর মারা যাওয়াটা কেউই ঠিক ভাবে নেয় নি।
    সবার আলাদা আলাদা কারণ।
    কেন বাঁচনো গেল না শনীচরিন বাঈকে? কেন পুলিশ সময়মত আসে নি? কেন কেউ নামজদ এফ আই আর করে নি? কেন পরে পুলিশ এলে একটাও সাক্ষী পাওয়া গেল না? কেন আমি ওই বাচ্চাদুটোকে কথা দিয়ে রাখতে পারলাম না?
    এইসব প্রশ্নগুলো আমাকে প্রায় পাগল করে দেয়!
    আমি অনেক খোঁজ খবর করে যা জানতে পেরেছি তা হলঃ
    এক, মানিকদা আমার শত অনুরোধেও নড়লেন না। উনি থানায় সময়্মত গেলে হয়ত মেয়েটাকে বাঁচানো যেত! কেন গেলেন না?
    সমীরদা আমাকে পরে বলেছিল-- উনি কি করে যাবেন? ওনাকে তো পুলিশ খুঁজছে। অন্য রাজ্যে ওর বিরুদ্ধে অনেকগুলো ধারায় মামলা চলছে। উনি দলের নির্দেশে বেইল জাম্প করে আন্ডারগ্রাউন্ড রয়েছেন

    দুই, কমরেড পবন সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু কেন পুলিশ এল না? সমীরদা বলল-- কেন এল না সেটা পুলিশই ভাল বলতে পারবে। হয়ত বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের পুলিশ গরীব মেয়ের জন্যে কোনকিছু ফিল করে নি। ব্যাপারটা একজন দলিত মহিলার সঙ্গে ওদের পাড়াপড়শির বিবাদ ভেবে নাক গলায় নি। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলে---।
    কিন্তু আমি জেনেছি -এটা সত্যি নয়।আমি অনুরোধ করায় কমরেড পবন সাইকেল নিয়ে রওনা দিয়েছিল বটে, কিন্তু থানায় যায় নি।
    গিয়েছিল পার্টি অফিসে। আর পার্টি ওকে এ নিয়ে থানাপুলিশ করতে বারণ করে। কারণ কমরেড মানিকের নিরাপত্তার প্রশ্ন।
    এই খবরটা আমাকে পাগল করে দেয়। কিন্তু সমীরদা ব্যাপারটা এভাবে দেখছে না। ওর মতে ঘটনাটা অত্যন্ত দুঃখের। কিন্তু কিছু করার ছিল না।
    --- ছিল না মানে? তোমাদের দলের কোন নৈতিক দায়িত্ব নেই? ওই মেয়েটির মৃত্যু তোমাদের কাছে একটা "ভেরি স্যাড্‌ ইনসিডেন্ট", ব্যস্‌? কী বলছ কি?
    সমীরদা একটু থতমত খায়।
    --শোন লতা; এই ধরনের ঘটনা এই শ্রেণীবিভক্ত সমাজে আগেও ঘটেছে, পরেও ঘটবে, যতদিন না সমাজ শোষণমুক্ত হয়। আর আমাদের লড়াই সেই লক্ষ্যেই।
    কিন্তু আমরা এইঅব্স্থায়, মানে আন্ডারগ্রাউন্ড অব্স্থায় নিজেদের সামনে আনতে পারব না। এটা আমাদের মজবুরি ধরে নাও। এখানে আমাদের বেস্‌ এখনো কাঁচা, মাত্র গড়ে উঠছে। এটাকে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। তাই পার্টি, মানে মানিকদা ও কমরেড পবন, পুলিশের কাছে না গিয়ে ঠিক করেছে।
    এই মৃত্যুর জন্যে পার্টির কোন নৈতিক দায়িত্ব নেই।এর আসল দায় আল্টিমেটলি ওই বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের।
    ---- আর আসল খুনি? পাথর হাতে উন্মাদ ওই লোকটা? ওকে তো আমি ভাল করে চিনি। পুলিশের কাছে নাই গেলে, কিন্তু তোমরা তো ওকে শাস্তি দিতে পারতে?
    চমকে ওঠে সমীরদা।
    --- কার কথা বলছ? কাকে চিনেছিলে?
    -- কথা ঘুরিও না, সমীরদা। পুলিশ না আসুক, সময়মত হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়ত মেয়েটা বেঁচে যেত। কিন্তু তখনই যে লোকটা গালাগাল দিতে দিতে তেড়ে এসে ভারী পাথর দিয়ে ওর মাথাটা কুচলে দিল সে তো তোমাদের দলের সমর্থক ওমপ্রকাশ নিষাদ। আমি ঠিক চিনেছি কারন ওই তো তোমাদের কথায় আমাকে ডাক্তার কুমারের কাছে নিয়ে গেছল, নার্সের চাকরিটায় লাগিয়ে দিয়েছিল।
  • সে | 188.83.87.102 | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৭:১১651024
  • চেনা প্যাটার্ণ। খুব পরিচিত ভারতবর্ষ।
  • sch | 192.71.182.106 | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ১৬:৪০651025
  • রঞ্জন-দা - এই লেখাটা পড়ে আবার আমার বিশ্বাসটা ভ্যালিডেট করলাম - মানুষ দু'রকমের হয় - সৎ আর অসৎ। এছাড়া আর সব দল, মত, গোষ্টী সংক্রান্ট ক্লাসিফিকেশান/এফিলিয়েশান অবান্তর
  • sm | 69.177.110.96 | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ২০:৪৯651026
  • রঞ্জন বাবু লিখছেন না কেন, জানাবেন।
  • সে | 188.83.87.102 | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ২১:১২651027
  • ভেরি ব্যাড রঞ্জনদা। লেখা কই?
  • ঐশিক | 24.140.33.186 | ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ ১৫:৩১651028
  • সচ দা/দি Date:26 Dec 2014 -- 04:40 PM র সাথে এক্কেরে একমত, রঞ্জন দা এভাবে ঝুলিয়ে রাখার কোনো মানে হয়?
  • ranjan roy | 24.96.86.188 | ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১651030
  • লেখাটা মনে মনে একটু সাজিয়ে নিচ্ছি। আর ২৮/২৯ জমসেদপুরে ছিলাম। কাল সক্কালে লিখবো।
  • ranjan roy | 24.99.176.171 | ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ ১৪:১২651031
  • সমীরদা একটু ভাবে। তারপর বলে--এই জায়গাটা আমার কাছেও বড় যন্ত্রণার লতা। কিন্তু কি করা যাবে? আমাদের দলে কালেক্টিভ ডিসিশন বড়। আমার একার কথায় কিছু যায় আসে না।
    আর এই শ্রমিক ওমপ্রকাশ। সত্যি সত্যি ওর বাচ্চাটা হটাৎ মারা যায়।কেমন একটা জ্বর হয়, ঘাড়টা কেৎরে কেৎরে যায়। কোন ওষুধ ধরে না। মারা গেলে বঈগা এসে গুনে বলে যে ওই শনিচরিন বাঈ ডাইনি ওকে খেয়েছে। তাই ও রাগে-দুঃখে পাগল হয়ে গেছল।
    --- তুমিও এসব বিশ্বাস কর ? শনিচরিনকে ডাইনি ভাব?
    -- না; একেবারেই না। কিন্তু আমার বিশ্বাসে কি আসে যায়? আমাদের পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ সমাজে সাধারণ খেটে খাওয়া শোষিত বঞ্চিত মানুষ ভাগ্যবাদী হয়। অদৃষ্ট মানে, নিয়তি মানে। শোষণের আসল চেহারাটা দেখতে পায় না, ওদের দেখতে দেওয়া হয় না।
    --ওসব বড় বড় কথা ছাড়। সব মেনে নিয়েও তোমাদের লড়াকু মজদুর ওমপ্রকাশ একজন খুনী, এক অসহায় মেয়েমানুষের হত্যারা! তোমরা কিছু করবে না?
    --- তুমি বুঝতে পারচ না, লতা। ও হল ফলস্‌ কনশাসনেস এর শিকার। ও মনে করছে না যে ও খুন করেছে, তাহলে তো এভাবে মারতই না। ও এত কাপুরুষ নয় যে এক বেসহারাও অওরতকে মেরে ফেলবে। আসলে ও তো ডাইনিকে মারছে, কোন মেয়েমানুষকে না। ও ভাবছে এক অশুভ পিশাচ শক্তিকে ও বধ করছে, দেশের ও দশের ভালো করতে, পুণ্যের কাজ করছে।
    -- তাহলে তোমার চোখে ও খুনি নয়, সমীরদা? কিন্তু শনিচরিন বাঈ যে মরেছে এটা তো সত্যি! কে মারল তাকে? বা কী করে ওর মৃত্যু হল?
    --- দেখ লতা। আইনও কোন সাময়িক উন্মাদনার বশে কেউ কাউকে হত্যা করলে খুনির সাজা দেয় না। অন্য ভাবে ডীল করে।
    -- চমৎকার! তাহলে তোমরা ঢাকঢোল বাজিয়ে কমরেড ওমপ্রকাশকে মানপত্র দিয়ে ঘটা করে সম্বর্ধনা দিচ্ছ না কেন?
    --এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে! কখন বলেছি যে ওমপ্রকাশ খুব ভাল কাজ করেছে? পার্টি এটাকে জনগণের অভ্যন্তরীণ কন্ট্রাডিক্শন হিসেবে দেখছে। তাই আমরা ওমপ্রকাশের জন্যে বিশেষ পার্টি ক্লাসের ব্যব্স্থা করেছি। ওকে স্বচ্ছ ভাবে বোঝাতে হবে।
    --কেন?
    -- দেখ , দুটো মৃত্যুই দুঃখের। শনিচরিন বাঈয়ের এবং ওমপ্রকাশের বাচ্চার।
    -- দুটো মৃত্যুর কারণ কি এক?
    সমীরদার চোখ হেসে ওঠে।
    --- এক হিসেবে এক,-- দুটো মৃত্যুরই কারণ অজ্ঞাত।
    আমি রাগে চিৎকার করে উঠি।
    --না-আ-আ!
  • সে | 188.83.87.102 | ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ ১৫:০০651032
  • জ্জিও!
  • ranjan roy | 24.99.176.171 | ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ ১৭:০৩651033
  • সমীরদা ঘাবড়ে যায়।
    --কী হল? অমন চেঁচিয়ে উঠলে কেন?
    --- হ্যাঁ, দুটো মৃত্যুই এক, কিন্তু কারণটা একেবারে আলাদা।
    --কীরকম?
    --- দুটোরই কারণ আমরা জানি, কিন্তু স্বীকার করতে চাইছি না। সে সাহস নেই।
    --- কী যা তা বলছ! যদি ধরেও নেই যে শনিচরিন বাঈয়ের নির্মম মৃত্যুর কারণ আমরা দুজনেই জানি, কিন্তু অন্যটা? বাচ্চাটার?
    -- সেটাও জানি।
    --আচ্ছা, তুমি জান? ডাক্তাররা ধরতে পারেনি আর তুমি ধরে ফেললে? ইন্টারেস্টিং! ঝেড়ে কাশ দেখি।
    --- বলছি। আচ্ছা তার আগে তুমি বল। তোমার কী মনে হয়? ওমপ্রকাশের বাচ্চাটা কেন মারা গেল?
    --আমার মনে হয় কোন ইনফেক্শন, তার থেকে জ্বর; চিকিৎসার গাফিলতিতে ম্যালিগন্যান্ট দাঁড়িয়ে গেল। ভাল ডাক্তার হলে ধরতে পারত।কিন্তু ওই হাতুড়ে ডাক্তার কুমার পারেনি।
    কিন্তু তুমিও তো ওই হাতুড়ে ডাক্তারের হাতুড়ে নার্স! ডবল হাতুড়ে। তুমি কী বলতে চাও?
    --- আচ্ছা, ওর সিমটমগুলো আবার বল দেখি, জোরে জোরে বলতে থাক।
    -- জ্বর; বারবার কেৎরে কেৎরে ওঠা। প্যারাসিটামলে কোন কাজ না হওয়া। এবার বল কী বলবে।
    -- আর একটা কথা বল। তোমাদের ওই হত্যারা , থুড়ি সাময়িক উন্মাদ কমরেড ওমপ্রকাশ কি কখনো এদিক সেদিক যেত?
    -- মানে?
    -- মানে রেড লাইট এরিয়া আর কি! যেত কি?
    --- তাতে কী?
    -- আঃ সোজাসুজি বল-- হ্যাঁ কি না?
    -- হতেও পারে। আসলে ওরা এটা কে খুব বেশি পাপ-টাপ মনে করে না। বৌকে ঠ্কানোও না। এই যেমন হপ্তা পেলে একদিন বাইরে মদ গিলে আসা বা চিকেন বিরিয়ানি খাওয়া গোছের। তাতে কী হল?
    -- হয়েছে। ওই কেৎরে কেৎরে ওঠা, জ্বর, প্যারাসিটামল কাজ না করা-- এগুলো সিফিলিসের জ্বরের লক্ষণ।
    --কী বলছ কী লতা? তুমি পাতি হাতুড়ে নার্স, তুমি কী করে এইসব জোর দিয়ে বলতে পার?
    -- ভুলে যাচ্ছ আমার বাবা সেই খনি শহরের নাম করা হোমিওপ্যাথ। সন্ধেবেলা ঘরে রোগি দেখতেন। তোমার মায়ের জন্যে তুমিও আমাদের বাড়িতে ওষুধ নিতে এসেছিলে। সেই প্রথম আমাকে দেখলে। আর এটা তো জান যে আমার ছোটবেলা থেকেই নার্স হওয়ার শখ। আসলে চাইতাম ডাক্তার হতে। সাহস করে বলতে পারিনি। গরীবের ঘোড়া রোগ!
    কিন্তু বাবা আর রোগীদের কথাবার্তা হাঁ করে গিলতাম। এইটে পড়ার সময় থেকেই লুকিয়ে বাবার জাবদা খাতায় লেখা নোটস পড়তাম। মারও খেয়েছি।
    এইরকমই কেস ছিল একটা। ওই লক্ষনগুলো দেখে বাবা বললেন-- কিছু মনে করবেন না , আপকী বাচ্চী কী জিন্দগি কী সওয়াল। কখনো গিয়েছিলেন বা এখনো যান? আপনার শরীরের বিষ ওর শরীরের কোষে।
    বাবা ওষুধ দিলেন সিফিলিটিকাম, কত পাওয়ার জানিনা। বাচ্চাটা বেঁচে গেল।
    সাহস থাকলে পার্তির শুদ্ধিকরণ ক্লাসে ওমপ্রকাশকে বুঝিয়ে দিও -- বাচ্চাটা মরে গেছল কার পাপে!
  • সিকি | 135.19.34.86 | ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ১৪:২৪651034
  • এইখানে একটা ব্রেক বনতা হ্যায়। কিন্তু কৌতূহলটাও আরও বেড়ে যাচ্ছে। ও রঞ্জনদা ...
  • ranjan roy | 24.99.165.178 | ০২ জানুয়ারি ২০১৫ ২০:৫৫651035
  • ৫)
    না, কমরেড ওমপ্রকাশের সঙ্গে ওর বাচ্চা মেয়ের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ নিয়ে কথা বলার সাহস কারও হয় নি, সমীরদারও না।
    অজুহাত অনেক। সবচেয়ে বড় অজুহাত এ নিয়ে কোন ডাক্তার কিছু বলে নি। আর আমি তো হাতুড়ে নার্স। আমার কথার ভিত্তিতে কাউকে অমন করে বলা?
    বুঝতে পারি, আসল কথা হল ওমপ্রকাশকে কেউ চটাতে চায় না, সে এই এলাকায় জমিন থেকে উঠে আসা সংগঠক,লড়াকু মজদুর। ওর ওপর ভরসা করে এখানে সংগঠন গড়ে উঠছে। আজ ওকে চটালে এখান থেকে দলের বিদায় নিশ্চিত। তাই অপ্রিয় সত্য বলা যাবে না।
    সমীরদা এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে রাজি হয় নি। বলে-- কোন প্যাথোলজিক্যাল টেস্ট রিপোর্ট ছাড়া, ডাক্তারের ওপিনিয়ন ছাড়া এ নিয়ে কথা বলার কোন মানে হয় না। তুমি প্যারানয়েড হয়ে যাচ্ছ লতা।
    কিন্তু কোথাও কিছু একটা হয়েছে। আমি কথা তোলায় দলের ভিতরে কিছু আলোচনা হয়েছে। ফলটা আমার জন্যে ভাল হয় নি।
    আগের অনেক কমরেডদের আমাদের ঘরে আসা কমে গিয়েছে। অল্পবয়সী কমরেড পবন আমাকে রাস্তায় দেখলে এড়িয়ে চলে। আর সমীরদার ভিতেরেও একটা অস্বস্তি, একটা ছটফটানি।
    আর আমি যে শনিচরিনের মৃত্যু ভুলতে পারছি না। ওর দুটো ছোট ছোট বাচ্চা? খোঁজ করে সংক্ষিপ্ত জবাব পেয়েছি -- মামাবাড়ি থেকে কেউ এসে নিয়ে গেছে। কোথায় সেই মামাবাড়ি? কেউ জানে না।

    কী করব? ভাবলাম সমীরদাকে বলি যে তুমি অন্য কোন জেলায় পার্টির কাজ নাও, আমি কোন না কোন গ্রাম্য ডাক্তারখানায় নার্সের কাজ পেয়ে যাব। যা কাজ শিখেছি তাতে সেটুকু ভরসা হয়েছে।
    সমীরদা জবাব দেয় নি, কিন্তু কিছু একটা ভাবছে সেটা বুঝতে পারি। ওর ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে।
    বেশির ভাগ সময় বাইরে বাইরে কাটায় আর রাত্তিরে ফিরে এসে একটা কথাও না বলে চুপচাপ খায়। আঁচিয়ে নিয়ে বাইরে গিয়ে বিড়ি ধরায়। ঘরে এসে বই পড়ে। কিছু বললে হুঁ-হাঁ করে জবাব দেয়।
    আমি ক্লান্ত হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ও কখন শুতে আসে টের পাই না।
    কখনো ঘুমের মধ্যে ওর গায়ে হাত ঠেকলে যদি টের পায় তো ঠেলে সরিয়ে দেয়।
    ব্যাপারটা বাড়তে বাড়তে অসহ্য হয়ে উঠল। একদিন ঠিক করলাম হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব।
    রাত্তিরের খাওয়ার পর যখন বিড়ি ধরাচ্ছিল তখন বললাম--ঘরের বাইরে যেও না, কথা আছে।
  • ranjan roy | 24.99.165.178 | ০২ জানুয়ারি ২০১৫ ২৩:১০651036
  • ও একবার তাকিয়ে দেখল। বিড়িটা নিভিয়ে এদিক ওদিক কেমন শূন্য দৃষ্টিতে দেখল। তারপর এসে আমার সামনে বসল।
    -- বোসো। এদিকে এসে বিছানায় ভাল করে পা তুলে বোসো।
    ও কেমন যন্ত্রচালিতের মত এসে আস্তে আস্তে বিছানায় বসে পড়ল।
    আমি একটা খবরের কাগজ তুলে হাওয়া করতে করতে বললাম-- কী হয়েছে?
    --- কিসের কী হয়েছে?
    --- সেটা তুমিই ভাল বলতে পারবে।
    --- বাজে কথা।
    -- তাহলে কাজের কথাটাই বলে ফেল। উসখুশ কর না। আর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল।
    --- কী বলব?
    -- যে কথাটা বলতে চেয়েও বলতে পারছ না। আমাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলছ। বলেই ফেল। আমাকে দয়া করতে হবে না।
    --- আরে সেরকম কিছু না!
    -- না মানে? তোমার পেট ফুলে আইঢাই করছে, ঠিক করে খাচ্ছ না, ঘুমোতে পারছ না। তোমার সঙ্গে ভালয়-মন্দয় প্রায় তিনবছরের মত কাটিয়ে ফেললাম। তোমাকে হাতের পাতার মত চিনি সমীরদা। তুমি মিথ্যে কথাটাও ভাল করে বলতে পার না। আমাকে নিয়ে তোমাদের কিছু হয়েছে?
    --- না, ঠিক তোমাকে নিয়ে নয়। হ্যাঁ, খানিকটা তোমাকে নিয়েও।
    -- তাহলে লুকোচ্ছ কেন? আমাকে নিয়ে যখন আমার তো জানা উচিৎ।
    -- তা তো বটেই।
    -- আমার জন্যে তোমাদের অসুবিধে হচ্ছে? সেই শনিচরিনের বীভৎস মৃত্যু ? বা ওমপ্রকাশের বাচ্চাটা?
    --- হ্যাঁ। সেটাই।
    -- তো আমাকেও পার্টির শুদ্ধিকরণের ক্লাস অ্যাটেন্ড করতে হবে? আমি তো তোমাদের দলের সদস্য নই।
    সমীরদা চুপ করে থাকে।
    -- কী হল? বলে ফেল।
    --- না, আমাকে বলা হচ্ছে তোমাকে ছেড়ে দিতে।
    -- মানে?
    -- মানে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করতে, ডিভোর্স দিতে।
    --- ও! আমি যদি ডিভোর্স না দিই? কী করবে? কী করতে পার তোমরা?
    সমীরদা চুপ করে থাকে। অসহায়ের মত এদিক ওদিক তাকায়। দুহাতের পাতা ঘষতে থাকে।
    কী আশ্চর্য! আমার একটুও ভয় করছে না, শক লাগছে না, কান্না আসছে না। তাহলে কি আমি এই পরিণতির জন্যে মনে মনে তৈরি হয়েছিলাম? নিজের অগোচরে?
    এবার আমি হেসে ফেলি। আমার পেটের ভেতর থেকে কুলকুলিয়ে হাসি উঠে আসছে।
    -- আরে, আরে! অমন করুণ মুখ চেহারা কেন? তোমাকে বিপদে ফেল্ব না; ব্ল্যাকমেইল করব না। তুমি যদি চাও তো ডিভোর্স দিয়ে দেব,একবাক্যে! কিন্তু তুমি কী চাও?
    --- না, আমি চাই না। লতা, তোমাকে ছাড়ার কথা ভাবতে পারিনে।
    -- বেশ, আমাকে তালাক দেওয়ার কথা উঠল কেন? মতে মেলেনি তাই?
    --- না, বলা হচ্ছে যে তোমার মত পার্টনারের জন্যে আমার বিপ্লবী বিকাশ থমকে গেছে। আমার নাকি কাজে আগের মত উৎসাহ নেই। আর তুমি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ, তোমার সংযম নেই, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই।
    ওই ঘটনায় তুমি আবেগের বশে পুলিশ ডাকার কথা বলে আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড সেট আপকে বিপদে ফেলে দিয়েছিলে। আত্মস্মালোচনা করার বদলে তুমি কমরেড ওমপ্রকাশের বিরুদ্ধে উলজলুল ক্যাম্পেন করছিলে। আজকাল তুমি আমাদের সংগঠনের জন্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছ।
    -- ব্যস্‌? এইটুকুই?
    --- প্রায় তাই। এছাড়া--।
    সমীরদা কথা শেষ করে না। উঠে পড়ে নেভানো বিড়িটা জ্বালাতে জ্বালাতে আমার দিকে না তাকিয়ে বলে-- তোমার ও কমরেড মানিকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়েও কথা উঠেছে। আমাদের কয়েকজন তোমাদের নিজের চোখে দেখেছে।
    --- কী দেখেছে সমীরদা?
  • সে | 188.83.87.102 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:২৯651037
  • হম্‌ম্‌।
  • ranjan roy | 24.96.78.50 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৫ ২৩:৫৮651038
  • ঘরের বাতি নেভানো। আমরা পাশাপাশি শুয়ে । যেন বুধবারী বাজারের অন্ধ্র থেকে আসা চালানী মাছ।
    নাঃ, ঠিক চালানী মাছ নয়; অন্ততঃ আমি তো নই। চালানী রুই-কাতলার কি চোখ দুটো জ্বলে?

    -- শোন লতা; সংস্কৃত পড় নি? আচ্ছা মিশনারী স্কুলে পড়াত না? কিন্তু রামায়ণের গল্প তো জান।
    -- হ্যাঁ, মানিকদা। তুলসীদাসের রামচরিতমানসের 'বিনয়পত্রিকা'র একটু আমাদের সেকন্ড ল্যাঙ্গুয়েজের কোর্সে ছিল। আর দিদার মুখে বাঙালী রামায়ণের গল্প।
    --- ও কৃত্তিবাসী রামায়ণ? ও তো ভক্তিগদগদ, তুলসীদাসীও তাই। রাম দোষহীন পুরুষশ্রেষ্ঠ। মর্য্যাদাপুরুষোত্তম। আর সীতা ও রাম বলতে অজ্ঞান। শুধু প্রেম নয়, ভক্তিও বটেক!
    আমি খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিলাম।
    -- কী বলতে চান, মানিকদা? ঝেড়ে কাসুন। রামায়ণের গল্প তো একটাই, যেই লিখুক।
    -- না লতা। প্রায় এক হয়েও এক নয়। বাল্মীকির সীতা প্রথম বিদ্রোহী নারী, অন্ততঃ পুরুষতন্ত্র শুরু হওয়ার পরে।
    শোন, রাম তো গুপ্তচরের চুগলি শুনে পোয়াতি স্ত্রীকে বনে পাঠালেন। সেখানে বাল্মীকি মুনির আশ্রমে লব-কুশ জোড়া সন্তানের জন্ম হল। যখন অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় লবকুশ-সীতা কে নিয়ে বাল্মীকি ওদের মর্যাদা সহকারে ফিরিয়ে দিতে গেলেন তখন ফের সীতার চরিত্র নিয়ে কথা উঠল। বাল্মীকি জোরের সঙ্গে সীতার পাতিব্রত্য নিয়ে আর্গুমেন্ট করলেন। গ্যারান্টি হিসেবে নিজের এতদিনের অর্জিত পূণ্যসমুহকে বন্ধক রাখতে অঙ্গীকার করলেন। রামের হৃদয়ে তুফান। কিন্তু নিজের দলের মুখ চেয়ে সীতাকে আবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন।
    এবার সীতার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল।
    চোখ বুঁজে হাত জোড় করে প্রার্থনা করলেনঃ
    " যদি আমি কখনো মনে মনে চিন্তায় একমুহুর্তের জন্যেও রাম বিনা অন্য কোন পুরুষের কথা ভেবে থাকি, তবে ধরিত্রীদেবী আমাকে গ্রহণ করুন"।
    এমনি ভাবে কয়েকবার বলার পর মাটি ফুঁড়ে পৃথিবীদেবী আবির্ভূতা হলেন এবং সীতাকে কোলে নিয়ে পাতালে চলে গেলেন।
    সেইসময় সাহিত্যে এই ঘটনা আসলে পুরুষতন্ত্রের গালে একটা বিরাট থাপ্পড়! আজ তার ওজন বোঝা কঠিন।

    সেদিন বুঝিনি, আজ ভাবছি ওই গল্পটা মানিকদা কেন শুনিয়েছিলেন? তিনি কী কিছু আন্দাজ করেছিলেন?
    সীতা তো পাতালে প্রবেশ করে অমর হয়ে গেলেন। আমি কোথায় যাব? আমার কে আছে? আর এ তো ত্রেতাযুগ নয় যে ধরিত্রীদেবী পাতাল ফুঁড়ে উঠে আসবেন। এ যে ঘোর কলি!

    কিন্তু মানিকদার শেষ কথাটা?
    ত্রেতাযুগে বিদ্রোহের তরিকা ওইরকম হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আজকে? এই কলির তিনপোয়া পূর্ণ হওয়ার দিনে? আজকে কেমন হওয়া উচিত নারীর প্রতিবাদের ধরণ?
    আপনি কেন বলে যান নি মানিকদা?
  • সিকি | 131.241.127.1 | ০৫ জানুয়ারি ২০১৫ ১৫:৩৮651039
  • " যদি আমি কখনো মনে মনে চিন্তায় একমুহুর্তের জন্যেও রাম বিনা অন্য কোন পুরুষের কথা ভেবে থাকি, তবে ধরিত্রীদেবী আমাকে গ্রহণ করুন"।
    এমনি ভাবে কয়েকবার বলার পর মাটি ফুঁড়ে পৃথিবীদেবী আবির্ভূতা হলেন এবং সীতাকে কোলে নিয়ে পাতালে চলে গেলেন।

    ---

    এর দ্বারা কি ধরিত্রীদেবী এটাই প্রমাণ করলেন না, যে, সীতা রাম বিনা অন্য পুরুষের কথা এক মুহূর্তের জন্যে হলেও ভেবেছিলেন? রামায়ণে কি এর সপক্ষে কোনও রেফারেন্স পাওয়া যায়?

    নাকি সীতা উল্টো প্রার্থনা করেছিলেন? যদি সতী হই, যদি রাম ভিন্ন অন্য পুরুষের কথা কখনও "না" ভেবে থাকি, তবে ধরিত্রীদেবী আমাকে গ্রহণ করুন?
  • - | 109.133.152.163 | ০৫ জানুয়ারি ২০১৫ ২৩:১০651042
  • উল্টো প্রার্থনাটাই, অর্থাৎ "না" ভেবে থাকি-টা ঠিক ভার্শান। এই "না"-টা মিস হয়ে যাওয়াটা মনে হয় রঞ্জনবাবুর টাইপো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন