যদি জিজ্ঞাসা করেন, আমার জাতীয়তা নিয়ে আমার মনোভাব কি, মুশকিলে পড়ে যাব। স্বাধীনতা সঙ্গ্রামীর নাতি হিসেবে এই দেশ নিয়ে হৃদয়ের খুব গভীরে একটা নরম কোণ আছে। আবার মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে- যে দেশে কার্টুন ফরওয়ার্ড করে জেলে যেতে হয় সেই দেশের মানুষ হওয়াটা আদৌ গর্বের কিনা। কখনো ইচ্ছে করে চতুর্থ বা পঞ্চম উদাহরণটির মত হতে। ছোটবেলায় চাকমা শরণার্থীদের দেখতাম তাড়া খাওয়া পশুর মত সীমান্তের এপার ওপার করতে বাধ্য হতে। সেই স্মৃতির দিকে তাকালে মনে হয় দেশ বা জাতীয়তা এগুলো সব অর্থহীন। এই লেখার শেষ প্যারাগ্রাফ লেখার আগে ভেবে চিনতে দেখছি, যে, দিনের শেষে আমার ভারতীয়ত্ব নিয়ে আমি মোটের ওপর গর্বিত। ... ...
সত্তরের দশকে কোলকাতার নকশালপন্থী আন্দোলন দমন করে এলিটবর্গের চোখে টাফ অফিসার হিসেবে খ্যাতিপ্রাপ্ত প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার রণ্জিৎ গুপ্ত নিজের মেমোয়ার্সে লিখেছেন যে সেই সময়ে মধ্যবর্গীয় নকশালপন্থী নেতারা ছিলেন রোম্যান্টিক স্বপ্নদর্শী। এঁদের সামরিক ব্যাপারে কোন সংগঠিত চিন্তাভাবনা ছিল না। ফলে দু'তিন বছরের মধ্যেই এদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু উনি খেয়াল করেছিলেন যে আশির দশকে অন্ধ্র প্রদেশে কোন্ডাপল্লী সীতারামৈয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতা বিস্তার করা পি ডব্লিউ জি বা পিপল্স্ ওয়ার গ্রুপ সামরিক ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক হয়ে প্রস্তুত হয়েছে। এরা অন্ধ্র প্রদেশের উপকূল এলাকা ধরে দক্ষিণবঙ্গে ছড়িয়ে পড়লে আগের কায়দায় নিয়ন্ত্রণ করা রাষ্ট্র এর পক্ষে কঠিন হবে। আজকে তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দশকের শেষে দেখা যাচ্ছে এটা অনেকখানি সত্যি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ... ...
এই ক্যাম্পের লোকেরা বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসেছে। মোটের উপর এটা কোনও গ্রাম নয় যেখানে যুগ যুগ ধরে গ্রামের প্রতিটা পরিবারের একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্যের সম্পর্ক; একটা গ্রাম যেটা জীবন্ত প্রতিজন গ্রামবাসীর নিঃশ্বাসে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দময় চলমান দিনের গতিবিধিময় প্রতিচ্ছবি; এটা একটা ক্যাম্প। শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য এই ক্যাম্প, এখানে মানুষ অপেক্ষা করে থাকে পুরাতন জীবনে ফিরে যাওয়ার, অথবা নতুন কোনও জীবন শুরু করার। এই সবের মাঝে দায়গ্রস্ত এরা শিখে নিয়েছে একে অপরের সাথে মিশে থাকার। ... ...
পুলিশ অফিসার, এস পি অঙ্কিত গর্গ আমাকে বললেন " শালী হারামী,কুত্তি। তুই তো একটা বেবুশ্যা। নকশাল লীডারদের কাছে তোর শরীর বেচিস তুই। ওরা আসেও তোর বাড়ীতে সারা দিনরাত ধরে। জানি,জানি, আমরা সব জানি।' আরো বল্লেন " তুই নিজেকে বলিস তুই একটা ভালো টিচার কিন্তু তুই তো দিল্লি গিয়েও তোর শরীর বেচে আসিস। তুই কি ভাবিস নিজেকে? তোর ধারনা তোর মতন একটা পাতি মেয়েছেলেকে বাঁচাতে কোনো হোমড়া চোমড়ারা ছুটে আসবে? " কোন অধিকারে কোনো পুলিশ অফিসার ঐ কথা বলতে পারে? আজকের দিনে ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে সব দেশেই যুদ্ধের সময়ে সেই দেশের মেয়েরা স্বদেশের জন্য কতো আত্মত্যাগ করেছেন। ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাইও তো বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন - তিনি তো নিজেকে বিক্রি করেন নি। ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন - তিনিও কি নিজেকে বিক্রি করেছিলেন? আর আজকের দুনিয়ায় যতো মহিলারা নিজের নিজের জায়গায় কাজ করছেন তারাও কি নিজেদের বেচে দিচ্ছেন? আমাদের সবারই তো একই সাথে থাকার কথা, কিন্তু আমাকে সাহায্য করতে কেন কেউ এগিয়ে আসছে না? আমি এর উত্তর চাই। ... ...
দ্রুত নোট প্যাড বের করে টুকে নেওয়া হয় নাম বিস্তৃত পাহাড়ির চাকমা ভাষার ভাষ্য। এনালগ ইয়াশিকা ক্যামেরায় তোলা হয় তার দু-একটি সাদাকালো ছবি। তিনি এই লেখককে জানান, তাদের গ্রামে আক্রমণ হতেই শিশুটিকে কোলে করে দুর্গম পাহাড়-জঙ্গল ভেঙে প্রায় ৩০ কিলিমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তিনি প্রথমে পৌঁছান জেলা সদরে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ নেতারা সার্কিট হাউজে আছেন — এই খবর শুনে তিনি আসেন সেখানে। অনর্গল চাকমা ভাষায় লোকটি শুধু একটা কথাই বলেন, বাবারা আমাকে একটু আশ্রয় দাও! চিদরেরা (সেনা বাহিনী) আমার কথা জানতে পারলে হয়তো আমাকেও মেরে ফেলবে! ... ...
এই যে মণিপুরের কথা বলছি এখানে রাতদিন লোকগুলোর ঘাড়ের ওপর শুধু বন্দুকের নিঃশ্বাস, যেকোনো লোক যেকোনো সময় গুলির সামনে পড়ে যেতে পারে। ওরা ভোট দিতে যায়, কিন্তু তার পেছনে কোনো রাজনৈতিক ভাবনা নেই। ওরা ভোট দেয় আঙুলে ঐ বেগুনী কালির দাগটুকু পাওয়ার জন্য। ঐ দাগ দেখলে সেনাচৌকি ওদের ছেড়ে দেবে, বিপ্লবী বলে সন্দেহ করবেনা। ঐ বেগুনী কালির দাগটুকু ওদের গুলি থেকে বাঁচাবে। এই লোকগুলোর গল্প সারা দেশের অন্য সবার গল্পের থেকে আলাদা। এবার সিনেমা বানানোর সময়ে এই গল্পটা,এর ভেতরের যত দ্বিধা, যত টানাপোড়েন তা আমরা তুলে ধরবো কেমন করে? একেক সময়ে মনে হয় যেভাবেই দেখাতে যাই না কেন, আসল ছবিটা কিছুতেই ফুটে ওঠেনা। মনে হয় আমাদের চেনা যত রকম পদ্ধতি আছে কোনটা দিয়েই ঐ ব্যথা-ভয়-কষ্ট গুলো তুলে ধরা যাচ্ছেনা। তখন নিজের ভেতরকার শিল্পী সত্বাটার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আমি একটাই উত্তর পাই -- এই আসল ছবি তুলে ধরতে গেলে অচিরাচরিতের রাস্তাতেই হাঁটতে হবে। সেটা যদি সাধারণের চোখে 'পলিটিকালি ইনকারেক্ট' হয় তো তাই সই। হলিউড বা বলিউডের আর পাঁচটা ছবির মতো করে এগোলে এ গল্পের সাথে অবিচার করা হবে। এই যে আমি এখানে রয়েছি, এত কাছ থেকে লোকগুলোকে দেখতে পাচ্ছি, এদের সুখ-দুঃখ-ভয়- ব্যথা চোখের সামনে রয়েছে, এই অঞ্চলের এই সত্যিগল্পকে সবার কাছে তুলে ধরতে গেলে আমাকে অন্যরকম ভাবেই ভাবতে হবে। আবার সাধারণ সিনেমা দর্শকরাও যাতে এ ছবি দেখতে উৎসাহ পান সেটাও মাথায় রাখা দরকার, সেইভাবে বানাবো কি করে তা বুঝতে পারছি না। সেটাই আমার কাছে চ্যালেঞ্জ। মেনস্ট্রীম ছবি হলে আমি জানি লোকে দেখবে, অর্থাৎ ছবি বিক্রী হবে ভালো, বাজারে কাটবে। এখন আমাকে এই পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সত্যিগল্পকে এমন একটা রূপ দিতে হবে যাতে লোকে দেখে। আমি বাজার নিয়ে চিন্তা করিনা, কিন্তু মানুষের এই ঘটনাগুলো দেখা দরকার। ... ...
স্টেটস্ম্যান পত্রিকায় উনসত্তর সালের গোড়ায় একটি ছোট্ট খবর বেরিয়েছিল --- বস্তারের সদর জগদলপুর শহরে মাওবাদী পোস্টার দেখা গেছে, পুলিশ সন্দেহ করছে বাইরে থেকে আসা কিছু যুবককে। শেষে ধরা পড়লেন ইস্পাতনগরী ভিলাইয়ের দুই বাঙালী। তাঁদের কিছুদিন জেলহাজতে রাখা হল। একজন অল্পদিনেই মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। অন্যজন কিছুদিন পরে জামিনে ছাড়া পেলেন। ইতিমধ্যে কোলকাতার মনুমেন্ট ময়দানে মে দিবসের জনসভায় কানু সান্যাল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) গঠনের ঘোষণা করেছেন। এবার রাজ্য কমিটিগুলো গঠনের পালা । তখন ছত্তিশগড় বিশাল মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত একটি অঞ্চল মাত্র। আর কেরালার চেয়ে সামান্য বড় বস্তার ছিল ছত্তিশগড়ের একটি জেলা। ... ...
ছত্তিসগড়ে হিংসামূলক কাজকর্মের জন্য উৎখাত হওয়া ১৬,০০০ জনেরও বেশী মানুষ অন্ধ্রপ্রদেশের খাম্মাম অঞ্চলে ২০৩ টে অস্থায়ী উপনিবেশে রয়েছেন। এইসব ক্যাম্পগুলির কিছু কিছু গ্রামের আশেপাশে। কিছুসংখ্যক এই ক্যাম্প মানবাধিকার সংস্থাগুলির দ্বারা নথিভুক্ত। তা সত্ত্বেও রাজ্য এই উপনিবেশগুলির অস্তিত্ব স্বীকার করতে নারাজ। বাস্তবিকই, রাজ্যের গন্ডীর মধ্যে এই ১৬,০০০ মানুষের বাঁচা বা মরা রাজ্যের দায় নয় – এটা বুঝিয়ে দিতে অন্ধ্রপ্রদেশ এই মানুষগুলির অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছে। এ যেন এমন এক অদৃশ্যকরণ জাদুকৌশল যেটা দক্ষতম জাদুকরেরও ক্ষমতার বাইরে। আপনি সরকারি নথিপত্র দেখতে পারেন, কিন্তু কোথাও এই মানুষগুলির উল্লেখ নেই। ... ...
ইঁদুর আমাদের সারা গাময় ঘুরে বেড়াত, পায়ের পাতার কাছে খুঁটে খুঁটে কামড় দিত। সকালে উঠে রক্ত পড়ে থাকতে দেখলে আমরা সবাই ভীত হয়ে যে যার নিজেদের পায়ের দিকে তাকাতাম। একদিন ১৬ ঘণ্টা ধরে হোসাঙ্গাবাদে লোডশেডিং ছিল, আমরা সেই অন্ধকারেই বসে খাচ্ছিলাম। সেই সুযোগে ইঁদুর এসে আমাদের রুটি নিয়ে চলে গেল।ও আমরা হাঁ করে বসে রইলাম। হরদা জেল ইঁদুরে ছেয়ে গিয়েছিল। আমাদের চাদর মুড়ি দিয়ে শুতে হতো তাতেও আমাদের চুলের কাছে এসে ইঁদুর গুলো জটলা পাকাত। আমি জেলারকে বলেছিলাম এই ইঁদুরের উপদ্রবের কথা। জেলার তার উত্তরে বলল, -এইটা জেল ম্যাডাম, ফাইভ স্টার হোটেল নয়। - তা বলে কি বন্দীরা এইভাবে ইঁদুরের কামড় খাবে, এইরকম কথা কোথাও লেখা আছে নাকি? দেখাতে পারলে আমারা আপনার কথা মেনে নেব। তা অন্ততপক্ষে আমাদের তো একটা মশারী দিতে পারেন? মশা না হোক ইঁদুরের থেকে তো আমরা রেহাই পেতে পারি। ... ...
হস্তিনাপুর কোন পথে চলবে তার উপরেই দুই নারীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে আছে। একজন যাবেন বাণপ্রস্থে, অন্যজন নগরের মধ্যেই থাকবেন, কিন্তু প্রাসাদে নয়। প্রাসাদের মতিগতি তাহলে নিয়ন্ত্রণের রাস্তা কিছুই থাকলো না কি? আছে। সত্যবতীর নিজস্ব চরেরা থাকবে। তারা থাকবে অলকার অধীনে। তার জন্য নির্দিষ্ট মাসোহারার বাইরেও সে অর্থ পাবে। সেই অর্থ আসবে সত্যবতীর নিজস্ব সম্পদ থেকে। মহারাজ শান্তনু জীবৎকালে তাঁকে যে গহনা ও ভূসম্পদ দান করেছিলেন সেই সম্পদ তিনি গচ্ছিত রাখছেন গাঙ্গেয়র কাছে। সেই সম্পদের থেকে আহরিত অর্থে এই বিশেষ বাহিনীর ব্যয় নির্বাহ হবে। এই বাহিনীতে বয়স্কা স্ত্রী লোক, সেই ঋষিপত্নীরা যাঁদের যাতায়াত থাকে অন্দরমহলে বিভিন্ন কারণে, নাপিতানি, ধাই-এরাই মূলত নিযূক্ত হত। এদের কাজ ছিল রাজপ্রাসাদের অন্দরমহল ও রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে কি ঘটছে তাও জানানো রাণীকে! ... ...
এখন অ্যাক্রোনিমের যুগ। বেশী কথা বলবার উপায় নেই। এই তো এখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগের খেলা চলছে, কিন্তু তা বললে হবে? আই-পি-এল বলতে হবে। তাতে কলকাতা(কোলকাতা) নাইট রাইডার্স বলে একটা টীম আছে। তা বললে হবে? কে-কে-আর বলতে হবে। অবশ্য সব জায়গায় চলবেনা। যেমন, মানুষের নামে। চলবেনা বললে ভুল হবে, ক্ষেত্র বিশেষে চলে তো বটেই, যেমন শাহরুখ খান হলেন এসআরকে। পি চিদাম্বরমকে পিসি(মা নয়) অনেকে বলেন বটে, তাই বলে সোনিয়া গান্ধী কে এসজি কিছুতেই বলা যাবেনা। ওটা সুনীল গাভাস্কার বা সৌরভ গাঙ্গুলী-ও হতে পারে। মনমোহন সিংকে এমএমএস বলা যাবে? লোকে তো মোবাইল খুলে ক্লিপ খুঁজবে। ... ...
শরৎ সাহিত্যের কী সব ‘দোষ’ সে আমার জানা নেই। কিন্তু বুঝতে পারি অনেক ‘দোষ’ আছে। এই যে আমার ‘দোষ-বোধ’ সে অন্যদের অভিমত থেকে পাওয়া বা শেখা যা আমাকে শেখানো হয়েছে। নিজে তা বুঝে উঠতে পারিনা কীভাবে কী কী কারণে শরৎ সাহিত্য দোষের হয়েছে! ধারণা করি হুমায়ুন সাহিত্যেও সেই রকম ‘কথ্য-কলঙ্ক’ লেপ্টেছে যেটাও কম বেশী দোষেরই। এই দোষটাও যে আমি খুব বুঝি তা নয়। এই সব অভিমতের বিচারকদের সম্পর্কে বরং আমার সব সময় ভিন্নমত থাকে.... ... ...
জনজাতিদের অবস্থাও যে খুব ভালো তা নয়। এরাও অতিদরিদ্র। ইতিহাসের দীর্ঘ পর্যায় জুড়ে এরা যেমন বাংলাদেশে, উত্তরবাংলাতে তেমনি অসমে বা পূর্বোত্তরেও নানা ভাবে বঞ্চিত। কিন্তু এখানে ‘কিন্তু’ আছে। এখানে হাজার রকমের জনজাতি বাস করেন। এদেরই মধ্যে আপাত সংখ্যাতেবেশি যারা তাদের সঙ্গে আপোস করে শাসনের সহযোগী করে নেবার চাল চিরদিনই চালিয়ে গেছে ভারতীয় বা স্থানীয় বর্ণহিন্দু শাসক শ্রেণি। তাই ইতিমধ্যে গড়েউঠা বহু জনজাতীয় রাজ্যেই ছোট জনজাতীয়দের দাবিয়ে রাখার কাজ বড়ো জনজাতীয়রাই করেন। যেমন কোচেদের জনজাতি বলে কোনো স্বীকৃতি নেই। এই দাবী জানালে বডোরাই এর বিরোধিতা করেন। বডোদের স্বশাসন দিয়ে তাদের শাসনের সহযোগী করে ফেলা হয়েছে। যেমন গোর্খাল্যাণ্ডে গোর্খাদের সহযোগী করে লেপচা ভুটিয়াদের দাবিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সমস্ত জনজাতীয় এবং সংখ্যালঘু ঐক্য যাতে না গড়ে উঠে এটা ভারতীয় শাসক শ্রেণি সুকৌশলে সুনিশ্চিত করে। বাঙালি-বিহারি-মারাঠি-গুজরাটি-অসমিয়া বর্ণহিন্দু শ্রেণিটি এই সুকৌশল খুবপছন্দ করেন। গোটা পূর্বোত্তরে প্রায় সমস্ত জাতি জনজাতিদের উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ছিল বা আছে। ব্যতিক্রম কেবল বাঙালি হিন্দু-মুসলমান। কিন্তু মুসলমানের বিরুদ্ধে টানা প্রচার আছে এরা আই এস আই-এর হয়ে কাজ করে, উগ্রপন্থীদের মদত দেয় ইত্যাদি। এগুলো মিথ্যাচারীদের প্রচার মাত্র। মাঝে মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থাও এই সব প্রচারে তথ্য যোগায়। কিন্তু আজ অব্দি এদের বডো ডিমাছা মণিপুরি নাগা উগ্রপন্থীদের মতো সংগঠিত রূপে দেখা যায় নি। গেলে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে অন্য অনেক সংগঠনকে যখন ভারত সরকার আলোচনার টেবিলে নিয়ে এলো তাদেরও আনতে পারত। আর পারে নি বলে বাংলাদশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত সরকার কোনো অভিযোগ জানিয়েছে বলেও জানা যায় নি। অথচ ওদিকে ওদেশের সঙ্গে ঘনঘনই তো ভারত এবং অসম সরকারের কথা হচ্ছে। মুসলমানেরা যাদের থেকে মার খান তাদের কেন মদত দিতে যাবেন? কিন্তু কেবল বিজেপি নয়, বহু বামেরাও এই প্রচারে সিদ্ধহস্ত। প্রচার মাধ্যমের কথা তো বলেই লাভ নেই। অসমেআলফা এন ডি এফ বি- যখন গোলাগুলি ইত্যাদি করত তখন বহু হিন্দু বাঙালি 'ভদ্রলোক'ও বলে বেড়াতো এগুলো মুসলমানের কাজ। ... ...
বরাক উপত্যকার বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ করে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা কিছুদিন আগে পর্যন্তও পশ্চিমবাংলাকে দেখিয়ে বড়াই করে বলতেন ‘বাঙালির মধ্যে জাতপাত নেই’। কীভাবে তাঁরা বুঝলেন যে সেখানে জাতপাতের বিভাজন নেই – কারণ বিহারে ভূমিহার-রাজপুত-ঠাকুর-দলিত-যাদব-কুর্মী ইত্যাদির মধ্যে সহিংস সংঘাত লেগেই থাকে, কিন্তু পশ্চিমবাংলায় অপার শান্তি। সেখানে যেমন রণবীর সেনা রয়েছে – তেমনি রয়েছে দলিত সেনা – পশ্চিমবাংলায় তো তেমন নেই। তাঁরা সম্পত্তি-সম্পর্ক বিচার করার দিকে না গিয়ে বহিরঙ্গের শান্তি-অশান্তির রূপ দিয়ে জাতপাতের বিচার করলেন। বিহারে উচ্চবর্ণের জমির মালিক সরাসরি জমির সাথে যুক্ত থেকে সস্তায় শ্রম শোষণকে সুনিশ্চিত করতে শারীরিক নিগ্রহ চালাত। দলিতরা তার প্রতিরোধ করলে কিংবা যে কোন শ্রেণি সংগ্রাম সেখানে শুরু থেকেই হিংসাত্মক রূপ নেয়। দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এই সম্পত্তি সম্পর্কের খানিকটা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে – কিন্তু তা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। পশ্চিমবাংলায় বর্ণহিন্দু আধিপত্য যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যেই বিরাজ করছিল তা এখন সবার কাছেই পরিষ্কার। সাচার প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার পর “পশ্চিমবাংলায় সাম্প্রদায়িকতা নেই” এই দাবিও যে ঠুনকো তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া গরীব মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার হিংসাত্মক রূপ পরিগ্রহ করার প্রয়োজন পড়ে না, কারণ বর্ণহিন্দু আধিপত্য যেখানে শান্তির বাতাবরণেই সবচাইতে সুরক্ষিত থাকে সেখানে অশান্তি ডেকে আনা আধিপত্যের পায়ে কুড়োল মারার সামিল। বরাক উপত্যকার ক্ষেত্রেও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জনসংখ্যাগত ভারসাম্যের চিত্রটি বাদ দিলে শান্তির এই একই যুক্তি ক্রিয়াশীল থাকে। ... ...
তো, নেলী আমাদের সাথেই আছে, অনেক দিন ধরে আছে। নেলী, মানে নেলী নামের অঞ্চলটি, আসামের আর পাঁচটা ছোট মফস্বলের মতই। ঘন সবুজ ধানখেত, দিগন্তে মেঘালয়ের কালো পাহাড় দেখা যাচ্ছে, দুএকটা জায়গায় সেগুনগাছ-ঝোপঝাড়, ব্যস্ত বাজার, দূর্গাপূজার মন্ডপ, আর জামাকাপড় থেকে বড়সড় মুসলমানদের জনসংখ্যা অনুমান করা গেল। ১৯৮৩-র দিনটিতে কী হয়েছিল তার কোনো স্মারকচিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে এরকমই তো হওয়ার কথা ছিল। দিল্লী ১৯৮৪ বা গুজরাট ২০০২-হত্যাকান্ডকে রাষ্ট্র ন্যূনতম বিচারের মাধ্যমে জবাব দিয়েছে, তার কারণ তাদের প্রেতাত্মারা ফিরে ফিরে আসে। আর নেলী দেশের দূরের কথা, রাজ্যের রাজনীতিতেও এক বিস্মৃত অধ্যায়। গরিব, পাড়াগেঁয়ে মুসলমানরা মরেছে এরকম এক গণহত্যা কে মনে রাখে। দ্বিতীয়ত, যারা মরেছে মরেছিল অবৈধ বিদেশীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়। ফলে তাদের সুবিচারের দাবি আরেকটু নড়বড়ে হয়ে যায় বইকি। দিল্লী বা গুজরাটের মৃতদের ঠিকঠাক ধর্ম ছিল না, কিন্তু তারা যে ভারতীয় নাগরিক, অনুপ্রবেশকারী নয় এই নিয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। তৃতীয়ত, হত্যাকান্ড ঘটেছে এক প্রান্তিক প্রদেশে, ভারতীয় মূলভূমি থেকে অনেক দূরে। তাই আমাদের জাতীয় যৌথ বিস্মৃতি ঘণ হয়ে ওঠে। সংক্ষেপে, নেলীর কথা কেউ শোনে না। একটি হত্যাকান্ডের পরোক্ষ বৈধতার জন্য যখন আগের একটিকে খাড়া করা হয়, নেলীর নাম তখনো আসে না। কেননা নেলীর মধ্যে পরবর্তী কোনো হত্যাকান্ডকে বৈধতা দেওয়ার মূল্যটুকু নেই। দেশের যৌথ স্মৃতির কাছে নেলী ঘটেইনি। ... ...
বোড়ো ও মুসলিমরা ঐতিহাসিক ভাবে অসমিয়া সমাজের প্রান্তিক মানুষ। অথচ সমাজ ও মিডিয়ার একাংশ বাংলাদেশ থেকে 'অবৈধ' অনুপ্রবেশ কে একপার্শ্বিক ভাবে দায়ী করছেন, যেন এই একটি কারণ সমস্ত হিংসার মূলে। আমরা মনে করি, এই ধরনের সংঘর্ষের এরকম সরল ব্যখ্যা হয় না। জাতিবিদ্বেষের ফাঁদ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখা এখন আমাদের সবার জন্য জরুরী। কিছু কায়েমী স্বার্থ সন্ধানী দল , এই হিংসা ও বিপর্যয়ের সময়টিকে বেছে নিয়েছেন, তাদের বহু পুরনো লক্ষ্য চরিতার্থ করতে। বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বিতাড়নের দাবীটি সামনে আনাই তাদের উদ্দেশ্য। হিংসাত্মক কার্যকলাপ আর জীবনহানিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণের এই চক্রান্তের আমরা কঠোর ভাষায় নিন্দা করি। আমাদের দাবীঃ ১) হিংসা, অগ্নি-সংযোগ ও হত্যা অবিলম্বে বন্ধ হোক। ২) আসাম সরকার, বিটিসি কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় সরকার জীবন ও জীবিকার এই ক্ষতির সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিক ও উৎখাত হওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুক। আমরা আবেদন করি ঃ ১) এই ধ্বংসলীলা রুখতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করুক। ২) শান্তি ও স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় সংগঠনগুলি একটি মিলিত সমাধানের ডাক দিক। ৩) সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ক্রমাবনতি রুখতে , স্থানীয় ও জাতীয় মিডিয়া, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার পরিচয় দিক। ... ...
প্রিয়াঙ্কাঃ শেষ প্রশ্ন এবং ব্যক্তিগত – এই আন্দোলন এবং আন্দোলনের পিছনে কারন নিয়ে আপনারা পুলিশ ক্যাডাররা কি ভাবেন? আলিঃ দেখুন, আমরা সাধারণ পুলিশ। ২০০৭ সালের আসাম পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী আমাদের একমাত্র কাজ হল অপরাধ দমন ও প্রতিরোধ করা। আইন- শৃঙ্খলা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে আমরা আগ্রহী নই। ... ...
এক ভীষণ ভয় জ্বরের মত কাঁপুনি দিল ওর শরীরে। বড়পুকুর কেন বাড়ির পেছনের চাপাকলার বাগানে যেতেই ওর বুক কেঁপে ওঠে। ভয় যেন ওকে তাড়া করে বেড়াতে লাগল। দাদা বউদির শাপ শাপান্ত বেড়েই চলল। ছোট ভাই বোনেরা হোক না হোক, কথায় কথায় ওকে গালাগালি করতে লাগল। চিন্তা করে কুল পায়না কী করে দাদা জরিমানা দেবে? কী করে দাদা মানুষকে ভোজ খাওয়াবে ? খুদকুড়ো আছে বলে একবেলা হলেও সকলের পেটে খাওয়া যাচ্ছে, আর কদিন পর ঝুড়িতে থাকা তলানিটুকুও ফুরিয়ে যাবে! ও ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।তবে এ টুকু বুঝতে পারছে কিছু একটা পথ খুঁজে বার করতেই হবে। শহর থেকে যে দয়ালু লোকগুলো এসেছিল ওদের খুঁজে বার করতে হবে। ওর ফটো তুলছিল যে নম্রশান্তযুবকগুলো, ওদের সহমর্মিতার কথা ওর মনে পড়ল। ধুতিপরা বয়স্ক লোকেদের মা-জননী ডাক ওর কানে ভেসে এল। যে ভদ্রমহিলারা এসেছিলেন তারাই বা কোথায় ? ... ...
শুধুমাত্র পরিবারের কথা বলে যাচ্ছি কারণ এদেরকে কাছ থেকে দেখেছি। এরকম কত পরিবার আছে, কত মানুষ আছে যারা ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে আম আদমির কাছে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। এদেরকে আমরা বিদ্বজ্জন বলে মানি না, সম্মান করিনা। কারণ এরা প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে আমাদের কাছে আসেন, আমাদের কথা বলেন, গানে, নাটকে, কবিতায়। নিজের চক্ষে সেদিনগুলো প্রত্যক্ষ করেছি, লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন মঙ্গলকাব্য, গম্ভীরা, মহাভারতের যুদ্ধ, সূর্যশিকার, ক্রীতদাস, গণনাট্যের এক একেকটা প্রযোজনা যখন আছড়ে পড়ছিল, শাসকের বুকে শেলএর মত বিঁধছিল, সেদিন আমি সাক্ষী ছিলাম। সাক্ষী ছিলাম ভোগবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ঘাড় সোজা করে লড়ে যাওয়া মানুষগুলোর লড়াইয়ের। তাই আজও হুজুগে শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের থেকে ওদেরকেই বেশি আপন মনে হয়। আমার কমরেড। ... ...
অবশেষে একদিন মৃত্যু আসে। আর মধ্যবিত্ত তার হারানো মন আর সময়ের স্মৃতিপুঞ্জসমেত হুমায়ূনকে কবর দিতে যায়। ফিরে আসার সময় তাদের খেয়াল হয়, তাদের প্রথম যৌবন থেকে প্রতিটি যৌবনাগত নতুন যুবক-যুবতী হুমায়ূনি জ্যোছনার কুহক-ধরায় ধরা ছিল। সেই সময় সেইসব মানুষ আর সেইসব কল্পনা অবসিত হলে পরে, হুমায়ূনের সাহিত্যিক জীবনীর আজ প্রথম দিন। ইহকাল শেষে হুমায়ূন সাহিত্যের মহাকালে বাস করা শুরু করলেন। সেই কাল ইতিমধ্যে তাঁর সাহিত্যে দাঁত বসানো শুরু করে দিয়েছে। দেখা যাক... ... ...